ভূমিকা
(প্রথম বাংলা একাডেমী সংস্করণের)
কোনো এনসাইক্লোকডিয়া বা জ্ঞানকোষ একক প্রচেষ্টায় প্রস্তুত বরা সম্ভব নয়। এজন্য যৌথ প্রচেষ্ঠা আবশ্যক। ইংরেজী ভাষায় ছোটবড় আকারের নানা এনসাইক্লোপিডিয়ার প্রকাশ দেখা যায়। বাংলা ভাষায়, বিশেষ করে বাংলাদেশে এরূপ জ্ঞানকোষ নাই। জ্ঞানকে সর্বজনীন করার জন্য জ্ঞানকোষ অপরিহার্য। এক্ষেত্রে আমাদের নিদারুণ দৈন্যই আমার মধ্য বর্তমান গ্রন্থ রচনার মানসিক তাগিদ সৃষ্টি করে। সে প্রায় ছ’বছর পূর্বের কথা। নিজের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কথা আমরা জানি। তথাপি এক্ষেত্রে কিছু না করাকে নিজের মনে অপরাধ বলে বোধ হয়েছে। এই মানসিক বোধ থেকে এবং বন্ধুজনদের উৎসাহে কাজটি শুরু করি। বাংলা একাডেমী কর্তৃপক্ষ একাডেমীর গবেষণা পত্রিকাকে ‘দর্শনকোষ’ খানি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করতে শুরু করেন ১৯৬৮ সনে। একাডেমী পত্রিকাতে প্রকাশিত হতে থাকলে সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, ছাত্রবন্ধু এবং জ্ঞানানুরাগী বিভিন্ন জনের কাছ থেকে আমি আন্তরিক উৎসাহজনক সাড়া পেতে থাকি। তাঁরা সবাই ‘দর্শনকোষ’খানি সমাপ্ত করার তাগিদ দেন। তাঁদের এই তাগিদ এবং পরামর্শ আমার এই কাজে বিশেষ অনুপ্ররেণা যোগায়।
‘দর্শনকোষ’ নামে বর্তমান গ্রন্থ প্রকাশিত হলেও দর্শনকে ব্যাপক অর্থে গ্রহণ করে দর্শন, সমাজতত্ত্ব, রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং ইতিহাসের অত্যাবশ্যকীয় পদ, তত্ত্ব, তাত্ত্বিক, চিন্তাবিদ এবং ঐতিহাসিক ব্যাক্তির উপর রচিত ব্যাখ্যামূলক প্রবন্ধের সংখ্যা চার শতের অধিক। জ্ঞানকোষের কোনো নির্দিষ্ট সীমা নাই। বর্তমান কোষ আকারে খুব বৃহৎ নয়। কিন্তু এর অন্তর্ভক্ত বিষয়গুলিকে আমাদের জ্ঞান এবং শিক্ষাক্ষেত্রের দিকে সযত্ন লক্ষ্য রেখে নির্বাচন করা হয়েছে। ব্যাখ্যা কিংবা বিবরণের পরিধিও সীমাবদ্ধ। তার কারণ, আমার উদ্দেশ্য হচ্ছে, এই বিষয়গুলিকে প্রাথমিকভাবে বাংরা ভাষায় উপস্থিত করা এবং পাঠকদের মনে বিষয়গুলির প্রতি কিছুটা আগ্রহ সৃষ্টি করা যাতে তাঁরা বৃহত্তর কোষ কিংবা গ্রন্থের মধ্যে তাঁদের জ্ঞানের পিপাসা নিবৃত করার চেষ্টা করেন।
কাজটি অগ্রসর হচ্ছিল। এমন সময়ে দেশের উপর পাকস্থানি দখলদার বাহিনীর অপ্রত্যাশিত এবং অচিন্তনীয় বর্বর হামলা শুরু হয় ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত্রিতে। এরপর যে-বর্বরতার অন্ধকার যুগ বাংলাদেশের বুকে নেমে আসে তাতে কত জ্ঞানী, গুনী, কবি, শিক্ষাবিদ, ছাত্র, শিক্ষক নির্মমভাবে নিহত হয়েছেন তাঁর সংখ্যা আজো নিদিষ্ট হয় নি। সেই অন্ধকার পর্যায়েও আপন শক্তি ও সাধ্যমতো ‘দর্শনকোষে’র কাজটি চালাবার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু পাকিস্থান সাময়িক বাহিনী আমাকে পরবর্তীকালে গ্রেফতার করে বন্দিনিবাসে নিক্ষেপ করে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে বন্দিনিবাস থেকে মুক্ত হয়ে আমি আবার কাজ শুরু করি এবং গত বৎসরই কাজটি সমাপ্ত করে একাডেমীর কাছে পেশ করি।
জ্ঞানকোষ মাত্রেরই সংযোজন এবং সংশোধনের অবকাশ থাকে। নতুন বিষয় সংযোজনের কাজটি চালিয়ে যাব। সম্ভব হলে নতুন সংস্করণের পূর্বেই কোষের নতুন সংযোজন প্রকাশ করা হবে। ‘দর্শনকোষ’ রচনার ক্ষেত্রে যে সমস্ত গ্রন্থ এবং বিশ্বকোষের উপর নির্ভর করা হয়েছে তার নাম অন্যত্র উল্লেখ করা হয়েছে। পাঠকবৃন্দ এবং সুহৃদজনের বাছে অনুরোধ, তথ্য কিংবা তত্ত্বগত কোনো গুরুতর ভূল নজরে পড়লে তাঁরা যেন লেখককে লিখিতভাবে জানিয়ে দেন।
‘দর্শনকোষ’ রচনার ও প্রকাশের ক্ষেত্রে একাধিক সুহৃদ ও শুভাকাঙ্ক্ষীর কথা মনে পড়েছে। তাঁদের সকলের নাম উল্লেখ করা সম্ভব নয়। বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক ‘দর্শনকোষ’ প্রকাশের ব্যাপারে যে আন্তরিক আগ্রহ প্রকাশ করেছেন সেজন্য তাঁকে আমার কৃতজ্ঞতা জানাই। প্রকাশন দপ্তরের পরিচালক জনাব ফজলে রাব্বি সহ-পরিচালক জনাব আবুল হাসনাত, গ্রন্থাগারিক জনাব শামসুল হক এবং বাংলা একাডেমীর অপরাপর বন্ধুরা এই ‘দর্শনকোষ’-এর সঙ্গে গোড়া থেকে এর উৎসাহদাতা এবং পরামর্শদাতা হিসাবে সংযুক্ত ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদেশী ভাষা বিভাগের প্রধান জনাব আব্দুল হাই বাংলা একাডেমীতে নিযুক্ত থাকাকালে এই দর্শনকোষ রচনার ব্যাপারে আমাকে উৎসাহ দিয়েছেন। বাংলা একাডেমীর মুদ্রণালয়ের কর্মীদের আগ্রহ এবং যত্ন ব্যতীত দর্শনকোষ প্রকাশে অধিকতর বিলম্ব ঘটত। তাঁদের মধ্যে মুদ্রণালয়ের অফিসার জনাব চৌধুরী আব্দুর রহমান, জনাব শামসুদ্দীন, জনাব মোহাম্মদ আফজাল হোসেন এবং অন্যান্য কর্মী তাঁদের যত্ন ও পরিশ্রম দ্বারা আমার কৃতজ্ঞতাভাজন হয়েছেন। তাঁরা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন ‘দর্শনকোষ’কে মুদ্রণপ্রমাদ মুক্ত রাখতে। তথাপি অনিবার্যভাবে মুদ্রণপ্রমাদ কিছু রয়ে গেছে। আশা করি ভবিষ্যৎ সংরক্ষণ অধিতকত শুদ্ধ এবং পূর্ণতরভাবে প্রকাশিত হবে।
গ্রন্থের মধ্যে বিষয়ের ইংরেজি নাম এবং বর্ণক্রম অনুসরণ করা হয়েছে। কারণ, আমাদের শিক্ষিত মহলে এর বেশিরভাগ বিষয়ের ইংরেজি নাম এখনো পরিচিত এবং প্রচলিত। বর্তমানে প্রয়োজন এই বিষয়গুলির বাংলা ভাষায় ব্যাখ্যা। গ্রন্থেশেষে ইংরেজি এবং বংলা বর্ণক্রমের ভিত্তিতে বিষয়সূচি সংযুক্ত করা হয়েছে।
পরিশেষে আবার বলি কোন জ্ঞানকোষই সম্পূর্ণ নয়। কারণ, জ্ঞানের শেষে নাই। জ্ঞানকোষ মাত্রই আমাদের মনে কিছু তৃপ্তি এবং অনেক অতৃপ্তি এবং অশ্বেষার সৃষ্টি করে। আমার এ প্রচেষ্টা জ্ঞানপিপাসুর মনে কিছু তৃপ্তি এবং অনেক অতৃপ্তি এবং অন্বেষার সঞ্চার করতে পারে তা হলেই নিজের শ্রমকে সার্থক মনে করব।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ সরদার ফজলুল করিম
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
৮ই ভাদ্র, ১৩৮০
২৫শে আগষ্ট, ১৯৭৩
।।২।।
যে ব্যক্তিক সীমাবদ্ধতা নিয়েই ‘দর্শনকোষ’ রচনার দুঃসাহস দেখাতে হয়েছিল সে সীমাবদ্ধতাকে এই গ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণেও যে অতিক্রম করা সম্ভব হয়নি, তা এই গ্রন্থের অনুরাগী পাঠকবৃন্দের কাছে উল্লেখের প্রয়োজন হবে না। ‘দর্শনকোষ’ যে বহুদিন যাবৎ বই-এর দোকানে, এমনকি সড়কের উপরে কিংবা দুস্প্রাপ্য বস্তুর আধারেও অপ্রাপ্য হয়ে রয়েছে, এটি পাঠকদের প্রীতিরই স্মারক। ‘দর্শনকোষ’কে তাঁরা বর্জনীয় পদার্থ বলে গণ্য করেন নি, তাকে সংরক্ষণের বিষয় বলে বিবেচনা করেছেন। পথে ঘাটে তরুণ ছাত্র, ছাত্রী, শিক্ষার্থী, বন্ধুজন, সুহৃদ, শিক্ষাবিদ এবং পাঠকবৃন্দের তাগিত এবং দাবি ছিল, ‘দর্শনকোষ’-এর নতুন একটি সংস্করণের প্রধান কৃতিত্ব বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক জনাব মনজুরে মওলার, যিনি গ্রন্থখানির গুরুত্ব উপলব্ধি করে তাঁদের প্রাতিষ্ঠানিক আর্থিক সংকট সত্ত্বেও এর নতুন সংস্করণ প্রকাশের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন।
‘দর্শনকোষ’ প্রকাশিত হওয়ার পরে স্বতঃস্ফুর্তভাবে গ্রন্থকারকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন শ্রদ্ধেয় জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক। তাঁর এমন উৎসাহদানে আমি অনুপ্রাণিত বোধ করেছিলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক বন্ধুবর মোহাম্মদ আবু জাফর জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের ‘বই’ মাসিকে ‘দর্শনকোষ’-এর একটি বিস্তারিত আলোচনা প্রকাশ করেছিলেন। তার মধ্যে এই গ্রন্থের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করে তিনি বেশ কয়েকটি পরামর্শও প্রদান করেছিলেন। আমি সকৃতজ্ঞভাবে তাঁর আলোচনা পাঠ করেছি এবং তাঁর সুপরামর্শের দিকে খেয়াল রেখে যথাসাধ্য একে সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করেছি। এ গ্রন্থের গুণগ্রাহী আলোচনা করেছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের তরুণ শিক্ষক মোকাররম হোসেনও। তিনি আমার ধন্যবাদের পাত্র। চট্রগামের এক তরুণ পাঠক সাগ্রহে চিঠি লিখে গ্রন্থ সম্পর্কে প্রশ্ন করেছেন, পরামর্শ দিয়েছেন। এরূপ জানা অজানা পাঠকবর্গের অকৃপণ উৎসাহদান আমার মধ্যে ‘দর্শনকোষ’ রচনার একটা সতর্কতাবোধ সৃষ্টি করেছে। আমার জীবনকালে ‘দর্শনকোষ’-এর নতুনতর কোনো সংস্করণ হবে, এমন আশা করা, বিরাজমান পরিস্থিতিতে, কিছুটা দুরাশা। কিন্তু এ বিশ্বাস আমি পোষণ করি যে, ‘দর্শনকোষ’-এর উত্তরপুরুষরা জ্ঞান বিজ্ঞানের নানা ক্ষেত্রে নানা জ্ঞানকোষ তৈরি দ্বারা এর সূচনার ধারাটি সমৃদ্ধ করে চলবেন। ইতিমধ্যে ‘সমাজবিজ্ঞান শব্দকোষ’, ‘ইতিহাসকোষ’, ‘জ্ঞানের কথা’, ‘চরিতাভিধান’ প্রভৃতি শিরোনামে ক্ষুদ্র বৃহৎ আকারের বিভিন্ন গ্রন্থ যে বাংলাদেশে রচিত ও প্রকাশিত হয়েছে এবং নতুনতর উদ্যোগে যে আরো নানা ক্ষেত্রে গ্রহণ করা হচ্ছে, এটি জ্ঞানের ক্ষেত্রে আমাদের জীবনের লক্ষণ।
বর্তমান ‘দর্শনকোষ’ কেবল দর্শনশাস্ত্রের পদ কিংবা সমস্যার আলোচনায় সীমাবদ্ধ নয়। সাধারণভাবে এ গ্রন্থ একটি ক্ষুদ্র জ্ঞানকোষ। সে কারণে ক্ষমতানুযায়ী এবং গ্রন্থের আকারের সীমাবদ্ধতার মধ্যে এর বর্তমান পরিবর্ধিত সংস্করণে বিভিন্ন বিষয়ে প্রায় এক শত নতুন অন্তর্ভূক্তি দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। তথাপি এ কোনো সুসম্পূর্ণ বিশ্বকোষ নয়। নতুন সংস্করণ প্রকাশের সিদ্ধান্তের পরে ’৮৫ সালের মহান একুশে ফেব্রুয়ারির মধ্যে প্রকাশনা সমাপ্ত করার লক্ষ্যে গ্রন্থের সর্বদিকে দৃষ্টিপাতের সময় খুবই সংকীর্ণ ছিল। সে কারণে ত্রুটি-বিচ্যুতির পরিমাণ হয়তো কম নয়। তথাপি যথাসাধ্য শুদ্ধ মুদ্রণ এবং অন্যান্য পরিপাট্যের প্রতি বাংলা একাডেমির পাঠ্য পুস্তক ডিভিশনের পরিচালক জনাব মোহাম্মদ ইবরাহিম, তাঁর সহকর্মী জনাব ফজলুল হক সরকার, জনাব আবদুল ওয়াহাব এবং আহছানিয়া মিশন প্রেসের কর্মী জনাব মোহসীন যে সাগ্রহ তত্ত্বাবধান প্রদান এবং পরিশ্রম স্বীকার করেছেন তার জন্য তাঁরা সকলেই আমার কৃতজ্ঞতাভাজন। ‘হিপোক্রাটিসের শপথ’টি সংগ্রহ করে দিয়েছেন স্নেহভাজন ডা. এস. এ. মাহমুদ। তাঁকে আমার স্নেহাশীর্বাদ।
‘দর্শনকোষ’-এর অবশ্যই একটি দর্শন আছে। বলা চলে রচনাকার বা সংকলকের দর্শন। সেটি জটিল কোনো দর্শন নয়। সে কেবল এই সহজ বিশ্বাস যে, মানুষের সামাজিক জীবন নিয়ত বিকাশশীল। প্রবাহমান।কেবল যান্ত্রিকভাবে নয়। সচেতন, সংঘবদ্ধ, সমাজগত যৌথ প্রচেষ্টায় উত্তম থেকে অধিকতর উত্তম জীবন সৃষ্টির লক্ষ্যে বিকাশমান প্রয়াস। মানুষের সমাজ জীবনের এমন বিকাশে শতবৎসরও কোনো হিসাবের কাল নয়। আসলে যেমন স্থান অসীম, তেমনি কাল অসীম। তাতে বর্তমানের কোনো সংকট, প্রতিবন্ধক কিংবা আশাভঙ্গ সেই অনিবার্য বিকাশের পরিচয়সূচক ব্যতীত তাকে রুদ্ধ করে দেওয়ার কোনো শক্তির প্রকাশ নয়। সেই বিশ্বাসে স্থির থেকেই বর্তমান নিবেদনের ইতি টানছি। এ গ্রন্থ বাংলা ভাষাভাষী জ্ঞানানুরাগী পাঠকবৃন্দের্ তাঁদের উদ্দেশ্যেই এ গ্রন্থ উৎসর্গিত।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ সরদার ফজলুল করিম
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ফেব্রুয়ারী, ১৯৮৬
।।৩ ।।
‘দর্শনকোষ’-এর পরিবর্ধিত দ্বিতীয় সংস্করণটি বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮৬ সনে। বেশ কিছুদিন ধরে এ সংস্করণের কপি আর বাজারে পাওয়া যাচ্ছে না। একাডেমীর বিক্রয়কেন্দ্রের কর্মীরাই ‘দর্শনকোষ’-এর নতুন সংস্করণের জন্য আমাকে তাগিদ দিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন, ছাত্র-ছাত্রী এবং অন্যান্য পাঠকবর্গ ‘দর্শনকোষ’খানি ক্রয়ের জন্য প্রায়শই একাডেমীর বিক্রয়কেন্দ্রে আসেন। কিন্তু কপি নিঃশেষিত হওয়ার কারণে ‘দর্শনকোষ’ তাঁরা ক্রয় করতে পারেন না বলে তাঁদের উদ্বেগ ও দুঃখ প্রকাশ করেন। ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষাবিদ এবং সাহিত্যিকগণ ব্যক্তিগতভাবেও আমাকে ‘দর্শনকোষ’ পুনর্মুদ্রণের কথা বলেছেন। তাঁদের তাগিদ এবং বাংলা একাডেমীর অনুকূল সিদ্ধান্তে ‘দর্শনকোষ’-এর তৃতীয় সংস্করণটি এখন প্রকাশিত হলো। এ জন্যে আমি উভয়ের নিকট কৃতজ্ঞ।
বর্তমান সংস্করণে গ্রন্থের কলেবন তেমন বৃদ্ধি করা না গেলেও পূর্বতন সংস্করণের ক্রটি-বিচ্যুতি যথাসাধ্য সংশোধনের চেষ্টা করেছি। বাংলাদেশের অসামান্য লোকদার্শনিক আরজ আলী মাতুব্বর সাহেব আজ প্রয়াত। তাঁর পরিচয়দানের দায়বদ্ধতা থেকে ‘দর্শনকোষ’-এর বর্তমান সংস্করণের উপযুক্ত স্থানে তাঁর উপর একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা আমি যুক্ত করেছি।
যথাসাধ্য সংশোধনের মাধ্যমে সময়বোধক আলোচনাকে সমকালীন পর্যায়ে নিয়ে আসার চেষ্টা করা হয়েছে। সব ্বালোচনাতে তা হয়তো সম্ভব হয় নি। পাঠকবৃন্দ আশা করি সে দিকটি খেয়ালে রেখে আলোচনার বিষয়কে অনুধাবন করার চেষ্টা করবেন।
শব্দের বানানের ক্ষেত্রে বাংলা একাডেমী গৃহীত বানান পদ্ধতি ব্যবহারের চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু সর্বক্ষেত্রে যে এই নিয়ম রক্ষিত হয়েছে এমন হয়তো বলা যাবে না।
বর্তমান এবং ভবিষ্যতের জ্ঞানানুরাগী পাঠকদের উদ্দেশে এই সংস্করণ উৎসর্গিত হলো্
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সরদার ফজলুল করিম
ফেব্রুয়ারী ১৯৯৫
দর্শনকোষ
A
Abelard, Pierre: পিয়ারে আবেলার্দ (১০৭৯-১১৪২ খ্রি.)
একাদশ ও দ্বাদশ খ্রিষ্টাব্দের ফরাসি দার্শনিক ও ধর্মতত্ত্ববিদ। ‘ইউনিভার্সাল’ বা অনন্য-নির্ভর ভাবের অস্তিত্বের প্রশ্নে আবেলার্দ মন-নির্ভর ভাবের পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন। যুগের পরিপ্রেক্ষিতে আবেলার্দের মন-নির্ভর ভাবের মতবাদ ভাবাদর্শের অগ্রগতির ক্ষেত্রে একটি প্রগতিশীল ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হয়েছিল। তাঁর ধর্মব্যাখ্যাও খ্রিষ্টান ধর্মের ‘গোঁড়া ক্যাথলিক মতের’ বিরোধী ছিল। আবেলার্দের ‘সিক এট নন’ ‘হাঁ এবং না’ নামক গ্রন্থখানি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করে। এই পুস্তকে তিনি যাজক সম্প্রদায়ের প্রচারিত ধর্মীয় ব্যাখ্যার পরস্পর-বিরোধিতা প্রতিপন্ন করেন এবং ধর্মের প্রশ্নে যুক্তিকে অগ্রাধিকার দান করেন। প্রশ্নের ক্ষেত্রে সমাধান না থাকলেও তাঁর আলোচনার দ্বন্দ্বমূলক পদ্ধতি মানুষের যুক্তিকে তীক্ষ্ণ এবং যুক্তিমূলক করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আবেলার্দের অভিমত ছিল, ধর্মীয় বিশ্বাস-বহির্ভূত যে-কোনো সমস্যার সমাধানের জন্য দ্বন্দ্বমূলক যুক্তিবাদী পদ্ধতি হচ্ছে একমাত্র পদ্ধতি। আবেলার্দের জীবনকালে তাঁর অভিমত অধিকাংশ দার্শনিকের নিকট গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত না হলেও যুগের বিভিন্ন প্রকার কুসংস্কারের মোহ থেকে মানুষকে মুক্ত করতে বিরাট প্রভাব বিস্তার করেছিল। আবেলার্দ বলতেন, ‘ধর্মীয় বিশ্বাসের কথা বাদ দিলে এমন কিছু নাই যাকে ভুলের উর্ধ্বে মনে করা যয়ি। ধর্মযাজক কিংবা প্রেরিত পুরুষ কেউই ভুলের উর্ধ্বে নয়’।
আবেলার্দের এরূপ যুক্তিবাদী মতের জন্য গোঁড়া ক্যাথলিক সম্প্রদায় তাঁকে সমাজচ্যুত করেছিল।
Absolate: পরম বা চরম সত্তা
ভাববাদী দর্শনে ‘পরম সত্তা’ একটি মৌলিক ধারণা। এই দর্শনের ব্যাখ্যানুযায়ী পরম সত্তা হচ্ছে চরম সম্পূর্ণ এক অস্তিত্ব। সমস্ত খণ্ড অস্তিত্ব পরম সত্তার প্রকাশ। কিন্তু কোনো খণ্ড অস্তিত্ব আপন শক্তিতে পরম সত্তার কোনো হানি বা অপূর্ণতা ঘটাতে পারে না। পরম সত্তা স্বয়ংসম্পূর্ণ। খণ্ড অস্তিত্বের সাধারণ সম্মেলনও পরম সত্তার সৃষ্টি নয়। পরম সত্তা সমস্ত সৃষ্টির মূল শক্তি। পরম সত্তা নির্বিশেষ সত্তা। সর্বপ্রকার বিশেষ-প্রকাশ-নিরেপেক্ষ সে। বস্তুবাদী দর্শন খণ্ড অস্তিত্ব বা বিশেষ-নিরপেক্ষভাবে কোনো পরম এবং নিরাকার অস্তিত্বকে স্বীকার করে না। পরম সত্তাকে বিভিন্ন ভাববাদী দার্শনিকের তত্বে বিভিন্ন নামে অবহিত হতে দেখা যায়। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক প্লেটোর দর্শনে পরম সত্তা ‘দি আইডিয়া’ বা বস্তু নিরপেক্ষ ভাব বলে ব্যাখ্যাত হয়েছে। ফিকটে অহংবোধ ‘আমি’কে পরম সত্তা বলেছেন। হেগেলের দর্শনে পরম সত্তাকে এক সার্বিক এবং পরম ভাব বলে প্রকাশ করা হয়েছে। শপেনহার ‘ইচ্ছা শক্তি’কেই পরম সত্তা বলেছেন। বার্গসাঁ একে ইনটুইশন বা স্বজ্ঞা বলেছেন। ধর্মের ক্ষেত্রে সর্বশক্তিমান স্রষ্টাকে পরম সত্তা বলে অভিহিত করা হয়।
Absolute and Relative: নিরপেক্ষ এবং সাপেক্ষ
যুক্তিবিদ্যায় যে পদ অপর কোনো পদের উপর নির্ভরশীল নয় তাকে নিরপেক্ষ পদ বলে।, যেমন- মানুষ, পানি, মাটি। অপরদিকে যে পদের অর্থ অপর কোনো পদের উপর নির্ভরশীল তাকে রিলেটিভ আ আপেক্ষিক পদ বলে। যেমন- ছাত্র কিংবা শিক্ষক ছাত্র-শিক্ষককে যুক্তভাবে পরস্পর নির্ভরশীল পদ বা ‘কোরিলেটিভ টার্মস’ বলে। দর্শনে অনন্য- নির্ভর সত্তাকে এ্যাবসোলিউট এবং কোনো সত্তার উপর নির্ভরশীল নয়; অপর কোনো সত্তার সঙ্গে সে যুক্ত নয়। অনন্য-নির্ভর সত্তা স্বয়ংসম্পূর্ণ; তার কোনো পরিবর্তন নাই।
আপেক্ষিক সত্তা অপর সত্তার সঙ্গে সংযুক্ত। পারস্পারিক নির্ভরতা এবং সম্পর্কের ভিত্তিতেই সামগ্রিক সত্তা অপর সত্তার সঙ্গে সংযুক্ত। পারস্পারিক নির্ভরতা এবং সম্পর্কের ভিত্তিতেই সামগ্রিক সত্তার উদ্ভব। সামগ্রিক সত্তার প্রতি অংশ অপর অংশের সঙ্গে সংযুক্ত। সেই সংযোগের ভিত্তিতেই প্রতিটি অংশ বা খণ্ডের বৈশিষ্ট্য নির্দিষ্ট হয়। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের মতে অনন্যনির্ভর স্বাধীন এবং অপরিবর্তনীয় চরম বলে কিছু নাই এবং তেমন কোনো অস্তিত্বের কল্পনা করাও চলে না। অস্তিত্বমাত্রই আপেক্ষিক। আপেক্ষিকের জটিল সম্মেলনে সে সামগ্রিক সত্তা সে তার অংশসহ নিরন্তর পরিবর্তমান ও বিকাশশীল।
Absolutism: নিরঙ্কুশতা
শাসনের অবাধ ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ শাসন বলা হয়। নিরঙ্কুশ শাসনে জনসাধারণ প্রত্যক্ষভাবে কিংবা নির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমে সরকারে কোনোরূপ অংশগ্রহণ করার অধিকার ভোগ করে না। নিরঙ্কুশ শাসনের বিপরীত হলো গণতান্ত্রিক শাসন।
গণতান্ত্রিক শাসন-পদ্ধতিতে কোনো এক ব্যক্তি বা সম্রাট শাসনের একচ্ছত্র অধিকার ভোগ করে না। নির্বাচনের মাধ্যমে জনসাধারণকে শাসন করে। গণতান্ত্রিক বা প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার আধুনিককালের সর্বজন স্বীকৃত এবং কাম্য ব্যবস্থা বলে পরিচিত। প্রাচীন গ্রিসে প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক শাসনের দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। অবশ্য প্রাচীন গ্রিসের এই গণতন্ত্রে দাসদের কোনো রাজনৈতিক অধিকার ছিল না। গ্রিক সভ্যতার ধ্বংসের পরবর্তীকাল থেকে আধুনিক পুঁজিবাদী বিপ্লব পর্যন্ত ইউরোপে এবং অন্যত্র সমন্ততান্ত্রিক যুগে রাজা বা সম্রাটদের একচ্ছত্র অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাই প্রচলিত ছিল।
Abstract and Concrete: বিমূর্ত এবং মূর্ত
যুক্তিবিদ্যায় যে পদ দ্বারা বস্তু-নিরপেক্ষভাবে কোনো গুণ বুঝায় তেমন পদকে গুণবাচক বা এ্যাবসট্রাক্ট পদ বলে। যথা, মনষ্যত্ব, দয়া, অন্ধত্ব। অপর পক্ষে যে পদ দ্বারা কোনো বস্তু বুঝায় তাকে বস্তুবাচক পদ বা কনক্রিট টার্ম বলে। যথা, গাছ, রহিম, ঢাকা শহর ইত্যাদি।
দর্শনে যা ইন্দ্রীয়গ্রাহ্য নয় তাকে বিমূর্ত এবং যা ইন্দ্রীয়গ্রাহ্য তাকে মূর্ত বলা হয়। মূর্ত এবং বিমূর্তের প্রশ্নে ইতিহাসে মত পার্থক্য দেখা যায়। ভাববাদী দর্শনে বিমূর্তকেই পরম বলে মনে করা হয়। বস্তুবাদী দর্শনে মূর্তের গুণাগুণকে মানসিকভাবে বস্তু থেকে বিচ্ছিন্নভাবে চিন্তা করাকে বিমূর্ত ক্ষমতা বলা হয়। উনবিংশ শতকে জার্মান দার্শনিক হেগেল মূর্ত এবং বিমূর্তের জ্ঞানের ক্ষেত্রে নতুনতর ব্যাখ্যাসহ প্রয়োগ করার চেষ্টা করেন। হেগেল মূর্ত এবং বিমূর্তের একটি দ্বন্দ্বমূলক এবং নিত্য বিকাশমান সম্পর্কের কল্পনা করেন। হেগেলের নিকট বিমূর্ত মূর্তের বিপরীত কোনো ভাব বা বস্তু নয়। নিরন্তর বিকাশে মূর্ত বিমূর্তে পরিণতি লাভ করে। এই বিমূর্ত আবার মূর্তেও প্রকাশিত হয়। হেগেলের চরম বিমূর্ত অবশ্য একটি ভাববাদী ধারণা। সে ব্যাখ্যায় চরম বিমূর্তের আংশিক প্রকাশ। ইতিহাস, সমাজ, বস্তুজগৎ: সবই এরূপ ব্যাখ্যায় চরম বিমূর্তের মায়ারূপ প্রকাশ-স্থায়ী সত্য নয়। বস্তুবাদী দর্শন, বিশেষ করে মার্কসবাদী দর্শন হেগেলের মূর্ত-বিমূর্তের ব্যাখ্যায় পরস্পর-বিরোধিতা আরোপ করে। মার্কসবাদী দার্শনিকদের মত মূর্তের বিকাশ ও সামগ্রিকতাই যদি বিমূর্তের সৃষ্টি, তবে মূর্তবিচ্ছিন্নভাবে বিমূর্তের কোনো অস্তিত্ব নেই। তেমন ক্ষেত্রে মূর্তই চরম সত্য, বিমূর্ত নয়। এবং সমাজ, ইতিহাস, জগৎকে বিমূর্তের ভ্রান্তিকর খণ্ড প্রকাশ বলাও যুক্তিসঙ্গত নয়।
মার্কসবাদী দর্শনের মতে ইন্দ্রিয়াদি অর্থ্যাৎ মানুষের জ্ঞান-মাধ্যমের গ্রাহ্য বস্তু, ভাব এবং ভাবনা অর্থ্যাৎজ্ঞান সাপেক্ষ জগৎই সত্য। জ্ঞান-সাপেক্ষ জগতের সামগ্রিক ধারণাই বিমূর্ত ধারণা। জ্ঞেন-জগতের উধ্বে কোনো অজ্ঞেয় বিমূর্ত সত্তা নেই। জ্ঞান-সাপেক্ষ-মূর্ত জগতের প্রতিটি অংশের সঙ্গে পারস্পারিক সম্পর্কে সম্পর্কিত।
সাধারণ ব্যবহারের ক্ষেত্রে ‘এ্যাবষ্ট্রাক্টের’ অর্থ হচ্ছে কোন কিছুর আংশিক বা অপূর্ণ ধারণা। ‘সাধারণ জ্ঞান’, ‘সাধারণ ধারণা’ এরূপ কথা দ্বারা এই ভাবটি ব্যক্ত করা হয়। এর বিপরীত ভাবে ‘কনক্রিট’ কথাটি ব্যবহৃত হয়। কনক্রিট বলতে কোনো কিছুর বস্তুগত বা নির্দিষ্ট ধারণাকে বুঝায়।
Abdul Gaffar Khan: আব্দুল গফফার খান (১৮৯১-১৯৮৮)
‘খান আব্দুল গফফার খান’রূপে ইনি পরিচিত। আফগানিস্তানের পার্শ্ববর্তী ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর পশ্চিম সীমান্ত এলাকার অধিবাসী। উপমহাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের আন্দোলনকালে গান্ধীজির অহিংস নীতির অনুসারী বলে ‘সীমান্ত গান্ধী’ হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেন। পুশতুভাষী এই অঞ্চলের অধিবাসীগণ নিজেদের একটি বিশিষ্ট জাতি বলে বিবেচনা করে। ভারত বিভাগের ফলে পাকিস্থানভূক্ত হলেও খান আব্দুল গফফার খান তাঁর এলাকার আত্মনিয়ন্ত্রণের জন্য ‘পাখতুনিস্তান’ আন্দোলন অব্যাহত রাখেন। তিনি ‘খোদাই খেদমতগার’ নামক সেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা। ইংরেজ শাসনের কাল ব্যতীত পাকিস্তান আমলেও তাঁর স্বাধীনচেতা এবং পাখতুনদের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের দাবির কারণে তাঁকে কারাবরণ করতে হয়। সীমান্ত অঞ্চলের অধিবাসীবৃন্দ প্রকৃতিগতভাবে দুর্ধর্ষ বলে পরিচিত। তাঁদের জনপ্রিয় নেতার মৃদুভাষণ, নম্র আচরণ এবং আপন নীতিতে অনমনীয়তা খান আবদুল গফফার খানকে আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিসম্পন্ন করেছে। বয়সের দিক থকে শতবর্ষ পূরণের নিকটবর্তী বয়সেও তিনি রাজনৈতিক জীবন যাপন করেছেন এবং পাখতুনদের আত্মনিয়ন্ত্রনের সংগ্রামী জীবনের স্বীকৃতি হিসাবে তাঁকে নেহেরু অ্যাওয়ার্ড (১৯৬৭) এবং ভারত রত্ন (১৯৮৭) প্রদান দ্বারা সম্মানিত করে। ১৯৮৮ সনে তাঁর মৃত্যু হয়।
Abul Kalam Azad, Maolana: মৌলানা আবুল কালাম আজাদ (১৮৮৮-১৯৫৪)
ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম জাতীয়তাবাদী নেতা এবং ইসলাম ধর্মের প্রাজ্ঞ পণ্ডিত। পিতা মওলানা খায়রুল দীন এবং পিতামহের সূত্রে মৌলানা আজাদের পরিবারের আরবের হেজাজ এবং মক্কার সঙ্গে সংযোগ ছিল। তাঁর পিতা একজন প্রখ্যাত পির ছিলেন এবং বোম্বে, কলকাতা এবং রেঙ্গুনে তার প্রচুর সংখ্যক মুরিদ ছিল।
আবুল কালামের শিক্ষা প্রধানত গৃহের মধ্যে পারিবারিক প্রথায় পরিচালিত হয়। কিন্তু কিশোরকাল থেকেই আবুল কালাম ছিলেন বিষ্ময়কর প্রতিভার অধিকারী। “প্রাচীন শিক্ষা পদ্ধতির পাঠক্রমের সবগুলি শিক্ষণীয় বিষয় তিনি পিতার শিক্ষকতায় পূর্ণভাবে আয়ত্ত করেন। ইহার পরে আজাদ গভীর ব্যক্তিগত অধ্যয়নের মাধ্যমে বিভিন্ন বিদ্যায় অসাধারণ ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। ভাষাগুলির মধ্যে তিনি প্রথমে ফরাসি এবং পরে ইংরেজি শিক্ষা লাভ করেন।” কিশোরকাল থেকেই তিনি কবিতা রচনা করতেন। এবং ‘আজাদ’ তাঁর কবিনাম। উর্দূ ভাষায় তিনি ক্ষমতাবান বাগ্মী ছিলেন। কিশোর বয়সে মাসিক সাহিত্যপত্র ‘লিসানাল সিদক’ সম্পাদনা করেন। ১৯১২ সনে কোলকাতা থেকে সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘আল হেলাল’ তাঁর সম্পদনায় প্রকাশিত হয়। প্রথম মহাযুদ্ধকালে যুদ্ধ সম্পর্কে ‘আল হেলালের’ ব্রিটিশ সরকার বিরোধী মতের কারণে ব্রিটিশ সরকার প্রথমে পত্রিকা থেকে জামানত তলব করে এবং জামানত বাজেয়াপ্ত করে। মৌলানা আজাদের মতামত সর্বদাই ইংরেজ সরকারের বিরোধী এবং ভারতের স্বাধীনতার পক্ষে সংগ্রামী চরিত্রের ছিল। তাঁর রাজনৈতিক মতের জন্য ১৯১৬ সনে তাঁকে কলকাতা থেকে বহিস্কার করা হয় এবং রাঁচিতে নজরবন্দি করে রাখা হয়। ১৯২০-এ ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে মৌলানা আজাদ বঙ্গীয় প্রাদেশিক খেলাফত কনফারেন্সের সভাপতি হন। আমৃত্যু ভারতের সকল সম্প্রদায়ের সমন্বয়ে ‘ভারতীয় জাতি’মূলক জাতীয়বাদী চেতনায় তিনি উদ্বুদ্ধ ছিলেন এবং ত্রিশের দশক থেকে সাম্প্রদায়িক হানাহানি এবং বিভেদ বৃদ্ধি পেলে এবং মুসলিম লীগ মুসলমানদের একমাত্র প্রতিষ্ঠান বলে মুসলিম লীগ নেতা মি. জিন্নাহ দাবি করলেও মৌলানা আজাদ সাম্প্রদায়িক চিন্তা প্রবাহের বিরুদ্ধতা করেন এবং অবিচলভাবে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং ইংরেজের সঙ্গে স্বাধীনতার আলোচনাকালে জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতিত্ব করেন। ১৯৪২-এর আগষ্ট মাসে ‘ইংরেজ, ভারত ছাড়’ আন্দোলন শুরু হলে গান্ধীসহ কংগ্রেসের অপর সকল প্রখ্যাত নেতার সাথে মৌলানা আজাদ কারারুদ্ধ হন। “রাঁচীর নজরবন্দি থেকে জুন ১৯৪৫ পর্যন্ত তাঁর বন্দি জীবনের দৈর্ঘ্য মোট দশ বৎসর সাত মাস হয়।” স্বাধীনতার পরে ১৯৪৭ সনে তিনি ভারতের শিক্ষামন্ত্রী হন এবং মৃত্যু পর্যন্ত এই পদে অধিষ্ঠিত থাকেন। ধর্ম এবং রাজনীতিক অভিমতমূলক যে সকল গ্রন্থ তিনি রচনা করেছেন তার কোন সংক্ষিপ্ত তালিকা তৈরি করা সহজ নয়। তাঁর মৃত্যুপূর্বকালে আত্মজীবনীমূলক রচনা ‘ইণ্ডিয়া উইনস ফ্রিডম’ বা ‘ভারতের স্বাধীনতালাভ’ গ্রন্থ তাঁর নির্দেশমতো মৃত্যুর পরে একটা নির্দিষ্টকাল অতিক্রম শেষে প্রকাশ করা হয়। এই গ্রন্থে তাঁর রাজনৈতিক নানা অভিমত নিঃসঙ্কোচে প্রকাশিত হয়েছে। ধর্মের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্থান রাষ্ট্র যে অধিককাল দ্বন্দ্বহীনভাবে বজায় থাকতে পারবে না, এ ভবিষ্যদ্বাণীও তিনি উক্ত পুস্তকে প্রকাশ করেন।
Academy of Plato: প্লেটোর একাডেমী
গ্রিক ‘একাডেমীয়া’ শব্দ থেকে ইংরেজি একাডেমী শব্দেরউৎপত্তি। প্রাচীন গ্রিসের রাজধানী এথেন্সের একটি বাগানকে একাডেমাসের বাগান বলা হয়। খ্রি. পূ. ৩৮৭ সনে প্লেটো এখানে দার্শনিক আলোচনার একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা করেন। পূর্বে এই বাগানে গ্রিক দেব-দেবীদের উদ্দেশে পশু উৎসর্গ করা হতো। এথেন্সের একাডেমীর ইতিহাসে তিনটি পর্যায়ের কথা জানা যায় (১) প্রথম পর্যায় বা প্লেটো পর্ব। প্লেটো পর্বে প্লেটোর পরে স্পুসিয়াস, জেনোক্রাটিস এবং পলেমনকে একাডেমীর সঙ্গে যুক্ত দেখো যায়। (২) দ্বিতীয় পর্বের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে আরসেসিলাস পরিচিত। এটাকে একাডেমীর মধ্যযুগ বলেও অভিহিত করা হয়। এই যুগে আলোচনার লক্ষ্য ছিল প্রাচীন স্টোয়িক বা প্রতিরোধহীন সমর্পণবাদকে খণ্ডন করা হয়। আরসেলিলাসের পরে আসেন ল্যাসিডিষ। (৩) তৃতীয় পর্যায়কে একাডেমীর নবপর্যায় বলেও অভিহিত করা হয়। এই পর্বের প্রধাস উদ্যোগী চিন্তাবিদ ছিলেন কারনিয়াডিস। কারনিয়াডিসের চিন্তাধারা পূর্বতন সন্দেহবাদের প্রকারবিশেষ।
প্লেটো ৩৪৭ খ্রি.পূ. অব্দে মারা যান। প্লেটোর মৃত্যুকাল পর্যন্ত দার্শনিক এ্যারিস্টটল একাডেমীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এই সময়ে অন্যান্য দার্শনিক যাঁরা একাডেমীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাঁদের মধ্যে জ্যোতিৃর্বিদ ইউডোক্সাস এবং ফিলিপাস, গণিত শাস্ত্রবিদ থিটিটাস এবং একাধারে সমাজতত্ত্ববিদ, ভূগোলবিদ এবং বৈজ্ঞানিক হিরাক্লিডিস বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রথম যুগকেই একাডেমীর স্বর্ণযুগ বলা যায়। এই যুগে একাডেমীর সদস্যগণ প্রতিষ্ঠানটিকে একটি মুক্তবুদ্ধি গবেষণা এবং দর্শন সম্পর্কিত আলোচনার কেন্দ্রে পরিণত করেছিলেন। এই যুগে মতামতের দ্বন্দ্বে দেখা যায় যে, স্পুসিপাস প্লেটোর বস্তুনিরপেক্ষ ‘পরমভাব’-এর ধারণাকে খণ্ডন করে ‘আংকিক সংখ্যাই হচ্ছে একমাত্র নিত্যসত্য’- পাইথাগোরীয় সম্প্রদায়ের এই অভিমতকে সমর্থন করেছেন। পুসিপাস আরো দাবি করেন যে, ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমেই আমরা সত্যজ্ঞান লাভ করতে পারি। প্রাকৃতিক জগতের ইতিহাস বর্ণনাতেও স্পুসিপাসের আগ্রহ ছিল। একাডেমীর আদি যুগের অন্যতম দার্শনিক জেনোক্রাটিস প্লেটোবাদ এবং পাইথাগোরীয়বাদের মধ্যে একটি সমঝতোতা স্থাপনের চেষ্টা করেন। তিনি একদিকে প্লেটোর নিকট থেকে সমস্ত অনিত্য প্রকাশের পেছনে এক নিত্য সত্তার অস্তিত্বকে গ্রহণ করেন, অপরদিকে নিত্য এবং অনিত্যের সংঘাতে সংখ্যার উৎপত্তি হয় বলে অভিমত প্রকাশ করেন। খ্রিষ্টাব্দের চতুর্থ এবং পঞ্চম শতকে একোডেমীর মতাদর্শ নব-প্লেটোবাদ বলে পরিচিত হয়। ৫২৯ খ্রিষ্টাব্দে রোমান সম্রাট জাস্টিনিয়ান একাডেমীর আলোচনা নিষিদ্ধ করে প্রতিষ্ঠানটিকে বন্ধ করে দেন। ইউরোপে নব জাগরণের যুগে (১৪৫৯-১৫২১) ফ্লোরেন্স শহরে ‘একাডেমী’ নামে আলোচনা ও গবেষণার নতুন প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়। এই পর্যায়ে প্লেটোর রচনাবলীর উদ্ধার এবং অনুবাদ এবং এ্যারিস্টটলের দর্শনের নতুনতর ব্যাখ্যা গুরুত্ব লাভ করে।
‘একাডেমী’ বর্তমানে একটি আন্তর্জাতিকভাবে প্রচলিত শব্দ। একাডেমী শব্দ দ্বারা সাহিত্য, শিল্প এবং বিজ্ঞানের আলোচনা ও গবেষণার কেন্দ্রে বা প্রতিষ্ঠানকে বুঝান হয়। এই অর্থে পৃথিবীর প্রায় সমস্ত দেশেই ‘একাডেমী’ নামক প্রতিষ্ঠানকে কার্যরত দেখা যায়। বিশ্বের বিখ্রাত একাডেমীগুলির মধ্যে ফরাসি একাডেমী, ইংল্যাণ্ডের ব্রিটিশ একাডেমী, গ্রিসের একাডেমীয়া এথেন্স, জাপানের দি ন্যাশনাল একাডেমী অব জাপান, আমেরিকায় যুক্তরাষ্ট্রের দি নিউইয়র্ক একাডেমী অব সায়েন্সস এবং রাশিয়ার একাডেমী অব সায়েন্সস বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশের বাংলা একাডেমীও একটি গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠান।
Accident, Accidens: অবান্তর লক্ষণ
যুক্তিবিদ্যায় বিশেষ অর্থে ব্যবহৃত একটি শব্দ। একটি পদের গুণ যদি এমন হয় যে, গুণটি কিংবা গুণসমূহ উক্ত পদের জাত্যর্থ বা কানোটেশনের অন্তর্ভূক্ত নয়, জাত্যর্থ থেকে উদ্ভূতও নয়-অর্থ্যাৎ উক্ত গুণকে পদের জাত্যর্থ থেকে অনুমান করা চলে না; কিন্তু গুণটিকে পদের মধ্যে স্থায়ী বা অস্থায়ীভাবে দেখতে পাওয়া যায়, তা হলে এরুপ গুণটিকে পদের মধ্যে স্থায়ী বা অস্থায়ীভাবে দেখেতে পাওয়া যায়, তা হলে এরূপ গুণকে উক্ত পদ বা টার্মের এ্যাকসিডেন্ট বা এ্যাকসিডেন্স বলা হয়। বাংলাতে এক ‘অবান্তর লক্ষণ’ বলা যায়। অনেক মানুষের ‘চুল কালো’, এই দৃষ্টান্তে চুল কালো বা কালো চুল থাকার গুণটি মানুষ পদের অবান্তর লক্ষণ। এ গুণটি ‘মানুষ’ হওয়ার অপরিহার্য গুণ হচ্ছে ‘জীবন্তু এবং যুক্তিবাদিতা’। অবান্তর লক্ষণ একটি পদের বিচ্ছেদ্য কিংবা অবিচ্ছেদ্য গুণ বলেও বিবেচিত হতে পারে। যে অবান্তর লক্ষণ পদের মধ্যে স্থায়ীভাবে দেখা যায়, তাকে অবিচ্ছেদ্য অবান্তর লক্ষণ বলে। যেমন কবি নজরুল ইসলাম ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহন করেছিলেন। একটি বিশেষ সনে জন্মগ্রহণ করার গুণটি উপরোক্ত পদটি অবিচ্ছদ্য অবান্তর লক্ষণ।
দর্শনশাস্ত্রেও ‘এ্যাকসিডেণ্ট’ বলতে অস্থায়ী, অনিত্য এবং অপরিহার্য গুণকে বুঝায়। এদিক থেকে নিত্যসত্তা বা পরম সত্তার বিপরীত হচ্ছে অনিত্যসত্তা বা এ্যাকসিডেণ্ট। পদের গুণের ক্ষেত্রে অপরিহার্য এবং অপরিহার্যের পার্থক্য প্রথম প্রকাশ করে দার্শনিক এ্যারিস্টোটল। ‘এ্যাকসিডেন্ট’ শব্দের ব্যবহার তার রচনাবলীতেই প্রথম দেখা যায়। পরবর্তীকালে মধ্যযুগের স্কলাসটিক বা ধর্মীয় দর্শনের মধ্যে ‘এ্যাকসিডেন্ট’-এর ব্যাপক ব্যবহার দেখা যায়। সপ্তদশ এবং অষ্টাদশ শতকের দর্শনেও বস্তুর অপরিহার্য এবং অপরিহার্য গুণের আলোচনার সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। কিন্তু দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের মতে কোনো বিশেষ বস্তুই যেমন অপর কোনো বিশেষ বস্তু থেকে চরমভাবে বিচ্ছিন্ন নয়, তেমনি বস্তুর কোনো গুণকে অপর কোনো বিশেষ বস্তু থেকে চরমভাবে বিচ্ছিন্ন নয়, তেমনি বস্তুর কোনো গুণকে অপর কোনো গুণের সঙ্গে তুলনাক্রমে চূড়ান্তভাবে বিচ্ছেদ্য গুণ বলা চলে না।
Accidental Evoluation: আকষ্মিক বিকাম, আকষ্মিক বিবর্তন
জীবন এবং প্রকৃতির ক্ষেত্রে ডারউইনের বিবর্তনবাদ এবং বস্তুবাদের বিরোধীতা হিসাবে ‘আকষ্মিক বিবর্তনবাদ’-এর উদ্ভব দেখা যায়। এ মতের প্রধান ব্যাখ্যাদাতাদের মধ্যে স্যামুয়েল আলেকজাণ্ডার, এস. লয়েড মরগান, সি. ডি. ব্রড প্রমুখ দার্শনিকের নাম উল্লেখযোগ্য। এই সমস্ত দার্শনিককে ‘নব বাস্তবাদী’ বলেও আখ্যায়িত করা হয়। কিন্তু এ ভাবধারা মূলত ভাববাদী দর্শনের প্রকারবিশেষ।
চার্লস ডারউইনে তাঁর ‘অরিজিন অব স্পিসিস’-গ্রন্থে বলেছিলেন, জীবন ও প্রকৃতির ইতিহাস হচ্ছে ক্রমবিকাশের ইতিহাস। বাস্তব পরিবেশের সঙ্গে জীবনের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে সমস্ত প্রকার প্রাণীর বিকাশ ঘটেছে। জীবনের বিবর্তনে অতীতের সঙ্গে সম্পর্ক-শূন্য কোনো নতুনের আবির্ভাব সম্ভব নয়। ডারউইনের এই মত বস্তুবাদী মত। উল্লিখিত দার্শনিকগণ বিবর্তনবাদের এই তত্ত্বকে জীবনের ব্যাখ্যায় যথেষ্ট মনে করেন না। এঁদের মতে জীবনের বিকাশের ইতিহাসে এমন সমস্ত পর্যায় এবং সৃষ্টির সাক্ষাৎ পাওয়া যায়, যাকে বিবর্তনবাদের ধারাবাহিকতা দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায় না। সৃষ্টির ধারা অনির্দিষ্ট। সে ধারার অতীত কিংবা ভবিষ্যৎ কোনো নির্দিষ্ট করা যায় না। সৃষ্টি অগ্রসর হয় আকষ্মিক নতুন সত্তার উদ্ভাবের মাধ্যমে। সৃষ্টির অগ্রগতির বৈশিষ্ট্য ক্রমবিকাশ ক্রমবিকাশ নয়।, আকষ্মিক উদ্ভব এবং উৎক্রমণ। জগতের কোনো নতুন অস্তিত্বের সঙ্গে অতীতের কোনো অস্তিত্বের সাদৃশ্য নাই। জীবনের বিকাশের এই ব্যাখ্যা আকষ্মিক বিবর্তনবাদের একটি দিক। এ ছাড়া সমগ্র অস্তিত্বের নতুনতর ব্যাখ্যাদানের চেষ্টাও এই দর্শনের অনুসারীগণ করেছেন। এই দর্শনের অন্যতম প্রবক্তা আলেকজাণ্ডার তাঁর ‘স্পেস, টাইম এণ্ড ডিটি’ গ্রন্থে এরূপ অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, অস্তিত্বের মূল হচ্ছে ‘স্থান-কাল’ এই ধারণা। ‘স্থান-কাল’ ধারণাই সমস্ত অস্তিত্বের সৃষ্টি করেছে; বস্তু বা অস্তিত্ব থেকে ‘স্থান-কাল’ ধারণার সৃষ্টি হয় নি। মর্গান মনে করেন, জগতের অস্তিত্ব মাত্রই সপ্রাণ। প্রাণ ব্যতীত আদৌ কোন বস্তু বা অস্তিত্ব নাই।
Acosta, Uriel: উরিয়েল এ্যাকোস্টা (১৫৮৫-১৬৪০ খ্রি.)
ওলান্দাজ দার্শনিক। জন্ম পর্তুগাল, ১৫৮৫ কিংবা ১৫৯০ খ্রিষ্টাব্দে। মৃত্যু ১৬৪০ খ্রিষ্টাব্দে। প্রথম জীবনে ক্যথলিক শিক্ষায় শিক্ষিত হন। কিন্তু যুক্তিবাদকে নিজের দর্শন হিসাবে গ্রহণ করে পরবর্তী কালে ক্যাথলিক ধর্ম পরিত্যাগ করে ক্যাথলিক নির্যাতনের ভয়ে ১৬১৪ খ্রিষ্টাব্দে হল্যাণ্ডে পালায়ন করেন। এই পর্যায়ে উরিয়েল এ্যাকোষ্টা ইহুদি ধর্ম গ্রহণ করেন। কিন্তু মূল ইহুদি ধর্মের ভাবধারাসমূহকে ইহুদি যাজক সম্প্রদায় বিকৃত করেছে বলে তিনি ইহুদি যাজক সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করেন। ১৬২৩ খ্রিষ্টাব্দে আত্মার অবিনশ্বরতার উপর ‘sbre a martali dade da alam do homen’ নামক গ্রন্থ রচনা করেন এবং দাবি করেন যে, দেহের মৃত্যুর পরে আত্মার অবিনশ্বরতা বলে কিছুই নাই। সনাতন মতের বিরুদ্ধচারণের জন্য উরিয়েল এ্যাকোস্টাকে ইহুদি সমাজ থেকে দু দুবার বহিস্কার করা হয়। একদিকে ইহুদি যাজক সম্প্রদায় এবং অপরদিকে ওলন্দাজ সরকারের নিগ্রহে উরিয়েল এ্যাকোস্টা আত্মহত্যা করেন। তাঁর অপর গ্রন্থের নাম ছির ‘Exemplar humane vitae’ এই পুস্তকে তিনি রাষ্ট্রীয় ধর্ম, ইহুদি এবং খ্রিষ্টান, সমস্ত ধর্মীয় বিশ্বাসের বিরোধিতা করেন। সপ্তদশ শতকের বিখ্যাত ওলন্দাজ দার্শনিক স্পিনোজা উরিয়েল এ্রাকোস্টার মতবাদে বিশেষ প্রভাবিত হয়েছিলেন। লেখক ক. এফ গুজকাউ-এর বিষদাত্মক নাটক ‘উরিয়েল এ্যাকোস্টা’ (১৮৪৭) উরিয়েল এ্যাকোস্টার জীবন-কাহিনীর ভিত্তিতে রচিত।
Activists: কার্যবাদী, ক্রিয়াবাদী
রাজনৈতিক দলের মধ্যে লক্ষ্য সাধনের ক্ষেত্রে মতামতের পার্থক্যের উদ্ভব হয়। এরূপ মতামতের যদি কোনো উপদল দলের লক্ষ্য সাধনের জন্য প্রত্যক্ষ সংগ্রাম বা কার্যের উপর অধিক জোর দেয় তবে তাদেরকে কার্যবাদী বা ক্রিয়াবাদী বলা হয়।
Activity: ক্রিয়া
মনোবিজ্ঞানে, মানসিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া। দশরএনর ব্যক্তির উদেশ্য সাধনার্থে গৃহীত কর্মবাদ বা প্রাগামেটিজমের তত্ব।
মনোবিজ্ঞানে ব্যক্তি এবং বস্তুর পাস্পারিক সম্পর্ক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। ব্যক্তি বস্তু বা পরিবেশকে ক্রিয়ার মাধ্যমে নিজের চাহিদা পূরণের উদ্দেশ্যে নিয়ন্ত্রিত করার প্রয়াস প্রায়। জীবনমাত্রেরই একটি স্বাধীন ক্রিয়ার ক্ষমতা আছে। কিন্তু সকল জীবের ক্ষেত্রে ক্রিয়ার স্বাধীনতা এবং বিকাশের স্তর সমান নয়। এজন্য প্রাথমিক ধরনের ক্রিয়া এবং জটিল উচ্চতর ধরনের ক্রিয়ার মধ্যে পার্থক্য করা হয়। মনুষ্যেতর জীবেরও কার্যক্ষমতা আছে। কিন্তু মনুষ্যেতর জীবের ক্রিয়ার মধ্যে মানুষের তুলতায় স্বাধীনতার পরিচয় কম। মনুষ্যেতর পশু-পক্ষীর ক্রিয়াকে পরিবেশই অধিক পরিমানে নিয়ন্ত্রিত করে। মানুষ পরিবেশ দ্বারা কেবল নিয়ন্ত্রিত হয় না; পরিবেশকে নিজের উদ্দেশ্য সাধনে পরিবর্তিত করার জন্যে আপন মস্তিস্ক এবং ইন্দ্রিয়াদির সাহায্যে বিশেষ বিশেষ ক্রিয়াকাণ্ড সম্পন্ন করে। মানসিকভাবে উদ্দেশ্য থাকা বা উদ্দেশ্যের সৃষ্টি করা কেবলমাত্র মানুষের ক্ষেত্রেই জটিল এবং উন্নতভাবে প্রকাশিত হতে দেখা যায়। ক্রিয়া কথার মধ্যে একটি সামাজিক অর্থ নিহত আছে। কোনো ব্যক্তি অপর ব্যক্তি-বিচ্ছিন্নভাবে কোনো কিছুর সঙ্গেই সম্পর্কিত নয়। ব্যক্তির অর্থ সামাজিক পরিবেশের ব্যক্তি। সে কারণে ব্যক্তির ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার পেছনে সামাজিক পরিবেশ এবং উক্ত পরিবেশের বিশেষ অবস্থা বিদ্যমান। মানুষের আদিতেও ব্যক্তির ক্রিয়া সামজিক পরিবেশের চাহিদা থেকেই শুরু হয়েছে। জৈবিক চাহিদা পূরনের জন্য প্রয়োজনীয় কর্ম ব্যক্তি অপর ব্যক্তির সমষ্টিগতভাবে গ্রহণ করেছে। মস্তিস্ক চালনার ক্ষেত্রে মনুষ্যেতর জীবের তুলনায় মানুষ অধিকতর জটিল এবং স্বাধীনতা চরম মনে করা ভূল। সামাজিক পরিবেশ-নিরপেক্ষভাবে ব্যক্তি কেবলমাত্র মস্তিৃস্কের ইচ্ছানুযায়ী কোনো ক্রিয়া-কাণ্ডের সূত্রপাত করতে পারে না। এদিক থেকে ব্যক্তি পরিবেশ-নিয়ন্ত্রিত। ব্যক্তি ও পরিবেশের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সম্পর্ক দ্বন্দ্বমূলক এবং পরস্পর-নির্ভরশীল। কেউই চরমরূপে স্বাধীন নয়।
মনোবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ক্রিয়া দুরকম হতে পারে। অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক। বাহ্যিক ক্রিয়ায় ব্যক্তি নিজের ইন্দ্রিয় সহযোগে বস্তুর উপর সক্রিয় হয়। অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে ব্যক্তি বস্তুর মানসিক স্মৃতি ও ছবির উপর কল্পনার মাধ্যমে ক্রিয়াশীল হয়। যে-কোনো বাহ্যিক ক্রিয়ার পূর্বে ব্যক্তি তাকে মানসিকভাবে পূর্বেই সম্পন্ন করা চেষ্টা করে। মুখে যে শব্দ উচ্চারণ করে অপর ব্যক্তির নিকট আমরা ভাব প্রকাশ করি, সে শব্দকে মানসিকভাবে প্রায়শই আমরা পূর্বে উচ্চারণ করে নিই। এরূপ ক্রিয়ার পৌনঃপুনিক চেষ্টায় মানসিক ক্রিয়া ক্রমান্বয়ে স্বয়ংক্রিয় বা মনেরও অগচরে হয়ে দাঁড়ায়। মানসিক ক্রিয়া পরিবেশকে পরিবর্তন করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। মানসিক ক্রিয়াই তত্ব হিসাবে প্রকাশিত হয়। তত্ব ও তার প্রয়োগমূলক ক্রিয়াও পরস্পর নির্ভরশীল। পরিবেশের আঘাত মস্তিস্ককে উপযুক্তরূপে পরিবর্তনের চিন্তায় সক্রিয় করে। মানসিকভাবে পরিকল্পিত ক্রিয়াকৌশল পরিবেশের উপর প্রয়োগের মারফত ব্যক্তি তার বাঞ্ছিত উদ্দেশ্য বাস্তবক্ষেত্রে কার্যকর করতে প্রয়াস পায়।
Adler, Alfred: আলফ্রেড এ্যাডলার (১৮৭০-১৯৩৮)
অষ্টিয়ার মনোবিজ্ঞানী। মনোসমীক্ষার প্রবর্তক সিগমণ্ড ফ্রয়েডের পরেই মনোসমীক্ষার ক্ষেত্রে এ্যাডলারের খ্যাতি। কিন্তু মনোবিশ্লেষণের প্রশ্নে দুজনার মত এক নয়। এ্যাডলারের মনোসমীক্ষাণ ব্যক্তিকেন্দ্রীক। এ্যাডলার ব্যক্তিকে একটি স্বয়ংসম্পর্ণ চরিত্র বলে মনে করেন। ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব পরিবেশ দ্বারা গঠিত। মনোবিকার বা মানসিক রোগের মূল হচ্ছে পরিবেশের সঙ্গে ব্যক্তির সংঘাত। ব্যক্তি চাই পরিবেশকে জয় করতে। জয়ের এই প্রবণতা ব্যক্তির জন্মগত। শৈশবেই এর উদ্ভব ঘটে। ব্যক্তি দৈহিক দুর্বলতা, মানসিক অক্ষমতা কিংবা অপর কোনো প্রতিকূল কারণে পরিবেশের সঙ্গে সংঘাতে জয়ী না হলে নিজের মনে সে বাস্তব অবস্থার পরিপূরক এর কপ্লজগতের সৃষ্টি করে। এভাবেই মানসিক রোগ কিংবা মসোবিকারের সূত্রপাত হয়। ব্যক্তি আপন কপ্ললোকে বাস্তব জগতের সর্বপ্রকার পরাজয়ের ক্ষতিপূরণ করার চেষ্টা করে। যে দৈহিকভাবে দুর্বল সে কল্পনা জগতে নিজেকে অপরিমিত শক্তিশালী মনে করে। এর ফলে বাস্তবের সঙ্গে ব্যক্তির সংঘাত অধিকতর বৃদ্ধি পায়। এ্যাডলারের তত্ত্ব অনুযায়ী মানসিক রোগীর রোগ দূরীকরণের জন্য ব্যক্তি শৈশবকাল এবং পরিবেশ উত্তমরূপে জানা আবশ্যক। কেন না, শৈশবকালে পরাজয়গুলিই রোগীর মনে বদ্ধমূল মনোবিকারের সৃষ্টি করে। রোগীকে এ অবস্থায় নিরাময় করবার প্রকৃষ্ট পথ হচ্ছে বাস্তবের সঙ্গে সংঘাতের বিপদ সম্পর্কে তাকে সচেতন করার চেষ্টা করা এবং যথাসম্ভব বাস্তব সঙঘাত থেকে তাকে দূরে রাখা। ফ্রয়েড যেখানে ব্যক্তির মূল জীবনবোধের পেছনে যৌন অনুভূতি এবং যৌন আকাঙ্ক্ষাকে আবিস্কার করেছেন, এ্যাডলার যেখানে ব্যক্তির জীবনবোধের পেছনে সামাজিক ক্ষেত্রে আত্মপ্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষার কথা বলেছেন। ফ্রয়েড মানসিকভাবে সুস্থ অসুস্থ উভয় ব্যক্তির মনকে যৌনাকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে বিশ্লেষণ করেছেন। যৌনাকাঙ্ক্ষার উপর এই গুরুত্ব আরোপের ক্ষেত্রে এ্যাডলার ফ্রয়েডের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন। এ্যাডলার ব্যক্তির যৌনবোধ অস্বীকার করেন না। কিন্তু তাঁর মতে যৌনবোধ বা অনুভূতি ব্যক্তির জটিল চরিত্রের মাত্র অনুভূতি। সর্বপ্রকার বোধ নিয়ে ব্যক্তির যে চরিত্র, তার বিবেচনা ব্যতীত ব্যক্তিচরিত্রের কোনো বিশেষ অনুভূতির সঠিক বিচার সম্ভব নয়। ব্যক্তির সামগ্রিক চরিত্রকে এ্যাডলার বলেছেন ব্যক্তির জীবনপ্রক্রিয়া। ব্যক্তিগত জীবনে এ্যাডলার একজন চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। ফ্রয়েডের সঙ্গে যখন তিনি যুক্ত হন, তখন ফ্রয়েড তাকেঁ মনোসমীক্ষণ সংঘের সভাপতি মনোনীত করেছিলেন। কিন্তু মনোবিশ্লেষণে মতপার্থক্যের জন্য এ্যাডলার ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে ফ্রয়েডের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করে ‘মুক্তবুদ্ধি মনোসমীক্ষণবিদ সংঘের’ প্রতিষ্ঠা করেন। মতবিরোধের ফলে উভয় বিজ্ঞানীর ব্যক্তিগত সম্পর্ক তিক্তরূপ ধারণ করে। কিন্তু মনোবিশ্লেষণের ক্ষেত্রে ব্যক্তি-চরিত্রের নতুনতর বিচার এ্যাডলারের খ্যাতিকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে। ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব ও চরিত্রকে জানার জন্য শৈশবকে জানার আবশ্যকতা এবং দুর্বলতাবোধ থেকে যে শৈশবকালেই ব্যক্তির জীবনে পরাজয়ের গ্লানি ও বিকার দেখা দিতে পারে এবং যে বিকার বদ্ধমূল হয়ে ব্যক্তিকে মানসিক রোগীতে পরিণত করতে পারে-এ্যাডলারের এই তত্ত্ব শিক্ষা-ব্যবস্থা ও সামাজিক সমস্যা বিচারে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বলে গৃহীত হয়েছে। এ্যাডলারের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের ইংরেজি নাম হচ্ছে ‘দি নিউরোটিক কনসটিটিউশন’ (১৯১২) এবং ‘ইনিডিভিডুয়াল সাইকোলজি’ (১৯২৪)।
Adler, Max: ম্যাকস এ্যাডলার (১৮৭৩-১৯৩৭)
অস্ট্রিয়ার রাজনীতিক লেখক এবং দার্শনিক। অস্ট্রিয়ার সোস্যাল ডিমোক্রাটিক পার্টির তাত্ত্বিক। প্রথম মহাযুদ্ধের পরবর্তীকাল থেকে এ্যাডলার সোস্যাল ডেমোক্রাটিক পার্টির বামপন্থী গ্রুপকে সমর্থন করেন। ১৯৩০ সালে কার্লরেনার এবং রুডরফ হিলপারডিং-এর সঙ্গে যৌথভাবে এ্যাডলার ভিয়েনাতে একটি শ্রমিকদের স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। অস্ট্রিয়ার মার্কসবাদে এ্যাডলারের ভূমিকার একটি দিক হচ্ছে, একটি সমাজতাত্ত্বিক তত্ত্ব হিসাবে মার্কবাদের জ্ঞানতত্ত্বকে দাঁড় করাবার চেষ্টা করেন। এ ক্ষেত্রে তিনি নব্য-কাণ্টীয় এবং আর্নেস্ট ম্যাকের পজিটিভিম দর্শন দ্বারা বিশেষ প্রভাবিত হয়েছিলেন। লেলিন পরবর্তীকালে তাঁর ‘ম্যাটেরিয়ালিজম এ্যাণ্ড এমপিরিও ক্রিটিসজিম’ গ্রন্থে ম্যাকের দর্শনকে ভাববাদী বলে সমালোচনা করেন।
Aenesidemus: এনিসিডেমাস (খ্রি. পূ. প্রথম শতক )
খ্রি. পূ. প্রথম শতকের গ্রিক দার্শনিক। জ্ঞানের ক্ষেত্রে এনিসিডেমাস সন্দেহবাদের সমর্থক ছিলেন। তিনি প্লেটোর একাডেমীর সদস্য ছিলেন। সন্দেহবাদের ক্ষেত্রে এনিসিডেমাসকে তাঁর পূর্বগামী বিখ্যাত গ্রিক দার্শনিক পিরহোর (৩৬৫-২৭৫ খ্রি. পূ.) অনুসারী বলা যায়। এনিসিডেমাসের মতে কোনো কিছু সম্পর্কেই সন্দেহাতীত জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব নয়। কারণ, তর্কের ক্ষেত্রে যুক্তির অভাব ঘটে না। এক যুক্তি যাকে সত্য বলে দাবি করে, অপর যুক্তি তাকে অসত্য বলে প্রমাণ করতে পারে। কাজেই সত্য ও অসত্য নিয়ে যুক্তি এবং পাল্টা যুক্তির লড়াই-এর চেয়ে শ্রেয় হচ্ছে মনের শান্তি বজায় রাখার চেষ্টা করা। যুক্তির লড়াই মনের শান্ত অভিমতকে বিনষ্ট করে। সত্যাসত্যের লড়াই ছাড়াই মানুষ জীবনযাপন করে। ‘অন্য সবাই যেমন চলে আমারও তেমনি চলাই কর্তব্য।’ সাধারণের মত গ্রহণ করা এবং অপরিহার্য বিশ্বাস করাই জীবনে শান্তিলাভের প্রকৃষ্টতম পথ। এনিসিডেমাসের পরবর্তীকালে খ্রিষ্টাব্দের দ্বিতীয় শতকে সেক্সটাস এমপিকাস-রচিত ‘দেবতায় বিশ্বাসে বিপক্ষ-যুক্তি’ নামক গ্রন্থ উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। প্রাচীন সন্দেহবাদীদের মধ্যে কেবলমাত্র তাঁর রচনাই পাওয়া যায়। উপরোক্ত গ্রন্থের একস্থানে দার্শনিক সেক্সটাস এমপিরিকাস সন্দেহবাদী দর্শনকে ব্যাখ্যা করে বলেছেন, আমরা সন্দেহবাদীরা জগতের প্রচলিত কিছু অমান্য করি না। কিন্তু প্রচলিত আচার-আচরণ তত্ত্বকে আমরা বিশ্বাসও করি না। বাস্তবে যা ঘটছে সে সম্পর্কে বিশ্বাস-অবিশ্বাস, স্বীকার কিংবা অস্বীকারের প্রশ্ন অবান্তর। দেবতাদের সবাই বিশ্বাস করে; তাদের নানা উপঢৌকন দেয়। মানুষ দেবতাদের উদ্দেশে নানা আচার-আচরণ করে। সে সমস্ত আচার আমরাও পালন করি। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, আমরা দেবতার অস্তিত্বে বিশ্বাসে-কিংবা অবিশ্বাসী। জ্ঞানের ক্ষেত্রে জোর করে কিছু বলার পক্ষপাতী আমরা নই।’ (বার্ট্রাণ্ড রাসেল হিস্টরি অব ওয়েস্টার্ন ফিলোসফি-২৬২ পৃষ্ঠা)
এই ব্যাখ্যায় প্রাচীন সন্দেহবাদের একটি পরিচয় পাওয়া যায়। এনিসিডিমাসের দর্শন তৎকালীন গ্রিক সামাজিক অবস্থারও পরিচয়বাহক। গ্রিসের সমাজ-ব্যবস্থার পূর্বকার শক্তি ও সমৃদ্ধি তখন বিনষ্ট। সমাজ জীবনে অস্থিরতা প্রবল হয়ে দেখা দিয়েছে। প্লেটো-এ্যারিস্টটলের দর্শন প্রতিপত্তি হারিয়েছে। এমন সামাজিক ও চিন্তাগত পরিবেশে গ্রিক সন্দেহবাদের উদ্ভব ঘটে।
জ্ঞানের বিপক্ষে এনসিডিডেমাস দশটি যুক্তি উপস্থিত করেছিলেন বলে অনেকে ধারণা। যুক্তিগুলি এরূপ: (১) মানুষের জ্ঞানের মাধ্যম হচ্ছে ইন্দ্রিয় এবং অনুভূতি। কিন্তু ইন্দ্রিয়ের বিচার এবং অনুভূতির সিদ্ধান্ত একরূপ হয় না। (২) ব্যক্তি জ্ঞান অর্জন করে। ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে দৈহিক এবং মানসিক পার্থক্য বিদ্যমান। এই পার্থক্যের কারণে ব্যক্তি থেকে ব্যক্তির জ্ঞান পৃথক হয়। (৩) ব্যক্তির বিভিন্ন ইন্দ্রিয় একই বিষয় সম্পর্কে পরস্পর পৃথক ধারণা সৃষ্টি করে। (৪) ব্যক্তির দৈহিক এবং মনাসিক অবস্থার উপর জ্ঞানের রূপ নির্ভরশীল। দৈহিক ও মানসিক অবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে জ্ঞানও পরিবর্তিত হয়। (৫) বস্তু সম্পর্কে ধারণা ব্যক্তির সঙ্গে দৃষ্ট বস্তুর দূরত্ব এবং অবস্থানের ভিত্তিতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন রূপ হয়। (৬) কোনো বস্তু বা বিষয়ের জ্ঞান কখনোই প্রত্যক্ষভাবে লাভ করা যায় না। জ্ঞান প্রতি ক্ষেত্রেই মাধ্যম-নির্ভর। (৭) বস্তুর বর্ণ, গুত, পরিমাণ, তাপ ইত্যাদি চরিত্র পরিবর্তিত হলে বস্তুর জ্ঞানও পরিবর্তিত হয়ে যায়। (৮) বিষয়ের সঙ্গে বিষয়ীর পরিচয়ের পরিমাণের ক্ষেত্রে পার্থক্য থাকলে বিষয় সম্পর্কে বিষয়ীর জ্ঞানও পৃথক রূপ লাভ করে। (৯) যাকে জ্ঞান বলা হয় তা আসলে ব্যক্তিবিশেষের অনুমান এবং অভিমত মাত্র। (১০) বিভিন্ন দেশে বিভিন্নরূপ অভিমত এবং আচার-আচরণের প্রকাশ দেখা যায়।
এই দশটি যুক্তির প্রত্যেকটি মৌলিক নয়। একটি ক্ষেত্রের যুক্তি ভিন্নতর প্রকাশে অপর ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে। কিন্তু জ্ঞানের নিশ্চয়তার বিপক্ষে এনিসিডেমাসের যুক্তিসমূহের মূল কথা হচ্ছে এই যে, সত্যের কোনো অনন্য-নির্ভর অস্তিত্ব নাই। বিভিন্ন অবস্থায় বিভিন্নরূপে একই সত্য প্রতিভাত হয়; ফলে কোনো সত্য সঠিক তা জানা সম্ভব নয়। জ্ঞানের অপরিহার্য মাধ্যম হচ্ছে ব্যক্তি। কোনো বস্তু বা বিষয় সম্পর্কে প্রত্যেক ব্যক্তির ধারণা ব্যক্তির বিশেষ অবস্থা ও পরিবেশের উপর নির্ভরশীল। ঘটনার ক্ষেত্রে কার্যকরণ সম্পর্কেও এনিসিডেমাস অস্বীকার করেন। দর্শনের ইতিহাসে আধুনিক যুগে জ্ঞানের প্রশ্নে সন্দেহবাদী দর্শনের যে প্রকাশ দেখা যায়, তার যুক্তি মূলত এনিসিডেমাস দার্শনিকের যুক্তিরই অনুরূপ।
Aesthetics: সৌন্দর্যতত্ত্ব
‘সৌন্দর্যতত্ত্ব’ কথাটি ব্যাপক। এ কারণে এর বিষয়বস্তুর সীমা নির্দিষ্ট করা কষ্টকর। সৌন্দর্যতত্ত্বের মধ্যে সৌন্দর্যানুভূতি, শিপ্লকলার বিচার, সুন্দর-অসুন্দরের পার্থক্য প্রভৃতি সমস্যাকে সাধারণত অন্তর্ভূক্ত মনে করা হয়। সৌন্দর্যতত্ত্বের সঙ্গে নীতিশাস্ত্রেরও একটি সম্পর্ক রয়েছে। এ-ক্ষেত্রে সমাজ-সংস্থার নিয়ন্ত্রণ এবং পরিবর্তনে সৌন্দর্যতত্ত্বের ভূমিকা আলোচিত হয়।
সাধারণভাবে সৌন্দর্যানুভুতিকে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি আদিম অনুভূতি বলে মনে করা হয়। প্রকৃতির মোকাবেলায় আদিমকাল থেকে মানুষ বিভিন্ন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার উৎস হিসাবে কাজ করেছে। এরুপ ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্যে কোনো কোনোটি মানুষের মনের আবেগময় প্রতিক্রিয়া। এই আবেগময় প্রতিক্রিয়ার মূলে মানুষের জীবন রক্ষার অচেতন জৈবিক প্রয়োজনই আদিকালে সমধিক কাজ করেছে। দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার মাধ্যমে মানুষ প্রাকৃতিক ঘটনা এবং শক্তির প্রকাশকে আপন জীবন রক্ষার সহায়ক কিংবা ক্ষতিকারক বলে চিহ্নিত করেছে। এ সমস্ত শক্তিকে প্রয়োজন অনুযায়ী নিজের মনে জাগরূক রাখার সে চেষ্টা করেছে। এই আদিম বোধ থেকেই আদি শিল্পকার্যের সৃষ্টি। এই উৎস থেকে সামাজিক ভালোমন্দ বোধেরও উৎপত্তি।
মানুষের নিজের জীবনের মতোই সৌন্দর্যানুভূতির ইতিহাস দীর্ঘ। সভ্যতার জটিল বিকাশের ধারায় সৌন্দর্যতত্ত্বকেও প্রাথমিক যুগে সহজ এবং আধুনিককালে জটিল এবং অবাস্তবের লক্ষণযুক্ত দেখা যায়।
কোনো বস্তু বা ঘটনা সম্পর্কে ব্যক্তির মনের আবেগময় অনুভূতি এবং তার ভাষাগত প্রকাশ ব্যতীত শিল্পকলা, ভাস্কর্য, সঙ্গীত এবং অন্যান্য মানবিক সৃষ্টিকে সুন্দর কিংবা অসুন্দর এবং ভালো কিংবা মন্দ হিসাবে বিচারের প্রয়াসকে সৌন্দর্যতত্ত্ব বলে অভিহিত করা হয়। সৌন্দর্যতত্ত্ব বলতে উপরোক্ত বিষয়গুলি সম্পর্কে বিশেষ কোনো তত্ত্বকে বুঝায় না। এর দ্বারা উপরোক্ত বিষয়গুলির উপরে বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন চিন্তাবিদের চিন্তা কিংবা ভাবধারার কথা বুঝায়। সৌন্দর্যতত্ত্বের সামগ্রকি আলোচনায় সুন্দর এবং অসুন্দরের অথবা ভালৌ এবং মন্দের কোনো নির্দিষ্ট আদর্শ কিংবা মানদণ্ড আছে কিনা সে প্রশ্ন নিয়েও আলোচনা করা হয়।
সৌন্দর্য়তত্ত্বের উদ্ভব প্রায় আড়াই হাজার বছর পূর্বে ব্যাবিলন, মিসর, ভারতবর্ষ এবং চীনের দাস-প্রধান সমাজে লক্ষ্য করা যায়। পরবর্তীকালে গ্রিসের হেরাক্লিটাস, সক্রেটিস, প্লেটো, এ্যারিসস্টটল এবং অপরাপর দার্শনিকের রচনায় সৌন্দর্যতত্ত্বের জটিলতর বিকাশের আমরা সাক্ষাৎ পাই। প্রাচীন রোমের দার্শনিক লুক্রেশিয়াস এবং হোরেসও সৌন্দর্যতত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করেন। মধ্যযুগে সেণ্ট অগাস্টিন এবং টমাস একুইনাস প্রমুখ ধর্মতাত্ত্বিকগণ সৌন্দর্যতত্ত্বে রহস্যবাদের আমদানি করেন। তাঁদের মতে, জগতাতীত এক ঐশ্বরিক সুন্দরের অস্তিত্ব রয়েছে। সেই ঐশ্বরিক সুন্দরের মানদণ্ডেই জাগতিক বস্তুনিচয়ের সৌন্দর্য পরিমাপ করতে হবে। মধ্যযুগের এই রহস্যবাদের প্রতিক্রিয়া ঘটে পরবর্তীকালে নব-জাগরণের চিন্তাবিদ এবং দার্শনিকগণের মধ্যে। এঁদের মধ্যে পেতরার্ক, আলবার্ট, লিওনার্দো দা ভিঞ্চি, দুরার,ব্রুনো এবং মণ্টেনের নাম বিখ্যাত। পাশ্চাত্যের নব-জাগরণের পরবর্তী জ্ঞানাস্বেষণের যুগের চিন্তাবিদদের মধ্যে বার্ক, হোগার্ত, ডিডেরক, রুশো, লেসিং প্রমুখ খ্যাতি অর্জন করেন। মানবতাবাদের এই ঐতিহ্যকে বহন করে সাহিত্যের ক্ষেত্রে শিলার এবং গ্যেটে ঘোষণা করেন যে, সৌন্দর্য এবং শিল্পের উৎস হলো মানুষ এবং তার বাস্ত জীবন।
সৌন্দর্যতত্ত্বের ইতিহাসে দুটি প্রধান ধারার সাক্ষাৎ সব যুগেই পাওয়া যায়। এদের একটি হচ্ছে সৌন্দর্য সম্পর্কে বস্তুবাদী ধারণা; অপরটি ভাববাদী। ভাববাদী সৌন্দর্যতত্ত্ব সৌন্দর্যকে অতি-প্রাকৃতিক একটি সত্তা বলে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছে। অতি-প্রাকৃতিক এই সত্তা সাধারণ মানুষের বুদ্ধি এবং সিদ্ধির অতীত। সমাজের উচ্চতর শ্রেণীর মানুষের পক্ষেই মাত্র এই নিকষ সুন্দরকে উপলব্ধি করা সম্ভব। এরূপ ব্যাখ্যায় ভাববাদী সৌন্দর্যতত্ত্ব এবং সুন্দরের ধর্মীয় রহস্যবাদী কল্পনায় কোনো পার্থক্য নেই। সাধারণ মানুষকে অজ্ঞানতার মোহ আবদ্ধ রাখার প্রয়াস সমাজের শক্তিমান শ্রেণীগুলো সব যুগেই করে এসেছে। সৌন্দর্যতত্ত্বের ক্ষেত্রে দর্শনের অন্যান্য মৌলিক প্রশ্নের ন্যায় ভাববাদের বিরোধী ব্যাখ্যা হচ্ছে বস্তুবাদী ব্যাখ্যা। বস্তুবাদী দার্শনিকগণ মানুষের বাস্তব পরিবেশ এবং জীবনের মধ্যেই সৌন্দর্যানুভূতির সৃষ্টি এবং বিকাশকে লক্ষ্য করেছেন। সৌন্দর্যতত্ত্বে বস্তুবাদ এবং ভাববাদের বিরোধ সমাজের শোষক এবং শোষিতের বাস্তব বিরোধের ভাবগত প্রতিফলন।
বস্তুবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে সৌন্দর্যতত্ত্বে তিনটি প্রশ্ন মূল (১) বস্তুজগতে সৌন্দর্যের সৃষ্টি এবং বিকাশ; (২) মনোজগতে সৌন্দর্যানুভূতির ব্যাখ্যা, এবং (৩) শিল্পকর্মের মূল্যায়ন। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের মতে পরিবেশের সঙ্গে মানুষের প্রবহমান ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সম্পর্কের ধারাতে ক্রমাধিক পরিমাণে আনন্দজনক জীবনযাপনের তাগিদে সুন্দর, অসুন্দর, মহৎ, হীন, হর্ষ এবং বিষাদ প্রভৃতি অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছে।
ব্যাপকতার দিক থেকে সৌন্দর্যতত্ত্ব কেবল শিল্পকলার সৌন্দর্যকে বিশ্লেষণ করে না। শিল্পকলার সৌন্দর্যের বিশ্লেষণে সৌন্দর্যতত্ত্বের একটি প্রয়োগগত দিক মাত্র। ব্যাপকভাবে সৌন্দর্যতত্ত্বের আলোচ্য হচ্ছে মানুষ। তার সৃজনশীল ক্ষমতার বাস্তব প্রকাশে, মহতের জন্য জীবন উৎসর্গে, দাসত্ব থেকে মুক্তির সংগ্রামে যে আনন্দানুভূতি সে বোধ করে কিংবা বর্বরতার আঘাতে যে ঘৃণা তার মনে উদ্ভূত হয়, তার বিকাশ-প্রক্রিয়া এবং বৈশিষ্ট্য।
Agent Provocateur: প্ররোচক, উস্কানিদাতা, দালাল
রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষ অনেক সময়ে নিজ পক্ষীয় লোককে অন্য পক্ষের ভিতর প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষের সমর্থকের ছদ্মবেশে অনুপ্রবেশ করিয়ে দেয়। এরূপ কৌশলের প্রধান উদ্দেশ্য হয় ছদ্মবেশী সমর্থক দ্বারা এমন কোনো ঘটনার সৃষ্টি করা যার ফলে উক্ত পক্ষের কোনো মারাত্মক ক্ষতি সাধিত হতে পারে। ক্ষতিগ্রস্থ পক্ষ এরূপ লোকের সন্ধান পলে তাকে প্ররোচক, উস্কানিদাতা বা দালাল বলে অভিহিত করে। ইংরেজি ‘এজেণ্ট প্রভোকেচার’ কথাটির মূল ফরাসি। এর অর্থ উস্কানিদাতা বা প্ররোচক। অনেক সময়ে দেখা যায় যে, কোনো রাজনীতিক দল নিজের ব্যর্থতার দ্বায়িত্ব কল্পিত ‘প্ররোচকের’ ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়। শূধু প্রতিদ্বন্দ্বী দল নয়, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও এক রাষ্ট্র কর্তৃক আর এক রাষ্ট্রকে আক্রমণের অজুহাতে সৃষ্টির জন্য প্ররোচক দ্বারা মারাত্মক ঘটনা ঘটাবার বহু দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়।
Agnosticism : অজ্ঞেয়বাদ
সাধারণভাবে অজ্ঞেয়বাদ বলতে জ্ঞানের ক্ষেত্রে জগৎ বা বিশ্বকে জানার অক্ষমতা বুঝায়। এদিক থেকে সন্দেহবাদ বা সংশয়বাদের সঙ্গে অজ্ঞেয়বাদের সাদৃশ্য আছে। কিন্তু অজ্ঞেয়বাদ কথাটি সংশয়বাদের মত প্রাচীন নয়। অজ্ঞেয়বাদের ইংরেজি শব্দ এ্যাগনসটিসিজম-এর প্রথম ব্যবহার দেখা যায় ঊনবিংশ শতকে ইংরেজ বৈজ্ঞানিক টমাস হাক্সলীর রচনায়। ধর্মের ক্ষেত্রে বিধাতার অস্তিত্তকে জানা সম্ভব কি অসম্ভবের প্রশ্নে অজ্ঞেয়বাদের উদ্ভব। উনিশ শতকে ধর্মের বিতকেৃ এরূপ একটা অভিমতের প্রকাশ দেখা যায় যে, জ্ঞানের ব্যাপারে মানুষের যে সীমাবদ্ধতা রয়েছে তাতে বিশ্বরাচরের কোনো বিধাতা আছে কিংবা নাই এরূপ কোনো সিদ্ধান্তে পৌছানই মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। সেরূপ কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের অর্থ হচ্ছে মানুষ যে সীমাকে অতিক্রম করতে পারে না, সেই সীমাকে অতিক্রম করে সিদ্ধান্ত গ্রহণের দাবি করা।
অজ্ঞেয়বাদের এই যুক্তি প্রধানত অষ্টাদশ শতকের কাণ্টীয় দর্শনের উপর ভিত্তি করেই করা হয়। আধুনিক ইউরোপীয় দর্শনে জ্ঞানের প্রশ্নে সন্দেহবাদের শুরু হয় ইংরেজি দার্শনিক হিউমের মধ্যে। হিউম জ্ঞান সম্পর্কে ১৭৪৮ খ্রিষ্টাব্দে ‘এ্যান এনকোয়ারি কনসারনিং হিউম্যান আনডারস্ট্যাণ্ডিং’ নামে একখানি পুস্তক রচনা করেন। তাঁর এই গ্রন্থে প্রধানত তাঁর পূর্বগামী ভাববাদী ধারণার জবাব হলেও তাঁর যুক্তির মারফত, মানুষের আদৌ কোনো জ্ঞান সম্ভব কিনা, সে মৌলিক প্রশ্নও উত্থাপিত হয়। পরবর্তীকালে জার্মান দার্শনিক কাণ্ট জ্ঞানের ক্ষেত্রে ভাববাদকে হিউমের মৌলিক আঘাত থেকে রক্ষা করাই জন্যই তার ‘নু মেনা’ বা মূল সত্তা হিসাবে বস্তুকে জানার অসম্ভবতার তত্ত্ব উপস্থিত করেন। তাঁর মতে মূল সত্তা হিসাবে বস্তুর অস্তিত্ব অবশ্যই আছে। কিন্তু মানুষ নিজের জ্ঞানসূত্র বা কাণ্টেগরি ব্যতিত কোনো কিছুর জ্ঞানই লাভ করতে পারে না। কিন্তু জ্ঞানসূত্র মারফত দৈনন্দিন-দৃষ্ট বস্তুকেই মাত্র জানা যায়। অ-দৃষ্ট মূল বস্তুসত্তাকে জানা যায় না। আধুনিক অজ্ঞেয়বাদ ধর্মের ক্ষেত্রে কাণ্টের যুক্তি প্রয়োগ করে বিধাতাকে স্বীকার-অস্বীকারের বাইরে রেখে দেবার প্রয়াস পায়। ঊনবিংশ শতকে দর্শনের ক্ষেত্রে অজ্ঞেয়বাদের উদ্ভব বৃহত্তর বাস্তব জীবনে বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি এবং আর্থিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে-পুঁজিবাদ-বিরোধ শ্রমিক শ্রেণীর অগ্রগতি এবং আর্থিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে পুঁজিবাদ-বিরোধী শ্রমিক শ্রেণীর ক্রমবর্ধমান শক্তি এবং সামাজিক সমস্যার সঙ্গে জড়িত। বিজ্ঞানের অগ্রগতি বাস্তব জগতের উপর মানুষের সমস্যার সঙ্গে জড়িত। বিজ্ঞানের অগ্রগতি বাস্তব জগতের উপর মানুষের শক্তিকে যত বেশি প্রতিষ্ঠিত করে তুলছিল, তত বেশি ধর্ম এবং দর্শনের রাজ্যে ভাববাদের নতুনতর যুক্তি আবশ্যক হয়ে উঠেছিল। এমন পরিস্থতিতে কাণ্ট যেমন দর্শনের ক্ষেত্রে জটিল যুক্তিজালে ভাববাদকে রক্ষা করার প্রয়াস পেয়েছেন, তেমনি ধর্মের ক্ষেত্রে অজ্ঞেয়বাদ বিধাতার অস্তিত্বকে জ্ঞানের বাইরে রেখে তাকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে। আধুনিক অজ্ঞেয়বাদ পরিণামে কেবল ধর্মের ক্ষেত্রেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখে নি। অজ্ঞেয়বাদীদের মতে কেবল যে, বিশ্ব-বিধাতাই অজ্ঞেয়, তাই নয়। মানুষের কাছে প্রাকৃতিক বিধান, সমাজের বিকাশের ধারা-সবই অজ্ঞেয়। তাই তাঁদের মতে বিজ্ঞান যে বিশ্বজগতের কোনো নির্দিষ্ট জ্ঞান আমাদের দিতে পারে, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ অজ্ঞেয়বাদকে অসার বলে অভিহিত করে। আধুনিক দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের প্রবক্তাদের অন্যত্তম হচ্ছেন ফ্রেডারিক এঙ্গেলস তাঁর সুবিখ্যাত গ্রন্থ ‘এ্যাণ্টিডুরিং’-এ অজ্ঞেয়তাবাদকে খণ্ডন করেছেন। তাঁর মতে বস্তুকে মানুষ আদৌ জানতে পারে কিনা, এ প্রশ্ন নিয়ে মানুষের মাথা ঘামাবার দিন শেষ হয়ে গেছে। কারণ মানুষ বস্তুকে কেবল তাত্ত্বিকভাবেই জানছে না। বাস্তবভাবে সে বস্তুকে স্পর্শ করছে, বিশ্লেষণ করছে, তার অন্তর্নিহিত বিধি-বিধানকে জানছে এবং জ্ঞাত সেই বিধানকে প্রয়োগ করে বস্তুকে সে নতুনভাবে গঠনও করছে। এর পরে জ্ঞানের ক্ষেত্রে অজ্ঞেয়বাদের অবকাশ থাকে না বলে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ অভিমত পোষণ করে।
Agrippa: আগারিপা (খ্রি. দ্বিতীয় শতক )
খ্রিষ্টাব্দের আনুমানিক দ্বিতীয় শতকের রোমান সংশয়বাদী দার্শনিক। কেউ কেউ আগরিপাকে গ্রিক দার্শনিক বলেও মনে করেন। প্রাচীন সন্দেহবাদীদের মধ্যে আগরিপা অবশ্যই বিশিষ্ট ছিলেন। কারণ প্রাচীন যুগে ‘আগরিপা’ নামে একখানা পুস্তক রচিত হওয়ার কথা জানা যায়।
আগরিপা জ্ঞানের ক্ষেত্রে তাঁর ‘পঞ্চ’ যুক্তির জন্য খ্যাতি অর্জন করেন। সংশয়বাদী এনিসিডেমাসের সমস্যা ছিলো দশটি। আগরিপার সমস্যার মূলগতভাবে এনিসিডেমাসের সমস্যা থেকে পৃথক না হলেও আগরিপার সমস্যার ব্যাপকতা এনিসিডেমাসের চাইতে অধিক। জ্ঞানের কোনো নিশ্চয়তা নাই-এ অভিমত আগরিপা তাঁর পঞ্চযুক্তির মারফত যত জোরালোভাবে উপস্থিত করেছিলেন, প্রাচীন দর্শনে সেরূপ জোরালো অভিমত অপর কোনো সংশয়বাদী উপস্থিত করেন নি।
জ্ঞানের অনিশ্চয়তার প্রমাণস্বরূপ আগরিপার পঞ্চযুক্তি নিন্মরূপ:
প্রথম যুক্তি পরস্পর-বিরোধীতা। বস্তুজগৎ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান পরস্পর-বিরোধী। সাধারণ মানুষ এবং দার্শনিক এরা কেউ জ্ঞানের মাধ্যম সম্পর্কে ঐকমত্য পোষণ করেন না। কোনো পক্ষের মতে ইন্দ্রীয়দত্ত জ্ঞানই জ্ঞান। আবার অপর কোনোপক্ষ এরূপ অভিমত পোষণ করে যে ইন্দ্রীয় এবং অনুভূতি উভয়ের মাধ্যমে আমরা জ্ঞান লাভ করি। পরস্পর-বিরোধী এই অভিমতের কোনো মীমাংসা নাই। ফলে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।
দ্বিতীয় যুক্তি বিরামহীন পশ্চাদ্ধবনের যুক্তি। জ্ঞানের ক্ষেত্রে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য আমরা একটি দত্ত সত্য বা প্রতিজ্ঞার উপর নির্ভর করি। একটি বিশেষ অনুমানের ক্ষেত্রে দত্ত সত্যকে সঠিক বলে ধারণা করি। কিন্তু সঠিক বলে গৃহীত সত্যেরও প্রমাণের আবশ্যক। সেরূপ প্রমাণের জন্য অপর একটি দত্ত সত্য বা প্রতিজ্ঞার উল্লেখ করি। কিন্তু এর প্রমাণের জন্য অপর আর একটি সত্যের আমরা বরাত দেই। বরাতের পরে এই বরাতের এই ধারা বিরামহীন। ফলে চুড়ান্তরূপে কোনো সিদ্ধান্তে পৌছান আমাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। স্বতঃসিদ্ধের ক্ষেত্রেও একই সমস্যা। যাকে স্বতঃসিদ্ধ বলে গ্রহণ করা হয়, তা যে স্বতঃসিদ্ধ-তারও প্রমাণ আবশ্যক। কিন্তু প্রমাণ শুরু করলেই আমরা বিরামহীন বরাতের অন্তহীন পশ্চাদ্ধাবনের পক্রিয়ায় জড়িত হয়ে পড়ি। ফলত জ্ঞান এ-ক্ষেত্রে অসম্ভব।
তৃতীয় যুক্তি: আপেক্ষিকতা। বিষয়ী বা যে জানে তার সঙ্গে বিষয় বা জানা হয় তার সম্পর্ক অর্থ্যাৎ বিষয়ের সঙ্গে বিষয়ীর সম্পর্ক জ্ঞানকে গঠিত করে। ফলে এই সম্পর্ক-বহির্ভূত অবস্থায় জ্ঞাত বিষয়ের চরিত্র কি তার জ্ঞানলাভ আমাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে।
চতুর্থ চুক্তি: হাইপথেসিস বা প্রকল্প। কোনো সিদ্ধান্তের জন্য সিদ্ধান্তের চেয়ে অধিকতর ব্যাপর একটি বিবৃতিকে আমরা সত্য বলে গ্রহণ করি। একে আমার হাইপথেসিস বা প্রকল্প বলি। গৃহীত সিদ্ধান্তের সত্যাসত্যকে আমরা স্বীকৃত প্রকল্পের সঙ্গে সঙ্গতি-অসঙ্গতির ভিত্তিতে প্রমাণ করি। কিন্তু সে প্রকল্পের ভিত্তিতে আমরা একটি বিশেষ সিদ্ধান্ত প্রমাণ করি, সেই প্রকল্পের প্রমাণের কোনো প্রশ্ন আমরা উত্থাপন করি নে; ফলে অপ্রমাণিতের ভিত্তিতে প্রমাণের অসঙ্গতি সৃষ্ট হয়।
পঞ্চম যুক্তি: চক্রাবর্তের সমস্যা। অনেক ক্ষত্রে স্বীকৃত প্রতিজ্ঞার প্রমাণের জন্য আমরা সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করি। এতে সিদ্ধান্তের প্রমাণের জন্য প্রতিজ্ঞা এবং প্রতিজ্ঞার প্রমাণের জন্য সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করার চক্রাবর্তের সৃষ্টি হয়; ফলে কোনোটি সম্পর্কেই আমরা কোনো জ্ঞানলাভ করতে সক্ষম হই ন। চক্রাবর্তের দৃষ্টান্ত হিসাবে এই যুক্তিটির উল্লেখ করা যায়: মানুষ মরণশীল। সক্রেটিস একজন ভালো মানুষ। সুতরাং সক্রেটিস মরণশীল। পুনরায় সক্রেটিস মরণশীল। সক্রেটিস একজন মানুষ। সুতরাং সকল মানুষ মরণশীল।
আগারিপার পঞ্চযুক্তির সবগুলো হয়তো তাঁর নিজের মৌলিক কোনো উপস্থাপনা নয়। আগারিপার পূর্বগামী সংশয়বাদী দার্শনিকগণ নানাভাবে জ্ঞানের অনিশ্চয়তার প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন। কিন্তু আগরিপার বেশিষ্ট্য এই যে, তিনি জ্ঞানের প্রশ্ন সংশয়কে যেরূপ স্পষ্ট এবং সুনির্দিষ্টভাবে প্রকাশ করেছেন, এরূপ সুনির্দিষ্ট প্রকাশ প্রাচীন সংশয়বাদের ইতিহাসে অপর কোনো দার্শনিকের মধ্যে দেখা যায় না।
Aggression: অন্যায় আক্রমণ, আগ্রাসন
একটি রাষ্ট্র অপর রাষ্ট্রের উপর বিনা কারণে সশস্ত্র আঘাত হানলে তাকে আক্রমণ বা আগ্রসন বলা হয়। অন্যায় আক্রমণ কথাটির অর্থ সহজ হলেও যুদ্ধমান পক্ষের কেউই আক্রমণকারী বলে চিহ্নিত করতে চায় না। পরস্পর পরস্পরকে আক্রমণকারী বলে অভিযুক্ত করে। একমাত্র নিরপেক্ষ কারুর পক্ষে বলা সম্ভব যে, এমন ক্ষেত্রে আক্রমণকারী কে। কিন্তু বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ শুরু হলে তখন আর কেউ নিরপেক্ষ থাকে না। কেবল বিশ্বযুদ্ধ নয়। আধুনিক আন্তর্জাতিক জটিল রাজনীতিতেও নিরপেক্ষ কোনো রাষ্ট্র আছে, একথা বলা কঠিন। কোনো অবস্থায় কোনো কার্য আক্রমণ বলে বিবেচিত হবে এর কোনো সংজ্ঞা জাতিসংঘের ঘোষণাপত্রেও গৃহীত হয় নি। ১৯৩৩ সালে আক্রমণের সংজ্ঞা নির্ধারণের জন্য আফগানিস্তান, এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, ইরান. পোলাণ্ড, রুমানিয়া, তুরস্ক এবং রাশিয়া এই আটটি দেশের একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সম্মেলনে এরূপ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল যে (ক) এক রাষ্ট্র কর্তৃক অপর রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা (খ) যুদ্ধ ঘোষণা ব্যাতিরেকে আক্রমণ (গ) যুদ্ধ ঘোষণা ব্যতীত অপর রাষ্ট্রের ভূখণ্ড, নৌযান বা বিমানের উপর সশস্ত্র আক্রমণ (ঘ) এক রাষ্ট্র কর্তৃক অপর কোনো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নৌঅবরোধ সৃষ্টি এবং (ঙ) প্রতিপক্ষীয় রাষ্ট্রের বিদ্রোহত্মক কোনো সশস্ত্র বাহিনীকে আশ্রয় দান কিংবা তাকে সশস্ত্রভাবে সজ্জিত করতে সাহায্য করা এবং প্রতিপক্ষীয় রাষ্ট্রের দাবি সত্ত্বেও এরূপ বাহিনীকে বহিষ্কার করে দিতে অস্বীকার করাকে একের বিরুদ্ধে অপরের আক্রমণ বলে বিবেচিত হবে।
Ajivika: আজীবিক
শব্দগত অর্থ আজীব আ +জীব+অ জীবনসাধন, জীবনোপায় জীবিকা। খ্রিষ্টপূর্ব সপ্তম এবং ষষ্ঠ শতাব্দিতে ভারতবর্ষে বৌদ্ধ এবং জৈনধর্মের প্রচারের সমকালে ‘আজীবিক’ নামক একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। এই সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ‘গোশাল’ বলে এক ব্যক্তি। গোশালে জন্ম বলেই তাঁর নাম গোশাল হয়েছিল এরূপ অনেকে মনে করেন। জীবন, ধর্ম, দেহ, আত্মা, বিশ্ব ইত্যাদি সমস্যা সম্পর্কে আজীবিক সম্প্রদায়ের অভিমত আজীবিকবাদ বলে প্রাচীন ভারতীয় দর্শন শাস্ত্রের ইতিহাসে আখ্যাত হয়েছে।
প্রাচীণ ভারতীয় দর্শনে আজীবিকদের তত্ত্বের একটি গুরুত্ব আছে। এঁরা জীরন ও জগতের ব্যাখ্যায় আত্মার অস্তিত্ব অস্বীকার করেছিলেন। এঁদেরকে অনুবাদী বলেও আখ্যঅয়িত করা হয়। আজীবিকদের মতে, বস্তু জগতের মূলে রয়েছে চারটি মৌলিক অণু, যথা- মৃত্তিকা, পানি, অগ্নি এবং বায়ু। জগতের যা কিছু সৃষ্টি তার এই চারটি মূল অণুর সম্মেলনেই গঠিত হয়। জীবন নিজে অণু নয়। জীবন এমন একটি শক্তি যার অণুর সম্মেলনকে অনুধাবন করতে সক্ষম। সৃষ্টির মৌলিক পদার্থ অণু শাশ্বত। অণুর বিভাজন নেই। অণু সৃষ্টির মূলে। কিন্তু নিজে সৃষ্ট নয়। অণুর ধ্বংসও সম্ভব নয়। মৌলিক অণুগুলি গতি নয়। এক অণু অন্য অণুতে রূপান্তরিত হতে পারে না। কিন্তু যে কোনো অণু যে কোনো অভিমুখে গতিশীল হতে পারে। বস্তুর যে গুণ তা একটি বিশেষ বস্তুর অণুর সংখ্যা এবং সম্মেলন প্রকারের ভিত্তিতে নির্দিষ্ট হয়। জীবন ও জগতের এই বিশ্লষেণ তেকে বুঝা যায়, আজীবিকগণ প্রাচীন ভারতীয় দর্শনে বস্তুবাদী মত পোষণ করতেন। সম্ভবত ইতিহাসে এঁরাই প্রথম অনুবাদী। আজীবিকদের অনুবাদী মতের সঙ্গে প্রাচীন গ্রিসের ডিমোক্রিটাস (খ্রি. পূ. ৪৬০-৩৭০) এবং এপিক্যুরাস (খ্রি. পূ. ৩৪১-২৭০) এর অনুবাদী তত্ত্বের বেশ সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়। আজীবিকদের প্রতিষ্ঠাতা গোশাল সম্পর্কে এরূপ কথিত আছে যে, তিনি জৈনধর্মের প্রতিষ্ঠাতা মহাবীরের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। গোশাল জৈনধর্মের জন্মের প্রকারভেদ অস্বীকার করেন। তাঁর মতে জীবন মাত্রই, নিয়তির বন্ধনে আবদ্ধ। জন্মের কোনো প্রকারভেদ বা জন্মান্তরের মধ্য দিয়ে ব্যক্তি কর্মের বন্ধন থেকে মুক্তি বা নির্বাণ লাভ করতে পারে, এ কথা গোশাল মানতেন না। গোশালের মতে জন্মান্তরের দীর্ঘ কিংবা হ্রস্ব কোনো সড়কেই জীবনের দুঃখ বা কর্মের বন্ধন থেকে মানুষের মুক্তির উপায় নেই। মানুষের জীবনের পথ পূর্ব থেকেই নির্ধারিত। কোনো সাধনা বা আচরণই জীবনের সেই নির্ধারিত পথকে পরিবর্তিত করতে পারে না।
গোশাল এবং আজীবিকগণ জীবনোপায় বা জীবনাচরণে সাধারণের ব্যতিক্রম ছিলেন। তাঁরা দিগম্বর থাকতেন এবং একটি দণ্ড হাতে চলতেন। এজন্য এঁদের ‘দণ্ডী’ও বলা হতো। এঁরা ভিক্ষা করে জীবন ধারণ করতেন। কিন্তু ভিক্ষা করেও প্রয়োজনের অধিক জমাতেন না।
সম্রাট অশোকের শাসনকাল ছিল খ্রি. পূ. ২৭৪-২৩২ সন। সম্রাট অশোকের নানা অনুশাসন প্রস্তর খণ্ডে উৎকীর্ণ করা হয়েছিল। এরূপ একটি প্রস্তরলিপিতে আজীবিক সম্প্রদায়ের উল্লেখ দেখা যায়। এই লিপিতে বলা হয়েছে যে, সম্রাটের এরূপ কর্মচারী বা মহামাত্রও নিযুক্ত রয়েছে যাদের দ্বায়িত্ব হচ্ছে আজীবিকদের বিষয়ে তত্ত্বাবধান করা।
Al-Farabi: আল – ফারাবী (৮৭৩-৯৫০ খ্রি.)
