ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের পারস্পরিক সম্পর্ক

ভূমিকা

 

ইতিহাস পর্যালোচনা করলে একথা দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, আম্বিয়ায়ে কিরাম সর্বদাই মানব সমাজের পুনর্বিন্যাস করেছেন। তাঁরা মানব জাতিকে এক বুনিয়াদী আদর্শের দিকে আহবান জানিয়েছেন। এবং সে আহবানে যারা সাড়া দিয়েছে, তাদেরকে এক নতুন ঐক্যসূত্রে গেঁথে দিয়েছেন। যে মানব গোষ্ঠী বিভিন্ন দল-গোত্র-খান্দানে দ্বিধাবিভক্ত হয়েছিলো, ছিলো পরস্পরের রক্ত পিপাসু ও ইজ্জতের দুশমন-এ আহবানর ফলে তারা পরস্পর পরস্পরের ভাই এবং একে অপরের ইজ্জতের সংরক্ষক বনে গেল। এই ঐক্যের ফলে এক নতুন শক্তির উদ্বোধন হলো এবং এই আহবান দুনিয়ার সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস সৃষ্টি করলো ও শ্রেষ্ঠতম সংস্কৃতি রূপায়ণের নিয়ামকে পরিণত হলো। এই গূঢ় সত্যের দিকেই আল কুরআন ইংগিত করেছে তার নিজস্ব অনুপম ভঙ্গিতেঃ

 

واذكروا نعمة الله عليكم اذ كنتم اعداء فالَّف بيت قلوبكم فاصبحتم بنعمته اخوانا وَّ كنتم على شفاء حفرة من النار فانقذكم منها –

 

“আল্লাহর সেই নিয়ামতের কথা স্মরণ করো, যখন তোমরা ছিলে পরস্পরের ঘোরতর দুশমন, তখন তিনিই তোমাদের হৃদয়কে জুড়ে দিলেন এবং তোমরা তাঁর অনুগ্রহ ও মেহরবানীর ফলে ভাই-ভাই হয়ে গেলে। (নিঃসন্দেহে) তোমরা ছিলে আগুনের গর্তের তীরে দাঁড়িয়ে। অতঃপর তিনি তোমাদেরকে সেখান থেকে নাজাত দিলেন (এবং ধ্বংসের হাত থেকে রা করলেন।)” আলে ইমরানঃ ১০৩

 

আম্বিয়ায়ে কিরাম মানব জাতিকে আহবান জানিয়েছেন এই বলেঃ

 

واعتصموا بحبل الله جميعا ولا تفرقوا –

 

“আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরো (ঐকবদ্ধ হও) এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না।”

 

ইসলামের এই একতা শুধু কানুনী বাহ্যিক একতা নয়, বরং এ হচ্ছে হৃদয়ের একত্ব। ইসলাম শুধু কানুনী ঐক্যকে ঐক্য মনে করে না, বরং এই বাহ্যিক ঐক্যের বুনিয়াদকে সে মানুষের হৃদয়ে স্থাপন করতে চায়। এর প্রকৃত উৎস হচ্ছে বিশ্বাস ও মতোবাদের ঐক্য, আশা ও আকাঙ্খার ঐক্য, সংকল্প ও হৃদয়াবেগের ঐক্য। সে বাইরে যেমন সবাইকে এক ঐক্য সূত্রে গেঁথে দেয়, তেমনি ভেতর দিক দিয়েও তাদেরকে এক ‘উখুয়্যাত’ বা ভ্রাতৃত্বের সম্পর্কে জুড়ে দেয়। আর এটাই সত্য যে, এই উভয় লক্ষণ যখন পূর্ণভাবে প্রকাশ পায়, প্রকৃত ঐক্য ঠিক তখনই গড়ে ওঠে। কারণ কৃত্রিম ঐক্য কখনো স্থায়ী হয়না ঘৃনা ও বিদ্বেষপূর্ণ হৃদয় কখনো যুক্ত হতে পারে না। মিথ্যা কখনো কোন ঐক্য গড়ে তুলতে পারে না। স্বার্থপরতামূলক ঐক্য শুধু বিভেদ ও অনৈক্যের উৎস হয়ে থাকে। আর শুধু আইনগত বন্ধনও কোন যথার্থ মিলন বা বন্ধুত্বের ভিত্তি রচনা করতে পারে না। এ কারণেই ইসলাম একতার ভিত্তিকে ঈমান, ভালোবাসা ও আত্মত্যাগের ওপর স্থাপন করেছে। এই ভিত্তিভূমির ওপর গড়ে ওঠা সম্পর্ক এমনি সুদৃঢ় প্রাচীরে পরিণত হয় যে, তার সাথে সংঘর্ষ লাগিয়ে বড় বড় তুফানও শুধু নিজের মস্তকই চূর্ণ করতে পারে, কিন্তু তার কোন তি সাধন করতে পারে না।

 

উপরন্তু এই ভিত্তির ওপর যে সমাজ সংস্থা গঠিত হয়, সেখানে বিরোধ ও সংঘর্ষের বদলে সহযোগিতা ও পোষকতার ভাবধারা গড়ে ওঠে। সেখানে একজন অপরজনের সহায়ক, পৃষ্টপোষক ও সাহায্যকারী হয়ে থাকে। সেখানে পড়ন্ত ব্যক্তিকে পড়ে যেতে দেয়া হয় না, বরং তার সাহায্যের জন্যে অসংখ্য হাত প্রসারিত হয়। সেখানে পিছে পড়ে থাকা ব্যক্তিকে ফেলে যাওয়া হয় না, বরং তাকে সর্বতো ভাবে সাহায্য করে সামনে এগিয়ে নেয়া হয়। এ সমাজ ব্যক্তিকে তার সমস্যাদির মুকাবেলা করার যোগ্য করে তোলে এবং পতনশীল ব্যক্তিকে আঁকড়ে ধরে রাখার কাজ আঞ্জাম দেয়।

