বাইয়াতের হাকিকাত

বাইয়াতের হাকিকাত

 


 

বাইয়াত ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিভাষা।সাহাবায়ে ক্যারাম রাসুল সাঃ এর ইন্তেকালের পর সাহাবায়ে কেরাম আবু বকর রাঃ এর নিকট বাইয়াত হয়েছেন। মুসলমানদের সামস্টিক পরিচালনার দায়িত্ব যার উপর ন্যস্ত হয়েছে তার নিকট বাইয়াত হওয়ার এ তরিকা ইসলামের ইতিহাসে ব্যাপকভাবে স্বীকৃত। প্রথম চার খলিফার পরও বাইয়াতের এ ধারা জারি ছিল। এমনকি যে খানে ইসলামী রাষ্ট্র ব্যাবস্থা নেই সেখানেও দীনি মহলে বাইয়াত শব্দটি বেশ প্রচলিত আছে।

 

আমাদের দেশে পীর-মুরীদীর বেলায়ই এ পরিভাষাটি বিশেষ ভাবে ব্যবহৃত হয়। যিনি মুরিদ হতে চান তাঁকে পীর সাহেবের নিকট বাইয়াত হতে হয়। দেশে বেশ সংখ্যাক পীর সাহেবান আছেন বলে এ পরিভাষাটি ব্যাপকভাবে পরিচিত। কিন্তু অনেকেই ইসলামের বাইয়াত পরিভাষাটির সঠিক তাতপরজ(হাকিকত) জানেননা। অথচ এ বিষয়টি ইসলামের সমাজ ব্যবস্থায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই এ সম্পর্কে আলোচনা করার বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে।

 

বাইয়াতের শাব্দিক অর্থ

 


 

বাইয়াত শব্দটি আরবি- শব্দ থেকে গথিত। ‘বাইয়’ অর্থ বেচা-কেনা,লেন-দেন, বিক্রি করা-খরিদ করা। এ শব্দটি বিক্রয় ও খরিদ উভয় অর্থেই ব্যবহার করা হয়। তবে এর আসল অর্থ বিক্রয়য়। জিনিস দিয়ে দাম নেয়ার নাম আরবি এভাবেই আরবি অর্থ বিক্রি ও আরবি অর্থ ক্রয়য়। যেহেতু বিক্রয় ছাড়া ক্রয় হতে পারেনা, এবং ক্রয় ছাড়া বিক্রয় হতে পারে না সেহেতু এ দু’টো শব্দই উভয় অর্থেই বাইয়াত ব্যবহার করা হয়ে থাকে। অবশ্য বিক্রয়ের কাজটাকেই বাইয়াত বলা হয়। আরবি শব্দের মূল অর্থ বিক্রয় বটে, কিন্তু এর গৌণ (secondary) অর্থ হলো চুক্তি,শপথ, অংগীকার। বেচা-কেনার ব্যাপারে ক্রেতার ও বিক্রেতার মধ্যে যেসব শর্ত(terms) ঠিক করা হয় তা মেনে নেয়ার চুক্তির ভিত্তিতেই লেন-দেন হয়ে থাকে। এভাবেই বাইয়াত শব্দটি চুক্তি,শপথ,অঙ্গীকার শ্রদ্ধা প্রদর্শন আনুগত্য স্বীকার ইত্যাদি অর্থে ব্যবহার করা হয়।

 

আরবি শব্দের ক্রিয়া-বাচক শব্দ হলো আরবি এর অর্থ শুধু বিক্রয় শব্দেই সীমাবদ্ধ নয়। এর অর্থ হয় চুক্তি করা, সম্মান প্রদর্শন করা, নেতৃত্ব মেনে নেয়া, আনুগত্যের শপথ করা, বিক্রয়ের জন্য পেশ করা, চুক্তি চূড়ান্ত করা এবং ব্যবসায় লেন-দেন করা ইত্যাদি।

 

বিখ্যাত আরবি-ইংরেজি অভিধান আরবি যার সংকলক MILTON COWAN, তাতে আরবি অর্থ লিখা হয়েছেঃ

 

To sell, to make a contract, to pay homage, to acknowledge as sovereign or leader, to pledge allegiance, to offer for sale, to agree on the term of a sell, to buy, to purchase etc.

 

এ অভিধানে আরবি অর্থ লিখা হয়েছে- agreement, arrangement, business deal, commercial transaction, bargain, sale, purchase, homage etc.