আল –ফারাবীর সম্পুর্ণ নাম হচ্ছে আবু নসর মুহাম্মদ আল -ফারাবী। দর্শনের ইতিহাসে ইনি আল –ফারাবী নামেই সুবিখ্যাত। ইসলামি দর্শনে আল –ফারাবীকে সর্বশ্রেষ্ঠ দার্শনি বলে মনে করা হয়। মুসলিম দার্শনিকগন মনে করতেন, আল –ফারাবীর শ্রেষ্ঠ যদি কেউ থাকেন তিনি হচ্ছেন গ্রিক দার্শনিক এ্যারিস্টটল। মুসলিম দার্শনিক আলকিন্দী আল -ফারাবীকে নিঃসন্দেহে ইবনে সীনা এবং ইবনে রুশদ-এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ বলে স্বীকার করেছেন।
ক্রিষ্টাব্দের নবম এবং দশম শতকে মুসলিম রাষ্ট্রসমূহে, বিশেষ করে বাগদাদে গ্রিক দর্শনের বিশেষ চর্চা হতো। এই সময়ে গ্রিসের প্লেটো এবং এ্যারিস্টটলের রচনাবলীর আরবি অনুবাদ হতে থাকে। আল –ফারাবী প্রধানত শিক্ষালাভ করেন বাগদাদের এ্যারিস্টটল-এর দর্শন শিক্ষাদানকারী খ্রিষ্টান বিদ্যাকেন্দ্রে। প্লেটোর দর্শনের নতুনতর ব্যাখ্যাদাতা প্লাটিনাস-এর ব্যাখ্যার প্রভাবও আল –ফারাবীকে এত প্রভাবিত করেছিল যে, উপরোক্ত দর্শনের এই দুই স্তম্ভ আল –ফারাবী কাউকে বর্জন করতে পারেন নি। এ কারণে আল –ফারাবী প্লেটো এবং এ্যারিস্টটলের সামঞ্জস্যের বিষয়ে একখানি পুস্তক রচনা করেন। আল –ফারাবী শিক্ষাগত জীবনে কেবল দর্শনের চর্চা করেন নি। তিনি সে-যুগের জ্ঞানের অন্যান্য শাখাও আয়ত্ব করার চেষ্টা করেন। পদার্থবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা এবং সঙ্গীতের বিচিত্র শাখাতে তিনি পারদর্শিতা অর্জন করেছিলেন।
আল –ফারাবী প্লেটোর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘রিপাবলিক’ এবং ‘লজ’ বা ‘বিধান’-এর উপর নিজের অভিমত লিপিবদ্ধ করেন। আল –ফারাবীর সমধিক বিখ্যাত গ্রন্থের নাম হচ্ছে ‘উত্তম রাষ্ট্রের অধিবাসীদের ভ্রান্তি সম্পর্কিত গ্রন্থ’। এ গ্রন্থ আদর্শ নগর বা ‘মদিনাল ফাজিলা’ বলেও আখ্যাত। গ্রন্থের নামকরণ এবং বিষয়বস্তু থেকে বুঝা যায়, প্লেটো যেমন ‘রিপাবলিক’ বা আদর্শ রাষ্ট্রের কল্পনা করেছিলেন, আল -ফারাবীও তেমন একটি আদর্শ রাষ্ট্রের কল্পনা করেছিলেন। আল -ফারাবীর আদর্শ রাষ্ট্র প্লেটোর রাষ্ট্রের ন্যায় সাধারণ মানুষের অসাধ্য বোধ হতো না। প্রকৃত পক্ষে আল –ফারাবী যে সমস্ত মুসলিম রাষ্ট্রকে কার্যকর দেখেছে, তাদের উন্নত করার উদ্দেশ্য নিয়ে নিজের আদর্শ রাষ্ট্র কল্পনা করেছিলেন। আল –ফারাবী কোনো চরম মত পোষণ করেন নি। চিন্তার ক্ষেত্রে প্রায়ই তিনি পরস্পর-বিরোধী ধারাকে এক সাথে মিলাবার চেষ্টা করেছেন। এই আপসের প্রমাণ যেমন প্লেটো এবং এ্যারিস্টটলকে ঐক্যবদ্ধ করার মধ্যে রয়েছে, তেমনি বিশ্বের স্রষ্টা এবং সৃষ্টির ব্যাখ্যাতেও রয়েছে। আল –ফারাবী একদিকে মনে করেছেন যে, আল্লাহই হচ্ছেন একমাত্র স্রষ্টা; আর সমস্ত সৃষ্টি আল্লাহর প্রকাশ। অপর দিকে আল্লাহকে স্রষ্টা স্বীকার করেও সৃষ্টি বা বিশ্বকে শাশ্বত বলে তিনি অভিমত পোষণ করেছেন। বিশ্বকে শাশ্বত মনে করার মধ্যে বস্তুজগৎ এবং বিজ্ঞানকে স্বীকারের প্রবণতা আল –ফারাবীর চরিত্রে দেখা যায়। এদিক থেকে সে-যুগে তিনি প্রগতিশীল চিন্তাবিদের স্বাক্ষর রেখেছেন, একথা বলা যায়। ধর্মের ন্যায় তাঁর রাষ্ট্র-ব্যবস্থাতেও একনায়কত্বের প্রকাশ ছিল। আল –ফারাবীর মতে রাষ্ট্রের রইস বা প্রধান থাকবে সবার উপরে। অপর সকলে তার বাধ্য হবে। সে নিজে কারু বাধ্য হবে না। নাগরিকদের মধ্যে ক্ষমতা ভাগের ক্ষেত্র স্তরভেদ থাকবে। এক স্তর তার উপরের স্তরের আদেশ মান্য করবে। এবং অধঃস্তরের উপর আদেশ জারি করবে। অধঃতম স্তরের নাগরিক কেবল হুকুম মান্যই করবে অপর কাউকে সে হুকুম দিবে না। কারণ হুকুম দেবার মতো তার নিচে অধঃতর কোনো স্তর থাকবে না। মুসলিম সভ্যতার অর্থনীতিক বিকাশের তৎকালীন যুগে একনায়কতন্ত্রের এই ধারণা গোত্রতান্ত্রিক বহুধাবিভক্ত সামন্তবাদী সমাজকে এককেন্দ্রিক বৃহত্তর রাষ্ট্র-কাঠামোর মধ্যে সংহত করার অনুকূল শক্তি হিসাবে কাজ করেছে। যুগের প্রেক্ষিতে এরূপ ভাবধারার বিশেষ গুরুত্ব ছিল। চরম সত্য বা স্রষ্টার ব্যাখ্যায় আল –ফারাবী যেমন প্লেটোর ভাবধারাকে গ্রহণ করেছেন, মনোজগতের বিশ্লেষণে তেমনি তিনি এ্যারিস্টটল-এর ব্যাখ্যাকেই অধিকতর স্বীকার করেছেন।
আল –ফারাবীর রচনাসমূহ জার্মান এবং ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়ে বিশেষভাবে আলোচিত হয়েছে।
Alberuni: আলবেরুণী (৯৭৩-১০৫০ খ্রি.)
পৃথিবীরঅন্যতম শ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক, বিজ্ঞানী, গবেষক এবং জ্ঞানসাধক। জন্ম মদ্য এশিয়ার (রাশিয়ার) খোরেজাম বা খারিজমের খিবায় ৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে। মৃত্যু ১০৪৮ কিংবা ১০৫০ খ্রিষ্টাব্দে।
‘আলবেরুণী’ নামে ইতিহাসে পরিচিত। আসল নাম আবু রায়হান মুহম্মদ বনি আহমদ । তাঁর সমসাময়িকদের মধ্য ছিলেন বোখারার বিখ্যাত দার্শনিক ইবনে সিনা (৮৯০-১০৩৭ খ্রি.)। জন্মসূত্রে আলবেরুণী পারসিক এবং শিয়া ছিলেন। ‘তাঁর সমালোচনার ক্ষমতা, সহনশীলতা, সত্যানুরাগ এবং মানসিক সাহস মধ্যযুগে অতুলনীয় ছিল। তিনি আরবি ভাষায় ভূগোল, গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যা সম্পর্কে বহু গ্রন্থ রচনা করেন।’ গবেষকগণ তাঁর রচনার সংখ্যাকে বিপুল বলে অনুমান করেন। “১০৩৫ খ্রিষ্টাব্দে এক বন্ধুর জিজ্ঞাসার জবাবে লেখা আল-বেরুণীর একটি চিঠির নকল পাওয়া গেছে যাতে তিনি তখন পর্যন্ত তাঁর লিখিত পুস্তক-পুস্তিকার একটি ফিরিস্তি দিয়েছিলেন। তালিকা মতে ১৩৮ টি পুস্তকের নাম আছে। এ তালিকা তৈরির পরেও তিনি প্রায় সতের বৎসর জীবিত ছিলেন। পরবর্তী সতের বৎসর ধরে তিনি আরো যেসব বই লিখেছিলেন তা ধরলে এবং অন্যান্য সাহিত্য গ্রন্থপঞ্জিতে যেসব বই-এর নাম পাওয়া যায় সেসব মিলিয়ে বর্তমান পণ্ডিতরা আলবেরুণীর রচিত ১৮০ টি পুস্তকের নাম পেয়েছেন। আলবেরুণীর গ্রন্থাবলী ১২ শতক থেকে ইউরোপে যতটা আদৃত হয়েছে, প্রাচ্যে ততটা হয় নি।”
বাংলাদেশে সাহিত্যিক সত্যেন সনে আলবেরুণীর ভারত আগমন এবং তাঁর জ্ঞান সাধনাকে ভিত্তি করে ‘আলবেরুণী’ নামক ঐতিহাসিক উপন্যাস রচনা করেছেন (১৯৬৯)। মধ্যযুগের ভারতবর্ষের সামাজিক ও ধর্মীয় জীবনের ইতিহাসের অতুলনীয় উপাদান হিসাবে আলবেরুণীর ‘ভারততত্ত্ব’ পৃথিবীতে আজ সুপরিচিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, ঐতিহাসিক আবু মহামেদ হবিল্লাহ আলবেরুণীর ‘ভারততত্ত্ব’ গ্রন্থটি মূল আরবি থেকে বাংলাতে অনুবাদ করেছেন (১৯৭৪)।
আলবেরুণীর ‘ভারততত্ত্ব’ গ্রন্থের মূল আরবি নাম ‘কিতাব কি তাহকিক মালিল হিন্দ মাকুলাত মাকবুলাত কি আল আকল উমর যুলাত।’ বাংলঅ গদ্যে এর মানে : বুদ্ধি বিচারে যা গ্রহনযোগ্য আর যা গ্রহনযোগ্য নয়, হিন্দুদের সব রকম চিন্তা পদ্ধতির সঠিক বর্ণনা।
Book on an accurate description of all catagories of Hindu thought, those which are admissible to reason as well as those which are not. এডওয়ার্ড জাকাউ (Edward Zachau) কর্তৃক সম্পাদিত মূল আরবি গ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৮৮৭ সালে লণ্ডন থেকে। Alberuni’s India- এই নামে দুখণ্ডে এর ইংরেজি অনুবাদ এডওয়ার্ড জাকাউ প্রকাশ করেন ১৮৮৮। কিতাবুল হিন্দ নামেও আলবেরুণীর ‘ভারততত্ত্ব’ পরিচিত।
গজনীর সুলতান মাহমুদ ভারত আক্রমণ করে তার উত্তর পশ্চিম দখল করছিলেন (১০২২ খ্রি.)। সুলতান মাহমুদ মধ্য এশিয়ার ক্ষূদ্র খারিজাম রাষ্ট্রও জয় করেছিলন। খারিজাম জয় করে সেখানকার গণ্যমান্য নাগরিক এবং জ্ঞানীদের তিনি তাঁর রাজ্য গজনীতে বন্দি করে এনেছিলেন (১০১৭ খ্রি.)। এই বন্দিদের মধ্যে খারিজামের আলবেরুণী ছিলেন। পরবর্তীকালে সুলতান মাহমুদ কর্তৃক হয়তো আলবেরুণীই ভারতের পশ্চিম অঞ্চলে প্রেরিত হয়েছিলেন। জ্ঞানসাধক আলবেরুণী তাঁর এই ভারত গমনকে ভারতের সামাজিক ও ধর্মীয় জীবন সাক্ষাৎভাবে অধ্যয়নের বিরাট সুযোগ হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। ভারতবর্ষে থাকাকালীন সময়ে তিনি ভারতীয় সমাজের তথ্যাবলী গভীর অভিনিবেশ এবং আগ্রহের সঙ্গে সংগ্রহ করেছিলেন। এই সংগ্রহ এবং পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে আলবেরুণী ‘কিতাবুল হিন্দ্’ রচনা সমাপ্ত করেন ১০৩৩ খ্রিষ্টাব্দে গজনী প্রত্যাবর্তন এবং সুলতান মাহমুদের মৃত্যুর পাঁচমাস পরে।
কিতাবুল হিন্দ্ বা ভারততত্ত্বে আলবেরুণী জটিল এবং বিচিত্র তত্ত্ব এবং তথ্য যেরূপ বিস্তারিতভাবে প্রাঞ্জল ভাষায় উপস্থিত করেছেন তা এক বিষ্ময়কর শক্তির ষ্মারক হিসাবে জ্ঞানের ইতিহাসে বিরাজ করছে। ‘কিতাবুল হিন্দ্’ রচনার পূর্বে আলবেরুণী কপিলের সাংখ্য এবং পাতঞ্জল দর্শনসহ পৌলিশ সিদ্ধান্ত, ব্রহ্ম সিদ্ধান্ত, বৃহৎসংহিতা, খণ্ডখাদ্যক, বরাহমিহিরের লঘুজাত কর্ম প্রভৃতি ছোটবড় ২২ টি ভারতীয় পুস্তক আরবিতে তর্জমা করেছিলেন। তিনি বহু ভাষাবিদ ছিলেন। ভারতীয় সংস্কৃত গ্রন্থের আরবি অনুবাদ থেকে বুঝা যায়, তিনি সংস্কৃত ভাষা আয়ত্ত করেছিলেন। তা ছাড়া ফার্সি, গ্রিক, হিব্রু এবং আরামিয় ভাষাতেও তিনি সুপণ্ডিত ছিলেন। আলবেরুণীর মাতৃভাষা ছিল খোরেজামী বা প্রাচীন ইরানি ভাষার একটি আঞ্চলিক শাখা। কিন্তু তাঁর বেশিরভাগ গ্রন্থ আরবি ভাষাতেই রচিত। কারণ তাঁর মাতৃভাষাকে তিনি বৈজ্ঞানিক ভাব প্রকাশের উপযোগী মনে করেন নি।
অধ্যাপক মহামেদ হবিবুল্লাহ বাংলা অনুবাদে দেখা যায় আলবেরুণীর ‘ভারততত্ত্ব’ প্রস্তাবনা ব্যতীত আশিটি অধ্যায়ে বিভক্ত। আলোচিত বিষয়ের আভাসদানের জন্যে কিছুসংখ্যক অধ্যায়ের শিরোনাম এখানে উল্লেখ করা গেল: ভারতীয়দের সাধারণ বৈশিষ্ট্য; ঈশ্বর সম্বন্ধে হিন্দুদের বিশ্বাস; ভাব এবং ইন্দ্রিয় জগৎ সম্পর্কে হিন্দুদের ধারণা; কার্যকরণ- আত্মার সঙ্গে জড় পদার্থের সম্বন্ধ;সৃষ্ট জীবসমূহের শ্রেণীবিভাগ ও তাদের নাম; মূর্তি পূজার সূচনা ও বিগ্রহসমূহের বর্ণনা; হিন্দুদের ব্যকরণ ও ছন্দশাস্ত্র; ভারতীয় পরিমাণ বিজ্ঞান; ভারতীয়দের বর্ণমালা, বর্ণচিহ্ন ও অদ্ভুত রীতি; ভারতবর্ষের নদ-নদী; সমুদ্র নাগরাদির পারস্পারিক দূরুত্ব ও সীমানার সংক্ষিপ্ত বিবরণ; গ্রহ নক্ষত্রাদির নাম, চন্দ্রের কক্ষপথ ও অনুরূপ বিষয়; মেরু পর্বতের কথা; সমুদ্রে জোয়ার ভাটার পারস্পর; সূর্য-চন্দ্রের গ্রহণ; আদালতের মামলা মোকদ্দমা।
মোটকথা, এ এক অতুলনীয় গ্রন্থ। এ গ্রন্থ দশম-একাদশ শতকের ভারতীয় জ্ঞান, সমাজ, ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচার আচরণের একটি পূর্ণ জ্ঞান কোষবিশেষ।
আলবেরুণী রচিত অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ইতিহাসের কাল নিরুপণের পদ্ধতি বিষয়ক ‘আসারূল বাকিয়া’; গণিতশাস্ত্র ও জ্যামিতি বিষয়ক গ্রন্থ ‘কিতাব কানুন আল মাসুদী কি হাইওআল নজুম’; ধাতুবিদ্যা বিষয়ক ‘কিতাবুল জামাহীর ফি মারেফাতুল জওয়াহীর’; চিকিৎসা শাস্ত্র বিষয়ক ‘কিতাব আল সায়দানা ফিল তিব্ব্’; এবং ভৌগলিক তথ্যমূলক গ্রন্থ ‘তাহদীদ ফি নেহায়াতুল আমাকিন’।
তাঁর রচনায় বিষয়ভিত্তিক সংখ্যা আলবেরুনীর নিজের প্রস্তুত একটি তালিকার ভিত্তিতে নিন্মরূপ : জ্যোতিষ পদ্ধতি ও জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ে ১৮; বিভিন্ন দেশের ভৌগোলিক তথ্য, আয়তন , দূরত্ব নির্ণয় ইত্যাদি-১৫; গণিত পদ্ধতি-৮; সূর্যকিরণ ও ছায়ায় বৈজ্ঞানিক তথ্য-৪; জ্যোতির্বিজ্ঞানের যন্ত্রপাতি নির্মাণ বিষয়ে-৫; কাল ও সময় নির্ণয়-৫; জ্যোতিশাস্ত্রে শুভাশুভ ফলাফল নির্ণয়-১২; জ্যোতিষ গণনাবিধি-৭; উপন্যাস, কাব্য ও অতিপ্রাকৃত কিংবদন্তি বিষয়ক-১৩; ধর্ম বিশ্বাস ও আচরণ বিষয়ে -৬।
(দ্রষ্টব্য: আলবেরুণীর ভারততত্ব: আবু মহামেদ হবিবুল্লাহ; আলবেরুণী: সত্যেন সেন।)
Al-Ghazali: আল –গাজ্জালী (১০৫৮-১১১১ খ্রি.)
আল গাজ্জালীর সম্পূর্ণ নাম ছিল আবু হামিদ মুহম্মদ আল –গাজ্জালী। খোরাসান বা ইরানের তুশের গাজলা গ্রামে জন্ম বলেই তিনি আল গাজ্জালী নামে পরিচিত হন। পরবর্তীকালে আল –গাজ্জালী ইসলামের সর্বশ্রেষ্ট ব্যাখ্যাতা এবং রক্ষক হিসাবে খ্যাতিলাভ করেন। আল –গাজ্জালীর দার্শনিক চিন্তাধারার মূল লক্ষ্য ছিল ইসলামকে ক্রমবর্ধমান অবিশ্বাসের হাত থেকে রক্ষা করা। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং বৈজ্ঞানিক অগ্রগতিকে পরলোক, দোজখ ইত্যাদি কল্পলোক সম্পর্কে মানুষের মনে ভয়ের পরিমাণ ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছিল। মুসলিম মুক্তবুদ্ধি মোতাজিলাদের দার্শনিক আলোচনা ও মতামতও মানুষের মনে বিশ্বাসের বদলে যুক্তির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছিল। অবস্থার এই বিকাশে আল –গাজ্জালী চিন্তান্বিত হয়ে পড়েন। মোতাজিলাবাদীদের যুক্তির বিরুদ্ধে অধিকতর জোরালো যুক্তি প্রতিষ্ঠা করে জ্ঞানের ক্ষেত্রে যুক্তির পরাক্রমকে পরাস্ত করতে হবে। এই উদ্দেশ্য নিয়ে আল –গাজ্জালী দর্শন চর্চা করেন। তারঁ এই লক্ষ্য অর্জনের চিন্তায় তিনি এত ব্যকুল হরেয় পড়েন যে, ৩৬ বছর বয়সে তিনি বাগদাদের নিজামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়েরে অধ্যাপনার পদ ত্যাগ করে সুফীজীবন যাপন করতে শুরু করেন। সুফী হয়ে তিনি মুসলিম জগতের বিভিন্ন দেশ পরিভ্রমণ করেন। বিচিত্র অভিজ্ঞতার শেষে তিনি যুক্তির পথ সর্বতোভাবে পরিত্যাগ করার সিদ্ধান্ত করে ঘোষণা করেন যে, যুক্তির মাধ্যমে সত্যকার জ্ঞান অর্জন সম্ভব নয়। বিশ্ব-স্রষ্টার সন্ধান এবং বিশ্ব-রহস্য উদঘাটন কেবল অহি বা আত্মোপলব্ধির মাধ্যমেই সম্ভব। এই সিদ্ধান্তে এসে তিনি ‘তাহফাতুল ফালাসিকা’ বা ‘দর্শনের ধ্বংস’ নামে গ্রন্থ রচনা করেন। এই পুস্তকে তিনি শাশ্বত চরিত্র, বুদ্ধির শক্তি প্রভৃতি তত্ত্বের যাথার্থ্য সম্পর্কে মুসলিম দার্শনিকদের উপস্থাপিত প্রমাণের অসারতা প্রতিপন্নের চেষ্টা করেন। তিনি ঘোষণা করেন, চরম সত্যের জ্ঞান প্রমাণ-ভিত্তিক যুক্তির মাধ্যমে লাভ করা সম্ভব নয়। আল –গাজ্জালী ঘটনার ক্ষেত্রে কার্যকরণ সম্বন্ধকেও অস্বীকার করেন। কোনো ঘটনাই অপর কোনো ঘটনার কারণ বা ফল নয়। দু’টি ঘটনার মধ্যে সমকালীনতা বা কালক্রম থাকতে পারে। অগ্নির সংঘটনের পরবর্তীকালেই কোনো দাহ্যবস্তুর দহনকে আমরা দেখতে পারি। কিন্তু তাতে এমন প্রমাণিত হয় না যে, আগুন দাহ্যবস্তুর দহনের কারণ হিসাবে কাজ করেছে। মুসলিম চিন্তার ক্ষেত্রে আসারীয় এবং মোতাজিলা নামে গোঁড়ামি এবং মুক্তবুদ্ধির যে দু’টি ধারার সাক্ষাৎ পাওয়া যায় আল –গাজ্জালী তার মধ্যে আসারীয় গোঁড়া সম্প্রদায়ের অন্তর্ভূক্ত ছিলেন। বস্তুত যুক্তি এবং বুদ্ধিবাদের এরূপ শক্তিমান প্রতিপক্ষের সাক্ষাৎ খুব কমই মেলে। তাঁর চিন্তাধারা সামাজিক ও ধর্মীয় রক্ষণশীলতাকে প্রভূত পরিণামে সাহায্য করেছে বলেই ইতিহাসের বিশ্লেষণকারীগণ মনে করেন। এ জন্য আল –গাজ্জালীকে দার্শনিকের চেয়ে ধর্ম-রক্ষক হিসাবে অধিক মর্যাদা দেওয়া হয়। তৎকালীন ইসলামি সমাজ ও রাষ্ট্রজীবনের অস্থিরতা এবং জটিলতাই আল –গাজ্জালীর অভিমতকে আবশ্যকীয় করেছিল। ইউরোপেও পরবর্তীকালে জ্ঞান-বিরোধী সে সন্দেহবাদ এবং অজ্ঞেয়বাদের উদ্ভব দেখা যায় আল –গাজ্জালীর মাধ্যে তার পূর্বাভাস সুস্পষ্টরূপে ধরা পড়ে। বস্তুত আল -গাজ্জালীর দর্শনবিরোধী ভূমিকাই পাশ্চাত্যের সংশয়বাদী এবং অজ্ঞেয়বাদীদের চমৎকৃত করে। সাম্প্রদায়িক বিরোধের ক্ষেত্রেও আল –গাজ্জালী নিরপেক্ষ ছিলেন। আব্বাসীয় খলীফা আল –মোসতাজিরের আদেশে আল –গাজ্জালী শিয়া সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে লেখনী ধারণ করেছিলেন বলে ঐতিহাসিকগণ মনে করেন। ইবনে রুশদ আল –গাজ্জালীর ‘দর্শনের ধ্বংস’ গ্রন্থের পাল্টা জবাব হিসাব ‘দর্শনের ধ্বংসের ধ্বংস’ নাম এককখানা গ্রন্থ লিখেছিলেন।
Aligrah Movement: আলীগড় আন্দোলন
১৮৫৭ সনের সিপাহি বিদ্রোহ তথা স্বাধীনতা সংগ্রামের পরবর্তীতে মুসলমান সম্প্রদায়ের উচ্চবিত্ত এবং নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের মধ্যে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় তার একটি ধারা আলীগড় আন্দোলন নামে পরিচিত লাভ করে। উত্তর ভারতের একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারের ইংরেজি শিক্ষিত, ব্রিটিশ শাসনের কর্মচারী স্যার সৈয়দ আহমদ (১৮১৭-১৮৯৮) এই ধারার উদ্যোগী ব্যক্তি। সিপাহবিদ্রোহে ইংরেজ সরকারের সঙ্গে ভারতবাসী, বিশেষ করে তার মুসলিম সম্প্রদায়ের যে বিদ্রোহাত্মক এবং অসহযোগী মনোভাব প্রকাশিত হয়েছিল স্যার সৈয়দ আহমদ তাকে মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য ক্ষতিকর বিবেচনা করেন। তিনি মনে করেন মুসলমান সম্প্রদায়ের তথা তার উচ্চতর বিত্তবান অংশের উন্নতির উপায় ইংরেজি শিক্ষা বর্জন এবং ইংরেজ সরকারের সঙ্গে অসহযোগিতায় নয়। তাদের উন্নতির উপায় হচ্ছে ইংরেজি ভাষা আয়ত্ত করা, তার মাধ্যমে পাশ্চাত্তের জ্ঞান বিজ্ঞানের পরিচয় লাভ করা এবং ইংরেজ শাসনের সঙ্গে সহযোগিতা করা। এই উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি আলীগড়ে এ্যাংলো-ওরিয়েন্টাল কলেজ নামে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন এবং একটি অনুবাদ সংস্থা তৈরি করে পাশ্চাত্যের জ্ঞানবিজ্ঞানকে উর্দূ ভাষায় উপস্থিত করার চেষ্টা করেন। স্যার সৈয়দ আহমদ ইংরেজ সরকারের সহযোগী হলেও ধর্ম এবং সামাজিক সমস্যার ব্যাখ্যা এবং অনুধাবনে তাঁর দৃষ্টি ছিল উদারতাবাদী এবং সংস্কারমূলক। কালক্রমে আলীগড় ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিম সমাজের উচ্চতর শ্রেণীর তরুণদের নিকট জ্ঞানচর্চার অন্যতম আকর্ষণীয় কেন্দ্র বলে বিবেচিত হতে থাকে। তাঁরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আলীগড় গমন করেন এবং তাঁদের মধ্যে ভারতবর্ষের মুসলিম হিসাবে একটি ‘জাতিবোধের’ও সৃষ্টি হতে থাকে। এই আন্দোলন থেকে পরবর্তীকালে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয় (১৯২০)।
Al-Kindi: আল কিন্দী (৮০০-৮৭০ খ্রি.)
আবু ইউসুফ ইয়াকুব এবনে ইসহাক আল –কিন্দীর মৃত্যুকাল সম্পর্কে মতপার্থক্য আছে। ৮৭০ কিংবা ৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মারা যান। বসরার মেসোপটেমিয়ার নিকটবর্তী অঞ্চলে আল –কিন্দী জন্মগ্রহণ করেন। নবম শতাব্দীতে তিনি মুসলিম দার্শনিক, বিশেষ করে আরবি ভাষার দার্শনিকদের মধ্যে সমধিক খ্যাতি অর্জন করেন। এই যুগে আরবি অনুবাদের মাধ্যমে গ্রিক দর্শনকে মুসলিম জগতে প্রচার করার যে ঐতিহাসিক চেষ্টা চলছিল তাতে আল –কিন্দীর ষ্মরণীয় আবদান রয়েছে। এ্যারিস্টটলের মেটাফিজিক্স বা তত্ত্বকথার আরবি অনুবাদের পরিকল্পনা আল –কিন্দী গ্রহণ করেছিলেন। আল –কিন্দীর রচনাবলীর খুব সামান্য অংশই রক্ষিত হয়েছে। কিন্তু গবেষকদের মতে তার রচনাবলীর সংখ্যা প্রচুর। আল –কিন্দী এ্যারিস্টটলের অর্গানন-এর উপর নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করে আলোচনা করেছিলেন। অন্যান্য মুসলিম দার্শনিকের ন্যায় আল –কিন্দী গ্রিক দর্শনের প্রধান দুই প্রবক্তা প্লেটো এবং এ্যারিসস্টলের ভাবধারায় বিরাটভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। বস্তুত আল –কিন্দী প্লেটো, এ্যারিস্টটল এবং পাইথাগোরাস-তিনজন গ্রিক দার্শনিককেই সমধিক শ্রদ্ধা করতেন। তাঁদের মধ্যে তত্ত্বগত পার্থক্য এবং বিরোধ সত্ত্বেও আল –কিন্দী উক্ত গ্রিক চিন্তাবিদগণকে নিজের জন্য আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন।। আল –কিন্দী বিশ্ব-জগতের রহস্যোদঘাটনের জন্য কার্যকরণের বিধানকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন। তাঁর মতে বিশ্ব-চরাচরে কার্য-কারণের বিধান অমোঘ এবং সার্বিক। কার্য-করণের মাধ্যেমেই বিশ্বজগৎ আমাদের নিকট প্রতিভাত হয়। কার্য-করণের উপর এই জোর সত্ত্বেও আল –কিন্দী ধর্মের ক্ষেত্রে মনে করতেন যে, বুদ্ধিগত জ্ঞানের চেয়ে অহিগত জ্ঞান শ্রেয়। এতদ্ব্যতীত, যে সমস্ত মুসলিম দার্শনিক জগৎকে শাশ্বত বলেছেন এবং আল্লাহর ন্যায় শাশ্বত কাল থেকে জগৎ বিকশিত হয়ে আসছে বলে মনে করেছেন, তাঁদের মতের তিনি বিরোধিতা করেন। কাল-কিন্দীর মতে বিশ্বজগৎ শাশ্বত নয়। স্রষ্টা কোনো একদিন শূন্যাবস্থা থেকে বিশ্বকে সৃষ্টি করেছের। ভবিষ্যতে কোনো একদিন বিশ্বজগৎ বিধাতার হুকুমে শূন্যে বিলীন হয়ে যাবে। বিশ্বজগৎ সম্পর্কে আল –কিন্দীর এ অভিমত মৌলিক নয়। ষষ্ঠ শতকের খ্রিষ্টান দার্শনিকগণ আলেকজান্দ্রিয়াতে এরূপ অভিমত পোষণ করতেন। আল -কিন্দী জ্ঞানের একাধিক বিষয়ে পারদর্শী ছিলেন। তিনি জ্যোতিষ শাস্ত্রকে একটি বিজ্ঞান বলে অভিহিত করেছেন। চিকিৎসাবিজ্ঞানে তাঁর উল্লেখযোগ্য অবদান হচ্ছে পদার্থের ন্যায় নিরাময় প্রণালির ক্ষেত্রে আঙ্কিক অনুপাতের প্রয়োগ। ঔষধ প্রস্তুত প্রণালিতে অনুপাতের বিধান যে একটি গুরুত্তপূর্ণ বিধান, বাস্তবভাবে আল –কিন্দী তা পোমাণ করেন। আল্লাহকে আল –কিন্দী সৃষ্টির মূল বলে স্বীকার করেছিলেন। বস্তু ও প্রাণীর মধ্যে স্তরক্রমে তাঁর প্রতিচ্ছায়া পড়ে। এই স্তরক্রম্যের মধ্য দিয়ে আত্মা দেহের বন্ধন থেকে মুক্তিলাভ করে অমরতা প্রাপ্ত হয়। আল –কিন্দী ধর্মের ক্ষেত্রে কোনো মৌলিক বিরোধী অভিমত পোষণ না করলেও দর্শন, বিজ্ঞান, জ্যোতিষ, চিকিৎসা, অঙ্ক অর্থ্যাৎ জ্ঞানের বিচিত্র শাখায় তাঁর আগ্রহ এবং অধ্যয়নের কারণে গোঁড়াপন্থী মুসলমানগণ আল -কিন্দীকে অবিশ্বাসী বিবেচনা করেন।
Alexander, Samuel: স্যামুয়েল আলেক্সাণ্ডার (১৮৫৮-১৯৩৮)
স্যামুয়েল আলেক্সাণ্ডার আধুনিককালের ব্রিটিশ দর্শনিকদের মধ্রে ‘নিওরিয়ারিস্ট’ বা নয়া বস্তুবাদী বলে পরিচিত। নয়া বস্তুবাদ প্রকৃত পক্ষে বস্তুবাদী দর্শনও নয়। ভাববাদের সে প্রকারবিশেষ। বিশ্বজগৎ সম্পর্কে স্যামুয়েল আলেক্সাণ্ডারের দার্শনিক অভিমতের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে, তিনি স্থান এবং কালকে ভাব কিংবা জ্ঞানসূত্র না বলে মহাবিশ্বের মূল বস্তু মনে করেছেন। মহাবিশ্বের এই মৌলিক বস্তু অর্থ্যাৎ স্থান এবং কালকে তিনি আবার গতি হিসাবে চিন্তা করেছেন। তাঁর অভিমতটি মোটামুটি এরূপ যে, স্থান-কালের গতি কিংবা স্থানকালরূপ গতি থেকে অচিন্তনীয় জটিল পরিক্রমায় বস্তু, জীবন, মন, মূল্যবোধ, বিধাতার বাহক এবং বিধাতা-সমস্ত সত্তারই উদ্ভব হয়েছে। অচিন্তনীয় অধিকতর সত্তার উদ্ভব এই পরিক্রমায় হচ্চে এবং হবে। বিশ্বপুঞ্জের এই ব্যাখ্যায় বিবর্তনবাদের স্বীকৃতি পাওয়া যায়। তবে একে বিশিষ্ট করার জন্য স্যামুয়েল আলেক্সাণ্ডার তাঁর বিবর্তনবাদকে ‘বিকাশমান বিবর্তন’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। নবতর সৃষ্টির আন্তপ্রেরণায় এই বিকাশমান বিবর্তন প্রবাহমান। স্যামুয়েল আলেক্সাণ্ডারের ইংরেজি ভাষায় লিখিত বিখ্যাত গ্রন্থের নাম হচ্ছে ‘স্পেস, টাইম এণ্ড ডিটি’ অর্থ্যাৎ স্থান, কাল এবং বিধাতা। ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ের গিফোর্ড বক্তৃতাবলী হিসাবে প্রদত্ত এবং ১৯২০ সালে পুস্তকারের প্রকাশিত এই অভিমতের মাধ্যমে আলেকজাণ্ডার সুসংবদ্ধ আকারে তাঁর দর্শন প্রকাশ করার চেষ্টা করেন। উক্ত গ্রন্থে তিনি তাঁর পদ্ধতিকে অভিজ্ঞতালব্ধ পরাবিদ্যা আখ্যা দেন। অভিজ্ঞতালব্ধ পরাবিদ্যা বা এমপিরিক্যাল মেটাফিজিক্স বলতে তিনি বিজ্ঞানের সামগ্রিকতাকে যেমন বুঝাতে চান, তেমনি বিভিন্ন শাখায় বিভক্ত বিজ্ঞান যে-সত্যে পৌছাতে পারে না, বিজ্ঞানোর্ধ্ব সেই সত্যের কথাও তিনি এর মারফত প্রকাশ করতে চেয়েছেন। তাঁর মতে মন এক দিক থেকে যেমন দেহ এবং দেহাভ্যস্তরের স্নায়ুমণ্ডলীর অতিরিক্ত কোনো সত্তা নয়, তেমনি অপরদিকে এ সত্তা বিকাশমান বিবর্তনের এক নতুন উদ্ভব। স্যামুয়েল আলেকজাণ্ডার তাঁর দর্শনে বিজ্ঞান এবং ধর্মের সমন্বয় ঘটাবার চেষ্টা করেছে। বস্তুবাদী দার্শনিকগণ মনে করেন যে, ধর্মের সঙ্গে বিজ্ঞানের সমন্বয় সাধনের চেষ্টায় আলেকজাণ্ডারের দর্শন আধুনিক বিজ্ঞান-বিরোধী অভিমতে পর্যবসিত হয়েছে। উপরোক্ত দার্শনিকের অন্যান্য উল্লেখযোগ্য রচনার মধ্যে রয়েছে ‘আর্ট এ্যাণ্ড দি ম্যাটেরিয়াল’ (১৯২৫) এবং ‘বিউটি এ্যাণ্ড আদার ফরমস অব ভ্যালু (১৯৩৩)।
Alexandrian School of Philosophy: আলেক্সান্দ্রীয় দর্শন
গ্রিক সভ্যতার পতনের পর মিশরের আলেক্সান্দ্রীয়া শহর প্রায় হাজার বছর ধরে বিজ্ঞান, সাহিত্য এবং দর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসাবে পরিচিত ছিল। খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৩ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ৩০ পর্যন্ত বিস্তারিত কালকে উপরোক্ত কেন্দ্রের বিজ্ঞান ও সাহিত্যের এবং খ্রিষ্টপূর্ব ৩০ থেকে ৬৪০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সময়কে এর দার্শনিক চিন্তাধারার সমধিক বিকাশের যুগ বলা হয়। আলেক্সান্দ্রিয়ার দার্শনিকগণ সে যুগের পাচ্য এবং পাশ্চাত্য দর্শনের যোগসুত্র হিসাবে কাজ করেছেন। আলেক্সান্দ্রীয় দর্শনের প্রধান মুখপাত্র হিসাবে দার্শনিক হিরোক্লিসের নাম সমধিক প্রসিদ্ধ। হিরোক্লিসের জন্মকাল সম্ভবত ৪২০ খ্রিষ্টাব্দ। আলেক্সান্দ্রিয়ার দার্শনিকগণ প্লেটোর দর্শন নিয়ে আলোচনা করেছেন। প্লেটোর দর্শনের নতুন ব্যাখ্যা তাঁরা উপস্থিত করেছেন। হিরোক্লিসের দার্শনিক চিন্তায় প্লেটোর প্রভাব প্রত্যক্ষ করা যায়। সমস্ত অস্তিত্বের মূলে রয়েছে ‘ভাব’, এ অভিমত ছিল প্লেটোর। প্লেটোর ‘ভাব’-এর প্রতিফলন পাওয়া যায় হিরোক্লিসের ‘ডেমিয়ার্জ’ রূপ ধারণায়। হিরোক্লিসের মতে এউ ‘ডেমিয়ার্জ’ হচ্ছে সমস্ত সৃষ্টি এবং সত্তার মূল। ‘ডেমিয়ার্জ’ আপন শক্তিতে শূন্যাবস্থা থেকে সমস্ত অস্তিত্বকে সৃষ্টি করে।
মূল’ডেমিয়ার্জ’ ক্ষুদ্রতর ডেমায়ার্জকে তার শক্তির বাহনরূপে ব্যবহার করে। এই বাহনদের মাধ্যমেই সকল অস্তিত্বের ভাগ্য ‘ডেমিয়ার্জ’ নিয়ন্ত্রিত করে। আরেক্সান্দ্রীয় দর্শনের ইতিহাসে হিপাসিয়া নামক একজন মহিলা দার্শনিকের নির্মম হত্যাকাণ্ড প্রচণ্ড আলোড়নের সৃষ্টি করেছিল। এরূপ কথিত আছে যে, খ্রিষ্টান ধর্মালম্বী জনতা উক্ত হিপাসিয়াকে তাঁর চিন্তাধারার জন্য নৃশংসভাবে প্রকাশ্যে হত্যা করে।
আলেক্সান্দ্রীয় দর্শনের একটি বৈশিষ্ট্য ছিল ধর্মের সঙ্গে দর্শনের মিলন ঘটাবার প্রয়াস। গ্রিক সভ্যতার ধ্বংসের যুগে বিভিন্ন প্রকার পরস্পর-বিরোধী দার্শনিক তত্ত্ব মানুষের মনে একটি অবিশ্বাস ও অনিশ্চয়তার সৃষ্টি করছিল। এই অবস্থাতে প্রাচ্যের ইহুদি ধর্মের সঙ্গে পাশ্চাত্য দর্শন, বিশেষ করে প্লেটোর দার্শনিক তত্ত্বের সংযোগ ঘটে আলেক্সান্দ্রীয়া নগরে। দার্শনিক ফিলো খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতকে জীবিত ছিলেন। তিনি প্লেটোর দর্শনের সাহায্যে বাইবেলের ব্যাখ্যা করেন। ফিলো প্লেটোর ‘ভাব’কে যেমন একদিকে গ্রহণ করেন তেমনি অপরদিকে তাকে বিশ্বচরাচর সৃষ্টিকারী এক বিশাল অগ্নিরূপে কল্পনা করেন। বিশ্বের প্রাণ-অপ্রাণ সমগ্র সত্তার মধ্যেই এই অগ্নির প্রকাশ ঘটেছে বলে ফিলো মনে করতেন।
Alienation: বিচ্ছিন্নতা
কোনো কিছুর গুণ বা শক্তিতে তার মূল আধার নিরপেক্ষভাবে স্বকীয় সত্তা হিসাবে প্রতিপন্ন করাকে দর্শনে বিচ্ছিন্নতা বলা হয়। সামাজিক অর্থনৈতিক বিকাশে বিচ্ছিন্নতাবাদ যে একটা প্রতিবন্ধকরূপে কাজ করে, সে সত্যকে মাকর্সবাদী দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা কার্ল মাকর্স প্রথমে উদঘাটন করেন। তাঁর মতে মানব সমাজের ক্রমবিকাশে মানুষের শ্রমশক্তি, শ্রমশক্তির বিভিন্ন ফলাফল যেমন- অর্থের উৎপাদন, মুদ্রার আবিস্কার, উৎপাদনের সম্পর্ক ইত্যাদি সবকিছুর আধার হচ্ছে শ্রমজীবী মানুষ। কিন্তু কালক্রমে শ্রমের এই ফলগুলোকে মূল আধার-নিরপেক্ষ শক্তি হিসাবে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করা হয়। শ্রম, মুদ্রা বা উৎপাদনের সম্পর্ক সব কিছুই যেন মানুষ-নিরপেক্ষ স্বাধীন সত্তা। মাকর্সবাদী মতে এরূপ বিচ্ছিন্নতাবাদ সামাজিক বিকাশের একটা বিশেষ স্তরে দেখা দেয়। মার্কসের মতে মানুষের আদি সমাজ ব্যবস্থায় ব্যক্তিগত সম্পত্তি বা সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানার কোনো অবকাশ ছিল না। কিন্তু প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সংগ্রামের ধারায় উন্নততর উৎপাদন বা জীবিকার্জনের উপায়ের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পতির উদ্ভব ঘটে। ব্যক্তিগত সম্পত্তির পরিমাণের পার্থক্যের ভিত্তিতে সমাজে শ্রেণীবিভাগের সৃষ্টি হয়। শ্রমেরও ক্রমাধিক পরিমাণে বিভাগ ঘটতে থাকে। শ্রমের এক বিভাগ অপর বিভাগ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পরস্পর-বিরোধী হয়ে দেখা দেয়। যে হাতের কাজ করে সে আর মাথার কাজ অর্থ্যাৎ চিন্তার কাজ করতে পারবে না। এক শ্রম অপর শ্রমের চেয়ে শ্রেয় কিংবা হীন বলে বিবেচিত হতে থাকে। কায়িক শ্রম এবং মানসিক শ্রম এভাবে বিরক্ত হয়ে পড়ে।
Allama Abul Fazl: আল্লামা আবুল ফজল
জন্ম জানুয়ায়ী ১৪, ১৫৫১, জন্মস্থান আগ্রা, ভারত। আবুল ফজলের মৃত্যু ঘটে আগষ্ট ২২, ১৬০২।
আবুল ফজল একাধারে ঐতিহাসিক এবং সামরিক অধিনায়ক ছিলেন। আবুল ফজল সম্রাট আকবরের দরবারে ধর্মতাত্ত্বিকও ছিলেন। গোড়াতে আবুল ফজল পিতার শিক্ষালয়ে শিক্ষাগ্রহণের পরে সম্রাট আকবরের দরবারে অঙ্গীভূত হন।
প্রচলিত ধর্ম বিশ্বাসের ক্ষেত্রে আবুল ফজলের সমালোচনায় সম্রাট আকবরের চিন্তার পরিবর্তন ঘটে এবং ধর্মের গোড়ামীর স্থানে তাঁর মনে একাধিক ধর্মের প্রতি সহানুভূতির সৃষ্টি হয়।
Altruism: পরার্থবাদ
ইংরেজি ‘অলট্রুইজম’ শব্দের উৎপত্তি ফরাসি ভাষা থেকে। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রখ্যাত ফরাসি দার্শনিক অগাস্ট কোঁতে তাঁর মতবাদের ব্যাখ্যায় এই শব্দের ব্যবহার করেন। ইগোইজম বা আত্মবাদের বিরোধীভাব হিসাবে পরার্থবাদ ব্যবহৃত হয়। পরার্থবাদ কথাটির সাধারণ অর্থ সুপরিচিত। এই অর্থে পরার্থবাদ দ্বারা অপরের জন্য দুঃখ-কষ্ট সহ্য করা বা ত্যাগ স্বীকারের মনোভাব বুঝায়। আত্মবাদের ন্যায় পরর্থবাদকেও মানুষের একটি সহজাত প্রবৃত্তি বলে অগাস্ট কোঁতে মনে করেন। মা যখন সন্তানের জন্য কষ্ট স্বীকার করে তখন মা পরার্থপরতার পরিচয় দেয়। পরার্থপরতা যখন মানুষের একটি সামাজিক অনুভূতি তখন এই অনুভূতির চর্চা এবং উন্নতি সাধন দ্বারা মানুষের সমাজকে স্বার্থের সংঘাত থেকে মুক্ত করা সম্ভব বলে কোঁতে মনে করতেন। সমাজকে উন্নত করার মাধ্যম হিসাবে পরার্থবাদকে উক্ত দার্শনিক একটি নীতিগত তত্ত্ব হিসাবে দাঁড় করান। কোঁতের মতে স্বার্থপরতা কেবল মানুষের নয়। মনুষ্যেতর জীবের মধ্যেও এর সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। এটা কেবল মৌলিক জৈবিক অনুভূতি। এই অনুভূতির জন্যই পশু-পাখিও সন্তানকে বিপদ থেকে রক্ষা করার জন্য নিজে বিপদ বরণ করে।
American Civil War: আমেরিকার গৃহযুদ্ধ
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর অঞ্চলের সঙ্গে দাসপ্রথার সমর্থক দক্ষিণাঞ্চলীয় কয়েকটি অঙ্গরাষ্ট্রের সশস্ত্র সংঘর্ষ আমেরিকার গৃহযুদ্ধ বলে পরিচিত। এই গৃহযুদ্ধ ১৮৬১ থেকে ১৮৯৫ সাল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। আব্রাহাম লিংকন তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেণ্ট। তাঁর নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় সরকার দাস প্রথা বিরোধী নীতি গ্রহণ করে। দাসপ্রথা বিলোপ কিংবা তাকে অব্যাহত রাখা, এই প্রশ্নে কেন্দ্রের সঙ্গে মত বিরোধের ভিত্তিতে দক্ষিণাঞ্চলের কয়েকটি অঙ্গরাজ্য যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্নতা ঘোষনা করে দাস প্রথা সমর্থক রাষ্ট্রের একটি ‘কনফেডারেসী’ গঠন করে। দক্সিণ ক্যারোরিনা রাষ্ট্রে কেন্দ্রীয় সৈন্যবাহিনী মোতায়েন করা নিয়ে ১৮৬১ সালের ১২ এপ্রিল গৃহযুদ্ধের সূচনা ঘটে। বিচ্ছিন্নতাবাদী দক্ষিণ ক্যারোলিনার বাহিনী কেন্দ্রীয় বাহিনীর দুর্গের উপর আক্রমন করে। ঐ সালে জুন মাস পর্যন্ত গৃহযুদ্ধ পূর্ণ আকার গ্রহনণ করে। কেন্দ্রীয় সরকার বিদ্রোহী দক্ষিণাঞ্চলকে বশীভূত করার জন্য সমুদ্রে অবরোধের সৃষ্টি করে। লোকবল, সৈন্যবল, শিল্প-শক্তি এবং সুসংগঠিত সরকারের শক্তিতে কেন্দ্রীয় সরকার বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং দাসপ্রথা অব্যাহত রাখার পক্ষপাতী কৃষি-প্রধান দক্ষিণাঞ্চলীয় রাষ্ট্রীয় জোটের চেয়ে অবশ্যই অধিক পরাক্রমশালী ছিল। তথাপি ১৮৬১ ও ৬২ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের সৈন্য বাহিনীকে দুইটি গুরুতর পরাজয়ের ক্ষতি স্বীকার করতে হয়। কিন্তু পরিণামে সরকারের নৌ অবরোধ এবং কেন্দ্রীয় সরকারের সামরিক অধিনায়ক জেনারেল গ্রাণ্ট এবং জেনারেল শারমানের যুদ্ধ পরিচালনার কৌশল প্রতিক্রিয়াশীল দক্ষিণীয় রাষ্ট্রজোট হতবল হতে শুরু করে। তাদের সেনাবাহিনীতে ব্যাপক আকারে ছাউনীত্যাগ শুরু হয় এবং ১৮৬৫ সালের ৯ এপ্রিল তাদের সেনাধ্যক্ষ কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। গৃহযুদ্ধ চলাকালীন অবস্থায় ১৮৬৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রেসিডেণ্ট আব্রাহাম লিংকন দাস প্রথার বিলোপ ঘোষণা করেন। এই প্রগতিশীল এবং মানবতাবাদী ভূমিকার জন্য দাস প্রথার সমর্থক প্রতিক্রিয়াশীলদের গুপ্তঘাতকের হাতে ১৮৬৫ সালের ১৪ এপ্রিল তারিখে আব্রাহাম লিংকন নিহত হন। দক্ষিণাঞ্চলকে পরিপূর্ণরূপে বশীভূত করার নীতি কেন্দ্রীয় সরকার ১৮৭৭ সাল পর্যন্ত অব্যাহত রাখে।
American Civilization: আমেরিকার সভ্যতা
আমেরিকার সভ্যতা বলতে কি বুঝায়? এশীয় সভ্যতা, ইউরোপীয় সভ্যতা এবং আফ্রিকার সভ্যতা- কথাগুলির একটি স্বাভাবিক অর্থ আছে। মহাদেশ হিসাবে বিভক্ত এই সমস্ত অঞ্চলের সভ্যতা বলতে প্রাচীনকাল থেকে এই সমস্ত অঞ্চলের অধিবাসীগণ যে সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠন করে এসেছে তাকেই এই সমস্ত অঞ্চলের সভ্যতা বলে নির্দিষ্ট করা হয়। কিন্তু ‘আমেরিকার সভ্যতা’ বলতে আধুনিককালে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা-এই মহাদেশের আদি অীধবাসীদের নিজেদের গঠিত সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে বুঝানো হয় না। অস্ট্রেলীয় মহাদেশের সভ্যতার ক্ষেত্রেও এক অবস্থা। আমেরিকার সভ্যতা বলতে আধুনিককালে যাকে বুঝানো হয় তার সূচনা খ্রিষ্টীয় পঞ্চদশ শতাব্দীর পূর্বে নয়। এবং এ সভ্যতা গঠন করেছে এই অঞ্চলের আদি অধিবাসীগণ নয়। গঠন করেছে ইউরোপ মহাদেশ থেকে আগত স্পেনীয়, পর্তুগীজ, ইংরেজ, জার্মান, ইটালিয়ান প্রভৃতি জাতির ভাগ্যান্বেষীগণ। বস্তুত ১৪৯২ খ্রিষ্টাব্দে কলাম্বাসের আমেরিকা ‘আবিস্কারের’ পর থেকে বিপুল আকারে ইউরোপীয় মানুষ আমেরিকায় আগমন করতে শুরু করে। কিন্তু কলম্বাস যখন আমেরিকার সন্ধান পান তখন বিরাট আমেরিকাভূখণ্ড জনশূন্য কিংবা সভ্যতাবিহীন ছিল না। আমেরিকার নিজস্ব অধিবাসীদের প্রতিষ্ঠিত সেই সভ্যতা ইউরোপীয় অধিবাসীদের আক্রমণ এবং গ্রাসের ফলে আজ বিলুপ্তপ্রায়। ইতিহাসের জাদুঘরে তার কেবলমাত্র কিছু রেশ এবং আভাস দেখা যায়। সভ্যতার হাতে সভ্যতার বিনষ্টির এ একটি বিষ্ময়কর এবং আধুনিক দৃষ্টান্ত।
এশিয়া মহাদেশ এবং উত্তর আমেরিকার মধ্যকার বেরিং প্রণালীর বিস্তার অনতিক্রমণীয় না হলেও বিপুল আয়তন আমেরিকা মহাদেশ, উত্তর এবং দক্ষিন আমেরিকা, ইউরোপ এবং এশিয়া থেকে ভৌগলিকভাবে মহাসমুদ্র দ্বারা বিচ্ছিন্ন ছিল। তার একদিকে আটলাণ্টিক মহাসমুদ্র। অপরদিকে প্রশান্ত মহাসমুদ্র বিস্তারিত। প্রাচীনকালে মহাসমুদ্র পাড়ি দেওয়া সম্ভব ছিল না। কিন্তু উত্তর-পূর্ব এশিয়া থেকে বেরিং প্রণালী অতিক্রম করে উত্তর আমেরিকার সঙ্গে জল যোগাযোগ একেবারে ছিল না, এমন অনুমান করা চলে না।
গবেষকগণ অনুমান করেন, আমেরিকার আদি অধিবাসীগণ পরস্পর বিচ্ছিন্ন গোত্র হিসাবে মহাদেশের বিভিন্ন বাসোপযোগী অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিল।
খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতকে উত্তর অঞ্চল থেকে একটি শিকারী জনগোষ্ঠীকে মেক্সিকোতে এসে বসতি স্থাপন করতে দেখা যায়। এই নবাগত জনগোষ্ঠী স্থানীয় কৃষিজীবী জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিলিত হয়ে জীবনযাপন করতে শুরু করে। এদের মিলিত জীবনযাত্রা থেকে টোকটেক নামীয় একটি জাতির বিকাশ ঘটে। মেক্সিকোর টোলটেক জাতির সভ্যতার চিহ্ন তাদের তৈরি মৃৎপাত্র এবং পিরামিড শীর্ষের মন্দিরের মধ্যে পাওয়া গেছে।
এর কয়েক শত বছর পরে খ্রিষ্টীয় দশম শতকে উত্তর অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে। এই নবাগতগণ ছিল আজটেক। এরা টোকটেকদের পরাভূত করে। আজটেক জাতি ‘টেনোছিটলান’ নামে একটি শহরের পত্তন করে। আধুনিক মেক্সিকো শহরের পূর্বভিত্তি আজটেকদের টেনোছিটলান। আজটেকদের সভ্যতা পূর্বের চেয়ে উন্নত ছিল। স্বর্ণ এবং তাম্রের ব্যবহার, গণনার একটি পদ্ধতির আবিস্কার, বর্ষপঞ্জী তৈরির ক্ষমতা এবং চিত্রলিপির ব্যবহার এই সভ্যতার বৈশিষ্ট্য ছিল।
আজটেকগণ ক্রমান্বয়ে তাদের বসতি মিক্সিকোর দক্ষিণ পূর্বের ইউকাতান উপদ্বীপে বিস্তারিত করে। ইউকাতানে তখন মায়াসভ্যতা নামে একটি সভ্যতা প্রতিষ্ঠিত ছিল।
আজটেকগণ মায়াসভ্যতাকেও পরাভূত করে। মায়াগণ প্রস্তরের নগর এবং মিশরের পিরামিডের ন্যায় প্রস্তরমন্দির তৈরিতে পারদর্শী ছিল। তারা বিরাটাকারের বাড়ি তৈরি করতে পারত। এ সমস্ত স্থাপত্যের বিচিত্র অঙ্গসজ্জার ধ্বংসাবশেষ তদের স্থাপত্য শিল্পের বিষ্ময়কর বিকাশের সাক্ষ্য বহন করে। মায়াদের গঠিত নগরের মধ্যে চিতেনইটজা, মায়াপান, উকসমল প্রভৃতি নগর খ্যাতি লাভ করে। এই নগরগুলি নগররাষ্ট্রের রূপ গ্রহণ করেছিল। দশম শতাব্দী থেকে কয়েক শত বছর এই নগররাষ্ট্রগুলি পরস্পরের মধ্যে তীব্র লড়াইয়ে নিযুক্ত ছিল। আমেরিকার নিজস্ব সভ্যতার মধ্যে মায়া সভ্যতাই সবচেয়ে প্রাচীন এবং বিকশিত বলে খ্যাত। মায়াসভ্যতার ক্ষয়ের কাল হচ্ছে দশম থেকে পঞ্চদশ শতাব্দী। মায়াসভ্যতার সমাজ ব্যবস্থায় অভীজাত ও পুরোহিতদের প্রাধান্য ছিল। অভিজাতদের হাতে কোকোয়ার জমি, মৌমাছির চাষ এবং লবণের খনিগুলো কেন্দ্রীভূত ছিল। অভিজাতদের অধীনে সংখ্যক দাসও থাকত। বিভিন্ন নগর রাষ্ট্রে বা বসতিতে মায়াগণ সে সংগঠিত জীবনযাপন করত তার মধ্যে গোত্রীয় জীবন-পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য প্রধান ছিল। কিন্তু বিকাশের পথে গোত্রীয় যৌথ জীবনের মধ্যে আর্থিক অসাম্যও ক্রমান্বয়ে সৃষ্টি হতে থাকে। যুদ্ধের বন্দি, দণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধী, ঋণবদ্ধ মানুষ এবং অনাথরা দাসশ্রেণীর প্রধান উৎস ছিল। মায়াদের মধ্যে এইকালে দাসসমাজের বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পেতে থাকে।
মায়াসভ্যতাকে পরাভূত এবং তার বিকাশকে গ্রহণ করে আজটেকগণ সমগ্র মেক্সিকোতে প্রাধান্য বিস্তার করেছিল। আজটেকগণ সেচ ব্যবস্থা উন্নতি ঘটিয়ে কৃষিকার্যকে অধিকতর বিকশিত করে। নানা রকম ফল ও সবজি ব্যতীত তামাকের চাষেরও তারা প্রচলন করে। হস্তশিল্পের মধ্যে আসবাসপত্র তৈরি, বস্ত্রবয়ন এবং ধাতবশিল্প বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আজটেকগণ প্রস্তর বা ইট দ্বারা বাড়ি তেরি করতে পারত। তা ছাড়া খালখনন ও বাঁধ তৈরিতেও তারা দক্ষতা অর্জন করেছিল।
আজটেকণও গোড়ার দিকে গোত্রীয় জীবনযাপন করত। জমি যৌথ সম্পত্তি ছিল। নির্বাচিত সমরপতি যুদ্ধ ও শান্তি, উভয় সময়ে গোত্রের প্রধান বলে বিবেচিত হতো। কয়েকটি গোত্র মিলে আবার যৌথ জীবনযাপনের জন্য প্রধান সমরপতিকে কোনো বিশেষ গোত্র থেকে নির্বাচিত করত। আজটেকগণ যুদ্ধবাজ ছিল। প্রায়ই তারা অভিযান, যুদ্ধ এবং লুণ্ঠনে লিপ্ত থাকত। আর এই যুদ্ধ পরিচালনা এবং জয়ের মধ্যে ক্রমান্বয়ে তাদের গোত্রীয় সাম্যবাদী জীবনের ভাঙন ঘটে। যুদ্ধের সম্পদ ও দাস প্রধানত সমরপতিগণের অধীকারভুক্ত হয়। এভাবে আজটেকের দাসে পরিণত হয়। এবং দাস ব্যবস্থা আজটেক সভ্যতার বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ায়। পঞ্চদশ এবং ষোড়শ শতকেও আজটেকদের যুদ্ধোম্মাদ জাতি হিসাবে দেখা যায়।
দক্ষিণ আমেরিকার এণ্ডিজ পর্বত অঞ্চলে আর একটি সভ্যতার সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। এখানে প্রাচীনকাল থেকে কুইচোয়া, আয়মারা এবং অন্যান্য জনগোষ্ঠী বাস করে আসছিল। এদের সভ্যতাএ বিশেষ বিকাশ লাভ করেছিল। পঞ্চদশ এবং ষোড়শ শতকে কুইচোয়ার গোত্রভূক্ত ইনকাগোত্র অন্যান্য গোত্রকে পরাভূত করে একটি বৃহদাকারের রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছিল। এই রাষ্ট্রের অধিপতি নিজেকে ‘সাপাইনকা’ (একমাত্র ইনকা) বলে অভিহিত করত এবং নিজেকে সূর্যদেবের পুত্র বলে বিশ্বাস করত। ইনকাগণও কৃষি, পশূপালন ও নানাপ্রকার হস্তশিল্পে বিশেষ দক্ষতা অর্জন করেছিল।
পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে ক্রমধিক সংযোগ এবং সংমিশ্রণের মাধ্যমে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার এ সমস্ত সভ্যতা অধিকতর বিকাশ করতে পারত। কিন্তু এই সভ্যতাসমূহের নিজেস্ব বিকাশ ধারা পঞ্চদশ এবং ষোড়শ শতাব্দীর উন্নততর মরাণাস্ত্রসজ্জিত ইউরোপীয় অভিযানকারীদের আক্রমন,লুণ্ঠন ও শোষণের দুর্বার আঘাতে রুদ্ধ হয়ে যায়।
American Philosophy: আমেরিকার দর্শন
সাম্প্রতিকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দার্শনিক চিন্তাধারাকে চিহ্নিত করার জন্য ‘আমেরিকার দর্শন’ আখ্যাটি ব্যবহার করা হচ্ছে। আমেরিকা বলতে কেবল মার্কিন-যুক্তরাষ্ট্র বুঝায় না। সে কারণে কেবল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দর্শনের বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করার জন্য ‘আমেরিকার দর্শন’ কথাটি উপযুক্ত নয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রধানত ইউরোপ মহাদেশ থেকে আগত অধিবাসীদের দ্বারা গঠিত হয়েছে। এ জন্য সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ইউরোপ মহাদেশে ঊনবিংশ শতকে প্রচলিত ভাবধারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও প্রচলিত ছিল। দর্শনের ক্ষেত্রেও ইউরোপের বিভিন্ন ধারা এবং উপধারার সাক্ষাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দার্শনিকদের মধ্যে পাওয়া যায়। ইউরোপ থেকে ভিন্নভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দর্শনকে চিহ্নিত করা সহজ ছিল না বলে বিগত শতকে দর্শনের ইতিহাসে ‘মার্কিন দর্শন’ বলে কোনো বিশেষ দর্শনের পরিচয় পাওয়া যায় না। তথাপি অর্থনৈতিক কারণে ইউরোপ ত্যাগকারী জনসমষ্টি একটি অনাবাদী ভূখণ্ডকে আবাদযোগ্য করে সভ্যতা গঠনে যে ভাবধারার আশ্রয় গ্রহণ করেছে তা বিশ্লেষণের যোগ্য। নতুন একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠনের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ এবং বৈজ্ঞানিকগণ যেভাবে সহায়তা করেছেন দার্শনিকগণও সেভাবে তাঁদের চিন্তাধারার মাধ্যমে এই গঠনকার্যে অংশগ্রহণ করেছেন। গঠনমূলক এই যুগের চিন্তার প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল বাস্তবতা। জীবনের সঙ্গে সম্পর্কহীনভাবে কোনো সমস্যার তাত্ত্বিক বিচার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই যুগের দার্শনিকগণের মধ্যে প্রকট হয় নাই। বাস্তব সমস্যা সমাধানের জন্য তাঁরা চিন্তা করেছেন। এ কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দার্শনিকদের মধ্যে বাস্তব জীবনের স্বীকৃতির পরিচয় পাওয়া যায়। এই জীবনবোধে থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রাগমেটিজম বা প্রয়োগবাদের জন্ম হয়।
১৮৮০ থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত বিস্তৃত সময়কে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দর্শনের স্বর্ণযুগ বলে আখ্যায়িত করা হয়। কেননা এই সময়ে দর্শন ও মনোবিজ্ঞানে জেমস ডিউই, পিয়ার্স, রয়েস, জর্জ সাণ্টায়ানা এবং আলফ্রেড নর্থ হোয়াইটহেডের মতো মৌলিক চিন্তাবিদদের উদ্ভব ঘটে। উপরোক্ত দার্শনিকদের গ্রন্থরাজি এবং অভিমত দর্শনের সমগ্র ইতিহাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করেছে। হোয়াইটহেডকে প্রাগমেটিজম বা প্রয়োগবাদী তত্ত্বের প্রবক্তা মনে করা হয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক দর্শনে যে সমস্ত তত্ত্ব সমধিক আলোচিত হচ্ছে তার মধ্যে লজিকাল পজিটিভিটিম বা যৌক্তিক দৃষ্টবাদ এবং লিঙ্গুইসটিক ফিলোসফি বা ভাষা-দর্শনই প্রধান।
American War of Independence: আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ (১৭৭৬-১৭৮১)
ইউরোপের ইতিহাসে অষ্টাদশ শতাব্দীতে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সংঘটিত হয়। আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ (১৭৭৬) এবং ফরাসি বিপ্লব (১৭৮৯)। আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধকে আমেরিকার বিপ্লব বলেও অভিহিত করা হয়।
আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ ইংল্যাণ্ডের অথনৈতিক বিকাশের একটি পর্যায়ের স্মারক। সপ্তদশ শতাব্দীতেই ইংল্যাণ্ডে শিল্প বিপ্লব সংঘটিত হয়। ইংল্যাণ্ডে পশম ও সুতার বস্ত্রশিল্প, কয়লা উত্তোলন এবং লৌহ তৈরির শিল্প দ্রুত বিকাশ লাভ করে। পশমশিল্পের বিস্তারের সঙ্গে ভূমি ও কৃষিক্ষেত্রে এক নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ভেড়ার পশম ছিল পশমশিল্পের মূল কাঁচামাল। কুষিপণ্যের চেয়ে পশমের লাভ অধিক দেখে জমিদারগণ জমি থেকে ব্যপকভাবে কুষকদের উচ্ছেদ করে তাদের জমিদারিকে মেষপালনের খামারে পরিণত করতে শুরু করে। এর ফলে বিপুল সংখ্যক কৃষক ভূমিহীন নিঃস্ব মুজরে পরিণত হয়ে শহরে এবং শিল্পঞ্চলে জমায়েত হতে থাকে। এই নিঃস্ব জমিহীন কৃষকরা শিল্পের সস্তা মজুর হিসাবে শিল্প বিকাশের গতিকে আরো ত্বরান্বিত করে। ইংল্যাণ্ডের এই বিকশিত শিল্পের জন্যে ক্রমান্বয়ে অধিক পরিমাণে বাজারের আবশ্যক হয়। এই বাজারের প্রয়োজনে শক্তিশালী নৌবহরের মালিক ইংল্যাণ্ডে উপনিবেশের জন্যে বিভিন্ন যুদ্ধে লিপ্ত হয়। ১৭০১ থেকে ১৭১৪ পর্যন্ত ফ্রান্সের সঙ্গে সাত বছরের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই সমস্ত যুদ্ধের ফলে ভারতে এবং উত্তর আমেরিকায় ইংল্যাণ্ডের শক্তি আরো বৃদ্ধি পায়। উত্তর আমেরিকাতে ফরাসিগণ কানাডাকে ইংল্যাণ্ডের হাতে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।
কিন্তু আমেরিকাতে এই বিজয় ইংল্যাণ্ডের শাসকদের জন্যে নতুন সংকটেরও সৃষ্টি হয়। পঞ্চদশ মতকের শেষদিকে (১৪৯২) কলাম্বাসের আমেরিকা সন্ধান লাভের পর থেকেই ইউরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্রের নানা ধরনের অধিবাসী ধনরত্নের আশায় আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকাতে আগমন করতে থাকে। ইউরোপীয়দের এই আগমন ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে বিরাট স্রোতের আকার ধারণ করে। এই সমস্ত অভিযানকারীগণ আমেরিকার আদি অধিবাসীদের তুলনায় মারণাস্ত্র এবং অন্যান্য কলাকৌশল অধিকতর উন্নত ও শক্তিশালী ছিল। বিশাল আমেরিকার বিপুল অংশ তখনো অনাবাদী অবস্থাতে ছিল। ইউরোপীয় অভিযাত্রীগণ একদিকে আমেরিকার আদি অধিবাসীগণকে ধ্বংস করে, অপরদিকে অনুধ্যুষিত অঞ্চলসমূহ দখল এবং আবাদ করে ইউরোপীয় উপনিবেশ বা বসতি স্থাপন করতে থাকে। অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগেই আটলান্টিক উপকূলব্যাপী ইংরেজদের উপনিবেশ বিরাট আকার ধারণ করে। ফ্রান্সের সঙ্গে যুদ্ধের ফলে কানাডা লাভের ফলে এই উপনিবেশ বৃদ্ধি পায়। এই সকল উপনিবেশের ইউরোপীয় অধিবাসীদের সংখ্যা এই সময়ের মধ্যে ত্রিশ লক্ষে পৌছে যায়। এই উপনিবেশের অধিবাসীগণ এখন আর ইউরোপ থেকে আগত কোনো অস্থায়ী বাসিন্দা নয়। এখন এরা নিজেদেরকে আমেরিকার অধিবাসী বলে গণ্য করে নিজেদেরকে ‘আমেরিকান’ বলে ঘোষণা করতে শুরু করে। এই সমস্ত উপনিবেশবাসীদের সাধারণ স্বার্থের সঙ্গে তাদের মূলদেশ ইংল্যাণ্ডের শাসকদের শাসন ব্যবস্থা ও স্বার্থের বিরোধ বৃদ্ধি পেতে থাকে। ইংল্যাণ্ডের পার্লামেণ্টে রচিত শাসনবিধি দ্বারা ইংল্যাণ্ডের রাজা আমেরিকার উপনিবেশগুলিকেও শাসন করত। পার্লামেণ্টে আমেরিকার উপনিবেশের কোনো প্রতিনিধিত্ব ছির না। উপনিবেশের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিগণ পূর্ব থেকেই ইংল্যাণ্ডের এই শাসনবিধির প্রতি সন্তুষ্ট ছিল না। কিন্তু ইংল্যাণ্ডের সরকারের বিরুদ্ধে কোনো বিদ্রোহাত্মক আন্দোলন ইংল্যাণ্ড ও ফ্রান্সের মধ্যকার সাত বছরের যুদ্ধের পূর্বে তেমন পরিচালিত হয় নি। তার একটা কারণ ছিল, ফ্রান্স সম্পর্কে উপনিবেশের অধিবাসীদের ভয়। ইংল্যাণ্ডের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে স্বাধীন হয়ে গেলে, কানাডা থেকে ফরাসিরা তাদের আক্রমণ করতে পারে। কিন্তু সাত বছরের যুদ্ধে ফ্রান্সের পরাজয় এবং কানাডা ইংরেজ উপনিবেশের অন্তর্ভূক্ত হওয়ায় আমেরিকার অধিবাসীদের সে ভয় এবার দূর হলো।
ইংল্যাণ্ডের পার্লামেণ্ট এবার যখন পুরোনো কায়দায় আমেরিকার উপনিবেশগুলির উপর ট্যাক্স ধার্যের আইন পাশ করতে লাগল, উপনিবেশের অধিবাসীদের নিজস্ব শিল্প ও বাণিজ্য প্রচেষ্টায় বিভিন্ন প্রকার বাধা নিষেধ আরোপ করে চলল তখন উত্তর আমেরিকার এই সমস্ত ইংরেজ উপনিবেশের অধিবাসীগণ বিদ্রোহাত্মক মনোভাব দেখাতে শুরু করল। এই সময়েই আমেরিকানগণ একটি উল্লেখযোগ্য সংগ্রাম ধ্বনি উচ্চারণ করে ‘নো ট্যাকসেশন উইদআউট রিপ্রেজেণ্টেশন: প্রতিনিধি নাই, তো ট্যাক্স নাই’ (১৭৬৭)। তারা সরকারের কর দিতে অস্বীকার করতে শুরু করল। ইংরেজ সরকার এর পাল্টা দণ্ডমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করলে উপনিবেশবাসীরা ইংল্যাণ্ডের প্রেরিত চা এবং অন্যান্য দ্রব্য বর্জন করার আন্দোলন শুরু করে (১৭৭৪)। ইংরেজ সরকার তার প্রতিক্রিয়ায় আমেরিকার বাণিজ্য নৌযানগুলিকে সমুদ্রপথে অবরোধ করে। এর জবাবে আমেরিকার উপনিবেশগুলি বিদ্রোহ ঘোষণা করে। ১৭৭৪ সালে আমেরিকানগণ সশস্ত্রভাবে সরকারের সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে রত হয়। ১৭৭৫ সনে লেকসিংটনে এক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে সামান্য রাইফেলধারী কিছূ আমেরিকানদের কাছে ব্রিটিশ সৈন্য ক্ষয়ক্ষতি ভোগ করে পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হয়। ১৭৭৫-এর মে মাসে বিদ্রোহী উপনিবেশগুলির প্রতিনিধিদের এক সম্মেলন ফিলাডেলফিয়াতে আহূত হয়। এই সম্মেলনে ইংল্যাণ্ডের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করে জর্জ ওয়াশিংটনের (১৭৩২-১৭৯৯) অধিনায়কত্বে এক আমেরিকান বাহিনী গঠন করা হয়। ফিলাডেলফিয়ার সম্মেলন ১৭৭৬-এর জুলাই ৪ তারিখে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র গ্রহণ করে এবং আমেরিকার ইংরেজ উপনিবেশগুলি নিজেদের ‘দি আমেরিকান স্টেইট’ বা আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র (ইউ.এস.এ.) হিসাবে ঘোষণা করে। ইতিহাসে এই ঘোষণা ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেছে।
এই ঘোষণা-পত্রের রচয়িতা ছিলেন টমাস জেফারসন (১৭৪৩-১৮২৬)। এই ঘোষণার পরে ইংল্যাণ্ডের সঙ্গে তীব্র যুদ্ধ শুরু হয়। গোড়ার দিকে ইংল্যাণ্ডের শক্তিশালী বাহিনীর বিরুদ্ধে ওয়াশিংটনের বাহিনী টিকে থাকতে অক্ষম হয়। ইংরেজ সৈন্য আমেরিকানদের হাত থেকে নিউইয়র্ক দখল করে।
ক্রমান্বয়ে আমেরিকার এই স্বাধীনতা যুদ্ধ আন্তর্জাতিক যুদ্ধের রূপ গ্রহণ করে। স্বাধীনতাকামী যুদ্ধরত আমেরিকানগণ ফ্রান্স ও স্পেনের সাহায্য কামনা করে। ফরাসি জনমত তো বটেই, ফরাসি সরকারও এই সুযোগে ইংরেজ সরকারের বিরোধিতা করে আমেরিকানদের অস্ত্র ও সৈন্য দিয়ে সাহায্য করতে অগ্রসর হয়। স্পেনও সাত সাগরের একচ্ছত্র অধিপতি ইংল্যাণ্ডকে আঘাত করার সুযোগ গ্রহণে পিছিয়ে থাকলো না। স্বাধীনতাকামী আমেরিকানদের পক্ষে ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে এবার একটি আন্তর্জাতিক জোট তৈরি হয়ে গেল। এই জোটের আঘাতের মুখে ইংরেজশক্তি আর টিককে সক্ষম হলো না। তারা ইয়র্ক টাউনের যুদ্ধে ফরাসি ও আমেরিকানদের নিকট পরাজয় স্বীকার করে আমেরিকার উপনিবেশজোটের স্বাধীনতা মেনে নিতে বাধ্য হলো (১৭৮১)।
আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ ছিল স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে স্বাদীনতাকামী মানুষের যুদ্ধ। এই যুদ্ধ ইংল্রাণ্ড, ফ্রান্স ও ইউরোপের অন্যান্য দেশের অন্যান্য দেশের প্রগতিশীল ও গণতন্ত্রীমনা চিন্তাবিদদের মধ্যে বিপুল আলোড়নের সৃষ্টি করেছিল। আমেরিকার সৈন্যগণকে ইংল্যাণ্ডের সাধারণ মানুষ ‘স্বাধীনতার সন্তান’ বলে গণ্য করতে শুরু করে। ইংল্যাণ্ডের চিন্তাবিদ সেইণ্ট সাইমন এবং পোলাণ্ডের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা যোসিসকোসহ অনেক প্রগতিশীল ব্যক্তি আমেরিকার স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহনের জন্য সমুদ্র পাড়ি দিয়ে আমেরিকাতে উপস্থিত হন। ১৭৮৯ সনের ঐতিহাসিক ফরাসি বিপ্লব সংঘটনের ক্ষেত্রে আমেরিকার স্বাধীনতাযুদ্ধ বিরাট অনুপ্রেরণার উৎস হিসাবে কাজ করেছিল।
Amphiboly: বাক্যের দ্ব্যর্থকতা
যুক্তির ক্রটিবিশেষ। যুক্তির মধ্যে একটি ব্যক্যকে যদি একাধিক অর্থে ব্যবহার করা হয় কিংবা বাক্যটি যদি এরূপভাবে গঠিত হয় যে তার একাধিক অর্থ করা সম্ভব, তা হলে সিদ্ধান্ত ভ্রান্ত হতে পাবে। এ কারণে একই যুক্তির মধ্যে একাধিক অর্থপূর্ণ কোন বাক্য ব্যবহারকে দ্ব্যর্থকতার দোষে দুষ্ট বলা হয়। সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য এরূপ দ্ব্যর্থক বাক্য বা শব্দ ব্যবহার পরিহার করা সঙ্গত। কিন্তু দ্ব্যর্থক বাক্য সাহিত্যের কাব্য, নাটক প্রভৃতি শাখার প্রচুর পাওয়া যায়। প্রাচীন গ্রিসের দেবমন্দিরের ভবিষ্যদ্বক্তাগণ দ্ব্যর্থক ভাষাতেই তাদের ভবিষ্যদ্বাণী প্রকাশ করত। এরূপ অনেক ভবিষ্যদ্বাণী ইতিহাসে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। প্রাচীন লিডিয়ার সম্রাট ক্রিসাস পারস্য সাম্রাজ্য আক্রমণ করার পূর্বে তাঁর ভাগ্য গণনার জন্য ডেলফির ভবিষ্যদ্বক্তার কাছ গিয়ে প্রশ্ন করেন এই অভিযানের ফলাফল কি হবে। ভবিষ্যদ্বক্তা বলেছিল: ‘আপনি একটি বিরাট সাম্রাজ্যের ধ্বংস সাধন করবেন।’ ভবিষ্যদ্বক্তার কথা সত্য হয়েছিল। ক্রিসাসের অভিযানে এক বিরাট সাম্রাজ্য অবশ্যই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল। কিন্তু সে সাম্রাজ্য পারস্য নয়; সে ছিল ক্রিসাসের নিজের সাম্রাজ্য।
Amritsar Massacre: অমৃতসর হত্যাকাণ্ড
প্রথম মহাযুদ্ধ পরবর্তীকালে ১৩ এপ্রিল, ১৯১৯ সনে অবিভক্ত ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের অমৃতসর শহরে ইংরেজ সামরিক অধিনায়ক জেনারেল ডায়ারের নির্দেশে জালিয়ানওয়ালাবাগ নামক একটি বন্ধ উদ্যানে সমবেত নিরস্ত্র জনতার উপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ ও হত্যাকাণ্ড অমৃতসর হত্যাকাণ্ড নামে বিখ্যাত। জালিয়ানওয়ালাবাগ থেকে এ ঘটনা জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড বলেও পরিচিত।
তখন ভারতবর্ষ ইংরেজ শাষনের অধীনে। ঊনবিংশ শতকের শেষ দিক থেকেই ভারতের উদীয়মান ধনিক ও মধ্যবিত্ত শ্রেনীর মধ্যে স্বায়ত্তশাসন এবং স্বাধীনতার আকাঙ্খা জাগরিত হতে থাকে। এই আকাঙ্খার সাংগঠনিক প্রকাশ ঘটে ১৮৮৫ সালে কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠায়। গোড়ার দিকে এ প্রতিষ্ঠানের দাবি ছিল ইংরেজ শাসনাধীনে ন্যায়বিচার এবং স্বায়ত্তশাসন লাভ। কিন্তু ইংরেজ শাসনের তরফ থেকে, এ দাবির কোনো পূরণ ঘটে না। ইংরেজ শাসকেরা বলতে থাকে, ভারতবর্ষ অনুন্নত দেশ। ভারতবর্ষের মানুষ স্বায়ত্তশাসন বা স্বাধীনতার উপযুক্ত নয়। কিন্তু ব্রিটিশ শাসনের নিজস্ব প্রয়োজনে এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অপরাপর ঘটনার প্রভাবে ভারতবর্ষের অর্থনীতিতে এবং দেশবাসীর চেতনায় ক্রমান্বয়ে পরিবর্তন ঘটতে থাকে। ক্রমান্বয়ে বৃহৎ ভারতীয় উপমহাদেশের সর্বত্র রেলপথ স্থাপিত হতে থাকে। টেলিগ্রাফ তারও বসানো হয়। কিছু কিছু শিল্প কারখানা স্থাপিত হতে থাকে। বিশেষ করে কাপড়ের কলের স্থাপনা ও বিস্তার ঘটে। আন্তর্জাতিক ঘটনার প্রভাবও দেশবাসীর চিন্তাকে প্রভাবান্বিত করতে থাকে। ১৯০৫ সালে একদিকে রাশিয়ার মতো বৃহৎ ইউরোপীয় শক্তি ক্ষুদ্র জাপানের মতো এশিয়া শক্তির নিকট রুশ-জাপান যুদ্ধে পরাজিত হয়। অপরদিকে রাশিয়ার ভেতরে নির্যাতিত জনসাধারণ সামন্ততান্ত্রিক জার সরকারের বিরুদ্ধে বিপ্লাবাত্মক অভ্যুত্থান সংঘটিত করে। ১৯০৫ সালের বিপ্লব পর্যদুস্ত হলেও পৃথিবীর পরাধীন জাতি এবং নির্যাতিত মানুষের উপর এর প্রভাব কম ছিল না। ধনতান্ত্রিক দুনিয়ার অর্থনৈতিক সংকটও বৃদ্ধি পেতে থাকে। বৃহৎ বৃহৎ ইউরোপীয় রাষ্ট্রের মধ্যে এশিয়া-আফ্রিকার অনুন্নত দেশকে দখল করে নিজেদের মধ্যে বণ্টন করে নেবার নতুন প্রতিযোগিতা এবং দ্বন্দ শুরু হয়। এরই ফলে ১৯১৪ সালে প্রথম মহাযুদ্ধ আরম্ভ হয়। জার্মানির বিরুদ্ধে ইংল্যাণ্ড এই যুদ্ধে জড়িত হয়। পৃথিবীব্যাপী যুদ্ধের জন্য ভারতীয়দের সৈন্যবাহিনীতে গ্রহণ করার জরুরি প্রয়োজন দেখা দেয়। পরাধীন ভারতবাসীর মনের সন্দেহ এবং অনিচ্ছা দূর করার জন্য ইংরেজ সরকার প্রতিশ্রুতি দিতে থাকে যে, এই যুদ্ধের লক্ষ্য হচ্ছে সকল জাতির শৃঙ্খলমুক্তি এবং স্বায়ত্তশাসনের অধিকার প্রদান। এরূপ ঘোষণায় বিশ্বাস করে ভারতবাসীরাও যুদ্ধে যোগদান করতে থাকে। অবিভক্ত ভারতের অন্যতম জননেতা গান্ধীজি এই সময়ে তাঁর দক্ষিণ আফ্রিকার সত্যাগ্রহ আন্দোলনের অভিজ্ঞতা নিয়ে ভারতে তাঁর কর্মস্থল স্থাপন করেন। তাঁরই উদ্যোগে প্রচুর সংখ্যক ভারতাবাসী সৈন্যবাহিনীতে যোগদান করে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রেরিত হতে থাকে।
কিন্তু ১৯১৯ সালে যুদ্ধ শেষ হলেও ভারতবাসী ইংরেজদের শাসনের নীতিতে কোনো পরিবর্তন দেখতে পায় না। যারা যুদ্ধে যোগদান করেছিল তাদেরকেও সৈন্যবাহিনী ভেঙ্গে বেকার করে গ্রামে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। যুদ্ধশেষের মন্দা অর্থনীতিতে আঘাত করে। বেকার সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। দুর্ভিক্ষাবস্থা এবং ইনফ্লুয়েঞ্জা-মহামারীতে এককোটির অধিক মানুষ মৃত্যুমুখে পতিত হয়। ভারতবাসীর মনে সন্দেহ এবং অস্থিরতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এমন অবস্থায় ইংরেজ সরকার একদিকে যেমন মণ্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কার বলে কিছু সীমাবদ্ধ শাসন সংস্কারের ঘোষণা করে তেমনি অপরদিকে রাওলাট বিল পাশ করে ইংরেজবিরোধী সকল রকম বিক্ষোভ ও প্রতিবাদকে নির্মমভাবে দমন করার ব্যবস্থা গ্রহণ করে। রাওলাট আইনের অধীনে বিনা কারণে গ্রেপ্তার, অন্তরীন এবং সংক্ষিপ্ত ও সাক্ষ্য প্রমাণহীন বিচার ও বন্দিত্বের বেপরোয়া পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।
এরূপ অবস্থায় গান্ধীজী সত্যাগ্রহ বা অহিংস পন্থায় এই দমনমূলক ব্যবস্থার প্রতিবাদের কথা ঘোষণা করেন। এপ্রিল মাসের গোড়ার দিকে (১৯১৯) পাঞ্জাবে যাওয়ার পথে গান্ধীজী গ্রেপ্তার হয়। এর প্রতিবাদে আহমেদাবাদের শিল্পশ্রমিক এবং পাঞ্চাবের মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। ধর্মঘট এবং বিক্ষোভের নানা ঘটনা ঘটতে থাকে। সরকার গান্ধীজীকে মুক্ত করে দিতে বাধ্য হয়।কিন্তু তথাপি বিক্ষোভ ক্ষান্ত হয় না। এই বিক্ষোভ প্রধানত পশ্চিম ভারত এবং পাঞ্জাবে কেন্দ্রীভূত ছিল। ধর্মঘট এবং বিক্ষোভে সরকারি দপ্তর এবং যানবাহন আক্রমণের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। শ্বেতকর্মের ইউরোপীয় অফিসার ও অধিবাসীও জনতার ক্রোধের পাত্র হয়ে উঠে। তারাও আক্রান্ত হতে থাকে। ১৩ এপ্রিল দুজন রাজনীতিক নেতাকে অমৃতসরে গ্রেপ্তার করা হয়। এর প্রতিবাদে জনতা সামরিক ছাউনি লক্ষ্য করে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করলে তাদের ছত্রভঙ্গ করা হয়। ছত্রভঙ্গ জনতা শহরে ঢুকে রেলওয়ে স্টেশন ও দুটি ব্যাঙ্ক আক্রমণ করে ভষ্মীভূত করে। চারজন ইউরোপীয় অধিবাসী জনতার আক্রমণে নিহত হয়। একজন মহিলা মিশনারী নিখোঁজ হয়। সাময়িক ছাউনির ইংরেজ অধিনায়ক জেনারেল ডায়ার ক্ষিপ্ত হয়ে শহরে সবরকম জনজমায়েত নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। কিন্তু তৎসত্ত্বেও ১৩ এপ্রিল অমৃতসরের জালিয়ানওয়ালাবাগ নামক একটি উদ্যানে বেশ কিছু লোক সরকারের দমননীতির প্রতিবাদে জমায়েত হয়। উদ্যানটির মাত্র একটি নিষ্ক্রমণ পথ ছিল। জেনারেল ডায়ার এই জমায়েতের সংবাদ পেয়ে একদল গুর্খা এবং বালুচ বাহিনী এবং সাঁজোয়া গাড়ি নিয়ে উদ্যানের মুখে হাজির হন। তাঁর হুকুমে উদ্যানের মুখ সাঁজোয়া গাড়ি দ্বারা বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং তারপর কোনোরকম হুঁশিয়ারী না দিয়ে সমবেত নিরস্ত্র জনতার উপর বিরামহীনভাবে গুলিবর্ষণ শুরু হয়। সর্বমোট ১৬০৫ রাউণ্ড গুলি বর্ষিত হয়েছিল। উদ্যানটি জনতায় পূর্ণ ছিল। হতচকিত প্রাণরক্ষার জন্য পালাবার চেষ্টা করে। কিন্তু পালায়নের কোন পথ ছিল না। নিজেদের প্রাণরক্ষার চেষ্টায় হুড়োহুড়িতে এবং অবিরাম গুলিবর্ষণে চার শতাধিক লোক ঐ স্থানে নিহত হয়। সরকারী হিসাব সাধারণত কমের দিকে থাকে। সরকারি হিসাব মতে ৩৭৯ জন নিহত এবং ১২০০ জন আহত হয়। ডায়ারের এই চণ্ডনীতি পাঞ্জাব সরকার সমর্থন করে। ১৫ এপ্রিল পাঞ্জাবে সামরিক আইন জারি করা হয়। এই সময় অমৃতসর এবং পাঞ্জাবের অীধবাসীদের উপর অমানুষিক অত্যাচার চালানো হয়। যে স্থান থেকে ইংরেজ মহিলাযাত্রী নিখোঁজ হয়েছিল সে স্থানে সকল মানুষকে চার হাত পায়ে পশুর মতো হামাগুড়ি দিতে বাধ্য করা হয়। সান্ধ্য আইনের বিন্দুমাত্র ব্যতিক্রম, ইংরেজ সামরিক অফিসারকে হাত তুলে সালাম না জানানো ইত্যাদি অপরাধের জন্য প্রকাশ্যে বেত্রাঘাতের দণ্ড দেওয়া হতে থাকে। দেশব্যাপী প্রতিরোধের ঝড় ওঠে। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ইতিপূর্বে ইংরেজ সরকারের নিকট থেকে যে ‘স্যার’ উপাধি পেয়েছিলেন সে খেতাব একটি প্রতিবাদলিপি পাঠিয়ে তিনি বর্জন করেন। দেশব্যাপী প্রতিবাদের ফলে সরকার যদিও ‘হাণ্টার কমিশন’ নামে তদন্ত কমিশন এই ঘটনার উপর নিযুক্ত করেছিলেন এবং তদন্ত কমিশনের সাধারণ সমালোচনামূলক রিপোর্টের ভিত্তিতে জেনারেল ডায়ারকে দ্বায়িত্ব থেকে অপসারণ করা হয় তথাপি কমিশনের নিকট ডায়ারের সদম্ভ উক্তিই যে ইংরেজ সরকারের মনোভাব প্রকাশ করেছিল, একথা অস্বীকার করা যায় না। জেনারেল ডায়ার নির্দ্বিদায় বলেছিলেন, “আমি যখন গুলিবর্ষণ শুরু করি তখন বিরামহীন ভাবেই করি। জনতা ছত্রভঙ্গ না হওয়া পর্যন্ত আমি গুলিবর্ষণ থেকে বিরত হয়নি। কারণ আমার মতে এই পরিমাণ ছিল ন্যূনতম প্রয়োজনীয় পরিমাণ। আমার হাতে সেদিন যদি সৈন্য অধিকতর থাকত হা হলে নিহত ও আহতদের সংখ্যা অবশ্যই অধিকতর হতো। কারণ, কেবল জনতাকে ছত্রভঙ্গ করা নয়। সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে প্রয়োজন ছিল উপস্থিত এবং অনুপস্থিত পাঞ্জাবের সকলের মনে উপযুক্ত বাধ্যতাবোধ সৃষ্টি করা।”
ঐতিহাসিকগণ মনে করেন ১৯১৯ সারের অমৃতসর হত্যাকাণ্ড তার পরবর্তী প্রতিক্রিয়ার দিক থেকে ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ-পরবর্তী প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে মাত্র তুলনীয়। এই সময় থেকেই ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে একটি পরিকর্তন সংঘটিত হয়। এখন থেকে ভারতবাসীর স্বাধীনতা আন্দোলন আপসহীনতার পথ গ্রহণ করতে থাকে। বলা চলে, জেনারেল ডায়ার সেদিন তার কামানের গর্জনে কেবল ইংরেজ বর্বরতাই ঘোষণা করেন নি, তিনি ভারতে ইংরেজ শাসনের অন্তিম কালেরও ঘোষণা করেছিলেন।
Analogy: উপমা, সাদৃশ্য, সাদৃশ্যানুমান
ইংরেজী ‘এ্যানালজি’ শব্দ গ্রিক শব্দ ‘এ্যানালজিয়া’ থেকে উদ্ভুত। এ্যানালজিয়ার অর্থ হচ্ছে অনুপাত। প্রাচীনকালে অনুপাতের সমতা বা সাদৃশ্য অঙ্কশাস্ত্রে সিদ্ধান্তের ভিত্তি হিসাবে ব্যবহৃত হতো। কিন্তু কেবল অনুপাতের সমতা নয়, দুইটি বিষয়ের মধ্যে কিছু পরিমাণ গুণের সাদৃশ্যের ভিত্তিতেও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা চলে। ইনডাকটিভ আ আরোহ যুক্তিতে সাদৃশ্যানুমান যুক্তির একটি পদ্ধতি। সাদৃশ্যানুমানের পদ্ধতিটি এরূপ ক এবং খ কে পারস্পারিকভাবে তুলনা করা হলো। দেখা গেল ক-এর ত,থ,দ,ধ নামক গুণ রয়েছে; খ-এরও থ,দ,ধ গুণ। ক-এর গুণের কিছু সংখ্যকের সঙ্গে খ-এর গুণের উক্ত সাদৃশ্যের ভিত্তিতে অনুমান করা চলে যে, খ-এর মধ্যে অপর অর্থ্যাৎ ‘ত’ গুণ গুণটিও থাকতে পারে।
সাদৃশ্যানুমানের এই গঠন থেকে বুঝা যায়, এরূপ সিদ্ধান্তে বৈজ্ঞানিক নিশ্চয়তা থাকে না। সিদ্ধান্তটি সঠিক হতে পারেও আবার না-ও হতে পারে, এরূপ একটা অনিশ্চিত অবস্থার অবকাশ এরূপ অনুমানের মধ্যে থেকে যায়। এ কারণে সাদৃশ্যানুমানকে সঠিক পর্যবেক্ষণ এবং বিশ্লেষণের ভিত্তিতে গৃহীত বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্ত হিসাবে গ্রহণ করা হয় না। কিন্তু সাদৃশ্যানুমানকে পুরোপুরি বাতিল করাও চলে না। মানুষের জ্ঞানের অনুন্নত পর্যায়ে সাদৃশ্যের ভিত্তিতে অনুমান একটি অপরিহার্য পদ্ধতি হিসাবে স্বীকৃত ছিল। এরূপ অনুমানের উপর নির্ভর করে প্রাথমিকভাবে গৃহীত সিদ্ধান্ত গবেষণার পরবর্তী পর্যায়ে অনেক ক্ষেত্রে সঠিক বলে প্রমাণিত হয়েছে। সুতরাং সাদৃশ্যানুমান জ্ঞানের প্রাথমিক সুত্র হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ।
একটি সাদৃশ্যানুমান কম-বেশি পরিমাণে নিশ্চিত হতে পারে। নিশ্চয়তার পরিমাণ নির্ভর করে উপমিত বস্তুদ্বয়ের পারস্পারিক সাদৃশ্যের সংখ্যা এবং চরিত্রের উপর। সিন্ধান্তের নিশ্চয়তা বৃদ্ধির জন্য লক্ষ্য রাখতে হবে যেন উপমিত বস্তদ্বয়ের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সাদৃশ্য থাকে; উভয়ের মধ্যে সাদৃশ্যের পরিমাণ বৈসাদৃশ্যের চেয়ে অধিক হয় উপমা দুইটি বস্তুর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে এবং একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
উপমা বা সাদৃশ্যের অসতর্ক ব্যবহার ভ্রান্তির সৃষ্টি করতে পারে। জননী এবং জন্মভূমির মধ্যে কিছু সাদৃশ্র আছে। ‘জননী সন্তানকে লালন পালন করে; জন্মভূমিও তার অধিবাসীর জীবনধারণের আবাস হিসাবে ব্যবহৃত হয়। সন্তান অসুস্থ হলে জননী তার শুশ্রুষা করে। সুতরাং জন্মভূমির অধিবাসী অসুস্থ হলে জন্মভূমিকে তার শুশ্রুষা করে হবে।’ এখানে জন্মভূমিকে জননীর সঙ্গে রূপকার্থে সদৃশ মনে করা হয়েছে। এরূপ সাদৃশ্যানুমান যথাযথভাবে সঠিক হতে পারে না।
সাদৃশ্যানুমানকে নিশ্চিত করার জন্য পরবর্তী পর্যায়ে উপযুক্ত গোবষণার ভিত্তিতে এর সত্যাসত্যতা পরীক্ষা করা আবশ্যক। নচেৎ, এরূপ অনুমান নিছক অপ্রমাণিত অনুমানেই সীমাবদ্ধ থাকে।
Analysis and Synthesis: বিশ্লেষণ এবং সংশ্লেষণ
উভয় শব্দ মানুষের মানসিক কিংবা দৈহিক একটি বিশেষ ক্রিয়ার কথা বুঝায়। বিশ্লেষণ বলতে একটি সমগ্রকে তার অন্তর্ভুক্ত অংশসমূহে বিভক্তকরণ এবং সংশ্লেষণ বলতে অংশসমূহের সম্মেলনের মাধ্যমে সমগ্র পুনর্গঠনকে বুঝায়। জ্ঞানের ক্ষেত্রে আদিকাল থেকে মানুষ এই পদ্ধতিকে ব্যবহার করে এসেছে। উভয় পদ্ধতি কোনো বিষয়ের যথার্থ জ্ঞান লাভের জন্য অপরিহার্য। বিশ্লেষণ পদ্ধতির মাধ্যমেই মানুষ এই সত্যে উপনীত হয়েছে যে,বস্তুজগতের কোনো বস্তুই একক নয়। এর প্রত্যকেটি এক একটি জটিল সত্তা। এ কারণে কোনো বস্তু বা সমস্যার যথার্থ জ্ঞান বিশ্লেষণ ব্যতিরেকে যথাযথভাবে লাভ করা চলে না। পরিপূর্ণ জ্ঞান লাভের জন্য বিশ্লেষণের পরিপূরক পদ্ধতি হচ্ছে সংশ্লেষণ। বিবেচ্য বিষয় বা বস্তুকে বিশ্লেষণ করে যেমন তার অন্তর্ভূক্ত অংশসমূহকে স্পষ্টতররূপে বুঝতে হবে, তেমনি অংশসমূহকে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত করে তাদের পারস্পারিক নির্ভরতার এ সম্পর্কের ভিত্তিতে মূল বস্তুটির সামগ্রিক রূপটিও উপলব্ধি করতে হবে। বিশ্লেষণ ব্যতীত সংশ্লেষণ সম্ভব নয়। আবার সংশ্লেষণ ব্যতীত বিশ্লেষণ সামগ্রিক জ্ঞানদানে অক্ষম। উভয় পদ্ধতি দ্বান্দ্বিকভাবে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ উক্ত পদ্ধতি দুইটির পারস্পারিক নির্ভরতার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে এই দর্শনের মতে ভাববাদী দর্শনে বিশ্লেষণ ও সংশ্লেষণের পারস্পারিক নির্ভরতাকে উপেক্ষা করা হয়। ভাববাদী দর্শনের বিশ্লেষণকে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ পদ্ধতি বলে মনে করা হয়।
আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশ্লেষণমূলক পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে। ভাষা, যুক্তি, রসায়ন বিজ্ঞান এবং মনোবিজ্ঞানে বিশ্লেষণমূলক পদ্ধতি প্রযুক্তি হচ্ছে। ইংরেজ দার্শনিক জি.ই. মূর এবং বার্ট্রাণ্ড রাসেল তাঁদের রচনাবলীতে বিশ্লেষণমূলক পদ্ধতির লজিকাল এ্যাটোমিজম বা ‘যৌক্তিক অণুবাদ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁর মতে কেবল পদার্থ নয়, বিশ্বের সামাজিক, মানবিক, রাষ্ট্রনৈতিক যে-কোনো অস্তিত্বই মৌলিক এবং জটিলতাহীন কতকগুলি সত্তা দ্বারা গঠিত। তাঁর মতে দার্শনিকের কর্তব্য হচ্ছে যা-কিছু জটিল তাকে বিশ্লেষণের মাধ্যমে তার অন্তর্ভূক্ত সহজ সত্তা প্রকাশ করা।
Anarchism: নৈরাজ্যবাদ, নৈরাষ্ট্রবাদ
রাষ্ট্রহীন সমাজ-ব্রবস্থার প্রচারক একটি সমাজ দর্শন। ইংরেজি এ্যানার্কিজম শব্দের মূল হচ্ছে গ্রিক ‘এ্যানার্কস’ শব্দ। সপ্তদশ শতকের গৃহযুদ্ধের সময়ে ইংল্যাণ্ডে শব্দটির ব্যবহর দেখা যায়। ‘লেভেলারপন্থীদের’ তখন নৈরাজ্যবাদী বলে আখ্যায়িত করা হতো। ফরাসি বিপ্লবে শব্দটিকে বিভিন্ন দলের মধ্যে পারস্পারিক আক্রমণের মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করা হয়। যে-কোনো দল তাদের চাইতে বিপ্লবাত্মক মতাদর্শের লোক এবং দলকেই নৈরাজ্যবাদী বলে অভিহিত করত। ফরাসি দার্শনিক প্রুধোঁর রচনার মধ্যেই নৈরাজ্যবাদী মতের সম্যক বিবরণ পাওয়া যায়। তিনি ১৯৪০ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘সম্পত্তি কি’ গ্রন্থে ‘নৈরাজ্যবাদ’ ব্যাখ্যা করেন। দাঁর মতে নৈরাজ্যবাদ যে-কোনো রাষ্ট্র-ব্যবস্থার বিরোধী। রাষ্ট্র-ব্যবস্থা হচ্ছে ব্যক্তির বিকাশের প্রতিবন্ধক। মানুষের জীবনে শৃঙ্খল বিশেষ। অত্যাচারের যন্ত্র। মানুষের সমাজে রাষ্ট্র নিষ্প্রয়োজন। পারস্পারিক ইচ্ছা এবং চুক্তির মাধ্যমে গঠিত অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংস্থা মানুষের জীবনকে পরিচালিত করবে; আইন. অস্ত্রপ্রয়োগকারী বাহিনী, শাসন, সংগঠন ইত্যাদি দ্বারা গঠিত রাষ্ট্র নয়।
এই তত্ত্বের পরিপূরক সিদ্ধান্ত হচ্ছে, সমস্ত রাষ্ট্রকাঠামোকে ধংস করে রাষ্ট্রহীন সমাজব্যবস্থা প্রবর্তন করা। এজন্য নৈরাজ্যবাদের সমর্থক কেউ কেউ বিপ্লবের কথা বলেছেন। কেউ বলেছেন বিপ্লব নয়, মানুষের সততার স্বাভাবিক বিজয়ের দ্বারা একদিন নৈরাষ্ট্রবাদ প্রতিষ্ঠিত হবে। আবার কেউ গুপ্তহত্যার মারফত ক্ষমতাসীনদের উট্ঠেদ করে উক্ত সমাজ-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার অভিমত পোষণ করেছেন। সাধারণত নৈরাজ্যবাদ বলেতে অরাজকতা বুঝায়। ব্যক্তিগত সন্ত্রাসমূলক কার্যকলাপও নৈরাজ্যবাদের সঙ্গে সংযুক্ত বলে মনে করা হয়। কিন্তু তত্ত্বগতভাবে নৈরাজ্যবাদের তথা নৈরাষ্ট্রবাদের সঙ্গে অরাজকতা বা সন্ত্রাসবাদের সম্পর্ক দেখা যায় না। নৈরাজ্যবাদ তত্ত্বের ইতিহাসে উক্ত মতের প্রখ্যাত ব্যাখ্যাতা এবং প্রবক্তা হিসাবে ইংল্যাণ্ডের উইলিয়াম গডুইন (১৭৫৬-১৮৩৬ খ্রি.), ফ্রান্সের পিয়ের যোশেফ প্রুধোঁ (১৮০৯-১৮৬৫ খ্রি.), রাশিয়ার মাইকেল বাকুনিন (১৮১৪-১৮৭৬ খ্রি.), প্রিন্স পিটার ক্রোপোটকিন (১৮৪২-১৯২১ খ্রি.) এবং রুশ লেখক কাউণ্ট লিও টলস্টয় (১৮২৮-১৯১০ খ্রি.)-এঁদের নাম পাওয়া যায়।
মার্কসবাদও পরিণামে রাষ্ট্রহীন সমাজব্যবস্থার আদর্শ পোষণ করে। কিন্তু নৈরাজ্যবাদের ব্যাখ্যার সঙ্গে মার্কসবাদ একমত নয়। মার্কসবাদ নৈরাজ্যবাদকে পাঁতিবুর্জোয়া অবাস্তব দর্শন বলে অবিহিত করে। মার্কসবাদের মতে নৈরাজ্যবাদ শোষণহীন সমাজের কথা বললেও সমাজের শোষণের উদ্ভব এবং শোষণের চরিত্র সম্পর্কে নৈরাজ্যবাদের কোনো বাস্তব এবং যথার্থ বিশ্লেষণ নাই। নৈরাজ্যবাদের অন্যতম সমর্থক মাইকেল বাকুনিন তাঁর মত প্রচারের জন্য সোশ্যাল ডেমোক্রাটদের আন্তার্জাতিক মৈত্রী নামক একটি সংঘের প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংঘ ১৮৬৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম আন্তর্জাতিক-এ যোগদান করে। কিন্তু সমাজের ব্যাখ্যা এবং সমাজ পরিবর্তনের পদ্ধতি নিয়ে মার্কসবাদীদের সঙ্গে বাকুনিনপন্থীদের বিরোধ দেখা দেয়। ফলে ১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম আন্তর্জাতিক ভেঙ্গে যায়।
Anaxagoras: এনাক্সাগরাস (৫০০-৪২৮ খ্রি.পূ.)