 

ইসলাম যে ভিত্তিগুলোর ওপর তার সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তোলে সেগুলোকে খুব ভালোমতো অনুধাবন করা এবং সে লক্ষ্য অর্জনের জন্যে নিজের শক্তি ও সামর্থকে নিয়োজিত করা ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের পক্ষে অবশ্য কর্তব্য।

 

আমাদের শ্রদ্ধেয় বন্ধু ও প্রিয় ভাই খুররম জাহ্ মুরাদ ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের এ বুনিয়াদী প্রয়োজনটি পূর্ণ করার জন্যে এই পুস্তকটি রচনা করেছেন। এ দেশের যে ক’জন নগন্য সংখ্যক যুবক পাশ্চাত্য শিক্ষা লাভ করা সত্ত্বেও ধর্মীয় জ্ঞান অর্জনে বিশেষ প্রচেষ্টা চালিয়েছেন এবং এ ব্যাপারে যথেষ্ট কৃতিত্ব অর্জন করেছেন, খুররম সাহেব তাঁদের অন্যতম। বস্তুতঃ খোশবু থেকে যদি ফুলের পরিচয় পাওয়া যায় তবে তাঁর এ রচনাটিও তাঁর চিন্তাধারা ও দৃষ্টিভংগী উপলব্ধি করার পক্ষে সহায়ক হবে। প্রকৃতপক্ষে আলোচ্য বিষয়টির তিনটি দিক রয়েছেঃ

 

একঃ এক সামাজিক ও সামগ্রিক জীবনধারা গড়ে তোলা এবং একে স্থিতিশীল রাখার জন্যে ইসলাম ব্যক্তি-চরিত্রে কোন্ কোন্ মৌলিক বৈশিষ্ট্যের প্রকাশ দেখতে চায়।

 

দুইঃ কি কি বস্তু এ ভিত্তিগুলোকে ধ্বংস ও দুর্বল করে দেয়, যাতে করে সেগুলো থেকে বেঁচে থাকা যায়।

 

তিনঃ কি কি গুণাবলী এ ভিত্তিগুলোকে মজবুত ও উন্নত করে তোলে, যাতে করে সেগুলোকে গ্রহণ করা যেতে পারে।

 

শ্রদ্ধেয় লেখক অত্যন্ত বিস্তৃতভাবে এ তিনটি প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। আমি বিশ্বাস করি, ইসলামী আন্দোলনের কর্মীগণ যদি এই জবাবগুলো অভিনিবেশ সহকারে পড়েন এবং এগুলো অবলম্বন করার প্রয়াস পান, তবে নিজেদের সামগ্রিক জীবনকেই তারা ঈমান, ভালোবাসা ও আত্মত্যাগের পুষ্পে- যা জীবনের ফুল-বাগিচাকে কুসুমিত করে তোলে –পুষ্পিত করতে পারবেন।

 

এ পুস্তিকা থেকে উপকারীতা লাভের ব্যাপারে কর্মীদের আরো একটি বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। সমস্ত জিনিস মানুষ রাতারাতি অর্জন করতে পারে না। তাই আমাদের কর্তব্য হচ্ছে: চরিত্র গঠনের গোটা পরিকল্পনাটিকে বুঝে নিয়ে এক একটি জিনিসকে মনের মধ্যে খুব ভালো মতো বদ্ধমূল করে নেয়া, তারপর তাকে গ্রহণ ও অনুসরণ করার চেষ্টা করা এবং এভাবে প্রথমটির পর দ্বিতীয়টির পর তৃতীয়টিকে গ্রহণ করা।

 

হযরত আব্দুল্লাহ বিন উমর (রাঃ) সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, তিনি সাত-আট বছরে সূরায়ে বাক্বারাহ পড়েছিলেন। এ সম্পর্কে তাঁর কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হলে তিনি বলেন যে, ‘আমি একটি জিনিস পড়ি, তাকে গ্রহণ করি এবং তারপর সামনে অগ্রসর হই।’ বস্তুতঃ চরিত্র গঠনের জন্যে এমনি ক্রমিক, ধারাবাহিক ও অবিশ্রান্ত প্রচেষ্টারই প্রয়োজন। নিছক অধ্যায়নই এর জন্যে যথেষ্ট নয়। এ উদ্দেশ্য কেবল ক্রমাগত প্রয়াস-প্রচেষ্টার দ্বারাই হাসিল হতে পারে। এ কথাও খুব ভালোভাবে মনে রাখতে হবে যে, এটা চড়াই-উৎরায়ের পথ। সাহস ও আস্থার সাথে অবিরাম প্রচেষ্টার ভেতরেই এ পথের সাফল্য নিহিত। এ পথে ব্যর্থতা আসবে কিন্তু দৃঢ়ভাবে তার মুকাবেলা করতে হবে। সমস্যা যুদ্ধের আহবান জানাবে, কিন্তু তাকে জয় করতে হবে। সংকট বাধার সৃষ্টি করবে, কিন্তু তাকে পরাভূত করতে হবে। এগুলো হচ্ছে এ পথের অনিবার্য পর্যায়। এসব দেখে কি আমরা ভীত কিংবা লক্ষ্যপথ থেকে পিছিয়ে যাবো|

 

-অধ্যাপক খুরশীদ আহমাদ।

 

ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের পারস্পরিক সম্পর্ক

খুররম জাহ মুরাদ

book স্ক্যান কপি ডাউনলোড