মাহে রমজান মুমিনদের আত্মগঠন ও প্রশিক্ষণের জন্য এক অনন্য চির বিপ্লবের সেরা মাস

মাহে রমজান মুমিনদের আত্মগঠন ও প্রশিক্ষণের জন্য এক অনন্য চির বিপ্লবের সেরা মাস

রমজান মাস সিয়াম সাধনা ও তাকওয়ার মাস, কল্যাণ ও বরকতের মাস, রহমত ও মাগফিরাত এবং জাহান্নামের অগ্নি থেকে মুক্তি লাভের মাস। মহান আল্লাহ এ মাসটিকে বহু ফজিলত ও মর্যাদা দিয়ে অভিষিক্ত করেছেন। মাহে রমজান মুমিনদের আত্মগঠন ও প্রশিক্ষণের জন্য এক অনন্য সেরা মাস। এ মাসের একটি ফরজ ইবাদাত অন্য মাসের ৭০টি ফরজ ইবাদাতের সমান। রমজান মাস আমাদের জন্য বার্ষিক প্রশিক্ষণের মাস। এ মাসে আছে সাহরি, ইফতার, তারাবিহ, ইতিকাফ, লইলাতুল কদর, ফিতরা ও ঈদুল ফিতর। কুরআন নাজিল হয়েছে এ মাসের লাইলাতুল কদরে, সংঘটিত হয়েছে ইসলামের প্রথম যুদ্ধ বদর ও বিজয় হয়েছে পবিত্র মক্কা। কাজেই আত্মগঠন ও বিজয়ের মাস রমজান। মাহে রমজান ইসলামের আদর্শকে সর্বস্তরের জনগণের কাছে পৌঁছানোর এক সুবর্ণ সুযোগ। দীর্ঘ ১১টি মাস অতিক্রম করে প্রতি বছর এ পবিত্র মাস মুসলিম উম্মাহর কাছে হাজির হয় অজস্র-অফুরন্ত রহমত ও কল্যাণের বার্তা নিয়ে। মুসলিম মিল্লাতের জন্য রহমতস্বরূপ এ মাসটি আত্মগঠন, নৈতিক উন্নতি, চারিত্রিক দৃঢ়তা, পরিচ্ছন্ন ও সুন্দর সমাজ গঠন এবং সামাজিক সাম্যের নিশ্চয়তা বিধানের এক অনন্য সুযোগ।

রমজান The word Ramadan is derived from the Arabic root word ramida or ar-ramad signifying strong burning heat and dryness, especially the ground. Spiritually, Ramadan burns out the sins with good deeds, as the sun burns the ground.  আর সিয়াম হল ফজরের উদয়লগ্ন থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত নিয়্যতসহ পানাহার ও যৌন মিলন থেকে বিরত থাকা।  রমজান মাসের রোজাকে ফরজ করে যে আয়াত নাযিল হয়?  তাতে আল্লাহ্ রোজার উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য নির্দেশ করেছেন : সিয়াম পালন তথা রোজা ফরজ এবং এটি ইসলামের অন্যতম একটি রুকন। আল্লাহ তা’আলা বলেন, ‘‘হে ঈমানদারগণ!  তোমদের ওপর রোজা ফরজ করে দেয়া হয়েছে, যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর ফরজ করা হয়েছিল, যাতে তোমরা মুত্তাকি হতে পার। (সূরা আল-বাকারাহ : ১৮৩)
‘‘সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা এ মাস পাবে, তারা যেন এ মাসে রোজা পালন করে।’’ (সূরা আল-বাকারাহ : ১৮৫)

রমজান মাসের মাহাত্ম্য : এ মাসের মাধ্যমে সম্ভব দুনিয়া ও আখেরাতে কল্যাণ সাধন করা ।
অতি মহিমান্বিত ও পবিত্র মাস : মহান আল্লাহ মানবজাতিকে সৃষ্টি করেই ক্ষান্ত হননি; সৃষ্টির সাথে সাথে সত্য প্রদর্শনের জন্য নবী-রাসুল প্রেরণ করেছেন। তাদের মাধ্যমে তিনি তার দিকনির্দেশনা বা বিধানও পাঠিয়েছেন যা ‘গাইডবুক’ হিসেবে অভিহিত। মহাগ্রন্থ ‘আল কোরআন’ তেমনি এক গাইডবুক। এ কোরআন পবিত্র রমজান মাসে নাজিল হয়েছে। অন্য সকল আসমানী কিতাবও এ পবিত্র মাসে নাজিল হয়। আল্লামা ইবনে কাছির বলেন “এটা সেই মাস যে মাসে নবীগণের ওপর আল্লাহর কিতাবসমূহ নাজিল করা হয়েছে।” অতএব, রমজান মাস শুধু কোরআন নাজিলের মাস নয়; সকল আসমানী কিতাব নাজিলেরও মাস। এ মাসেরই ৬ তারিখে মুসা (আ:) এর ওপর তাওরাত, ১৮ তারিখে দাউদ (আ:) এর ওপর যবুর, ১৩ তারিখে ঈসা (আ:) এর উপর ইনযিল এবং শেষ ১০ দিনের কোন এক বিজোড় রাতে আল কোরআন অবতীর্ণ হয়। কোরআন নাযিলের এ রাতকে ‘লাইলাতুল কদর’ বা ‘কদরের রাত’ বলা হয়। শুধু তাই নয় এ মাসের ২য় হিজরির ১৭ই রমজান বদর যুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং মুসলমানরা বিজয়ী হয়, ৮ম হিজরির ২০ শে রমজান মক্কা বিজয় হয়, রমজানের প্রথম রাত্রি হযরত ইবরাহিম আ:-এর ওপর সহিফা নাজিল হয়, ১৩ই রমজান আমর বিন আসের নেতৃত্বে জেরুসালেম জিয় হয়, রমজান মাসেই হযরত সুমাইয়া নির্মমভাবে শহীদ হন, ৯২ হিজরিতে রমজান মাসেই তারেক বিন জিয়াদ কর্তৃক স্পেন বিজয় হয়, রমজান মাসে মুসলমানদের পবিত্রস্থান বায়তুল  মোকাদ্দাস বিজয় হয়। আর এ কারণে মাসটি অতি মহিমান্বিত।

