ইসলামের যাকাত বিধান ( ২য় খন্ড )

প্রসঙ্গ-কথা

মানুষেল অর্থনৈতিক জীবনে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, বিশেষত গরীব, নিঃস্ব ও অসহায় লোকদের জীবিকার নিশ্চয়তা বিধান নিঃসন্দেহে একটি কঠিন সমস্যা। এই সমস্যাটির সুষ্ঠু সমাধানের লক্ষ্যে বিভিন্ন দেশে ও বিভিন্ন অর্থ ব্যবস্থায় কিছু ‘কল্যাণধর্মী’ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। কিন্তু সে সব পদক্ষেপ সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্যে কোন নিশ্চয়তা বিধান করতে পারে নি। ফলে কল্যাণধর্মী বলে খ্যাত রাষ্ট্রগুলোতেও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ও দারিদ্র্য বিমোচনের কর্মসূচী এখনো নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। দৃশ্যত কিছু কল্যাণধর্মী ব্যবস্থা গ্রহণ সত্ত্বেও লক্ষ লক্ষ অসহায় মানুষ সে সব দেশে চরম দুরাবস্থার মধ্যে বসবাস করছে। ইসলাম আল্লাহর দেয়া এক পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। এ জীবন ব্যবস্থায় এক সুষম ও ভারসাম্যপূর্ণ অর্থনীতি ছাড়াও সামাজিক ন্যায়বিচারকে নিশ্চিত করার জন্যে যাকাত-এর একটি চমৎকার কর্মসূচীর বিধান রাখা হয়েছে। সমাজের বিত্তবান ও সচ্ছল লোকদের বাড়তি সম্পদের একটি নির্দিষ্ট অংশ নিয়মিত আদায় করে দরিদ্র ও বঞ্চিত লোকদের মধ্যে যথাযথ বণ্টন করাই এ কর্মসূচীর প্রধান বৈশিষ্ট্য। বলাবাহুল্য, এটি যেমন একটি রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম, তেমনি ইসলামের একটি মৌলিক ইবাদতও। তাই পবিত্র কুরআনের বহুতর স্থানে নামায প্রতিষ্ঠার সাথে সাথে যাকাত প্রদানেরও আদেশ করা হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় যে, যাকাত সম্পর্কে স্পষ্টতর ধারণার অভাবে এই কল্যানময় ব্যবস্থাটি থেকে আমাদের সমাজ যথোচিতভাবে উপকৃত হতে পারছে না। আরব জাহানের স্বনামধন্য ইসলামী চিন্তাবিদ ও সুপন্ডিত আল্লামা ইউসূফ আল-কারযাভী প্রণীত ‘ফিকহুয যাকাত’ নামক বিশাল গ্রন্থটি এদিক থেকে আমাদের জন্যে এক পরম সম্পদ। যাকাত আদায়ের উৎস ও ব্যয়ের খাতগুলো অত্যন্ত পুংখানুপুংখভাবে বিবৃত করা হয়েছে দুই খন্ডে বিভক্ত এই মূল্যবান গ্রন্থে। এ কালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইসলামী চিন্তাবিদ ও দার্শনিক আল্লামা মুহাম্মাদ আবদুর রহীম (র) ’ইসলামের যাকাত বিধান’ শিরোনামে এই অনন্য গ্রন্থটি বাংলায় অনুবাদ করে সময়ের এক বিরাট দাবি পূরণ করেছেন। কিন্তু গ্রন্থটির প্রকাশনায় ধারাবাহিকতা না থাকায় এর অপরিমেয় কল্যাণ থেকে যথোচিতভাবে উপকৃত হতে পারেননি আমাদের বিদগ্ধ পাঠক সমাজ, বরং গত কয়েক বছর ধরে গ্রন্থটি বাজারে পাওয়া যাচ্ছে না বলে আগ্রহী পাঠকরা সরাসরি অভিযোগ করেছেন আমাদের কাছে। এই অবস্থার প্রেক্ষাপটে আল্লামা মুহাম্মাদ আবদুর রহীম (রহ)- এর গ্রন্থাবলী প্রকাশের দাবিতে নিয়োজিত ‘খায়রুন প্রকাশনী’ এখন থেকে ‘ইসলামের যাকাত বিধান’ শীর্ষক গ্রন্থটির যথাযথ প্রকাশনার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। তদনুসারে এর প্রথম খন্ডটি পাঠকের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে এবং বর্তমানে এর দ্বিতীয় খন্ডটিও সহৃদয় পাঠকদের হাতে তুলে দেয়া হল। গ্রন্থটির এ সংস্করণে আমরা পূর্বেকার মুদ্রণ- প্রমাদগুলোর সংশোধনের জন্যে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি। এর অঙ্গসজ্জা ও মুদ্রণ পারিপাট্যকেও উন্নত করার ব্যাপারে যত্ন নেয়া হয়েছে। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, গ্রন্থটির ও সংস্করণ পাঠকদের কাছে পূর্বাপেক্ষা অধিকতর সমাদৃত হবে। মহান আল্লাহ গ্রন্থকার ও অনুবাদককে এই অনন্য খেদমতের উত্তম প্রতিফল দান করুন, এটাই আমাদের সানুনয় প্রার্থনা। ঢাকাঃ জানুয়ারী ২০০১ মুহাম্মাদ হাবিবুর রহমান চেয়ারম্যান মাওলানা আবদুর রহীম ফাউন্ডেশন অনুবাদকের কথা ‘যাকাত’ দ্বীন ইসলামের মৌলিক বিধানের অতীব গুরুত্বপূর্ণ রুকণ। কিন্তু এ পর্যায়ে আধুনিক সমাজ ও অর্থনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে বিস্তারিত আলোচনা সম্বলিত কোন গ্রন্থ দুনিয়ার কোন ভাষায় আছে বলে আমার জানা ছিলো না। তবে এ যুগের প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ, গবেষণা ও গভীর ব্যাপক পান্ডিত্যের অধিকারী কাতারের রাজধানী দোহায় বসবাসকারী ও তথাকার শিক্ষা বিভাগের দায়িত্বশীল পদে নিযুক্ত আল্লামা ইউসুফ আল-কারযাভী লিখিত ফিকহুল যাকাত فقه الزكواة নামক আরবী গ্রন্থটির নাম শুনে আসছিলাম তার প্রথম প্রকাশ ১৯৬৯ সন থেকেই। কিন্তু দুটি খন্ডে বিভক্ত ও বিরাট গ্রন্থখানি পড়ার কোন সুযোগ পূর্বে আমি পাইনি। ১৯৭৯ সনের রমযান পাসে ঢাকস্থ ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক জনাব শামসুল আলমের কাছে এ বইখানি দেখতে পাই। তিনি এর বাংলা অনুবাদ করানোর ইচ্ছা প্রকাশ করেন এবং তখনই আমি সেই অনুবাদের দায়িত্ব গ্রহণ করি। আমি নিঃসন্দেহে বিশ্বাস করি, আল্লামা ইউসূফ আল-কারযাভীর এ এক তুলনাহীন অমর সৃষ্টি। আমার জানামতে আরবী ভাষায়ও এ পর্যায়ে বা এর সমতুল্য গ্রন্থ আর একটি নেই। ইসলামী জ্ঞান ও আদর্শের ক্ষেত্রে যাকাত যেমন মহান আল্লাহর একটি বিশেষ অবদান, দুনিয়ার চিরকালের বঞ্চিত মানবতার জন্যে দারিদ্র্য মুক্তিরও এ এক অনন্য ও অনবদ্য ব্যবস্থা, তার বিস্তারিত ও ব্যাপক গভীর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে এ গ্রন্থখানি অনুরূপ এক মহামূল্য সম্পদ। ইসলামের বিশেষজ্ঞ মনীষিগণ এ গ্রন্থখানিকে যাকাত বিষয়ে বিশ্বকোষ বলে আখ্যায়িত করেছেন। এ গ্রন্থখানি রচনা করে তিনি দ্বীন-ইসলামের এক অতুলনীয় খেদমত আঞ্জাম দিয়েছেন এবং সেই সাথে গোটা মুসলিম জাহানের মহাকল্যাণ সাধন করেছেন। আমি আশা করি এ গ্রন্থখানি আদ্যাপাস্ত পাঠ করে পাঠকবৃন্দ যাকাতের গুরুত্ব ও মানবতার কল্যাণে তার কল্পনাতীত বিরাট ভূমিকার কথা বিস্তারিতভাবে জানতে পারবেন। ফিকহুয যাকাত’ নামক এ বিরাট গ্রন্থের পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ সম্পন্ন করে বাংলাভাষী জনগনের সম্মুখে পেশ করতে পারা আমার জন্যে একটি অনুপম সৌভাগ্যের ব্যাপার বলে মনে করি এবং এজন্যে মহান আল্লাহর দরবারে নিবেদন করছি অশেষ শুকরিয়া। (মাওলনা) মুহাম্মাদ আবদুর রহীম মুস্তাফা মনযিল ২০৮, নাখালপাড়া

সূচী পত্র প্রথম অধ্যায়ঃ যাকাত ব্যয়ের খাত ভূমিকা কুরআন যাকাত ব্যয়ের খাতের উল্লেখ যাকাত ব্যয় খাত পর্যায়ে কুরআনী ঘোষণার তাৎপর্য প্রথম পরিচ্ছেদঃ ফকীহ ও মিসকীন ফকীর’ ও মিসকীন’ বলতে কাদের বোঝায়? হানাফী মতে ‘ফকীহ’ ও মিসকীন’ ফকীর-মিসকীনের অংশ থেকে কোন ধনীকেই কিছু দেয়া যেতে পারে না ধনীর যাকাত গ্রহণ নিষিদ্ধ ইমাম সওরী প্রমুখের অভিমত হানাফী মাযহাবের মত ইমাম আল-কাসানী বলেছেন ইমাম মালিক, শাফেয়ী ও আহমদের মত উপার্জনক্ষম দরিদ্র ইবাদতে লিপ্ত ব্যক্তি যাকাত পাবে না ইলম শেখার কাজে একনিষ্ঠ ব্যক্তি যাকাত পাবে প্রচ্ছন্ন আত্মসম্মান রক্ষাকারী দরিদ্ররা সাহায্য পাওয়ার অধিকারী ফকীর ও মিসকীনকে কি পরিমাণ যাকাত দেয়া যাবে প্রথমত জীবনকালের প্রয়োজন পরিমাণ দান যখন দিবেই তখন সচ্ছল করে দাও দ্বিতীয় মতঃ এক বছরের জন্যে যথেষ্ট পরিমাণ দিতে হবে বিয়ে করিয়ে দেয়াও পূর্ণমাত্রার যথেষ্ট পরিমাণের অন্তর্ভূক্ত ইলমের বই-পত্র দানও যথেষ্ট দানের অন্তর্ভূক্ত কোন মতটি গ্রহণ করা উত্তম ফকীরকে দেয় পরিমাণ পর্যায়ে অন্যান্য মত ইমাম গাজালীর মত দানে প্রশস্ততার মতকে অগ্রাধিকার দান উপযুক্ত মানের জীবিকা ব্যবস্থা স্থায়ী ও সুসংবদ্ধ সাহায্য ব্যবস্থা

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদঃ যাকাত কার্যে নিয়োজিত কর্মচারী যাকাতের অর্থনৈতিক ও প্রতিষ্ঠানগত ব্যবস্থাপনা যাকাত আদায়কারী প্রেরণ সরকারের দায়িত্ব যাকাত আদায়কারী কর্মচারীদের কর্তব্য যাকাতের জন্যে দুটো প্রতিষ্ঠান যাকাত পাওয়ার যোগ্যতা নির্ণয়ের ওপর গুরুত্ব যাকাত কর্মচারী হওয়া শর্ত কর্মচারীকে কত দেওয়া হবে যাকাতের মালের প্রতি লোভের ওপর রাসূলের কঠোরতা বেতনভুক্ত কর্মচারীদের জন্য দেয়া উপঢৌকন ঘুষ যাকাত সংগ্রহকারীদের প্রতি নবী করীমের উপদেশ মালের মালিকদের জন্যে দোয়া মুসলিম জনকল্যানমূলক কাজে ব্যতিব্যস্ত লোকদের কি যাকাত কাজের কর্মচারী মনে করা হবে

তৃতীয় পরিচ্ছেদঃ যাদের মন সন্তষ্ট করা প্রয়োজন এই খাতটির ফায়দা এই লোকদের কয়েকটি ভাগ রাসূলের ইন্তেকালের পর এই খাতটি কি পরিত্যাক্ত মনসূখ হওয়ার দাবি অগ্রহনযোগ্য মন তুষ্ট করার প্রয়োজন কখনই ফুরায় না মন সন্তুষ্টকরণ ও মুয়াল্লাফাতু’র জন্যে যাকাত ব্যয়ের অধিকার কার এ যুগে মুয়াল্লাফাত’ খাতের টাকা কোথায় ব্যয় করা হবে যাকাতের মাল ছাড়াও এ কাজ করা জায়েয

চতুর্থ পরিচ্ছেদঃ ফির-রিকাব – দাসমুক্তি কুরআনে খাত নির্ধারণে অক্ষর প্রয়োগের পার্থক্য ফির-রিকাব-এর তাৎপর্য দাসপ্রথা বিলুপ্তকরণের ইসলামের অগ্রবর্তীতা মুসলিম বন্দীকে দাসমুক্তির অংশ দিয়ে মুক্ত করা যাবে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অধীন জাতিসমূহকে কি যাকাত দিয়ে সাহায্য করা যাবে পঞ্চম পরিচ্ছেদঃ আল গারেমূন’- ঋণগ্রস্ত লোকগণ গোরেমূন কারা নিজের প্রয়োজনে ঋণ গ্রহণকারী লোক আকস্মিক বিপদগ্রন্তরা এই পর্যায়ে গণ্য ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ঋণ গ্রহণকারীকে সাহায্যদেয়ার শর্ত ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ঋণ গ্রহীতাকে কত দেয়া হবে ঋণগ্রন্তদের প্রতি ইসলামের ভীতি প্রদর্শন দ্বিতীয় প্রকারঃ অন্য লোকের কল্যাণে ঋণগ্রন্ত হওয়া মৃতের ঋণ শোধে যাকাত ব্যবহার শিয়া জাফরী ফিকাহরও এই মত যাকাত থেকে ‘কারযে হাসানা’ দেয়া ষষ্ঠ পরিচ্ছেদঃ ফী-সাবীলিল্লাহ- আল্লাহর পথে হানাফী মাযহাব মালিকী মাযহাবের মত শাফেয়ী মত হাম্বলী মত আলোচ্য বিষয়ে চারটি মাযহাবের ঐকমত্য যারা সাবীলিল্লাহর তাৎপর্য ব্যাপক মনে করেন কতিপয় ফিকাহবিদের মত আনাস ও হাসান সম্পর্কে বলা কথা জাফরী ইমামিয়া ফিকাহর মত জায়দীয়া ফিকাহর মত الروضة النديه এর লেখকের অভিমত মুহাদ্দিসমন্ডলীর মত-আল কাসেমী রশীদ রিজা ও শালতুতের অভিমত মাখলুকের ফতোয়া তুলনা ও অগ্রাধিকার দান কুরআনে সাবীলিল্লাহ’ ব্যয় করার কথাটির পার্শ্বে ‘সাবীলিল্লাহর’ অর্থ কি যাকাত ব্যয়ক্ষেত্রে ‘সাবীলিল্লাহর অর্থ কোথায় ব্যয় করা হবে কাফরী শাসন থেকে ইসলামী দেশ মুক্তকরণ সব যুদ্ধই ‘ফী সাবীলিল্লাহ’ নয় ইসলামী শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা আল্লাহর পথে জিহাদ একালে ইসলামী জিহাদের বিচিত্র রূপ সপ্তম পরিচ্ছেদঃ ইবনুল সাবীল- নিঃস্বপথিক ইবনুস সাবীল’ কে ইবনুস সাবীল-এর প্রতি কুরআনের বদান্যতা ইবনুস সাবীল- এর প্রতি গুরুত্ব দানের যৌক্তিকতা সামাজিক নিরাপত্তার এক দৃষ্টান্তহীন ব্যবস্থা সফর শুরুকারী ও সফর সমাপ্তকারী জমহুর ফিকাহবিদদের বক্তব্য ইবনুস সাবীল পর্যায়ে ইমাম শাফেয়ীর বক্তব্য এই গ্রন্থকারের বিবেচনা ইবনুস সাবীলকে যাকাত দেয়ার শর্ত ইবনুস সাবীলকে কত দেয়া হবে এযুগে ইবনুস সাবীল পাওয়া যায় কি ইবনুস সাবীল এর বাস্তবরূপ পালিয়ে যাওয়া ও আশ্রয়গ্রহণকারী লোক ফিকাহর পরিভাষায় তাদের কি বলা হবে? নিজ ঘরে থেকেও নিজের মালের ওপর কর্তৃত্ব নেই যার কল্যাণমূলক কাজে বিদেশ গমনকারী আশ্রয় বঞ্চিত লোকেরা পড়ে পাওয়া মানুষ অষ্টম পরিচ্ছেদঃ যাকাত পাওয়ার যোগ্য লোকদের সম্পর্কে পর্যালোচনা যাকাত পাওয়ার যোগ্য লোকদের সম্পর্কে ফিকাহবিদদের সামগ্রিক পর্যালোচনা الروضة النديه গ্রন্থকারের গবেষণা আবূ উবাইদের অগ্রাধিকার দান রশিদ রিজার অগ্রাধিকার দান খাতসমূহের যাকাত বন্টনের সার কথা নবম পরিচ্ছেদঃ যেসব খাতে যাকাত ব্যয় করা হবে না প্রথম আলোচনাঃ ধনী সচ্ছল লোকেরা ছোট বয়সের ধনী পুত্র পিতাকেও ধনী করে দেয় দ্বিতীয় আলোচনাঃ উপার্জনশীল শক্তিসম্পন্ন লোক তৃতীয় আলোচনাঃ অমুসলিমকে যাকাত দেয়া যায়ে কি নাস্তিক, দ্বীন ত্যাগকারী ও ইসলামের সাথে যুদ্ধকারীকে যাকাত দেয়া যাবে না যিম্মীদের যাকাত দেয়া নফল সাদকা দান সাদকায়ে ফিতর থেকে দেয়া জমহুর ফিকাহবিদদের দৃষ্টিতে মালের যাকাত অমুসলিমকে দেয়া জায়েয নয় ইজমা হওয়ার দাবির পর্যালোচনা তুলনা ও অগ্রাধিকার দান ফাসিক ব্যক্তিকে কি যাকাত দেয়া যাবে নামায তরককারী সম্পর্কে বলেছেন সাইয়্যেদ রশীদ রিজার বক্তব্য ইসলামের পরস্পর বিরোধী গোষ্ঠীসমূহকে যাকাত দান চতুর্থ আলোচনাঃ স্বামী, পিতামাতা ও নিকটাত্মীয়কে কি যাকাত দেয়া যাবে স্ত্রীকে যাকাত দেয়া জায়েয নয় স্ত্রী কি তার দরিদ্র স্বামীকে যাকাত দিতে পারে অন্যান্য নিকটাত্মীয়দের যাকাত দানঃ নিষেধকারী ও অনুমতিদানকারী নিকটাত্মীয়দের যাকাত দেয়া জায়েয বলেছেন যারা তুলনা অগ্রাধিকার দান পঞ্চম আলোচনাঃ মুহাম্মাদ (সা) এর বংশ পরিবার যেসব হাদীস মুহাম্মাদ (স) এর বংশ পরিবারের জন্যে যাকাত হারাম বলে আলে মুহাম্মাদ (স) কারা হাশিমীর গণীমত ও ফাই সম্পদের অংশ না পেলে পর্যালোচনা ও অগ্রাধিকার দান ষষ্ঠ আলোচনাঃ যাকাত ব্যয় ভুল-ভ্রান্তি যাকাতদাতা যাকাত ব্যয়ে ভুল করলে কি করা হবে মালিকী মতে যায়দীয়া ফিকাহবিদদের মতে দ্বিতীয় অধ্যায়ঃ যাকাত আদায় করার পন্থা ভূমিকা প্রথম পরিচ্ছেদঃ যাকাতের সাথে রাষ্ট্রের সম্পর্ক যাকাতের ব্যাপারে রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও জবাবদিহি কুরআনের দলিল হাদীস নবী ও খুলাফায়ে রাশেদুনের বাস্তব সুন্নাত সাহাবিগণের ফতোয়া এই ব্যবস্থার তত্ত্ব ও বৈশিষ্ট্য যাকাত সম্পদের ঘর প্রকাশমাল ধন-মাল ও প্রচ্ছন্ন ধনমাল এবং তার যাকাত যে পাবে হানাফিদের রায় মালিকী মাযহাবের বক্তব্য শাফেয়ী মাযহাবের মত বাম্বলী মাযহাবের বক্তব্য জায়দীয়া ফিকাহবিদদের মত আবাজায়ীদের মত শবী, বাকের, আবু রুজাইন ও আওযায়ীর মত তুলনা ও অগ্রাধিকার দান আবূ উবাইদের মত এবং তার পর্যালোচনা এ যুগে যাকাত আদায়ের দায়িত্ব কার ওপর যাকাত গোপনকারী, দিতে অস্বীকারকারী বা দেয়ার মিথ্যা দাবিকারী সম্পর্কে বিভিন্ন মাযহাবের অভিমত হানাফী ফিকাহবিদদের মত মালিকী মাযহাবের মত শাফেয়ী মাযহাবের মত যাকাত দিতে অস্বীকারকারীকে শিক্ষাদান ও জোরপূর্বক গ্রহণে ঐকমত্য যাকাত দিতে অস্বীকারকারীকে তার অর্ধেক মাল নিয়ে শাস্তিদান ও বিভিন্ন মত পর্যালোচনা ও অগ্রাধিকার দান হাম্বলী মাযহাবের মত জায়দীয়া মতের লোকদের বক্তব্য অত্যাচারী শাসকের কাছে যাকাত দেয়ার যাঁরা জায়েয বলেছেন তাঁদের বক্তব্য যাঁরা নিষেধ করেছেন তাঁদের অভিমত এবং দলিল যাঁরা পার্থক্যকরণের মত দিয়েছেন হানাফীদের মত হাম্বলীদের মত তুলনা ও অগ্রাধিকার দান শাসকের মুসলিম হওয়া শর্ত দ্বিতীয় পরিচ্ছেদঃ যাকাতে নিয়তের স্থান যাকাতে নিয়তের শর্তকরণ ইমাম আওযায়ীর মত এবং তার পর্যালোচনা যাকাতের নিয়তের অর্থ কি প্রশাসকের যাকাত গ্রহণ অবস্থায় নিয়ত যাকাতে নিয়তের সময় তৃতীয় পরিচ্ছেদঃ যাকাতের মূল্য প্রদান মূল্য প্রদানে ফিকাহবিদাদের বিভিন্ন মত মতবৈষম্যের কারণ মূল্যদানের নিষেধকারীদের দলিল মূল্য প্রদান জায়েয মতের দলিল তুলনা ও অগ্রাধিকার দান চতুর্থ পরিচ্ছেদঃ যাকাত স্থানান্তকরণ কোন স্থানের জনগণ দারিদ্রমুক্ত হলে সেখানকার যাকাত অন্যত্র নিয়ে যাওয়া জায়েয পূর্ণ অভাবমুক্তি না হওয়া সত্ত্বেও স্থানান্তরি করণে বিভিন্ন মত রাষ্ট্র প্রধানের ইজতিহাদে স্থানান্তর জায়েয বিশেষ প্রয়োজন ও কল্যাণ দৃষ্টিতে ব্যক্তিদের যাকাত স্থানান্তরিতকরণ পঞ্চম পরিচ্ছেদঃ যাকাত প্রদানে দ্রুততা ও বিলম্বিতকরণ দ্রুত ও অনতিবিলম্বে যাকাত দিয়ে দেয়া ফরয যাকাত প্রদানে তাড়াহুড়া করা নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বেই যাকাত আদায় করা যাঁরা জায়েয বলেন না তাঁদের দলিল যাঁরা জায়েয বলেন তাঁদের দলিল অগ্রিম দেয়ার কোন নির্দিষ্ট সীমা আছে কি যাকাত বিলম্বিত করা কি জায়েয বিনা প্রয়োজনে যাকাত প্রদান বিলম্বিত করা যাকাত দেয়ার পর তা বিনষ্ট হয়ে গেলে যাকাত ফরয হওয়ার পর ও প্রদানের পূর্বে মাল ধ্বংস হলে বিষয় দুটিতে মতপার্থক্যের কারণে আগে-পরে হলে কি যাকাত রহিত হবে যাকাতের ঋণ অপরাপর ঋণের তুলনায় ষষ্ঠ পরিচ্ছেদঃ যাকাত প্রদান পর্যায়ে বিভিন্ন বিক্ষিপ্ত আলোচনা যাকাত রহিত করার উদ্দেশ্যে কৌশল অবলম্বন ফিকাহবিদদের বিভিন্ন মত মালিকী মতের লোকেরা কৌশল হারাম বিলুপ্ত করেন হাম্বলী মতের লোকেরা মালিকী লোকদের মতই জায়দীয়া মতের লোকেরা কৌশল অবলম্বন হারাম মনে করেন যাকাতদাতা ও গ্রহীতা কি বলবে যাকাত প্রদানের উকিল নিয়োগ যাকাত প্রকাশ্যভাবে প্রদান ফকীরকে জানাতে হবে না যে এ যাকাত গরীব ব্যক্তির ঋণ রহিত করাকে যাকাত গণ্য করা যাবে তৃতীয় অধ্যায়ঃ যাকাতের লক্ষ্য এবং ব্যক্তি ও সামষ্টিক জীবনে তার প্রভাব ভূমিকা প্রথম পরিচ্ছেদঃ ব্যক্তি জীবনে যাকাতের লক্ষ্য ও প্রভাব প্রথম আলোচনাঃ যাকাতের লক্ষ্য ও দাতার জীবনে তার প্রভাব যাকাত লোভ নিবারক ও তা থেকে পবিত্রকারী যাকাত অর্থদান ও ব্যয়ে অভ্যস্ত করে আল্লাহর চরিত্র ভুষিত হওয়া যাকাত আল্লাহর নিয়ামতের শোকর দুনিয়া প্রেমের চিকিৎসা ধনীর ব্যক্তিত্ব বিকাশে যাকাত যাকাত ভালবাসা উদ্ভাবক যাকাত ধন-মালের পবিত্রতা বিধান করে যাকাত হারাম মাল পবিত্র করে না যাকাত ধন-মালের প্রবৃদ্ধির কারণ দ্বিতীয় আলোচনাঃ গ্রহণকারীর জীবনে যাকাতের লক্ষ্য ও প্রভাব যাকাত তার গ্রহণকারীকে অভাবগ্রস্ততা থেকে মুক্তি দেয় যাকাত হিংসা ও বিদ্বেষ দূর করে দ্বিতীয় পরিচ্ছেদঃ যাকাতের লক্ষ্য ও সমাজ জীবনে তার প্রভাব যাকাত ও সামাজিক নিরাপত্তা যাকাত ও অর্থনৈতিক রূপায়ন যাকাত ও জাতির আধ্যাত্মিক উপাদান পার্থক্য সমস্যা ভিক্ষাবৃত্তি সমস্যা কাজই আসল ভিত্তি লোকদের কাছে চাওয়া হারাম যে ধনাঢ্যতা ভিক্ষঅ হারাম করে কর্মক্ষম লোকদের কর্মসংস্থানই ভিক্ষাবৃত্তি রোধের বাস্তব উপায় অক্ষম লোকদের জীবিকার নিরাপত্তা পারস্পরিক শত্রুতা ও সম্পর্ক বিনষ্টির সমস্যা সৌভ্রাতৃত্ব মৌল ইসলামী লক্ষ্য ইসলামী ভ্রাতৃত্বের দৃষ্টান্তমূলক সমাজ ইসলাম বস্তবভিক্তিক আইন তৈরী করে যুদ্ধ-বিগ্রহ মানব সমাজের আদিম ক্রিয়া ঝগড়া-বিবাদ ও দ্বন্দ্ব-সংগ্রামে ইসলামের ভূমিকা মীমাংসার জন্যে হস্তক্ষেপ করা সমষ্টির দায়িত্ব মীমাংসাকারী কমিটি অর্থনৈতিক দায়-দয়িত্ব একটি ফিকহী প্রশ্ন কঠিন দুঃখপূর্ণ ঘটনার সমস্যা প্রাচুর্য ও বিপদমুক্ততা কালের ঘাত-প্রতিঘাত আকস্মিক দুর্ঘটনা উত্তরকালে বীমা ব্যবস্থা সূচনা করেছে ইসলামী বীমা ব্যবস্থা ঋণগ্রন্তদের অংশে আকস্মিক দুর্ঘটনার সাহায্য আকস্মিক বিপদগ্রস্তকে কত দেয়া হবে চাষের জমির বিপদ কুমারিত্বের সমস্যা ইসলামে বৈরাগ্যবাদ নেই পালিয়ে যাওয়ার সমস্যা একটি জরুরী সতর্কবাণী চতুর্থ অধ্যায়ঃ ফিতরের যাকাত প্রথম পরিচ্ছেদঃ ফিতরের যাকাত এর অর্থ তার হুকুম ও যৌক্তিকতা ফিতরের যাকাত এর অর্থ ফিতরের যাকাতও ওয়াজিব ফিতরের যাকাত বিধিবদ্ধ হওয়ার যৌক্তিকতা দ্বিতীয় পরিচ্ছেদঃ যাকাতুল ফিতল কার উপর ওয়াজিব এবং কাদের পক্ষ থেকে দেয়া ওয়াজিব ফিতরের যাকাত কার ওপর ওয়াজিব স্ত্রী ও শিশুর ওপরও কি ওয়াজিব দর্ভস্থ সন্তানের ফিতরাও কি ওয়াজিব সাদকায়ে ফিতর ওয়াজিব হওয়ার জন্যে নিসাব কি শর্ত দুরিদ্রদের ওপর ফিতরা ওয়াজিব হওয়ার শর্ত দীর্ঘমেয়াদী ঋণ ফিতরা দেয়ার প্রতিবন্ধক নয় তৃতীয় পরিচ্ছেদঃ ওয়াজিব ফিতরার ঋণ এবং কি থেকে দিতে হবে অর্ধ ছা’গম দেয়ার কথা যাঁরা বলেছেন তাঁদের মত এক ছা’ পরিমাণ ওয়াজিব যাঁরা বলেছেন তাঁদের দলিল অর্ধ ছা’ যথেষ্ট বলার সমর্থনে আবূ হানিফার দলিল পর্যালোচনা ও অগ্রাধিকার দান এক ছা’ পরিমাণের বেশী দেয়া কি জায়েয এক ছা’ এর পরিমাণ যেসব জিনিস ফিতরা বাবদ দেয়া হয় মূল্য প্রদান মূল্য প্রদান সম্পর্কিত বিষয়াদি চতুর্থ পরিচ্ছেদঃ ফিতরা কখন ওয়াজিব হয় এবং তা কখন প্রদান করতে হবে ফিতরা কখন ওয়াজিব হয় কখন প্রদান করা হবে পঞ্চম পরিচ্ছেদঃ ফিতরা কাদের দেয়া হবে ফিতরা মুসলমান গরীবকে দিতে হবে যিম্মী মিসকীনদের ব্যাপারে মতানৈক্য ফিতরাও কি যাকাতের আটটি খাতে বন্টনীয় ফিতরা যাকে দেয়া যাবে না স্থানীয় দরিদ্র ব্যক্তি বেশী অধিকারী পঞ্চম অধ্যায়ঃ যাকাত ছাড়া ধন-মালে কোন অধিকার কি স্বীকৃতব্য ধন-মালের যাকাত ছাড়াও কোন অধিকার আছে কি প্রথম পরিচ্ছেদঃ ধন-মালে যাকাত ছাড়া আরও কিছু অধিকার থাকার বিরোধী মত এ মতের সমর্থনে উপস্থাপিত হাদীসসমূহ বিপরীতধর্মী দলিলসমূহ সম্পর্কে তাদের বক্তব্য দ্বিতীয় পরিচ্ছেদঃ ধন-মালে যাকাত ছাড়া অধিকার আছে এই কথায় বিশ্বাসীদের মত তাদের দলিল দ্বিতীয় দলিলঃ কাটাকালে ফসলের হক তৃতীয় দলিলঃ দবাদিপশুর ও ঘোড়ার হক চতুর্থ দলিলঃ অতিথির অধিকার পঞ্চম দলিলঃ নিত্য ব্যবহার্য জিনিসের হক ষষ্ঠ দলিলঃ মুসলিম সমাজে পারস্পরিক দায়িত্ব গ্রহণ কর্তব্য ইবনে হাজম এ মতটি পক্ষাবলম্বন করেছেন কুরআনী দলিল হাদীসের দলিল সাহাবিগণের উক্তি ভিন্ন মতের লোকদের ইবনে হাজমের সমালোচনা তৃতীয় পরিচ্ছেদঃ মুক্তকরণ ও অগ্রাধিকার দান দুই পক্ষের মধ্যকার দ্বন্দ্বের ক্ষেত্রে উদঘাটন পর্যালোচনা ও অগ্রাধিকার দান ভিন্ন মতের লোকদের দলিল হিসেবে উপস্থাপিত হাদীসসমূহের তাৎপর্য ষষ্ঠ অধ্যায়ঃ যাকাত ও কর প্রথম পরিচ্ছেদঃ কর-এর মৌল তত্ত্ব ও যাকাতের মৌল তত্ত্ব যাকাত ও কর এর পারস্পারিক একত্বের কতিপয় দিক যাকাত ও কর এর মধ্যে পার্থক্যের দিকসমূহ যাকাত, ইবাদত ও কর-একসাথে দ্বিতীয় পরিচ্ছেদঃ কর ধার্যকরণ ও যাকাত ফরযকরণের দার্শনিক ভিত্তি কর’ ধার্যকরণের আইনগত ভিত্তি সামাজিক চুক্তি সংক্রান্ত মতবাদ রাষ্ট্রের প্রাধান্যের মতবাদ যাকাত ফরয করার ভিত্তি শরীয়াত পালনে বাধ্য করার সাধারণ দৃষ্টিকোণ খলিফা বানানোর মত ব্যক্তি ও সমষ্টির মধ্যকার দায়িত্ব গ্রহণের মতবাদ মুসলমানদের মধ্যে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব তৃতীয় পরিচ্ছেদঃ কর ধার্যের ক্ষেত্রে বনাম যাকাত ধার্যের ক্ষেত্রে প্রথম আলোচনাঃ মুলধনে যাকাত যাকাতে মূলধন করের বৈশিষ্ট্য আছে-দোষ ত্রুটি নেই মূলধনের ওপর কর ধার্যের বৈশিষ্ট্য-তার সমর্থকদের দৃষ্টিতে মূলধনের ওপর কর ধার্যকরণ বিরোধীদের বক্তব্য মূলধনের ওপর কর ধার্যকরণ কালে অবশ্য গ্রহণীয় সতর্কতা যাকাত ফরযকরণের এই বিষয়গুলোর ওপর লক্ষ্য আরোপে ইসলামের অগ্রবর্তীতা দ্বিতীয় আলোচনাঃ আয় ও উৎপন্নের উপর যাকাত আয়-এর তাৎপর্য ইসলাম শরীয়াতের আয়ের যাকাত তৃতীয় আলোচনাঃ ব্যক্তিদের উপর ধার্য যাকাত ব্যক্তিদের উপর ধার্য কর বিশেষত্ব ও দোষ ত্রুটি ফিতারার যাকাতে ব্যক্তিগণের কর এর মতই সুবিধা চতুর্থ পরিচ্ছেদঃ কর ও যাকাতের মধ্যে সুবিচারের ভূমিকা প্রথম আলোচনাঃ সুবিচার ও ন্যায়পরতার ক্ষেত্রে প্রথমঃ যাকাত ফরয হওয়ার সমতা ও সাম্য দ্বিতীয়ঃ নিসাবের কম পরিমাণ ধন-মাল বাবদ যাবে তৃতীয়ঃ জোড়া যাকাত নিষিদ্ধ চতুর্থঃ কষ্টের পার্থক্যের দরুন যাকাত পরিমাণে পার্থক্য পঞ্চমঃ করদাতার ব্যক্তিগত অবস্থার প্রতি লক্ষ্য দান ষষ্ঠঃ সংগতি বিধানে সুবিচার দ্বিতীয় আলোচনাঃ দৃঢ় প্রত্যয় তৃতীয় আলোচনাঃ মধ্যম নীতি অনুসরণে পঞ্চম পরিচ্ছেদঃ কর’ ও যাকাতের’ মধ্যে স্থিতি ও ঊর্ধ্বগামিতা স্থিতিশীল কর ও ঊর্ধ্বগামী কর যাকাত ঊর্ধ্বমুখী নীতিতে গ্রহণ করা হয় না কেন ষষ্ঠ পরিচ্ছেদঃ কর-এর নিশ্চয়তা যাকাতের নিশ্চয়তা কর’ ফাঁকি দেয়া কর’ ফাকি দেয়ার কারণ কর’ ফাঁকি দেয়ার ধরণ ও পদ্ধতি কর ফাঁকি দেয়ার ক্ষতি ফাঁকি প্রতিরোধ ও কর দেয়া নিশ্চিতকরণ ইসলামী শরীয়াতে যাকাতের নিশ্চয়তা দ্বীনী ও নৈতিক নিশ্চয়তা আইনগত ও সাংগঠনিক নিশ্চয়তা যাকাত সংগ্রহকারীদের সহযোগিতা করা ও কোন জিনিস গোপন না করার নির্দেশ যাকাত এড়ানোর কৌশল অবলম্বণ নিষিদ্ধ যাকাত দিতে অস্বীকারকারীর অপরাধ ও আর্থিক দন্ড সপ্তম পরিচ্ছেদঃ যাকাতের পরও কি কর ধার্য হবে প্রথম আলোচনাঃ যাকাতের পাশাপাশি কর ধার্যকরণ জায়েয হওয়ার দলিল প্রথমঃ সামষ্টিক দায়িত্ব গ্রহণ কর্তব্য দ্বিতীয়ঃ যাকাত ব্যয় ক্ষেত্র সুনির্দিষ্ট, রাষ্ট্রের আর্থিক দায়িত্ব বহু তৃতীয় শরীয়াতের সর্বাত্মক নিয়ম চতুর্থঃ মাল দিয়ে জিহাদ এবং বড় পরিমাণ ব্যয়ের দাবি পঞ্চমঃ জনসম্পদের লাভবান হওয়া দ্বিতীয় আলোচনাঃ কর ধার্যকরণের অবশ্য পালনীয় শর্তাবলী প্রথম শর্তঃ অর্থের প্রকৃত প্রয়োজন- অন্য আয়সূত্র না থাকা দ্বিতীয় শর্তঃ কর-এর বোঝা ইনসাফ সহকারের বন্টন তৃতীয় শর্তঃ জাতীয় কল্যাণে ব্যয় করতে হবে পাপ ও নির্লজ্জতার কাজে নয় চতুর্থ শর্তঃ উপদেষ্টা পরিষদ ও জনমতের সামঞ্জস্য রক্ষা পরামর্শ করা কুরআন সুন্নাহর প্রমাণে ফরয পরামর্শ কি জ্ঞানদানকারী না বাধ্যতামূলক তৃতীয় আলোচনাঃ কর ধার্যের বিরোধীদের সংশয় প্রথম সংশয়ঃ ধন-মালের যাকাত ছাড়া আর কিছু প্রাপ্য নেই দ্বিতীয় সংশয়ঃ ব্যক্তিগত মালিকানার মর্যাদা রক্ষা তৃতীয় সংশয়ঃ কর ও শুল্ক ধার্যকারণের বিরুদ্ধে বর্ণিত হাদীস প্রথম সংশয়ের জবাব তৃতীয় সংশয়ের জবাবঃ শুল্ক কর শরীয়াতসম্মত কর নয় মুসলমানদের عشور মুক্তি সংক্রান্ত হাদীসের তাৎপর্য আবূ উবাইদের ব্যাখ্যা তিরমিযীর ব্যাখ্যা আল মুনাভীর অভিমত ও তার পর্যালোচনা চার মাযহাবের ফিকাহবিদগণ সুবিচারপূর্ণ কর জায়েয মনে করেন হানাফী ফিকাহতে অবশিষ্ট তিনটি মাযহাবের ফিকাহতে অত্যাচারমূলক কর পর্যায়ে ফিকহী খুঁটিনাটি অষ্টম পরিচ্ছেদ যাকাতের পর কর ধার্যের প্রয়োজন হবে না মুসলিম জীবনের বাস্তব বৈপরীত্য এই বৈপরীত্য সৃষ্টিতে সম্রাজ্যবাদের প্রভাব যাকাতের ব্যাপারে ইসলামী সরকারের দায়িত্ব সরকার যাকাত না নিলে ব্যক্তির দায়িত্ব কি কর দিয়েই যাকাতের দায়িত্ব থেকে মুক্তির ফতোয়া অধিকাংশ আলিম কর বা مكس কে যাকাত পর্যায়ের মনে করেন না ইবনে হাজার হায়সামীর বক্তব্য ইবনে আবেদীনের বক্তব্য শায়খ আলী শের ফতোয়া সাইয়্যেদ রশীদ রিজর ফতোয়া শায়খ শালতুতের ফতোয়া শায়খ আবু জুহরার অভিমত সার কথা উপসংহার ইসলামের যাকাত এক অভিনব ও অনন্য ব্যবস্থা যাকাত একটা আর্থিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তা একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা তা একটি নৈতিক ব্যবস্থা সর্বোপরি তা একটা দ্বীনী ব্যবস্থা যাকাতের পক্ষে ভিন্নমতের লোকদের সাক্ষ্য মুসলিম সমাজ সংস্কারকদের কথা ইসলামের মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্যে যাকাত আদায় বাধ্যতামূলক করাই যথেষ্ট যাকাত উম্মতের কাছ থেকে ও তাদের প্রতি মুসলিম সমাজে যাকাতের ভূমিকা ইসলামে যাকাতের উজ্জ্বলতম দিক শেষ কথা ইসলামের যাকাত বিধান দ্বিতীয় খন্ড بسم الله الرحمن الرحيم আল্লাহর বিধান خُذْ مِنْ أَمْوَالِهِمْ صَدَقَةً تُطَهِّرُهُمْ وَتُزَكِّيهِمْ بِهَا وَصَلِّ عَلَيْهِمْ إِنَّ صَلَاتَكَ سَكَنٌ لَهُمْ وَاللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ লোকদের ধন-মাল থেকে যাকাত গ্রহণ কর, তার দ্বারা তাদের পবিত্র ও পরিশুদ্ধ কর এবং তাদের জন্যে কল্যাণের দো’আ কর। নিঃসন্দেহে তোমার এই দো’আ তাদের জন্যে পরম সান্ত্বনার কারণ। আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা সর্বজ্ঞ। প্রথম অধ্যায় যাকাত ব্যয়ের খাত ফকীর ও মিসকীন (যাকাত আদায় ও বন্টন কাজে) নিয়োজিত কর্মচারীবৃন্দ যেসব লোকের মন জয়ের প্রয়োজন দাস মুক্তকরণ ঋণগ্রস্ত লোক আল্লাহর পথে নিঃস্ব পথিক যাকাত পাওয়ার অধিকারী বিভিন্ন প্রকার লোকদের সম্পর্কে বিছিন্ন আলোচনা যেসব ব্যক্তির জন্যে যাকাত ব্যয় করা হবে না ভূমিকা কুরআন মজীদে যাকাত প্রসঙ্গে নামায অপেক্ষাও সংক্ষিপ্ত এবং মোটামুটিভাবে আলোচিত হয়েছে। কোন সব ধন-মালে যাকাত ফরয হবে, তাতে কত পরিমাণ হলে কত পরিমাণ যাকাত ধার্য হবে, কুরআনের আয়াতসমূহে তা বলা হয়নি। এ পর্যায়ে যেসব শর্ত রয়েছে- যেমন মালিকানার একটি বছর অতিবাহিত হওয়ার, নির্দিষ্ট নিসাব পরিমাণের মালিক হওয়া এবং তার কম পরিমাণের ওপর যাকাত ধার্য না হওয়া-ইত্যাদি বিষয়েও কুরআন মজীদে কিছুই আলোচিত হয়নি। আইন প্রনয়নমূলক ‘সুন্নাত’ এ পর্যায়ে বিরাট অবদান রেখেছে। তা যেমন রাসূলে করীম (স) এর কথার দ্বারা প্রমাণিত, তেমনি তাঁর কাজও এক্ষেত্রে অকাট্য ও স্পষ্ট। তা যাকাত পর্যায়ের অবিস্তারিত কথাকে সবিস্তারে উপস্থাপিত করেছে, যেমন সুস্পষ্ট করে দিয়েছে নামায সংক্রান্ত যাবতীয় কথা। আর অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য ও সুবিন্যস্ত মহান ব্যক্তিগণ নবী করীম (স) থেকে তা অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে বর্ণনা করেছেন। এই বর্ণনা বংশানুক্রমে যুগের পর যুগ ধরে অবিচ্ছিন্ন ধারাবাহিকতা সহকারে চলে এসেছে। এ কারণে নবী করীম (স) এর সুন্নাতের প্রতি ঈমান আনা ও রাখা একান্তই জরুরী এবং সে ঈমান অনুযায়ী সুন্নাতকে গৃহীত হতে হবে ইসলামের শিক্ষার আইন প্রণয়নের উৎস হিসেবে। বস্তুত ইসলামী আইন বিধানের জন্যে কুরআনের পরে পরে ও সঙ্গে সঙ্গে এই সুন্নাতই হচ্ছে তার উৎস, তার ব্যাখ্যাকারী, বিস্তারিত বর্ণনাকারী, প্রতিটি বিষয়কে স্বতন্ত্র মর্যাদায় অভিষিক্তকারী এবং সুনির্দিষ্টকারী। মহান আল্লাহ সত্যই বলেছেনঃ وَأَنْزَلْنَا إِلَيْكَ الذِّكْرَ لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ إِلَيْهِمْ وَلَعَلَّهُمْ يَتَفَكَّرُونَ এবং আমরা তোমার প্রতি আল-কুরআন নাযিল করেছি, যেন তুমি হে নবী লোকদের জন্যে বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করে বলে দাও তা যা তাদের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে। তাতেই আশা করা যায়, তারা সে বিষয়ে চিন্তা ভাবনা করবে। (সূরা নহলঃ ৪৪) আবু দাউদ বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেনঃ হযরত ইমরান ইবনে হুসাইন (রা) কে এক ব্যক্তি বললেন, “হে আবু নুজাইদ, আপনি কেন এমন কিছু হাদীস আমাদের নিকট বর্ণনা করেন, যার কোন ভিত্তি কুরআন মজীদে খুঁজে পাওয়া যায় না?” একথা শুনে হযরত ইবরান রাগান্বিত হলেন এবং লোকটিকে বললেন, “প্রতি চল্লিশ দিরহামে এক দিরহাম বা একটি ছাগী বাবদ এই এই এবং এতটি উটের মধ্যে দিতে হবে, এসব কথা কি তোমরা কুরআন মজীদে পেয়েছে?” বললে, না তা পাইনি।” বললেন “হ্যা “কুরআনে তা পাওনি, তাহলে এসব কথা কোথেকে জানতে পারলে? তোমরা এসব কথা জানতে পেরেছ আমাদের নিকট থেকে এবং আমরা তা জানতে পেরেছি স্বয়ং নবী করীম (স) থেকে।” বর্ণনাকারী বলছেন, এ পর্যায়ে সাহাবী আরও অনেক কয়টি জিনিসের উল্লেখ করেছেন। কুরআনে যাকাত ব্যয়ের খাতের উল্লেখ পূর্বে যেমন বলেছি, কুরআন মজীদে যাকাতের ব্যাপারটি সংক্ষিপ্ত ও অবিস্তারিতভাবে আলোচিত হয়েছে। তবে যাকাত কোথায় এবং কার জন্যে ব্যয় করা হবে, কুরআনে তা উদ্ধৃত হয়েছে। এই ব্যাপারটি কোন প্রশাসকের ইচ্ছার ওপর ছেড়ে দেয়া হয়নি। আর সেসব লোভী লোকদের জন্যে তা করায়ত্ত্ব করার সুযোগও রাখা হয়নি, যাদের জন্যে যাকাতে কোন অংশই নির্দিষ্ট নেই। ফলে তারা তা পাওয়ার প্রকৃত যোগ্যতাসম্পন্ন লোকদের সাথে কোনরূপ প্রতিযোগিতা বা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে না। স্বয়ং রাসূলে করীম (স) এ জীবদ্দশায় অনুরূপ ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল। তখন কতিপয় লোভী ও দুষ্ট মানসিকতাসম্পন্ন ব্যক্তি বিশেষভাবে লালায়িত হয়ে উঠেছিলো। সাদকা ও যাকাতের মালের লোভে তাদের মুখে পানি জমেছিল। মনে করেছিল, রাসূলে করীম (স) তাদের সংগ্রহ-উৎসাহ দেখে তাদের প্রতি কৃপার দৃষ্টি নিক্ষেপ করবেন ও কিছু না কিছু দিয়ে তাদের লালসা প্রতিনিবৃত্ত করবেন। কিন্তু নবী করীম (সা) তাদের প্রতি ভ্রুক্ষেপ মাত্র করলেন না, তাদের ভাগে যাকাতের কোন অংশ দিয়ে করে দিতে প্রস্তুত হলেন না। তখন তারা রাসূলে করীম (স) এর বিরুদ্ধে কুৎসা রচাতে শুরু করে দিল। এমন কি নবীর উচ্চতর ও মহানতার মর্যাদার ওপরও কটাক্ষ করতে কুণ্ঠাবোধ করল না। এই অবস্থায় কুরআনের আয়াত নাযিল হয়ে তাদের মুনাফিকী মতোবৃত্তি উদ্ঘাটিত করে দিল। তাদের কুৎসিৎ মন-মানসিকতা লোককদের সম্মখে স্পষ্ট করে তুলে ধরল। তাদের ব্যক্তি-স্বার্থের লোলুপ জিহ্বার ফণা চুর্ণ করে দিল। সেই সাথে যাকাত ব্যয়েরে সঠিক ক্ষেত্রে ও খাতসমূহের সুস্পষ্ট উল্লেখও করা হল। কুরআনের সে আয়াতটি এই وَمِنْهُمْ مَنْ يَلْمِزُكَ فِي الصَّدَقَاتِ فَإِنْ أُعْطُوا مِنْهَا رَضُوا وَإِنْ لَمْ يُعْطَوْا مِنْهَا إِذَا هُمْ يَسْخَطُونَ وَلَوْ أَنَّهُمْ رَضُوا مَا آتَاهُمُ اللَّهُ وَرَسُولُهُ وَقَالُوا حَسْبُنَا اللَّهُ سَيُؤْتِينَا اللَّهُ مِنْ فَضْلِهِ وَرَسُولُهُ إِنَّا إِلَى اللَّهِ رَاغِبُونَ إِنَّمَا الصَّدَقَاتُ لِلْفُقَرَاءِ وَالْمَسَاكِينِ وَالْعَامِلِينَ عَلَيْهَا وَالْمُؤَلَّفَةِ قُلُوبُهُمْ وَفِي الرِّقَابِ وَالْغَارِمِينَ وَفِي سَبِيلِ اللَّهِ وَابْنِ السَّبِيلِ فَرِيضَةً مِنَ اللَّهِ وَاللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٌ- লোকদের মধ্যে কেউ কেউ যাকাতের ব্যাপারে- হে নবী- তোমাকে জ্বালাতন করে। তা থেকে কিছু তাদের দেয়া হলে তারা খুব খুশী ও সন্তুষ্ট হয় আর কিছু দেয়া না হলে ঠিক তখনই তারা হয় অসন্তুষ্ট। অথচ আল্লাহ এবং রাসূল তাদের যা কিছু দেন, তা পেয়েই তারা যদি সন্তুষ্ট থাকত এবং বলত, আল্লাহই আমাদের জন্যে যথেষ্ট, তিনি নিশ্চয়ই তাঁর অনুগ্রহ আমাদের দেবেন এবং তাঁর রাসূলও; আমরা নিশ্চয়ই আল্লাহর প্রতি আগ্রহশীল। আসল কথা হচ্ছে, সাদকাত- যাকাত- গরীব মিসকীন, তাঁর জন্যে নিয়োজিত কর্মচারী, যাদের হৃদয় আকৃষ্ট করতে হবে, যাদের গর্দান দাসত্ব শৃংখলে বন্দী, যারা ঋণগ্রস্ত, আল্লাহর পথে এবং নিঃস্ব পথিক- এ সবের জন্যে নির্দিষ্ট। এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে ধার্য। আর আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও সুবিজ্ঞনী। (সূরা তওবাঃ ৫৮-৬০) এ আয়াতটি নাযিল হওয়ার ফলে যাকাত সম্পদের প্রতি সর্বপ্রকার লোভ-লালসা যেমন নিঃশেষ হয়ে গেল, তেমনি তার ব্যয় ও বন্টনের ক্ষেত্র বা খাতসমূহ সুম্পষ্ট ও প্রকট হয়ে উঠল। প্রত্যেকেই জানতে পারল তাতে কার কি হক বা অধিকার রয়েছে। আবূ দাঊদ জিয়াদ ইবনুল হারিস আস-সাদায়ীর সুত্রে বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন। তিনি বলেছেনঃ আমি রাসূলে করীম (স) এর নিকট উপস্থিত হলাম এবং অতঃপর তাঁর হাতে বায়’আত করলাম। এ পর্যায়ে তিনি দীর্ঘ কাহিনী বর্ণনা করেছেন- এ সময় তাঁর নিকট এক ব্যক্তি আসল এবং বললঃ আমাকে যাকাত থেকে দান করুন। তখন রাসূলে করীম (স) তাকে বললেনঃ যাকাতের ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলা কোন নবী বা অন্য কারুর কথা বলার অবকাশ রাখতে রাজী হন নি। বরং এ পর্যায়ে তিনি নিজেই চূড়ান্ত ফায়সালা দান করেছেন। আল্লাহ তা’আলা যাকাত সম্পদকে আটটি ভাগে বিভক্ত করার ব্যবস্থা দিয়েছেন। তাই তুমি যদি সেই আট ভাগের কোন ভাগে গণ্য হও, তা হলে আমি তোমাকে প্রাপ্য হক দেব। [এই হাদীসের সনদে একজন বর্ণনাকারী হচ্ছেন আবদুর রহমান ইবনে জিয়াদ ইবন আনউম আল-আফ্রিদী। অনেক হাদীসবিদ তাঁর সম্পর্কে আপত্তি তুলেছেন।] যাকাত-ব্যয় খাত পর্যায়ে কুরআনী ঘোষণার তাৎপর্য অর্থনীতি ও সমাজতত্ত্ববিদ মনীষিগণ বলেছেন, ধন-সম্পদের ওপর কর ধার্যকরণ ও তা আদায় বা সংগ্রহকরণের ব্যাপারটি খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়। সরকার মাত্রই নানা উপায় ও পন্থার মাধ্যমে নানাবিধ কর আদায় করতে সক্ষম। অবশ্য তা অনেক ক্ষেত্রে ইনসাফ ও সুবিচারের ভিত্তিতেই হয়ে থাকে। কিন্তু সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, সংগ্রহ ও আদায় করার পর তা কোথায় ব্যয় করা হবে? এখানেই বিচারের মানদন্ড একদিকে ঝুঁকে পড়ে, মানুষের লালসা শয়তানী খেলায় মেতে উঠে। তখন ধন-মাল সেই লোক গ্রহণ করে থাকে, যে তা ন্যায়ত পাওয়ার যোগ্য বা অধিকারী নয়। আর বঞ্চিত থেকে যায় সেসব লোক, যারা তা পওয়ার প্রকৃত অধিকারী। এই কারণেই কুরআন মজীদ ও ব্যাপারটির ওপর যথাযথ গুরুত্বরোপ করেছে এবং ব্যাপাটিকে কিছু মাত্র অস্পষ্ট করে রাখেনি- যাকাত সংক্রান্ত বহু ব্যাপারই যেমন সুন্নাতের ব্যাখ্যার জন্যে ছেড়ে দিয়েছে; কিন্তু এই মূল ব্যাপারটি সে রকম রাখা হয়নি- এটা ‍কিছুমাত্র বিচিত্র নয়। ইসলামের পূর্বকালীন বহু প্রকারের কর ধার্যকরণের অর্থনৈতিক ইতিহাস সর্বজনজ্ঞাত। বিভিন্ন গোষ্ঠী ও গোত্রের নিকট থেকে তখন নানা প্রকারের কর আদায় করা হত; করা হত কোথাও জোর-জবরদস্তি করে, কোথাও লোকদের রাজী ও সন্তুষ্ট করে। তা সঞ্চয় করা হত অহংকারী রাজা-বাদশার খাজাঞ্চিখানায়। তারা তা নিজেদের ও তাদের নিকটাত্মীয়দের খাহেশ ও খেয়াল খুশীমত ব্যয় ও ভোগ-ব্যবহার করত। তাদের বিলাসিতা ও বড়লোকী বৃদ্ধি পেত, তাদের আধিপত্য ও কর্তৃত্ব প্রকাশ পেত। আর ওদিকে গরীব-মিসকীন, দর্বল, শ্রমজীবী চাষী-মুজুররা চরমভাবে শোষিত, নির্যাতিত ও বঞ্চিত হয়ে থাকতে বাধ্য হত। কিন্তু ইসলাম এসে সর্বপ্রথম এই অভাবগ্রস্থ জনগণের প্রতি কৃপার দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। তাদের জন্যে বিশেষভাবে যাকাত সম্পদে একটা পর্যাপ্ত পরিমাণ অংশ নির্দিষ্ট করে দিল। আর সাধারণভাবে সমগ্র জাতীয় সম্পদের আবর্তনেও অনুরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ করল। অর্থনৈতিক জগতে কর ধার্যকরণ ও সরকারী ব্যয় বন্টন ক্ষেত্রে ইসলামের এই সামষ্টিক কল্যাণমূলক পদক্ষেপ সর্বাগ্রে গৃহীত ব্যাপার। মানবতা দীর্ঘকাল পর এই বিষয়ে জানতে ও অবহিত হতে পেরেছে। যাকাত পাওয়ার অধিকারী লোকদের পর্যায়ে কুরআনুল করীম যা কিছু বলেছে, রাসূলে করীম (স) এর ও খুলাফায়ে রাশেদুনের সুন্নাতে যা বিশ্লেষণ করা হয়েছে, তার আলোকে আমরা আটটি যাকাত ব্যয় খাত সম্পর্কে পরবর্তী সাতটি পরিচ্ছেদে বিস্তারিত আলোচনা করব। অষ্টম পরিচ্ছেদে আলোচনা করা হবে যাকাত পাওয়ার অধিকারী লোকদের বিভিন্ন প্রকার সম্পর্কে। আর যাদের জন্যে যাকাত ব্যয় করা আদৌ জায়েয নয় তাদের সম্পর্কে আলোচনা করা হবে সর্বশেষে। প্রথম পরিচ্ছেদ ফকীর ও মিসকীন [‘ফকীর’ একবচন, বহুবচনে কুকারা’। মিসকীন একবচন বহুবচনে মাসাকীন] উপরে উদ্ধৃত সূরা তওবার আয়াতিটি যাকাত ব্যয়ের খাত বা ক্ষেত্রে সুস্পষ্টভাবে নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। সে খাত হচ্ছে আটটি। তন্মধ্য প্রথম দুইটি খাত হচ্ছেঃ ফকীর ও মিসকীন। যাকাত সম্পদে আল্লাহ তা’আলা সর্ব প্রথমে তাদের জন্যেই অংশ নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। এ থেকে সুস্পষ্ট বোঝা যায়, দারিদ্র্য ও অভাব-অনটন দূর করাই যাকাতের প্রথম লক্ষ্য। ইসলামী সমাজে দারিদ্র্য অভাব-অনটনের কোন স্থিতি থাকতে পারে না। তার বড় প্রমাণ, এ পর্যায়ে কথা শুরু করে কুরআন মজীদ সর্বপ্রথম ফকীর ও মিসকীনদের কথাই বলেছে। আর আরবী কথন রীতি হচ্ছে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের কথা সর্বপ্রথম বলা। দারিদ্র দূর করা ও ফকীর-মিসকীনদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বিধানই যাকাত ব্যবস্থার প্রথম লক্ষ্য – যাকাতের আসল উদ্দেশ্য। সেই কারণে নবী করীম (স) ও কোন কোন হাদীসে শুধু এ কথাটিরই উল্লেখ করেছেন। তিনি হযরত মুয়ায (রা) কে যখন ইয়েমেনে পাঠাচ্ছিলেন, তখন তাঁকে বললেনঃ (আবরী***********) তাদের জানিয়ে দেবে যে, তাদের ওপর যাকাত ফরয করা হয়েছে, যা তাদের ধনী লোকদের নিকট থেকে নেওয়া হবে এবং তাদের গরীব লোকদের মধ্যে বণ্টন করা হবে। ’ফকীর’ ও মিসকীন বলতে কাদের বোঝায়? কুরআনের আয়াতে উদ্ধৃত ফকীর’ ও মিসকীন’ বলতে কাদের বোঝায়? এরা কি দুই ধরনের লোক না একই পর্যায়ের এবং অভিন্ন? হানাফী মতের ইমাম আবু ইউসূফ এবং মালিকী মাযহাবের ইবনুল কাসেম মত প্রকাশ করেছেন যে, ফকীর ও মিসকীন বলতে আসলে একই লোক বোঝায়। কিন্তু জমহুর ফিকাহবিদদের মতে এরা আসলেই দুই ধরনের লোক- একই প্রজাতিভুক্ত। আর সে প্রজাতি হচ্ছে অভাব-অনটন লাঞ্ছিত জনগণ। তবে শব্দ দুটির তাৎপর্য নির্ধারণে তাফসীরকার ও ফিকাহবিদগণের ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। অবশ্য একটি আয়াতে একই প্রসঙ্গে শব্দ দুটি ব্যবহৃত হয়েছে, তাৎপর্য নির্ধারণে এ বিষয়টির প্রতি অবশ্যই গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। এ ঠিক ‘ইসলাম’ ও ঈমান শব্দদ্বয়ের ব্যবহারের মত বিশেষজ্ঞগণ বলেছেন, এ দুটি শব্দ এক স্থানে ব্যবহৃত হলে তাৎপর্য ভিন্ন ভিন্ন হবে। তখন প্রতিটি শব্দের একটা বিশেষ অর্থ হবে। আর এ দুটি ভিন্ন ভিন্ন স্থানে ব্যবহৃত হলে অর্থ হবে অভিন্ন অর্থাৎ একটার উল্লেখ হলে অপরটির অর্থও তার মধ্যে শামিল আছে বলে মনে করতে হবে। এই দৃষ্টিতেই প্রশ্ন উঠেছে, এখানে ‘ফকীর, ও মিসকীন’ এই শব্দদ্বয়ের প্রকৃত তাৎপর্য কি? শায়খুল মুফাসসিরীন ইমাম তাবারী লিখেছেন, ফকীর অর্থঃ (আরবী*******************) সেই অভাবগ্রস্থ ব্যক্তি, যে নিজেকে সর্বপ্রকারের লাঞ্ছনা থেকে রক্ষা করে চলছে, কারুর নিকটই কিছুর প্রার্থনা করে না। আর ‘মিসকীন’ হচ্ছে লাঞ্ছনাগ্রস্ত অভাবী ব্যক্তি, যে চেয়ে ভিক্ষা করে করে বেড়ায়। তার এই ব্যাখ্যার সমর্থনে তিনি বলেছেন, - মাসকানা- দারিদ্র্য শব্দটিই এই কথা বোঝায়, যেমন আল্লাহ তাআলা ইয়াহুদীদের প্রসঙ্গে বলেছেনঃ (আরবী****************) তাদের ওপর লাঞ্ছনা ও দারিদ্র্য চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। [(আরবী*********)] (সূরা বাকারাঃ ৬১) সহীহ হাদীসে বলা হয়েছেঃ সে মিসকীন নয়, যাকে একটি বা দুটি খেজুর দিয়ে দেয়া হয়। বরং মিসকীন সে, যে নিজেকে পবিত্র রেখে চলে।[বুখারী ও মুসলিম- বর্ণনাকারী হযরত আবু হুরায়রা (রা)] তবে এটা মিসকীন শব্দের আভিধানিক অর্থ নয়। অথচ আভিধানিক অর্থই তাদের নিকট গ্রহণীয়। এই কথাটি এ পর্যায়ের, যেমন বলা হয়েছে, কুস্তিগিরি দ্বারা শক্তিমত্তার পরিচয় হয় না, শক্তিধর সে যে ক্রোধের সময় নিজেকে সামলাতে পারে।’ এই কারণে ইমাম খাত্তাবী বলেছেনঃ লোকেরা বাহ্যত তাকেই মিসকীন বলে মনে করে, যে ভিক্ষার জন্যে ঘরে বেড়ায়। কিন্তু নবী করীম (স) তাকে মিসকীন বলেন নি। কেননা সে তো ভিক্ষা করে প্রয়োজন পরিমাণ অনেক ক্ষেত্রে তার চাইতেও অধিক-আয় করে থাকে। তখন তার অভাব মিটে যায়। দারিদ্র্যের নাম- চিহ্ন পর্যন্ত মুছে যায়। তাবে যে ব্যক্তি দরিদ্র হয়েও ভিক্ষাবৃত্তি গ্রহণ করেনি, তাকে অভাব ও দারিদ্র্য অক্ষুন্নই থেকে যায়। কেউ তার কষ্টের কথা বুঝে না, দেয়ও না তাকে কিছু। [(আরবী*******)] ফিকাহবিদগণও বিভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। তাঁদের মনে প্রশ্ন জেগেছে, এই দুই ধরনের দরিদ্র ব্যক্তির মধ্যে অধিক দুরবস্থা কার। - ফকীরের, না মিসকীনের? শাফেয়ী ও হাম্বলী মতে ফকীর এর অবস্থাই অধিক খারাপ। মালিকীদের নিকট ব্যাপারটি উল্টো- হানাফীরাও এই মত গ্রহণ করেছেন বলে সকলে জানেন। উভয় পক্ষের নিকট অভিধান ও শরীয়াত- দুই দিক দিয়েই দলীল রয়েছে। শব্দ দিয়ে তাৎপর্য নির্ধারণে উপরিউক্ত মতদ্বৈততার ব্যাপারটি যত গুরুত্বপূর্ণই হোক, তারা নিজেরাই চূড়ান্ত করে বলেছেন যে, এর কোন দীর্ঘসূত্রিতা নেই, আর এর তত্ত্বানুসন্ধানের পরিণতিতে যাকাতের ব্যাপারে আপরণযোগ্য কোন ফলই পাওয়া যাবে না। [প্রাচ্যবিদ শাখত ‘ইসলামী বিশ্বকোষ’ এ ফকীহ ও মিসকীন শব্দদ্বয় প্রসঙ্গে আলোচনাকালে দুঃখজনক ভূমিকা গ্রহণ করেছেন। বলেছেন, ফুকারা ও মাসাকীন শব্দদ্বয়ের মধ্যে যে পার্থক্য করা হয় তা খুবই অবিচারমূলক। ফিকাহর আলিমগণ সর্বাবস্থায়ই সংজ্ঞার এমন ব্যাখ্যা দিতে অভ্যস্ত হয়েছেন, যেন তারা নিজেরাই দুইটি শ্রেণীর মধ্যে কোন একটির মধ্যে প্রধান হিসেবে গণ্য হতে পারেন। (১০ম খণ্ড, ৩৬০ পৃ.) কিন্তু আলিম চরিত্রসম্পন্ন কোন ব্যক্তির নিকট থেকেই এরূপ দুর্বলতা প্রকাশিত হওয়া নিতান্তই অবাঞ্ছিত। হানাফী মাযহাবের সরখসী বা মালিকী মাযহাবের ইবনুল আরাবী, শাফেয়ী মাযহাবের নব্বী, হাম্বলী মাযহাবের ইবনে কুদামাহ, জাহিরী মতের ইবনে হাজম প্রমুখ ইসলামী মাযহাব সমূহের ফিকাহবিদগণ। দারিদ্র্য বা অনটনগ্রস্ত হওয়ার ভান করে যাকাতের অংশ গ্রহণের লোভ করেবেন- এমন কথা চিন্তাই করা যায় না। সংজ্ঞাসমূহের মনগড়া ব্যাখ্যা দিয়ে কোন বৈষয়িক স্বর্থ উদ্ধারের চেষ্টা করবেন, তাও নিতান্তই অকল্পনীয়। কেননা এসব ফিকাহবিদ দানকারী ধনী ও আত্মসম্মান রক্ষাকারী দারিদ্র ব্যক্তিদের মধ্য থেকে ছিলেন। তাঁদের জীবনচরিত সম্পর্কে অবহিত সকল লোকের নিকটই তা স্পষ্ট। আর যে অবিচারমূলক পার্থক্য সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে, তাতে একই প্রসঙ্গে ব্যবহৃত এসব শব্দের মধ্যে সূক্ষ্মতর পার্থক্যের কথা চিন্তা করা যায় না। আসলে এটা প্রথমে আভিধানিক ব্যাপার। ফিকাহ পর্যায়ের বিতর্ক তো পারে। এজন্যেই আভিধানিক ও তাফসীরবিদগণ এ বিষয়ে তেমনই অনুসন্ধিৎসা চালিয়েছেন, যেমন চালিয়েছেন ফিকাহবিদগণ। আর একথা তো অকাট্য যে, এই মতপার্থক্যের কোন প্রভাবই যাকাতের ক্ষেত্রে প্রতিফলিত নয়।] হানাফী মতে ফকীর ও মিসকীন এখানে যে কথা উল্লেখ্য তা হচ্ছে, হানাফীদের মতে যে লোক শরীয়তভিত্তিক যাকাতের নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক নয়, সেই ফকীর অথবা যে লোক মালিক হবে ঘরের দ্রব্যসামগ্রী, সাজ –সরঞ্জাম, কাপড়-চোপড়, বই-কিতাব ইত্যাদি জরুরী প্রয়োজনে ব্যবহার্য এবং মৌল প্রয়োজন পরিপূরণে আবশ্যকীয় দ্রব্যাদির, যার মূল্য নিসাব পরিমাণ কিংবা তার অধিক হবে। আর তাঁদের মতে মিসকীন হচ্ছে সে যার কিছুই নেই। সাধারণভাবে এটাই প্রসিদ্ধ কথা। তবে হানাফী আলিমগণেল মধ্যে নিসাব বলতে কি বোঝায় তা নির্ধারণে মতপার্থক্য রয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে দুশ দিরহামের নিসাব ধরা হবে কিংবা যে কোন মালের প্রচলিত নিসাব ধরে হিসাব করলেই চলবে? [(আরবী ************* দ্রষ্টব্য)] অতএব তাঁদের মতে দারিদ্র্য বা অভাবের দিক দিয়ে যাকাত পাওয়ার অধিকারী লোক হচ্ছে এরাঃ ১. নিঃস্ব – যার কিছুই নেই, সে মিসকীন। ২. যার ঘর, দ্রব্য ও ঘরের কিছু না কিছু সামগ্রী রয়েছে, যা দিয়ে উপকৃত হওয়া যায় বটে কিন্তু তা দারিদ্র্য মোচন যথেষ্ট হয় না- তার মূল্য যাই হোক না কেন। ৩. নগদ সম্পদের নির্ধারিত নিসাব পরিমান অপেক্ষা কম সম্পদের যে মালিক দুশ দিরহাম নগদ সম্পদের কম পরিমাণের মালিক। ৪. নগদ সম্পদ ছাড়া অন্যান্য সম্পদের নিসাব পরিমাণের কম সম্পদের যে মালিক- যেমন চারটি উটের মালিক কিংবা উনচল্লিশটি ছাগলের মালিকও ফকীর গণ্য হতে পারে। তবে শর্ত এই যে, তার মূল্য যেমন দুশ দিরহাম পর্যন্ত না পৌছায়। আরও একটি ব্যাপারে মতদ্বৈততা রয়েছে। তা হচ্ছে, নগদ সম্পদ ছাড়া অন্যান্য সম্পদের নিসাব – যেমন পাঁচটি উট বা চল্লিশটি ছাগলের মূল্য যদি নগদ সম্পদের নিসাব পরিমাণ না হয়, তাহলে এরূপ অবস্থায় কারো মতে তার পক্ষে যাকাত গ্রহণ করা জায়েয এবং তাকে নিকেজেও যাকাত আদায় করতে হবে। আর অপররা বলেছেন, সে তো ধনী ব্যক্তি, তাকে যাকাত দেয়া যেতে পারে না। [(আরবী*************)] কি পরিমাণের ধনাট্যতা যাকাত গ্রহণের প্রতিবন্ধক তা স্পষ্ট করার জন্যে আমরা শীঘ্রিই বিস্তারিত আলোচনায় প্রবৃত্ত হচ্ছি। অপর তিনজন ইমাম ফকীর ও মিসকীন সম্পর্কে যে মত দিয়েছেন, তাতে বলা হয়েছে, ইমাম আবূ হানীফা ছাড়া অপর তিনজন প্রধান ইমামের দৃষ্টিতে নিসাব পরিমাণ সম্প-সম্পত্তির মালিকানা না থাকার ওপর দারিদ্র্য ও মিসকীনী নির্ভরশীল নয়। বরং প্রয়োজন পরিমাণ সম্পদ না থাকাই দারিদ্র্য প্রমাণ করে। অতএব ফকীর সে, যার কোন মাল-সম্পদ নেই, নেই তার উপযোগী হালাল উপার্জন, যদ্দ্বারা তার প্রয়োজন পূরণ হতে পারে, যার খাওয়া-পরা ও থাকার স্থান বা ঘর এবং অন্যান্য জরুরী জিনিসপত্র নেই। না তার নিজের জন্যে, না তার ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তিদের জন্যে। খুব অপচয়ের প্রশ্ন নয়, নিম্নতম প্রয়োজনের কথাই বলা হচ্ছে। যেমন যার দৈনিক প্রয়োজন দশ টাকা, অথচ সে পাচ্ছে চার বা তিন কিংবা দুটাকা মাত্র সে তো নিঃসন্দেহে ফকীর। আর মিসকীন হচ্ছে সে, যার এমন পরিমাণ সম্পদ বা হালাল উপার্জন সম্পূর্ণ মাত্রায় আছে যাদ্দ্বারা তার ওপর নির্ভরশীল লোকদের প্রয়োজন পূরণ হতে পারে বটে, কিন্তু তার হচ্ছে না। যেমন যার প্রয়োজন দশ টাকার সে পাচ্ছে সাত বা আট টাকা- যদিও সে নিসাব পরিমাণ কিংবা একটা মোটা সম্পদের মালিক হয়ে আছে। কোন কোন ফিকাহবিদ বলেছেন, অর্ধেক বা তদূর্ধ্ব পরিমাণ দ্বারা যাবতীয় প্রয়োজন পূরণ হতে পারে। এরূপ অবস্থায় এই যথেষ্ট পরিমাণের অর্ধেক বা তার চাইতে বেশির মালিক হলেও সে মিসকীন। আর ফকীর হচ্ছে, তার অর্ধেকেরও কম পরিমাণ সম্পদের মালিক। এই সংজ্ঞার সারনির্যাস হচ্ছে, দারিদ্য ও মিসকীনীর নামে যাকাত পাওয়ার অধিকারী হচ্ছে নিম্নেদ্ধৃত তিন পর্যায়ের যে কোন এক পার্যায়ের লোকঃ প্রথমঃ যার কোন সম্পদ নেই, নেই আসলেই কোন উপার্জন। দ্বিতীয়ঃ যার কিছু মাল বা উপার্জন আছে বটে; কিন্তু তা তার ও তার পরিবারের লোকদের প্রয়োজন পূরণের জন্যে যথেষ্ট নয়। তৃতীয়ঃ যার মাল-সম্পদ আছে বা অর্ধেক কিংবা ততোধিক প্রয়োজন পূরণের পরিমাণ উপার্জন আছে, যাদ্দ্বারা তার ও তার ওপর নির্ভরশীল লোকদের প্রয়োজনের অর্ধেক পূরর্ণ হয়; তার প্রয়োজন পূরা মাত্রায় পুরণ হয়না। ফকীর বা মিসকীনের জন্যে ’যথেষ্ট পরিমাণ’ বলতে মালিকী ও হাম্বলী মতে একটি বছরের জন্যে যথেষ্ট হওয়া বোঝায়। আর শাফেয়ী মতে তার সম্মানের লোকদের জীবনের বেশির ভাগ সময়ের জন্যে যথেষ্ট বোঝায়। যদি সাধারণ বয়সের গড় ষাট বছর হয় এবং সে হয় ত্রিশ বছর বয়সের লোক, আর তার নিকট বিশ বছর বয়স পর্যন্ত প্রয়োজন পূরণ হওয়ার মত সম্পদ থাকে, তাহালে অবশিষ্ট দশ বছরের প্রয়োজন পূরণের জন্যে সে যাকাত গ্রহণের অধিকারী হবে। শামসুদ্দীন রমলী বলেছেন, সংজ্ঞার এই বিশ্লেষণে অধিক সংখ্যক ধনী লোকেরই যাকাত গ্রহণের সুযোগ ঘটবে, এমন কথা বলা যায় না। কেননা আমরা তার জাবাবে বলব, যার এমন মাল আছে যে, তার মুনাফাই তার জন্যে যথেষ্ট হবে; কিংবা এমন পরিমাণ জমি আছে যার উৎপাদন তার জন্যে যথেষ্ট হবে, সেই ধনী ব্যক্তি। অধিকাংশ ধনী ব্যক্তিই এরূপ। [(আরবী***********)] তাই এই ধনী ব্যক্তিরা কখনই যাকাত পেতে পারে না। কোন ফকীর বা মিসকীন ব্যক্তির উপযুক্ত একখানা ঘর থাকলেই তার দারিদ্র্য ও মিসকীনী থেকে মুক্তি ঘটেছে বলে মনে করা যুক্তিযুক্ত নয়। কেননা এ ঘর তার জন্যে প্রয়োজনীয়, তা বিক্রয় করে দিয়ে প্রয়োজনের জন্যে ব্যয় করতে তাকে বাধ্য করা যায় না। আর যার এমন পরিমাণ জমি রয়েছে যে, তার ফসল তার প্রয়োজন পূরণ করে না, সে নিশ্চয়ই ফকীর ও মিসকীন। তবে সে জমি যদি খুব উত্তম হয়, যা বিক্রয় করে দিলে তার জন্যে যথেষ্ট পরিমাণ ফসল ক্রয় করা সম্ভবপর হয়, তাহলে তা বিক্রয় করে দেয়াই তার কর্তব্য-বাহ্যত তা-ই মনে হয়। ঘরের মতই তার মালিকানার কাপড়-চোপড়ও , বছরের বিশেষ বিশেষ সময়ে শোভা বর্ধনের জন্যে তার ব্যবহার প্রয়োজনীয় হলেও। এই কাপড়ের মালিকানা থাকলেই সে দরিদ্র্য থাকবে না, ধনী গণ্য হবে, এমন কথা নয়। নারীর জন্যে উপযুক্ত অলংকারাদির কথাও তাই। স্বাভাবতই সৌর্দর্য বৃদ্ধির উদ্দেশ্যেই তার প্রয়োজন। তা থাকলেই তার দরিদ্র ও মিসকীন থেকে মুক্তি ঘটেছে, তা বলা যেতে পারে না। জ্ঞান-বিজ্ঞানের বই-কিতাব, যা খুবই প্রয়োজনীয়, বিরল বা দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থাদি- বছরের মাত্র একবারই তার প্রয়োজন দেখা দিলেও তা শরীয়ত সম্পর্কিত ফিকাহ, তাফসীর- হাদীসের গ্রন্থাদিই হোক, কিংবা অভিধান বা সাহিত্যের ন্যায় সাহায্যকারী গ্রন্থাদিই হোক। অথচ বৈষয়িক উপকারী গ্রন্থাদি- যেমন চিকিৎসাশাস্ত্র সম্পর্কিয় বই, এ সবের দরুনও কারুর দারিদ্র বা মিসকীনী ঘুচে যায় না। পেশা সংক্রান্ত যন্ত্রাপাতি, শিল্পের পাত্রাদি- যা শিল্পোৎপাদন কর্মে বিশেষভাবে প্রয়োজনীয় , তাও এ পর্যায়েই গণ্য। যেসব ধন-মাল ব্যবহার অনুপযোগী, দূরবর্তী কোন স্থানে অবস্থিত বলে অথবা নিকটে উপস্থিত মাল হওয়া সত্ত্বেও কোন প্রতিবন্ধক থাকার কারণে তা থেকে উপকৃত হওয়া যায় না। যেমন কোন স্বৈরতান্ত্রিক সরকার তা আটক করেছে বা তার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে, কিংবা তাকেই বন্দী করে রেখেছে। দীর্ঘ মেয়াদী ঋণ থাকলেও অনুরূপ অবস্থাই হয়। কেননা যদ্দিন মেয়াদ শেষ না হচ্ছে, তার দারিদ্র্য দূর হচ্ছে না। ফকীর-মিসকীনের অংশ থেকে কোন ধনীকেই কিছু দেয়া যেতে পারে না দারিদ্র্য ও মিসকীনী পর্যায়ে ফিকাহবিদদের দৃষ্টিবঙ্গি স্পষ্ট করে তোলবার জন্যে এবং যাকাত পাওয়ার যোগ্য দুই প্রকারের লোকদের পরিচিতি পূর্ণাঙ্গ করার উদ্দেশ্য এর বিপরীত অর্থবোধক শব্দটির ওপরও দৃষ্টিপাত করা আবশ্যক। কেননা এর বিপরীত গুণের লোক তো আর যাকাত পাওয়ার অধিকারী হতে পারে না। তাই ফকিরী ও মিসকীনী এই দুইয়ের বিপরীতে গুণসম্পন্ন শব্দ ধনীর ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে। ফিকাহবিদগণ এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ একমত যে, ফকীর ও মিসকীনের প্রাপ্য যাকাতের অংশ কোন ধনী লোককেই দেয়া যেতে পারে না। কেননা যাকাতকে আল্লাহ তাআলা ফকীর ও মিসকীনদের জন্যেই চিরতরে নির্দিষ্ট করে নিয়েছেন। ধনী লোক যাকাত পাওয়ার যোগ্য লোকদের মধ্যে গণ্য নয়। নবী করীম (স) তো স্পষ্ট ভাষায় বলেছেনঃ (আরবী*********************) তা ধনীদের নিকট থেকে গ্রহণ করা হবে, তাদের মধ্যকার গরীব লোকদের মধ্যে তা বন্টন করার উদ্দেশ্য। তিনি আরও বলেছেনঃ যাকাত ধনী লোকের জন্যে হালাল নয়।’ (আবুদাউদ, তিরমিযী) কেননা ধনী লোকেরাই যাকাত নিয়ে নিলে তা পাওয়ার প্রকৃত অধিকারী লোকেরা তা থেকে বঞ্চিত থেকে যাবে। তাহলে তা ফরয করার আসল উদ্দেশ্য গরীব লোকদের দারিদ্র্য মোচন-মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়ে পড়বে। ইবনে কুদামা তাই বলেছেনঃ [(আরবী ********)] কিন্তু ধনী কে ধনীর সংজ্ঞা কি? ধনীর যাকাত গ্রহণ নিষিদ্ধ যে ধনাঢ্যতা যাকাত গ্রহণ করার প্রতিবন্ধক, তার সংজ্ঞা কি, সে বিষয়ে ফিকাহবিদদের বিভিন্ন কথা উদ্ধৃত হয়েছে। আমরা বলেছি, ধনাঢ্যতা যাকাত গ্রহণের প্রতিবন্ধক, কেননা ধনাঢ্যতাই যাকাত ফরয হওয়ার কারণ। এ বিষয়ে ফিকাহবিদগণ মোটামুটি অভিন্ন মত পোষণ করেন। আর তা হচ্ছে, সর্বজনবিদিত ক্রমবৃদ্ধিশীল ধন-মালের নিসাব পরিমাণের মালিকানা- কয়েকটি বিশেষ শর্তের ভিত্তিতে। অথচ এই ফিকাহবিদগণই যাকাত গ্রহণে প্রতিবন্ধক পরিমাণ ধনাঢ্যতার সংজ্ঞায় বিভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। এখানে আমরা সেই বিভিন্ন মত উল্লেখ করছিঃ ইমাম সওরী প্রমুখের অভিমত সুফিয়ান সওরী, ইবনুল মুবারক ও ইসহাক ইবনে রাহুয়াই বলেছেন, যে ধনাঢ্যতা থাকলে যাকাত – সাদকা গ্রহণ করতে বাধা দেয়- নিষেধ করে, তা হচ্ছে পঞ্চাশ দিরহাম বা এই মূল্যের সমান পরিমাণ স্বর্ণের মালিকানা অর্থাৎ নগদ সম্পদের নিসাবের এক চতুর্থাংশের অর্ধেক। [(আরবী**************)] দলীল হিসেবে তাঁরা হযরত ইবনে মাসউদ (রা) বর্ণিত একটি হাদীস উদ্ধত করেছেন। রাসূলে করীম (স) বলেছেনঃ (আরবী******************) যে ব্যক্তি তার যথেষ্ট সম্পদ থাকা সত্ত্বেও ভিক্ষা করবে, কিয়ামতের দিন তার মুখাবয়বে আচড়ানো ক্ষতচিহ্ন থাকবে। একথা শুনে বলা হল, ইয়া রাসূল! ধনাঢ্যতা বলতে কি বোঝায়? বললেনঃ পঞ্চাশ দিরহাম নগদ সম্পদ কিংবা এই মূল্যের স্বর্ণের মালিকত্ব থাকা। [(আরবী****************)] ইমাম আহমাদ থেকেও এই মতের বর্ণনা উদ্ধুত হয়েছে। অবশ্য নগদ সম্পদের মালিকানা ও অনগদ সম্পদের মালিকানার মধ্যে পার্থক্য করা হয়েছে। যে লোক অ-নগদ সম্পদের একট পরিমাণের মালিক হবে, যা তার জন্যে যথেষ্ট নয়, সে ধনী বলে অভিহিত হতে পারে না- তার মূল্য যত বেশিই হোক না কেন। আর যে লোক পঞ্চাশ দিরহাম নগদ সম্পদ বা এই পরিমাণ মূল্যের স্বর্ণের মালিক হবে, সে ধনী বিবেচিত হবে। কেননা নগদ সম্পদ ব্যয়ের জন্যে প্রস্তুত সামগ্রী। উপরে উদ্ধৃত হযরত ইবনে মাসউদ বর্ণিত হাদীসেও এ কথারই সমর্থন পাওয়া যায়। কিন্তু হাদীসের মূল্যায়ন ও যাচাই পরখকারীরা উক্ত হাদীসটিকে দুর্বল বলে অভিহিত করেছেন। এ দর্বলতার কারণও নির্দেশ করেছেন। হাদীসটিকে সহীহ মেনে নিয়েও অনেক মনীষী তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন এই বলে যে, রাসূলে করীম (স) এ কথাটি ঠিক সেই জাতির লোকদের জন্যে বলেছেন, যারা পঞ্চাশ দিরহামের মূলধন নিয়ে ব্যবসা করত এবং তা তাদের জন্যে যথেষ্ট হতো। [(আরবী**********)] অন্যরা বলেছেন, নবী করীম (স) উক্ত কথা বলেছিলেন তখন, যখন এই পঞ্চাশ দিরহাম সাধারণভাবেই যথেষ্ট হয়ে যেত। [(আরবী**************)] অনেকে ব্যাখ্যা করেছেন, কথাটি আসলে ভিক্ষাবৃত্তি সংক্রান্ত; কাজেই যে লোক পঞ্চাশ দিরহামের মালিক হবে, ভিক্ষা চাওয়া তার জন্যে হারাম হবে; কিন্তু গ্রহণ করা হারাম হবে না। [(আরবী****************)] ইমাম খাত্তাবী বলেছেন, হাদীসবিদগণ মত প্রকাশ করেছেন, হাদীসে একথা বলা হয়নি যে, যে লোক পঞ্চাশ দিরহামের মালিক হবে, তার জন্যে যাকাত সাদকা হালাল নয়। তার পক্ষে ভিক্ষা চাওয়া অপসন্দনীয়, এ কথাই শুধু বলা হয়েছে। কেননা ভিক্ষা চাওয়াটা নিতান্ত প্রয়োজনেই হয়ে থাকে, কিন্তু যে লোক উপস্থিত প্রয়োজন মেটানোর পরিমাণ সম্পদের মালিক, তার ভিক্ষা চাওয়ার কোন প্রয়োজন হতে পারে না। [(আরবী*****************)] হানাফী মাযহাবের মত হানাফী আলিমগণ মনে করেন, যে ধনাঢ্যতা যাকাত-সাদকা গ্রহণের প্রতিবন্ধক, তা নিম্নোক্ত যে কোন একটি মাত্রার হবেঃ প্রথম, যে কোন মালের যাকাতের নিসাব পরিমানের মালিকত্ব। যেমন মুক্তভাবে পালিত পাঁচটি উট অথবা দুশ দিরহাম নগদ; কিংবা দীনার নগদ (এক্ষণে তার মূল্য ৮৫ গ্রাম স্বর্ণ মনে করা হয়েছে)। কেননা শরীয়াত মানুষকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছে। এক প্রকার হচ্ছে ধনী লোক, যাদের নিকট থেকে যাকাত গ্রহণ করা হবে আর অন্য প্রকার হচ্ছে গরীব, মিসকীন- তাদের মধ্যে যাকাত বন্টন করা হবে। আর একজন লোক একই সময় ধনী ও গরীব উভয়ই হতে পারে না। যেমন, কারুর নিকট নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকলে সেই সম্পদের ওপর যাকাত ধার্য হবে। কিন্তু তার যদি বিপুল সংখ্যক সন্তান-সন্ততি থাকে, যাদের জন্যে বহু পরিমাণ ব্যয় করার প্রয়োজন হয়ে পড়ে, তাহলে সে যাকাত দিতে পারে না আর যাকাত গ্রহণও তার জন্যে জায়েয হয় না। অপর কোন কোন হানাফী আলিমের মত হচ্ছে, যে কোন মালের নিসাব পরিমাণ থাকাটাই গণনাযোগ্য সেই একই জাতীয় মাল দ্বারা নিসাব পূর্ণ হোক আর নাই হোক। তাই যে লোক চল্লিশটি ছাগীর মালিক ছাগীর নিসাবও তাই- তার মূল্য যদি দুশ দিরহাম সমান না হয়, তাহলে উপরিউক্ত মত অনুযায়ী সে গরীব ব্যক্তি। এমতাবস্থায় তাকে যাকাত দিতেও হবে এবং সে যাকাত গ্রহণও করতে পারবে। এই মতের সমর্থনে কেউ কেউ দলীল হিসেবে একটি হাদীসের উল্লেখ করেছেন। হাদীসটি এইঃ কোন ব্যক্তির যথেষ্ট পরিমাণ সম্পদ থাকা সত্ত্বেও সে যদি ভিক্ষা চায়, তাহলে সে (কুরআনে অপসন্দনীয় বলে ঘোষিত ভাবে) লোকদের পাকড়াও করে ভিক্ষা চাইল। লোকেরা জিজ্ঞাসা করলঃ ‘যথেষ্ট পরিমাণ’ বলতে কি বোঝায়? বললেনঃ দুশ দিরহাম নগদ। কিন্তু হাদীসটি যয়ীফ। তাসত্ত্বেও তা ভিক্ষা নিষেধকারী দলীল হিসেবে গণ্য হতে পারে। তা সে সব হানাফী ফিকাহবিদদের বিরুদ্ধে পেশ হতে পারে না, যারা মনে করেন যে, যার নিকট দুশ দিরহাম রয়েছে, অথচ তা তার জন্যে যথেষ্ট হয় না, তার পক্ষে যাকাত গ্রহণ করা সম্পূর্ণ জায়েয। কেননা যে ধনাঢ্যতা ভিক্ষা চাওয়াকে হারাম করে, তা যাকাত গ্রহণকে হারাম করে না। এই উভয় মতের কোন একটির ওপর নির্ভরতা গ্রহণের ক্ষেত্রে হানাফী আলিমগণের মধ্যে পারস্পরিক মতবিরোধ রয়েছে। এই মতবিরোধের কথা তাদেরে লিখিত গ্রন্থাবলীতে বিশদভাবে আলোচিত হয়েছে। দ্বিতীয়, যেসব মালে যাকাত ফরয হয় না সেসব মালের মালিকানা যদি প্রয়োজনের অতিরিক্ত পরিমাণের হয় এবং তার মূল্য দুশ দিরহামের বেশি হয়- যেমন কাপড়, বিছানা, তৈজসপত্র, বই-কিতাব, ঘড়-বাড়ি, দোকান ঘর, চতুষ্পদ জন্তু ইত্যাদি- প্রয়োজনের অতিরিক্ত যদি থাকে, অথচ এর সবগুলোই ব্যয়-ব্যবহারের জন্যে, বিক্রয় করে ব্যবসা করার জন্যে নয়। সেগুলো যদি দুশ দিরহাম মূল্যের হয়, তা হলে তার পক্ষে যাকাত গ্রহণ হারাম হয়ে যাবে। কারুর দুইখানি ঘর থাকারেও একখানি ঘর দ্বারাই তার প্রয়োজন পূর্ণ হলে-যা বিক্রয় করা নগদ সম্পদের নিসাব পরিমাণ মূল্য পাওয়ার আশা হবে, তার জন্যেও যাকাত গ্রহণ জায়েয হবে না। অনুরূপভাবে কারুর নিকট উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া বই-কিতাব বা কাজের পাত্র-ভান্ডার তৈজসপত্র থাকলে- যার মুল্য নিসাব পরিমাণ হবে অথচ সেগুলো তার জন্যে প্রয়োজনীয় নয়, কেননা সে নিজে কোন লেখাপড়ার ব্যক্তি নয়, নয় সে সেই কাজের যোগ্য যার পত্রগুলো রয়েছে- তা হলেও তার যাকাত গ্রহণ জায়েয হবে না। ইমাম আল-কাসানী বলেছেনঃ ইমাম করখী ‘প্রয়োজন পরিমাণ পর্যায়ে’ বলেছেনঃ যারা একখানি ঘর আছে, আছে ঘরের দ্রব্য-সামগ্রী-সরঞ্জাম, আছে একজন খাদেম, বিছানা পাত্র, পরিধানের কাপড়, শিক্ষিত হলে বই-পত্র, তার এই অতিরিক্ত পরিমাণের মুল্য যদি এমন পরিমাণ হয় যার দরুন তার মালিকের পক্ষে যাকাত গ্রহণ করা হারাম হয়ে যায়, তাহলে তাকেও যাকাতের অংশ দেয়ায় কোন দোষ নেই। কেননা হাসান বসরী থেকে বর্ণিত হয়েছে, সাহাবিগণ এমন ব্যক্তিকেও যাকাত দিতেন যে ঘোড়া, হাতিয়ার, খাদেম ও ঘর ইত্যাদি দশ হাজার দিরহাম মূল্যের সম্পত্তির মালিক ছিল। কেননা এই জিনিসগুলো তো মৌল প্রয়োজনের অন্তর্ভুক্ত-এগুলো মানুষের জন্যে একান্ত আবশ্যক। তাই এগুলোর থাকা না থাকা সমান। [(আরবী**************)] ’আল-ফাতওয়া’ কিতাবে উদ্ধৃত হয়েছে, যার দোকান ও শস্যাদি রাখার ঘর আছে, কিন্তু সে শস্য তার ও তার পরিবারবর্গের প্রয়োজন পূরণে যথেষ্ট হয় না, সে ফকীর, দরিদ্র ব্যক্তি। তার পক্ষে যাকাত গ্রহণ সম্পূর্ণ জায়েয। ইমাম মুহাম্মাদ এই মত দিয়েছেন। কিন্তু ইমাম আবূ ইউসূফের মতে এই ব্যক্তির পক্ষে যাকাত হালাল নয়। অনুরূপভাবে কারুর যদি ফলের বাগান থাকে এবং তার ফসল তার প্রয়োজন পূরণের জন্যে যথেষ্ট না হয়, তাহলে........। যদি কারুর নিকট এমন পরিমাণের খাদ্য মজুদ থাকে যার মূল্য দুশ দিরহাম, তা যদি তার এক মাসের প্রয়োজন পূরণের জন্যে যথেষ্ট হয়, তাহলে তার পক্ষে যাকাত গ্রহণ জায়েয হবে। যদি এক বছরের জন্যে যথেষ্ট হয়, তাহলে বলা হয়েছে হালাল হবে না। আবার কেউ কেউ বলেছেন, হালাল হবে। কেননা প্রয়োজন পরিমাণ পাওয়ার তার অধিকার আছে। তাই মনে করতে হবে যে, তার কিছুই নেই। খোদ নবী করীম (স) তাঁর পরিবারবর্গের জন্যে এক বছর কালের জন্যে প্রয়োজনীয় খাদ্য জমা করে রেখেছিলাম। যদি করুর শীতকালীন কাপড় থাকে, যা গ্রীষ্মকালে প্রয়োজনীয় নয়, (এবং তার মূল্য নিসাব পরিমাণও হয় তাহলেও) তার পক্ষেও যাকাত গ্রহণ করা হালাল। ’তাতারখানীয়া’ ফতোয়ার কিতাব লিখিত রয়েছে, কারুর বসবাসের একখানা ঘর থাকলে আর তা সবাইর বসবাসের জন্যে যথেষ্ট না হলে তার পক্ষেও যাকাত গ্রহণ করা জায়েয। তাতে আরও উদ্ধত হয়েছে, ইমাম মুহাম্মাদকে জিজ্ঞেস করা হয়, একজনের জমি আছে, সে তা চাষাবাদ করে, কিংবা দোকান রয়েছে, যা দ্বারা সে মুনাফা পায়, অথবা তিন হাজার মূল্যের একখানা ঘর রয়েছে; কিন্তু তার নিজের ও তার পরিবারবর্গের খরচপত্রের জন্যে যথেষ্ট পরিমাণ আয় না থাকে, তাহলে তার পক্ষে যাকাত গ্রহণ করা জায়েয কিনা? জবাবে বললেনঃ হ্যাঁ জায়েয, তার মূল্য কায়েক হাজার হলেও। এই মতের ওপরই ফতোয়া দেয়া হয়েছে। কিন্তু ইমাম ইউসূফ ও মুহাম্মাদের মতে হালাল নয়। ফিকাহবিদ ইবনে আবেদীনের নিকট জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, যে মেয়েটিকে দান-জিহাজ সহকারে তার স্বামীর বাড়িতে পাঠানো হয়েছে, সে কি ধনবতী গণ্য হবে? জবাবে বলেছিলেন, বাহ্যত দেখা যায়, ঘরের দ্রব্য-সরঞ্জাম, পরনের কাপড়-চোপড় ও ব্যবহার্য ভাণ্ড বা তৈজসপত্রাদি মৌল প্রয়োজনীয় জিনিসের মধ্যে গণ্য, একান্তই অপরিহার্য। তাই তার অতিরিক্ত অলংকারাদি, তৈজসপত্র ও সৌন্দর্য বৃদ্ধিকারী সামগ্রীসমূহ যদি নিসাব পরিমাণ হয়, তাহলে তার মালিক ধনী গণ্য হবে। তিনি আরও বলেছেন, ‘তাতারখানীয়া’ গ্রন্থের ফিতর সাদকা অধ্যায় লিখিত রয়েছেঃ যে মেয়েলোকটির হীরা-জহরত রয়েছে, যা সে ঈদ ও অন্যান্য উৎসবাদিতে পরিধান করে, স্বামীর জন্যে সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে সেগুলো ব্যবসায়ের জন্যে নয়, তার ওপর ফিতরা সাদকা দেয়া ওয়াজিব কিনা, হামান ইবনে আলীকে জিজ্ঞাস করা হলে জবাবে তিনি বলেছিলেনঃ হ্যাঁ ঐসব জিনিস নিসাব পরিমাণের হলে তা ওয়াজিব হবে। আর উমর-আল-হাফেযকে ও বিষয়ে জিজ্ঞাস করা হলে তিনি বললেন, তার ওপর তেমন কিছুই ওয়াজিব হবে না। ইবনে আবেদীন বলেছেন, এই আলোচনার সারকথা হচ্ছে অলংকারাদি আসল ও মৌল প্রয়োজনের মধ্যে গণ্য অ-নগদ সম্পদ। [(আবরী*************)] (প্রকৃত ব্যাপারে তো আল্লাহই ভালো জানেন) ইমাম মালিক, শাফেয়ী ও আহমাদের মত যে-সম্পদ দ্বারা প্রয়োজন পূরণ হয়, তা-ই ধনাঢ্যতা। একজন লোক যখন পরমুখাপেক্ষী নয়, তখন যাকাত গ্রহণ তার জন্যে হারাম, কোন জিনিসের মালিকানা না থাকলেও। আর অভাবগ্রস্ত ও পরমুখাপেক্ষী হলেই তার জন্যে যাকাত গ্রহণ হালাল- সে নিসবা পরিমাণ বা বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক হলেও। ইমাম মালিক, শাফেয়ী ও অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বর্ণনানুযায়ী ইমাম আহমাদের এই অভিমত। ইমাম খাত্তাবী বলেছেনঃ ইমাম মালিক ও ইমাম শাফয়ীর মত হচ্ছে, ধনাঢ্যতার কোন সীমা বা সংজ্ঞা সুপরিচিত নয়। ব্যক্তির সচ্ছলতা ও অর্থশক্তির প্রেক্ষিতেই তা নির্ধারণ করতে হবে। ব্যক্তির নিকট যা আছে, তা তার জন্যে যথেষ্ট হলে তার পক্ষে যাকাত গ্রহণ জায়েয হবে না। অভাবগ্রস্ত হলে তা জায়েয হবে। [(আরবী*************)] ইমাম শাফিয়ী বলেছেন, ব্যক্তি কখনও দিরহামের মালিক হয়ে ধনী গণ্য হয়-উপার্জন চালু থাকলে। আর কোন ব্যক্তির হাজার টাকার মালিকানা থাকলেও তার অক্ষমতা ও বিপুল সংখ্যক সন্তানাদি থাকার কারণে সে ধনী গণ্য হবে না। শরীয়াত তার দলীলাদি দ্বারা এই মতকেই সমর্থন করে। শরীয়াতের মৌল ভাবধারাই তাই। অভিধান ও তার প্রয়োগ থেকেও তারই সমর্থন পাওয়া যায়। নিম্নোদ্ধৃত কথাগুলো থেকেও এ মতের যথার্থতা প্রমাণিত হয়ঃ ক. হাদীসে উদ্ধৃত হয়েছে, নবী করীম (স) কুবাইচা ইবনুল মাখারিকের এক প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেনঃ তিনজনের যে কোন একজনের পক্ষে ভিক্ষা করা জায়েযঃ যে ব্যক্তি অভুক্ত রয়েছে, সে যতক্ষণ পর্যন্ত জীবনে বেঁচে থাকার সম্বল না পাচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত ভিক্ষা চাইতে পারে। খ. দরিদ্র্য হচ্ছে অভাবগ্রস্ততার অপর নাম। আর ধনাঢ্যতার বিপরীত। কাজেই যে লো অভাবগ্রস্ত, সেই দরিদ্র এবং কুরআনী আয়াতের আওতায় পড়ে প্রত্যক্ষভাবে অর্থাৎ সে যাকাত গ্রহণ করতে পারবে। আর যে লোক পরমুখাপেক্ষিতমুক্ত, সে যাকাত হারাম হওয়ার সাধারণ ঘোষণার মধ্যে পড়বে অর্থাৎ যাকাত গ্রহণ তার জন্যে হারাম। অভাবগ্রন্ততাই যে দারিদ্র্য, তার দলীল হচ্ছে আল্লাহর ঘোষণাঃ (আরবী***************) হে মানুষ! তোমরা সকলেই আল্লাহর প্রতি মুখাপেক্ষী। এ কথার ভিত্তিতে দুটি বিষয়ে কথা বলা হচ্ছেঃ প্রথম, যে ব্যক্তির যথেষ্ট পরিমাণ ধন মাল আছে তা যাকাত দেয়া মাল হোক কিংবা অন্য ধরনের; অথবা তার উপার্জিত কর্মের বিনিময়ে বা মজুরী হিসেবে পাওয়া জমি হোক কিংবা অন্য কিছু তার পক্ষে যাকাত গ্রহণ জায়েয নয়। ধন-মালের যথেষ্ট হওয়ার ব্যাপারটি বিবেচ্য হবে তার নিজের, তার ওপর নির্ভরশীল তার সন্তানাদি ও অন্যান্যদের প্রেক্ষিতে। কেননা এদের সকলেরই প্রয়োজন পুরণ করা আল্লাহ প্রদত্ত বিধানের লক্ষ্য। তাই এক ব্যক্তির জন্যে যা প্রয়োজন বিবেচিত হবে তা ই বিবেচিত হবে অন্যদের জন্যেও। সাধারণ শ্রমজীবী ও বেতভুক্ত লোকেরও এই শ্রেণীর মধ্যে গণ্য এবং তাদের নিত্য সব উপার্জনের কারণে ধনী বলে বিবেচিত। তার ধন ও পুঞ্জীভুত সম্পদের দরুন নয়। অতএব যারা নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক না হওয়ার দরুন গরীব ও দারিদ্র বিবেচিত হবে, তারা সবাই যাকাত পাওয়ার যোগ্য হবে........ কিন্তু এ কথা গ্রহনযোগ্য। দ্বিতীয়, যে লোক যাকাত দেয়া মালের নিসাব পরিমাণের বা তার অধিকের মালিক হবে, যা তার নিজের ও তার ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তিদের জন্যে যথেষ্ট নয়, তার পক্ষে যাকাত গ্রহণ বৈধ। কেননা সে ধনী নয়। কাজেই যার হাজার দীনার বা ততোধিক মূল্যের পণ্যদ্রব্য রয়েছে, কিন্তু তা থেকে লব্ধ মুনাফা তার প্রয়োজনের জন্যে যথেষ্ট হয় না বাজারের মন্দা অবস্থার কারণে, কিংবা তার অধিক সংখ্যক সন্তান-সন্ততি থাকার কারণে তার পক্ষে যাকাত গ্রহণ সম্পূর্ণ জায়েয। যার পাঁচ ‘অসাক’ পরিমাণ কৃষি ফসল রয়েছে; কিন্তু তা সত্ত্বেও তা তার জন্যে যথেষ্ট হয় না, তার পক্ষেও যাকাত নেয়া জায়েয। অবশ্য এই অবস্থা তার ওপর যাকাত ফরয হওয়ার প্রতিবন্ধক হবে না। কেননা যে ধনাঢ্যতা যাকাত ফরয হওয়ার কারণ হয় তা হচ্ছ শর্তাধীন নিসাবের মালিকানা। যাকাত গ্রহণের প্রতিবন্ধক ধনাঢ্যতা হচ্ছে তা, যদ্বারা প্রয়োজন যথেষ্ট মাত্রায় পূরণ হবে। এ দুটির মধ্যে কোন বাধ্যবাধকতা নেই। [আরবী*************)] মাইনূনী বলেছেন, ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বলকে লক্ষ্য করে বলেছিলামঃ এক ব্যক্তির উট ও ছাগল রয়েছে, যার ওপর যাকাত ফরয হয়, অথচ তা সত্ত্বেও সে ফকীর-দরিদ্র। তার চল্লিশটি ছাগী থাকতে পারে, কাছে কৃষিজমি; কিন্তু তা তার জন্যে যথেষ্ট হয় না, এই ব্যক্তিকে কি যাকাত দেয়া যাবে? তিনি বললেনঃ হ্যাঁ অবশ্যই। হযরত উমরের উক্তি হচ্ছেঃ ‘এদের দাও, তাদের এত এত উট থাকলেও’। [(আরবী**************)] ইবনে আহমাদ বলেছেন, কারুর ভূ-সম্পদ বা জমি থাকলে-যার ফসল হয় দশ হাজার বা ততোধিক, কিন্তু তা-ও তার জন্যে যথেষ্ট হয় না, সে যাকাত নেবে। [(আরবী************)] তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলে, এক ব্যক্তির মাঠে দাঁড়িয়ে থাকা ফসল রয়েছে, কিন্তু তা কাটার সরঞ্জাম নেই, সে কি যাকাত নেবে? বললেনঃ হ্যাঁ। যার মুখস্থকরণ ও অধ্যয়নের জন্যে জরুরী বই-পত্র রয়েছে অথবা ব্যবহারে বা ভাড়া দেয়ার অলংকারাদি রয়েছে যা জরুরী, তার এই থাকাটা যাকাত গ্রহণের প্রতিবন্ধক নয়। উপার্জনক্ষম দরিদ্র যাকাত পাওয়ার অধিকার হওয়ার ভিত্তি হচ্ছে অভাব-ব্যক্তির অভাব তার নিজের ও তার ওপর নির্ভরশীল লোকদের প্রয়োজন যথেষ্ট মাত্রায় পূরণের। এক্ষণে কোন নিষ্কর্মা অভাবগ্রস্ত ব্যক্তিকে- যে সমাজের ওপর বোঝা, সাহায্য ও দান নিয়ে বেঁচে থাকছে- যাকাত দেয়া জায়েয হবে কিনা? অথচ সে লোকটি শক্ত-সুঠাম দেহসম্পন্ন, উপার্জন করতে সক্ষম এবং শ্রমোপার্জনের মাধ্যমে যেস নিজেকে পরমুখাপেক্ষীহীন ও দারিদ্রমুক্ত বানাতে পারে, তা সত্ত্বেও তাকে যাকাত দেয়া যাবে কিনা? এ পর্যায়ে শাফেয়ী ও হাম্বলী মাযহাবের বিশেষজ্ঞগণ মত প্রকাশ করে বলেছেন, যাকাত ফকীর ও মিসকীনের প্রাপ্য, তার কোন অংশ কোন ধনী ব্যক্তিকে দেয়া জায়েয নয়। অনুরূপভাবে যে উপর্জনের মাধ্যমে তার নিজের ও পরিবারবর্গের প্রয়োজন যথেষ্ট মাত্রায় পূরণ করতে সক্ষম তাকেও তার অংশ দেয়া যেতে পারে না। আমার বিবেচনায় এ মতই অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য। [(আরবী***********)] শরীয়াতের অকাট্য দলিল ও নিয়মাদিও এই মতকেই শক্তিশালী করে। যদিও কোন কোন হানাফী আলিম উপার্জনশীল দরিদ্র ব্যক্তিকেও যাকাত দেয়া জায়েয মনে করেন, অবশ্য তার নিজের উচিত নয় তা গ্রহণ করা। কেননা গ্রহণ জায়েয হলেও তা গ্রহণ করতেই হবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা নেই। যেমন কোন ধনী ব্যক্তিকে দরিদ্র মনে করে যাকাত দেয়া হলে তা গ্রহণ না করাই তার উচিত। তাই দেয়া জায়েয হলেও গ্রহণ করা হারাম। আর জমহুর হানাফী ফিকাহবিদগণ বলেছেন, গ্রহণ করাও হারাম নয়। তবে গ্রহণ না করা অধিক উত্তম সেই ব্যক্তির পক্ষে, যার পক্ষে জীবনযাত্রা মোটামুটিভাবে নির্বাহ করা সম্ভব। [আরবী******)] কোন কোন মালিকী মাযহাবপন্থী ফিকহবিদ মত দিয়েছেন যে, উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে যাকাত দেয়া জায়েয নয়। [(আরবী************)] উপরিউক্ত মতটি শরীয়তের দলিল ও নিয়মাদিও সমর্থন করে। এই কথা বলছি এজন্য যে, ইসলাম প্রত্যেক শক্তিমান ব্যক্তির জন্যে কাজ করে উপার্জন করা ফরয করে দিয়েছে। সেই সাথে তার জন্য তার কাজ করে উপার্জন করা সহজ করে দেয়া কর্তব্য বলে ঘোষণা করেছে। ফলে সে স্বীয় শ্রম ও কাজের বিনিময়ে উপার্জন দ্বারা যাবতীয় প্রয়োজন পূরণ করতে সক্ষম হবে। সহীহ হাদীসে বলা হয়েছেঃ (আরবী*******************) স্বীয় উপার্জনে খাওয়া অপেক্ষা অধিক উত্তম খাদ্য কেউ কখনও খায়নি। কেউ যখন যথেষ্ট উপার্জনের কাজ পায়, তার পক্ষে সে কাজ অগ্রাহ্য করা- দান সাদকা গ্রহণ বা মানুষের নিকট ভিক্ষা চাওয়ার আশায়-কিছুতেই জায়েয হতে পারে না। এ কারণেই আমরা দেখছি, নবী করীম (স) সুস্পষ্ট ভাষায় বলছেনঃ (আরবী**************) ধনী ব্যক্তির জন্যে যাকাত-সাদকা জায়েয নয়, সুস্থ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সম্পন্ন শক্তিশালী ব্যক্তির জন্যেও নয়। তাহাবী জুহাইরুল আমেরী থেকে বর্ণনা উদ্ধত করেছেন, তিনি আবদুল্লাহ ইবনে আমরুবনিল-আ’সকে যাকাত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলেনঃ তা কোন ধরণের মাল? বললেনঃ পংশু, আহত, অন্ধ, দুর্বল, বিপদগ্রস্ত ও উপার্জনে অক্ষম ব্যক্তিদের প্রাপ্য মাল। পরে বললেন, এই কাজের কর্মচারী ও মুজাহিদদেরও তাতে অংশ বা অধিকার রয়েছে। আবদুল্লাহ বলেছেন, মুজাহিদ লোকদের জন্যে জিহাদের প্রয়োজন ও সে কাজে সাহায্যকারী সম্পদ যাকাত থেকে গ্রহণ করা সম্পূর্ণ করে দেয়া হয়েছে। আর কর্মচারীরা তাদের কাজের পরিমাণ অনুযায়ী নিতে পারবে। অতঃপর বলেছেন, ধনী ও শক্তিমান ব্যক্তিদের জন্যে যাকাত গ্রহণ জায়েয নয়। [(আরবী***********)] আবদুল্লাহ ইবনে আমরের এই কথাটি বহু সংখ্যক সাহাবী স্বয়ং নবী করীম (স) থেকে শুনে বর্ণনা করেছেন। তাবে দৈহিক শক্তি ও উপার্জনে শরীরিক যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও কার্যত যদি যথেষ্ট পরিমাণে উপার্জন করতে সক্ষম না হয়, তাহলে তার কোন মূল্য বা গুরুত্ব নেই। কেননা উপার্জনহীন শক্তি-সামর্থ্য ক্ষুধার্তের অন্ন ও বস্ত্রহীনের বস্ত্রের ব্যবস্থা করতে পারে না। ইমাম নববী বলেছেন, উপার্জনকারীকে কাজে নিয়োগ করার কেউ না থাকলে (অন্য কথায় বেকার ব্যক্তির পক্ষে) যাকাত গ্রহণ করা জায়েয। কেননা সে তো কার্যত অক্ষম। [(আরবী*************)] উপরিউক্ত হাদীসে শুধু সুস্থ পূর্ণাঙ্গ দেহ বলেই শেষ করা হয়েছে। কিন্তু অপর একটি হাদীসে নিশ্চিত করে বলা হয়েছে, ক্ষমতা থাকলেই হবে না, উপার্জন করতে হবে, তবেই তার জন্যে যাকাত গ্রহণ না-জায়েয হবে। আবদুল্লাহ ইবনে আদী বলেছেন, তাঁকে সংবাদ দেয়া হয়েছে, দুজন লোক নবী করীম (স) এর নিকট উপস্থিত হয়ে যাকাতের অংশ প্রার্থনা করল। নবী করীম (স) তাদের দুজনের ওপর তীক্ষ্ম দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। দেখতে পেলেন, দুজন লোকই সুস্থ শক্তিমান। তখন তিনি বললেনঃ “তোমরা চাইলে আমি যাকাতের মাল তোমাদের দেব। কিন্তু জেনে রাখবে, ধনী ব্যক্তির জন্যে তাতে কোন অংশ নেই। অংশ নেই শক্তিমান উপার্জনশীলের জন্যেও। [الحمد , ابو لؤد , نسائى আহমাদ বলেছেন, হাদীসটি উত্তম। নববী বলেছেন, হাদীসটি সহীহ। আবূ দাউদ ও মুনযেরী কিছুই বলেননি।] নবী করীম (স) এ দুজন লোকের আসল অবস্থা জানতেন না বিধায় উক্তরূপ কথা বলে তাদেরকে যাকাত গ্রহণ করা না করার স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। কেননা তারা বাহ্যত শক্তিমান হলেও বাস্তবভাবে বেকার ও অ-উপার্জনকারী হতে পারে। অথবা উপার্জন করেও যথেষ্ট পরিমাণে থেকে বঞ্চিত থেকে যেতে পারে। আর তা হলে তাদের জন্যে যাকাত গ্রহণ না-জায়েয হবে না। এই প্রেক্ষিতে হাদীসে বিশেষজ্ঞগণ বলেছেন, রাষ্ট্রকর্তা বা যাকাতদাতার উচিত, যাকে যাকাতের মাল দেয়া হচ্ছে, তার প্রকৃত অবস্থা না-জানার দরুন তাকে উক্তরূপ নসীহত করা। একথা স্পষ্ট করে বলা দরকার যে, যাকাতের মাল ধনী লোকের প্রাপ্য নয়, উপার্জনক্ষম ব্যক্তির জন্যেও নয়। তা-ই হচ্ছে রাসূলে করীম (স) এর আদর্শ। [(আরবী***************)] উপার্জনের অর্থ হচ্ছে প্রয়োজন পরিমাণ উপার্জন। তা না করতে পারলে যাকাত গ্রহণ জায়েয হবে। আসলে উপার্জনের অক্ষমতাই সেজন্যে শর্ত নয়। কেবল অক্ষম, রোগাক্রান্ত লোকদের মধ্যেই যাকাত সম্পদ বিতরণ করতে হবে, এমনও কোন কথা নেই। ইমাম নববীর কথানুযায়ী উপার্জন এমন হতে হবে, যা তার অবস্থা ও মর্যাদার উপযোগী। তা না হলে তাকে উপার্জনহীনই মনে করতে হবে। [১১১১১] তবে সে হাদীসে সুস্থ শক্তিমান ব্যক্তির ওপর যাকাত হারাম বলা হয়েছে, তা শক্তিসম্পন্ন অথচ সর্বক্ষণ বেকার ব্যক্তির ক্ষেত্রে সাধারণ অর্থেই গ্রহণ করতে হবে। সারকথা হচ্ছে, যে উপার্জনক্ষম ব্যক্তির ওপর যাকাত গ্রহণ হারাম, তাতে নিম্নোদ্ধৃত শর্তাবলী পুরামাত্রায় বর্তমান থাকতে হবেঃ ১. উপার্জন করার মত কাজ পাওয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে। ২. এই কাজ শরীয়তসম্মত ও হালাল হতে হবে। কেননা শরীয়াতে হালাল নয় এমন থাকলেও তা না থাকার মতই মনে করতে হবে। ৩. সাধ্য ও শক্তির অতিরিক্ত কোন কাজের বোঝা গ্রহণ করতে হবে না। কেননা সাধারণ সাধ্যায়ত্ত কাজই মানুষ করতে পারে। (সাধ্যাতীত কাজের ব্যবস্থা থাকলে তাতে বেকারত্ব ঘুচে না।) ৪. কাজটি এতটা পরিমাণ হতে হবে, যাদ্বারা তার নিজের ও তার ওপর নির্ভরশীল পরিবারপর্গের প্রয়োজন পূরণে যথেষ্ট হবে। তার অর্থ হচ্ছে, উপার্জনক্ষম প্রত্যেক ব্যক্তির প্রতিই শরীয়াতের আশা এই যে, তার নিজের প্রয়োজন সে নিজে পূরণ করবে। সেই সাথে সাধারণভাবে সমাজ ও বিশেষভাবে রাষ্ট্রনায়ক এই কাজে তার সহযোগিতা করবে। এটা তার অধিকার এবং সমাজ ও রাষ্ট্রনায়কের তা কর্তব্য। তাই যে লোক এরূপ উপার্জনে অক্ষম হবে- ব্যক্তিগত দুর্বলতার কারণে, যেমন বালকত্ব, বার্ধক্য, রোগ ও পঙ্গুত্ব ইত্যাদি অথবা কর্মক্ষম হয়েও তার উপযোগী কোন হালাল উপার্জন পাওয়া থেকে বঞ্চিত থেকে যাচ্ছে কিংবা উপার্জনের ক্ষেত্রে ও সুযোগ পেয়েও তার নিজের ও পরিবারবর্গের জন্যে প্রয়োজনীয় ও যথেষ্ট পরিমাণের উপার্জন করতে পারছে না, এরূপ অবস্থায় তার পক্ষে যাকাত গ্রহণ সম্পূর্ণ জায়েয। তা গ্রহণ করলে তাতে তার কোন দোষ হবে না আল্লাহ দ্বীনের বিচারে। বস্তুত এই হচ্ছে ইসলামের মহান শিক্ষা। এতে যেমন ইনসাফ ও সুবিচারের দিকটি প্রকট, তেমনি দয়া অনুগ্রহের ভাবধারাও পূর্ণরূপে কার্যকর। একালে যে স্লোগান উঠেছেঃ ’ যে কাজ করবে না সে খাবেও না’- তা সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক কথা যেমন, তেমনি নৈতিকতা পরিপন্থী এবং অমানবিকও। বস্তুত পাখি ও জন্তু জগতে এমন অনেকই রয়েছে যেখানে শক্তিমান দুর্বলকে বহন করে, কর্মক্ষম অক্ষমকে সাহায্য করে। মানুষ কি এসব ইতর প্রাণীর অপেক্ষাও নিকৃষ্টতর? ইবাদতে লিপ্ত ব্যক্তি যাকাত পাবে না ইসলামের ফিকাহবিদগণ সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, কোন উপার্জনক্ষম ব্যক্তি যদি কামাই-রোজগার ছেড়ে দিয়ে নামায-রোযা ইত্যাদি নফল ইবাদতে মশগুল হয়ে যায়, তা হলে তাকে যাকাত দেয়া যেতে পারে না, তার পক্ষে তা গ্রহণ করাও জায়েয নয়। কেননা তার ইবাদতের কল্যাণই তাকে সংকুচিত করে ফেলেছে। কাজ ও শ্রমে সে অংশ গ্রহণ করেনি। [(আরবী********)] অথচ শ্রম করার ও জমির পরতে পরতে রিজিকের সন্ধান করার জন্যে তাকে সুস্পষ্ট ভাষায় আদেশ দেয়া হয়েছে। উপরন্তু ইসলামে এ ধরনের কোন রাহবানিয়াতের একবিন্দু স্থান নেই। বরং এরূপ অবস্থায় হালাল উপার্জনে নিয়োজিত হওয়া এই সব ইবাদতের তুলনায় অনেক উত্তম কাজ, অবশ্য নিয়ত যদি যথার্থ হয় এবং উপার্জনের ক্ষেত্রে আল্লাহর নির্ধারিত সীমা লংঘন না করে। ইলম শেখার কাজে একনিষ্ঠ ব্যক্তি যাকাত পাবে তবে কেউ যদি কল্যাণকর ইলম শেখার-বিদ্যার্জনের কাজে একনিষ্ঠভাবে নিয়োজিত হয়, তাহলে তার প্রয়োজন পূরণের জন্যে তাকে যাকাত দেয়া যাবে। তাকে ইলমের প্রয়োজনীয় কিতাব খরিদ করে দেয়া যেতে পারে যাকাতের টাকা দিয়ে। কেননা তার তার দ্বীন ও দুনিয়ার জন্যে সত্যিই কল্যাণকর। ইলম শিক্ষার্থীকে যাকাত দেয়া যায় এ কারণেও যে, সে ফরযে কেফায়া আদায়ের কাজে আত্মনিয়োগ করে আছে। এই ইলম শেখার কল্যাণটা তার নিজের মধ্যেই সীমিত হয়ে থাকবে না। তা গোটা জাতির জন্যেই কল্যাণবহ। তাই তাকে যাকাতের টাকা দিয়ে সাহায্য করা বাঞ্ছনীয়। আসলে যাকাত ব্যয় করা যায় মুসলিম অভাবগ্রস্ত ব্যক্তির জন্যে। এমন কাজেও ব্যয় করা যায় যা মুসলিম উম্মতের জন্যে জরুরী। কেউ কেউ শর্ত করেছেন যে, তাকে উত্তমতায় শ্রেষ্ঠ হতে হবে এবং তার দ্বারা মুসলিম জনগণকে উপকৃত হতে হবে। নতুবা সে যাকাত পাওয়ার অধিকারী বিবেচিত হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত সে উপার্জনক্ষম থাকবে।[ঐ এবং (আবরী**********)] এ কথাটি যুক্তিসম্মত। আধুনিক রাষ্ট্রসমূহ এই নীতি অনুযায়ী কাজ করে এবং সমাজের উত্তম ও অগ্রসরমান লোকদের জন্যেই অর্থ ব্যয় করে থাকে। তাদের জন্যে বিশেষ অধ্যয়নের ব্যবস্থা করে কিংবা উচ্চতর শিক্ষা-প্রশিক্ষণের জন্যে তাদের অভ্যন্তরীণ বা বৈদেশিক প্রতিনিধিত্বে শরীক করে। প্রচ্ছন্ন আত্মসম্মান রক্ষাকারী দরিদ্ররা সাহায্য পাওয়ার অধিকারী ইসলামে সমান শিক্ষার ভুল প্রয়োগের কারণে সাধারণত লোকেরা ধারণা করে যে, যাকাত পাওয়ার অধিকারী সেসব গরীব মিসকীন, যারা কোন উপার্জনের কাজ করে না বা করবে না কিংবা যারা লোকরদের নিকট প্রার্থনা করা, ভিক্ষা চাওয়াকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছে, যারা নিজেদের দারিদ্র ও দুঃখ-দুর্দশার কথা প্রচার করে ও দেখিয়ে বেড়ায়। পথে ঘাটে-হাটে, বাজারে, মসজিদের দুয়ারে লোকদের সম্মুখে প্রার্থনার হস্ত প্রসারিত করে। সম্ভবত মিসকীনের এই চিত্র ও ছবিই দীর্ঘকাল ধরে লোকদের মন-মানসে ভাসমান হয়ে আছে। এমন কি স্বয়ং নবী করীম (স) এর জীবদ্দশায়ও এরূপ প্রকৃত মিসকীন ও সমাজ সমষ্টির সাহায্য পাওয়ার যোগ্য লোক কে সে বিষয়ে বলে দেয়ার প্রয়োজন বোধ করেছেন। বলেছেঃ (আরবী******************) প্রকৃত মিসকীন সে নয় যাকে তুমি একটা বা দুটো খেজুর দিয়ে অথবা এক মুঠি বা দুমুঠি খাবার দিয়ে বিদায় কর। বরং প্রকৃত মিসকীন সে যে দরিদ্র হয়েও প্রার্থনা থেকে বিরত থেকে আত্মমর্যাদা বজায় রাখে। তোমরা ইচ্ছা করলে পড়তে পার, কুরআনের আয়াতঃ যারা লোকদের জড়িয়ে ধরে ভিক্ষা চায় না.......[(আরবী*************)] অর্থাৎ যারা কাঁদ কাঁদ হয়ে ভিক্ষা চায় না, ভিক্ষা দিতে লোকদের বাধ্য করে না, লোকদের কষ্ট দেয় না যতক্ষণ পর্যন্ত তারা চুড়ান্তবাবে ঠেকে না যায়। যে লোক নিজের প্রয়োজন পূরণের ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও ভিক্ষা চায়, সে তাই করে। এই পরিচিতি বর্ণনা করা হয়েছে সে ফকীর-মুহাজির লোকদের, যারা নিজেদের যথাসর্বস্ব ছেড়ে-ছুড়ে দিয়ে আল্লাহ ও রাসূলের দিকে চলে গেছে। এখন তাদের ধন-মাল বলতে কিছু নেই, নেই উপার্জন করে নিজেদের প্রয়োজন পূরণের কোন উপায়। [(আরবী*******)] আল্লা এদের সম্পর্কেই বলেছেনঃ (আরবী*******************) দান-সাদকা যাকাত সে সব ফকীরদের জন্যে, যারা আল্লাহর পথে পরিবেষ্টিত হয়ে পড়েছে, পৃথিবীতে কামাই-রোজকার করে বেড়ানোর সামর্থ্যবান নয়, মুর্খ লোকেরা তাদের ধনী মনে করে, তারা ভিক্ষা থেকে বিরত থাকে আত্মমর্যাদা রক্ষার জন্যে, অথচ তুমি তাদের বাহ্যিক অবস্থা দেখেই চিনতে পার, তারা লোকদের নিকট কাঁদ কাঁদ হয়ে জাড়িয়ে ধরে ভিক্ষা চায় না। বস্তুত এসব লোকই সাহায্য পাওয়ার তুলনামূলকভাবে অধিক উপযুক্ত অধিকারী। নবী করীম (স) পূর্বোক্ত হাদীসে এ কথাই বলেছেন। (আরবী*************************) লোকদের নিকট ঘুরে ঘুরে যে-লোক ভিক্ষা চায়-যাকে তুমি এক বা দুমুঠি খাবার বা একটি বা দুটো খেজুর দিয়ে বিদায় কর- সে প্রকৃত মিসকীন নয়। বরং প্রকৃত মিসকীন সে, যে স্বাচ্ছন্দ্য অর্জনের উপায় পায় না, লোকেরাও তাদের দারিদ্র বুঝতে পারে না বলে তাদের দেয়ও না কিছুই্ আর তারা লোকদের নিকট ভিক্ষা চাইতেও দাঁড়ায় না। (বুখারী, মুসলিম) এই মিসকীনই সাহায্য পাওয়ার উপযুক্ত অধিকারী। যদিও লোকেরা এই মিসকীন সম্পর্কে উদাসীনই থাকে। বুঝতে পারে না যে, এই লোককে সাহায্য দেয়া উচিত। এজন্য নবী করীম (স) এই লোকের প্রতিই জনগণের দৃষ্টি আকৃষ্ট করেছেন। বিবেক-বুদ্ধি নিয়োগ করতেও বলেছেন তাদের জনেই। তাহলেই বহু প্রচ্ছন্ন দরিদ্র ও আত্মসম্মান রক্ষাকারীি পরিবার প্রয়োজনীয় সাহায্য পেয়ে অভাবমুক্ত হতে পারে। এদের অনেক লোকই অবস্থার দুর্বিপাকে পড়ে গেছে বা অক্ষমতা তাদের দরিদ্র বানিয়েছে। অথবা সন্তান-সন্তাতির আধিক্যের কারণে তাদের সম্পদ কম পড়ে যাচ্ছে। হয়ত উপার্জন করে এত সামান্য যে , তা তাদের প্রয়োজন পূরণ করতে পারে না। ইমাম হাসানুল বাসরীকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলে, এক ব্যক্তির ঘর-বাড়ি আছে, আছে সেবক-খাদেম, সে কি যাকাত গ্রহণ করতে পারে? জবাবে তিনি বলেছিলেন, হ্যাঁ সে যদি অভাব বোধ করে তাহলে নিতে পারে, কোন দোষ নেই তাতে। [(আরবী*****)] পূর্বে উল্লেখ করেছি, ইমাম মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান ফতোয়া দিয়েছিলেন, এক ব্যক্তির চাষের জমি রয়েছে, অথবা আছে দোকান ব্যবসা করার; কিংবা তার আয় তিন হাজার টাকা; কিন্তু তা তার নিজের ও পরিবারবর্গের প্রয়োজন পূরণে যথেষ্ট নয়, তার পক্ষে যাকাত গ্রহণ করা জায়েয। যদিও তার আয় কয়েক হাজার পর্যন্ত পৌছায়। এই মতের উপরই ফতোয়া দেয়া হয়েছে। ইবনে আবেদীন এই কথা উল্লেখ করেছেন। [(আরবী**************)] ইমাম আহমাদের অনুরূপ একটি ফতোয়ার কথা উল্লেখ করেছি এর পূর্বে। তার মর্ম এই যে, যে-ব্যক্তির ফসল ফলানের জমি আছে, যার আয় দশ হাজার দিরহাম বা তার কম-বেশী পরিমাণ হবে, কিন্তু তা তার জন্যে যথেষ্ট হয় না, সেও যাকাত গ্রহণ করতে পারবে। [(আরবী**************)] শাফেয়ী মাযহাবের লোকদের মত হচ্ছে, কারুর জমি থাকলে ও তার আয় তার প্রয়োজন পরিমাণের তুলনায় কম হলে সে ফকীর বা মিসকীন গণ্য হবে। তাকে যাকাত দিয়ে তার প্রয়োজন পূরণ করা সম্ভব। তাকে তার জমি বিক্রয় করে দিতে বাধ্য করা যাবে না। মালিকী মাযহাবের লোকদের মত হচ্ছে, যে লোক নিসাব পরিমাণ বা তার বেশি সম্পদের মালিক, তার খাদেম এবং ঘর-বাড়ি আছে; কিন্তু প্রয়োজন পূরণ হয় না, তাকেও যাকাত দেয়া জায়েয। [(আরবী**************)] তার অর্থ, যার কিছুই নেই, যে কোন কিছুরই মালিক নয় এমন নিঃস্ব ফকীরকেই যাকাত দেয়া লক্ষ্য নয়। বরং প্রয়োজন পূরণের কতকাংশ যার আছে, তার পূর্ণমাত্রায় প্রয়োজন পূরণের ব্যবস্থা করে দেয়াও লক্ষ্য। কেননা সে তার যথেষ্ট মাত্রায় সম্পদের অধিকারী নয়। ফকীর ও মিসকীনকে কি পরিমাণ যাকাত দেয়া যাবে? ফকীর ও মিসকীনকে কতটা পরিমাণ যাকাত দেয়া যাবে, সে বিষয়ে ফিকাহবিদদের বিভিন্ন মত রয়েছে। এ মতপার্থক্যকে আমরা নিম্নলিখিতভাবে দুটি ভাগে ভাগ করে বলতে পারিঃ প্রথম, তাদের দেয়া হবে প্রচলিত নিয়মে এতটা পরিমাণ, যাদ্বারা তাদের প্রয়োজন যথেষ্ট মাত্রায় পূর্ণ হয়-বিশেষ কোন পরিমাণ নির্ধারণ করা ছাড়াই। দ্বিতীয়, তাদের দেয়া যাবে নির্দিষ্ট পরিমাণের মাল, যা তাদের অনেকের নিকট সামান্য আবার অনেকের নিকট অধিক বিবেচিত হবে। আমরা প্রথমটি নিয়ে প্রথমেই আলোচনা করব। কেননা ইসলাম-কুরআন ও সুন্নাতের দৃষ্টিতে যাকাতের লক্ষ্য পর্যায়ে তা-ই অতীব নিকটবর্তী মত। এই দিকটিতেও দুটো মত রয়েছেঃ ১. একটি মত, আয়ুষ্কাল পর্যন্তকার জন্যে যথেষ্ট পরিমাণ দেয়া, ২. আর একটি মত, এক বছরের জন্যে যথেষ্ট পরিমাণ দেয়া। প্রথমত জীবনকালের প্রয়োজন পরিমাণ দান এমত অনুযায়ী ফকীরকে এতটা পরিমাণ দিতে হবে, যাদ্বারা তার দারিদ্রর মূলোৎপাটন হয়ে যায়। তার অভাব-অনটন দুর হওয়ার কারণ ঘটে এবং স্থায়ীভাবে যথেষ্ট মাত্রায় তার প্রয়োজন পূরণ হতে পারে। আর দ্বিতীয়বার যেন তার যাকাত গ্রহণের মুখাপেক্ষিতা না থাকে। ইমাম নববী বলেছেন, ফকীর-মিসকীনদের দেয় পরিমাণ পর্যায়ে ইরাকী ও বিপুল সংখ্যক খোরাসানী ফিকাহবিদগণ বলেছেন, তাদের এমন পরিমাণ দিতে হবে যা তাদেরকে দারিদ্র থেকে মুক্ত করে স্বাচ্ছন্দ্য ও ধনাঢ্যতার দিকে নিয়ে যেতে পারে অর্থাৎ যা তাদেরকে স্থায়ীভাবে সচ্ছলতা দান করবে। ইমাম শাফেয়ী নিজেও এই মত দিয়েছেন। কুবাইচা ইবনুল মাখারকি আল হিলালী বর্ণিত একটি হাদীস দলিল হিসেবে তাঁরা উল্লেখ করেছেন। হাদীসটি হচ্ছে, নবী করীম (স) বলেছেনঃ তিনজনের যে কোন একজনের পক্ষে ভিক্ষা চাওয়া জায়েয। একজন, যার ওপর এমন বোঝা চেপেছে যে, তার জন্যে ভিক্ষা করা জায়েয হয়ে গেছে যতক্ষণ পর্যন্ত সে সেই পরিমাণ না পাচ্ছে। তা পেয়ে গেলে সে তা থেকে বিরত থাকবে। দ্বিতীয়, এক ব্যক্তি বড় দুরবস্থার সম্মুখীন হয়ে পড়েছে, বিপদে পড়ে গেছে, তার সব ধন-মাল নিঃশেষ হয়েগেছে। তার পক্ষে ভিক্ষা চাওয়া জায়েয যতক্ষণ পর্যন্ত সে জীবনযাত্রার স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ মাত্রার মালিক না হচ্ছে। আর তৃতীয় ব্যক্তি সে, যে অনশনের সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। এমন কি তার সমাজের জনগণের মধ্য থেকে অন্তত তিন ব্যক্তি বলতে শুরু করেছে যে, অমুক ব্যক্তি অনশনে দিন কাটাচ্ছে। এই ব্যক্তির পক্ষেও ভিক্ষা চাওয়া জায়েয, যতক্ষণ না সে তার যথেষ্ট পরিমাণ সম্পদ লাভ করছে। এই তিনজন ব্যতীত অপর লোকদের পক্ষে ভিক্ষা চাওয়া- হে কুবাইচা- একান্তই ঘুষ ছাড়া আর কিছুই নয়। এরূপ ভিক্ষা করলে তা ঘুষ হবে। (মুসলিম) অর্থাৎ প্রয়োজন পূরণ না হওয়া পর্যন্ত ভিক্ষা চাওয়ার অনুমতি নবী করীম (স) দিয়েছেন। যদি সে উপার্জনের কোন পেশা ধরতে পারে, তবে প্রয়োজনীয় দ্রব্য-সামগ্রী বা হাতিয়ার-যন্ত্রপাতি তাকে ক্রয় করে দিতে হবে, তার মূল্য বেশি হোক বা কম, যেন তৎলব্ধ মুনাফা এমন পরিমাণ হয় যা তার প্রয়োজন যথাসম্ভব পূরণ করে দেবে। তাবে পেশা, দেশ, শহর-স্থান, সময়-কাল ও ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে পার্থক্য হতে পারে। আমাদের সঙ্গীদের অনেকেই বলেছেন, যে লোক সবজি বিক্রয় করতে পারে, তাকে পাঁচ বা দশ দিরহাম দেয়া যেতে পারে। যার পেশা হীরা-জহরত ও স্বর্ণ-রৌপ্য বিক্রয়, তাকে দশ হাজার দিরহাম পর্যন্ত দেয়া যেতে পারে, যদি তার কম পরিমাণ দ্বারা প্রয়োজন পরিমাণ আয় করা না যায়। আর যে ব্যবসায়ী, রুটি প্রস্তুতকারী, আতর প্রস্তুতকারী বা মুদ্রা বিনিময়কারী, তাকে সেই অনুপাতে যাকাতের অর্থ দেয়া যেতে পারে। যে দরজী কাজে পটু, কাঠ মিন্ত্রী, কসাই বা যৌগিক পদার্থ সৃষ্টিকারী হবে, কোন শিল্পকর্মে পারদর্শী হবে, তাকে এতটা পরিমাণ দিতে হবে যাদ্বারা সে তার কাজের জন্যে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি খরিদ করতে পারবে। যদি সে কৃষ্টিজীবী হয়, তাহলে তাকে জমির ব্যবস্থা করে দিতে হবে এমন পরিমাণ, যেখানে ফসল ফলিয়ে সে চিরজীবন স্বাচ্ছন্দ্য সহকারে কাটাতে সক্ষম হবে। যদি এই ধরনের পেশা গ্রহণে সক্ষম না হয়, কোন শিল্প দক্ষতারও অধিকারী না হয়, ব্যবসা ইত্যাদি কোন উপার্জনযোগ্য মাধ্যম অবলম্বন করে জীবিকা নির্বাহ করতে সক্ষম না হয়, তাহলে তাকে তার বসবাসের স্থানের উপযোগী জীবনযাত্রা নির্বাহের আয়ুষ্কালীন ব্যবস্থা করে দিতে হবে। শামসুদ্দিন রমলী নববী লিখিত ‘আল-মিনহাজ্জ’ গ্রন্থের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে লিখেছেন, ফকীর ও মিসকীন উপরিউক্ত ধরনের কোন উপার্জন পন্থা, কোন পেশা বা ব্যবসায় অবলম্বন করতে যদি সক্ষম না হয়, তাহলে তার সারাজীবন কাটাবার জন্যে প্রয়োজন পরিমাণ সম্পদ তাকে দিতে হবে। কেননা উদ্দেশ্য হল লোকটিকে মুখাপেক্ষিতা থেকে বিকুক্ত করা। আর তা করা না হলে এই মুখাপেক্ষিতা থেকে তার মুক্তি সারাজীবনে সম্ভব হবে না। আর বয়স যদি বেশি হয়ে যায়, তাহলে এক এক বছরের জন্যে প্রয়োজনীয় পরিমাণ দিতে হবে। যে লোক উপার্জন করতে সক্ষম নয়, তাকে যাকাত দিতে বলার অর্থ এই নয় যে, তার স্বাভাবিক জীবনযাত্রা নির্বাহের জন্যে নগদ অর্থ তাকে দিতে হবে এবং তার অর্থ তাকে এমন জিনিস ক্রয় করে দিতে হবে, যার আয় থেকে তার প্রয়োজন পূরণ হবে এবং ভবিষ্যতে সে যাকাত গ্রহণ থেকে বেচেঁ যেতে পারবে। তাহলে সে সেই জিনিসের মালিক হতে পারবে ও উত্তরাধিকারসূত্রে তা বন্টিতও হতে পারবে তার বংশধরদের মধ্যে। জরকাশী যেমন আলোচনা করেছেন, সরকারী ব্যবস্থাধীনেই সেই জিনিস ক্রয় হওয়া উচিত অথবা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকেই বাধ্য করা দরকার সেই জিনিস ক্রয় করার জন্য এবং তা কোন অবস্থায়ই হস্তান্তর না করার জন্যে। এই মালিকানা যদি তার জীবনব্যাপী প্রয়োজনের জন্যে যথেষ্ট না হয় তাহলে যাকাতের অর্থ দ্বারাই তা পূর্ণ করে দিতে হবে। তখন সে দরিদ্র ও মিসকীন কিনা তা শর্ত করার আবশ্যকতা নেই। মা-অর্দী বলেছেন, যদি তার নব্বই থাকে, আর একশ না হলে তার প্রয়োজন পূর্ণ না হয়, তাহলে এই দশ তাকে দিয়ে দিতে হবে। আর কোন উপার্জন ব্যতিরেকেই এই নব্বই যদি তার জন্যে যথেষ্ট হয় তাহলে হয়ত তার সমগ্র জীবনব্যাপী প্রয়োজন পূরণে যথেষ্ট হবে না। এই সব কথাই বলা হচ্ছে সে লোক সম্পর্কে, যে ভাল উপার্জন করছে না। যে-লোক উপযুক্ত কোন পেশা গ্রহণ করতে পারবে, যা তার জন্যে যথেষ্ট হবে, তাহলে তাহলে তাকে তার পেশার জন্যে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ক্রয়ের মূল্য দেয়া যেতে পারে তা যাত বেশিই হোক না কেন। তাই যে লোক ভাল ব্যবসা করতে পারে, তাকে যথেষ্ট পরিমাণে মুলধন দেয়া যেতে পারে, যেন ব্যবসায়ের মুনাফা দ্বারা সে তার প্রয়োজন যথেষ্টভাবে পূরণ করতে সক্ষম হয়। আর এই মূলধন দেয়ার ব্যাপরটি ব্যক্তি ও স্থানের তারতম্যের দরুন কমবেশিও হতে পারে। যদি সে বেশির ভাগ উত্তম পেশা গ্রহণে সক্ষম হয় আর সবটাই তার জন্যে যথেষ্ট হয়, তাহলে তাকে মূল্য বা মুলধন যতটা কম দিলে চলে, তা-ই দিতে হবে। যদি তাকে কতকাংশ দিলে যথেষ্ট হয়, তাহলে তা-ই তাকে দেয়া যাবে। তার একাংশ যদি একজনের জন্যে যথেষ্ট না হয়, তাহলে সেই একজনের দিতে হবে এবং তার বেশি বেশি জমি ক্রয় করে দেয়া যাবে, যার আয় তার অসম্পূর্ণ প্রয়োজন যথেষ্টভাবে পূর্ণ করবে। [আরবী***************)] ইমাম শাফেয়ী তাঁর الام গ্রন্থে এই কথাগুলো লিখেছেন। তাই তাঁর অধিকাংশ সঙ্গী-সাথীও এই মতকেই অগ্রাধিকার দিয়েছেন। এর ওপর ভিত্তি করে তার অনেক শাখা-প্রশাখা বের করেছেন। আর এ পর্যায়ে তিনটি বিস্তরিত সূক্ষ্ম আলোচনার অবতারণা করেছেন, যা আমরা এখানে উদ্ধৃত করলাম। ইমাম আহমাদের মতও ইমাম শাফেয়ীর প্রায় অনুরূপ। তিনি দরিদ্র ফকীর ব্যক্তির পক্ষে তার চিরজীবনের প্রয়োজন পরিমাণ সম্পদ গ্রহণ জায়েয বলে মত প্রকাশ করেছেন। আর তা নেয়া যেতে পারে ব্যবসায় মূলধন বা কোন শিল্প সংক্রান্ত যন্ত্রপাতি হিসেবে। হাম্বলী মতের কোন কোন ফিকাহবিদও এই মত গ্রহণ করেছেন এবং তদনুযায়ী কাজ করাকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। [(আরবী*************)] ইমাম খাত্তাবী উপরে উদ্ধৃত কুবাইচা বর্ণিত হাদীসের ব্যাখ্যায় লিখেছেন, সাদকা বা যাকাত দানের চূড়ান্ত প্রান্তিক পরিমাণ হচ্ছে প্রয়োজন পূরণে যথেষ্ট পরিমাণ, যাদ্বারা জীবনের প্রয়োজন যথেষ্টভাবে পূরণ হবে, জীবিকা সমস্যার সমাধান হবে এবং দারিদ্র প্রেক্ষিতে । তাতে কোন সীমা নির্দিষ্ট নেই। প্রত্যেক ব্যক্তির অবস্থার তারতম্যের বিচারেরই তা নির্ধারণ করতে হবে। [(আরবী*************)] যখন দিবেই, তখন সচ্ছল করে দাও উপরিউক্ত মতটি হযরত উমর ফারূক (রা) থেকে বর্ণিত মতের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। হযরত উমর ফারূকের রাজনীতি এই খাতেই প্রাবহিত দেখতে পাচ্ছি এবং এ নীতি অতীব যুক্তিসঙ্গত, নিখুঁত ও সুষ্ঠু সন্দেহ নেই। হযরত উমর ফারূকেরই অপর একটি উক্তি হচ্ছেঃ (আরবী***************) যখন দিবেই, তখন ধনী বানিয়ে দাও-সচ্ছল বানিয়ে দাও। [(আরবী**************)] হযরত উমর (রা) যাকাত সম্পদ দিয়ে দরিদ্র ব্যক্তিকে বাস্তবিকই ধনী ও সচ্ছল বানিয়ে দিতেন। সামান্য খাদ্যের ব্যবস্থা করে দিয়ে কিংবা কয়েকটি দিরহাম দিয়ে তা ক্ষুধা বা উপস্থিত প্রয়োজন পূরণ করে দিয়েই ক্ষান্ত হতেন না। তখনকার সময়ের ঘটনা, এক ব্যক্তি তার নিকট এসে তার অর্থনৈতিক দুরবস্থার বর্ণনা দিয়ে সাহায্য প্রার্থনা করে বসলো। তিনি তাকে তিনটি উট দিয়ে দিলেন। এটা ছিল তাকে দরিদ্র্য থেকে বাঁচানোর জন্যে। তিনি যাকাত বণ্টনকারী কর্মচারীদের নির্দেশ দিলেন, যাকাত পাওয়ার যোগ্য লোকদের মধ্যে বারবার তা বণ্টন কর- তাতে এক একজন একশটি করে উট পেয়ে গেলেও ক্ষতি নেই। [(আরবী*****************)] দরিদ্রদের ব্যাপারে তার নীতি ঘোষণা করলেন উদাত্ত কণ্ঠেঃ (আরবী********************) আমি তাদের বারবার যাকাত দেব, তাদের একজন একশটি করে উট পেয়ে গেলেও। তাবেয়ী ফিকাহবিদ আতা বলেছেন, ‘কোন মুসলিম ঘরের লোকদের মধ্যে যাকাত বণ্টন করলে পূর্ণমাত্রায় দাও। তা-ই আমার নিকট পসন্দ।’ এই মত অনুযায়ী ইসলামী রাষ্ট্র যাকাত-সম্পদ দ্বারা বড় বড় কল-কারখানা, খামার ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পারে, যার মালিক হবে কেবলমাত্র গরীব লোকেরা-তার সবটার অথবা তার কিছু অংশের। যেন তার এই সবের মালিক হলেও তা বিক্রয় করার বা মালিকানা হস্তান্তর করার কোন অধিকার তাদের থাকবে না। ফলে এসব প্রতিষ্ঠান ‘প্রায় ওয়াকফ’ সম্পত্তিতে পরিণত হয়ে স্থায়ী হয়ে থাকবে। দ্বিতীয় মতঃ এক বছরের জন্যে যথেষ্ট পরিমাণ দিতে হবে এখানে দ্বিতীয় একটি মত রয়েছে। মালিকী, হাম্বলী ও অন্যান্য মতের সাধারণ ফিকাহবিদগণ এ মতটি উপস্থাপিত করেছেন। এ মতের বক্তব্য হল, ফকীর ও মিসকীনকে যাকাত সম্পদ থেকে এতটা পরিমাণ দিতে হবে, যা তার ও তার উপর নির্ভরশীলদের এক বছরের জন্যে প্রয়োজন পূরণে যথেষ্ট হবে। এ মতের লোকেরা সারা জীবনের জন্যে যথেষ্ট-এমন পরিমাণ দেয়ার প্রয়োজন মতে করেন নি। অনুরূপভাবে এক বছরের জন্যে প্রয়োজন পরিমাণের কম দেয়ারও যৌক্তিকতা তারা স্বীকার করেন নি। তাঁরা এক বছর সময়ের জন্যে দেয়ার পক্ষপাতী এজন্যে যে, সাধারণত প্রত্যেক ব্যক্তি তার সমাজ তথা রাষ্ট্রের নিকট থেকে এই মেয়াদকালে জৈবিক নিরাপত্তা লাভের অধিকারী। রাসূলে করীম (স) এর অনুসৃত নীতিতেও এর সমর্থন ও দৃষ্টান্ত রয়েছে। একথা সহীহ সুত্রে জানা গেছে যে, তিনি তার পরিবারবর্গের জন্যে এক বছর কালের খোরাক মজুত করে রাখতেন। [বুখারী , মুসলিম] উপরন্তু যাকাতের মাল তো সাধারত বার্ষিক হিসেবে সংগ্রহ করা হয়। কাজেই তা থেকে কাউকে সারা জীবনের রসদ যোগাবার কোন কারণ থাকতে পারে না। প্রতি বছরই যাকাত সম্পদ সংগৃহীত হবে এবং তা পাওয়ার যোগ্য লোকদের মধ্যে বার্ষিক হিসেবে বণ্টন করা হবে, এটাই যুক্তিযুক্ত কথা। [মালিকী মাযহাবের কেউ কেউ বলেছেন, যাকাত বার্ষিক হিসেবে বণ্টন করা না হলে এক সঙ্গে এক বছরের প্রয়োজনের অধিকও দেয়া যেতে পারে।] এ মতের লোকেরা একথাও মনে করেন যে, এক বছরের জন্যে এতটা যথেষ্ট, তার কোন পরিমাণ-সীমা নির্দিষ্ট নয়। বরং যথাসম্ভব পাওয়ার যোগ্য লোকদের এক বৎসরের সচ্ছলতা বিদানকারী মান অনুযায়ীই বণ্টন করতে চেষ্টা করা উচিত। যদি কোন ফকীর বা মিসকীনের এক বৎসরের প্রয়োজন যথেষ্টভাবে পূরণ হতে নিসাব পরিমাণেরও বেশির প্রয়োজন হয়, তাহলে তাকে তা-ই দিতে হবে। তাতে যদি সে ধনী হয়ে যায়, তবু কোন দোষ নেই। কেননা দেয়ার সময় তো সে ফকীর বা মিসকীনই ছিল এবং যাকাত পাওয়ার যোগ্য ছিল। বিয়ে করিয়ে দেয়াও পূর্ণমাত্রার যথেষ্ট পরিমাণের অন্তর্ভুক্ত যথেষ্ট পরিমাণে দিতে হবে’ এই নীতির আলোকে আমি আরও একটি কথা এখানে বলতে চাই। তা হচ্ছে, ফকীর বা মিসকীনের জন্যে যথেষ্ট পরিমাণের পূর্ণ মাত্রার বাস্তবায়ন ও সম্পূর্ণতা দান। ইসলামী ফিকাহ তাই মনে করে। এই প্রেক্ষিতে ইসলামের আলিমগণের একথা বিবেচনা করা বাঞ্ছনীয় যে, শুধু পান-আহার পোশাকই কেবল মানুষের মৌল প্রয়োজন নয়। মানুষের স্বভাবজাত প্রয়োজন ও তাগীদ আরও রয়েছে। যা না হলে মানুষের জীবন পূর্ণত্ব পেতে পারে না। সে প্রয়োজনের চরিতার্থতা একান্তই আবশ্যক। আর তা হচ্ছে প্রজাতি ও সংরক্ষণ ও যৌন প্রবণতার চরিতার্থতা বিধান। আল্লাহ তায়ালা পৃথিবী আবাদকরণ ও মানব বংশ সংরক্ষণে আল্লাহর ইচ্ছা বাস্তবায়নে এ বিষয়টিকে চাবুকের মত বানিয়ে দিয়েছেন, মানুষ এর দ্বারাই চালিত হয় সেই লক্ষ্যের পানে। ইসলাম এই স্বভাবজাত ভাবধারার প্রতি কোন রূপ উপেক্ষা প্রদর্শন করে নি; বরং এই জিনিসকে সুসংগঠিত করেছে এবং আল্লাহর বিধানের ভিত্তিতে তার সীমা ও নিয়ম-কুনুন নির্ধারণ করেছে। অপরদিকে ইসলাম অবিবাহিত জীবন যাপন, নারীবিহীন অবস্থায় জীবন কাটানো বা পুরুষত্ব হনন-হরণের কাজকে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। মানুষের যৌন ও প্রজনন শক্তি দমনের কোন চেষ্টা ভাবধারাকেই আদৌ সমর্থন দেয়নি এবং প্রত্যেক দৈহিক সামর্থ্যসম্পন্ন পুরুষকে বিয়ে করার নির্দেশ দিয়েছে। আদেশ হচ্ছেঃ (আরবী**********************) ’তোমাদের যে কেউ সামর্থ্যবান হবে, সেই যেন বিয়ে করে। কেননা এই বিয়েই তার দৃষ্টিকে নত রাখবে এবং তার যৌন অঙ্গের সংরক্ষন করবে অতীব উত্তমভাবে। [(আরবী*****************)] অতএব সমাজের বিবাহেচ্ছুক (বিবাহক্ষম) নর-নারী মহরানা ইত্যাদি দিতে বিবাহিত না হলেও বিয়ের প্রয়োজন হয়ে থাকলে তার বিয়ের ব্যবস্থা করে দেয়া ও তাকে যথেষ্ট পরিমাণে যাকাত দেয়ার অন্তর্ভুক্ত কাজ। [(আরবী**************)] শুধু তা-ই নয়, তারা এতদূর বলেছেন যে, যদি কারুর একজন স্ত্রী যথেষ্ট না হয়, তাহলে দুইজন স্ত্রী যোগাড় করে দিতে হবে। কেননা যথেষ্ট পরিমাণে, দেয়ার মধ্যে এটিও গণ্য। [(আরবী***************)] খলীফায়ে রাশেদ উমর ইবনে আবদুল আজীজ লোকদের মধ্যে ঘোষণা করতেনঃ ‘কোথায় মিসকীনরা, কোথায় ঋণগ্রস্ত লোকেরা, কোথায় বিবাহেচ্ছু লোকগেণ........।’ তার এই ডাকের উদ্দেশ্য ছিল এ পর্যায়ের সকল লোকের প্রয়োজন বায়তুলমাল থেকে পূরণ করার ব্যবস্থা করা। এ পর্যায়ের আসল ভিত্তি হচ্ছে হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বর্ণিত একটি হাদীস। এক ব্যক্তি রাসূলে করীম (স) এর নিকট উপস্থিত হয়ে বলল, আমি আনসার বংশের একটি মেয়ে বিয়ে করেছি। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘কত মহরানা নির্দিষ্ট করলে?” বললে “চার আউকিয়া (৪*৪০=১৬০ দিরহাম)।” নবী করীম (স) বললেন, “মাত্র চার আউকিয়া? মনে হচ্ছে, তোমরা এই পাহাড়টি ফেলানের জন্যে রৌপ্য খোদাই করছ। এখন তো আমাদের নিকট কিছু নেই। কিন্তু খুব শীগগীরই আমরা তোমাকে এমন প্রতিনিধিত্বে পাঠাব, যাতে তুমি অনেক কিছুই পেয়ে যাবে।” [(আরবী********************)] হাদীসটি থেকে জানা গেল, এই অবস্থায় নবী করীম (স) এর বিরাট দানের কথা লোকদের ভালভাবে জানা ছিল। এ করণেই তিনি বলেছিলেনঃ এখন তো আমার নিকট দেবার মত কিছু নেই, তবে তোমার জন্যে অন্য ব্যবস্থা করা হবে, যা থেকে তুমি প্রচুর পেয়ে যাবে। ইলমের বই-পত্র দানও ‘যথেষ্ট দানের অন্তর্ভুক্ত ইসলাম মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধির বিকাশ দানকারী দ্বীন। তা মানুষকে ইলম শেখার আহবান জানিয়েছে, বিদ্বান লোকদের সম্মান ও মর্যাদা অনেক উঁচু করে তুলেছে, বরঞ্চ ইলমকে ঈমানের কুঞ্চিকা এবং কর্মের প্রেরণাদায়ক বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। অন্ধ অনুসরণকারীর ঈমান ও অজ্ঞ-মুর্খের ইবাদতের কোন মূল্য ইসলাম গণ্য করা হয়নি। কুরআন সুস্পষ্ট ভাষায় প্রশ্ন তুরেছেঃ ’যারা জানে, আর যারা জানে না, তারা উভয় কি সমান হতে পারে।?[(আরবী*******************)] বিজ্ঞ ও মূর্খ এবং ইলম ও মূর্খতার মধ্যকার পার্থক্য স্পষ্ট করে দেয়ার উদ্দেশ্যে বলা হয়েছেঃ অন্ধ ও দৃষ্টিমান পুঞ্জীভূত অন্ধকার ও আলো কখনই অভিন্ন হতে পারে না। [(আরবী****************)] রাসূলে করীম (স) বলেছেনঃ ইলম সন্ধান-অর্জন মুসলিম মাত্রের জন্যেই ফরয। [(আরবী*******************)] এখানে যে ইলম এর কথা বলা হয়েছে তা প্রচলিত ধরনের দ্বীনি ইলমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং সকল প্রকার কল্যাণকর ইলমই এর অন্তর্ভুক্ত। মুসলিম সমাজ তার এই জীবনে যত কিছু জ্ঞানের মুখাপেক্ষী তা সবই শিখতে হবে। তাতে স্বাস্থ্য রক্ষা, অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়ন ও সমাজ সভ্যতা পরিচালনা ও সংগঠন সংক্রান্ত সব ইলম শামিল রয়েছে। শত্রুদের প্রতিরোধ করার জন্যে সামরিক বিদ্যাও এর বাইরে নয়। এর সবই ফরযে কিফায়া। বিশেষজ্ঞ আলেমগণ এই মত দিয়েছেন। এ করণে ইসলামের ফিকহবিদগণ যাকাত বণ্টনের বিধানে ঘোষণা করেছেন, ইলম অর্জনে একটিষ্টভাবে নিয়োজিত ব্যক্তবর্গকে তার অংশ দিতে হবে-দেয়া যাবে। অথচ ইবাদতের কাজে একন্তভাবে আত্মনিয়োগকারীর জন্যে আর ইলম শিক্ষার্থীর কাজ তার নিজের জন্যে যেমন, তেমনি সমগ্র মানবতার কল্যাণেও। [(আরবী**************)] ইসলাম এ কথা বলেই ক্ষান্ত হয়নি। ফিকহবিদগণ এও বলেছেন যে, ফকীর-মিসকীন ব্যক্তির ইলম অর্জনে প্রয়োজনীয় কিতাবাদি খরিদ করার উদ্দেশ্য যাকাত গ্রহণ করতে পারে, যদি তা দ্বীন ও দুনিয়ার কল্যাণের জন্যে অপরিহার্য হয়ে পড়ে। [আরবী***********)] হানাফী ফিকাহবিদদের মতে যাকাতের মাল এক শহর থেকে অন্য শহরে নির্দ্বিধায় স্থানান্তরিত করা জায়েয, যদিও এটা নিয়মের পরিপন্থী-যদি তা ইলম শিক্ষার্থীকে সাহায্য করার উদ্দেশ্য হয়। [(আরবী***************)] কোন মতটি গ্রহণ করা উত্তম? ইসলামী ফিকাহর উপরিউক্ত দুটি মতের বিস্তারিত আলোচনার পর প্রশ্ন হচ্ছে, কোন মতটি অনুসরণ করা উত্তম?...... একটি মত অনুযায়ী ফকীর-মিসকীনকে একবারে সারা জীবনের প্রয়োজন পূরণের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। আর অপর মতটি হচ্ছে, মাত্র একটি পূর্ণ বছরের জন্যে সেই ব্যবস্থা যথেষ্ট পরিমাণে করে দিতে হবে। এ উভয় মতের স্বপক্ষে কারণ ও দলীলও ইতিপূর্বে পেশ করা হয়েছে।...... বিশেষ করে, ইসলামী রাষ্ট্র যখন যাকাত বণ্টনের দায়িত্ব পালন করবে, তখন এ দুটি মতের কোনটি অনুসরণ করবে সে প্রশ্নটি তীব্র হয়ে দেখা দিয়েছে। এ পর্যায়ে এই গ্রন্থকারের মত হচ্ছে, প্রতিটি মতই যুক্তিযুক্ত, অতএব এক এক অবস্থায় এক একটি মত অনুযায়ী কাজ করা যেতে পারে। তার কারণ হচ্ছে ফকীর ও মিসকীন দুই প্রকারেরঃ এক প্রকারের ফকীর-মিসকীন শ্রম ও উপার্জন করতে পারে, যা তার প্রয়োজন পূরণেও যথেষ্ট হতে পারে- যেমন শিল্পকর্মে অভিজ্ঞ, ব্যবসায়ী ও কৃষিজীবি। তার হয়ত শিল্পকর্মের জন্যে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি বা মূলধন অথবা জমি কিংবা বীজ বা কৃষি যন্ত্রপাতির অভাব পড়েছে। এরূপ অবস্থায় তাথে যাকাত ফাণ্ড থেকে এমন পরিমাণ সাহায্য দেয়া উচিত, যা পেয়ে সে তার জীবনব্যাপী প্রয়োজন যথেষ্ট মাত্রায় পূরণের ব্যবস্থা করে নিতে পারে, দ্বিতীয়বার সে কখনও যাকাতের মুখাপেক্ষী হবে না। কেননা তার পেশার জন্যে উৎপাদন করবে, মুনাফা করবে, ফসল ফলাবে। তাই সে আর কখনও যাকাতের মুখাপেক্ষী থাকবে না। আর দ্বিতীয় প্রকারের ফকীর-মিসকীন উপার্জনে অক্ষম। যেমন পঙ্গু অন্ধ, থুরথুরে বুড়ো এবং বিধবা, ইয়াতীম, বালক শিশু। এ ধরনের ফকীরকে তো এক বছর কালের প্রয়োজন অনুপাতে যাকাতের অংশ দেয়া উচিত। তাদের দিতে হবে বার্ষিক হিসেবে নিয়মিতভাবে। এক বছরের জন্যে সে নিয়ে যাবে এবং বছরান্তর পুনরায় পাওয়ার জন্যে আসবে। বরং সারা বছরেরটা এক সাথে দিলে সে অপব্যয় করে বসবে-অপ্রয়োজনীয় কাজে খরচ করবে এই ভয় থাকলে তাকে মাসিক হিসেবে দেয়া উচিত। এ কালে এই নীতিই অনুসরণীয়। কর্মচারীদের যেমন মাসিক বেতন হিসেবে দেয়া হয়, এই আর্থিক সাহায্যও মাসিক হিসেবে দিতে হবে। এই মতের সমর্থন আমি হাম্বলী মতে লিখিত কোন কোন কিতাবেও পেয়েছি। ‘গায়াতুল মুনতাহা’ নামক গ্রন্থ ও তার শরাহ কিতাব এ পর্যায়ে ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বলের মতের উল্লেখ রয়েছে। এক ব্যক্তির চাষের জমি আছে, বাগান আছে। তাতে দশ হাজার বা তার অধিক উপার্জন হয় বটে, কিন্তু তা তার জন্যে যথেষ্ট নয় না। ইমাম আহমাদের মতে এ ব্যক্তি যাকাত গ্রহণ করে তার প্রয়োজন যথেষ্ট মাত্রায় পূরণ করতে পারবে। এরূপ অবস্থায় পেশাদারকে তার পেশার যন্ত্রপাতি দেয়া যাবে- তা যত বেশিই হোক, ব্যবসায়ীকে যথেষ্ট মাত্রায় মূলধন দেয়া যাবে। এতদ্ব্যতীত অন্যান্য ফকীর-মিসকীনকে তাদের ও তাদের বংশাবলীর প্রয়োজন পরিমাণ দেয়া যাবে। প্রতি বছর বার্ষিক হিসেবে তারা যাকাত পাবে। আমার অবলম্বিত মতের অতীব নিকটবর্তী এ মত, যদিও সারাজীবনের জন্যে যথেষ্ট পরিমাণের কথা স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ নেই। কিন্তু মূলধন ও যন্ত্রপতির মূল্য দেয়ার তাৎপর্য তো তাই। ফকীরকে দেয় পরিমাণ পর্যায়ে অন্যান্য মত দ্বিতীয় দৃষ্টিকোণ হচ্ছে, ফিকাহবিদগণ ফকীর ও মিসকীনকে নি পরিমাণ দেয়া হবে-কম ও বেশী এর মধ্যবর্তী একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ ওয়াজিব বলে মনে করেছেন। ইমাম আবূ হানীফা ও তার সঙ্গী সাথিগণ মত প্রকাশ করেছেন যে, একজনকে দেয় এই পরিমাণটা দশ দিরহাম-নগদ সম্পদের নিসাব-এর অধিক হওয়া উচিত নয়। কারুর স্ত্রী ও সন্তানাদি থাকলে তাদের প্রত্যেকের জন্যেই এই নিসাব পরিমাণ গ্রহণ করা জায়েয হবে। অপর কোন কোন ফিকাহবিদ এর চাইতে কম পরিমাণের পক্ষে মত দিয়েছেন। তাঁর পঞ্চাশ দিরহামের অধিক দেয়া জায়েয মনে করেন না। আবার একদিন ও একরাতের খাওয়ার প্রয়োজনের অতিরিক্ত দেয়া পসন্দ করেন নি অনেকে। তবে ইবনে হাজম প্রমুখ জাহিরী মতের ফিকাহবিদ এসব মত প্রত্যাখ্যান করে বলেছেনঃ যাকাত থেকে কমও দেয়া যেতে পারে, বেশিও দেয়া যেতে পারে, তার কো সীমা নির্দিষ্ট নেই। কেননা এই ক্ষেত্রে কুরআন ও সুন্নাহ কো সীমা বা পরিমাণ নির্দিষ্ট করে দেয়নি।[(আরবী***************)] ইমাম গাজালীর মত ইমাম গাজালী তাঁর প্রখ্যাত ইহয়াউল উলুম গ্রন্থে ফকীর ও মিসকীনকে এক বছরের জন্যে যথেষ্ট, পরিমাণ যাকাত দেয়ার মতকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। কেননা এই পরিমাণটা তাদের প্রয়োজন পূণের নিকটবর্তী বলে মনে করা যায়। রাসূলে করীম (স) এর তাঁর পরিবারবর্গের জন্যে এক বছরের খোরপোষ সংগ্রহ করে রাখার কাজটি এ পর্যায়ে সুন্নাতরূপে গণ্য। তিনি আরও লিখেছেন, যাকাত ও সাদকা থেকে গ্রহণীয় পরিমাণ পর্যায়ে আলিমগণের বিভিন্ন মত রয়েছে। দেয় পরিমাণ কম করার ক্ষেত্রে একদিন এক রাতের খোরাক পরিমাণ হচ্ছে সর্বনিম্ন মান। এ পরিমাণের দলীল হিসেবে ইবনুল হানজালা বর্ণিত হাদীসটির উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি বর্ণনা করেছেন, নবী করীম (স) ধনাঢ্য থাকা অবস্থায় ভিক্ষা করা হলে তিনি বলেছিলেনঃ (আরবী***************) তার দুপুর ও রাত্রিকালীন খাবার থাকা। [আবূ দাউদ ও ইবনে হাব্বান] অন্যরা বলেছেন, ধনাঢ্যতার, পরিমাণ পর্যন্ত গ্রহণ করতে পারে। আর ধনাঢ্যতার সীমা হচ্ছে যাকাতের নিসাব পরিমাণ সম্পদ। কেননা আল্লাহ তাআলা যাকাত ফরয করেছেন কেবলমাত্র ধনী লোকদের উরপ। তাই আলিমগণ বলেছেন, একজন ফকীর বা মিসকীন তার নিজের ও তার পরিবারের প্রত্যেকের জন্যে যাকাত ফরয হওয়া পরিমাণ সম্পদ গ্রহণ করতে পারে। অপরাপর লোকদের বক্তব্য হচ্ছে, পঞ্চাশ দিরহাম কিংবা এই মূল্য পরিমাণ স্বর্ণের মালিকানা ধনাঢ্যতার সীমা। ইবনে মাসউদ (রা) বর্ণনা করেছেন, নবী করীম (স) বলেছেন, যার যথেষ্ট পরিমাণ সম্পদ থাকা সত্ত্বেও ভিক্ষা চাইবে, কিয়ামতের দিন তার মুখমন্ডল ক্ষতবিক্ষত হবে। পরে জিজ্ঞাসা করা হল, তার যথেষ্ট পরিমাণ বলতে কি বোঝায়? বললেন পঞ্চাশ দিরহাম অথবা তার মূল্যের স্বর্ণ।’ এ বর্ণনাটির বর্ণনাকারী খুব শক্তিশালী নয় বলে অভিযোগ করা হয়েছে। [(আরবী***********)] কিছু লোক বলেছেন, চল্লিশ দিরহাম। আতা ইবনে ইয়ামার এ কথাটির বর্ণনা করেছেন। অনেকে এই পরিমাণটিকে অধিক প্রশস্ত করে বলেছেন, যাকাত থেকে এমন পরিমাণ গ্রহণ করবে যাদ্দারা সে জমি ক্রয় করতে পারবে, যেন সে তার আয় দ্বারা সারা জীবন ধনী হয়ে থাকতে পারে অথবা এমন পরিমাণ পণ্য ক্রয়ের ব্যবস্থা করতে পারবে। কেননা ধনাঢ্যতা বলতে তো তাই বোঝায়। এ পর্যায়ে হযরত উমরের কথা- যখন দেবে তো ধনী বানিয়েই দাও’ পূর্বেই উদ্ধুত হয়েছে। এমনকি , কেউ কেউ এতদূর উদারতা পোষণ করেন যে, কেউ যদি গরীব হয়ে যায়, তাহলে সে এতটা গ্রহণ করতে পারবে যাদ্বারা সে তার পূর্বানুরূপ আর্থিক অবস্থা পুনরায় লাভ করতে সক্ষম হবে। তার পরিমাণ দম হাজার হলেও ক্ষতি নেই। তবে স্বাভাবিকতার সীমা লংঘিত না হয়, সেদিকে অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে। হযরত আবূ তালহা (রা) যখন তাঁর বাগানের কাজে এতই মশগুল হয়ে পড়লেন যে, নামায পর্যন্ত চলে গেল, তখন তিনি বললেনঃ ‘আমি এই বাগান সাদকা করে দিলাম।’ নবী করীম (স) তাকে উপদেশ দিলেনঃ ‘তুমি বাগানটি তোমার নিকটাত্মিয় কোন লোককে দিয়ে দাও। তোমার জন্যে তাই ভাল হবে।’ তাই তিনি তা দিয়ে দিলেন হাসসান ও আবূ কাতাদাহকে। পরে দেখা গেল, বাগানটিতে এতই খেজুর ধরেছে যা দুজন লোকের জন্যে অনেকটা বেশি এবং তা তাদের ধনী বানিয়ে দিল। হযরত উমর (রা) একজন বেদুঈনকে একটি উট দান করলেন, তার বাচ্চাটিও তার সঙ্গে ছিল। এ পর্যায়ে এরূপ বর্ণনাই উদ্ধুত হয়েছে। আর কম করে একদিনের খোরাক দেয়া বা আউকিয়া দেয়ার কথাও বলা হয়েছে, ভিক্ষা করা ও দ্বারে দ্বারে ঘরে বেড়ানোকে ঘৃণা করা হয়েছে বলে। কেননা এটা বাস্তবিকই অত্যন্ত ঘৃণ্য কাজ। এ পর্যায়ে আরেকটি প্রস্তাবনা রয়েছে। তা হচ্ছে একটি জমি ক্রয় করে দেয়া। সম্ভবত তার দ্বারা সে ধনী ও সচ্ছল হয়ে যেতে পারবে। এটাও অবশ্য অপব্যয় ও বাড়াবাড়ি মনে হয়। অধিক ভারসাম্যপূর্ণ কাজ হচ্ছে, এক বছরের জন্যে যথেষ্ট পরিমাণ দিয়ে দেয়া, এক অধিক হলে বিপদের আশংকা। আর কম হলে সংকীর্ণতা আরোপিত হয়। [এই হাদীসটি সম্পর্কে বলেছেন, সুনান গ্রন্থাবলীতে এই হাদীসটি উদ্ধৃত হয়েছে। তিরমিযী এটিকে হাসান বলেছেন। আর নাসায়ীও বলেছেন দুর্বল।] ইমাম গাজ্জালী যাকাত গ্রহণের নিয়ম-কানুন বর্ণনা প্রসঙ্গে এসব কথা বলেছেন। প্রসঙ্গত দারিদ্র্য ও মিসকীনীর নামে যা কিছু গ্রহণ করা হয় সেই পর্যায়ে বিবেচনা করা হয় বা ওয়াজিব মনে হয়, তারও তিনি উল্লেক করেছেন। ইহইয়াউ উলুম’ নামের এই কিতাবখানি তাসাউফপন্থী ও পরহেযগার লোকদের জন্যে লিখিত। তাতে যাকাত গ্রহণে বিশেষ সংকীর্ণতার পন্থাই নির্ধারিত হবে, এটাই ধারণা করা যায়। কিন্তু আমরা দেখছি, আবূ হামেদ আল-গাজালী এ পর্যায়ে ভারসাম্যপূর্ণ নীতিই উপস্থাপিত করেছেন; বরং বলা যায়, অধিক প্রশস্ততার কথাই সংকীর্ণকারীদের তুলনায় ও মতের বিশ্বাসীদের তিনি অধিক নিকটবর্তী বলে মনে করেছেন। আর তা সবই হযরত উমর ও আবূ তালহা থেকে বর্ণিত দলীলের ভিত্তিতে বলা হয়েছে। নবী করীম (স) এর নির্দেশ অনুযায়ী প্রাচীরবেষ্টিত বাগান নিয়ে যা করা হয়েছে, তাও সমানে রয়েছে। দানে প্রশস্ততার মতকে অগ্রাধিকার দান ইসলামী অর্থব্যবস্থা পর্যায়ে অকাট্য দলীল পারদর্শী ফিকাহবিদ ইমাম আবূ উবাইদ মুজতাহিদ ছিলেন। তিনি দান করার ব্যাপারে কোন রূপ রক্ষণশীলতা ও সীমা নির্ধারণ ব্যতিরেকেই প্রশস্ততার মতটিকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। তিনি আবূ তালহা আবূ কাতাদাহ ও হাসসানকে প্রাচীর বেষ্টিত বাগানটি দিয়ে দেয়ার কথারও উল্লেখ করেছেন। পরে বলেছেন, প্রাচীরবেষ্টিত বাগানটি তো খেজুর, গাছপালা ও কৃষি ফসল সমন্বিত ছিল। তাহলে তার কম সে কম মূল্য কত হওয়া উচিত? আবূ তালহা দানের খ্যাতি লুকাতে পারবেন না বলে ভয় পেয়েছিলেন। এ কারণে তিনি তা মাত্র দুজনকে দিয়েছিলেন। তৃতীয় কাউকে তাতে শরীক করেন নি। আবু উবাইদ বলেছেন, এটাই হচ্ছে প্রকৃত দান বা সাদকা। যদিও তা নফল। তাহলে ফরয দানের পন্থা এর চাইতে ভিন্নতর কিছু হতে পারে না। কেননা যে ফরয যাকাত ধনীদের ধনে কেবল ফকীর-মিসকীনদের জন্যে নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে তার বেশি পরিমাণ গ্রহণ করা যদি হারাম গণ্য হয়, তাহলে নফল দানে-যা ওয়াজিব বা ফরয না অধিক পরিমাণ গ্রহণ অধিক সংকীর্ণ ও হারাম হবে নিশ্চিতভাবেই। আর তা যদি হলাল নয় আর নফল দানের দানকারী যদি হয় অনুগ্রহকারী কল্যাণকারী, তাহলে ফরয দানে সে অবশ্যই অধিক উদার ও বেশি বেশি দানকারী হবে। [(আরবী*************)] পরে আবূ উবাইদ হযরত উমর ও আতা প্রমুখ থেকে কয়েকটি হাদীস উদ্ধৃত করেছেন। তারপর লিখেছেন, এসব নিঃসন্দেহে প্রমাণ করে যে, যে অভাবগ্রস্তকেই যাকাত থেকে কিছু দেয়া হবে, তার জন্যে মুসলিমদের প্রতি এমন কোন পরিমাণ বা সীমা নির্দিষ্ট নেই যে, তা লংঘন করা অন্যায় হয়ে যাবে- অবশ্য দানকারী যদি কৃপণ না হয়; বরং ভালবাসা ও বদান্যতা সম্পন্ন হয়, তবেই এ কাজটি হবে। যেমন কেউ কোন নেককার মুসলিম পরিবারবর্গকে দারিদ্র্য ও অভাব নিপীড়িত দেখতে পেল, সে নিজে বিপুল ধন-সম্পদের অধিকারী। ঐ লোকদের কোন ঘর-বাড়ি নেই যেখানে তারা আশ্রয় নিতে পারে এবং নিজেদের একাকীত্ব ও গোপনতা রক্ষা করতে পরে। তখন সেই ধনী লোকটি তাদের জন্যে তার যাকাতের মাল থেকে একটি বাড়ি ক্রয় করে দিল। সেখানে তারা বসবাস করবে-শীতের আক্রমণ ও গ্রীষ্মের তাপ থেকে তারা আত্মরক্ষা করতে পারবে অথবা তাদের দেখা গেল উলঙ্গ-পরিধানে কাপড় নেই। তখন তাদের জন্যে পরিধেয় কাপড় কিনে দিল, যা দিয়ে তারা তাদের লজ্জাস্থান আবৃত করে নামায পড়বে এবং শীত-গ্রীষ্মের কষ্ট থেকেও রক্ষা পাবে অথবা দেখল, একজন ক্রীতদাস খারাপ মনিবের হাতে মর্মান্তিকভাবে নির্যাতিত হচ্ছে। তাকে সেই মনিবের তাহ থেকে রক্ষা করার উদ্দেশ্য খরিদ করে মুক্ত করে দিল। কিংবা কোন দূরদেশের পথিক নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। বাড়ি-ঘরের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন। তখন টাকা খরচ করে তাকে ও তার সঙ্গী তার পরিবারবর্গকে তার দেশে পাঠিয়ে দেয়া হল। এসব এবং এ পর্যায়ের কোন কাজই বিপুল পরিমাণে অর্থ ব্যয় ব্যতিরেকে সুসম্পন্ন হতে পারে না। আর যে এ কাজ করবে, সে তার নফল দান দিয়েও এ কাজ করতে রাজী হল না। তখন সে তার মালের যাকাত দিয়ে এ ধরনের বড় বড় কাজ করল। তাহলে তাতে কি তা ফরয যাকাত আদায় হয়ে যাবে?..... হ্যাঁ নিশ্চয়ই যাকাত আদায় হবে। আর সেই সাথে সে বড় দয়াবান বলেও স্বীকৃত হবে। উপযুক্ত মানের জীবিকা ব্যবস্থা এই আলোচনা থেকে একথা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, যাকাত দেয়ার লক্ষ্য ফকীর-মিসকীনকে একটি বা দুটি দিরহাম দিয়ে নয়। আসলে লক্ষ্য হচ্ছে উপযুক্ত মানের জীবিকার ব্যবস্থা করে দেয়া। লক্ষ্য রাখতে হবে, সে একজন মানুষ। আল্লাহ তাকে সম্মানার্হ ও মর্যাদাবান বানিয়েছেন, পৃথিবীর বুকে তাকে আল্লাহ তাঁর খলীফা বানিয়েছেন। ওপরন্তু অনুগ্রহ ও সুবিচারের প্রবর্তন দ্বীন ইসলামে সে বিশ্বাসী-একজন মুসলিম। সে সেই উম্মতের একজন, যাকে বিশ্বমানবতার কল্যাণের জন্যে তৈরী করা হয়েছে। এই মান অনুপাতে কম-সে-কম যে ব্যবস্থা হওয়া আবশ্যক, তা হচ্ছে, ফকীর-মিসকীন ব্যক্তি ও তার পরিবারবর্গের জন্যে খাদ্য, সুপানীয়, শীত-গ্রীষ্মের পোশাক এবং উপযুক্ত সুবিধাজনক একটি বাসস্থান। ইবনে হাজম তার আল-মুহাল্লা গ্রন্থে এ বিষয়টি বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। আমরাও অষ্টম অধ্যায়ে তার উল্লেখ করব। ইমাম নববী তাঁর المجموع ও الروضه গ্রন্থে এর উল্লেখ করেছেন। এভাবে বহু সংখ্যক আলিমই এ বিষয়টির উপস্থাপন করেছেন। ইমাম নববী অভাবগ্রস্ত ব্যক্তির জন্যে যাকাত ফান্ড থেকে যথেষ্ট পরিমাণে দেয়ার কথা বলে তা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। আমাদের সাথীরা বলেছেন, প্রত্যেক ব্যক্তির জন্যেই খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানের- এবং সেই সাথে আরও যা একন্ত দরকার তার ব্যবস্থা তার উপযুক্ত করে করা আবশ্যক। অবশ্য কোনরূপ অপচয় বা বেহুদা খরচ না হয়, সেই সঙ্গে কার্পণ্যও দেখানো না হয়, সেই দিকে নজর রাখতে হবে। এই ব্যবস্থা প্রত্যেক ব্যক্তির জন্যে যেমন হতে হবে, তার ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তিদের জন্যেও। [(আরবী***********)] অবশ্য একালের লোকদের প্রত্যেকের জন্যে শিক্ষার ব্যবস্থা হওয়াও একান্তই প্রয়োজন। যে শিক্ষায় দ্বীনের হুকুম-আহকাম শেখা হবে, সেই শিক্ষা ও সংস্কৃতির কথা বলা হচ্ছে। মূর্খতার অন্ধকার থেকে বাঁচা, ভদ্র শলীন জীবন যাপনের পদ্ধতি জানা, বৈষয়িক দায়িত্ব পালনে যোগ্য করে তোলার জন্যে এই শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। মুসলিম ব্যক্তির মৌল প্রয়োজন পর্যায়ের আলোচনা আমরা এ বিষয় বিস্তারিত আলোচনা করেছি। শিক্ষার প্রয়োজন মূর্খতা দূর করার জন্যে। কেননা মূর্খতা জ্ঞান ও সংস্কৃতি উভয় দিক দিয়েই মৃত্যুর সমান। মূর্খ ব্যক্তি তাৎপর্যগতভাবে মৃত। এ যুগে প্রত্যেকের জন্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা হওয়াও আবশ্যক। কোন ব্যক্তি বা তার পরিবারবর্গের কারুর রোগ হলে তাকে সুস্থ করে তোলার ব্যবস্থা করা দরকার। রোগকে উন্মক্ত করে ব্যক্তিকে স্বাস্থীহীন করে রাখার সুযোগ দেয়া যায় না। অন্যথায় প্রাণী হত্যার অপরাধ হবে, ব্যক্তিকে নিক্ষেপ করা হবে ধ্বংসের মুখে। হাদীসে বলা হয়েছেঃ (আরবী****************) হে আল্লাহর বন্দারা! তোমরা রোগের চিকিৎসার ব্যবস্থা কর। কেননা আল্লাহ এমন কোন রোগেরই সৃষ্টি করেন নি, যার জন্যে কোন ঔষধের ব্যবস্থা করেন নি। [(আরবী**********)] আল্লহা তাআলা নিজেই বলেছেনঃ তোমরা নিজেদের ধ্বংসের দিকে নিক্ষেপ করো না। [(আরবী**********)] (আরবী****************) তোমরা নিজেদের হত্যা করো না। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের প্রতি অনেক দয়াবান। (সূরা আন-নিসাঃ ২৯) সহীহ হাদীসে বলা হয়েছেঃ (আরবী***************) মুসলামন মুসলমানের ভাই। সে তার ওপর জুলুম করতে পারে না, তাকে অসহায় করে ছেড়েও দিতে পারে না। কাজেই কোন মুসলিম ব্যক্তি বা সমাজ-সমষ্টি যদি অপর কোন ব্যক্তিকে অসহায় করে ছেড়ে দেয়, রোগ তাকে ধ্বংস করতে থাকে এবং তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা না হয়, তাহলে তাকে অসহায় করে ফেলে দেয়া হবে, তাকে লজ্জিত ও লঞ্ছিত করা হবে, তাতে কোন ই সন্দেহ নেই। আসলে লক্ষণীয় বিষয় হল ব্যক্তির জন্যে সাধারণ জীবনমান স্থায়ী ও অপরিবর্তনীয় করে নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। কেননা তা সময় ও অবস্থার পার্থক্যের কারণে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে অনিবার্যভাবে। প্রত্যেক জাতির আর্থিক অবস্থা ও আয়ের তারতম্যের কারণেও এ পার্থক্য অবস্বীকার্য হয়ে পড়ে। অনেক জিনিস এমনও আছে যা এক যুগে বা এক অবস্থায় পূর্ণাঙ্গ বিবেচিত হয়। এক সময় একটা জিনিস অত্যন্ত জরুরী হয়ে পড়ে, কিন্তু অপর এক যুগে ও অবস্থায় তা সেরূপ বিবেচিত হয় না। স্থায়ী ও সূংসবদ্ধ সাহায্য ব্যবস্থা যে ফকীর বা মিসকীন কোন ভাল পেশা অবলম্বনে সমর্শ নয়, এমন কোন শ্রমেও করতে পারে না যা তার পরিবারবর্গের জন্যে উপযুক্ত ও যথেষ্ট পরিমাণে জীবনযাত্রার ব্যবস্থা করতে পারবে, যাকাত বণ্টনের ভিত্তি হিসেবে তার জন্যে একটি পূর্ণ বছর ব্যাপী যথেষ্ট পরিমাণে দানের ব্যবস্থা করতে হবে। এই হচ্ছে যাকাতের লক্ষ্য। এ ব্যবস্থা এক মাস বা দুই মাসের জন্যে চলবে না। বরং এ ধরনের যাকাত পাওয়ার যোগ্য লোকদের জন্যে একটা স্থায়ী ও সুসংগঠিত ব্যবস্থা হওয়া বাঞ্ছনীয়। এর ফলেই দারিদ্র সচ্ছলতায় রূপান্তরিত হতে পারে এক ব্যক্তি বা একটি পরিবারের জীবনে। তার দূর্বলতা ও অক্ষমতা দূর হয়ে শক্তি ও সামর্থ্য এবং মর্যাদা লাভ সম্ভবপর হতে পারে। বেকারত্ব দূর হয়ে কর্মব্যবস্ততা সূষ্ঠু উপার্জনের তৎপরতা শুরু হতে পারে। এ পর্যায়ে ইমাম আবূ উবাইদ যে বর্ণানার অবতারণা করেছেন তা এখানে বিবেচনা করতে পারি। একদা হযরত উমর (রা) মধ্যাহ্নকালে একটি গাছের ছায়ায় শায়িত ছিলেন। এ সময় একজন বেদুঈণ মহিলা এসে উপস্থিত হল। লোকেরা তা লক্ষ্য করছিল। মহিলটি বলল, ”আমি একজন মিসকীন মেয়েলোক আর আমার ছেলেপেলেও রয়েছে। আমীরুল মু’মিনীন উমর ইবনুল খাত্তাব (রা) মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামাকে যাকাত সংগ্রহ ও বিতরণকারী নিযুক্ত করে পাঠিয়েছেন। কিন্তু তিনি আমাকে কিছই দেন নি। এরূপ অবস্থায় সম্ভবত আপনি আমার জন্যে তার কাছে সুপারিশ করতে পারেন” এ কথা শুনে হযরত উমর (রা) মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামাকে ডেকে পাঠালেন। মহিলাটি বললেঃ আমার জন্যে সাফল্যজনক ব্যবস্থা এই হতে পারে যে, আপনিই আমাকে নিয়ে তার কাছে উপস্থিত হবেন। তিনি বললেনঃ হ্যাঁ, তাই করা হবে, ইনশাআল্লাহ। পরে মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামা উপস্থিত হয়ে সালাম দিয়ে বললেনঃ আমি হাযির, নির্দেশ করুন হে আমীরুল মু’মিনীন! একথা শুনে মহিলাটি ভয়ানক লজ্জা পেল। হযরত উমর (রা) বললেনঃ আল্লাহর নামে শপথ! আমি তো তোমাদের কল্যাণ চাইতে ত্রুটি করি না। কিন্তু আল্লাহ যখন তোমাকে এ মেয়েলোকটি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন , তখন তুমি কি জবাব দেবে?....... এই কথা শুনে মুহাম্মাদের দুই চোখ দিয়ে অশ্রুধারা প্রবাহিত হতে লাগল। পরে হযরত উমর বললেনঃ আল্লাহ তাআলা আমাদের প্রতি তার নবী করীম (স) কে পাঠিয়েছেন। আমরা তাঁকে সত্য নবীরূপে মেনে নিয়েছি আর অনুসরণ করেছি। তিনি আল্লাহর নির্দেশ ও বিধান অনুযায়ী কাজ করে গেছেন। তিনি সাদকা-যাকাত মিসকীনদের জন্যে নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। পরে হযরত আবূ বকর (রা) খলীফা হল। তিনি রাসূলের সুন্নাত অনুযায়ী আমল করে দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন। তারপর আমাকে খলীফা বানানো হয়েছে। আমি তো তোমাদের মধ্য থেকে উত্তম লোকদেরই নানা কাজে নিযুক্ত করেছি। আমি যদি তোমাকে পাঠাই, তাহলে এক বছরের যাকাত পরিমাণ এই মহিলাকে দেবে। আর আমি জানি না, সম্ভবত আগামী বছর আমি তোমাকে পুনরায় পাঠাব কি না। পরে মেয়েলোকটির জন্যে কিছু ব্যবস্থা করার নির্দেশ দিলেন। ফলে তাকে এক উট বোঝাই ময়দা জায়তুন দেয়া হল। তাকে বললেনঃ এখনকার মত তুমি এসব নিয়ে যাও। পরে খায়বরে তুমি আমার সাথে সাক্ষাৎ করবে। আমি খায়বর যাওয়ার ইচ্ছা করেছি। পরে মহিলাটি খায়বরে তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করলে তিনি মহিলাটিকে দুটি উট দিয়ে দিলেন। বললেন, এই উট দুটো নিয়ে যাও। সম্ভবত মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামার আগমন পর্যন্ত এ দিয়ে তোমার চলে যাবে। আমি তাকে নির্দেশ দিয়েছি, তোমাকে বিগত এক বছর কালের জন্যে ও আগামী বছরের জন্যে হক দিয়ে দিতে।[(আরবী************)] এই কাহিনী এবং এ কথোপথন থেকে কি প্রমাণিত হয়? এ ঘটনার বিবরণ থেকে অনেক মূল্যবান মৌল নীতি জানা যায়। ১. ইসলামী রাজ্যের অধিবাসী প্রতিটি নাগরিকের প্রতি শাসক ও প্রশাসকের কঠিন দায়িত্ব ও জবাবদিহি রয়েছে। এ বিষয়ে ইসলামী রাষ্ট্রর সর্বোচ্চ শাসক খলীফাতুল মুসলিমীন প্রচন্ড ভাবে সচেতন ছিলেন। ২. ইসলামী রাজ্যের নাগরিকগণ তাদের উপযুক্ত জীবিকা পাওয়ার অধিকার রাখে এবং সে বিষয়ে তারা পূর্ণমাত্রায় সচেতন। রাষ্ট্রেই এ অধিকার আদায়ের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। ৩. ইসলামী সমাজে জীবিকার নিরাপত্তা বিধানে যাকাত হচ্ছে প্রাথমিক পর্যায়ের দান বা আর্থিক সাহায্য। ৪. এই সাহায্য ছিল সুসংগঠিত এবং স্থায়ী। যদি কেউ তার অংশ না পায়, তাহলে সেজন্যে ফরিয়াদ করতে পারে, তার প্রতিকার চাইতে পারে, এই অধিকার প্রতিটি যাকাত পাওয়ার যোগ্য ব্যক্তিরই রয়েছে। ৫. হযরত উমরের রাষ্ট্রনীতি ছিল রাশেদা- সত্য ও সৎপথ অনুসরণকারী। তা এতটা পরিমাণ দেয়ার পক্ষপাতী ছিল যা প্রাপকদের জন্যে যথেষ্ট হয়, তাদের পরমুখাপেক্ষিতামুক্ত ও ধনী বানিয়ে দেয়। তিনি মহিলাটিকে ময়দা ও জয়তুন বোঝাই উট দিয়ে দিলেন। পরে তার সঙ্গে আরও দুটো উট মিলিয়ে দিলেন। আর এই গোটা দানকে তিনি সাময়িক দান হিসেবে গণ্য করেছিলেন, যতক্ষণ না মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামা এসে তাকে বিগত বছর ও আগামী বছরের জন্যে এক সাথে দিচ্ছে। এসবের শেষে একথাও প্রমাণিত হয় যে, হযরত উমর (রা) এ কাজ সর্বপ্রথম করেন নি। এক্ষেত্রেও তিনি নবী করীম (স) ও প্রথম খলীফা হযরত আবূ বকর (রা) এর অনুসারী ছিলেন। দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ যাকাত কার্যে নিয়োজিত কর্মচারী যাকাতের অর্থনৈতিক ও প্রতিষ্ঠানগত ব্যবস্থাপনা কুরআনে নির্দিষ্ট যাকাত ব্যয়ের খাতসমূহের মধ্যে তৃতীয় হচ্ছে এজন্যে নিয়োজিত কর্মচারী। এর পূর্বে ফকীর ও মিসকীনের কথা বলা হয়েছে। যাকাতে নিয়োজিত কর্মচারী, বলতে বোঝায় যাকাত আদায়, সংরক্ষাণ ও ব্যয়-বণ্টন সংক্রান্ত যাবতীয় কাজের জন্যে গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনা। এর মধ্যে যাকাত আদায়কারী, সংরক্ষণকারী, পাহারাদার, লেখক, হিসাব রক্ষক এবং তার বণ্টনকারী সব লোকই গণ্য। এসব লোকের পারিশ্রমিক যাকাত সম্পদ থেকে দেয়ার ব্যবস্থা স্বয়ং আল্লাহ তাআলাই করে দিয়েছেন,- যেন তারা মালের মালিকদের নিকট থেকে যাকাত ছাড়া আর কিছুই গ্রহণ না করে, তার প্রয়োজনও তারা বোধ না করে। উপরন্তু এই ব্যবস্থা দ্বারা এ কথাও প্রমাণিত হয় যে, যাকাত একটা স্বয়ংসম্পূর্ণ ব্যবস্থা ও সংস্থা। এর নিজের আয় দ্বারাই তাকে চলতে হবে। অপর কোন আয়ের উৎসের ওপর নির্ভরশীল হবে না। এই সংস্থার সঙ্গে জড়িত সকলের প্রয়োজন এখান থেকেই পূরণ করতে হবে। কুরআন মজীদে যাকাত ব্যয়ের অন্যতম খাতরূপেই তাদের উল্লেখ করা হয়েছে এবং তা একটি অকাট্য দলীল। যাকাত পাওয়ার যোগ্য আট প্রকারের মধ্যে এরাও এক প্রকারের প্রাপক। এদের স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে ফকীর ও মিসকীনের পর। কেননা এরাই প্রথম প্রাপক ও অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত লোক। এই সব কিছু প্রমাণ করে যে, যাকাত-ব্যবস্থা ইসলামে ব্যক্তির ওপর অর্পিত কাজ নয়। বরঞ্চ এটা আসলে রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের অন্তর্ভূক্ত। রাষ্ট্রই এর যাবতীয় ব্যবস্থাপনা, গঠন ও পরিচালনা করবে। যাকাত আদায়কারী, খাজাঞ্চী, লেখক ও হিসাবরক্ষক সব কিছু নিযুক্ত করা ইসলামী রাষ্ট্রের দায়িত্ব। বস্তুত যাকাতের একটা আয় রয়েছে, আছে একটা বিশেষ বাজেট বা আয়-ব্যয়ের পরিকল্পনা। যারা এখানে কাজ করবে, তাদের মাসিক বেতন এখান থেকেই দেয়া হবে। [যাকাতের সাথে সরকারের সম্পর্ক’ অধ্যায় দ্রষ্টব্য] যাকাত আদায়কারী প্রেরণ সরকারের দায়িত্ব এ পর্যায়ে ফিকাহবিদগণ ঘোষণা করেছেন, যাকাত গ্রহণের জন্যে লোক পাঠানোর কাজটি রাষ্ট্রপ্রধানকে বা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে করতে হবে। নবী করীম (স) এবং তাঁর পরে খুলাফায়ে রাশেদুন যে তাই করেছেন, একথা সর্বজনবিদিত। বুখারী ও মুসলিমে উদ্ধৃত হযরত আবূ হুরায়রা (রা) কর্তৃক বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছে, নবী করীম (স) হযরত উমর (রা) কে যাকাত আদায়ের কাজে নিযুক্ত করে পাঠিয়েছিলেন। হযরত সহল ইবনে সায়াদ (রা) থেকেও বর্ণনা উদ্ধৃত হয়েছেঃ নবী করীম (স) ইবনে লাতবিয়াকে যাকাত আদায়ের কাজে নিযুক্ত করেছিলেন। এ পর্যায়ে হাদীসের সংখ্যা বিপুল। এই ব্যবস্থা করা হয়েছে এ কারণে যে, লোকেরা ধন-মালের মালিক হয়ে বসে; কিন্তু সেজন্যে তাদের ওপর কি কর্তব্য দাঁড়িয়েছে তা তারা জানে না, বুঝে না। অনেকে আবার বুঝেও কর্পণ্য করে। এজন্যেই যাকাত আদায়কারী পাঠনো একান্তই জরুরী হয়ে পড়েছে। [(আরবী*******)] রাষ্ট্রপ্রধান কিংবা তাঁর দায়িত্বশীল কর্মকর্তা কৃষি ফসল ও ফল-মূলের যাকাত আদায় করার জন্যে লোক প্রেরণ করবে। এসবের যাকাত বছর হিসেবে আদায় করা হয় না, হয় ফসল হিসেবে; যখনই তা দেয়া ফরয হয়, তখন। কাজেই ফসল ও ফল কাটা ও মাড়াইর সময়ই তা যাকাত গ্রহণের জন্যে লোক যেতে হবে। এ ছাড়া গৃহপালিত গবাদি পশুর যাকাতে বছরের হিসাব গণ্য হবে। সেজন্যে বছরের একটি মাস নির্দিষ্ট করে নেয়ার প্রয়োজন। আদায়কারী বছরান্তর নির্দিষ্ট মাস বা সময়ে সেজন্যে উপস্থিত হবে। সেজন্যে মুহাররম মাসটি নির্দিষ্ট হওয়া ভাল; শীতকাল হোক কি গ্রীষ্মকাল। কেননা শরীয়াতী হিসেবে এটিই হচ্ছে বছরের প্রথম মাস। যাকাত আদায়কারী কর্মচারীদের কর্তব্য যাকাত সংক্রান্ত কাজে নিয়োজিত কর্মচারীদের বহু প্রকারের দায়িত্ব ও বিভিন্ন রকমের কাজ রয়েছে। তা সবই যাকাত সংগঠনের সাথে সংশ্লিষ্ট। কোন লোকের ওপর এবং কোন মালে যাকাত ধার্য হবে, যাকাতের পরিমাণ কত হবে, যাকাত কে কে পেতে পারে, তাদের সংখ্যা কত, তাদের প্রয়োজনের চূড়ান্ত মাত্রা বা পরিমাণ কত- কত পেলে তাদের জন্যে যথেষ্ট হয়, প্রয়োজন মেটে, এসব নির্ধারণ তাদেরই বড় কাজ। যাকাতের জন্যে দুটো প্রতিষ্ঠান আমাদের এ যুগে যাকাতের সম্পূর্ণ ব্যাপারটি সুষ্ঠুভাবে আঞ্জাম দেয়ার জন্যে দুটো শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা যেতে পারে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের অধীন বহু কয়টি শাখা সংস্থাও গড়ে উঠতে পারেঃ প্রথমঃ যাকাত আদায় বা সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠান। দ্বিতীয়ঃ যাকাত বণ্টনকারী প্রতিষ্ঠান। ১. যাকাত সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠান ও তার বিশেষত্বসমূহ যাকাত সংগ্রহ করার কাজে নিয়োজিত দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের কাজ আসলে কর, সংগ্রহ পর্যায়ের কাজ। এ পর্যায়ে যে দায়িত্ব যে দায়িত্ব পালন করতে হয় ও তার ওপর যে গুরুত্ব আরোপ করতে হয়, তাকে আমরা বলতে পারি কর আদায়ের দায়িত্ব। তাদের বড় কাজ হল, যাদের ওপর ফরয যাকাত ধার্য হতে পারে, তাদের তালিকা তৈরী করা, তাদের ধন-মালের প্রকার এবং কত পরিমাণ যাকাত ফরয হয় তা নির্ধারণ করা, নিকটে গিয়ে তা পর্যবেক্ষণ করা, মালিকদের নিকট থেকে তা সংগ্রহ করা, অতঃপর তার পূর্ণমাত্রায় সংরক্ষণ করা- যাকাতা ব্যয় ও বণ্টকারী প্রতিষ্ঠানের নিকট সমর্পণ করা পর্যন্ত। ধরে নেয়া যায়, এজন্যে বিভিন্ন স্থানে, শহরে নগরে, অঞ্চলে বহু সংখ্যক শাখা-প্রশাখা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। তবে এই প্রতিষ্ঠানটির বিশেষত্ব আধুনিক কালের কর আদায়ের প্রতিষ্ঠানের তুলনায় কর্মক্ষেত্রের প্রেক্ষিতে অধিকতর প্রশস্ত ও বিশাল। কেননা কর আদায়কারী প্রতিষ্ঠান সাধারণত নগদ অর্থ গ্রহণ করে থাকে, কোথাও তা স্বর্ণ রৌপ্যরূপের হতে পারে। কিন্তু যাকাত সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠানকে নগদ অর্থ-স্বর্ণ-রৌপ্য ছাড়াও বহু প্রকারের ফল ও ফসল গ্রহন ও সংরক্ষণের দায়িত্ব পালন করতে হয়। বহু গবাদি পশুও থাকে যাকাত বাবদ গৃহীত সম্পদের মধ্যে। যদিও এসব ক্ষেত্রেই নগদ মূল্য গ্রহণেরও অবকাশ রয়েছে। ইমাম আবূ হানীফা ও তার সঙ্গী-সাথিগণ এরূপ মত প্রকাশ করেছেন। পরবর্তী অধ্যায়ে আমরা তার বিস্তারিত আলোচনা করব। যাকাত বাবদ সংগৃহীতব্য ধন-মালের বিভিন্ন প্রকারের দৃষ্টিতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গঠন করা যেতে পারে। এক-একটি প্রতিষ্ঠান এক-এক ধরনের মাল গ্রহণ করবে এবং সেই সংক্রান্ত যাবতীয় দায়িত্ব পালন করবে। এই প্রতিষ্ঠানসমূহ নিম্নরূপ হতে পারেঃ ক. রিকাজ, খনিজ সম্পদ গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠান। এগুলোর মধ্যে এক-পঞ্চমাংশ দেয়। খ. শস্য ও ফল-মূল গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠান। এগুলোতে এক-দশমাংশ বা তার অর্ধেক গ্রহণীয় ১০% বা ৫%। গ. গবাদি-পশুর যাকাত গ্রহণকারী পতিষ্ঠান। উট, গরু-মহিষ ও ছাগল ইত্যাদি এই পর্যায়ের পশু। এর একটা বিশেষ ধরনের হিসাব রয়েছে। ঘ. নগদ সম্পদ ও ব্যবসা পণ্যের যাকাত গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠান। এ ক্ষেত্রে এক-দশমাংশের এক-চতুর্থাংশ শতকরা আড়াই-আদায় করতে হবে। ২. যাকাত বণ্টনকারী প্রতিষ্ঠান ও তার বিশেষত্ব এই প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম সামাজিক অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বিধান’ পর্যায়ের। একালের পরিভাষায় তাই বলতে হয়, যাকাত পাওয়ার যোগ্য লোকদের চিনবার ও জানবার নির্ভূল ও উত্তম পন্থা উদ্ভাবন ও তগিত অনুভব করা, তাদের প্রয়োজনের প্রমাণ নির্ধারণ, কত পরিমাণ দিলে কার জন্যে যথেষ্ট হতে পারে-তার সব প্রয়োজন যথাযথভাবে পূরণের ব্যবস্থা হতে পারবে তা জানতে হবে। এজন্যে একটা সুস্থ ভিত্তি গড়ে তুলতে হবে, যা তাদের সংখ্যা, পাত্রত্ব ও সামাজিকতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে। ইমাম নববী বলেছেন, রাষ্ট্রপ্রধান, যাকাত সংগ্রহকারী এবং যাকাত বণ্টনের দায়িত্বশীলদের কর্তব্য হচ্ছে, পাওয়ার যোগ্য লোকদের তালিকা সংরক্ষণ, তাদের সংখ্যাটা জানা, তাদের প্রয়োজনের পরিমাণ সম্পর্কে অবহিত হওয়া, যেন সংগৃহীত সব যাকাত সুষ্ঠুরূপে বণ্টন করে স্বস্তি লাভ করা যায়, পাওনাদারদের পাওনা দিয়ে দেয়া যায় িএবং তাদের নিকট পড়ে থেকে যাকাত সম্পদ যেন বিনষ্ট বা ধ্বংসপ্রাপ্ত না হয়। [(আরবী*************)] এ থেকে এ কথাও বোঝা যায় যে, ইসলামের বিশেষজ্ঞ মণীষিগণ যাকাত বণ্টন ব্যবস্থা সুসংগঠিত ও সুসংবদ্ধ করার ওপর যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করেছেন, সেজন্যে চিন্ত-ভাবনাও করেছেন ব্যাপকভাবে। পাওয়ার যোগ্য লোকদের প্রতি চূড়ান্তভাবে লক্ষ্য নিবদ্ধ রেখেছেন যেন তাদের প্রাপ্য অল্প সময়ের মধ্যে তাদের হাতে পৌছে যায়। তাদের চাওয়া বা দাবি করার যেন অপেক্ষা না থাকে। এই প্রতিষ্ঠানটিরও বহু কয়টি শাখা-সংস্থা গড়ে তোলা যেতে পারে। প্রতিটি জেলা, মহকুমা বা থানা, ইউনিয়ন হিসেবে আমরা এই প্রতিষ্ঠানের কাজকে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করতে পারি। ক. অক্ষমতার কারণে কাজ ও উপার্জন থেকে বঞ্চিত ফকীর-মিসকীনের সংস্থা। থুরথুরে বড়ো, বিধবা, ইয়াতীম, কাজের ব্যাপদেশে বিপদের সম্মুখীন হওয়ায় অক্ষম হয়ে পড়েছে, স্থয়ী রোগের দরুন অক্ষমতা দেখা দিয়েছে, যারা সাময়িকভাবে বেকার, কাজ থেকে অবসরপ্রাপ্ত, আকষ্মিক দুর্ঘটনায় সর্বস্বান্ত হয়ে যাওয়া লোক, বিবেকবুদ্ধির দুর্বলতা অক্ষমতা দেখা দেয়ার দুরণ কাজের অনুপযুক্ত হয়ে পড়া লোক, বোকা নির্বোধ ধরনের লোক প্রভৃতি ও পর্যায়ে গণ্য হবে। তাবে তারা যে ধনী ও সচ্ছল নয় উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া যা পূর্ব অর্জিত সম্পদের দরুন, এ বিষয়ে নিশ্চিত হতে হবে। খ. যথেষ্ট পরিমাণের কম আয়ের অধিকারী লোক। এরা উপার্জন করে বটে, কিন্তু তাদের উপার্জন তাদের প্রয়োজনের তুলনায় কম, তাদের জন্যে যথেষ্ট নয়-হয় মজুরী পরিমাণ কম হওয়ার দরুন কিংবা তাদের ওপর নির্ভরশীল লোকদের বিপুল সংখ্যক হওয়ার কারণে অথবা দ্রব্যমূল্যের আকাশ-ছোঁয়া অবস্থা হওয়ার কারণে। কোন কোন ফিকাহবিদ এই লোকদেরই মিসকীন নামে চিহ্নিত করেছেন। গ. ঋণ ভারাক্রান্ত লোকদের সংস্থা। দুর্বৈব-দুর্দশাগ্রস্ত লোকও এর মধ্যে গণ্য হবে। পারস্পারিক সম্পর্কোন্নয়ন ও বিবাদ মীমাংসাকরণের কাজের দরুন যারা ঋণগ্রস্ত হয়েছে, এ ধরনের অন্যান্য কল্যাণমূলক ও সামাজিক সামষ্টিক কাজে জড়িত হওয়ার দরুন যারা ঋণী হয়ে পড়েছে তারা সকলেই এ সংস্থার অধীন গণ্য হবে। ঘ. মুহাজির, স্বদেশ তড়িত ও রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণকারী লোক, যারা কুফর ও অশান্তিপূর্ণ দেশ ত্যাগ করে এসে আশ্রয় গ্রহণ করেছে, ইসলামের খেদমতে বিদেশে প্রেরিত ছাত্র বা লোক প্রভৃতি এই সংস্থাভুক্ত হবে। শেষোক্তরা ফী-সাবীলিল্লাহ পর্যায়ে গণ্য বলে তাদের জন্যে যাকাত ব্যয় করা যাবে। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা পরে করা হবে। ঙ. কাফিরী দেশে ইসলাম প্রচার সংস্থা। বিশ্বব্যাপী ইসলামী দাওয়াত প্রচারের কাজ, ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা, ইসলামী দেশকে কাফিরদের কর্তৃত্ব ও আদিপত্য থেকে মুক্তকরণ, কাফিরী শাসনের অবসান করে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি কাজ এই সংস্থার অধীনে চলবে। এটাও ফী-সাবীলিল্লাহ’ পর্যায়ে গণ্য। এ বিষয়েও পরে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। এই বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে কোনটিতে কত ব্যয় করা হবে, তাও নির্ধারণ করতে হবে। এজন্যে যাকাতের একটা পূর্ণাঙ্গ বাজেট তৈরী করা আবশ্যক হবে। রাষ্ট্রকর্তার ইজতিহাদ এক্ষেত্রে কাজ করবে পরামর্শদাতা বা উপদেষ্টা পরিষদের অধীন। এজন্যে পরিসংখ্যান বিভাগ চাল্য করতে হবে। অবশ্য যেখানে থেকে যাকাত সংগ্রহ করা হয়েছে সেই স্থানের কল্যাণের দিকে অধিক লক্ষ্য রাখতে হবে ইসলামের সামগ্রিক কল্যাণ দৃষ্টির পরিপ্রেক্ষিতে। একটা বিশ্বব্যাপী ইসলামী দাওয়াতের ব্যবস্থা করার ওপরও লক্ষ্য রাখতে হবে। সারা দুনিয়ার মুসলমানের কল্যাণও এই কল্যাণদৃষ্টির অন্তর্ভূক্ত থাকবে। তারা দুনিয়ার জাতিসমূহের মধ্যে একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্যর অধিকারী উম্মত একথা বিস্মৃত হওয়া চলবে না। যাকাত পাওয়ার যোগ্যতা নির্ণয়ের ওপর গুরুত্ব যাকাতের মাল যার যার জন্যে ও যে যে ক্ষেত্রে ব্যয় করা হবে, সে সে ব্যক্তি ও সংস্থার যাকাত পাওয়ার যোগ্যতা ও অধিকার নির্ণয় করা এই বিভাগের একটা বড় কাজ। এ পর্যায়ে বহু নিয়ম-কানুন রয়েছে, ফিকাহবিদগণ নবী করীম (স) এর হাদীস থেকে তা ইস্তেম্বাত করে প্রকাশ করেছেন। তাঁদের বক্তব্য থেকে আমরা এখানে কতিপয় শর্ত ও নিয়ম কানুনের উল্লেখ করছিঃ ক. ফকীর মিসকীনের অংশ পাওয়ার জন্যে সর্বপ্রথম শর্ত এই যে, তার নিজের কোন মাল বা উপার্জন এমন থাকবে না যাদ্বারা তার ও তার পরিবারবর্গের প্রয়োজন যথেষ্ট মাত্রায় পূরণ হতে পারে। উপার্জনে একেবারেই ও আসলেই অক্ষম হওয়া শর্ত নয়। যেসব উপার্জনক্ষম লোক কাজ পাচ্ছে না, বেকারত্ব ভুগছে, তাদের জন্যও যাকাতের মাল সম্পূর্ণ হালাল। এরূপ অবস্থায় সেও অক্ষম বিবেচিত হবে। আর যে লোক উপার্জন করে, কিন্তু সে উপার্জন প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নয়, সে তার প্রয়োজন যথেষ্ট মাত্রায় পূরণের জন্য যাকাত গ্রহণ করতে পারবে। খ. ব্যক্তির অবস্থা ও সামাজিক বা বংশীয় মর্যাদার সাথে সংগতি সম্পন্ন পরিমাণ উপার্জনই গণ্য হবে। যার উপার্জন এরূপ নয়, কিছুই নেইর মধ্যে গণ্য হবে। আলিম, কবি, সাহিত্যিক, লেখক প্রভৃতি যারা দৈহিক পরিশ্রমে অভ্যস্ত নয়, তারা ফকীর-মিসকীনের অংশ থেকে গ্রহণ করতে পারে, যদ্দিন না তারা উপযোগী কোন উপার্জন উপায় পাচ্ছে। গ. উপার্জনক্ষম হওয়া সত্ত্বেও ইলম অর্জনে ব্যস্ত হওয়ার দারুন প্রয়োজন পূরণ করতে পারছে না, কেননা আত্মনিয়োগ করলে তার ইলম হাসিল করা হয় না, তার জন্যেও যাকাত হালাল হবে। যেলোক প্রকৃতই ইলম অর্জনে নিয়োজিত, তার জন্যেই এ কথা প্রযোজ্য। কেননা তার অর্জিত ইলম দ্বারা গোটা মুসলিম সমাজ উপকৃত হবে বলে আশা করা যায়। কিন্তু যেলোক প্রকৃতই ইলম হাসিল করছে না, করার যোগ্যতা নেই, অথচ উপার্জন করার ক্ষমতা আছে, তার পক্ষে যাকাত গ্রহণ হালাল নয়, যদিও যে কোন মাদ্রাসায় শিক্ষর্থী হিসেবে অবস্থান করছে। ঘ. যার কোন চাষযোগ্য জমি থাকবে, কিন্তু তার আমদানী যথেষ্ট পরিমাণ হয় না, সে ফকীর বা মিসকীন গণ্য হবে এবং যাকাত থেকে তার প্রয়োজন যথেষ্ট মাত্রায় পূরণ করে দেয়া যাবে। তাকে সেই জমি বিক্রয় করে দিতে বাধ্যকরা যাবে না- শিক্ষার কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিকেও বাধ্য করা যাবে না তার বই পুস্তক বিক্রয় করে দিতে। কেননা বই-পুস্তক তো তোর জন্যে অপরিহার্য অন্য লোকের তুলনায়। চ. কোন ব্যক্তির যাকাতের মাল চিহ্নিত হওয়ার পর সে যদি দাবি করে যে সে ফকীর হয়ে গেছে, তাহলে তার দারিদ্র্য প্রমাণ না করা পর্যন্ত সে মাল তার কাছে থেকে গ্রহণ করা যাবেনা। কেননা ধনাঢ্যতা প্রমাণিত হওয়ার পর তার দারিদ্র্য প্রমাণ না করা পর্যন্ত তার দাবি মেনে নেয়া যায় না। যেমন কারুর যাকাতের মাল চিহ্নিত হওয়ার পর কারুর দেয় ঋণ তার ওপর সাব্যস্ত হলে, এক্ষণে যেস স্বীয় অভাব ও আর্থিক সংকটের কথা পেশ করল, তখনও তাই করতে হবে। ছ. যার মাল চিহ্নিত করা হয়নি, সে যদি স্বীয় দারিদ্র্য ও অনটনের কথা প্রকাশ করে, তাহলে তার কথা মেনে নিতে হবে। এতে কোন মতদ্বৈততা নেই। কেননা দারিদ্র্য একটা প্রচ্ছন্ন ব্যাপার। কোন দলীল দিয়ে তা প্রমাণ করা সহজ নয়। জ. কেউ দাবি করলে যে, তার কোন উপার্জন নেই- সে বেকার, তার বাহ্যিক অবস্থা দেখে যদি তাই মনে হয়- যেমন থুরথুরে বুড়ো কিংবা স্বাস্থ্যহীন কর্মক্ষমতাহীন যুবক তা হলে কোনরূপ কিড়া কসম ছাড়াই তার দাবি মেনে নিতে হবে। কেননা বাহ্যত এবং কার্যত তার কোন উপার্জন নেই। শক্তিশালী যুবকও যদি স্বীয় দারিদ্র্যর কথা বলে, তাহলে তার কথাও গ্রহণ করা হবে; কিন্তু তাকে কিড়া-কসম করতে বলতে হবে কিনা, এ পর্যায়ে দুটো কথা রয়েছেঃ শাফেয়ী এবং এ মতের অন্যান্য লোকদের কথা হচ্ছে, কিড়া করতে বলা যাবে না। ইমাম আহমাদ, আবূ দাউদ ও নাসায়ী বর্ণনা করেছেন, দুই ব্যক্তি এসে রাসূলে করীম (স) এর কাছে যাকাত চাইল। নবী করীম (স) চোখ তুলে তাদের দেখলেন ও চোখ নিচু করে নিলেন। তিনি দেখলেন, দুজনই বেশ স্বস্থ্যবান। তখন বললেনঃ তোমরা চাইলে আমি দেব। তবে কথা হচ্ছে, কোন ধনী সচ্ছল ব্যক্তির জন্যে এটা প্রাপ্য নয়, শক্তিসম্পন্ন উপার্জনক্ষমের জন্যেও নয়। এ হাদীস অনুযায়ী নবী করীম (স) এর সুন্নাত অনুসরণার্থে যাকাত বণ্টনকারীর কর্তব্য প্রত্যেক শক্তিসম্পন্ন দরিদ্র ব্যক্তিকে যাকাতের অংশ দেয়ার সময় এরূপ নসীহত করা। এটা মূর্খকে শিক্ষাদান এবং অসতর্ককে সতর্ককরণ। ঝ. ফকীর বা মিসকীন যদি দাবি করে যে, তার সন্তানাদি রয়েছে এবং তাদের সকলের জন্যে প্রয়োজনীয় পরিমাণ দরকার, তাহলে দলীল-প্রমাণ ছাড়া তার সন্তানাদির কথা মেনে নেয়া যাবে না। কেননা সাধারণত সন্তানাদি না থাকার কথা আর থাকলে তা প্রমাণ করাও কঠিন নয়। ঞ. কেউ নিজেকে ঋণগ্রস্ত হওয়ার দাবি করলে প্রমাণ ছাড়া তা মেনে নেয়া যাবে না। ট. এসব ক্ষেত্রে বিচারকের দালীল শ্রবণ করা এবং দাবি দায়ের করা অস্বীকার করা ও সাক্ষ্য জানানোই যথেষ্ট নয়। বরং দুজন ন্যয়বাদী সত্যবাদী চরিত্রবান বিশ্বস্ত ব্যক্তির সাক্ষ্যদান অবশ্যক। সাক্ষীদ্বয় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির দাবির সত্যতার পক্ষে বা বিপক্ষে সাক্ষ্য দান করবে। জনশ্রুতি বা জনগণের মধ্যে ব্যাপক-বিস্তৃতি দলীল প্রমাণের স্থলাভিষিক্ত। কেননা যতটা জানা দরকার, তা এভাবে হয়ে যায়। স্পষ্ট ধারণা করতেও কোন অসুবিধা হয় না। এমন কি কেউ কেউ এদ্দুর বলেছেন, একজন লোকও যদি প্রকৃত অবস্থা জানাতে পারে, তাবে তাই যথেষ্ট হবে। [এই সমস্ত আলোচনা ইমাম নববী রচিত (আরবী*****) থেকে গৃহীত।] ভিক্ষা চাওয়া কার জন্যে জায়েয, সে বিষয়ে বিভিন্ন হাদীসে বলা হয়েছে। একটি হাদীসের কথাঃ ‘যে ব্যক্তি অনশন জর্জরিত।’ তার আশপাশের জানে-শুনে- এমন অন্তত তিনজন লোক বলবেঃ হ্যাঁ লোকটি সত্যই অনশনে রয়েছে। এরূপ ব্যক্তির পক্ষে ভিক্ষঅ করা জায়েয। ইমাম খাত্তাবী বলেছেনঃ এ হাদীসটির প্রয়োগ হবে সেই ব্যক্তির ক্ষেত্রে, যার মালিকানা প্রমাণিত এবং বাহ্যিক সচ্ছলতা সুপরিচিত, সে যদি দাবি করে যে, তার ধন-মাল ধ্বংস হয়ে গেছে চোর-ডাকাতের লুণ্ঠনে, অথবা আমানতদারের বিশ্বাসঘাতকতার দরুন অথবা এ ধরনের এমন কোন ঘটনার ফলে যার পর্যবেক্ষনীয় কোন চিহ্ন থাকে না; কিন্তু তা সত্ত্বেও এ দাবির সভ্যতা সম্পর্কে যদি সন্দেহের সৃষ্টি হয়, তা হলে তার অবস্থা সুস্পষ্ট হওয়া ও তার সত্যতা প্রমাণিত হওয়ার পূর্বে তাকে যাকাত থেকে কিছুই দেয়া যাবে না। সেজন্যে প্রয়োজন হলে তার সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ লোকদের নিকট জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। ঠিক এ কথাই হাদীসের শেষে বল হয়েছে এই ভাষায়ঃ যতক্ষণ না তার আশপাশের জানে-শুনে এমন অন্তত তিনজন লোক তার দুরবস্থা সম্পর্কে সাক্ষ্য দেবে......। জানাশোনা লোক হওয়ার শর্ত হয়েছে এজন্যে যে, যারা জানে না, বুঝে না তাদের কথার কোন মূল্য নেই। ব্যাপারসমূহের অন্তর্নিহিত প্রকৃত অবস্থা অনুধাবন তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। এ ব্যাপারটি সাক্ষ্য দানের ব্যাপার নয়, প্রমাণ করা ও পরিচিতি লাভের ব্যাপার। তাই তার প্রতিবেশী বা স্বজাতীয় স্ব-সমাজী জানে-শুনে এমন তিনজন লোক তার অবস্থা সম্পর্কে সাক্ষ্য দেবে। বলবে যে, তার দাবি সত্য, তাহলে তাকে যাকাত দেয়া যাবে। [(আরবী**********)] যাকাত-কর্মচারী হওয়ার শর্ত যাকাতের কাজে কর্মচারীরূপে নিযুক্ত পাওয়ার জন্যে নিম্নলিখিত শর্তাবলী লক্ষণীয়ঃ ১. তাকে মুসলিম হতে হবে। কেননা এই কাজটা মুসলিম সমাজের প্রতিনিধি করার পর্যায়ের। অতএব ইসলামে বিশ্বসী হওয়া জরুরী শর্তরূপে গণ- অপরাপর সব প্রতিনিধিত্বের মতই। তবে যাকাত সংগ্রহ ও বণ্টন কাজ ছাড়া অন্যান্য কাজের ক্ষেত্রে এ শর্ত নেই। যেমন পাহারাদার, দারওয়ান, গাড়ি চালক ইত্যাদি। ইমাম আহমাদ এর একটি বর্ণনায় যাকাতের কর্মচারী অমুসলিমও হতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কেননা কুরআনী ঘোষণা নিঃশর্তে উল্লিখিত হয়েছে। মুসলিম ও অমুসলিম-কাফির উভয়ই এর অন্তর্ভূক্ত হতে পারে। উপরন্তু কর্মচারী যা পাবে, তা হচ্ছে তার শ্রম বা কাজের মজুরী মাত্র। তাই অন্যান্য কাজের মজুরী গ্রহণে যেমন এ ধরনের কোন শর্ত নেই, এখানেও তাই। ২. আসলে এটা ইসলামের পরম উদারতা। কিন্তু তা সত্ত্বেও এটা যেহেতু একটি ইসলামী ফরয কাজ, তাই এ কাজে অমুসলিম লো নিয়োগ না করাই উত্তম। ইবনে কুদামাহ বলেছেনঃ যেহেতু এ কাজের জন্যে আমানতদারী ও পরম বিশ্বস্ততা থাকা জরুরী শর্ত বিশেষ, তাই কর্মচারীরও মুসলিম হওয়া জরুরী। সাক্ষ্যের ক্ষেত্রে যেমন এই শর্ত রয়েছে। এটা মুসলমানদের একটা নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বও বটে। তাই কোন কাফিরকে এ কাজে নিযুক্ত করা জায়েয হবে না। তা ছাড়া যে লোক নিজে যাকাত ফরয হয় এমন লোকদের মধ্যে গণ্য নয়, তাকে এ কাজের দায়িত্ব দেয়া উচিত নয়। কাফির ব্যক্তি আমানতদার গণ্য হতে পারে না। এ কারণে হযরত উমর (রা) বলেছেনঃ ‘এই লোকদের তোমরা আমানতদার বানিও না। কেননা তারা নিজেরাই আল্লাহর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে’। হযরত উমর (রা) হযরত আবূ মুসা আশআরীর দফতরে কেরানীপদে একজন খৃস্টানকে নিয়োগ করাকে পসন্দ বা সমর্থন করেন নি। আর যাকাত হচ্ছে ইসলামের একটা ফরয। তাতে এই নীতি অব্যশই বাধ্যতামূলক হবে। [(আরবী***********)] ২. পূর্ণ বয়স্ক ও সুস্থ বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন হতে হবে। ৩. বিশ্বস্ত ও আমানতদার হতে হবে। কেননা মুসলিম জনগণের আমানত তার নিকট রাখা হবে। তাই কোন ফাসিক ও খিয়ানতকারীকে এ কাজে লাগানো যেতে পারে না। কেননা এই পরিচিতির লোকদের আমানতদারী বিশ্বাস্য নয়। তারা লালসার বশবর্তী হয়ে কাফীর-মিসকীনের অধিকার হরণ করতে পারে, উপস্থিত স্বার্থ লোভের বশবর্তী হয়ে যেতে পারে, এই ভয় বা আশংকা থেকেই যায়। ৪. যাকাতের বিধান সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান থাকা। ফিকাহবিদদের আরোপিত আর একটি শর্ত হচ্ছে যাকাত সংক্রান্ত শরীয়াতী হুকুম আহকাম ও আইন বিধান সম্পর্কে অবহিত ও ওয়াকিফহাল হওয়া, যদি সে সাধারণ কর্যাবলীর দায়িত্বশীল হয়। কেননা সে এসব বিষয়ে অজ্ঞ হলে সে সঠিকভাবে কাজ করতে পারবে না, তার ভুল বেশি হবে সঠিক কাজের তুলনায়। [১১১১] কেননা কি তাকে গ্রহণ করতে হবে, আর কি গ্রহণ করা চলবে না, তাও তার জানা থাকা আবশ্যক। এজন্যে তার আংশিক ইজতিহাদ করার প্রয়োজনও দেখা দেবে যাকাত সংক্রান্ত নিত্য সৃষ্ট মাসলা-মাসায়েল ও হুকুম-আহকামের ক্ষেত্রে। তবে তার কাজই যদি হয় আংশিক, সুনির্দিষ্ট একটা বিশেষ পরিধির মধ্যে, তাহলে অন্তত তার কাজের পরিমাণটুকু সম্পর্কে তার জানা থাকতে হবে। ৫. কাজের যথেষ্ট যোগ্যতা থাকতে হবে। যে কাজের দাযিত্ব অর্পিত হবে, নিয়োগকৃত কর্মচারীর মধ্যে সে কাজটুকু আঞ্জাম দেয়ার মত কর্মক্ষমতা থাকতে হবে, তার যোগ্য হতে হবে। কেননা শুধু বিশ্বস্ততাত ও আমানতদারীর গুণ প্রয়োজনীয় কর্মক্ষমতার বিকল্প বা স্থলাভিষিক্ত হতে পারে না। কুরআনে বলা হয়েছেঃ (আরবী************) তুমি যাকে কাজে নিযুক্ত করবে, সেজন্যে শক্তিসম্পন্ন ও বিশ্বস্ত ব্যক্তিই উত্তম। (সূরা কাসাসঃ ২৬) এ কারণে হযরত ইউসূফ (আ) বলেছিলেন বাদশাহকেঃ (আরবী*****************) আমাকে পৃথিবীর ধন-ভান্ডারের ওপর দয়িত্বশীল নিযুক্ত করুন। আমি নিঃসন্দেহে সংরক্ষণকারী সুবিজ্ঞ। (সূরা ইউসূফঃ ৫৫) তাই সংরক্ষণ অর্থাৎ আমানতদারী এবং ইলম অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট কাজ উত্তমভাবে ও যথেষ্ট মাত্রায় করা জ্ঞান ও যোগ্যতা থাকতে হবে কর্মচারীর মধ্যে। বস্তুত প্রত্যেক সফল কাজের এ দুটোই হচ্ছে ভিত্তি। ৬. নিকটাত্মীয় নিয়োগ করা কি জায়েয? অনেকে এও শর্ত করেছেন যে, নবী করীম (স) এর নিকটাত্মীয় বনু হাশেমের লোক এই কাজে নিযুক্ত না হওয়া উচিত। কেননা ফযল ইবনে আব্বাস ও মতলব ইবনে রবীয়া দুই ব্যক্তি নবী করীম (স) এর নিকট যাকাত সংক্রান্ত কাজে বিনিয়োগের প্রার্থনা করেছিলেন। একজন বললেন, ‘ হে রাসূল! আমরা আপনার নিকট এসেছি এই উদ্দেশ্যে যে, আপনি আমাদেরকে যাকাত সংক্রান্ত এই কাজে নিযুক্ত করবেন। তাহলে অন্যান্য লোকের ন্যায় আমরাও এ থেকে সুবিধা ও মুনাফা লাভ করতে পারব। লোকেরা যেমন আদায় করে দেয় আপনার নিকট, আমরাও তেমনিভাবে আদায় করে দেব।’ তখন তিনি বললেন, যাকাত (সংক্রান্ত কাজ) মুহাম্মাদ ও তাঁর বংশাবলীর পক্ষে শোভন নয়। তা তো আসলে মানুষের আবর্জনা বিশেষ।’ হাদীসটি আহমাদ ও মুসলিম বর্ণনা করেছেন। অপর একটি বর্ণার ভাষা হচ্ছেঃ যাকাত মুহাম্মাদ ও মুহাম্মাদের বংশাবলীর জন্যে হালাল নয়।’। [(আরবী*******)] হাদীসটি মুহাম্মাদ (স) এর বংশধরদের যাকাতের মালের দিকে চোখ তুলে তাকাতেও নিষেধ করছে। তা থেকে উপকৃত হওয়াও অনুরূপ নিষিদ্ধ। কথাটির শেষ দিক তুলনামূলক। যাকাত হচ্ছে লোকদের ধন-মাল ও মন মানসিকতার পরিচ্ছন্নতা বিধানের মাধ্যম। আল্লাহ বলেছেন, তুমি তাদের পবিত্র করবে, পরিশুদ্ধ করবে এই যাকাত দ্বারা, এ কারণে তাকে আবর্জনা (Dirt-filth) বলা হয়েছে। বস্তুত যাকাতের মাল সাধরণ জনগণের মাল। অতএব তা কোন রূপ অধিকার ছাড়া পাওয়া যেতে পারে না। সেরূপ পাওয়া ইসলমী শরীয়াতের দৃষ্টিতে অতি বড় গুনাহ। নবী করীম (স) এ মাল থেকে তার নিকটাত্মীয়দের দূরে রাখার ও ভীত করার জন্যে একটা দৃষ্টান্ত দিতে চেয়েছিলেন মাত্র। তিনি এ বিষয়ে লোকদের সাবধান করেছেন তার খোঁজ-খবর লওয়ার আগ্রহ থেকে, তা বেশি পরিমাণে পাওয়ার লোভ থেকে। আহলি বাইত-এর ফিকাহবিদ নাসের মনে করেছেন, বনু হাশিমের লোকদের কাজে নিযুক্ত করে যাকাত থেকে বৃত্তিদান না মাসিক বেতন দান জায়েয। ইমাম শাফেয়ী এবং আহমদেরও তা-ই মত। কাযী আবূ ইয়ালা যাকাত সংক্রান্ত কাজে বনু হাশিমের লোকদের নিয়োগ করা পর্যায়ে বলেছেনঃ যারা পক্ষে যাকাত-সাদকা গ্রহণ করা হারাম রাসূলের নিকটাত্মীয়দের ক্রীতদাসদের মধ্যে থেকে, তাকে এই কাজে কর্মচারী হিসেবে নিযুক্ত করা জায়েয। কেননা সে যা পাচ্ছে তা তার পারিশ্রমিক, যাকাত নয়। এই কারণে তার কাজ অনুপাতে তার প্রাপ্যও নির্ধারিত হবে। আর খারকী বলেছেন, বনু হাশিম, কাফির ও গোলামকে যাকাত দেয়া যাবে না। তবে তারা যদি এই কাজের কর্মচারী নিযুক্ত হয়ে থাকে, তা হলে তাদের কাজ অনুপাত তাদের দেয়া যাবে। [(আরবী*******)] অন্য কথায় হাদীসটির তাৎপর্য হচ্ছে, এই পর্যায়ের কাজ পেতে চাওয়া থেকে বনু হাশিমের লোকদের দূরে সরিয়ে রাখা-এ বিষয়ে তাদের মনে বিতৃষ্ণা ও অনীহা জাগিয়ে তোলা- তা হারাম করে দেয়া হয়নি তাদের জন্যে। হাদীসটি দ্বারা বনু হাশিমের লোকদের জন্যে এই কাজ হারাম করা হয়েছে বলে যারা মনে করেছেন, তাদের মত হচ্ছে, রাসূলের নিকটাত্মীয়দের যাকাত থেকে বেতন বা মজুরী গ্রহণ নিষিদ্ধ হয়েছে। কিন্তু তারা যদি এ কাজে নিযুক্ত কর্মচারী হয়ে যাকাত ছাড়া অন্য ফাণ্ড থেকে বেতন গ্রহণ করে, তাহলে তা সর্বসম্মতভাবে জায়েয হবে। হযরত আলী (রা) বনু আব্ববাস লোকদের যাকাত সংক্রান্ত কাজে কর্মচারী নিযুক্ত করেছিলেন। [(আরবী*************)] ৭. পুরুষ হওয়া কি শর্ত? অনেকে শর্ত আরোপ করেছেন যে, যাকাত সংক্রান্ত কাজে পুরুষ লোকদেরকে কর্মচারী নিযুক্ত করতে হবে, মহিলাদের এ কাজে নিযুক্ত করা তাঁদের মতে জায়েয হবে না কেননা এই কাজটি হচ্ছে যাকাত-সাদকার ওপর কর্তৃত্বকরণ। কিন্তু এই মতের সমর্থনে নবী করীম (স) এর একটি কথাই শুধু দলীল হিসেবে পেশ করা সম্ভব হয়েছে। সে কথাটি হলোঃ (আরবী******************) যে জাতি তাদের সামষ্টিক কার্যাবলীতে স্ত্রীলোকদের কর্তৃত্বশীল বানায়, সে জাতি কখনই কল্যাণ লাভ করতে পারে না। (বুখারী) কিন্তু এই হাদীসটি তে সাধারণ জাতীয় নেতৃত্বের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। যেখানে মহিলাকে সর্বোচ্চ কর্তৃত্বে আদেশ ও নিষধকরণের কাজে নিযুক্ত করা হয়, কিন্তু সাধারণ চাকরী-বাকরীর ক্ষেত্রে যাকাত সংক্রান্ত কর্মচারী তন্মধ্যেই গণ্য- এই হাদীসটি প্রযোজ্য নয়। অনেকে যুক্তি দেখিয়েছেন, যাকাত সংক্রান্ত কাজে কোন মহিলাকে নিযুক্ত করা হয়েছে, তার কোন নজীর নেই। আগের কালের লোকেরাও তা করেন নি, শেষের দিকের লোকেরাও নয়। অতএব নিছক এ ব্যাপারই প্রমাণ করে যে, তা জায়েয নয়। কিন্তু এটা কোন দলীল হল না। ইসলামের স্বর্ণযুগে মহিলারা অর্থনৈতিক ও সামষ্টিক কাজে নিযুক্ত হওয়ার যোগ্যতাসম্পন্ন ছিল না। কিন্তু কার্যত তাদেরকে নিয়োগ না করা একথা প্রমাণ করে না যে, তা হারাম। কেউ কেউ বলেছেন আল্লাহর ব্যবহৃত শব্দ (আরবী*********) মহিলাদের শামিল করে না। কেননা এটা পুংলিঙ্গের শব্দ।[(আরবী************)] এই দলীলটি মোটেই যথার্থ নয়। কেননা তাই যদি গৃহীত হত তাহলে ফকীর, মিসকীন, গারেমীন ইত্যাদি শব্দও পুংলিঙ্গ, মহিলাদেরকে তাতেও শামিল করা যাবে না। কিন্তু তা তো ইজমার পরিপন্থী। কেননা এসব ক্ষেত্রেই মহিলারা পুরুষদের অধীন অনুষঙ্গ হিসেবে শামিল রয়েছে। সম্বোধন ও ব্যবহৃত শব্দসমূহ বাহ্যত পুরুষদের জন্যে হলেও তাতে কোন ক্ষতি নেই। সত্যি কথা হচ্ছে এ পর্যায়ে যাকাত সংক্রান্ত কাজে মাহিলাদের নিয়োগ করা নিষিদ্ধ হওয়ার পক্ষে বিশেষ কোন দলীলই নেই। তবে সাধরণ নিয়ম-কানুন হচ্ছে মহিলাদেরকে পুরুষদের ভিড় ও অবাধ মেলামেশার স্থান ও কেন্দ্র থেকে দূরে সরে থাকতে হবে। বিনা প্রয়োজনে এসব ক্ষেত্রে মহিলাদের যাওয়াই অনুচিত। এ কারণেই এ কাজে মহিলাদের অপেক্ষা পুরুষদেরই নিযুক্ত করা উচিত। তবে সীমিত পরিবেষ্টনীতে মহিলাদেরও এ কাজে লাগানো যেতে পারে। যেমন বিধবা ও অক্ষম মহিলাদের নিকট যাকাতের মাল পৌছে দেয়ার কাজ তারা করতে পারে। অন্তত পক্ষে এ কাজে মহিলারা যথেষ্ট যোগ্যতাসম্পন্ন। অনুপাতে তারা মজুরীও পেতে পারবে। মহান উদার শরীয়াতে এ ধরনের সুযোগ না দেয়ার মত কোন সংকীর্ণতা নেই। ৮. অনেকে শর্ত আরোপ করেছেন, কর্মচারী হিসেবে স্বাধীন মুক্ত নাগরিককেই নিয়োগ করতে হবে, ক্রতদাস নয়। কিন্তু অন্যরা এই মত প্রত্যাখ্যান করেছেন। তাঁরা দলীল হিসেবে আহমাদ ও বুখারী বর্ণিত হাদীস উদ্ধৃত করেছেন। নবী করীম (স) বলেছেনঃ (আরবী**********) তোমরা শোন, আনুগত্য কর, তোমাদের ওপর চেপটা মাথার কোন ক্রিতদাসকে প্রশাসক বানিয়ে দেয়া হলেও। আর যেহেতু ক্রিতদাস হলেও তার দ্বারা কাজ সুসম্পন্ন করানো যেতে পারে, তাই সেও ঠিক মুক্ত স্বাধীন নাগরিকদের মতই। কর্মচারীকে কত দেয়া হবে কর্মচারী মাসিক বেতনভুক্ত। কাজেই তাকে একটা পরিমাণ বেতন বা ভাতা দিতে হবে যা তার প্রয়োজন পুরণে যথেষ্ট হবে। এটা তার মজুরী মাত্র। তা তার সামাজিক মর্যাদার দৃষ্টিতে নিম্নমানের হওয়া উচিত নয় যেমন, তেমনি খুব বেশি বাড়াতিও হওয়া উচিত নয়। ইমাম শাফেয়ী থেকে বর্ণিত, যাকাত ফাণ্ড থেকে কর্মচারীদের বেতন দ্রব্যমূল্য অনুপাতে দেয়া উচিত। তার এই মতটি বিভিন্ন প্রকারের দ্রব্যমূল্যে সমতা বিধানের নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত। তাদের বেতন যদি দ্রব্যমূল্যের তুলনায় অধিক দিতে হয় তা হলে তা যাকাত ছাড়া অন্য ফাণ্ড থেকে দেবে। জমহুর ফিকাহবিদগণ মনে করেন, যাকাত সংক্রান্ত কাজে নিযুক্ত কর্মচারীদের বেতন যাকাত থেকেই দিতে হবে। কুরআনের কথা থেকে তাই মনে হয়। তারা যাকাত থেকেই পেতে পারে, দ্রব্যমূল্যের তুলনায় অধিক হলেও। ইমাম শাফেয়ী থেকে প্রাপ্ত বর্ণাও তাই বলে। তবে তাঁর এ মতটি যুক্তিভিত্তিক কেননা তাতে ফকীর ও যাকাত যাওয়ার যোগ্য অন্যান্য লোকদের কল্যাণের প্রতি লক্ষ্য রাখা হয়েছে। কর’ সংক্রান্ত হাদীসের সাথেও তার মিল রয়েছে। তাতে সংগ্রহ-ব্যয়ে মধ্যম নীতি অবলম্বন করাকে ওয়াজিব করে দেয়া হয়েছে। নিযুক্ত কর্মচারী ধনী হলেও তাকে তার ভাতা বা বেতন দিতে হবে। কেননা সে তো তার কাজের মজুরী গ্রহণ করছে তার প্রয়োজনে, কনোরূপ সাহায্য বাবদ নয়। আবূ দাউদ নবী করীম (স) থেকে বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন। তিনি বলেছেনঃ যাকাত পাঁচ জন লোক ছাড়া অপর কোন ধনী ব্যক্তির জন্যে জায়েয নয়। আল্লাহর পথে যুদ্ধকারী, তার কর্মচারী, ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি, কেউ যদি তা স্বীয় মালের বিনিময়ে ক্রয় করে নেয়, অথবা এমন ব্যক্তি যার প্রতিবেশী মিসকীন ছিল, সে অপর এক মিসকীনকে দান করল। এই মিসকীন ব্যক্তি কোন ধনী ব্যক্তিকে হাদিয়া হিসেবে দিল-এই হচ্ছে পাঁচ জন।[ইমাম নববী তাঁর المجموع গ্রন্থে লিখেছেনঃ এ হাদীসটি হাসান বা সহীহ। আবূ দাউদ এটি দুইটি সুত্রে বর্ণনা করেছেন।] যাকাতের মালের প্রতি লোভের ওপর রাসূলের কঠোরতা কোন কর্মচারী যদি যাকাত সংক্রান্ত কাজে সরকারের পক্ষ থেকে দায়িত্বশীল বেতনভুক্ত হয়, তাহলে তাকে যাকাত সংগ্রহের কাজ নির্দেশমতই করে যেতে হবে। তা ব্যয় ও বণ্টনও করতে হবে বিধান অনুযায়ী। যাকাতের কোন মাল স্বীয় মুনাফা বা সুবিধা অর্জনের কাজে ব্যবহার করতে পারবে না, করা জায়েয হবে না। যা সংগৃহীত হয়েছে তার থেকে কম কি বেশি- কোন পরিমাণের মালই সে গোপন করতে পারবে না। কেননা তা জনগণের মাল। তার ওপর কারুর লোভ হওয়া বা বিনা অধিকার তা থেকে কিছু গ্রহণ করা জায়েয হতে পারে না। এ পার্যায়ে যেসব হাদীস উদ্ধৃত হয়েছে তা পড়লে কলিজা ফেঁপে উঠে, পরিণামের ভয়ে শরীর শিউরে উঠে। যে মালে কারুর হক নেই তার প্রতি তার কোন রূপ লোভ হওয়াটা কঠিন আযাবের কারণ হবে। হযরত আদী ইবনে উমাইরাতা (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, “আমি রাসূলে করীম (স) কে বলতে শুনেছিঃ (আরবী******************) আমরা যাকে কোন দায়িত্বপূর্ণ কাজে নিযুক্ত করেছি, সে যদি একটি সুচও বা তার চাইতেও বড় জিনিস গোপন করে রাখে, তাহলে তা বিশ্বাসঘাতকতা হবে। কিয়ামতের দিন তা অবশ্যই ফেরত দিতে হবে। এ কথা শুনে আনসার বংশের এক কালো ব্যক্তি দাঁড়িয়ে আমি তার প্রতি তাকিয়েছিলাম- বললেনঃ হে রাসূল! আপনি আপনার কাজ আমার নিকট থেকে ফেরত নিয়ে নিন। রাসূল (স) বললেনঃ কেন, তোমার কি হয়েছে? লোকটি বললেন, আমি শুনলাম, আপনি এই এই বলেছেন। তিনি বললেনঃ হ্যাঁ, আমি এখনই বলেছি; আমরা তোমাদের মধ্য থেকে যাকেই কোন কাজে নিযুক্ত করেছি, সে যেন তার সামান্য বা বেশি –সবই সুসম্পন্ন করে মালসমূহ নিয়ে আসে। তাকে যা দেয়া হবে, সেতাই নেবে, আর যা নিতে নিষেধ করা হবে, তা থেকে সে বিরত থাকবে।’ (মুসলিম, আবূ দাউদ) আবূ রাফে’ থেকে বর্ণিত হয়েছে তিনি রাসূলে করীমের সঙ্গে ’জান্নাতুল বাকি তে চলছিলেন। নবী করীম (স) সহসা বলে উঠলেনঃ তোমার জন্যে দুঃখ, তোমার প্রতি ঘৃণা। আবূ রাফে বলেনঃ আমি মনে করলাম, রাসূলে করীম (স) আমাকে লক্ষ্য করেই বুঝি এরূপ উক্তি করলেন। তাই আমার পক্ষে এই উক্তি খুবই ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ালো। আমি চলার গতিতে একটু মন্থরতা অবলম্বন করলাম। রাসূলে করীম (স) আমার এরূপ অবস্থা দেখে বললেনঃ কি হয়েছে তোমার বল। আমি বললামঃ আপনি কি কোন কথা বলেছেন? বললেনঃ তাতে তোমার কি? বললামঃ আপনি আমার জন্যে দুঃখ আরোপ করেছেন। বললেনঃ না তোমাকে নয়। অমুক ব্যক্তিকে অমুক গোত্রের যাকাত আদায়ের জন্যে আদায়কারী নিযুক্ত করে পাঠিয়েছিলাম। সে যাকাতের মাল থেকে একটা সুতির কাজ করা পশমী চাদর চুরী করেছে। ফলে সে ঐ রকমেরই একটা আগুনের চাদর পরিধান করেছে।’ নাসায়ী ও ইবনে খুজাইমা নিজ নিজ সহীহ সংকলনে এই হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন। উবাদাহ ইবনে সামেত থেকে বর্ণিত, নবী করীম (স) তাঁকে যাকাত সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত করে পাঠিয়েছিলেন। তখন বলে দিলেনঃ হে আবূ অলীদ! আল্লাহকে ভয় কর, তুমি কিয়ামতের দিন এমন উট নিয়ে আসতে পারবে না, যা উটের আওয়াজ দিতে থাকবে, কিংবা এমন গাভী যার হাম্বা রব হবে অথবা এমন ছাগী যার মি, মি আওয়াজ হবে। বললেনঃ হে রাসূল! সত্যই কি তাই হবে নাকি? বললেনঃ হ্যাঁ, যার হাতে আমার প্রাণ, তাঁর কসম করে বলছি। একথা শুনে উবাদাহ বললেনঃ যে আল্লাহ আপনাকে পরম সত্যতা সহকারে পাঠিয়েছেন তাঁর নামে শপথ করে বলছি, আপনার কোন কাজ করব না। বর্ণনাটি তাবারানী তার আল-কাবীর, গ্রন্থে উদ্ধৃত করেছেন। এর সনদ সহীহ। উবাদাহ এরূপ ঘোষণা দিলেন কেন, তিনি তো একজন মুসলিম? বলেছেন, তাঁর নিজের দ্বীনী সালামতী রক্ষার জন্যে, বিপদের আশংকা থেকে আত্মরক্ষা করা জন্যে, খারাপ পরিণতির ভয়ে- তিনি হয়ত তার মধ্যে পড়ে যাবেন, অথচ তিনি টেরও পাবেন না এই আতংকে। বেতবভুক্ত কর্মচারীদের জন্যে দেয়া উপঢৌকন ঘুষ যাকাত কার্যে নিয়োজিত বেতনভুক্ত কর্মচারীদের জন্যে যেমন যাকাতের এক বিন্দু জিনিস লুকিয়ে রাখা বা হস্তগত করা জায়েয নয়,- তা একটি সুঁচই হোক না-কেন, অনুরূপভাবে মালদার লোকদের প্রদত্ত কোন উপঢৌকন গ্রহণ করাও তাদের পক্ষে জায়েয হতে পারে না, তা ব্যক্তিগতভাবে তাকেই দেয়া হলেও। কেননা এটা ঘুষ গণ্য হবে, যদিও নাম হবে হাদিয়া বা তোহফা- উপঢৌকন। যেহেতু সে তো তার কাজের জন্যে যথেষ্ট পরিমাণে বেতন-মজুরী গ্রহণ করছে সরকারের নিকট থেকে। অতএব যাকাতদাতাদের কাছ থেকে তার অতিরিক্ত একবিন্দু জিনিসও গ্রহণ করতে পারবে না। গ্রহণ করলে কুরআনে নিষিদ্ধ বাতিল উপায়ে লোকদের মাল ভক্ষণ করা হবে। উপরন্তু মালদারদের কাছ থেকে যাকাত গ্রহণে সে দায়িত্ব পালন করতে পারবে না। তাতে ফকীর-মিসকীনের হক নষ্ট হবে। সেই সাথে সে খারাপ দোষের অভিযোগে অভিযুক্ত হবে। আর যে লোক নিজেকে সন্দেহের অবস্থায় ফেলে দেয় তার প্রতি লোকদের ধারণা খারাপ হয়ে যাওয়ার দরুন তিরষ্কৃত ও ভৎসিত হতে হবে তাকে। আবূ হুমাইদ সায়েদী থেকে বর্ণিত, নবী করীম (স) আজদ গোত্রের ইবনে লাতবিয়া নামের এক ব্যক্তিকে যাকাত সংক্রান্ত কাজে কর্মচারী নিযুক্ত করেছিলেন। সে যখন কর্মস্থল থেকে ফিরে এলো, তখন কিছু ধন-মাল দিয়ে বললেঃ এগুলো আমাকে উপঢৌকন দেয়া হয়েছে। এ কথা শুনে নবী করীম (স) দাঁড়িয়ে ভাষণ দিতে শুরু করলেন। শুরুতে যথারীতি হামদ ও সানা পড়লেন। পরে বললেনঃ অতপর কথা হচ্ছে, আমি তোমাদের একজনকে একটা কাজের জন্যে নিযুক্ত করি সেই অধিকারের বলে যা আল্লাহ আমার ওপর অর্পণ করেছেন। লোকটি কর্মক্ষেত্র থেকে ফিরে এসে বলেঃ এ মাল তোমাদের জন্যে আর এ মাল আমাকে তোহফা-হাদিয়া দেয়া হয়েছে। আমি জিজ্ঞাস করি, তার এ কথা সত্য হলে তার পিতামাতার ঘরে তার বসে থাকার পরও তার নিকট হাদিয়া তোহফা আসতে থাকা উচিত। (কিন্তু তা তো হবার নয়।) আল্লাহর শপথ, তোমাদের কেউই তার হক ছাড়া কিছু গ্রহণ করলে কিয়ামতের দিন তাকে সেই জিনিস বহন করে নিয়ে এসে আল্লাহর সম্মুখে দাঁড়াতে হবে। আমি সেই লোককে নিশ্চয়ই চিনব না যে আল্লাহর সম্মুখে উট বহন করে নিয়ে আসবে। আর উট চিৎকার করতে থাকবে। কেউ গাভী বহন করে নিয়ে আসবে, তা হাম্বা রব করতে থাকবে। অথবা কেউ একটা ছাগী নিয়ে আসবে, সেটিও মি, মি, করতে থাকবে। তারপর তিনি দুই হাত উপরে তুললেন এমনভাবে যে, তার দুই বগলের শ্বেত দৃশ্যমান হয়ে পড়ল। তিনি বলছিলেনঃ হে আমাদের আল্লাহ! আমি কি পৌছিয়েছি? বুখারী, মুসলিম ও আবূ দাউদ হদীসটি নিজ নিজ গ্রন্থে উদ্ধৃত করেছেন। যাকাত সংগ্রহকারীদের প্রতি নবী করীমের উপদেশ যাকাত আদায়ে নিযুক্ত লোকদের প্রতি নবী করীম (স) বিশেষ আনুষ্ঠানিকতা সহকারে উপদেশ দিতেন, লোকদের প্রতি নম্র ব্যবহার, দয়া প্রদর্শন ও ভারসাম্যপূর্ণ আচরণ করার জন্যে তাগিদ সহকারে বলতেন। ওদিকে তিনি তাঁর সাহাবীদের মধ্য থেকে বাছাই করা উত্তম লোকদেরই এই কাজে নিযুক্ত করতেন। কৃষি ফসল ও ফলের যাকাত সংগ্রহের জন্যে তিনি সাহাবীদের মধ্য থেকে সেই লোকদের নিযুক্ত করতেন যারা ফল বা ফসলের যাকাত-পরিমাণ অনুমান করে বলতে পারতেন অর্থাৎ ফল ও ফসল কাটাই মাড়াইর পূর্বেই আনুমানিকভাবে বলে দিতেন এতে এতটা ফসল হবে এবং তার যাকাত-পরিমাণ আনুমানিক এত। ইবনে আবদুল বার-এর ব্যাখ্যা অনুযায়ী এরূপ আগাম আনুমানিক পরিমাণ নির্ধারণের বড় ফায়দা হত, মালের মালিকের পক্ষ থেকে তার ওপর কোনরূপ যাকাত-বিরোধী হস্তক্ষেপ প্রতিরোধ করা। অনুমাণ করার পর তার চাইতে যদি কম হয় তাহলে সে কমতির দাবি অকাট্য প্রমাণ ব্যতিরেকে গ্রহণ করা হবে না। এতে করে ফকীর-মিসকীনের পাওনাটা নিশ্চিত হতে পারবে এবং যাকাত আদায়কারী দাবি থাকবে পরিমিত পরিমাণের মধ্যে। ফল ফাকড়ার পরিমাণ অনুমান পর্যায়ে আমরা ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি। নবী করীম (স) ফলের পরিমাণ অনুমান করা জন্যে কর্মচারী নিযুক্ত করেছিলেন। তাদের বলেছিলেনঃ পরিমাণটা কম করে ধর, কেননা ধন-মালের ক্ষেত্রে ওসিয়ত থাকে, ধার উদ্ধার থাকে, পড়ে যায় অনেক, পাখ-পাখালীরা অনেক খেয়ে যায়, অনেক ঝড়-ঝঞ্ঝার ব্যাপার ঘটে। বস্তুত এটা হত নবী করীমের সাবধান ও সতর্কবাণী, যাকাতদাতাদের অনুগ্রহের দৃষ্টি রাখার জন্যে যাকাত আদায়কারীদের প্রতি এটা ছিল তাঁর শুভ আচরণ গ্রহণের আহ্বান। তাদের এ কথাও স্মরণ করিয়ে দেয়া হত যে, ধন-মালের ওপর যাকাত ছাড়া আরও অনেক দাবি দাওয়া থাকে। মানুষ তা অস্বীকার করতে পারে না, এর মধ্যে কোন কোন দাবি ব্যক্তি নিজের জন্যে বাধ্যতামূলক বানিয়ে নেয়। কতগুলো স্বাভাবিক অবস্থার পরিণতিতে হয়ে থাকে। মালের মালিকদের জন্যে দোয়া বস্তুত যাকাত ধন-মালের মালিকরা দেয় স্বীয় আন্তরিক ইচ্ছা ও প্রেরণায়। সে তা দিয়ে মহান আল্লাহর নিকট তা কবুল হোক, এটাই চায়। ঠিক এ কারণেই ফরয যাকাত ও সাধারণ কর এবং খাজনা-ট্যাক্স ইত্যাদির মধ্যে আসমান-জমিন পার্থক্য হয়ে থাকে। যাকাত সংগ্রহকারীরা যাকাতদাতার জন্যে দোয়া করা জন্যে নির্দেশিত। কুরআনের আয়াতেই বলা হয়েছেঃ ’তাদের ধন-মাল থেকে যাকাত গ্রহণ কর তাদের পবিত্র ও পরিশুদ্ধতা দিয়ে এবং তাদের জন্যে দোআ কর। কেননা তোমার এই দোয়া তাদের জন্যে বিরাট সান্ত্বনার কারণ।’ আবদুল্লাহ ইবনে আবূ আওফা থেকে বর্ণিত, তাঁর পিতা রাসূলে করীম (স) এর নিকট তাঁর নিজের ধনমালের যাকাত নিয়ে উপস্থিত হল। তখন নবী করীম (স) বললেনঃ হে আল্লাহ! আবূ আওফার বংশধরদের প্রতি পূর্ণ মাত্রায় রহমত নাযিল কর। [আহমাদ, বুখারী, মুসলিম] মুসলিম জনকল্যাণমুলক কাজে ব্যতিব্যস্ত লোকদের কি যাকাত কাজের কর্মচারী মনে করা হবে ইবনে রুশদ উল্লেখ করেছেন, ফিকাহবিদগণ যাকাত সংক্রান্ত কর্মচারীদের জন্যে তা থেকেই বেতন ভাতা গ্রহণ করা জায়েয; তারা ধনী হলেও সেই সাথে বিচারক এবং যাদের দ্বারা সাধারণ মুসলিম জনগণের কল্যাণ সাধিত হচ্ছে, তাদের সকলের জন্যে যাকাত ফাণ্ড থেকে ব্যবস্থা গ্রহণ করা জায়েয বলেছেন। [বিদায়াতুল মুজতাহিদ, ১ম খণ্ড, ২৮৬ পৃঃ] আবাজিয়া ফিকাহর কিতাব আন নাইল এবং তার শারহে গ্রন্থ উদ্ধৃত হয়েছে যাকাত দেয়া যাবে তার কাজে নিযুক্ত কর্মচারী এবং এই ধরনের অন্যান্য লোকদেরও যেমন বিচারক, প্রশাসক, মুফতি ও অন্যান্য যারা সামষ্টিক কাজে ব্যস্ত থাকে। এই মাসলাটার রায় ঠিক করা হয়েছে কর্মচারীদের ওপর কিয়াস করে। অতএব তাদের দায়-দায়িত্ব, ব্যস্ততা ও ইসলামের দিক দিয়ে তাদের কাজের কল্যাণকামিতা অনুপাতে- তারা যদি ধনী লোক হয় তবুও। কেননা মুসলিম জনগণের কাজে একান্তভাবে ব্যস্ত থাকার কারণে তারা নিজেদের জন্যে আয় করার কাজে মনোনিবেশ করতে পারেনি। [আরবী************)] কিন্তু সাধারণ ফিকাহবিদগণ এই লোকদিগকে যাকাত ছাড়া অন্যান্য রাষ্ট্রীয় আয় যা ফাই, বা খারাজ ইত্যাদি নামে অভিহিত- থেকে বেতন দেয়ার পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন। তবে যাকাতের অন্যতম ব্যয় ক্ষেত্র ফী সবীলিল্লাহ এর পরিধি অধিকতর বিশাল ও বিস্তীর্ণ করে ধরে নেয়া হলে সেটা সম্ভব। তাতে প্রতিটি কল্যাণমূলক কাজই অন্তর্ভুক্ত হবে। ষষ্ঠ অধ্যায়ে এ বিষয়ে বিস্তরিত আলোচনা করা হবে। তৃতীয় পরিচ্ছেদ যাদের মন সন্তুষ্ট করা প্রয়োজন এই পার্যায়ে সেই লোক গণ্য যাদের মন ইসলামের দিকে আকৃষ্ট করার জন্যে, কিংবা ইসলামের ওপর তাদের সুপ্রতিষ্ঠিত রাখার জন্যে অথবা যাদের দুষ্কৃতি থেকে মুসলিম জনগণকে রক্ষা করার জন্যে বা তাদের থেকে রক্ষা পাওয়ার কাজে তাদের অনুকূল্য লাভের আশায় অথবা মুসলমানদের শত্রুদের ওপর কোনরূপ বিজয় লাভের উদ্দেশ্যে তাদের সাহায্য প্রয়োজনীয় বলে এদের জন্যে যে অর্থ ব্যয় করার প্রয়োজন হবে, যাকাত ফাণ্ড থেকে তা করা যাবে। এই খাতটির ফায়দা এই খাতটি পর্বে বলা কথাকে অধিকতর স্পষ্ট করে আমাদের জানিয়ে দেয় যে, যাকাত কোন ব্যক্তিগত দয়া-অনুগ্রহের ব্যাপারে নয়। নিছক ইবাদতও নয় তা, যা শুধু ব্যক্তিগতভাবেই আদায় করলে চলবে। কেননা এই খাতটি সাধারণত ব্যক্তিগতভাবে পালন পর্যায়ে নয়। আসলে তা রাষ্ট্রপ্রধানের কিংবা তার প্রতিনিধির করণীয় কিংবা জাতির কর্তৃত্বসম্পন্ন অপর কোন ব্যক্তির পালনের ব্যাপারে। এই লোকেরাই বুঝতে পারে, কোন লোকদের মন সন্তুষ্ট করার প্রয়োজন কিংবা কাদের তা করতে হবে না। কাদের মন সন্তুষ্ট করতে হবে এবং সেজন্যে অর্থব্যয় করতে হবে ইসলামের অগ্রাগতি ও মুসলিম জনগণের কল্যাণের জন্যে, তাদের গুণ-পরিচয় নির্ধারণ করাও তাদেরই করণীয়। এই লোকদের কয়েকটি ভাগ এ পার্যায়ের লোক যেমন কাফির সমাজের মধ্যে থাকবে, তেমনি থাকতে পারে মুসলিম নামে পরিচিত লোকদের মধ্যেওঃ ক. যাকে অর্থ দিলে সে বা তার গোত্র বা বংশের লোকেরা ইসলাম কবুল করবে বলে আশা করা যায়, তারা এই পর্যায়ে গণ্য। দৃষ্টান্তস্বরূপ উল্লেখ করা যায়, মক্কা বিজয়ের দিন নবী করীম (স) সাফওয়ান ইবনে ইমাইয়্যাকে নিরাপত্তা দিয়েছিলেন এবং তার দাবি অনুযায়ী তার ব্যাপারটি পর্যবেক্ষণের জন্যে চারটি মাস সময় নির্ধারণ করেছিলেন। পরে সে নিরুদ্ধেশ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু হুনাইন যুদ্ধকালে উপস্থিত হয়ে সে মুসলমানদের সাথে যোগদান করে, অথচ তখন পর্যন্ত সে ইসলাম কবুল করেনি। নবী করীম (স) এই যুদ্ধে যাত্রা করার পূর্বে তার অস্ত্রশস্ত্র ধান নিয়েছিলেন এবং তিনি তাকে বিপুল সংখ্যক উট দিয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেনঃ এটা সেই দান যা পাওয়ার পর দারিদ্র্য সম্পর্কে কোন ভয় থাকে না। মুসলিম ও তিরমিযী সায়ীদ ইবনুল মুসাইয়্যিব সুত্রে বর্ণনা করেছেন, সাফওয়ান বলেছে, নবী করীম (স) পূর্বে আমার নিকট সর্বাধিক ঘৃণ্য ব্যক্তি ছিলেন, কিন্তু তিনি আমাকে ক্রমাগতভাবে দান করেছিলেন। তাঁর নিকট থেকে এই অব্যাহত দান পেয়ে পেয়ে এমন অবস্থা হলে যে, তিনিই হয়ে গেলেন আমার নিকট সর্বাধিক প্রিয় ব্যক্তি। [(আরবী*************)] এই লোকটি পরে ইসলাম কবুল করে খুবই ভাল মুসলমান হয়েছিল। ইমাম আহমাদ সহীহ সনদে হযরত আনাস সূত্রে বর্ণনা করেছেন, নবী করীম (স) এর নিকট ইসলামের নামে যা কিছু প্রার্থনা করা হত, তিনি তা অবশ্যই দান করতেন। এ ব্যক্তি এসে তাই প্রার্থনা করেছিল। নবী করীম (স) তাকে বহু সংখ্যক ছাগল দিয়ে দেবার নির্দেশ দিলেন। এগুলো যাকাত নিজের গোত্রের লোকদের নিকট উপস্থিত হল, বললঃ হে লোকেরা, তোমরা ইসলাম কবুল কর। কেননা মুহাম্মাদ (স) লোকদের এত বেশি দান করেন যে, অতপর আর দরিদ্র বা অনশনের ভয় করতে হয় না।’ [(আরবী*************)] এ দানও এই পর্যায়ে শামিল। খ. যে লোকের দুষ্কৃতির ভয় করা হয়, তাকে টাকা-পয়সা দিলে তার দুষ্কৃতি এবং তার সাথে সাথে অন্যদের ক্ষতিকর কার্যকলাপ থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে বলে আশা করা যায়, তাকেও এই যাকাত থেকে দেয়া যাবে। হযরত ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত হয়েছে, কতগুলো লোক নবী করীম (স) এর নিকট বারে বারে আসত। তিনি যদি যাকাতের সম্পদ থেকে কিছু দিতেন, তাহলে তারা ইসলামের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হত। বলত, এ উত্তম দ্বীন। আর কিছু না দিলে তারা দোষ গেয়ে বেড়াত ও গালমন্দ বলতে শুরু করত। এই ধরনের লোকদেরও যাকাত ফাণ্ড থেকে দেয়া যায়। [(আরবী*************)] গ. নতুন ইসলাম গ্রহণকারী লোকেরা (অর্থনৈতিক সংকটের সম্মুখিন হয় বলে) তাদের আর্থিক সাহায্য করতে হয়। তবেই তারা ইসলামের স্থির ও অটল হয়ে থাকবে বলে আশা করা যায়। আল-মুয়াল্লাফতু কুলুবুহুম- শব্দদ্বয়ের ব্যাখ্যা ইমাম জুহরীর নিকট জানতে চাওয়া হয়েছিল জবাবে তিনি বললেন, যে ইয়াহুদী বা খৃষ্টান ইসলাম কবুল করবে, সেই এর মধ্য গণ্য। জিজ্ঞেস করা হল, সে যদি ধনী লোক হয়? বললেন, সে যদি ধনী লোক হয়, তবুও তাকে এই ফাণ্ড থেকে সাহায্য দেয়া যাবে। [(আরবী*************)] হাসান বলেছেন, যারা (নতুনভাবে) ইসরাম কবুল করবে, তারা সকলেই সাহায্য পাওয়ার অধিকরী। [(আরবী*************)] কেননা নতুন ইসলাম গ্রহনকারী ব্যক্তি তার পূর্বতন ধর্ম ত্যাগ করেছে, তার পিতামাতা ও বংশ-পরিবারের নিকট তার প্রাপ্য ধন-মালের দাবিও প্রত্যাহার করেছে। তার বংশের বহু লোকই তার সাথে শত্রুতা করতে শুরু করে দেবে, এটাই স্বাভাবিক। এর ফলে তার জীবিকার সব পথ ও উপায় বন্ধ বা বিনষ্ট হয়ে যেতে পারে। এরূপ দুনিয়ার স্বার্থ ত্যাগকারী ও আল্লাহর জন্যে নিজেকে বিক্রয়কারী ব্যক্তি ইসলাম ও মুসলিম সমাজের নিকট থেকে বিপুল উৎসাহ ও সাহায্য-সহযোগীতা পাওয়ার অধিকারী, তাতে কোনই সন্দেহ নেই। ঘ. মুসলিম সমাজের নেতৃস্থানীয় ও কর্তা ব্যক্তিদের পক্ষে অনেক কাজের লোকদের সাথে সাক্ষাৎ ও কথাবার্তা এবং চিন্তার আদান-প্রদান করার সুযোগ ঘটে। অনেকের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কও গড়ে উঠতে পারে। এই সময় তারা যদি তাদের কিছু দান করে, তাতে তারা ইসলামের প্রতি খুবই আশাবাদী হয়ে উঠতে পারে। হযরত আবূ বকর (রা) আদী ইবনে হাতেম ও জারকার ইবনে বদরকে অনেক দান-উপঢৌকনে ধন্য করে দিয়েছিলেন। তাদের নিজ জাতির লোকদের নিকট তাদের উচ্চতর মর্যাদার কারণে ইসলামের প্রতি তাদের আচরণ খুবই উত্তম ছিল। [(আরবী*************)] ঙ. দুর্বল ঈমানের নেতৃস্থানীয় মুসলমানরাও এই শ্রেণীভুক্ত। তারা জনগণের নিকট অনুসৃত, তাদের ওপর যথেষ্ট প্রভাবশালী হয়ে থাকে। তাদেরকে অর্থদান করা হলে তারা ইসরামে স্থিত থাকবে, তাদের ঈমান দৃঢ় ও শক্তিশালী হবে এবং কাফিরদের সাথে জিহাদ তাদের নিকট থেকে মূল্যবান আনুকূল্য পাওয়া যাবে বলে খুবই আশা করা যায়। নবী করীম (স) সমাজের এই শ্রেণীর লোকদিগকে হাওয়াজিন যুদ্ধে প্রাপ্ত গণীমতের মাল থেকে বিপুল পরিমাণ দান করেছিলেন। এরাই মক্কার সেসব লোক ছিল, যাদেরকে নবী করীম (স) ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। পরে তারা খুবই পাক্কা মুসলিম হয়ে গিয়েছিল, যদিও পূর্বে তারা হয় মুনাফিক, না হয় দুর্বল ঈমানের লোক ছিল। পরবর্তীকালে ইসলামী আদর্শ পালনে তাদের দৃঢ়তা আদর্শস্থানীয় হয়েছিলে। [(আরবী*************)] চ. অনেক মুসলামন শত্রুদেশের সীমান্তে একেবারে মুখের কাছে অবস্থিত থাকে। শত্রুদের আক্রমণ হলে তারা প্রতিরক্ষামূলক কাজ করে মুসলিম সমাজকে রক্ষা করতে পারে। এদেরকেও যাকাত ফাণ্ড থেকে সাহায্য দেয়া যেতে পারে। ছ. অনেক মুসলমান সমাজে এমন প্রভাবশালী হয়ে থাকে যে, তাদের বাস্তাব সহযোগীতা না হলে- তারা প্রভাব বিস্তার না করলে ও চাপ সৃষ্টি না করলে যাকাত সংগ্রহ করাই অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। অন্যথায় সেজন্যে যুদ্ধ করার প্রয়োজনও দেখা দিতে পারে। এই কারণে তাদেরকে সন্তুষ্ট রেখে তাদেরকে সরকারের সহযোগী ও সাহায্যকারী বানিয়ে রেখে কাজ করা খুবই প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। তা করা দুটো মারাত্মক কাজের মধ্যে অপেক্ষাকৃত কম ক্ষতিকর কাজ, দুটো কল্যাণমূলক কাজের মধ্যে অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য কল্যাণ পথ। এই কাজটি আংশিক হলেও অনেক সময় সাধারণের জন্যে অধিক কল্যাণের কারণ হতে পারে। [(আরবী*************)] এই সকল পর্যায়ের লোকেরা (আরবী***********) এর অন্তর্ভুক্ত তারা কাফির হোক, কি মুসলিম। ইমাম শাফেয়ী বলেছেন, যারা ইসলামে দাখিল হল তারাই এর মধ্যে গণ্য হবে। কোন মুশরিক ব্যক্তির হৃদয় ইসলামের দিকে আকৃষ্ট করার উদ্দেশ্যে তাকে যাকাত ফাণ্ড থেকে দেয়া যাবে না। কেউ যদি বলে যে, খোদ নবী করীম (স) হুনাইন যুদ্ধের বছর কোন কোন মুশরিকের হৃদয় সন্তুষ্ট করার জন্যে দান করেছেন, তাহলে আমি বলব হ্যাঁ, তা দেয়া হয়েছিল ফই সম্পদ থেকে, বিশেষভাবে নবী করীম (স) এর জন্যে নির্দিষ্ট অংশ থেকে, যাকাত থেকে নয়। ইমাম শাফেয়ী এই বলে দলীলের ব্যাখ্যা করেছেন যে, আল্লাহ তাআলা মুসলমানদের যাকাত তাদের মধ্যেই বণ্টন করে ফিরিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা কার্যকর করেছেন, দ্বীনের বিরুদ্ধবাদীদের দেয়ার কোন ব্যবস্থা করেন নি। [১১১১] তিনি হযরত মুয়ায বর্ণিত হাদীসের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন, যাতে বলা হয়েছেঃ যাকাত মুসলামনদের ধনী লোকদের নিকট থেকে নেয়া হবে এবং তাদের মধ্যকার ফকীরদের মধ্যে বণ্টন করা হবে। ইমাম রাযী তাঁর তাফসীরে ওয়াহিদী থেকে বর্ণনা উদ্ধৃত করে লিখেছেন, তিনি বলেছেন, আল্লাহ তাআলা মুশরিকদের হৃদয় সন্তুষ্ট বা আকৃষ্ট করার কাজ থেকে মুসলমানকে রক্ষা করেছেন। মুসলিম রাষ্ট্রনেতা যদি মনে করেন, কোন কল্যাণের জন্যে- যার ফায়দাটা মুসলমানরাই পাবে- যেমন তারা যদি মুসলিম হয়ে যায়, তা হলে যাকাত ফাণ্ড থেকে কাফির মুশরিকদের অর্থ সাহায্য দেয়া যাবে। কিন্তু কোন মুশরিকের জন্যে যাকাতের মাল ব্যয় করার দরকার হলে তা ফাই সম্পদ থেকে করতে হবে, যাকাত থেকে নয়। শেষে তিনি লিখেছেন, ওয়াহিদীর এই কথা- আল্লাহ মুশরিকদের হৃদয় সস্তুষ্ট করার ঝামেলা থেকে মুসলমানদের রক্ষা করেছেন- এই ভিত্তিতে বলা যায় যে, নবী করীম (স) যাকাতেরই একটা অংশ মুশরিকদের দিয়েছেন। কিন্তু তা কখনই প্রমাণ করা যাবে না। আয়াতটিতেও এমন কোন প্রমাণ পাওয়া যাবে না যা থেকে বোঝা যাবে যে, আল-মুয়াল্লাফতু কুলুবুহুম বলে বুঝি মুশরিকদেরই বুঝিয়েছেন। বরং এ কথার মধ্যে সাধারণভাবেই মুসলিম-অমুসলিম সব শ্রেণীর লোকই শামিল রয়েছে। কাতাহাহ থেকে বর্ণনা পাওয়া গেছে, মুয়াল্লাফাতু কুলুবুহম’ কথাটি এক শ্রেণীর মরু বেদুঈন লোক বোঝায়। সেই সাথে তাদের ছাড়াও লোকজন ছিল, যাদের হৃদয় নবী করীম (স) সন্তুষ্ট করেছেন দানের সাহায্যে, যেন পরবর্তীকালে তারা ইসলাম কবুল করে। হযরত আনাস বর্ণিত হাদীস থেকে জানা গেছে, নবী করীম (স) যে ব্যক্তিকে যাকাত বাবদ আদয়কৃত ছাগল দিয়েছিলেন, সেই লোকটি নিজের গোত্রের লোকদের সম্বাধন করে বলেছিলেন, হে লোকেরা! ইসলাম কবুল কর! কেননা মুহাম্মাদ (স) এমন দান করেন যে, তারপর আর অভুক্ত থাকার কোন আশংকাই থাকে না। এ থেকে মনে হয়, দান পাওয়ার সময় সে মুসলিম ছিল না। বস্তুত কোন কাফির ব্যক্তির অন্তর ইসলামের দিকে আকৃষ্ট করার বা তার অন্তরে ইসলামের প্রতিষ্ঠা সুদৃঢ় করার উদ্দেশ্যে মুসলমানদের দেয়া যাকাত থেকে কাফিরকে দান করা খুব একটা বিস্ময়কর ব্যাপার নয়। কেননা ইমাম কুরতুবী যেমন বলেছেন- এটাও এক প্রকারের জিহাদ। কেননা মুশরিকরা তিন প্রকারের। এক প্রকারের মুশরিক লোক অকাট্য যুক্তি প্রমাণ পেয়ে শিরক ত্যাগ করে ইসলাম কবুল করতে পারে। আর এক প্রকারের মুশরিক বল প্রয়োগ ও শক্তি বিনিয়োগের ফলে ইসলাম কবুল করবে। আর এক প্রকারের মুশরিক দান ও অনুগ্রহের বশবর্তী হয়ে ইসলাম কবুল করতে পারে। আর ইসলাম রাষ্ট্রকর্তা সচেতন থেকে সর্বাদিকে নজর রেখে এসব শ্রেণীর মুশরিকদের ওপর অর্থ ব্যয় করতে পারবে, যার পরিণতিতে তারা কুফরী ও শিরক থেকে মুক্তি লাভ করবে এবং এই অর্থ ব্যয়ই তার কারণ হবে। [(আরবী*********)] রাসূলের ইন্তেকালের পর এই খাতটি কি পরিত্যক্ত ইমাম আহমাদ এবং তাঁর সঙ্গিগণ মত প্রকাশ করেছেন যে, যাকাত ব্যয়ের কুরআন নির্দেশিত এই খাত – আল মুল্লাফাতু কুলুবুহুম- যথাপূর্ব কার্যকর আছে, তা বাতিল বা মনসূখ হয়ে যায়নি, তাতে কোনরূপ পরিবর্তনও আনা হয়নি। ইমাম জুহরী এবং আবূ জাফর আল-বাকেরও এই মতই প্রকাশ করেছেন। এই শেষোক্ত মতটি জাফরী ও জায়দীয়া মাযহাবের। [(আরবী*********)] ইউনূস বলেছেন, ইমাম জুহরীকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বললেনঃ এটা মনসূখ হওয়ার কোন কথাই আমার জানা নেই। আবূ জাফর আন-নুহাম বলেছেন, তার অর্থ, এই খাতটি পুরোপুরি সক্রিয় এবং কার্যকর রয়েছে। একালেও কারুর মন সন্তুষ্ট করার প্রয়োজন দেখা দিলে এবং তার থেকে মুসলমানদের কোন ক্ষতি বা বিপদ হওয়ার আশংকা থাকলে অথবা উত্তরকালে তার ভাল মুসলিম হওয়ার আশা করা গেলে তাকে এই ফাণ্ড থেকে দেয়া যাবে। কুরতুবী মালিকী মাযহাবের কাযী আবদুল ওহাবের এই উক্তি উদ্ধৃত করেছেনঃ কোন কোন সময় প্রয়োজন দেখা দিলে তোমরা তা দাও।’ কাযী ইবনুল আরাবী বলেছেন, আমার মত হচ্ছে, ইসলাম শক্তিশালী হলে এই খাতে আর অর্থ ব্যয় করা যাবে না। তবে এই খাতে ব্যয় করার প্রয়োজন দেখা দিলে তা দেয়া যাবে, যেমন নবী করীম (স) নিজে তা দিতেন। কেননা সহীহ হাদীসে উদ্ধৃত হয়েছে, ইসলাম অপরিচিত অবস্থায় শুরু হয়েছে, আবার অপরিচিত অবস্থার মধ্যে পড়ে যাবে- যেমন শুরু হয়েছিল।’ নাইল কিতাবে এবং তার শরাহে গ্রন্থে আবাজীয়া ফিকাহর মত লিখিত হয়েছেঃ আমাদের মতে এই খাতটি পরিত্যক্ত থাকবে যদ্দিন ইসলামী রাষ্ট্রকর্তা শক্তিশালী থাকবে ও এই লোকদের কিছু দেয়ার প্রয়োজন থাকবে না------ প্রয়োজনে এই খাতেব্যয় করার অনুমতি রয়েছে, মুসলিম সমাজকে তাদের শত্রুভাবপন্ন লোকদের দুষ্কৃতি থেকে রক্ষা করার জন্যে, কিংবা কোন সুবিধা অর্জনের উদ্দেশ্য। তাহাবী হাসান থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেন, এ কালে এমন কেউ নেই, যার হৃদয় সন্তুষ্ট করার প্রয়োজন হতে পারে।[১১১১] আমের আশ-শা’বী বলেছেন, মুয়াল্লাফতু কুলুবুহুম’ কার্যকর ছিল রাসূলে করীম (স) এর সময়ে। পরে যখন হযরত আবূ বকর (রা) খলীফা হল তখন এই ঘুষের ব্যবস্থা ছিন্ন হয়ে গেল। [২২২২২] ইমাম নববী ইমাম শাফেয়ীর মত উদ্ধৃত করেছেন তা হলো কাফিরদের মনস্তুষ্টির জন্যে অর্থ ব্যয় করার অনুমতি হলেও তা করা হবে ফাই (রাষ্ট্রের অন্যান্য আয়ের) সম্পদ থেকে কল্যাণের কাজের জন্যে, যাকাত থেকে দেয়া যাবে না। কেননা যাকাতে কাফিরদের কোন অধিকার বা হক স্বীকার করা হয়নি। আর মুসলমানদের মধ্যে যাদের হৃদয় সন্তুষ্ট করার প্রয়োজন দেখা দেবে, তাদেরকে নবী করীম (স) এর দেয়ার ব্যাপারে তাঁর দুটো কথা রয়েছে। প্রথম কথা দেয়া যাবে না। কেননা, আল্লাহ তাআলা দ্বীন ইসলামকে শক্তিশালী বানিয়ে দিয়েছেন বলে টাকা পয়সা দিয়ে লোকদের মন জয় করার প্রয়োজন থাকেনি। এবং দ্বিতীয় কথা দেয়া যাবে। কেননা যে ধরনের লোকদের আগে দেয়া হয়েছে, নবী করীম (স) এর পরও সেই ধরনের লোক থাকতে পারে। যদি দেয়া হয়, তাহলে কোথেকে কোন ফাণ্ড থেকে দেয়া হবে? এখানেও তাঁর দুটো মত জানা গেছে। একটি মতে বলা হয়েছে, যাকাতের ফাণ্ড থেকে দেয়া হবে। কেননা কুরআনের আয়অতে তাই রয়েছে। আর দ্বিতীয় মত, ‘ফাই’ সম্পদের কল্যাণমূলক কাজের অংশ হিসেবে দিতে হবে। কেননা এরূপ অবস্থায় তাদের জন্যে অর্থ ব্যয় করা গোটা মুসলিম সমাজেরই কল্যাণ সাধন। [(আরবী*********)] মালিকী মাযহাবের দুটো মত জানা গেছে। একটি মত, এই খাতটাই ছিন্ন হয়ে গেছে ইসলামের শক্তিশালী হওয়া ও পূর্ণত্ব প্রকাশ পাওয়ার দরুন। আর অপর মত অনুযায়ী, এই খাতটি অবশিষ্ট আছে। কাযী আবদুল ওহাব ও কাযী ইবনূল আরাবীল মত ইতিপূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। [(আরবী*********)] ‘খলীল’ নামক গ্রন্থে বলা হয়েছে, এই খাতটি কার্যকর আছে, এটি মনসূখ হয়ে যায়নি। কেননা যাকাত দেয়অর উদ্দেশ্য হল, তাদরেকে ইসলামের দিকে আকৃষ্ট করা, তাদের কোন সাহায্য লাভ করা নয়। শেষ পর্যন্ত ইসলাম বিস্তীর্ণ হয়ে পড়লে তখন তা শেষ হয়ে যাবে। মতের এ পার্থক্য হচ্ছে এই কথায় যে, যার সন্তুষ্টির জন্যে টাকা দেয়া হবে সে লোকটির কাফির। তাকে ইসলামের প্রতি আগ্রহী বানাবার উদ্দেশ্যে দেয়া হবে। ইবন হুবাইবও এই মত দিয়েছেন। দ্বিতীয় কথা, সে ব্যক্তি মুসলিম হবে। খুব অল্প সময় হয়েছে, সে ইসলাম কবুল করেছে। তাকে যাকাত দেয়া যাবে, যেন সে ইসলামের ওপর দৃঢ় ও অীবচল হয়ে থাকে। এরূপ অবস্থায় এ খাতটি অবশ্যই কার্যকর মনে করতে হবে। তাতে কোন দ্বিমতের স্থান নেই। [(আরবী*********)] জমহুর হানাফী ফিকাহ্বিদদের বক্তব্য হল, এ খাতের অংশটি মনসূখ হয়ে গেছে, বাতিল হয়ে গেছে। নবী করীম (স)-এর পর এ পর্যায়ে কোন জিনিসই দেয়া হয়নি, এখনও এ পর্যায়ে কোন কিছুই দেয়া যাবে না। বাদায়ে-ওয়াস-সানায়ে’ গ্রন্থে এ মতটিকে সহীহ্ বলা হয়েছে। যেহেতু হযরত আবূ বকর (রা) ও উমর (রা) ‘মুয়াল্লাফাতুল কুলুবুহুম’ খাতে যাকাত থেকে কাউকে কিছু দেন নি। কোন সাহাবীও তাঁদের এই না দেয়ার কাজের প্রতিবাদ করেন নি। বর্ণিত হয়েছে, নবী করীম (স)-এর ইন্তিকালের পর এই শ্রেণীর লোকেরা হযরত আবূ বকরের নিকট উপস্থিত হয়ে তাদের অংশ চাইলে তিনি একখানি সরকারী পত্র লিখে দিলেন তাদেরকে তাদের প্রাপ্য দেয়ার জন্যে। পরে তারাই হযরত উমরের নিকট এসে সেই পত্র দেখিয়ে তাদের প্রাপ্য চাইলে তিনি তাদের নিকট থেকে পত্রটি নিয়ে টুকরা টুকরা করে ফেললেন। বললেন: রাসূলে করীম (স) তোমাদের দিতেন তোমাদরে হৃদয় ইসলামের দিকে আকৃষ্ট ও আগ্রী বানানোর জন্যে। কিন্তু এক্ষণে আল্লাহ্ তা’আলা দ্বীন ইসলামকে শক্তিশালী করে দিয়েছন। এখন তোমরা যদি ইসলামে স্থিত থাক তো ভাল নতুবা তোমাদের ও আমাদের মধ্যে তরবারিই মীমাংসা করে দেবে, তারা আবার হযরত আবূ বকরের নিকট ফিরে গিয়ে বললো, ‘ খলিফাতুল মুসলিমীন’ আপনি, না উমর? ...... বললেন, হ্যাঁ সেও হবে আল্লাহ্ চাইলে, তিনি তাদের কথার প্রতিবাদ করলেন না, পরে সাধারণ সাহাবীদের মধ্যে কথাটি প্রচারিত হয়ে পড়ে। তারাও এ ব্যাপারে কোন উচ্চ-বাচ্য করলেন না। তাহলে দেখা গেল, এ খাতিটর অকেজো হয়ে পড়ার ব্যপারে সমস্ত সাহাবীই একমত এবং এ মতেই ইজ্মা হয়ে গেছে, মনে করতে হবে। তাছাড়া এ কথা তো সর্বসম্মত যে, নবী করীম (স) তাদেরকে দিতেন ইসলামের ব্যপারে তাদের মন তুষ্ট করার জন্যে। আল্লাহ্ এজন্যেই নাম দিয়েছেন ‘আল-মুয়াল্লাফাতুল কুলুব’। তখনকার সময়ে ইসলাম শক্তিশালী ছিল না। মুসলমানদের সংখ্যাও ছিল অনেক কম। আর ওরা ছিল সংখ্যায় বিপুল এবং শক্তিশালী। আল্লাহ্র শোকর, আজকের দিনে ইসলাম অনেক শক্তিশালী। তাদের সংখ্যাও অনেক। তাদের শক্তি-সামর্থ্যও কম নয়- ভিত্তি অত্যন্ত মজবুত। মুশরিকরা বরং অনেক হীন ও লাঞ্ছিত। এই বিধানটি যখন বিশেষ অর্থে যুক্তিসঙ্গত, তখন সেই বিশেষ অর্থ নিঃশেষ হয়ে গেলে বিধানটিও থাকতে পারে না। [(আরবী*********)] বাদায়ে-ওয়াস-সানায়ে গ্রন্থে যা কিছু বলা হয়েছে, তার সার হচ্ছে দুটি কথা। একটি এই যে, বিধানটি মনসূখ হয়ে গেছে। সাহাবীদের ইজমাই এটিকে মনসূখ করেছে। দ্বিতীয়টি এই যে, সন্তুষ্টির জন্যে অর্থ ব্যয়ের নির্দেশটি ছিল একটি বিশেষ অর্থে তাৎপর্যপূর্ণ। আর তা হচ্ছে এরূপ কাজের প্রয়োজন ও অপরিহার্যতা। কিন্তু ইসলামের ব্যাপক প্রসারতা ও প্রাধান্য লাভের দরুন সেই অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। তার অর্থ, একটা কারণের দরুন একটা কাজের হুকুম দেয়া হলে সেই কারণটি যখন থাকবে না, তখন হুকুমটিও বাতিল হয়ে যাবে। তাই যে কারণে এই লোকদের যাকাতের অর্থ দেয়া হত, সেই কারণটি যখন থাকল না- দেয়ার বিধান করা হয়েছিল দ্বীন ইসলামকে শক্তিশালী বানানোর জন্যে, এক্ষণে তা অর্জিত হয়েছে। কাজেই তখন সেই হুকুম অবশিষ্ট থাকতে পারে না। মুনসূখ হওয়ার দাবি অগ্রহণযোগ্য সত্য কথা, উপরিউক্ত দুটো কথাই অসত্য। কেননা একে তো আয়াতটি মনসূখ হয়নি এবং দ্বিতীয়ত মনস্তুষ্টি সাধনের প্রয়োজন কিছুমাত্র ফূরিযে যায়নি। হযরত উমরের উপরিউক্ত কথার ভিত্তিতে এ কথা মনে করা মুয়াল্লাফাতুল কুলুব খাতটি বুঝি সম্পূর্ণ মনসূখ হয়ে গেছে, আদৌ ঠিক নয়। কেননা সেটা কোন দলীল নয়। তিনি তাঁর কথার দ্বারা নবী করীম (স) এর সময়ে এক শ্রেণীর লোকদের যাকাত দিয়ে সন্তুষ্ট রাখার হত, তাদের প্রতি এই খাতটি নিষিদ্ধ ও অপ্রয়োজনীয় ঘোষণা করেছেন মাত্র। তিনি মনে করেছেন, এদেরকে যাকাত দিয়ে সন্তুষ্ট রাখার আর কোন প্রয়োজন নেই। কেননা এক্ষনে আল্লাহ ইসলামকে শক্তিশালী করে দিয়েছেন। এদের ওপর নির্ভরশীলতা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তিনি যা বলেছেন, তাতে তিনি প্রকৃত সত্যকে একবিন্দু অতিক্রম করে যান নি। কেননা সন্তুষ্ট রাখার কাজটি কোন সদাসক্রিয়, প্রতিষ্ঠিত ও অপরিবর্তনীয় ব্যাপার নয়। এককালে যাদের এ খাত থেকে টাকা দিয়ে সন্তুষ্ট রাখা হত, চিরদিন তাদের সন্তুষ্ট রাখার প্রয়োজন অবশিষ্ট থাকবে এমন কোন কথা নেই। সন্তুষ্ট রাখার প্রয়োজন এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নির্ধারণ করা সাম্প্রতিক রাষ্ট্র পরিচালকের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত এবং ইসলামের উন্নতি ও মুসলমানদের কল্যাণের প্রতি লক্ষ্য রেখে তার পরিমান নির্ধারণও তারই কাজ। ফিকাহর মৌল নীতি বিশেষজ্ঞগণ বলেছেন, বিশেষ একটা হুকুমকে এমন একটা গুণের সাথে সংশ্লিষ্ট করে দয়া যা অপর একটি অবস্থা থেকে নিঃসৃত, যা ঐ নিঃসৃতির কারণের সাথে জড়িত। এখানে যাকাত ব্যয়ের কাজটি জড়িতে করা হয়েছে মুয়াল্লাফাতুল কুলুব এর সাথে। তা থেকে বোঝা গেল যে, মনতুষ্টি সাধন কারণ বা ইল্লাত হচ্ছে যাকাত ব্যয়ের। তাই এ কারণটি যখন পাওয়া যাবে- সে কারণ হল মন সন্তুষ্ট রাখার মত লোক থাকা- তখন তাদের অবশ্যই তা দেয়া হবে। আর যদি না পাওয়া যায়, তাহলে দেয়া হবে না। কারুর মন সন্তুষ্ট রাখার জন্য যাকাতের অর্থ দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার অধিকার কার? প্রথমত তা মুসলিম রাষ্ট্রকর্তার। কেননা সেই মুসলমানদের পক্ষ থেকে কাজ করার অধিকারী এবং দায়িত্বশীল। কাউকে সন্তুষ্ট রাখার জন্য টাকা দেয়া- পূর্ববর্তী শাসকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দেয়া হত, পরে তা বন্ধ করা- এসব কিছুর ইখতিয়ার তারই। কোন শাসকের আমলে এ রকমের লোক থাকার দুরন একবার দেয়ার সিদ্ধান্ত করা, আবার যখন সে রকমের লোক থাকবে না বা তার প্রয়োজনও হবে না, তখন তা না দেয়া তার ইচ্ছাধীন। কেননা এগুলো ইজতিহাদী ব্যাপার, যা কাল, স্থান ও অবস্থার তারতম্যের কারণে বিভিন্ন রকম হতে পারে। হযরত উমর যখন না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তখন তিনি কুরআনের অকাট্য দলিলকে অকেজো করে দেন নি, শরীয়াতের কোন বিধানকে মনসূখও করেন নি। কেননা যাকাত আল্লাহর নির্দেশ ও বিধান অনুযায়ী আটটি খাতে বণ্টন করা হবে যখন প্রত্যেকটি খাত পাওয়া যাবে। যখন যে খাতের লোক পাওয়া যাবে না, তখন তার অংশ মুলতবি হয়ে গেছে মনে করতে হবে। কিন্তু তখন এ কথা বলা যাবে না যে, এ অংশটি রহিত করে আল্লাহর কিতাবের বিধানকে অকেজো করে দেয়া হয়েছে কিংবা বলা যাবে না যে, তা মনসূখ করা হয়ে গেছে। যাকাতের জন্য কিযুক্ত কর্মচারী একটা খাত। ইসলামী হুকুমত না থাকলে এ খাতটিও থাকবে না। কেননা যাকাতের জন্যে কর্মচারী নিযুক্ত করা ইসলামী হুকুমতের কাজ ও দায়িত্ব। তাই যখন তা পাওয়া যাবে না, তখন যাকাত জমাও করা হবে এবং পাওয়ার যোগ্য লোকদের মধ্যে তা বণ্টনও করা হবে। এ কাজে যারা দায়িত্বশীল হবে, তাদেরও মাসিক বেতন দেয়া হবে। কিন্তু ঠিক العاملين عليها বলে যে খাতটির উল্লেখ করা হয়েছে, তাদের অংশ প্রত্যাহার করা হবে। যেমন فى الرقاب বলে যাকাত ব্যায়ের যে খাতের কথা বলা হয়েছে, যদি তা না পাওয়া যায় যেমন বর্তমান কালে দাস প্রথার অস্তিত্ব নেই- তা হলে এ খাতটি মুলতবী মনে করতে হবে। এ মুলতবী করার অর্থ নিশ্চয়ই এই হবে না যে, কুরআনের আয়াত মনসূখ করা হয়েছে কিংবা একটা বিধানকে অকেজো করে দেয়া হয়েছে। [এ থেকে সুস্পষ্ট হয় যে, সমসাময়িক কালের যেসব লোক বলেন যে, কুরআনের বিধান অকেজো করা এবং প্রয়োজন দেখা দিলে তা বিরোধিতা করা জায়েয এবং হযরত উমরের মুয়াল্লাফাতুল কুলুব সংক্রান্ত সিদ্ধান্তকে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপিত করা সম্পূর্ণরূপে বাতিল ও অগ্রণযোগ্য। সাবহী মাখমাবানী তার فلسفة التشريع গ্রন্থে ১৭৮ পৃষ্ঠায় দাবি করেছেন যে, শরীয়াতী রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ বা মুসলিম জনগণের কল্যাণ চিন্তায় কুরআনের অকট্য দলিলের বিরোধিতা করতে হযরত উমর দ্বিধা করেন নি- একটু বিলম্বও করেন নি। আর তার দলিল হিসেবে তিনি মুয়াল্লাফাতুল কুলুব সংক্রান্ত পদক্ষেপের উল্লেখ করেছেন। তার এই মত গ্রহণযোগ্য নয়। উস্তাদ মাহমুদ আল-লাবাবিদী রিসালাতুল ইসলাম’ নামক কায়রো থেকে প্রকাশিত পত্রিকায় (আরবী************) শীর্ষক এক প্রবন্ধে দাবি করেছেন যে, জাতি তার সার্বভৌমত্ব নিঃসৃত শূরার প্রতিনিধিত্ব করতে গিয়ে কুরআনের কোন কোন অকাট্য দলীলকে অকেজো করে রাখা বা তার বিরোধিতা করার অধিকারী যদি তারা তাতেই কল্যাণ নিহিত বলে মনে করে। এবং এই মতের স্বপক্ষে হযরত উমরের কথিত পদক্ষেপকে দলিল হিসেবে উল্লেখ করেছেন, এটাও সম্পূর্ণ ভুল কথা জামে আজহারের আলিমগণ এই মতের প্রতিবাদ করেছেন। মরহুম শেয়খ মুহাম্মাদুল মাদানীও তার এক রচনায় উপরিউক্ত মতের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন।] এ থেকে স্পষ্ট হল যে, হযরত উমর যা করেছেন, তা মুয়াল্লাফাতুল কুলুব কে যাকাত দেয়ার নির্দেশকে কোন না কোন কারণ দর্শিয়ে বাতিল বা মনসূখ করে দয়ার কাজ নয়, তার ওপর ইজমা অনুষ্ঠিত হওয়া তো অনেক দূরের কথা। হাসান, শা’বী প্রমুখ ফিকাহবিদও বলেছেন, আজকের দিনে মুয়াল্লাফাতুল কুলুব নেই। কোন অবস্থায়ই কুরআনের হুকুম মনসূখ করার কথা বলা হয়নি; বরং সেকালের প্রকৃত অবস্থার বর্ণনা দেয়া হয়েছে মাত্র। মনসূখ করা কাকে বলে? আল্লাহর শরীয়াতের কোন বিধানকে যদি বাতিল করা হয় বলা হয় এই কাজটা করা হবে না, তাহলে মনসূখ করা বোঝায়। আর যে সত্তা বা সংস্থা আইন প্রণয়ন করে, সেই তা মনসূখ বা বাতিল করতে পারে, অন্য কেউ তা পারে না। ইসলামে আইন প্রণয়নকারী একমাত্র আল্লাহ তাআলা। তিনি রাসূলের প্রতি অহী নযিল করার পন্থায় এই কাজটি করেছেন। কাজেই কোন বিধান মনসূখ হতে পারে রাসূলে করীমের জীবদ্দশায় ও অহী নাযিল হওয়া কালে। আর তা আসল আইন প্রণয়নকারীর নিজের ঘোষণা থেকেই জানা যেতে হবে। অথবা দুটো কুরআনী বিধানের মধ্যে যদি চূড়ান্ত মাত্রায় পারস্পরিক বিরোধিতা বা বৈপরীত্য দেখা দেয় এবং একটিকে অপরটির ওপর অগ্রাধিকার দেয়ার মত অবস্থাও না থাকে- দুটো বিধানের ইতিহাসও যদি জানা থাকে, ঠিক তখনই বলা যাবে যে, শেষের হুকুমটি আগের হুকুমটিকে মনসূখ করে দিয়েছে। কিন্তু আলোচ্য বিষয়ে কি সেই অবস্থা দেখা দিয়েছে? এখানে কুরআনের বা সুন্নাতের কোন বিধান কি মুয়াল্লাকাতুল কুলুব বিধানটির সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে দাড়িয়েছে? না, তা হয়নি। শুধু তা-ই নয়। এখানে মনসূখ হওয়ার কোন দলিল আদৌ নেই। উপরিউক্ত প্রশ্নের জবাবে এই দৃঢ় নেতিবাচক কথাই বলা যেতে পারে।তাহলে আল্লাহর কিতাবের একটি সুস্পষ্ট আয়াত প্রদত্ত হুকুম মনসূখ হয়ে গেছে বলে কি করে দাবি করা যেতে পারে? রিসালাতের আমলে তো এই নীতি অনুযায়ী কাজ হয়েছে। সেই আমল নিঃশেষে অতীত হয়ে যাওয়ার পর এখন মনসূখ হওয়ার কথা কোনক্রমেই বলা যেতে পারেনা। এ অবস্থাকে সামনে রেখেই ইমাম শাতেবী বলেছেনঃ শরীয়াত পালনে বাধ্য ব্যক্তির শরীয়াতের আইন কার্যকর হওয়ার পর উহার মনসূখ হয়ে যাওয়ার দাবি কেবলমাত্র প্রমাণিত দালিলের ভিত্তিতেই করা যেতে পারে। কেননা তা আগেই প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং শরীয়াত পালনকারী তা পালনও করেছে। কাজেই প্রমাণিত ও কার্যকর হওয়ার কথা জেনে নেয়ার পর তা প্রত্যাহৃত হওয়ার কথা অনুরূপ জ্ঞানের ভিত্তিতেই মেনে নেয়া যেতে পারে। এ কারণে বিশেষজ্ঞগণ একমত হয়ে বলেছেন, খবরে ওয়াহিদ (হাদীস) কুরআনকে মনসূখ করতে পারে না, পারে না মুতাওয়াতির হাদীস তা মনসূখ করতে। কেননা তা পারলে নিছক অনুমানভিত্তিক কথার বলে অকাট্য নিশ্চিত কথা কে প্রত্যাহার করা শামিল হবে। [(আরবী***********)] খবরে ওয়াহিদ’ যখন কুরআনকে মনসূখ করতে পারে না- যদিও তা রাসূলে করীম (স) থেকে বর্ণিত, তখন একজন সাহাবীর কথা বা আমলের দৃষ্টান্ত দেখিয়ে কুরআনের আয়াত মনসূখ হওয়ার কথা আমরা কি করে বলতে পারি?........ একটু চিন্তা করলেই বোঝা যাবে, হযরত উমরের উপরিউক্ত কথাকে মনসূখ করার অর্থে কোনক্রমেই গ্রহণ করা যেতে পারে না। শাতেবীর পূর্বে ইবনে হাজম বলেছেন, আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমানদার কোন মুসলিম ব্যক্তির জন্য কুরআন ও সুন্নাহর কোন বিষয় সম্পর্কে তা মনসূখ হয়ে গেছে বলে দৃঢ় প্রত্যয় ছাড়া দাবি করা আদৌ হালাল বা জায়েয নয়। কেননা আল্লাহ তাআলা নিজেই বলেছেনঃ (আরবী**************) আল্লাহর অনুমতিক্রমে আনুগত্য ও অনুসরণ করা হবে-এ উদ্দেশ্যেই আমরা রাসূল পাঠিয়েছি। [(আরবী************)] বলেছেনঃ (আরবী**************) তোমরা মেনে চল তা, যা তোমাদের আল্লাহর নিকট থেকে তোমাদের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছে। [(আরবী************)] অর্থাৎ আল্লাহ কুরআনে কিংবা নবীর জবানীতে যা কিছুই নাযিল করেছেন, তা সবই মেনে চলা ফরয। কেউ যদি তার কোন জিনিস মনসূখ হয়েছে বলে দাবি করে, তাহলে সে সেই বিধান না মানাকে নিজের জন্যে বাধ্যতামূলক করে নিচ্ছে, তা পালনের বাধ্যবাধকতাকে সে অস্বীকার বা অগ্রাহ্য করছে। বস্তুত এটাই হচ্ছে আল্লাহর নাফরমানী ও সুস্পষ্ট আল্লাহদ্রোহীতা। তবে কেউ যদি তার এ ধরনের কথা যথার্থতা প্রমাণের পক্ষে অকাট্য দলিল পেশ করতে পারে, তবে তার কথা নিশ্চয়ই বিবেচ্য হবে। অন্যথায় সে অহংকারী দাম্ভিক ও বাতিলপন্থী প্রমাণিত হবে। এই যা কিছু বলা হল তার বিপরীত কথা যদি কেউ নিয়ে আসে, তাহলে তার কথার তাৎপর্য হবে আল্লাহ প্রদত্ত সমগ্র শরীয়াতকে অকেজো করে দেয়া। কেননা কোন আয়াত বা হাদীস মনসূখ হয়েছে বলে কারুর দবি করা ও অপর ব্যক্তির অপর কোন আয়াত বা হাদীস মনসূখ হয়েছে বলে দাবি করার মধ্যে কোন মৌলিক পার্থক্য নেই। কারণ, এ রূপ অবস্থায় কুরআন ও সুন্নাহর কোন বিধানই সহীহ অবস্থায় থাকতে পারবে না। আর তাকেই বলা হয় ইসলাম থেকে বের হয়ে যাওয়া। উপরন্তু যা দৃঢ় প্রত্যয়ের ভিত্তিতে প্রমাণিত তা অনুমানের সাহায্যে বাতিল করা যেতে পারে না। আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল আমাদেরকে যে কাজের নির্দেশ দিয়েছেন তার মনসূখ হওয়ার কথা দৃঢ় প্রত্যয়ের ভিত্তিতে প্রমাণিত হওয়া পর্যন্ত- যাতে একবিন্দু সন্দেহের অবকাশ থাকবে না- সেই নির্দেশ প্রত্যাহার করা যেতে পারে না। [(আরবী************)] তাহলে এক্ষনে যথার্থ সহীহ কথা হচ্ছে, যাকাত বণ্টনের খাত হিসেবে মুয়াল্লাফাতুল কুলুব খাতটি যথাযথভাবে বর্তমানে এবং কার্যকর রয়েছে। তা মনসূখ হয়ে যায়নি, অকেজো করেও রাখা হয়নি। সূরা তওবার আয়াত তা সুস্পষ্ট ও অকাট্যভাবে প্রতিষ্ঠিত করে রেখেছে। আর কুরআনের সর্বশেষ সূরাই হচ্ছে এই সূরাটি। আবূ উবাইদ বলেছেন, এতদসংক্রান্ত আয়াতটি সুদৃঢ়। তার মনসূখ হওয়া সম্পর্কে কোন কথাই কুরআন-সুন্নাহ থেকে জানা যায়নি। তাই কোন জাতির লোকজনের অবস্থা যদি এই হয়- ইসলামে কোন আল্লাহ নেই শুধু কিছু পাওয়ার লোভ ছাড়া, আর তাদের মুরতাদ হয়ে যাওয়া ও তাদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার পরিণামে যদি ইসলামের ক্ষতি হওয়ার আশংকা দেখা দেয়- যদি তাদের দরুন ইসলামের শক্তি বৃদ্ধি হয় ও প্রতিরোধ মজবুত হয় এবং রাষ্ট্রনেতা তাদেরকে যাকাত ফাণ্ডের কিছু অর্থ বা সামগ্রী দেয়া ভালো মনে করে, তাহলে তার পক্ষে তা করা সম্পূর্ণ জায়েয হবে তিনটি কারণেঃ একটি, তাতে কিতাব ও সুন্নাত অনুযায়ী আমল হবে। দ্বিতীয়, মুসলমানের স্থিতি লাভ হবে। এবং তৃতীয়, তাদের প্রতি কোন নৈরাশ্য দেখা দেবে না, তারা ইসলামে দাঁড়িয়ে থাকলে ইসলামের উপলব্ধি অর্জন করতে পারবে ও ইসলামের প্রতি তাদের উত্তম আগ্রহও হবে। [(আরবী************)] ইবনে কুদামাহ আল মুগনী গ্রন্থে যাকাত ব্যয়ের অনতম খাত হিসেবে এই খাতটির স্থায়ী, অপরিবর্তিত ও কার্যকর থাকার হাম্বলী মাযহাবের মত সমর্থন প্রসঙ্গে বলেছেনঃ আমাদের দলীল হচ্ছে আল্লাহর কিতাব এবং তাঁর রাসূলের সুন্নাত। আল্লাহ যাদের জন্যে যাকাত নির্ধারণ করেছেন তাদের মধ্যেই মুয়াল্লাফাতুল কুলুব দের কথাও বলেছেন। নবী করীম (স) বলেছেন, আল্লাহই যাকাত পর্যায়ে বিধান দিয়েছেন, তার আটটি অংশ নির্দিষ্ট করেছেন।’ বহু কয়টি সর্জনবিদিত হাদীসে আল মুয়াল্লাফাতু কুলুবুহুম এর কথা উদ্ধৃত হয়েছে। রাসূলে করীম (স) এর ইন্তেকালের সময় পর্যন্ত তা পুরোমাত্রায় কার্যকর ছিল। আর আল্লাহ ও রাসূলের কোন বিধান মনসূখ না হওয়া পর্যন্ত তা পালন ত্যাগ করা যেতে পারে না। সম্ভব্যতার ভিত্তিতে কোন কিছুর মনসূখ হওয়া কোনক্রমেই প্রমাণিত হতে পারেনা। উপরন্তু শরীয়াতের কোন কিছুর মনসুখ হওয়া সম্ভব ছিল নবী করীম (স) এর জীবদ্দশায়। কেননা সে জন্যে অকট্য দলীলের প্রয়োজন। কিন্তু নবীর ইন্তেকালের পর এ ধরনের অকাট্য দলীল কোথাও পাওয়া যেতে পারে না। অহীর নাযিলকাল শেষ হওয়ার পর সে দলীল কোথেকে আসবে? তাছাড়া কুরআনের আয়াত কুরআন দ্বারাই মনসূখ হতে পারে। কিন্তু কুরআনের উক্ত আয়াতটির মনসুখ হওয়ার কোন কথা নেই। হাদীসেও কিছু নেই। তা হলে শুধু কিছু লোকের মত, জোর-জবরদস্তি কিংবা কোন সাহাবীর কথার দ্বারা কুরআন ও সুন্নাহর বিধান কেমন করে তরক করা যেতে পারে? সাহাবীদের কথা এমন দলিলও নয় যাদ্বারা কিয়াস পরিহার করা যেতে পারে। তাহলে এই লোকেরা কুরআন ও সুন্নাহ কেমন করে পরিহার করতে পারে একজন সাহাবীর কথার ভিত্তিতে? ইমাম জুহরী বলেছেন, মুয়াল্লাফাতু কুলুবুহুম মনসূখ হওয়ার কোন কথাই আমার জানা নেই। [আল-মুয়াল্লাফাতু কুলুবুহুম’ বিধানটি মনসূখ হয়েছে অথচ তা অকাট্য কুরআনী দলীল দ্বারা প্রমাণিত- হানাফীদের এই মতে এক মনসূখ করল, তাই নিয়ে তাদের মধ্যেই মতবিরোধ রয়েছে। তাদের কেউ কেউ দাবি করেছেন, এ বিষয়ে ইজমা হয়েছে। হযরত উমর তার আমলে এই খাতটি অকেজো করেছিলেন এবং সাহাবীদের কেউ তার প্রতিবাদ করেননি, এটিকেই ইজমা বলে মনে করেছেন। কিন্তু এ যে কত অন্তঃসারশূন্য কথা, তা আমরা আগেই জানতে ও বুঝতে পেরেছি। কেউ কেউ ইজমাকে সনদযুক্ত প্রমাণ করে তাকেই মনসূখকারী বলে ধরে নিয়েছেন। পরে আবার তার সনদযুক্ত হওয়ার নির্ধারণে মতবিরোধের সৃষ্টি হয়েছে। ইবনে নজীম (আরবী*****) গ্রন্থে সূরা কাহাফের আয়াতঃ (আরবী*************) টিকে হযরত উমর আল মুয়াল্লাফাতু আয়াতের মুকাবিলায় দাড় করেছেন বলে উল্লেখ করেছেন। ইবনে আবেদীন বলেছেনঃ ইজমা কে উক্ত আয়াতের নাসেখ মনে করা হয়নি। কেননা তা সহীহ নয়। মনসূখ হওয়া তো সম্ভব ছিল রাসূলের জীবদ্দশায়। আর ইজমা হতে পারে রাসূলের ইন্তেকালের পর। কেউ কেউ হযরত মুয়াযকে ইয়েমেনে প্রেরণ সংক্রান্ত হাদীসকে নাসেখ গণ্য করেছেন। দেখঃ (আরবী**************) সত্য কথা হচ্ছে এই ধরনের ঘটনা দ্বারা কোন অকাট্য আয়াত মনসুখ হতে পারে না। সূরা কাহাফের যে আয়াতটি উল্লেখ করা হয়েছে তা নিঃসন্দেহে মক্কী সূরা। তার দ্বারা কি করে মদীনায় অবতীর্ণ একটি সর্বশেষকালের আয়াত মনসূখ হতে পারে- প্রথমটির দীর্ঘ কয়েক বছর পরে নাযিল হয়েছে। তাছাড়া আয়াত দুটোর মধ্যে কোন পারস্পারিক বৈপরীত্যও নেই। তাই একটির দ্বারা অন্যটিকে মনসুখ করারও কোন প্রয়োজন দেখা দেয়নি। হযরত মুয়ায সংক্রান্ত হাদীসও তাই। তাতে শুধু এই টুকু কথা বলা হয়েছে যে, যাকাত জনগণের নিকট থেকে নিয়ে জনগণের মধ্যেই বণ্টন করতে হবে। তা পূর্ববর্তী রাজা-বাদশাহদের ধার্য করা কর বা খাজনার মত নয়। তা তো গরীবদের নিকট থেকে নিয়ে ধনীদের মধ্যে বণ্টন করা হয়। উক্ত হাদীসে শুধু ফুকারা গরীব লোকদের মধ্যে বণ্টনের কথা বলার দরুন মুয়াল্লাফাতু কুলুবুহুম এর খাত মুছে যায়নি। তাহলে তো অন্যান্য তার জন্যে নিয়োজিত কর্মচারী, ঋণগ্রস্ত, দাস প্রভৃতির অংশও বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া উচিত হয়। কিন্তু তাতো হয়নি, কেউই সে মত দেন নি। এজন্যে হানাফী মতের ফিকাহ্‌বিদ আলাউদ্দিন ইবনে আবদুল আজীজ বলেছেন, উত্তম হচ্ছে এরূপ বলাঃ এ হচ্ছে নবী যুগের কর্মপদ্ধতির প্রতিবেদন তাৎপর্যগতভাবে। মূয়াল্লাফাতুল কুলুব দের যাকাতের অংশ দেয়ার মূলে লক্ষ্য ছিল ইসলামকে শক্তি দান করা, কেননা তখন তা দুর্বল ছিল, তখন কুফর ছিল প্রতিষ্ঠিত ও শক্তিশালী। কিন্তু পরে অবস্থার পরিবর্তন ঘটে, ইসলাম বিজয়ীরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন না দেয়াতই ইসলামের শক্তি ও মর্যাদা রক্ষিত হয়। সেকালে দেয়া ও একালে না দেয়া উভয়ই দ্বীন-ইসলামকে শক্তিসম্পন্ন করার একটা উপায় ছিল। আর তাই ছিল লক্ষ্য। তা সর্বাবস্থায়ই হতে পারে। কাজেই মনসূখ হয়ে যায়নি।....... বলেছেন, এ ব্যাপারটি গোটা গোত্রের ওপর খুনের দিয়েত দায়িত্ব চাপানের মত। কেননা নবী করীম (স) এর যুগে গোটা কবীলার ওপর ওয়াজিব ছিল। পরবর্তীকালে তা আহলি দিওয়ানের ওপর বর্তায়। কেননা দিয়েত দেয়ার দায়িত্ব গোত্রের ওপর চাপানোর উদ্দেশ্য ছিল সকলের সাহায্য গ্রহণ। এ সাহায্য কর্মে নবীযুগে গোত্রই এগিয়ে আসত। পরবর্তীকালে আহলি দিওয়ানের সঙ্গে জুড়িয়ে দেয়া হয়। তার অর্থ এই নয় যে, পূর্বরটি মনসুখ হয়েগেছে বরং সেই তৎপর্যকেই প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে, যার দরুন দিয়েত ওয়াজিব করা হয়েছিল। আর তা হচ্ছে সাহয্য চাওয়া। নিহায়া গ্রন্থ এই ব্যাখ্যাকে পসন্দ ও সমর্থন করা হয়েছে। এই বিশ্লেষণের সারকথা হল, ইসলাম যদি কখনও দুর্বল অবস্থার মধ্যে পড়ে যায়- যেমন আমাদের এই যুগে তাহলে যাকাত থেকে মুয়াল্লাফাতু কুলুবুহুম দের অংশ দিয়ে তাকে শক্তিশালী করতে চেষ্টা পাওয়া উচিত। তবে হানাফী মতে এটা জায়েয নয়। এই কারণে ইবনুল হুম্মাম তাদের সমালোচনা করেছেন এই বলে যে, হানাফীরা যেমন বলেন, তা আসলে মনসূখ হয়ে যায়নি। কেননা তাদের দেয়াটা শরীয়াতের বিধান, ‍সুপ্রতিষ্ঠিত ও প্রমাণিত। পরে তার প্রয়োজন থাকে না। (তাফসীর রুহুল মায়ানী- আ-লুসী, ৩য় খণ্ড, ৩২৭ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য)] তবে যে তাৎপর্যের কথা ফিকাহবিদগণ বরেছেন, তা এবং কিতাব ও সুন্নাতের মধ্যে কোন বৈপরীত্য নেই। কেননা তাদের প্রতি মুখাপেক্ষিতা এই হুকুমটির মুলতবী হওয়া জরুরী করে না। আর কেবলমাত্র এখনই এই খাতে দেয়া বন্ধ করা যেতে পারে, যখন তাদের প্রতি মুখাপেক্ষিতা দূর হয়ে যাবে। অতএব যখনই তাদেরকে দেয়ার প্রয়োজন দেখা দেবে, তাদের দিতে হবে। যাকাতের অন্যান্য খাত সম্পর্কেও এই কথা। সে কয়টির মধ্যে কোন একটি খাতের প্রয়োজন কোন সময় ফুরিয়ে গেলে ঠিক সেই সময়ের জন্যে এই খাতটি মুলতবি থাকবে। আবার যখন প্রয়োজন দেখা দেবে, তখন আবার তা দিতে শুরু করতে হবে। [(আরবী*********)] মন তুষ্ট করার প্রয়োজন কখনই ফুরায় না যাঁরা বলেন, ইসলামের ব্যাপক প্রচার সাধিত হওয়ার কারণে ‘মুয়াল্লাফাতুল কুলুবুহুম’ খাতে যাকাতের অংশ ব্যয়ের ও এ পর্যায়ের লোকদের তা দেয়া প্রয়োজন নিঃশেষ হয়ে গেছে এবং এক্ষণে ইসলাম দুনিয়ার অন্যান্য ধর্মের ওপর প্রাধান্য লাভ করতে সক্ষম হয়েছে, তাদের এই কথা তিনটি কারণে গ্রহণযোগ্য নয়ঃ ১. মালিকী মাযহাবের কোন কোন ফিকাহবিদ যেমন বলেছেন, মুয়াল্লাফ বা সন্তুষ্ট করার জন্যে যাকাতের অংশ দেয়ার কারণ আমাদের জন্যে তাদের সাহায্য করা নয়। কাজেই তা ইসলামের বিস্তৃতি ও আধিপত্য লাভের দরুন বাতিল হয়ে যাবে না। বরং এই দেয়ার উদ্দেশ্য হল তাদের মনে ইসলামের প্রতি আগ্রহ ও উৎসাহ জাগিয়ে তোলা। আর তার উদ্দেশ্য হচ্ছে তাদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে নিষ্কৃতি দান। এই মতে মনে করা হয়েছে, এ খাতটি কার্যকর থাকলে তা ইসলামী দাওয়াতের কাজ চালিয়ে যাওয়ার একটা উপায় হতে পারে যা কোন কোন লোকের নিকট পাওয়া যেতে পারে এবং তার দ্বারা তাদেরকে ইসলামের নিকটে আনা ও কুফর থেকে তাদেরকে রক্ষা করা সম্ভব হতে পারে। আর যে কোন উপায়ে গণমানুষকে হেদায়াত দান দুনিয়ায় তাদেরকে জাহিলিয়াতের অন্ধকার থেকে এবং পরকালের জাহান্নামের আজাব থেকে বাঁচানো সম্ভব, তা বাস্তবে প্রয়োগ করা- এই ধরনের উপায়কে অকেজো করে না রাখা মুসলমানদের জন্যে অবশ্য কর্তব্য। একথা সত্য যে, বৈষয়িক স্বর্থের জন্যেও কেউ ইসলামে প্রবেশ করতে পারে; কিন্তু এওতো সম্ভব যে, ইসলাম এসে সে পাক্কা ও প্রকৃত মুসলিম হয়ে যাবে। হযরত আনাস ইবনে মালিক থেকে আবূ ইয়ালা বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেন, ‘কোন ব্যক্তি যদি এমনও হত যে, রাসূলে করীম (স) এর নিকট এসে কোন বৈষয়িক স্বার্থের জন্যে সালাম করত, কেবল তাকেই সালাম দিত, তাহলে পরে এমন অবস্থা দেখা দিত যে, ইসলাম তার নিকট দুনিয়া ও দুনিয়ার মধ্যে অবস্থিত সবকিছুর অপেক্ষা অধিক প্রিয় হয়ে গেছে। অপর একটি বর্ণনায় বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তি যদি নবী করীম (স) এ নিকট বৈষয়িক জিনিস চাইত, তাহলে তিনি তাকে তা দিতেন........ পরবর্তী কথা উক্তরূপ। কোন কাফির ব্যক্তিকে ইসলামের প্রতি আগ্রহী বানাবার জন্যে দেয়া হলে তাবেই এই কথা বলা যাবে। কিন্তু এ পর্যায়ের সব লোকই সেরকম নয়। এমন অনেক লোকই আছে, যাদের মন সন্তুষ্ট করা হয়েছে, তারা তাদের প্রাচীন ধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম কবুল করেছে। তখন সে তার পরিবারবর্গ ও সেই ধর্মের লোকদের পক্ষ থেকে চরম বিরোধিতা, শত্রুতা, নির্যাতন ও বঞ্চনার সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। এরূপ অবস্থায় তাকে যাকাতের অত্র অংশ দিয়ে সাহায্য করা, সাহসী বানানো ও বিপদমুক্ত করা একান্তই কর্তব্য, যেন সে ইসলামে শক্ত হয়ে টিকে থাকতে পারে, ইসলামে তার কদম দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত হয়। ২. কারুর মন সন্তুষ্ট করার প্রয়োজন হয় ইসলাম ও মুসলমানদের দুর্বলতার কারণে- এই মত যারা পোষণ করেন, তাদের এই মতের ওপর ভিত্তি করেই এই খাতটির মনসুখ হয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। অপর লোকদের মত হল, যার মন সন্তুষ্ট করার জন্যে যাকাতের অংশ দেয়া হবে, তাকে অবশ্যই ফকীর ও অভাবগ্রস্ত ব্যক্তি হতে হবে- এটা শর্ত। অথচ এসব বলে বিনা দলিলে আল্লাহর সেই কথাকে শর্ত সম্পন্ন বানিয়ে দেয়া হয়, যার ওপর তিনি নিজে কোন শর্ত আরোপ করেন নি। এতে করে বিনা কারণে শরীয়াতের একটা কর্মনীতির বিরোধিতা করা হয়। আমাদের এই যুগে আমরা দেখছি, বড় বড় শক্তিশালী রাষ্ট্র ক্ষদ্র ও দুর্বল রাষ্ট্র বা জাতিকে সন্তুষ্ট করা বা স্বপক্ষে দিচ্ছে, দিচ্ছে উন্নতিশীল বহু প্রাচ্য অঞ্চলের রাষ্ট্রকে। রাশিয়া দিচ্ছে বহু দুর্বল সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে। ইমাম হাবারী এ পর্যায়ে যা বলেছেন তা খুবই সুন্দর। কথাটি হচ্ছেঃ আল্লাহ তায়ালা দুটো মহাসত্যের প্রেক্ষিতে যাকাতের ব্যবস্থা কার্যকর করেছেনঃ একটা হচ্ছে, মুসলিম জনগণের দারিদ্র্য বিদূকরণ এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে ইসলামকে সহায়তা দান এবং তাকে শক্তিশালী করা। যাকাতের যে অংশ ইসলামের সহায়তা এবং তার কার্যকারণসমুহকে শক্তিশালী করে তোলার কাজে নিয়োজিত হবে তা দেয়া যাবে ধনী, গরীব নির্বিশেষে। কেননা তা তো ইসলামেরই প্রয়োজনে দেয়া হবে তাকে। দ্বীনের সহায়তার জন্যেই দেয়া হবে তা। এই দোয়াটা ঠিক তেমনি, যেমন আল্লাহর পথে জিহাদের জন্যে দেয়া হয়। তা দেয়া হয় সে ব্যক্তি ধনী হোক কি দরিদ্র। দেয়া হয় যেন সে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারে, দারিদ্র্য মুক্তির উদ্দেশ্যে নয়। মুয়াল্লাফাতু কুলুবুহুম খাতে যাকাত দানের ব্যাপারটি ঠিক তেমনি। তা দেয়া যাবে তারা পারিভাষিক অর্থে ধনী হলেও। এ দেয়াটা ইসলামের স্বার্থে, তাকে শক্তিশালী করে তোলার উদ্দেশ্য, সহায়তার জন্যে। নবী করীম (স) বহু যুদ্ধে বিজয় লাভের পরও এই দেয়ার কাজ চালু রেখেছেন। অথচ তাখন ইসলাম ব্যাপক প্রচার লাভ করেছিল, মুসলিম জাতি শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। কাজেই যদি কেউ বলে যে, আজ ইসলামের জন্যে কারুর মন সন্তুষ্ট করা যাবে না- তা চাওয়ার লোকদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার দরুন তা নিষিদ্ধ হওয়ার কারণে, তবে তার এই কথার যৌক্তিকতা স্বীকার্য হবে না। কেননা নবী করীম (স) বর্তমানের এই গুণের অধিকারী লোকদেরকেই তা দিয়েছেন।[(আরবী*********)] ৩. অবস্থা পরিবর্তিত হয়েছে, দুনিয়া তার পৃষ্ঠকে মুসলিমদের প্রতি ঘুরিয়ে দিয়েছে, তারা পূর্বের ন্যায় দুনিয়ার নেতৃত্ব লাভ করতে পারেনি। বরং ইসলাম আবার অপরিচিত হয়ে পড়েছে, যেমন শুরুতে ছিল। দুনিয়া জাতিসমূহ মুসলিমদের ওপর এমনভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছে যেমন করে হিংস্র দানব সন্ত্রস্ত শিকারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাদের হৃদয় মনে একটা কঠিন ভীতির সৃষ্টি হয়েছে। আল্লাহই সব ব্যাপারের পরিণতির মালিক। ইসলাম ও মুসলিমের চরম দুর্বলতার দিন আবার ফিরে এসেছে। এসেই দুর্বলতা যা মুয়াল্লাফাতু কুলুবুহুম খাতে যাকাত ব্যয়ে ইল্লাত বা কারণ হতে পারে এবং তা দেয়া সঙ্গত বিবেচিত হতে পারে। যাকাতের অংশ মুয়াল্লাফাতু কুলুবুহুম কে দেয়ার এটাই উপযুক্ত সময়। দেয়া জায়েয যেমন ইবনুল আরাবী প্রমুখ বলেছেন। [তাবে হানাফীরা নিজেরাই বলেছেন, মন সন্তুষ্টকরণ একটা কারণের ভিত্তিতে হবে, কারণ দর্শনোও নিঃশেষ হয়ে গেছে, এই কথা কোন কারণভিত্তিক নির্দেশ বন্ধ করার দলীল হতে পারে না। কেননা কোন কারণের ভিত্তিতে দেয়া হুকুম তার স্থায়ীত্বের জন্যে সেই কারণের স্থায়িত্বের মুখাপেক্ষী নয়। কেননা অতপর সে হুকুমটি কারণের প্রয়োজনীয়তামুক্ত হয়ে গেছে। যেমন দুসপ্রথা, ইহরামের কাপড় পরার ধরন ও রমল করার নিয়ম। তাই শর্তাধীন বিধিবদ্ধ করা কোন হুকুমের স্থায়িত্ব সেই কারণের স্থিতিরে ওপর নির্ভশীল হওয়ার জন্যে একটা দলিলের প্রয়োজন। তাঁরা আরও বলেছেন, এই ব্যাপারটিকে ইজমার ক্ষেত্রে স্থাপনের কোন প্রয়োজন নেই। দলিল প্রমাণিত হলে আমরা তার ভিত্তিতে হুকুম প্রকাশ করতে পারি। যদিও তা আমাদের জন্যে প্রাকশমান নয়। (রদ্দুল মুহতার, ২য় খণ্ড, ৮২-৮৩ পৃ.) তা সত্ত্বেও হানাফীরা তাদের মতের দুর্বলতা থেকে নিষ্কৃতি পায়নি।] মন সন্তুষ্টকরণ ও মুয়াল্লাফাতুর জন্যে যাকাত ব্যয়ের অধিকার কার আমি বলব, মন সন্তুষ্টকরণ এবং তার প্রয়োজন নির্ধারণ ইত্যাদি কাজের দায়িত্ব সম্পূর্ণরূপে মুসলিম রাষ্ট্রনেতার ওপর অর্পিত। এ কারণে নবী করীম (স) নিজে এবং খুলাফায়ে রাশেদুন নিজেরাই এ কাজটি আঞ্জাম দিতেন। ব্যাপারটির প্রকৃতির সাথে এই নীতিই সামঞ্জস্যপূর্ণ। কেননা এ ব্যাপারটি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীন ও বৈদেশিক নীতির সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত। সেই সাথে দ্বীন-ইসলাম ও মুসলিম জাতির কল্যাণ চিন্তাও বিশেষভাবে বিবেচ্য থাকবে। [شرح الازهار ১ম খণ্ড ৫১৩ পৃষ্ঠায় লিখিত হয়েছে, সন্তুষ্টকরণের কাজটি কেবলমাত্র রাষ্ট্রনেতারই করণীয় দ্বীনী কল্যাণের দৃষ্টিতে, অপর কারুর পক্ষে তা জায়েয নয়। জায়দীয়া ফিকাহর ভিন্নমত রয়েছে।] আর একালে যেমন, রাস্ট্র যদি যাকাত সংগ্রহ বণ্টন এবং সাধারণভাবে ইসলামী বিধান সংক্রান্ত দায়িত্ব পালন না করে, তাহলে ইসলামী সামষ্টিক সংস্থাসমূহ রাষ্ট্রের এ দায়িত্ব পালন করতে পারে। রাষ্ট্র বা সামাজিক সংস্থা কোনটিই যদি এই দায়িত্ব পালন না করে এবং কোন ব্যক্তি মুসলিমের নিকট যাকাতের মাল অতিরিক্ত হয়ে পড়ে, তাহলে তার পক্ষে এই খাতে যাকাত ব্যয় করা জায়েয হবে কিনা, এ একটা শক্ত প্রশ্ন। এই গ্রন্থকারের মতে তা জায়েয নয়। তবে অন্য কোন ব্যয় ক্ষেত্র যদি পাওয়াই না যায়, তাহলে অবশ্য জায়েয হবে। যেমন যে সব মুসলমান অনৈসলামী রাষ্ট্রে বাস করে এবং তথায় যাকাত পাওয়ার যোগ্য কোন মুসলমান পাওয়া না যায় এবং দেখতে পায় যে, এমন কাফির লোক রয়েছে যাদের এ টাকা দিলে তাদের মন ইসলামের দিকে ঝুঁকে পড়বে, মুসলিমদের প্রতি বন্ধুত্বসম্পন্ন হবে, তাহলে ঠিক এরূপ অবস্থায় প্রয়োজনের কারণে তা দেয়া যেতে পারে, যদিও এরূপ অবস্থায় ইসলামের প্রচার কার্যে যাকাতের টাকা ব্যয় হওয়া উত্তম যদি তা কোন ইসলামী রাষ্ট্রে পাঠিয়ে দেয়া সম্ভবপর না হয়। এ যুগে ‘মুয়াল্লাফাতু’ খাতের টাকা কোথায় ব্যয় করা হবেঃ ‘মুয়াল্লাফাতু কুলুবুহুম’ খাতটি বাতিল হয়নি এবং যাকাতের অংশ এই খাতে ব্যয় করার অবকাশ এখনও আছে। তাই প্রশ্ন, উঠে, বর্তমান যুগে এই খাতের টাকা কোন কাজে ব্যয় করা হবে? এই প্রশ্নের জবাব আমাদের পূর্ববর্তী আলোচনা থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। শরীয়াতের বিধানদাতা যে উদ্দেশ্যে এ খাতটি রেখেছেন, ঠিক সেই উদ্দেশ্য এ যুগেও তা ব্যয়িত হবে। আর তা হচ্ছে, লোকদের মন ইসলামের দিকে আকৃষ্ট করা এবং ইসলামে প্রতিষ্ঠিত ও দৃঢ় করে রাখার কাজে এই টাকা ব্যয় করা অথবা ইসলামে যারা দুর্বল অবস্থায়, রয়েছে, তাদের শক্তিশালী করার জন্যে ব্যয় করা। ইসলামের সাহায্যকারী লোক সংগ্রহ কিংবা ইসলামী দাওয়াতী আন্দোলন ও ইসলামী রাষ্ট্রের শত্রুদের অনিষ্ট প্রতিরোধ করার কাজেও ব্যয়িত হতে পারবে। কোন কোন সময়ে কোন অনৈসলামী রাষ্ট্রকে মুসলমানদের স্বপক্ষে রাখার জন্যেও তা ব্যয় করার প্রয়োজন দেখা দিতে পারে, কোন কোন সংস্থা, গোত্র বা দল কিংবা শ্রেণীকে ইসলামের সহায়তা করার দিকে উৎসাহী বানানো বা রাখার জন্যেও তা ব্যয় করার দরকার হতে পারে। ইসলামের প্রতিরক্ষার কাজে কোন কোন লেখনী বা মুখপাত্র নিয়োগের প্রয়োজন দেখা দিতে পারে এবং সেজন্যেও এই খাতটি ব্যবহার হতে পারে। ইসলামের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণাকারীদের মুখ বন্ধ করার জন্যে এবং তাদের সমুচিত জবাব দেয়ার জন্যেও তা লাগানো যেতে পারে। যেমন প্রতিবছর লোকেরা দলে দলে ইসলামে প্রবেশ করে, কিন্তু কোন ইসলামী রাষ্ট্রের নিকট থেকে তারা কোনরূপ সাহায্য-সহযোগিতা পায় না, তাদেরকে একবিন্দু উৎসাহিতও করা হয় না। তাদেরকে এই খাত থেকে সাহায্য দেয়া একান্ত জরুরী হয়ে পড়ে। তা হলে তাদের কোমর শক্ত হবে, তারা ইসলামে অবিচল হয়ে থাকবে। ইমাম জুহরী ও হাসান বসরী বর্ণিত, খৃষ্টান মিশনারীরা এই ব্যবস্থা নিয়েছে যে, যে লোকই খৃষ্ট ধর্ম গ্রহণ করবে তার যাবতীয় ব্যয়ভার বহন এবং বস্তুগত ও সাহিত্যিক সাংস্কৃতিক অনুকূল্য দেয়ার দায়িত্ব তারাই গ্রহণ করে। এসব মিশনারী তাদের বিপুল পরিমাণ টাকা-পায়সা দিয়েও সাহায্য করে। এভাবে প্রতিবছর বহু সংখ্যক খৃষ্টান মিশনারী প্রতিষ্ঠান সাহায্য দানের কাজ করে যাচ্ছে। দ্বীন ইসলামের ন্যায় তাদের মধ্যে যাকাতের মত কোন ব্যবস্থা নেই। আমাদের পক্ষেই এটা সম্ভব যে, আমরাই যাকাতের একটা বড় অংশ লোকেদের মন সন্তুষ্ট রাখা ও ইসলামের ওপর অবিচল রাখার জন্যে ব্যয় করতে পারি। বস্তুত ইসলামে সুস্থ প্রকৃতি ও সুষ্ঠু বিবেক-বুদ্ধির সাথে সামঞ্জস্যসম্পন্ন সুস্পষ্ট ভাবধারা রয়েছে। তাই তা স্বতই দুনিয়ার বিভিন্ন দিকে প্রচারিত হয়ে পড়েছে। কিন্তু যারাই ইসলাম গ্রহণ করেছে তারা এমন কোন বৈষয়িক সুযোগ-সুবিধা পায় না, যারা ফলে তারা দ্বীন-ইসলামে গভীর অন্তদৃষ্টি ও পাণ্ডিত্য লাভ করতে পারে না। যার দরুণ তারা এর হেদায়েতে সত্যিকারভাবে উপকৃত হতে পারছে না। তারা যে ত্যাগ স্বীকার করেছে, তার কিছুরও প্রতিবিধান করা হচ্ছে না কিংবা তার প্রতিপক্ষ বা অত্যাচারী রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আসা কঠিন নির্যাতন সে ভোগ করতে বাধ্য হয়েছে, তা থেকে কিছুমাত্র নিস্কৃতি দেয়ার ব্যবস্থাও করা হচ্ছে না। বিভিন্ন দেশে অবশ্য এমন বহু সংস্থা আছে, যেগুলো এই সুবিধাসমূহ দুর করার জন্যে নিরন্তর চেষ্টা চালাচ্ছে; কিন্তু সেগুলো প্রয়োজন পরিমাণ সাহায্য-সহযোগীতা পাচ্ছে না। এটা খুবই দুঃখের কথা। আফ্রিকা মহাদেশে ভায়বহ ধর্মীয় ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ নিত্যকার ঘটনা –দুর্ঘটনা হয়ে রয়েছে। তথায় বিভিন্ন শক্তি, গোত্রপতি, রাষ্ট্র-ক্ষমতা দখলের চেষ্টায় নিয়োজিত রয়েছে। একদিকে মিশরানী সাম্রাজ্যবাদ বা সাম্রাজ্যবাদী মিশনারীরা চেষ্টায় লেগে আছে, অপরদিকে দিয়ে ইসরাইলী ইয়াহুদী সাম্রাজ্যবাদ সর্বাত্মক শক্তি এই উদ্দেশ্য নিয়োজিত করে রেখেছে। আর তৃতীয় দিক দিয়ে মার্কসীয় কমিউনিষ্ট সাম্রাজ্যবাদও ওৎ পেতে আছে। প্রত্যেকেই আফ্রিকা দখল করে স্বীয় রঙে রঙীন করে তোলার চেষ্টায় রত আছে। এসব আক্রমণাত্মক পরিস্থিতি ও ঘটনাবলীর প্রেক্ষিতে ইসলাম নির্বাক, নিষ্ক্রিয় ও নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকতে মুসলিম জাতিকে অনুমতি দেয়না। তাই এ সময় এমন একটি রাষ্ট্র থাকা একান্তই জরুরী, যা তার এই দায়িত্ব যথাযথ পালন করবে, দ্বীন-ইসলামের দাওয়াত প্রচার করবে এবং আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দ্বীন কায়েম করবে। ইসলাম একদিন আক্রমণাত্মক বা সম্প্রসারণের ভূমিকায় ছিল। আর বর্তমানে তা প্রতিরক্ষার ভূমিকায় চলে গেছে। চারদিক থেকে তা আক্রমণের সম্মখীন, তার নিজের ঘর রক্ষার দায়িত্বের ব্যতিব্যস্ত। অতএব আজকের দিনেও লোকদের মনস্তুষ্টি সাধনের চেষ্টায় নিয়োজিত হওয়া অধিক কর্তব্য। সাইয়েদ রশীদ রিজা লিখেছেন- কাফিররা মুসলমানদের মনতুষ্টি সাধন করে তাদের স্বপক্ষে কিংবা তাদের ধর্মে শামিল করে নিয়ে যাচ্ছে। সমস্ত মুসলমানকে দাস বা গোলাম বানাবার চেষ্টায় রত আছে সাম্রাজীবাদী রাষ্ট্রসমূহ। সেই সাথে বিপুল সংখ্যক মুসলমানের মনস্তুষ্টি সাধনের কাজে অপরিমেয় ধনসম্পদ ও কলাকৌশল ব্যয় ও প্রয়োগ করে যাচ্ছে। কেউ কেউ মুসলমানদের ইসলামের সীমার মধ্য থেকে বহিষ্কৃত করে তাদের সাহায্য লাগানোর উদ্দেশ্য তাদের মনস্তুষ্টি সাধনের কাজ করে যাচ্ছে। তাদের সমর্থনে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে এই কাজ করছে অনেকগুলো সংস্থা। মুসলিমদের ঐক্য ও ইসলামী রাষ্ট্রসমূহ ধ্বংস করাই তাদের চরম লক্ষ্য। এরূপ অবস্থায় মুসলমানদের কি উচিত নয় তাদের সঠিক দায়িত্ব পালনে নেমে যাওয়া। [(আবরী**************)] যাকাতের মাল ছাড়াও এ কাজ করা জায়েয উপরের এই দীর্ঘ আলোচনার পরও আমরা বলে রাখতে চাই যে, প্রয়োজনীয় মনস্তুষ্টি সাধনের এ কাজটি কেবলমাত্র যাকাত দ্বারাই করতে হবে, অন্য কোন উপায়ে করা যাবে না, এমন কথাও নয়। বায়তুল মালের যাকাত সহ অন্যান্য আয় দ্বারাও এই কাজ করা যাবে। এজন্য একটা স্বতন্ত্র ফাণ্ডও গঠন করা যাবে। বেশী অভাবগ্রস্ত হয়ে পড়ে কিংবা তাদের সংখ্যা যদি অনেক বেশী হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে তা করা ছাড়া উপায় থাকে না। ইমাম শাফেয়ী ও অন্যান্য ফিকাহবিদ এ মত দিয়েছেন। তার অর্থ জনকল্যাণমূলক ফাণ্ড দ্বারা ‘মুয়াল্লাফাতু কুলুবুহুম’ খাতে কাজ করা। আসলে আদর্শবাদী সুবিচারক রাষ্ট্রকর্তার অভিমতের ওপরই তা একান্তভাবে নির্ভর করে। পরিমাণটা উপদেষ্টা পরিষদের নির্ধারিতব্য। শুরা সদস্যদের পরামর্শক্রমেই এ কাজটি সুষ্ঠূভাবে আঞ্জাম পেতে পারে। চতুর্থ পরিচ্ছেদ ফির-রিকার-দাসমুক্তি কুরআনে খাত নির্ধারণে অক্ষর প্রয়োগের পার্থক্য পর্বে উদ্ধৃত হয়েছে, কুরআনের আয়াতে যাকাত ব্যয়ের আটটি খাত নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ইতিপূর্বেই চারটি বিষয়ের আলোচনা উপস্থাপিত করা হয়েছেঃ ফকীর, মিসকীন, যাকাত কার্যে নিয়োজিত কর্মচারী এবং মুয়াল্লাফাতু কুলুবুহুম- ইসলামের জন্যে যাদের মনস্তুষ্টি সাধনের প্রয়োজন। এখনও চারটি খাতের আলোচনা অবিশিষ্ট রয়ে গেছে। তা হচ্ছে ১. ফির-রিকার- দাসমুক্তি, আটটির মধ্যে পঞ্চম খাত। ২. আল-গারেমীন- ঋণগস্ত লোক, আটটির মধ্যে ষষ্ট খাত। ৩. ফী সাবীলিল্লাহ- আল্লাহর পথে, আটটির মধ্যে সপ্তম খাত। ৪. ইবনুস সাবীল- নিঃস্ব পথিক, আটটির মধ্যে অষ্টম ও সর্বশেষ খাত। কুরআনের উক্ত আয়াতটি যাকাত ব্যয় ক্ষেত্রকে আটটি খাতের মধ্যে সীমাবদ্ধ করেছে। প্রথমে চারটি এবং শেষে চারটি। প্রথম চারটি খাতের কথা বলেছে এ ভাষায়ঃ (আবরী******************) সাদকা-যাকাত কেবলমাত্র ফকীর, মিসকীন, যাকাত সংক্রান্ত কর্মচারী ও যাদের হৃদয় সন্তুষ্ট করা দরকার এদের জন্যে। আর শেষের চারটি খাতকে বলা হয়েছে এই ভাষায়ঃ (আরবী***************) দাসমুক্তি ও ঋণগ্রস্তদের কাজে এবং আল্লাহর পথে ও নিঃস্ব পথিকের কাজে। পূর্বে বলার ধরনে ও এ পার্যায়ের বলার ধরনে এই পার্থক্য কেন? প্রথম চারটির গুরুত্ব ل লাম অক্ষরটি লাগানো হয়েছে, যা মুলত تمليك বা মলিক বানানো’ অর্থে ব্যবহৃত হয়। আর শেষের চারটির পূর্বে فى বসানো হয়েছে যা পাত্র বা ক্ষেত্র বোঝায়। এরূপ বলার মূলে কি তাৎপর্য নিহিত আছে? কুরআন নিশ্চয়ই একটি অক্ষরের স্থলে অপর একটি অক্ষর ব্যবহার করে না। একাধিক ব্যাখ্যার মধ্যে পারস্পরিক পার্থক্য দেখতেও দ্বিধা করে না। বরং তার অলৌকিক কালামের সাহায্যে তাতে নিহিত যৌক্তিকতা সম্পর্কে অবহিত করে দেয়। কিন্তু এই পদ্ধতি কেবল বিদ্বজ্জনেরাই বুঝতে পারে। তাহলে সেই প্রশ্নই থেকে যায়- এখানে সেই যৌক্তিকতাটি কি? প্রখ্যাত কুরআন ব্যাখ্যাকারী যামাখশারী এ প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। বলেছেন, শেষের চারজন যাকাত প্রাপকদের ক্ষেত্রে ل এর পরিবর্তে فى ব্যবহার করা হয়েছে একথা বুঝিয়ে দেয়ার জন্যে যে, যাকাত পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রথম চারজনের তুলনায় শেষোক্ত চারজনের অধিকার অত্যধিক দৃঢ়। কেননা فى পাত্র বোঝায়। এ দিয়ে জানানো হয়েছে যে, তাদের ক্ষেত্রে যাকাত স্থাপন অধিকক প্রয়োজন, তারা অন্যদের তুলনায় বেশি অধিকারী-এদিকে দিয়ে যে, যাকাত তাদের মধ্যেই রাখা ও বণ্টন করা হবে, যেন তারাই তার ক্ষেত্র ও প্রাপক। [(আরবী*******************)] ইবনুল মুনীর তাঁর الانتصاف নামের গ্রন্থে যামাখশারীর উপরিউক্ত বক্তব্যের ওপর সমালোচনা করে অধিকতর সূক্ষ্ম ও গভীর তত্ত্ব উদঘাটিত করেছেন। বলেছেন, এখানে আরও একটি তত্ত্ব নিহিত রয়েছে। তা যেমন অধিক প্রকাশমান, তেমনি অধিকতর নিকটবর্তী। আর তা হচ্ছে, প্রথমোক্ত চার প্রকারের ব্যয়ক্ষেত্র প্রাপ্ত যাকাতের মালিক। তারা তা মলিকানার অধিকারে পেয়েও গ্রহণ করে থাকে। একথা বোঝাবার জন্যে শুরুতে ل অক্ষরটির ব্যবহারই যথাযথ। কিন্তু শেষোক্ত চারজন প্রাপ্ত যাকাতের মালিক হয় না- তাদের জন্য ব্যয় নাও হতে পারে। তবে তাদের সাথে সংশ্লিষ্ট কল্যাণমূলক কাজে তা ব্যয় হবে। যে মাল দাসত্বের বন্ধন থেকে মুক্তিদানের উদ্দেশ্য ব্যয়িত হবে, তা পাবে তার মালিক, তার বিক্রেতা বা চুক্তিকারী মালিক পক্ষ। ফলে তাদের ভাগের যাকাত অংশ তারা নিজেরাও নিজেদের হাতে পেল না। এই কারণে তাদের কথা বলতে গিয়ে ل অক্ষরটি ব্যবহৃত হয়নি। কেননা তা তাদের মালিক হওয়া বোঝায় সেই জিনিসের, যা তাদের জন্যে দেয়া হবে। এক্ষেত্রে এই শেষোক্ত চারজন হল যাকাত ব্যয়ের ক্ষেত্র, তাদের কল্যাণে তা ব্যয়িত হবে। তবে তার মালিক হবে না। ঋণগ্রস্ত লোকেরাও অনুরূপ। তাদের প্রাপ্য যাকাত দেয়া হবে তাদের নিকট যারা পাওনাদার, তাদেরকে, তাদের ঋণ শোধ করার জন্যে। তা ঠিক তাদেরকে দেয়া হবে না। আর আল্লাহর পথে- এ ব্যাপারটি তো এদিক দিয়ে খুবই স্পষ্ট। ইবনুল সাবীল- নিঃস্ব পথিক- যেন ঠিক আল্লাহর পথে নিয়োজিত। এই কথাটি এ বচনে বলা হয়েছে তার বিশেষ বিশেষত্বের কারণে। এর ওপর ل বা فى কোনটিই ব্যবহৃত হয়নি। বরং ل এর পরবর্তী শব্দ হিসেবে উল্লিখিত হয়েছে। কিন্তু তা অধিক নিকটবর্তী। [(আরবী******************)] এই গ্রন্থকারের বক্তব্য হচ্ছে, নিঃস্ব পথিকের জন্যে যা ব্যয় করা হবে, তাকে তার মালিক বানিয়ে দেয়া হবে না। তা তার কল্যাণে ব্যয়িত হবে মাত্র। তা দিয়ে তার বাড়িতে ফিরে যাওয়ার সফরের ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ব্যবস্থা করে দেয়া হবে। তা দিয়ে যানবাহনের ভাড়া দেয়া যাবে, যাতে চড়ে সে তার বাড়ি পর্যন্ত পৌছতে পারবে। যানবাহন নৌকা, বাস, রেল-গাড়ি বা উড়োজাহাজ, সামুদ্রিক জাহাজ- যাই ই হোক না কেন। ইমাম ফখরুদ্দিন আর-রাযীও এ ধরনের তত্ত্ব বিশ্লেষণ করেছেন। বলেছেনঃ আল্লাহ তাআলা যাকাতকে প্রথমোক্ত চার প্রকারের প্রাপকদের জন্যে নির্দিষ্ট করেছেন ل অক্ষর দিয়ে, যা মালিক বানিয়ে দেয়া বোঝায়। যেমন বলা হয়েছে। (আরবী**************) কিন্তু فى الرقاب দাসমুক্তির কথা বলতে গিয়ে ل এর পরিবর্তে فى বসিয়েছেন। এই পার্থক্যকরণে একটা সফলতা নিশ্চয়ই রয়েছে। আর সে সুফলতা হচ্ছে, প্রথমোক্ত চার প্রকারের প্রাপকদের হাতে তাদের প্রাপ্য অংশ দিয়ে দেয়া হবে। তারা যেভাবে ইচ্ছা তা ব্যয় এবং ব্যবহার করবে। কিন্তু দাসমুক্তির ক্ষেত্রে তাদের প্রাপ্য অংশ তাদের দাসত্ব শৃংখলা থেকে মুক্তকরণের কাজে ব্যয় করা হবে। তা তাদের হাতে তুলে দেয়া হবে না। তারা তা নিজেদের ইচ্চামত কাজে লাগাতে বা ব্যয়-ব্যবহার করতেও পারবে না। তাদের পক্ষ থেকে তা দিয়ে তাদের মুক্ত করা হবে। ঋণগ্রস্ত লোকদের পর্যায়ের এই কথা। তাদের ঋণ শোধের কাজে তা ব্যয় করা হবে। আর যোদ্ধাদের যুদ্ধ কাজে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সংগ্রহে তা ব্যয় করা হবে। পথিকের ব্যাপারটিও এমনি। সার কথা হচ্ছে, প্রথম চার প্রকারের প্রাপকদের প্রাপ্য তাদের হাতেই তুলে দেয়া হবে। তারা ইচ্ছামত তা ব্যয় ও ব্যবহার করতে পারবে। আর শেষোক্ত চারজনকে তাদের প্রাপ্য দেয়া হবে না, যে কারণে তারা যাকাত পাওয়ার যোগ্য প্রমাণিত হয়েছে, সে কারণটা দূর বা পূরণ করার কাজে তা ব্যয় করা হবে। [(আরবী***********)] তাফসীরে খাজেনেও এ কথাই বলা হয়েছে। [(আরবী**************)] যাকাত পাওয়ার আটটি খাত বর্ণনায় এই যে পার্থক্য করা হয়েছে, تفسير المنار এর লেখক তা দুই ভাগে দুটি পরিবৃত্তে বিভিক্ত করেছেন। [(আরবী**************)] শায়খ শালতুত তা সমর্থন করেছেন। [(আরবী**************)] বলেছেন, এরা হচ্ছে কতিপয় ব্যক্তি এবং কয়েকটি কল্যাণমূলক কাজ। কতিপয় ব্যক্তি হচ্ছে প্রথমোক্ত চারজন- ঋণগ্রস্ত লোক ও পথিকসহ। আর কল্যাণময় কাজের দুটো ক্ষেত্রঃ দাসমুক্তি ও নিঃস্ব পথিক। এই দুটো ক্ষেত্রের পূর্বস্থানে فى বসানো হয়েছে। ঋণগ্রস্ত লোক ও নিঃস্ব পথিক এই দুইজনকে অন্যান্য কল্যাণমূলক কাজের ক্ষেত্রে গণ্য করা হয়নি। বরং এই দুটোর বর্ণনা গুণবাচক যা প্রথম পর্যায়ের লোকদের রয়েছে, যাদের পূর্বে ل বসানো হয়েছে। এটা হয়েছে এজন্যে যে, ছয়টি ক্ষেত্রের মধ্যে গুণগত সাদৃশ্য রয়েছে। এরা বিশেষ গুণের দিক দিয়ে যাকাত পাওয়ার যোগ্য বিবেচিত হয়েছে। ফকীররাও দারিদ্র গুণে যাকাত পাওয়ার অধিকারী আর ঋণগ্রস্ত লোকেরা ঋণগ্রস্ততার গুণে। কথাটি এভাবেও বলা যায় যে, প্রতিটি প্রকারকে তার নিকটস্থ প্রতিবেশীর সঙ্গে যুক্ত করে বলা দুরবর্তীর সাতে যুক্ত করে বলার তুলনায় অনেক উত্তম। কুরআনের ভাষালংকারের দৃষ্টিতে অধিক উপযুক্ত বর্ণনাভংগী হচ্ছে, যে যে প্রকারের লোকদের যাকাত দিয়ে দেয়া হবে, সে সে প্রকারের লোকদের উল্লেখ এক সাথে পর পর করা বাঞ্ছনীয়। আর যে যে দিকে যাকাত বিতরণ বা ব্যয় করা হবে, সেগুলোর উল্লেখ পাশাপাশি হওয়া উচিত। জামাখশারী, ইবনুল মুনীর, রাযী প্রমুখ বিশেষজ্ঞ এরূপ ব্যাখ্যাই দিয়েছেন। ইমাম রাযী প্রথম চার প্রকার ও শেষের চার প্রকার যাকাত পাওয়ার লোকদের মধ্যে পার্থক্য বোঝাবার জন্য যা বলেছেন আল মুগনী প্রণেতা তা সমর্থন করেছেন। [(আরবী**************)] বলেছেন এভাবেঃ চার প্রকারের লোক যাকাত গ্রহণ করে স্থায়ীভাবে। দেয়ার পর তারা তা নিয়ে করে, তার প্রতি ভ্রূক্ষেপ করা হয়না। তারা হচ্ছে, ফকীর, মিসকীন, কর্মচারী ও মুয়াল্লাফাতু কুলুবুহুম। তারা যখনই যাকাত গ্রহণ করলো, তারা তখনই মালিক হয়ে বসল স্থায়ী ও চিরকালীন মালিক হিসেবে। ফিরিয়ে দেয়া কোন অবস্থায়ই তাদের কর্তব্য হবে না। আর অন্যান্য চারজন- ঋণগ্রস্ত লোক, দাসমুক্তি, পথিক ও আল্লাহর পথে- যাকাত গ্রহণ করে বিশেষ প্রয়োজন পূরণের জন্য। যদি যে কারণে তারা যাকাত পাওয়ার যোগ্য হয়েছে, সেই কাজে তা ব্যয় করে, তবে তারা তা যথার্থভাবেই গ্রহণ করল। নতুবা তা তাদের নিকট থেকে ফেরত নেয়া হবে। এই কয় প্রকার প্রাপক ও পূর্ববর্তী কয় প্রকারের প্রাপকের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। এই শেষোক্ত লোকেরা যাকাত গ্রহন করেছে এমন এক লক্ষ্যে যা যাকাত গ্রহণের সাথে সাথেই অর্জিত হয়ে যায়নি। অথচ প্রথম প্রকারের প্রাপকদের লক্ষ্য যাকাত গ্রহণ করাতেই অর্জিত হয়ে গেছে। আর তাহচ্ছে ফকীর মিসকীনদের স্বাচ্ছন্দ্য অর্জন, যাদের মন সন্তুষ্ট করার তাদের মন সন্তুষ্টকরণ, এবং যারা এজন্যে কাজ করেছে তাদের পারিশ্রমিক দান। কিন্তু শেষাক্ত চার ধরনের লোকদের প্রয়োজন পূরণ হওয়ার পর যাকাতের মাল তাদের নিকট উদ্ধত্ত হয়ে থাকলে ওসব ব্যয় হয়ে না গেলে যা অবশিষ্ট রয়েছে তা ফিরয়ে দিতে হবে। অবশ্য মুজাহিদকে তা দিতে হবেনা। তার নিকট কিছু উদ্ধৃত্ত থাকলে তা তারিই হয়ে যাবে। তাতে অবশ্য সে সব জিনিস গণ্য নয় যা যুদ্ধের পরও স্থায়ীভাবে থেকে যাবে। যেমন অস্ত্র-শস্ত্র, ঘোড়া ইত্যাদি। যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে এ পর্যায়ের উদ্ধৃত্ত জিনিসসমূহ বায়তুল মালে ফিরিয়ে দিতে হবে। আল মুগনী গ্রন্থকার ইবনে কুদামাহ দুই পর্যায়ের প্রাপকদের মধ্যে পার্থক্য প্রদর্শনস্বরূপ যা বলেছেন, তা যথার্থ, সহীহ। আর আসলে তাই সমর্থনযোগ্য। কেননা কুরআন মজীদই এই দুই পর্যায়ের লোকদের মধ্যে বর্ণনা ভঙ্গীর মাধ্যমে পার্থক্য সৃষ্টি করেছে। পরবর্তীকালে হাম্বলী আলিম (আরবী***********) গ্রন্থের ব্যাখ্যা লেখক এই বিষয়ে বিস্তারিতভাবে অবহিত করেছেন। [(আরবী**************)] ফির-রিকাব- এর তাৎপর্য الرقاب বহুবচনের শব্দ। একবচনে رقبة কুরআনের পরিভাষায় তার অর্থ দাস বা দাসী। তা বলা হয় তাকে মুক্ত করার প্রচেষ্টকালে। কুরআন মজীদ এই শব্দটি বলে পরোক্ষভাবে একথাই বোঝাতে চেয়েছে যে, মানুষের জন্যে দাসত্ব গলায় বাঁধা শৃংখলের মত অথবা বলদের ঘাড়ে বাঁধা জোয়ালের মত। আর দাসকে এই শৃংখল থেকে মুক্ত করা যেন গলায় বাঁধা রশি খুলে ফেলা। মানুষ যে জোয়ালের তলায় পড়ে, থাকে, তা থেকে তা সরিয়ে দুর করে দেয়া। যাকাত- ব্যয়ের ক্ষেত্র বলতে আল্লাহ বলেছেনঃ (আরবী**************) তার অর্থ, মানুষের গলা মুক্তকরণের কাজে যাকাত ব্যয় করা হবে। আর এই কথা দাস দাসীকে দাসত্বের শৃংখল থেকে মুক্তকরণ বোঝাবার জন্যে যথেষ্ট। এ কাজটি দুভাবে হতে পারেঃ ১. যে দাস বা দাসী মনিবের সাথে চুক্তি করেছে যে, সে তাকে এত টাকা দিয়ে দিলে সে তাকে মুক্ত করে দেবে, যাকাত দিয়ে তার এই চুক্তি পূরণে সাহায্য করা হবে। তাই এ টাকা দেয়া হলেই সে তার ঘাড়কে মুক্ত করে নিতে পারল, সে স্বাধীনতা পেল। আল্লাহ তাআলা মুসলিম জনগণকে তাদের দাস-দাসীদের মধ্যে যারাই এরূপে বিনিময় দানের শর্তে চুক্তি করতে ইচ্ছুক, তাদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। তারা নিজেদের জন্যে যা বাধ্যতামূলক বানিয়ে নিয়েছে তা পরিপূরণে পূর্ণাঙ্গ সাহায্য দান করতেও বলেছেন, যেন মালিক মনিবরা তাদের মুক্তিপথ সহজ করে দেয়, তাদের দেয় পরিমাণ হ্রাস করে। গোটা মুসলিম সমাজই যেন দাসত্ব শৃংখল থেকে মুক্তি লাভের এই চেষ্টায় তাদের সাথে পূর্ণ সহযোগিতা করে। এ পর্যায়ে আল্লাহর কথা হচ্ছেঃ (আরবী**************) তোমাদের মালিকানাভুক্ত যেসব ক্রিতদাস বা দাসী চুক্তিবদ্ধ হতে ইচ্ছা করে, তোমরা তাদের সাথে লিখিতভাবে চুক্তিবদ্ধ হও যদি তোমরা তাদের মধ্যে কল্যাণ জানতে পার......... এবং তাদেরকে আল্লাহর সেই মাল থেকে দাও যা তিনি তোমাদের দান করেছেন। (সূরা নূরঃ ৩৩) অতঃপর যাকাতের একটা অংশ তাদের জন্য নির্ধারিত করে দিয়েছেন। চুক্তি অনুযায়ী অর্থ দিয়ে দাসত্বমুক্তির এই চেষ্টায় তাদের সাহায্য করা হবে। এটাই নির্ধারণের লক্ষ্য। দাসত্ব মুক্তির এই পদ্ধতির পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন ইমাম আবূ হানীফা, শাফেয়ী এবং তাঁদের সঙ্গিগণ। লাইস ইবনে সায়াদও এ মত সমর্থন করেছেন। তাঁরা দলিল হিসেবে হযরত ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত হাদীস উল্লখ করেছেন। তিনি বলেছেন, আল্লাহ তাআলা وفى الرقاب বলে মুক্তির জন্য চুক্তিবদ্ধ ক্রীতদাস বা দাসী বুঝিয়েছেন। আর তা আরও দৃঢ় হয়েছে আল্লাহর কথা শেষাংশ (আরবী**************) দিয়ে। [(আরবী**************)] (এবং তাদের দাও আল্লাহর সেই মাল থেকে যা তিনি তোমাদের দিয়েছেন।) ২. ধনবান ব্যক্তি তার মালের যাকাত- সম্পদ দিয়ে একজন দাস বা দাসীকে ক্রয় করবে এবং পরে তাকে মুক্ত করে দেবে। অথবা আরও কয়েকজন একত্রিত হয়ে এই ক্রয় ও মুক্তি দানের কাজ করবে। রাষ্ট্রকর্তাও সংগৃহীত যাকাত সম্পদ দিয়ে দাস বা দাসী ক্রয় করে মুক্ত করে দেবে- এটাও সম্ভব। ইমাম মালিকের এই মতটি প্রখ্যাত। ইমাম আহমাদ ও ইসহাক এ মতই প্রকাশ করেছেন। ইবনুল আরাবী বলেছেনঃ বস্তুত এটাই যথার্থ ও সঠিক পদ্ধতি। তার সমর্থনে তিনি কুরআনের বাহ্যিক বাচন-ভঙ্গীকেই দলিল হিসেবে তুলে ধরেছেন। কেননা আল্লাহ তাঁর কিতাবে যে দাসত্বের উল্লেখ করেছেন, তার লক্ষ্য হচ্ছে মুক্তিদান। যদি চুক্তিবদ্ধ দাসদাসীর সাহায্যেই লক্ষ্য হত, তাহলে তিনি তাদের এই বিশেষ নাম সহকারেই উল্লেখ করতেন। তা না বলে যখন الرقبة বলেছেন, তখন বোঝা গেল, তিনি মুক্তিদানই বোঝাতে চেয়েছেন। আর তাৎপর্যগত কথা হচ্ছে, চুক্তিবদ্ধ লোকেরা আসলে ঋণগ্রস্ত লোকদের গোষ্ঠীর মধ্যে শামিল হয়ে গেছে। এখন তাদের ওপর এটা একটা ঋণ বিশেষ। কাজেই তারা فى الرقاب পর্যায়ে গণ্য হবে না। আর সাধারণভাবে চুক্তিবদ্ধ দাস দাসীও এর মধ্যে গণ্য ধরা হয় বটে। কিন্তু চূড়ান্ত পর্যায়ে তাদের মুক্তই করা হবে। [(আরবী**************)] আসলে সত্য কথা হচ্ছে, চুক্তিবদ্ধ দাস-দাসীর সাহায্যকরণ ও ক্রয় করে দাস মুক্তকরণ উভয় কাজই আয়াতটির অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ইবরাহীম নাখয়ী ও সায়ীদ ইবনে জুবাইর তাবেয়ী ফিকাহবিদ থেকে বর্ণিত, তাঁরা দুজনই যাকাতের টাকা দিয়ে দাস ক্রয় করে মুক্তকরণ অপসন্দ করতেন। কেননা তাতে যাকাতদাতার ব্যক্তিগত স্বর্থ জড়িত থাকে। তা হচ্ছে ইসলামের বিধান অনুযায়ী মুক্তকারীর নিকট দাসের এক ধরনের সম্পর্ক যুক্ত থাকা এবং মুক্তকারীর কোন উত্তরাধীকারী না থাকলে মুক্ত দাস مولى তার উত্তরাধিকারী হতে পারে- এই সুবিধা। এ দৃষ্টিতেই ইমাম মালিক থেকে বর্ণিত হয়েছে, যে লোক তার মালের যাকাত দিয়ে দাস মুক্ত করবে, তার মুক্তকরণ সম্পর্ক ও উত্তরাধিকার সমস্ত মুসলিম জনগনেল জন্যে হবে অর্থাৎ বায়তুলমালের সম্পদ হবে। [(আরবী**************)] কিন্তু আবূ উবাইদ ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণনা উদ্ধত করেছেন, কোন মুসলিম তার মালের যাকাত দিয়ে কোন দাসকে মুক্ত করবে তাতে তিনি কোন দোষ দেখতে পান নি। নখয়ীও ইবনে জুবাইরের মত উদ্ধৃত করার পর বলেছেনঃ এ পর্যায়ে আমাদের নিকট এ পর্যন্ত যত মতই পৌছেছে, তন্মধ্যে ইবনে আব্বাসের মতই সর্বোত্তম। তিনি খুব বেশি অনুসরণীয়, কুরআনের তাৎপর্য ব্যাখ্যা ও মর্মোদ্ধারের কাজেও তিনি অধিক পারদর্শী। হাসান বসরীও এ ব্যাপারে তাঁর সাথে ঐকমত্য প্রকাশ করেছেন। অধিক সংখ্যক বিশেষজ্ঞও এ মতেই রয়েছেন। [(আরবী**************)] তিনি আরও বলেছেন, এ মতটি আরও বলিষ্ঠতা পায় এ দিক দিয়ে যে, মুক্তকারীর যদি ভয় থাকে যে, তার মীরাস মুক্তকরণ সম্পর্কের দরুণ الوالاء মুক্ত দাসই পেয়ে যাবে, তাহলে তার এ-ও ভয় থাকতে পারে যে, সে এমন কোন ফৌজদারী অপরাধ করে বসবে যার রক্তমূল্য বা ক্ষতিপূরণ দেয়া তার বা তার গোত্রের লোকদের জন্যে কর্তব্য হয়ে পড়বে। আর তাহলে তারা দুজন পারস্পরিক সম্পর্কিত হয়ে গেল। [(আরবী**************)] এসব কথাই সে অবস্থায় প্রযোজ্য, যখন যাকাত বণ্টনের কাজ ব্যক্তিগতভাবে বা সম্পদ মালিকের প্রতিনিধির মাধ্যমে সম্পন্ন হবে। কিন্তু এ কাজ যদি মুসলিম শাসক বা ইসলামী সরকার কর্তৃক সম্পন্ন হয়- যাকাতের মৌল ব্যবস্থাপনাই তাই তাহলে আর এ সব মতপার্থক্যের কোন কারণ থাকবে না। অতএব এ ব্যক্তি তার মালের যাকাতে যতটা কুলাস দাস ক্রয় করে মুক্ত করতে পারে যাকাত ব্যয়ের অপরাপর ক্ষেত্রকে লংঘন করা ছাড়াই। (ইমাম শাফেয়ী অবশ্য যাকাত পাওয়ার যোগ্য আট প্রকারের লোকদের মধ্যে সমান পরিমাণে বণ্টন করা ওয়াজিব মনে করেন। তা হলে আট ভাগের এক ভাগে নেহায়েত কম পড়বে না।) উত্তম ব্যবস্থা হচ্ছে, রাষ্ট্রকর্তা দুটি ব্যাপারকে একত্রিত করবে। চুক্তিবদ্ধ দাসদের সাহায্য করবে এবং দাস-দাসী ক্রয় করেও মুক্ত করবে। ইমাম জুহরী খলীফা উমর ইবনে আবদুল আজীজকে তা-ই লিখেছিলেন। তাতে তিনি বলেছিলেন, দাস মুক্তকরণের অংশটি দুই ভাগে বিভক্ত হবে, অর্ধেক ব্যয়েত হবে মুসলিম চুক্তিকারী দাসদের সাহায্যার্থে। আর অপর অর্থেক দিয়ে ইসলাম গ্রহণকারী ও নামায-রোযা পালনকারী দাসদের ক্রয় করে মুক্ত করার কাজে। তা হলে এই উভয় প্রকারের দাস-দাসীই যাকাতের সাহায্যে মুক্তি লাভ করবে। [(আরবী**************)] কিন্তু কোন ইসলামী রাষ্ট্রকর্তা অর্ধেক বা অপর কোন হার মেনে চলতে বাধ্য এ কথা আমরা মনে করি না। সে যেভাবেই ভাল মনে করবে সেভাবেই তা করতে পারবে। অবশ্য পরামর্শদাতাদের নিকট থেকে উপদেশ গ্রহণ করতে ইসলামের পরামর্শ গ্রহণ নীতি অনুযায়ী। দাসপ্রথা বিলুপ্তকারণে ইসলামের অগ্রবর্তিতা এ কথা বলা যায়, ব্যক্তিদের দাসকরণের প্রথা দুনিয়া থেকে এখন বিলুপ্ত প্রায়। এই প্রেক্ষিতে একথা ঘোষণা করার আমাদের পূর্ণ অধিকার আছে যে, দাসপ্রথা বিলুপ্তকরণ এবং ক্রমশ তা নিঃশেষে উৎখাত করার জন্যে ইসলামই সর্বপ্রথম সর্বাত্মক, চেষ্টা চালিয়েছে ও সর্বপ্রকারের কার্যকর ব্যবস্থা অবলম্বণ করেছে। দুনিয়ায় দাস প্রথা চালু হওয়ার বহু পথ ও পন্থা ছিল। ইসলাম তন্মধ্যে কতগুলো প্রশস্ত দ্বার চিরদিনের তরে রুদ্ধ করে দিয়েছে। স্বাধীন মুক্ত মানুষকে হাইজ্যাক করে নিয়ে তাকে দাস বানানোকে কঠিন ও কঠোরভাবে হারাম ঘোষণা করেছে। মানুষ ছোট শিশু হোক, কি বড় ও পূর্ণ বয়স্ক। মানুষকে কোন অবস্থায়ই বিক্রয় করা জায়েয নয়। কেউ নিজেকে বা নিজের সন্তান বা স্ত্রীকে বিক্রয় করার অধিকার রাখে না। কোন ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিকে তার ঋণের বিনিময়ে- যদি সে ঋণ শোধ করতে অক্ষম হয়- দাস বানিয়ে রাখার কোন বিধান নেই। কোন অপরাধীকে তার অপরাধের শাস্তিস্বরূপও দাস বানানো যেতে পারে না। এই আদর্শ যেমন পূর্ববর্তী ধর্ম-বিধানসমূহের, প্রচীন অন্ধকার যুগের গোত্র বা জাতিসমূহের পক্ষেও বৈধ ছিল না অপর গোত্র বা জাতিকে দাস বানিয়ে রাখা শত্রুতা বা বিদ্রোহের প্রতিবিধানস্বরূপ। [(আরবী**************)] দাসপ্রথা প্রচলিত পওয়ার যেসব কারণের সাথে বিশ্বমানব পরিচিত তার কোন একটিও অবশিষ্ট ছিল না। কেবলমাত্র একটি পন্থা বা কারণই ছিল চূড়ান্তভাবে ও একান্তরূপে। এই পথে দাস বানানো জায়েয বরং ইচ্ছাদীন ছিল, আবশ্যিক বা বাধ্যতামূলক নয়। আর তা হচ্ছে, শরীয়াতসম্মত ইসলামী যুদ্ধে বন্দীদের দাস বানানো হত। এই পন্থাটিরও অবশ্য ইসলাম কর্তৃক সূচিত হয়নি সীমলংঘন করা দরুন। এটা ইসলামে সম্ভব হতে পারে যদি মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধান ততেই উম্মত ও মিল্লাতের সার্বিক কল্যাণ নিহিত বলে মনে করে ও পরামর্শের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তাও তখন যখন শত্রুপক্ষ মুসলিম বন্দীদের দাস বানিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত করে। এরূপ অবস্থায় সমতাপূর্ণ নীতি গ্রহণেই কল্যাণ নিহিত বলে মনে করতে হয়। তবে ইসলামী রাষ্ট্রের সুবিচারক প্রধান যদি কোনরূপ বিনিময় নিয়ে ছেড়ে দিতে ইচ্ছা করে তবে তাও করার অধিকার রয়েছে। সে বিনিময় কোন বস্তুগত জিনিস হতে পারে, হতে পারে কোন তাৎপর্যগত বা বস্তু ঊর্ধ্ব জিনিস। মুশরিক শত্রু পক্ষ মুসলিম বন্দীদের ছেড়ে দিলে তার বিনিময়ে কাফির বন্দীদের ছেড়ে দেয়া যায়। যুদ্ধরত কাফির বন্দীদের সম্পর্কে কুরআন মজীদে এ কথা স্পষ্ট ভাষায় বলে দেয়া হয়েছেঃ (আরবী**************) শেষ পর্যন্ত তোমরা তাদের চূর্ণবিচূর্ণ করে দেবে, তখন বন্দীদেরকে শক্ত করে বাঁধবে। অতপর তোমাদের ইচ্ছা অনুগ্রহ প্রদর্শনপূর্বক তাদের ছেড়ে দেবে কিংবা বিনিময়ের ভিত্তিতে কার্য সম্পাদন করবে। ইসলাম যেমন দাসপ্রথার একটা সংকীর্ণ দ্বার জায়েযরূপে উন্মুক্ত রেখেছে, তেমনি তাদের মুক্ত ও আযাদকরণের বহু কয়টি প্রশস্ত দ্বারও খুলে দিয়েছে। দাস মুক্তকরণের প্রথা উন্মুক্তকরণ তো কেবলমাত্র ইসলামেরই অবদান। কিন্তু দাস বানানোর কোন নতুন পথ ইসলাম খুলে দেয়নি। ইসলাম দাস মুক্তকরণের আহবান জানিয়েছে। সেজন্যে বিপুল উৎসাহ দান করেছে, তাকে আল্লাহ্র নৈকট্য লাভের সর্বোত্তম পন্থারূপে চিহ্নিত করেছে। উপরন্তু মুসলিমের ব্যক্তিগত বহু সংখ্যক মানবিক ভুলতুটি বা গুনাহের কাফ্ফারারূপে দাসমুক্তকরণকে নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। যেমন কিড়া-কসম করে তা ভঙ্গ করলে, স্ত্রীর প্রতি স্বামীর ‘জিহার’ হলে, রমযান মাসে দিনের বেলা স্ত্রী-সহবাসকরা হলে এবং ভুলবশত নরহত্যা করা হলে দাসমুক্তি দানই তার কাফ্ফারা। কোন মনিব যদি তার ক্রীতদাসকে অন্যায়ভাবে মারধোর করে, তাহলে তাকে মুক্ত করাই হয় তার এই অপরাধের কাফ্ফারা। তাছাড়া মনিবদের নির্দেশদেয়া হয়েছে, দাসদের মধ্যে কোন কল্যাণ দেখতে বা জানতে পারলে তাদের সাথে মুক্তির চুক্তি সম্পাদন করতে হবে। আর তা সম্ভব হয়, যদি তাকে মুক্তভাবে উপার্জন করর অবাধ সুযোগ দেয়া হয় এবং যদি ইসলামী সমাজ সমষ্টি তাদের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসে। কুরআনের সুদৃঢ় স্পষ্ট ঘোষণায় যেমন আল্লাহ্ তা’আলা ইরশাদ করেছেন: (আরবী**********) তোমাদের দক্ষিণ হস্ত যেসব কৃতদাসের মালিক হয়েছে, তাদের কেউ যদি তোমাদের সাথে মুক্তির চুক্তিতে আবদ্ধ হতে চায়, তা হলে তোমরা নে চুক্তি অবশ্য সম্পাদন করবে- যদি তোমরা তাদের মধ্যে কোন কল্যাণের কথা জানতে বুঝতে পার। আর তাদের আল্লাহ্র সেই মাল থেকে দাও যা তিনি তোমাদের দিয়েছেন। (সূরা নূর: ৩৩) এসব বলার অধিক অতিরিক্ত ব্যবস্থারূপ দাসমুক্ত ও আযাদকরণকে যাকাতের মালের একটা ব্যয়ক্ষেত্ররূপেও নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। যাকাত এমন একটা ‘কর’ বিশেষ যা বিপুল সংখ্যক মুসলিম জনতা দিয়ে থাকে। আর ইসলামী বায়তুলমালের জন্যে তা একটা স্থায়ী আয়-ব্যবস্থা। তাতেই রক্ষিত হয়েছে দাস মুক্তকরণের অংশ। [দাস-দাসীদের বস্তুগত ও সাংস্কৃতিক মর্যাদা বৃদ্ধি, উন্নতকরণ এবং তাদের সত্যিকার অর্থে সম্মানা্হ মানুষ বানাবার- বরঞ্চ মনিবের ভাই বানিয়ে দেয়ার জন্যে এ ছাড়াও আরও অনেক কার্যকর ব্যবস্থা করা হয়েছে। মালিক ও দাসের খাওয়া-পরার মান অভিন্ন রেখেছেন। সাধ্যের অতীত কোন কাজের জন্যে তাদের বাধ্য করা, তাদের মারধর করা, তাদের কষ্ট-পীড়ন দেয়া- ‘আমার দাস, আমার দাসী’ বলে তাদের মনে কষ্ট দেয়া সম্পূর্ণ রূপে হারাম ও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আলোচ্য মুক্তি পথ খুলে দেয়া এসবের বাইরের ব্যবস্থা।] এই বার্ষিক আবর্তনশীল আমদানী থেকে দাসমুক্তির জন্যে একটা অংশ স্থায়ীও চিরকালের তরে নির্দিষ্ট করে দিয়েছে ইসলাম। কিন্তু তা নিশ্চয়ই কোন সহজসাধ্য কাজ ছিল না। যাকাতলব্ধ জিনিসের মূল্য কখনও বিপুল হয়, কখনও সামান্য। অনেক সময় অবশ্য অন্যান্য খাতে ব্যয়ের প্রয়োজন না থাকার দরুন সমস্ত যাকাত সম্পদই এ খাতে ব্যয় হতে পারে। হযরত উমর ইবনে আবদুল আজীজের সময়ে ঠিক তাই হয়েছিল। ইয়াহ্ইয়া ইবনে সায়ীদ বলেছেন, উমর ইবনে আবদুল আজীজ আমাকে আফ্রিকায় যাকাত আদায়ের জন্য পাঠিয়েছিলেন। আমি সে যাকাত যথারীতি আদায় ও সংগ্রহ করার পর তা বন্টন করে দেয়ার জন্য ফকীর-মিসকীনদের সন্ধান করলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত একজন ফকীরও পেলাম না। এমন একজনকেও পেলাম না, যে যাকাত গ্রহণ করতে রাজী হতে পারে। আসলে উমর ইবনে আবদুল আজীজ জনগণকে বিপুলভাবে সচ্ছল ও অর্থশালী বানিয়ে দিয়েছিলেন। তখন আমি তা দিয়ে ক্রীতদাস ক্রয় করে তাদের মুক্ত করে দিয়েছিলাম। [(আরবী ************)] বস্তুত মুসলমানগণ যদি উত্তম ও পূর্ণাঙ্গ দ্বীন ইসলামকে বাস্তবায়িত করত এবং সৎপন্থী সুবিচারক প্রশাসক ব্যবস্থা কার্যকর করে রাখত দীর্ঘকাল পর্যন্ত, তাহলে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই দাস প্রথার উৎখাত হয়ে যেত, দুনিয়ার কোথাও তার অস্তিত্ব থাকত না। মুসলিম বন্দীকে দাসমুক্তির অংশ দিয়ে মুক্ত করা যাবে কুরআনের ব্যবহৃত শব্দ (*****) কেবলমাত্র ক্রীতদাসকেই বোঝায়। এক্ষণে প্রশ্ন হচ্ছে, এ শব্দটির সাধারণ প্রয়োগে মুসলিমবন্দীদেরকে শামিল করা ও তাদের মুক্তির জন্যে এই অংশের যাকাত ব্যয় করা যাবে কিনা.... যাদের ওপর কাফির শত্রুরা ঠিক সেভাবেই প্রভুত্ব করে যেমন করে মনিব-মালিক তার ক্রীতদাসের ওপর? আসলে এই মুসলিম বন্দীরা ঠিক ক্রীতদাসদের মর্মান্তিক অবস্থার মধ্যেই নিপতিত হয়ে থাকে। ইমাম আহমাদের মতের বর্ণনানুযায়ী তা করা সম্পূর্ণ জায়েয। মুসলিম বন্দীকে যাকাতের টাকা দিয়ে মুক্ত করা অবশ্যই শরীয়াতসম্মত কাজ হবে। কেননা তাতেও তো ‘ঘাড়’কে বন্দীদশা থেকে মুক্তই করা হয়। কাযী ইবনুল আরাবী মালিকী বলেছেন, যাকাতের টাকা দিয়ে বন্দী মুক্তকরণ পর্যায়ে আলিমগণের বিভিন্ন মত রয়েছে। আতবাগ বলেছেন, তা জায়েয হবে না। ইবনে হুবাইব বলেছেন, অবশ্যই জায়েয হবে। মুসলিমদাসকে যখন একজন মুসলমানের নিকট থেকেই যাকাতের অর্থ দিয়ে মুক্ত করা ইবাদতের পর্যায়ের কাজ এবং জায়েয, তখন মুসলিম বন্দীকে কাফিরের দাসত্ব শৃংখল ও লাঞ্ছনা থেকে মুক্ত করার কাজে যাকাতের অর্থ দিয়ে মুক্ত করা ইবাদতের পর্যায়ের কাজ এবং জায়েয, তখন মুসলিমবন্দীকে কাফিরের দাসত্ব শৃংখল ও লাঞ্ছনা থেকে মুক্ত করার কাজে যাকাতের অর্থ ব্যয় করা অধিক উত্তম কাজ বলে বিবেচিত হওয়া বাঞ্ছনী। [(আরবী ************)] দাসপ্রথা পরিত্যক্ত হয়েছে বটে কিন্তু যুদ্ধ বিগ্রহ তো চিরকালের জন্যেই লেগে আছে, সত্য ও মিথ্যার মধ্যকার দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষ কোন দিনই সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যাবে না এবং তাতে বহু মুসলমান কাফির শক্তির হাতে বন্দীও হতে পারে। কাজেই মুসলমান বন্দীকে যাকাতের এ অংশ থেকে বিনিময় মূল্য দিয়ে অবশ্যই মুক্ত করতে হবে উদার হস্তে ও প্রশেস্তভাবে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অধীন জাতিসমূহকে কি যাকাত দিয়ে সাহায্য করা যাবে সাইয়্যেদ রশীদ রিজা তাঁর তাফসীর ‘আল-মানার’-এ লিখেছেন, ‘ফির-রিকাব’ বলে যাকাতের যে ব্যয়-খাতটি নির্দিষ্ট করা হয়েছে, তাকে পরাধীন গোত্র ও জাতিসমূহকে মুক্তকরণের কাজে ব্যবহার করা যাবে- যখন ব্যক্তিদের মুক্তকরণে তা ব্যয় করা হবে না। [(আরবী ************)] প্রধান শিক্ষাবিদ শায়খ মাহ্মুদ শালতুত তাগিদ করে বলেছেন, ব্যক্তি দাসের মুক্তিকরণের সুযোগ যখন নিঃশেষ হয়ে গেছে- আমি যা মনে করি- এ ব্যয়ের ক্ষেত্রটি নতুনভাবে নির্ধারিত হয়েছে জাতি ও গোত্রসমূহকে সাম্রাজ্যবাদীদের অধীনতাপাশথেকে মুক্তির সংগ্রামে সাহায্যকরণ। কেননা এই অবস্থাটি মানবতার পক্ষে অধিকতর কঠিন, দুঃসহ ও বিপজ্জনক। এক্ষেত্রে মানুষদাস হয় চিন্তা-বিশ্বাস, ধন-মাল ও রাজনৈতিক কর্তৃত্বে। তাদের গোটা দেশের স্বাধীনতা বলতে কিছুই থাকে না। আগের কালে ব্যক্তিকেন্দ্রিক দাসত্বের প্রথা চালু ছিল। সে ব্যক্তির মৃত্যুতে দাসত্বেরও মৃত্যু ঘটত। যতটা দুনিয়ার অন্যান্য স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের থাকত। কিন্তু এখনকার দাসত্ব হচ্ছে গোটা জাতির। জাতির জন্মই হয় দাসত্বের অবস্থায় তাদের বাপ-দাদার মতই। এ দাসত্ব সাধারণ ও স্থায়ী। একটি অন্ধ জুলুমকারী শক্তি তাদের দাসত্ব শৃংখলে বন্দী করে নেয় ও রাখে। এই দাসত্বের মুকাবিলা-প্রতিরোধ এবং তা থেকে মুক্তিলাভের জন্যে চেষ্টা ও সংগ্রাম করা ও লাঞ্ছনা গঞ্জনা তাদের ওপর থেকে অপসারণ করার জন্যে যাকাতের এ অংশ ব্যয় করা অধিকতর বাঞ্ছনীয়। তা কেবল যাকাত সাদকার দ্বারাই নয়, সমস্ত ধন-মাল ও প্রাণ দিয়েই তা করতে হবে। এ থেকে আমরা এ-ও বুঝতে পারি, এ পর্যায়ের ইসলামী জাতিসমূহকে পরাধীনতার শৃংখল থেকে মুক্ত করার ব্যাপারে দুনিয়ার ধনী মুসলিমদের বিরাট দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। [(আরবী ************)] সাইয়্যেদ রশীদ রিজা ও মাহ্মুদ শালতুত এই যা কিছু বলেছেন, তা বলেছেন (****) শব্দের ব্যাপক তাৎপর্য স্বরূপ। তাতে ব্যক্তি ক্রীতদাসের পর্যায়ে এসে গেছে জাতি বা গোত্র ক্রীতদাস। মূল্যের দিক দিয়ে উভয়ের মধ্যে কোনই পার্থক্য নেই। তবে আমার কথা হচ্ছে, যে বাক্য বা শব্দের তাৎপর্যে এ ব্যাপকতা নেই, তাতে কৃত্রিমভাবে ব্যাপকতা নিয়ে আসার কোন প্রয়োজনই আমাদের নেই। আমরা তো সাম্রাজ্যবাদী শক্তির গোলামী থেকে মুক্তি লাভের সংগ্রামে আর্থিক সাহায্য দানের ব্যবস্থা যাকাতের বন্টন ক্ষেত্রেই দেখতে পাচ্ছি- তা হচ্ছে: (*****)-এর অংশ। যদিও রাষ্ট্রের অপরাপর আয়ও এ কাজে ব্যয় হতে পারে। বরং এজন্যে সমস্ত মুসলিম জনতা ও রাষ্ট্রের প্রধানগণ এগিয়ে আসা একান্তভাবেই কর্তব্য। পঞ্চম পরিচ্ছেদ ‘আল গারেমূন’ –ঋণগ্রস্ত লোকগণ কুরআনের আয়াত অনুযায়ী যাকাতের ষষঠ ব্যয়-ক্ষেত্র হচ্ছে, আল-গারেমূন-ঋণগ্রস্ত লোকগণ।কিন্তু ‘গারেমূন’ বলতে কোন্ সব লোক বোঝায়? ‘গারেমূন’ কারা ‘গারেমূন’ বহুবচন। একবচনে ‘গারেম’ (***) ঋনগড়্রস্ত ব্যক্তিকে ‘গারেম’ বলা হয়। [ইবনুল হুম্মাম উল্লেখ করেছেন, ‘গারেমূন’ হচ্ছে সেই লোক যার উপর ঋণ চেপেছে অথবালোকদের নিকট যার পাওনা রয়েছে, কিন্তু তা আদায় করতে পারছে না, তাকেও ‘গারেম’ বলার প্রচলন রয়েছে। এই লোকের নিসাব পরিমাণ সম্পদ নেই বলে তার ওপর যাকাত ফরয হয় না।কিন্তু এই কথাটিতে আপত্তি আছে। কেননা আভিধানিকভাবে ‘গারেম’ কেবল তাকেই বলা হয়, যার ওপর ঋণ চেপেছে। সম্ভবত ‘গারেম’ ও গারীম’-একই শব্দে দুটি তার বিভ্রান্তি ঘটেছে। কেননা ‘গরীম’ বলতে ঋণদাতা ও ঋণগ্রহীতা উভয়কেই বোঝায়। মানুষ তো, ভুলের ঊর্ধ্বে কেবলমাত্র আল্লাহ। তবে (****) গ্রন্থে এ রূপটি উল্লেখকরা হয়েছে,তা সেই ব্যক্তিকে বোঝায় যার পাওনা রয়েছে লোকদের নিকট.... তাকেও যাকাত দেয়া জায়েয। কেননা সে কার্যত ফকীর- নিঃস্ব পথিক। সে ঋণগ্রস্ত..... তাকেও যাকাত দেয়া জায়েয। কেননা সে কার্যত ফকীর- নিঃস্ব পথিক। সে ঋণগ্রস্ত বলে নয়। দেখুন: (আরবী ************)] তবে ‘গরীম’ বলা হয় ঋণ গ্রহীতাকে, যদিও ঋণদাতাকে বোঝারবার জন্যেও এই শব্দটির ব্যবহার হয়ে থাকে। আর (****) শব্দের আসল অর্থ অপরিহার্যতা, লেগে যাওয়া। জাহান্নাম সম্পর্কে আল্লাহ্র কথা: (আরবী ************) ‘নিশ্চয়ই জাহান্নামের আযাব অবশ্যম্ভবাবী“ এ থেকেই ‘গারেম’ নাম দেয়া হয়েছে। কেননা ঋণ তার উপর চেপে বসেছে, অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে (তা ফিরিয়ে দেয়া)। আর ‘গারীম’ বলা হয় এজন্যে যে, ঋণদাতারসাথে তার ঋণের অবিচ্ছিন্ন সম্পর্ক স্থাপিত হয়ে গেছে। ইমাম আবূ হানীফার মতে (***) ‘ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিৎ।’-যার ওপর ঋণ চেপেছে, ঋণ পরিমাণ সম্পদের অতিরিক্ত নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক নয়।[(আরবী ************)] (তাই সে যাকাত পেতে পারে।) ইমাম মালিক, শাফেয়ী ও আহমদের মতে, ‘গারেমূন’ দুই শ্রেণীর লোক। এক শ্রেণীর লোক তারা, যারা নিজেদের প্রয়োজন পূরণের জন্যে ঋণ গ্রহণ করেছে। আর দ্বিতীয় শ্রেণীর লোক হচ্ছে সমাজ সমষ্টির কল্যাণে ঋণ গ্রহণকারী। এই উভয় শ্রেণীর লোকদের জন্যে আলাদা-আলাদা আইন-বিধান রয়েছে। নিজের প্রয়োজনে ঋণ গ্রহণকারী লোক প্রথম শ্রেণীতে রয়েছে যেসব লোক যারা নিজেদের প্রয়োজন পূরণ ও কল্যাণ সাধনের জন্যে অর্থ ঋণ করে থাকে। ঘরের প্রয়োজন, কাপড়-চোপড় খরিদ, বিবাহ অনুষ্ঠান, কিংবা রোগের চিকিৎসা, ঘর-বাড়ি নির্মাণ, ঘরের প্রয়োজনীয় দ্রব্য-সামগ্রী বা সাজ-সরঞ্জাম ক্রয়, কিংবা সন্তানের বিবাহ দান প্রভৃতি কাজে অথবা ভুলবশত অপরের কোন জিনিসনষ্ট করে দেয়া ইত্যাদি কারণে ঋণ করেছে। তাফসীর লেখক ইমাম তাবারী আবূ জাফর কাতাদাহ প্রমুখথেকে বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন: ‘গারেম’-ঋণকারী অপচয়কারী নয়- রাষ্ট্রপ্রধানের উচিত তার এই ঋণটা বায়তুলমাল থেকে পরিশোধ করে দেয়া। [(আরবী ************)] আকস্মিক বিপদগ্রস্তরা এই পর্যায়ে গণ্য এ গুণটির বাস্তবতা লক্ষ্য করা যায় যেসব লোকের মধ্যে যারা আকস্মিকভাবে জীবনের কঠিনতম বিপদে নিপতিত হয়েছে। তারা এমন সব আঘাত পেয়ে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেছে যে, তাদের ধন-মালেসবই নিঃশেষে শোষিত হয়েছে। তখন তারা প্রয়োজনবশতই নিজেদের পরিবারবর্গের জন্যে ঋণ গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে। মুজাহিদ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, তিনজন লোক ‘ঋণগ্রস্ত’ ‘গারেম’রূপে গণ্য: একজন, যার ধন-মাল ফসল-ফল বন্যায় ভেসে গেছে। দ্বিতীয জন যার সব কিছু জ্বলে পুড়ে ভস্ম হয়ে গেছে আর তৃতীয, যার বহু সন্তান ও পরিজন কিন্তু তার ধন-মাল বলতে কিছুই নেই। সে ঋণ নিয়ে পরেবারবর্গের জন্যে ব্যয় করতে বাধ্য হয়। [(আরবী ************)] কুবাইচাতা ইবনুল মাখারিকের-আহমাদ ও মুসলিম উদ্ধৃত হাদীস-এ বলা হয়েছে, যে লোক বিপদগ্রস্ত হয়ে সব ধন-মাল খুইয়েছে, রাষ্ট্র-সরকারের নিকট যাকাত ফাণ্ড থেকে তার হক্ পাওয়ার জন্যে দাবি করা সম্পূর্ণ জায়েয ও মুবাহ, যেন সে জীবনযাত্রা নির্বাহের প্রয়োজন পরিমাণ লাভ করতে পারে। (‘গারেমীন’ সম্পর্কিত দ্বিতীয পর্যায়ের আলোচনায় আমরা এ প্রসঙ্গ সম্পূর্ণভাবে উল্লেখ করব।) এভাবে যাতে বিপদ মুকাবিলার লক্ষ্যে সামষ্টিক নিরাপত্তা দানের (Social Security) দায়িত্ব পালন করে। আকস্মিকভাবে বিপদে পড়া লোকেরা নিজেদের জীবন-জীবিকার নিরাপত্তা লাভ করতে পারে যাকাত ব্যবস্থার দরুন। বিশ্ব-সমাজ এর পূর্বে এ ধরনের সামাজিক নিরাপত্তার সাথে কিছুমাত্র পরিচিত ছিল না। জীবনবীমা ব্যবস্থার প্রচলন নিতান্তই এ কালের ব্যাপার। তবে ইসলাম যাকাত ব্যবস্থার মাধ্যমে তার লোকদের জন্যে যে নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে, তা অধিকতর উন্নত, পূর্ণাঙ্গ ও কার্যকর-জীবন বীমার তুলনায়। পাশ্চাত্য জগত আধুনিককালে পর্যায়ক্রমে এই বীমার ব্যবস্থা খাড়া করেছে বটে, কিন্তু পাশ্চাত্য পদ্ধতিতে তা থেকে উপকৃত হতে পারে কেবলমাত্র সেসব লোক, যারা কার্যত তার পলিসি ক্রয় করে নির্দিষ্ট পরিমাণে বীমা কোম্পানীর কিস্তি আদায় করতে সমর্থ হয়। আর বিনিময় দেয়ার সময় বিপদগ্রস্ত ব্যক্তিকে ঠিক ততটা পরিমাণই দেবে, যার সে বীমা করেছে। কিন্তু যে পরিমাণ ক্ষতি সাধিত হয়েছে বা যা তার প্রয়োজন, সে পরিমাণ অর্থ তাকে কখনও দেবে না। ফলে যে লোক বিরাট পরিমাণ টাকার বীমা ক্রয় করেছে, বড় বড় কিস্তি দিয়েছে, সে বড় পরিমাণ বিনিময় লাভ করবে। পক্ষান্তরে যে লোক সামান্য পরিমাণের পলিসি করেছে, সে সেই দৃষ্টিতে সামান্যই পরিমাণই পাবে- তার বিপদটা যত বড় প্রয়োজন যত বেশিই হোক না কেন। আর কম আয়ের লোকেরা যে খুব সামান্য পরিমাণেরই বীমা পলিসি করতে পারে, তা তো জানা কথাই। এরূপ অবস্থায় তার বিপদ যত বড়ই হোক, প্রাপ্য হবে খুবই কিঞ্চিৎ। তার কারণ হচ্ছে, পাশ্চাত্য বীমা ব্যবস্থার ভিত্তি হচ্ছে ব্যবসায়িক এবং বীমাকারী লোকদের দেয়া টাকার মধ্য দিয়ে মালিক পক্ষের বিপুল পরিমাণে মুনাফা কামাই করে নেয়ার নীতির ওপর সংস্থাপিত। কিন্তু ইসলামী সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা পূর্বে প্রদত্ত কিস্তির শর্তের ওপর স্থাপিত নয়। বিপদগ্রস্ত ব্যক্তিকে সেখানে দেয়া হবে তার প্রয়োজন পরিমাণ, ক্ষতির পরিমাণ অনুপাতে, যেন তার অসুবিধাটা দূর হয়ে যায়। ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ঋণ গ্রহণকারীকে সাহায্য দেয়ার শর্ত এই প্রকারের ঋণগ্রস্তকে ঋণ-শোধ পরিমাণে দেয়া হবে। তবে সে-জন্যে নিম্নোক্ত শর্তসমূহ অবশ্যই রক্ষা করতে হবে: প্রথম শর্ত: তার প্রয়োজটা হবে ঋণ শোধ করার। সে যদি ধনী হয় নগদ টাকা বা তার নিজের জিনিসপত্র দিয়ে তা শোধ করতে সমর্থ হয়, তাহলে তাকে যাকাত থেকে দেয়া যাবে না। [ইমাম শাফেয়ীর কথা হচ্ছে, তার স্বাচ্ছন্দ্য থাকা সত্ত্বেও তাকে দেয়া যাবে। কেননা সে ঋণগ্রস্ত সে নিজস্ব প্রয়োজনে ঋণ গ্রহণকারী। দেখুন (আরবী ************)] তার নিকট যদি ঋণের কিছু অংশ শোধ করার মত অর্থ থাকে, তাহলে অবশিষ্ট পরিমাণ শোধ করার জন্যে যাকাত দেয়া যাবে। আর যদি তার কোন জিনিসই না থেকে থাকে, সে ম্রম করে উপার্জন করে ঋণ শোধ করতে সক্ষমহয় তাহলেও তাকে যাকাত দেয়া যাবে। কেননা সে যদি তা কামাই-রোজগার করে শোধ করতে পারেও, তবু তা সে পারবে দীর্ঘদিন পর। এই সময়ের মধ্যে উণ শোধের প্রতিবন্ধকও কিছু ঘটতে পারে। কিন্তু ফকীরের অবস্থা ভিন্নতর। সে তো বর্তমানেই উপার্জন করে তার প্রয়োজন পূরণ সমর্থ তবুও তাকে যাকাত দেয়া যাবে। ঋণগ্রস্তের ঋণ-শোধ পরিমাণ প্রয়োজনের শর্ত করা অর্থ এই নয় যে, তাকে একেবারে শূন্য হাত-কিছুরই মালিক নয়, এমন হতে হবে। বিশেষজ্ঞগণ স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, দারিদ্র্য বিচারে বসবসস্থল- ঘর-বাড়ি, কাপড়-চোপড়, বিছানা, তৈজসপত্র ইত্যাদি গণ্র করা হবে না। এমন কি, অবস্থার দৃষ্টিতে প্রয়োজনীয় খাদেম ও যানবাহন থাকলেও তা গণ্য করা যাবে না। এসবের মালিক হলেও ঋণগ্রস্তের ঋণ শোধ করা যাবে যাকাতের টাকা দিয়ে। ঋণগ্রস্তের যদি এতটা পরিমাণ মাল-সম্পদ থাকে, যা দিয়ে ঋণ শোধ করা হলে সে মাল-সম্পদ তার জীবিকা নির্বাহের জন্যে যথেষ্ট হবে না, তাহলে তার জন্যে যথেষ্ট হয় এমন পরিমাণ মাল রেখে দিতে হবে, অবশিষ্ট পরিমাণ ঋণ শোধ করার জন্যে যাকাত থেকে দেয়া হবে। ‘যথেষ্ট পরিমাণ’ বলতে- শাফেয়ী আলিমদের মতে- পূর্বে বিশ্লেষণ করা ‘যথেষ্ট পরিমাণ’ বোঝানো হয়েছে। তা হচ্ছে, বাহ্যত যতদূর বোঝা যায়, বেশির ভাগ জীবনের জন্যে যথেষ্টভাবে প্রয়েঅজন-পূরণকারী পরিমাণ। অতঃপর কোন জিনিস অতিরিক্ত হলে তা তার ঋণ শোধে ব্যয় করা হবে। যা অপূরণ থাকবে, তা যাকাত ফাণ্ড থেকে দিতে হবে। দ্বিতীয় শর্ত: লোকটি ঋণ গ্রহণ করেছে আল্লাহ্র বন্দেগী পালন বা কোন মুবাহ পর্যায়ের কাজ সম্পন্ন করার জন্যে-এরূপ হতে হবে। যদি কোন নাফরমানীর কাজ করার জন্যে ঋণ করে থাকে- মদ্যাপান, ব্যভিচার, জুয়া বা হাস্য-কৌতুক, চিত্ত-বিনোদন প্রভৃতি বিচিত্র ধরনের কোন হারাম কাজ করার জন্যে ঋণ গ্রহণ করে থাকে, তাহলে তাকে যাকাত দেয়া যাবে না। অনুরূপভাবে নিজের ও পরিবারবর্গের জন্যে অপব্যয়-অপচয়ের জন্যে ঋণ করে থাকলেও দেয়া যাবে না- তা মুবাহ পর্যায়ের কাজ হলেও। কেননা মুবাহ কাজের জন্যে ঋণ হওয়ার পরিমাণ ব্যয় করা মুসলিম ব্যক্তিমাত্রের জন্যেই হারাম। আল্লাহ্ তা’আলা ইরশাদ করেছেন: (আরবী ************) হে আদম সন্তান! তোমরা প্রত্যেক নামাযের সমুদয় সুন্দর পরিচ্ছদ পরিধান কর এবং তোমরা খাও, পান কর; কিন্তু অপচয় করো না। কেননা আল্লাহ্ অপচয়কারীদের পসন্দ করেন না। (সূরা আ’রাফ: ৩১) ঋণ করে মুবাহ কাজ করা ইসরাফ বা বেহুদা খরচ পর্যায়ে গণ্য। আয়াতে তাই নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে। পাপ কাজে ব্যয় করার জন্যে ঋণ গ্রহণকারীদের যাকাত দেয়া যাবে না এ কারণে যে, তা দিলে আল্লাহ্র নাফরমানীর কাজে তাকে সাহায্য ও সহায়তা করা হবে। তার এই পাপ কাজে তার অনুসরণ করতে অন্যদেরকেও উৎসাহিত করা হবে। তবে সে যদি তওবা করে, তাহলে সে যাকাত থেকে ঋণ শোধ করতে পারে। তওবা করলেই সে তা পাবে। কেননা তওবা অতীতের পাপ ধুয়ে মুছে ফেলে। পাপের কাজ থেকে তওবাকারী পাপমুক্ত ব্যক্তির মতই। কোন কোন ফিকাহ্বিদ অবশ্য শর্ত করেছেন, পাপ কাজ থেকে তওবা করার ও তা প্রকাশ করার পর এমন একটা সময় অতিবাহিত হওয়া উচিত, যার মধ্যে তার অবস্থা সংশোধন হওয়ার ও তওবার ওপর স্থির থাকার কথা নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হবে। অন্যরা বলেছেন, তার তওবা সত্যতা ও যথার্থতার ওপর একটা সাধারণ বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপন করা গেলেই যাকাত দেযা যাবে, মেয়াদ তার যত স্বল্পই হোক-না-কেন। তৃতীয় শর্ত: ঋণটা সাম্প্রতিক হতে হবে। ঋণ যদি বিলম্বিত হয়, দীর্ঘমেয়াদী হয়, তাহলে তা শোধের জন্যে যাকাত দেয়া যাবে কিনা, এ বিষয়ে মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেছেন, দেয়া যাবে। কেননা সে তো ‘গারেম’ ঋণগ্রস্ত। কুরআনের সাধারণ ঘোষণার অর্তর্ভুক্ত। আবার কেউ কেউ বলেছেন, দেয়া যাবে না। কেননাসে এক্ষণে তার জন্যে ঠেকা নয়। আবার অন্যরা বলেছেন, যদি সেই মেয়াদটা সেই বছরই শুরু হয়, তাহলে তাকে যাকাত দেয়া যাবে, অন্যথায় সেই বছরের যাকাত থেকে তাকে দেয়া যাবে না। [এসব শর্তের উল্লেখ হয়েছে: (আরবী ************)] এই গ্রন্থকারের মতে গ্রহণীয় কথা হচ্ছে, উপরিউক্ত কোন একটি মত অনুযায়ী কাজ করার পূর্বে যাকাতলব্ধ সম্পদের পরিমাণ ও সর্বশ্রেণীর প্রাপকদের সংখ্যা ও তাদের প্রয়োজনের পরিমাণ দেখা আবশ্যক। যদি লব্ধ সম্পদের পরিমাণ বিরাট ও তাদের প্রয়োজনের পরিমাণ দেখা আবশ্যক। যদি লব্ধ সম্পদের পরিমাণ বিরাট হয় এবং পাওয়ার যোগ্য লোকদের সংখ্যা আনুপাতিক হারে কম হয়, তাহলে প্রথমোক্ত মতটি গ্রহণ ও অনুসরণ করতে হবে এবং যাকাত দেয়া তাকে দেয়া যাবে- তার ঋণ সাময়িক দেয় হোক কি দীর্ঘ মেয়াদী। যদি ব্যাপারটি এর বিপরীত হয়, তাহলে দ্বিতীয মত অনুযায়ী কাজ করতে হবে। তখন দীর্ঘমেয়াদী ঋণ গ্রহীতার ওপর অন্যান্য শ্রেণীর প্রাপকদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। আর যদি ব্যাপার মধ্যম ধরনের হয়, তাহলে তৃতীয় মতটি গ্রহণীয় হবে (প্রকৃত কথা আল্লাহ্ই ভালো জানেন)। যাকাতদাতা যদি ব্যক্তিগতভাবেই যাকাত বন্টন করে, তাহলে সে তার বিবেচনায় অধিক প্রয়োজনশীল অভাবগ্রস্ত ব্যক্তিকে কম প্রয়োজনশীলের ওপর অগ্রাধিকার দেবে। চতুর্থ শর্ত: ঋণটা এমন হতে হবে যেজন্যে ঋণ গ্রহীতাকে কয়েদ করা যেতে পারে। সন্তানের ঋণও তার পিতার ওপর বর্তাতে পারে। কম আয়ের লোকের ঋণও হতে পারে। তবে কাফ্ফাপরা ও যকাত দেয়ার দরুন গৃহীত ঋণ এর অন্তর্ভুক্ত হবে না। কেননা যে ঋণের দরুন ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিকে কয়েদ করা যেতে পারে, তা হচ্ছে মানুষের নিকট থেকে গ্রহণ করা ঋণ। আর কাফ্ফাপরা ও যাকাত পর্যায়ের কাজগুলো হচ্ছে আল্লাহ্র জন্য। [দেখুন: (আরবী ************)] এই যা বলা হল, তা মালিকী মাযহাবের মত। সব ফিকাহ্বিদই এই শর্তগুলো আরোপ করেন নি। হানাফী ফিকাহ্বিদগণ যাকাতকে সেসব ঋণের মধ্যে গণ্য করেন, যার দাবি জনগণের পক্ষথেকে করা হয় অর্থাৎ রাষ্ট্রপ্রধান করে। ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ঋণ গ্রহীতাকে কত দেয়া হবে ব্যক্তিগত প্রয়োজনে যে লোক ঋণ গ্রহণ করেছে, তার প্রয়োজন পরিমাণ দিতে হবে। আর এখনকার প্রয়োজন হচ্ছে তার ঋণ শোধ করা। তাকে যদি সামান্য পরিমাণ দেয়া হয়, তাহলে সে ঋণ শোধ করা সম্ভব হবে না তার দ্বারা। বরং তখন ঋণদাতা তাকে হয় ক্ষমা করেদেবে, কিংবা তার পক্ষথেকে অন্যরা তা দিয়ে দেবে কিংবাসে যাকাত চাড়া অন্য মাল দ্বারা শোধ করবে, যথার্থ কাজ হবে তার নিকট থেকে তা ফিরিয়ে নেয়া হলে। কেননা তার সে পরিমাণের প্রয়োজন নেই। [(আরবী ************)] ঋণের পরিমাণ কম হোক কি বেশি, তা শোধ করাই কাম্য এবং তাকে এই দায়িত্বের ঝুঁকি থেকে নিষ্কৃতি দানই আসল লক্ষ্য। ঋণগ্রস্তদের প্রতি ইসলামের ভীতি প্রদর্শন ঋণগ্রস্ত ও ঋণগ্রহণকারী লোকদের ব্যাপারে সাধারণভাবে দ্বীন ইসলামের ভূমিকা ভীতিপূর্ণ ও অনন্য। ক. ইসলাম প্রথম মুসরিম জনগণকে জীবনের সর্বক্ষেত্রে মধ্যম ও ভারসাম্যপূর্ণ ইনসাফভিত্তিক নীতি গ্রহণের শিক্ষা দেয়, যেন কোন কারণেই তারা ঋণ গ্রহণের মুখাপেক্ষী হয়ে না পড়ে। খ. মুসলিম ব্যক্তি যদি জীবন-জীবিকার জন্যে ঋণ গ্রহণ করতে বাধ্য হয়, তবে তার কর্তব্য হচ্ছে, যত শিগ্গির সম্ভব সে ঋণ ফেরত দেয়ার দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করা। তাহলে সে তার ঋণশোধের ব্যাপারে আল্ল্হ্র সাহায্য পাবে, সহযোগিতা পাবে- তার নিয়ত অনুযায়ী। ‘যে লোক জনগণের মাল-সম্পদ নেবে তা ফিরিয়ে দেয়ার নিয়ত সহকারে, আল্লাহ্ই তা তার পক্ষথেকে আদায় করে দেবেন (আদায়ের সাহায্য করবেন)। আর যে লোক তা নেবে তা ধ্বংস বা নষ্ট করার নিয়বে, আল্লাহ্ তাকে ধ্বংস করবেন। [বুখারী, আহমাদ, ইবনে মাজাহ, আবূ হুরায়রা বর্ণিত (কাঞ্জুল, ৬ষ্ঠ খণড-১১৪পৃ.)। গ. ঋণ আদায়ের দৃঢ় সংকল্প ও চেষ্টা-প্রচেষ্টা থাকা সত্ত্বেও যদি কেউ তার সব বা আংশিক ঋণ আদায়ে অক্ষম থেকে যা্য়, তাহলে রাষ্ট্র তাকে পিঠ চূর্ণকারী ও মানুষের মক্তক অবনতকারী এই ঋণের বোঝা থেকে মুক্ত করার জন্যে এগিয়ে আসবে। এজন্যেই বলা হয়েছে। (আরবী ************) ঋণ রাত্রিকালের দুশ্চিন্তা এবং দিনের আলোয় অপমানকারী। নবীকরীম (স) সব সময়ই এ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে মহান আল্লাহ্র নিকট পানা চাইতেন। বলতেন: (আরবী ************) হে আমাদের আল্লাহ! আমি তোমার নিকট পানা চাই ঋণের প্রচণ্ডতা, শত্রুর দাপট ও শত্রুদের তিরস্কার থেকে। [হাফেয-মুহাদ্দিস ‘মুলুগুল মারাম’ গ্রন্থে বলেছেন (৩১৩ পৃ.) হাদীসটি নাসায়ী আবদুল্লাহ ইবনে উমর থেকে রাসূল (স)-এর কথা হিসেবে বর্ণনা করেছেন। হাকেম এটিকে সহীহ বলেছেন।] ঋণ কেবলমাত্র ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির মনস্তত্ত্ব ও মনের প্রশান্তির ওপর কঠিন বিপদ নিয়ে আসে তাই নয়, তার চরিত্র ও নৈতিকতার ওপর তা বড় আঘাতও বটে। তাঁর আচার-আচরণকেও প্রভাবিত করে সাংঘাতিকভাবে। বুখারী বর্ণিত একটি হাদীস এই বিষয়ে আমাদের সাবধান করেছে। নবী করীম(স) আল্লাহ্র নিকট খুব বেশি- বেশি পানা চাইতেন ঋণগ্রস্ততা থেকে। সাহাবিগণ এর গভীর নিহিত কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন, তিনি কোন্ কারণে তা থেকে এত বেশি বেশি পানাহ চাইছেন? ঋণ থেকে পানা চাওয়ার সাথে সাথে কবর আযাব থেকেও পানা চাইতেন, খুব দীর্ঘজীবন ও মরণের ফেত্না, মসীহ দাজ্জালের ঈমান নষ্টকপারী বিপদ থেকেও রক্ষা পেতে চাচ্ছেন কেন? তাদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বললেন: ‘ব্যক্তি যখন ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে তখন সে কথা বললে মিথ্যা বলে, ওয়াদা করলে তার খেলাফ করে।’ –(এটাই সাধারণ নিয়ম) বুখারী (আরবী ************) এটা নবীকরীম(স) –এর প্রসঙ্গক্রমে বলা একটি অতীব সত্য কথা। এ থেকে মানুষের নৈতিকতা ও আচার-আচরণের ওপর অর্থনৈতিক অবস্থার ব্যাপক প্রভাবের কথা অকাট্যভাবে জানতে পারে যায় এবং এ কথাটি সত্যই অনস্বীকার্য। তবে মানব চরিত্রের ওপর কেবল অর্থনীতিই একক প্রভাবশালী শক্তি বলে যারা মনে করে, তাদের এই মতকে আমরা সম্পূর্ণ অসত্য বলে বিশ্বাস করি। নবী করীম (স) সাহাবায়ে কিরামের মনে ঋণ গ্রহণের প্রতি ঘৃণার উদ্রেক করার উদ্দেশ্যে অনেক কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। তন্মধ্যে একটি হচ্ছে, তার সাহাবীদের মধ্যে কেউ ঋণগ্রস্ত হয়ে মরলে ও তা আদা করার ব্যবস্থা রেখে না গিয়ে থাকলে তার জানাযা নামাযই তিনি পড়তেন না। আর এটা ছিল ঋণগ্রস্ততা থেকে সাহাবীদেরকে বিরত রাখার জন্যে তার প্রচণ্ড একটা ধাক্কা। কেননা তাঁদের প্রত্যেকেই চূড়ান্তভাবে বাসনা পোষণ করতেন মৃত্যুর পর নবীকরীম (স)-ই যেন তাঁর জানাযা নামায পড়ান, যেন তিনি তার জন্যে দো’আ করেন। আর তা না হলে কঠিন আযাবে নিক্ষিপ্ত হওয়ার ভয় তাদেরকে কাতর করে ফেলত। তাঁরা মনে করতেন, এটা একটা অপূরণীয় ভয়াবহ ক্ষতি বিশেষ। উত্তরকালে আল্লাহ তা’আলা যখন তাকে বিপুল বিজয় ও ধন-দৌলত দিলেন, বায়তুলমালের আয় যখন ব্যাপপকভাবে বৃদ্ধি পেয়ে গেল, তখন তিনি নিজেই মুসলমানদের ঋণ শোধের দায়িত্ব গ্রহণ করতেন। হযরত আবূ হুরায়রা (রা) এই পর্যায়ে বর্ণনা করেছেন, নবী করীম (স)-এর সম্মুকে যখন কোন লাশ নিয়ে আসা হত জানাযা নামাযের জন্যে, যার ওপর ঋণ চেপে আছে, তখন তিনি জিজ্ঞাসাপ করতেন, ঋণ শোধ করার মত সম্পদ রেখে গেছে কিনা? যদি বলা হত যে, ঋণ শোধের ব্যবস্থা করে গেছে, তাহলে তিনি তার নামায পড়তেন। অন্যথায় তিনি বলতেন, ‘তোমরাই তোমাদের সঙ্গীর জানাযা নামায পড়।’ অতঃপর যখন তাকে ব্যাপক বিজয় দান করলেন আল্লাহ তা’আলা, তখন তিনি বললেন: (আরবী ************) মুমিনদের জন্যে তাদের নিজেদের তুলনায়ও অধিক উত্তম। যে লোক ঋণের বোঝা নিয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হবে, তা শোধ করার দায়িত্ব আমার ওপর বর্তাবে। ঋণগ্রস্ত লোকদের সাহায্যে এগিয়ে আসার জন্যে এই হাদীসে বিপুলভাবে উৎসাহ দান করা হয়েছে। এতেই ভ্রাতৃত্বের অধিকার আদায়ের ব্যবস্থা নিহিত। পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতার এটাই বাস্তব পন্থা। আর আল্লাহ্র সন্তুষ্টি ও অনুগ্রহ লাভের এ একটা মহৎ উপায়। হযরত আবূ সায়ীদ খুদরী (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূলে করীম (স)-এর যুগে এক ব্যক্তি ফলের ব্যবসায়ে বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়ে। সে তা বিক্রয় করে দেয়; কিন্তু তার ঋণের পরিমাণ বিপুল হয়ে দাঁড়ায়। ফলে সে হয়ে যায় নিতান্ত গরীব। তখন রাসূলে করীম (স) বললেন: তোমরা সকলে লোকটিকে সাহায্য কর। লোকেরা তার প্রতি দান-সাহায্য করল। কিন্তু তাতে তার ঋণ শোধ হওয়ার পরিমাণ সম্পদ পাওয়া গেল না। তখন নবী করীম (স) পাওনাদারদের বললেন: ‘যা পাও নিয়ে নাও। তোমরা এ ছাড়া আর কিছু পেতে পার না।’ [(আরবী ************)] লোকদের যাকাতরে মালে ‘গারেমূন’ –এর জন্যে যে অংশটি কুরআন মজীদে নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে, তা পাওনাদারদের ঋণের এই বোঝা খতম করার উদ্দেশ্যেই আল্লাহ্র নির্ধারণ বিশেষ। ইসলামে আইন প্রণয়নের মৌল ভাবধাদরা ও পদ্ধতি এটাই। ইসলাম ঋণগ্রস্তদের গলদেশ ঋণের শৃংখল থেকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে- তলিয়ে যাওয়ার গভীর গহ্বরের মুখ থেকে তাকে উদ্ধার করার লক্ষ্যে এই বাস্তব ব্যবস্থা বিধিবদ্ধ করে দিয়েছে। ঋণের কারণে কাউকে নির্যাতিত ও নিঃস্ব হয়ে যেতে এবং দরিদ্র্যের চরম প্রকাশ ঘটাতে ইসলাম নারাজ। ইসলাম ভিন্ন দুনিয়ার অপর কোন সমাজ-বিধান ঋণগ্রস্ত নাগরিকদের ঋণের বোঝার কঠিন দুঃখের চাপ থেকে মুক্তকরণের লক্ষ্যে এরূপ কোন বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে বলে জানা যায় না। এটা কেবলমাপত্র মহান আল্লাহ্রই নির্ধারণ। ইসলাম যাকাতের মাল থেকে সৎকাজের দরুন ঋণী হওয়া লোকদের ঋণ মুক্তির এই ব্যবস্থা করেছে দুটি বিরাট লক্ষ্যে: প্রথম: তার সম্পর্ক সেই ঋণগ্রস্তের সাথে, যার ওপর ঋণ চেপে বসেছে। তদ্দরুন সেদিনের লজ্জায় ও রাতের দুশ্চিান্তায় ভয়ানকভাবে কাতর হয়ে পড়েছে। ঋণ ফেতর দেয়ার দাবি ও চাপে এক চরম অবস্থার সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। পাওনাদারদের মামলায় কারাগমনের কারণ ঘটে গেছে। এ ছাড়া নানারূপ নির্যাতন-নিষ্পেষণের অবস্থাও দেখা দিয়েছে। ইসলাম এই ব্যক্তির ঋণ আদায় করে দেয়ার ব্যবস্থা করেছে এবং যে জিনিস তাকে চিন্তায় ভারাক্রান্ত করে তুলেছে, তা দূর করার কার্যকর ব্যবস্থা নিয়েছে। দ্বিতীয়: তার সম্পর্ক ঋণদাতার সাথে যে ঋণ গ্রহীতাকে ঋণ দিয়েছে, তার শরীয়াতসম্মত কাজে তার সহায়তা করেছে। এরূপ অবস্থায় ইসলাম যেমন তার প্রাপ্য ফেরত দেয়ার ব্যাপারে তার সহায়তা করেছে, তেমনি সমাজ-সমষ্টির লোকদেরকে সহানুভূতিপূর্ণ আচার-আচরণ, সহযোগিতা ও বিনা সুদে ঋণ দিতেও যথেষ্টভাবে উৎসাহ দান করেছে। এদিক দিয়ে বলা চলে, যাকাত সুদী কারবারের প্রতিরোধে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে সক্ষম। বস্তুত ইসলামী শরীযাত কঠিন বিপদে পড়া এসব ঋণ গ্রহীতাদের হস্ত মজবুতভাবে ধারণ করেছে। তাদের নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ও আসবাবপত্র বিক্রয় করে ঋণ শোধ করতে তাদের বাধ্য করা হয়নি। কেননা তাহলে তো প্রতিটি মানুষ ও পরিবার জীবনের মৌল উপকরণ-উপাদানাদি থেকেই বঞ্চিত হয়ে যাবে। সব সুখ-শান্তি-সুবিধার সরঞ্জামাদি থেকেই বঞ্চিত হয়ে যেতে বাধ্য হবে। না, ইসলাম তা চায় না, তা হতে দিতে পারে না। হযরত উমর ইবনে আবদুল আজীজ তাঁর খিলাফত আমলে প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের প্রতি লিখিত নির্দেশ পাঠিয়েছিলেন, ‘তোমরা ঋণগ্রস্ত লোকদের ঋণ পরিশোধ করে দাও।’ একজন শাসনকর্তা জবাবে লিখেছিলেন, আমরা তো দেখতে পাচ্ছি, এক ব্যক্তির ঘর-বাড়ি আছে, খাদেম-সেবক, অশ্বযান ও ঘরের আসবাবপত্র সবই আছে, তা সত্ত্বেও সে ব্যক্তি ঋণগ্রস্ত। এরূপ অবস্থায় কি করা যাবে? হযরত দ্বিতীয় উমর লিখে পাঠালেন, ‘জেনে রাখ, মুসলিম নাগরিক মাত্রের জন্যেই বসবাসের ঘর-বাড়ি, কষ্টের কাজে সাহায্যকারী খাদেম এবং শত্রুর সাথে যুদ্ধ-জিহাদ করার জন্যে অশ্ববাহন একান্তই জরুরী। সেই সাথে তার ঘরে প্রয়োজনীয় আসবাবপত্রও থাকতে হবে। হ্যাঁ, তা সত্ত্বেও তার ঋণ শোধ কর। কেননা সে (কুরআনী পরিভাষানুযায়ী) ‘গারেম’। [(আরবী**********)] এটাই ইসলামী শরয়াতের অবদান। তা চৌদ্দশ’ বছর থেকেই মানুষের প্রতি সুবিচার, ন্যায়পরতা ও দয়া-অনুগ্রহের এই অবদান নিয়ে বিশ্বের জনসমক্ষে সমুপস্থিত। এর তুলনায় মানব রচিত মতবাদ ও আইন-বিধান মানবতাকে কি দিয়েছে? অথচ তাকেই সভ্যতা ও আধুনিক সংস্কৃতির উচ্চতর দৃষ্টান্ত মনে করা হচ্ছে? কিন্তু তাই ঋণগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের দারিদ্রের ঘোষণা দেয়ার, তাদের ব্যবসায় সমস্যার জটিলতা বিধানের এবং পরিমাণে তাদের ঘরবাড়ি সর্বস্বান্ত ও উজাড় করে দিতে বাধ্য করেছে। এতদ্সত্ত্বেও সমাজ বা সরকার তাদের ঋণমুক্তির কোন কার্যকর ব্যবস্থাই গ্রহণ করছে না! রোমান আইনই বা ন্যায়বাদী দয়াশীল ইসলামী শরীযাতের মুকাবিলায় কোন্ অবদান রেখেছে? দুস্থ মানবতার বিপদমুক্তির ক্ষেত্রে কি ভূমিকা রয়েছে ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে? রোমান আইন তো ঋণদাতাকে এই অধিকার দিয়েছে যে, ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি ঋণ শোধ দিতে অক্ষম হলে তাকে ক্রীতদাস বানিয়ে রাখবে। ‘বারো পর্যায়ের আইন’ নামক রোমান আইন বলা হয়েছে, ‘ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি ঋণ শোধ করতে অক্ষম হলে তাকে ক্রীতদাস বানানোর নির্দেশ দেয়া হবে- যদি সে স্বাধীন নাগরিক হয়ে থাকে। আর সে ক্রীতদাস হলে তাকে কয়েদ করর বা হত্যা করার হুকুম হবে। [এই কথা গ্রন্থকার (আরবী**********) ৩২৮ পৃষ্ঠা থেকে উদ্ধৃত করেছেন।] জাহিলিয়াতের যুগে আরব সমাজেও এই বিধানই পরিচিত ও ব্যাপকভাবে কার্যকর ছিল। ঋণে জর্জরিত ব্যক্তিকে ধরে ক্রীতদাস বানিয়ে বিক্রয় করা হত এবং এভাবেই ঋণদাতার প্রাপ্য আদায় করে নেয়া হত। কারো কারো বর্ণনা মতে ইসলামের প্রথম যুগেও এটা চালু ছিল। পরে অবশ্য তা বাতিল হয়ে যায়। অতঃপর ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিকে দাস বানানোর কোন উপায়ই থাকেনি ঋণদাতার পক্ষে। [আরবী**********)] আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেছেন। (আরবী**********) ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি যদি অর্থশূন্য দরিদ্র হয়ে যায়, তাহলে তার পক্ষে দেয়া সম্ভব এমন অবকাশ অবশ্যই দিতে হবে। আর তোমরা যদি পাওনাটা সাদ্কা করে দাও, তাহলে তো তোমাদের জন্যে খুবই উত্তম- যদি তোমরা জান। দ্বিতীয় প্রকার: অন্য লোকের কল্যাণে ঋণগ্রস্ত হওয়া ঋণগ্রস্ত লোকদের দ্বিতীয় প্রকার হচ্ছে দানশীল উদার হস্ত লোক সমষ্টি। তাদের আত্মা অনেক বড় ও উচ্চ। তা ইসলামী ও আরব সমাজেই কেবল সুপরিচিত, সুলভ। এরা পারস্পরিক অবস্থার সংশোধন ও উন্নয়নের কাজে নেমে অনেক সময় ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে। দৃষ্টান্তটা এরূপ হতে পারে যে, একটা বিরাট জনসমষ্টি- দুটি গোত্র বা দুটি জনবসতি- হত্যাকাণ্ড ধনসম্পত্তির জন্য পারস্পরিক বিবাদে লিপ্ত হয়ে পড়ে। সে কারণে পারস্পরিক শত্রুতা ও হিংসার মাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে যায়। তখন কেউ অগ্রসর হয়ে এই বিবাদমান জনসমষ্টির মধ্যে সন্ধি করিয়ে দিতে চেষ্টা চালায়। তখন হয়ত সে পারস্পরিক বিবাদের কেন্দ্রবিন্দু কোন ধন-সম্পদের দায়িত্ব নিজের স্কন্ধে তুলে নেয়- বিবাদের জ্বলন্ত আগুনের নিভানোর উদ্দেশ্যে। এটা একটা ব্যাপক প্রচলিত প্রথা। এরূপ অবস্থায় দায়িত্ব বোঝাটা যাকাতের ‘গারেমুন’-এর জন্য নির্দিষ্ট অংশ থেকে বহন করা যাবে যেন সমাজের সংশোধন প্রয়াসী কল্যাণকামী নেতৃবৃন্দ নিজেদের ওপর এই বোঝা চাপিয়ে নিয়ে নিষ্পিষ্ট হতে বাধ্য না হন কিংবা তদ্দরুন তাদের সংশোধন-সংকল্পও ব্যাহত ও পর্যুদস্ত হয়ে না পড়ে অথবা তার প্রতি অনীহা ও অনুৎসাহের সঞ্চার না হয়। এ কারণে ইসলামী শরীযাতে ব্যাপারটিকে এভাবে সমাধান করার ব্যবস্থা দিয়েছে। এদের জন্যে যাকাতের একটা অংশ নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। [(আরবী**********)] আমাদের আলিম সমাজ যদি এই সিদ্ধান্ত দেন যে, পারস্পরিক বিবাদ মীমাংসার দরুন কেঋ ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়লে তার এই ঋণ শোধের জন্যে তাকে যাকাতের অংশ দেয়া হবে। এই মীমাংসার ব্যাপারটা যিম্মীদের দুই দলের মধ্যকার বিবাদের ক্ষেত্রে হলেও তা করা যাবে। [দেখুন: (আরবী**********)] তা হলে খুবই ভাল হয়। জনসমষ্টির পারস্পরিক বিবাদ মীমাংসার পর্যায়ে সেই লোকেরাও পড়ে যারা কোন সামষ্টিক শরীযাতসম্মত ভালোকাজের জন্যে দায়িত্ব সহকারে কাজ করবে। যেমন ইয়াতীমদের কোন প্রতিষ্ঠান, গরীবদের চিকিৎসায় নিয়োজিত কোন হাসপাতাল, নামাযের জন্যে কায়েম করা কোন মসজিদ, মুসলিমদের শিক্ষাদানের জন্যে প্রতিষ্ঠিত কোন মাদ্রাসা- শিক্ষা প্রতিষ্ঠান-কিংবা এর সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ কোন কল্যাণময় বা সামষ্টিক খেদমতের কাজ প্রভৃতি। এসবের মাধ্যমে সমাজের সাধারণ কল্যাণ সাধনের জন্যে সে দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। কাজেই সাধারণ ধন-সম্পদ থেকেই তার সাথে সহযোগিতা করতে হবে। ‘গারেমীন’ শব্দ দ্বারা কেবলমাত্র পারস্পরিক বিবাদ মীমাংসাকারী লোকদেরই বুঝতে হবে, অন্য কেউ তার মধ্যে শামিল হতে পারবে না, এমন কথা শরীয়াত থেকে জানা যায় না। ওরা যদি গারেমীন-এর শব্দে গণ্য নাও হয়, তবু ‘কিয়াস’-এর সাহায্যে এই বিধান অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে। তার অর্থ, যে লোক উক্তরূপ সামষ্টিক কল্যাণকর কাজ-কর্মের দরুন ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়বে, তাকে যাকাত ফাণ্ড থেকে তার ঋণশোধ পরিমাণ অর্থ অবশ্যই দিতে হবে- সে নিজে ধনশালী হলেও। কোন কোন শাফেয়ী ফিকাহ্বিদ একথা বলিষ্ঠভাবে বলেছেন। [কোন কোন শাফেয়ী ফিকাহ্বিদ বলেছেন, কেউ যদি ইমারত নির্মাণ বা বন্দীমুক্তিকরণ কিংবা মেহ্মানদারী প্রভৃতির জন্যে ঋণগ্রস্ত হয়, তাহলে তাকে যাকাত থেকে দেয়া যাবে- যদি সে ধনীও হয় এবং তার এই ধনশীলতা যদি জমি-জায়গা থেকেহয়, নগদ অর্থের কারণে না হয়। দেখুন: (আরবী**********) রমলীবলেছেন, এই কথার ভিত্তিতে যদি বলা যায় যে, নগদ টাকায় ধনী হলেও কোন তারতম্য হবে না। কেননা এটা আল্লাহ্র এক সাধারণ কল্যাণমূলক ব্যবস্থা, তা হলে তা অস্বাভাবিক কথা হবে না। দেখুন: (আরবী**********)] প্রথম প্রকারের লোকেরা যখন ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ঋণগ্রস্ত হয়েছে এবংতা সত্ত্বেও তাদের সাহায্য করার বৈধতা স্বীকৃত হয়েছে, তাহলে এই দ্বিতীয় শ্রেণীর লোকেরা তো সামষ্টিক কল্যাণে ঋণগ্রস্ত হয়েছে, তারা তো অধিক উত্তমভাবে সাহায্য পাওয়ার অধিকারী। প্রথম শ্রেণীর লোকদের যদি দলবদ্ধতা ছাড়া দেয়া না হয়, তাহলে এই শ্রেণীর লোকদের দেয়া হবে তাদের দানশীরতা থাকা সত্ত্বেও। [এটা হবে তখন, যদি তারা নিজেরা নিজেদের মাল থেকে তা কার্যত না দিয়ে থাকে। কেননা সে অবস্থায় তারা নিজেরা ঋণগ্রস্ত হয়নি। আলিমগণ তাই বলেছেন।] ইতিপূর্বে ‘যাকাত সংস্থার কর্মচারী’ পর্যায়ের আলোচনায় আমরা একটা হাদীস উদ্ধৃত করে এসেছি। তাতে বলা হয়েছে, ‘পাঁচজন ছাড়া অন্যদের জন্যে যাকাত হালাল নয়।’ তারা হচ্ছে: মহান আল্লাহ্র পথে যুদ্ধকারী কিংবা যাকাত সংস্থার কর্মচারী অথবা ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি..... কুবাইচা ইবনে মাখারিক আল-হিলালী বলেছেন, আমি একটা বিপদের ঝুঁকি গ্রহণ করলাম। পরে আমি রাসূলে করীম(স)-এর কাছে উপস্থিত হয়ে সে ব্যাপারে কিছু সাহায্য পাওয়ার জন্যে প্রার্থনা করলাম। তখন তিনি বললেন, দাঁড়াও, আমাদের কাছে যাকাতের মাল আসুক, তখন আমি তোমাকে তা থেকে দেয়ার জন্যে আদেশ করব।’ অতঃপর তিনি বললেন, ‘হে কুবাইচা, তিনজনের যে-কোন একজন ছাড়া অন্যদের জন্যে ভিক্ষা চাওয়া হালাল নয়। তারা হচ্ছে এমন ব্যক্তি যে কোন বিপদের ঝুঁকি গ্রহণ করেছে। সেজন্যে ভিক্ষা চাওয়া তার পক্ষে জায়েয-যতক্ষণ না সে তা পায় ও শেষ পর্যন্ত তা থেকে বিরত হয়ে যায় অর্থাৎ ভিক্ষা পরিহার করা। দ্বিতীয সেই ব্যক্তি যার কোন বিপদ ঘটেছে, যার দরুন তার সমস্ত ধন-মাল নিঃশেষ হয়ে গেছে। তখন তার পক্ষে ভিক্ষা চাওয়া জায়েয, যেন সে জীবনের প্রয়োজনীয় সম্বল অর্জন করতে পারে (কিংবা বলেছেন, জীবনের প্রয়োজন মেটাতে পারে)। আর তৃতীয সে, যে অবুক্ত রয়েছে। এমন কি তার নিকটবর্তী যে কোন তিনজন লোক বলতে শুরু করেছে, অমুক ব্যক্তি অবুক্ত রয়েছে। তখন তার পক্ষে ভিক্ষা করা জায়েয, যেন জীবনে বেঁচে থাকার সম্বল সে পেতে পারে। অথবা বলেছে- জীবনের প্রয়োজন মেটাতে পারে। এদের ছাড়া- হে কুবাইচা- অন্য কেউ ভিক্ষা করলে তা ঘুষ হবে এবং সে ঘুষের ন্যায় হারাম খাবে। [হাদীসটি বর্ণনা করেছেন আহমাদ, মুসলিম, নাসায়ী, আবূ দাউদ নাইলুন আওতার ৪র্থ খণ্ড-১৬৮ পৃ.] হাদীসের কথা ‘বিপদের ঝুঁকি গ্রহণ’ থেকে প্রমাণিত হয় যে, সে লোক ব্যক্তিগতভাবে ধনী। কেননা ফকীরের জন্যে তো জীবিকার উপকরণ সংগ্রহ প্রচেষ্টা থেকে বিরত থাকার কোন প্রশ্ন ওঠে না। [(আরবী**********) এই গ্রন্থকার লিখিত: ২২১-২২২পৃ] বস্তুত পারস্পরিক সম্পর্কের সুস্থতা বিধান, শান্তি-সম্প্রীতি স্থাপন বা রক্ষা করার জন্যে ঋণগ্রস্ত প্রত্যেক ব্যক্তিকে অর্থ দিয়ে সাহায্যকরণ ইসলামের একটা বিশেষ অবদান। বিপদগ্রস্ত ও আঘাতপ্রাপ্ত লোকদেরকে অর্থ দিয়ে সাহায্য করা এবংতাদের হাত এমন দৃঢ়ভাবে ধারণ করা- যেন তার পতিত অবস্থা থেকে সে উপরে উঠতে পারে। সন্দেহ নেই, এটা কেবলমাত্র ইসলামেরই এক বিশেষ অবদান। বিশ্বে যখন জিনিসপত্র, পণ্যদ্রব্য, জীবন ইত্যাদির ওপর দুর্ঘটনা ও বিপদাপদের ক্ষেত্রে সীমা ব্যবস্থা চালু হয়নি- বিশ্ব মানব তার সাথে কিছু মাত্র পরিচিতও ছিল না, ঠিক তখনই এ সবের বহু পূর্বের ইসলাম বাস্তবভাবে এই পদক্ষেপ নিয়েছে। অতএব যে দরিদ্র ব্যক্তির অনশন অবস্থা সম্পর্কে প্রতিবেশীর অন্তত তিনজন লোক সাক্ষাৎ দেবে, তারই জন্যে দয়া ভরা দুটি বাহু বিস্তীর্ণ করে দেয়ার শিক্ষা মানুষকেই ইসলাম দিয়েছে। অবশ্য একজন লোক অভুক্ত থাকলেই এবং দরিদ্র্যের দাবি করলেই তা করতে হবে এমন কথা নয়। ইসলামের এই অবদানের ওপর আরও বড় অবদান হচ্ছে, যাকাত দেয়ার চরম লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারিত হয়েছে জীবিকার সুষ্ঠু ব্যবস্থা করে দেয়া। সুখী জীবনের যাবতীয় প্রয়োজন পূরণকরণ- যার ফলে সে সত্যিই নিশ্চিত ও স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ জীবন যাপন করতে সক্ষম হবে। কেবল দুই চার মুঠি খাবার দিয়ে তার মেরুদণ্ড খাড়া রাখাই তার উদ্দেশ্য নয়। [(আরবী **********)] মৃতের ঋণ শোধে যাকাত ব্যবহার এখানে একটি প্রশ্ন রয়ে গেছে, তা হচ্ছে, যাকাত দ্বারা যেমন জীবিত ব্যক্তির ঋণ শোধ করা যায়, তেমনি মৃত ব্যক্তির ঋণও কি শোধ করা যাবে? ইমাম নববী এ পর্যায়ে শাফেয়ী মাযহাবের দুটি মতের উল্লেখ করেছেন। একটি হচ্ছে জায়েযন। বলা হয়েছে সাইমারী, নখরী, আবূ হানীফা ও আহমাদ এই মতই পোষণ করতেন। আর দ্বিতীয়, তা জায়েয। কেননা আয়াতে সাধারণভাবেই ঋণগ্রস্তের কথা বলা হয়েছে। অতএব মৃতকে জীবিতের ন্যায় মনে করেই তার ঋণও শোধ করা যাবে। আবূ সওর এ মতই দিয়েছেন। [(আরবী **********)] অনুরূপ ইমাম আহমদ থেকে বর্ণিত হয়েছে, মৃতের ঋণ শোধে যাকাতের টাকা দেয়া জায়েয নয়। কেননা এ অবস্থায় ঋণগ্রস্ত ব্যকিত্ মৃত। তাকে তো দেয়ার উপর নেই। আর যদি ঋণদাতাকে দেয়া হয়, তাহলে তা দেয়া হবে ঋণদাতাকে, ঋণগ্রস্তকে নয়। [(আরবী **********)] দ্বিতীয কথা হচ্ছে, মৃতের ঋণ শোধে যাকাত জায়েয। কেননা আয়াত সাধারণ অর্থবোধক। তা সর্ব প্রকারের ও স্বাবস্থার ঋণগ্রস্ত পরিব্যাপ্ত; সে জীবিত হোক, কি মৃত। তাছাড়া মৃত ব্যক্তির ঋণ শোধ দিয়ে তার প্রতি একটা বাদান্যতা দেখানোও সম্ভব এবং এটা সঠিক কাজ। মালিক ও আবূ সওরও এই কথা বলেছেন। [দেখুন (আরবী **********)] খলীলের মূল রচনার ওপর টীকা লিখতে গিয়ে খরশী বলেছেন: ঋণগ্রস্তের ক্ষেত্রে জীবিত ও মৃতের মধ্যে কোন পার্থক্য করা যাবে না। রাষ্ট্রকর্তা যাকাত ফাণ্ড থেকে নিয়ে মৃতের ঋণ শোধ করে দেবে। বরং অন্যরা বলেছেন, মৃতের ঋণ বাবদ যাকাত প্রদান জীবিতের ঋণের তুলনায় অনেক বেশি গুরুত্বসম্পন্ন যেহেতু তার ঋণ শোধ হওয়ার আর কোন আশা নেই। কিন্তু জীবিতের ঋণ সে রকম নয়। [দেখুন (আরবী **********)] ইমাম কুরতুবী লিখেছেন, [(আরবী **********)] আমাদের আলিম ও অন্যরা বলেছেন, যাকাতের অর্থ দিয়ে মৃতের ঋণ শোধ করা যাবে। কেননা সেও ‘গারেমীন’ ‘ঋণগ্রস্ত’ লোকদের মধ্যে গণ্য। নবী করীম (স) বলেছেন: (আরবী **********) প্রত্যেক মুমিন ব্যক্তির জন্যে আমি তার নিজের থেকে অধিক আপন যে লোক ধন-মাল রেখে যাবে তা তার উত্তরাধিকারীরা পাবে। আর যে লোক ঋণ অথবা (বলেছেন) অসহায় সন্তানাদি রেখে যাবে তা আমার ওপর ন্যস্ত হবে। [হাদীসের শব্দ (****) বলতে ছোট ছোট শিশু সন্তান বোঝানো হয়েছে, যারা দারিদ্র্যের চাপে অসহায় বলে ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। হাদীসটি বুখারী মুসলিম উদ্ধৃত।] শিয়া জাফরী ফিকাহ্রও এই মত [(আরবী **********)] এই গ্রন্থকার একটি মতকে অগ্রাধিকার দিতে চান। শরীয়াতের অকাট্য দলীলসমূহ ও তার অন্তর্নিহিত ভাবধারা যাকাত থেকে মৃতের ঋণ শোধ করতে কোন বাধা দিচ্ছে না, নিষেধও করছে না। কেননা আল্লাহ্ যাকাত ব্যয়ের ক্ষেত্র দুই প্রকারের নির্ধারণ করেছেন। এক প্রকারের হল তারা তাদের পাওয়ার অধিকার রয়েছে, তাদের উল্লেখ করা হয়েছে। দিয়ে অর্থাৎ মালিক বানানো। তারা হচ্ছে, ফকীর, মিসকীন, যাকাত কাজে নিযুক্ত কর্মচারী এবং মুয়াল্লাফাতুল কুলুবুহুম। এরা যাকাত পেয়ে তার মালিক হয়ে যায়। আর অপর ভাগের লোকদের উল্লেখ করেছেন (***) এর অধীন। তারা অবশিষ্ট চার শ্রেণীর লোক- দাসমুক্তি, ঋণগ্রস্ত লোক, আল্লাহ্র পথে ও নিঃস্ব পথিক অর্থাৎ তিনি যেন বলেছেন, যাকাত ‘গারেম’ দের মধ্যে ব্যয় হবে, গারেমদের জন্যে বলেন নি। অতেএব গারেমকে যাকাতরে মালিক বানানোর প্রশ্ন নেই। ফলে তাদের ঋণ শোধ করাসম্পূর্ণ জায়েয। ইমাম ইবনে তাইমিয়া এই মত পসন্দ ও গ্রহণ করেছেন, তার পক্ষে ফতোয়াও দিয়েছেন। [(আরবী **********)] উপরিউক্ত হাদীসও এই মতের সমর্থক। যাকাত থেকে ‘করযে হাসানা’ দেয়া এই পর্যায়ের আলোচনা পূর্ণাঙ্গ করার জন্যে আরও একটি বিষয়ে কথা বলতে হবে। তা হচ্ছে, যাকাতের টাকা ‘করযে হাসানা’ স্বরূপ দেয়ার বিষয়... তা কি জায়েয হবে- যদি ঋণগ্রস্তদের মতই মনে করা যায় ‘কযে হাসানা প্রার্থীদেরকে?... না আমরা আক্ষরিকভাবেই তাকে ধরে নেবও তা জায়েয নয় মনে করব? এই কথা ধরে নিয়ে যে, ‘গারেম’ হচ্ছে শুধু সেসব লোক,যারা কার্যত ঋণ গ্রহণ করেছে? আমি মনে করি, যাকাত পর্যায়ের সহীহ্ কিয়াস ও ইসলামের সাধারণ লক্ষ্য উদ্দেশ্যের প্রেক্ষিতে ‘গারেম’দের জন্যে নির্দিষ্ট যাকাত অংশ থেকে ঠেকায় পড়া লোকদেরকে ‘করয’ দেয়া সম্পূর্ণ জায়েয। তবে সেজন্যে বিশেষ ব্যবস্থা করতে হবে ও একটি নির্দিষ্ট ফাণ্ড গড়ে তুলতে হবে। সুদী কারবার প্রতিরোধের কার্যকর ব্যবস্থাস্বরূপ যাকাতকে এভাবে বন্টন করা বাঞ্ছনীয়। ‘করযে হাসানা’ দান সুদী কারবার রীতির সম্পূর্ণ পরিপন্থী। আবূ জুহ্রা, খাল্লাফ ও হাসান- একালের ইসলামী চিন্তাবিদগণ যাকাত সম্পর্কে উপরিউক্ত রূপ মত প্রকাশ করেছেন। তার কারণ ধরা যায় এই যে, ভালো কাজের জন্যে গৃহীত ঋণ যদি যাকাত থেকে আদায় করা যায়, তা হলে সুদমুক্ত ঋণ- ‘করযে হাসানা’ –তা থেকে দেয়া যাবে আরও অধিক উত্তমভাবে। .... তা তো শেষ পর্যন্ত বায়তুলমালেই প্রত্যাবর্তিত হবে। [(আরবী **********)] চিন্তাবিদগণ এই কথা বলেছেন উপরিউক্তি কিয়াসের ভিত্তিতে। উপমহাদেশীয় প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ ডঃ হামিদুল্লাহ হায়দারাবাদীই (ইস্তাম্বুল, প্যারিস প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক)-ও এই মতই প্রকাশ করেছেন। [এই গ্রন্থটির আরবী অনুবাদ প্রকাশ করেছেন (আরবী **********) সিরিজ হিসেবে।] তিনি ‘সুদবিহীন ঋণ ও ব্যাংক’ শীর্ষক আলোচনায় এই কথাটির বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি এই পর্যায়ে যুক্তি প্রদর্শনরূপ বলেছেন, কুরআন যাকাতের পরিকল্পনায় ‘গারেমীন’ –ঋণগ্রস্ত লোকদের জন্যে একটি অংশ নির্দিষ্ট করেছে। এই ঋণ ভারাক্রান্ত লোকেরা দুই প্রকারের হয়ে থাকে- তা সকলেই জানেন: ১. প্রতি মুহূর্ত প্রতিঘাতকারী দারিদ্র্য ও উপায়-উপকরণহীন হওয়ার কারণে যারা নির্দিষ্ট সময়ে ঋণ ফেরত দিতে সমর্থ হচ্ছে না। ২. এমন সব লোক, যাদের রয়েছে সাময়িক প্রয়োজন, অবশ্য তাদের উপায়-উপকরণও রয়েছে, যদ্দারা একটা সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে সে সাহায্য সহযোগিতা লাভ করতে পারে, যা তারা ঋণ হিসেবে গ্রহণ করে থাকে। [দেখুন পূর্বোক্ত সূত্রের ৮-৯ পৃ.] উপরিউক্ত চিন্তাবিদ এই প্রকারের ঋণ প্রার্থীদেরকে কুরআনে বর্ণিত ‘গারেমীন’ পর্যায়ে গণ্য করেছেন। কিন্তু তা কি করে হয়? ‘করয’ গ্রহণের পূর্বে তো সে ‘গারেম’ ছিল না? কাজেই আবূ জুহ্রা প্রমুখ উপরিউক্ত তিন জন ফিকাহ্বিদ যে মত দিয়েছেন তাই অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য। তারা উত্তম কিয়াসের ভিত্তিতেই এ কথা বলেছিলেন। ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ ফী-সাবীলিল্লাহ্- আল্লাহ্রপথে কুরআন মজীদ সপ্তম পর্যায়ে যাকাত ব্যয়ের ক্ষেত্র বাখাত হিসাবে উল্লেখকরেছে (****) এবং আল্লাহ্র পথে...। এই খাতটির প্রকৃত লক্ষ্যকি? আয়াতে কোন্সব লোকদের সাহায্যের জন্যে বলাহয়েছে? বাক্যটির প্রকৃত আভিধানিক অর্থ সুস্পষ্ট। ‘সাবীল’ অর্থ পথ। আর ‘সাবীলিল্লাহ্’ অর্থ আকীদা-বিশ্বাস ও কাজের দিক দিয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দেয় যেপথ, তা। ‘আল্লামা ইবনুল আসীর বলেছেন: ‘সাবীল’ অর্থ পথ। আর সাবীলিল্লাহ্ সাধারণ অর্থবোধক এমন যে কোন কার্যক্রমই বোঝায়, যা খালেসনিয়তে করা হবে আল্লাহ্র নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে, তা করা যাবে ফরয, নফল ও বিভিন্ন ধরনের ইবাদত-বন্দেগী ও আল্লাহ্র সন্তুষ্টিমূলক কাজ-কর্মের মাধ্যমে, আর এই কথাটি যখন বাস্তবে প্রয়োগ করা হবে, তখন প্রধানত তা ব্যবহৃত হবে ‘জিহাদ’ অর্থে। ব্যাপক ও বেশি বেশি ব্যবহারের দরুন এক্ষণে যেন ‘ফী-সাবীলিল্লাহ’ বলতে এই জিহাদকেই বোঝাচ্ছে। মনে হচ্ছে এই বাক্যটির যেন এ ছাড়া অন্য কোন অর্থই নেই। [আরবী *********] ইবনুল আসীর কর্তৃক ‘ফী-সাবীলিল্লাহ’ বাক্যের উপরিউক্ত তাফসীর থেকে আমাদের সম্মুখে নিম্নোদ্ধৃত কথাগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে: ১. বাক্যটির আসল আভিধানিক অর্থ: এমন সব খালেস আমল যা আল্লাহ্র নৈকট্য লাভ করিয়ে দেয়। সর্বপ্রকারের নেক আমলিই এর অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। তা ব্যক্তিগত পর্যায়ের হোক, কি সামষ্টিক। ২. বাক্যটির অর্থ সাধারণভাবে ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে যা মনে করা হয়, তা হচ্ছে জিহাদ। এই অর্থে বেশি ব্যবহারের দরুন কেবল এটার মধ্যেই সীমিত হয়ে গেছে বাক্যটির সমস্ত তাৎপর্য। উপরিউক্ত দুটি অর্থের দ্বন্দ্বে যাকাত ব্যয়ের এ খাতটির সঠিক তাৎপর্য নির্ধারণে ফিকাহ্বিদদের মধ্যে মতভেদ সৃষ্টির কারণহয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এ কারণেই এ দ্বিতীয় অর্থটি ‘সাবীলিল্লাহ্’-এর তাৎপর্যের অন্তর্ভুক্ত ধরে নেয়া হয়েছে ফিকাহ্বিদদের ঐকমত্যের ভিত্তিতে। কিন্তু অন্য একটি ব্যাপারে আলিমগণের মধ্যে মতভেদের সৃষ্টি হয়েছে। তা হচ্ছে, ‘ফী-সাবীলিল্লাহ্’- এর অর্থ কি শুধু জিহাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ- যেমন ব্যবহারিকতায় সাধারণভাবেই তা বোঝা যায় অথবা তা অগ্রসর হয়ে তার আসল আভিধানিক অর্থটিকেও শামিল করে নেবে? .... তখন তা কেবল জিহাদের সীমার কাছে এসে থেমে যাবে না, এবং সর্বপ্রকারের কল্যাণময় নেকের কাজই শামিল হবে, কোন একটিও এর বাইরে পড়ে থাকবে না। আমরা এখানে ফিকাহ্বিদদের মতামত ও এই খাতের শরীয়াতসম্মত তাৎপর্য নির্ধারণে তাঁদের মতবৈষম্যের ওপর ভিত্তি করে বিশদ আলোচনা উপস্থাপিত করছি। আমাদের বিবেচনায় যেটি সত্যতা-যথার্থতার নিকটবর্তী হবে, আমরা সেই মতটিকে অগ্রাধিকার দেব। তাওফীক আল্লাহ্ই দেবেন। হানাফী মাযহাব হানাফী ফিকাহ্বিদগণ ‘সাবীলিল্লাহ্’ –এর বিশ্লেষণেবলেছেন: ‘ফী-সাবীলিল্লাহ্’ বলে- ইমাম আবূ ইউসুফের মতে- মুজাহিদদের সাথে শামিল হয়ে ইসলামী জিহাদে অংশ গ্রহণ করতে পারেনি যেসব লোক তাদের দারিদ্র্যে কারণে- সম্বলবা যানবাহন প্রভতি ধ্বংস হয়ে যাওয়ার বা না থাকার কারণে, তাদের সাহায্য দেয়াই এর উদ্দেশ্য। তারা নিজেরা উপার্জনকারী হলেও তাদের জন্যে যাকাত গ্রহণ জায়েয হবে। কেননা উপার্জনে মশগুল থাকলে তারা জিহাদে শরীক হতে পারবে না। ইমাম মুহাম্মাদের মত হচ্ছে, ‘সাবীলিল্লাহ্’ বলে সেসব হাজীদের বোঝানো হয়েছে, যারা কোন কারণে হজ্জ কার্যকরতে সমর্থ হচ্ছে না। কেননা বর্ণিত হয়েছে, এক ব্যক্তি তার একটি উট ‘ফী-সাবীলিল্লাহ্’ দিয়ে দিল। তখন নবী করীম(স) তাকে নির্দেশদিলেন উটটিকে হাজী বহন করে নেয়ার কাজে লাগানোর জন্যে। তাহলে বোঝা গেল যে, হজ্জ্ও আল্লাহ্র পথ। আরও এজন্যে যে, ‘আল্লাহ্পর পথে’ বলতে আল্লাহ্র আদেশ পালন ও তাঁর আনুগত্য করা বোঝায়, আল্লাহ্র দুশমন নফ্সবা কুপ্রবৃত্তি দমন এর অন্তর্বুক্ত। বলা হয়েছে, ‘ফী-সাবীলিল্লাহ্’ বলে দ্বীনি ইলম শিক্ষার্থীদের বোঝানোহয়েছে। ‘ফতোয়ায়ে জহীরীয়া’ গ্রন্থে কেবলমাত্র এই অর্থটিই গৃহীত হয়েছে। কিন্তু অনেকে এ অর্থটি অবাস্তব মনে করেন। কেননা আয়াত যখন নাযিল হয়েছিল,তখন সে সমাজে ‘দ্বীনি ইল্ম শিক্ষার্থী’ বলতে কোন লোক-সমষ্টির অস্তিত্ব ছিল না। এর জবাবে বলা হয়েছে, দ্বীনি ইলম শিক্ষা হচ্ছে শরীয়াতের বিধান শিখে উপকৃত হওয়া। নবী করীম(স)-এর সঙ্গে লেগে থেকে যারা ইসলামী বিধান শিক্ষা লাভ করেছিলেন, কোন ‘তালেবে ইলম’ই কি তাঁদের মর্যাদায় পৗঁছাতে পারে?... আসহাবে সুফফার সমান মর্যাদার লোক আছে কি দুনিয়ায়? আল্লামা কাসানী তাঁর (********) গ্রন্থে ‘ফী-সাবীলিল্লাহ্’ বলতে আল্লাহ্র নৈকট্য ও ইবাদতমূরকসমস্ত কাজই’ মনে করেছেন। আর কাব্যটির আসল তাৎপর্যও তাই। ফলে আল্লাহ্র কাজে চেষ্টাকারী ও সর্বপ্রকার কল্যাণমূলক কাজে নিয়োজিত লোকগণই এর অন্তর্ভুক্ত হবে- যদি তারা অভাবগ্রস্ত হয়। ইবনে নজীম ‘বাহ্রুর’ রায়েক’ গ্রন্থে বলেছেন, দারিদ্র্যের শর্ত লাগানোহলেতার সর্বদিক দিয়েই দারিদ্র্য থাকতে হবে। [দেখুন : আরবী********)] ‘আল-মানার তাফসীর লেখক’ বাহরুর-রায়েক’ গ্রন্থকারের উপরিউক্ত মতের সমালোচনা করে বলেছেন: [আরবী ********]: দরিদ্র্যের শর্ত করার ফলে ‘ফী-সাবীলিল্লাহ্’ খাতটি স্বতন্ত্র খাত হওয়ার মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়ে যায়। কেননা তাহলে তারা তো প্রথমখাত (****)-এর মধ্যেই গণ্য হতে পারে। [হানাফী আলিমগণ এরূপ আপত্তি তুলেছেন। তারা যা জবাব দিয়েছন তা সন্তোষজনকনয়। ‘বাহ্র’ গ্রন্থে ‘আন-নিহায়া’ থেকে উদ্ধৃত করা হয়েছে, বলেছেন, জিহাদকারী ও হাজীদের পেছনে থেকে যাওয়া লোকদের নিজেদের দেশে কোন ধন-মাল না থাকলে তারা ফকীর শ্রেণীভুক্ত। অন্যথায় তারা ‘ফী-সাবীলিল্লাহ্’ খাতে সাহায্য পাবে। আমিবলব, সে ফকীর, তবে আল্লাহ্র ইবাদতে একান্তভাবে মশগুল হয়ে আছে, এটা অতিরিক্ত। ফলে সে সাধারণ ফকীর থেকে ভিন্ন অবস্থার হয়ে গেল। তখন এই শর্ত থেকে মুক্ত হল। (দেখুন: (আরবী*******) আমি বলব, অবস্থা যা-ই হোক, ফকীর শ্রেণীর পর্যায় বাইরে আসতে পারেনি। আলূসী তাঁর তাফসীরে (৩য় খণ্ড ৩২৮ পৃ.) ফিকাহ্বিদদের মত উদ্ধৃত করেছেন: যুক্তিপূর্ণ কথা যা আল-যাসসাস উল্লেখ করেছেন, তা হল যে লোক তার নিজের দেশে ও শহরে ধনী, যার খাদেম ও যানবাহন ঘোড়া আছে এবং অতিরিক্ত অর্থ আছে, এমন যে, তার পক্ষে যাকাত গ্রহণ হালাল হয় না, সেযদি জিহাদের সফরে গিয়ে প্রস্তুতি ও অস্ত্রশস্ত্রের অভাবে পড়ে- নিজ বাড়িতে যদিও সে সেজন্যে অভাবগ্রস্ত নয়- তাকে যাকাত দেয়া সম্পূর্ণ জায়েয, সে নিজ দেশে ধনী হলেও।] হানাফী ফিকাহ্র আলিম ‘সাবীলিল্লাহ্’-এর তাৎপর্য নির্ধারণে বিভিন্ন মত দিয়ে থাকলেও এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ একমত যে, ‘ফী-সাবীলিল্লাহ্’র মধ্যে গণ্য হওয়া সব লোকের জন্যেই গরীবও অভাবগ্রস্ত হওয়া জরুরী শর্ত বিশেষ- সে ইসলামী যোদ্ধা হোক, কি হাজী, তালেবে-ইলম হোক, কি কল্যাণময়কাজসমূহে চেষ্টা-প্রচেষ্টাকারী। এজন্যেই তাঁরাবলেছেন, মতপার্থক্যটা আসলে শব্দগত, যখন এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ মতৈক্য রয়েছে যে, যাকাত পেতে পারে এমন সব পর্যায়ের লোকদেরকে তা দেয়া যাবে। তবে যাকাত কাজে নিয়োজিত কর্মচারীদের ব্যাপারে এই শর্ত নেই। আমরা জানি, অভাবগ্রস্ত ফকীরের জন্যে যাকাতের একটা নির্দিষ্ট অংশ রয়েছে, যদিও এসব গুণের কোন একটিরও তারা অধিকারী বা এই গুণে বিশেষিত নয়। তাহলে এ ক্ষেত্র ব্যাখ্যাটি আলাদাভাবে উল্লিখিত হয়ে কোন্ ভূমিকাটা পালন করেছে? কুরআন তাকে আলাদা একটি খাতরূপে চিহ্নিতই বা করল কেন? যেমন হানাফী আলিমগণ এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ একমত যে, যাকাতকে একজনের মালিকানাভুক্ত করে দিতে হবে। কাজেই তা মসজিদ, পুল, পানশালা নির্মাণও রাস্তাঘাট মেরামতের কাজে ব্যয় হতে পারে না। খাল কাটা, হজ্জ, জিহাদ ইত্যাদির কাজেও তা লাগতে পারে না, কেননা এসব ক্ষেত্রে কোন ব্যক্তিকে যাকাতের মালিক বানিয়ে দেয়া সম্ভব হয় না। মৃতের কাফন ও তার ঋণ শোধ দেয়ার ব্যাপারেও এই কথা সত্য। [(আরবী**********)] মালিকী মাযহাবের মত কাযী ইবনুল আরাবী ‘আহকামুল কুরআন’ গ্রন্থে ‘ফি-সাবীলিল্লাহ্’-এর ব্যাখ্যা দান প্রসঙ্গে ইমাম মালিকের এই মত উদ্ধৃত করেছেন: আল্লাহ্র পথ বলতে অনেক কিছুই বোঝায়। কিন্তু এখানে ‘সাবীলিল্লাহ্’-এর তাৎপর্য যে ইসলামী যুদ্ধ- আল্লাহ্র বহু পথের একটি, তাতে কোন মতবিরোধ আছে বলে আমার জানা নেই। মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল হেকাম বলেছেন, পানি পান করানো অস্ত্রশস্ত্র ও যুদ্ধের জন্যে প্রয়োজনীয় অন্যান্য যন্ত্রপাতি বা জিনিসপত্র ক্রয়ের কাজে যাকাত ব্রয় হতে পারবে। শত্রুপক্ষকে অবস্থান গ্রহণ থেকে বিরত রাখার কাজেই তাই। কেননা এসবই যুদ্ধ ও তার পক্ষের কার্যাবলী। নবী করীম (স) সহল ইবনে আবূ হাস্মা কর্তৃক সৃষ্ট বিপজ্জনক অবস্থায় বিদ্রোহের আগুন নিভাবেনার জন্য একশত উট যাকাত ফাণ্ড থেকে দিয়েছিলেন। [ (আরবী **********)] খলীলের মূল আলোচনায় দর্দীর রচিত ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, মুজাহিদ, পাহারাদার এবং এই দুইজনের কাজের জন্যে প্রয়োজনীয় অস্ত্রপাতি সংগ্রহে যাকাতের টাকা দেয়া যাবে। এই টাকা দিয়ে অস্ত্রশস্ত্র ক্রয় করা যাবে, চলাচলের জন্যে ঘোড়াও খরিদ করা যাবে। মুজাহিদ নিজে ধনী হলেও সে যাকাত নিতে পারবে। কেননা তার এই যাকাত গ্রহণ জিহাদের জন্যে- জিহাদের কারণে, দারিদ্র্যের কারণে নয়। গুপ্তচর পাঠিয়ে শত্রু সম্পর্কিত খবরাখবর সংগ্রহ করার জন্যেও যাকাত ব্যয় করা যাবে। সে কাফির হয়েও যদি খবর এনে দেয় তা হলেও। কিন্তু খলীলের মত অনুযায়ী শহর-নগরের চতুর্দিকে কাফিরদের আক্রমণ প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে প্রাচীর নির্মাণের জন্যে যাকাত ব্যয় করা জায়েয হবে না। যে যানবাহনে চড়ে শত্রুদের সাথে যুদ্ধ করা হয়, তা ক্রয় করার কাজেও তা ব্যয় হবে না। দসূকী তাঁর টীকায় উল্লেখ করেছেন, প্রাচীর নির্মাণ ও যুদ্ধের যানবাহন নির্মাণে যাকাত ব্যয় না করর এই মতটি ইবনে বশীরের; অন্যদের নিকট এই কথাটি পরিচিত নয়। ইবনে আবদুল হেকাম তার বিপরীত কথা বলেছেন। লখ্মী প্রমুখ তার উল্লেখ করেন নি। ‘তাওজীহ’ গ্রন্থে তা প্রকাশ করা হয়েছে। ইবনে আবদুস সালাম এই মতটিকে সহীহ্ বলে অভিহিত করেছেন। [দেখুন : (আরবী **********)] মালিকী মযাহাবের মতে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো লক্ষণীয়: ১. তাঁরা সকলে একমত এ ব্যাপারে যে, ‘সাবীলিল্লাহ্’ কথাটির সম্পর্ক যুদ্ধ-জিহাদ ও এই অর্থের পাহারাদারী ইত্যাদি কাজের সাথে। কিন্তু হানাফী মতের আলিমগণ জিহাদ, হজ্জ, ইল্ম শিক্ষা ও অন্যান্য আল্লাহ্র নৈকট্যমূলক কার্যাবলীর মধ্যকার পার্থক্যের ব্যাপারে বিভিন্ন মত পোষণ করেন। ২. তাঁরা জিহাদকারী ও পাহারাদারীর কাজে নিযুক্ত লোককে ধনী হলেও যাকাত দেয়া জায়েয মনে করেন। হানাফীরা ভিন্ন মত দিয়েছেন। তাঁদের এ বিষয় সংক্রান্ত মতটি কুরআনের বাহ্যিক অর্থের সাথে সংগতিপূর্ণ। কেননা কুরআনে ‘ফী-সাবীলিল্লাহ্’কে ফকীর মিসকীন উভয় খাত থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র একটি খাতরূপে চিহ্নিত করেছে। উক্ত মত হাদীসের সাথে নৈকট্যসম্পন্ন, কেননা হাদীসে উদ্ধৃত হয়েছে: পাঁচজন লোক ছাড়া অন্যদের জন্যে যাকাত হালাল নয়। এই পাঁচজনের মধ্যে ‘আল্লাহ্র পথে যুদ্ধকারী’ও উল্লেখ রয়েছে। এ বিষয়ে ‘গারেমীন’ পর্যায়ের আলোচনায় বিশদভাবে কথা বলা হয়েছে। হানাফীরা যোদ্ধার জন্যে গরীব হওয়ার যে শর্ত করেছেন, ইবনুল আরাবীর মতে তা অত্যন্ত দুর্বল কথা। বলেছেন, এটা কুরআনের কথার ওপর অতিরিক্ত। আর তাঁদের মতে মূল দলিলের ওপর অতিরিক্ত বলা হলে সেই কথাকে মনসূখ করা হয়, অথচ কুরআনের কোন কিছু মনসূখ হতে পারে কেবল অনুরূপ কুরআনের দ্বারা অথবা ‘মুতাওয়াতির’ হাদীস দ্বারা মাত্র। [দেখুন: (আরবী**********)] ৩. জমহুর ফিকাহ্বিদগণ যুদ্ধ সংক্রান্ত যাবতীয মাল-মসলা, অস্ত্রশস্ত্র, অশ্ব বা যানবাহন, প্রাচীর, যুদ্ধজাহাজ প্রভৃতি সবকিছু যাকাতের টাকা দিয়ে ক্রয় বা নির্মাণ করা সম্পূর্ণ জায়েয বলে মনে করেন। তাঁরা যাকাতকে কেবলমাত্র জিহাদকারীদের জন্যে ব্যয় করার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে রাজী নন। তা হচ্ছে হানাফীদের মত। কেননা তারা তো একজন নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে যাকাতের মালিক বানিয়ে দেয়াও ওয়াজিব বলে মনে করেন। কিন্তু জিহাদে বিনিয়োগে তা সম্ভব নয়। সত্য কথা হচ্ছে, মালিকীদের উপরিউক্তি মত কুরআনের ব্যাখ্যারসাথে অধিক সাযুজ্যপূর্ণ। কেননা কুরআনের এই বাক্যটি (***) দিয়ে বলা হয়েছে: (***) দিয়ে নয়, (***) দিলেই মালিক করানো বোঝা যেত। বাহ্যত এরূপ বর্ণনার দরুন যুদ্ধ সংক্রান্ত কাজে যাকাত ব্যয় করার প্রয়োজনীয়তা ব্যক্তি মুজাহিদদের জন্যে ব্যয় করার পূর্বেই অনুভূত হয়। শাফেয়ী মত শাফেয়ী মাযহাবের বক্তব্য হল, ‘সাবীলিল্লাহ’ বলতে তাদের বোঝায়, যারা যুদ্ধ করছে সওয়াব হাসিলের উদ্দেশ্যে, এজন্যে সরকারের নিকট থেকে কোন মাসিক বেতনের দাবি করে না। ইমাম নববীর লিখিত ‘আল-মিনহাজ’ গ্রন্থে এবং ইবনে হাজার আল হাইসী রচিত তার ব্যাখ্যায় এ কথা উদ্ধৃত হয়েছে। অথবা ইবনে হাজারের কথানুযায়ী রিযিকপাওয়ার লোকদের তালিকায় তাদের জন্যে অংশ নির্দিষ্ট নেই। বরং তারা স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে যুদ্ধে যোগদান করে যখন তারা নিজেরাই উৎসাহী হয়। অন্যথায় তারা নিজেদের পেশা ব্যবসায় ও শিল্পকর্মে লিপ্ত থাকে। বলেছেন, ‘সাবীলিল্লাহ’ বিষয়গতভাবে সেই পথ যা আল্লাহ্র নিকট পৌঁছিয়ে দেয়। পরে শব্দটি জিহাদ বোঝাবার জন্যে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। কেননা জিহাদে শরীক হওয়ার পরই মানুষসেই শাহাদাত বরণ করার সুযোগ পেতে পারে যা আল্লাহ্র নিকটবর্তী করে দেয়। অতঃপর উক্ত লোকদের বোঝানো হচ্ছে। কেননাপ তারা কোনরূপ বিনিময় না নিয়েই জিহাদ করছে। ফলে তারা যাকাত পাওয়ার ব্যাপারে অন্যদের তুলনায় উত্তম অধিকারী হয়ে দাঁড়ায়। [দেখুন (আরবী ************) এবং ] তাদের যুদ্ধকাজে সাহায্যকারী ও প্রয়োজনীয় জিনিস ক্রয়করে দেয়া যাবে- তারা নিজেরা ধনী হলেও। ইমাম শাফেয়ী তাঁর (****) গ্রন্থে অকাট্যভাবে লিখেছেন ‘সাবীলিল্লাহ’র ভাগ থেকে যোদ্ধাদের যাকাত দেয়া যাবে, সে গরীব হোক কি ধনী। তা থেকে অন্যদের দেয়া যাবে না। তবে দেয়া একান্ত প্রয়োজন হয়ে পড়লে দেয়া যাবে তাকে যে যাকাতের প্রতিবেশী হয়ে কাফিরদের আক্রমণের মুকাবিলায় প্রতিরক্ষার কাজ করে। [(আরবী ************)] (যাকাতের প্রতিবেশী অর্থ: যে অঞ্চল থেকে যাকাত সংগৃহীত হয়েছে, সেখানকার অধিবাসী হওয়া)। যাকাত প্রতিবেশী হওয়ার শর্ত করা হয়েছে এজন্যে যে, যেখানে যাকাত পাওয়া গেল সেখান থেকে তা স্থানান্তরিত করা জায়েয নয়। ইমাম নববী তাঁর (****) গ্রন্থে লিখেছেন: ‘গাযী-ইসলামী যোদ্ধাকে তার যাতায়াতকালীন যাবতীয় ব্যয় ও পোশাক দেয়া হবে, বিদেশে অবস্থানকালেও, তা যত দীর্ঘই হোক। তবে সমস্ত শ্রমমূল্য দেয়া হবে, না বিদেশ যাত্রার দরুন যা অতিরিক্ত হবে শুধু ততটুকু দেয়া হবে, এ পর্যায়ে দুটি দিক রয়েছে: ‘অশ্ব ক্রয়ের টাকা দেয়া হবে যদি সে অশ্বারোহী হয়ে যুদ্ধ করে। অস্ত্র ও যুদ্ধ সংক্রান্ত অন্যান্য যাবতীয় প্রয়োজনীয় দ্রব্যও ক্রয় করার ব্যবস্থা করে দেয়া হবে এবং তা সবই তার মালিকানাভুক্ত হবে। অবশ্য অস্ত্রও যানবাহন ভাড়ায়ও নেয়া যেতে পারে। সম্পদের প্রাচুর্য বা স্বল্পতার দৃষ্টিতে তা বিভিন্ন হবে। আর পায়ে হেটে যুদ্ধ করলে তাকে অশ্বক্রয়ের জন্যে যাকাত দেয়া হবে না।’ ইমাম নববী আরও বলেছেন, ‘আল-মিফতাহ্’ গ্রন্থের কোন কোন শরাহ গ্রন্থে লিখিত রয়েছে, গাযীকে তার নিজের এবং তার পরিবারবর্গের খরচপত্র দেযা হবে যুদ্ধযাত্রা, অবস্থান গ্রহণ ও প্রত্যাবর্তনকালীন সমস্ত সময়ের জন্যে। তবে জম্হুর ফিকাহ্বিদগণ যোদ্ধার পরিবারবর্গের ব্যয়ভার বহন পর্যায়েকিছু বলেন নি। কিন্তু তা দেয়াও অকল্পনীয় নয়, অস্বাভাবিকও নয়। বলেছেন, রাষ্ট্রপ্রধান এ ব্যাপারে ইচ্ছাধিকারী। ইচ্ছা করলে ঘোড়া ও অস্ত্রশস্ত্র সবকিছুরই তাকে মালিক বানিয়েও দিতে পারে। আর ইচ্ছা করলেতার জন্যে একটা বাহানও ভাড়া করতে পারে। আবার ইচ্ছা করলে যাকাতের এই অংশথেকে একটা ঘোড়া ক্রয় করে তা আল্লাহ্র পথে ওয়াক্ফও করে দিতে পারে।তখন সে তার ওপর প্রয়োজন মত আরোহণ করবে ও প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে তা ফেরত দেবে। [(আরবী ************)] যদি রাষ্ট্রীয় অর্থ ভাণ্ডার থেকে ‘ফাই’ নিঃশেষিত হয়ে যায়, রাষ্ট্রের হাতে এমন সম্পদ না থাকে যা দিয়ে যাদের রিযিক দেয়ার দায়িত্ব নেয়া হয়েছে তাদের তা দেয়া সম্ভব হতে পারে এবং মুসলিমসমাজ যদি কাফির শত্রুদের দুষ্কৃতি থেকে সংরক্ষিত থাকার জন্যে কোন লোক নিয়োগের প্রয়েঅজনবোধ করে, তাহলেতাদেরকে যাকাতের ‘ফী-সাবীলিল্লাহ্’ অংশ থেকে দেয়া যাবে কি না, এ একটি জরুরী প্রশ্ন। এ পর্যায়ে শাফেয়ী ফকীহ্গণ আলোচনা করেছেন। ইমাম নববী বলেছেন, এ পর্যায়ে দু’টি কথা। তন্মধ্যে অধিক স্পষ্ট কথা হচ্ছে, দেয়া যাবে না। তবে মুসলিম ধনী লোকদের দিয়েতার সাহায্য করাতে হবে। [(আরবী *********)] ধনী লোকেরা যদি অস্বীকার করে; কিংবাতাদের নিকট অতিরিক্ত ধন-মাল না থাকে এবং রাষ্ট্রপ্রধান ‘ফাই’ পাওয়ার যোগ্য লোকদের ছাড়া অন্য কাউকেনা পায়, তাহলেতাদের জন্যে যাকাত থেকে প্রয়োজনমত গ্রহণ করা কি জায়েয হবে? ইবনুলহাজার জোর করে বলেছেন, হ্যাঁ, তা তাদের জন্যে হালাল হবে। [(আরবী ************)] এ পর্যায়ে আমাদের বিবেচনা হচ্ছে: ‘ফী-সাবীলিল্লাহ্’র খাতটিকে কেবলমাত্র জিহাদ ও মুজাহিদদের মধ্যে সীমিতকরণে শাফেয়ী ও মালিকী মাযহাব ঐকমত্য পোষণকরে।আর মুজাহিদকেতার জিহাদের সাহায্যকারী জিনিসপত্র দেয়ার ব্যাপারে- সে ধনী ব্যক্তি হলেও জায়েয এবং মুজাহিদের জন্যে জরুরী অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহে যাকাত ব্যয় করার অনুমতি প্রদানের ব্যাপারেও কোন মতপার্থক্য দেখা যায় না। কিন্তু শাফেয়ীরা এ পর্যায়ে দুটি ব্যাপার হাম্বলীদের থেকে ভিন্নমত পোষণকরেন: ১. তাঁরা শর্ত করেছেন, মুজাহিদকে নফল জিহাদকারী হতে হবে, যার জন্যে যাকাতের কোন অংশ বা সরকারী ভাণ্ডারে কোন বেতন নির্দিষ্ট নেই। ২. এই অংশ ফকীর-মিসকীনের জন্যে নির্দিষ্ট অংশদ্বয়ের তুলনায় অধিক ব্যয় করা জায়েয মনে করেন না।– কেননা ইমাম শাফেয়ীর কথা হচ্ছে, আটটি খাতের মধ্যে সমান পরিমাণ ব্যয় করা ওয়াজিব।... হাম্বীল মত শাফেয়ী মাযহাবের ন্যায় হাম্বলী মাযহাবের বক্তব্য হল, যাকাতের ‘সাবীলিল্লাহ’ খাত থেকে অংশ দেয়া হবে সেই মুজাহিদদের যারা নফল হিসেবে যুদ্ধে যোগদান করেছে, যাদের জন্যে কোন বেতন নির্দিষ্ট নেই বা তাদের প্রয়োজনের তুলনায় কম সম্বল রয়েছে। এরূপ অবস্থায় মুজাহিদকে তার যুদ্ধ কাজের জন্যে প্রয়োজন অনুপাতে যথেষ্ট পরিমাণদেয়া হবে- সে ধনী ব্যক্তি হলেও। সে যদি কার্যত যুদ্ধ না করে তাহলে সেযা নিয়েছে তা ফেরত দেবে। এদের নিকট এটাই ঠিকযে, ঘাঁটিসমূহে পাহারাদারীকরাও কার্যত যুদ্ধের মতই কাজ এবং উভয়ই ‘ফী-সাবীলিল্লাহ্’ রূপে গণ্য। ‘গায়াতুল মুন্তাহা’ গ্রন্থ এবংতার শরাহ্ পুস্তকে উল্লেখ করা হয়েছে, রাষ্ট্রপ্রধান যাকাতের মাল দিয়ে অম্ব খরিদ করে তা এমন ব্যক্তিকে দিতে পারে- দেয়া জায়েয- যে তার ওপর সওয়ার হয়ে যুদ্ধ করবে। সেই যোদ্ধা নিজে যাকাতদাতা হলেও কোন দোষনেই। কেননা সে নিজের যাকাত বায়তুলমালে জমা দেয়ার পর তা থেকে নিঃসম্পর্ক হয়ে গেছে। অনুরূপভাবে যাকাতের টাকা দিয়ে যুদ্ধজাহাজও ক্রয় করতে পারে। কেননা তা যোদ্ধা ও তার সুবিধার জন্যে একান্ত প্রয়োজনীয়। আর মুসলিম জনগণের কল্যাণের জন্যে যে কোন কাজ করা- যে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করাই রাষ্ট্রপ্রধানের জন্যে সম্পূর্ণ জায়েয। কেননা তিনি অন্যদের তুলনায় সাধারণ জনকল্যাণ বিষয়ে অধিক অবহিত উদার দৃষ্টিসম্পন্ন অবশ্যই হবেন।কিনতউ ধন-মালের মালিক ব্যক্তির নিজের পক্ষে তা করা জায়েয হবে না। সে নিজের যাকাতের টাকা দিয়ে ঘোড়া ক্রয় করে ‘ফী-সাবীলিল্লাহ্’ নিয়োজিত করে দিতে পারে না। কোন জমি ক্রয় করে যোদ্ধার জন্যে ওয়াক্ফ করে দিতে পারে না। কেননা সে যে কাজ করতে নির্দেশিত হয়েছিলতা সে করিনি। [দেখুন (আরবী *********)] তবে হজ্জ সম্পর্কে ইমাম আহমাদ থেকে দুটি বর্ণনা উদ্ধৃত হয়েছে: একটি হচ্ছে তা ‘ফী-সাবীলিল্লাহ্’ কাজ। তাই যাকাত কোন ফকীরকে দেয়া হলে তা দিয়ে সে যদি ইসলামী নিয়ামানুযায়ী হজ্জ করে কিংবা এই কাজে যে সাহায্য দান করে, তবে তা জায়েয হবে। কেননা উম্মে মাকাল আল-আসাদিয়া থেকে বর্ণিত হয়েছে, তাঁর স্বামী একটা নব্য বয়সের উটকে ‘ফী-সাবীলিল্লাহ্’ নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন। আর তিনি নিজে উমরা করার ইচ্ছা করেছিলেন, তখন তিনি তাঁর স্বামীর নিকট সে উটটি চাইলেন, কিন্তু তিনি তা দিতে অস্বীকার করলেন। পরে তিনি নবী করীম (স)-এর উপস্থিত হয়ে এই বিষয়টির উল্লেখ করলেন। নবী করীম (স) স্বামীকে নির্দেশ দিলেন তাকে উটটি দেয়ার জন্যে এবং বললেন: হজ্জ ও উম্রা ‘ফী-সাবীলিল্লাহ্’ আল্লাহ্র পথে অর্থাৎ আল্লাহ্র পথের কাজ। [হাদীসটি আহমাদ ও অন্যান্যরা বর্ণনা করেছেন। হাদীসটি যয়ীফ। কেননা এর সনদে একজন অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি রয়েছে। একজন বর্ণনাকারী সম্পর্কে আপত্তি তোলা হয়েছে, তা ছাড়া এতে এলোমেলো অবস্থা (****) রয়েছে। আবূ দাউদ অপর এক সূত্রে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। সে সনদে মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক রয়েছে। সে সনদে তালাশ করে দেখুন। (আরবী ****) এই বর্ণনাটি হযরত ইবনে আব্বাস ও ইবনে উমর (রা) থেকেও বর্ণিত হয়েছে। ইসহাকের কথাও তাই। দ্বিতীয়ত, যাকাত হজ্জের কাজে ব্যয় করা যাবে না। জমহুর ফিকাহ্বিদদের বক্তব্যও তাই। ইবনে কুদামাহ তাঁর ‘আল-মুগ্নী’ গ্রন্থে বলেছেন: এই কথাটি অধিকতর সহীহ্। কেননা ‘ফী-সাবীলিল্লাহ্’-এর উল্লেখ হয়েছে, সেখানেই তার অর্থ ‘জিহাদ’ করা হয়েছে- দু-একটি ছাড়া। অতএব আয়াতটিকে তার যথার্থ অর্থেই গ্রহণ করা ওয়াজিব। কেননা বাহ্যত তাই আল্লাহ্র বক্তব্য মনে করতে হবে। উপরন্তু যাকাত দু’জনার যে-কোন একজনের জন্য ব্যয় করতে হবে: যে তার মুখাপেক্ষী তার জন্যে- যেমন ফকীর, মিসকীন ও দাসমুক্তি। আর গারেমীনদের জন্যে তাদের ঋণ শোধে অথবা মুসলমান যার মুখাপেক্ষী তার জন্যে ব্যয় করা যাবে, যেমন যাকাত কার্যে নিযুক্ত কর্মচারী, যোদ্ধা, মুয়াল্লাফাতু কুলুবুহুম এবং ‘গারেম’- ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি তাদিয়ে নিজের অবস্থা সংশোধন করে নেবে। কিন্তু কোন ফকীর ব্যক্তির হজ্জ আদায়ে মুসলিম জনগণের কোন কল্যাণ হওয়ার কথা নেই, মুসলমানদের জন্যে তার প্রয়োজনীয়তাও তেমন কিছু নেই, সেই ফকীর ব্যক্তির পক্ষেও তা আদায় করার আদৌ কোন প্রশ্নই ওঠে না। তা নিজের ওপর ওয়অজিব করে নিলেও তাতে কোন কল্যাণ নিহিত নেই। তার ওপর হজ্জ আদায়ের কর্তব্য চাপিয়েদিলে তাকে এমন একটা কষ্টে নিক্ষেপ করা হবে যা আল্লাহ তার ওপর থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। তার কর্তব্যের বোঝা হালকা করে দিয়েছেন। ফকীরকে হজ্জ করার জন্যেযাকাত না দিয়ে বরং অন্যান্য সব প্রাপকদের মধ্য থেকে অভাবগ্রস্ত লোকদের প্রাপ্য পরিমাণটা বাড়িয়ে দিয়ে মুসলমানদের সাধারণ কল্যাণমূলককাজে তা ব্যয় করা হলে তা অধিক উত্তম কাজ হবে।(আরবী *********) এটা বিশ্লেষণটা অতীব গভীর ও আলোকমণ্ডিত। তার ওপর নতুন করে কিছু বলার প্রয়োজন করে না। ইমাম আহমাদ থেকে অপর যে বর্ণনায় প্রাপ্ত হাদীসের উল্লেখ করা হয়েছে, তার সনদ যয়ীফ। হাদীসটিকে সহীহ্ বলে মেনে নিলেও কোন কোন শাফেয়ী ফিকাহ্বিদ উক্ত কথার জবাব দিয়েছেন এই বলে যে, ‘হজ্জ ‘ফী-সাবীলিল্লাহ্’ পর্যায়ের কাজ’ –এই কথা বলতে আমরা নিষেধ করছি না। তবে (*****) বলে যে আয়াতটির সূচনা, তার এক স্থানে যে ‘ফী-সাবীলিল্লাহ্’ বাক্য এসেছে তার তাৎপর্য কি, তাই নিয়েই তো দ্বন্দ্ব। সেই সাথে (*****) বলে যে হাদীসটির শুরু তাতে যে (*****) যোদ্ধা আল্লাহ্র পথের উল্লেখ করা হয়েছে, তা তো উক্ত আয়াতের সাথে তাৎপর্যগতভাবে সাযুজ্যপূর্ণ। তবে এই হাদীসটি আসল দাবির সমর্থন করে কিনা, সেবিষয়ে বক্তব্য রয়েছে। কেননা যে হাদীসটিতে উটকে ‘ফী-সাবীলিল্লাহ’ সাদ্কা দেয়ার কথাবলা হয়েছে; কিংবা যেটি সম্পর্কে ‘ফী-সাবীলিল্লাহ্’ দৃষ্টিতে অসীয়ত করা হয়েছে- যেমন অপর একটি বর্ণনায় হজ্জ করতে ইচ্ছুক ব্যক্তিকে তা দেয়ার জন্যে নির্দেশকরা হয়েছে- এক্ষণে আমরা যদি ধরে নিই যে, সেটি যাকাতের উট ছিল, তাহলে সম্ভবত যাকে সেটি দেয়া হয়েছিল সে ফকীর ছিল, তার পক্ষেতা ব্যবহার করে ফায়দা গ্রহণ জায়েয ছিল অথবা তাকে তার মালিক না বানিয়েই তার ওপর সওয়াব করানো হয়েছিল এবং তার ওপর তার মালিকত্ব ছিল না। [দেখুন: (আরবী *********)] আলোচ্য বিষয়ে চারটি মাযহাবের ঐকমত্য উপরে চারটি মাযহাবের মত বিশ্লেষণের মাধ্যমে আমরা লক্ষ্য করছি যে, আলোচ্য বিষয়ে তিনটি ব্যাপারে এই মাযহাব চতুষ্টয়ের ঐকমত্য রয়েছে: ১. জিহাদ নিশ্চিত ও নিঃসন্দেহভাবেই ‘ফী-সাবীলিল্লাহ্’ ভুক্ত। ২. যাকাতের অর্থ মুজাহিদ ব্যক্তিদে জন্যে ব্যয় করা শরীয়াতসম্মত হলেও জিহাদের প্রস্তুতি ও সুবিধা বিধানের জন্য যাকাত ব্যয় পর্যায়ে মাযহাবের চতুষ্টয়ের মধ্যে ঐকমত্য হয়নি। ৩. বাধ, পুল, মসজিদ, মাদ্রাসা নির্মাণ, রাস্তাঘাট মেরামত ও মৃতের দাফন-কাফন ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের সাধারণ জনকল্যাণ ও সওয়াবমূলক কাজে যাকাত ব্যয় করা জায়েয নয়। এসব কাজে সম্পন্ন করা হবে বায়তুলমালের অপরাপর-ফাই-খারাজ ইত্যাদি আয় থেকে। এসব কাজে যাকাত ব্যয় করা জায়েয না হওয়ার কারণ হচ্ছে, এসব ক্ষেত্রে কোন ব্যক্তিকে যাকাতের মালিক বানানোর সুযোগ নেই। এটা হানাফীদের কথা অথবা তা করা যাবে না এজন্যে যে, যাকাতের নির্দিষ্ট আটটি খাতের কোন একটিতে এগুলো পড়ে না। অন্যান্যরা এটাই বলেছেন। ‘বাদায়ে-ওয়াস-সানায়ে’ গ্রন্থ থেকে ‘ফী-সাবীলিল্লাহ্’র তাফসীর প্রসঙ্গে ‘সর্বপ্রকারের ইবাদত ও আল্লাহ্র নৈকট্যমূলককাজকে এ পর্যায়ে গণ্য করার কথা উদ্ধৃত হয়েছে বটে; কিন্তু তাতে যাকাতকে এক ব্যক্তির মালিকানায় দেয়ার শর্ত করা হয়েছে। অতএব তা সাধারণে ও নির্বিশেষে বন্টন করা বা ব্যয় করা যায়না। যেমন ব্যক্তির ফকীর হওয়ারও শর্ত করা হয়েছে। ফলে এই মতটি ‘ফী-সাবীলিল্লাহ্’র সংকীর্ণ তাৎপর্য গ্রহণের আওতার বাইরে আসতে পারেনি। ইমাম আবূ হানীফা মুজাহিদ ব্যক্তির ফকীর হওয়ার শর্ত আরোপ করেছেন। বলেছেন, তবেই তাকে যাকাত দেয়া যেতে পারে। এই মত কেবলমাত্র তাঁর একার। অপর দিকে ইমাম আহমাদ হাজী ও উমরাকারীর জন্যে যাকাত ব্যয় করা জায়েয বলে যে মত দিয়েছেন, তাঁর এই মত অপর কেউই গ্রহণ করেন নি। শাফেয়ী ও হানাফী উভয়ই এই শর্ত আরোপে একমত যে, সেসব মুজাহিদই যাকাত গ্রহণ করতে পারবে, যারা স্বেচ্ছামূরক কাজ হিসেবে জিহাদে শরীক হচ্ছে, যাদের জন্যে কোন মাসিক বেতন সরকারী দফতরে নির্দিষ্ট করা হয়নি। হানাফীরা ছাড়া অন্যরা সর্বাধিকভাবে জিহাদের সর্বপ্রকার কল্যাণমূলক কাজে যাকাত ব্যয় করা শরীয়াতসম্মত হওয়ার ব্যপারে একমত হয়েছেন। যাঁরা ‘সাবীলিল্লাহ্’র তাৎপর্য ব্যাপক মনে করেন প্রাচীন ও আধুনিককালে বিপুল সংখ্যক আলিম ‘সাবীলিল্লাহ্’-এর ব্যাপক তাৎপর্য গ্রহণ করেছেন।তাঁরা কেবল জিহাদ ও তৎসংশ্লিষ্ট কাজের মধ্যেই তার তাৎপর্য সীমিত বলে মনে করেন না। বরং তাঁদের তাফসীরে সর্বপ্রকার কল্যাণমূরক, আল্লাহ্র নৈকট্যবিধায়ক ও নেক কাজকে এর মধ্যে শামিল করেছেন। কেননা বাক্যটির আসল তাৎপর্য সেই রকমই। সেদিকে লক্ষ্য রেখেই তাঁরা এই মত দিয়েছেন। কতিপয় ফিকাহ্বিদের মত ইমাম রাযী তাঁর তাফসীরে এ পর্যায়ের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন (***) এই কথাটির বাহ্যিক তাৎপর্য অনুযায়ী তা থেকে কেবল যোদ্ধাদের বোঝানোই কোন ওয়াজিব কাজ নয়। পরে বলেছেন, এর অর্থের দৃষ্টিতে কিফাল তাঁর তাফসীর গ্রন্থে কোন কোন ফিকাহ্বিদের মত উদ্ধৃত করেছেন। তাঁরা যাকাতকে সর্বপ্রকারের কল্যাণমূরক কাজে ব্যয়করা জায়েয বলে মত দিয়েছেন। তার মধ্যে মৃতের লাশ কাফন-দাফন, কেল্লা ও মসজিদ নির্মাণ শামিল করেন। কেননা আল্লাহ্র কথা (*****) সর্বব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত। [আরবী ************] কিন্তু সেই ফিকাহ্বিদ কারা তা আমাদেরকে তিনি বলেন নি। তবে বিশেষজ্ঞগণ ‘ফকীহ’ গুণবাচক নামটি কেবল ‘মুজতাহিদ’ বোঝাবার জন্যেই ব্যহার করেন। যেমন ইমাম রাযী কিফালের কথার উদ্ধৃতি দেয়ার পর তার ওপর কোন মন্তব্য করেন নি। ফলে তা থেকেতাঁর মনে ঝোঁকটাও বোঝা যাচ্ছে না। আনাস ও হাসান সম্পর্কে বলা কথা ইবনে কুদামাহ তাঁর ‘আল্-মুগনী’ গ্রন্থে আনাস ইবনে মালিক ও হাসান বসরী- এই দুজনের মত উল্লেখ করেছেন্ তাঁরা দুজন বলেরেছন- যাকাতের যে অংশ পুল ও রাস্তাঘাট নির্মাণে ব্যয় করা হয়েছ, তা চলমান সাদ্কা বা সাধারণ দান বিশেষ। [***২] এই কথাটি থেকে বোঝা যায় যে, পুল বানানো, রাস্তা নির্মাণ ও তা মেরামত করার কাজে যাকাত ব্যয় করা জায়েয। তা একটি প্রবাহমান, জায়েয ও গ্রহণীয় সাদ্কা বিশেষ। কিন্তু আবূ উবাইদ উক্ত দুজন থেকে উক্ত কথাটি উদ্ধৃত করেছেন, যা ভিন্ন এক অর্থ বোঝায়। উল্লেখ করেছেন, মুসলিম ব্যক্তি যদি তার যাকাত শুল্ক আদায়কারীর নিকট নিয়ে যায় এবং সে যদি তার যাকাতের বিকল্প হিসেবে গ্রহণ করে অথচ এই ওশর গ্রহণকারী সরকার কর্তৃক যাকাত গ্রহণকারীরূপে নিয়োজিত ছিল- তারা যদি পুলবা রাস্তার ওপ দাঁড়িয়ে থেকে আশ্রয় গ্রহণকারী যুধ্যমান ও যিম্মী ব্যবসায়ী প্রভৃতি লোকদের নিকট থেকে এবং মুসলিম ব্যবসায়ীদের ওপর ধার্য ব্যবসায়ী কর আদায় করে, তাহলে তারা সম্ভবত সীমানার ওপরই দাঁড়িয়ে আছে এবং শুল্ককর আদায় করছে। আবূ উবাইদ কয়েজকজন তাবেয়ী ও তৎপরবর্তীকালের ফিকাহ্বিদদের মত উদ্ধৃত করেছেন। তারা হচ্ছেন ইবরাহীম, শাবী, আবূ জা’ফর, বাকের, মুহাম্মদ ইবনে আলী প্রমুখ। তাদের মত উপরিউক্ত অর্থটিকে তাকীদ করে। আর তা হচ্ছে, শুধু আদায়কারী যা গ্রহণ করেছে, তাকে যাকাত হিসেবে গণ্য করা হবে। এই কথা হাসান নিজেই স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন বলে উদ্ধৃত হয়েছে। যদিও সে মত এই পর্যায়ে মাইমুন ইবনে মাহ্রানের কথার সাথে সমঞ্জস্য নয়। তিনি তাঁর মালের যাকাত দেন; কিন্তু কি বাবদ তা নেয়া হল তার বিবেচনা করা হয় না। কিন্তু আবূ উবাইদ বলেন: আমাদের মতে ব্যাপারটি তাই যা আনাস, হাসান, ইবরাহীম, শা’বী ও মুহাম্মাদ ইবনে আলী বলেছেন এবং সব লোকই এই মত পোষণ করেন। [(আরবী *************)] ইবনে আবূ শাইবাও এই বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন। [(আরবী *************) বর্ণনাটির ভাষা হচ্ছে: ****] তাঁদের দুজন থেকে ‘যে বলেছে, শুল্ক আদায়কারী যা গ্রহণ করেছে, তা অবশ্যই গণ্য করা হবে’ শীর্ষক অধ্যায়ে তা উদ্ধৃত হয়েছে, আবূ উবাইদও তাই করেছেন। এই দৃষ্টিতে বলা যায়, ইবনে কুদামাহ, আনাস ও হাসান (রা)-এর নামে যে উক্তির উল্লেখ করেছেন। তা বোধ হয় টিক নয়, দৃঢ়ভিত্তিক নয়। জাফরী ইমামিয়া ফিকাহ্র মত ‘ইমামিয়া জাফরিয়া’ ফিকাহ্র কিতাব (*****) গ্রন্থে উদ্ধৃত হয়েছে, বলেছেন, (***) বলতে সর্বপ্রকার এমন কাজ বোঝায়, যা আল্লাহ্ নেকট্যবিধান করে, যা সার্বিক কল্যাণমূলক- যেমন হজ্জ, জিহাদ ও পুল নির্মাণ ইত্যাদি। কেউ কেউ বলেছেন, তা শুধু জিহাদ অর্থে ব্যবহৃত।[(আরবী *************)] (********)-জাফরী ফিকাহ্র একখানি বিশ্বকোষবত বিরাট গ্রন্থ। তাতে বলা হয়েছে: পুল, মুসজিদ নির্মাণ, হজ্জ ও সমস্ত কল্যাণময় ভালোকাজ ‘ফী-সাবীলিল্লাহ্’ পর্যায়ে গণ্য। শেষের দিকে সর্বসাধারণ ফিকাহ্বিদ এই মতই পোষণ করেন। এটাই শব্দের মৌল ভাবধারা বলে উক্ত মতের সমর্থন দেয়া হয়েছে। কেননা ‘সাবীল’ অর্থ পথ। বলা হয়েছে ‘সাবীলিল্লাহ’ এমন সব কিছুই বোঝায় যা আল্লাহ্র সন্তুষ্টি অর্জন ও সওয়াব পাওয়ার মাধ্যম বা কারণ হতে পারে। এই কারণে জিহাদও তার মধ্যে গণ্য। [দেখুন (আরবী *************)] জায়দীয়া ফিকাহ্র মত ইমাম জায়দ থেকে বর্ণিত যাবতীয় বিষয়ের ব্যাখ্যায় রচিত গ্রন্থাবলীর মধ্যে উল্লেখ্য গ্রন্থ (*****)। এই গ্রন্থে বলা হয়েছে: যাকাতের টাকা মৃতের কাফন ও মসজিদ নির্মাণ ব্যয় করা যাবে না। বলেছেন, যাঁরা তা জায়েয মনে করেন, তাঁরা দলিল দিয়েছেন এই মর্মে যে, এ সবই ‘ফী-সাবীলিল্লাহ্’-এর মধ্যে শামিল। কেননা তা সাধারণভাবেই কল্যাণের পথ, যদিও তার অধিক ব্যবহার ব্যক্তি পর্যায়ে জিহাদের জন্যে হয়েছে। কেননা ইসলামের প্রথম যুগে এই জিহাদের ঘটনাই তো খুব বেশি সংঘটিত হয়েছে। আর তা হয়েও থাকে। কিন্তু প্রচলিত তত্ত্বেও সীমা পর্যন্ত নয়। তাই তা তার প্রথম অর্থেই অবশিষ্ট রয়েছে। অতএব তাতে সর্বপ্রকারের আল্লাহ্র নৈকট্যমূলক কাজ শামিল ও গণ্য হবে। সাধারণ ও বিশেষ কল্যাণের দিকে দৃষ্টি দিলেও তা-ই বাঞ্ছনীয় মনে হয়। অবশ্য কোন বিশেষ দলিল যদি তার কোন বিশেষ অর্থ নিতে তাকীদ করে, তাহলে ভিন্ন কথা। আর ‘বাহ্রুর রায়েক’ গ্রন্থের বক্তব্যের বাহ্যিক অর্থ তাই যা বলেছি: বাহ্যত ‘সাবীলিল্লাহ’ সাধারণ অর্থই দেয়, কোন বিশেষ দলিল বিশেষ অর্থ গ্রহণের তাকীদ হলে ভিন্ন কথা।’ [জায়দীয়া ফিকাহ্র মত ইমাম জায়দ থেকে বর্ণিত যাবতীয় বিষয়ের ব্যাখ্যায় রচিত গ্রন্থাবলীর মধ্যে উল্লেখ্য গ্রন্থ (*****)। এই গ্রন্থে বলা হয়েছে: যাকাতের টাকা মৃতের কাফন ও মসজিদ নির্মাণ ব্যয় করা যাবে না। বলেছেন, যাঁরা তা জায়েয মনে করেন, তাঁরা দলিল দিয়েছেন এই মর্মে যে, এ সবই ‘ফী-সাবীলিল্লাহ্’-এর মধ্যে শামিল। কেননা তা সাধারণভাবেই কল্যাণের পথ, যদিও তার অধিক ব্যবহার ব্যক্তি পর্যায়ে জিহাদের জন্যে হয়েছে। কেননা ইসলামের প্রথম যুগে এই জিহাদের ঘটনাই তো খুব বেশি সংঘটিত হয়েছে। আর তা হয়েও থাকে। কিন্তু প্রচলিত তত্ত্বেও সীমা পর্যন্ত নয়। তাই তা তার প্রথম অর্থেই অবশিষ্ট রয়েছে। অতএব তাতে সর্বপ্রকারের আল্লাহ্র নৈকট্যমূলক কাজ শামিল ও গণ্য হবে। সাধারণ ও বিশেষ কল্যাণের দিকে দৃষ্টি দিলেও তা-ই বাঞ্ছনীয় মনে হয়। অবশ্য কোন বিশেষ দলিল যদি তার কোন বিশেষ অর্থ নিতে তাকীদ করে, তাহলে ভিন্ন কথা। আর ‘বাহ্রুর রায়েক’ গ্রন্থের বক্তব্যের বাহ্যিক অর্থ তাই যা বলেছি: বাহ্যত ‘সাবীলিল্লাহ’ সাধারণ অর্থই দেয়, কোন বিশেষ দলিল বিশেষ অর্থ গ্রহণের তাকীদ হলে ভিন্ন কথা।’ [জায়দীয়া ফিকাহ্র মত ইমাম জায়দ থেকে বর্ণিত যাবতীয় বিষয়ের ব্যাখ্যায় রচিত গ্রন্থাবলীর মধ্যে উল্লেখ্য গ্রন্থ (*****)। এই গ্রন্থে বলা হয়েছে: যাকাতের টাকা মৃতের কাফন ও মসজিদ নির্মাণ ব্যয় করা যাবে না। বলেছেন, যাঁরা তা জায়েয মনে করেন, তাঁরা দলিল দিয়েছেন এই মর্মে যে, এ সবই ‘ফী-সাবীলিল্লাহ্’-এর মধ্যে শামিল। কেননা তা সাধারণভাবেই কল্যাণের পথ, যদিও তার অধিক ব্যবহার ব্যক্তি পর্যায়ে জিহাদের জন্যে হয়েছে। কেননা ইসলামের প্রথম যুগে এই জিহাদের ঘটনাই তো খুব বেশি সংঘটিত হয়েছে। আর তা হয়েও থাকে। কিন্তু প্রচলিত তত্ত্বেও সীমা পর্যন্ত নয়। তাই তা তার প্রথম অর্থেই অবশিষ্ট রয়েছে। অতএব তাতে সর্বপ্রকারের আল্লাহ্র নৈকট্যমূলক কাজ শামিল ও গণ্য হবে। সাধারণ ও বিশেষ কল্যাণের দিকে দৃষ্টি দিলেও তা-ই বাঞ্ছনীয় মনে হয়। অবশ্য কোন বিশেষ দলিল যদি তার কোন বিশেষ অর্থ নিতে তাকীদ করে, তাহলে ভিন্ন কথা। আর ‘বাহ্রুর রায়েক’ গ্রন্থের বক্তব্যের বাহ্যিক অর্থ তাই যা বলেছি: বাহ্যত ‘সাবীলিল্লাহ’ সাধারণ অর্থই দেয়, কোন বিশেষ দলিল বিশেষ অর্থ গ্রহণের তাকীদ হলে ভিন্ন কথা।’ [ (আরবী ************)] এই আলোচনা থেকে প্রমাণিত হল যে, ‘বাহ্র’[ ও ‘আর-রওজ’ এই গ্রন্থ দুটির লেখকদ্বয় ‘সাবীলিল্লাহ’র খুব ব্যাপক অর্থ গ্রহণের পক্ষপাতী। (******) গ্রন্থ বলা হয়েছে, কুরআন নির্ধারিত এই খাতের অতিরিক্ত ও উদ্ধৃত যাকাতের অর্থ সাধারণ মুসলিম জনগণের কল্যাণ ব্যয় হতে হতে পারে। আল-ইমামুল হাদী এই কথা বলিষ্ঠ ভাষায় বলেছেন। আবূ তালিব বলেছেন: হ্যাঁ, এ সব কল্যাণময় কাজে যাকাত ব্যয় করা যাবে দরিদ্র জনগণকে সচ্ছল বানানোর পর। সেখানে যদি কোন ফকীর এখন অভাবগ্রস্ত থেকে থাকে, তাহলে সে-ই যাকাত পাওয়ার অধিকারী। তাঁদের অন্যরা মনে করেন, এই শর্তটি ‘মুস্তাহাব’ বা উত্তম বলে ধরা যায়। অন্যথায় ফকীর-মিসকীন থাকা সত্ত্বেও এসব কল্যাণকর কাজে যাকাত ব্যয় করা হলে তা নিশ্চয়ই জায়েয হবে। ‘আল-আজহা’র গ্রন্থের টীকায় ‘আল্-বাহর; গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত করা হয়েছে, ‘সাবীলিল্লাহ’ খাতে ব্যয় করার পর যা উদ্ধৃত থাকবে তা-ই শুধু কল্যাণময় কাজে ব্যয় করা যাবে, এমন কথা নয়। বরং আটটি খাতে ব্যয় করার পর যা উদ্ধৃত থাকবে, তা-ই সাধারণ কল্যাণে ব্যয় করা যাবে, যেমন কল্যাণময় কাজের জন্যে নির্দিষ্ট অর্থ ফকীর-মিসকীনদের জন্যে ব্যয় করা সঙ্গত। [দেখুন: জায়দীয়া ফিকাহ্র মত ইমাম জায়দ থেকে বর্ণিত যাবতীয় বিষয়ের ব্যাখ্যায় রচিত গ্রন্থাবলীর মধ্যে উল্লেখ্য গ্রন্থ (*****)। এই গ্রন্থে বলা হয়েছে: যাকাতের টাকা মৃতের কাফন ও মসজিদ নির্মাণ ব্যয় করা যাবে না। বলেছেন, যাঁরা তা জায়েয মনে করেন, তাঁরা দলিল দিয়েছেন এই মর্মে যে, এ সবই ‘ফী-সাবীলিল্লাহ্’-এর মধ্যে শামিল। কেননা তা সাধারণভাবেই কল্যাণের পথ, যদিও তার অধিক ব্যবহার ব্যক্তি পর্যায়ে জিহাদের জন্যে হয়েছে। কেননা ইসলামের প্রথম যুগে এই জিহাদের ঘটনাই তো খুব বেশি সংঘটিত হয়েছে। আর তা হয়েও থাকে। কিন্তু প্রচলিত তত্ত্বেও সীমা পর্যন্ত নয়। তাই তা তার প্রথম অর্থেই অবশিষ্ট রয়েছে। অতএব তাতে সর্বপ্রকারের আল্লাহ্র নৈকট্যমূলক কাজ শামিল ও গণ্য হবে। সাধারণ ও বিশেষ কল্যাণের দিকে দৃষ্টি দিলেও তা-ই বাঞ্ছনীয় মনে হয়। অবশ্য কোন বিশেষ দলিল যদি তার কোন বিশেষ অর্থ নিতে তাকীদ করে, তাহলে ভিন্ন কথা। আর ‘বাহ্রুর রায়েক’ গ্রন্থের বক্তব্যের বাহ্যিক অর্থ তাই যা বলেছি: বাহ্যত ‘সাবীলিল্লাহ’ সাধারণ অর্থই দেয়, কোন বিশেষ দলিল বিশেষ অর্থ গ্রহণের তাকীদ হলে ভিন্ন কথা।’ [****১]] (*******)-এর লেখকের অভিমত সাইয়েদ সিদ্দিক হাসান খান লিখিত (******) গ্রন্থের বক্তব্য এখানে তুলে দেয়া হচ্ছে। স্বতন্ত্র ধরনের আহলি হাদীস লোকদের মত এই গ্রন্থে লিপিবদ্ধ হয়েছে। বলেছেন, ‘সাবীলিল্লাহ্’-এর তাৎপর্য এখানে হচ্ছে, ‘আল্লাহ্র নিকট পৌঁছার পথ।’ ‘জিহাদ’ যদিও আল্লাহ্র নিকট পৌঁছার বহু সংখ্যক পথের মধ্যে অনেক বিরাট ও উচ্চ পথ, তা সত্ত্বেও কেবল এই একটি অর্থেই তা বিশেষভাবে ব্যবহৃত মনে করার কোন প্রমাণ নেই। বরং তা মহান আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছার যে-কোন কাজে তা ব্যয়করা যথার্থ ও সহীহ্ হবে। এ হচ্ছে আয়াতটির আভিধানিক অর্থ। আর এই আভিধানিক অর্থের ওপর স্থিতি গ্রহণই কর্তব্য। তার স্থানান্তরকরণ এখানে শরীয়াতের দৃষ্টিতে সঠিক হতে পারে না। পরে বলেছৈন, ‘সাবীলিল্লাহ্’ পর্যায়ের একটি বড় ব্যয় হল দ্বীনদার মুসলিম জনগণের সার্বিক কল্যাণের কাজে আত্মনিয়োগকারী আলিমগণের জন্যে ব্যয় করা। কেননা আল্লাহ্র ধন-মালে তাদের অংশ রয়েছে, তারা ধনী হোক, কি দরিদ্র। বরঞ্চ এই প্রয়োজনে ব্যয় করা অতীব গুরুত্বপূর্ণ কাজ কোন সন্দেহ নেই। কেননা আলিমগণ হচ্ছেন নবীগণের উত্তরাধিকারী। দ্বীনের ধারক ও বাহক হচ্ছেন তাঁরা। ইসলামের মৌল আকীদা ও সার সংরক্ষণ তাদের কারণেই সম্ভব হয়েছে। মুহাম্মাদ (স)-এর উপস্থাপিত শরীযাত তাঁদের চেষ্টা-প্রচেষ্টায়ই জারি আছে। [(আরবী ************)] মুহাদ্দিসমণ্ডলীর মত-আল কাসেমী শায়খ জামালুদ্দিন আল কাসেমী (র) তাঁর তাফসীরে তাই লিখেছেন, যার উল্লেখ করেছেন ইমাম ফখরুদ্দীন আর-রাযী। তা হল বাহ্যত বাক্যটিথেকে কেবল যোদ্ধাদেরই বুঝাতে হবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা নেই। কেফাল এ পর্যায়ে কোন কোন ফিকাহ্বিদদের মতামত উদ্ধৃত করেছেন। পরে ‘তাজ’ গ্রন্থের উদ্ধৃতি দিয়েছেন: ‘এমন প্রত্যেক পথই আল্লাহ্র পথ যার মূল লক্ষ্য হচ্ছেন আল্লাহ্’ –তাই কল্যাণময়, পূণ্যময়। [(আরবী ************)]..... এবং উপরের উদ্ধৃতিসমূহের ব্যাপারে নীরবতা অবলম্বন করেছেন। সে বিষয়ে কোন উচ্চবাচ্যও করেন নি। রশীদ রিজা ও শালাতুতের অভিমত ‘আল-মানার’ তাফসীর প্রণেতা সাইয়্যেদ রশদি রিজা (র) যাকাত ব্যয়ের ক্ষেত্র সংক্রান্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেছেন: প্রকৃত সত্য হচ্ছে, এই পর্যায়ে ‘সাবীলিল্লাহ্’ বলতে বোঝায় মুসলিম জনগণের কল্যাণময় যাবতীয কাজ, যার দৌলতে ব্যক্তির পরিবর্তে দ্বীন ও সমষ্টি তথা রাষ্ট্রের স্থিতি সম্ভব। ব্যক্তিগণের হজ্জ এ পর্যায়ে গণ্য নয়। কেননা হজ্জ তো সামর্থ্যবান ব্যক্তিদের ওপর ফরয, অন্যদের ওপর নয়। তা হচ্ছে আইন ফরয, তার শর্তগুলো নামায-রোযার মতই। তা দ্বীনি সামষ্টিক কল্যাণময় কাজের মধ্যে গণ্য নয়। তবে হজ্জ অনুষ্ঠান ও উম্মতের প্রতিষ্ঠা সেই পর্যায়ে গণ্য। তাই হজ্জের পথের নিরাপত্তা বিধান, পানি ও খাদ্যের প্রাচুর্যের ব্যবস্থা এবং হাজীদের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত ব্যবস্থাদি গ্রহণে যাকাতের এই ভাগের টাকা ব্যয় হতে পারে- যদি তার জন্য অপর কোন ব্যয়ের ক্ষেত্র না থাকে। [(আরবী ************)] এর একটু পরেই উক্ত তাফসীরকার লিখেছেন: ‘সাবীলিল্লাহ্ বলতে সর্বসাধারণের কল্যাণময় শরীয়াতসম্মত কার্যাবলী বোঝায়, যাতে দ্বীন ও জাতি বা রাষ্ট্রের কল্যাণ নিহিত। তন্মধ্যে সর্বোত্তম ও সর্বপ্রথম অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য হচ্ছে যুদ্ধের প্রস্তুতি ও যোগ্যতা অর্জন, অস্ত্র ক্রয়, সেনাবাহিনীর খাদ্য, যানবাহন ও যোদ্ধাদের সজ্জিতকরণ ইত্যাদি কাজ (এই কথা ইসলামী যুদ্ধ ও ইসলামী সেনাবাহিনীর দৃষ্টিতে বিবেচ্য, যারা কেবলমাত্র আল্লাহ্র কলেমা প্রচারের উদ্দেশ্যে যুদ্ধ করবে)। মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল হেকামও এই মত দিয়েছেন, যা ইতিপূর্বে উদ্ধৃত হয়েছে; তবে যেসব জিনিস দিয়ে যোদ্ধাকে সুসজ্জিত করা হবে, তা যুদ্ধের পর বায়তুলমালে ফেরত নিতে হবে- যদি তা অবশিষ্ট থাকে। যেমন অস্ত্রশস্ত্র, ঘোড়া ইত্যাদি যানবাহন। কেননা যোদ্ধা এগুলো যুদ্ধকালে ব্যবহার করলেও সে তার স্থায়ী মালিক হয়ে যায়নি। সে তো তা আল্লাহ্র পথে ব্যবহার করবে মাত্র। আল্লাহ্র পথের যোদ্ধা হওয়ার সেই অবস্থা শেষ হয়ে গেলে তা থেকে যাবে। এই সাধারণ প্রয়োগের মধ্যে সামরিক হাসপাতালও অন্তর্ভুক্ত। অন্যান্য সাধারণ কল্যাণময় কাজও শামিল এর মধ্যে। নতুন রাস্তাঘাট নির্মাণ ও পুরাতনের মেরামত, রেল লাইন ব্যারেজ, সামরিক এয়ারপোর্ট, দুর্গ ও পরিখা খনন ইত্যাদি। আমাদের এই যুগে ‘ফী-সাবীলিল্লাহ্’ খাতের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে ইসলামের দিকে আহ্বানকারী লোক তৈয়ার ও সংগঠন করা, তাদেরকে কাফিরদের দেশে প্রেরণ করা, সুসংগঠিত বড় বড় সংগঠনের পক্ষ থেকে, যা তাদেরকে যথেষ্ট পরিমাণ পাকা-পয়সা দিয়ে সাহায্য করবে। কাফিরদের মিশনারী প্রতিষ্ঠানসমূহ যেমন করছে। আমরা এই আয়াতের ব্যাখ্যায় এই বিরাট কল্যাণময় কাজের বিস্তারিত রূপরেখা তুলে ধরছি। [আলে ইমরান, ১০৪ আয়াত] (আরবী ************) তোমাদের মধ্যে কল্যাণময় কাজের দিকে আহ্বানকারী একটি দল অবশ্যই থাকতে হবে। শায়খ মাহমুদ শালতুত (র) ‘সাবীলিল্লাহ্র’ ব্যাখ্যায় অনুরূপ কথাই বলেছেন। তিনি লিখেছেন: ‘যে সাধারণ কল্যাণময় কাজের কোন ব্যক্তি মালিক নয়, যার কল্যাণ কোন ব্যক্তি বিশেষের সাথে সংশ্লিষ্টও নয়, তার মালিক হচ্ছেন আল্লাহ্ তা’আলা, তার কল্রাণ আল্লাহর সৃষ্টিকুলের জন্য। যে সামরিক প্রস্তুতি ও প্রতিষ্ঠান দ্বারা জাতি বিদ্রোহ দমন করে, মান-মর্যাদা রক্ষা করে, মানবীয় আবিষ্কার ও নবোদ্ভাবনসমূহের প্রস্তুতি ও সংরক্ষণ পরিচালনা করে, তা সবই এর মধ্যে সর্বাগ্রগণ্য। সামরিক ও সামষ্টিক হাসপাতালসমূহ এর মধ্যে পড়ে। রাস্তাঘাট নির্মাণ ও মেরামতকরণ, রেল লাইন বিছানো প্রভৃতিও এর মধ্যে শামিল। কেননা এগুলো যোদ্ধাদের জন্যে প্রয়োজনীয়। শক্তিশালী পরিপক্ক ইসলাম প্রচারক দল প্রস্তুতকরণ- যারা ইসলামের সৌন্দর্য ও মাহাত্ম বর্ণনা করবে, তার যৌক্তিকতার ব্যাখ্যা করবে, তার বিধানসমূহ লোকদের জানিয়ে দেবে, শত্রুপক্ষের সব আক্রমণের মুকাবিলা করবে- যেন যার ফলে তাদের ষড়যন্ত্র তাদেরই বিরুদ্ধে যায়- প্রভৃতি খুবই জরুরী কাজ। অনুরূপভাবে যেসব উপায়-উপকরণ দ্বারা কুরআন হেফ্কারীদের স্থায়ী সংরক্ষণ সম্ভব- যারা ক্রমাগতভাবে কুরআন তার নাযিল হওয়ার সময় থেকে এ পর্যন্ত রক্ষা করে নিয়ে এসেছে- কিয়ামত পর্যন্ত নিয়ে যাবে ইন্শাআল্লাহ্- সে সবের ব্যবস্থা করাও এর মধ্যে গণ্য। [(আরবী ************)] এই আলোচনা ‘আল-মানার’ তাফসীর লেখকের মতেরই সমর্থন করছে। মসজিদ নির্মাণে যাকাত ব্যয় করা যায় কিনা, এই প্রশ্নের জবাবে এরই ভিত্তিতে ফতোয়া হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে: ‘যে মসজিদ নির্মাণ বা মেরামত করার ইচ্ছা করা হয়েছে, তা যদি তথায় একমাত্র মসজিদ হয়েথাকে, অপর একটি মসজিদ থাকলেও তাতে নামাযীদের সংকুলান হয় না- যদি এমন হয় এবং আর একটি মসজিদের প্রয়োজন তীব্র হয়ে দেখা দেয়, তাহলে এই সমজিদের নির্মাণবা মেরামতে যাকাতের টাকা ব্যয় করা শরীয়াতসম্মত ও সহীহ্ কাজ হবে। আর এরূপ অবস্থায় মসজিদের জন্য ব্যয় সেই খাত থেকে করা হবে, যা সূরা তওবার আয়াতে ‘সাবীলিল্লাহ্’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে যাকাত ব্যয়ের খাত প্রসঙ্গে। এ কথার ভিত্তি হচ্ছে এই অবলম্বন যে, ‘সাবীলিল্লাহ্’ বলতে সাধারণ জনকল্যাণমূরক কাজই বোঝায়, যাতে তাবৎ মুসলিম জনগণ উপকৃত হতে পারে, কোন বিশেষ এক ব্যক্তি বিশেষভাবে উপকৃত হবে না এমন হবে। তাহলে তাতে মসজিদ, হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ইস্পাত কারখানা, গুদাম ও তৎসংশ্লিষ্ট সব কিছু তার মধ্যে গণ্য। কেননা এগুলোর কল্যাণ লোকসমষ্টি পায়। এখানে একথাও বলার প্রয়োজন মনে করি যে, বিষয়টি নিয়ে আলিমগণের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। (এর পর ইমাম রাযী কিফাল থেকে সর্বপ্রকার কল্যাণময় কাজে যাকাত ব্যয় করা প্রসঙ্গে যা লিখেছেন, তাই উদ্ধৃত করেছেন) শেষ পর্যন্ত বলেছেন: আমি এই কথা পসন্দ করি, এতে মনের নিশ্চন্ততা পাই এবং এরই অনুকূলে ফতোয়া দিচ্ছি। কিন্তু মসজিদ প্রসঙ্গে যে শর্তের উল্লেখ করেছি, সে মসজিদটি এমন যে, তা ছাড়া চলে না। নতুবা মসজিদ ছাড়া অন্যান্য কাজে ব্যয় করাই উত্তম ও বেশি অধিকারসম্পন্ন। [দেখুন: (আরবী ************)] মাখলুফের ফতোয়া শায়খ হুসাইন মাখলুফ (মিশরের প্রাক্তন মুফতী)-কে ইসলামী জনকল্যাণমূলক সংস্থাসমূহকে যাকাত দেয়া জায়েয কিনা- প্রশ্ন করা হলে তিনি ফতোয়া দিলেন যে, হ্যাঁ, তা জায়েয। ইমাম রাযী কিফাল প্রমুখ থেকে ‘সাবীলিল্লাহ্’র অর্থ তাৎপর্য পর্যায়ে যা কিছু উল্লেখ করেছেন তাই ছিল তাঁর বড় দলিল। [দেখুন: (আরবী ************)] তুলনা ও অগ্রাধিকার দান উপরের চারটি মাযহাবের মতই উল্লেখ করা হয়েছে, যার অধিকাংশরই মত হচ্ছে, ‘সাবীলিল্লাহ্’ বলতে জিহাদ ও তৎসংশ্লিষ্ট কার্যাদি বোঝায়। তার পরে আমরা প্রাচীনকালীন ফিকাহ্বিদ ও মুহাদ্দিসগণের অভিমতও উদ্ধৃত করেছি। তাতে দেখা গেছে যে, এরা সকলেই ‘সাবীলিল্লাহ্’র ব্যপক অর্থ গ্রহণ করার পক্ষপাতী। এক্ষণে এ দুটি মতের কোন্টি অধিকতর সত্যানুগ ও অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য, তা চিহ্নিত করা আমাদের জন্যে একান্তই কর্তব্য হয়ে পড়েছে। যারা সাবীলিল্লাহ্’-এর ব্যপক অর্থ গ্রহণ করেছেন, তাঁদের ভিত্তি স্থাপিত একটা সুস্পষ্ট দলিলের ওপর। আর তা হচ্ছে ‘সাবীলিল্লাহ্’ কথাটির আসল ও মূলগত অর্থ। তা বাস্তবিকই সর্বপ্রকারের কল্যাণের কাজে শামিল করে। যেসব কাজের ফায়দা সার্বিকভাবে মুসলিম জনগণ পেতে পার, তা সবই এর অন্তর্ভুক্ত। ফলে ধরা যায় যে, তাঁরা মসজিদ নির্মাণ, মাদ্রাসা ও হাসপাতাল চালানো এবং সর্বপ্রকারের কল্যাণমূলক কাজেই যাকাত ব্যয় করা জায়েয বলে মনে করেছেন। কিন্তু চারটি মাযহাবের জম্হুর ফিকাহ্ডবিদগণই এই মত সমর্থন করেন নি। উক্ত কার্যাদিতে যাকাত ব্যয় করতে তাঁরা নিষেধ করেছেন। তাঁরা দুটি দলিলের ভিত্তিতে এই মত গ্রহণ করেছেন: প্রথম হচ্ছে, হানাফী মাযহাবের সেই গোঁড়ামী (***) যে, প্রাপককে যাকাতের মালিক বানিয়ে দেয়া যাকাতের একটা রুকন্ বিশেষ- যা না হলে যাকাত আদায় করা হয় না। অথচ মালিকবিহীন কল্যাণমূলক কার্যাদিতে এটা অনুপস্থিত, সেখানে তা অকল্পনীয়। মালিক বানিয়ে দেয়াকে রুক্ন হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে, আল্লাহ্ একে সাদ্কা নামে অভিহিত করেছেন। আর ‘সাদ্কা’র তত্ত্বকথা হচ্ছে কোন ফকীর মালের (****) মালিক বানিয়ে দেয়া। [(আরবী ************)] দ্বিতীয়: মসজিদ, মাদ্রাসা, পানি পানের ব্যবস্থা প্রভৃতি যেসব কাজের উল্লেখ এই পর্যায়ে করা হয়, তার কোনটিই যাকাত ব্যয়ের ঘোষিত আটটি খাতের মধ্যে কোন খাতেও পড়ে না। কুরআন মজীদই এই খাতসমূহ নির্দিষ্ট করে দিয়েছে স্পষ্ট ভাষায়। বলেছে: (আরবী ************) সাদ্কা-যাকাত- কেবলমাত্র ফকীর.... ইত্যাদির জন্যে। (****) শব্দটি দ্বারা এই খাতসমূহকে সীমাবদ্ধ ও সুচিহ্নিত করে দেযা হয়েছে। তা উল্লিখিত বিষয়গুলোকে প্রমাণিত করে এবং তাছাড়া অন্যগুলোকে নিষিদ্ধ করে দেয়। সেই সাথে হাদীসও রয়েছে: (আরবী ************) তার প্রারম্ভিক কথা হল, আল্লাহ্ তা’আলা যাকাতের ব্যাপারে চূড়ান্ত ফয়সালা করে দিয়েছেন, তিনি নিজেই তাকে আটটি অংশে বিভক্ত করে দিয়েছেন.... ইত্যাদি... ইবনে কুদামাহ তাঁর ‘আল-মুগনী’ গ্রন্থেও এই হাদীসটিকেই ভিত্তি করেছেন। [(আরবী ************)] প্রথমোক্ত দলিলটি সম্পর্কে বক্তব্য রয়েছে। পূর্বে অবশ্য বলা হয়েছে, কুরআন যেসব খাতের উল্লেখ করেছে (***) দিয়ে তাতে, (****) ‘মালিক বানিয়ে দেয়া’র শর্ত নেই। যেসব ফিকাহ্বিদ যাকাতের টাকা দিয়ে দাসমুক্তকরণ ও মৃতের ঋণ শোধ করা জায়েয বলে ফতোয়া দিয়েছেন- যদিও তাতে মালিক বানানোর সুযোগ নেই- তাঁরই উক্তরূপ ফতোয়া প্রচার করেছেন। তাছাড়া রাষ্ট্রীয় বায়তুলমালে যাকাত জমা করা হলেই তো রাষ্ট্রপ্রধানকে তার মালিক বানিয়ে দেয়া হল সব ফকীর মিসকীনের প্রতিনিধিরূপে। ফকীরের হাতে যাকাত দিয়ে তাকে মালিক বানিয়ে দেয়া তো জরুরী নয়, তাছাড়া অন্য কোনভাবে মালিক বানানো যায় না এমনও তো নয়। তাই রাষ্ট্রপ্রধান বা তার প্রতিনিধি যখন যাকাত গ্রহণ করলেন, তখন তো তিনি উপরিউক্ত কার্যাবলীতে যাকাত ব্যয় করতে পারেন। কেননা তিনি তো যাকাত পাওয়ার লোকদের পক্ষথেকে তার মালিক হয়েছেন তা গ্রহণ করে। আর দ্বিতীয় দলিল- যাকাত ব্যয়ের খাত আটটির মধ্যে সীমিত- এই মতের ওপর ভিত্তিশীল। এমতাবস্থায় যারা সাবীলিল্লাহ্র ব্যাপক অর্থ গ্রহণের পক্ষপাতী তাদের জবাব দেয়ার জন্য একথা যথেষ্ট নয়, যতক্ষণ পর্যন্ত তাঁরা বলবেন যে, মসজিদ ইত্যাদি নির্মাণ ‘সাবীলিল্লাহ্’র মধ্যকার কাজ। কেননা তা বলা হলে আল্লাহ্র কথায় সীমিত ও নির্ধারিত আটটি খাতের বাইরে তো যাওয়া হল না। কিন্তু এই মতের লোকদের জন্যে সঠিক জবাব হতে পারে ‘সাবীলিল্লাহ্’র তাৎপর্য স্পষ্টভাবে নির্ধারণ করা হলে তা কি শুধু যুদ্ধ ও মারামারির অর্থে বিশেষভাবে ব্যবহৃত- যেমন জমহুর ফিকাহ্বিদগণ মত দিয়েছেন, না তা সর্বপ্রকারের কল্যাণ ও আল্লাহ্র নৈকট্যমূলক কার্যাবলীও সাধারণভাবে শামিল করে? এই মতের কথা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। আর শব্দের সাধারণ তাৎপর্যের দিক দিয়েও তা বোঝা যায়। এই শব্দের তাৎপর্য সূক্ষ্মভাবে নির্ধারণের জন্যে কুরআনের যেসব স্থানে এই শব্দ উল্লিখিত হয়েছে তার সব কয়টির একত্রে উল্লেখ প্রয়োজন হয়ে পড়েছে আমাদের পক্ষে। তাহলেই কোথায় তার কি অর্থ করা হয়েছে তা বোঝা যাবে। আর কুরআনের উত্তম তাফসীর তো কুরআন দিয়েই হতে পারে। কুরআনে ‘সাবীলিল্লাহ্’ কুরআন মজীদের ‘ফি-সাবীলিল্লাহ্’ পূর্বে ‘ফি-সাবীলিল্লাহ্’ অক্ষরটি ব্যবহৃত হয়েছে, যেমন আলোচ্য যাকাতের খাত সংক্রান্ত আয়াতে রয়েছে এবং এটাই অধিক মাত্রায় ব্যবহৃত। কখনও তার পূর্বে (****) রয়েছে। এরূপ ব্যবহার কুরআনে প্রায় তেইশটি আয়াতে রয়েছে। এসব আয়াতে তার পূর্বে (***) বিরত রাখা) ব্যবহৃত হয়েছে- যেমন: (আরবী ************) যেসব লোক কুফরী করে ও (লোকদের) আল্লাহ্র পথ থেকে বিরত রাখে, তারা নিঃসন্দেহে পথভ্রষ্ট হয়ে অনেক দূরে চলে গেছে। -সূরা নিসা: ১৮৭ (আরবী ************) যারা কুফরী গ্রহণ করে তারা (লোকদের) আল্লাহ্র পথ থেকে বিরত রাখার উদ্দেশ্যে তাদের ধন-মাল ব্যয করে। -সূরা আনফাল ৩৬) কোন কোন আয়াতে ‘সাবীলিল্লাহ্’র পূর্বে (***) ‘গুমরাহ করা’ শব্দটি এসেছে। যেমন: (আরবী ************) এমন লোকও আছে, যারা খেল-তামাশার কথা ক্রয় করে (লোকদেরকে) আল্লাহ্র পথ থেকে গুম্রাহ্ করে নেয়ার উদ্দেশ্যে। -(সূরা লোকমান: ৬) ২. যে যে আয়াতে ‘সাবীলিল্লাহ্’ শব্দটির পূর্বে (*****) এসেছে-আর এই ধরনের আয়াতের সংখ্যাই অধিক- সেখানে হয় (****) ‘ব্যয় করা’ শব্দটি তার পূর্বে এসেছে। যেমন: (আরবী ************) তোমরা আল্লাহ্র পথে অর্থ ব্যয় কর। অথবা ‘হিজরাত’ শব্দটি এসেছে। যেমন: (আরবী ************) আর যারা হিজরাত করেছে আল্লাহ্র পথে... কিংবা (****) (যুদ্ধ) বা (***) (হত্যা) শব্দটি এসেছে। যেমন: (আরবী ************) তারা সশস্ত্র যুদ্ধ করে আল্লাহ্র পথে, তাতে তারা হত্যাও করে আর নিজেরাও নিহত হয়। যেমন: (আরবী ************) যারা আল্লাহ্র পথে নিহত হয়, তাদের মৃত বলো না। অথবা তার পূর্বে জিহাদ শব্দ ব্যবহার হয়েছে। যেমন: (আরবী ************) এবংতোমরা জিহাদ কর আল্লাহ্র পথে। কিংবা দুর্ভিক্ষ বা মার বা অনুরূপ কোন শব্দ এসেছে। এসব ক্ষেত্রে ‘ফি-সাবীলিল্লাহ্’ শব্দের কি অর্থ বা তাৎপর্য গ্রহণ করা হবে? আভিধানিক অর্থে ‘সাবীল’ অর্থ পথ। আর ‘সাবীলিল্লাহ্’ অর্থ ‘আল্লাহ্র সন্তুষ্টি ও প্রতিফল পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দেয়ার পথ।’ আর আল্লাহ তা’আলা নবিগণকে পাঠিয়েছেন গোটা সৃষ্টিলোককে সেই দিকের পথ-প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে এবংতাঁর শেষ নবীকে সেই দিকে দাওয়াত দেয়ার জন্যে নির্দেশ দিয়েছেন এই বলে: (আরবী *********) আহ্বান কর তোমার আল্লাহ্র পথে সুদৃঢ় যৌক্তিকতা ও উত্তম উপদেশ সহকারে। -সূরা নহল: ১২৫ লোকদের মধ্যে এই কথা ঘোষণা করারও নির্দেশ দিয়েছেন: (আরবী *********) এটাই আমার পথ। আমি আল্লাহ্র পথে আহ্বান জানাই বুঝে শুনে ও অন্তর্দৃষ্টি সহকারে- আমি এবং আমার অনুসারী লোকেরা। -সূরা ইউসুফ এখানে আরও একটা পথ রয়েছে। কিন্তু তা উক্তপথের বিপরীত। তা হচ্ছে তাগুতের পথ। ইবলিশ শয়তান এবং তার চেলা-চামণ্ডরা সেই পথে লোকদের আহ্বান জানায়। সে পথটি তার পথিককে জাহান্নাম ও আল্লাহ্র ক্রোধ-অসন্তুষ্টির দিকে নিয়ে যায়। এ দুটো পথের ও এই পথ-দ্বয়ের পথিকদের মধ্যে তুলনাস্বরূপ আল্লাহ্ তা’আলা ইরশাদ করেছেন: (আরবী *********) ঈমানদার লোকেরা যুদ্ধ করে আল্লাহ্র পথে এবং কাফিররা যুদ্ধ করে তাগুতের পথে। -সূরা নিসা: ৭৬ ‘সাবীলিল্লাহ্’-‘আল্লাহ্র পথের আহ্বানকারী স্বল্পসংখ্যক এবং তার শত্রুপক্ষ-এই পথ থেকে বিরত রাখতে সচেষ্ট লোকের সংখ্যা বিপুল। আল্লাহ্র ঘোষণা: ‘তারা তাদের ধন-মাল ব্যয় করে এই উদ্দেশ্যে যে, তারা আল্লাহ্র পথ থেকে লোকদের বিরত রাখবে।’ ‘লোকদের মধ্যে এমনও আছে যারা খেলা-তামাশার বস্তু ক্রয় করে লোকদের আল্লাহ্র পথ থেকে বিরত রাখার উদ্দেশ্যে।’ বলেছেন, ‘তুমি যদি পৃথিবীর অধিকাংশ লোকের আনুগত্য অনুসরণ কর, তাহলে তারা তোমাকে আল্লাহ্র পথ থেকে গুমরাহ করে দেবে।’ .... এ সব কারণে যে, এ পথে অনিবার্য কষ্ট ও দায়দায়িত্ব মানব-মন ও কামনা-বাসনাকে এই পথের বিরোধী ও রোধকারী বানিয়ে দেয়। এই কারণে মনের কামনা-বাসনা অনুসরণের পরিণতি সম্পর্কে হুশিয়ারী উচ্চারিত হয়েছে কুরআন মজীদে: (আরবী **********) তুমি মনের কামনা-বাসনা অনুসরণ করো না। তা করলে তোমাকে আল্লাহ্র পথ থেকে গুমরাহ করে দেবে। আল্লাহ্র দুশমনরা যখন তাদের চেষ্টা-সাধনা ও অর্থশক্তি দ্বারা লোকদেরকে আল্লাহ্র পথে চলায় বাধা দান করার কাজে নিয়োজিত করেছে, তখন আল্লাহ্র সাহায্যকারী মুমিন লোকদের কর্তব্য হচ্ছে তাদের শক্তি-সামর্থ্য ও অর্থবল আল্লাহ্র পথে ব্যয় করা, আর ইসলাম তা ফরযও করে দিয়েছে। তাই এই কাজটিকে ফরয যাকাতের একটা অংশরূপে নির্দিষ্ট করেছে ‘আল্লাহ্র পথে’র এই গুরুত্বপূর্ণ ব্যয়খাতে ব্যয় করার জন্যে- যেমন করে মুমিনদেরকে সাধারণভাবেতাদের ধন-মাল আল্লাহ্র পথে ব্যয় করার জন্যে উৎসাহ দান করেছে। ব্যয় করার কথাটির পার্শ্বে ‘সাবীলিল্লাহ’র অর্থ কি? কুরআনে যেখানে ব্যয় করার কথাটির পাশে ‘সাবীলিল্লাহ্’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, তথায় এই শব্দের দুটি অর্থ হতে পারে: ১. সাধারণ অর্থ- যেমন শব্দটির আসল তাৎপর্য হয়- সর্ব প্রকারের নেক কাজ, আল্লাহ্র আনুগত্য ও জনকল্যাণমূলক কাজ। তার দৃষ্টান্ত আল্লাহ্র এই কথাটি: (আরবী *********) যারা তাদের ধন-মাল আল্লাহ্র পথে ব্যয় করে তাদের দৃষ্টান্ত-একটি দানার মত, যা সাতটি ছড়া উৎপাদন করে, প্রতিটি ছড়ায় একশ’টি করে দানা থাকে।... আল্লাহ যাকে চান এর চাইতেও কয়েকগুণ বেশি করে দেন। বলেছেন: (আরবী *********) যেসব লোক তাদেরধন-মাল আল্লাহ্র পথে ব্যয় করে, পরে তার কারণে নিজেদের অনুগ্রহের বোঝা চাপায় না বা কোনরূপ পীড়ন করে না, তাদের জন্য তাদের আল্লাহ্র কাছে বড় শুভ ফল রয়েছে; তাদের কোন ভয় নেই, তাদের দুশ্চিন্তারও কোন কারণ নেই। এ সব আয়াত থেকে কোন লোকই এ কথা বুঝেন নি যে, এসব কথা কেবলমাত্র যুদ্ধ ও তৎসংক্রান্ত বিষয়াদির মধ্যেই বিশেষভাবে সীমাবদ্ধ থাকবে। ‘অনুগ্রহের বোঝা চাপানো’ ও ‘পীড়ন করা’ সম্পর্কিত কথার দরুন তা অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয়। কেননা এ দুটো ব্যাপর গটতে পারে যদি ফকীর, মিসকীন ও অভাবগ্রস্ত লোকদের জন্যে অর্থ ব্যয় করা হয়। বিশেষ করে কষ্ট দানের ব্যাপারটি। আল্লাহ্র এ কথাটিও এ পর্যায়েই পড়ে: যেসব লোক স্বর্ণ ও রৌপ্য সঞ্চয় করে রাখে এবং তা আল্লাহ্রন পথে ব্যয় করে না, তাদের পীড়াদায়ক আযাবের সুসংবাদ দাও। এ সব আয়াতে ‘সাবীলিল্লাহ্’র সাধারণ অর্থই গ্রহণীয়। হাফেয ইবনে হাজার এ কথাই লিখেছেন। [(আরবী *********)] এসব কথা কেবলমাত্র যুদ্ধ সম্পর্কেই নয় নতুবা যেসব লোক ফকীর-মিসকীন, দরিদ্র-ইয়াতীমও নিঃস্ব পথিক প্রভৃতি অ-যুদ্ধ পর্যায়ের কাজে অর্থ ব্যয় করবে, তারা এই আয়াত অনুযায়ীই সঞ্চয়কারী ও আযাবের সুসংবাদ প্রাপ্তির উপযুক্ত লোকদের মধ্যে গণ্য হবে। এ কালের কোন কোন চিন্তাবিদ মনে করেছেন: ‘ফী-সাবীলিল্লাহ্’ বাক্যটি যদি ইনফাক বা ব্যয় করার কথাটির পার্শ্বে ব্যবহৃত হয়, তাহলে তার অর্থ নিশ্চিতরূপে জিহাদ হবে। তা ছাড়া অন্য অর্থই বোঝা যাবে না। [(আরবী *********)] কিন্তু এ কথা কুরআন মজীদে বাক্যটির ব্যবহারকৃত সব কয়টি আয়াত একত্রিত করে তাৎপর্য অনুধাবনের সর্বাত্মক চেষ্টা না করেই বলা হয়েছে। সূরা আল-বাকারা ও সূরা তওবার পূর্বোদ্ধৃত আয়াতদ্বয় তো উক্ত কথার স্পষ্ট প্রতিবাদ করে। ২. ‘সাবীলিল্লাহ্’র বাক্যটির দ্বিতীয় অর্থ বিশেষভাবে নির্দিষ্ট হচ্ছে আল্লাহ্র দ্বীনের সাহায্য, তাঁর শত্রুদের সাথে মুকাবিলাকরণ এবং পৃথিবীতে আল্লাহ্র বাণীর প্রচারকার্যের জন্যে যেন কোন ফিতনা- আল্লাহ্র বিধানের শাসনহীন অবস্থা অবস্থিতনা থাকে এবং প্রভুত্ব ও কর্তৃত্ব সম্পূর্ণরূপে এক আল্লাহ্তে স্থাপিত হয়। বাক্যটির পূর্বে কথাই পূর্বোক্ত সাধারণ অর্থ থেকে এই বিশেষ অর্থকে আলাদা করে বিশিষ্ট মর্যাদা দানে ভূষিত করেছে। আর এই বিশেষ অর্থই গ্রহণ করতে হবে, যেখানে যুদ্ধ ও জিহাদের উল্লেখের পর তার উল্লেখ হয়েছে। যেমন: (আরবী *********) তোমরা যুদ্ধ কর আল্লাহ্র পথে। (আরবী *********) তোমরা জিহাদ কর আল্লাহ্র পথে। সূরা আল-বাকরায় ‘কিতাল’ বাযুদ্ধসংক্রান্ত কথার পর যা বলা হয়েছে তাও এই অর্থেই গ্রহণীয়। যথা: (আরবী *********) এবং তোমরা আল্লাহ্র পথে (ধন-মাল) ব্যয় কর এবং তোমরা নিজেদেরকে ধ্বংসের মধ্যে নিক্ষেপ কর না এবং খুব দয়ার্দ্র আচরণ গ্রহণ কর। কেননা আল্লাহ্ তা’আলা দয়ার্দ্র আচরণকারীদের ভালোবাসেন। -সূরা বাকারা: ১৯৫ এই আয়াতে যে ‘ইনফাক’ ব্যয় করার কথা বলা হয়েছে, তা নিশ্চয়ই ইসলামের সাহায্য এবং যুধ্যমান ও তাঁর বাধাদানকারী আল্লাহ্র শত্রুদের মধ্যে আল্লাহ্র বাণীর প্রচার কার্যে ব্যয় করার অর্থে। সূরা আল-হাদীসে আল্লাহ্র বলা এ কথাটিও এ পর্যায়ের: (আরবী *********) আর তোমাদের কি হয়েছে যে, তোমরা আল্লাহ্র পথে ব্যয় করো না? ..... অথচ আকাশমণ্ডলও পৃথিবীর উত্তরাধিকার আল্লাহ্রই জন্যে। তোমাদের যারা (মক্কা) জয়ের পূর্বে ব্যয় করেছে ও যুদ্ধ করেছে- তারা অন্যদের সমান নয়, তাদের মর্যাদা অনেক বড়- তাদের তুলনায়, যারা (বিজয়ের) পরে ব্যয় করেছে ও যুদ্ধ করেছে। এ সবই আল্লাহ্র উত্তম ওয়াদা বিশেষ। -সূরা হাদীদ: ১০ পূর্বোদ্ধৃত আয়াতসমূহে বলাব্যয়ের সমপর্যায়ভুক্ত। সূরা আল-আনফাল-এ আল্লাহ্র এই ইরশাদটি উদ্ধৃত হয়েছে: (আরবী *********) তোমরা শত্রুদের মুকাবিলায় শক্তি সঞ্চয় কর যতদূর তোমাদের সাধ্যে কুলায়- ঘোড়ার পাহারাদারিও, তার দ্বারা তোমরা আল্লাহ্র শত্রুকে ভীত-সন্ত্রস্ত্র করবে, তোমাদের শত্রুকেও, তাদের ছাড়া অন্যান্য আরও যেসব রয়েছে তাদেরও যাদের কথা তোমরা জান না, আল্লাহ্ই তাদের জানেন আর তোমরা আল্লাহ্র পথে যা কিছুই ব্যয় কর, তা তোমাদের প্রতি পূর্ণ মাত্রায় ফিরিয়ে দেয়া হবে- তোমরা নিশ্চয়ই অত্যাচারিত হবে না। -সূরা আনফাল: ৬০ এ আয়াতে ‘সাবীলিল্লাহ্’ যেখানে উদ্ধৃত হয়েছে, তাই স্পষ্টরূপে প্রমাণ করে যে, এখানে ‘সাবীলিল্লাহ’ বলে আল্লাহ্র দুশমনদের সাথে সংগ্রাম করার এবং আল্লাহ্র দ্বীনের সাহায্য করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সহীহ্ হাদীসে ঠিক এই কথাটিই স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে: (আরবী *********) যে লোক আল্লাহ্র কালেমাকে শ্রেস্ঠ ও প্রভাবশালী বানাবার উদ্দেশ্যে যুদ্ধ করল,তার এই যুদ্ধই ‘আল্লাহ্র পথে’ হল। [বুখারী, মুসলিম, আবূ মূসা আল-আশআরী বর্ণিত] এই বিশেষ অর্থ বোঝাবার জন্যে কখনও কখনও ‘জিহাদ’ ‘গজওয়া’- যুদ্ধ ইত্যাদি শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। আর আমরা এর ব্যাখ্যা করেছি‘ইসলামের সাহায্য’ বলে এবংতা খুবই উত্তম। অন্যথায় আল্লাহ্র কথা (*****)-এর অর্থ ‘জিহাদের মধ্যে জিহাদ কর’ করতে হয়। কিন্তু তা খুবই হাস্যকর। যাকাত ব্যয়ক্ষেত্রে ‘সাবীলিল্লাহ্’র অর্থ ‘ইনফাক’ (ব্যয়) করার পর ‘সাবীলিল্লাহ্’র উল্লেখ হলে তার এই সাধারণ ও বিশেষ- এ দুটো অর্থই গ্রহণকরতে হয়- যেমন ইতিপূর্বে বিস্তারিত বলা হয়েছে- তখন যাকাত-ব্যয় সংক্রান্ত আয়াতে উল্লিখিত ‘সাবীলিল্লাহ্’র কি অর্থ হবে? .... এখানেও ব্যয় করার তাৎপর্যটি বিদ্যমান, যদিও শাব্দিকভাবে তার উল্লেখ হয়নি। এই গ্রন্থকারের দৃষ্টিতে অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য এই কথা যে, ‘সাবীলিল্লাহ’ বাক্যের সাধারণ অর্থটি এখানে শোভন হয় না। কেননা এইসাধারণ অর্থেঅনেকগুলো দিক এসে যায়, যার প্রকারগুলো সীমিত করা সম্ভব নয়, তার ব্যক্তিগুলোকে চিহ্নিত করা তো দূরের কথা। আর তা যাকাত ব্যয়ের ক্ষেত্র হিসেবেআটটির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখারও পরিপন্থী হবে। আয়াতটির বাহ্যিক বিবেচনা থেকে তাই প্রকাশিত হয়। নবী করীম(স) থেকে এ পর্যায়ে বর্ণিত হয়েছে: আল্লাহ্ তা’আলা যাকাতের ক্ষেত্রে নবী বা অন্যকারোর হুকুমে কিছু ফরয করেন নি। তিনিনিজেই এ ব্যাপারে চূড়ান্ত বিধান দিয়েছেন এবং তাকে আটটি ভাগে বিভক্ত করেছেন। যেমন ‘সাবীলিল্লাহ’ তার সাধারণ অর্থের দিক দিয়ে ফকীর-মিসকীন ও সাত প্রকারের লোকদের দান করাকেও শামিল করে। কেননা এ সব কাজই ভালো, পুণ্যময়ও আল্লাহ্র আনুগত্যমূলক।তাহলে এই ব্যয়ক্ষেত্রটিও তার পূর্বের ও পরের ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে পার্থক্য কোথায়? মনে রাখা আবশ্যক, আল্লাহ্র কালাম অতিশয় উচ্চমানের, মানব সাধ্যের ঊর্ধ্বের, তা নিশ্চয়ই অর্থহীন পুনরাবৃত্তির দোষ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ও পবিত্র। অতএব এখানে তার এমন একটা বিশেষ অর্থ গ্রহণ করতে হবে যা সেটিকে অপরাপর ব্যয় ক্ষেত্র থেকে স্বতন্ত্র মর্যাদায় চিহ্নিত ও ভূষিত করবে। প্রাচীনকাল থেকে তাফসীরকার ও ফিকাহ্বিদগণ এই কথাই বুঝেছেন। ফলে তাঁরা ‘সাবীলিল্লাহ্র অর্থ করেছেন ‘জিহাদ’ এবং তাঁরা বলেছেন, ‘ফি-সাবীলিল্লাহ্’ নিঃশর্তভাবে ব্যবহৃত হলে তাই তার অর্থ হবে। এ কারণে ইবনুল আসীর লিখেছেন: এই বাক্যটি এই অর্থে খুব বেশি ব্যবহৃত হয়েছে বলে মনে ধারণা জন্মেছে যে, এর এটাই একমাত্র অর্থ। এ অধ্যায়ের প্রথম ভাগে আমরা এ পর্যায়ে সব কথাই উদ্ধৃত করেছি। ইবনুল-আসীরের কথার সমর্থন পাওয়া যায় তাবারানী বর্ণিত একটি কথায়। তা হল সাহাবায়ে কিরাম একদা রাসূলে করীম (স)-এর সঙ্গী ছিলেন। তাঁরা সকলে একজন শক্ত-সমর্থ যুবককে দেখতে পেলেন। তাঁরা বললেন, ‘যুবকটির যৌবন ও শক্তি-সামর্থ্য যদি আল্লাহ্র পথে নিয়োজিত হত! অর্থাৎ যদি তা জিহাদ ও ইসলামের সাহায্য কাজে নিয়োজিত হত! (তাহলে কতই না ভালো হত!) রাসূলে করীম (স) ও সাহাবয়ে কিরাম (রা) থেকে বহু সহীহ হাদীস বর্ণিত হয়েছে, যা প্রমাণ করে যে, ‘সাবীলিল্লাহ্’ বাক্যটি থেকে সহজেই যে কথাটি বোঝা যায়- মনে জেগে ওঠে- তা হচ্ছে জিহাদ। যেমন হযরত উমরের একটি কথা সহীহ হাদীসে উদ্ধৃত হয়েছে: (আরবী *********) আমি ঘোড়ার পিঠে আল্লাহর পথে নীত হয়েছি অর্থাৎ জিহাদে ঝাঁপিয়ে পড়েছি। বুখারী মুসলিমে উদ্ধৃতহাদীস হচ্ছে: (আরবী *********) আল্লাহ্র পথে একটি সকাল কিংবা একটি বিকাল অতিবাহিত করা দুনিয়াও দুনিয়ার যা কিছু আছে সবকিছু অপেক্ষা অধিক উত্তম। বুখারীতে হাদীস উদ্ধৃত হয়েছে: (আরবী *********) যেলোক একটি ঘোড়া আল্লাহ্র পথে বেঁধে রাখবে আল্লাহ্র প্রতি ঈমান সহকারে ও তাঁর ওয়াদাকে সত্য ধরে নিয়ে, তার পেট পুরে খাওয়া, তার তৃষ্ণা নিবৃত্তি, তার পেশা-পায়খানা সবই কিয়ামতের দিন ওজন বা মূল্য পাবে। অর্থাৎ এসবই নেক কাজের মধ্যে গণ্য হবে। বুখারী মুসলিমে উদ্ধৃত হাদীস: (আরবী *********) যে বান্দাই আল্লাহ্র পথে একটি দিন রোযা রাখে, আল্লাহ এই দিনটির বিনিময়ে তার সত্তাকে জাহান্নাম থেকে সত্তরটি অধ্যায়ের বছর দূরে রাখবেন। নাসায়ী ও তিরমিযী বর্ণিত ও উত্তম বলে ঘোষিথ হাদীস: (আরবী *********) যে লোক আল্লাহ্র পথে কিছু পরিমাণ ব্যয় করবে, তার সাত শত গুণ বেশি তার জন্যে লিখত হবে। বুখারী উদ্ধৃত হাদীস: (আরবী *********) যে বান্দাহর দুই পা আল্লাহ্র পথে ধূলি-মলিন হবে তা জাহান্নাম কখনই স্পর্শ করবেনা। প্রভৃতি বিপুল সংখ্যক হাদীস রয়েছে; কিন্তু এই সবে উদ্ধৃত ‘সাবীলিল্লাহ’ বাক্য দ্বারা ‘জিহাদ’ ছাড়া অন্য কোন অর্থ কেউই বুঝেন নি বা গ্রহণ করেন নি। এ সব দলির-প্রমাণ ও লক্ষণাদি এ কথা বলার জন্যে যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য যে, যাকাত বন্টন সংক্রান্ত আয়াতে ‘সাবীলিল্লাহ’র অর্থ হিসেবে ‘জিহাদ’ই অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য। জমহুর আলিমগণ তাই বলেছৈন। তার আসল আভিধানিক অর্থ, গ্রহণীয় নয়। আর এই হাদীসটি থেকেও এ কথাই প্রমাণিত হবে যাতে বলা হয়েছে: ‘যাকাত কোন ধনীর জন্যে হালাল নয় এই পাঁচজন ছাড়া’... তাদের মধ্যে ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি ও আল্লাহ্র পথে যোদ্ধাকে গণ্য করা হয়েছে। অতএব ‘সাবীলিল্লাহ’ বাক্যের অর্থে এখানে কোন ব্যাপকতাকে প্রাধান্য দেয়া যায় না। তাই সর্বপ্রকারের কল্যাণময় ও আল্লাহ্র নৈকট্যমূলককাজগুলোকে এর মধ্যে শামিল করা যাবে না। অনুরূপ তার অর্থে এতটা সংকীর্ণতাকেও প্রশ্রয় দিতে চাই না, যার ফলে ‘জিহাদ’ বলতে কেবল সামরিক পদক্ষেপই মনে করতে হবে। জিহাদের এ সকল প্রকার ও রূপই সাহায্য ও অর্থব্যয়ের মুখাপেক্ষী। গুরুত্বপূর্ণবিষয় হল, এ ক্ষেত্রে মৌলিক শর্ত হিসেবে একথা স্পষ্ট ও প্রকাশমান হতে হবে যে, তা ‘আল্লাহ্র পথে... অর্থাৎ ইসলামের সাহায্য ও পৃথিবীতে আল্লাহ্র কালেমা প্রচারে নিয়োজিত। প্রতিটি জিহাদেরই লক্ষ্য হতে হবে: আল্লাহ্র কালেমা উচ্চতর করা। অতএব তা সবই আল্লাহ্র পথে, তা যে-কোন ধরনের ও রূপের এবং অস্ত্রের হোক না কেন। ইমাম তাবারী তাঁর তাফসীরে ‘ফী-সাবীলিল্লাহ’র ব্যাখ্যায় লিখেছেন: ‘অর্থাৎ আল্লাহর দ্বীনের সাহায্যে ব্যয়ে।’ আল্লাহ্ তাঁর বান্দাহ্দের জন্যে যে শরীয়াতের বিধান দিয়েছেন, সেই পথে তাঁর দুশমনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মাধ্যমে এবং তা-ই কাফিরদের বিরুদ্ধে লড়াই। প্রধান তাফসীরকারের উক্ত কথার প্রথম অংশটি স্পষ্ট এবং গ্রহনীয়। তাতে ইসলামের সাহায্যে ও তার শরীয়াতের সমর্থনে সর্বপ্রকার ব্যয়ই শামিল হবে।তবে আল্লাহ্র দুশমনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও কাফিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এই দ্বীনের সাহায্য প্রক্রিয়াসমূহের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ পন্থা বৈ তো নয়। আল্লাহ্র দ্বীনের, তাঁর পন্থা ও শরীয়াতের সাহায্য কর্ম কোন কোন অবস্থায় সশস্ত্র যুদ্ধ ও লড়াই দ্বারা বাস্তবায়িত হয়। বরঞ্চ কোন সময় ও স্থানে আল্লাহ্র দ্বীনের সাহায্যরূপে এটাই একমাত্র পন্থারূপে নির্দিষ্ট হয়ে যায়। তা সত্ত্বেও এমন একটা সময় আসে- যেমন আজকেরসময় চিন্তা, মতবাদ ও মানসিক মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধটা অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ, বিপদ দূরকারী ও গভীর প্রভাবশালী হয়ে পড়ে বস্তুগত সামরিক যুদ্ধের তুলনায়। প্রাচীন চারটি মায্হাবের জমহুর ফিকাহ্বিদগণ যখন যাকাতের এ অংশটিকে যোদ্ধা ও অগ্রবর্তী বাহিনীকে সজ্জিতকরণ এবং তাদের প্রয়োজনীয় ঘোড়া, অস্ত্রশস্ত্র ও যানবাহন ক্রয়ে সাহায্য করার কাজে নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন, আমরা এ কালের প্রয়োজনে এক ভিন্ন ধরনের যোদ্ধা ও অগ্রবর্তী বাহিনীকে তার সাথে শামিল করছি। তারা হচ্ছে সেসব লোক, যারা ইসলামের শিক্ষাদানে, জনগণে বিবেক-বুদ্ধিকে ইসলামের দিকে নিয়ে আসার জন্যে কাজ করছে। এরা ইসলামের দাওয়াতদাতা লোক, এরা তাদের চেষ্টা-সাধনা, মুখের কথা, ভাষা-সাহিত্য দিয়ে ইসলামী আকীদা-বিশ্বাস ও ইসলামী বিধানে সংরক্ষণও প্রতিরক্ষার কাজে সদা নিয়োজিত। জিহাদের তাৎপর্যে আমরা এই যে ব্যাপকতা ও প্রশস্ততা নিয়ে আসছি, তার দলিলও আমাদের নিকট রয়েছে। তা এই: প্রথম: ইসলামের জিহাদ কেবলমাত্র সামরিক তৎপরতা ও সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। নবী করীম(স) থেকে সহীহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, কোন্ জিহাদ উত্তম? তিনি বললেন: (আরবী *********) অত্যাচারী শাসকের সম্মুখে স্পষ্ট সত্যকথা বলা। [আহমাদ, নাসায়ী ও বায়হাকী হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন জিয়া মাকদাসী তারেক ইবনে শিহাব থেকে।মুনযেরী বলেছেন, হাদীসটির সনদ সহীহ্। (আরবী *********)] ইমাম মুসলিমতাঁর সহীহ্ গ্রন্থে ইবনে মাসউদ থেকে বর্ণিত হাদীস উদ্ধৃত করেছেন- নবী করীম (স) ইরশাদ করেছেন: আমার পূর্বে আল্লাহ তা’আলা যে নবীই কোন উম্মতের প্রতি পাঠিয়েছেন তার উম্মতের মধ্যেতাঁর বহু সংখ্যক ‘হাওয়ারী’ ও সাহাবী (সঙ্গী-সাথী) বানিয়ে দিয়েছেন, যারা তাঁর সুন্নাতকে ধারণ করে এবং তাঁর আদেশ যথাযথভাবে পালন করে। পরে তাদের উত্তরাধিকারীরা যখন প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন তারা বলে এমন এসব কথা যা তারা বাস্তবে করে না এবং করে সেসব কাজ, যার নির্দেশ তাদেরকে দেয়া হয়নি। এরূপ অবস্থায় যে লোক তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করবে নিজের হস্ত (শক্তি) দ্বারা, সে মুমিন, যে যুদ্ধ করবে তাদের বিরুদ্ধে নিজের মুখের কথা-ভাষা দ্বারা সে-ও মুমিন। আর যে যুদ্ধ করবে তাদের বিরুদ্ধে তার অন্তর দ্বারা সে-ও মুমিন। এর পরে আর কারোর একদানা পরিমাণ ঈমানও নেই বলে মনে করতে হবে।’ রাসূলে করীম (স) বলেছেন: (আরবী *********) তোমরা মুশরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর তোমাদের ধন-মাল দিয়ে, তোমাদের মনদ্বারা ও তোমাদের মুখের (ভাষা) দ্বারা। [হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন ইমাম আহমাদ, আবূ দাউদ, নাসায়ী, ইবনে হাব্বান ও হাকেম আনাস থেকে এবং বলেছেন, হাদীসটি সহীহ্। তাঁরা এটিকে স্বীকার করে নিয়েছেন: (আরবী *********)] দ্বিতীয়, উপরে জিহাদের যে বিভিন্ন বস্তু ও ইসলামী তৎপরতার উল্লেখ করেছি, তা যদি জিহাদের অর্থের অন্তর্ভুক্ত না হয়ে থাকে অকাট্য দলিলের অভাবে, তাহলে তা কিয়াসের সাহায্যে অবশ্যই তার অন্তর্বুক্ত হবে। কেননা এ উভয় পর্যায়ের কাজই ইসলামের সাহায্যে নিবেদিত, তার প্রতিরক্ষাই লক্ষ্য এবং তার সাহায্যে ইসলামের শত্রুদের মুকাবিলা করা হয়, আল্লাহ্র জমিনে তাঁরই কালেমা প্রচার করা হয়। মুসলমানদের মধ্যে এমন ফিকাহ্বিদও আমরা পাচ্ছি, যাঁরা যাকাত সংস্থার কর্মচারীরূপে গণ্য করেন এমন সমস্ত লোককে, যারা সাধারণ মুসলিম জনগণের পক্ষে কল্যাণকর কাজে নিয়োজিত। ইবনে রুশ্দ বলেছেন: যাঁরা কর্মচারীদের জন্য- তারা ধনী হলেও- যাকাত জায়েয বলেছেন, বিচারকমণ্ডলী এবং এই ধরনের কাজে নিয়েঅজিত লোকদের জন্যে তা জায়েয বলে ঘোষণা করেছেন। কেননা তাদের সকলের দ্বারা সাধারণ মুসলিম উপকৃত হয়ে থাকে। [(আরবী *********)] যেমন হানাফী মাযহাবের এমন ফিকাহ্বিদ আমরা দেখতে পাই, যারা ইবনুস-সাবীল-নিঃস্ব পথিক পর্যায়ে’ গণ্য করেছেন এমন সমস্ত লোককে, যারা নিজেদের ধন-মাল থেকে অনুপস্থিত, তা ব্যয়-ব্যবহার করতে অক্ষম, যদিও তারা নিজেদের ঘর-বাড়ি ও গ্রাম-শহরে অবস্থান করছে।কেননা এক্ষেত্রে আসলকারণ হচ্ছে প্রয়োজন বা অভাব- আর তা এখানে পূর্ণমাত্রায় উপস্থিত। এই প্রেক্ষিতে আমরা যদি জিহাদ অর্থাৎসশস্ত্র যুদ্ধের সাথে এমন সব কাজকেও শামিল মনে করি যা তার উদ্দেশ্য পূর্ণ করে এবং কথা বা কাজ দ্বারা এই কাজের সহায়তা করে, তা হলে তাতে বিস্ময়ের কোন কারণ থাকতে পারে না। কেননা ‘কারণ’ বা ‘ইল্লাত’টা এখানে অভিন্ন। আর তা হচ্ছে ইসলামের সাহায্য। এর পূর্বে আমরা দেখেছি, যাকাত অধ্যায়ে ‘কিয়াস’-এর একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এমন কোন মাযহাব নেই, যা কোন-না কোন-ভাবে ও কোন-না-কোন অবস্থায় তার প্রয়োজন মনে করেন নি। এই ‘সাবীলিল্লাহ্’ পর্যায়ে আমরা যে মতটি গ্রহণ করেছি, তার যৌক্তিকতা এই প্রেক্ষিতেই অনুধাবনীয়। আর তা হচ্ছে, তার অর্থে সামান্য প্রশস্ততার ভাবধারা সহকারে জনমতের গুরুত্ব। এই পর্যায়ে আমি এ ব্যাপারটিও জানিয়ে দিতে চাই যে কোন কোন কাজ ও প্রকল্প কোন-না-কোন সময়ে কোন-না কোন স্থানে ও অবস্থায় ‘আল্লাহ্র পথে জিহাদরূপে গণ্য হয়ে যায়, হয়ত তা অপর সময়েও অপর স্থানে ও অবস্থায় ‘জিহাদ’রূপে গণ্য হয় না। সাধারণভাবে একটা দ্বীনী মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা নেক কাজ ও প্রশংসনীয় চেষ্টা-প্রচেষ্টারূপে গণ্য হয়, যা দ্বীন-ইসলামের বিরাট কল্যাণ করে; কিন্তু তা ‘জিহাদ’রূপ গণ্য হয় না। কিন্তু যেখানে গোটা শিক্ষা-প্রশিক্ষণ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ সম্পর্কে সম্পূর্ণভাবে খৃস্টান মিশনারী বা কমিউনিস্ট অথবা ধর্মহীন-নিরপেক্ষতাবাদীদের একচেটিয়া কর্তৃত্বে চলে গেছে,সেখানে একটা খালেস দ্বীনী শিক্ষার প্রতিষ্ঠান কায়েমসও চালু করা এবং রাখাও বিরাট জিহাদরূপে অবশ্যই গণ্য হবে, যা মুসলমান সন্তানদের দ্বীনি শিক্ষাদানের কাজ করবে এবং চিন্তা-বিশ্বাসের বিপর্যয় থেকে তাদের রক্ষা করবে, জীবন-ধারা, লেখাপড়া, শিক্ষকদের বিবেক-বুদ্ধি ও সাধারণ জন-মানুষের মৌল ভাবধারায় যে বিষ ছড়ানো হচ্ছে, তা থেকে তাদের বাঁচাবে। বিপর্যয়কারী বই-পুস্তকের মুকাবিলায় ইসলামী বই-পুস্তক প্রকাশ ও পাঠাগার গড়ে তোলাও এ পর্যায়েরই কাজ বলে গণ্য হবে। মুসলমানদের চিকিৎসার জন্যে একটা চিকিৎসালয় বা হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা এবং খৃস্টান মিশনারীদের নৈতিক ও আকীদা-বিশ্বাসে বিপর্যয় সৃষ্টিকারী চিকিৎসা থেকে তাদের রক্ষা করাও একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ- যদিও চিন্তা-বিশ্বাস ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ অধিকতর বিপদ সৃষ্টিকারী ও সুদূরপ্রসারী প্রভাবশালী হয়ে থাকে। একালে ‘সাবীলিল্লাহ’র অংশ কোথায় ব্যয় করা হবে? পূর্বের আলোচনায় আমরা দেখেছি, চারটি মাযহাবের প্রখ্যাত ও নির্ভরযোগ্য মত হচ্ছে: ‘সাবীলিল্লাহ’-এর অর্থ হচ্ছে সামরিক ও সশস্ত্রতার অর্থে জিহাদ ও যুদ্ধ। অন্য কথায়, ‘সাবীলিল্লাহ’ হচ্ছে ইসলামী যুদ্ধ। যেমন সাহাবায়ে কিরাম ও মহান তাবেয়িগণ যুদ্ধ করেছেন। তাঁরা তাঁর সূচনা করেছেন আল্লাহ্র নামে, কুরআনের ঝাণ্ডার তলে। তাঁদের লক্ষ্য ছিল মানুষকে সৃষ্টিকুলের বন্দেগী ও দাসত্বের শৃংখল থেকেমুক্ত করে কেবলমাত্র এক আল্লাহ্র বান্দাহ বানিয়ে দেয়া, জীবনের সংকীর্ণতা-কাঠিন্য থেকে নিষ্কৃতি দিয়ে জীবনের প্রশস্ততা-উদারতার মধ্যে নিয়ে আসা, ধর্মের নামে অত্যাচার-নিপীড়ন থেকে বের করে ইসলামের সুবিচার ও ন্যায়-নিষ্ঠা নিয়ে আসার জন্যে। কেউ কেউ মনে করেন, আজকের দিনে এ ধরনের যুদ্ধের আর কোন অস্তিত্ববা অবকাশ নেই, দীর্ঘকাল পর্যন্তই তার অস্তিত্ব ছিলও না। যেসব রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ এ কালের মুসলিম দেশগুলোর ওপর চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে এবং কিছুকাল ধরে চালিয়ে যেতে বাধ্য করা হচ্ছে, তা নিশ্চয়ই ইসলামী যুদ্ধ নয়। মুসলমান তাতে কাফিরদের বিরুদ্ধে লড়ছে না। সেগুলো হচ্ছে জাতীয় বা স্বদেশিক পর্যায়ের যুদ্ধ, তা একটি জাতি করে তাদের বিরুদ্ধে, যারা তাদের দেশ বা জাতির বিদ্রোহী হয়েছে অথবা অন্যায়ভাবে দখলকরে নিয়েছে। এগুলো আসলে নেহায়েত বৈষয়িক যুদ্ধ, দ্বীনের সাথে তার দূরতম সম্পর্কও নেই। অতএব এসব যুদ্ধ কখনই ‘ফী-সাবীলিল্লাহ’ বলে গণ্য হতে পারে না। আর এজন্যেই এসব যুদ্ধে যাকাত ব্যয় করা কোন মুসলমানের পক্ষেই জায়েয নয়। কোন কোন মুসলমান এরূপ ধারণা করেন, বলেনও। কিন্তু এ কথাটি বিশ্লেষণ সাপেক্ষ, তত্ত্বানুসন্ধান আবশ্যক, যেন তার ভুলও শুদ্ধ দিকটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ইসলামী যুদ্ধ বা ইসলামী জিহাদ কেবলমাত্র সেসব রূপের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, যা সাহাবায়ে কিরামের যুগে পরিচিত ছিল। বিদ্রোহী স্বৈরাচারী শক্তিসমূহ দমন বা উৎখাতের উদ্দেশ্যে যেসব যুদ্ধ পরিচালিত হচ্ছে- যার ফলে মুসলমানকে ইসলাম থেকে বলপূর্বক দূরে সরিয়ে নেয়া হয় এবং ইসলামের দাওয়াত ও আন্দোলনকে ইসলাম থেকে বলপূর্বক দূরে সরিয়ে নেয়া হয় এবং ইসলামের দাওয়াত ও আন্দোলনকে শক্তিবলে নেস্তানাবুদ করা হয়, ইসলামের আন্দোলনকারীদের অত্যাচার-নিপীড়ন সহকারে হত্যা করা হয়, এ ধরনের যুদ্ধ- তার লক্ষ্য ও নিয়ম-নীতিসহ ইতিহাসে কখনই পরিচিত বা পরিচালিত ছিল না। এসব যুদ্ধের ফলাফল ও প্রভাবের কোন দৃষ্টান্ত অতীতে খুঁজে পাওয়া যাবে না। আসলে এগুলো ছিল বিদ্রোহীদের কর্তৃত্ব থেকে জাতিসমূহকে মুক্তকরণের উদ্দেশ্যে, তারা আল্লাহ্র বান্দাহদেরকে নিজেদের দাসানুদাস বানাবার উদ্দেশ্যেই এসব যুদ্ধ চালিয়েছে। সন্দেহ নেই, এ অবস্থা ইসলামী যুদ্ধ এবং ইসলামী জিহাদের পক্ষে খুব ভয়াবহ, কিন্তু তা-ই একমাত্র অবস্থা নয়। ইসলামের ইতিহাসে এমন এমন যুদ্ধও সংঘটিত হতে দেখাগেছে, যাতে ইসলাম ও ইসলামপন্থীরা নিজেদের সত্তা, মান-মর্যাদা, ইজ্জত-আবরু, দেশ বা জন্মভূমি ও পবিত্রতম প্রতিষ্ঠানসমূহ রক্ষা করার উদ্দেশ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ইসলামের জন্যেই তারা ইসলামের দুশমনদের সাথে যুদ্ধ করেছে যার পবিত্রতা সাহাবা-তাবেয়ীনের যুদ্ধের তুলনায় কিছুমাত্র সামান্য নয়। এসব যুদ্ধের ইতিহাসের ইমাদুদ্দীন জংগী, নুরুদ্দীন মাহমুদ, সালাহুদ্দীন আইয়ুবী, কুতজ ও জাহির বেবিরস প্রমুখের নাম আজও জ্বলজ্বল করছে। এগুলো হিত্তীন, বাইতুল মাকদিস ও জানুত-কূপের যুদ্ধ। ইসলামী দেশকে তাতার ও ক্রুস যোদ্ধাদের কবল থেকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে এসব যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। সাহাবী ও তাবেয়ীনের যুদ্ধ যখন ইসলামীদাওয়াত সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে সংঘটিত হয়েছিল, তখন নূরুদ্দীন, সালাহুদ্দীন ও কুতুজের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল ইসলামের দেশ ও ভূমি রক্ষার উদ্দেশ্যে। আর জিহাদ যেমন ফরয হয়েছে ইসলামী আকীদা-বিশ্বাস রক্ষার্তে- তার সমর্থনে, তেমনি ফরয হয়েছে ইসলামী দেশ রক্ষার জন্যেও। কেননা ইসলামী আকীদা-বিশ্বাস ইসলামী দেশের মতই। এ দুটোরই পূর্ণ সংরক্ষণ এবং আক্রমণকারীদের দাঁত ভেঙ্গে দেয়া একান্ত আবশ্যক। দেশ বা জমিনের এরূপ গুরুত্ব এবং তার সংরক্ষণ প্রতিরক্ষা একটা ইবাদত ও পবিত্র কর্তব্যরূপে গণ্য হওয়ার কারণ হচ্ছে তা দারুল-ইসলাম- ইসলামের আবাসস্থল, ইসলামের অবস্থানক্ষেত্র, ইসলামের পরিবেশ। পিতৃভূমিবা মাতৃভূমি অথবা বাপ-দাদার দেশ বলে নয়। কেননা মুসলমান অনেক সময় এই বাপ-দাদার দেশ থেকেও হিজরত করে ইসলামেরই ভালোবাসায়- ইসলামের সাথে আন্তরিক সম্পর্ক রক্ষার্থে অন্য দেশে- সম্পূর্ণ বিদেশ বিভূঁইয়ে চলে যেতেও প্রস্তুত হয়- যদি পূর্বের স্থানে ও দেশে ইসলাম পালন করা সম্পূর্ণ অবসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়, ইসলামের কথা শুনতে একটি কর্ণও প্রস্তুত না থাকে। রাসূলে করীম(স) এবংতাঁর সাহাবিগণ ঠিক এ কারণেও এরূপ অবস্থায়ই মক্কা ত্যাগ করে চলে গিয়েছিলেন। তখন তাঁরা হয়েছিলেন ‘মুহাজির ফী-সাবীলিল্লাহ’। এরূপ অবস্থা আজও হতে পারে শুধু তাই নয়, রাত-দিন হতে দেখা যাচ্ছে। কাফিরী শাসনথেকে ইসলামের দেশ মুক্তকরণ কোন সন্দেহ নেই, এ কালেও জিহাদ শব্দের বাস্তব প্রয়োগ হতে পারে জোরপূর্বক দখলকারী কাফিরদের প্রশাসন থেকে ইসলামী দেশ মুক্তকরণের সংগ্রামের ওপর। কেননা তারা তথায় আল্লাহ্র বিধান উচ্ছেদ করে কাফিরী শাসন প্রতিষ্ঠিত করেছে। এই কাফির ইয়াহুদী হোক, খৃস্টান হোক বা মূর্তিপূজারী অথবা নাস্তিক কমিউনিস্ট বা পাশ্চাত্যানুসারী- এরা কেউ ই আল্লাহ্র দ্বীন মেনে চলে না। আর কুফর- তার রূপ যাই হোক- এক অভিন্ন শক্তি, ইসলামের দুশমন। পুঁজিবাদী ও কমিউনিস্টপন্থী, পাশ্চাত্যবাদী বা প্রাচ্যবাদী, আহ্লি কিতাব কিংবা ধর্মহীন- ইসলামের দৃষ্টিতে সকল ইসমান। এই সবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা ফরয- যদি তারা বল প্রয়োগ করে কোন ইসলামী দেশ বা তার কোন অংশ দখল করে নেয়। কোন অংশ দখল করে নিলেও তা গোটা দেশের সমান গুরুত্বপূর্ণ। এই কর্তব্য কাজে শরীকহওয়ার বাধ্যবাধকতা নৈকট্যের দৃষ্টিতে বিচার্য। যারা অতি নিকটে, তাদের কর্তব্য সর্বাগ্রে। শেষ পর্যন্ত এই কর্তব্য গোটা মুসলিম জাতির ওপর বর্তে। কেউই এ কর্তব্য পালন থেকে অব্যাহতি পেতে পারে না। অবশ্য সকলের যোগদানের পরিবর্তে কিছু লোকের অংশ গ্রহণে যদি উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়, তাহলে ভিন্ন কথা। তবে একালে অনেক কয়টি মুসলিম দেশ কাফির শক্তি কর্তৃক দখলকৃত বাঅধিকৃত, আক্রান্ত হওয়ার দরুন এখানকার গোটা মুসলিম জাতির ওপরই এক কঠিন দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে- যা ইতিপূর্বে কখনইদেখা যায়নি। এ দেশগুলোর মধ্যে প্রথম উল্লেখ্যহ হচ্ছে ফিলিস্তিন। দুনিয়ায় বিচ্ছিন্নভাবে অবস্থানকারী ইয়াহুদীরা এ দেশটি দখল করে নিয়েছে। কাশ্মীরের প্রধান প্রধান অংশ দখল করে নিয়েছে হিন্দু মুশরিকরা। এরিটেরিয়া, আবিসিনিয়া, চাদ, পশ্চিম সোমালিয়া ও কবরুচ বা ক্রীট-ষড়যন্ত্রকারী হিংসুক খৃস্টান বা কমিউনিস্ট শক্তি এসব দেশ দখল করে নিয়েছে। আর সমরখন্দ, বোখারা, তাসখন্দ, উজবেকিস্তান ও আলবেনিয়া প্রভৃতি ইসলামী দেশ নাস্তিকখোদা বিদ্রোহী কমিউনিস্টরা শক্তি প্রয়োগ করে দখল করে নিয়েছে। এখনকার মত শেষ শিকার হচ্ছে আফগানিস্তান। রাশিয়া নিতান্ত গায়ের জোরেই তা দখল করে রেখেছে। এসব দেশ পুনরুদ্ধার করা ও কুফরী শাসন থেকে মুক্ত করা- কুফরী আইন-বিধান সম্পূর্ণ উৎখাত করা সামষ্টিকভাবে গোটা মুসলিম জাতিরই একান্ত কর্তব্য। এসব শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা একটা বড় ইসলামী ফরয বিশেষ। এ উদ্দেশ্যে এসব দেশের যে কোন অংশে কোন যুদ্ধ শুরু হলে গেলে তা নিঃসন্দেহে ‘জিহাদ ফী-সাবীলিল্লাহ’ হবে। অবশ্য লক্ষ্য হতে হবে কুফরী শাসন ও কাফিরী কর্তৃত্ব থেকে মুক্তকরণ। এ যুদ্ধে ধন-মাল ব্যয় করা ও কার্যত সাহায্য-সহায়তা করা অবশ্যই ফরয হবে। আর এজন্যে যাকাতের একটা অংশ দেয়াও একান্ত উচিত হবে। সে অংশের পরিমাণ কমও হতেও পারে, বেশিও হতে পারে- যাকাত বাবদ সঞ্চিত সম্পদের হার অনুপাতেই তা হবে একদিক দিয়ে। আর জিহাদের প্রয়োজনের দৃষ্টিতেও তা কম বা বেশি হতে পারে অপর দিকের বিচারে। আর অন্যান্য সর্ববিধ প্রয়োজনীয় ব্যয়ের তীব্রতা ও দুর্বলতার দৃষ্টিতেও তার বিবেচনা হতে পারে। এ সবই নির্ভর করে দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের বিবেচনাভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ওপর। মুসলিম পরামর্শদাতা বা উপদেষ্টগণ যেরূপ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন সেরূপই হবে। সব যুদ্ধই ‘ফী-সাবীলিল্লাহ’ ন?য় এ পর্যায়ে একটি বিষয়ে খুব সতর্কতার প্রয়োজন। কোন কোন মুসলমান মনে করেন, মুসলিম নামধারী লোকদের যে কোন উদ্দেশ্যে অস্ত্রধারণই ‘আল্লাহ্র পথে যুদ্ধ’ বলে বিবেচিত হবে, তার লক্ষ্যও উদ্দেশ্য যা-ই হোক, তার আচার-বিধি ও ভঙ্গি-দৃষ্টিকোণ যেরূপই হোক না কেন। সে যুদ্ধ আল্লাহ্র নামে শুরু করা হোক কিংবা অপর কারোর নামে। যে ঝাণ্ডার তলে সমবেত হয়ে যুদ্ধ করাহবে, তা ইসলামীঝাণ্ডা হোক, কি কাফিরী ঝাণ্ডা অর্থাৎ তাদের দৃষ্টিতে ইসলামী যুদ্ধ বা জাতীয়তা কিংবা দেশমাতৃক বা শ্রেণীভিত্তিক- সব যুদ্ধই মুসলমানদের জন্যে কর্তব্য। আমরা তাকীদ সহকারে বলতে চাই, যুদ্ধ কেবল তখনই ‘ফী-সাবীলিল্লাহ্’ –আল্লাহ্র পথে’ গণ্য হতে পারে, যদি তা ইসলামী লক্ষ্যে ও ইসলামী রীতি নীতি অনুযায়ী হয়। অন্য কথায় যুদ্ধ হতে হবে দ্বীন ইসলামের সাহায্যার্থে, আল্লাহ্র কালেমার প্রচার উদ্দেশ্যে, ইসলামের আবসক্ষেত্রের সংরক্ষণ ও ইসলামের মর্যাদা রক্ষার্থে। আর এ জিনিসই ইসলামী যুদ্ধকে অন্যান্য সর্বপ্রকার যুদ্ধ থেকে স্বতন্ত্র ও ভিন্ন মর্যাদায় অভিসিক্ত করতে পারে। কোন যুদ্ধ এসব নৈতিক ও আধ্যাত্মিক ভাবধারাশূন্য হলেতা নিতান্তেই বৈষয়িক যুদ্ধ হবে। আর এ ধরনের যুদ্ধ সাধারণত নাস্তিক ধর্মহীন লোকেরাই করে থাকে। এ ধরনের যুদ্ধ কোথাও শুরু হলে- যাতে মহান আল্লাহ্র বা তাঁর দ্বীনের, তাঁর কিতাবের, তাঁর রাসূলের কোন স্থান বা স্বীকৃতি নেই- তাতে যাকাতের একটি পয়সা ব্যয় করাও সম্পূর্ণ না-জায়েয হবে- তাকে যতই ‘ফী-সাবীলিল্লাহ্’ মনে করা হোক না কেন। মনে করা যেতে পারে, আলবেনীয় বা উজবেকিস্তানী কোন কমিউনিস্ট গোষ্ঠী যদি তাদের দেশ- যা মূলত ইসলামী দেশ ছিল- রুশীয় কমিউনিস্টটদের কর্তৃত্ব-আধিপত্য থেকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে তৎপরতা শুরু করে ও সেজন্যে যুদ্ধের সূচনাকরে, তাহলে এই যুদ্ধটিকে কি ‘জিহাদ ফী-সাবীলিল্লাহ্’ গণ্য করা যাবে?... তাতে কি জায়েয হবে যাকাতের টাকা ব্যয় করা? কেননা বলা যেতে পারে, একটি ইসলামী দেশকে বিদেশীয়- রুশীয় কর্তৃত্ব থেকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে এই যুদ্ধ করা হচ্ছে। এর উত্তর অকাট্যভাবে নেতিবাচক, কেননা উজবেকী কমিউনিস্ট ও রুশীয় কমিউনিস্টদের মধ্যে ইসলামের দৃষ্টিতে কোন পার্থক্য নেই। এ যুদ্ধের ফলে হয়ত কমিউনিস্ট আধিপত্য থেকে মুক্তি লাভ করা সম্ভব হবে; কিন্তু তার পরিণতিতে অপর এক কমিউনিস্ট আধিপত্যের অধীনতা ছাড়া আর তো কিছুই হবার নয়। ইসলামে কেবল জাতীয়তা বা স্বাদেশিকতার পার্থক্যের কোনই মূল্য নেই।– কেননা এরা সকলেই খোদা-দ্রোহী- তাগুত; কিংবা তাগুতের চেলামুণ্ডা মাত্র। তবে মুসলমানরাই এ যুদ্ধের সূচনা করে কাফিরী শাসন খতম করে ইসলামী শাসন প্রশাসন- প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে এবং তারা যদি জাহিলীয়াতের পতাকা পরিহার করে ইসলামী তওহীদী পতাকা উড্ডীন করে তবেই তা ‘ইসলামী জিহাদ’ নামে অভিহিত হতে পারে। ইসলাম নিছক ‘জিহাদ’ নামের মারামারি ও হত্যাকাণ্ড মাত্রকেই পবিত্র বলে গ্রহণ করতে রাজী নয়। হ্যাঁ, যদি এ জিহাদ ও নরহত্যা আল্লাহ্র পথে হয়, তবেই তা ইসলামের দৃস্টিতে গুরুত্ব পেতে পারে। সে অবস্থায় সমস্ত মানুষই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবে, শত্রুদের হত্যা করবে, এ কাজে তারা ধন-মাল ও মনপ্রাণ বিনিয়োগ করবে। নিজেদেরও রক্ষা করবে, নিজেদের ইজ্জত-আবরু ও স্বদেশও রক্ষা করবে। এ কাজে ফাসিক-ফাজের, দ্বীন-ধর্মহীন লোকেরাও অনেক বীরত্ব দেখাবে, অনেক কুরবানী দেবে, রক্ষা করবে নিজেদের দেশ ও ঘর-বাড়ি, জাতি ও জনতাকে। কিন্তু তাদের এই চেষ্টা-সাধনা আল্লাহ্র নিকট কোন মূল্যই পাবে না। এ সব যুদ্ধে মুমিনরা যোদ্ধা ও জিহাদকারী হয়েও অন্যদের থেকে স্বাতন্ত্র্য পেতে পারে শুধু এ দিক দিয়ে যে, তারা জিহাদ করছে আল্লাহ্র পথে, অস্ত্র চালনা করছে আল্লাহ্র সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে। এটাই তাদের বৈশিষ্ট্য ও বিশেষত্ব এবং তাই তাদের চরম লক্ষ্য। এ মহান লক্ষ্যই তাদের জিহাদ ও যুদ্ধকে পবিত্র ও মহান বানিয়ে দিয়েছে। আল্লাহ্র নৈকট্য লাভের মাধ্যম ও বিরাট ইবাদতের পর্যায়ে গণ্য হওয়ার যোগ্য বানিয়েছে। মুসলিম ব্যক্তি যখন কোন ভূ-খণ্ড মুক্তকরণের লক্ষ্যে অস্ত্র চালনা করে, তখন তারা একটি জাতিকে উৎখাত করে অনুরূপ অপর একটি জাতিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে যুদ্ধ করে না। একটি শ্রেণীর স্থানে অপর একটি শ্রেণীকে প্রাধান্য বানিয়ে দেয়াও তাদের লক্ষ্য হয় না। তারা যুদ্ধ করে গায়রুল্লাহ্র শাসন খতম করে আল্লাহ্র সার্বভৌমত্বভিত্তিক শাসন-বিধান প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে। তথায় আল্লাহ্র শরীযাতের প্রাধান্য হবে, আল্লাহ্র কালেমা বুলন্দ হবে, এই উদ্দেশ্যে। এ তাৎপর্য বহন না করলে কোন যুদ্ধই ইসলামের সাথে সম্পরিা্কত হতে পারে না। তা হয়ে যাবে নিছক বৈষয়িক উদ্দেশ্যে করা যুদ্ধ, মাটির জন্যে যুদ্ধ- দ্বীনের জন্যে নয়। এ দুই ধরনের যুদ্ধের মাঝে যে বিরাট পার্থক্য রয়েছে, তা সকলেরই অনুধাবনীয়। এই ধরনের যুদ্ধকে ‘ফী-সাবীলিল্লাহ্’ নামে অভিহিত করার কোন জ্ঞানী দ্বীনপন্থী মুসলিমের পক্ষেই সম্ভবপর নয়। তাতে ফরয যাকাতের কোন অংশ ব্যয় করার জন্যে মুসলমানদের বলতেও পারে না কেউ। অনেক সময় দেখা যায়, এ সব যুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করে এমন সব লোক যারা প্রকৃত কাফিরদের অপেক্ষাও ইসলামের কট্টর দুশমন। হাফেয আবূ মুহাম্মাদ আবদুল গনী তাঁর সনদে আবদুর রহমান ইবনে আবূ নায়অম থেকে বর্ণনা করেছেন। বলেছেন: আমি একদা আবদুল্লাহ ইবনে উমরের নিকট বসা ছিলাম। তখন একজন স্ত্রীলোক এসে তাঁকে বললো: হে আবূ আবদুর রহমান, আমার স্বামী তাঁর সমস্ত ধন-মাল ‘ফী-সাবীলিল্লাহ্’ দেয়ার অসীয়ত করে গেছেন। ইবনে উমর বললেন: তাহলে তা তাতেই উৎসর্গিত হবে- আল্লাহর পথে। ইবনে আবূ নায়াম বললেন: এই কথা বলেতো আপনি স্ত্রীলোকটির চিন্তা-ভাবনা বৃদ্ধি করেই দিলেন (অর্থাৎ স্ত্রীলোকটি প্রশ্ন করে যে সমস্যার সমাধান চেয়েছিল, এই জবাবে তা সে পায়নি)। ইবনে উমর বললেন: তাহলে তুমি আমাকে কি বলতে বল, হে ইবনে আবূ নায়াম?... আমি কি তা সেসব সৈন্য-সামন্তকে দিতে বলব, যারা দুনিয়ায় সীমা লংঘনের জন্যে বে’র হয় এবং পথে পথে ডাকাতি করে বেড়ায়? আমিবললাম: তাহলে আপনি মেয়েলোকটিকে কি করতে বললেন? জবাবে তিনি বললেন: ‘আমি তাকে নির্দেশ দিচ্ছি, এই ওয়াক্ফকৃত ধন-মাল নেক লোকদের মধ্যে ও আল্লাহ্র ঘরের হজ্জ যাত্রীদের মধ্যে বিতরণ করতে। এরাই হচ্ছে আল্লাহ্র প্রতিনিধি, এরাই আল্লাহ্র প্রতিনিধি, এরাই আল্লাহ্র প্রতিনিধি।’ [তাফসীরে কুরতুবী ৮ম খণ্ড, ১৮৫পৃ.। মনে হচ্ছে, আসল ঘটনাটিই হযরত ইবনে উমর থেকে বর্ণিত যে, হজ্জ আল্লাহ্র পথের ব্যাপার। কুরতুবীর বর্ণনা প্রসংগ থেকে তাই বোঝা যায়। ইবনে উমরের কথা থেকে এ কথাও প্রমাণিত হয় যে, ‘সাবীলিল্লাহ’ কথাটি নিঃশর্তবাবে বলা হলে তা থেকে জিহাদ বুঝা যাবে। কিন্তু এই প্রাথমিক ও সহজ ধারণা থেকে ভিন্ন অর্থে নেয়া হয়েছে যখন দেখা গেছে জিহাদকারীদের আদর্শচ্যুতি ও বিভ্রান্তি বিপর্যয়।] হযরত ইবনে উমর (রা) তাঁর সময়কাল সৈন্য-সামন্তদের কর্মতৎপরতা আল্লাহ্র পথে হওয়ার ব্যাপারে সন্দিহান হয়েচিলেন অথচ সেকালের সৈন্যদের অনৈসলামী ঝাণ্ডা বাইসলাম-বিরোধী তেমন কোন কার্যকলাপ ছিল না। এমন কি খারেজী সৈন্যদের সম্পর্কেও এ কথা চলে। তাহলে এ যুগের সৈন্য-সামন্তদের সম্পর্কে কি বলা যায়? আজকের সৈন্যদের যদি তিনি দেখতে পেতেন, এরা আল্লাহ্র নাম উচ্চারণ করে না, ইসলামেরও নাম জানে না, বলে না। সৈন্যবাহিনীর মধ্যে নামায কায়েমের বা আল্লাহ্র ইবাদত-বন্দেগীর কোন ব্যবস্থা নেই... যদি তিনি দেখতে পেতেন, সেনাধ্যক্ষদের অবস্থা, তারা তাসখেলা ও মদ্যপান ছাড়া আর কিছু জানে না, যদি দেখতে পেতেন, একালের সেব সেনাবাহিনীর কার্যকলাপ ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী রীতি ও পন্থায় পরিচালিত হচ্ছে, তথায় আল্লাহ্-রাসূল বা আল্লাহ্র দ্বীন ও কিতাবের কোন স্থান নেই, তাদের বৈশিষ্ট্যও বিশেষত্ব ইসলাম-বিরোধী জাহিলিয়াত ছাড়া আর কিছুই নয়, কাফির ও কুফরের প্রাধান্য বিস্তার করেছে মাত্র, দ্বীন ইসলাম ও তার ধারক-বাহকদের ঠাট্টা-বিদ্রূপ করছে দিন-রাত, দ্বীনের গুরুত্ব কিছুমাত্র স্বীকার করে না- তার নাম যদি কখনও নেয় তো শুধু প্রাণ-শক্তির বৃদ্ধি ও উৎসাহ-উদ্দীপনা জাগানোর উদ্দেশ্যে..... তাহলে তিনি কি বলতেন? আমরা আবার বলছি, আজকেরদিনের সব যুদ্ধই সংঘটিত হচ্ছে গায়র-ইসলামী ঝাণ্ডার নীচে, ইসলামের সাহায্য করার উদ্দেশ্যে নয়, ইসলামের মর্যাদা রক্ষার্থেও নয়। তাই এসব যুদ্ধই গায়র-ইসলামী। এই যুদ্ধকে ‘ফী-সাবীলিল্লাহ্’ বলা দ্বীনের সাথ ঠাট্টা-বিদ্রূপ করা ছাড়া আর কিছুই নয়। এ পর্যায়ে আমাদের দলিল হচ্ছে অনেক কয়জন হাদীসগ্রন্থ প্রণেতার উদ্ধৃত হাদীস, হযরত আবূ মূসা থেকে বর্ণিত, বলেছেন, রাসূলে করীম (স)-কে জিজ্ঞেস করা হল এমন এক ব্যক্তি সম্পর্কে, যে খুব বীরত্ব সহকারে লড়াই করেছিল, আর এক ব্যক্তি সম্পর্কে যে যুদ্ধ করছিল অন্ধ আত্মম্ভতিা ভরে, অপর এক ব্যক্তি লড়ছিল লোক দেখানো ছলে, এদের মধ্যে কার যুদ্ধ আল্লাহ্র পথে হচ্ছে? রাসূলে করীম(স) বললেন: যে লোক যুদ্ধ করলে আল্লাহ্র কালেমা বুলন্দ করার লক্ষ্যে, সেটাই আল্লাহ্র পথে হচ্ছে মনে করতে হবে। [(*****) গ্রন্থে। দেখুন: (আরবী **********)] বস্তুত ইসলামী জিহাদ ও জাহিলী যুদ্ধ-বিগ্রহের মধ্যে এটাই হচ্ছে মৌলিক ও নৈতিক পার্থক্য- আল্লাহ্র পথ ও তাগুতের পথের মধ্যকার লক্ষণীয় তারতম্য। যে লোক আল্লাহ্র কালেমার প্রাধান্য সৃষ্টির উদ্দেশ্যে লড়াই করছে, কেবল তাই ‘ফী-সাবীলিল্লাহ্’ –অন্য কিছু নয়। [পূর্বোদ্ধৃত সূত্র।] তবে লোকদের অন্তর দীর্ণ করে ভিতরকার অবস্থা দেখার জন্যে মুসলিমদের বাধা করা হয়নি।স্বতন্ত্র ব্যক্তিদের অবস্থা ও সমষ্টির বাহ্যিক অবস্থা্ই লক্ষণীয় স্বাভাবিক অবস্থা বুঝবার জন্যে, তাদের সাধারণ মতি-গতি দৃষ্টি ভঙ্গী অনুধাবনের জন্য, তাদের লক্ষ্য ও চরিত্র মূল্যায়নের লক্ষ্যে। যা তারা প্রকাশ্যভাবে বলছে, তা-ই ধরা যেতে পারে। মনের গোপন গহনে কার কি মানসিকতা ও প্রেরণার উৎস, কোন্ ব্যক্তির কি, সেব্যাপারটি সম্পূর্ণরূপে আল্লাহ্র নিকট সমর্পিত। এ দীর্ঘ আলোচনা থেকে একথা স্পষ্ট হচ্ছে যে, এ কালের সব যুদ্ধই ইসলামী নয়, নয় আল্লাহ্র পথে- কেননাপ তা সাহাবায়ে কিরামের যুদ্ধের মত নয়- এরূপ বলা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক এবং বিশেষ ধরনের স্পর্ধাও বটে! ঠিক যেমন একথা বলাও অযৌক্তিক যে, এ কালের মুসলমানের যে কোন যুদ্ধ বা সামরিক পদক্ষেপ- উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য তার যা-ই হোক, ভঙ্গী ও দৃষ্টিকোণ যা-ই হোক, চিন্তা-বিশ্বাস যা-ই হোক- আল্লাহ্র পথের যুদ্ধ। এরূপ বলাও একটা বড় ধৃষ্টতা ছাড়া আর কিছু নয়। তাই একালের আলিমগণের কর্তব্য, ফতোয়া দানের সময় যেন তারা মহান আল্লাহ্কে ভয় করেন এবং প্রকৃত সত্য যা জানতে ও অনুধাবন করতে চেষ্টা করেন যেন যেসব লোক গোপনে বা প্রকাশ্যে ইসলামের সাথে শত্রুতা করছে তাদের জন্যে মুসলমানদের ধন-মাল ব্যয় করা না হয়, যেন মুসলমানদের সমর্থন পেয়ে এই শ্রেণীর লোকেরা বর্বরতা ও পাশবিকতা দেখাবার সুযোগ না পায়, ইসলামকে ‘সেকেলে’ বলে অভিহিত করতে না পারে, যেমন এ কালে ইসলামের ধারক-বাহকদের বলা হয় পশ্চাদপদ ও প্রক্রিয়াশীল। এ শ্রেণীর লোকদের অনেক সময় মুসলিম ধরনের বটে; কিন্তু কার্যত তারা ইয়াহুদ-খৃস্টান-কমিউনিস্টদের চাইতেও অধিক ক্ষতিকর ও মারাত্মক হয়ে যাবে দ্বীন-ইসলাম ও মুসলিম জনতার পক্ষে। ইসলামী শাসন পুনপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা আল্লাহ্রন পথের জিহাদ এ কালে যাকাতের ‘ফী-সাবীলিল্লাহ্’ অংশের ধন-সম্পদ সেই কাজে ব্যয় করা বাঞ্ছনীয়, যার উল্লেখ করেছেন প্রখ্যাত সংস্কারক মনীষী আল্লামা সাইয়েদ রশীদ রিজা (রা)। তিনি মুসলিমদের মধ্যে যারা দ্বীন ও দ্বীনী মর্যাদাসম্পন্ন লোক রয়েছেন, তাঁদের নিকেট একটা সংস্থা গড়ে তোলার প্রস্তাব করেছেন। এ সংস্থাটি যাকাত সংক্রান্ত যাবতীয ব্যাপার সুসংগঠিত করবে, সংগ্রহ ও বন্টন করবে এবং সর্বাগ্রে তা ব্যয় করবে এই সংস্থার সাথে সংশ্লিষ্ট যাবতীয় কল্যাণময় কাজে, অন্যত্র নয়। বলেছেন: এ সংস্থাটির সংগঠনেরন এটা লক্ষ্য রাখা আবশ্যক যে যাকাতের ‘ফী-সাবীলিল্লাহ’ খাতটির একটা ব্যয়ক্ষেত্র রয়েছে ইসলামী শাসন ও রাষ্ট্রব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা-প্রচেষ্টায় বর্তমান। অবস্থায় কাফিরদের আগ্রাসন থেকে ইসলামকে সংরক্ষণের জন্যে জিহাদ করার তুলনায় এটা অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। এজন্যে দাওয়াতী কাজও তার একটা ব্যয়ক্ষেত্র, মুখের বক্তৃতা ও ভাষা-সাহিত্য রচনার সাহায্যে তার প্রতিরক্ষা জরুরী। কেননা এখানে শক্তি প্রয়োগ করে প্রতিরক্ষা করা অধিক কঠিন বরং অসম্ভব ব্যাপার। [(আরবী **********)] এ মূল্যবান প্রস্তাব গভীর অনুধাবন শক্তির পরিচায়ক। মনে হচ্ছে, তিনি সূক্ষ্মভাবে পরিস্থিতি বিবেচনা করেছেন ইসলামের জন্যে- জীবনের সব কিছুর জন্যে। ইসলামের আহ্বান-আন্দোলনকারীদের উচিত এই প্রস্তাবটি শক্ত করে ধারণ করা, বোঝা ও বাস্তবায়ন করা। কেননা দ্বীনদার লোকদের ধন-মাল নিয়ে নাস্তিক, চরিত্রহীন, আদর্শহীন ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের জন্যে তা ব্যয় করার মত নির্বুদ্ধিতা আর কিছু হতে পারে না। হ্যাঁ, প্রথমও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণকাজ ‘ফী-সাবীলিল্লাহ’ খাতে ইসলামী জীবনবিধান পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্যে সর্বাত্মক চেষ্টা-প্রচেষ্টা চালানো, যেখানে ইসলামী আইন বিধান বাস্তবায়িত হবে, ইসলামী আকীদা-বিশ্বাস, আচার-আচরণ, শরীয়াত, চরিত্র ইত্যাদি সবকিছু পুরামাত্রায় কার্যকর হবে। সর্বাত্মক চেষ্টা-প্রচেষ্টা বলতে আমরা বুঝি সামষ্টিক সুসংগঠিত ও লক্ষ্যভিত্তিক কাজ এবং তা হল ইসলামী জীবন বিধান বাস্তবায়নের জন্যে, ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। আর তা হল ইসলামী খিলাফতের পুনঃপ্রতিষ্ঠা, মুসলিম উম্মতের পুনর্জাগরণ, ইসলামী সভ্যতার পুনরাভ্যুদয়। এ ক্ষেত্রটিই প্রকৃতপক্ষেএমন যে, মুসলিম দানশীল লোকদের পক্ষেতাদের যাকাতরে মাল ও অপরাপর সাধারণ সাদ্কা এই কাজে বিনিয়োগ করাই অধিক উত্তম ও কর্তব্য। কিন্তু দুঃখের বিষয, বহু মুসলমানই এ ক্ষেত্রটির গুরুত্ব অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছন, মাল ও মনন শক্তির দ্বারা এই কাজের সমর্থন দানের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে পারেন নি। সর্বশক্তি দিয়ে এ ব্যাপারে চেষ্টা চালাতে মনে-প্রাণে প্রস্তুত হন নি। অথচ অবস্থা এই যে, যাকাত ও যাকাত-বহির্ভূত আর্থিক সাহায্য দিলে যাকাত ব্যয়ের অন্য খাতসমূহ নিঃশেষ হয়ে যায় না। একালে ইসলামী জিহাদের বিচিত্র রূপ আমরা এক্ষণে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেছি যে, ইসলামীজিহাদের কাজটি কেবলমাত্র বৈষয়িক বস্তুগত সামরিক পদক্ষেপের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; এ পথে জিহাদের আরও বহু প্রশস্ত ও ক্ষেত্র রয়েছে। সম্ভবত এ কালের মুসলিমগণ সেই অন্যান্য প্রকারের জিহাদের মুখাপেক্ষী তুলনামূলকভাবে বেশি। বস্তুত এ কালে আমরা ঘোষিত ইসলামী জিহাদের আরও কতিপয় পদ্ধতি আয়ত্ত করতে পারি। সে পদ্ধতি ও দৃষ্টান্তসমূহ পেশ করার পূর্বে এ বিষয়টির নিগূঢ় তত্ত্ব এবং তার গুরুত্ব সম্পর্কে কথা বলা প্রয়োজন মনে করছি। সে নিগুঢ় তত্ত্ব হচ্ছে এই: সুসংগঠিত সেনাবহিনী সজ্জিতকরণ, তাকে সশস্ত্র বানানো এবং তার জন্যে অর্থ ব্যয়ের সমস্ত দায়-দায়িত্ব- ইসলামের সূচনাকাল থেকেই ইসলামী রাষ্ট্রের সাধারণ অর্থ ভাণ্ডারের ওপর অর্পিত ছিল। কেবল যাকাতের টাকা দিয়েই এ কাজটি হত না। সেজন্যে ‘ফাই’ ‘খারাজ’ প্রভৃতি বাবদ সংগৃহীত অর্থ সেনাবাহিনী, অস্ত্র ক্রয় ও যুদ্ধকাজে ব্রয় করা হত। যাকাতের অর্থ ব্যয় করা হত কতিপূ পরিপূরক কাজে।যেমন নফল হিসেবে যুদ্ধে যোগদানকারীদের খরচ বহন ইত্যাদি। অনুরূপভাবে আমরা দেখছি, সেনাবাহিনী ও প্রতিরক্ষার যাবতীয় খরচের সামষ্টিক বোঝা সাধারণ বাজেটের কাঁধের ওপা চাপানো হয়ে থাকে। কেননা সে বাবদ একটা বিরাট ও ভয়াবহ ব্যয়ভারের দাবি করা হয়, যা কেবলমাত্র যাকাত সম্পদই বহন করতে সক্ষম হয় না। এরূপ ব্যয়ভার যদি যাকাত ফাণ্ডকেই বহন করতে হয়, তাহলে যাকাত বাবদ অর্জিত সমস্ত সম্পদ নিঃশেষ ব্যয় হয়েও তার প্রয়োজন পূরণ সম্ভব হবে না। এ কারণে আমরা মনে করি, যাকাত খাতের সমস্ত আয় সাংস্কৃতিক প্রশিক্ষণমূলক ও প্রচরধর্মী কার্যাবলীতে ব্যয় করাই একালে উত্তম। তবে শর্ত এই যে, সে জিহাদটি ইসলামী হতে হবে সর্বতোভাবে, খালেস এবং যথার্থ ইসলামীতা কখনো জাতীয়তা বা স্বাদেশিকতাবাদী ভাবধারায় কলুষিত হবে না। পাশ্চাত্য বা প্রাচ্য উপাদান সম্পন্ন ইসলামী ঝাণ্ডাধারীও হবে না তা। কেননা তাতে বিশেষ ধর্মমত বা বিশেষ ব্যবস্থা কিংবা শহর বা দেশ, শ্রেণী অথবা ব্যক্তির খেদমতই লক্ষ্য হয়ে থাকে। যেহেতু আমরা লক্ষ্যকরছি, ইসলাম অনেক সময় এমন সব প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার শিরোনাম হয়ে দাঁড়ায়, যার অভ্যন্তরীণ ভাবধারা পুরাপুরি ধর্মনিরপেক্ষ বা ধর্মহীন হয়ে থাকে। অতএব এক্ষণে ইসলামকেই ভিত্তি ও মৌল উৎসরূপে গৃহীত হতে হবে, তা-ই হতে হবে চরম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। অনুপ্রেরক ও পথ প্রদর্শক হতে হবে তাকে। তাহলেই এ সব প্রতিষ্ঠান আল্লাহ্র নামের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার মর্যাদা লাভের উপযুক্ত হতে পারবে। আর সে কাজটাই ‘আল্লাহ্র পথের জিহাদ’ নামে অভিহিত হতে পারবে। আমরা এ পর্যায়ে এমন বহু কাজের দৃষ্টান্তের উল্লেখ করতে পারি, যাও ওপরে এ কালে ইসলামী দায়িত্ব পালন অনেক মাত্রায় নির্ভর করে। তাও ‘আল্লাহ্র পথের জিহাদ’ নামে অভিহিত হওয়ার যোগ্য হতে পারে। সঠিক ইসলামী দাওয়াত প্রচারের কেন্দ্র স্থাপন এবং অমুসলিম লোকদের মধ্যে ইসলাম প্রচারের দায়িত্ব পালন একালে সব কয়টি মহাদেশেই একান্ত কর্তব্য। কেননা একালে বিভিন্ন ধর্ম ও মতবাদের মধ্যে প্রচণ্ড দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষ চলছে। এ কাজও ‘জিহাদ-ফী-সাবীলিল্লাহ’ রূপে গণ্য হতে পারে। খোদ ইসলামী দেশসমূহের অভ্যন্তরে ইসলাম প্রচার কেন্দ্র গড়ে তোলা এবং মুসলিম যুব সমাজকে এ কাজেনিয়োজিত ও প্রতিপালন করা একান্ত আবশ্যক। এ সব কেন্দ্র যথার্থ ইসলামী আদর্শ প্রচার করে সর্বস্তরের জনগণকে ইসলামী আদর্শে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। রক্ষা করতে পারে তাদেরকে সকল প্রকার নাস্তিক্যবাদী মতবাদের কু-প্রভাব থেকে, চিন্তা-বিশ্বাসের কঠিন বিপর্যয় থেকে, আচার-আচরণের বিচ্যুতি থেকে। এ কাজও ইসলামের সাহায্যরূপে চিহ্নিত হতে পারে, তাই ইসলামের দুশমনদের প্রতিহত করার এ-ও একটা কাজ এবং তাও ইসলামী জিহাদ। খালেস ইসলামী মতবাদ ও চিন্তাধারামূলক বই-পুস্তক ও পত্র-পত্রিকা প্রচার করাও একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তা প্রতিহত করবে বিধ্বংসী ও বিভ্রান্তিকর চিন্তা-বিশ্বাসের ধারক বই-পুস্তক ও পত্র-পত্রিকার যাবতীয় কারসাজি। তার ফলেই আল্লাহ্র কালেমা প্রাধান্য লাভ করতে পারে এবং সত্য সঠিক চিন্তা সর্বত্র প্রচারিত হতে পারে। সম্ভব হতে পারে ইসলামের প্রতিরক্ষা। কেননা এ কালে ইসলামের ওপর বহু মিথ্যা ও ভিত্তিহীন কথা আরোপ করা হচ্ছে। জনমনে বহু সংশয় ও বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে দিচ্ছে। এই বই ও পত্রিকা ইসলামকে সর্বপ্রকার বাহুল্য ও বাড়াবাড়ি মুক্ত করে তার আসল রূপে উপস্থাপিত করবে। এ কাজও আল্লাহ্র পথে জিহাদ। মৌলিক ইসলামী গ্রন্থাদি প্রকাশ করা- ইসলামের প্রকৃত বৈশিষ্ট্য সৌন্দর্য বিশ্লেষণ করা, তার অন্তর্নিহিত পবিত্র ভাবধারাসমূহ বিকশিত করা ইসলামী আদর্শের শ্রেষ্ঠত্ব, সমস্যার সমাধানে তার সর্বধিক যোগ্যতা ও ক্ষমতা জনগণের সম্মুখে উপস্থাপিত করা একটা বিরাট কাজ। তা ইসলামের দুশমনদের সৃষ্ট সব বিভ্রান্তি ও সন্দেহের ধূম্রজাল ছিন্নভিন্ন করে দেবে। এ ধরনের বই-পুস্তক ব্যাপক ও সাধারণভাবে প্রচার করা একটা ইসলামী জিহাদ সন্দেহ নেই। শক্তিমান বিশ্বস্ত ও নিষ্ঠাবান লোকদের পূর্বোক্ত কার্য ক্ষেত্রসমূহে সার্বক্ষণিকভাবে নিয়োগ করা, তাদের দৃঢ় সংকল্প ও মর্যাদাবোধ সহকারে সুস্পষ্ট রূপরেখা সম্মুখে নিয়ে এই দ্বীনের খেদমত করার সুযোগ করে দেয়া- বিশ্বের চারদিকে ইসলামের নির্মল জ্যোতির কিরণ ছড়ানো, ওঁৎ পেতে থাকা শত্রুদের সব ষড়যন্ত্র জাল ছিন্ন করা আর ঘুমন্ত মুসিলম জনগণকে জাগ্রত করা এবং খৃস্টান মিশনারী ও নাস্তিকতার প্রচারকদের মুকাবিলা করা নিশ্চয়ই ইসলামী ‘জিহাদ ফী-সাবীলিল্লাহ্’। প্রকৃত ইসলাম প্রচারকদের সাহায্য করাও কর্তব্য।কেননা তাদের ওপর বাইরের জগতের ইসলামের দুশশনদের প্রচার প্রচণ্ড চাপ পড়ে। অভ্যন্তরীণভাবে আল্লাহদ্রোহী ও মুর্তাদ লোকদের কাছ থেকে তারা পাচ্ছে সর্বাত্মক অসহযোগিতা ও বিরোধিতা। তাদের ওপর আসে আঘাতের পর আঘাত প্রচণ্ডভাবে। নানা ধরনের আযাবে তারা হয় নিত্য জর্জরিত, তাদের হত্যা করা হয়, নিপীড়ন করা হয় মর্মান্তিকভাবে, তাদের পানাহার বন্ধ করে দিয়ে কষ্ট দেয়া হয়, মেরে ফেলার ব্যবস্থা করা হয়। কুফর ও আল্লাহদ্রোহিতার এ প্রচণ্ড চাপের মুখে ঈমানের ওপর অবিচল থাকার কাজে তাদের সর্বপ্রকার সাহায্য করা নিঃসন্দেহে আল্লাহ্র পথে অতি বড় জিহাদ। এ ধরনের বহুবিধ বিচিত্র ক্ষেত্র এমন রয়েছে, যেখানে একালে যাকাতের সম্পদ ব্যয় করা মুসলমানদের জন্যে খুবই কল্যাণকর হতে পারে। যাকাতের ওপরও- আল্লাহ্র পরে ইসলামের ধারক-বাহকগণের প্রয়োজন পূরণের গুরুত্ব রয়েছে, বিশেষ করে ইসলামের বর্তমান দুর্দিনে তো আর গুরুত্ব কোন অংশেই কম হওয়া উচিত নয়। সপ্তম পরিচ্ছেদ ইবনুস-সাবীল- নিঃস্ব পথিক ‘ইবনুস-সাবীল’ কে? জমহুর আলিমগণের মতে ‘ইবনুস-সাবীল’ বলে বোঝানো হয়েছে সেই পথিক- মুসাফিরকে, যে এক শহ্র থেকে অন্য শহরে- একদেশ থেকে অন্য দেশে চলে যায়। ‘সাবীল’ অর্থ পথ।পথিকদের ‘ইবনুস-সাবীল বলা হয় এজন্যে যে, পথিকের জন্যে পথই অবিচ্ছিন্ন সাথী। যেমন কবি বলেছেন: (আরবী *******) আমি সমর সন্তান, তা-ই আমায় জন্মকাল থেকে লালিত করেছে- শেষ পর্যন্ত আমি যৌবন লাভ করেছি এবং বৃদ্ধ হয়েছি জটিল সমস্যার মধ্যে পড়ে.... আরবরা তা-ই করে। সেযে জিনিসের সাথে জড়িত হয়ে পড়ে, নিজেকে সে জিনিসেরই সন্তান বলে ঘোষণা করে।বলে.... তাঁর পুত্র। [আরবী *******] তাবারী মুজাহিদ থেকে বর্ণনা করেছেন, বলেছেন, ইবনুস-সাবী- পথিক ব্যক্তির একটা হক্ য়েছে যাকাত সম্পদে, সে যদি ধনী হয়তবুও- যদি সে তার নিজের ধন-সম্পদ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ইবনে জায়দ বলেছেন: ‘‘ইবনুস-সাবীল’’ মানে মুসাফির, পথিক-সে ধনী হোক, কি গরীব উভয় অবস্থায়ই, যদি সে স্বীয় প্রয়োজনীয় ব্যয়ের ব্যাপারে বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়ে, সম্পদ হারিয়ে ফেলে অথবা অন্য কোন ধরনের বিপদের সম্মুখীন হয়ে পড়ে অথবা তার হাতে যদি কোন সম্পদই না থাকে, তাহলে তার এই হক অবশ্যই প্রাপ্য। [ঐ] (এ কারণে বাংলায় আমরা ইবনুস-সাবীল-এর অনুবাদ করেছি এক শব্দে ‘নিঃস্ব পথিক’ বলে –অনুবাদক) ‘ইবনুস-সাবীল’-এর প্রতি কুরআনের বদান্যতা কুরআন মজীদ ‘ইবনুস-সাবীল’ শব্দটি দয়ার পাত্রহিসেবে- সদ্ব্যবহার পাওয়ার অধিকারীরূপে- আটবার উল্লেখ করেছে। কুরআনের মক্কী অংশেরসূরা আল-ইসরায় আল্লাহ তা’আলা বলেছেন: (আরবী *******) এবং নিকটাত্মীয়কে দাও তার হক্ এবং মিসকীন, নিঃস্বপথিককেওএবং তুমি অপব্যয় করবে না। [সূরা বনী ইসরাঈল: ২৬আয়াত] সূরা ‘আর-রূম’-এ বলা হয়েছে: (আরবী *********) ‘অতএব দাও নিকটাত্মীয়কে তার হক্ এবং মিসকীন ও নিঃস্ব পথিককেও। এ কাজ অতবি কল্যাণময় সেসব লোকের জন্যে, যারা আল্লাহ্র সন্তুষ্টি চায়। [সূরা রূম: ৩৮ আয়াত] কুরআনের মাদানী সূরাসমূহে ‘ইবনুস-সাবীল’কে ফরয কিংবা নফল অর্থব্যয়ের ক্ষেত্রে হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ বলেছেন: (আরবী *********) লোকেরা তোমাকে জিজ্ঞাসা করে, তারা কি এবং কোথায় ব্যয় করবে? বল, তোমরা যে- ধন-মালই ব্যয় কর না কেন, তা আল্লাহ্র জন্যে, পিতামাতার জন্যে, নিকাটাত্মীয়দের জন্যে, ইয়াতীম মিসকীন ও নিঃস্ব পথিকদের জন্যে। [সূরা বাকারা: ২১৫] দশটি অধিকার সংক্রান্ত আয়াতে ‘ইবনুস-সাবীল’-এর প্রতি দয়া অনুগ্রহ করার আদেশ করা হয়েছে। আয়াতটি এই: (আরবী *********) তোমরা সকলে আল্লাহ্র বন্দেগী কবুল কর, তাঁর সাথে কোন কিছুই শরীক করোনা, পিতামাতার সাথে উত্তম দয়ার্দ্র ব্যবহার কর এবং নিকটাত্মীয়, পার্শ্ববর্তীসঙ্গী, নিঃস্ব পথিক এবং তোমাদের দক্ষিণ হস্তের মালিকানাভুক্ত দাস-দাসীদের সাথে। [সূরা নিসা: ৬৩] বায়তুলমালেগনীমতের এক-পঞ্চমাংশ জমাহলে তাতেও নিঃস্ব পথিকের জন্যে একটা অংশ নির্দিষ্ট হয়ে যায়। ইরশাদ হয়েছে: (আরবী *********) তোমরা জেনে রাখ, যে জিনিসই তোমরা গনীমত হিসেবে পাও, তার এক-পঞ্চমাংশ আল্লাহ্র জন্যে, রাসূলের জন্যে, নিকটাত্মীয়ের জন্যে, ইয়াতীম, মিসকীন ও নিঃস্ব পথিকের জন্য নির্দিষ্ট। -আনফাল: ৪১ ‘ফাই সম্পদেও তার জন্যে অংশ নির্দিষ্ট রয়েছে। ইরশাদ হয়েছে: (আরবী *********) আল্লাহ্ তাঁর রাসূলকে নগরবাসীদের নিকট থেকে ‘ফাই’ সম্পদ পাইয়ে দেন, তা আল্লাহ্র জন্যে, রাসূলেরজন্যে, নিকটাত্মীয়ের জন্যে এবং ইয়াতীম, মিসকীন ও নিঃস্ব পথিকের জন্যে যেন ধন-সম্পদ কেবলমাত্র তোমাদের ধনী লোকদের মধ্যেই আবর্তিত হতে না থাকে। -সূরা হাশর: ৭ অনুরূপভাবে কুরআন যাকাতেরও একটা অংশ নিঃস্ব পথিকের জন্যে নির্দিস্ট করেছে। তা এখনকার আলোচ্য আয়াতে বলা হয়েছে। যার সূচনা হয়েছে এভাবে: (****) যাকাত আদায় করর পরও ব্যক্তিদের নিকটযে মাল-সম্পদ সঞ্চিত থাকে, তাতেও তার জন্যে অংশ নির্দিষ্ট হয়েছে। এরূপ অবস্থায় এই দান আল্লাহ্ভীতি ও পরম পুণ্যময় কাজের অন্তর্ভুক্ত। আয়াতটি হচ্ছে: (আরবী *********) এবং দেয় মাল-সম্পদ আল্লাহ্র প্রতি ভালোবাসার দরুন নিকটাত্মীয়কে, ইয়াতীম, মিসকীন, নিঃস্ব পথিক, প্রার্থী, দাসত্ব-শৃংখলে বন্দী লোকদেরকে এবং নামায কায়েযম করেও যাকাত দেয়। -সূরা বাকারা: ১৭৭ ইবনুস-সাবীল-এর প্রতি গুরুত্ব দানের যৌক্তিকতা নিঃস্ব-পথিকের ব্যাপারে কুরআনের এতটা গুরুত্ব দানের মূলে নিহিত কারণ ও যৌক্তিকতা হচ্ছে, দ্বীন-ইসলাম মানুষকে দেশ ভ্রমণ ও বিদেশ গমনের উপদেশ দিয়েছে নানাভাবে ও বিবিধ কারণে। দুনিয়ার ঘুরে-পরিব্রমণ করে দেখার ও উৎসাহ দানের মূলে কতগুলো কারণ নিহিত রয়েছে: ক. এক ধরনের পরিভ্রমণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে রিযিক সন্ধানের উদ্দেশ্যে। আল্লাহ্ বলেছেন: (আরবী *********) তাই চল তোমরা পৃথিবীর কন্দরে কন্দুরে এবং তার কাছে থেকে পাওয়া রিযিক আহার কর। -সূরা মূলক: ১৫ বলেছেন: (আরবী *********) অন্যরা পৃথিবীতে ঘুরে বেড়ায়, সন্ধান করে আল্লাহ্র অনুগ্রহ (রিযিক) এবং আরও অন্যরা আল্লাহ্র পথে যুদ্ধ করে। -সূরা মুযাম্মিল: ২০ নবী করীম (স) বলেছৈন: (*****) তোমরা পরিভ্রমণ কর, পরিণামে ধনী হয়ে যাও। [মুনযেরীহাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন: (****) গ্রন্থে। ২য়খণ্ড কিতাবুস সাওম বলেছেন, তাবারানী হাদীসটি উদ্ধৃত করেছে (****) গ্রন্থে, এর বর্ণনাকারিগণ নির্ভরযোগ্য।] খ. আর এক প্রকারের পরিভ্রমণের জন্যে ইসলাম উদ্বুদ্ধ করেছে। তা হচ্ছে জ্ঞান-শিক্ষার উদ্দেশ্যে বিদেশ ভ্রমণ। বিশ্বের অবস্থা অবলোকন এবং সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা আল্লাহ্র নিদর্শনাবলী দেখে উপদেশ গ্রহণের লক্ষ্যে। সাধারণভাবে সৃষ্টিকর্মে আল্লাহ্র অনুসৃত নীতিসমূহ দেখার উদ্দেশ্যে। বিশেষ করে মানব সমাজের মধ্যে নিহিত অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্যে।তিনি বলেছেন: (আরবী *********) বল, তোমরা পরিভ্রমণ কর পৃথিবীর আনাচে-কানাচে এবং দেখ কিভাবে সৃষ্টিকর্ম সূচিত করেছিলাম। -সূরা আনকাবুত: ২০ এ আয়াতের ভূ-তত্ত্ব (Geology) ও জীবনের ইতিহাস এবং তৎসংশ্লিষ্ট অপরাপর তত্ত্ব আলোচনা-পর্যালোচনা ও অধ্যয়নের নির্দেশ নিহিত রয়েছে। আল্লাহ বলেছেন: (আরবী *********) তোমাদের পূর্বে বহু যুদ-কাল অতিবাহিত হয়ে গেছে অতএব তোমরা পৃথিবী পরিভ্রমণ কর এবং পর্যবেক্ষণকর আল্লাহতে অবিশ্বাসীদের পরিণতি কি হয়েছে। -সূরা আলে-ইমরান: ১৩৭ বলেছৈন: (আরবী *********) এ লোকেরা কি পৃথিবীতে পরিভ্রমণ করেনি? করলে তারা এমন হৃদয় লাভ করতে পারত যদ্দারা তারা প্রকৃত অবস্থা অনুধাবন করতে সক্ষম হত; কিংবা এমন শ্রবণেন্দ্রিয় পেতে পারত যদ্দ্বারা তারা অনেক তত্ত্ব জানতে পারত। কেননা প্রকৃত অন্তুদৃষ্টি কখনও অন্ধ হয় না; অন্ধ হয় হৃদয়- যা বুকের মধ্যে অবস্থিত। -সূরা হজ্জ: ৪৬ সেই বক্ষে নিহিত অন্তর্দৃষ্টি জাগ্রত করার লক্ষ্যে এই ভূ-পর্যটনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। রাসূলে করীম(স) বলেছেন: ‘যে লোক ইলম অর্জনের উদ্দেশ্যে পথ চলবে, আল্লাহ্ তার জন্যে জান্নাতের পথে চলা সহজ করে দেবেন। [মুনযেরী, মুসলিম কিতাবুল ইলম] আর যে লোক ইলম সন্ধান করার উদ্দেশ্যে বের হল, সে আল্লাহ্র পথেই রয়েছে যতক্ষণ না সে ফিরে আসে।’ (তিরমিযী) প্রাথমিককালের আলিমগণ একটা দৃষ্টান্ত পেশ করেছেন। দৃষ্টান্তটি খুব উচ্চমানের। তা ইলম সন্ধানের পথে দৃষ্টিহীন পরিভ্রমণের কাহিনী। এ কালের আলিম ও পাশ্চাত্য-প্রাচ্যের ঐতিহাসিকগণ খুব বিস্ময় ও শ্রদ্ধা সহকারে তার উল্লেখ করেছেন। গ. ইসলাম অপর এক প্রকারের ভ্রমণের আহ্বান জানায়। তা হচ্ছে আল্লাহ্র পথে জিহাদের জন্যে সফর। সর্বপ্রকার বিদেশী বিজাতীয় দখলদারী থেকে দেশের স্বাধীনতার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা শক্ত করা, ইসলামী দাওয়াতের কাজের নিরাপত্তা বিধান, দুর্বল লোকদের নিষ্কৃতি সাধান ও ওয়াদা ভঙ্গকারীদের যথাযথ শাস্তি প্রদান প্রভৃতিই হচ্ছে আল্লাহ্র পথ। আল্লাহ্ বলেছেন: (আরবী *********) তোমরা বের হয়ে পড় হালকাভাবে ও ভারী হয়ে এবং জিহাদ কর তোমার ধন-মাল ও জান-প্রাণ দিয়ে আল্লাহ্র পথে। এটাই তোমাদের জন্য কল্যাণময়, যদি তোমরা জান। -সূরা তওবা: ৪১ এরপর মুনাফিকদের সম্পর্কে বলা হয়েছে: (আরবী *********) হে নবী! যদি সহজলভ্য স্বার্থ হত এবং সফরও হত কষ্টবিহীন, তা হলে ওরা নিশ্চয়ই তোমার পেচনে চলার জন্যে প্রস্তুত হয়ে যেত। কিন্তু তাদের জন্য এই পথ তো খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে। এক্ষণে তারা আল্লাহ্র নামে শপথ করে করে বলবে, আমরা যদি চলতে পারতাম তা হলে নিশ্চয়ই তোমাদের সঙ্গে যেতাম। তারা নিজেরাই নিজেদেরকে ধ্বংসের মধ্যে নিক্ষেপ করছে। আল্লাহ্ তো বালো করেই জানেন যে, ওরা মিথ্যাবাদী। -সূরা তওবা: ৪২ মুজাহিদদের সওয়াব দানের কথা বলার পর আল্লাহ ইরশাদ করেছেন: (আরবী *********) ‘অনুরূপভাবে এটাও কখনই হবে না যে, (আল্লাহ্র পথে) অল্প বা বেশি কিছু খরচ তারা বহন করবে এবং (জিহাদী চেষ্টা-প্রচেষ্টায়) কোন উপত্যকা তারা অতিক্রম করবে এবং তাদের পক্ষে তা লিখে না নেয়া হবে, উদ্দেশ্য হচ্ছে, আল্লাহ্ তাদের এই ভালো কীর্তির পারিশ্রমিক তাদের দান করবেন। [(আরবী *********)] নবী করীম (স) বলেছেন: আল্লাহ্র পথে একটা সকাল কিংবা একটা বিকাল অতিবাহিত করা সারা দুনিয়া এবং তার মধ্যে যা আছে সেসব কিছু থেকে উত্তম। [বুখারী, কিতাবুল জিহাদ] চ. আর এক প্রকারের সফরের প্রতি ইসলাম আহ্বান জানিয়েছে। তা হচ্ছে আল্লাহ্র একটা সার্বজনীন বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ইবাদত- হজ্জ পালনের উদ্দেশ্যে আল্লাহ্র ঘর পর্যন্ত যাওয়ার জন্যে। তা ইসলামের একটা অন্যতম ‘রুকন’। আল্লাহ্ বলেছেন: (আরবী *********) ‘আল্লাহ্র জন্যে কা’বায় হজ্জ করা লোকদের জন্যে ফরয- যারা সে পর্যন্ত যাওয়ার সামর্থবান হবে। -সূরা আলে-ইমরান: ৯৭ (আরবী *********) এবং লোকদেরকে হজ্জের জন্যে সাধারণ অনুমতি দিয়ে দাও, তারা তোমার নিকট সব দূরান্তরের স্থান থেকে পায়ে হেঁটে এবং উটের ওপর সওয়ার হয়ে আসবে। যেন তারা সেই সুযোগ-সুবিধা ও কল্যাণ দেখতে পারে যা এখানে তাদের জন্যে রক্ষিত হয়েছে এবং কতিপয় নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহ্র নাম নেবে....। –সূরা হজ্জ: ২৭-২৮ দেশ-বিদেশ ভ্রমণ ও ঘোরাফেরার এ হচ্ছে বিভিন্ন ও বিচিত্র ধরন। ইসলাম এ সব সফরের জন্য আহ্বান জানিয়েছে, উৎসাহ দিয়েছে। পৃথিবীতে নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্যে এ সব পরিভ্রমণে উদ্বুদ্ধ করেছে মুসলমানদের। ইসলামের মহান শিক্ষার বাস্তবায়ন এভাবেই সম্ভবপর হতে পারে। এ ছাড়া আরও কয়েক ধরনের বিশ্বপরিভ্রমণ রয়েছে। আর দ্বীন ইসলামের বৈশিষ্ট্যই এখানে যে, এ সব সফরে গমনকারী লোকদের প্রতি তা খুব বেশি ও বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছে। আরও বিশেষ করে তাদের প্রতি, যারা এইসফরে বের হয়ে পথ হারিয়ে ফেলেছে এবং তার আপন লোকজন ও ধন-মাল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ইসলাম সাধারণভাবেই এ সবের প্রতি সাহায্যের হাত প্রসারিত করার নির্দেশ দিয়েছে এবং বিশেষ করে যাকাতের অংশ- জনগণের দেয়া সম্পদ থেকে তাদের প্রয়োজন পরিমাণ দেয়ার ব্যবস্থা করেছে। আর তা করে বিদেশ ভ্রমণের পক্ষে ইসলামের উৎসাহ দানকে শক্তিশালী করেছে, শরীয়াত সম্মত উদ্দেশ্যে বিশেধ ভ্রমণের কাজটিকে আকর্ষনীয় করে তুলেছে। ভ্রমণকারীদের অপরচিত পরিমণ্ডলে সম্মান ও মর্যাদা পাওয়ার অধিকারী বানিয়েছে। মুসলিম সমাজের সকল অংশই যে পরস্পর সম্পৃক্ত- দৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ তার বাস্তব প্রমাণ উপস্থাপিত করেছে। এ সমাজের লোকেরা পরস্পরের হাত ধরাধরি করে চলে, একের বিপদ বা অসুবিধায় অপর লোক বন্ধুত্বের হাত প্রসারিত করে দেয়। সে ক্ষেত্রে দেশ-বিদেশের কোন পার্থক্যের প্রতি আদৌ কোন ভ্রূক্ষেপ করা হয় না। আর দেশী-বিদেশীদের মধ্যে ইসলামে কোন পার্থক্যই করা যেতে পারে না। সামাজিক নিরাপত্তার এক দৃষ্টান্তহীন ব্যবস্থা ইসলাম বিদেশী অপরিচিতির মধ্যে নিঃস্ব হয়ে পড়া মুসাফিরদের ব্যাপারে যে গুরুত্ব আরোপ করেছে তা সমাজ-ব্যবস্থার ইতিহাসে দৃষ্টান্তহীন। এ দুনিয়ার অপর কোন মতবাদ, সমাজ-ব্যবস্থা বা কোন বিধানই এরূপ কোন ব্যবস্থার দৃষ্টান্ত উপস্থাপিত করতে পারেনি। আর আসলে এটা এক ধরনের সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা- এ পর্যায়ের একক ও অন্যান্য ব্যবস্থা। কোন দেশে বসবাসকারী লোকদের স্থায়ী প্রয়োজন ও অভাব-অনটন দূর করার ব্যবস্থা করেই ইসলাম ক্ষান্ত হয়নি। বরং ভ্রমণ ও বিদেশ গমন ইত্যাদি ক্ষেত্রে ও কার্যকারণে মানুষ যেসব অভাব ও নিঃস্বতার সম্মুখীন হয়, তার জন্যেও সুষ্ঠু ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। বিশেষ করে ইসলামের এই অবদান সেই কালে- যখন পথে-ঘাটে শহরে-বন্দরে, হোটেল-মুসাফিরখানা, বিশ্রামাগার বা হোটেল-রেস্তোঁরা একালের মত কোথাও ছিল না। কার্যতও আমরা দেখতে পাচ্ছি, ইবনে সায়াদ বর্ণনা করেছেন, হযরত উমর ইবনুল খাত্বা (রা) তাঁর খিলাফত আমলে একটা ঘর নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন এবং তার ওপর লিখে দিয়েছিলেন ‘দারুদ্দাকীক’-ময়দার ঘর। তার কারণ সেই ঘরে ময়দা, আটা, খেজুর, পানি ও অন্যান্য দরকারী দ্রব্য সংগ্রহ করে রেখেচিলেন। যেসব নিঃস্ব পথিক ও অতিথি তাঁর নিকট আসত সেসব দিয়ে তাদের সাহায্য করা হত। অনুরূপভাবে মক্কা ও মদীনার দীর্ঘ পথের মাঝেও হযরত উমর অনুরূপ ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। নিঃস্ব লোকেরা এখান থেকে যথেষ্ট উপকৃতহত এবং একটা স্থান থেকে পানি নিয়ে পরবর্তী স্থানে পৌঁছতে পারত। [(আরবী *********)] পঞ্চম খলীফায়ে রাশেদ হযরত উমর ইবনে আবদুল আজীজের সময়কার ব্যবস্থা সম্পর্কে আবূ উবাইদ বর্ণনা করেছেন, তিনি ইমাম ইবনে শিহাব জুহ্রীকে যাকাত-সাদকা সংক্রান্ত রাসূলে করীমের বা খুলাফায়ে রাশেদুনের যেসব সুন্নাত বা হাদীস মুখস্ত আছে তা তাঁর জন্যে লিখে পাঠাবার নির্দেশ দিয়েছিলেন। ফলে তিনি একখানি দীর্ঘ লিপি লিখে পাঁঠিয়েছিলেন। তাতে প্রত্যেকটি অংশ আলাদা আলাদা বিভক্ত করে দিয়েছিলেন। এই লিপিখানিতে ‘ইবনুস-সাবীল’ পর্যায়ে এই কথাটি উদ্ধৃত হয়েছে: ইবনুসসাবীল-এর অংশ প্রত্যেক রাস্তায় চলাচলকারী লোকদের সংখ্যানুপাতে বিভক্ত করে হবে, যে কোন নিঃস্ব পথিক- যার কোন আশ্রয় নেই, আশ্রয় দেয়ার মত কোন পরিবারও নেই- তাকে খাওয়অতে হবে যতক্ষণ না সে তেমন একটা আশ্রয়স্থল পেয়ে যায় বা তার প্রয়োজন পূর্ণ হয়। প্রত্যেকটি পরিচিত বাড়ি-ঘর নির্ভরযোগ্য লোকের হাতে ন্যস্ত করতে হবে। যেন যে কোন নিঃস্ব পথিক সেখানে উপস্থিত হতে পারবে এবং তাকে আশ্রয়ও দেবে এবং খাবার দেবে। তার সঙ্গে বাহন জন্তু থাকলে তার খাবারের ব্যবস্থাও করবে- যতক্ষণ তাদের নিকট রক্ষিত দ্রব্যাদি নিঃশেষ হয়ে না যায়। ইনশাআল্লাহ্। [(আরবী *********)] অভাবগ্রস্ত ও বিপন্ন পথিকের জন্যে এরূপ ব্যবস্থা বিশ্বমানব কোথাও দেখেছে কি?.... ইসলামী ব্যবস্থা ছাড়া আর কোন ব্যবস্থায় এরূপ নিরাপত্তা কোথাও পাওয়া যায় কি? মুসলিম উম্মত ছাড়া দুনিয়ার অপর কোন উম্মতম এরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সমর্থ হয়েছে কি? সফর শুরুকারী ও সফর সমাপ্তকারী এখানে একটি বিষয় ফিকাহ্বিদদের মধ্যে মতবিরোধের কারণ ঘটিয়েছে। প্রশ্নটি হচ্ছে, যে মুসাফির পথ অতিক্রম করে গেছে লক্ষ্যহীনভাবে, তাকে ‘ইবনুস সাবীল’ বলা হবে, না সে সহ সেই মুসাফিরও তার মধ্যে শামিল হবে যে দেশে বা শহরের দিকে যাত্রা শুরু করতে চাইছে। জমহুর ফিকাহ্বিদদের বক্তব্য সফর সূচনাকারী ব্যক্তি ‘ইবনুস সাবীল’ পর্যায়ে গণ্য হওয়ার অধিকারী হবে না। তা এজন্যে: (ক) কেননা ‘সাবীল’ মানে পথ। আর ‘ইবনুস-সাবীল’ হচ্ছে সেই পথিক যে পথে চলমান রয়েছে। যেমন ‘ইবনুল লাইল’ বলা হয় সে লোককে যে রাত্রিবেলা বাইরে খুব বেশি যাতায়াত করে। নিজ শহরে বা ঘরে অবস্থানকারী তো আর পথে পড়ে নেই। তাই ‘পথিক’ বলতে যা বোঝায় তা তাকে বলা যাবে না। কাজেই যে-লোক শুধু সংকল্প করেছে, কার্যত পথে এখনও নামেনি, তাকে ‘পথিক’ সংক্রান্ত গুণে গুণান্বিত বা সেই পরিচয়ের অধিকারী বলা যায় না। (খ) ‘ইবনুস সাবীল’ বলতে ‘বিদেশী’ লোকই বোঝায়। যে লোক নিজের দেশে নিজের ঘরে রয়েছে, তাকে তা বলা চলে না। তার যত প্রয়োজন বা অভাবই দেখা দিক না কেন। [***১] তাই জমহুর ফিকাহ্বিদদের মতে আয়অতে উল্লিখিত ‘ইবনুস-সাবীল’ বলে কেবলমাত্র ‘বিদেশী লোক’ই বোঝা যেতে পারে, অন্যকে নয়। সে লোকের নিজের দেশে সম্পদ সংগতি থাকা সত্ত্বেও তাকে যাকাতের অংশ দেয়া হবে এজন্যে যে, সে তার নিজের সম্পদ ব্যবহার করতে পারছে না, তা থেকে উপকৃত হতে পারছে না বিদেশে পড়ে আছে বলে। এক্ষণে সে নিঃস্ব ফকীরবত। আর ‘পথিক’ নিজ দেশে গরীব হলেও তাকে তা দেয়া হবে দুটি কারণে। একে তো সে দরিদ্র, দ্বিতীয় সে বিদেশে নিঃস্ব অবস্থায় রয়েছে। ‘নিস্ব পথিক’ হিসেবে তাকে দেয়া হবে তার বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছার প্রয়োজনীয় সম্বল। আর তার এই প্রয়োজনের দৃষ্টিতে তাকে খরচ বাবদ দেয়া হবে তার প্রয়োজন পরিমাণ। ‘ইবনুস-সাবীল’ পর্যায়ে ইমাম শাফেয়ীর বক্তব্য যে অপরিচিত ব্যক্তি- পথ অতিক্রমকারী কিংবা সফর সূচনাকারী উভয়ই অর্থাৎ যে লোক সফর করার ইচ্ছা করেছে; কিন্তু সম্বল পাচ্ছে না। এই দুই ধরনের লোককেই তাদের প্রয়োজন মত দেয়া হবে- তাদের যাওয়ার জন্যে ও প্রত্যাবর্তনের জন্যে। কেননা পথে চলার সংকল্পকারী সফরের ইচ্ছা করেছে, কোন পাপ কাজের নয়। ফলে সে পথ অতিক্রমকারীর পর্যায়ভুক্ত। কেননা এই দুই লোকই সফর সম্বলের মুখাপেক্ষী, যদিও দ্বিতীয় ব্যক্তিকে ইবনুস সাবীল বলা হবে পরোক্ষ অর্থে। [দেখুন: (আরবী *********)] এই গ্রন্থকারের বিবেচনা প্রথমোক্ত মতটির আয়াত উদ্ধৃত ‘ইবনুস-সাবীল’-এর সাথে অধিকতর সামঞ্জস্যপূর্ণ। শরীয়াতের লক্ষ্যের দিক দিয়েও অধিক নিকটবর্তী। তার ওপর কিয়াস করা হয়েছে সফরে আগ্রহী বা সংকল্পকারী প্রত্যেক ব্যক্তিকে। তাকেও যাকাতের মাল থেকে দেয়া যাবে, যদিও সে তার সফর দ্বারা বিশেষ কোন ফায়দা লাভ করার ইচ্ছা করেছে। হতে পারে সে জীবিকা অর্জনের কোন উপায় তালাশ করেছে কিংবা মনের আনন্দস্ফূর্তি লাভের উদ্দেশ্যে বিদেশে যাওয়ার সংকল্প করেছে। তবে ইমাম শাফেয়ীর অভিমত- আমি মনে করি- গ্রহণ করা যেতে পারে তাদের ক্ষেত্রে, যারা এমন কোন সাধারণ কল্যাণের উদ্দেশ্যে সফর করে, যার কল্যাণটা দ্বীন-ইসলামকিংবা মুসলিমসমাজ পেয়ে যায়। যেমন কেউ সফর করে কোন শিক্ষা সংক্রান্ত প্রতিনিধিত্বে বা মুসলিম দেশের জন্যে প্রয়োজনীয় কোন কাজের জন্যে। এমন কোন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারের জন্যেও এ সফর হতে পারে যা দ্বীন-ইসলাম ও মুসলিম সমাজের জন্য উপকারী সাধারণভাবে।তবে তাতে অভিজ্ঞ ও বিশ্বস্ত লোকদের মতামতকে গ্রাহ্য করতে হবে। এ ধরনের সফরকারী কার্যত ‘ইবনুস-সাবীল’ না হলেও সে ‘ইবনুস সাবীল’ হবে তার সংকল্পের দৃষ্টিতে। আর যা কাছাকাছি ও নিকটবর্তী তা সেই আসলেজিনিসের মর্যাদা পেয়ে থাকে। এই লোককে কোন সাহায্যদান জাতি ও উম্মতের জন্যে সাধারণ কল্যাণে দানের সমান। ফলে তা ‘ফী-সাবীলিল্লাহ’ দেয়ার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। পারস্পরিক সম্পর্ক সংশোধন বা উন্নতকরণের উদ্দেশ্যে যারা ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে তাদেরকে যাকাত দেয়ার মতই এই দান। তাই এরূপ দান শরীয়াতের অকাট্য স্পষ্ট দলিলের ভিত্তিতে সমর্থনীয় না হলেও কিয়াসের ভিত্তিতে সমর্থনীয়। এই বক্তব্যের সমর্থনে বলা যায়, উক্ত আয়াতে ‘ইবনুস সাবীল’ বাক্যটি এসেছে ফী-সাবীলিল্লাহ-এর পর। যেন বলা হয়েছে: ‘আল্লাহ্র পথে ও পথ সন্ধানে’। পূর্বে উল্লেখ করেছি, এই আয়াতটিতে কতিপয় ব্যয়ক্ষেত্রকে (***) অক্ষরের পর উল্লেখ করায় এ সুবিধাটাকু পাওয়া গেছে যে, এটা এমন কল্যাণকর কাজ যাতে যাকাত দেয়া যাবে, এক ব্যক্তিকে দেয়ার পূর্বে। এমন কি এদের কোন একজন যদি যাকাতের অংশ নিয়ে নেয় তবে সে তা নেবে তার পরিচিতি সহকারে শরীয়াত যে সাধারণ কল্যাণ ব্যবস্থা চালু করতে চেয়েছে সেই সাধারণ কল্যাণের জন্যেই। এই কারণে এ চারটি ক্ষেত্রে কাউকে যাকাতের সম্পদের মালিক বানিয়ে দেয়ার শর্ত করা হয়নি- দাসমুক্তি, ঋণগ্রস্ত, আল্লাহ্র পথে ও পথ-পুত্র’ এর ক্ষেত্রে। এটাই নির্ভুল মত। উপরিউক্ত কথার ভিত্তিতে ‘ইবনুস সাবীল, (পথ-পুত্র) সাধারণ কল্যাণের প্রতিভূ। সে নিজের প্রতিনিধিত্ব করছে না। তাই সঠিক পন্থা হচ্ছে, সে নিজ হাতে যাকাতের সেই অংশ গ্রহণ না করে তার জন্যে ব্যয়কারী কোন প্রতিষ্ঠান তা নিয়ে নেবে। হাম্বলী মাযহাবের লোকেরা প্রথমোক্ত মতের সমর্থনকারী। তাঁরা বলেছেন, ‘ইবনুস সাবীল’ যদি তার নিজের গ্রাম বা শহরে যাওয়ার পরিবর্তে অনত্র যেতে চায়, তাহলে তাকে সেখানে যাওয়ার ও সেখান থেকে নিজের ঘরে পৌঁছার জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণ সম্বল দিতে হবে, কেননা এটা বৈধ সফরের জন্যে সাহায্য, সঠিক উদ্দেশ্য লাভই এই সফরের লক্ষ্য। তবে সফরটা শরীয়াতসম্মত হতে হবে। হয় আল্লাহ্র নৈকট্য লাভমূলক হবে, যেমন হজ্জ, জিহাদ ও পিতামার সাথে সাক্ষাৎ, অথবা হবে মুবাহ সফর, যেমন জীবিকার সন্ধান, ব্যবসায়ের সুযোগ-সুবিধার অনুসন্ধান। আর সফরটা যদি প্রমোদ বিহার (Excursion- Pleasure trip) হয়, তাহলে তাতে দুটো পন্থা হতে পারে: একটি, তাকে দেয়া হবে। কেননা তার এই সফর কোন পাপ কাজের জন্যে নয়। আর দ্বিতীয় হচ্ছে, তাকে দেয়া যাবে না। কেননা তার জন্যে এই সফর কোন প্রয়োজনীয় বা আবশ্যকীয় ব্যাপর নয়। [দেখুন: (আরবী ***********)] পথ অতিক্রমকারী মুসাফিরকে যাকাত দান- তার লক্ষ্যে উপনীত হতে পারে তার জন্যে, এটা তার উদ্দেশ্য লাভের জন্যে সাহায্য বিশেষ। তার জীবিকার সন্ধানে হলে- বরঞ্চ প্রমোদ বিহার হলেও তাকে যাকাতের অংশ দেয়াই উত্তম। কেননা ইসলাম বা মুসলিমের জন্যে কোন যথার্থ উদ্দেশ্যসফর করার মূলে যে কারণ নিহিত থাকতে পারে, এক্ষেত্রেও তা রয়েছে। ‘ইবনুস সাবীল’কে যাকাত দেয়ার শর্ত ‘ইবনুস-সাবীল’- ‘পথ-পুত্র’কে যাকাতের অংশ দেয়ার ব্যাপারে কতিপয় শর্ত আরোপ করা হয়েছে। কয়েকটি শর্ত সর্বসম্মত এবং কয়েকটি শর্তের ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে। প্রথম শর্ত, ‘পথ-পুত্র’ যে স্থানে রয়েছে, সেখানেই তাকে অভাবগ্রস্ত হতে হবে তার স্বদেশ পৌঁছার সম্বলের জন্যে। তার নিকট সেই সম্বল থেকে থাকলে তাকে যাকাতের অংশ থেকে দেয়া যাবে না। কেননা তার তো কাজ হল তার নিজের ঘরে পৌঁছা। মুজাহিদের অবস্থা ভিন্নতর। সে যাকাতের অংশ নিতে পারবে- অ-হানাফীদের মতও এই- যদিও সে তার নিজের অবস্থান স্থানে ধনশালী ব্যক্তি। কেননাতাকে তা দেয়া হবে শত্রুদের ভীত ও বিতাড়িত করার লক্ষ্যে। আর জিহাদকারীকে যাকাত দেয়যা হবে আল্লাহ্র দুশমনদের মুকাবিলায় তাকে সাহসী শক্তিমান করে তোলার উদ্দেশ্যে। দ্বিতীয, তার সফর পাপমুক্ত হতে হবে। তার সফর যদি কোন পাপ কাজের লক্ষ্যে হয়- যেমন কাউকে হত্যা করা বা হারাম ব্যবসায়ের জন্যে প্রভৃতি- তা হলে তাকে যাকাতের অংশদেয়া যাবে না একবিন্দুও। কেননা তাকে দেয়ার অর্থ তার সেই পাপ কাজে তাকে সহায়তা করা। কিন্তু মুসলমানদের ধন-মাল দিয়ে আল্লাহ্র নাফরমানীর কাজে সহায়তা করা যেতে পারে না। তবে সে যদি খালেসভাবেতওবা করে, তবেতার অবশিষ্ট সফরের খরচ বাবদ দেয়া যাবে। তার যদি অভাববে মরে যাওয়ার আশংকা দেখা দেয় তাহলে তওবা না করলেও তাকে দেয়া যাবে। কেননা পাপ করলে সে করবে, তাকে মারার জন্যে ছেড়ে দিয়ে সমাজ তো পাপ করতে পারে না। [দেখুন: (আরবী ***********) মালিকী মতের কেউ কেউ বলেছেন, তার মৃত্যুর আশংকা হলেও তাকে দেয়া যাবে না। কেননা তার মুক্তি তার নিজের হাতেই রয়েছে, সে সহজেই তওবা করতে পারে। দেখুন : (আরবী ***********) অন্যরা বলেছেন, পাপটা কি ধরনের তা দেখতে হবে। নর হত্যার বা কারুর ইজ্জত নষ্ট করার ইচ্ছা থাকলে দেয়া যাবে না, তওবা করলে দেয়া যাবে।] আর যে সফরে কোন গুনাহ নেই সে সফর কোন ইবাদতের জন্যেহতে পারে, হতে পারে কোন প্রয়োজনের জন্যে বা প্রমোদবিহারও হতে পারে। ইবাদতের সফর যেমন হজ্জ, জিহাদ ও কল্যাণকর ইল্ম সন্ধান এবং জায়েয যিয়ারতের সফর ইতাদি, সে সব পথিককে যাকাত দানে কোন মতভেদ নেই। কেননাইবাদতের কাজে সাহয্য তো শরীয়াতের কাম্য। বৈষয়িক প্রয়োজনের সফরও হতে পারে- যেমন ব্যবসা, জীবিকা সন্ধান প্রভৃতির উদ্দেশ্যে বিদেশ গমন। যারা বলেন যে, ‘ইবনুস সাবীল’ হচ্ছে সেইলোক, যে তার নিজের ঘর-বাড়ি ও ধন-মাল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে, তাদের মতে সে পথিককে যাকাত দেয়া যাবে। কেননা এ হচ্ছে বৈধ বৈষয়িক প্রয়োজনের কাজে সাহায্য দান। সটিক লক্ষ্য অর্জনের জন্যে সাহায্য। যে শাফেয়ী ফিকাহ্বিদ নিজ ঘর থেকে রওয়ানাকারীকেও ‘ইবনুস-সাবীল’ মনে করেন, উক্ত ব্যাপারে তাদের দুটি কথা: একটি, দেয়া যাবে না। কেননা এ সফরে তার কোন প্রয়োজন নেই। দ্বিতীয, দেয়া যাবে। কেননা শরীয়াত সে সফরের রুখসাত বা অনুমতি দিয়েছে তাতে ইবাদতের সফর ও মুবাহ সফরের মধ্যে কোন পার্থক্য করা হয়নি। যেমন নামায ‘কসর’ পড়া যাবে, রোযা ভাংগা যাবে উভয়বিধ সফরেই। এ অত্যন্ত সহীহ কথা। আনন্দ ও বিনোদনের সফর পর্যায়ে খুব বেশি মতভেদের সৃষ্টি হয়েছে বিশেষ করে শাফেয়ী ও হাম্বলী মাযহাবের লোকদের মধ্যে। তাঁদের কেউ কেউ বলেছেন, দেয়া যাবে। তাঁদের কেউ কেউ বলেছেন, দেয়া যাবে। কেননা এ সফর পাপমুক্ত। অপররা বলেছেন, দেয়া যাবে না। কেননা এ সফরের প্রকৃত কোন প্রয়োজন নেই। বরং এ এক প্রকারের বেহুদা অর্থব্যয়। [দেখুন: (আরবী ***********)] তৃতীয়, সে যদি ঋণ বা অগ্রিম হিসেবে পাওয়ারও কোন উপায় না পায়- তাকে দেয়ার মত কোন লোকই না পাওয়া যায় সেই স্থানে, যেখানে সে রয়েছে তাহলে তাকে যাকাত থেকে দেয়া যাবে। এই কথা সে লোক সম্পর্কে যারনিজের ঘরে ধন-মাল রয়েছে, ঋণ শোধ করার সামর্থ্যও আছে।; [এই জন্য দেখুন: (আরবী ***********)] এই শর্তটি মালিকী ও শাফেয়ী মাযহাবের কেউ কেউ আরোপ করেছেন যদিও এ মাযহাবেরই অপর লোকেরা এর বিরোধিতা করেছেন। ইবনুল আরাবী তাঁর আহকামুল কুরআন’ গ্রন্থে এবং কুরতুবী তাঁর তাফসীরে অগ্রাধিকার দিয়েছেন এ মতকে যে, ‘ইবনুস-সাবীল’কে যাকাত থেকে দেয়া যাবে, অগ্রিম দেয়ার মত কোন লোক পাওয়া গেলেও।তাঁরা দুজনই বলেছৈন, কারোর ব্যক্তিগত অনুগ্রহের বশবর্তী হওয়ার কোন আবশ্যকতা নেই। আল্লাহ্র অনুগ্রহ নিয়ামতও তো পাওয়া গিয়েছে। [(আরবী *********)] তা-ই যথেষ্ট। ইমাম নববী বলেছেন, ‘ইবনুস সাবীল’ যদি এমন লোক পেয়ে যায়, যে তাকে লক্ষ্যস্থলে পৌঁছার জন্যে প্রয়োজন পরিমাণ সম্পদ ঋণ বাবদ দেবে, তবু তার পক্ষে ঋণ করা জরুরী নয়। বরং তার জন্যে যাকাত ব্যয় করা সম্পূর্ণ জায়েয। [(আরবী ********)] হানাফী আলিমগণের বক্তব্য হচ্ছে, পারলে ঋণ নেয়াই তার পক্ষে উত্তম।