প্রতিবাদের ভাষা সবসময় একরকম হয় না। মুখের ভাষায় কিংবা রাস্তায় বিভিন্নভাবে অবস্থান করার মাধ্যমে স্বাধীন দেশে মানুষ তার স্বাধীন মত প্রকাশ করবে, এটা আবহমানকাল থেকে বাংলার রীতি ছিলো। বিশেষ করে বাকশাল পরবর্তী বাংলাদেশে মানুষ স্বাধীনতার স্বাদ পেতে শুরু করেছিলো। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় হলে স্বাধীনতার সূর্য নতুন ধারায় অস্তমিত হতে শুরু করে। ইংরেজদের কাছে রাজসিংহাসনের কতিপয় আত্মবিস্মৃত গুরুত্বপূর্ণ নেতার পদস্খলনের মাধ্যমে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয় পরবর্তী পরাধীন জীবনের সাথে আজকের বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকারের তুলনা করা একটু কঠিন।
জাতীয় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো সিনিয়র সিটিজেনদের মধ্যে যারা উচ্চশিক্ষিত। এই শ্রেণির মানুষদের চিন্তাধারার ওপর সবসময় সাধারণ মানুষ আস্থাশীল থাকে। দুঃখজনকভাবে সত্য ঘটনা হচ্ছে, এই বুদ্ধিজীবী শ্রেণির সুশীলসমাজের অধিকাংশই আজকে ইচ্ছে করে হোক অথবা বাধ্য হয়ে ক্ষমতাসীন সরকারের আজ্ঞাবহ হয়ে কথা বলেন, মত প্রকাশ করেন এবং থিওরি ছাড়েন। ফলশ্রুতিতে সত্য চর্চাকারী সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এই সিনিয়র সিটিজেনদের সার্বিক সাপোর্ট পাওয়া সরকার পাকাপোক্ত হয়ে যা ইচ্ছে তা-ই করতে থাকে। হয়েছেও তাই। বিপরীতে সত্যপন্থী সাধারণ মানুষ প্রতিবাদে মুখর হতে যেহেতু বাধাগ্রস্ত হচ্ছেন, তাই তারা মৌন থেকেই আজ প্রতিবাদ করছেন।
সরকারের অংশীদার হওয়ার সুবাদে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনকারী ব্যক্তিও পেশাদারিত্ব ভুলে গেছে আজ। এমনকি পেশাদারিত্বহীনতা যেন আজ গেজেটেড উদ্যোগ হয়ে গেছে। অর্থাৎ আপনি আওয়ামী লীগ সরকারের অনুগত হলে রাষ্ট্রের যে দায়িত্বেই থাকেন না কেন, দায়িত্বপালনরত অবস্থায়ও আওয়ামী লীগের ভোকালিস্ট হতে কোনো বাধা নেই। সম্প্রতি রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয় ছাত্রলীগ আয়োজিত এক সম্মেলনে রাজশাহী সিটি করপোরেশন মেয়র খায়রুজ্জামান লিটন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবির নেতাকর্মীদের যেখানেই পাওয়া যাবে সেখানেই গলা কেটে হত্যা করার নির্দেশ দেন।
মর্মান্তিক বিষয় হচ্ছে, এর প্রতিবাদে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবির কিংবা এরকম হত্যার হুমকিপ্রাপ্ত যে কেউ প্রত্যক্ষ প্রতিবাদ করতে গেলে উল্টো রাষ্ট্রীয় প্রশাসন ব্যবহার করে দমনপীড়ন করতে যখন সরকার তৎপর হয়, তার বিপরীতে সেইসব সুশীলসমাজের কাউকে কণ্ঠ উঁচু করতে দেখা যায় না। যার কারণে নিরীহ অসহায় জনগণ মুখ বুজে প্রতিবাদ করার সিদ্ধান্ত নেয়াকেই অবলম্বন করে যায়।
এই প্রশ্ন এখন সারা বাংলার সকল শোষিত বঞ্চিত মানুষের। সরকার একের পর এক অন্যায় আইন করে জাতির সীমাহীন ক্ষতির বীজ বপন করে যাচ্ছে। মানুষ বুঝতে পেরেও নিজ অবস্থান প্রকাশ করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়ে যখন সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখছে, তখনও কণ্ঠরোধের মজবুত খড়গ নিয়ে প্রশাসনকে পাঠাচ্ছে। ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন দিয়ে খুঁজে খুঁজে বের করে আনছে সরকারের অন্যায় সম্পর্কে বিরোধিতাকারী। তার দলীয় পরিচয় না থাকলেও রেহাই নেই। বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরারের মতো পরিণতির ভয়ে তাই মানুষ একেবারেই প্রকাশ্যে প্রতিবাদ বন্ধ করে মনে মনে প্রতিবাদ করে যাচ্ছে। হাহাকারগুলো আজ মানুষের অন্তরে অন্তরে প্রতিবাদ ছড়াচ্ছে।