নৈতিক শুদ্ধতার প্রশিক্ষণ : খাওয়া-দাওয়া, চলাফেরা এবং আরো কিছু দৈনন্দিন প্রয়োজন পূরণ করতে গিয়ে মানুষের দৈহিক কামনা-বাসনা অনেক সময় মাথা-চাড়া দিয়ে ওঠে। অনেক সময় সে উচ্ছৃংখল হয়ে ওঠে। মানুষের এই মৌলিক চাহিদাগুলোর অপব্যবহারের ফলে লাগামহীন ঘোড়ার মতো সমাজে অন্যায়, ব্যভিচার, এবং অসৎ কার্যকলাপের সূচি দীর্ঘ হয়। পানাহার ছাড়া মানুষ যেহেতু বাঁচতে পারে না, তাই কঠিন ক্ষুধার সময় তার যে কষ্ট অনুভব হয় তা সহ্য করার মাধ্যমে সে ধৈর্যশীল ব্যক্তিতে পরিণত হয়। এর ফলে অন্য যে কোন কঠিন পরিস্থিতি ধৈর্যের সাথে সে মোকাবেলা করতে পারে। আর এর প্রশিক্ষণ পায় সে এ রমজান মাসে। তাইতো হাদিসে বলা হয়েছে, এ মাস হলো ধৈর্যের মাস, এ ধৈর্যের বিনিময় হলো জান্নাত। সমাজ হতে দরিদ্র শ্রেণীর মানুষেরা অনাহারে থেকে যে কষ্ট পায়, অনাহারীর সে ক্ষুধার জ্বালা রোজার মাধ্যমে উপলব্ধি করা যায়। এতে করে ক্ষুধার্ত  ব্যক্তিদের প্রতি অনুকম্পা ও সহমর্মিতার অনুভূতি জাগ্রত হয়। সমবেদনায় সিক্ত হয়ে তাদের প্রতি অনেকের সাহায্যের হাত প্রসারিত হয়। ধনীদের মধ্যে সমাজের দরিদ্রতা বিমোচনে ভূমিকা পালন করার অনুভূতি জাগ্রত হয়। এ রোজা একজন ব্যক্তির ওপর অনেকগুলো আচরণগত নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। মিথ্যা বলা, পরনিন্দা, ধোঁকা দেয়া, প্রতারণা, হিংসা-বিদ্বেষ, অশ্লীল কথা ও কাজ এ সবকিছুই এমনিতেই নিষেধ। কিন্তু রোজা পালনকালে এগুলো বর্জনের চর্চা হয় অনেক বেশি। রমজান মাসের এ চর্চা পরবর্তী এগারোটি মাস পালন করা হলে সুন্দর, সুশৃংখল ও পরিচ্ছন্ন সমাজ গড়ে ওঠা সহজেই সম্ভব।

এতসবের পরও পরকালের সফলতার জন্য রমযান মাস একটি দুর্লভ মাস। এ মাসে একটি সন্মানিত রাত্রির সুসংবাদ রয়েছে। আর তা হলো ‘লাইলাতুল কদর’ যা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম একটি রাত্রি। হাদীসে বলা হয়েছে, এ মাসের প্রথম দশক রহমতের, মধ্য দশক মাগফিরাতের ও শেষ দশক জাহান্নাম থেকে নাজাতের। এ মাসে নফল ইবাদতে অন্য মাসের ফরজের সমতুল্য সওয়াব রয়েছে। একটি নফল আদায়ে অন্য মাসের ৭০টি ফরজের সমান সওয়াব রয়েছে (মেশকাত)
নৈতিক কল্যাণ সাধনে রমযানের রোয়া উপকারী।

রমযান ও বিজ্ঞান : মুসলমান পরিবারের সন্তানরা রোযা রাখতে অভ্যস্ত হয় ছোট বেলা থেকেই। অনেক মা সুস্থ সন্তানকে দুর্বলতার আশঙ্কায় রোজা রাখতে বারণ করেন। আবার অনেকে পড়াশুনার জন্য রোযা ছেড়ে দেন। মনে রাখা প্রয়োজন ইসলাম একটি সহজ, সুন্দর ও সুশৃঙ্খল জীবন পদ্ধতি। এখানে অকল্যাণকর, অপ্রয়োজনীয়, ধ্বংসাত্মক কোন বিধান নেই। যিনি এমন সুন্দর পদ্ধতি দিয়েছেন তিনি সবকিছু বুঝেই দিয়েছেন। ডা: বেন কিম  Fasting for Health গ্রন্থে বেশ কিছু রোগের ক্ষেত্রে উপবাসকে চিকিৎসা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। সেগুলো হচ্ছে  হৃদরোগ, উচ্চরক্তচাপ, অনেক দিনের মাথা ব্যথা, অন্ত্রনালীর প্রদাহ, বয়সজনিত ডায়েবেটিস ইত্যাদি। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান সিয়াম পালনকে এক বাক্যে উপকারী হিসেবে রায় প্রদান করা হয়েছে। ‘Scientific Indication in the Quran’ গ্রন্থে বলা হয়েছে: “Allah clearly declares that fasting in Ramadan is good for mankind. We do not yet know all the physical and spiritual benefits of Ramadan fasting”