সক্রেটিসের র্পূববর্তী যুগের অন্যতম গ্রিক দার্শনিক। এই যুগের অপর গ্রিক দার্শনিকদের মধ্যে থেলিস, এনাক্সিমেনিস এবং এনাক্সিমেণ্ডারের নাম বিখ্যাত। আদি গ্রিক দার্শনিকদের বৈশিষ্ট্য ছিল জীবন এবং জগতের ব্যাখ্যায় বাস্তবতাবোধ। এনাক্সাগোরাসের দর্শনেও এই বৈশিষ্ট্যের পরিচয় পাওয়া যায়। তবে পরিপূর্ণ বস্তুবাদের বদলে তাঁর দর্শনে ভাববাদেরও প্রকাশ দেখা যায়।
এনাক্সাগোরাসের মতে বস্তুপুঞ্জ সংখ্যাহীন মূল বস্তুনিচয়ের দ্বারা গঠিত। বস্তু বা অস্তিত্বের অন্তর্ভূক্ত বস্তুনিচয়ের মধ্যে সাদৃশ্যের কোনো সম্পর্ক নেই। একটির সঙ্গে অপরটির কোনো মিল নেই। আদিতে সত্তা স্থির ছিল। সেই স্থির অস্তিত্বে ‘নাউসের’ অনুপ্রবেশে অস্থিরতা এবং আবর্তের সঞ্চার হয়। এই আবর্তের ফলেই বিশ্ব চরাচরে অসংখ্য অস্তিত্বের সৃষ্টি হয়েছ। এনাক্সাগোরাস যাকে ‘নাউস’ বলেছেন, তাকে মন বলা চলে।সক্রেটিসের পূর্বে সৃষ্টির মূলে মনের মৌলিক ভূমিকার কথা এনাক্সাগোরাসের ন্যায় অপর কেউ বলেন নি। নাউসের কারণেই এক বস্তু অপর বস্তু থেকে পৃথক হয়েছে। এবং বস্তুর প্রকারভেদ ঘটেছে। মন সমগ্র সত্তার সৃষ্টির কারণ হলেও মন কোনো অস্তিত্বের সঙ্গেই অভেদ আকারে সম্পৃক্ত নয়। এনাক্সাগোরাসের মতে আদি সত্তার মধ্যেও সংখ্যাহীন অস্তিত্ব রয়েছে। তার কারণ, কোনো অস্তিত্বই অনস্তিত্ব থেকে উদ্বূত হতে পারে না। সে জন্য প্রত্যেকটি উদ্ভূত অস্তিত্বই অপর অস্তিত্বই অপর অস্তিত্বের মধ্যে নিহিত। মাথার চুল নিশ্চয়ই যা চুল নয় তা থেকে উদ্ভূত হতে পারে না। সে অবস্থা থেকে চুলের উদ্ভব তার মধ্যে চুলের বৈশিষ্ট্য অবশ্যই নিহিত আছে।
এনাক্সাগোরাস মনে করতেন, পৃথিবী আকারে চেপ্টা এবং বায়ুর সমুদ্রে ভাসমান। চাঁদ আলো দেয় বটে-কিন্তু সে আলো সূর্য থেকে সে পায়। সূর্য, চন্দ্র, তারা এ সবগুলি উত্তপ্ত পাথর। কোনোটার আকার বড়, কোনোটার আকার ছোট। আমাদের চেতনার মূলে রয়েছে পরস্পরবিরোধী অবস্থার সম্পর্ক। কারণ একটি সদৃস অবস্থা আর একটি সদৃশ অবস্থাকে আলোড়িত করে তুলতে পারে না। আমরা যখন ঠাণ্ডা বোধ করি, তখন আমাদের শরীরের ভিতরের অবস্থা উঞ্চ এবং বাইরের অবস্থা ঠাণ্ডা বলেই আমরা শরীরের ভিতরে ঠাণ্ডা বোধ করি।
এনাক্সাগোরাসের দর্শনের উপরোক্ত সংক্ষিপ্ত বিবরণ থেকে বুঝা যায়, তিনি প্রধাণত বস্তুবাদী ছিলেন। প্রাকৃতিক জগতের ব্যাখ্যায় অতিপ্রাকৃতিক কোনো শক্তিরই তিনি উল্লেখ করেন নি। সৃষ্টির মূল শক্তি মনকেও এনাক্সাগোরাস সূক্ষ্ম এবং বিশুদ্ধ বলে কল্পনা করেছেন। ঐশ্বরিক অস্তিত্ব অস্বীকারের জন্য এনাক্সাগোরাসকে নাস্তিক বলে মনে করা হতো। তিনি দেবতাদের অস্তিত্ব স্বীকার করেন না-এই অভিযোগ এথেন্সের তৎকালীন সরকার এনাক্সাগোরাসকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করে। জীবন রক্ষার্থে এনাক্সাগোরাসকে এথেন্স থেকে পালায়ন করতে হয়। ‘প্রাকৃতিক জগৎ’ সম্পর্কে এনাক্সাগোরাসের যে পুস্তক রচনা করেন তার কিছু অংশ অবলুপ্তির হাত থেকে রেহাই পেয়ে পরবর্তী যুগের জ্ঞানান্বেষণে আলোকবর্তিকার কাজ করেছে। এনাক্সাগোরাস আইওনিয়া দ্বীপের ক্লাজোমিনীর অধিবাসী বলে পরিচিত। খ্রিষ্টপূর্ব ৪৬৪ সালে তিনি আইওনিয়া পরিত্যাগ করে এথেন্স আগমন করেন এবং দীর্ঘ ত্রিশবৎসর এথেন্সে জীবন-জগৎ-অঙ্কশাস্ত্র-জ্যোতির্বিজ্ঞান প্রভৃতি সম্পর্কে তাঁর অভিমতের ব্যাখ্যা করেন। পেরিক্লিস এবং ইউরিপাইডিস তাঁর নিকট শিক্ষা গ্রহণ করেন। অনেকে মনে করেন যে, দর্শন-গুরু সক্রেটিসও এক সময়ে এনাক্সাগোরাসের শিষ্য ছিলেন।
Anaximander: এনাক্সিোমণ্ডার (খ্রি. পূ. ৬১০-৫৪৬)
Anaximander: এনাক্সিমেণ্ডার (খ্রি.পূ. ৬১০-৫৪৬)
আদি গ্রিক দার্শনিক থেলিসের শিষ্য। এনাক্সিমেণ্ডারের দর্শন বস্তবাদী বৈশিষ্ট্যের জন্য বিখ্যাত। জীবন এবং জগৎ সম্পর্কে এনাক্সিমেণ্ডারের ব্যাখ্যা দ্বন্দ্বমূলক চরিত্রে বিশিষ্ট। বস্তুজগৎ এবং প্রাণীজগতের বিবর্তনমূলক ব্যাখ্যার আভাসও এনাক্সিমেণ্ডারের দর্শনে স্পষ্টরূপে পাওয়া যায়। গ্রিক ভূ-বিজ্ঞান এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানের আদি প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে এনাক্সিমেণ্ডার বিজ্ঞানের ইতিহাসে ষ্মরণীয় হয়ে আছেন। পৃথীবির প্রথম মানচিত্র, মহাকাশের তারকারাজির নকশা, সূর্যের দৈনিক ও বার্ষিক পরিক্রমা অনুধাবনের জন্য সূর্যঘড়ি আবিস্কার এবং পৃথিবীর গোলক তৈরির আদি কৃতিত্ব এনাক্সিমেণ্ডারের। মহাবিশ্বে পৃথিবী যে স্থির হয়ে আছে তার কারণ এই যে, মহাবিশ্ব একটা বৃত্তস্বরূপ। পৃথিবী হচ্ছে সেই বৃত্তের কেন্দ্র। বৃত্তের সর্ববিন্দ থেকে পৃথিবীর সমদূরত্বেই পৃথিবীর স্থির অবস্থাকে নিশ্চিত করেছে। থেলিসের শিষ্য হলেও পৃথিবী সম্পর্কে এনাক্সিমেণ্ডারের এই ব্যাখ্যা থেলিসের ব্যাখ্যা থেকে স্পষ্টত পৃথক। থেলিসের মতে পৃথিবী জলের সমৃদ্রে ভাসমান। প্রাকৃতিক জগতের বিকাশ সম্পর্কে এনাক্সিমেণ্ডারের অভিমতও সুনির্দিষ্টরূপে বৈজ্ঞানিক। পৌরাণিক কোনো কল্পনা কিংবা অতিপ্রাকৃতিক ঐশ্বরিক শক্তির আশ্রয় নিয়ে তিনি প্রাকৃতিক জগৎকে ব্যাখ্যা করতে চান নাই। এনাক্সিমেণ্ডারের মতে আপেরিয়ন বা অসীমতা থেকেই বিশ্বের শুরু। আপেরিয়ন বা সৃষ্টির মূলশক্তি তাপ এবং শৈত্যের সম্মেলন। আপেরিয়ন থেকে অগ্নির সৃষ্টি। আদি অগ্নি বায়মুণ্ডলকে পরিবেষ্টিত করলে তা থেকেই সৃষ্ট হয়েছে চন্দ্র, সূর্য এবং তারকারাজি। নিসর্গজগতের এই সৃষ্টিসমূহ এক একটি অগ্নির চক্র হয়ে মহাবিশ্বে নিয়ত ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং মাঝে মাঝে অগ্নির হল্কা ছুঁড়ে দিচ্ছে। আদিতে বিশ্ব কেবল বাষ্পময় ছিল। সমুদ্র বাষ্পেরই সৃষ্টি। আদি বাস্পের অবশিষ্ট অংশই বাতাস এবং শুষ্ক পৃতিবীর রূপ গ্রহণ করেছে। এভাবে বিশ্বের যা-কিছু সৃষ্টি, আকাশ, বাতাস, সমুদ্র, ভূখণ্ড সবই আদি শক্তি তাপ এবং শৈত্যের চিরন্তন সংঘর্ষ এবং বিচ্ছুরণের ফল। এনাক্সিমেণ্ডারের মতে আদিশক্তি তাপ এবং শৈত্যের সংঘর্ষকে স্বীকার করে নিলে বৃষ্টি, বিদ্যুৎ, বজ্র কোনো কিছুর সঠিক ব্যাখ্যা পেতে আমাদের অসুবিধা হবে না। জীবনের বিকাশও তাপ এবং শৈত্যের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে ঘটেছে। জীবনের আদি সৃষ্টি জলজ –প্রাণ হিসাবে ঘটে। পরবর্তী পর্যায়ে জীবন শুষ্ক ভূখণ্ডে আশ্রয় গ্রহণ করে। এনাক্সিমেণ্ডারের বিবর্তনবাদী এই মতে মানুষের রুপও আদিতে বর্তমানের ন্যায় ছিল না। বিশেষ করে মানব শিশু বর্তমানে যেরূপ দুর্বল প্রাণী তাতে প্রকৃতির আদি অবস্থায় বর্তমান রূপে সে নিশ্চয় রক্ষা পেতে পারত না। মানবশিশুর তুলনায় অপরাপর পশু শিশু অবস্থায় অনেক বেশি শক্তিশালী। সে কারণে অনুমান করতে হবে যে, মানুষ আদিতে অবশ্যই অপর কোনো প্রাণী থেকে উদ্ভূত হয়েছে। প্রাকৃতিক জগৎ সম্পর্কে এনাক্সিমেণ্ডারের গদ্যে লেখা গ্রন্থই আদি দার্শনিক গ্রন্থ হিসাবে স্বীকৃত।
Anaximenes: এনাক্সিমেনিস (৫৮৮-৫২৫ খ্রি. পূ.)
গ্রিক দর্শনের আদি যুগকে প্রাকৃতিক দর্শনের যুগ বলা হয়। বাস্তব জগতে মানুষ বাস করে। তার আকাশ, বাতাস, সমুদ্র, ঝড়-ঝঞ্বা নিয়ত মানুষের জীবনকে আঘাত করছে। তাকে অসহায় করে তুলছে। মানুষ জীবনের তাগিদেই প্রাকৃতিক শক্তির মোকাবেলা করে। ঝড় শুরু হলে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে। বন্যার পানি বাঁধ বেঁধে ঠেকাবার চেষ্টা করে। সমুদ্রের সীমানার সন্ধান করে। প্রকৃতিকে নিজের বাধ্য করতে না পারলে মানুষের রক্ষা নাই। প্রকৃতিকে বাধ্য করার জন্য আবশ্যক হচ্ছে প্রকৃতি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা। জগতের মূল কি? আলো, বাতাস, আর পানি? এরাই সৃষ্টির মূলে? এই জ্ঞান ব্যতিরেকে মানুষের পক্ষে প্রকৃতিকে বশ করা সম্ভব নয়। মানুষের সভ্যতা, ইতিহাস, দর্শন-সব কিছুর মূলে রয়েছে এই স্বাভাবিক প্রশ্ন। আদি গ্রিক দর্শনের খ্যাতি এই কারণে যে, আদি গ্রিক দর্শন মানুষের জীবনের সকল প্রশ্নের যথাসম্ভব জবাব দিয়ে মানুষকে জ্ঞানের শক্তিতে শক্তিশালী করার চেষ্টা করেছে। এই যুগের থেলিস, এনাক্সিমেণ্ডার এবং এনাক্সিমেনিসের নাম শুধু দর্শনে নয়, জ্ঞান-বিজ্ঞানের ইতিহাসে অবিষ্মরণীয় হয়ে রয়েছে।
সৃষ্টির মূল কি? এ প্রশ্নের জবাবে এনাক্সিমেনিস বলেছেন: বায়ু হচ্ছে বিশ্বের মূল শক্তি। বায়ুর শেষ নাই, সীমা নাই। বায়ু থেকেই সমস্ত অস্তিত্বের সৃষ্টি। ঈশ্বর আর দেবতা-তারাও বায়ুর প্রকাশ। বায়ুর চরিত্র হচ্ছে এই যে, বায়ু অস্থির। বায়ু সদাঘূর্ণ্যমান। আবর্তের মধ্যে বায়ুর রূপান্তর ঘটে। ঘূর্ণ্যমান বায়ু একদিকে যেমন গতির বেগে বাষ্পে পরিণত হে পারে, তেমনি অপরদিকে সে জমাট বাঁধা বায়ু আবহাওয়ার উৎপত্তি ঘটায়। আবহাওয়া থেকে সৃষ্টি হয় মেঘ। মেঘ থেকে সৃষ্টি হয় পানি। পানি জমাট বেঁধে হয় মাটির সৃষ্টি। মাটির মধ্যে তৈরি হয় প্রস্তর। এমনি করে পৃথিবীর সৃষ্টি।
মূলশক্তি বায়ুর সাথে এনাক্সিমেনিস বস্তুর তাপ এবং শৈত্যাবস্থার ভূমিকাকেও স্বীকার করেছেন। ঘূর্ণ্যমান বায়ুর কারণে যে অস্তিত্বের সৃষ্টি হচ্ছে তার মধ্য আছে তাপ এবং শৈত্য বায়ুর গুণবিশেষ।
আমাদের পৃথিবী হচ্ছে চেপ্টা। তার গভীরতা তেমন কিছু নাই। অন্তরীক্ষের নক্ষত্ররাজী অগ্নিপিণ্ড। এগুলি নিশ্চয় অন্তরীক্ষে আপন স্থানে কোনো কিছু দিয়ে আটকা আছে। সেই অবস্থায় আকাশের দৃশ্যমান অস্তিত্বগুলি পৃথিবীকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে। তারকারাজি অগ্নিগোলক। কেবল দূরত্বের কারণে তার তাপ আমাদের দগ্ধ করতে পারে না। দিনরাত্রির ভেদাভেদের কারণ নিশ্চয়ই এই যে, আবর্তিত হতে হতে চন্দ্র, সূর্য এবং নক্ষত্র পৃথিবীর সুউচ্চ পাহাড়-পর্বতের আড়ালে গেলে আমরা ওদের দেখতে পাই না। জমাট বায়ু থেকে যেমন মেঘের সৃষ্টি, তেমনি জমাট বায়ুর কারণেই বৃষ্টি, শিলাবর্ষণ এবং বিদ্যুৎ ও বজ্রের উৎপত্তি।
বিশ্বে যে একটা নিয়মের ব্যাপার চলেছে। তা এনাক্সিমেনিসের দৃষ্টি এড়ায় নি। কিন্তু নিয়মের কারণেই নিয়ম এরূপ তত্ত্বে পৌছার অবস্থা তখনো জ্ঞানান্বেষণের ক্ষেত্রে পৌঁছে নি। এনাক্সিমেনিস বললেন, কারণ বাদে কোনো কাজ হতে পারে না। নিয়মেরও নিশ্চয়ই কারণ আছে। আর সে কারণ হচ্ছে বায়ু। আমাদের আত্মা যেমন আমাদের দেহের সূত্রধর, তেমনি বায়ু সমস্ত বিশ্বকে ধারণ করে তার নিয়মের মূল বা সূত্র হিসাবে কাজ করেছে।
গ্রিকদর্শনের আদি যুগে বস্তুজগতের সৃষ্টি এবং সংগঠন সম্পর্কে যে অন্বেষা চলছিল, সে অন্বেষার ক্ষেত্রে এনাক্সিমেনিসের উপরোক্ত অভিমতসমূহের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। ‘ঘূর্ণ্যমান বায়ু পর্যায় বিশেষের সঙ্গে মিলিত হতে পারে, এবং নতুন অস্তিত্ব তৈরি করতে পারে’ এনাক্সিমেনিসের এই অভিমতের মধ্যে ‘সংখ্যা থেকে গুণে রূপান্তরের’ দ্বন্দ্বমূলক বৈজ্ঞানিক সত্যোপলব্ধির স্পষ্ট আভাস পাওয়া যায়।
Annexation: পররাজ্য গ্রাস
কোনো অঞ্চল কিংবা অপর কোনো রাষ্ট্র্রের কোনো অংশকে জোর দখল করাকে পররাজ্য গ্রাস বলে। এরূপ দখলের মাধ্যমে দখলকৃত অঞ্চলের সার্বভৌম কর্তৃত্ব দখলকারী রাষ্ট্র প্রয়োগ করে। অপর রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রাংশের উপর সার্বভৌম অধিকার প্রয়োগ পররাজ্যগ্রাসের একটি লক্ষণ হলেও জাতিসংঘের সনদ অনুযায়ী কোনো আশ্রিত বা অছিরাষ্ট্রকে এই পর্যায়ভুক্ত করা চলে না। অছিভুক্ত একটি রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতাও সাময়িককালের জন্য অপর রাষ্ট্রের হাতে দেওয়া যেতে পারে।
Animism: আত্মবাদ, সর্বপ্রাণবাদ
ল্যাটিন এ্যানিমা শব্দ থেকে ইংরেজি এ্যানিমিজম শব্দের উৎপত্তি। ‘এ্যানিমার’ অর্থ হচ্ছে আত্ম। আত্মার নিজস্ব থাকার অভিমতকে ‘আত্মাবাদ’ বলা চলে। এই অর্থে ‘আত্মাবাদ’ মানুষের প্রাচীনতম অভিমতগুলির অন্যতম। উৎপাদনের অনুন্নত এবং প্রাথমিক অবস্থায় মানুষ যখন প্রকৃতির নিকট অসহায় ছিল তখন বাঁচার প্রয়োজনে প্রাকৃতিক নানা রহস্যের সন্ধান পাবার সে চেষ্টা করেছে। সে দেহ কিছুকাল পূর্বেও সচল ছিল সে দেহ মৃত্যুর কারণে এখন নিশ্চল। তা হলে মৃত্যু কি? মানুষ ভেবেছে, মৃত্যু হচ্ছে দেহ থেকে আত্মার তিরোধান। আদিকাল থেকে কথাটা আজো আমাদের মধ্যে চলে আসছে। এখনো আমরা মৃত মানুষের আত্মার শান্তি কামনা করি। মানুষ নিদ্রা যায়। তখন আত্মা দেহে থাকে না। তাই মানুষের চেতনা থাকে না। কিন্তু আবার আত্মা দেহে প্রত্যাবর্তন করে। দেহে তাই চেতনার সঞ্চার হয়। মৃত্যুকালেও আত্মা দেহ ছেড়ে প্রস্থান করে। যে আত্মা আজ প্রস্থান করেছে, সে কাল হয়তো ফিরে আসবে। তাই প্রাচীনকালে মানুষ মৃতদেহ কবরে রেখে আসার সময়ে আত্মার জন্য প্রয়োজনীয় সুস্বাদু খাদ্যসামগ্রীও রেখে আসত । আত্মা যখন আবার ফিরবে তখন সে নিশ্চয়ই ক্ষুধার্ত থাকবে। ক্ষুধার্ত আত্মা যেন নিরন্ন, উপবাসী না থাকে, তাই এই ব্যবস্থা। আত্মা একবার প্রস্থান করলে সহজে আবার না-ও ফিরতে পারে। সে পথে-বিপথে ঘুরে বেড়াতে পারে। কিন্তু তাকে ফিরিয়ে আনার প্রয়োজন রয়েছে। তাই ভারত মহাসাগরে ‘বিপদ-দ্বীপে’র মানুষ এখনো বিভ্রান্ত আত্মাকে ধরার জন্য ফাঁদ ব্যবহার করতে দ্বিধা করে না। আত্মা যে-কোনো দেহ বা বস্তুতেই আশ্রয় নিতে পারে। যে- আত্মা মানুষের ছিল, সে-আত্মা স-জীব, যে-কোনো আধারে প্রবেশ করতে পারে। তাই ইট, পাথর, গাছ, লতা-পাতা, আকাশ, বাতাস, গ্রহ, নক্ষত্র সব কিছুরই আত্মা আছে। এ-কারণেই এ তত্ত্ব সর্বপ্রাণবাদ বলেও পরিচিত। জন্মান্তরবাদ তত্ত্বের মূলেও এই বিশ্বাস। আত্মার স্বাদীন অস্তিত্ব ধর্মীয় বিশ্বাসেরই অপরিহার্য অংশরূপে স্বীকৃত। এই বিশ্বাস থেকে দেবদূত, ভূত, প্রেত ইত্যাদি অস্তিত্বের কথাও মানুষ কল্পনা করেছে। অশান্ত, বিভ্রান্ত কিংবা দুষ্ট আত্মাকে জয় করার প্রয়োজনে মানুষের আদিম অবস্থায় তুক-তাক মন্ত্র বা জাদুবিদ্যার উদ্ভব হয়েছে। সর্বপ্রাণ এবং আত্মাবাদ মানুষের আদিম সংস্কৃতির অন্যতম নিদর্শন। ইংরেজ গ্রন্থাকার ই.বি টেইল তাঁর বিখ্যাত ‘প্রিমিটিভ কালচার’ পুস্তকে সর্বপ্রাণ এবং আত্মাবাদের বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
Anselm: এনসেলম (১০৩৩-১১০৯ খ্রি.)
ইংল্যাণ্ডের ধর্মতাত্ত্বিক এবং দার্শনিক। এনসেলম ধর্মের সঙ্গে যুক্তির মিলন ঘটাবার চেষ্টা করেন। তৎকালে অন্ধ ধর্মীয় বিশ্বাস এবং গোঁড়ামির যে প্রবল ধারা খ্রিষ্টিয় সমাজে প্রচলিত ছিল, এনসেলম তার মধ্যে যুক্তির ভূমিকা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। যুক্তি মাত্রই ধর্মীয় বিশ্বাসকে বিনষ্ট করে-প্রচলিত এই ধারণার তিনি বিরুদ্ধতা করেন।এনসেলম বলেন যে, যুক্তি বিশ্বাসকে বিনষ্ট করবে এমন কোনো কারণ নেই। যুক্তি ধর্মীয় বিশ্বাসকে দৃঢ়তর করতে পারে। এই তত্ত্বের ভিত্তিতে এনসেলম ঘোষণা করেন: ‘জ্ঞানের জন্যেই আমি বিশ্বাস করি।’ অন্ধবিশ্বাস জ্ঞানকে সাহায্য করে না। তাই অন্ধবিশ্বাস নয়, যুক্তির উপর ধর্মীয় বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এনসেলমের এই অভিমতের অনুসরণেই মধ্যযুগের ইউরোপে ধর্মের ক্ষেত্রেও যুক্তি-তর্ক প্রয়োগের একটি ঐতিহাসিক ধারার সূচনা হয়। এই ধারা স্কলাসটিসিজম নামে পরিচিত। এনসেলম বিধাতার অস্তিত্বের জন্য দার্শনিক প্রমাণ উপস্থিত করার চেষ্টা করেন। এই উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি দুখানি গ্রন্থ রচনা করেন। এর একখানি গ্রন্থে তিনি জাগতিক অস্তিত্বের ভিত্তিতে বিধাতার অস্তিত্বের প্রমাণ দেন। অপর গ্রন্থে বিধাতার গুণাবলীর আলোচনা করেন।
Antagonistic and Non-Antagonistic Contradiction: আপসহীন এবং আপসমুলক বিরোধ
সমাজের ক্রমবিকাশের ব্যাখ্যায় মাকর্সপন্থীগণ আপসহীন এবং আপসমূলক বিরোধ কথা দুটি ব্যবহার করেন। মাকর্সবাদ তথা দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের মতে বিরোধী শক্তির সংঘাতের মাধ্যমেই সমাজ বিকাশ লাভ করে, সমাজের এক স্তরের স্থানে নতুন স্তর প্রতিষ্ঠালাভ করে। বিরোধ হচ্ছে সমাজ বিকাশের প্রাণশক্তি। একেবারে বিরোধশূন্য কোনো জীবন বা সমাজের কল্পনা মার্কসবাদের মতে অবাস্তব কল্পনা। মাকর্সপন্থীগণ বিরোধকে প্রধানত দুই শ্রেণীতে বিভক্ত করেন। এক শ্রেণীর বিরোধকে তাঁরা বলেন, আপসহীন বিরোধ। অপর শ্রেণীকে তাঁরা আপসমূলক বিরোধ বলে আখ্যায়িত করেন। উৎপাদনের মারফতই মানুষ জীবন ধারণ করে। উৎপাদনের হাতিয়ার বা উপায়ের মালিকানার তারতম্যের ভিত্তিতে কোনো বিশেষ সমাজের অধিবাসীগণ বিভিন্ন আর্থিক শ্রেনীতে বিভক্ত হয়। কোনো বিশেষ যুগের উৎপাদনের হতিয়ার যাদের একচ্ছত্র মালিকানায় কবলিত হয়, তারা শোষক এবং শাষকে পরিণত হয় এবং সে যুগে যাদের হাতে উৎপাদনের উপায়গুলি থাকে না তারা শোষিত এবং নির্যাতিত শ্রেণীতে পরিণত হয়। ইতিহাসের প্রাথমিক যুগের পরে এই কারণেই সমাজে কোনো যুগে মানুষ প্রভু এবং দাসে বিভক্ত হয়েছে; কোনো যুগে ভূস্বামী এবং ভূমিদাসে এবং আর এক যুগে পুঁজিপতি এবং শ্রমিকে বিভক্ত হয়েছে। শ্রেণীতে শ্রেণীতে এরূপ বিরোধকে মাকর্সপন্থীগণ আপসহীন বিরোধ বলে বিবেচনা করেন। এরূপ বিরোধ আপসহীন এই কারণে যে, এদের উভয়ের স্বার্থ এরূপ পরস্পর-বিরোধী যে, এর কোনো শান্তিপূর্ণ সমাধান সম্ভব নয়। বিরোধের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে চরম অবস্থায় তীব্রতম সংঘর্ষে বা বিপ্লবের মাধ্যমে এর সমাধান ঘটে। অর্থ্যাৎ উৎপাদনের হাতিয়ারে নতুন মালিকানার প্রতিষ্ঠা ঘটে, পূর্বতন মালিকশ্রেণী ক্ষমতাচ্যুত হয় এবং ক্রমান্বয়ে সমাজের আর্থিক কাঠামো থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায়। এই নিয়মে বিপ্লবের মাধ্যমে দাস সমাজ সামন্ততান্ত্রিক সমাজে এবং সামন্ততান্ত্রিক সমাজ পুঁজিবাদী সমাজে রুপান্তরিত হয়েছে। আধুনিককালে পুঁজিবাদী সমাজ সমাজতান্ত্রিক সমাজ পুঁজিবাদী সমাজে রূপান্তরিত হয়েছে এবং হচ্ছে। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক সমাজেও উৎপাদনের হাতিয়ারের উপর মালিকানা নিয়ে শ্রেণী-বিভাগের সৃষ্টি হবে এবং আপসহীন বিরোধের অবকাশ থাকবে, মার্কসবাদীগণ এরূপ অভিমত পোষন করেন না। সমাজতন্ত্রবাদে উৎপাদনের হাতিয়ার নিয়ে অর্থ্যাৎ উৎপাদনের সম্পর্কের ক্ষেত্রে আপসহীন বিরোধের অবকাশ থাকে না। কিন্তু আপসমূলক বিরোধের অবকাশ সমাজতান্ত্রিক সমাজেও থাকবে। আপসমূলক বিরোধ বলতে তাঁরা পুরাতন ভাবধারার সাথে নতুন ভাবধারার বিরোধ, এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সত্ত্বেও আঞ্চলিক অসাম্যের বিরোধ, কায়িক এবং মানসিক শ্রমের মূল্য নির্ণয়ের বিরোধ, গ্রাম ও শহরের আপেক্ষিক বিরোধ-ইত্যাদির কথা বুঝান। এ সমস্ত বিরোধ সমাধানের জন্য চরম সংঘর্ষ কিংবা বিপ্লবের আবশ্যক হবে না। শ্রেণীগত আর্থিক শোষণের বিলোপের পরে প্রাকৃতিক শক্তিকে মানুষ যত অধিক পরিমাণে জয় করে মানুষের সার্বিক কল্যাণে নিয়োজিত করতে থাকবে, তত অধিক পরিমাণে আপসমূলক বিরোধগুলিরও সমাধান ঘটতে থাকবে। সমাজের অগ্রগতির সঙ্গে নতুনতর বিরোধের উদ্ভব ঘটবে কিন্তু সে বিরোধ আপসহীন নয়; সে বিরোধ আপসমূলক।
Anti-Duhring: এ্যাণ্টিডুরিং
দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ফ্রেডারিক এঙ্গেলস-এর একখানি গ্রন্থের প্রচলিত মান হচ্ছে ‘এ্যাণ্টিডুরিং’। আসলে এঙ্গেলস-এর গ্রন্থখানির মূল নাম হচ্ছে ‘হার ইউজেন ডুরিংস রিভোল্যুশন ইন সায়েন্স’ বা ‘হর ইউজেন ডুরিংকৃত বিজ্ঞানে বিপ্লব’। নামটির মধ্যে একটি ব্যঙ্গাত্মক সুর আছে। কারণ ডুরিং নামক সমকালীন এক লেখক মাকর্সবাদের ভূল ব্যাখ্যা দিচ্ছিলেন। তাঁর সেই ভূল ব্যাখ্যার সমালোচনা হিসাবে এঙ্গেলস ১৮৭৬ সালে ধারাবহিক প্রবন্ধ লিখতে শুরু করেন। এই সমস্ত সমালোচনামূলক প্রবন্ধের সংকলন উল্লিখিত নামে ১৮৭৮ সালে প্রকাশিত হয়। এ্যাণ্টিডুরিং-এর মধ্যে এঙ্গেলস মাকর্সবাদের তিনটি মুল দিকের ব্যাখ্যা উপস্থিত করেন ১. দ্বন্দ্বমূলক এবং ঐতিহাসিক বস্তুবাদ; ২. রাষ্ট্রনীতিক অর্থনীতি; ৩. বৈজ্ঞানিক সাম্যবাদের তত্ব। গ্রন্থের তিনটি ভাগে এই মূল বিষয়গুলির আলোচনা করা হয়। প্রথমভাগে এঙ্গেলস দ্বন্দ্বমূলক এবং ঐতিহাসিক বস্তুবাদের ব্যাখ্যা পেশ করেন। এই প্রসঙ্গে তিনি দর্শনের মূল প্রশ্ন কি, বস্তুজগতের মূল বিধান, জ্ঞানের সমস্যা, স্থানকালের বস্তবাদী ব্যাখ্যা এবং বস্তুর গতি সম্পর্কে আলোচনা করেন। প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের আলোচনায় এঙ্গেলস বিবর্তনের ডারউইনীয় তত্ত্ব, বিকাশে জৈবকোষের ভূমিকা, কাণ্টের বিশ্বতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ের উপর তাঁর অভিমত প্রকাশ করেন। এই অংশে এঙ্গেলস সামাজিক নীতি, সাম্য এবং ব্যক্তির কার্যে স্বাধীনতা এবং অনিবার্যতার প্রশ্নও আলোচনা করেন। গ্রন্থের দ্বিতীয়ভাগে এঙ্গেলস রাষ্ট্রনীতিক অর্থনীতির বিশ্লেষণকালে ডুরিং-এর তত্ত্বের সমালোচনা করেন। দ্রব্যমূল্য, উদ্বৃত্ত মূল্য, পুঁজি, জমির খাজনা প্রভৃতি অর্থনীতিক প্রশ্নে মাকর্সবাদের তত্ত্বগুলি এঙ্গেলস ব্যাখ্যা করেন। সমাজের বিকাশের মূল নিয়ামক কে? ব্যক্তি কিংবা রাষ্ট্রীয় শক্তি? না মানুষের অর্থনৈতিক সম্পর্ক? এই প্রশ্নে শক্তির তত্ত্বকে নাকচ করে অর্থনৈতিক সম্পর্কের নিয়ামক ভূমিকার কথা এঙ্গেলস ব্যাখ্যা করেন এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তি এবং অর্থনীতিক শ্রেণীর উদ্ভব এবং বিকাশকে প্রাঞ্জলভাবে তুলে ধরেন। গ্রন্থের তৃতীয়ভাগে এঙ্গেলস বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রকে ব্যাখ্যা করেন এবং কাল্পনিক সমাজতন্ত্রের সঙ্গে তার পার্থক্য নির্দিষ্ট করে দেন। সমাজতন্ত্রে এবং সাম্যবাদে দ্রব্যের উৎপাদন এবং বন্টন কি রূপ গ্রহণ করবে, পরিবারের কি রূপান্তর ঘটা সম্ভব, শিক্ষা-ব্যবস্থা কীভাবে পুনর্গঠিত হবে, শহর ও গ্রামের মধ্যকার বিরোধ কীভাবে বিলুপ্ত হবে, দৈহিক ও মানসিক পরিশ্রমের পার্থক্য কীভাবে নির্ধারিত হবে-সমাজতান্ত্রিক সমাজের ইত্যাকার সমস্যারও এঙ্গেলস আলোচনা করেন এবং তা সমাধানের সূত্র ব্যাখ্যা করেন। বস্তুত এ্যাণ্টিডুরিং মাকর্সবাদের একখানি মৌলিক গ্রন্থ। মাকর্সকাদের মূল প্রশ্নসমূহের প্রাঞ্জল আলোচনা গ্রন্থখানিকে জনপ্রিয় চিরায়িত সৃষ্টিতে পরিণত করেছে।
Anti-thesis: বিরোধ, প্রতিশক্তি
বস্তজগতে নিত্যপ্রবাহিত ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সম্পর্ক হচ্ছে প্রতিশক্তির দ্বন্দ্ব বা বিরোধে সম্পর্ক। বিরোধ হচ্ছে বস্তজগতের গতির মূল নিয়ামক। বিরোধ বা দ্বন্দ্বের মাধ্যমে বস্তজগতের বিকাশকে সাধারণত ইংরেজিতে থিসিস, এ্যাণ্টিথিসিস এবং সিনথেসিসরূপে প্রকাশ করা হয়। দ্বন্দ্বমান দুটি বস্তু বা অবস্থার একটিকে থিসিস এবং অপরটি এ্যাণ্টিথিসিস বলা হয়। থিসিস এবং এ্যাণ্টিথিসিসের দ্বন্দ্ব নিষ্ফলভাবে কার্যরত থাকে না। এই দ্বন্দ্ব কালক্রমে বস্তুর মধ্যে নতুন পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটায়। এই নতুন অবস্থাকে সিনথেসিস বলা হয়। সিনথেসিসও আবার স্থায়ীভাবে থিনথেসিস থাকে না। সিনথেসিসই কালক্রমে আবার থিসিস এবং এ্যাণ্টিথিসিসের উদ্ভব ঘটায়। সূত্রটি আমরা অস্তি, নাস্তি এবং সমন্বিত অস্তিত্ব বা সমন্বস্তি বলেও প্রকাশ করতে পারি। মানব সমাজের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিকাশের পর্যায়ক্রমিক ধারাকে মাকর্সবাদীগণ দ্বন্দ্বের এই সূত্র দ্বারা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন।
Anrithesis of Mental and Physical Labour: মানসিক ও দৈহিক শ্রমের বিরোধ
শ্রমের বিভাগ কথাটি আজ অত্যান্ত সুপরিচিত। শ্রমের ক্ষেত্রে মানসিক ও দৈহিক শ্রমের বিভাগটিও পরিচিত। কিন্তু সভ্যতার আদিতে শ্রমের কোনোরূপ বিভাগই ছিল না। অনুন্নত অবস্থায় জীবন রক্ষার্থে প্রত্যেক ব্যক্তিকে প্রয়োজনীয় সমস্ত শ্রমই করতে হতো। কিন্তু প্রকৃতিকে অধিকতর পরিমাণে বশ করার প্রয়োজনে মানুষ একদিন শ্রম বিভাগের আবশ্যকতা বোধ করল। দৈহিক শ্রমের ক্ষেত্রে অল্প শ্রম এবং অধিক শ্রমের কাজের পার্থক্য প্রথমে শুরু হয়। এই শ্রম বিভাগের উদ্ভব ঘটে দাস সমাজে। অর্থ্যাৎ এক মানুষ অপর মানুষকে শক্তির জোরে অধীনস্থ করে নিজের স্বার্থে খাটাবার কৌশল যেদিন আবিষ্কার করেছে, সেদিন থেকে প্রভু এবং দাসের শ্রমে পার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে। প্রভু-শ্রেণীর শ্রম তখন থেকে দৈহিক থেকে মস্তিষ্কের ব্যবহারজনিত শ্রমে রুপান্তরিত হতে থাকে। প্রয়োজনের তাগিদে যেমন এই শ্রমবিভাগের উৎপত্তি তেমনি সমাজের অর্থনৈতিক বিকাশ এবং প্রকৃতিকে জয় করার সংগ্রামে আদিতে এ বিভাগ প্রগতিশীল ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু পরবর্তীকালে শ্রমবিভাগ, বিশেষ করে মানসিক ও দৈহিক শ্রমের বিভাগ শ্রেণীগত এবং বংশগতভাবে অপরিবর্তনীয় হতে শুরু করায় শ্রমের বিভাগ মানুষের সামগ্রিক শক্তির বিকাশের সহায়ক না হয়ে তার প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াতে শুরু করে। একদিকে শ্রমবিভাগের আবশ্যকতা, অপরদিকে শ্রমবিভাগের অপরিবর্তনীয়তা সমাজের মধ্যে বিরোধের সৃষ্টি করেছে। এই বিরোধ শ্রেণীবিরোধে রূপান্তরিত হয়ে সামাজিক বিপ্লবের উৎস হিসাবে কাজ করেছে। দ্বন্দ্বমূলক বস্তবাদী দর্শন এরূপ অভিমত পোষণ করে যে, অর্থনৈতিকভাবে শ্রেণীহীন সমাজেই কেবল শ্রমবিভাগের অবাঞ্ছিত বিরোধাত্মক বৈশিষ্ট্য বিলুপ্ত হতে পারে। এরূপ সমাজে শ্রমবিভাগের দৈহিক ও মানসিক শ্রমের কোনো অপরিবর্তনীয় বিভাগ থাকবে না। এরূপ বিভাগ বংশগতও হবে না। সমাজের ব্যক্তিমাত্রই জ্ঞান-বিজ্ঞানের কলাকৌশলের এরূপ অধিকারী হবে না, কোনো শ্রেণী শুধুমাত্র দৈহিক শ্রমে এবং অপর কোনো শ্রেণী শুধুমাত্র মানসিক অর্থ্যাৎ মস্তিষ্কের শ্রমে নিয়োজিত থাকবে না। ফলে মানসিক শ্রম এবং তার পরিফল কোনো বিশেষ শ্রেণীরই করায়ত্ত থাকবে না।
Antinomy: বিরোধী সিদ্ধান্তের সমস্যা
একই যুক্তি থেকে পরস্পর-বিরোধী সিদ্ধান্তের উদ্ভব হলে সিদ্ধান্তের সমস্যার সৃষ্টি হয়। প্লেটো, এ্যারিস্টটল, জেনো প্রমুখ প্রাচীন গ্রিক দার্শনিকের রচনায় পরস্পর-বিরোধী সিদ্ধান্তমূলক দৃষ্টান্তের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। গতি এবং সংখ্যার যুক্তিতে যে পরস্পর-বিরোধীতার অবকাশ রয়েছে, দর্শিনিক জেনো তা দৃষ্টান্ত সহযোগে প্রমাণ করেন। গতি সম্পর্কে জেনোর দৃষ্টান্ত বিশেষ খ্যাতি লাভ করেছে। জেনো বলেন যে, একটি তীর গতিশীল বলার অর্থ তীরটির একটি নির্দিষ্ট মুহূর্তে একটি নির্দিষ্ট স্থানে থাকা এবং না থাকা। তীরটি যদি একটি নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান করে তবে উক্ত মুহূর্তে তীরটি গতিশীল নয়। অপরদিকে তীরটি যখন গতিময়, তখন কোনো বিশেষ মুহূর্তে কোনো বিশেষ স্থানে তার অবস্থান ঘটতে পারে না। কারণ অবস্থিতি মানে গতিশূন্যতা। ফলে অবস্থান হলে গতি থাকে না। আবার গতি থাকলে অবস্থান থাকে না। এ-যুক্তিতে দেখা যায় যে, তীরের গতি আছে বা গতিময় তীর-এর সত্যটি আমাদের পক্ষে প্রমাণ করা সম্ভব নয়। আধুনিক কালে কাণ্টের দর্শনে পরস্পর-বিরোধী সিদ্ধান্তমূলক সমস্যার বিশেষ উল্লেখ পাওয়া যায়। পরস্পর-বিরোধী সিদ্ধান্তের পদ্ধতি দ্বারা কাণ্ট তাঁর সত্তার অজ্ঞেয়তা প্রমাণ করার চেষ্টা করেন। কাণ্টের সত্তার অজ্ঞেয়তার মূল কথা হলো এই যে, মানুষের জ্ঞানের মাধ্যম হচ্ছে বুদ্ধি। কিন্তু ইন্দ্রিয়কে অতিক্রম করতে পারে না। অপরদিকে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অভিজ্ঞতাই সত্তা নয়। চরম সত্তা ইন্দ্রিয় অতিক্রান্ত অস্তিত্ব। ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে সেই চরমসত্তা বা বস্তুর বস্তৃত্ব অনুধাবন করার প্রচেষ্টায় বিশ্বজগৎ সসীম এবং অসীম, যা জটিল তা অ-জটিলের সংযোগ এবং কোনো কিছুই অ-জটিল নয়; বিশ্ব সংসারে মানুষ স্বাধীন; বিশ্বসংসারে মানুষ স্বাধীন নয় এবং বিশ্বের সৃষ্টির মূলে কারণ আছে; বিশ্বের সৃষ্টির মূলে কোনো কারণ নেই এরূপ পরস্পর-বিরোধী সিদ্ধান্তের উদ্ভব হয়। পরস্পর-বিরোধী সিদ্ধান্তের উপরোক্ত সমস্যায় যেটি লক্ষ রাখা আবশ্যক সে হচ্ছে এই যে, জ্ঞানের প্রক্রিয়ায় এরূপ সিদ্ধান্তের উদ্ভব কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। জ্ঞান মানুষের একটি গতিশীল প্রক্রিয়া। উক্ত প্রক্রিয়ায় এক সময়ে যা সত্য অপর সময়ে তা অসত্য হয়ে যেতে পারে। সত্য এবং অ-সত্যের দ্বন্দ্বের মাধ্যমেই জ্ঞান অগ্রসর হয়। মানুষ সসীম। আবার সেই সসীম মানুষের সিদ্ধান্ত হচ্ছে যে, বিশ্ব অসীম। এখানে আপাতদৃষ্টিতে একটি পরস্পর-বিরোধীতার উদ্ভব ঘটছে সসীম যদি অসীমকে জানতে না পারে তা হলে ‘বিশ্ব যে অসীম’ এ কথা সে জানল কি করে; আবার সে যদি জেনেই থাকে যে, বিশ্ব অসীম তা হলে সে জ্ঞাত বিশ্বকে আর অসীম বলা যায় কেমন করে? বস্তুত মানুষ যা জেনেছে তাই তার জ্ঞাত; যা সে জানে নাই তাই অজ্ঞাত এবং অসীম। কিন্তু যা অসীম তাকে মানুষ জ্ঞাত হয়ে যে অসীম বলছে একথা যেমন সত্য নয়, তেমনি যা জ্ঞাত তাতেই জ্ঞেয় জগতের শেষ নয়; জ্ঞাত-র বাইরে রয়েছে অজ্ঞাত অর্থ্যাৎ অসীম জ্ঞানের জগৎ। সে জগৎও মানুষ ক্রমান্বয়ে জ্ঞাত হবে। এ বিচারে জ্ঞানের জগৎ সসীম এবং অসীম, উভয় কথাই সত্য। এখানে পরস্পর-বিরোধীতার সমস্যা যথার্থ নয়, বাহ্য। দর্শনের ইতিহাসে এই পরস্পর-বিরোধী সিদ্ধান্তের দৃষ্টান্ত দ্বারা অজ্ঞেয়বাদকে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস বিভিন্ন যুগে দেখা গেছে। ভাববাদ যে এরূপ দৃষ্টান্ত দ্বারা চরম সত্তাকে জ্ঞানের বাইরে রাখার চেষ্টা করেছে, কাণ্টের মধ্যেই তার প্রকৃষ্টতম উদাহরণ মেলে।
Anti-Semitism: ইহুদি বিদ্বেষ
ইহুদি বিদ্বেষ প্রচণ্ডরূপ ধারণা করে হিটলারের নাজিদল শাষিত জার্মানিতে বিংশ শতকের তৃতীয় দশকে। নাজিগণ জার্মান দেশে শাসনের মূলনীতি হিসাবে আর্যজাতি তত্ত্বকে গ্রহণ করে। জার্মানগণ আর্য এবং জার্মানির অর্থনীতি শিক্ষা ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে প্রভাবশালী সম্প্রদায় ইহুদিগণ অনার্য এবং বিশুদ্ধ জার্মানদের চাইতে হীন-এই বিদ্বেষমূলক তত্ত্বের ভিত্তিতে নাজিসরকার ইহুদির বিরুদ্ধে নানা প্রকার আইন-কানুন প্রণয়ন করতে থাকে। প্রথম মহাযুদ্ধে জার্মানির পরাজয়ের মূলে ইহুদিরা, তারা জার্মানির অর্থনীতিক দুর্দশার কারণ, ইহুদিদের রক্ত অপবিত্র এই অভিযোগ তুলে হিটলারের সরকার জার্মানির ইহুদি সম্প্রদায়কে বিভিন্নভাবে নির্যাতন করতে শুরু করে। ক্রমান্বয়ে এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আশঙ্কা যত ঘনীভূত হতে থাকে তত ইহুদিদের বিরুদ্ধে নির্যাতন বৃদ্ধি পেতে থাকে। সমস্ত প্রকার নাগরিক অধিকার থেকে ইহুদি সম্প্রদায়ের লোকদের বঞ্চিত করা হয়। তাদের সঙ্গে খাস জার্মানদের বৈবাহিক সম্পর্ক নিষিদ্ধ করা হয়। ১৯৩৯ সালে হিটলার বিভিন্ন দেশ আক্রমণ করে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সূত্রপাত ঘটালে জার্মানির অভ্যন্তরে ইহুদি নির্যাতন চরম আকার গ্রহণ করে। সমস্ত ইহুদি সম্প্রদায়কে বলশেভিক বা সাম্যবাদের অনুচর আখ্যা দেওয়া হয় এবং নাজিরা ব্যাপকভাবে ইহুদিদের গ্রেপ্তার করে বন্দি নিবাসে প্রেরণ করতে থাকে এবং লক্ষ লক্ষ ইহুদিকে নির্বিচারে হত্যা করে। এরুপ পরিবেশে আইনস্টাইনের ন্যায় যে সমস্ত ইহুদি বুদ্ধিজীবি, বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক জার্মানি থেকে পালায়ন করে অন্যান্য দেশে আশ্রয় নিতে সক্ষম হন কেবল তাঁরা এই নিধনযজ্ঞ থেকে রেহাই পান।
Apartheid: পৃথগবাসন, বর্ণবৈষম্য
দক্ষিন আফ্রিকার নগন্য শ্বেতবর্ণের স্বৈরতান্ত্রিক শাষক দল কর্তৃক সংখ্যাগুরু এবং দক্ষিণ আফ্রিকার মূল কৃষ্ণবর্ণ অধিবাসীদের বিরুদ্ধে অনুসৃত প্রথগবাসনের এবং নিগ্রহের নীতি বর্ণবিদ্বেষ বলে পরিচিত। ইংরেজ ‘আপারথিড’ কথার উদ্ভব দক্ষিণ আফ্রিকায়। এর অর্থ জাতিগত পার্থক্যের ভিত্তিতে অধিবাসীদের পৃথক বাসের ব্যবস্থা করা। ইউরোপের শ্বেতবর্ণের সাম্রাজ্যবাদী শক্তি কর্তৃক আফ্রিকা মহাদেশ জোর করে দখলের সূচনায় অর্থ্যাৎ সপ্তদশ শতকের মধ্যভাগ থেকেই দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবৈষশ্যের নীতি গ্রহণ করা হয়। কিন্তু ১৯৪৮ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় ন্যাশনাল পার্টি নামক রাজনৈতিক দল ক্ষমতা গ্রহণ করার পর থেকে দক্ষিণ আফ্রিকার কৃষ্ণবর্ণ অধিবাসীদের বিরুদ্ধে নান প্রকার বৈষম্যমূলক বিধান প্রণয়ন করা হতে থাকে। এই সমস্ত আইন দ্বারা শেবতবর্ণের সরকার অশ্বেতকায়দের সব রকম রাজনীতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। তাদের যাতায়াতের অধিকার, জীবিকার্জনের স্বাধীনতা, ধর্মপালন এবং বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের ব্যক্তিগত স্বাধীনতাকে খর্ব করা হয়েছে। বাণ্টুস্থান নির্বিশেষে মানুষ সমান এবং সমান সুযোগের অধিকার একথা প্রচার করা কিংবা বিশ্বাস করা দক্ষিণ আফ্রিকাতে অপরাধ বলে বিবেচিত। ১৯৫২ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার অনুসৃত এই বর্ণবৈষম্যের নীতির উপর আলোচনা করা হয় এবং দক্ষিণ আফ্রিকার সরকারের বিরুদ্ধে নিন্দাজ্ঞাপক প্রস্তাব গ্রহণ করে সকল রাষ্ট্র যেন দক্ষিণ আফিকাকে আন্তর্জাতিকভাবে বর্জন করে এরূপ আহব্বানও গৃহীত হয়। কিন্তু এরূপ প্রস্তাবের কোনো বাস্তব কার্যকর ভূমিকা না থাকতে দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার তার নীতির কোনো পরিবর্তন করে নি। সাম্রাজ্যবাদী দেশসমূহ দক্ষিণ আফ্রিকার সরকারের সঙ্গে তাদের সম্পর্কও অব্যাহত রেখেছে। বর্ণ বৈষম্যের বিরুদ্ধে দক্ষিণ আফ্রিকার জনসাধারণ দীর্ঘকাল যাবৎ বিভিন্ন প্রকারে সংগ্রাম পরিচালনা করে আসছে। ১৯৮৫ সালে এ সংগ্রাম সাফল্যের এক ক্রান্তিলগ্নে এসে পৌছেছে, একথা বলা যায়। বর্ণবৈষম্য কেবল দক্ষিণ আফ্রিকাতেই অনুসৃত হচ্ছে না। ধনবাদী এবং সাম্রাজ্যবাদী দেশসমূহে বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবৈষম্যের আবহাওয়া বিশেষ প্রকট। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকার কেন্দ্রীয়ভাবে নিগ্রো অধিবাসীদের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক নীতি অনুসরণ না করলেও তার দক্ষিণাঞ্চলীয় অনেকে অঙ্গরাষ্ট্রে সরকারিভাবে নিগ্রোদের বিরুদ্ধে বাসস্থান, শিক্ষা ও জীবিকায় বৈষম্যমূলক নীতি অনুসরণ করা হয়। দক্ষিণ আফ্রিকার ক্ষেত্রে অবশেষে নব্বই দশকের গোড়ার দিকে শ্বেতবর্ণের শাসনকারী সরকার দক্ষিণ আফ্রিকার সকল নাগরিকের ভোটদানের এবং শাসন করার অধিকার স্বীকার করার ইচ্ছা প্রকাশ করায় দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবৈষম্যের অবসানের সম্ভাবনা দেখা দেয়।
Apriori and Apsteriori: অভিজ্ঞতা-পূর্ব এবং অভিজ্ঞতালব্ধ
ভাববাদী দর্শনের দুটি বহুল ব্যবহৃত শব্দ। জ্ঞানের ক্ষেত্রে কোনো জ্ঞান যথার্থ এবং কোনো জ্ঞান যথার্থ নয়-এই প্রশ্নে প্রাচীনকাল থেকেই শব্দের ব্যবহার পাওয়া যায়। প্লেটো, বার্কলে, কাণ্ট প্রমুখ প্রখ্যাত ভাববাদী দার্শনিকের মতে জ্ঞান হচ্ছে দুরকম: অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা উধ্ব বা অভিজ্ঞতা-পূর্ব জ্ঞান। কিন্তু ইন্দ্রীয়ের শক্তি সীমাবদ্ধ বলে ইন্দ্রীয়লব্ধ জ্ঞান চরম সত্যের জ্ঞানদানে সক্ষম নয়। সঠিক জ্ঞান, অভিজ্ঞতা-পূর্ব জ্ঞান, অর্থ্যাৎ সঠিক জ্ঞান ইন্দীয়ের মাধ্যমে অর্জিত হয় না। ফরাসি দার্শনিক দেকার্ত মনে করতেন মানুষের নিজের অস্তিত্ববোধ অভিজ্ঞতা-উধ্বজ্ঞান। যেমনি অঙ্গশাস্ত্রের সিদ্ধান্ত কিংবা কোনো কিছু একই সঙ্গে সত্য এবং মিথ্যা হতে পারে না, এরূপ যৌক্তিক সিদ্ধান্তও অভিজ্ঞতালব্ধ নয়- এরা অভিজ্ঞতাঊর্ধ্ব। কাণ্ট ‘নিজ সত্তার বস্ত’ বা ‘থিং ইন ইটসেলফ’কে অজ্ঞেয় রাখার জন্য অভিজ্ঞতালব্ধ এবং অভিজ্ঞতাঊর্ধ্ব কথাকে ব্যবহার করেছেন। তাঁর মতে ইন্দ্রীয়ের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞান সত্তার দৃষ্ট প্রকাশের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ। এরূপ জ্ঞান সত্তার ‘নিজ সত্তার অবস্থিত বস্তুর’ যথার্থ জ্ঞান নয়। কিন্তু নিজ সত্তায় অবস্থিত বস্তুই হচ্ছে চরম সত্তা। এই চরম সত্তার জ্ঞান অভিজ্ঞতার বাইরে কেবল অনুভূতির মাধ্যমেই লাভ করা সম্ভব। কাণ্টের মতে, স্থান, কাল, কার্যকারণ, সম্পর্ক ইত্যাদি জ্ঞানসুত্রগুলি মানুষের অভিজ্ঞতাঊর্ধ্ব বোধ, অভিজ্ঞতালব্ধ নয়। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদী দর্শন জ্ঞানকে অভিজ্ঞতালব্ধ এবং অভিজ্ঞতা-পূর্ব বলে পরস্পর-বিরোধী মাধ্যমে বিভক্ত করার বিরোধী। এই দর্শনের মতে জ্ঞানের একমাত্র মাধ্যম, ‘অভিজ্ঞতা-পূর্ব’ বলে জ্ঞানের কোনো মাধ্যম নেই।
Aristotle: এ্যারিস্টটল (৩৮৪-৩২২ খ্রি. পূ.)
পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিকরূপে ইতিহাসে পরিচিত। গ্রিক সম্রাট আকেজাণ্ডেরর কিশোর বয়সে এ্যারিস্টটল তাঁর শিক্ষক ছিলেন। জগৎ এবং জীবন সম্পর্কে মানুষের জ্ঞানের ক্ষেত্রে এ্যারিস্টটলের অবদান অতুলনীয়। প্রাচীন গ্রিক দর্শন এ্যারিস্টটলের হাতে চরম উৎকর্ষ লাভ করে। নিজের শিক্ষা জীবনে এ্যারিস্টটল প্লেটোর শিষ্য ছিলেন। কিন্তু প্লেটোর জীবিতকালেই এ্যারিস্টটল দর্শনের গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে প্লেটো থেকে ভিন্নতর অভিমত পোষণ করতে শুরু করেন। কিন্তু প্লেটোর জীবনকালে দুজনার মধ্যে কোনো বিচ্ছেদ ঘটে নি। এতে উভয়ের মধ্যে পারস্পারিক শ্রদ্ধা এবং স্বীকৃতির পরিচয় পাওয়া যায়। প্লেটোর মৃত্যুর পরে (৩৪৭ খ্রি. পূ.) এ্যারিস্টটল প্লেটোর একাডেমী পরিত্যাগ করে স্বাধীনভাবে লাইসিয়াম-এ শিক্ষাদান শুরু করেন। এ্যারিস্টটল জন্মগ্রহণ করেন মেসিডোনিয়ায় একটি নগরে। মেসিডোনিয়া এবং মেসিডোনিয়ার সম্রাট ফিলিপ ও আলেকজাণ্ডারের সঙ্গে সম্পর্কের কারণে এথেন্স নগরীতে তাঁকে পরবর্তী জীবনে বিরুদ্ধতার সন্মুখীন হতে হয়। কিন্তু মেসোডোনিয়ার সাম্রাজ্য বিস্তারকেও এ্যারিস্টটল সমর্থন করেন নি। মানসিকভাবে তিনি গ্রিসের দাস প্রধান নগর-গনতন্ত্রের সমর্থক ছিলেন। দাস এবং প্রভুর শ্রেণীভেদ জন্মগত বলেই তিনি মনে করতেন। কিন্তু তিনি স্বৈরতন্ত্রকে সমর্থন করেন নি। যুগের পরিপ্রেক্ষিতে এ্যারিস্টটলের চিন্তার ক্ষমতা এবং ব্যাপকতা যেরূপ বিষ্ময়কর ছিল, তেমনি তাঁর চিন্তাধারায় দাস-প্রধান গ্রিক সমাজের সীমাবদ্ধতার পরিচয়ও দুর্লভ নয়। জীবন ও জগতের এমন কোনো দিক ছিল না, যেদিকে এ্যারিস্টটল তাঁর গবেষণার দৃষ্টিকে প্রসারিত করেন নি। এ কারণে এ্যারিস্টটলকে জ্ঞানসমুদ্র বলে ষ্মরণ করা হয়।
এ্যারিস্টটলের দর্শন এবং চিন্তাধারার বৈশিষ্ট্য এই যে, প্রকৃতিক রহস্য ভেদে তাঁর অভিমত প্রধানত বস্তুজগৎ এবং বস্তুজগৎ সম্পর্কে বাস্তব জ্ঞানের উপর প্রতিষ্ঠিত। নিছক কল্পনার উপর নয়। কিন্তু প্লেটোর ভাববাদী প্রভাব তিনি সম্পূর্ণরূপে অতিক্রম করতে সক্ষম হন নি। এ কারণে এ্যারিস্টটলের দর্শনে বস্তুবাদ এবং ভাববাদের মিশ্রণ দেখা যায়।
এ্যারিস্টটলের মতে বস্তুমাত্রেরই তিনটি রূপ আছে। বস্তুত্ব, আকার, গতি বা লক্ষ্য। বস্তুর বস্তুত্ব একদিকে অনড়, গতিহীন; কিন্তু অপর দিকে বস্তুর বস্তুত্বের মধ্যে বস্তুত্ব আকার, গতি এবং লক্ষ্যও নিহিত বা সুপ্ত। যা বস্তুর আকার তা বস্তুর অন্তনির্হিত বা সুপ্ত শক্তিরই প্রকাশ। কিন্তু সে জন্য বস্তুর আকার এবং বস্তুর বস্তুত্ব এক নয়। আকার বস্তু থেকে পৃথক। আকার ব্যতীত বস্তু কল্পনা করা যায় না। আকারই বস্তুকে উপলব্ধির যোগ্য করে। এ কারণে আকার অবশ্যই অধিকতর সত্য এবং চিরন্তন। বস্তুর পরিবর্তন কিংবা ক্ষয় আছে। কিন্তু আকারের পরিবর্তন বা ক্ষয় নাই। আকার অনুযায়ী বস্তুকে আমরা উপলব্ধি করি, বস্তু অনুযায়ী আকারকে নয়। আকারের এইরূপ ব্যাখ্যায় এ্যারিস্টটলীয় দর্শনের ভাববাদী বৈশিষ্ট্যটি প্রকট হয়ে দেখা দেয়। আকার থেকে এ্যারিস্টটল সমগ্র সৃষ্টির মূল শক্তি হিসাবে অতিপ্রাকৃতিক ঈশ্বরের সিদ্ধান্তও গ্রহণ করেছিলেন। ঈশ্বর হচ্ছে সমস্ত অস্তিত্বের গতির উৎস। কিন্তু ঈশ্বরের নিজের কোনো গতি নেই। এ্যারিস্টটলের দার্শনিক ব্যাখ্যায় সব সময় ঐক্য এবং পারস্পর্যের সাক্ষাৎ মেলে না। বস্তু থেকে আকারকে পৃথক ভাবলেও এ্যারিস্টটল অন্যত্র প্লেটোকে এই কারণে তীব্র সমালোচনা করেছেন যে, প্লেটো সাধারণ ভাবকে (মনুষ্যত্ব, পশুত্ব ইত্যাদি) বিশেষ বস্তু থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করেছেন। প্লেটোর সমালোচনা হিসাবে এক্ষেত্রে এ্যারিস্টটল এরূপ অভিমত পোষণ করেন যে, বিশেষ থেকে সাধারণ ভাবকে আদৌ পৃথক করা যায় না। বিশেষের মাধ্যমেই কেবল সাধারণ বা ‘নির্বিশেষ’ ভাবকে অনুধাবন করা চলে। প্লেটোর দর্শনের ক্ষেত্রে এ্যারিস্টটলের এই সমালোচনা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। বস্তুত এ্যারিস্টটলের উপরোক্ত সমালোচনা ভাববাদের একটি মৌলিক সমালোচনা। এই সমালোচনার ভিত্তিতে পরবর্তী বস্তুবাদী দর্শন বিকাশ লাভ করে।
দেহের গবেষণা অর্থ্যাৎ চিকিৎশাস্ত্রেও এ্যারিস্টটলের অবদান ষ্মরণীয়। তিনি দেহের প্রথম রোগ নিরাময়ের জন্য অস্ত্রোপচার এবং দেহ ব্যবচ্ছেদের পদ্ধতি প্রয়োগ করেন। এ্যারিস্টটলের পিতা নিজে চিকিৎসাবিদ ছিলেন। এ্যারিস্টটলের শিশুকালে তিনি মারা গেলেও চিকিৎসা-বিজ্ঞানে গবেষণার পারিবারিক ঐতিহ্য হয়তো এ্যারিস্টটলকে প্রভাবান্বিত করেছিল।
এ্যারিস্টটল যুক্তিশাস্ত্রের পিতা বলে স্বীকৃত। মানুষের চিন্তা ও তার প্রকাশকে বিশ্লেষণ করে সুশৃঙ্খলভাবে তার প্রকার নির্ধারণ ইউরোপীয় দর্শনের ক্ষেত্রে এ্যারিস্টটলই সর্বপ্রথম করেন। যুক্তির মৌলিক বিধানগুলি তিনি লিপিবদ্ধ করেন। এই বিধানগুলি প্রায় অপরিবর্তিতভাবে আজও যুক্তিশাস্ত্রে গৃহীত এবং আলোচিত হচ্ছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পর্যবেক্ষণ এবং তুলনামূলক আলোচনার শুরুও এ্যারিস্টটলে।
সত্তা, গুণ, পরিমাণ বা সংখ্যা, সম্পর্ক, স্থান কাল, অবস্থান, করণ, অধিকরণ ইত্যাদি জ্ঞানসুত্রগুলির গভীর দার্শনিক ব্যাখ্যা এ্যারিস্টটল করেছিলেন। তাঁর সমস্ত সূত্রের অনেকগুলি জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আজও প্রযুক্ত হচ্ছে। এ্যারিস্টটলের সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান হচ্ছে, তাঁর সময় পর্যন্ত বিকশিত জ্ঞান-বিজ্ঞানের সমস্ত ক্ষেত্রকে তিনি সুসংবদ্ধ আকারে লিপিবদ্ধ করার চেষ্টা করেন। এ্যারিস্টটল থেকেই যে-কোনো সমস্যার সুসংবদ্ধ বৈজ্ঞানিক গবেষণার সূত্রপাত হয়েছে, একথা অবিসংবাদীরূপে সত্য।
এ্যারিস্টটলের দর্শনের বস্তুবাদী এবং বৈজ্ঞানিক বৈশিষ্ট্য মধ্যযুগের অন্ধকার ভেদ করে নতুন বৈজ্ঞানিক গবেষণার সূচনায় এক বিরাট শক্তিশালী অস্ত্র হিসাবে কাজ করেছে। মুসলিম সভ্যতার আমলেও এ্যারিস্টটলের দর্শনই মুসলিম চিন্তাবিদদের ব্যাখ্যায় কেন্দ্র হিসাবে কাজ করেছে। এ্যারিস্টটলের তত্ত্বসমূহের বিরুদ্ধবাদী বা সমর্থনকারী সমালোচনাই মুসলিম চিন্তাবিদদের আলোচনাকে ধর্মবিশ্বাসাতিরিক্ত দার্শনিক আলোচনার গুণে গুনান্বিত করেছিল। মুসলিম দার্শনিকদের নিকট থেকে ইউরোপ এ্যারিস্টটলের পরিচয় লাভ করে। মধ্যযুগে ইউরোপের গোঁড়া ধর্মবিশ্বাস এ্যারিস্টটলের দর্শনের ভাববাদী তত্ত্বকে ধর্মতত্ত্বের পরিপোষক হিসাবে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছে। এর ভিত্তিতেই মধ্যযুগীয় স্কলাসটিসিজম বা যুক্তিবাদী ধর্মতত্ত্বের প্রতিষ্ঠা হয়।
মার্কসবাদী দর্শনের অন্যতম প্রবক্তা ফ্রেডারিক এঙ্গেলস এ্যারিস্টটলকে প্রাচীন জ্ঞান দর্শনের শীর্ষমণি বলে আখ্যাত করেছেন।
Associationist Psychology: অনুষঙ্গী মনোবিজ্ঞান
কোনো কিছু আমাদের ষ্মরণে জাগরিত হওয়ার কারণ কি? ‘ক’ বললেই অর্থ্যাৎ ‘ক’ ষ্মরণ করলে সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ‘খ’ ষ্মরণে এসে যায়, খ বললে গ। কিন্তু এর কারণ কি? এর সাধারণ উত্তর দিই আমরা এভাবে যে, শিশু বয়সে বারংবার একটা ধারাক্রমে উচ্চারণ করে আমরা এদের মুখস্থ করেছি। মুখস্থ করেছি একথা সত্য, কিন্তু মুখস্থ করায় আমাদের মনে কিংবা মস্তিষ্কে এ ব্যাপারে কি পরিবর্তন ঘটেছে যাতে ‘ক’ মনে করলেই ‘খ’ ও উদিত হয়? আমার মায়ের কথা মনে হলেও বাড়ির ছবি আমার মনে জাগরিত হয়? দর্শন এবং মনোবিজ্ঞানে এটি বেশ পুরাতন প্রশ্ন। ষ্মরণশক্তির বা ষ্মরণে পড়ার বিভিন্ন প্রকার ব্যাখ্যা বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন দার্শনিক এবং মনোবিজ্ঞানী দিয়েছেন। এঁদের একটি ব্যাখ্যা হচ্ছে এই যে, একটি স্টিমুলাস বা উদ্দীপক অপর একটি উদ্দীপকের নৈকট্য এবং পৌনঃপুনিকতার কারণে আমাদের মন বা মস্তিষ্কের কোষে পরস্পর সম্পর্কিত প্রতিছাপের সৃষ্টি করে। ফলে কিছুকালের ব্যবধানেও পরস্পর সম্পর্কিত উদ্দীপকগুলির প্রতিছাপের কোনো একটি ক্রিয়াশীল হলেও অপরগুলিও ক্রিয়াশীল হয়ে উঠে। ইংরেজীতে একেই এ্যাসোসিয়েশন নামে অভিহিত করা হয়। এই ব্যাখ্যার ভিত্তিতেই এ্যাসোসিয়েশনিস্ট সাইকোলজি বা অনুষঙ্গী মনোবিজ্ঞানের সৃষ্টি হয়েছে। মনের ক্রিয়াকালাপের অনুসঙ্গী ব্যাখ্যা মনোবিজ্ঞানের আধুনিক বিকাশের পূর্বে হবস, লক এবং ষ্পিনোজার দর্শনের মধ্যে পাওয়া যায়। পরবর্তীকালে এই ব্যাখ্যায় ভিত্তিতে মনোবিজ্ঞানে একটি বস্তুবাদী ধারা বিকাশ লাভ করে। এই ধারাটি বিংশ শতাব্দীতে ব্যবহারবাদ বা বিহেভিয়রিজম তত্ত্বের রূপ গ্রহণ করেছে।
Attention: মনোযোগ, মনোদৃষ্টি
একটি মুহূর্তে কোনো কিছুর উপর মন কিংবা মস্তিষ্কের ক্রিয়াশীল হওয়াকে মনোযোগ বা মনোদৃষ্টি বলা হয়। মনোযোগ দুরকমের হতে পারে ইচ্ছাকৃত মনোযোগ এবং অনিচ্ছাকৃত মনোযোগ। ইচ্ছাকৃত মনোযোগের ক্ষেত্রে মন আন্তরিক কোনো উদ্দীপক বা স্টিমুলাসের কারণে একটি বিষয়ের উপর দৃষ্টি নিবেশ করতে পারে। অর্থ্যাৎ একটি বিষয় সচেতন মনের বিবেচনার সীমার মধ্যে আসতে পারে। অনিচ্ছাকৃত মনোযোগের ক্ষেত্রে কোনো উদ্দীপক তার অস্বাভাবিকতা বা বৈপরিত্য কিংবা নতুনত্ব দ্বারা ইন্দ্রীয়গুলির উপর এরূপ আঘাত হানতে পারে-যাতে মনের দৃষ্টি উদ্দীপকের উপর পড়তে বাধ্য হয়। যেমন, সাধারণভাবে যে-শব্দের মধ্যে আমি কোনো একটা মহূর্তে অবস্থান করছি, সে মহূর্তে একটি বিকট শব্দ হলে শব্দের অস্বাভাবিকতাই আমার মনকে আকৃষ্ট করবে। বলা চলে, মন বাধ্যতামূলক এই উদ্দীপকের দিকে আকৃষ্ট হবে। অসংখ্য উদ্দীপক দ্বারা আমরা সর্বদা পরিবেষ্টিত। মনুষ্যেতর প্রাণী উদ্দীপক মাত্রতেই ক্রিয়াশীল হয়ে উঠে। কেবলমাত্র মানুষই নিজের স্বার্থের বিবেচনায় অসংখ্য উদ্দীপকের কোনো একটিকে বাছাই করে তাকে তার উপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। যখন আমার উদ্দেশ্য হয় আমার গ্রন্থের একটি কঠিন দার্শনিক কথার অর্থ উদ্ধার করা, তখন শব্দ তরঙ্গের যথেষ্ট পরিমাণ হ্রাস-বৃদ্ধিও আমার মনকে আকৃষ্ট না করতে পারে। ইচ্ছানুযায়ী মনোযোগ দানের ক্ষমতাকেই মনোবিজ্ঞানে ইচ্ছাকৃত মনোযোগ বলা হয়। মানুষের মন আদিতে অন্যান্য প্রাণীর মতোই উদ্দীপক মাত্ররেই দাস ছিল। যে-কোনো উদ্দীপক যখন তখন তার মনকে আকৃষ্ট করতে পারত। শত শত বছরের শ্রমের অভিজ্ঞতা এবং জীবনের তাগিদে উদ্দীপকের দাস হওয়ার চেয়ে উদ্দীপককে দাস করার ইচ্ছায় মানুষ ইচ্ছামূলক মনোযোগের ক্ষমতা নিজের মধ্যে অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। মানুষের মন এবং মস্তিষ্কের ক্ষমতা আজ যেমন, তার শৈশবেও তেমন ছিল, এমন কথা ভাবা ঠিক নয়।
August Movement: আগষ্ট আন্দোলন
১৯৪২ সালের আগষ্ট মাসে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ভারতের স্বাধীনতার জন্য ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন আরম্ভ করে তা আগষ্ট আন্দোলন নামে পরিচিত।
এই শতাব্দীর বিশের দশক থেকে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের দাবি প্রবর হতে শুরু করে। বিশের এবং ত্রিশের দশকে বিভিন্ন প্রকার আইন অমান্য আন্দোলনের মধ্যে এবং তার চেয়েও জঙ্গী শ্রমিক-কৃষকদের জীবিকার সংঘবদ্ধ আন্দোলন এবং মধ্যবিত্তের সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রমে এই স্বাধীনতার দাবির তীব্রতা প্রকাশ পেতে থাকে। কিন্তু একদিকে ব্রিটিশ সরকারের দমননীতি এবং অপরদিকে ভারতের প্রধান রাজনীতিক দল কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের অনৈক্যের কারণে ভারতে স্বাধীনতার আন্দোলন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হওয়া পর্যন্ত সফলতা অর্জন করতে পারে নি। ১৯৩৯ সালে ইউরোপে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। ক্রমান্বয়ে এই যুদ্ধ এশিয়াতে বিস্তারিত হয়। জাপান অক্ষশক্তি, অর্থ্যাৎ জার্মানি ও ইতালির পক্ষে যুদ্ধে যোগদান করে। মিত্রপক্ষের প্রধান শক্তি ছিল সোভিয়েত রাশিয়া, ব্রিটেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। পরাধীন ভারতও ব্রিটিশ সরকারের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে এই যুদ্ধে জড়িত হয়ে পড়ে। ১৯৪২-এ এশিয়াতে যুদ্ধের সীমানা ব্রহ্মদেশে অতিক্রম করে বাংলার নিকটে এসে পড়ে। ব্রহ্মদেশও তখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীন। ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনী ব্রহ্মদেশ পরিত্যাগ করে পশ্চাদপসরণ করতে থাকে। জাপান কলকাতা নগরী ও চট্রগ্রামের উপর বিমান থেকে বোমা বর্ষণ করে। ব্রিটিশ সরকার তখন একটা সামরিক বিপর্যয়ের সষ্মুখীন। ব্রিটিশ সরকারের এই সঙ্কটকে স্বাধীনতা লাভের উত্তম সময় বিবেচনা করে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ব্রিটিশ সরকারের নিকট ৪২-এর আগস্ট মাসে একটি প্রস্তাব মারফত কতগুলি দাবি উত্থাপন করে। ভারতীয় জাতীয় কমিটির ওয়ার্কিং কংগ্রেসের এই প্রস্তাব আগস্ট প্রস্তাব নামে পরিচিত। প্রস্তাবটির এক অংশে সরকারের নিকট অবিলম্বে ভারতের স্বাধীনতা প্রদানের দাবি করা হয়েছিল। তাতে বলা হয়েছিল, মিত্রপক্ষের যুদ্ধে জয়লাভের জন্য ভারতের স্বাধীনতা অপরিহার্য। স্বাধীন ভারতের স্বাধীন সরকারই মাত্র মিত্রপক্ষকে যুদ্ধ জয়ে উপযুক্ত রূপে সাহায্য করতে সক্ষম হবে। প্রস্তাবের অপর অংশে গান্ধীর নেতৃত্বে গণআন্দোলন শুরু করার কথাও বলা হয়েছিল। কংগ্রেস নেতৃত্বের আশা ছিল, তাদের স্বাধীনতার দাবি এবং আন্দোলনের হুমকীতে ব্রিটিশ সরকার তাদের সঙ্গে আপস আলোচনাতে সম্মত হবে। কিন্তু ভারতের জনমত তখনো জাতীয় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের নেতৃত্বে বিভক্ত। এই অনৈক্য ছিল ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের দুর্বলতা। ব্রিটিশ সরকার এই দুর্বলতাকে ভিত্তি করে কংগ্রেসের সঙ্গে আলোচনার পরিবর্তে দমননীতি গ্রহণ করে। আগষ্ট প্রস্তাব গ্রহণ করা হয় ৮ আগষ্ট। তার পরদিনই ৯ আগষ্ট ব্রিটিশ সরকার গান্ধীসহ কংগ্রেস ওয়াকিং কমিটির নেতৃবৃন্দকে গ্রেপ্তার করে।
কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের গ্রেপ্তারে দেশব্যাপী প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। বিভিন্নস্থানে আন্দোলন জঙ্গী এবং ধ্বংসাত্মক আকার গ্রহণ করে। রেল লাইন, টেলিগ্রাফ তার এবং শাসনযন্ত্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আন্দোলনকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত করতে থাকে। মেদিনীপুরের একটি অঞ্চলে ব্রিটিশ সরকারের শাসন ব্যবস্থা অস্বীকার করে স্বাধীন সরকার স্থাপন করা হয়। কিন্তু এ সমস্ত কার্যক্রম খুব সংগঠিত ছির না। কোনো কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে এ আন্দোলন পরিচালিত হয় নি। অহিংসার নীতিতে বিশ্বাসী গান্ধী তখন কারাগারে আবদ্ধ। বিচ্ছিন্ন এবং নেতৃত্বহীন এরূপ স্বতস্ফূর্ত বিক্ষোভ ব্রিটিশ সরকারের সামরিক এবং নির্মম দমনের মুখে অধিক দিন স্থায়ী হতে পারে নি। ৪২ সালের ডিসেম্বর মাসের মধ্যেই এ আন্দোলন দমিত হয়ে যায়। আগষ্ট ৯ এবং ডিসেম্বর ৩১-এর মধ্যে ৬০ হাজারের অধিক লোককে গ্রেপ্তার করা হয়; ১৮০০০ রাজনীতিক কর্মীকে ভারত রক্ষা আইনে আটক রাখা হয়; পুলিশ এবং সামরিক বাহিনীর গুলি বর্ষণে প্রায় এক হাজার নিহত হয়। ( দ্রষ্টব্য: রজনী পামে দত্ত: ‘ইন্ডিয়া টু ডে’)
Augustine Saint: সেণ্ট অগাস্টিন (৩৫৪-৪৩০ খ্রি.)