ফেরআউনের যুগে এরকম জুলুম-অত্যাচার হয়েছিলো। আল্লাহ বরদাশত করেননি। নীল দরিয়ায় ডুবিয়ে মেরেছিলেন মহান আল্লাহ। আল্লাহ অন্যায়কারীর অন্যায় বাড়তে দেন। এসব অপরাধীদের ঢিল দিয়ে দিয়ে তিনি অন্যায়-অপরাধ করতে করতে তারা কতদূর এগোতে পারে, তা দেখেন। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের অন্যায়-অপরাধও আল্লাহ একদিন আটকাবেন ইনশাআল্লাহ।
প্রশ্ন হচ্ছে- জাতি কবে এই জুলুমবাজ সরকারের বিপরীতে প্রতিবাদমুখর হবে। তার আগে খেয়াল করতে হবে, জাতির মধ্যে প্রতিবাদের প্রয়োজনীয়তার গুরুত্ব কতটুকু। আপনার মনে প্রশ্ন হতে পারে, জাতির তো নাভিশ^াস উঠে গেছে, এরপরও কি প্রতিবাদের প্রয়োজনীয়তা খুঁজতে হবে! আমি বলবো এই ধারণা নিয়ে আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে। কারণ খুব সহজ। প্রতিদিন কোনো না কোনো বড় ধরনের জুলুমের সম্মুখীন হচ্ছি দেশে। পরের দিন আর আগের বিষয় মনে রাখছি না। যার কারণে নতুন নতুন দুঃখজনক পরিণতির দিকে জাতিকে ধীরে ধীরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, কোনো মানুষই ঘুরে দাঁড়াচ্ছে না। পাশাপাশি আরেকটা বিষয়তো আছেই, ব্যক্তি হিসেবে আপনি যদি সরকারের বশ্যতা স্বীকার করে চলতে পারেন, তাহলে আপনি নিজেই আরেকজন জুলুমবাজ শোষকে পরিণত হয়ে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করে বীরদর্পে মাথা উঁচিয়ে চলতে পারবেন।
অন্যদিকে একেবারে কেউ যে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে না, তা নয়। জাতিকে নিয়ে কিছুসংখ্যক চিন্তাশীল ও দায়িত্বশীল মানুষ ভাবছে। কিন্তু তাদের পক্ষাবলম্বনকারী লোকসংখ্যা কম হওয়া এবং সরকারের জুলুম দৃঢ় হওয়ায় সকল অনুসারীর অবস্থান সবসময় একইরকম থাকছে না। ফলে শক্তভাবে দাঁড়িয়ে যাওয়া কঠিন হচ্ছে।
আশার বাণী হচ্ছে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান করার জন্য সমাজে অন্যায় থাকাটা জরুরি। তাহলে ন্যায়বোধের প্রয়োজনীয়তা বোঝা যায়। বর্তমান সময়ে ন্যায়বোধের চর্চাকারী গোষ্ঠী কিংবা দলগুলোকে এই বিষয়টি উপলাব্ধি করতে হবে। বিশেষ করে ইসলামী আন্দোলনের বিজয়ের স্বপ্ন দেখেন যেসকল দল, তাদের জন্য এখন সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। দলগুলো যদি তাদের সত্য দাওয়াত নিয়ে মানুষের কাছে পৌঁছতে পারে, তাহলে এক বিশাল সত্যানুরাগী জনগোষ্ঠীর মনে আলোর মশাল জ্বালিয়ে দেওয়া সম্ভব হতে পারে। সেই শক্তির প্রতিবাদের ভাষা যাই হোক না কেন, কণ্ঠ উচ্চকিত হবেই হবে ইনশাআল্লাহ।
আমাদের দেশের বর্তমান তরুণ ও যুবসমাজের জন্যও বর্তমান সময় খুব গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান সরকারের অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্তের কারণে শিক্ষাব্যবস্থা একেবারে খাদের কিনারে অবস্থান করছে। একজন সচেতন শিক্ষার্থীকে এই ক্ষতিকর পরিস্থিতি থেকে নিজেকে বাঁচাতে এবং জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে নিজেকে জাতির কল্যাণে উৎসর্গ করা অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু কী করে এই পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে, তার ধারণা অনুপস্থিত। দেশের মেধাবী তরুণ-যুবকদের এই পয়েন্টটি ধরতে পারা জরুরি। নিজেদের ভবিষ্যৎ গড়ে দেওয়ার যে পরিমাণ বক্তব্য সরকারের পক্ষ থেকে তুলে ধরা হচ্ছে, তার সবটাই যে ভুয়া তা বুঝতে হবে। সরকার যদি আগামী প্রজন্ম নিয়ে সত্যিই ভাবতো, তাহলে তারা এতো দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে শিক্ষার্থীদের অন্ধকারে রাখতো না।