রমজানের তাৎপর্য : মুমিন বান্দার জীবনে বছরের মধ্যে রমজান মাসটিই এক দুর্লভ সুযোগ এনে দেয়। রমজান আমল করার মাস, এর প্রতিটি মুহূর্ত আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের বিশেষ অনুগ্রহ লাভের বিরাট সুযোগ। রমজান মাসে বান্দাহ আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছ থেকে অনেক নৈকট্য অর্জন করতে পারেন। রোজাদারের মর্যাদা উল্লেখ করে হাদিস শরিফে রাসূল (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘রোজাদারের নিদ্রা ইবাদতের সমতুল্য, তার চুপ থাকা তসবিহ পাঠের সমতুল্য, সে সামান্য ইবাদতে অন্য সময় অপেক্ষা অধিকতর সওয়াবের অধিকারী হয়। নবী করিম (সা.) ঘোষণা করেছেন, ‘যারা রমজান মাসের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত রোজা পালন করেছে, তারা ওই দিনের মতো নিষ্পাপ হয়ে যাবে, যেদিন তাদের মাতা তাদের নিষ্পাপরূপে প্রসব করেছিলেন।’

হযরত আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা) এরশাদ করেন, যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে এবং সওয়াবের বিশ্বাসে রমজানের রোজা রাখে তার পূর্ববর্তী সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়। আর যে ব্যক্তি রমজানের রাত্রি জাগরণ করে ইবাদতে লিপ্ত থাকে তারও পূর্ববর্তী সকল গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়। যে ব্যক্তি শবেকদরের রাতে ঈমান ও একিন সহকারে ইবাদত করে তারও সকল গুনাহ আল্লাহ ক্ষমা করে দেন (বুখারী ও মুসলিম)। Prophet Muhammad (sm.) Said, “Anyone who fasts during this month with purity of belief and with expectation of a good reward (from his Creator), will have his previous sins forgiven; anyone who stands in prayers during its nights with purity of belief and expectation of a reward, will have his previous sins forgiven”.

রোজা একটি ধৈর্যের প্রশিক্ষণ, ব্যক্তিজীবন গঠন, সমাজের উন্নয়নে, মানবতার সেবা, দ্বীনি দায়িত্ব পালনে পাহাড়সম বাধা মোকাবেলার জন্য প্রয়োজন অপরিসীম ধৈর্য, সেই জন্য রাসূল (সা) এ মাসকে ধৈর্যের মাস হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘এটা সবরের মাস আর সবরের বিনিময় হচ্ছে জান্নাত।’ অন্য একটি হাদিসে বলা হয়েছে, হযরত আবু হুরাইরা (রা) বর্ণনা করেছেন : কেবল আহারাদি থেকে বিরত থাকার নাম রোজা নয়। অশ্লীল কথাবর্তা ও অশালীন আলোচনা থেকে দূরে থাকাই আসল রোজা। অতএব হে রোজাদার! যদি কেউ তোমাকে গালি দেয় বা তোমার সাথে অভদ্রতা করে তাহলে তাকে বলো : আমি রোজাদার। (ইবনে খোযায়মা ও ইবনে হিক্বাম)