উত্তর আফ্রিকার হিপোতে অগাস্টিনের জন্ম। যৌবনকালে অগাস্টিন ছিলেন ধর্মীয় বিশ্বাসে প্যাগান বা প্রকৃতবাদী। কিন্তু কিশোর বয়স থেকেই তাঁর মধ্যে সত্যানুসন্ধানের প্রবল আগ্রহ প্রকাশ পেতে থাকে। অগাস্টিনের রচনার আগ্রহ এবং ক্ষমতাও ছিল অসাধারণ। তাঁর সমকালীন জীবনের ধর্মীয়, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় এবং ব্যক্তির জীবনের নীতিগত সমস্ত সমস্যাই তাঁর রচনাসমূহে আলোচিত হয়েছে। এই রচনার মধ্যে তাঁর ‘কনফেকশন’ বা ‘স্বীকারোক্তি’ এবং ‘সিটি ব গাড’ বা ‘ঈশ্বরের রাজ্য’ প্রসিদ্ধ। তাঁর স্বীকারোক্তির মধ্যে তাঁর যৌবনকালের আচরণ এবং বিচিত্র ধর্মীয় অভিজ্ঞতার বর্ণনা। বিভিন্ন ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসরণ এবং বিচার শেষে ৩৩ বৎসর বয়সে অগাস্টিন খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেন। ৩৯১ খ্রিষ্টাব্দে তাঁকে হিপোর ধর্মযাজক রূপে ঘোষণা করা হয়। খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করার পর তিনি খ্রিষ্টধর্মের একজন শক্তিশালী প্রচারক এবং রহস্যবাদী দার্শনিকরূপে জীবনযাপন করেন। দর্শনের ক্ষেত্রে অগাস্টিনের মূল কথা ছিল: বিশ্বাস ব্যতীত জ্ঞান সম্ভব নয়। তাঁর ‘ঈশ্বরের রাজ্য’ বা ‘সিটি অব গড’ খন্ডাকারে তের বছর ধরে রচিত হয়। সর্বপ্রকার সমস্যাই তিনি তাঁর এই গ্রন্থে আলোচনা করেন। ‘ঈশ্বরের রাজ্য’ এবং ‘পাপের রাজ্য’কে অগাস্টিন পুণ্য এবং পাপ; সৎ এবং অসৎ-এর দ্বন্দ্বমান জগৎরূপে কল্পনা করেন। বিশ্ব সম্পর্কে খ্রিষ্টধর্মের বিশ্বাস অগাস্টিনের ইতিহাস ব্যাখ্যার ভিত্তি হিসাবে কাজ করেছে। ইতিহাসের এ ব্যাখ্যাকে অদৃষ্টবাদ বলা হয়। বিশ্বে যা কিছূ ঘটেছে, ঘটছে বা ঘটবে তা সবই ঈশ্বর কর্তৃক পূর্ব নির্ধারিত।
Auterchy: স্বশাসন, স্বয়ংসম্পূর্ণতা
Autonomy: স্বায়ত্তশাসন
অটারকী এবং অটোনমি উভয়ই গ্রিক শব্দ থেকে উদ্ভূত। গ্রিক ‘অটারকীয়া’র অর্থ স্বয়ংসম্পূর্ণতা। অর্থনীতিকভাবে কোনো রাষ্ট্র যদি এরূপ নীতি গ্রহণ করে যে, জীবনের যা কিছু প্রয়োজন সেসব রাষ্ট্রের অভ্যন্তরেই উৎপাদিত হবে এবং কোনো কিছুর জন্যই সে অপর রাষ্ট্রের উপর বা অপর রাষ্ট্র থেকে আমদানির উপর নির্ভর করবে না তা হলে একে অটারকী বা সয়ংসম্পূর্ণতার নীতি বলা যায়। অপরদিকে স্বায়ত্বশাসন বলতে যেমন কোনো পরাধীন জাতির পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনের ইচ্ছা বুঝাতে পারে, তেমনি স্বায়ত্তশাসন দ্বারা একটি রাষ্ট্রীয় কাঠামোর অন্তর্ভূক্ত বিশেষ কোনো অঞ্চল বা অধিবাসীর নির্দিষ্ট পরিমাণ শাসনাধিকারকেও বুঝাতে পারে। স্বায়ত্তশাসনের বাস্তব এবং সঙ্গত দাবি পূর্ণ না হলে এবং রাষ্ট্রের কোনো প্রভাবশালী জনাংশের মধ্যে নির্যাতিত কিংবা বঞ্চিত থাকার অবিযোগে দীর্ঘদিন প্রবাহিত হতে থাকলে স্বায়ত্তশাসনের দাবি বিচ্ছিন্নতা এবং পূর্ণ স্বাধীনতার রূপ গ্রহণ করতে পারে।
Axis: অক্ষ
Axis Power: অক্ষশক্তি
অক্ষ বলতে গণিত ও জ্যোতিষ শাস্ত্রে সূর্য থেকে কোনো দূরত্বের পরিমাণ ভূগোলে পৃথিবীর গ্রহের কাল্পনিক মেরুকেন্দ্ররেখা এবং প্রাণিবিদ্যায় প্রাণীদেহের মেরুদণ্ডকে বুঝায়। কিন্তু রাজনীতিতে ‘অক্ষশক্তি’ কথাটি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় প্রচারিত হয়। অক্ষশক্তি দ্বারা তখন জার্মানি, ইতালি এবং জাপান এই তিন শক্তির জোটকে বুঝান হত। শক্তির কেন্দ্র হিসাবে অক্ষ কথাটি ব্যবহার করে প্রথমে ১৯৩৬ সালে ফ্যাসিবাদী ইতালির শাসক মুসোলনী। মুসোলিনী নাকি জার্মানির হিটলারের সঙ্গে আঁতাত গঠনের কালে রোম-বার্লিন সম্পর্কের শক্তির অক্ষরেখা বলে অভিহিত করে। এই আঁতাততে তারা ইস্পাতদৃঢ় আঁতাত বলে আখ্যায়িত করে। ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রগোষ্ঠীর জঙ্গীনীতির মূল লক্ষ্য সমাজতন্ত্রের ধ্বংস এবং তখনকার একমাত্র সমাজতান্ত্রিক দেশ সোভিয়েত রাশিয়াকে আক্রমণ করা। এই মূল লক্ষ্যের জন্য জার্মানি এবং ইতালি জাপানকেও সাম্যবাদবিরুদ্ধতার চুক্তির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। যুদ্ধের প্রথম দিকে দ্বিধা থাকলেও যুদ্ধের সংকটজনক পরিস্থিতিতে ইংল্যাণ্ড এবং মার্কিনযুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে বৃহত্তর ঐক্যজোট গঠনে বাধ্য হয়। এই ঐক্যের ফলে অক্ষশক্তি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ১৯৪৫ সালে পরাজয় বরণে বাধ্য হয়।
B
Babeuf: বাব্যুফে (১৭৬০-১৭৯৭ খ্রি.)
ফরাসি বিপ্লবী। ১৭৯৬ সালে বাব্যুফের নেতৃত্বে ‘সমানদের ষড়যন্ত্র’ নামে একটা আন্দোলন সংঘটিত হয়। ষড়যন্ত্র উদ্ঘাটিত হওয়াকে বাব্যুফ এবং তাঁর অন্যতম সাথী ডারথেকে ১৭৯৭ সালে গিলোটিনে হত্যা করা হয়। বাব্যুফে থেকে বাব্যুফবাদের জন্ম হয়। বাব্যুফ এবং তাঁর সঙ্গীরা সমগ্র ফরাসি দেশে একটি কেন্দ্র থেকে শাসনের ভিত্তিতে ‘সমানদের রিপাবলিক’ বা সমানদের একটি জাতীয় কম্যুন প্রতিষ্ঠার আন্দোলন সংগঠিত করতে চেয়েছিলেন। তৎকালীন সমাজতান্ত্রিক চিন্তার ক্ষেত্রে বাব্যুফবাদ প্রগতিমূলক ছিল। বাব্যুফবাদীগণ ফরাসি দেশে প্রথম সমাজতান্ত্রিক তত্ত্বকে বাস্তবে বিপ্লবী আন্দোলনরূপে প্রকাশ করার চেষ্টা করেন।
Bacon, Francis: ফ্রান্সিস বেকন (১৫৬১-১৬২৬ খ্রি.)
দর্শন এবং জ্ঞানের ক্ষেত্রে বস্তুবাদী এবং বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির পথপ্রদর্শক।
বেকনের জ্ঞান এবং গবেষণার উৎসাহ কোনো একটি বিষয়ে সীমাবদ্ধ ছিল না। দর্শন, বিজ্ঞান, রাষ্ট্রনীতি, আইন, সর্বক্ষেত্রেই বেকন তাঁর সৃষ্টিশীল মেননের পরিচয় দিয়েছেন। বেকনকে তাই সর্ব-বিষয়ে পারদর্শী বলা যায়। কেবল জ্ঞানের তত্ত্বগত আলোচনায় নয়, ব্যক্তিগত জীবনে ক্শমতা লাভের প্রচেষ্টায়ও তিনি ক্ষমতা অর্জন করেছিলেন। ইংরেজ সম্রাট প্রথম জেমস-এর রাজত্বকালে ‘লর্ড-চ্যান্সেলর’ হিসাবে নিযুক্ত হয়ে বেকন সম্রাটের শাসন ব্যবস্থার সর্বোচ্চ পদমর্যদার অধিকারী হন। একদিকে যেমন জ্ঞানের ক্ষেত্রে বেকন অন্ধবিশ্বাস এবং গোঁড়ামির বিরুদ্ধে সংগ্রামী অপরদিকে ব্যক্তিগত জীবনে আত্মস্বার্থসাধনে তিনি ছিলেন বিবেকহীন।
‘নোভাম অর্গানাম’, এসেজ, এডভাঞ্চমেণ্ট অব লারনিং, ‘সাইণ্টিয়ারাম’, ‘নিউ এ্যাটলাণ্টিস’ প্রভৃতি গ্রন্থের মধ্যে ‘নোভাম অর্গানাম’ গ্রন্থের জন্যই বেকন খ্যাতি অর্জন করেন সমধিক। এই গ্রন্থের মাধ্যেই বেকনের বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক চিন্তার সুসংবদ্ধ প্রকাশ পাওয়া যায়। বেকন নিজে বৈজ্ঞানিক ছিরেন না সত্য, কিন্তু আধুনিক বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির তিনি যে উদগাতা ছিলেন এ সত্য অনস্বীকার্য। ষোড়শ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডের অর্থনৈতিক-সামাজিক জীবনে রূপান্তর সাধিত হচ্ছিল। পুজিঁবাদের তখন প্রথম যুগ। পুজিঁবাদের বাধাহীন বিকাশের জন্য উৎপাদনের নতুনতর উপাদান অর্থ্যাৎ কলকব্জা, যন্ত্রপাতি, অস্ত্র-শস্ত্রের আবিস্কার যেরূপ আবশ্যক ছিল তেমনি আবশ্যক ছিল বস্তুবাদী বৈজ্ঞানিক ভাবাদর্শের। পুঁজিবাদ এবং জ্ঞানের বিকাশকে বেকন এই ভাবদর্শ দ্বারা অবারিত করেছিলেন।
জ্ঞান অর্জনের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বেকন ঘোষণা করেন যে, মানুষ জ্ঞানলাভ করবে প্রকৃতিকে জানার জন্য এবং তাতে বশ করার জন্য। এরূপ জ্ঞানলাভের একমাত্র উপায় হচ্ছে পর্যবেক্ষণ এবং পরীক্ষা দ্বারা নিয়ত পরিবর্তিত বিশ্ব-প্রকৃতির পরিবর্তনের সত্যকার কারণ জানা। প্রকৃতির কার্য-কারণকে জ্ঞাত হওয়া প্রচলিত দর্শন ও ধর্মতত্ত্বের অলীক জাল বুননি দ্বারা সম্ভব নয়। প্রচলিত দর্শন আর ধর্মতত্ত্বের প্রবক্তাগণ মাকড়শার মতো নিজেদের কল্পনার জাল বিস্তার করে বিশ্ব-প্রকৃতিকে ব্যাখ্যা করতে চান কিন্তু এ পথ সত্যকার জ্ঞানের পথ নয়। সত্যকার জ্ঞান শুরু হবে সন্দেহ এবং প্রশ্ন দিয়ে। জ্ঞানের ক্ষেত্রে চার রকম দেবতার মূর্তিপূজা অনড় আসন গেড়ে বসে আছে। সেই অনড় মূর্তিদের ধ্বংসকারী হিসাবে নিজেকে ঘোষণা করে বেকন বলেন, মানুষের মনকে এই অপদেবতাদের প্রভাব থেকে মুক্ত করতে হবে। বেকনের মতে এই অপদেবতা বা আইডলগুলোকে চারভাগে ভাগ করা যায়। যথা (১) জাতিগত অপদেবতা মানুষ হিসাবে মানুষের জাতিগত কুসংস্কার ও অবাস্তব ধারণা বদ্ধমূল হয়ে আছে সেগুলিকে মানুষের জাতিগত অপদেবতা বলা যায়। মানুষ বিনা প্রশ্নে নিজের জ্ঞানের অসীমতা সম্পর্কে যে ধারণা পোষণ করে তাকে বেকন তাঁর একটি জাতিগত কুসংস্কার বলে আখ্যায়িত করেন। প্রাকৃতিক সমস্যার বিচারের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ না হওয়ার প্রবণতাও মানুষের একটা জন্মগত সংস্কার। মানুষ কেবল তাকেই সত্য বলে স্বীকার করতে চায় যা তার আত্মস্বার্থ সাধন করে। ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানকেও মানুষ এই কারণে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই চরম জ্ঞান বলে মনে করে। (২) অন্ধকার বিবরের অপদেবতা হচ্ছে মানুষের মনের দ্বিতীয় অপদেবতা। প্লেটোর গুহায় বন্দি মানুষ যেমন সত্যের ছায়াকেই সত্য বলে মনে করত তেমনি সকল মানুষই ব্যক্তিগতভাবে নিজ জীবনের অন্ধকার গুহায় বন্দি। ব্যক্তিজীবনের গুহার অন্ধকারে বসে মানুষ সত্যের আসল রূপ প্রত্যক্ষ করতে পারে না। তার ছায়াকেই সত্য বলে আঁকড়ে থাকে। এই গুহা থেকে বেরিয়ে আসতেও সে অনিচ্ছা প্রকাশ করে। কিন্তু সত্য সাধককে বিবরের এই বন্ধন ছিন্ন করতে হবে। যে তত্ত্বের প্রতি ব্যক্তির মানসিক আকর্ষণ প্রকট হয়ে ওঠে, সত্য সাধক হিসাবে তাকে সেই তত্ত্বকেই অধিক সন্দেহের চোখে দেখতে হবে। পর্যবেক্ষণ, প্রয়োগ ও পরীক্ষার মারফত তার সত্যাসত্য নির্ধারণ করতে হবে। (৩) বাজারী অপদেবতার বাধাও জ্ঞানলাভের জন্য কম নয়। ভাষার সীমাবদ্ধতাকে বেকন বাজারের অপদেবতা বা ‘আইডলস অব দি মার্কেট প্লেস’ বলে আখ্যায়িত করেন। ভাষার মারফত মানুষ ভাবের বিনিময় করে। কিন্তু ভাষার অর্থ বহনের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতার জন্য এক ব্যক্তি যা বলে অপরে তা সঠিকভাবে বুঝে না। নিজের ইচ্ছামতো অপরের কথাকে সে গ্রহণ করে। তাই একই শব্দের একাধিক অর্থ। এ কারণে সঠিক জ্ঞানের জন্য সর্বপ্রথমে আবশ্যক হচ্ছে দর্শন ও বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত সঠিক অর্থ নির্দিষ্টকরণ। (৪) থিয়েটার বা মঞ্চের অপদেবতার কারণেও আমরা বিশ্বপ্রকৃতির সঠিক জ্ঞান লাভে ব্যর্থ হই। প্রচলিত দার্শনিক তত্ত্বসমূহের বেকন মঞ্চের অপদেবতা বলেছেন। তার কারণ, মঞ্চে যেমন বাস্তবে একটা কল্পলোক তৈরি করা হয় তেমনি দার্শনিকগণ আসল সত্যকে আড়াল করে মিথ্যা জগতের পরিবেশ তৈরি করেন। তত্ত্বদ্বারা দার্শনিক জ্ঞানলাভের প্রচেষ্টায় এই প্রতিষ্ঠিত দার্শনিক মতগুলোকে আমাদের ভূমিসাৎ করতে হবে। দর্শনের সমালোচনার সময়ে বেকন মধ্যযুগের ধর্মতত্ত্ব এবং দর্শনকে আক্রমন করলেও প্রাচীন গ্রিসের দর্শন, বিশেষ করে ডিমোক্রিটাস এবং অন্যান্য বস্তুবাদী গ্রীক দার্শনিকদের তিনি প্রশংসা করেছেন।
এভাবে অজ্ঞানতার প্রতিভূ অপদেবদতাদের ধংধ্ব করে বেতন বৈজ্ঞানিক জ্ঞানলাভের সুত্র প্রতিষ্ঠিত করেন। বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের জন্য বেকন আরো তিনটি সূত্র উল্লেখ করেন। যথা: (১) কোনো সমস্যার সমাধান বা কারণের অনুসন্ধানে প্রথমে কারণের উপস্থিতিসূচক ঘটনাসমূহকে সংগ্রহ এবং পর্যবেক্ষণ করতে হবে; (২) দ্বিতীয়ত, উক্ত কারণের অনুপস্থিতিসূচক ঘটনাসমূহকে পর্যবেক্ষণ এবং বিশ্লেষণ করতে হবে; (৩) তৃতীয়ত উভয় ধরনের ঘটনাকে তুলনাক্রমে বিচার করে উভয়ের পারস্পারিক সম্পর্ক এবং পরিবর্তনের ক্রম উদ্ঘাটন করতে হবে। বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ ও অনুসন্ধানের এই তিনটি সূত্রকে ভিত্তি করে পরবর্তীকালে জন স্টুয়ার্ট মিল তার আরোহী বা ইনডাকটিভ পদ্ধতিতে মিল এ অ-মিলের যুক্ত পদ্ধতি (জয়েন্ট মেথড অব এ্যাগ্রিমেণ্ট এ্যাণ্ড ডিফারেন্স) এবং পরিবর্তনের যুক্তক্রম (মেথড অব কনকোমিট্যাণ্ট ভেরিয়েশন্স) নামক পদ্ধতি প্রবর্তন করেন।
বিখ্যাত ফরাসি লেখক ডিডেরট বেকনের অবদানকে স্বীকৃতি দিয়ে বলেছিলেন বেকনের অবিষ্মরণীয় অবদান এই যে, মানুষের জ্ঞানের ইতিহাস রচনাও যখন সম্ভব ছিল না বেকন তখন মানুষের ভবিষ্যৎ পথকে সুনিশ্চিতভাবে নির্দিষ্ট করার ক্ষমতা দেখিয়েছেন।
রাষ্ট্রনৈতিক তত্ত্বে বেকন রাজতন্ত্রের সমর্থনকারী ছিলেন। তিনি সামন্ততন্ত্রের বিরোধিতা করে এককেন্দ্রীক শক্তিশালী রাজতন্ত্রের কথা প্রচার করেন। ‘নিউ এ্যাটলাণ্টিক’ গ্রন্থে তিনি এক কল্পরাজ্যের বর্ণনা করেছেন। বিজ্ঞানের ভিত্তিতে সে রাষ্ট্রের রাজকার্য সাধিত হয়। শোষক এবং শোষিতের অস্তিত্ব সত্ত্বেও বেজ্ঞানিক উপায়ের ব্যবহারে একটা রাষ্ট্র কি বিষ্ময়কর অর্থনৈতিক উন্নতি লাভ করতে পারে তার চিত্র তিনি এই গ্রন্থে তুলে ধরেন।
জ্ঞানলাভের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রতিষ্ঠাকালে বস্তুজগতের যে ব্যাখ্যা বেকন উপস্থিত করেন তার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে: বস্তু এবং প্রকৃতি বিভিন্ন গুণ সমন্বিত অংশসমূহের সম্মেলনের প্রকাশ। বস্তুর প্রধান লক্ষণ হচ্ছে তার গতি, যান্ত্রিক গতিকে বেকন একমাত্র গতি বলে স্বীকার করতেন না। বস্তুর অন্তরেই গতি নিহিত্ যান্ত্রিক গতিতেই কেবল বস্তু গতিবান হয় না। কিন্তু ফ্রান্সিস বেকনের দার্শনিক অভিমত ক্রটিহীন ছিন না। তাঁর দার্শনিক ব্যাখ্যায়বিভিন্ন সময়ে বস্তুবাদকে অতিক্রম করে ধর্মীয় প্রভাব প্রকট হয়েছে। তাঁর প্রবর্তিত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি আজ হয়তো হুবহু ব্যবহৃত হয় না। কিন্তু আধুনিক ইউরোপীয় দর্শন, বিজ্ঞান এবং সামগ্রিকভাবে জ্ঞানান্বেষণের ক্ষেত্রে বেজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রবর্তনের জন্য বেকন অবিষ্মরনীয় হয়ে রয়েছেন।
Bacon, Roger: রোজার বেকন (১২১৪-১২৯২ খ্রি.)
ইউরোপীয় মধ্যযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ, দার্শনিক এবং আধুনিক পরীক্ষামূলক বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠার প্রয়াসে প্রথম পথিকৃৎ। ষোড়শ শতকে ফ্রান্সিস বেকন দর্শন ও বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যে নবযুগের সূচনা করেন তার বীজ বপন করেছিলেন তিনশত বছরেরও পূর্বে ত্রয়োদশ শতকে তাঁর স্বদেশবাসী রোজার বেকন। রোজার বেকন জ্ঞানের একাধিক বিষয়ে পারদর্শী ছিলেন। দর্শনের বস্তুবাদী চিন্তা, অন্ধ বিশ্বাসের বিরুদ্ধতা এবং পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষার পদ্ধতিকে বিশ্ব প্রকৃতির জ্ঞানলাভের পথ বলে ঘোষণা করার অপরাধে তাঁকে যাজক সম্প্রদায় ধর্মদ্রোহী ঘোষণা করে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনার অধিকার থেকে রোজার বেকনকে বঞ্চিত করা হয়। বেকন বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার সাহায্যে বিবর্ধক কাচ বা ম্যাগনিফাইং গ্লাস এবং বন্দুকের জন্য এক প্রকার বারুদও আবিস্কার করেন। গ্রিক দর্শন এবং আবর জগতের দার্শনিক ও চিন্তাবিদদের চিন্তারাজিকে বেকন অধ্যয়ন করেন। জ্ঞানের প্রশ্নে ধর্মযাজকের বাণীর চেয়ে গ্রিক এবং আরব দার্শনিকদের যুক্তি অধিক মূল্যবান ঘোষণা করায় যাজক সম্প্রদায় তাঁর উপর অধিকতর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। তাঁর দার্শনিক চিন্তাধারায় বৈজ্ঞানিক আবিস্কার এবং গ্রিক ও আরব দর্শনের দৃষ্টান্তের উল্লেখ সব কিছুই ধর্মীয় অপরাধ বলে ঘোষিত হয় এবং পোপের আদেশে তাঁকে দীর্ঘ দশ বছর যাবৎ নজরবন্দি করে রাখা হয়। এই বন্দি অবস্থায় বেকন যাতে কোনো প্রকার জ্ঞানের চর্চা করতে না পারেন, সেজন্য দীর্ঘ দশবছরই তাকে সর্বপ্রকার বই এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার যন্ত্রাদি থেকে বঞ্চিত রাখা হয়।
রোজার বেকনের ‘ওপাস মাইউস’ নামক গ্রন্থে তাঁর বিষ্ময়কর প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়। এই গ্রন্থের আলোচ্য বিষয়কে তিনি সাতভাগে বিভক্ত করেন, যথা: মানুষের ভ্রান্তির কারণ, দর্শন, ভাষার অধ্যয়ন, অঙ্কশাস্ত্র, চক্ষুর চিকিৎসা, পরীক্ষাসিদ্ধ বিজ্ঞান বা এক্সপেরিমেণ্টাল সায়েন্স এবং নীতিশাস্ত্র।
প্রথম ভাগের আলোচনায় রোজার বেকন বলেন যে, জ্ঞানের ক্ষেত্রে মানুষের ভ্রান্তির কারণ চার প্রকার, যেমন: (১) অজ্ঞানীর হুকুম স্বীকার করে তার কাছে আত্মসমর্পণ; (২) প্রচলিত প্রথার মোহ; (৩) জনপ্রিয় কুসংস্কার; এবং (৪) তথাকথিত জ্ঞানের কৌশলের আড়ালে অজ্ঞানতার প্রশ্রয়দান।
জ্ঞানের পথ হচ্ছে অভিজ্ঞতার পথ। অবশ্য অভিজ্ঞতাকে রোজার বহিঃঅভিজ্ঞতা এবং অন্তঃঅভিজ্ঞতা হিসাবে বিভক্ত করণ। ইন্দ্রিয়লব্ধ অভিজ্ঞতা হচ্ছে আমাদের বহিঃঅভিজ্ঞতা। এ হচ্ছে বাস্তব জগতের অভিজ্ঞতা, মানুষের আভ্যন্তরিক অভিজ্ঞতার উৎস হচ্ছে বিধাতা। ইন্দ্রিয়-অভিজ্ঞতার যেমন প্রয়োজন আছে তেমনি জ্ঞানের নিশ্চয়তা কেবল বিধাতার দয়াতেই সম্ভব। অভিজ্ঞতার এই ব্যাখ্যা রোজার বেকনের বস্তবাদকে ক্রটিপূর্ণ করেছে। তা সত্ত্বেও যুগের প্রেক্ষিতে রোজার বেকনের দর্শন ও বিজ্ঞান সম্পর্কীয় অভিমতসমূহ অপরিসীম তাৎপর্যপূর্ণ।
Bakunin, Mikhail Alexandrovich: বাকুনিন (১৮১৪-১৮৭৬ খ্রি.)
অভিজাত পরিবারের সন্তান বাকুনিন ছিলেন একজন পেটিবুর্জোয়া বা মধ্যবিত্ত চরিত্রের রুশ বিপ্লবী। নৈরাষ্ট্রবাদ বা এ্যানার্কিজম মতবাদের প্রচারকারী হিসাবেই বাকুনিন বিখ্যাত হন।
বাকুনিনের মতাদর্শে বিভিন্ন দার্শনিক এবং রাষ্ট্রনৈতিক চিন্তাধারায় আকৃষ্ট হন। পরবর্তীকালে হেগেলের দর্শনের বস্তুবাদী ব্যাখ্যার পরিবর্তে তার ভাববাদী ও প্রতিক্রিয়াশীল ব্যাখ্যা গ্রহণ করেন।
সমাজ ও রাষ্ট্র সম্পর্কে বাকুনিনের মতবাদ ছিল এরূপ মানুষ মূলত দুটি যন্ত্র দ্বারা নিষ্পোষিত হচ্ছে একটি রাষ্ট্রযন্ত্র অপরটি ধর্মযন্ত্র বা অলীক বিধাতার দণ্ড। রাষ্ট্রযন্ত্রের অত্যাচার থেকে মুক্তির আশ্বাসে মানুষ ধর্মীয় বিশ্বাসের আশ্রয় নেয়। আসলে ধর্ম এবং রাষ্ট্র যুক্তভাবেই মানুষকে শোষণ করে। মানুষের মুক্তির একমাত্র পথ হচ্ছে এই উভয় যন্ত্রকে ধ্বংস করা। বাকুনিনের ধ্বংসমূলক এ মতের পরিপূরক কোনো গঠনমূলক মত ছিল না। তাঁর মতে রাষ্ট্রযন্ত্র বাদে মানুষ স্বাভাবিকভাবে যূথবদ্ধ হয়ে জীবন যাপন করতে সক্ষম। সে সমাজে কারুর কোনো শাসন বা খবরদারী থাকবে না। বাকুনিনের মতের একটি বিপ্লবাত্মক দিক আছে। কার্ল মার্কসও প্রচলিত রাষ্ট্র-ব্যবস্থার উচ্ছেদের কতা প্রচার করেছেন। কিন্তু প্রচলিত রাষ্ট্রব্যবস্থার স্থলে সমাজতন্ত্রবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠন মার্কসবাদের অপর অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার সমালোচনার ক্ষেত্রে সাদৃশ্যের কারণে মার্কস বাকুনিনকে প্রথম আন্তর্জাতিকের সদস্য হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে মাকর্সবাদী চিন্তার বিরোধিতার ফলে বাকুনিন প্রথম আন্তর্জাতিক থেকে ১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে বহিস্কৃত হন। মাকর্স-এর সঙ্গে বাকুনিনের মতাদর্শের বিরোধের মূল কারণ ছিল মার্কস বাকুনিনকে হঠকারী বিপ্লবী বলে গণ্য করতেন।
বাকুনিন সমাজ বিপ্লবের পরবর্তী অবস্থা সম্পর্কে যেমন কোনো গঠনমূলক মত পোষণ করতেন না, তেমনি সমাজ বিপ্লবের জন্যও কোনো সুসংবদ্ধ সংগঠন ও আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করতেন না। বাকুনিন কৃষক এবং ভবঘুরে সর্বহারাকে বিপ্লবের প্রধান শক্তি বলে বিবেচিত করতেন। কৃষক ও ভবঘুরে সর্বহারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ধ্বংস করবে, এই ছিল বাকুনিনের বিশ্বাস। সমসাময়িক সমাজবাদী চিন্তাবিদ প্রুধোর মতামতের প্রভাবও বাকুনিনের মধ্যে লক্ষ করা যায়। ‘ফেডারিলিজম, সোস্যালিজম এ্যাণ্ড এ্যাণ্টি থিওলজিজম’ বলে লিখিত বাকুনিনের গ্রন্থে সমাজের যে পরিকল্পনা বাকুনিন প্রথমে উপস্থিত করেন, তা মূলত প্রুধোর নিকট তেকেই গৃহীত।
বাকুনিনের জীবন ঘটনাবহুল। নিজের মতাদর্শ নিয়ে তৎকালীন বিক্ষুদ্ধ ইউরোপের বিভিন্ন দেশের বিপ্লব ও আলোড়নে একাধিকবার অংশগ্রহণ করেন।এর মধ্যে ১৮৪৮-৫০ প্রেগবিপ্লবে তাঁর অংশগ্রহণ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। উক্ত ঘটনার পরে রুশদেশে প্রত্যাবর্তনকালে বাকুনিনকে গ্রেপ্তার করে রুশ সরকার সাইবেরিয়ায় নির্বাসিত করে। ১৮৬১ সালে সাইবেরিয়ায় নির্বাসন থেকে পালায়ন করে জাপান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হয়ে বাকুনিন আবার ইউরোপে উপস্থিত হন। রাশিয়ার নারোদনীক পন্থীগণ বাকুনিনের নৈরাষ্ট্রবাদী মতদ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবান্বিত হয়েছিল। কার্ল মার্কস ব্যতীত ফ্রেডারিক এঙ্গেলস এবং লেলিনও বাকুনিনের নৈরাষ্ট্রবাদী মতের তীব্র সমালোচনা করেন।
Balance of Payments: লেনদেনের ভারসাম্য
কোনো দেশ যখন তার আমদানি ও রপ্তানির মধ্যে একটা সমতা বজায় রাখে তখন তাকে লেনদেনের ভারসাম্য বলা হয়। লেনদেনের ভারসাম্যে প্রধান ভূমিকা পালন করে দেশ থেকৈ বিদেশে রপ্তানিকৃত দ্রব্যাদি এবং বিদেশ থেকে আমদানিকৃত দ্রব্যাদির মূল্য। কিন্তু দ্রব্যের আমদানি-রপ্তানি ব্যতীতও একটি দেশের আমদানি খাতে ব্যয় এবং রপ্তানি খাতে আয় হতে পারে। এরূপ আয়ের উৎস হচ্ছে সাধারণত দেশের মধ্যে বিদেশী পর্যটকদের ভ্রমণাদি এবং এই উপলক্ষে পর্যটকদ কর্তৃক বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়ে দেশীয় মুদ্রা গ্রহণ। আবার ব্যয়ের কারণও ঘটে দেশীয় নাগরিকগণ যখন বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে বিদেশে গমন করেন তখন। এ ছাড়া এক দেশের মধ্যে অপর দেশের ব্যাঙ, বীমা ইত্যাদির ব্যবস্থাপনার খাতেও একটি রাষ্ট্রের বৈদেশিক মুদ্রার আয় কিংবা ব্যয় ঘটতে পারে। এ সমস্ত আয়-ব্যয় উৎপাদিত দ্রব্যাদির আমদানি কিংবা রপ্তানির ভিত্তিতে ঘটে না বলে বৈদেশিক মুদ্রার এরূপ আমদানি রপ্তানিকে অদৃশ্য আমদানি কিংবা অদৃশ্য রপ্তানি বলে অভিহিত করা হয়।
Balance of Power: শক্তির ভারসাম্য
শক্তির ভারসাম্য একটি দেশের কূটনীতির ক্ষেত্রে অনুসৃত কৌশলের ব্যাপার। একটি রাষ্ট্র যদি তার বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে এরূপ কৌশল অবলম্বন করে কিংবা করার চেষ্টা করে যাতে তার নিজের রাজনীতিক, অর্থনীতিক এবং সামরিক শক্তিকে আর কোনো রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রগোষ্ঠীয় অনুরূপ শক্তি অতিক্রম করে যেতে না পারে তা হলে এই কৌশলকে শক্তির ভারসাম্য বজায় রাখার কৌশল বলা হয়। ঊনবিংশ শতকের শেষার্ধে থেকে প্রথম মহাযুদ্ধ পর্যস্ত ইংরেজ সরকার ইউরোপের ক্ষেত্রে এই কূটনীতিক কৌশল অনুসরণ করে চলছিল। ইউরোপে তখন একদিকে ছিল জার্মানি, অষ্ট্রিয়া এবং ইতালির ত্রয়ী-জোট এবং অপর দিকে ছিল ইংরেজ, ফরাসি এবং রাশিয়ার ত্রয়ী-জোটের শক্তি। এই দুই জোটের পারস্পারিক লক্ষ্য ছিল যেন প্রতিপক্ষ তাকে অতিক্রম করে যেতে না পারে। প্রথম মহাযুদ্ধের পরে ইউরোপে জার্মানি যখন ক্রমান্বয়ে পররাজ্য গ্রাস করে নিজ পক্ষের শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকে তখন ইংল্যাণ্ড তার পাল্টা কোনো ব্যবস্থা গ্রহণে অক্ষম হয়। এই পর্যায়ে ব্রিটিশ সরকার নাজিবাদী জার্মানির প্রতি তোষণনীতি অবলম্বন করে। বস্তুত প্রথম মহাযুদ্ধের পরে ১৯১৭ সালের রুশ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্রমে বিরাট রুশদেশে ধনবাদের প্রতি-ব্যবস্থা হিসাবে সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা পুরাতন ভারসাম্যব্যবস্থাকে ধনবাদী যে কোন রাষ্ট্রের নিকট অপ্রয়োজনীয় এবং অকেজো করে তোলে। এখন থেকে ধনবাদী এবং সমাজতন্ত্রী শক্তির মধ্যে ভারসাম্যের প্রশ্নটির সূচনা হয়। কিন্তু দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ পর্যন্ত ধনবাদী ও ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রসমূহের বিশ্বাস ছিল যে, সমাজতন্ত্রী ব্যবস্থা ও শক্তি দীর্ঘজীবি হবে না। তারা সমাজতন্ত্রিক শক্তিকে ধ্বংস করতে পারবে। কিন্তু দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত রাশিয়ার বিষ্ময়কর বিজয়, অধিকতর দেশসমূহের সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত হওয়া এবং জার্মানির মতো দুর্ধর্ষ ধনবাদী রাষ্ট্রের পরাজয় এই বিশ্বাসকে ভিত্তিহীন প্রমাণ করে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর থেকে ধনবাদী রাষ্ট্রসমূহের প্রধান শক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সমাজতন্ত্রকে প্রধান প্রতিপক্ষ বলে গণ্য করে তার সঙ্গে শক্তির ভারসাম্য বজায় রাখার নীতি অনুসরণ করতে থাকে। বর্তমানে শক্তির ভারসাম্য বলতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত রাশিয়ার পারস্পারিক শক্তির সমতা বুঝায়।
নব্বই-এর দশকের গোড়াতে সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার পতনের পর আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একক প্রাধান্য সৃষ্টির পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে।
Basic Democracy: মৌলিক গনতন্ত্র
১৯৫৮ সালের অক্টোবর মাসে পাকিস্থানের সামরিক বাহিনীর অধিনায়ক ফিল্ড মার্শাল মুহম্মদ আইয়ুব খান সামরিক আইন জারি করে দেশের পার্লামেণ্টারী শাসন-ব্যবস্থা বাতিল করেন এবং স্থানীয় স্বায়ত্ত্বশাসনের ক্ষেত্রে ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ নামে একটি শাসন-ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। এই ব্যবস্থার প্রধান লক্ষ্য ছিল দেশের পার্লামেণ্ট, প্রাদেশিক পরিষদ এবং প্রেসিডেণ্ট নির্বাচনে পরোক্ষ নির্বাচনের পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করা। এই উদ্দেশ্যে সমগ্র দেশকে নির্দিষ্ট সংখ্যক নির্বাচকমণ্ডলীতে ভাগ করা হয় জনসাধারণ এই নির্বাচকমণ্ডলী প্রেসিডেণ্টকে নির্বাচিত করত এবং যথাক্রমে জাতীয় পরিষদ এই অধিকার ব্যতীত পর্যায়ক্রমে ইউনিয়ন, থানা, জেলা ও বিভাগীয় কাউন্সিলে অংশ গ্রহণের কম বেশি অধিকার দেওয়া হয়। এক হাজার অধিবাসীর ভিত্তিতে একজন করে নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ প্রথম পর্যায়ে ইউনিয়ন কাউন্সিল গঠন করত। কিন্তু পরবর্তী থানা পর্যায়ে ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যানগরই মাত্র থানা কাউন্সিলের সদস্য এবং থানা কাউন্সিলের সদস্যদের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণই জেলা কাউন্সিলে, আবার জেলা কাউন্সিলের নির্বাচিত সদস্যদের নির্বাচনে বিভাগীয় কাউন্সিলের সদস্যগণ নির্বাচিত হত। ফলে জনসাধারণের প্রত্যক্ষ ভোটদানের ক্ষমতা নির্বাচকমন্ডলীর নির্বাচনেই সীমাবদ্ধ ছিল। জাতীয় পরিষদ, প্রাদেশিক পরিষদ কিংবা প্রেসিডেণ্টের নির্বাচনে জনসাধারণের প্রত্যক্ষ অধিকার ছিল না। স্থানীয় স্বায়ত্ত্বশাসনের ক্ষেত্রেও প্রাথমিক পর্যায়ের ইউনিয়ন কাউন্সিল ব্যতীত অপর স্তরগুলিতে ক্রমাধিক পরোক্ষ নির্বাচন এবং সীমিত অধিকারের ব্যবস্থা করা হয়। প্রেসিডেণ্ট আইয়ুব খান অভিমত পোষণ করতেন যে, দেশের জনসাধারণ পার্লামেণ্টারী গণতন্ত্রের উপযুক্ত নয়। তাঁর প্রবর্তিত ব্যবস্থাকে ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ নাম দিয়ে তিনি জনসাধারণকে এই বলে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছিলেন যে, জনসাধারণ হচ্ছে মূল এবং সেখানে গণতন্ত্র প্রবর্তন করাই হচ্ছে মৌলিক গণতন্ত্র। এবং মৌলিক গণতন্ত্র হচ্ছে সেরা গণতন্ত্র। কার্যত মৌলিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ছিল জনসাধারণকে দেশের জাতীয় সমস্যার আলোচনা ও সমাধানের অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখার একটি সুকৌশল স্বৈরতান্ত্রিক প্রচেষ্টা। স্থানীয় শাসনের ক্ষেত্রেও জনসাধারণের কোনো কার্যকর অধিকার ছিল না। প্রতিটি স্তরে আমলাতন্ত্রকে জনসাধারণের প্রতিনিধিদের উপর খবরদারির অধিকার দেওয়া হয়েছিল এবং ১৯৫৮ সালের পূর্ব পর্যন্ত ইউনিয়ন ও জেলা বোর্ডের প্রতিনিধিগণ স্বায়ত্ত্বশাসনের যে অধিকার ভোগ করত সে অধিকারও মৌলিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্তায় বিলুপ্ত করা হয়। ১৯৬৯-৭০-এর গণআন্দোলনে আইয়ুব খান ক্ষমতা থেকে অপসারিত হন এবং কাঁর মৌরিক গণতন্ত্র ব্যবস্থার বিলোপ ঘটে।
ক্ষমতায় আরোহণ করার পর জনসাধারণের রাজনৈতিক অধিকার সঙ্কুচিত করার প্রবণতা উচ্চতর শ্রেণীর শাসকদের একটি সাধঅরণ প্রবণতা। ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ ছিল এই প্রবণতারই প্রকাশ।
Basis and Supersructure: মূল ও উপরিকাঠামো
সমাজের অর্থনৈতিক বুনিয়াদের সঙ্গে তার সাংস্কৃতিক, রাষ্ট্রনৈতিক, ধর্মীয় এবং অন্যান্য অংশের সম্পর্কের ব্যাখ্যায় মার্কসবাদী দর্শন ‘মূল এবং উপরি-কাঠামো’ নামক দুটি শব্দ ব্যবহার করে। মার্কসবাদের মতে যে-কোনো সমাজের অর্থনৈতিক বুনিয়াদই হচ্ছে সমগ্র সমাজের মূল বুনিয়াদ। সমাজ বিকাশের যে-কোনো বিশেষ পর্যায়ে উৎপাদনের উপায় অর্থ্যাৎ জীবিকা অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় হাত-পা, মস্তিস্ক এবং যন্ত্রপাতির মালিকানার ভিত্তিতে গঠিত হয় সেই পর্যায়ের অর্থনেতিক বুনিয়াদ। সংক্ষেপে একে বলা হয় ‘উৎপাদনের উপায় এবং উৎপাদনের সম্পর্ক’। উৎপাদনের উপায় এয সম্পর্কের ভিত্তিতে গঠিত মূল বুনিয়াদের উপরই রচিত হয় সে সমাজের আইন-কানুন, নিয়ম-নিষেধ, মতামত, বিশ্বাস, অবিশ্বাস, সাহিত্য এবং সংস্কৃতি। অর্থনৈতিক বুনিয়াদের উপর রচিত এই কাঠামোকে মার্কসবাদ বহির্গঠন, উপরি-কাঠামো বা সুপার স্ট্রাকচার বলে অভিহিত করে।
অর্থনৈতিক বুনিয়াদ বা সমাজের মূল কাঠামো অনুযায়ী তার বহিঃকাঠামো গঠিত হয়। যে সমাজের অর্থনৈতিক বুনিয়াদ হচ্ছে দাসের দৈহিক শ্রমের মালিকানার ভিত্তিতে প্রভুদের সম্পদ সৃষ্টি সে সমাজের বহিঃকাঠামোর মধ্যে অবশ্যই এই মূল কাঠামোর রাষ্ট্রনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং অপরাপর ভাবগত প্রয়োজন প্রতিফলিত হবে। আবার মূল কাঠামোর অন্তর্নিহিত বিরোধও বহিঃকাঠামোর ভাবদর্শের ক্ষেত্রে প্রকাশ পাওয়ার চেষ্টা করবে। এই বিচারে কোনো সমাজের বহিঃকাঠামোর সঙ্গে আমাদের সাক্ষাৎ ঘটলে তার সঠিক প্রকৃতি বিচারে সে সমাজের মূল কাঠামোর বিশ্লেষণ আবশ্যক।
সমাজ বিকাশের মূল কাঠামোর পরিবর্তনের পরে উপরি-কাঠামোতে পরিবর্তন আসে। একারণে মূলকাঠামোর পরিবর্তন ব্যতীত ইচ্ছা করলেই কেউ উপরিকাঠামোতে স্থায়ী কোনো পরিবর্তন আনতে পারে না। সমস্ত সমাজের মূল অর্থনৈতিক কাঠামো যখন পরিবর্তিত হয়ে পুঁজির মালিকানা-ভিত্তিক নতুনতর অর্থনৈতিক বুনিয়াদ তৈরি হয়েছে তখনি সামন্ত সমাজের ভাবনা-চিন্তা, আইন-কানুন, বিশ্বাস-অবিশ্বাস বিলুপ্ত হয়ে নতুন বহিঃকাঠামো প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মার্কসবাদের মতে পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক বুনিয়াদের পরিবর্তনের মাধ্যমেই মাত্র তার পুঁজিবাদী বহির্গঠন পরিবর্তিত হয়ে সমাজবাদী বহির্গঠন প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
মার্কসবাদের মূল দর্শন দ্বন্দ্বমূলক এবং ঐতিহাসিক বস্তুবাদ। দ্বন্দ্বমূলক এবং ঐতিহাসিক বস্তুবাদের মতে সমাজের মূল কাঠামো এবং বহিঃকাঠামোর মধ্যকার সম্পর্ক কেবল একমূখী নয় এ সম্পর্কের চরিত্রও দ্বন্দ্বমূলক এবং দ্বিমূখী। কেবল যে মূল কাঠামো সমাজের বহিঃকাঠামোকে নিয়ন্ত্রিত এবং প্রভাবান্বিত করে, তাই নয়। বহিঃকাঠামো গঠিত হওয়ার পরে তার মধ্যকার বিভিন্ন সামাজিক ব্যবস্থা, আইন-কানুন, অর্থনৈতিক শ্রেণীসমূহের সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় ও দার্শনিক চিন্তাধারাও মূল গঠনকে প্রভাবান্বিত করে। অর্থনৈতিক বুনিয়াদের বিকাশ ও ক্রিয়াশীলতার ক্ষেত্রে তার বহিঃকাঠামোর বিভিন্ন অংশও সক্রিয় ভূমিকা পালন করে।
একটি ভাব বস্তু বা বাস্তব অবস্থা থেকে উদ্ভূত হয়। কিন্তু একবার উদ্ভূত হলে সে ভাব বাস্তব অবস্থাকেও পরিবর্তত করতে পারে। মার্কসবাদের এ্ই অভিমতটি এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। মার্কসবাদের মতে ব্যক্তিগত মালিকানা-ভিত্তিক সমাজের অর্থনৈতিক বুনিয়াদ বা মূল কাঠামোর সঙ্গে তার বহিঃকাঠামোর সম্পর্কের অপর দিকটি হচ্ছে বিরোধাত্মক। অর্থনৈতিক বুনিয়াদের মধ্যকার শ্রেণীগত বিরোধ বহিঃকাঠামোর মধ্যেও প্রতিফলিত হয়। কালক্রমে এই বিরোধ মূল কাঠামো পরিবর্তনের আন্দোলনের রূপ লাভ করে। একটি সমাজের সামগ্রিক কাঠামোর মূল ও বহির্ভাগের বিভাগ ও বেশিষ্ট্য স্বাভাবিক। মার্কসবাদের মত অনুযায়ী এই উভয় দিকের পারস্পারিক সম্পর্কের বিরোধাত্মক চরিত্র সমাজতান্ত্রিক সমাজে আর থাকতে পারে না। কারণ সমাজতন্ত্রের অর্থনৈতিক বুনিয়াদের শ্রেণীতে শ্রেণীতে মারাত্মক বিরোধের অবকাশ নেই। এ কারণে তার উপরি-কাঠামোর মধ্যেও আপসহীন বিরোধের উদ্ভব ঘটে না। তখন সমাজের মূল গঠন এবং বহির্গঠন সংযুক্তভাবে সমগ্র সমাজের অধিতকর অর্থনৈতিক উন্নতি এবং সুসমঞ্জস সভ্যতা বিকাশের মাধ্যম হিসাবে কাজ করে।
Bastille, fall of: বাস্তিলের পতন
১৭৮৯ সালের ১৪ জুলাই বাস্তিলের পতন অত্যাচারী ফরাসি সম্রাটের বিরুদ্ধে জনতার বিপ্লবী অভ্যুত্থানের সূচক বলে ইতিহাসে পরিগণিত হয়। বাস্তিল দুর্গ ছিল প্যারিস শহরে ফান্সের বিখ্যাত কারাগার। স্বৈরতান্ত্রিক সম্রাট এবং সামন্তবাদী শাসন ও অত্যাচারের প্রধান প্রতীক হিসাবে বাস্তিল দুর্গ জনসাধারণের মনে সর্বাধিক ঘৃণা এবং ক্রোধের সৃষ্টি করেছিল। বিপ্লব শুরু হলে প্যারিস শহরের একটি কারখানার শ্রমিকদের নেতৃত্বে বিক্ষুদ্ধ জনতা বাস্তিল দুর্গকে আক্রমণ করে এবং দুর্গের সশস্ত্র বাহিনীকে পর্যদস্ত করে দুর্গের দ্বার ভেঙ্গে ফেলে দুর্গের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ে। জনতার হাতে দুর্গের শাসক নিহত হয়। সমগ্র ফ্রান্সের নির্যাতনের প্রতীক হিসাবে জনতা এরপরে দুর্গকে একেবারে ভূমিসাৎ করে ফেলার জন্য তার প্রাচীরের পাথর একটি একটি করে খুলে ফেলতে আরম্ভ করে। ১৪ জুলাই বাস্তিলের পতন দিবসকে আজো ফরাসি দেশের জনসাধারণ শক্তির দিবস হিসাবে পালন করেন। বাসিবতল আক্রমণের লক্ষ্য এবং এর পতনের তাৎপর্য নিয়ে ইতিহাসের গবেষকদের মধ্যে মতের পার্থক্য আছে। অনেকে মনে করেন যে, বাস্তিল দুর্গে রাজনীতিক বন্দিদের মুক্তির জন্য জনতা বাস্তিল আক্রমণ করেছিল, একথা ঠিক নয়। আসলে জনতার প্রধঅন লক্ষ্য ছিল দুর্গের অস্ত্র দখল করা। কিন্তু একথা ঠিক যে, বাস্তিলের পতনের মধ্যে দিয়ে বিপ্লবী আক্রমণের উদ্যোগ ব্যপকতম জনসাধারণের হাতে চলে গিয়েছিল। এদিক দিয়ে ফরাসি বিপ্লবের সবচেয়ে নাটকীয় এবং তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ছিল বাস্তিলের পতন। এই ঘটনার পরে জনসাধারণের প্রতিনিধিদের জাতীয় পরিষদই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার উৎস হয়ে দাঁড়ায়।
Behaviourism: আচরণবাদ, ব্যবহারবাদ
আধুনিক মনোবিজ্ঞানে ‘বিহেভিয়রিজম’ একটি নতুন ধারা। বাংলায় একে আচরণবাদ বা ব্যবহারবাদ বলে আখ্যায়িত করা হয়। প্রাগমেটিজম বা প্রয়োগবাদ কিংবা কার্যবাদ নামক আধুনিক দার্শনিক তত্ত্বের ভিত্তিতে প্রধাণত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মনোবিজ্ঞানের আচরণবাদ তত্ত্বের বিকাশ ঘটে; এ তত্ত্বের প্রথম প্রবক্তা ছিলেন চিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জন বি. ওয়াটসন (১৮৭৮-১৯৫৮)। অবশ্য এ ক্ষেত্রে ওয়াটনসনের পূর্বগামী হিসাবে থর্নডাইকের (১৮৭৪-১৯৪৯) উল্লেখ করা যায়। জীব-জন্তুর আচরণের উপর থর্নডাইক যে সমস্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছিলেন ওয়াটসন তাকেই মনোবিজ্ঞানের নতুন তত্ত্বে ব্যবহার করেন।
আচরণবাদ বা ব্যবহারবাদের ক্ষেত্রে ‘আচরণ’ বা ‘ব্যবহার’ শব্দ বিশেষ অর্থ বহন করে। সাধঅরণ জীবনে ‘ব্যবহার’ বা আচরণের সঙ্গে ভালো-মন্দের একটি প্রশ্ন জড়িত থাকে। এবং ব্যবহার বা আচরণ বলতে আমরা কোনো অবস্থায় মানুষের মনের উদ্যোগে গৃহীত কোনো প্রতিক্রিয়ার কথা বুঝাই। সে দিক থেকে অনিচ্ছাকৃত বা বাধ্যতামূলক কোনো প্রতিক্রিয়াকে ব্যবহার বা আচরণ বলঅ হয় না। যেমন একটি আলপিন দিয়ে কারুর আঙুল বিদ্ধ করলে সে হাত টেনে নেয় বা বেদনার্ত চিৎকার করে ওঠে। এ প্রতিক্রিয়া সাধারণ অর্থে ব্যবহার বা আচরণ নয়। কিন্তু আচরণবাদী মনোবিজ্ঞানীর নিকট উল্লিখিত প্রতিক্রিয়াটি ব্যক্তির একটি আচরণ বা ব্যবহার।
আচরণবাদের উদ্ভব ঘটে মনসর্বস্ব কায়েমী মনোবিদ্যার প্রতিবাদ হিসাবে। এতদিন পর্যন্ত এই তত্ত্বই গৃহীত হয়ে আসছিল যে, মানুষের জীবনে মনই হচ্ছে আসল সত্তা। মনের ইচ্ছা-অনিচ্ছা অনুযায়ী মানুষ পরিবেশের সঙ্গে ব্যবহার করে। কিন্তু মন অদৃশ্য এবং অস্পশ্য। এ তত্ত্বের হেরফের কিছু যে না ঘটছে তা নয়। মনের সঙ্গে দেহের সম্পর্ক স্থাপন করারও চেষ্টা হয়েছে। মনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াকে ভুনড ঘড়ি ধরে মাপার চেষ্টা করেছেন। ডারউইন, মরগান, স্পেন্সার প্রমুখ জীববিজ্ঞানীগণও মনকে পরিবেশ-নির্ভর বলে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেছেন। স্পেন্সার ব্যাক্তি বা সাধারণভাবে মানুষের জীবনকে পরিবেশের সঙ্গে ক্রমাধিকভাবে খাপ খাইয়ে চলার প্রক্রিয়া হিসাবে দেখিয়েছেন।
কিন্তু কায়েমী মনোবিদ্যার বিরুদ্ধে সবচেয়ে জোরালো প্রতিবাদ আসে আচরণবাদী এবং পাভলভ-পন্থীদের পক্ষ থেকে। আচরণবাদের প্রতিষ্ঠাতা ওয়াটসন ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দে প্রদত্ত তাঁর বক্তৃতায় কায়েমী মনোবিদ্যার বিরুদ্ধে নিন্মোক্ত যুক্তিগুলি উপস্থিত করেন: (১) অদৃশ্য এবং অস্পশ্য মনকে চরম বলে স্বীকার করলে মনোবিদ্যা কেবল দার্শনিক তত্ত্ব হয়ে থাকবে; মনোবিদ্যা মনোবিজ্ঞানের রূপান্তরিত হতে পারবে না। কারণ মনকে নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা চলে না। (২) কায়েমী মনোবিদ্যার অন্তদর্শন বা ইনট্রোসপেকসন পদ্ধতি মনোবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে কোনো কার্যকর পদ্ধতি নয়। এ পদ্ধতি দ্বারা শিশু কিংবা পাগল, কারুর মনের খবরই জানা সম্ভব নয়। এ পদ্ধতি ব্যক্তির জীবনকে দুর্জ্ঞেয় করে রাখে। এমনকি ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বা বুদ্ধির পরিমাপও অন্তদৃষ্টির মারফত করা সম্ভব নয়।
এই সমালোচনার ভিত্তিতে আচরণবাদ মনোবিজ্ঞানের নতুন তত্ত্ব উপস্থিত করে। ওয়াটসন বললেন, মানুষের সমস্ত প্রকার ব্যবহারের কার্যকরণ সুত্র উদ্ধার কর মানুষের উন্নততর জীবনের জন্য আবশ্যক। এ উদ্দেশ্য সিদ্ধ হতে পারে যদি মানুষের ব্যবহার নিয়ে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পর্যবেক্ষণ এবং পরীক্ষা পরিচালিত হয়। আলপিন বিদ্ধ হলে জীবন্ত ব্যক্তির দেহ বিশেষ আচরণ করতে বাধ্য। আলপিন এখানে স্টিমুলাস বা উত্তেজক। মনুষ্যেতর জীবও এরূপ ক্ষেত্রে একই ব্যবহার করে। এ উত্তেজক যখনই প্রয়োগ করা হবে, তখনি ব্যক্তি এইরূপ আপরণ করবে। মনের ইচ্ছায় আচরণের কোনো মৌলিক পার্থক্য ঘটবে না। এরূপে ব্যক্তির যে-কোনো ব্যবহারই কোনো একটি উত্তেজকের প্রয়োগে দেহের প্রতিক্রয়া বিশেষ। যে-প্রতিক্রিয়াকে মানসিক বলে বিবেচনা করা হয় বা হত, সে-আচরণকেও উত্তেজক বা উদ্দীপক প্রয়োগের প্রতিক্রিয়া হিসাবে দেখানো চলে। যেমন রুশ জীববিজ্ঞানী পাভলভ তাঁর কুকুরের পরীক্ষা দ্বারা প্রমাণ করেছেন যে, খাদ্য দেখে কুকুরের জিহ্বায় লালা নিঃসরণ কুকুরের মনের ক্রিয়া বলে মনে করা হলেও খাদ্যের বদলে একটি শব্দ দ্বারাও কুকুরের জিহ্বাকে লালাসিক্ত করা যায়। এজন্য তিনি প্রথম খাদ্যের সঙ্গে শব্দের উদ্দীপকও প্রয়োগ করতেন। পরবর্তীকালে খাদ্য বাদে কেবল শব্দের উত্তেজক কুকুরের জিহ্বা লালাসিক্ত আরম্ভ করেঅ কাজেই দেখা যাচ্ছে যে, মানুষের যে-কোনো ক্রিয়াই উত্তেজকের প্রতিক্রিয়া এবং যে-কোনো প্রতিক্রিয়াকেই উত্তেজক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত করা চলে। অর্থ্যাৎ উত্তেজক বা পরিবেশ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ব্যক্তির প্রতিক্রিয়াও নিয়ন্ত্রণ কার সম্ভব। শিশুর মধ্যে জন্মগত প্রতিক্রিয়ার সংখ্যা সামান্য। শিশু ক্রমান্বয়ে যেরূপ উত্তেজক বা পরিবেশ লাভ করে সেইরূপ প্রতিক্রিয়া দ্বারা সে গঠিত হয়। উত্তেজকের ভিত্তিতে গঠিত প্রতিক্রিয়ার বংশপরাস্পরা হওয়ার কোনো উপায় নেই।
আচরণবাদের এই সংক্ষিপ্ত বিবরণ থেকে বুঝা যায় যে, আচরণবাদ মন বা চেতনার কোনো স্বাধীন অস্তিত্ব স্বকিার করে না। এবং আচরণবাদকে চরম আকারে গ্রহণ করলে মানুষের ব্যবহার উত্তেজক প্রয়োগমাত্র দেহের যান্ত্রিক প্রতিক্রিয়া ব্যতীত আর কিছুই নয়। একথা সত্য যে, আচরণবাদ মনোবিদ্যাকে মনোবিজ্ঞানে পরিণত করার ক্ষেত্রে একটি তাৎপর্যপূর্ণ সাহসিক পদক্ষেপ। মনময় হয়ে মনোবিদ্যা এতকাল যে তত্ত্বমার্গে আবদ্ধ ছিল সেখান থেকে আচরণবাদ তাকে বাস্তব পরীক্ষাগারে এনে মানুষের শিক্ষাগত, সমাজগত, জীবিকাগত দিকগুলিকে ক্রমাধিক পরিমাণে সুনির্দিষ্ট এবং ফলপ্রসূ করে তুলেছে। তবে আচরণবাদের চরম ব্যাখ্যা অর্থ্যাৎ মানুষের ব্যবহার ‘উত্তেজক-প্রতিক্রিয়া’ ব্যতীত কিছুই নয় এবং মানুষ্যেতর জীবের সঙ্গে তার ব্যবহারের কোনো পার্থক্য নেই, এরূপ অভিমত দ্বিধাহীনভাবে গৃহীত হয় না। অনেক আচরণবাদী মানুষের জটিল ব্যবহার ব্যাখ্যার জন্য সম্প্রতিকালে ইণ্টারমিডিয়েট ভেরিয়েবলস বা ‘মধ্যবর্তী ব্যত্যয়’-রূপ ধারণাও গ্রহণ করতে শুরু করেছেন।
Bellarmine, Roberd: রবার্ট বেলারমিন (১৫৪২-১৬২১ খ্রি.)
মধ্যযুগের একজন বিখ্যাত ক্যাথলিক লেখক। ফরাসিদেশের জেসুইটপন্থী ধর্মযাজক। খ্রিষ্ট ধর্মের গির্জার শাসনে পোপের ঐশ্বরিক অধিকারের বিষয় নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে বেলারমিন সরকারের প্রকার ভেদ নিয়েও আলোচনা করেন। শাসনের প্রশ্নে বেলারমিন অভিজাততন্ত্রকে নাকচ করেন। তাঁর মতে নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্র হচ্ছে সর্বোত্তম সরকার। কিন্তু একজন আদর্শ চরিত্রবান রাজা পাওয়া মানুষের ভাগ্যে কদাচিৎই ঘটে। সে কারণে জনসাধারণের নির্বাচিত প্রতিষ্ঠান দ্বরা রাজার যদৃচ্ছা শাসনকে নিয়ন্ত্রিত করার ব্যবস্থা থাকা বাঞ্ছনীয়। কারণ রাষ্ট্র শাসনের মূল অধিকার জনগনের। রাজার হস্তে জনসাধারণই শাসনের অধিকার ন্যস্ত করে। অর্থ্যাৎ জনগণকে শাসন করার রাজার ঐশ্বরিক অধিকারের কথা বেলারমিন অস্বীকার করেন। গীর্জা এবং রাষ্ট্রের সম্পর্কের প্রশ্নে বেলারমিন এরূপ অভিমত প্রকাশ করেন যে, গীর্জার শাসন এবং রাষ্ট্রের শাসন পরস্পর পৃথক। মানুষের লৌকিক ব্যাপারে পোপের কোনো প্রত্যক্ষ অধিকার থাকতে পারে না। পোপের অধিকার ধর্মীয় বিষয়ে সীমাবদ্ধ। তবে রাষ্ট্রের শাসক ধর্মের বিরোধী কোনো আইন প্রবর্তন করার চেষ্টা করলে পোপের অধিকার থাকবে সেরূপ আইনকে নিবৃত করার জন্য হস্তোক্ষেপ করার এবং গীর্জার অলঙ্ঘনীয়তাকে শাসক আক্রমণ করলে শাসককে ক্ষমতাচ্যুত করার অধিকার গীর্জার থাকবে। ফরাসি আইনবিদরা বেলারমিন এরূপ হস্তক্ষেপমূলক অভিমতের তীব্র সমালোচনা করেন।
Bentham, Jeremy: জেরেমী বেনথাম (১৭৪৮-১৮৩২ খ্রি.)
অষ্টাদশ শতকের ইংল্যাণ্ডের প্রখ্যাত নীতিশাস্ত্রবিদ এবং আইনের ব্যাখ্যাতা। নীতিশাস্ত্রের ক্ষেত্রে জেরেমী বেনথামকে ইউটিলিটারিয়ানিজম বা উপযোগবাদের প্রতিষ্ঠাতা মনে করা হয়। নীতিশাস্ত্রের ন্যায়-অন্যায় এবং ভালো-মন্দ প্রশ্নের আলোচনা করে বেনথাম বলেন যে, নীতি বা ন্যায়ের মূলে রয়েছে কার্যের প্রয়োগ বা সার্থকতার প্রশ্ন। একটা কার্য ভালো বা ন্যায্য বলে বিবেচিত হবে তার প্রয়োগ বা সার্থকতার ভিত্তিতে। সার্থকতা কি? কোনো কাজের ফলে সৃষ্ট সুখই হচ্ছে সে কাজের সার্থকতা। ব্যক্তি যখন কোনো কাজ করে তখন সে সুখ লাভ করার জন্যই ইহার সম্পাদন করে। আকাঙ্ক্ষিত সুখ লব্ধ হলেই কাজটি সার্থক এবং ন্যায্য। সুখের পরিবর্তে দুঃখের লাভ ঘটলে ব্যক্তির কাছে সে কাজ অসার্থক। সুখের এ ব্যাখ্যা একেবারেই ব্যক্তিক। সুখের এই ব্যক্তিক ব্যাখ্যাকে হিডোনিজম বা আত্মসুখবাদ বলে প্রচার করতে চান নি। সে জন্য উপযোগ বা সুখের ব্যাখ্যাকে ব্যাপক করে তিনি সুখ বলতে সামাজিক সুখকেও বুঝাতে চেয়েছেন। রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে উপযোগবাদের এই তত্ত্বকে সম্প্রসারিত করে বেনথাম বলেছেন যে, রাষ্ট্রের যে-কোনো আইন বা কার্যের সার্থকতার পরিমাপ হবে অধিকতম সুখের বিধান দ্বারা। সুখকেই কাজের সার্থকতার মাপকাঠি করা, আবার অধিক সংখ্যকের সুখ বিধানের সুপারিশের মধ্যে বেনথাম-তত্ত্বের স্ববিরোধিতা প্রকট হয়েছে। এর কারণ, বেনথাম একদিকে যেমন তৎকালীন ইংল্যাণ্ডের পুঁজিবাদী সমাজের ব্যক্তিকেন্দ্রীকতার পরিপোষক ছিলেন তেমনি অপরদিকে মানবিকতার বোধ থেকে তিনি সে সমাজের বৈষম্য এবং সুখের সামাজিক বণ্টনে ভারসাম্যহীনতাকেও অস্বীকার করতে পারেন নি। এ বিরোধিতার সমঝোতা করার জন্য বেনথাম বলেছেন যে, ব্যক্তিগত সুখ এবং সামাজিক সুখের মধ্যে আসলে বিরোধ নেই। একের সুখেই বহুর সুখ। আবার বহুর সুখেই একের সুখ। আত্মসুখ সাধনের মাধ্যমে মানুষ অপরের সুখও সাধন করতে পারে। কারণ সুখ মানে কেবল দেহের আরাম নয়। বিপন্নকে উদ্ধার করার জন্য জীবদানের মধ্যেও সুখ নিহিত আছে। আর সে সুখই উত্তম সুখ।
নিজের মানবতা বোধ থেকে বেনথাম ইংল্যাণ্ডের আইনের সংস্কারের চেষ্টা করেন। ফরাসি বিপ্লবের বৎসর ১৭৮৯ খ্রিষ্টাব্দে বেনথামের ‘ফ্রাগমেণ্ট অন গভার্নমেণ্ট’ বা সরকার সংক্রান্ত মতামত উপস্থিত করেন। বেনথাম বলেন, রাষ্ট্রের যে-কোনো বিধান বা কাজের লক্ষ্য হবে সর্বাধিক সংখ্যক অধিবাসীর সর্বাধিক পরিমাণ সুখের বিধান করা। ব্যক্তি বা রাষ্ট্রের কোনো কাজ ন্যায় কিংবা অন্যায় তা নির্ধারিত হবে সে কাজের ফলে সে সুখ লব্ধ হবে কিংবা বিনষ্ট হবে, তার তুলনামূলক পরিমাণ দ্বারা। রাষ্ট্রের কোনো শাস্তিমূলক বিধানের সার্থকতার মাপকাঠিও এইরূপ হবে। এ বিধান যাদের উপর প্রযুক্ত হবে তাদের সুখের পরিমাণ এর প্রয়োগে যদি বৃদ্ধি পায় তবেই এ বিধান ন্যায্য। অন্যথায় এ বিধান অন্যায্য।
তৎকালীন ইংল্যাণ্ডের রাষ্ট্রীয় বিধানের অধিকাংশই ছিল অলিখিত। আইনের বিশ্লেষণ করে বেনথাম বলেন, রাষ্ট্রের যে কোনো বিধানেরই একটি খারাপ দিক আছে। এর দ্বারা আহত ব্যক্তির সুখ বিনষ্ট হয়। কিন্তু বিনষ্ট পরিমাণের চেয়ে লব্ধ সুখের পরিমাণ অধিক হওয়া মধ্যেই এ বিধানের ন্যায্যতা নিহিত। প্রত্যেক বিধানের আরো দুটি দিক আছে। একটি তার অধিকারের দিক, অপরটি তার দায়িত্বের দিক। যেমন রাষ্ট্র, তেমনি ব্যক্তি উভয়রে ক্ষেত্রে এ সত্য। এ কারণে প্রত্যেক রাষ্ট্রীয় আইনের অধিকারও দায়িত্ব উভয় দিক সম্পর্কে নাগরিকমাত্রেরই ওয়াকিবহাল থাকতে হবে। সে জন্য আইনকে বিধিবদ্ধ, প্রকাশিত এবং প্রচারিত হতে হবে।
বেনথামের নীতিশাস্ত্রীয় তত্ত্বে স্ববিরোধিতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তা ছাড়া তিনি সুখের পরিমাণকে আঙ্কিক হিসাবে পরিমাপ করা যায় বলেও মনে করতেন। কিন্তু সুখের পরিমাণের এরূপ আঙ্কিক পরিমাপ সম্ভব বলে তাঁর পরবর্তী অনুসারীগণ মনে করতেন না। কন্তু স্ববিরোধিতা সত্ত্বেও তাঁর নীতিতত্ত্বে একটি মানবতাবোধের পরিচয় আছে। এই বোধ থেকে তাঁর আইনের বিশ্লেষণ এবং আইন বিধিবদ্ধ করার প্রয়াস ইংল্যাণ্ডের সামাজিক অর্থনৈতিক জীবনে বহু সংস্কারের সূচনা করে।
Bergson, Henri: হেনরী বার্গসঁ (১৮৫৯-১৯৪১ খ্রি.)
আধুনিক ভাববাদের প্রখ্যাত ফরাসি প্রবক্তা। বার্গসঁ বহু গ্রন্থের রচয়িতা। এই সমস্ত গ্রন্থের মধ্যে ‘সময় এবং স্বাধীন ইচ্ছা’ এবং সৃজনশীল অভিব্যক্তি বিশ্বব্যাপী পরিচিত। উক্ত গ্রন্থ দুখানার ইংরেজী অনূদিত নাম হচ্ছে টাইম এ্যান্ড ফ্রি উইল এবং ক্রিয়েটিভ ইভোল্যুশন।
বার্গসঁর ভাবধারা জটিল এবং দুর্বোধ্য। তবে তাঁর অভিমনের মূল বলে যা স্বীকৃত সে হচ্ছে এই যে, বার্গসঁ জ্ঞানের ক্ষেত্রে যুক্তির পদ্ধতি এবং সত্যের ক্ষেত্রে বস্তুর অস্তিত্ব অস্বীকার করেন। সাধারণভাবে বার্গসঁকে জীবনকাল বিস্তৃত ছিল। ঊনবিংশ শতকের শেষার্ধ এবং বিংশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত ফরাসি দেশ এবং ইউরোপের বিবর্তমান সমাজের তিনি অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিলেন। ধনতান্ত্রিক সমাজ-ব্যবস্থার স্বর্ণযুগ অস্তমিত। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রনৈতিক সঙ্কট, সংঘাত, বিদ্রোহ, বিপ্লব, মহাসমর, অরাজকতা সভ্যতার শিখরে উন্নীত মানুষের জীবনে দুরারোগ্য ব্যাধি বলে বার্গসঁর মনে হয়েছে। মানুষ আত্মবিনাশকারী সংঘর্ষের নিরসন করে সুস্থ স্বাভাবিক নতুন মানব সমাজ তৈরি করতে পারে, এ জীবনবাদের উপর তাঁর আস্থা ছিল না। আধুনিক বুদ্ধিজীবীদের জন্য এ এক সঙ্কটময় পরিস্থিতি। এ পরিস্থিতি থেকে মুক্তির দুটি পথ। এক, মানুষের সৃজনশীল ক্ষমতার উপর আস্থা রেখে বাস্তব সঙ্কট ও অরাজকতার কারণ দূর করে নতুন সমাজ তৈরির কার্যে এবং ভাবধারায় অংশগ্রহণ করা; দ্বিতীয় পথ হচ্ছে জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা এবং বস্তুর সত্যাসত্যতার প্রশ্ন তুলে চিন্তার জাল বুনে চলা। এ পথ যাঁরা আধুনিক যুগে গ্রহণ করেছেন, বার্গসঁ তাঁদের অন্যতম। অবশ্য এ পথ কেভল যে ব্যক্তিগত স্বার্থ সাধন করে, তা নয়। ক্ষয়িষ্ণু সঙ্কটগ্রস্ত ধনতান্ত্রিক সমাজের এটাই হচ্ছে অপরিহার্য দর্শন। অবাস্তব চিন্তার জালে বাস্তব সঙ্কট ও তার কারণকে আড়াল করে সে সঙ্কটের মূল রক্ষা করার প্রয়াস হচ্ছে এ দর্শনের লক্ষ্য। এ বিচারে বার্গসঁ অসাধারণ লেখনীর ক্ষমতা প্রয়োগে এক জটিল মায়ারাজ্য রচনা দ্বারা আধুনিক ধনতন্ত্রের শ্রেষ্ঠ দার্শনিকের মর্যাদা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন।
‘টাইম এ্যাণ্ড ফ্রি উইল’ পুস্তকের মধ্যে বার্গসঁ তাঁর মতামতকে অত্যন্ত জোরের সঙ্গে উপস্থিত করার চেষ্টা করেছেন। তাঁর মতে আমাদের ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান আদৌ কোনো জ্ঞান নয়। মানুষের পঞ্চ ইন্দ্রিয় মানুষকে যে জ্ঞান দেয়, সে জ্ঞান হচ্ছে পরিমাপযোগ্য বিভাজ্য বস্তুনিচয়ের জ্ঞান। কিন্তু সত্য হচ্ছে অবিভাজ্য এবং পরিমাপের অযোগ্য। সেই অখণ্ড এবং অপরিমেয় সত্যের জ্ঞান কেবলমাত্র ইনট্যুশন অর্থাৎ উপলব্ধি বা স্বজ্ঞার মারফতই মানুষ লাভ করতে পারে, বুদ্ধি, যুক্তি এবং বাহ্যিক অভিজ্ঞতার মাধ্যমে আমরা আমাদের সাধারণ জ্ঞান লাভ করি। কিন্তু এ জ্ঞান অলীক। বার্গসঁর তত্ত্বকে অ-যুক্তিবাদের দর্শন বলেও অভিহিত করা হয়। বার্গসঁ তাঁর স্বজ্ঞার দৃষ্টান্ত এবং ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানের অলীকতা বুঝাবার জন্য একটি ঘটনার উল্লেখ করেন। কোনো ব্যক্তি তার একটি হাত রাখা অবস্থা থেকে তুলল। এই ঘটনার দুটি দিক আছে। একটি হচ্ছে হাতের মালিকের অনুভূতির দিক। এ ব্যাপারে তার অনুভূতি একটি অখণ্ড অনুভূতি। কিন্তু এই ঘটনাটিকে একজন পর্যবেক্ষক যখন দেখে তখন তার কাছ এ ঘটনা হাতের সঞ্চালন প্রক্রিয়ার কতকগুলি মুহুর্ত বা অবস্থা ব্যতীত কিছু নয়। হাত তোলার এটাই ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান। কিন্তু এ জ্ঞান এবং হাত তোলার মুহুর্তে হাতের মালিকের অখণ্ড উপলব্ধি বা স্বজ্ঞার মধ্যে আদৌ কোনো মিল বা সাদৃশ্য নেই। পদ্ধতির দিক থেকে এরা পরস্পর-বিরোধী। কেবল পদ্ধতি নয়। উভয়ের প্রদত্ত ফল বা সত্যও পরস্পর-বিরোধী। স্বজ্ঞা ব্যক্তিকে এ ক্ষেত্রে যে সত্য সম্পর্কে জ্ঞান করে, সাধারণ জ্ঞানের সত্য তার বিরোধী। একটি ঘটনার ক্ষেত্রে যা সত্য, সমগ্র বিশ্ব চরাচর অর্থাৎ জগৎ সম্পর্কে তাই সত্য। বুদ্ধি ও যুক্তি আমাদের সত্যের অলীক ধারণা দেয়। স্বজ্ঞাই কেবল অখণ্ড সত্তা হচ্চে ‘ড্যুরেশন বা স্থিতিকাল’। ‘স্থিতিকাল’ বস্তু নয়, কিন্তু স্থিতিকালই হচ্ছে সমস্ত বস্তুর মূল। স্থান, কাল, পাত্র বলে যে সমস্ত অস্তিত্বের কথা আমরা বলি, বার্গসঁর মতে সেগুলি এই স্থিতির প্রকার-ভেদ।
কেবল বস্তু নয়, বস্তুর বিকাশের প্রশ্নেও বার্গসঁ বস্তুবাদী বিকাশবাদের বিরোধিতা করেন। বিকাশের বস্তুবাদী তত্ত্ব হচ্ছে যে, বস্তু অন্তর্নিহিত বিরোধের মাদ্যমে নিয়ত পরিবর্তমান। কিন্তু ‘স্থিতিকালের’ তত্ত্ব প্রয়োগ করে বার্গসঁ বলেন যে, সমস্ত সত্তার মূলে যেমন স্থিতিকাল, তেমনি সেই স্থিতিকাল একটা প্রাণবেগে অভিব্যক্ত হচ্ছে। খণ্ডিত সত্তার ক্ষেত্রে যেমন একথা সত্য; চরম বা সমগ্র সত্তা সম্পর্কেও একথা সত্য। চরম সত্তা অভিব্যক্ত হয়ে চলেছে এবং এ অভিব্যক্তির মূলে রয়েছে একটা প্রাণাবেগ বা ‘ভাইটাল ইমপালস’। লতা, বৃক্ষ, জীব-জন্তু, সবকিছু প্রাণাবেগে অভিব্যক্ত হয়ে চলেছে। কেবল প্রাণের প্রশ্ন নয়। সপ্রাণ, অপ্রাণ, বস্তুমাত্রের ক্ষেত্রেই প্রাণাবেগ হচ্ছে অভিব্যক্তির কারণ। ‘প্রানাবেগের’ তত্ত্বের ভিত্তিতে বার্গসঁর বিকাশের অভিমত ক্রিয়েটিভ ইভোল্যুশন বা সৃজনশীল অভিব্যক্তিবাদ বলে পরিচিত।
সামাজিক প্রশ্নে বার্গসঁ ছিলেন রক্ষণশীল। সমাজের আর্থিক বৈষম্য, শ্রেণীগত শোষণ ইত্যাদি অন্যায় নয়। এগুলিও স্থিতিকালের অভিব্যক্তি এবং স্বাভাবিক ব্যাপার।
Berkeley George: জর্জ বার্কলে (১৬৮৫-১৭৫৩ খ্রি.)
খ্রিষ্টান ধর্মযাজক এবং অন্যতম ইংরেজ ভাববাদী। প্রাচীন গ্রিসের শ্রেষ্ঠ ভাববাদী দার্শনিক প্লেটো এবং আধুনিক ভাববাদী দার্শনিক কাণ্টের মধ্যবর্তী দীর্ঘ সময়ে জর্জ বার্কলের ন্যায় শক্তিশালী ভাববাদী দার্শনিক আর দ্বিতীয় কেউ ছিলেন না। ধর্মযাজকদের জেহাদী মনোভাব নিয়ে জর্জ বার্কলে চিন্তার জগতে বস্তুবাদী দর্শনকে নস্যাৎ করার পণ গ্রহণ করেন। মধ্যযুগের ধর্মান্ধতা ছিন্ন করে আধুনিক বিজ্ঞান, দর্শন ও সমাজতত্ত্ব ইংল্যাণ্ডে দৃঢ় পদক্ষেপে অগ্রসর হচ্ছিল। ফান্সিস বেকনের পর্যবেক্ষণমূলক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি, নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব এবং জন লকের ব্যক্তি-স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের সমর্থনমূলক ভাবধারা ইংল্যাণ্ডের নতুন সমাজ-ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা দুরারোগ্য করে তুলছিল। প্রচলিত ধর্মীয় ভাবধারা বিজ্ঞান, দর্শন এবং সমাজতত্ত্বের এই অগ্রগতিতে অতিশয় বিপন্ন বোধ করেন। ধর্মীয় ভাবধারার এই সঙ্কটকালে যাজক পরিবারের সন্তান জর্জ বার্কলে ধর্মকে রক্ষা করা নিজের কর্তব্য হিসাবে গ্রহণ করেন। জর্জ বার্কলের গ্রন্থসমূহের মধ্যে ‘প্রিন্সিপলস অব হিউম্যান নলেজ’ বা ‘মানবজ্ঞানের সূত্রসমূহ’ নামক গ্রন্থ অতিশয় বিখ্যাত। এই গ্রন্থের মধ্যেই বার্কলের দর্শনের মূলকথা লিপিবদ্ধ। অথচ এ গ্রন্থ ১৭১০ অর্থাৎ বার্কলের মাত্র পঁচিশ বৎসর বয়সে প্রকাশিত হয়। এ গ্রন্থ তাই দার্শনিক কূটতর্কে অংশগ্রহণে এবং নিজের অভিমত উপস্থাপনে তাঁর বিস্ময়কর ক্ষমতার সাক্ষ্য।
জর্জ বার্কলে তাঁর দার্শনিক অভিমত তাঁর পূর্ববর্তী দার্শনিক জন লকের দার্শনিক মতামতের সমালোচনা এবং জবাব হিসাবে উপস্থিত করেন। তাঁর উল্লিখিত গ্রন্থ ১৬৯০ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত জন লকের ‘এসে কনসারনিং হিউম্যান আণ্ডারস্ট্যাণ্ডিং’ বা মানববিজ্ঞান সম্পর্কিত নিবন্ধের সরাসরি সমালোচনা।
বস্তুজগৎ এবং বস্তুজগতের জ্ঞান সম্পর্কে জন লকের অভিমত ছিল এরূপঃ বস্তু সম্পর্কে পদার্থবিজ্ঞানের সাক্ষ্য যথার্থ। অণুর সম্মেলনেই বস্তু গঠিত। একটা যান্ত্রিক গতিতে বস্তু গতিময় হয়ে আছে। সেই যান্ত্রিক গতিতে ব্সতু গঠিত। একটা যান্ত্রিক গতিতে বস্তু গতিময় হয়ে আছে। সেই যান্ত্রিক গতিতে বস্তু যখন আমাদের ইন্দ্রিয়কে আঘাত করে তখন সে ইন্দ্রিয় সেই আঘাতজনিত অনুভূতিকে মনের মধ্যে বহন করে। এভঅবেই মনের মদ্যে বিশেষ বিশেষ বস্তু সম্পর্কে ভাবের সৃষ্টি হয়। এভাবেই সমন্বয়েই বস্তুজগৎ সম্পর্কে মানুষের জ্ঞানভাণ্ডার তৈরি হয়। সুতরাং জ্ঞানের মাধ্যম ভাব এবং ভাবের উৎস অভিজ্ঞতা বা বস্তু। লক অবশ্য অবিমিশ্র বস্তুবাদী অভিমত পোষন করতে পারেন নি। তিনি বস্তু সম্পর্কিত ভাবের শ্রেণীভেদ করে এক প্রকার ভাবকে মৌলিক বা বস্তুসঞ্জাত এবং অপর প্রকার ভাবকে অমৌলিক বা মনসঞ্জাত বলে অভিহিত করেছিলেন। এটা জন লকের দর্শনের দুর্বলতা।
পক্ষান্তরে জর্জ বার্কলে মনে করেন যে, বস্তুকে জ্ঞানের মূল উৎস হিসাবে গ্রহণ করলে ধর্মীয় বিধাতার অস্তিত্বকে অস্বীকার করা হয়। বস্তুই তা হলে চরম সত্তা হয়ে দাঁড়ায়। তাই তিনি জন লকের উপরোক্ত তত্ত্বকে ধর্মের দিক দিয়ে বিপজ্জনক ঘোষণা করে যুক্তির ক্ষেত্রে গ্রহণের অযোগ্য বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন। বার্কলে বললেন লকের তত্ত্ব অনুযায়ী মানুষ জ্ঞানের ক্ষেত্রে মনের ভঅবকে জানে। এ কথা স্বীকার্য; কিন্তু এর অধিক যখন লক বলেন যে, মনের সে ভাব মনের বাইরে মননিরপেক্ষ বস্তুর অস্তিত্বের পরিচায়ক ও প্রতিভূ, তখনি লক হাস্যকর যুক্তির অবতারণা করেন। মন আসলে ভাবের বাইরে আদৌ যেতে পারে না। মন কেবল মনের ভাবকেই জানতে পারে। আমরা যখন টেবিল, চেয়ার, কলম ইত্যাকার কথাগুলি বলি তখন এগুলি দ্বারা আমাদের এক একটি ভাবকে নির্দেশিত করি। ‘টেবিল’ কথাটি একটি টেবিল নামক ‘বস্তু’ নয়। লকের মত অনুযায়ী ‘টেবিল’ কথাটি যদি ‘টেবিল’ বস্তুর প্রতিভূ হয়, তা হলে টেবিলরূপ ভাব এবং টেবিলরূপ বস্তুর মধ্যে একটা ব্যবধান এবং পার্থক্য রয়েছে, তাকে স্বীকার করতে হয়। টেবিল কথা বা ভাব-ই যদি টেবিলরূপ বস্তু না হয়, তাহলে এ ভঅব যে টেবিলরূপ ব্সুতর যথার্থ প্রতিভূ, তার নিশ্চয়তা কোথায়? মনের ভাব ব্যতীত জ্ঞানের কোনো মাধ্যম নেই। আবার মনেরও কোনো ক্ষমতা নেই নিজের ভাবকে অতিক্রম করে বস্তু বা অমনীয় কোনো সত্তাকে স্পর্শ করার। এমন অবস্থায় যাকে আমরা বস্তু বলি যে মনের ভাব ব্যতীত কিছুই নয়। লক যদি একপ্রকার ভাবকে মন নির্ভর বলে থাকেন, তা হলে তাঁর অপর প্রকার ভাবই বা মন নির্ভর হবে না কেন? টেবিল, চেয়ার, কলমের ন্যায় প্রত্যেকটি ভাবই মন-নির্ভর। মন যখন তাদের সম্পর্কে সচেতন হয় তখনি মনের নিকট তারা অস্তিত্বশীল হয় ‘এসসি এট পারসিপি’ –‘আমি তাকে দেখি বা প্রত্যক্ষ করি, আর তাই তার অস্তিত্ব’।
বস্তুবাদের এই খণ্ডন বিজ্ঞান ও বস্তুবাদের বিকাশের সেই যুগে বুদ্ধিজীবী এবং জনসাধারণের নিকট বিশেষ জোরালো বলে মনে হয়েছিল। জন লকের দর্শনের দুর্বলতাই ছিল বার্কলের অভিমতের শক্তির মূল। বার্কলের দর্শনের উপরোক্ত সংক্ষিপ্ত বর্ণনা থেকেই বোঝা যায়, এ দর্শন মনময় দর্শন। শুধু মনময় নয়, এ দর্শন ব্যক্তির মনের মধ্যে আবদ্ধ দর্শন। বার্কলে যখন বলেন, ‘আমি দেখি, তবেই সে থাকে’ তখন ভাবমাত্রই ব্যক্তির চেতনার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। বার্কলে নিজেও তাঁর অভিমতনের এই সঙ্কট সম্পর্কে সচেতন হয়েছিলেন। এ পর্যন্ত তাঁর অভিমত ছিল ‘সলিপসিস্ট’ বা ব্যক্তির মনের ভাবময় দর্শন। বস্তুকে নাকচ করে মনকে চরম বলে স্বীকার করার ফরে বার্কলের দর্শন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল, যেখানে মানুষের সমাজ ব্যক্তির মনের বিচ্ছিন্ন স্বাধীন চিন্তার পরস্পর সংযোগহীন একটা অরাজক অবস্থা ছাড়া আর কিছু নয়। এখানে ধর্মীয় বিধাতার কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না এবং যেটাকে আমি টেবিল বলে ভাবছি সেটাকে আর দশটি মনও যে কেন টেবিল বলে ভাবছে তারও হদিস মেলে না। তাঁর দর্শনকে এই সঙ্কট থেকে মনও যে কেন টেবিল বলে ভাবছে তারও হদিস মেলে না। তাঁর দর্শনকে এই সঙ্কট থেকে বাঁচাবার জন্য বার্কলে আর দুটি সূত্রের অবতারণা করেন। ১. ব্যক্তিক মনের বাইরে এক স্বাধীণ চরম মনের অস্তিত্ব আছে। সেই চরম মন হচ্ছে ধর্মীয় বিধাতা; ২. বিধাতার মনে সমস্ত ভাবই সুপ্ত অবস্থায় বিদ্যমান রয়েছে। বিধাতার ইচ্ছায় তাঁর সুপ্ত ভাব ব্যক্তিমনের সক্রিয় ভাবরূপে প্রকাশিত হয়। বিধাতার মধ্যে সব ভান বিদ্যমান বলে আমরা যখন টেবিল বা চেয়ার বা কলম সম্পর্কে অচেতন থাকি, তখনও টেবিল, চেয়ার কলম অস্তিত্বহীন হয়ে যায় না। বিধাতার মনে তাদের অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকে; আবার বিধাতার কারণেই এক টেবিলরূপ ভাব সকলের মনেই জাগ্রত হয়; এক ভাব ভিন্নরূপে ভিন্ন ভিন্ন মনে জাগ্রত হতে পারে না। বার্কলে এরূপে তার অভিমতের ব্যাখ্যা করে মনে করেন যে, লকের বস্তুকে তিনি অস্তিত্বহীন প্রমাণ করে ভাব এবং বিধাতার অস্তিত্বকে অখণ্ডনীয় করতে সক্ষম হয়েছেন।
এই দর্শনের অনুসিদ্ধান্ত হিসাবে বার্কলে তাঁর যুগের বৈজ্ঞানিক আবিস্কারাদির সত্যকে অস্বীকার করেন এবং বিজ্ঞানের বিকাশে বাধাদানের চেষ্টা করেন। তিনি বিজ্ঞানের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে বলেন যে, বিজ্ঞানের কাজ হবে জগতের মূলে যে স্রষ্টা রয়েছে তার প্রকাশ বোঝার চেষ্টা করা; জাগতিক কার্যকারণ সম্পর্ক দ্বারা প্রকৃতিকে ব্যাখ্যা করা নয়। নিউটনের মহাশূন্য এবং মাধ্যাকর্ষণের তত্ত্বকে তিনি ভিত্তিহীন বলে মনে করেন।
সহজবোধ্য উদাহরণ দ্বারা বার্কলে তাঁর ভাববাদকে জনপ্রিয় করার চেষ্টা করেছিলেন। ঊনবিংশ শতকের ‘ইমানেন্স’, ‘প্রাগমেটিজম’, ‘এমপিরিও ক্রিটিসিজম’ প্রভৃতি বিভিন্ন ভাববাদী উপধারার মধ্যে জর্জ বার্কলের মনময় দর্শনের প্রভাব লক্ষ করা যায়। মার্কসবাদী দার্শনিক ভি. আই. লেনিন তাঁর ‘এমপিরিও ক্রিটিসিজম’ গ্রন্থে বার্কলে দর্শন এবং তার আধুনিক পুনঃপ্রকাশের বিশ্লেষণ ও সমালোচনা করেন।
Berlin wall: বার্লিন প্রাচীর
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে প্রাচ্য তথা রাশিয়া এবং পাশ্চাত্য বা ইংল্যাণ্ড এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইংল্যাণ্ডের উদ্যোগে বার্লিন শহরকে দুই ভাগে বিভক্ত করে পূর্বকে পূর্ব বার্লিন আর পশ্চিম অংশকে পশ্চিম বার্লিন বলা হয়। দুই বার্লিনের দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে ১৯৮৯ সনে পাশ্চাত্য শক্তির আঘাতে বার্লিন দেয়ালের পতন ঘটে।
Bernstein, Eduard: এডওয়ার্ড বার্নস্টাইন (১৮৫০-১৯৩২ খ্রি.)