শিক্ষাব্যবস্থার বর্তমান দুঃখজনক অবস্থার কারণে আগামী প্রজন্ম অন্তসারশূন্য হয়ে গড়ে উঠছে। বিশেষ করে করোনা পরিস্থিতির দোহাই দিয়ে বাংলাদেশে যে দীর্ঘ সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে, বিশ্বের কোনো দেশে তা করা হয়নি। বিপরীতে এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় অনলাইন ক্লাস নেয়ার কথা বলা হলেও দেশ ডিজিটাল দিক থেকে উন্নত হওয়ার বক্তব্য কোনো কাজে লাগেনি। পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন না করে পাইকারি হারে পাস করিয়ে দেয়ার ঘটনা জাতিকে হতবাক করেছে। যার মাশুল দিতে হচ্ছে বিশ্ব বিদ্যালয়গুলোকে। মেধাহীন প্রজন্মকে নিয়ে তারা দিশেহারা। তাই তারা গুণগত মানের শিক্ষার দিকে বেশি মনোযোগী হতে গিয়ে আসন কমিয়ে মান নিশ্চিতের দিকে হাঁটছে। অথচ তার বিপরীতে লাখো শিক্ষার্থীর উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হওয়ার পরিস্থিতি নিশ্চিত হয়েছে। এককথায় শিক্ষাব্যবস্থার দিকে সরকারের অমনোযোগিতার ফলাফল হিসেবে সরকার যে সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে, তাতেই হোঁচট খাচ্ছে।
এই করুণ অবস্থা থেকে জাতিকে বিশেষ করে আগামী প্রজন্মকে নিয়ে খুব কমসংখ্যক মানুষ ভাবছে। বিশেষ করে ছাত্রসংগঠনগুলোর এই একটি পয়েন্টে এক হয়ে কাজ করা প্রয়োজন আছে বলে মনে করছি। এবং এখনই সিদ্ধান্ত না নিলে তাদেরও রাজনীতি করার ভবিষ্যতের সকল সুযোগ চিরতরে বন্ধ হতে পারে।
ক্ষতির মৌলিক খতিয়ান নিয়ে ভাবতেই হবে
সচেতন সত্য-ন্যায় অবলম্বনকারী বুদ্ধিজীবী, দায়িত্বশীল ছাত্রসংগঠন এবং মেধাবী শিক্ষার্থীদের বর্তমান সময়ের মৌলিক কয়েকটি বিষয় নিয়ে অবশ্যই ভাবতে হবে এবং এখান থেকে পরিত্রাণের লক্ষ্যে শক্ত অবস্থান জোরদার করতেই হবে। এ ভূখণ্ডের মানুষের ভাষার অধিকারের ওপর আঘাত আসার পর কিন্তু ঠিকই জেগে উঠতে হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ কিন্তু কোনো আবেগনির্ভর উদ্যোগ ছিলো না। শত শোষণ-বঞ্চনার বিপরীতে সচেতন দেশবাসীকে জাগতেই হয়েছে। এখন সেই ‘পিক আওয়ার’ চলমান জেগে ওঠার।
সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি, সারাদিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি- কবির এই লাইনগুলো আর কাজে লাগছে না। কারণ রাষ্ট্রীয়ভাবে আইন করে পরিবার, সমাজকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শনের জন্য সুযোগ দেওয়া হয়েছে। মাদক আইন নির্দেশ করছে, কোনো যুবককে আর বাধা দিয়ে এই কাজ থেকে ফেরানোর সুযোগ থাকছে না। কারণ মাদক সেবনের পারমিটধারী হচ্ছে মানে, তার বিরুদ্ধে কেউ অবস্থান নিলে আইনের আশ্রয় নিতে পারবে সে। ওটিটি আইনের দ্বারা ডিজিটাল কন্টেন্ট নির্মাণে অশ্লীলতার পারমিশন পাওয়া যাবে। অনলাইন প্ল্যাটফর্ম হলো উন্মুক্ত জগৎ। এখানে এখানো বয়সের রেসট্রিকশন বাস্তবায়নের অবস্থায় বাংলাদেশ পৌঁছেনি। তার আগেই এসব উন্মুক্ত হলে পর্নোগ্রাফি দেশেই তৈরি শুরু হবে। আর এর প্রভাব কেমন হবে, তা সকলেই বোঝার কথা।
এই যে মৌলিক এক ভয়ঙ্কর ক্ষতির ঝুঁকি, তার পুরোটাই আগামী প্রজন্মের। কেউ যদি মনে করেন, আমি নিজের মতো করে চলবো, নিজেকে নিয়ে নিজের পরিবার নিয়ে বা একটি সুন্দর সমাজে আলাদা করে সুখে শান্তিতে বসবাস করতে থাকবো; তারা বোকার রাজ্যে বসবাস করছেন। বর্তমান সরকারের একের পর এক জাহেলি সিদ্ধান্ত আসলে আমাদেরকে সুখে শান্তিতে থাকতে দেবে না। সমাজ পরিবার কিংবা ব্যক্তি নিজেও নিজেকে কখন হারিয়ে ফেলবে, তা বুঝতেই পারবে না। মূলত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আগেই সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রকৃত সময়ে আমরা অবস্থান করছি। গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, নৈতিক শিক্ষা সমুন্নত করা, অন্যায় প্রতিরোধ করা এই অবস্থানের মূলমন্ত্র হওয়া প্রয়োজন।
লেখক : -রাশেদুল ইসলাম
সাবেক সম্পাদক, ছাত্র সংবাদ