সুতরাং রোজার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে লুকিয়ে থাকা পাশবিকতাকে দমন এবং নৈতিক উৎকর্ষ সাধনের সুন্দর ব্যবস্থা বিদ্যমান। আজকে অশান্ত পৃথিবীর সর্বত্র খুন, রাহাজানি, যুদ্ধ-বিগ্রহ, জুলুম-নির্যাতন, অশ্লীলতা বেহায়াপনায় সব কিছই মানুষের পশুপ্রবৃত্তির পরিণাম। বিশ্বব্যাপী অস্ত্রের প্রতিযোগিতা, দলিত-মথিত মানবতা, মজলুমের ফরিয়াদে ভারাক্রান্ত আকাশ-বাতাস। পারমাণবিক বোমার তেজস্ক্রিয়তায় বিকলাঙ্গ এবং পঙ্গু মানব সভ্যতা। অথচ আল্লাহতায়ালা পৃথিবীকে বাসের উপযোগী করে গড়ে তোলার জন্য মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। আর রোজার আত্ম সংযমের প্রশিক্ষণই পারে মনুষের সেই পাশবিকতাকে দমন করতে। রোজার পুরস্কার সম্পর্কে আল্লাহ নিজেই বলেছেন, ‘‘রোজা আমার জন্য আর এর পুরস্কার আমি দেবো।”
১. রমজান হল কুরআন নাজিলের মাস : আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন : “রমজান মাস, এতে নাজিল হয়েছে আল-কুরআন, যা মানুষের দিশারি এবং স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্যকারী।” (সূরা বাকারা : ১৮৫) রমজান মাসে সপ্তম আকাশের লওহে মাহফুজ থেকে দুনিয়ার আকাশ বায়তুল ইজ্জতে পবিত্র আল-কুরআন একবারে নাজিল হয়েছে। সেখান থেকে আবার রমজান মাসে অল্প অল্প করে নবী করিম সা.-এর প্রতি নাজিল হতে শুরু করে। এ মাসে মানুষের হেদায়াত ও আলোকবর্তিকা যেমন নাজিল হয়েছে তেমনি আল্লাহর রহমত হিসেবে এসেছে সিয়াম। তাই এ দুই নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করতে বেশি বেশি করে কুরআন তেলাওয়াত করা উচিত। প্রতি বছর রমজান মাসে জিবরাইল রাসূলুল্লাহ সা:-কে পূর্ণ কুরআন শোনাতেন এবং রাসূল সা:ও তাকে পূর্ণ কুরআন শোনাতেন। আর জীবনের শেষ রমজানে আল্লাহর রাসূল দুইবার পূর্ণ কুরআন তিলাওয়াত করেছেন। সহীহ মুসলিমের হাদিস দ্বারা এটা প্রমাণিত।
২. এ মাসে জান্নাতের দ্বারসমূহ উন্মুক্ত রাখা হয়, জাহান্নামের দ্বারসমূহ রুদ্ধ করে দেয়া হয় : নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “রমযান মাস এলে জান্নাতের দ্বারসমূহ উন্মুক্ত রাখা হয় জাহান্নামের দ্বারসমূহ রুদ্ধ করে দেয়া হয় এবং শয়তানদের শৃংখলিত করা হয়।  (সহীহ বুখারী, হাদিস নং ১৮০০)
৩. এ মাসে রয়েছে লাইলাতুল কদরের ন্যায় বরকতময় রজনী : মহান আল্লাহ বলেন, “লাইলাতুল ক্বদর হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। এ রাত্রে ফেরেশতাগণ ও রূহ অবতীর্ণ হন প্রত্যেক কাজে, তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে। শান্তিময় এ রজনী, ঊষার আবির্ভাব পর্যন্ত।” (সূরা আল ক্বদর : ৩-৫)
৪. এ মাস দো’আ কবুলের মাস : নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “(রামাদানের) প্রতি দিন ও রাতে (জাহান্নাম থেকে) আল্লাহর কাছে বহু বান্দা মুক্তিপ্রাপ্ত হয়ে থাকে। তাদের প্রত্যেক বান্দার দো’আ কবুল হয়ে থাকে (যা সে রমযান মাসে করে থাকে)।” (সহীহ সনদে ইমাম আহমদ কর্তৃক বর্ণিত, হাদিস নং ৭৪৫০)
৫. রোজার পুরস্কার আল্লাহ স্বয়ং নিজে প্রদান করবেন : একটি হাদিসে কুদসিতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন- আল্লাহ বলেন, “বনি আদমের সকল আমল তার জন্য, অবশ্য রোযার কথা আলাদা, কেননা রোযা আমার জন্য এবং আমিই এর পুরস্কার দেবো।” (সহীহ বুখারী, হাদিস নং ১৮০৫)
৬. রোযা রাখা গোনাহের কাফফারা স্বরূপ এবং ক্ষমালাভের কারণ : রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সাওয়াবের আশায় রমজান মাসে রোযা রাখবে, তার পূর্বের সকল গোনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে।” (সহীহ বুখারী, হাদিস নং ১৯১০)
৭. রোজা জান্নাত লাভের পথ : রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “জান্নাতে একটি দরজা রয়েছে যাকে বলা হয় ‘রাইয়ান’। কিয়ামতের দিন এ দরজা দিয়ে রোযাদারগণ প্রবেশ করবে। অন্য কেউ এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না… রোযাদারগণ প্রবেশ করলে এ দরজা বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে আর কেউ সেখান দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না।” (সহীহ বুখারী, হাদিস নং ১৭৯৭)
৮. সিয়াম রোযাদারের জন্য কিয়ামতের দিন সুপারিশ করবে : রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন: “কিয়ামতের দিন রোযা এবং কুরআন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। রোযা বলবে,  ‘হে রব! আমি তাকে দিনের বেলায় পানাহার ও প্রবৃত্তির কামনা হতে বাধা দিয়েছি; সুতরাং তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ কবুল করুন।’ কুরআন বলবে, ‘আমি তাকে রাতের বেলায় ঘুমাতে দেয়নি; সুতরাং তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন। ফলে এ দুয়ের সুপারিশ গ্রহণ করা হবে।’ (মুসনাদ, হাদিস নং ৬৬২৬)
৯. রোযা জাহান্নামের অগ্নি থেকে মুক্তিলাভের ঢাল : রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, “যে বান্দাহ আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের নিমিত্তে আল্লাহর রাস্তায় একদিন রোযা রাখে আল্লাহ তার ও জাহান্নামের মধ্যে ৭০ বছরের দূরত্ব  তৈরি করেন।” (সহীহ বুখারী, হাদিস নং ১৮৯৪)
১০. এ মাসের রোযা রাখা একাধারে বছরের দশ মাস রোযা রাখার সমান : রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, রামাদানের রোযা দশ মাসের রোযার সমতুল্য, ছয় রোযা দুই মাসের রোযার সমান, এ যেন সারা বছরের রোযা।
১১. রোযাদারের মুখের দুর্গন্ধ আল্লাহর কাছে মিসকের সুগন্ধির চেয়েও উত্তম : রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “যার হাতে মুহাম্মাদের প্রাণ তার শপথ! রোযাদারের মুখের গন্ধ কিয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে মিসকের চেয়েও সুগন্ধিময় হবে।” (সহীহ বুখারী, হাদিস নং ১৮৯৪)
১২. রোযা ইহপরকালে সুখ-শান্তি লাভের উপায় : রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “রোজাদারের জন্য দুটো খুশির সময় রয়েছে। একটি হলো ইফতারের সময় এবং অন্যটি স্বীয় প্রভু আল্লাহর সাথে মিলিত হওয়ার সময়।” (সহীহ বুখারী, হাদিস নং ১৮০৫)

তাকওয়া অর্জনই প্রধান উদ্দেশ্য : সিয়াম ছাড়া অন্য ইবাদাত তাকওয়া সৃষ্টিতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে না। ইসলামের মৌলিক ইবাদতগুলোর মধ্যে যেমন নামাজের মাধ্যমে মানুষকে দেখানোর সুযোগ রয়েছে, জাকাতের মাধ্যমে মানুষ দেখতে পায়, অন্তত যাকে জাকাত দেয়া হল সে তো জানতে পারে। হজ পালনে মানুষ বুঝতে পারে। কিন্তু রোজা যদি কেউ একান্তে গোপনে ঘরে নিভৃত কোণে বসে পানাহার করে তা কোনো মানুষ দেখতে পায় না, সেই ক্ষেত্রে কেবলমাত্র আল্লাহভীতি বা তাকওয়ার গুণাবলিই লোকচক্ষুর অন্তরালে ব্যক্তিকে আল্লাহর পক্ষ থেকে নিষিদ্ধ কাজ থেকে বিরত রাখতে পারে। আর তাকওয়ার এই প্রশিক্ষণ শুধুমাত্র রমজান মাসের জন্য নয় বরং তার জীবন চলার পথে যাবতীয় অন্যায়, দুর্নীতি, পাপ, খারাপ কাজ থেকে লোক ভয় নয়, আল্লাহর ভয়ে বিরত থাকার এক উন্নততর প্রশিক্ষণ তৈরি করে দেয়।