জার্মান সোস্যালডিমোক্রাট। মার্কসবাদীগণ বার্নস্টাইনকে বিপ্লবী শ্রমিক আন্দোলনের বিরোধী ব্যক্তি এবং সংশোধনবাদের প্রতিষ্ঠাতা বলে গণ্য করেন। বার্নস্টাইন মার্কসবাদের মূল দর্শন, অর্থনীতি এবং বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রকে নিজস্ব ব্যাখ্যা দ্বারা সংশোধন করার চেষ্টা করেন। বিপ্লবী সমাজতন্ত্রের বদলে বার্নস্টাইন বিবর্তনবাদী সমাজতন্ত্রের তত্ত্ব উপস্থিত করেন। তাঁর ‘ইভোল্যুশনারী সোস্যালিজম’ বা ‘বিবর্তনবাদী সমাজতন্ত্র’ নামক গ্রন্থে বার্নস্টাইন এরূপ অভিমত প্রকাশ করেন যে ১. মার্কস পুঁজিবাদের আসন্ন পতনের যে কথা বলেছিলেন তা বাস্তবে সত্য বলে প্রমাণিত হয় নি; ২. মার্কস শ্রেণীবিরোধকে যেভাবে আপসহীন বিবেচনা করেছেন এবং পুঁজিপতি এবং সর্বহারার দুই প্রান্তে সমাজকে বিভক্ত করেছেন, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অব্যাহত অস্তিত্ব তাকে ভুল প্রমাণিত করেছে; ৩. পুঁজিবাদের চরিত্রে পরিবর্তন সংঘটিত হচ্ছে। সমাজসংস্কারের আন্দোলনের ফলে পুঁজিবাদের শোষণমূলক চরিত্রের অনেক পরির্তন সংঘটিত হচ্ছে; ৪. চরম সংঘর্ষের বদলে ধীরে এবং ক্রমান্বয়ে সামাজিক সংস্কারের লক্ষ্য দ্বারা শ্রমিকশ্রেণী অধিকতর স্থায়ী ফল লাভ করতে পারে। বার্নস্টাইনের কাছে হেগেলের দ্বন্দ্ব এবং মার্কসের দ্বন্দ্বের মধ্যে কোনো পার্থক্য নাই। মার্কসবাদের ‘সর্বহারার একনায়কত্বে’র তত্ত্বকে তিনি অস্বীকার করেন। তাঁর মতে শ্রেণীসংগ্রাম ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে একটি সমন্বিত সমাজব্যবস্থা রূপ লাভ করবে। সমাজতন্ত্রের কোনো চরম লক্ষ্য থাকার প্রয়োজনকেও বার্নস্টাইন অস্বীকার করেন। শ্রমিকশ্রেণীর লক্ষ্য হবে সমাজের সংস্কারসাধন, বিপ্লব সংঘটিত করা নয়। “চরম লক্ষ্যের কোনো মূল্য নাই। সংস্কারের চেষ্টা বা আন্দোলনই আসল বিষয়”। রাশিয়ার শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে মেনশেভিক এবং অর্থনীতিবাদী বা ইকনমিস্টদের বার্নস্টাইনের অনুসারী মনে করা হয়। প্লেখানভ এবং লেনিন তীব্রভাবে বার্নস্টাইনের সমালোচনা করেন।
Bhutbada: ভূততত্ত্ব, প্রকৃতিতত্ত্ব
ভারতীয় দর্শনের পাশ্চাত্য ভাষ্যকারগণের কেহ কেহ প্রাচীন ভারতীয় দর্শনের লোকায়ত মতকে ভূতবাদ বলে আখ্যায়িত করেন। খ্রিষ্টীয় প্রথম শতককে এই মতের উৎপত্তিকাল বলে অনুমান করা হয়।
‘ভূতবাদ’ আখ্যা দ্বারা জগৎ ও সৃষ্টি সম্পর্কে প্রাচীন ভারতীয় দর্শনকে সংক্ষেপে চিহ্নিত করা চলে। প্রাচীন গ্রিক দর্শনের ন্যায় প্রাচীন ভারতীয় দর্শনের বৈশিষ্ট্য ছিল প্রধানত জাগতিক। জীবন ও বস্তু জগতের মূলে কি আছে, এ প্রশ্নের জবাবে প্রাচীন ভারতীয় দর্শনের লোকায়ত শাখা এরূপ মনে করত যে, জীবন ও জগৎ হচ্ছে ‘পঞ্চ ভূতাত্ত্বক’। প্রাচীন চিন্তাবিদগণ এই পঞ্চভূতকে যথাক্রমে ক্ষিতি (পৃথিবী) অপ (পানি), তেজ (অগ্নি), মরুৎ (বায়ু) এবং ব্যোম (আকাশ) বলে অভিহিত করতেন। পঞ্চভূত বা পঞ্চমূলের আবির্ভাব সম্পর্কে বিভিন্ন প্রকার মত ছিল। বেদান্ত দর্শনের মতে প্রথমে আকাশ থেকে অগ্নি, অগ্নি থেকে পানি এবং পানি থেকে পৃথিবী, এভাবে পঞ্চভূতের আবির্ভাব হয়। এই পঞ্চভূতই হচ্ছে সমস্ত সৃষ্টির মূল উপাদান। সৃষ্টির মধ্যে যত প্রকার বা ভেদ সবই এই মৌলিক উপাদান-সমূহের বিভিন্ন প্রকার সম্মেলনের ফল। এমনকি মন বা চেতনাও সমস্ত উপাদানের একটি বিশেষ ধরনের সম্মেলনের ফলে উদ্ভূত হয়েছে। কিন্তু ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম এই পঞ্চভূতের বিশেষ এবং জটিল সম্মেলনে সৃষ্ট চেতনার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে, চেতনা অপর কোনো পদার্থে চেতনা সৃষ্টি করতে না পারলেও মূল পদার্থের মিলন প্রক্রিয়ায় সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করে বিভিন্ন নতুন পদার্থ সৃষ্টিতে সে সক্ষম।
ভূততত্ত্বের চেয়ে ভারতীয় দর্শনের বস্তুবাদী ধারা চার্বাক দর্শন নামে অধিকতর পরিচিত। উল্লিখিত পঞ্চভূতের মধ্যে ব্যোম বা আকাশ ছাড়া অপর চারটি পদার্থের স্বীকৃতি প্রচীনতম চার্বাক দর্শনে পাওয়া যায়। সৃষ্টি ব্যতীত জ্ঞানের ক্ষেত্রেও লোকায়ত বা চার্বাক দর্শনের অভিমত ছিল বস্তুবাদী। চার্বাক দর্শন ইন্দ্রিয়-বহির্ভূত জ্ঞানকে অলীক বলে মনে করত। এ কারণে পরোক্ষ বা অনুমানসিদ্ধ জ্ঞান তাদের কাছে যথার্থ বলে স্বীকৃত হয় নি। ধর্মের অলৌকিক শক্তি বা বিধাতার অস্তিত্ব অনুমানের উপর নির্ভরশীল। এ জন্য চার্বাকরা অজ্ঞেয় বিধাতার অস্তিত্ব এবং আত্মার পুনর্জন্মকেও অস্বীকার করেছে।
Binet, Alfred: আলফ্রেড বাইনেট (১৮৫৭-১৯১১ খ্রি.)
ফরাসি পরীক্ষামূলক মনোবিজ্ঞানী। ফরাসি দেশে ১৮৯৫ সনে আলফ্রেড বাইনেট প্রথম ফরাসি মনোবিজ্ঞানের পত্রিকার প্রতিষ্ঠা করেন। মনোবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তাঁর সহকর্মী সাইমনের সঙ্গে যুক্তভাবে বাইনেট শিশুর বুদ্ধি পরিমাপের একটি পদ্ধতি আবিস্কার করেন। এ কারণেই প্রধানত আলফ্রেড বাইনেট খ্যাতি অর্জন করেন। উক্ত পদ্ধতি মনোবিজ্ঞান বাইনেট পরিমাপক বা বাইনেট-সাইমন পরিমাপক নামে পরিচিত। সাধারণ মনোবিদ্যায় এ পর্যন্ত ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে বুদ্ধিগত পার্থক্য এবং তার কারণের বিষয় আলোচিত হয় নি। কেবল অন্তর্দৃষ্টি বা ইনট্রোসপেকশানের মারফত এ পার্থক্যের কারণ স্থির করার উপায় ছিল না। আধুনিক শিল্প-বিপ্লবের পূর্বে ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে পার্থক্যের বিষয়টি সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে এত তাৎপর্যপূর্ণ হয়েও দেখা দেয় নি। কিন্তু শিল্প-বিপ্লব একদিকে যেমন অসংখ্য মানুষকে অর্থনৈতিক জীবনের এক একটি কেন্দ্রে কেন্দ্রীভূত করতে শুরু করল, তেমনি উৎপাদনের ক্ষেত্রে শ্রমের বিভাগ এক এক ব্যক্তির উপর উৎপাদনের প্রত্যন্ত অংশের দায়িত্ব ন্যস্ত করল। ফলে উৎপাদনের কোনো সমগ্র প্রক্রিয়ার পরিবর্তে এক একটি বিশেষ দিকে দক্ষতা অর্জন ব্যক্তির জন্য অধিকতর প্রয়োজনীয় হয়ে উঠল। সামাজিক এই পরিবশে আলফ্রেড বাইনেটের দৃষ্টি ক্রমান্বয়ে সাধারণ মনোবিদ্যা থেকে পরীক্ষামূলক মনোবিজ্ঞানের বিকাশে নিবদ্ধ হয়। একই পরিবারের পাঁচটি শিশু একই রকম বুদ্ধির পরচয় দেয় না। কি কারণে একই পরিবেশে একটি শিশু যে কাজ যেরূপ দক্ষতার সঙ্গে করতে পারে, অপর শিশু তা পারে না? এই কারণ অনুসদ্ধানেই বাইনেট তাঁর মনোবিজ্ঞানের গবেষণা নিবদ্ধ করেন। নিজের দুটি কন্যার বুদ্ধিগত পার্থক্যই তাঁর প্রথম পরীক্ষার বিষয় হয়। পরে তিনি অপ্রাপ্ত বুদ্ধির শিশুদের শিক্ষায়তনে দল হিসাবে তাঁর তত্ত্বের পরীক্ষা করেন। বাইনেটের প্রধান প্রতিপাদ্য ছিল এই যে, বুদ্ধির কোনো একক আছে। দেহের যেমন বয়স বৃদ্ধি ঘটে, তেমনি জন্ম থেকে শিশুর বুদ্ধিরও বৃদ্ধি ঘটে। কিন্তু দেহে বয়সের বৃদ্ধির সঙ্গে সমতা রেখে শিশুর বয়স বৃদ্ধি না পেতে পারে এবং কোনো স্থানে এসে তার বুদ্ধির বয়স বৃদ্ধির প্রক্রিয়া স্তব্ধ হয়েও যেতে পারে।
এই প্রতিপাদ্য প্রমাণের জন্য বাইনেট বিভিন্ন বয়সের শিশুদের জন্য ত্রিশ রকম পরীক্ষা উদ্ভাবন করেন। মৌখিক বা অ-মৌখিক ক্রিয়াগত এই পরীক্ষাগুলিকে বাইনেট খুব সহজ করার চেষ্টা করেন। তাঁর মতে এই পরীক্ষাগুলির মাধ্যমে আমরা যে-কোনো শিশুর বুদ্ধির পর্যায় স্থির করতে পারি। পরীক্ষাগুলির ফলাফলের গড়ের ভিত্তিতে শিশুর বুদ্ধির একক বার করা সম্ভব। এই একক বা নির্দেশককে ইংরেজিতে ‘ইনটেলিজেন্স কুশেণ্ট’ বলা হয় এবং সংক্ষেপে ‘আই. কিউ’ অক্ষরদ্বয় দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। বাইনেটের পদ্ধতি ক্রমান্বয়ে কেবল শিশু নয়, যে-কোনো বয়সের ব্যক্তির বুদ্ধি পরিমাপের ক্ষেত্রে প্রযুক্তি হতে থাকে। ব্যক্তির বুদ্ধি পরিমাপের জন্য বাইনেট এরূপ স্থির করেন কোনো শিশু বা ব্যক্তির দেহের বয়ঃক্রমের সংখ্যাকে তার বুদ্ধির বয়সের ক্রম সংখ্যা দ্বারা ভাগ করে উক্ত ফলকে ১০০ দ্বারা গুণ করলে ব্যক্তির বুদ্ধির মান বা ‘আই. কিউ’ বার করা সম্ভব হবে। বাইনেট প্রবর্তিত পদ্ধতি হুবহু ব্যবহার করা না হলেও তাঁর পরীক্ষামূলক মনোজ্ঞানের নীতি মনোবিদ্যাকে প্রভূত পরিমাণে উন্নত করেছে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিভিন্ন সমস্যার ক্ষেত্রে কোন ব্যক্তি উপযুক্ত হবে এবং কোন ব্যক্তি উপযুক্ত হবে না, তা নির্ধারণের জন্য বাইনেটের পরীক্ষার নীতি ও পদ্ধতি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। ব্যক্তি থেকে ব্যক্তির বুদ্ধিগত পার্থক্য নিরূপণকে বাইনেট তাঁর মনোবিজ্ঞানের প্রধান লক্ষ্য হিসাবে স্থির করায় তাঁর অভিমতকে ডিফারেনশিয়াল সাইকোলজি বা ভেদাত্মক মনোবিজ্ঞান বলেও আখ্যায়িত করা হয়।
Biology: জীববিদ্যা, জীববিজ্ঞান
জীববিদ্যা বা জীববিজ্ঞান বলতে জীবনের বিকাশের নিয়ম এবং জীবনের প্রকারভেদ নিয়ে আলোচনা এবং গবেষণা বুঝায়। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিকদের চিন্তাধারায় জীবনের বিকাশগত সমস্যার সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। এ নিয়ে তাঁরা চিন্তা করেছেন। কিন্তু স্বাধীন, সুসংবদ্ধ এবং পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষাভিত্তিক বিজ্ঞান হিসাবে এর উদ্ভব আধুনিককালেই মাত্র ঘটেছে। ফরাসি প্রকৃতিতত্ত্ববিদ লামার্ক (১৭৪৪-১৮২৯ খ্রি.) তাঁর আলেচনায় প্রথম ‘জীববিদ্যা’ কথা ব্যবহার করেন।
জ্ঞানের ক্ষেত্রে জীববিজ্ঞানের পরিধি বিশেষ ব্যাপক। বস্তুত বর্তমানে জীববিজ্ঞান বলতে পদার্থবিজ্ঞানের ন্যায় একটিমাত্র বিজ্ঞানকে বুঝায় না। জ্ঞানের একটি দিক হিসাবে জীববিদ্যাকে দেখা হয়। যে-কোনো প্রাণীর মধ্যে জীবনের যে বিকাশ ঘটেছে তার বৈজ্ঞানিক আলোচনাই জীববিজ্ঞানের পরিধির অন্তর্ভুক্ত। এজন্য এই বৃহৎ পরিধির মধ্যে একাধিক জীবনবিষয়ক বিজ্ঞানের বিকাশ ঘটেছে। জীববিজ্ঞানের মধ্যে জুলজি বা প্রাণিবিজ্হান, বোটানি বা উদ্ভিদবিজ্ঞান, এমব্রিওলজি বা ভ্রূণবিজ্ঞান, পেলিওনটলজি বা প্রত্নজীববিজ্ঞান, মাইক্রোবাইওলজি বা জীবাণুবিজ্ঞান, জেনিটিক্স বা বংশতত্ত্ব এবং ফিজিওলজি বা দেহতত্ত্বকে অন্তর্ভুক্ত মনে করা হয়।
জীবনের পর্যবেক্ষণমূলক আলোচনা ঊনবিংশ শতকেই শুরু হয়। এই শতকের মধ্যভাগে জীবন সম্পর্কে চার্লস ডারউইনের পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা জীববিদ্যায় একটি বিপ্লব সাধন করে। ইতোপূর্বে জীবন এবং তার বিকাশ কেবল দার্শনিক তত্ত্বকথার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। তখন পর্যন্ত মানুষের সাধারণ এবং ব্যাপক ধারণা ছিল যে, জীবনের শুরু থেকে মানুষ বর্তমান আকারেই ছিল। মানুষজাতি বর্তমান অবয়বে জীবনের শুরুতেই সৃষ্ট হয়েছে। ডারইউনের ক্রমবিবর্তনবাদ এবং সজীবদেহের মূল হিসাব সংখ্যাহীন জীবকোষের আবিস্কার জীবন সম্পর্কে পুরাতন বদ্ধমূল ধারণাকে আমূল পাল্টে দেয়। জীবনের বিকাশের মূল কারণকেও ডারউইন উদঘাটিত করেন। এর ফলে পূর্বকার টেলিওলজিক্যাল বা উদ্দেশ্য প্রণোদিত বিকাশবাদের তত্ত্বও নস্যাৎ হয়ে যায়।
দার্শনিক তত্ত্ব যেমন বহুকাল দর্শনের পরিধির মধ্যে রেখে জীববিদ্যাকে প্রভাবিত করেছে, অপরদিকে জীববিদ্যার আধুনিক বিকাশ দর্শনকেও প্রভূত পরিমাপে প্রভাবান্বিত করেছে। বর্তমান জীবন সম্পর্কে দার্শনিক আলোচনা জীববিজ্ঞানের সিদ্ধান্তের স্বীকৃতির ভিত্তিতেই করা হয়। এ ছাড়া জীববিদ্যার বিকাশ দর্শনের জন্য আলোচনার নতুনতর সমস্যাও সৃষ্টি করেছে। এ সমস্ত সমস্যার মধ্যে জীবদেহের সামগ্রিকতার সঙ্গে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ব্যবহারগত সম্পর্কের সমস্যাটি অন্যতম। জীববিজ্ঞানের সিদ্ধান্ত হচ্ছে যে, একটি জীবনের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ভিত্তিতে যে একটি পূর্ণ সত্তা বা ‘হোল’ তৈরি করে, সেই সত্তার বাইরে এই অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের অনুরূপ ব্যবহার সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। ইংরেজিতে এই সমস্যাকে ‘Wholism’-এর সমস্যা বলে আখ্যায়িত করা হয়।
Blanqui, Luis: লুই ব্লাঙ্কুই (১৮৫০-১৮৮১ খ্রি.)
ফরাসিদেশের কাল্পনিক সাম্যবাদী। ১৮৩০ এবং ১৮৪৮ এর বিপ্লবী অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করেন এবং দু’বার মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন। জীবনের প্রায় অর্ধভাগ তাঁর কারাগারে অথিবাহিত হয়। ব্লাঙ্কুইর উপর প্রভাব পড়েছিল অষ্টাদশ শতকের বস্তুবাদ, নিরীশ্বরবাদ, কাল্পনিক সমাজবাদ এবং বিশেষ করে বাব্যুফবাদের। তাঁর মনোভাব ছিল বিপ্লবী। কিন্তু বিপ্লব সাধনের জন্য গণআন্দোলন এবং বিপ্লবী দল গঠনের তাৎপর্য তিনি উপলব্ধি করেন নি। এ কারণে তাঁর বিপ্লবী প্রচেষ্টা অনেক ক্ষেত্রে ষড়যন্ত্রমূলক আঘাতে পর্যবসিত হয়েছিল।
Bodin, Jean: বোদিন বা জাঁবোদা (১৫৩০-১৫৯৬ খ্রি.)
ষোড়শ শতাব্দীর বিখ্যাত ফরাসি রাষ্ট্রচিন্তাবিদ। তাঁর রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের তত্ত্ব বিশেষ আলোচিত তত্ত্ব। ষোড়শ শতাব্দীতে ফরাসিদেশ যখন শক্তিসঞ্চার করতে থাকে, এবং একটি কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা বিকাশলাভ করে, বোদিনের সার্বভৌমিক তত্ত্ব তখন রাজার একচ্ছত্র শাসনের অধিকারকে জোরদার করে। বোদিন রাষ্ট্রের উৎপত্তির প্রশ্নে পরিবারকে মূল বলে গণ্য করেন। আদিতে পরিবারসমূহের গোষ্ঠীবদ্ধতার সমাজ বিভক্ত ছিল। পারিবারিক গোষ্ঠীসমূহের মধ্যে যুদ্ধ বিগ্রহের মাধ্যমে শক্তিশালী গোষ্ঠীর জয়লাভ এবং দুর্বল গোষ্ঠীসমূহের পরাজয় এবং বশ্যতা স্বীকারের ভিত্তিতে রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটেছে বলে বোদিন অভিমত পোষণ করেন। বোদিনের মতে রাষ্ট্রের শাসকই হচ্ছে সার্বভৌম। ঈশ্বরের বিধান এবং প্রাকৃতিক ও সামাজিক নৈতিক বিধানের বাইরে রাষ্ট্রের গানরিকদের উপর শাসকের শাসনের সার্বভৌমত্বের অপর কোনো সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে না। এই যুক্তিতে বোদিন রাজতন্ত্রকে সরকারের সর্বোত্তম প্রকার বলে বিবেচনা করেন। কারণ সার্বভৌম রাজাই নাগরিকদের জীবনে শান্তি এবং শৃঙ্খলার নিশ্চয়তা দান করতে পারে। তাঁর মতে রাষ্ট্রের তাত্ত্বিক সার্বভৌমত্ব বাস্তবে শাসক রাজার মাধ্যমেই প্রকাশিত হয়। তা সত্ত্বেও বোদিন আবার রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব এবং শাসক রাজা বা রাষ্ট্রের সরকারকে অভিন্ন বিবেচনা করেন নি। সার্বভৌমত্ব যুক্তিগতভাবে অবশ্যই রাষ্ট্রের। কিন্তু বাস্তবে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের প্রকাশ ও প্রয়োগ ঘটে যে ব্যবস্থার মাধ্যমে তা হচ্ছে সরকার। কাজেই রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রাজতান্ত্রিক, অভিজাততান্ত্রিক কিংবা গণতান্ত্রিক বিভিন্ন প্রকার সরকারের মাধ্যমেই প্রকাশিত হতে পারে।
Border-Line Situation: প্রান্তিক পরিস্থিতি
জাসপারস-এর অস্তিত্ববাদী তত্ত্বের একটি নীতি। জাসপারস-এর মতে ভীতি, অপরাধ, দ্বন্দ্ব, অসন্তোষ, মৃত্যু ইত্যাদি হচ্ছে মানুষের জন্য প্রান্তিক পরিস্থিতি। এগুলি মানুষের আত্মিক অভিজ্ঞতার সীমাকে চিহ্নিত করে। এরা হচ্ছে অস্তিত্বের প্রান্ত। এই প্রান্তকে অতিক্রম করে অনস্তিত্বের সূচনা। জাসপারস-এর মতে প্রান্তিক পরিস্থিতি মানুষ মাত্রের জন্য অমোঘ এবং অনিবার্য। পান্তিক পরিস্থিতি অতিক্রম করার অর্থই হচ্ছে, মানুষের অস্তিত্ব থেকে অনস্তিত্বে উৎক্রমণ। মানুষে যথার্থভাবে ন্যায়, অন্যায়, ভালো, মন্দ, সৎ-অসৎ-এর বিসংবাদের মীমাংসা করে নীতিগত সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত কেবলমাত্র এই প্রান্তিক পরিস্থিতির অনিবার্যতা উপলব্ধির মাধ্যমেই গ্রহণ করতে পারে।
Bradley, F.H. : ব্রাডলে (১৮৪৬-১৯২৪ খ্রি)
ঊনবিংশ, বিংশ শতকের ব্রিটিশ ভাববাদী দার্শনিক। ব্রাডলের ‘এ্যাপিয়ারেন্স এ্যাণ্ড রিয়ালিটি’ বা ‘প্রকার ও সত্তা’ একখানি বিখ্যাত দার্শনিক গ্রন্থ। রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রেও ব্রাডলে একজন উল্লেখযোগ্য চিন্তাবিদ। উল্লিখিত কালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন অধ্যাপক, যেমন কেয়ারড (১৮৩৫-১৯০৮), টমাস হিল গ্রিন (১৮৩৬-১৮৮২), বারনার্ড বোসানকোয়েট (১৮৪৮-১৯২৩) এঁরা ‘অক্সফোর্ড ভাববাদী’ বলে পরিচিত হন। ইতোপূর্বে ইংল্যাণ্ডে শিল্প বিপ্লবের ফলশ্রুতিতে এবং রাজতন্ত্রের একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে ব্যক্তি স্বাধীণতার আন্দোলনের মাধ্যমে যে চরম ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের বিকাশ ঘটেছিল অক্সফোর্ড ভাববাদীদের মধ্যে তার একটা প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের প্রাধান্যের কালে যেখানে ব্যক্তির জীবনে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপকে মূলতই অবাঞ্ছিত বলে গণ্য করা হয়, সেখানে এই ব্রাডলে এবং উল্লিখিত চিন্তাবিদগণ ব্যক্তির জীবনে রাষ্ট্রের কল্যাণমূলক হস্তক্ষেপের যে প্রয়োজন রয়েছে, তার উল্লেখ করেন। এঁদের মতে মানুষ যেমন একটি নৈতিক প্রাণী এবং তার কার্যের মূল বিচার তার নীতি বা লক্ষ্যের ভিত্তিতে, রাষ্ট্রের বিচারও তার লক্ষ্যের ভিত্তিতে। রাষ্ট্রের লক্ষ্য হচ্ছে মানুষের নৈতিক উন্নতি সাধন। এ লক্ষ্যে ব্যক্তি এবং রাষ্ট্রকে পরস্পরবিরোধী শক্তি হিসাবে বিবেচনা করা অযৌক্তিক। ব্যক্তিকে নিয়ে যেমন রাষ্ট্র এবং ব্যক্তির উন্নতিতেই রাষ্ট্রের উন্নতি, তেমনি রাষ্ট্র বা সমাজের বাইরেও ব্যক্তির কোনো অস্তিত্ব থাকতে পারে না। ব্রাডলে এই দৃষ্টিভঙ্গির উপর জোর প্রদান করে তার ‘এথিক্যাল স্টাডিস’ গ্রন্থে বলেন যে, নৈতিক প্রাণী হিসাবে পরিবার এবং সমাজের বাইরে ‘ব্যক্তি’ হিসাবে ব্যক্তির কোনো অস্তিত্ব নাই। পিতামাতার কাছ থেকে প্রাপ্ত দৈহিক এবং মানসিক গুণাবলী যেমন ব্যক্তির অস্তিত্বের মৌল উপাদান তেমনি যে সমাজে সে বর্দ্ধিত হয় এবং জীবন ধারণ করে সেই সমাজের ভাসা, আচার-আচরণ, সংস্কার, বিশ্বাস এবং প্রতিষ্ঠানই তার সামাজিক অস্তিত্বকে তৈরি করে। কাজেই ব্যক্তি বনাম সমাজ বা রাষ্ট্র, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের এমন চরম চিন্তার কোনো বাস্তব ভিত্তি থাকতে পারে না। অক্সফোর্ড ভাববাদী বলে কথিত চিন্তাবিদদের এই সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রাচীন গ্রিক চিন্তাবিদ এ্যারিস্টটলের রাজনৈতিক চিন্তার বেশ কিছুটা পুনঃপ্রকাশ লক্ষ্য করা যায়।
Brahe, Tycho: টাইকো ব্রাহে (১৫৪৬-১৬০১ খ্রি.)
জ্যোতির্বিজ্ঞানের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। ডেনমার্কের একটি অভিজাত পরিবারে জন্ম। কোপেন হেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন অধ্যয়ন শুরু করলে ১৫৬০ সনে ২১ আগস্ট সূর্যের পূর্ণগ্রহণের দৃশ্য টাইকো ব্রাহেকে জ্যোতির্মণ্ডলের পর্যবেক্ষণ ও গবেষণায় আকৃষ্ট করে। এতদিন পর্যন্ত যেখানে অন্তরীক্ষের তারকামণ্ডলীকে এ্যারিস্টটলীয় তত্ত্ব অনুযায়ী অপরিবর্তনীয় মনে করা হত সেখানে টাইকো ব্রাহে তারকামণ্ডলীর পরিবর্তনকে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করে এ্যারিস্টটলীয় তত্ত্বকে ভুল প্রমাণিত করেণ। টাইকো ব্রাহের জ্যাতির্বিজ্ঞানের পর্যবেক্ষণ ও গবেষণায় তাঁর মৃত্যুর কিছুকাল পূর্বে কেপলারের আবিস্কারের মূলে টাইকোর পর্যবেক্ষণ ও পরামর্শের বূমিকা বৈজ্ঞানিকগণ দ্বারা আজ স্বীকৃত।
Bruno, Giordano: গিওর্দানো ব্রুনো (১৫৪৮-১৬০০ খ্রি.)
ইউরোপীয় পুনর্জাগরণ যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ। গিওর্দানো ব্রুনো কেবল দার্শনিক ছিলেন না। তিনি ইতালির বিখ্যাত কবি এবং নাট্যকার বলেও পরিচিত। স্বাধীন প্রবক্তা ব্রুনো খ্রিষ্টধর্মের ডমিনিকান মত পরিত্যাগ করায় গোঁড়া সাধক সম্প্রদায় তাঁকে ইনকুইজিশন বা ধর্মীয় আদালতে বিচার করে প্রথমে কারাগারে নিক্ষেপ করে। দীর্ঘ আট বছর কারাগারে নির্মম নির্যাতনের পরে ব্রুনোকে রোম শহরে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়।
গিওর্দানো ব্রুনো মধ্যযুগের ধর্মতত্ত্বের বিরোধী ছিলেন। তিনি রোমান ক্যাথলিক মতকে সমালোচনা করেন। জীবন এবং জগৎ সম্পর্কে তাঁর অভিমত ছিল বিস্ময়কররূপে বস্তুবাদী। এই বস্তুবাদী বিশ্বদৃষ্টি তিনি প্রাচীন গ্রিসের বস্তুবাদী দার্শনিকদের নিকট থেকেই প্রধানত লাভ করেন। তাঁর বস্তুবাদ প্যানথিজম বা সর্বপ্রাণবাদ বলে আখ্যায়িত হয়। ব্রুনো বিশ্বাস করতেন, একটা বিশ্বপ্রাণের অস্তিত্ব আছে। এই প্রাণ সর্ববস্তুতেই প্রকাশমান। ব্রুনোর মতে প্রকৃতি বা জগৎ হচ্ছে অসীম। তিনি পৃথিবী সম্পর্কে কপারনিকাসের তত্ত্বকে স্বীকার করেন। কিন্তু ব্রুনোর অভিমতে আমরা কেবলমাত্র কপারনিকাসের তত্ত্বের স্বীকৃতি পাইনে, তাঁর অভিমতে কপারনিকাসের তত্ত্বের অধিকতর বৈজ্ঞানিক বিকাশও লক্ষ করা যায়। কারণ কপারনিকাস যেখানে সূর্যকে স্থির এবং সৌরমণ্ডলকে একমাত্র মণ্ডল বলে মনে করতেন, সেখানে গিওর্দানো ব্রুনো এরূপ অভিমত প্রকাশ করেন যে, সূর্য স্থির নয় এবং সৌরমণ্ডল একমাত্র সৃষ্টিমণ্ডল নয়। তাঁর মতে মহাজগতে অসংখ্য জগতের অস্তিত্ব রয়েছে এবং সৌরমণ্ডল একমাত্র সৃষ্টিমণ্ডল নয়। তাঁর মতে মহাজগতে অসংখ্য জগতের অস্তিত্ব রয়েছে এবং পৃথিবী ছাড়া অপর জগতেও জীবন থাকা সম্ভব। ব্রুনোর পূর্বে পৃথিবী গ্রহের গঠন সম্পর্কে কোনো সুসমঞ্জস ধারণা ছিল না। ব্রুনোই বলেন যে, পৃথিবরি সর্বাঞ্চলের গঠনের মধ্যেই মাটি, পানি, বাতাস, তেজ এবং ইথারের ক্ষেত্রে সাদৃশ্য আছে। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিকের ন্যায় ব্রুনোও বস্তুকে গতিময় মনে করতেন। মানুষের চেতনাও বস্তু বা প্রকৃতিরই ভেদ। এ সমস্ত অভিমত ছাড়া সমগ্র প্রকৃতির গতি, মহাজগতের ঐক্য এবং অস্তিত্বের পারস্পরিক নির্ভরতা প্রভৃতি প্রশ্নেও ব্রুনোর চিন্তা ছিল বৈজ্ঞানিক।
Buddhism: বৌদ্ধবাদ
প্রাচীন ধর্মসমূহের অন্যতম ধর্ম হচ্ছে বৌদ্ধ ধর্ম। অভিজ্ঞানপ্রাপ্ত সিদ্ধার্থ বা বুদ্ধ এই ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা। বুদ্ধের জীবনকাল ছিল ৫৬৩-৪৮৩ খ্রি. পূ.। প্রাচীন ভারতে হিন্দু বা ব্রাহ্মণ্যধর্মের প্রতিপত্তি ছিল। বুদ্ধের অভিমত এই প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্মণ্যধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহস্বরূপ। এ কারণে হিন্দুধর্ম এবং হিন্দু সম্রাটগণ বুদ্ধের ধর্মের প্রচারকে রুদ্ধ করে দেবার চেষ্টা করেন। বুদ্ধের অনুসারীদের উপর নানাপ্রকার অত্যাচার ও নির্যাতন অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু ব্রাহ্মণ্যধর্মের গোঁড়ামি, আচার-অনুষ্ঠান, ব্যাপক পশুবলি এবং অনমনীয় বর্ণপ্রথার বিরুদ্ধে জনমতের প্রতিধ্বনিস্বরূপ ছিল বলে বৌদ্ধধর্ম দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জন করে। শুধু ভারতে নয় –ভারতের বাইরে সিংহল, নেপাল, বার্মা, চীন এবং জাপানে বৌদ্ধ ধর্ম প্রসারিত হয়। প্রথমে বিরোধাত্মক সম্পর্ক থাকলেও কালক্রমে ব্যাপক হিন্দুধর্ম বুদ্ধকে তার অন্যান্য অবতারের সঙ্গে নবম অবতার বলে স্বীকৃতিদান করে।
বাংলাদেশের একজন প্রাচীন বৌদ্ধ কবি রামচন্দ্র বুদ্ধকে লক্ষ্য করে যে উক্তি করেন, তাতে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম এবং বৌদ্ধ ধর্মের বিরোধের ভাবটি সুন্দররূপে প্রকাশ পেয়েছে। উক্ত কবির মতে “ব্রহ্মা অবিদ্যা দ্বারা অভিভূত; বিষ্ণু মহামায়ার আলিঙ্গন বিমুগ্ধ; শঙ্কর আশক্তিবশত পার্বতীকে নিজ দেহে ধারণ করিয়াছিলেন; কিন্তু মুনিপুঙ্গর বুদ্ধ অবিদ্যা, মায়া, আসক্তি এই সমূহ হইতে সম্পূর্ণ বিমুক্ত”।–(বিশ্বকোষ) প্রাচীন ভারতীয় সমাজের একদিকে যখন আদিম গোত্রতান্ত্রিক যৌথ সমাজ-ব্যবস্থা ভেঙে পড়ছিল এবং অপরদিকে সমাজের একটা অংশ তার অনড় আচার-অনুষ্ঠান এবং বর্ণাশ্রমের মাধ্যমে নিজের স্বার্থকে রক্ষা করার চেষ্টা করছিল, বৌদ্ধধর্মের প্রসার ঘটে সেইকালে। বুদ্ধ ভগবানের অস্তিত্ব, বেদের নির্ভূলতা এবং বর্ণাশ্রম প্রথাকে অস্বীকার করেন।
কিন্তু বুদ্ধ ব্রাহ্মণ্যধর্মের অসার অনুষ্ঠান এবং নির্যাতনমূলক বর্ণ প্রথার শৃঙ্খল থেকে জনসাধারণকে মুক্ত করার জন্য সামাজিক পরিবর্তনের কথা বলেন নি। জনসাধারণকে তিনি আত্মার উন্নতি সাধনের মাধ্যমে কুক্তি অর্জন করতে বলেছেন। হিন্দু ধর্মের জন্মান্তরবাদের তত্ত্বকে বুদ্ধ সম্পূর্ণ উপেক্ষা করতে পারেন নি। তাঁর মতে আত্মা জন্মান্তর গ্রহণ করে। কিন্তু সে জন্মান্তরের ভালো-মন্দ বর্ণের মধ্যে আবদ্ধ নয়। মানুষ তার কৃতকর্মের কারণে ভালো কিংবা মন্দ জন্মগ্রহণ করে। জীবনের ভোগ বাসনা পরিত্যাগের সাধনা দ্বারাই জীবন জন্মান্তরের বন্ধন থেকে মুক্তি বা নির্বাণ লাভ করতে পারে।
বৌদ্ধধর্মে দুটি ধারা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। একটি হীনযান ধারা, অপরটি মহাযান ধারা। হীনযান ধারাই বৌদ্ধ ধর্মের প্রাচীনতম এবং বুদ্ধের শিক্ষা-ভিত্তিক প্রতিষ্ঠিত ধারা। হীনযান মতে বিশ্ব এবং জীবকে এক ধারায় গ্রথিত করা হত। সৃষ্টি হচ্ছে বস্তু এবং চেতনার বিবর্তন। বিবর্তিত সৃষ্টিমাত্রেরই বিশেষ বিশেষ স্বভাব আছে। এই স্বভাবই হচ্ছে সৃষ্টির ধর্ম। কোনো অস্তিত্ব বা সত্তার নির্বাণের জন্য আবশ্যক হচ্ছে তার নিজের ধর্মের বর্জন। স্বভাবের বর্জনে সত্তার সমস্ত প্রকার স্বভাব বা ধর্মরূপ শৃঙ্খল থেকে মুক্তি। এই মতের মধ্যে প্রকৃতি ও বস্তু জগতের একটা স্বীকৃতি আছে। পরবর্তীকালে মহাযান মতবাদ বুদ্ধের জীবনের নৈকট্যমূলক অভিমত বর্জন করে। মহাযান পন্থীরা বুদ্ধকে দেবতার আসনে প্রতিষ্ঠিত করে এবং বিবিধ অনুষ্ঠান মারফত বুদ্ধের দয়া উদ্রেকের মধ্যে মানুষের মুক্তি নিহিত বলে প্রচার করে। মহাযানপন্থীদের মতে বস্তু বা বস্তুর ধর্ম হচ্ছে অলীক বা মায়া। জগৎও মায়া। খ্রিষ্টাব্দ দ্বিতীয় শতকের বিখ্যাত বৌদ্ধ যুক্তিবিদ নাগার্জুন যুক্তির পারম্পর্যে জগৎকে মায়া বা শূন্য বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন।
Bukharin: বুখারিন (১৮৮৮১৯৩৮ খ্রি.)
রুশ বিপ্লবের একজন প্রখ্যাত রাজনৈতিক তাত্ত্বিক। কিন্তু বলশেভিক পার্টির নেতা লেনিনের সঙ্গে যেমন তাঁর ১৯১৮ সনে তত্ত্বগত মতবিরোধ ঘটে, তেমনি বিপ্লবোত্তর রাশিয়াতে স্ট্যালিনের সঙ্গে তার মতান্তর সৃষ্টি হয়। রাশিয়াতে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার জন্য স্টালিনের সাংগঠনিক ও তাত্ত্বিক নেতৃত্বে যে নীতি সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টি গ্রহণ করে, বুখারিত পার্টির অভ্যন্তরে দক্ষিণপন্থী ভিন্ন একটি গ্রুপ গঠনের মাধ্যমে তার বিরোধিতা করেন বলে স্ট্যালিন অভিযোগ করেন। পরবর্তীকালে এই বিরোধ গ্রুপের ধ্বংসাত্মক কাজের অভিযোগে বিচার অনুষ্ঠিত হয় এবং তাঁর অপর সঙ্গীদের সঙ্গে বুখারিনকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়।
Burke, Edmund: এডমাণ্ড বার্ক (১৭২৯-১৭৯৭ খ্রি.)
অষ্টাদশ শতকের ইংল্যাণ্ডের পার্লামেণ্টের বিখ্যাত বাগ্মী সদস্য এবং রাজনীতিবিদ। বার্কের রাজনৈতিক চিন্তা, বক্তৃতা এবং রচনার মধ্যে উদারনীতি এবং রক্ষণশীলতার মিশ্রণ ঘটে। ইংল্যাণ্ডের সরকার আমেরিকার উপনিবেশের উপর ট্যাক্স আরোপ করলে বার্ক উপনিবেশের পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করেন। ওয়ারেন হেস্টিংস-এর শাসনে ভারতে ব্রিটিশ শাসনে ব্যাপক দুর্নীতির বিরুদ্ধেও তিনি উচ্চকণ্ঠ হন। সে সময়ে রাজনৈতিক দল হিসাবে হুইগ দল কনজারভেটিভ দলের চাইতে উদারনীতিক ছিল। বার্ক হুইগ দলের সদস্য ছিলেন। কিন্তু বার্ক তার সুপরিচিত পুস্তক ‘রিফ্লেকশানস অন ফ্রেঞ্চ রিভোল্যুশন’ বা ‘ফরাসি বিপ্লবের উপর চিন্তা’ গ্রন্থে ফরাসি বিপ্লবের তীব্র সমালোনার মাধ্যমে নিজের রক্ষণশীল মনোভাবের প্রকাশ ঘটান। বস্তুত ফরাসি বিপ্লবের বিরুদ্ধে বার্কের সমালোচনার মাধ্যমে ইংল্যাণ্ডের প্রতিষ্ঠিত বুর্জোয়া শাসন ব্যবস্থার একটি অংশের ফরাসি বিপ্লবের সুদূরপ্রসারী তাৎপর্য সম্পর্কে আশঙ্কা এবং ভীতির প্রকাশ ঘটে। ইংল্যাণ্ডে রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের বিপ্লবের উদ্যোগী ভূমিকা ইংল্যাণ্ডের পুঁজিবাদী শ্রেণী গ্রহণ করলেও অষ্টাদশ শতকের ফরাসি বিপ্লবের ‘সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার’ আওয়াজ মানুষের চিন্তায় একটা নতুন পর্যায়ের সূচনা ঘটায়। ফরাসি বিপ্লবের এই নতুন তাৎপর্যে কেবল যে ইউরোপের সামন্ততান্ত্রিক শ্রেণী ও রাজতান্ত্রিক শাসকরা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে তাই নয়, ইংল্যাণ্ডের বুর্জোয়া শাসকশ্রেণীও ফরাসি বিপ্লবের ‘সাম্যে’র আওয়াজে নিজেদের শ্রেণী শাসনের প্রতি আঘাতের তাৎপর্যকেও উপলব্ধি করে। এডমাণ্ড বার্ক যখন তাঁর ওজস্বিনী ভাষায় ফরাসি বিপ্লবকে আক্রমণ করে বলেন: “ফরাসি বিপ্লবীদের কাছে আমাদের শিক্ষা গ্রহণের কোনো প্রয়োজন নেই। আমরা ঈশ্বরকে যেমন বয় করি, রাজাকে তেমনি সমীহ করি; আমরা পার্লামেণ্টকে যেমন ভালবাসি, সরকারকে তেমন মান্য করি; আমরা গীর্জার পুরোহিতদের যেমন ভক্তি করি, অভিজাতদের তেমনি সম্মান করি” –তখন কেবল ব্যক্তিগত আবেগ নয়, সমাজের অধিকতর বিপ্লবী বিকাশের প্রশ্নে ইংল্যাণ্ডের শাসকশ্রেণীর শ্রেণীগত উদ্বেগের প্রকাশ ঘটে।
C
Campanella, Thomas: টমাস ক্যাম্পানেলা (১৫৬৮-১৬৩৯ খ্রি.)
ষোড়শ এবং সপ্তদশ শতকের ইতালির দার্শনিক এবং কল্পনাবাদী চিন্তাবিদ। ১৫২৮ সনে ক্যাম্পানেলা সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করেন। ক্যাম্পানেলার চিন্তার মধ্যে অ-খ্রিষ্টীয় অভিমত, ম্যাকিয়াভেলীর বাস্তববাদ এবং খ্রিষ্টীয় ধর্মীয়ভাব –এসবের মিশ্রণ দেখা যায়। স্কলাসটিসিজম বা মধ্যযুগের ধর্মীয় যুক্তিবাদের বদলে ক্যাম্পানেলা প্রকৃতি এবং ইতিহাসের ব্যাখ্যায় শক্তি, যুক্তি এবং প্রেম এই তিন নীতি অধিকতর শ্রেয় বলে বিশ্বাস করতেন। ‘সিভিটাটিস সলিস’ নামে সংলাপের রীতিতে তিনি যে কল্পনা-রাজ্য রচনা করেন সেখানে রাজা হলো একদল নির্বাচকমণ্ডলী দ্বারা নির্বাচিত; রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় কাজের সেখানে সম্মিলন ঘটেছে এবং সর্বজনীন শ্রমের মাধ্যমে যে সম্পদ উৎপাদিত হচ্ছে তার মালিকাতা হচ্ছে যৌথ। কালের বিচারে ক্যাম্পানেলার এরূপ কাল্পনিক সাম্যমূলক চিন্তার সেকালে একটি প্রগতিশীল ভূমিকা ছিল। মুক্তচিন্তার জন্য ক্যাম্পানেলা ধর্মান্ধ গীর্জার কোপানলে পতিত হন। ১৫৯৯ খ্রিষ্টাব্দে ক্যাম্পানেলা ইতালিকে স্পেনের দখলকারী শাসন থেকে মুক্ত করার জন্য একটি দেশপ্রেমিক বিদ্রোহ সংগঠিত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাঁর সে চেষ্টা ব্যর্থ হয় এবং তাঁকে নির্মম নির্যাতনের পরে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। ২৭ বছর ক্যাম্পানেলাকে কারাগারে বন্দি রাখা হয়। কারাগারে তিনি তাঁর ‘সিভিটাটিস সলিস’ বা ‘সূর্য নগরী’ রচনা করেন।
Capital: পুঁজি, মূলধন
১. উৎপাদনের ক্ষেত্রে পুঁজি হচ্ছে প্রয়োজনীয় উপাদানসমূহের মধ্যে একটি উপাদান। সম্পদ বৃদ্ধির জন্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে জমি, যন্ত্র, শ্রম এবং পুঁজি এই চারটি উপাদান প্রধান। ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে ‘পুঁজি’ শব্দ দ্বারা নতুন পণ্য ক্রয়ের আর্থিক সামর্থ্য বুঝায়। এরূপ অর্থ পুঁজি বলতে কেবল টাকা নয়, মালিকের মালিকানাধীন দালানকোঠা, জমি, যন্ত্রপাতি এবং অন্যান্য দ্রব্যসামগ্রি বুঝাতে পারে। ‘জাতীয় পুঁজি’ দ্বারা দেশের শিল্পে উৎপাদিত সমগ্র পণ্য এবং অধিকতর পণ্য উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় মজুর সম্পদকে বুঝায়। মার্কসীয় অর্থনীতির ব্যাখ্যায় ‘পুঁজির আসল কাজ হলো বাড়তি পণ্য অর্থাৎ বাড়তি মূল্য সৃষ্টি করা এবং এই কাজ দিয়েই তার পরিচয়’। কাজেই ‘যে কোনো উৎপাদন যন্ত্র বা উপায় বাড়তি মূল্য তৈরির কাজে নিয়োজিত হলে তাকে আমরা বলতে পারি পুঁজি। পুঁজিকে আবার দুরকম ভাগে ভাগ করা যায় –পরিবর্তনশীল ও অপরিবর্তনশীল পুঁজি। কলমালিক তার পুঁজি দিয়ে দুরকম জিনিস কেনে; এক হচ্ছে শ্রমশক্তি, আর এক হচ্ছে সুতো, কাঁচামাল, কলকব্জা ইত্যাদি। সুতো, কাঁচামাল কলকব্জা ইত্যাদির মূল্য যত ছিল ঠিক ততটাই উৎপাদিত পণ্যের ভেতর চলে যায়, এদের মূল্যের কিছু পরিবর্তন হয় না। এই জন্য এদের বলে অপরিবর্তনশীল পুঁজি বা কনসট্যাণ্ট বা ফিক্সড ক্যাপিটাল। পুঁজির অন্যভাগ যা শ্রমশক্তির জন্য খরচ হয় তা কিন্তু পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে দেয়। এই জন্য একে বলে পরিবর্তনশীল পুঁজি বা ভেরিয়েবল ক্যাপিটাল’। (নীহাররঞ্জন সরকার; ছোটদের অর্থনীতি)।
২. মার্কস-এর বিখ্যাত গ্রন্থের নাম ‘পুঁজি’ বা ক্যাপিটাল। এই গ্রন্থে কার্লমার্কস পুঁজিবাদী উৎপাদনব্যবস্থা বিশ্লেষণ করে তার মৌলিক বিধান উদঘাটন করে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের তাত্ত্বিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত করেন। ‘পুঁজি’র প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয় ১৮৬৭ সালে। তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর আজীবন সাথী ফ্রেডারিক এঙ্গেলস-এর সম্পাদনায় ‘পুঁজি’র দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশিত হয় ১৮৮৫ সালে এবং তৃতীয় খণ্ড ১৮৯৪ সালে। প্রথম খণ্ডে মার্কস পুঁজির গঠন অর্থাৎ পুঁজি কিভাবে সৃষ্টি হয়; দ্বিতীয় খণ্ডে পুঁজির সঞ্চারণ বা সারকুলেশন এবং তৃতীয় খণ্ডে তিনি সামগ্রিকভাবে পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার বিশ্লেষণ করেন। চতুর্থ খণ্ডে স্থান পেয়েছে বাড়তি বা উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ত্ব। মানুষের সভ্যতার ক্রমবিকাশের ক্ষেত্রে মার্কস পুঁজিবাদকে একটি বিশেষ পর্যায় বলে চিহ্নিত করে তার সুবিস্তারিত বিশ্লেষণ পেশ করেছেন। এই বিশ্লেষণের মাধ্যমে তিনি পুঁজিবাদের উৎপত্তি বিকাশ এবং তার পরিণাম বা ধ্বংসের বিধানকে উদঘাটন করেন। মার্কস-এর ‘পুঁজি’ কেবল আর্থনীতিক বিশ্লেষণমূলক গ্রন্থ নয়। মার্কস-এর সামগ্রিক বিশ্বদৃষ্টি অর্থাৎ তাঁর দর্শন এই গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে। বস্তুত মার্কসবাদ তথা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের মূল গ্রন্থ হচ্ছে ‘পুঁজি’। মার্কস তার দ্বন্দ্বমূলক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদের প্রয়োগের ভিত্তিতে মানুষের সামাজিক আর্থনীতিক বিকাশকে বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে, পুঁজিবাদ কোনো অনড় এবং স্থায়ী অস্তিত্ব নয়। পুঁজিবাদ একটি বিকাশমান প্রক্রিয়া। এই আর্থনীতিক প্রক্রিয়া এবং তার উপর প্রতিষ্ঠিত সামাজিক কাঠামো যেমন আদিতে ছির না, তেমনি ভবিষ্যতেও এর পরিবর্তন বা রূপান্তরের মাধ্যমে নতুন অর্থনীতিক উৎপাদন প্রক্রিয়া এবং সামাজিক-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে। পুঁজিবাদের অভ্যন্তরে ক্রম পরিবর্তনের মাধ্যমে সেই গুণগত রূপান্তরের মুহুর্ত যে অনিবার্যবাবে অগ্রসর হয়ে আসছে তা মার্কস সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করেন। অন্যান্য ব্যবস্থায় যেমন, পুঁজিবাদের অভ্যন্তরেও তেমনি পরিবর্তনের মূল কারণ তার আভ্যন্তরিক বিরোধ। এই বিরোধ পুঁজিবাদী ব্যবস্থার জন্মের পর থেকে উৎপাদনের উপায়ের উপর ব্যক্তিগত মালিকানা এবং উৎপাদন সম্পর্কের অনিবার্য যৌথ বা সমষ্টিগত রূপের মধ্যে জন্ম নিয়েছে এবং সে বিরোধ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে বিস্ফোরণের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এই পরিবর্তনের প্রক্রিয়ার একমাত্র পরিণাম হচ্ছে ‘এক্সপ্রোপ্রিয়েটিং দি এক্সপ্রোপ্রিয়েটরস’ বা ‘উচ্ছেদকের উচ্ছেদ’ অর্থাৎ উপাদনের উপায়ের উপর সমষ্টিগত মালিকানার প্রতিষ্ঠা। পরির্তনের এই ক্রম ব্যাখ্যায় মার্কস এই বিরোধের ক্রম বিকাশের প্রতিটি স্তর, সে স্তরের বৈশিষ্ট্য, তার সংকটের বিশেষ সমাধানের ভিত্তিতে নতুনতর স্তরে আগমন বিস্তারিতভাবে দেখিয়েছেন এবং পরিশেষে এই বিকাশের বিধানের উল্লেখ করে বলেছেন ‘একটি বিশেষ উৎপাদন-ব্যবস্থায়ে যে বিরোধ অন্তর্নিহিত থাকে তার ঐতিহাসিক বিকাশের মাধ্যমেই মাত্র সেই উৎপাদন-ব্যবস্থার উচ্ছেদ এবং তার স্থানে নতুন উৎপাদন-ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা সম্ভব’।
Capitalism: ধনতন্ত্র, পুঁজিবাদ
সামাজিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বিশেষ। ষোড়শ শতাব্দীতে ইউরোপের কয়েকটি দেশে এই সমাজ-ব্যবস্থাতর প্রথম প্রতিষ্ঠা ঘটে। মানুসের সামাজিক অর্থনৈতিক কাঠামো যে বিভিন্ন পর্যায়ের মধ্য দিয়ে বিকাশলাভ করছে এটি আধুনিক চিন্তাধারার একটি স্বীকৃত সত্য। আদিতে মানুষ যেরূপ অসহায় ছিল তেমনি আবার মানুষের গোষ্ঠীবদ্ধ আদি সমাজে কোনো শ্রেণীগত বিভেদ ছিল না। জীবন ধারনের জন্য উন্নত থেকে উন্নততর জীবিকার উপায় আবিস্কারের প্রয়োজন এবং ইচ্ছা মানুষের সহজাত। এই প্রচেষ্টায় শ্রেণীহীন আদিম গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষের সমাজ উৎপাদনের হাতিয়ারের মালিক প্রভু এবং উৎপাদনের হাতিয়ারহীন দাসের শ্রেণী সমাজে পরিণত হয়। এই দাস সমাজই আবার কালক্রমে জমির মালিকানার ভিত্তিতে সামন্তপতি এবং ভূমিহীন কৃষকের সামন্তবাদী সমাজে বিকাশ লাভ করে। সামন্তবাদী সমাজের উত্তরকালে বিজ্ঞানের উন্নতি ক্রমান্বয়ে উৎপাদনের আবিস্কার হতে শুরু করে। এ সমস্ত যন্ত্রপাতির যারা মালিক হলো তারা দেখল যে, যন্ত্রপাতি চারাবার জন্য প্রচুর সংখ্যক লোকের আবশ্যক। কিন্তু তখনো অধিকাংশ মানুষ সামন্তবাদী প্রভুর হুকমে জমির সীমানার শিকলে আবদ্ধ। তারা ভূমির মালিক নয়। ভূমির দাস। নতুন শক্তি দেখল সামন্তবাদ কেভল মানুষকেই ভূমির দাস বানিয়ে রাখে নি। তার অস্তিত্ব নতুন উৎপাদনের প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভূমির মালিক এবং বূমির দাসের পারস্পরিক সম্পর্ক শোষক এবং শোষিতের। বিজ্ঞানের অগ্রগতি সামন্তবাদের পরিবর্থন অপরিহার্য করে তুলল। কৃষকের বিদ্রোহ এবং উৎপাদনের নতুন পদ্ধতির অজেয় শক্তি সামন্তবাদকে ক্রমান্বয়ে উৎসাহিত করে নতুনতর এক সমাজ-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করলঃ ধনতান্ত্রিক বা পুঁজিবাদী ব্যবস্থা। নতুন উৎপাদনী যন্ত্রের মালিক এখানে সমাজের প্রভু। যন্ত্রের মালিক নির্দিষ্ট মজুরিতে যন্ত্রহীন মানুষ দিয়ে তার যন্ত্র চালায় আর অধিক থেকে অধিকতর পরিমাণে উৎপাদন করে দ্রব্য, পণ্য যা সে দেশে-দেশান্তরে বিক্রি করতে পারে এবং বিক্রি করে অর্থ আনতে পারে, অধিক যন্ত্র তৈরি করতে পারে এবং অধিকতর সংখ্যক মজুর নিয়োগ করে অধিকতর পণ্য আবার তৈরি করতে পারে। এ এক নতুন ব্যবস্থা, নতুন সমাজ। এখানে জমির চেয়ে যন্ত্র মূল্যবান। কিন্তু এ যন্ত্র থেকে লাভ অর্জনের মূল সূত্র মজুর এবং বাঁধা মজুরিতে মালিকের জন্য তার অবাধ উৎপাদনের ক্ষমতায়। যন্ত্রের মালিকের মুনাফা আসে মজুরের মজুরির অতিরিক্ত শ্রম থেকে। এ ব্যবস্থায় উৎপাদনের সম্পর্কে হলো একদিকে যন্ত্রের ব্যক্তিগত মালিকানা, অপরদিকে বহু মজুরের যৌথক্রিয়ায় উৎপাদনের যৌথপদ্ধতি। ধনতান্ত্রিক সমাজ-ব্যবস্থার বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ প্রথমে করেন কার্ল মার্কস এবং তাঁর আজীবন সঙ্গী ফ্রেডারিক এঙ্গেলস। তাঁরা সামন্তবাদের সঙ্গে তুলনাক্রমে সমাজ বিকাশে ধনতন্ত্রবাদের অগ্রসর ভূমিকার কথা যেমন উল্লেখ করেন তেমনি এ সমাজেরও অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্ব এবং বৈষম্যেরও উদঘাটন করেন। যন্ত্রের ব্যক্তিগত মালিকানা এবং তাঁর উৎপাদনের যৌথ পদ্ধতির মধ্যে রয়েছে এর দ্বন্দ্ব। সামাজিক ক্ষেত্রে এ দ্বন্দ্ব হচ্ছে যন্ত্রের মালিকদের শোষণ এবং যন্ত্রের মালিকদের শোষণ এবং যন্ত্রের শোষিত শ্রমিকদের দ্বন্দ্ব। এই বৈষম্য এবং দ্বন্দ্ব পরিণামে ধনতন্ত্রীদের উৎপাদনের কারণ হয়ে নতুনতম সমানতান্ত্রিক সমাজ বা উৎপাদনের উপায়ের যৌথ মালিকানা এবং যৌথ মালিকদের যৌথ উৎপাদনের নতুন ব্যভস্থা প্রবর্তণ করবে বলে মার্কসবাদীগণ বিশ্লেষণ করে দেখান। সমাজবিকাশের এই প্রক্রিয়ায় একাধিক দেশে ধনতন্ত্রবাদের স্থলে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু অপরাপর দেশের প্রধান আর্থিক ব্যবস্থা এখনো ধনতান্ত্রিক।
ধনতন্ত্রের অগ্রসর ভূমিকা ইউরোপেই প্রধানত কার্যকরী হয়। কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দী যখন শেষ হচ্ছে ধণতন্ত্রবাদ তখন নিজ নিজ দেশের সীমা অতিক্রম করে বিদেশকে করায়ত্ত করে নতুন সাম্রাজ্যবাদী বৈশিষ্ট্য ধারণ করতে শুরু করেছে। ব্যক্তিগত প্রতিযোগিতা এবং পরবর্তীকালে ধনতান্ত্রিক দেশ কিংবা ধনতান্ত্রিক গোষ্ঠীসমূহের মধ্যে অধিক থেকে অধিকতর উৎপাদন এবং ক্রমাধিক মুনাফা অর্জনের প্রতিযোগিতাই হচ্ছে ধনতন্ত্রের মূল চালিকাশক্তি। এ কারণেই নিজ দেশে মুনাফার বৃদ্ধি সীমিত হয়ে এলে ধনতন্ত্রবাদ অপর দেশ দখল করে মুনাফার ক্রমাধিক বৃদ্ধির প্রাণশক্তিকে জীবিত এবং সক্রিয় রাখতে চায়। ক্রমে আবার এই প্রয়াস ধনতান্ত্রিক ও সাম্রাজ্যবাদী দেশসমূহের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব এবং বিরোধের আকার গ্রহণ করে।
Capitalism, General crisis of: পুঁজিবাদের সাধারণ সংকট
ধনতন্ত্র বা পুঁজিবাদের বর্তমান অবস্থার মার্কসবাদী বিশ্লেষণে ‘পুঁজিবাদের সাধারণ সংকট’ একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা। মার্কসীয় বিশ্লেষণের অনুসারীদের মতে পুঁজিবাদের গোড়াকার প্রগতিশীল ভূমিকা আর বজায় নেই। পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা শক্তিহীন হয়ে পড়েছে। পুঁজিবাদী রাষ্ট্র এবং ব্যবস্থা এখনো শক্তিশালী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বিদ্যমান। কিন্ত এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় তেজী-মন্দার চক্র ক্রমাধিক পরিমাণে তীব্র হয়ে উঠছে। কর্মহীন বা বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ক্রমাধিক পরিমাণে লাভে পণ্য বিক্রি করতে না পারার সমস্যা বাড়ছে। কিন্তু এই সংকট থেকে মুক্তি পাবার চেষ্টাও পুঁজিবাদী ব্যবস্থা করছে। ব্যবস্থা মাত্রই তার অস্তিত্ব বজায় রাখতে চায়। অস্তিত্ব রক্ষার এই চেষ্টা নানাভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। উৎপাদনের ব্যয় হ্রাসের মাধ্যমে লাভের হার বজায় রাখার জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে গবেষনা চালানো হচ্ছে। নতুন নতুন যন্ত্র আবিস্কৃত হচ্ছে। পূর্বের অবাধ প্রতিযোগিতার নীতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরিত্যক্ত হচ্ছে। উৎপাদন ও লাভকে বহাল এবং বৃদ্ধি করার জন্য রাষ্ট্রযন্ত্রের উপর বৃহৎ বা একচেটিয়া পুঁজিবাদী প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি করার চেষ্টা করা হচ্ছে। জাতীয় সীমা অতিক্রমকারী বহু জাতীয় করপোরেশন বা কারটেল গঠিত হচ্ছে। সামরিক অস্ত্রপাতি উৎপাদন এবং বিভিন্ন দেশে তা বিক্রি করে লাভ অর্জনের চেষ্টা করা হচ্ছে। মানুষের শ্রমের ফসল ধ্বংসকারী সমর শিল্প তাই অতীতের চাইতে অধিক ব্যাপক এবং উন্নত হয়ে উঠছে। সমরশিল্পকে বহাল রাকা এবং বৃদ্ধি করার জন্য প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে যুদ্ধের আবহাওয়া, বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আবহাওয়া তৈরী করার চেষ্টা হচ্ছে। এ সকল বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে বর্তমানের পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য। এবং এর মাধ্যমেই পুঁজিবাদের সাধারণ সংকটের প্রকাশ ঘটছে।
নিম্নের বিবরণটিকে এই বিষয়টির মার্কসবাদী বিশ্লেষণের একটি সংক্ষিপ্ত দৃষ্টান্ত হিসাবে বিবেচনা করা চলে।
“ব্যক্তিগত মালিকানা এবং শোষণ যার নীতি সেই বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ঐতিহাসিক বিকাশ সম্ভাবনা আজ নিঃশেষিত। পুঁজিবাদ আজ গভীর এক সাধারণ সংকটে নিপতিত। পুঁজিবাদের মীমাংসাহীন দ্বন্দ্ব এবং তার চরিত্রগত বিধান এই সংকটকে অনিবার্য করে তুলছে। পুঁজিবাদের সাধারণ সংকটের অর্থ হচ্ছে, পুঁজিবাদ বিকাশের বদলে আজ ক্ষয়ের পর্যায়ে প্রবেশ করছে। এ ক্ষয় আজ বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদী ব্যবস্থার প্রত্যেক দেশে, এ ক্ষয় উপর থেকে নিচে সর্বত্র বিস্তারিত। এ ক্ষয় গ্রাস করছে তার অর্থনীতি, সামাজিক ব্যবস্থা, এর আদর্শ এবং সংস্কৃতিকে। সাধারণ এই সংকটের ফলে একের পর এক, বিভিন্ন দেশ যারা পুঁজিবাদী-অক্ষ পরিত্যাগ করে সমাজতান্ত্রিক বিকাশের পথ অবলম্বন করছে তাদের নিজের অক্ষের মধ্যে আবদ্ধ রাখতে পুঁজিবাদ ব্যর্থ হচ্ছে।
“পুঁজিবাদের এই সাধারণ সংকটের সূচনা ঘটে রাশিয়ার অক্টোবর বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার মাধ্যমে। এই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ফলে পৃথিবীতে পুঁজিবাদী ব্যবস্থাই একমাত্র ব্যবস্থা বলে বিদ্যমান থাকার পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটে। গোড়াতেও পুঁজিবাদী জগৎ সোভিয়েট সমাজবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকে সামরিক আক্রমণ, অর্থনৈতিক অবরোধ, সীমাহীন অপপ্রচার, আদর্শগত ধ্বংসাত্মক কাজ প্রভৃতির মাধ্যমে সর্বপ্রকারের প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে। কিন্তু তার চেষ্টা ব্যর্থ করে সোভিয়েট সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তার অব্যাহত অস্তিত্বের মাধ্যমে নতুন সমাজ ব্যবস্থার প্রাণশক্তির প্রমাণ ঘটায়।
“পুঁজিবাদের সাধারণ সংকটের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং ইউরোপ ও এশিয়ার একাধিক দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার মাধ্যমে। বর্তমানে পুঁজিবাদী ব্যবস্থাই একমাত্র বিশ্বব্যবস্তা নয়। তার প্রতিশক্তি হিসাবে একটি বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাও বিদ্যমান আছে।
“বর্তমানে পুঁজিবাদের সাধারণ সংকটের তৃতীয় পর্যায়ের প্রধান বৈশিষ্ট্য এই যে, শান্তির ভারসাম্য আজ পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিপরীতে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিপরীতে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার দিকে পরিবর্তিত হয়েছে। সমাজতান্ত্রিক শক্তিসমূহ পৃথিবীব্যাপী বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হচ্চে। সমাজতন্ত্রের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদ অনিবার্যভাবে দুর্বল হচ্ছে।
“বর্তমান যুগে পুঁজিবাদের সাধারণ সংকটের একটি বৈশিষ্ট্য এই যে, এই সংকট পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অর্থনীতি, রাজনীতি ও নৈতিক চরিত্র –সর্বক্ষেত্রকে গ্রাস করে সার্বিক সংকটের রূপ গ্রহণ করছে। তার বর্তমান অর্থনৈতিক মন্দা ১৯৩০-এর মারাত্মক মন্দার সঙ্গে তুলনীয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বিশ্বপুঁজিবাদের প্রধান সকল কেন্দ্রগুলিতেই এই সংকট বিস্তারিত হয়েছে। এই সংকট হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে বিকশিত রাষ্ট্রীয় একচেটিয়া অর্থনীতির সংকট। উৎপাদনের আকস্মিক পতন ঘটছে, বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। পুঁজিবাদের পক্ষে কোনো দেশেরই সক্শ জনসংখ্যাকে কার্যে নিযুক্ত করার ক্ষমতা নেই। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী সত্তর দশকে উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলিতে এক কোটি পঞ্চাশ লক্ষ কর্মক্ষম লোক পুরো বেকার। স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র এবং উৎপাদনের উন্নততর যান্তিকীকরণ শ্রমজীবী মানুষের মঙ্গলে আসার বদলে লক্ষ লক্ষ মানুষকে ‘ফজলু’ বা বাহুল্য বলে বাতিল করে দিচ্ছে।
“এই অবস্থা থেকে যুক্তিগত সিদ্ধান্ত হচ্ছে এই যে, পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যে উৎপাদনের শক্তি বা উপায় এবং উৎপাদনের সম্পর্কের দ্বন্দ্ব এরূপ তীব্রতা লাভ করেছে। পুঁজিবাদী উৎপাদন সম্পর্কে উৎপাদনী শক্তির শৃঙ্খল হয়ে থাকে রুদ্ধ করে রাখার চেষ্টা করছে।
“কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, সাম্রাজ্যবাদ তথা পুঁজিবাদের অর্থনৈতিক শক্তি একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেছে। সমাজতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার সঙ্গে অস্তিত্বের লড়াই, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রসরমান দাবি এবং এক পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের সঙ্গে অপর পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের নিমর্ম অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা প্রভৃতি পুঁজিবাদের জন্য উৎপাদনের উন্নতি এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সর্বশেষ উদ্ভাবনের প্রয়োগকে অনিবার্য করে তুলছে।
“সাধারণ সংকটের এই নবতম পর্যায়ে পুঁজিবাদের অন্যান্য অন্তর্দ্বন্দ্বও তীব্রতর হয়ে উঠছে। মজুর এবং পুঁজির দ্বন্দ্বের গতি বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিভিন্ন রাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে কতিপয় একচেটিয়া বহুজাতিক পুঁজিবাদী প্রতিষ্ঠান ও শক্তির সংঘাত তীব্র হচ্ছে। পুঁজিবাদী দেশসমূহের অসম অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক বিকাশের ফলে পুঁজিবাদ বিশ্বব্যবস্থার অভ্যন্তরেও শক্তিসমূহের জোটবদ্ধতার ক্ষেত্রে পরিবর্তণ সংঘটিত হচ্ছে। বিভিন্ন পুঁজিবাদী রাষ্ট্র ও পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের গোষ্ঠীসমূহের পারস্পরিক বৈরিতা বৃদ্ধি পাচ্ছে”। (ফাণ্ডামেণ্টালস অব সায়েন্টিফিক কম্যুনিজম, মস্কো, ১৯৭৭)
Categories: সূত্র, মাধ্যম
মানুষের জ্ঞান কতকগুলি মৌলিক ধারণা বা সূত্রের উপর নির্ভরশীল। এই ধারণাগুলির মধ্যে প্রধান হচ্ছে স্থান, কাল, সম্পর্ক, গুণ, পরিমাণ ইত্যাদি। এই ধারণাগুলি বাকে আমাদের পক্ষে কোনো কিছুর জ্ঞান লাভ সম্ভব নয়। ‘স্থান’ ধারণার উপর নির্ভর করেই আমরা একটা বস্তুকে স্থানের অন্তর্ভুক্ত করি। আমরা বলি এই বস্তুটি অমুক স্থানে আছে। কালের ধারণা থেকে আমরা বস্তু বা ঘটনার উপর কালানুক্রম আরোপ করি। এরূপ ধারণা ব্যতীত আমাদের জ্ঞানলাভ সম্ভব নয় বলে দর্শনে এদের জ্ঞানের মূলসূথ্র বা মাধ্যম বলা হয়।
জ্ঞানের জন্য যে কিছু সংখ্যক মৌল ধারণার আবশ্যক এ সত্য বিভিন্ন দেশের প্রাচীন দার্শনিকগণই জ্ঞানের প্রক্রিয়াকে বিশ্লেষণ করে আবিস্কার করেছেন। ভারতীয় বৈশেষিক দর্শন বস্তু, গুণ এবং ক্রিয়াকে জ্ঞানের মূলসূত্র বিবেচনা করেছে। গ্রিক দার্শনিক এ্যারিস্টটল জ্ঞানের এরূপ সূত্রের বিস্তৃততর বিশ্লেষণ করে এর সংখ্যা দশটি বলে স্থির করেছে। আধুনিক ইউরোপীয় দর্শনে জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কাণ্ট জ্ঞানসূত্র নিয়ে আলোচনা করেছেন। জ্ঞানসূত্রগুলির উৎপত্তি ও বিকাশ সম্পর্কে দার্শনিকদের মধ্যে মতের পার্থক্য আছে। ভাববাদী দার্শনিকদের মতে জ্ঞানসূত্রগুলি মানুষ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার মারফত লাভ করে না। অভিজ্ঞতা-পূর্ব ধারণা হিসাবে মূল জ্ঞানসূত্রগুলি মানুষের মধ্যে জন্মগতভাবেই থাকে। এই ভাববাদী মতের প্রধান আধুনিক ব্যাখ্যাতা হচ্ছেন কাণ্ট। জ্ঞানের সমস্যার কাণ্টীয় বিশ্লেষণ সংক্ষেপত এরূপ মানুষ চরম সত্তাকে জানতে পারে না। মানুষ চরম সত্তার বহিঃপ্রকাশকেই মাত্র জানতে পারে। এই বহিঃপ্রকাশকে মানুষ জানে স্থান, কাল, গুণ, সম্পর্ক এরূপ মৌলসূত্রের মাধ্যমে। জ্ঞানের এই সূত্রগুলি মানুষের মনে অভিজ্ঞতা-পূর্ব ভাব হিসাবে উদ্ভুহত হয়। অভিজ্ঞতার মধ্যে এদের উদ্ভব নয়। বস্তুবাদ জ্ঞানসূত্রগুলিকে নির্বিশেষে ধারণা বলে স্বীকার করলেও অভিজ্ঞতা-পূব উদ্ভবের তত্ত্বকে অস্বীকার করে। বস্তুবাদ, বিশেষ করে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ মানুষের জ্ঞানলাভের প্রক্রিয়াকে একটি সদা বিকাশমান দ্বন্দ্বমূলক জটিল প্রক্রিয়া বলে ব্যাখ্যা করে। বস্তু থেকে যেমন মানুষের বিকাশ, তেমনি মানুষেল সঙ্গে বস্তুর দ্বান্দ্বিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সম্পর্কের মাধ্যমেই মানুষের চেতনার বিকাশ ঘটেছে। মানুষ বস্তুর সাক্ষাৎ সম্পর্কে আসে। বিভিন্ন বস্তু তার চেতনাকে আঘাত করে করে চেতনাকে বিকশিত করে। বিকশিত সেই চেতনা একাধিক বস্তুকে তুলনা করার ক্ষমতা অর্জন করে। তাদের উপর মিল-অমিলের গুণ আরোপ করে। এমনবাবে যে সূত্রগুলি আজ মানুষের জ্ঞানের মূলসূত্র বা যে সূত্রগুলি মানুষজাতির জন্মগত এবং অভিজ্ঞতা-পূর্ব সম্পদ বলে বিবেচিত হচ্ছে সেগুলি একদিন অভিজ্ঞতার মাধ্যমেই মানুষ লাভ করেছে। এরূপ মৌলসূত্র নির্দিষ্ট সংখ্যায় একদিনে সৃষ্টি হয়নি কিংবা চিরকালের জন্য এ সংখ্যার সীমাও স্থির হয়ে যায় নি। জ্ঞানের বিকাশমান প্রক্রিয়ায় মানুষ ক্রমান্বয়ে নতুনতর সূত্র অর্জন করে যাচ্ছে।
Categorical Imperative: শর্তহীন বিধান
শর্তহীন বিধান দর্শন, বিশেষ করে দার্শনিক কাণ্টের নীতি-শাস্ত্রে ব্যবহৃত একটি কথা। কাণ্টের মতে নৈতিক জীবনে যে সমস্ত বিধান কার্যকরী সেগুলিকে শর্তসাপেক্ষ এবং শর্তহীন বলে বিভক্ত করা চলে। শর্তসাপেক্ষ বিধানের নিয়ামত হচ্ছে কোনো বিশেষ আকাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য। আমার সন্তানকে যদি আমি এই আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ভালবাসি যে, সেও একদিন আমার বৈষয়িক জীবনে সাহায্যকারী হবে তা হলে সন্তানের প্রতি এই ভালবাসা শর্তসাপেক্ষ ভালবাসা। ভবিষ্যতের প্রতিফলের আকাঙ্ক্ষাই আমার বর্তমানের ভালবাসার নিয়ামক। এখানে সন্তানের প্রতি ভালবাসা শর্তসাপেক্ষ বিধানেরই একটি দৃষ্টান্ত। শর্তসাপেক্ষ বিধান একটি লক্ষ্য অর্জনের উপায় মাত্র। কাণ্টের মত অনুযায়ী মানুষের নৈতিক জীবনের নিয়ামক হবে শর্তহীন বিধান। শর্তহীন বিধান দ্বারা কাণ্ট এমন একটি বিধানকে বুঝাতে চেয়েছেন যে বিধান অপর কোনো লক্ষ্য অর্জনের উপায়মাত্র নয়ে, যে-বিধান নিজেই লক্ষ্য। পিতা যদি সুখশান্তি-সম্পদ অর্থাৎ কোনো প্রকার প্রতিদানের আকাঙ্ক্ষা না করেতার সন্তানকে শুধু ভালবাসার জন্য ভালবাসতে পারে তবেই সে ভালবাসা অপর কোনো লক্ষ্যের উপায়মাত্র না হয়ে নিজেই লক্ষ্য হয়ে দাঁড়াবে। আর এরূপ ভালবাসাই হচ্ছে সন্তানের প্রতি পিতার আদর্শ ভালবাসা। অনুরূপভাবে ব্যক্তি তার সমাজ জীবনে কেবল শর্তহীন বিধান দ্বারা পরিচালিত হবে, শর্তসাপেক্ষ বিধান দ্বারা নয়। আমাদের ব্যক্তিগত জীবনের যে-কোন কাজের পেছনেই একটি নীতি বা লক্ষ্য থাকে। সমাজে যে বিরোধ, বৈপরিত্য বা সংঘর্ষের সৃষ্টি হয় তার কারণ ব্যক্তি নিজের স্বার্থসাধনের লক্ষ্যকেই চরম মনে করে। সমাজে যে অধকার সে নিজে ভোগ করতে চায় সে অধিকার অপরের প্রাপ্য একথা সে স্মরণ করে না। কিন্তু যে অধিকার ব্যক্তি নিজে ভোগ করবে সে অধিকার অপরকেও ভোগ করতে না দেওয়ার নীতি অযৌক্তিক। মানুষ যুক্তিবাদী জীবন। তার পক্ষে অযৌক্তিক কাজ করা সম্ভব নয়। ব্যক্তি তার যে-কোন সামাজিক আচরণের ক্ষেত্রে এমন নীতি দ্বারা পরিচালিত হবে, যে নীতি শুধু তার নিজের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়; যে নীতি সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, যে নীতি সার্বিক। যে ব্যক্তি চুরি করতে যাচ্ছে তাকে বিবেচনা করতে হবে, যে চুরির অধিকার সে ভোগ করতে যাচ্ছে সে চুরির অধিকার অপর সকলেরই আছে; সে মনে করবে যে মুহুর্তে অপরের দ্রব্য সে আত্মসাৎ করছে। এরূপ চিন্তায় ব্যক্তি তার আচরণের অন্তর্নিহিত অসঙ্গতি উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে। যে নীতিকে সে সার্বিক নীতি হতে দিতে চায় না সে নীতিকে নিজেও পরিত্যাগ করবে। এমনিভাবে আদর্শ সঙ্গতিপূর্ণ সমাজ সৃষ্টি হবে। কাণ্ট তাঁর শর্তহীন বিধান দ্বারা এক কল্পলোক বা ইউটোপিয়া তৈরীর চেষ্টা করেছেন। শর্তহীন বিধান দ্বারা প্রত্যেক ব্যক্তি পরিচালিত হলে একটি আদর্শ সমাজের সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু বাস্তবে ব্যক্তি কেন স্বার্থপর হয়, কেন সে নিজে যে অধিকার ভোগ করে অপরকে সে অধিকার দিতে চায় না এর কারণের কোনো বিশ্লেষণ কাণ্টের নীতিশাস্ত্রে নেই। ফলে, শর্তহীন বিধান একটি অবাস্তব ইচ্ছায় মাত্র পর্যবসিত হয়েছে। নীতিশাস্ত্র মানুষের সামাজিক আচরণের আলোচনা। বাস্তব অর্থনীতিক ও সামাজিক অবস্থাই ব্যক্তির আচরণের নিয়ামক। কোনো বিশেষ সমাজের বাস্তব অবস্থার বিশ্লেষণ ব্যতিরেকে ব্যক্তির আচরণের সঙ্গতি-অসঙ্গতি নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। বাস্তব অবস্থার সঙ্গে সম্পর্কহীনভাবে কোনো চরম আদর্শ ব্যক্তির সামনে পেশ করা নিরর্থক। কাণ্ট তাঁর নীতিশাস্ত্রে এই সত্যকে অস্বীকার করেছেন।
Catharsis: বিমোক্ষণ
পুঞ্জিভূত আবেগ বা শক্তির মাধ্যমে শক্তির আধারে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া বা উপায়কে ক্যাথারসিস বা বিমোক্ষণ বলা হয়। ইংরেজী ক্যাথারসিস শব্দের মূল গ্রিক শব্দের অর্থে বিশুদ্ধকরণের ভাব যুক্ত ছিল। গ্রিক গণ তাদের সৌন্দর্যতত্ত্বে এবং সাহিত্যে এই অর্থে শব্দটির ব্যাখ্যা করেছেণ। এ্যারিস্টটল ব্যক্তির উপর সঙ্গীতের প্রভাব আলোচনা করে বলছেন যে, ব্যক্তির উপর সঙ্গীতের একটি বিশুদ্ধকরণে দিক আছে। সঙ্গীতের মাধ্যমে ব্যক্তির আবেগের প্রকাশ ঘটে এবং ব্যক্তি তার ফলে আনন্দ বা স্বস্তি বোধ করে। আধুনিককালে মনোবিজ্ঞানে, বিশেষ করে মানসিক রোগ নিরাময়ের একটি উপায় হিসাবে, বিমোক্ষণের উল্লেখযোগ্য ব্যবহার দেখা যায়। মনোবিকলনের ফ্রয়েডীয় বিশ্লেষণের ভিত্তিতে মনোবিকলনের রোগীকে যদৃচ্ছা আবেগ প্রকাশের সুযোগ দেওয়া হয়। এরূপ ক্ষেত্রে মনোবিজ্ঞানী অনুমান করেন যে, রোগীর মনে তার অপূর্ণ কামনা বাসনা, ইচ্ছা অনিচ্ছাসঞ্জাত যে আবেগ জমা হয়ে আছে তা যে কোন প্রকারে প্রকাশের পথ পেলে রোগী আবার রোগপূর্ব স্বাভাবিক ভারসাম্য ফিরে পাবে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আবেগ বিমোক্ষণের এ পদ্ধতি রোগীর মনকে হালকা করে তার ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে। কিন্তু ব্যক্তির ভারসাম্য বিনষ্টির কারণ ব্যক্তির নিজের মধ্যে তত নয় যত তার পরিবেশ ও সমাজের মধ্যে। রোগীকে সমাজ-নিরপেক্ষ বিবেচনা করে তার মনের কথায় বা সীমাবদ্ধ আচরণে প্রকাশের সুযোগদান কোনো স্থায়ী ফল দিতে পারে না। এ কারণে বিমোক্ষণে আবেগ প্রকাশের একটি পদ্ধতি হলেও তা মনোবিকলনের ক্ষেত্রে নিরাময়ের কোনো নিশ্চিত উপায় হয়ে উঠে নি।
Catholicism: ক্যাথলিকবাদ
খ্রিষ্টান ধর্মের মধ্যে দুটি সম্প্রদায় প্রধানঃ ক্যাথলিক এবং প্রটেষ্টান্ট সম্প্রদায়। মূল খ্রিষ্টান ধর্মের আচার, আচরণ, ব্যাখ্যা প্রভৃতি ক্ষেত্রে মত পার্থক্য থেকে এই দুই সম্প্রদায়ের উদ্ভব। ক্যাথলিক সম্প্রদায়ই গোড়াকার ধারা। প্রটেস্টান্ট সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটেছে পরবর্তীকালে ষোড়শ শতকে জার্মানীর মার্টিন লুথারের নেতৃত্বে। ক্যাথলিকবাদ খ্রিষ্টান ধর্মের গোঁড়া মতবাদ। ক্যাথলিকবাদের বিশ্বাস পবিত্র আত্মার উৎস কেবল ঈশ্বর নয়। তার উৎস যিশুখ্রিষ্ট বা ঈশ্বরের পুত্রও। পরলোকে পারগেটরী বা পাপীদের শোধনাগারও ক্যাথলিকদের বিশ্বাসের একটি অংশ। পোপ দোষত্রুটিশূণ্য। ক্যাথলিকবাদে ধর্মযাজকদের জন্য বিবাহ এবং পারিবারিক জীবন নিষিদ্ধ। রোমের ভ্যাটিকান হচ্ছে পোপের রাজধানী। ইউরোপে মধ্যযুগে পোপতন্ত্র কেবল ধর্শের ক্ষেত্রে নয়, পার্থিব সম্পদ ও শক্তিরও এক বিপুল সাম্রাজ্য হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। এখনও পৃথিবীতে খ্রিষ্টান ধর্মের মধ্যে ক্যাথরিকদের প্রভাব এবং সাংগঠনিক শক্তি প্রধান।
Causality: কার্য-কারণবাদ
দর্শন শাস্ত্রের একটি শব্দ। দুটি বস্তু বা ঘটনার মধ্যকার অনিবার্য সম্পর্ককে কার্যকারণ সম্পর্ক বলে অভিহিত করা হয়। দুটি ঘটনার যেটি পূর্বে সংঘটিত হয় তাকে কারণ এবং যেটি তার ফল হিসাবে পরে সংঘটিত হয় তাকে কার্য বলে। কার্য-কারণ সম্পর্ক দুটি ঘটনা বা বস্তুর সম্পর্ক হলেও কার্য ও কারণ হিসাবে দুটি ঘটনা বিশ্বের অপরাপর ঘটনা থেকে বিযুক্তভাবে সংঘটিত হয় না। উপলব্ধির সুবিধার জন্য আমরা দুটি ঘটনাকে অপরাপর ঘটনা থেকে বিযুক্তভাবে ভাবার চেষ্টা করি। কিন্তু আসলে যে ঘটনাকে কার্য বলে অভিহিত করা হচ্ছে সে একই সময়ে অপর ঘটনার কারণ এবং যাকে কারণ বলে অভিহিত করা হচ্ছে সে অপর ঘটনার কার্য বা ফল হিসাবে সংঘটিত হচ্ছে। বস্তুর সমগ্র বিশ্বচরাচর কার্য কারণের সামগ্রিকসূত্রে আবদ্ধ। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কারণ হিসাবে হিটলারের কথা উল্লেখ করা যায়। কিন্তু সে হিটলার জার্মানীর তৎকালীন অর্থনৈতিক-সামাজিক রাষ্ট্রীয় অবস্থারই কার্য বা ফল। আবার বিংশ শতকের ধনতন্ত্রবাদী দুনিয়ার অভ্যন্তরীণ সংকটের কারণেই জার্মানীর সেই সামাজিক অর্থনৈতিক রাষ্ট্রীয় অবস্থার সৃষ্টি। তাই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কারণ কেবল হিটলার নয়। একটি কার্যের সামগ্রিক কারণ তাই একটি নির্দিষ্ট কারণের চেয়ে বৃহত্তর। কোনো ঘটনার নির্দিষ্ট কারণ তার সামগ্রিক কারণের ভিত্তিতেই উপলব্ধি করা সম্ভব। কিন্তু প্রাত্যহিক জীবনে সামগ্রিক কারণ উপলব্ধি করে আমরা জীবন যাপন করি নে। একটি ঘটনার নির্দিষ্ট কারণকেই আমরা স্থির করার চেষ্টা করি।
ঘটনামাত্রেরই কারণ আছে কিংবা কারণমাত্রেরই ফলাফল আছে। কথাটা স্বতঃসিদ্ধ হলেও দর্শনে কার্যকারণের কথা একটি মৌলিক বিষয়। প্রাচীন ভারতের বৈশেষিক দর্শন থেকে শুরু করে আধুনিক ইউরোপের অজ্ঞেয়বাদী হিউমের দর্শনেও কার্যকারণের সমস্যা বিশেষ আলোনার বিষয় বলে বিবেচিত হয়েছে। অন্যান্য সমস্যার ন্যায় কার্যকারণের সমস্যার আলোচনারও দুটি ধারণা দেখা যায়। একটি হচ্ছে ভাববাদী ধারা; অপরটি বস্তুবাদী। ভাববাদী মতে ঘটনায়-ঘটনায় কিংবা বস্তুতে-বস্তুতে কার্যকারণের সম্পর্ক আমাদের মনের কল্পনার বিষয়। কার্যকারণ সম্পর্ক কোনো বস্তু বা ঘটনা নয়। সুতরাং কার্যকারণ সম্পর্ক দৃশ্য নয়। আমরা বস্তুকে দেখি, কিন্তু বস্তুতে বস্তুতে সম্পর্ককে দেখি নে। আমরা আগুণ দেখতে পারি। আমরা ধোঁয়া দেখতে পারি, কিন্তু আগুন ও ধোঁয়ার মধ্যে কার্যকারণ রয়েছে বা আগুন ধোঁয়ার কারণ এবং ধোঁয়া আগুনের কার্য বা ফল এটা আমরা দেখতে পারি নে। হিউমা এই যুক্তিতে কার্যকারণ সম্পর্কের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করতে চেয়েছেন। দার্শনিক কাণ্ট একদিকে কার্য-কারণ সম্পর্কের বাস্তবতাকে অস্বীকার করেছেন, আবার অপরদিকে তাকে আমাদের জ্ঞানের অন্যতম অপরিহার্য সূত্র বা মাধ্যম বলে আখ্যাত করেছেন। তাঁর মতে অন্যান্য মূলসূত্রের ন্যায় কার্য-কারণ সম্পর্কের ধারণা আমাদের একটি অভিজ্ঞতা-পূর্ব জন্মগত ধারণা। বস্তুবাদী দর্শন, বিশেষ আধুনিককালের দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদী দর্শন, কার্যকারণ সম্পর্কের ভাববাদী ব্যাখ্যাকে অস্বীকার করে। এই মত অনুযায়ী মানুষের জ্ঞানলাভের পদ্ধতি হচ্ছে মানুষের সাথে বস্তুর সাক্ষাৎ সম্পর্কের অভিজ্ঞতার নিয়ত বিকাশমান প্রক্রিয়া। বাস্তব ঘটনাকে মানুষ আদিকাল থেকে প্রত্যক্ষ করেছে। মানুষ হিসাবে এই অভিজ্ঞতার পথেই ঘটনার সম্পর্কের কার্যকারণরূপ সে উপলব্ধি করেছে এবং আবিস্কার করেছে। কার্যকারণ যে, বস্তু জগতের প্রতিটি অণুর সঙ্গে অপর অণুর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া-ঘটনা মানুষের কল্পনার বিষয় নয়। আর এই ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াই হচ্ছে বস্তুর কার্যকারণ সম্পর্ক। একটি আলপিন আমার আঙুলে বিদ্ধ হয়েছে। এটি প্রত্যক্ষ ঘটনা। এই ঘটনার প্রতিক্রিয়াতে আঙুল থেকে রক্ত নির্গত হচ্ছে এবং আমি ব্যথা বোধ করছি। বিশ্বচরাচরের বস্তুজগতে বস্তুতে বস্তুতে কোনো ফাঁক বা শূন্যনা নেই। ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সতত সম্পর্কে বস্তু-জগৎ আবদ্ধ এবং ক্রিয়াশীল।
Chaitanya: চৈতন্য (১৪৮৫-১৫২৭ অথবা ১৫৩৪ খ্রি.)