তবে তা করা কর্তব্য নয়। কেননা হতে পারে সে ঋণ আদায় করতে অক্ষম হয়ে পড়বে। [দেখুন: (আরবী ***********)] ইবনুল আরাবী ও কুরতুবী যে কারণে উল্লেখ করেছেন, তার সাথে সংযোজিত এ হচ্ছে অপর একটি কারণ। এই দুই ‘ইল্লাত’ বা কারণ ইবনুস সাবীলের জন্যে ঋণ গ্রহণ করার বাধ্যতা আরোপ করতে নিষেধ করে: প্রথম, ঋণ গ্রহণ করায় লোকদের অণুগ্রহ স্বীকার করতে হয়। কিন্তু আল্লাহ তা করার জন্যে চাপ দেন নি। দ্বিতীয়, ঋণ ফেরত দিতে অক্ষম হওয়া সম্ভব। আর তা হলে সেটা তার পক্ষেও যেমন ক্ষতিকর, তেমনি ক্ষতিকর ঋণদাতার জন্যেও। ‘ইবনুস-সাবীল’কে কত দেয়া হবে ক. ‘ইবনুস-সাবীল’কে খোরাক-পোশাকের ব্যয় এবং লক্ষ্যস্থল পর্যন্ত পৌঁছার জন্যে যা প্রয়োজন অথবা তার ধন-মাল পথিমধ্যে কোথাও থাকলেতা যেখানে রয়েছে, সে পর্যন্ত পৌঁছার খরচ দিতে হবে।এ ব্যবস্থা তখনকার জন্যে, যখন পথিকের সঙ্গে আদৌ কোন ধন-মাল থাকবে না। আর যদি এমন পরিমাণ মাল তার সঙ্গে থাকে যা যথেষ্ট নয়, তা হলে প্রয়োজনীয় পরিমাণ দিতে হবে। খ. সফর দীর্ঘ পথের হলে তার জন্যে যানবাহনের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। দীর্ঘ সফরের পরিমাণ হচ্ছে যে পথে চললে নামায ‘কসর’ করা চলে তা। প্রায় ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ। অথবা পথিক দুর্বল- পথ চলতে অক্ষম হলে সে দৃষ্টিতেও পথের দৈর্ঘ্য নিরূপণ করা যায়। আর পথিক যদি সক্ষম ব্যক্তি হয় এবং তার সফর নামায ‘কসর’ করার পরিমাণ দীর্ঘ পথের না হয় তাহলে যানবাহনের ব্যবস্থা করা হবে না। তবে তার সঙ্গের জিনিসপত্র নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা যাবে। কিন্তু সে জিনিসপত্র যদি সে নিজেই বহন করে নিতে সক্ষমহয় তাহলেতা বহনের ব্যবস্থা করারও প্রয়োজন হবে না। ফিকাহ্বিদগণ বলেছেন, যানবাহনের ব্যবস্থা করাবলতে বোঝায়, সম্পদ বিপুল থাকলে তা দিয়ে একটা যান ক্রয় করা। আর কম হলে ভাড়ায় নেয়া হবে। তাঁরা একথা বলেছেন এজন্যে যে, সেকালে যানবাহনরূপে সাধারণ জন্তু-জানোয়ারই ব্যবহৃত হত। এজন্যেই তা ক্রয় করতে বা ভাড়ায় নিতে বলা হয়েছে। কিন্তু আজকেরদিনে যানবাহনের অনেক বিবর্তন ও উন্নতি সাধিত হয়েছে। মোটর গাড়ি, রেল গাড়ি, জাহাজ, লঞ্চ, উড়োজাহাজ ইত্যাদি কত রকমেরই না যানবাহন একালে পাওয়া যায়! এগুলো ক্রয় করার কোন উপায় নেই, প্রয়োজনও নেই্ মোটকথা অবস্থা অনুপাতে সহজলভ্য কোন যানবাহনের ব্যবস্থা করে দিলেই হবে। যার পক্ষে রেল গাড়ি বা জাহাজ-লঞ্চ সহজ হবে, তার জন্যে উড়োজাহাজের ব্যবস্থা করা অনাবশ্যক। যেন যাকাতের মাল নির্দয়ভাবে ব্যয় করা না হয়। যা না হলে চলে না, শুধু তার ব্যবস্থাই তা দিয়ে করা যাবে। গ. সফরের সব খরচই বহন করা যাবে। কেবল তা-ই শুধু নয়, যা সফরের দরুন অতিরিক্ত পড়ছে। এটাই সহীহ কথা। ঘ. সফরকারী উপার্জনে সক্ষম হোক কি অক্ষম- উভয় অবস্থাতেই দেয়া যাবে। ঙ. তার যাওয়ার ও ফিরে আসার জন্যে যে পরিমাণটা যথেষ্ট তা-ই দেয়া যাবে- যদি সে ফিরে আসার ইচ্ছা রাখে এবং সেখানে ধন-মাল কিছু পাওয়ার সুযোগ তার যদি না থেকে থাকে। কোন কোন আলিম বলেছেন, তার সফরকালে ফিরে আসার জন্য কিছু দেয়া যাবে না, তা দেয়া যাবে যখন সে ফিরে আসবে তখন। আর কেউ কেউ বলেছেন, সে যদি যাওয়ার পরই ফিরে আসবার ইচ্ছা রাখে তাহলে ফিরে আসার জন্যেও দেয়া যাবে।আর সে যদি একটা সময় পর্যন্ত তথায় অবস্থান করার ইচ্ছা রাখে তাহলে ফিরে আসার জন্যে দেয়া যাবে না। কিন্তু প্রথমোক্ত মতটিই ঠিক। চ. অবস্থান করার ইচ্ছা থাকলে তখন কি করা হবে এই পর্যায়ে শাফেয়ী আলিমগণ একটু বিস্তারিত করে বলেছেন। আর তা হচ্ছে, যদি চারদিনের কম সময় অবস্থান করার ইচ্ছা থাকে- যাওয়া ও আসার দিন ছাড়া তাহলে অবস্থানের ব্যয়ও বহন করা হবে। কেননা আসলেসে তখন সফরেই রয়েছে। এজন্যে সেরোযা ভাংতে পারে, নামায কসর করতে পারে, সফরের সব সুবিধাই সে ভোগ করতে পারে। কিন্তু যোদ্ধার ব্যাপার তা নয়। তার দূরদেশে অবস্থানকালীন খরচাদিও বহন করতে হবে, তা যত দীর্ঘই হোক। পার্থক্য হচ্ছে, যোদ্ধাকে তো বিজয়ের আশায় বসে থাকতে হয়। যোদ্ধা ‘গাযী’ এই নাম বা পরিচিতিটা তার অপরিবর্তিতই থাকে কোন স্থানে অবস্থান করলেও বরং তা আরও শক্ত হয়। কিন্তু সফরকারীর তা হয় না। অন্যদের কেউ কেউ বলেছেন, ‘ইবনুস সাবীল’কেও দিতে হবে তার অবস্থানকালের জন্যেও তা যত দীর্ঘই হোক। অবশ্য সাফল্যের আশায় অবস্থান করার প্রয়োজন দেখা দিলে তবেই। [দেখুন: (আরবী ***********)] ছ. ‘ইবনুস সাবীল’ যখন সফর থেকে ফিরে আসবে, তখন কিছু পরিমাণ সম্পদ উদ্বৃত্ত ও অবশিষ্ট থাকলে তা তার নিকট থেকে ফেরত নেয়া হবে কি হবে না এ একটা প্রশ্ন। ফিকাহ্বিদগণ এ বিষয়ে মতামত ব্যক্ত করেছেন। এর জবাবে শাফেয়ীরা বলেছেন: হ্যাঁ, নেয়া হবে, সে নিজের ওপর কৃচ্ছতা গ্রহণ করে থাকুক কি না-ই থাকুক। অন্য মত হচ্ছে, যদি সে নিজের ওপর কৃচ্ছতা করে থাকে তবে এবং এই কারণেই যদি সম্বল উদ্বৃত্ত থেকে থাকে, তাহলে তা ফেরত নেয়া হবে না। কিন্তু যোদ্ধার জন্যে তা নয়। সে নিজের ওপর কৃচ্ছতা করে থাকলে তার নিকট থেকে ফেরত নেয়া হবে না। কেননা যোদ্ধা যা নেয়, তা বিনিময় হিসেবেই নেয়। আমরা তার মুখাপেক্ষী, সে যুদ্ধ করলেই আমরা রক্ষা পাই। আর তা সে করছে। পক্ষান্তরে ‘ইবনুস সাবীল’ নিজেই তার নিজের প্রয়োজনে সাহায্য গ্রহণ করে আর এই সাহায্য গ্রহণ করায় তার সে প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। [(আরবী ***********)] অতএব উদ্বৃত্তের ওপর তার কোন অধিকার থাকার কথা নয়। এ যুগে ‘ইবনুস-সাবীল’ পাওয়া যায় কি সমকালীন কোন কোন আলিম মনে করেছেন, আমাদের এ যুগে ‘ইবনুস-সাবীল’ ধরনের লোক দেখতে পাওয়া যায় না। কেননা এ কালের যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই উন্নাত, দ্রুত গতিবান এবং বিচিত্র ধরনের। মনে হচ্ছে, গোটা পৃথিবী যেন একটি শহরে পরিণত হয়েছে। তাছাড়া লোকদের উপায়-উপকরণও বিপুল, সহজলভ্য। দুনিয়ার যে কোন স্থানে বসে মানুষ স্বীয় ধন-মাল নিয়ন্ত্রিত করতে পারে ব্যাংকের মাধ্যমে, অন্যান্য উপায়ে। [দেখুন: (আরবী ***********) সূরা হাশর-এর ষষ্ঠ আয়াতের তাফসীরে এই মত লেখা হয়েছে।] উপরিউক্ত কথা মরহুম শায়খ আহমাদ আল-মুস্তাফা আল-মারাগী তাঁর তাফসীরে উদ্বৃত্ত করেছেন। কিন্তু আমরা এই মতের বিপরীত কথা বলতে চাই। কেননা আমরা দেখতে পাচ্ছি, আমাদের এ যুগেও ‘ইবনুস্-সাবীল’ পাওয়া যায়- যে কোন শহর থেকে- যে কোন উপায়েই হোক ধন-মাল লাভ করা যেতে পারে বলে যতই দাবি করা হোক না কেন। ‘ইবনুস-সাবীল’ এর বাস্তপ রূপ ১. কোন কোন লোক ধনী গণ্য হয় বটে, কিন্তু তা সত্ত্বেও ব্যাংকের সাহায্য নেয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। সে যখন বিদেশে অর্থহীন সম্বলহীন হয়ে পড়বে তখন সে কোথায় পাবে তার প্রয়োজনীয় সম্পদ? অনুরূপভাবে বিভিন্ন কার্যকরণ ও পরিস্থিতির দরুন কোন দূরবর্তী গ্রামে কিংবা ধূলি-ধূসর মরুভূমিতে যে লোক আটকে যাবে, কোন নগর কেন্দ্রে পৌঁছার সামর্থ্য লাভ করছে না, ফলেসে তার ব্যাংক থেকে ইচ্ছামত সম্পদ গ্রহণও করতে পারে না। এরূপ অবস্থায় এই লোকের পরিণতি কি হবে? এ ধরনের লোক অবশ্যই ‘ইবনুস-সাবীল’ রূপে গণ্য হবে। কেননা সে ধনী হওয়া সত্ত্বেও তার ধন-মাল থেকে সে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। অতএব সে সাহায্য পাওয়ার যোগ্য হয়েছে। উপরিউক্ত অবস্থা বিরল হলেও তা কখনও কখনও সংঘটিত হয়ে থাকে, হতে পারে। পালিয়ে যাওয়া ও আশ্রয় গ্রহণকারী লোক ২. এমন বহু লোকই আছে যারা স্বদেশ ত্যাগ করে চলে যেতে বাধ্য হয় অবস্থার কারণে এবং তারা তাদের ধন-মালও মালিকানা সম্পদ-সম্পত্তি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তা হয় বিদেশী দখলদার যোদ্ধা বাহিনীর অত্যাচার-নিপীড়নের দরুন অথবা বিদেশী স্বৈরাচারী আল্লাহ্ বিরোধী লোকদের চাপে। তারা কাফির প্রশাসক হতে পারে বা প্রায় কাফিরদের ন্যায় আচরণ গ্রহণকারীও হতে পারে। এ ধরনের লোকেরাই দেশের ভালো ও কল্যাণকামী লোকদের ওপর অমানুষিক অত্যাচার চালিয়ে থাকে। তাদেরকে দেশ থেকে বহিষ্কৃত করে অন্যায়ভাবে বঞ্চিত করে তাদের নিজেদের ধন-মাল ভোগ-ব্যবহারের সুযোগ-সুবিধা ও অধিকার থেকে। তাদের অপরাধ এ ছাড়া আর কিছুই হয় না যে, তারা বলে: ‘আমাদের রব্ব একমাত্র আল্লাহ। তাকে ছাড়া আর কাউকেই আমরা মানি না।; এরূপ অবস্থায় বহু লোক নিজেদের দ্বীন-ঈমান লয়ে দেশ ত্যাগ করে ভিন্ন দেশে চলে যেতে বাধ্য হয়। তাদের ধন-বাড়িতে রক্ষিত ধন-মাল থেকেও তারা হয়ে পড়ে বঞ্চিত। তার নিজ দেশের ব্যাংকে তার নামে তার নিয়ন্ত্রণে বহু ধন-মাল থাকলেও বা অনুরূপ কোন অবস্থা হলেও- তার নিজের কোন কাজের আসে না তা। বহু নিপীড়িত-বিতাড়িত-বহিষ্কৃত ও বিদেশে আশ্রয় গ্রহণকারী রাজনীতিক বা সাধারণ নাগরিক এ কালে অনেক দেশেই দেখা যায়। ফিকাহ্র পরিভাষায় তাদের কি বলা হবে? তাদের নিজেদের দেশে তাদের ধন-মাল রয়েছে একথা সত্য। কিন্তু তার ওপর এক্ষণে তাদের কোন কর্তৃত্ব নেই। তা পাওয়ারও কোন উপায় নেই। এরূপ অবস্থায় তারা আসলে ধনী হলেও কার্যত নিতান্তই দরিদ্র, সর্বহারা। আর এরূপ অবস্থা যাদেরই হবে, তারাই ‘ইবনুস্ সাবীল’ –এর মর্যাদা ও অধিকার পাবে। নিজ ঘরে থেকেও নিজের মালের ওপর কর্তৃত্ব নেই যার ৩. হানাফী ফিকাহ্বিদের কেউ কেউ এমন প্রত্যেককে ‘ইবনুস-সাবীল’ গণ্য করেছেন, যে তার নিজের ধন-মাল থেকে অনুপস্থিত, তা ব্যবহারে অক্ষম যদিও সে নিজের ঘরে উপস্থিত। সে ব্যক্তির প্রয়োজন বা অভাবগ্রস্ততাই তার যাকাত প্রাপ্তির যোগ্য হওয়ার কারণ। এ কারণটি এখানে পুরোপুরি উপস্থিত। কেননা এখন সে কার্যত ফকীর, দরিদ্র, বাহ্যত সে যতই ধনীই হোক। [দেখুন : (আরবী ***********)] তাঁরা বলেছেন: কোন ব্যবসায়ী ব্যক্তির যদি লোকদের নিকট টাকা পাওনা থাকে কিন্তু তা সে আদায় করতে পারছে না, কিছুই ফেরত পাচ্ছে না- তার পক্ষে যাকাত গ্রহণ করা জায়েয। কেননা সে কার্যত ফকীর-ইবনুস সাবীল-এর মতই। [(আরবী ***********)] কল্যাণমূলক কাজে বিদেশ গমনকারী ৪. যে লোক বিদেশ গমনে ইচ্ছা করেছে, কিন্তু প্রয়োজনীয় সফর সম্বল যোগাড় করতে পারছে না, শাফেয়ী মাযহাব তাকেও ইবনুস সাবীল গণ্য করেছে। এই মত যদি আমরাও গ্রহণ করি এবং এই সফর ইসলামে গণ্য কোন কল্যাণকর কাজের জন্যে অথবা মুসলিম জনগোষ্ঠীর প্রয়োজনে হতে হবে বলে আমরা যে শর্ত আরোপ করেছি, তা এখানে আছে বলে যদি আমরা মনে করি, তা হলে আমাদের এই যুগেও এ পর্যায়ের বহু অবস্থা ও রূপ এবং বহু ব্যক্তিকে দেখতে পাব। তারা প্রতিভাবান ছাত্র হতে পারে, দক্ষ শিল্পপতি হতে পারে, সূক্ষ্ম শিল্পী বা কারিগত হতে পারে এবং এ পর্যায়ের এমন সব লোকও হতে পারে, যারা বিদেশে প্রতিনিধিত্বের জন্যে প্রেরিত হয়ে থাকে। প্রেরিত হয়ে থাকে কল্যাণকর জ্ঞানে বিশেষত্ব অর্জনের উদ্দেশ্যে, ফরপ্রসূ কর্মে উচ্চতর প্রশিক্ষণ লাভের লক্ষ্যে। এসবের সুফলটা দ্বীন ও জাতি- উভয়ই পেয়ে থাকে শেষ পর্যন্ত। আশ্রয় বঞ্চিত লোকেরা ৫. হাম্বলী মাযহাবের কোন কোন আলিম ইবনুস-সাবীল-এর অপর একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাতে বহু লোকই এর অন্তর্ভুক্ত গণ্য হতে পারে আমাদের এ কালেও। উল্লেখ করেছেন, সেইসব লোকও ‘ইবনুস-সাবীল’ যারা লোকদের পথে ঘাটে জড়িয়ে ধরে ও পাকড়াও করে ভিক্ষা চায়। [(আরবী ***********)] লজ্জা ও দুঃখে কপাল ঘুচিয়ে যায় যখন আমরা প্রায়শই দেখতে পাই যে, বহু দেশ ও শহর-নগরের অধিবাসী মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও বহু সহস্র লোক সাধারণ আশ্রয় ও বসবাস্থল থেকেও বঞ্চিত হয়ে আছে। তারা নিরুপায় হয়ে পথের পার্শ্বে কিংবা গাছতলায় কোন-না-কোন রকমের একটা আশ্রয় বানিয়ে নিয়েছে। সর্বত্র মাটি ছড়িয়ে আছে, তার ওপরই শয্যা রচনা করেছে। বাতাসকেই তারা গাত্রাবরণ বানিয়েছে। এরা নিঃসন্দেহে ‘পথের সন্তা’ –‘ইবনুস-সাবীল’। কেননা পথই তাদের মা-বাপ। এটা বস্তুতই সমাজ-সমষ্টির কলংক। কাজেই কুরআন তাদের প্রতি গুরুত্ব আরোপ কর থাকলে তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। কুরআন তাদেরকে একটা বিশেষ গুণেও ভূষিত করে থাকতে পারে এবং তা ‘ফকীর’ মিসকীন’ ইত্যাদি থেকে ভিন্নতর। ইসলামের প্রধান ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ‘কর’ যাকাতে তাদের জন্যে একটা অংশও নির্দিষ্ট করে দিয়ে থাকতে পারে, তা কিছুমাত্র অস্বাভাবিক নয়। এসব লোককে ‘ইবনুস-সাবীল’ ধরে নিয়ে যাকাতের অংশ দেয়া হলে তা কিছুমাত্র অশোভন কাজ হবে না। তাদের ‘ফকীরও’ মনে করা যায়। প্রথমোক্ত পরিচিতির ভিত্তিতে তাদেরকে ‘পথ-সন্তান’ হওয়ার অবস্থা থেকে মুক্তকরণের উদ্দেশ্যে তাদের উপযোগী ‘বাসস্থান’ বানিয়ে দেয়া একান্তই আবশ্যকীয় মনে হয়। আর দ্বিতীয় পরিচিতির ভিত্তিতে তাদের যাবতীয় প্রয়োজন পূরণের ব্যবস্থা করা- তাদের জীবিকার নির্ভরযোগ্য সংস্থান করে দেয়াও আবশ্যক মনে হয়। তাতে করে তারা কোনরূপ অপচয়, বাহুল্য ব্যয় ও কৃচ্ছতা ব্যতিরেকেই মানবীয় প্রয়োজন তৃপ্তিদায়ক মাত্রায় পূরণ করতে সক্ষম হবে। পড়ে পাওয়া মানুষি ৬. সাইয়্যেদ রশীদ রিজা তাঁর তাফসীর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ‘কুড়িয়ে পাওয়া (Founding) শিশু’ও সম্ভবত ‘ইবনুস-সাবীল’-এর মধ্যে গণ্য হতে পারে। তিনি এ-ও উল্লেখ করেছেন যে, সমকালীন বহু প্রতিভাবান ব্যক্তি তাঁদের লিখিত গ্রন্থে এটাও একটি যথার্থ তাৎপর্য বলে ঘোষণা করেছেন। শায়খ রশীদ যদিও খুব দৃঢ়তার সাথে না হলেও তার উক্ত কথাটিকে সমর্থন যুগিয়েছেন এই বলে যে, ‘কুড়িয়ে পাওয়া’ বালক বা শিশুও এর মধ্যে গণ্য হতে পারে, যা অপর কোন শব্দে শামিল হয় না। আর কুরআন যেহেতু ইয়াতীম-এর ওপর খুব বেশি গুরুত্ব আরোপ করেছে এবং তার প্রতি ভালো দয়ার্দ্র ব্যবহার করার উপদেশ দিয়েছে উচ্চমানের বুদ্ধিমত্তা ও যৌক্তিকতা সহকারে। এ কারণে যে ইয়াতীম কোন আত্মর্যাদাসম্পন্ন শক্তিশালী সাহায্যকারী পিতা পায় না বলেই নিরুপায় হয়ে পড়ে তার চরিত্র গঠন হয় খুবই ত্রুটিপূর্ণভাবে। বিবেক-বুদ্ধির ওপর আবরণ সৃষ্টিকারী মূর্খতা তাকে সর্বাত্মকভাবে গ্রাস করে বসে। মন-মানসিকতার বিকৃতির দরুন নৈতিক চরিত্রেরও চরম বিপর্য ঘটে। আর এই মূর্খতা ও নৈতিক বিকৃতির দরুন সমাজের ও জাতির কুলাংগার সন্তান হয়ে দাঁড়ায় তারা। তারা এক সঙ্গে বাস করেও তাদের জন্যে তারা বিপর্যয়ের সৃষ্টি করে। ইয়াহীমেরই যখন এরূপ পরিণতি, তখন কুড়িয়ে পাওয়া সন্তান তো সমাজের স্নেহ-যত্ন-আশ্রয় ও লালন-পালন বেশি মাত্রায় অধিকারী। উপরে এই যৌক্তিকতা ও ফিকহী দৃষ্টিকোণের কথাই বলা হয়েছে। বলেছেন, প্রায় সব তাফসীরকারই এই কুড়িয়ে পাওয়া সন্তানের উল্লেখ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। হয়ত এজন্যে যে, তাঁদের সময়ে কুড়িয়ে-পাওয়া সন্তানদের সংখ্যা খুবই বিরল ছিল। আর শেষেরদিকের তাফসীর লেখকগন তো কেবল পূর্ববর্তী লেখকদের রচনাবলীর অনুলিপিই তৈরী করেছেন মাত্র। [(আরবী ***********)] তাছাড়া ‘কুড়িয়ে পাওয়া সন্তান’ ‘ইবনুস-সাবীল’ পর্যায়ে গণ্য না হলেও তারা সাধারণ পকীর-মিসকীনের মধ্যে তো অনিবার্যভাবেই গণ্য হবে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। কেননা ‘ফকীর’ হচ্ছে ‘অভাবগ্রস্ত’ –ঠেকে যাওয়া লোক। তা অল্প বয়সেরহোক কি বেশি বয়সের। তার পক্ষে যাকাতের অংশ পাওয়া তো সবদিক দিয়েই নিশ্চিত। অষ্টম পরিচ্ছেদ যাকাত পাওয়ার যোগ্য লোকদের সম্পর্কে পর্যালোচনা যাকাত পাওয়ার যোগ্য লোকদের সম্পর্কে ফিকাহ্বিদদের সামগ্রিক পর্যালোচনা আল্লাহ্ তা’আলা যাকাতরে ব্যয়খাতসমূহের উল্লেখ করেছেন তাঁর কিতাব কুরআন মজীদে। এই খাতসমূহকে আটটি ভাগে বিভক্ত করেছেন। এই ভাগসমূহের বিস্তারিত ব্যাখ্যা আমরা করেছি, প্রত্যেক বিষয়ে সুস্পষ্ট বর্ণনা আমরা উপরে উদ্ধৃত করেছি। তা সত্ত্বেও একটি বিষয় এখানে অবশিষ্ট থেকে গেছে, যার বিশ্লেষণ আমরা এ পর্যায়ে করতে চাচ্ছি। তা হচ্ছে- যাকাত বন্টনকারী ব্যক্তি নিজে হোক কি সরকার বা বায়তুলমাল সংরক্ষক, সে কি এই আট প্রকারের লোকদের মধ্যে যাকাত বন্টন করবে এবংতাদের মধ্যে পরিমাণ সমান করে দেবে? কোন কোন ফিকাহ্বিদ তা-ই মনে করেছেন। তন্মধ্যে ইমাম শাফেয়ীও রয়েছেন। তিনি তাঁর কিতাব ‘আল-উম্ম’-এর বহু কয়টি অধ্যায়ে এই বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। ইমাম নববী তা*র (****) গ্রন্থে লিখেছেন- ইমাম শাফেয়ী ও তাঁর সঙ্গীদের কথা হচ্ছে, ‘মূল মালিকই যদি যাকাত বন্টনকারী হয় কিংবা তার প্রতিনিধি, তাহলে যাকাত সংস্থায় কর্মচারীদের জন্যে (***) নির্দিষ্ট অংশ বন্টন থেকে বাদ যাবে, যে অংশটি অপর সাতটি অংশের সাথে মিলিত হয়ে বন্টিত হবে- যদি সেগুলো পাওয়া যায়। অন্যথায় যে কয়টি খাতে লোক পাওয়া যাবে, সে সব খাতেই তা বন্টন করা হবে। কোন একটি খাতে লোক পাওয়া সত্ত্বেও তাতে যাকাত অংশ না দেয়া জায়েয নয়। বাদ দেয়া হলে সে অংশের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে অর্থাৎ আমাদের মত হচ্ছে, সব কয়টি খাতেই যাকাত ব্যয় করা। ইকরাম, উমর ইবনে আবদুল আজীজ, জুহ্রী ও দাউদ জাহিরী এই মত পোষণ করেন। [(আরবী **********)] ইমাম আহমাদ থেকেও বর্ণনা পাওয়া গেছে শাফেয়ী মাযহাবের সমর্থনে। তিনি তো সব কয়টি খাতেই ব্যয় করা, এগুলোর মধ্যে সমতা বিধান এবং প্রতিটি খাতে তিন বা ততোধিককে দেয়া ওয়াজিব বলে মনে করেন। কেননা এই ‘তিন’ হচ্ছে জামায়াত হওয়ার কম-সে কম সংখ্যা। তবে (***) এর কথা স্বতন্ত্র। সে যা গ্রহণ করে তা তার পারিশ্রমিকস্বরূপ। তাই একজন হলেও চলবে ও দিতে হবে আর ব্যক্তি মালিক নিজেই যাকাত বন্টন করলে ‘কর্মচারীর’ খাত বাদ দিতে হবে। হাম্বলী মাযহাবের আবূ বকরও এ মত দিয়েছেন। [(আরবী **********)] মালিকী মাযহাবের আলিম ‘আচবাগ্’ সকল খাতে সাধারণ বন্টনের ব্যাপারে ইমাম শাফেয়ীর মতকে খুবই পসন্দ করেছেন। যেন তাদের সকলেরই অধিকারের কথা ভুলে যাওয়া বা উপেক্ষা করা না হয়। তাছাড়া তাতে করে বিভিন্ন প্রকারের কল্যাণ সাধিত হওয়াও সম্ভবপর।তাতে দারিদ্র্য বিদূরণ, যুদ্ধ পরিচালন ও ঋণ শোধ প্রভৃতি সব কাজ একই সাথে সম্পন্ন হতে পারে। এই সকলের দো’আও সেই জিনিসকেই বাধ্যতামূলক করে দেয়। [‘চাভীতা’র টীকায় একথা উদ্ধৃত করেছেন, ১ম খণ্ড, ৩৩৪ পৃ., খরশী থেকে উদ্ধৃত।] ইব্নুল আরাবী বলেছেন, ফিকাহ্বিদগণ একমত হয়ে বলেছেন- যাকাত সংস্থার কর্মচারীদেরকে সবকিছু দেয়া যাবে না। [(আরবী **********)] কেননা তাতে শরীয়াতের যাকাত বন্টন নীতির লক্ষ্য বিনষ্ট হওয়ার আশংকা রয়েছে। সে লক্ষ্য হচ্ছে- মুসলমানদের দারিদ্র্য নিরসন, ইসলামে বিশ্বাসীদের রিক্ততা বিদূরণ- যেমন ইমাম তাবারী বলেছেন। ইমাম শাফেয়ীর সঙ্গিগণ দলিল হিসেবে নির্ভর করেছেন এই কথার ওপর যে আল্লাহ্ তা’আলা সাদকা যাকাতকে ‘মালিক করে দেয়া’ বোঝায় যে (***) ‘লাম’ তা সহ উল্লেখ করে (****) যাকাত পাওয়ার অধিকারী লোকদের উল্রেখ করেছেন। তাতে শরীক হিসেবে মালিকানা লাভ সম্ভব হতে পারছে। ফলে তা হচ্ছে প্রাপক লোকদের বিবরণ। এটা হল, ঠিক যেমন সুনির্দিষ্ট লোকদের জন্যে অথবা কোন এক প্রকারের লোকদের জন্যে অসিয়ত করা। কাজেই তাদের সকলকেই তাতে শরীক করা ওয়াজিব হয়ে পড়ল। হাদীসের দলিল হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে আবূ দাউদ-এ জিয়াদ ইবনুল হারিস আস সাদায়ী’ থেকে বর্ণিত হাদীসটি। তিনি বলেছেন: আমি নবী করীমের নিকট উপস্থিত হলাম এবং তাঁর নিকট ‘বায়’আত’ করলাম। এই সময় তার নিকট আর এক ব্যক্তি উপস্থিত হল। বলল: আমাকে যাকাতের অংশ দিন। নবী করীম (স) তাকে বললেন: ‘আল্লাহ্ তা’আলা কোন নবীর বা অপর কারোর হুকুমের যাকাতের বিধানও বিভক্তি করেন নি। তিনি নিজেই এ ব্যাপারে চূড়ান্ত ফয়সালা করে দিয়েছেন এবং তাকে আটটি অংশে বিভক্ত করেছেন। এখন তুমি যদি সেই বিভক্তির কোন একটিতে গণ্র হও, তাহলে আমি তোমার হক দিয়ে দেব।’ ইমাম শাফেয়ী এ ব্যাপারে ইমাম মালিক ও ইমাম আবূ হানীফার এবং তাঁর সঙ্গীদের বিরোধিতা করেছেন। এরা যাকাত বন্টনে সব কয়টি খাতকে শরীক করাওয়াজিব মনে করেন নি। তাঁরা বলেছেন- আয়াতের যে (***)‘লাম’ এর কথা বলা হয়েছে তা ‘মালিক বানিয়ে দেয়া’ অর্থ বোঝায় না। তা ‘জন্যে’ বোঝাবার উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন বলা হয়, ‘এই লাগামটি জন্তুর জন্যে’, ‘দুয়ার ঘরের জন্যে।’ তাঁরা দলিলস্বরূপ এ আয়াতটির উল্লেখ করেছেন: (আরবী **********) তোমরা যদি দান-সাদকা প্রকাশ্যভাবে দাও, তা-ও উত্তম, আর যদি তা গোপন কর এবং তা ‘ফকীরদের’ই উল্লেখ করা হয়েছে সাদকার ব্যয়খাত হিসেবে। আর কুরআনে সাদকা যখনই নিঃশর্ত উল্লিখিত হবে, বোঝা যাবে যে, তা ফরয সাদকা অর্থাৎ যাকাত। নবী করীম (স) বলেছেন: (আরবী **********) আমি সাদকা-যাকাত তোমাদের ধনীদের নিকট থেকে গ্রহণকরব ও তোমাদের গরীবদের মধ্যে তা ফিরিয়ে দেব, এজন্যে আমি আদিষ্ট হয়েছি। যাকাত ব্যয়খাতের আটটির মধ্যে শুধু একটি খাতের উল্লেখ করার দলিল ও কুরআন হাদীস উভয় থেকেই এখানে উদ্ধৃত হল। [(আরবী **********)] আবূ উবাদ ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন। তিনি বলেছেন: (আরবী **********) তুমি যখন খাতসমূহের মধ্য থেকে কোন একটি খাতে যাকাত ব্যয় করলে তখন তা-ই তোমার জন্যে যথেষ্ট হল। কেননা মহান আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, ‘সাদকা’ ফকীর ও মিসকীনদের জন্যে’.... অমুক অমুকও পাবে। যেন এই খাতসমূহ ছাড়া অন্যকোথাও তা নিয়োগকৃত না হয়....। হুযায়ফা থেকেও অনুরূপ বর্ণিত হয়েছে। ইবনে শিহাব থেকে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেছেন: (আরবী **********) তোমাদের মধ্যে যাকাতের ব্যাপারে অধিক সৌভাগ্যবান সে, যে হবে তাদের মধ্যে সংখ্যার দিক দিয়ে অনেক বেশি এবং অনশনের দিক দিয়ে অনেক বেশি কষ্টকারী তাদের মধ্যে। অর্থাৎ যাদের সংখ্যা বেশি এবং যারা ক্ষুধার অধিক মাত্রায় কাতর, তারা যাকাত পাওয়ারও বেশি অধিকারী। ইবরাহীম থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন: (আরবী **********) লোকেরা কেবল দারিদ্র্য ও অনশন সম্পর্কেই জিজ্ঞাসা করত (যে, তা নিরসনের উপায় কি?)। সুফিয়ান ও ইরাকবাসী আবূ হানীফা এবং তাঁর সঙ্গিগণ বলেছেন: (আরবী **********) যাকাত আটটি খাতের কোন একটিতে ব্যয় হলেই তা যথেষ্ট হবে। ইবরাহীম নখয়ী বলেছেন: যাকাত সম্পদ বিপুল হলে তা সব কয়টি খাতে বন্টন কর। আর কম বা স্বল্প হলে তা একটি খাতেই ব্যয় কর। আতা থেকেও অনুরপ বর্ণিত হয়েছে। [আবূ উবাদ তাঁর (****) গ্রন্থে এ সব কথা উদ্ধৃত করছেন, ৫৭৬-৫৭৮।] আবূ সওর বলেছেন, যাকাতদাতা নিজেই তা বন্টন করলে একটি মাত্র খাতে ব্যয় করা তার পক্ষে জায়েয। আর সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধান বন্টন করলে সব কয়টি খাতেই তা করবে। ইমাম মালিক বলেছৈন, সাদকা-যাকাত-বন্টনের ব্যাপারে আমাদের মতে কাজটি রাষ্ট্রপ্রধানের ইজতিহাদ ছাড়া আর কোনভাবে সম্পন্ন করা যাবে না। যে খাতের প্রয়োজন তীব্র ও পাওয়ার যোগ্য লোকদের সংখ্যা বেশি হবে, সে খাতটিতে রাষ্ট্রপ্রধান প্রয়োজন পরিমাণ অধিক ব্যয় করবে। এক বা দুই বৎসর কিংবা কয়েক বৎসর পর তা অন্য খাতে স্থানান্তরিত করা যাবে। কাজেই অভাবগ্রস্ত ও অধিক সংখ্যাকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে তা যতটা এবং যেভাবেই হোক। আমার পসন্দনীয় আলিমগণকে আমি এই মতেরই ধারক পেয়েছি। [(আরবী **********)] উপরিউক্ত মতসমূহের মধ্যে নখ্য়ী, আবূ সওর ও মালিক প্রমুখের কথাই অধিক যুক্তি সঙ্গত মনে হয়- আমি যা মনে করি- তা পরস্পর সম্পূরক। (******) গ্রন্থকারের গবেষনা (*****) গ্রন্থকার এ ব্যাপারটির পর্যায়ে ব্যাপক গবেষণা ও অনুসন্ধান চালিয়েছেন। বলেছেন, আল্লাহ তা’আলা সাদকা-যাকাতকে আটটি খাতের জন্য বিশেষভাবে নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। এর বাইরে অপর কোন খাতে তা ব্যয় করার কোন সুযোগ রাখেন নি। কিন্তু এই বিশেষভাবে নির্দিষ্টকরণ থেকে একথা জরুরী হয়ে পড়ে যে, সেই খাতসমূহে একেবারে সমান পরিমাণে বন্টন করতে হবে। আর কম বেশি যা-ই সংগৃহীত হবে, তা-ই তাদের মধ্যে বন্টন করতে হবে এমন কথাও নয়। তার অর্থ হচ্ছে, সাদকা-যাকাত জাতীয় সম্পদ এই আট জাতীয প্রাপকদের মধ্যে বন্টনীয়। যার ওপর যাকাত-সাদকা জাতীয় কিছু দেয়া ফরয হবে, সে যদি তা এই আট জাতীয় খাতে ব্যয় করে দিল, তাহলে সে এ বিসয়ে আল্লাহ্র নির্দেশ পালন করল এবং আল্লাহ্র আরোপ করা ফরয আদায় হয়ে গেল। যদি বলা হয় মালিক যদি যাকাত ফরয হওয়ার পরিমাণ সম্পদ লাভ করল তার পক্ষে আট প্রকারের ব্যয় খাতগুলির বর্তমান থাকা সত্ত্বেও সেই সব কয়টিতেই তা ভাগ করা- কষ্ট ও অসুবিধা ছাড়াও-প্রাচীন ও শেষদিকের মুসলমানদের কাজের পরিপন্থী পদক্ষেপ হবে। অনেক সময় যাকাত বাবদ স্বল্প পরিমাণ সম্পদ জমা হয়, তা যদি সবকয়টি খাতেই বন্টন করা হয়, তা হলে প্রতিটি খাতই লব্ধ অংশ থেকে উপকৃত হতে পাল- তা একটি প্রকার হলেও, বেশি সংখ্যক হওয়া তো দূরের কথা। জিয়াদ ইবনুল হারিস বর্ণিত হাদীসে নবী করীম (স) বলেছেন: আল্লাহ নবী বা অন্য কারুর হুকুমে যাকাত বন্টনের ব্যবস্থা করেন নি। তিনি নিজেই ফায়সালা করে দিয়েছেন ও আটটি ভাগে বিভক্ত করেছেন- এ হাদীসটি দলিল হিসেবে গণ্য ধরে নিয়েও (হাদীসটির সনদ সম্পর্কে আপত্তি উঠেছে) বলা যায় তার অর্থ হচ্ছে, যাকাত সম্পদ বিবক্তি তার খাত বিভক্তি অনুযায়ী হবে। আয়াতটিতে যেমন করে খাত কয়টির উল্লেখ হয়েছে- নবী করীম (স) যা বলতে চেয়েছেন, মূল যাকাত বন্টনই যদি লক্ষ্য হয়ে থাকে, তা হলে তার অ্থ, প্রতিটি অংশ তার জন্যে নির্দিষ্ট খাত ছাড়া অন্য খাতে ব্যয় জায়েয হবে না। যে খাতটির অস্তিত্ব নেই, সেই খাতের জন্যে নির্দিষ্ট অংশটি অপর খাতে ব্যয় করা কখনই জায়েয হবে না। তা মুসলিম উম্মতের ইজমার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। উপরন্তু তা মেনে নিলে তা হবে সমষ্টিগত যাকাত সম্পদ হিসেবে যা রাষ্ট্রপ্রধান অর্থাৎ বায়তুলমালে-সংগৃহীত হবে। ব্যক্তি বিশেষ বা প্রত্যকটি ব্যক্তি হিসেবে নয়। তাহলে সমান বন্টন ওয়াজিব হওয়ার মত কোন কথাই অবশিষ্ট থাকল না। বরং কোন কোন পাওয়ার যোগ্য লোককে কোন কোন যাকাত এবং অপর লোকদের অপর কোন যাকাত দেয়া সম্পূর্ণ জায়েয। হ্যাঁ রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকার যদি কোন বিশেষ ভূ-খণ্ডের সমস্ত প্রকারেরযাকাত সংগ্রহ করে এবং আটটি খাতের সব কয়টি উপস্থিত হয়ে যায়, তাহলে প্রতিটি খাতেরই তার অংশের দাবি করার অধিকার রয়েছে আল্লাহ্র বিভক্তি অনুযায়ী পাওয়ার। কিন্তু তা তাদের মধ্যে সমান পরিমাণে বন্টন করা এবং দান করার ক্ষেত্রে সবাইকে শামিল করা জরুরী কর্তব্য নয়। কতিপূ খাতকে অপর খাতের তুলনায় অধিক পরিমাণে দেয়ার তার অধিকার রয়েছে। এমনকি কাউকে দেবে কাউকে নয়, যদি তা-ই ইসলাম ও মুসলিমের জন্যে কল্যাণ বিবেচিত হয়- তাহলে তা করারও অধিকার আছে। যেমন তার নিকট যাকাত সংগৃহীত হল এই সময়ই জিহাদ সংঘটিত হল এবং কাফির ও বিদ্রোহীদের হামলা থেকে ইসলামের ঘর প্রতিরক্ষার দাবি উপস্থিত হল, তাহলে তখন মুজাহিদদের জন্যে নির্দিষ্ট খাতসমূহকে অগ্রাধিকার দেয়া ও তাতেই সব ব্যয় করা সম্পূর্ণ জায়েয হবে। তাতে যাকাতলব্ধ সব সম্পদ ব্যয় হয়ে গেলেও আপত্তি করা চলবে না। অনুরূপভাবে মুজাহিদ ছাড়া অন্যান্য খাতে ব্যয় করার অধিক তাকীদ দেখা দিলে তা করা খুবই সংগত হবে। [(আরবী **********)] আবূ উবাইদের অগ্রাধিকার দান ইমাম আবূ উবাইদ উপরিউক্ত মতটিকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। ইমাম আবূ জুহরা যাকাতরে পর্যায় ও স্থান সম্পর্কে হযরত উমর ইবনে আবদুল আজীজকে যা লিখেছিলেন তার উল্রেখ করেছেন, যেমন হাদীসে উদ্ধৃত হয়েছে। বলেছৈন, এখানে আটটি অংশ রয়েছে। একটি ফকীরদের জন্যে আর একটি মিসকীনদের জন্যে... এভাবে আটটি অংশ। পরে ফকীর থেকে ইবনুস সাবীল পর্যন্ত প্রতিটি খাতে যা ব্যয় হবে তা আলাদা আলাদা করে দেখিয়েছন। আটটি খাতের প্রতিটিতে একটি অংশ কিভাবে বন্টন করা হবে তাও দেখিয়েছেন। অতঃপর আবূ উবাইদ বলেছেন, এগুলো হচ্ছে যাকাত ব্যয় করার ক্ষেত্র, যখন তাকে অংশে অংশে বিভক্ত করা হবে। আর এ-ই হচ্ছে পদ্ধতি যে তা করতে সক্ষম ও সামর্থ্যবান হবে তার জন্যে। কিন্তু আমি মনে করি, রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকার ছাড়া এরূপ করা আর কারুর জন্যেই ফরয নয়। তার ফাণ্ডে যদি মুসলমানদের দেয়া যাকাতের পরিমাণ বিপুল হয় তখন সব কয়টি খাতের প্রাপ্য দিয়ে দেয়া আবশ্যক হবে। তখন তা বন্টন করার ব্যাপারে সাহায্যকারী বহু সংখ্যক হস্ত কাজ করবে। কিন্তু যার নিকট তার বিশেষ করে নিজের ধন-মালের জন্যে নিয়েঅজিত লোক ছাড়া আর কেউ থাকে না, সে যদি কোন কোন খাতে তা দেয় অপর কোন কোন খাত বাদ দিয়ে, তাহলে তা তার জন্যে যথেষ্ট এবং জায়েয হবে। যেসব আলিমের নাম উপরে উদ্ধৃত করা হয়েছে তাঁদের এটাই মত। এক্ষেত্রে মূল ভিত্তি হচ্ছে নবী করীম (স) থেকে বর্ণিত হাদীস। তিনি যাকাত প্রসঙ্গে বলেছেন: (আরবী **********) তা নেয়া হবে তাদের ধনীদের থেকে। পরে তা ফিরিয়ে বন্টন করা হবে তাদেরই গরীবদের মধ্যে। এখানে তো একটি মাত্র খাতের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। পরে তাঁর নিকট ধন-মাল আসল। তখন তিনি তা ফকীরদের ছাড়া দ্বিতীয় খাতে নিয়োগ করেছেন। তারা হচ্ছে ‘আল-মুয়াল্লাফাতুলকুলবুহুম’ আল আকরা ইবনে হাবে, উয়াইনা ইবনে হাসান, আলা ও জায়দ ইবনুল খায়ল প্রমুখ ব্যক্তিরা ছিল এই খাতের প্রাপক। তাদের মধ্যে সেই রৌপ্য বন্টন করে দিলেন যা হযরত আলী নবী করীম (স)-এর নিকট ইয়ামেনবাসীদের ধন-মাল থেকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তা সেই লোকদের নিকট থেকেই গ্রহণ করা হয়েছিল,যাদের ধন-মাল থেকে তখন যাকাত নেয়া হত। পরে তার নিকট আরও মাল আস। তখন তিনি তা তৃতীয় খাতে নিয়োগ করলেন, তা হচ্ছে ‘আল-গারেমূন’ –ঋণগ্রস্ত লোক। কুবাইচা ইবনুল মাখারিক যে দুর্বহ বোঝা নিয়েচিলেন, তাতে তাঁকে বলেছিলেন, ‘তুমি অপেক্ষাকর, আমাদের নিকট যাকাতের মাল আসুক’। অতঃপর হয় আমরা সে বোঝা বহনে তোমাদের সহায়তা করব, না হয় বোঝাটি তোমার ওপর থেকে আমরা তুলে নিয়ে যাব। এ কথাটিও এই পর্যায়েরই। এতে নবী করীম (স) বিশেষ একটি খাতকে অপরাপর খাত অপেক্ষা অধিক ভাগ্যবান বানিয়ে দিয়েচিলেন এবংতাতেই যাকাত সম্পদ ব্যয় করেছিলেন। মোটকথা, রাষ্ট্রপ্রধান-সরকার-সব কয়টি খাতে যাকাত বন্টনের ব্যাপারে পূর্ণ স্বাধীনতার অধিকারী- কোন কোন খাত বাদ দিয়ে অপর কোন কোন খাতে সে তা ব্যয় করতে পারে। তখন তা ইজতিহাদ পন্থায় সমাধা করা হবে এবং সত্যকে পরিহার করার প্রবণতাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হবে। রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকার ছাড়া অন্যদের জন্যেও এরূপ অবাধ অধিকার রয়েছে (ইনশা আল্লাহ্)। [(আরবী **********)] রশীদ রিজা’র অগ্রাধিকার দান আল্লামা রশীদ রিজা ‘আল-মানার’ তাফসীর গ্রন্থে লিখেছেন: পূর্বকালের আলিম ও বিভিন্ন দেশের ইমামগণের মধ্যে বিষয়টি নিযে যে মতপার্থক্যের সৃষ্টি হয়েছে, তা প্রমাণ করে যে, এ ব্যাপারে পূর্ব থেকে কোন সুস্পষ্ট নীতি পাওয়া যায়নি যার ওপর নবী করীম (স) থেকে এ পর্যন্ত এ বিসয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকবে। খুলাফায়ে রাশেদুন-এর সময় থেকেও এ পর্যায়ে কোন ঐকমত্য ভিত্তিক নীতি পাওয়া যায়নি। মনে হচ্ছে, তাঁরা ব্যাপারটি কল্যাণময়তার দৃষ্টিতে বিবেচনা করতেন এবং তদনুযায়ী অগ্রাধিকার দিযে কাজ করতেন- যা রাষ্ট্রনায়কগণ পাওয়ার অধিকারেরদৃষ্টিতে ও যাকাত সম্পদের পরিমাণ সল্পতাও বিপুলতা এবং বায়তুলমালে তা সংগৃহীত হওয়ার প্রেক্ষিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন। কল্যাণকরতা বিবেচনায় সব কয়জন ইমামের মধ্যে ইমাম মালিক ও ইবরাহীম নখ্য়ী’র কথা অধিক গ্রহণযোগ্য। আর ইমাম আবূ হানীফার মত সাধারণ কল্যাণ ও অকাট্য দলির উভয় দিকের বিচারেই গ্রহণযোগ্যতা থেকে অনেক দূরে। [পূর্বে উল্রেখ করেছি, আবূ উবাইদ ইবনে আব্বাস ও হুযাইফা থেকেএরূপ কথার বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন। একটি মাত্র খাতে সব যাকাত সম্পদ ব্যয় জায়েয হওয়ার সম্পর্কিত মতটি প্রয়োজনও বন্টন ক্ষেত্রের কল্যাণের বিরোধী নয়- যদি তা-ই মুসলিম মানসিকতার সাথে সঙ্গতিসম্পন্ন হয়।] তবে সংগৃহীত সম্পদ খুব বেশি মাত্রায় কম হলে অন্যকথা। তখন একজনকে দেয়া হলে সে তা দিয়ে উপকৃত হবে। আর তা যদি অন্যান্য কয়েকটি খাতেও ব্যয় করা হয় কিংবা একই খাতের বহু ব্যক্তির মধ্যে বন্টন করা হয়- যেমন ‘ফুকারা’ খাত- তা হলে তা কারোর জন্যেই যথেষ্ট হবে না। তবে একই খাতের পাওয়ার যোগ্য লোকদের মধ্য থেকে মাত্র একজনকে বিপুল সম্পদ দেয়া জায়েয হওয়ার বাস্তবিকই কোন কারণ বা যৌক্তিকতা নেই, তা নিঃসন্দেহ। আল্লাহ তা’আলা প্রতিটি খাতকে বহু বচনে উল্লেখ করেছেন। আবূ হানীফা বা অন্য কেউ ইলম ও চিন্তা-ভাবনার দিক দিয়ে একথা বলতে পারেন না যে, একটি খাতের একজন লোককে দিয়ে দিলেই আল্লাহ্র আদেশ পালন এবং কুরআনের বিধান অনুযায়ী কাজ হয়ে যাবে। দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের মজলিশে শূরা প্রতিটি যুগে ও দেশে কার পরে কার অগ্রাধিকার তা নির্ধারণ করবে এটাই বাঞ্ছনীয়। সমস্ত যাকাত সম্পদও যখন যথেষ্ট হবে না তখন রাজা-বাদশাহ্ প্রশাসক সকলকেই ইচ্ছামত বন্টন বা ব্যয় করা থেকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে। আর প্রয়োজন বা অভাবের যেমন শ্রেণী বা মাত্রা পার্থক্য রয়েছে, তেমনি কোন কোন স্থানে ও সময়ে কোন কোন খাত কার্যত দেখা যায় না, অপর কয়েকটি খাত পাওয়া যায়- এটাও স্বাভাবিক। [(আরবী **********)] খাতসমূহে যাকাত বন্টনের সারকথা উপরিউদ্ধৃত বহু মত, গবেষণা-বিশ্লেষণ ও অগ্রাধিকার সংক্রান্ত যাবতীয় কথার সারনির্যাস আমরা এখানে তুলে ধরছি: ১. যাকাত সম্পদের পরিমাণ বিপুল ও বেশি হলে সব কয়টি খাতে তা বন্টন করা বাঞ্ছনীয়- যদি সব কয়টি খাতই পাওয়া যায়, সে সবের প্রয়োজন সমান মাত্রায় হোক বা পার্থক্যপূর্ণ হোক। তার কোন একটা খাতের প্রয়োজন থাকা ও অধিকার প্রতিষ্ঠা হওয়া সত্ত্বেও তাতে কিছুই ব্যয় না করা- খাতটিকে বঞ্চিত করা জায়েয নয়। এই কথাটি সুনির্দিষ্ট রাষ্ট্রপ্রধান বা শরীযাতসম্মত কর্তৃপক্ষের জন্যে, যা যাকাত সংগ্রহ ও প্রাপকদের মধ্যে বন্টনের কাজ করবে। ২. আটটির সব কয়টি খাতের বর্তমান থাকা অবস্থায় সব খাতেই যখন যাকাত বন্টন করা হবে, তখন প্রতিটি খাতে ব্যয়ের পরিমাণ সর্বতোভাবে সমান করা ওয়াজিব বা ফরয নয়। বরং তা হতে হবে প্রয়োজন ও সংখ্যা মাত্রা অনুপাতে। কেননা কোন এলাকায় হয়ত এক হাজার জন ফকীর রয়েছে; ‘কিন্তু গারেমুন’ বা ‘ইবনুস-সাবীল’ খাতে দশ জনের বেশি পাওয়া যায় না- এমনটা হতে পারে। এরূপ অবস্থায় দশজনকে যা দেয়া হবে, তা-ই এক হাজার জনকে কিভাবে দেয়া যেতে পারে? এ কথাটি ইমাম মালিক এবং তাঁর পূর্বের ইমাম জুহ্রীর মাযহাবের সাথে অধিক সাযূজ্যপূর্ণ দেখতে পাচ্ছি। তারা যে খাতের লোকদের সংখ্যা বেশি প্রয়োজন তীব্র, সেই খাতিটকে বড় অংশ দিয়ে অগ্রাধিকার দিতেন। [দরদী তা*র (******) গ্রন্থে বলেছৈন: অধিক অভাবগ্রস্তকে অন্যদের ওপর অগ্রাধিকার দিতে হবে, হয় বিশেষভাবেই তাদের দিতে হবে, নয় অধিক পরিমাণে দিতে হবে- আস্থানুযায়ী যেটা সমীচীন বোধ হবে। কেননা অভাব মোচনই লক্ষ্য। (১ম খণ্ড, ২৩৪ পৃ.)] কিন্তু তা ইমাম শাফেয়ীর মতের খেলাফ। ৩. বিশেষভাবে কয়েকটি খাতে সমগ্র যাকাত সম্পদ ব্যয় করা জায়েয, যদি শরীয়াতসম্মত কল্যাণ দৃষ্টি এই বিশেষ নীতি গ্রহণ করার প্রয়োজন প্রকাশ করে। ঠিক যেমন আটটি খাতের মধ্য থেকে মাত্র একটি খাতে ব্যয় করা কালে তার সমস্ত ব্যক্তিগণের মধ্যে দেয় পরিমাণ সর্বতোভাবে সমান করা জরুরী নয়। বরং তাদের প্রয়োজন অনুপাতে কম বেশি করা জায়েয। কেননা প্রয়েঅজনের মাত্রা বিভিন্ন ব্যক্তির মধ্যে অনেক সময় তারতম্যপূর্ণ হতে পারে। জরুরী কথা হচ্ছে, পরিমাণে কম-বেশি করা যাবে যদি তার কারণ থাকে, যদি তা করা কল্যাণকর হয়। ইচ্ছামত ও খাহেশ অনুপাতে তা করা যাবে না এবং তা করা যাবে অপরাপর খাত বা ব্যক্তিদের প্রতি কোনরূপ বিদ্বেষ পোষণ ব্যতিরেকে। [এই পর্যায়ে উত্তম কথা পড়েছি (আরবী **********) গ্রন্থে, তাতে বলা হয়েছে: রাষ্ট্রপ্রধান (সরকার) কম বেশি করার এই কাজ করতে পারবে কেবল মাত্র তখন, যখন অপরাপর খাতের প্রতি কোনরূপ অবিচার করার মনোভাব না থাকে। যদি তা থাকে, তবে তা করা যাবে না। কেননা তা হচ্ছে সত্য বিরোধী ঝোঁক ও প্রবণতা, অবিচার। এই অবিচার এরূপ, যেমন একজন ঋণগ্রস্তকে তার ঋণ পূরণের অধিক পরিমাণ দেয়া হল আর অপর ঋণ গ্রস্তকে তার ঋণ পমিাণ থেকেও অনেক কম দেয়া হল। অথবা একজন ইবনুস সাবীলকে তার বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছার পরিমাণ দেয়া হল আর অপর জনকে তার কম দেয়া হল। অথবা একজন ফকীরকে দেয়া হবে যা তার ও তার পরিবারবর্গের জন্যে যথেষ্ট। আর অপর জনকে তার তুলনায় অনেক কম। অথচ তার যুক্তিসঙ্গত কোন কারণ নেই। এই পার্থক্যকারী যেন কারুর মন সন্তুষ্টকরণের কাজ করল। অবশ্য রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকার কোন কোন ব্যক্তিকে অগ্রাধিকার দিয়ে তাকে পরিমাণবেশি দিতে পারে অন্যদের তুলনায় বহু কয়টি কারণে যেমন, যাকাত পাওয়ার অধিকারের কারণ। যেমনহয়তো কোন দরিদ্র্য ব্যক্তি মুজাহিদ। যাকাত সংস্থার কর্মচারী ও ঋণগ্রস্ত হবে। এরূপ ব্যক্তিকে বহু কয়টি কারণ একত্রিত হওয়ার দরুন অন্যদের তুলনায় বেশি দেয়া যেতে পারে।] ৪. যেসব খাতে যাকাত ব্যয় করা হবে তন্মধ্যে ফকীর ও মিসকীনই হতে হবে প্রথম পর্যায়ে গণ্য ও অগ্রাধিকার প্রাপ্ত। কেননা তাদের সচ্ছল বানানো ও যথেষ্ট মাত্রায় প্রয়োজন পূরণই হচ্ছে যাকাতের প্রথম লক্ষ্য। এমনকি রাসূলে করীম(স) হযরত মুয়ায (রা) বর্ণিত হাদীসে কেবল মাত্র এই একটি খাতেরই উল্লেখ করেছেন: ‘তাদের ধনীদের নিকট থেকে যাকাত নেয়া হবে এবং তাদের গরীব লোকদের মধ্যেই তা বন্টন করা হবে’ এই বাণীতে। এটা এজন্যে যে, এই খাটির গুরুত্ব অন্য কয়টির তুলনায় অধিক। তাই সরকারের পক্ষে সেনা সংগ্রহে যাকাত সম্পদ ব্যয় করার উদ্দেশ্যে তা গ্রহণ করা জায়েয হবে না, যদি দরিদ্র মিসকীন প্রভৃতি দুর্বললোকদের খাতসমূহ বঞ্চিত করে তাদেরকে ক্ষুধা, বস্ত্রহীনতা ও বিলুপিড্তর হাতে ছেড়ে দেয়া হয় এবং হিংসা, পরশ্রীকাতরতা ও বিদ্বেষ তাদের জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ভস্ম করতে থাকে। এ সবই যতক্ষণ পর্যন্ত বিশেষ ও সাময়িক ক্ষেত্র হয়ে না দাঁড়াবে, ততক্ষণ তার চিকিৎসাকে দারিদ্র্য ও মিসকীন রোগের চিকিৎসার ওপর অগ্রবর্তিতা দেয়া যাবে। ৫. যাকাত সংস্থা কর্মচারীদের জন্যে ‘কর’ হিসেবে ও বন্টনস্বরূপ সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণে ইমাম শাফেয়ীর মতটি গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়। তিনি পরিমাণ নির্ধারণ করেছেন লব্দ যাকাত সম্পদের এক-অষ্টমাংশ পরিমাণ। তাই তার বেশি হওয়া জায়েয নয়। কেননা আরোপেত অধিকাংশ ‘কর’ ব্যবস্থা সম্পর্কে দোষারোপ করা হয় এই বলে যে, তার একটা বিরাট পরিমাণই ব্যয় হয়ে যায় প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত কাজকর্মে। ফলে মূল ভাণ্ডারে অর্জিত সম্পদের খুব সামান্য অংশই সঞ্চিত থাকে। অর্জন ও সংগ্রহ ব্যয় বাবদ বহু অপচয়ের দরুন লব্ধ পরিমাণ সম্পদের অধিকাংশ হ্রাসপ্রাপ্ত হয়ে যায়। তাতে বড় বড় পদ সৃষ্টি করা হয় ও তার বাহাদুরী ও মর্যাদা রক্ষার্থে, অফিস সংক্রান্ত কায়দা-কানুন ও বাহ্যিক প্রকাশ ও দেখানো যে জটিলতা সৃষ্টির প্রবণতার কারণে বিপুল ব্যয় অপরিহার্য হয়ে দেখা দেয়। তাতে বহু জাঁকজমক দেখানো হয় ও বহু সম্পদ নিয়োজিত হয়, আসলে তা পাওনাদারদের প্রাপ্ত অংশ থেকেই নেয়া হয় নতুবা পাওয়অর যোগ্য লোকদের অংশের পরমাণ আরও অনেক বড় হতে পারে।’ ৬. যাকাত বাবদ সংগৃহীত সম্পদের পরিমাণ স্বল্প হলে- যেমন খুব বড় সম্পদশালী নয় এমন এক ব্যক্তির দেয়া যাকাত- কেবল একটি খাতেই তা নিয়োগ করা যাবে। নখ্য়ী ও আবূ সওর তা-ই বলেছৈন। বরং তা এক ব্যক্তিকেই দিতে হবে, যেমন ইমাম আূ হানীফা বলেছেন। কেননা এই সামান্য পরিমাণ সম্পদ বহু কয়টি খাতে কিংবা একই খাতের বহু লোকের মধ্যে বন্টন করা হলে যাকাত থেকে যে ফায়দাটা পাওয়ার আশা, তা-ই ব্যাহত হয়ে পড়বে। পূর্বে ‘ফকীর’ ও মিসকীন’ খাতে যাকাত দিয়ে সচ্ছল করে দেয়া পর্যায়ে ইমাম শাফেয়ীর অগ্রাধিকার দানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বিপুল সংখ্যাক ব্যক্তির মধ্যে প্রত্যেককে একটি-দুটি করে ‘দিরহাম’ বন্টনের তুলনায় তা অনেক উত্তম। কেননা এই শোষোক্ত পন্থা গ্রহণ করা হলে কারুরই কোন উপকার হবে না, কারুর জন্য যথেষ্টও হবে না। এই ব্যবস্থা তখনকার জন্যে যখন উপস্থিতির সংখ্যা কম হলেও খুব বেশি সাহায্যের প্রয়োজনসম্পন্ন লোক খুব বেশি হবে না। তা যদি হয়, তাহলেতা তখন সেই অনুপাতে বন্টন করাই অধিক উত্তম হবে। নবম পরিচ্ছেদ যেসব খাতে যাকাত ব্যয় করা হবে না ‘যাকাত’ একটি বিশেষ ধরনও ভাবধারাসম্পন্ন ‘কর’ বিশেষ। তা ব্যক্তি ও সমষ্টির এবং মানব-বিশ্বের জীবন ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যসমূহ সম্মুখে রেখে তার বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে বিধিবদ্ধ করা হয়েছে। তাই কোন ব্যক্তিরই তা পাওয়ার যোগ্য অধিকারী না হয়ে তা থেকে একবিন্দু গ্রহণ করার অধিকার থাকতে পারে না। ধন-মালের মালিক বা সরকার কর্তার পক্ষেও নিজ ইচ্ছেমত ও উপযুক্ত খাত তালাশ না করে তার ব্যয় করাররও কোন অধিকার স্বীকৃত নয়। এই কারণে ফিকাহ্বিদগণ শর্ত করেছেন যে, যাকাত গ্রহণকারী ব্যক্তি সে সব পর্যায়ের লোক হতে পারবে না, যাদের জন্যে যাকাত হারাম হওয়ার অকাট্য দলিল প্রমাণ উপস্থিত হয়েছে এবং যাকাত ব্যয়ের জন্যে তাদেরকে সহীহ ও উপযুক্ত খাতরূপে গণ্য করেনি। যাদের জন্যে যাকাত গ্রহণ হারাম ঘোষিত হয়েছে, তারা মোটামুটি এই: ১. ধনী সচ্ছল লোকেরা ২. শক্তিসম্পন্ন উপার্জনকারী লোক ৩. নাস্তিক, আল্লাহ-দ্রোহী, ইসলামের সাথে শত্রুতাকারী, বিরোধিতাকারী, প্রতিবন্ধকতাকারী লোক। সর্বসম্মতভাবে এই লোকেরা যাকাত পেতে পারে না। আর জমহুর ফিকাহ্বিদদের মতে যিম্মিরাও যাকাত পাবে না। ৪. যাকাতদাতার সন্তানেরা, তার পিতামাতা এবং তার স্ত্রী (তার নিকট থেকে যাকাত নিদে পারবে না- অনুবাদক)। এ ছাড়া অন্যান্য নিকটাত্মীয় পাবে যদিও এই ব্যাপারে বিভিন্ন মত রয়েছে এবং তা বিস্তারিত আলোচনা সাপেক্ষ। ৫. নবী করীম (স)-এর ঘর-পরিবার বংশধর। বনু হাশেম গোত্রের লোকমাত্রই। অথবা বনু হাশেম ও বনু মুত্তালিব। এ বিষয়ে বিভিন্ন মত রয়েছে। পরবর্তী আলোচনায় আমরা এ পর্যায়ে বিস্তারিত কথা বলব। প্রথম আলোচনা ‘ফকীর ও মিসকীন’ পর্যায়ের আলোচনায় আমরা উল্লেখ করে এসেছি যে, ‘ফকীর ও মিসকীন’ খাতের জন্যে নির্দিষ্ট অংশের যাকাত কোন ধনী ব্যক্তিকে দেয়া যাবে না। এ বিষয়ে ইসলামের সকল ফিকাহ্বিদই সম্পূর্ণরূপে একমত। কেননা নবী করীম (স) বলেছেন: ধনীর পক্ষেযাকাত গ্রহণ হালাল নয়। [হাদীসদ্বয়ের উৎসের উল্লেখও তথায় করা হয়েছে।] তিনি হযরত মুয়ায (রা)-কে বলেছিলেন: ‘যাকাত ধনীদের নিকট থেকে নেয়া হবে ও তাদের সমাজের গরীব লোকদের মধ্যে বন্টন করা হবে’। [হাদীসদ্বয়ের উৎসের উল্লেখও তথায় করা হয়েছে।] তাঁরা বলেছেন: যাকাত ধনী লোকদের দেয়া হলে তা ফরয করার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যই ব্যাহত হবে।কেননা সে উদ্দেশ্য হচ্ছে, তা দিয়ে গরীব লোকদের ধনী বানানো। কিন্তু ধনীদের তা দিলে এই উদ্দেশ্যটা পূরণ হতে পারে না। এ পর্যায়ে ফিকাহ্বিদগণের পূর্ণ ঐকমত্য থাকা সত্ত্বেও ‘ধনী’ কাকে বলে- কোন ধনীকে যাকাত দেযা নিষেধ এবং তা গ্রহণ করা কোন ‘ধনী’র পক্ষে হারাম তা নির্ধারণে তাঁরা বিভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। আর এ পর্যায়ের যাবতীয় কথাবার্তাও আমরা ‘ফকীর-মিসকীন’ খাতের বিশদ আলোচনায় উল্লেখ করেছি। তা আবার দেখে নেয়া যেতে পারে। অন্যান্য খাতসমূহ সম্পর্কেও ফিকাহ্বিদদের বিভিন্ন মত রয়েছে। ইমাম আবূ হানীফা বলেছেন: ধনীকে যাকাত দেয়া যাবে না, যদিও সে ‘ফী-সাবীলিল্লাহ’ হয় কিংবা হয় ঋণগ্রস্ত পারস্পরিক বিবাদ মীমাংস করা দরুন। হযরত মুয়ায ও অপর হাদীসটি অনুযায়ী আমল করার জন্যে এই মত গ্রহণ করা হয়েছে। তারা যাকাত সংস্থার কর্মচারী ছাড়া উক্ত নিষেধ থেকে আর কাউকে বাদ দেন নি। কেননা কর্মচারী যা নেবে তা তার কাজের পারিশ্রমিক স্বরূপ। ‘মুয়াল্লাফঅতুল কুলুবুহম’কেও বাদ দেয়া হয়েছে উক্ত নিষেধের আওতা থেকে।কিন্তু তাঁরা যেমন বলেছৈন, ইসলামের ব্যাপক প্রচার ও প্রসার লাভের দরুন এই খাতটিই বাতিল হয়ে গেছে। [দেখুন: (আরবী *********)] অন্যান্য ইমাম মত দিয়েছেন: যাকাত কেবল ‘ফকীর’ দরিদ্রদের মধ্যে বন্টন করাকে একমাত্র খাত হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে হযরত মুয়ায সংক্রান্ত হাদীসের ভিত্তিতে। কেননা যাকাত ফরয করার লক্ষ্যই হল ‘গরীব জনগণকে সচ্ছল বানানো’। যাকাত যদি ‘ফকীর’ ও ‘মিসকীন’ ছাড়া অন্য কাউকে না দেয়া যায় তাহলে সূরা তওবার আয়াতে এ দুটো খাতের উল্লেখের পর আরও ছয়টি খাতের উল্লেখ করার কোন অর্থ হয় না। যাকাত কর্মচারী ও ‘ইবনুস-সাবীল’ নিজ দেশে ধনী হলেও এই নিষেধাজ্ঞা থেকে তাদেরকে মুক্ত মনে করা হয়েছে, তেমনি যোদ্ধাকে- যার জন্যে সরকারীভাবে কোন বেতন ধার্য করা হয়নি এবং পারস্পরিক বিবাদ মীমাংসার্থে ঋণগ্রস্ত হওয়া ব্যক্তিকেও তোমরা উক্ত নিষেধাজ্ঝা থেকে বাদ দিতে পার। সত্যি কথা হচ্ছে, যাকাত ব্যয়ের খাত সংক্রান্ত আয়াতে পাওয়ার যোগ্য লোকদের দুটি গোষ্ঠীকে একত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথম গোষ্ঠী: যেসব মুসলমান অভাবগ্রস্ত, আর তারা হচ্ছে: ফকীর, মিসকীন, ক্রীতদাসনিজেদের কাজের দরুন ঋণগ্রস্ত হওয়া ব্যক্তি ও ইবনুস-সাবীল। এদেরকে যাকাত দেয়া হবে তাদের অভাব ও মুখাপেক্ষীতার কারণে। তা পেয়েই তারা তাদের উপস্থিত প্রয়োজন মেটাতে পারে। আর দ্বিতীয় প্রকারের লোক তারা, যাদের প্রতি মুসলমানরা মুখাপেক্ষী।তারা হচ্ছে, যাকাত সংস্থার কর্মচারী, মুয়াল্লাফাতুল কুলুবুহুম, অন্যলোকদের কল্যাণার্থে ঋণগ্রস্ত হওয়া ব্যীক্ত এবং ফী-সাবীলিল্লাহ্ অর্থাৎ জিহাদে নিযুক্ত ব্যক্তিরা। এই লোকদেরকে যাকাত দেয়া যাবে, তারা দরিদ্র হোক, কি ধনী। এ পর্যায়ে নবী করীম(স)-এর হাদীস বিস্তারিত ও আলাদা আলাদা করে কথা বলেছে: ‘ধনীর জন্যে যাকাত জায়েয নয় পাঁচ জন লোক ছাড়া-আল্লাহ্র পথে যোদ্ধা, কিংবা যাকাতের কর্মচারী, কিংবা ঋণগ্রস্ত ব্যীক্ত; অথবা এমন ব্যক্তির জন্যেও যে তা নিজের সম্পদ দ্বারা ক্রয় করেছে অথবা সেই ব্যক্তির জন্যও জায়েয, যার পা্রতিবেশী মিসকীন লোক। ‘সে মিসকীনকে সাদকাস্বরূপ দিল, মিসকীন তাকেহাদিয়াবা উপঢৌকন স্বরূপ দিল’। ইমাম নববী বলেছেন: এই হাদীসটি ‘হাসান’ বা সহীহ্। আবূ দাঊদ দুটো সূত্রে হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন। একটি সূত্র ‘মুরসাল’। আর অপরটি ধারাবাহিক। [(*****) গ্রন্থে (৬খণ্ড, ২০৬ পৃ.) লিখেছেন: উভয় সূত্রের হাদীসটির সনদ নির্ভরযোগ্য। বায়হাকী হাদীসটির সবগুলো সূত্রকে একত্রিত করেছেন। তাতে বলা হয়েছে, মালিক ও ইবনে উযাইনা দুজনই হাদীসটিকে ‘মুরসাল’ বলেছেন। আর মা’মর ও সওরী ধারাবাহিক সূত্র সমন্বিত বলেছেন। এরা দুজনই নির্ভরযোগ্য হাফেযে হাদীস পর্যায়ে গণ্য আর যে হাদীস ‘মুরসাল’ ও ‘মুত্তাসিল’ উভয় ধরনের বর্ণিত, সহীহ মতে তাকে ‘মুত্তাসিল’-ধারাবাহিক সনদসম্পন্ন মনে করতে হবে।] ছোট বয়সের ধনী পুত্র পিতাকেও ধনী করে দেয় ‘ধনী’র পক্ষে দারিদ্র্য অভাব-অনটনের কারণ যাকাত গ্রহণে হালাল নয়, কেননা মানুষ কখনও নিজেই ধনীথাকে, আবার কখনও অপর ব্যক্তির ধনী হওয়ার কারণে ধনী হয়ে যায়। ছোট বয়সের সন্তানকে ধনীই মনে করতে হবে, যদি তার পিতা ধনী হয়। এক্ষেত্রে পুরুষ ও মেয়ের মধ্যে কোনই পার্থক্য নেই। তবে বড় বয়সের লোক যদি দরিদ্র হয় তাহলে ভিন্ন কথা। কেননা তার পিতার সচ্ছলতা তাকে ধনী বানিয়ে দেবে না- যদি তার যাবতীয় ব্যয়ভার তাকেই বহন করতে হয়। যেমন দরিদ্র মেয়ে, যার স্বামী নেই ও দরিদ্র পুত্র-উপার্জনে অক্ষম। [দেখুন: (আরবী *********)] দরিদ্র মেয়েলোক স্বামীর ধনাঢ্যতার দরুন ধনী গণ্য হতে পারে। কেননা জানা মতে ও শরীয়াতের দৃষ্টিতে সে তো তার সাথেতই সম্পৃক্ত। তার হিসাব-নিকাশ স্বামীর ওপর অর্পিত। স্বামীর দেযা যথেষ্ট মাত্রার খরচ ব্যবস্থা তার জন্যে রয়েছে। কাজেই তাকে যাকাত দেয়া জায়েয হবে না। কেননা কার্যত তো তা ধনী স্বামীকেই দেয়া হবে, যা জায়েয নয়। ইমাম আবূ হানীফার দেয়া বাহ্যিক মতে ধনী ব্যক্তির স্ত্রীকে যাকাত দেয়া জায়েয করে, স্বামী তার জন্যে যাবতীয ব্যয়ের ব্যবস্থা করে দিয়ে থাক আর না-ই থাক। ইমাম আবূ ইউসুফের মত হচ্ছে, তা জায়েয নয়। কেননা তার স্বামী ধনী ব্যক্তি, স্ত্রী যাবতীয় ব্যয়ভার যথেষ্ট মাত্রায় বহন তার করত্ব্য।তার মোটমুটি অবস্থা সচ্ছলতাপূর্ণ হোক কিংবা দারিদ্র্যের চাপে সংকীর্ণতাপূর্ণ। সেই স্ত্রীকে যাকাত দেয়া কার্যত ধনী অল্প বয়সী সন্তানকে দেয়ার মতই। [ঐ, (আরবী *********)এবং ] আর হানাফী আলিমগণ ধনী লোকের স্ত্রী ও তার সন্তানের মধ্যে পার্থক্য করেছেন এজন্যেযে, স্ত্রীর যাবতীয ব্যয়ভার স্বামী কর্তৃক বহন তো স্ত্রীর ‘পারিশ্রমিক’ স্বরূপ। ছোট বয়সের সন্তানের ব্যয়ভার বহন করা ওয়অজিব হওয়া তা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার। কেননা সন্তান তো ধনী ব্যক্তির অংশ-ঔরসজাত। তার ব্যয়ভার বহন নিজের ব্যয়ভার বহনের মতই। কাজেই তাকে যাকাত দেয়া আসলে ধনী ব্যীক্তকে যাকাত দেযঅর মতই ব্যাপর। [(আরবী *********)] শাফেয়ী মাযহাবের কোন কোন আলিম ধনী ব্যক্তির দরিদ্র স্ত্রীকে এবং তার দরিদ্র সন্তানকে যাকাত দেয়া জায়েয বলেছেন, স্বামী ও পিতার যাবতীয় ব্যয়ভার বহনের দায়িত্ব থাকা সত্ত্বেও। অন্যরা এর বিরোধিতা করেছেন। এ পর্যায়ে বহু কয়টি মত রয়েছে। [(আরবী *********)] তন্মধ্যে একটি মত হচ্ছে, সন্তান বা স্ত্রী কিংবা অন্য নিকটাত্মীয়- যার যার ব্যয়ভার বহন কোন ধনী ব্যক্তির দায়িত্ববুক্ত হবে,তার জন্যে যাকাত হারাম। কেননা তার প্রয়েঅজন পূরণের দায়িত্ব তো গৃহীত হয়েছে। আর এটাই তার জন্যে যথেষ্ট। [(আরবী *********)] মালিকী আলিমদের কথা হচ্ছে, যে ফকীর ব্যক্তির খরচ বহনের দায়িত্ব কোন ধনী ব্যক্তির ওপর অর্পিত, তার জন্যে যাকাত হারাম- কার্যত সে ব্যয়ভার বহন না করা হলেও। কেননা সে তা গ্রহণ করতে সক্ষম বিচার বিভাগের রায় বা আনুকূল্য নিয়ে। কিন্তু সেই ধনী ব্যক্তির ওপর দাবির মামলা যদি দায়ের না হতে পারে কিংবা তার ওপর রায় কার্যকর করা যদি কঠিন বা অসম্ভব হয়, তাহলে অবশ্য ভিন্ন কথা হবে। [দেখুন: (আরবী *********)] আমি পূর্বে যা বলেছি, আমার মতে সেটাই অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য। তা হচ্ছে, ছোট বয়সের সন্তান ও স্ত্রী পিতা ও স্বামীর ধনাঢ্যতার দরুন ‘ধনী’ গণ্য হবে। কেননা সন্তান পিতার সাথে ও স্ত্রী স্বামীর সাথে এতই একাত্ম যে, তা কোনক্রমেই বিচ্ছিন্ন করা যায় না। এই দুজনের ব্যয়ভার বহনের দায়িত্ব পালন ওয়াজিব করে দেয়া হয়েছে কুরআন ও সুন্নাহ উভয় দলিলেই। এরা দুজনই এমন যে, তাদের প্রয়েঅজন যথেষ্ট মাত্রায় পূরণের দায়িত্ব স্থায়ী বাধ্যতামূরক ও অপরিহার্যভাবে গ্রহণ করা হয়েছে। অতএব এ দুজনকে যাকাত দেয়া জায়েয নয় এবং দুজনের পক্ষে তা গ্রহণ করাও হালাল নয়। তবে অন্যান্যসব নিকটাত্মীয়ের ব্যাপরটা এরূপ নয়। সরকারই তাদের জন্যে যাকাত বা অন্যান্য সরকারী আয়ের ফাণ্ড থেকে যাবতীয় ব্যয়ভার বহনের দায়িত্ব পালন করবে এবং তাদেরকে তাদের নিকটাত্মীয়ের ব্যয়ভার বহন থেকে মুক্ত করে দেবে। মুসলিম ব্যক্তিদের পক্ষে তাদের যাকাত থেকেও এমন পরিমাণ দেয়া জায়েয হবে যদ্দ্বারা প্রাপ্ত সম্পদ দ্বারা অপূরণ থাকা প্রয়োজনগুলো পূরণের ব্যবস্থা করবে। অথবা সে ব্যয়ভার বহন থেকে সম্পূর্ণ মাত্রায় মুখাপেক্ষীহীন বানিয়ে দেবে। এ কথা সত্য তাঁদের মত অনুযায়ীও যাঁরা বলেন যে, ফকীর ও মিসকীনকে সারা জীবনের জন্যে যথেষ্ট পরিমাণ দিতে হবে। [পূর্ববর্তী অধ্যায়ের আলোচনা: ‘ফকীর-মিসকীনকে কত পরিমাণ যাকাত দেয়া হবে’ দ্রষ্টব্য।] দ্বিতীয় আলোচনা উপার্জনশীল শক্তিসম্পন্ন লোক হাদীসসমূহে ধনী লোকদের জন্যে যাকাত হারাম হওয়ার কথা যেমন বলা হয়েছে, তেমনি বলা হয়েছে শক্তিমান ভারসাম্যপূর্ণ দেহাঙ্গের অধিকারী ব্যক্তির ওপর যাকাত হারাম হওয়ার কথা। কেননা তার দেহ সর্বপ্রকার পঙ্গুত্ব ও অক্ষমতামুক্ত। এই শক্তিমান ব্যক্তির ওপর যাকাত হারাম করা হয়েছে এজন্যে যে, এই ব্যক্তি কাজ করবে, নিজের প্রয়োজন নিজেই যথেষ্ট মাত্রায় পূরণ করবে, বেকার নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে থাকবে না ও দান-সাদকা পাওয়ার ওপরও নির্ভরশীল হবে না, এটাই তো কাম্য। তবে লোকটি যদি স্বাস্থ্যসম্পন্ন হয়, কিন্তু উপার্জনের সুযোগ বা কাজ না পায়, তাহলেসে ‘মা’যু’র বটে; যাকাতহ দিয়ে তার সাহায্য করাই বাঞ্ছনীয়- এটা তার অধিকারও, যতক্ষণ পর্যন্ত সে উপযুক্ত কোন কাজ না পাবে। অপর একটি হাদীসে বলা হয়েছে: (আরবী *********) ধনী ও শক্তিমান উপার্জনশীল ব্যক্তির জন্যে যাকাতের কোন অংশ থাকতে পারে না। ‘ফকীর’ ‘মিসকীন’ পর্যায়ের আলোচনায় এই কথাটি বিস্তারিতভাবে আলোচিত হয়েছে। হানাফী আলিমগণ এই মতের বিরোধিতা করেছেন। তাঁরা বলেছৈন: নিসাব-পরিমাণ কম সম্পদের মালিককে- সে সুস্বাস্থ্যবান উপার্জনশীলহলেও- যাকাত দেয়া জায়েয হবে। কেননা সে তো ‘ফকীর’। আর ‘ফকীর’ হল যাকাতরে একটা নির্দিষ্ট ব্যয়ক্ষেত্র। তা ছাড়া প্রকৃত প্রয়োজনটা তার দ্বারা পূরণ হতে পারছে না। তাই তার দলিলের ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে যে, নিসাব-পরিমাণ সম্পদের অনুপস্থিতিই যাকাত পাওয়ার অধিকার সৃষ্টি করে। ইবনুল হুম্মাম বলেছেন: ‘অনেকের মতেই উপার্জনশীল লোকদের পক্ষেযাকাত নেয়া জায়েয নয়।’ দলিলটা হচ্ছে উপরে উদ্বৃত সেই হাদীস। নবীকরীম(স) বলেছৈন, ‘ধনী ও সুস্থ দেহধারী ব্যক্তির জন্যে যাকাত হালাল নয়। আর যে দুজন লোক তার নিকট যাকাত চেয়েছিল, তিনি তাদেরকে মোটা সোটা স্বাস্থ্যবান ব্যক্তি দেখতে পেয়ে বলেছিলেন, ‘আসলে তো তোমাদের দুজনের কোন অধিকার নেই যাকাত পাওয়ার। তা সত্ত্বেও তোমরা চাইলে আমি তোমাদের দেব।’ এর জবাবস্বরূপ বলেছেন, দ্বিতীয় হাদীসটি প্রমাণ করছে: এর তাৎপর্য হচ্ছে, তাদরে দুজনের চাওয়াটাই হারাম। কেননা নবী করীম (স) বলেছিলেন: ‘তোমরা দুজনে চাইলে আমি তোমাদের দেব।’ গ্রহণ করা হারাম হলে এরূপ বলতেন না। [ দেখুন (আরবী *********)] পূর্বেও এ হাদীসটি উদ্ধৃত এবং আলোচিত হয়েছে।তাতে আছে, ‘তোমরা দুজনে চাইলে আমি তোমাদের দুজনকে দেব’ আর ‘এতে ধনী ও শক্তিমান উপার্জনশীল ব্যক্তির জন্যে কোন অংশ নেই’। তাদেরকে একথা বলেছিলেন এজন্যে যে, তাদের প্রকৃত অবস্থা তাঁর জানা ছিল না। আর সব স্বাস্থ্যবান ব্যক্তিই তো আর উপার্জনশীল হয় না, যা তার জন্যে যথেষ্ট হতে পারে। এ কারণে তাদের দিয়েছেন বটে; কিন্তু সেই সাথে তাদের নসীহতও করেছেন, নির্ভুল পথও দেখিয়েছেন এই বলে যে, ধনী ও উপার্জনশীল ব্যক্তির জন্যে যাকাতে কোন অংশ নেই। এটা ইমাম আবূ উবাইদের পসন্দ করা মত। কেননা নবীকরীম(স) ধনাঢ্যতা ও উপার্জন ক্ষমতার ভিত্তিস্বরূপ ঘোষণা করেছেন, যদিও সব শক্তিমান ব্যক্তিই ধনশালী হয় না। এক্ষণে তারা দুজনেই সমান। তবে এই শক্তিমান ব্যক্তি যদি পেশা গ্রহণ সত্ত্বেও- রিযিক সন্ধান করেও তা পায় না বলে- রিযিক থেকে বঞ্চিত বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়ে থাকে, সে তার পরিবারবর্গের জন্যে উপার্জনে প্রাণপণে চেষ্টা করে যাচ্ছে। তা সত্ত্বেও চাহিদা তাকে অক্ষম করে রেখেছে। অবস্থা যদি এরূপ হয়, তাহলে তখন মুসলিম জনগণের ধন-মালে তার হক ও হিস্সা রয়েছে। কেননা আল্লাহ বলেছেন: (আরবী *********) তাদের ধন-মালে তাদের জন্যে অংশ রয়েছে। হযরত ইবনে আব্বাস থেকে এই আয়াত পর্যায়ে বর্ণিত হয়েছে: (***) হচ্ছে, যারা উপার্জনের পেশা গ্রহণকারী লোক হওয়া সত্ত্বেও প্রয়োজন পরিমাণ উপর্জন করতে পাছে না। [(আরবী *********)] তৃতীয় আলোচনা অমুসলিমকে যাকাত দেয়া যায় কি নাস্তিক, দ্বীন-ত্যাগকারী ও ইসলামের সাথে যুদ্ধকারীকে যাকাত দেয়া যাবে না মুসলিম উম্মত এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ একমত যে, কাফির, মুসলিমদের সাথে যুধ্যমান লোকদের যাকাতের একবিন্দও দেয়া যাবে না। [এই ইজমা’র কথা (****) গ্রন্থের ২য় খণ্ডের ১৮৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করা হয়েছে।] এই ইজমা (ঐকমত্যের) প্রমাণ ও ভিত্তি হচ্ছে আল্লাহ্র কথা: (আরবী *********) তোমাদেরকে সে সব লোকের সাথে যারা তোমাদের সাথে দ্বীনের ব্যাপারে যুদ্ধ করেছে, তোমাদেরকে তোমাদের ঘর-বাড়ি থেকে বহিষ্কার করেছে এবং তোমাদেরকে বহিষ্কৃত করার ব্যাপারে খুব বেশি বাড়াবাড়ি করেছে, তাদের সাথে বন্ধুত্ব করা থেকে নিষেধ করা হচ্ছে। যারাই তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে, তারাই জালিম। আরও এজন্য যে, তারা ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। ওরা প্রকৃত সত্যের দুশমন, সত্যের ধারকদের শত্রু। তাদের প্রতি যে সাহায্যই করা হবে, তা-ই খঞ্জর হয়ে দ্বীনকে ক্ষত-বিক্ষত করবে। তার দ্বারা মুসলমানদের হত্যা করবে। আর নিজেকে হত্যা করা ও তাদের পবিত্র স্থানসমূহের ওপর সীমালংঘনমূলক কার্যকলাপ করার জন্য কাউকে নিজেদের ধন-মাল দেয়া, না ধর্মের কথা হতে পারে, না এটা বিবেকসম্মত হতে পারে। মুলহিদ-নাস্তিকের ব্যাপারটাও তদ্রূপ। সে তো আল্লাহ্কেই অস্বীকার করে। নবুয়ত ও পরকালকে করে সম্পূর্ণ অবিশ্বাস। দ্বীনের বিরুদ্ধে লড়াই করা তো তার স্বাভাবিক প্রবণতা হবে। অতএব এই দ্বীনের ধন-মাল থেকে কিছুতেই দেয়া যেতে পারে না। অনুরূপভাবে ইসলাম থেকে মুর্তাদ- দ্বীন ত্যাগকারী হয়ে বের হয়ে যাওয়া ব্যক্তিকেও যাকাত দেয়া যেতে পারে না। কেননা সে তো ইসলামের মধ্যে ছিল, পরে সে বের হয়ে গেছে। ইসলামের দৃষ্টিতে এই ব্যক্তি বেঁচে থাকারই অধিকারী নয়। সে দ্বীন ত্যাগ করে মহাঅপরাধ করেছে। মুসলিম সমাজকেও সে প্রত্যাখ্যান করেছে। এজন্যেই নবী করীম(স) বলেছেন: (আরবী *********) যে লোক দ্বীন ত্যাগ করেছে তাকে তোমরা হত্যা কর। যিম্মীদের যাকাত দেয়া ইসলামী রাষ্ট্রের অনুগত অমুসলিম নাগরিকদের মধ্যে যারা আহ্লি কিতাব আর যারা অনুরূপ কোন ধর্মে বিশ্বাসী-অনুসারী- যারা মুসলিম সমাজের মধ্যে বসবাস করছে, যারা মুসলমানদের দায়িত্বাধীন হয়ে গেছে, মুসলমানদের রাষ্ট্রের আনুগত্য স্বীকার করেছে, ইসলামের দেশীয় আইন বিধান (Law of the land) তাদের ওপর জারি করার অণুমতি দিয়েছে ও এই সূত্রের দারুল-ইসলামের অধীনতা অর্জন করেছে অথবা অনুরূপ ‘নাগিরকত্ব’ (Citizenship) লাভ করেছে, তাদের জন্যে যাকাত সাদকা ব্যয় করার ব্যাপারে বহু মতবিরোধ রয়েছে, তা বহু দীর্ঘ আলোচনা সাপেক্ষ। এখানে তা তুলে ধরছি। ‘নফল সাদকা’ দান মুসলমানদের নফল দান-খয়রাত অমুসলিমদের দেয়ায় কোনই নিষেধ নেই, দোষ নেই। এটা মানবতা ও মানবিকতার দৃষ্টিতেও যুক্তিসঙ্গত। মুসলমানদের সাথে তাদের যে চুক্তি রয়েছে, তার মর্যাদাটাও এতে রক্ষা পেতে পারে। ইসলামের প্রতি তাদের অবিশ্বাস-অস্বীকৃতি (***) তাদের প্রতি মুসলমানদের সদ্ব্যবহার ও দয়া-সহানুভূতি প্রদর্শন কিছুমাত্র প্রতিবন্ধক হতে পারে না। তবে তা ততদিন পর্যন্ত, যতদিন তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুধ্যমান হবে না। আল্লাহ্ নিজেই বলেছেন: (আরবী *********) আল্লাহ্ তোমাদিগকে সেই লোকদের ব্যাপারে নিষেধ করেছেন না যারা দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের সাথে যুদ্ধ করেনি, তোমাদের ঘন-বাড়ি থেকে তোমাদের বহিষ্কৃত করেনি- এ দিক দিয়ে যে, তোমরা তাদের প্রতি ভাল কল্যাণমূলক আচরণ করবে ও তাদের প্রতি সুবিচার করবে। আল্লাহ্ নিশ্চয়ই সুবিচারকারীদের ভালবাসেন। [(আরবী *********)] মুসলমানরা যখন তাদের মুশরিক নিকটাত্মীয়দের প্রতি ভাল ও শুভ আচরণ গ্রহণ করার ব্যপাপারে কুণ্ঠা বোধ করেছিলেন, তখন এই কুণ্ঠা রদ করার উদ্দেশ্যেই উক্ত আয়াতটি নাযিল হয়েছিল। এর পূর্বে হযরত ইবনে আব্বাসের বর্ণনাটি প্রনিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন: মুসলমানরা তাদের বংশের ও আত্মীয় মুশরিক লোকদেরকে দান-সাদকা দেয়াটা অপসন্দ করেছিলেন। এ বিষয়ে তাঁরা রাসূলে করীম(স)-কে প্রশ্নও করেছিলেন। তিনি তাঁদের অনুমতি দিয়েছিলেন এবং নিম্নোক্ত আয়াতটি তখন নাযিল হয়েছিল। [(আরবী *********)] (আরবী *********) হে নবী! তাদের হেদায়েত করে দেয়ার দায়িত্ব তোমার নয়, আসলে হেদায়েত আল্লাহ্ই করেন যাকে চান। আর তোমরা যে মাল ব্যয় কর, তা তোমাদের নিজেদের জন্যে আর তোমরা যা কিছু খরচ কর তা কর আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে। এভাবে তোমরা যা ব্যয় করবে, আল্লাহ্ তা তোমাদের প্রতিই পুরোপুরি ফিরিয়ে দেবেন। আর তোমাদের প্রতি কোন অবিচার করা হবে না। [(আরবী *********)] ‘তোমরা যা কিছু ব্যয় কর, তা কর কেবলমাত্র আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে’- এই আয়অতাংশের তাৎপর্যস্বরূপ ইবনে কাসীর লিখেছেন: ‘সাদকা দানকারী যদি আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে দান করে তা হলে তাতেই তার শুভ ফল আল্লাহ্ দেবেন; কিনতউ তা কে পেল, সে নেককার পরহেজগার ব্যক্তি, না পাপী, সে তা পাওয়ার যোগ্য কি অযোগ্য- এ ব্যাপারে তার ওপর কোন দায়িত্ব নেই। সে তার নিয়ত অনুযায়ীই সওয়াব পেয়ে যাবে। আয়াতের অপর অংশ তার দলিল, যাতে বলা হয়েছে, ‘তোমরা যে মালই খরচ কর, তা তোমাদের প্রতি পূর্ণ করে ফিরিয়ে দেয়া হবে এবং তোমাদের প্রতি অবিচার করা হবে না।’ [(আরবী *********)] তার বান্দাদের মধ্যে যারা নেককার, ভালো আচরণকারী, তিনি তাদের প্রশংসা করেছেন এই বলে: (আরবী *********) তারা তার-ই ভালবাসাস্বরূপ মিসকীন, ইয়াতীম ও বন্দীদের খাবার খাওয়ায়। [(আরবী *********)] এই সময়কার বন্দী ছিল মুশরিক লোকেরা। হাসান প্রমুখ থেকে তা-ই বর্ণিত হয়েছে। [দেখুন: (আরবী *********)] ‘সাদকায়ে ফিতর’ থেকে দেয়া নফল সাদকার মতই-কাচাকাছির-ই ‘সাদকায়ে ফিত্র’ কাফ্ফারা দেয়া ও মানত পুরা করা ইত্যাদি। ইমাম আবূ হানীফা, মুহাম্মাদ ও আর কয়েকজন ফিকাহ্বিদ উক্ত দানসমূহ ‘যিম্মী’দের দেয়ার অনুমতি দিয়েছেন। কেননা দলিল এই সাধারণ অনুমতির ধারক। যেমন আল্লাহ্ সাদকাত পর্যায়ে বলেছেন: (আরবী *********) তোমরা যদি সাদকা প্রকাশ্রভাবে দাও, তা-ও উত্তম। আর যদি তা গোপন কর এবং তা দাও ‘ফকীর’দের তাহলে তাও তোমাদের জন্য কল্যঅণকর।তা তোমাদের থেকে তোমাদের খারাপগুলো দূর করে দেবে। [(আরবী ***********)] এ আয়াতে ‘ফকীর’ দরিদ্র্যদের মধ্যেকোন তারতম্য করা হয়নি। আর কাফ্ফারা’ পর্যায়ে আল্লাহ্ বলেছৈন: (আরবী *********) তাহলে তার কাফ্ফারা হবে দশজন মিসকীন খাওয়ানো- তোমরা তোমাদরে পরিবারবর্গের যে মধ্যম মানের খাবার দাও সেই রূপ খাবার। [(আরবী ***********)] (আরবী *********) তারপরে যারা সমর্থ হবে না, তার জন্যে ষাটজন মিসকীন খাওয়ানোই হল কাফ্ফারা। [(আরবী ***********)] এ সব আয়াতে মিসকীনের মধ্যে কোন পার্থক্য বা তারতম্য করা হয়নি। বিশেষ করে এজন্যে যে, এ কাজটি হল তাদের প্রতি কল্যাণ পৌঁছানো। আর এ কাজ থেকে আমাদের নিষেধ করা হয়নি। তা সত্ত্বেও তাঁরা বলেছৈন, এ সব জিনিস মুসলিম সমাজের ফকীর মিসকীনদের দেয়া অতীব উত্তম কাজ, কোন সন্দেহ নেই। কেননা মুসলিমকে সাহায্য করা হবে আল্লাহ্র বন্দেগীর কাজে। ইমাম আবূ হানীফা শর্ত করেছেন, সে অমুসলিম যেন মুসলমানদের দুশমন ও তাদের বিরুদ্ধে যুধ্যমান না হয়। কেননা সেরূপ ব্যক্তিকে সাহায্য দিলে তা মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্যে তাদেরকে সাহায্য করা হবে। আর তা কখনই জায়েয হতে পারে না। [দেখুন: (আরবী ********)] আবূ উবাইদ ও ইবনে আবূ শায়বা কোন কোন তাবেয়ী থেকে বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন: তাঁরা পাদ্রী-পুরোহিতদের সাদকায়ে ফিতরের অংশদিতেন। [দেখুন: (আরবী ***********) যে ইজমা’র কথা বলা হয়েছে, আসলে তা মুয়াল্লাফাতু কুলুবুহুম সম্পর্কে।] জম্হুর ফিকাহ্বিদদের দৃষ্টিতে মালের যাকাত অমুসলিমকে দেয়া জায়েয নয় কিন্তু মালের যাকাত- ওশর ও অর্ধ-ওশর দেয়ার ব্যাপারে আলিমসমাজের সংখ্যাগরিষ্ট দল এই মত দিয়েছেন: কোন অমুসিলমকে তা দেয়া জায়েয নয়। এমন কি, ইবনুল মুনযির বলেছৈন, এই মতের ওপর উম্মতের ‘ইজমা’ অনুষ্ঠিত হয়েছে যে, যিম্মীকে যাকাত দিলে তা আদায় হবে না। তবে সাদ্কায়ে ফিত্র-এর ব্যাপারে তাঁদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। [দেখুন: (আরবী ***********)যে ইজমা’র কথা বলা হয়েছে, আসলেতা মুয়াল্লাফাতুল কুলুবুহুম সম্পর্কে।] জমহুর ফিকাহ্বিদগণ এ পর্যায়ে যে দলিল পেশ করেছেন, তার মধ্যে অধিক শক্তিশালী দলির হচ্ছে হযরত মুয়ায বর্ণিত হাদীস: (আরবী ***********) আল্লাহ তা’আলা তাদের ধন-মালে তাদের ওপর যাকাত ফরয করেছেন তা তাদের ধনীদের নিকট থেকে নেয়া হবে এবং তাদেরই গরীবদের মধ্যে বন্টন করা হবে। এ হাদীসে যাদের- অর্থাৎ যে সমাজেরই ধনী লোকদের নিকট থেকে যাকাত নেয়া হবে, তাদেরই- অর্থাৎ সেই সমাজেরই গরীবদের মধ্যে তা বন্টন করতে হবে বলে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আর তারা (যাকাতদাতাগণ) হচ্ছে সব মুসলিম। অতএব তাদের ছাড়া অমুসলিম গরীবদের যাকাত দেয়া জায়েয হতে পারে না। ‘ইজমা’ হওয়ার দাবির পর্যালোচনা কিন্তু ইবনুল মুনযির যে ইজমার দাবি করেছেন, তা এখানে অগ্রহণযোগ্য। অন্যরা ইবনে সিরীন ও জুহ্রী থেকে বর্ণনা করেছেন, তাঁরা দুজন কাফিরদের যাকাত দেয়া জায়েয বলেছৈন। [(আরবী ***********)] সারাখসী ‘আল-মাবসূত’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, আবূ হানীফার সঙ্গী ইমাম জুফর যিম্মীকে যাকাত দেয়া জায়েয বলেছৈন। সারাখসী বলেছৈন, এটা কিয়াস মাত্র। কেননা ফকীর-অভাবগ্রস্ত ব্যক্তিকে আল্লাহ্র নৈকট্য ও গনিষ্ঠতা লাভের পথে ধনী বানিয়ে দেয়াই লক্ষ্য। আর তা এখানে অীর্জত হয়েছে। কিন্তু মুয়ায বর্ণিত হাদীসের দলির দ্বারা জুফার-এর কথা প্রতিবাদ করেছন। [দেখুন: (আরবী ***********)] ইবনে আবূ শায়বা হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ থেকে বর্ণনা করেছেন, তাকে সাদকা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, তা কাকে দেয়া হবে। তিনি বললেন: তোমাদের মিল্লাতের মধ্রকার মুসলিম ও যিম্মিগণকে দেবে। আরও বলেছেন, নবী করীম (স) যিম্মীদের মধ্যে সাদকা ও লব্ধ এক-পঞ্চমাংশ বন্টন করে দিতেন। [(আরবী ***********)] বাহ্যত প্রশ্নটি থেকে বোঝা যায় যে, তা ছিল ফরয সাদকা অর্থাৎ যাকাত সম্পর্কে। অবশ্য সেই সাথে নফল সাদকার বিষয়েও হতে পারে। এতদসত্ত্বেও নবী করীম (স)-এর নিকট জমা করা হত ও তা থেকে যোগ্য লোকদের মধ্যে বন্টন করা হত যেসব সাদ্কাত তা প্রধানত যাকাত সম্পদই।কিন্তু এ হাদীসটি মুরসাল। ইবনে আবূ শায়বা তার সনদে হযরত উমর থেকে যাকাতের আয়অত [সূরা তওবা- ৬০ আয়াত] সম্পর্কে বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন, এরা হচ্ছে সমকালীন আহলি কিতাব। [(আরবী ***********)] উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলীর মধ্যে একটা ঘটনা ইমাম ইউসুফ উদ্ধৃত করেছেন। হযরত উমর (রা) একজন বৃদ্ধ ইয়াহুদীর জন্যে মুসলমানদের বায়তুলমাল থেকে প্রয়োজনীয় পরিমাণ সাহায্য নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন। তাঁর দলিল ছিল কুরআনের আয়অত: (আরবী ***********) এই মিসকীনরা আহলি কিতাব থেকে। [দেখুন: (আরবী ***********) বালাযুরী ইতিহাস গ্রন্থে এই বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন (১৭৭পৃ.)। উমর ইবনুল খাত্তাব দামেশকের আল-জাবীরা নামক স্থানে খৃস্টান কুষ্ঠ রোগগ্রস্ত লোকদের নিকট উপস্থিত হলেন। তিনি তাদের জন্যে সাদকাত ও খাদ্য যোগাড় করে দেয়ার নির্দেশ দিলেন। এই সাদকাত বলতে বাহ্যত যাকাতই মনে করা যায়। কেননা তা-ই কেবল রাষ্ট্র ব্যবস্থার অধীন হয়। তা হলেই তা থেকে খাদ্য ব্যবস্থা করা চলে।] ‘রওজুননজীর’ গ্রন্থ [দ্বিতীয় খণ্ড, ৪২৫ পৃ.] প্রণেতা ইবনে আবূ শায়বার হযরত উমর সম্পর্কিত বর্ণনা উদ্ধৃত করার পর লিখেছেন: ‘এই ঘটনা প্রমাণ করে যে, হযরত উমর (রা) আহলি কিতাব লোকদেরকে যাকাত দেয়া জায়েয মনে করতেন।’ ‘আল-মানার’ তাফসীর লেখক জায়দীরা থেকে অনুরূপ উদ্ধৃত করেছেন। এবং (****)[(আরবী ***********)] গ্রন্থে জুহরী ও ইবনে সিরীন থেকে এই বর্ণনা উদ্ধৃত হয়েছে। বলেছৈন: আয়াতে ‘আল-ফুকারা’ শব্দটি সাধারণ অর্থবোধক ও নির্বিশেষ এটাই তাদের দলিল। তাবারী [(আরবী ***********)] ইকরামা থেকে উক্ত আয়াত পর্যায়ে এই মত উদ্ধৃত করেছেন মুসলিম ফকীরদেরকে এই মিসকীন মনে করো না। এরা হচ্ছে আহলি কিতাবের মিসকীন। [আবূ জুহ্রা, আবদুর রহমান হাসান ও খাল্লাফ এই তাফসীর পর্যায়ে মত প্রকাশ করেছেন: তিনি বলেন যে, উক্ত আয়াতে মিসকীন বলতে আহলি কিতাবের মিসকীন বোঝানো হয়েছে, তিনি দুটি কায়দা করে দিচ্ছেন। একটি হচ্ছে, ফকীর ও মিসকীন দুটি পরস্পর পার্থক্যপূর্ণ জনগোষ্ঠী। আয়াতের একটির উল্লেখ করা হলে অপরটির উল্লেখ আপনা আপনি হয়ে যেত না আর দ্বিতীয় হচ্ছে, যিম্মীদের মধ্যে যারা মিসকীন তাদেরকে যাকাত দেয়া জায়েয হয়ে যায় এই শর্তে যে, তারা নিঃশর্তে উপার্জনে অক্ষম হলে তা পাবে। কেননা সক্ষম যিম্মীদের নিকটথেকে তো জিযিয়া আদায় করা হবে। আর তাদের নিকট থেকে জিযিয়া নেয়া হবে আর যাকাতও তাদের দেয়া হবে, এটা বোধগম্য নয়। দেখুন: (আরবী ***********)] এই পর্যায়ে কেউ কেউ যিম্মীকে যাকাত দেয়ার ব্যাপারে এই শর্ত আরোপ করেছেন যে, যাকাতদাতা যদি যাকাত গ্রহণকারী মুসলমান না পায়, তবেই তা জায়েয হবে। আল জাস্সাস উবায়দুল্লাহ্ ইবনুল হাসান থেকে তা-ই বর্ণনা করেছেন। [(আরবী ***********)] আবাদীয়া গোষ্ঠীর কোন কোন লোকেরও এই কথা। [(আরবী ***********)] তুলনা ও অগ্রাধিকার দান আমরা বলব, জমহুর ফিকাহ্বিদগণ তাদের মতের সমর্থনে যে অধিক শক্তিশালী দলিলের উল্লেখ করেছেন, তা হচ্ছে হযরত মুয়াযের হাদীস। হাদীসটি যে সহীহ্, সে বিষয়ে সকলেই সম্পূর্ণ একমত। কিন্তু যে কথা প্রমাণ করার উদ্দেশ্যে হাদীসটির উল্লেখ করেছেন, তা অকাট্য নয়। হাদীসটি এই সম্ভাবনা তুলে ধরে যে, প্রতিটি অঞ্চলের ধনী লোকদের থেকে যাকাত গ্রহণ করা হবে এবং তা তাদেরই ফকীর লোকদের মধ্যে বন্টন করা হবে। এরা সকলে অঞ্চল স্বাদেশিকতা ও প্রতিবেশীরবিচারে সেই ধনী লোকদেরই দরিদ্র জনগণ গণ্য হবে। এখান থেকেই তাঁরা এ হাদীসকে দলিলরূপে পেশ করেছেন এ কথা প্রমাণের জন্যে যে, এক শহর বা ঞ্চলের যাকাত সেখান থেকে অন্য শহর বা অঞ্চলে তুলে নেয়া জায়েয নয়। সাদকায়ে ফিতর ও অনুরূপ অন্যান্য সাদকা ব্যয় করা জায়েয হওয়ার পক্ষে হানাফী আলিমগণ যেসব দলিলের উল্লেখ করেছেন তন্মধ্যে সেই সব আয়াতের নিঃশর্ত তাৎপর্যও রয়েছে, যাতে ফকীর লোকদের মধ্যে কোনরূপ পার্থক্যের সৃষ্টি করা হয়নি। সে দৃষ্টিতে সব মিসকীনই সম্পূর্ণ সমান ও অভিন্ন। হযরত উমর, জুহ্রী, ইবনে সিরীন, ইকরামা, জাবির ইবনে জায়দ ও জুফার থেকে যা বর্ণিত হয়েছে, উক্ত দলিল তারও সাক্ষী। সূরা আল-মুমতাহিনা’র আয়াত বলছে: ‘যেসব লোক তোমাদের বিরুদ্ধে দ্বীনের ব্যাপারে যুদ্ধ করেনি এবংতোমাদেরকে তোমাদের ঘরবাড়ি থেকে বহিষ্কৃতও করেনি, তাদের সাথে তোমরা ভাল ব্যবহার করবে, আল্লাহ্ তোমাদেরকে তা থেকে নিষেধ করছেন না।’ তাঁরা বলেছেন: ‘এই আয়াতটির বাহ্যিক অর্থ যিম্মীদের প্রতি যাকাত ব্যয় করার জায়েয হওয়ার দাবি করে। কেননা যাকাত দেয়াটা তাদের প্রতি একটা ভালো ব্যবহারই বটে, যদিও মুয়াযের হাদীসথেকে তা প্রমাণিত হয় না। [ দেখুন: (আরবী ***********)] অথচ আমাদের নিকট এ কথা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, মুয়ায বর্ণিত হাদীসটি অপর দলিলের নিঃশর্ততা ও সাধারণত্বের পরিপন্থী নয়। আর হযরত উমর (****) আয়াতের তাৎপর্যে মনে করেছেন যে, এর মধ্যে মুসলিম অমুসলিম উভয়ই সমানভাবে শামিল রয়েছে। দলিলসমূহের পারস্পরিক তুলনা থেকে আমার মনে হচ্ছে, যাকাতের ব্যাপরে আসল কথা হল, তা প্রথমত কেবল মুসলিম ফকীর-মিসকীনকেই দিতে হবে। কেননা তা বিশেষভাবে মুসলিম ধনী লোকদের ওপরই ধার্য করা ফরয বিশেষ। কিন্তু যাকাত সম্পদে প্রশস্ততা ও বিপুলতা থাকলে এবং মুসলিম ফকীরদের কোন ক্ষতি না হলে যিম্মী ফকীরকে দিতে নিষেধ বা বাধা কিছু নেই। এ ব্যাপারে আয়অতটির সাধারণ ও নিঃশর্ত তাৎপর্যই আমাদের জন্যে যথেষ্ট দলিল। হযরত উমরের আমল(বাস্তব কাজ) কম দলিল নয়। এ ছাড়া রয়েছে ফিকাহ্বিদদের রায় ও অভিমত। বস্তুত এই ধরনের একটা উচ্চতর বদানস্যতা ও মহানুভবতা ইসলাম ছাড়া অন্য কোন ধর্মই উপস্থাপিত বা প্রবর্তিত করতে পারেনি। উপরিউক্তি কথা এখানকার জন্যে, যখন দেয়া হবে দরিদ্র্য ও অভাব বা প্রয়োজনের নামে। কিন্তু যদি মনস্তুস্টি সাধানকল্পে (***) তার নিকট ইসলামকে প্রিয় করে তোলার উদ্দেশ্যে দেয়া হয়, দেয়া হয় তার সাহায্য করে মুসলমানদের সাথে ও তাদের রাষ্ট্রের সাথে মনের আকর্ষণ বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে, তাহলে আল্লাহ্র কিতাব ও তাঁর রাসূলের সনতের অকাট্য দলিল দ্বারা আগেই আমরা তা জায়েয হওয়ার মতকে অগ্রাধিকার দিয়ে এসেছি, আর এই অংশটি যে, চিরদিন থাকবে, সে কথাও বলেছি। যদিও আমরা বলে যে, ‘মনস্তুষ্টিকরণ’ ও ‘মুয়াল্লাফাতু কুলবুহুম’ খাতে যাকাত ব্যয় করার কাজটি আসলে ইসলামী সরকারের করণীয় নয়, ব্যক্তিমনের নয়। অবশ্য ইসলামী সংস্থাসমূহ এই রাষ্ট্র সরকারের বিকল্প হতে পারে। এখানে একটি বিষয়ে সতর্ক করে দেয়া আবশ্যক। তা হচ্ছে, যারা বলেছেন, যিম্মীদের যাকাতরে সম্পদ দেয়া যাবে না, তার অর্থ এই নয় যে, তাদেরকে অনশন ও বস্ত্রহীনতার মধ্যে রেখে তিল তিল করে মরতে দেয়া হবে। কখখনই নয়। তাদেরকে বায়তুলমালের অপরাপর আয়- যেমন ‘ফাই’, গনীমতের এক-পঞ্চমাংশ, খনিজ সম্পদ ও খারাজ প্রভৃতি- থেকে অবশ্যই সাহায্য করা হবে। আবূ উবাইদ তাঁর (***) গ্রন্থে উমর ইবনে আবদুল আজিজের তাঁর বাওরা’র ওপর নিযুক্ত প্রশাসককে লিখিত ফরমানের উল্লেখ করেছেন। তাতে রয়েছে: ‘তোমার নিজের দিক থেকে যিম্মীদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ কর; যাদের বয়স বেশি হয়ে গেছে, শক্তিহীন বা দুর্বল হয়ে পড়েছে, তাদের কামাই-রোজগার সংকীর্ণ হয়ে গেছে। এরূপ লোকদের জন্যে মুসলমানদের বায়তুলমাল থেকে প্রয়োজনীয় পমিাণ সাহায্য চালু কর। [(আরবী ***********)] সত্য কথা এই যে, তিনি যিম্মীদেরকে সাহায্য চাওয়া অপেক্ষায় রাখাও পসন্দ করেন নি। বরং খলীফাতুল মুসলমীন নিজেই আঞ্চলিক প্রশাসককে তাদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ ও তাদের দাবি-দাওয়া জানবার জন্যে নির্দেশ দিয়েছেন, যেন বায়তুলমাল থেকে প্রয়োজনীয় সাহায্য দান করা যায়। আর এটাই হচ্ছে ইসলামের সুবিচার। ফাসিক ব্যক্তিকে কি যাকাত দেয়া যাবে ফাসিক সম্পর্কে ফিকাহবিদগণ মত দিয়েছেন, তারা যতক্ষণ পর্যন্ত আসল ইসলামের ওপর অবিচল থাকবে, যতক্ষণ তার অবস্থার সংশোধনের জন্যে চেষ্টা চলতে থাকবে, ততক্ষণ তাদেরকে যাকাত দেয়া যাবে। তার মনুষ্যত্বের প্রতি সম্মান প্রদর্শনই এর লক্ষ্য। আর যেহেতু এরূপ ব্যক্তির নিকট থেকে যাকাত গ্রহণ করা হবে, তাই তাদের দেয়াও যাবে। ফলে ‘ধনী লোকদের নিকট থেকে তা নেয়া হবে ও তাদেরই গরীব লোকদের মধ্য তা বন্টন করা হবে’- হাদীসে এই সাধারণ তাৎপর্যপূর্ণ ঘোষণার অন্তর্ভুক্ত হয়ে আছে। [ দেখুনঃ (আরবি ****************)] তবে তা অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে। কেননা আল্লাহর মাল দিয়ে তো আর আল্লাহর নাফরমানীর কাজে সহায়তা-সহযোগিতা করা যায় না। সাধারণ ধারণাই এ ব্যাপারে যথেষ্ট মনে করতে হবে। এ কারণে মালিকী মাযহাবের কোন কোন আলিম বলেছেন, পাপী গুনাহগার লোকদের যাকাত দেয়া যাবে না যদি মনে করা হয় যে, তারা তা এ সব পাপ কাজে ব্যয় করবে। অন্যথায় তাদের তা দেয়া জায়েয হবে। [ দেখুনঃ (আরবি ****************) এই মত জাফরী মাযহাবের সাথে সংগতিসম্পন্ন। যেমন ইমাম জাফরের ফিকাহতে উদ্ধৃত হয়েছে ২য় খণ্ড, ৯৩ পৃ. এবং আবাজীয়া ফিকাহায়ও তাই রয়েছে, (আরবি ****************)] জায়দীয়াদের মতে ফাসিক ধনী ব্যক্তির ন্যায়, তার জন্যে যাকাত জায়েয নয়, তাকে দিলে যাকাত আদায় হবে না। হ্যাঁ, তবে সে যদি যাকাত সংস্থার কর্মচারী হয় কিংবা ‘মুয়াল্লাফাতু কুলুবুহুম’-এর কেউ হয়, তাহলে ভিন্ন কথা। [ (আরবি ****************)] আমার মতে অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য মত হচ্ছে, ফাসিক ব্যক্তি যদি তার ফিসক-ফুজুরী দ্বারা মুসলমানদের চ্যালেঞ্জ না করে তাহলে তাকে যাকাত দেয়ায় কোন দোষ নেই। যদিও নেককার ও দৃঢ় আদর্শবাদী চরিত্রবান লোকই হচ্ছে যাকাত পাওয়ার ইজমাসম্মত উপযুক্ত ও উত্তম লোক। কিন্তু যে ফাজের-গুনাহগার ব্যক্তি ধৃষ্টতা দেখায় তার সর্ববিধ পাপ কাজ নিয়ে অহমিকা বোধ করে-নির্ভীকভাবে ফাসিকী কাজ করতে থাকে, তাহলে তার অহংকারী মনোভাব নির্মূল না হওয়া ও তওবা না করা পর্যন্ত তাকে যাকাতের টাকা বা সম্পদ দেয়া যেতে পারে না। কেননা ঈমানের শক্তিশালী ও নির্ভরযোগ্য রজ্জু হচ্ছে আল্লাহর জন্য ভালোবাসা আল্লাহরই জন্যে অসন্তোষ। [ একটি হাদীসের তরজমা. যা ইমাম আহমাদ. ইবনে আবূ শায়বা ও বায়হাকী তার শুয়ূবুক ঈমানে উদ্ধৃত করেছেন। সয়ুতী হাদীসটি সহীহ বলে ইঙ্গিত করেছেন তার (আরবি ****************) গ্রন্থে।] আল কুরআনে বলা হয়েছেঃ (আরবি ****************) আর মুমিন পুরুষ ও মুমিন মহিলাগণ পরস্পরের বন্ধু-পৃষ্ঠপোষক। তারা ভাল ও সৎকাজের আদেশ করে এবং অন্যায় ও পাপ কাজ থেকে নিষেধ করে। [(আরবি ****************)] এই আয়াতের ঐকান্তিক দাবি হচ্ছে, মুসলিম সমাজ কোন ফাসিক ব্যক্তির দিকে সাহায্যের হস্ত প্রসারিত করবে না- এরূপ অবস্থায় যে, সে তার নাফরমানীর কাজে গভীরভাবে মগ্ন রয়েছে এবং তার গুনাহের দ্বারা সে পরস্পরের প্রতি লানত করছে, তার সাধারণ চেতনাকে চ্যালেঞ্জ করছে। তাই বলে এটা গুনাহগার ও ফাসিক লোকদের প্রতি নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন, এমন কথা বলার কোন যুক্তি নেই। মুসলিম সমাজের মধ্য থেকেও তাদের ক্ষুধা-কাতর হয়ে ধ্বংস হয়ে যেতে দেয়া হবে, এমন অপবাদেরও যৌক্তিকতা স্বীকার করা যায় না। ইসলাম তো আসলেই বিশাল উদারতা, দয়া-সহানুভূতি এবং ক্ষমা-সহিঞ্চুতা নিয়ে এসেছে। ক্ষমা-সহিঞ্চুতা ব্যক্তিগত দোষ ও অন্যায়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে। কিন্তু যে লোক গোটা সমাজকেই কলুষিত ও পাপপ্রবণ বানিয়ে দিচ্ছে, দ্বীন ও দ্বীনদার লোকের লাঞ্ছিত করছে, তাকে ক্ষমা করার কোন প্রশ্নই উঠতে পারে না। তাকে ক্ষমা করার ক্ষমতাও নেই কারোর। যে লোক নিজের প্রতি দয়া প্রদর্শন করে, সেই অন্যের নিকট থেকে দয়া পাওয়ার অধিকারী হতে পারে। তবে তওবা করলে ভিন্ন কথা। আর তা না করে যদি ক্রমাগতভাবে পাপ করতেই থাকে, শয়তানের আনুগত্য করায় সে পৌনপৌনিকতা বজায় রেখে চলে- গুমরাহীর পথে চলতেই থাকে, সমাজ ও তার মূল্যমান, তার আদর্শের প্রতি বৃদ্ধাংগুষ্ঠি দেখাতেই থাকে, তাহরে সে না খেয়ে মরলেও কোন দোষ নেই। এমন ব্যক্তির কোন মর্যাদাই স্বীকার করা যেতে পারে না। আর যে লোক নিজেই নিজেকে অপমানিত করে সে অন্য লোকের নিকট সম্মান পাওয়ার অধিকারী নয়। যে নিজেকে দয়া করে না, সে দয়া পেতেও পারে না। যে লোক নামায-রোযা পালন, মদ্যপান-জুয়া খেলার ওপর না খেয়ে মরাকে অগ্রাধিকার দেয় সে সমাজের নিকট কোনরূপ সাহায্য-সহানুভূতি পাওয়ার অধিকারী নয়। অন্তত এরূপ যার স্বভাব চরিত্র ও ইচ্ছা-বাসনা, তার পক্ষে সমাজের দয়া-সহানুভূতি পাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু এই ধৃষ্টতাকারী ফাসিক ব্যক্তির যদি তার ওপর নির্ভরশীল কোন পরিবার থাকে, তাহলে সেই পরিবারের লোকদেরকে যাকাতের মাল দেয়া আবশ্যক। সেই ব্যক্তির দোষে তার পরিবারকে কষ্ট দেয়া যায় না। আল্লাহ তাই বলেছেনঃ (আরবি ****************) প্রত্যেকটি ব্যক্তির ওপর তার নিজের উপার্জনই চাপবে। কোন বোঝা বহনকারীই অপরের বোঝা বহন করবে না। [(আরবি ****************)] বিদ’আত পন্থী কিংবা বেনামাযী ব্যক্তিকে যাকাত দেয়া যাবে কিনা, ইমাম ইবনে তাইমিয়াকে এই প্রশ্ন করা হলে তিনি জবাবে বললেনঃ যাকাতদাতা ব্যক্তির উচিত দ্বীনদার শরীয়াত অনুসরণকারী মুসলমানদের মধ্য থেকেই ফকীর, মিসকীন, গারেমীন প্রভৃতি যাকাত পাওয়ার যোগ্য লোক সন্ধান করা। যে লোক প্রকাশ্যভাবে বিদ্’আত করছে; কিংবা পাপ কাজ করে যাচ্ছে, সে তো পরিত্যক্ত হয়ে শাস্তি পাওয়ার যোগ্য; তাকে তওবা করতেও বলা যেতে পারে।.... তাহলে এরূপ ব্যক্তিকে কি করে সাহায্য করা যায়? [(আরবি ****************)] নামায তরককারী সম্পর্কে বলেছেন ‘যে লোক নামায পড়ছে না, তাকে নামায পড়তে বলতে হবে। সে যদি বলে যে, হ্যাঁ, আমি নামায পড়ি, তাহলে তাকে দেয়া যাবে। অন্যথায় দেয়া যাবে না। [(আরবি ****************)]। অর্থাৎ সে যদি তওবা করার কথা প্রকাশ করে এবং নমায পড়বে এই মর্মে ওয়াদা করে তাকে এ ব্যাপারে সত্যবাদী মনে করে যাকাত দেয়া যাবে। (আরবি ****************) গ্রন্থে শায়খুল-ইসলাম লিখেছেনঃ ‘যে লোক যাকাত পেয়ে তদ্দ্বারা আল্লাহর আনুগত্যের কাজে সাহায্য পেতে চাইবে না, তেমন লোককে যাকাত দেয়া যায় না। কেননা আল্লাহ যাকাত ফরয করেছেন তার ইবাদত-আনুগত্যের কাজে তদ্দ্বারা সহায়তা গ্রহণকল্পে-যে সব মুমিন ব্যক্তি তার মুখাপেক্ষী হবে। যেমন ফকীর, ঋণগ্রস্ত কিংবা যে লোক মুসলমানদের কাজে সহযোগিতা করে-যেমন যাকাত সংস্থার কর্মচারী ও আল্লাহর পথে জিহাদকারী ব্যক্তি। তাই অভাবগ্রস্ত লোকদের মধ্যে যারা নামায পড়ে না, সে যতক্ষণ তওবা না করবে এবং নামায রীতিমত পড়তে শুরু না করবে, ততক্ষণ তাকে যাতাক আদৌ দেয়া যাবে না। [(আরবি ****************)] সাইয়্যেদ রশীদ রিজা’র বক্তব্য এ পর্যায়ে ইসলামী সমাজ সংস্কারক সাইয়্যেদ রশীদ রিজার একটি গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য তুলে দিয়ে এই প্রসঙ্গটি আমরা শেষ করতে চাই। তিনি তাঁর তাফসীরে লিখেছেনঃ অভিজ্ঞতা থেকে জানা গেছে, ইংরেজ ফ্রাংগ্রীরা যে সব দেশের ইসলামী ভিত্তিকে নষ্ট করে দিয়েছে, শিক্ষা ব্যবস্থাকে বিকৃত-বিভ্রান্ত করেছে, সে সব দেশে নাস্তিকতা ও আল্লাহদ্রোহিতা মারাত্মক রকম বৃদ্ধি পেয়ে গেছে। আর দ্বীন-ইসলামের ফায়সালাও জানা গেছে যে, ইসলাম ত্যগকারী ব্যাক্তি আসল কাফির অপেক্ষাও অনেক বেশি ক্ষতিকর। তাই এরূপ ব্যক্তিকে যাকাত বা সাদকায়ে ফিতর-এর কিছুই দেয়া যেতে পারে না। তবে প্রকৃত কাফির যদি অ-যুধ্যমান হয়, তাহলে তাকে নফল সাদকার টাকা বা সম্পদ দেয়া জায়েয হতে পারে; কিন্তু ফরয যাকাত দেয়া যাবে না। (জমহুর ফিকাহবিদদের মত-ই তিনি সমর্থন করে গেছেন।) এই সব দেশে মুজাহিদ – নাস্তিক অ-ধার্মিক লোক বহু রকমের। তাদের মধ্যে কেউ কেউ প্রকাশ্যভাবে আল্লাহকে অস্বীকার করে- হয় বলে, আল্লাহ নিষ্কর্মা হয়ে গেছেন; কেউ কেউ সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বকেই অস্বীকার করছে অথবা ইবাদতের ক্ষেত্রে আল্লাহর সাথে শিরক করছে। অন্যরা কেউ কেউ ‘অহী’ অস্বীকার করছে, নবুয়ত-রিসালাতের সত্যতা মানছে না বা নবীর প্রতি গালাগাল করছে কিংবা কুরআনকে যা তা বলছে অথবা পুনরুত্থান ও বিচার দিনকে অমান্য করছে। এদের কেউ কেউ আবার ইসলামকে শুধু রাজনৈতিক জাতীয়তা হিসেবে মানছে, কিন্তু তারা মদ্যপান, জ্বেনা-ব্যভিচার, নামায তরক করা প্রভৃতি ইসলামের ‘রুকন’ সমূহকে অস্বীকার করছে, নামায পড়ছে না, যাকাত দিচ্ছে না, রোযা পালন করছে না, সামর্থ থাকা সত্ত্বেও আল্লাহর ঘরে হজ্জ করতে রাজী হচ্ছে না। এ সব লোকের ভৌগোলিক বা বংশীয় ইসলাম গণনার যোগ্য নয়। তাই উল্লিখিত কোন ব্যক্তিকেই যাকাত দেয়া জায়েয হতে পারে না। বরং যাকাতদাতার কর্তব্য হচ্ছে, ইসলামের সহীহ্ আকীদায় অবিচল লোক তালাশ করে বের করে তাদের যাকাত দেবে। দ্বীনের অকাট্য আদেশ-নিষেধের প্রতি যাদের দৃঢ় প্রত্যয় রয়েছে, এমন লোক বের করবে। এসব লোক একবিন্দু গুনাহও করবে না এমন শর্ত কখনই করা যেতে পারে না। কেননা মুসলিম ব্যক্তি কখনও কখনও গুনাহ করে; কিন্তু সেই সাথে সে তওবাও করে। আর আহলি সুন্নাহর মৌল নীতি হচ্ছে, কাবাকে কেবলা মানে, এমন কোন লোককে কোন গুনাহের দরুন তারা কাফির বলবে না। কার্যত বিদ’আতে নিমজ্জেত বা শরীয়াতের দলিলে ব্যাখ্যাগত ভিত্তির ওপর বিদ’আতী আকীদা সম্পন্ন লোকও কাফির হয়ে যায় বলে তারা মনে করেন না। বস্তুত আল্লাহর আদেশ-নিষেধ বিশ্বাসকারী মুসলমান যদি গুনাহ করে এবং ফরয তরক করা ও নির্লজ্জ কাজ-কর্ম করা যারা হালাল মনে করে, এই দুই শ্রেণীর লোকদের মধ্যে বিরাট পার্থক্য রয়েছে। এই ব্যক্তি এসব কাজ আল্লাহ কর্তৃক অর্পিত দায়িত্বের এক বিন্দু চেতনা ছাড়াই পৌনপুনিকতা সহকারে করে। সে আল্লাহর নাফরমানী করেছে, এই খেয়ালও হয় না তার। তার উচিত আল্লাহর নিকট তওবা করা, তার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করা। যে মুসলিমের ইসলামে সংশয় রয়েছে, তাকেও যাকাত দেয়া সমীচীন নয়। যেসব লোককে রমযান মাসে দিনের বেলা কফিখানা, হোটেলে-রেস্তোরা ও খেল-তামাশার লীলাকেন্দ্র ধূম্র উদগীরণ করতে বা মদ্যপানে মত্ত হয়ে থাকতে অথবা চর্ব-চোষ্য-লেহ্য-পেয়-র স্বাদ আস্বাদনে ব্যতিব্যস্ত দেখা যায়- এমনকি জুম’আর দিনের নামাযের সময়ও- তারা উক্তরূপ কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকে না তাদের সম্পর্কে কি বলা যাবে, আমি জানি না। অনেক সময় আবার এ সব বিভ্রান্ত লোকেরা কোন-না-কোন জুম’আর মসজিদে উপস্থিতও হয়ে থাকে। এই লোকদেরকে কি গুনাহগার মুসলিম’ বলা যাবে কিংবা বলা যাবে সব সীমালংঘনকারী নাস্তিক? তাদের সম্পর্কে যে ধারণাই পোষণ করা হোক, যাকাতের কোন মাল যে এদেরকে দেয়া যেতে পারে না, তা নিঃসন্দেহে। তাই যাদের দ্বীন ঈমান ও সচ্চরিত্রতা সম্পর্কে নির্ভর করা যাবে সেই লোকের সন্ধান করতে হবে যাকাত দেবার জন্যে। তবে ফাসিক ব্যক্তিকে দিলে তার সংশোধন হবে এমন ধারণা হলে তাকে মুয়াল্লাফাতু কুলুবুহুম’ –এর মধ্যে গণ্য করে দেয়া যাবে। ইসলামের পরস্পর বিরোধী গোষ্ঠিসমূহকে যাকাত দান ইসলামে পরস্পর বিরোধী যতগুলো ফির্কা বা জনগোষ্ঠী রয়েছে আহলি সুন্নাত তাদের ‍‘বিদআতপন্থী’ বা ‘স্বেচ্ছাচারবাদী’ (আরবি***************) নামে অভিহিত করেছে। ‘বিদআত’ দুই ধরনের। একটা হল মানুষকে কাফির বানিয়ে দেয় এমন বিদ’আত (আরবি***************) এ বিদ’আত তার অনুসারীকে ঈমান থেকে বের করে কুফরির মধ্যে নিয়ে যায়। এই পর্যয়েও বিভিন্ন গোষ্ঠী বিভিন্ন মানের হয়ে থাকে। কিছু হয় সীমালংঘনকারী, কিছু মধ্যমপন্থী। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে মানুষকে ‘ফাসিক বানিয়ে দেয় এমন বিদ’আত’ (আরবি***************)। তা তার অনুসারীকে কাফির বানায় না বটে; কিন্তু ফাসিক’ অবশ্যই বানিয়ে দেয়। আর এই ‘ফিসক’টা প্রধানত চিন্তা ও আকীদা বিশ্বাসের ক্ষেত্রে কাজ করে। একে ব্যাখ্যাগত ফিসক-ও বলা চলে তবে বাস্তব কাজ ও আচার-আচরণে ফিসক (সীমালংঘন প্রবণতা) থাকে না। এ সব পরস্পর বিরোধী ফির্কা বা জনগোষ্ঠীসমূহের মধ্যে যেসব ফকীর ও যাকাত পাওয়ার যোগ্য লোক আছে তাদেরকে যাকাত দেয়া সম্পর্কে কি হুকুম সেটাই প্রশ্ন। সত্যি কথা হচ্ছে, আহলি সুন্নাহ’ গোটা মুসলিম উম্মতের মধ্যে উদারতা ও বদান্যতা প্রদর্শনে অগ্রসর অতি বড় একটি জনগোষ্ঠী। যে বিদ’আত মানুষকে কাফির বানায় ও ইসলাম থেকে বের করে নিয়ে যায়, [ দৃষ্টান্তস্বরূপ দেখুনঃ(আরবি***************)] তাদের ছাড়া অন্য সব বিদ’আত পন্থীদেরই- আহলি কেবলা মুসলিম মাত্রকেই যাকাত দেয়ার পক্ষপাতী, যদি তারা কল্যাণ ও স্থিতিশীলতাসম্পন্ন হয়। আর এতেও সন্দেহ নেই যে, আহলি সুন্নাহ লোকেরা বিদ’আত মুক্ত ও রাসূলের সুন্নাতের অনুসারী প্রত্যেক ব্যক্তিকে যাকাত দেয়াকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছে, যদিও তারা তাদের সাথে সম্পর্কশীল। তাহলে অন্যদের ব্যাপারে কি করতে হতে পারে? আসলে এ পর্যায়ে কথা হচ্ছে, দেয়া জায়েয- দিলে যাকাত আদায় হবে, কিংবা হবে না, এই বিষয়েই যা মতপার্থক্য। জা’ফরী ইমামীয়া শিয়াদের মত হচ্ছে এই শর্তে যে, যাকাতদাতা ইসনা আসরিয়া শিয়া সতের লোক হবে- ইমামের কথাঃ সাদকা ও যাকাত কেবল তোমার সঙ্গী-সাথীদেরই দাও।’ মুয়াল্লাফাতু কুলুবুহুম’ ছাড়া আর কাউকে এই শর্ত থেকে নিষ্কৃতি দেয়নি। কেননা এ কথা ধরে নেয়া হয়েছে যে, এরা কাফির বা মুনাফিক হবে। যাকে যাকাত দেয়া হবে সাধারণ কল্যাণময় কাজের জন্যে- তার দারিদ্র্য দূর করার বা তার বিশেষ ধরনের প্রয়োজন পূরণের জন্যে নয়, তা-ও উক্ত শর্ত থেকে মুক্ত। ইমাম জাফর-এর ফিকাহতে শায়খ মুগনীয়া এই শর্তটিকে বিশেষ করে শুধু যাকাতের ব্যাপারে প্রয়োগ করার দিকে ইঙ্গিত করেছেন। আর মুস্তাহাব দান-সাদকা যে কোন অভাবগ্রস্ত ব্যক্তিকে দেয়া জায়েয বলে মত প্রকাশ করেছেন। [(আরবি***************)] একথা বলেছেন এতদসত্ত্বেও যে, শায়খ এক্ষেত্রে মাযহাবী ইমাম (র)-এর প্রদত্ত মতের ওপর নির্ভর করেছেন ও আস্থা স্থাপন করেছেন। সে মতটি হচ্ছে, সাদকা ও যাকাত কোন কিছুই না দেয়া। এখানে ‘সাদকা’ অর্থ ফরয দান বলা ঠিক নয়। অন্যথায় তার পর যাকাত বলা পুনরুক্তির দোষে দূষিত হয়ে পড়ে। মূল দলিরে- যদি বর্ণনাটি সহীহ্ সাব্যস্ত হয়- মূল বক্তব্যের এমন সাধারণ অর্থ করা যেতে পারে যা সব মুসলিমকেই শালিম করে। আহলি বায়াতের কোন কোন আলিমের এমন মত জানা গেছে, যা উপরিউক্ত সাধারণ ও ব্যাপক তাৎপর্যকে সমর্থন করে। ‘বুহরানী’ তাঁর (আরবি***************) গ্রন্থে আবূ জাফর আল-বাকের (র) থেকে এ কথা উদ্ধৃত হয়েছেঃ একজন লোক তার নিকট উপস্থিত হয়ে তাকে বলরেনঃ আল্লাহ আপনাকে রহমত করুন’ আমার নিকট থেকে এই পাঁচ শত দিরহাম গ্রহণ করুন, পরে তা যথাস্থানে ব্যয় বা বন্টন করুন। আসলে এটা আমার মালের যাকাত। এ কথা শুনে ইমাম বললেনঃ না, ওটা বরং তুমিই নাও। এবং ওটা তোমার প্রতিবেশী ইয়াতীম ও মিসকীন এবং তোমার মুসলিম ভাইদের মধ্যে বন্টন করে দাও।[(আরবি***************)] ইমামুস-সাদেকের পিতা থেকে এ দলিলটি বর্ণিত। সওয়ালকারীকে তিনি কোন শর্ত বলে দেন নি। শুধু দুটি বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন। তা হচ্ছে, প্রয়োজন ও অভাব এবং দ্বিতীয় ইসলাম বা মুসলিম হওয়া। অতএব ইসলামী ভ্রাতৃত্ব সব হিসেবের ঊর্ধ্বের জিনিস। মুমিনরা সকলেই পরিস্পরের ভাই, এ কথা সর্বজনস্বীকৃত। আবাজীয়া গোষ্ঠীর লোকদের মধ্যে সেই মাযহাব অনুসারী ছাড়া অন্য মুসলমানকে যাকাত দেয়া জায়েয হওয়া পর্যায়ে মতবিরোধ রয়েছে। তাদের কেউ কেউ বলেছেন, যদি জানা যায় যে, সে দরিদ্র ব্যক্তি; কিন্তু সে পক্ষের কি বিপক্ষের, সমর্থক কি বিরোধী- তা জানা না যায় তাহলে তাকে যাকাত দেয়া যাবে। কেউ কেউ আবার বিরোধীকেও দেয়া জায়েয বলে মত দিয়েছেন। বলা হয়েছে, এমন লোক আমাদের চোখের সম্মুখে থাকলে তাকে দেয়া জায়েয। আবার কেউ বলেছেন, দাতার নিকটে থাকলে তাকে যাকাত দেয়া হবে। (আরবি***************) গ্রন্থে বলেছেন, সহীহ্ এবং সত্য কথা হচ্ছে, দেয়া যাবে না, দেয়া যাবে শুধু সমমাযহাব লোকদের। যদি সে রকম লোক না পাওয়া যায়, তা হলে এই দিক দিয়ে পরিচিতি ব্যক্তিকে দেয়া হবে। আর তাও পাওয়া না গেলে দেয়া হবে তা থেকে সম্পর্কহীন ব্যক্তিকে নতুবা এমন বিরোধীকে যে তার নিজের মাযহাবী মতের অনুগত। তবে অগ্রাধিকার দেয়া হবে সেই ব্যক্তিকে যে আমাদের গালাগাল করে না, আর তার পরে সেই ব্যক্তিকে যে কম গালাগাল করে আর তার পরে খুব বেশি গালাগালকারীকে। আর তাও না হলে খৃষ্টানকে দেয়া হবে নতুবা ‘সাবুনী’ বা সাবেয়ীকে। আর তাও না হলে ইয়াহুদীকে। আর তারপর অগ্নিপূজককে নতুবা মূর্তিপূজারীকে। এসব কথা সম্ভব না হওয়ার ওপর ভিত্তিশীল। আকস্মিক মৃত্যুর ভয় দেখানো হয়েছে এবং পাঠাবার কোন পথ না পাওয়ার ওপর নির্ভর করা হয়েছে। [(আরবি***************)] লক্ষণীয়, এই শেষোক্ত শর্তগুলো লোকদের পক্ষে মাযহাবপন্থীদের গোষ্ঠী থেকে বের হয়ে যাওয়াকে কঠিন করে দেয়া হয়েছে। আর জায়দীয়া গোষ্ঠীর মত (আরবি***************) গ্রন্থে উদ্ধৃত হয়েছেঃ জায়দ ইবনে আলী (রা) এ প্রসঙ্গে বলেছেনঃ তোমার মালের যাকাত কাদরীয়া পন্থীদের দেবে না [ কদরীয়া’ বলতে প্রাচীন কালের সে সব লোককে বোঝানো হয়, যারা বলত, প্রতিটি ব্যাপারই সূচনা। অর্থাৎ তার পূর্বে আল্লাহ জানতেন না। এভাবে ঘটনাবলী সম্পর্কে আল্লাহ জানতে পারেন তা সংঘটিত হওয়ার পর। এ মত সর্বপ্রথম প্রকাশ করেছে ‘আল জুহানী’। সহীহ মুসলিমে তাই বলা হয়েছে। মু’তাজিলাদের বোঝাবার জন্যেও এই শব্দ ব্যবহৃত হত। তবে এখানে প্রথম ব্যবহারটিই লক্ষ্য। ইমাম জায়দ একজন তাবেয়ী। মনে করা হচ্ছে যে তিনি তাবেয়ীদের দেখতে পেয়েছেন।] মুর্জিয়াকেও নয় [ ‘মুর্জিয়া, বলতে বোঝায় সে লোক, যে ফাসিক লোকদের ওপর অভিশাপ বর্ষণে বাড়াবাড়ি ত্যাগ করেছে। পূর্বকালের একটি জামা’আতের এটাই মত। সেই ব্যক্তিকেও বলা হয়, যে বিশ্বাস করে আমল ছাড়াও ঈমান হতে পারে। ঈমান থাকা অবস্থায় গুনাহ কোন ক্ষতি করে না, যেমন কুফরী অবস্থায় আল্লাহর ইবাদত কোন ফায়দা দেয় না। শব্দটি (আরবি***************) থেকে, অর্থ বিলম্বিতকরণ। উক্ত মতের লোক যেহেতু আমলকে ঈমান থেকে দূরে নিয়ে গেছে, সেই কারণে তাকে মুর্জিয়া বলা হয়। ইমাম জায়েদের মতের দৃষ্টিতে শেষোক্ত ব্যবহারটাই সমীচীন।] হারুরীয়াকেও নয় [ ‘হারুরা’ একটা স্থানে নাম। সেই সম্পর্কের দিক দিয়ে ‘হারুরীয়া’ বলা হয়েছে। স্থানটি কুফাতে অবস্থিত। প্রাথমিক খাওয়ারিজ লোকেরা এখানে একত্রিত হয়েছিল। পরে প্রত্যেক খারিজী মতের লোককে হারুরীয়া বলতে শুরু করা হয়েছে। এদেরকে (আরবি***************) ও বলা হয়। এরা হযরত আলী ও হযরত ওসমানকে কাফির মনে করে।] রাসূলের আহলি বায়ত লোকদের বিরুদ্ধে যারা ‍যুদ্ধ করেছে তাদেরকেও নয়। [ তাদের সাথে যারা সশস্ত্র যুদ্ধ করেছে, বিদ্রোহ করেছে, সীমালংঘন করেছে, রক্তপাত করা হালাল মনে করেছে, এ কথা সাধারণভাবে তাদেরকে এবং অন্যদেরকেও বোঝায়। কিন্তু তাদের ব্যাপারে খুব বেশি করে যেসব ইজতিহাদী মাসলায় তাদের ইজমা হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়নি তাতে এবং দ্বীনের যেসব মৌল বিষয়ে উভয় পক্ষ থেকে প্রবল সংশয়ের অবকাশ রয়েছে, তাতে বিরোধিতা খুব বেশী ক্ষতিকর বা নিন্দনীয় নয়। দেখুনঃ(আরবি***************)] ‘রওজুন নজীর’ গ্রন্থে বলা হয়েছে, উক্ত ইমাম (আ)-এর কথা ফাসিককে যাকাত দেয়া জায়েয নেই’ ব্যাখ্য সাপেক্ষ। হাদী, কাসেম ও নাসের এরূপ বলেছেন। তাদের দলিলহল (আরবি***************) বলে সম্বোধন করা হয়েছে মুমিন লোকদের প্রতি এজন্য যে, যাকাতের টাকা দিয়ে যেন আল্লাহর নাফরমানীমূলক কোন কাজের সহায়তা করা না হয়। বলেছেনঃ প্রাচীন লোকদের একটি জামায়াত তা জয়েয বলে মত দিয়েছেন। ‘মুসান্নাফ ইবনে আবূ শায়েবা’ গ্রন্থে ফুজাইলের সনদে বলা হয়েছেঃ আমি ইবরাহীম নখয়ীকে (আরবি***************) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি বললেনঃ ওরা সে লোক যারা নিজেদের অভাব ছাড়া কখনও ভিক্ষা চাইত না। মুয়াইয়্যিদ বিল্লাহ ইমাম ইয়াহইয়া, হানাফী শাফেয়ী মাযহাবের লোকেরা তাই বলেছেন। কেননা (আরবি***************) শব্দটি সাধারণ অর্থবোধক। আরও এজন্যে যে, ধনীদের নিকট থেকে নিয়ে তাদেরই ফকীর গরীবদের মধ্যে বন্টন করা হয়।’ (হাদীস) ইমাম শাফেয়ীর দুটো কথার একটি ইমাম ইয়াহইয়া গ্রহণ করেছেন। তা হচ্ছেঃ ফাসিকের ফিসক যদি মুসলমানদের জন্যে ক্ষতিকর হয় তাহলে তাকে যাকাত থেকে দেয়া যাবে না। যেমন বিদ্রোহী ও যুদ্ধ লিপ্তকে দেয়া হয় না, এদেরকেও যাকাত দেয়া যাবে না। কেননা তাতে রাষ্ট্রপ্রধানের কথর অপমান হয়। আর তারও মুসলিম জনগণের দায়িত্ব পালন এই দুটোর মধ্যেই ব্যাপারটি আবর্তিত হয়। [(আরবি***************)] যা কিছুমাত্র বাঞ্ছনীয় নয়। চতুর্থ আলোচানা স্বামী, পিতামাতা ও নিকটাত্মীয়কে কি যাকাত দেয়া যাবে নিকটবর্তী ব্যক্তি যদি ঘনিষ্ঠতার দিক দিয়ে দূরবর্তী হয়, তাহলে যাকাতদাতা ধনশালী ব্যক্তির পক্ষে সেই লোকের ব্যয়ভার বহন বাধ্যতামূলক হয় না। কাজেই তার এই নিকটবর্তী ব্যক্তির যাকাত তাকে দিতে কোন দোষ নেই। নিকটবর্তী ব্যক্তি নিজেই দিক কিংবা অন্য যাকাতদাতা দিক, তা সমান কথা কিংবা তা দেবে সরকার বা তার প্রতিনিধি অর্থাৎ যাকাত বিতরণ প্রতিষ্ঠান তা দেবে। আর ফরীর-মিসকীনদের জন্যে নির্দিষ্ট অংশ থেকে দেয়া হোক, কি অন্য কোন খাত থেকে, তাতেও কোন পার্থক্য থাকে না। কিন্তু যে নিকটবর্তী ব্যক্তি ঘনিষ্ঠতম নৈকট্য সম্পর্কশীল; যেমন পিতা-মাতা, সন্তান, ভাই-বোন ও চাচা-চাচী- এদেরকে যাকাত দেয়া জায়েয হওয়া পর্যায়ে বিশদ আলোচনার প্রয়োজন। সেই নিকটবর্তী ব্যক্তি যদি যাকাত পাওয়ার যোগ্য হয়- হয় এজন্যে যে, সে যাকাত সংস্থার কর্মচারী, ক্রীতদাস বা ঋণগ্রস্ত অথবা আল্লাহর পথেরে মুজাহিদ, তাহলে সেই যাকাতদাতা নিকটবর্তী ব্যক্তির পক্ষে তাকে যাকাত দেয়ায় কোন দোষ হতে পারে না। কেননা লোকটি যাকাত পাওয়ার যোগ্য এমন গুণগত কারণে, যাতে এই নৈকট্যের কোন প্রভাব খাটতে পারে না। আর এই নিকটবর্তী ব্যক্তিরও নৈকট্যের নাম করে ঋণগ্রস্তের ঋণ শোধ করা বা আল্লাহর পথের মুজাহিদদের খরচ বহন করার অনুরূপ কিছু করারও প্রয়োজন হয় না, তাও ওয়াজিব নয়। অনুরূপভাবে নিঃস্ব পথিককেও সফর খরচ দান করা সম্পূর্ণরূপে জায়েয হবে। তবে ‘মুয়াল্লাফাতু কুলুবুহুম’ খাতে কাউকে ব্যক্তিগতভাবে সাহায্য বা যাকাতের টাকা দেয়া উচিত নয়। এটা রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকার প্রতিনিধিরই করণীয়। পূর্বে এ কথা বলে আসা হয়েছে। আর ঘনিষ্ঠ নৈকট্যসম্পন্ন নিকটবর্তী ব্যক্তি যদি “ফকীর’ বা মিসকীন’ হয়ে থাকে, তাহলে কি এই ফকীর ও মিসকীনের যাকাতে-অংশ তাকে দেয়া যাবে?..... এর জবাব দেয়ার জন্যে সর্বপ্রথম দাতা লোকটিকে তা জানা আবশ্যক। যাকাত বিতরণকারী ব্যক্তি যদি রাষ্ট্র প্রধান বা তার প্রতিনিধি হয় কিংবা এ কালের পরিভাষায় সরকারই যাকাত সংগ্রহ বন্টনের দায়িত্ব পালন করেন, তাহলে সে প্রয়োজন, অভাব ও পাওয়ার যোগ্যতার দৃষ্টিতে যাকে দেয়ার প্রয়োজন মনে করবে, তাকে দেবে, সে যদি যাকাতদাতার সন্তান বা তার পিতা বা স্বামীও হয়, তবুও। [ দেখুনঃ (আরবি***************)] তার কারণ হচ্ছে, যাকাতদাতা তো মুসলমানদের দায়িত্বশীল ব্যক্তির নিকট যাকাত পৌঁছিয়ে দিয়েছে। সে যথাস্থানেই জমা করে দিয়েছে, তাতে তার ফরয পালনের দায়িত্ব থেকে মুক্তি সংঘটিত হয়েছে। এক্ষণে তার বন্টনের ব্যাপারটি সরকারের ওপর ন্যস্ত। কেননা যাকাতের মাল বায়তুলমালে জমা হয়ে যাওয়ার পর তার পূর্ব-মালিক দাতার সাথে তার কোন সম্পর্কই অবশিষ্ট থাকে না। এক্ষণে তা আল্লাহর মাল কিংবা মুসলিম জনগণের সম্পদ। সেই নিকটবর্তী ব্যক্তি যদি ‘ফকীর’ কিংবা মিসকীন’ হয় আর যে লোক তাকে যাকাত দেবে, সে নিজেই হয় তার নিকটবর্তী ঘনিষ্ঠ আত্মীয়, তাহলে এই নৈকট্য ও ঘনিষ্ঠতার মান এবং কোন্ লোক তার নিকটবর্তী, সেটা সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। এই ফকীর যদি যাকাতদাতার পিতা হয়, মা হয়, হয় পুত্র বা কন্যা, এরা সেই ধরনের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় যাদের যাবতীয় ব্যয়ভার বহনের জন্যে ধনী ব্যক্তিকে বাধ্য করা যাবে, তাহলে এদের কাউকেই সেই ধনী ব্যক্তির যাকাত দেয়া চলবে না। ইবনুল মুনযির বলেছেন, ইসলামের বিশেষজ্ঞগণ এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ একমত হয়েছেন যে, যাকাতদাতা তার যাকাত তার আপন পিতামাতাকে দিতে পারবে না, দেয়া জায়েয হবে না, কেননা অবস্থা তো এই যাকাতদাতা নিজেই এদের যাবতীয় ব্যয়ভার বহনে স্বাভাবিকভাবেই বাধ্য এবং দায়ী। এমতাবস্থায় এদেরকে তার যাকাত দেয়া হলে তাদের খরচ বহনের দায়িত্ব পালন থেকে তাদের মুখাপেক্ষিতা দূর করা হবে বটে কিন্তু সেই লোক তার স্বাভাবিক দায়িত্ব থেকে মুক্ত হয়ে যাবে। ফলে যাকাতের প্রত্যক্ষ ফায়দাটা সে নিজেই পেয়ে যাবে। তখন মনে হবে, সে নিজেই যেন নিজেকে যাকাত দিয়েছে অথচ তা জায়েয নয়- যেমন যাকাত দ্বারা সে নিজের ঋণ পূরণ করতে পারে না। [ দেখুনঃ(আরবি***************) ] আরও এজন্যে যে, সন্তানের ধন-মাল তো পিতামাতার ধন-মাল। এই কারণে মুসনাদ ও সুনান হাদীস সংকলন গ্রন্থে একাধিক সূত্রে রাসূলে করীম (সা) থেকে বর্ণনা উদ্ধৃত হয়েছে। তিনি বলেছেনঃ (আরবি***************) তুমি ও তোমার ধন-মাল তোমার পিতার জন্যে। [ তাফসীরে ইবনে কাসীর, ৩য় খণ্ড, ৩০৫পৃ.। ইমাম আহমাদ হাদীসটি তিনটি সূত্রে বর্ণনা করেছেন। আমর ইবনে শুয়াইব তাঁর পিতা তাঁর দাদা থেকে। শায়খ শাকের হাদীসটিকে সহীহ্ বলেছেন। দেখুন, ১৬৭৮, এবং ৬৯০২, ৭০০১-১খণ্ড ও ১২ খণ্ড। ইবনে মাজাহ গ্রন্থে হযরত জাবির থেকে বর্ণনা উদ্ধৃত হয়েছে, এই সূত্রের বর্ণনাকারী ব্যক্তিগণ সিকাহ। তাবারানী বর্ণনা করেছেন সামুরাতা ও ইবনে মাসউদ থেকে যয়ীফ সূত্রে (আরবি***************) দেখুন।] যেমন করে কুরআন পুত্রদের ঘরকে পিতার ঘর বলে ঘোষণা দিয়েছে। যখন বলেছেঃ (আরবি***************) এবং তোমাদের ওপর কোন দোষ বর্তাবে না যদি তোমরা আহার কর তোমাদের ঘর-বাড়ি থেকে......। [(আরবি***************)] অর্থাৎ তোমাদের পুত্রদের ঘর থেকে। [(আরবি***************) ] আয়াতটিতে সংশ্লিষ্ট নিকটাত্মীয়দের প্রকৃত রূপটা তুলে ধরা হয়নি। ব্যক্তির নিজের ঘরে খাবার গ্রহণে এমন কোন দোষের প্রশ্ন নেই, যা দূর করার জন্যে কুরআনী আয়াত নাযিল করতে হবে। তাই আয়াতে বলা ‘তোমাদের ঘর’ বলে বুঝিয়েছে ‘তোমাদের পুত্রদের ঘর’। নবী করীম (সা) বলেছেনঃ(আরবি***************) ব্যক্তির নিজের উপার্জন থেকে আহার গ্রহণ খুব বেশি উত্তম এবং ব্যক্তির সন্তান তার নিজেরই উপার্জন বিশেষ। [হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন তিরমিযী, নাসায়ী ও ইবনে মাজাহ হযরত আয়েশা (রা) থেকে এমন সনদে যাকে তিরমিযী উত্তম বলেছেন। আবূ হাতিমও হাদীসটিকে সহীহ বরেছেনঃ (আরবি***************) এ তা উদ্ধৃত হয়েছে। আহমাদ অনুরূপ বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন সহীহ্ সনদে। তা ৬৬৭৮ ও ৭০০১ নম্বর হাদীসের অংশ বিশেষ।] এ পর্যায়েই হানাফী মাযহাবের আলিমগণ বলেছেনঃ সম্পদের উপকারিতা পিতামাতা ও সন্তানদের মধ্যে সম্মিলিত ও সুসংবদ্ধ। তাই ফকীর পিতামাতাকে মালিক বানিয়ে দেয়ায় সর্বতোভাবে যাকাত আদায় হবে না। বরং তা নিজের জন্যে ব্যয় হয়ে দাঁড়াবে এক হিসেবে। তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক খুব শক্তিসম্পন্ন থাকায় তাদের পরস্পরের জন্যে সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য হবে না। [ দেখুনঃ (আরবি***************)] তার মূলেও এই কারণই নিহিত। অনুরূপভাবে সন্তানদেরকে যাকাত দেয়াও জায়েয নয়। কেননা তারা হল যাকাতদাতার অংশ। তাদের যাকাত দেয়া নিজেকে দেয়ার সমান। বুখারী ও আহমাদ মায়ান ইবনে ইয়াজীদ থেকে যে হাদীস বর্ণনা করেছেন তা এ পর্যায়ে প্রতিবন্ধক হতে পারে না। তা হলঃ ‘আমার পিতা মসজিদের এক ব্যক্তির নিকট বহু দীনার স্বর্ণমুদ্রা বের করলেন তা দান করার উদ্দেশ্যে। আমিও তথায় উপস্থিত থেকে তা নিলাম। পরে পিতা বললেনঃ আল্লাহর নামের শপথ আমি তোমাকে তো দিতে চাইনি, তুমি নিলে কেন? পরে আমি রাসূলের নিকট উপস্থিত হয়ে এ বিষয়ে তাঁর সাথে আলোচনা করলাম। তখন নবী করীম (সা) বললেনঃ হে-ইয়াজীদ! তুমি তোমার নিয়ত অনুযায়ী সওয়াব পাবে। আর যে মায়ান, তুমি যা নিয়েছ, তা তোমার জন্যই থাকবে।’ বাহ্যতই বোঝা যায়, এই সাদকাটা ছিল নফল সাদকা। শওকানী তাই বলেছেন- ওটা ফরয যাকাতের ব্যাপারে নয়। [দেখুন(আরবি***************)] তা যদি হত তাহলে পিতার দেয়া যাকাত তার পুত্র নিতে পারত না, নিলে তা জায়েয হত না। এই ব্যাপারের বিরুদ্ধে এসেছে মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান এবং শিয়া মতের আবদুল আব্বাস থেকে পাওয়া একটি বর্ণনা। তাতে বলা হয়েছে, বাবা মাকে যাকাত দিলে তা আদায় হয়ে যাবে। শেষের দিকের জায়দীয় ফিকাহবিদদের একটি গোষ্ঠীও উক্ত মতের সমর্থন করেছে, মূল, শাখা প্রশাখা বংশের লোক এবং রক্ত সম্পর্কের অপরাপর সকল পর্যায়ের লোকদের মধ্যে যাকাত ব্যয় করাকে তারা জায়েয ঘোষণা করেছেন। তাঁরা দলিল হিসেবে বলেছেন- আসল কথা হল, যাকাত সংক্রান্ত কথাগুলো সম্পূর্ণ সাধারণ অর্থবোধক, সব শ্রেণীর লোকই তার মধ্যে শামিল ও গণ্য হতে পারে। তাতে এমন কোন বিশেষত্ব বিধায়ক কথা নেই যা সহীহ্ হতে পারে ও কাউকে কাউকে তা পাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারে। [(আরবি***************)] ইমাম মালিক থেকেও অনুরূপ বর্ণনা পাওয়া গেছে। বলেছেনঃ পুত্রদের পুত্রদের মধ্যে এবং ঊর্ধ্বে দাদা ও দাদীর জন্যে যাকাত বন্টন বৈধ। [(আরবি***************)] সম্ভবত ইবনুল মুনযির ও বহরুয যাকাত’ গ্রন্থে প্রণেতাদ্বয়ের নিকট উক্ত বর্ণনা সমূহ সহীহ্ বলে গৃহীত হয়নি। এরাঁ দুজন বর্ণনা করেছেনঃ ব্যক্তির বংশমূল পিতা, মা, দাদা ও দাদী এবং নিজের বংশের শাখা প্রশাখা- সন্তান ও সন্তানের সন্তানদের মধ্যে যাকাত ব্যয় নাজায়েয হওয়ার ওপর ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা ঘোষিত হয়েছে। [দেখুনঃ(আরবি***************)] ইবনুল মুনযির প্রমুখ যে দলিলটির উল্লেখ করেছেন, তা-ই হচ্ছে এই ঐকমত্যের সনদ। আর তা হচ্ছেঃ এদেরকে যাকাত দিলে তা তাদেরকে তার খরচ বহন থেকে নিষ্কৃতি দান করবে, এই দায়িত্ব তার ওপর থেকে সরিয়ে দেবে। তার ফায়দাটা তার নিজের প্রতিই প্রত্যাবর্তিত হবে। মনে হবে, যকাতটা নিজেকেই দেয়া হয়েছে। আর তাতে যাকাত আদায় হয় না। ইবনুল সুনযির এ কথার ওপর ঐক্যমত্যের কথা বলেছেন যে, পিতামাতাকে যাকাত দেয়া জায়েয নয়। কেননা অবস্থা এরূপ যে, যাকাতদাতাকে তাদের যাবতীয় ব্যয়ভার বহনের জন্যে বাধ্য করা হবে। এই অবস্থাটা যদি বাস্তবায়িত না থাকে- সন্তান যদি অর্থনৈতিক সংকীর্ণতার মধ্যে পড়ে দরিদ্র না হয়, বরং সে নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়ে পড়ার দরুন যাকাত দেয়া তার জন্যে কর্তব্য হয়ে পড়ে, এরূপ অবস্থায় ইমাম নববী বলেছেন, সন্তান বা পিতামাতা যদি ফকীর বা মিসকীন হয়, কোন কোন অবস্থায় পিতামাতার খরচ বহন সন্তানের জন্যে ওয়াজিব না হয়, তাহলে তার পিতা-মাতা ও সন্তানের জন্যে ফকীর ও মিসকীনের জন্যে নির্দিষ্ট অংশ থেকে যাকাত দেয়া জায়েয হবে। কেননা এরূপ অবস্থায় সে নিঃসম্পর্ক ও দায়িত্বমুক্ত ব্যক্তি। [(আরবি***************)] ইমাম ইবনে তাইমিয়া বলেছেনঃ পিতামাতা ও তদূর্ধ্ব আত্মীয়কে যাকাত দেয়া জয়েয- নিচের দিকে সন্তানকে দেয়াও জায়েয- যদি তারা ‘ফকীর’ হয় এবং সে তাদের খরচ বহনে অক্ষম হয়ে পড়ে। এই কথার সমর্থনে যাকাত ব্যয়ের মৌল কারণ-দারিদ্র্য ও অভাবের দাবিকে তুলে ধরা হয়েছে। এ দাবি পূরণের পথে কোন শরীয়াতসম্মত প্রতিবন্ধক পাওয়া যায়নি। ইবনে তাইমিয়া বলেছেন, ইমাম আহমাদের দুটো কথার একটি হচ্ছে এই- মা যদি দরিদ্রা হয় এবং তার ছোট ছোট অক্ষম সন্তান থাকে যাদের ধন-মাল রয়েছে, যাকাত তাদের জন্যে ব্যয় করা হলে তাদের ক্ষতি সাধন করা হবে, তাহলে তাদের যাকাত থেকে মাকে অংশ দেয়া যাবে। [(আরবি***************)] স্ত্রীকে যাকাত দেয়া জায়েয নয় উপরে পিতামাতা ও সন্তানদের বিষয়ে যা বলা হয়েছে, স্ত্রী সম্পর্কেও সেই কথাই বলা চলে। এজন্যে ইবনুল মুনযির বলেছেনঃ বিশেষজ্ঞগণ একমত হয়ে বলেছেন, কোন ব্যক্তিই তার যাকাত তার স্ত্রীকে দেবে না। কেননা স্ত্রীর যাবতীয় ব্যয়ভার তো যাকাতদাতাকেই বহন করতে হবে। আর তা করা হলে স্ত্রীর পক্ষে যাকাতের মুখাপেক্ষী থাকার কারণ অবশিষ্ট থাকবে না। অতএব স্ত্রীকে যাকাত দেয়া জায়েয হতে পারে না। স্ত্রীর ভরণ-পোষণ ব্যয় বাবদ তা দেয়া হলেও তা জায়েয হবে না। তাতে যাকাত আদায় হবে না। তাছাড়া স্ত্রী তার স্বামীর সাথে এমন অভিন্নভাবে সম্পৃক্ত যে, স্ত্রী না যেন সে নিজে কিংবা তার অংশ। যেমন আল্লাহ বলেছেনঃ (আরবি***************) তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে এ-ও একটি যে, তিনি তোমাদের জন্যে তোমাদের মধ্য থেকেই জুড়ি সৃষ্টি করে দিয়েছেন। [(আরবি***************)] (স্বামী স্ত্রীর জন্যে জুড়ি, স্ত্রী স্বামীর জন্যে) তার স্বামীর ঘর তার নিজেরই ঘর। যেমন আল্লাহ বলেছেনঃ(আরবি***************) এবং তাদেরকে তাদের ঘর থেকে বহিষ্কৃত করো না। [(আরবি***************) তাদের ঘর অর্থ – তাদের স্বীয় ঘর।] এই ঘর বৈবাহিক সম্পর্কের ঘর স্বভাবতই স্বমীর মালিকানা সম্পদ। অন্যেরা বলেছেনঃ [(আরবি***************)] স্বামী তার যাকাত স্ত্রীর জন্যে ব্যয় কররে তা গণ্য হবে না- তাতে যাকাত আদায় হবে না। কেননা এরূপ অবস্থায় ডান হাতে দিয়ে বাম হাতে নিয়ে দেয়া ছাড়া প্রকৃতপক্ষে আর কিছুই হয় না। স্ত্রী কি তার দরিদ্র স্বামীকে যাকাত দিতে পারে মিসকীন ও দরিদ্র স্বামীকে স্ত্রীর নিজের সম্পদের যাকাত দেয়ার ব্যাপারে ইমাম আবূ হানীফা ও অন্য কয়েকজন ফিকাহবিদ মত দিয়েছেন যে, তা জায়েয নয়, কেননা স্বামী তার স্ত্রী থেকে ভিন্নতর ও বিছিন্ন কেউ নয়। যেমন ভিন্নতর ও বিছিন্ন কেউ নয় স্ত্রী স্বামী থেকে। আর এই উভয় ক্ষেত্রেই স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে এবং স্ত্রী কর্তৃক স্বামীকে যাকাত দান নিষিদ্ধ। কিন্তু স্বামীর দেয়াটাকে স্ত্রীর দেয়ার ওপর কিয়াস করা সহীহ হতে পারে না। বিবেক-বুদ্ধি ও বিচার – বিবেচনা উভয় দিক দিয়েই তা যেমন অযৌক্তিক, তেমনি হাদীস ও সাহাবীদের বক্তব্যের দিক দিয়েও। বিবেক-বুদ্ধি ও বিবেচনার দিক দিয়ে ইমাম আবূ উবাইদ যেমন বলেছেন- স্বামী তার স্ত্রীর ব্যয়ভার বহন করতে বাধ্য- স্ত্রী যদি সচ্ছল অবস্থার হয়, তবুও। আর স্ত্রীকে বাধ্য করা যায় না স্বামীর ব্যয়ভার বহন করতে সে যদি খুব কষ্টের মধ্যেও থাকে। তা হলে এ দুটোর মধ্যকার পার্থক্যের তুলনার কোনটি অতিশয় বড় কঠিন পার্থক্যের ব্যাপার হবে, তা আমাদের অবশ্যই খতিয়ে দেখতে হবে। ইবনে কুদামা জায়েয হওয়ার পন্থা বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে লিখেছেনঃ কেননা স্বামীর ব্যয়ভার বহনের দায়িত্ব স্ত্রীর ওপর বর্তায় না। কাজেই স্বামীকে স্ত্রীর যাকাত দেয়া নিষিদ্ধ হতে পারে না, যেমন নিষিদ্ধ নয় ভিন্নতর ও নিঃসম্পর্ক কোন পুরুষকে দেয়া। কিন্তু স্ত্রীকে যাকাত দেয়ার ব্যাপারটি সম্পূর্ণ আলাদা। কেননা তার ব্যয়ভার বহন করা স্বামীর কর্তব্য। আর মৌলিকতার দিক দিয়ে যাকাত দেয়াটা জায়েয, কেননা যাকাত পাওয়ার চিহ্নিত নামগুলো যেহেতু সাধারণ প্রয়োগযোগ্য, নিষেধ করার কোন অকাট্য দলিল নেই। এর ওপর কোন ইজমাও অনুষ্ঠিত হয়নি। আর যার ব্যাপারে নিষেধ প্রমাণিত, তার ওপর এই ব্যাপারটি কিয়াস করা সহীহ্ হতে পারে না। কেননা এ দুটোর মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান। অতএব দেয়া জায়েয হওয়াটা প্রমাণিত অবস্থায় বর্তমান থেকে গেল। [(আরবি***************) ] বর্ণিত দলিলাদির দিক দিয়ে উল্লেখ্য হচ্ছে ইমাম আহমাদ, বুখারী ও মুসলিমের আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদের স্ত্রী জয়নব থেকে বর্ণিত হাদীস। তিনি বললেনঃ রাসূলে করীম (সা) ইরশাদ করেছেনঃ ‘হে মহিলা সমাজ! তোমরা দান-সদকা কর, তোমাদের অলংকারাদি থেকে হলেও।’ তিনি বললেনঃ অতঃপর আমি ফিরে এসে আবদুল্লাহকে বললামঃ ‘তুমি তো খুব সংকীর্ণ হাতের (দারিদ্র্যপীড়িত) লোক। আর রাসূলে করীম (সা) আমাকে দান-সাদকা করার নির্দেশ দিয়েছেন। এখন তুমি তাঁর নিকট গিয়ে জানতে টেষ্টা কর (তোমাকে দিলে যাকাত আদায় হবে কিনা? যদি আমার যাকাত দেয়া হয়ে যায় তোমাকে দিলে তাহলে তোমাকেই দেব।) অন্যথায় আমি তা অন্য লোকদের দিয়ে দেব, বললেন। আবদুল্লাহ বললেনঃ তুমিও চল। বললেন, অতঃপর আমিও গেলাম। তখন তথায় দেখলাম রাসূলের ঘরের দ্বারদেশে একজন আনসার বংশীয় মহিলাও দাঁড়িয়ে আছে। তার প্রয়োজনও ঠিক আমারই মত। তখন নবী করীম (সা)-এর স্বাস্থ্যগত অবস্থা ভালো ছিল না বলে হযরত বিলাল (রা) আমাদের সম্মুখে উপস্থিত হলেন। আমরা তাঁকে বললামঃ তুমি রাসূলের নিকট গিয়ে খবর দাও, দুইজন মহিলা দরজায় দাঁড়িয়ে আপনার নিকট জানতে চাচ্ছে, তাদের স্বামীদেরকে এবং তাদের ক্রোড়ে লালিত ইয়াতীম সন্তানদেরকে যাকাত দিলে তা তাদের পক্ষ থেকে আদায় হয়ে যাবে কি না?........ কিন্তু আমরা কারা, তা তাঁকে বলো না।...... পরে বিলাল ঘরে প্রবেশ করে রসূলের নিকট উক্ত বিষয়ে জিজ্ঞেস করলেন। রাসূলে করীম (সা) জিজ্ঞেস করলেন, কে কে এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করছে? তিনি বললেনঃ আনসার বংশের মহিলা একজন আর অপরজন জয়নব। রসূলে করীম (সা) জিজ্ঞেস করলেন, কোন্ জয়নব? বললেন, আবদুল্লাহর স্ত্রী। তখন নবী করীম (সা) বললেনঃ এই দুজনের জন্যে দুটো করে শুভ কর্মফল। একটি হচ্ছে নৈকট্য রক্ষার শুভ কর্মফল আর অপরটি হচ্ছে দানের।’ হাদীসটি আহমাদ ও বুখারী, মুসলিম কর্তৃক উদ্ধৃত। বুখারী উদ্ধৃত ভাষায় প্রশ্নটি ছিলঃ আমরা স্বামীর জন্যে এবং আমার ক্রোড়ে লালিত ইয়াতীমদের জন্যে ব্যয় করলে আমার যাকাত আদায় হয়ে যাবে কি? [দেখুনঃ (আরবি***************)] ইমাম শাওকানী বলেছেন, এই হাদীসটিকে দলিল হিসেবে গ্রহণ করে বলা হয়েছে, স্ত্রী তার স্বামীকে যাকাত দিলে তার থেকে তা আদায় হয়ে যাবে- তার জন্যে এই দেয়া সম্পূর্ণ জায়েয। সওরী, শাফেয়ী, আবূ হানীফার দুই সঙ্গী এবং মালিক ও আহমাদ থেকে পাওয়া দুটো বর্ণনার একটি উক্ত মতের সমর্থন রয়েছে। হাদী, নাসের, মুয়াইয়্যিদ বিল্লাহও এই মত দিয়েছেন। দলিল হিসেবে তা সম্পূর্ণতা পায় যদি ধরে দেয়া হয় যে, এখানে ফরয সাদকা বা যাকাতের কথা বলা হয়েছে। মাজেরী এ কথা দৃঢ়তা সহকারে বলেছেন। মহিলা দুইজনের প্রশ্নঃ ‘আমার দিক থেকে আদায় হবে কি?’ থেকেও উক্ত কথার সমর্থন মেলে। অন্যরা এ হাদীসটি থেকে বুঝেছেন যে, এটা নফল দান-সাদকার কথা, সেই প্রসঙ্গেই প্রশ্ন, ফরয যাকাত সম্পর্কে নয়। রাসূলের কথা, তোমাদের অলংকারাদি থেকে হলেও’ তার প্রামাণ। ‘আমাদের দিক থেকে আদায় হবে কি’ প্রশ্নের ব্যাখ্যা এরা করেছেন এই অর্থেঃ ‘এ দান আমাদের জাহান্নাম থেকে রক্ষা করবে কি’ অর্থাৎ মহিলাটি ভয় করেছিলেন, তার স্বামীকে দানটা দিয়ে দিলে সওয়াব লাভ করার লক্ষ্য হাসিল হবে কি, আযাব থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে কি?...... সেজন্যেই এই প্রশ্ন করেছিলেন। শাওকানী এ বিষয়ে লিখেছেন, বাহ্যত স্ত্রীর যাকাত স্বামীকে দেয়া জায়েয হতে পারে বলে মনে হয়। প্রথমত এজন্যে যে, তার নিষেধকারী কিছু নেই। যে বলেছে যে, জায়েয নেই, তার প্রমাণ তাকেই ‍দিতে হবে। দ্বিতীয়ত প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে নবী করীম (স) কোন বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদ করেন নি বলে ব্যাপারটি সাধারণ ও সার্বজনীন পর্যায়ে পড়ে গেছে। সাদকাটা নফল না ফরয ওয়াজিব, তা যখন তিনি জিজ্ঞেস করেন নি, তখন মনে হচ্ছে, তিনি বলেছিলেনঃ হ্যাঁ, স্বামীকে দিলে তোমার তরফ থেকে আদায় হয়ে যাবে- তা ফরয সাদকা হোক, কি নফল। [দেখুন (আরবি***************)] অন্যান্য নিকটাত্মীয়দের যাকাত দানঃ নিষেধকারী ও অনুমতিদানকারী ভাই, বোন, চাচা, ফুফা-ফুফী ও খালা-খালু প্রভৃতি নিকটাত্মীয়কে যাকাত দেয়া যাবে কিনা সে পর্যায়ে ফিকাহবিদগণ বিভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। কেউ বলেছেন, জায়েয হবে। অন্যরা বলেছেন, তা না, হবে না। এভাবে বহু বিরাট মতবিরোধ। এদের মধ্যে কেউ উক্ত আত্মীয়দের সকলকেই দেয়া জায়েয বলেছেন। আর অন্যরা এদের সকলকেই দিতে নিষেধ করেছেন। কিছু ফিকাহবিদ কোন কোন নিকটাত্মীয়কে দিতে পারা যায় বলেছেন, অন্যদের দিতে নিষেধ করে মত দিয়েছেন। যাঁরা নিষেধ করেছেন, তাঁরাও নিষেধের ভিত্তি নির্ধারণে বিভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। তাঁদের কেউ কেউ নিকটাত্মীয়কে পরিবারের সাথে বাস্তবভাবে যুক্ত দেখতে পেয়েছেন। তাই যতক্ষণ তারা পরিবারবরর্গের সাথে মিলে-মিশে থাকবে, ততদিন সে তার স্ত্রী ও সন্তানদের পর্যায়ভুক্ত হবে। এরূপ অবস্থায় তাকে যাকাত দেয়া জায়েয হবে না। এদের কেউ কেউ এমন, যাঁরা মনে করেন যে, প্রশাসক স্ত্রীর ব্যয়ভার বহনের জন্যে তাকে বাধ্য করতে পারে। তাই যতক্ষণ এরূপ কোন আদালতি নির্দেশ জারি না হচ্ছে যা তার নিকটবর্তী ব্যক্তির খরচ বহনে তাকে বাধ্য করবে, ততক্ষণ তার যাকাত তাকে দেয়া জায়েয হবে। এদের কেউ কেউ মনে করেছেন, শরীয়াত অনুযায়ীই তার খরচ বহন বাধ্যতামূলক, তাই তাদেরকে যাকাত দেয়া জায়েয হবে না। কেননা শরীয়াতই তাদের খরচ বহনের জন্যে যাকাতদাতাকে বাধ্য করছে। আর যার খরচ বহন শরীয়াত অনুযায়ী বাধ্যতামূলক নয়, তাকে দেয়া যেতে পারে। এই মতের লোকেরা যে নিকটবর্তী ব্যক্তির খরচাদি বহন বাধ্যতামূলক তাকে যাকাত দেয়া জায়েয হবে কিনা, সে বিষয়ে বিভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। আবূ উবাইদা তার সনদে ইবরাহীম ইবনে আবূ হাফসা থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেনঃ আমি মায়ীদ ইবনে জুবাইরকে জিজ্ঞেস করেছিলামঃ আমি আমার খালাকে যাকাত দেব কি না? জবাবে বললেন, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই দেবে, যতক্ষণ পর্যন্ত তুমি তার জন্যে দ্বার রুদ্ধ করে না দেবে [দেখুনঃ (আরবি***************)] অর্থাৎ যতক্ষণ পর্যন্ত তাকে তার নিজের পরিবার ও সন্তানাদির সাথে মিলিয়ে একাকার করে না নিচ্ছে, ততক্ষণ তা জায়েয। হাসান থেকে বর্ণনা করা হয়েছে, তিনি বলেছেনঃ যাকাতদাতা ব্যক্তি তার যাকাত তার নিকটাত্মীয় লোকদের দেবে যতক্ষণ পর্যন্ত সেন তার পরিবারবর্গের মধ্যে গণ্য না হচ্ছে। [(আরবি***************)] আতা বলেছেন, ব্যক্তির নিকটাত্মীয় যদি তার পরিবারবর্গের অন্তর্ভুক্ত না হয় যার ব্যয়ভার সে বহন করছে, তাহলে সে বা তারা অন্যদের তুলনায় তার যাকাত পাওয়ার অধিক বেশি অধিকার সম্পন্ন- যদি তারা ফকীর হয়। [(আরবি***************)] ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণনা এসেছে, তিনি বলেছেনঃ তোমার ভরণ-পোষণের আওতাভুক্ত কোন লোককে যাকাত না দিলে তোমার কোন দোষ নেই। [(আরবি***************)] কোন কোন বিশেষজ্ঞের এটাই মত। তাঁরা দেখেছেন, নিকটাত্মীয়কে পরিবারবর্গের মধ্যে শামিল করা হয়েছে কি হয়নি। যদি হয়ে থাকে, তাহলে তাকে যাকাত দেয়া জায়েয নয় বলে মত দিয়েছেন। কিন্তু শরীয়াত অনুযায়ী তার খরচ বহন বাধ্যতামূলক কিনা সেদিকে বা অন্য দিকে তারা নজর দেন নি। আবূ উবাইদা আবদুল্লাহ ইবনে দাউদ থেকে অপর একটি মত উদ্ধৃত করেছেন। তিনি বলেছেনঃ নিকটাত্মীয়দের যাকাত দেয়া অপসন্দনীয় হবে যদি সরকার যাকাতদাতাকে তাদের খরচ বহনের জন্যে বাধ্য করে। যতক্ষণ বাধ্য করা হবে না, ততক্ষণ তাদের যাকাত দেয়ায় কোন দোষ নেই। [(আরবি***************)] আবূ উবাদইদা নিজে বলেছেনঃ উক্ত মতটি আবদুর রহমান ও ইবনে দাঊদের ব্যাখ্যার ফলশ্রুতি। এ দুটো স্বতন্ত্র অভিমত, যারা তা চাইবে- অনুসরণ করবে। [(আরবি***************)] এই সব মত ও রায়ের মধ্যে প্রসিদ্ধ মতটি হচ্ছে তার, যিনি যাকাত দেয়া নিষেধের ভিত্তি বানিয়েছেন শরীয়াত অনুযায়ী খরচ বহনের বাধ্যতাকে, তাই শরীয়াত অনুযায়ী যে নিকটাত্মীয়ের খরচ বহন ওয়জিব, তাকে যাকাত দেয়া জায়েয নয়। তাঁরা এর দুটো কারণ বলেছেন। একটি এই যে, সে ধনী বলে তার কিছু ফায়দা দাতার ভাগেই আসে এবং খরচ বহনের দায়িত্ব বাতিল হয়ে যায়। [দেখুনঃ (আরবি***************)] এটাই হচ্ছে ইমাম মালিক ও শাফেয়ীর মত। ইমাম আহমাদ থেকেও একটি বর্ণনা এই মর্মে এসেছে। জায়দ ইবনে আলী, আল-হাদী কাসেম, নাসের ও মুয়াইয়্যিদ বিল্লাহর অভিমতও এই। কোন্ নিকটাত্মীয়ের ব্যয়ভার বহন বাধ্যতামূলক, তা নির্ধারণে তাদের বিভিন্ন মত রয়েছে। জায়েদ ইবনে আলী ও আহমাদ ইবনে হাম্বল থেকে বর্ণিত, যে লোক যার উত্তরাধিকারী তার খরচ বহন তারই ওপর বর্তায়। ইমাম জায়েদ আরো বলেছেনঃ রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকার কর্তৃক যাকে খরচ বহনের দায়িত্ব অর্পণ করা হবে তাকে যাকাত দেয়া যাবে না। প্রশ্ন হয়েছেঃ বলেছেনঃ রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকার কার খারচাদি বহনের কথা বলবেন? জবাবে বলেছেনঃ তার সব কয়জন উত্তরাধিকারীর খরচাদি। [(আরবি***************)] ইমাম শাফেয়ী ব্যক্তির মূলের দিকের- তা যত উচ্চেই উঠুক এবং শিকড়ের দিক- তা যত নিচেই হোক- আত্মীয়দের খরচ বহন ওয়াজিব মনে করেন। খরচাদি ওয়াজিবকরণে অধিক সংকীর্ণ মত হচ্ছে ইমাম মালিকের। তাঁর মতে তার ঔরসজাত পুরুষ সন্তানের জন্যে তার মূলের দিকে পিতার খরচ জরুরী- ওয়াজিব যতক্ষণ তারা পূর্ণ বয়ষ্ক হয়ে উঠতে না পারছে। [শায়খ আলীশ মালিকীকে একজন পূর্ণ বয়ষ্ক ও উপার্জনক্ষম শিক্ষার্থী সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তার বাবাকে যাকাত দিলে তা আদায় হয়ে যাবে কি? জবাবে বলেছিলেন, হ্যা জায়েয। কেননা তার পূর্ণ বয়ষ্ক ও উপার্জনক্ষম হওয়ার দরুন সে দায়িত্ব শেষ হয়ে গেছে। আর বিদ্যার্জনে মশগুল থাকার কারণে সে যাকাত পেতে পারে। (আরবি***************)] আর এমন মেয়েদেরও, যতক্ষণ তাদের বিয়ে না হচ্ছে। তাদের স্বামীরাও এদের মধ্যে গণ্য। তবে সন্তানের সন্তানের কথা ভিন্নতর। তাদের খরচ বহনদাতার কর্তব্যভুক্ত নয়। যেমন নাতিদের কর্তব্য নয় দাদার খরচ বহন। সন্তানের তার দরিদ্র- ফকীর পিতামাতার খরচ বাধ্যতামূলক, যেমন স্বামীর জন্যে তার স্ত্রীর ও তার স্ত্রীর ও তার একজন সেবকের খরচ বহন করা বাধ্যতামূলক। ভাইবোন ও অপর নিকটাত্মীয় ও মুহররম ব্যক্তি সম্পর্কিত আত্মীয়ের। [(আরবি***************)] খরচ বহন কারুর জন্যে বাধ্যতামূলক নয়। [ঐ. পৃ. ২৫৪।] এক্ষণে সেই লোকের পিতা-মাতা ও সন্তান এই নিকটাত্মীয় ব্যতীত অন্যান্য নিকটাত্মীয়ের যাকাত জায়েয- যেমন ইমাম মালিকের মত। নিকটাত্মীয়দের যাকাত দেয়া জায়েয বলেছেন যাঁরা অন্যান্য আলিম নিকটাত্মীয়দের যাকাত দেয়া জায়েয বলেছেন পিতা-মাতা ও সন্তানদের ছাড়া। তাদের কেউ কেউ ভিত্তি করেছেন এই কথার ওপর যে, নিকটাত্মীয়ের যাবতীয় ব্যয়ভার বহনের দায়িত্ব পালন শুধু একটা সদাচরণ ও আত্মীয়তা রক্ষার মহান ব্রত মাত্র। এটা কারুর ওপর চাপিয়ে দেয়া যায় না, কাউকে তা করার জন্যে বাধ্য করা যায় না, মজবুর করা যায় না অথচ তাদেরই অনেকেই মনে করেছে, এটা একান্তই পালনীয় ওয়াজিব। এতদসত্ত্বেও তারা নিকটাহত্মীয়কে যাকাত দেয়ায় কোন প্রতিবন্ধকতা আছে বলে মনে করেন না। ইমাম আবূ হানীফা, তার সঙ্গিগণ এবং ইমাম ইয়াহইয়া এই মত প্রকাশ করেছেন। ইমাম আহমাদ থেকে বাহ্যিক বর্ণনাও এরূপ। ইবনে কুদামাহ বলেছেন, এই বর্ণনাটি বহুসংখ্যক মুহাদ্দিস কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে। বলেছেন, ইসহাক ইবনে ইবরাহীম ও ইসহাক ইবনে মনসুরের বর্ণনায় এই কথা রয়েছেঃ তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন ভাই, বোন ও খালাকে যাকাত দেয়া যাবে? জবাবে বললেনঃ পিতামাতা ও সন্তানাদি ছাড়া আর সব নিকটাত্মীয়কেই দেয়া যাবে। এটাই অধিকাংশ আলিমের মত। আবূ উবাইদ বলেছেন, আমারও সেই কথা। কেননা নবী করীম (সা) বলেছেনঃ (আরবি***************) দান মিসকীনকে দিলে হয় দান আর রক্ত সম্পর্কের আত্মীয়কে দিলে তা যেমন দান, তেমনি তা আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষাও। [আবূ দাঊদ ছাড়া অপর পাঁচখানি হাদীস গ্রন্থে উদ্ধৃত।] এখানে নফল বা ফরয-কোন কিছুরই শর্ত করা হয়নি। উত্তরাধিকারী ও অপরদের মধ্যেও কোন পার্থক্য রাখা হয়নি। কেননা এরা বংশের মূল কাঠামোর সাথে সম্পর্কিত নয়। ফলে অনাত্মীয় লোকদের মত হয়ে গেছে। [(আরবি***************)] ইবনে আবূ শায়বা ও আবূ উবাইদা একদল সাহাবী ও তাবেয়ীন থেকে এই বর্ণনাটি উদ্ধৃত করেছেন। ইবনে আব্বাসের বর্ণনায় তিনি বলেছেনঃ নিকটাত্মীয়রা অভাবগ্রস্ত হলে তাকে যাকাত দেবে।’ ইবরাহীম থেকে বর্ণিত, ইবনে মাসউদের স্ত্রী তার অলংকারের যাকাত সম্পর্কে তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন- তিনি অলংকারের যাকাত দিতে হয় বলে মনে করতেন- আমার ক্রোড়ে আমার ভাইয়ের ইয়াতীমরা লালিত, আমার যাকাত তাদের দেব? তিনি বলেছিলেনঃ হ্যাঁ। সায়ীদ ইবনুল মুসাইয়্যিব বলেছেনঃ আমার ইয়াতীম ও আমার নিকটাত্মীয়রাই আমার যাকাত পাওয়ার সবচাইতে বেশি অধিকারী। হাসানকে জিজ্ঞাসা করেছিলঃ আমার ভাইকে আমার যাকাত দেব? বললেনঃ হ্যাঁ, নিশ্চয়ই, ভালোবেসে দেবে। ইবরাহীমকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলঃ একজন মেয়েলোকের সম্পদ আছে। সে তার যাকাত তার বোনকে দেবে কি? বললেনঃ হ্যাঁ। দহহাক থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেনঃ তোমার নিকটাত্মীয়রা গরীব হয়ে থাকলে অন্যদের অপেক্ষা তারাই তোমার যাকাত পাওয়ার বেশি অধিকারী। মুজাহিদ থেকে কর্ণিত, বলেছেনঃ গ্রহণ করা হবে না এরূপ অবস্থায় যে, তার রক্ত সম্পর্ক তার মুখাপেক্ষী। [এসব উক্তি ‘মুসান্নাফ ইবনে আবূ শায়বা’ গ্রন্থের ৪র্থ খণ্ডের ৪৭-৪৮ পৃষ্ঠায় (আরবি***************) গন্থের ৫৮১-৫৮২ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য।] তুলনা ও অগ্রাধিকার দান উপরে যে বিভিন্ন মত ও উক্তি উদ্ধৃত হয়েছে আমি তার মধ্যে অগ্রাধিকার দিচ্ছি সাহাবী, তাবেয়ীন ও তৎপরবর্তীকালের অধিক সংখ্যক আলিম সে মত দিয়েছেন, সেটিকে। আর তা হচ্ছে, পিতামাতা ও সন্তান ছাড়া অন্যান্য সব নিকটাত্মীয়কেই যাকাত দেয়া জায়েয হবে। ইমাম আবূ উবাইদাও তাঁর (আরবি***************) গ্রন্থে এই মতকেই তারজীহ্ দিয়েছেন। এ ব্যাপারে আমাদের দলিল হচ্ছেঃ প্রথমত যে সব শরীয়াতী দলিল যাকাতকে সাধারণভাবে ফকীর মিসকীনদের জন্যে নির্দিষ্ট করেছে, তাতে নিকটাত্মীয় ও অনাত্মীয়ের মধ্যে কোন তারতম্য করা হয়নি। যেমন যাকাতের মূল আয়াতঃ ‘সাদকাত কেবলমাত্র ফকীর ও মিসকীনের জন্যে’। হাদীসেও বলা হয়েছেঃ তাঁদের ধনীদের নিকট থেকে তা দেয়া হবে এবং তাদেরই ফকীরদের মধ্যে তা বণ্টন করা হবে।’ এই সাধারণ তাৎপর্যসম্পন্ন ঘোষণাবলী সব নিকটাত্মীয়কেও শামিল করে। তাদেরকে এই সাধারণ অধিকারের বাইরে নিয়ে যাওয়ার মত কোন তারতম্যধর্মী দলিল একটিও নেই। তবে স্ত্রী, পিতামাতা ও সন্তানদের কথা স্বতন্ত্র। এদেরকে এই সাধারণ অধিকার থেকে বাইরে গণ্য করে ইজমা। ইবনুল মুনযির, আবূ উবাইদ ও ‘বাহারিযুখনার’ গ্রন্থ প্রণেতাগণ এই ইজমার কথা উল্লেখ করেছেন নিজ নিজ গ্রন্থে। এ ছাড়া আরও দলিল-প্রমাণ রয়েছে। যথাস্থানে আমরা সে সবের উল্লেখ করেছি। দ্বিতীয়ঃ যেসব দলিলে বিশেষভাবে নিকটাত্মীয়দের প্রতি সাদকা দানের উৎসাহ দেয়া হয়েছে- যেমন রাসূলে করীম (সা)-এর কথা মিসকীনকে সাদকা দিলে তা একটা সাদকাই হয়। আর রক্ত সম্পর্কশীল আত্মীয়কে দিলে তা সাদকা ও আত্মীয়তা রক্ষা উভয়ই হয়। [হাদীসটি আহমাদ, নাসায়ী, তিরমিযী, ইবনে হাব্বান, হাকেম, দারে কুতনী উদ্ধৃত করেছেন। তিরমিযী হাদীসটিকে হাসান বলেছেন। (আরবি***************)] ‘সাদকা’ যাকাত বোঝায়- যেমন পূর্বে বলা হয়েছে। নবী করীম (সা)-এর আর একটি বাণীঃ (আরবি***************) নিকটাত্মীয়কে দান করার উত্তম দিক হচ্ছে তোমার শত্রুতা গোপনকারী। [হাদীসটি আহমাদ ও তাবারানী কর্তৃক আবূ আইউব থেকে এবং এ দুজনই হাকীম ইবনে হেজাম থেকে বর্ণিত হয়েছে। (আরবি***************) এ-ও তা উদ্ধৃত হয়েছে। বলেছেনঃ এর সনদ হাসান। অনুরূপভাবে তাবারানী উদ্ধৃত করেছেন (আরবি***************) গ্রন্থে উম্মে কুলসুম বিনতে আকাবা থেকে। এর বর্ণনাকারিগণ নির্ভরযোগ্য। (আরবি***************)] অনুরূপভাবে তাবারানী ও বাজ্জার আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ থেকে বর্ণনা করেছেন ( পূর্বে উদ্ধৃত হাদীসটির অংশ- যা বুখারী, মুসলিম ও আহমাদ উদ্ধৃত করেছেনঃ) তার স্ত্রী বিলালকে বললেনঃ দুই মুহাজির মহিলার পক্ষ থেকে রাসূলে করীমকে সালাম বল। কিন্তু আমাদের পরিচিতি প্রকাশ করো না। তাকে বলঃ তার স্বামী নিঃস্ব এবং তার ক্রোড়ে পালিত তার ভাইয়ের ঐরসজাত সন্তান ইয়াতীমদের জন্যে তার যাকাত ব্যয় করলে সে কি শুভ ফল পাবে? অতঃপর বিলাল নবী করীমের নিকট উপস্থিত হয়ে জিজ্ঞাসা করায় তিনি বলরেনঃ হ্যা, তার জন্যে দ্বিগুণ শুভ ফল। একটা হল নিকটাত্মীয়তার আর একটা দানের সওয়াব। [হাদীসটি তাবারানী (আরবি***************) গ্রন্থে উদ্ধৃত করেছেন, বাজ্জারও অনুরূপ বর্ণনা তুলেছেন। একজন বর্ণনাকারী হাজ্জাজ ইবনে নছর, ইবনে হাব্বান প্রমুখ তাকে সিকাহ’ বলেছেন: কিন্তু তার সম্পর্কে আপত্তি আছে। বাজ্জারের বর্ণনাকারিগণ সহীহ্। দেখুনঃ (আরবি***************) সহীহ্ ইবনে হাব্বানেও উদ্ধৃত হয়েছে। দেখুনঃ (আরবি***************) ] আমরা বলেছি, কোনরূপ বিস্তারিত কথা জিজ্ঞাসা না করাটা এই সম্ভাব্যতা আনে যে, কথার তাৎপর্য হচ্ছে সাধারণ নির্বিশেষ। ইলমে উসূলের বিশেষজ্ঞগণ এই তত্ত্ব উপস্থাপিত করেছেন। তাঁদের কথা- ‘নিকটাত্মীয়দের দিলে তার ফায়দাটা তার নিজেরই হয়, এবং তার নিজের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব ছুটে যায়, এ কথাটি স্ত্রী, সন্তান ও পিতামাতার ক্ষেত্রে খুবই সত্য ও প্রযোজ্য। কেননা তাদের ফায়দা মিরিত অবিভাজ্য। তারা সকলেই তার মালে সমানভাবে শরীক। এদের ব্যয়ভার বহন তার জন্যে ওয়াজিব এবং তা কুরআন ও সুন্নাহ থেকে প্রমাণিত। অন্যান্য নিকটাত্মীয়ের ব্যাপারে- আমি যা মনে করি, তাদের ব্যয়ভার বহন নিকটাত্মীয়ের জন্যে বাধ্যতামূলক হয় যদি তথায় মুসলমানদের ধন-মালে তাদের জন্যে যথেষ্ট পরিমাণ সম্পদ না থাকে। আর যাকাত, ফাই, এক-পঞ্চমাংশও বায়তুলমালের অন্যান্য আয় উৎস। এগুলোর দ্বারা ব্যবস্থা করা না হলে তখন সচ্ছল অবস্থার নিকটাত্মীয়কে ক্ষুধা-বস্ত্রহীনতার মধ্যে পড়ে মরে যেতে দিতে পারে না। অনুরূপভাবে সরকার যদি যাকাত সংগ্রহকারী ও দরিদ্র জনগণের জীবিকার নিরাপত্তা দানকারী না হয়, তখন ধনী নিকটাত্মীয়ের কর্তব্য হয় তার নিকটাত্মীয় দরিদ্র ব্যক্তির ভরণ-পোষণের দায়িত্ব পালন করা। অভাব-অনটনে জর্জরিত হয়ে মরতে দিতে পারে না সে। এই নিরাপত্তা দান সম্পূর্ণ মাত্রায় কার্যকর হোক, কি আংশিক, তার জন্যে যাকাত দ্বারা এই ব্যবস্থা গ্রহণ করায় কোন দোষ নেই। কেননা নিকটাত্মীয়ের নিরাপত্তা দান, তার প্রয়োজন পূরণ ও তার দুঃখ বিদূরণই ওয়াজিব। এটা আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষার্থে এবং তার অধিকার আদায়স্বরূপ। আর এই নিরাপত্তা ব্যবস্থা চালু করার জন্যে যাকাতকে একটা আয়রূপে গণ্য করার পথে প্রতিবন্ধক কোন দলিল পাওয়া যায়নি। সরকার যদি এই যাকাত সংগ্রহ করত তাহলে এই সব দরিদ্র ব্যক্তির ব্যয়ভার যাকাতের আয় থেকেই বহন করা সম্ভব হত। তাই এরূপ অবস্থায় যখন এরূপ সরকার নেই- একজন মুসলিম ব্যক্তি রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রপ্রধানের প্রতিনিধি হিসেবে তার নিকটাত্মীয়দের জন্যে এই নিরাপত্তার ব্যবস্থা গ্রহণ করবে- করবে সেই যাকাত দিয়েই, যা দিয়ে রাষ্ট্রেরই কর্তব্য ছিল তা সংগ্রহ ও বন্টন করে এই ব্যবস্থা কার্যকর করা। তবে এমন আলিমও রয়েছেন, যারা নিকটাত্মীয়ের ব্যয়ভার পালনের বাধ্যবাধকতা এবং তাকে যাকাত দেয়ার মধ্যে কোন বৈপরীত্য আছে বলে মনে করেন না। তাঁরা বলেছেন, নিকটাত্মীয়দের ব্যয়ভার বহন করা বিশেষ কয়েকটি শর্তের ভিত্তিতে ওয়াজিব। তা সত্ত্বেও তাদেরকে যাকাত দেয়া তাঁরা জায়েয বলেছেন। এটা ইমাম আবূ হানীফা ও তাঁর সঙ্গিগণের অভিমত। তাঁরা চিন্তা করেছেন, ব্যয়ভার বহন বাধ্যতামূলক হলেও তা যাকাত দেবার প্রতিবন্ধক নয়। যাকাত দেবার প্রতিবন্ধক হচ্ছে দাতা ও গ্রহীতার মধ্যে ফায়দার মালিকানার ক্ষেত্রে অংশীদারিত্ব। এরূপ অবস্থায় ‘মালিক বানিয়ে দেয়া’ তাদের মতে যাকাতের যে-রুকন, এই অবস্থাটা দাতা ও তার সন্তান পিতামাতার মধ্যে সংঘটিত হয়, তা ছাড়া অন্য কোনখানে তা ঘটে না। এই কারণেই তাদের পরস্পরের পক্ষে পরস্পরে সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয় না। কিন্তু অন্য নিকটাত্মীয়দের বেলায় তা নয়। তাদেরকে যাকাত দিলে সেখানে ‘তামলীক’ হতে পারে। কেননা সেক্ষেত্রে যাকাতের ফায়দাটা পারস্পরিক শরীকানায় থাকে না, সেটা ছিন্ন হয়ে যায়। আর এ কারণে তাদের পারস্পরিক সাক্ষ্যদানও বৈধ বলে স্বীকৃত হয়। [ দেখুন (আরবি***************)] ‘রওজুন্ নজীর’ গ্রন্থ প্রণেতা শেষ দিকের জায়দীয়া ফিকার ফিকাহবিদ। তিনি বলেছেনঃ ‘আলিমগণ যে কারণ দেখিয়েছেন যে, নিকটাত্মীয়কে যাকাত দিরে তাতে ভবিষ্যতের যে ব্যয়ভার বহন তর দায়িত্ব, তা প্রত্যাহৃত হয়ে যায়। তাই নিকটাত্মীয়দের সাদকা দানের ব্যাপারে হাদীসসমূহে যে উৎসাহ দান করা হয়েছে তার সাথে সাংঘর্ষিক হওয়ার দরুন তা গহণ যোগ্য নয়। কেননা বাধা হচ্ছে, বলা যাবে যে, নিকটাত্মীয়ের খরচ বহনও ওয়াজিব- তাকে যাকাত দিলে তা বিন্দুমাত্র নষ্ট হয়ে যায় না। কেননা নিকটাত্মীয় কর্তৃক নিকটাত্মীয়ের খরচ বহনের ব্যাপারটি কখনও কখনও ওয়াজিব হয়, স্থায়ীভাবে তো নয়। [(আরবি***************)] ইমাম শাওকানী বলেছেন, আসল কথা হচ্ছে, কোনই প্রতিবন্ধকতা নেই। যে লোক মনে করেন, নিকটাত্মীয়তা কিংবা ব্যয়ভার বহন ওয়াজিব হওয়া দুটিই প্রতিবন্ধক, তার স্বপক্ষে দলিল পেশ করা তারই কর্তব্য। কিন্তু আসলে তেমন কোন দলিল-ই নেই। [(আরবি***************)] পঞ্চম আলোচনা মুহাম্মদ (স)-এর বংশ পরিবার যেসব হাদীস মুহাম্মদ (স)-এর বংশ-পরিবারের জন্যে যাকাত হারাম বলে আহমাদ ও মুসলিম মুত্তালিব ইবনে রবীয়াতা ইবনুল হারিস ইবনে আবদুল মুত্তালিব থেকে বর্ণনা করেছেনঃ তিনি এবং ইবনে আব্বাস পুত্র ফযল একসাথে রাসূল করীমের নিকট উপস্থিত হলেন। পরে আমাদের একজন কথা বলতে গিয়ে বললেনঃ ‘হে রাসূল! আমরা আপনার নিকট এসেছি এই উদ্দেশ্যে যে, আপনি আমাদেরকে এ সব যাকাত-সাদকাতের ব্যাপারে দায়িত্বশীল নিযুক্ত করবেন। তাহলে তা থেকে অন্যরা যেমন ফায়দা পাচ্ছে, আমরাও তেমনি তার ফায়দা পেতে পারব। লোকেরা যেমন আপনার নিকট যাকাতের মাল পৌঁছিয়ে দেয়, আমরাও তেমনি পৌঁছিয়ে দেব। তখন নবী করীম (সা) বললেনঃ(আরবি***************) সাদকা-যাকাত মুহাম্মাদ ও মুহাম্মাদের বংশ পরিবারের লোকদের জন্যে বাঞ্ছনীয় নয়। কেননা তা লোকদের ময়লা আবর্জনা ছাড়া আর কিছুই নয়। অপর বর্ণনার ভাষা হচ্ছেঃ (আরবি***************) মুহাম্মাদ ও মুহাম্মাদের বংশ-পরিবারের লোকদের জন্যে যাকাত হালাল নয়। ‘মুন্তাকা’ গ্রন্থে এই হাদীস উদ্ধৃত হয়েছে। [(আরবি***************)] আবূ দাঊদ ও তিরমিযী আবূ রাফে থেকে বর্ণনা করেছেন (তিরমিযী হাদীসটিকে বলেছেন সহীহ্) বলেছেন রাসূলে করীম (সা) বনু মাখজুম গোত্রের এক ব্যক্তিকে সাদকা-যাকাত সংগ্রহের কাজে নিযুক্ত করেছেলেন। পরে সেই ব্যক্তি আবূ রাফেকে বললেঃ তুমি আমাকে অনুসরণ কর, তাহলে তুমিও তা থেকে পাবে। আমি বললামঃ আমি নিজেই রাসূলের নিকট প্রার্থনা করব, তাই করলামও। তখন তিনি আমাকে বললেনঃ (আরবি***************) জনগণের মুক্ত দাস তদের নিজেদের মধ্যেই গণ্য হয়। আর আমরা আহলি বাইতের লোক। আমাদের জন্যে সাদকা-যাকাত হালাল হয় না। [দেখুনঃ (আরবি***************)] আবূ রাফে রাসূলে করীমের মুক্ত দাস ছিলেন। ইমাম বুখারী (আরবি***************) অধ্যায়ে হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বর্ণিত হাদীস উদ্ধৃত করেছেন। তিনি বলেছেনঃ হযরত আলীর পুত্র হাসান যাকাতের খেজুর থেকে একটি খেজুর ধরে মুখে পুরেছিলেন ( তিনি বালক বা শিশু ছিলেন) তখন নবী করীম (সা) বললেনঃ এ্যা, এ্যা, কি করছ?......... যেন তিনি তা ফেলে দেন। পরে বললেনঃ (আরবি***************) তুমি কি বুঝতে পারনি, আমরা তো যাকাত খাই না? হাদীসটি মুসলিমও উদ্ধত করেছেন। হাফেয ইবনে হাজার বলেছেন, মুসলিমের বর্ণনার ভাষা এইঃ (আরবি***************) আমাদের জন্যে যাকাত হালাল নয়। অপর বর্ণনা মা’মার থেকে। তাঁর ভাষাঃ (আরবি***************) সাদকা-যাকাত মুহাম্মাদের বংশধরদের জন্যে জায়েয নয়। ইমাম আহমাদ, তাহাভী হাসান ইবনে আলীর নিজের বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন। তিনি বলেছেনঃ (আরবি***************) আমি নবী করীম (সা) এর সঙ্গে ছিলাম। তখন যাকাতের খেজুরের দুটি বোঝা চলে এলো। আমি তার একটি ধরলাম ও সেটি মুখে নিক্ষেপ করলাম। নবী করীম (সা) তখনই সেটিকে মুখের পানিসহ ধরে ফেললেন। অতঃপর বললেনঃ মুহাম্মাদের বংশের লোকদের জন্যে যাকাত হালাল নয়। এই হাদীসটির সনদ খুব মজবুত। [(আরবি***************)] এ পর্যায়ে উল্লিখিত সমস্ত হাদীসই অকাট্যভাবে প্রমাণ করে যে, নবী করীম (সা) এবং তার বংশের লোকদের জন্যে যাকত হালাল নয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আলে মুহাম্মাদ’ – মুহাম্মাদের বংশের লোক’ কারা?.... কোন ধরনের সাদকা তাঁদের জন্যে হালাল নয়? এ ক্ষেত্রে খুব বেশি মতবিরোধ দেখা যায়। আমরা তা এখানে উল্লেখ করছি। শেষে আমাদের অভিমতও প্রকাশ করব, কেন মতটিকে আমরা অগ্রাধিকার দিচ্ছি তাও বলব। ‘আলে মুহাম্মাদ (স)’ কারা হাফেয ইবনুল হাজার ‘ফতহুল বারী’ গ্রন্থে এবং শাওকানী ‘নাইলুল আওতার’ গ্রন্থে ’আলে’ বলতে কি বোঝায় তার বিস্তারিত ব্যাখায় ফিকাহবিদদের মতপার্থক্যের উল্লেখ করেছেন। ইমাম শাফেয়ী ও বিপুল সংখ্যক আলিম বলেছেন, তারা হচ্ছে বনু হাশিম ও বনু-মুত্তালিব। ইমাম শাফেয়ীর এই মতের দলিল হচ্ছে, নবী করীম (সা) বনু মুত্তালিবকে বনু হাশিমের সাথে শরীক বানিয়েছেন নিকটাত্মীয়দের জন্যে নির্দিষ্ট অংশে। তাদের ছাড়া কুরাইশ বংশের অন্য কাউকে কিছু দেন নি। যে সাদকা দাতাদের প্রতি হারাম ঘোষণা করেছেন, তার বিকল্প ব্যবস্থা এই দানটা। বুখারী জুবাইর ইবনে মুতয়িম বর্ণিত হাদীসে এই কথাই দেখিয়েছেন। হাদীসটির বক্তব্য হচ্ছেঃ আমি ও উসমান ইবনে আফফান নবী করীম (সা)-এর নিকট গেলাম। এবং বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল। আপনি বনু-মুত্তালিবকে তো খায়বরের এক-পঞ্চমাংশ দিয়েছেন, কিন্তু আমাদের বাদ দিয়েছেন। অথচ আমরা ও তারা একই মর্যাদার লোক। তখন রাসূলে করীম (সা) বলরেনঃ (আরবি***************) বনু মুত্তালিব ও বনু হাশিম তো এক ও অভিন্ন জিনিস। এ কথার জবাব দেয়া হয়েছে এই বলে, তিনি তাদের তা দিয়েছেন তাদের সাথে আত্মীয়তার সম্পর্কের কারণে, যাকাতের বিকল্প হিসেবে নয়। আবূ হানীফা, মালিক ও সাদুইয়া বলেছেন, শুধু বনু হাশিমরাই হচ্ছে আলে মুহাম্মাদ। আহমাদ থেকে বনু মুত্তালিব সম্পর্কে দুটি বর্ণনা এসেছে। আর অন্যদের থেকে এসেছে, তারা হচ্ছে, বনু গালেব ইবনে ফহর। ‘ফতহুল বারী’ গ্রন্থে এরূপ বলা হয়েছে। ‘বনু হাশিম’ বরতে বোঝায়, আলী, আকীল, জাফর, আব্বাস ও আল-হারাম-এর বংশধররা। তার মধ্যে আবূ লাহাবের বংশধররা গণ্য নয়। কেননা এই বংশের লোকই রাসূলের জীবদ্দশায় ইসলাম কবুল করে নি। এই কথার প্রতিবাদ করে (আরবি***************) গ্রন্থে বলা হয়েছেঃ উৎবা ও মা’কাব নামে আবূ লাহাবের দুই পুত্র মক্কা বিজয়ের বৎসর ইসলাম কবুল করেছিল। নবী করীম (সা) তাদের ইসলাম কবুলের দরুন খুব আনন্দিত হয়েছেলেন। তাদের জন্যে তিনি দো’আও করেছিরেন। এরাই দুইজন রাসূলে করীম (সা) এর সঙ্গে হুনাইন ও তায়েফ যুদ্ধে শরীকও হয়েছিল। বংশাবিজ্ঞ লোকদের মতে এই দুজনের অনুসরণকারীও ছিল বহু লোক। ইবনে কুদামাহ্ লিখেছেন, বনু হাশিমের জন্যে ফরয যাকাত হালাল নয়, এ বিষয়ে কোন মতিবিরোধের কথা আমরা জানি না। আহলি বাইতের আবূ তালিবও তাই বলেছেন। ‘বাহরি যুখখার’ গ্রন্থে তার সূত্রে এ কথা উদ্ধৃত হয়েছে। ইবনে বাসলান এই পর্যায়ে ইজমা হওয়ারও উল্লেখ করেছেন। তাবারী ইমাম আবূ হানীফার এই মত উদ্ধৃত করেছেন যে, বনু হাশিমের জন্যে সাদকা গ্রহণ জায়েয। তার এই মতটিও উদ্ধৃত হয়েছে যে, তারা রাসূলের নিকটাত্মীয়দের জন্যে নির্দিষ্ট অংশ থেকে বঞ্চিত হলে যাকাত গ্রহণ তাদের পক্ষে জায়েয হবে। তাহাভী এই কথা বলেছেন। কোন মালিকী আলিম আবহরী সূত্রে এই কথা উদ্ধৃত করেছেন। ‘ফতহুল বারী’ গ্রন্থে বলা হয়েছে, কোন কোন শাফেয়ীরও এই মত। ইমাম আবূ ইউসুফ থেকেও এই কথা উদ্ধৃত হয়েছঃ যাকাত তাদের মধ্যে পারস্পরিকভাবে গ্রহণ করা জায়েয, অন্য লোকদের নিকট থেকে জায়েয নয়। ‘বাহর’ গ্রন্থে জায়দ ইবনে আলী, মুর্তাজা, আবুল আব্বাস ও ইমামীয় সূত্রেও এ কথাই বলা হয়েছে। আর ‘শিফা’ গ্রন্থে আল-হাদী ও আল-কাসেম আল-ইয়ামীর সূত্রেও এ মতই বর্ণিত হয়েছে। ইবনুল হাজার বললেন, এ পর্যায়ে মালিকী মাযহাবের পক্ষে চারটি প্রসিদ্ধ বক্তব্য রয়েছেঃ জায়েয, নিষিদ্ধ, নফল দান জায়েয, ফরয নয় আর তার বিপরীত। শাওকানী লিখেছেন, যে সব হাদীস সাধারণভাবে হারাম হওয়ার কথা বলে, তা সকলের জন্যেই প্রবর্তিত। বলা হয়েছে এই হাদীসসমূহ তাৎপর্যতভাবে ‘মুতাওয়াতির’। খোদ আল্লাহর কালামও তাই বলেঃ (আরবি***************) বল এই কাজের বিনিময়ে আমি তোমাদের নিকট কোন পারিশ্রমিক চাই না- শুধু নৈকট্যে ভালোবাসা চাই। বলেছেনঃ (আরবি***************) বল, এই কাজের জন্যে আমি তোমাদের নিকট কোন পারিশ্রমিকই চাই না। এই পারিশ্রমিক বা যাকাত যদি তার আলে’র জন্যে হালাল করে দিতেন, তাহলে তারা সেজন্যে সম্ভবত দোষ ধরত। আল্লাহর এ কথাটিও পঠনীয়ঃ (আরবি***************) তুমি তাদের নিকট থেকে যাকাত গ্রহণ কর, তুমি তাদের পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করবে তার দ্বারা। নবী করীম (সা) এর কথাটিও প্রমাণিত হয়েছেঃ (আরবি***************) যাকাত জনগণের ময়লা। [ ইবনুল হাজার বলেছেনঃ এ দলিল থেকে নফল সাদকা জায়েয প্রমাণিত হতে পারে, ফরয যাকাত নয়। অধিকাংশ হানাফী আলিমেরও এই মত। শাফেয়ী ও হাম্বলী মাযহাবের লোকদের নিকটও তাই,। তার বিপরীতটা-ফরয যাকাত জায়েয, নফল দান জায়েয নয়। বলেছেন, ফরয দান গ্রহণ করায় কোন লাঞ্ছনা নেই, নফল দানের কথা আলাদা। বনু হাশিম ও অন্যদের মধ্যে এই তারতম্য করার কারণ হচ্ছে নীচের হাত উপরের হাতের ওপর তোলাই হল নিষিদ্ধ হওয়ার কারণ। কিন্তু উপরের হাতও যদি সেরূপ হয়, তাহলে দোষ নেই। (আরবি***************)] মুসলিমের বর্ণনা। যারা বলেছেন, হাশিমীরা হাশিমীদের নিকট থেকে গ্রহণ করতে পারে- তা হালাল, তারা দলিল হিসেবে পেশ করেছেন হযরত আব্বাস বর্ণিত হাদীস। এ হাদীসটি মুহাদ্দিস হাকেম ‘উলুমুল হাদীস’ –এর ৩৭তম অধ্যায়ে এমন সনদের সূত্রে উদ্ধৃত করেছেন যার সব কয়জন লোকই বনু হাশিম থেকে। তা হচ্ছে, হযরত আব্বাস ইবনে আব্দুল মুত্তালিব বলেছেনঃ ‘আমি বললাম, হে রাসূলুল্লাহ! আপনি তো আমাদের পরস্পর থেকে তা গ্রহণ করা হালাল হবে কি না? বললেন হ্যাঁ। কিন্তু এই হাদীসের কতিপয় বর্ণনাকারীর ওপর ‘তুহমাত’ (দোষ) আরোপিত হয়েছে। ইমাম ইবনে হাজার ও ইমাম শাওকানী যা উদ্ধৃত করেছেন, তা ছাড়াও এখানে আমরা চারটি মাযহাবের গ্রন্থাবলী যা যা বলা হয়েছে, তা উদ্ধৃত করছি। এতে করে আলোচনাটি পূর্ণাঙ্গ রূপ লাভ করবে। হানাফী ফিকাহর (আরবি***************) গ্রন্থে বলেছেনঃ ইমাম আবূ হানীফা থেকে বর্ণিতঃ তাদেরকে নফল ও ফরয যাকাত দিতে কোন দোষ নেই। ইমাম মুহাম্মাদের (আরবি***************) –এ বলা হয়েছেঃ ইমাম আবূ হানীফা থেকে এপর্যায়ে দুটি বর্ণনা এসেছে। ইমাম মুহাম্মাদ বলেছেনঃ আমরা জায়েয হওয়ার বর্ণনাটি গ্রহণ করছি কেননা তা তাদের জন্যে হারাম ছিল বিশেষভাবে স্বয়ং রাসূলে করীমের জামানায়। (আরবি***************) গ্রন্থে বলা হয়েছেঃ ইমাম আবূ হানীফা থেকে হাশিমীকে যাকাত দেয়া অনুরূপভাবে জায়েয বলে বর্ণনা এসেছে। তাঁর থেকে এসেছেঃ আমাদের এই যুগে তা নিঃশর্তভাবে জায়েয। তাহাভী বলেছেনঃ আমরা এই মতটিই গ্রহণ করছি। কাহাস্তানী প্রমুখও এই কথাটিকেই বহাল রেখেছেন। [দেখুনঃ (আরবি***************)] শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া অগ্রাধিকার দিয়ে বলেছেন, বনু হাশিমের জন্যে হাশিমীদের যাকাত গ্রহণ করা জায়েয। [(আরবি***************)] জাফরীয়া’র মতও তাই। [(আরবি***************) এই গ্রন্থে রয়েছেঃ মুস্তাহাব যাকাত সব মানুষ থেকেই গ্রহণ তাদের জন্যে জায়েয ব্যবসায়ের যাকাতের ন্যায়। তাছাড়া যব, গম, খেজুর, কিশমিশ ও অন্যান্য কৃষি ফসলেরও।] এক্ষেত্রে সবচাইতে কঠিন ও কঠোর মাযহাব হচ্ছে জায়দীয়া মাযাহাব। তাতে হাশেমীদের হাশেমী থেকে যাকাত গ্রহণও জায়েয মনে করা হয়নি। তাদের নিকট এটার ওপরই নির্ভরতা। তারা যাকাত গ্রহণের চাইতে লাশ খাওয়া ভাল বলেছেন। বলেছেনঃ লাশ ভক্ষণ যদি তাকে ক্ষতি করে, তা হলে ঋণ হিসেবে যাকাত নিতে পারে। এ গ্রন্থে লিখিত রয়েছেঃ মুস্তাহাব যাকাত সব মানুষ থেকেই গ্রহণ তাদের জন্যে জায়েয- ব্যবসায়ের যাকাতের ন্যায়। তাছাড়া যব, গম, খেজুর, কিসমিস ও অন্যান্য কৃষি ফসলেরও। তা যখনই সম্ভব হবে ফিরিয়ে দেবে। এ সব কথা সেই কঠিন ঠেকায় পড়া ব্যক্তি সম্পর্কে, যার ক্ষুধায় বা পিপাসায় কিংবা নগ্নতা প্রভৃতির দরুন ধ্বংস ও মৃত্যু নিশ্চিত হয়ে পড়েছে। [(আরবি***************)] হাশিমীর গনীমত ও ফাই সম্পদের অংশ না পেলে এখানে একটি গুরুতর প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়েছে। আর তা হচ্ছে, বায়তুলমালে যখন গনীমত দও ফাইর সম্পদ থাকবে না কিংবা এমন ব্যক্তি তার কর্তা হয়ে বসল যে, তাদেরকে সে কিছুই দিচ্ছে না, তখন বনু হাশিমের অবস্থা কি হবে? মালিকী মাযহাবের কেউ কেউ বলেছেন, বায়তুলমাল থেকে তাদের যা প্রাপ্য তা যদি তাদেরকে দেয়া না হয় আর সে কারণে তারা কষ্টের দারিদ্র্যের সম্মুখীন হয়ে পড়ে, তাহলে তখন তাদেরকে যাকাত থেকে দিতে হবে। এরূপ অবস্থায় তাদেরকে দেয়া অন্যদেরকে দেয়ার তুলনায় অনেক উত্তম। তবে তাঁদের কেউ কেউ এই শর্ত করেছেন যে, এই দানটা জায়েয হবে কেবল কঠিন প্রয়োজন দেখা দিলে, এরূপ অবস্থায় অন্যান্য হারাম জিনিসও যেমন হালাল হয়ে যায়, এও তেমনি। এরূপ অবস্থায় লাশ ভক্ষণ করাও মুবাহ হয়ে যায়। তার অর্থ, তা আসলে হারাম প্রয়োজন বশত হালাল হয়ে গেছে। (হালাল হয়ে গেছে ঠিক নয়, শুধু খাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়েছে শর্ত সাপেক্ষে)। অন্যরা বলেছেনঃ এই শেষের যুগে এসে দৃঢ় প্রত্যয় দুর্বল হয়ে পড়েছে। কাজেই তাদেরকে যাকাত দেয়া যিম্মী ও কাফির-ফাজিরদের যাকাত দেয়ার তুলনায় অনেক সহজ। [(আরবি***************)] হানাফীদের কারুর কারুর বক্তব্য আমরা একটু পূর্বেই উদ্ধৃত করেছি। শাফেয়ী মাযহাবের আবূ সায়ীদ আল-ইস্তুখরী বলেছেনঃ তারা যদি ‘খুমুস’ থেকে বঞ্চিত হয়, তাহলে তাদের যাকাত দেয়া জায়েয। কেননা তাদের জন্যে যাকাত হারাম করা হয়েছে এই কারণে যে, গনীমতের এক-পঞ্চমাংশের এক-পঞ্চমাংশে তাদের প্রাপ্য নির্দিষ্ট হয়েছিল। অতএব এই প্রাপ্য যখন তারা পাবে না, তখন যাকাত দেয়া ওয়াজিব। নববী রাফেয়ী থেকে উল্লেখ করেছেনঃ গাযালীর সঙ্গী মুহাম্মাদ ইবনে ইয়াহইয়া উক্ত মতের সমর্থনে ফতোয়া দিতেন। [(আরবি***************)] ইবনে তাইমিয়া ও হাম্বলী মাযহাবের কাযী ইয়াকুব অগ্রাধিকার দিয়ে বলেছেন, তারা যদি গনীমত ও ফাই সম্পদের এক-পঞ্চমাংশ থেকে বঞ্চিত হয়, তাহলে জনগণের যাকাত থেকে তারা অংশ গ্রহণ করতে পারে-তা জায়েয। কেননা এক্ষণে তারা বড় অভাব ও প্রয়োজনের মধ্যে রয়েছে। [(আরবি***************)] ইমামীয়া জাফরীয়া’র মাযহাব-ও তাই। [(আরবি***************)] বনু হাশিমকে যাকাত দেয়ার পক্ষে জমহুর ফিকাহবিদগণ কোন মত দেন নি। (এককভাবে তারা কিংবা মুত্তালিবসহ- এ পর্যায়ের মতভেদ পূর্বে উদ্ধৃত হয়েছে) তারা যদি এক- পঞ্চমাংশ পাওয়া থেকে বঞ্চিতও হয় তবুও। কেননা যাকাত তাদের জন্যে হারাম করা হয়েছে রাসূলে করীমের সাথে তাদের সম্পর্কের মর্যাদার কারণে, তাই ‘খুমুস’ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হলে এই মর্যাদাটা তো শেষ হয়ে যায় না। [(আরবি***************)] পর্যালোচনা ও অগ্রাধিকার দান আমি যা মনে করি, আমাদের এ কালে নবী করীম (সা)-এর নিকটাত্মীয়দের যাকাত দেয়ার কথাটিই অধিক যুক্তিসংগত ও শক্তিশালী। কেননা এ কালের তারা গনীমত ও ফাই সম্পদের এক-পঞ্চমাংশ পাচ্ছে না। নবী করীম (সা)-এর জীবদ্দশায় তাদের প্রতি সাদকা-যাকাত হারামকরণের বিনিময়ে বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে আল্লাহ তা’আলার তরফ থেকে এই গনীমত ও ‘ফাই’ সম্পদের এক-পঞ্চমাংশ দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। আর নিকটাত্মীয় হিসেবে যে অংশটি নির্দিষ্ট হয়েছিল, তার উল্লেখ এই আয়াতটিতে রয়েছেঃ (আরবি***************) তোমরা জেনে রেখো, যে জিনিসই তোমারা গনীমতরূপে পাবে, তার এক-পঞ্চমাংশ আল্লাহর জন্যে এবং রাসূলের জন্যে, নিকটাত্মীয়দের জন্যে, ইয়াতীম, মিসকীন ও নিঃস্ব পথিকের জন্যে। [(আরবি***************)] অপর আয়াতঃ (আরবি***************) আল্লাহ্ তাঁর রাসূলকে নগর-গ্রামবাসীদের কাছ থেকে ‘ফাই’ হিসেবে যা-ই দিবেন, তা আল্লাহর জন্যে, রাসূলের জন্যে, নিকটাত্মীয়, ইয়াতীম, মিসকীন ও নিঃস্ব পথিকের জন্যে যেন ধন-সম্পদ কেবলমাত্র তোমাদের ধনী লোকদের মধ্যেই আবর্তনশীল হয়ে না থাকে। [(আরবি***************)] বনু হাশিমের জন্যে যাকাত হারাম করা হয়েছিল তাদের মর্যাদা রক্ষার্থে। এ কথাটি খুব শক্তিশালী নয়। বরং উত্তম কথা হল, তা ছিল রাসূলের তরফ থেকে তাদের সংরক্ষণ এবং সাহায্যদান স্বরূপ। ফলে এই প্রাপ্তিতে তাদের মুসলিম ও কফির উভয় শ্রেণীর লোকই অংশীদার হয়েছিল। বনু মুত্তালিবকে বনু হাশিমের সাথে সংযুক্ত করার উদ্দেশ্যে কোন কোন শাফেয়ী উক্তরূপ কথা বলেছেন। তাঁরা যুক্তিস্বরূপ বলেছেন, এরা সকলেই রাসূলে করীমের সঙ্গে বহু দুঃখ-কষ্ট নির্যাতন ও ক্ষুধা-যন্ত্রণা ভোগ করেছেন। এরা তার সঙ্গী হয়ে আবূ তালিব গুহায় প্রবেশ ও অবস্থান করেছেন এবং কুরাইশের ক্রোধ ও বয়কটের যন্ত্রণা তিলে তিলে সহ্য করেছেন। পরে যদি কোন-না-কোন কারণে নিকটাত্মীয়ের জন্যে নির্দিষ্ট এই অংশটি প্রত্যাহার করা হয়, বায়তুলমাল শূন্য হওয়া অথবা শাসকদের স্বৈর নীতি অনুসরণের কারণে তা দেয়া বন্ধ হয়ে যায়, তখন তাদেরকে যাকাত থেকে বঞ্চিত করা কিছুতেই উচিত হতে পারে না নতুবা সন্দেহটা তাহাদের জন্যে খুব মারাত্মক হয়ে দেখা দেবে। রাসূলে করীম (সা)-এর দুনিয়া ছেড়ে চলে যাওয়ার পর নিকটাত্মীয়ের জন্যে নির্দিষ্ট এই অংশটি বাতিল হয়ে গেছে বলে যখন বিপুল সংখ্যক আলিম ও বিশেষজ্ঞ অভিমত ব্যক্ত করেছেন এবং পরবর্তী খলীফার নিকটাত্মীয়ের জন্যে তা পুনঃনির্ধারিত হয়ে গেছে অথবা তা জিহাদের প্রস্তুতি ও অস্ত্রশস্ত্র ক্রয়ে ব্যয় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে, [ আবূ উবাইদাও কিতাবুল খারাজে আবূ ইউসূফ এবং ইবনে জরীর সূরা আনফাল-এর উপরিউক্ত (গনীমত সংক্রান্ত) আয়াতের তাফসীর প্রসঙ্গে হাসান ইবনে মুহাম্মাদ হানাফীয়া থেকে বর্ণিত একটি হাদীস উদ্ধৃত করেছেন। তাতে বর্ণিত হয়েছে, তাঁকে রাসূলের ও নিকটাত্মীয়ের অংশ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। জবাবে তিনি বলেছিলেন, রাসূলের ইন্তেকালের পর লোকেরা এ দুটি অংশ সম্পর্কে নানা মতবিরোধের মধ্যে পড়ে যায়। কারুর মত এই হয় যে, নৈকট্যের জন্যে নির্দিষ্ট অংশ ছিল রাসূলের নিকটাত্মীয়ের জন্যে। অপর লোকেরা বলেলেন, তা এখন মুসলমানদের খলীফার নিকটাত্মীয়রা পাবে। অপর লোকেরা বললে, নবী করীমের জন্যে নির্দিষ্ট অংশ তাঁর পরবর্তী খলীফা পাবে। পরে সকলের মতের সমন্বয় করা হয় এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে যে, এই দুটি অংশ আল্লাহর পথে জিহাদের প্রস্তুতিতে ব্যয় করা হবে। পরে হযরত আবূ বকর ও হযরত উমরের খিলাফত আমলে এই ব্যবস্থাই কার্যকর হয়। দেখুনঃ (আরবি***************) আরও দেখুনঃ (আরবি***************)- পরে পযরত আলী (রা) যখন খলীফা হলেন, তখনও এই নীতি কার্যকর থাকে (আরবি***************) ] তখন তার বিকল্প যাকাত তাদের জন্যে জায়েয হওয়া একান্তই বাঞ্ছনীয়। উপরিউক্ত মতটি আরও শক্তিশালী হয় এই কথায় যে, জমহুর আলিম যেসব হাদীসের ভিত্তিতে বনু হাশিমের ওপর কিয়ামত পর্যন্ত সময়ের জন্যে যাকাত হারাম হওয়ার মত দিয়েছেন, কেউ কেউ বনু মুত্তালিবকেও তাদের সাথে যুক্ত করেছেন, সেই সব হাদীস আসলে উক্তরূপ সিদ্ধান্ত গ্রহণের পক্ষে সুস্পষ্ট রায় দেয় না। সত্যি কথা হচ্ছে, যে লোকই সর্বপ্রকার দিদ্বেষ-আত্মপক্ষ, অন্ধ অনুসরণ, প্রশাসকদের খ্যাতি ও মতদাতাদের দাপট প্রভৃতি থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে অনাবিল বিচার-বুদ্ধি দিয়ে সে সব বিষয় বিবেচনা করবেন, তাঁরই সম্মুখে উক্ত মতের বিপরীত কথাই সুস্পষ্টরূপে প্রতিবাদ হয়ে উঠবে, তা হচ্ছেঃ ক. মুত্তালিব ইবনে রবীয়াতা বর্ণিত হাদীসের বক্তব্য হচ্ছে বনু হাশিমের দুইজন যুবক রাসূলে করীম (সা)-এর নিকট যাকাত-সাদকাত সংগ্রহের দায়িত্বে নিযুক্তির প্রার্থনা করে, যেন অন্য লোক যে ফায়দা পাচ্ছে, তারাও তা পেতে পারে। নবী করীম (সা) তাদের জন্যে এই পথ বন্ধ করে দেয়ার ইচ্ছ করলেন এবং তার ঘর ও নিকটবর্তী বংশের লোকদের পক্ষ থেকে ত্যাগ ও কুরবানীর অনুসরণযোগ্য আদর্শ কায়েম করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। গনীমতের মাল ও অনুরূপ ফায়দা পাওয়া থেকেও তাদেরকে দূরে রাখলেন। মক্কা বিজয়ের দিন তারা রাসূলের নিকট কাবার খেদমত ও পানি পান করানোর সেবার সুযোগ লাভ করতে চাইলেন। তখন তিনি তাদেরকে এই কাজের সুযোগ দিলেন। কেননা এ কাজে ঝুঁকি ও কষ্ট রয়েছে। তখন তিনি তাদেরকে সম্বোধন করে বলেছিলেনঃ (আরবি***************) তোমাদের পক্ষে উত্তম হচ্ছে তা যা তোমরা দেবে, তা নয় যা তোমরা পাবে। [(আরবি***************)] বুখারী উদ্ধৃত হাদীসের ভাষা হচ্ছে, ‘যাকাত আলে-মুহাম্মাদের জন্যে বাঞ্ছনীয় নয়’। এ থেকে বড়জোর মকরুহ তানজীহী বোঝায়্ মনে হয় যে কাজে হালাল নয় এমন জিনিস গ্রহণের আশংকা থাকে, তার নিকটে যাওয়া থেকে। তিনি তাদের মনে ঘৃণা বা এড়ানোর ভাব জাগাতে চেয়েছিলেন। ‘ইবনুল লাতবিয়’ তাই মনে করেছেন। আর এ কারণেই উবাদাতা ইবনুচ্ছামেত প্রমুখ সাহাবী সাদকাত-যাকাত সংগ্রহের কর্তৃত্বপূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। কেননা তাতে জায়েয নয় এমন অনেক কাজ হওয়ার আশংকা ছিল। এই কর্তৃত্বপূর্ণ দায়িত্বটি কঠোরতার ওপর ভিত্তিশীল। কেননা তা জনগণের ধন-সম্পদের সাথে সংশ্লিষ্ট। আর তা গোটা মুসলিম সমষ্টির সম্পদ। মুসলমান অভাবগ্রস্ত লোকদের – কিংবা মুসলমানদের যে জিনিসেরই প্রয়োজন, তা পাওয়ার অধিকারে সম্পদ। তাই ভারপ্রাপ্ত কর্মচারী পাওয়ার অধিকারসম্পন্ন লোকদের থেকে অতিরিক্ত যা-ই গ্রহণ করবে, তাতেই ফকীর ও অভাবগ্রস্ত লোকদের খালেছ অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ করা হবে এবং সমষ্টির সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করা হবে। এই হাদীস থাকা সত্ত্বেও অনুসৃত মাযহাবগুলোর বিপুল সংখ্যক আলিম বনু হাশিমের লোকদের জন্যে এই বিভাগের কর্মকর্তা হওয়ার অনুমতি দিয়েছেন। ‘যাকাত সংস্থার কর্মচারী’ পর্যায়ের আলোচনায় আমরা এসব কথা বিশদভাবে বলে এসেছি। আবূ রাফে বর্ণিত হাদীসটিও এই তাৎপর্যকেই শক্তিশালী করে। তা স্পষ্ট করে বলে দেয় যে, রাসূলের ঘরের লোকদেরকে যাকাত-সাদকা সংক্রান্ত কাজকর্ম থেকে দূরে সরিয়ে রাখার মূল কারণ তাদের বংশীয় মর্যাদা রক্ষা নয়, বরং তাদের ওপর যে মিথ্যা সন্দেহ ও অভিযোগ হতে পারে, তা থেকে রক্ষা করাই ছিল আসল লক্ষ্য। ফলে মিথ্যা দোষারোপকারীদের মুখ যেমন বন্ধ থাকবে, তেমনি একটা উত্তম অনুসরণীয় আদর্শও সংস্থাপিত হবে। রাসূলের বংশ ও তাঁদের মুক্ত করা লোকদের এই প্রশিক্ষণও হবে যে, তারা কষ্ট ও ঝুঁকি বরদাশত করতে মন-মানসিকতার দিক দিয়ে প্রস্তুত হবে। গনীমতের মালের প্রতিও তাঁদের লোভ হবে না। কেবল মর্যাদা রক্ষাই যদি এই নিষেধের কারণ হত, তাহলে তাঁদের লোভ হবে না। কেবল মর্যাদা রক্ষাই যদি এই নিষেধের কারণ হত, তাহলে তাঁদের মুক্ত করা গোলামদের নিশ্চয়ই তাদের সাথে যুক্ত করা হত না। খ. হাসান ইবনে আলীর বর্ণনা, রাসূলের কথাঃ ‘তুমি বোঝ না, আমরা যাকাত-সাদকা খাই না’ – এবং মুসলিমের বর্ণনাঃ ‘আমাদের জন্যে সাদকা যাকাত হালালা নয়,’ এসব থেকে আমার মনে হচ্ছে নবী করীম (সা) রাষ্ট ও সমাজপ্রধান হিসেবেই এসব কথা বলেছিলেন। কেননা তাঁর কর্তৃত্বে যাকাত-সাদকাত সংগৃহীত ও একত্রিত হলেই তো হালাল হয়ে যায় না। তা তো মুসলিম সমষ্টির মালিকানা সম্পদ। হযরত উমর (রা) যাকাতের দুগ্ধ পান করেছিলেন ভুলবশত, সঙ্গে সঙ্গেই তা থু থু করে ফেলে দিয়েছিলেন’- বর্ণনাটিও ঠিক এ পর্যায়ে গণ্য। [(আরবি***************)] (আরবি***************) গ্রন্থে ঠিক এই জন্যেই বলা হয়েছেঃ ‘রাষ্ট্রপ্রধানের জন্যে হালাল নয়, যেমন রাসূলও রাষ্ট্রপ্রধানই। হযরত উমর যাকাতের দুগ্ধ এ জন্যেই পরিহার করেছিরেন। [(আরবি***************)] গ. উক্ত হাদীসসমূহ যেসব কার্যকারণ ও সম্ভাবনা উপস্থাপিত করেছে, তা থেকে আমরা যখন দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলাম ও নিছক শব্দ সমূহের বিবেচনায় আত্মনিয়োগ করলাম, তখন বিবেচ্য হলঃ ‘আলে মুহাম্মাদ’ বাক্যটি কি বোঝায়? তা কি নিশ্চিতভাবে শুধু বনু হাশিমের লোকদের কিংবা তাদের সাথে বনু মুত্তালিবও বোঝায় কিয়ামত পর্যন্ত? এরূপ অর্থ হওয়ার কোন অকাট্য ও নিরংকৃশ প্রমাণ পাওয়া যায় না। বরং ‘আলে-মুহাম্মাদ’ ঠিক ‘আলে ইবরাহীম’ ‘আলে ইমরান’ –এর মতই তাৎপর্যের ধারক। যেমন কুরআনের আয়াতে উদ্ধৃত হয়েছেঃ (আরবি***************) নিশ্চয়ই আল্লাহ্ আদম, নূহ, আলে ইবরাহীম ও আলে ইমরানকে সারা জাহানের ওপর মনোনীত করেছেন। এ আয়াতের ‘আলে-ইমরান’ বলতে মরিয়াম ও তাঁর পুত্র ঈসা (আ)-কে বোঝায়। আর আলে-ইবরাহীম’ বলতে ইসমাইল, ইসহাক, ইয়াকুব ত তাঁদের বংশধরদের বোঝায়। কিন্তু তাঁদের কিয়ামত পর্যন্ত বংশধরদের বোঝায় না। ইবরাহীম ও ইসহাক প্রসঙ্গে আল্লাহ নিজেই বলেছেনঃ (আরবি***************) এখন এ দুজনের বংশধরদের মধ্য থেকে কেউ মুহসিন, সদাচারী আর কেউ নিজের আত্মার ওপর সুস্পষ্ট জুলুমকারী। [(আরবি***************)] বিশ্ব বিধ্বংসী ইয়াহুদীরা তো হযরত ইবরাহীমেরই বংশোদ্ভূত লোক; আল্লাহর এ কথাটিও এ অর্থেইঃ (আরবি***************) পরে তাকে ফিরাউনের লোকেরা তুলে নিল। [(আরবি***************)] এবং (আরবি***************) এবং ডুবিয়ে দিলাম ফিরাউনের লোকজনকে। [(আরবি***************)] (আরবি***************) এবং ফিরাউনের লোকজনের ওপর নিকৃষ্ট ধরনের আযাব ভেঙ্গে পড়ল। [(আরবি***************)] এক্ষণে প্রশ্ন হচ্ছে, ‘আলে-ফিরাউন’ বলে কেবল ফিরাউনকেই বুঝাতে হবে, না তার ঘরের লোকজনসহ সবাইকে এবং তাদের সাথে ঘনিষ্ঠতর সম্পর্কশীল লোকদেরও বুঝতে হবে?..... নিশ্চয়ই তা-ই হবে তার তাৎপর্য। তাই এখানেও – ‘আলে-মুহাম্মাদ’ বলে- কেবলমাত্র তার ঘরের লোক, তাঁর স্ত্রীগণ, সন্তানাদি, বংশধর এবং তাঁর ঘনিষ্ঠতম ব্যক্তিবর্গই বুঝতে হবে। আর এ কথাও বিশেষভাবে যথার্থ ও প্রয়োগযোগ্য কেবলমাত্র তাঁর (সা) জীবনে বেঁচে থাকা অবস্থার ক্ষেত্রে। ইমাম আবূ হানীফারও এই কথাই তাঁর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। তাঁর সাথী মুহাম্মাদ ইবনুল হাসানও এই মতই গ্রহণ করেছেন। (আরবি***************) গ্রন্থ প্রণেতা বলেছেন, ইমাম মালিকের অনেক কয়টি মতের মধ্যে এ মতটি অন্যতম। আর তার কারণ দেখিয়েছেন এই বলে যে, মিথ্যা সন্দেহ ও দোষারোপ থেকে তাদের বাঁচাবার উদ্দেশ্যেই তা তাদের জন্যে হারাম ঘোষণা করা হয়েছিল। আর তা রাসূলের জীবনের অবসানের সাথে সাথেই নিঃশেষ হয়ে গেছে। [(আরবি***************)] ইমাম শাওকানী ‘বল, আমি এই কাজের জন্যে তোমাদের কাছে কোন পারিশ্রমিক চাই না’ কুরআনী ভাষায় রাসূলের এ কথার ভিত্তিতে বলেছিলেন, তিনি যদি তাদের জন্যে যাকাত হালাল করে দিতেন, তাহলে এ জন্যে তাদেরকে অভিযুক্ত হতে হত। এই কথাটি বাতিল হয়ে যায়। কেননা এ সবই ছিল রাসূলে করীম (সা)-এর জীবদ্দশার ব্যাপার। কিন্তু তাঁর ইন্তেকালের পর তারা সকলে অন্যান্য মুসলমানের সমান মর্যাদার হয়ে গেছে। অতঃপর তাদের জন্যে কোন বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের প্রশ্ন ওঠে না এবং এই ঘোষণা যথাযথভাবে কার্যকর হবেঃ ‘যাকাত গ্রহণ করা হবে সমাজের ধনী লোকদের থেকে এবং বণ্টন করা হবে তাদেরই দরিদ্রদের মধ্যে।’ আমরা এই কথা বলেছি দুটি কারণেঃ প্রথমঃ ইসলামী শরীয়াত যাবতীয় বিধি-বিধানে নবী করীম (সা) এর নিকটাত্মীয়দের সাধারণ জনগণ থেকে ভিন্ন করে দেখেনি। বরং তিনি তো ঘোষণাই করেছেন যে, জনগণ চিরুনীর দাঁত বা কাঁটাগুলোর মতই সমান ও সর্বতোভাবে অভিন্ন। অধিকার ও দায়িত্ব কর্তব্যের ক্ষেত্রেও এই অভিন্নতা পুরোপুরি রক্ষিত হয়েছে, ঝুঁকি ও শাস্তি প্রদানের ক্ষেত্রে কোনরূপ বৈষম্য পার্থক্যকে স্থান দেয়া হয়নি। নবী করীম (সা) উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছেনঃ ‘আল্লাহর কসম, মুহাম্মাদ-তনয়া ফাতেমাও যদি চুরি করে, তাহলেও আমি তার হাত কেটে দেব।’ [ বুখারী, মুসলিম] তিনি আরও বলেছেনঃ (আরবি***************) যার নিজের আমল ও চরিত্র মন্থর, তার বংশ তাকে দ্রুতগতিশীল বানাতে পারে না। [বুখারী, মুসলিম] দ্বিতীয়ঃ আর এ কারণটাই অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। তা হচ্ছে ইসলামের যাকাত একটা বাধ্যতামূলকভাবে ধর্যকৃত ফরয। তা সর্বজনবিদিত হক ও অধিকার-একটা সুনির্দিষ্ট ‘কর’ বিশেষ। রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারই তা আদায় করার ও পাওয়ার যোগ্য লোকদের মধ্যে বন্টন করার জন্যে দায়িত্বশীল। তাই তাতে কারুর ওপর কারুর ব্যক্তিগত অনুগ্রহ বর্ষণের কোন অবকাশ থাকে না। যে লোক তা থেকে নেবে, তা নেবে তার পাওয়ার অধিকারের ভিত্তিতে। অতএব তাতে কোন দোষের স্থান নেই। বিস্ময়ের ব্যাপার, কোন কোন ফিকাহবিদ-এবং অধিকাংশই হাশিমী বংশের লোকদের জন্যে ফরয – যাকাত হারাম মনে করেছেন বটে; কিন্তু নফল দান-সাদকা গ্রহণকে সম্পূর্ণ মুবাহ্ মনে করেছেন। অথচ ব্যক্তিগত অনুগ্রহ দেখাবার সুযোগ এই ক্ষেত্রেই অধিক। আলে-মুহাম্মাদের ওপর যাকাত কিয়িামত পর্যন্ত হারাম করে দেয়ার কথা যদি সহীহ্-ই হত, তাহলে হারাম হত নফল দান গ্রহণ। ইবনুল হাজার কোন কোন ফিকাহবিদের এরূপ উক্তি উদ্ধৃত করেছেন। তাঁরা এই বলে দলিল দিয়েছেন যে, যা ফরয, তা গ্রহণে কোন লাঞ্ছনার অবকাশ থাকতে পারে না। নিন্তু নফল দান-সাদকার অবস্থা এরূপ নয়। পূর্বের আলোচনা থেকে এ কথাটিও স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, এ বিষয়ে কখনই কোন ইজমা অনুষ্ঠিত হয়নি। তাই যারা তাদের জন্যে যাকাত হালাল বলে মত দিয়েছেন, তাঁরা ঐকমত্যের ইজমার প্রাচীর দীর্ণ ও চূর্ণ করেছেন বলে তাদের ওপর দোষারোপ করা যায় না। কেননা আমরা দেখেছি, ইমাম আবূ হানীফা জায়েয পওয়ার কথা বলেছেন, তাঁর সাথী ইমাম মুহাম্মাদ এই মতই অবলম্বন করেছিলেন, কোন কোন শাফেয়ী আলিমের মতও তাই এবং মালিকী মাযহাবের কারো কারো কাছে এটাই গ্রহণীয়। তবে কোন কোন বর্ণনায় এমন তাৎপর্য রযেছে যা নিঃশর্ত জায়েয হওয়ার মতের সমর্থক। তার একটির কথা ‘বাহরি যুখখার’ গ্রন্থে উদ্ধৃত হয়েছে। তা এইঃ নবী করীম (সা) বনু মুত্তালিবের বিধবাদের জন্যে দান করেছিলেন। উক্ত গ্রন্থ প্রণেতার মতে তা ছিল নফল সাদকা। [(আরবি***************)] যেমন আবূ দাঊদ তাঁর ‘সুনান’ গ্রন্থে ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন। তিনি বলেছেনঃ আমার পিতা আমাকে নবী করীম (সা) –এর কাছে একটি উটের ব্যাপারে পাঠিয়েছিলেন, যা তিনি তাঁকে যাকাত থেকে দিয়েছিলেন। অপর বর্ণনায় বলা হয়েছেঃ সেটি বদলানোর জন্যে এলেন। [আবূ দাঊদ (আরবি***************) আধ্যায়ে হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন। মুনষেরী এই বিষয় নীরব রয়েছে। নাসায়ীও হাদীসটি তুলেছেন। দেখুনঃ (আরবি***************)] ইমাম নববী দুই দিক দিয়ে এ হাদীসের জবাব দিয়েছেনঃ একটি, বনু হাশিমের প্রতি প্রথম দিক দিয়ে যাকাত হারাম ছিল, পরে তা মনসূখ হয়ে গেছে, যেমন বলা হয়েছে। দ্বিতীয়, হযরত আব্বাস (রা) থেকে গরীর লোকদের জন্যে একটি উট ধার নিয়েছিলেন। পরে সেটি তিনি যাকাতের উট থেকে ফেরত দিলেন। অপর একটি বর্ণনায়ও এমন কথা এসেছে যা এই কথা বোঝায়। খাত্তাবীও এ কথার দ্বারাই জবাব ‍দিয়েছেন। প্রকৃত ব্যাপার আল্লাহই ভালো জানেন। [(আরবি***************)] সন্দেহ নেই, হাদীসের বাহ্যিক তাৎপর্যই গ্রহণ করতে হবে- কোনরূপ ব্যাখ্যা অবলম্বন না করেই কিংবা মনসূখ কথা না বলেই। আমার মনে হচ্ছে, ইমাম বুখারীর নিকট এ পর্যায়ে সহীহ্ সনদের কোন হাদীম প্রতিভাত হয়নি, যা স্পষ্টভাবে কিছু বোঝায়। এ কারণেই তিনি এরূপ শিরোনাম দিয়ে একটি হাদীস উদ্ধৃত করেছেনঃ (আরবি***************) নবী করীম (সা) ও তাঁর বংশের লোকদের যাকাত দেয়া পর্যায়ে যা বলা হয়, তার অধ্যায়........ ‘যা বলা হয়’..... কথাটি স্পষ্ট প্রমাণ করে যে, যে হাদীস নিয়ে আসা হচ্ছে তা যয়ীফ এবং তাতে সংশয় রয়েছে।’ এ হচ্ছে পূর্ব কথার উদ্ধৃতির দিক দিয়ে কথা। কিন্তু ইসলামী বিধান রচনার অন্তর্নিহিত যৌক্তিকতা বিবেচনা করলে আমরা দেখতে পাই যে, বাহ্যত তা নবী করীম (সা) ও তাঁর বংশধরদের জন্যে তাঁর জীবনকালে হারাম করারই সিদ্ধান্ত দেয়। কেননা নবী করীম (সা) নিজেই নিজেকে ও তাঁর বংশের লোকদেরকে যাকাত-সাদকা গ্রহণ থেকে দূরে সরিয়ে পবিত্র রাখতে চেয়েছিলেন, যেন পবিত্রতা ও স্বার্থহীনতার একটা উচ্চতর দৃষ্টান্ত মুসলিম জনগণের জন্যে সংস্থাপন করা যায়। যেন দেয়ার জন্যে তাঁদের মনে লোভ দেখা না দেয়। তাহলে নবী করীম (সা) যে উচ্চতর আদর্শবাদিতার কথা ঘোষণা করেছিলেন, বাস্তবে তার সাথে পূর্ণ সামঞ্জস্য রক্ষা পায়। তিনি ঘোষণা করেছিলেনঃ (আরবি***************) উপরের হাত নীচের হাতের চেয়ে অনেক ভালো। [(আরবি***************)] এজন্যে যে, কোনরূপ বস্তুগত বিনিময় বা মুনাফা ছাড়া সম্পদ দানের মধ্যে গ্রহীতার প্রতি দাতার একটা ব্যক্তিগত অনুগহ বর্ষণের ভাব বিদ্যমান থাকে। কিন্তু রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকার যদি ধনীদের কাছ থেকে যাকাত-সাদকাত গ্রহণ করে ও দরিদ্রের মধ্যে বণ্টন করে জনগণের প্রতিনিধি ও দায়িত্বশীল হিসেবে তা হলে তাতে ব্যক্তিগত অনুগ্রহের ভাব প্রকাশের কোন অবকাশ থাকে না। রাষ্ট্রপ্রধান নিজে ব্যক্তিগতভাবে মুমিনদের কাছে থেকে যাকাত-সাদকাত গ্রহণ করে নিজের ঘাড়ে এই অনুগ্রহ দেখানোর ঝুঁকি গ্রহণ করবেন এবং তাঁর ঘরের লোকজনের ওপরও এই মর্যাদা চাপিয়ে দেবেন তা কোনক্রমেই বাঞ্ছনীয় নয়। এরূপ ব্যবস্থার মধ্যে একটা নিগূঢ় তত্ত্ব নিহিত রয়েছে। আল্লামা শাহ দেহলভী এই বিষয়ে অবহিত করেছেন। বলেছেনঃ রাষ্ট্রপ্রধান নিজে ব্যক্তিগতভাবে যদি যাকাত-সাদতাত গ্রহণ করে এবং তাঁর বিশেষ লোকদের জন্যে তা গ্রহণ করাকে জায়েয করে দেন- সে যেরূপ ফায়দা তা থেকে পায় সেরূপ ফায়দা যদি পায় তারাও, তাহলে তাঁকে কেন্দ্র করে একটা সন্দেহ সংশয়ের ধূম্র কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠবে এবং লোকেরা তাঁর সম্পর্কে এমন সব কথা বলবে যা তাঁর ক্ষেত্রে সত্য নয়। এ কারণে এসব ছিদ্রপথকে সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। প্রকাশ্যে ঘোষণা দেয়া হয়েছে যে, যাকাত দানের ফায়দাটা তাদের দিকেই ফিরে আসছে। কেননা যাকাত সম্পর্কে চূড়ান্ত কথা হচ্ছেঃ তা দেয়া হবে সমাজের ধনী লোকদের কাছ থেকে এবং সেই সমাজেরই দরিদ্র জনগণের মধ্যে তা বন্টন করা হবে। এটা তাদের সকলের প্রতি আল্লাহর একটা অনুগ্রহ বিশেষ। মূল ফায়দাটা তাদের নিকটই ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে, তাদেরকে কল্যাণের নিকটবর্তী করে দেয়া হয়েছে, পাপ ও অন্যায়ের সংস্পর্শ থেকে তাদের রক্ষা করা হয়েছে, [(আরবি***************)] তবে আলে-মুহাম্মাদের জন্যে যাকাতকে কিয়ামত পর্যন্ত সময়ের জন্যে হারাম করে দেয়ার কোন যৌক্তিকতা বা বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব নিহিত আছে বলে মনে হচ্ছে না। বিস্ময়কর ব্যাপার হল, যারা বনূ হাশিম ও বনূ মুত্তালিবের জন্যে যাকাত হারাম করেছেন, তা গ্রহণ তাদের জন্য জায়েয নয় বলেছেন, তারা যদি বায়তুলমালের এক- পঞ্চমাংশের এক-পঞ্চমাংশ গ্রহণের ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতেন, তাহলে এই পঞ্চমাংশও নির্মূল হয়ে যেত। এ কালে যেমনটা ঘটছে, বিশেষ করে প্রশাসকদের স্বৈরতন্ত্রের কারণে। অতীত কালেও তা-ই দেখা গেছে, প্রশ্ন হচ্ছে, দরিদ্র ও অভাবগ্রস্ত লোকদের যদি যাকাত দেয়া না হয়- এরূপ প্রয়োজনের অবস্থায়ও, তাহলে নবীর ঘরের লোকদেরকে অনশনে মরে যাওয়ার জন্যে ছেড়ে দিলেই তাঁদের প্রতি সম্মান দেখানো হবে? যাকাতের মানে তাঁদের অধিকার থাকা সত্ত্বেও তাঁদের তা না দিয়ে কষ্ট দেয়ার কি অর্থ থাকতে পারে; এ বাস্তবিকই বোধগম্য নয়। এই কারণে চারটি মাযহাবের আলিমসমষ্টি ও অন্যরা ফতোয়া দিয়েছেন যে, ‘আলে-মুহাম্মাদ’ লোকদের যদি বায়তুলমাল থেকে এক-পঞ্চমাংশ না দেয়া হয়, তাহলে যাকাত গ্রহণ করা তাঁদের পক্ষে সম্পূর্ণ জায়েয। কেননা তাঁদের প্রয়োজন রয়েছে, তারা অভাবগ্রস্ত এবং সে অভাব অবশ্যই পূরণ হতে হবে। [দেখুনঃ(আরবি***************)] বরং মলিকী মাযহাবের কতিপয় আরিম মত দিয়েছেন যে, এরূপ অবস্থায় তাদেরকে যাকাত দান অন্যদেরকে দেয়ার তুলনায় অনেক উত্তম। আর এটাই হচ্ছে সহীহ্ কথা (আরবি***************) ষষ্ঠ আলোচনা যাকাত ব্যয়ে ভুল-ভ্রান্তি যাকাতদাতা যাকাত ব্যয়ে ভুল করলে কি করা হবে যাকাতদাতা যদি ভুল করে এমন ক্ষেত্রে যাকাত ব্যয় করে বসে যা প্রকৃতপক্ষে যাকাত ব্যয়ের ক্ষেত্র নয়, তা করেছে নিজের অজ্ঞতার কারণে, পরে তার নিজের কাছেই ভুলটা স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়েছে, এরূপ অবস্থায় তার যাকাত কি দেয়া হল এবং ফরযের দায়িত্ব থেকে সে মুক্ত হল। কিংবা এই যাকাত তার ওপর ঋণ হয়ে থাকবে স্থায়ীভাবে যতক্ষণ না সে তা তার সঠিক ক্ষেত্রে ব্যয় করছে? এই বিষয়ে ফিকাহবিদদের দৃষ্টিভঙ্গি বিভিন্ন। আবূ হানীফা, মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান ও আবূ উবাইদা বলেছেন, সে যা দিয়েছে, তা-ই তার জন্যে যথেষ্ট। তার যাকাত আদায় হয়ে গেছে, মনে করতে হবে, পুনরায় যাকাত দেয়ার জন্যে তার নিকট দাবি করা যাবে না। মায়ান ইবনে ইয়াযীদ বলেছেনঃ আমার পিতা সাদকা দেয়ার জন্যে দীনারসমূহ বের করে এনেছিলেন। পরে তা মসজিদে এক ব্যক্তির কাছে রেখে দিলেন। পরে আমি এসে তাঁর নিকট থেকে তা ফিরিয়ে নিয়ে যাই। তখন পিতা বললেনঃ আল্লাহর কসম, আমি তোমাকে দিতে চাই নি। পরে আমি বিষয়টি নিয়ে রাসূলে করীমের দরবারে মামলা দায়ের করি। তখন তিনি বলেনঃ হে ইয়াযীদ, তুমি যা নিয়ত করেছে, তা তুমি পেয়ে যাবে। আর হে মায়ান, তুমি যা নিয়েছ তা তোমার জন্যে। হাদীসটি আহমাদ ও বুখারী কর্তৃক বর্ণিত। হাদীসে সাদকার কথা বলা হয়েছে, তা সম্ভবত নফল হবে। তবে (ماশব্দ) তুমি যা নিয়ত করেছ বা ক্যের ‘মা’ শব্দটি সাধারণত্বের তাৎপর্য বহন করে। এঁদের দলিল হিসেবে হযরত আবূ হুরায়রা বর্ণিত হাদীসটিও উল্লেখ্য। নবী করীম (সা) বলেছেনঃ এক ব্যক্তি [ লোকটি ছিল ইসরাঈলী বংশের।] বললেঃ আমি অদ্য রাতের বেলা অবশ্যই সাদকা দেব। পরে সে সাদকা নিয়ে এল এবং একজন চোরের হাতে রেখে দিল। (সে যে চোর তা তার জানা ছিল না)। পরে তারা বলতে শুরু করল, রাতের বেলা সাদকা করতে গিয়ে একজন চোরের হাতে দিয়ে দিল। সে লোক বললেঃ হে আল্লাহ! তোমার প্রশংসা [ সেই অবস্থার দরুন আল্লাহর প্রশংসা করল নতুবা কোন খারাপ কাজের দরুন তো আর আল্লাহর হামদ করা হয় না।] আমি নিশ্চয়ই সাদকা দেব। পরে সে সাদকা নিয়ে বের হয়ে তা এক জ্বেনাকারের হাতে রেখে দিল। সকাল বেলা লোকেরা বলাবলি শুরু করে দিলঃ রাতের বেলা লোকটি একজন জ্বেনাকারের হাতে সাদকা দিয়েছে! লোকটি বললেঃ হে আল্লাহ! তোমার প্রশংসা, আমি আবার সাদকা করব। পরে সে সাদকা নিয়ে বের হয়ে ধনী ব্যক্তির হাতে দিল। সকালবেলা আবার লোকেরা বলতে শুরু করলেঃ রাতের বেলা একজন ধনীকে সাদকা দিয়েছে। পরে সে বললেঃ হে আল্লাহ্! তোমার প্রশংসা, জ্বেনাকার, চোর ও ধনীর ব্যাপারে। পরে সে স্বপ্নে দেখল, তাকে বলা হচ্ছে, তোমার সাদকা চোরের হাতে পড়েছে সম্ভবত সে চৌর্যবৃত্তি থেকে মুক্তি পাবে, জ্বেনাকার সম্ভবত তার দরুন জ্বেনা থেকে বিরত থাকবে। আর ধনী ব্যক্তি সম্ভবত সাদকা পেয়ে চেতনা লাভ করবে এবং আল্লাহ তাকে যে ধন-সম্পদ দিয়েছেন, তা আল্লাহর পথে ব্যয় করতে শুরু করে দেবে। [ আহমাদ, বুখারী, মুসলিম। ] এক ব্যক্তি রাসূলে করীমের কাছে যাকাত চেয়েছিল। তিনি তাকে বলেছিলেনঃ তুমি যদি সেই বিভক্তি খাতসমূহের কোন একটিতে গণ্য হও, তাহলে নিশ্চয়ই আমি তোমার পাওনা দিয়ে দেব।’ এবং দুই শক্ত সমর্থ ব্যক্তিকে তিনি বরে দিয়েও ছিলেন, ‘তোমরা চাইলে আমি তা থেকে তোমাদের দেব; কিন্তু জেনে রাখো, কোন ধনী এবং শক্তিমান উপার্জনক্ষম ব্যক্তির জন্যে কোন অংশ এতে নেই।’ যদি ধনাঢ্যতার আসল রূপটা ধরতেই হত, তাহলে এই লোক দুটির মৌখিন কথাকেই তিনি যথেষ্ট মনে করতেন না। ‘আল-মুগিনী’ গ্রন্থেও এরূপ বলা হয়েছে। [(আরবি***************)] এই সহজ নীতির ধারক লোকদের প্রতিকূলে এক জনসমষ্টি এ ব্যাপারে খুব বেশি কঠোরতা অবলম্বনের পক্ষপাতী। তাদের মত হচ্ছে, যে লোক যাকাত পাওয়ার অধিকারী নয়, তাকে তা দেয়া হলে তার যাকাত আদায় হল না। যখন তার ভুল ধরা পড়বে, তখন তাকে দ্বিতীয়বার যোগ্য অধিকারীকে তা দিতে হবে। কেননা সে ফরয পাওনাটা এমন ব্যক্তিকে দিয়েছে যে তা পেতে পারে না। অতএব মনে করতে হবে, সে ফরয আদায় করেনি। তার দায়িত্ব পালিত হয়নি। লোকদের পাওয়া ঋণের মতই তা অ-দেয়া থেকে গেছে ও তার নিকট পাওনা রয়ে গেছে। শাফেয়ী মাযহাবও অনুরূপ কঠোরতাপ্রবণ। ‘রওজাতুন নাজীর’ প্রভৃতি গ্রন্থে তার উল্লেখ রয়েছে। [(আরবি***************)] ইমাম আহমাদের মাযহাব হচ্ছে-কাউকে ফকীর মনে করে তাকে যাকাত দেয়ার পর যদি প্রকাশ হয়ে পড়ে যে, সে ধনী লোক, তাহলে এ ব্যাপারে দুটি বর্ণনা পাওয়া গেছে। একটি বর্ণনা মতে, তার যাকাত আদায় হয়ে গেছে। আর অপর বর্ণনাটির দৃষ্টিতে তা অ-দেয়া রয়ে গেছে। আর যদি জানা যায় যে, গ্রহণকারী দাস বা কাফির কিংবা হাশিমী বংশের অথবা দাতার নিকটাত্মীয় কেউ-যাকে যাকাত দেয়া জায়েয নেই, তাহলে এ দেয়াটা গণ্য হবে না। এ হচ্ছে একটি বর্ণনা। এর কারণ বলা হয়েছে, অন্যদের ছাড়া ধনী ও গরীবকে আলাদা করে চিনতে পারা খুবই দুষ্কর ব্যাপার। যেমন আল্লাহ বলেছেনঃ (আরবি***************) তাদের অবস্থা প্রকাশ না করা ও ভিক্ষা না চাওয়ার দরুন জাহেল লোক তাদেরকে ধনশালী মনে করে। [(আরবি***************)] এই দুই প্রান্তিক মতের লোকদের মধ্যবর্তী বহু ফিকাহবিদ রয়েছেন, যারা উভয় অবস্থার মধ্যে পার্থক্য করেছেন, একটিকে অপরটি থেকে আলাদা করে দেখেছেন। ফলে তাঁরা কোন কোনটিকে জায়েয বলেছেন- আদায় হয়ে গেছে বলে ফতোয়া দিয়েছেন, আর কোন কোন অবস্থার দেয়াকে অগ্রাহ্য করেছেন। হানাফীদের মতেঃ যে লোক বহু চিন্তা-ভাবনা ও কষ্ট করে বিচার-বিবেচনার পর যাকাত পাওয়ার যোগ্য লোক মনে করে যাকাত দিয়েছে; কিন্তু তার পরও প্রকাশিত হয়েছে যে, সে লোকটি ধনী কিংবা যিম্মী অথবা জানা গেছে যে, গ্রহীতা তার পিতা, পুত্র, স্ত্রী বা হাশেমী বংশের কেউ, তা হলে তার যাকাত সঠিকভাবে দেয়া হয়েছে, তাকে তা পুনরায় দিতে হবে না। কেননা তার সাধ্যমত সে করেছে। তেব যদি প্রকাশিত হয় যে, যাকাত গ্রহীতা কাফির, মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত-যদিও সে এখন আশ্রয়প্রার্থী, তা হলে আবূ হানীফার মতে এই দেয়া যথার্থ ও যথেষ্ট হবে, পুনরায় দিতে হবে না। কেননা এখানেও যতটা সতর্কতা অবলম্বন সম্ভব ছিল, তা সে করেছে। অপর একটি বর্ণনায় অবশ্য বলা হয়েছে, তা আদায় হয়নি মনে করতে হবে। আবূ ইউসুফেরও এই কথা। কেননা যুদ্ধলিপ্ত হওয়ার পরিচিতিটা শরীয়াত অনুযায়ী শুভ নয়। এ কারণে নফল সাদকাও তাকে দেয়া জায়েয হতে পারে না। তাই ফরয আদায় করেও আল্লাহর নৈকট্য লাভ হল না। অতএব পুনরায় তা দিতে হবে। কোনরূপ সন্দেহ ও অনুসন্ধিৎসা ছাড়াই কাউকে যাকাত দেয়া হলে তা যাকাত-ব্যয়ের যথার্থ ক্ষেত্র কিনা সে বিষয়ে মনে কোন প্রশ্নই যদি না জেগে থাকে-পরে তার ভুল প্রকাশিত হয়ে পড়ল, জানা গেল যে, যাকাত ব্যয়ের সঠিক ক্ষেত্র নয়-তা হলে তা আদায় হয়নি, পুনরায় তাকে তা দিতে হবে। কেননা সে তার সাধ্যমত চেষ্টা করেনি। আর যদি তার ভুল প্রকাশিত না হয় ও ধরা না পড়ে, তবে তা জায়েয ধরে নিতে হবে। আর যদি সঠিক ক্ষেত্র বের করার জন্যে চেষ্টা চালিয়ে থাকে, যাকাত দিল এমন ব্যক্তিকে যে তার যথার্থ ক্ষেত্র নয় বলে ধারণা হওয়া সত্ত্বেও কিংবা সন্দেহ করল, কিন্তু যথার্থ ক্ষেত্র জানতে চেষ্টা করেনি, তা হলে আদায় হবে না- যতক্ষণ না তা সঠিক ক্ষেত্ররূপে প্রকাশিত হয়। পরে যদি তার যথার্থতা প্রকাশিত হয়, তাহলে সহীহ্ কথা- তা জায়েয হল। ফিকাহবিদগণ বলেছেন, যাকে দেয়া হল, সে যদি ফকীরদের কাতারে দাঁড়িয়ে তাদের মতই কাজ করে, অথবা তাদের মতই তার বেশ-বাস থাকে, কিংবা সে চাইল, তাই দিয়ে দিল- এ সব কার্যকারণ সঠিক জ্ঞান লাভের চেষ্টার পর্যায়ে গণ্য, এরূপ অবস্থায় পরে যদি তার ধনী হওয়ার কথা প্রকাশিতও হয়, তবু পুনরায় দিতে হবে না। ভুলবশত গ্রহণ করা হলে তা কি তার নিকট থেকে ফেরত দেয়া হবে? যুদ্ধে লিপ্ত ব্যক্তির নিকট থেকে ফেরত নিতে হবে না। হাশিমী হলে সে পর্যায়ে দুটি বর্ণনা। নিজের ধনী সন্তান হলে ফেরত নিতে হবে। তা কি তার জন্যে শুভ হবে?...... এ বিষয়ে মতভেদ আছে। আর যদি শুভ না হয়, তাহলে- বলা হয়েছে- সে দান করে দেবে, অন্যরা বলেছেন, দাতার কাছে প্রত্যর্পিত করতে হবে। [(আরবি***************)] মালিকী মতে সঠিক ক্ষেত্র জানতে চেষ্টা করেও যদি প্রকৃত অনুপযুক্ত লোককে যাকাত দিয়ে থাকে- যেমন সে ধনী, কাফির ইত্যাদি- যদিও ধরণা ছিল যে, সে পাওয়ার যোগ্য, তখন তা ফেরত নেয়া সম্ভব হলে তা ফিরিয়ে নিতে হবে – যদি তা অবশিষ্ট থেকে থাকে। অন্যথায় তার পরিবর্তনে অন্য কিছু নিতে হবে-যদি তা শেষ হয়ে গিয়ে থাকে। যেমন যদি খেয়ে ফেলে থাকে। বিক্রয় করে দিয়ে থাকে কিংবা কাউকে দান করে থাকে- এরূপ অবস্থায় গ্রহীতা তাকে ধোঁকায় ফেলে থাকুক, কি না-ই থাকুক। যদি নৈসর্গিক কারণে তানষ্ট হয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে তা বিবেচনা সাপেক্ষ গ্রহীতা যদি দাতাকে ধোঁকা দিয়ে থাকে-সে ধনী হওয়া সত্ত্বেও দারিদ্র্য প্রকাশ করে প্রতারিত করে থাকে অথবা কাফির হওয়া সত্ত্বেও মুসলমান হওয়ার কথা প্রকাশ করে থাকে, তা হলে তার বিনিময়টা তার কাছ থেকে ফেরত নেয়া ওয়াজিব। আর যদি ধোঁকা দিয়ে না থাকে; তা হলে গ্রহীতাকে কিছু ফেরত দিতে হবে না। দাতাকেই বরং দ্বিতীয়বার নিজ থেকে যাকাত দিতে হবে। কেননা প্রথমবারের দেয়াটা যথার্থ হয়নি। যেহেতু তা পাওয়ার যোগ্য লোক- মুসলিম দরিদ্র- তার সম্মুখে আসেনি, এ ধরনের লোক যাকাত পায়নি। এসব কথা ব্যক্তিগতভাবে যাকাত দেয়া অবস্থার জন্যে প্রযোজ্য। কিন্তু যদি রাষ্ট্রপ্রধান বা তাঁর প্রতিনিধি সঠিক ক্ষেত্র বের করতে চেষ্টা করার পর যাকাত দিয়ে থাকেন- কিন্তু পরে জানা গেল যে, গ্রহীতা তা পাওয়ার অনুপযুক্ত তাহলে তা আদায় হয়ে গেছে, রাষ্ট্রপ্রধানকে তা জরিমানাস্বরূপ পুনরায় ফকীরকে দিতে হবে না। কেননা সে তো মুসলমানদের কল্যাণেব জন্যে চেষ্টা করেছে। আর তাই এই চেষ্টার পুনরাবৃত্তি সম্ভব নয়। এ কারণে কেউ কেউ বলেছেন যে, তাঁর এই দেয়াটা যথার্থ হবে যদি তা ফিরিয়ে দেয়া সম্ভবও হয়, তবুও। এর ওপরও এ বলে আপত্তি তোলা হয়েছে যে, মাযহাবপন্থীদের কথা থেকে বোঝা যায় যে, প্রশাসক যাকে দিয়েছে তার হাত থেকে তা কেড়ে নিতে হবে- যদি গ্রহীতা তা পাওয়ার অধিকারী না হয়- যদি তা সম্ভবপর হয়। এ কথাটি পরিষ্কার। কেননা যাকাত তো আর ধনী লোকদের হতে দেয়া যায় না এবং তাদের হাত থেকে তা কেড়েও নেয়া যায় না? এরূপ অবস্থায় রাষ্ট্র প্রধান হচ্ছেন অছি; বিচারপতির অগ্রবর্তী। এ দুজনের ক্ষেত্রে তা যথার্থ হবে বলে ঐকমত্য প্রকাশ করেছেন- যদি তা ফেরৎ নেয়া দুষ্কর হয় কোনরূপ প্রতারিত না হলেও। আর যদি ফিরিয়ে নেয়া সম্ভব হয়, তাহলে তা ওয়াজিব হবে-এটা সর্বসম্মত মত। [(আরবি***************)] যায়দীয়া ফিকাহবিদদের মতে যে লোক যাকাত দেবে এমন লোককে, যে তা পাওয়ার যোগ্য নয় সর্বসম্মতভাবে-কিংবা তার মাযহাব অনুযায়ী যাকে দেয়া যায় এমন লোককে ছাড়া দেয়া হলে তা পুনর্বার দিতে হবে। প্রথম বারের দেয়াকে যাকাত মনে করা যাবে না। সর্বসম্মতভাবে যাকাত পাওয়ার অযোগ্য লোক হচ্ছে কাফির- কাফির ব্যক্তির পিতামাতা ও সন্তান এবং ধনী-যার ধনাঢ্যতা সর্বসম্মতভাবে স্বীকৃত। এরূপ লোককে যাকাত দেয়া হলে তা পুনরায় দিতে হবে, তাদেরকে দেয়া হারাম তা জেনে-শুনে দিক, কি না জেনে শুনে, কিংবা এই ধারণার বশবর্তী হয়ে যে, কাফির মুসলিম এবং সন্তান ও পিতামাতা কেউ অপরিচিত নয়। আর ধনী গরীবও চেনা যায় না কিংবা এরূপ কোন ধারণা ছাড়াই। সর্বাবস্থায়ই তা পুনরায় দিতে হবে। যেসব লোকের যাকাত পাওয়ার অধিকারে মতবৈষম্য রয়েছে- যেমন এমন নিকটাত্মীয় যার ব্যয়ভার বহন তার জন্যে জরুরী, আর ধনী-যার ধনাঢ্যতায় মতপার্থক্য রয়েছে-এদের কাউকে যাকাত দেয়া হলে অথচ তার মাযহাবী মত হচ্ছে যে, তাকে দেয়া জায়েয নয়, দিল এই কথা জেনে-শুনে যে, তার সাথে ঘনিষ্ঠতা রয়েছে, অথচ তার মাযহাব অনুযায়ী কথা নিষিদ্ধ-তা পুনরায়য় দেয়া একান্তই আবশ্যক। এই কথা সর্বসম্মত। তাদেরকে যাকত দেয়া হারাম, কিংবা তার মাযাহাব না জেনেও অথবা ওরা অপরিচিত লোক এই ধারণা নিয়ে কিংবা ধনী ব্যক্তিকে দরিদ্র মনে করেই যদি দিয়ে থাকে, তাহলে তা পুনরায় দিতে হবে না। কেননা মত বিরোধীয় বিষয়াদি সম্পর্কে অজ্ঞ লোক তো ভুলো মনের মতই অক্ষম অথবা ইজতিহাদকারী ভুল করলেও যেমন হয়, এ-ও তেমনি। [(আরবি***************)] এসব বিভিন্ন অবস্থাকে বিচার-বিবেচনা করে আমি মনে করি, যে লোক সত্য জানতে প্রাণপণ চেষ্টা করেও ভুল করেছে ও তার যাকাত যথার্থ স্থানে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়েছে, সে তো মাযূররূপে গণ্য। কাজেই তার এ ভুলের জন্যে তাকে ক্ষতিপূরণ বাবদ কিছু করতে বাধ্য করা যায় না। কেননা সে তো তার সাধ্যমত চেষ্টা চালিয়েছে। হানাফীদেরও এই মত। তার দলিল হচ্ছেঃ (আরবি***************) আল্লাহ তো মানুষকে দায়িত্ব দেন তার সাধ্যে যতটা কুলোয় ততটাই, তার বেশি নয়। আর আল্লাহ কারুরই শুভকর্ম ফল বিনষ্ট করেন না। যেমন কোন ব্যক্তি যদি তার যাকাত কোন চোরের, ব্যভিচারীর বা ধনী ব্যক্তির হাতে পৌঁছায় তাহলে যেমন হয়, এ-ও ঠিক তেমনি। হ্যাঁ, সত্য জানার চেষ্টার ত্রুটি করে থাকলে, বে-পরোয়াভাবে যাকাত বন্টন বা ব্যয় করে থাকলে যদি প্রকাশিত হয় যে, সে ভুল করে বসেছে, যথার্থ ক্ষেত্রে যাকাত পৌঁছাতে পারেনি, তাহলে তাকে তার এই ভুলের দণ্ড-যা তার নিজের ত্রুটির দরুন দেখা দিতে পেরেছে- ভোগ করতে প্রস্তুত থাকতে হবে। তাই তাকে পুনরায় যাকাত দিতে হবে যেন যথার্থ স্থানে তা পৌঁছানো সম্ভবপর হয়। কেননা আসলে তা- ফকীর, মিসকীন ও অন্যান্য পাওনাদার লোকদের হক, তাদেরকেই তা না দেয়া পর্যন্ত তাদের দায়িত্ব পালন সম্পূর্ণ হতে পারে না অথবা দিতে হবে তাদের প্রতিনিধি রাষ্ট্রপ্রধানের হাতে – তাদের সাধ্যে যেটা কুলোয়। আর এই উভয় অবস্থাতেই যে লোক তা গ্রহণ করেছে ও জানতে পেরেছে যে, তা যাকাত- সে তা পাওয়ার যোগ্য নয়, তার কর্তব্য হচ্ছে, তা ফিরিয়ে দেয়া অথবা তা ধ্বংস হয়ে গিয়ে থাকলে তার বদল বা বিকল্প ফেরত দেবে। অন্য লোকের অধিকার সে কিছুতেই ভক্ষণ করতে পারে না। তা খেলে তার পেট আগুন খেয়ে ফেলবে। এটা তখনকার জন্যে যখন তাগিদ করা হবে বা তার বেশির ভাগ ধারণা হবে যে, সে তা পাওয়ার অধিকারী নয়। অন্যথায় তা তারই হয়ে যাবে। যেমন সে তা গ্রহণ করল; কিন্তু তা যে যাকাত তা সে জানতে পারল না, তা তার হতে বিনষ্ট হয়ে গেল- তখনও এই হুকুম। হাদীসে উদ্ধৃত রাসূলের উক্তি ‘হে মায়ান, তুমি যা নিচ্ছ তা তোমার’ এ কথাটি বলার তাৎপর্য হচ্ছে, যে সম্ভবত তা পাওয়ার যোগ্য ছিল, যদিও তার পিতা তা পসন্দ করেন নি। রাষ্ট্রপ্রধান যদি যাকাত ব্যয়ের ক্ষেত্র সম্পর্কে ভুর করেন, তাহলে তাঁকে তার ক্ষতিপূরণ করতে হবে না। কেননা তিনি তো মুসলিম জনকল্যাণের জন্যে বিশ্বস্ত দায়িত্বশীল, যদি এই ধরনের অনুপযুক্ত লোক তা নেয় এবং তার হতে তা মওজুদ থাকে, তাহলে তা ফেরত দেয়া কর্তব্য- যেমন মালিকী আলিমরা বলেছেন। দ্বিতীয় অধ্যায় যাকাত আদায় করার পন্থা যাকাতের সাথে রাষ্ট্রের সম্পর্ক যাকাতের ক্ষেত্রে নিয়তের স্থান যাকাত বাবদ মূল্য প্রদান সংগৃহীত যাকাত ভিন্ন জায়গায় স্থানান্তর যাকাত দেয়া তরান্বিতকরণ ও বিলম্বিতকরণ যাকাত আদায় সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় ভূমিকা পূর্ববর্তী অধ্যায়সমূহের আলোচনা থেকে আমরা জানতে পেরেছি যাকাত ফরয হওয়ার কথা, কার ওপর তা ফরয, কোন সব মাল-সম্পদে তা ফরয, তার প্রত্যেকটিতে কত পরিমাণ ফরয-এর সবই জানতে পারা গেছে। অনুরূপভাবে এও জানতে পেরেছি, কার জন্যে যাকাত ব্যয় করতে হবে, পাওয়ার যোগ্য লোক কত প্রকারের এবং কোন্ কোন্ প্রকারের লোকদেরকে যাকাত দেয়া জায়েয নয়- এ সব বিষয়েই বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। এক্ষণে যাকাত আদায় করার যথার্থ পন্থা কি, সেই বিষয়ে জানা বাকী রয়েছে। যার ওপর যাকাত ফরয, সে নিজেই কি পাওয়ার যোগ্য লোকদের মধ্যে তা বন্টন করার দায়িত্বশীল কিংবা সে দায়িত্ব সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানের? আর এটা সর্বপ্রকারের মালের যাকাতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, না কোন কোন ধনমালের ক্ষেত্রে এবং কোন কোন ধন-মালের ক্ষেত্রে নয়? উপরন্তু রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যাকাত আদায়ের ব্যবস্থা যদি না থাকে কিংবা রাষ্ট্রচালক যদি জালিম অথবা কাফির হয়, তাহলে তখণ কি করা যাবে? যাকাত আদায়ে নিয়তের কি শর্ত আছে? যাকাতদাতার নিয়ত ছাড়াই সরকার যদি জোর করে নিয়ে নেয়, তাহলে তখন কি হবে? রাষ্ট্র-সরকারের পক্ষে কিংবা দাতার পক্ষে এবং এক স্থান থেকে অন্য স্থানে- এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাকাত স্থানান্তরিত করা কি জায়েয? এ ব্যাপারে সীমা কি এবং কোথায়? যাকাত জিনিসের বদলে তার মূল্য দেয়া কি জায়েয কিংবা ঠিক যেটা দেয়া ফরয, সেই আসল জিনিসটাই দিয়ে দিতে হবে-দেয়া কি ওয়াজিব- যাকাত ফরয হওয়ার পর তা আদায় তরতে বিলম্ব করা কি জায়েয? যদি বিলম্বিত করা হয়, তাহলে কি হুকুম? বিলম্ব করলে কি যাকাত ফরয পরিত্যক্ত হবে? আর খুব তাড়াতাড়ি দেয়ার বা হুকুম কি? যাকাত গোপন করা কি জায়েয? যে তা গোপন করল, তার কি শাস্তি হবে? যাকাত আদায় করার দায়িত্ব এড়ানোর পরিণাম কি? তা প্রত্যাহার করানোর উদ্দেশ্যে কোন কৌশল অবলম্বন করলে কি হবে?...... এগুলো এবং আরও অনেক প্রশ্ন যাকাত আদায় ও বন্টন পর্যায়ের সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত। এগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা হওয়া আবশ্যক। আমরা এ পর্যায়ে এসব ও এর সাথে সংশ্লিষ্ট আরও বহু প্রশ্ন নিয়ে পরবর্তী পরিচ্ছেদসমূহে সবিস্তারে আলোচনা করব। এই উদ্দেশ্যেই এ অধ্যায়ের অবতারণা। প্রথম পরিচ্ছেদ যাকাতের সাথে রাষ্ট্রের সম্পর্ক যাকাতের ব্যাপারে রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও জবাবদিহি পূর্বে যেমন সবিস্তারে বলা হয়েছে, যাকাত একটা প্রমাণিত ও সুনির্দিষ্ট অধিকার বিশেষ- তা আল্লাহ কর্তৃক ফরয করা হয়েছে। কিন্তু মূলত তা এমন অধিকারের জিনিস নয় যা ব্যক্তিদের ওপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে বলে মনে করতে হবে। অতঃপর যে লোক আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পরকালীন মুক্তি চায়, সে তা দেবে; আর যার পরকালের প্রতি প্রত্যয় দুর্বল, আল্লাহর ভয়ের মাত্রা ক্ষীণ- অন্তরে আল্লাহর মহব্বতের তুলনায় ধন-মালের মহব্বত প্রবল, সে তা দেবে না। এরূপ মনে করা ঠিক নয়। না, যাকাত কোন ব্যক্তিগত অনুগ্রহ বা দয়ার ব্যাপার নয়। তা একটা সামষ্টিক ঘংগঠনের সাথে গভীরভাবে সংশ্লিষ্ট। রাষ্ট্র-সরকারই এই সংগঠন ও তৎসংশ্লিষ্ট ব্যাপারাদি আঞ্জাম দেয়ার জন্যে দায়িত্বশীল। তা একটা সুগঠিত প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতিতে পালনীয়। সরকারই এ অনন্য দায়িত্ব পালনের জন্যে একান্তভাবে দায়ী। যার ওপর যাকাত ফরয তার কাছ থেকে সরকারই তা আদায় ও সংগ্রহ করবে এবং যাদের তা প্রাপ্য, তাদের মধ্যে তা সুষ্ঠু বন্টনের দায়িত্বও সরকারের ওপরই অর্পিত। কুরআনের দলিল এই কথার সবচাইতে বড় দলিল হচ্ছে, যাকাত আদায়-সংগ্রহ ও বন্টনের ব্যাপারে যারাই দায়িত্বশীল, আল্লাহ্ তা’আলা নিজেই তাদের উল্লেখ করেছেন এবং তাদের নাম দিয়েছেনঃ (আরবি***************) –’এই কাজের কর্মচারী লোকগণ’। আর মূল যাকাতেই এদের জন্যে একটা অংশও নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন তাদের মজুরী বা পারিশ্রমিক হিসেবে। অন্য কোন ফাণ্ড বা দুয়ার থেকে তাদের বেতন গ্রহণের জন্যে তাদেরকে বাধ্য করেন নি। ফলে তাদের জীবিকার পূর্ণ নিরাপত্তা দেয়া হয়েছে, তারা যাতে করে সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম হয়, তার নির্ভরযোগ্য ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। আল্লাহ্ নিজেই বলেছেনঃ (আরবি***************) যাকাত কেবলমাত্র গরীব ও মিসকীন, সে কাজে নিযুক্ত কর্মচারী, যাদের হৃদয় সন্তুষ্ট রাখতে হচ্ছে, ক্রীতদাসের ঋণগ্রস্তদের, আল্লাহর পথে এবং নিঃস্ব পথিকের ব্যাপারে ব্যয়িত হওয়ার জন্যে নির্দিষ্ট। এটা আল্লাহর কাছ থেকে আরোপিত ফরয। আর আল্লাহর সর্বজ্ঞ, মহাবিজ্ঞানী। [(আরবি***************)] কুরআন মজীদে এই সুস্পষ্ট-অকাট্য ঘোষণা দেয়ার পর কারুর পক্ষে এ থেকে রুখসত বা নিষ্কৃতি পাওয়ার কিংবা অন্য কোন রকম ব্যাখ্যা করার অথবা ভিন্ন কোন ধারণা পোষণ করার একবিন্দু অবকাশ থাকতে পারে না। বিশেষ করে যখন বলা হয়েছেঃ এটা আল্লাহর কাছ থেকে ধার্যকৃত ফরয’ এবং তার বন্টন ক্ষেত্র হিসেবে এ থাতগুলোর উল্লেখ করা হয়েছে এবং তা সুনির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। অতঃপর আল্লাহ কর্তৃক ধার্যকৃত ফরযকে কে অকেজো করে দিতে পারে, কার সে অধিকার আছে? যে সূরাতে যাকাত ব্যায়ের উপরিউক্ত ক্ষেত্রসমূহের উল্লেখ করা হয়েছে, ঠিক সেই সূরাটিতেই আল্লাহ্ তা’আলা বলেছেনঃ (আরবি***************) তুমি তাদের ধন-মাল থেকে যাকাত গ্রহণ কর, তুমি তাদের পবিত্র কর, এবং তদ্দারা তাদের পরিশুদ্ধ কর এবং তাদের জন্যে পূর্ণ দো’আ কর। তোমার পূর্ণ দো’আ নিঃসন্দেহে তাদের জন্যে সান্ত্বনার কারণ। [(আরবি***************)] আগের কালের ও একালের জমহুর মুসলমান মত প্রকাশ করেছেন যে, আলোচ্য আয়াতে ‘সাদকা (আরবি***************) অর্থ যাকাত।’ প্রথম অধ্যায়ে আমরা এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করে এসেছি। উপরিউক্ত কথার সমর্থনে একটা বাস্তব ও ঐতিহাসিক দলিল হচ্ছে, হযরত আবূ বরক (রা) এর খিলাফত আমলের ‘যাকাত দিতে অস্বীকারকারী’ লোকেরা এই আয়াতটিকেই ভিত্তি করেছিল। বাহ্যত উক্ত আয়াতটি বোঝায় যে, যাকাত গ্রহণের দায়িত্ব শুধুমাত্র নবী করীম (সা)এর। তিনিই তার বিনিময়ে তাদের জন্যে দো’আ করবেন। একজন সাহাবীও এই দাবি করেনি যে, এই আয়াতটি ফরয যাকাত ভিন্ন অন্য কোন বিষয়ে কথা বলছে। তাঁদের পরে ইসলামের মহান ইমামগণ সেই লোকদের উত্থাপিত সন্দেহের প্রতিবাদ ও অপনোদন করেছেন। তাঁরা সকলেই যা বলেছেন, তা হচ্ছে, ‘তাদের ধন-মাল থেকে যাকাত নাও’ বলে যে নির্দেশটি দেয়া হয়েছে, তা যেমন নবী করীম (সা) এর প্রতি ছিল, তেমনি ছিল তাঁর পরবর্তী মুসলিম মিল্লাতের দায়িত্বশীল প্রত্যেক ব্যক্তির জন্যেও।........ এ বিষয়েও আমরা প্রয়োজনীয় কথা বলে এসেছি। হাদীস আল্লাহর কিতাবে উদ্ধৃত দলিল সম্পর্কিত কথা উপরে বলা হয়েছে। এক্ষণে এ বিষয়ে নবীর সুন্নাত উপস্থাপিত করা হচ্ছে। বুখারী, মুসলিম ও অন্য গ্রন্থাবলীতে উদ্ধৃত হযরত ইবনে আব্বাস বর্ণিত হাদীস হচ্ছেঃ নবী করীম (সা) যখন হযরত মুয়ায (রা) কে ইয়েমেন পাঠিয়েছিলেন, তখন তিনি তাঁকে বলেছিলেনঃ তাদের তুমি জানিয়ে দেবে, আল্লাহ তা’আলা তাদের ধন-মালে যাকাত ফরয করে দিয়েছেন, যা তাদের ধনী লোকদের কাছ থেকে গ্রহণ করা হবে, পরে তাবন্টন করা হবে তাদের দরিদ্র লোকদের মধ্যে। তারা যদি তোমার এ কথা মেনে নেয়, তাহলে তুমি তাদের বাছাই করা উত্তম মালসমূহ থেকে দূরে থাকবে। আর নিপীড়িতের ফরিয়াদকে তুমি খুবই ভয় করবে। কেননা তার ও আল্লাহর মধ্যে কোন প্রতিবন্ধক নেই। (ইবনে আব্বাস থেকে অনেকেই হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন)। এ হাদীসটিতে আমরা লক্ষ্য করছি, নবী করীম (সা) সেই ফরয যাকাত সম্পর্কেই বলেছেনঃ তাদের ধনী লোকদের থেকে তা নেয়া হবে এবং তাদেরই দরিদ্রদের মধ্যে তা বন্টন করা হবে। হাদীসটি স্পস্ট ভাষায় ঘোষণা করছে, কোন গ্রহণকারী আদায়কারী তিদের নিকট থেকে তা গ্রহণ ও আদায় করবে এবং বন্টনকারী তা বন্টনও করবে। যার ওপর তা ফরয, তার ইচ্ছার ওপর তা ছেড়ে দেয়ার কোন প্রশ্নই ওঠেনা। শায়খুল ইসলাম হাফেয ইবনুল হাজার বলেছেনঃ উক্ত হাদীস এ কথার দলিল যে, রাষ্ট্রপ্রধান (সরকারই) যাকাত সংগ্রহ ও ব্যয় বন্টনের জন্যে দায়িত্বশীল, হয় সে নিজে এ কাজ করবে, নয়তো করবে তার প্রতিনিধি। আর যে লোক তা দিতে অস্বীকার করবে, তার কাছ থেকে তা বল প্রয়োগের মাধ্যমে নেয়া হবে। [(আরবি***************)] শাওকানী তাঁর ‘নাইলুল আওতার’ গ্রন্থে এ সব হাদীসই উদ্ধৃত করেছেন। [(আরবি***************)] যাকাতের কাজে নিযুক্ত এইসব কর্মচারীদের কথা বিশ্লেষণ পর্যায়ে বিপুল সংখ্যাক হাদীস উদ্ধৃত হয়েছে। তখন তাদেরকে (আরবি***************) অথবা (আরবি***************) ‘চেষ্টাকারী লোকগণ’ বা ‘সাদকা আদায়কারী লোকগণ’ নামে অভিহিত করা হত। পূর্ব অধ্যায়ে আমরা ‘যাকাত কার্যে নিযুক্ত কর্মচারী’ খাত সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছু কথা বলেছি। যাকাত দেয়া যাদের ফরয তাদের এই যাকাত সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছূ কথা বলেছি। যাকাত দেয়া যাদের ফরয তাদের এই যাকাত সংগ্রহকারীদের প্রতি কি কর্তব্য, বহু সংখ্যক হাদীসে বিশদভাবে বলা হয়েছে। আমরা শিগগিরই এ পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ কথাগুলো বলব। নবী ও খুলাফায়ে রাশেদুনের বাস্তব সুন্নাত উপরে রাসূলে করীম (সা)এর কথার সুন্নাত উদ্ধৃত হয়েছে। তাঁর বাস্তব কর্মের সুন্নাত সেই কথাকে অধিকতর বলিষ্ঠ করে তোলে। রাসূলের এবং তারপর খুলাফায়ে রাশেদুনের সময়ে যেদ কর্মধারা প্রবহমান ছিল, তার ঐতিহাসিক ঘটনাবলীও সেই কথারই সত্যতা ও বাস্তবতা প্রমাণ করে। হাফেয ইবনুল হাজার (আরবি***************) গ্রন্থে ইমাম রাফেয়ী উদ্ধৃত এ হাদীসটির উল্লেখ করেছেনঃ নবী করীম (সা) এবং তারপর খলীফগণ যাকত গ্রহণের উদ্দেশ্যে চেষ্টাকারী লোক (আরবি***************) পাঠাতেন। এ হাদীসটি মশহুর। বুখারী ও মুসলিমে আবূ হুরায়রা (রা) থেকে উদ্ধৃত হয়েছেঃ ‘হযরত উমর যাকাতের জন্যে লোক পাঠালেন। ঐ দুটি গ্রন্থ আবূ হুমাইদ থেকে উদ্ধৃত হয়েছেঃ ‘আজাদ’ বংশের ইবনুল লাতবীয়’ নামক এক ব্যক্তিকে এই কাজে কর্মচারী নিযুক্ত করেছেলেন।’ গ্রন্থদ্বয়ে হযরত উমর থেকে উদ্ধৃত হয়েছে, তিনি ইবনে সাদীকে কাজে নিযুক্ত করেছিলেন। আবূ দাঊদ থেকে বর্ণিত হয়েছে নবী করীম (সা) আবূ মাসউদকে একজন যাকাত সংগ্রহকারীরূপে ‍নিযুক্ত করে পাঠিয়েছিলেন। মুসনাদে আহমদ গ্রন্থে রয়েছে; তিনি আবূ জহম ইবনে হুযায়ফাকে যাকাত ‍আদায়কারী করে পাঠিয়েছিলেন। তাতে আছেঃ তিনি উকবা ইবনে আমেরকে যাকাত আদায়কারীরূপে পাঠালেন। তাতে কুররা ইবনে দমূচ বর্ণিত হাদীসে রয়েছেঃ ‘দহহাক ইবনে কায়সকে যাকাত আদায়কারী করে পাঠালেন।’ ‘মুস্তাদরাক’ গ্রন্থে রয়েছেঃ তিনি কায়স ইবনে সায়াদকে যাকাত সংগ্রহকারীরূপে পাঠালেন। তাতে উবাদাহ ইবনে সামেত বর্ণিত হাদীস হচ্ছে, নবী করীম (সা) তাকে যাকাতদাতাদের কাছে পাঠালেন। অলীদ ইবনে উকবাকে বনুল মুস্তালিকের কাছে যাকাত আদায়কারী করে পাঠালেন। বায়হাকী শাফেয়ী থেকে বর্ণনা করেছেনঃ হযরত আবূ বকর ও উমর (রা) দুজনই যাকাত আদায়ের জন্যে লোক পাঠাতেন। শাফেয়ী ইবরাহীম ইবনে মায়াদ থেকে জুহরী থেকে সূত্রে উক্ত হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন। তাতে অতিরিক্ত রয়েছেঃ ‘এবং তা আদায় করাকে কোন বছরই বিলম্বিত করতেন না।’ প্রাচীন বর্ণনায় রয়েছেঃ উমর থেকে বর্ণিত, তিনি এই কাজ ‘রিমাদাহ’র বৎসর বিলম্বিত করেছিলেন। পরে যাকাত সংগ্রহকারী পাঠালেন। সে দুই দুই বছরের যাকাত নিয়ে এল। তাবকাতে ইবনে সাযাদ-এ উল্লিখিত হয়েছেঃ নবী করীম (সা) নবম সনের মুহররম চাঁদে (মাসে) আরবদের কাছে যাকাত আদায়কারী প্রেরণ করেছিলেন। এ কথাটি আল-ওয়াকিদী রচিত ‘কিতাবুল মাগাজী’তে বিস্তারিতভাবে এসেছে। [(আরবি***************)] ইবনে সায়াদ সে সব গোত্রের ও তাদের প্রতি প্রেরিত যাকাত আদায়কারীর নামও উল্লেখ করেছেন। উয়াইনা ইবনে হুনাইনকে পাঠিয়েছিলেন বনূ তামীম গোত্রের প্রতি তাদের যাকাত আদায়ের জন্যে। বুয়াইদা ইবনুল হাবীবকে আসলাম ও গাইফার প্রতি তাদের যাকাত আদায়ে জন্যে পাঠিয়েছিলেন। তাকে বলা হত কায়াস ইবনে মালিক। উবাদাহ ইবনে বাশার আল-আশহালকে মুলাইম ও মুলাইম ও মুজাইনা গোত্রের কাছে প্রেরণ করেছিলেন। রাফে ইবনে মাকীসকে জুহাইনা গোত্রের কাছে পাঠিয়েছিলেন। আমার ইবনুল আসকে পাঠিয়েছিলেন ফাজারাহ গোত্রের কাছে। দহহাক ইবনে সুফিয়ানুল কাইলানীকে বনু কিলাবের কাছে পাঠিয়েছিলেন। বুসর ইবনে সুফিয়ানুল কায়াবীকে বনু কায়াবের নিকট পাঠিয়েছিলেন। ইবনুল লাতামিয়া আল আজদীকে বনু যুবইয়ানের নিকট পাঠিয়েছিলেন। সায়াদ হুযাইমের কাছে তাদের যাকাতের জন্যেও এক ব্যক্তিকে পাঠিয়েছিলেন। ইবনে সায়াদ বলেছেন, রাসূলে করীম (সা) তাঁর প্রেরিতব্য যাকাত আদায়কারীদের ক্ষমাশীলতা অবলম্বনের জন্যে এবং লোকদের উত্তম ও বাছাই করা ধন-মাল বেছে বেছে নেয়া পরিহার করার জন্যে নির্দেশ দিতেন। [(আরবি***************)] ইবনে ইসহাক অপরাপর জনগোষ্ঠীর উল্লেখ করেছেন, যাদেরকে নবী করীম (সা) বিভিন্ন গোত্র ও আরব উপদ্বীপের অন্যান্য এলাকার প্রতি প্রেরণ করেছিলেন। মুহাজির ইবনে আবূ উমাইয়্যাতাকে ছানয়ায় পাঠিয়েছিলেন। পরে তার কাছে আসওয়াদ আল-আনাসী বের হয়ে এসেছিল, সে সেখানেই অবস্থান করছিল। জিয়াদ ইবনে লবীদকে হাজরা মওতে পাঠিয়েছিলেন। আদী ইবনে হাতেমকে তাই ও বনু আসাদ গোত্রের প্রতি পাঠিয়েছিলেন। মালিক ইবনে নুযাইরাতাকে বনু হিঞ্জালার যাকাতের জন্যে পাঠিয়েছিলেন। মলিক ইবনে নুযাইরাতাকে বনু হিঞ্জালার যাকাতের জন্যে পাঠিয়েছিলেন। বনু মায়াতের যাকাত আদায়ের দায়িত্ব দুই ব্যক্তির মধ্যে ভাগ করে দিয়েছিলেন। জবরকান ইবনে বদরকে একদিকে এবং কাইস ইবনে আবেমকে অপরদিকে পাঠিয়েছিলেন। ‘আলা’ ইবনুল হাজরামীকে বাহরাইনে পাঠিয়েছিলেন। হযরত আলীকে পাঠিয়েছিলেন নাজরানের দিকে তাদের যাকাত সংগ্রহ করার উদ্দেশ্য এবং এজন্য যে, তারা তাদের জিযিয়া তাঁর নিকট পেশ করবে। [(আরবি***************)] আল-কাত্তানী রচিত (আরবি***************) গ্রন্থে ইবনে হাজমের (আরবি***************) থেকে, ইবনে ইসহাক ও আল-কালায়ী রচিত ‘সীরাত’ থেকে ইবেন হাজার রচিত ‘আল-ইসাবাহ’ থেকে সেসব সাহাবীদের নাম উদ্ধৃত করা হয়েছে যাঁদেরকে নবী করীম (সা) যাকাত বিভাগের দায়িত্বে বা সে বিষয়ে লেখাপড়া করার জন্যে বিভিন্ন দায়িত্বে ‍নিযুক্ত করেছিলেন। বলেছেনঃ ইবনে হাজম তাঁর (আরবি***************) নামক গ্রন্থে বলেছেনঃ যাকাতের হিসাব লেখার জন্যে রাসূলে করীম (সা)-এর নিযুক্ত ব্যক্তি ছিলেন জুবাইর ইবনুল আওয়াম (রা), তাঁর অনুপস্থিতি কিংবা অক্ষমতার ফলে জুহাম ইবনুস সালাত ও হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামোন এই লেখার কাজ সমাধান করতেন। [(আরবি***************)] আরও বলেছেনঃ [(আরবি***************)] গ্রন্থে আল-আরকাম ইবনে আবুল আরকমের আজ-জুহরীর জীবন বৃত্তান্ত লেখা হয়েছে। তাতে উল্লেখ করা হয়েছেঃ তাবারানী উল্লেখ করেছেনঃ নবী করীম (সা) তাঁকে (আরকাম) যাকাত সংগ্রহের কাজে কর্মচারী নিযুক্ত করেছিলেন। তাতে কাফীয়া ইবনে সাবা আল-আসাদীর বৃত্তান্তও উদ্ধৃত হয়েছে। ওয়াকিদী থেকে উদ্ধৃত হয়েছেঃ নবী মুস্তফা (সা) তাঁকে তাঁর গোত্রের লোকজনের যাকাতের ব্যাপারে কর্মচারী নিযুক্ত করেছিলেন। হুযায়ফাতা ইবনুল ইয়ামান প্রসঙ্গেও লেখা হয়েছে, ইবনে সায়াদ থেকে উদ্ধৃত করা হয়েছে, নবী করীম (সা) তাঁকে ‘আজদ’ গোত্রের যাকাত সংগ্রহের কাজে নিযুক্ত করেছিলেন। ‘আল-ইসাবা’ গ্রন্থে কাহাল ইবনে মালেক ‘আল-হাযালী’র বৃত্তান্ত লেখা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, নবী মুস্তফা (সা) তাঁকে হুযাইলের যাকাত সংগ্রহের কাজে কর্মচারী নিযুক্ত করেছিলেন। তাতে খালিদ ইবনুল বারচায়ার কথাও উদ্ধৃত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, আবূ দাঊদ ও নাসায়ী মা’মার জুহরী থেকে- আয়েশা (রা) থেকে সূত্রে উদ্ধৃত করেছেনঃ নবী করীম (সা) আবূ জহম ইবনে হুযাইফা (রা)-কে যাকাত আদায়কারী নিযুক্ত করেছিলেন। খালেদ ইবনে সায়ীদ ইবনুল আঁচ আল-উমাভীর বৃত্তান্তে বলা হয়েছে যে, নবী মুস্তাফা (সা) তাঁকে মুযহিজ-এর যাকাত সংগ্রহে নিযুক্ত করেছিলেন। হুযাইমাতা ইবনে আসেম আর-আকলীর জীবনীতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ইবনে কানে’ সাইফ ইবনে উমর- থেকে মায়সের ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে আদাস থেকে-এই সূত্রে বর্ণনা করেছেন যে, আদাস ও খুজাইমা নবী করীম (সা)-এর কাছে প্রতিনিধি হয়ে এলেন। পরে তিনি খুজাইমাকে আহলাফ গোত্রের প্রশাসক নিযুক্ত করলেন এবং তাঁকে লিখলেনঃ ‘আল্লাহর নামে যিনি দয়াবান ও করুণানিধান’ আল্লাহ রাসূল মুহাম্মাদ থেকে খুজামা ইবনে আসেমের নামেঃ আমি তোমাকে তোমার লোকজনের ওপর যাকাত সংগ্রহকরূপে ‍নিযুক্ত করলাম। সেই লোকেরা যেন আহত না হয়, তাদের ওপর যেন জুলুম করা না হয়। এ কথাটি রাশাতী উল্লেখ করেছেন এবং বলেছেনঃ আবূ উমর তা উপেক্ষা করল। সাহম ইবনে মিনজাব তাইমীর জীবন বৃত্তান্তে তাবারী থেকে উদ্ধৃত করেছেন যে, তিনি নবী করীম (সা)-এর নিয়োজিত বনু তমীমের যাকাত সংগ্রহ কাজে কর্মচারী ছিলেন। নবী করীম (সা)-এর ইন্তেকালের পর পর্যন্ত তিনি এ কাজে নিযুক্ত ছিলেন। ইকরামা ইবনে আবু জেহলের জীবন বৃত্তান্তে তাবারী থেকে উদ্ধৃত করেছেনঃ নবী করীম (সা) তাঁকে হাওয়াজিনের যাকাত সংগ্রহ কাজে নিযুক্ত করেছিলেন তাঁর ওফাতের বছর। মালিক ইবনে নুযাইরাতার জীবনীতে উল্লেখ করেছেনঃ তিনি বেশ কয়জন রাজা-বাদশাহর সহযাত্রী ছিলেন। নবী করীম (সা) তাঁকে তাঁর জনগণের যাকাত সংগ্রহ কাজে কর্মচারী ‍নিযুক্ত করেছিলেন মুনয়িম ইবনে নুযাইরাতা তামীমীর জীবন কাহিনীতে বলেছেনঃ নবী করীম (সা) তাঁকে বনু তমীমের যাকাত সংগ্রহের জন্যে প্রেরণ করেছিলেন। মুরদাম ইবনে মালেক আল-গনভীর জীবন বৃত্তান্তে বলা হয়েছে, নবী করীম (সা) তাঁকে তাঁর লোকজনের যাকাত সংগ্রহ কজে ক্ষমতাশালী করে নিযুক্ত করেছিলেন। এভাবেই নবী করীম (সা) প্রায় গোটা উপদ্বীপ পরিব্যপ্ত করে ফেলেছিলেন। [দেখুনঃ (আরবি***************) আমরা (আরবি***************) নামক দেমাশক থেকে প্রকাশিত পত্রিকাটি থেকে- যা নবী জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলী (আরবি***************) নামের সমষ্টির মধ্যে স্পষ্ট করে তুলেছে, তা থেকেই এই কথা উদ্ধৃত করেছি, তা যদিও পূর্ণাঙ্গ নয়। তবে ইবনে ইসহাক উদ্ধৃত কাহিনী তার সাথে মেশালে তা সম্পূর্ণ হয়। তবে ম্যাপটিতে গোত্রসমূহের অবস্থান দেখানোর কারণে উদ্দেশ্যপূর্ণ হয়ে যায়।] সর্বত্র তিনি যাকাত আদায়কারী ও সে জন্যে চেষ্টাকারী কর্মচারীদেরকে নিযুক্ত করেছিলেন, যেন যাকাত ফরয হওয়া লোকেরা তা যথাযথভাবে আদায় করার সুবিধা পায়। নবী করীম (সা) এ কাজে নিযুক্ত লোকদেরকে ধন-মালের মালিকদের সাথে ইসলামী শিক্ষা অনুযায়ী কিরূপ আচরণ করতে হবে সেই সংক্রান্ত মূল্যবান উপদেশে সুসমৃদ্ধ ও শক্তিমান করে দিতেন। তাদের সাথে দয়ার্দ্র ও সহজাতমূলক আচরণ গ্রহণ করার-সেই সাথে আল্লাহর হক আদায়ের ব্যাপারে কোনরূপ উপেক্ষা-অপমানের আবেশ না আসতে পারে সে বিষয়ে যত্মবান হওয়ার উপদেশ দিতেন। অনুরূপভাবে কোনরূপ অধিকার ছাড়া জনগণের একবিন্দু মাল গ্রহণ সম্পর্কে তীব্র ভাষায় ও কঠিনভাবে হুঁশিয়ার করে দিতেন। তাঁদের কারোর কারোর কাছ থেকে যাকাত সংগ্রহের হিসেবও গ্রহণ করা হত, যেমন পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, ইবনুল লাতবীয়া যখন কর্মক্ষেত্র থেকে ফিরে এলেন তাঁর নিকট থেকে সংগৃহীত যাকাতের হিসাব নেয়া হয়েছিল। ইবনুল কাইয়্যেম লিখেছেন, দায়িত্বশীল কর্মচারীদের নিকট থেকে হিসাব গ্রহণ এবং তাদের কার্যকলাপের যে বিচার বিশ্লেষণ করা হত তার প্রমাণ এতেই রয়েছে। তাতে কারুর কোন বিশ্বাসভঙ্গের ত্রুটি ধরা পড়লে তাকে বরখাস্ত করা হত এবং অপেক্ষাকৃত বিশ্বস্ত লোক নিযুক্ত করা হত, [(আরবি***************)] এতেও কোনই সন্দেহ নেই। এসব কিছুই আমাদের সম্মুখে অকাট্যভাবে প্রতিভাত করে তুলে যে, নবী করীম (সা)-এর যুগ হতেই যাকাত সংক্রান্ত গোটা ব্যাপারটি সরকারীভাবে পালনীয় কাজরূপে গণ্য হয়ে এসেছে। এটা একান্তভাবে সরকারী কাজরূপে গণ্য। এই কারণে নবী করীম (সা) ইসলাম গ্রহণকারী প্রত্যেকটি জনগোষ্ঠী ও গোত্রের জন্যে একজন করে যাকাত আদায়কারী নিযুক্ত করার ইচ্ছা করেছিলেন। সে সেখানকার ধনী লোকদের নিকট থেকে যাকাত আদায় করবে তা পাওয়ার যোগ্য লোকদের মধ্যে তা বন্টন করবে। তাঁর পরবর্তী খলীফাগণও এই ব্যবস্থাই চালু রেখেছিলেন। এই কারণে আরিমগণ বলেছেন, যাকাত আদায়ের জন্যে কর্মচারী নিয়োগ ও প্রেরণ করা রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব। কেননা নবী করীম (সা) ও তৎপরবর্তী খলীফাগণ তাই করেছেন। তাঁরা যাকাত আদায়কারী লোক সর্বত্র পাঠাতেন। আরও এজন্যে যে, লোকদের ধন-মাল থাকলেও তা থেকে তাদের কি দিতে হবে, তা সাধারণত তারা জানে না। অনেকে কার্পণ্যও করে। অতএব আদায়কারী পাঠানো একান্তই কর্তব্য। [(আরবি***************)] বিভিন্ন গোত্রের ধনশালী ব্যক্তিদেরও কর্তব্য হচ্ছে যাকাত আদায়ে নিযুক্ত লোকদের সাথে এই কাজ সুষ্ঠুরূপে আঞ্জাম দেয়ার ব্যাপরে পূর্ণ সহযোগিতা করা, তাদের ওপর যা যা ধার্য হবে তা নিজ থেকেই আদায় করে দেয়া এবং বিন্দুমাত্রও গোপন না করা, তাদের ধন-মালের কোন অংশ বাদ দিয়ে হিসাব না করাও কর্তব্য। রাসূলে করীম (সা) নিজেই এবং তাঁর সাহাবিগণ এরূপই আদেশ করেছেন। জবীর ইবনে আবদুল্লাহ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেনঃ আরব বেদুইনদের কিছু লোক রাসূলে করীম (সা)-এর কাছে উপস্থিত হয়ে বললেঃ যাকাত আদায়কারী কিছু লোক আমাদের কাছে আসে, তারা আমাদের ওপর জুলুম করে। তখন নবী করীম (সা) বললেনঃ তোমরা তাদেরকে রাজী-সন্তুষ্ট রাখতে চেষ্টা করবে। [ হাদীসটি মুসলিম তাঁর সহীহ্ গ্রন্থে উদ্ধৃত করেছেন।] জাবির ইবনে আতীক (রা) থেকে বর্ণিত , রাসূলের করীম (সা) বলেছেনঃ খুব শীঘ্র তোমাদের কাছে এমন অশ্বারোহী লোক আসবে, যারা তোমাদেরকে ক্রুদ্ধ করতে চাইবে। কাজেই তারা যখন তোমাদের কাছে আসবে তখন তেমরা তাদেরকে স্বাগতম জানাবে, তাদের পথ ছেড়ে দেবে, তারা যা চাইবে তা তাদের নিতে দেবে। এতে তারা যদি সুবিচার করে, তা হলে তাতে তাদেরই কল্যাণ হবে। আর জুলুম করলে তার অকল্যাণ তাদেরই ভোগ করতে হবে। মনে রাখবে, তোমাদের সম্পূর্ণ যাকাত দিয়ে দেয়াই তাদেরকে সন্তুষ্টকরণের উপায় এবং তাদের উচিত তোমাদের জন্যে দোআ করা। [ হাদীসটি আবূ দাউদ কর্তৃক বর্ণিত। নাইলুল আওতার’ গ্রন্থে তাই বলা হয়েছে (৪র্থ খণ্ড ১৫৫ পৃঃ-উসমানীয়া ছাপা) মুনাভী ‘ফায়খ’ গ্রন্থে লিখেছেনঃ সন্দেহ নেই, নবী করীম (সা) কখনই কোন জালিম লোককে কর্মচারীরূপে নিযুক্ত করেন নি। বরং তাঁর নিযুক্ত যাকাত আদায়কারীরা চূড়ান্ত মাত্রার ইনসাফপন্থী ছিলেন। তার হবেই বা না কেন? হযরত আলী, হযরত উমর ও মুয়ায (রা) প্রমুখই ছিলেন তাঁর নিযুক্ত লোক। রাসূল (সা) কোন জালিম লোক নিয়োগ করেছিলেন, তা বলা থেকেও পানা চাই। উক্ত কথার তাৎপর্য হচ্ছে শীঘ্র তোমাদের কাছে আমার কর্মচারীরা যাকাত চাইতে আসবে। কিন্তু সাধারণত মানব-মন ধন-মালের প্রেমে মশগুল থাকে। তাই তখন তোমরা ক্রুদ্ধ বা অসন্তুষ্ট হতে পার এবং তোমরা তাদেরকে জালেম ভাবতে পার। আসলে তারা তা নয়। রাসূলের কথাঃ ‘তারা জুলুম করলে’ উক্ত ধারণার প্রেক্ষিতেই বলা। ‘যদি’ শব্দই এই কথা প্রমাণ করে অর্থাৎ ধরে নেয়া হয়েছে, প্রকৃতপক্ষে তা হয়নি। মাযহারী বলেছেনঃ কথাটি সকল কালব্যাপী। তাই এর অর্থ তারা যেভাবেই যাকাত নিক না কেন, তোমরা বাধা দিও না। তারা তোমাদের প্রতি জুলুম করলেও না। যেহেতু তাদের বিরোধিতা করার অর্থ রাষ্ট্র-সরকারের বিরোধিতা। কেননা তারা সরকার কর্তৃক নিয়োজিত। আর সরকারের বিরোধিতা চরম অশান্তির সৃষ্টি করে। আদায়কারীদের জুলুমের বিরোধিতা করতে গিয়ে মাল গোপন করা জায়েয বলার প্রতিবাদ করে বলেছেন, তা কোন অবস্থায়ই জায়েয নয়। একটি হাদীসে লোকদের প্রশ্ন উদ্ধৃত হয়েছেঃ আদায়কারীরা বাড়াবাড়ি করলে আমরা কি মাল গোপন করব? জাবাবে রাসূল বলেছিলেনঃ না। তবে রাসূলের নিযুক্ত কর্মচারী ছাড়া অন্যদের নিযুক্ত কর আদায়কারীদের মধ্যে যারা জালিম, তাদের অসন্তুষ্ট করা ওয়াজিব। তারা যে জুলুম করে তার সহায়তা করে তাদেকে সন্তুষ্ট করা সম্পূর্ণ হারাম।(আরবি***************) আনাস (রা) থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি রাসূলে করীম (সা) কে বললেঃ আমি যদি আপনার প্রেরিত ব্যক্তির কাছে যাকাত শোধ করে দিই, তাতে কি আমি আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের কাছে থেকে দায়িত্বমুক্ত হয়ে যাবো? বলরেনঃ হ্যাঁ, আমার প্রেরিত ব্যক্তির কাছে তুমি যদি যাকাত দিয়ে দাও, তাহলে তুমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কাছে দায়িত্বমুক্ত হবে। আর তুমি তার সওয়াব পবে। যদি কেউ তা বিকৃত করে, তাহলে তার গুনাহ তারই ওপর পড়বে। [(আরবি***************) গ্রন্থে মুসনাদে আহমাদের বর্ণনায় বলা হয়েছে, ‘নাইলুল আওতার’ পূর্বোদ্ধৃতি।] সাহাবিগণের ফতোয়া সহল তাঁর পিতা আবূ সালেহ্ থেকে বর্ণনা করে বলেছেনঃ আমার কাছে ব্যয়যোগ্য সম্পদ সঞ্চিত হয়েছিল, তাঁর মধ্যে যাকাতও ছিল (অর্থাৎ যাকাতের নিসাব পরিমাণ সম্পদ আমি সায়াদ ইবনে আবূ ওয়াক্কাস, ইবনে উমর, আবূ হুরায়রা ও আবূ সায়ীদুল খুদরী (রা) কে জিজ্ঞাসা করলামঃ আমি নিজেই তা বণ্টন করে দেব, না সরকারের কাছে জমা করে দেব? তারা সকলেই আমাকে তা সরকারের কাছে জমা করে দেবার নির্দেশ দিলেন। এ বিষয়ে তাঁরা কেউই আমার নিকট ভিন্ন মত প্রকাশ করেন নি। অপর একটি বর্ণনায় বলা হয়েছেঃ আমি তাদেরকে বললামঃ আপনারা কি মনে করেন, এই সরকার যাকাত সেভাবেই ব্যয় করবেন যেমন আপনারা উচিত বলে মনে করেন? (বলা বাহুল্য, এটা উমাইয়া শাসন আমলের ঘটনা).... আর তা সত্ত্বেও আমি আমার যাকাত তার কাছেই জমা করে দেব? তাঁরা সকলেই বললেনঃ হ্যাঁ, তাই দাও। ইমাম সায়ীদ ইবনে মনসূর তাঁর মুসনাদ’ গ্রন্থে উপরিউক্ত বর্ণনাটি উদ্ধৃত করেছেন। [নববী তাঁর (আরবি***************) গ্রন্থে এরূপই লিখেছেন।] হযরত ইবনে উমর (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেনঃ আল্লাহ যাকে তোমাদের সামষ্টিক ব্যাপারের দায়িত্বশীল বানিয়েছেন, তোমরা তোমাদের যাকাত তাকেই-তার কাছেই জমা করে দাও। সে ভালো কাজ করলে তার শুভ ফল সে পাবে। আর গুনাহ করলে তার শাস্তিও সেই ভোগ করবে। জিয়াদের ‍মুক্ত গোলাম কাজায়া থেকে বর্ণিত, ইবনে উমর বলেছেন, ‘তোমরা তাদের (সরকারী কর্মকর্তাদের) কাছেই যাকাত জমা করে দাও, তা দিয়ে তারা মদ্য পান করলেও।’ ইমাম নববী বলেছেনঃ বায়হাকী উক্ত হাদীস দুটি সহীহ্ কিংবা হাসান সনদে উদ্ধৃত করেছেন। [এসব হাদীস ও সাহাবীদের উক্তি ইমাম নববী তাঁর (আরবি***************) গ্রন্থে উদ্ধৃত করেছেন। ৬ষ্ঠ খণ্ড, ১৬২-১৬৪ পৃ.] মুগীরা ইবনে শ’বা থেকে বর্ণিত, তিনি তাঁর এক মুক্ত গোলামকে-সে তায়েফে তার ধন-মালের ব্যবস্থাপক ছিল-জিজ্ঞেস করলেনঃ আমার ধন-মালের যাকাত দেয়ার ব্যাপারে তুমি কি কর? বললেনঃ তার কিছু অংশ আমি নিজেই বন্টন করে দিই। আর কিছু অংশ সরকারের নিকট জমা করে দিই। বললেনঃ তোমার নিজের কি করার আছে এ ব্যাপারে? (তাঁর নিজের বন্টন করা অপসন্দ করলেন) বললেঃ ওরা তো যাকাত নিয়ে তা দিয়ে জমি ক্রয় করে ও ধুমধাম করে বিয়েশাদী করে। বললেনঃ তাদেরকেই তুমি দেবে। কেননা রাসূলে করীম (সা) তাদের কাছেই জমা করে দেয়ার জন্যে আমাদেরকে আদেশ করেছেন। বায়হাকী ‘সুনামুল কুবরা’ গ্রন্থে এই বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন। এসব হাদীস রাসূলে করীম (সা) থেকে বর্ণিত, সুস্পষ্ট অর্থ জ্ঞাপক। উক্ত ফতোয়াসমূহও সাহাবিগণের আর অকাট্য। তা আমাদের মনে এই অনুভূতি বরং দৃঢ় প্রত্যয় সৃষ্টি করে যে, মূলত ইসলামী শরীয়াতের বিধান হচ্ছে, মুসলিম সরকারই যাকাত সংক্রান্ত যাবতীয় ব্যাপারের দায়িত্বশীল। তাই তা সংগ্রহ করবে ধনমালী লোকদের কাছ থেকে এবং পাওয়ার যোগ্য লোকদের মধ্যে বণ্টনও করবে। আর জাতির জনগণের কর্তব্য হচ্ছে এই কাজের দায়িত্বশীল লোকদের সাথে এ ব্যাপারে পূর্ণ সহযোগিতা করা। এই সংস্থাকে স্বীকৃতিদান, ইসলামের সাহায্যে অগ্রসর হওয়া এবং মুসলমানদের বায়তুলমালকে শক্তিশালী করা। এই ব্যবস্থার তত্ত্ব ও বৈশিষ্ট্ কউ বলতে পারেন, ধর্মের কাজ হচ্ছে লোকদের মনকে জাগ্রত করা, অন্তরে চেতনা সৃষ্টি করা এবং জনগণের সম্মুখে উন্নত মহান আদর্শসমূহ প্রকট করে তুলে ধরা। এই লক্ষ্যে কাজ করা যে, জনগণ নিজেরাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে আল্লাহর কাছে সন্তুষ্টি ও শুভ ফললাভের জন্যে আগ্রহাম্বিত হবে। তাঁর শাস্তির চাবুকের ভয়ে তারা পরিচালিত হবে। সরকারী লোকদেরই এ কাজ করতে দেয়া উচিত যে, তারাই তা নির্দিষ্ট করবে, সুসংগঠিত করবে, দাবি করবে, অন্যথায় শাস্তি দেবে। এসবই রাষ্ট্র সরকারের দায়িত্ব। ধর্মের এই পথ প্রদর্শনের কোন প্রয়োজন করে না। এর জবাবে বলা হচ্ছে, হ্যাঁ, উক্ত কথা দুনিয়ার অন্যান্য ধর্ম সম্পর্কে যথার্থ, সন্দেহ নেই। কিন্তু ইসলাম সম্পর্কে এ কথা কোনক্রমেই যথার্থ নয়। কেননা ইসলাম যেমন একটা বিশ্বাসের ব্যাপার তেমনি তা একটা পূর্ণাঙ্গ সমাজ বিধানও। তাতে যেমন উন্নত নৈতিকতার শিক্ষা রয়েছে, তেমনি সমাজ ও রাষ্ট্র-সরকার গঠন ও পরিচালনের আইন-বিধানও রয়েছে। কুরআন গ্রন্থও সার্বভৌম। ইসলাম মানুষের জীবনকে বিভিন্ন খণ্ডে বিভক্ত ও বিচ্ছিন্ন করেনি যে, তার একটি অংশে ধর্ম কর্ম হবে আর অপর অংশ দুনিয়ার জন্যে পরিচালিত হবে সম্পূর্ণ ভিন্নতরভাবে। মানব জীবনকে এরূপ খণ্ডে খণ্ডে বিভক্ত করা যায় না। তার একটি অংশ কাইজার-বাদশাহ-কে আর একটি অংশ আল্লাহকে দেয়া যায় না। বস্তুত গোটা জীবন একটি অবিভাজ্য সমগ্র। মানুষ সামগ্রিকভাবেই মানুষ। গোটা বিশ্বলোক এক অবিভাজ্য সমষ্টি- কেবলমাত্র মহাশক্তিমান আল্লাহর বিধানে নিয়ন্ত্রিত। ইসলাম এমনি এক সর্বাত্মক জীবন বিধান হয়েই এসেছে। মানুষের সামগ্রিক জীবনে পথ-প্রদর্শন ও বিধান প্রদানই তার কাজ। এজন্যে তার অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে ব্যক্তির স্বাধীনতা, ব্যক্তির মর্যাদা- সমষ্টির কল্যাণ ও উন্নয়ন। গোটা জাতি ও সরকারসমূহকে সত্য ও কল্যাণের দিকে পরিচালিত করাই ইসলামের লক্ষ্য। সমগ্র মানবতাকে আল্লাহর দিকে পরিচালিত করাই ইসলামের অবদান। মানুষ কেবল এক আল্লাহ্র বন্দেগী করবে, তাতে একবিন্দু শিরক করবে না এবং পরস্পর পরস্পরকেও- আল্লাহ্কে বা দিয়ে- রব্ব প্রভু-মানব বানাবে না- এই হচ্ছে ইসলামের দাওয়াত। এই প্রেক্ষিতেই ‘ইসলামের যাকাত বিধান’ বিচার্য। তা কখনই ব্যক্তিগত ব্রাপারে নয়। ইসলামীসরকারকেই এ পর্যায়ের যাবতীয় দায়িত্ব পালন করতে হবে। তাই ইসলাম তা সংগ্রহ ও পাওয়ার যোগ্য লোকদের মধ্যে তা বন্টনের সম্পূর্ণ দায়িত্ব সরকারের ওপরই ন্যস্ত করেছে। ব্যক্তিদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ব্যাপার করে রাখা হয়নি তা। আর এসব কারণে যাকাতকে কোনরূপ উপেক্ষা করা ইসলামী শরীযাতের পক্ষে শোভন হতে পারে না। আরও কতিপয় কারণে উল্লেখ এখানে করা যাচ্ছে: প্রথম, অনেক ব্যক্তিরই মন-মানসিকতা মৃতপ্রায় হয়ে থাকে, তাতে রোগের সৃষ্টি হতে পারে, অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়তে পারে তা। এ সব লোকযদি গরীব লোকদের অধিকার আদায়ে অবজ্ঞা প্রদর্শন করে, তা হলে তাদের কোন নিরাপত্তাই থাকে না। দ্বিতীয়, গরীব মানুষ তার অধিকার সরকারের কাছ থেকেই পেতে পারে, ধনী ব্যক্তির কাছ থেকে নয়। তাতে তার নিজের মর্যাদা রক্ষা পায়, তার মুখ লাঞ্ছনার হাত থেকে বেঁচে যায়, প্রার্থনার কালিমা লেপন থেকে মুক্ত থাকতে পারে। ব্যক্তির অনুগ্রহ ও তৎজনিত পীড়ন তার ব্যক্তি সত্তাকে ক্ষতবিক্ষত করে দেয়- এই অবস্থা থেকেও নিষ্কৃতি সম্ভব। তৃতীয় এই ব্যাপারটি ব্যক্তিদের হাতে ছেড়ে দিলে তার বন্টন অর্থহীন হয়ে পড়বে।ধনী ব্যক্তি নিজ ইচ্ছামত মাত্র একজন গরীবকেহয়তো সব যাকাত সম্পদ দিয়ে দেবে, এটা অসম্ভব কিছু নয়। তা হলে অন্যরা তা থেকে বঞ্চিত থেকে যাবে, কেউ তা বুঝতেও পারবে না- অথচ তারা অধিকতর তীব্রদারিদ্র্য-পীড়িত লোক হতে পারে। চতুর্থ,যাকাত কেবলমাত্র ফকীর-মিসকীন-নিঃস্ব পথিক প্রভৃতি ব্যক্তিদের মধ্যে বন্টনীয় ব্যাপার নয়। মুসলমানদের সাধারণ জনকল্যাণমূলক কাজেও যাকাত বিনিয়োগ করতে হবে। কিন্তু তা ব্যক্তিদের সাধ্যায়ত্ব নয়। তা মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে রাষ্ট্র পরিচালক-পরামর্শ পরিষদ সদস্যদের করণীয়। যেমন ‘মুয়াল্লাফঅতু কুলূবুহুম’দের জন্যে ব্যয় করা, আল্লাহ্র পথে জিহাদের প্রস্তুতি গ্রহণ এবং সারা জাহানে ইসলামের দাওয়াত প্রচারের জন্যে লোক গঠন ও প্রেরণ করা প্রভৃতি কাজও যাকাত সম্পদ দ্বারাই আঞ্জাম দিতে হবে। পঞ্চম, ইসলাম যেমন দ্বীন, তেমন রাষ্ট্র-রাষ্ট্রব্যবস্থাও। কুরআন পঠনীয়, সার্বভৌমত্ব প্রশাসনীয়। আর এই সার্বভৌমত্ব এই রাষ্ট্র ব্যবস্থার জন্যে ধন-মালের প্রয়েঅজন, যা দিয়ে রাষ্ট্র চলবে। তবে তার পরিকল্পনাসমূহ বাস্তাবয়িত হবে। আর সেজন্যে আয়ের সূত্র ও উপায় প্রয়োজন। আর ইসলামে যাকাত হচ্ছে বায়তুলমালের গুরুত্ব ও স্থায়ী আয়ের একটা উৎস।[(আরবী *********)] যাকাত সম্পদের ঘর এই আলোচনা থেকেই আমরা জানতে পারি যে, ইসলামী জীবন-বিধানের দৃষ্টিতে যাকাতের একটা বিশেষ বাজেট পরিকল্পনা থাকতে হবে। তা স্বতঃপ্রতিষ্ঠিত সঞ্চয়। তা থেকে বিশেষভাবে নির্দিষ্ট খাতসমূহে খরচ করা হবে। এই খাতসমূহ যেমন পুরামাত্রায় মানবিক, তেমন খালেসভাবে ইসলামী। রাষ্ট্রের বিরাট সাধারণ বাজেটের সাথে মিলে একাকার হতে পারবে না। কেননা সরকারী সাধারণ বাজেট তো বহু বিচিত্র ধরনের পরিকল্পনা সমন্বিত হয়ে থাকে এবং খরচও করা হয় বহু ধরনের খাতে। যাকাতের খাত বর্ণনাকারী সূতরা তওবার আয়াতটি এই লক্ষ্যের দিকে ইঙ্গিত করেছে। তাতেই বলা হয়েছে যে, যাকাত সংগ্রহ ও বন্টনের কাজে নিযুক্ত কর্মচারীরা তাদের মাসিক বেতন-ভাতা এই যাকাত ফাণ্ড থেকেই গ্রহণ করবে। তার অর্থ, এর জন্যে একটা স্বতন্ত্র বাজেট প্রয়োজন। তাতে যাকাত প্রতিষ্ঠানের জন্যে ব্যয় করার ব্যবস্থা থাকবে। যাকাত ব্যয়ের খাতসমূহের বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে আমরা একথা বিশেষভাবে বলে এসেছি। শুরু থেকেই মুসলিমগণ এ কথাই চিন্তা করে এসেছেন। এই উদ্দেশ্যে তাঁরা যাকাতের জন্যে একটা স্বয়ংক্রিয় বায়তুলমাল রচনা করেছিলেন। কেননা ইসলামী রাষ্ট্রের বায়তুলমালসমূহকে তাঁহা চারটি ভাগে বিভক্ত করেছেন। হানাফী ফিকাহ্বিদগণ তাঁদের গ্রন্থাবলীতে তার আলাদা আলাদা ব্যাখ্যা দিয়েছেন। প্রথম, বিশেষভাবে যাকাতের জন্যে বায়তুলমাল। তাতে গৃহপালিত গবাদি পশুর যাকাতের জন্যে ব্যবস্থা থাকবে। জমির ওশর এবং মুসলিম ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে গৃহীত শুল্ক হিসেবে যা গ্রহণ করা হবে, তা-ও তাতে থাকবে। দ্বিতীয়, বিশেষভাবে জিযিয়া ও খারাজ বাবদ লব্ধ সম্পদের জন্যে একটা বায়তুলমাল। তৃতীয়, ছাগল ও রিকাজের জন্যে একটা বিশেষ বায়তুলমাল। রিকাজ সম্পর্কে কেউ কেউ মত দিয়েছেন যে, তা যাকাতের মধ্যে গণ্য হবে না। যাকাত ব্যয়ের খাতসমূহেও তা ব্যয় হবে না, উক্ত কথা তাদের দৃষ্টিতেই বলা হয়েছে। চতুর্থ, মালিকবিহীন ধনসম্পদের জন্য একটা বিশেষ বায়তুলমাল। যেসব ধন-সম্পদের মালিক পাওয়া যায় না- যেমন যে-সব ধন-মালের উত্তরাধিকারী কেউ নেই, কিংবা উত্তরাধিকারী থাকা সত্ত্বেও তা গ্রহণ করতে কেউ আসে না- যেমন স্বামী বা স্ত্রী এই দুজনের একজন, নিহত ব্যক্তি রক্তমূল্য হিসেবে পাওয়া সম্পদ বা দিয়েত- যার অলী কেউ নেই, আর পড়ে পাওয়া সম্পদ, যার মালিকের খোঁজ পাওয়া যায় না। [দেখুন: (আরবী *********)] প্রকাশমান ধন-মাল ও প্রচ্ছন্ন ধন-মাল এবং তার যাকাত যে পাবে যে-সব ধন-মালে যাকাত ধার্য হয়, ফিকাহ্বিদগণ তাকে তুই ভাগে বিভক্ত করেছেন: একটা প্রকাশমান আর দ্বিতীয়টি অপ্রকাশিত, প্রচ্ছন্ন। প্রকাশমান ধন-মাল হচ্ছে তা, যা মালিক নয় এমন ব্যক্তির পক্ষেও চিহ্নিত ও আয়ত্ত করা সম্ভব। কৃষিলব্ধ ফসল দানা ও ফল এবং উট, গরু ও ছাগল প্রভৃতি পশু সম্পদ এর মধ্যে গণ্য। আর অপ্রকাশিত ধন-সম্পদ হচ্ছে, নগদ টাকা বা এই পর্যায়ে আর যা পড়ে আছে এবং ব্যবসায় পণ্য। ফিত্রার যাকাত সম্পর্কে ফিকাহ্বিদদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ তাকে প্রকাশমান মালের মধ্যে গণ্য করেছেন আর অন্যরা তাকে গোপন বা প্রচ্ছন্ন মাল ধরেচেন। প্রথম প্রকার- প্রকাশমান ধন-মাল সম্পর্কে ফিকাহ্বিদগণ এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ একমত হয়েছেন যে, তার যাকাত সংগ্রহ পাওয়ার যোগ্য লোকদের মধ্যে তা বন্টন করার দায়িত্ব মুসলমানদের রাষ্ট্রপ্রধানের তথা সরকারের। ব্যক্তির করণীয় ব্যাপার নয়, ব্যক্তিদের ব্যক্তিগত দায়িত্বে তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা ও তাদের পরিমাণ নির্ধারণের ওপর এই কাজ ছেড়ে দেয়া হয়নি। হাদীসের বর্ণনাসমূহ ‘মুতাওয়াতির’ সূত্রে পাওয়া গেছে, নবী করীম(স) এ পর্যায়ের মালের ফরয যাকাত সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তাঁর নিয়েঅজিত ব্যীক্তবর্গ কর্মচারী প্রেরণ করতেন। তা রাষ্ট্রের কাছে অর্পণ করার জন্যে মুসলমানদের বাধ্য করতেন। আর কেউ তা দিতে অস্বীকৃতহলে এই লোকেরা তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করত। [(আরবী *********)] যেসব আরব গোত্র নবী করীম (স)-এর সময়ে যাকাত দিত হযরত আবূ বকর (রা)-এর খিলাফতের সূচনাকালে তা দিতে তারা অস্বীকার করলে এই কারণেই তিনি বলেছিলেন: (আরবী *********) আল্লাহ্র কসম! ওরা রাসূলেল জামানায় দিত এমন একটি রশিও যদি দিতে অস্বীকার করে, তাহলে আমি তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করব কেবল এই কারণে। এই ঘোষণাটি প্রকাশমান ধন-মালের যাকতা সম্পর্কেই ছিল। আরও বিশেষ করে তা ছিল গবাদি পশুর যাকাত সম্পর্কে। আর দ্বিতীয় প্রকারের- অপ্রকাশমান, প্রচ্ছন্ন ধন-মাল, নগদ টাকা ও ব্যবসায় পণ্যের যাকাত সম্পর্কেও ফিকাহ্বিদগণ একমত হয়েছেন যে, রাষ্ট্রপ্রধান সরকারই তা আদায় করার জন্যে দায়িত্বশীল। তার হাতেও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমেই তা পাওয়ার যোগ্য লোকদের মধ্যে বণ্টিত হতে হবে। কিন্তু তা করা কি তার পক্ষে ফরয বা ওয়অজিব? তা তার বা তার নিযুক্ত লোকদের কাছে অর্পণ করার জন্যে জনগণকে বাধ্য করা যাবে? সেজন্যে কি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা যাবে- যেমন হযরত আবূ বকর (রা) করেছেন? এই বিষয়ে ফিকাহ্বিদগণের বিভিন্ন মত রয়েছে। যাকাত সংক্রান্ত দায়িত্ব পালনের বিষয়ে বিভিন্ন মাযহাবের বক্তব্য আমরা এখানে তুলে ধরছি। হানাফীদের রায় হানাফীদের মতে প্রকাশমান ধন-মালের যাকাত সংক্রান্ত দায়িত্ব রাষ্ট্রপ্রধান অর্থাৎ সরকারের ওপর অর্পিত। ধন-মালের মালিকদের দায়িত্ব ছেড়ে দেয়া হয়নি। কেননা আল্লাহ্ বলেছেন: (আরবী *********) তুমি গ্রহণ কর তাদের ধন-মাল থেকে যাকাত। আরও এজন্যে যে, হযরত আবূ বকর (রা) মুসলমানদের খলীফা হিসেবেই জনগণের নিকট যাকাত দেয়ার দাবি করেছিলেন এবং দিতে অস্বীকৃত হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। উপরন্তু যে জিনিস হস্তগত করা কর্তৃত্বের দৃষ্টিতে রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারের দায়িত্ব, তা তার মালিককে বা পাওয়ার যোগ্য লোককে দেয়া জায়েয হতে পারে না। যেমন ইয়াতীমের ওলীলর ব্যাপর। [দেখুন: (আরবী *********)] তবে প্রচ্ছন্ন ধন-মালের যাকাত দিয়ে দেয়া ধনের মালিকদের দায়িত্বে অর্পণকরা হয়েছে। আসলে সে দায়িত্বও রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারেরই ছিল। পরে তা হযরত উসমানের খিলাফত আমল থেকে জনগণের দায়িত্বে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। কেননা তাই তখন সুবিধাজনক ছিল এবং তাতেই জনগণের কল্যাণ মনে করা হয়েছে বলে সাহাবিগণ তা সমর্থন করেছেন। (পরে এ বিষয়ে আলোচনা করা হবে) ফলে ধন-মালের মালিকরাই তখন রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারের প্রতিনিধি হয়ে এই কাজ করেছে। কিন্তু তাই বলে তাও সরকারের কাছে দেয়া ও সরকারের পক্ষথেকে তার দাবি করার অধিকার বাতিল হয়ে যায়নি। এই কারণেই ফিকাহ্বিদগণ বলেছেন: ‘সরকার যদি জানতে পারে যে, কোন স্থানে লোকেরা তাদের প্রচ্ছন্ন ধন-মালের যাকাত দিচ্ছে না, তাহলে তারই দায়িত্ব তার দাবি করা ও আদায় করা। অন্যথায় তা নয়। কেননা তা করা হলে ইজ্মার বিরোধিতা করা হবে। [(আরবী *********)] ব্যবসায়পণ্য স্বস্থানে প্রচ্ছন্ন ধন-মালের মধ্যে গণ্য। কিন্তু তা যদি এক স্থান থেকে অন্যত্র স্থানান্তরিত হয় এবং ব্যবসায়ী তার শুল্ক আদায় করে, তাহলে তখন তা প্রকাশমান ধন-মালের মধ্যে গণ্য হবে। তারও যাকাত সরকারের কাছেই দিতে হবে। শুল্ক আদায়কারী তো পথে ঘাটে সরকার কর্তৃক নিয়োজিত। ব্যবসায়ীরা তাদের পণ্য নিয়ে যখন এক স্থান থেকে অনত্র চলে যায়, তখন শুল্ক অফিসার তাদের কাছ থেকে শুল্ক আদায় করে। এজন্যে ফিকাহ্বিদগণ বলেছেন: শুল্ক আদায়কারীদের সম্পর্কে অনেক মন্দ কথা বলা হয়েছে, তার কারণ, তারা লোকদের ওপর জুলুম করে শুল্ক আদায় করে থাকে। [ঐ: ৪১-৪২ পৃ.] মালিকী মাযহাবের বক্তব্য মালিকী মাযহাবের ফিকাহ্বিদগণ বলেছেন, সুবিচারক ও ন্যায়নীতিবান রাষ্ট্রপ্রধান তথা সরকারের কাছেই যাকাত জমা করে দেয়া ওয়াজিব যার আদায়করণ ও বন্টনে ন্যায় নীতিবাদী হওয়া সুপরিচিত। কিন্তু সে যদি অন্যান্য ক্ষেত্রে জুলুমকারী-পীড়নকারী হয, তার জুলুমও পীড়ন গবাদিপশু, কৃষি ফসল কিংবা নগদ সম্পদ- যে ক্ষেত্রেই হোক, সেযদি সুবিচার করতে চায়াও এবং তা তার কাছে দিয়ে দেয়ার দাবি করে, তবুও তাকে দেয়া যাবে না। উক্তরূপ রাষ্ট্রপ্রধান সরকারের নিকট যাকাত দেয়া কি ওয়অজিব, না শুধু জায়েয? দরদীর তাঁর (***) গ্রন্থের শরাহ্ গ্রন্থে বলেছেন, তা ওয়াজিব। কিন্তু দাসূকী তাঁর টীকায় বলেছেন, তা মাক্রূহ। ‘তাওজীহ্’ প্রভৃতি গ্রন্থেও তাই বলা হয়েছে। বস্তুত যাকাত গ্রহণ ও ব্যয়-বন্টন এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে ন্যায়নীতি অবলম্বনকারী রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারের কাছে যাকাত জমা দেয়া ওয়াজিব। [(আরবী *********)] কুরতুবী বলেছেন, রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকার যদি যাকাত গ্রহণ ও বন্টনে ন্যায়নীতির অনুারী হয়, তাহলে নগদ বা অন্যান্য সস্পদের মালিকের পক্ষে নিজস্বভাবে তা বন্টন বা ব্যয় করর কোন অধিকার নেই। বলা হয়েছে: নগদ সম্পদের যাকাত দেয়ার দায়িত্ব তার মালিকদের ওপরই অর্পিত। ইবনুল মাজেশূন বলেছেন, তা হতে পারে যদি যাকাত শুধু ফকীল-মিসকীনের জন্যেই ব্যয় করা হয়। কিন্তু যদি এ দুটি ছাড়া অপরাপর খাতে ব্যয় করার প্রয়োজন দেখা দেয়, তাহলে তা বন্টন করার কাজ কেবলমাত্র রাষ্ট্রপ্রধান- সরকারেরই করণীয় হবে। [(আরবী *********)] শাফেয়ী মাযহাবের মত শাফেয়ী মতাবলম্বীদের মতে কেবল প্রচ্ছন্ন ধন-মালের মালিকই নিজস্বভাবে ব্যয়-বন্টন করতে পারে। স্বর্ণ, রৌপ্য, ব্যবসায় পণ্য ও ফিতরের যাকাত প্রভৃতিই এ পর্যায়ে গণ্য। (ফিত্রা সম্পর্কে অপর একটা মত হচ্ছে, তা প্রকাশমান সম্পদ।) প্রকাশমান ধন-সম্পদ, কৃষি ফসল, খনিজ সম্পদ প্রভৃতির যাকাত মালিকের নিজের বন্টন করার ব্যাপারে দুটি মত রয়েছে। তন্মধ্যে অধিক পরিচিত- যা নতুনও- মত হচ্ছে, তা জায়েয। আর প্রাচীন মত হচ্ছে, তা জায়েয নয়। বরং রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকার ন্যায়নীতির অনুসারী হলে তা তার কাছে জমা করে দেয়া ওয়াজিব। কিন্তু যদি অন্যায়কারী হয়, তাহলে তাতে দুটি মত। একটি মতে তা জায়েয; কিন্তু ওয়াজিব নয়। আর বিশুদ্ধতম মত হচ্ছে তার কাছেই জমা করে দেয়া ওয়াজিব তার হুকুমের কার্যকরতা ও তার সাথে অসহযোগিতা না করার লক্ষ্যে। ফিকাহ্বিদগণ বলেছেন: রাষ্ট্রপ্রধান-সরকার যদি প্রকাশমান ধন-মালের যাকাত দাবি করে, তাহলে কোনরূপ বিরুদ্ধ মনোভাব ছাড়াই তা তার কাছে জমা করে দেয়া ওয়অজিব। তাহলেই তার আনুগত্য সম্পন্ন হতে পারে। আর লোকেরা যদি তা না দেয় তাহলে রাষ্ট্রপ্রধান সরকার তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে, যদি তারা নিজেরাই তা বের করে বন্টন করতে প্রস্তুত হয়, তবুও। আর রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকার যদি তা না চায়, কোন আদায়কারীও যদি না নাসে, মালের মালিক যাকাত দেয়া বিলম্বিত করতে যতদিন পর্যন্ত আদায়কারী আগমনের আশা থাকবে। শেষ পর্যন্ত যদি আদায়কারীর আগমন সম্পর্কে নিরাশহয়ে যায়, তাহলে তখন সে তা নিজেই বন্টন করে দেবে। কিন্তু প্রচ্ছন্ন ধন-মালের যাকাত-সম্পর্কে মা-অর্দীর বক্তব্য মতে-রাষ্ট্রপ্রধান বা আদায়কারীদের সঠিককিচু জানা থাকে না, ধন-মালের মালিকরাই সে বিষয়ে অবহিত। তাই তারা নিজেরাই যদি স্বতস্ফূর্তভাবে তা বন্টন করে দেয়, তাহলে তা মেনে নেয়া যাবে। রাষ্ট্রপ্রধান-সরকার- যদি কারো সম্পর্কে জানতে পারে যে, সেনিজে থেকে যাকাত দিচ্ছে না, তাহলে রাষ্ট্রপ্রধান-সরকার- কি তাকে বলবে: হয় তুমি নিজেই দিয়ে দাও অথবা আমার কাছে অর্পণ কর, আমি তা বন্টন করি? এই বিষয়ে দুটি কথা রয়েছে, মানত ও কাফ্ফারার ক্ষেত্রে তা কার্যকর। ইমাম নববী বলেছেন: সর্বাধিক সহীহ্ কথা, রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারের উক্ত রূপ কথা বলা ওয়াজিব, অবাঞ্ছিত কিছু ঘটার আশংকা দূর করার উদ্দেশ্যে। [(আরবী *********)] হাম্বলী মাযহাবের বক্তব্য হাম্বলী মাযহাবের অভিমত হল, রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারের কাছে যাকাত জমা দেয়া ওয়াজিব নয়। তবেতার অধিকার আছে তা নেয়ার বা গ্রহণ করার। ‘আল-মুগ্নী’ গ্রন্থে যেমন বলা হয়েছে- তা রাষ্ট্রপ্রধান তথা সরকারের কাছে সমর্পণ করা জায়েয, এই ব্যাপারে মাযহাবটি কোন মত পোষণ করে না। সে রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকার ন্যয়বাদী হোক, কি অন্যায়বাদী এবং তা প্রকাশমান ধন-মাল হোক, কি প্রচ্ছন্ন, তাতে কোন পার্থক্যনেই। তা অর্পণ করেই যাকাতদাতা দায়িত্বমুক্ত হয়ে যাবে, তা তার হাতে জমা হওয়ার পর বিনষ্ট হয়ে যাক, কি না হোক, তার জন্যে নির্দিষ্ট খাতসমূহে তা ব্যয় করা হোক, কি নাই হোক, তাতেও কোন পার্থক্য হবে না। কেননা সাহাবীদের কাছ থেকে এরূপ কথাই পাওয়া গেছে। আর যেহেতু রাষ্ট্রপ্রধান-সরকার-জনগণের প্রতিনিধি শরীয়াত অনুযায়ী, কাজেই তাকে দেয়া হলেই ব্যক্তি দায়িত্বমুক্ত হয়ে যাবে। যেমন ইয়াতীমেরই গ্রহণ করা হয়ে যায়, আর মালের মালিক নিজেই যদি তা ভাগ-বন্টন করে দেয়, তা হলেও মাযহাব সে ব্যাপারে কোন ভিন্নমত পোষণ করে না। মাযহাবে ভিন্নমত এদিক দিয়ে অর্থাৎ উত্তম ও অধিক পসন্দনীয় নীতি হচ্ছে, মালিক নিজেই তা বিলি-বন্টন করবে যদি রাষ্ট্রপ্রধান বাসরকার তা তার নিকট জমা দিতে না বলে; কিংবা উত্তম ও পসন্দনীয় নীতি এই যে, ন্যায়বাদী রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে তা দিয়ে দেবে, যেন সে তা যথাস্থানে ব্যয় করার দায়িত্ব পালন করে। ইবনে কুদামাহ ‘আল-মুগ্নী’ গ্রন্থে লিখেছেন: ‘প্রত্যেকটি মানুষের পক্ষে তার যাকাত ব্যক্তিগতভাবে নিজের হাতে বিলি-বন্টন করাই মুস্তাহাব-পসন্দনীয়। তবেই তা পাওয়ার যোগ্য লোকেরা পেল বলে তার প্রত্যয় অর্জিত হতে পারে। তা প্রকাশমান মালেরই যাকাত হোক, কি অপ্রকাশমান মালের। ইমাম আহ্মাদ বলেছেন: আমি খুশি হই যদি সম্পদের মালিক নিজেই তা বন্টন করে। আর সরকারী ব্যবস্থাপনার কাছে দিলেও তা জায়েয হবে।’ হাসান, মকহুল, সায়ীদুবনি জুবাইর এবং মাইমুন ইবনে মাহ্রান বলেছেন: ধন-মালের মালিক নিজেই নিজের যাকাত যথাস্থানে ব্যয় করবে। সওরী বলেছেন: সরকারী যাকাত সংগ্রহকারীরা যদি তা যথাস্থানে ব্যয়-বিনিয়েঅগ না করে, তাহলে তুমি কিরা-কসমকর, মিথ্যা বল, তবু তাদেরকে কিছুই দিও না। বলেছেন: না, তাদেরকে কিছু দেবে না। আতা বলেছৈন: ‘হ্যাঁ, তারা যদি তা যথাস্থানে ব্যয় বিনিয়োগ করে, তবে তাদেরকেই যাকাত দিয়ে দাও।’ এ কথার তাৎপর্য হচ্ছে, তারা সেরূপ না হলে তাদের হাতে যাকাত দেয়া যাবে না। শবীও আবূ জাফর বলেছেন: তুমি যদি দেখ যে, সরকারী দায়িত্বশীল লোকেরা যাকাতের ব্যাপারে ন্যায়নীতি অনুসরণ করছে না, তা হলে স্থানীয় অভাবগ্রস্ত লোকদের মধ্যে তুমি নিজেই বন্টন করে দাও। (লক্ষণীয়, এ সমস্ত কথাই অন্যায় নীতির অনুসারী যাকাত কর্মচারীদের সম্পর্কে বলা হয়েছে। তা ‘আল-মুগ্নী’ যা বলেছেন তার সমর্থন করছে না।) বলেছেন: আহমাদ থেকে বর্ণিত, তিনি মত দিয়েছেন, ‘জমি ফসলের যাকাত সরকারের নিকট প্রদান আমি পসন্দ করি। কিনতউ অন্যান্য ধন-মালের যাকাত যেমন গবাদিপশু- তা নিজেই গরীব-মিসকীনদের মধ্যে বিতরণ করলে কোন দোষ হবে না। এর বাহ্যিক অর্থ হল, তিনি বিশেষভাবে ‘ওশর’ রাষ্ট্রকর্তার হাতে পৌঁছে দেয়া পছন্দ করেন। কেননা ‘ওশর’ সম্পর্কে লোকদের মত হচ্ছে তা জমির খাজনা। অতএব তা খারাজ সমতুল্য। রাষ্ট্রকর্তারাই তার বিলি-ব্যবস্থার অধিকারী। কিন্তু অন্যান্য যাকাতের অবস্থা এরূপ নয়। বলেছেন: ‘আল-জামে’ গ্রন্থে আমি দেখেছি, তাতে বলা হয়েছে, সাদ্কায়ে ফিতর সরকারী তহবিলে দেয়াই আমি পছন্দ করি। পরে আবূ আবদুল্লাহ্- অর্থাৎ ইমাম আহমাদ বলেছেন, হযরত উমর (রা)-কে লোকেরা বলল, ওরা এই যাকাত নিয়ে তা দিয়ে কুকুরের গলায় ফিতা বাঁধে এবং তা দিয়ে ওরা মদ্যপান করে! তবুও কি ওদের দেব? বললেন: হ্যাঁ, ওদের কাছেই দেবে। ইবনে আবূ মূসাও আবুল খাত্তাব বলেছেন, ‘ন্যায়বাদী রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারের তহবিলে যাকাত দিয়ে দেয়া উত্তম।’ ইমাম শাফেয়ীর সঙ্গীদেরও এই মত। অতঃপর ইবনে কুদামাহ সর্বপ্রকারের মালের যাকাতই রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারের তহবিলে দেয়া ওয়াজিব বলে যাঁরা মত দিয়েছেন, তাঁদের বক্তব্য উল্লেখ করেছেন। যাঁরা শুধু প্রকাশমান মালের যাকাতের কথা বলেছেন- ইমাম মালিক, আবূ হানীফা ও আবূ উবাইদ প্রমুখের কথারও উল্লেখ করেছেন। তাঁদের দলিল হচ্ছে পূর্বে উল্লিখিত আয়াত ‘নাও তাদের ধন-মাল থেকে.... এবং এরই জন্যে হযরত আবূ বকর ও সাহাবিগণ (রা) রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ পর্যন্ত করেছেন....। এদের কথা রদ্দ্ করেছেন এই বলে: ‘যাকাত নিজেরহাতে দেয়া জায়েয হওয়া পর্যায়ে আমাদের দলির হচ্ছে, তা হল হক্- যার যা পাওনা, তাকেই তা দিয়ে দেয়া হয়। এটা তার বৈধ কাজ। এ করা হলে যাকাত আদায় হয়ে গেল। যেমন ঋণটা মূল ঋণদাতাকেই দেয়া হল। প্রচ্ছন্ন ধন-মালের যাকাতের ব্যাপারটিও তাই। যেহেতু দুই ধরনের যাকাতের এও একটা। ফলে অন্য প্রকারের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ হল। উক্ত আয়াত প্রমাণ করে যে, রাষ্ট্রপ্রধান- সরকারের অধিকার রয়েছে তা গ্রহণ করার। এতে কোন মতদ্বৈততা নেই। হযরত আবূ বকর (রা) এজন্যেই তার দাবি করেছিলেন যে লোকেরা তা পাওয়ার অধিকারী লোকদেরকে দিচ্ছিল না, তারা নিজেরাও যদি তা পাওয়ার অধিকার লোকদেরকে দিয়ে দিত, তাহলে তিনিন তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতেন না। কেননা ব্যক্তিগতভাবেতিলে তাতে যাকাত আদায় হয় কিনা, তা নিয়ে বিভিন্ন মত রয়েছে। সে কারণেই তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা যায় না। রাষ্ট্রপ্রধান-সরকার ধনমালের মালিকদের কাছে যাকাত দাবি করে পাওয়ার অধিকারী লোকদের প্রতিনিধি হিসেবে অর্পিত- দায়িত্ব পালনের লক্ষ্যে। তাই তারা নিজেরাই যদি উপযুক্ত লোকদের মধ্যে বন্টন করে দেয়, তবে তা অবশ্যই জায়েয হবে। কেননা তারা বয়স্ক সমঝদার লোক। অল্প বয়স্ক পিতৃহীন ছেলেমেয়ে- ইয়াতীমে- কথা আলাদা। নিজ হাতে যাকাত বিতরণের একটা বিশেষত্ব রয়েছে। তাতে ‘হক্টা তার পাওয়ার যোগ্য লোকদের কাছে সরাসরিভাবে পৌঁছে যায়। তাতে কর্মচারীদের মজুরী বেঁচে যায় যেমন, তেমনি লোকদের দারিদ্য-পীড়ন থেকে সরাসরিভাবে মুক্ত করা সম্ভব হয়। তা দিয়ে তাদেরকে সচ্ছল বানিয়ে দেয়া যায়। নিকটবর্তী ও রক্ত সম্পর্কসম্পন্ন অভাবগ্রস্তদের যাকাত দেয়া উত্তম, তাও এভাবেই রক্ষা পায়। আত্মীয়তারক্ষা করার এ একটা উপায়। অতএব তা উত্তম। যেমন তা গ্রহণকারী সরকারী লোক যদি ন্যায়বাদী না হলে ব্যক্তিগতভাবে দিয়ে দেয়া উততম, এও ঠিক তেমিন। ইবনে কুদামাহ বলেছেন যদি প্রশ্ন তোলা হয় যে, তাহলে আসলে কথা হচ্ছে ন্যায়বাদী রাষ্ট্রনায়ক- তথা সরকারকে কেন্দ্র করেই। এরূপ অবস্থায় খিয়ানত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। আমরা বলব, রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকার নিজ থেকেই তো আর যাকাত নেয়ার অধিকারী হয় না, নিজেই তা গ্রহণ বা বন্টন করে না। সব কাজই এই উদ্দেশ্যে নিয়োজিত কর্মচারীদের ওপর ন্যস্ত করতে হয়। কিন্তু তারা সকলেই তো আর খিয়ানতের ঊর্ধ্বে হয় না, তা থাকে নিরাপত্তাও পাওয়া যায় না। তা ছাড়া অনেক সময় আসলে পাওয়ার যোগ্য লোকেরা তা পায় না। সম্পদ-মালিক নিজেই তার পরিবারের প্রতিবেশী রোকজনের কাছ থেকে এ বিষয়ে নির্ভরযোগ্যভাবে অব্যহতি হতে পারে। আর তারাই এ নৈকট্যের সম্পর্কের কারণে তা পাওয়ার অন্যদের অপেক্ষা অনেক বেশি অধিকারী। [দেখুন: (আরবী ********)] জায়দীয়া ফিকাহ্বিদদের মত জায়দীয়া ফিকাহ্বিদদের মত হচ্ছে, যাকাতের ব্যাপারে পূর্ণ কর্তৃত্ব রাষ্ট্রপ্রধানের, তা প্রকাশমান ধন-মাল হোক, কি প্রচ্ছন্ন ধন-মাল। ন্যায়বাদী রাষ্ট্রপ্রধান থাকা অবস্থায় ধন-মালের মালিকের কোন কর্তৃত্ব থাকে না। প্রকাশমান ধন-মাল বলতে তারা বুঝেন গবাদি পশু, ফল এবং অনুরূপ ফিত্রা, খারাজ ও খুমুস প্রভৃতি সম্পদ। আর প্রচ্ছন্ন ধনমাল বলতে তাঁরা বুঝেন নগদ সম্পদ- স্বর্ণ রৌপ্যের মুদ্রা বা এ ধরনের আর যা কিছু- যেমন কারখানা ও ব্যবসায় পণ্য। এটা হবে, যদি তাদের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়। তাদের দলিল উপরিউক্ত আয়াত: ‘গ্রহণ কর তাদের ধন-মাল থেকে...’ এবং হাদীস: ‘তাদের ধনী লোকদের নিকট থেকে যাকাত গ্রহণ করা হবে এবং ... ‘ প্রভৃতি। নবীকরীম (স)-এর নিজের পক্ষ থেকে যাকাত সংগ্রহকারী প্রেরণ, খলীফাগণের তাই করা... এসবই। এটা কাফ্ফারা, মানব, ক্ষতিপূরণ ইত্যাদির মত নয়। কেননা এসবের ওপর রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারের কোন কর্তৃত্ব নেই। এগুলো ব্যক্তিগণের ব্যক্তিগত পর্যায়ের করণীয় কাজ। তবে লোকেরা নিজেরা যদি তা দেয়া থেকে বিরত থাকে, তাহলে রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকার তা দিতে তাদেরকে বাধ্য করবে। পার্থক্য এ কারণে যে, যাকাত প্রভৃতি ফরয হয়েছে আল্লাহ্ নিজেই তা ফরয করেছেন বলে। কিন্তু কাফ্ফারা ইত্যাদি তো ব্যক্তির নিজস্ব কারণে ওয়াজিব হয়ে থাকে। যখন প্রমাণিত হল যে, যাকাত ব্যাপারটি সার্বিকভাবে রাষ্ট্রপ্রধান বাসরকারের সাথে সংশ্লিষ্ট, তখন যে লোক তার যাকাত সরকারী তহবিল ভিন্ন অন্যভাবে দেবে- সরকারের কাঝে জমা দেয়ার তাগিদ থাকা সত্ত্বেও এ দেয়াটা তার যথেষ্ট হবে না, তা পুনর্বার দেয়া একান্তই আবশ্যকীয় হবে। যদি মূর্খতাবশত অন্যভাবে যাকাত আদায় করে থাকে সে মূর্খতা হতে পারে সরকারের কাছে জমা দেয়ার প্রয়োজনীয়তা অথবা তার পক্ষ থেকে দাবির কথা না জানার কারণে। কিন্তু কর্তব্য সম্পর্কে মূর্খতা তা পালন করার অক্ষমতার ওযর হতে পারে না। কেউ কেউ আপত্তি তুলেছেন, সর্বসম্মত কর্তব্যের বিষয়ে অজ্ঞতা কোন ওযর হতে পারে না, তা মেনে নিলাম; কিন্তু সে বিষয়ে ভিন্ন মত রয়েছে তাতে অজ্ঞতা ইজতিহাদ সমতুল্য, তার একটা কারণ রয়েছে। তাই সর্বপ্রকারের ধন-মালের যাকাত পর্যায়ে কর্তৃত্ব কেবলমাত্র রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারের হওয়াটা সর্বসম্মত কথা নয়, -তাতে বিভিন্ন মত রয়েছে, তাই মূল হুকুম অজানা থাকার কারণে তার ব্যক্তিগতভাবে আদায় করাটাই যথেষ্ট হওয়া বাঞ্ছনীয়। এর জবাবে বলা যায়, উক্ত মতবৈষম্য তো রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারের পক্ষ থেকে দাবি না করার দরুন অন্যত্র আদায় করার ক্ষেত্রে মাত্র। কিন্তু সেই দাবি যদি করা হয়, তাহলে তা যে তারই নিকট অর্পণ করতে হবে ও যাকাতের ওপর রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারের কর্তৃত্বই মেনে নিতে হবে, তাতে কোন মতবৈষম্য নেই, তা সর্বসম্মত। [(আরবী ********)] আর যদি কোন সময় রাষ্ট্রপ্রধান বা ইমাম মুসলিম না থাকে কিংবা তা সত্ত্বেও ধন-মালের মালিক তার কর্তৃত্ব না রাখে, তাহলে তখন পূর্ণবয়স্ক সম্পদ মালিক নিজেই পাওয়ার যোগ্য লোকদের মধ্যে বন্টন করবে। আর সম্পদ মালিক যদি পূর্ণবয়স্ক ও সুস্থ বিবেক-বুদ্ধির অধিকারী না হয়, -যেমন বালক, পাগল ও এ ধরনের অন্য কিছু- যেমন বেঁহুশ, নিখোঁজ, তাহলে তার অভিভাবক-অলী-তারই নিয়তে বন্টন করে দেবে। [(আরবী ********)] আবাজীয়াদের মত আজাবাজীয়া ফিকাহ্ মতে, প্রকাশমান রাষ্ট্রপ্রধান বা ইমাম (সরকা) থাকলে যাকাতের সমস্ত ব্যাপার তারই কাছে সমর্পিত হবে। কোন ধনী ব্যক্তিই নিজস্বভাবে যাকাত বন্টন করবে না। যদি তা করে, তাহলে আদায় হবে না, পুনরায় আদায় করতে হবে যথানিয়মে। হ্যাঁ, তবে রাষ্ট্রপ্রধান বা ইমাম বা সরকার তা করার নির্দেশ বা অনুমতি দিলে তবে আদায় হয়ে যাবে। রাষ্ট্রপ্রধানের প্রতিনিধি ও কর্মচারী পর্যায়েও এই কথা। রাষ্ট্রপ্রধানের- সরকারের অনুমতি ছাড়াই তা দিলে তাদের একটি মতে তা পালন হয়ে গেল এবং তার কাজ জায়েয বলে ঘোষিত হবে। আর অপর একটি মতে তা মোটামুটি নিঃশর্তভাবে আদায় হয়ে যাবে বটে; তবে রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকার যদি তা চায়, তাহলে তখন তা তাকে আবার দিতে হবে। আদায় করেছে তা জানার পরও যদি দাবি করে তাহলেও। এই শোষোক্ত কথার দলিলস্বরূপ বলা হয়েছে যে, ইবনে মাসউদ (রা) তাঁর স্ত্রীর নিকট যাকাত দাবি করলেন। এক্ষণে কথা হচ্ছে, রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারের অনুমতি ব্যতীত দিয়ে থাকলে তা আজার দেয়া জায়েয না হলে তিনি তা চাইতেন না। কিন্তু ইবনে মাসউদ (রা)-এর বেগম বললেন: না, তা দেব না, যতক্ষণ না এ বিষয়ে রাসূলে করীমের কাছে জিজ্ঞেস করছি, এই অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন এই ভয়ে যে, স্ত্রীর পক্ষেতার স্বামী ও সন্তানদের তার নিজের যাকাত দিয়ে দেয়া হয়ত জায়েয হবে না। যারা যাকাত রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারী তহবিলে দেয়া ওয়াজিব বলেছৈন, তাঁদের দলির হচ্ছে, হযরত আবূ বকরের এই কথা: ‘ওরা যদি আমাকে যাকাতের এমন একটা রশি দিতেও অস্বীকার করে যা তারা রাসূলে করীম(স)-কে দিতহ, তাহলে আমি সেজন্যে তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করব।’ তার অর্থ এই যে, লোকেরা রাষ্ট্রপ্রধান তথা সরকারী তহবিলে যাকাত দিতে অস্বীকার করলে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা শুধু মুবাহ্ নয়, একটা অবশ্যকর্তব্য ফরয বলে তিনি বিশ্বাস করতেন। তাহলে এ মধ্যে সেই অবস্থাও শামিল হয়ে গেল যে, যদি তারা তা দিতে অস্বীকার করে এই কাণে যে, তারা তা ইতিপূর্বে তা পাওয়ার যোগ্য লোকদের দিয়ে ফেলেছে, অথবা তারা তা তাদের মধ্যে নিজেরাই বণ্টন করে দেবে বলে ইচ্ছা করেছে অথবা তাদের তা আদপেই না দিতে চাওয়া- দিতে অস্বীকার করার কারণেও তা হতে পারে। ঠিক এ ব্যাপারেই ইতিপূর্বে ঘটনা সংঘটিত হয়ে গেছে, যখন তারা বলেছিল, ‘আমাদের ধন-মালে আমরা কোন অংশীদার বানাতে রাজী নই’ এবং অতঃপর তারা মুর্তাদ হয়ে গেল। অতএব শব্দের সাধারণ তাৎপর্যকেই ধরতে হবে, তার কারণে বিশেষত্বকে নয়। আর এখানে সাধারণভাবেইযাকাত দিতে অস্বীকৃত হওয়ার দরুন যুদ্ধ করাকে সম্পর্কিত করা হয়েছে প্রকাশ্য শব্দ যোজনার মাধ্যমেই। [(আরবী *********)] শবী, বাকের, আবূ রুজাইন ও আওযায়ীর মত শবী, মুহাম্মাদ ইবনে আলী বাকের, আবূ রুজাইন ও আওযায়ী প্রমুখ ফিকাহ্বিশারদ মত দিয়েছেন যে, যাকাত অবশ্যই রাষ্ট্রপ্রধান সরকারকে (তার তহবিলে) জমা দিতে হবে। কেননা যাকাতের ব্যয় খাতসমূহ সম্পর্কে সে-ই অধিক মাত্রায় অবহিত। আর তা একবার তার কাছে দিয়ে দিলে প্রকাশ্য অপ্রকাশ্য উভয় মালেই তা আদায় হয়ে যাবে, দাতা দায়িত্বমুক্ত হবে। আর ফকীরকে দিয়ে দিলে তা বাতেনীভাবে দায়িত্বমুক্ত করবে না। কেননা আশংকা রয়েছে, সে হয়ত পাওয়ার যোগ্য নাও হতে পারে। আরও এই জন্যে যে, সে দিয়েছে বটে; কিন্তু এ বিষয়ে মতভেদ রয়েছে, অবশ্য তুহ্মতটা অপসৃত হবে। ইবনে উমর (রা) তাঁর যাকাত দিয়ে দিতেন ইবনে জুবাইরের পক্ষ থেকে যে কোন আদায়কারী তাঁর নিকট আসত, তাকেই অথবা নজদাতুল হারুরীকে। ‘সুহাইল থেকে- আবূ সালেহ থেকে, সূত্রে বর্ণিত বলেছেন: আমি সায়াদ ইবনে আবূ ওয়াক্কাবের কাছে উপস্থিত হলে বললাম: আমার মাল রয়েছে, আমি তার যাকাত দিতে চাই আর এরা সব হচ্ছে পাওয়ার যোগ্যযা মনে হচ্ছে, এখন আপনার কি আদেশ আমার প্রতি? বললেন, ‘তুমি তাদেরকেই দিয়ে দাও।; পরে আমি ইবনে উমরের কাছে এলাম, তিনিও তাই বললেন। তারপর এলাম আবূ হুরায়রার কাছে, তিনিও তাই বললেন। পরে আবূ সায়ীদের নিকট এলে তিনিও বললেন। হযরত আয়েশা (রা) সম্পর্কেও অনুরূপ বর্ণনা রয়েছে। [দেখুন: (আরবী *********)] তুলনা ও অগ্রাধিকার দান ফিকাহ্বিদদের মাযহাব ও মতামত- উক্তিসমূহ উদ্ধৃত করার পর আমি যা মনে করি- উত্তম বলে ধারণা করি, তাকে অগ্রাধিকার দেয়ার পূর্বে আমি এদিকে ইঙ্গিত করতে ইচ্ছা করেছি যে, সমস্ত মাযহাবের ফিকাহ্বিদগণ বিস্তারিত ও খুঁটিনাটি ব্যাপারে তাঁদের মধ্যে শত মতবৈষম্য থাকা সত্ত্বেও দুটি মৌলিক ব্যাপারে সম্পূর্ণ একমত। প্রথমত, রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারের জনগণের কাছে যাকাতের দাবি করার পূর্ণ অধিকার রয়েছে। মাল –সম্পদ যে ধরনের ও যে প্রকৃতি বা রূপেরই হোক-না-কেন। প্রকাশমান মাল হোক, কি অপ্রকাশমান এবং বিশেষ করে যখন নগরবাসীদের এই অবস্থা জানা যাবে যে, তারা যাকাত দেয়ার ব্যাপারে খুবই উপেক্ষা প্রদর্শন করছে। আল্লাহ এরূপ করারই নির্দেশ দিয়েছেন। এ ব্যাপারে হানাফী আলিমগণ খুব তাগিত করেছেন। এই কারণে কোন কোন ফিকাহ্বিদ বলেছেন, রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকার যদি যাকাতরে জন্যে দাবি না করে, তাহলে সেই অবস্থায়ও যাকাতের ব্যাপারটি তারই ওপর সমর্পিত কিনা, এ নিয়ে মতভেদ আছে। কিন্তু রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকার যদি তা সরকারী তহবিলে দেয়ার জন্যে দাবি করে, তাহলে তখন এ ব্যাপারটির কর্তৃত্ব সর্বসম্মতভাবেই সরকারের হবে, তাতে কোন মতভেদ নেই। [দেখুন: (আরবী *********)] এমনকি আমরা যদি বলি যে, মতবৈষম্য রয়েছে; কিনতউ তার দাবি ও বাধ্যতামূলককরণে সে মতভেদ নিঃশেষ হয়ে যায়। কেননা কোন ইজতিহাদী বিষয়ে ইমাম বা সরকারের কোন হুকুম হয়ে গেলে ও তার কর্তৃক পরিস্থিতি বিশ্লেষিত হলে সব মতভেদই দূর হয়ে যায় যেমন কাযীর বিচার হয়ে গেলে তাই হয় চূড়ান্ত। [দেখুন: (আরবী *********)] দ্বিতীয়ত, এই ব্যাপারটি নিরংকুশ ব্যাপার, এতে কোন সন্দেহ নেই, কোন মতভেদও নেই, যে ইমাম- রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকার যদি যাকাতের ব্যাপারটি উপেক্ষা করে চরে এবং তা জমা দেয়ার জন্যে নির্দেশ বা দাবি পেশ কনা করে, তাহলে ধন-মালের মালিকদের যাকাত আদায়ের দায়িত্ব প্রত্যাহার হয় না বরং তা তাদের মাথার ওপর থেকেই যায়। আ তা কোন অবস্থায়ই তাদের জন্যে শুভ হয় না। তখন তাদের নিজেদেরই পাওয়ার যোগ্য লোকদের মধ্যে বিতরণ করে দেয়া একান্তভাবেই ওয়াজিব হয়ে পড়ে। কেননা যাকাত ইবাদত, দ্বীনী-দায়িত্ব ও ফরয। তা অবশ্যম্বাবীরূপে পালনীয়। এমন কি কোন প্রশাসক যদি এ কথা বলার দুঃসাহস করে: আমিতোমাদেরকে যাকাত আদায়ের দায়িত্ব মাফ করে দিলাম কিংবা তা তোমাদের ওপর থেকে প্রত্যাহার করলাম- সর্বপ্রকারের ধন-মালেরই- তা হলেও তার এ কথা বাতিল গণ্য হবে, তার এ কথা অর্থহীন গণ্যহবে। তখন প্রত্যেকটি মুসলিম- যার ওপর যাকাত ফলয- তা পাওয়ার যোগ্য লোকদের মধ্যে নিজস্বভাবে বিতরণের জন্যে দায়িত্বশীল হবে। এ দুটি সত্য যখন সর্বসম্মতভাবে প্রমাণিত হল, তখন এখানে একটি ব্যাপার অবশিষ্ট থেকে যায়। তা হচ্ছে সেই বিষয়, যাতে তাঁরা বিভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। যে বিষয়টি হচ্ছে প্রাক্তন ও অপ্রকাশমান ধন-সম্পদ। এ পর্যায়ে প্রশ্ন হচ্ছে, এই ধন-মালের যাকাতের ব্যাপারটি কি রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারের ওপর অর্পিত, না ব্যক্তিগণের ওপর? আমি মনে করি, শরীয়াতের দলিল প্রমাণসমূহ- যা যাকাতকে রাষ্ট্রপ্রধান বা ইসলামী হুকুমতের কর্তৃত্বাধীন বানিয়ে দেয়- প্রকাশমান ধন-মাল ও অপ্রকাশমান ধন-মালের যাকাত সংক্রান্ত দায়িত্ব পালনে ব্রতী হওয়া, তা সংগ্রহ করা এবং বিতরণ ও বণ্টন করা। এ দায়িত্বের ব্যাপারে সেটাই হচ্ছে আসল কর্তব্য। নিম্নোদ্ধৃত আলোচনায় তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে: ক. ইমাম রাযী তাঁর তাফসীর গ্রন্থ (****) আয়াতটির ব্রাখ্যায় লিখেছেন: ‘এই আয়াতটি প্রমাণ করে যে, এই যাকাতসমূহ গ্রহণ করা ও বন্টন করা রাষ্ট্রপ্রধান ও তার নিযুক্ত কর্মকর্তাদের দায়িত্বের ব্যাপারে। তার প্রমাণ হচ্ছে, আল্লাহ তা’আলা নিজেই যাকাত সংক্রান্ত কর্মচারীদের জন্যে যাকাতের একটি অংশ নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। আর তাই প্রমাণ করে যে, যাকাত আদায়ের জন্য কর্মচারী নিযুক্ত করা আবশ্যক। আর রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকার কর্তৃক যে কর্মচারী যাকাত গ্রহণের জন্যে নিযুক্ত হবে, সেই হবে এ বিভাগের কর্মচারী। অতএব এ দলিলই অকাট্যভাবে প্রমাণ করে যে, রাষ্ট্রপ্রধান যাকাত গ্রহণ করবে। আল্লাহ্র নিম্নোদ্ধৃত আয়াতটিও একথা অকাট্যভাবে প্রমাণ করে: (আরবী *********) তাদের ধন-মাল থেকে তুমি যাকাত গ্রহণ কর।’ [রাসূলে করীম (স)-কে এই নির্দেশ এবংতিনি রাষ্ট্রপ্রধান] অতএব প্রচ্ছন্ন ধন-মালের মালিক নিজেই তার যাকাত বন্টন করবে, এ কথা জানা যায় অপর একটি দলিল দ্বারা। আল্লাহ্র এ কথাটিও ধরা যেতে পারে তা প্রমাণ করার জন্যে: (আরবী *********) তাদের ধন-মালে প্রার্থনাকারী ও বঞ্চিত লোকের হক্- অধিকার রয়েছে। এই অধিকারটি যখন প্রার্থনাকারী ও বঞ্চিত লোকের অধিকার, তখন প্রথম এবং সরাসরি তাদেরকেই তা দেয়া ওয়অজিব হয়ে পড়ে। [(আরবী *********)] তবে কথা হচ্ছে, ইমাম রাযী এই যে আয়াতটির উল্লেখ করেছেন, তা দলিল হিসেবে ধরা ঠিক হয় না। কেননা প্রার্থ ও বঞ্চিতদের হক্ পাওনা রয়েছে প্রকাশমান ধনমালেও, তা নিঃসন্দেহ। তা সত্ত্বেও আরও অনেক দলিল রয়েছে যা প্রমাণ করে যে, যাকাত সংক্রান্ত দায়িত্ব রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারের ব্যক্তিদের নয়। এ কথাটি স্বতঃই সুস্পষ্ট। খ. প্রখ্যাত হানাফী বিশেষজ্ঞ কামালুদ্দীন হুম্মাম বলেছেন, আল্লাহ্র কথা: ‘তাদের ধন-মাল থেকে যাকাত গ্রহণ কর’- এর বাহ্যিক অর্থ হচ্ছে, যাকাত গ্রহণের সম্যক ও নিরংকুশ দায়িত্ব রাষ্ট্রপ্রধানের। তা প্রকাশমান ধন-মাল হোক, কি প্রচ্ছন্ন ধন-মাল। রাসূল করীম(স) এবং তাঁর পরবর্তী খলীফা দুজনও এই নীতিরই বাস্তব অনুসারী ছিলেন। হযরত উসমান (রা) যখন খলীফা হলেন, লোকদের অবস্থার পরিবর্তন প্রকাশ হয়ে পড়ল, তখন যাকাত আদায় কাজে নিয়েঅজিত ব্যক্তিবর্গ লোকদের প্রচ্ছন্ন ও গোপন ধন-মালের আতি-পাতি সন্ধান করা অপসন্দ করল। ফলেসরকারের প্রতিনিধি হিসেবে পাওয়ার যোগ্য লোকদের সরাসরিভাবে যাকাত দিয়ে দেয়ার দায়িত্ব মালিকদের ওপরই ন্যস্ত করা হল। এ ব্যাপারে সাহাবিগণ কোনরূপ মতপার্থক্য প্রকাশ করেন নি। কিন্তু তার দরুন রাষ্ট্রপ্রধানের যাকাত চাওয়া ও সংগ্রহ করার মৌলিক দায়িত্ব কখনই বাতিল হয়ে যায় না বা যায়নি। এ কারণে রাষ্ট্রপ্রধান যদি কখনও জানতে পারে যে, কোন অঞ্চলের লোকেরা তাদের যাকাত দিচ্ছে না, তা হলে রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকার তাদের নিকট যাকাত চাইবে ও নেবে। [(আরবী *********)] গ. নবী করীম (স) সর্বপ্রকারের-প্রকাশমান ও অপ্রকাশমান- ধন-মালেরই যাকাত গ্রহণ করতেন। তার বড় প্রমাণ হচ্ছে আবূ উবাইদ, তিরমিযি ও দারে কুতনী বর্ণিত হাদীস: নবী করীম (স) হযরত উমরকে যাকাত সংগ্রহকারীরূপে নিযুক্ত করেছিলেন। পরে তিনি হযরত আব্বাসের নিকট তার মালের যাকাত চাইতে আসলেন। তখন তিনি বললেন: আমি তো রাসূলের নিকট দুই বছরের যাকাত এক সঙ্গে পূর্বেই পৌঁছিয়ে দিয়েছি। তখন হযরত উমর বিষয়টি রাসূল (স)-এর কাছে পেশ করলেন। তখন তিনি বললেন: আমার চাচা ঠিক এবং সত্য কথাই বলেছেন। আমরা তাঁর কাছ থেকে দুই বছরের যাকাত একসঙ্গে আগেই নিয়েছি। [(*******) হাদীসটি বহু কয়টি সূত্র থেকেই বর্ণিত হয়েছে, তা যয়ীফ হলেও পরস্পর পরস্পরকে শক্তিশালী করে দেয়। দেখুন: (আরবী *********) ফিকাহ্বিদগণ এই হাদীসের বলে বলেছেন যে, যাকাত অগ্রিমও নেয়া যেতে পারে।] একথা সর্বজনবিদিত যে, হযরত আব্বাস একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। তাঁর কোন কৃষি সম্পদ ছিল না, পালিত পশুও ছিল না। ঘ. অনুরূপ আরও একটি হাদীস উদ্ধৃত হয়েছে। নবী করীম (স) যাকাত সংগ্রহকারী লোকদের পাঠিয়েছিলেন। তখন কতিপয় বিরুদ্ধবাদী প্রচারণা চালাতে লাগল: ইবনে জামীল, খালিদ ইবনে অলীদ ও আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিব যাকাত দিতে অস্বীকার করেছে। তখন নবী করীম (স) দাঁড়িয়ে ভাষণ দিলেন। দেখা গেল দুজন সম্পর্কে মিথ্যা বলা হয়েছে, তাঁরা হলেন- আব্বাস ও খালিদ (রা)। ইবনে জামীল সম্পর্কে সত্য বলা হয়েছিল, বলেছিল, ওরা খালিদের ওপর জুলুম করেছে। খালিদ তাঁর বর্ম বন্ধকক রেখেছেন এবং তা আল্লাহ্র পথে নিয়োগ করেছেন। আর রাসূলে করীম(স)-এর চাচা হযরত আব্বাসের ওপর যাকাত ধার্য হয়েছে, তাঁর কাছে আরও অবশিষ্ট রয়েছে। অপর একটি বর্ণনায় বলা হয়েছে তা তাঁর ওপর এবং অনুরূপ আরও তাঁর সাথে। [(আরবী *********) আহ্মাদ, বুখারী, মুসলিম, নাইলুল আওতার ৪/১৪৯] ঙ. আবূ দাউদ প্রমুখ কর্তৃক হযরত আলী বর্ণিত হাদীসও তার সমর্থন করে। তাতে বলা হয়েছে, নবী করীম(স) বলেছেন: তোমরা দশভাগের একভাগের এক-চতুর্থাংশদাও অর্থাৎ প্রতি চল্লিশদিরহামে এক দিরহাম...শেষ পর্যন্ত [দেখুন: (আরবী *********) ‘তাহযীবুন সুনানে আবূ দাউদ’ গ্রন্থে ইবনুল কাইয়্যেম যে টীকা লিখেছেন, তা-ও মুলসহ।] রাসূলের কথা: ‘দাও’ প্রমাণ করেছে যে, নবী করীম (স) নগদ অর্থের যাকাত দিতে বলেছেন এবং এ-ও প্রমাণিত হয় যে, রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারী তহবিলেই দিতে হবে। চ. বহু কয়টি বর্ণনা উদ্ধৃত হয়েছে এই মর্মে যে, হযরত আবূ বকর, উমর, উসমান, ইবনে মাসউদ, মুয়াবীয়া, উমর ইবনে আবদুল আজীজ প্রমুখ রাষ্ট্রপ্রধান নিজ নিজ শাসন আমলে সরকারী দান থেকে যাকাত নিতেন। এ দান হচ্ছে সৈন্যদের ও অনুরূপ অন্যান্যসরকারী কর্মচারীদের যাদের নির্দিষ্ট বেতন সরকারী ভাণ্ডার থেকে দেয়া হত, তা এবং দেবার সময়ই তার যাকাত নিয়ে নেয়া হ। হযরত আবূববকর (রা) লোকদের যখন কোন দান দিতেন, তখন তাকে প্রশ্ন করতেন: তোমার ধন-মাল কিছু আছে? যদি বলত ‘হ্যাঁ’, তাহলে এ দান থেকে তার যাকাত হিসেব মত নিয়ে নিতেন, আর ‘না’ বললেসবটাই তাকে দিয়ে দিতেন। ইবনে মাসউদ (রা) তাঁর দানসমূহ থেকে যাকাত নিয়ে নিতেন। তার হিসেব ছিল, প্রতি হাজারে পঁচিশ। কেননা তাঁর মত ছিল যে, অর্জিত সম্পদের ওপর যাকাত ফরয হওয়ার জন্যে একটি পূর্ণ বছর অতিবাহিত হওয়া শর্ত পূর্বে এ পর্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে। হযরত উমর (রা) যখন ‘দান’ দেবার জন্যে বের করতেন তখন ব্যবসায়ীদের মাল একত্রিত করতেন। তার মধ্যে কোনটা নগদ কোনটা বাকী, তার হিসেবে করতেন। তার পরে উপস্থিত প্রত্যেকটি থেকে যাকাত নিয়ে নিতেন। [(আরবী *********)] কুদামা থেকে বর্ণিত, বলেছেন: আমি যখন হযরত উসমান (রা)-এর কাছে উপস্থিত হয়ে আমাদে দেয়া দান গ্রহণ করতাম, তখন তিনি আমাজে জিজ্ঞেস করতেন: তোমার কাছে কি এমন ধন-মালআছে যার যাকাত দেয়া ফরয? আমি বলতাম: হ্যাঁ। তাহলে আমাদে দেয়া ‘দান’ থেকে আমার সেই মালের যাকাত নিয়ে নিতেন। আর যদি বলতাম ‘না’, তাহলে তিনি আমার জন্যে দেয় ‘দান’ সম্পূর্ণ আমাকে দিয়ে দিতেন। [(আরবী *********)] ছ. হযরত ইবনে উমর ও অন্যান্য সাহাবী (রা) থেকে শাসকগণ জুলুম করলেও যাকাত তাদের কাছে দেয়াই ওয়াজিব- এ পর্যায়ে যেসব ফতোয়া বর্ণিত হয়েছে,তাতে প্রকাশমান ধন-মাল ও অপ্রকাশমান ধন-মালের মধ্যে কোন পার্থক্য করা হয়নি। আবূ উবাইদের মত ও তার পর্যালোচনা কোন কোন আলিম দুই প্রকারের মালের মধ্যে পার্থক্যকারী দলিলের উল্লেখ করেছেন। আর তা হচ্ছে বাস্তব সুন্নাত। কেননা আমাদের পর্যন্ত ‘মুতাওয়াতির’ বা ‘মশহুর’ কোন বর্ণনা এমন পৌঁছায়নি, যা এ কথা প্রমাণ করে যে, রাসূলে করীম (স) তাঁর কর্মচারীদের এ উদ্দেশ্যে পাঠিয়েছেন যে, তারা এসব ধন-মাল থেকে বায়তুলমালের অংশ নিয়ে নেবে- তা নগদ হোক, কি ব্রবসায় পণ্য এবং তা রাসূলের কাছে পাঠিয়ে দিত, অথবা রাসূলের সমর্পিত দায়িত্ব হিসেবে তা পাওয়ার যোগ্য লোকদের মধ্যেবন্টন করে দেবে- যেমন করেছে অন্যান্য প্রকাশমান ধন-মালের ক্ষেত্রে। এ কারণে কতিপয় ইমাম এই মাযহাব গ্রহণ করেছেন যে, এই প্রচ্ছন্ন ধন-মালের যাকাত সরকারী তহবিলে দেয়া বা তা নিজস্বভাবে বন্টন করা জায়েয- এই শর্তে যে, আল্লাহকে ভয় করবে ও তা যথাস্থানে রাখবে। তদ্দ্বারা কারুর পাক্ষপাতিত্ব করবে না। এ দুটির মধ্যে যে কোন একটি কাজ ধনের মালিক যদি করে, তাহলেই সে তার ওপর ধার্যকৃত ফরয আদায় করল বলে স্বীকৃতি পেল। আবূ উবাইদ বলেছেন, স্বর্ণ-রৌপ্য ও ব্যবসায় পণ্য ইত্যাদি নির্বাক সম্পদে ইরাক ও হিজাজবাসী সুন্নাত ও ইলমের অধিকারী লোকদের মত হচ্ছে এই এবং তা-ই আমাদের মতে গ্রহণীয়। কেননা মুসলমানগণ এর জন্যে আমানতদার বানানো হয়েছে, যেমন তাদেরকে আমানতদার বানানো হয়েছে নামাযের। গবাদিপশু, দানা, ফল ইত্যাদির যাকাত আদায় ও বণ্টন ক রেন প্রশাসকগণ। এসবের মালিকের কোন অধিকার নেই, ক্ষমতাও নেই তাদের থেকে গোপন করার বা লুকিয়ে রাখার। সে নিজেই যদি তা বণ্টন করে ও যথাস্থানে রাখে, তাহলে তার যাকাত আদায় হবে না। তাকে সে যাকাত পুনরায় তাদের কাছে আদায় করতে হবে। হাদীস ও সাহাবিগণের কথা এ দুয়ের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। তোমরা কি লক্ষ্য কর না, হযরত আবূ বকর (রা) মুহাজির ও আনসার লোকদের মধ্যে যারা গবাদিপশুর যাকাত দিতে অস্বীকার করে মুর্তাদ হয়ে গিয়েছিল, তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঘোষণা করেছিলেন?.... কিন্তু স্বর্ণ ও রৌপ্যের যাকাতের জন্যে তা করেন নি? [(আরবী **********)] এরপর আবূ উবাইদ সমগ্র ‘আ-সা-র’ (সাহাবিগণের উক্তির) উল্লেখ করে প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে, ব্যক্তিগণই তাদের প্রচ্ছন্ন ধন-মালের যাকাত দেয়া পূর্ণ কর্তৃত্বের অধিকারী। আবূ উবাইদের উল্লেখ করা- ব্যক্তির গোপন ধন-মালের যাকাত নিজস্বভাবে বন্টন ও তা সরকারী তহবিলে না দেয়া জায়েয প্রমাণকারী ও সব ‘আ-সা-র’ সম্পর্কে যাঁরাই একটু চিন্তা-ভাবনা করবেন, তাঁরাই দেখতে পাবেন, বস্তুতই তাকে আসল থেকে বাদ দেয়া (Exemted) হয়েছে। যে বিষয়ে ফতোয়া দেয়া হয়েছে তার প্রতি তা অর্পণ করায় তারা রাসূলে করীম (স) ও খুলাফায়ে রাশেদুনের সুন্নাতের বিপরীত কিছু দেখতে রাজনৈতিক ফেত্নার অন্ধকার ছেয়ে যাওয়ার পর, ইবনে সাবা ও অনুরূপ লোকদের ইয়াহুদী ষড়যন্ত্র যখন থেকে কাজ করতে শুরু করেছে- হযরত উসমান (রা)-এর হত্যার ঘটনার সময় পর্যন্ত। আবূ উবাইদ তাঁর সনদে ইবনে সিরীন থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেন [***১]: যাকাত তো দেয়া হত (কিংবা বলেছেন: তোলা হত) নবী করীম (স) কিংবাতাঁর নির্দেশিত ব্যক্তির কাছে, হযরত আবূ বকর (রা) কিংবাতাঁর ভারপ্রাপ্ত ব্যক্তির কাছে, তাঁর পরে হযরত উমর কিংবা তাঁর নিযুক্ত ব্যক্তির কাছে এবং তাঁর পরে হযরত উসমান (রা) কিংসা তাঁর ভারপ্রাপ্ত ব্যক্তির কাছে কিন্তু হযরত উসমান (রা) যখন শহীদ হলেন, তখনলোকদের মধ্যে মতপার্থক্য দেখাদেয়। তখন কেউ কেউ তা সরকারী তহবিলেদিয়েদিত, আবার অনেকে নিজেরাই বণ্টন করে দিত। যাঁরা সরকারী তহবিলে দিতেন, হযরত ইবনে উমর (রা) ছিলেন তাঁদের অন্যতম। হযরত ইবনে উমর (রা) থেকে এ কথাই প্রসিদ্ধ। তিনি বলেছেন, ‘ওরা যতক্ষণ পর্যন্ত নামায আদায়কারীথাকবে, ততক্ষণ তোমরাওদের কাছেই যাকাত দিতে থাক।’ তাঁর থেকে পাওয়া কোন কোন বর্ণনায় আমার এ শর্তটির উল্লেখ নেই। বরং তাঁর কাছে যেলোকই ফতোয়া চেয়েছে, তাকেই তিনি বলেছেন: ‘যাকাত শাসক-প্রশাসকদের কাছেই দাও, তারা তা দিয়ে কুকুরের মাংসতাদের ধ্বংস স্থলে বণ্টন করলেও।’ অপর একজনকে বরেছিলেন: ‘হ্যাঁ’ তা ওদেরই দিয়ে দাও, তা দিয়ে তারা কাপড় ও সুগন্ধি কিনলেও।’ কিন্তু কোন কোন বর্ণনা এই ধারণা দেয় যে, তিনি তাঁর একথা পরে প্রত্যাহার করেছেন। বলেছেন: (আরবী **********) তা তার যথাস্থানেই রাখ (অর্থাৎ নিজেই বণ্টন কর।) [(আরবী **********)] তাঁর এক বন্ধু তাঁর এ কথার প্রতিবাদ করে বললেন: ‘তুমি যাকাত সম্পর্কে কি মনে কর, কেননা এই লোকেরা তো তা নিয়ে যথাস্থানে নিয়োগ করে না? তখন হযরত ইবনে উমর (রা) বললেন: ‘তা ওদেরই দিয়ে দাও।’ এক ব্যক্তি বলে, ‘ওরা যদি নামাযও ঠিক সময়ে না পড়ে তবুও কি তুমি ওদের সঙ্গেই নামায পড়বে?’ বললেন, ‘না।’ বললেন, ‘তাহলে নামায কি যাকাতের মতই নয়?’ বললেন: ‘ওরা আমাদের ওপর গোলক ধাঁধার সৃষ্টি করেছে, আল্লাহ্ই ওদের ওপর গোলক ধাঁধার সৃষ্টি করবেন।’ [(আরবী **********)] এ কাহিনী এক ব্যক্তির দৃষ্টিকোণমেনে নেয়ার কথা প্রমাণ করে। ইবরাহীম নখ্য়ী ও হাসান বসরী থেকেও অনুরূপ কথা পাওয়া গেছে।তাঁরা দুজনই বলেছেন: ‘যাকাত তার যথাস্থানে দিয়ে দাও এবং শাসক প্রশাসকদের থেকে তা গোপন করে যাও।’ [(আরবী **********)] মাইমুন ইবনে মাহ্রান থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন: তা ছিদ্রের মধ্যে রেখে দাও। পরে তা তোমাদের চেনা-জানা লোকদের মধ্যে বন্টন করে দাও এবং প্রত্যেকটি মাস আসার আগেই তা তোমরা বণ্টন করে দিতে থাকবে। [(আরবী **********)] আবূ ইয়াহ্ইয়া আল-কিনদী থেকে বর্ণিত, বলেছেন: আমি সায়ীদ ইবনেস জুবাইরকে যাকাত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। বললেন: ‘তা দায়িত্বশীল সরকারীলোকদের নিকট দিয়েদাও। পরে সায়ীদ যখন চলতে লাগলেন, আমি তার পিছনে পিছনে গেলাম।এক সময় বললাম: আপনি আমাকে দায়িত্বশীল সরকারী লোকদের হাতে যাকাত দিয়েদিতে বললেন। কিন্তু তারা তো তা দিয়ে এই... এই কাজ করে.... এই ধরনে কাজে তারা তা ব্যয় করে? তখন বললেন: তা বণ্টন করে দাও তাদের মধ্যে যাদের দেয়ার জন্যে আল্লাহ্ তোমাকে নির্দেশ দিয়েছেন। তুমি তো লোকদের সম্মুখে আমাকে প্রশ্ন করেছ, তাই তখন তোমাকে আসল কথা বলতে পারিনি। [(আরবী **********)] এসব ‘আ-সা-র- সাহাবিগণের মত এবং এ সব ফতোয়ার ওপর নির্ভর করেই আবূ উবাইদ উপরিউক্তি কথা বলেছৈন। উমাইয়া শাসনের কোন কোন প্রশাসকের আচার-আচরণে ইসলামী মন-মানসিকতার ওপর যে আঘাত লেগেছে ও তাতে যে ক্রোধের সঞ্চার হয়েছে, তাতে তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। খুলাফায়ে রাশেদূনের সময়ে জনগণ যে পরিবেশ ও আচার-আচরণ দেখেছিল, এ সময় তা থেকে অনেকটা বিচ্যুতি তাদের চোখে প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছিল। তা ছাড়া দুই ধরনের ধন-মালের মধ্যে পারথক্যকরণ যখন নবীর সুন্নাত অনুযায়ীই সহীহ্ প্রমানিত হল- নবী করীম (স) নিজেই গোপন বা প্রচ্ছন্ন ধন-মালের যাকাত গ্রহণের উদ্দেশ্যে তাঁর নিয়োগকৃত যাকাত আদায়কারী পাঠাতেন না- তা দুটি কারণে ছিল: ১. লোকেরা নিজেরাই স্বতঃসক্ফূর্তভাবে এ মালের যাকাত রাসূলে করীম (স)-এর কাছে দিয়ে দিত ঈমানের তাকীদ ও আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্যে ফরয আদায়করার ঐকান্তিক উৎসাহের কারণে। ২. যেহেতু এ পর্যায়ের মালের হিসেব-নিকাশ আয়ত্ত করা তার মালিকদের ছাড়া অন্যদের পক্ষে অসম্ভব, এ কারণে তার যাকাত দেয়া ও তা বণ্টন করার কাজটি তাদের মন ও ঈমানের ওপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে যাকে ইসলাম সঞ্জীবিত করে তুলেছে ঈমানী শক্তির সাহায্যে। প্রথম খলীফা হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা)-এর সময় সেরূপ কাজই হয়েছে। হযরত উমর ফারুক (রা)-এর খিলাফত আমলের ইসলামী খিলাফতের সীমান্ত অনেক দূর পর্যন্ত প্রসারিত হয়ে পড়ে। আর সেই কারণে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা পুনর্গঠনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। সে জন্য ‘দোয়ান’ স্থাপন করা হয়। আর সেই সাথে সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা কার্যকর করা হয়। এমন কি ইসলামী সমাজের প্রতিটি সন্তানের জন্য মাসিক বৃত্তির ব্যবস্থা করা হয়। শেষ পর্যন্ত মুসলমানদের সাথে যিম্মীদের সামাজিক নিরাপত্তারও ব্যবস্থা নেয়া হয। আর এ ধরনের একটি সমাজ ব্যবস্থার পক্ষে বিরাট ধনাগার ও বিপুল আয়ের উৎসের প্রয়োজন দেখা দেবে, তাতে আর সন্দেহ কি? তাই আমরা যখন দেখি, হযরত উমর (রা) প্রকাশমান ও প্রচ্ছন্ন উভয় ধরনের ধন-মালের যাকাত সংগ্রহের জন্যে যদি তাঁর কর্মচারীদের দায়িত্ব দিয়ে থাকেন, তাহলে তাতে বিস্ময়ের কিছু থাকতে পারে না। প্রচ্ছন্ন ধন-মালের যাকাত তার মালিকদের নিজেদের হাতে বন্টন করার স্বাধীনতা তখন দেয়া হয়নি। আর এ সবই করা হয়েছে ‘সামাজিক নিরাপত্তা’ ব্যবস্থার বাজেট পূরণের উদ্দেশ্যে, মুসলমানদের বায়তুলমালকে অধিকতর শক্তিশালী করে তোলার লক্ষ্যে। এই উদ্দেশ্যে হযরত উমর (রা) ‘কর আদায়কারী (****) নামের একদল পরিচিত লোকদের ‘সিস্টেম’ গড়ে তুলেছিলেন। এদেরকে (****) বল াহত এজন্যে যে, তাহা যুধ্যমান দেশের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে শুল্ক আদায় করত, সে শুল্ক হত ১০%, যেমন তারা মুসলমানদের কাছ থেকে তা আদায় করে নিত। আর যিম্মী ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে গ্রহণ করত, ‘অর্ধ-ওশর’। এটা হত হযরত উমর তাদের সাথে শর্তসন্ধি করতেন সেই শর্তানুযায়ী। মুসলিম ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে নিত এক-দশমাংশের এক-চতুর্থাংশ পরিমাণ (আর এটা হচ্ছে ব্যবসায়ের যাকাতের ধার্য পরিমাণ)। হযরত উমর (রা) এ পর্যায়ে যে মহান শিক্ষা ও আদর্শ সংস্থাপন করেছেন তারই অনুরূপ। [দেখুন: (আরবী **********)] তাদের এ গ্রহণটা ‘ওশর’, ‘অর্ধ ওশর’ ও ‘ওশরের এক চতুর্থাংশ’-এ হারে আবর্তিত হত। আলিমগণ হযরত উমর ফারূক (রা)-এর এই আমল বা কাজকে প্রচ্ছন্ন ধন-মালের মালিকদের প্রতি সহানুভূতিমূলক আচরণ বলে মনে করেছেন। কেননা তাঁরা ইসলামী খিলাফত কেন্দ্র থেকে বহু দূরবর্তী স্থানসমূহে বিস্তীর্ণ হয়েছিল। তাদের ধন-মালের যাকাত খিলাফতকেন্দ্রে বহন করে নিয়ে আসা ছিল খুবই দুষ্কর কাজ। এজন্যে তা একত্রিত করার উদ্দেশ্যে (****) নিয়োগ করা হয়েছিল। তার অর্থ এই যে, রাষ্ট্রপ্রধান ও তাঁর প্রতিনিধি-অর্থাৎ সরকারী ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রকাশমান ও প্রচ্ছন্ন উভয় ধরনের ধন-মালের যাকাত আদায় করার রীতি স্থায়ীভাবে চলেছৈ। যদিও হযরত উমর (রা) কর্তৃক গৃহীত কর্মপন্থা নবী করীম (স) ও হযরত আবূ বকর (রা)-এর কর্মপন্থা থেকে খনিটকা ভিন্নতর ছিল প্রচ্ছন্ন ধন-মালের ক্ষেত্রে, তাও ইসলামী রাজ্যের অধিকতর সম্প্রসারিত হয়ে পড়ার কারণে। পরে হযরত ওসমান ইবনে আফ্ফান (রা)-এর খিলাফত আমলে ‘ফাই’, গনীমত, খা্রাজ, জিযিয়া, শুল্ক কর ও যাকাত সাদ্কা প্রভৃতি খাতে বায়তুলমালের আয় বিরাট হয়ে পড়ে। আল্লাহ্ তখন মুসলমানদের জন্যে যেমন বিজয়ের দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন, তেমনি ধন-সম্পদ অফুরন্ত প্রস্রবণের মত প্রবাহিত হয়ে পড়েছিল। তখন হযরত উসমান (রা) শুধু প্রকাশমান ধন-মালের যাকাত সরকারীভাবে আদায় ও সংগ্রহ করাকেই যথেষ্ট মনে করেছিলেন। আর প্রচ্ছন্ন ধন-মালের যাকাত তার মালিকদের কাছেই সোপর্দ করা হয়েছিল যে, তারা নিজেরাই তা আদায় করে দেবে তাদের দায়িত্ব ও লোকদের কাছে জবাবদিহির দৃষ্টিতে। এ ব্যাপারে তাদের দ্বীন ও ঈমানের প্রেক্ষিতে তাদের ওপর পূর্ণ নির্ভরতা গ্রহণ করা হয়েছিল। সন্ধুন-খোঁজ-খবর ও সংগ্রহ করার কষ্ট তাদের থেকে দূর করা, সংগ্রহ ও বণ্টনের ব্যয়ভার বিরাট হয়ে পড়ার দরুন তা হ্রাস করার উপায় উদ্ভাবনের উদ্দেশ্যেই তিনি এ পন্থা ধরেছিলেন। এটা ছিল তাঁর নিজের ইজতিহাদযদিও উত্তরকালে এপন্থার পরিণতিতে প্রচ্ছন্ন ধন-মালের যাকাত আদায়ের দিক দিয়ে জনগণের মধ্যে চরম উপেক্ষার ভাব জেগে উঠেছিল। আর তারও কারণ ছিল তাদের দ্বীনী জ্ঞান-গভীরতা হারিয়ে ফেলেছিল এবং ঈমানের জোরও অনেকটা হ্রাস পেয়ে গিয়েছিল। কোন কোন ফিকাহ্বিদ এ ব্যাপারটির ব্যাখ্যা দিয়েছেন এই বলে যে, আমীরুল মুমিনীন হযরত ওসমান (রা) প্রচ্ছন্ন ধন-মালের মালিকদেরকেই তাঁর পক্ষ থেকে তাদের সে ধরনের ধন-মালের যাকাত দিয়ে দেয়ার দায়িত্ব দিয়ে দিয়েছিলেন। আল-কাসানী তাঁর (****) গ্রন্থে এ পর্যায়ে বলেছেন: রাসূলে করীম (স) এবং হযরত আবূ বকর (রা) ও উমর ফারুক (রা) যাকাত গ্রহণ করতেন, হযরত ওসমান (রা)-এর সময় পর্ন্ত তাই চলছিল। কিন্তু তাঁর সময়ে ধন-মালের পরিমাণ যখন বিপুল হয়ে দাঁড়ায়, তখন যাকাত আদায় ও বন্টনে ভার মালিকদের ওপর ন্যস্ত করাতেই কল্যাণ নিহিত বলে মনে করলেন সাহাবিগণের ইজমার ভিত্তিতে। তখন ধন মালের মালিকরা রাষ্ট্রপ্রধানের ভারপ্রাপ্ত প্রতিনিধি হয়ে দাঁড়াল। ‘তোমরা কি দেখছ না’, তিনি বলেছেন, ‘যার ওপর ঋণ রয়েছে, তা যেন সে আদায় দিয়ে দেয়।’ আর তার মালের যে যাকাত অবশিষ্ট রয়েছে, তার যেন সে নিজেই দিয়ে দেয়।’ যাকাত দিয়ে দেয়ার জন্যে এটা ছিল তার দায়িত্ব অর্পণের ঘোষণা। কাজেই তাতে রাষ্ট্রপ্রধানের অধিকার বাতিল হয়ে যায়নি। এজন্যে আমাদের লোকদের বক্তব্য হচ্ছে রাষ্ট্রপ্রধান যখন কোন অঞ্চলের লোকদের যাকাত না দেয়ার খবর জানবে তখন তিনি তার দাবি করবেন [(আরবী **********)] ও তার কাছে দিতে বলবেন। এ সব থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, এ পর্যায়ে সাধারণ মূলনীতি হচ্ছে, প্রকাশমান ও অপ্রকাশমান উভয় ধরনের ধন-মালের যাকাত রাষ্ট্রপ্রধান সরকারই সংগ্রহ করবেন। কিন্তু হযরত ওসমানের খিলাফতকালে প্রচ্ছন্ন মালের যাকাত সংগ্রহ করা সরকারের পক্ষে কঠিন ও দুরূহ হয়ে পড়ে। তখন বায়তুলমালের সম্পদরাজিও স্তুপীকৃত হয়ে পড়ে। তাই তখন তিনি তার যাকাত আদায়ের ব্যাপারটি প্রতিনিধিত্ব হিসেবে তার মালিকদে ওপরই ন্যস্ত করেছেন। তবে তারা যদি প্রতিনিধিত্বের এ দায়িত্ব পালনের কোনরূপ ত্রুটি প্রদর্শন করে এবং তাদের ধনমালে আল্লাহ্র যে হক রয়েছে তা আদায় করতে প্রস্তুত না হয়, তাহলে রাষ্ট্রপ্রধানই তা সংগ্রহ করার দায়িত্ব ফিরিয়ে নেবেন- যেমন আসলেই দায়িত্বটা তাঁর ছিল। এই যুগে যাকাত আদায়ের দায়িত্ব কার ওপর আমাদের একালের মুরব্বী চিন্তাবিদ আবদুল ওহ্হাফ খাল্লাফ, আবদুর রহমান হাসান (রা) ও মুহাম্মদ আবূ জুহ্রা (আল্লাহ্ তাঁদের প্রতি অসীম রহমত বর্ষণ করুন) এ বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করেছেন। দামেশকে ১৯৫২ সকনে ‘যাকাত’ পর্যায়ে অনুষ্ঠিত সেমিনারে প্রদত্ত ভাষণে তাঁরা এ বিষয়ে নিজেদের মতামত উপস্থাপিত করেছেন। ‘জামায়ায়ে আরাবীয়া’ এ সেমিনারের আয়োজন করেছিল। তাঁরা বলেছেন: ‘এক্ষণে একথা নিশ্চিত হচ্ছে যে, প্রকাশমান ও অপ্রকাশমান ধন-মালের যাকাত সংগ্রহ করার দায়িত্ব রাষ্ট্রকর্তাই পালন করবেন। তার দুটি কারণ হচ্ছে: প্রথমটি, এ কালের সাধারণভাবে জনগণ তাদের প্রকাশমান ও অপ্রকাশমান উভয় ধরনের ধন-মালেরই শাসক-প্রশাসকদের অর্পিত প্রতিনিধিত্বের দায়িত্ব পালন থেকে বিরত রয়েছে, আর ফিকাহ্বিদগণও একথা চূড়ান্তভাবে বলে দিয়েছেন যে, রাষ্ট্রকর্তা যদি জনগণ যাকাত দিচ্ছে না বলে জানতে পারে, তাহলে সে তা বল প্রয়োগের মাধ্যমে অবশ্যই আদায় করবে।... এক্ষেত্রে প্রকাশমান ও অপ্রকাশমান ধন-মালের মধ্যে কোনরূপ পার্থক্য করা চলবে না এই কারণে যে, তাদের প্রতিনিধিত্ব খতম হয়ে গেছে। তাই সেই মূলের দিকে ফিরে যাওয়া- রাষ্ট্রকর্তারই যাকাত আদায় করা একান্ত কর্তব্য। ফিকাহ্বিদগণ যে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, সেই অনুযায়ীই এখন কাজ করতে হবে। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, এ কালের ধন-মাল সবই প্রকাশমান হয়ে পড়েছে প্রায়। ব্যবসায়ী অস্থাবর সম্পদ-সম্পত্তি সবই প্রতি বছরের আয় হিসেবে পরিমাপ করা হয়। ব্যবসায়ী তা ছোট কি বড় প্রত্যেকের জন্যেই একটা ‘রেকর্ড’ স্টক রেজিস্টা থাকে যার মধ্যে সব মালের গণনা রক্ষা করা হয়, তার ভিত্তিতে সহজেই লাভ-লোকসানের হিসেব করা হয়। তাই যে সব উপায়ে মুনাফা নির্ধারণ করা হয়, সরকারী কর ধার্য করা হয়, মূলধনের ওপর ফরয যাকাত ধার্য করা তার ওপর খুব সহজেই হতে পারে। এই ফরয যাকাত হচ্ছে, মহান আল্লাহ্র হক, প্রার্থনাকারী ও বঞ্চিত লেঅকদেরও হক। আর নগত টাকা-পয়সা তো বিভিন্ন খাতে ও অনুরূপ কাজে নিয়োজিত থাকে। উপরিউক্ত পন্থায় তার হিসেবটাও সহজেই জানা যেতে পারে। তবে তারা তাদের নগদ সম্পদ মাটির তলায় পুতে রাখে, তারা আসলে খুব বেশি সচ্ছলতার অধিকারী নয়। এ কালে এ ধরনের লোকদের সংখ্যাও দিন দিন কমে যাচ্ছে। অতএব তাদের যাকাতের ব্যাপারে তাদের দ্বীনদারীর ওপর নির্ভর করা যেতে পারে অনায়াসেই। খলীফা হযরত উসমান (রা) প্রবর্তিত নীতি অনুসরণ পর্যায়ে ফিকাহ্বিদগণ সিদ্ধান্ত দিয়েছেন যে, তা করতে হবে প্রচ্ছন্ন ধন-মালের প্রকাশিত হয়ে পড়া অবস্থায়। তখন তার যাকাতও রাষ্ট্রকর্তার কর্মচারীরা নিয়ে নেবে। এ কারণে হযরত উসমান (রা)-এর অনুসৃত নীতি কার্যকর থাকা অবস্থায়ও (****) দের কাজ যথাযথভাবে চলছিল। কেননা তারা নগদ সম্পদ ও ব্যবসায় পণ্য এক স্থান থেকে অন্যত্র স্থানান্তরিত হওয়াকালে তার যাকাত গ্রহণ করত। এরূপ অবস্থায় তা আর প্রচ্ছন্ন মাল বলে গণ্য হত না, প্রকাশ্যমান মালরূপে গণ্য হত। তারা এই স্থানান্তর কালেই যাকাত নিয়ে নিত। তবে মালের মালিক যদি প্রমাণ দিতে পারত যে, সে এ সব মালের যাকাত গরীবদের মধ্যে বন্টন করে দিয়েছে অথবা এ বছরই তা অপর কোন কর আদায়কারীকে দিয়ে দিয়েছে, তাহলে তারা তা থেকে রক্ষা পেতে পারত। [(আরবী **********)] এ সব কথা পূর্ণাঙ্গভাবে সুস্পষ্ট। দলিলের বলিষ্ঠতা স্বীকার্য। এ জন্যে তার ওপর কোন টীকা-টীপ্পনীর প্রয়োজন করে না। এ দৃষ্টিতেই বলা হচ্ছে যে, প্রত্যকটি ইসলামী রাষ্ট্র ও সরকারের কর্তব্য এমন একটা ‘প্রতিষ্ঠান’ বা সংস্থা বিশেষভাবে গড়ে তোলা, যা যাকাত সংগ্রহ ও বণ্টন সংক্রান্ত যাবতীয় দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করবে। তা গ্রহণ করবে যেমনভাবে গ্রহণ করতে আল্লাহ তা’আলা আদেশ করেছেন এবং তা ব্যয় ও বণ্টনও করবে যেমনভাবে আল্লাহ্ তা করার নির্দেশ দিয়েছেন। আমরা ইতিপূর্বে (****) খাতটির ব্যাখ্যা ‘যাকাত ব্যয়ের খাতসমূহ’ অধ্যায়ে বিস্তারিতভাবে দিয়ে এসেছি। কিন্তু আমি মনে করি, ফরয যাকাতের একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ এক-চতুর্থাংশ বা এক-তৃতীয়াংশ- ধন-মালের মালিকদের নিজেদের হাতে বিতরণের উদ্দেশ্যে ছেড়ে দেয়া উচিত। তারা তাদের আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীদের মধ্যে প্রচ্ছন্ন দারিদ্র্য ও ঠেকায় পড়া লোকদের মধ্যে তাদের নিজস্ব পরিস্থিতির ভিত্তিতে ব্যয় ও বণ্টন করবে। এটা রাসূলের করীম (স)-এর অনুসৃত নীতির ওপর কিয়াস করে বলা হচ্ছে। তিনি যাকাত পরিমাণ অনুমানকারীদের এ অধিকার দিতেন যে, তারা ধনের মালিকদের জন্যে এক-তৃতীযাংশ বা এক-চতুর্থাংশ পরিমাণ রেখে দিত, তারা নিজেরা দুই রকম ব্যাখ্যার যে কোন একটা অনুসারে সে যাকাত ব্যয় ও বন্টন করত। ফলে উভয় প্রন্থার মধ্যে যা কিছু কল্যাণবহ, এতে করে আমরা তা গ্রহণকরতে সক্ষম হব। তাতে দুই মংগলের একত্রিকরণ ও সমন্বয় সাধন করা হবে এবং হাম্বলী ফিকাহ্বিদরা যে মালিকের নিজের যাকাত নিজের হাতেই বণ্টন করা মুস্তাহাব বলেছেন, সে হিসেবটাও রক্ষা পাবে। এ সব কথাই বলা হচ্ছে ইসলামী হুকুমাত বর্তমান থাকার কথা মনে করে। কেননা এ ধরনের হুকুমতই ইসলামকে বাধ্যতামূলক ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করে কাজ করতে পারে। ইসলামই হচ্ছে রাষ্ট্র পরিচালনার সংবিধান। তার যাবতীয় সাংস্কৃতির, সামষ্টিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কার্যকলাপ পরিচালনার জন্যে ইসলামই একমাত্র পদ্ধতি। যদিও কোন কোন খুঁটিনাটি ব্যাপারে শরীয়াতের হুকুম পরস্পর বিপরীত হয়ে পড়তে পারে। সে বিষয়ে আমরা পরে বিস্তারিত বলতে চাই। কিন্তু যে রাষ্ট্র সরকার ইসলামকে রাষ্ট্রীয় ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করতে অস্বীকার করে, প্রশাসনও বিচারের সংবিধান হিসেবে তাকে মেনে নেয়নি- আল্লাহ্র নাযিল করা বিধানকে বাদ দিয়েই প্রশাসন চালিয়ে যায়- যেমন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দেশের রাষ্ট্রসমূহ মানব্ রচিত বিধান অনুযায়ী পরিচালিত হচ্ছে- এ ধরনের রাষ্ট্রের যাকাত সংগ্রহ করার কোন অধিকার থাকতে পারে না। যদি তা করতে সচেষ্ট হয় তা হলে সে রাষ্ট্র আল্লাহ্র গজবের উপযুক্ত হবে। আল্লাহ্র জিজ্ঞাসা: আল্লাহ্র কিতাবের কতকাংশ বিশ্বাস কর আর কতকাংশ অবিশ্বাস কর’-এই জিজ্ঞাসার সম্মুখীন হতে হবে। কেননা ‘তোমাদের মধ্যে থেকে যারাই এই নীতি অনুযায়ী কাজ করবে তাদের শাস্তি এ ছাড়া আর কিছুই নয় যে, বৈষয়িক জীবনে তাদের হবে চরম লাঞ্ছনা এবং কিয়ামতের দিন তারা নিক্ষিপ্ত হবে কঠিনতর আযাবে। আল্লাহ্ তোমাদের আমল-কার্যকলা- সম্পর্কে মোটেই অনবহিত নন’। [আল-বাকরা: ৮৫ আয়াত।] যাকাত গোপনকারী, দিতে অস্বীকারকারী বা দেয়ার মিথ্যা দাবীদারী সম্পর্কে বিভিন্ন মাযহাবের অভিমত যাকাত পর্যায়ে রাষ্ট্রের একটা বড় দায়িত্ব হচ্ছে যাকাত দিতে অস্বীকারকারীদের কঠোর শাস্তি দান, তাদের কাছ থেকে বল প্রয়োগের মাধ্যমে তা আদায় করে নেয়া- যদি ইচ্ছা করে ও স্বতস্ফূর্তভাবে না দেয়। ইসলামী মাযহাবসমূহের ফিকাহ্বিদগণ এ কথা চূড়ান্ত করে বলেছৈন। তাঁদের কেউ কেউ এ কথাটি আলাদা করে বলেছেন যে, যদি নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক না হওয়া মিছামিছি দাবি করে কিংবা তার ওপর যাকাত ধার্য না হওয়ার মিথ্যা কথা বলেও এই ধরনের মিথ্যার আশ্রয় নেয়, তাহলে তাকে সুকঠিন শাস্তি দিতে হবে। হানাফী ফিকাহ্বিদদের মত হানাফী ফিকাহ্বিদগণ বলেছৈন, যাকাত আদায়কারী লোক যার কাছে গিয়ে তার যাকাত দাবি করবে, তখন যদি সে বলে যে, তার মালিকানায় একটি বছর এখনও পূর্ণ হয়নি; কিংবা যদি বলে, আমার ধন পরিমাণ ঋণ রয়েছে, কিংবা নিসাব পরিমাণের কম সম্পদ আছে, তা হলে তাকে আল্লাহ্র নামে কসম করে বলতে হবে। সে ‘কসম’ করলে তাকে সত্যবাদী মনে করে নিতে হবে। অপর বর্ণনায় শর্ত করা হয়েছে এই বলে যে, অপর একজন ‘কর’ গ্রহণকারীকে দেয়ার মুক্তিপত্র বার করতে হবে। ফিকাহ্বিদগণ এই বর্ণনাটি রদ্দ করেছেন এই বলে যে, একটি রেখা অপর রেখার সাধে সাদৃশ্যসম্পন্ন হয়ে থাকে। [আমাদের এ কালে প্রমাণিত হয়েছে যে, লেখা বা রেখাসমূহ বাহ্যত পরস্পর সদৃশ হলেও বাস্তবিকভাবে তা পরস্পর বিভিন্ন হয়ে থাকে। প্রত্যেক ব্যক্তির লেখায় একটি নিজস্ব স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্র্য থাকে, যা অন্য লেখা থেকে ভিন্নতর হয়। এ কারণে প্রতীক ও প্রমাণসমূহ লেখা চেনার বিশেষ গুণসম্পন্ন লোকেরা চিনতে পারে। শরীয়াতের বিধান ধারণার প্রাধান্যের ওপর ভিত্তিশীল। আমাদের এ কালের লেখা ও রেখার ওপর এক অপরিহার্য নির্ভরতা এসে গেছে। যেমন রাষ্ট্রসমূহ তাদের বেতনভুক্ত লোকরেদ বেতন দেয় নির্ভরযোগ্য স্বাক্ষর নিয়ে আর জালকারীদের কঠোর শাস্তি হয়ে থাকে।] অনেক সময় তা জাল হয়ে থাকে। অসতর্কতার দরুন নিষ্কৃতি পায় না। গ্রহণের পর তা নষ্ট করে ফেলা হয়। তখন তার ওপর ভিত্তি করে কোন বিচার হতে পারে না। এ কারণে তা গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে কিরা-কসমও করাতে হবে। আর কিরা-কসমের পর যদি তার মিথ্যাবাদিতা প্রকাশ হয়ে পড়ে- কয়েক বছর পর হলেও তার কাছ থেকে যাকাত আদায় করতে হবে। কেননা নেয়ার অধিকার প্রমাণিত, তা মিথ্যা-কিরা-কসম দ্বারা বাতিল হতে পারে না। ‘কর’ আদায়কারী কারুর কাছে যাকাত দাবি করলে সে যদি বলে: আমি নিজে স্থানীয় গরীবদের মধ্যে বন্টন করে দিয়েছি এবং কিরা করে, সেজন্যে তাহলে তাকে সত্যবাদী মানতে হবে। কিন্তু গবাদি পশুর যাকাতের ক্ষেত্রে তা গ্রহণীয় হবে না। কেননা তার যাকাত গ্রহণের অধিকার সরকারের। অন্য কেউ নিয়ে তা বাতিলকরতে পারে না। তেমিন প্রচ্ছন্ন ধন-মাল যদি এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়, তা হইলেই তা প্রকাশমান হয়ে গেল। তখন সরকার বা সরকারের প্রতিনিধি তা গ্রহণ করবে। [লক্ষ্য করা যাচ্ছে অধিকাংশ হানাফী মতের লোক ওশর-এর ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছেন। মনে হচ্ছে তা যেন যাকাত ছাড়া অন্য কিছু। কেননা তা নিছক ইবাদত নয়। তাতে জমির খাজনার দিকটিও রয়েছে। তাতে এক বছর সময় অতিবাহিত হওয়ার শর্ত নয়। এটা সর্বসম্মত মত। আবূ হানীফার মতে তার কোন নিসাব নেই। পরিত্যক্ত সম্পত্তি থেকেওতা নিয়ে নেয়া হবে, মালিক মৃত্যুর পূর্বে অসিয়াত না করে গেলেও্ ঋণ থাকা অবস্থায়ও তা আদায় করা হবে। ‘অল্প বয়সের, পাগলের এবং ওয়াক্ফ সম্পত্তি থেকেও নেয়া হবে। এজন্যে ফিকাহ্বিদগণ বলেছৈন, ওশরকে যাকাত বলাটা পরোক্ষভাবে। অন্যরা বলেছৈন, তা যাকাত কেবলমাত্র ইমাম আবূ ইউসুফ ও মুহাম্মদের কথা মত। মুহাক্কিক ইবনুল হুম্মাম বলেছেন, তা যাকাত, সন্দেহ নেই।কৃষি ফসলের যাকাত পর্যায়ে আমরা এসব উল্লেখ করেছি। সঠিক কথা যা, তা আমরা কয়েকবার দাগিত করে বলেছি। তা হচ্ছে, যাকাত নিছক ইবাদত মাত্র নয়। এ কারণে, তাতে প্রনিধিত্ব চলে এবং জোর পূর্বকও নেয়া হয়। বালক ও পাগলের মালেও তা ধার্য হয়। এটাই উত্তম কথা।] অনুরূপ অবস্থা হচ্ছে জমির উৎপাদন, কৃষিফসল, ফল। এগুলো প্রকাশমান মালের মধ্যে গণ্য। [(আরবী **********)] রাষ্ট্রপ্রধান এ কারণে বল প্রয়োগ করে লোকদের কাছ থেকে যাকাত গ্রহণের অধিকারী। জমির মালিকের ওপর থেকে ফরয প্রত্যাহৃত হবে যদি সে নিজেই তা আদায় করে দিয়ে থাকে। তবে ফিকাহ্বিদের বক্তব্য হচ্ছে, সে যে নিজ হস্তে তা বন্টন করেছে তাতে সে ইবাদতের সওয়াব পাবে। আর রাষ্ট্রপ্রধান যদি তা গ্রহণ করে থাকেন, তবে তা মালি আল্লাহ্র সন্তুষ্টিতে নিয়োজিত হওয়ার সওয়াব পাবে। [(আরবী **********)] মালিকী মাযহাবের মত যে লোক যাকাত দিতে অস্বীকার করবে, তার কাছ থেকে তা জোরপূর্বক নিয়ে নেয়া হবে। যদি তার প্রকাশমান ধন-মাল থেকে থাকে, যদি তার প্রকাশমান মাল না থাকে- আর আছে বলে সে জনগণের মধ্যে পরিচিত হয়ে থাকে, তাহলে তাকে বন্দূ করে তার সে মাল বের করতে হবে। পরেযদি তার কিছু অংশও প্রকাশিত হয় এবং অপরাপর মাল লুকিয়ে রাখার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়, তাহলে ইমাম মালিকের বক্তব্য হল- তাকে সত্যবাদী ধরা হবে, তাকে কিরা কসম করতে বাধ্য করা হবে না এই কারণে যে, সে গোপন করেনি, যদিও সে অভিযুক্ত হয়েছে। যেলোকদেরকে কিরা-কসম করতে বাধ্য করে সে ভুল করে। আর যদি তার কাছ থেকে যাকাত গ্রহণ যুদ্ধ না করা পর্যন্ত সম্ভব নয়, তাহলে রাষ্ট্রপ্রধান তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবেন। কিন্তু তাকে হত্যা করা লক্ষ্য হবে না। যদি সে কাউকে হত্যা করে বসে, তাহলে অবশ্য তাকে এজন্যে হত্যা করা হবে। আর এ সময় কেউ তাকে হত্যা করলে সে রক্তপাত বেহুদা হবে। [(আরবী **********)] শাফেয়ী মাযহাবের মত (****) গ্রন্থ প্রণেতা বলেছেন, শাফেয়ী মাযহাবের মত হচ্ছে, যার ওপর যাকাত ফরয হয়েছে, সে যদি তা দিতে অস্বীকার কর, তাহলে দেখতে হবে: সে যদি যাকাত ফরয হওয়াটাকেই অস্বীকার করে তাহলে মনে করতে হবে, সে কাফির হয়ে গেছে এবং এই কুফরির অপরাধের শাস্তিস্বরূপ তাকে হত্যা করা হবে, যেমন মুর্তাদ ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়। কেননা এটা সকলেরই জানা কথা যে, যাকাত ফরয হওয়াটা আল্লাহ্র দ্বীনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাই যে লোক তা অস্বীকার করবে, সে আল্লাহ্কে অস্বীকার করল, অস্বীকার করলতাঁর রাসূলকে। অতএব সে কাফির হয়ে গেল। আর যদি নিছক কার্পণ্যেল কারণে যাকাত না দেয়, তাহলে তার কাছ থেকেতানেয়া হবে এবং এই না দেয়ার জন্যে তাকে শাস্তি দিতে হবে। ইমাম শাফেয়ী পূর্বে বলেছিলেন: সে লোকের কাছ থেকে যাকাত তো নেয়া হবেই, সেই সাথে তার ধন-মালের অর্ধেকও নেয়া হবে। কেননা বহজ ইবনে হুকাইম তাঁর পিতা- তাঁর দাদা-রাসূলে করীম থেকে বর্ণনা বর্ণিত হয়েছে, নবী করীম (স) বলেছেন: (আরবী **********) আর যে লোক তা (যাকাত) দিতে অস্বীকার করবে, আমরা অবশ্যই তার কাছ থেকে তা নেব, সেইসাথে নেবতার মালের অর্ধেক। আল্লাহ্র চূড়ান্ত সিদ্ধান্তসমূহের মধ্যে এ একটি। আর আলে মুহাম্মাদের জন্যেতা কোন অংশ নেই। [হাদীসটি আহ্মাদ, আবূ দাউদ ও নাসায়ী কর্তৃক উদ্ধৃত। প্রথম অধ্যায়ে এ বিষয়ে বক্তব্য পেশ করা হয়েছে। হাকেমও হাদীসটি তার আল-মুস্তাদরাক’ গ্রন্থে উদ্ধৃত করেছেন(১ম খণ্ড, ৩৯৮ পৃ.)। তার সনদ সহীহ বলা হয়েছে এবং যাহবীও তা সমর্থন করেছেন। ইয়াহ্ইয়া ইবনে সরীন বলেছেন: হাদীসটির সনদ সহীহ্ যদি তা বহজ ছাড়া হয়। বহজ সিকাহ্ বর্ণনাকারী ইমাম আহ্মাদককে এই হাদীসটি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বললেন: আমি তাঁর অবস্থা জানি না। তাঁর সনদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে বললেন: (****) খুবই উত্তম সনদ। আবূ হাতিম বলেছেন, বিশ্বস্ততায় মশ্হুর নয় এবংবলেছেন, বর্ণনাকারী ইবনুত তালা মজহুল। অজ্ঞাত পরিচিত ব্যক্তি।যদিও ইমামগণের এক জামায়াত তাঁকে সিকাহ্ বলেছেন। ইবনে আদী বলেছেন, তাঁর বর্ণিত কোন হাদীস আমি ‘মুনকার’ ‘অগ্রহণযোগ্য’ পাইনি। যাহ্বী বলেছেন, কোন আলিমতাঁকে কখনই পরিত্যাগ করেন নি। তবে তাঁর বর্ণিত হাদীসকে কেউ দলিল হিসেবে গ্রহণ করেনি। তাঁর সমালোচনা করে বলা হয়েছে, তিনি শতরঞ্জ খেলতেন। ইবনুল কাতান বলেছেন, এটা তার জন্য ক্ষতিকরকিছু নয়। কেননা সকলের জানা ফিকাহ্ মস্লা হল, তা মুস্তাহাব। ইমাম বুখারী বলেছেন, তাঁর ব্যাপারে লোকেরা বিভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। ইবনে কাসীর বলেছেন, অধিকাংশ ফিকাহ্বিদ তাকে দলিল হিসেবে নেন না। হাকেম বলেছেন, তার বর্ণিত হাদীস সহীহ্। তাঁর অনেক কয়টি হাদীসকে ইমাম তিরমিযী ‘হাসান’ অভিহিত করেছেন। ইমাম আহমদ ও ইসহাক তাঁকে সিকাহ বলেছেন, তাঁর বর্ণিত হাদীস দলিল হিসেবেও নিয়েছেন। ইমাম বুখারী সহীহ্ বুখারী গ্রন্থের বাইরে তাঁকে গ্রহণ করেছেন। তাঁর ওপর টীকা লিখেছেন। আবূ দাউদ থেকে বর্ণিত, তিনি তাঁর মতে দলিল। দেখুন: (আরবী **********)] প্রথম কথাটাই ঠিক। যাকাত দিতে কার্পণ্যকারী ব্যীক্ত যদি বাধা দেয়, তাহলে রাষ্ট্রপ্রধান তার সাথে যুদ্ধ করবে। কেননা আবূ বকর সিদ্দীক (রা) যাকাত দিতে অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। [দেখুন: (আরবী **********)] যাকাত দিতে অস্বীকারকারীকে শিক্ষাদান ও জোরপূর্বক গ্রহণের ঐকমত্য প্রথম সিদ্ধান্তটি- যে লোক যাকাত ফরয হওয়াকে অস্বীকার করে তা দিতে প্রস্তুত হবে না তার কাফির হয়ে যাওয়ার কথা এবং তাকে মুর্দাত হিসেবে হত্যা করার ঘোষণা সর্বসম্মত। তবে শর্ত এইযে, সে লোক এমন হবে না, যার কোন ‘ওজর’ থাকতে পারে। যেমন নও-মুসলিম হওয়া কিংবা মুসলমানদের বসতি থেকে দূরে জন্মগ্রহণ করা ও লালিত পালিত হওয়া। প্রথম অধ্যায়ে এসব কথা উল্লেখ করা হয়েছে। অনুরূপভাবে দ্বিতীয় সিদ্ধান্তটি- যার ওপর যাকাত ফরয হয়েছে কিন্তু সে তা কার্পণ্যের কারণে দিতে অস্বীকার করছে, তার কাছ থেকে জোরপূর্বক নেয়া হবে এবং তাকে শাস্তিও দেয়া হবে। সেই সাথে তাকে বন্দী করে উপযুক্ত শিক্ষাও দিতে হবে। [দেখুন: (আরবী **********)] যাকাত দিতে অস্বীকারকারীকে তার অর্ধেক মাল নিয়ে শাস্তি দান ও বিভিন্ন মত যাকাত দিতে অস্বীকারকারীর অর্ধেক মাল নিয়ে তাকে শাস্তিদান অন্য কথায় তার অর্ধেক মাল বাজেয়াপ্ত করা- তাকে ইসলামী নীতি শিক্ষাদান ও তার মত অন্যান্য লোককে সচেতন করার উদ্দেশ্যে যেমন বহজ ইবনে হুকাইম বর্ণিত পূর্বোদ্ধৃত হাদীসেবলা হয়েছে- এ পর্যায়ে ফিকাহ্বিদদের বিভিন্ন মত রয়েছে। ইমাম শাফেয়ী প্রথম দিকে এ কথাই বলেছিলেন। ইমাম ইসহাকও তাই। আহ্মাদ ও আওযায়ী এই স্পষ্টভাষী হাদীসটিকে দলিল হিসেবে গ্রহণ করেছেন। হাম্বলী মাযহাবের কেউ কেউ উক্ত মতটিকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। যেমন পরে বলা হচ্ছে। শাফেয়ীর পরবর্তী নতুন মত হচ্ছে, তার কাছ থেকে যাকাত পরিমাণ মালই গ্রহণ করা হবে। জম্হুর ফিকাহ্বিদদেরও তাই মত। ক. এজন্যে যে, হাদীসে বলা হয়েছে: ব্যক্তির ধন-মালে যাকাত ছাড়া আর কারুর কোন অধিকার নেই। [পরে হাদীসটির সূত্র উল্লেখ করা হবে।] খ. এবং যেহেতু তা একটি ইবাদত, তা পালন করতে কেউ অস্বীকার করলে তার অর্ধেক মাল নিয়ে নেয়া ওয়াজিব হতে পারে না। যেমন অন্যান্য ইবাদতের ক্ষেত্রে করা হয়। গ. এবং যেহেতু হযরত আবূ বকর (রা) ও সাহাবীদের সময়ে যাকাত দিতে অস্বীকারকারী লোক ছিল বিপুল সংখ্যক, কিন্তু তাদের কাছ থেকে অধিক মাল নেয়ার কথা কেউ বর্ণনা করেনি, নেয়া হয়েছে বলেও জানানো হয়নি। [(আরবী **********)] বহজ বর্ণিত হাদীসটি বায়হাকী শাফেয়ী থেকে উদ্ধৃত করেছেন। তিনি বলেছেন, হাদীস পারদর্শিগণ এমন কোন হাদীস প্রমাণ করেন নি, যার বলে যাকাতও গ্রহণ করা হবে আর সেই সাথে তার উটেরও অর্ধেক (তার এই যাকাত না দেয়ার জরিমানাস্বরূপ) নেয়া হবে। যদি তেমন কিছু প্রমাণিত হত, তাহলে আমরা নিশ্চয়ই তামেনে নিতাম। [***৩] বায়হাকী শাফেয়ীর উক্ত কথাকে সমর্থন করেছেন এই বলে যে, বুখারী ও মুসলিম এ ধরনের কোন হাদীস নিয়ে আসেন নি। [(আরবী **********)] তাঁর বর্ণিত হাদীসকে যয়ীফ প্রমাণ করার জন্যে এতটুকু কথাই যথেষ্ট নয়। কেননা এমন বহু সংখ্যক সহীহ্ হাদীসইরয়েছে যা বুখারী ও মুসলিম উদ্ধৃত করেন নি অথচ তার অধিকাংশ বায়হাকী ও অন্যান্যইমাম দলিল হিসেবে নিয়েছেন। তার পরেও ‘বায়হাকী’ বলেছেন, ইসলামের প্রাথমিক যুগে চোরকে দ্বিগুণ জরিমানা দিতে হ।