আর  মুমিনের জীবনে তাকওয়া হলো সিরাতুল মোস্তাকিম থেকে বিচ্যুত হওয়ার সার্বক্ষণিক ভয়। যে কোন মুহূর্তে সেও বিচ্যুত হতে পারে মহান আল্লাহর নির্দেশিত পথ থেকে। রোযার মূল কাজ এমন তাকওয়ার বৃদ্ধি। তাই তাকওয়া নিছক ক্ষুধা, তৃষ্ণা ও যৌনতাকে দমিয়ে রাখার সামর্থ্য নয়, বরং সর্ব প্রকার জৈবিক, আত্মিক ও আর্থিক কুপ্রবৃত্তি দমনের ঈমানী শক্তি। এমন তাকওয়া থেকেই প্রেরণা আসে আল্লাহপাকের হুকুমগুলি জানার এবং সে সাথে সেগুলি অনুসরণের। সিয়াম পালনকারী ব্যক্তি এক দিকে নফসের যাবতীয় দাবি প্রত্যাখ্যান করে বিদ্রোহী ও অবাধ্য নফসকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। সমস্ত জুলুম-অনাচার, অত্যাচার ও পাশবিকতার বিরুদ্ধে হয়ে ওঠে সংগ্রামী।

আল-কুরআন পাওয়ার হাউজ : এভাবে মহাগ্রন্থ আল-কুরআনই কেবল মানবজাতির জন্য হুদাল্লিন্নাস অর্থাৎ পথ নির্দেশিকা, যাতে রয়েছে মানবজাতির সকল সমস্যার সমাধান এবং উত্তম জীবনব্যবস্থা। মুসলমানদের পাওয়ার হাউস অর্থাৎ শক্তির উৎসই হচ্ছে আল-কুরআন। এ শক্তির কারণে মুসলমানদের আল্লাহ ব্যতীত আর কারো সামনে মাথা নত করে না। আল্লাহ ব্যতীত আর কারো নির্দেশ পালন করে না। জীবন বিলিয়ে দিতে পারে তবু আপস করে না। প্রকৃতপক্ষে এ মাসের মর্যাদা ও গুরুত্ব বৃদ্ধির উৎস হলো, এ মাসে মানবতার মুক্তি সনদ মহাগ্রন্থ আল কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে। প্রসঙ্গত বলা যায়, ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমানদেরকে কঠিনভাবে দমন নির্যাতন করার পরও কেন বার বার তারা আবার জেগে ওঠে, কোথায় শক্তির সেই আধার? এ প্রশ্নোত্তরের জন্য তৎকালীন ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ব্রিটিশ কলোনিয়াল সেক্রেটারি গোল্ডস্টোনকে দায়িত্ব দিয়ে উপমহাদেশে পাঠিয়েছিল ইংরেজ সরকার। দীর্ঘ প্রচেষ্টা, জরিপ ও গবেষণা করে গোল্ডস্টোন পার্লামেন্টে যে রিপোর্ট জমা দেন, তার সারাংশে একটি মন্তব্য করেন। তার ভাষায় : ‘So long as the muslim have the Quran we shall be unable to dominate them. We must either take it from them or make them lose their love of it’.

বিপ্লবের সেরা মাস : সিয়াম সাধনার মাধ্যমে আমরা প্রশিক্ষণের সেই মাপকাঠিতে উন্নীত হতে পারি, যেমন রাসূল (সা)-এর নেতৃত্বে দ্বিতীয় হিজরি ১৭ রমজান ঐতিহাসিক বদরের প্রান্তরে ইসলাম এবং কুফরির প্রথম সংঘাতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সংখ্যার স্বল্পতা, অস্ত্র রসদ এবং খাদ্য ঘাটতির পরও ঈমান, তাকওয়ার বদৌলতে হকের বিজয়কে নিশ্চিত করেছেন। ঠিক একইভাবে আজকে নব্য জাহেলিয়াত ইসলামের বিরুদ্ধে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক যড়যন্ত্র, ঈমান আকিদা পরিপন্থী সকল নীল নকশাকে প্রতিহত করার শক্তি অর্জন করতে হবে। শানিত করতে হবে ঈমানের তেজকে, টপকে যাওয়ার চেষ্টা করতে হবে বাধার সকল দেয়ালকে, গতি পরিবর্তন করে দিতে হবে অপসংস্কৃতি এবং নগ্নতার স্রোত ধারাকে। কুফরি এবং ফাসেকির ফানুসগুলোকে জ্বালিয়ে দিয়ে উড়াতে হবে দ্বীনের বিজয় কেতন। তাহলেই কেবল সিয়াম সাধনার মাধ্যমে (লায়াল্লাকুম তাত্তাকুন) গুণাবলি অর্জন সম্ভব। হযরত আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত একটি হাদিসের শেষাংশে বর্ণিত এই বৈশিষ্ট্যগুলো অর্জনের তৌফিক কামনা করছি। রাসূল (সা) বলেছেন, “আল্লাহর রাহে মুজাহিদের উদাহরণ সেই ব্যক্তির ন্যায় যে রোজাও রাখে, রাতে নামাজও পড়ে এবং কালামে পাক তেলাওয়াত করে। কিন্তু রোজায় সে কাতর হয় না। নামাজেও তার শৈথিল্য আসে না। ফিরে না আসা পর্যন্ত আল্লাহর পথে জিহাদকারীর অবস্থাও অনুরূপ থাকে।” (বুখারী ও মুসলিম)