বৈষ্ণব ধর্মের চৈতন্য সম্প্রদায়ের প্রবর্তক। বাংলাদেশ শ্রী চৈতন্য বা চৈতন্যদেব বলে সুপরিচিত। বর্তমান পশ্চিম বঙ্গের নদীয়া জেলার ১৪৮৫খ্রিষ্টাব্দে একটি ব্রাহ্মণ পরিবারে চৈতন্যদেবের জন্ম হয়। কিশোর বয়সেই চৈতন্যদেব সংস্কৃত ভাষায় এবং হিন্দু ধর্মের গীতা এবং ভাবগত পুরানে গভীর জ্ঞান অর্জন করেন। গীতায় কৃষ্ণা বা ঈশ্বরের উপর ভক্তি স্থাপনকে মানুষের মুক্তির প্রকৃষ্টতম উপায় হিসাবে বলা হয়েছে। চৈতন্যদেব গীতার এই ভক্তিতত্ত্বে বিশেষভাবে প্রভাবিত হন।
পঁচিশ বছর বয়সে শ্রী চৈতন্য সংসার ত্যাগ করে সন্নাসব্রত অবলম্বন করেন। এই পর্যায়ে তিনি উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের প্রায় সকল প্রধান ধর্ম-কেন্দ্রগুলি পরিভ্রমণ করেন এবং পরিশেষে উড়িষ্যার জগন্নাথ মন্দিরকে নিজের ধর্ম প্রচারের কেন্দ্র হিসাবে নির্দিষ্ট করেন। চৈতন্যদেবের পরলোকগমন সম্পর্কে মতভেত আছে। চৈতন্য সম্প্রদায় মনে করে, চৈতন্যদেব সমুদ্রের তরঙ্গশীর্ষে তাঁর অরাধ্য কৃষ্ণকে রাধার সঙ্গে নৃত্যরত দেখেন এবং কৃষ্ণের সঙ্গে মিলনের আকর্ষণে তিনি গভীর সমুদ্রে গিয়ে নিমজ্জিত হন। অপর অনেকের মত হচ্ছে শ্রী চৈতন্য ১৫৩৪ খ্রীস্টাব্দে পরলোকগমন করেন।
শ্রী চৈতন্য-প্রচারিত ধর্মের মূল কথা ভক্তিতেই মুক্তি, যুক্তি কিংবা কোনো আচার-আচরণ বা পূজায় নয়। ঈশ্বর করুণার আধার। শিশুতে, প্রেমাস্পদে এবং সর্বজীবে মায়া ও মমতারূপে তার প্রকাশ। মানুষে মানুষে জাতি বা বর্ণের কোনো পার্থক্য নেই। ঈশ্বরকে লাভ করার জন্য প্রেমময়রূপে কল্পনা করতে হবে। তাকে প্রেমাস্পদের ন্যায় ভালবাসতে হবে। রাধা-কৃষ্ণের প্রেমের উপাখ্যান চৈতন্যদেব তার ধর্মীয়তত্ত্ব আরোপ করেন।
শ্রী চৈতন্যের প্রবর্তিত ধর্মের একটি সামাজিক তাৎপর্য আছে। চৈতন্যদেব হিন্দু ধর্মেরই একজন ব্যাখ্যাতা। হিন্দু ধর্মের বর্ণাশ্রম প্রথা এবং ব্রাহ্মণদের একাধিপত্যের বিরুদ্ধে বৌদ্ধ ধর্ম একদিন বিরাটভাবে প্রসার লাভ করেছিল। বৌদ্ধধর্ম হিন্দুধর্মের বর্ণাশ্রমপ্রথা এবং জন্মান্তরবাদ তত্ত্বের বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ ছিল। বৌদ্ধধর্ম হিন্দুধর্মের বর্ণাশ্রমপ্রথা এবং জন্মান্তরবাদ তত্ত্বের বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ ছিল। বৌদ্ধধর্মের প্রসারে হিন্দুধর্ম অনেকটা আঘাতপ্রাপ্ত হয়। হিন্দুধর্মের মূল আচার সর্বস্বতাও অনেকের মনে হিন্দুধর্ম সম্পর্কে বিরূপ ধারণার সৃষ্টি করে। শ্রী চৈতন্য হিন্দুধর্মের নতুন ব্যাখ্যা দিয়ে তাকে এই দ্বিবিধ আক্রমণ থেকে রক্ষা করার প্রয়াস পান। তাঁর মন্দিরে বংশ, বর্ণ বা জাতির কোনো ভেদাভেদ থাকবে না –এ নীতি সমাজের নির্যাতিত মানুষের মনে প্রবল আবেগের সঞ্চার করে। ফলে চৈতন্যদেবের ব্যাখ্যার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত চৈতন্যবাদ ভারতবর্ষে বিভিন্ন অংশে বিশেষ করে বাংলাদেশে নির্যাতিত শ্রেণীর মধ্যে দ্রুত প্রসার লাভ করে। বাংলা সাহিত্যে চৈতন্যদেবের ভক্তিবাদ প্রেমমুলক গীতিকবিতার সৃষ্টি করে। নতুন দৃষ্টিতে রাধা-কৃষ্ণের প্রেম নিয়ে বাংলার কবিগণ সাহিত্য সৃষ্টি করতে শুরু করেন। চৈতন্য অনুসারীগণ চৈতন্যদেবকেও ঈশ্বররূপে কল্পনা করে তাঁর প্রতি ভক্তি প্রকাশের জন্য তাঁর প্রশংসামূলক জীবনী রচনা করতে শুরু করেন। এর ফলে বাংলা কাব্য সাহিত্যে যে নতুন সৃষ্টির প্রাবল্য দেখা দেয়, তাকে সাহিত্যের ইতিহাসকারগণ চৈতন্যযুগ বলে আখ্যায়িত করেন।
শ্রী চৈতন্যের ধর্মতত্ত্বের দার্শনিক তাৎপর্যটি এই যে, চৈতন্যের মতে ঈশ্বর এবং তার প্রকাশের জন্য তাঁর প্রশংসামূলক জীবনী রচনা করতে শুরু করেন। এর ফলে বাংলা কাব্য সাহিত্যে যে নতুন সৃষ্টির প্রাবল্য দেখা দেয়, তাকে সাহিত্যের ইতিহাসকারগণ চৈতন্যযুগ বলে আখ্যায়িত করেন।
শ্রী চৈতন্যের ধর্মতত্ত্বের দার্শনিক তাৎপর্যটি এই যে, চৈতন্যের মতে ঈশ্বর এবং তার প্রকাশের মধ্যে একদিকে যেমন কোনো দ্বৈত ভাব নেই, তেমনি অপর দিকে ঈশ্বরের প্রকাশ এবং ঈশ্বরওএক কথা নয়। প্রাচীন বৈষ্ণব ধর্ম ঈশ্বর এবং তার প্রকাশকে দ্বৈতরূপে কল্পনা করেছে। এর উপর ভিত্তি করে বৈষ্ণব ধর্মের দ্বৈতবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। চৈতন্য ঈশ্বর বা চরম সত্তার সঙ্গে তার প্রকাশের দ্বৈতরূপ বা বিরোধকে অস্বীকার করেছেন। কিন্তু অপরদিকে তিনি মানুষ অর্থাৎ চরম সত্তার প্রকাশকে ভক্তির মাধ্যমে পরিণামে পরম সত্তার মধ্যে নিজের অস্তিত্ব লোপ করে দেবার লক্ষ্য নিয়ে অগ্রসর হতে বলেছেন। একদিকে দ্বৈতভাবের অস্বীকার, অপরদিকে ভক্তির মাধ্যমে ঈশ্বর প্রাপ্তির কথা বলার জন্য শ্রী চৈতন্যের অভিমতকে অচিন্ত্য বা অভাবনীয় ভেদাভেদ বলে ভারতীয় দর্শনে আখ্যায়িত করা হয়। চৈতন্যদেবের ভক্তিবাদ এবং মুসলিম সুফী চিন্তাবিদদের মতবাদের মধ্যে বিশেষ মিল দেখা যায়।
Chartism: চার্টিস্ট আন্দোলন, চার্টার বা অধিকার আন্দোলন (১৮৩৮-১৮৪৮)
উনিশ শতকের ইংল্যাণ্ডের গণঅধিকার অর্জনের ঐতিহাসিক একটি এন্দোলনের নাম ‘চার্টিস্ট আন্দেলন’ বা চার্টার আন্দোলন। রাজনৈতিক অধিকারসহ ১৮৩৮ এর গণঅধিকার অর্জন এই আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল। জনসাধারণের দাবির অন্যতম ছিল প্রাপ্তবয়স্কদের সর্বজনীন ভোটাধিকার, পার্লামেন্টের নিয়মিত বার্ষিক অধিবেশন আহবান, ব্যালটের মাধ্যমে ভোটপ্রদান, পার্লামেন্টের সদস্যদের ভাতা দান, নির্বাচনী এলাকাগুলির সম আকার, পার্লামেন্টের সদস্য হওয়র জন্য বিশেষ পরিমাণ আর্থিক সঙ্গতি থাকার শর্ত বিলোপ। এই সমস্ত দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলনের নেতারা ১৮৩৯ সনে একটি জাতীয় কনভেনশন আহবান করেন। এবং সে কনভেনশনে পার্লামেন্টে গণসহিসহ গণদরখাস্ত পেশকরার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। গণসহি সংগ্রম সরে সেই গণসহির স্তূপ বহন করে পার্লামেন্টে নিয়ে আসার চেষ্টায় পুলিশ বাধা দিলে জনসাধারণের সঙ্গে একাধিক সংঘর্ষ সংঘটিত হয়। বার্মিংহামে এরূপ সংঘর্ষে ২৪ জন চার্টিষ্ট বা চার্টার আন্দোলনের কর্মী নিহত হয়। এই গণ আন্দোলন ১৮৩৮ থেকে ১৮৪৮ পর্যন্ত নানা অবস্থার মধ্য দিয়ে অব্যাহত থাকে। ১৮৩৯, ১৮৪২ এবং ১৮৪৮: তিন দফায় গণসহিসহ গণদরখাস্ত পার্লামেন্টে পেশ করা হয়। প্রতিবারই পূর্বের চেয়ে অধিকতর সংখ্যক সহি সংগৃহীত হতে থাকে। প্রথমে ১২ লক্ষ, দ্বিতীয় বারে ৩৩ লক্ষ এবং তৃতীয়বারে প্রায় ৫০ লক্ষ সহি সংগৃহীত হয়। এ সহির বোঝা এত বিরাট আকার এবং ভারী হয় যে ১৮৪২ সালে এই সহির বোঝা একটা বিরাট পাত্রে স্থাপন করে বিশজন আন্দোলনকারীকে বহন করতে হয়।
বস্তুত এত বিপুল আকারে সহি সংগ্রহ করার ঘটনা ইতিহাসে ইতোপূর্বে আর কখনো ঘটে নি। সহি সংগ্রহ উপলক্ষে আন্দোলনকারীগণ সমাজের সমস্যাসমূহ নিয়ে যে সভা, আলোচনা ইত্যাদি সংগঠিত করে তাতে শ্রমিকসহ সমাজের নিচের তলার ব্যাপকতর মানুষ আলোড়িত হয়ে ওঠে। এই আন্দোলন শ্রমিকদের দ্বারাই পরিচালিত হয় এবং আন্দোলনের ফলে শ্রমিকদের মধ্যে নিজেদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের শক্তি সম্পর্কে একটি অভূতপূর্ব উপলব্ধির সৃষ্টি হয়। ১৮৪০ সনে চার্টিস্টরা একটি ঐক্যবদ্ধ চার্টিস্ট পার্টি তথা একটি শ্রমিক পার্টি গঠন করার সর্বপ্রকার চেষ্টা করে। চার্টিষ্ট আন্দোলন পুঁজিবাদী শাসনের সে যুগের ক্ষমতা ও অবস্থার পটভূমিতে বাহ্যত ব্যর্থ হলেও শ্রমজীবী মানুষের চেতনা সঞ্চারে এক বিরাট ভূমিকা পালন করেছিল। এ কারণে শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে ইংল্যাণ্ডের চার্টিস্ট আন্দোলন একটি উল্লেখযোগ্য তাৎপর্যপূর্ণ আন্দোলন
Charvake: চার্বাক
ভারতীয় দর্শনের বস্তুবাদী মতবাদ চার্বাকবাদ বলে পরিচিত। বস্তুবাদী দর্শনকে লোকায়ত দর্শনও বলা হয়। ভারতীয় দর্শনকে সাধারণত ভাববাদী বলে মনে করা হয়। কিন্তু গ্রীক দর্শনের ন্যায় ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসেও অতি প্রাচীনকাল থেকে বস্তুবাদী দর্শনের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। ঋগবেদে বৃহস্পতির যে মতের উল্লেখ দেখা যায় সে মতকে ভারতীয় দর্শনের আদি বস্তুবাদী মত বলা যায়। বস্তুই হচ্ছে চরম সত্তা –ঋগবেদে বৃহস্পতি এরূপ অভিমতের উল্লেখ আছে। বৃহস্পতির এই বস্তুবাদী অভিমতের অনুসরণ করে চার্বাকবাদের উৎপত্তি ঘটে। মহাকাব্য রামায়ণে ঋষি জাবালীর উক্তির মধ্যেও বস্তুবাদী ভাব পাওয়া যায়। বার্চাকবাদী দর্শনের ভিত্তি হচ্ছে জ্ঞানতত্ত্ব। তাদের মতে জ্ঞানের ক্ষেত্রে ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান বা প্রত্যক্ষ জ্ঞানই হচ্ছে যথার্থ জ্ঞান। প্রত্যক্ষ জ্ঞানের বাইরে কোনো জ্ঞানই সংশয়মুক্ত হতে পারে না। চার্বাক দর্শনে গোড়ার দিকে ইন্দ্রিয়কে জ্ঞানের একমাত্র মাধ্যম মনে করা হত। এ কারণে চার্বাক দর্শনে প্রথমে আনুমানকে জ্ঞানের উপায় হিসাবে স্বীকার করা হয়নি। প্রত্যক্ষভাবে মানুষ কেবল বিশেষকেই জানতে পারে, নির্বিশেষকে নয়। এ জন্য যে জ্ঞান বিশেষের নয়, নির্বিশেষের সে জ্ঞানের কোনো নিশ্চযতা নেই। অনুমান হচ্ছে নির্বিশেষে জ্ঞান। কিন্তু অনুমানকে অস্বীকার করলে আমাদের জ্ঞানের পরিধি সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। এই উপলব্ধি থেকে পরবর্তীযুগের চার্বাকবাদীগণ ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানের সঙ্গে অনুমানকেও জ্ঞানের একটি মাধ্যম বলে স্বীকার করেছেন। অনুমানের অস্বীকৃতির ভিত্তিতে আদি চার্বাকবাদীগণ কার্যকারণের জ্ঞানকেও অগ্রাহ্য করেন। মানুষ ঘটনাকেই শুধু প্রত্যক্ষ করতে পারে। তাদের মধ্যকার সম্বন্ধকে সে প্রত্যক্ষ করতে পারে না। ঘটনায় ঘটনায় কোনো প্রত্যক্ষ যোগ সম্পর্ক নেই। মানুষ বলে, আগুণের কারণে ধোঁয়া সৃষ্টি হয়। চার্বাক দর্শনের মতে আগুন এবং ধোঁয়া দুটি ঘটনা। মানুষ এই ঘটনা দুটিকেই প্রত্যক্ষ করতে পারে। আগুণ ও ধোঁয়ার মধ্যে কোনো সম্পর্ককে সে প্রত্যক্ষ করতে পারে না। কাজেই একটি অপরটির কারণ কিংবা ফল একথা বলার উপায় নেই। চার্বাকবাদীদের এই মতের সঙ্গে ইউরোপীয় অজ্ঞেয়বাদী দার্শনিক হিউমের কার্যকারণতত্ত্বের মিল দেখা যায়। চার্বাকবাদীগণ ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ অর্থাৎ মাটি, পানি ও আগুন এবং বায়ু এই চাররকম বস্তুকে সমস্ত সৃষ্টির মূল বলে স্বীকার করেন। বস্তু থেকেই জীবনের সৃষ্টি। চেতনার কোনো দেহাতীত অস্তিত্ব নেই। মনুষ দেহ এবং তার চেতনা হচ্ছে মূল-সত্তা ক্ষিতি, অপ, তেজ ও মরুতের যৌগিক মিশ্রণের ফল। মন বা আত্মারও কোনো দেহাতীত অস্তিত্ব নেই। দেহের মৃত্যুর সঙ্গে চেতনা বা আত্মারও মৃত্যু ঘটে। জীবন্ত দেহ মৃহ হয়ে পরিশেষে তার মূল বস্তুতে পরিণত হয়। এই তত্ত্বের ভিত্তিতে আত্মার পুনর্জন্মকে সর্বকালের চার্বাকবাদীগণই অস্বীকার করেছেন। বিশ্বচরাচরের সৃষ্টি হয়েছে মূল পদার্থের আকষ্মিক সংমিশ্রণে, কোনো অতি প্রাকৃতিক স্রষ্টার কারণে নয়। ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে কোনো প্রত্যক্ষ জ্ঞান মানুষের নেই। ভারতীয় দর্শনের ভাববাদ যেখানে জগৎকে মায়া এবং দুঃখপূর্ণ বলে অভিহিত করেছে চার্বাকবাদীগণ সেখানে জগৎ এবং জীবনকে আশাবাদের দৃষ্টিতে দেখেছেন। চার্বাকবাদীদের মতে জগৎ কেবল দুঃখপূর্ণ নয়। জীবনের লক্ষ্য হচ্ছে সুখলাভ। সুখই হচ্ছে যথার্থ উত্তম। চার্বাকবাদীদের সুখলাভের তত্ত্বকে ভাববাদীগণ বিকৃত করে তাকে কেবলমাত্র স্থূল এবং অবিমিশ্র সুখের তত্ত্ব বলে ব্যাখ্যা করেছেন। এই দৃষ্টিভঙ্গি ‘ঋণং কৃত্য ঘৃতং পিবেৎ’ প্রবচনকে বিকৃতভাবে চার্বাকবাদীদের জীবনদর্শন বলে প্রচার করা হয়েছে। কিন্তু চার্বাকবাদীগণ অবিমিশ্র সুখের কল্পনাকে অসার বলেছেন। ‘ঋণ করেও ঘৃত’ খাবার নীতি দ্বারা চার্বাকগণ জীবনে দুঃখকে বড় না করে দুঃখের মধ্যেও জীবনকে আনন্দময় ভাবার চেষ্টা করতে বলেছেন। চার্বাকবাদীগণ সামাজিক শ্রেণীভেদকেও অস্বীকার করেছেন। ব্রাহ্মণ কিংবা চণ্ডাল সকলের দেহের রক্তের রঙই লাল, এরূপ দ্বিধাহীন সাম্যমূলক উক্তি চার্বাকবাদীগণ করেছেন। বস্তুত ভারতীয় দর্শনে চার্বাকবাদ কোনো এক বিশেষ ব্যক্তির দর্শন নয়। প্রতি যুগের কুসংস্কার এবং অজ্ঞানতার প্রতিবাদই চার্বাকবাদ। ভারতীয় দর্শনে বিভিন্ন যুগে ভাববাদী চিন্তা ধারাই প্রাধান্য লাভ করেছে। প্রধান সেই ভাবধরারা চার্বাকবাদী বা লোকায়ত চিন্তাধারাকে তার প্রতিপক্ষ মনে করে তাকে বিকৃত এবং নিষিদ্ধ করেছেন। চার্বাকবাদ কোনো প্রখ্যাত দার্শনিকের দর্শন হিসাবে স্বীকৃত না হলেও ভাববাদী ধারার আক্রমণের ভিতরে তার অস্তিত্বের প্রমাণ স্পষ্ট।
Chinese Philosophy: চীনা দর্শন
চীনের দর্শনের ইতিহাস ভারত ও গ্রীক দর্শনের ন্যায় সুপ্রাচীন। খ্রীষ্টাব্দের হাজার বছর পূর্বেও চীনে জীবন ও জগৎ সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশ্নের দার্শনিক আলোচনার সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। এই সময়ে চীনে দর্শনের বৈশিষ্ট্য ছিল বস্তুবাদী। কিছু সংখ্যক দার্শনিক সূত্র এই সময়ে প্রচলিত ছিল। এই দার্শনিক সূত্রগুলির বক্তব্য ছিল যে, বিশ্বপ্রকৃতির মূলে রয়েছে পঞ্চশক্তি যথা –পানি, আগুন, কাঠ, ধাতু এবং মাটি। সমস্ত সৃষ্টি এই পঞ্চশক্তির সম্মেরনেরই ফল। পরবর্তীকালে ইকিং বা পরিবর্তনের গ্রন্থে এই সূত্রগুরি গ্রথিত হয়। ইকিং-এ বিশ্বপ্রকৃতির মূল হিসাবে পাঁচটির বদলে আটটি বস্তুর উল্লেখ দেখা যা। ইকিং –এর বাইরে ইন এবং ইয়াং বলে আরও দুটি সূত্রের কথাও জানা যায়। ইন-এর অর্থ হচ্ছে স্থিতি এবং ইয়াং-এর অর্থ গতি। এদেরকে অনেক সময় যথাক্রমে প্রকৃতির অন্ধকার এবং আলো; অস্তি এবং নাস্তি; পুরুষ এবং স্ত্রী হিসাবে উল্লিখিত হতে দেখা যায়। খ্রিষ্টাব্দ শুরু হওয়ার পূর্বে পঞ্চম থেকে তৃতীয় শতাব্দীতে প্রাচীন চীনা দর্শন অধিকতর সুস্পষ্ট রূপ লাভ করে।এই সময়ে চীনা দর্শনের বিভিন্ন প্রাচীন মতবাদ বা শাখা বিকাশ লাভ করে। এদের মধ্যে তাও দর্শণ এবং মোতিদর্শন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। লাওজ এবং চুংজুকে তাও দর্শনের প্রধান ব্যাখ্যাতা বলা হয়। এঁরা বস্তুর অস্তিত্ব এবং চরিত্র ইত্যাকার দার্শনিক সমস্যার আলোচনা করেন। অপরকে দার্শনিক মোতি এবং তাঁর অনুসারীগণ জ্ঞানের সমস্যা মীমাংসা করার চেষ্টা করেছেন। এ আলোচনায় ভাববাদী ব্যাখ্যারও সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। কুংসুঙলুন নামক দার্শনিক ভাবকে বস্তুনিরপেক্ষ ভাবের মিল দেখা যায়। নীতিগত এবং রাষ্ট্রীয় প্রশ্নে কনফুসিয়াস এবং মেঙজুর মতের প্রসার ঘটে। প্রাচীন চীনা দর্শনের এ যুগকে স্বর্ণযুগ বলে অভিহিত করা হয়। এই যুগের দার্শনিক আলোচনার বিষয় ছিল প্রধানত আকাশ ‘মনের ভাব’, ধর্মশক্তি, চরিত্র, বস্তুর মৌলিক গুণ ইত্যাদি। কনফুসিয়াস ও মেঙজুর মতামতের বৈশিষ্ট্য ছিল, একজন যেখানে মানুষকে স্বভাবগতভাবে ভালো মনে করেছেন, অপরজন সেখানে মানুষকে স্বভাবগতভাবে খারাপ মনে করেছেন। খ্রিষ্টাব্দের প্রথম শতকে চীনা দর্শনে ভাববাদ ও বস্তুবাদের দ্বন্দ্ব অধিকতর স্পষ্টরূপে আত্মপ্রকাশ করে। চীন ভূখণ্ডে বৌদ্ধধর্মের প্রসারও এই যুগে ঘটতে থাকে। কনফুসিয়াসবাদ এবং তাওবাদের সঙ্গে বৌদ্ধবাদ একটি তৃতীয় দার্শনিক মত হিসাবে অনুসৃত হতে শুরু করে। বৌদ্ধবাদীগণ জগৎকে মায়া বলে ব্যাখ্যা করেন। কনফুসিয়াস ও তাওবাদ ভাববাদী দর্শনের উদগাতা। কিন্তু কেবল ভাববাদী দর্শনই নয় –এই যুগের বিখ্যাত দার্শনিক হো চেন তিয়েন এবং ফানচেন জগৎ, অস্তিত্ব, আত্মার অমরতা ইত্যাদি প্রশ্নে বস্তুবাদী মত প্রচার করেন। দশম থেকে ত্রয়োদশ শতকে চীনের সমাজ পরিবর্তন তার ভাবাদর্শেও প্রকাশ পেতে শুরু করে। ভাব এবং বস্তুর প্রকৃতি ও সম্পর্কের ক্ষেত্রে কনফুসিয়াস ও বুদ্ধের মতবাদের স্থানে নবকনফুসিয়াসবাদের উদ্ভব ঘটে এই সময়ে। এই যুগের অন্যতম দার্শনিক চুশী ‘লী’ এবং ‘চী’ অর্থাৎ ভাব এবং বস্তুর মধ্যে ভাবকে প্রধান বলে গণ্য করে ভাববাদের পক্ষ অবলম্বন করেন। চীনের আধুনিক পর্বের শুরু হিসাবে আফিং যুদ্ধের বৎসর অর্থাৎ ১৮৪০ সালকে উল্লেখ করা যায়। এই সময় থেকে চীনের সমাজ জীবনে নতুন আলোড়ন ও পরিবর্তনের ধারা বইতে শুরু করে। একদিকে বৈদেশিক শক্তি চীনকে ক্রমান্বয়ে গ্রাস করার চেষ্টা করে। চীনের সঙ্গে আধুনিক জগতের সাক্ষাৎ পরিচয় ঘটতে শুরু করে। আবার অপরদিকে বিদেশীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধাত্মক জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ হতে আরম্ভ করে। চীন ক্রমান্বয়ে আধা উপনিবেশে পরিণত হয়। কিন্তু ভাবাদর্শের ক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ নতুন সংগ্রামী বস্তুবাদী চিন্তাধারারও পথ প্রশস্ত করে দেয়। তাণসেতুঙ এবং সানইয়াত সেনের ন্যায় অগ্রসরবাদী চিন্তাবিদ এবং নেতৃবৃন্দ প্রাচীন বস্তুবাদের ঐতিহ্যকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা কজরে সামন্তবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে নতুন সমাজ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে প্রচার এবং প্রয়োগ করতে শুরু করেন।
Christianity: খ্রিষ্টধর্ম
পৃথিবীর প্রচলিত প্রধান ধর্মসমূহের একটি হচ্ছে খ্রিষ্টধর্ম। যিশু খ্রিষ্টের উপদেশ এবং তাঁর মূল অনুসারীদের নতুন গ্রন্থ বা নিউটেস্টামেন্টে রক্ষিত কাহিনী ও কথামৃত হচ্ছে খ্রিষ্টধর্মের ভিত্তি।
খ্রিষ্টান ধর্মের উদ্ভব ঘটে পূর্ব রোমান-সাম্রাজ্যে নির্যাতিত দাস এবং দরিদ্র মানুষের মধ্যে। রোমান সম্রাটদের দ্বারা দাসদের বিদ্রোহ পর্যুদস্ত হওয়ায় দাস এবং দরিদ্রের মধ্যে হতাশার সঞ্চার হয়। কন্তু হতাশার মধ্যে তারা এই বিশ্বাসও পোষণ করতে থাকে, কোনো এক উদ্ধারকারী মর্তে আগমন করে সকল অত্যাচার থেকে তাদের মুক্ত করবে। এমন পরিস্থিতিতে যিশু অত্যাচারিত মানুষের ত্রাতা হিসাবে আবির্ভূত হন বলে এই ধর্মের অনুসারীগণ বিশ্বাস পোষণ করেন। এরূপ কাহিনী আছে যে, জুযিয়ার রোমান শাসক পন্টিয়াস পাইলেট ক্রুশে বিদ্ধ করে যিশুকে হত্যা করে। কিন্তু যিশু মৃত্যুর পরে পুনরায় সশরীরে পুনরুত্থিত হন এবং স্বর্গে আরোহন করেন। নির্যাতিতের কাছে অপর ধর্মসমূহের ন্যায় খ্রিষ্ট ধর্মেরও এই আশ্বাস যে, যারা সততার সঙ্গে দুঃখ কষ্ট ভোগ করেও জীবনযাপন করবে স্বর্গে তাদের সুখ লাভ হবে। অপরাপর অনেক ধর্মের ন্যায় খ্রিষ্ট ধর্মের মধ্যেও অনুসারীদের জাতি, অঞ্চল এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য প্রভৃতির ভিত্তিতে মতামতের পার্থক্য সৃষ্টি হয়ে থাকে। এর ফলে কালক্রমে খ্রিষ্টান ধর্ম তিনটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ক্যাথলিক ধর্ম, পূর্বাঞ্চলের মৌলবাদী খ্রিষ্টান ধর্ম এবং সংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে ষোড়শ শতকে ইউরোপের মার্টিন লুথারের নেতৃত্বে সংগঠিত প্রটেস্ট্যান্ট ধর্ম। (দ্র. প্রটেস্ট্যান্টবাদ ও মার্টিন লুথার)
Cicero: সিসেরো (খ্রি. পৃ. ১০৬-৪৩)
প্রাচীন রোমের বাগ্মী, দার্শনিক এবং রাজনীতিক। প্লেটো যেরূপ সংলাপের আকারে রচিত গ্রন্থে তার দর্শনকে প্রকাশ করেছিলেন, সিসেরাও তেমন পদ্ধতিতে তাঁর দর্শন লিপিবদ্ধ করেন। সিসেরোর দর্শন প্রধানত সমন্বয়বাদী। জ্ঞানের ক্ষেত্রে সিসেরোকে সন্দেহবাদের সমর্থক বলা যায়। তাঁর মতে কোনটি সত্য, কোনটি মিথ্যা, তা নির্ণয় করার কোনো উপায় নেই। রাজনীতিক তত্ত্বের ক্ষেত্রে সিসেরোর এই শাসনব্যবস্থায় রাজতন্ত্রী, অভিজাততন্ত্রী এবং গণতন্ত্রী বৈশিষ্ট্যকে সম্মিলিত করা উত্তর বলে মনে করতেন। প্রাচীন রোমে, সিসেরোর জীবনকালে বিভিন্ন রাজনীতিক ব্যক্তিত্বের বিরোধ, লড়াই এবং পারস্পরিক হত্যা রাজনৈতিক জীবনের বৈশিষ্ট্য ছিল। খ্রি. পূ. ৪৯-এ জুলিয়াস সিজারের হত্যার পরে যে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব চলতে থাকে তাতে খ্রি. পূ. ৪৩ সনে সিসেরো ক্ষিপ্ত জনতার হাতে নির্মমভাবে নিহত হন।
Class: শ্রেণী
Class Struggle: শ্রেণী সংগ্রাম
কোনো বৈশিষ্ট্য বা গুণের ভিত্তিতে যে-কোন সমষ্টিকে শ্রেণী বলে অভিহিত করা চলে। ‘শ্রেণী’ শব্দটি তত্ত্ব এবং বিজ্ঞানের বাইরে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের একটি বহুল ব্যবহৃত শব্দ। যুক্তিবিদ্যায় কোনো জাতিবাচক পদকে শ্রেণী বলা হয়। ‘মানুষ’, ‘পশু’, ‘বাঙালী’, ‘হিন্দু’, ‘মুসলমান’ –ইত্যাদি পদ শ্রেণীবাচক পদ। কোনো বিশেষ গুণের ভিত্তিতে একাধিক ব্যক্তি বা উপাদানের উপর প্রযোজ্য নাম। মার্কসীয় তত্ত্বে ‘শ্রেণী’ শব্দের প্রধান ব্যবহার অর্থনৈতিক ব্যবহার। জীবন ধারণের সম্পদের মালিকানা এবং অ-মালিকানার ভিত্তিতে কোনো সমাজের মানুষকে চিহ্নিত করার তত্ত্ব। মার্কসবাদের মতে মনুষ্যসমাজের আদিতে সামাজিক সম্পদের কোনো ব্যক্তিগত মালিকানা ছিল না। সে হিসাবে সেই আদি কালের মনুষ্যসমাজ শ্রেণীহীন ছিল বলে অনুমান করা চলে। জীভন যাপনের হাতিয়ার বা যন্ত্রপাতির বিকাশের একটা বিশেষ পর্যায়ে সম্পদের উপর ব্যক্তিগত মালিকানা প্রতিষ্ঠা করা যখন সমাজের কোনো অংশের পক্ষে সম্ভব হয়, তখনই সমাজে এরূপ অর্থনৈতিক শ্রেণীর উদ্ভব হয়। এবং তারপর থেকে সমাজ বিকাশের প্রধান চালিকা শক্তি হিসাবে সম্পদের এরূপ মালিকশ্রেণী এবং সম্পদের মালিকানাবিহনীন সম্পদহীন শ্রেণীর মধ্যকার দ্বন্দ্ব এবং সংগ্রাম কাজ করে আসছে বলে মার্কসবাদ মনে করে। এ হিসাবে কার্ল মার্কস এবং এঙ্গেলস তাঁদের বিখ্যাত ‘কমিউনিষ্ট ইশতেহারে’ উল্লেখ করেন যে, ‘মানবজাতির জ্ঞান ইতিহাস হচ্ছে শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাস’। অবশ্য মার্কসবাদের অপর এক তত্ত্ব হচ্ছে এই যে, মানুষের সমাজের বিকাশের পরিণতিতে ভবিষ্যতে সমগ্র সামাজিক সম্পদের উপর মানুষের সামাজিক মালিকানা যখন প্রতিষ্ঠিত হবে তখন এরূপ বৈষম্যমূল অর্থনৈতিক শ্রেণীর আর অস্তিত্ব থাকবে না।
Cognition: জ্ঞান প্রক্রিয়া
‘আমাদের জ্ঞান আছে, আমরা জ্ঞান আহরণ করি’ ইত্যাদি কথা আমরা সব সময়ই ব্যবহার করি। জ্ঞানের দ্বারাই মানুষ আদিকাল থেকে নিজের জীবন রক্ষা করে এসেছে, প্রকৃতিকে সে জয় করে চলেছে এবং মানুষের সভ্যতা সৃষ্টি করেছে। জ্ঞান বাদে মানুষ নাই। কিন্তু মানুষ কি করে জ্ঞানলাভ করে একটি দর্শনের একটি বিশেষ আলোচনার বিষয়। জ্ঞানের সমস্যার ক্ষেত্রে ভাববাদী দার্শনিক জর্জ বার্কলির মত খুব পরিচিত। তিনি এরূপ মত প্রকাশ করেছিলেন যদিচ মানুষ বস্তু জগৎকে জানে বলে স্বতঃসিদ্ধভাবে ধরে নেয়, তবু যুক্তিগতভাবে মানুষ বস্তুকে আদৌ জানতে পারে না। মানুষ কেবল তার মনের ভাবকেই জানে। বস্তু কথাটিও মানুষের মনের ভাব। বস্তুর অস্তিত্ব মানুষের মন জানতে পারে না। মানুষের জ্ঞান কতকগুলি প্রধান এবং অপ্রধান ধারণা দ্বারা গঠিত। প্রধান বা মৌল ধারণাগুলি বিশ্বচরাচরের বিধাতা মানুষের মনে সৃষ্টি করেদেন। সেগুলির ভিত্তিতেই মানুষ তার জ্ঞানের জগৎ তৈরী করে। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ জ্ঞানপ্রক্রিয়ার এই ভাববাদী ব্যাখ্যাকে অগ্রাহ্য করে। এই মতানুযায়ী মানুষের জ্ঞান হচ্ছে বস্তুজগতের সঙ্গে মানুষের ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়ামূলক সম্পর্কের ফল। মানুষ তার জন্ম থেকে জৈবিক তাড়নাতেই বাইরের বস্তুকে নিজের জীবনের স্বার্থে আয়ত্ত করার চেষ্টা করে আসছে। বস্তুকে সে নিজের হাতে-পায়ে চোখে-কানে অনুভব করছে। এই প্রক্রিয়ায় বস্তু মানুষের দেহে এবং মস্তিষ্কের কোষে বিভিন্ন সাড়ার সৃষ্টি করেছে। এই মাধ্যমে মানুষের মস্তিষ্ক বিকাশলাভ করেছে। মানুষের মধ্যে বস্তু সম্পর্কে অনুধাবনের, ব্স্তুর উপর গুণ আরোপ করার এবং গুণের সাহায্যে বস্তুকে স্মরণ রাখার শক্তি জন্মেছে। বস্তুজগতের সঙ্গে মানুষের এই জটিল সম্পর্কই যেমন জ্ঞানের প্রক্রিয়া তেমনি এই প্রক্রিয়া থেকেই মানুষের জ্ঞানের সৃষ্টি। জ্ঞান বিধিদত্ত কোনো সম্পদ নয়। জ্ঞানকে মানুষই সৃষ্টি করেছে এবং করছে। বস্তু-বিচ্ছিন্নভাবে জ্ঞান এবং জগৎ বলে কিছু নেই। মানুষের জ্ঞানের লক্ষ্য হচ্ছে বাস্তব জগতের রহস্য উদঘাটন করা। বাস্তবকে জেনে জীবন রক্ষার স্বার্থে তাকে ব্যবহার করা, পরিবর্তন করা। জ্ঞান কোনো স্বয়ংসম্পূর্ণ সীমাবদ্ধ বিষয় নয়। জ্ঞানের প্রশ্নের মানুষের সঙ্গে তার বাস্তব জগতের সক্রিয় সম্পর্ক সর্বদাই জড়িত। মানুষের বাস্তব জগৎ আর্থিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় কাঠামো হিসাবে সংঘটিত। মানুষের জ্ঞানও তাই তার আর্থিক সামাজিক অবস্থার দ্বারা একদিকে যেমন নিয়ন্ত্রিত অপরদিকে তেমনি মানুষের জ্ঞান দ্বারা বিশেষ পর্যায়ের সামাজিক ও আর্থিক কাঠামো নিজেও নিয়ন্ত্রিত। ব্যবহার বাদে জ্ঞান অর্থহীন। মানুষ সতত যেমন তার পরিপার্শ্ব সম্পর্কে জ্ঞান আহরণ করছে তেমনি নিয়ত সেই জ্ঞানের প্রয়োগ দ্বারা তার পরিবেশকে নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য লাভের জন্য পরিবর্তিত করার চেষ্টা করছে।
Coherence: সামঞ্জস্য, সামঞ্জস্যবাদ
দর্শনে সত্যের মাপকাঠি নিয়ে তর্ক আছে। একটা কথা বা বক্তব্য সত্য –এরূপ দাবির অর্থ কি? কেউ যদি বলে, সে ভূত দেখেছে তা হলে তার সে কথাকে মিথ্যা বলে অভিহিত করি। কিন্তু ‘ওখানে একটি চেয়ার আছে’ এ কথাকে আমরা সত্য বলি। কিসের ভিত্তিতে একটি বাক্য বা বক্তব্যকে সত্য বলা হবে? সত্যের মাপকাঠির এই প্রশ্নে দর্শনে দুটি প্রধান তত্ত্বের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। একটি হচ্ছে ‘থিওরি অব করেন্সপণ্ডেন্স’। একে বাংলায় সাদৃশ্যের তত্ত্ব বলা যায়। অপরটি হচ্ছে থিওরি অব কোহারেন্স। একে সামঞ্জস্যের তত্ত্ব বলা যায়। সাদৃশ্যের তত্ত্বের দাবি হচ্ছে যে, কোনো বক্তব্য অনুযায়ী বাস্তব জগতে যদি কোনো অস্তিত্ব থাকে তবে সে বক্তব্যকে সত্য বলা হবে। ‘ওখানে একটি চেয়ার আছে’ এই বক্তব্য অনুযায়ী চেয়ার কথার সদৃশ কোনো বস্তুর যদি অস্তিত্ব বক্তব্যের মুহুর্তে থাকে তবে ওখানে একটি চেয়ার আছে কথাটি সত্য হবে।
সামঞ্জস্যবাদ ভিন্নতরভাবে সত্য নিরূপণ করতে চায়। এই তত্ত্বের ব্যাখ্যাদাতাতের মতে একটি বক্তব্যের বরাবর বাস্তব অস্তিত্ব সত্যের মাপকাঠি হতে পারে না। বিশ্লিষ্ট বা এ্যাবষ্ট্রাক্ট বক্তব্যের বরাবর কোনো বাস্তব অস্তিত্ব আমরা পাইনে। দয়া একটি মহৎ গুণ। কিন্তু দয়ার অস্তিত্ব কোথায়? দয়ালু মানুষ আছে বটে। কিন্তু মানুষ নিরপেক্ষভাবে স্বাধীন অস্তিত্ব সম্পন্ন দয়াকে আমরা দেখতে পাইনে। কাজই সাদৃশ্যের তত্ত্ব সমস্ত সত্যের ব্যাখ্যা করতে পারে না। সামঞ্জস্যবাদ অনুযায়ী সত্যের জগৎ হচ্ছে একটা সামগ্রিক সত্তা। তার অন্তর্ভুক্ত সমস্ত সত্যই পরস্পর যৌক্তিক সম্পর্কে সম্পর্কিত। তাই আমরা যখন কোনো কথা উচ্চারিত করি বা অভিমত পেশকরি তখন তার যথার্থতার বা সত্যের নিরূপণ হবে সত্যের সমগ্র সত্তার সঙ্গে সে সঙ্গতিময় কিংবা সঙ্গতিময় নয় তার বিচারে।
Comte, August: অগাস্ট কোঁতে (১৭৯৮-১৮৫৭ খ্রি.)
‘পজিটিভজম’ বা দৃষ্টবাদের প্রবক্তা ফরাসি দার্শনিক অগাস্ট কোঁতের দর্শন এবং তাঁর রচনাবীল দুটি দিক বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি প্রথতে তাঁর যুগ পর্যন্ত জ্ঞানের সমগ্র বিকাশের একটি ইতিহাস তৈরীর চেষ্টা করেন। এই প্রচেষ্টায় ইতিহাসের যে ব্যাখ্যা তিনি উপস্থিত করেন সে ব্যাখ্যাকে পজিটিভজম বা দৃষ্টবাদ বলে তিনি আখ্যাত করেন। অগাস্ট কোঁতে জ্ঞানের বিকাশে তিনটি স্তরকে চিহ্নিত করেছেন। তাঁর মতে জ্ঞানের বিকাশের আদিযুগ হচ্ছে ধর্মীয় যুগ। এই যুগে রহস্যের ব্যাখ্যায় মানুষ অতি-প্রাকৃতিক শক্তি বা ঈশ্বরের আশ্রয় গ্রহণ করেছে। জ্ঞানের ইতিহাসে দ্বিতীয় যুগ হচ্ছে দার্শনিক যুগ। এ যুগে দার্শনিক চরম কারণ বা চরম সত্তার অস্তিত্বের ভিত্তিতে মানুষ ও জগতের ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছে। এটাকে কোঁতে ধর্মীয় যুগেরই প্রকারভেদ বলেছেন। জ্ঞানের তৃতীয় বা শেষ যুগ হচ্ছে পজিটিভিজম বা দৃষ্ট প্রকৃতির যুগ। এ যুগে বিজ্হানের মাধ্যামে দৃষ্ট প্রকৃতিকে মানুষ চরম বলে স্বীকার করেছে। এ যুগে এসে মানুষ উপলব্ধি করেছে যে, প্রকৃতির বাইরে ঈশ্বর বা চরম সত্তার অনুসন্ধান নিরর্থক। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা বা দৃষ্ট প্রকৃতিকে অতিক্রম করে যাওয়ার কোনো ক্ষমতা মানুষের নেই। দৃষ্ট প্রকৃতিই হচ্ছে চরমসত্তা। কাজেই বিজ্ঞান বা জ্ঞান প্রক্রিয়ার কর্তব্য হচ্ছে বাস্তব জগতের দৃষ্ট বিষয়ের বর্ণনা দান; অভিজ্ঞতার গভীরে অপর কোনো সত্তার অনুসন্ধান করা নয়। জ্ঞানের বিকাশের ইতিহাস রচনার যে বিরাট চেষ্টা কোঁতে করেছেন সে চেষ্টায় তাঁকে আধুনিক ইতিহাসকারদের পথিকৃৎ বলা চলে। ধর্ম কিংবা দার্শনিক চরমসত্তার স্থানে প্রকৃতির প্রাধান্য স্থাপনের চেষ্টায়ও তিনি বিশেষভাবে স্মরণীয়। কিন্তু মানুষের স্থান কেবল তার দৃষ্ট বস্তুপুঞ্জের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে –দৃষ্টের ভিত্তিতে অ-দৃষ্ট কোনো কিছু সম্পর্কে অনুমানের ক্ষমতা মানুষের নাই, এ মত ধর্মীয় বিশ্বাসের বিপরীত সীমান্তের আর এক চরম মত। এর ফলে অগাষ্ট কোঁতের পজিটিভিজম বা দৃষ্টবাদকে চরম অভিজ্ঞতাবাদ বা ভাববাদের একটি প্রকারবিশেষ ব্যতীত বৈজ্ঞানিক কোনো দর্শণ বলে গ্রহণ করা চলে না।
Communist Manifesto: কমিউনিস্ট ইশতেহার
মার্কস এবং এঙ্গেলস রচিত ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেসটো’ বা ম্যানিফেস্টো অব দি কমিউনিস্ট পার্টি ১৮৪৮ সনে প্রকাশিত হয়। লণ্ডনে নির্বাসিত সাম্যবাদী মতবাদে বিশ্বাসী ‘লীদ অব কমিউনিস্টস’ বা সাম্যবাদী সমিতি মার্কস এবং এঙ্গেলস-এর উপর তাদের মতবাদ ব্যাখ্যা করে একটি ইশতেহার রচনার দায়িত্ব ন্যস্ত করে। এই দায়িত্ব হিসাবে আজীনব পরস্পরের সঙ্গী মার্কষ এবং এঙ্গেলস ক্ষুদ্রাকারের হলেও অত্যন্ত সুনির্দিষ্ট এবং ব্যাখ্যামূলকভাবে এই ইশতেহারটি রচনা করেন। কালক্রমে এই ইশতেহার শ্রমিকশ্রেণীর সাম্যবাদী বিপ্লবী বিশ্বাসের অন্যতম মৌলিক দলিল হিসাবে পৃথিবীব্যাপী খ্যাতি অর্জন করে। পৃথিবীর প্রায় সমস্ত ভাষায় কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো অনূদিত হয়েছে। মার্কস এবং এঙ্গেলস তাঁদের পূর্বকার কল্পনাবাদী সমাজতন্ত্রী চিন্তাবিদ যথা –সেন্ট সাইমন, ফৌরিয়ার প্রভৃতির ব্যাখ্যা থেকে পার্থক্য নির্দেশ করার জন্য ‘কমিউনিস্ট’ শব্দের ব্যবগহার করেন। ইশতেহারের শীর্ষে তাঁরা ‘দুনিয়ার সকল দেশের শ্রমিক এক হও’ এই আহবার ঘোষণা করেন।
১। বুর্জোয়া এবং প্রলেটরিয়ানস বা সর্বহারা,
২। সর্বহারা এবং কমিউনিস্টগণ,
৩। সমাজতন্ত্রী এবং কমিউনিস্টগণ,
৪। বিদ্যমান বিভিন্ন বিরোধীদলের সঙ্গে কমিউনিস্টদের সম্পর্ক।
এরূপ চারটি প্রধান শিরোনামে মার্কস এবং এঙ্গেলস তাঁদের সাম্যবাদী দর্শন ব্যাখ্যা করেন। শ্রমিকশ্রেণীর সাম্যবাদী দলগুলিকে বিভিন্ন দেশে বেআইনী অবস্থায় গুপ্তভাবে তাদের আন্দোলনকে পরিচালনা করতে হত। ১৮৭২ সনে এর একটি জার্মান সংস্করণ এবং ১৮৮২ সনে প্রকাশিত হয় ইংরেজী সংস্করণ। মার্কস জীবিত থাকাকালে এসব সংস্করণের ব্যাখ্যামূলক ভূমিকা তাঁদের উভয় দ্বারা যুক্তভাবে রচিত হয়। মার্কসের মৃত্যুর পরে ১৮৮৮ সনের ইংরেজী সংস্করণের ভূমিকার একস্থানে এঙ্গেলস লিখেছিলেন “যদিও এই ম্যানিফেস্টো আমাদের যৌথ রচনা, তবুও আমার একথা বলা আবশ্যক যে, এই ইশতেহারের মূল যে বক্তব্য তা মার্কসেরই চিন্তাপ্রসূত। এবং এই মূল বক্তব্য হচ্ছে এই দর্শন যে, ইতিহাসের প্রতিটি যুগে অর্থনৈতিক উৎপাদন এবং বিনিময়ের প্রধান যে ব্যবস্থা তার উপরই প্রতিষ্ঠিত হয় সে যুগের রাজনৈতিক এবং বুদ্ধি বা ভাবগত ইতিহাস। এই মূল ভিত্তি দ্বারাই মাত্র এদের ব্যাখ্যা করা সম্ভব। ফলত মানব জীবনের আদি গোষ্ঠীসমূহের জমির উপর যৌথ মালিকানার পরবর্তী ইতিহাস হচ্ছে শোষক এবং শোষিতের মধ্যকার শ্রেণীসংগ্রামের ইতিহাস। এবং এই ইতিহাস এখন বিকাশের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে আজ এমন পর্যায়ে এসে উপস্থিত হয়েছে যেখানে আজকের যুগের শোষিত এবং নির্যাতিত প্রধান শ্রেণী তথা প্রলেটারিয়েট শ্রেণী তার শোষক এবং শাসক বুর্জোয়া শ্রেণীর আধিপত্য থেকে নিজের মুক্তি সমগ্র সমাজের মধ্যে শ্রেণী বৈষম্য এবং শ্রেণী শোষনের বিলোপ সর্বকালের জন্য সাধন করা ব্যতীত অর্জন করতে পারে না”।
কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোর ভাষা যেমন সুনির্দিষ্ট তেমনি তার মধ্যে সর্বহারা শ্রেণীর ভবিষ্যৎ অনিবার্য বিজয়ের আবেগময় বিশ্বাসের প্রকাশও সুস্পষ্ট। মানুষের সমাজের ঐতিহাসিক বিকাশের পর্যায়সমূহের উল্লেখ এবং বিশ্লেষণ এবং সাম্যবাদী কর্মীদের করণীয়ের নির্দেশের পরিশেষে কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোর অন্তিম অনুচ্ছেদটি নিম্নরূপে রচনা করা হয়েছে; ‘কমিউনিস্টরা নিজেদের উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্যকে গোপন করতে ঘৃণা বোধ করে। একথা তারা প্রকাশ্যেই ঘোষণা করছে যে, তাদের লক্ষ্য কেবল বিদ্যমান সকল সামাজিক অবস্থার জোরপূর্বক উৎসাদনের মাধ্যমেই সম্ভব। শাসক শ্রেণীগুলি কমিউনিস্ট বিপ্লবের আতঙ্কে কম্পিত হোক। তাদের নিজেদের শৃঙ্খলকে হারানো ব্যতীতত সর্বহারার হারাবার কিছু নেই। তাদের লাভ করার আছে সমগ্র পৃথিবী। সকল দেশের শ্রমজীবী মানুষ ঐক্যবদ্ধ হও”।
Communism, Primitive:আদিম সাম্যবাদ
সমাজতাত্ত্বিক গবেষক, বিশেষ করে মার্কসবাদীদের মতে মানুষের প্রাথমিক সামাজিক সংগঠনের রূপ ছিল যৌথ এবং সাম্যবাদী। জীবন রক্ষার জন্য উৎপাদনের উপায়গুলো তখনো খুবই অনুন্নত। শ্রমের বিভাগও বিকাশ লাভ করে নি। নারী-পুরুষের কাজের মধ্যেও তেমন পার্থক্য সৃষ্টি হয় নি। এই পর্যায়ে উৎপাদনের ক্ষেত্রে ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে সম্পর্ক ছিল অপরিহার্যরূপে সামাজিক ও সমষ্টিগত। উৎপাদনের উপায় অর্থাৎ সুচালো পাথর, বর্শা, বল্লম ইত্যাকার উৎপাদনী যন্ত্রগুলি ছিল গোত্র বা গোষ্ঠীর যৌথ মালিকানাধীন সম্পত্তি এবং তার ব্যবহার ছিল সমষ্টিগত। উৎপাদিত বা সংগৃহীত খাদ্য সম্পদের ভোগও ছিল সমষ্টিগত। অবশ্য এই সামগ্রিক যৌথ ব্যবস্থার মধ্যেও ব্যক্তিগত মালিকানা যে কিছুই ছিল না, এমন নয়। দেহাবরণ অবশ্যই ব্যক্তিগত ছিল। উৎপাদনী যন্ত্র যে আদৌ ব্যক্তিগত থাকতে পারতো না এমনও নয়। কিন্তু সামগ্রিকভাবে বাস্তব পরিস্থিতি এমন ছিল যে, গোত্র বা গোষ্ঠীর ঐক্যবদ্ধ এবং যৌথ চেষ্টা ও পরিশ্রম ব্যতীত ব্যক্তির পক্ষেও খাদ্র সংগ্রহ করে এবং বৈরী প্রকৃতি ও বন্যপশুর বা প্রতিদ্বন্দ্বী মানবগোষ্ঠীর আক্রমণ প্রতিরোধ করে জীবন রক্ষা সম্ভব ছিল না। এর পরে সামাজিক পরিশ্রমে বিভাগ শুরু হয়। পশুপালন এবং কৃষিকাজ দুটি আলাদা জীবিকার রূপ গ্রহণ করে। এই বিভাগের ভিত্তিতে সমাজের উৎপাদনী ক্ষমতা দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে। বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে বিভিন্ন প্রকার দ্রব্য-সামগ্রীর পরিমাণের তারতম্যে দ্রব্যবিনিময় শুরু হয় এবং সম্পদের ব্যক্তিগত মালিকানাও সম্ভব হতে শুরু করে। কালক্রমে ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে জীবনের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির পরিমাণের পার্থক্যে অসাম্য উদ্ভুত হতে থাকে। গোত্রে গোত্রে লড়াই বা যুদ্ধের পরিণামে পরাজিত গোত্রের মানুষ বিজয়ী গোত্রের দাস বলে গণ্য হয়ে উৎপাদনের এক অভাবিতপূর্ব উপায়রূপে বিজয়ী গোত্রের কাছে কিংবা বিজয়ী গোত্রের শক্তিমান ব্যক্তিদের কাছে দেখা দেয়। এবার সামগ্রিকভাবে সামাজিক কাঠামোতে সাম্যবাদ বজায় রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। দাস এবং উৎপাদনের যন্ত্রাদির ব্যক্তিগত মালিকানায় উৎপাদন বৃদ্ধির যে বিপুল সম্ভাবনা দেখা দেয় পূর্বকার যৌথ ব্যবস্থাপনার অবস্থিতি যে সম্ভাবনার বিকাশের প্রতিশ্রুতি বা শৃঙ্খলের কাজ করতে থাকে। হস্তশিল্প থেকে কৃষিকাজের পৃথকীকরণ শ্রমের বিভাগকে বিস্তৃততর করে উৎপাদন ক্ষমতাকে আরো বাড়িয়ে দেয়। এই প্রক্রিয়ার পরিণামে আদি সাম্যবাদী সমাজ ভেঙে শ্রেণীবিভক্ত সামজের উদ্ভব ঘটে। শ্রেণী বিভক্ত সমাজ রক্ষার প্রয়োজনে রাষ্ট্রযন্ত্রেরও সৃষ্টি হয়। ইতিহাসে দাস ও প্রভুতে বিভক্ত সমা জন্মলাভ করে।
Copernicus: কপারনিকাস (১৪৭৩-১৫৪৩ খ্রি.)
আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের জনক কপারনিকাসের জন্ম হয়েছিল পোলাণ্ডে। সৌরজগতের বর্তমান সূর্যকেন্দ্রিক তত্ত্বের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন কপারনিকাস। এতদিন পর্যন্ত সূর্য, চন্দ্র এবং পৃথিবীর আবর্তনের ব্যাখ্যায় টলেমীর পৃথিবী কেন্দ্রীক তত্ত্বই ছিল স্বীকৃত তত্ত্ব। টলেমীর তত্ত্বানুযায়ী পৃথিবী হচ্ছে বিশ্বের কেন্দ্র। পৃথিবীকে কেন্দ্র করেই সূর্য-চন্দ্র প্রভৃতির আবর্তন। মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস; দার্শনিক এ্যারিস্টটল-এর ব্যাখ্যা কিংবা টলেমীর তত্ত্বের মধ্যে কোনো পার্থক্য ছিল না। সকেলই পৃথিবীকেই বিশ্বজগতের কেন্দ্র বলে মনে করেছে। এই প্রতিষ্ঠিত মতের ক্ষেত্রে কপারনিকাসের তত্ত্ব সাধারণ বিশ্বাসের একেবারে বিপরীত ছিল। প্রাচীন গ্রিসের বস্তুবাদী দার্শনিকদের পৃথিবী আবর্তনের তত্ত্বের উপর নির্ভর করে পূর্ণতর গবেষণায় কপারনিকাস দার্শনিকদের পৃথিবী ৩৬৫ দিনে যেমন সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে তেমনি নিজের মেরুদণ্ডের উপরও সে আবর্তিত হচ্ছে। কেবল পৃথিবী নয়, পৃথিবীর মতোই গ্রহ হচ্ছে মারস (মঙ্গল), মার্কারী (বুধ), ভেনাস (শুক্র), জুপিটার (বৃহস্পতি), স্যাটার্ন (শনি)। এরাও সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। সূর্য থেকে দূরত্বের ভিত্তিতে এদের সূর্য প্রদক্ষিণের কালেরও তফাৎ ঘটছে। মার্কারী ৮৮ দিনে, ভেনাস ২২৫ দিনে, মারস ৬৮৬ দিনে, জুপিটার ১২ বছরে এবং স্যাটার্ন ৩০ বছরে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে। এভাবে তৈরি হয়েছে সৌরজগৎ। কপারনিসাকের পরবর্তী বৈজ্ঞানিকগণ বিশেষ করে কেপলার, (১৫৭১-১৭২৭ খ্রি.) গ্রহ-উপগ্রহগুলির পরিক্রমণ পথ আরো সুনির্দিষ্টভাবে নির্ধারিত করেন। কিন্তু পৃথিবীকেন্দ্রীক ধারণার উপর প্রথম আঘাত হানার কৃতিত্ব কপারনিকাসের। মানুষ যেখানে এর পূর্বে পৃথিবীকে সর্ববৃহৎ বলে কল্পনা করেছে আর এই পৃথিবীর মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রেখেছে, সেখানে কপারনিকাস মানুষের জ্ঞানের সীমাকে পৃথিবীর বাইরে বৃহত্তর বিশ্বে অবারিত করেছেন। ধর্মের অন্ধ এবং অনড় বিশ্বাসের শেকল থেকে বিজ্ঞানের মুক্তিদাতার ভূমিকা তিনি পালন করেছেন। এ কারণে যাজক-সম্প্রদায় থেকে শুরু করে প্রচলিত ধ্যানধারণায় বিশ্বাসী সকল মহলই কপারনিকাসের উপর সেদিন ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল।
Corce, Bendetto: বেনেদাতো ক্রোচে (১৮৬৬-১৯৫২ খ্রি.)
আধুনিককালের প্রখ্যাত ইতালীয় দার্শনিক। ক্রোচের দর্শন ভাববাদের প্রকার বিশেষ। অনেকে এ দর্শনকে ঐতিহাসিক ভাববাদ বলে আখ্যাত করেন। ক্রোচের রচনাসমূহের বিশ্লিষ্ট চিন্তার দুর্বোধ্য প্রকাশ করেছে। এসথেটিকস বা নন্দনতত্ত্বের ক্ষেত্রে তাঁর মতামত আধুনিককালের, বিশেষ করে ভাববাদী শিল্প আলোচনায় প্রভূত প্রভাব বিস্তার করেছে। ক্রোচের দর্শনের সাধারণ এবং সংক্ষিপ্ত ধারণা দানের চেষ্টায় বলা যায় যে, এ দর্শনের মূল হচ্ছে ইণ্টুইশন বা সজ্ঞা। বস্তু এবং মনের মধ্যে প্রধান শক্তি কে? এ প্রশ্নে ক্রোচ-দর্শনের জবাব হচ্ছে যে, মনই হচ্ছে আসল শক্তি। আর মনের সত্তা বা অস্তিত্ব নিহিত রয়েছে তার ক্রিয়ায়। মনের ক্রিয়ার বাইরে মন বলে কিছু নেই। মানসিক ক্রিয়াই মন। ক্রোচের মতে মনের ক্রিয়া দুরকম তাত্ত্বিক এবং প্রযুক্তিক। তত্ত্বগত ক্রিয়ার মাধ্যমে মন বস্তুর সত্তাকে উপলব্ধি করে আপন সত্তায় তাকে লীন করে নেয় এবং প্রযুক্তিক ক্রিয়ায় মন সৃজনশীল হয়ে নতুন সত্তার সৃষ্টি করে। মনের ক্রিয়া ইণ্টুইশন বা সজ্ঞা, কনসেপশান বা উপলব্ধি, বিশেষের এবং নির্বিশেষের ইচ্ছঅ –এই চার রকমে প্রকাশ পেতে পারে। এই চার রকম ক্রিয়ার মাধ্যমেই মানুষের শিল্প, দর্শন, নীতিশাস্ত্র এবং আর্থিক কর্মপ্রবাহের উদ্ভব। এই চার প্রকার সৃষ্টির একটি অপরটির বিরোধী নয়। এরা পরস্পর পরিপূরক। ক্রোচের মতে শিল্পবোধ বা সৌন্দর্যানুভূতি হচ্ছে সর্বোৎকৃষ্ট জ্ঞান মাধ্যম। সৌন্দর্যবোধই হচ্ছে মানুষের আদিম বোধ। এ বোধ মানুষ বুদ্ধির মারফতে লাভ করতে পারে না। এ বোধ তার সহজাত বা সজ্ঞাজাত। কিস্তু সজ্ঞা কেবল মনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। সৌন্দর্য বা শিল্পসৌকর্য কেবল অনুভূতি নয়। এর অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে প্রকাশে। কোনো সৌন্দর্যানুভূতি অপ্রকাশিত থাকতে পারে না। প্রকাশই হচ্ছে মনের অনুভূতির ভাষা। মানুষের মুখের যে ভাষা তাও সেই সৌন্দর্যানুভূতিরই প্রকাশ। এদিক থেকে ভাষালোচনা এবং সৌন্দর্যালোচনার মধ্যে কোনো পার্থক্য নাই।
Confucianism: কনফুসিয়াসবাদ
চীনের প্রাচীন সামাজিক ও ধর্মীয় নেতা কনফুসিয়াসের উপদেশাবলীকে কনফুসিয়াসবাদ বলা হয়। কনফুসিয়াসের জীবনকাল ৫৫১ থেকে ৪৭৯ খ্রিষ্ট-পূর্বাব্দ বলে ধারণা করা হয়। কনফুসিয়াসের উপদেশাবলী মানুষের জীবনের সর্বক্ষেত্রেই ব্যাপ্ত ছিল। প্রাচীন সমাজে তিনি কোনো বিশেষ ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে যত পরিচিত নন তার চেয়ে চীন সমাজের সংরক্ষণকারী হিসাবেই তাঁর ঐতিহাসিক পরিচয়। মানুষ ব্যক্তিগত জীবনে, পারিবারিক ক্ষেত্রে, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় সংস্থায় এবং ঈশ্বরের সঙ্গে সম্পর্ক কিরূপ জীবন যাপন করবে এর প্রতিটি বিষয়ে কনফুসিয়াস তাঁর অভিমত প্রকাশ করেছেন। তাঁর সমস্ত উপদেশের লক্ষ্য ছিল প্রচলিত সামাজিক ব্যবস্থায় ভারসাম্য রক্ষা করা।
পৃথিবীর উপরে যদি কাউকে মান্য করতে হয় তা হলে মানুষ মান্য করবে ঈশ্বরকে, ঈশ্বরের বিধানকে। যে মানুষ মহৎ সে ঈশ্বরের বিধানেই মহৎ। যে-মানুষ অধম সে ঈশ্বরের বিধানেই অধম। এর কোনো পরিবর্তনের প্রশ্ন আসে না। প্রশ্ন হচ্ছে সেই বিধানকে সুসঙ্গতভাবে মেনে চলা। যে রাজা, সে ঈশ্বরের বিধানেই রাজা। ছোটর কর্তব্য হচ্ছে বড়কে মানা। রাজা-প্রজা, পতী-পত্নী, পিতা-পুত্র, জ্যেষ্ঠ-কনিষ্ঠ, এই প্রকারের সম্বন্ধের ভিত্তিতেই সমাজ গঠিত। বিধির বিধানে যে স্থানে যে অধিষ্ঠিত সেই স্থান অনুযায়ী দায়িত্ব সুচারুরূপে পালন করা তার কর্তব্য। রাজার আদর্শ হবে উত্তম রাজা হবার এবং প্রজার আদর্শ হবে উত্তম প্রজারূপে তার দায়িত্ব পালন করা। কনফুসিয়াসের অনুসারীগণ বিভিন্নভাবে তাঁর অভিমতকে ব্যাখ্যা করেন। তার ফলে কনফুসিয়াসবাদেও বিভিন্ন উপধারার উদ্ভব হয়। কনফুসিয়াসের অন্যতম শিষ্য মেঙজু মনে করতেন যে, সমাজে যে অসাম্য বিদ্যমান তা বিধাতারই বিধান। বিশ্ব প্রকৃতির ব্যাখ্যায় কনফুসিয়াসের অপর এক অনুসারী সুনজু কিছুটা বস্তুবাদী মত প্রচারের প্রয়াস পান। তাঁর মতে ঈশ্বর প্রকৃতির অংশ, প্রকৃতির ঊর্ধ্বে কোনো সত্তা নয়। খ্রিষ্টাব্দের একাদশ এবং দ্বাদশ শতকে চুশী এবং অন্য অনুসারীগণ নব কনফুসিয়াসবাদের প্রবর্তন করেন। তাঁদের মতে বিশ্বের মূলে রয়েছে ‘লী’ এবং ‘চী’র দ্বন্দ্ব। ‘লী’ হচ্ছে ভাব, আর ‘চী’ হচ্ছে বস্তু। ‘লী’র কারণেই মানুষের মধ্যে মহত্ত্বের সৃষ্টি আর ‘চী’র কারণে মানুষ লোভ, মোহ ইন্দ্রিয় সুখ ইত্যাদির কাছে আত্মসমর্পণ করে। সুর্দীঘকাল স্থায়ী সামন্ততান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় চীনে তিনটি ভাবাদর্শের উদ্ভব দেখা যায়। এই তিনটির একটি হচ্ছে কনফুসিয়াসবাদ এবং অপর দুটি হচ্ছে তাও এবং বৌদ্ধ ধর্ম।
Culture: সংস্কৃতি
মানৃষের সর্বপ্রকার বৈষয়িক এবং আত্মিক সৃজন ও সম্পদের ব্যাপক অর্থবহ শব্দ। অনেক সময় সাহিত্য, শিল্প, দর্শন, সামাজিক আচরণ ও নীতি –অর্থাৎ মানুষের ভাবগত সৃষ্টিকর্মকে কেবল সংস্কৃতি বলে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু মানুষের সৃষ্টির সম্পূর্ণ অর্থে আর্থিক ও কারিগরি সৃজন কর্ম এবং তার ফসল অর্থাৎ উৎপাদনের যন্ত্র, কলকারখানা এবং উৎপাদিত বৈষয়িক সম্পদ ও সৌধকেও একটা মানব সমাজের সংস্কৃতি হিসাবে গণ্য করা উচিত। পার্থক্য হিসাবে ভাবগত সৃষ্টিকে ‘আত্মিক সংস্কৃতি’ এবং দেহগত সৃষ্টিকে ‘বৈষয়িক সংস্কৃতি’ বলে চিহ্নিত করা চলে। কিন্তু এরূপ পৃথকীকরণও কেবলমাত্র আপেক্ষিকভাবে স্বীকার্য। আত্মিক ও বৈষয়িক সংস্কৃতির মধ্যে কোনো চরম পার্থক্য বা বিরোধের অবকাশ নাই। কোনো আত্মিক সংস্কৃতি দেহ এবং বৈষয়িক অবস্থা-নিরপেক্ষভাবে সৃষ্টি হতে পারে না। আবার কোনো বৈষয়িক কর্মই মনের কল্পনা বাদে সাধিত হতে পারে না। সংস্কৃতি হচ্ছে সামাজিক সৃষ্টি। সামাজিক সম্পর্কের ভিত্তিতে মানুষের ব্যক্তিগত এবং যৌথ ক্রিয়া-কাণ্ডের ফলে এর উদ্ভব। এ কারণে সমাজ-সংগঠনের বিশিষ্ট রূপ দ্বারা সমাজের সংস্কৃতির রূপ প্রধানত নির্দিষ্ট হয়। এক সমাজ থেকে আর এক সমাজের সংস্কৃতি এই ভিত্তিতেই পৃথক হয়। আর্থিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে মানুষের সমাজের ইতিহাস শ্রেণীভেদের অবস্থাহীন আদিম সাম্যবাদী সমাজ এবং তারপরে শ্রেণীভেদ সম্পন্ন দাস সমাজ, সামন্ততান্ত্রিক সমাজ এবং পুঁজিতান্ত্রিক সমাজ হিসাবে এ পর্যন্ত বিভক্ত হয়েছে। এই পর্যায় মানুষের সংস্কৃতির ইতিহাসকেও দাস সমাজের সংস্কৃতি, সামন্ত সমাজের সংস্কৃতি ও পুঁজিতান্ত্রিক সমাজের সংস্কৃতি বলে চিহ্নিত করা হয়। এক একটা সমাজের সংস্কৃতি ও পুঁজিতান্ত্রিক সমাজের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলির ভিত্তিতে সংস্কৃতির এই পরিচয়। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, দাস বা সামন্ততান্ত্রিক বা পুঁজিতান্ত্রিক সংস্কৃতি বলতে তার অভ্যন্তরে বৈচিত্র, বিরোধ এবং বিভিন্নতাশূন্য একটি অখণ্ড সৃষ্টিকে বুঝায়। দাস সমাজে প্রভু এবং দাসের মধ্যে যে বিরোধ, সে বিরোধ প্রভুশ্রেণীর এবং দাসের বৈষয়িক ও মানসিক কর্মকাণ্ডেও প্রতিফলিত। সামন্ততান্ত্রিক সমাজেও অনুরূপ। পুঁজিতান্ত্রিক সমাজেও উৎপাদনের হাতিয়ারের ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত মালিকানা, উৎপাদনের যৌথ প্রক্রিয়া এবং উৎপাদিত সম্পদের ভোগ থেকে অধিকাংশকে বঞ্চিত রাখার ব্যবস্থায় যে শ্রেণীগত বিরোধ, বৈষম্য, সংঘাত এবং ভাবভাবনার সৃষ্টি হয় তার প্রতিরূপ পুঁজিতান্ত্রিক সমাজের সংস্কৃতি, বিশেষ করে তার আত্মিক সৃষ্টির ক্ষেত্রে প্রকাশ পায়। সমাজতান্ত্রিক সমাজে –অর্থাৎ যে সমাজে উৎপাদনের ক্ষেত্রে মানুষ শোষক এবং শোষিত হিসাবে বিভক্ত নয়, সে সমাজের সংস্কৃতিতে মৌল কোনো আর্থিক সংঘাতের প্রতিফলনের অবকাশ নাই। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক সমাজের সংস্কৃতিও বৈচিত্রহীন নয়। বিরোধাত্মক বৈচিত্রের স্থানে সমাজতান্ত্রিক সংস্কৃতির বৈচিত্র সাধিত হয় সমাজের বিভিন্নমুখী উন্নতি সাধনের বিচিত্র সৃজনকর্মের মাধ্যমে।
Cynic: উদাসীন
Cynicism: ঔদাসীন্য, উদাসীনতাবাদ
ইংরেজী ‘সিনিক’ এবং ‘সিনিসিজম’ শব্দ দ্বারা জীবনের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য আরাম আয়েশ সব কিছুর প্রতি একটা কঠোর ঔদাসীন্য বুঝায়। ইংরেজী সিনিক শব্দের উদ্ভব গ্রিক ‘কিওনস’ থেকে। ‘কিওনস’ বলতে কুকুর বুঝায়। আর তাই ‘কিনিকাল’ বা ‘সিনিকাল’ দ্বারা কুকুরের ন্যায় অদমনীয় মনোভাব বুঝাত।
কিন্তু এই শব্দের দার্শনিক তাৎপর্য গ্রিক দার্শনিক এ্যান্টিসথেনিস (খ্রি. পূ. ৪৩৫-৩৭০) এবং তাঁর অনুসারী ডায়োজেনিস, ক্রেটিস প্রমুখ দার্শনিকদের জীবন দর্শণ এবং জীবনাচার থেকে উদ্ভুত। দাসদের শোষণের ভিত্তিতে গ্রিক গণতন্ত্র এককালে যে শৌর্য এবং বীর্যের পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছিল, খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীর শেষের দিকে বিভিন্ন গ্রিক নগর রাষ্ট্রের আত্মঘাতী সংঘর্ষে সে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা সমাজে অবিশ্বাস, অন্তর্ঘাত এবং নৈরাজ্যের সৃষ্টি করতে থাকে। সমাজের এই অস্থির অবস্থায় এমন একদল চিন্তাবিদ ও দার্শনিকের উদ্ভব ঘটে যাঁরা মানুষের শান্তি সামাজিক ও রাজনীতিক ক্রিকাকাণ্ডে অংশগ্রহণে নয়, সমস্তরকম সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব এবং জীবনের আরাম আয়েশ বিলাস ব্যসন সব কিছু পরিত্যাগের মধ্যে চিহ্নিত করার প্রয়াস পান। এই মনোভাবের প্রাথমিক লক্ষণ মহৎ ব্যক্তি সক্রেটিসের জীবনাচরণ এবং অভিমতের মধ্যে দেখা যায়। রাষ্ট্রীয় নেতৃত্ব নয়, জ্ঞানের অন্বেষণ এবং সহজ জীবনযাপনের মধ্যেই তিনি ব্যক্তির মহৎ কর্তব্য নির্দিষ্ট করেছিলেন। সহজ জীবন যাপনের সক্রেটিসীয় নীতি সিনিকপন্থীগণ অধিকতর কঠোরভাবে অনুসরণ করার জন্য জীবনের প্রায় সব প্রয়োজনকে বাহুল্য বলে বর্জন করার চেষ্টা করে। ‘অঞ্জলিদে যদি তৃষ্ণার পানি পান করা সম্ভব তা হলে পেয়ালা বাহুল্য। অতএব সে বর্জনীয়’। সিনিক দার্শনিক ডায়োজেনিস (খ্রি. পূ. ৪১২-৩২৩) সম্পর্কে এরূপ কাহিনী প্রচলিত আছে যে, গ্রিক সম্রাট আলেকজাণ্ডার একদিন ডায়োজেনিসের নিকট উপস্থিত হয়েছিলেন। ডায়োজেনিস তখন সূর্যালোকে উপবিষ্ট। সম্রাট আলেকজাণ্ডার সূর্যের রশ্মিকে আড়াল করে ডায়োজেনিসের নিকটবর্তী হয়ে যখন দার্শনিককে বললেন, ‘আমি আপনার কি উপকার করতে পারি?’ তখন দার্শনিক উত্তরে বললেন, ‘আপনি আমার উপর নিপতিত সূর্যের রশ্মিকে আড়াল না করে একটু সরে দাঁড়াতে পারেন।
সিনিক দার্শনিকদের সবকিছু বর্জন করার নীতির একটি রাজনৈতিক তাৎপর্য ছিল। শোষণ এবং অনাচারপূর্ণ তৎকালীন গ্রিক সমাজের সবকিছু বর্জণ করে জ্ঞানের মধ্যে মুক্তি অন্বেষণের নীতিকে সমাজ ব্যবস্থার অসঙ্গতি ও শোষণের সমালোচনা হিসাবে ব্যাখ্যা করা যায়। সিনিকপন্থীগণ সমাজে দাস ও প্রভুর বৈষম্যকে স্বীকার করত না। সকল মানুষ সমান, এই মতাদর্শ তারা অনুসরণ করত। এই আদর্শ তৎকালীন মানুষের দৃষ্টিকে গ্রিক নগর রাষ্ট্রের সংকীর্ণ প্রাচীর অতিক্রম করে বৃহত্তর মনুষ্য সমাজের মধ্যে বিস্তারিত করার সহায়ক শক্তি হিসাবে কাজ করেছিল। সিনিক দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা এ্যাণ্টিসথেনিস ছিলেন প্লেটোর সমকালীন। তিনি এরূপ অভিমত পোষণ করতেন যে, যিনি জ্ঞানী তাঁর কর্তব্য হচ্ছে ন্যায়পরায়ণতার সর্বজনীন আদর্শকে অনুসরণ করা। তিনি আরো মনে করতেন, জীবন যাপনের ক্ষেত্রে মানুষ সভ্যতার কৃত্রিমতাকে বর্জন করে যত বেশী পশুর প্রাকৃতিক সহজ জীবনে প্রত্যাবর্তন করতে পারবে তত সে স্বাভাবিক এবং উত্তজ জীবনের অধিকারী হবে। এ্যান্টিসথেনিস ‘সাইনো সারজেম’ নামক স্থানে তাঁর দর্শন প্রচার করতেন। এই স্থান থেকেও ‘সিনিক’ শব্দের উৎপত্তি ঘটে থাকতে পারে। বিভিন্ন গ্রিক দর্শনের সঙ্গে দর্শনের প্রচার স্থানের নাম যুক্ত হতে দেখা যায়। একাডেমীয়া স্থান থেকে প্লেটোর একাডেমী। লাইসিউম থেকে এ্যারিস্টটলের লাইসিউম দর্শনপিঠের প্রসিদ্ধি।
D
D’ Alembert: ডি, আলেম্বার্ট (১৭১৭-১৭৮৩ খ্রি.)
ফরাসি বিশ্বকোষিকদের অন্যতম দার্শনিক এবং গণিতশাস্ত্রবিদ ছিলেন ডি’ আলেম্বার্ট। বৈজ্ঞানিক হিসাবে বায়ু প্রবাহের উপর তিনি ১৭৪২ খ্রিষ্টাব্দে একখানি গ্রন্থ রচনা করেন। বিশ্বকোষ রচনার ক্ষেত্রে তিনি ডিডেরটকে বিশেষভাবে সাহায্য করেন। ধর্মের ক্ষেত্রৈ তিনি নিরীশ্বরবাদী না হলেও ঐশ্বরিক প্রত্যাদেশের মাধ্যমে ঈশ্বরের বাণী লাভে তিনি বিশ্বাস করতেন না। এরূপ অভিমত যাঁরা পোষণ করেন তাঁদের ইংরেজীতে ‘ডিস্ট’ বা ঈশ্বরবাদী কিন্তু ঈশ্বরের প্রত্যাদেশবাদী নয় বলে অভিহিত করা হয়। ডি’ আলেম্বার্ট খ্রিষ্ট ধর্মের ‘জেসুইট’ এবং ‘ক্যালভিনিস্ট’ উভয় সম্প্রদায়ের সমালোচনা করেন।
Dadaism: দাদাবাদ, খেয়ালবাদ
প্রথম মহাযুদ্ধকালে ইউরোপ এবং পরবর্তী সময়ে আমেরিকার মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কিছুসংখ্যক শিল্পী ও সাহিত্যিকের মধ্যে উদ্ভুত এক প্রকার শিল্প ও সাহিত্য আন্দোলন। মহাযুদ্ধের বিভীষিকায় আকঙ্কগ্রস্ত এবং জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে কিছু সংখ্যক ফরাসী বুদ্ধিজীবী সুইজারল্যাণ্ডের জুরিক শহরে আশ্রয় গ্রহণ করেন। তাঁদের নিজেদের মতের হতাশা এবং আতঙ্ককে শিল্প ও সাহিত্যে প্রকাশ করার জন্য তাঁরা অ-চিন্তিত এবং অসাধারণ মাধ্যমের আশ্রয় নেন। তাঁরা মনে করতেন সমাজে যুদ্ধ, ধ্বংস, অসাম্য, অত্যাচার –এসবের কারণ মানুষের নিজের চরিত্রে পাশবিক ব্যবহার। এটাকে স্বীকার করা ব্যতীত কোনো উপায়ন্তর নেই। সমাজ কোনো নীতি মেনে চলে না। শিল্পীর পক্ষেও তাই প্রচলিত কোনো নিয়ম-নীতি মেনে চলার প্রয়োজন নেই। মনে যা আসে তাই করো। শিল্পের মাধ্যম হিসাবে যা ইচ্ছা হয় তাই গ্রহণ করো। অক্ষরগুলো এ যাবৎ যেমন লেখা হয়ে আসছে, তেমন করে কেন লিখবো? অক্ষরগুলো উল্টিয়ে লিখলে ক্ষতি কি? এরূপ অরাজক মানসিকতা থেকে জাঁ ককতু, হানস আর্প, মার্সেল দুকাম্প প্রমুখ সাহিত্যিক ও শিল্পী, সাহিত্য ও শিল্পের ক্ষেত্রে প্রচলিত সমস্ত নিয়মনীতিকে লঙ্ঘন করার চেষ্টা করেন। কবি ও ঔপন্যাসিক জাঁ ককতুর মতে যে-কোন শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্মই বিশৃঙ্খলার অভিধানবিশেষ। দাদাবাদকে খেয়ালবাদ বলা হয়। বস্তুত ফরাসি ‘দাদা’ শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘খেয়াল ঘোড়া’। আধুনিক শিল্প ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে সার রিয়ালিজম বা অধিবাস্তববাদ নামক যে আর একটি ধারার সাক্ষাৎ পাওয়া যায় দাদাবাদ তার উৎস হিসাবে কাজ করেছে। দাদাবাদ বা শিল্পে অরাজকতার এই মনোভাব ১৯২২ সালের দিকে স্তিমিত হয়ে পড়ে।
Dante, Alighieri: দান্তে (১২৬৫-১৩২১ খ্রি.)
মধ্যযুগের ইতালির কবি দান্তে তাঁর ‘ডিভাইন কমেডি’ গ্রন্থের জন্য ইতিহাসের সুবিখ্যাত। কিন্তু কেবল কাব্য ও সাহিত্যকর্মে তিনি নিয়োজিত ছিলেন না। তৎকালীন ইতালির রাজনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে তিনি জড়িত ছিলেন। সেকালে ইতালির রাজনীতি পোপ সমর্থক এবং পোপ বিরোধী, এই দুই প্রধান ধারায় বিভক্ত ছিল। খ্রিষ্ট ধর্মের ধর্মীয় গুরু পোপের সমর্থকরা বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত ইতালিকে ঐক্যবদ্ধ করার বিরোধী শক্তি বলে পরিগণিত হত। পোপের একচ্ছত্র এবং সমগ্র ইউরোপব্যাপী সাম্রাজিক ক্ষমতার বিরুদ্ধে বিভিন্ন দেশের শাসক তথা রাজাগণও অভিমত পোষণ করতেন। রাষ্ট্রের সুশাসনের জন্য রাজার অধীনে কেন্দ্রীয় জাতীয় শাসনের তখন বাস্তব প্রয়োজন দেখা দিচ্ছিল। কবি দান্তের নিজ নগর ফ্লোরেন্স থেকে পোপ বিরোধী অভিমতের কারণে তাঁকে বহিস্কৃত হতে হয়। তাঁর এই নির্বাসিত জীবনে বিভিন্ন রাষ্ট্রের বিচিত্র রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা তিনি অজর্ন করেন। এই অভিজ্ঞতাপ্রসূত তাঁর রাজনৈতিক অভিমত তিনি তাঁর রাজনৈতিক গ্রন্থ ‘মনারকিয়া’ বা ‘রাজতন্ত্র’ গ্রন্থে প্রকাশ করেন। সেকালের প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনীতিক চিন্তাধারার ক্ষেত্রে মধ্যযুগীয় বিভিন্ন যুক্তির পরিচয় থাকলেও এ গ্রন্থ একটি অগ্রসর চিন্তার বাহক হিসাবে কাজ করে। তখনো ইইরোপে বিগত রোমান সাম্রাজ্যের প্রভাবে একটি সাম্রাজ্যের চিন্তা বিরাজ ককরত। অর্থাৎ সমগ্র ইউরোপে এক সাম্রাজ্য এবং তার এক সম্রাট থাকবে। পোপের পক্ষের যুক্তি ছিল, ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসাবে রোমের পোপ হবেন এই সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র এবং ধর্মীয় ও জাগতিক সকল বিষয়ের শাসক। এক সাম্রাজ্যের প্রয়োজনের কথা কবি দান্তেও তাঁর ‘মনারকিয়া’ গ্রন্থে স্বীকার করেন। কিন্তু জাগতিক ক্ষেত্রে পোপ নয়, রাষ্ট্রের শাসক ততা রাজা হবেন প্রধান –এই ছিল দান্তের অভিমত। মধ্যযুগীয় ধর্মীয় আইন কানুন, বিধিবিধানের প্রভাব সত্ত্বেও ‘মনারকিয়া’র মধ্যে এইরূপ আধুনিক চিন্তারও প্রকাশ ঘটে যে, রাষ্ট্রের অস্তিত্বের মূল হচ্ছে ব্যক্তির মঙ্গল এবং রাষ্ট্রের পরিচালনাতে ব্যক্তিরও ভূমিকা থাকা আবশ্যক।
Darwin, Charles Rbbert: চার্লস রবার্ট ডারউইন (১৮০৯-১৮৮২ খ্রি.)