 

কুরআনে এ পরিভাষার ব্যবহার

 


 

কুরআন মজীদে বাইয় শব্দটি বেচা-কেনা, ব্যবসা-বাণিজ্য ও রুজি রোজগারের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন রকম কাজে লেগে থাকার অর্থে কয়েকটি সূরায় ব্যবহার করা হয়েছে।

 

আরবি

 

‘জুমআর দিনে যখন নামাজের জন্য ডাকা হয় তখন আল্লাহ্‌র যিকরের দিকে দৌড়াও এবং বেচা-কেনা বাদ দাও।’ সূরা জুমআঃ৯ আয়াত)

 

আরবি

 

সেসব লোক যাদেরকে ব্যবসা,বেচা কেনা ও কাজ কারবার ইত্যাদি কোন কিছুই আল্লাহ্‌র যিকর থেকে গাফেল করে দেয় না।

 

  সূরা নুরঃ ৩৭

 

এ দুটো আয়াতে জীবিকা অর্জনের সব রকম ব্যাবস্থাকেই বাইয় শব্দ দ্বারা প্রকাশ করা হয়েছে।

 

সূরা তাওবা,সুরা ফাতহ, সূরা মুমতাহিনায় বাইয় শব্দটি রুপকভাবে বিক্রয় অর্থেই ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু এখানে বিক্রয় মানে নিজের সত্তা ও জান-মালকে কোন মহান উদ্দেশ্য আল্লাহ্‌ ও রাসুলের নিকট সমর্পণ করার চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়া বা ওয়াদা করা।

 

আরবি

 

‘নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ মুমিনদের জান ও মাল বেহেশতের বদলে কিনে নিয়েছেন। তার আল্লাহ্‌র পথে লড়াই করে,(দুশমনকে) মারে এবং নিজেরাও নিহত হয়।তাওরাত,ইঞ্জিল, ও কুরআনে তাদের জন্ন(বেহসত দেয়ার এ ওয়াদা) আল্লাহ্‌র দায়িত্ব একটা পাকা ওয়াদা, আল্লাহ্‌র চেয়ে বেশী ওয়াদা পূরণকারী আর কে আছে? সুতরাং তোমরা যে বাইয়াত করেছ সে বিসয়ে তোমরা সন্তুষ্ট থাক। এটাই সবচেয়ে বড় কামিয়াবি।’ সূরা তাবা ১১১

 

আরবি

 

‘হে রাসুল! যেসব লোক আপনার নিকট বাইয়াত হচ্ছিল। তাদের হাতের উপর আল্লাহ্‌র কুদরতের হাত ছিল। সূরা ফাতহ ১৮

 

আরবি

 

‘হে নবী! আপনার নিকট যদি মেয়েরা এ কথার উপর বাইয়াত হবার জন্য আসে যে তারা আল্লাহ্‌র সাথে কাউকে শরিক করবেনা, চুরি করবেনা,যিনা করবেনা, তাদের সন্তান হত্যা করবেনা, নিজেরা কোন অপবাদ রচনা করে আনবে না ও ন্যায্য ব্যাপারে আপনার অবাধ্য হবে না, তা হলে আপনি তাদের বাইয়াত কবুল করুন। নিশ্চয় আল্লাহ্‌ অতি ক্ষমাশীল ও দয়াবান।’ সূরা মুমতাহিনা ১২

 

এ কয়টি আয়াতে বাইয়াত শব্দটি নির্দিষ্ট অর্থে ইসলামী পরিভাষা হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। সূরা তওবাতে জান ও মাল আল্লাহ্‌র নিকট সমর্পণ করার অর্থে, সূরা ফাতহে রাসুলের নির্দেশে মৃত্যুবরণ করার অর্থে এবং সূরা মুমাতাহিনায় আল্লাহ্‌ ও রাসুলের সাথে নাফরমানি না করার ওয়াদার অর্থে বাইয়াত কথাটি ব্যবহৃত হয়েছে। আল্লাহ্‌ ও রাসুলের পূর্ণ আনুগত্যের শপথই এসব বাইয়াতের আসল উদ্দেশ্য।

 

সূরা তাওবাতে বাইয়াতে মানে মুমিনদের জান ও মালকে আল্লাহ্‌র মরজি মতো কাজে লাগাবার এবং নিজেদের খেয়াল এবং খুশি মতো ব্যবহার না করার ওয়াদা। সূরা ফাতহে বাইয়াত মানে রাসুল সাঃ এর নির্দেশে জীবন দেয়ার শপথ করা।হুদাইবিয়ার সন্ধির পূর্বে হযরত ওসমান রাঃ কে মক্কাবাসীরা হত্যা করেছে বলে গুজব শুনে কুরাইশদের বিরুদ্ধে নিরস্ত্র অবস্থায়ও উপস্থিত সকল সাহাবা যুদ্ধ করতে প্রস্তুত বলে ঐ শপথ করেছিলেন। আর সূরা মুমতাহিনাতে আল্লাহ্‌ ও রাসুলের অবাধ্য না হওয়ার ওয়াদাই বায়াতের উদ্দেশ্য। সুতরাং এসব কয়টি আয়াতেই বাইয়াতের সারমর্ম হল মুমিনের জান মাল,ইচ্ছা- বাসনা,রথাত পূর্ব সত্তাকে আল্লাহ্‌র মর্জির নিকট সমর্পণ করা। এটাই ইসলাম কবুলের মর্মকথা। ইসলাম শব্দের অর্থও আত্নশমর্পন। বাইয়াতের মাধ্যমে আত্নশমর্পনের বাহ্যিকরূপ প্রকাশ পায়।

 

বাইয়াতের হাকিকাত

অধ্যাপক গোলাম আযম

book স্ক্যান কপি ডাউনলোড