রমযানে ঐতিহাসিক ঘটনাবলি : বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবদ্দশায় ও রমজান মাসে বিভিন্ন অবিস্মরণীয় ঘটনাবলি সংঘটিত হয়। তার মধ্য থেকে কয়েকটি ঘটনার আলোকপাত করা হলো। এক. নবুওয়তের প্রথম বছর রমজান মাসে হেরা গুহায় পবিত্র কুরআন শরীফ অবতীর্ণ হয়। দুই. নবুওয়তের ষষ্ঠ বছর রমজান মাসে হজরত উমর (রা.) এবং হজরত হামজা (রা.) ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তিন. নবুওয়তের দশম বছর রমজান মাসে রাসূল (সা:)-এর চাচা আবু তালিব এবং হযরত খাদিজা (রা.) ইন্তেকাল করেন। চার. দ্বিতীয় হিজরির ১৭ রমজানুল মুবারকে ইসলামের প্রথম জিহাদ ঐতিহাসিক ‘গাজওয়ায়ে বদর’ সংঘটিত হয়। পাঁচ. পঞ্চম হিজরির রমজান মাসে খন্দকের যুদ্ধ হয়। ছয়. অষ্টম হিজরির ১০ রমজান জুমার দিনে মক্কা বিজয় হয়। সাত. অষ্টম হিজরির ১৬ রমজান কিয়ামত পর্যন্ত সুদকে হারাম করা হয়। আট. নবম হিজরির রমজান মাসে তাবুকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। নয়. এগারো হিজরির রমজান মাসে ফাতিমা (রা:) ইন্তেকাল করেন। দশ. আটান্ন হিজরির মাহে রমজানে হজরত আয়েশা (রা:) ইন্তেকাল করেন।

পবিত্র রমযানুল মোবারক যেমন কুরআন নাজিলের মাস, তেমনি তা কুরআন বিজয়েরও মাস। কুরআনের আদেশ নিষেধ তথা ইসলামী জীবনব্যবস্থা কায়েমের জন্য পবিত্র রমজান মাসেই গুরুত্বপূর্ণ জিহাদ বা বিপ্লবগুলো সংঘটিত হয়েছিল। রমযান হলো শক্তি ও বিজয়ের প্রতীকী মাস। রমযানের বরকত এবং আল্লাহর রহমতেই মুসলমানরা সেগুলোতে বিজয় লাভ করেছিল। মুসলমানরা এ মাসে এত বেশি বিজয় লাভ করেছে যা অন্য মাসে সম্ভব হয়নি। এই মাসে একটি জিহাদও নেই যে জিহাদে মুসলমানরা পরাজিত হয়েছে। ষষ্ঠ হিজরির রমযান মাসে মুসলমানরা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মুজাহিদ বাহিনীকে বিভিন্ন অভিযানে পাঠায়। তাদের মধ্যে ওক্কাসা বিন মাসফি ও আবু উবায়দা বিন জাররাহর নেতৃত্বে দুটো দল দুটো অভিযানে যায়। যায়েদ বিন হারিসার নেতৃত্বাধীন দলটি খন্দকযুদ্ধে কুরাইশদের সাথে অংশগ্রহণকারী বনি ফোজারার সাথে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়। সপ্তম হিজরির রমযান মাসে গালিবের নেতৃত্বে ১৩০ জন মুজাহিদ বনি আবদ বিন ছাবিলার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য বের হয়। তারা প্রকাশ্যে মুসলমানদের বিরুদ্ধে শত্রুতা করে, যার ফলে যুদ্ধ শুরু হয় এবং হযরত গালিবের বাহিনী জয়লাভ করে।

রাসূল (সা:)-এর ওফাতের পর দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর ফারুক  (রা:)-এর শাসনামলে ১৫ হিজরির ১৩ই রমযান  আবু উবায়দা ইবনে জাররাহ (রা:) জেরুসালেম জয় করেন। কাদিসিয়ার ময়দানে  পারস্য স¤্রাট ইয়াজদাগদের প্রধান সেনাপতি রুস্তমের সাথে ১৫ হিজরির রমযান মাসে মোকাবেলা হয়। তাতে রুস্তম পরাজিত হয় এবং মুসলিম বাহিনী জয়লাভ করে। মুসলমানদের তৃতীয় পবিত্র স্থান বায়তুল মুকাদ্দাসও এই পবিত্র রমযান মাসে জয় করা হয়।

তদানীন্তন পরাশক্তি রোমান সা¤্রাজ্য ইসলামকে উৎখাত করার বহু চেষ্টা চালায়। হযরত আমর বিন আস (রা:)  ২০ হিজরির ২রা রমজান ব্যাবিলন দুর্গ অবরোধ করার পথে রোমান বাহিনীকে পর্যুদস্ত করেন। উমাইয় খলিফা ওয়ালিদের আমলে তার সেনাধ্যক্ষ মূসা বিন নোসাইর ৯১ হিজরির ১লা রমজান তোয়াফ বিন মায়ৈশকে স্পেনের রাস্তা আবিষ্কারের জন্য পাঠান। তারপর ৯২ হিজরির রমজানে তাকে বিন যিয়াদের হাতে স্পেন জয় হয়। ৯৩ হিজরির ৯ই রমজান মূসা বিন নোসাইর স্পেনে পরিপূর্ণ বিজয় লাভের জন্য আক্রমণ চালান এবং বিজয়ীর বেশে ফিরে আসেন। ৯৬ হিজরির রমজান মাসে মোহাম্মদ বিন কাসিমের হাতে অত্যাচারী সিন্ধু রাজা দাহির পরাজিত হয়। ২১২ হিজরির রমজান মাসে জিয়াদ বিন আগলাকের হাতে ইতালির ‘সিসিলি’ দ্বীপ জয় হয়।
সুতরাং আজও যদি  মুসলমানরা প্রকৃত ঈমানের বলে বলীয়ান হয়ে পবিত্র রমজান মাস থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে ইসলামী বিপ্লবে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তাহলে এ বিশ্বের নেতৃত্ব মুসলমানরাই  দেবে।