ঊনবিংশ শতকের ইংল্যাণ্ডের অবিস্মরণীয় জীববিজ্ঞানী। জীবনের ঐতিহাসিক বিকাশবাদের প্রতিষ্ঠাতা। প্রাকৃতিক জগতের রহস্যভেদ করার প্রবল আগ্রহ চার্লস ডারউইন কিশোর বয়স থেকেই বোধ করতেন। জীবন সম্পর্কে অধিকতর জ্ঞান লাভ করতে পারবেন মনে করে নিজের পাঠ্যকালে তিনি চিকিৎসাবিজ্ঞান পাঠ্য হিসাবে নির্বাচন করে। এর পরবর্তীকালে চার্লস ডারউইনের জীবনের যুগান্তকারী ঘটনা হচ্ছে একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রকৃতির বিভিন্ন দিকে পর্যব্কেষণ ও গবেষনার জন্য ‘বিগল’ জাহাজকে বিশ্ব অভিযানে প্রেরণ এবং চার্লস ডারউইনকে উক্ত জাহাজে প্রকৃতি-বিজ্ঞানী হিসাবে নিয়োগ দান। ‘বিগল’-এর অভিযান ডারউইনের জীবনে অকল্পিত এক সুযোগ এনে দেয়। এ অভিযান ১৮৩১ থেকে ১৮৩৬ সাল পর্যণ্ত স্থায়ী হয়। এ অভিযানে ডারউইন পৃথিবীর এক প্রান্ত, দক্ষিণ আমেরিকার উপকূল ভাগের, তার অভ্যন্তরের, মহাসাগরীয় বিভিন্ন দ্বীপের এবং পৃথিবীর অপর প্রান্ত নিউজিল্যাণ্ডের অসংখ্য জীব-জন্তুর সাক্ষাৎ লাভ করেন। প্রাচীনকালের অনেক বৃহদাকার জন্তুর কঙ্কাল বা ফসিলও তাঁর পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ ঘটে। সমস্ত জায়গা থেকে জীব-জন্তুর নানা প্রকার নমুনা তিনি সংগ্রহ করেন। এই সমস্ত জীব-জন্তুর সাদৃশ্য, বৈসাদৃশ্য, তাদের গঠনের সরলতা-জটিলতা ইত্যাদির উপর গবেষণা করে চার্লস ডারউইন অবশেষে ১৮৫৯ সালে জীব-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিপ্লবাত্মক গ্রহ্ণ ‘অরিজিন অব স্পেসিস’ প্রকাশ করেন। তাঁর এই গ্রন্থের প্রতিপাদ্য ছিল যে, পৃথিবীজে জীবনের যে বৈচিত্র্য রয়েছে সে বৈচিত্র্য কোনো একদিন একই সময়ে জগতে কোনো বিধাতা সৃষ্টি করে নি। জগতে জীবনের ক্ষেত্রে সতত পরিবর্তন চলছে। জীবনের গঠন জটিল থেকে জটিলতর হয়েছে। অতীতকালের অতিকায় জন্তু-জানোয়ারের কঙ্কাল পাওয়া যাচ্ছে, অথচ এসব প্রাণীর আজ অস্তিত্ব নেই কেন? এ প্রশ্নের জবাবে ডারউইন বললেন, জীবনের ক্ষেত্রে আদিকাল থেকে বাঁচার সংগ্রাম চলছে। প্রকৃতি-জগতে নানা পরিবর্তন সংঘটিত হয়। প্রাকৃতিক জগতের পরিবর্তন অনুযায়ী পরিবর্তিত হয়ে জীবন রক্ষা করার তাগিদ জীবমাত্রের মধ্যে স্বাভাবিক। এই প্রচেষ্টায় যারা বিফল হয়েছে তারা দেহে বিরাট হলেও জীবন রক্ষা করতে পারেনি এবং জাতি হিসাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। এই অভিমতের মূল তত্ত্ব হচ্ছে এই যে, জীব-জগৎ সতত প্রবহমান পরিবর্তনের মাধ্যমে সহজ থেকে জটিল হয়ে বিকাশ লাভ করেছে। এই তত্ত্বের পরিপূরক হিসাবে ১৮৭১ খ্রিষ্টাব্দে মানুষের জন্ম এবং বিকাশ সম্পর্কে ডারউইন ‘ডেসেন্ট অব ম্যান’ প্রকাশ করেন। এ গ্রন্থে তিনি দাবি করেন যে, মানুষের গঠনের সঙ্গে মনুষ্যেতর অনেক প্রাণীর সাদৃশ্য আছে। এ সাদৃশ্য থেকে সিদ্ধান্ত হচ্ছে যে, অন্যান্য প্রাণীর ন্যায় মানুষ, মানুষের চেয়ে সহজতর গঠনের জীবন থেকে পরিবর্তনের চরম অবস্থায় বিকাশ লাভ করেছে। মানুষও ‘মানুষ’ হিসাবে কোনো ঊর্ধ্বলোক থেকে নিক্ষিপ্ত হয় নি। চার্লস ডারউইনের বিকাশবাদের এই তত্ত্বের তাৎপর্য বিজ্ঞানের বিকাশের জন্য ছিল অপরিসীম। একটি বিরাট সামাজিক বিপ্লবের ন্যায় ডারউইনের তত্ত্বের বিরুদ্ধে আক্রমণ ও প্রতিবাদের ঝড় বইতে শুরু করে। কিন্তু বাস্তব বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব অন্ধ বিশ্বাসের উপর ক্রমে জয়ী হয়ে আজ প্রায় সর্বজনস্বীকৃত সত্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। ডারউইনের তত্ত্বের মধ্যে জগতে যে সতত শক্তিতে শক্তিতে দ্বন্দ্ব চলছে এবং সেই দ্বন্দ্বের ভিত্তিতেই যে জীবন বিকাশ লাভ করে সে বিকাশে পরিবর্তন চরম আকার লাভ করে নতুন অস্তিত্বের সৃষ্টি করতে পারে, দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের এই তত্ত্বেরও স্বাভাবিক স্বীকৃতি লক্ষ করা যায়।
Decembrists: ডিসেম্বরপন্থী
১৮২৫ সালের ডিসেম্বর মাসে রাশিয়ার জারতন্ত্রের বিরুদ্ধে কিছুসংখ্যক সামরিক অফিসারের নেতৃত্বে একটি অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছিল। এই অভ্যুত্থানকারীদের অনুসারীদের রুশ ইতিহাসে ডিসেম্বরপন্থী আখ্যায়িত করা হয়। রাশিয়ার জারের স্বৈরতন্ত্র এবং সামন্তবাদী সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলনের ইতিহাস সুদীর্ঘ। এই সুদীর্ঘ ইতিহাসে ১৮২৫ সালের ডিসেম্বরের সামরিক অভ্যুত্থানকে রুশ ইতিহাসকারগণ একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বলে বিবেচনা করেন। সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার প্রতিষ্ঠাতা ভি.আই. লেলিনের মতে রাজতন্ত্রের যুগে রাশিয়ার গণতান্ত্রিক মুক্তি আন্দোলনের ইতিহাসে ডিসেম্বরপন্থীদের স্থান অনন্য। ডিসেম্বরের অভ্যুত্থান সংঘটিত হয় ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ান কর্তৃক রাশিয়া আক্রমণের পরে। রুশ-ফরাসি যুদ্ধকালে রাশিয়ার সামরিক বাহিনী পশ্চিম ইউরোপের সামাজিক অবস্থার সাক্ষাৎ পরিচয় লাভের সুযোগ পায়। ফলে উক্ত যুদ্ধের পরে রাশিয়ার অভ্যন্তরে জারতন্ত্রের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলন অধিকতর অনিবার্য রূপ লাভ করতে থাকে। সমাজের অভিজাত এবং শিক্ষিত সম্প্রদায়ের অধিবাসীগণই সামরিক বাহিনীর অফিসার সম্প্রদায়ের বৃহত্তম অংশ ছিল। কিন্তু তাদের মধ্যেও যুদ্ধ-পরবর্তীকালে গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তাবোধ বৃদ্ধি পেতে থাকে। সামরিক বাহিনীর এই সমস্ত অফিসার গুপ্ত সমিতিতে সংঘবদ্ধ হয়ে দেশের শাসনতান্ত্রিক রাজতন্ত্র কিংবা প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করতে শুরু করে। প্রথম আলেকজাণ্ডর তখন রাশিয়ার সম্রাট। সামরিক বাহিনীর অফিসারগণ তাঁর মৃত্যুকালে একটি অভ্যুত্থান মারফত দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংকল্প করে। ১৮২৫ সালের ২৫ ডিসেম্বর প্রথম আলেকজান্ডার মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পরে সিংহাসনের উত্তরাধিকার নিয়ে বেশ পরিমাণ অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়। এই অনিশ্চয়তার সুযোগ গ্রহণ করে সামরিক বাহিনীর শাসনতন্ত্রবাদী অফিসারগণ ২৬ ডিসেম্বর বিদ্রোহ ঘোষণা করে দেশে শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার এবং নিকোলাসের পরিবর্তে তাঁর জ্যেষ্ঠভ্রাতা কনস্টান্টাইনকে সম্রাট হিসাবে অধিষ্ঠিত করার দাবি জানায়। প্রথম আলেকজাণ্ডারের মৃত্যুর পরে নিকোলাস সম্রাট হিসাবে অধিষ্টিত হন। সম্রাট নিকোলাস তাঁর অনুগত সাঁজোয়া বাহিনীর মারফত বিদ্রোহ দমন করে। সাঁজোয়া বাহিনীর আক্রমণে বহু অভ্যুত্থানকারী এবং সাধারণ মানুষ নিহত হয়। জার সরকার ৫৭৯ জনকে গ্রেপ্তার করে বিদ্রোহ হিসাবে বিচার করে। এদের মধ্যে ৫ জনকে ফাঁসি দেওয়া হয়, ৩১ জনকে যাবজ্জীবনের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। এভাবে ডিসেম্বরের অভ্যুত্থান পর্যুদস্ত হয়। ডিসেম্বর অভ্যুত্থান কেবল সামরিক বাহিনীর একটি অংশের আন্দোলন ছিল না। গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের প্রয়োজন বোধ তখন সমাজের বিভিন্ন অংশে প্রসারিত হয়ে পড়েছিল। তখনকার রুশ সমাজের শিক্ষিত এবং অভিজাত সম্প্রদায়ের ব্যাপকতম অংশ এই আন্দোলনে সমর্থন যোগাচ্ছিল। হারজেনের ন্যায় ইতিহাস-বিখ্যাত বিজ্ঞানীরও সমর্থন ছিল এই গণতান্ত্রিক আন্দোলনের উপর। ডিসেম্বরপন্থী বলে তাই রুশ ইতিহাসে কেবল কিছু সংখ্যক সামরিক অফিসারই পরিচিত নয়। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রথম যুগের সমস্ত প্রগতিশীল অংশই এই নামে পরিচিত। একটি সামাজিক আন্দোলন হিসাবে এই যুগের কবি-সাহিত্যিক-বৈজ্ঞানিক ও সমাজ-কর্মীদের মতামত রুশ ইতিহাসে আলোচিত হয়ে থাকে। ডিসেম্বর আন্দোলনের অনেক সাহিত্যিক ও বৈজ্ঞানিকই সমাজ ও জীবনের ব্যাখ্যায় বস্তুবাদী প্রগতিশীল মত পোষণ করতেন। হারজেন এবং তাঁর সাথীরা বস্তুকে প্রধান বলে বিবেচনা করতেন। চিন্তা মানুষের মস্তিষ্কেরই বিশেষ শক্তি, মন নামক অপর কোনো সত্তার নয়, এরূপ অভিমতও তাঁরা পোশষ করতেন। এঁদের অনেকে ধর্মকে শোষকের হাতে শোষণের অস্ত্র এবং শোষিতের সান্ত্বনার আশ্রয় বলে বিশ্লেষণ করেছেন। কিন্তু সামাজিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে ডিসেম্বরবাদীগণ বিপ্লবী ছিল না। তাদের অভ্যুত্থানের পেছনে ব্যাপক কোনো গণ-সংগঠন এবং গণ-ভিত্তি ছিল না। এ কারণে সামরিক বাহিনীর একটি অংশের অভ্যুত্থান গণ-বিপ্লবে প্রসারিত না হয়ে সরকারের নিষ্পেষণযন্ত্রে সহজেই পর্যুদস্ত হয়ে যায়। কিন্তু পরাজিত হলেও ডিসেম্বরের অভ্যুত্থান রাশিয়ার পরবর্তীকালের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে প্রভূতভাবে প্রভাবান্বিত করেছে।
Declaration of Independence: স্বাধীনতার ঘোষণা
ইংল্যাণ্ডের শাসনের বিরুদ্ধে আমেরিকার উপনিবেশসমূহ ১৭৭৬ সনে ৪ জুলাই তারিখে যে ঘোষণা দ্বারা স্বাধীনতার কথা উচ্চারণ করে তা ইতিহাসে স্বাধীনতার ঘোষণা তথা আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণা নামে খ্যাতি লাভ করেছে। ঘোষণাটির মধ্যে টমাস জেফারসন, বেনজামিন ফ্রাঙ্কলিন প্রভৃতি প্রখ্যাত চিন্তাবিদ ও রাজনীতিকগণ স্বাধীণতার যে যুক্তি উল্লেখ করেন সে যুক্তি মানুষের রাষ্ট্র ও শাসনব্যবস্থার মৌলিক অধিকার তত্ত্বের তাৎপর্যে পূর্ণ। এই ঘোষণার মধ্যে দার্শনিক লকের বিখ্যাত গ্রন্থ ‘টু ট্রিটিজেস অন সিভিল গভর্ণমেন্ট’ বা শাসনব্যবস্থার উপর দুটি নিবন্ধের গভীল প্রভাবের পরিচয় পাওয়া যায়। ‘আমেরিকার তেরটি যুক্তরাষ্ট্রের সর্বসম্মত ঘোষণা’ শিরোনামে উচ্চারিত ঘোষণার মুখবন্ধে বলা হয়: ইতিহাসের গতিপথে যখন একটি জনসমষ্টির জন্য অনিবার্যরূপে প্রয়োজন হয়ে পড়ে অপর একটি জনসমষ্টির সঙ্গে ছেদন করে প্রকৃতি এবং বিধির প্রদত্ত মানুষের সার্বভৌম এবং সমঅধিকারকে স্থাপন করার, তখন সেই সম্পর্ক ছেদনের যুক্তিকে প্রকাশিত করারও প্রয়োজন উপস্থিত হয়। সেই প্রয়োজনের বোধ থেকে আমরা ঘোষণা করছি পৃথিবীর সকল মানুষ জন্মগতভাবে সমান। এবং বিধাতা কতিপয় অবিচ্ছেদ্য অধিকারে ভূষিত করে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। এবং এই অধিকারের অন্তর্গত হচ্ছে জীবন, স্বাধীণতা এবং সুখের অর্জন। মানুষের জীবন, স্বাধীণতা এবং সুখের নিশ্চয়তা বিধানের জন্য গঠিত হয় সরকার। এবং এই সরকার তথা শাসকের ন্যায়সঙ্গত ক্ষমতার উৎস হচ্ছে রাষ্ট্রের শাসিত তথা জনসাধারণ। এবং সেই কারণেই যখন কোনো সরকার শাসিতের এই মৌলিক অধিকারসমূহের ধ্বংসকারী হয়ে দাঁঢ়ায় তখন জনসাধারণের অধিকার থাকে সেই সরকারকে বিলুপ্ত কিংবা পরিবর্তিত করে নতুন সরকার গঠিত করার।
আমেরিকার স্বাধীণতার ঘোষণাপত্র ফরাসি বিপ্লবের চিন্তাবিদদের বিপুলভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। এখনও যুক্তরাষ্ট্রে ৪ জুলাইকে সাধারণ ছুটির মাধ্যমে স্বাধীনতা ঘোষণার দিবস হিসাবে পালন করা হয়।
Deduction: সিদ্ধান্ত, অনুমান, অবরোহ
এক কিংবা একাধিত প্রতিজ্ঞা বা যৌক্তিক দত্তবাক্য থেকে তাদের অন্তর্নিহিত সম্পর্কের ভিত্তিতে কোনো অনুমান বা সিদ্ধান্ত গ্রহণকে ইংরেজীতে ডিডাকশান বলে। দূরে ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে; মনে হয় ওখানে আগুণ লেগেছে। এখানে ‘আগুণ লেগেছে’ এ সিদ্ধান্তটি ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে এই দত্ত সত্যের ভিত্তিতে গৃহীত অনুমান। অনুমানকে যুক্তিশাস্ত্রে সাধারণত দুই ভাগে বিভক্ত করা হয়। কোনো সার্বিক বা সাধারণ সত্য থেকে কোনো বিশেষ সত্যের অনুমানকে অবরোহী অনুমান এবং বিশেষ সত্যের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সাধারণ বা সার্বিক সত্যে পৌঁছাকে আরোহী অনুমান বলা হয়। এই বিবাগ অনুযায়ী ‘সকল মানুষ মরণশীল; সক্রেটিস একজন মানুষ সুতরাং সক্রেটিসও মরণশীল’, এই পদ্ধতিটিকে আরোহী অনুমান এবং ‘রাম মরেছে, রহিম মরেছে, করিম করেছে, সুতরাং সকল মানুষ মরবে বা সকল মানুষ মরণশীল’, এই দৃষ্টান্তটিকে একটি আরোহী অনুমানের দৃষ্টান্ত বলা হয়। উপরোক্ত বিভাগ থেকে মনে হতে পারে যে, অবরোহী ও আরোহী অনুমান পরস্পর পৃথক এবং আরোহী অনুমানই কেবল বৈজ্ঞানিক এবং অভিজ্ঞতা-সিদ্ধ অনুমান, অবরোহী অনুমান অভিজ্ঞতাভিত্তিক অনুমান নয়। কিন্তু আবরোহী এবং আরোহী অনুমানের এরূপ ব্যাখ্যা ঠিক নয়। আরোহী এবং অবরোহী অনুমান পরস্পর নির্ভরশীল এবং সংযুক্ত। যুগব্যাপী সঞ্চিত অভিজ্ঞতা দ্বারাই বিশেষকে ব্যাখ্যা করি; বিশেষ সম্পর্কে অধিকতর জ্ঞানলাভ করি। বিশেষের ভিত্তিতে নির্বিশেষে জ্ঞান লাভ এবং নির্বিশেষের প্রয়োগে বিশেষের অনুধাবন –জ্ঞানের এই দ্বিবিধ প্রক্রিয়া আদিকাল থেকেই মানুষ অনুসরণ করে আসছে। তবে এ প্রক্রিয়ার বিশ্লেষণ প্রথমে বিস্তারিতভাবে করেন গ্রিক দার্শনিক এ্যারিস্টটল। তিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণের কতকগুলি সূত্র ব্যাখ্যা করেন। এগুলিকে যুক্তিশাস্ত্রের এ্যারিস্টটলীয় বিধান বলে আখ্যায়িত করা হয়। এ বিধানগুল প্রধানত অবরোহী অনুমানের বিধান। এ জন্য অবরোহী অনুমানের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে এ্যারিস্টটলকে উল্লেখ করা হয়। অবরোহী অনুমানের সঠিকতা নির্ভর করে দত্ত সত্যের সঙ্গে অনুমিত সত্যের অন্তর্নিহিত সংযোগের উপর। দত্তবাক্য বা সত্যগুলি যদি পরস্পর সম্পর্কিত না হয় তা হলে তা থেকে কোনো সঙ্গত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা চলে না। এ নিয়মের অপর একটি তাৎপর্য হচ্ছে এই যে, অবরোহী অনুমানে দত্তবাক্য বা অনুমিত বাক্যের বাস্তব যথার্থতা বিচার্য বিষয় নয়। অবরোহী অনুমানের বিচার্য বিষয় হচ্ছে প্রতিজ্ঞা বা দত্তবাক্য যা আছে (সত্য কিংবা মিথ্যা যাই হোক না কেন), তার ভিত্তিতে অনুমিত সিদ্ধান্ত গৃহীত হতে পারে কিনা। এ নিয়মে ‘সকল মানুষ অমর’ এ দত্তবাক্য থেকে ‘রহিম একজন মানুষ, সুতরাং রহিমও অমর’, এ সিদ্ধান্তে আমরা গ্রহণ করতে পারি। গ্রিসের ন্যায় ভারতীয় উপমহাদেশের অনুমান শাস্ত্রও অতি প্রাচীন। গ্রীক বৈজ্ঞানিক ইউক্লিডের জ্যামিতি অবরোহী অনুমানের প্রাচীন বৈজ্ঞানিক দৃষ্টান্ত। উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে কিছু সংখ্যক আধুনিক দার্শনিক ‘আঙ্কিক অনুমানের’ বিশ্লেষণ দ্বারা অনুমানের ক্ষেত্রে নতুনতর বিকাশ সাধন করেছেন।
Definition: সংজ্ঞা
ইংরেজী ‘ডেফিনিশন’ শব্দটি ল্যাটিন ‘ডিফিনিশিও’ শব্দ থেকে উদ্ভুত। ‘ডেফিনিশিও’ শব্দের অর্থ হচ্ছে, কোনো ব্যক্তি বা বিষয়ের মূল বৈশিষ্ট্যগুলিকে চিহ্নিত করা। যে বৈশিষ্ট্য ব্যতিরেকে একটি বিষয় আর সেই বিষয় বলে পরিচিত হতে পারে না, কেবলমাত্র সেই বৈশিষ্ট্যই সংজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত হবে- অপর কোনো বৈশিষ্ট্য নয়। আমাদের জীবনে সংজ্ঞার আবশ্যকতা সমধিক। সংজ্ঞা একটি সংকেত বিশেষ। সংজ্ঞা দ্বারা আমরা নির্দিষ্ট বিষয়কে স্মরণ রাখি। বস্তুপুঞ্জকে সংজ্ঞা দ্বারা শ্রেণীবিভক্ত করি। সংজ্ঞাকরণের ক্ষমতা মানুষের জ্ঞানের বিকাশের একটি উন্নত স্তরের পরিচায়ক। মানুষ যখন তার মস্তিষ্ক দ্বারা বিশেষকে পর্যবেক্ষণ করে বিশেষে বিশেষে সম্ভব হয়েছে। সংজ্ঞাকরণের প্রক্রিয়া বিশ্লেষণ প্রথমে এ্যারিস্টটল করেছেন বলে ইউরোপীয় দর্শনের ইতিহাস উল্লেখ করা হয়। এ্যারিস্টটল সংজ্ঞাকরণের বিধান নির্দিষ্ট করে বলেছেন যে, সংজ্ঞাকরণের অর্থ হচ্ছে, সংজ্ঞেয় পদের জাতি এবং সহজাতির সঙ্গে তার পার্থক্যসূচক গুণের নির্দেশ করা। এর দৃষ্টান্ত হিসাবে তিনি মানুষকে ‘যুক্তিবাদী জীব’ বলে উল্লেখ করেছেন। মানুষ জীবের অন্তর্গত। অর্থাৎ জীব বা জন্তু হচ্ছে মানুষের জাতি এবং যুক্তিবাদিতা হচ্ছে তার সহজাতি কুকুর-বিড়াল ইত্যাদি পশুর সঙ্গে তার পার্থক্যসূচক গুণ। এই বিধান অনুযায়ী ব্যক্তিবাচক কোনো পদের সংজ্ঞা সম্ভব নয়। রহিম একটি ব্যক্তিবাচক পদ। একটি নাম। রহিম মানুষ হলে তাকে একজন মানুষ বলা যায় বটে –কিন্তু তাতে তার বিশেষ কোনো পরিচয় পাওয়া যায় না। যে বিশেষ গুণে রহিম করিম কিংবা যাদব নয়, যে গুণ রহিমকে একজন মানুষ বললেই স্পষ্ট হয় না। এ জন্য বিশেষ ব্যক্তি বা বস্তুর কোনো যৌক্তিক সংজ্ঞা হতে পারে না। সংজ্ঞা হতে পারে কেবলমাত্র জাতিবাচক পদের। কিন্তু যে জাতি পরিধিতে ব্যাপকতম কিংবা চরম, তারও সংজ্ঞা চলে না। কেননা চরম জাতিকে অপর কোনো বৃহত্তর জাতির অন্তর্ভুক্ত করে পরিচিত করা চলে না। মানুষকে জন্তুর অন্তর্ভুক্ত করা যায়। জন্তুকে প্রাণীর অন্তর্ভুক্ত করে পরিচিত করা চলে না। তাই এ্যারিস্টটলের বিধান অনুযায়ী চরম জাতি এবং ব্য্কিত বা বস্তুবিশেষের কোনো সংজ্ঞা দেওয়া সম্ভব নয়।
Deism: ঈশ্বরবাদ
সৃষ্টির আদি কারণরূপে ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস। এটি একটি দার্শনিক তত্ত্ব। ধর্মীয় বিশ্বাসের সঙ্গে এর কিছুটা পার্থক্য আছে। ধর্মীয় ঈশ্বর কেবল আদি স্রষ্টা নন। তিনি তাঁর নির্বাচিত প্রতিনিধির নিকট প্রত্যাদেশ মারফত তাঁর অস্তিত্ব ঘোষণা করেন। তিনি সৃষ্টির ধারক, বাহক, প্রতিপালক এবং বিচারক। দয়া-মায়া, কঠোরতা বিভিন্ন গুণে তিনি গুণান্বিত বলে মানুষ কল্পনা করে। তিনি সর্বশক্তিমান। এই প্রচলিত ধর্মীয় ঈশ্বরবাদের পরিবর্তে ইংল্যাণ্ডের হার্বার্ট (১৫৮৩-১৬৩৮ খ্রি.) দার্শনিক ঈশ্বরবাদের ব্যাখ্যা তৈরী করেন। দার্শনিক ঈশ্বরবাদের মতে সৃষ্টির আদি কারণ হিসাবে ঈশ্বরের অস্তিত্ব আমাদের বিশ্বাস করতে হয়। কিন্তু ধর্মীয় ঈশ্বর এবং সৃষ্টির আদি কারণরূপ ঈশ্বর এক নয়। দার্শনিক ঈশ্বর বিশ্বজগতের আদি কারণ মাত্র। তিনি জগতের সর্বকালের ধারক, বাহক কিংবা নিয়ন্তা নন। সৃষ্ট হওয়ার পরে সৃষ্টির সঙ্গে ঈশ্বরের কোনো সম্পর্ক নেই। বিশ্ব জগৎ তার আপন বিধান অনুযায়ী চলছে, ঈশ্বরের ইচ্ছানুযায়ী নয়। দার্শনিক ঈশ্বরবাদের প্রচারকালে এর একটি প্রগতিশীল ভূমিকা ছিল। প্রচলিত অন্ধ ধর্মীয় বিশ্বাস-বিজ্ঞানের বিকাশে প্রতিবন্ধকতার কাজ করছিল। কিন্তু বাস্তব জীবনে বিজ্ঞানের স্বীকৃতিকে অনিবার্য করে তুলেছিল। এরূপ অবস্থায় ঈশ্বরের অস্তিত্বের বিশ্বাস জাগতিক জ্ঞানের বিকাশে যাতে প্রতিবন্ধক হয়ে থাকতে না পারে, সে জন্যই হার্বার্ট দার্শনিক ঈশ্বর তত্ত্বের ব্যাখ্যা দেন। ঈশ্বরকে সামাজিকভাবে অস্বীকার করা চলে না, আবার ঈশ্বরকে জ্ঞানের পথে দুর্লঙ্ঘ্য পাহাড় করেও রাখা যায় না –দার্শনিক ঈশ্বরবাদ এই মানসিকতা থেকেই উদ্ভুত। এ তত্ত্ব অনুযায়ী যুক্তির মাধ্যমেই ইশ্বরকে স্বীকার করা যায়। আবার যুক্তিগতভাবে এও স্বীকার করতে হয় যে, আদি কারণের অধিক কিছুর জন্য ঈশ্বরের প্রয়োজন নায়। এভাবে ঈশ্বর ও বিজ্ঞান উভয়কে রক্ষা করা সম্ভব বলে শুধু হার্বার্ট নন, তাঁর পরবর্তী ভলটেয়ার, রুশো, লক, নিউটন, অনেক দার্শনিক ও বিজ্ঞানী এই যুগে এই অভিমত পোষণ করেছিলেন। আধুনিককালে ধর্মীয় ঈশ্বরবাদ এবং দার্শনিক ঈশ্বরবাদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। উভয়ই মূলত ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাসী তত্ত্ব বলে পরিচিত।
Democracy: গণতন্ত্র
আধুনিক রাষ্ট্রমাত্রেরই শাসন বা পরিচালব্যবস্থার আরাধ্য পদ্ধতি হচ্ছে গণতন্ত্র। শব্দগতভাবেও গণের তন্ত্র বা ব্যবস্থা হচ্ছে গণতন্ত্র। যে শাসনব্যবস্থা রাষ্ট্রের অধিবাসীদের প্রাপ্তবয়স্ক এবং সুস্থ অংশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা পরিচালিত হয় তাকে গণতন্ত্র বলে। আধুনিক শাসনব্যবস্থার প্রধান রূপ গণতন্ত্র হলেও, গণতন্ত্র কেবল আধুনিক সভ্যতারই অবদান এমন কথা বলা যায় না। সীমিতভাবে হলেও, প্রাচীন নগর রাষ্ট্র এথেন্সের অ-দাস বা প্রভুশ্রেণীর অধিবাসীরা প্রত্যক্ষ সভা সম্মেলনের মাধ্যমে তাদের শাসনকার্য পরিচালনা করত বলে জানা যায়। গ্রিক শব্দ ‘ডেমস’ বা ‘সাধারণ’ থেকে ইংরেজী ‘ডিমোক্রাসী’ শব্দের উদ্ভব ঘটেছে বলে রাষ্ট্রচিন্তাবিদগণ মনে করেন। এথেন্সের রাষ্ট্র পরিচালনার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত সাধারণ নাগরিকদের গণসম্মেলন বা একলেসিয়াতে গৃহীত হতো বলে প্রাচীন এথেন্সের গণতন্ত্রকে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র এবং আধুনিকখালের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে পারিচালিত ব্যবস্থাকে পরোক্ষ গণতন্ত্র বলা হয়।
প্রতিনিধিত্বমূলক আধুনিক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার উদ্ভব ইউরোপে। ইংল্যাণ্ড এবং ফ্রান্সে প্রথমে সামন্তবাদ এবং রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন লড়াই এবং সংগ্রামের শাসনব্যবস্থাই হচ্ছে সমাজ ও রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। বিদ্যমান প্রধান অর্থনৈতিক বা উৎপাদনব্যবস্থার স্বার্থসাধকারী পরিচালন বা শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। ইংল্যাণ্ডের সপ্তদশ শতকের এবং ফ্রান্সের অষ্টাদশ শতকের বিপ্লবসমূহের মধ্যে সেকালের উদীয়মান নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তথা পণ্য উৎপাদনকারী পুঁজিবাদী ব্যবস্থার চাহিদারই প্রকাশ ঘটেছিল। এজন্য এই বিপ্লবসমূহকে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার চাহিদারই প্রকাশ ঘটেছিল। এজন্য এই বিপ্লবসমূহকে পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক বিপ্লব বলে অভিহিত করা হয়। এই নতুন শাসনব্যবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, প্রাপ্ত বয়স্কদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে আইনসভা বা পার্লামেণ্টের গঠন এবং পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের পরিচালনায় দেশের শাসন। শাসনব্যবস্থার এই কাঠামোগত রূপ একদিনে প্রতিষ্ঠিত হয় নি। ব্যক্তি স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা –প্রভৃতি অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই-এর মাধ্যমে নাগরিকদের মৌলিক অধিকারসমূহের রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠান হিসাবে পার্লামেণ্টারী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় নি এবং অনেক উন্নয়নশীল দেশে, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা শাসন পরিচালনায় ব্যাপকতর জনসাধারণের চেতনা ও শক্তি ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পায় বলে কায়েমী স্বার্থ ও সংকীর্ণ চিন্তার বাহক এবং অর্থনৈতিক শ্রেণীর মুখপাত্র হিসাবে অনেক সময়ে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে নাকচ করে সামরিক-চক্র শাসন কায়েক করেছে। অবশ্য এমন সামরিক শাসকদের ক্ষমতা দখলের এই অজুহাতটি উল্লেখযোগ্য যে প্রায়শ এরা বলে থাকে গণতন্ত্র ব্যর্থ হয়েছে কিংবা দেশ গণতন্ত্রের উপযুক্ত হয় নি কিংবা দেশে আর্থিক ও আইন শৃঙ্খলার সংকট তীব্র হয়েছে, সে কারণে সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠায় এরা বাধ্য হয়েছে এবং পরিণামে গণতন্ত্র পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করা হবে। অর্থাৎ সামরিক শাসকরাও গণতন্ত্রকে চূড়ান্তরূপে নাকচ করে দিবার ক্ষমতা রাখে না।
আধুনিক কালের রাজনৈতিক আলোচনায় ‘গণতন্ত্র’ শব্দটি আবার ব্যাখ্যামূলকভাবেও ব্যবহৃত হয়। পৃথিবীতে আজ দুটি প্রধান অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বিদ্যমান। এদের একটি ব্যক্তি মালিকানাভিত্তিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থা। অপরটি হচ্ছে যৌথ বা রাষ্ট্রীয় মালিকানাভিত্তিক সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। এই দুই ব্যবস্থার মুখপাত্রগণ সাধারণত প্রতিপক্ষীয় ব্যবস্থার পরিচালন বা শাসনকে যথার্থ গণতন্ত্র বলে স্বীকার করতে চায় না। মার্কসবাদীগণ পুঁজিবাদী শাসনব্যবস্থাকে রাষ্ট্রের প্রধান তথা পুঁজিবাদী শ্রেণীর শাসন বলে অভিহিত করে; সংখ্যাগুরু শ্রমজীবী জগণের গণতান্ত্রিক শাসন নয়। বিপরীতভাবে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সমর্থকরা সমাজতান্ত্রিক দেশের শাসনব্যবস্থাকে একদলীয় শাসনব্যবস্থা তথা দলের ডিক্টেটরশীপ বলে অভিহিত করে থাকে। এরূপ বিতর্কের একটি তাৎপর্য এই যে, গণতন্ত্র যেমন একটি শাসনব্যবস্থা, তেমনি একটি আরাধ্য আদর্শও বটে। এ কারণে এক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা থেকে অপর অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ‘গণতন্ত্র’ দ্বারা হুবহু অভিন্ন কোন শাসনব্যবস্থা বা কাঠামোকে বুঝান সম্ভব নয়।
Democratic Centralism: গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতা
কমিউনিস্ট পার্টির পরিচালন ব্যবস্থা এবং সমাজতান্ত্রিক শাসন ও অর্থনীতি ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ এবং তত্ত্ব। ‘গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতা’ শব্দগতভাবে পরস্পর বিরোধী বলে বোধ হতে পারে। গণতান্ত্রিক বললে কেন্দ্রীকতা বা কেন্দ্রীয় নেতৃত্ববিহীন একটি অবস্থা, আবার কেন্দ্রীকতা বললে গণতন্ত্রের অভাব মনে হয়। আসলে নেতৃত্ব এবং গণতান্ত্রিকতা উভয়ই সঙ্গতিবিহীন সমাজ। শ্রেণীবিভক্ত সমাজ প্রবল শ্রেণীল নেতৃত্ব এবং শাসনে পরিচালিত হয়। সেজন্য সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমজীবী মানুষের সে সমাজে যথার্থ গণতন্ত্র বা গণতান্ত্রিক উদ্যোগ থাকে না। শাসক এবং প্রবল শ্রেণীর কেন্দ্রীকতাই তার বৈশিষ্ট্য। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক কথা শ্রেণীহীন সমাজে একদিকে যেখানে সমাজের সম্পদের ব্যবস্থাপনার জন্য কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের প্রয়োজন, তেমনি সমাজের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক সকল কর্মক্ষেত্রে নিয়োজিত মানুষের সচেতন এবং সম্মতিসূচক অংশগ্রহণও আবশ্যক। এবং এ কারণেই কেন্দ্রীকতা এবং গণতন্ত্রের ভারসাম্য এবং সমন্বয় অপরিহার্য। এর যে-কোন একটি ব্যত্যয় সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নানা বিচ্যুতি এবং সংকটের সৃষ্টি করতে পারে। এ দুটি উপাদানের দ্বান্দ্বিক সম্পর্কটি যেমন উপলব্ধি করা আবশ্যক, তেমনি বাস্তব জীবনে উভয়ের প্রয়োগের চেষ্টা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে মার্কসবাদীগণ লেনিনের এরূপ উক্তির উল্লেখ করেন যেখানে লেনিন বলেছেন “গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতা সামাজিক জীবনের প্রতিটি স্তর এবং ক্ষেত্রের উদ্যোগের সঙ্গে কেন্দ্রীয় ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত এবং পরিচালনাকে সংযুক্ত করে সমাজের সামগ্রিক উন্নতি এবং বিকাশকে সম্ভব করে’।
Democritus: ডিমোক্রিটাস (৪৬০-৩৭০ খ্রি. পূ.)
প্রাচীন গ্রিসের বিখ্যাত বস্তুবাদী দার্শনিক। জ্ঞানের ক্ষেত্রে প্রাচীনকালের প্রথম বিশ্বজ্ঞানী হিসাবেও ডিমোক্রিটাস স্মরণীয়। পদার্থবিদ্যা, মনোবিদ্যা, ন্যায়, গণিত, চিকিৎসা, কৃষি, চিত্রশিল্প, সাহিত্য, নীতিশাস্ত্র এবং সামরিক কৌশল –এরূপ বিচিত্র বিষয়ের উপর ২৯০ টি পুস্তক বা পুস্তকাংশ ডিমোক্রিটাস রচনা করেছিলেন বলে গবেষকগণ মনে করে। বিজ্ঞান ও দর্শনের সর্বপ্রথম বিশ্ব জগতের সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা লাভ করি। এই তত্ত্ব অনুযায়ী সৃষ্টির মূল শক্তি হচ্ছে অণুর এবং মহাশূন্যতা। অসংখ্য মৌলিক অণু মহাশূন্যতার মধ্যে নিরন্তর আবর্তিত হচ্ছে। এই আবর্তনের অণুতে অণুতে সংঘর্ষ ঘটছে; মহাশূন্যতার মধ্যে সংযোগও সাধিত হচ্ছে। এই সংঘর্ষ এবং সংযোগের মাধ্যমে সৃষ্ট হচ্ছে সমস্ত রকম বস্তুপুঞ্জ। বস্তুর সৃষ্টির পেছনে আবর্তিত অণু ব্যতীত ঈশ্বর বা অণুর অতীত অপর কোনো সত্তা নেই। সংযুক্ত অণুর বিয়োজনে সৃষ্ট বস্তুর ধ্বংস। অণুর নতুনতর সংযোগে ধ্বংসপ্রাপ্ত বস্তু আবার নতুনতন বস্তুরূপে সৃষ্ট হয়। অণুর মধ্যেই অণুর গতি। অণুর সঙ্গে অণুর পার্থক্য শুধু আকারে, অবস্থানে এবং পারস্পরিক সংযোগের প্রকারে। রঙ, স্বাদ কিংবা এরূপ অপর কোনো গুণ অণুর মধ্যে নেই। এ সমস্ত গুণ অণুর জটিল সংযোগক্রমে বস্তুর মধ্যে সৃষ্ট হয়। বিশ্ব চরাচরে যা কিছু সংঘটিত হচ্ছে তা অনুর কারণে অনিবার্যভাবে সংঘটিত হচ্ছে। বস্তুজগতে কারণহীনতা বলে কিছু নেই। আমাদের অজ্ঞানতা থেকেই আকস্মিকতা বা কারণহীনতার বিশ্বাস জন্মে। মানুষ আত্মাকে অ-বস্তু মনে করে। কিন্তু আত্মাও অণুর সংযোগ ফল। এ কারণে আত্মাও বস্তু, অ-বস্তু নয়। অণুর বিয়োজননে দেহের মৃত্যুর সঙ্গে আত্মারও মৃত্যু ঘটে। আত্মার অমরতা অযৌক্তিক কথা। বস্তুজগতের বাইরে দেবতাদেরও অপর কোনো অস্তিত্ব থাকতে পারে না। দেবতাদের অস্তিত্ব থাকলে তারাও জন্ম-মৃত্যুর নিয়মে আবদ্ধ। দেবতাদের অস্তিত্বের যে বিশ্বাস সাধারণ মানুষ পোষণ করে, তার মূলে রয়েছে ধূমকেতু, ভূমিকম্প, উল্কাপাত, লাভার উদগীরণ ইত্যাকার বৃহৎ বৃহৎ প্রকৃতির ঘটনাপুঞ্জ সম্পর্কে অজ্ঞানতা ও ভীতি। তৎকালীন দাসভিত্তিক অভিজাততন্ত্রের সামাজিক ব্যবস্থার বিরোধী ছিলেন ডেমোক্রিটাস। ডিমোক্রিটাসের বস্তুবাদের তত্ত্বকে আমরা পরবর্তী গ্রিক দার্শনিক এপিকুরাস এবং রোমান দার্শনিক লিউক্রেটিসারে বস্তুবাদের তত্ত্বকে আমরা পরবর্তী গ্রিক দার্শনিক এপিকুরাস এবং রোমান দার্শনিক লিউক্রেটিয়াসের মধ্যে অনুসৃত হতে দেখি।
Derozio: হেনরি ডিরোজিও (১৮০৯-১৮৩১ খ্রি.)
উনিশ শতকে বঙ্গে ইংরেজী শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে, বিশেষ করে কলকাতায়, জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা এবং মুক্তবুদ্ধির প্রকাশের মধ্য দিয়ে যে নবজাগরণ সূচিত হয় তার অন্যতম প্রাণপুরুষরূপে স্মরণীয় হচ্ছেন হেনরি ডিরোজিও। ডিরোজিও এ্যাংলো ইণ্ডিয়ান সম্প্রদায়ে জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু নিজেকে তিনি ভারতীয় বলে দাবি করতেন এবং বাংলার মণীষীগণও তাঁকে বাঙালীবলে গর্ববোধ করেন। মাত্র ২৩ বৎসর বয়সে তিনি আকস্মিকবাবে কলেরা রোগে আক্রান্ত হয়ে পরলোকগমন করেন। কিন্তু তাঁর এই স্বল্পকালের জীবনও মহৎ কর্ম এবং বিচিত্র উদ্যোগে এরূপ পূর্ণ ছিল যে, সে জীবনের স্মরণে উত্তর কালের মন শ্রদ্ধা এবং বিস্ময়ে ভরে ওঠে। ডিরোজিও ‘ইতিহাস, দর্শণ এবং ইংরেজী সাহিত্যে ব্যুৎপত্তি লাভ করেন’। তিনি ছিলেন সংস্কারমুক্ত এবং যুক্তিবাদী। ১৮২৬ সনে তিনি হিন্দু কলেজে শিক্ষকরূপে যোগদান করেন। তাঁর চারিত্রিক উদারতা এবং সাহসন,ন সংস্কার-মুক্ত মন এবং জ্ঞানের প্রতি আগ্রহ ও দর্শন, সাহিত্য প্রভৃতি ক্ষেত্রে তাঁর দখল তাঁকে তাঁর ছাত্রদের কাছে অত্যন্ত প্রিয় শিক্ষকে পরিণত করে। তাঁর গৃহে ছিল ছাত্রদের অবাধ অধিকার। যুগের বিচারে নিষিদ্ধ দ্রব্য এবং চিন্তা উভয়েরই ছিল তাঁর গৃহে তাঁর তরুণ ছাত্রদের আপ্যায়নের উপাদান। তিনি তাঁর ছাত্রদের প্রচলিত সকল রকম সামাজিক, ধর্মীয় এবং বুদ্ধিগত সংকীর্ণতা, অজ্ঞতা ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের মনোভাব দ্বারা অনুপ্রাণিত করে তুলতেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত এবং পরিচালিত বিতর্ক এবং আলোচনা সমিতি বা সভাসমূহ যে যুদের কলকাতারবিদ্বৎ মহলের আকর্ষণের কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। ডিরোজিওর শিষ্যদের ‘ইয়ং বেঙ্গল’ বলা হতো। ডিরোজিও তরুণদের মধ্যে এরূপ বিদ্রোহের ভাব সৃষ্টি করাতে কলেজ কর্তৃপক্ষ সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠেন এবং প্রাচীনপন্থীদের বিরোধিতার কারণে তিনি হিন্দু কলেজের শিক্ষকতা থেকে ১৮৩১ সনের এপ্রিল মাসে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন এবং এই সনেই ১ জুন তারিখে তাঁর মৃত্যু হয়। (দ্র. সংসদ বাঙালি চিরতাভিধানঃ গোপাল হালদার: বাংলা সাহিত্যের রূপরেখা।)
Descartes, Rene: দেকার্ত (১৫৯৬-১৬৫০ খ্রি.)
সপ্তদশ শতকের প্রখ্যাত ফরাসি দার্শনিক ও গণিতশাস্ত্রবিদ বিজ্ঞানী। কর্মজীবনের দেকার্ত প্রতমে স্বদেশের সামরিক বাহিনীতে নিযুক্ত করেন এবং সেখানে প্রায় বিশ বছর নিরবিচ্ছিন্নভাবে তিনি দর্শন ও বিজ্ঞানের চর্চা করেন। তাঁর বৈজ্ঞাননিক মতামতের জন্য হল্যাণ্ডের গোঁড়া ধর্মযাজকদের হাতে তাঁকে নানাপ্রকার নিগ্রহ ভোগ করতে হয়। তাদের নির্যাতন থেকে মুক্তির জন্য দেকার্ত অবশেষে সুইডেনে আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং সুইডেনেই মৃত্যুমুখে পতিত হন। জ্যামিতি এবং মেকানিক্স বা বলবিদ্যার ক্ষেত্রে দেকার্ত গতি এবং স্তিতির আপেক্ষিক তত্ত্ব এবং ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার নিয়ম আবিস্কার করেন। সৌরজগতের সৃষ্টি সম্পর্কে বস্তুবাদী মত তখনো আশ্রুত। এ ক্ষেত্রেও দেকার্ত বস্তুবাদী ব্যাখ্যা দেবার প্রয়াস পান। বস্তুর ব্যাখ্যায় দেকার্ত এরূপ মত পোষণ করতেন যে, বস্তুর মৌলিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তার স্থানভিত্তিক বিস্তার। বস্তুর বিভিন্ন গুণের মধ্যে বিস্তারের ক্ষেত্রে বস্তু অনন্যনির্ভর। অর্থাৎ বস্তুর স্বাদ, গন্ধ, রঙ ইত্যাকার অন্যান্য গুণ মানুষের মনের উপর নির্ভরশীল হলেও বস্তুর বিস্তার মনের উপর নির্ভর করে না। দেকার্তের বস্তুবাদ অবিমিশ্র নয়। বস্তুর অস্তিত্ব যেমন তিনি স্বীকার করেছেন, তেমনি বস্তুর গতির প্রশ্নে তিনি ভাববাদের আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। তাঁর মতে বস্তুর গতির আদি কারণ হচ্ছে ঈশ্বর। ঈশ্বর গতি ও স্থিতি উভয়ই বস্তুর মধ্যে তৈরী করেন এবং গতি ও স্থিতির পরিমাণের অপরিবর্তনীয়তাও তিনি রক্ষা করেন। দেকার্তের এ মতবাদকে দ্বৈতবাদ বলা যায়। মানুষের দেহ এবং মনের ব্যাখ্যায়ও দেকার্ত দ্বৈতবাদী। মানুষ হচ্ছে দেহ এবং মনের সম্মিলিত সংগঠন। দেহ হচ্ছে মনহীন বস্তু আর মন হচ্ছে বস্তুহীন সত্তা। দেহ আর মন চরিত্রগতভাবে পরস্পর বিরোধী। এই দুই বিরোধী সত্তা পাইনিয়াল গ্লাণ্ড নামক একটি তন্ত্রীয় মাধ্যমে মিলিত হয়ে পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সম্পর্কে সম্পর্কিত হয়। বেকনের ন্যায় দেকার্তও প্রকৃতির কার্যকারণ জ্ঞাত হয়ে প্রকৃতিকে জয় করা এবং মানুষের চরিত্রকে উন্নত করাই জ্ঞানের উদ্দেশ্য বলে মনে করতেন। সঠিক জ্ঞানলাভের কি পদ্ধতি হবে? এর জবাবে দেকার্ত তাঁর বিখ্যাত সন্দেহবাদের তত্ত্ব ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, সুনিশ্চিত জ্ঞানলাভের জন্য এমন একটি ভিত্তি থেকে শুরু করতে হবে, যে ভিত্তি সর্বপ্রকার সন্দেহের ঊর্ধ্বে। যে সূত্র সন্দেহযোগ্য তার মাধ্যমে সুনিশ্চিত জ্ঞানলাভ সম্ভব নয়। এই তত্ত্বের ভিত্তিতে দেকার্ত প্রচলিত সমস্ত সূত্রের উপর সন্দেহ পোষণ করতে করতে ‘আমার নিজের অস্তিত্ব সন্দেহের ঊর্ধ্বে’ বা ‘কাজিটো আরগোসাম’ –এই সিদ্ধান্তে আসেন। ব্যক্তি সব কিছুতেই সন্দেহ করতে পারে, কিন্তু সে নিজের অস্তিত্বকে সন্দেহ করতে পারে না। এ তত্ত্বের একটি অজ্ঞেয়বাদী তাৎপর্য আছে। কিন্তু দেকার্ত অজ্ঞেয়বাদী না হয়ে নিজের তত্ত্বকে ব্যাখ্যা করে বলেন যে, নিজের অস্তিত্ব সন্দেহাতীত, এই সূত্রকে স্বতঃসিদ্ধ হিসাবে গ্রহণ করে আমরা জগতের সুনিশ্চিত জ্ঞানমণ্ডল আবার তৈরী করতে পারি। দেকার্তের এই জ্ঞানতত্ত্ব সাধারণত র্যাশনালিজম বা যুক্তিতত্ব নামে পরিচিত। তাঁর মতে জ্ঞানের ক্ষেত্রে নিজের অস্তিত্বের মতো আরো কতকগুলি জন্মগত সুনিশ্চিত সূত্রগুলি ঈশ্বর মানুষের মধ্যে সৃষ্টি করে দেন। ঈশ্বরের সৃষ্টি বলে এ সূত্রগুলি সন্দেহাতীত এবং সন্দেহাতীত সূত্রের ভিত্তিতে যুক্তি পরম্পরায় লব্ধ যে-কোন জ্ঞান সঠিক হতে বাধ্য। দেকার্ত তাঁর দর্শনে ও চিন্তায় যথার্থই দ্বৈতবাদী ছিলেন। এ কারণে একদিকে বস্তুবাদী মত দ্বারা তিনি যেমন গোঁড়ামীর বেড়াজাল বেঙে চিন্তার মুক্তিকে সাহায্য করেছেন, তেমনি অপরদিকে অতি-প্রাকৃতিক অস্তিত্বে জ্ঞানের মূল স্থাপন করে তিনি ইউরোপের আধুনিক দর্শনে ভাববাদী ধারারও প্রবর্তন করেন।
Determinism, Indeterminism: নির্ধারণবাদ, অনির্ধারণবাদ
জীবন ও জগতের সবকিছুই কার্যকারণের বিধান দ্বারা নির্ধারিত, এ তত্ত্বকে নির্ধরণবাদ বলা হয়। এর বিপরীতে, কোনো কিছুই কিছুর দ্বারা নির্ধারিত নয় কিংবা কোনো ঘটনা বা কার্য কিসের দ্বারা নির্ধারিত, তা ঈশ্বর বাদে কেউ জানে না এবং সে কারণে কোনো কিছু পূর্ব নির্ধারিত একথা মানুষ বলতে পারে না, এই বিশ্বাসকে অনির্ধারণবাদ বলা হয়। নির্ধারণবাদ এবং অনির্ধারণবাদ অনিবার্যতা এবং স্বাধীনতা কথাটিরই আর এক প্রকাশ। (দ্র. Freedom and Necessity: স্বাধীনতা এব অনিবার্যতা)।
Dewey, John: জন ডিউন (১৮৫৯-১৯৫২ খ্রি.)
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত দার্শনিক এবং শিক্ষাবিদ জন ডিউইকে আমেরিকান প্রাগমেটিজম বা প্রয়োগবাদী দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা বলে গণ্য করা হয়। তিনি তাঁর এই দর্শনে এই অভিমতের উপর জোর দেন যে, কোনো ভাবের যথার্থতার মাপকাঠি হচ্ছে বাস্তব জীবনে তাঁর প্রত্যাশিত ফল পাওয়া, না-পাওয়া। অর্থাৎ কার্যক্ষেত্রে কোনো বাব বা তত্ত্ব ফলদায়ক না হলে সে তত্ত্বের কোনো মূল্য নেই। চিকাগোতে তিনি তার চিন্তাধারার পরীক্ষাগার হিসাবে শিশুদের জন্য একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। শিক্ষার বিষয়ে তাঁর প্রখ্যাত গ্রন্থগুলির মধ্যে রয়েছে, ‘দি স্কুল এ্যাণ্ড সোসাইটি’, ‘দি চাইলড এ্যাণ্ড দি কারিকুলাম’ এবং ‘হাউ ইউ থিঙ্ক’। ‘ডিমোক্রসি এ্যাণ্ড এডুকেশন’ তাঁর সমধিক প্রসিদ্ধ গ্রন্থ। এর প্রকাশকাল ১৯১৬। শিক্ষার সমস্যার উপর রচিত তাঁর গ্রন্থসমূহে ডিউই শিশুদের শিক্ষাকে সমাজের চাহিদার সঙ্গে সংযুক্ত করা, কর্মের ভিত্তিতে শিক্ষা প্রদান, খেলাধুলার সঙ্গে শিক্ষার যোগ প্রভৃতি বিষয়ে তাঁর গভীর চিন্তা ও অভিজ্ঞতাপ্রসূত অভিমতসমূহকে প্রকাশ করেন। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দ্বারা সমাজকে পরিবর্তনের ক্ষেত্রে মানুষের প্রজ্ঞার যৌথ সম্মিলন ও প্রয়োগের উপর তিনি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন।
Dhirendranath Datta: ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত
ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত (১৮৮৬-১৯৭১) ১৯৪৮ সনের ২৩শে ফেব্রুয়ারী বাংলা ভাষার প্রন্তটি উত্থাপন করেছিলেন পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনের প্রথম দিনই। তিনি পাকিস্তান জাতীয় কংগ্রেসের সভ্য ছিলেন। উর্দু এবং ইংরেজীর পাশাপাশি বাংলাকেও গ্রহণযোগ্যতা পায়নি বলেই ১৯৪৮ সন থেকেই তিনি পাকিস্তান গোয়েন্দা বাহিনীর সতর্ক দৃষ্টির পাহারায় ছিলেন। তারই পরিণতিতে ১৯৭১ সালের ১৪ই এপ্রিল কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে অকথ্য নির্যাতনের পর তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তাই ধীরেন্ত্রনাথ দত্ত বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ: এ কথা ইতিহাসগতভাবে উল্লেখ করার দাবী রাখে।
Dialectics: দ্বন্দ্ব, দ্বান্দ্বিকতা
Dialectical Materialism: দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ
প্রাকৃতিক জগৎ, মানুষের সমাজ এবং চিন্তার ক্ষেত্রে ক্রিয়াশীল বিধানসমূহের পরিচায় জ্ঞাপক তত্ত্ব। ইংরেজী ‘ডায়ালেটিকস’ শব্দ গ্রিক শব্দ ‘ডায়ালোগ’ থেকে উদ্ভুত। গ্রিক দর্শনে ডায়ালোগ শব্দের ব্যবহার দেখা যায়। কোনো সমস্যার ক্ষেত্রে প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে সমাধান সন্ধানের পদ্ধতিকে গ্রিক দার্শনিকরা ডায়ালোগ বলতেন। প্রশ্ন, উত্তর বা পাল্টা প্রশ্নের মধ্যে একটা দ্বন্দ্বের অবস্থা বিরাজমান। এই দ্বন্দ্বের মাধ্যমে সমাধানের পৌঁছার প্রক্রিয়ায় একটা গতির আভাসও বিদ্যমান। বস্তুদ দ্বন্দ্ব, পরিবর্তন, গতি, এ কথাগুলি পরস্পরের ইঙ্গিতসূচক। যেখানে দ্বন্দ্ব আছে, সেখানে পরিবর্তন ও গতি আছে। প্রাচীন গ্রিসের একাধিক বস্তুবাদী দার্শনিক জগৎ সম্পর্কে তাঁদের ব্যাখ্যায় এই দ্বন্দ্ব গতি ও পরিবর্তনের কথা স্বীকার করেছেন। প্লেটো ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাববাদী দার্শনিক হলেও তাঁর সংলাপসমূহ দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির উত্তম দৃষ্টান্ত। দ্বন্দ্ব কেবল প্রশ্নোত্তরের ক্ষেত্রে নয়। তার সংলাপে এরূপ আবাবসও পাওয়া যায় যে, ‘ভাব’ বা চরম যে সত্তা তাকেও নির্দ্বান্দ্বিকভাবে সম্যকরূপে উপলব্ধি করা যায় না। চরম সত্তা একদিক দিয়ে যেমন অস্তিত্ব, তেমনি অপর দিক দিয়ে সে অনস্তিত্ব, একদিকে সে যেমন নিজে যা তাই, তেমনি সে নিজে যা নয় তা-ও বটে। সে অপরিবর্তনীয়, আবার পরিবর্তনীয়। যে-কোনো অস্তিত্বের আভ্যন্তরিক দ্বন্দ্বকে অস্তিত্বের মূল বলে স্বীকৃতিদাব এবং জগৎ, সমাজ ও জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তার ব্যাপকতম প্রয়োগ ঘটেছে আধুনিককালে মার্কসীয় দার্শনিকদের দ্বারা। এ দর্শনের প্রবক্তা হিসাবে কার্ল মার্কস এবং ফ্রেডারিক এঙ্গেলস বিখ্যাত। মার্কস এবং এঙ্গেলস দ্বান্দ্বিকতার পূর্ণতম ব্যাখ্যা হেগেল-এর দর্শনে ঘটেছে বলে মনে করেন। তাঁদের মতে প্রাচীন দর্শনের পর হেগেলই সুস্পষ্টভাবে দ্বান্দ্বিকতার নীতি প্রকাশ করেছেন। হেগেলের মতে আমাদের চিন্তাই যে কেবল অস্তি, নাস্তি এবং নাস্তির নাস্তিত্বের মাধ্যমে নতুনতর অস্তির উদ্ভবের প্রক্রিয়ায় অগ্রসর হয় তাই নয়, চরম সত্তাও অনুরূপ অস্তি ও নাস্তির দ্বন্দ্বের মাধ্যমে নিজের সত্তাকে সৃষ্টি করে চলে। মার্কস এবং এঙ্গেলস হেগেলের দ্বান্দ্বিক গতিকে স্বীকার করেছেন, অপর দিকে তেমনি চরম সত্তাকে ভাব বরে ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর কাছে বস্তু চরম ভাবের দ্বান্দ্বিক ক্রিয়ার প্রকাশবিশেষ, বস্তু চরম সত্তা নয়। মার্কস এঙ্গেলস হেগেলের ক্রিয়াশীল তেমনি চরম সত্তা হচ্ছে বস্তু, ভাব নয়। ভাব হচ্ছে দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিতে ক্রিয়াশীল বস্তুরই বিকাশবিশেষ। এদিক দিয়ে মার্কসবাদ হেগেলের দর্শনের পরিপূর্ণ প্রতিপক্ষ। কাজেই হেগেলীয় ডায়ালেকটিকস বা দ্বান্দ্বিকতা বস্তুর ক্রিয়াশীলতা এবং জ্ঞানের ক্রিয়াশীলতাকে একই সূত্রে আবদ্ধ করেছে। বস্তু এবং বস্তুর জ্ঞানের ক্ষেত্রে দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ার কয়েকটি সূত্র উল্লেখ করা যায়: বস্তুর মধ্যে দ্বন্দ্ব নিয়ম বিদ্যমান। দ্বন্দ্ব থেকে গতির সঞ্চার। দ্বন্দ্বহীন এবং গতিহীন কোনো সত্তার অস্তিত্ব নেই। দ্বন্দ্বমূলক গতিকে একটা বিশেষ অবস্থা থেকে এভাবে ব্যাখ্যা করা যায় যে, একটা বিশেষ অবস্থাকে যদি ‘অস্তি’ বলে বিবেচনা করা যায়, তা হলে দ্বন্দ্ব এবং গতির কারণে কালক্রমে ‘অস্তি’ নাস্তির সৃষ্টি করে, অস্তি ও নস্তির সংগ্রামে আবার কালক্রমে নতুনবাবে অস্তিত্বের সৃষ্টি হয় যার মধ্যে অস্তি ও নাস্তির অভিনব এবং উন্নততর সম্মেলন সংঘটিত হয়। ইংরেজীতে এই তিনটি অবস্থা ‘থিসিস’, ‘এ্যান্টিথিসিস’ এবং ‘সিনথেসিস’ বলে পরিচিত। দ্বান্দ্বিক গতির আর একটি বৈশিষ্ট্য এই যে, দ্বন্দ্বের মাধ্যমে পরিবর্তনের ক্রম সব সময় এক রকম থাকে না। পরিবর্তনের ক্রম বৃদ্ধি পেয়ে পেয়ে অবস্থার ক্ষেত্রে একটা গুণগত পরিবর্তন সৃষ্টি করতে পারে। মার্কস এবং এঙ্গেলস বস্তুর ক্ষেত্রে এই দ্বান্দ্বিকতার নীতি প্রয়োগ করে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ এবং সমাজ ও ইতিহাসের ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ দ্বারা ঐতিহাসিক বস্তুবাদের দর্শন প্রতিষ্ঠা করেছেন। আদি সাম্যবাদী সমাজ থেকে পুঁজিবাদী সমাজের উত্তরণকে মার্কসবাদীগণ ইতিহাসের ক্ষেত্রে দ্বান্দ্বিকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বলে মনে করেন। এই নীতিতে কালক্রমে পুঁজিবাদী সমাজ নতুনতন সমাজতান্ত্রিক সমাজে রূপান্তরিত হবে বলেও মার্কস ও এঙ্গেলস ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। সোভিয়েত রাশিয়া এবং অন্য অনেক দেশে সমাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার জন্য আন্দোলন এবং অপরদিকে পুঁজিবাদের পক্ষ থেকে তার তীব্র বিরোধিতা চলছে, একেও দ্বন্দ্বমূলক দর্শনের বাস্তব দৃষ্টান্ত বলে গণ্য করা হয়।
Dialogue: সংলাপ
সাহিত্যিক রচনায় দুটি চরিত্রের মধ্যকর কথোপকথনকে সংলাপ বলে। সাধারণ কথোপকথন থেকে সংলাপের বৈশিষ্ট্য এই যে, সংলাপ পূর্বপরিকল্পিত এবং এর মাধ্যমে রচনাকারী কোনো একটা প্রতিচাদ্যকে ধারাবাহিকভাবে প্রমাণের স্তরে নিয়ে যান। কোনো সমস্যা বা প্রশ্নের উভয় দিক উপস্থাপনের জন্য সাহিত্যিকগণ সংলাপকে সব যুগেই একটি উত্তম কৌশল বলে বিবেচনা করেছেন। লেখক প্রশ্নের পরস্পরবিরোধী দুটি দিক দুই চরিত্রের মাধ্যমে এমনভাবে উপস্থিত করেন যাতে যুক্তির খণ্ডনে যুক্তি অগ্রসর হতে হতে এমন সিদ্ধান্ত সমুপস্তিত হয় যেখানে আর বিরোধের অবকাশ থাকে না। যে চরিত্র প্রতিপাদ্যের প্রতিপক্ষের ভূমিকা পালন করেছে সে চরিত্রও সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতাকে স্বীকার করে। সংলাপমূলক রচনার উদ্ভব গ্রিক সাহিত্যে বলে অনেকে মনে করেন। সক্রেটিসকে প্রধান চরিত্র করে প্লেটো তাঁর সমস্ত দার্শনিক তত্ত্বকে সংলাপের মাধ্যমে প্রকাশ করেন। তাঁর রচনা কেবলমাত্র দার্শনিক এই বিতর্কের জন্যই নয়; তার নাটকীয়তা এবং রচনার মাধুর্যও অতুলনীয়। প্লেটোর সংলাপমূলক রচনাশৈলী কোনো উদ্ভাবন নয়। প্লেটোর পূর্বে গ্রিক দার্শনিকদের মধ্যে সংলাপের মাধ্যমে তত্ত্ব পেশ করার রীতি প্রচলিত ছিল। সক্রেটিস কোনো গ্রন্থ রচনা করেন নি। কিন্তু দৈনন্দিন জীবনে তিনি অপর চরিত্রের সঙ্গে জীবন ও জগতের সমস্যা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করতেন। এবং বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে তাত্ত্বিক বিষয় পেশ করার জন্য সংলাপের স্থানে নিবন্ধই প্রধান মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু সংলাপ একেবারে পরিত্যক্ত হয় না। বিভিন্ন দেশের খ্যাতনামা সাহিত্যিক অন্যান্য শৈলীর সঙ্গে সংলাপের শৈলীও ব্যবহার করেছেন। ইংরেজী সাহিত্যে দর্শনের ক্ষেত্রে জর্জ বার্কলের ‘হাইলাস ও ফিলোনাস’ –এর সংলাপ এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য।
Dicast: ডাইকাস্ট
প্রাচীন এথেন্স নগর-রাষ্ট্রের একটি রাষ্ট্রীয় পদের নাম। ডাইকাস্টকে জুরী বা বিচার-ব্যবস্থা বলে মনে করা যায়। এথেন্সের যারা নাগরিক অর্থাৎ যারা দাস কিংবা ঋণের দায়ে নাগরিকতা থেকে বঞ্চিত হয় নি এমন নগরবাসীদের মধ্য থেকে প্রতি বছর ছহাজার বিচারকের একটি তালিকা নির্বাচনের মাধ্যমে প্রস্তুত করা হতো। এই বিচারক বা ডাইকাস্টগণ রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিধানের ব্যাখ্যা এবং বিরোধমূলক ঘটনার বিচার করতেন। গোড়ার দিকে এর জন্য কোনো পারিশ্রমিক না থাকলেও ডাইকাস্টদের জন্য পেরিক্লিস (খ্রি. পূ. ৪৯০-৪২৯) বেতন-দানের ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। এথেন্সের রাজনীতিক দলাদলি ও বিরোধ দ্বারা বিশেভভাবে প্রভাবিত হত। নিরপেক্ষ বিবেচনা বা বিচারের পরিবর্তেথ ডাইকাস্টের সদস্যগণ তাদের মনোভাব এবং ব্যক্তিগত স্বার্থ দ্বারা অধিক পরিচালিত হতেন। এথেন্সের বিচার-ব্যবস্থার এই দুর্নীতিকে বিষয় করে রচিত গ্রিক নাট্যকার এ্যারিন্সোফেনিসের ‘ওয়াসপ’ বা বোলতা নামক নাটক বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিল।
Dictatorship of the proletariat: সর্বহারার একনায়কত্ব
সর্বহারার একনায়কত্ব কথাটি মার্কসবাদী রাষ্ট্রতত্ত্বের একটি ধারণা। মার্কসবাদী রাষ্ট্রতত্ত্বানুযায়ী শ্রেণীবিভক্ত সমাজে রাষ্ট্র হচ্ছে প্রতিষ্ঠিত শাসক শ্রেণীর হাতে বিভিন্ন প্রকারে তাদের নিজেদের স্বার্থ রক্ষার অস্ত্র। মার্কসবাদীরা মনে করেন যে, মানব সমাজে রাষ্ট্র অতীতের সর্বযুগে বিদ্যমান ছিল না এবং ভবিষ্যতেও একদিন থাকবে না। আদিম সাম্যবাদী মানব সমাজে রাষ্ট্রের উদ্ভব সম্ভব ছিল না। উৎপাদন ব্যবস্থার উন্নতির একটা পর্যায়ে সমাজ যখন উৎপাদনের উপায়ের কিছু সংখ্যক মালিক এবং উৎপাদনের উপায়হীন অধিক সংখ্যক মানুষে বিভক্ত হয়ে গেল, তখনি মাত্র রাষ্ট্রযন্ত্রের উদ্ভব ঘটে। এই অবস্থায় উৎপাদনের উপায়ের একচ্ছত্র মালিকদের আইন প্রণয়নের এবং আইনভঙ্গকারীর শাস্তিবিধানের ব্যবস্থার। প্রথম যুগের শ্রেণীবিভক্ত অর্থাৎ দাস সমাজের রাষ্ট্র আধুনিককালের রাষ্ট্র থেকে সহজতর হলেও মূলত উভয়ের চরিত্রই এক। রাষ্ট্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য উৎপাদনের মালিকদের মৌলিক স্বার্থ প্রতিপক্ষের হাত থেকে রক্ষা করার ব্যবস্থা করা। মার্কসবাদী তত্ত্বানুযায়ী শ্রেণীবিভক্ত দাস সমাজ, সামন্ততান্ত্রিক সমাজ এবং পুঁজিতান্ত্রিক সমাজ-এর প্রত্যেকটি পর্যায়েই রাষ্ট্র হচ্ছে শাসকশ্রেণীর একনায়কত্বের ধারক ও বাহক। পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার কথা বলা হলেও এর কোনো গণতন্ত্রই পুঁজিবাদের উচ্ছেদ করে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯১৭ সালের বিপ্লবে রাশিয়ায় এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরবর্তীকালে অপর কয়েকটি দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সমাজতন্ত্রে রাষ্ট্রের রূপ কি? এ প্রশ্নের জবাবে মার্কসবাদের অন্যতম ব্যাখ্যাকারী এবং নেতা ভি.আই. লেনিন বলেছেন যে, সমাজতন্ত্রও পরিপূর্ণরূপে শ্রেণীহীন রাষ্ট্র নয়। সমাজতন্ত্র শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থ এবং পুঁজিপতি শ্রেণীর স্বার্থ পরস্পর-বিরোধী। এ কারণে শ্রমিকশ্রেণীকে বিপ্লব মারফৎ পুঁজিবাদ উচ্ছেদ করে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হয়। কোনো শ্রেণীই তার স্বার্থ বিনা প্রতিবাদে বা বিনা প্রতিরোধে প্রতিপক্ষকে ছেড়ে দেয় না। জীবনের ক্ষেত্রে এটাই স্বাভাবিক। বিপ্লবের পূর্বে যেমন, বিপ্লবের পরেও তেমনি প্রকাশ্য-পরোক্ষ, সশস্ত্র-নিরস্ত্র এবং ভাবগত নানাভাবে পুঁজিবাদ শ্রমিকশ্রেণীকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে। প্রতিষ্ঠিত সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে বহির্দেশের পুঁজিবাদী রাষ্ট্রসমূহের সহায়তায় উচ্ছেদ করে পুনরায় পুঁজিবাদী ব্যবস্থা কায়েম করার চেষ্টা সমাজতান্ত্রিক দেশে চলতে থাকা সম্ভব। এ কারণে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে নির্বিকার থাকলে চলে না। শ্রমিকশ্রেণীর স্বার্থ রক্ষার জন্য তাকেও সংগঠনগত সর্বপ্রকার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। তাই সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হচ্ছে শ্রমিকশ্রেণীর স্বার্থরক্ষাকারী সংগঠন। এদিক থেকে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রও একটি শ্রেণী-রাষ্ট্র। শ্রমিকশ্রেণীর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত এবং শ্রমিকশ্রেণীর একক নেতৃত্ব রক্ষাকারী সংগঠন। এ কারণে সমাজতন্ত্রের রাষ্ট্রীয় সংগঠনকে সর্বহারার বা শ্রমিকশ্রেণীর একনায়কত্ব বলা হয়। পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের সঙ্গে শ্রমিকশ্রেণীর সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পার্থক্য এখানে যে, পুঁজিবাদ উচ্ছেদ হওয়ার করণে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে শোষিত এবং উৎসাদিত পুঁজিপতি শ্রেণীর প্রতিরোধ বিলুপ্ত হলে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের স্বার্থরক্ষাকারী ভূমিকার প্রয়োজনও বিলুপ্ত হয়ে যাবে এবং সাম্যবাদী মানব সমাজে শ্রেণী হিসাবে কোনো বিশেষ শ্রেণীর স্বার্থরক্ষা করার কোনো রাষ্ট্রীয় সংগঠনের প্রয়োজন আদৌ থাকবে না। রাষ্ট্র বলতে এখন যা বুঝায়, তেমন শক্তি প্রয়োগকারী সংগঠন বিলুপ্ত হয়ে যাবে। মার্কসবাদের এই রাষ্ট্রীয় তত্ত্ব থেকে দেখা যায় যে, সর্বহারার একনায়কত্ব পুঁজিবাদ থেকে সাম্যবাদে পৌঁছার জন্য আবশ্যকীয় একটি অন্তর্বর্তী স্তরবিশেষ। ১৮৭০ সালে প্যারিস শহরে শ্রমিকরাও বিপ্লবের মাধ্যমে প্যারিকম্যুরন নামে একটি শ্রমিক-রাষ্ট্র কায়েম করেছিল। ফরাসী ধনীকশ্রেণী শক্তি প্রয়োগ করে সেদিন তাকে পর্যুদস্ত করে দেয়। কার্লমার্কস এবং এঙ্গেলস প্যারিকম্যুনের পরিণতি থেকে সমাজতন্ত্র রক্ষার জন্য সর্বহারার একনায়কত্বের আবশ্যকতা উপলব্ধি করেন।
Diderot: দিদেরত (১৭১৩-১৭৮৪ খ্রি.)
অষ্টাদশ শতকে ফরাসিদেশে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিস্তারের জন্য ‘বিশ্বকোষ’ রচনার পরিকল্পনা করেছিলেন মুক্তিবুদ্ধির যে পথিকৃতরা তাঁদের অন্যতম ছিলেন দিদেরাত। ইংল্যাণ্ডের প্রকাশিত সেকালের বিশ্বকোষের আদর্শে দিদেরস ফরাসি ভাষায় বিজ্ঞান, সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতির উপর বিশ্বকোষ রচনার কথা চিন্তা করেন। এ কাজে তাঁর অপর এক সঙ্গী ছিলেন ডি’ আলেম্বার্ট। বিরাট প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে তাঁরা জ্ঞান প্রচারের এই পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হতে থাকলে ১৭৫৯ সনে সামন্ততান্ত্রিক সরকার এ পরিকল্পনার কাজ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। এমন অবস্থায় অনেক সঙ্গী তাঁকে পরিত্যাগ করেন। কিন্তু দিদেরত পরাজয় স্বীকার করতে থাকেন। তাঁর এই অদম্য চেষ্টা ক্রমান্বয়ে তাঁকে ফরাসি বিদ্বৎ মহলে সম্মান ও শ্রদ্ধার আসতে প্রতিষ্ঠিত করে। অভিজাত শ্রেণীর উদারপন্থী ব্যারণ এবং লেখক ডি হলবাক তাঁর পৃষ্ঠপোষক হন। বিশ বছরের চেষ্টায় ফরাসি বিশ্বকোষের যে ১৭টি খণ্ড প্রকাশিত হয়েছিল, সে জ্ঞানকোষ ফরাসি জনমানসে নতুন বৈজ্ঞানিক ও ইহজাগতিক এক দৃষ্টিভঙ্গীর ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেছিল। দারিদ্র্যের কারণে নিজের অপরিসীম পরিশ্রমে প্রতিষ্ঠিত তার গ্রন্থাগারটিকে প্যারিস থেকে স্থানান্তর না করে প্যারিসে দিতেরতকে তার গ্রন্থাগারিক নিযুক্ত করেন। বিশ্বকোষ তৈরির উদ্যোগের পূর্বে দিদেরত ফরাসি দেশের প্রচলিত ব্যবস্থার অন্যায় এবং কুসংস্কারকে ব্যঙ্গ করে যে গ্রন্থ রচনা করেছিলেন সরকার তা নিষিদ্ধ করে দিদেরতকে কারাগারে বন্দি করেছিলেন। কিন্তু কোনো নির্যাতন মুক্তবুদ্ধির প্রবক্তা দিদেরতকে দমিন করতে পারে নি। তাঁর জীবনকালেই তিনি ফরাসি দেশের অন্যতম অগ্রসর চিন্তানায়ক এবং লেখক স্বীকৃতি লাভ করেন।
Diagenes: ডায়োজেনিস (খ্রি. পূ ৪১২-৩২৩)
ডায়োজেনিস ছিলেন গ্রিসের সিনিক বা উদাসীন দার্শনিক (দ্র. Cynic: উদাসীন) ডায়োজেনিস সিনি দর্শনের প্রবক্তা এ্যান্টিসথেনিসের শিষ্য ছিলেন। একবার সমুদ্রযাত্রায় জলদস্যুরা তাঁকে অপহরণ করে কোরিন্থে দাস হিসাবে বিক্রিয় করে। কোরিন্থে তিনি জীবনের বাকি অংশ অতিবাহিত করেন এবং তাঁর আত্মসংযম ও কৃচ্ছ্বতাপালনমূলক দর্শনের প্রচার করেন। তাঁর সম্পর্কে নানা উপকথা প্রচলিত আছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে এই যে, সম্রাট আলেকজান্ডার তাঁর কি উপকার করতে পারেন এরূপ প্রশ্নকালে তিনি ব্যঙ্গসহকারে বলেছিলেন: আপনি দয়া করে আমার সূর্যের আলোকটুকু আড়াল না করে সরে দাঁড়াতে পারেন। ডায়োজেনিস মনে করতেন, জীবনের সার্থকতা ভোগে নয়, ত্যাগে এবং কষ্টভোগে, কৃচ্ছ্বতাসাধনে। কষ্ট এবং দুঃখভোগ উত্তম চরিত্র অর্জনের প্রকৃষ্ট উপায়। প্রকৃতিতে প্রত্যাবর্তন এবং সহজ জীবনযাপনেই মাত্র মানুষের সকল প্রকার রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি ও অস্থিরতা থেকে মুক্তির পথ। ডায়োজেনিস প্লেটোর ভাব বা নির্বিশেষে সত্তার অস্তিত্ব অস্বীকার করেন। তাঁর মতে বিকাশই একমাত্র অস্তিত্ব। নির্বিশেষে অস্তিত্বহীন।
Distribution of Terms: পদের বণ্টন
যুক্তিবিদ্যায় একটি যুক্তির মধ্যে বাক্যের একটি টার্ম বা পদের সংখ্যা বা ব্যাক্তার্থকে সামগ্রিকভাবে বুঝানো হল বাক্যের সেই পদটিকে বণ্টিত পদ বা ডিস্ট্রিব্যুটেড টার্ম বলে। অবরোহ যুক্তিতে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য যুক্তির মধ্যে পদের বণ্টন এবং অ-বণ্টনের প্রতি দৃষ্টি রাখা আবশ্যক হয়। যৌক্তিক বাক্যকে সাধারণত চারভাগে ভাগ করা হয় যথা: সার্বিক এবং বিশেষ; হ্যাঁ বাচক এবং না বাচক। একটি নির্দিষ্ট নিয়ম অনুযায়ী সার্বিক হাঁ বাচক বাক্য তার উদ্দেশ্য পদকে, সার্বিক না বাচক তার উদ্দেশ্য বিধেয় উভয় পদকে, বিশেষ না বাচক কেবল তার বিধেয় পদকে বণ্টন করে। কিন্তু বিশেষ হ্যাঁ বাচক কোনো পদকেই বণ্টন করে না। সকল মানুষ মরণশীল, এটি একটি সার্বিক হাঁ বাচক বাক্য। এখানে উদ্দেশ্যপদ ‘মানুষ’ –এর সংখ্যা বা ব্যক্তার্থের সমগ্রের উপর বক্তব্যটি প্রযোজ্য বলে উদ্দেশ্য পদটি বণ্টিত। ‘কিছু মানুষ সৎ’ এটি একটি বিশেষ হ্যাঁ বাচক বাক্য। এখানে সকল মানুষের ক্ষেত্রে যেমন সততার কথাটি প্রযোজ্য নয়, তেমনি সকল সৎ-এর উপরও এই বাক্যের ‘কিছু মানুষ’ পদটি প্রযোজ্য নয়। এ কারণে এই বাক্যের কোনো পদই বণ্টিত নয়। যুক্তির মধ্যে কোনো পদ বণ্টন না করে সিদ্ধান্তে তাকে বণ্টন করা হলে অবণ্টিত পদের বণ্টনজনিত ভ্রান্তির সৃষ্টি হয়।
Divine Right: ঐশ্বরিক অধিকার
ঐশ্বরিক অধিকার একটি রাষ্ট্রীয় তত্ত্ব। এই তত্ত্ব অনুযায়ী রাজা বিধাতার প্রতিনিধি। রাজার আনুগত্য বিধাতার প্রতি। প্রজার আনুগত্য রাজার প্রতি। রাজার কোনো কাজের জন্য রাজা প্রজার নিকট দায়ী থাকবে না। সে দায়ী থাকবে বিধাতার নিকট। রাজার স্বৈরতান্ত্রিক শাসনকে যুক্তিসঙ্গত এবং জোরদার করার জন্য এক সময়ে এই তত্ত্ব বিশেষবাবে ব্যবহৃত হতো। এই তত্ত্ব এরূপ চরম আকারে রাষ্ট্রীয় শাসনে প্রয়োগ করতে শুরু করেন যে, এর ফলে সপ্তদশ শতকের ইংল্যাণ্ডে রাজার সঙ্গে পার্লমেন্ট ও জনসাধারণের বিরোধ তীব্র আকার গ্রহণ করেন। ১৭৮৯ খ্রিষ্টাব্দের ফরাসি বিপ্লবের পূর্ব পর্যন্ত ঐশ্বরিক অধিকার তত্ত্বের বিশেষ প্রভাব ছিল। ফরাসি বিপ্লব এই তত্ত্বকে আঘাত করে বুর্জোয়া বিপ্লব সংঘটিত করে সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করে।
Dream: স্বপ্ন
স্বপ্ত বয়স নির্বিশেষে সকল মানুষের প্রায় নিত্যদিনের অভিজ্ঞতা। ‘নিদ্রার মধ্যে চেতনার একটি প্রকাশ’ বলে স্বপ্নের একটি সংজ্ঞা দেওয়া চলে। সাধারণভাবে একথা সত্য যে, নিদ্রার মধ্যে দেহের সচেতন কার্যাবলী বন্ধ বা স্থগিত থাকে। নিদ্রার মধ্যে আমরা কোনো দ্রব্যকে চোখ দিয়ে দেখি না। হাত নেড়ে কোনো কাজ করি না। পা দিয়ে হাঁটি না। তাই মনে করা হয়, নিদ্রার মধ্যে মস্তিষ্ক বিশ্রাম করে নিজের ক্ষয়কে পূরণ করে জাগরিক হয়ে পুনরায় কার্যে নিবদ্ধ হয়। কিন্তু নিদ্রার মধ্যে মস্তিষ্ক যে একেবারে নিষ্ক্রিয় থাকে না তারই পরিচয় বহন করে মানুষের স্বপ্ন। আমরা বলি মানুষ স্বপ্ন দেখে। অবশ্যই আমরা চোখ দিয়ে স্বপ্ন দেখি না। কিন্তু স্বপ্নের মধ্যে সচেতন সময়ের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের একরূপ অভিজ্ঞতা ঘটে। ‘স্বপ্ন’ ব্যাপারটা পূর্বে ঐশ্বরিক এবং রহস্যজনক ব্যাপার বলে মনে করা হতো। যেমন প্রাচীনকালে তেমনি এখনো সাধারণ মানুষ তাদের স্বপ্নের তাৎপর্য উদঘাটনের জন্য ধর্মীয় পুরুষ তথা পীর দরবেশ সন্ন্যাসীর শরণাপন্ন হয়। কিন্তু আধুনিককালে স্বপ্ন নিয়ে বৈজ্ঞানিকগণ, বিশেষ করে মনোবিজ্ঞানীগণ বিশেষ গবেষণা সম্পাদন করার চেষ্টা করেছেন। সাধারণভাবে আজকাল স্বপ্নকে বাস্তব জীবনের অপূর্ণ কামনা বাসনার একরকম পূরণ বলে মনে করা হয়। বিভিন্ন পরীক্ষা দ্বারা দিনের বাস্তব অভিজ্ঞতার সঙ্গে স্বপ্নের বিষয়ের সম্পর্ক নির্ধারণ করা হয়েছে। শিশুদের বেশিরভাব স্বপ্নই তাদের সচেতন অবস্থার নানা আদর আবদার আঘাতের সঙ্গে জড়িত। বয়স্কদের ক্ষেত্রে এরূপ সম্পর্ক সহজে ধরা না গেলেও, যে কামনা বাসনা মানুষ তার সচেতন সামাজিক জীবনে নানা বাধা নিষেধ সংকোচ ও সংস্কারে পূরণ করতে পারে না সেসব কামনা বাসনা প্রত্যক্ষরূপে না হলেও পরোক্ষ এবং নানা প্রতীকে নিদ্রার মধ্যে যে তাকে কিছুটা তৃপ্ত করতে পারে, এ অভিমত আজ সাধারণভাবে স্বীকৃত। স্বপ্ন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার সাক্ষাৎ পাওয়া যায় বিংশ শতকের বিশ ও ত্রিশের দশকে ইউরোপের চিকিৎসাবিদ ও মনোবিজ্ঞানী সিগমণ্ড ফ্রয়েডের গবেষণা ও প্রকাশনায়। ফ্রয়েড এবং তাঁর অনুসারী মনোবিজ্ঞানীগণ মনকে চেতন, অবচেতন ভাগে ভাগ করে বিবেচনা করেন। তাঁদের মনের চেতন ভাগ তেমন বৃহৎ নয়। মানুষের আপাত বিস্মৃত এবং অবদমিত চিন্তা, ভাবনা, উদ্বেগ, কামনা অবচেতনা এবং অচেতনে নিক্ষিপ্ত হলেও তারা বিলুপ্ত হয়ে যায় না। প্রত্যেকটি কামনা একটি শক্তি বা এনারজিবিশেষ। যে –কোন ভাবে প্রকাশের মাধ্যমে তার পূর্তি না ঘটলে তার বিলোপ ঘটে না। ফ্রয়েড স্বপ্নকে মানুষের অবচেতন এবং অচেতন জগতের রহস্য উদ্ধারের একটি চাবিকাঠি বলে গণ্য করেন। এই তত্ত্বের উপরই আধুনিক মনঃসমীক্ষণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
Dutt, Aswinkumar: অশ্বীনীকুমার দত্ত (১৮৫৬-১৯২৩ খ্রি.)
বর্তমান বাংলাদেশের বরিশাল জেলার অধিবাসী। অশ্বিনীকুমার তত্তের পৈতৃক বাড়ি এই জেলার বাটাজোড় গ্রামে। তিনি জন্মগ্রহণ করেন তাঁর পিতার কর্মস্থল পটুয়াখালীতে। পিতা ব্রজমোহন দত্ত একজন সাবজজ ছিলেন। ঊনবিংশ শতকের শিক্ষিত হিন্দু মধ্যবিত্তের নেতৃস্থানীয় পরিবার বরিশালের দত্ত পরিবার। অশ্বিনীকুমার দত্ত এম, এ, বি, এল ছিলেন। ছাত্রজীবনের পরে কিছুকাল তিনি একটি স্কুলে শিক্ষকতা করেছিলেন। কিন্তু অল্পকালের মধ্যেই তিনি শিক্ষকতার চাকুরী পরিত্যাগ করে সমাজসেবায় আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর পিতা ব্রজমোহনের নামে তিনি বি, এম স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন ১৮৮৪ সনে। ১৮৮৯ সনে ব্রজমোহন কলেজ বা বি.এম. কলেজকেও তিনি স্থাপন করেন। এই কলেজে তিনি পঁচিশ বছর কোনো বেতন গ্রহণ না করে অধ্যাপকের কাজ করেন। তাঁর উদ্যোগে ১৮৮৭ সনে বাখরগঞ্জ (বরিশাল জেলার পুরাতন নাম) ডিস্ট্রিক্ট বোর্ড স্থাপিত হয়। অশ্বিনীকুমার দত্ত তৎকালীন ভারতীয় কংগ্রেসের প্রভাবশালী কর্মী ছিলেন। বরিশালের তিনি জনপ্রিয় নেতা ছিলেন। ১৯০৬ সনে বরিশালে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের অধিবেশনে পুলিশ লাঠিচার্জ করলে অশ্বিনীকুমার দত্তসহ কংগ্রেসের বহু নেতা আহত হন। ১৯০৮-১৯১০-এ অশ্বিনীকুমার কারাগারে বন্দি ছিলেন। তার কর্মকাণ্ড কেবল রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ ছিল না। সমাজসেবামূলক কার্যে তাঁর সাংগঠনিক শক্তি তিনি নিয়োগ করেন। তি ব্রাহ্ম সমাজে যোগদান করেছিলেন এবং সমাজ ও ধর্ম সম্পর্কে তাঁর চিন্তাধারা ব্যাখ্যা করে যে সকল পুস্তক রচনা করেন –সে সকল পুস্তক তাঁকে একজন বিশিষ্ট সাধক এবং চিন্তাবিদ হিসাবে বৃহত্তর জনসমাজে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তাঁর রচনাসমূহের মধ্যে ‘ভক্তিযোগ’, ‘কর্মযোগ’, ‘প্রেম’, ‘আত্মপ্রতিষ্ঠা’, ‘ভারতগীতি’ প্রভৃতি বিখ্যাত। বরিশালে বিখ্যাত স্বদেশ প্রেমিক চারণ কবি ও গায়ক মুকুন্দ দাস (যজ্ঞেস্বর দাস) অশ্বিনীকুমারের অনুপ্রেরণায় নিজের মুদী দোকানের ব্যবসায় পরিত্যাগ করে ‘মুকুন্দ দাস’ নামে খ্যাতি অর্জন করেন। সমগ্র জীবনব্যাপী তাঁর সমাজসেবা অশ্বিনীকুমারকে দেশব্যাপী মহৎ আত্মার অধিকারী বলে প্রতিষ্ঠিত করে। বরিশাল শহরে আজ অবধি বি.এম. স্কুল; বি.এম কলেজ এবং অশ্বিনীকুমার টাউন হল তাঁর কর্মোদ্যোগের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। পাকিস্তান-শাসনকালে ষাটের দশকে প্রতিক্রিয়াশীল মহল অশ্বিনীকুমারের অবদান অস্বীকার করে বরিশাল শহরের ‘অশ্বিনীকুমার টাউন হলে’র নাম পরিবর্তন করে ‘আয়ুব খাঁ টাউন হল’ রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু জাতীয়তাবাদী দেশপ্রেমিক তরুণ সমাজ ১৯৬৯-এর গণ আন্দোলনের সময়ে এই প্রচেষ্টাকে প্রত্যাখ্যান করে টাউন হলের নাম ‘অশ্বিনীকুমার টাউন হল’ হিসাবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে।
E
Eckecticism: সারবাদ, সমন্বয়বাদ
তত্ত্বের ক্ষেত্রে কেউ যদি একাধিক তত্ত্বের অংশবিশেষ গ্রহণ করে সবটা মিলিয়ে একটা তত্ত্বের আকার দেবার চেষ্টা করেন, তা হলে তাঁকে সারবাদী বা সমন্বয়বাদী বলে আখ্যায়িত করা হয়। জ্ঞানের রাজ্যে বিভিন্ন সমস্যার ব্যাপারে একটি মাত্র তত্ত্বই উদ্ভুত হয় নি। একই সমস্যার ব্যাপারে বিভিন্ন চিন্তাবিদ ও দার্শনিক বিভিন্ন মত উপস্থিত করেছেন। বস্তু, জীবন, জগৎ প্রভৃতির মূল চরিত্র কি? এ প্রশ্নে বস্তবাদ মনে করে যে, বস্তুই সব কিছুর মূল। অপরপক্ষে ভাববাদ মনে করে মানুষের মনের ভাব কিংবা ব্যক্তির মন নিরপেক্ষ এক চরম ভাবই হচ্ছে সব কিছুর মূল। এ দুটো মত পরস্পর বিরোধী। সামাজিক সমস্যার ক্ষেত্রে পুঁজিবাদ মনে করে আর্থিক উৎপাদনেরর ক্ষেত্রে ব্যক্তির অর্থাৎ পুঁজিসম্পন্ন ব্যক্তি বা সংস্থার অবাধ স্বাধীনতা এবং উদ্যোগই কাম্য। সমাজতন্ত্রবাদ মনে করে উৎপাদনের উপায়ের উপর সমষ্টির অধিকারই কাম্য, ব্যক্তিগত মালিকানা অসঙ্গত। এ দুটি মতও পরস্পর-বিরোধী। সাধারণত যে বস্তুবাদী, সে ভাববাদকে গ্রাহ্য করতে চায় না। যে পুঁজিবাদী, সমাজতন্ত্রবাদকে পুরোপুরি নাকচ করে। যে-কোন তত্ত্বের ব্যাখ্যাতা অনুসারীর পক্ষে এটাই যুক্তিসঙ্গত। কারণ একটি তত্ত্ব সামগ্রিক তত্ত্ব হয়ে ওঠে পৃথিবীর যাবতীয় সমস্যা ব্যাখ্যা করার ক্ষমতার দাবির ভিত্তিতে। সাধারণ মানুষ সবসময়ে কোনো একটি তত্ত্বের একনিষ্ঠ অনুসারী হয়ে জীবন যাপন করে না। দৈনন্দিন প্রয়োজনে এবং সমস্যার সাময়িক জবাবে বিভিন্ন তত্ত্বের, এমনকি পরস্পর-বিরোধী তত্ত্বের পছন্দমতো অংশ সে গ্রহণ করতে দ্বিধা করে না। এ প্রবণতা কেবল সাধারণের ক্ষেত্রে নয়। ইতিহাসে প্রখ্যাত অনেক চিন্তাবিদের মধ্যেও বিভিন্ন মত সমন্বয়ের প্রয়াস দেখা যায়। বিভিন্ন মতের সমন্বয়কে একটা প্রবণতা হিসাবে ব্যাখ্যা করাই সঙ্গত। সর্বমতের সমন্বয় মারফত কোনো ঐক্যবদ্ধ সামঞ্জস্যপূর্ণ তত্ত্ব দাঁড় করানো সম্ভব নয়। যাঁরা এরূপ চেষ্টা করেন, তাঁদের মধ্যে মানুষের কল্যাণ সাধনের একটা সহজ আবেগই বেশি কাজ করে। তাঁরা মনে করেন, সত্য কোনো একটি তত্ত্বের মধ্যে নিহিত না থেকে সমস্ত তত্ত্বেই আংশিকভাবে প্রকাশিত হতে পারে। সত্যসন্ধানীর কাজ হবে সমস্ত ক্ষেত্র থেকে অংশসমূহকে একত্র করে সত্যের একটি সমগ্র-সত্তা তৈরি করা। এরূপ ইচ্ছার মধ্যে কল্পনার প্রকাশই বেশী। ফলে, সমন্বয়বাদী তত্ত্বের একটির সাথে অপরটির সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া যায় না। সমন্বয়বাদীর মতে পুঁজিবাদ ও সমানতন্ত্রবাদ, বস্তুবাদ ও ভাববাদ একই সময়ে গ্রাহ্য বলে বিবেচিত হতে পারে। সমন্বয়বাদী মনে করে, সমাজতন্ত্রবাদ এবং পুঁজিবাদ মিলিয়ে সর্বসমস্যার সমাধান করা যেতে পারে। আধুনিককালের ন্যায় দর্শনের ইতিহাসে অতীতকালেও এরূপ সমন্বয়বাদী লেখক ও দার্শনিকের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। প্রাচীন রোমের বাগ্মী ও দার্শনিক সিসিরো (১০৬-৪৩ খ্রি পূ.) এরূপ সমন্বয়বাদী বলে প্রখ্যাত। সমন্বয়বাদের মনোভাব থেকে তিনি মতামত-নিরপেক্ষভাবে প্রাচীন গ্রিকদর্শনের সর্বপ্রকার দার্শনিক মতকে রোমকদের কাছে পেশ করার চেষ্টা করেন।
Economism: অর্থবাদ
শ্রমিক আন্দোলনে রাজনৈতিক সংগ্রাম পরিত্যাগ করে আংশিক আর্থিক দাবি আদায়ের প্রবণতাকে অর্থবাদ বলে আখ্যায়িত করা হয়। ১৯১৭ সালে সংঘটিত রুশ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পূর্বে আন্দোলনের মধ্যে অর্থবাদ একটি বিতর্কিত ধারা ছিল। লেনিনের অনুসারী বলশেভিকগণ নরমপন্থীদের বিরুদ্ধে অর্থবাদের অভিযোগ আনেন। এঁদের মতে অর্থবাদের অনুসারীগণকে সমাজতন্ত্রবাদী বলা চলে না। কেননা, সমাজতন্ত্রবাদের আন্দোলন কেবলমাত্র শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির আন্দোল নয়। সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন শ্রমিকদের নেতৃত্বে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠারও আন্দোলন। শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলন দ্বারা শ্রমিকদের মুক্তি সম্ভব নয়। রুশ বলশেভিক সংগঠনের মধ্যে কারা অর্থবাদী এবং তাদের মত কিরূপে সমাজতন্ত্রী আন্দোলনের জন্য ক্ষতিকর, তার বিশ্লেষণ করে লেনিন ‘কি করণীয়’ নামক পুস্তক রচনা করেন। শ্রমিক আন্দোলন এবং সমাজতান্ত্রিক সংগ্রাম আজ কোনো বিশেষ দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। একে একটি আন্তর্জাতিক ধারা বলে অভিহিত করা চলে।
Economic Determinism: অর্থনৈতিক নির্ধারণবাদ
মার্কসবাদের সমালোচকগণ ইতিহাসের মার্কসীয় ব্যাখ্যাতা স্থুলভাবে ‘অর্থনৈতিক নির্ধারণবাদ’ বলে অভিহিত করেন। তাঁদের মতে মার্কসবাদ ইতিহাসের মূল চালক-শক্তি হিসাবে কেবল আর্থনীতিক শক্তি তথা উৎপাদন ব্যবস্থার উপর জোর দেয়, মানুষের উপর ভাব তথা সাহিত্য, সংস্কৃতি, বিশ্বাস ইত্যাদির প্রভাবকে অস্বীকার করে। মার্কসবাদীগণ এরূপ সমালোচনাকে মার্কসবাদের স্থূল ব্যাখ্যা মনে করেন। মার্কস-এঙ্গেলস তথা মার্কসবাদের প্রবক্তাদের মতে মানুষের জীবনে এবং তার ইতিহাসের বিকাশে মানুষেল জীবন ধারণ তথা তার জীবিকার ক্ষেত্রে বিদ্যমান এবং বিকাশমান উৎপাদনের উপায় এবং উৎপাদের সম্পর্ক মূল শক্তি হিসাবে কাজ করে। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, মানুষের জীবন স্থূলভাবে উৎপাদনের প্রক্রিয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। উৎপাদনের উপায়কে উন্নত এবং পরিবর্তিত করার জন্যই মানুষের চিন্তা ভাবনা এবং তার থেকে উদ্ভুত বিজ্ঞান, সাহিত্য, সংস্কৃতি, বিশ্বাস। উৎপাদনের উপায়ের সঙ্গে এগুলি দ্বান্দ্বিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার সম্পর্কে সম্পর্কিত। উৎপাদনের উপায় ও সম্পর্ক যেমন সমাজের ভাবগত সৃষ্টিগুলির উৎস এবং তাদেরকে প্রভাবিত করে, মানুষের ভাবনা, চিন্তা, বিশ্বাস, আবিস্কারও উৎপাদনের উপায় ও সম্পর্ককে তেমনি প্রভাবিত এবং পরিবর্তিত করে। কাজেই এ তত্ত্বকে কেবল অর্থনৈতিক নির্ধারণবাদ কিংবা মানুষের ভাবকে অস্বীকারমূলক তত্ত্ব বলে আখ্যায়িত করা ভুল।
Eleatics: ইলিয়া-দর্শন
খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ ও পঞ্চম শতকে দক্ষিণ ইতালির ইলিয়া নামক দ্বীপটি প্রাচীন গ্রিক দর্শনচর্চার একটি কেন্দ্র হিসাবে প্রসিদ্ধি লাভ করে। জেনোফেন্স, পারমিনাইডিস, জেনো এবং মিলিসাস এই দ্বীপের অধিবাসী ছিলেন। তাঁদের দার্শনিক অভিমতসমূহ ইলিয়া দ্বীপের দর্শন নামে খ্যাতি লাভ করে। জীবন এবং জগৎ সম্পর্কে উপরোক্ত দার্শনিককের মতের একটি ঐক্য এই ছিল যে, এঁরা সকলেই মনে করতেন, সৃষ্টির মূল সত্তা অপরিবর্তনীয়। বস্তুর মধ্যে যে পরিবর্তন মানুষের ইন্দ্রিয়গোচর এটা বাহ্য এবং মায়া। পরিবর্তন এবং বৈচিত্র্য সৃষ্টির মূল সত্তার ক্ষেত্রে আদৌ প্রযোজ্য নয়। বিচিত্র বাহ্যবস্তুর মূলে একটিমাত্র সত্তা বিরাজমান। ইলিয়া দার্শনিকদের এই একত্ববাদী চিন্তা প্রাচীন দর্শনের ভাববাদী ধারার সূচনা করে। এতদিন পর্যন্ত গ্রিসের হিরাক্লিটাস এবং অন্যান্য দার্শনিক সৃষ্টির মূলে একটি বদলে একাধিক সত্তার কল্পনা করেছেন। বিশেষ করে মাটি, জল, বায়ু এবং অগ্নি প্রভৃতিকে সৃষ্টির মূল বলে তাঁরা আখ্যায়িত করেছেন। এই বহুত্ববাদী চিন্তাকে ইলিয়া দার্শনিকগণ নাকচ করে এরূপ অভিমত প্রকাশ করেন যে, সৃষ্টির মূল সত্তা এক, অবিভাজ্য, অপরিবর্তনীয় –স্থির এবং অসীম। ইলিয়া দর্শনের পরবর্তীযুগ খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ এবং তৃতীয় শতকে প্লেটো এই চিন্তাকেই অধিকতর সূক্ষ্ম যুক্তির মাধ্যমে এক অ-বস্তুমূলক, অসীম, অক্ষয় এবং অজ্ঞেয় ভাবকে সমস্ত প্রকাশের মূল বলে ঘোষণা করেন। ইলিয়ার দার্শনিকগণ বস্তুর বৈচিত্র্য এবং পরিবর্তনকে অস্বীকার করে জ্ঞানের ক্ষেত্রে কার্যত ইন্দ্রিয় অর্থাৎ চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহবা, ত্বক ইত্যাদি মাধ্যমের নির্ভরযোগ্যতাকে অস্বীকার করেন এবং জ্ঞানকে অতীন্দ্রিয় বিষয় বলে মনে করেন।
Einstein: আলবার্ট আইনস্টাইন (১৮৭৯-১৯৫৫ খ্রি.)
আধুনিক বিজ্ঞানের বিখ্যাত ‘রিলেটিভিটি’ বা আপেক্ষিকতা তত্ত্বের প্রবক্তা। ধর্মগতভাবে আইনস্টাইন ছিলেন ইহুদী। তাঁর পিতামাতা তার শিশু বয়সে জার্মানির মিউনিকে আসেন। পরবর্তীতে তাঁর পরিবার ইতালির মিলানে যান। শিক্ষা জীবন আঙ্কশাস্ত্র এবং পদার্থবিদ্যা অধ্যয়ন করেন। কিছুকাল একটি স্কুলে অঙ্কের শিক্ষকতা করেন। পরবর্তীকালে বার্লিনে একটি পরিবারে গৃহশিক্ষকতাও করেন। ১৯০৫ সনে আইনস্টাইন আলোর রূপান্তর বা ট্রান্সফরমেশন অব লাইট, অণুর মাত্রা বা মলিক্যুলার ডাইমেনশনস, গতিময় পদার্থের তড়িৎ প্রবাহ বা ইলেকট্রো ডাইনামিকস অব মুভিং বডিস প্রভৃতি বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ব্যাখ্যা করে নিবন্ধাদি প্রকাশ করেন। এই সূত্রে ম্যাক্স প্লাক্সের সঙ্গে তার সম্পর্ক ঘটে। ১৯০৯ সনে আইনস্টাইন জুরিকে তাত্ত্বিক পদার্থের বিশেষ অধ্যাপক নিযুক্ত হন। ১৯১৪ সনে তিনি বার্লিনের কাইজার ফিজিক্যাল ইনস্টিটিউটের পরিচালক নিযুক্ত হন। ১৯৩৩ সনে হিটলারের নাজিবাদের ইহুদী বিদ্বেষের কারণে উক্ত পদ থেকে অপসারিত হন এবং জার্মানি যুক্তরাষ্ট্রে গমন করেন এবং নিউজার্সির প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপকের পদ লাভ করেন। আইনস্টাইনের তত্ত্ব সাধারণভাবে ব্যাখ্যা করা কঠিন। তবে একথা বলা যায় যে, আলোর বিকিরণ তত্ত্বে তিনি সময় এবং স্থানের আপেক্ষিকতা দ্বারা নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করেন।
তাঁর মতে সময় এবং স্থান কোনো দ্রষ্টা-নিরপেক্ষ সত্তা নয়। আইনস্টাইনের তত্ত্ব আধুনিক দর্শন এবং বিজ্ঞানের সকল ক্ষেত্রকেই প্রভাবিত করেছে। বৈজ্ঞানিক গ্রন্থসমূহের বাইরে সাধারণ পাঠকের জন্যও তিনি সমকালের বিভিন্ন সমস্যার উপর চিন্তা করেছেন এবং গ্রন্থ রচনা করেছেন। যুদ্ধের বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান ছিল দ্বিধাহীন এবং সুস্পষ্ট। ১৯৩৩ সনে ফ্রয়েডের সঙ্গে যুক্তভাবে শান্তির উপর তিনি যে গ্রন্থ প্রকাশ করেন তার নাম ‘যুদ্ধ কেন?’ ‘হোয়াই ওয়ার’। ১৯৩৪ সনে প্রকাশিত হয় তাঁর ‘আমার দর্শন’ নামক গ্রন্থ। প্রখ্যাত বাঙালি বৈজ্ঞানিক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এককালীন পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ বসু (১৮৯৪-১৯৭৪) তাঁর ইউরোপে গবেষণা কর্মে নিযুক্ত থাকা কালে আইনস্টাইনের সাহচর্যে আসেন। আইনস্টাইন ১৯২৪ সনে অধ্যাপক বসুর ‘প্ল্যাঙ্ক সূত্র এবং কোয়াণ্টাম প্রকল্প’ প্রবদ্ধটি পাঠ করে চমৎকৃত হন এবং সেটি নিজে জার্মান ভাষায় অনুবাদ করে প্রকাশ করেন। এই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিটি বোস আইনস্টাইন সংজ্ঞা নাম প্রসিদ্ধি লাভ করে।
Elements: মূল, মূল উপাদান, মৌল পদার্থ
দৃশ্যত বস্তু বিভিন্ন আকারের এবং বহু প্রকারের। দূর অতীতেও মানুষ স্বাভাবিকভাবে এই বহুর পেছনে বহুর উৎস বা কারণ হিসাবে একটি মূলের সন্ধান করেছে। কিন্তু বিচিত্রের মূলে মাত্র একটি সত্তা আছে, এ সিদ্ধান্ত মানুষ শুরুতেই করতে পারে নি। তবে বাহ্যত যত প্রকার বস্তু দেখা যায়, সবই মূল নয়, এ ধারণা মানুষ বাহ্য বস্তুর দ্রুত পরিবর্তন, রূপান্তর বা বিলুপ্তি করার চেষ্টা করে। এরূপ চেষ্টার সাক্ষাৎ পাওয়া যায় বিশেষভাবে প্রাচীন গ্রিস এবং ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে। প্রাচীন ভারতীয় দার্শনিকগণ ক্ষিতি (মাটি), অপ (জল), তেজ (অগ্নি), মরুৎ (বায়ু) এবং ব্যোম (আকাশ)-কে বিশ্বের মূল বলে মনে করতেন। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিকগ৯ণ বস্তুর বদলে তাপ-শৈত্য, আর্দ্রতা-শুষ্কতা প্রভৃতি বিপরীত গুণকে সমস্ত সৃষ্টির একক বলে কল্পনা করেছেন। এই সমস্ত বিপরীত ধর্ম বা গুণের সংযোগে সমস্ত রকম বস্তু বা সৃষ্টির প্রকাশ। খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ ও তৃতীয় শতকে গ্রিক দার্শনিক ডিমোক্রিটাস এবং এপিক্যুরাস বস্তুর মূলে অণুর অস্তিত্বের তত্ত্ব তৈরি করেন। তাঁদের মতে, অণু হচ্ছে বস্তুর সূক্ষ্মতম এবং অবিভাজ্য মৌলিক উপাদান। অণুর সংযোগই বস্তুর বৈচিত্রের সৃষ্টি। এ আলোচনা থেকে বুঝা যাচ্ছে যে, বস্তুর মূল সম্পর্কে ধারণা মানুষের জ্ঞানের বিকাশের সাথে জড়িত। জ্ঞানের প্রাথমিক অবস্থাতে সৃষ্টির মূল উপাদান সম্পর্কে মানুষের যে ধারণা ছিল, জ্ঞানের বিকাশ এবং বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে সে ধারণা বিভিন্ন পর্যায়ে পরিবর্তিত হয়েছে। এই বিবর্তনের একটা বিষয় লক্ষণীয়। বস্তুর মূল কি, অর্থাৎ বস্তুর প্রকৃতি স্থির করার গবেষণার মানুষ একদিকে যেমন জটিলতাহীন এবং অবিভাজ্য কোনো এককের সন্ধান লাভের আকাঙ্ক্ষা পোষণ করেছে তেমনি গবেষণার বাস্তব অভিজ্ঞতা মানুষকে ক্রমান্বয়ে এই সত্য স্বীকারে বাধ্য করেছে যে, বস্তু এক অসীম জটিল অস্তিত্ব। কারণ, মানুষ মূলে অবিভাজ্য কোনো এককের আবিস্কার করতে আজো সক্ষম হয় নি। উনিশ শতকের পূর্ব পর্যন্ত বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও ধারণা ছিল যে, বস্তুর মূলে একক হিসাবে অপরিবর্তনীয় অবিভাজ্য কোনো উপাদান আছে। কিন্তু উনিশ শতকের বৈজ্ঞানিক আবিস্কারসমূহ, বিশেষ করে পদার্থ-বিজ্ঞান বস্তুর সেই পুরাতন ধারণাকে একেবারেই নাকচ করে দিয়েছে। আধুনিক পদার্থ বিজ্ঞানের কাছে বস্তুর মূল বলে যে ইলেকট্রন, প্রোটেন এবং নিউট্রন বিবেচিত হয়, তাদের গঠনও অশেষ জটিলতাপূর্ণ। আধুনিক দর্শনের ক্ষেত্রে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুরবাদ বস্তুর মূল সত্তাকে সদা দ্বান্দ্বিক বা বিরোধাত্মক ধারায় পরিবর্তনশীল অস্তিত্ব বলে বিবেচনা করে। ভ্রাদিমির লেনিন তাঁর ‘ম্যাটেরিয়ালিজম এ্যাণ্ড এমপিরিও ক্রিটিসিজম’ গ্রন্থে বর্তমান শতকের গোড়ার দিকে এরূপ উক্তি করেছিলেন যে, ‘এ্যাটমের ন্যায় ইলেকট্রন হচ্ছে অসীম সম্ভাবনাময় এবং বিশ্বজগতের কোনো শেষ নেই’।
Elite, Elitism: এলিট, অভিজাত, এলিটবাদ, নয়া-অভিজাতবাদ
আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী তাত্ত্বিকদের মধ্যে আলোচিত একটি তত্ত্ব হচ্ছে এলিট তত্ত্ব। ‘এলিট’ শব্দের অর্থ শ্রেষ্ঠ। এ থেকে এলিটবাদকে শ্রেষ্ঠত্ববাদ কিংবা নয়া অভিজাতবাদ বলেও অভিহিত করা চলে। এই তত্ত্বের প্রধান প্রবর্তন হিসাবে ইতালির ভিলফ্রেডো পারেটো (১৮৪৩-১৯২৩) এবং গায়টানো মসকা পরিচিত। এ সমস্ত চিন্তাবিদ প্রধানত অযুক্তি এবং শক্তিবাদী তত্ত্বে বিশ্বাসী। মানুষের চরিত্রের মধ্যে অযুক্তি এবং শক্তির প্রতি আকর্ষণমূলক প্রবণতার উপর এঁরা জোর প্রদান করেন। এঁদের মতে প্রকৃতি মানুষকে সমাজ হিসাবে তৈরি করে নি। মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই নানা গুণের ভিত্তিতে ‘এলিট’ বা শ্রেষ্ঠ এবং ‘অ-এলিট’ বা ‘অ-শ্রেষ্ঠ’ হিসাবে বিভক্ত। এবং সমাজের নেতৃত্ব কিংবা রাষ্ট্র শাসন উভয় ক্ষেত্রে চিরকাল যারা বিদ্যা, বুদ্ধি, চাতুর্য, কূট-কৌশল দৈহিক শক্তি ইত্যাদি গুণে শ্রেষ্ঠ তারা শাসন করে এসেছে এবং ভবিষ্যতেও এরাই শাসন করবে। এই শ্রেষ্ঠ অংশ অবশ্যই সংখ্যালঘু। সংখ্যায় তারা অল্প। সেদিক থেকে অল্পরাই অধিকের উপর শাসন করে। এরূপ তত্ত্বের অপর এক সমর্থক রবার্ট মিশেল-এর মতে মানুষেল জীবনে অল্পের শাসন হচ্ছে নিয়মের অমোঘ বিধান। তাঁর এরূপ অভিমত ‘আয়রন ল অব অলিগার্কী’ বা ‘কতিপয়ের লৌহ বিধান’ বলে পরিচিত। প্রাচীনকালে প্লেটো-এ্যারিস্টটলও মানুষের বিদ্যাবুদ্ধিগত গুণের উপর জোর দিয়ে মানুষের একাংশকে অভিজাত বলে অভিহিত করতেন। তার ভিত্তিতে ‘অভিজাততন্ত্র’ বলে এক প্রকার শাসন ব্যবস্থাকেও তাঁরা নির্দিষ্ট করেন। কিন্তু সে বর্তমান কালের এলিটবাদ বা শ্রেষ্ঠত্ববাদ কেবল মহৎ গুণের দ্বারা বিভক্ত করা অর্থহীন। চোর কিংবা ডাকাতের দক্ষতাও দক্ষতা, রাজনীতিকদের মধ্যে বাগ্মী বা কৌশলী রাজনীতিকের দক্ষতাও দক্ষতা। এদিক থেকে মানুষেল যে-কোন পেশা বা গোষ্ঠীর মধ্যেই ‘শ্রেষ্ঠ’ ‘অ-শ্রেষ্ঠ’ বলে ভাগ থাকে। এবং প্রত্যেকটি অংশের শ্রেষ্ঠরাই তথা অল্পরাই শাসন করে এবং অ-শ্রেষ্ঠ তথা সংখ্যাধিকেরা শাসিত হয়। শাসনের ক্ষেত্রে এলিটদের দুই নামে অভিহিত করা চলে। যারা শাসকমণ্ডলীল অন্তর্গত তারা ‘পাওয়ার এলিট’ বা ‘শাসক-এলিট’ এবং যারা ‘শাসনের বাইরে অবস্থিত’ তারা ‘অ-শাসক’ বা ‘নন পাওয়ার এলিট’ বলে অভিহিত। এর ভিত্তিতে এদের তত্ত্বে ‘এলিট সঞ্চালন’ বা সারকুলেশন অব এলিট’ কথাটি এসেছে। শাসনের বাইরে এলিটরা শাসনের ভেতরে যাওয়ার চেষ্টা করে। কালক্রমে শাসক-এলিটরা অ-শাসক এলিট দ্বারা স্থানচ্যুত হয়। এই প্রক্রিয়া অব্যাহতভাবে চলতে থাকে। সমাজকে শ্রেষ্ঠ, অ-শ্রেষ্ঠ এবং সংখ্যাল্প ও সংখ্যাধিকে বিভক্ত করার তত্ত্ব কোনো মৌলিক বা বিশ্লেষণমূলক তত্ত্ব নয়। এর মাধ্যমে মানুষের সমাজের সংকটের চরিত্র অনুধাবনে তেমন কোনো সুবিধা হয় না। বাহ্যত বিবরণমূলক এবং নীৎসের শক্তিবাদের সমর্থক এ তত্ত্বের লক্ষ্য হচ্ছে সমাজ পরিবর্তনের আশাবাদী চিন্তাকে নস্যাৎ করা। এর আক্রমণের প্রধান বিষয় হচ্ছে আধুনিক গণতান্ত্রিক এবং সাম্যবাদী চেতনা। মার্কসবাদী শ্রেণী বিশ্লেষণকে এ তত্ত্ব নাকচ করার চেষ্টা করেছে। এবং শক্তিবাদী এই তত্ত্বের অনুসরণেই বিংশ শতকে ইতালি, জার্মানি, জাপান প্রভৃতি রাষ্ট্রের সামন্তবাদী ও একচেটিয়া পুঁজিবাদী শ্রেণীসমূহ ফ্যাসিবাদ, নাজীবাদ ও সমরবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার উদ্ভব ঘটায়।
Emergent Evolution: আকস্মিক বিকাশ, আকস্মিক বিবর্তন
দ্র: Accidental Evolution
Emotion: আবেগ, প্রক্ষোভ
ব্যক্তির মানসিক অবস্থাবিশেষ। ব্যক্তি তার পরিবেশ অর্থাৎ অপর ব্যক্তি ও বস্তুর সঙ্গে সতত একটা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সম্পর্কে সম্পর্কিত। এই ক্রিয়া-প্রক্রিয়া মানসিক অবস্থায় যখন কোনো ব্যতিক্রমের উদ্ভব ঘটায়, তখন তাকে মনের আবেগ বা প্রক্ষোভ বলে অভিহিত করা হয়। আবেগ মনোবিজ্ঞানের একটি ব্যাপকার্থক শব্দ। এর মাধ্যমে আমরা পরিবেশ অর্থাৎ অপর ব্যক্তি এবং বস্তুজগৎ বা ঘটনার সঙ্গে আমাদের বিশেষ প্রতিক্রিয়াজনিত একটা অবস্থাকে বুঝাই। ব্যক্তি তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দ্বারা পরিবেশের সঙ্গে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সম্পর্কে সম্পর্কিত হয়। কিন্তু ব্যক্তির ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া কেবল যান্ত্রিক নয়। ব্যক্তির ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার পেছনে মানসিক ইচ্ছা-অনিচ্ছা এবং সে ইচ্ছা-অনিচ্ছার আগ্রহ, তীব্রতাও কাজ করে। ব্যক্তির দৈহিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে মানসিক ইচ্ছা-অনিচ্ছা ইত্যাদির ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের উপর প্রাচীন গ্রিসে খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতকের জ্ঞানী এমপিডোকলিসকে আলোকপাত করতে দেখা যায়। যে-কোনো প্রকার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার নিয়ন্ত্রণকারী হিসাবে আবেগের ভূমিকা মানুষের জীবনে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত সক্রিয় আবেগ এবং নিরানন্দ বা বিমর্ষতা উৎপাদক আবেগকে নিষ্ক্রিয় আবেগ বলা হয়। আবেগ শুধু মনের ব্যপার নয়। আবেগের ফলে মস্তিষ্ক এবং দেহের বিভিন্ন অংশে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। দেহের আভ্যন্তরিক এবং প্রতিক্রিয়া ব্যতীত মনের আবেগের উদ্ভব সম্ভব নয়। মন যখন আনন্দিত হয় দেহের রক্ত সঞ্চালন, পেশির সম্প্রসারণ, ক্রিয়াশীলতা প্রভৃতি তখন বৃদ্ধি পায়। এর ফলেই সক্রিয় আবেগে মনের কোনো সিদ্ধান্ত বাস্তবে কার্যকর করতে দেহ অধিক শক্তি প্রয়োগ করতে সক্ষম হয়। নিষ্ক্রিয় আবেগ দেহকে আড়ষ্ট করে তার প্রতিক্রিয়ার ক্ষমতা হ্রাস করে দেয়। এ কারণে নিরানন্দ, কোনো দুঃখজনক বা ভীতিজনক ঘটনার প্রতিক্রিয়ার ব্যক্তি অনেক সময়ে যুক্তিগতভাবে প্রয়োজনীয় কাজ সমাধা করতে কিংবা উপযুক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণে অক্ষম হয়।
দেহের সঙ্গে আবেগের আত্যন্তিক সম্পর্ক আধুনিক মনোবিজ্ঞানে যান্ত্রিক উপায়ে নির্ধারণযোগ্য বিষয় বলে গণ্য করা হয়। আবেগকে বিশ্লেষণ করে তার অন্তর্ভুক্ত মেজাজ, আধান বা সঞ্চারণ, বৈশিষ্ট্য এবং অতিরাগ নির্দিষ্ট করা হয়। অতিরাগ আর মেজাজের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে এই যে, মেজাজের স্থায়িত্ব আধান ও প্রতিক্রিয়া সঞ্চারী মানসিকতার চেয়ে অধিককাল স্থায়ী। প্রতিক্রিয়ার সিদ্ধান্তটি ক্ষণমুহুর্তের হতে পারে। বিশেষ মেজাজ অর্থাৎ আনন্দ-নিরানন্দজনক মানসিকতার মধ্যে বিশেষ সিদ্ধান্ত মুহুর্তের উদ্ভব হয়। অতিরাগ বা প্যাশনকে অধিকতর স্থায়ী আবেগ বলে মনে করা হয়। মানুষের আবেগ মহৎ কিংবা অমহৎ বলেও বিভক্ত হতে পারে। নীতিবোধ, দায়িত্বজ্ঞান, আত্মোৎসর্গ, সমষ্টির জন্য ব্যক্তির স্বার্থ বিসর্জন, মর্যাদাবোধ ইত্যাদিও মানুষের মহৎ আবেগ। মনোবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে উইল হেলম ভুনড-কে (১৮৩২-১৯২০ খ্রি.) বৈজ্ঞানিক মনোবিদ্যার প্রতিষ্ঠাতা বিবেচনা করা হয়। ভুনড-এর মতে ব্যক্তির যে-কোন প্রতিক্রিয়া বা আচরণেই একটি আবেগগত দিক আছে। আধুনিক মনোসমীক্ষার মতে আনন্দ, বেদনা, প্রেম-ভালবাসা, ঘৃণা বিদ্বেষ সবই আবেগ। এবং মানুষ যে কেবল সচেতন অবস্থাতেই আবেগ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় তাই নয়। কোনো আবেগকে দমন করার প্রচেষ্টাও যেমন ব্যক্তির জীবনে সেই আবেগের প্রভাব নির্দেশ করে, তেমনি কোনো অবদমিত আবেগ ব্যক্তির অগোচরে এবং তার অবচেতনে সক্রিয় থেকে তার কোনো বিশেষ বা সমগ্র জীবনকেও প্রভাবিত করতে পারে। অবদমিত যৌনানুভূতির ভিন্নতার প্রকাশের মাধ্যমে ব্যক্তির জীবনে অনেক সময়ে কার্যকর হওয়া এর একটি প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। মনসমীক্ষণবিদ ফ্রয়েডের গবেষণা মানুষের আবেগের জগৎকে মনোবিজ্ঞানের এক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয়ে পরিণত করেছে।
Empedocles: এমপিডকলিস (৪৮৩-৪২৩ খ্রি.)
প্রাচীন গ্রিসের অন্যতম কবি, বৈজ্ঞানিক এবং বস্তুবাদী দার্শনিক। তাঁর মৃত্যু সম্পর্কে এরূপ কাহিনী আছে যে, তিনি ইটনা পর্বতের গহ্বরের মধ্যে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। ‘প্রকৃতি’ নামে তাঁর বিখ্যাত দার্শনিক কবিতার মধ্যেই এমপিডকলিস নিজের দার্শনিক অভিমতসমূহ প্রকাশ করেন। তাঁর দর্শনের মধ্যে পূর্বগামী দার্শনিক পাইথাগোরাস, হিরাক্লিটাস এবং পারমিনাইডসের ভাবধারার সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। এঁরা সকলেই সেকালের বস্তুবাদী বা প্রকৃতিবাদী দার্শনিক ছিলেন। এঁদের সকলের মতামতই এমপিডকলিস কমবেশী গ্রহণ করেন। পারমিনাইডিসকে স্বীকার করে এমপিডকলিস বলেনঃ বস্তু হচ্ছে অ-সৃষ্ট অর্থাৎ বস্তুর কোনো স্রষ্টা নেই এবং বস্তুর কোনো বিলয় নেই। হিরাক্লিটার্স বলেছিলেন বস্তুর ক্ষেত্রে বিরামহীন গতি আর পরিবর্তনই একমাত্র সত্য। বস্তু অ-সৃষ্ট এবং পরিবর্তনশীল এই দুই অভিশতকে সংযুক্ত করে এমপিডকলিস বলেন যে, দৃশ্যবস্তুপুঞ্জের মধ্যে পরিবর্তন আছে, তার সৃষ্টি এবং লয় দেখা যায় একথা সত্য; কিন্তু দৃশ্যবস্তু মূলত যে সত্তা বা উপাদানে গঠিত তার কোনো শুরু, শেষ বা পরিবর্তন নেই। বস্তুর মূলে রয়েছে চারটি সত্তা যথা, মাটি, পানি, বাতাস এবং আগুন। দৃশ্যবস্তুর সৃষ্টি, লয় এবং পরিবর্তন সাধিত হয় বস্তুর মৌলিক উপাদান মাটি, বায়ু, পানি আর আগুনের পারস্পরিক সংযোজন এবং বিয়োজনের মাধ্যমে। সংযোজন এবং বিয়োজন আকর্ষণ এবং বিকর্ষণ, প্রেম, অ-প্রেম, ভালবাসা, ঘৃণা বস্তুর মূল উপাদানের মধ্যে সতত সংঘাতের মাধ্যমে ক্রিয়াশীল। সংযোজন, আকর্ষণ, প্রেম, ভালবাসা যেখানে জয়ী, সেখানে সৃষ্টি এবং বৃদ্ধি। আর বিয়োজন, বিকর্ষণ, ঘৃণা যেখানে জয়ী সেখানে ক্ষয় এবং ধ্বংস। আকর্ষণ বিকর্ষণের তত্ত্বের ভিত্তিতে এমপিডকলিস প্রকৃতির ক্ষেত্রে তাঁর বৃত্তের তত্ত্বও তৈরি করেন। আকর্ষণ বা প্রেম জয়ী হতে হতে ক্ষুদ্রকে মহৎ করে, অসম্পূর্ণকে সম্পূর্ণ করে। কিন্তু এ অবস্থাও স্থায়ী হতে পারে না। সম্পূর্ণের মধ্যে আবার বিকর্ষণ, ঘৃণা বা অ-প্রেম উদ্ভুত হয়। ক্রমান্বয়ে ঘৃণা প্রেমকে পরাভূত করে বৃহৎকে ক্ষুদ্র করে এবং সম্পূর্ণকে অসম্পূর্ণতে পর্যবসিত করে। এই তত্ত্বের মধ্যে প্রকৃতির জগতের দ্বান্দ্বিক গতির স্পষ্ট স্বীকৃতি পাওয়া যায়। কিন্তু কেবল চক্রাকারে আবর্তন নয়। এমপিডকলিস এরূপও মনে করতেন যে, প্রাকৃতিক জগতের একটা বিকাশও আছে। স্বধর্মী অস্তিত্বের মধ্যে পারস্পরিক আকর্ষণ ও সংযোজন বিকর্ষণের চেয়ে অধিকতর শক্তিশালী অস্তিত্ব সৃষ্টি করে, বিকর্ষণকে পরাভূত করে, আকর্ষণ ও প্রেম সৃষ্টিকে ধারাবাহিকভাবে রক্ষা করে চলে। এমপিডকলিসের এরূপ চিন্তার মধ্যে আধুনিক বিবর্তনবাদের পূর্বাভাস পাওয়া যায়।
Empiricism: অভিজ্ঞতাবাদ
‘অভিজ্ঞতাবাদ’ হচ্ছে একটি জ্ঞান-তত্ত্ব। মানুষের জ্ঞানের উৎস কি এবং জ্ঞানের ক্ষমতা এবং সীমাবদ্ধতা কি, এ বিষয়ে দর্শনে বিভিন্ন তত্ত্ব আছে। সাধারণভাবে অভিজ্ঞতাবাদ বলতে এরূপ তত্ত্বকে বুঝায় যে, মানুষের ইন্দ্রিয়-অভিজ্ঞতাই হচ্ছে জ্ঞানের একমাত্র উৎস। তবে অভিজ্ঞতা কথাটি দর্শনে একটি ব্যাপক ব্যবহৃত শব্দ। ভাববাদ এবং বস্তুবাদ উভয় তত্ত্বে অভিজ্ঞতার ব্যবহার দেখা যায়। কিন্তু ভাববাদের অভিজ্ঞতার অর্থ এবং বস্তুবাদের অভিজ্ঞতার অর্থ এক নয়।
জ্ঞানের উৎস কি, এটি দর্শনের একটি মৌলিক প্রশ্ন। সাধারণ ভাবকে জ্ঞানের উৎস বলা হয়। কোনো বিশেষ বস্তু সম্পর্কে আমরা যখন কোনো বক্তব্য প্রকাশ করি, তখন সেই বস্তুটির যে ভাব আমাদের মনে থাকে, সেই ভাবটি নিয়েই আমাদের বক্তব্য তৈরী হয়। ‘ওখানে একটি টেবিল আছে’ –এই বক্তব্যটি আমার মনে ‘টেবিলরূপ’ ভাব কিংবা ভাবসমূহের উপর একটি বক্তব্য। দর্শনে প্রথমে প্রশ্ন জাগে, মনের ভাবকে আমরা কিরূপে বা কোথা থেকে লাভ করি। এই প্রশ্নের চিরাচরিত জবাব দেকার্ত প্রমুখ যুক্তিবাদীগণ এভাবে দিয়ে আসছিলেন যে, মানুষের মনে জন্মগতবাবেই কতকগুলো মৌলিক ভাব থাকে। মানুষ এই মৌলিক ভাবগুলো বিধাতার নিকট থেকে প্রাপ্ত হয়। আর জন্মগত এই মৌলিক ভাবগুলোর ভিত্তিতেই মানুষের জ্ঞানমণ্ডল তৈরি হয়। এক কথায় এ তত্ত্ব হচ্ছে মনসর্বস্ব তত্ত্ব। আর এ তত্ত্বে মনের ভাবের উৎস বস্তু বগতের ঊর্ধ্ব কোনো লোক। বাস্তব বা ব্সতু জগতের স্বাধীন অস্তিত্ব এ মতে অস্বীকৃত। বিজ্ঞানের অগ্রগতি জ্ঞানের এ তত্ত্বকে ক্রমান্বয়ে অগ্রাহ্য করে তোলে। এবং এর জোরালো প্রতিবাদ আসে ফ্রান্সিস বেকন (১৫৬১-১৬২৬), হবস (১৫৮৮-১৬৭৯), জন লক (১৪৩২-১৭০৪) প্রমুখ বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিকের কাছ থেকে সপ্তদশ শতকের জন লককেই অভিজ্ঞতাবাদের প্রধান প্রবক্তা মনে করা হয়। ভাব এবং জ্ঞানের উৎস কি এ প্রশ্নে তিনি জোর দিয়ে বলেন যে, ভাবের উৎস হচ্ছে বাস্তব অভিজ্ঞতা। জন্মগতবাবে মানুষের মন আদৌ কোনো ভাব লাভ করে না। জন্মের সময়ে শিশুর মন একখানি ‘ট্যাবুলারাস’ বা ‘নিদাগ শ্লেট’ বৈ আর কিছু নয়। বাস্তব অভিজ্ঞতা ক্রমান্বয়ে এই ‘নিগদাগ শ্লেটে’ ভাবের দাগ এঁকে দেয়। আর সেই ভাবের দাগ দিয়েই মানুষ তার জ্ঞানজগৎ তৈরি করে। জন লকের ‘অভিজ্ঞতাবাদের’ এই বিবরণটি বিশেষ সংক্ষিপ্ত। আসলে তিনি অবিমিশ্র অভিজ্ঞতাবাদী ছিলেন না। অবিমিশ্র অভিজ্ঞতাবাদ দ্বারা জ্ঞানের জটিল প্রশ্নের জবাব দানে অসমর্থ হয়ে তিনি মনের অন্তঃঅনুভূতিকেও ভাবের একটি উৎস বলে স্বীকার করেছিলেন।
এ আলোচনায় দেখা যায় যে, অভিজ্ঞতাবাদ দুরকমের হতে পারে ভাববাদী অভিজ্ঞতাবাদ এবং বস্তুবাদী অভিজ্ঞতাবাদ।
বস্তুবাদী অভিজ্ঞতাবাদের মত অনুযায়ী আমাদের চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহবা, ত্বক –অর্থাৎ ইন্দ্রিয়সমূহ হচ্ছে ভাবের বাহক এবং বস্তুজগৎ হচ্ছে ভাবের উৎসকেন্দ্র। ইন্দ্রিয়জ অভিজ্ঞতাই হচ্ছে জ্ঞানের মূল। ইন্দ্রিয়ের বাইরে কোনো ভাবের সৃষ্টি সম্ভব নয়। এই নিছক অভিজ্ঞতাবাদের দুর্বলতা এই যে, এরূপ তত্ত্ব দ্বারা মানুষের মনের সংশ্লেষণ, বিশ্লেষণ, অনুমান প্রভৃতি জটিল ক্ষমতার ব্যাখ্যা দান সম্ভব নয়। অভিজ্ঞতা জ্ঞানের উৎস বটে, কিন্তু ইন্দ্রিয়জ অভিজ্ঞতার স্তূপই জ্ঞানজগৎ নয়। মানুষের মন ইন্দ্রিয়লব্ধ অভিজ্ঞতাকে ভেঙেচুরে তার জটিল যোগবিয়োগ বস্তু বগতের জ্ঞান তৈরী করেন। মানুষের মনের এই ক্ষমতাকেও স্বীকার করতে হয়। না হলে জ্ঞান কেবল ইন্দ্রিয়ানুভূতির স্তূপে পর্যবসিত হয়।
ভাববাদী অভিজ্ঞতাবাদকে যুক্তিবাদ বলা হয়। ভাববাদের সমস্ত দার্শনিকই জ্ঞানের ব্যাপারে মূলত এই তত্ত্বকে অনুসরণ করেন। এই তত্ত্ব অনুযায়ী বার্কলের ন্যায় ভাববাদীর মতে মনের বাইরে জ্ঞেয় বলে কিছু নেই। মনের ভাবই জ্ঞানের একমাত্র বস্তু। আবার কাণ্ট এবং হেগেলের ন্যায় ভাববাদীদের মতে বস্তুজগৎ আছে বটে, আর সে বস্তুজগৎ আমাদের ইন্দ্রিয়জ অনুভূতির সংশ্লেষণ, বিশ্লেষণ ও উপলব্ধির সূত্র হচ্ছে স্থান, কাল, সম্পর্ক ইত্যাদি সূচক মনের এমত কতকগুলো ভাব যার উৎস হচ্ছে মানুষের অজ্ঞেয়, কিন্তু অনস্বীকার্য এবং অপরিহার্য এক সত্তা।
Empirio-Critism: নব অভিজ্ঞতাবাদ, ইন্দ্রিয়ানুভূতিবাদ
উনিশ শতকের শেষ দিকে ইউরোপে ‘অভিজ্ঞতার সমালোচনা’ নাম দিয়ে আভানারিয়াস (১৮৪৩-১৮৯৬) এবং ম্যাক (১৮৩৮-১৯১৬) একটি দার্শনিক তত্ত্ব দাঁড় করাবার চেষ্টা করেন। বিজ্ঞানের অগ্রগতি, বিশেষ করে বস্তুর মৌল উপাদান সম্পর্কে পদার্থবিজ্ঞানের নবতম গবেষণাসমূহের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে তাঁরা এরূপ অভিমত প্রকাশ করেন যে, বস্তুর স্বাধীন অস্তিত্বকে আর স্বীকার করা চলে না। কাজেই বাস্তব জগতের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে মানুষ জ্ঞান অর্জন করে, যুক্তিগতভাবে একথাও ঠিক নয়। মানুষের জ্ঞান কতকগুলো ইন্দ্রিয়ানুভূতির আকস্মিক সংযোগ এবং বিয়োগ ব্যতীত আর কিছু নয়। বাস্তব জগতে মানুষ যে কার্যকারণের বিধান আরোপ করে তাও মানুষের মানসিক ব্যাপার –বস্তুগত অভিজ্ঞতা নয়। জ্ঞানের ক্ষেত্রে ‘চিন্তার মিতব্যয়িতা এবং অবিচ্ছেদ্যতার সূত্র’ –অবতারণা করে এই মতবাদীগণ বলেন যে, জ্ঞেয় ও জ্ঞাতকে বিচ্ছিন্ন করা চলে না। ইন্দ্রিয়ানুভূতির উপর অতি জোরের জন্য এই মতকে ইন্দ্রিয়ানুভূতিবাদও বলা চলে। তা ছাড়া জ্ঞেয় এবং জ্ঞাতার যে ব্যাখ্যা এঁরা উপস্থিত করতে চেয়েছেন তা ইংল্যাণ্ডের ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকের ব্যাক্তিকেন্দ্রিক ভাববাদের ব্যতিক্রম বৈ নতুন কোনো তত্ত্ব নয়। ১৯০৫ সালের রুশ বিপ্লবের পরাজয়ের পরে প্রতিক্রিয়ার পাল্টা আক্রমণের যুগে রুশ সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীদের একাংশের মধ্যে এই চিন্তা প্রসারলাভ করাতে ভি.আই. লেনিন, ম্যাক এবং অ্যাভানারিয়েসের তত্ত্বকে তীব্রভাবে তাঁর ‘ম্যাটেরিয়ালিজম এ্যাণ্ড এমপিরিও ক্রিটিসিজম’ গ্রন্থে সমালোচনা করেন। লেনিনের মতে, বিজ্ঞানের অগ্রগতি এবং সামাজিক জীবনে বিপ্লবাত্মক পরিস্থিতির বিকাশের মুখে এ তত্ত্ব বিভ্রান্ত মধ্যবিত্তের ঈশ্বরবাদে প্রত্যাবর্তনের একটি আবরণ বিশেষ।
Encyclopadisis: বিশ্বকোষিকবৃন্দ
ফরাসিদেশে অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে মুক্তবুদ্ধি এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিস্তারের জন্য যাঁরা জ্ঞানকোষ রচনা করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন তাঁদের ‘এনসাইক্লোপিডিস্টস’ বা বিশ্বকোষিকবৃন্দ বলা হয়। যুক্তি, বিজ্ঞান, শিল্প সাহিত্যের উপর এই ফরাসি বিশ্বকোষের ১৭টি খণ্ড এবং তিনটি সংযোজনী খণ্ড ১৭৫১-১৭৮০ সনের মধ্যে প্রকাশিত হয়। অষ্টাদশ শতকের ফরাসি বিপ্লবের ভাব ও আদর্শগত পথ উন্মুক্ত করার ক্ষেত্রে এই বিশ্বকোষের এক এতিহাসিক অবদান ছিল। ডি. আলেম্বার্টের সহযোগিতায় চিন্তাবিদ এবং অদমনীয় উদ্যোগী পুরুষ ডিডেরট এই বিশ্বকোষ রচনা প্রচেষ্টার মূল শক্তি হিসাবে ১৭৭২ সন পর্যন্ত সক্রিয় ছিলেন। এই বিশ্বকোষিক চিন্তাবিদদের মধ্যে অপর যাঁরা অন্তর্ভূক্ত ছিলেন তাঁরা হচ্ছেন মণ্টেসক্যু, রুশো, ভলটেয়ার, হলবাক এবং হেলভেটিয়াস।
Engels, Fraderick: ফ্রেডারিক এঙ্গেলস (১৮২০-১৮৯৫ খ্রি.)
আধুনিক সমাজতন্ত্রবাদী আন্দোলন এবং দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদী দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে কার্ল মার্কসের সঙ্গে ফ্রেডারিক এঙ্গেলস –এর নাম যুক্তভাবে উচ্চারিত হয়। চিন্তা, আদর্শ এবং সংগ্রামী আন্দোলনের ইতিহাসে যৌথ প্রয়াস এবং অবিচ্ছিন্ন সাথীত্বের এরূপ দৃষ্টান্ত খুবই বিরল। জার্মানিতে জন্ম হলেও এঙ্গেলস তাঁর সংগ্রামী জীবনের অধিকাংশকাল ইংল্যাণ্ডে অতিবাহিত করেন। ইংল্যাণ্ড আগমন করেন কার্ল মার্কস-এর (১৮১৮-১৮৮৩) সঙ্গে পরিচিত হবার পর থেকে তাঁর আমরণ সংগ্রামী সাথীতে পরিণত হন। কার্ল মার্কস বিপ্লবী চিন্তা এবং আন্দোলনের জন্য জার্মানির তৎকালীন সামন্ততান্ত্রিক সরকার কর্তৃক বহিষ্কৃত হয়ে ইংল্যাণ্ডে নির্বাসিতের জীবন যাপন করেছিলেন। কিমোর বয়স থেকেই এঙ্গেলস চিন্তাধারায় বস্তুবাদী এবং সংগ্রামী অগ্রসর মানুষের পক্ষভুক্ত ছিলেন। ১৮৪২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি জার্মান দার্শনিক শেলিং-এর ভাববাদী দর্শনকে সমালোচনা করে একখানি বই লিখেন। ১৮৪৮-৪৯ খ্রিষ্টাব্দ জার্মানীতে সামন্তবাদের বিরুদ্ধে কৃষক ও শিল্পের শ্রমিকদের বিপ্লবী আন্দোলনের কাল ছিল। এই বিপ্লবী আন্দোলনের পরাজয়ের পরে তিনি দেশ ত্যাগ করে ইংল্যাণ্ড গমন করেন। ধনতান্ত্রিক সমাজের বিকাশে ইংল্যান্ড তখন শীর্ষস্থানে ইংল্যাণ্ডের শিল্পে নিয়োজিত শ্রমিকদের বাস্তব জীবনের সাক্ষাৎ অভিজ্ঞতা এঙ্গেলসকে ধনতন্ত্রবাদের মৌলিক বিরোধ সম্পর্কে নিঃসন্দেহরূপে প্রত্যয়ী করে তোলে। এই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এঙ্গেলস ‘ইংল্যাণ্ডের শ্রমিক শ্রেণীর অবস্থা’ নামে তাঁর অন্যতম বিখ্যাত গ্রন্থ রচনা করেন। ১৮৪৮ খ্রিষ্টাব্দে মার্কসের সঙ্গে যুক্তভাবে তিনি ‘কমিউনিস্ট ইশতেহার’ রচনা করেন। ‘কমিউনিস্ট ইশতেহার’ ছিল তখনকার সাম্যবাদী দলগুলোর ঘোষণাপত্র। কমিউনিষ্ট ইশতেহার তখন থেকে কেবল বিপ্লবী দলের ঘোষণাপত্র নয়, মার্কসবাদী তত্ত্বের স্পষ্টতম এবং অতুলনীয় ঘোষণাসার হিসাবে পৃথিবীময় পরিচিতি আসছে। এঙ্গেলসের আর্থিক আনুকূল্য ব্যতীত মার্কসের পক্ষে ইংল্যাণ্ডে জীবন ধারণ করা এবং তাঁর সমাজবাদী গবেষণা চালানো অসম্ভব হয়ে পড়ত। পুঁজিবাদী সমাজের বিশ্লেষণ ও সমালোচনার গ্রন্থরাজি হিসাবে মার্কসের ‘পুঁজি’ বা ‘ক্যাপিটাল’ সুবিখ্যাত। এ গ্রন্থসমূহের রচনাতে মার্কস এঙ্গেলসের ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা এবং বাস্তব সাহায্য লাভ করেন। মার্কসের মৃত্যুর পরে তাঁর ‘ক্যাপিটালের’ দ্বিতীয় ও তৃতীয় খণ্ডের সম্পাদনা কাজ এঙ্গেলস সমাধা করেন। এই গ্রন্থের ভূমিকা, ‘এ্যাণ্টিডুরিং’, ‘লুডুউইগ ফয়েরবাক’, ‘পরিবার ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি’ প্রভৃতি গ্রন্থ এঙ্গেলস-এর মনীষার উদাহরণ। তাঁর অনবদ্য আকর্ষণীয় রচনা-রীতি মার্কসবাদের সামাজিক বিশ্লেষণ ও দার্শনিক অভিমতসমূহকে জনপ্রিয় করে তুলতে বিরাটভাবে সাহায্য করেছে। তাঁর রচনার বৈশিষ্ট্য এই যে, প্রত্যেক গ্রন্থেই তিনি মার্কসবাদের প্রতিপক্ষীয়দের অভিমতকে খণ্ডন করে ব্যাখ্যার মাধ্যমে মার্কসবাদের তত্ত্বে আপন মনীষার সংযোজন ঘটিয়েছেন। দর্শনের ক্ষেত্রে তিনি প্রচলিত ধারণাকে সমালোচ৬না করে দেখা নযে, দর্শনকে বিজ্ঞানের বিজ্ঞান বা এরূপ অতি-বাস্তব উচ্ছ্বাসমূল আখ্যাদান কৃত্রিম এবং অজ্ঞানতার পরিচায়ক। দর্শন কোনো রহস্যলো কনয়। দর্শনের ভূমিকা হবে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সকল শাখাকে সংযুক্ত করে জানার কৌশল উদ্ভাবনে মানুষকে সাহায্য করা, কোনো অতি-বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব আবিষ্কার নয়। তাঁর সমস্ত গ্রন্থেই তিনি যে-কোনো যুগ বা ব্যক্তির দর্শনের শ্রেণীচরিত্র প্রকাশ করার চেষ্টা করেছেন। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদকে ব্যাখ্যা করে এঙ্গেলস দেখিয়েছেন যে, স্থুল বস্তুবাদ বা ইতোপূর্বকার যান্ত্রিক বস্তুবাদের সাথে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের পার্থক্য আছে। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ মনকে যেমন বস্তুর অতিরিক্ত স্বাধীন কোনো সত্তা বলে স্বীকার করে না, মনকে বস্তুর জটিল বিকাশের বিশেষ পর্যায় বলে বিচেচনা করে, তেমনি মনকে অস্বীকারও করে না। বস্তুর সঙ্গে মনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সম্পর্ককে সে গুরুত্বপূর্ণ বলে গণ্য করে। সমাজে বিকাশে মানুষের জীবিকার ভূমিকা প্রধান; কিন্তু ইতিহাসে ব্যক্তির ভূমিকাকেও মার্কসবাদে নস্যাৎ করে না। জীবিকা যেমন ব্যক্তিকে নিয়ন্ত্রিত করে, তেমনি আবার ব্যক্তিও তার মস্তিষ্ক ও মনের চিন্তা-ভাবনা দ্বারা সেই বাস্তব জীবিকার অবস্থা পরিবর্তন করার ক্ষমতা বহন করে। এঙ্গেলস-এর রচনাবলীতে বস্তু এবং গতি, সময় ও স্থানের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক জ্ঞানের ক্ষেত্রে বাস্তব অভিজ্ঞতার সাথে মনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সম্পর্ক, অজ্ঞেয়বাদের অসারতা, বস্তুর উপাদানের জটিল গঠন এবং তার উন্মোচিত অসীমতা প্রভৃতি বিষয়ের আলোচনা এবং এ সব সমস্যায় তাঁর সুস্পষ্ট মার্কসবাদী অবদানের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়।
Enthymeme: উহ্যবাক্য-যুক্তি, সংক্ষিপ্ত যুক্তি
সংক্ষিপ্ত যুক্তিকে ইংরেজিতে ‘এনথিমেমি’ বলে। একে উহ্যবাক্যযুক্তিও বলা চলে। যুক্তিবিদ্যার অনুমানের, বিশেষ করে অবরোহী অনুমানের প্রধান রীতি হচ্ছে একটি সাধারণ বাক্যের সঙ্গে একটি সাধারণ বা বিশেষ বাক্যের সম্পর্কের ভিত্তিতে একটি অনুমান বা সিদ্ধান্ত গ্রহণ। ইংরেজিতে একে সিলোজিজম বলা হয়।
সকল মানুষ মরণশীল
সক্রেটিস একজন মানুষ
সক্রেটিস মরণশীল
এই দৃষ্টান্তটি অবরোহ যুক্তির সিলোজিজম-এর একটি দৃষ্টান্ত। কিন্তু আমরা সব সময়ে এত সুশৃঙ্খল এবং ধারাবাহিকভাবে যুক্তি প্রদর্শন করি না। অনেক সময়ে মানুষ সংক্ষিপ্ত যুক্তির আশ্রয় গ্রহণ করে। এরূপ সংক্ষিপ্ত যুক্তিতে পূর্ণাঙ্গ যুক্তির কোনো একটি অংশ উহ্য থাকতে পারে। উপরের যুক্তিটি যদি এভাবে বলা হয় যে
সকল মানুষ মরণশীল,
সক্রেটিস মরণশীল
তা হলে যুক্তিটিকে সংক্ষিপ্ত যুক্তি বলা হবে। এখানে দ্বিতীয় বাক্য ‘সক্রেটিশ একজন মানুষ’ উহ্য। এজন্য এরূপ যুক্তিকে উহ্যবাক্য-যুক্তিও বলা যায়। সিলোজিজমে সাধারণ যুক্তির অ-প্রধান বাক্য বলা হয়। সংক্ষিপ্ত যুক্তির মধ্যে প্রধান, অ-প্রধান কিংবা সিদ্ধান্ত যে-কোনো বাক্যকে উহ্য রেখেও কেউ যুক্তি প্রকাশ করতে পারে। ইংরেজিতে প্রধান বাক্য উহ্যসূচক যুক্তিকে প্রথম স্তরের এনথিমেমি বলা হয়। সিদ্ধান্ত বাক্য উহ্য থাকলে, সেটি তৃতীয় স্তরের এনথিমেমি এবং কেবলমাত্র একটি বাক্য দ্বারা যুক্তি গঠন করার চেষ্টা করা হলে তাকে চতুর্থ স্তরের এনথিমেমি বলে।
Epicurus: এপিক্যুরাস (৩৪১-২৭০ খ্রি. পূ.)
প্রাচীন গ্রিসের বস্তুবাদী দার্শনিক এবং নীতিশাস্ত্রের এপিক্যুরিয়ানিজম বা প্রাচীন সুখবাদের প্রতিষ্ঠাতা। প্রাচীন গ্রিসে এপিক্যুরিয়ানিজম-এর প্রতিদ্বন্দ্বী মত ছিল স্টয়েসিজম বা বৈরাগ্যবাদ। এপিক্যুরাস একনিষ্ঠ জ্ঞান-গবেষক ছিলেন। ৩১০ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দে তিনি মাইটিলেন নামক স্থানে তাঁর দর্শনাগারের প্রতিষ্ঠা করেন। সুখবাদ বলতে নির্বিচারে ইন্দ্রিয়াসক্তি এবং স্থূল সুখভোগের ধারণা এপিক্যুরাসের নীতিবাদের সঙ্গে জড়িত হয়ে আছে। কিন্তু এপিক্যুরাসের নিজের জীবনের মিতব্যবহার, সরল জীবন যাপন এবং সুখ সম্পর্কে তাঁর নিজের ব্যাখ্যা এরূপ ধারণাকে মিথ্যা প্রমাণিত করে। তাঁর চারিত্রিক গুণাবলীতে আকৃষ্ট হয়ে গ্রিসের সর্বস্থান হতে দর্শনশিক্ষার্থীগণ তাঁর শিক্ষাগারে এসে জমায়েত হতে থাকে। এদের মধ্যে প্রভুদের প্রাসাদের নর্তক এবং দাস সম্প্রদায়ের লোক, এমনকি মহিলাদের সাক্ষাৎও পাওয়া যায়।
নীতিবাদই এপিক্যুরাসের দর্শনের মূল। তাঁর কারণ, এপিক্যুরাস মনে করতেন, জ্ঞানার্জনের উদ্দেশ্য হচ্ছে, মানুষের জীবনযাপনের এমন নীতি স্থির করা যে নীতিতে মানুষ সত্যকার জ্ঞানার্জনের উদ্দেশ্য হচ্ছে, মানুষ সত্যকার শান্তিলাভে সক্ষম হবে। যথার্থ দর্শনের কাজ হবে মানুষের জীবনের যন্ত্রণা নিবারণ করা। মানুষের যথার্থ শান্তি কিসে? এ প্রশ্নের উত্তরের পূর্বে স্থির করতে হবে মানুষের কর্মের মূল চালক কি? এপিক্যুরাসেরমতে মানুষের কর্মের উৎস হচ্ছে সুখের আকাঙ্ক্ষা এবং দুঃখের পরিহার। মানুষ স্ববাবগতভাবেই মুখের কামনা করে, সুখের অন্বেষণ করে এবং দুঃখকে পরিহার করতে চায়। কিন্তু যে- কোনো সুখই সুখ নয়। আপাতদৃষ্টিতে যা সুখময় মনে হবে, তা পরিণামে সুখদায়ক না হয়ে যন্ত্রণার কারণও হতে পারে। এজন্য মানুষকে বিবেচক হতে হবে এবং যথার্থ সুখের অন্বেষণ করতে হবে। তাকে কোনো কিছু উপভোগের ফলাফল চিন্তা করতে হবে। প্রজ্ঞা বা বিবেচনাই হচ্ছে মানুষের জীবনের হিতের মহৎ উপায়। মানসিক সুখ আর দৈহিক সুখ বলে সুখকে বিভক্তকরে দৈহিক সুখকে স্থূল আর মানসিক সুখকে বিমল ভাবার কোনো কারণ নেই। সব সুখের উৎস হচ্ছে দেহ। ক্ষুধার তৃপ্তিতেই সুখের শুরু। দেহের ক্ষুধা নিবৃত্ত না হলে মনের সুখ আদৌ আসতে পারে না। কিন্তু অবিমিশ্র মাত্রাতিরিক্ত দৈহিক সুখও যথার্থ সুখ নয়। কারণ অবিমিশ্র দৈহিক সুখ পরিণামে যন্ত্রণা ও ক্লেশের উদ্ভব ঘটায়। কাজেই দৈহিক সুখেরও পরিমাণ থাকতে হবে। বস্তুত পরিমিতি এবং ভারসাম্য বজায় রাখাই হচ্ছে মানুষের সর্বাধিক কর্তব্য। জীবনের যে ক্ষুধা অপরিহার্য এবং স্বাভাবিক কেবল তাকে তৃপ্ত করাই হবে মানুষের পক্ষে সঙ্গত। চরম সুখ, চরম উপভোগ নয়। চরম সুখ হচ্ছে সমস্ত প্রকার অভাব ও ক্লেশমুক্ত অবস্থা। এপিক্যুরাসের এই সুখতত্ত্ব যে আদৌ নির্বিচার ইন্দ্রিয় ভোগের তত্ত্ব নয়, একথা বুঝতে অসুবিধা হয় না। বস্তুত এপিক্যুরাসের নীতি নির্দেশে যৌন ভোগ পরিহার করার উপদেশেরও সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। অনেকে মনে করেন, এপিক্যুরাস তাঁর বস্তুবাদী দর্শন ও যুক্তিবাদী মন দিয়ে সুখকে জীবনের প্রধান কাম্য মনে করলেও তিনি পিরহোর বৈরাগ্যবাদ দ্বারা বিশেষ প্রবাবিত হয়েছিলেন আর তাই তাঁর নীতি দর্শনে তিনি মানুষকে জীবনের প্রয়োজন বৃদ্ধি করার বদলে সীমিত করার উপদেশ দিয়েছেন। তাঁর অনুসারীদের তিনি জ্ঞান-বিজ্ঞানের গবেষণার নিরত হতে এবং তার মধ্যে জীবনের শান্তি লাভের আহবান জানিয়েছেন। এপিক্যুরাসের নীতিবাদ কোনো সামাজিক তত্ত্ব নয়। এ তত্ত্ব ব্যক্তিকেন্দ্রিক।
সুখবাদ বা নীতি-তত্ত্ব এপক্যুরাসের দর্শনের কেন্দ্র হলেও তাঁর মনের জিজ্ঞাসা ছিল বিচিত্রমুখী। সত্যের মাপকাঠি কি, বস্তুর মূল সত্তা কি, আত্মা কীভাবে গঠিত, ইত্যাদি বিষয়েও তাঁর মতামত সুস্পষ্ট ছিল। মানুষ দৃশ্য থেকে অদৃশ্য সম্পর্কে অনুমান করে। মানুষের কাছে দৃশ্য এবং প্রত্যক্ষ হচ্ছে তার ইন্দ্রিয়লব্ধ অভিজ্ঞতা। ইন্দ্রিয়ানুভূতি প্রত্যক্ষ বলে ইন্দ্রিয়ানুভূতি হচ্ছে মানুষের জ্ঞানের যথার্থতা বা সত্যের পরিমাপক। মন হচ্ছে ইন্দ্রিয়-লব্ধ অনুভূতির সংগ্রহশালা। এই সংগ্রহশালা থেকে উপকরণ সংগ্রহ করে মন বিশ্লেষণ, পরিমাপ, তুলনা, অনুমান ইত্যাদির ক্ষমতা অর্জন করে। বস্তুর সার বা মূলের প্রশ্নে ডিমোক্রিটাস (৪৬০-৩৭০ খ্রি. পূ.) এর ন্যায় এপিক্যুরাসও অনুতত্ত্বের অভিমত প্রকাশ করেন। এপিক্যুরাসও মনে করতেন যে, বস্তুর মূলে আছে অিচিন্তনীয় রূপে সূক্ষ্মারকারের অবিভাজ্য সংখ্যাহীন অণু। অণু পরিবর্তনীয় এবং দুর্ভেদ্য। অসীম শূন্যে ঘূর্ণ্যমান অণুর আকস্মিক সংযোগ এবং বিয়োগে সংখ্যাহীন বিচিত্র সৃষ্টির নিয়ত উদ্ভব এবং ধ্বংস সাধিত হয়। এপিক্যুরাস ছিলে নিরীশ্বরবাদী। তিনি বলতেন, মানুষকে ভূত, ভগবান এবং পরকালের ভীতি থেকে মুক্ত করতে পারলেই তাঁর মধ্যে সত্যকার সৎচরিত্রের সৃষ্টি সম্ভব হবে এবং মানুষ পরম শান্তি লাভ করতে সক্ষম হবে। ডিমোক্রিটাসের বিখ্যাত মনোবিদ্যারও বিকাশ ঘটে এপিক্যুরাসের হাতে। তিনি মানুষের মন বা আত্মাকে দুইভাগে বিভক্ত বলেমনে করেন। এক ভাগে হচ্ছে তার যুক্তির ভাগ। এ ভাগের অবস্থান মানুষের হৃদয়ে। মানুষের এ অংশে বিচিত্র প্রকারের অণু জটিল গতিতে সংযোজিত হয়ে মানুষের চিন্তা, ইচ্ছা, আবেগ প্রভৃতি বোধের সৃষ্টি করে। মনের অপর ভাগ হচ্ছে স্থূল বা অযুক্তির ভাগ। দেহের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিয়ে এ ভাগের গঠন এবং এর অণুগুলি তত দৃঢ় সংযোজনে আবদ্ধ নয়। কিন্ত মানুষের এই দুই অংশ নিয়েই তার সমগ্র কাঠামো গঠিত। মৃত্যুর পরে আত্মার অস্তিত্ব রক্ষা করা সম্ভব নয়। দর্শনের ইতিহাসে এপিক্যুরাসের নাম সঙ্গতিপূর্ণ বস্তুবাদী দার্শনিকদের মধ্যে অন্যতম দার্শনিক হিসাবে প্রখ্যাত হয়ে আছে।
Epistemology: জ্ঞানতত্ত্ব
দর্শনের আলোচ্য বিষয়কে সাধারণত তিন ভাগে বিভক্ত করে দেখানো হয় জ্ঞানতত্ত্ব, পরাতত্ত্ব বা চরম সত্তার তত্ত্ব এবং নীতি বা মূল্যতত্ত্ব।
জ্ঞানতত্ত্বের প্রধান প্রশ্ন হচ্ছে জ্ঞান বলতে কি বুঝায়। জ্ঞান কি প্রকারে অর্জিত হয়? মানুষের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা আছে কিংবা নেই ইত্যাদি। দর্শনের উল্লিখিত বিভাগগুলি তেমন পরস্পর বিচ্ছিন্ন নয়। জ্ঞানতত্ত্বেই যে কেবল জ্ঞানের প্রশ্ন নিহিত আছে, অপর বিভাগে নেই, একথা ঠিক নয়। প্রত্যেক ক্ষেত্রেই জ্ঞানের প্রশ্ন জড়িত। কিন্তু দর্শনের মূল প্রশ্নগুলির বৈশিষ্ট্য নিয়ে উপরোক্ত বিভাগগুলি চিহ্নিত করা চলে।
দর্শনের অন্যান্য বিষয়ের ন্যায় জ্ঞানের প্রশ্নেও কোনো একক এবং সর্বজনগ্রাহ্য সিদ্ধান্ত নেই। বিশ্বরহস্যের আলোচনায় দর্শনের ইতিহাসে ভাববাদী এবং বস্তুবাদী যে দুটি ধারার সাক্ষাৎ পাওয়া যায়, তারই অনুসরণে জ্ঞানের প্রশ্নেও দুটি প্রধান মত বিকাশ লাভ করেছে। একটি যুক্তিবাদী; অপরটি অভিজ্ঞতাবাদী। ‘যুক্তিবাদী জ্ঞানতত্ত্ব’ কথাটিতে ‘যুক্তি’ বিশেষ অর্থে ব্যবহৃত হয়। যুক্তি বলতে এখানে মন বুঝান হয়। যুক্তিবাদী জ্ঞানতত্ত্বের প্রধান ব্যাখ্যাতা হিসাবে ফরাসি দার্শনিক রেনে দেকার্ত (১৫৯৬-১৬৪০)-এর নাম বিখ্যাত।
ইউরোপে মধ্যযুগ অতিক্রান্ত হলে জ্ঞানের পুনর্জাগরণ এবং বিজ্ঞানের অগ্রগতি বিভিন্ন মৌলিক প্রশ্নকে আলোচ্য বিষয় করে তোলে। বাস্তবভাবে বিজ্ঞান মানুষকে বিশ্ব সম্পর্কে নানা জ্ঞানে শক্তিশালী করে তুললেও দার্শনিকগণ প্রশ্ন তোলেন, জ্ঞান বলতে কি বুঝায়? ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে মানুষ কতকগুলি অনুভূতি লাভ করে। সেই অনুভূতির সংশ্লেষণ ও বিশ্লেষণ যে কার্যকারণ, অতীত-ভবিষ্যৎ নানা বিষয় সম্পর্কে অনুমান গ্রহণ করে। জ্ঞানের প্রধান উপায় অনুমান। কিন্তু অনুমান মানসিক ব্যাপার। সেই অনুমান-দত্ত জ্ঞানের যথার্থতার নিশ্চয়তা কি? পৃথিবী সূর্যকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে –এ সিদ্ধান্ত মানুষের অনুমান। ইন্দ্রিয় মানুষকে অসংখ্য অনুভূতি দেয়। কিন্তু সেই অনুভূতিই কি জ্ঞান? বস্তুর অনুভূতি আর বস্তু কি এক? যদি এক না হয়, তা হলে অনুভূতির ভিত্তিতে বস্তু সম্পর্কে যে অনুমান গ্রহণ করা হয়, সে যে যথার্থ অর্থাৎ সিদ্ধান্ত বা অনুমান অনুযায়ী কোনো বস্তুর যে অস্তিত্ব আছে, তার প্রমাণ কি? জ্ঞানের ক্ষেত্রে এ প্রশ্নগুলি যুক্তিসঙ্গত। কিন্তু এ প্রশ্নের জবাব বিভিন্নভাবে দেওয়া যায়। রেনে দেকার্ত, জর্জ বার্কলে, ইমানুয়েল কাণ্ট প্রমুখ দার্শনিকের রচনায় জ্ঞানের এই প্রশ্নুগলির বিস্তৃত আলোচনা পাওয়াযায়। এ সমস্ত প্রশ্নের জবাবে এঁদের মতে জ্ঞান একান্ত করে মনের উপর নির্ভরশীল। জ্ঞানের ক্ষেত্রে ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি বড় কথা নয়। বড় কথা হচ্ছে সেই অনুভূতির বিন্যাস করে মন, কতকগুলি সাধারণ সূত্রের মাধ্যমে। আর এই সূত্রগুলির উৎস মানুসের বাস্তব অভিজ্ঞতা নয়। স্থান, কাল, পাত্র, সম্পর্ক, কার্য-কারণ, নিয়মানুবর্তিতার বোধ ইত্যাদির সূত্র অভিজ্ঞতালব্ধ নয়। এগুলি মানুষের জন্মগত এবং এদের উৎস অতিজাগতিক, অতিপ্রাকৃতিক, অদৃশ্য এবং অজ্ঞেয় কোনো সত্তা। কাজেই মানুষের জ্ঞানের নিশ্চয়তা ইন্দ্রিয় এবং অভিজ্ঞতায় নয়। মানুষের জ্ঞানের নিশ্চয়তা নির্ভর করে বিধাতা কিংবা অজ্ঞেয় সত্তার উপর।
বেকন, হবস, লক প্রমুখ দার্শনিকগণও জ্ঞানের প্রশ্ন নিয়ে পূর্বোক্ত দার্শনিকদের ন্যায়ই বিস্তৃতভাবে আলোচনা করেছেন। এঁদের জবাব অভিজ্ঞতাবাদ বলে পরিচিত। এঁদের মধ্যেও পরস্পরিক পার্থক্যের চেয়ে মিল এবং ঐক্যের সূত্র অধিক প্রবল। এঁদের মতে, জ্ঞানের উৎপত্তি মানুষের বাস্তব অভিজ্ঞতায়। অভিজ্ঞতা জ্ঞানের যেরূপ উৎস, তেমনি সমস্ত অনুমানের যথার্থতা কিংবা অযথার্থতার পরিমাপকও হচ্ছে অভিজ্ঞতা।
জ্ঞানের এই তত্ত্বে গোড়ার দিকে অনেক অসঙ্গতি ছিল। এই ধারার কোনো কোনো দার্শনিকের তত্ত্ব কেবল ইন্দ্রিয়লব্ধ অনুভূতিতে পর্যবসিত হয়েছে। কেউ কেউ অনুমান বা বিমূর্ত ধারনাকে ইন্দ্রিয়লব্ধ অনুভূতি দিয়ে ব্যাখ্যা করতে অসমর্থ হয়ে জন্মগত বা বিধিদত্ত ভাবেরও আশ্রয় গ্রহন করেছেন। ঊনবিংশ শতকে বিজ্ঞানের অগ্রগতি এবং দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের বিকাশ জ্ঞানের অভিজ্ঞতাবাদী তত্ত্বকে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদী তত্ত্বে পরিণত করেছে। কার্ল মার্কস, ফ্রেডারিক, এঙ্গেলস, ভি.আই. লেনিন দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের প্রবর্তক ও ব্যাখ্যাতাগণ জ্ঞানের সমস্যাটি ঐতিহাসিক বিকাশের দৃষ্টিতে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। তাঁদের মতে মানুষের বাস্তব অভিজ্ঞতাই জ্ঞানের মূল মাপকাঠি। কিন্তু অসংযুক্ত খণ্ড খণ্ড বাস্তব অভিজ্ঞতা বা ইন্দ্রিয়ানুভূতিই জ্ঞান নয়। মানুষের মন ও মস্তিষ্ক বস্তুর সঙ্গে প্রত্যক্ষ সম্পর্কের ভিত্তিতে বিকাশ লাভ করেছে এবং ক্রমাধিক পরিমাণে বাস্তব অনুভূতি বা অভিজ্ঞতার সংযোজন, বিয়োজন, শ্রেণীকরণ ইত্যাদি বিমূর্ত চিন্তার ক্ষমতার উদ্ভব মানুষের মধ্যে ঘটেছে। বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং সেই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বিকশিত মানুষের বিমূর্ত চিন্তার ক্ষমতা –উভয় দিকের নিয়ত ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ামূলক সম্পর্কের ভিত্তিতে মানুষের জ্ঞান পর্যবেক্ষণ, আন্দাজ, অনুমান, প্রয়োগকরণ –মোটকথা প্রমাণ পরীক্ষার মাধ্যমে অগ্রসর হয়ে চলে। জ্ঞানের জন্য মানুষ বিধাতার দয়ার উপর নির্ভরশীল নয়। মানুষের জীবন এবং বিম্বজগতের ন্যায় মানুষের জ্ঞানের কোনো সীমা মানুষের জন্য চিরস্থায়ীরূপে চিহ্নিত করা চলে না।
Essence and Appearance: মূল ও প্রকাশ
মূল ও প্রকাশ একটি দার্শনিক প্রশ্নের প্রকাশ। অস্তিত্ব বা সত্তার মূল চরিত্র এবং তার সৃষ্টি বা প্রকাশের মধ্যকার সম্পর্ক এবং উভয়ের বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ দর্শনের একটি আবহমান প্রয়াস। মানুষের প্রত্যক্ষভাবে যে অভিজ্ঞতার সম্পর্কে জড়িত হয়, তাকে সে অপর কোনো কিছুর প্রকাশ মনে করে। গভীরতর কোনো অস্তিত্ব এবং সাধারণভাবে দৃশ্যমান তার প্রকাশের পার্থক্য-বোধ মানুষের মধ্যে দৃশ্যমান বস্তু জগতের সতত পরিবর্তন থেকেই প্রথমে উদ্ভূত হয়। দৃশ্যমান জগতের অনেক কিছুই ক্ষণকালের। এই আছে, এই নাই। কিন্তু ক্ষণকালও আপেক্ষিক কথা।পরিবর্তমান জগতের কারুর স্থিরতা মুহুর্তকালের, কারুর স্থিরতা বা স্থায়িত্ব যুগব্যাপী। যে যত বেশী স্থায়ী তাকে তত বেশী মৌলিক এবং যে যত ক্ষণকালের তাকে স্থায়ী অস্তিত্বের প্রকাশমাত্র বলে মানুষ বিবেচনা করেছে। অধিকতর স্থায়ী বা স্থিরকে অধিক মূল্যদান মানুষের জীবনের প্রয়োজনের দিক থেকে স্বাভাবিক। ক্ষণকাল থেকে অধিককাল স্থায়ী অস্তিত্বের কল্পনার সঙ্গে মানুষ বস্তুর পরিবর্তনের হ্রাসবৃদ্ধিকেও যুক্ত করেছে। মানুষ মনে করেছে, যে বস্তু যত অধিককাল একরূপে স্থায়ী, তার পরিবর্তন ক্ষণকালের বস্তুর চেয়ে কম। এই পরিমাণ-বোধ থেকে মানুষ কল্পনা করার প্রয়াস পেয়েছে: এর চরম মূলে আছে যে অস্তিত্ব, সে-ই চিরস্থায়ী এবং সে অস্তিত্বের আদৌ কোনো পরিবর্তন নেই।
শুধু অপরিবর্তনীয় নয়। নিত্যকালের স্থায়ী অস্তিত্ব আদৌ বস্তু নয়। বস্তু সতত পরিবর্তিত হয়। প্রাচীন কালের প্লেটো কিংবা আধুনিক কালের কাণ্ট, হেগেল এঁরা চিরস্থায়ী কিংবা অপরিবর্তনীয় স্থির অস্তিত্বকে পরমভাব কিংবা অজ্ঞেয় সত্তা বলে আখ্যায়িত করেছেন। অনেকে আবার চিরস্থায়ীকে একমাত্র সত্য এবং প্রকাশকে অসত্য বা মায়া বলে বিবেচনা করেছেন। কেউ কেউ মূল এবং প্রকাশের পার্থক্য অস্বীকার করে মুহুর্তের দৃশ্য প্রকাশকেই একমাত্র সত্য অস্তিত্ব বলে ঘোষণা করে মূলের অস্তিত্ব নাকচের প্রবণতা দেখিয়েছেন। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ অস্তিত্বের মূল এবং প্রকাশকে বৈজ্ঞানিক এবং স্বাভাবিকভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে। এই মত অনুযায়ী মূল এবং প্রকাশ পরস্পর নির্ভরশীল অস্তিত্ব। বীজ থেকে অঙ্কুর হয়। অঙ্কুর থেকে বৃক্ষ। এখানে বৃক্ষের মূল অঙ্কুর এবং অঙ্কুরের মূল বীজ –একথা বলা অসঙ্গত নয়। বস্তুত প্রত্যেক অস্তিত্বেরই দুটি দিক আছে: একটিকে অন্যটির তুলনায় মূল অথবা প্রকাশ বলা চলে। মূল এবং প্রকাশের পারস্পরিক সম্পর্ক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার বা দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক। মূল ব্যতীত প্রকাশ নেই। প্রকাশ বলতেই কোনো কিছুর প্রকাশ। আবার কোনো মূলই প্রকাশহীন হতে পারে। চরম স্থির মূল বলেও কোনো অস্তিত্ব নেই। বস্তু হচ্ছে চরম অস্তিত্ব। কিন্তু কোনো প্রকাশ বা কোনো প্রকাশের অপরিবর্তনীয় নয়। আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের আবিস্কারকে স্বীকার করে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ বলে যে, বস্তুর মূল যে, উপাদান ইলেকট্রন-নিউট্রন-প্রোটন, সে উপাদানও জটিল, নিয়ত গতিময় ও পরিবর্তনশীল।
Ether: ঈথার
মহাশূন্যে পরিব্যাপ্ত পদার্থ বিশেষকে পূর্বে ঈথার নামে আখ্যায়িত করা হত।
পৃথিবীর নিকটমণ্ডলে বাতাস আছে। কিন্তু যত ঊর্ধ্বে যাওয়া যায়, তত বাতাস হ্রাস পেয়ে এক পর্যায়ে শূন্য হয়ে যায়। এ অভিজ্ঞতা প্রাচীন মানুষেরও ছিল। অভিজ্ঞতা থেকে প্রশ্নের উদ্ভব হয় যে, পৃথিবীর অতি ঊর্ধ্বের বায়ুহীন স্তর কি পদার্থহীন শূন্যতা, না মাটি, জল, বায়ু, আগুন এই পরিচিত পদার্থের অতিরিক্ত অপর কোনো পদার্থের অস্তিত্ব সেখানে রয়েছে। জগতের কোথাও বস্তুহীন শুন্যতা যে বিরাজ করতে পারে না, এ ধারণা কেবল আধুনিক বিজ্ঞানের নয়, প্রাচীন গ্রিসের জ্ঞানীদের রচনাতেও এ ধারনার সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। গ্রিকগণ প্রথমে মনে করত যে, পৃথিবীর ঊর্ধ্বলোকও বায়ুশূন্য নয়। তবে অতি ঊর্ধ্বের বায়ু অতিরূপে পরিশুদ্ধ। আর এ বায়ুর জীবন আছে এবং সে স্বর্গীয়। মহাশুন্যের ব্যাখ্যা প্রথমে দেন দার্শনিক এনাক্সাগোরাস (৫০০-৪২৮ খ্রি. পূ.)। তিনি বলেন, বিশ্বের বহির্মণ্ডলে ঈথার পরিব্যাপ্ত এবং শুন্যতা বলে বিশ্বের কোথাও কিছু নেই। ডিমোক্রিটাস তাঁর অণুতত্ত্বের ব্যাখ্যায় বলেন, শুন্যতা যে নেই তা নয়। শূন্যতা ঈথাররূপ অণু দ্বারা পূর্ণ। এই ঈথার অণুর গতির মাধ্যমেই গ্রহ এবং তারকারাজির আবর্তন সম্ভব হচ্ছে। এ্যারিস্টটল ঈথারকে বায়ু, অগ্নি, পানি এবং মাটির সঙ্গে পঞ্চম পদার্থ বলে অভিহিত করেন। সপ্তদশ শতকের দার্শনিক এবং অঙ্কবিদ দেকার্ত বস্তুর আলোচনায় বলেন, বস্তুর মৌলিক চরিত্র হচ্ছে স্থানিক। অর্থাৎ স্থানের মধ্যে বস্তুর আলোচনায় বলেন, বস্তুর মৌলিক চরিত্র হচ্ছে স্তানিক। অর্থাৎ স্থানের মধ্যে বস্তু পরিব্যাপ্ত। এ অভিমতের একটি গভীর বৈজ্ঞানিক তাৎপর্য ছিল। এর ফলে কোনো স্থানকে আর মানুষের পক্ষে বস্তুশূণ্য বলে কল্পনা করা সম্ভব হলো না। স্থান মানে বস্তু, তবে মহাশূন্যের বস্তু থেকে সূক্ষ্মতর বলে কল্পনা করেছিলেন। পৃথিবীর ঊর্ধ্বলোকে বাতাস নেই। কিন্তু সেই বায়ুশূন্য স্তর অতিক্রম করেও সূর্যের আলো পৃথিবীর ঊর্ধ্বলোকে বাতাস নেই। কিন্তু সেই বায়ুশূন্য স্তর অতিক্রম করেও সূর্যের আলো পৃথিবীতে পৌঁছে। আলো কোনো মাধ্যম ব্যতীত এই পথ অতিক্রম করতে পারে না। কাজেই মহাশূন্যে কোনো মাধ্যম অবশ্যই আছে। কিন্তু সে মাধ্যম জল, বায়ু বা ধাতব কোনো পদার্থ হতে পারে না বলে এই অনস্বীকার্য মাধ্যম ঈথার বলে আধুনিক বিজ্ঞানেও অভিহিত হয়েছে। তবে পদার্থ বিজ্ঞানের আধুনিকতম সিদ্ধান্তে মহাশূন্যকে ঈথারমণ্ডল না বলে একটা বস্তুক্ষেত্র বলে অভিহিত করা হয়।
Ethics: নীতিশাস্ত্র
নীতিশাস্ত্র দর্শনের একটি শাখার নাম। মানুষের ব্যবহারগত সম্পর্কের তাৎপর্যের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনার ভিত্তিতে নীতিশাস্ত্র বিকাশ লাভ করেছে।
নীতিশাস্ত্রের দুটি দিক প্রধান। একটি হচ্ছে নীতির তত্ত্বের দিক। অর্থাৎ ভালোমন্দ কাকে বলে; মানুষের কর্মের পেছনে একটা চালক শক্তি আছে, এ কথার তাৎপর্য কি ইত্যাদি প্রশ্নের তত্ত্বগত এবং ঐতিহাসিক আলোচনা হচ্ছে নীতি-তত্ত্বের বিষয়। নীতিশাস্ত্রের অপর দিক হচ্ছে তত্ত্বের প্রয়োগগত দিক। মানুষের কোনো ব্যবহার সৎ বা ভালো এবং কোনো ব্যবহার মন্দ; মানুষের সঙ্গে মানুষের কি সম্পর্ক থাকা সঙ্গত; ব্যক্তি ও সমাজের মধ্যে কোনো নীতির বন্ধন কাম্য এবং কোনো আদর্শ অনুসরণ সঙ্গত –এ সসমস্ত বিষয়ের আলোচনা ব্যবহারিক নীতিশাস্ত্রের প্রয়োগের শাখায় অধিক পরিমাণে করা হয়।
ন্যায়-অন্যায়, সঙ্গত-অসঙ্গত, উচিত-অনুচিতের বোধ মানুষের জীবনে গোড়া থেকেই বিদ্যমান। মানুষ যখন গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে বাস করতে শুরু হলে গোষ্ঠী সে ধরনের কাজকে অসঙ্গত বলেছে। আবার গোষ্ঠীর কোনো অনুশাসন ব্যক্তির নিরানন্দ ব্যক্তির নিরানন্দ, দুঃখ কিংবা লাঞ্ছনার কারণ হলে সে অনুশাসনকে ব্যক্তি অনুচিত মনে করেছে। আদিম গোষ্ঠীবদ্ধ সাম্যমূলক সমাজে ব্যক্তি ও গোষ্ঠী নানা নীতি ও অনুশাসনে পারস্পরিকভাবে আবদ্ধ থাকলেও তখন নীতিশাস্ত্রের উদ্ভব হয় নি। নীতিশাস্ত্রের উদ্ভব ঘটেছে সভ্যতার বিকাশে এবং সর্বপ্রথম দাস-প্রভুতে বিভক্ত এবং রাষ্ট্রনৈতিক কাঠামোতে সংগঠিত সমাজে। এই সময় থেকে নীতিশাস্ত্র কেবল ব্যক্তির মনোভাব নয়। নীতিশাস্ত্র রাষ্ট্রীয় অনুশাসনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে পরিগণিত হতে থাকে। শ্রেণীবিভক্ত সমাজে ক্রমান্বয়ে সমাজ ও ব্যক্তির মধ্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে বিরোধাত্মক সম্পর্কের তীব্রতা প্রশমিত করার জন্য তথা প্রভু শ্রেণীর সমাজ-ব্যবস্থা ও স্বার্থ রক্ষার দিক থেকে সমাজে ব্যক্তির আচরণের নীতিগত আলোচনা ও নীতি-নির্ধারক অনুশাসনের প্রণয়ন শুরু হয়। এইধারায় ক্রমান্বয়ে ব্যক্তির কর্মের পেছনে অতিমানবিক রহস্যময় এই আদর্শের আকর্ষণ সৃষ্টি করার চেষ্টা হতে থাকে। তত্ত্বগতভাবে কেউ বলতে থাকেন, এক অজ্ঞেয় অলভ্য চরম মহৎকে সামনে রেখেই মানুষ জীবন যাপন করবে। তার দৈনন্দিন সুখ-দুঃখভোগ ন্যায় বা অন্যায় আচরণ সব কিছুরই পরিমাপক হবে সেই পরম মহৎ-এর নৈকট্যলাভের প্রায়াস। আবার কেউ ব্যক্তিক এবং দৈহিক সুখরাভ বা উপভোগকে সমস্ত কর্মের মূল লক্ষ্য বলে ঘোষণা করেন।
প্রাচীন ভারতের চার্বাকপন্থীগণ, চীনের কনফুসিয়াস, ইয়াংচু, লাওজে, গ্রিসের ডিমোক্রিটাস, এপিক্যুরাস, এ্যারিস্টটল প্রমুখ জ্ঞানী ও দার্শনিকগণ মানুষের জীবন নীতিগত দিকের বিশেষ আলোচনা করেছেন।
ইউরোপে পুঁজিবাদী সমাজ যখন প্রতিষ্ঠিত হলো তখন একদিকে বিস্ময়কর আবিস্কারসমূহ, শিল্পের প্রতিষ্ঠা, বিপুল সংখ্যক শ্রমিকের দাসের মতো যূথবদ্ধভাবে উৎপাদন, অপরদকে নগণ্য সংখ্যক ধনপতির সমস্ত সম্পদের ভোগ –ইত্যাকার অবস্থা মিল যে অভূতপূর্ব জটল পরিস্থতির সৃষ্ট হয়, তাতে ব্যক্তি ও সমাজর জীবনে ন্যায়, সঙ্গত-অসঙ্গত, শান্তি-অশান্তির প্রশ্নও নানারূপে মাথা তুলতে শুরু করে। এই পর্যায় থেকে নীতি-শাস্ত্রের আলোচনায় বস্তুবাদী এবং ভাববাদী বৈশিষ্ট্য অধিকতর পরস্পর-বিরোধী রূপ গ্রহণ করে। ভাববাদী নীতিশাস্ত্রের চরম প্রকাশ দেখা যায় ইমানুয়েল কাণ্টের রচনায়। তিনি মানুষের নীতির ক্ষেত্রে কতকগুলি ‘ক্যাটেগরিকাল ইম্পারেটিভ’ বা ‘শর্তহীন বিধান’ প্রবর্তনের চেষ্টা করেন। তাঁর মতে এই বিধানগুলি মানুষ মেনে চললে সমাজে যে অন্যায়, বিরোধ ও সংঘাতের সৃষ্টি হয়েছে তা বিদূরিত হবে। তাঁর নীতি-বিধানের অন্যতম বিধান বাস্তব সমাজের পরিস্তিতির সঙ্গে সম্পর্কশূন্য এবং বাস্তব সমাজের বিশ্লেষণ এখানে অনুপস্থিত। ইংল্যাণ্ডের জেরমী বেনতাম (১৭৪৮-১৮৩২) এবং জন স্টুয়ার্ট মিল (১৮০৬-১৮৭৩) নীতির ক্ষেত্রে ‘হিতবাদ বা উপযোগবাদ’-এর প্রতিষ্ঠাতা বলে পরিচিত। তাঁরা বৃহত্তম সংখ্যক মানুষের সুখ লাভকে ব্যক্তি ও সমাজের কাম্য আদর্শ বলে ঘোষণা করেন। বৃহত্তম সংখ্যক মানুসের সুখ লাভকে ব্যক্তি ও সমাজের কাম্য আদর্শ বলে ঘোষণা করেন। বৃহত্তম মানুষের উপর অনুষ্ঠিত অসঙ্গত আচরণ থেকে তাঁদের এ নীতি উদ্ভুত হলেও তাঁদের এ ঘোষণারও তেমন কোনো ব্যবহারিক তাৎপর্য ছিল না। তাঁদের মত যত বিমূর্ত মহৎ আদর্শের কথাই নীতির ক্ষেত্রে কেউ প্রচার করুক না কেন, তার বাস্তব তাৎপর্য সেই সময়ের অর্থনৈতিক-সামাজিক-রাষ্ট্রীয় কাঠামো দ্বারা নির্দিষ্ট হয়। মানুষ সামাজিক জীব। সমাজবদ্ধ হয়ে সে বাস করে। কিন্তু সেই সমাজ ইতিহাসে বিভিন্ন পর্যায় অতিক্রম করে অগ্রসর হয়েছে। প্রতিষ্ঠিত সমাজের শাসক শ্রেণীর ব্যবস্থাদি রক্ষণের জন্যই সেই সমাজের বিশষ নীতিশাস্ত্র রচিত হয়। সমাজবদ্ধ মানুষের ব্যক্তি ও সমাজ উভয়ের জন্য জীবন ধারণের ও বিকাশের সঙ্গত অবস্থা সৃষ্টিকে মানুষের কাম্য নৈতিক আদর্শ বলে মনে করে।
Euclid: ইউক্লিড (৩৩০-২৭৫ খ্রি. পূ.)
প্রাচীনকালের গ্রিক অঙ্কশাস্ত্রবিদ, জ্যামিতিক। জন্ম আলেকজান্দ্রিয়ায়। জীবন-বৃত্তান্ত তেমন জানা যায় না। কিন্তু আধুনিককাল পর্যন্ত তাঁর জ্যামিতিক তত্ত্বসমূহ শিক্ষার ক্ষেত্রে বিদ্যালয়ের মূল পাঠ্য হিসাবে চলে এসেছে। কেবলমাত্র সাম্প্রতিককালে তাঁর তত্ত্বসমূহের পরিবর্তে নতুন তত্ত্ব প্রচারিত হচ্ছে। ইউক্লিডের জ্যামিতিক তত্ত্ব অবরোহী বা ডিডাকটিভ অনুমানের প্রধান ভিত্তি হিসাবে কাজ করেছে। ইউক্লিড তাঁর ‘ডাটা’ বা ‘ডিডোমেনা’ গ্রন্থে ৯৫টি থিওরেম পেশ করেছেন। এসব থিওরেমের প্রতিপাদ্য হচ্ছে এই তত্ত্ব যে, কতগুলি স্বতঃসিদ্ধ স্বীকার করলে তার ভিত্তিতে একাধিক সিদ্ধান্তকে আমরা প্রতিষ্ঠা করতে পারি। বিজ্ঞানের ইতিহাসে আলেকজান্দ্রিয় যুগটি অঙ্কমাস্ত্রের বিকাশে বিশেষ অবদান রেখেছে বলে মনে করা হয়। আলেকজান্দ্রিয়ার একাডেমীর অন্যতম অঙ্কবিদ ছিলেন ইউক্লিড। ইউক্লিডের ‘এলিমেন্টস অব জিওমেট্রি’ সম্পর্কে এরূপ বলা হয় যে, তাঁর এই গ্রন্থ আধুনিককাল পর্যন্ত যে-বিপুল সংখ্যায় পঠিত হয়েছে সে সংখ্যা কেবল খ্রিষ্টানধর্মের ‘বাইবেল’ পাঠের সংখ্যার সঙ্গেই তুলনীয়।
Eratosthens: এরাটোসথেনিস (২৭৬-১৯৪ খ্রি. পূ.)
আলেকজান্দ্রিয়ার বিখ্যাত গ্রন্থাগারিক এবং ব্যাকরণবিদ। প্রাচীনকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্বান বলেও পরিচিত। কেবল যে গ্রন্থাগারিক এবং ব্যাকরণবিদ তাই নয়। ভূগোলবিজ্ঞানেও তাঁর অবদান স্বীকৃত। তিনি সেকালে পৃথিবী গ্রহকে পরিমাপেরও একটি সূত্র আবিস্কার করেন।
Eudemonism: সুখবাদ, হিতবাদ
নীতিশাস্ত্রের একটি মতকে সুখবাদ বা হিতবাদ বলা হয়। প্রাচীন গ্রিসের ডিমোক্রিটাস, এপিক্যুরাস, সক্রেটিস এবং এ্যারিস্টটলের রচনায় এবং ভারতের চার্বাকপন্থীদের আলোচনায় এই নীতির ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। এ তত্ত্বের মূল বক্তব্য হচ্ছে যে, মানুষের কর্মের নিয়ামক হচ্ছে সুখ। সুখ ব্যক্তিক কিংবা সামাজিক হতে পারে। ইতিহাসের আধুনিক যুগে ইউরোপে ফরাসি দেশের হেলভেটিয়াস, ডিডেরট এবং ইংল্যাণ্ডের বেনথাম ও জন স্টুয়ার্ট মিলকে এই তত্ত্বের ব্যাখ্যাতা হিসাবে দেখা যায়। প্রাচীন কিংবা আধুনিক সুখবাদের একটা বৈশিষ্ট্য এই যে, এ তত্ত্বের প্রবর্তকগণ কোনো অতিজাগতিক নীতি বা আদর্শকে মানুষের কর্মের নির্ধারক বলেন নি। স্বর্গলোকে নয়, এই পৃথিবীতে মানুষ কীভাবে সুখময় জীবন যাপন করতে পারে সে কথা এঁরা আলোচনা করেছেন। এ দিক থেকে সুখবাদ বস্তুবাদী তত্ত্ব। কিন্তু বাস্তব সামাজিক-আর্থিক অবস্থা নিরপেক্ষভাবে সুখকে কাম্য বললেই ব্যক্তি বা সমাজ জীবনে সুখ প্রতিষ্ঠিত হয় না। মহৎ সুখকে আদর্শ বলে যদি ব্যক্তি কল্পনা করে, তা হলেও সুখ তার লাভ না হতে পারে। সুখের প্রতিষ্ঠা সম্ভব সামাজিক অসঙ্গতি দূরীকরণের মাধ্যমে। কাজেই মহৎ সুখ কি এবং কি করে তা লাভ করা যায়, তার আলোচনা কোনো বিশেষ যুগের সমাজ ব্যবস্থার আলোচনা এবং তার অসঙ্গতি দূরীকরণের উপায় নির্দেশ ব্যতীত অবাস্তব এবং অসার্থত হতে বাধ্য। এ কারণে এপিক্যুরাস, সক্রেটিস কিংবা আধুনিক হিতবাদীদের নীতি-তত্ত্বের কোনো বাস্তব ব্যবহারিক তাৎপর্য দেখা যায় না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এ তত্ত্ব নির্বিচার দৈহিক সুখলাভের বিকারে পর্যবসিত হয়েছে। সামাজিক সমস্যার বিশ্লেষণ ও তা নিরসনের উপায়ের ইঙ্গিত না থাকাতে প্রতিপক্ষীয়গণ এপিক্যুরাসের মতকে যদৃচ্ছা সুখ ভোগ এবং চার্বাকবাদীদের মতকে ‘ঋণং কৃত্য ঘৃতং পিবেৎ’-এর তত্ত্ব বলে প্রচার করতে সক্ষম হয়েছে।
Evolution and Revolution: বিবর্তন এবং বিপ্লব
বিবর্তন ও বিপ্লব বিকাশের অবিচ্ছেদ্য দুটি দিক। বিবর্তন বলতে কোনো অস্তিত্ব বা বিষয়ের মধ্যে পরিবর্তনের ধারাবাহিক এবং পরিমাণগত বৃদ্ধিকে বুঝায়। বিপ্লব বলতে বিকাশের কোনো পর্যায়ে অস্তিত্বের মধ্যে দ্রুত এবং আকস্মিক পরিবর্তন বুঝায়।
বিবর্তন ও বিপ্লবের মধ্যকার সম্পর্ক যে অবিচ্ছেদ্য, এটি আধুনিক বিজ্ঞানের এবং সমাজবিজ্ঞান, দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের তত্ত্ব। পূর্বে মানুষ বিবর্তন ও বিপ্লবকে পরস্পর বিচ্ছিন্ন এবং বিরোধাত্মক ব্যাপার বলে মনে করত। পূর্বে এরূপ ধারণা ছিল যে, বিবর্তন ঘটতে থাকবে; অর্থাৎ পরিবর্তনের কেবল পরিমাণগত বৃদ্ধি হতে থাকবে, অস্তিত্বে নতুন কোনো গুণের উদ্ভব হবে না। এ ধারনার অস্তিত্বের বিকাশে বিবর্তন একমাত্র প্রক্রিয়া। এ ধারণায় বিপ্লব কেবল জবরদস্তির নামান্তর। অস্তিত্বের বহির্ভূত কোনো শক্তি হিসাবে বাইরে থেকে অস্তিত্বকে পরিবর্তিত করতে চায়। আধুনিক বিজ্ঞান অস্তিত্বের বিকাশের ধারণাকে সুস্পষ্ট করে দিয়েছে। পানি যখন উত্তপ্ত হতে থাকে, তখন পানির মদ্যে বিন্দু বিন্দু পরিমান পরিবর্তন সংঘটিত হতে থাকে। কিন্তু পরিবর্তনের এই বৃদ্ধি অনির্দিষ্ট কালের জন্য কেবল পরিমাণেই সীমাবদ্ধ থেকে পানিকে পানি হিসাবে বজায় রেখে এগোয় না। পরিবর্তনের পরিমাণগত বৃদ্ধির একটা চরম বিন্দুতে পানির পুরাতন অস্তিত্বের আমূল রূপান্তর সংঘটিত হয়। পানি বাষ্পে পরিণত হয়। পানি থেকেই বাষ্প; কিন্তু পানি এবং বাষ্পকে আমরা দৃশ্যত এক অস্তিত্ব মনে করি না। এখানে পানির বিকাশে বিবর্তনের একটা স্তরে বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে, এ কথা বলা যায়। প্রাকৃতিক জগতে এরূপ দৃষ্টান্তের অভাব নেই।
সামাজিক জীবনে বিবর্তন ও বিপ্লব প্রশ্নের পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণ ঘটেছে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ এবং মার্কসবাদের হাতে। মার্কসবাদের প্রবক্তাগণ প্রাকৃতিক জগতের অস্তিত্বে সক্রিয় পরিবর্তনের নিয়মকে সমাজের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে বলেন যে, সমাজ-দেহেও পরিবর্তনের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে পেয়ে একটি চরম পর্যায়ে বিপ্লব সংগঠিত হয়। বিপ্লব কোনো অস্বাভাবিক কিংবা অস্তিত্বের বহির্ভূত ব্যাপার নয়। বস্তুগত কিংবা সামাজিক সমস্ত অস্তিত্বই সতত গতিশীল। অস্তিত্ব মাত্রের গতি সৃষ্টি হয় তার আভ্যন্তরিক বিরোধের ভিত্তিতে। অস্তিত্বের অন্তর্গত দ্বন্দ্বমান শক্তির বিরোধ বিভিন্ন কারণে বৃদ্ধি পেতে পেতে একটা বিস্ফোরণের মূহুর্তে উপস্থিত হয়। এক বিস্ফোরণই বিপ্লব। বিপ্লবের ফলে অস্তিত্বের এমন সব চরিত্র সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে যে চরিত্রগুলি বিপ্লবের পূর্বে অস্তিত্বের মধ্যে সুপ্ত কিংবা স্বল্প প্রকাশিত ছিল; কিন্ত এরূপ প্রবল এবং প্রধান হয়ে কার্যকর হয় নি।
বিবর্তন শব্দের একটা সাধারণ ব্যবহার আছে। সমাজের বিবর্তন, বিশ্ব জগতের বিবর্তন। এরূফ ব্যবহারে কোনো ক্ষেত্রে বিবর্তন ও বিপ্লবসহ পরিবর্তনের সমগ্র বিষয়টিকেই বুঝান হয়।
বিপ্লব শব্দের অনেক বিকৃত এবং সংকীর্ণ ব্যবহারও দেখা যায়। বিপ্লবের মৌলিক অর্থ অস্তিত্বে অদৃষ্টপূর্ব নতুন চরিত্রের উদ্ভব। কিন্তু অনেক সময়ে কোনো রাষ্ট্রকাঠামোতে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর জবরদস্তি ক্ষমতা দখলকেও বিপ্লব বলে অভিহিত করা হয়। পাকিস্তানে ১৯৫৮ সালে শাসনযন্ত্রের অধিকারীর ক্ষেত্রে অনিয়মতান্ত্রিক পন্থায় কিছু সংখ্যক ব্যক্তির রদ-বদল সংঘটিত হয়েছিল। এই ঘটনায় পাকিস্তানের সামাজিক চরিত্রে কোনো মৌলিক পরিবর্তন ঘটে নি। কিন্তু শাসকগণ একে বিপ্লব বলে আখ্যায়িত করেছিল। জবরদস্তি এবং রক্তপাত মাত্রকেই বিপ্লব বলা যায় না। বাস্তব সমাজের মধ্যে মৌলিকভাবে নতুন চরিত্রের উদ্ভব বিপ্লবকে সূচিত করে।
Existence: অস্তিত্ব
সাধারণ ‘অস্তিত্ব’ দ্বারা স্থায়ী, অস্থায়ী, স্থির এবং অস্থির সমস্ত সৃষ্টিকেই বুঝায়। তা হ