বাতিলে বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া ও জিহাদী প্রেরণা নবায়ন করা : বর্তমান মুসলিম সমাজের অনেকেরই ধারণা ‘রমজান’ এসেছে শুধু যুহদ বা আত্মিক পরিশুদ্ধির জন্য। কিন্তু এটা ঠিক নয়। এ মাস শুধু ‘যুহদের’ নয়; বরং জিহাদেরও মাস এ রমযান। ইসলামের ইতিহাসে সবচেয়ে দু’টি উল্লেযোগ্য ঘটনা বদর যুদ্ধ ও মক্কা বিজয় সংঘটিত হয় এ রমজান মাসেই। তাই বলা যায়, রমজান হলো খোদাদ্রোহী তাগুতি শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামের মাস, আত্মশুদ্ধির মাস, দ্বীনকে বিজয়ী শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠার মাস। অতএব, দুনিয়ার বিপদগ্রস্ত মুসলিম জাতির লাঞ্ছনা, বঞ্চনা এবং নিস্তেজ অস্তিত্বের গ্লানি দূর করতে রমযানের সাধনা থেকে শক্তি সংগ্রহ করতে হবে। খোদাদ্রোহী তাগুতি শক্তির সকল অপকৌলশ, কূটজাল আর চক্রান্তের বেড়াজাল ছিন্ন করে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর প্রত্যয়ী সিদ্ধান্তও নিতে হবে এ রমজানের অর্জন থেকেই।

রোযার ট্রেনিং এত অপরিহার্য কেন? ভালো মানের কৃষক, শ্রমিক, ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার গড়ার জন্যও লাগাতর ট্রেনিং চাই। তেমনি ট্রেনিং চাই নিষ্ঠাবান মুসলমান গড়ার জন্যও। সে ট্রেনিংয়ের মূল কথা হলো জিহ্বা, পেট ও যৌনতার ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ। ব্রেক ছাড়া কোন গাড়ি নির্মাণ ও সে গাড়িকে রাস্তায় নামানোর বিপদ ভয়াবহ। তাতে অনিবার্য হয় দুর্ঘটনা। তেমনি জিহ্বা, পেট ও যৌনতার ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছাড়া সভ্য সমাজ নির্মিত করা যায় না। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র জুড়ে অশান্তির মূল কারণ হলো লাগামহীন জিহবা। তেমনি পেটের লালসার ওপর নিয়ন্ত্রণ না থাকলে মানুষ তখন উপার্জনে দুর্নীতির আশ্রয় নেয়। তেমনি যৌন লালসার ওপর নিয়ন্ত্রণ না থাকলে মানুষ ব্যভিচারের দিকে ধাবিত হয়। নবীজী (সা:) বলেছেন, অধিকাংশ মানুষ জাহান্নামে যাবে জিহ্ববা ও যৌনাঙ্গের ওপর নিয়ন্ত্রণ না থাকার কারণে। রমযানের মাসব্যাপী রোজা মূলত সে নিয়ন্ত্রণকেই প্রতিষ্ঠা করে। রমযানের রোযা যদি সে নিয়ন্ত্রণ স্থাপনেই ব্যর্থ হয় তবে বুঝতে হবে রোযাদারের মাসব্যাপী ট্রেনিং সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়ে গেছে। রোযা তাকে দিনভর উপবাসের কষ্ট ছাড়া আর কিছ্ইু দেয়নি। বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের রোযা যে তাদের জীবনে কোনরূপ নিয়ন্ত্রণ আনতে পারেনি তা শুধু রমযানের মাসে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে ধরা পড়ে না, প্রকটভাবে ধরে দুর্নীতির মধ্য দিয়েও।

ব্যর্থ হচ্ছে কেন এ প্রশিক্ষণ? আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, সৈনিকের খাতায় নাম লেখালে বা প্রশিক্ষণ কোর্সে ভর্তি হলেই কেউ ভালো সৈনিক রূপে গড়ে ওঠে না। ভালো সৈনিক হতে হলে সৈনিক জীবনের মূল দর্শন ও মিশনের সাথেও সম্পূর্ণ একাত্ম হতে হয়। দেশের স্বাধীনতা ও সংহতিতে তাকে পূর্ণ বিশ্বাসী হতে হয়। এখানে আপস চলে না। তেমনি জীবনভর নামাজ-রোযা, হজ-জাকাতের প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েও বহু মানুষের জীবনে পরিশুদ্ধি আসে না। পরিশুদ্ধি আসে নামায-রোজা, হজ-জাকাতের পাশাপাশি জীবন ও জগৎ নিয়ে ইসলামের যে মূল দর্শন, তার সাথে একাত্ম হওয়ায়। কথা হল, সে দর্শনটি কী? সেটি হলো, আল্লাহকে একমাত্র প্রভু, প্রতিপালক, আইনদাতা ও রিজিকদাতারূপে মেনে নেয়া এবং তাঁর দ্বীনকে বিজয়ী করার লক্ষ্যে নিজেকে একজন আত্মসমর্পিত  সৈনিক রূপে পেশ করা।

মুসলমানের মিশন মূলত আল্লাহর কাছে এক আত্মসমর্পিত গোলামের মিশন। সে দায়িত্ব নিছক নামায- রোযা, হজ-জাকাতে পালিত হয় না। সে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রটি বরং বিশাল; এবং সেটি সমগ্র দেশ, সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা ও সংস্কৃতি জুড়ে। দায়িত্ব পালনের লক্ষ্যে কখনও তাকে দ্বীনের প্রচারক হতে হয়, কখনও রাজনৈতিক কর্মী বা নেতা হতে হয়, আবার কখনও সৈনিক বা জেনারেলের বেশে যুদ্ধও লড়তে হয়। মুসলিম শব্দটির উদ্ভব তো হয়েছে আত্মসমর্পন থেকে, যার নমুনা পেশ করেছিলেন হযরত ইবরাহিম (আ:)। যিনি আল্লাহর প্রতিটি হুকুমেÑ সেটি শিশুপুত্রের কোরবানি হোক বা নিজ দেশ ছেড়ে হিজরত হোকÑ সব সময়ই লাব্বাইক (আমি হাজির এবং মেনে নিলাম) বলেছেন। নামায- রোযা, হজ-যাকাতের মত কোরআনি প্রশিক্ষণ তো এমন আত্মসমর্পিত মুসলমানদের জন্যই। বেঈমান ও মুনাফিকদের জন্য নয়। যারা জান্নাত চায়, আল্লাহতায়ালার এ প্রশিক্ষণ তো তাদেরকে সে মহাপুরস্কার লাভের জন্য যোগ্য করে গড়ে তোলে। প্রতিটি ঈমানদার যেমন এ প্রশিক্ষণ থেকে ফায়দা পায়, তেমনি এর সাথে একাত্মও হয়।

রমযান মাসে আমাদের করণীয় :
ষ    সর্বোত্তম পন্থায় সিয়াম পালন করা।
ষ    কুরআনুল কারীম তেলাওয়াত, চর্চা ও গবেষণা
ষ    কিয়ামুর লাইল
ষ    আল্লাহর পথে অর্থ ব্যয়
ষ    লাইলাতুল কদর অন্বেষা ও ইবাদতের মাধ্যমে তা উদযাপন
ষ    সঠিক সময়ে সেহরি ও ইফতার করা ও অন্যকে করানো
ষ    রমযানের প্রতিটি মুহূর্ত কাজে লাগানোর জন্য চেষ্টা করতে হবে
ষ    সমাজে ও রাষ্ট্রে দ্বীনি পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে
ষ    কুরআন তেলাওয়াত করা এবং এর মর্ম উপলব্ধি করা
ষ    আল্লাহর রাস্তায় বেশি বেশি দান ও সদকা করা
ষ    বেশি বেশি দো’আ, যিকর এবং ইস্তেগফার করা
ষ    সকল প্রকার ইবাদতে নিজেকে ব্যাপৃত রাখা
ষ    লাইলাতুল ক্বাদর ও রমজানের ফজিলত

শরীয়ত যা বর্জন করতে নির্দেশ দিয়েছে :
শরীয়তের পক্ষ থেকে মূলত ছোট-বড় সকল গোনাহ ও পাপ সর্বদা বর্জন করার নির্দেশ এসেছে। আর রমজান মাস  ফজিলতের মাস এবং আল্লাহর ইবাদতের প্রশিক্ষণ লাভের মাস হওয়ায় এ মাসে সর্বপ্রকার গোনাহের কাজ পরিত্যাগ করা অধিক বাঞ্ছনীয়। তদুপরি রমজান মাসে সৎকাজের সওয়াব ও নেকি বহুগুণে বৃদ্ধি পায়, তাই রামাদানের সম্মান ও ফজিলতের কারণে এ মাসে সংঘটিত যে কোন পাপের শাস্তি অন্য সময়ের তুলনায় ভয়াবহ হবে এটাই স্বাভাবিক। এ জন্যই রোযাদারদের উচিত তাকওয়াবিরোধী সকল প্রকার মিথ্যা কথা ও কাজ পরিপূর্ণভাবে বর্জন করা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “যে ব্যক্তি  (রোযা রেখে) মিথ্যা কথা ও সে অনুযায়ী কাজ করা বর্জন করে না তবে তার শুধু খাদ্য ও পানীয় বর্জন করায় আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই।” (সহীহ বুখারী, হাদিস নং ১৮০৪) অন্য আরেকটি হাদিসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “তোমাদের কেউ রোযার দিনে অশ্লীল কথা যেন না বলে এবং শোরগোল ও চেঁচামেচি না করে। কেউ তাকে গালমন্দ করলে বা তার সাথে ঝগড়া করলে শুধু বলবে, আমি রোযাদার।” (সহীহ বুখারী, হাদিস নং ১৮০৫)

শেষ কথা : ত্বাকওয়া অর্জনের এ মুবারক মাসে মুমিনদের ওপর অর্পিত হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব, সৃষ্টি হয়েছে পুণ্য  অর্জনের বিশাল সুযোগ এবং প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে মহান চরিত্র অর্জনের সুন্দর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। এ অর্পিত দায়িত্ব পালন এবং সুবর্ণ সুযোগের সদ্ব্যবহার করে আজ সারা বিশ্বের মুসলিমদের উচিত চারিত্রিক অধঃপতন থেকে নিজেদের রক্ষা করা, নেতিয়ে পড়া চেতনাকে জাগ্রত করা এবং সকল প্রকার অনাহূত শক্তির বলয় থেকে মুক্ত হয়ে হক প্রতিষ্ঠার প্রতিজ্ঞাকে সুদৃঢ় করা, যাতে তারা রিসালাতের পবিত্র দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারে এবং কুরআন নাজিলের এ মাসে কুরআনের মর্ম অনুধাবন করতে পারে, তা থেকে হিদায়াত লাভ করতে পারে এবং জীবেনের সর্বক্ষেত্রে একেই অনুসরণের একমাত্র মত ও পথ রূপে গ্রহণ করতে পারে। রমাদান আমাদের জীবনে বয়ে আনতে পারে অপরিসীম কল্যাণ। রমাদানের উদ্দেশ্যাবলি অর্জন করতে পারলে আমাদের জীবন হয়ে উঠবে সুন্দর, পূত-পবিত্র ও মহিমান্বিত।  পবিত্র মাহে রমযানের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ সর্বজনীন-কল্যাণের শাশ্বত চেতনায় সকল অকল্যাণ ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে মানবতাকে বিজয়ী করার পথে আমাদের এগিয়ে দিক। রমজানের শিক্ষার আলোকে আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রকে গড়ে তুলতে হবে। আল্লাহ আমাদের সকল আমল কবুল করুন এবং আমাদের সবাইকে আরো উত্তম আমল করার তাওফিক দান করুন।