ত পরে তা বাতিল হয়ে যায়। ইমাম শাফেয়ী উক্ত নিয়ম মনসূখ হওয়ার ব্যাপারে বরা ইবনে আজেব বর্ণিত হাদীসকে দলিল হিসেবে নিয়েছেন। হাদীসটিতে তার উটটি যে বিপর্যয় করেছিল তার উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু সে কিস্সায় নবী করীম (স) থেকে এ কথা বর্ণিত হয়নি যে, তিনি তার জরিমানা দ্বিগুণ করে দিয়েছিলেন, বরং তাতে শুধু ক্ষতিপূরণ দেয়ার জন্যেতিনি যে হুকুম দিয়েছিলেন তারই উল্লেখ হয়েছে। তাই এ ব্যাপারটিও অনুরূপ হওয়ার সম্ভাবনা। [(আরবী **********)] মা-অর্দী বলেছৈন, ‘ধন-মালের যাকাত ভিন্ন অন্য কোন হক নেই’ রাসূলে করীম (স)-এর এ কথাটিতে এমন কিছু ভাব রয়েছে, যা হাদীসটিকেক যাকাত ফরয হওয়ার বাহ্যিক অর্থ থেকে তম্বীহ্ ও ভয় প্রদর্শনের দিকে ফিরিয়ে নেয়। যেমন বলেছেন, ‘যে লোক তার ক্রীতদাস হত্যা করবে, আমরাও তাকে হত্যা করব’। [পাঁচখানি গ্রন্থে হাদীসটি উদ্ধৃত হয়েছে। তিরমিযী বলেছৈন, (*****) তার সনদে দুর্বলতা আছে। কেননা তা হাসানের বর্ণনা সামুরা এর বাহ্যিক অর্থকে কতিপয় আলিম গ্রহণকরেছেন। (আরবী **********)] যদিও সে তার দাস হত্যার কারণে নিহত হবে না। [(আরবী **********)] ইমাম নববী (****) গ্রন্থে লিখেছেন: সুনানে আবূ দাউদ প্রভৃতি গ্রন্থে যে হাদীসটি উদ্ধৃত হয়েছে ‘তার অর্ধেক মাল নেয়া’ সম্পর্কে ইমাম শাফেয়ী যে হাদীসটিকে ‘যয়ীফ’ বলেছেন এবং হাদীস পারদর্শীদের থেকেই এ কথা বর্ণনা করেছেন যে, তাঁরাও হাদীসটিকে ‘সপ্রমাণিত’ মনে করেন না। এ জবাবটাই পসন্দনীয়, গ্রহণীয়। কিন্তু আমাদের সাথীদের মধ্যে যাঁরা এই জওয়াব দিয়েছেন যে, ও হাদীসটি মনসূখ হয়ে গেছে, তা কিন্তু যয়ীফ কথা। কেননা কোন দলিল ছাড়া মন্সূখ প্রমাণ করা যায় না। কিন্তু তা করার এখন আর কোন উপায় নেই। [(আরবী **********)] তিনি (****) গ্রন্থেও এরূপ বলেছেন। যেসব সাহেবান বহজ বর্ণিত হাদীসটিকে মন্সূখ বলে জবাব দিয়েছেন, বলেছেনতা ছিল তখন, যখন মাল দ্বারা শাস্তি দেয়া হত। বলেছেন, এ জবাবটা দুটি কারণ দুর্বল। একটি হচ্ছে, ইসলামের প্রথম যুগে মালের জরিমানা করে শাস্তি দেয়া হত এই বলে যে, তারা দাবি করেছে, তা প্রমাণিত কথা নয়, লোকরেদ কাছে পরিচিতও নয়। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে, মনসূখ হওয়ার কথা গ্রহণ করা যেতে পারে যদি তার তারিখ জানা যায়। কিন্তু তা এখানে জানা যায়নি। তাই সহীহ্ জবাব হচ্ছে, মূল হাদীসটিই ‘যয়ীফ’। তাই অগ্রহণীয়। [(আরবী **********)] পর্যালোচনা ও অগ্রাধিকার দান আমরা যা মনে করি, বহজ ইবনে হুকাইম বর্নিত হাদীসটিতে এমন কোন ত্রুটি নেই যা গণ্য করা যেতে পারে।তা- যেমন পূর্বে বলেছি [ঐপ্রথম খণ্ড, ৭৭ পৃ.]- রাষ্ট্রপ্রধানের মত নির্ধারণের ফলে যে তা’জীরী শাস্তি দেয়া সাব্যস্ত হবে, তাই দিতে হবে। তা সেই পর্যায়ে গণ্য যা আমরা বারবার উল্লেখ করেছি অর্থাৎ সে সব হাদীসের মধ্যে একটি যা রাসূলে করীম(স) সমাজ নেতা ও রাষ্ট্রকর্তা হিসেবে বলেছেন। কিরাফী ও শাহ্ দিহলভী প্রমুখও এরূপই বলেছেন। [দেখুন: ঐ ২৩০ পৃ. ২৩৩ পৃ.] এ হাদীসটি সেই পর্যায়ের যা আধুনিক কালের আইন রচনায় রয়েছে ধার্যকৃত কর দিতে অস্বীকারকারীলোকদের ভীত-সন্ত্রস্ত করার উদ্দেশ্য। যাঁরা বহজ বর্ণিত হাদীসটি রদ্দ করেন, তাঁরা নিম্নোক্ত তিনটির যে কোন একটির ওপর নির্ভর করেছেন: ২. তাঁদের কেউ কেউ নির্ভর করেছেন হাদীসসমূহের পারস্পরিক বৈপরীত্যের ওপর।কেননা যাকাত চাড়া ধন-মালের অন্যকোন হক নেই, এ হাদীসটি সহীহ্ ও প্রমাণিত। এ পর্যায়ে মরফু হাদীসও বর্ণিত হয়েছে। [দেখুন: (আরবী **********)] ২. তাঁদের কেউ কেউ নির্ভর করেছেন এ কথার ওপর যে, তা মাল জরিমানার মাধ্যমেএক প্রকারের শাস্তি দান। তাইসলামের প্রাথমিক যুগে ছিল, পরে মনসুখ হয়ে গেছে। ৩. অপর কিছু লোকনির্ভর করেছেন একথার ওপর যে, হাদীসটি ‘যয়ীফ’-তার বর্ণনাকারী বহজ-এর দুর্বলতার কারণে। এই ভিত্তিতে নববী অবিচার করেছেন। প্রথম কথা, একটা স্বতন্ত্র অধ্যায়ে আমরা বলব, ধন-মালের যাকাত ছাড়াও হক্ ধার্য হয়। এ পর্যায়ে কুরআনের আয়াতও রয়েছে। অনেক কয়টি সহীহ্ হাদীসও উদ্ধৃত ও বর্ণিত হয়েছে। অতএব বহজ বর্ণিত হাদীসও অন্য হাদীসের মধ্যে কোন বৈপরীত্য নেই। আর দ্বিতীয় কথা, মালের জরিমানা করে শাস্তিদানের নীতি-সহীহ্ কথা এই- মনসূখ হয়নি। গবেষক ইবনুল কাইয়্যেমতাঁর (*****) গ্রন্থে রাসূলে করীম (স) এবং তাঁর খুলাফায়ে রাশেদুনের পনেটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন। তার প্রত্যেকটি থেকে মালের জরিমানা দ্বারা শাস্তি দেয়ার কথা প্রমাণিত। [দেখুন: (আরবী **********)] হাদীসটিকে ‘যয়ীফ’ মনে করার ব্যাপারে আমার বক্তব্য হচ্ছে- বাহ্যত মনে হচ্ছে, তা সনদের দিক দিয়ে ‘যয়ীফ’ নয়। বরং তা হাদীস মওজু হওয়ার কারণ সমূহের মধ্যে একটি কারণ। তা পূর্ববর্তী দুটি ব্যাপারের ওপর ভিত্তিশীল। এ কারণে তাঁরা বা তাঁদের কেউ কেউ বহজকে এই হাদীসের দরুন ‘যয়ীফ’ বলেছেন।কিন্তু বহজ-এর কারণে হাদীসটি ‘যয়ীফ’ বলা হয়নি। তা-ই সম্ভব। ইবনে আব্বাস বলেছৈন: এ হাদীসটি না হলে বহজকে আমি ‘সিকাহ’ বর্ণনাকারীদের মধ্যে গণ্য করতাম। ইবনুল কাইয়্যেম (*******) গ্রন্থে বহজ সম্পর্কে ইমামগণের বক্তব্য উল্লেখ করার এবং আহমাদ, ইসহাক ও ইবনুল মাদীনী যে তাকে সহীহ্ বলেছেন, তার উল্লেখের পর লিখেছেন: ‘এ হাদীসটি যে লোক রদ্দ করেছেন, তার কাছে কোন দলিল নেই।’ হাদীসটি মনসূখ হওয়ার দাবিও বাতিল। কেননা সে দাবির স্বপক্ষেও নেই কোন প্রমাণ। অথচ মাল নিয়ে শাস্তি দেয়ার শরীয়াতসম্মত প্রমাণের অনেক হাদীস রাসূলে করীম (স) থেকে বর্ণিত হয়েছে। কোন দলিলের ভিত্তিতে সেগুলোর মনসূখ হওয়া প্রমাণিত নয় বরং রাসূলেকরীম (স)-এর পরবর্তীকালে তাঁর খলীফাগণ তদানুযায়ী আমল করেছেন। বরা ইবনে আজেবের উটের ঘটনা প্রসঙ্গে বর্ণিত হাদীসের সাথে তার বৈপরীত্যটাও চরম মাত্রার দুর্বল কথা। কেননা শাস্তি দেয়া ন্যায়সংগত হতে পারে যদি শাস্তি প্রাপ্ত ব্যক্তি কোন কর্তব্য কাজ করতে অস্বীকৃত হয় কিংবা কোন নিষিদ্ধ কাজ করে বসে। কিন্তু যা তার নিজের ইচ্ছা ও কাজ ছাড়াই ঘটে গেছে, তার ওপর কোনরূপ শাস্তি চাপানোর যৌক্তিকতা কেউ মেনে নেবে না। যাঁরা মনে করেন যে, ও কথাটি শুধু ভীত করার জন্যে বলা, আসলে তা নয়, তাদের এ ধারণা চরম মাত্রার বিপর্যয় সৃষ্টিকারী। নবী করীম (স)-এর কালাম এরূপ অবাস্তবতা থেকে সম্পূর্ণ পবিত্র। ইবনে হাব্বানের কথা ‘এ হাদীসটি না থাকলে বহজকে আমি সিকাহ্ বর্ণনাকারীদের মধ্যে করে নিতাম’ যারপর নাই অগ্রহণযোগ্য কথা। কেননা তার ‘যয়ীফ’ হওয়ার কারণ কেবলমাত্র এই একটি হাদীস ছাড়া যদি আর কিছুই না থেকে থাকে, অথচ তাঁকে যয়ীফ বলা হয়েছে কেবলমাত্র এই হাদীসটির কারণে, তাহলে এ তো ‘আবর্তনশীল’ এবংতা বাতিল। অথচ তাঁর বর্ণনায় এমন কিছু নেই যা তাঁর যয়ীফ হওয়ার কারণ ঘটাতে পারে। কেননা ফিকাহ্ বর্ণনাকারীগণ এ পর্যায়ে তার বিপরীত কিছুই পেশ করেন নি। [(আরবী **********)] আশ্চর্যের কথা, ফিকাহ্ বিষয়ে নির্ভরযোগ্য গ্রন্থাদির লেখকগণ- যেমন শীরাজী ‘আল-মুহায্যার-এর লেখক, মা’আর্দী ‘আল-আহ্কামুস্ সুলতানিয়ার গ্রন্থকার এবং আল-মুগনীর’ লেখথক কিংবা কমপক্ষে তার সহীহ্ হওয়াটায় বিভিন্ন মত থাকার দরুন- এমন এক হাদীসের বলে, যার কোন মূল্যই নেই ইল্মী দিক দিয়ে। সে হাদীসটি হচ্ছে- ধন-মালের যাকাত ভিন্ন অন্য কোন দাবি নেই। এ কারণে হাদীসসমূহের গুরুত্ব, মর্যাদা ও মূল্যবান- সেসবের মূল উৎস এবং সূত্রের দিক দিয়ে সঠিকভাবে জেনে নেয়া একান্তই আবশ্যক। ‘অবহিত ব্যক্তির ন্যায় তোমাকে আর কেউ অবহিত করতে পারবে না।’ [সূরা ফাতির ১৪ আয়াত] হাম্বলী মায্হাবের মত হাম্বলী মাযহাবের মত ঠিক শাফেয়ী মাযহাবের মতই। যাকাত দিতে অস্বীকারকারীদের অমান্যতা, বিদ্রোহ ও মিথ্যা বলার কারণে মুর্তাদ হয়ে যাওয়ার বর্ণনা দেয়ার পর ইবনে কুদাহাম্ লিখেছেন: ‘যাকাত ফরয হওয়া বিশ্বাস করা সত্ত্বেও যদি তা দিতে অস্বীকার করে, তখন রাষ্ট্রপ্রধান যদি তার নিকট থেকে যাকাত নিয়ে নিতে পারেন, তবে তাই নেবেন এবং তাকে শাস্তি দেবেন। অধিক সংখ্যক আলিমের কথা হচ্ছে, তার অতিরিক্ত কিছু নেবেন না।... অনুরূপভাবে যদি গোপন করেও মিথ্যা বলে, যার ফলে রাষ্ট্রপ্রধান, তার যাকাত গ্রহণ করতে না পারেন- পরে তা যদি প্রকাশিত হয়ে পড়ে, তাহলে ইসহাক ইবনে রাহ্ওয়াই ও আবূবকর আবদুল আজীয বলেছেন, তার যাকাতও নেবে, সেই সাথে তার মোট মালের অর্ধেকও নেবে। যেমন বহজ ইবনে হুকাইম বর্ণনা করেছেন। সেই অস্বীকারকারী ব্যক্তি যদি রাষ্ট্রপ্রধানের যাকাত গ্রহণে বাধাদান করে, তাহলে তিনি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবেন। কেননা সাহাবায়ে কিরাম (রা) যাকাতের প্রতিবন্ধকতাকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। সে যুদ্ধে যদি রাষ্ট্রপ্রধান জয়লাভ করেন, তার সব ধন-মালও দখলে আসে, তাহলে তা থেকে যাকাত নেবেন; তখনও তার অতিরিক্ত কিছু নেবেন না। তার সন্তানদের গোলাম বানানো যাবে না। কেননা এই সন্তানরা কোন অপরাধ করেনি। আর যাকাত দিতে অস্বীকারকারীকে যখনই গোলাম বাননো হয় না, তখন তার সন্তানদের তো কোন কথাই উঠতে পারে না। আর যুদ্ধে যদি জয় হয় কিন্তু ধন-মাল না পাওয়া যায়, তাহলে তা দেবার জন্যে তাকে বলতে হবে এবং তওবা করতে বলতে হবে তিনবার। যদি সে তওবা করে এবং যাকাতও দিয়ে দেয়, তো ভাল কথা, নতুবা তাকে হত্যা করা হবে। তবে তাকে কাফির বলা যাবে না। অবশ্য ইমাম আহমাদের একটি মত বর্ণিত হয়েছে। তা হচ্ছে- যাকাত না দেয়ার দরুন সে যখন যুদ্ধই করতে নেমেছে, তখন সে কাফির না হয়ে যায় না। মাইমুনী ইমাম আহমাদের এক কথা বর্ণনা করেছেন যে, লোকেরা যখন যাকাত দিতে অস্বীকৃত হবে- যেমন লোকেরা হযরত আবূ বকর (রা)-কে দিতে অস্বীকার করেছিল এবং তারা সেজন্যে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল, তাহলে তাদের উত্তরাধিকারী কেউ হবে না, তাদের জানাযার নামাযও পড়া হবে না। আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ বলেছেন: যাকাত তরককারী মুসলিম নয়। তার কাণ, যেমন বর্ণিত হয়েছে, হযরত আবূ বকর (রা) যখন যাকাত দিতে অস্বীকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন, যুদ্ধ তাদের কামড়ে ধরল, তখন তারা বলেছিল: হ্যাঁ আমরা যাকাত দেব। তখন হযরত আবূ বকর (রা) বলেছিলেন: আমি তা গ্রহণ করব না যতক্ষণ পর্যন্ত তোমরা এ সাক্ষ্য না দেবে যে, আমাদের পক্ষের নিহত ব্যক্তিরা জান্নাতবাসী হবে এবং তোমাদরে পক্ষের নিহতরা হবে জাহান্নামবাসী। কোন সাহাবী এ কথার প্রতিবাদ করেছেন, এমন কথা কেউ বর্ণনা করেনি। তাহলে প্রমাণিত হল যে, তারা কাফির হয়ে গিয়েছিল। প্রথম বিবেচ্য, হযরত উমর (রা) ও অন্যান্য সাহাবী শুরুতে যখন যুদ্ধ যোগদান করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন, যদি তাঁরা মনে করতেন যে, ওসব লোক কাফির হয়ে গেছে, তাহলে তাঁরা নিশ্চয়ই যুদ্ধ করতে ইতস্তত করতেন না। পরে তাঁরা যুদ্ধে একমত হলেন বটে; কিন্তু তাদের কাফির হওয়ার ব্যাপারটি মৌলিকভাবে ‘না’র ওপর থেকে গেল। আরও এজন্যে যে, যাকাত হচ্ছে পূর্ণাঙ্গ দ্বীনের একটি শাখা। তা শুধু তরক করলেই একজন লোক কাফির হয়ে যায় না, যেমন হজ্জ। আর যাকাত তরক করলে যদি কাফির না হয়, তাহলে তার জন্যে যুদ্ধ করলেই কাফির হয়ে যাবে না। যেমন বিদ্রোহীরা। হযরত আবূ বকর (রা) যাদেরকে উক্ত কথা বলেছিলেন, হতে পারে তারা যাকাতকে ফরয মানতেই অস্বীকার করেছিল। এ ব্যাপারটি তো একটা নির্দিষ্ট অবস্থায় সংঘটিত হয়েছিল। তাই হযরত আবূ বকর (রা) ঠিক কোন্ সব লোককে সম্বোধন করে উক্ত কথাটি বলেছিলেন, তা আজ প্রকট ও প্রমাণ করা সম্ভব নয়। হতে পারে তারা মুর্তাদ হয়ে যাওয়া লোক ছিল্ হতে পারে তারা যাকাত ফরয হওয়াকেই অস্বীকার করেছিল। আরও অনেক কিছু হতে পারে। তাই বিভিন্ন মতদ্বৈততার ক্ষেত্রে কোন একটা চূড়ান্ত কথা বলা চলে না। হয়ত হযরত আবূ বকর (রা) একথা বলেছিলেন এজন্যে যে, তারা কবীরা গুনাহ্ করেছে এবং তওবা না করেই মৃত্যুবরণ করেছে। এজন্যে তাদের জাহান্নামী হওয়ার কথা বলেছেন প্রকাশ্যভাবে, যেমন প্রকাশ্যভাবে মুজাহিদ শহীদদের জান্নাতবাসী হওয়ার কথা বলেছিলেন। আর সব ব্যাপারে চূড়ান্ত ফয়সালা তো আল্লাহ্র ওপর ন্যস্ত। তারা চিরকাল জাহান্নামে থাকবে, এমন কথাও বলেন নি। কেউ জাহান্নামী হবে একথা বললে তার চিরকাল জাহান্নামে থাকার কথা বলা হয় না। পরন্তু নবী করীম (স) সংবাদ দিয়েছেন যে, তাঁর উম্মতের মধ্য থেকে বহু লোক চিরকাল জাহান্নামে থাকবে। পরে আল্লাহ্ তা’আলা তারেকে জাহান্নাম থেকে বের করে জান্নাতে নিয়ে যাবেন। [দেখুন: (আরবী **********)] ‘যায়দীয়া’ মতের লোকদের বক্তব্য ‘জায়দীয়া’ মতের কিতাব (****) এবং তাঁর শরাহ গ্রন্থে বলা হয়েছে: ধন-মালের মালিক যদি দাবি করে যে, তার ওপর যাকাত ফরয নয়, সে নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক নয়, তাহলে তার কথা গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু রাষ্ট্রপ্রধান কিংবা তাঁর প্রতিনিধির কর্তব্য হল, তার কথার সত্যতায় কোনরূপ সন্দেহের উদ্রেক হলে সে ব্যক্তিকে কিরা-কসম করতে বাধ্য করবে। আর তা করা হবে যদি তার বিশ্বস্ততা প্রকাশমান ও সর্বজনবিদিত না হয়। কিন্তু সে লোক যদি প্রকাশমানভাবে বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তি হয়, তাহলে তাকে কিরা-কসম করতে বাধ্য করা হবে না। [(আরবী **********)] কিন্তু ধন-মালের মালিক যদি অঙ্গীকার করে যে, তার ওপর যাকাত ফরয আর সেই সাথে এও দাবি করে যে, সে তা রাষ্ট্রপ্রধানের পক্ষথেকে দাবি করার পূর্বেই পাওয়ার যোগ্য লোকদের মধ্যে বন্টন করে দিয়েছে- এ কথার সত্যতা প্রমাণকারী যদি কেউ না থাকে, তাহলে বন্টন করার দাবিকারীকে তার প্রমাণ পেশ করতে হবে। কেননা আসল কথা হল যাকাত আদায় করে না দেযা এবং বণ্টনটা ঘটেছে রাষ্ট্র প্রধানের দাবি করার পূর্বে। সে যদি যাকাত ওয়াজিব হওয়া ও বন্টন করা ইত্যাদি সব কিছু প্রমাণ পেশ করে তো ভালো কথা নতুবা তার নিকট থেকে যাকাত আদায়কারী তা আদায় করে নেবে। তখন তার বণ্টন করার দাবি মেনে নেয়া যাবে না, সেযদি প্রকাশমান-বিশ্বাসযোগ্য হয়, তবুও। [(আরবী **********)] অত্যাচারী শাসকের কাছে যাকাত দেয়া অত্যাচারী শাসকের কাছে যাকাত দেয়া পর্যায়ে আলিমগণ যা কিছু বলেছেন এবং এ ব্যাপারে তাঁদের মধ্যে যে মতভেদ রয়েছে, তার সম্পূরক ও চূড়ান্ত কথা হচ্ছে তিনটি: ১. নিঃশর্তভাবে তা জায়েয। ২. নিঃশর্তভাবে তা নিষিদ্ধ এবং ৩. পার্থক্যকরণ। যাঁরা জায়েয বলেছেন, তাঁদের বক্তব্য অত্যাচারী শাসকের কাছে যাকাত দেয়া জায়েয বলেছেন যাঁরা, তাঁদের দলিল হচ্ছে সে সব হাদীস, যাতে এ বিসয়ে স্পষ্ট কথা উদ্বৃত হয়েছে। (****) গ্রন্থে তন্মধ্য থেকে অনেকগুলো হাদীস উদ্ধৃত হয়েছে। [দেখুন: (আরবী **********) এবং দেখুন: ] ক. হযরত আনাস থেকে বর্ণিত, দুই ব্যক্তি বলল: হে রাসূল (স) আমি যদি আপনার প্রেরিত ব্যক্তির কাছে যাকাত আদায় করে দিই, তাহলে কি আমি আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের কাছে দায়িত্বমুক্ত হতে পারলাম? বলেন: হ্যাঁ, তুমি যদি তা আমার প্রেরিত ব্যক্তির কাছে দিয়ে দাও, তাহলে তুমি আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের কাছে সম্পূর্ণ দায়িত্বমুক্ত হলে। তখন তুমি তোমার শুভ কর্মফল পাবে। যে তার ব্যয়ক্ষেত্র বদলে দেবে, গুনাহ তারই হবে। [আহমাদ বর্ণনা করেছেন, যেমন নাইলূল আওতার’ ৪র্থ খণ্ড ১৫৫ পৃ. রয়েছে।] খ. ইবনে মাসউদ থেকে বর্ণিত, রাসূলে করমি (স) বলেছেন: আমার পরে নিশ্চয়ই এমন সব নিদর্শনাদি ও ব্যাপারসমূহ সংঘটিত হবে, যা তোমরা খারাপ মনে করবে। সাহাবিগণ বললেন: হে আল্লাহ্র রাসূল, সেই অবস্থার জন্যে আমাদেরকে কি নির্দেশ দেন? বললেন: তোমাদের ওপর ধার্য কর্তব্য ও হক তোমরা আদায় করতে থাকবে আর তোমাদের যা পাওনা ও অধিকার, তা আল্লাহ্র নিকট চাইবে। [বুখারী ও মুসলিম। ঐ] গ. ওয়েল ইবনে হুজর থেকে বর্ণিত, আমি রাসূলে করীম (স)-কে বলতে শুনেছি, এক ব্যক্তি তাঁর কাছে প্রশষ্ন করছিল- আপনি কি মনে করেন, আমাদের ওপর যদি এমন সব কর্তৃত্বসম্পন্ন লোক প্রতিষ্ঠিত হয় যারা আমাদের হক আমাদেরকে দিতে অস্বীকার করে আর তাদের হক্ তারা আমাদের কাছে চায়, তাহলে তখন আমরা কি করব? বললেন: তোমরা তা শোন এবং মান্য কর। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, তাদের ওপর তা ধার্য হবেই যা তারা নিজেদের ওপর চাপিয়ে নিয়েছে এবং তোমাদের ওপর তাই ধার্য যা তোমরা চাপিয়ে নিয়েছ নিজেদের ওপর। [মুসলিম, তিরমিযী তিনি এ হাদীসকে সহীহ্ বলেছেন, ঐ] এ সব হাদীসের খুব গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য রয়েছে। আর তা হচ্ছে ইসলামী রাষ্ট্র সব সময়ই এমন ধন-মালের মুখাপেক্ষী, যার দ্বারা তা সামাজিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা কায়েম করবে এবং সাধারণ কল্যাণমূরক কাজ আঞ্জাম দেবে, যার ফলে ইসলামের কালেমা বুলন্দ হবে। কিন্তু জনগণ যদি তাদের হস্তে প্রয়োজনীয় ধন-মাল দেয়া থেকে বিরত রাখে- কোন কোন প্রশাসকের জুলুম নিপীড়নের কারণে, তাহলে রাষ্ট্রের আর্থিক ভারসাম্য বিনষ্ট হবে। উম্মতের রজ্জু ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়বে। অপেক্ষামান শত্রুরা তাদের ব্যাপারে অনেক লোভ-লালসা করবে। অতএব সে রাষ্ট্রের আনুগত্য করা- যাকাত ইত্যাদি যা কিছু দেয় তা যথারীতি আদায় করা একান্তই কর্তব্য। ইসলামী শরীয়াত জুলূম প্রতিরোধ করার যত পথ দেখিয়েছে তা অবলম্বনের পথে এ নির্দেশ কোন বাধা নয়। তাই মুসলিম ব্যক্তিবর্গের কাছে যে সব আর্থিক অধিকার পাওনা রয়েছে তা দিয়ে দেয়া তাদের কর্তব্য। সেই সাথে দায়িত্বশীল জাতীয় কর্মকর্তাদের কল্রাণ কামনামূরক উপদেশ- নসিহত করাও বাঞ্ছনীয়। কেননা দ্বীন ইসলামের দিক দিয়ে তা ওয়াজিব এবং তা পালন করা উচিত। কুরআনী ঘোষণানুযায়ী পারস্পরিক সত্য, ন্যায় ও ধৈর্য ধারণের উপদেশ দান এবং ন্যায়ের নির্দেশ ও অন্যায়ের প্রতিরোধ নাগরিক হিসেবে একটা অতি বড় কর্তব্য। মুসলিম সমাজের অধিকার এবং কর্তব্য ও দায়িত্ব অবিসংবাদিত, অবিস্মরণীয়। আর তা হচ্ছে শাসক-প্রশাসকদের মধ্যে স্পষ্ট ও প্রকাশ্য কুফরী দেখতে পেলে এবং কুরআনী দলিলের ভিত্তিতে নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হলে তাদের আনুগত্য করা একটা অতি বড় দায়িত্ব। অনুরূপভাবে মুসলিম ব্যক্তির অধিকার এবং কর্তব্য হচ্ছে, যে কোন স্পষ্ট গুনাহের কাজ দেখতে পারে, তার প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করবে। যেমন হাদীসে বলা হয়েছে: (আরবী **********) শোনা এবং আনুগত্য করা প্রত্যক মুসলিমব্যক্তির অধিকার এবং কর্তব্য-পসন্দ ও অপসন্দ সর্বপ্রকারের কাজে, যতক্ষণ পর্যন্ত কোন গুনাহের কাজে আদিষ্ট না হবে। যদি কোন পাপ বা নাফরমানীর কাজের আদেশ হবে, তখন তা শোনাও যাবে না, আনুগত্যও করা যাবে না। [বেশ কয়জন মুহাদ্দিস হাদীসটি নিজ নিজ গ্রন্থে উদ্ধৃত করেছেন ইবনে উমর থেকে, যেমন (*****) গ্রন্থে উদ্ধৃত হয়েছে।] যাঁরা নিষেধ করেছেন তাঁদের অভিমত এবং দলিল অত্যাচারী শাসকের কাছে যাকাত দিতে যাঁরা নিঃশর্তভাবে নিষেধ করেছেন, তাঁদের এই মতটি ইমাম শাফেয়ীর দুটি কথা একটি। আল-মাহদী তা (****) গ্রন্থে আহ্লি বয়েত থেকে উদ্ধৃত করেছেন। তাহলে জালিম প্রশাসকদের কাছে যাকাত দেযঅ জাযেয নয়, তাতে ফরয আদায় হবে না। তাদের দলির হচ্ছে আল্লাহ্ তা’আলার এই বাণী: (আরবী **********) আমার কোন দায়িত্ব-কর্তৃত্ব অত্যাচারী লোকেরা পেতে পারে না। ইমাম শাওকানী এ আয়াতকে দলিল বানানোর প্রতিবাদ করেছেন। তিনি বলেছেন: এই বিতর্কিত বিষয়ে এরূপ একটি সাধারণ অর্থবোধক আয়াতকে দলিলরূপে পেশ করা যথার্য বলে নিলেও দেখা যায়, আয়াতটির সাধারণ অর্থবোধকতা এই অধ্যায়ে উদ্ধৃত হাদীসসমূহ দ্বারা সীমিত ও নির্ধারিত হয়ে গেছে। [***১] যাঁরা পার্থক্যকরণের মত দিয়েছেন শাফেয়ী, মালিকী ও হাম্বলী মাযহাবের কোন কোন আলিম এই মত পোষণ করেছেন যে, মালের মালিকের পক্ষে সরকার নিযুক্ত যাকাত আদায়কারী ও প্রতিনিধির কাছে যাকাত অর্পণ করা জায়েয- তারা ফাসিক হলেও যদি তারা তা যথাস্থানে স্থাপন করে এবং আল্লাহ্র বিধান মত ব্যয় করে। আর তারা যদি তা যথাস্থানে স্থাপন না করে ও তা পাওয়ার যোগ্য লোকদের মধ্যে বন্টন না করে, তাহলে তাদের কাছে যাকাত অর্পণ করা সম্পূর্ণ হারাম। তখন তা গোপন করা ও লুকিয়ে ফেলা ওয়াজিব। [***২] এবং ‘আল-মাঅর্দী শাফেয়ী মতের আরিম হয়েও এ ধরনের শাসক-প্রশাসক সম্পর্কে বলেছেন: তারা যখন মালের মালিকদের কাছ থেকে জোর ও জবরদস্তি করে যাকাত গ্রহণ করবে, তাদের মালে আল্লাহ্র যে হক ধার্য হয়েছে তা আদায় হবে না। তখন তা নিজস্বভাবে পাওয়ার যোগ্য লোকদের মধ্যে পুনরায় বণ্টন করা তাদের কর্তব্য হবে। [(আরবী **********)] মালিকী মাযহাবের লোকদের মতে: দরদীর (আরবী **********) [ঐ. *********)] গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন: যাকাত ব্যয়ে অত্রাচারী বলে পরিচিত ও খ্যাত ব্রক্তিকে যে লোক যাকাত দেবে সে যদি কার্যতও জুলুম ও অবিচারমূরক কাজ করে, তাহলে সে যাকাত আদায় হবে না। তাকে দিতে অস্বীকার করা এবং সম্ভব হলে তা নিয়ে পালিয়ে যাওয়া কর্তব্য আর যদি কার্যত, অবিচার না করে, পাওয়ার যোগ্য লোকদেরমধ্যেই তা করে, তাহলে তা আদায় হবে। আর সে যদি যাকাত গ্রহণ ও ব্যয়ে সুবিচার ও ন্যায়পরতা করে, যদি সে অত্যাচারী হয় অন্যান্য ক্ষেত্রে ও ব্যাপারে, তাহলে দরদীর বলেছেন- তার কাছে দেয়াই করত্ব্য। দসূকী তাঁর টীকায় লিখেছেন, তা ঠিক নয়, বরং তা তখনও তা মাকরূহ হবে। [(আরবী **********)] শাযখ জরুখ তাঁর (আরবী **********) গ্রন্থে লিখেছেন: ‘সুবিচারক ও ন্যায়বাদী রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে যাকাত ইচ্ছামূলকভাবে দেয়া যাবে, তাতে কোনরূপ মতভেদ নেই। আর অীবচারক ও অন্যায়বাদী রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে যাকাত দেয়া যাবে না। তবে সে যদি দাবি করে এবং তার কাছ থেকে তা গোপন করা যদি সম্ভব না হয়, তাহলে তাকে দিতে হবে। যার পক্ষে তা না দিয়েই নিজস্বভাবে বণ্টন করা সম্ভব হবে, তার পক্ষে তাকে দেয়ায়যাকাত আদায় হবে না। ইবনুল কাসেম ও ইবনে নাফে বর্ণনা করেছেন, যে যদি তাকে সেজন্য কিরা-কসম করতে বলে, তাহলে তাকে দিয়ে দেয়া যথেষ্ট হবে। তবে তখন আবার দেয়া মুস্তাহাব। ইবনে আবদুল হাকাম মদীনার শাসনকর্তাকে যাকাত দিয়েছিলেন। ইবনে রুশদ বলেছেন: যে লোক যাকাতের ব্যাপারে ন্যায়পরায়ণ নয় এবং তা তার উপযুক্ত স্থানে সংস্থাপন করে না, তাকে যাকাত দেয়া যথেষ্ট হওয়া পর্যায়ে বিভিন্ন মত রয়েছে (****) আচবাগ, ইবনে আহব এবং ইয়াহ্ইয়ার শ্রবণ মতে কাসেমের দুটি কথার একটি হচ্ছে- তা যথেষ্ট হবে। আর শ্রবণে ইবনুল কাসেমের দ্বিতীয় কথা হচ্ছে তা যথেষ্ট হবে না। মশহুর কথা হচ্ছে, তা যথেষ্ট হবে যদি সেজন্য জোরজবরদস্তি করে। আল্লাহই জালিমের বড় হিসেব গ্রহণকারী। কিন্তু তা জায়েয হবে না যতক্ষণ তাকে যাকাত বলে নামকরণ ও চিহ্নিত করণ না করা হবে এবং তা যথানিয়মে গ্রহণ না করা হবে। [(আরবী **********)] অর্থাৎ ট্যাক্স বা ‘কর’ বা অনুরূপ কোন নামে যাকাত গ্রহণ করা হলে সব মাযহাবের মতেই তা আদায় হবে না। হানাফীদের মত আল্লাহদ্রোহী ও অত্যাচারী শাসকগণ যদি প্রকাশমান ধন-মালে যাকাত বা খারাজ নিয়ে নেয় এবং তা যথাস্থানে ব্যয় করে, তাহলে ধন-মালিকদের পক্ষে পুনরায় যাকাত দেয়ার কোন প্রয়োজন নেই। পক্ষান্তরে তারা যদি তা যথাস্থানে ব্যয় না করে আর তা স্থাপন করে তার জন্যে শরীয়াতসম্মত স্থানে, তাহলে বান্দাহ এবং আল্লাহ্ পারস্পরিক সম্পর্ক রক্ষার্থে পুনরায় যাকাত দেয়া তাদের জন্যে কর্তব্য হবে। তবে খারাজ আবার দিতে হবে না। কেননা তার ব্যয়ক্ষেত্র তারাই। তা যুদ্ধের পাওনা, তারাই তো যুধ্যমান শত্রুর বিরুদ্ধে মুকাবিলা করে থাকে। অবশ্য অপ্রকশমান ধন-মালের ক্ষেত্রে এ পর্যায়ে বিভিন্ন মত রয়েছে। কেউ কেউ ফতোয়া দিয়েছেন, তা আদায় হয়নি। কেননা যাকাত গ্রহণ করার জালিম শাসকের কোন অধিকার নেই। এই কারণে তার কাছে যাকাত অর্পণ করা জায়েয নয়। কেননা তা গ্রহণ করার যার বৈধ অধিকারই নেই তার কাছে তা দেয়া হলে আদায় হতে পারে না। ‘আল-মবসূত’ গ্রন্থে বলা হয়েছে, জালিম লোকের হাতে যাকাত অর্পণ করে যদি তাদের প্রতি সাদ্কা করার নিয়ত করে, তাহলে তা সহীহ্ হওয়াই অধিক যথার্থ কথা। কেননা তাদের ওপর যে দায়-দায়িত্ব রয়েছে, সে হিসেবে তারাই ফকীর পর্যায়ে গণ্য। [(আরবী **********) সত্য কথা হচ্ছে, ঐ লোকদের ওপর জনগণের যে সব অধিকার রয়েছে ও ধন-মাল ধার্য হয়েছে, সে হিসেবে তারাই ঋণগ্রস্ত ও ঋণী বলে গণ্য হবে। আর ‘আল-গারেমুন’ খাত পর্যায়ে আমরা বলে এসেছি যে, তার এ ঋণটা বেহুদা ব্যয় বা পাপ কাজে ব্যয়ের দরুন হবে না, তবেই সে ঋণগ্রস্ত বলে যাকাত পাওয়ার অধিকারী হবে। কিন্তু এখানে সে শর্ত পাওয়া যায়নি।] হাম্বলীদের মত হাম্বলী ফিকাহ্বিদদের মতে- ইবনে কুদামাহ্ তাঁর (****) গ্রন্থে লিখেছেন: ‘খাওয়ারিজ ও বিদ্রোহীরা যদি যাকাত নিয়ে নেয়, তাহলে দাতার যাকাত আদায় হবে। অনুরূপভাবে শাসকমণ্ডলীর কেউ যদি ধন-মালের মালিকের কাছ থেকে যাকাত নিয়ে নেয়, তবে তাতেও ফরয আদায় হয়ে যাবে, গ্রহণকারী তা নিয়ে ন্যায়পরতা রক্ষা করল কি অবিচার করল এবং তা জোরপূর্বক নিল কিংবা ইচ্ছা করেই তা তাকে দিল, তাতে কোন পার্থক্য হবে না। ইব্রাহীম নখ্য়ী বলেছৈন: ওশর বা কর আদায়কারীরা তোমাদের কাছ থেকে যা আদায় করে নেয়,তাতে তোমরা দায়িত্বমুক্ত হবে। সাল্মমাতা ইবনে আক্ওয়া থেকে বর্ণিত, তিনি তাঁর যাকাত নজ্দা খারেজীকে দিয়েছিলেন।’ ইবনে উমর (রা) থেকে বর্ণিত, তাঁকে ইবনুয যুবাইর ও নজ্দার নিয়োজিত যাকাত আদায়কারীদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। জবাবে তিনি বলেছিলেন: এদের যা কাছেই তোমাদের যাকাত দিয়ে দাও না কেন, তোমার দায়িত্ব পালন হয়ে গেল। কিয়াসের পক্ষপাতী ফিকাহ্বিদ্দের মতও অনুরূপ, যে সব স্থানে তাদের শাসন চলে সব স্থানে তা-ই কার্যকর। তাঁরা বলেছেন, যখন খাওয়ারিজদের কাছে যাবে, তখন তাদেরকে শুল্ক দিলে যাকাত আদায় হবে না। যেসব খাওয়ারিজ যাকাত আদায় করে, তাদের সম্পর্কে আবূ উবাইদ বলেছৈন, তারা যাদের নিকট থেকে যাকাত নিল তাদেরকে তা পুনরায় দিতে হবে। কেননা ওরা তো মুসলমানদের জননেতা ও দায়িত্বশীল শাসক নয়। ফলে তারা ডাকাত সমতুল্য। ইবনে কুদামাহ বলেছেন, আমাদের জন্যে সাহাবীদের কথাই দলিল, তাঁদের সময়ে তাঁদের মধ্যে কোন পার্থক্য ছিল বলে বলে আমরা জানি না। অতএব ইজমা হয়েছিল, ধরে নিতে পরি। কেননা তা কর্তৃত্বসম্পন্ন লোকের কাছেই দেয়া বিদ্রোহীদের নিকট দেয়ার মতই। [(আরবী **********)] (আরবী **********) গ্রন্থেও অনুরূপভাবে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রনায়কের কাছে যাকাত দেয়া জায়েয হওয়ার ব্যাপারে মাযহাবের মধ্যে কোন মতপার্থক্য নেই। সে সুবিচারক হোক, কি অত্যাচারী। আর ধন-মাল প্রকাশমান হোক, কি প্রচ্ছন্ন। এ পর্যায়ে সাহাবিগণ থেকে যা কিছু বর্ণিত হয়েছে, তা-ই তাদের দলিল। আহমাদ বলেছেন, তাঁরা শাসকদের কাছে যাকাত দিত। রাসূলের সাহাবীগণই তাদেরকে তা দিয়ে দিতে বলতেন এবং তারা তা কোথায় ব্যয় করে তাও তাঁরা জানতেন। এরূপ অবস্থায় আমার কি বলবার থাকতে পারে? [(আরবী **********)] তুলনা ও অগ্রাধিকার দান এ সব বিষয়ে আমি যা মনে করি, তা হচ্ছে, জালিম শাসকরা যা নেয়, তা যদি যাকাতরে নামে নেয়, তাহলে তাদের হস্তে যাকাত অর্পণ করা অন্যায় হবে না এবং কোন অবস্থাতেই মুসলমানকে পুনর্বার যাকাত দিতে বাধ্য করা যাবে না। হ্যাঁ, তারা যদি যাকাতের নামে না নেন, তাহলে তা দিয়ে যাকাত আদায় করা হল, মনে করা যাবে না। মালিকী মাযহাবের আলিমগণ এবং অন্যরা তাই বলেছৈন। ‘যাকাত ও কর’ এ পর্যায়ে আমরা আরও আলোচনা পেশ করবো। জালিমের হাতে যাকাত দেয়া হবে কিনা, এই প্রশ্নে আমি তা দেয়াই ভালো মনে করি- যদি তারা তা পাওয়ার যোগ্য লোকদের মধ্যে বন্টন করে এবং শরীয়াতে তার জন্যে নির্দিষ্ট খাতসমূহে তা ব্যয় করে, অন্যান্য কোন কোন ক্ষেত্রে তারা জুলুম করলেও। যদি তা যথাস্থানে স্থাপন না করে, তাহলে তাদের হাতে যাকাত দেয়া যাবে না। কিন্তু যদি দাবি করে, তাহলে তো না দিয়ে উপায় থাকবে না। তখন আমল করতে হবে সে সব হাদীস অনুযায়ী যা আমরা পূর্বে উল্লেখ করে এসেছি। শাসক ও রাজন্যবর্গ জুলুম করলেও তাদের হাতে যাকাত সঁপে দেয়া সংক্রান্ত সাহাবাগণের বারবার দেয়া ফতোয়া অনুযায়ীও আমল হবে। শাসকের মুসলিম হওয়া শর্ত যে কথাই কোনই সন্দেহ নেই তা হচ্ছে সাহাবিগণ যেসব শাসক-প্রশাসকের হাতে যাকাত সঁপে দেয়ার ফতোয়া দিয়েছেন, তাঁরা মুসলমান- ইসরামের প্রতি ঈমানদার ও ইসলাম অনুসারী লোক ছিলেন। তাঁরা ইসলামীশাসন প্রতিষ্ঠার জন্যে জিহাদ করেছেন এবং তাতেই তাঁরা সন্তুস্ট ছিলেন না। ইসরামেরই নামে তাঁরা বহু যুদ্ধে জয়লাভ করেছেন, ইসলামেরই ঝাণ্ডা তাঁরা বুলন্দ করেছেন, যদিও পরবর্তীকালে কোন কোন হুকুম আহকামের বরখেলাফ কাজ করেছেন দুনিয়ার প্রতি গুরুত্বারোপ ও লালসার দাসত্ব করতে গিয়ে। এই শ্রেণীর লোকদের নিকট যাকাত দেয়া যেতে পারে, আদায় করা যেতে পারে এবং সর্বপ্রকারের অর্থীনৈতিক অধিকার। সহীহ হাদীসসমূহ তা স্পষ্ট করে বলে দিয়েছে এবং জমহুর ফিকাহ্বিদগণ এ সব হাদীসকেই দলিল হিসেবে গ্রহণ করেছেন। আমাদের এ কালের শাসক-প্রশাসকদের মধ্যে এই ধরনের লোক খুব বেশি নেই। অধিকাংশই তো ইসলামের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে।তাকে পিছনের দিকে ফেলে রেখেছে, কুরআন মজীদকে তারা ত্যাগ করেছে। শুধু তা-ই নয়, তাদের অনেকে ইসলাম, মুসলমান ও ইসলামের দাওয়াত বিস্তারকারীদের ওপর খড়গহস্ত হয়ে পড়েছে। এ লোকদের তো সাহায্য সহযোগিতা করা যেতে পারে না, যাকাতরে মাল এদের হাতে সঁপে দিয়ে। কেননা তা দিয়ে তারা তাদের কুফরী ও নাস্তিকতা প্রচার করবে এবং দুনিয়ার চরম বিপর্যয় সৃষ্টি করবে। তাই শাসক-প্রশাসকের মুসলিম ও ইসলাম পালনকারীহওয়া একটি অনিবার্য শর্ত তাদের হাতে যাকাত দেয়া জায়েয হওয়ার জন্যে। জমহুর ফিকাহ্বিদগণ সম্পূর্ণ একমত হয়ে বলেছেন, কোন কাজে সফরকারী ইবনুস সাবীল হলেও তাকে যাকাতরে মাল দেয়া যেতে পারে না, যতক্ষণ সে তওবা না করবে। পাপ কাজের দরুন ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি সম্পর্কেও এই কথা। কেননা আল্লাহ্র মাল দিয়ে আল্লাহ্র নাফরমানীর কাজে সাহায্য ও সহযোগিতা করা যেতে পারে না। যে শাসক আল্লাহ্র মাল দিয়ে আল্লাহ্র পথেই বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়- সে পথ রুদ্ধ করে দেয়, আল্লাহ্র শরীয়াতকে অচল করে রাখে এবং আল্লাহ্র বিধানের দিকে আহ্বানকারী প্রত্যেক ব্যক্তিকে মর্মান্তিকভাবে উৎপীড়ন দিয়ে জর্জরিত করে, তাদের হাতে যাকাত সঁপে দেয়ার কোন প্রশ্নই ওঠতে পারে না। সমাজ সংস্কারক আল্লামা সাইয়্যেদ রশীদ রিজা (র) তাঁর তাফসীর ‘আল-মানার’ এ পর্যায়ে যা লিখেছেন, তা আমাকে চরমভাবে সন্তুষ্ট ও উদ্বুদ্ধ করেছে। তিনি লিখেছেন: ‘দারুল ইসলামে মুসলমানদের নেতা- যার হাতে যাকাত দিয়ে দেয়া যায়, সেই আসলে যাকাত সংগ্রহ ও তা পাওয়ার যোগ্য লোকদের মধ্যে বণ্টন করার অধিকারী। তার কাছে যাকাত দিতে অস্বীকারকারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা তার একান্ত কর্তব্য- ওয়াজিব। কিন্তু এ যুগে বহু মুসলিম দেশেই ইসলামী হুকুম কায়েম নেই, যা ইসলামী দাওয়াতের দায়িত্ব পালন, ইসলামের ওপর আক্রমণ প্রতিরোধ এবং ফরযে আইন বা ফরযে কিফায়া পর্যায়ে জিহাদ করবে, আল্লাহ্র হদ্দসমূহ কায়েম করবে, ফরয যাকাত গ্রহণ করবে- যেমন তা ফরয করা হয়েছে এবং আল্লাহ্র নির্দিষ্ট ব্যয় খাতসমূহে তা ব্যয় করবে। বরং অধিকাংশ মুসলিম দেশই ফ্রান্সী শাসনের অধীন হয়ে পড়েছে। বহু দেশের শাসকগণ মুর্তাদ হয়ে গেছে, নাস্তিকতায় বিশ্বাস হয়ে গেছে। [আজকের মুসলিম দেশসমূহের অধিকাংশই এ ধরনের অবস্থার মধ্যে পড়ে গেছে। ফ্রান্সী শাসন থেকে মুক্ত হওয়ার পর ধর্ম ও আদর্শহীন শাসকদের অধীন হয়ে পড়েছে।] ফ্রান্সী রাষ্ট্রসমূহের অধীন ভৌগলিক নামের মুসলমানদের বহু নেতাকেই ফ্রান্সীরা ইসলামের নামে গোলাম বানাবার কাজে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। তাদের দ্বারাই ইসলামের খতম করানো হচ্ছে। মুসলমানদের জন্যে কল্যাণময় কাজ ও যাকাত সাদকাত ওয়াক্ফ প্রভৃতি ধর্মীয় গুণ পরিচিতসম্পন্ন ধন-মালের ওপরও তারা হস্তক্ষেপ করতে শুরু করেছে এই মুসলিম নামধারী নেতৃবৃন্দের মাধ্যমে। তাই এ ধরনের সরকারের হাতে যাকাতের একবিনদুও সোপর্দ করা কোনক্রমেই জায়েয হতে পারে না। তাদের উপাধি ও সরকারী পদ যা-ই হোক না কেন। অন্যান্য যে সব ইসলামী হুকুমাতের নেতা, কর্তা ও প্রধানরা দ্বীন ইসলাম পালন করে চলে এবং সেখানকার ‘বায়তুলমালের ওপর বিদেশীদের কোন কর্তৃত্ব আধিপত্য নেই, সেসবের কাজে প্রকাশমান ধন-মালের যাকাত সঁপে দেয়া অবশ্য কর্তব্য। প্রচ্ছন্ন ধন-মাল-স্বর্ণ-রৌপ্য, নগদ সম্পদ ইত্যাদির যাকাতও তাদেরই দিতে হবে- যদি তারা তা দেবার জন্যে দাবি করে, যদিও তারা কোন কোন ক্ষেত্রে ও আইন বিধান জুলুমকারী হয়ে থাকে তবুও। যেমন ফিকাহ্বিদগণ বলেছৈন, তাদের হাতে যে লোক নিজের যাকাত সঁপে দেবে, তারা তা যথাস্থানে কুরআনী আয়াত দ্বারা নির্দিষ্ট খাতসমূহের ইনসাফ সহকারে ব্যয় না করলেও তা দিতে বাধ্য হবে। বিশেষজ্ঞগণ এ বিষয়ে চূড়ান্ত কথা বলেছৈন, যেমন (****) প্রভৃতি কিতাবেবলা হয়েছে- রাষ্ট্রপ্রধান বা প্রশাসক যদি জুলুমকারী হন, যাকাত তার শরীয়াতী বিধান অনুযায়ী নির্দিষ্ট খাতসমূহে ব্যয় না করে তাহলে উত্তম নীতি হচ্ছে,নিজ হস্তে পাওয়ার যোগ্য লোকদের মধ্যে ফরয যাকাত বন্টন করে দেযঅ- যদি রাষ্ট্রপ্রধান কিংবা তাঁর কর্মচারীরা তা দেবার দাবি পেশ না করেন, তবে। [(আরবী **********)] দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ যাকাতের নিয়তের স্থান যাকাত এক হিসেবে ইবাদত, আল্লাহ্র নৈকট্য লাভের বড় মাধ্যম। কেননা তা ইসলামের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য, প্রতীক এবং ঈমানের তৃতীয় ভিত্তি। কুরআন মজীদ এবং রাসূলের সুন্নতের অসংখ্য স্থানে তা নামাযের সাথে মিলিত ও যুক্তভাবে উল্লিখিত। কিনতউ তা সত্ত্বেও তা একটি বিশেষ ধরনের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ও স্বতন্ত্র ইবাদত। অপরদিক দিয়ে তা একটা নির্দিষ্ট কর, ধনীদের ধন-মালে ফকীর ও আল্লাহ্র কিতাবে উল্লিখিত সমস্ত পাওয়ার যোগ্য লোকদের জন্যে সুনির্দিষ্ট হক। তা এমন একটা কর, যা সংগ্রহ করা ও ব্যয় করার মৌলিক দায়িত্ব ও কর্তব্য রাষ্ট্রের। যাদের ওপর তা ধার্য হয়, তারা স্বতস্ফূর্তভাবে তা না দিলে শক্তি প্রয়োগ করে তা আদায় করবে রাষ্ট্রশক্তি। এই অধিকার তাকে দেয়া হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও তা একটা বিশেষ ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ কর। অর্থাৎ যাকাত এদিক দিয়ে ইবাদতের তাৎপর্যবহ কর এবং এমনএকটা কর যা ইবাদতের রূপ ও প্রকৃতির ধারক। যাকাত এই দুই ভাবধারা সম্বলিত বলে তার প্রতি ফিকাহ্বিদদের দৃষ্টিবঙ্গিতে বেশ পার্থক্য পারিলক্ষিত হচ্ছে। তাঁদের কেউ কেউ যাকাতের প্রথম উল্লিখিত বিশেষত্বের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছেন এবং অপর কেউ কেউ এই দ্বিতীয় উক্ত বিশেষত্বকে অধিক মাত্রায় গুরুত্ব দিয়েছেন। কোন কোন আহকামের ক্ষেত্রে কতক ফিকাহ্বিদ দু’টি তাৎপর্যের একটিকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন এবং অপর আহকামে হয়ত দ্বিতীয় তাৎপর্যটির ওপর লক্ষ্য আরোপ করেছেন তুলনামূলকভাবে বেশি। এরূপ মতভেদের চেহারা দেখা যায় বালক, পাগল ও এ পর্যায়ের অন্যদের ধন-মালের যাকাত ফরয হওয়ার পর্যায়ে। যেমন ‘নিয়ত’ –ও যাকাতে তার স্থান বিষয়ে তা স্পষ্ট হয়ে দেখা দিয়েছে। যাকাতের নিয়তের শর্তকরণ যাকাত দেবার জন্যে নিয়তের কোন শর্ত আছে কি নেই? সাধারণ ফিকাহ্বিদদের মত হচ্ছে, যাকাত আদায়ের নিয়তের শর্ত রয়েছে। কেননা তা একটি ইবাদত বিশেষ এবং কোন ইবাদতই নিয়ত ছাড়া আদায় হয় না। আল্লাহ তা’আলা বলেছেন: (আরবী **********) লোকদের শুধু এই নির্দেশই দেয়া হয়েছে যে, তারা আল্লাহ্র ইবাদত করবে, আনুগত্যকে একান্তভাবে তাঁরই জন্যে একনিষ্ট করে সবদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে এবং নামায কায়েম করবে ও যাকাত দেবে। রাসূলে করীম (স) বলেছেন: ‘কাজসমূহ নিয়ত ভিত্তিক’। যদি নিয়ত না করে- ভুল ভ্রান্তির কারণে হলেও- কোন ইবাদত হবে না। কেননা ভুল-ভ্রান্তির কারণে নিয়ত না করা পমাণ করে যে, লোকটি মাল দিয়েছে বটে; কিন্তু ইবাদত পালনের ও আল্লাহ্র নৈকট্য লাভের কোন নিয়ত করেনি।ত খন তা মৃতের কাজ হয়ে দাঁড়ায় কিংবা তা যেন একটা প্রাণহীন প্রতিকৃতিমাত্র। নিয়ত ওয়অজিব। হয় তাকে নিজেকেই তা করতে হবে, নতুবা করেতে হবে ধন-মালের প্রতিনিধিত্বকারী ব্যক্তিকে। যেমন বালক, পাগল বা নির্বোধ ব্রীক্ত- যার মাল ব্যয়ের ক্ষমতা নেই তার প্রতিনিধিত্বকারী ব্যক্তি নিয়ত করবে, তার বা সে যার প্রতিনিধিত্ব করছে তার ধন-মালে যা ফরয ধার্য হয়েছেতা-ই সে আদায় করছে। [***১] বালকের বা পাগলের প্রতিনিধি (অভিভাবক) যদি সে দুজনের মালের যাকাত দেয় কোনরূপ নিয়ত ছাড়াই তাহলে তা যথাস্থানে পৌঁছবে না। তাকে তার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। [***২] ইমাম আওজায়ীর মত এবং তার পর্যালোচনা যাকাতের জন্যে নিয়তের শর্ত করার পর্যায়ে জমহুর ফিকাহ্বিদদের মতের বিরোধিতা করেছেন ইমাম আওজায়ী। বলেছৈন: তার জন্যে কোন নিয়তের প্রয়োজন নেই। কেননা তা ঋণ সমতুল্য। অন্যান্য ঋণ আদায়করণে যেমন নিয়তের প্রয়োজন হয় না, এই ঋণটি আদায়করণেও অনুরফভাবে কোন নিয়তের আবশ্যকতা নেই। নিয়ত ছাড়াই ইয়াতীম বালকের মালের যাকাত তার অভিভাবক দিবে এবং দিতে অস্বীকারকারীর কাছ থেকে শাসক তা জোরপূর্বক নিয়ে নেবে। [(আরবী **********)] এ কথার প্রতিবাদ করেছেন ফিকাহ্বিদগণ এবং রাসূল (স)-এর উপরিউক্ত প্রখ্যাত হাদীসটি তার দলিলরূপে পেশ করেছেন: ‘আমলসমূহ নিয়ত অনুযায়ী মূল্য পায়।’ যাকাত আদায় করা একটা ‘আমল’। তা একটা ইবাদতও যা বারবার ফরযরূপে ধার্য হয়। তা যেমন ফরয হয়, তেমনি নফলও হয়। অতএব তা নামাযের মতই নিয়তের মুখাপেক্ষী। ঋণ প্রত্যর্পণ থেকে তা ভিন্ন প্রকৃতির। কেননা ঋণ প্রত্যর্পণ কোন ইবাদত নয়। তা পাওনাদার প্রত্যাহার করলেই প্রত্যাহৃত হয়ে যায়। কিন্তু যাকাত সেরূপ নয় তা যার ওপর ফরযরূপে ধার্য হয়, তার ওপর থেকে তা কেউ পত্যাহার করতে পারে না। কেননা ফকীর-দরিদ্র্যের জন্যে যে মাল ব্যয় করা হয়, তা কয়েক ধরনের হতে পারে। তা যাকাত হতে পারে, মানবত হতে পারে, কাফফারা ও নফল দানও হতে পারে। তাই ঠিক কোন ধরনের মাল তাদের দেয়া হচ্ছে তার নিয়ত করে তাতে পার্থক্য সৃষ্টি করতে হবে। বালকের অভিভাবক ও প্রশাসক এই দুইজনও নিয়ত করবে প্রয়োজন দেখা দিলে। কোন কোন মালিকী মতের আলিমও আওজায়ীর অনুরূপ মত পোষণ করেন। তা হচ্ছে, যাকাত নিয়তের মুখাপেক্ষী নয়। এ মতটি মালিকী মাযহাবের একটি বিরল মত। তাই গ্রহণ করে বলা হয়েছে, ফকীহগণ যাকাতরে মালের অংশীদার। এক অংশীদার অপর অংশীদারের হাত থেকে তার অংশটা নিয়ে নেবে, এতে নিয়তের কোন প্রয়োজন পড়ে না। গ্রহণকারীরও কোন নিয়তের প্রয়োজন হবে না, দাতারও নয়। উক্ত মাযহাবের লোকদের একটা কথা হচ্ছে: ‘যাকাত আদায় করতে অসম্মত ব্যক্তির কাছ থেকে তা জোরপূর্বক নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে দেয়া এবং তার ওপর জোর প্রয়োগ করে নিয়ে নেয়ার মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য রয়েছে। তবে মালিকী মতের নির্ভরযোগ্য কথা হচ্ছে: ‘যাকাত আদায় হওয়ার নিয়তের শর্ত রয়েছে।’ দিতে অসম্মত ব্যক্তির কাছ থেকে জোরপূর্বক যাকাত গ্রহণ পর্যায়ে ইবনুল আরাবীর মত- যা পরে বলা হবে যাকাত আদায় হবে বটে, কিন্তু তার থেকে সওয়াব লাভ হবে না। [(আরবী **********)] যাকাত পাওয়ার যোগ্য ব্যক্তি যদি ধনীর ধন-মাল থেকে যাকাত পরিমাণ মাল চুরি করে নিয়ে যায়, তাতে কিন্তু যাকাত আদায় হবে না। কেননা এখানে যাকাত দেয়ার নিয়তের কোন অস্তিত্ব নেই। [(আরবী **********)] যাকাতের নিয়ত অর্থ কি ‘নিয়ত’ বলতে বোঝায়- দাতা তার মনে এই বিশ্বাস স্থাপন করবে যে, এটা তার নিজেরধন-মালের যাকাত, অথচা যার পক্ষ থেকে সেদিচ্ছে তার ধন-মালের যাকাত, এই অভিভাবত্ব হয় বালক বা পাগলের ক্ষেত্রে। নিয়তের স্ফূরণক্ষেত্র হচ্ছে হৃদয়- সর্বপ্রকারের বিশ্বাস, ধারণা ও অনুভূতির উৎসই হচ্ছে এই হৃদয়। [দেখুন: (আরবী **********) শাফেয়ী মতের বক্তব্য হল, মুখের উচ্চারণ অন্তরে স্থলাভিষিক্ত হবে। যেমন (আরবী **********) তে বলা হয়েছে। (****) গ্রন্থে তা দাউদের মত বলা হয়েছে, তার কোন যৌক্তিকতা নেই. (আরবী **********)] হুকুম সংক্রান্ত নিয়তই যথেষ্ট, যেমন কোন কোন মালিকী ফিকাহ্বিদ স্পষ্ট করে বলেছেন। যখন একজন তার টাকা-পয়সা গণনা করল এবং তার ওপর যা ফরয রূপে ধার্য, সে তা বের করে দিল এবং এটা লক্ষ্য করল না যে, সে যা বের করল তার যাকাত। কিনতউ তাকে প্রশ্ন করা হলে সে নিশ্চয় বলবে। তা হলেই তার যাকাত হয়ে যাবে। [(আরবী **********)] একটা দৃষ্টান্ত দেয়া যাক। যদি কারোর এ অভ্যাস থাকে যে, সে জায়দ নামের এক ব্যক্তিকে প্রতি বছর কিছু টাকা দিয়ে থাকে। যখন সে তাকে দিল, দেয়ার পর সে নিয়ত করল যে, সে যাকাত দিয়েছে এবং জায়দ যাকাত পাওয়ার যোগ্য, তাহলে তার যাকাত আদায় হবে না কেননা এখানে প্রকৃত বা হুকুম পর্যায়ের কোন নিয়ত পাওয়া যায়নি। [(আরবী **********)] বস্তুত এ নিয়তই হচ্ছে ইবাদত ও আল্লাহ্র নৈকট্য প্রভৃতি পর্যায়ের কাজসমূহের মধ্যে পার্থক্যকারী। আর জমহুর ফিকাহ্বিদগণ যাকাতে এই নিয়তের শর্ত আরোপ করেছেন। আল্লাহ্র কাছে তা নিয়ত ছাড়া গৃহীত হবে না। এ থেকেই যাকাতের ইবাদতের দিকটি আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। প্রশাসকের যাকাত গ্রহণ অবস্থায় নিয়ত প্রশাসক যখন যাকাত গ্রহণ করবে- সম্পদের তা স্বতঃস্ফূর্তভাবে দেবে কিংবা দিতে অসম্মত হওয়ার কাণে তার কাছ থেকে জোরপূর্বক নেবে- এ উভয় অবস্থায় নিয়তের ব্যাপারটি কিরূপ হবে? প্রশাসকের নিয়তই সম্পদের মালিকের নিয়তের স্থলাভিষিক্ত হবে, কি হবে না? সর্বাবস্থায়ই কি যাকাত আদায় হয়ে যাবে, না কোন কোন অবস্থায় আদায় হবে? আর যখন আদায় হবে, তখন কি শুধু বাহ্যিকভাবে আদায় হল, না বাহ্যিক ও প্রকৃত উভয়রূপেই তা আদায় হয়ে যাবে? অধিকাংশ ফিকাহ্বিদদের মত হচ্ছে, ইচ্ছামূলক ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে দেয়া কালে প্রশাসকের নিয়ত সম্পদের মালিকের নিয়তের স্থলাভিষিক্ত হবে না- মতার নিয়তই যথেষ্ট হবে না। ইমাম শাফেয়ীর মতে সে নিয়ত যথেস্ট হওয়ার পক্ষে। এমনকি প্রশাসক যদি কোন নিয়ত নাও করে, তবুও। (***) গ্রন্থে লিখিত ভাষ্যের এটাই বাহ্যিক কথা। আর অপর মতটি হচ্ছে- না, সে নিয়ত যথেষ্ট হবে না। কেননা প্রশাসক হচ্ছে গরীব-মিসকীনের প্রতিনিধি। সম্পদের মালিক যদি মিসকীনকে যাকাত দেয় কোনরূপ নিয়ত ছাড়াই, তা হলে তা গৃহীত হবে না। তাদের প্রতিনিধির অবস্থাও অনুরূপ। [নববী (****) গ্রন্থে লিখেছেন: এ দ্বিতীয় মতটি কাযী আবূ তাইয়্যেবের নিকট গ্রহণীয়, সহীহতম এবং তাহজীব ও ‘আল-মুহাজ্জাব’ গ্রন্থ প্রণেতাদ্বয় ও শেষকালের জমহুর ফিকাহ্বিদের কাছে। তাঁরা শাফেয়ীর কথা: দিতে অসম্মত ব্যক্তির জন্যে প্রযোজ্য মনে করেছেন। যা গ্রহণ করা হয়েছে, তা কবুল হবে নিয়ত না হলেও। কিন্তু (****) গ্রন্থে লিখেছেন: তা কবুল হবে ইচ্ছা করে দিক বা অনিচ্ছাসহ। (আরবী **********)] নববী বলেছেন: ‘যাকাত দিতে অস্বীকারকারীরকাছ থেকে জোরপূর্বক গ্রহণকালেযদি সে তার নিয়ত করে, তাহলে বাহ্যিক ও প্রকৃত উভয়দিক দিয়েই তার দায়িত্ব পালিত হল। রাষ্ট্রপ্রধানের নিয়ত করার কোন প্রয়েঅজন পড়বে না। নতুবা রাষ্ট্রপ্রধান নিয়ত করলেও বাহ্যত যথেষ্ট হবে। দ্বিতীযবার তার কাছে দাবি করা যাবে না। আসলেও- প্রকৃতপক্ষেও কি তা আদায় হয়ে গেল? এর দুটি জবাব আছে। সহীহ্তম জবাব হল হ্যাঁ, যথেস্ট হবে। যেমন বালকের অভিভাবক নিয়ত করলে হয়ে যাবে- তার নিয়ত তার নিয়তের স্থলাভিষিক্ত হবে। আর রাষ্ট্রপ্রধান নিয়ত না করলে প্রকৃতপক্ষে ফরয আদায় হবে না কস্মিনকালেও। সহীহতম কথাই বাহ্যত তা হবে না। মাযহাব হচ্ছে, রাষ্ট্রপ্রধানের ওপর নিয়ত করা ফরয, তার এই নিয়ত সম্পদের মালিকের নিয়তের স্থলাভিষিক্ত হবে। অপর একটি মতে বলা হয়েছে, ফরয নয়, যেন সম্পদের মালিক একটি ইবাদতের কাজকে এত সহজ মনে করে না বসে। [(আরবী **********)] ইবনে কুদামাহ্ তাঁর আল-মুগ্নী গ্রন্থে লিখেছেন: ‘রাষ্ট্রপ্রধান যদি জোরপূর্বক যাকাত নিয়ে নেন, তাহলে নিয়ত না হলেও চলবে। কেননা মালিকের পক্ষে নিয়ত করা দুষ্কর হওয়া তা আর তার ওপর ওয়াজিব থাকল না- এটা ইমাম শাফেয়ীর মত। কেননা রাষ্ট্রপ্রধানের গ্রহণটা দুই অংশীদারের মধ্যে সম্পদ বন্টন করার পর্যায়ে গণ্য। তাই নিয়তের অপেক্ষায় থাকা হবে না। আরও এজন্যে যে, রাষ্ট্রপ্রধানের অধিকার রয়েছে তা গ্রহণ করার। এজন্যে তিনি দিতে অসম্মত ব্যক্তির কাছ থেকে নিয়ে নিতে পারেন। যদি তাতে যাকাত আদায় না হয়ে যেত, তাহলে তিনি নিতেন না, হাম্বলী মতের আবূ খাত্তাব ইবনে আকীল এ মত গ্রহণ করেছেন যে, ব্যপারটি বান্দাহ ও আল্লাহ্ তা’আলার পারস্পরিক- তাতে মালের মালিকের নিয়ত ছাড়া যাকাত আদায় হতে পারে না। কেননা রাষ্ট্রপ্রধান হয় সেই মালিকের প্রতিনিধি নতুবা প্রতিনিধি গরীব লোকদের অথবা এক সাথে দুই জনেরই। যারই প্রতিনিধি হোক, তার নিয়ত কখনই মালের মালিকের নিয়তের স্থলাভিষিক্ত হতে পারে না। আও এ কারণে যে, যাকাত হচ্ছে একটা ইবাদত। আর ইবাদত মাত্রেই নিয়ত অপরিহার্য। তাই যার ওপর সে ইবাদত ফরয, তার নিজের নিয়ত ভিন্ন তা আদায় হতে পারবে না- যদি সে নিয়ত করার যোগ্য ব্যক্তি হয়ে থাকে। যেমন নামায। যাকাত আদায় হবে না, তা সত্ত্বেও তার কাছ থেকে তা নেয়া হবে শরীয়াতের বাহ্যিক দিকটা রক্ষার উদ্দেশ্যে। যেমন নামায পড়তে জোরপূর্বক হলেও বাধ্য করা হবে- অন্তত বাহ্যিক রূপটা বজায় থাক এ উদ্দেশ্যে। এখন নামাযী যদি নিয়ত ছাড়াই নামায পড়ে, তাহলে আল্লাহ্র কাছে তা গ্রাহ্য হবে না। ইবনে আকীল বলেছেন, ফিকাহ্বিদদের কথা যথেস্ট হবে বা আদায় হয়ে যাবে।’ অর্থাৎ বাহ্যত, তার অর্থ: তা দ্বিতীয়বার দিতে বলা হবে না- বলা যাবে না। যেমন আমরা ইসলামের এই নিয়মের কথা বলেছি যে, মুর্তাদ হয়ে যাওয়া ব্যক্তিকে ঈমানের শাহাদত দিতে বলা হবে। যদি সে ঈমানের সাক্ষ্য দেয়, তাহলে বাহ্যত তার মুসলিম হওয়ার কথা স্বীকার করে নেয়া হবে। কিন্তু সে যা উচ্চারণ করছে, তার সত্যতার প্রতি যদি সে বিশ্বাসী না হয়। তাহলে আসলে ও প্রকৃতপক্ষে তার ইসলাম গ্রহণীয় হবে না অর্থাৎ আল্লাহর কাছে তাও গ্রহ্য হবে না। [(আরবী**********)] মালিকী মতের কার্য ইবনুল আরাবীও এ কথা বলেছেনঃ ‘যাকাত জোর পূর্বক নেয়া হলে আদায় হবে বটে; কিন্তু তাতে কোন সওয়াব হবে না। [(আরবী*******) গ্রন্থে বলা হয়েছেঃ দিতে অসম্মত ব্যক্তির কাছ থেকে যাকাত নিতে হলে রাষ্ট্রপ্রধানের নিয়তই যথেষ্ট হবে- এটা সহীহ মত।] দলিরসমূহের ভিত্তিতে এ মতটি বের করা যাকাতের প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ যথার্থতা ও সঠিকতার অতি নিকটবর্তী। তাই রাষ্ট্রকর্তার যাকাত গ্রহণ মালের মালিকের নিয়ত ছাড়াই নিছক আইনের দিক দিয়ে ফরয আদায়ের জন্যে যথেষ্ট হবে- এ অর্থে যে, তাকে পুনরায় তা দিতে বলা হবে না। কিন্তু তাতে আল্লাহর নিকট সওয়াব পাওয়ার দিক দিয়ে একান্তই জরুরী হচ্ছে মালের মালিক নিয়ত করতে সমর্থ হলে তাকে অবশ্যই স্পষ্টরূপে নিয়ত করতে হবে। কেননা নিয়ত ছাড়া যে ‘আমল’ তা প্রাণহীন দেহাবয়ব মাত্র। (‘নিয়তই হচ্ছে আমলের রূপকার’ কথাটির যথার্থতা স্বীকার্য।) হানাফী মতে ফতোয়া দেয়া হয়েছে এ কথার ওপর যে, যার ওপর যাকাতর ফরয, সরকারী আদায়কারী যদি তার কাছ তা জোরপূর্বক নিয়ে নেয়, তাহলে তার ফরয আদায় হল- প্রকাশমান মালে ধার্য ফরয তার ওপর অনাদায় থেকে যাবে না। কেননা তার তো তা নেয়ার কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা বা অধিকার রয়েছ। কিন্তু অপ্রকাশমান মালের ক্ষেত্রে এই ফরয অবশিষ্ট থাকে যাবে। (আরবী********) যাকাতে নিয়তের সময় যাকাতের জন্যে যখন নিয়ত শর্ত, কখন প্রশ্ন হচ্ছে এ নিয়ত কখন করতে হবে? হানাফীদের বলিষ্ঠ কথা হচ্ছে, নিয়তটা দেয়ার সাথে সময়ের দিক দিয়ে নিকটবর্তী ও ঘনিষ্ঠতম হতে হবে। আর ‘আদায়’ বা ‘দেয়ার ’ অর্থ হচ্ছে, ফকীরকে যা রাষ্ট্রপ্রধানের কছে দিয়ে দেয়া- হস্তান্তর করা। রাষ্ট্রপ্রধান ‘ফকীরদের প্রতিনিধি। সময়ের ঘনিষ্ঠতার শর্ত করা হয়েছে এজন্যে যে, নিয়তটাই তো আসল। অপরাপর ইবাদতের অনুষ্ঠানেও এই কথা। যাকাত আদায়ের জন্যে মোটামুটি নিকটবর্তীতা বা ঘনিষ্ঠতা হওয়াই যথেষ্ট। যেমন , নিয়ত ছাড়াই দিয়ে দিল, পরে নিয়ত করল, পরে প্রতিনিধি দিল নিয়ত ছাড়াই অথবা কোন যিম্মীর হাতে দিল ফকীরদের দেবার জন্যে, তাহলে তা জায়েয হবে। কেননা মূলত আদেশদাতার নিয়তটাই গণ্য। যাকাত আদায়ের জন্যে মোটামুটি নিকটবর্তীতা বা ঘনিষ্ঠতা হওয়াই যথেষ্ট। যেমন, নিয়ম ছাড়াই দিয়ে দিল, পরে নিয়ত করল যখন যাকাতের মালটা ফকীরের হাতে রয়েছে অথবা প্রতিনিধিকে দেয়ার সময় নিয়ত করল, পরে প্রতিনিধি দিল নিয়ত ছাড়াই। অথবা কোন যিম্মীর হাতে দিল ফকীরদের দেবার জন্যে, তাহলে তা জায়েয হবে। কেননা মূলত আদেশদাতার নিয়তটাই গণ্য। যেমন সমস্ত মাল থেকে যাকাতের ফরয পরিমাণ আলাদা করার সাথে নিয়তের ঘনিষ্ঠতা বা নিকটবর্তীতা হলেও যথেষ্ট হবে, যদিও তা আসলের বিপরীত। কেননা পাওয়ার যোগ্য লোকদের দিয়ে দেয়া বিচ্ছিন্নভাবে হয়। এজন্যে প্রত্যেকবার দেয়ার সময় নিয়তকে উপস্থিত রাখা দুরূহ ব্যাপার। তাই মূল আলাদা করা কালীন নিয়তই যথেষ্ট হবে- অসুবাধাটা দূর করার জন্যেই এ ব্যবস্থা। কিন্তু কেবল আলাদা করার দ্বারাই দায়িত্ব মুক্ত হয়ে যাবে না। দায়িত্বমুক্ত হবে ফকীরদের হাতে পৌঁছানোর পর। কেউ যদি তার সমস্ত ধন-মাল দান করে দেয়, তাহলে তার ওপর যাকাত ফরয থকাবে না। যদি সে কার্যত নিয়ত যাকাতরেই করল অথবা আসলে কোন নিয়তই করল না। কেননা ফরযটা ধার্য এক অংশের ওপর। অথচ সে সমস্তটাই আল্লাহর ওয়াস্তে দান করে দিয়েছে। নিয়তটা শর্ত ছিল প্রতিবন্ধক দূর করার উদ্দেশ্যে। সে যখন সবটাই দিয়ে ফেলল, তখন প্রতিবন্ধক বলতে কিছুই থাকল না। [আরবী*********] মালিকী ফিকাহ মতে যাকাতের মাল আলাদা করা কালে এবং পাওয়ার যোগ্য লোকদেরকে দিয়ে দেয়ার সময়ই নিয়ত করা কর্তব্য। তা কোন সময় হলেও তা যথেষ্ট হবে। কিন্তু আলাদাকরণ বা দিয়ে দেয়া কোন সময়ই যদি নিয়ত করা না হয়- নিয়ত করল পরে কিংবা এ উভয় সময়েরই পূর্বে, তাহলে তা গ্রহণীয় হবে না। [আরবী*********] শাফেয়ী ফিকাহর দুটি বক্তব্য যাকাত বিতরণের পূর্বে নিয়ত করা পর্যায়ে। সহীহতম কথা হচ্ছে, যেমন নববী বলেছেন- আদায় হবে, যথেষ্ট হবে। কেননা দুটি কাজকে এক সঙ্গে করা ওয়াজিব করা হলে খুবই কষ্টকর হত। আরও এজন্যে যে, আসলে উদ্দেশ্য তো ফকীরের দারিদ্র্য দুর করা। এ কারনে মালের মালিক তার প্রতিনিধির কাছে হস্তান্তর করা কালে নিয়ত করলেই যথেষ্ট হবে। আর দ্বিতীয় বক্তব্য, মিসকীনদের মধ্যে যাকাত বন্টনকালে প্রতিনিধির নিয়ত করা জরুরী শর্ত। তাঁরা বলেছেনঃ কেউ যদি প্রতিনিধি নিযুক্ত করে এবং নিয়ত করার দায়িত্বও তারই ওপর অর্পণ করে, তাহলে তাও জায়েয হবে। [আরবী ********] হাম্বলী মাযহাবের লোকদের মত- ‘আল-মুগনী’ গ্রন্থে লিখিত হয়েছেঃ যাকাত আদায় কারা সামান্য পূর্বে নিয়ত করা হলে তাও চলবে, যেমন সমস্ত প্রকারের ইবাদতে হয়ে থাকে। আর যেহেতু এ ইবাদতটিাকে প্রতিনিধিত্ব বলে, তাই যাকাত বের করার সাথে নিয়তের ঘনিষ্ঠতা ও নিকটবর্তিতা তার মাল নিয়ে প্রলুব্ধকরণ পর্যন্ত পৌঁছে দেবে। সময়ের নিকটবর্তীতা ঘটানোর ক্ষেত্রে এ সহজতা মেনে নেয়া সত্ত্বেও অপর দিকটিতে খুব বেশি কঠোরতা আরোপ করেছেন। তাই ‘আল-মুগনী’ গ্রন্থে বলা হয়েছেঃ যাকাত কেউ তার প্রতিনিধির কাছে দিয়ে দিলে এবং প্রতিনিধি ছাড়াই সে নিজে নিয়ত করলে জায়েয হবে, যদি তার নিয়ত দেয়ার বহু পূর্বে না হয়ে থাকে। খুব দীর্ঘ সময় পূ্েব হরে জায়েয হবে না। তাবে প্রতিনিধির কাছে দেয়ার সময় নিয়ত করলে ভিন্ন কথা। কখন প্রতিনিধি পাওয়ার যোগ্য লোকদের কাছে দেয়ার সময় নিয়ত করবে। কেউ যদি তার সমস্ত মাল ইচ্ছা করে দান করে দেয় এবং এর দ্বারা যাকাত আদায় করার নিয়ত না করে তাহলে যাকাত আদায় হবে না। কেননা সে তো ফরয আদায় করার নিয়ত করেনি। যেমন কেউ যদি একশ’ রাকায়াত নাময পড়ে, কিন্তু তাতে ফরয আদায়ের নিয়ত না করে, তাহলে ফরয নাময আদায় হবে না। শাফিয়ীও এ কথা বলেছেন। [আরবী **********] এ সমস্ত অবস্থায় আমি পসন্দ করি, সহজতা বিধান এবং আদায় হয়ে যাওয়ার কথা, কবুল হওয়ার কথা। আর মুসলমানের যাকাত বের করার সাধারণ নিয়ত থাকাটাই যথেষ্ট। যাকাতের মূল্য প্রদান মূল্য প্রদানে ফিকাহবিদদের বিভিন্ন মত কারোর ছাগপালের মধ্যে একটি ছাগী যদি যাকাত বাবদ দেয়, সাবস্ত্য হয় কিংবা কারোর উটের পাল থেকে একটি উষ্টী অথবা এ ‘আরদব’ গম, ফলের এক কান্তার যাকাত বাবদ দেয়া হয়, তাহলে একথা কি চূড়ান্ত যে, তাকে মূল এ জিনিসগুলোই দিয়ে দিতে হবে। কিংবা মূল এ জিনিসগুলো দেয়া ও তার নগদ মূল্যটা দেয়ার মধ্যে তাকে কোন স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে? ... এবং মূল্য দিয়ে দিলেও তা যথেষ্ট হবে ও তার যাকাত যথার্থভাবে আদায় হয়ে যাবে? ফিকাহবিদগণ এ ব্যাপারে বিভিন্ন কথা বলেছিন। কেউ কেউ তা নিষেধ করেছেন, কেউ কেউ বলেছেন, কোনরূপ দ্বিধা-কুণ্ঠা ছাড়াই তা জায়েয হবে। আবার কারোর কারোর মতে তা জায়েয হলেও মাকরুহ। অন্যান্য কিছু লোকের মত হচ্ছে, তা কোন কোন অবস্থায় জায়েয আবার কোন কোন অবস্থাতে জায়েয হবে না। মূল্য দেয়া নিষিদ্ধাকরণে সবচাইতে বেশি কঠোরতা অবলম্বনকারী হচ্ছেন শাফেয়ী ও জহিরী মতের ফিকাহবিদগণ। হানাফীরা বিপরীত মতের ধারক। তাঁরা বলেছেন যে, সর্বাবস্থাতেই যাকাত জিনিসের মূল্য দেয়া জায়েয। মালিকী ও হাম্বালী মতের বহু কয়টি বর্ণনা ও কথা রয়েছে। (আরবী **********) গন্থে বলা হয়েছে, যাকাত জিনিসের মূল্য প্রদান যথেষ্ট হবে না। ইবনুল জায়েব ও ইবনে বশীরও এ কথাই গ্রহণ করেছেন। (আরবী*******) গ্রন্থে এর ওপর আপত্তি পেশ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, (আরবী********) গ্রন্থে এর বিপরীত কথা বলা হয়েছে। তার প্রসিদ্ধ কথা হচ্ছে, মূল্য দেয়া যেতে পারে বটে- দেয়া হারাম নয়, তবে মাকরূহ। [(আবরী***********) গ্রন্থে বলা হয়েছে, যে জিনিস যাকাত বাবদ দেয়, সে বাবদ কোন অস্থায়ী বা খাদ্য ধরনের জিনিস দেয়া যাবে না। কারোর নিজের দেয় যাকাত জিনিস খরিদ করা মাকরূহ। তাকে যাকাত ক্রয়ের মধ্যে গণ্য করা হয়েছে এবং তা মাকরূহ। ইবনে আবদুস সালামও একথা বলেছেন। ‘বাজী’ বলেছেনঃ (আরবী *******) ও অন্যান্য গন্থের বাহ্যিকভাবে বক্তব্য হচ্ছে, এ কাজটি যাকাত ক্রয় পর্যায়ের। আর এ সম্পর্কে প্রসিদ্ধ কথা হচ্ছে, তা মাকরূহ- হরাম নয়। মালিকী মাযহাবের কেউ কেউ বলেছেন, ফিকাহবিদদের প্রকাশ্য কথা হচ্ছে, ‘তাওজীহ’ ও ইবনে আবদুস সালাম যা বলেছেন, তাই অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য। ইবনে রুশদও এ কথাই গ্রহণ করেছেন। তিনি বলেছেন, সকল মতের মধ্যে ‘জায়েয’ হওয়ার মতটাই অধিক ভাল। ইবনে ইউনুসও এ কথাকে যথার্থ বলেছেন। যাকাতের মূল্য দেয়া পর্যয়ে অনেক বিস্তারিত ও পার্থাক্যমূলক কথা রয়েছে। কোন কোন মালিকী মতের ফিকাহবিদ তা এককভাবে বলেছেন। দরদীরও তার উল্লেখ করেছেন। তা হচ্ছে, কৃষি ফসল বা পশুর যাকাত জিনিসের মূল্য দেয়া জায়েয মাকরুহসহ, কিন্তু এ দুটোর পরিবর্তে কোন অস্থায়ী জিনিস দেয়া কিংবা আসলের স্থালে অন্য কৃষি ফসল বা পশু দিয়ে দেয়া জায়েয হবে না। দেখুনঃ (আরবী************) ইবনে নাজী রচিত [আরবী ************] (আরবী **************) গন্থে আশহুব ও ইবনুল কাশেমের এ মত উদ্ধৃত হয়েছে যে, মূল্য প্রদান মোটামুটি জায়েয। কেউ কেউ বিপরীত কথাও বলেছেন। (আরবী *********) গন্থে বলা হয়েছে, যাকাত আদায়কারী যাকাতের মূল্য গ্রহণে কাউকে বাধ্য করলে তার যাকাত আদায় হয়ে গেছে আশা করা যায়, বড় বড় ফিকাহবিদগ বলেছেনঃ তা এজন্যে যে, সে প্রশাসক এবং প্রশাসকের হুকুম সকল বিরোধ দূর করে। [ দেখুন আরবী **********] হাম্বলদের মত বলে ‘আল-মুগনী’ গন্থে বলা হয়েছেঃ ইমাম আহমদের বাহ্যিক মত হচ্ছে, কোন যাকাতের জিনিসেরই মূল্য দেয়া গ্রহণযোগ্য হবে না। ফিতারায় যাকাতও নয়। মালের যাকাতও নয়। কেননা তা সুন্নাতের পরিপন্থী। ইমাম আহমাদ থেকে বর্ণিত একটি কথা হচ্ছে, ফিতরার যাকাত ছাড়া অন্য সর্বক্ষেত্রে মূল্য প্রদান জায়েয। আবূ দাউদ বলেছেন, ইমাম আহমাদকে প্রশ্ন করা হয়েছেল, এক ব্যক্তি তার বাগানের ফল বিক্রয় করে দিয়েছে, সে কি করে যাকাত কেবে? বললেন, যার কাছে বিক্রয় করা হয়েছে, তার ওপর ধার্য করা হবে। বলা হল তাহলে কি খেজুর দেবে, না তার মূল্য? বললেন, সে ইচ্ছা কররে ফলও দিতে পারে, ইচ্ছা করলে তার মূল্যও দিতে পারে। মূল্য দেয়া জায়েয হওয়ার এটা একটি দলিল। [আরবী***********] ফিতরার যাকাত পর্যায়ে খুব কঠোরতা দেখিয়েছেন। বলেছেন, তার মূল্য দেয়া জায়েয হবে না। যারা উমর ইবনে আবদুল আজীজের কাজকে দলিল হিসেবে উল্লেখ করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে তিনি প্রতিবাদ জানিয়েছেন। [আরবী***********] এ বিষয়ে আমরা চতুর্থ অধ্যায় আলোচনা করব। মতবৈষম্যের কারণ এ মতবৈষম্যের প্রথম কারণ যাকাতের মৌলিক তাৎপর্য বিভিন্ন দৃষ্টিকোণের অবস্থিতি। তা একটা ইবাদত ও আল্লাহ্র নৈকট্য লাভের মাধ্য; কিংবা ধনীদের ধন-মালে ফকীরদের জন্যে আরোপিত ও নির্ধারিত অধিকার- এই প্রশ্নে দৃষ্টিকোণের পার্থক্য রয়েছে। আমাদের মতে তা একটা অর্থ সংক্রন্ত কর- নিসাব পরিমাণ ধন-মালের মালিকের ওপর ফরয করা হয়েছে। সত্যি কথা হচ্ছে- একাধিকবার আমরা যেমন বলেছি- দুটি তাৎপর্য ধারণ। কিন্তু শাফেয়ী ও আহমাদ এবং মালিকী মাযহাবের ও জাহিরী ফিকাহবিদদের কারো কারো করো মতে যাকাতের ইবাদত ও আল্লাহর নৈকট্য লাভের তাৎপর্যটি প্রাধান্য পেয়েছে। তাই তাঁর যাকাতের মূল জিনিসটিই- যার ওপর দালিল আরোপিত হয়েছে- দেয়ার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তাঁর মূল্য প্রদান করাকে আদৌ জায়েয মনে করেননি। আর আবু হানীফা, তাঁর মতের অন্যান্য এবং অপর দিকের ইমামগণের মতে যাকাত হচ্ছে একটি সম্পদগত অধিকার, যদ্দারা গরীব লোকদের দারিদ্র্যমুক্ত করতে চাওয়া হয়েছে। ফলে তাঁদের মতে জিনিসের মূল্য দেয়া যেতে পারে। মূল্যদানে নিষেধকারীদের দালিল যাকাত জিনিসের মূল্য দেয়া জায়েয নয় বলে যাঁরা মত দিয়েছেন, তাদের বিভিন্ন দলিল রয়েছে। তা যেমন চিন্তা বিবেচনামূলক তেমনি পূর্বর্তীদের উক্তি। নিন্মে আমরা তার বিভিন্নতা ও বিন্যাসকে তুলে ধরছিঃ ১. শাফেয়ী মতের হারামাইনের ইমাম আল- জুরাইনী বলেছেনঃ আমাদের মতের লোকদের নির্ভরযোগ্য দলিল হচ্ছে, যাকাত আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য লাভের মাধ্যম। আর যে কাজ এ পর্যায়ের হবে, তাতে সরাসরি আল্লাহর নির্দেশ পালন করাই বিধয়। কেউ যদি তার প্রতিনিধিকে বলেঃ একটি কাপড় ক্রয় কর, এবং সে প্রতিনিধি যদি জানে যে, তার উদ্দেশ্য হচ্ছে ব্যবসা এবং সে তার মালিকরে পক্ষে অধিক মুনাফাদায়ক কোন পণ্য পায় এবং সে মনে করে যে, মালিক সেটাকে অধিক মানাকাদায়ক দেখলে তার বিরোধিতা করবে না, এটা যদি হতে পারে তাহলে আল্লাহ যা দেবার আদেশ করলেন সেটা দিয়ে তা পালন করাই তো অধিক উত্তম হওয়া বাঞ্ছনীয়। অনুরূপভাবে নামাযে যেমন গাল ও চিবুকের ওপর সিজদা করা জায়েয হয় না, কেননা সিজদার স্থান হচ্ছে কপাল ও নাক। আর তার কারণ বিনয় আনুগত্য আত্মসমর্পণের ভাবধারা এভাবেই প্রাকশিত হওয়া সম্ভব। তাই গাল ও চিবুকের ওপর সিজদা করা হলে তা মূল দলিলের বিপরীত হবে এবং আল্লাহর দাসত্ব স্বীকারমূলক ভাবধারও বিনষ্ট হবে। অনুরূপভাবে যাকাতে ছাগীর বা উটের মূল্য প্রদান জায়েয হবে না। দানা বা ফলের মূল্য দিলে যাকাত আদায় হবে না, তাতে যে পরিমাণ দেয়, সেই পরিমাণ ফসল ও ফলই দিতে হবে। তা না করা হলে মূল দলিলের পরিপন্থী কাজ হবে। আল্লাহ্ দাসত্বমূলক ভাবধারারও বিপরীত হবে। যাকাত তো নামাযেরই বোন। [আরবী************] এ কথার ব্যাখ্যা এই যে, মহান আল্লাহ তা‘আলা তাঁর কিতাবে যাকাত দেয়ার আদেশ করেছেন সংক্ষিপ্তভাবে, শুধু এই কথা বলেঃ (আরবী***********) ‘এবং তোমরা যাকাত দাও’ অতঃপর রাসূলের সুন্নত কুরআনের এ সংক্ষিপ্ত কথাটুকুর বিস্তারিত ব্যাখ্যঅ দিয়েছে। ধন-মালের কত পরিমাণ থাকলে কি পরিমাণ যাকাত বাবদ দিতে হবে, তাও বলে দিয়েছে। যেমন রাসূলে করীম (স) বলেছেনঃ ‘প্রত্যেক চল্লিশটি ছাগীতে একটি করে ছাগী’ দিতে হবে, ‘প্রতি পাঁচটি উটে একটি করে ছাগী দিতে হবে’ প্রভৃতি। তার অর্থ যেন আল্লাহই বলেছেনঃ ‘তোমার যাকাত দাও প্রতি চল্লিশটি ছাগীতে একটি ছাগী।’ ফলে এ দলিলের বলে যাকাত গরীবের অধিকারের জিনিস হয়ে দাঁড়াল। অতএব এ মূল ছাগী থেকে দারিদ্রদের বঞ্চিত করার উদ্দেশ্যে এর কারণ বিশ্লেষণে আত্মনিয়োগ করা উচিত বা জায়েয হতে পারে না। ২. অপর একটি ব্যাপারে এ জিনিসেকে অধিকতম তাগিদপূর্ণ করে দিয়েছে। কাযী আবূ বকর ইবনুল আরাবী মালিকী সেই ব্যাপারটির উল্লেখ করেছেন। আর তা হচ্ছে, যাকাত বাধ্যকরণ- এ বাধ্যবাধকতায় লোকদের বন্দীকরণ শুধু মাল হ্রাসকরণের লক্ষ্যেই নয়- যেমন ইমাম আবূ হানীফা মনে করেছেন। কেননা মক মানের জিনিস নির্ধারণে শরীয়াত পালনের অধিকার পূরণের পথে একটি বিরাট প্রতিবন্ধকতা। তা কম পরিমাণের ওপর শরীয়াতের বাধ্যবাধকতা এড়িয়ে যাওয়ার উপায়। কেননা সম্পদের মালিক চায়, তার মালিকানা যথাযথ বর্তমান ও অক্ষুণল্ণ থাক আর অপর জিনিস থেকে বোঝা চলে যাক। তার মন যখন ধন-মালের দিকে ঝুঁকে পড়বে ও তার সাথে জড়িয়ে পড়বে, তখন মন ও মালের সেই অংশের মধ্যবর্তী যে সম্পর্ক তা ছিন্ন করে দেয়াই শরীয়াত পালনের লক্ষ্য। এ কারণে মালের সেই নির্দিষ্ট অংশটিই যাকাত বাবদ দিয়ে দেয়া অবশ্য কর্তব্য। [আরবী************] ৩. তৃতীয় তাৎপর্য- আর তা হচ্ছে, ফকীর ও মিসকীনের প্রয়োজন পূরণের লক্ষ্যে যাকাত ফরয করা হয়েছে। সে সাথে মালের নিয়ামত দেয়ার জন্যে আল্লাহ্র শোকর আদায়স্বরূপ। আর প্রয়োজন তো বিচিত্র ধরনের হয়ে থাকে। অতএব ধার্য ফরযও বিচিত্র ধরনের হবে, এটাই বাঞ্ছনীয়। তবেই না ফকীর মিসকীনরা সর্বপ্রকারের মাল পেয়ে তাদের প্রয়োজন পূরণ করতে পারে এবং আল্লাহর দেয়া নিয়ামতে জাতীয় জিনিস দিয়ে ফকীর- মিসকীনের প্রতি সহানুভূতি দেখাতে পারলেই নিয়ামতের শোকর আদায় হতে পারে। [দেখুন (আরবী***************)] ৪. অতঃপর কথা হচ্ছে, আবূ দাউদ ও ইবনে মাজা [এই হাদীস (আরবী***********) গ্রন্থে উদ্ধৃত হয়েছে। শাওকানী লিখেছেনঃ হাকেম বুখারী ও মুসলিম আরোপিত শর্তানুযায়ী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন। তার সনদে ‘আতা মুয়ায থেকে’ উদ্ধৃত হয়েছে, অথচ আতা মুয়াযের কাছ থেকে শুনতে পাননি। কেননা আতার জন্ম হয়েছে তাঁর মুত্যুর এক বছর পর। (আরবী**************)] বর্ণনা করেছেন, নবী কারীম (স) যখন হযরত মুয়ায (রা) কে ইয়েমেন পাঠিয়েছিলেন তখন তাঁকে বলেছিলেনঃ দানা থেকে দানা গ্রহণ কর, ছাগল (আরবী ***********) থেকে ছাগী (আরবী************) গ্রহণ কর, উট থেকে উট গ্রহণ কর এবং গরু থেকে গরু গ্রহণ কর। এটা অকাট্য স্পষ্ট দলিল। অতএব যা বলা হয়েছে তাই করার ওপর স্থিতি গ্রহণ করা কর্তব্য। কাজেই তার মূল্য গ্রহণ করে এ নির্দেশ পালণ থেকে সরে যাওয়া জায়েয হবে না। কেননা মূল্য গ্রহণ করা হলে দানার স্থান এমন জিনিস গ্রহণ করা হবে যা দানা নয়। অনুরূপভাবে ছাগলের পরিবর্তে ছাগী না দিয়ে অন্য কোন জিনিস নেয়া হবে- যাকাত বাবদ। আর তাহলে হাদীসের নির্দেশের বিপরীত কাজ কার হবে। মূল্য প্রদান জায়েয মতের দলিল যাঁরা মূল জিনিসের পরিবর্তে তার মূল্যটা যাকাত বাবদ দেয়া জায়েয বলেছেন, তারা হলেন, হানাফী মতের ও তার সমর্থক ফিকাহবিদ। তাঁরা তাঁদের মতের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করেছেন এবং এ পর্যায়ে যুক্তি ও বর্ণিত দলিলের ওপর তাঁর নির্ভরতা গ্রহণ করেছেন, সেসব উপস্থপিত করেছেন। আমরা এখানে তার উল্লেখ করছিঃ ১. আল্লাহ তা‘আলা বলেছেনঃ ‘তাদের ধন-মাল থেকে যাকাত গ্রহণ কর।’ এ দলিল অকাট্যভাবে বলছে যে, গ্রহণীয় জিনিসটি অবশ্যই ‘মাল’ হবে। আর মূল্যটাও ‘মাল’। অতএব মূল্য দিলে দলিল অনুরূপ কাজ হবে। তা ছাড়া নবী করীম (স) কুরআনের ‘মুজমাল’ অবিস্তারিত কথার বিশ্লেষণ দিয়েছেন এই বলে- যেমন, ‘প্রতি চল্লিশটি ছাগল একটি করে ছাগী নিতে হবে।’ এটা বলে গবাদি পশুর মালিকদের প্রতি সহজতা বিধান করা হয়েছে। কেবল সেই ‘ছাগী’ দেয়ার বাধ্যতা আরোপ করার উদ্দেশ্য একথা বলা হয়নি। কেননা গবাদি পশুর মালিকদের হাতেও নগদ টাকা থাকে। কাজেই তাদের কাছে রক্ষিত সেই নগদ টাকা দ্বারা যাকাত আদায় করা তাদের পক্ষে সহজতর পন্থ। [আরবী***********] ২. বায়হকী তাঁর সনদসূত্রে এবং বুখারী তায়ূস থেকে টীকাস্বরূপ বর্ণনা করেছেনঃ মুয়ায ইয়েমেন গিয়ে লোকদের বলেছিলেনঃ ‘তোমরা আমাকে পাঁচগজি কাপড় বা অন্য কোন পোশাক দাও। আমি তা তোমাদের কাছ থেকে যাকাতের স্থানে বা যাকাত বাবদ গ্রহণ করব। কেননা তাই তোমাদের পক্ষে সহজ এবং মদীনায় বাসবাসকারী মুহাজিরদের জন্যেও তা খুবই কল্যাণবহ।’ অপর বর্ণনায় ভাষাটি এইঃ ‘আমাকে তোমরা কাপড়ের একটি বান্ডিল দাও। আমি তা তোমাদের কাছ থেকে চাল ও যবের স্থালে নিয়ে নেব।’ [আরবী**********] এটা এজন্যে যে, ইয়েমেনবাসীর কাপড় বুনন ও বস্ত্র শিল্পে খুবই খ্যাতিমান ছিল। কাজেই এ কাপড় দেয়া ছিল তাদের পক্ষে অতি সহজ। অপরদিকে মদীনাবাসীদেরও খুব বেশি প্রয়োজন ছিল এ কাপড়ের। আর ইয়েমেনবাসীদের দেয়া যাকাত সেখানকার লোকদের প্রয়োজনের চাইতে বেশি হত। ফলে মুয়ায তা মদীনায় পঠিয়ে দিতেন- যা ছিল ফিলাফতের কেন্দ্র, রাজধানী। মুয়াযের উক্ত কথা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল। তাই ইয়েমেনের ফিকাহবিদ ও তাবেয়ী যুগের ইয়েমেনী ইমাম তায়ূস তা বর্ণনাও করেছেন। তা প্রমাণ করে যে, অপর যে হাদীসে রাসূলে করীম (স) ‘দানা থেকে ও উটের যাকাত বাবদ ছাগী নাও’ বলে যে আদেশ করেছেন, তা থেকে ঠিক সেই জিনিসটিই বাধ্যতামূলকভাবে নিতে হবে, এমন কথা বুঝতে পারেন নি। কিন্তু যেহেতু ধন-মালের নির্ভরশীল। যে জিনিসের যাকাত বাবদ সেই জিনিসটা গ্রহণ করায় ধন-মালের মালিকদের প্রতি সহজতা বিধান করা হয়। কেননা প্রত্যেক মালের মালিকের পক্ষে সেই জাতীয় মাল দেয়া, যা তার নিকট রয়েছে, সহজ হয়। যেমন কোন বর্ণনায় সাহাবিগণের উক্তি হিসেবে এসেছে যে, নবী করীম (স) দিয়েতের ক্ষেত্রে কাপড়ওয়ালাদের জন্যে কাপড় দেয়ার পথ করে দিয়েছিলেন। [আরবী**********] ৩. আহমাদ ও বায়হাকী বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন, ‘নবী করীম (স) যাকাত বাবদ পাওয়া উটের পালের মধ্যে একটা খুব বয়ষ্ক উষ্টী দেখতে পেয়ে খুবই ক্রুদ্ধ হলেন এবং বললেনঃ এই উষ্ট্রটি যে নিয়ে এসেছে আল্লাহ তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবেন। লোকটি বললেঃ হে রাসূল! আমি যাকাতের মধ্যে থেকে দুটি উটের পরিবর্তে এই একটি উট নিয়েছি।’ তখন নবী করীম (স) বললেনঃ তাহলে ঠিক আঁছে। এ হাদীসটি সনদের দিক দিয়েও দলিলরূপে গৃহীত হওয়ার যোগ্য। [আরবী ***********] আর এ হাদীসটি উপরিউক্ত কথাই প্রমাণ করে। কেননা দুটি উটের পরিবর্তে একটি উট গ্রহণ করা মূল্যই গ্রহণেরই শামিল। ৪. যাকাতের লক্ষ্য হচ্ছে, ফকীরকে স্বচ্ছল বানানো, অভাবগ্রস্তের অভাব মোচন এবং আল্লাহ্র কালেমা বুলন্দারী উম্মত ও মিল্লাতের সামিষ্টিক কল্যাণ সাধন। আর তা মূল্য গ্রহণ দ্বারাও সাধিত হতে পারে, যেমন তা হতে পারে ছাগী নিলে। তাবে অনেক সময় মূল জিনিসটির পরিবর্তে মূল্য দিলে এ লক্ষ্য অধিক ভালো ও সহজভাবে পূর্ণ হতে পারে। কেননা প্রয়োজন তো বিচিত্র ধরনের। আর মূল্য গেলে তদ্দারা যে কোন প্রয়োজন পূরণ সম্ভব। ৫. তাছাড়া মূল্য জিনিসের পরিবর্তে সেই জাতীয় অন্য জিনিস অবলম্বন ইজমার ভিত্তিতে জায়েয। যেমন কেউ তার ছাগলের যাকাত যদি তার নিজের ছাগল ছাড়া অন্য ছাগল থেকে দেয়, কেউ তার জমির ওশর তার নিজের কৃষির ফসল ছাড়া অন্য ফসল ও দানা দিয়ে দেয়, তাহলে তা আদায় হবে। তাহলে দেখা গেল এক জাতীয় জিনিস থেকে অন্য জাতীয় জিনিস চলে যাওয়া- একটির পরিবর্তে অন্যটি দেয়া জায়েয, এই কথায় কযী ইবনুল আরাচীর অভিমতের প্রতিবাদ রয়েছে। কেননা তিনি মনে করেন যে, যে মাল থেকে যাকাত ফরয করা হয়েছে। সেই জিনিসের অংশ নির্ধারণে শরীয়াতের বিধানদাতার লক্ষ্য হচ্ছে সম্পদের মালিকের অন্তর ও সেই জিনিসের নির্দিষ্ট অংশের সাথে যে একাত্মাতার সম্পর্ক রয়েছে তা ছিন্ন করা। তার কারণ এই যে, শরীয়াতদাতার যদি তাই লক্ষ্য হত, তাহলে মালের এ নির্দিষ্ট অংশের পরিবর্তে অন্য মাল থেকে সেই পরিমাণ দিলে যাকাত আদায় হয়ে যেত না। ৬. সায়ীদ ইবনে মনসুর তাঁর ‘সুনানে আতা’ থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেন, উমর ইবনুল খাত্তাব যাকাত বাবদ দিরহামের পরিবর্তে জিনিস গ্রহণ করতেন। [আরবী**********] তুলনা ও অগ্রাধিকার দান আমি মনে করি, উভয় পক্ষের দলিল- প্রমাণসমূহ পর্যালোচনা ও তুলন করার পর আমাদের সম্মুখে এ বিষয়ে হানাফী মাযহাবের দৃষ্টিকোণটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এ মাযহাব পূর্বোদ্ধৃত খবর ও সাহাবী- তাবেয়ীনের উক্তির ওপর ভিত্তি করেছে। বাস্তব চিন্তা ও বিবেচনাও এই মাযহাবের যৌক্তিকতা অকাট্য করে তোলে। প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে, যাকাতের ব্যাপারে ইবাদতের দিকটির প্রাধান্য স্বীকার করা ও মূল দলিলের আক্ষরিক অনুসরণের শর্তে নামাযের ওপর ‘কিয়াস’ কার যাকাতের সেই প্রকৃতির সাথে সংগতিসম্পন্ন নয় যাতে হানাফীদের বিরোধীরা নিজেরা অপর দিকটিকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। আসলে তা একটা অর্থনৈতিক অধিকার বা দায়িত্ব এবং বিশিষ্ট ধরনের ইবাদত- এ দুটোই তাতে সন্নিবেশিত। বালক ও পাগলের মারে তাঁর এ কারণেই যাকাত ফরয ধরেছেন। অথচ তাদের ওপর নামায ফরয ধার্য হয়নি। এ পর্যায়ে তাঁর যা বলেছেন, এখানে তাঁদের উচিত ছিল সে কথার উল্লেখ করা। তদ্দারা তাঁরা হানাফীদের প্রতিবাদ করেছেন অথচ হানাফীরা শরীয়াত পালনে অযোগ্য লোকদের ওপর নামাযের ওপর কিয়াস করে- যাকাতকে ফরয করেননি। বস্তুত হানাফী মাযহাবের মতটি আমাদের যুগে অধিক উপযোগী। জনগণের পক্ষেও অধিক সহজাসাধ্য। হিসেব রক্ষা করাও কষ্টমুক্ত। বিশেষ করে যদি সেখানে এমন প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা থাকে যা যাকাত সংগ্রহ, একত্রিতকরণ ও বণ্টনের দায়িত্ব পালন করে। মূল জিনিস গ্রহণ করা হলে তা তার স্থান থেকে নিয়ে বহু দুরে অবস্থিত প্রতিষ্ঠানের কাছে পৌঁছানো, তার পাহাপরাদারী করা ও তাকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা ইত্যাদি কাজে অনেক বেশি ব্যয় হওয়ার আশংকা রয়েছে। আর যাকাত বাবদ গবাদি পশু এলে তার খাবার পনি, বাসগৃহ ও ময়লা নিষ্কাশন ব্যবস্থা এবং সর্বক্ষণ তার কাছে লোকের উপস্থিতির ব্যবস্থা করায় খুব বেশি অর্থ ব্যয় ও কষ্ট স্বীকার অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু তা ‘কর’ ব্যয় হ্রাসকরণ নীতিরও পরিপন্থী। উমর ইবনে আবদুল আজীজ ও হাসান বসরী থেকেও এ মতিটিই বর্ণিত হয়েছে, সুফিয়ার ও সওরীও এ মতই প্রকাশ করেছেন। ফিতরায় যাকাত ছাড়া অন্য সব ক্ষেত্রে ইমাম আহামাদেরও একথা বলে বর্ণিত হয়েছে। [আরবী**********] ইমাম নববী বলেছেন, এ ক্ষেত্রে ইমাম বুখারী হানাফী মতের সাথে আনুকূল্য করেছেন। হানাফীদের মতই এর নিজের মত অথচ তিনি বহু ক্ষেত্রেই তাঁদের বিরোধিতা করেছেন। কিন্তু উপরিউক্ত দলিল প্রমাণই তাঁকে হানাফীদের অনুরূপ মত গ্রহণে বাধ্য করেছে। [আরবী************] তা এভাবে হয়েছে যে, ইমাম বুখারী তাঁর হাদীস গ্রন্থে ‘যাকাতের দ্রব্যাদি গ্রহণ’ (আর তা মূল্য হিসেবে) শীর্ষক একটি অধ্যায় দাঁড় করেছেন। তাতে তিনি দলিল হিসেবে উপস্থিত করেছেন হযরত মুয়াযের সেই কথা বা তায়ূস তাঁর কাছ থেকে বর্ণনা করেছেন। তাতে বলা হয়েছে, তিনি যাকাত বাবদ দানা শস্য ও যবের বদলে লোকদের কাছ থেকে কাপড় নেয়ার কথা বলেছিলেন। কেননা তা দেয়া তাদের পক্ষে সহজতর ছিল এবং মদীনায় বসবাসকারী লোকদের জন্যেও অধিক কল্যাণবহ ছিল। [বুখারী তায়ুস বর্ণিত উক্ত সংবাদটি ‘মুয়াল্লাকে’ স্বরূপ দৃঢ়তা সহাকরে উদ্ধৃত করেছেন। তা যে তাঁর কাছে সহীহ, এটাই তার প্রামণ। তায়ূস ইয়েমেনের ইমাম ও তাবেয়ী যুগের ফিকাহবিদ ছিলেন। মুয়াযের ইয়েমেন অবস্থানকালীন যাবতীয় খবর সম্পর্কে অধিক অবহিত ছিলেন। ইমাম বুখারী এ সংবাদটি দলিল হিসেবে তাঁর গ্রন্থে উদ্ধৃত করায় বোঝা যায় যে, তিনি ওটাকে শক্তিশালী মত মনে করেন। আরবী************)] ইমাম বুখারী অবশ্য অন্যান্য হাদীসকেও দলিল হিসেবে তুলে ধরেছেন। গবাদি পশুর যাকাত পর্যায়ে হযরত আবূ বকর (রা) লিখিত চিঠিখানিও তন্মধ্যে একটি। তাতে লিখিত ছিলঃ ‘যারা যাকাত হবে এক বছর বয়সের উষ্ট্রী ছানা, তা তার কাছে না থাকলে তার কাছ থেকে দুই বছর বয়সের উষ্ট্রী ছানা গ্রহণ করা হবে। তবে যাকার আদায়কারী তাকে বিশ দিরহাম কিংবা দুটি ছাগী ফেরত দেবে।’ তাহলে এক বয়সের পশুর স্থলে অন্য বয়সের পশু গ্রহণ করা যায়- পার্থক্যের মূল্যটা দিরহাম বা ছাগী বাবদ ফেরত দিলেই হল। তা থেকে প্রমাণিত হয় যে, ঠিক যে জিনিসটি যাকাত বাবদ চিহ্নিত হবে ঠিক সেই আসল জিনিসটিই ফকীরকে দিয়ে দিতে হবে- এমন কথা নয়। তবে সম্পদের মালিকের পক্ষে যা সহজে দেয়, তা-ই গ্রহণ করা যেতে পারে। কিন্ত ইবনে হাজম তায়ূস বর্ণিত উক্ত হাদীসকে দলিল হিসেবে উপস্থাপিত করার প্রতিবাদ করেছেন। তাঁর ধারণা, ওটাকে দলিল হিসেবে দাঁড় করানো যায় না। তার কয়েকটি কারণও তিনি উল্লেখ করেছেন। প্রথমত, উক্ত হাদীসটি ‘মুরসাল, (সাহাবীর নাম না বলে তাবেয়ীর বর্ণনা করা।) কেননা তায়ূস মুয়াযকে দেখতে পাননি; তাঁর ইন্তেকালের পর তাঁর জন্ম হয়েছে। দ্বিতীয়ত, তা যদি সহীহ হত, তাহলে নিশ্চয়ই তার একটা দলিল থাকত। আর। ওটা দলিল নয় এজন্যে যে, তা রাসূলে করীম (স) থেকে বর্ণিত নয়। আর যা রাসূলে করীম (স) থেকে বর্ণিত নয়, তা দিললই হতে পারে না। তৃতীয়ত, উক্ত বর্ণনায় একথা নেই যে, কথাটি তিনি যাকাত প্রসঙ্গে বলেছেন। যদি তা সহীহ হয় তবুও তিনি তা জিযিয়াদাতাদের বলে থাকতেন, তারও সম্ভাবনা রয়েছে। কেননা সেক্ষেত্রে ‘জিযিয়া’ বাবদ দানা, চাল ও যব গ্রহণ করতেন। আর জিজিয়ার টাকা পরিবর্তে জিনিস বা দ্রব্যদি গ্রহণ করা যায়। চতুর্থত, এ সৎবাদটি যে বাতিল, তার দলিল তাতেই নিহিত রয়েছে। কেননা তাতে মুয়াযের উক্তির একটি অংশ হচ্ছে ‘মদীনাবসীদের জন্য কল্যাণবহ।’ আমি মনে করি না, মুয়ায এরূপ কথা বলতে পারেন। কেননা এ কথাটি সত্য হলে আল্লাহ তাদের কল্যাণের জন্যে যা ফরয করেছেন, তার পরিবর্তে অন্য জিনিসে তাদের কল্যাণ আছে বলে দাবি করা হয়, (আল্লাহ না করুন, এরূপ দাবি একজন সাহাবী করবেন!) [আরবী***********] এ গ্রন্থকারের মনে ইবনে হাজম কর্তৃক উপস্থাপিত এসব কারণ খুবই দুর্বল। কেননা তায়ূস যদিও হযরত মুয়াযকে দেখতে পাননি, তা সত্ত্বেও তাঁর ইয়ামন অবস্থানকালীন যাবতীয় কার্যকলাপ সম্পর্কে তায়ূস বিশেষ অবহিত ছিলেন। ইমাম শাফেয়ী তো তাই বয়েছেন। আর তায়ূস তো ইয়েমেনের তাবেয়ী যুগের ইমাম ছিলেন। তিনি মুয়াযের যাবতীয় অবস্থা ও সংবাদ সম্পর্কে বিশেষ সমীক্ষাশালী ছিলেন। আর তাঁর সময়টাও খুব নিকটবর্তী। হযরত মুয়াযের ইয়েমেনে কার্যক্রম এবং যাকাত বাবদ জিনিসের মূল্য গ্রহণ প্রমাণ করছে যে, তাতে নবী করীম (স)- এর সুন্নাতের বিরোধিতা কিছুই নেই। তিনিই তো কুরআন ও সুন্নাতের পর ইজতিহাদেকে শরীয়াতেরন তৃতীয় দলিল হওয়ার মর্যাদা প্রদান করেছেন। সেই সাথে একথাও যে, তখনকার কোন সাহাবীই তাঁর এই কাজকে শরীয়াত বিরোধী বলেননি। তাও প্রমাণ করে যে, সমস্ত সাহাবীই এ পর্যায়ে তাঁর সাথে পূর্ণ আনুকূল্য রক্ষা করেছেন। এই কথাটি জিযিয়া সম্পর্কিত হওয়ার সম্ভবনাটিও খুবই দুর্বল। বরং বাতিল মনে করতে হবে। আল্লামা আহমদ শারে (আরবী**********) গ্রন্থের টীকায় এ কথা বলেছেন। কেননা ইয়াহইয়া ইবনে আদামের বর্ণনায় (আরবী**********) ‘যাকাতের স্থলে’ কথাটি উদ্ধৃত রয়েছে। আর চতুর্থ কারণ পর্যায়ে ইবনে হাজম যা বলেছেন, তা তাঁর জুলুম ছাড়া কিছু নয়। তিনি এটা জোর করে বলেছেন বলতে হবে। কেননা উক্তির মধ্যে ‘তোমাদের জন্যে কল্যাণবহ’ যে কথাটি আছে তার অর্থ ‘তোমাদের জন্য উপকারী।’ কেননা মদীনাবাসীদের কাপড়ের খুব বেশি অভাব ছিল খাদ্য-শস্য- দানা ও যবের তুলনায়। এটা একটা বাস্তব ঘটনা এতে কোন মতদ্বৈততা নেই। কথার এই অংশ- ‘আল্লাহ তা ফরয করেন নি- এ কথাটি মতদ্বৈততার বিষয়। কাজেই শুধু মৌখিক দাবিকে দলিল মনে করা জায়েয হবে না। আর মূল্য গ্রহণ তো সেই পর্যায়ে গণ্য, যা আল্লাহ তা‘আলা তাঁর শরীয়াতে ফরয করেছেন। ইমাম ইবনে তাইমিয়া এক্ষেত্রে দুই বিবদমান পক্ষের মধ্যবর্তী একটা মত বা মাযহাব গ্রহণ করেছেন। তিনি এ সম্পর্কে বলেছেনঃ ‘এ ব্যাপারে অধিক স্পষ্ট কথা হচ্ছে, কোন প্রয়োজন বা অগ্রধিকার প্রাপ্ত কোন কল্যাণ বিবেচনা ব্যতীত যাকাত বাবদ দেয় দ্রব্যের মূল্য প্রদান সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এ কারণে নবী করীম (স) দুটি ক্ষতিপূরণের বিধান দিয়েছেন একটি ছাগী অথবা বিশটি দিরহাম দেয়ার কথা বলে। কিন্তু মূল্যকে মূল জিনিসের বিকল্প ধরা হয়নি। আরও এজন্যে যে মূল জিনিসের মূল্য প্রদান যখনই জায়েয ঘোষিত হবে, তখনই সম্পদ-মালীক নিন্মতম মালের বিচিত্র ধরনের মাল বিকল্পস্বরূপ নিয়ে আসবে। তাছাড়া মূল্য নির্ধারণেও অনেক সময় ক্ষতির কারণ থাকতে পারে। যেহেতু যাকাতের ভিত্তি হচ্ছে সহানুভুতি জ্ঞাপন। তা কার্যকর হতে পারে মালের একটি পরিমাণ থেকে সেই জাতীয় মাল দিলে। আর প্রয়োজন বা বিশেষ কল্যাণ বিচারে অথবা ন্যায়পরতা রক্ষার্থে মূল্য প্রদান করা হলে তাতে কোন দোষ থাকতে পারে না। যেমন বাগানের সব ফল বা ক্ষেতের সব ফসল নগদ টাকা বিক্রি করে দেয়া হলে মোট প্রাপ্ত মূল্যের এক-দশমাংশ দেয়া হলে তাতে যাকাত আদায় হয়ে যাবে। তা দিয়ে ফল বা ফসল ক্রয় করে দেবার জন্যে বাধ্য করা যাবে না। কেননা সে জিনিস দরিদ্র ব্যক্তির প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করেছে। ইমাম আহমাদও তা জায়েয বলে বলিষ্ঠ বক্তব্য রেখেছেন। আর যেমন পাঁচটি উটের যাকাত বাবদ একটি ছাগী দেয়া ফরয ধার্য হল; কিন্তু তার কাছে ছাগী ক্রয় করার কোন লোক নেই। তখন তার মূল্য প্রদানই যথেষ্ট হবে। সেজন্যে অপর শহরে গমন করে ছাগী ক্রয় করতে বাধ্য করার কোন যৌক্তিকতা থাকতে পারে না। অথবা এও হতে পারে যে, যাকাত পাওয়ার যোগ্য লোকেরাই তার কাছে মূল্য প্রদানের দাবি করল তা তাদের জন্যে অধিক উপকারী মনে করে। তাহলে তাদেরকে তা-ৈই দেয়া যাবে অথবা যাকাত সংগ্রহকারী কর্মকর্তাই যদি মূল্য প্রদান ফকীর মিসকীনদের জন্যে অধিক উপকারী মনে করে তবুও। মুয়ায ইবনে জাবাল (রা) তো তাই করেছেন বলে বর্ণনা করা হয়েছে। তিনি নিজেই ইয়েমেনবাসীদের বলেছিলেনঃ তোমরা আমাকে পাঁচগজি কাপড় বা তৈরী পোশাক দিয়ে দাও। তা তোমাদের জন্যেও যেমন সহজতর, তেমনি মদীনায় বসবাসকারী আনসার ও মুহাজিরদের পক্ষেও অনেক কল্যাণকর। ( এ কথাটি কাদের জন্যে বলা হয়েছে?..... কেউ বলেছেন, যাকাতদাতাদের লক্ষ্য করে, কারোর মতে ‘জিযিয়ার’ ক্ষেত্রে বলেছেন।) [আরবী ***********] এ কথাটি আমাদের গৃহীত মতের নিকটবর্তী। আমাদের এ যুগে প্রয়োজন ও কল্যাণ উভয় দিক দিয়েই মূল্য গ্রহণ জায়েয হওয়া বিধেয় হওয়া উচিত- অবশ্য যদি তাতে ফকীর-মিসকীন ও সম্পদের মালিকদের পক্ষে কোনরূপ ক্ষীতর কারণ না হয়। চতুর্থ পরিচ্ছেদ যাকাত স্থানান্তরকরণ যাকাতলব্ধ সম্পদ ব্যয় ও বিনিয়োগ বা বণ্টনের ক্ষেত্রে ইসলামের একটা বিশেষ বিজ্ঞানসম্মত ও ন্যায়বাদী নীতি রয়েছে। আমাদের এ যুগে প্রতিষ্ঠানগত, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা যতই পরিবর্তিত হোক না- কেন, তার সাথে সে নীতির পূর্ণ সংগতি বিদ্যমান। অধিকন্তু লোকদের ধারণা-কল্পনায় ভবিষ্যতে যত রকমের প্রতিষ্ঠান বা সংস্থাই গড়ে উঠুক এবং যতই নতুন নতুন আইন-বিধান তৈরী হোক; ইসলামের এই নীতির সাথেও উপযুক্ততা ও সংগতি রক্ষা করে অতি আধুনিক ও নতুন হয়ে কাজ করতে সক্ষম হবে। আরব জাহিলিয়াত ও ইউরোপ ইত্যাদির অন্ধকার জাহিলিয়াতের যুগেও লোকেরা ভালভাবে জানতো, কৃষক-চাষী, শিল্প মালিক, পোশকধারী, ব্যবসায়ী প্রতৃতির নিকট থেকে কিভাবে কর- এর নামে অর্থ লুট করে নেয়া হত। অথচ তখন এ লোকেরা কত না কঠোর শ্রম করে মাথার ঘাম ফেলে ও রাত জেগে জীবিকা উপার্জন করত! লোকদের ঘাম রক্ত ও অশ্রুনিষিক্ত এই অর্থ চলে যেত সম্রাট, রাজা-বাদশাহ, স্থানীয় শাসক-প্রশাসক ইত্যাদির হাতে এবং তা তাদের বিলাস-ব্যসনে, রাজধানী ও রাজপ্রাসাদের চাকচিক্য বিধানে অকাতরে ব্যয় করা হত। তাদের সিংহাসন খচিত করা হত তাদের বাহাদুরী ও শান-শওকত বৃদ্ধির জন্যে। তাতে চারপাশের পাহারাদার, সাহায্যকারী ও অনুগমনকারীদের অপেক্ষা নিজেদের অধিকতর প্রাচুর্য উন্নত করে তুলবার ব্যবস্থা ছিল। তারপরও কিছু অবশিষ্ট থাকলে তা রাজধানী সম্প্রসারণ, সৌন্দর্য বিধান ও তার অধিবাসীদের সুখ- স্বাচ্ছন্দ্য বৃদ্ধিকল্পে ব্যয়িত হত। তারপরও কিছু বেঁচে গেলে সর্বোচ্চ কর্তার নিকটবর্তী ব্যক্তি ও শহরের বিশিষ্টদের মধ্যে বণ্টন করা হত। আর তারা সকলেই সেই দূরবর্তী অনগ্রসর ও দুর্দশাগ্রস্ত কষ্টে নিমজ্জিত গন্ডগ্রামের লোকদের প্রতি চরম উপেক্ষা ও অনীহা পোষণ করত অথচ সে সব ‘কর’ এই স্থানসমূহ থেকেই নেয়া হয়েছে, সংগ্রহ করা হয়েছে এ সব বিলাস দ্রব্য।[গ্রন্থকারে (আরবী************)থেকে উদ্ধৃতি।] কিন্তু দুনিয়ায় যখন ইসলামের আগমন হল এবং মুসলিম ধনী ব্যক্তিদের জন্যে নিয়মিতভাবে যাকাত দেবার বিধান জারি করল, সেই সাথে তা আদায় করার জন্যে দায়িত্বশীল নিযুক্ত করা হল, তখন এ নীতিও চালু ও কার্যকর করা হল যে, এ যাকাত যেখান থেকে পাওয়া যাবে- আদায় ও সংগ্রহ করা হবে, সেখানেই তা বণ্টনও করা হবে। এ নীতিটি গবাদি পশু, কৃষি ফসল ও ফল-ফাঁকড়ার যাকাতের ক্ষেত্রে সর্বসম্মতভাবে গৃহীত ও পালিত। কেননা যাকাত বণ্টন করতে হবে যেখানেই তা পাওয়া যাবে। সেই সাথে এ ব্যাপারেও কোন দ্বিমত নেই যে, রোযার ফিতরা-ফিতরার যাকাত সেখানেই বণ্টন করা হবে, যেখানে বসবাস করে সেই ব্যক্তি যার উপর তা ওয়াজিব হয়েছে। তবে নগদ সম্পদের যাকাত পর্যায়ে ফিকাহ্বিদদের মধ্যে যথেষ্ট মতপার্থাক্য রয়েছে। এ যাকাত কি সেখানেই বণ্টন করা হবে যেখানে তা পাওয়া গেছে অথবা যেখানে সম্পদের মালিক বসবাস করে? [দেখুনঃ (আরবী************)] প্রখ্যাত কথা-যা অধিকাংশ ফিকাহ্বিদের মত- হচ্ছে, এ পর্যায়ে মালের অবস্থান ধরতে হবে, মালিতের নয়। এই নীতির দলিল হচ্ছে রাসূলে করীম (স) ও খুলাফায়ে রাশেদুনের সুন্নত। নবী করীম (স) যখনই এবং যেখানেই যাকাত আদায়কারী লোক প্রেরণ করেছেন-প্রশাসক নিয়োগ করেছেন কোন অঞ্চলে, শহরে বা রাজ্যে তাদের স্পষ্ট ভাষায় নির্দেশ দিয়েছেন যে, তারা যেন সেখানকার ধনী লোকদের কাছ থেকে যাকাত গ্রহণ করে এবং সেখানকারই ফকীর-মিসকীনের মধ্যে তা বণ্টন করে দেয়। হযরত মুয়ায সংক্রান্ত হাদীস অনেকবার উদ্ধৃত করা হয়েছে। সে হাদীসটি যে সহীহ, সে ব্যাপারে কোন দ্বিমত নেই- সর্বসম্মত। তাতে বলা হয়েছে, নবী করীম (স ) তাঁকে ইয়েমেন পাঠিয়েছিলেন এবং তাঁকে নির্দেশ দিয়েছিলেন সেখানকার ধনী লোকদের কাছ থেকে যাকাত গ্রহণ করে সেখানকারই গরীব লোকদের মধ্যে তা বণ্টন করে দিতে। হযরত মুয়ায রাসূলে করীম (স)-এর এ আদেশকে পুরোপরি ও যথাযথভাবে কার্যকর করেছেন। ইয়েমেনবাসীদের যাকাত সেখানকারই তা পাওয়ার যোগ্য লোকদের মধ্যেই বণ্টন করে দিয়েছিলেন। বরং প্রতিট রাজ্যের বা অঞ্চলের যাকাত বিশেষভাবে সেখানকার অভাবগ্রস্ত লোকদের মধ্যেই বণ্টন করেছিলেন। আর তাদের জন্যে একটি সনদও লিখে দিয়েছিলেন। তাতে ছিলঃ যে‘ জেলায়’ [মূল্য (আরবী**********) শব্দ রয়েছে। ইবনুল আসীর (আরবী**********) গ্রন্থে বলেছেনঃ ইয়ামনে ‘মেখ’ ‘লাফ’ তেমন যেমন ইরাকে রুস্তাক (আরবী********) অর্থাৎ তা একটি শাসন এলাকা যেমন প্রদেশ বা জিলা।] যারা লোকজন জমি ও সম্পদ সেখান থেকে সে অন্যত্র চলে গেলেও তার যাকাত ও ওশর তার লোকজনের সেই জেলাতেই (বণ্টিত) হবে’। [আবূ হুযায়ফা থেকে তায়ূস এই বর্ণনাটি করেছেন সহীহ সনদে। সায়ীদ ইবনে মনসূর এবং তাঁর ন্যায় আমরাও তা উদ্ধৃত করেছি, যেমন (আরবী*************) তে উদ্ধৃত হয়েছে।] আবূ হুযায়ফা বলেছেনঃ আমাদের কাছে রাসূল (স)- এর প্রেরিত যাকাত আদায়কারী উপস্থিত হল। সে আমাদের মধ্যকার ধনী লোকদের কাছ থেকে যাকাত আদয় করে আমাদেরই গরীব লোকদের মধ্যে বণ্টন করে দিল। তখন আমি ছিলাম এক ইয়াতীম ক্রীতদাস। আমাকে সে যাকাত সম্পদ থেকে একটা উট দিয়েছিল। [ঘটনাটি তিরমিযী উদ্ধৃত করেছেন এবং বলেছেন হাদীসটি ‘হাসান’ উক্ত সূত্র] সহীহ্ গ্রন্থে উদ্ধৃত হয়েছে, একজন আরব বেদুঈন রাসূলে করীম (স)- কে অনেক প্রশ্ন করেছিলেন। তন্মধ্যে একটি এইঃ আল্লাহ্ আপনাকে রাসূল বানিয়েছেন, তাঁর কসম, আল্লাহ্ কি আপনাকে আদেশ করেছেন যে, আপনি আমাদের ধনী লোকদের কাছ থেকে যাকাত গ্রহণ করবেন এবং তা বণ্টন করবেন আমাদেরই দরিদ্র লোকদের মধ্যে? বললেনঃ হ্যাঁ। আবূ উবাইদ উমর (রা) থেকে বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন, তিনি তাঁর উপদেশনামায় বলেছেনঃ আমি আমার পরবর্তী খলীফাকে অসিয়ত করছি এ বিষয়ে। আরও অসিয়ত করছি এই......বিষয়ে এবং অসিয়ত করছি আরব বেদুঈনদের কল্যাণ করার জন্যে। কেননা তারাই আসল আরব ও ইসলামের সারবস্তু এবং এভাবে করতে হবে যে, তাদের মালদার লোকদের কাছ থেকে তাদের ধন-মালের যাকাত গ্রহণ করতে হবে এবং তা তাদেরই দরিদ্রদের মধ্যে বণ্টন করতে হবে। [আরবী*************] হযরত উমর (রা)-এর জীবনকালীন কাজের ধারাও তা-ই ছিল। তিনি যেখান থেকে যাকাত সংগ্রহ করতেন, সেখানেই বণ্টন করাতেন। আর সরকার নিয়েজিত যাকাত কর্মচারীরা মদীনায় ফিরে আসতো রিক্ত হস্তে, সঙ্গে নিয়ে আসত শুধু সে সব কাপড়-চোপড়, যা পরিধান করে তারা গিয়েছিল নিজ নিজ ঘর থেকে অথবা সেই লাঠি, যার ওপর তারা ভর করে চলাফেরা করত আগে থেকেই। এ পর্যয়ে সায়ীদ ইবনুল মুসাইয়্যিব থেকে বর্ণিত হয়েছে, হযরত উমর মুয়াযকে বনু কিলাব গোত্রের বা বনু সায়াদ ইবনে যুবিয়ান গোত্রের যাকাত সংগ্রহকারীরূপে পঠিয়েছিলেন। সেখানকার যাকাত বণ্টন করে দেয়ার পর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। পরে তিনি সেই পোশাকেই রাজধানীতে ফিরে আসেন, যা তার পরিধানে ছিল যাওয়ার সময়।[আরবী*************] ইয়ালা ইবনে উমাইয়্যাতার সঙ্গী ও হযরত উমর যাদেরকে যাকাত আদয়ে কর্মচারী নিযুক্ত করেছিলেন তাদের মধ্যে থেকে সায়াদ বলেছেনঃ আমরা যাকাত আদায়ের জন্য বের হয়ে যেতাম। পরে আমরা ফিরে আসতাম শুধু আমাদের চাবুকগুলো হাতে নিয়ে।[আরবী*************] হযরত উমর (রা)- কে সওয়াল করা হয়েছিলঃ আরব বেদুঈনদের যাকাত কি জিনিস থেকে নেয়া হবে? তা নিয়ে আমরা কি বা কেমন করব? জবাবে হযরত উমর (রা) বলেছিলেনঃ আল্লাহ্র শপথ, আমি তাদের ওপর সহজভাবে যাকাত ফিরিয়ে দেব, পতক্ষণ তাদের এক- এক জনের ভাগে একশ ‘উষ্ট্রী বা একশ’ উট পড়ে।[আরবী************] পরিপন্থী- ক্ষতিকর, যে জন্যে যাকাত ফরয করা হয়েছে। এ কারণে আল-মুগনী গ্রন্থে বলা হয়েছেঃ যেহেতু যাকাতের উদ্দেশ্য হচ্ছে তদ্দারা গরীব-মিসকীন লোকদের ধনী বা সচ্ছল বানানো। অতএব তাকে স্থানন্তরিত করাকে যদি আমরা মুবাহ করে দিই, তাহলে সেই স্থানের ফকী- মিসকীনদের অভাবগ্রস্ত অবস্থায় রেখে দেওয়ার পরিস্থিতি দেখা দেবে। [আরবী************] রাসূলে করীম (স) ও তাঁর খুলাফায়ে রাশেদুন উপস্থপিত নীতি ও পদ্ধতির ওপরই স্থিতিশীল রয়েছেন সুবিচারক ও ন্যায়বাদী প্রশাসকবৃন্দ। সাহাবী ও তাবেয়ীনের মধ্যে ষাঁরা ফতোয়ার ইমাম ছিলেন, তাঁরাও তা থেকে এক বিন্দু বিচ্যুত হন নি। ইমরান ইবনে হুচাইন (র) জিয়াদ ইবনে আবীহ্ কিংবা বনু উমাইয়্যা বংশোর কোন প্রশাসকের পক্ষ থেকে যাকাতের কর্মকর্তা নিযুক্ত হয়েছিলেন। তিনি যখন ফিরে এলেন তাঁকে সে জিজ্ঞাসা করলঃ মাল-মত্র কোথায়? তিনি বললেনঃ আমাকে কি মাল আনতে পাঠিয়েছিলেন? মাল তো সেখান থেকেই আমরা পেয়িছি, যেখান থেকে আমরা রাসূলে করীম (স)-এর যুগে পেতাম এবং তেমনিভাবেই তা রেখে এসেছি যেমন করে পূর্বে রেখে আসতাম।[আবূ দাউদ ও ইবনে মাজাহ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। দেখুনঃ (আরবী*************] মুহাম্মাদ ইবনে ইউসূফ সাকাফী তায়ূসকে- যিনি ইয়েমেনের ফিকাহবিদ বলে খ্যাত ছিলেন- মিখ্লাফ এলাকার যাকাতের কর্মকর্তা নিযুক্ত করেছিলেন। তিনি তথায় ধনীদের কাছে থেকে যাকাত গ্রহণ করতেন এবং তা ফকীরদের মধ্যে ভাগ করে দিতেন। যখন বণ্টনের কাজ শেষ করতেন, তখন তাকে বলা হলঃ তোমার হিসেব পেশ কর। বললেনঃ আমার কোন হিসেব নেই। আমি তো ধনীর কাছ থেকে নিতাম ও মিসকীনকে দিয়ে দিতাম।[আরবী**************] ফাসকাদ সাবখী থেকে বর্ণিত আছেঃ আমি আমার মালের যাকাত বহন করে নিয়ে মক্কায় বিতরণ করতে চেয়েছিলাম। পথে সায়ীদ ইবনে জুবাইরের সাথে সাক্ষাত করলাম। তিনি বললেনঃ ওসব ফিরিয়ে নিয়ে যাও এবং তোমার নিজের শহরেই তা বিতরণ করে দাও।[আরবী*************] আবূ উবাইদ বলেছেনঃ এ কালের আলিমগণ এসব উক্তি ও দলিলের ব্যাপারে সম্পূর্ণ একমত। প্রত্যেকটি শহর বা এলাকার জনগণ- মরুবাসীদের ক্ষেত্রে প্রত্যেক পানি কেন্দ্রের লোকেরা সেখানকার যাকাত পাওয়ার ব্যাপারে আমাদের তুলনায় বেশী। অধিকারসম্পন্ন- যতক্ষণ পর্যন্ত তথায় অভাবগ্রস্ত লোক থাকবে- একজন বা বহু তাতে যদি সমস্ত যাকাতই নিঃশেষিত হয়ে যায়- এমন কি যাকাতের কর্মচারীকে রিক্ত হস্তে ফিরে আসতে হয়, তবুও। একটু পূর্বে যা উল্লেখ করা হয়েছে- হযরত মুয়ায সংক্রান্ত কথা যে, তিনি যে পোশাক পরে গিয়েছিলেন, তা পরা অবস্থায়ই ফিরে এসেছিলেন; সায়ীদ সংক্রন্ত কথা- তিনি বলেছেলেনঃ আমরা যাকাত সংগ্রহে বের হয়ে যেতাম, পরে আমাদের মুয়ায ইয়েমেনবাসীদের উদ্ধৃত যাকাত হযরত উমরের নিকট পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি তা ফেরত পাঠিয়েছিলেন- আবূ উবাইদ এ সবকেই দলিলরূপে উপস্থাপন করেছেন। পরে আবূ উবাইদ বলেছেনঃ এ সব হাদীস প্রমাণ করছে যে, প্রত্যেক স্থানের জনগণ সে স্থানের যাকাত পাওয়ার সর্তবিধ অধিকারী- যতক্ষণ না তার সম্পূর্ণরূপে যাকাতের ওপর নির্ভরতা- মুখাপেক্ষিতা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হচ্ছে। আমরা যে অন্যদের তুলনায় কেবল সে স্থানের লোকদের অধিকারের কথা বলছি, তার কারণ হচ্ছে, হাদীসে সুন্নাতের প্রতিবেশীর মর্যাদা ও অধিকারের ওপর খুব বেশী গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। ধনীর পাশে দারিদ্রদের ঘর হওয়াটা তাদেরকে এই অধিকার এনে দিয়েছে। [আরবী***************] হ্যাঁ, যাকাতদাতা যদি ভুলে যায় বা না জানে এবং সে যাকাত এক স্থান থেকে অন্য এক স্থনে বহন করে নিয়ে যায়, অথচ সেখানকার সেই প্রথম স্থানের লোক তার মুখাপেক্ষী, তাহলে রাষ্ট্রপ্রধান তা তাদের কাছে ফেরত পাঠাবে- যেমন হযরত উমর ইবনে আবদুল আজীজ করেছিলেন এবং যেমন সায়ীদ ইবনে জুবাইর এ মতের ওপর ফতোয়া দিয়েছেন। [আরবী*************] অবশ্য ইবরাহীম নখ্য়ী ও হাসানুল বখরী যাকাতদাতার এ অধিকার আছে বলে মনে করেন যে, সে তার যাকাত পাওয়ার নিকটবর্তী অধিকার কার তা অগ্রাধিকার দিয়ে ঠিক করবে। আবূ উবাইদ বলেছেন, ব্যক্তির বিশেষত্ব ও তার মালের বিবেচনায় তা জায়েয হবে। কিন্তু জনসাধারণের যাকাত সম্পদ- যা দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা সংগ্রহ করে ও বণ্টনের দায়িত্ব পালন করে, সে ক্ষেত্রে এ কাজ জায়েয নয়। উপরিউক্ত ফকীহ্ দুজনের মত বহন করে আবদুল আলীয়া বর্ণিত হাদীস। তাতে বলা হয়েছে, তিনি তাঁর যাকাত মদীনায় বহন করে নিয়ে যেতেন। আবূ উবাইদ বলেছেন, ‘আমরা মনে করি, তিনি তা তাঁর নিকটাত্মীয় ও মুক্ত করা গোলামদের মধ্যেই বিশেষভাবে বণ্টন করেছেন, আর কাউকে দেন নি। [আরবী***********] কোন স্থানের জনগণ দারিদ্র্যমুক্ত হলে সেখানকার যাকাত অন্যত্র নিয়ে যাওয়া জায়েয মূলত ও সর্ববাদীসম্মত মত যেমন এই যে, যাকাত যে স্থানের ধন-মালের ওপর ফরয হয়েছে তদুযায়ী আদায় হয়েছে, সেই স্থানের দারিদ্রদের মধেই তা বণ্টন করতে হবে; অনরূপভাবে এ কথাও সর্বসম্মত যে, সে স্থানের জনগণ যখন সে যাকাতের ওপর নির্ভরশীলতা থেকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে মুক্ত হবে, তখন তা অন্যত্র নিয়ে যাওয়া সর্বতোভাবে জায়েয। সে নির্ভরশীলতা থেকে মুক্তি হয় এ কারণে হতে পারে যে, তা পাওয়ার যোগ্য বিভিন্ন প্রকারের লোক তথায় নেই অথবা এজন্যে যে, তাদের সংখ্যা কম আর যাকাতের মালের পরিমাণ বিপুল। তখন হয় রাষ্ট্রপ্রাধানের কাছে অবশিষ্ট পরিমাণ যকাত ফিরিয়ে দিতে হবে, যেন সে প্রয়োজন মত ব্যয় করতে পারে অথবা সে স্থানের আবূ উবাইদ বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন, হযরত মুয়ায ইবনে জাবাল (রা) রাসূল (স) কর্তৃক ইয়েমেনে প্রেরিত হওয়ার পর তাঁর ও তাঁর পরে হযরত আবূ বকর (রা)-এর ইন্তেকালের পরবর্তী সময় পর্যন্ত ‘জামাদ’ নামাক স্থানে অবস্থান করছিলেন। পরে হযরত উমর (রা)- এর সময় তিনি ফিরে আসেন। তখন তিনিও তাঁকে পূর্বের সেই দায়িত্বে পুনর্বহাল করেন। তখন হযরত মুয়ায তাঁর কাছে লোকদের কাছ থেকে পাওয়া এক-তৃতীয়ংশ যাকাত পাঠিয়েছিলেন। হযরত উমত (রা) তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করলেন এবং বলে পাঠালেন, ‘আমি তো তোমাকে কর আদয়কারী করে পাঠাইনি। জিযিয়া গ্রহণকারীরূপেও নয়। পাঠিয়েছি এ উদ্দেশ্যে যে, তুমি ধনী লোকদের কাছ থেকে (যাকাত) নেবে ও তা তাদের মধ্যকার দরিদ্রদের মধ্যে বণ্টন করবে। হযরত মুয়ায (রা) জানালেনঃ আমি আপনার কাছে এমন অবস্থায় কিছুই পাঠাইনি যে, তা গ্রহণ করার এখানে কজন লোকও পাওয়া গিয়েছিল (অর্থাৎ যা পাঠিয়েছি তা গ্রহণ করার এখানে কেউ নেই।) পরবর্তী বছর তিনি খলীফার কাছে অর্ধ-পরিমাণ যাকাত পাঠিয়ে দিলেন। সেবারও তিনি তা ফেরত পাঠিয়ে দিলেন। তৃতীয় বছরে তিনি যাকাত বাবদ প্রাপ্ত সমস্ত সম্পদ খলীফার কাছে পাঠিয়ে দিলেন। তখনও হযরত উমর পূর্বের ন্যায় ফেরত পাঠালেন। তখন হযরত মুয়ায বললেনঃ আমার কাছ থেকে কোন কিছু গ্রহণ করার একজন লোকও এখানে পাই নি। [(আরবী ***********) এবং আমার গ্রন্থ (আরবী***********) গন্থের শেষের টীকা দেখুন।] প্রথমবার হযরত উমর (রা) হযরত মুয়ায কর্তৃক প্রেরিত যাকাত সম্পদ গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছিলেন- তারপরও বারবার তাই করেছিলেন- এ থেকে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয় যে, যাকাতের ব্যাপারে মৌল নীতি হচ্ছে তা প্রাপ্তির স্থানেই বণ্টন করতে হবে। পরে শেষবার হযরত উমর (রা) হযরত মুয়াযের কাজকে বহাল রেখেছিলেন তা পাওয়ার যোগ্য লোক পাওয়া যাবে না। পূর্ণ অভাবমুক্ত না হওয়া সত্ত্বেও স্থানান্তরিতকরণে বিভিন্ন মত যাকাত সংগৃহীত হওয়ার স্থানের লোকদের অভাবমুক্ত না হওয়া সত্ত্বেও তা অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে ফিকাহ্বিদগণ বিভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। এ ব্যাপারে কোন কোন মাযহাব খুব বেশী কঠোরতা অবলম্বন করেছেন। এ মতের লোকেরা কোনক্রমেই অন্যত্র নিয়ে যাওয়াকে সমর্থন করতে প্রস্তুত নন। এমনকি ততটা দূরত্বের নিয়ে যাওয়া জায়েয মনেস করেন না যতটা দূরত্বে গেলে নাময ‘কছর’ করা যায়, যত বড় প্রয়োজনই হোক না কেন । শাফেয়ী মতের লোকদের বক্তব্য হল, যাকাত এক স্থান থেকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া জায়েয নয়, নেখান থেকে তা পাওয়া গেছে সেখানেই তা ব্যয় ও বণ্টন করা ওয়াজবি। তবে সে স্থানে তা পাওয়ার যোগ্য লোক যদি আদৌ না থাকে, তাহলে ভিন্ন কথা। হাম্বলী মতের লোকদেরও এ মত। পাওয়ার যোগ্য লোক থাকা সত্ত্বেও যাকাত স্থানান্তরিত করা হলে গুনাহ্ হবে, যদিও যাকাত আদায় হবে। কেননা যাকাতের তো তা পাওয়ার যোগ্য লোককে দিয়েছে তাই সে দায়িত্বমুক্ত হবে, যেমন ঋণের ক্ষেত্রে হয়। অন্যবা বলেছেন, যাকাত আদায়ই হবে না। কেননা অকাট্য দলিলের বিরোধিতা করা হয়েছে। [ (আরবী ***********) মুল্লা আলী আল-কারী মিশকাত-এর শরাহ্ গ্রন্থে তাবেযী থেকে উদ্ধৃত করেছেন, ফিকাহ্বিদগণ এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ একমত যে, যাকাত সম্পদ স্থানান্তরিত করা হলেও আদায় করা হলে ফরয পালন হবে। তবে উমর ইবনে আবদুল আবদুল আজীজ ভিন্ন মত পোষণ করেন। কেননা তাঁর সময়ে খোরাসান থেকে যাকাত সম্পদ ‘শাম’ চলে যাওয়ার পর তিনি তা তার স্থানে ফেরত দিয়েছিলেন। আ-কারী লিখেছেন,এতে এই প্রমাণ হয় যে, তাঁর এ কাজটা ইজমা’র বিরোধিতা করা বোঝায় না। বরং তিনি তা করেছেন পূর্ণ মাত্রায় ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে এবং লোভ প্রতিরোধ করার উদ্দেশ্যে। দেখুনঃ আরবী**********] আর হানাফী মাযহাবের লোকদের মত হচ্ছে যাকাত স্থানান্তর করা মাক্রুহ বটে; তবে তা যদি নিকটাত্মীয় অভাবগ্রস্ত লোকদেগর মধ্যে বণ্টনের উদ্দেশ্যে নেয়া হয়, তাহলে মাকরুহ্ হবে না। কেননা তাতে ‘ছেলায়ে রেহমী’ রক্ষার দিকটি প্রবল অথবা যদি এমন ব্যক্তি বা জনগোষ্ঠীর কাছে তা নিয়ে যাওয়া হয় যারা স্থনীয় লোকদের তুলনায় অধিক অভাবগ্রস্ত; কিন্তু তা স্থানান্তরিতকরণ মুসলিম জনগণের পক্ষে অধিক কল্যাণকর বিবেচিত হয় অথবা তা ‘দারুল হরব’ থেকে দারুল- ইসলামের মুসলিম ফকীর মিসকীন দারুল হরবের ফকীর- মিসকীনের তুলনায় সাহায্য পাওয়ার উত্তম ও বেশী অধিকারসম্পন্ন। কোন আলিম বা তালেবে ইলমকে দেয়ার জন্যে নেয়া হয়, তাতেও আপত্তি নেই। কেননা তাতে তাকে সাহায্য করা হবে ও তার লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করা হবে অথবা যদি অধিক আল্লাহ্ভীরু বা মুসলিম জনগণের পক্ষে অধিক উপকারী ও কল্যাণকামী ব্যক্তির কাছে নিয়ে যাওয়া হয়,- এও হতে পারে যে, যাকাত বছর শেষ হওয়ার পূর্বেই তা আদয় করা হয়েছে- এসব অবস্থায় যাকাত স্থানান্তরিত করা মাকরুহ্ নয়। [আরবী*************] মালিকী মতের লোকদের অভিমত হচ্ছে, যাকাত ফরয হওয়া স্থানে বা তার নিকটবর্তী স্থানে তা বণ্টন করা ওয়াজিব। এই নিকটবর্তী স্থান বলতে নামায ‘কসর’ করা যায় এমন দূরুত্বের কম বোঝায়, কেননা তাও যাকাত ফরয হওয়ার স্থানের মধ্যে গণ্য। আর যাকাত ফরয হওয়া বা তার নিকটস্থ স্থানে তা পাওয়ার যোগ্য লোক যদি না পাওয়া যায়, তাহলে তা এমন স্থানে নিয়ে যাওয়া ওয়াজিব, যেখানে তা পাওয়ার যোগ্য লোক রয়েছে। তা ‘নামায কসর’- এর দূরত্বে হলেও কোন দোষ নেই। যাকাত ফরয হওয়ার স্থানে বা তার নিকটবর্তী স্থানে কোন যাকাত পাওয়ার যোগ্য লোক থাকে, তাহলে তা সেই স্থানে বণ্টন করা অবশ্যম্ভাবী হবে। তখন তা ‘নামায-কসর,- এর দূরত্বে নিয়ে যাওয়ার জায়েয হবে না। তবে তা যাদের কাছে নিয়ে যাওয়া হবে তারা যদি তুলনামূলকভাবে অধিক অভাবগ্রস্ত ও দরিদ্রও হয়, তাহলে বেশী পরিমাণ তাদের জন্যে নিয়ে যাওয়া মুস্তাহাব হবে। আর যদি সবটাই সেখানে নিয়ে যায়, কিংবা তার সবটা ওয়াজিব হওয়া স্থানেই বণ্টন করে, তাহলেও চলবে। কিন্তু তা যদি অধিক দুঃস্থ ও অধিক অভাবগ্রস্ত নয় এমন লোকদের জন্যে স্তানান্তরিত করা হয়, তাহলে তার দুটি অবস্থাঃ প্রথম, তুলনামূলকভাবে ওয়াজিব হওয়া স্থানের লোকদের সমান অভাবগ্রস্ত লোকদের জন্যে নিয়ে যাওয়া হয়, তাহেল তা জায়েয হবে না। যাকাত অবশ্য আদায় হয়ে যাবে, তা পুনরায় দিতে হবে না। আর দ্বিতীয়, অপেক্ষাকৃত কম অভাবগ্রস্ত লোকদের জন্যে নিয়ে যাওয়া হলে তাতে দুটি কথাঃ প্রথম কথা, খলীল তাঁর (আরবী***********) –এ বলেছেন, তাতে যাকাত আদায় হবে না। আর দ্বিতীয় কথা, ইবনে রুশদ ও আলকাফী বলেছেন, যাকাত আদায় হয়ে যাবে। কেননা তা তার জন্যে নির্দিষ্ট ব্যয় ক্ষেত্রেই ব্যয় করা হয়েছে। [আরবী*************] জায়দীয়া ফিকাহ্র মতে যাকাত আদয়ের স্থানে তার গরীব লোক থাকা সত্ত্বেও তাদের ছাড়া অন্যদের মধ্যে তা বণ্টন করা মাক্রুহ্। বরং সেখানে দারিদ্র লোক থাকলে তাদের মধ্যে বণ্টন করাই উত্তম। মালের মালিক ও রাষ্ট্রপ্রধান সেখানেই থাকুক, কি অন্যত্র তাতে কোন পার্থাক্য হবে না তাঁরা বলেছেনঃ আমাদের মতে মাক্রুহ্ বলতে বোঝায় মুস্তাহাবের বিপরীতটা। সে স্থানের গরীবদের ছাড়া অন্যত্র যাকাত ব্যয় করা হলে যাকাত আদায় হবে বটে; তবে মাকরুহ্ হবে। যদি না তা উত্তম ও অধিক ভালো কোন উদ্দেশ্যের জন্য স্থানান্তরিত কার হয়ে থাকে। সে ভালো উদ্দেশ্যে হতে পারে নিকটাত্মীয় কোন ব্যক্তি বা দ্বীনী শিক্ষার্থী যদি যাকাত পাওয়ার যোগ্য হয় তবে তাকে দেয়া। খুব বেশী ঠেকায় পড়া কোন লোককে দেয়। এরূপ অবস্থায় যাকাত স্থানান্তরিত করা হলে ত মাক্রুহ্ তো হবেই না বরং তাই উত্তম কাজ হবে। [আরবী*********** ] আবাজীয় মতের লোকদের দৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, রাষ্ট্রপ্রধান প্রতিটি স্থানের দরিদ্রদের মধ্যে যেখান থেকে যাকাত পাওয়া গেছে, সেখানে এক-তৃতীয়াংশ অথবা অর্ধেক পরিমাণ বিতরণ করবেন এবং অবশিষ্ট পরিমাণ ইসলামী রাষ্ট্রের শক্তি বৃদ্ধির উদ্দেৃশ্যে নিয়োগ করবেন?...... এ প্রশ্নের জাবাবে দুটি কথাঃ তাঁরা বলেছেন, যদি সম্পূর্ণ পরিমাণই ব্যয় করার প্রয়োজন হয়, তবে তাই নিয়ে নেবে এবং তাদের দেবে তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী। যদি প্রয়োজন না হয়, তাহলে সবটাই বণ্টন করে দেবে। আর একটি স্থনের লোকের যখন যথেষ্ট পরিমণ পেয়ে যাবে, তখন তার নিকটবর্তী আর একটি স্থানকে গ্রহণ করতে হবে। [আরবী**************] রাষ্ট্রপ্রধানের ইজতিহাদে স্থানান্তর জায়েয আমার যা মনে হয়- উপরে যেসব হাদীস, সাহাবীদের উক্তি এবং তাবেয়ীদের মন্তব্য- বক্তব্য উদ্ধৃত হয়েছে তার ভিত্তিতে এ বিশ্বাস জন্মে যে, যাকাতের মূল কথা হচ্ছে, যেখান থেকে তা সংগৃহীত হবে সেখানেই তা বণ্টন করে দিতে হবে প্রতিবেশীর অধিকারের মর্যদা প্রতিষ্ঠা এবং দারিদ্র্য বিরোধী যুদ্ধ ও প্রতিঘাত সংঘঠিত করার লক্ষ্যে। সেই সাথে প্রত্যেক অঞ্চলকে স্বয়ংসম্পূর্ণ ও স্বনির্ভর করে তোলার উদ্দেশ্যে ও সেখানকার স্থানীয় অভ্যন্তরীণ সমস্যাসমূহের মুকাবিলা করার জন্যে। আরও বিশেষ করে এজন্যে যে, স্থানীয় ফকীর-মিসকীনরা তো তাদের দৃষ্টি ও মন এসব ধন-মালের ওপর নিবদ্ধ করে রেখেছে এবং তার যাকাত পাওয়ার জন্যে উদগ্রীব হয়ে রয়েছে। ফলে অন্যদের তুলনায় তাদের অধিকার অগ্রাধিকার পাওয়ার অধিকারী হয়েছে। এসব সত্ত্বেও এ মৌলনীতির বিপরীত কোন কাজ করার পথে প্রতিবন্ধক কিছু আছে বলে মনে করার কারণ দেখছি না। যদি ন্যায়পরায়ণ রাষ্ট্রপ্রধান উপদেষ্টা পরিষদের পরামর্শক্রমে তা করা মুসলিম জনগণের পক্ষে কল্যাণকর এবং ইসলামের পক্ষে মংগলজনক মনে করে, তাহলে তা সে অনায়াসেই করতে পারে। এ পর্যয়ে ইমাম মালিক যা বলেছেন, তা আমার খুব মনঃপূত হয়েছে। তা হচ্ছেঃ যাকাত স্থানান্তরকরণ জায়েয নয়। তবে কোন স্থানের লোকদের জন্যে তা অপরহার্যভাবে প্রয়োজনীয় বোধ হলে রাষ্ট্রপ্রধান স্বীয় ইজাতিহাদ ও সবিবেচনার ভিত্তিতে তা করতে পারেন।[আরবী***********] তাঁর সহকর্মীদের মধ্য থেকে ইবনুল কাসেম বলেছেনঃ যাকাতের কিছু অংশ প্রয়োজনের কারণে স্থানান্তরিত করা আমি সঠিক বলে মনে করি।[] মসনূন থেকে বর্ণিত- তিনি বলেছেন, “রাষ্ট্রপ্রধান যদি জানতে পারেন যে, কোন কোন স্থানে অভাব ও প্রয়োজন খুব তীব্র হয়ে দেখা দিয়েছে, তাহলে রাষ্ট্রপ্রধান যাকাতের একটা অংশ অন্যদের জন্যে স্থানান্তরিত করতে পারেন- তা তাঁর জন্যে জায়েয। কেননা অভাব যখন দেখা দেয়, তখন তাকে অভাবমুক্ত এলাকার ওপর অগ্রাধিকার দেয়া- একান্তই কর্তব্য। হাদীস বলছেঃ (আরবী************) ‘একজন মুসলমান অপর মুসলমানের ভাই। সে তাকে বিপদের মুখে ছেড়ে দিতে পারে না, তার ওপর সে জুলুমও করতে পারে না। [আরবী**********] (আরবী**********) গ্রন্থে ইমাম মালিক থেকে উদ্ধৃত হয়েছে, হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা) মিশরে অবস্থানরত হযরত আমর ইবনুল আ’স (রা)- কে মহাদুর্ভিক্ষের বছর লিখে পাঠিয়েছিলেনঃ [(আরবী************) হাকেম তাঁর (আরবী**********) গ্রন্থে এ উক্তিটি (আরবী**********) এর তুলনায় আরও দীর্ঘ আকারে উদ্ধৃত করেছেন এবং বলেছেন, এটি ইমাম মুসলিম আরোপিত শর্তানুযায়ী সহীহ্। যাহবীও তাই বলেছেনঃ (১ম খন্ড, ৪০৫-৪০৬ পৃ.)] হায় হায়, আরবদের জন্যে মহাসংকট! উষ্ট্রের একটি কাফেলা বোঝাই খাদ্য আমার কাছে পাঠাও। তা যেন এত দীর্ঘ হয় যে, তার প্রথমটি আমার কাছে পৌঁছবে যখন, তখন কাতারের শেষ উটটি থাকবে তোমার কাছে। কাপড়ের বস্তায় ছাতু বহন করবে। তা পৌঁছার পর পযরত উমত আরবদের মধ্যে স্বীয় বিবেচনা অনুযায়ী বণ্টন করতে শুরু করলেন। এ কাজের জন্যে কয়েক ব্যক্তিকে তিনি দায়িত্বশীল বানিয়েছিলেন। তাদেরকে তিনি উটের গলার কাছে উপস্থিত থাকতে আদেশ করতেন এবং বলতেন ‘আরবরা উট ভালোবাসবে। আমি ভয় করছি তারা তাকে বাঁচিয়ে রাখবে। অতএব তা যবেহ করা বাঞ্ছনীয় এবং তার গোশত্ ও চর্বি মাখা দরকার এবং যে বস্তায় ছাতু এসেছে তা দিয়ে জোব্বা বানিয়ে পরা আবশ্যক।’ বস্তুত কঠিন দুর্ভিক্ষ ও ব্যাপক অভাব অনটনকালে মুসলিম সমাজ পরস্পরের পরিপোষণ ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বিধানের জন্যে কাজ করে। একজনের এক অঞ্চলের অভাব অপরজন ও অপর অঞ্চল পূরণ করে দিতে এগিয়ে আসে। পরবর্তী কথাও এরই সমর্থক ও পরিপূরক। প্রথম যে শহর বা অঞ্চল বিশাল ইসলামী রাষ্ট্রের অধীন হওয়া সত্ত্বেও সম্পূর্ণরূপে স্বাধীন ও স্বতন্ত্র নয় এবং সমগ্র প্রশাসন হতে যে প্রশাসনিক অঞ্চল সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন নয়, বরং কেন্দ্রীয় সরকারে সূত্রেও সমগ্র মুসলিমের সাথে সম্পর্কযুক্ত- যেমন অংশ ‘সমগ্র’- এর সাথে সংযুক্ত থাকে, ব্যক্তি পরিবার সংস্থার সাথে জড়িত থাকে, অংগগুলো গোটা দেহের সাথে সম্পৃক্ত থাকে। এই একত্ব পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ততা ও একে অপরের দায়িত্বশীলতার শিক্ষাই দেয় ইসলাম এবং তা ফরয করে। কোন অঞ্চল বা শহরকে অন্যান্য ইসলামী দেশসমূহ থেকে- ইসলামের কেন্দ্রীয় রাজধানী থেকে স্বতন্ত্র ও বিচ্ছিন্ন মনে করা যায় না। অতএব দুর্ভিক্ষ, আগুনে জ্বলা বা মাহামারী প্রভৃতি ধরনের কোন বিপদ যদি কোথাও এসে পড়ে, তাহলে সেখানকার জনগণ সাহায্য ও সহযোগিতা পাওয়ার বেশী অধিকারী। যাকাত সংগ্রহের স্থানের লোকদের অপেক্ষা ওদের সাহায্য দান অধিক প্রয়োজনীয়। দ্বিতীয়, যাকাতের অনেক ব্যয়-ক্ষেত্রে রয়েছে। যেমন ইসলামের দিকে লোকদের মন আকৃষ্ট করার ও ইসলামী রাষ্ট্রের সমর্থক বানানোর জন্যে অর্থ ব্যয় করা, সাবীলিল্লাহ্- আল্লাহ্র পথে ব্যয় পর্যায়ে জিহাদ এবং যেসব কাজ ইসলামের পক্ষে আসে, ইসলামের কালেমা বুলন্দ হয়, তার সাহায্য করাও বিশেষভাবে গণ্য হয় আর এ ধরনের সব কাজই রাষ্ট্রপ্রধানের করণীয়, আধুনিক পরিভাষায় বলতে হয়, কেন্দ্রীয় ‘জিহাদ’ পর্যায়ে পরিচালিত করা হয়, তাও তো ব্যক্তির করণীয় হতে পারে না, স্থানীয় প্রতিষ্ঠানেরও করণীয় ব্যাপারি নয়।বরং তাও সর্বতোভাবে সর্বোচ্চ সরকারের দায়িত্ব। এ আলোচনা থেকে একথা স্পষ্ট হল যে, কেন্দ্রয়ী সরকারের একটা নিজস্ব আায়ের উৎস থাকা আবশ্যক, যেখান থেকে সেসব কাজে অর্থ ব্যয় করা সম্ভব হবে, যা সামগ্রিক দৃষ্টিতে ইসলামের কল্যাণ ও মুসলিম জনগণের পক্ষে পরম উপকারী বিবেচিত হবে। অবশ্য তার কাছে যদি এমন সব আয়ের উপায় থাকে, যার দরুন যাকাতের মুখাপিক্ষিতা থাকবে না, তাহলে সে তো ভালই; খুবই উত্তম কথা। অন্যথায় রাষ্ট্রপ্রধানের এ অধিকার থাকতে হবে যে, সে বিভিন্ন অঞ্চল বা প্রদেশ থেকে যাকাতের টাকা নিয়ে নেবে যদ্দারা এ গুরুতর কাজগুলো করা হবে। এ কারণে ইমাম কুরতুবী এ সম্পর্কে কোন আলিমের মত উল্লেখ করেছেন। তা হচ্ছে- ফকীর ও মিসকীনদের জন্যে যাকাতের যে অংশ তা স্থানীয়ভাবে বণ্টন করতে হবে এবং অবশিষ্ট অংশ রাষ্ট্রপ্রধানের ইজতিহাদ অনুযায়ী ব্যয় করার জন্যে কেন্দ্রে স্থানান্তরিত হবে। [আরবী*************] এসব হচ্ছে ইজতিহাদী বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত আর তাতে উপদেষ্টা পরিষদের লোকদের পরামর্শ শামিল হওয়া আবশ্যক। খুলাফায়ে রাশেদুর ঠিক এভাবেই কাজ করতেন। এই কারণে কোন স্থির ও অনড় নীতি নির্ধারণের কাছে নীতি স্বীকার করা যাবে না এবং প্রতি বছরের জন্যে বাধ্যতামূলকভাবে কোন অভিন্ন নীতি ধরে রাখা যেতে পারে না। উমর ইবনে আবদুল আজীজ থেকে যা আমাদের পর্যন্ত বর্ণিত হয়ে এসেছে, তা-ও এ কথারই ব্যাখ্যা দেয়। তিনি তাঁর কর্মচারীদের লিখে পাঠিয়েছিলেন, “তোমরা অর্ধেক পরিমাণ যাকাত- আবূ উবাইদ বলেছেন- যথাস্থানে স্থাপন কর এবং অপর অর্ধেক আমার কাছে পাঠিয়ে দাও।” পরবর্তী বছর আবার লিখে পাঠলেনঃ ‘সব’ যাকাতই যথাস্থানে ব্যয় কর।[আরবী*************] ‘রায়’ থেকে কুফা পর্যন্ত বহন করে নিয়ে যাওয়া যাকাত তিনি পনর্বার ‘রায়’ তে ফেরত পাঠিয়েছিলেন, তা আমরা পূর্বে উল্লেখ করে এসেছি। আমার মনে হয়, এ ব্যাপারে কোন মতদ্বৈততা বা বৈপরীত্য নেই। সামগ্রিক কল্যাণ ও প্রয়োজনের দৃষ্টিতেই তিনি এ কাজ করেছিলেন। এজন্যে ইমাম ইবনে তাইমিয়া বলেছেন, নামায কসর পরিমাণ দূরত্বের যাকাত স্থানান্তরিতকরণ সম্পূর্ণ ও নিশ্চিতরূপে নিষিদ্ধ হওয়ার কোন শরীয়াতী দলিল নেই। তাই শরীয়াতী কল্যাণ দৃষ্টিতে যাকাতও তদনুরূপ অন্যান্য জিনিস স্থানান্তারিত করা সম্পূর্ণ জায়েয। [আরবী*************] তৃতীয় প্রসিদ্ধ ও প্রত্যয়ে পরিণত কথা হচ্ছে, নবী (স) আরবের বিভিন্ন স্থান থেকে মদীনায় যাকাত আনিয়ে নিতেন এবং মদীনায় মহাজির ও আনসারদের মধ্যে তা বণ্টন করে দিতেন। নাসায়ী আবদুল্লাহ্ ইবনে হিলাল সাকাফী বর্ণিত হাদীস উদ্ধৃত করেছেন। তিনি বলেছেন, “এক ব্যক্তি রাসূলে করীম (স)- এর কাছে উপস্থিত হয়ে বললেঃ আমি যাকাতের ছাগী বা ছাগলের বিনিময়ে নিহত হওয়ার অবস্থায় পড়েছিলাম। তখন নবী করীম (স) বললেনঃ যদি তাড মুহাজির দরিদ্রদের দেয়া না হত তাহলে আমি তা গ্রহণ করতাম না।” অনুরূপ পারিবারিক বোঝা বহন প্রসঙ্গে কুবাইচা ইবনুল মুযারিক (রা)- কে বলে নবী করীমের কথাঃ অপেক্ষা কর যতক্ষণ না আমাদের কাছে যাকাতের মাল এসে যায়, তখন হয় আমরা এ ব্যপারে তোমায় সাহয্য করব নতুবা এ বোঝা তোমার ওপর থেকে আমরা তুলে নেব। লোকটি ছিল নজদের অধিবাসী। তাকে হিজাজ থেকে সংগৃহীত যাকাত থেকে দেয়ার কথা রাসূলে করীম (স) চিন্তা করছিলেন এবং তা নজ্দ্বাসীদের কাছ থেকে হিজাজবাসীদের কাছে বহন করে নিয়ে যাওয়ার চিন্তা করছিলেন।[ও] আদী ইবনে হাতেম (রা) তাঁর গোত্রের যাকাত নবী করীম (স)- এর পর হযরত আবূ বকর (রা)- এর কাছে বহন করে নিয়ে গিয়েছিলেন। চারদিকে মুর্তাদ হওয়ার হিড়িকের বছর সম্পর্কেও সেই কথাই সত্য। হযরত উমর (রা) ইবনে আবূ যুবাবকে শুষ্কুতার পর দুর্ভিক্ষের বছর পাঠিয়েছিলেন তখন তিনি তাঁকে বলেছিলেনঃ লোকদের ওপর দুটি বার্ষিক যাকাত বাধ্যতামূলক করে দেবে এবং একবারেরটা সেখানকার লোকদের মধ্যে বণ্টন করে দেবে এবং দ্বিতীয়বারেরটা আমার কাছে নিয়ে আসবে। [আরবী*************] মুয়াযের সেই কথাটিও এরূপ, যা তিনি ইয়েমেনবাসীদের বলেছিলেনঃ তোমরা আমার কাছে নিয়ে আস পাঁচ গজি কাপড় বা পোশাক। আমি তা যাকাতের স্থালে গ্রহণ করব। কেননা তা মদীনায় বসবাসকারী মুহাজিরদের জন্যে খুবই উপকারী ও সুবিধানজনক হবে। [ও] আবূ উবাইদ বলেছেন, এসব জিনিস তখনই স্থানন্তরিত হতে পারে যদি তা স্থানীয় লোকদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত হয় তাদের সচ্ছলতা লাভের পর উদ্ধৃ্ত্ত থাকে। উমর ও মুয়ায সংক্রান্ত বর্ণনা আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি। [ঐ] আমি বলব, স্থনীয় লোকদের নিরংকুশ ও চরম মাত্রায় সচ্ছল হতে হবে, তা আদৌ জরুরী ও বাধ্যতামূলক নয়। সচ্ছলতারও স্তরভেদ রয়েছে। তার কোনটি অপরটি থেকে নিম্মে এবং কোনটি অপরটির তুলনায় উচ্চে। প্রয়োজনও অভিন্ন নয়। তাই কার প্রয়োজন অধিক তীব্র, তা দেখা রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব এবং অবিলম্বে তাকে সাহায্য পৌঁছিয়ে দেয়া কর্তাব্য। যার অবস্থা একটা সময় পর্যন্ত বিলম্ব সইতে পারবে ও ধৈর্য ধারণ সম্ভব হবে, তাকে সাহায্য দেয়ায় বিলম্ব হলে কোন দোষ হবে না। কেননা দ্রুত কল্যাণ সাধনের প্রয়োজন দেখা দিতে পারে কোথাও। কোথাও এমন মারাত্মক বিপদ দেখা দিতে পারে যে, তা বিলম্ব সহ্য করতে পারে না, সেখানে খুব দ্রুত সাহায্য পৌঁছাতে হবে। তবে যাকাতের সবটাই স্থানান্তরিত না করে তার একটা অংশ পাঠিয়ে দেয়া বাঞ্ছনীয়। সমস্তটা স্থানান্তরিত করা যাবে কেবলমাত্র তখন, যখন সে স্থানের লোকেরা পূর্ণাঙ্গ মাত্রায় সচ্ছলতা পেয়ে যাবে। উমর ও মুয়ায (রা) সংক্রান্ত খবরে একথা বলা হয়েছে। অবশ্য একটি সতর্কতামূলক কথা বলা দরকার।শাফেয়ী মাযহাব যাকাত স্থানান্তরিত করার ব্যাপারে সব কয়টি মাযহাবের মধ্যে সর্বাধিক কড়াকড়ি ও কঠোরতা করার পক্ষপাতী হলেও তাঁর এ কাড়াকড়ি হ্রাস করেন যদি যাকাতের মালেক নিজেই তা বণ্টন করে। আসলে রাষ্ট্রপ্রধান ও যাকাত সংগ্রহের কর্মচারী- উভয়েল পক্ষেই যাকাত স্থানান্তরিত করা জায়েয, এটাই সহীহ্ কথা। শাফেয়ী মতের ‘আলী মুহায্যাব’ গ্রন্থের লেখক বলেছেনঃ রাষ্ট্রপ্রধান যাকাত কর্মচারীকে যাকাত বণ্টনের অনুমতি দিলে সে তা বণ্টন করবে। আর বণ্টন করার অনুমতি না দিয়ে থাকলে সে তা বহন করে তার কাছে নিয়ে যাবে। [আরবী*************] ইমাম নববী তাঁর ‘শরাহ্’ গ্রন্থে লিখেছেনঃ জেনে রাখ, উপরিউক্ত বক্তব্য দাবি করে যে, যাকাত স্থানান্তরিত করার অধিকার রাষ্ট্রপ্রধান ও যাকাত কর্মচারীর নিশ্চিতভাবে রায়েছে। আর যাকাত স্থানান্তরিতকরণে যে প্রসিদ্ধ মতভেদ রয়েছে, তা হচ্ছে বিশেষভাবে মালের মালিকের নিজের স্থানান্তরিত করা পর্যায়ে। রাফেয়ী এ কথাটিকে অগ্রাধিকার দিয়ে বলেছেনঃ এই যে কথটিকে তিনি অগ্রধিকার দিয়েছেন, হাদীসসমূহের দৃষ্টিতেও তাই অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য। [ঐ- ১৭৫ পৃ.] বিশেষ প্রয়োজন ও কল্যাণদৃষ্টিতে ব্যক্তিদের যাকাত স্থানান্তরিতকরণ রাষ্ট্রপ্রধানের পক্ষে গণনরাযোগ্য ইসলামী কল্যাণ দৃষ্টিতে ইজতিহাদ করে এক স্থান থেকে অন্যত্র যাকাত নিয়ে যাওয়া যখন জায়েয, যে মুসলিম ব্যক্তির ওপর যাকাত ফরয ধার্য হয়েছে, কোন প্রয়োজন ও গ্রহণযোগ্য কল্যাণ বিচারে যাকাত স্থানান্তরিত করা তার পক্ষেও জায়েয হবে। অবশ্য যদি সে নিজেই স্বীয় ধনমালের যাকাত বণ্টনের দায়িত্ব পালনে অগ্রসর হয়ে আসে। উপরিউক্ত দীর্ঘ আলোচনার তাই ফলশ্রুতি। হানাফীরা স্থানান্তরকরণ পর্যায়ে যেসব দিক বিবেচনার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছেন, সেগুলোও লক্ষণীয়। যেমন নিকটাত্মীয় অভাবগ্রস্তদের কাছে নিয়ে যাওয়া, অধিক অনশন অভাবগ্রস্ত ব্যক্তির জন্যে বহন করে নেয়া, মুসলমানদের জন্যে অধিক কল্যাণকামী ও সাহায্য পাওয়ার বেশী অধিকারী ব্যক্তির কাছে নিয়ে যাওয়া অথবা অপর স্থানে কোন ইসলামী পিরকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়া- যার ফলে মুসলিম জনগণের পক্ষে বিপুল ও বিরাট কল্যাণ সাধিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে- যাকাত যেঙ স্থানে থেকে সংগৃহীত সেখানে অনুরূপ কোন পরিকল্পনা না পাওয়া গেলে-ইত্যাদি ধরনের কার্যক্রম ও কল্যাণকর পদক্ষেপ- তাৎপরতা, যা দ্বীনপন্থী মুসলমানদের হৃদয়কে আশ্বস্ত করতে পারবে, সেই সাথে আল্লাহ্রও সন্তুষ্টি অর্জিত হবে- তা সম্পূর্ণ জায়েয, তাতে কোনই সন্দেহ নেই। পঞ্চম পরিচ্ছেদ যাকাত প্রদানে দ্রুততা ও বিলম্বিতকরণ দ্রুত ও অনতিবিলম্বে যাকাত দিয়ে দেয়া ফরয হানাফী ফিকাহ্বিদদের প্রসিদ্ধ মত হচ্ছে, যাকাত খুব ব্যপকতা সহকারে ফরয হয়। ধন-মালের যে মালিকের ওপর তা ফরয হয়, তা তার কাছে যতক্ষণ দাবি করা না হবে, ততক্ষণ তা দেয়া বিলম্বিত করার পূর্ণ ইখতিয়ার তার রয়েছে। কেননা যাকাত আদায়ের হুকুমটা শর্তহীন তাই দেয়ার জন্যে সময়ের প্রথম ভাগকে অপর অংশ থেকে আলাদা করে নির্দিষ্ট করা যায় না। যেমন এক স্থানের পরিবর্তে অপর স্থনে আদায় করার দির্দেশও দেয়া যায় না। ইমাম আবূবকর আর-রাযীও এ মত গ্রহণ করেছেন। কিন্তু হানাফী ইমামগণের মধ্য থেকে ইমাম আল-কারখী বলেছেন, যাকাত তাৎক্ষণিকভাবে দেয়া ফরয। কেননা ‘আদেশ’ তো তাৎক্ষণিকতার দাবি করে। এমন কি যদি তাৎক্ষণিকতার দাবি না করে, বিলম্বিত করারও দাবি নেই। তাহলে ফিকাহ্ বিশারদ ইবনুল হুম্মাম যেমন বলেছেন- ফকীরকে তা দিয়ে দেয়ার নির্দেশটা তাৎক্ষণিকতার নিদর্শনসম্পন্ন। তা হচ্ছে, নির্দেশ তো তার প্রয়োজন দূর করার উদ্দেশ্যে। আর খুব শীঘ্রতা সম্পন্ন। তা তাৎক্ষণিকাভাবে ফরয না হলে দেয়া ফরয করার উদ্দেশ্যটা পূর্ণমাত্রায় হাসিল হতে পারে না। [আরবী************] এই কথাটি যথার্থ। ইমাম মালিক, শাফেয়ী, আহ্মদ এবং জম্হুর ফিকাহ্বিদগ আলিমগণ এই মত দিয়েছেন। ইবনে কুদামাহ্ যেমন বলেছেন, এটা এজন্যে যে, ‘আদেশ’ তো আসলে তাৎক্ষণিকতার দাবি করে। যেমন ফিকাহ্র মৌল নীতি বলে। এ কারণে বিলম্বকারী আযাব পাওয়ার উপযোগী হয়। এ কারণে তো আল্লাহ্ তা’আলা ইবলিসকে তাঁর দরবার থেকে বহিষ্কার করেছেন, তার ওপর অসন্তুষ্ট ও ক্রুদ্ধ হয়েছেন। সিজদা করার আদেশ হওয়া মাত্র তা পালন করা থেকে বিরত থাকার দরুনই তাকে তিরস্কার করেছিলেন। কেউ যদি তার গোলামকে তাকে পানি খাওয়াবার নির্দেশ দেয় আর তা পালন করতে বিলম্ব করে, সে নিশ্চয়ই শাস্তি পাওয়া যোগ্য হবে। আরও এজন্যে যে, বিলম্ব করা জায়েয হলে তা ফরযের পরিপন্থী হয়ে পড়ে। কেননা ফরয তো তা, যা পালন না করলে আযাব দেয়া হবে। তাই আদেশ পালনে বিলম্ব করা জায়েয হলে উদ্দেশ্য ছাড়া অন্য কাজ করা জায়েয হতে হয়। আর তাহলে তা অমান্য করলে সেজন্যে আযাব দেয়া ন্যায় হয়ে পড়ে। আমরা যদি মেনেও নিই যে, নিঃশর্ত আদেশ তাৎক্ষণিকতার দাবি করে না, তাহলে আমাদের বিষয়টিই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। কেননা এখানে যদি বিলম্বিতকরণ বৈধ করা হয়, তা হলে তার প্রকৃতির দাবি অনুযায়ীই তা বিলম্বিত করা হবে সে ব্যাপারে এই নির্ভরতা সহকারে যে, বিলম্ব করা হলে গুনাহ্ হবে না। তাহলে এর মধ্যে তার মৃত্যু সংঘটিত হলে ফরযটাই অবহেলিত হয়ে থাকবে এ সময় তার ধন-মাল বিনষ্ট হয়ে যেতে পারে বো সে তা পালনে অক্ষম হয়ে পড়তে পারে। আর তাহলে যাকাত পাওয়ার অধিকারী ফকীর-মিসকীন ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে পড়বে। আসলে এখানে তাৎক্ষণিতদার দাবি প্রবল, সেই লক্ষণটা প্রকট। তা হচ্ছে, যাকাত ফরয হয়েছে ফকীর-মিসকীনের অভাব ও প্রয়োজন দূর কারার লক্ষ্যে। আর এ অভাব ও প্রয়োজন তো চলামান, গতিশীল। অতএব ফরয পালনটাও চলমান ও গতিশীল হতে হবে। তা ছাড়া তা একটা বারবার পালনীয় হওয়া ইবাদতও। কাজেই তা পালন করা ততটা বিলম্বিত হওয়া উচিত নয়, যতে করে আবার ফরয হওয়ার সময় উপস্থিত হয়ে পড়তে পারে- যেমন নামায ও রোযা। এসব কথাই প্রযোজ্য তখন, যখন কোনরূপ ক্ষতির আশংকা থাকবে না। মূলত যাকাত দেয়ার ব্যাপারে কোন ক্ষতি বা অসুবিধা হওয়ার আশংকা থাকলে অথবা তার এছাড়া অন্য মাল থেকে থাকলে তা দিতে বিলম্ব করা জায়েয হবে। কেননা নবী করীম (স) বলেছেনঃ (আরবী************) ‘ক্ষতি করাও যাবে না, ক্ষতি স্বীকার করাও যাবে না। [ হাদীসটি আহমাদ ও ইবনে মাজা উদ্ধৃত করেছেন ইবনে আব্বাস (রা) থেকে। ইবনে মাজাহ্ উবাদাতা ইবনুস সামেত থেকেও উদ্ধৃত করেছেন। আর হাকেম ও দারে কুত্নী উদ্ধৃত করেছেন আবূ সায়ীদ থেকে। নবী তাঁর (আরবী*************) গ্রন্থে হাদীসটিকে ‘হাসান’ বলেছেন। বলেছেনঃ মালিক তার ‘মুরসাল’ রূপে এমন সব সূত্র উদ্ধৃত করেছেন, যা পরস্পরকে শক্তিশালী করে। ‘হায়সামী’ হাদীসটির বর্ণনাকরীরা সকলেই সিকাহ্। আর আল-আলায়ী বলেছেন, হাদীসটির সমর্থক ও সাক্ষীস্বরূপ বহু সংখ্যক হাদীস রয়েছে, যার সমষ্টি ‘সহীহ্’ হওয়ার মর্যাদা পায়, অথবা ‘হাসান’ হওয়ায় যাকে দালিলরূপে গ্রহণ করা যেতে পারে। শয়খ আহমাদ শাকের মুসনাদের ২৮৬৭ নম্বরের হাদীসটির সনদ বের করতে গিয়ে বলেছেনঃ হাদীসটির সনদ ‘যয়ীফ’। তার অর্থ, উবাদাতা ইবনে সাবেত বর্ণিত হাদীসটি যা ইবনে মাজাহ্ উদ্ধৃত করেছেন, সে সনদটি সহীহ্ ও প্রমাণিত। ‘ক্ষতি করা’ ও ক্ষতি স্বীকার করার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। ক্ষতি করা হচ্ছে একটি কাজের সূচনা। আর ক্ষতি স্বৎীকার করা হচ্ছে সেই কাজের পরিণতি। প্রথমটি নিঃশর্তভাবে অন্যের সাথে বিপর্যায়কারী মিশিয়ে দেয়া। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে, বিপর্যয়তারীকে তার সাথে মেশানো তার মুকাবিলা বা প্রতিক্রিয়াস্বরূপ। এ হাদীস সম্পর্কে ইবনে রজব প্রণীত (আরবী************) গ্রন্থে বহু কালাম করা হয়েছে। তা দেখুন। মুল্লা কারী প্রণীত (আরবী************) গ্রন্থের ১৮০-১৮৫ পৃষ্ঠায় এবং আল-মুসাভী রচিত (আরবী***********) গ্রন্থের ৬ষ্ঠ খন্ডে ৪৩১-৪৩২ পৃষ্ঠায়ও বিশদ আলোচনা হয়েছে।] আরও যেহেতু কারোর ঋণ শোধ করায় বিলম্ব করা যখন জায়েয উপরিউক্ত কারণে, তখন যাকাত বিলম্বিত করা তো আরও উত্তমভাবে জায়েয হবে। [আরবী***********] ইবাদত পালনে দ্রুততা এবং তা আদায়ের জন্যে সাধারণ অর্থেই খুব তীব্রত কারার জন্যে ইসলাম আহ্বান জানিয়েছে, উৎসাহ যুগিয়েছে। আল্লাহ তা’আলা নিজেই ইরশাদ করেছেনঃ (আরবী************) তোমরা খুব দ্রুততা সহকারে অগ্রসর হয়ে যাবতীয় কল্যাণময় কাজে যোগদান কর। [] তিনি আরও বলেছেনঃ (আরবী***********) এবং দ্রুত দৌড়ে চল তোমাদের কাছ থেকে ক্ষমা ও জান্নাত লাভের জন্যে। [আরবী**************] সর্বপ্রকারের নেক কাজেই এ দ্রুততা ও তরান্বিককরণ যখন খুবই পসন্দনীয় প্রশংসণীয়, তখন যাকাত প্রভৃতি জনগণের অর্থনৈতিক অধিকারসন্পন্ন কাজগুলোতে তা গ্রহণ অধিকতর প্রশংসনীয় হবে, তা খুবই স্বাভাবিক। তাছাড়া লোভ ও মায়া বিজয়ী হয়ে ওঠোর আশংকাও রয়েছে, নফ্সের খায়েশ তার পথে বাধার সৃষ্টি করতেও পারে অথবা বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতা মাঝখানে দাঁড়িয়েও যেতে পারে- এ ভয়টা পুরোপুরি রয়েছে। তাহলে তো ফকীর-মিসকীনের অধিকার বিনষ্ট হতে পারে! এ কারণে আলিমগণ বলেছেন, সকল প্রকার কল্যাণমূলক কাজই খুব তাড়াহুড়া ও দ্রুততা সহকারে করে ফেলা বাঞ্ছনীয়। কেননা বিপদ-আপদ আসতে পারে, কাজের সুযোগ না-ও থাকতে পারে। আর মৃত্যুর ব্যাপারে তো কোন নিরাপত্তাই নেই। কাজেই বিলম্ব করা অপসন্দনীয়, অপ্রশংসনীয়। দ্রুততা ও দায়িত্ব মুক্তর অধিক সহায়কও। প্রয়োজন ও অভাব দূরকারী, ঘৃণ্য অলসতা থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় এবং আল্লাহ্কে সন্তুষ্ট করা ও গুনাহ্ নির্মূলকরণে অধিক কার্যকর। [আরবী**********] হাদীসে উদ্ধৃত হয়েছে- নবী করীম (স) বলেছেনঃ ‘যে ধন-মালে যাকাত মিলে মিশে যায় (তা থেকে আলাদা করা হয় না), তা ধ্বংস করে দেয়।’ শাফেয়ী ও বুখারী তাঁর ‘তারিখ’ গ্রন্থে এবং হুমাইদীও উক্ত হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন। তাতে অতিরিক্ত কথা এটুকু রয়েছেঃ হতে পারে তোমরা মলে যাকাত ফরয হয়েছে। এখন তুমি যদি তা হিসাব করে বের করে না দাও, তাহলে এই হারাম মাল হালাল মালকে ধ্বংস করে ফেলবে। [আরবী**************] আর যাকাত খুব দ্রুততা সহকারে ও অবিলম্বে বের করা যখন খুব প্রশংসনীয় ব্যাপার, তাহলে তার জন্যে সুনির্দিষ্ট ওয়াদার সময় থেকে তাকে আগে নিয়ে আসা ও পিছনে ঠেলে দেয়া এই উভয় কাজই জায়েয হতে পারে?........ যেমন বছন পূর্ণ হওয়া কিংবা ফসল কর্তিত হওয়ার পূর্বেই কি তা আদায় করা জায়েয হবে? এই বিষয়ে ফিকাহ্বিদদের বিভিন্ন মত রয়েছে। একটু পরেই আমরা সে আলোচনায় আসছি। নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বেই যাকাত আদায় করা। যাকাত ফরয যেসব মালে, তা দু’প্রকারের- এক প্রকারের মালে একটি বছর পূর্ণ হওয়ার শর্ত করা হয়েছে। যেমন গৃহপালিত গবাদি পশু নগদ টাকা-পয়সা ও ব্যবসায়ের পণ্য। আর অন্য প্রকারের মলে যাকাত ফরয হওয়ার জন্যে একটি বছন পূর্ণ হওয়ার শর্ত নেই- যেমন কৃষি ফসল ও ফল-ফলাদি। প্রথম প্রকারের মাল সম্পর্কে অধিক সংখ্যক ফিকাহ্বিদ এ মত পোষণ করেন, যে, যাকাত ফরয হওয়ার কারণ যখনই ঘটবে- আর তাহলে পূর্ণ মাত্রায় নিসাব বা নিসাবের পরিমাণ পূর্ণ হওয়া- একটি বছর অতিক্রম হওয়ার পূর্বেই যাকাত দিয়ে দেয়া জায়েয। শুধু তা-ই নয়, দুই কিংবা ততোধিক বছরের যাকাত অগ্রিম দেয়া হলেও তা জায়েয হবে। তবে নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়ার পূর্বে যাকাত দিলে তা জায়েয হবে না। হাসান বসরী, সায়ীদ ইবনে জুবাইর, জুহ্রী, আওযায়ী, আবূ হানীফা, শাফেয়ী আহমদ, ইসহাক, আবূ ইউসুফ প্রমুখ ফিকাহ্ বিশারদ উপরিউক্ত মত পোষণ করেন। [আরবী************] রাবীয়, মালিম ও দাউদ বলেছেন, মালিকানায় একটি বছর পূর্ণ হওয়ার পূর্বে যাকাত দিয়ে দেয়া জায়েয নয়- তা নিসাব পরিমাণের মালিকানা লাভের পূর্বে দেয়া হোক, কি তার পর। [(আরবী***********) ইবনে রুশদ তাঁর (আরবী*************) গ্রন্থে লিখেছেন (১ম খন্ড, ২৬৬পৃ.) এ মতভেদের কারণে তা ইবাদত না মিসকীনদের জন্যে ধার্য হক্- এ নিয়ে মতভেদ। যারা তাকে শুধু ইবদত মনে করেন এবং তাকে নামাযের সাথে তুলনা করেন, তাঁরা যাকাত নির্দিষ্ট সময়ের পূর্ব দেয়া জায়েয মনে করেন না। আর যাঁরা তাকে নির্দিষ্ট সময়ভিত্তিক ধার্য হক্ মনে করেন, তাঁরা নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বে ইচ্ছঅ করে দিলে জায়েয হবে বলে মনে করেছেন। ইমাম শাফেয়ী হযরত আলী বর্ণিত হাদীসকে দলিলণ হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তা হচ্ছে, ‘নবী করীম (স) বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই হযরত আব্বাসের যাকাত নিয়ে নিয়েছিলেন।’] কোন কোন মালিকী মাযহাবপন্থী আলিম বলেছেন, নির্দিষ্ট সময়ের অল্প পূর্ব যাকাত দিয়ে দিলে তা জায়েয হবে। তবে তা নগদ সম্পদের, আবর্তনশীল ব্যবসায়ী পণ্যের বিক্রয় থেকে লব্ধ ফেরত পাওয়ার আশা পূর্ণ ঋণ (লোকদের কাছে পাওনা)- নিজের করা ঋণ নয়, ইত্যাদির হতে হবে। যে সব গবাদি পশুর জন্যে চেষ্টা যত্ন নিতে হয় না, তাও এর মধ্যে গণ্য। এসবের যাকাত অগ্রিমভাবে দেয়া যাবে, যদিও অগ্রিম দেয়া মাকরূহ। কৃষি ফসল ও ফলের মওজুদ করা ব্যবসায় পণ্য আবর্তনশীল ঋণ ইত্যাদির যাকাত অগ্রিমভাবে আদায় করা যায় না। অনুরূপভাবে যে সবের জন্যে আদায়কারী নিযুক্ত হয়েছে- যদি যাকাতের কর্মকর্তা ছাড়াই এক বছর পূর্ণ হওয়ার পূর্বে যাকাত দিয়ে দেয়, তাও আদায় হবে না। কিন্তু যদি যাকাতের জন্যে নিযুক্ত কর্মীকে এক বছর পূর্ণ হওয়ার কিছু সময় পূর্ব দেয়া হয়, তাহলে সে যাকাত আদায় হবে। এ‘কিছু সময়’ বলতে কি বোঝায়- যে সময়ের পূর্ব দিলে যাকাত হবে তা নির্ধারণে ফিকাহ্বিদগণ একদিন দুদিন হতে শুরু করে এক মাস দুমাস পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ের কথা বলেছেন। আরন নির্ভরযোগ্য হচ্ছে এক মাস কাল। তাই তার অধিক সময় পূর্ব দিলে আদায় হবে না। আগে ভাগে যাকাত দেয়া কোনরূপ ‘কেরাহিয়াত’ ছাড়াই জায়েয হবে যদি যাকাত সংগ্রহের স্থান থেকে অধিকতর তীব্র প্রযোজনক্লিষ্ট কোন ফকীরকে দেয়ার জন্যে স্থানান্তরিত করা হয়, যেন বছর শেষ হওয়া কালেই তা পাওয়ার যোগ্য লোককে দেয়া সম্ভব হয়। বরঞ্চ এরূপ আগে দেয়া তো ফরযও হয়ে পড়ে, যেমন মলিকী মযহাবের কেউ কেউ বলেছেন। এমন কি যাকাত যদি বিনষ্ট হয়ে যায় কিংবা আগে দেয়ার ফলে তা নিঃশেষ হয়ে যায়, তাহলেও তা আদায় হবে এবং তার ক্ষতিপূর্ণ দিতে হবে না। কেননা এ যাকাত তো যথাস্থানে নিয়ে দেয়া হয়েছে। এ সময়টাও ঠিক তা ফরয হওয়ার সময়রূপেও নির্ধারিত হল। তখন অবশিষ্ট সময়ের যাকাত বের করা তার পক্ষে জরুরী নয়। কিন্তু পূর্বোক্ত ধরনে যদি সময়ের আগে যাকাত দেয়া হয়, তাহলে অবশিষ্ট সময়ের জন্যে যাকাত দিতে হবে যদি মালিকানা নিসাব পরিমাণ হয়। [দেখুনঃ (আরবী****************)] যাঁরা জায়েয বলেন না তাঁদের দলিল যাঁরা অগ্রিম যাকাত দেয়া জায়েয বলেন না, তাঁদের দলিল হচ্ছে, যাকাত ফরয হওয়ার দুটি শর্তঃ একটি নিসাব পূর্ণ হওয়া আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে মালিকানার একটি বছর পূর্ণ হওয়া। কাজেই একটি পূর্তির পূর্বে তা দেয়া জায়েয হবে না, যেমন সর্বসম্মতভাবে জায়েয হবে না নিসাব পরিমাণের মালিকানা হওয়ার পূর্বে দিলে। কেননা শরীয়াত যাকাতের জন্যে একটি সময় নির্দিষ্ট করে দিয়েছে আর তা হচ্ছে একটি বৎসর পূর্তি হওয়া। তাই তার পূর্বে অগ্রিম দেয়া জায়েয হবে না, যেমন নামায সময় হওয়ার আগে পড়লে নামায হবে না। [আরবী***************] যাঁরা জায়েয বলেন তাঁদের দলিল যাঁরা অগ্রিম যাকাত দেয়া জায়েয বলেছেন, তাঁদের দলিল হচ্ছে- আবূ দাউদ প্রমুখ উদ্ধৃত ও হযরত আলী (রা) থেকে বর্ণিত হাদীস। তা হচ্ছে হযরত আব্বাস (রা) রাসূলে করীম (স)- এর কাছে এক বছর পূর্তির পূর্বে অগ্রিম যাকাত দেয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি তাঁকে সেজন্যে ‘রুখসত’ (অনুমতি) দিয়েছিলেন। [হাদীসটি নাসায়ী ছাড়া অবশিষ্ট পাঁচখানি সহীহ্ গ্রন্থে উদ্ধৃত হয়েছে। হাকেম, দারে কুত্নী ও বায়হাকী উদ্ধৃত করেছেন। দারে কুত্নী ও আবূ দাউদ বলেছেন, হাদীসটি ‘মুরসাল’। অপরাপর বহু হাদীস এটিকে শক্তিশালী বানিয়েছে। দেখুনঃ (আরবী**************)] এ হাদীসটির সনদ সম্পর্কে কথা উঠেছে বটে; তবে বায়হাকী হযরত আলী (রা) থেকে যে বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন, তা এর পক্ষে সাক্ষ্য দিচ্ছে। তা হচ্ছে, নবী করীম (স) হযরত উমর (রা)- কে যাকাতের জন্যে পাঠালেন। পরে বলা হল, উবনে জামীল, খালেদ উবনুল অলীদ ও নবী করীম (স)- এর চাচা আব্বাস (রা) তা দিতে অস্বীকার করেছেন। তখন নবী করীম (স) খালেদ ও আব্বাসের মর্যাদা রক্ষা করলেন। তখন তিনি যা বলেছিলেন, তার মধ্যে এই কথাটিও ছিলঃ ‘আমরা খুব ঠেকায় পড়েছিলাম। পরে আব্বাস থেকে আমরা দুই বছরের যাকাত অগ্রিম নিয়ে নিরেছি। [আরবী************) আবূ দাউদ তায়ালিসী আবূ রাফে’র এই হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন, নবী করীম (স) উমর (রা)- কে বললেনঃ ‘আরমা আব্বাসের মালের যাকাত প্রথম বছর অগ্রিম নিয়েছিলাম। (আরবী*************)] সহীহ্ বুখারী গ্রন্থেও এই কিস্সাটি আবূ হুরায়রা (রা) বর্ণিত হাদীসে এসেছে। তাতে এ কথা আছে, ‘আব্বাসের ব্যাপার হচ্ছে তাঁর যাকাত আমার কাছে এবং অনুরূপ আরও যাকাত সেই সাথে।’ পরে বললেনঃ হে উমর! তুমি কি জানো না এক ব্যক্তির চাচা তার পিতার মূল- শাখা বিশেষ হয়ে থাকে।’ [ঐ- এ কিস্সা সহীহ্ মুসলিমের রয়েছে।] আবূ উবাইদ বলেছেন, (আরবী**************) এ বর্ণনার সারকথা হচ্ছে, তাঁর কাছ থেকে দুই বছরের যাকাত অগ্রিম নেয়া হয়েছিল- সে বছরের এবং তার পূর্বের বছরের। [শাওকানী বলেছেন, তার অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত তাৎপর্য হচ্ছে, নবী করীম (স) যদি হযরত আব্বাসের ওপর ধার্য যাকাত নিজের ওপর নিয়ে নেন এজন্যে যে, তিনি দিতে অস্বীকার করেছেন, তাহলে অনুরূপ আরও এক বছরে দায়িত্ব নিতে পারেন কোনরূপ বাড়তি ছাড়া। দ্বিতীয়ত দিতে অস্বীকার করার কথা মনে করলে হযরত আব্বাসের প্রতি খারাপ ধারণা করা হবে। (আরবী**************)] চিন্তাবিবেচনা ও কিয়াসের ভিত্তিতে তাঁর এ দলিল পেশ করেছেন যে, এই অগ্রিম গ্রহণ এমন মালের যাকাত যা ফরয হওয়ার কারণ পাওয়া গেছে তা ফরয হওয়ার পূর্বেই। আর তা জায়েয। যেমন ঋণ আদায় করার নির্দিষ্ট পূর্বেই তা আগেভাগে দিয়ে দেয়, যেমন কসম খাওয়ার পর কসমের কাফ্ফারা আদায় করা তা ভংগ করার পূর্বেই। কাউকে জখম করার পর তার প্রাণ বের হওয়ার পূর্বেই হত্যার কাফ্ফারা দিয়ে দেয়া ইমাম মারিকের মতে জায়েয। [আরবী**************] তাঁদের এই কথা, বছর পূর্তি হওয়া যাকাতের দুটি শর্তের অন্যতম। অতএব তা জায়েয নয়- যেমন নিসাব এই কথা সমর্থনযোগ্য নয়। কেননা নিসাব পরিমাণের মালিক হওয়ার পূর্বে অগ্রিম যাকাত দেয়া কারণ ঘটার পূর্বেই কার্যকে আগাম করার সমতুল্য। ফলে তা সমমের পূর্বে কাফ্ফারা দেয়া ও আহত করার পর হত্যার কাফ্ফারা দেয়ার মতই হয়ে যায়। তখন অবস্থা হয়, যেনস দুটি শর্ত পূরণ হওয়ার পূর্বে তা অগ্রিম দেয়া হয়েছে। আর প্রথমোক্ত অবস্থায় একটি শর্তের হওয়ার অর্থাৎ বছর পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই দিয়ে দেয়া- এ দুটি কখনও এক ও অভিন্ন নয়। [আরবী***************] ‘যাকাতের জন্যে একটি সময় নির্দিষ্ট আছি’- এ কথার জবাবে আমরা তা- ই বলব, যা ইমাম খাত্তাবী বলেছেন। আর তা হচ্ছে, কোন জিনিসে যদি সময় প্রবেশ করে মানুষের প্রতি সদয়তাস্বরূপ হয়ে, তাহলে সে তার অধিকারে অনুমতি নিতেও পারে এবং তার প্রতি হৃদ্যতা পরিহারও করতে পারে। যেমন, কারোর বিলম্বিত অধিকার তাড়াতাড়ি দিয়ে দিল, যেমন কোন অনুপস্থিত ব্যক্তির যাকাত কেউ আদায় করে দিল, যদিও তার প্রতি তা ফরয হওয়ার দৃঢ় প্রত্যায় অর্জিত হয়নি। কেননা হতে পারে, সেই মাল সেই সময়ে সংগৃহীত হয়েছে। [আরবী*************] তবে নামায ও রোযা নিছক ইবাদত ছাড়া আর কিছু নয়্ তার জন্যে যে সময় নির্দিষ্ট করা হয়েছে, তার তাৎপর্য বোঝার অপেক্ষা রাখে না। তা শরীয়াত আরোপিত দায়িত্ব, একটা কাজের পরীক্ষা। অতএব তা ঠিক সেভাবেই আদায় করা যেতে পারে মাত্র। যদি কেউ তার মালিকানাভুক্ত নিসাবের যাকাত অগ্রিম দিয়ে দেয়- যা তার কাছে উৎপন্ন হবে তা থেকে কিংবা তাতে তার যে মুনাফা হবে তা থেকে, তাহলে কোনরূপ বৃদ্ধি ছাড়াই নিসাব থেকে তা আদায় হয়ে যাবে ইমাম শাফেয়ী ও আহমাদের মতে। কেননা সে অগ্রিম যাকাত দিয়েছে এমন মালের যা তার মালিকানায় নেই। এ কারণে তা জায়েয হবে না। ইমাম আবূ হানীফার মতে তা আদায় হবে। কেননা সে যে জিনিসের মালিক, তা তার অধীন। অতএব তা তারই মর্যাদা পাবে। [আরবী***************] মালের দ্বিতীয় প্রকার হচ্ছে সে সব যাতে যাকাত ফরয হওয়ার জন্যে এক বছর অতিবাহিত হওয়ার শর্ত থাকে না। যেমন কৃষি ফসল, ফল, খনিজ সম্পদ, রিকাজ ইত্যাদি। এসবে যাকাত অগ্রিম দেয়া জায়েয নয়। তবে শাফেয়ী মাযহাবের কেউ কেউ ওশর অগ্রিম দেয়া জায়েয বলেছেন। কিন্তু অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত মত হচ্ছে, তা- ও জায়েয নয়। কেননা ‘ওশর’ ফরয হয় একটি মাত্র কারণে। তা হচ্ছে ফসল পাওয়া- হস্তগত হওয়া, দানা হাতে আসা। তা যদি অগ্রিম দেয়া হয়, তাহলে ফরয হওয়ার করণ দেখা দেয়ার পূর্বেই তা দেয়া হবে। এজন্যে তা জায়েয বা আদায় হবে না। যেমন নিসাব পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই যদি কেউ যাকাত দেয়, তাহলে তা হয় না। [দেখুন (আরবী***************)] হাম্বলী মাযহাবের কেউ কেউ অগ্রিম ‘ওশর’ দেয়ার ব্যাপারে শর্ত আরোপ করেছেন যে, তা হতে হবে পাছ বড় হওয়ার ও খেজুরের ছাড়া বের হয়ে আসা- প্রভৃতির পর। অগ্রিম দেয়ার কোন নির্দিষ্ট সীমা আছে কি যাকাত অগ্রিম দেয়া যখন জায়েয, তখন তার জন্যে কয় বছরের সীমা নির্দিষ্ট করা হয়েছে কিংবা কোন সীমা ছাড়াই তা জায়েয? হানাফী ও অন্যান্য ফিকাহ্বিদগণ বলেছেন, মালিক যে- কয় বছরের ইচ্ছা অগ্রিম যাকাত দিতে পারে, সেজন্যে কোন সীমা নেই। এমন কি তাঁর এতদূর বলেছেন, কারোর যদি তিনশ’ দিরহাম সম্পদের মালিকানা থাকে আর তা থেকে সে ভবিষ্যতের বিশ বছেরের যাকাত বাবদ একশত দিরহাম দিয়ে দেয়, তাহলেও তা জায়েয হবে। কেননা ‘কারণ’ এখানে পাওয়া গেছে। তা হল নিসাব পরিমাণ ক্রমবর্ধনশীল সম্পদের মালিকানা। ওশর এরকম নয়। তা গাছ বেড়ে ওঠা ও ফল বের হওয়ার পূর্বে অগ্রিম দেয়া জায়েয হবে না। এমন কি- চারা করা ও গাছ বপনেরও পূর্বে! কেননা ওশর ফরয হওয়ার কারণটাই এখানে অনুপস্থিতি। যেমন নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিকানার পূর্বেই অগ্রিম যাকাত দেয়া জায়েয নয়। [আরবী**************] এ কারণে অগ্রিম না দেয়া ও যথাসময়ে যাকাত বের করাই উত্তম ও অধিক ভাল। তাহলে সর্বপ্রকারের মতদ্বৈততা থেকে বাঁচা যাবে এবং সেই সাথে রাষ্ট্রর বার্ষিক আর্থিক আয়ও সুসংহত ও সুসংবদ্ধ থাকবে। অবশ্য অগ্রিম দেয়ার বা নেয়ার কোন প্রয়োজনই যদি দেখা দেয় তা হলে তা স্বতন্ত্র কথা। যেমন বায়তুলমালের আয় ফরয জিহাদ পালনের জন্যে বৃদ্ধি করার প্রয়োজন দেখা দিলে অথবা দরিদ্রদের অভাব পূরণের তাৎক্ষিণিক ব্যবস্থা নিতে হলে সমস্ত ধন-মালের বা কতিপয়ের যাকাত অগ্রিম নেয়া যবে, যেমন স্বয়ং নবী করীম (স) তাঁর চাচা হযরত আব্বাসের কাছ থেকে নিয়েছিলেন। তবে অগ্রিম বা পূর্বের যাকাত দুই বছরের অধিক সময়ের নেয়া উচিত নয়। তাহলে অন্ততঃ মূল দলিলের ওপর শক্তভাবে আমল করা হবে। যাকাত বিলম্বিত করা কি জায়েয প্রয়োজন বা কোন কল্যাণ- দৃষ্টিতে অগ্রিম যাকাত নেয়ার বিষয়ে আমরা বিশদ আলোচনা করেছি এবং জয়েয বলেছি। তাই তা ফরয হওয়ার সময় থেকে বিলম্বিত করা বা দেরী করে যাকাত দেয়াটা কোন বিশেষ কারণ ছাড়া জায়েয হতে পারে না। কোন গুরুত্বপূর্ণ কল্যাণ- দৃষ্টির দাবি অনুযায়ী যাকাত প্রদান বিলম্বিত করা হলে তা স্বতন্ত্র কথা। যেমন কোন অনুপস্থিত ফকীরকে দেয়ার উদ্দেশ্য- যার প্রয়োজন উপস্থিত অন্যান্য ফকীরের তুলনায় অনেক বেশী মনে হবে- বিলম্বিত করা হলে জায়েয হবে। অনুরূপভাবে তা কোন অভাবগ্রস্ত নিকটাত্মীয়কে দেয়ার জন্যে বিলম্বিত করাও জায়েয। কেননা তার অধিকারটা অত্যন্ত তাগিদপূর্ণ এবং তাতে কয়েক গুণ বেশী সওয়াবও রয়েছে। উপস্থিত আর্থিক ওযরের কারণে যাকাত দিতে দেরী করা যেতে পারে। যেমন যদি মালিকের নিজেরই যাকাত সম্পদের প্রতি অধিক প্রয়োজন দেখা দেয়, তাহলে তা যদি ব্যয় করে এবং তা তার ওপর ঋণ হয়ে চাপে, তবে তাতে খুব বেশী দোষ হবে না। অবশ্য তার সুযোগ- সুবিধা হওয়ার প্রথম ভাগেই তা আদায় করে দেয়া তার কর্তব্য হবে। শমসুদ্দীন রমলী বলেছেন, অধিকতর অভাবগ্রস্ত, অধিক কল্যাণকর বা নিকটবর্তী কিংবা প্রতিবেশীর অপেক্ষায় যাকাত প্রদানে বিলম্ব করায় যাকাতদাতার অধিকার রয়েছে। কেননা এই বিলম্বকরণটা স্পষ্ট উদ্দেশের জন্যে, আর তা মর্যদা। অনুরূপভাবে উপস্থিত লোকদের অধিকার লাভের বিবেচনায় বিলম্ব করা যাবে। তবে এই বিলম্বকরণে যদি যাকাতের মাল ধ্বংসপ্রাপ্ত বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে তার ক্ষত্পিূর্ণ দিতে হবে। এজন্যে যে তার খুব বেশী সম্ভাবনা রয়েছে। সে তো নিজের গরজে বিলম্বিত করেছে। এ কারণে তার বৈধতা জিনিসটির নিরাপত্তার শর্তাধীন করে দেয়ার প্রয়োজন আছে। অপর পক্ষে বিলম্বিত করায় উপস্থিত ফকীর যদি না খেয়ে থাকার দারুনস ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে এ বিলম্বকরণ সম্পূর্ণ হারাম হবে। কেননা তার ক্ষতি কোনক্রমেই জায়েয হতে পারে না। [আরবী**************] কোন প্রয়োজনে যাকাত প্রদান বিলম্বিত করা জায়েয হওয়ার ইবনে কুদামহ্ শর্ত আরোপ করেছেন যে, তা খুব সামান্য জিনিস হতে হবে। যদি পরিমাণ বিপুল হয়, তাহলে তা জায়েয হবে না। তিনি ইমাম আহমাদের এ কথা উদ্ধৃত করেছেন, ‘কারোর নিকটাত্মীয়দের মধ্যে যাকাত প্রতি মাসে দেয়া হয় না অর্থাৎ তা দিতে এতটা বিলম্ব করা যাবে না যে, তা মাসিক হিসেবে প্রতি মাসে কিছু কিছু করে বিচ্ছিন্নভাবে দেয়ার পদ্ধতি গ্রহণ করা হবে। যদি অগ্রিম দেয়া হয়, তাহলে তাদের বা অন্যদের দেবে- বিচ্ছিন্নভাবেও দেয়া যাবে, এক সঙ্গে সবও দিয়ে দেয়া যাবে। কেননা সে তা তার জন্যে নির্দিষ্ট সময় থেকে বিলম্বিত করেনি। অনুরূপভাবে যদি কারো নিকট দুই প্রকারের মাল থাকে অথবা বহু মাল থাকে, কিন্তু তার যাকাত একই হয়। আর তার বছর হয় বিভিন্ন তারিখে- যেমন কারো কাছে নিসাব রয়েছে অথচ বছরের মধ্যেই সে অনুরূপ মাল অর্জন করল যা নিসাব পরিমাণের কম, তাহলে এসবের যাকাত একত্রিত করা ও একসাথে দেয়ার উদ্দেশ্যে বিলম্ব করা জায়েয হবে না। কেননা এ একত্রিতকরণ এভাবেও হতে পারে যে, বছরের মাঝখানে পাওয়া সম্পদের যাকাত অপর মালের ওপর যাকাত ধার্য হওয়ার শুরুতে দিয়ে দেবে। [আরবী*************] মালিকী মাযহাবের কেউ কেউ এ কথাটির ব্যাখ্যা এই দিয়েছেন যে, যাকাত তাৎক্ষণিকভাবে বণ্টন করাই ওয়াজিব। মালের মালিকরে কাছে তা অবশিষ্ট থাকা এবং পাওয়ার যোগ্য- লোক তার কাছে যখনই আসবে তখন তা প্রদান করা বছরের দীর্ঘ মেয়াদের মধ্যে- এ নীতি জায়েয নয়।[আরবী*************] রাষ্ট্রপ্রধান কিংবা তাঁর দায়ীত্বশীল বেতনভূক্ত প্রতিনিধির পক্ষে যাকাত সম্পদ একত্রিত ও সংগৃহীতকরণে বিশেষ কোন কল্যাণ বিবেচনায় বিলম্বিত করা জায়েয। সে কল্যাণ বিবেচনা এ হতে পারে যে, মালের মালিক কোন দুর্ভিক্ষের মধ্যে পড়ে গেছে, মাল ও ফল- ফসল বিনষ্ট হয়েছে এই সব। ইমাম আহমাদ এটাকে জায়েয বলেছেন হযরত উমর (রা)- এর হাদীসকে দলিলরূপে গ্রহণ করে। তারা এক বছর খুব বেশী ঠেকায় পড়ে গিয়েছিল। হযরত উমর (রা) সেই বছর তাদের কাছ থেকে যাকাত নেন নি। নিয়েছেন পরবর্তী বছর। [দেখুন (আরবী*************)] আবূ উবাইদ ইবনে আবূ যুবাবের সূত্রে উল্লেখ করেছেনঃ হযরত উমর (রা) শুষ্কতা ও দুর্ভিক্ষের বছর যাকাত সংগ্রহের কাজ বিলম্বিত করেছিরেন। পরে যখন লোকেরা বৃষ্টিপাতের দরুন নতুন জীবন ফিরে পেল, তখন আমাকে পাঠালেন। বলে দিলেন, লোকদের কাছ থেকে দুইবারের যাকাত আদায় করবে। তার একবারেরটা সেখানকার লোকদের মধ্যেই বণ্টন করে দেবে আর অপরটা আমার কাছে নিয়ে আসবে। [আরবী****************] এটা ছিল হযরত উমর (রা)- এর ফিলাফত পরিচালনার নীতি এবং এ যে অতীব উত্তম ও মানব কল্যাণকর, তা নিঃসন্দেহে। জনসাধারণের প্রতি ছিল তাঁর অগাধ স্নেহ ও মমত্ববোধ। এ কারণে দুর্ভিক্ষের বছর বিপন্ন লোকদের কাছ থেকে যাকাত গ্রহণকে বিলম্বিত করেছিলেন। ঠিক যেমন তিনি চোরের হাত কাটার দন্ডও এ বছর মওকুফ রেখেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, (আরবী************) ‘দুর্ভিক্ষের বছর চোরের হাত কাটা চলবে না।’ যাকাত অগ্রিম দেয়া পর্যায়ে হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছে, হযরত আব্বাস (রা)- এর যাকাত বিলম্বিতকরণের ওযর বলতে গিয়ে নবী করীম (স) বলেছিলেনঃ এ যাকাত তো তাঁর ওপর আছে এবং তার সাথ অনুরূপ আরও একটি। আবূ উবাইদ বলেছেনঃ আল্লাহ্ই প্রকৃত ব্যাপার জানেন, তবে আমি মনে করি, নবী করীম (স) হযরত আব্বাসের বিশষ কোন প্রয়োজন দেখা দেয়ায় তাঁর যাকাত বিলম্বিত করে দিয়েছিলেন। আর রাষ্ট্রপ্রধানের বিশেষ বিবেচনায় এরূপ করার ইখতিয়ার রয়েছে। অবশ্য পরে তা নিয়ে নেবে। [আরবী**************] বিনা প্রয়োজনে যাকাত প্রদান বিলম্বিত করা কোনরূপ ‘ওযর’ বা কোন প্রয়োজন ছাড়াই যাকাত প্রদান বিলম্বিত করা জায়েয নেই। তা করলে সে গুনাহ্গার হবে। তার পরিণতি তাকেই ভোগ করতে হবে। কেননা একথা স্পষ্টভাবে প্রামণিত যে, যাকাত তাৎক্ষণিকভাবে প্রদান করা ফরয। শাফেয়ী মতের (আরবী************) গ্রন্থে প্রণেতা এ পর্যায়ে লিখেছেন, ‘যার’ ওপর যাকাত ফরয হয়েছে, তার পক্ষে তা প্রদানে বিলম্ব করা জায়েয নয়। কেননা তা এমন একটা হক- অধিকার, যা কোন ব্যক্তি পর্যন্ত পৌঁছানো ফরয। তাকে দিয়ে দেয়ার দাবি তো প্রবল হয়ে আছে। আতএব বিলম্ব করা জায়েয হতে পারে না। যেমন কারো কোন আমানতের জিনিস তার মালিক যখনই চাইবে, অবিলম্বে দিয়ে দিতে হবে। যদি দিতে বিলম্ব করে- দিতে সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও, তাহলে তাকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। কেননা সে একটা ফরয কাজকে বিলম্বিত করেছে যথাসময়ে দেয়ার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও। আতএব ক্ষতিপূরণ দান অনিবার্য- আমানতের মতই। [আরবী***************] হানাফীদের গ্রন্থাবলীতে লিখিত আছে, কোনরূপ প্রয়োজন ব্যতীতই যাকাত প্রদান বিলম্বিত করার অপরাধ এত বড় যে, তা যে করবে তার সাক্ষ্য কবুল করা যাবে না, তার গুনাহ্ হবে- মেন আল-করখী প্রমুখ এ কথা স্পষ্ট করে বলেছেন। আর তা ঠিক সেই কথাই যার উল্লেখ ইমাম আবূ জাফর তাহাভী করেছেন আবূ হানীফা (র) থেকে। কথাটি হচ্ছে, তিনি তা মাকরূপ মনে করেন। মাকরূপ তাহরীমীই মনে করতে হবে যখন শুধু ‘কিরাহিয়াত’ বলা হবে। আমাদের তিনজন ইমাম থেকে একথা প্রমাণিত হয়েছে, তাৎক্ষণিকভাবে এবং ইমাম মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান। তাঁরা বলেছেন, বাহ্যত তো এ কথাই সত্য যে, যাকাত প্রদানে বিলম্ব করলে- সে বিলম্ব একদিন বা দুইদিন বা যত কম সময়ের জন্যেই হোক- গুনাহগার হবে। কেননা তারা ‘তাৎক্ষণিক বলতে বুঝেছেন সম্ভাব্য সময়ের প্রথম মুহূর্ত। বলা যায়, লক্ষ্য হচ্ছে, পরবর্তী বছর পর্যন্ত যেন ঠেলে নিয়ে যাওয়া না হয়। কেননা (আরবী**************) গ্রন্থ থেকে (আরবী*************) গ্রন্থে উদ্ধৃত করা হয়েছে যে, যাকাত সময়মত না দেয়া অবস্থায় যদি দুটি বছর অতিবাহিত হয়ে যায়, তাহলে খুবই খারাপ হবে ও গুনাহ হবে। [আরবী****************] আমার মতে মাযহাবের ফিকাহ্বিদগণের যে মত জানা গেছে, তার বাহ্যিক অর্থ যা, তা থেকে অন্যথা করা উচিত নয়। তা একদিন বা দুই বা কয়েক দিনের উপেক্ষা বা অবহেলা হলেও একটা সম্ভব ব্যাপার, সহজতা বিধঅন ও অসুবিধা দূর করণের নিয়মে তা হতে পারে। কিন্তু এক মাস বা দুই মাস- কি ততোধিক সময়ের উপেক্ষা- এক বছরের কম সময় পর্যন্ত- যেমন (আরবী**************) গ্রন্থের উদ্ধৃতি থেকে বোঝা যায়, তা গণ্য করা ঠিক হবে না, মানুষ যেন তাৎক্ষণিকভাবে দেয় ফরযের কথা ভুলে না যায়, তা দেখতে হবে। যাকাত দেয়ার পর তা বিনষ্ট হয়ে গেলে অনেক সময় এমনও ঘটে যে, মালের মালিক যাকাত বের করে দিয়েছে, তারপর কোন কারণে তা বিনষ্ট হয়ে গেল। হয় চুরি হল, জ্বলে গেল, কিংবা এ ধরনের অন্য কিছু ঘটল। তখন কি হবে, এ ব্যাপারে ফিকাহ্বিদদের মত বিভিন্ন। ইবনে রুশ্দ তা খুব সুন্দরভাবে ও সংক্ষিপ্তরূপে পেশ করেছেন। বলেছেনঃ ‘যাকাত দিয়ে দেয়ার পর যদি তা নষ্ট বা ধ্বংস হয়ে যায়, তাহলে কি হবে?- কিছু লোক বলেছেন, তাতেই যাকাত আদায় হয়ে যাবে। অপর কিছু লোক বলেছেন, প্রদান স্থানে ধ্বংস বা বিনষ্ট হরে তার ক্ষতিপূরণ তাকেই করতে হবে, যতক্ষণ না তার যথাস্থানে তা স্থপিত হয়। অপর লোকরা দুই অবস্থার মধ্যে পার্থক্য করেছেন। হয় তা দিয়েছে তা দেয়া সম্ভব হওয়ার পর নতুবা তা দিয়েছে ফরয ও সম্ভব হওয়ার প্রথম সুযোগেই। কেউ কেউ বলেছেন, ফরয ও সম্ভব ও সম্ভব হওয়ার কিছু দিন পর যদি তা বের করে থাকে। তাহলে উক্ত অবস্থায় তার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। আর যদি তা দিয়ে থাকে প্রথম ফরয হওয়ার কালেই এবং তাতে দাতার কোন ক্রটি না হয়, তাহলে উক্ত অবস্থায় তাকে কোন ক্ষতিপূরণ দিতে হবে না। ইমাম মালিকের প্রসিদ্ধ মত এটাই। অন্য লোকেরা বলেছেন, দাতার ক্রটি ধরা পড়লে ক্ষতিপূরণ তাকে দিতে হবে। আর তার কোন ক্রটি না হলে সে অবশিষ্টের যাকাত দেবে। আবূ সওর ও শাফেয়ী এ মত দিয়েছেন। অন্যারা বলেছেন, বরং সব কিছু থেকে যা যাবার তা যাওয়ার পর মিসকীনরা মালের মালিক অবশিষ্ট সম্পদে দুটনই শরীক গণ্য হবে মালের মালিকর অংশ থেকে তাদরে দুজনের অংশ অনুপাতে। যেমন দুই শরীক- সম্মিলিত মালের কিছু অংশ নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে সে অনুপাতে তারা দু’জনই ক্ষতিপূরণে শরীক হয়- এ- ও তেমনি। আলোচ্য বিষয়ে মোটামুটি পাঁচটি মত পাওয়া গেলঃ ১. একটি মতঃ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে না নিঃশর্তভাবে, ২. একটি মতঃ ক্ষতিপূরন দিতে হবে নিঃশর্তভাবে, ৩. একটি মতঃ দাতার কোন ক্রটি হলে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, ক্রটি না হলে নয়। ৪. একটি মতঃ ক্রটি হলে ক্ষতিপূরণ দেবে, নতুবা অবশিষ্টের যাকাত দেবে, ৫. একটি মতঃ (পঞ্চম০ অবশিষ্টের মধ্যে ইভয়ই অংশীদার হবে। [আরবী************] যাকাত ফরয হওয়ার পর ও প্রদানের পূর্বে মাল ধ্বংস হলে ইবনে রুশ্দে অপর একটি বিষয়েরও উত্থাপন করেছেন। তা হচ্ছে, যাকাত ফরয হওয়ার পর এবঙ তা প্রদানের পূর্বে তা ধ্বংস হয়ে গেলে কি হবে? বলেছেন, ফরয হওয়ার পর ও প্রদানে সক্ষম হওয়ার পূর্বে কিছু অংশ মাল যদি চলে যায়, তাহলে কিছু সংখ্যক ফিকাহ্বিদ বলেছেন, যা অবশিষ্ট আছে তা থেকে যাকাত দেবে। অপর লোকেরা বলেছেন, তখন মিসকীনরা ও মালের মালিক দুই শরীকের অবস্থায় এসে যাবে, উভয়ের অংশ থেকে কিছু কিছু বাদ যাবে। বিষয় দুটিতে মতপার্থক্যের কারণ ইবনে রুশ্দ বলেছেন, এ পর্যায়ে ফিকাহ্হিদদের মতপার্থক্য হওয়ার কারণ হচ্ছে, যাকাতকে ঋণের মত মনে করা অর্থাৎ অধিকারটা সম্পর্কিত হবে দায়িত্বের সাথে, মূল মালের সাথে সম্পর্কিত হয়, মাল যার হাতে তার দায়িত্বের সাথে নয়। যেমন আমানতরক্ষাক লোক প্রভৃতি। যাকাতদাতাদেরকে যারা আমানতদাতাদের ন্যায় মনে করেছে, তাঁরা বলেছেন, যখন যাকাত বের করে দিল, তারপর তা ধ্বংস হয়ে গেলে সেজন্যে তার ওপর কিছুই বর্তাবে না। আর যাঁরা তাদেরকে ঋণগ্রস্তদের মত মনে করেছেন তাঁরা বলেছেন তারা ক্ষতিপূরণ করতে বাধ্য হবে। আর যাঁরা ক্রটি হওয়া ও ক্রটি না হওয়ার মধ্যে পার্থক্য করেছেন, তাঁরা তাদেরকে সবদিক দিয়েই আমানতদারদের মত মনে করেছেন। কননা আমানতদারের ক্রটি হলে সে ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য থাকে। আর যিনি বলেছেন, ক্রটি না হয়ে থাকলে অবশিষ্টের যাকাত দেবে, তিনি তাকে মনে করেছেন সেই লোক যার যাকাত বের করার পর কিছু মাল নষ্ট হয়ে গেছে, সে সেই লোকের মত যার কিছু মাল নষ্ট হয়ে গেছে যাকাত ফরয হওয়ার পর। যেমন কারো ওপর যাকাত ফরয হল, সে তো শুধু যে মাল মজুদ আছে তার যাকাত দেবে। এখানেও তাই। তার যে মাল এখানে বর্তমানে আছে, কেবল সে মালেরই যাকাত দেবে। এরূপ মতপার্থক্যের কারণ হচ্ছে সম্পদের মালিককে ঋণগ্রস্ত ও আমানতদার এবং শরীক ও ফরয হওয়ার পূর্বেই যার মাল ধ্বংস হয়ে গেছে- এ দুয়ের সাথে তুলনা আবর্তিত হওয়া। আর যখন যাকাত ফরয হবে এবং তা প্রদানে সক্ষম হবে, কিন্তু তা সত্ত্বেও সে তা প্রদান করল না- এর মধ্যে কিছু মাল চলে গেল- এ অবস্থায় আমার বিশ্বাস, সব ফিকাহ্বিদই এ ব্যাপারে একমত যে, মালের মালিক ক্ষতিপূরণ দেবে। তবে পবাদি পশুর ক্ষেত্রে মনে করেছে যে, তাতে যাকাতে ফরয হওয়াটা সম্পূর্ণতা পায় এক বছর অতীত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যদি যাকাত আদায়কারী যাকাত নেয়ার জন্যে উপস্থিত হয়্ এ হচ্ছে ইমাম মালিকের মায্হাব। [(আরবী*************) দেখুনঃ (আরবী**************)] আগে-পরে হলে কি যাকাত রহিত হবে কোন বিশেষ ওযরের দরুন কিংবা ওযর ছাড়াই যদি যাকাত প্রদান বিলম্বিত করে, অতঃপর এ অবস্থায় একটি কিংবা কয়েকটি বছর অতিবাহিত হয়ে যায়, কিন্তু তা আদায় করা হয় না, তা পাওয়ার যোগ্য লোকদেরকে তা প্রদান করা হয় না, এভাবে কয়েকটি বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেলে কি যাকাত রহিত হয়ে যাবে? জবাব” আসলে যাকাত একটা অধিকার, আল্লাহ্ তা’আলা তা ফকীর মিসকীন ও অন্যান্য পাওয়ার যোগ্য লোকর জন্যে এ অধিকার নির্দিষ্ট ও ফরয করেন দিয়েছেন। এ হিসেবে যাকাত কোন অবস্থায়ই রহিত না হওয়া স্বাভাবিক। কেননা তা ফরয ধার্য হয়েছে, তা প্রদান করা বাধ্যতামূলক হয়েছে, তা প্রদানে এক বছন বিলম্ব হোক, কি তার অধিক কাল। কিছু কালের অতিক্রমণে প্রমাণিত হক্ বা অধিকার কখনই রহিত হতে পারে না। ইমাম নববী এ পর্যায়ে বলেছেন, যাকাতদাতার যদি অনেক কয়টি বছর অতিক্রান্ত হয়ে যায় এবং এর মধ্যে যাকাত প্রদান না করে, তাহলেও এ সব কয়টি বছরের যাকাত প্রদান করা তার জন্যে বাধ্যতামূলক- সে যাকাত ফরয হওয়ার কথা জানুক আর নাই জানুক। অনুরূপভাবে সে দারুল ইসলামে বসবাসকারী হোক, কি দারুল হরবে। এটা আমাদের মাযহাব। ইবনুল মুন্যির বলেছেন, বিদ্রোহীরা যদি কোন দেশ-শহর-স্থঅন দখল করে নেয় এবয় সেখানকার ধনী লোকেরা যদি ক্রমাগত কয়েক বছরের যাকাত প্রদানে অক্ষম হয়ে থাকে আর তারপর মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধান তথায় বিজয়ী হয়ে পুনর্দখলে সক্ষম হয়, তা হলে এ অতীত বছরগুলোর যাকাত তখন নিয়ে নিতে হবে। ইমাম মালিক, শাফেয়ী ও আবূ সত্তর এ মত প্রকাশ করেছেন। কিয়াসের পক্ষপাতী ফিকাহ্বিদগণ বলেছেন, অতীত বছরগুলোর যাকাত তাদের দিতে হবে না। তাঁরা এ-ও বলেছেন, দারুল হরবে কিছু লোক যদি ইসলাম কবুল করে এবয় তথায় কয়েক বছর অবস্থান করে, পরে দারুল ইসলামে চলে আসে, তাহলে এই অতীত বছরগুলোর কোন যাকাত তাদের দিতে হবে না। [আরবী************] আবূ মুহাম্মাদ ইবনে হাজম বলেন, [আরবী**********], যে লোকের ধন-মালে দুই বা ততোধিক বছরের যাকাত অদেয় অবস্থায় জমা হয়ে থাকল অথচ সে জীবিত আছে, তা সবই প্রত্যেকটি বছরের জন্যে সেই সংখ্যানুপাতে প্রদান করতে হবে যা প্রত্যেক বছর তার ওপর ফরয হয়েছে। তা তার ধান-মালসহ পালিয়ে যাওয়ার দরুন হয়ে থাক অথবা সরকার নিয়োজিত যাকাত আদায়কারীর বিলম্বে পৌঁছার কারণ হোক কিংবা তার অজ্ঞতা বা অন্য যে কোন কারণেই হোক এবং তা সে মূল নগদ সম্পদে, কৃষি ফসলে গবাদি পশুর ক্ষেত্রে হোক অথবা যাকাত তার সমস্ত মালের ওপর ধার্য হোক কিংবা না-ই হোক তার মাল থেকে যাকাত নিয়ে নেয়ার পর সে মালের দিকে ফিরে আসুক যার পওর যাকাত ধার্য হয়নি, কি ফিরে না আসুক- এই অবস্থাসমূহের মধ্যে কোন পার্থাক্য হবে না। ঋণদাতারা কিছুই নিতে পারবে না যতক্ষণ না যাকাত পুরোমাত্রায় আদায় হয়ে যায়। [এ মতটি সহীহ্ কথার ওপর ভিত্তিশীল। যাকাত তো সম্পদের মালিকের দায়িত্বভুক্ত হয়ে যায়, মূল মালের মধ্যে শামিল থাকে না। যখন কারো দায়ীত্ব তা ফরয হয়ে গেল, তারপর তার মালের ওপর দিয়ে যদি দুটি বছর অতিক্রান্ত হয়ে যায়- তার যাকাত দেয়া না হয়, তাহলে এ অতীত বছরগুলোর যাকাত প্রদান করা তার কর্তব্য হবে। দ্বিতীয়ং বছর গিয়ে তার যাকাতের পরিমাণ একবিন্দু কমে যাবে না। অনুরূপ যদি নিসাবের পরিমাণের অপেক্ষা বেশী হয়ে যায়, তাতেও যাকাত হ্রাস পাবে না, যদিও তার ওপর কয়েকটি বছর অতিবাহিত হয়ে যায় অতএব তার কাছে চল্লিশটি ছাগল থাকলে- তার ওপর কয়েকটি বছর অতিবাহিত হয়ে যায়; কিন্তু যাকাত আদায় না করে, তা হলে তার ওপর তিনটি ছাগী ফরয হবে। যদ একশ’টি দীনার থাকে, তাকে সাড়ে সাত দীনার দিতে হবে। কেননা যাকাত তার দায়ীত্বে ফরয হয়ে গেছে, তাই নিসাব হ্রাস পেলে তার কোন প্রভাব হবে না। কিন্তু তার যদি অন্য মাল না থাকে, তা হলে তা থেকেই যাকাত দেবে, সে পরিমাণ যাকাত হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। কেননা ঋণ তো যাকাত ফরয হওয়ার প্রতিবন্ধক। দেখুনঃ (আরবী*************)] সরকার ধার্যকৃত কর যদিও আগে- পিছে হওয়ার ও বহু বছর অতিবাহিত হওয়ার দরুন আইনের নির্ধারণ অনুযায়ী কমবেশী রহিত হয়ে যায়, কিন্তু যাকাত একটা ঋণরূপেই মুসলিম ব্যক্তির গলায় ঝুলে থাকবে, তার দায়িত্বমুক্তি হবে না, তার ইসলাম যথার্থ হবে না, তার ঈমানকে সত্য ও সঠিক মনে করা যাবে না- তা আদায় না করা পর্যন্ত, মাঝখানেস যতটি বছরই অনাদায় অবস্থায় অতিবাহিত হোক না কেন। মৃত্যুতে কি যাকাত রহিত হয় জমহুর ফিকাহ্বিদগণ এ মত দিয়েছেন যে, ধনের মালিকের মৃত্যুতে যাকাত রহিত হয়ে যায় না, বরং তার পরিত্যক্ত সম্পদ থেকে সে যাকাত আদায় করে দিতে হবে- যদি তার অসীয়ত সে নাও করে যায়। এটা আতা, হাসান, জুহরী, কাতাদাহ ও ইমাম মালিকের মত। [ মালিকী মাযহাবের গ্রন্থাবলীতে লিখিত হয়েছে” যাকাত কখনও বের করা হয় মূলধন থেকে, কখনও এক-তৃতীয়াংশ সম্পদ থেকে অর্থাৎ কৃতের পরিত্যক্ত সম্পদ থেকে। সে যদি অসীয়ত করে যায়, তাহলে এক- তৃতীয়াংশ থেকে দেয়া হবে। আর যদি যাকাতের বছর পূর্তির অঙ্গিকার করে এবং তা দেয়ার অসীয়ত করে যায়, মূলধন থেকে দিতে হবে। (আরবী**********) গ্রন্থে মালিকের মৃত্যুর বছর- সে যদি তা দিয়ে যেতে না পারে, তাহলে তার মূলধন থেকে দেযা হবে, কেননা তা সুনির্দিষ্ট। দেখুন (আরবী*************)] শাফেয়ী, [ নববী বলেছেন, যাকাত ফরয হয়ে যাওয়ার পর তা আদায় করতে সক্ষম হয়েও যদি তা না দিয়েই মরে যায়, তাহলে তার মৃত্যুর দারুন- আমাদের মতে- যাকাত রহিত হয়ে যাবে না। বরং তার মাল থেকে তা আদায় করে দেয়া কর্তব্য হবে। এটা আমাদের মত। দেখুনঃ (আরবীঁ***********)] ইসহাক, আবূ আহ্মাদ, সত্তর ও ইবনুল মুনযিরও [আরবী**************] এ মত দিয়েছেন। জায়দীয়া মাযহাবও তাই বলে। [আরবী*************] আওযায়ী ও লাইস বলেছেন, অন্যান্য অসীয়ত পূরণের আগেই এক- তৃতীয়াংশ সম্পদ- সম্পত্তি থেকে তা নেয়া হবে। কিন্তু সে যাকাত আদায় করতে গিয়ে এক- তৃতীয়াংশ পরিমাণ ছাড়িয়ে যাওয়া চলবে না। ইবনে সীরীন, শবী, নখয়ী, হাম্মাদ ইবনে সুলায়মান, সওরী প্রমুখ বলেছেন, মৃত্যুর পূর্বে অসীয়ত করে না গেলে তা আদায় করা যাবে না, অসীয়ত করে গিয়ে থাকলে দেয়া যাবে। আবূ হানীফা ও তাঁর সঙ্গিগণ এ মত দিয়েছেন, যার ওপর যাকাত ফরয হয়েছে তার মৃত্যুতে যাকাত রহিত হয়ে যাবে, তবে অসীয়ত করে গিয়ে থাকলে তা দিতে হবে এবং তা দেয়া হবে তার পরিত্যক্ত সম্পওির এক-তৃতীয়াংশ থেকে। যাদের জন্যে অসীয়ত করে গেছে, তারা তো তার ওপর ভিড় জমাবে। আর যদি অসীয়ত করে না যায়, তাহলে তা রহিত হয়ে যাবে। উওরাধিকারীরা তা দিতে বাধ্য হবে না। যদি দেয় তবে তা হবে নফল দান। কেননা যাকাত ইবাদত হলেও তা আদায় করায় নিয়তের শর্ত রয়েছে। তাই যে মরে গেছে তার ওপর ধার্য যাকাত রহিত হয়ে যাবে- নামায ও রোযার মত। [ইমাম আবী হানীফার এ কথা স্বর্ণ ও রৌপ্য সম্পর্কে। কিন্তু কৃষি ফসল ও গবাদি পশুর পর্যায়ে তাঁর কাছ থেকে বিভিন্ন বর্ণনা পাওয়া গেছে- মৃত্যুর পর তা রহিত হয়ে যায় কিংবা তা নিয়ে নেয়া হবে এ বিষয়ে। দেখুনঃ (আরবী**************)] তার অর্থঃ হানাফীরা বলেন, যাকাত না দিয়ে মরলে সে গুনাহগার হয়ে মরল। তার মৃত্যুর পর তার ওপর থেকে তা রহিকরণের আর কোন উপায়ই নেই- যেমন নামায- রোযা তরককারী। এজন্যে কোন কোন হানাফী আলিম বলেছেন, ‘যাকাত বিলম্বিত করলে এ সময় সে যদি রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে, তাহলে উওরাধিকারীদের থেকে লুকিয়ে তা আদায় করে দিতে হবে। [ এ কথা (আরবী************) গ্রন্থে (আরবী**************) থেকে উদ্ধৃত করা হয়েছে।] প্রথমোক্ত কথা বা মতই সবদিক দিয়ে সহীহ্। কেননা- ইবনে কুদামাহ, যেমন বলেছেন- যাকাত হচ্ছে হক,- অধিকার, অবশ্য পালনীয়। সে বিষয়ে অসীয়ত সহীহ্ হয়। কাজেই মৃত্যুর দারুন তা রহিত হতে পারে না- যার ওপর তা ফরয, তার ওপর থেকে। যেমন অন্য কারো ঋণ পাওনা। তা একটা আর্থিক অবশ্য দেয় অধিকার বিশেষ। অতএব যার ওপর তা ফরয, তার মৃত্যুতে তা রহিত হবে না। এটা ঋণের মতই নামায রোযা থেকে তা ভিন্ন রকমের। কেননা এ দুটি দৈহিক ইবাদত। এ দুটির ব্যাপারে কোন অসীয়ত চলে না। প্রতিনিধিত্বও করা যায় না। [আরবী************] তবে একটি সহীহ্ হাদীসে বলা হয়েছে, ‘যে মরে গেল তার ওপর রোযা পালনের দায়িত্ব রয়েছে এরূপ অবস্থায়, তাহলে তার পক্ষ থেকে তার অভিভাবক রোযা পালন করবে।’ অথচ রোযা একটা ব্যক্তিগত দৈহিক ইবাদত বিশেষ। এক্ষেত্রে হাদীস অনুযায়ী মৃত্যুর পর প্রতিনিধিত্ব চলে বলে দেখা যায়। বুঝতে হবে, এটা মহান আল্লাহ্র একটা অনুগ্রহ ও দয়া ছাড়া আর কিছুই নয়। রোযার যদি এটা সম্ভব তাহলে যাকাতের ক্ষেত্রে তো অধিক উত্তমভাবে সম্ভব হওয়া উচিত। কেননা তা একটা আর্থিক অধিকারের ব্যাপার যেমন পূর্বে বলেছি। যাকাতের ঋণ অপরাপর ঋণের তুলনায় শাফেয়ী মাযহাবের গ্রন্থ (আরবী*************)- এর লেখক [আরবী**************] বলেছেনঃ ‘যার ওপর যাকাত ফরয হয়েছে এবং সে তা আদায় করতে সক্ষম হয়েও তা প্রদান না করেই মরে গেল, তার এ যাকাত তার পরিত্যক্ত সম্পওি থেকে প্রদান করা ওয়াজিব। কেননা তা একটা আর্থিক অধিকার যা তার জীবদ্দশায়ই তার ওপর বাধ্যতামূলকভাবে চেপে বসেছে। তার মৃত্যুর দরুন তা রহিত হয়ে যেতে পারে না- অন্য লোকের প্রাপ্য ঋণের মতই। যদি অদেয় যাকাত ও অন্য লোকের প্রাপ্য ঋণ একত্রিত হয়; কিন্তু পরিত্যক্ত সম্পদ- সম্পত্তি যা আছে তা থেকে উভয়টি দিয়ে দেয়া সংকুলান না হয়, তাহলে তা কি করা যাবে এ পর্যায়ে তিনটি মত পাওয়া গেছেঃ একটি প্রথমে লোকের ঋণ শোধ করতে হবে। কেননা তার ভিওি অত্যান্ত কঠোর ও তাগিদের ওপর সংস্থাপিত। আল্লাহ্র হক্ তার তুলনায় অনেক হালকা ও অগুরুত্ব সম্পন্ন। দ্বিতীয়, যাকাত সবার আগে দিয়ে দিতে হবে। কেননা নবী করীম (স) হজ্জ প্রসঙ্গে বলেছেনঃ ‘আল্লাহ্র ঋণ সর্বাধিক অধিকারী যে, তা আদায় করা হবে। [বুখারী ও মুসলিম গ্রন্থদ্বয়ে হাদীসটি উদ্ধৃত ইবনে আব্বাসের এবং রোযা সম্পর্কে।] এবং তৃতীয়, উভয়ের মধ্যে ত্যক্ত সম্পত্তি-সম্পদ ভাগ করা হবে। কেননা দিয়ে দেযার বাধ্যবাধকতার দিক দিয়ে উভয়ই সমান গুরুত্বপূর্ণ, অতএব উভয়ই আদায় হতে হবে সমান গুরুত্ব সহকারে। যাকাতকে অপরাপর মানুষের প্রাপ্য ঋণের ওপর অগ্রধিকার দেয়ার মতটি জাহিরী মতের লোকদের। আবূ মুহাম্মাদ ইবনে হাজম এ মতটিকে অধিক সহায়তা করেছেন। কুরআন ও সুন্নাহ্ থেকে সহীহ্ দলিলসমূহ পেশ করে মতটিকে অধিকতর শক্তিশালী করে তুলেছেন। বলেছেন, ‘যদি সে লোক মরে যায় যার ওপর যাকাত ফরয হয়েছে এক বা দুই বছর ধরে তাহলে তা তার মূলধনে গণ্য হয়ে গেছে। তার সাথে মিলে-মিশে স্থিতি পেয়ে গেছে। সে তা নিজে স্বীকার করবে অথাব তার ওপর অকাট্য প্রশাণ আনা হবে। তার সন্তানরা তা উওরাধিকারসূত্রে পেয়ে যাবে অথবা ‘কালালা’ হবে। [‘কালালা’ বলা হয় সে ব্যক্তিকে যার ওয়ারিশ হয় তার পিতামাতা ও সন্তানাদি ছাড়া অন্য কেউ।] পাওনাদার, অসীয়ত যাদের জন্যে করা হয়েছে এবং উওরাধিকারী লোকেরা কেউ কোন অধিকারই পাবে না যতক্ষণ সম্পূর্ণ যাকাত পুরামাত্রায় আদায় করে নেয়া না হবে- তা সেই আসল জিনিস, গবাদি পশু ও কৃষি ফসল যে থেকেই নেয়া হোক না কেন, তাতে কোন পার্থক্য হবে না। ইবনে হাজম হানাফী প্রমুখদের সমালোচনা করেছেন। যাঁরাই বলেছেন যে, মালের মালিকের মৃত্যুতে তার ওপর ফরয হওয়া যাকাত রহিত হয়ে যাবে। ইবনে হাজমের মতে তাঁরা খুব মারাত্মক ধরনের ভুল করেছেন। কেননা তাঁরা এক ব্যক্তির জীবদ্দশায় তার ওপর ফরযরূপে ধার্য হওয়া আল্লাহ্র ঋণ সে ব্যক্তির মৃত্যুর দরুন তার ওপর থেকে রহিত বলে ঘোষণঅ করেছেন কোনরূপ দলিল-প্রমাণ ছাড়াই। বড় জোর তাঁরা শুধু এতুটুকুই বলেছেন যে, যদি তাই হত, তাহলে তার পরিত্যক্ত সম্পওির একবিন্দু পরিমাণেরও কেউ উওরাধিকারী না হোক, তাই হত প্রত্যেকটি মানুষের কাম্য। বলেছেন, প্রশ্ন করেছেন, যে লোক অন্য লোকদের ধন-মাল খুব বেশী ধ্বংস করে এ উদ্দেশ্যে যে, তা তার ওপর ঋণ হয়ে চাপবে এবং তার মৃত্যুর পর উওরাধিকারীরা কেউ কিছু পাবে না, সে সম্পর্কে তোমরা কি বলবে? সে ঋণগুলো যদি ইয়াহুদী বা খৃষ্টানদের প্রাপ্য হয় তাদের জন্যে খরচ করা মদের কারণে, তাহলেও তাই হবে? তাহলে কে বলবে যে, এ সবই তার মূলধন থেকে দিতে হবে, তার উওরাধিকারীরা কিছু পেল আর না-ই পেল? তাহলে তহারা তাদের সঙ্গে করে দিল যা তিনি ফকীর- মিসকীন মুসলমানদের জন্যে নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন-ঋণগ্রস্ত, দাসত্বশৃংখলে বন্দী, আল্লাহ্র পথে ও নিঃস্ব পথিকের জন্যেও। তা নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে আল্লাহ্র কাছ থেকে ধার্য করা ফরযস্বরূপ অথচ তারা লোকদের পাওনাটা ফেরত দেয়া ওয়াজিব করে দিয়েছেন এবং উওলাধিকারীদেরকে হারাম খাওয়াবার ব্যবস্থা করেছেন? এ সবই খুব আশ্চর্যের বিষয়, তাঁরা ইচ্ছাপূর্বক নামায তরককারীর জন্যে নামায ফরয মনে করেছেন তার জন্যে নির্দিষ্ট সময় চলে যাওয়ার পর! কিন্তু ইচ্ছাপূর্বক যাকাত প্রদান থেকে বিরত থাকা লোকদের ওপর থেকে তা প্রত্যাহার করলেন তার জন্যে নির্দিষ্ট সময়ে সে তা আদায় করেনি বলে! আবূ মাহাম্মাদ বলেছেন, ‘আমাদের কথা যে সহীহ্ এবং বিরুদ্ধবাদীদের বক্তব্য যে বাতিল, তা মহান আল্লাহ্র উওরাধিকারী আইন সংক্রান্ত আয়াত স্পষ্ট করে দিচ্ছে। আয়াতে বলা হয়েছেঃ [আরবী**************] অসীয়ত যা করা হয় তা কিংবা ঋণ আদায় করার পরই। [আরবী*************] এ আয়াতে আল্লাহ্ তা‘আলঅ সর্বপ্রকারের ঋণকে এ পর্যায়ে সাধারণভাবে গণ্য করেছেন। যাকাতও আল্লাহ্র জন্যে নির্দিষ্ট একটা ঋণ। সেই সাথে তা মিসকীন, ফকীর, ঋণগ্রস্ত ও অন্যান্য সবার জন্যে- যাদের কথা যাকাতের আয়াতে বলে দেয়া হয়েছে। পরে ইবনে হাজম তাঁর সনদে সেই হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন যা মুসলিম তাঁর সহীহ্ গ্রন্থে উদ্ধৃত করেছেন। সায়ীদ ইবনে জুবাইর, মুজাহিদ ও আতা অযরত ইবনে আব্বাস (রা) থেকে এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেনঃ এক ব্যক্তি রাসূলে করীম (স)- এর কাছে এসে বললঃ ‘আমার মা মরে গেছে, তার ওপর এক মাসের রোযা অপালিত হয়ে আছে। আমি কি তা তার পক্ষ থেকে ‘কাজা’ স্বরূপ আদায় করব? নবী করীম (স) বললেন, তোমার ‘মা’র ওপর যদি ঋণ থাকত, তাহলে তুমি কি তা আদায় করতে? বলল, ‘হ্যা’। বললেন, ‘তাহলে আল্লাহ্র ঋণ তো বেশী অধিকারী এ দিক দিয়ে যে, তা আদায় করা হবে।’ ইবনে আব্বাস থেকে অপর বর্ণনায়- ইবনে জুবাইর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, নবী করীম (স) বলেছেনঃ ‘তাহলে তোমরা সকলে আল্লাহ্র পাওনা পূরণ কর, কেননা তা পূরণ হওয়ার বেশী অধিকারী।’ বলেছেন, আতা, সায়ীদ ইবনে জুবাইর, মুজাহিদ- এঁরা উক্ত হাদীসটি হযরত ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন। এ সকলকে পিছনে ফেলে রেখে ওঁরা নিজেদের মতের ভিত্তিতে বলেছেন যে, আল্লাহ্র পাওনাটা রহিত হয়ে যাবে। আর মানুষের পাওনাটা প্রত্যর্পিত হওয়ার বেশ অধিকারী হবে- মানুষের পাওনা পূরণ বেশী গুরুত্বপূর্ণ। [আরবী****************] ঝগড়া- বিতর্কে ইবনে হাজম ব্যবহৃত রূঢ় তীব্র কটাক্ষ ভাষা ও ভঙ্গী থেকে [কোন কোন লোক মনে করেন, ইবনে হাজম অপরাপর মাযহাব ও তার অনুসারীদের বিরোধিতায় এত চরম মাত্রার কঠোরতা ও তীব্রতার পন্থা গ্রহণ করেন যে, তাঁর মহামূল্য ও জ্ঞানগর্ভ আলোচনা থেকে আমরা কোন উপকার পাই না। এ পর্যায়ে আমাদের বক্তব্য হচ্ছে ইবনে হাজম সম্পর্কিত এ কথটি আমরা স্বীকার করি না। বরং তিনি যে সব উচ্চমানের চিন্তা-বিবেচনাপূর্ণ কথা উপস্থাপন করেন, তা আমাদের অবশ্যই অনুধাবন করতে চেষ্টা করতে হবে। তীব্রতা-রূঢ়তা যা আছে তা তাঁর ওপর থাক। প্রত্যেক ব্যক্তি তাঁর নিয়ত অনুযায়ীই ফল পাবেন। তার হিসাব-নিকাশ গ্রহণ তো আল্লাহ্র কাজ। আরে এ তো জানা কথা যে, সব মানুষই তার কথাবার্তার দরুনও পাকড়াও হবে। নিষ্কৃতি পাবেন কেবল নবী করীম (স)।] দৃষ্টি ফিরিয়ে কুরআন ও সুন্নাহ্ থেকে যেসব দলিল তিনি পেশ করেছেন, কেবল তাই যদি বিবেচনা করি, তাহলে তাকীদ সহকারে এ কথা আমাদের সম্মুখে প্রতিভাত হয়ে ওঠে যে, যাকাত একটা মৌলিক ও সুপ্রতিষ্ঠিত সত্য, আগে পরে হলেই বা কারোর মৃত্যুতে তা রহিত হয়ে যায় না, পরিত্যক্ত সম্পদ-সম্পওি থেকেও তা অবশ্যই নেয়া হবে এবং অন্য সর্বপ্রকারের পাওনার ওপর তা অগ্রাধিকার ও গুরুত্ব পাবে। অন্যান্য ঋণের স্থান তার পরে হবে। এভাবেই ইসলাম আধুনিক অর্থনৈতিক বিধান রচনার ক্ষেত্রেও অগ্রবার্তী অবদান রাখতে পেরেছে। আধুনিক অর্থনীতি ও সরকারের আর্থিক অধিকার অপরাপর ঋণও অধিকারের ওপর স্থান দিয়েছে। সেগুলো সব পরে বিবেচিত হতে পারে। [আরবী***************] যাকাত প্রদান পর্যায়ে বিভিন্ন-বিক্ষিপ্ত আলোচনা যপাকাত রহিত করার উদ্দেশ্যে কৌশল অবলম্বন যাকাত এড়িয়ে যাওয়ার বা তা প্রদান থেকে পালিয়ে বেড়ানো কি জায়েয? অন্য কথায়, যার ওপর যাকাত ফরয হয়েছে, তার ওপর থেকে তা রহিতকরণের উদ্দেশ্যে কোন কৌশল অবলম্বন করা কি জায়েয? ফিকাহ্বিদদের বিভিন্ন মত ইবনে তাইমিয়া (আরবী*****************) গ্রন্থে লিখেছেনঃ আবূ হানীফা যাকাত রহিত করানোর উদ্দেশ্যে কৌশল অবলম্বন করা জায়েয মনে করেন। বলেছেনঃ তবে তাঁর সঙ্গীরা ভিন্ন মত পোষণ করেন- এরূপ করা মাক্রূপ, কি মাক্রূহ্ নয়? ইমাম মাহাম্মাদ মনে করেন, ইমাম আবূ ইউসুফ মাক্রূহ্ মনে করেন না। বলেছেন, যাকাত প্রত্যাহার করানোর লক্ষ্যে কৌশল অবলম্বন করাকে ইমাম মালিক হারাম বলেছেন। এরূপ কৌশল সত্ত্বেও তা ফরযই থাকবে। ইমাম শাফেয়ী যাকাত রহিত করানোর উদ্দেশ্যে কৌশল অবলম্বন করা মাক্রূহ কলেছেন। কিন্তু ইমাম আহ্মদ এ কৌশল অবলম্বন পর্যায়ে ইমাম মালিকের মতই কথা বলেছেন। অর্থাৎ যাকাত রহিত করানোর জন্যে কৌশল করাকে তিনিও ‘হারাম’ বলেছেন। কৌশল সত্ত্বেও তা ফরযই থাকবে। সূরা নূন [জান্নাতবাসীদের কিস্সার কথা মনে করা হয়েছে। ইবনে কুদামাহ্র বর্ণনায় তা এরটু পরই আসেছে।] ও অন্যান্য দলিল প্রমাণ [আরবী***************] থেকেও তা-ই প্রমাণিত হয়। ইমাম আবূ ইউসূফ সম্পর্কে ইবনে তাইমিয়া যা লিখেছেন, তা আবূ ইউসুফের নিজ রচিত ‘কিতাবুল খারাজ’- এ স্পষ্ট ভাষায় বলা কথার বিপরীত। তিনি তাতে অকাট্য ভাষায় বলেছেনঃ ‘যে লোক আল্লাহ্ ও পরকালের প্রতি ঈমান রাখে, তার পক্ষে যাকাত দিতে অস্বীকার করা বা অপ্রস্তুত হওয়া এবং তা নিজের মালিক না থেকে সমষ্টির মালিকানয় বণ্টন করা জন্যে না দেয়া- যেন তার থেকে যাকাত রহিত হয়ে যায় এমন কারোর ওপরই যাকাত ফরয হবে না- হালাল হতে পারে না। কোন কারণ বা অবস্থার দারুন যাকাত রহিত করার কৌশলও কেউ করতে পারে না। [আরবী***************] উপরিউক্ত কালাম স্পষ্ট এবং অকাট্যভাবে প্রমাণ করছে যে, ইমাম আবূ ইউসূফ যাকাত রহিতকরণ এবং কোন কারণ বা অবস্থার দরুন তা প্রত্যাহার করানোকে সম্পূর্ণ হারাম মনে করেন। ইমাম ইবনে তাইমিয়া যা বলেছেন এবং আবূ ইউসুফ সম্পর্কে যে কথা খুব ছড়িয়ে পড়েছে, তা হচ্ছেঃ কৌশল বিচারে কার্যকর হবে, যদিও ঈমানকারীর দিক দিয়ে তা জায়েয নয়। হানাফী ফিকাহ্র কিতাবসমূহে স্পষ্টভবে যা বলা হয়েছে, তা হচ্ছেঃ কোন কোন কৌশল মাকরূহ্ এবং কোন কোনটা মাক্রূহ্ নয়। তাঁরা আরও বলেছেন, যাকাতকে সম্পদ মলিকের অভাবগ্রস্ত পিতামাতার দিকে ফেরাবার জন্যে কৌশল করা- এভাবে যে, তা এক ফকীরকে দিয়ে দেয়া হবে, সে ফকীর তা মূল মালিকের পিতামাতাকে দেবে- মাকরূহ্। তাঁদের বেশীর ভাগ কিতাবেই এ কথাটি আলোচিত হয়েছে। আর তাঁরাই যখন বলেছেন, যাকাত মসজিদ নির্মাণে ব্যয় করা যাবে না, মৃতের কাফন খরিদ করায় ব্যয় করা যাবে না, তা দিয়ে ঋণ শোধ করা যাবে না- ইত্যাদি বলেছেন, ওসব জিনিসের জন্যে তা দেয়ার কৌশল করা এভাবে যে, সহীহ্ভাবেই এক ফকীরকে যাকাত দেয়া হবে, পরে তাকেই এসব কাজ করতে আদেশ করা হবে, তাতে যাকাতের সওয়াব তো সে পাবেই, ফকীরও ওসব কাজের সওয়াব পাবে। যেমন এ ক্ষেত্রে তাঁরা বলেছেন, ফকীরের অধিকার আছে; সে চাইলে উক্ত আদেশ সে অমান্য করবে। কেননা তাকে মালিক বানানো সহীহ্ হওয়ার অনিবার্য দাবিই হচ্ছে এই। বাহ্যত এত কেন সংশয় নেই। কেননা সে তো তার মালের যাকাতের মালিক তাকে বানিয়ে দিয়েছে, তার পরে তার ওপর যে শর্ত চাপিয়েছে, তা অবশ্য ‘ফাসেদ’-অগ্রণযোগ্য। কিন্তু হেবা- দানও যাকাত ‘ফাসেদ’ শর্তের দারুন ‘ফাসেদ’ হয়ে যাবে না। [আরবী**************] কিন্তু লক্ষণীয় যে, যাকাতকে ভিন্ন পথে নিয়ে যাওয়ার এসব কৌশলের মধ্যে কিছু মাকরূহ আর কিছু মাকরূহ নয়। তবে সম্পদের মালিকের ওপর থেকে যাকাত রহিতকরণ পর্যায়ে হানাফীদের গ্রন্থাবলীতে- যা আমি দেখতে পেয়েছি- স্পষ্টভাবে জয়েয বলার কোন কথা লিখিতভাবে পাইনি। মলিকী মতের লোকেরা কৌশল হারাম বলেন ও তার প্রভাব বিলুপ্ত করেন মালিকী মতের লোকদের দৃষ্টিতে ঈমানদারীর দিকে দিয়ে কৌশল করা জায়েয নয় এবং বিচারে তা কার্যকর হবার নয়। এজন্যে তাঁরা বলেছেন, যার কাছে নিসাব পরিমাণ মাল-সম্পদ রয়েছে, তার ওপর যাকাত ফরয হয়,- যেমন গবাদি পশু- সে যদি তার সবটা বা কিছু অংশ বছরান্তে কিংবা তার অল্প পূর্বে- যেমন একমাস পূর্বে- সেই প্রজাতীয় অন্য গবাদি পশু দ্বারা বদল করে ফেলে, যেমন পাঁচটি উটকে চারটি দ্বারা বদল করল অথবা অন্য পজাতীয় পশু দ্বারা- যেমন উট বদল করে ছাগল বা এর উল্ট বদল করে নেল। এ ধরনের পশু নিসাব পরিমাণ হোক কি তার কম, কিংবা তা বদলানো নগদ টাকায় বা দ্রব্যাদিতে বা তার পশু যবেহ্ করে ফেলল বা এ ধরনের অন্য কোন পন্থঅ অবলম্বন করল এবং জানা গেল যে, সে তা করেছে যাকাত এড়াবার উদ্দেশ্যে বা যাকাত ফরযরূপে ধার্য হতে না দেয়ার উদ্দেশ্যে তা তার নিজের স্বীকারোক্তী থেকে জানা যাক বা অবস্থার লক্ষণ দেথে, এরূপ পরিবর্তন বা এ ধরনের অন্য কোনরূপ হস্তক্ষেপে বদলে দেয়া মালের ওপর যাকাত ফরয হওয়া রহিত হতে পারে না। বরং তার যাকাত অবশ্যই নেয়অ হবে- তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার সাথে আচরণ করতে হবে। বদলের পর যে জিনিস এসছে তার যাকাত বেশী হলেও তা নেয়া হবে না। কেননা বদলানো জিনিসের মালিকানার মেয়াদ এক বছর না হওয়ার কারণে তার ওপর যাকাত ফরয হবে না। এটা এজন্যে যে, মায্হাবে এটা সিদ্ধান্ত যে, ইবাদতে কৌশল যেমন কোন ফায়দা দেয়া না, তেমনি লেনদেন-মুয়ামিলাতেও নয়। তাঁরা বলেছেন, বাতিল কৌশল হচ্ছেঃ মালিক তার মাল সম্পদ সম্পূর্ণ বা তার অংশ যেন পূর্তির কাছাকাছি সময়ে তার সন্তান বা তার ক্রীতদাসের নামে হেবা করে দিল, যেন পরবর্তী সময়ে বছর পূর্তি হওয়া সত্ত্বেও তার ওপর যাকাত ফরয দাঁড়াতে না পারে। পরে তা তার কাছ থেকে নিঙ্ড়িয়ে বা কেড়ে নিয়ে নেবে। তখন তার ধারণা মতে মালিকানার কেবল সূচনা কাল হবে। এরূপ কৌশল স্বামী করে থাকে স্ত্রীকে দিয়ে। পরে তাকে বলে, ‘আমি তোমাকে যা দিয়েছিলাম, তা আমাকে ফিরিয়ে দাও, এবং তা করা তারও কর্তব্য হবে তা প্রদান করা। [দেখুনঃ (আরবী****************)] হাম্বলী মতের লোকেরা মালিকী মতের লোকদের মতই ইবনে কুদামাহ্ তাঁর (আরবী**************) গ্রন্থে লিখেছেনঃ ‘আমরা বলে এসেছি, নিসাব পরিমাণ সম্পদ অন্য জাতীয় জিনিসের সাথে অদল-বদল করা বছর শেষ হওয়ার উদ্দেশ্যে কেউ করে, তবে তাতে যাকাত রহিত হবে না। তা গবাদি পশু বদলানো হোক, কি নিসাবের অন্য কোন জিনিস। অনুরূপভাবে কেউ যদি নিসাব পরিমাণ সম্পদ থেকে কিছু অংশ নষ্ট করে নিসাব হয় না প্রমাণের উদ্দেশ্যে- যেন তার ওপর যাকাত ফরয না হয়, তাতেও যাকাত রহিত হবে না। বছর শেষ হলেই তার কাছ থেকে যাকাত নিয়ে নেয়া হবে, যদি তা বদলানো ও বিনষ্ট করা ফরয হওয়ার কাছাকাছি সময়ে সংঘটিত হয়। আর তা যদি বছরের শুরুতে করে, তাহলে যাকাত ওয়াজিব হবে না। কেননা যাকাত এড়িয়ে যাওয়ার জিনিসই নয়। এই যা বলা হল, মালিক, আওজায়ী, ইবনুল মাজেলূন, ইসহাক ও আবূ উবাইদ প্রমুখও তাই বলেছেন। আবূ হানীফা ও শাফেয়ী বলেছেনঃ তার যাকাত রহিত হবে। কেননা তার সম্পদ বছর পূর্তির পূর্বেই নিসাব পরিমাণের চাইতেও কম হয়ে গেছে। তাই তার ওপর যাকাত ফরয থাকবে না। যদি তার নিজের প্রয়োজনে নষ্ট করা হয়, তা হলেও তা-ই। ইবনে কুদামাহ্ বলেছেন- আমাদের দালিল হচ্ছে আল্লাহ্ তা‘আলার কথাঃ (আরবী****************) আমরা এ (মক্কার অধিবাসী) লোকদেরকে সেরূপ পরীক্ষায় ফেলেছি, যেমন একটি বাগানের মালিকগণকে পরীক্ষার সম্মুখীন করে দিয়েছিলাম, তারা যখন যখন কিরা-কসম করে বলল আমার খুব সকাল বেলা অবশ্য- অবশ্যই আমাদের বাগানের ফল পাড়ব। তারা এ কথার কোনরূপ ব্যতিক্রমের সম্ভাবনা রাখছিল না। রাতের বেলা তারা নিদ্রামগ্ন হয়। এ সময় তোমার আল্লাহ্র কাছ থেকে একটি বিপদ সেই বাগানের ওপর আপতিত হল এবং তার অবস্থা যেন কর্তিত ফসলের মত হয়ে পেল। [আরবী************] আল্লাহ্ এ লোকদের শাস্তি দিলেন এজন্যে যে, তারা যাকাত এড়াতে চেয়েছিল এবং এজন্যে যে, যে ফকীর-মিসকীনের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হতে পারত, তা যাতে প্রতিষ্ঠিত হতে না পারে ও তাদের অংশ রহিত হয়, তার জন্যে চিন্তা ও চেষ্টা করেছিল কিন্তু এতে যাকাতের দায়িত্ব রহিত হয় না। যেমন কেউ যদি মুমুর্ষাবস্থায় তার স্ত্রীকে তালাক দেয়, তাহলে তার মীরাসের অংশ রহিত হবে না। আর এজন্যে যে, সে একটা খারাপ উদ্দেশ্য গ্রহণ করেছে, তার উদ্দেশ্যকে নস্যাৎ করে দিয়ে তার শাস্তি প্রদান সুবিচারের ঐকান্তিক দাবি। যেমন কেউ যদি সে যার উওরাধিকার পাবে তা পাওয়াকে তরান্বিত করার উদ্দেশ্যে তাকে হত্যা করে, তাহলে শরীয়াত তাকে মীরাস থেকে বঞ্চিত করে এই অপরাধের শাস্তি দেয়। [আরবী*************] কিন্তু মালিক যদি তা নিজের প্রয়োজনে কিছু পরিমাণ মাল বিনষ্ট করে, তাহলে তার অবস্থা ভিন্নতর হবে। কেননা সে কোন খারাপ উদ্দেশ্যে তা করেনি। অতএব সে শাস্তি পাওয়ার যোগ্যও হয়নি। জায়দীয়া মতের লোকেরা কৌশল অবলম্বন হারাম মনে করেন এ ব্যাপারে জায়দীয়া ফিকাহ্ অনেকটা বিস্তারিত কথা বলেছে। এ ফিকাহ্র অনুসারীরা বলেছেন, যাকাত রহিত করার উদ্দেশ্যে কৌশল করা জায়েয নেই। এ ব্যাপারে দুটি অবস্থা- একটি হচ্ছে, ফরয হওয়ার পূর্বে (আর সূক্ষ্মভাবে বললে, এক বছর অতিবাহিত হওয়ার শর্ত পূরণ হওয়ার পূর্বে। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে, তার পর। ফরয হওয়ার আগের কৌশল- যেমন কেউ নগদ সম্পদের নিসাব পরিমাণের মালিক হল। তার ওপর একটি পূর্ণ বছর অতিক্রম হওয়ার পূর্বেই সে তদ্দারা এমন কোন জিনিস ক্রয় করল যার ওপর যাকাত ফরয হয় না- যেমন খাদ্য, উদ্দেশ্য হচ্ছে যাকাত রহিত করার জন্যে কৌশল করা। এটা জায়েয নেই। তা করলে গুনাহ্গার হবে- যদিও যাকাত ফরয হবে না। এদের ফিকাহ্বিদদের মধ্যে কেউ কেউ বলেছেন, এরূপ করা মুবাহ্। যাকাত ফরয ধার্য হওয়ার পর কৌশল করা- যেমন তা ফকীরকে দিয়ে দিল ও শর্ত করল তা থেকে ফিরিয়ে দেয়ার, এ শর্তের সাথে একটা চুক্তিও করল। যেমন-বলল- আমি আমার যাকাত থেকে জিনিসটি তোমাকে দিচ্ছি এই শর্তে যে, তুমি ওটি আমাকে ফিরিয়ে দেবে। এরূপ করা জায়েয নয়। এরূপ করলে যাকাত রহিত হবে না। মাযহাবে এ নিয়ে কেন মতভেদ নেই। যদি শর্ত আগে আসে- যেমন এক সাথে সংঘটিত হল- দেয়ার পূর্বে ফিরিয়ে দেয়ার, পর তা ফকীরকে দিল কেনরূপ শর্ত ছাড়াই- যা এক সাথে ঘটে গেছে, মাযহাবের বক্তব্য হচ্ছে, এরূপ করা জায়েয নয়। এতে যাকাত আদায় হবে না। অপর কিছু লোক বলেছেন, যাকাত হবে, তবে মাক্রূহ তাহ্রীমী সহকারে। মাযহাবের এ মতের কারণ হচ্ছে, এর ফলে ফকীরদের অধিকার রহিত হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। আল্লাহ তা’আলা তা তাদের জন্যেই নির্দিষ্ট করেছেন। এরূপ কর হলে আল্লাহ্ যা ইচ্ছা করেছেন, যা বিধান দিয়েছেন তা বাতিল করা হয়। আর যে কৌশলের পরিণতি হবে শরীয়াতের বিধানদাতার ইচ্ছা ও উদ্দেশ্যের পরিপন্থী তা-ই হারাম। এ আচরণ তার সুফলও নিঃশেষ করে দেয়। [আরবী****************] তাঁরা যেমন যাকাত রহিত করার লক্ষ্যে কৌশল করতে নিষেধ করেছেন, তেমনি তা গ্রহণ বা পাওয়ার লক্ষ্যে কৌশল করাকেও নিষেধ করেছেন। তাঁরা বলেছেনঃ যার পক্ষে যাকাত গ্রহণ জায়েয নয়, তার পক্ষে তা পাওয়ার জন্যে কৌশল করাও জয়েয নেই। তা পাওয়ার জন্যে কৌশলের দুটি রূপ হতে পারেঃ একটি এই যে, ফকীর কৌশলস্বরূপ যাকাত নিল, যেন সে নিতে পারে তার জন্যে যার জন্যে তা জায়েয নেই- যেমন হাশেমী বংশের লোক বা ধনী, নিজের সন্তান, পিতা বা অন্য যারা যাকাত পাওয়ার যোগ্য লোক নয়। এরূপ করা জায়েয় নয়, এতে যাকাত আদায়ও হবে না। তা ফিরিয়ে দেয়া ওয়াজিব হবে। এ কথার একটা ব্যতিক্রম তাঁরা স্বীকার করেছেন। তা হচ্ছে কোন হাশেমী ফকীর ব্যক্তিকে দেবার জন্যে যদি গ্রহণ করে বা এ ধরনের কিছু। এরূপ জায়েয-যদি পারস্পরিক আনুকূল্যের কথা পূর্বহ্নে হয়েও থাকে। দ্বিতীয় অবস্থা হচ্ছে, বিশেষভাবে ধনাঢ্যতার কারণে যার জন্যে যাকাত মোটিই হালাল নয়, সে যদি তার মালিকানা সম্পদ পরের মালিকানায় দিয়ে দেয় নিজে দরিদ্র সাজার উদ্দেশ্যে, যেন তার জন্যে যাকাত গ্রহণ হালাল হয়। মায্হাবের বক্তব্য হল, এরূপ করাও জায়েয নয়। কেউ কেউ এ শর্ত দিয়েছেন যে, এরূপ যদি সে করে বেশী সম্পদ করার উদ্দেশ্যে, এ উদ্দেশ্যে নয় যে, সে আয় বৃদ্ধির সময় পর্যন্ত তার জন্যে যা যথেষ্ট হয় তা পাওয়ার উদ্দেশ্যে তা জায়েয হবে। [আরবী**************] সারকথা, কৌশলের লক্ষ্য যদি হয় আল্লাহ্র সন্তুষ্টি বিধান, শরীয়াতের উদ্দেশ্যাবলীর সাথে আনুকূল্য করা, হারাম থেকে ফিরে থাকা, তা হলে তা জায়েয। আর তার লক্ষ্য যদি হয় শরীয়াতের উদ্দেশ্যের বিরোধিতা করা, তা হলে তা জায়েয হবে না। আমরা যদি তা মোটামুটি জায়েয বলিও তাহলে সব হারামই হালাল হয়ে যাবে। [(আরবী**************)এবং দেখুনঃ (আরবী*************)] (আরবী*************) গ্রন্থের টীকায় শাওকানী থেকে উদ্ধুত হয়েছে, তিনি বলেছেনঃ ‘যে পরিণাম থেকে রক্ষা নেই, তা হচ্ছে প্রতিটি কৌশলই আল্লাহ্র ঘোষিত হারামকে হালাল করে দেবে কিংবা হালালকে করে দেবে হারাম। কৌশলকে সহীহ্করণ শরীয়াতের কাজ নয়-না আমাদানীতে, না দিয়ে দেয়ায়। [ঐ, ২৪০ পৃঃ।] যাকাতদাতা ও গ্রহীতা কি বলবে রাষ্ট্র সরকারসমূহের ধার্যকৃত সাধারণ কর প্রথা থেকে ইসলামের যাকাত ব্যবস্থা যে বহু দিক দিয়েই ভিন্নতর, যাকাতের যে একটি আধ্যত্মিক দিক রয়েছে, যা সাধারণ কর প্রথায় নেই এবং এ হিসেবে যাকাত যে অধিক উন্নত এক মানবিক ব্যবস্থা, এক্ষণে আমরা সেদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে চাচ্ছি। আমাদের এ দৃষ্টি এ কারণেও যে, ইসলামী জীবন-ব্যবন্থায় যাকাত ইবাদতের গুণেও মহীয়ান হয়ে রয়েছে। একটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, যাকাত সংগ্রহ কাজে নিযুক্ত ব্যক্তি তার হস্তে যখন যাকাত দ্রব্য অর্পণ করা হবে তখন সে দাতার জন্যে দো‘আ করতে আদিষ্ট হয়েছে। এ জন্যে তাকে উৎসাহ দান করবে। সেই সাথে তাকে এ কথাও জানিয়ে দেবে যে, যাকাতদাতা ও গ্রহীতার মধ্যে পরিপূর্ণ সব ধর্ম ও মিল্লাতের লোক এবং জবরদস্তিমূলক করদাতা লোকদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নতর বৈশিষ্ট্যে মন্ডিত করে তুলবে। এই দো‘আ করার কাজটি মহান আল্লাহ্র আদেশ পালন স্বরূপ হয়ে থাকে। কেননা তিনি বলেছেনঃ (ধনী) লোকদের নিকট থেকে যাকাত গ্রহণ কর, তুমি তাদের পবিত্র কর ও পরিশুদ্ধ কর তার দ্বারা এবং তাদের প্রতি উচ্চমানের রহমতের দো‘আ কর। নিশ্চয়ই তোমার দো‘আ তাদের জন্যে বড় সান্ত্বনা বিশেষ। আয়াতের কথা (আরবী*************) অর্থ তুমি তাদের জন্যে উচ্চমানের রহমাতের দো’আ কর। যাকাতদাতাদের মনের ওপর এ দো‘আর ক্রিয়া ও প্রভাব কি হতে পারে তাও আল্লাহ্ তা‘আলা এই সঙ্গেই বলে দিয়েছেন। তা হচ্ছে পরম সান্ত্বনা, সুগভীর নিশ্চিন্ততা ও অস্বস্তি, নিরাপওা ও স্থিতি-দৃঢ়তা বোধ। হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আবূ আওফা বর্ণনা করে বলেছেনম, লোকেরা যখন তাদের যাকাতের মাল নিয়ে আসত, নবী করীম (স) তাদের জন্যে দো‘আ করতেন। বলতেন ‘হে আল্লাহ্, তুমি এদের প্রতি পূর্ণাঙ্গ রহমত নাযিল কর’। আবূ আওফাও তাঁর যাকাত নিয়ে তাঁর কাছে উপস্থিত হলেন, তখন নবী করীম (স) বললেনঃ হে আমাদের মহান আল্লাহ্! তুমি আবূ আওফার লোকদের প্রতি পূর্ণ মাত্রার রহমত বর্ষণ কর। [(আরবী**************) গ্রন্থে বলা হয়েছে, হাদীসটি বুখারী ও মুসলিমে উদ্ধৃত , ‘নাইলুল আওতার’ ৪র্থ খন্ড, ১৫৩ পৃ।] এই দো‘আর জন্যে কোন স্থায়ী বা সুনির্দিষ্ট ভাষা নেই। ইমাম শাফেয়ী বলেছেনঃ (যাকাতদাতা যখন যাকাত দেয় তখন গ্রহীতা এই কথা বলুক,) এটাই আমি পসন্দ করিঃ আল্লাহ্ তোমাকে পূর্ণ শুভ ফল দান করুন যা তুমি দিলে সেজন্যে এবং তাকে তোমার জন্যে পবিত্রকারী বানিয়ে দিন, এবং তোমার কাছে যা অবশিষ্ট রয়েছে তাতে আল্লাহ্ তোমাকে বরকত ও প্রবৃদ্ধি দান করুন। [আরবী***************] নাসায়ী বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেনঃ নবী করীম (স) একটি লোকের জন্যে দো‘আ করেছিলেন, যে লোক একটি সুন্দর উষ্ট্রী পাঠিয়েছিল। তিনি বলেছিলেনঃ হে আল্লাহ্ তুমি তার মধ্যেও এবং তার এই উষ্ট্রীতে বরকত দাও। [আরবী**************] একটি প্রশ্ন, এরূপ দো‘আ করা কি ওয়াজিব, না মুস্তাহাব? উপরিউক্ত আয়াতে যা আদেশ রয়েছে, তাতে বাহ্যত মনে হয়, দো‘আ করা ওয়াজিব। জাহিরী ফিকাহ্ ও শাফেয়ী মায্হাবের কিছু লোকের এটাই মত। জমহুর ফিকাহ্বিদ্গণ বলেছেন দো‘আ করা ওয়াজিব হলে নবী করীম (স) তাঁর নিয়োজিত যাকাত কর্মচারীবৃন্দকে তা শিক্ষা দিতেন ও আদেশ করতেন- হযরত মুযায (রা)-কেও বলতেন। কিন্তু তিনি বলেছেন, এরূপ কোন বর্ণনা পাওয়া যায়নি। [(দেখুনঃ ) আরবী**************] উপরিউক্ত কথাটি অ-গ্রহণযোগ্য। কেননা এজন্যে নবী করীম (স) উপরিউক্ত আয়াতটিকেই যথেষ্ট মনে করেছেন। আর হযরত মুযায (রা)- এর মত লোকদের কাছে তা আদৌ গোপন থাকতে পারেনি। তাঁরা আরও বলেছেন, রাষ্ট্রপ্রধান ঋণ ও কাফ্ফারা ইত্যাদি বাবদ আর যত কিছুই গ্রহণ করে থাকেন, সেজন্যে তার দো‘আ করার দায়িত্ব নেই। যাকাতও সে-ই গ্রহণ করে। [আরবী*************] এর জন্যে আলাদা কোন দলিলের প্রয়োজন পড়ে না। কেননা কুরআনের উক্ত আয়াতে দো‘আ করার আদেশটি কেবল মাত্র যাকাত প্রসঙ্গেই, অন্য কেন কিছু প্রসঙ্গে নয়। তাও এজন্যে যে, দ্বীন-ইসলামে যাকাতরে স্থান ও মর্যাদা অনেক বড় ও উচ্চ। আর তা বাধ্যতামূলক ও আবর্তনশীল অধিকারের ব্যাপারও। অতএব তাতে উৎসাহ দান খুবই উওম, এই কাজে দাতাকে প্রতিষ্ঠিত রাখা খুবই প্রয়োজনীয়। এই দো‘আ করাটা বিশেষভাবে নবী করীম (স) এর জন্যে বাধ্যতামূলক। কেননা তাঁর দো‘আয় লোকদের জন্যে নিশ্চিত সান্ত্বনার বিষয় নিহিত। অন্যদের ব্যাপার সেরূপ নয়। এটা স্থিতিদান সেই সংশয়ের জন্যেও; যার অধীন হযরত আবূ বকর (র)- এর খিলাফতকালে যাকাত দিতে অস্বীকারকারী লোকেরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। কোন একজন সাহাবীও তার সমর্থন দেননি। তাই প্রশ্ন হচ্ছে, আয়াতটির প্রথম অংশ সাধারণ তাৎপর্যপূর্ণ ও শেষাংশ কেবল রাসূল (স)-এর জন্যে নির্দিষ্ট মনে করা যেতে পারে কিভাবে? অতএব অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য কথা হচ্ছে, আদেশটি তার আসলরূপে অবশিষ্ট থাকবে, তা কার্যটিকে ওয়াজিব প্রমাণ করছে। আর বিশেষভাবে যাকাতের প্রকৃতির সাথে এর সাযুজ্য সুর্স্পষ্ট। সাধারণত যে সব ‘কর’ ধার্য করে থাকে, তা থেকে যাকাতের স্বাতন্ত্র্য ও বিশিষ্টতা খুবই স্পষ্ট হয়ে ওঠে এর দ্বারা। দ্বিতীয় বিশিষ্টতা হচ্ছে, যাকাতদাতার হৃদয় যাকতের প্রতি খুবই সন্তুষ্টিসিক্ত থাক- এটাই কাম্য। আল্লহ্র তার দেয়া যাকাত কবুল করুন এই ভাবধারা ও মিনতিতে তার হৃদয় ভরপুর হয়ে থাকে। আল্লাহ্ যেন তা তার জন্যে ‘গনীমত’ বানান, জরিমানা নয়, এই দো‘আও সে সব সময় কাতর কণ্ঠে করতে থাকে। রাসূলে করীম (স) সে শিক্ষাই তো দিয়েছেন আমারেকে। তিনি বলেছেনঃ ‘তোমরা যখন যাকাত দেবে, তখন তার সওয়াবের কথাটা ভুলে থেকো না। তখন তোমরা বলবেঃ হে আল্লাহ্ এই যাকাতকে গনীমতের মাল বানাও, তাকে জরিমানার মাল বানিও না। [ হাদীসটি ইবনে মাজা কর্তৃক উদ্ধৃত, ১ম খন্ড, ১৭৯৭ সংখ্যা। আবদুর রাজ্জাক তাঁর জামে গ্রন্থেও এই হাদীসটি এনেছেন। সয়ূতূ তাঁর (আরবী*************) গ্রন্থে সেদিকে ইঙ্গিক করেছেন।– হাদীসটি আবূ হুরায়রা (রা) বর্ণিত। তিনি হাদীসটির ‘যয়ীফ’ হওয়ার দিকেও ইশারা করেছেন। মুনাভী (আরবী*************) গ্রন্থে (১ম খন্ড, ২৯০ পৃঃ) বলেছেনঃ হাদীসটি খুব বেশী ‘যয়ীফ’ নয়। যেমন ধারণা করা হয়েছে। (আরবী************) এ বলা হয়েছে, সে পরিত্যক্ত। দেখুনঃ (আরবী*************)] হাদীসটির তাৎপর্য হচ্ছে, যার ওপর যাকাত ফরয সে যখন ইমামের প্রতিনিধি হিসেবে নিজেই পাওয়ার-যোগ্য-ফকীর কিংবা সরকার নিয়োজিত কর্মচারীকে দেবে তখন যেন এই দো‘আর কথা সে ভুলে না যায়- উপেক্ষা না করে। তাহলে তার জন্যে এর সওয়াব পূর্ণত্ব পাবে। এ দো‘আর তাৎপর্য হচ্ছে, হে আল্লাহ্! এই যাকাতের দরুন আমার মন ও মানসকে পবিত্র, একনিষ্ঠ ও নিষ্কলুষ বানাও, যেন আমি তা প্রদান করাকে গনীমত এবং আমার দ্বীনী ও বৈষয়িক জীবনে এবং পরকালে আমার জন্যে খুবই লাভজনক মনে করতে পারি। এটাকে যেন আমি জরিমানা মনে না করি, যা জোরপূর্বক নেয়া হয় ও অসন্তুষ্ট চিত্তে দেয়া হয়। কিরমিযী হযরত আলী (রা) থেকে বর্ণিত একটি হাদীস উদ্ধৃত করেছেন। তাতে রাসূলের কথা রয়েছেঃ ‘আমার উম্মত যদি পনেরটি নৈতিক কাজ করে, তাহলে তার ওপর মুসিবত নেমে আসবে। তন্মধ্যে একটি হচ্ছেঃ ‘আমানতকে যখন গনীমতরূপে গ্রহণ করা হবে’ আর যাকাতকে যখন জরিমানা মনে করা হবে। [ হাদীসটির সনদ যয়ীফ ‘নাইনুল আওতার’ গ্রন্থে যেমন বলা হয়েছে।] আর কোন মুসলিম ব্যক্তি যদি তার আল্লাহ্র কাছে দো‘আ করে এই বলে যে, তার যাকাতকে যেন জরিমানা বানানো না হয়, তাহলে তিনি তাঁর মন ও তাঁর উম্মতকে বিপদের কারণসমূহ থেকে দূরে রাখবেন ও রক্ষা করবেন। এ কথা এ ভিওিতে বলা হচ্ছে যে, হাদীসের শদ্ব (আরবী**********) কর্তাবাচক হবে। শদ্বটি কর্তৃবাচকও হতে পারে। মুনাভী তাই বলেছেন। তখন সম্বোধনটা যাকাত যাওয়ার যোগ্য লোকদের প্রতি নিবদ্ধ ধরা হবে। অর্থ হবে যাকাত পাওয়ার যোগ্য হে লোকরা, তোমাদেরকে যখন যাকাত প্রদান করা হবে, তখন তোমরা যাকাতদাতার এই দয়া ও অনুগ্রহের কৃতজ্ঞতা স্বরূপ একথা বলতে ক্রটি করো নাঃ ‘হে আল্লাহ্ তুমি এই লোকের জন্যে এই যাকাতকে গনীমত বানিয়ে দাও, তার উপর তাকে জরিমানাস্বরূফ চাপিয়ে দিও না। [(আরবী*****************) গ্রন্থের ১ম খন্ড ২৯০ বলা হয়েছে, বোঝা যায়, এরূপ বলা মস্তাহাব। যদিও তারা তার উল্লেখ না করে। কেননা এ হল ফযীলতের কাজ। একটা মৌল নীতির অধীন। তা হচ্ছে, যাকাতদাতার জন্যে দো‘আ চাওয়া] পাওয়ার যোগ্য লোকদের পক্ষ থেকে যে ‘উকীল’ বা প্রতিনিধি হবে- সে রাষ্ট্রপ্রধান হোন বা তাঁর প্রতিনিধি, এরূপ দো‘আ করা তাঁ জন্যেও কর্তব্য হবে। আল্লাহ্র কথাঃ (আরবী************) এর এটাই তাৎপর্য। যাকাত প্রদানে উকীল নিয়োগ কোন মুসলিম নিজের যাকাত নিজেকেই প্রদান করতে হবে, এমন কথা নেই। বরং সে অপর একজন মুসলিম বিশ্বস্ত নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিকে এ কাজের জন্যে দায়িত্বশীল বানাতে পারে। সে তার পক্ষ থেকে তার যাকাত প্রদান করবে। (আরবী***************) বিশ্বস্ত নির্ভরযোগ্য বলতে বোঝায় এমন ব্যক্তিকে যার আমানতদারীর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস আছে যে, সে যাকাত পাওয়ার যোগ্য লোকদের মধ্যেই তা যথাযথভাবে বিতরণ ও বণ্টন করে দেবে। অবিশ্বাস্য ও অনির্ভরযোগ্য ব্যক্তির ওপর এ দয়িত্ব দয়ৈ বণ্টন পর্যায়ে নিশ্চিত হওয়া যায় না। কোন কোন ফিকাহ্বিদ সেজন্যে শর্ত আরোপ করেছেন যে, সে ‘উকীল’ কে অবশ্যই মুসলিম হতে হবে। কেননা যাকাত একটা বিশেষ ইবাদত। অমুসলিম ব্যক্তির পক্ষে তা করা সম্ভব নয়, শোভন নয়। অন্যরা বলেছেন, যাকাত প্রদানের জন্যে কোন ‘যিম্মী’ (ইসলামী রাষ্ট্রের অনুগত অমুসলিম নাগরিক।– কে ‘উকীল’ বানানো জায়েয হতে পারে যদি যাকাতদাতা নিজে নিয়তের কাজটা করে। তার নিয়তই যথেষ্ট হবে। [দেখুনঃ (আরবী*****************)] আমি মনে করি, কোন বিশেষ কারণ বা প্রয়োজন ছাড়া কোন অমুসলিম ব্যক্তিকে যাকাত প্রদানের জন্যে ‘উকীল’ বানানো কেবলমাত্র তখনই জায়েয হতে পারে, যদি এ নিশ্চিন্ততা ও নির্ভরতা থাকে যে, সে দাতার আগ্রহ-অনুরূপ বিশ্বস্ততা রক্ষা করে যাকাত প্রদান করতে সক্ষম হবে। মালিকী মাযহাবের কেউ কেউ বলেছেন, দাতার যাকাত প্রদানের জন্যে কাউকে প্রতিনিধি বানানো একটা মুস্তাহাব ব্যাপার। রিয়াকারী ও দেখানোপনা থেকে বাঁচার জন্যে এটা করা যেতে পারে। তার এ ভয়ের উদ্রেক হতে পারে যে, সে নিজেই যদি যাকাত বণ্টন করার দায়িত্ব পালন করতে যায়, তাহলে লেকাদের প্রশংসা ও স্তুতি পাওয়ার ইচ্ছা তার মনে জাগতে পারে। তাহলে রিয়াকারী হবে। যদি নিজ সম্পর্কে কেউ এতটা সচেতন হয়, তাহলে তার যাকাত কোন প্রতিনিধির মধ্যমে বণ্টন করানো ওয়াজিব। কেবল ভয়েরই ব্যাপার নয়, কে যাকাত পাওয়ার যোগ্য তা যদি দাতার জানা না থাকে, তাহলে তার উচিত হবে এমন ব্যক্তিকে বণ্টনকারী বানানো, যে তা যথাস্থানে স্থাপন করতে ও তা পাওয়ার যোগ্য লোকদেরকে দিতে পারবে। [দেখুনঃ (আরবী**********)] যাকাত প্রকাশ্যভাবে প্রদান ইমাম নববী বলেছেন, যাকাত প্রদানে প্রকাশনীতি অবলম্বন উওম যেন অন্য লোকেরা তা দেখেতে ও জানতে পারে। তাহলে তারাও অনুরূপ কাজ করবে, তার প্রেরণা ও উৎসাহ পাবে। অন্যথায় লোকেরা খারাপ ধারণা করে বসবে। এটা ঠিক ফরয নামায আদায়ের মত। তা প্রকাশ্যভাবে পড়াই পসন্দনীয়। গোপন কার মুস্তাহাব শুধু নফল নামায-রোযা-দান ইত্যাদি। [(আরবী***********) এবং দেখুনঃ (আরবী*************) তাতে একটি বর্ণনায় বলা হয়েছে (আরবী************) ‘যাকাত গোপনে দেয়ার পরিবর্তে জানিয়ে শুনিয়ে দেয়া অনেক ভাল।’] তা এজন্যে যে, যাকাত হচ্ছে ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ। তা প্রকাশ করা, তার বিরাটত্ব প্রতিষ্ঠিত করা এবং সে বিষয়ে চারদিকে জানাজানি করা খুবিই সঙ্গত ও কাম্য তাতে দ্বীনকে যেমন শক্তিশালী করা হয়, তেমনি মুসলিমদের ব্যক্তিত্বও প্রতিষ্ঠিত হওয়া সম্ভব হয়। যাকাত দাতার মনে এ মহান লক্ষ্য প্রবল থাকা ও উক্ত উদ্দেশ্যে লাভ করা আগ্রহ জাগা আবশ্যক। লোকদের দেখানোর কোন মনোবৃওি থাকা উচিত নয়, তাতে নিয়তটাই খারাপ হয়ে যায়। কাজটা কলুষযুক্ত হয় এবং আল্লাহ্র কাছে শুভ ফল লাভের সম্ভাবনা নিঃশেষ হয়ে যায়। ইসলামের মৌল গুরুত্বপূর্ণ কার্যাবলীর প্রচার-প্রকাশ তার মহও প্রতিষ্ঠিত করা এবং লোকদের কাছে তাকে অতিশয় প্রিয় করে তোলার লোভ ও ইচ্ছা ঈমানের লক্ষণ তাকওয়ার চিহ্ন। আল্লাহ্ নিজেই বলেছেনঃ (আরবী**************) তা এজন্যে যে, যে লোক আল্লাহ্র নিদর্শনাবলীকৈ বিরাট করে তুলবে-সম্মনিত করবে, তার এ কাজটা হৃদয়ের আল্লাহ্-ভীরুতার লক্ষণরূপে গণ্য। [আরবী***************] সম্ববত আল্লাহ্ তা‘আলা যাকাত প্রদানে যে মনোভাবে ও আত্মচেতনাবোধ সৃষ্টি করা পসন্দ করেন, যে বিষয়ে নবী করীমের হাদীস উদ্ধৃত হয়েছে, তা উক্ত আয়াতে বিবৃত হয়েছে। হাদীসে বলা হয়েছেঃ যে আত্মচেতনাবোধ মহান আল্লাহ্ তা‘আলা পসন্দ করেন, তা হচ্ছে ব্যক্তির নিজের সম্পর্কে চেতনাবোধ যুদ্ধকালে ও যাকাত প্রদানের সময়ে। আর এ পর্যায়ে আসল কথা হচ্ছে আল্লাহ্ তা‘আলার এ কথাটিঃ (আরবী*************) তোমরা যদি যাকাত প্রকাশ্যভাবে দাও, তাহলে তা খুবই উওম। [আরবী**************] ফকূরকে জানাতে হবে না যে, এ যাকাত ইসলামী বা মুসলিম রাষ্ট্র সরকারই যাকাত সংগ্রহ ও বণ্টনের সঠিক দায়িত্বশীল। কিন্তু তা যদি না থাকে আর ব্যক্তিরাই যদি যাকাত বণ্টনের দায়িত্ব পালন করতে থাকে তা পাওয়ার যোগ্য লোকদের মধ্যে,- একালের প্রায় সব মুসলিম দেশেই এ অবস্থা বিরাজমান- তখন উওম নীতি হচ্ছে, যাকাতদাতা ফকীরকে বলবে না যে, এটা যাকাতের মাল। কেননা এরূপ কথা গ্রহীতার পক্ষে খুবই মনসিক কষ্টদায়ক হতে পারে। বিশেষ করে গ্রহণকারী লোক যদি আত্মগোপনকারী হয়, যারা যাকাত গ্রহণ থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখতে সদা সচেতনভাবে সচেষ্ট। আর তা বলার প্রয়োজনও নেই। (আরবী***********) গ্রন্থে বলা হয়েছেঃ একজনকে ফকীর মনে করে তাকে যাকাতের মাল দেয়া কালে তা যাকাতের মাল, তা বলে দেয়ার কোন প্রয়োজন করে না। হাসান বলেছেনঃ তুমি কি তাকে আঘাত দিতে চাও? ……. না, তাকে জানিও না। আহমাদ ইবনুল হাসান বলেছেনঃ আমি আহমাদকে বললাম, এক ব্যক্তি যখন অপর ব্যক্তিকে যাকাত দেয়, তখন কি সে বলবে যে, এটা যাকাতের মাল?............. না চুপ থাকবে? বললেনঃ এ কথা বলে তাকে নিন্দিত করা কেন? তাকে দেবে ও চুপ থাকবে। তাকে আঘাত দিতেই হবে, এমন কি প্রয়োজন পড়েছে। [আরবী***************] বরং মলিকী মাযহাবের কেউ কেউ বলেছেনঃ বলাটা মাকরূহ। কেননা তা বললে ফকীরের অন্তর চূর্ণ করা হয়। [আরবী************] জা‘ফরী মতের লোকদের ‘মাসলাকে’ তা-ই যা এ ব্যাপারে আহলুস্ সুন্নাতের নীতি। তাঁরাও ফকীরকে যাকাত দেয়ার সময় বা তারপরে জানিয়ে দেয়া ওয়াজিব মনে করেন না। আবূ বসীর বলেছেনঃ আমি ইমাম বাকের (রা)-কে জিজ্ঞেস করলামঃ আমাদের লোকদের মধ্যে কেউ কেউ যাকাত গ্রহণে লজ্জাবোধ করে। আমি তাকে যাকাত দিই। কিন্তু বলি না যে, এটা যাকাত। এতে আপনার মত কি? বললেনঃ হ্যাঁ, তাকে দাও। কিন্তু বলো না। মুমিনকে লাঞ্ছিত করো না। [দেখুনঃ (আরবী**************)] গরীব ব্যক্তির ঋণ রাহিত করাকে যাকাত গণ্য করা যাবে ইমাম নববী বলেছেন, কোন অসচ্ছল ব্যক্তির যদি দেয় ঋণ থাকে, তখন যদি এ ইচ্ছা করা হয় যে, যাকাত বাবদ সে ঋণটা রহিত করা হবে এবং তাকে বলেঃ ঋণটাকে আমার দেয় যাকাত বাবদ কেটে দিলাম। এ ব্যাপারে শাফেয়ী মাযহাবে দুটি দিক রয়েছে। তার মধ্যে অধিক সহীহ্ দিক হচ্ছে, এতে যাকাত আদায় হবে না। আবূ হানীফা ও আহমাদের মাযহাবও তাই। কেননা যাকাত হচ্ছে ধনী ব্যক্তির দায়িত্বভুক্ত। তা অন্যকে ধরিয়ে দিয়ে দেয়া ছাড়া এ দায়িত্ব পালিত হতে পারে না। দ্বিতীয়, যাকাত আদায় হয়ে যাবে। এটা হাসান বসরী ও আতা’র মাযহাব। কেননা সে যদি যাকাতের টাকা তাকে দেয় এবং ঋণ শোধ বাবদ তার কাছ থেকে তা নিয়ে নেয়, তাহলে তা জায়েয হবে। তাহলে তার হাতে না দিয়ে তাকেই যদি যাকাত ও পরে ঋণ বাবদ ফেরত ধরে নেয়া হয় তাহলে জায়েয হবে না কেন? যেমন কারো কাছে যদি কিছু টাকা আমানতরূপে গচ্ছিত থাকে এবং তা যাকাতরূপে কেটে দেয়, তাহলে তাতে যাকাত দেয়া হয়ে যাবে, তা সে নিজের হাতে নিল, কি না-ই নিল। কিন্তু যাকাত তাকে যদি এরূপ শর্ত করে দেয় যে, সে তা তার ঋণ আদায়স্বরূপ ফেরত দেবে তাহলে তাকে দেয়া সহীহ্ হবে না। আর তাতে যাকাতও আদায় হয়ে যাবে না। এটা এ মাযহাবে সর্বসম্মত। আর এভাবে ঋণ শোধ করাও সহীহ্ নয় সর্বসম্মত মতে। অবশ্য উভয়েই যদি অনুরূপ নিয়ত করে- কিন্তু শর্ত না করে, তাহলে সর্বসম্মতভাবে জায়েয হবে এবং যাকাতও আদায় হবে। আর যদি সে তার ঋণ শোধরূপে তা তাকে ফেরত দেয়, তা হলে সে ঋণ থেকে মুক্ত হয়ে যাবে। আর ঋণী ব্যক্তি যদি বলেঃ তোমার যাকাত আমাকে দাও, আমি তোমার ঋণ শোধ করে দেব এবং তাই যদি করেও, তাহলে যাকাত আদায় হয়ে যাবে। যার মুঠে তা আছে সেই তার মালিক হবে না। তা আর তাকে ঋণ শোধস্বরূপ দেয়ার প্রয়োজন হবে না। যদি দেয়, তাহলে তা কবুল হবে। [(আরবী*************)] নববী হাসান থেকে এ পর্যায়ে যা উল্লেখ করেছেন, আবূ উবাইদ তা উদ্ধৃত করেছেন। তা হচ্ছেঃ তিনি তাতে কোন দোষ মনে করেন না। যদি তা ফরয হয়। বলেছেনঃ কিন্তু ‘তোমাদের এ বিক্রয় বা ক্রয়, তা জায়েয হবে না অর্থাৎ ঋণ যদি কোন প্রণ্যের মূল্য হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে জায়েয হবে না। যেমন ব্যবসায়ীর ঋণসমূহের অবস্থা হয়ে থাকে। হাসান তাতে যাকাত আদায় হয় বলে মনে করেন না। এটা উওম শর্ত। তবে আবূ উবাইদ এ ব্যাপারে খুবই কড়াকড়ি করেছেন। তিনি কোন অবস্থায়ই তা জায়েয মনে করেন না। সুফিয়ান সওরী থেকেই এটা উদ্ধৃত করেছেন। তিনি তাতে সুন্নাতের বিরোধিতা দেখতে পেয়েছেন। যেমন এ ভয় হয় যে, ঋনদাতা এভাবে ঋণ দিয়ে নিজের ধন-মাল বাঁচাতে চেষ্টা করতে পারে যা পাওয়া থেকে সে নিরাশ হয়েছে। এভাবে সে যাকাতকে তার ধন-মালের সংরক্ষণের সাহায্য হিসেবে মনে করতে পারে। কিন্তু আল্লাহ্ তো কেবল তাই গ্রহণ করেন, যা কেবলমাত্র তাঁরই উদ্দেশ্যে খালেসভাবে দেয়া হবে। [আরবী***************] ইবনে হাজম বলেছেন, যাকাতদাতা লোকদের কারো কারো কাছ থেকে যারা ঋণ নেয়, পরে সে তাকে সেই ঋণটাকেই যাকাতস্বরূপ রহিত করে দিলে, সে তা কবুল করে নেবে এবং নিয়ত করবে যে, এটা যাকাত বাবদ নিল। তা হলে তা আদায় হয়ে যাবে। অনুরূপভাবে সেই ঋণটাকে যদি দান করে দিল এমন ব্যক্তিকে, যে যাকাত নেয়ার যোগ্য এবং তা হাওয়ালা করে দিল সেই ব্যক্তির যার যার কাছে তার ঋণ দেয়া আছে এবং তা করে যাকাত দিল বলে নিয়ত করল, তাতেও তার যাকাত আদায় হবে। তার দলিল হচ্ছে, সে তো ফরয যাকাত দিতে আদিষ্ট। তা সে দিল এভাবে যে, যাকাত পাওয়ার লোকদের মধ্য থেকে যার ওপর তার ঋণ আছে সে সেটিকেই যাকাত ধরে দিল। সে ব্যক্তি যখন ঋণমুক্ত হয়ে গেল, তখন সেটিকেই যাকাত মনে করে নেবে। এতে তার যাকাত আদায় হয়ে যাবে। ইবেন হাজম এ কথার দলিলস্বরূপ সহীহ্ মুসলিমে উদ্ধৃত আবূ সায়ীদ বর্ণিত হাদীসের উল্লেখ করেছেন। বলেছেন, রাসূলে করীম (স)- এর যুগে এক ব্যক্তি ফল ক্রয় করে খুব বিপদে পড়ে গেল। তার ঋণের পরিমাণ বেড়ে গেল। তখন নবী করীম (স) বললেনঃ তোমরা সকলে এ লোকটিকে যাকাত দান কর। বলেছেন, আতা ইবনে আবূ রিবাহ্ প্রমূখও এ মত গ্রহণ করেছেন। [আরবী****************] জাফরীয়া মাযহাবেরও এটাই মত। এক ব্যক্তি ইমাম জাফর সাদেককে প্রশ্ন করল এই বলেঃ আমার ঋণ পাওনা রয়েছে লোকদের কাছে। দীর্ঘদিন পর্যন্ত তা তাদের কাছে আটক রয়েছে। তারা সে ঋণ শোধ করতে সমর্থ হচ্ছে না। অবশ্য তারা যাকাত পাওয়ার যোগ্য লোকও। তাহলে আমি কি তাদের কাছে পাওনাটা ছেড়ে দেব এবং মনে করে নেব যে, আমি তাদেরকে যাকাত দিলাম? বললেনঃ হ্যাঁ। [আরবী******************] আমার মতে এ মতটিই অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য। যতক্ষণ ফকীর-মিসকীনরা যাকাত দ্বারা নিজেদের আসল মৌল প্রয়োজন পূরণ দ্বারা চূড়ান্তভাবে উপকৃত হতে থাকবে- তাদের মৌল প্রয়োজন এখানে তাদের ঋণ শোধ করা- তাহলে তা জায়েয হবে, কুরআন মজীদে অভাবগ্রস্ত ব্যক্তির কাছে পাওনা ঋণ ছেড়ে দেয়াকে ‘সাদকা’ বা যাকাত বলা হয়েছে। আল্লাহ্র কথাঃ (আরবী*************) ‘ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি যদি অভাবে আক্রান্ত হয়, তাহলে তার সুবিধাজনক সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে থাক। আর যদি ‘সাদকা’ দিয়ে দাও, তাহলে তা তোমাদের জন্যে খুবই উওম-যদি তোমরা জান। [আরবী*************] অসচ্ছল ঋণী ব্যক্তিকে এভাবেই যাকাত বা সাদ্কা দেয়া হয়। যদিও তাতে হাতেও ধরা হয় না, মালিকও বানিয়ে দেয়া হয় না। কিন্তু কাজ তো সম্পন্ন হয় নিয়তের গুণে, তর বাহ্যিক অনুষ্ঠানে নয়। এটা তখন জায়েয হবে, যদি ঋণগ্রস্ত ঋণ শোধ করতে অক্ষম হয়ে পড়ে। তখন তাকে ঋণের শৃংখল থেকে মুক্তি দেয়া হবে এবং তাকে তা জানিয়েও দেয়া চলবে। এরূপ অক্ষম ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি যদি ঠিক ফকীর-মিসকীনের মধ্যে গণ্য নাও হয়, তাহলেও তারা নিঃসন্দেহে ঋণগ্রস্তদের মধ্যে গণ্য। আর ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিও যাকাত পাওয়ার যোগ্য। ঋণভার থেকে মুক্তি দানটা যাকাতের মাল দরিয়ে দেয়ার শামিল। এতে ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির মানসিক প্রয়োজন পূরণ হওয়ার ব্যবস্থা রয়ছে। আর তা হলো তাঁর কাঁধের ওপর থেকে ঋণের বোঝা অপসারিত করা। তাহলে সে রাতের দুশ্চিন্তা ও দিনের লাঞ্ছনা থেকেও বেঁচে যায়। তাগাদার ও কয়েদ হওয়ার ভয়ও দূল হয়। আর সর্বোপরি পরকালীন আযাব থেকে বাঁচার পথটিও খুলে যায়। তবে হাসান যে ব্যবসায়ের ঋণ না হওয়া ও কর্য লওয়ার ঋণ হওয়ার শর্ত করেছেন, এ ব্যাপারটি অবশ্য গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা বাঞ্ছনীয়। ঋণে বা বাকীতে বিক্রির মাধ্যমে ব্যবসায়কে ছড়েয়ে দেয়া হয়। খুব বেশী মুনাফা লাভের লোভে পড়ে, তাতে এ ভয়টা তীব্র হয়ে রয়েছে। যখন সে ঋণের দাবিতে তাদেরকে অতিষ্ঠ করে তুলবে, তখন যাকাত থেকে কেটে নেবে। এতে যথেষ্ট আপওির কারণ আছে। কোন কোন ফিকাহ্বিদ এ পর্যায়ে একটি মাস্লা উপস্থাপন করেছেন। তা হচ্ছে কেউ যদি কোন ইয়াতীম বা মেহমান ফকীরকে খাবার খাওয়ায় যাকাত দেয়ার নিয়তে, তাকে যে খাবার দিল তা কি যাকাত গণ্যৗ হবে যদি তার নিয়ত করে? ….. এ হিসেবে যে, সে তা তাদের জন্যে মুবাহ মনে করে নিয়েছে? হানাফী ও অন্যান্য আলিমগণ অকাট্যভাবে বলেছেন, এ খাবার দেয়া যাকাত আদায় বলে গণ্য হবে না। কেননা যাকাত প্রদানে ‘মালিক বানানো’ জরুরী; কিন্তু খাবার খাওয়ালে ‘মালিক বানানো’ হয় না। এ তো তাদের জন্যে অনুমরিত দানমাত্র। কিন্তু তাঁরা বলেছেন, খাদ্যদ্রব্য কাউকে যাকাতের বিকল্প হিসেবে দিলে তাতে যাকাত আদায় হবে। যেমন কাউকে কাপড় পরিয়ে দেয়া হল, কেননা তা ফকীরকে যাকাত আদায়ের নিয়তে দিয়ে তাকে তার মালিক বানিয়ে দেয়া হয়েছে। ফলে যে খাবার খেলো সে তার মালিক হয়ে গেল আর যদি নিজের সাথে বাসিয়ে খাওয়ানো হয়, তাহলে তাতে যাকাত আদায় হবে না। [আরবী**********] জায়দীয়া ফিকাহ্র কেউ কেউ ফকীর মেহমানদের সম্মুখে যা পেশ করা হবে তা যাকাতের মধ্যে গণ্য হতে পারে বলে মত দিয়েছেন পরপৃষ্ঠায় বর্ণিত শর্তের ভিওিতেঃ (১) যাকাতের নিয়ত করতে হবে। (২) মূল খাদ্য অবশিষ্ট থাকতে হবে- যেমন খেজুর ও কিশমিশ। (৩) প্রত্যেককে এমন জিনিস দিতে হবে যার মূল্য আছে এবং এ কাজের ভুল করা যাবে না। (৪) ফকীর তা নিজের মুঠোর মধ্যে নেবে কিংবা তারও সেই জিনিসের মধ্যে পথ উন্মুক্ত করে দেবে- তার জানা শোনা সহকারে এবং (৫) ফকীর জানবে যে, এটা যাকাতের মাল। অন্যথায় যাকাত হল বলে বিশ্বাস করা যাবে না। জামীল এ কথার প্রতিবাদ করেন। [আরবী***************] তৃতীয় অধ্যায় যাকাতের লক্ষ্য এবং ব্যক্তি ও সামষ্টিক জীবনে তার প্রভাব • যাকাতের লক্ষ্য এবং ব্যক্তি জীবনে তার প্রভাব • যাকাতের লক্ষ্য এবং সামষ্টিক জীবনে তার প্রভাব ভুমিকা ‘কর’- এর যে কোন মানবিক বা সামষ্টিক কিংবা অর্থনৈতিক লক্ষ্য থাকতে পারে, অর্থনীতি ও কর পারদর্শী ব্যক্তিবর্গ দীর্ঘকাল পর্যন্ত এই চিন্তাকে সযন্তে এড়িয়ে চলেছেন। তাঁদের ভয় ছিল, এই ব্যাপারটি তাঁদের নিজেদের প্রথশ লক্ষ্য- অর্জিত সম্পদের প্রাচুর্যের ওপর কোন প্রভাব বিস্তার করে না বসে। ধন-সম্পদের প্রাচুর্য ভান্ডারে উচ্ছুসিত হয়ে ওঠে কেবলমাত্র আদায়ের মাধ্যমে। এই চিন্তা-ভাবনার নাম দেয়া হয়েছে ‘কর’ সংক্রান্ত নিরপেক্ষতার মত’। শেষ পর্যন্ত চিন্তার বিবর্তন, অবস্থার পরিবর্তন এবং বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠার পর তাঁরা উক্ত পুরাতন অন্ধ অনুসরণের চিন্তা-ভাবনা পরিহার করে সুনির্দিষ্ট সামষ্টিক ও অর্থনৈতিক লক্ষ্য বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে ‘কর’-এর কল্যাণ গ্রহণের আহ্বান ও ঘোষণা দিতে বাধ্য হয়। সে উদ্দেশ্যস্বরূপ বলা হয় শ্রেণীসমূহের মধ্যকার পার্থক্য হ্রাসকরণ এবং সমাজের মধ্যে অর্থনৈতিক ভারসাম্য পুনঃস্থাপনে……………. ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু ইসলামের যাকাত ব্যবস্থার একটা ভিন্নতর বিশেষত্ব রয়েছে। ইসলাম যাকাতকে তার অন্যতম রুকন স্তম্ভ বানিয়েছে। তার বহু বিশেষত্বমূলক নিদর্শনের অন্যতম হচ্ছে যাকাত। উপরন্তু ইসলামের উপস্থাপিত ইবাদতসমূহের মধ্যে একটি অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হিসেবে দাঁড় করেছে এ যাকাতকে। মুসলিম ব্যক্তি তা একটি পবিত্র দ্বীনী গুণসম্পন্ন ফরয হিসেবে দিয়ে থাকে- দিয়ে সে আল্লাহ্র স্পষ্ট অকাট্য আদেশ পালন করে তাঁর সন্তুষ্টি পাওয়ার লক্ষ্যে। দেয় সে স্বীয় মনের পবিত্র প্রেরণার দরুন, সে ব্যাপারে তার নিয়ত থাকে খালেস, নিষ্কলুষ, যেন তা মহান আল্লাহ্র কাছে গৃহীত হয়। যেমন হাদীসে বলা হয়েছেঃ (আরবী*************) নিয়ত অনুযায়ীই আমলের মূল্যায়ন হয়। আর প্রত্যেক ব্যক্তি তাই পায় যার সে নিয়ত করে। [এ হাদীসের উৎসের কথা পূর্বে বলা হয়েছে।] আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেছনঃ (আরবী****************) লোকদের আদেশ করা হয়েছে শুধুমাত্র আল্লাহ্র ইবাদত করা, তাঁর জন্যে আনুগত্য একনিষ্ঠ করার মাধ্যমে সব দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে এবং তারা নামায কায়েম করবে ও যাকাত দেবে। আর এ হচ্ছে সুদৃঢ় দ্বীন। [আরবী***************] প্রথম পর্যায়ে যাকাত, মুসলিম ব্যক্তি তা পালন কর আল্লাহ্র কাছ থেকে মানুষের জন্যে জীবন বিধান অবর্তীর্ণ হয়েছে তার একটি হিসেবে। এ মানুষকেই তো আল্লাহ তা‘আলা পৃথিবীতে তাঁর খলীফা বানিয়েছেন। উদ্দেশ্য হচ্ছে, মানুষ কেবল তাঁরই ইবাদত করবে। পৃথিবীকে সত্য ও ইনসাফ দ্বারা পুনর্গঠিত ও সুবিন্যস্ত করে তুলবে, যেন তার সুফল সে পরকালে সংগ্রহ করতে পারে। মানুষ প্রস্তুতি নেয়, পরিচ্ছন্ন হতে সবের মধ্যে পড়ে সে পরীক্ষা দিয়ে তৈরী হয় যেন সে নিজেকে পরকালীন জান্নাতের চিরন্তন অধিবাসী হওয়ার যোগ্য করে তুলতে পারে। এভাবে তার মন ও মানসিকতা যখন পবিত্র হবে, তার অন্তর হবে পরিশুদ্ধ আল্লাহ্র কড়া আইনসমূহ পালনের মাধ্যমে ও তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করার ফলে, তবেই সে পরকালীন জীবনের নিয়ামতসমূহ পেতে পারবে আল্লাহ্র জান্নাতে তাঁর নিজটবর্তী হওয়ার সুযোগ পাবে। সেই লোকদের মধ্যে গণ্য হতে পারবে, যাদের কথা বলা হয়েছে এ আয়াতেঃ (আরবী************) ফেরেশতাগণ যাদেরকে মৃত করেন পবিত্র থাকা অবস্থায়, তারা বলবেঃ তোমাদের ওপর সালাম, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ কর তোমরা যা করেছ তার ফলস্বরূপ। [আরবী******************] ঠিক এ কারণেই কুরআন মজীদে নামায ও যাকাতকে ২৮টি স্থানে পাশাপাশি উল্লেখ করা হয়েছে। আর হাদীসে এ দুটির উল্লেখ পাশাপাশি হয়েছে দশ-দশটি স্থানে। ইসলামে একথা সর্বজন পরিচিত যে, যাকাত হচ্ছে নামাযের বোন। এ দুটির মধ্যে কোন বিচ্ছেদ বা পার্থক্যকরণ স্বীকার করা যেতে পারে না। তা জায়েযও নয়। কেননা আল্লাহ্ই এ দুটিকে একত্র করেছেন। এ কারণে যে সব লোক নামায কায়েম করত, কিন্তু যাকাত দিতে অস্বীকার করেছিল, তাওেদর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ব্যাপারে যে সব সাহাবী ইতস্ততঃ করছিলেন, হযরত আবূ বকর (রা) তাঁদের বলেছিলেনঃ আল্লাহ্র কসম, যারা নামায ও যাকাতের মধ্যে পার্থক্য করে তাদের বিরুদ্ধে আমি অবশ্যেই যুদ্ধ করব। এ কারণেই ইসলামী ফিকাহর কিতাবসমূহে মাযহাবী মতপার্থক্য থাকা সও্বেও যাকাত সংক্রান্ত হুকুম-আহকাম ‘ইবাদত’ অধ্যায় উল্লেখ করা হয়েছে নামায সংক্রন্ত হুকুম-আহকামের পরে পরে। [এটা অধিকাংশ ফিকাহর কিতাব সম্পর্কে সত্য। সংখ্যক কিতাবে অবশ্য নামাযের পর রোযা সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে। তার ভিওি হচ্ছে, এই দুটিই দৈহিক ইবাদত অর্থাৎ এ দুটি পালনে দৈহিক কষ্ট ও শারীরিক কৃচ্ছ্রতা সহ্য করতে হয়। কিন্তু যাকাত হচ্ছে শুধু আর্থিক ইবাদত আর হজ্জ আর্থিক ও দৈহিক উভয় দিকের ইবাদত এক সাথে।] তাতে কুরআন ও সুন্নাহকেই অনুসরণ করা হয়েছে। যাকাতে ইবাদতের ভাবধারা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠা সও্বেও তাতে একটা মহান মানিবিক কল্যাণের লক্ষ্য প্রকট হয়ে আছে। তা নৈতিকতার দিক দিয়ে অতি উন্নতমানের আদর্শও বটে। উচ্চতর আধ্যাত্মিক মূল্যমানও তাতে নিহিত রয়েছে। ইসলাম তা বাস্তবায়িত ও প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছে যাকাতের ফরয আদায়ের মাধ্যমে। উপরিউক্ত আয়াত ও হাদীসসমূহ সে বিষয়ে আমাদেরকে অবহিত করেছে। এ ছাড়া ইসলামের বহু মনীষীও এ দিকের বিস্তরিত ব্যাখ্যা দান করেছেন। প্রাথমিক যুগে মুসলমানরা যখন ইসলামী শরীয়াতকে বাস্তবে কার্যকর করেছিলেন-যেমন আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল নির্দেশ দিয়েছেন, তখন এ সব মহান লক্ষ্য বাস্তবায়িত হয়ে ফুটে উঠেছিল, ব্যক্তি মুসলিমের জীবনে তার প্রভাব স্পষ্ট ও প্রকট হয়ে উঠেছিল। আর ইসলামী সমাজ সমষ্টি সে অপূর্ব ভাবধারায় পরিপূর্ণ হয়ে ভরে উঠেছিল। দুনিয়ার চক্ষুসমূহের সম্মুখে তা জ্বচলজ্বল করছিল। এসব লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নেহায়েত বস্তুগত নয় আদৌ। নয় একান্তভাবে আধ্যত্মিক। এ বস্তুগত ওও আধ্যাত্মিক উভয় দিকই সমম্বিত ছিল তাতে। আধ্যত্মিক ও নৈতিক লক্ষ্যের অবদান সেখানে সর্বোতভাবে একাকার হয়ে দেখা দিয়েছিল অর্থনৈতিক ও ভারসাম্যপূর্ণ দৈনন্দিন জীবনের ক্ষেত্রে। এ লক্ষ্যসমূহ নিছক ব্যক্তিকেন্দ্রিক নয় যেমন, তেমনি নয় নিছক সামষ্টিক। তার অনেকগুলি ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে প্রতিভাত হয়, সে যাকাতদাতা হোক কি গ্রহীতা। আবার তার অনেকগুলো ভাবধারা মুসলিম সমাজে প্রতিফলিত হয় তার লক্ষ্য বাস্তবায়নে, তার কল্যাণময় দায়িত্বের সম্প্রসারণে এবং তার সমস্যাসমূহের সুষ্ঠু সমাধানে। পরবর্তী অধ্যায়টি দুটি মৌলিক পরিচ্ছেদে বিভক্ত। প্রথমঃ যাকাতের লক্ষ্য ও মসলিম ব্যক্তির জীবনে তার প্রভাব পর্যায়ের আলোচনা। আর দ্বিতীয়ঃ যাকাতের লক্ষ্য ও মুসলিম সমাজের ওপর তার প্রভাব সংক্রন্ত আলোচনা। প্রথম পরিচ্ছেদ ব্যক্তি জীবনে যাকাতের লক্ষ্য ও প্রভাব এ পরিচ্ছেদে দুটি আলোচনা সংযোজিত হচ্ছেঃ প্রথম, যাকাতের লক্ষ্য- দাতার প্রসঙ্গে। দাতা হচ্ছে সেই ধনী ব্যক্তি, যার ওপর যাকাত ফরয হয়েছে। আ দ্বিতীয়, যাকাতের লক্ষ্য- গ্রহণকারীরও তা থেকে উপকার প্রাপ্ত ব্যক্তির প্রসঙ্গে। এ সেই অভাবগ্রস্ত লোক যাকে যাকাত দেয়া হয় এবং যাকাত ব্যয় করা হয় এমন লোকের জন্যে যার প্রতি মুসলমানরা ঠেকা- যেমন মুয়াল্লাফাতু কুলুবুহুম, ঋণগ্রস্ত, পারস্পরিক বিবাদ মীমাংসার্থে, আল্লাহ্র পথের যোদ্ধা, যাকারেত জন্যে নিযুক্ত কর্মচারী। এসব লোক যাকাতের সামষ্টিক লক্ষ্য সংক্রান্ত আলোচনার অন্তর্ভুক্ত হবে। প্রথম আলোচনা যাকাতের লক্ষ্য ও দাতার জীবনে তার প্রভাব যাকাত বিধান জারি করার মূলে ইসলামের লক্ষ্য শুধু মাল সম্পদ সংগ্রাহ করা নয়। রাষ্টীয় ভান্ডার বিপুল সম্পদ সম্ভারে ভরপুর হবে, তাই একমাত্র কাম্য নয়। দুর্বল, অক্ষম ও অভাবগ্রস্ত লোকদের সাহায্য-সহযোগিতা ও তাদের দুঃখ-দারিদ্র্য দুরীভূত করাই কেবল উদ্দেশ্য নয়। বরং তার প্রথম লক্ষ্য, মানুষ বস্তুর ঊর্ধ্বে উঠবে; বস্তুর দাসানুদাস নয়, তার পরিচালক, নিয়ন্ত্রক ও কর্তা হয়ে বসবে। এখানে থেকেই দাতার ব্যাপারে যাকাতের লক্ষ্য, তার কাছ থেকে যাকাত গ্রহণের পূর্ণ মাত্রার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। মানুষের সাধারণভাবে ধার্যকৃত কর থেকে যাকাত একটি ফরয কার্যরূপে বিশেষ বিশেষত্বের অধিকারী হয়েছে। কেননা ‘কর’ ধার্যকরণে দাতাকে রাষ্ট্রীয় ভান্ডারের একটি আয়ের মাধ্যম কিংবা ভান্ডারে ভর্তিকারী ছাড়া অন্য কোন দৃষ্টিতে বিবেচনা করা হয় না। কুরআন মজীদ যাকাতের লক্ষ্যের ব্যাখ্যায় সেই ধনীদের প্রতি গুরুত্বের লক্ষ্য আরোপ করেছে, যাদের কাছ থেকে যাকাত গ্রহণ করা হয়ং কয়েকটি অক্ষরের সমন্বয়ে গড়া দুটি সংক্ষিপ্ত শব্দে তা বিবৃত হয়েছে। কিন্তু এ সংক্ষিপ্ত শব্দদ্বয় যাকাতের বিপুল গভীর তও্ব ও তার বিরাট মহান লক্ষ্যে সমৃদ্ধ হয়ে আছে। সে শব্দদ্বয় হচ্ছেঃ (আরব*************) ‘পবিত্রকরণ’, এবং (আরবী************) ‘পরিশুদ্ধকরণ’ কুরআনের আয়াতে এ শব্দদ্বয় বিশেষ গুরুত্ব সহকারে ব্যবহৃত হয়েছে। আয়াতটি হচ্ছেঃ (আরবী**************) তাদের ধন-মাল থেকে তুনি যাকাত গ্রহণ কর, তুমি তার দ্বারা তাদের পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করবে। এই ‘পবিত্রকরণ’ ও ‘পরিশুদ্ধকরণ’ শব্দদ্বয়ের মধ্যে পূর্ণমাত্রার পবিত্রতা ও পরিশুদ্ধতা নিহিত। তা বস্তুগত হোক, কি তাৎপর্যগত, তা ধনীর আত্মা, মন-মানসিকতা ও তার যাকতীয় মাল ও সম্পদ পূর্ণঙ্গভাবে পরিব্যাপ্ত। পরবর্তী বাক্যসমূহের দ্বারা আমরা তার বিস্তারিত বিশ্লেষণ পেশ করব। যাকাত লোভ নিবারক ও তা থেকে পবিত্রকারী মুসলিম ব্যক্তি আল্লাহ্র আদেশ পালন ও তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে যে যাকাত প্রদান করে, তা তার নিজের জন্যে পবিত্রকারী সাধারণভাবে সমস্ত গুনাহের মালিনতা-কলুষতা থেকে এবং বিশেষভাবে লোভ ও কার্পণ্যের হীনতা, নীচতা, সংকীর্ণতা থেকে। বস্তুত লোভ ও কার্পণ্য খুবই ঘৃণ্য ও নিন্দিত, মানব মন তাতে খুব বেশী আক্রান্ত হয়ে পড়ে, তার আনীত কঠিন বিগদে নিমজ্জিত হয়। আল্লাহ তা‘আলা মানুষের অন্তঃকরণ বাগানে মনস্তাও্বিক বা প্রকৃতিগত প্রতিরোধের বৃক্ষ রোপণ করার ইচ্ছা করলেন, যা মানুষকে পৃথিবীতে চেষ্টা-সাধনা ও সংগঠনের প্রচিষ্টায় নিয়োজিত করে। মানুষের মধ্যে রয়েছে আত্মপ্রেম এবং ধন-সম্পদের মালিক হওয়ার লিন্সা ও স্পৃহা, দুনিয়ায় স্থিতি লাভের প্রেরণা। এ সব প্রকৃতিগত ভাবধারার লক্ষণ ও প্রকাশক হচ্ছে ব্যক্তির লোভ ও কার্পণ্য নিয়ে যা তা হাতে রয়েছে। অন্য মানুষের তুলনায় নিজেকে বেশী বেশী কল্যাণ ও মুনাফা-সুবিধার দৌলতে সমৃদ্ধ করে তোলার কামনা ও বাসনা। কুরআনে বলা হয়েছেঃ (আরবী*************) মানুষ বড় সংকীর্ণমনা হয়ে পড়েছে। [আরবী*************] আরবী*************) মনকে কার্পণ্য ও লোভ পরিব্যাপ্ত করে নিয়েছে। [আরবী****************] অতএব ক্রমোন্নতিশীল বা মুমিন মানুষের জন্যে তার মনের জগতে, প্রভাব বিস্তারকারী স্বর্থপরতা ও আত্মম্ভরিতার প্রতিরোধঘকারী ভাবধারা প্রবল হয়ে ওঠা একান্তই অপরিহার্য ছিল। আবশ্যক ছিল ঈমানী শক্তির বলে লোভ-লালসার লেলিহান জিহ্বাকে দমন করার ব্যবস্থা গ্রহণ করার। আর প্রকৃতপক্ষেই এ মারাত্মক লোভ ও কার্পণ্যের ওপর বিজয়ী হয়ে ওঠা ছাড়া দুনিয়া ও আখিরাতে তার কল্যাণ লাভের আর কোনই উপায় ছিল না। বস্তুত লোভ ও কার্পণ্য একটি কঠিনতর বিপদ-ব্যক্তির জন্যেও যেমন, সমষ্টির জন্যেও তেমন। যার ওপর তা সওয়ার হয়, তাকে রক্তপাতের দিকে তাড়িত করে, মান মর্যাদা নষ্ট হওয়ার কারণ ঘটায়। দ্বীন লংঘন করতে ও দেশ মাতৃকাকে শত্রুর হাতে বিক্রয় করে দিতেও প্ররোচিত করে। এ জন্যেই রাসূলে করীম (স) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি এ লোভ ও কার্পণ্যেকে কয়েকটি মারাত্মক বিধ্বংসী ভাবধারার মধ্যে গণ্য করেছেন এবং বলেছেনঃ তিনটি ভাবধারা খুবই বিধ্বংসী-লোভ, যা অনুসৃত হয় লালসা-যা পূরণে নিয়োজিত হতে হয় এবং ব্যক্তির নিজেকে নিয়ে বড়ত্ব বোধ ও আত্ম-অংহকার। [হাদীসটি তাবারানী তাঁর (আরবী**************) গ্রন্থে ইবনে উমর থেকে যয়ীফ সনদসূত্রে উদ্ধৃত করেছেন, যেমন (আরবী****************) গ্রন্থে বলঅ হয়েছে।] আল্লাহ তা‘আলাও ইরশাদ করেছেনঃ (আরবী****************) যারাই তাদের মন মানসের লোভ ও কার্পণ্যকে রোধ করতে সক্ষম হবে, তারাই কল্যাণধন্য ও সাফল্যমন্ডিত হবে। [আরবী******************] কুরআনে এই একই আয়াতে দুবার উদ্ধৃত হয়েছে। যারাই এ মারাত্মক রোগ থেকে নিজেদের বাঁচাতে পারবে, তারাই সফলকাম হবে, এটাই তিনি বোঝাতে ও সেদিকে উদ্ধুদ্ধ করতে চেয়েছেন। নবী করীম (স) ভাষণ দান প্রসঙ্গ বলেছেনঃ তোমরা লোভ ও কার্পণ্য থেকে দূরে থাকবে। কেননা তোমাদের পূর্ববর্তীরা এ লোভ ও কার্পণ্যর দরুনই তো ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। এ লোভই তাদেরকে কার্পণ্যে উদ্ধুদ্ধ করেছে। ফলে তারা কার্পণ্য করতে শুরু করেছে। তা তাদেরকে নিকটাত্মীয়দের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করতে আদিষ্ট করেছে। তারা তাই করেছে, যা তাদেরকে শরীয়াতের বিধান লংঘন করে পাপানুষ্ঠানে প্ররোচিত করেছে, ফলে তারা তা-ই করেছে। [হাদীসটি আবূ দাউদ ও নাসায়ী উদ্ধৃত করেছেন। দেখুনঃ (আরবী***************)] এই বিচারে যাকাত বাস্তবিকই পবিত্রতাকারী অর্থঃ তা ব্যক্তিকে বিধ্বংসী- লোভ কার্পণ্য-কলূষতা থেকে পবিত্র করে দেয়। এ পবিত্রকরণ কার্যটি হবে যতটা তাকে প্রয়োগ ও কার্যকর করা হবে। এ কার্পণ্য যতটা দূল করা যাবে ততটাই তার হৃদয় উৎফুল্ল হয়ে উঠবে। নিজেকে যত বেশী আল্লাহমুখী করতে পারবে, তার চিওও ততটা স্ফূরিত হবে। যাকাত যেমন মন পবিত্রকরণের লক্ষ্যকে বাস্তবায়িত করে, মনকে ঠিক সেই অনুপাতে মুক্ত ও স্বাধীনচেতা বানিয়ে দেয়, তার মুক্তি মালের বন্ধনের যিল্লাতী থেকে, মনের কাতরতা ও অধোগতি থেকে, টাকা-পয়সার দাসত্বের হীনতা-নীচতা থেকে। কেননা ইসলাম চায়, মুসলিম ব্যক্তি কেবলমাত্র আল্লাহ্র বান্দা হোক, অন্য সব কিছুর অধীনতা আনুগত্য থেকে মানুষ সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে উঠুক। এ বিশ্বলোকে যা কিছু আছে-বস্তুগত উপাদান উপকরণ ও দ্রব্য সামগ্রী মানুষ সেই সবকিছুর কর্তা ও নিয়ন্ত্রক হয়ে দাঁড়াক। আল্লাহ তো মানুষকে পৃথিবীর বুকে তাঁর খলীফা ও সৃষ্টির সেরা বানিয়েছেন। কিন্তু সে শুরু করে দিয়েছে নিজের নফসের দাসত্ব করতে, বস্তু ও সম্পদের উপাসনা করতে-এর চাইতে দুঃখের বিষয় আর কী হতে পারে! এর চাইতে বড় দুঃখ ও লজ্জার ব্যাপার আর কি হতে পারে, ধনসম্পদ সংগ্রহ করাকেই মানুষ তার জীবনের লক্ষ্য ও সবচাইতে বেশী চিন্তার বিষয়রূপে নির্দিষ্ট করেছেন। তার জ্ঞানের চূড়ান্ত পরিধি বানিয়েছে, জীবনের লীলাকেন্দ্র বানিয়েছে, এ ধনসম্পদকে। অথচ আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে একটা বিরাট দায়িত্ব দিয়ে দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন। তার লক্ষ্য তো খুবই উঁচু অতীব মহান। সন্দেহ নেই, নবুয়তের দ্বীপস্তম্ভ থেকে জ্যোতি এসেছে-ছড়িয়ে পড়েছে চতুর্দিকে। মুসলিমকে এই দুঃখজনক অবস্থা সম্পর্কে নানাভাবে হুশিয়ার ও সাবধান করে দিয়েছে। কেননা তার অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে আল্লাহ ছাড়া অন্য শক্তির দাসত্ব ও আনুগত্য। রাসূলের বাণীঃ টাকা-পয়সার দাস হতভাগ্য, অর্থ সম্পদের দাস ভাগ্যহত। মখমল বস্ত্রের দাস ভাগ্যহীন………. এদের জন্য দুঃখ। তারা দুঃখ কুড়িয়েছে এবং বারবার সেই অবস্থায় ফিরে এসেছে। আর যখনই বাধাদান করা হয়েছে, তখনই স্ফীত হয়ে উঠেছে। [বুখারী, কিতাবুল জিহাদ ও রিকাক এ এবং ইবনে মাজা (আরবী***********)- এ উদ্ধৃত।] যাকাত অর্থদান ও ব্যয়ে অভ্যস্ত করে যাকাত যেমন মুসলিম ব্যক্তির মন-মানসকে লোভ থেকে পবিত্র করে, তেমনি অর্থদান, সাধারণ ব্যয় ও ত্যাগ স্বীকারে অভ্যস্ত হতেও সাহায্য করে। নৈতিকতা ও প্রশিক্ষণ পারদর্শী বিশেষজ্ঞগণের মধ্যে এ বিষয়ে কোন মতপার্থক্য নেই যে, মানুষের আদত অভ্যাসের একটা গভীর প্রভাব রয়েছে মানুষের চরিত্রে, আচারণ-আহরণে ও তার লক্ষ্য নির্ধারণে। এ কারণেই তো বলা হয়ঃ ‘অভ্যাস দ্বিতীয় প্রকৃতি’ তার অর্থ, অভ্যাসের একটা শক্তি ও আধিপত্য রয়েছে, যা মানুষের জন্মগত প্রথম প্রকৃতির অনুরূপ দৃঢ়তামূলক হয়ে থাকে। যে মুসলমান অর্থ ব্যয় এবং ফসল কাটার সাথে সাথেই তার যাকাত ‘ওশর’ ও তার অন্যান্য আয়ের যখনই তা পাওয়া যায় যাকাত বের করে দিতে অভ্যস্ত হয়, তার গবাদি পশুর ও ব্যবসায় পণ্যের যাকাত বছর পূর্ণ হতেই দিয়ে দেয়, ঈদুল ফিতর নামযের পূর্বেই যে ফিতরা-যাকাত দরিদ্রদের মধ্যে বণ্টন করে, এ মুসলমান দান ও অর্থব্যয়ের একটা মৌলিক গুণের অধিকারী হতে পারে। তার এই চরিত্রের প্রকৃতির গভীরে শিকড় গেড়ে ও ছড়িয়ে দিয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়াতে পারে। এ কারণে এ চরিত্রটি কুরআনের দৃষ্টিতে মুওাকী মমিনের একটা অন্যতম গুণ হয়ে রয়েছে। মানুষ যখন মহান গ্রন্থ খুলে বসে ও সূরা আল-ফাতিহা পাঠের পর পরবর্তী পৃষ্ঠার দিকে তাকায় সূরা আল-বাকারা পাঠের উদ্দেশ্যে সেখানেই মুওাকীদের গুণাবলী পড়তে পারে। যারা মহান কিতাক পাঠে উপকৃত হতে পারে, তারা হচ্ছেঃ (আরবী**************) এই কিতাব………। কোন সন্দেহ নেই এতে। তা মুওাকীদের জন্যে হেদায়েত,(মুওাকী) তারা, যারা গায়েবের প্রতি ঈমান রাখে, নামায কায়েম করে এবং আমরা তাদের যে রিযিক দিয়েছি, তা থেকে ব্যয় করে। [আরবী************] এর পূর্বেও-আয়াতটি মদীনায় অবর্তীর্ণ-মক্কায় অবতীর্ণ কুরআনে মুমিনদের এ অন্যমত মহান চরিত্র সম্পর্কে কথা বলতে ভুলে যাওয়া হয়নি। মক্কায় অবতীর্ণ সূরা (আরবী************) তে বলা হয়েছেঃ (আরবী**************) তোমাদেরকে যে জিনিসই দেয়া হয়েছে তা নিছক দুনিয়ার জীবনের সামগ্রী। আর যা আল্লাহ্র কাছে রয়েছে তা অতীব উওম ও স্থায়ী তাদের জন্যে, যারা ঈমান এনেছে। তারা যখন রাগাম্বিত হয়, ক্ষমা করে দেয়। আর যারা তাদের আল্লাহ্র আহ্বানে সাড়া দেয়, নামায কায়েম করে তাদের যাবতীয় ব্যাপার পারস্পরিক পরামর্শের ভিওিতে আঞ্জাম পায় এবং আমরা যে রিযিক দিয়েছি, তা থেকে তারা ব্যয় করে। [আরবী***************] এ কথার তাৎপর্য নির্ধারণে তাফসীরকারদের বিভিন্ন মত রয়েছে। কেউ বলেছেন, তার অর্থ ফরয যাকাত দেয়। হযরত ইবনে আব্বাসের মতরূপে বর্ণিত। কেননা এখানে নামায কায়েম করার কথার সাথেই ‘ইনফাক’ অর্থ ব্যয় করার কথা বলা হয়ছে। অতএব তার অর্থ হবে যাকাত প্রদান। কারো মতে নফল দান-সাদকা। দহহাক এ মত দিয়েছেন বলে বর্ণিত। তাঁরা দৃষ্টি এদিকে নিবদ্ধ যে, যাকাতের কথা কুরআনের বিশেষভাবে সেই শদ্বেই বলা হয়েছে। অন্য কারো কারো মতে পরিবার-পরিজনের জন্যে অর্থ ব্যয় করার কথা হলা হয়েছে। অন্যদের মত হচ্ছে, শদ্বটি সাধারণ অর্থবোধক, সর্ব প্রকারের অর্থ ব্যয়ই এর অন্তর্ভুক্ত। [দেখুনঃ (আরবী*************] এ কথাটাই যথার্থ। এরই আলোকে গোটা আয়াত অধ্যয়ন ও অনুধাবন আবশ্যক। এখানকার কথা ফরয যাকাত কিংবা নফল সাদ্কা অথবা পরিবার-পরিজনের জন্যে ব্যয় থেকেও অধিক ব্যাপক ও বিস্তীর্ণ। আসলে মুমিনদের চরিত্রসমূহের এ একটা বিশেষ চরিত্র গুণঃ (আরবী**************) যারা তাদের ধন-মাল ব্যয় করে রাতে ও দিনে গোপনে ও প্রকাশ্যে [আরবী***********] (আরবী***********) যারা ব্যয় করে স্বচ্ছন্দ অবস্থায় এবং অভাব-অনটনের সময়। [আরবী***********] (আরবী*************) আর ধৈর্যশীল, সত্যবাদী, বিনয়ী, অনুগত, ব্যয়কারী এবং শেষ রাতে মাগফিরাতে কামনাকারী……। [] মক্কী আয়াতসমূহে মুওাকীদের যে গুণাবলীর উল্লেখ হয়েছে, তাও এ কথাই বোঝায়ঃ (আরবী***************) নিংসন্দেহে মুওাকীগণ জান্নাতে ও ঝর্ণাধারাসমূহে অবস্থান করবে, গ্রহণকারী হবে তাদের আল্লাহ তাদেরকে যা দিয়েছেন তার। পূর্বে তারা ইহসানের নীতির অনুসারী ছিল্ রাতে তারা খুব কমই নিদ্রা যেত। শেষ রাতে তারা মাগফিরাত চাইত এবং তাদের ধন-মালে হক রয়েছে প্রার্থনাকারী ও বঞ্চিতের জন্যে। [আরবী***************] (আরব***************) মানুষ খুবই সংকীর্ণমনা-ছোট আত্মার-সৃষ্ট হয়েছে। তার ওপর যখন বিপদ আসে, তখন ঘাবড়িয়ে ওঠে এবং যখন স্বচ্ছন্দ্য-সচ্ছলতা আসে তখন সে কার্পণ্য করতে শুরু করে। কিন্তু সেসব লোক (এই জন্মগত দুর্বলতা থেকে মুক্ত) যারা নামাযী, যারা নিজেদের নামায রীতিমত আদায় করে, যাদের ধন-মালে প্রার্থনাকারী ও বঞ্চিতের একটা নির্দিষ্ট হক রয়েছে। [আরবী**************] যারা অর্থ ব্যয় করতে অভ্যস্ত নিজেদের তহবিল থেকে অন্যদের জন্যে, ভাইদের প্রতি সহানুভূতিস্বরূপ নিজেদের মালিকানা থেকে ত্যাগ স্বীকার করে এবং নিজেদের জাতির সামষ্টিক কল্যাণের লক্ষ্যে তারা অন্য লোকের ধন-মাল ও মালিকানার ওপর হস্তক্ষেপ করা- চুরি বা অপহরণ থেকে অবশ্য অবশ্যই বিরত থাকবে। যারা নিজেদের ধন-মাল আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভের লক্ষ্যে অন্যদের দান করে, তাদের পক্ষে যা তাদের নয় তা হস্তগত করা খুবেই কঠিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। কেননা তাতে আল্লাহ্র গজবই তো টেনেস আনা হবে নিজেদের ওপর। মক্কায় প্রাথমিক দিক দিয়ে অবতীর্ণ সূরাসমূহের অন্যতম হচ্ছে সূরা ‘আল-লাইন’। তাতে আল্লাহ তা‘আলা কসম খেয়ে বলেছেনঃ (আরবী*************) রাত্রির শপথ, যখন তা আচ্ছন্ন করে নেয় শপথ দিনের যখন তা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। শপথ সেই সওার যিনি পুরুষ ও স্ত্রী সৃষ্টি করেছেন। আসলে তোমাদের চেষ্টা-প্রচেষ্টা বিভিন্ন ধরন ও প্রকারের। পরন্তু যে লোক (আল্লাহ্র পথে) ধন-মাল দিল (আল্লাহ্র নাফরমানী থেকে) আত্মরক্ষা করল এবং কল্যাণ ও মঙ্গলকে সত্য মেনে নিল, তাকে আমি সহজ পথে চলার সহজতা দান করব। আর যে কার্পণ্য করল , তার জন্যে আমি শক্ত ও দুষ্কর পথের সহজতা বিধান করব। তার ধন-মাল কোন্ কাজে আসবে-যখন সে-ই ধ্বংস হয়ে যাবে। পথ-প্রদর্শন নিঃসন্দেহে আমরাই দায়িত্ব। আর পরকাল ও ইহকালের সত্যিকার মালিক তো আমিই। অতএব আমি তোমাকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে দিলাম জ্বলন্ত অগ্নিস্ফুলিঙ্গ সম্পর্কে। তাতে ভম্মীভূত কেউই হবে না, হবে কেবল সেই চরম হতভাগ্য ব্যক্তি যে অমান্য করল ও মুখ ফিরিয়ে নিল। আর তা থেকে দূরে রাখা হবে সেই অতিশয় পরহেজগার ব্যক্তিকে, যে পবিত্রতা অর্জনের লক্ষ্যে নিজের ধন-মাল দান করে। তার ওপর কারো অনুগ্রহ এমন নেই, যার বদলা তাকে দিতে হতে পারে, সে তো শুধু নিজের মহান শ্রেষ্ঠ আল্লাহ্র সন্তোষ লাভের উদ্দেশ্যে এ কাজ করে। তিনি অবশ্যই (তার প্রতি) সন্তুষ্ট হবেন। এক ভাগের লোকদের আল্লাহ প্রশংসা করেছেন এবং তাদের জন্যে সহজতা বিধানেরও ওয়াদা করেছেন। কেননা সে দিয়েছে, আল্লাহকে ভয় করেছে, পরম সত্যকে সত্য বলে মেনে নিয়েছে। তাহলে ‘দান’ তাকওয়া ও মহান পরম সত্যকে সত্য বলে জানার ও মানার দিক দিয়ে একটা অতীব মৌলিক গুণ বিশেষ। কুরআন তার এ ‘দান’ করার গুণের উল্লেখ করেছে; কি দিয়েছে, কত দিয়েছে, কোন্ প্রকারের ও কোন্ প্রজাতীয় জিনিস দান করেছে তা বলেনি। সেদিকে ভ্রূক্ষেপও করেনি। কেননা তার লক্ষ্য হচ্ছে এমন মহান আত্ম গড়ে তোলা যা হবে দানশীল, ব্যয় ও ত্যাগ স্বীকারকারী। নিষিদ্ধকারী ও পরশ্রীকাতর নয়। তাই বলতে হবে দানশীল আত্ম ও মনই হচ্ছে কল্যাণকর ও ইহসানের নীতির অনুসরণকারী, যার প্রকৃতিই হচ্ছে লোকদের প্রতি দয়া ও অনুগ্রহ করা, ধন-মাল লোকদের দান করা। সে তার ভাল জিনিস দেয়-নিজেকে ও অন্য মানুষকেও। তা যেন একটা প্রস্রবণ, তা পান করে ও করিয়ে বিপুল সংখ্যক লোক পরিতৃপ্ত হচ্ছে। পান করিয়েছে তাদের যানবাহন, চতুষ্পদ জন্তু ও তাদের কৃষি ক্ষেতকে। তারা তা থেকে উপকৃত হয় যেমন তারা ইচ্ছা করে। তা এই কাজের জন্যে খুবই সহজলভ্য। এ ধরনের মানুষ সব সময়ই বরকত লাভে ধন্য-যেখানেই প্রয়োজন কল্যাণ করতে ব্রতী হয়ে যায়। এর শুভ প্রতিফল হচ্ছে আল্লাহ তাকে ‘মহাসহজতার জন্যে (জান্নাতের জন্যে) সহজতা দান করবে, যেমন তার মন দান-এর জন্যে সহজপন্থী ছিল। অপর ধরনের লোক এর প্রতিকূলে, আল্লাহ তাদের নিন্দা করেছেন, এবং কঠিনতর দিক সহজ করে দেন। কেননা তারা কার্পণ্য করেছে তারা বিমুখ হয়েছে এবং মহাসুন্দরকে অস্বঅকার করেছে। এ লোকেরা লোভী, পরশ্রীকাতর, নিজেদের ধন-মালের কার্পণ্যৗ করেছে। নিজেদেরকে আল্লাহ থেকেও বিমুখ লোকদের থেকেও মুখাপেক্ষীহীন বানিয়েছে। আল্লাহ সত্যিকার মুমিনদের জন্যে যে উওম পরিণতির ওয়াদা করেছেন তাকে অসত্য মনে করেছে। এ কারণে আল্লাহ তাদেরকে জ্বলন্ত আগুনের ভয় দেখিয়েছেন। তাতে যাবে শুধু সেই হতভাগ্য ব্যক্তি যে সত্যকে সত্য বলে মেনে নেয়নি এবং বিমুখ হয়ে গেছে। যেমন মহাসুন্দরকে যে লোক অসত্য মনে করে এবং দান ও তাকওয়া থেকে বিরত থাকে। আর তা থেকে দূরে রাখা হবে সেই অতিশয় পরহিজগার ব্যক্তিকে, যে পবিত্রতা অর্জনের লক্ষ্যে নিজের ধন-মাল দান করে। তার ওপর কারো অনুগ্রহ নিয়ামত এমন নেই, যার বদলা তাকে দিতে হতে পারে। সে তো শুধু নিজের মহান শ্রেষ্ঠ আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যেই এ কাজ করে। তিনি অবশ্যই (তার প্রতি) সন্তুষ্ট হবেন। আল্লাহ্ন চরিত্রে ভূষিত হওয়া মানুষ যদি কার্পণ্য ও লোভ থেকে পবিত্র হতে পারে, দান-ব্যয় ও ত্যাগ স্বীকারে অভ্যস্ত হতে পারে, তাহলেই সে মানবীয় লোভের পংকিলতা-‘মানুষ বড়ই সংকীর্ণমনা হয়েছে’ [আরবী***************] বলে যেদিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে- থেকে ঊর্ধ্বে উঠতে পারে, আল্লাহ প্রদও উচ্চতর পূর্ণঙ্গ গুণাবলীতে পারে ভূষিত হতে। কেননা মহান আল্লাহ তা‘আলার অসীম গুণাবলীর অন্যতম হচ্ছে কল্যাণ, রহমত, অনুগ্রহ ও দয়া বর্ষণ-আল্লাহ্র নিজের লভ্য কোন স্বার্থ ছাড়াই। এ গুণাবলী অর্জনের উদ্দেশ্যে মানবীয় শক্তি সামর্থ্যের যতটা কুলায়-চেষ্টা চালিয়ে আল্লাহ্র চরিত্রে ভূষিত হওয়া একান্তই আবশ্যক। আর তা-ই হচ্ছে মানুষের উৎকর্ষের চরমতম মান। ইমাম আর-রাযী বলেছেন, [আরবী***************] ‘মানুষ যে ‘নফসে-নাতেকা’র দারুন মানুষ হয়েছে তার দুটি শক্তিঃ মতবাদগত এবং বাস্তব কর্মগত। মতবাদগত শক্তির পূর্ণত্ব নিহিত রয়েছে আল্লাহ্র আদেশ-আইন বিধানের বড়ত্ব স্বীকার ও তার প্রতি মর্যাদা দানে। আর বাস্তব কর্মগত শক্তির পূর্ণত্ব নিহিত রয়েছে আল্লাহ্র সৃষ্টিকুলের প্রতি দয়া-দাক্ষিণ্য করাতে। এ কারণে আল্লাহ যাকাত ফরয করেছেন, যেন আত্মর মৌল শক্তি এই পূর্ণত্ব অর্জন করতে সক্ষম হয়। আর তা হচ্ছে সৃষ্টিকুলের প্রতি দয়া অনুগ্রহশীল হওয়ার গুণে গুণান্বিত হওয়া। তাদের কল্যাণ সাধনে সদা সচেষ্ট হওয়া, তাদের ওপর আপতিত বিপদ-আপদসমূহ বিদূরণকারী হওয়া। এই তও্বকে [হাদীস হিসেবে রাসূলের এ কথাটি বর্ণনা করা হয় কিন্তু আমি কোন ভিওি পেলাম না। কে এ বর্ণনা করেছেন তাও জানা যায়নি।] সম্মুখে রেখেই নবী করীম (স) বলেছেনঃ (আরবী************) তোমরা সকলে আল্লাহ্র চরিত্রে ভূষিত হও। [এই অর্থের নিকটবর্তী একটা কথাও রয়েছে। কোন জিনিস না পেয়ে তার মুখাপেক্ষী না থাকা কোন জিনিস পেয়ে মুখাপেক্ষীহীন হওয়ার চেয়ে অনেক বড় গুণ। কেননা কোন জিনিস পেয়ে যে মুখাপেক্ষী হয় তাতে সেই জিনিসের মুখাপেক্ষিতা প্রমাণিত হয়, তবে তা পেয়ে অন্য জিনিস থেকে মুখাপেক্ষীহীনতা অর্জন করা ভিন্ন কথা। কিন্তু কোন জিনিস না পেয়ে তা থেকে যে মুখাপেক্ষীহীনতা তা হচ্ছে মহান স্রষ্টার গুণ। তাই মহান আল্লাহ যখন তাঁর কোন কোন বান্দাকে বিপুল পরিমাণ ধনসম্পদ দিলেন, তিনি তাকে প্রচুর পরিমাণ রিযিক দিলেন-এটা হল কোন জিনিস পেয়ে তা থেকে মুখাপেক্ষীহীনতা হওয়া। তিনিই যখন তাকে যাকাত দেবার নির্দেশ দিলেন তখন তার মূল লক্ষ্য হচ্ছে, কোন জিনিস পেয়ে যে মুখাপেক্ষীহীনতা সে স্তর থেকে সেই উন্নত স্তরে তাকে নিয়ে যাওয়া যা তার চেয়েও অনেক বেশী মূল্যবান ও মর্যাদাসম্পন্ন। আর তা হচ্ছে জিনিস পেয়ে তা থেকে মুখাপেক্ষীহীন হওয়া।] এহেন চরিত্র এবং সেই আত্ম-যাকে ইসলাম মুসলমানদের মধ্যে যাকাত প্রথার মাধ্যমে সৃষ্টি ও লালন করেছে-ত্যাগের চরিত্র ও কল্যাণের ভাবধারা-তা সেই সদা প্রবহমান ও সর্বক্ষণ কার্যকর দান-সদকাসমূহ যা মুসলিম মহান ব্যক্তিগণ তাঁদের পরবর্তীকালের লোকদের উপকারার্থে রেখে গেছেন। কল্যাণমূলক ওয়াকফ ব্যবস্থা তাপর উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত। কল্যাণমূলক কাজের ঐকান্তিক আগ্রহে মুসলমানগণ ওয়াকফ ব্যবস্থা কায়েম করে তুলনাহীন দৃষ্টান্ত। রেখে গেছেন। তাদের দিলে যে মানুষের প্রতি কল্যাণবোধ ও আন্তরিক দরদ ছিল তারও প্রমাণ রেখে গেছেন। বিভিন্ন প্রয়োজনে তাদরে এই ভাবধারার ব্যাপকতা লক্ষ্য করা যায়। লোকেরা বহু প্রকারের প্রয়োজনে বস্তুগত বা তাৎপর্যগহত সাহায্যের মুখাপেক্ষী ছিল-বিভিন্ন জাতি ও বিভিন্ন শ্রেণীর লোক তারা। বরং মানব-বংশ ছাড়া কোন কোন জীবের ক্ষেত্রেও তাই। [এই পর্যায়ের কিছু নমুনা দেখা যাবে এ গ্রন্থকার প্রণীত (আরবী******************) গ্রন্থের (আরবী*************) পরিচ্ছেদ।] যাকাত আল্লাহ্র নিয়ামতের শোকর এ কথা সর্বজনবিদিত যে, সুন্দরকে সুন্দর বলে স্বীকার করা এবং নিয়ামরেত শোকর-দাতার কৃতজ্ঞতা একান্তই অপরিহার্য। মানুষের বিবেক তার জন্যে তাড়া করে, প্রকৃতি এর প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে, নৈতিকতা তার দাবি করে এবং সকল প্রকার ধর্ম ও আইন ব্যবস্থা সেজন্যে বিশেষভাবে উৎসাহ দান করে। যাকাতদাতার মন-মানসিকতায় আল্লাহ্র শোকরের ভাবধারা জাগিয়ে দেয়। ইমাম গাযালী যেমন বলেছেন, আল্লাহ্র বান্দাগণের ওপর অফুরন্ত নিয়ামত-তার মনে, তার ধন-মালে। দৈহিক ইবাদাতসমূহগ দৈহিক নিয়ামতের শোকর, আর্থিক নিয়ামতের শোকর হয় আর্থিক ইবাদত পালন করে। যে দরিদ্র ব্যক্তির রিযিক সংকীর্ণ, নানাভাবে অভাবগ্রস্ত তার প্রতি যার দৃষ্টি পড়ে, তারপরও যার মনে আল্লাহ্র শোকরের ভাবধারা জাগে না এই ভেবে যে, আল্লাহ তাকে অন্য মানুষের কাছে ভিক্ষার হাত দরাজ করার হীনতা থেকে মুক্ত রেখেছেন এবং সে তার সম্পদের দশ ভাগের এক ভাগের এক-চতুর্থাংশ কিংবা দশ ভাগের এক ভাগ ফসল দিয়ে তার শোকর আদায় করে না, তার মত সংকীর্ণমনা ও হীন চরিত্রের লোক আর কে হতে পারে? [আরবী******************] মুসলমানদের চিন্তা ও চেতনায় যে গভীর ভাবধারা জাগ্রত হয়। তার মধ্যে একটি হচ্ছে এই ভাবধারা যে,যাকাত হচ্ছে আল্লাহ্র নিয়ামতের বিনিময়। প্রতিটি নিয়ামতের বিনিময়ে মানুষের যাকাত দেয়া একান্ত আবশ্যক-সে নিয়ামত বস্তুগত হোক, কি তাৎপর্যগত। এ কারণে মুসলিম সমাজে এ কথা ব্যাপকভাবে প্রচারিত ও প্রচলিতঃ ‘তুমি তোমরা সুস্থতার যাকাত দাও, তোমার দৃষ্টিশক্তির যাকাত দাও, চোখের জ্যোতির মহাসৌভাগ্যের যাকাত দাও’………….. এমনিভাবে একটি নির্মল ভাবধারা মুসলিমের মনে জেগে ওঠে। হাদীসেও বলা হয়েছেঃ ‘প্রতিটি জিনিসেরই যাকাত দিতে হয়।’ [হাদীসটি ইবনে মাজাহ আবূ হুরায়রা (রা) থেকে উদ্ধৃত করেছেন। তাবারানী উদ্ধৃত করেছেন সহল ইবনে সায়দ থেকে, সুয়ূতী হাদীসটির যয়ীফ হওয়ার ইশারা করেছেন। মুনযেরী (আরবী****************) গ্রন্থেও এ দিক ইঙ্গিত করেছেন।] দুনিয়া প্রেমের চিকিৎসা অপর দিক দিয়ে যাকাত মুসলিমের মনেকে আল্লাহ্র প্রতি-পরতালের ব্যাপারে তার কর্তব্য সম্পর্কে সতর্ক করে তোলে। দুনিয়ার প্রেমে মনের ভরপুর হওয়ার-ধন-মালের জন্যে পাগলপ্রায় হওয়ার চিকিৎসা হচ্ছে এ যাকাত। এ কারণে শরীয়াতের সুষ্ঠু ব্যবস্থা হিসেবে ধন-মালের মালিককে তার মালের কিছু অংশ তার হাত থেকে বের করার জন্যে দায়িত্বশীল বানিয়ে দেয়া একান্তই যুক্তিসঙ্গত বলে মনে করেছে। এই কিছু পরিমাণ মাল আলাদা করে কাউকে দিয়ে দেয়া ধন-মালের প্রতি যে তীব্র আকর্ষণ এবং মায়া মালিকের মনে রয়েছে তা চূর্ণ করে দিতে পারে। মনকে সেদিকে সম্পূর্ণরূপে ঝুঁকিয়ে দেয়ার পথে প্রতিবন্ধক হতে পারে। তার জন্যে হুঁশিয়ারী হতে পারে এদিক দিয়ে যে, ধন-মারের সন্ধানে নিমজ্জিত হলে মানুষ পরম সৌভাগ্য লাভ করতে পারবে না। বরং পরম সৌভগ্য লাভের অন্যমত পন্থা হচ্ছে মহান আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে ধন-মাল ব্যয় করা। অতএব বলা যায়, যাকাত ফরয করা হয়েছে অন্তর থেক দুনিয়া ও ধন-মালের প্রেম রোগের সুনির্দিষ্ট ও সঠিক চিকিৎসা বিধানের লক্ষ্যে। [ও] মানব মনের ওপর মালের প্রেম আধিপত্যশীল হয়ে পড়ার পরিণতি কি হতে পরে, এ পর্যায়ে ইমাম রাযী স্পষ্ট করে বলেছেনঃ [তাঁর তাফসীর, ঐ, ১০১ পৃষ্ঠা।] ধন-মালের আধিক্য ও প্রাচুর্য শক্তির তীব্রতা ও সামর্থ্যের পূর্ণত্ব সৃষ্টি করে। আর ধন-মাল বেশী বেশী চাওয়ার মানে বেশী বেশী মক্তি লাভের চেষ্টা। আর বেশী বেশী শক্তি লাভের চেষ্টা সেই শক্তিতে বেশী বেশী স্বাদ পাওয়ার বেশী বেশী চেষ্টা চালানো। আর স্বাদ আস্বাদনের বেশী বেশী আকাঙ্ক্ষা মানুষকে বাধ্য করে সেই মাল লাভের জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা চালাতে, যা এই বেশী বেশী মাত্রার স্বাদ আস্বাদনের সুযোগ করে দেয়। এভাবে ব্যাপারটি আবর্তমশীল হয়ে দাঁড়ায়। কেননা মালের প্রাচুর্য বিধানে যদি চরম মাত্রার চেষ্টা বেশী হবে, তা-ই আবার মানুষকে বেশী বেশী মাল পাওয়ার জন্যে চেষ্টানুবর্তী বানাবে-এভাবে। আর ব্যাপারটি যখন চক্রাকারে আবর্তিত হতে থাকবে, তখন আর কোন শেষ মাত্রা বা সীমা কখনই দেখা যাবে না। এ কারণে শরীয়াত একটা শেষ পর্যায় নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। আর তা এভাবে যে, ধন-মালের মালিমের ওপর তার ধন-মালের একটা অংশ আল্লাহ্র সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে ব্যয় করার বাধ্যবাধকতা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে, যেন মনকে সেই অন্ধকারময় শেষহীন আবর্তনশীলতার চক্র থেকে নিষ্কৃতি দেয়া যায় এবং তাকে আল্লাহ্র বান্দা হওয়ার পরিমন্ডলে ফিরিয়ে এনে তাঁর সন্তুষ্টি সন্ধানে নিয়োজিত করা সম্ভব হয়। তার অর্থ আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর মুমিন বান্দাকে একটা শেষহীন চক্রের মধ্যে পড়ে অনন্ত কাল ধরে আবর্তিত হতে দেয়া পসন্দ করেন না। সে চক্রটি হচ্ছে ধন-মাল সংগ্রহ সঞ্চয়ের চক্র। তিনি তাকে স্মরণ করিয়ে দিতে চান যে, ধন-মাল একটা উপায় মাধ্যম মাত্র, চরম লক্ষ্য নয়। একটা নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছার পর তিনি তাকে বলে দিতে চানঃ থাম, যা অর্জন করেছ তা থেকে ব্যয় কর, দান কর-এর মধ্যে আল্লাহ্র হক রয়েছে, তা আলাদা করে বের করে দিয়ে দাও-ফকীরের হক দিয়ে দাও-সমাজ সমষ্টির অধিকার আদায় কর। আল্লাহ তা‘আলা মুসলমানদের জন্য ধন-মাল উপার্জন ও সঞ্চয় করাকে ‘মবাহ’ করে দিয়েছেন। দুনিয়ার যাবতীয় পাক-পরিচ্ছন্ন জিনিসই তার জন্যে জায়েয। কিন্তু তাকেই জীবনের একমাত্র চিন্তা-ধান্ধার ব্যাপার ও চরম লক্ষ্যরূপে গ্রহণ করাতে আল্লাহ আদৌ রাজী নন। কেননা মানুষ তো তার চাইতেও অনেক উঁচু ও মহান উদ্দেশ্যের জন্যে সৃষ্ট হয়েছে। তার জন্যে নির্মিত হয়েছে সেই ঘর যা চিরন্তন। এ বিশ্বলোক-এ দুনিয়া মানুষের জন্যে সৃষ্ট। আর সে নিজে সৃষ্ট পরকালের জন্যে-আল্লাহর ইবাদত করার জন্যে। এ দুনিয়াটা তো পরকালেরই পথ। মানুষ এই ‘পথ’কে সৃন্দর সুসজ্জিত করে পড়ে তুলুক, তাতে কোন দোষ নেই। কিন্তু তার একথা ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে, সে একটা লক্ষ্যের পানে চলমান, একটা মহান লক্ষ্যের জন্যেই সে চেষ্টাকারী। আল্লাহ তো ধন-মাল দেন, যাকে তিনি ভালোবাসের তাকেও, যাকে ভালোবাসেন না তাকেও। মুমিন ও কাফির উভয়কেই দেন। পাপী ও আল্লাহ্ভীরু কাউকেই বঞ্চিত রাখেন না। বলেছেনঃ (আরবী**************) এদেরকেও এবং ওদেরকেও উভয় শ্রেণীর লোকদেরকে আমরা (দুনিয়ায়) জীবনের সামগ্রী দিয়ে যাচ্ছি, এটা তোমার আল্লাহ্র দান। আর তোমারা আল্লাহ্র দানকে প্রতিরোধ করতে পারে এমন কেউ নেই। [আরবী****************] অতএব কোন লোকের হাতে ধন-মালের অবস্থিতি প্রমাণ করে না যে, সে খুবই উওম ব্যক্তি, খুবই মর্যাদাবান ব্যক্তি। বৈশিষ্ট্য মর্যাদা ও সার্বিক ভাল আল্লাহ্র জন্যে মর্যাদা পাওয়া সম্ভব। তার হাতের জিনিস ব্যয় করতে হবে সে জিনিস পাওয়ার জন্যে যা আল্লাহ্র হাতে নিবদ্ধ। ইসলামের দৃষ্টিতে ধন-মাল একটা বড় নিয়ামত, কল্যাণেল উৎস। কিন্তু তা এমন কল্যাণ যা দিয়ে মানুষের পরীক্ষা করা হয় যেমন পরীক্ষা করা হয় খারাপ জিনিস দিয়ে বলেছেনঃ (আরবী*****************) পরীক্ষার উদ্দেশ্যে আমরা তোমাদেরকে কল্যাণে নিমজ্জিত করি, অকল্যাণেও। [আরবী************] (আরবী**************) জেনে রাখ তোমাদের ধন-মাল ও তোমাদের সন্তান পরীক্ষাস্বরূপ। [আরবী**********] (আরবী***********) মানুষকে তার রব্ব যখন পরীক্ষা করেন, তখন তাকে সম্মানিত করেন এবং নিয়ামতদানে ভূষিত করেন। [আরবী********] এরূপ অবস্থায় মহাভাগ্যবান সে, যে নিজেকে ধন-মালের আমানতদার এবং তাতে সে আল্লাহ্র খলীফা মনে করে কাজ করে। আল্লাহ্র নির্দেশ অনুযায়ী তা ব্যয় করেঃ (আরবী***************) এবং তোমরা ব্যয় কর সে জিনিস থেকে, যাতে তোমাদেরকে খলীফা বানানো হয়েছে। [আরবী************] যাকাত ব্যবস্থা দুনিয়ার ফেতনা ও ধন-মালের ফেতনা থেকে রক্ষা পাওয়ার প্রশিক্ষণ দেয় মুসলিম ব্যক্তিকে এভাবে যে, তা তাকে অর্থ ব্যয়ে অভ্যস্ত করে। আল্লাহ্র আদেশ পালন এবং তাঁর সন্তুষ্টি পাওয়ার জন্যে চেষ্টা সাধনা করতে প্রস্তুত করে। দুনিয়ায় জাতিসমূহ অনেক সময় নানা বিপদের সম্মুখীন হয়। তার সমস্ত ভয়াবহ প্রস্তুতিও বন্যার তৃণখন্ডের মত ভেসে যায়, তার শত্রুরা তাতে হয়ত উওেজ্বিত হয়, তা হচ্ছে, তার লোকের চরম দুর্বলতার মধ্যে পড়ে যায়, সাহস-হিম্মত হারিয়ে ফেলে। মন-মানসিকতা চেতনাহীন হয়ে পড়ে, দৃঢ় সংকল্পবদ্ধতা কর্পূরের মত উড়ে যায়। অন্তর্নিহিত আত্ম নিহত হয়। রাসূলে করীম (স)-এর এ বিশ্লেষণ অনুযায়ী এ দুর্বলতা দুটি কারণে ঘটে থাকেঃ দুনিয়া-প্রেম ও মৃত্যুভয়। কাজেই মুসলমান যখন জানতে পরবে দুনিয়াকে পরকালের জন্যে কিভাবে ছাড়তে হয় এবং আল্লাহ্র জন্যে ধন-মল ব্যয় করতে অভ্যস্ত হবে, অন্য লোকেরা কল্যাণ কামানায়-অন্য লোকেরা প্রয়োজন পূরণে সে স্বীয় মনের লালসা-বাসনাকে দমন করতে সক্ষম হবে, তখনই এ দুর্বলতারন জমাট বাঁধা বরফ গলবে, মনে এক পরম শক্তির উন্মেষ ও বিকাশ ঘটবে আর শেষ পর্যন্ত গোটা জাতি জেগে উঠবে, শক্তিশালী হয়ে উঠবে। ধনী ব্যক্তিত্ব বিকাশে যাকাত যাকাত যে ‘তাজকিয়া’ করে, তার তাৎপর্য হচ্ছে, ধনী ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের সমৃদ্ধি, তার অন্তর্নিহিত সওার বিকাশ সাধন। তাই যে লোক কল্যাণের হাত প্রসারিত করে, ন্যায়সঙ্গত কাজ সম্পন্ন করে এবং তা নিজের ও তার হাতের সম্পদ ও শক্তি নিয়োজিত করে তার দ্বীনী ভাই ও মানবতাকে উদ্বুদ্ধ করার জন্যে, যেন তার ওপর আল্লাহ্র যে অধিকার আরোপিত তা সে যথাযথভাবে পালন করতে সক্ষম হয়, সে তার নিজের মধ্যে একটা প্রশান্তি, সম্প্রসারতা এবং তার বক্ষে উদারতা, বিশালতা-বিপুলতা অনুভব করতে শুরু করবে, যুদ্ধে বিজয়ী হওয়ার সুখ অনুভব করবে। সে কার্যতই তার দুর্বলতাকে কাটিয়ে ওঠে, তপার কূপ্রভাব থেকে মুক্ত হতে এবং তার লালসা ও লোভের শয়তানকে দমন করতে সক্ষম হয়েছে বলে মনে করবে। এটাই হচ্ছে মানসিক বিকাশ ও উৎকর্ষ-আত্মিক ঐশ্বর্য লাভ। কুরআনের আয়াতঃ (আরবী*************) থেকে আমরা এ তাৎপর্যই অনুধাবন করতে পারছি। আয়াতে (আরবী************) শব্দটি (আরবী************) শব্দের পরে ‘এবং’ বলে আনা হয়েছে। এ থেকেই উপরিউক্ত তাৎপর্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কেননা কুরআনের প্রতিটি শব্দ-প্রতি অক্ষরেরই একটা অর্থ আছে-একটা তাৎপর্য আছে। যাকাত ভালোবাসা উদ্ভাবক যাকাত ধনী ব্যক্তি এবং তার সমাজ সমষ্টির মধ্যে একটা ঘনিষ্ঠতা- একটা গভীর সূক্ষ্ম সম্পর্ক সৃষ্টি করে। এ সম্পর্কটি হয় খুবই দৃঢ়, দৃশ্ছেদ্য। ভালোবাসা ভ্রাতৃত্ব ও পারস্পরিক সহযোগিতাই এর মূল সূত্র। কেননা মানুষ যখন অন্য কারো সম্পর্কে জানতে পারে যে, তার কল্যাণে সে আগ্রহ রাখে-তার যাতে ভালো হয় সেই চেষ্টাই সে করে, তার জন্যে যা ক্ষতিকর তা সে দূর করতে চায়, তা হলে সে তাকে ভালোবাসবে স্বাভাবিকভাবেই। তার মন-মানস তার প্রতি আকৃষ্ট হতে অনিবার্যভাবে। এজন্যে হাদীসে বলা হয়েছেঃ যে লোক যার কল্যাণ করল তার হৃদলে তার জন্যে স্বাভাবিকভাবেই ভালোবাসা জাগবে। আর যে তার অকল্যাণ করেছে, তার প্রতি স্বভাবতই জাগাবে অসন্তোষ ও ক্রোধ। [ইবনে আদী (আরবী***********) গ্রন্থে উদ্ধৃত করেছেন, আবূ নয়ীম উদ্ধৃত করেছেন (আরবী***********) গ্রন্থে, আর বায়হাকী উদ্ধৃত করেছেন (আরবী*************) গ্রন্থে- ইবনে মাসুউদ থেকে, রাসূলের কথা হিসেবে। তবে সনদ যয়ীফ। বরং এটিকে ‘সউজ’ রচিত’ বলা হয়েছে। বায়হাকী অবশ্য সহীহ বলেছেন ইবনে মাসউদের কথা হিসেবে। মাথাভী বলেছেন, এটি রাসূলের কথাও নয়, সাহাবীর কথাও নয়-বাতিল। (আরবী*****************)] ফকীর-মিসকীনরাও যখন জনবে যে, এ ধনী ব্যক্তি তার ধন-মালের একটা অংশ তাদেরকে দেবে। তার ধন-মাল বেশী বেশী তাদের জন্যে, তার ব্যয়ের পরিমাণও অবশ্য বেশী হবে। তখন তারা তার জন্যে আল্লাহ্র কাছে দো‘আ করে, তার সাহস বৃদ্ধি করে। আর জনগণের এ মনোভাবের একটা প্রভাব অবশ্যই আছে। হৃদয়গুলোর উওাপ তাকে অধিক উৎসাহিত করবে। সে সব দো‘আ- আন্তারিক শুভেচ্ছো সেই ব্যক্তি সর্বক্ষণ কল্যাণকর ও মহানুভবতার কাজে নিমগ্ন থাকার কারণ হয়ে দাঁড়াবে-যেমন ইমাম রাযী বলেছেন। আল্লাহ্র এ কথায় সেদিকেই ইঙ্গিত রয়েছেঃ (আরবী*****************) যা মানুষের জন্যে কল্যাণকর তাই দুনিয়ায় টিকে থাকে। [আরবী*******************] নবী করীম (স)-এর কথাঃ (আরবী****************) তোমরা তোমাদের ধন-মাল যাকাত দ্বারা সংরক্ষিত করা। [আবূ দাঊদ ‘মুরসাল’ হিসেবে তাবারানী ও বায়হাকী প্রমুখও উদ্ধৃত করেছেন অনেক কয়জন সাহাবী থেকে রাসূলের কথা হিসেবে। সনদ ধারাবাহিক। মুনযেরী বলেছেনঃ মুরসাল হওয়াই অধিক গ্রহণীয়।] একই তাৎপর্য বহন করে। যাকাতা ধন-মালের পবিত্রতা বিধান করে যাকাত যেমন মন-অন্তর হৃদয়ের পবিত্রতা ও পিরশুদ্ধতার বিধান করে, তেমনি তা ধনীর ধন-মালের পবিত্রতা সাধন করে, তার প্রবৃদ্ধি ঘটায়। যাকাত ধন-মাল পবিত্র করে এভাবে যে, মালের সাথে অপর লোকের মাল মিলেমিশে থাকলে তা কলুষিত হয়। সেই অপরের মাল তা থেকে বের করে না দেয়া পর্যন্ত তা পবিত্র হতে পারে না। এদিকে লক্ষ্য রেখেই পূর্বকালের কেউ কেই বলেছেনঃ অপহৃত ইট কোন দালানে থাকলে তার ধ্বংস তাতেই গচ্ছিত হয়ে আছে। অনুরূপভাবে যে পয়সা ফকীর মিসকীনের-ধনীর মালের মধ্যে শামিল রয়ে গেছে, তার সবটাই তাতে কলুষিত হয়ে গেছে। এ কারণেই নবী করীম (স) বলেছেনঃ ‘তুমি যখন তোমার মালের যাকাত দিয়ে দিলে তখন তুমি তা থেকে খারাবীটা দূর করে দিলে।’ [ইবনে খুজাইমা তাঁর সহীহ প্রন্থে এবং হাকেম এ হাদীস উদ্ধৃত করেছেন হযরত জাবি থেকে। এ হাদীস সম্পর্কে কথা আছে, তা বলা হবে অষ্টম অধ্যায়ে।] রাসূলে করীম (স) থেকে বর্ণিত ও পূর্বে উদ্ধৃতঃ ‘তোমরা তোমাদের ধন-মালকে সংরক্ষিত কর’ হাদীসটি সবচাইতে বড় কথা। ধনী ব্যক্তিরা এ সংরক্ষণ ব্যবস্থার খুব বেশী মুখাপেক্ষী। বিশেষ করে আমাদের এ যুগে-যখন চারদিকে ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম চলছে ও লাল বিপ্লবের আগুন দাউ দাই করে জ্বলে উঠেছে। বস্তুত ধনীর মালের সাথে অক্ষম ফকীরের সম্পর্ক খুবই দৃঢ় ও অবিচ্ছিন্ন। এমন কি কোন কোন ফিকাহবিদ এতদূর বলেছেনঃ ‘যাকাত মূল মালের মধ্যে শামিল, তা ধনীর কোন দায়িত্বের ব্যাপারে নয়। তাই মূল মালটাই ধ্বংসের জন্যে প্রস্তুত হয়ে থাকবে যকক্ষণ না তা থেকে যাকাত বের করে দেয়া হবে। এ বিষয়েই বলা হয়েছে রাসূলে করীম (স)-এর হাদীসেঃ যাকাত যদি কোন মালের মধ্যে শামিল হয়ে মিলেমিশে থাকে তাহলে তা এ মালকে ধ্বংস করবে। কোন কোন বর্ণনায় উদ্ধৃত হয়েছেঃ ‘তোমার মালের ওপর যাকাত ফরয ধার্য হয়ে থাকতে পারে। তা যদি তুমি বের করে না দাও তাহলে হারামটা হালালটাকে ধ্বংস করবে। [এ হাদীসের সূত্র পূর্বে বলা হয়েছে।] শুধু তাই নয়, গোটা জাতির ধন-মাল হ্রাস পাওয়ার আশংকা দেখা দেয়, আসমানী মুসিবতে এসে যে সাধারণ উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং জাতীয আয়ের হার নিম্নগামী হয়ে পড়ে, তাতে বুঝতে হবে তা মহান আল্লাহ্র গজব ছাড়া আর কিছু নয়। তা নেমে এসেছে এমন সমাজ ও জাতির লোকদের ওপর যারা পরস্পরে নিরাপওার ব্যবস্থঅ করে না, পারস্পরিক সাহায্যের কোন ব্যবস্থা যাদের মধ্যে নেই, যাদের শক্তিমান ব্যক্তি তাদের দুর্বল ব্যক্তিকে ধারণা করে না। হাদীসে বলা হয়েছেঃ যে জতি যাকাত দিতে অস্বীকৃত হয়েছে সে জাতি আকাশ থেকে বৃষ্টিপাত হওয়াকে বাধা দিয়েছে। জন্তু-জানোয়াররা যদি না থাকতে তাহলে সেই অবস্থায় বৃষ্টিপাত আদৌ হত না। [এর উৎস ও সূত্র পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে।] ব্যক্তি ও সমষ্টির ধন-মাল থেকে ধ্বংস ও হ্রাসপ্রাপ্তির কারণসমূহ থেকে পবিত্রকরণ ও সংরক্ষণের একটি মাত্র পন্থা হচ্ছে, তা থেকে আল্লাহ্র হক ও গরীবের হক বের করা। আর তাই হচ্ছে যাকাত ব্যবস্থ। যাকাত হারাম মাল পবিত্র করে না আমরা যখন বলি, যাকাত ধন-মালের পবিত্রতা বিধানকারী, তার প্রবৃদ্ধির কারণ, তাতে বরকত হওয়ার উসিলা তখন আমরা হালাল মালের কথাই বলি। হালাল মাল সম্পর্কেই এ কথা প্রযোজ্য। যে মাল তার মালিক বা দখলদারের হাতে শরীয়াতসম্মত পন্থায় পৌঁছেছে, তা-ই হালাল মাল, কিন্তু খবীস খারাপ মাল তা যা অপহরণ, ছিলতাই, ঘুষ, অকারণ মূল্য বৃদ্ধিকরণ কিংবা সুদ ও জুয়া খেলা থেকে প্রাপ্ত কিংবা লোকদের ধন-মাল হরণ করার যে কোন হারাম পন্থায় লব্ধ ধন-মালকে যাকাত পবিত্র করে না, তাতে বরকত সৃষ্টি করে না। কোন কোন বুদ্ধিজীবী বিজ্ঞানী খুব সত্যই বলেছেনঃ ‘হারাম মাল যাকাত দ্বারা পবিক্রকরণটা ঠিক প্রস্রাব দিয়ে পায়খানা ধোয়ার মত।’ বড় বা ছোট বহু চোর-ডাকাত-যারা চৌর্যবৃওি বা নানা মথ্যা ও বিভ্রান্তকারী নামের অধীন লকিয়ে নেয়ার দক্ষতায় খুব খ্যাতি অর্জন করেছে-তারা মনে করে যে, তারা সুদ-ঘুষের মাধ্যমে যা উপার্জন করেছে এবং যে সব হারাম মাল সঞ্চয় করেছে তা থেকে কিছু অংশ সাদকা করে দিলেই যথেষ্ট হবে। আর এভাবে তারা যখন আল্লাহ্র কাছে ‘মকবুল’ হয়ে যাবে তখন জনগণের কাছেও নির্দোষ নিষ্পাপ ও পবিত্র সাব্যস্ত হবে। আসলে এটা একটা মিথ্যা ধারণা। ইসলাম এ ধারণাকে অসত্য বলছে, তা মেনে নিতে অস্বীকার করছে। ইসলামের নবী এ প্রসঙ্গ বলেছেনঃ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাইয়্যের পবিত্র মাহন, তিনি তাইয়্যেব-পবিত্র ছাড়া কিছুই গ্রহণ করেন না। [হাদীসটি মুসলিম, তিরমিযী (আরবী***************) উদ্ধৃত করেছেন। সহীহ বুখারীতে অনুরূপ বর্ণনা হয়েছে (আরবী****************)] বলেছেনঃ ‘যে লোক হারাম উপয়ে মাল সংগ্রহ করল, পরে তা দান করে দিল, এতে তার কোন শুভ ফল প্রাপ্য হবে না। বরং তা বোঝাটা তার ওপরই চাপবে। [হাদীসটি ইবনে খুজাইমা ও ইবনে হাব্বান তাঁদের সহীহ প্রন্থদ্বয়ে এবং হাকেম উদ্ধৃত করেছেন। হাকেম বলেছেন হাদীসটি সনদের দিকে দিয়ে সহীহ। (আরবী**************** ] আল্লাহ তা‘আলা বিশ্বাস ভঙ্গ করা বা চুরি করা মালের সাদকা (যাকাত) কবুল করেন না, অযুবিহীন নামাযও গ্রহণ করেন না। [হাদীসটি আবূ দাউদ সহীহ সনদে উদ্ধৃত করেছেন। উপরে তারই ভাষা। মুমলিমও তাঁর সহীহ গ্রন্থে তুলেছেন। (আরবী*****************)] বস্তুত এই ধরনের কলুষযুক্ত ধন-মালের যাকাত আল্লাহ তা‘আলা কবুল করেন না, যেমন অযুর পবিত্রতা ছাড়া নামায কবুল করেন না। তিনি আরও বলেছেনঃ যার মুঠোর মধ্যে আমার প্রাণ তাঁর কসম, কোন বান্দাহ যদি হারাম মাল উপার্জন করে তা দান করে তার পরিমাণ হ্রাস পাবে-তা থেকে ব্যয় করা হলে তাতে তার জন্যে কোন বরকত হবে না। আর তা তার পিঠের পিছনে রেখে দিলে তা জাহান্নামের দিকেই তার পথ প্রশস্ত করবে। আল্লাহ খারাপকে খারাপ দ্বারা দূর করেননা; বরং খারাপকে দূর করেন ভালোর দ্বারা। কেননা খারাপ খারাপকে নির্মূল করতে পারে না। [হাদীসটি আহমাদ প্রমুখ এমন সুত্রে উদ্ধৃত করেছেন, যাকে ইলমে হাদীসের কোন কোন আলেম ‘হাসান’ বলেছেন। (আরবী******************)] কুরতুবী বলেছেন, আল্লাহ হারাম মালের ‘দান’ কবুল করেন না; কেননা তা তো দানকারীর মালীকানাভুক্ত নয়, সে মালের ওপর তার হস্তক্ষেপ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অথচ তা দান করে সে তার ওপর হস্তক্ষেপ করেছে। তা যদি তার কাছ থেকে কবুল করা হয় তাহলে যা একদিক দিয়ে নিষিদ্ধ, তাই আদিষ্ট হয়ে পড়া আবশ্যক হয়।’ কিন্তু তা অসম্ভব। [আরবী***********] বরং হানাফী আলিমদের কেউ কেউ বলেছেনঃ কেউ যদি ফকীরকে হারাম মাল থেকে কিছু দেয় ও তার ফলে সে সওয়াব পাওয়ার আশা করে, তাহলে এ কারণে সে কাফির হয়ে যাবে। আর সে ফকীর যদি সে কথা জানতে পারা সও্বেও তার জন্যে দো’আ করে, তাহলে সেও কাফির হয়ে যাবে। অপর কোন লোক তা শুনতে পেয়ে তার দো‘আর ওপর সে যদি ‘আমিন’ বলে-অবস্থা জানা থাকা সও্বেও তাহলে সেও অনুরূপ কাফির হবে। এমনিভাবে হারাম মাল দ্বারা যদি কোন মসজিদ নির্মিত হয়-তার ফলে আল্লাহ্র নৈকট্যের আশা করা হয়-তাহলেও অনুরূপ পরিণতি হবে। কেননা সে এমন কাজের সওয়াব পেতে চাচ্ছে যার পরিণাম আযাব ছাড়া কিছু নয়। আর তা হতে পারে কেবল তখনই যদি হারামকে হালাল মনে করা হয়। কিন্তু সেটাও কুফরী। তবে এ সব কথা কেবল সেই হারাম সম্পর্কে যা নিশ্চিত, নিঃসন্দেহ। কোন সন্দেহপূর্ণ জিনিস সম্পর্কে উপরিউক্ত কথা প্রযোজ্য হবে না। [দেখুনঃ (আরবী*******************)] তাই কেউ যেন এমন ভিওিহীন ধারণা পোষণ না করে যে, যাকাত কাফফারা হবে অপহরণকারীর অপহরণ অপরাধের, ঘুষখোরের ঘুষখোরীর অপরাধের, সুদখোরীর সুদী কারবারের অপরিবত্রতা থেকে। না তাদের এই ধারণা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও দুঃখজনক। কেননা হারাম মালের কোন যাকাত গ্রহণযোগ্য হতে পরে না। আসলে তাতে যাকাতই ফরয হয় না। যাকাত ফরয হয় কেবলমাত্র সেই মালে, যা একজনের হালালভাবে মালিকানাভুক্ত। আর ইসলাম হারাম মালের কোন মালিকানাই স্বীকার করে না, তার ওপর যত আশার জালই বুনানো হোক-না কেন। ইসলাম পরের ধন হরণকারী ঘুষখোর ও ছোট বা বড় চোরদের কখনও বলে নাঃ ‘তোমরা যাকাত দাও; বরং তাদেরকে সর্বাগ্রে বলে, তোমাদের দাখলে যে সব মাল-সম্পদ রয়েছে তা সবেই তার আসল মালিকদের কাছে ফিরিয়ে দাও।’ যাকাত ধন-মালের প্রবৃদ্ধির কারণ এ সবের পর যাকাত পর্যায়ে বক্তব্য হচ্ছে তা ধন-মালের প্রবৃদ্ধির কারণ। তা তাতে বরকত সৃষ্টি করে। অবশ্য কেউ কেউ এ কথা শুনে বিস্ময় প্রকাশ করে। কেননা যাকাত তো বাহ্যত মালের পরিমাণ হ্রাস করে-তার একটি অংশ অপরকে দেয়া হয় বলে। তাহলে তা মালের প্রবৃদ্ধি ও পরিমাণে বেশী হওয়ার কারণ হয় কি করে? কিন্তু প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে অবহিত লোকেরা জানেন যে, বাহ্যত এ হ্রাস প্রাপ্তি প্রকৃতপক্ষে প্রবৃদ্ধিতে পরিণতি লাভ করবে। সামষ্টিক ধন-সম্পদের পরিমাণ বৃদ্ধি ধনীর মূল সম্পদেই প্রবৃদ্ধি ঘটবে। কেননা যাকাত বাবদ দিয়ে দেয়া এ সামান্য অংশ তার কাছে কয়েকগুণ বেশী হয়ে ফিরে আসে এমনভাবে যা সে হয় জানতে পরে, না হয় জানতেই পারে না। এরই কাছাকাছি একটি ব্যাপার আমরা সচরাচর লক্ষ্য করি। তা হচ্ছে বিপুল পরিমাণ ধন-মালের মালিক কোন কোন দেশ কোন কোন দরিদ্র দেশকে আর্থিক সাহায্য দিয়ে থাকে-আল্লাহ্র ওয়াস্তে নয়-দেয় এই উদ্দেশ্যে, যেন সে দেশের ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, যার ফলে সে দেশ সেই ধনী দেশেরই উৎপাদন ক্রয় করবে। আমরা আরও স্বচ্ছ দৃষ্টিতে বিবেচনা করলে দেখতে পাব, এক ব্যক্তির হাতে একটি টাকার জন্যে তার প্রাণ ধুক ধুক করে ওঠে তার মায়ায় এবং তার জন্যে দো‘আর মুখগুলো নড়ে ওঠে, ধ্বনি করে। সাহায্য ও সংরক্ষণের হস্ত তাকে রিবেষ্টিত করে রাখে। টাকাসহ এই ব্যক্তি বিপুল শক্তির অধিকারী হয়ে পড়ে, অন্যের হাতের বিপুল টাকার তুলনায় সে অধিক গতিশীল ও কর্মতৎপর হয়ে ওঠে। এই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ব্যাখ্যার দিকেই সম্ভবত কুরআনের এই আয়াতসমূহ ইঙ্গিত করেঃ (আরবী*************) তোমরা যা ব্যয় কর তা তার স্থলভিষিক্ত বানিয়ে দেয়। আসলে সেই আল্লাহই বর্বোওম রিযিকদাত। [আরবী***************] (আরবী****************) শয়তান তোমাদেরকে দারিদ্র্যের ভয় দেখায় এবং নির্লজ্জ কার্যাবলীর আদেশ করে তোমাদেরকে। কিন্তু আল্লাহ তোমাদেরকে তাঁর ক্ষমা দানের ওয়াদা করেন এবং অনুগ্রহ দানের। আর আল্লাহ বিপুর বিশাল সর্বজ্ঞ। [আরবী****************] (আরবী***************) তোমরা যে যাকাত দাও, আল্লাহ্র সন্তুষ্টি পাওয়ার ইচ্ছা কর তোমরা, তাহলে তারাই প্রবৃদ্ধির অধিকারী। [আরবী***************] (আরবী***************) আল্লাহ সুদ নির্মূল করে দেন এবং দান-সাদকা-যাকাত বৃদ্ধি করে দেন। [আরবী*****************] এই স্থলাভিষিক্তকরণ ও প্রবৃদ্ধি সাধনে মহান আল্লাহ তা‘আলার যে অনু্গ্রহের বিরাট অবদান রয়েছে তার কার্যকারিতার কথা তোমরা ভুলে যাবে না, যদিও আমরা তার কার্যকরণের কোন খবর রাখি না। আল্লাহ তো তাই দান করেন- যা তিনি চান, যার জন্যে তিনি চান। আর আল্লাহ অসীম বিরাট অনুগ্রহশীল। উপরন্তু মুসলমানের ধন-মাল থেকে প্রতি বছর যে সম্পদ যাকাত বাবদ গৃহীত হয়, পিছন দিক থেকে তা-ই তার ধন-মালকে অধিক মুনাফা ও তার সম্পদকে অধিক প্রবৃদ্ধি দানের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। হয় তা স্বতঃই কিংবা অন্যের সাথে শরীকানার ভিওিতে। শেষ পর্যন্ত যাকাত সে মূলধনকে খেয়ে ফেলে না। আর এই বেশী মুনাফা ধন-মালের মালিকরাই পেয়ে থাকে, এটাই আল্লাহ্র স্থায়ী নিয়ম। তিনি যা গ্রহণ করেন তা কয়েক গুণ বেশী তাকে প্রদান করাই আল্লাহ্র রীতি। তাতে অন্যথা হতে পারে না। দ্বিতীয় আলোচনা গ্রহণকারীর জীবনে যাকাতের লক্ষ্য ও প্রভাব যাকাত গ্রহণকারীর ক্ষেত্রে তা মানুষের জন্যে মর্যাদাহানির অবস্থা থেকে মুক্তি বিধায়ক। জীবনের ঘটনা-দুর্ঘটনা ও কালের আবর্তন-বিবর্তনসমূহের বিরুদ্ধে চলমান সংগ্রমের তা এক কার্যকর ও মনস্তও্বিক প্রতিরোধ। কোন্ লোক যাকাত গ্রহণ করে এবং কোন্ সব ব্যক্তি তা পেয়ে উপকৃত হয়? সে হল ফকীর-দরিদ্র ব্যক্তি, দারিদ্র্য যাকে পর্যুদস্ত করেছে; অথবা সেই মিসকীন, অভাবগ্রস্ততা যাকে ধূলি লুণ্ঠিত ও লাঞ্ছিত অবমানিত করেছে; অথবা সেই ক্রীতদাস, দাসত্ব শৃংখলা যাকে মনুষ্যত্বের মর্যাদা থেকেও বঞ্চিত করেছে; অথাব সেই ঋণগ্রস্ত, ঋণ যাকে হেস্ত-নেস্ত করেছে; অথবা সেই নিঃস্ব পথিক, যে তার পরিবারবর্গ ও ধন-মাল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার কারণে অসহায় হয়ে পড়েছে। যাকাত তার গ্রহণকারীকে অভাবগ্রস্ততা থেকে মুক্তি দেয় ইসলাম চায় মানুষ অতীব উওম ও পবিত্র জীবন যাপন করুক। এ জীবনে তারা প্রাচুর্য ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনকে ধন্য করে তুলুক। আসমান ও জমিনের সব ‘বরাকাত’ তারা লাভ করুক। ওপর থেকে ভ্রান্ত নিয়ামতসমূহ এবং নীচ থেকে প্রাপ্ত সম্পদসমূহ আয়ও করে তারা ধন্য হোক, সেই সৌভাগ্য তারা অনুভব করুক, যা তাদের অবয়বসমূহকে স্বাচ্ছেন্দ্যপূর্ণ করে দেবে, পরম শান্তি ও সমৃদ্ধিতে তাদের হৃদয় কানায় কানায় ভরে দেবে, আল্লাহ্র নিয়ামতের চেতনায় তাদের মন ও জীবন ভরপুর হয়ে উঠুক। বস্তুত মানুষের সৌভাগ্য বিধানে বস্তুগত সুযোগ-সুবিধার বাস্তবায়নকে একটা গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ বানিয়ে দিয়েছে ইসলাম। রাসূলে করীম (স) বলেছেনঃ (আরবী******************) তিনটি হচ্ছে মহাসৌভাগ্যের অবলম্বনঃ সেই স্ত্রী, যাকে তুমি দেখলে সে তোমাকে উৎফুল্ল সন্তুষ্ট করে দেবে, তুমি তার কাছে অনুপস্থিত থাকলে সে নিজেকে ও তোমার ধন-মালকে সংরক্ষিত রাখে। সেই যানবাহন যা স্থিতিশীল সুদৃঢ় হবে এবং তা তোমাকে তোমার বন্ধু-স্বজনদের সাথে মিলিত করবে। আর ঘরবাড়ি, যা প্রশস্ত হবে এবং খুবই আরামদায়ক হবে। [আরবী****************] অপর হাদীসে বলা হয়েছেঃ চারটি হচ্ছে সৌভাগ্যের উপাদান-সত্যাচারিণী স্ত্রী, প্রশস্ত বসত ঘর, চরিত্রবান প্রতিবেশী, সহজগামী যানবাহন। আর চারটি হচ্ছে দুর্ভাগ্যের কারণ-দুশ্চরিত্র প্রতিবেশী, খারপ স্ত্রী, খারাপ যানবাহন ও সংকীর্ণ বসত ঘর। [আরবী*******************] এ হচ্ছে দাম্পত্য জীবন, যোগাযোগ ব্যবস্থা, বসতবাটি ও প্রতিবেশের দিক দিয়ে মানুষের সৌভাগ্য ও দুর্ভগ্যের ব্যাপরে নবুয়তের সূত্রে প্রাপ্ত দিগন্ত উজ্জ্বলকারী আলোকসম্পাত। বাস্তব জীবন এ কথার সত্যতা সর্বাধিক মাত্রার বাস্তবতার আলোকে সত্যায়িত করে তুলেছে। হ্যাঁ, ইসলাম চায় মানুষ ধনাঢ্যতায় সৌভাগ্যবান হোক। দারিদ্র্যের যন্ত্রণায় জর্জরিত হোক কোন মানুষ তা ইসলামের কাম্য নয়। কিন্তু সে দারিদ্র্য যদি বণ্টন ব্যবস্থার ক্রটি ও সামষ্টিক জুলুম পীড়ন-বঞ্চনার দরুন হয়, কেউ অন্য কারোর অধিকার হরণ করেছে-এ কারণে দেখা দেয়, তা হলে দারিদ্র্যের সাথে ইসলামের শত্রুতা-দারিদ্র্যের প্রতি ইসলামের ঘৃণা ও বিদ্বেষ তীব্রতর হয়ে ওঠে। ইসলামী সামাজ বিধান ও বস্তবাদী সমাজ-ব্যবস্থার মধ্যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। বস্তুবাদী সমাজ ব্যবস্থা মানুষকে উদরপূর্তি ও যৌন তৃপ্তিতে চারিতার্থ করতে চায়। বস্তুগত দুনিয়ার সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের পরিধি অতিক্রম করা তার সাধ্যাতীত। সুখ-স্বচ্ছন্দ্য ও প্রশস্ততা তার দূরতম লক্ষ্য। তার স্বপ্ন স্বর্গ সবই এ পৃথিবীতে। এ ছাড়া কোন ‘স্বর্গের চিন্তা করাই তার পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু ইসলামী জীবন বিধান ধনাঢ্যতা ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের মাধ্যমে মানুষের ‘রূহ’ কে মহান আল্লাহ্র দিকে রুজু করতে চায়। চায়, তারা যেন খাদ্যের সন্ধানে একান্তভাবে মশগুল এবং খাদ্যের সংগ্রামে সংগ্রামলিপ্ত হয়ে না পড়ে, যেন ভুলে না যায় আল্লাহ্র পরিচিতি, আল্লাহ্র সাথে গভীর সম্পর্ক রক্ষার প্রয়োজনীয়তা, সেই সাথে পরকালীন জীবনের বিষয়টিও যেন তাদের চোখের আড়াল পড়ে না যায়। কেননা সেই জীবনটাই তো অধিকতর কল্যাণময় এবং চিরন্তন। মানুষের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য যখন বৃদ্ধি পায়, তার পরিবারবর্গের ভরণ-পোষণ যখন নিশ্চিন্ততার মাত্রায় পৌঁছায়, তখনই তার জীবনে স্বস্তি আসে, আল্লাহ্র ইবাদতে গভীর তন্ময়তা সহকারে আত্মনিয়োগ করা সম্ভবপর হয়। সেই আল্লাহই তো মানুষকে ক্ষুধার অন্ন যোগান এবং ভয় থেকে নিরাপওা দান করেন। ইসলাম যে দারিদ্র্যেকে ঘৃণা করে, ধনাঢ্যতা পসন্দ করে এবং মানুষের পবিত্র স্বচ্ছন্দ জীবন কামনা করে, তার বড় প্রমাণ হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলা তার দরিদ্র রাসূলকে সচ্ছল বানিয়ে দিয়েছিলেনঃ (আরবী*****************) এবং তিনি (আল্লাহ) তোমাকে দারিদ্র পেয়েছেন, অতঃপর তিনিই তোমাকে সচ্ছল বানিয়ে দিয়েছেন। [আরবী********] হিজরতের পর মুসলমানদের প্রতি তাঁর অপরিসীম অনুগ্রহের কথা স্বরণ করিয়ে দিয়ে বলেছেনঃ (আরবী**********) অতঃপর তিনি তোমাদেরকে আশ্রয় দিয়েছেন, তাঁর বিশেষ সাহায্য দিয়ে তোমাদেরকে শক্তিশালী বানিয়েছেন এবং তোমাদেরকে রিযিক দিয়েছেন পবিত্র দ্রব্যাদি-যেন তোমরা শোকর কর। [আরবী******************] রাসূলে করীম (স)- এর একটা প্রসিদ্ধ দো‘আ হচ্ছেঃ (আরবী******************) হে আমাদের আল্লাহ! আমি তোমার কাছে হোদায়াত, তাকওয়া নৈতিক পবিত্রতা, রোগ নিরাময়তা এবং ধনাঢ্যতার প্রার্থনা করছি। [আরবী******************] রাসূলে করীম (স) আল্লাহ্র শোকর আদালয়কারী ধনী ব্যক্তিকে ধৈর্যশীল দরিদ্র ব্যক্তির ওপর অধিক মর্যাদাবান বলে ঘোষণা করেছেন। [যেমন হাদীস থেকে প্রমাণিত হয়ঃ বিলুপ্তি বলে লোকের মজুরী নিয়ে গেছে (বুখারী, মুসলিম।)] কুরআন মজীদ ধনাঢ্যতা ও পবিত্র জীবনকে নেককার মুমিনদের জন্যে আল্লাহ্র দেয়া তাৎক্ষণিক সওয়াব বা শুভু প্রতিফলস্বরূপ দান বলে ঘোষণা করেছে। আর কাফির-ফাসিক ব্যক্তিদের জন্যে দারিদ্র্য ও জীবন সংকীর্ণতাকে তাৎক্ষণিক আযাব হিসেবে ব্যবস্থা করে থাকেন বলে জানিয়েছেন। আল্লাহ্ নিজেই বলেছেনঃ (আরবী****************) যে পুরুষ বা নারীই নেক আমল করবে, ঈমানদার হয়ে তাকেই আমরা পবিত্র জীবন যাপনের সুযোগ করে দেবে। [আরবী************] (আরবী***************) নগরবাসীরা যদি ঈমান আনে ও তাকওয়া অবলম্বন করে, তাহলে আমরা তাদের জন্যে আসমান ও জমিনের বরকতসমূহ উন্মূক্ত করে দেব। [আরবী***************] (আরবী**************) যে লোক আল্লাহকে ভয় করবে তিনি তার জন্যে মুক্তির পথ বানিয়ে দেবেন এবং তাকে রিযিক দেবেন এমন পথে। যা সে চিন্তাও করতে পারে না। [আরবী**************] (আরবী****************) এবং আল্লাহ দৃষ্টান্তস্বরূপ উপস্থাপিত করেছেন একটি নগরের কথা যা খুবই শান্তিপূর্ণ ছিল। তথায় প্রাচুর্য সহকারে রিযিক আসত সব দিক দিয়ে। সেই নগরবাসীরা কুফরী করে আল্লাহ্র নিয়ামতের প্রতি। ফলে আল্লাহ তাদেকে ক্ষুধার পোশাক পরিযে ভয়ের স্বাদ আস্বদন করান তাদের কার্যকলাপের বিনিময়ে। [আরবী***************] হযরত আদম ও হাওয়া যেদিন পৃথিবীতে অবতীর্ণ হলেন তখনই সৃষ্টিকুলে আল্লাহ্র চলিত বিধানের কথা তাঁদের জনিয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেনঃ (আরবী***************) তোমরা দুইজন নেমে যাও একত্রে। অতঃপর তোমাদের কাছে আমার কাছ থেকে হেদায়েত আসতে থাকবে। পরে যে আমার হোদায়েত অনুসারে চলবে সে পথভ্রষ্ট হবে না-হতভাগ্য হবে না। আর যে লোক আমার স্মরণ থেকে বিমুখ হয়ে যাবে তার জন্যে সংকীর্ণতাপূর্ণ জীবন যাত্রা হবে এবং কিয়ামতের দিন আমরা তাকে অন্ধ অবস্থায় হাশরের ময়দানে আসব। -(সূরা ত্ব-হাঃ ১২৪) এসব আয়াতের আলোকে আমাদের সম্মুখে এ কথা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, তাসাউফপন্থীদের পরিবেশে দারিদ্র্যকে যেভোবে মহান মনে করা হচ্ছে, তাকে স্বাগত জানানো হচ্ছে এবং সাধারণভাবে ধনাঢ্যতার নিন্দা করা হচ্ছে সেদিক দিয়ে লোকদের ভীত-সন্ত্রস্ত করা হচ্ছে-এ সব নতুন সৃষ্টি চিন্তাধারা আসলে পারসিক মানুষের উৎক্ষিপ্ত চিন্তাধারা, ভারতীয় বৈষ্ণববাদী চিন্তাধারা, খৃষ্টীয় পাদ্রীসুলভ চিন্তাধারা। এই সব চিন্তা ইসলামের নয়, বাইরে থেকে ইসলামের মধ্যে অনুপ্রবেশকারী চিন্তাধঅরা এবং বিদ‘আত। [দেখুন মৎপ্রণীত (আরবী************) অধ্যায় (আরবী*************)] এ সব কারণেই আল্লাহ তা‘আলা যাকাত ফরয করেছেন এবং তাকে দ্বীন ইসলামের একটা বড় অবদানরূপে গণ্য করেছেন। তা ধনী লোকদের কাছ থেকে গ্রহণ করা হবে এবং দারিদ্রের মধ্যে তা বিতরণ করা হবে। তা পেয়ে দরিদ্ররা তাদের বস্তুগত প্রয়োজন ও অভাব-অনটন দূর করবে-খাবার, পানীয়, বস্ত্র ও বাসস্থানের সুষ্ঠু ব্যবস্থা করবে। সেই সাথে জৈ-মনস্তাও্বিক প্রয়োজন পূরণেরও ব্যবস্থা করা সম্ভব হবে-যেমন বিয়ে। মানীষিগণ তাকে পূর্ণঙ্গ জীবনের জরুরূ অংশ বলে গণ্য করেছেন, মানুষের আত্মিক প্রয়োজনের দিক দিয়েও তার গুরুত্ব অপরিসীম। যেমন লেখাপড়ায় নিয়োজিত লোকদের জন্যে বইপত্র প্রয়োজন। এ ফকীর-দরিদ্র ব্যক্তি যদি এসব জিনিস পায়, তাবেই সে জীবন যাত্রা শুরু করতে ও তা চালিয়ে নিতে পারে। পারে আল্লাহ্র আনুগত্য অনুসরণ স্বীয় দায়িত্ব পালন করতে। বিশেষ। তাকে ধ্বংস হয়ে যেতে দেয়া হবে না। সে নয় কোন অর্থহীন সূল্যহীন ব্যক্তি। সে মানুষের মহান সমাজের একজন, তার প্রতি লক্ষ্য রাখা হচ্ছে, তার গুরুদ্ব যথাযথভাবে স্বীকার করা হচ্ছে। সে বিপদে পড়লে তাকে উদ্ধার করা হবে, তার প্রতি সহায়তা-সহাযোগিতার হস্ত প্রসারিত করা হবে-খুবই সম্মানজনকভাবে। তার ওপর কারো ব্যক্তিগত দয়া-অনুগ্রহের বোঝা চাপানো হবে না। তার দোহাই দিয়ে কেউ তাকে জ্বালাযন্ত্রণাও দেবে না। তার সুষ্ঠু ও নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থা সমাজে কার্যকর রয়েছে। রাষ্ট্রের হস্তই তার ওপর ছায়া বিস্তার করে আছে। সে মর্যাদাবান, উন্নত শির, উচ্চতর সম্মানের অধিকারী। কেননা সে তো তার জন্যে নির্দিষ্ট ও সর্বজনজ্ঞাত অধিকার পাচ্ছে। তার ন্যায্য অংশ পাওয়ায় কোন অনিশ্চয়তাই নেই। এমন কি ইসলামী সমাজ সংস্থার কাঠামো চুরমার হয়ে গেলেও এবং মুসলিম ব্যক্তিগণ নিজেরাই যাকাত বণ্টনকারী হয়ে পড়লেও কুরআন মজীদ তাদের সাবধান করে দিয়েছে দারিদ্র মিসকীনদের কোনরূপ অপমান-লাঞ্ছনা দেয়া-তাদের অনুভূতির ওপর আঘাদ হানা-গ্রহীতার ওপর দাতার উচ্চ কর্তৃত্ব দেখানোর মর্মান্তিক পরিণতি সম্পর্কে। তাদের ওপর কোনরূপ অনুগ্রহ প্রদর্শন করতেও নিষেধ করেছে। কোন দিক দিয়েই তার মানবিক ক্ষন্ন হতে পারে এমন কোন কাজ করাই সম্ভবপর রাখা হয়নি। সে যেন একজন মুসলিম হিসাবে প্রাপ্য মর্যাদা পেতে পারে, সেদিকে লক্ষ্য রাখার জন্যে কঠোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেনঃ (আরবী***************) হে ঈমানদার লোকেরা, তোমরা তোমাদের দান-সাদকাকে অর্থহীন বানিয়ে দিও না অনুগ্রহ দেখিয়ে ও কষ্ট দিয়ে সেই ব্যক্তির মত, যে তার মাল খরচ করে লোক দেখানোর জন্যে এবং আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান রাখে না। এ ব্যক্তির এই কাজের দৃষ্টান্ত হচ্ছে শক্ত প্রস্তর, তার ওপর মাটি, মুষলধারার বৃষ্টি পৌঁছে শূন্য শক্ত প্রস্তরই ফেলে রাখাল। [আরবী***********] ফকীর-মিসকীনের এ চেতনা থাকতে হবে যে, সে সমাজে অসহায় ধ্বংসশীল ব্যক্তি নয়। সমাজ তার জন্যে চিন্তা-ভাবনা করে। কার্যকর ব্যবস্থাও গ্রহণ করে। তার ব্যক্তিত্বের জন্যে একটা বিরাট উপার্জন রয়েছে। তার মানসিকতার পবিত্রতা বিধানের ব্যবস্থাও আছে। তার এই চেতনাই তার জন্যে একটা বিরাট সম্পদ, গোটা উম্মতের জন্যে তা মোটেই উপেক্ষণীয় নয়। পৃথিবীতে মানুষের দায়িত্ব এবং মহান আল্লাহর নিকট তার সম্মান ও মর্যাদা-উভয়ই যুগপতভাবে দাবি করে যে, সমাজে এমন বারিদ্র্য থাকতে দেয়া হবে না, যা ব্যক্তিকে নিজেকে ও তার আল্লাহ্কে বিম্মৃত হতে বাধ্য করে, তার দ্বীন ও দুনিয়া সম্পর্কে তাকে উদাসীন বানায়, তাকে গোটা জাতি থেকেও তার দায়িত্ব কর্তব্য থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। সে কেবল তার ক্ষুণা নিবৃওি, লজ্জা নিবারণ ও আশ্রয় অর্জনের চিন্তায়ই দিনরাত মশগুল থাকতে বাধ্য হবে। শহীদ সাইয়্যেদ কুতুব তাঁর বলিষ্ঠ লেখনীতে এ বিষয়টি খুব সুন্দরভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি লিখেছেনঃ ইসলাম দারিদ্র্য ও লোকদের অভাব-অনটনকে ঘৃণা করে। কেননা ইসলাম চায় তাদের বৈষয়িক জীবনের যাবতীয় প্রয়োজন যথাযথভাবে পূরণ হোক-যেন সে তার চাইতেও বিরাট ও জাতীয় ব্যাপারসমূহে অংশ গ্রহণের অবসর পায়-যা মানবতার সাথে সায়ুঞ্জ্যপূর্ণ, আল্লাহ বনি আদমকে মর্যাদা দিয়েছেন তার সাথে সামঞ্জস্যশীল। নিশ্চয়ই আদম বংশকে আমরা সম্মানিত করেছি স্থল ও জলভাগে এবং তাদের রিযিক দিয়েছি পবিত্র জিনিসমূহ এবং তাদের মর্যদাবান বানিয়েছি যথার্থভাবে আমরা বহু সৃষ্টির ওপর। [আরবী*************] আল্লাহ মানুষকে কার্যত সম্মানিত করেছেন বিবেক-বুদ্ধি পারস্পরিক আকর্ষণ এবং দৈহিক প্রয়োজনেরও ঊর্ধ্বে আধ্যাত্মিক ভঅবধারা ও চেতনা দিয়ে। এক্ষণে জীবনের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির প্রাচুর্য থাকলেই এসব চিন্তামূলক ক্ষেত্রেও আধ্যাত্মিক চেতনা পরিতৃপ্ত রাখার সুযোগ পেতে পারে। আর যদি তা থাকে তাহলে তার এ মর্যাদা থেকে বঞ্চিত থাকতে বাধ্য হয়। তখন মানুষ নিতান্ত জীবজন্তুর পর্যায়ে নেমে যায়। তা-ও নয়, প্রায়ই তা থেকে বঞ্চিত থাকে না, উপরন্ত জন্তুরা খেলা করে, লম্ফ-ঝম্ফ দেয়, আনন্দ-উল্লাস করে। অনেক পাখী গলা খুলে গান গায়-ধ্বনি করে, জীবন নিয়ে নৃত্য করে এবং তা করে পেটভরা খাদ্য ও পানীয় পাওয়ার পর। কিন্তু মানুষরে কি হয়েছে, আল্লাহ্র নিকট তার মান-মর্যাদারই বা কি মূল্য? তাকে তো খাদ্য পানীয়ের এতটা মশগুল করে রাখে যে পাখী ও জন্তু-জানোয়ারেরা কি পাচ্ছে; তা অনুধাবন করার মত শক্তিও তার থাকে না। তারা আল্লাহ্র নিকট সম্মানর্হ হওয়ার পর তাদের ওপর যে কর্তব্য-দায়িত্ব চেপেছে তা যথাযথভাবে পালন করার মত অবকাশও তারা পায় না। তার সময় ও শ্রম নিঃশেষ করেও যখন সে প্রয়োজন পরিমাণ খাদ্যপানীয় পায় না, তখন তার ওপর এমন একটা আঘাত হয়ে পড়ে, যা আল্লাহ্র ইচ্ছা ও মর্জিকে আয়ও করার শক্তিও হারিয়ে ফেলে। মানুষ যে সমাজে বাস করে, তা-ও ব্যাপারে অন্ধ ও বধির হয়ে যায়। তখন স্পষ্ট মনে হয়,এ এমন একটা পতিত সমাজ, যা আল্লাহ্র ইচ্ছার বিরুদ্ধে চলেছে। মানুষ পৃথিবীতে আল্লাহ্র খলীফা। তাকে খলীফা বানানো হয়েছে এ উদ্দেশ্যে যে, সে এ দুনিয়ার জীবনেকে প্রবৃদ্ধি দান করবে, তাকে উন্নত করে তুলবে। পৃথিবীকে সুন্দর চাকচিক্যময় করে সজ্জিত করবে। পরে তার সৌন্দর্য ও চাকচিক্য সে উপভোগ করবে। তারপরে আল্লাহ্র দেয়া এই অমূল্য নিয়ামতসমূহের শোকর আদায় করবে। কিন্তু মানুষ এ সবের কোন একটাও করতে পারে না, যদি তার জীবনটাই নিঃশেষ হয়ে যায় একমঠি অন্নের সন্ধানে, তা যতই যথেষ্ট ও পেটভরা হোক না কেন । তাহলে সেই তার জীবনের প্রয়োজনই যদি কেউ পূর্ণ করতে না পারল, তাহলে সে তার জীবনটা কীভাবে কাটাবে? যাকাত হিংসা ও বিদ্বেষ দূর করে যাকাত হিংসা ও ঘৃণা প্রভৃতি রোগ থেকে মানুষকে মুক্ত করে-দাতাকে যেমন, গ্রহীতাকেও তেমনি। তাই কোন মানুষকে যদি তার দারিদ্র্যের দন্ত দংশন করতে থাকে, প্রয়োজনের আঘাত যদি তাকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দেয়-অথচ সে তার চতুর্দিকের মানুষকে মাহ সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য সহাকারে দিনাতিপাত করতে দেখতে পায়-মাহপ্রাচুর্যের পাহাড় জমে উঠাতে দেখা তাদরে ঘরে-সংসারে; কিন্তু তারা কেউ তার সাহায্যে হস্ত প্রসারিত না করে-দারিদ্র্যের উপর্যুপরি আঘাতে চূর্ণ-বিচূর্ণ হওয়ার জন্য তাকে অসহায় করে ছেড়ে দেয়, তাহলে এ ব্যক্তির হৃদয় হিংসা ও বিদ্বেষের বিষবাষ্প থেকে কি করে মুক্ত থাকতে পারে? তার হৃদয়ে পরশ্রীকাতরতা কেন জাগবে না? তার ক্ষতি সাধনের প্রবৃওি কেন তব্র হয়ে উঠবে না সেই সমাজের প্রতি যা তাকে অসহায় করে ছেড়ে দিয়েছে ধ্বংস হওয়ার জন্যে? সে সেই সমাজের কল্যাণের কোন চিন্তাই করতে পারে না। আসলে লোভ ও আত্মম্ভরিতা প্রত্যেক সচ্ছল ব্যক্তির প্রতি হিংসা ও বিদ্বেষই সৃষ্টি করে। ইসলাম মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক তাদের সমন্বকারী ভ্রাতৃত্বের ভিওিতে পড়ে তোলে। আর সেই ভ্রাতৃত্বের আসল কথা হচ্ছে অভিন্ন মনুষ্যত্ব ও আকিদা বিশ্বাসের পরম ঐক্য ও একাত্মতা। ইসলামের আহ্বানঃ (আরবী***********) তোমরা সকলে আল্লাহ্র বান্দাহ ভাই হয়ে যাও। [মুসলিম, আবূ হুরায়রা থেকে বর্ণিত।] (আরবী**********) মুসলমান মুসলমানের ভাই। [বুখারী, মুসলিম ইবনে উমর থেকে, মুসলিম উকবা ইবনে আমের আবূ দাউদ, আমর ইবনুল আহওয়াস ও কিবলা বিনতে মাখরামা থেকে। দেখুনঃ (আরবী***********)] কিন্তু এক ভাই যদি পেট ভরে খেয়ে পরিতৃপ্ত হয়ে থাকে আর অন্য ভাইদের ক্ষুধার জ্বালায় ছটফট করার জন্যে ছেড়ে দেয়া হয় আর সে তাদের দেখতে থাকে কিন্তু তাদের প্রতি সাহায্যের হস্ত প্রসারিত না করে, তাহলে তাদের মধ্যে কাঙ্ক্ষিত ভ্রাতৃত্ব কখনই কায়েমে হতে ও স্থয়ী হতে পারবে না। তার পরিণতি হচ্ছে ভাইদের মধ্যকার সম্পর্ক ছিন্নভিন্ন করা এবং ফকীর ও বঞ্চিতের মনে ঘৃণা ও হিংসার আগুন প্রজ্বলিত করা ধনী ও পরিতৃপ্ত লোকদের বিরুদ্ধে। কিন্তু ইসলাম তা চায় না। মুসলমান সমজকে সে অবস্থা থেকে অনেক দূরে সরিয়ে রাখতে বদ্ধপরিকর। কেননা হিংসা ও বিদ্বেষ বিচ্ছিন্নকারী রোগ, হত্যাকারী বিপদ, ব্যক্তি ও সমাজকে পর্যুদস্তকারী মহাক্ষতির কারণ। হিংসা দ্বীনের একটা সহাবিপর্যয়। কেননা তা হিংসাকারীর দুশ্চিন্তায় বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। আল্লাহ তাঁর বান্দাদের রিযিকদানের ক্ষেত্রে যে বণ্টননীতি কার্যকর করেছেন, সে সম্পর্কে তার মনে অনেক প্রকারের খারাপ ধারণা জেগে ওঠে। লোকদের পরস্পরের মধ্যে যে সামজিক জুলুম নির্যাতন চলতে থাকে, তাই চরম বিদ্রোহের সৃষ্টি করে। এ কারণে কুরআন মজীদ ইয়াহুদীদের পরিচিতিস্বরূপ বলেছেঃ (আরবী************) ওরা কি লোকদের প্রতি হিংসা পোষণ করে আল্লাহ্ তাঁর যে অনুগ্রহ তাদের দিয়েছেন সে জন্যে? [আরবী**********] হিংসা ও শত্রুতা, ক্রোধ ও আক্রোশ এমন সব বিপদ, যা জরাজীর্ণ করে দেয় ব্যক্তির দৈহিক ও আত্মিক সওাকে। সমাজের বৈষয়িক ও আত্মিক সংস্থাকেও ভেঙ্গে ছিন্নভিন্ন করে ফেলে। এরূপ অবস্থায় যে ব্যক্তি হৃদয় হিংসার লড়াইয়ে তৎপর হয়, ঘৃণা ও ক্ষতির ইচ্ছা তাকে করায়ও করে, সে কখনই পূর্ণ ঈমানদার মানুষ হতে পারে না। কেননা আল্লাহ্র বান্দাহদের প্রতি হিংসা যে হৃদয়কে বিষাক্ত করে তোলে সেখানে আল্লাহ্র প্রতি ঈমান কখনই স্থান পেতে পারে না। হিংসা ও ঘৃণা আক্রোশ-একটা প্রকৃতিগত রোগ, যেমন পাকস্থলীতে জখম ও রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়া। হিংসা ও ঘৃণা সামাজিক উৎপাদন ও অর্থনীতিকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে। হিংসুক ঘৃণা জর্জরিত মানুষ উৎপাদরকে দুর্বল করে-যদিও সম্পূর্ণ বন্ধ্যা বানিয়ে দেয় না। সে কাজ ও উৎপাদনে সনোযোগ দেয়ার পরিবর্তে হিংসার ও ঘৃণা ও আক্রোশেই সমস্ত ক্ষমতা নিঙড়িয়ে ব্যয় করে। এ কারণে ইসলামের নবী যদি এ সব বিপদকে ‘জাতীয় রোগ’ নামে আখ্যায়িত করে থাকেন এবং সে বিষয়ে লোকদের সাবধান করে দিয়ে থাকেন, তাহলে তা কিছু মাত্র বিম্ময়ের কথা নয়। এগুলো বিচ্ছু ও বিষাক্ত কীটের মত নিঃশব্দে লোকদের মধ্যে প্রবেশ করে। নবী করীম (স) বলেছেনঃ তোমাদের পূর্বেকার জাতিসমূহ থেকে জাতীয় রোগসমূহ নিঃশব্দে তোমাদের মধ্যে এসে গেছে, তা হচ্ছে-হিংসা-ক্রোধ, আক্রোশ ও প্রতিহিংসা-এগুলো তো নির্মূলকারী। তাবে আমি একথা বলছি না যে, তা চুল কামিয়ে দেয় বরং বলছি, তা দ্বীনকে নির্মূল করে। [হাদীসটি বাজ্জার উদ্ধৃত করেছেন উওম সনদে এবং বায়হাকী প্রমুখও (আরবী*************)] ইসলাম এসব মনস্তাও্বিক সামষ্টিক কঠিন রোগসমূহের কেবল ওয়ায-নসীহত ও মৌলিক উপদেশ দ্বারাই মুকাবিলা করেনি এবং তা করাকেই যথেষ্ট মনে করেনি। বরং ইসলাম কার্যত ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এ সবের কারণসমূহকে জীবন ও সমাজ থেকে উৎপাটিত করার জন্য বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন, কেননা ক্ষুধা-কাতর বঞ্চিত বিবস্ত্র মানুষকে হিংসা-বিদ্বেষের বিপদ বিপর্যয় সম্পর্কে একটা মর্মস্পর্শী ওয়ায শুনিয়ে দেয়াই কখনও যথেষ্ট হতে পারে না। তার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই তো দুঃখময়, শুষ্ক, নির্মম। আর তার চুতর্দিকে রয়েছে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে পরিতৃপ্ত মহাবিলাসী মানুষের জাঁকজমকপূর্ণ জীবনধারা। তা তাদের সম্মুখে সম্পূর্ণ বিপরীত ধরনের বাস্তব নিদর্শনাদি উপস্থাপিত করছে। এরূপ অবস্থায় তাদের মনে-প্রাণে হিংসা জাগবে না কেন? পরশ্রীকাতরতায় তারা জর্জরিত হবে না কেন? বিদ্বেষের আগুন তাদের হৃদয় মনে দাউদাউ করে জ্বলে উঠবে না কেন? এই কারণেই তো ইসলাম যাকাত ফরয-বাধ্যতামূলক করেছে। করেছে এজন্যে যেন বেকার কাজ পায়, অক্ষম উপার্জনহীন মানুষও বাঁচার স্থানে আপন জনের মধ্যে ফিরে যেতে পারে। তাবেই না মানুষ অনুভব করতে পারবে-তারা পরস্পরের ভাই, পরস্পরের অভিভাবক, পৃষ্ঠপোষক। প্রয়োজন ও অভাবের সময় অন্য লোকদের ধন-মাল তাদেরই ধন-মাল হবে। ব্যক্তি অনুভব করবে তার ভাইয়ের শক্তি সে তো তারই শক্তি-যদি সে দুর্বল হয়ে পড়ে, তার ভাইয়ের ধনাঢ্যতা তার জন্যে সাহায্য, যদি সে দরিদ্র হয়ে পড়ে। বস্তুত এরূপ পরিচ্ছন্ন পরিবেশেই ঈমানের ছায়া বিস্তার হওয়া সম্ভব, লোকদের মধ্যে জাগতে পারে ভালোবাসা ও ত্যাগ-তিতিক্ষা। রাসূলের কথাঃ (আরবী*************) তোমাদের কেউই ঈমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে তার ভাইয়ের জন্যে তাই পসন্দ করবে, যা পসন্দ করে সে নিজের জন্যে। [হাদীসটি বর্ণনা করেছেন আহমদ, বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, নাসায়ী, ইবনে মাজা আনাস থেকে। (আরবী*************)] দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ যাকাতের লক্ষ্য এবং সমাজ-জীবনে তার প্রভাব যাকাতের সামাজিক সামষ্টিক লক্ষ্য স্পষ্ট অতীব প্রকট। এতে কোন সন্দেহ নাই। যাকাতের ব্যয় খাতসমূহের ওপর চোখ বুলালেই তা স্পষ্ট বোঝা যায়। তার ওপর এক তড়িৎ দৃষ্টিও আমাদের সম্মুখে এই মহাসত্য প্রতিভাত করে তোলে যেমন রাতের অবসানে পৃথিবী চোখের সম্মুখে ভেসে ওঠে প্রত্যক্ষ হয়ে। সুরা তওবার এ আয়াতটি যখন আমরা পাঠ কিরঃ নিঃসন্দেহে যাকাত-সাদকাত কেবলমাত্র ফকীর-মিসকীন, তার জন্যে নিয়োজিত কর্মচারী, যাদের হৃদয় সন্তুষ্ট করতে হবে- এদের জন্য এবং ক্রীতদাস ঋণগ্রস্ত, আল্লাহ্র পথ ওনিঃস্ব পথিকের ব্যাপারে নিয়োজিত হওয়ার-আল্লাহ্র নিকট থেকে ফরয করে দেয়া। তখন আমাদের নিকট স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, এ লক্ষ্যসমূহের একটা দ্বীনী রাজনৈতিক রূপ রয়েছে। কেননা তা দ্বীন ও রাষ্ট্র হিসেবেই ইসলামের সাথে মিলিত হয়। যাদের হৃদয় সন্তুষ্ট করতে হবে এবং আল্লাহ্র পথে-প্রধানত এ দুটি অংশই সেদিকে স্পষ্ট ইঙ্গিত করছে। এ দু্ই ব্যয়খাত দাবি করছে, দ্বীন-ইসলাম একটা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বিধান, এ রাষ্ট্র যাকাতসমূহ ধন-মালের মালিকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করবে তার জন্যে নিযুক্ত কর্মচারীদের মাধ্যমে। পরে তা ব্যয় করা হবে ইসলামের দাওয়াত প্রচার ও তার কালেমার বিস্তার সাধনের কাজে, তার ভূমিকে শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্যে আর তা হবে লোকদের হৃদয় আকৃষ্টকরণ এবং জাতিসমূহের সেদিকে দাওয়াত দেয়ার দ্বারা। কেননা ‘আল্লাহ্র পথের দিকে রায়েছে ইসলামের উদাও আহ্বান। ‘যাকাত ব্যয়ের খাতসমূহের বিস্তরিত ব্যাখ্যার আলোচনা আমরা এ দুটি খাত সম্পর্কে প্রয়োজনীয় কথা বলে এসেছি। এক্ষণে তার ওপর নতুন করে দৃষ্টি নিক্ষেগ করা আবশ্যক। এ পরিচ্ছেদে আমরা আলোচনা করব ‘মুসলিম সমাজ ও ইসলামী উম্মতের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শক্তিসমূহের সাথে যাকাতের সম্পর্ক।’ যাকাত ও সামজিক নিরাপওা উপরিউক্ত লক্ষ্য ও খাতসমূহ সামাজিক-সামষ্টিক রঙে রঙিন। অভাবগ্রস্ত লোকদের সাহায্য করা, ফকীর-মিসকীন ঋণগ্রস্ত ও নিঃস্ব পথিক প্রভৃতি দুর্বল লোকদের হাত ধরে উপরে উঠানো ইত্যাদি, এদের সাহায্য ও সহযোগিতা দান তাদের ওপর প্রভাব ফেলবে তাদের ব্যক্তি হওয়া হিসেবে যেমন, তেমনি সমাজসমষ্টির ওপরও পড়বে এ হিসেবে যে, তারা সকলে পরস্পর সংযুক্ত এক অভিন্ন দেহ সংস্থা বৈ কিছু নয়। সত্রি কথা। ব্যক্তি ও সমষ্টির সীমা পরস্পরের মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট, ব্যক্তিদের সমষ্টিই সমাজ। তাই ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব যতটা শক্তিশালি হবেম তার প্রতিভাসমূহ উৎকার্ষিত হবে এবং তার বস্তুগত ও অন্তর্নিহিত শক্তিসামর্থ্য যতটা বিকাশিত হবে, সমাজ ঠিক তাতটাই শক্তিশালী হয়ে উঠবে, ততটাই উৎকর্ষ লাভ করবে-এত আর কোনই সন্দেহ নেই। পক্ষান্তরে সমাজের ওপর যা কিছু সাধারণভাবে প্রভাব বিস্তার করবে, তা তার ব্যক্তিদের ওপরও প্রভাবশালী হয়ে উঠবে-তারা তা অনুভব করতে পারুক আর নাই পারুক। অতএব বেকারকে কাজ দেয়া, অক্ষমকে সহযোগিতা দেয়া এবং ফকীর-মিসকীন দাস-ঋণগ্রস্ত প্রভৃতি ঠেকে যাওয়া লোকদের সাহায্য করা ‘সামাজিক সামষ্টিক লক্ষ্য’ গণ্য করা-কিছুমাত্র বিম্বয়ের ব্যাপার নয়। কেননা এ সব কাজের মাধ্যমেই সমাজ-সমষ্টিক ধারণ করা সামজিক নিরাপওা বিধান করা সম্ভব হয়ে থাকে। এ সব কাজ একই সময় যেমন ব্যক্তি পর্যায়ের লক্ষ্য এ সব যাকাত গ্রহণকারী লোকদের বিচারে, তেমনি সামষ্টিক সামাজিকও। বস্তুত যাকাত ইসলামে সামাজিক নিরাপওা ব্যবস্থার একটা অংশ। পাশ্চাত্য এ সামাজিক নিরাপওা ব্যবস্থা খুবই সংকীর্ণ ধারণা পোষণ করে। তা কেবল অর্থনৈতিক রিাপওা। দারিদ্র অক্ষম লোকগুলোকে আর্থিক সাহায্য দিয়েই তারা এ কার্য সম্পাদন করে। কিন্তু ইসলাম সামাজিক নিরাপওার এ ব্যবস্থাকে একটি বিশাল ও গভীর পরিমন্ডলে তুলে ধরেছে। বস্তুগত ও আধ্যাত্মিক উভয় জীবনের সমগ্য দিকেই তার অন্তর্ভুক্ত। এখানে সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক নিরাপওা আছে, জ্ঞান ও শিক্ষাগত নিরাপওা আছে, রাজনৈতিক, প্রতিরক্ষামূলক, নৈতিক, অর্থনৈতিক, ফৌজদারী ইবাদতমূলক সভ্যতা সংক্রান্ত এবং সর্বশেষে জৈবিক জীবনের পূর্ণ নিরাপওার ব্যবস্থা কার্যকর অথচ আজকের দিনে ভুলবশত তার নাম দেয়া হয়েছে শুধু ‘সামাজিক নিরাপওা।’ [ডঃ মুস্তফা সাবায়ী রচিত (আরবী*************) গ্রন্থে এ ধরনের নিরাপওা ব্যবস্থাসমূহের উল্লেখ করা হয়েছে।] ‘সামাজিক নিরাপওা’ এখন যাকাত অপেক্ষাও অধিক ব্যাপক ও সর্বাত্মক ব্যবস্থা। কেননা সমগ্র জীবনের শাখা প্রশাখাসমূহের তা বাস্তবভাবে কার্যকর হয়ে চলছে। মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের সমস্ত দিক-ই তার অন্তর্ভুক্ত। এ সমস্ত শাখা বা প্রশাখার একটা অংশ হচ্ছে যাকাত। তার অন্তর্ভুক্ত রয়েছে এখানকার সামাজিক বীমা ও সামাজিক নিরাপওা দুটিই। ‘সামাজিক বীমা’ ও ‘সামাজিক নিরাপওা’ এ দুটির মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে বীমায় প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার নিজের আয় থেকে কিস্তি দিতে হবে। আর সামাজিক বা স্থায়ী অক্ষমতা দেখা দিলে তখন সে তা থেকে উপকৃত হবে। কিন্তু ‘নিরাপওা’ ব্যবস্থায় রাষ্ট্রিই তার রাষ্ট্রীয় বাজেট থেকে এর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। সমাজের ব্যক্তিদের সেজন্যে নির্দিষ্ট হারে কোন কিস্তি দিয়ে তাতে শরীক হতে হবে না। এমন দেখা গেছে, বহু লোক যারা এ বছর যাকাত দিয়েছে, পরবর্তী বছর হয়ত তারাই যাকাত পাওয়ার যোগ্র বিবেচিত হয়েছে। কেননা তখন তাদের হাতে তাদের প্রয়োজন পূরণ পরিমাণ সম্পদ অবশিষ্ট থাকেনি অথবা উপর্যুপরি এমন সব বিপদ-আপদ এসছে, যার ফলে তারা নিজেদের ও নিজেদের পরিজনের প্রয়োজন পূরণের জন্যে হয়ত ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছে অথবা তারা নিজেদের দেশ ঘর-বাড়ী থেকে বহু দূরে হঠাৎ নিঃস্ব হয়ে যাকাতের আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। এমনি তারা আরও অনেক কিছু হতে পারে। এ দিকে দিয়ে তা সামাজিক বীমা পর্যায়ের। এদের মধ্যে এমন অনেজ লোকই হয়ত আছে পূর্বে যাদের ওপর যাকাত ফরয হয়েছেল। এজন্যে তখন তারা যাকাতের কোন অংশ পায়নি। কিন্তু এক্ষণে তাদের দারিদ্র্য ও অভাবের জন্যে তারা যাকাত পাওয়ার যোগ্য হয়েছে। এ হিসেবে যাকাত হচ্ছে ‘সামাজিক’ ব্যবস্থা। [(আরবী*************)] তা ছাড়া যাকাত বাস্তবিকপক্ষে বীমার পরিবর্তে ‘সামাজিক নিরাপওার নিকটবর্তী ব্যবস্থা।’ কেননা তাতে বীমার মত ব্যক্তিদের কোন পরিমাণের কিছু (প্রিমিয়াম) দেতে হয় না, ব্যক্তিকেও তা থেকে দেয়া হয় ততটুকু পরিমাণ, যা তার জন্যে প্রয়োজন। তা কমও হতে পারে, বেশীও হতে পারে। যাকাত এ কারণে ‘সামাজিক নিরাপওা‘র পথে সর্বপ্রথম বাস্তব ব্যবস্থা, ব্যক্তিগত নফল দান সাদকার ওপর তা নির্ভরশীল নয়। বরং তা সরকারী সুসংগঠিত ও আবর্তনশীল সাহায্যদানের ওপর চলে। এ সব সাহায্যের লক্ষ্য হচ্ছে প্রত্যেক অভাবগ্রস্ত ব্যক্তির প্রয়োজন পূরণের বাস্তব ব্যবস্থা গ্রহণ। এ প্রয়োজন পূরণ খাদ্য, বস্ত্র-বাসস্থান অন্যান্য প্রয়োজনের ক্ষেত্রে। তা হবে ব্যক্তির জন্যে, ব্যক্তির ওপর নির্ভরশীল পরিজনদের জন্যে-কোনরূপ অপচয় বা ব্যয় বাহুল্য কিংবা কার্পন্য ছাড়াই। বস্তুত মানুষের যত প্রকারের প্রয়োজনের কথাই চিন্তা করা যায়, যা ব্যক্তিগত অক্ষমতা কিংবা সামাজিক বিপর্যয়ের দরুন সৃষ্ট হয়-তা সবই পূরণ করে যাকাত। এমন সব অবস্থাও দেখা দিতে পারে যা থেকে কোন মানুষই সাধারণত রক্ষা পায় না। ইমাম জুহরী উমর ইবনে আবদুল আজীজ-খলীফাকে ‘যাকাতের ক্ষেত্রে সুন্নতের ভূমিকা’ সম্পর্কে যা লিখে পাঠিয়েছিলেন, তা আমরা পড়ি, নিশ্চয়িই তাতে অংশ রয়েছে সাময়িকভাবে অভাবগ্রস্ত বেকার বসে থাকা লোকদের জন্যে, প্রত্যেক মিসকীনের জন্যেও তাতে অংশ রয়েছে-যার কোন বিপদ বা রোগ হয়েছে, পরিবারবর্গের ভরন-পোষণ করতে এবং দুনিয়য় ঘোরাফেরা করতে সমর্থ হচ্ছে না। যেসব মিসকীন ভিক্ষা করে, তাদের জন্যেও অংশ রয়েছে- তাদেরও খাবার প্রয়োজন (শেষ পর্যন্ত তারা না।) যেসব মুসলমান কারাবন্দী হয়ে আছে তাদের জন্যেও একটা অংশ রয়েছে-যাদের কোন অভিভাবক নেই। মসজিদসমূহে যেসব মিসকীন আছে ভিক্ষার জন্যে-যাদের সাধারণত দেয়া হয় না, তাদের জন্যে নির্দিষ্ট অংশও নেই। (যাদের জন্যে মাসিক বৃওি নির্ধারিত হয়নি-বিধিবদ্ধ সুসংগঠিত কোন অর্থ ব্যবস্থাও নেই) তা সও্বেও তারা লোকদের কাছে চেয়ে বেড়ায় না- ভিক্ষা করে না। যে লোক দারিদ্র হয়ে পড়েছে, তার ওপর ঋণও চেপেছে, সে ঋণ থেকে আল্লাহ্র নাফরমানির কাজে কিছুই ব্যয় করা হয়নি, তার দ্বীনী চরিত্রে কোন দোষরোপ নেই অথবা ঋণের মধ্যের কোন ফাঁকি নেই। আশ্রায়হীন প্রত্যেক পথিকও তা থেকে অংশ পাবে, যার এমন দেয়া হবে, খাবার দেয়া হবে এবং তার জন্তু বাহনকে ঘাস (এ কালে বাহন যন্ত্রকে তেল বা ভাড়া) দেয়া হবে যতক্ষণ না সে বসবাস ও অবস্থানের কোন স্থান লাভ করেছে অথবা তার প্রয়োজন পূরণের ব্যবস্থা হয়েছে। [দেখুনঃ (আরবী*************)] এ ব্যবস্থা সকল প্রকার অভাবগ্রস্ত ও ঠেকায় পড়া লোকদেরই নিরাপওার জন্যে। তাদের সর্বপ্রকারের প্রয়োজনের জন্যেও, তা দৈহিক, মানস্তাও্বিক ও বুদ্ধি-বিবেকগত যা-ই হোক না কেন। বিবাহ করিয়ে দেয়াকেও মৌলিক প্রয়োজনের মধ্যে গণ্য করা হয়েছে। তা কেমন করে হল, তা আমরা ইতিপূর্বে দেখেছি। বিদ্যার্থীর জন্যে জ্ঞান আহরণের বই-পুস্তক প্রয়োজনের অন্তর্ভুক্ত, তা কি করে হল, তা আমরা ইতিপূর্বে আলোচনা করেছি। এ ব্যবস্থা কেবল মুসলমানদের জন্যেই নয়। মুসলমানদের রাষ্ট্রে ইয়াহুদী, খৃষ্টান (হিন্দু, বৌদ্ধ) যারাই বসবাস করবে তাদের সকলের জন্যেই এই ব্যবস্থা কার্যকর থাকবে। হযরত উমর (রা) একজন ইয়াহুদীকে দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করতে দেখে তার জন্যেও এ ব্যবস্থাই গ্রহণ করেছিলেন। মুসলমানদের বায়তুলমাল থেকে তার যাবতীয় প্রয়োজন পূরণ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এটা ছিল তার জন্যে এবং তার মত অন্যান্য লোকদের জন্যে একটা সূচনামূলক ব্যবস্থা। [(আরবী*************)] তেমনি তিনি দামেশক যাওয়ার পথে খৃষ্টান লোকদেরকে কুষ্ঠ রোগাক্রান্ত দেখতে পেয়ে ইসলামী বায়তুলমাল থেকে তাদের জন্যে জীবিকার ব্যবস্থা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। [(আরবী*************)] বস্তত এই হচ্ছে ‘সামাজিক নিরাপওা ব্যবস্থা’। পাশ্চাত্য জগত এরূপ ব্যবস্থার সাথে পরিচিত হয়েছে খুব বেশী দিনের কথা নয়। তার যা-ও বা চিন্তা করেছে খালেসভাবে আল্লাহ্র জন্যে তা করেনি, দুর্বল লোকদের প্রতি দয়াপরবশ হয়েও তা করেনি, ক্রমাগত বিদ্রোহ-বিপ্লব এবং সমাজতান্ত্রিক ও কমিউনিষ্ট মতবাদের আঘাত তাদেরকে এরূপ ব্যবস্থা নিতে বাধ্য করেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধজনিত পরিস্থিতিও তা করার প্রয়োজন সৃষ্টি করেছে। জনগণকে খুশী করার উদ্দেশ্যেই তা করা হয়েছে। রক্ত ও ঘাম পানি করে শ্রম করে যেতে অব্যাহতভাবে তাদেরকে প্রস্তুত রাখার মতলবেই তা করেছে যেন তারা কখনই বিদ্রোহী হয়ে উঠতে না পারে। এরূপ সরকারী নিরাপওা ব্যবস্থা সর্বপ্রথম গৃহীত হয় ১৯৪১ সনে। এ সময় বৃটিশ ও আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র আটলান্টিক চুক্তিতে ব্যক্তিবর্গের সামাজিক নিরাপওা দানের বাধ্যাবাধকতার ওপর একমত হয়। [(আরবী*************)] কিন্তু তা সও্বেও তা ইসলাম নিরাপওা ব্যবস্থার পর্যায়ে দেশের সকল অধিবাসীকে অন্তর্ভুক্ত করার এবং তাদের পরিবারের সার্বিক মৌল প্রয়োজন পূরণের দায়িত্ব নেয়ার দিক দিয়ে উন্নীত হতে পারেনি। ইমাম শাফেয়ী ও তাঁর সমর্থকবৃন্দ ফকীর-মিসকীনের সারা জীবনের প্রয়োজন পূরণ এবং যাকাত দ্বারা তাদেরকে স্থয়ীভাবে সচ্ছল বানিয়ে দেয়ার-যেন অতঃপর কোনদিনই আর কোনরূপ সাহায্য-সহযোগিতা মাখাপেক্ষী না হয়-যে কথা বলেছেন তার সমান ব্যবস্থা নেয়া তো অনেক দূরের ব্যাপার। ইসলাম সামাজিক নিরাপওা ব্যবস্থা গ্রহণ এ সব রাষ্ট্রের বহু বছর পূর্বেই যে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, তা কম বিস্ময়ের ব্যাপার নয়। দ্বীন তা ফরয করেছে, রাষ্ট্র এ দায়িত্ব পালন করার সংস্থা কায়েম করেছে। এ উদ্দেশ্যে তলোয়ারও চালিয়েছে ধনী লোকদের মুঠ থেকে গরীব জনগণের অধিকার আদায় ও মক্ত করার লক্ষ্যে। তা সও্বেও আমরা লক্ষ্য করছি, বহু লেখকই সামাজিক নিরাপওা ব্যবস্থায় ইউরোপের অবদানকে অগ্রবর্তিতা ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রদানের জন্য কলম চালিয়েছেন। কিন্ত আমাদের জাতীয় ইতিহাস ও উওরাধিকার তার ওপর মাটি নিক্ষেপ করছে। এ পর্যায়ে উল্লেখ ঘটনা হচ্ছে, আরবী রাষ্ট্রসমূহের বিশ্ববিদ্যালয় জোট দামেশকে শহরে ১৯৫২ সনে সমাজবিদ্যা অধ্যয়নের একটা চক্র আহ্বান করে। এ চক্রকে ‘সামাজিক নিরাপওা’ বিষয়ে অধ্যয়নের বিশেষ দায়িত্ব দেয়। চক্রের পরিচালক-মিঃ দানীল এস জীরজ ‘সামাজিক নিরাপওা’ শিরোনাসে একটা রচনা পেশ করেন। তাতে তিনি উল্লেখ করেনঃ প্রাচীনকালের অভাবগ্রস্ত লোকদের সম্মুখে না খেয়ে মরার হাত থেকে বাঁচার জন্যে লোকদের কাছে সাহায্য চাওয়া বা সাদকা পেতে চেষ্টা করা ছাড়া আ কোন উপায় ছিল না। সরকারীভাবে গরীব লোকদের সাহায্য করার জন্যে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের ইতিহাস সপ্তদশ শতাব্দীতে সূচিত হয়। জাতীয় সংস্থার পক্ষ থেকে গরীব লোকদের সাহায্য করার সংগঠন পড়ার প্রথম পদক্ষেপ তখন গৃহীত হয়……….[(আরবী************)] এরূপ ইতহাস রচনার কারণ ইসলামের ইতিহাস ও যাকাত ফরয হওয়ার মৌল তও্ব সম্পর্কে চরম অজ্ঞতা ছাড়া কিছুই নয়। পূর্বে যেমন বলেছি, এতে সন্দেহ নেই যে, মুসলিম সরকারই যাকাত সংগ্রহ করে এবঙ তা বণ্টনেরও দায়িত্ব পালন করে। তা ব্যক্তিগত কোন দয়া বা অনুগ্রহের ব্যাপার নয় আদৌ। আর তা কোন নফল দানও নয়। যাকাত বস্তুতই অভঅবগ্রস্ত লোকদের জন্যে নির্ধারিত ও সর্বজনজ্ঞাত অধিকার বিশেষ। আর ধনী লোকদের প্রতি তা বাধ্যতামূলকভাবে দেয় সনির্দিষ্ট কর। মুসলিম রাষ্ট্রই এ কর আদায় করে এবং বণ্টন করে। তবে যাকাত তার স্থায়িত্ব ও চিরন্তনতার দিক দিয়ে সাধারণ রাষ্ট্রসমূহের ধার্য করা কর থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নতর জিনিস। রাষ্ট্রসরকার যদি কখনও তার প্রতি অবহেলা করে এবং তা আদায় না করে তাহলে তখনও তা আদায় না করা পর্যন্ত কোন মুসলিম ব্যক্তির ইসলাম সহীহ হবে না, তার ঈমান পূর্ণ হবে না, এবং তা আদায় করতে হবে আল্লাহ তা‘আলাকে সন্তষ্ট করার উদ্দেশ্যে মাত্র। আর নিজের তাজকীয়া এবং তার ধন-মালের পবিত্রতা এ উপায়েই হতে পারে। ব্যক্তির জন্যে যা ফরয করে দেয়া হয়েছে, সে তা নিজের মনের আগ্রহে ও উৎসাহে আদায় করবে। তাতে কোনরূপ অনুগ্রহ প্রদর্শনের ও পীড়াদানের একবিন্দু ইচ্ছাও থাকবে না। এরূপ অবস্থায় যে অভাবগ্রস্ত ব্যক্তি তা গ্রহণ করবে, সে তা গ্রহণ করবে-ইমলাম তাকে জানিয়ে দিয়েছে যে, আল্লাহ তাঁর কোন কোন বান্দাকে তার মালের ওপর খলীফা বানিয়েছেন, সেই মালে তার জন্যে হক নির্দিষ্ট করে ধার্য করা হয়েছে, এটা তার প্রাপ্য অধিকার। সমাজকে দায়িত্বশীল বানানো হয়েছে এজন্যে। এ জানা অধিকার আদায়ের জন্যে যুদ্ধ করতে হলেও সমাজ তা করতে বাধ্য। যাকাত ও অর্থনৈকিত রূপায়ণ গোটা অর্থনীতির ওপর যাকাত ব্যবস্থার প্রত্যেক্ষ প্রভাব অনস্বীকার্য। পূর্বের পরিচ্ছেদে আমরা বলে এসেছি, ধনীদের কাছে থেকে যাকাত যা কিছু নেয়া হয়, তাই তাদেরকে অধিক কর্মে উদ্বুদ্ধ করে-যা নেয়া হয়েছে তার বিনিময়ে। নগদ সম্পদের যাকাতের বেলায় এ কথাটি খুবই স্পষ্ট। কেননা ইসলাম নগদ সম্পদেকে সঞ্চয় করাকে সম্পূর্ণ হারাম ঘোষণা করেছে। তার আবির্তিত ও উৎপাদনমূলক কাজে বিনিয়োগকৃত হওয়ার পথে বাধা সৃষ্টি করাও নিষিদ্ধ। এ পর্যাযে আল্লাহ তা‘আলার বজ্রকঠিন ঘোষণা এসেছেঃ (আরবী************) আর যারাই স্বর্ণ ও রৌপ্য পূঁজি করে রাখবে এবং তা আল্লাহ্র পথে ব্যয় করবে না, তাদের পীড়াদায়ক আযাবের সুসংবাদ দাও। শুধু এ কঠোর ঘোষনা দিয়েই কুরআন ক্ষান্ত হয়নি; বরং পুজিকরণের বিরুদ্ধে যুদ্ধও ঘোষণা করেছে এবং নগদ সম্পদকে ভান্ডার ও ব্যাংক হিসাবে থেকে বের করার সরকারী পদক্ষেপ গ্রহণেরও নির্দেশ দিয়েছে। তা এভেবে যে, ইসলাম যখন নগদ সম্পদের ওপর শতকরা আড়াই ভাগ যাকাত বাবদ দেয়া ফরয করেছে-মালিক তা উৎপাদনে বিনিয়োগ করে থাকুক, কি না-ই করুক তখন এ যাকাত বাবদ বের করা নগদ সম্পদই একটা চাবুক হয়ে তাকে পরিচালিত করবে অধিক শ্রম করে, উৎপাদন করে উপার্জন করতে ও প্রবৃদ্ধি লাভ করার দিকে। এ কাজ সে বছরের পর বছর করে যেতে থাকবে। এ পর্যায়ে বহু হাদীস এবং সাহাবীদের উক্তি উদ্ধৃত হয়েছে। যেমনঃ (আরবী************) তোমরা অভিভাবকরা ইয়াতীমদের মাল নিয়ে ব্যবসা কর, যেন তাদের মাল যাকাত খেয়ে না ফেলে। নগদ সম্পদের যাকাত পর্যায়ে আমরা অনেক কথা বলেছি। যাকাত যে মূলধানের ওপর ধার্য হয়, তাও ব্যাখ্যা করেছি। যাকাত ও জাতির আধ্যত্মিক উপাদান সর্বোপরি যাকাতের অনেক লক্ষ্য রয়েছে-প্রভাব রয়েছে মুসলিম উম্মতের উন্নতমানের জীবন যাত্রা নির্বাহের ব্যবস্থা বাস্তবায়নে। এ উম্মত সেভাবেই জীবন যাপন করেবে তার আধ্যত্মিক উপাদানসমূহ যার ওপর তার ভিওি স্থাপিত, তার কাঠোমো সংস্থাপিত-সংরক্ষিত হবে এবং তার ব্যক্তিত্বের স্বাতন্ত্র্য চিহ্নিত হবে। উস্তাদ বহী আল খাওলী যেমন বলেছেন, উম্মত তার আধ্যাত্মি শক্তি-সামর্থ্যের বলেই গড়ে উঠতে পারে, কেবল বস্তুগত শক্তির বলে নয়। বরং জাতি গঠনের বস্তগত শক্তি সামর্থ্যের কোন মূল্যই নেই, আধ্যাত্মিক শক্তি-সামর্থ্য ছাড়া তার সংগঠন সওা গড়ে উঠতে পারে না। এজন্যেই আমরা দেখতে পাচ্ছি ইসলাম আধ্যাত্মিক শক্তির ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছে। সমষ্টিক ধন-মাল ব্যক্তিবর্গের জন্যে ব্যয় করা এবং ব্যক্তিগণের সাহায্য কাজে তৎপর হওয়াকে ইমলাম ফরয ঘোষণা করেছে- অপরিহার্য কর্তব্য বলেছে। তা সমষ্টিক আধ্যাত্মি অস্তিত্ব রক্ষার জন্যে অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ, যেমন খাদ্যপানীয় তিনটি মৌল নীতিতে সন্নিবদ্ধ ও সবিন্যস্ত করে দিয়েছে-যাকাত ব্যয় সংক্রান্ত আয়াত সে দিকে ইঙ্গিত করেছে। প্রথম মৌল নীতিঃ সমাজের ব্যক্তিগণের স্বধীনতা সংরক্ষিত করা। কিন্তু এ স্থানে দাসমুক্তির ওপর অধিক জোর দেয়া হয়েছে অর্থাৎ ক্রীতদাসদেরকে দাসত্ব শৃংখল থেকে মুক্ত করার-এ লাঞ্ছনা তিরোহিত করা। দাসমুক্তির পর্যায়ে উচ্চতর আইন ক্ষেত্রে বিশ্বমানবতা সর্বপ্রথম ইমলামের এ অবদানই লাভ করেছে। তাদের ধন-মালের নির্দিষ্ট অংশ দিয়ে তাদের মুক্তকরণকে মুসলমানদের জণ্যে ফরয করে দিয়েছে। যাকাত সংক্রান্ত আয়াতে এ সত্যটি ধ্বনিত ও স্থপিত হয়েছে আল্লাহ্র কথা (আরবী************) ‘এবং দাস মক্তিতে’। দ্বিতীয় মৌল নীতিঃ ব্যক্তিগণের সংকল্প ও পুরুষোচিত ভাবধারোকে কল্যাণময় কাজে নিয়োজিতকরণ, যা সমষ্টিক জন্যে সাংস্কৃতিক ও অনুভবনীয় লাভ সৃষ্টি করে অথবা কোন অপসন্দনীয় অবস্থায় মধ্যে পড়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করে। তা এজন্যে যে, ব্যক্তিগণের মধ্যে কল্যাণ প্রেমের সীমাহীন শক্তি নিহিত রয়েছে। বিভিন্ন সামষ্টিক অবদান রাখার যোগ্যতাও তাদের মধ্যে রায়েছে। তা বিবেক, বুদ্ধির অবদানের মতেই অমূল্য। আল্লাহ তা নিরর্থক সৃষ্টি করেননি সৃষ্টি করেছেন তাঁর নিজ সওার বিকাশ ও উৎকর্ষ সাধনের উদ্দেশ্যে যেন সে জীবনে তার দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম হয়। কেননা মানসিক শক্তিকে উৎকর্ষদান এবং তার ভূমিকা বাস্তবায়ন একান্তই কর্তব্য-যেন সে তার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে পারে জীবনে। তাই ব্যক্তিগণের মধ্যে প্রকৃতিগত প্রতিভার উৎকর্ষ সাধন অধিক উওম এবং বেশী অধিকারসম্পন্ন। কেবল তার ফলশ্রুতি এবং জীবনে যে ঔদার্যের ভাবধারা ফুটে ওঠে কেবল সেজন্যে নয়। বরং এজন্যে যে, আমাদের জন্যে মূল্যবান ব্যক্তি তৈরী করার একমাত্র পন্থাও তাই। উম্মতের জন্যে তার উচ্চ মহান মানসিকতার মৌলিক সম্পদ কেবল এভাবেই পাওয়া সম্ভব। কোন কল্যাণময় কাজই ভল নয়-যে মন তা করে কেবল তা-ই ভাল। আর যে নিয়ত মনোভাব তা করায়, তা-ই ভাল। যে জাতি এ পন্থাকে অবলম্বন করে সে শক্তির কার্যকারণ ও মর্যাদার সম্স্ত উপকরণে সমৃদ্ধ হতে পারে। তাই মর্যাদাও জীবনের যোগ্যতার জন্যে যথেষ্ট। তা-ই কল্যাণে দৃঢ় সংকল্প জাগিয়ে তোলে ভালোবাসার সাহাত্ম্য সৃষ্টি করে। সত্যেল প্রতি পুণ্যময় আহরণের জন্যে তা যথেষ্ট, মূল জীবনের জন্যেও তা কল্যাণকর। মন ও প্রকৃতির উৎস থেকে তা যা কিছু বের করে তা খুবই মূল্যবান সম্পদ। মন খনির সর্বোওম উৎপাদন তা। জীবনকে তা উওম তাৎপর্য দান করে। মনূষ্যত্বকে তা সর্বোচ্চ মানে উন্নীত করে। আর তা-ই হচ্ছে সেই উচ্চতর আদর্শ যার ওপর মনুষ্যত্ব ও মানুষের জীবনকে প্রতিষ্ঠিত করতে আল্লাহ তা‘আলা চেয়েছেন। অতএব সমাজের কর্তব্য হচ্ছে তার ব্যক্তিগণের মনের মধ্যে সেই শক্তিসমূহ জাগ্রত করবে, তদ্দারা তাকে হুঁশিয়ার করবে। জাগিয়ে তুলবে এবং প্রবৃদ্ধি ঘটাবে। তাকে নিষ্ক্রিয় ও স্থবির করে রাখবে না-যার ফলে তার কর্মশক্তি দুর্বল হয়ে পড়েতে পারে, তার ভিততে নিহিত শক্তি উৎসসমূহ মুছে বা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তখন তাদের একেকজন প্রস্তুত থাকতে তার ধন-মাল সম্পূর্ণভাবে ব্যয় করতে এবং শেষ পর্যন্ত নিঃস্ব হয়ে যেতে-যেন তার উম্মতের এমন এক-একটি অন্যায়ের দ্বার রুদ্ধ করে দেয়, যার দরুন গোটা জতির শাস্তি সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়ে যেতে পারত। তাদের কিছু লোকের হৃদয়ে যে প্রতিহিংসা ও ক্রোধ জেগে ওঠেছে তার বিরুদ্ধে লড়াই করবে। এ ব্যক্তিকে-যার মনুষ্যত্বেবোধ এতটা করেছে-যদি দারিদ্যের ক্রোড়ে ঠেলে দেয়া হয় এবং তার এ কর্মের সুফল থেকে তাকে বঞ্চিত করা হয় তাহলে সে আবার কখনই অনরূপ মনুষ্যত্ববোধসম্পন্ন কল্যাণকর কাজে ফিরে আসবে না, যদি একবার এ আছাড়া খাওয়া থেকে সে উঠবার সুযোগ পায়। অতঃপর সে অপর কোন মনুষ্যত্ববোধ সম্পন্ন মানুষের অনুসরণও করবে না। অতএব সত্য ও ন্যায়বিচারের দাবি হচ্ছে, এই যে ব্যক্তি অথবা এ সামষ্টিক সম্পদে সাধারণভাবে মনুষ্যত্ববোধ সম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্যে একটা অংশ ধার্য হওয়া একান্তই আবশ্যক। তাদের মধ্যে যে জনকল্যাণমূলক কাজ করার প্রবৃওি রয়েছে, তাকে উৎসাহিত করতে হবে। তাহলে তাদের কেউ দারিদ্র্যের আঘাত আহত হবে না।– পূর্বে জাতির জন্যে সে যে কল্যাণমূলক কাজ করেছে, তার জন্যে। ঠিক এ কারণেই ইমলাম তাদের জন্যে এ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে এবং মহান আল্লাহ তা‘আলাও যাকাতের আয়াত স্পষ্ট করে বলেছেনঃ (আরবী************) ‘এবং ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিগণ’। তৃতীয় মৌল নীতীঃ মানুষের অন্তরে নিহিত প্রাকৃতিক শক্তিসমূহের ‘তাজকিয়া’র উদ্দেশ্যে’ যে সব আকীদা-বিশ্বাস এবং শিক্ষা ও আদর্শ অবতীর্ণ হয়েছে, বিশেষ করে আল্লাহ্র কাছে সম্পর্ক রক্ষা পর্যায়ের হুকুম-আহকাম, ব্যক্তির জীবনের লক্ষ্য সম্পর্কে সচেতনকরণ এবং তার পরকালীন পর্যায়সমূহ-যা পত্যেককে অতিক্রম করতে হবে অনন্তকালের অধ্যায়সমূহে বিবর্তিত তাগিদে-তার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ একান্তই আবশ্যক। উক্ত মূল আয়াতের এ দিকের গুরুত্ব লক্ষ্য করেই আল্লাহ তা‘আলা বলেছেনঃ (আরবী***********) ‘এবং আল্লাহ্র পথে।’ এ ‘আল্লাহর পথে’ কথাটির তাৎপর্য যুদ্ধ ও প্রতিরক্ষামূলক অর্থাৎ সামরিক প্রস্তুতিমূলক কার্যবলী অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ইসলামে প্রতিরক্ষা ও জিহাদ আসলে দায়িত্বমূলক কাজ নয়। নয় শুধু দেশমাতৃকার জন্যে যুদ্ধ, যেখানে আল্লাহ্র পথে জিহাদ। আর আল্লাহ্র পথে জিহাদের সবচাইতে বড় বিশেষত্ব হচ্ছে, তা হয় ইসলামের আকীদা রক্ষা, বহিরাক্রমণ থেকে তার প্রতিরক্ষা এবং তার ওপর স্থিতি ও প্রতিষ্ঠা অর্জনের লক্ষ্যে এ আকীদার প্রভাববলয় সম্প্রসারিত করার উদ্দেশ্যে। [উস্তাদ আল বাহী আল খাওলী লিখিত- (আরবী***********) থেকে উদ্ধৃত।] এ তিনটি মৌল নীতির প্রতি লক্ষ্য রেখে যাকাত উচ্চতর মূল্যমান প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে তার ভূমিকা পালন করে। এ আসল তাৎপর্যগত বিশেষত্বের জন্যেই মুসলিম সমাজ অধিক আগ্রহী। বরং এর ওপরই তার গোটা সংস্থা গড়ে ওঠে-যেমন পূর্বে বলেছে। বস্তুত ইসলামী জীবনে পরিপূরবতা ও পূর্ণত্ব এসবের মাধ্যমেই আসে। সমস্ত ইসলামী সংস্থাও তাই। অতএব যাকাত বাহ্যিক দৃষ্টিতে একটা অর্থনৈতিক বিধান হলেও ইসলামের মৌল আকীদা থেকে- ইসলামের ইবাদত থেকে তা কখনই বিচ্ছিন্ন হয় না। মূল্যমান ও নৈতিকতা কখনই উপেক্ষিত হয় না। রাষ্ট্রনীতি ও জিহাদের সাথে তার সম্পর্ক চিরন্তন। ব্যক্তি ও সমষ্টির সমস্যা ও জটিলতা দূর করাই তার বড় অবদান। জীবনে বাঁচিয়ে তার মৌল ভাবধারা। পরবর্তী আলোচনাসমূহে আমরা কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ সামষ্টিক জটিলতার উল্লেখ করব, আমাদের সমাজ-সমষ্টি যা নিয়ে খুব বেশী চিন্তা-ভাবনা করে। সমাজ সংস্করকগণ সে সবেরেই সংশোধন চান। এসব জটিলতার চিকিৎসা কিংবা এসবের প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া লাঘব করার ব্যাপারে যাকাত ব্যবস্থার একটা বিরাট ভূমিকা রয়েছে। আমার লিখিতঃ (আরবী***********) (ক) ‘দারিদ্র্য সমস্যা ও তার সমাধান ইসলাম কিভাবে করেছে’ গ্রন্থে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। এ সংশোধন ও চিকিৎসা ব্যবস্থায় যাকাতের ভূমিকা বিশ্লেষণ করে এ স্বতন্ত্র গ্রন্থখানি প্রকাশ করেছি। [প্রকাশক (আরবী***********)] তা যার ইচ্ছা পড়ে নিতে পারেন। পার্থক্য সমস্যা সাময়িস বা আবর্তনশীল সহায্য দিয়ে কেবল দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাই যাকাতের একমাত্র ও চূড়ান্ত লক্ষ্য নয়। মালিকানা নীতির ব্যাক্তি ও প্রশস্তি বিধান, সম্পদের মালিক ধনী লোকদের সংখ্যা বৃদ্ধি, ধনী লোকদের প্রতি মুখাপেক্ষী দরিদ্র জনগণের মধ্যে এমন বিপুল সংখ্যক লোক গড়ে তোলা-যারা সারা জীবনের জন্যে যথেষ্ট পরিমাণ সম্পদের অধিকারী হবে- ইত্যাদিও যাকাতের লক্ষ্যের অন্তর্ভুক্ত। তা এভাবে যে, যাকাতের লক্ষ্য হচ্ছে দরিদ্র ব্যক্তিকে ধনী ও সচ্ছল বানানো-যাকাত বাবদ লব্ধ যতটা সংকুলান হয় এবং তাকে অভাবের পরিমান্ডল থেকে বহিষ্কৃত করে স্থায়ী সচ্ছলতার দিকে নিয়ে যাওয়া। আর তা হবে প্রত্যেক অভাবগ্রস্ত ব্যক্তিকে তার প্রয়োজনীয় ও যথেষ্ট পরিমাণ সম্পদের মালিক বানানোর দ্বারা। যেমন ব্যবসায়ী ব্যবসায় এবং তৎসংশ্লিষ্ট দ্রব্যাদির মালিক হয়। কৃষক একখন্ড ভূমি ও তৎসংশ্লিষ্ট অন্যান্য জিনিসের মালিক হয়। কোন পেশার লোক মালিক হয় তার পেশার কাজের জন্য প্রয়োজনীয় হাতিয়ার ও যন্ত্রপাতি-অনুরূপ অন্যান্য জিনিসের। যাকাতের ব্যয়খাত সংক্রান্ত আলোজনায় আমরা এ পর্যায়ে স্পষ্ট কথা বলে এসেছি। [‘ফকীর-মিসকীনকে কত দেয়া হবে, চতুর্থ অধ্যায় প্রথম পরিচ্ছেদ দ্রষ্টব্য।] এভাবেই যাকাত তার বিরাট লক্ষ্য বাস্তবায়নে কাজ করে। আর তা হচ্ছে নিঃস্ব লোকদের সংখ্যা কমানো এবং মালিক শ্রেণীর লোকদের সংখ্যা বৃদ্ধিকরণ। সমাজ ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে এটাই হচ্ছে ইসলামের অন্যতম ও বড় লক্ষ্য- যে জনগণ এ পৃথিবীতে আল্লাহ্র সৃষ্ট যাবতীয় কল্যাণ ও সুখশান্তিমূলক দ্রব্যাদি ও উপায়-উপকরণ সমানভাবে অংশ গ্রহণের সুযোগ পারে; সেগুলো কেবলমাত্র ধনী শ্রেণীর লোকদের মধ্যেই সীমিতভাবে আবর্তিত হতে থাকবে না- যার ফলে অন্যান্য লোক সে সব থেকে বঞ্চিত হতে পারে। বরং তা নির্বিশেষে সকলের মধ্যেই আবর্তিত হতে থাকবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেনঃ (আরবী************) তিনি সেই সওা যিনি তোমাদের সমস্ত লোকের জন্যে পৃথিবীর সব কিছু সৃষ্টি করেছেন। [(আরবী************)] আয়াতের (আরবী************) ‘সমস্ত লোক’ শব্দটি পৃথিবীর সব কিছুর তাগিদস্বরূপ বলা হয়েছে মনে করা সহীহ। তাতে যাদের সম্বোধন করা হয়েছে সে সমস্ত মানুষ বোঝাবার ওপর গুরুত্বারোপও বোঝাতে পারে। আর এক সাথে উভয় অর্থ বোঝাতে চাইলেও কোন প্রতিবন্ধকতা নেই। এ পেক্ষিতে অর্থ হবেঃ পৃথিবীর বুকে যা কিছু আছে তা সবই সৃষ্ট হয়েছে সমস্ত মানুষের জন্যে, অল্প সংখ্যক লোকেরা অন্যদের বঞ্চিত করে তা নিরংকশভাবে আয়ওাধীন করে নেবে এজন্যে নয়। এ পরিপ্রেক্ষিতেই ইসলাম সুবিচারপূর্ণ বণ্টনের নীতি গ্রহণ করেছে। সমষ্টির ধন-মালে মালিকত্ব অভিন্ন হবে। ইসলাম এক্ষেত্রে ভারসাম্য কার্যকর করার জন্যে যাকাত, ফাই প্রভৃতি ব্যবস্থা অবলম্বন করেছে। তাতে মানুষ পরস্পরের সমান মনে এসে যায়। ‘ফাই’ বণ্টন সংক্রন্ত আয়াতে কুরআন মজীদে তা স্পষ্ট ভাষায় বলে দেয়া হয়েছে। বলেছেনঃ (আরবী************) আল্লাহ তাঁর রাসূলকে নগরবাসীদের কাছ থেকে যা কিছুই দিয়েছেন, তা আল্লাহ্র জন্যে এবং রাসূলের নিকটাত্মীয়দের, ইয়াতীম, মিসকীন ও নিঃস্ব পথিকের জন্যে-যেন তা কেবল তোমাদের মধ্যকার ধনী লোকদের মধ্যেই আবর্তিত হতে না থাকে। [(আরবী************)] ইসলাম জীবিকা ও রুটি রুজির দিক দিয়ে বিভিন্ন মানুষের মধ্যে পার্থক্য স্বীকার করেছে। কেননা তা যে জন্মগত কর্মক্ষমত্, শক্তি-সামর্থ্য, প্রতিভা ও বুদ্ধিসওার দিক দিয়ে বিভিন্ন মানুষের মধ্যে নিহিত পার্থক্যের ফলশ্রুতি, তাতে কোনই সন্দেহ নেই। সে সাথে একথাও স্বীকার্য যে, এ পার্থক্য কমবেশী হওয়ার অর্থ এ নয় যে, ইসলাম ধনীদের ধন বৃদ্ধির কাজ করবে এবং দরিদ্রদের তিল তিল করে নিঃস্ব হয়ে যাওয়ার জন্যে ছেড়ে দেবে, যার ফলে উভয় শ্রেণীর মধ্যে পার্থক্যটা অধিকতর বৃদ্ধি পেয়ে যাবে, ধনীরা সমাজে এমন শ্রেণী হয়ে দাঁড়াবে যার জন্যে লিখে দেয়া হবে যে; তারা গজদন্ডের উচ্চ শিখরে বসবাস করবে, সর্বপ্রকারের যে ধনসম্পদ ও নিয়ামরেত উওরাধিকারী কেবল তারা হবে আর দরিদ্র লোকেরা এমন একটা শ্রেণী হয়ে বসবে, পর্ণকুটিরে থেকে নিঃস্বতা ও বঞ্চনার আঘাতে মৃত্যুবরণ করাই হবে যাদের একমাত্র ভাগ্যলিপি।……না, ইসলাম এরূপ অবস্থায় পক্ষপাতী নয়। বরঞ্চ ইসলাম আইন বিধান রচনা ও বাস্তব সংগঠন গড়ে তোলার মাধ্যমে এজন্যে কাজ শূরু করেছে। তার উপদেশ, উৎসাহ দান ও পরিণতি সম্পর্কে সাবধানকরণকেও এজন্যে কাজে লাগিয়েছে। সমাজের এ উভয় শ্রেণীর লোকদের মধ্যকার পার্থক্য দূরত্ব হ্রাস করাই ইসলামের লক্ষ্য। এজন্যে ধনীদের অত্যাচারে-উৎপীড়ন ও শোষণের সীমা নির্ধারণ এবং দরিদ্রদেরকে সমান মানে উচ্চে উওোলনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এ পর্যয়ে ইসলাম গৃহীত উপায় ও পন্থাসমূহ সম্পর্কে আমি খুব বেশী কিছু বলতে চাই না। সে সবের মধ্যে যাকাত যে একটা স্পষ্ট ও প্রধান উপায়, সে পর্যায়ে আমি পরে বিস্তারিত কথা বলব। কেননা তাতো ধনীদের কাছ থেকে নেয়া হয় এবং দরিদ্রের দেয়া হয়। আমরা যখন সুষ্ঠু সহীহ্ ইসলামী সমাজের চিন্তা করি, দেখতে পাই তার ব্যক্তিগণ নিখুঁতভাবে কাজ করেছে ইসলামের আহ্বানের সাড়া দিয়ে। জমিনের পরতে পরতে গমন করছে, তার অভ্যন্তরে নিহিত কন্দর থেকে রিযিকের সন্ধান করছে, তা বের করে নিয়ে আসছে বাইরের জগতে। চতুর্দিকে কৃষি কাজ ও শিল্পোৎপাদন ছড়িয়ে বাড়িয়ে দিচ্ছে, ব্যবসায়ী হিসেবে ছড়িয়ে পড়েছে এক দিগন্ত থেকে অন্য দিগন্তে। বহু ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে তারা কর্মতৎপর হয়ে রয়েছে। নানা পেশায় মানুষ ব্যতিব্যস্ত, সর্বশক্তি নিয়োগ দিয়েছেন, সর্বশক্তি দিয়ে তার কল্যাণ গ্রহণ করছে। এ ধরনের একটি সমাজের চিত্র যখন আমাদের সম্মুখে ভেসে ওঠে তখন দেখতে পাই অসংখ্য মানুষ এমন সক্ষম, যাদের ওপর যাকাত ফরয হতে পারে তাদের ধন-সম্পদে, তাদের আয়ে উৎপন্ন। হারটা নিশ্চয়ই খুব বড় হবে এবং এ শ্রেণীর লোকদের সংখ্যা অনেক বেশী হবে। তথায় এমন লোকও বিরল হবে না, যারা অক্ষমতার দরুন কাজ থেকে দূরে বসে থাকবে অথবা পরিবারের লোকসংখ্যা বিপুল ও আয়ের মাত্রা কম হওয়ার দরুন খুবই অসচ্ছলতার মধ্যে দিনাতিপাত করবে। কিন্তু তাদের সংখ্যা খুব বেশী হবে না। যতই হোক, সংখ্যাটা অবশ্যই সীমিত হবে। তার ফলে এখানে যাকাত বাবদ লব্ধ সম্পদের তুলনায় প্রাপকদের প্রাপ্তি পরিমাণ বিপুল হবে। তখন কম আয়ের বা আয়হীন লোকদের মালিক বানানোর জন্যে বিপুল সম্পদ দেয়া সম্ভব হবে। ফলে জাতির ‘আছে’ ও ‘নেই’ লোকদের মধ্যকার পারস্পরিক পার্থক্য দূরত্ব অনেকখানি হ্রাস করা খুবই সহজ হয়ে দেখা দেবে। কষ্টদায়ক দারিদ্র্যের সাত্রা বেশী হওয়া-একদিকে বিপুল ধনসম্পদের মালিক এবং অপরদিকে দিনের খোরাক বঞ্চিত লোকদের অবস্থিতিই- একটা সমাজের জন্যে খুব বড় বিপদ। এ বিপদটা সমাজ-সংস্থাটিকেই বিপর্যস্ত করে তার অস্থিমজ্জা জরাজীর্ণ করে দেয়- তার চেতনা হোক আর না-ই হোক। কিছু লোক পেটের ওপর হাত রেখে অতিভোজজনিত বদহজমের অভিযোগ করে আর তাদেরই পার্শ্বে থাকে এমন লোক, যারা পেটের ওপর হাত রেখে ক্ষুধার আগুন দমনে প্রয়াসী। কিছু লোক আকাশচুম্বী প্রাসাদের মালিক-বাসকারী লোকের অভাব বা স্বল্পতা আর কাছেই জরাজীর্ণ পর্ণকুটির-পা বিছিয়ে শোয়ারও সংকুলান হয় না, বাপ-মা, স্ত্রী-পুত্র নিয়ে মাথা গুঁজে থাকতেও পারে না! এ এক অমানুষিক দৃশ্য! কিন্তু যাকাত মানুষে মানুষে এ বীভৎস ও কুৎসিত পার্থক্য দূরীভূত করে দেবে। অন্তর এ দ্বিতীয় শ্রেণীর লোকেরা যে প্রয়োজন পরিমাণ ও খাদ্য পোশাক বাসস্থান পাচ্ছে না, এরূপ লোক কোথাও পাওয়া যাবে না। অধিকন্তু যাকাত এ শ্রেণীর লোকদের অর্থনৈতিকভাবে ঊর্ধ্বে তুলে নেয়ার-এবং ধনী লোকদের পর্যায়ে গন্য হওয়ার সুযোগদানের অনূকুল কাজ করবে। ভিক্ষাবৃওি সমস্যা ইসলাম ভিক্ষাবৃওির বিরুদ্ধে লড়াই করেঃ বাস্তবভাবে ইসলাম মুসলামানের মনে লোকদের কাছে ভিক্ষার হাত দরাজ করার প্রতি তীব্র ঘৃণার সৃষ্টি করে। সেজন্যে তার ব্যক্তিত্ব ও আত্মসম্মানবোধ জাগাবার জন্যে প্রশিক্ষাণ দেয়। সর্বপ্রকারের নীচতা ও হীনতার ঊর্ধ্বে উঠবার প্রেরণা যোগায়। ইসলামের নবী রাসূলে করীম (স) সহাবীদের কাছ থেকে যেসব বিষয়ে ‘বায়’আত’ গ্রহণ করতেন, তার শুরুতেই এ বিষয়ের অঙ্গীকারের উল্লেখ করতেন। তাকে ‘বায়‘আতের’ অন্যতম ‘রোকন’ হিসেবে বিশেষভাবে স্মরণ করিয়ে দিতেন। আবূ মুসলিম আল খাওলানী থেকে বর্ণিত- তিনি বলেছেন, আমার বিশ্বস্ত বন্ধু আউফ ইবনে মালিক আমার কাছে হাদীস বর্ণনা করেছেন। তিনি এক হিসেবে আমার বন্ধু। অন্য হিসেবে তিনি আমার দৃষ্টিতে বিশ্বস্ত আমানতদার। বলেছেঃ ‘আমরা সাত বা আট কিংবা নয়জন লোক রাসূলে করীম (স) এর কাছে বসা ছিলাম। তখন তিনি বলেলনঃ তোমরা কি রাসূলে করীম (স) এর হাতে ‘বায়‘আত’ করবে না। আমরা নও মুসলিম হিসেবে বায়‘আত করেছি বেশী দিন হয়নি- বললামঃ আমরা তা আপনার কাছে বায়‘আত করেছি।………. পরপর তিনবার হললেন…. তা সও্বেও আমরা হাত প্রসারিত করেছিলাম, তারপর বায়‘আতও করলাম। একজন বললেনঃ হে রাসূল! আমরা তো আপনার কাছে ইতিপূর্বে ‘বায়‘আত’ করেছি। এখন আবার কিসের ওপর ‘বায়‘আত’ করব। তিনি বললেনঃ বায়আত করবে একথার ওপর যে, তোমরা আল্লাহ্র বন্দেগী করবে, তাঁর সাথে একবিন্দু শিরক করবে না, পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়বে, তোমরা শুনবে ও আনুগত্য করবে। পরে খুব আস্তে করে বললেনঃ ‘তোমরা লোকদের কাছে কিছু চাইলে না। হাদীসটির বর্ণনাকারী বলেছেন, সেই লোকদের কেউ কেউ তার চাবুক ফেলে দিচ্ছিল-অতঃপর কেউই তাকে কিছু দেয়ার জন্যে কারো কাছেই এবং কখনই সওয়াল করবে না। [হাদীসটি মুসলিম, আবূ দাউদ, নাসায়ী ও ইবনে মাজাহ উদ্ধৃত করেছেন যেমন (আরবী************)] গ্রন্থে ২য় খন্ড (আরবী************) এ বলা হয়েছে।] নবীর কাছে বায়‘আতকারী লোকেরা এমনিভাবে বায়‘আতের আক্ষরিকভাবে অনুসরণ ও বাস্তবায়ন করেছেন। অতঃপর বাস্তবিকই তাঁরা কারোর কাছেই কিছু চাননি-অর্থ পর্যায়ের কোন জিনিস কিংবা কোনরূপ কষ্টের কাজ-কেন ক্ষেত্রেই নয়। এজন্যে আল্লাহ সাহাবীদের প্রতি সন্তষ্ট ছিলেন। বস্তুত তারা দুনিয়াকে জয় করেছিলেন নিজেদের নফসকে জয় করার পর। (যারা নিজের ওপর কর্তৃত্ব করতে পারে, তারাই পারে অন্য মানুষের ওপর কর্তৃত্ব করতে।) তাঁরা নিজেদেরকে সীরাতুল মোস্তাকীমে চালিয়েছিলেন বলেই দুনিয়াকে সীরাতুল মুস্তকীম দেখাতে সক্ষম হয়েছিলেন। রাসূল করীম (স) এর মুক্ত গোলাম সওবান (রা) থেকে বর্ণিত, বলেছেন রাসূলে করীম (স) ইরশাদ করেছেনঃ ‘যে লোক আমাকে নিশ্চয়তা দিতে পারবে যে, সে লোকদের কাছে কিছুই চাইবে না, আমি তাকে জান্নাতের নিশ্চয়তা দিতে পারি।’ সওবান বললেনঃ ‘আমি হে রাসূল! বললেনঃ হ্যাঁ, লোকদের কাছে কিছুই চাইবে না এবং অতঃপর তিনি বাস্তবিকই কারো কাছে কিছুই চাইতেন না। [হাদীসটি আবূ দাউদ বর্ণনা করেছে-পূর্বে সূত্র। বায়হাকী উদ্ধৃত করেছেন (আরবী************) ৪র্থ খন্ড ১৯৭ পৃ.] নবী করীম (স) সাহাবীদের কাছে গ্রহণকারী হাতকে ‘নীচের হাত’ বলে চিহ্নিত করেছেন। আর আত্মসংসম রক্ষাকারী বা দাতা হাতকে ‘উপরের হাত’ বলে দেছিয়েছেন। তিনি তাদের শিক্ষা দিয়েছেন, তাঁরা যেন (ভিক্ষা) চাওয়া থেকে আত্মরক্ষা করায় নিজেদের রাজী করেন, তাহলে আল্লাহও তাদের মর্যাদা রক্ষা করবেন। তাঁরা যেন অন্য লোকের প্রতি মুখাপেক্ষী না হন, তাহলে আল্লাহ তাদের মুখাপেক্ষীহীন বানাবেন। হযরত আবূ সায়ীদ খদরী (রা) থেকে বর্ণিত, আনসারদে কতিপয় লোক রাসূরে করীম (স) এর কাছে কিছু প্রার্থনা করলে তিনি তাদের তা দিলেন। পরে আবার চাইলে তখনও দিলেন। শেষে রাসূলের কাছে যা ছিল তা তখন নিঃশেষে ফুরিয়ে গেল, বললেন, আমার কাছে কোন মাল থাকলে আমি তা তোমাদের না দিয়ে পূজি করে রাখতাম না। আর যে লোক চাওয়া থেকে বিরত থাকবে আল্লাহও তাকে পরমুকাপেক্ষিতা থেকে রক্ষা করবেন। যে ধৈর্য ধারণ করবে, আল্লাহ তাকে ধৈর্যশীল বানাবেন। আর ধৈর্য থেকে অধিক প্রশস্ত জিনিস কেউ কাউকে দিতে পারে না। [ইবন মাজা ছাড়া অন্যান্য সকলে হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন। দেখুনঃ (আরবী************) এবং তার পরে।] কাজেই আসল ভিওি রসূল (স) সাহাবিগণকে ইসলামের মূলনীতিসমূহের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ দুটি মৌল নীতি শিখিয়েছেন। প্রথম মৌলনীতিঃ কর্মই উপর্জনের ভিওি। মুসলিম মাত্রেরই কর্তব্য পৃথিবীর-জমির- পরতে পরতে গমন করা এবং আল্লাহ্র অনুগ্রহ সন্ধান করা। আর কাজ- যদিও কেউ কেউ তাকে উপেক্ষার দৃষ্টিতে দেখে- লোকদের কাছে চাওয়া থেকে বিরত থাকা অপেক্ষাও অনেজ উওম। লোকদের কাছে চাওয়ার মুখের পানি ফেলানোর তুলনায়ও তা ভাল। কেউ যদি পিঠের ওপর রশি রেখে এ বোঝা কাঠ নিয়ে আসে তা বিক্রয় করে, তাহলে আল্লাহ্ তার মুখ রক্ষা করবেন। তা অনেক ভালো লোকদের কাছে চওয়া থেকে-তারা দিল কি দিল না, তা তো অনিশ্চিত। [বাখারী জুবাইর থেকে উদ্ধৃত করেছেন (আরবী************) এর শুরুতে।] লোকদের কাছে চওয়া হারাম আর দ্বিতীয় মৌলনীতি হচ্ছে, মূলত লোকদের কাছে চাওয়া এবং তাদের জড়িয়ে ধরে দিতে বাধ্য করা হারাম। কেননা তাতে একটি মানুষকে স্বীয় মান-মর্যাদা ক্ষুন্ন করে চমভাবে লাঞ্ছিত ও অপমানিত করা হয়। অতএব কোন মুসলমানেরই চাওয়ার পথ ধরা উচিত নয়। তবে বাস্তবিকই কোন কঠিন প্রয়োজন-অভাব, দারিদ্র্য- যদি তাকে চাইতে বাধ্যই করে, তাহলে স্বতন্ত্র কথা। যদি কেউ অন্য লোকের কাছে চায় অথচ তার জন্যে যথেষ্ট পরিমাণ সম্পদ তার কাছে রয়েছে, তা হলে তার এ ‘চাওয়া’টা কিয়ামতের দিন তার মুখমন্ডলে ‘জখম’ হয়ে দেখা দেবে। এ মর্মে বহু সংখ্যক হাদীস রয়েছে, যাতে লোকদের কাছে ‘চাওয়া’ সম্পর্কে হুঁশিয়ারী করে দেয়া হয়েছে, এমন সব ভয়াবহ পরিণতির কথা বলা হয়েছে, যা শুনলে অন্তর কেঁপে ওঠে। অন্মধ্য থেকে বুখারী মুসলিম নাসায়ী কর্তৃক হযরত ইবনে উমর (রা) থেকে রাসূল (স)- এর কথা হিসেবে উদ্ধৃত হয়েছেঃ লোকদের কাছে চেয়ে বেড়ানো তোমাদের মধ্য থেকে কারোর অভ্যাস হায়ে দাঁড়িয়ে থাকলে সে যখন আল্লাহ্র সাক্ষাতে উপস্থিত হবে, তখন তার মুখে গোশতের এক টুকরাও থাকবে না। ‘সুনান’ প্রণেতাগণ উদ্ধৃত করেছেনঃ ‘যে অন্যদের কাছে চাইল অথচ তার যথেষ্ট পরিমাণ ধনাঢ্যতা আছে, কিয়ামতের দিন সে ক্ষতবিক্ষত মুখমন্ডল নিয়ে আসবে। বলা হলঃ হে রাসূল! ধনাঢ্যতা হয় কিসে? বললেনঃ পঞ্চাশ দিরহাম অথবা সেই পরিমাণ স্বর্ণমূল্য।’ [চারখানি হাদীস গ্রন্থে উদ্ধৃত।] অর্থাৎ লোকদের কাছে ‘চাওয়া’ কাজটির পরিণতি ব্যক্তির মনুষ্যত্ব ও মর্যাদা প্রকাশকারী মুখমন্ডলে প্রকাশিত হবে। আর একটি হাদীসঃ ‘যে চাইল’ অথচ তার কাছে যথেষ্ট আছে, সে আগুনের মাত্রা বৃদ্ধি করতে চাইছে অথবা জাহান্নামের অগ্নিস্ফুলিংগ বেশী করতে চেয়েছে।’ সাহাবিগণ বললেনঃ হে রাসূল! ‘যথেষ্ট পরিমাণটা কি? বললেনঃ যে পরিমাণে তার সকাল-সন্ধ্যা চলে যায়। [আবূ দাউদে উদ্ধৃত।] অপর হাদীসঃ যে চাইল, অথচ তার কাছে এক আউকিয়া রয়েছে, সে তো লোকদের জড়িয়ে ধরার অপরাধ করল। [আবূ দউদনাসায়ী উদ্ধৃত।] ‘আউকিয়া’- চল্লিশ দিরহাম। উপরের হাদীসের অর্থ কি এই যে, যার কাছে একদিনের সকাল-সন্ধ্যার খোরাক আছে? অথবা তার তাৎপর্য এই যে, সে প্রতি দিনের প্রয়োজনীয় খাদ্য উপার্জন করে, ফলে সে সব সময়ই সকাল-সন্ধ্যার খোরাক পায়? সম্ভবত এ শেষোক্ত তাৎপর্যটিই অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য, এটাই অধিক সমীচীন। অতএব যে লোক এভাবে নিত্য নতুন রিযিক পাচ্ছে, তার এ পাওয়াই চাওয়ার লাঞ্ছনা থেকে বিরত থাকার জন্রে যথেষ্ট। যে ধনাঢ্যতা ভিক্ষা হারাম করে উপরিউক্ত হাদীসসমূহে ভিক্ষা চাওয়া হারাম হয় যে পরিমাণ ধনাঢ্যতায়, তাতে বিভিন্ন পরিমাণের উল্লেখ করা হয়েছে- তার কারণ কি? শাহ্ অলী উল্লাহ্ দিহলভী তাঁর অন্যান্য গ্রন্থ ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা’য় উক্ত প্রশ্নের যে উওর দিয়েছেন, তা খুবই উওম। তিনি বলেছেনঃ আমাদের মতে এসব হাদীস পরস্পর বিরোধী নয়। কেননা মানুষ বিভিন্ন স্থানে বাস করে। প্রত্যেকেরই একটা উপার্জন আছে, তা থেকে দিকে যাওয়া সম্ভব নয়। অতএব যে লোক কোন পেশার মাধ্যমে উপার্জনকারী হবে, সে সেই পেশার জন্যে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি-হাতিয়ার না পাওয়া পর্যন্ত অক্ষম। যে চাষী তার চাষের প্রয়োজনীয় হাল-গরু না পাওয়া পর্যন্ত, যে ব্যবসায়ী সে পণ্যদ্রব্য না পাওয়া পর্যন্ত এবং যে লোক জিহাদে যোগদান করে সকাল-সন্ধ্যায় পাওয়া গনিমতের মাল দিয়ে রিযিকের ব্যবস্থা করে-যেমন রাসূলে করীম (স)-এর সাহাবিগণ ছিলেন-এ সকলের জন্যে নির্ধারিত পরিমাণ হচ্ছে এক ‘আউকিয়া’ অথবা পঞ্চাশ ‘দিরহাম’। আর যে লোক উপার্জন করে হাটে-বাজারে বোঝা বহন করে; কিংবা কাঠ সংগ্রহ ও বিক্রয় করে এবং অনুরূপ অন্যান্য উপার্জনকারী, তাদের বেলায় নির্ধারিত পরিমাণ তা- যা সকাল-সন্ধ্যা খাবার জোটাতে পারে। [২য় খন্ড, ৪৯ পৃঃ (আরবী**************) হানাফী আল্লামা আবূ জাফর তাহাভী [(আরবী**************)] গ্রন্থে বলেছেন, নবী করীম (স) প্রথম দিক দিয়ে ভিক্ষা চাওয়া হারাম হয় যে পরিমাণ খাদ্য থাকলে- তা নির্ধারণে খুব কড়াকড়ি করেছেন। পরে ক্রমশ সে কঠোরতাকে হালকা করেছেন। শেষে বলেছেন পাচঁ ‘আউকিয়া’ আর তা রৌপ্যে যাকাত ফরয হওয়ার পরিমাণ। কিন্তু এ কথার কোন দলিল নেই। তাই শাহ্ দিহলভীর ব্যাখ্যা অধিক গ্রহণীয়। আল্লামা তাহভী পাঁচ ‘আউকিয়া’র যে হাদীসের কথা বলেছেন, সে হাদীসের শুদ্ধতা প্রমাণিত হয়নি।] বিবেচনাসম্মত কথা হচ্ছে, যে পরিমাণ ধনাঢ্যতা ভিক্ষা চাওয়া হারাম করে, তা যাকাত গ্রহণ হারাম করে যে পরিমাণ ধনাঢ্যতা, তা থেকে অনেক কম। কেননা শরীয়াতের বিধানদাতা ভিক্ষাবৃওির ওপর কঠোরতা গ্রহণ করেছেন। সে ব্যাপারে হুঁশিয়ারী উচ্চারণে খুব গুরুত্ব দিয়েছে। অতএব নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া কোন মুসলিমের জন্যেই ভিক্ষাবৃওি জায়েয নয়। আর ভিক্ষা করার সময়টিতেও প্রয়োজন পরিমাণ যার আছে, তার তো ভিক্ষা করার প্রয়োজন থাকতে পারে না- খাওাবী তাই বলেছেন। ইসলাম তার প্রতি ঈমানদার লোকদের জন্যে এ প্রশিক্ষণেরই ব্যবস্থা করেছে। আর তাদের জন্যে ওসবই হচ্ছে মূল্যবান উপদেশ, নসীহত। কিন্তু কেবল নীতিগত উপদেশ ও নৈতিক আবেদন এবং মনস্তাও্বিক প্রশিক্ষণ কখনই যথেষ্ট হতে পারে না, যদি সাথে ভিক্ষুক লোকদের জন্যে-যারা সমুপস্থিত প্রয়োজনেই, শক্তিশালী বাধ্যবাধকতায়ই ভিক্ষাবৃওি করে-বাস্তব ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হবে। এজন্যেই বলা হয়েছে, ‘জবরের আওয়াজ বিবেকের ধনীর চাইতে অনেক শক্তিশালী।’ কর্মক্ষম লোকদের কর্মসংস্থানই ভিক্ষাবৃওি রোধের বাস্ত উপায় ভিক্ষাবৃওি রোধের বাস্তব কর্মপন্থা দুটি ক্ষেত্রে প্রতিফলিত হয়। প্রথম, প্রত্যেক কর্মক্ষম বেকার লোকের জন্যে উপযুক্ত কাজের ব্যবস্থা করা। এটা ইসলামী রাষ্ট্রের দায়িত্ব তার নাগরিকদের প্রতি। যে দায়িত্বশীল, সে তা জনগণের জন্যে দায়ী (Responsible)। দেশবাসীর মধ্যে কর্মক্ষম বেকার লোকদের সম্মুখে তার হাত কচলাতে থাকা কোনক্রমেই উচিত নয়। তেমনি তাদের প্রতি স্থায়ভাবে যাকাত-সাদ্কা’র সাহায্য দানে হাত প্রসারিত করতে থাকাও জায়েয নয়-পরিমাণ কম কি বেশী। যাকাতের ব্যয়খাত পর্যায়ে আমরা রাসূলে করীম (স)- এর হাদীস উল্লেখ করে এসছিঃ ‘যাকাত ধনীর জন্যে বা সুস্থদেহ শক্তিসম্পন্ন ব্যক্তির জন্যে হালাল নয়। সুস্থদেহ শক্তিসম্পন্ন ব্যক্তিকে যে বস্তুগত সাহায্যেই দেয়া হবে, তা এক দিক দিয়ে বেকারত্বে উৎসাহিত করা ছাড়া আর কিছুই নয়। আর অপর দিক দিয়ে তা দুর্বল অক্ষম অপূর্ণাঙ্গ দেহ লোকদের অধিকারে বেশী লোকের ভিড় সৃষ্টি মাত্র।’ ওসব ভিক্ষা-চাওয়া লোকদের একজনের প্রতি রাসূলে করীম (স) যে নীতি গ্রহণ করেছিলেন, তা-ই হচ্ছে বাঞ্ছনীয় ও কর্তব্য পদক্ষেপ। আনাস ইবনে মালিক (রা) [হাদীসটি আবূ দাউদ, তিরমিযী, নাসায়ী ও ইবনে মাজা উদ্ধৃত করেছেন। তিরমিযী বলেছেনঃ এ হাদীসটি ‘হাসান’- কেবল আখ্জার ইবনে আজলাম সূত্রেই আমরা তা জানি। তার সম্পর্কে ইয়াহ্ইয়া ইবনে মুয়ীনি বলেছেনঃ[(আরবী**************) আবূ হাতেম আর রাজী বলেছেনঃ তাঁর বর্ণিত হাদীস লেখা হত। দেখুনঃ [(আরবী**************)] থেকে বর্ণিত, একজন আনসার বংশীয় লোক রাসূলে করীম (স)-এর কাছে উপস্থিত হয়ে ভিক্ষা চাইলে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমরা ঘরে কি কিছুই নেই’? সে বলল, হ্যাঁ, আছে। উটের পিঠে পরাবার বা ঘরে গরম কাপড়ের নিচে বিছানোর একটা কাপড়- তার একটা অংশ পরিধান করি, আর অপর অংশ বিছাই, আর একটি পাত্র। তাতে পানি পান করি।’ তখন নবী করীম (স) বললেন, জিনিস দুটি আমার কাছে নিয়ে এসো।’ সে তা তাঁর কাছে নিয়ে এল। রাসূলে করীম (স) তা হাতে নিয়ে বললেন, এই দুটি কে কিনবে? এক ব্যক্তি বলল, আমি নেব এক দিরহাম মূল্যে।’ তিতিন বললেন, ‘তার বেশী দিতে কেউ প্রস্তুত আছে?’………দুবার……….. তিনবার। তখন অপর একটন বলল, ‘আমি এ দুটি জিনিস দুই দিরহাসে কিনব।’ তখন নবী করীম (স) জিনিস দুটি সে লোকটিকে দিলেন ও দুটি দিরহাম গ্রহণ করলেন। দিরহাম দুটি তিনি আনসারীকে দিয়ে বললেন, ‘একটি দিরহাম দিয়ে খাদ্য ক্রয় করে তোমার পরিবারের কাছে পৌঁছাও। আর অপর দিরহামটি দিয়ে একটি কুঠার কিনে আমার কাছে নিয়ে এসো।’ পরে রাসূলে করীম (স) নিজ হাতে তাতে হাতল লাগিয়ে দিলেন। তাকে বললেন, ‘যাও’ কাঠ সংগ্রহ কর এবং বিক্রয় কর এবং আমি যেন তোমাকে পনের দিন পর্যন্ত না দেখি।’ অতঃপর লোকটি চলে গেল। সে কাঠ নিয়ে এসে বিক্রয় করতে লাগল। পরে যখন সে ফিরে এলো, এ সময়ে সে দশ দিরহাম উপার্জন করেছে। তার কিছু দিয়ে সে কাপড় ক্রয় করল এবং কিছু দিয়ে সে খাদ্য ক্রয় করল। এ সময় রাসূলে করীম (স) বললেন, ‘কিয়ামতের দিন তোমার মুখমন্ডলে ভিক্ষার কালো চিহ্ন পড়ুক, তার চাইতে এটা অনেক ভালো। কেননা ভিক্ষা চাওয়া তিনজন লোক ছাড়া শোভা পায় না। কঠিন দারিদ্র্যে পাড়িত ব্যক্তি [কঠিন দারিদ্র্য বলতে- মূলে ব্যবহৃত শব্দের দৃষ্টিতে- বোঝানো হয়েছে এমন দারিদ্র্য যা ব্যক্তিকে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয় অর্থাৎ তার কাছে এমন জিনিসও থাকে না যা দিয়ে সে মাটি থেকে সরে থাকতে পারে।] অথবা ন্যক্কারজনক বিরাক্তকর ঋণে জর্জরিত ব্যক্তি অথবা এমন দিয়েত দিতে বাধ্য ব্যক্তি, যা দিলে সে এত দরিদ্র হয়ে পড়বে যে, তার জন্যে ভিক্ষা চাওয়া হালাল হয়ে যাবে। এ সুস্পষ্ট হাদীসে আমরা দেখতে পাচ্ছি, নবী করীম (স) প্রার্থী আনসারীকে যাকাত গ্রহণ করতে দিননি। কেননা সে উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। আর তার জন্যে তা জায়েয নেই। জায়েয হতে পারে কেবল তখন, যখন তার সম্মুখে চলার পথ সম্পূর্ণরূপে সংকীর্ণ হয়ে পড়ে, কোন পন্থা গ্রহণও অসম্ভব হয়ে পড়ে অথচ রাষ্ট্র সরকারের দয়িত্ব হচ্ছে তার জন্যে হালাল উপার্জনের সুযোগ করে দেয়া এবং তার সম্মুখে কর্মের দ্বার উন্মুক্ত করে দেয়া। এ হদীসটি থেকে ইসলামের এমন কতগুলো অগ্রবর্তী পদক্ষেপের কথা জানা যায়, ইসলামের আত্মপ্রকাশের পর দীর্ঘ কয়েক শতাব্দী কাল অতিবাহিত হওয়ার পরই মানবতা এ সব বিষয়ে অবিহিত হতে পেরেছে। নবী করীম (স) অভাবগ্রস্ত ভিক্ষাপ্রার্থী ব্যক্তিকে সাময়িকভাবে কিছু বস্তুগত সাহায্য দিয়েই তার সমস্যার সমাধান করতে চান নি- যেমন অনেকে তাই চিন্তা করেছে। নিছক উপদেশ-ওয়ায বলেও ভিক্ষাবৃওির বিরুদ্ধে ঘৃণা জগিয়ে দিয়েও তিনি দায়িত্ব পালন করেননি-যেমন অনেকে সাধারণত করে থাকে। তিনি স্বহস্তে সমস্যাটির বাস্তব সমাধান দেয়ার এবং এক সফল পন্থায় তার দারিদ্র্য দূর করার চেষ্টা করেছেন। তাকে শিক্ষাদান করেছেন যে, তার মধ্যে যাত শক্তি ও কর্মক্ষমতা রয়েছে, তাকে অবশ্যই কাজে লাগাতে হবে- সে শক্তি যত ক্ষুদ্রই হোক, যত উপায় ও পন্থা পয়োগ করা সম্ভব, তাও অবলম্বন করতে হবে-তা যতই দুর্বল কিন্তু তবুও ভিক্ষা করবে না- যদি তার কাছে এমন জিনিস থাকে যা ব্যবহার করলে প্রয়োজন পরিমাণ উপার্জন করা সম্ভব হতে পারে, তাহলে তা অবশ্যই ব্যবহার করবে। তাকে এও শিক্ষা দিলেন যে, যে কাজই হালাল রিযিক এনে দেয় তা-ই ভাল ও অদ্রজনোচিত কাজ, যদিও তা কাঠ যোগাড় ও বোঝা বহন করে নিয়ে এসে বিক্রয় করার কাজই হোক-না-কেন। তা হলেই আল্লাহ তার মুখমন্ডলকে ভিক্ষার লাঞ্ছনা থেকে রক্ষা করবেন। রাসূল (স) তাকে এমন কর্মের পথ দেখালেন, যা তার ব্যক্তিত্ব, শক্তি- সামর্থ্য, পরিবেশের পরিপ্রেক্ষিতে সবদিক দিয়েই তার উপযোগী। তার জন্যে কাজের একটা হাতিয়ারও যোগাড় করে দিলেন। সেটি নিয়ে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার পথ দেখালেন; তাকে দিশেহারা করে ছেড়ে দিলেন না- না খেয়ে তিল-তিল করে মরে যাওয়ার জন্যে। তাকে পনের দিনের একটা মেয়াদও নির্দিষ্ট করে দিলেন; এ কাজ তার জন্যে শোভন কিনা এ মেয়াদের শেষে তা তিনি জানতে পারবেন বলে। এই মেয়াদের মধ্যে যদি সে কাঙ্খিত দায়িত্ব পালনে সক্ষম প্রমাণিত হয় তা হলে তাকে এ কাজে বহাল রাখবেন। অন্যথায় তার জন্যে অন্য কোন উপাযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন, এটাই ছিল তাঁর পরিকল্পনা। লোকটির সমস্যার বাস্তব সমাধান পেশ করার পরই তিনি সেই নীতিগত সংক্ষিপ্ত উপদেশ তার সম্মুখে পেশ করলেন, যাতে ভিক্ষাবৃওি সম্পর্কে উচ্চমানের সতর্কতা ও ভয় প্রদর্শন রয়েছে। সেই সীমার কথাও বলে দিলেন, যার মধ্যে বিচরণ চায়েয। আমরা মুসলিমদের জন্যে নবী প্রদর্শিত এ নির্ভুল পন্থা অবলম্বন ও অনুসরণ করা একান্তই কর্তব্য। মুখের কথা ও ওয়ায-নসীহতের সাহায্য ভিক্ষাবৃওির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার পূর্বেই আমাদের উচিত সমস্যাসমূহের বাস্তব সমাধান পেশ করা- প্রত্যেক বেকার ব্যক্তির জন্যে কাজের সংস্থান করা। [এ গ্রন্থকার প্রণীত (আরবী*************) থেকে উদ্ধৃত।] এ প্রেক্ষিতে যাকাতের ভূমিকা কত বড় গুরুত্বপূর্ণ, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। যাকাত সম্পদ থেকে কর্মক্ষম বেকার লোকদের জন্যে যে ধরনের হাতিয়ার, যন্ত্রপাতির প্রয়োজন তা কিনে দেয়া কিংবা ব্যবসায়ের জন্যে মূলধন সংগৃহীত যাকাত সম্পদ থেকে দেয়া সম্ভব হলে তাই দেয়া। যাকাত ব্যয়ের খাতসমূহের বিশ্লেষণে আমরা তা বিস্তারিত বলে এসেছি। এ থেকে সেবামূলক কাজের প্রশিক্ষণও দেয়া যেতে পারে, যাকে কেউ পেশা বা উপার্জন-উপায়রূপে গ্রহণ করবে এবং তা থেকেই সে জীবিকার সংস্থান করবে। যৌথ প্রকল্প প্রতিষ্ঠা, শিল্প কারখানা স্থাপন ও ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, কৃষি ফার্ম কায়েম করা ইত্যাদি ধরনের বহু কাজের ব্যবস্থাই তা থেকে করা যেতে পারে। বেকার কর্মক্ষম লোকেরা সেখানে কাজ করবে, উপার্জন করবে এবং শরীকানায় বা সমগ্রটার কিংবা তার কোন অংশের তারা মালিক হয়ে বসবে। অক্ষম লোকদের জীবিকার নিরাপওা দ্বিতীয়-অর্থাৎ ভিক্ষাবৃওি ও লোকদের কাছে চেয়ে বেড়ানো সমস্যার বাস্তব কর্মের মাধ্যমে সমাধান করার উপায়সমূহের মধ্যে ইসলামের দৃষ্টিতে দ্বিতীয় পন্থা হচ্ছে, উপার্জনে অক্ষম প্রত্যেক ব্যক্তের জন্যে উপযুক্ত ও যথেষ্ট মাত্রার রিযিকের নিরাপওা দান। তার অক্ষমতা দুটি কারণে হতে পারেঃ ক. দৈহিক দুর্বলতা ও শক্তিহীনতার দরুন তা হতে পারে। অল্প বয়স্কতাও তার ও উপার্জনের মাঝখানে প্রতিবন্ধক হয়ে দাড়াঁতে পারে, আশ্রয়দাতা বা অভিভাবক না থাকা যেমন ইয়াতীমদের বেলায় হয় কিংবা কোন কোন ইন্দ্রিয় শক্তির বা কোন অংগের অক্ষমতার দরুনও তা হতে পারে। হতে পারে দীর্ঘ মেয়াদী ও অক্ষমকারী রোগের দরুন….. ইত্যাদি ইত্যাদি। এগুলো দৈহিক কারণ, যে কেউই এ অক্ষমতার মধ্যে পড়ে যেতে পারে এবং তার ওপর বিজয়ী হওয়া কিংবা তাকে দমিত করার কোন উপায়ই হয়ত সে পেতে পারে না। এরূপ ব্যক্তিকে যাকাত থেকে এমন পরিমাণ দিতে হবে, যা তার জন্যে যথেষ্ট হবে, তাকে সচ্ছল বানিয়ে দেবে, তার দুর্বলতা দূর করার ও তার অক্ষমতার প্রতি দয়াপরবশ হয়ে তা করতে হবে-যেন সে সমাজের ওপর একটা বোঝা হয়ে না দাঁড়ায়। যদিও আমাদের এ আধুনিক যুগে বিজ্ঞানের সাহায্য আংশিক অক্ষমতাসম্পন্ন লোকদের অবস্থার পরিবর্তন করে জীবনযাত্রা সহজ করে তোলা সম্ভবপর-যেমন অন্ধ, বধির ইত্যাদি। তাদেরকে নানা শিল্প ও পেশা শেখানো যেতে পারে- যা তাদের উপযোগী হবে, তাদের অবস্থার সাথে সংগতিসম্পন্ন হবে এবং ভিক্ষার লাঞ্ছনা থেকে তাদের রক্ষা করবে, সম্মানজনক জীবিকার সংস্থান করবে। তাদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণদানে যাকাতের মাল ব্যয় করায় কোনই অসুবিধা থাকতে পারে না। খ. উপার্জনে অক্ষমতার দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, কর্মক্ষম হওয়া সও্বেও হালাল কাজ বা উপার্জন পন্থা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যাওয়া। কাজ চাইলেও পাওয়া না যাওয়ার মত অবস্থা হওয়া, কাজের জন্যে বহু চেষ্টা করেও ব্যর্থ হওয়া। রাষ্ট্রকর্তার পক্ষ থেকে এ……..এ লোকদের জন্যে উপার্জনের সুবিধা দান সও্বেও তা না পাওয়া- দৈহিকভাবে অক্ষম লোকদের মতই এদের অবস্থা মনে করতে হবে, যদিও তারা শক্তি-সামর্থ্য ও যোগ্যতার অধিকারী। এজন্যে যে, কেবল দৈহিক তদ্দারা উপার্জন করা না যাবে। ইমাম আহ্মাদ প্রমুখ সে দুই ব্যক্তির কিস্সা বর্ণনা করেছেন, যারা রাসূলে করীম (স)- এর কাছে উপস্থিত হয়ে যাকাতের অংশ চেয়েছিল। নবী (স) তাদের দুজনের আপাদমস্তক দেখে নিলেন; দেখলেন, দুজনই খুব স্বাস্থ্যবান শক্তিসম্পন্ন ব্যক্তি। পরে তাদের বললেনঃ ‘তোমরা চাইলে আমি তোমাদের দেব; কিন্তু জেনে রাখ, যাকাতে ধনী ও উপার্জনশীল শক্তিসম্পন্ন ব্যক্তির কোন প্রাপ্য নেই। অতএব শক্তিসম্পন্ন উপার্জনকারী ব্যক্তির যাকাত পাওয়ার কোন অধিকার নেই। উপারিউক্ত বর্ণনায় আমাদের সম্মুখেই বহু লোকেরই বিভ্রান্তিমূলক চিন্তার ভিওিহীনতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যাদের ধারণা হচ্ছে, যাকাত বুঝি প্রার্থীমাত্রকেই দেয়া যেতে পারে- যে ই তা পেতে চাইবে, তাকেই বুঝি তা দিতে হবে! না, তা নয়। অনেকে এও মনে করেন যে, যাকাত বুঝি বিপুল সংখ্যক প্রার্থী ও ভিক্ষুককে সাহায্য করে। না, বরং আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, ইসলাম যেভাবে যাকাতের বিধান বিধিবদ্ধ করেছে তা যদি বাস্তবিকই অনুধাবন করা হয়- ইসলামের বিধান অনুযায়ী সংগ্রহ করা হয় এবং ইসলাম যেভাবে বণ্টন করার বিধান দিয়েছে সেই অনুযায়ী অংশ ভাগ করে ও সেভাবে ভাগ করে দেয়া হয়, তাহলে অকারণ ভিক্ষাকারী ও কৃত্রিমভাবে ভিক্ষুক সাজার পধ চিরতরে ও স্থায়ীভাবে বন্ধ করা খুবই সম্ভবপর হবে। পারস্পরিক শত্রুতা ও সম্পর্ক বিনষ্টির সমস্যা সৌভ্রাতৃত্ব মৌল ইসলামী লক্ষ্য ইসলামের মৌল লক্ষ্য হচ্ছে সমস্ত মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সৌভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক গড়ে তোলা-কিশেষভাবে ইসলামী সমাজের লোকদের পরস্পরের মধ্যে। এরূপ ভ্রাতৃত্ব- যার মধ্যে প্রীতি ও ভালোবাসার গভীরতা রয়েছে এবং তার ফলশ্রুতিতে পারস্পরিক সহযোগিতা ও অর্থনৈতিক নিরাপওা ব্যবস্থা কার্যকর হলেই প্রকৃত শান্তি ও নির্বিঘ্নতা স্থাপিত হতে পারে। তখন এ শান্তিই হবে সমাজ-সমষ্টির বিশেষত্ব। তখন লোকেরা ছোট ছোট ব্যাপারে বড় বড় ঝগড়া-বিবাদ অনুষ্ঠিত হতে এবং বিলাসপূর্ণ জীবনের স্বার্থে স্থায়ী দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষ হওয়ার মত অবস্থা চলতে দেখতে পারে না। কিন্তু এরূপ একটি সামাজিক অবস্থা কেবলমাত্র তখনই পাওয়া যেতে পারে, যদি লোকদের অন্তরে আল্লাহ্র প্রতি এর পরকালের প্রতি প্রকৃত ও গভীর ঈমান গড়ে ওঠে ও স্থায়ী হয়ে থাকে। বিরাট লক্ষ্যকে সামনে রেখেই মানুষ বাঁচে এবং প্রয়োজন হলে তারই জন্য মৃত্যুও বরণ করে। সে লক্ষ্য হচ্ছে মহাসত্যের ও মহাকল্যাণের সাহায্য কাজ। এরূপ লক্ষ্য গ্রহণ করা হলেই মুমিন ব্যক্তির পক্ষে সামান্য নগণ্য সামগ্রী বা ব্যাপারাদি উপেক্ষা করা সম্ভবপর। তখন তার দৃষ্টি নিবদ্ধ হবে ঊর্ধ্ব দিগন্তে, পথিমধ্যে বৈষয়িক স্বার্থের জন্য লড়াই করতে প্রবৃও হবে না তারা। কেননা তা খুবই সামান্য মূল্যের জিনিস আর পরকাল হচ্ছে সর্বোওম এবং চিরস্থায়ী। ইসলামী ভ্রাতৃত্বের দৃষ্টান্তমূলক সমাজ পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব-ভালোবাসাসস্পন্ন লোকদের সমাজের একটা দৃষ্টান্ত রূপ আমরা দেখতে পেয়েছি প্রথম ইসলামী সমাজে। রাসূল করীম (স) এর নেতৃত্বে মদীনা শহরকে কেন্দ্র করে এই সমাজটি গড়ে উঠেছিল। যদিও তথায় পারস্পরিক বিরোধিতা ও শত্রুতার অনেক দিক ছিল। তা সও্বেও এই প্রোজ্বল ভ্রাতৃত্বের পথে অগ্রসর হওয়া সম্ভবপর হয়েছিল। এ সমাজ প্রাথমিকভাবে গড়ে উঠেছিল মুহাজির ও আনসারদের সমন্বয়ে। মহাজিররা ছিলেন বহিরাগত ও নগরবাসীদের ওপর অনুপ্রবেশকারী। তাঁরা আদনানী আরব ছিলেন। আর আনসাররা ছিলেন নগরের আদিম অধিবাসী। তাঁরা আরবা আরবের লোক ছিলেন অর্থাৎ কাহতানী। এ কাহ্তানী ও আদনানী আরবদের প্রত্যেকের মধ্যে ছিল প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও পারস্পরিক গৌরব-অহংকার প্রকাশের রীতি। এমন কি, এ আনসারার দুটো বড় বংশধারায় দানা বাঁধছিলেন-দীর্ঘদিন পর্যন্ত তাদের পরস্পরের মধ্যে যুদ্ধ এবং রক্তপাতও চলছিল, উওরাধিকারসূত্রে তা অব্যাহতভাবে শত্রুতা নিয়ে আসছিল। তারা ছিল ‘আওস’ বা ‘খাজরাজ’ নামে পরিচিত। তা সও্বেও এ লোকদের মধ্যে তুমি দেখতে পাচ্ছ বিলাল হাবসীকে, সালমান ফারসীকে এবং সুহাইব রুমীকে। সেখানে এ দুর্ধর্ষ মরুচারীদের উপরে দেখবে আবূ যারকে এবং সভ্যতার আলোকপ্রাপ্ত ও নিয়ামতের ক্রোড়ে লালিত মুচয়িচ্ ইবনে উমাইর (রা) কে। এসব সও্বেও ঈমানের ভিওিতে এমন অনন্য ভ্রাতৃত্ব গড়ে উঠেছিল যা দুনিয়ার চক্ষু কোনদিনই দেখতে পায়নি। আমরা তথায় এমন এক সমাজ সংস্থা দেখতে পাচ্ছি, যেথায় ব্যক্তি তার দ্বীনী ভাইয়ের জন্যে তাই পসন্দ করছে, যা পসন্দ করছে সে নিজের জন্যে, তা-ই অপসন্দ করছে, যা সে অপসন্দ করছে নিজের জন্যে। তারা প্রত্যেকেই মনে করছে যে, এরূপ না হলে তার ঈমানই পূর্ণ ও যথার্থ হবে না। উপরন্ত আমরা সেখানে এও দেখতে পাই যে, এক ভাই অপর ভাইকে নিজের ওপর অগ্রাধিকার দিচ্ছে। নিজে দুঃসহ ক্ষুধায় কাতর হওয়া সও্বেও তার ক্ষুধার্ত ভাইকে খাবার দিচ্ছে, নিজে পিপাসায় প্রাণান্তকর অবস্থার মধ্যে পড়েও তার পিপাসার্ত ভাইকে অগ্রে পানি পান করার সুযোগ করে দিচ্ছে। এহেন উন্নত মনের সমাজ সংস্থার আরেকটি চিত্র কুরআন মজীদ আমাদের সম্মুখে তুলে ধরেছে নিম্মোক্ত আয়াতেঃ (আরবী*************) (‘ফাই’ লব্ধ মাল) সেসব মুহাজির ফকীরদের জন্যে, যারা নিজেদের ঘর-বাড়ি ও বিও-সম্পওি থেকে বহিষ্কৃত বিতাড়িত হয়েছে। এ লোকেরা আল্লাহ্র সন্তুষ্টি ও অনুগ্রহ পেতে চাচ্ছে। এরা আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূলের সাহায্য সমর্থনে সদা সক্রিয় থাকে। এরাই সত্যপন্থী লোক। (তা সেই লোকদের জন্যেও) যারা এ মুহাজিরদের আগমনের পূর্বেই ঈমান গ্রহণ করে হিজরত কেন্দ্রে অবস্থান গ্রহণ করেছিল। এরা এসেছে। আর যা কিছুই তাদের দেয়া হয়, তারা নিজেদের হৃদয়ে তার কোন প্রয়োজনই অনুভব করে না এবং তারা নিজেদের ওপর অন্যদের অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে- নিজেরা যতই অভাবগ্রস্ত হোক না-কেন। প্রকৃত কথা হচ্ছে, যারা নিজেদের মনের সংকীর্ণতা থেকে রক্ষা পেয়ে গেছে, তারাই সফলকাম। [(আরবী*************)] ইসলাম বাস্তবভিওিক আইন তৈরী করে ইসলাম এ ধরনেরই একটি সমাজকে আদর্শ ও দৃষ্টান্তস্বরূপ সম্মুখে রেখেছে। সেদিকেই জনগণের মন আকৃষ্ট ও উদ্বুদ্ধ করতে সচেষ্ট। সেদিকেই চক্ষু নিবদ্ধ রেখেছে ইসলামে বিশ্বাসী লোকেরাও এবং বাস্তবভাবে এরূপ একটি আদর্শ সমাজ গঠন ও কায়েমের লক্ষ্যে দুনিয়ার নিষ্ঠাবান লোকেরা নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে। বস্তুত ইসলাম বাস্তবাবদী দ্বীন। ইসলাম উচ্চতর আকাশ-মর্গের জন্যে আইন তৈরী করে না- ভুলে যায় না নিম্মে ধরনীতল। ইসলাম বিরল সংঘটিত অবস্থার প্রেক্ষিতে আইন তৈরী করে না-স্বাভাবিক ও প্রায়ই সংঘটিতব্য অবস্থাকে উপেক্ষা করে। ইসলাম মানুষকে ফেরেশতা মনে করে না, মনে করে সেই মানুষ, যারা পৃথিবীর উপরে বিচরণ বেড়ায় না। ইসলাম মানুষ সম্পর্কে এ ধারণা দিয়েছে যে, কুপ্রবৃওি তাদের তাড়ানা করে, তাদের মধ্যে নিহিত ‘নফসে আম্মারা’ তাকে খারাপ কাজের প্ররোচনাও দেয়। মানুষ শয়তান ও জ্বিন-শয়তান তাদের মনে ‘ওয়াস্ওয়াসার’ সৃষ্টি করে। পরস্পরের মনে গোপনভাবে বিভ্রন্তিকর কথাবার্তা চাকচিক্যময় ও লোভনীয় করে জাগ্রত করে দেয়। বৈষয়িক জীবনের স্বার্থ লোভ তাদের কাছে আকর্ষণীয় করে তোলে। ফালে ফেত্না-ফাসাদ, অত্যাচার-নিপীড়নের ঝঞ্ঝা-বাত্যা ছুটতে শুরু করে। এ কারণেই মানুষ পারস্পরিক ঝগড়া বা বিপদে নিমজ্জিত হয়, দ্বন্ধে লিপ্ত এবং রক্তক্ষয়ী যুদ্ধও শুরু করে দেয়। তখন মানুষের ধন-মাল যেমন লুন্ঠিত হয়, তেমনি ইযযত-আবরুও হয় পদদলিত। যুদ্ধ-বিগ্রহ মানব সমাজের আদিম ক্রিয়া পারস্পরিক যুদ্ধ-বিগ্রহের এ ব্যাপারটি সেদিন থেকেই সূচিত, যেদিন প্রথম এ বিশাল পৃথিবীতে পিতামাতা ও সন্তানসমন্বিত একটি পরিবার বাস করতে শুরু করেছে। হযরত আদম ও হাওয়া এবং তাঁদের পুত্র ও কণ্যাগণের সমন্বয়েই এ পরিবারটি গঠিত হয়েছিল। তখনও ভাই ভাইয়ের ওপর সীমালংঘন করেছে, শত্রুতা সীমালংঘনমূলক ভূমিকায় পড়ে তাকে হত্যা করেছে। এ কারণেই ফেরেশতাগণ এ নব্য সৃষ্টি সম্পর্কে খারাপ ধারণা পোষণ করত, যাকে আল্লাহ্ পৃথিবীতে তাঁর খলীফা বানিয়েছিলেন। তখন খিলাফতের মর্যাদা অনুধাবন করতে না পেরে ফেরেশতাগণ বলেছিলেনঃ (আরবী*************) হে আল্লাহ! তুমি কি পৃথিবীতে এমন সৃষ্টি নিয়ে আসবে, যা তথায় বিপর্যয় সৃষ্টি করবে ও রক্তপাত করবে? আমরাই তো তোমার প্রশংসায় তাসবীহ পাঠ করছি এবং তোমার পবিত্রতা বর্ণনা করছি। [(আরবী*************)] হযরত আদমের দুই পুত্রের কিস্সা কুরআন মজীদ বিবৃত করেছে। মানুষ যদি প্রবৃওির তাড়ানায় চলতে শুরু করে এবং ঈমানের তাগিদ উপেক্ষা করে চলে, তাহেলে কি অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে, তা আমরা সেই কিস্সার প্রত্যক্ষ করতে পারি। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেছেনঃ (আরবী*************) তাদের সম্মুখে আদমের দুই সন্তানের কিস্সা সত্যতা সহকারে বর্ণনা কর। যখন দুজনই কুরবানী করেছিল, তখন তাদের একজনের কুরবানী গৃহীত হয় এবং অপরজনের পক্ষ থেকে তা গৃহীত হয় না। তখন সে বললঃ আমি নিশ্চয়িই তোকে হত্যঅ করব। সে বললঃ আল্লাহ্ তো কেবল মওাকী লোকদের কাছ থেকেই কবুল করেন। তুমি যদি আমাকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে আমার প্রতি তোমার হস্ত প্রসারিত কর, আমি তোমাকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে আমার হাত তোমার দিকে প্রসারিত করব না। আামি তো সারা জাহানের রব্ব্ আল্লাহ্কে ভয় করি। আমি তো চাই, তুমি আমার গুনাহ্ এবং তোমার গুনাহ্ উভয়ই নিয়ে যাও। তাহলে তুমি একজন জাহান্নমী হবে। আর জালিম লোকদের এটাই কর্মফল। অতঃপর তার নফ্স তাকে তার ভাইকে হত্যা করার জন্যে প্রবুদ্ধ করে, পরে সে তাকে হত্যা করে ফেলে। এতে করে সে ভয়ানক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেল। পরে আল্লাহ্ একটি কাক পাঠালেন, কাকটি মাটি খুঁড়ছিল-যেন সে তার ভাইয়ের লাশ সমাধিস্থ করার পন্থা শেখাতে পারে। তখন সে বললঃ হায়! আমি এ কাকটির মত হতেও অক্ষম হয়ে পড়লাম আমার ভাইয়ের লাশ দাফনের পদ্ধতি জানতে পারিনি।……. এভাবে সে লজ্জিত ও অনুতপ্ত হয়ে গেলে। [(আরবী*************)] এ ছিল মানব জীবনের সূচনাকাল। মানুষ তখন পর্যন্ত লাশ দাফনের প্রক্রিয়াও জানতো না। ইতিপিূর্বে কোন লাশ দাফন হতেও দেখেনি।……একজন মানুষ তার ভাই মানুষকে হত্যা করে বসল……..সে ছিল তার আপন ভাই। ঝগড়া-বিবাদ ও দ্বন্দ্ব-সংগ্রামে ইসলামের ভূমিকা এ প্রাচীনতম অথচা একালের এ মানবীয় সমস্যার সমাধানের জন্যে বাস্তবপন্থী আদর্শ স্থানীয় জীবন-বিধানি ইসলাম কি কার্যকর পন্থা গ্রহণ করেছে? মানবীয় প্রকৃতির দিক দিয়ে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব, ঝগড়া-বিবাদ ও যুদ্ধ-বিগ্রহ যখন এমনই যে, তা থেকে মানুষের নিষ্কৃতি নেই, তখন তার বিপদটা ঘনীভূত হয়ে আসবাব, তার স্ফুলিংগ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ার এবং দিনের পর দিন তার খারাপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে দেয়ার জন্যে উন্মুক্ত করে ছেড়ে দেয়ার কোনই অর্থ হয় না। তাই যখনই কোন ঝগড়ার সৃষ্টি হবে, দ্বন্দ্ব তীব্র হয়ে উঠবে যখনেই সে আগুন দাউদাউ করে জ্বলে উঠবে, তখন কি তাকে সমাজ সভ্যতা সংস্কৃতি সব কিছুই জ্বালিয়ে ভস্ম করে দেবার জন্যে সুযোগ করে দেয়া হবে?..... না, ইসলামের তা নীতি নয়। অবিলম্বে সমাজ-সমষ্টির তাকে হস্তক্ষেপ করা একান্ত আবশ্যক। সমস্ত শক্তি নিয়োগ করে যত শীঘ্র সম্ভব এ আগুন নিভিয়ে ফেলতে চেষ্টা করা সমাজের একটা বড় দায়িত্ব। আর সেজন্যে সমাজের পক্ষ থেকে কিছু সংখ্যক লোককে এ কাজের জন্যে দায়িত্বশীল বানিয়ে দেয়া হবে এবং সেজন্যে সম্ভাব্য প্রয়োজনীয় সর্বপ্রকার প্রস্তুতি ও শক্তি-সামর্থ সহাকারে তাদেরকে এ কাজে অগ্রসর হতে হবে। যে কোন আগুন জ্বলবে-জ্বালাবে একটি ঘর কিংবা বেশী, তা নির্বাপনের ব্যবস্থা করা এবং এদিকে দিয়ে জনগণকে নিরাপওা দন সমাজ-সমষ্টিরেই দায়িত্ব। অনুরূপভাবে যে বিবাদ-বিসম্ভাদের প্রক্রিয়া গোটা সমাজকে ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে বলে ভয় হবে, তা মিটাবার ও নির্মূল করার দায়িত্বও তাকেই বহন করতে হবে। মীমাংসার জন্যে হস্তক্ষেপ করা সমষ্টির দায়িত্ব পারস্পরিক বিবাদ-বিসংবাদ এক ভিন্ন ধরনের আগুন। এ আগুন কেবল ঘর বাড়ি পাথরই ধ্বংস করে না, কেবল বাঁশ, গাছ ও দ্রব্যসম্ভারই ভস্ম করে না, সমাজের লোকদের হৃদয়, মন ও আত্মকে খেয়ে ফেলে, ভালোবাসা, প্রেমপ্রীতির ভাবধারা হৃদয় মনকে নির্মূল করে দেয়। এই বিপদটি মানুষের ঈমান ও নৈতিকতাকেও ধ্বংস করে। কাজেই সমাজ-সমষ্টি এ আগুন নির্বাপনের জন্যে এবং তা থেকে জনগণকে নিরাপওা দান কারা জন্যে দায়ী। রাসূলে করীম (স) এরূপ ঘটনার খারাপ প্রতিক্রিয়ার কথা বলেছেন এভাবে ‘পারস্পরিক সম্পর্কের বিপর্যয়-তা-ই নির্মূলকারী? [তিরমিযী এই বাড়তি কথাটুকু উদ্ধৃত করেছেন বটে। কিন্তু কোন সনদের উল্লেখ করেননি।] তাঁর এ কথাটিও বর্ণিত হয়েছেঃ আমি বলি না তা চুল নির্মূলকারী এবং বলছি তা দ্বীন-তথা দ্বীনদারীকেই নির্মূল করে দেয়।’ [আবূ দাউদ ও তিরমিযী উদ্ধৃত।] সমাজের লোকদের পরস্পরে যে ভাঙন-ফাটল-বিবাদই দেখা দিক, তা নির্মূল করার জন্যে হস্তক্ষেপ করা সমাজ সমষ্টিরই কর্তব্য। এমন কি, তা যদি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেও দেখা দেয়, তবু সে ব্যাপারে সমাজ নিষ্ক্রিয় থাকতে পারে না। তবে একথা স্বতন্ত্র যে, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার বিবাদ মীমাংসার জন্যে এবং তার আগুন নির্বাপনের জন্যে তাদের নিকটাত্মীয়দেরই দায়িত্ব নিতে হবে সর্বপ্রথম।– যেন ছেঁড়াজীর্ণ কাপড়ে তালি লাগানোর প্রশ্ন দেখা না দেয়। এ পর্যায়ে আল্লাহ্ বলেছেনঃ (আরবী*************) যদি তোমরা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কোন ফাটল ধরার আশংকা বোধ কর, তাহলে তোমরা স্বামীর পক্ষ থেকে একজন মীমাংসাকারী এবং স্ত্রীর পক্ষ থেকে আর একজন মীমাংসাকারী নিযুক্ত কর। তারা দুজন মীমাংসা আসতে চাইলে আল্লাহ্ তার তওফীক দেবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ সর্বজ্ঞ ও সর্ববিষয়ে অবহিত। (সূরা-নিসাঃ ৪৩) আয়াতটি স্পষ্ট বলে দিয়েছেন যে, মীমাংসাকারীদ্বয় স্বামী-স্ত্রী উভয়েরই পরিবারস্থ লোক হতে হবে। কিন্তু এ মীমাংসাকারী প্রেরণ এবং ‘পারিবারিক মজলিশ’ সংগঠনের দায়িত্ব সমাজের ওপর অর্পিত। ‘নিযুক্ত কর’- বা ‘পাঠাও’ বলে ইসলামী রাষ্ট্রের যাবতীয় সমস্যার সমাধানে নিযুক্ত দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গকেই নির্দেশ করা হয়েছে। এ ধরনের লোক পাওয়া না গেলে গোটা সমাজই সেজন্যে দায়ত্বশীল হবে-নিরাপওাদান মূলক দায়িত্ব। একটি পরিবারে সৃষ্ট ক্ষুদ্র দ্বন্দ্ব মেটাবার জন্যে সমাজ-সমষ্টিই যখন দায়িত্বশীল, তখন দুটো ভিন্ন ভিন্ন পরিবার, গোত্র বা দেশ কিংবা জাতির মধ্যে সৃষ্ট অতিশয় বড় আকারের বিবাদ-বিসম্বাদ মীমাংসা করার দায়িত্বও সমাজ-সমষ্টির ওপরিই অর্পিত হবে স্বাভাবিকাভাবেই। এ দায়িত্ব নিঃসন্দেহে অনেক বড়, নিঃসন্দেহে অধিকতর বাধ্যতামূলক এবং জটিল। এ প্রেক্ষেতেই কুরআন মজীদ দুই পক্ষের মধ্যকার দ্বন্দ্ব মীমাংসা করার জন্যে-বিবাদ থামাবার জন্যে-সমাজকেই দায়িত্বশীল বানিয়েছে, সেজন্যে যদি অস্ত্রধারণও করতে হয়, তবু এ দায়িত্ব সমাজকেই পালন করতে হবে। কুরআনের ঘোষণাঃ (আরবী**************) মুমিনদের দুটো দল যদি পারস্পরিক যুদ্ধে লিপ্ত হয়, তাহলে তোমরা তাদের মীমাংসা করে দাও। পরে যদি এক পক্ষ অপর পক্ষের ওপর সীমা লংঘন করে তাহলে সেই সীমা লংঘনকারী পক্ষের বিরুদ্ধে তোমরা যুদ্ধ কর-যেন শেষ পর্যন্ত আল্লাহ্র নির্দেশের প্রতি ফিরে আসে। যদি ফিরে আসে, তাহলে সে পক্ষদ্বয়ের মধ্যে ন্যায়পরতা সহকারে মীমাংসা করে দাও এবং সুবিচার কর। আল্লাহ্ সুবিচারকারীদের ভালোবাসেন। নিঃসন্দেহে মুমিনরা ভাই-ভাই। অতএব তোমাদের ভাইদের পরস্পরে মীমাংসা কর। আর আল্লাহ্কে ভয় কর, সম্ভবত তোমাদের প্রতি রহমত করা হবে। [(আরবী************)] কুরআন মজীদ বহুতর স্থানে লোকদের পরস্পরের মধ্যে মীমাংসা করার জন্যে উপদেশ দিয়েছে, উৎসাহ প্রদান করেছে। একটি আয়াতে বলেছেঃ (আরবী************) তোমরা আল্লাহ্কে ভয় কর এবং তোমাদের পরস্পরে মীমাংসা কর। আর আল্লহ্ ও তাঁর রাসূলকে মানো-যদি তোমরা মুমিন হও। [(আরবী************)] অন্য আয়াতঃ (আরবী************) লোকদের বহু কানপরামর্শেই কোন কল্যাণ নেই। তবে যে লোক দান কার বা কোন ভালো কাজ অথবা লোকদের মধ্যে মীমাংসার্থে যে পরামর্শ করা হয়, তা স্বতন্ত্র। আর যে লোক এ কাজ করবে আল্লাহ্র সন্তুষ্টি পাওয়ার উদ্দেশ্যে, আমরা নিশ্চয়ই তাকে বিরাট শুভ কর্মফল দেব। [(আরবী************)] রাসূলে করীম (স)- এর বহু সংখ্যক হাদীসও বর্ণিত হয়েছে, যা এ কাজটির ওপর খুবই গুরুত্ব আরোপ করে এবং মীমাংসা কাজের উৎসাহ দেয় ঠিক উক্তরূপ শক্তিশালী ও প্রভাব বিস্তারকারী পদ্ধতিতে। একটি হাদীসঃ আমি কি নামায, রোযা ও দান-সাদ্কার তুলনায়ও অধিক মর্যাদা সম্পন্ন উওম কাজের কথা তোমাদের বলব?..........তা হচ্ছে পারস্পরিক মীমাংসা করা। কেননা পারস্পরিক বিবাদই হচ্ছে নির্মূলকারী। [আবূ দাউদ (আরবী************) এ উদ্ধৃত, তিরমিযী উদ্ধৃত (আরবী************) বলেছেনঃ হাদীসটি সহীহ।] মীমাংসাকারী কমিটি সমাজকে কেবলমাত্র পুরুষ লোকদেরকে বিবাদাগ্নি নির্বাপনের কাজে নিযুক্ত করতে বলা হয়েছে। সেই সাথে গাড়ি ও পানি ‘শোষ পাইপ’ ইত্যাদি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রও সঙ্গে দেয়ার কথা বলা হয়েছে। অনরূপভাবে মানুষের পরস্পরের মধ্যে মীমাংসা কার্য সম্পাদানের জন্যে বিশেষভাবে পুরুষদেরকে নিযুক্ত করাই বাঞ্ছনীয়। সেই সাথে এ মীমাংসা কার্যে অংশ প্রহণের জন্যে নানা কমিটি গঠন করতে হবে প্রতিটি দিকে ও গ্রামে। যে কোন বিবাদের ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করার ক্ষমতা সেসব কমিটিকে দিতে হবে। সেই কমিটিগুলোর জন্যে সকল উপায় প্রয়োগ কাজ করার সুযোগও থাকতে হবে। অর্থনৈতিক দায়-দায়িত্ব অস্বীকার করার উপায় নেই, লোকদের পারস্পরিক বিবাদ নিরসন ও মীমাংসা বাস্তবায়নে একটা দায়দায়িত্ব থাকে এবং বিশেষভাবে তা হচ্ছে অর্থনৈতিক দায়দায়িত্ব। কেননা এ বিবাদের কারণ ‘দিয়েত’ বা ‘রক্তমূল্য’ হতে পারে অথবা দুই পক্ষের মধ্যে এক পক্ষের বা উভয় পক্ষের ওপর ধার্য জরিমানাও হতে পারে এবং হতে পারে, সে জরিমানা দিতে এক সক্ষম হচ্ছে না কিংবা তা দেয়ার যৌক্তিকতা সে স্বীকার করে না; কিন্তু অপর পক্ষ তা ছেড়ে দিতে মোটেই রাজী নয়। আর শক্তি প্রয়োগ করা হলে মীমাংসার পথই বন্ধ হয়ে যাওয়ার মত অবস্থা হয়। আর আঘাত ভুলানো ও জখম শুকানোর লক্ষ্যে তা করা সমীচীনও মনে হয় না। তা হলে তখন কি করা যাবে? পারস্পরিক মীমাংসা সৃষ্টির কি উপায় হতে পারে তখন? এ অর্থনৈতিক দায়দায়িত্বটা কার মাথায় চাপানো চায়? সমাধান অতীব সহজ এবং এ সহজলভ্য সমাধান আমাদেরকে যাকাতই দিচ্ছে। যাকাতের অন্যতম ব্যয়খাত হচ্ছে ‘আল-গারেমীন’- ঋণগ্রস্ত লোকগণ। ‘যাকাত ব্যয়ের খাত’ আলোচনায় আমরা বলে এসেছি এ ঋণগ্রস্ত লোকদের মধ্যে সে সব বড় বড় হৃদয়ওয়ালা লোকও গণ্য-ইসলামী সমাজ যাদের পরিচিতি উপস্থাপিত করেছে। অগ্রসর হত এবং মীমাংসা বাস্তবায়িত করার জন্যে ‘দিয়েত’ বা জরিমানাটা নিজের মাল থেকে দিয়ে দিতে বাধ্য হত-বিবাদের আগুন নিভানোর এবং শান্তি ও স্বস্তি কায়েমের উদ্দেশ্যে। এসব লোককে সাহায্য দেয়ার জন্যে যাকাতের এ খাতটি নির্ধারিত হয়েছে। এটা ইসলামের এক অন্যন্য অবদান। কুবাইচাতা ইবনুল মাখারিক আল-হিলালী (রা) যিনি এমনি এক মীমাংসার কাজে গিয়ে একটা বড় বোঝা মাথায় তুলে নিয়েছিলেন-পরে তিনি রাসূলে করীম (স)- এর কাছে উপস্থিত হয়ে এ ব্যাপারে সাহায্যের প্রার্থনা করেছিলেন। এ সংক্রান্ত হাদীসে বলা হয়েছে, তিনি এ ব্যাপারে সাহায্য প্রার্থনা করতে কোন দ্বিধাবোধ করেন নি। নবী করীম (স) তখন তাঁকে বলেছিলেনঃ অপেক্ষা কর, যাকাতের মাল আসুক, তখন তা থেকে আমরা তোমাকে দিতে বলব। পরে তিনি তাকে বললেনঃ যে ব্যক্তিই এরূপ কোন ঋণের বোঝা নিজের মাথায় গ্রহণ করবে, তার পক্ষে ‘চাওয়া’ হালাল। যেন সে তা পায় এবং পরে সে সতর্ক হয়। (আহমাদ ও মুসলিম এ হাদীস উদ্ধৃত করেছেন।) ইসলামের অবদানের একটা উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে-ফিকাহ্বিদগণ দৃঢ়তার সাথে বলেছেন-পারস্পরিক বিবাদ মীমাংসা করতে গিয়ে যে লোক ঋণগ্রস্ত হবে, যাকাত থেকে তাকে দিতে হবে-যদিও সেই মীমাংসার ব্যাপারটি ইহুয়াদী-খৃষ্টান যিম্মীদের মধ্যকারই হোক-না-কেন। [(আরবী************)] কেননা ইসলামী সমাজ-পরিধির মধ্যে যারা বাসন করে, তাদের সকলের মধ্যে শান্তি ও চুক্তি-সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত করাই ইসলামের লক্ষ্যসমূহের মধ্যে অতীব মৌলিক লক্ষ্য। একটি ফিকহী প্রশ্ন কিন্তু সেজন্যে কি এক ব্যক্তিকে সর্বপ্রথম নিজের মাল থেকে সন্ধি-সমঝোতার জরিমানা দিয়ে দিতে হবে, পরে সে যা দিয়েছে তা যাকাতের মাল থেকে তাকে দিয়ে দিতে হবে, যেন প্রকৃতপক্ষে ঋণগ্রস্ত হওয়া ব্যক্তিকে যাকাত থেকে দেয়ার কাজটি হয়? জবাবে বলা যায়-সাধারণভাবে ফিকাহ্বিদদের বক্তব্য থেকে বোঝা যায় যে, হ্যাঁ, এ শর্তটি রক্ষা করা আবশ্যক। তাহলেই যাকাত সংক্রন্ত আয়াতের আক্ষরিক মর্যাদা রক্ষিত হতে পারে। [(আরবী************) গ্রন্থ এবং তার শরাহ গ্রন্থে বলঅ হয়েছেঃ ষষ্ঠ হচ্ছে ঋণী যে পারস্পরিক বিবাদ মীমাংসা করতে গিয়ে ঋণগ্রস্ত হয়েছে, সে ধনী হলেও, সে যদি নিজের মাল থেকে তা না দিয়ে থাকে। কেননা নিজের মাল থেকে দিয়ে থাকলে তো সে ঋণগ্রস্ত হল না। যদি সে ঋণ নিয়ে তা দিয়ে থাক, তাহলে তা পূরণের জন্যে সে যাকাত থেকে নিতে পারে। কেননা ঋণ তো রয়ে গেছে। (আরবী************)] কিন্তু আয়াতটির ভাবধারা এবং যাকাতের এ অংশটি রেখে বিধানদাতা যে লক্ষ্য পেতে চান, তা হচ্ছে, সালিশী কমিটিকে তা দিয়ে দিতে নিষেধ করা যাবে না, যেন সে তার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে পাওনাদারকে তার প্রাপ্য দিয়ে দিতে পারে। অবশ্য যখন কোন কমিটির দায়িত্বে এ কাজটি হবে, সমাজ তার রায়কে গুরুত্ব দেবে। কেননা সমাজই এ কমিটি গঠন করেছে এবং তাতে রাজী হয়েছে। আর যদি কুরআন প্রস্তাবিত রূপটা সংরক্ষণ করাই অপরিহার্য হয়, তাহলে কমিটির একজন সদস্যকে তা কোন লোকের বা কোন সংস্থার কাছ থেকে করজ নিয়ে দিয়ে দেবার জন্যে দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে। পরে যাকাতের এ ঋণগ্রস্তের জন্যে নির্দিষ্ট অংশ থেকে তাকে তা দিয়ে দেয়া যাবে। ঋণগ্রস্তদের জন্যে নির্দিষ্ট অংশই হচ্ছে ‘সন্ধি-সমঝোতার ফাগু’। তবে এ ব্যাপারের গুরুত্ব অস্বীকার করা উচিত নয় যে, প্রথম প্রকার-সমাজের হৃদয়-কন্দর থেকে যা ফুটে ওঠেছে-যে দয়াপরবাশ হয়ে মীমাংসার উদ্দেশ্যে নিজের কাছ থেকে ব্যয় করেছে, তা ফেরত পাওয়ার কোন নিশ্চয়তা ছাড়াই, নৈতিকতার মানদন্ডে েএ প্রথম পন্থাটি মূলত লক্ষ্যভূত। ইসলামের নির্ধারণে তা খুব বেশী গুরুত্ব পারে। ‘জাতীয় আধ্যাত্মিক মূল্যমানের সাথে যাকাতের সম্পর্ক’ পার্যায়ে আমরা এ বিষয়ে স্পষ্ট ও বিস্তারিত কথা বলেছি। কঠিন দুঃখপূর্ণ ঘটনার সমস্যা প্রাচুর্য ও বিপদমুক্ততা ইসলামের কাম্য হচ্ছে সমাজের প্রত্যেকটি ব্যক্তি জীবন সামগ্রীর প্রাচুর্য ও ভয়-ভীতিমুক্ত পরিবেশে বসবাস করুক, যেন সে আল্লাহ্র ইবাদত পালন করতে পরে-ঐকান্তিক আল্লাহ্র ভয়, নতি স্বীকার ও আত্মোৎসর্গের ভাবধারা সহকারে। এ কারণে আল্লাহ্ তা‘আলা কুরাইশদের কাছে তাঁর ইবাদতের দাবি করেছেন এ দুটো নিয়ামতের বিনিময়েঃ প্রাচুর্য ও ভয়হীনতা। আল্লাহ্ বলেছেনঃ (আরবী************) যেহেতু কুরাইশরা অভ্যস্ত হয়েছে অর্থাৎ শীতকাল ও গ্রীষ্মকালে বিদেশ যাত্রায় অভ্যস্ত। কাজেই তাদের কর্তব্য হচ্ছে এ ঘরের আল্লাহ্র ইবাদত করা, যিনি তাদের ক্ষুধা থেকে রক্ষা করে খাবার দিয়েছেন এবং ভয়-ভীতি থেকে দূরে রেখে নিরাপওা দান করেছেন। বস্তুত একটি স্থান বা দেশের পক্ষে সবচাইতে দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, উক্ত দুটো-খাবার ও নিরাপওার-নিয়ামত থেকে বঞ্চিত হওয়া। অন্য আয়াতে আল্লাহ্ তা‘আলা তাই বলেছেন, ‘আল্লাহ্র একটি নগরকে দৃষ্টান্ত স্বরূপ উপস্থাপিত করেছেন, যা নিরাপওাপূর্ণ, নিশ্চিত ছিল, সেখানকার প্রয়োজনীয় রিযিক সর্বদিক দিয়ে প্রচুর পরিমাণে আসত। পরে নগর (বাসী) আল্লাহ্র নিয়ামতসমূহের প্রতি কুফরী করে। তার ফলে আল্লাহ্র তাকে ক্ষুধার ভয়ের পোশাক পরিয়ে দিলেন-যা তারা করত তার কুফল হিসেবে। এ কারণেই আমরা লক্ষ্য করছি ইসলামী বিধান তার অধীন বসবাসকারী প্রত্যেকটি-মুসলিম বা অমুসলিম-মানুষের জন্যে সমহারে ও মানে উপযোগী জীবিকার ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করে দিয়েছে, তাতে সে খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থান পারে- যেমন পারে চিকিৎসা ও শিক্ষা অতীব সহজ ও আয়াসহীনভাবে। যাকাতের বিধান প্রণয়নে তা বেকার কার্যক্ষম লোকদের জন্যে কাজের ব্যবস্থা এবং অভাবগ্রস্ত ব্যক্তির জন্যে যথেষ্ট পরিামাণে দ্রব্য দেয়ার ব্যবস্থা করে দারিদ্র্য সমস্যার সমাধান কিভাবে করতে চেয়েছে, তা আমরা লক্ষ্য করেছি। এ প্রাচুর্যের ব্যবস্থা হবে তার জন্যে ও তার পরিবারের জন্যে-একটি মতে এক বছরকালের জন্যে আর অপর মতে তার সমগ্র জীবনের জন্যে প্রাচুর্যের ব্যবস্থা করাই লক্ষ্য। যার কাছে যাথেষ্ট মাত্রার কম অংশ রয়েছে, তাকে তা পূর্ণ করে দেয়া হবে তার জীবিকার মান উন্নত করার লক্ষ্যে। কালের ঘাত-প্রতিঘাত কিন্তু দেখা গেছে, মানুষ প্রয়োজন পরিমাণ বরং বিপুল প্রশস্ততা সহাকরে জীবিকার পাচ্ছে, কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই কালের বিষদাঁত তাকে দংশন করে বসল। আকস্মিকভাবে তার ওপর আঘাতের ওপর আঘাত হানল। ধনী ছিল, হঠাৎ তাকে নিতান্ত নিঃস্ব দরিদ্র বানিয়ে ফেলল। সম্মনিতাকে করে দিল লাঞ্ছিত অবমানিত-পরম শান্তি-স্বস্তি ও নরাপওার পর চরমভাবে বিপর্যস্ত করে দিল এবং চূর্ণ করে দিল তাকে এ আকস্মিক বিপদ ও দুঃখপূর্ণ ঘটনার আঘাত যা থেকে তার রক্ষা পাওয়ার বা তা প্রতিরোধ করার কোন উপায়ই থাকে না। একজন ব্যবসায়ী মহাস্বাচ্ছন্দ্য জীবন যাপন করছিল, তার পণ্য বহনকারী নৌকা বা জাহাজ হঠাৎ নদী-সমুদ্রে নিমজ্জিত হল কিংবা জ্বলে-পুড়ে ছাই হয়ে গেল আর তাতে নিয়োজিত ছিল তার সমস্ত মূলধন। কৃষক, বাগান মালিক-আসমানী মুসীবতে তার ফসল বা গাছপালা সব ধ্বংস হয়ে যাওয়ার দরুন সম্পূর্ণ নিঃস্ব হয়ে পড়ল, চাষীর সোনার ফসল খেয়ে ফেলল কীট-পতঙ্গ –পোকা। সে ফসল সে ঘরে আনতে পারল না-তুলা, গম, ধান যে ফসলই হোক অথবা চাষের গরু মরে গেল, সেই দুঃখে মালিকই মরণাপন্ন হয়ে পড়ল। আকস্মিক দুর্ঘটনা উওরকালে বীমা ব্যবস্থার সূচনা করেছে এ ধরনের বহু প্রকারের আকস্মিক দুর্ঘটনা-দুঃখজনক ঘটনাবলী দীর্ঘদিন ধরে বহু সভ্যতা ধ্বংস করেছে এবং সচ্ছলতার সোনালী পরিবেশে বসবাসকারী বহু মানুষকে চরম দারিদ্র্যের নিম্নতম পংকে ডুবিয়ে দিয়েছে। লোকেরা তাদের ব্যবসার শিল্প-কারখানা ও মূলধনের ব্যাপারে- এবং তাদের অন্তর্ধানের পর তাদের বংশধরদের ব্যাপারে কোনরূপ নিরাপওার সন্ধান পাচ্ছিল না। তারা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল। তখন তারা কালের আঘাত ও সময়ের ভ্রুকুট থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় সন্ধানে আত্মনিমগ্ন হল। এর ফলেই বীমা ব্যবস্থার উদ্ভব হল। বিগত শতাব্দীতেই পাশ্চাত্য এ ব্যবস্থার প্রবর্তন করে। তার রূপ ও সংগঠন বিভিন্ন, ক্ষেত্র নানাবিধ। ইসলামী বীমা ব্যবস্থা শতাব্দীকাল পূর্বে পশ্চিমা সমাজ যে বীমাব্যবস্থার সাথে পরিচিত হয়েছে তারও বহু পূর্বে ইসলামী সমাজব্যবস্থা একটা বিশেষ পন্থায় ব্যক্তিগণের জন্য নিরাপওার ব্যবস্থা উপস্থাপিত করেছে। মুসলমানদের জন্যে বায়তুলমালই ছিল এ ব্যবস্থা। তা একটা বিরাট সামগ্রিক নিরাপওা ব্যবস্থা। কালের আঘাতে জর্জরিত প্রত্যেকটি ব্যক্তি এ ব্যবস্থার আশ্রয় পেতে পারে, তা হলে সে পাবে সাহায্য এবং আশ্রয়। এরূপ বিপন্ন ব্যক্তিকে লোকদের অনুগ্রহের দানের ওপর নির্ভরশীল থাকার জন্যে ছেড়ে দেয়া হবে না। লেকাদের পক্ষ থেকে দুটো কল্যাণ সে পেতে পারে-যদি সে তা নিষেধ না করে। তার ব্যাপারে আগ্রহ পোষণ করা হবে। কল্যাণমূলক ভাবধারা প্রবৃদ্ধি এবং লোকদের মধ্যে পারস্পরিক দয়ামূলক আচরণ। নবী করীম (স)-এর কাছে এক ব্যক্তি তার ওপর আগত বিপদের অভিযোগ করল। তখন তিনি তাঁর সাহাবীদের বললেনঃ তোমরা সকলে লোকটাকে দান-সাদকা দাও। অতঃপর লোকেরা তাই করল। [পূর্বে এ ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে এক স্থনে। আহমাদ এটি উদ্ধৃত করেছেন, ৩য় খন্ড, ৩৬পৃ. মুসলিম (আরবী************) আবূ দাউদ-নাসায়ী (আরবী***********) তিরমিযী (আরবী*********)ইবনে মাজাহ (আরবী***********)] ঋণগ্রস্তদের অংশে আকস্মিক দুর্ঘটনার সাহায্য ইসলাম বিপদগ্রস্ত ব্যক্তিকে কেবলমাত্র নেক লোকদের স্বেচ্ছেমূলক দানের ওপর নির্ভরশীল করে ছেড়ে দেয়নি। বায়তুলমালে তার জন্যে একটা অংশ রয়েছে-যাকাতের মালে তো বটেই। এজন্যে রাষ্ট্রপ্রধান বা দায়িত্বশীল ব্যক্তির কাছে দাবি করা যাবে। তাতে কোন ভয় বা লজ্জার কারণ নেই। কেননা সে একজন মুসলিম নাগরিক-মুসলমানদরে বায়তুলমাল থেকে সে তার অধিকার চেয়ে-আদায় করে নেবে। পূর্বে উল্লিখিত কুবাইচাতা উবনুল মাখারিক সংক্রান্ত হাদীসে বলা হয়েছে, নবী করীম (স) বলেছেনঃ ভিক্ষা চাওয়া তিনজন লোক ছাড়া আর কারোর জন্যে জায়েয নয়। তার মধ্যে রয়েছে সেই ব্যক্তি, যে আকস্মিকভাবে বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়েছে এবং তার যথাসর্বস্ব নিঃশেষ হয়ে গেছে। তার জন্যে ভিক্ষা চাওয়া সম্পূর্ণ জায়েয-যেন সে বেঁচে ও সক্রিয় থাকার মত জীবিকা পায়। ‘আল-গারেমীন’- এর ব্যাখায়-যাকাত ব্যয়ের খাত সংক্রন্ত আয়াতে প্রাচীন কালের দাফসীরকারেরা বলেছেনঃ যার ঘর পুড়ে গেছে, কিংবা বন্যায় ধন-মাল ভাসিয়ে নিয়েছে, ফলে সে পরিবারবর্গকে নিয়ে কঠিন বিপদে পড়েছে, সে লোকও এ পর্যায়ে গণ্য। [আলগারেমী, যাকাত ব্যয়ের খাত সংক্রন্ত আলোচনা দেখুন] আকস্মিক বিপদগ্রস্তকে কত দেয়া হবে কুবাইচাতা সংক্রন্ত রাসূলে করীম (স)-এর হাদীসে আমরা দেখেছি, তার হক্ চাওয়ার অধিকার আছে এবং সেজন্যে দায়ীত্বশীলদের কাছে সে চাইতে পারে-যেন জীবনে বেঁচে থাকার জন্যে প্রয়োজনীয় পরিমাণ সাহায্য পেতে পারে। ‘জীবনে বেঁচে থাকার পরিমাণ’ বলতে বোঝায় প্রত্যেক ব্যক্তির অর্থনৈতিক মান ও সমাজকেন্দ্রিক পরিবেশ উপযোগী পরিমাণ পাওয়া। অতএব যার ঘর পুড়ে গেছে তার জন্যে উপযুক্ত এবং তার ও তার পরিবারবর্গের সংকুলান হয় এমন প্রশস্ত একটা ঘর-তার অবস্থার সাথে সংগতিসম্পন্ন আসবাবাপত্রসহ। যে ব্যবসায়ী ব্যবসায় ক্ষেত্রে বিপদে পড়েছে, তার উপযোগী বেঁচে থাকা ব্যবস্থা হচ্ছে, তার ব্যবসায়ের চাকাটাকে আবার আবর্তিত করে দেয়া। পূর্বের ন্যায় প্রশস্ততা ও সম্পদশীলতা না হলেও কোন দোষ নেই। এভাবে প্রত্যেক ব্যক্তিই তার সাথে সংগতিসম্পন্ন ব্যবস্থা পাবে। কোন কোন ফিকাহবিদ মনে করেন, তাকে তার পূর্ববর্তী অবস্থায় ফিরে যাওয়ার মত ব্যবস্থা করে দিতে হবে। [গাজালী একথা উল্লেখ করেছেন তাঁর (আবরী************) গ্রন্থে। ‘ফকীর ও মিসকীন’ শীর্ষক যাকাত ব্যয় খাত পর্যায়ে আমরা একথা উদ্ধৃত করেছি।] কিন্তু আমি মনে করি এ মত বা অন্য মত গ্রহণ করা নির্ভর করে যাকাত-ফান্ডের সামর্থ্যের ওপর। তা বেশী হলে একরূপ আর কম হলে অন্য রূপ, সেই সাথে অন্যান্য ব্যয়-খাতগুলোর চাহিদার তীব্রতা বা দুর্বলতার প্রতিও লক্ষ্য রাখতে হবে। চাষের জমির বিপদ চাষের জমির যে সব মালিক কষ্ট করে-শ্রম করে চাষকার্য করে কোন বিপদে পড়েছে, তারা যাকাতের অংশ পেয়ে উপকৃত হওয়ায়-অন্যদের তুলনায় বেশী অধিকারী। তাদের প্রয়োজনও অনেক তীব্র। প্রাচীনকালে গ্রামবাসীরা এ সব অবস্থায় পারস্পরিকভাবে সাহায্য-সহযোগিতার ব্যবস্থা করে নিত। কারোর ওপর তেমন বিপদ এলে তারা পারস্পরিকভাবে সাহায্য সংগ্রহ ও একত্রিত করত। তারা বিপদগ্রস্ত ব্যক্তির দুঃখ দূর করা ও পিঠ শক্ত করার উদ্দেশ্যে এ সাহায্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে দিয়ে দিতে। পরবর্তীকালে লোকদের মন থেকে কল্যাণমূলক ভাবধারা যখন কর্পূরের মত উবে যায় কিছু সংখ্যক বাদে-মিসকীন চাষী এমন অবস্থায় সম্মুখীন হয় যে, তার চাষের গরু মরে গেলে কপালে হাত চাপড়িয়ে দুঃখ করত, যেন সেটি তার পরিবারেরই একজন। তার স্ত্রী ও পুত্র-কন্যারা সেজন্যে কান্নাকাটি করত, যেন অতি প্রিয়জন মরে গেছে। মা কিংবা বাপ। লোকেরা জানতে পারত যে, অমুক ব্যক্তির কোমর ভেঙে গেছে। এমনিভাবে যার ফসল আসমানী বিপদে নষ্ট হয়ে যেত কিংবা তার চাইতেও কঠিন-আগুনে ঘরবাড়ি জ্বলে যেত, তার জীবিকা ও সঞ্চয় নিঃশেষ হয়ে যেত। এ সব বিপদগ্রস্ত লোকই যাকাতের এ ‘আল-গারেমুন’ খাত থেকে এবং ফকীর-মিসকীনের জন্যে নির্দিষ্ট খাত থেকে সাহায্য লাভ করতে পারত, যেন লেকটি আকস্মিক বিপদের আঘাতে একেবারে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে না যায়। তার হাত ধারে তুলে দেয়া হত যেন সে চলমান জীবনের কাফেলায় শরীক থেকে সক্ষমতায় চলতে পারে, তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে না পড়ে, কেননা তা হলে সেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া লেকাদের সঙ্গে থেকে চিরতরে ধ্বংস হয়ে যাবে। কুমারিত্বের সমস্যা ইসলামে বৈরাগ্যবাদ নেই ইসলাম মানব প্রকৃতিতে নিহিত যৌন প্রবৃওির লাগাম ছেড়ে দেয়ার পক্ষপাতী নয়। তাহলে তা যথেচ্ছভাবে বিচরণ শুরু করে দেবে। কোন বাঁধান-কোন নিয়ন্ত্রণই তা মানবে না তখন। এ কারণে ইসলাম জ্বিনা-ব্যভিচারকে সম্পূর্ণরূপে হারাম করে দিয়েছে। যেসব কাজ বা অবস্থা মানুষকে সেদিকে অগ্রসব করে এবং তার মধ্যে নিক্ষেপ করে, সেগুলোকেও হারাম কারা হয়েছে। কিন্তু তার সাথে চরম শত্রুতামূলক আচরণ গ্রহণ করা- তাকে সম্পূর্ণ দমন করতে চেষ্টা করা-সমূলে বিনষ্ট করার পন্থা অবলম্বন করাকেও ইসলাম আদৌ সমর্থন করেনি। এজন্যে ইসলাম বিয়ে কারার পন্থা উদঘাটন করেছে, সেজন্যে আহ্বান জানিয়েছে ও উৎসাহ দিয়েছে এবং স্ত্রী বা স্বামী বিবর্জিত জীবন যাপন ও ‘খাসি’ করে পৌরুষকে চিরতরে খতম করাকে হারাম ঘোষণা করেছে। অতএব কোন মুসলিম ব্যক্তির উচিত নয় শক্তি-সামর্থ্য থাকা সও্বেও বিয়ে কার থেকে বিরত থাকা। আল্লাহ্র জন্যে একান্ত হয়ে যাওয়ার কিংবা ইবাদত, বৈরাগ্যবাদ এবং দুনিয়া ত্যাগ করার দোহাই দিয়ে অবিবাহিত হয়ে থাকা কোনক্রমেই বাঞ্ছনীয় হতে পারে না। নবী করীম (স) তাঁর কোন কোন সাহাবীর মধ্যে এরূপ মনোভাব গ্রহণের ইচ্ছা বা সংকল্পের কথা জানতে পেরে উদাও কণ্ঠে ঘোষণা করলেনঃ ‘এটা ইসলামের জীবন পদ্ধতি থেকে বিভ্রান্তি ও বিচ্যুতি, নবী (স)-এর সুন্ন তারে পরিপন্থী।’ তিনি তাঁদের এও বললেনঃ আমি তোমাদের মধ্যে আল্লাহ্ সম্পর্কে বেশী জানা লোক এবং তোমাদের তুলনায় তাঁর কাছে বেশী ভীত। কিন্তু তা সও্বেও আমি রাত্রি জাগরণ করে ইবাদত করি-ঘুমাইও। আমি নফল রোযা রাখি আবার ভাংগিও। আমি বিয়ে এবং স্ত্রী সঙ্গমও করি। অতএব আমার এ সুন্নাত যে রিহার করে চলবে, সে আমার মধ্যে গণ্য হবে না। [ও] হযরত সায়দ ইবনে আবূ ওয়াক্কাস (রা) বলেছেনঃ ‘রাসূলে করীম (স) উসমান ইবনে সজ্উনের (রা) স্ত্রীহীনতা ও আল্লাহ্র ইবাদতে গ্রহণের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে দিয়েছিলেন। তিনি তাঁকে অনুমতি দিলে আমরা সকলেই ‘খাসি’ হয়ে যেতাম’। [বুখারীতে এসব হাদীস উদ্ধৃত।] তিনি যুব সমাজকে সাধারণভাবে সম্বোধন করে বলেছিলেনঃ হে যুব সমাজ! তোমাদের মধ্যে যে-ই যৌন মিলনে সক্ষম, তার বিয়ে করা কর্তব্য। কেননা তা দৃষ্টিকে নত রাখে এবং যৌন শক্তিকে সংরক্ষিত করে। [বুখারীতে এ সব হাদীস উদ্ধৃত।] এ প্রক্ষিতে কোন কোন বিশেষজ্ঞ বলেছেনঃ বিয়ে করা মুসলিম মাত্রের জন্যেই ফরয। যতক্ষণ সে কাজে সক্ষম থাকবে, তা ত্যাগ করা তার হালাল নয়। ‘রিযিক’ বা জীবিকা কম বা সংকীর্ণ হয়ে পড়ার ভয়েও কোন মুসলিমের উচিত নয় বিয়ে থেকে রিত থাকা। তার কাঁধে পরিবারের ভরণ-পোষণ যোগানোর দায়িত্বের দুর্বহ বোঝা চাপবে, এ ভয়েও বিরত থাকা উচিত নয়। তার তো কর্তব্য মুকাবিলা করা। চেষ্টা করা, আল্লাহ্র অনুগ্রহ ও সে সাহায্য পাওয়ার জন্যে অপেক্ষা করা যার ওয়াদা তিনি করেছেন বিবাহিত লোকদের দেবেন বলে এবং বিবাহ করার মাধ্যমে যারা নিজেদের নৈতিক পবিত্রতা ও চারিত্রিক নিষ্কলুষতা রক্ষা করতে চেয়েছে। আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেছেনঃ (আবরী************) এবং বিবাহ দাও তোমাদের বয়স্ক সন্তান ও নেককার দাসদের ও দাসীদেরকে-তারা দারিদ্র হলে আল্লাহ তাঁর অনুগ্রহের তাদের সচ্ছল বানিয়ে দেবেন। [(আবরী************)] রাসূলে করীম (স) বলেছেনঃ তিনজন লোকের সাহায্য করা আল্লাহ্র দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত, নৈতিক পবিত্রতা রক্ষার ইচ্ছায় বিবাহিত, দাসমুক্তির চুক্তিকারী-যে তা আদায় করতে ইচ্ছুক- যে দাস একটা পরিমাণের মালের বিনিময়ে নিজেকে মুক্ত করতে চায় এবং সে শর্তের চুক্তিপত্র করে আর আল্লাহ্র পথের যোদ্ধা। [আহমাদ, নাসায়ী, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ্ ও হাকেম-আবূ হুরায়রা থেকে সহীহ্ সনদে। যেমনঃ (আবরী************)- এ বলা হয়েছে।] আল্লাহ্র অনুগ্রহ এবং তাঁর সে সাহায্য-যার ওয়াদা তিনি করেছেন বিয়ে করেন নিজেকে পবিত্র রাখতে ইচ্ছুক মুমিন ব্যক্তিকে তার মধ্যে এ ব্যাপারটিও গণ্য যে, মুসলিম সমাজ সরকার বা যাকাত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অভাবগ্রস্ত হলে মোহরানা ও বিয়ের ব্যয় বহনে তার প্রতি সাহায্যের হস্ত প্রসারিত করব। যেন সে দৃষ্টি নীচু রাখা ও যৌন-অংগের পবিত্রতা রক্ষা করার জ্যে ঘেষিত ইসলামের আহ্বানে পুরামাত্রা সাড়া দিতে পারে; একটি মুসলিম পরিবার গঠন এবং আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর বান্দাদেরকে যে স্পষ্ট উজ্জ্বল আয়াত সম্পর্কে অবহিত করেছেন তা অনুধাবন করা তার পক্ষে যেন সম্ভব হয়। আল্লাহ্র বাণীঃ (আবরী************) আল্লাহ্র একটি নিদর্শন হচ্ছে, তিনি তোমাদের নিজেদের মধ্য থেকে তোমাদের জন্যে জুড়ি সৃষ্টি করেছেন, যেন তার কাছে শান্তি লাভ করা এবং তোমাদের পরস্পরের মধ্যে বন্ধুত্ব দয়া-মায়া উদ্রেক করেছেন। নিঃসন্দেহে এ ব্যবস্থায় বহু নিদর্শন নিহিত রয়েছে চিন্তাশীল লোকদের জন্যে। [(আবরী************)] উপরিউক্ত কথা আমি নিজ থেকে নতুন করে কিংবা নিজের মতে ইজতিহাদ করে বলিনি। আমার একথা পূর্বেও বলা হয়েছে। কিন্তু আমাদের ইমাম ও নেতৃবৃন্দ কয়েক যুগ ধরে বিয়েকেই ‘পূর্ণ মাত্রার প্রাপ্তি’ বা ‘যথেষ্ট মাত্রা’ নির্দিষ্ট করে ধরেছেন। তাঁরা বলেছেনঃ গরীব ব্যক্তির যথেষ্ট মাত্রার প্রাপ্তি হচ্ছে এমন পরিমাণ পাওয়া যদ্দারা যে বিয়ে করতে পারবে-যদি তার স্ত্রী (বা স্বামী) না থাকে এবং বিয়ে করার প্রয়োজন বোধ করে। যাকাতের ব্যয়খাত পর্যায়ের আলোচনায় যথাস্থানে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করেছি। [দেখুনঃ ‘বিয়ে যথেষ্ট মাত্রার প্রাপ্তি’ বিষয়।] পালিয়ে যাওয়ার সমস্যা কুরআন মজীদ নিঃস্ব পথিকের সমস্যাটির ওপর মক্কী ও মাদানী উভয় পর্যায়ের আয়াতসমূহের কত বেশী গুরুত্ব আরোপ করেছে, ‘যাকাতা ব্যয়ের অধ্যায়ে আমরা তা বিস্তারিতভাবে আলোচনা ও বিশ্লেষণ করেছি। কুরআনের অধিকাংশ স্থানেই নিঃস্ব পথিকের প্রতি দয়া প্রদর্শন এবং তাকে তার অধিকার দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সর্বশেষ যাকাতের মালে তার জন্যে একটা অংশও নির্দিষ্ট করা হয়েছে। এটা এজন্যে যে, ইসলাম প্রতিটি মানুষের জন্যে একটি বাসস্থান বা ঘর থাকা একান্তই প্রয়োজন বলেণ মনে করে কেউ ‘পথের সন্তান’ হোক তা তার কাম্য নয় পসন্দও নয়। এ প্রেক্ষিতেই ইসলামী শরীয়াত প্রতিটি মানুষের জন্যে তার উপযোগী একটি ঘর থাকা সনির্দিষ্টভাবে বাধ্যতামূলক করেছে-যেখানে সে এবং তার পরিবারবর্গ একটি ঘর থাকা সুনির্দিষ্টভাবে বাধ্যতামূলক করেছে-যেখানে সে এবং তার পরিবারবর্গ আশ্রয় নেবে। এটাকে মৌল প্রয়োজনের অন্তর্ভুক্ত গণ্য করা হয়েছে, মানুষের জীবনে বেঁচে থাকা ও স্থিতি গ্রহণের জন্যে এ ঘরের অপরিহার্যতা অনস্বীকার্য। যতটুকু প্রাচুর্য বা ‘যথেষ্ট মাত্রার সম্পদ’ না থাকলে মানুষ ফকীর বা মিসকীন গণ্য হয়, তার তাৎপর্য বিশ্লেষণে ইমাম নববী বলেছেনঃ এ পর্যায়ে গণ্য হচ্ছেঃ খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান-অন্যান্য একান্ত প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি-কোন রূপ অপচয় বা কার্পণ্র করা ছাড়াই তার জন্যে শোভন হয় এমন। তা এক ব্যক্তির জন্যে এবং তার ব্যয় বহনের ওপর নির্ভরশীল যারা তাদের সকলের জন্যে। [জীবন-উপযোগী মান দ্রষ্টব্য।] ইবনে হাজম মৌলিক দ্রব্যাদি-ইসলামী সমাজ বিধানে যা প্রতিটি মানুষের জন্য প্রচুর মাত্রার হওয়া আবশ্যক-বর্ণনায় বলেছেনঃ প্রত্যেক দেশ (বা স্থানের) ধনী লেকাদের কর্তব্য হচ্ছে সেখানকার গরীব লোকদের দায়িত্বশীল হয়ে দাঁড়ানো। রাষ্ট্র সরকার তাদের সেজন্যে বাধ্য করবে। যদি যাকাত ও ফাই সম্পদ দ্বারা সমস্ত মুসলমানের প্রয়োজন পূরণ না হয়, তাহলে অপরিহার্যভাবে প্রয়োজনীয় খাদ্য, শীত-গ্রীষ্ম উপযোগী পোশাক এবং সূর্যের তাপ, বৃষ্টি ও পথিকদের দৃষ্টি থেকে রক্ষা পাওয়ার মত একটা ঘরের ব্যবস্থা অবশ্যই করতে হবে। [(আবরী************)] যাকাতের ব্যয়খাত পর্যায়ে ‘ইবনুস্ সাবীল’ আলোচনায় আমরা বলে এসেছি যে, একালের বিশেষজ্ঞদের মধ্যে কেউ কেউ ‘ইবনুস্ সাবীল’ বলতে ‘পথে হারানো অবস্থায় পাওয়া লোক’ বোঝানো হয়েছে বলে মনে করেছেন। আমার মতে তা খুব বিচিত্র বা অসম্ভব নয়। কেননা উক্ত রূপ ব্যক্তির জন্যে পথই হচ্ছে তার পরিজন, তার মা, তার বাপ। ‘পথ হারিয়ে যাওয়া অবস্থায় পাওয়া’ মানুষ অন্য অন্য মানুষের কৃত অপরাধের ফলশ্রুতি। কিন্তু তারা সে অপরাধের বোঝা বহন করে না। আল্লাহ্ বলেছেনঃ (আবরী************) প্রত্যেক ব্যক্তির উপার্জন তারই জন্যে। কোন বহনকারী অন্যের বোঝা বহন করে না। [(আরবী************)] অতএব এ ‘পথে পড়ে পাওয়া লোকদের’ জন্যে যাকাত সম্পদের একটা অংশ নির্দিষ্ট হওয়া আবশ্যক, যদ্দারা তাদের প্রয়োজন পূরণ করা হবে। তাদের উওম প্রশিক্ষণ তা ব্যয় করা হবে এবং উজ্জ্বল ভবিষ্যতের উপযোগী করে তাদের তৈরী করা হবে। যারা ‘ইবনুস-সাবীল’-এর মধ্যে এ ‘পথে পড়ে পাওয়া লোকদের’ গণ্য করেন না, তারা তাদেরকে নিশ্চয়ই ‘ফকীর’ মিসকীন’দের মধ্যে গণ্য করেন আর তাও যে যাকাত ব্যয়ের খাত তাতে কোন মতপার্থক্য নেই। একটি জরুরী সতর্কবাণী এ অধ্যায়ের উপসংহারে এ বিষয়ে সতর্ক করে দেয়া আবশ্যক বলে মনে হয় যে, যাকাত পূর্ণঙ্গ ইসলামী বিধানের অংশ। আল্লাহ্র তা‘আলা এ বিধান দিয়েছেন দুনিয়ার মানুষকে হোদায়েত দান এবং তাদের জীবনকে সুন্দর করে গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে। সমাজের সর্ব প্রকারের সমস্যার সমাধান কেবলমাত্র যাকাত দ্বারাই করা যাবে বলে মনে করা ঠিক নয়। এ পর্যায়ে কিছু কথা আমরা ইতিপূর্বে বলেছি। বিশেষ করে যে সমাজের জীবনের সমগ্র দিক ও বিভাগ থেকে ইসলাম এবং তার শরীয়াতকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে, যেখানকার আচার-আচরণ ও নীতি নির্ধারণ ইসলামী নৈতিকতাকে বাধ্যতামূলকাভাবে মেনে চলা হয় না-ইসলামী-নীতি অনুসরণ করা হয় না, তথায় একা যাকাত কি করতে পারে? ইসলাম পূর্ণঙ্গ ও পরস্পর অবিচ্ছিন্ন শরীয়াত। তার কিছু অংশ গ্রহণ এবং অপর কিছু অংশ বাদ দিয়ে চলা কোনক্রমেই সমীচীন হতে পারে না। ঠিক তেমনি জীবনের কোথাও ইসলাম ছাড়া অন্য কোন বিধান ‘আমদানী’ করাও সম্পূর্ণ অবাঞ্ছনীয়। ইসলামের কোন একটা অংশ-যেমন যাকাত- দিয়ে গায়র ইসলামী বিধানের সাথে জোড়াতালি দিলে যেমন অশোভন হবে, তেমনি হবে সম্পূর্ণ নিষ্ফল। এরূপ জোড়াতালি দেয়া নীতি সম্পূর্ণ পরিত্যাজ্য। ইয়াহুদীরা এ নীতি গ্রহণ করেছিল বলে আল্লাহ্ তাদের তীব্র সমালোনা করেছেন। তাদের প্রশ্ন করেছেনঃ (আরবী************) তোমরা কি আল্লাহ্র কিতাবের কিছু অংশ বিশ্বাস কর আর কিছু অংশ অবিশ্বাস করা? [(আরবী************)] রাসূলে করীম (স) এবং তার পর প্রত্যেক শাসককে যারাই আল্লাহ্র বিধানের কিছু অংশ বাদ দিয়েছে-আল্লাহ্ তা‘আলা সাবধান করে দিয়েছেন এই বলেঃ (আরবী************) আল্লাহ্র নাযিল –করা বিধান অনুযায়ী লোকদের ওপর প্রশাসন চালাও, তাদের কেয়াল-খুশীর অনুসরণ করো না, তাদের ব্যাপারে সাবধান থাকবে-তোমার প্রতি আল্লাহ্র নাযিল করা বিধানের কিছু অংশ থেকে তারা তোমাকে বিরত রাখতে পারে। [(আরবী************)] আসলে যাবতীয় সমস্যার সমাধান হচ্ছে ইসলামকে গ্রহণ-পূর্ণঙ্গ ইসলামের বাস্তবায়ন। [দেখুন মৎ প্রণীত গ্রন্থঃ (আরবী************)] চতুর্থ অধ্যায় ফিতরের যাকাত • তার অর্থ, তার বিধান, তার যৌক্তিকতা-বৈশিষ্ট্য। • কার ওপর তা ওয়াজিব? কাদের পক্ষ থেকে দেয়া ওয়াজিব? • দেয় পরিমাণ, কিসে তা ওয়াজিব হয়? • ওয়াজিব হওয়ার সময় এবং দিয়ে দেয়ার সময়। • ফিতরের যাকাত কার জন্যে ব্যয় করা হবে? এ অধ্যায়ের পাঁচটি পরিচ্ছেদ প্রথমঃ ‘ফিতরের যাকাত-এর তাৎপর্য, তার বিধান বর্ণনা এবং তার বিধিবদ্ধ হওয়ার যৌক্তিকতা। দ্বিতীয়ঃ কার ওপর তা ওয়াজিব? এবং কাদের পক্ষ থেকে দেয়া ওয়াজিব? তৃতীয়ঃ ওয়াজিবের পরিমাণ, কোন জিনিসে তা হবে? মূল্য দিয়ে আদায় করার হুকুম কি? চতুর্থঃ ওয়াজিব হওয়ার সময়-দেয়ার সময়। পঞ্চমঃ ফিতরের যাকাত কার জন্যে ব্যয় করা হবে? প্রথম পরিচ্ছেদ ফিতরের যাকাত-এর অর্থ, তার হুকুম ও যৌক্তিকতা ফিতরের যাকাত- এর অর্থ ‘যাকাতুল ফিতর’- ‘ফিতরের যাকাত’ বলতে সেই যাকাত বোঝায়, যা রমযানের রোযা শেষ করার কারণে ধার্য হয়। তাকে ‘সাদকায়ে ফিতর’- ও বলা হয়। আমরা বলেছি, (আরবী************) শব্দটি শরীয়াতের ব্যবহারে ‘ফরয যাকাত’ বোঝায়। কুরআন ও সুন্নাতে এর বহুল ব্যবহার লক্ষণীয়। একে ‘যাকাতুল ফিত্রাতও নাম দেয়া হয়েছে; তা যেন প্রকৃতি বা স্বভাবসম্মত- সৃষ্টিত্বের সাথে সম্পর্কিত। মানব প্রকৃতির ওপর তা ওয়াজিব করা হয়েছে আত্মর ‘তাজকীয়’ এবং তার কার্যবলী পরিচ্ছন্ন-নির্ভুল-নিষ্কলুষ করার লক্ষ্যে। এখানে উৎসকে ‘ফিত্রাত’ বলা হয়-অর্থাৎ ‘জন্ম দানকারী’। তা আরবী নয়, বাইরে থেকে এসে আরবী হয়ে যাওয়া শব্দও নয়। এটা হচ্ছে ফিকাহবিদদের পরিভাষা। [ইবনে আবেদীন তাঁর টীকায় বলেছেনঃ (আরবী************) গ্রন্থে বলা হয়েছে, (আরবী************) শব্দটি ফিকাহবিদ প্রমুখের কালামে ‘জন্ম স্থান’ অর্থে ব্যবহৃত। কেউ কেউ এটিকে ‘সাধারণের কথা’ বলে অভিহিত করেছেন অর্থাৎ ‘ফিত্রাত’ অর্থ সাদ্কা- আভিধানিক ব্যবহার। কেননা অভিদানে এইরূপ অর্থ লেখা হয়নি। ‘আল-কামুস’-এ বলা হয়েছে, ‘আলফিত্রাতু’ অর্থ ‘সাদাকাতুল ফিতর’- রোযা না রাখার সাদকা। আর একটি অর্থঃ ‘সৃষ্টিতত্ব (আরবী************) কোন কোন বিশেষজ্ঞ প্রথমটি অসহীহ্ বলে আপওি করেছেন। কেননা এর উৎস শরীযাতদাতা ছাড়া কেউ জানে না। ‘আল-কামুস’-এর ভ্রান্তির মধ্যে গণ্য-যা বেশীর ভাগই হয় শরীয়াতী তও্বকে আভিধানিক তও্বের সাথে সংমিশ্রিত করার কারণে। (আরবী************) গ্রন্থে লেখা হয়েছেঃ ‘ফিত্রাত’ শব্দটি এই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে ইমাম শাফেয়ীর রচনায় আর তা অভিধানের দৃষ্টিতে সহীহ্ যদিও আমার কাছে রক্ষিত মৌল গ্রন্থাবলীতে তা পাওয়া যায়নি। নববী রচনায় বলা হয়েছে, ‘ফিত্রাত’ জন্ম স্থান বোঝায়, সম্ভবত তা সেই ‘ফিত্রাত’ থেকে গৃহীত, যার অর্থ ‘সৃষ্টি কার্য’। আবূ মুহাম্মাদ আল-আরহরী বলেছেন, তার অর্থ, ‘যাকাতুল খিলাকাত-‘সৃষ্টির যাকাত’ অন্য কথায় তা ‘দেহের যাকাত’। (আরবী************) গ্রন্থে বলা হয়েছেঃ আল ফিত্রাত’ অর্থ ‘মূল’। ফিত্রাত যাকাত ওয়াজিব অর্থ দেহের যাকাত। ‘দেহ’ শব্দটি উহ্য করে “ফিতরাত” শব্দটিকে তদস্থানে বসানো হয়েছে। এতেই অর্থ বোঝা যায় বলে এরূপ ব্যবহার যথেষ্ট মনে করা হয়েছে। আল-কাহাস্তানীও এ কথা বলেছেন। এজন্যে কারো কারো কথাঃ মাথার সাদকা, দেহের যাকাত। সারকথা, ‘আল-ফিতরাতু’ শব্দের আভিধানিক অর্থ নিঃসন্দেহে ‘সৃষ্টিতত্ব’। তা এ ক্ষেত্রে ব্যবহার তার উৎস বোঝাবার জন্যে। কোন উহ্য না ধরে তা ব্যবহার করা হলে তা জন্মস্থানের শরীয়াতসম্মত পরিভাষা গণ্য হবে। আর উহ্য ধরা হলে তার আভিধানিক অর্থ গণ্য হবে। সম্ভবত (আরবী************) গ্রন্থকার এ কথাই বলতে চেয়েছেন। দেখুনঃ (আরবী************)] ‘সাদকায়ে ফিতর’ হিজরতের দ্বিতীয় বছর ধার্য করা হয়েছে। আর এ বছরই ফরয হয়েছে রমযান মাসের রোযা। [(আরবী************)] ‘ফিত্রা’ ওয়াজিব হয়েছে রোযাদারের বেহুদা ও অশ্লীল কথা-কাজ থেকে তাকে পবিত্রকরণের লক্ষ্যে। সেই মিসকীনদের জন্যেও খাদ্য ব্যবস্থা গ্রহণ, অভাবের লাঞ্ছনা থেকে-ঈদের দিনে ভিক্ষাবৃওি থেকে তাদের বাঁচানো এর সুফল। এ যাকাতটি অন্য সব যাকতা থেকে স্বতন্ত্র এক প্রকারের কর। কেননা এটা ব্যক্তিদের ওপর ধার্য হয়। আর অন্যগুলো ধার্য হয় ধন-মালের ওপর। এ কারণে অপরাপর যাকাতে যা কিছু শর্ত, এখানে সেগুলো গণ্য করা হয়নি। নিসাব পরিমাণের মালিকানা থাকা শর্ত নয়-যার বিস্তারিত বিবরণ যথাস্থানে দেয়া হয়েছে। পরেও এর ওপর আলোকপাত করা হবে। ফিকাহবিদগণ এ যাকতের নাম দিয়েছেন, ‘মাথার যাকাত’ ‘ঘাড়ের যাকাত’ ‘শরীরের যাকাত’ ইত্যাদি। আর শরীর বলেতে ব্যক্তি বোঝায়-প্রাণ বা আত্ম নয়। ফিতরের যাকাতও ওয়াজিব বহু কয়জন হাদীস গ্রন্থ সংকলক আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) সূত্রে বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন যে, রাসূলে করীম (স) রমযানের ফিতরের যাকাত ধার্য করেছেন এক ছা’খেজুর অথবা এক ছা’ গম প্রত্যেক স্বাধীন বা ক্রীতদাস ব্যক্তির ওপর-পুরুষ কিংবা মেয়েলোক-মুসলিমদের মধ্যে থেকে। [(আরবী************) গ্রন্থে উদ্ধৃত নাইলুল আওতার, ৪র্থ খন্ড, ১৭৯ পৃষ্ঠা উসমানীর ছাপা।] পূর্বের ও পরবর্তী জমহুর আলিমগণ বলেছেনঃ হাদীসের শব্দ (আরবী************) অর্থ বাধ্যতামূলক করেছেন, ওয়াজিব করে দিয়েছেন। অতএব ফিতরের যাকাত-তাঁদের মতে ওয়াজিব বা ফরয। কেননা তাও আল্লাহ্র সাধারণ অর্থবোধক আদেশ (আরবী************) ‘এবং যাকাত দাও’-এর আওতাভুক্ত। রাসূলে করীম (স)-একে ‘যাকাত’ বলেছেন। কেননা তা আল্লাহ্র আদেশের আওতাভুক্ত। আর রাসূলে করীম (স)-এর কথা (আরবী************) বেশীর ভাগ এ অর্থেই ব্যবহৃত হয়। একটা তাগিদের দিক হল (আরবী************) অর্থ ‘ওয়াজিব কারেছেন’- বাধ্যতামূলক করেছেন। এ শব্দটির পরই****** (ওপর) ব্যবহৃত হয়েছে। তাও ‘ওয়াজিব’ই বোঝায়। কেননা হাদীসে প্রত্যেক স্বাধীন ও ক্রীতদাসের ওপর বলা হয়েছে। সহীহ বর্ণনাসমূহে তাই উদ্ধৃত হয়েছে ****** ‘আদেশ করেছেন; আর বাহ্যত ******* ‘ওয়াজিব’ বোঝায়। [(আরবী************)] আবুল আলীয়া, আতা ও ইবনে সিরীন স্পষ্ট ভাষায় বলেছেনঃ তা ফরয-যেমন বুখারী প্রন্থে উদ্ধৃত হয়েছে। তা ***** হিসেবে উদ্ধৃত হয়েছে। হাফেয ইবনে হাজার ‘ফতহুলবারী’ গ্রন্থে বলেছেনঃ আবদুর রাজ্জাক হাদীসটিকে ইবনে জুরাইজ থেকে-আতা থেকে- এ সূত্রে ‘মুওাছিল’ রূপে উদ্ধৃত করেছেন। ইবনে আবূ শায়বা আছেমুল আহওয়াল থেকে-অন্যান্যদের থেকে- এ সূত্রে ‘মুওাছিল’ রূপে উদ্ধৃত করেছেন। বুখারী শুধু এদের উল্লেখ করেই ক্ষান্ত হয়েছে। কেননা তারা ফিতরা ফরয বলেছেন নতুবা ইবনুল-মুনযির প্রমুখ বলেছেন যে, এর ওপর ‘ইজমা’ অনুষ্ঠিত হয়েছে।] আর তাই মালিক, শাফেয়ী আহমাদের মত। হানাফীদের মতে তা ওয়াজিব, ফরয নয়। এটা ফরয ও ওয়াজিবের মধ্যকার পার্থক্যের নিয়মের ওপর ভিওিশীল। তাঁদের মতে ফরয হচ্ছে শুধু তা যা অকাট্য দলিল দ্বারা প্রমাণিত। আর ওয়াজিব হচ্ছে তা, যা ***** অপ্রত্যয়মূলক দলিল দ্বারা প্রমাণিত। এ পার্থক্যটার ফলশ্রুতি হচ্ছে, ফরয অমান্যকারী কাফির হবে; কিন্তু ওয়াজিব অমান্যকারী কাফির হবে না। এ কারণে তাঁরা ওয়াজিবকে বলেন, ‘বাস্তব কর্মীয় ফরয’ (আরবী************) আর তার মুকাবিলায় রয়েছে ‘আকীদাগতভাবে ফরয। কিন্তু অপর তিনজন ইমামের মতে ফরয এ থেকে ভিন্ন। তা দুভাগের সমন্বয়ঃ যা অকাট্য দলিল দ্বারা প্রমাণিত, আর যা ***** দলিল দ্বারা প্রমাণিত। এ থেকে আমরা জানতে পারিঃ হানাফীরা হুকুমের ক্ষেত্রে অপর তিনটি মাযহাবের বিরোধী নন। [মুহাক্কিক ইবনুল হুম্মাম বলেছেনঃ তাৎপর্যের দিক দিয়ে এ দুই অর্থের মাঝে কোন পার্থক্য নেই-মতবিরোধ নেই। কেননা তাঁরা যাকে ফরয বলেনতা এ রকম নয় যে, তা অস্বীকার করলে কাফির হতে হবে। তা ওয়াজিব অর্থে যাকে আমরা ওয়াজিব বলি। সারকথা হচ্ছে, তাঁদের পরিভাষায় যা ফরয, তা আমাদের বচনে ওয়াজিব। তার দুটি অংশের একটিতে আমরা প্রয়োগ করেছি। হানাফীরা ফিতরাকে ওয়াজিব বলেন-ফরয নয় এজন্যে যে, তার ওয়াজিব হওয়ার ব্যাপারেই কিছুটা মতপার্থক্য রয়েছে সেসব হাদীস ৈএ পর্যায়ে উদ্ধৃত হয়েছে তা অকাট্যভাবে প্রমাণিত নয়। তার তাৎপর্যও নয় অকাট্য। দেখুনঃ (আরবী************)] আসলে এটা পরিভাষাগত মতপার্থক্য। আর পরিভাষায় কোন দোষ নিহিত নেই। মালিকী মতে লোকেরা ‘আশহুর’ থেকে উদ্ধৃত করেছেন তা সুন্নাতে মুয়াক্কিদাহ। [ইবনে হাজম ‘আল-মুহাল্লা’ গ্রন্থে (৬ষ্ঠ খন্ড- ১১৮ পৃ.) মালিক থেকে বর্ণনা করেছেনঃ ফিতরের যাকাত ফরয নয়। শায়খ শাকের তার ওপর টীকায় লিখেছেন যে, এটা ইবনে হাজমের বোঝার ভুল কিংবা যে তার থেকে বর্ণনা করেছেন, তার ভুল। ইমামা মালিক ******** গ্রন্থে বলেছেনঃ যাকাত ওয়াজিব হয় মরুবাসীদের ওপর, যেমন ওয়াজিব হয় নগরবাসীদের ওপর। আর তা এজন্যে যে, ‘রাসূলে করীম (স) রমযানের ফিতরা লোকদের ওপর ফরয করেছেন’।….. ইবনে রুশদ তাঁর (আরবী************) গন্থে (১ম খন্ড ২৬৯ পৃষ্ঠা) মাযহাবের শেষে দিকের কোন কোন আলিম থেকে এ কথা উদ্ধৃত করেছেন- নির্দিষ্ট করেননি।] আর জাহিরী মরেত কারো কারো কথাও এই। শাফেয়ী মতের ইবনুল-লুবান এ মত দিয়েছেন। তারা ****** শব্দটির যা হাদীসে ব্যবহৃত হয়েছে-‘ নির্ধারণ করেছেন’ এ অর্থ মনে করেছেন। পূর্বে আমরা যা উল্লেখ করেছি, তা তাদের জবাব। ইবনে দকীকুল ঈদ বলেছেনঃ অভিধানে ****** অর্থ ****** ‘পরিমাণ ঠিক করা।’ কিন্তু শরীয়াতী বচনে তার অর্থ ‘ওয়াজিব’ করা। অতএব এ অর্থে গ্রহণ করাই বাঞ্ছনীয়। ইবনুল হুম্মাম বলেছেনঃ শরীয়াতদাতার কালামে ব্যবহৃত শব্দকে তার শরীয়াতী প্রকৃত তাৎপর্যে গ্রহণ করা একটা স্থির সিদ্ধান্ত-যতক্ষণ অন্য কোন অর্থ গ্রহণে বাধ্যকারী কিছু না আসে। আর শরীয়াতী তও্ব নিছক একটা নির্ধারণই নয়-বিশেষ করে বুখারী ও মুসলিম গ্রন্থদ্বয়ে ব্যবহৃত শব্দে। নবী করীম (স) ফিতরের যাকাত দেয়ার আদেশ ****** করেছেন। আর ****** শব্দের অর্থ ******* ‘আদেশ করেছেন।’ তাকে যাকাত বলায় তার ‘ওয়াজিব’ (ফরয) হওয়াটারই সমর্থন মেলে। তাই তা সাধারণ যাকাতের অন্তর্ভুক্ত-যার আদেশ করেছেন আল্লাহ্ তা‘আলা এবং তা দিতে অস্বীকারকারীদের কঠিন আযাব দেয়ার ওয়াদা করেছেন। এ প্রেক্ষিতে ইমাম নববী ইবনুল লুবানের মত উদ্ধৃত করেছেন যে, তা সুন্নাত। পরে বলেছেন, এটা বিরল, অগ্রহণীয়। বরং সুস্পষ্ট গলদ। ইসহাক ইবনে রাহ্আই বলেছেন, ফিতরের যাকাতকে ওয়াজিব মনে করা ‘ইজমা’ সমর্থিত। বরং ইবনুল মুন্যির বলেছেনঃ তার ওয়াজিব হওয়ার ওপর ‘ইজমা’ অনুষ্ঠিত হয়েছে। ইসহাকের এ কথাটি দুর্বোধ্য। কেননা তাতে ত্রুটিপূর্ণ অপর্যাপ্ত মতপার্থক্য রয়েছে যেমন পূর্বে উল্লেখ করেছি। আরও এজন্যে যে, ইবরাহীম ইবনে উলিয়া ও আবূ বকর আল-আসম বলেছেন, যাকাত ফরয হওয়ার দরুন তার ওয়াজিব হওয়াটা নাকচ হয়ে গেছে। তাঁদের উভয়ের দলিল হচ্ছে কাইস ইবনে সায়াদ ইবনে উবাদ থেকে আহমাদ ও নাসায়ী উদ্ধৃত বর্ণনা তাঁকে সাদকায়ে ফিতর সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। তখন তিনি বলেছেনঃ রাসূলে করীম (স) যাকাত সংক্রান্ত আয়াত নাযিল হওয়ার পূর্বে ‘সাদকায়ে ফিতর দেয়ার জন্যে আদেশ করেছিলেন। পরে যখন যাকাতের আয়াত নাযিল হয়, অতঃপর তিনি আমাদের আদেশও করেন নি, নিষেধও করেন নি অথচ আমরা দিয়ে যাচ্ছিলাম। এ বর্ণনার সনদে আপওি আছে। কেননা তার একজন বর্ণনাকরী অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি। হাফেজ ইবনে হাজার যেমন বলেছেন। [সয়ূতী নাসায়ীর শরাহ গ্রন্থে এটারই অনুসরণ করেছেন। আর শাওকানী তাঁর ‘নাইলুল আওতার’ গ্রন্থে (৪র্থ খন্ড-১৮০ পৃ.) উসমানিয়া ছাপা) কিন্তু শায়খ আহমাদ শায়েক ইবনে হাজার তার মতের লোকদের কথায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন-হাদীসটি উদ্ধৃত করার পর যেমন নাসায়ী উদ্ধৃত করেছেন (৫ম খন্ড, ৪৯ পৃ.) দু’টি সনদ সূত্রে। সনদ দুটি সম্পর্কে বলেছেনঃ ‘দুটি সহীহ সনদ; ফিকাহ বর্ণনাকারীরাই তা বর্ণনা করেছেন। তাতে অজ্ঞাত পরিচয় কেউ নেই আদৌ। (আরবী************)] তা সহীহ হবে ধরে নিলে তাতে এমন দলিল নেই যা তার মনসূখ হওয়া প্রমাণ করতে পারে। কেননা রাসূলে করীম (স) প্রথমবার আদেশ দেয়াকে যথেষ্ট মনে করেছেন, আবার আদেশ দেয়ার প্রয়োজন মনে করেননি। কেননা একটি ফরযের আদেশ নাযিল হলে অপর ফরযটি নাকচ হওয়া বাধ্যতামূলক করে না। [(আরবী************)] আল্লাহ্ ও রাসূলে (স)-এর আদেশের মৌল কথা হচ্ছে, তা সব সময় সুদৃঢ় ও স্থায়ী থাকে। আর শুধু সম্ভাব্যতার দ্বারা ‘মনসূখ’ হওয়া প্রমাণিত হয় না। এ কারণে মুসলমানদের কাছে চূড়ান্তভাবে স্থিত যে,ফিতরের যাকাত ওয়াজিব। কেউ বিরূপ মত পোষণ করলে সেজন্যে কারোর কোন পারোয়া নেই। কেননা তা তার পূর্বে ও পরে অনুষ্ঠিত ইজমা’র বিরোধী। [দেখুনঃ (আরবী************)] প্রাচ্যবিদ শাখ্ত এ পর্যায়ে যা কিছু উল্লেখ করেছেন, তাতে বহু এলামেলো কথা বলেছে। [শাখত (আরবী************) বলেছেন, ফিতরার যাকাত ওয়াজিব হওয়ার ব্যাপারে ফিকাহবিদগণ বিভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। বলেছেন, শেষ পর্যন্ত যে মতটি প্রাধান্য পেয়েছে তা ফিতরের যাকাতকে ওয়াজিব বলেছে। আর মালিকীদের মতে তা সুন্নত ছাড়া আর কিছু নয়। এ কথায় বহু ভূল রয়েছে। আমরা দেখেছি, ফিকাহবিদগণ ফিতরার ওয়াজিব হওয়ার মতে সকলেই ঐক্যবদ্ধ। ইবনুল মুনযির তাঁর ওপর ইজমা হওয়ার কথা বলেছেন। বিভিন্ন যুগে দুই জন বা তিনজন যদি ভিন্ন মত পোষণ করে থাকেন, তা হলে তাদের এ বিরূপ মত ধর্তব্য নয়। তবে মালিকীদের মতে তা ওয়াজিব ছাড়া আর কিছুই নয়। এ মাযহাবের নির্ভরযোগ্য গ্রন্থাবলীতে তাই বলা হয়েছে। দৃষ্টান্তস্বরূপঃ (আরবী************) দ্রষ্টব্যৗ ‘আশহুব যা উল্লেখ করেছেন, তা এ মযাহাবে নির্ভরযোগ্য নয়। শাখত-এর দলিল ***** গ্রন্থে উদ্ধৃত ইবনে আবূ জায়দের কথায় বিভ্রান্ত হয়েছে। তাতে লেখা আছেঃ ‘ফিতরের যাকাত সুন্নাত, ওয়াজিব, রাসূলে করীম (স) তা ছোট বড় সকলের ওপর ফরয করেছেন। তিনি যদিও শুধু ‘সুন্নাত’ বলেই ক্ষান্ত হন নি। বরং বলেছেন, ওয়াজিব, রাসূলে করীম (স) তা নির্ধারিত করেছেন। এজন্যে ব্যাখ্যাকারীরা বলেছেনঃ প্রসিদ্ধ মত হচ্ছে, তা সুন্নাত নির্ধারিত। দেখুনঃ (আরবী************) মালিক আল-মুয়াওা গ্রন্থে স্পষ্ট করে লিখেছেন, তা ওয়াজিব এবং হাদীসের দলিল দ্বারা তা প্রমাণিত করেছেন-যেমন পূর্বে বলেছি। এ ক্ষণে প্রমাণীত হল যে, ফিতরার ওয়াজিব হওয়াটা কেবল ‘রায়’ দ্বারা ঠিক করা হয়নি। যেমন শাখত মনে করেছেন। বরং তা রাসূলে করীম (স)-এর সময় থেকেই সমাজে চালু হয়েছে।] ফিতরের যাকাত বিধিবদ্ধ হওয়ার যৌক্তিকতা এ যাকাত (ফিতরা) ওয়াজিব হওয়ার যৌক্তিকতা পর্যায়ে হযরত ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত হয়েছেঃ (আরবী************) রাসূলে করীম (স) ফিতরের যাকাত নির্ধারিত করেছেন রোযাদারকে বেহুদা অশ্লীল কথা ও কাজ থেকে পবিত্র রাখা এবং মিসকীনদের জন্যে খাবারের ব্যবস্থাস্বরূপ। [হাদীসটি আবূ দাউদ কর্তৃক (আরবী************) অধ্যায়ে উদ্ধৃত করেছেন। এবং তিনি মুনযেরী এ বিষয়ে কোন মন্তব্য করেননি। তার হাদীসে বর্ণিত যৌক্তিকতা দুটি ব্যাপারের সমন্বয়। অর্থ, দুজনই হাদীসটিকে ‘হাসান’ মনে করেন-যেমন বলা হয়েছে। হাকেমও উদ্ধৃত করেছেন। (১ম খন্ড-৪০৯ পৃ.) এবং বলেছেন, হাদীসটি সহীহ বুখারীর শর্তে। যাহবী তা সমর্থন করেছেন। ইবনে মাজাহও উদ্ধৃত করেছেন ‘যাকাতুল ফিতর’ অধ্যায়। দারে কুতনী (২১৯ পৃ.) বলেছেনঃ এ হাদীসের বর্ণনাকারীদের মধ্যে কেউ ‘দোষী’ বা ‘আহত’ নয়। বায়হাকী ১৬৩ পৃষ্ঠার। দেখুনঃ মিরকাত-৪র্থ খন্ড, ১৭৩ পৃ. (আরবী************) ২য় খন্ড, ৪১১ পৃ.। আর হাদীসটির শেষ অংশ হচ্ছেঃ (আরবী************) যে তা নামাযের পূর্বে আদায় করবে, তার যাকাত গৃহীত, (আরবী************) আর যে তা নামাযের পরে দেবে, তা একটি সাধারণ দান হবে। হাদীসের ****** শব্দটি অর্থহীন-ফায়দাহীন কাজ বোঝায়-যার কোন তাৎপর্য থাকে না অথবা ‘বাতিন’ও হতে পারে। আর ******** মূলত যৌন মিলন ও স্বমী-স্ত্রীর মধ্যকার কাজ বোঝায়। পরে তা সকল অশ্লীল বীভৎস কাজ বোঝাচ্ছে সাধারণ অর্থে।] হাদীসে বর্ণিত যৌক্তিকতা দুটি ব্যাপারের সমম্বয়। প্রথম ব্যাপার রমযান মাসের রোযাদারদের সাথে সাথে সম্পৃক্ত। তাদের রোযা কোন বেহুদা কথা ও অশ্লীল কাজের দোষযুক্ত হয়ে যেতে পারে এ আংশকা আর পূর্ণঙ্গ রোযা তো তাই যা মুখ ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পালন করে-যেমন রোযা থাকে পেট ও যৌন অঙ্গ। কাজের রোযাদারকে তার মুখ, তার কান, তর চক্ষুদ্বয়, তার হাত কিংবা তার পা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (স) কর্তৃক নিষিদ্ধ কথা কাজ দ্বারা কলুষিত হলে তা ক্ষমা করা হবে না। আর রোযাদার সাধারণতই এ সব থেকে রক্ষা পেতে পারে না- বিজয়ী মানবীয় দুর্বলতার দরুন। এ কারণে রোযা শেষ হওয়ার পর এ যাকাতের ব্যবস্থা করা হয়েছে-ঠিক ‘গোসল’ বা ‘হাম্মামের’ মত-মন দুষিত হলে তার ক্ষতি থেকে পবিত্র হওয়ার লক্ষ্যে অথবা রোযা দোষযুক্ত হলে তার ত্রুটির ক্ষতি পূরণের জন্যে এ ব্যবস্থা। ‘কেননা ভাল ও উওম কার্যাবলী খারাপকে ধুয়ে মুছে দেয়’- এতো জানা কথা। যেমন শরীয়াতের বিধানদাতা পাঁচ ওয়াক্ত ফরয নামাযের সাথে নিয়মিত সুন্নাত নামায চালূ করেছেন। কেননা ফরয নামাযে কোন ত্রুটি বা কোন কোন নিয়ম পালনে অসবিধা হতে পারে। কোন কোন ইমাম এ ব্যবস্থাকে ‘সহু সিজদা’র সাথে তুলনা করেছেন। অকী, ইবনুল জাররাহ বলেছেন, ‘রমযান মাসের জন্যে ফিতরের যাকাত নামাযের ‘সহু সিজদা’র সমতুল্য। তা রোযার ত্রুটি-বিচ্যুতির ক্ষতি পূরণ করে দেয়, যেমন সহু সিজদা নামাযের ত্রুটির ক্ষতিপূরণ করে। [(আরবী************)] আর দ্বিতীয় ব্যাপার সমাজ-সমষ্টির সাথে সম্পৃক্ত, তার সর্বত্র-বিশেষ করে মিসকীন ও অভাবগ্রস্ত লোকদের মধ্যে ভালোবাসা, প্রীতি ও আনন্দ বিস্তৃত করা একটা বড় লক্ষ্য। কেননা ঈদ তো সাধারণভাবে আনন্দ স্ফূর্তর দিন। কাজের সে দিন সমাজের সমস্ত লোক যাতে করে এ আনন্দ স্ফূর্তিতে যোগদান করতে পারে তার ব্যবস্থা করা একান্ত বাঞ্ছনীয়। কিন্তু মিসকীনরা কখ্খনই আনন্দ লাভ করতে পারে না যদি কেবল ধনী সচ্ছল লোকেরাই চর্ব্য-চোষ্য লেজ্য-পেয় ভোগ করে, আর তারা এ মহা ঈদের দিনে খাবারও না পায়। এ কারণে শরীয়াতরে যৌক্তিক দৃষ্টিকোণ এ দিনে এমন ব্যবস্থা গ্রহণের অপরিহার্যতা মনে করেছে, যার ফলে অভাবগ্রস্তরা অভাব ও ভিক্ষার লাঞ্ছনা থেকে মুক্ত থাকতে পারবে। সেই সাথে তার মনে এ চেতনাও জাগবে যে, সমাজ তাকে ভুলে যায়নি, তার প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন করেনি। বিশেষ করে এ জাতীয় আনন্দ ও উৎসবের দিনে। এ কারণে হাদীসে বলা হয়েছেঃ (আরবী************) তোমরা এ দিনে তাদের সচ্ছল করে দাও। [‘নাইলুল আওতার’ গ্রন্থে বলা হয়েছেঃ হাদীসটি বায়হাকী ও দারেকুতনী কর্তৃক ইবনে উমর থেকে উদ্ধৃত হয়েছে। বায়হাকীর বর্ণনায় রয়েছে (আরবী************) এ দিনে দ্বারা দ্বারে ভিক্ষা করে বেড়ানো থেকে তাদের বাচাও। ইবনে সায়দ ‘তাবাকাত’ গ্রন্থে আয়েশা ও আবূ সায়ীদ থেকে উদ্ধৃত করেছেন ৪র্থ খন্ড, ১৮৬ পৃ. (আরবী************) দেখুনঃ (আরবী************)] শরীয়াতের বিধানদাতার সম্মুখে ওয়াজিব পরিমাণটা হ্রাস করাও লক্ষ্য হিসেবে ছিল-যেমন পরে বলা হবে এবং লোকদের নিজেদের খাদ্য থেকে যাতে সহজেই দিয়ে দিতে পারে তা ব্যবস্থা করাও বাঞ্ছনীয় ছিল যেন সম্ভাব্যভাবে জাতির বৃহওর জনগোষ্ঠী এ মহাউৎসবে যোগদান করতে পারে। এ মহান উপলক্ষেই শরীয়াতে তাৎক্ষণিক অবদান হিসেবে এ ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে। দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ যাকাতুল ফিতর কার ওপর ওয়াজিব এবং কাদের পক্ষ থেকে দেয়া ওয়াজিব ফিতরের যাকাত কার ওপর ওয়াজিব উপরে বহু কয়জন হাদীস গ্রন্থকার উদ্ধৃত ও হযরত ইবনে উমর (রা) বর্ণিত হাদীসটির ভাষা হচ্ছেঃ (আরবী************) রাসূলে করীম (স) রমযানের ফিতরের যাকাত ধার্য করেছেন প্রত্যেক স্বধীন মুক্ত ও ক্রীতদাস-পুরুষ বা স্ত্রী মুসলমানের ওপর। বুখারী তারই থেকে যে বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন, তাতে বলা হয়েছেঃ রাসূলে করীম (স০ ফিতরের যাকাত বাবদ এক ছা’ খেজুর বা এক ছা’ গম ধার্য করেছেন দাস মুক্ত স্বাধীন পুরুষ-স্ত্রী এবং ছোট ও বয়স্ক মুসলমানদের ওপর। আবূ হুরায়রা (রা) থেকে ফিত্রের যাকাত পর্যায়ে বলা হয়েছেঃ প্রত্যেক মুক্ত ও দাস পুরুষ ও নারী, ছোট ও বয়স্ক, ধনী ও গরীবের ওপর। [হাদীসটি আহ্মদ‘বুখারী’ মুসলিম ও নাসায়ী উদ্ধৃত করেছেন। তা কিতাবুয্ যাকাতের১৮৬ নম্বর হাদীস- ফত্হুর রাব্বানী ৯ম খন্ড, ১৩৯ পৃ.] এ আবূ হুরায়রা (রা)-এর কালাম। কিন্তু এরূপ কথা কেউ নিজের ইচ্ছামত বলতে পারে না। তাই তা অবশ্যই রাসূলে করীম (স)-এর কাছ থেকে শোনা কথা হবে। এ সব হাদীস প্রমাণ করেছে যে, এ যাকাতটা মুসলমানদের ব্যক্তি ও মাথাপিছু সাধারণভাবে ফরয ধার্য করা। স্বাধীন, মুক্ত ও ক্রীতদাস বা পুরুষ-স্ত্রী কিংবা ছোট ও বয়স্ক, ধনী ও গরীব এবং সভ্যতার আলোক প্রাপ্ত ও মরুবাসী-এদের মধ্যে এদিক দিয়ে কোনই পার্থক্য নেই। জুহরী, রাবীয়াতা ও লাইস বলেছেনঃ ফিত্রের যাকাত কেবল সভ্যতালোকিত নগরবাসীর ওপর বিশেষভাবে ধার্যকৃত, মরুবাসীদের ওপর তা ওয়াজিব নয়। আর উপরিউদ্ধৃত হাদীসসমূহ বাহ্যত এ কথার প্রতিবাদ করে। অতএব সঠিক ও যথার্থ কথা তাই যা জমহুর ফিকাহবিদগণ বলেছেন। [(আরবী************)] ইবনে হাজম এ কথাটি আতা থেকে বর্ণনা করেছেন এবং এই বলে তার প্রতিবাদ করেছেন যে, রাসূলে করীম (স) এ ব্যাপারে বদ্দু ও এ রাবীকে অন্য থেকে আলাদা করেন নি-(বিশেষভাবে কারোর ওপর নয়, সব মুসলিমের ওপরই তা ধার্য হয়েছে।) অতএব এ ব্যাপারে মুসলমানদের মধ্য থেকে কাউকে আলাদা করা- এ দায়িত্ব থেকে নিষ্কৃতি দেয়া জায়েয নয়। [(আরবী************)] স্ত্রী ও শিশুর ওপরও কি ওয়াজিব হাদীসের ‘পুরুষ বা স্ত্রী’ কথাটি আবূ হানীফার মাযাহাব সমর্থন করে অর্থাৎ তা নারীর ওপরও ওয়াজিব-তার স্বামী থাক আর না থাক। স্ত্রীর ওপর নিজস্বভাবেই তা ওয়াজিব এবং তার নিজের মাল থেকে আদায় করা কর্তব্য। জাহিরী ফিকাহর মাযাহাব এই। [(আরবী************) কিতাবুয যাকাতের ১৮৭ নম্বরের হাদীস।] অন্য তিনজন ইমাম এবং লাইস ও ইসহাকের মতে স্বামীরই কর্তব্য তার স্ত্রীর ফিত্রের যাকাত আদায় করে দেয়া। কেননা তার যাবতীয় ব্যয়ভার তাকেই বহন করতে হয় এবং এটিও তার মধ্যে গণ্য। হাফেয ইবনে হাজার বলেছেন, এ কথাটিতে আপওি আছে। কেননা তারা বলেছেনঃ ‘স্বামী যদি দরিদ্র হয় এবং স্ত্রী হয় ক্রতদাসী, তা হলে তার ফিত্রা আদায় করা মনিবের কর্তব্য হবে। সাধারণ ব্যয়ভারের কথা স্বতন্ত্র। তাহলে দুটির মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। আর তাঁরা সকলে এ ব্যাপারে একমত যে, মুসলিম ব্যক্তি তার কাফির স্ত্রীর পক্ষ থেকে ফিত্রা দেবে না অথচ তার সাধারণ ব্যয়ভার তাকেই বহন করতে হবে। শাফেয়ী মুহাম্মাদ ইবনে আলী আল-বাকের সুত্রে বর্ণিত ‘মুরসাল’ হাদীসকে দলিল হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তা হচ্ছেঃ ‘তোমরা সাদকায়ে ফিতর সেই সকলের পক্ষ থেকে দাও, যাদের যাবতীয় খরচ তোমরা বহন করা। [বায়হাকী হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন এ সূত্রেই- ৯ম খন্ড, ১৪০ পৃষ্ঠার সনদে ‘আলী’কে অতিরিক্ত উল্লেখ করেছেন। হাদীসটি ******* ইবনে হাজম বলেছেন, এখানে একটা পরম বিস্ময়ের ব্যাপার রয়েছে। আর তা হচ্ছে ইমাম শাফেয়ী হাদীসটিকে ******* বলেন নি। পরে এখানে বলতে শুরু করেছে যে, তা’ মুরসাল’- ইবনে আবূ ইয়াহইয়ার বর্ণনা থেকে। (আরবী************) বায়হাকী ইবনে উমরের হাদীস হিসেবে বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেনঃ (আরবী************) এর সনদ অশক্তিশালী, যেমন বলেছেন (৪র্থ খন্ড ১৬১ পৃ.।) দারে কুতনীও বর্ণনা করেছেন। (আরবী************) যার ওপর তোমার ব্যয়ভার বহন চালু হয়েছে, তার পক্ষ থেকে খাইয়ে দাও। এর বর্ণনাকারী আবদুল আ’লা অশক্তিশালী- যেমন বায়হাকী বলেছেন। কিন্তু তার পূর্ববর্তী বর্ণনার সাহায্যে তা শক্তিশালী হয়ে যায়। ******* গ্রন্থে বলা হয়েছেঃ এটা ******* (২য় খন্ড ১৯৯ পৃ.) দেখুনঃ (আরবী************)] কিন্তু এ ধরনের বর্ণনা ‘যয়ীফ’ বলে তাকে দলিল হিসেবে গ্রহণ করা যায় না, অথচ শাফেয়ী এবং তার সমমতের ফিকাহবিদগণ ব্যক্তির কর্মচারী এবং তার কাফির দাসের পক্ষ থেকেও ফিত্রা দেয়া বাধ্যতামূলক বলে মত প্রকাশ করেছেন। ইবনুত্তার কুমানীও এ কথা বলেছেন। [আরবী************] কেননা মালিক তো দুই জনেরই যাবতীয় খরচ বহন করে থাকে। অনুরূপভাবে ইমামীয়া বলেছেন, ফিতরের যাকাত নিজের এবং যার যার খরচ বহন করা হয় তাদের সকলের পক্ষ থেকে দিতে হবে। [আরবী************] লাইস বলেছেন, যে কর্মচারীর মজুরী সুনির্দিষ্ট নয় সে কর্মচারীর পক্ষ থেকে মালিক ফিত্রা দেবে। আর তার মজুরী সুনির্দিষ্ট হলে তার ফিত্রা তার আদায় করা জরুরী নয়। [আরবী************] আর জায়দীয়া মতের লোকেরা শুধু যার খরচ বহন করা হয় নিকটাত্মীয় বা স্ত্রী অথবা দাস হওয়ার কারণে, কেবল তার ফিত্রা দেয়া বর্তব্য বলে শেষ করেছেন। [আরবী************] আর ‘ছোট বয়স্ক’ কথাটি প্রমাণ করে যে, ছোট বয়সের নাবালেগ কোন শিশুও যদি ধন-মালের মালিক হয়, তা হলে তার ওপরও তা ওয়াজিব। তার অভিভাবকিই তার পক্ষ থেকে তা দিয়ে দেবে। আর তার ধন-মাল না থাকলে তার ফিত্রাটা দেয়া ওয়াজিব হবে যে তার খরচাদি বহন করে তার ওপর। এটা জমহুরের মাযহাব। মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান বলেছেনঃ তা দেয়া ওয়াজিব শুধু তার পিতার ওপর, তার বাপ না থাকলে তার ওপর কিছুই ওয়াজিব নয়। [আরবী************ দেখুনঃ] সায়ীদ ইবনুল মুসাইয়্যের ও হাসান বসরীর মত হচ্ছেঃ ফিতরের যাকাত ওয়াজিব শুধু তার ওপর যে রোযা থাকে। কেননা রোযাকে পবিত্রকরণের লক্ষ্যেই তা ওয়াজিব করা হয়েছে। আর অল্প বয়স্ক নাবালেগ এ পবিত্র করণের মুখাপেক্ষী নয়। কেননা তার কোন গুনাহ হয় না। তার দলিল হচ্ছে ইবনে আব্বাস (রা) বর্ণিত হাদীস। তিনি বলেছেনঃ ‘রাসূলে করীম (স) ফিতরের যাকাত ধার্য করেছেন রোযাদারকে বেহুদা ও লজ্জাষ্কার কাজকর্ম থেকে পবিত্রকরণের লক্ষ্যে।’ এর জবাবে বলা হয়েছে, হাদীসে ‘পবিত্রকরণ’ কথাটি সধারণভাবে ও বেশী ভাল লোকের প্রতি লক্ষ্য রেখে বলা হয়েছে। [পূর্বোল্লিখিত উৎসসমূহ।] যেমন কোন হাদীসে ফিত্রা ওয়াজিব করার ভিন্নতর হেকমতের উল্লেখ করা হয়েছে। যেমনঃ ‘মিসকীনদের খাবারের ব্যবস্থাস্বরূপ’। আর যেমন অপর এক হাদীসে বলা হয়েছেঃ ‘এ দিনে তাদের সচ্ছল বানিয়ে দাও।’ এ ফিত্রা যখন এক হিসেবে পবিত্রকরণের লক্ষ্যে ধার্যকৃত, তখন অন্য হিসেবে তা গরীবদের খাদ্য ও তাদের সচ্ছল বানানোর পন্থা। আর এ লক্ষ্যটা অল্প বয়স্কের ক্ষেত্রেও পুরোপরি প্রযোজ্য-যেমন বড়দের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। গর্ভস্থ সন্তানের ফিত্রাও কি ওয়াজিব জমহুর ফিকাহ্বিদদের মতে গর্ভস্থ সন্তানের পক্ষ থেকে ফিত্রা দেয়া ওয়াজিব নয়। ইবনে হাজম বলেছেন, গর্ভস্থ সন্তান যদি তার মায়ের গর্ভে একশ বিশ দিন-চার মাস কাল-পূর্ণঙ্গ লাভ করে থাকে ফিতরের রাতের ফজর হওয়ার পূর্বে, তা হলে তার পক্ষ থেকেও সাদকায়ে ফিতর আদায় করা ওয়াজিব হবে। কেননা সহীহ হাদীসে বলা হয়েছে যে, এ সময়ে ভ্রূণের দেহে প্রাণের সঞ্চার হয়ে থাকে। ইবনে হাজম দলিলস্বরূপ উল্লেখ করেছেন, নবী করীম (স) ছোট বয়সের ও বড় বয়সের সকলের ওপরেই সাদকায়ে ফিতর ওয়াজিব করেছেন। আর গর্ভস্থ সন্তানকে ‘ছোট বয়সের’ বলা চলে। আর ‘ছোট বয়স’-এর শিশুর ওপর যে হুকুম প্রযোজ্য তার ওপরও তাই প্রযোজ্য। হযরত উসমান ইবনে আফফাত থেকে ইবনে হাজম বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন, তিনি ছোট বড় ও গর্ভস্থ (সন্তানের) সন্তানেরও সাদকায়ে আদায় করেতেন। আবূ কালাবা থেক বির্ণিত, তিনি ছোট ও বড় এমনকি মায়ের গর্ভে অবস্থিত সন্তানের পক্ষ থেকেও সাদকায়ে ফিতর দেয়া খুব পসন্দ করতেন। ইবনে হাজম বলেছেন, আবূ কালাবা সাহাবাদের দেখতে পেয়েছেন, তাঁদের সঙ্গও পেয়েছেন এবং তাঁদের থেকে হাদীসও বর্ণনা করেছেন (তাবেয়ী)। সুলায়মান ইবনে ইয়াসারকে গর্ভস্থ সন্তান সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল-তারও ফিত্র দেয়া হবে কি? বললেনঃ হ্যাঁ। বলেছেন, এ ব্যাপারে সাহবীদের কেউ হযরত উসমানের বিরোধিতা করেছেন বলে উল্লেখ পাওয়া যায়নি। [আরবী************] সত্যি কথা হচ্ছে, ইবনে হাজম যা-ই বলুন, গর্ভস্থ সন্তানের ফিত্রা দেয়া ওয়াজিব হওয়ার প্রমাণকারী কোন দলিল নেই। আর হাদীসের শব্দ ‘ছোট’ বলতে গর্ভস্থ সন্তানও বোঝায়-এ বলা খুব গোঁড়ামি ও জোরপূর্বক বলা ছাড়া আর কিছু নয়। হযরত ওসমান ও অন্যদের সম্পর্কে যা কিছু বর্ণিত হয়েছে, তাতেও বড় জোর ‘মুস্তাহাব’ প্রমাণিত হতে পারে মাত্র। আর নফল ইবাদতের কোন সীমা শেষ নেই, যেই তা করবে সেই বিপুল সওয়াব পারে, সন্দেহ নেই। ইমাম শাওকানী উল্লেখ করেছেন, ইবনুল মুনযির গর্ভস্থ সন্তানের পক্ষ থেকে ফিত্রা দেয়া ওয়াজিব নয় বলে ‘ইজমা’ হওয়ার কথা উদ্ধৃত করেছেন। ইমাম আহমাদ তাকে মুস্তাহাব মনে করতেন। ওয়াজিব নয়। [আরবী************] সাদকায়ে ফিতর ওয়াজিব হওয়ার জন্য ‘নিসাব’ কি শর্ত ইবনে উমর বর্ণিত উপরিউদ্ধৃত হাদীসে ‘মুক্ত ও গোলাম’ কথাটি ধনী ও নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক নয় এমন ফকীরকেও শামিল করে। আবূ হুরায়রা (রা) তাঁর বর্ণিত হাদীসে স্পষ্ট করে উল্লেখ করেছেন, ‘ধনী ও গরীব’ উভয়ের ওপর ওয়াজিব। জমহুর এবং তিনজন ইমাম এ মত দিয়েছেন। তাঁর সকলেই ফিত্রা ওয়াজিব হওয়ার জন্যে শুধু ইসলামের বিশ্বাসী এবং ফিত্রা পরিমাণটা, তার সেই দিনের খোরাকের অতিরিক্ত হওয়ার শর্ত করেছেন মাত্র। এ খোরাকে তার নিজের এবং সে সব লোকের খোরাকী দেয়া তার দায়িত্ব তাদের খোরাকও শামিল করতে হবে। আর সে দিন অর্থ রাতসহ দিন। আর অতিরিক্তি শর্ত হচ্ছে তার বাসস্থান, ঘরের জিনিসপত্র ও মৌলিক প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের অতিরিক্ত। শাওকানী বলেছেনঃ এটাই ঠিক। কেননা এ পর্যায়ের দলিলসমূহ নিঃশর্ত। গরীব ধনীর কোন বিশেষত্ব নেই। যে পরিমাণের মালিক হলে ফিত্রা দিতে হবে তা নির্ধারণে ইজতিহাদ করার কোন সুযোগ নেই। বিশেষ করে যে ‘কারণে’ ফিত্রা বিধিবদ্ধ হয়েছে, তা গরীব ধনী সকলের সধ্যেই বর্তমান থাকে। আর তা হচ্ছে বেহুদা ও অশ্লীল কথা ও কাজ থেকে পবিত্রকরণ। আর এক দিন ও রাত্রির খাবারে মালিক হওয়াটা তো জরুরী শর্ত। কেননা ঈদের দিনে যারা গরীব তাদের সচ্ছল বানানোই হল ফিত্রা বিধান করার লক্ষ্য। এখন সেদিনের খোরাক থাকার শর্ত না পাওয়া গেলে সে তো বরং সে লোকদের মদ্যে গণ্য হবে যাদের সেদিন সচ্ছল বানানোর জন্যে আদেশ করা হয়েছে। এ আদেশ যাদের প্রতি করা হয়েছে তাদের মধ্যে সে গণ্য বা শামিল হবে না। [আরবী************] আবূ হানীফা ও তাঁর মাযহাবের লোকেরা উপরিউক্ত মতের বিরোধিতা করেছেন। তাঁরা বলেছেন, সাদকায়ে ফিত্র ওয়াজিব শুধু তার ওপর, যে নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক। তাঁদের দলিল বুখারী [বুখারী তাঁর গ্রন্থের (আরবী************) তে **** হিসেবে উদ্ধৃত করেছেন। আর তার ******* সহীহ ধরে নিতে হবে, জমহুরের তাই মত। ইবনে হাজম এর বিপরীত মত পোষণ করেন।] ও নাসায়ী বর্ণিত হাদীসেঃ ‘যাকাত শুধু ধনীদের দেয়-ধনের প্রকাশ।’ আর ‘ধনী’ সে যে নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক। যে ফকীর তার কোন ধন নেই। অতএব তার ওপর ওয়াজিব নয়। তার ওপর তা দেয়া ফরয নয়। তাঁর মালের যাকাত ফরয হওয়ার ওপর কিয়াস করেছেন। অন্যান্যরা এর জবাবে বলেছেন-যেমন শাওকানী উল্লেখ করেছেন, তাঁরা যে হাদীসের উল্লেখ করেছেন তা দিয়ে উদ্দেশ্য হাসিল হয় না, আসলে আবূ দাউদ [শাওকানী কেবল আবূ দাউদের নাম করেই ক্ষান্ত রয়েছেন অথচ বুখারী (আরবী************)-এ নাসায়ী (আরবী************) এবং আহমাদ তাঁর মুসনাদে (২য় খন্ড, ৩৪৫-৩৭৮ পৃ.)ও মুসলিম যাকাত অধ্যায়ে উদ্ধৃত করেছেন। মুসলিম-এর ভাষা এইঃ (আরবী************)] এ হাদীসটি এ ভাষায় উদ্ধৃত করেছেনঃ (আরবী************) যা ধনের বাহ্যিক দিক থেকে দেয়া হয় তাই উওম যাকাত। এ হাদীসটি আবূ হুরায়রা (রা) বর্ণিত হাদীসের সাথে সাংঘর্ষিক। সে হাদীসটি আবূ দাউদ ও হাকেম কর্তৃক মরফু- রাসূলের কথা হিসেবে উদ্ধৃত। তা হচ্ছেঃ (আরবী************) আর তাবরানী কর্তৃক আবূ ইমামা থেকে বর্ণিত মরফূ হাদীস হচ্ছেঃ (আরবী************ ‘নিহায়া’ গ্রন্থে এর ব্যাখ্যা করা হয়েছে এমন পরিমাণ যা স্বল্প মালের অবস্থা ধারণ করে। এবং আবূ হুরায়রার হাদীস নাসায়ী, ইবনে খুজায়মা ও ইবনে হাব্বানের গ্রন্থে উদ্ধৃত। শব্দ ইবনে হাব্বানের গ্রন্থে ব্যবহৃত। হাকেম হাদীসটি সহীহ বলেছেন মুসলিমের শর্তের ভিওিতে। নবী করীম (স) বলেছেনঃ একটি দিরহাম এক লক্ষ দিরহামকে ছাড়িয়ে গেছে। এক ব্যক্তি বললঃ তা কি করে হল হে রাসূল? তিনি বললেনঃ এক ব্যক্তির বিপুল ধনসম্পদ ছিল। সে তার মাল সম্পদ থেকে এক লক্ষ দিরহাম নিয়ে দান করেছিল। আর এক ব্যক্তির ছিল মাত্র দুটি দিরহাম। সে তার একটি নিয়ে দান করে দিল। এ লোকটি তার মোট সম্পদের অর্ধেক দিয়ে দিল……….. তবে মালের যাকাতের ওপর কিয়াস করে যে দলিল দেয়া হয়েছে, তা সহীহ নয়-যেমন শাওকানী বলেছেন। কেননা এটা অসম কিয়াস। কিয়াসের জন্যে যে ভিওির সাদৃশ্যের প্রয়োজন, তা এখানে নেই। যেহেতু ফিত্রা ওয়াজিব হওয়াটা দেহ সংশ্লিষ্ট, আর অন্যান্য যাকাত ওয়াজিব হওয়াটা ধনমালের সাথে সংশ্লিষ্ট। অতএব এ দুটি ভিন্ন ভিন্ন জিনিস। [দেখুনঃ (আরবী************)] এ ছাড়া অন্যরা যে বলেছেন, নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিকানা হলেই ধনী গণ্য হয় আর ফকীরের ধনসম্পদ নেই, অতএব তার ওপর ফিত্রাও ওয়াজিব নয়-এ মতটির প্রতিবাদে সেসব সহীহ হাদীসের সাধারণ তাৎপর্যের কথা বলা হয়েছে, যা ধনী-গরীব সব মুসলমানের ওপর ফিতর ওয়াজিব হওয়া পর্যায়ে উদ্ধৃত হয়েছে। আবূ হুরায়রা (রা) তাঁর হাদীসে ‘ধনী’ বা ‘গরীব’ শব্দদ্বয় দ্বারা এ কথা স্পষ্ট করে তুলেছেন। আহমাদ ও আবূ দাউদ সালাবাতা ইবনে আবূ সগূর তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন। রাসূলে করীম (স) বলেছেনঃ তোমরা ফিতরের সাদকা বাবদ দাও এক ছা’ গম (মূল শব্দ ***** বা ***** অর্থ একই) ছোট বা বড়, মুক্ত বা গোলাম, ধনী বা গরীব পুরুষ বা স্ত্রী-প্রতিটি মানুষের পক্ষ থেকে। তারপর তোমাদের ধনী লোকেরা তো যাকাতও দেবে। আর গরীব লোকেরা যা দেবে তার চাইতে অনেক বেশী আল্লাহ তাদের ফিরিয়ে দেবেন। আবূ দাউদের অপর একটি বর্ণনায় রয়েছেঃ প্রত্যেক দুজনের পক্ষ থেকে ছা’ গম দাও। ইবনে কুদামাহ যেমন বলেছেন, এ সাদকাটা মালের হক কিন্তু মাল বেশী হলেই তার পরিমাণ বেশী হয় না। অতএব তাতে নিসাব পরিমাণ মালের মালিক হওয়া শর্ত হতে পারে না-যেমন কাফফারার ক্ষেত্রে তা শর্ত নয়। তার থেকে নিতেও কোন বাধা নেই, দিতেও বাধা নেই। যেমন যার কৃষি ফসলে ওশর ওয়াজিব-পরে সে তার ও তার পরিবারবর্গের প্রয়োজন পূরণে অভাবগ্রস্ত হয়ে পড়তে পারে। (তাই সে যেমন দেবে, তেমনি পারেও অন্য কথায়, তার কাছে থেকে যেমন নেয়া হবে, তেমনি তাকে দেয়াও হবে।’-অনুবাদক) আর ‘ধরনের প্রকাশ থেকেই যাকাত দিতে হয়’ হাদীসটি মালের সাদকা-মালের যকাতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আর এ ফিতরের যাকাতটি বিশেষভাবে দেহ ও মনের তরফ থেকে দিতে হয়। [দেখুনঃ (আরবী************)] আমি মনে করি, ফিতরের যাকাত প্রত্যেক ধনী-গরীব মুসলিমরে ওপর ধার্য করার মূলে শরীয়াতের বিধানদাতার একটা নৈতিক প্রশিক্ষণমূলক লক্ষ্য নিহিত রয়েছে। আর তা হচ্ছে, মুসলমানকে সচ্ছলতার অবস্থার মত দারিদ্র্যাবস্থাতেও আল্লাহ্র জন্যে অর্থ ব্যয়ে অভ্যস্ত করে তোলা। তাতে দারিদ্র্যের কঠিন অবস্থায়ও ত্যাগ স্বীকারের অভ্যাস হবে সচ্ছল অবস্থার মতই। আর কুরআন মজীদ মুওাকী লোকদের পরিচিতি প্রসঙ্গে বলেছেঃ (আরবী************) তারা অর্থব্যয় করে সচ্ছল অবস্থায় এবং কষ্ট-দরিদ্র্যের অবস্থায়। [(আরবী************)] এ থেকে মুসলিমরা এ শিক্ষা লাভ করে যে, সে ধন-দৌলতের দিক দিয়ে দরিদ্র এবং চরম দুরবস্থার সম্মুখনি হলেও তার হাতটাও ‘উঁচু হাত’ হতে পারে এবং সেও অন্যকে দান করা-অন্যের জন্যে ব্যয় করার স্বাধ আস্বাদম করতে পারে-যদিও তা বছরের মাত্র একবার, একটি দিনের জন্যে। এ কারণে জমহুর ফিকাহবিদগণ এ সাদকা ওয়াজিব হওয়ার জন্যে নিসাব পরিমাণের মালিক হওয়ার শর্ত না করাকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। অনুরূপভাবে স্ত্রীর নিজের মাল থাকলে তা থেকে এ সাদকা দেয়া ওয়াজিব-আবূ হানীফা প্রমুখেল এ মতটিকেও অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। কেননা তার ফলে একজন মুসলিম মহিলা তার সমান কর্তব্যের অনুভূতি লাভ করতে পারবে। তাকে তার নিজের মাল থেকে ব্যয় করতে অভ্যস্ত করাও হবে, কেবল স্বামীর ওপর নির্ভরশীল হওয়া থেকেও- অন্তত এ ক্ষেত্রে তাকে বাঁচানো যাবে। তা সত্ত্বেও স্বামী যদি সদিচ্ছা পরবশ হয়ে স্ত্রীরটাও দিয়ে দেয় তাহলে তা অবশ্যই আদায় হবে। দরিদ্রের ওপর ফিতরা ওয়াজিব হওয়ার শর্ত দরিদ্র বা ফকীর ব্যক্তির ওপর ফিতরা ওয়াজিব হওয়ার জন্যে জমহুর ফিকাহবিদগণ এ শর্ত আরোপ করেছেন যে, এ ফিতরার পরিমাণটা তার ও তার ওপর নির্ভরশীল লোকদের ঈদের দিন ও রাত্রির প্রয়োজনীয় খাবারের অতিরিক্ত হতে হবে। তার বাসস্থান, দ্রব্যসামগ্রী ও তার মৌলিক প্রয়োজনেরও বাড়তি হতে হবে। তাই যার একটা ঘর আছে, যা তার নিজের বসবাসের জন্যে দরকার অথবা তার নিজের ব্যয় পূরণের জন্যে তার ভাড়াটা তার প্রয়োজন অথবা একটা কাপড় যা তার নিজের বা তার ওপর নির্ভরশীলদের জন্যে আবশ্যক কিংবা কোন জন্তু যা তার চলাচল ও তার মৌল প্রয়োজন পূরণে তার নিজের দরকার অথবা গৃহপালিত গবাদিপশু যার প্রবৃদ্ধি তার প্রয়োজন অথবা এমন পণ্য যা থেকে ফিতরা দিলে তার মুনাফাটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এরূপ ফকিরের ওপর ফিতরা ওয়াজিব হবে না। কেননা তার যা আছে তা সবই তার মৌলিক প্রয়োজন পূরণের জন্যে জরুরী। অতএব তা বিক্রয় করতে তাকে বাধ্য করা যাবে না, তার নিজের বন্দোবস্তের মতই। আর যার অনেক বই পত্র রয়েছে যা পড়া তার দরকার বা তা থেকে কিছু মুখস্থ করা তার প্রয়োজন, ফিতরা দেয়ার জন্যে তাকে তা বিক্রয় করতেবলা যাবে না। এ ছাড়া তার মৌল প্রয়োজনের অথিরিক্ত যা থাকবে যা বিক্রয় করে ফিতরা দেয়ার জন্যে ব্যয় করা সম্ভব হবে, তা দিয়ে ফিতরা দেয়া ওয়াজিব হবে। কেননা তার আসল প্রয়োজন পূণকে কোনরূপ ক্ষতিগ্রস্ত না করেই তা দেয়া সম্ভব। এটা ঠিক সে রকম যে, কারো কাছে তার নিজের খাদ্যের অতিরিক্ত থাকলে সে তা দেবে। [(আরবী***************)] দীর্ঘমেয়াদী ঋণ ফিতরা দেয়ার প্রতিবন্ধক নয় যে লোকের কাছে সাদকায়ে ফিতরা দেয়ার মত সম্পদ আছে, কিন্তু তার ওপর এতটা পরিমাণ ঋণের বোঝাও রয়েছে, তারও কর্তব্য হবে ফিতরা দেয়া। তবে ঋণ শোধের খুব বেশী তাকীদ ও চাপ থাকলে ভিন্ন কথা হবে। তখন তার ঋণ শোধ করাই উচিত হবে, ফিতরা দিতে হবে না। ইবনে কুদামাহ বলেছেন, ঋণ ফিতরা দেয়ার প্রতিবন্ধক নয়, যদিও তা প্রতিবন্ধক মালের যাকাত দেয়ার, কেননা ফিতরার ওয়াজিব হওয়াটা খুব বেশী তাগিদপূর্ণ। তার বড় প্রমাণ তা গরীব মানুষের ওপরও ওয়াজিব এবং দিতে পারে এমন প্রত্যেক মুসলিম ব্যক্তির ওপরই তা ধার্য। এমন কি যার যাবতীয় ব্যয়ভার অন্য কেউ বহন করে তার পক্ষ থেকেও তা দেয়া ওয়াজিব। কোন বিশেষ পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়া শর্তও নয় এখানে। অতএব তা সাধারণ ব্যয়ের মধ্যে গণ্য। আরও এজন্যে যে, মালের যাকাত ফরয হয় মালিকানার কারণে। ঋণ তো এই মালিকানাকে প্রভাবিত করে ফিতরা ওয়াজিব হয় ব্যক্তির দেহের ওপর, ঋণ তার ওপর কোন প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। তবে ঋণের দাবি যদি খুব তীব্র ও তাৎক্ষণিক হয়, তা হলে ফিতরা প্রত্যাহৃত হবে। কেননা ঋণ ফেরত চাইলে তা আদয় করো ওয়াজিব হয়ে পড়ে। আর তা বিশেষ এক নির্দিষ্ট ব্যক্তির পাওনা, কারোর অসচ্ছলতা বা দারিদ্র্য তা প্রত্যাহৃত হয় না। আর তা কার্যকারণের দিক দিয়ে অগ্রবর্তী, ওয়াজিব হওয়ার দিক দিয়েও তার গুরুত্ব সর্বাধিক। তা দিতে বিলম্ব করলে গুনাহগার হতে হবে। অতএব তা ফিতরা ছাড়া আর সবকিছুই প্রত্যাহার করে- যদি তার তাগাদা করা নাও হয়। কেননা ঋণের তাগাদা আদায়ের বাধ্যবাধকতা আরোপ করে এবং বিলম্ব করা হারাম হয়ে যায়। [(আরবী***************)] তৃতীয় পরিচ্ছেদ ওয়াজিব ফিতরার পরিমাণ এবং কি থেকে দিতে হবে হযরত ইবনে উমর (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেনঃ রমযানের ফিতরের যাকাত হিসেবে রাসূলে করীম (স) এক ছা’ খেজুর অথবা এক ছা’ গম ধার্য করেছেন। হাদীসটি বহু কয়খানি গ্রন্থে উদ্ধৃত হয়েছে। আবূ সায়ীদ খুদরী (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেনঃ আমরা রাসূলে করীম (স) এর জীবদ্দশায় ফিতরের যাকাত বাবদ এক ছা’ খাদ্য অথবা এক ছা’ খেজুর কিংবা এক ছা’ কিশমিশ অথবা এক ছা’ পনির দিতাম। আমরা এভাবেই দিয়ে আসছিলাম। শেষে একবার মুয়াবীয়া মদীনায় আগমন করেন এবং বলেনঃ আমি দেখেছি, সিরিয়ার লোকেরা দুই মদ্দকে এক ছা’ খেজুর দ্বারা বদল করে। পরে লোকেরা তাই গ্রহণ করল। হাদীসটি কয়েকজন গ্রন্থ প্রণেতা উদ্ধৃত করেছেন। বুখারী ছাড়া অন্যরা একটু বাড়তি বর্ণনা দিয়েছে। তা হচ্ছে আবূ সায়ীদ বলেছেনঃ অতপর আমি সব সময় সেই পূর্বের মতই দিয়ে যাচ্ছিলাম। উপরিউক্ত হাদীসদ্বয় প্রমাণ করছে যে, ফিতরের যাকাত বাবদ সর্বপ্রকার জিনিস থেকে এক ছা’ পরিমাণ দেয়। শাহ দিহলভী লিখেছেন- এক ছা’ পরিমাণ নির্ধারণ করার কারণ হচ্ছে, এ পরিমাণ খাদ্য ঘরের লোকদের পরিতৃপ্তি দিতে পারে। এতে এত খাদ্য থাকে যা যথেষ্ট এবং গরীবরা সে পরিমাণ খাদ্যে অভ্যস্ত। আর দাতাদের পক্ষেও এ পরিমাণ খাদ্য দান করলে সাধারণত করোর কোন ক্ষতি হয় না। [(আরবী***************)] গম ও কিশমিশ ছাড়া অন্য জিনিসের বেলায় এক ছা’ পরিমাণ দেয়া ইজমার ভিত্তিতে ওয়াজিব। আর তিনজন ইমামের মতেও সে অন্য জিনিসের ক্ষেত্রে এক ছা’ পরিমাণ ওয়াজিব। আবূ সায়ীদ খুদরী, আবূল আলীয়া, আবূশ শা’মা, হাসানুল বসরী, জাবির ইবনে জায়দ, ইসহাক, আল-হাদী, আল-কাসেম, আন-নাসের ও আল-সুয়াইয়্যাদ বিল্লাহ প্রমুখেরও এ মত- শাওকানী এ কথাই লিখেছেন। [(আরবী***************) এ গ্রন্থে লিখিত হয়েছেঃ আলী ইবনে আব্বাস ও শাবী থেকে বিভিন্ন কথার বর্ণনা পাওয়া গেছে। কোনটিতে এক ছা’ আবার কোনটিতে অর্ধ ছা’। ইবনে হাজম আবূ সায়ীদ থেকে এমন বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন, যা এক ছা’ ওয়াজিব হওয়ার সুপরিচিত মতের বিপরীত। এটা খুবই বিস্ময়কর। (আরবী**********)] অর্ধ ছা’ গম দেয়ার কথা যাঁরা বলেছেন, তাঁদের মত আবূ হানীফা এবং তার সঙ্গীরা বলেছেনঃ অর্থ ছা’ পরিমাণ গম যথেষ্ট। তবে কিশমিশ তাঁর থেকে বিভিন্ন মতের বর্ণনা এসেছে। [আবূ ইউসূফ ও মুহাম্মাদ কিশমিশকে খেজুরের মতই মনে করেছেন। এটা ইমাম আবূ হানীফা থেকেও বর্ণিত। কোন কোন হানাফী আলিম এ বর্ণনাকে সহীহ বলেছেন। ইবনুল হুম্মাম ফাতহুল কাদীর গ্রন্থে দলিলের দিক দিয়ে উক্ত মতকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। আর সররুল মুখতার গ্রন্থে বহু কয়জনকে বক্তব্য উদ্ধৃত রয়েছে যে, এ মতের ওপর ফতোয়া হয়েছে। (আরবী*********)] এটা জায়দ ইবনে আলী ও ইমাম ইয়াহইয়ার মাযহাব- যেমন শাওকানী বলেছেন।[(আরবী***************)] ইবনে হাজম বলেছেন, উমর ইবনে আবদুল আজিজ, তায়ূস, মুজাহিদ, সায়ীদ ইবনুল মুসাইয়্যিব, ওরওয়া ইবনুজ জুবাইর, আবূ সালামাতা ইবনে আবদুর রহমান ইবনে আউফ, সায়ীদ ইবনে জুবাইর প্রমুখ থেকেও সহীহ বর্ণনা পাওয়া গেছে এ মতের সমর্থনে। আওজায়ী, লাইস ও সূফিয়ান সাওরীর কথাও তাই। যেমন ইবনে হাযম বহু সংখ্যক সাহাবী থেকে উপরিউক্ত মতের সমর্থনে বহু কয়টি বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন। তাঁদের মধ্যে আবূ বকর, উমর, উসমান, আলী, আয়েশা, আসমা বিনতে আবূ বকর, আবূ হুরায়রা, জারির ইবনে আবদুল্লাহ, ইবনে মাসউদ, ইবনে আব্বাস, ইবনুজ জুবাইর, আবূ সায়ীদ খুদরী প্রমুখ উল্লেখ্য। তবে আবূ বকর ইবনে আব্বাস ও ইবনে মাসউদ ছাড়া আর সকল থেকেই উক্ত মত সহীহ প্রমাণিত হয়েছে। [(আরবী*******) এবং দেখুন (আরবী*********)] এক ছা’ পরিমাণ ওয়াজিব যাঁরা বলেছেন, তাঁদের দলিল জমহুর ফিকাহবিদদের দলিল হচ্ছে আবূ সায়ীদ বর্ণিত হাদীস। তার কথায় এক ছা’ খাদ্য কিংবা এক ছা’ খেজুর কিংবা এক ছা’ গম অথবা এক ছা’ কিশমিশি বা এক ছা’ পনির। নববী বলেছেন, দুটি দিক দিয়ে তা প্রমাণ করেঃ একটি হিজাজবাসীদের পরিভাষায় খাদ্য বলতে বিশেষভাবে গম বোঝায়। তার সঙ্গে রয়েছে অন্যান্য উল্লিখিত জিনিস। এবং দ্বিতীয় হচ্ছে, হাদীসে বিভিন্ন জিনিসের উল্লেখ রয়েছে। সেগুলোর মুল্য বিভিন্ন অথচ প্রত্যেক প্রকারের খাদ্য থেকে এক ছা’ পরিমাণ ধার্য করা হয়েছে। তাতে বোঝা দেল ছা’ ই আসলে গণ্য, মূল্যের প্রতি কোন নজর নেই। [(আরবী***********)] বলেছেন, তাঁদের কাছে কোন প্রমাণ নেই শুধু হযরত মুয়াবিয়ার হাদীস ছাড়। আর কায়েকটি হাদীসও অবশ্য রয়েছে, কিন্তু হাদীস পারদর্শীরা সেগুলোরক যয়ীফ বলেছেন। এ গুলোর দুর্বল হওয়াটা প্রকট ও অকাট্য। [(আরবী***************)] জমহুর ফিকাহবিদগণ হযরত মুয়াবিয়া হাদীসের জবাব দিয়েছেন। বলেছেন, তা একজন সাহাবীর উক্তিমাত্র আবূ সায়ীদ ও অন্যান্য যে সব সাহাবী (রা) রাসূলে করীম (স) সংস্পর্শ তাঁর চাইতে বেশী দিন পেয়েছেন, তাঁরা তাঁর এ কথার বিরোধিতা করেছেন। তাঁরা রাসূলে করীম (স) সম্পর্কে জানেনও বেশী। আর একটি নীতি হচ্ছে, সাহাবিগণের মত বিভিন্ন হলে তাঁরা কেউ অন্যদের তুলনায় উত্তম বিবেচিত হবেন না। এমতাবস্থায় অন্য দলিল সন্ধান করা আবশ্যক। তাঁরা বলেছেন” বহু হাদীস ও কিয়াস অন্যান্য জিনিসের মতো গমেরও এক ছা’ হওয়ার শর্তকরণে ঐক্যবদ্ধ, অতএব তার ওপর নির্ভর করতে হবে। মুয়াবিয়া (রা) তো স্পষ্ট করে বলেছেন যে, তিনি যা বলেছেন, তা তাঁর একটা মত- একটা বিবেচনা মাত্র। তিনি তা নবী করীম (স) এর কাছ থেকে শ্রবণ করেছেন, এমন কথা তিনি বলেন নি। তাঁর উক্ত মজলিসে বহু লোক উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও একজনও যদি জানতেন যে, মুয়াবিয়ার কথা রাসূলে (স) এর সুন্নাতের সাথে সামঞ্জস্যশীল, তাহলে তিনি তার উল্লেখ করতেন। অন্যান্য সব ব্যাপারেও তেমনটাই হয়েছে। [(আরবী**************)] রায় এবং ইজতিহাদ উভয়ই শরীয়াতসম্মত। মুয়াবিয়া ও অন্যান্য সাহাবী (রা) এর অনুসৃত নিয়মাবলী থেকে তা প্রমাণিত হয়, কিন্তু যে বিষয়ে অকাট্য সম্পদ দলিল পাওয়া যাবে সেখানে তা অগ্রহণীয়। [(আরবী**************)] অর্থ ছা’ যথেষ্ট বলার সমর্থনে আবূ হানীফার দলিল ইমাম আবূ হানীফা ও তাঁর মতের লোকদের দলিল হচ্ছেঃ প্রথম আবদুল্লাহ ইবনে সালাবাতা অথবা সালাবাতা ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে সূয়াইর বর্ণিত ও আবূ দাউদ উদ্ধৃত হাদীস। তার কথাঃ রাসূলে করীম (স) বলেছেনঃ ফিতরের সাদকা হচ্ছে এক ছা’ গম (বা আরবী*******) প্রত্যেক দুইজনের পক্ষ থেকে। [আবূ দাউদ হাদীসের ভাষা ও সূত্র দেখা যেতে পারে। (আরবী********) এবং (আরবী*******) এ প্রসঙ্গে ইবনে হাজমের বক্তব্যঃ (আরবী**************)] আর হাকেম ইবনে আব্বাস (রা) থেকে রাসূলে করীম (স) একথা উদ্ধৃত করেছেনঃ (আরবী****************) সাদকায়ে ফিতরের পরিমাণ হচ্ছে দুই মদ্দ গম। আর আমরা জানি দুই মদ্দ অর্থ অর্ধ ছা’। অনুরূপভাবে তিরমিযী আমর ইবনে শূয়াইব তার পিতা তার দাদা সূত্রে রাসূলের কথা হিসেবে এবং আবূ দাউদ ও নাসায়ী হাসান থেকে মুরসাল হিসেবে হাদীস উদ্ধৃত করেছেনঃ রাসূলে করীম (স) এ সাদকা নির্ধারণ করেছে, এক ছা’ খেজুর কিংবা গম অথবা অর্ধ ছা’ গম (আরবী**********)। [দেখুন (আরবী**************)] এভাবে আরও বহু কয়টি হাদীস উদ্ধৃত হয়েছে, যার সমষ্টি প্রমাণ করে যে, এক ছা’ পরিমাণটাই বিশেষভাবে নির্দিষ্ট। শাওকানী তাই বলেছেন এ কথা মনে নিয়ে যে, যে খাদ্য কথাটি সহীহ বর্ণানায় উদ্ধৃত হয়েছে তার মধ্যে بر (গম) ও শামিল। [(আরবী************)] দ্বিতীয়, বহু সংখ্যক সাহাবী থেকে সহীহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছেঃ তাঁরা অর্ধ ছা’ গম দিতে দেখেছেন। সুফিয়ান সওরী তাঁর জামে গ্রন্থে হযরত আলী (রা) এর কথা হিসেবে উদ্ধৃত করেছেনঃ অর্ধ ছা’ গম। চারজন খলীফা থেকেও অনুরূপ বর্ণনা এসেছে। [(আরবী************)] এসব সাহাবীর উক্তির ওপর আল-মুনযেরী নির্ভর করে বলেছেনঃ গম সম্পর্কে কোন কথা নবী করীম (স) থেকে নির্ভরযোগ্য সূত্রে প্রমাণিত হয়েছে বলে আমরা জানি না। [হাকেম এক ছা’ গম পর্যায়ে যে সব হাদীস উদ্ধৃত (১ম খণ্ড ৪১০-৪১১পৃ.) করেছেন, যার সব কয়টিকে সহীহ বলেছেন- যাহবী তন্মধ্যে দুটিকে স্বীকার করে নিয়েছেন – তা পানি ঘোলা করেছ। এ দুটির একটি সায়ীদ জুমহী ইবনে উমর সুত্রে বর্ণিতা। কিন্তু বায়হাকী বলেছেনঃ এতে গম এর উল্লেখ সুরক্ষিতভাবে হয়নি। (৪র্থ খণ্ড-১৬৬ পৃ.) অতএব তা দলিল হতে পারে না। আর দ্বিতীয় হাদীসটিকে হাকেমের মতই ইবনে খুজায়মাও তাঁর সহীহ গ্রন্থে উদ্ধৃত করেছেন ইবনে ইসহাক, আবদুল্লাহ ইবনে উসমান ইবনে হুকাইম, ইয়াজ ইবনে আবদুল্লাহ সুত্রে। আবূ সায়ীদ বলেছেনঃ লোকেরা তাঁর কাছে রমযানের সাদকার উল্লেখ করলে তিনি বলেলেনঃ আমি তো তাই দেই যা রাসূলে করীম (স) এর যগে দিতাম- এক ছা’ খেজুর কিংবা এক ছা’ গম বা এক ছা’ আটা অথবা এক ছা’ পনির। তখন একজন লোক বললোঃ দুই মদ্দ গম? বললেনঃ না ওটা তো মুয়াবিয়ার মূল্যায়ন। আমি তা গ্রহণ করি না। তদনুযায়ী আমলও করি না। কিন্তু ইবনে খুজায়মা বলেছেনঃ আবূ সায়ীদের কথায় গম বা আটার উল্লেখ ভুলবশত হয়েছে। কেননা আবূ সায়ীদ যদি বলেই থাকতেন যে, তাঁর কথাঃ একজন লোক বলল, থেকে বুঝা যায় যে, কাহিনীর শুরুতে গমের উল্লেখ সুরক্ষিত নয়। ভুলটা কার আমি জানিনা। তাঁরা রসূল (স) এর যগে এক ছা’ গম দিতেন, তাহলে লোকটি তাঁকে নিশ্চয়ই জিজ্ঞেস করত নাঃ দুই মদ্দ গম? আবূ দাউদ ইবনে ইসহাকের এ বর্ণনাটির দিকে ইঙ্গিত করেছেন এবং বলেছেন, তাতে গমের উল্লেখ সুরক্ষিত হয়। ফতহুল বারী থেকে উদ্ধৃত ২য় খণ্ড ৩৭৩ পৃ. ইবনে হাজম এ হাদীসটি তাঁর المحلى গ্রন্থে (৬ষ্ঠ খণ্ড- ১৩০) উদ্ধৃত করেছেন ইবনে ইসহাকের সূত্রে। কিন্তু তাতে এক ছা’ গমের উল্লেখ নেই। সে দলিলের ভিত্তিতে বলেছেন যে, আবূ সায়ীদ গম দিতে মোটামুটি নিষেধ করেন। কিন্তু আল্লামা শায়খ আহমাদ শাকের দারে কুতনী উদ্ধৃত (২২২) বর্ণনা এনে তার বিরোধিতা করেছেন। হাকিম আল-মুস্তাদারক (১ম খণ্ড ৪১১ পৃ.) গ্রন্থে যে বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন, সেটিকে আমরা এখানে উদ্ধৃত করেছি। তাতে এটুকু কথা অতিরিক্ত রয়েছেঃ অথবা এক ছা’ গম। বলেছেনঃ এটা বর্ণনাকারীদের পার্থক্য। কেউ একটার উল্লেখ করেন অথবা অন্যটার উল্লেখ করেন। আসলে সবেই সহীহ। সিকাহ বর্ণনাকারী কিছু বাড়তি বললে তা গ্রহণীয়। উক্ত শায়খ ইবনে খুজায়মা ও আবূ দাউদের ও বাড়তি অংশ সম্পর্কে যে কথা বলেছেন, তা জানতে পরেননি। ফতহুল বারী তা উদ্ধৃত করেছে। হ্যাঁ সিকাহ বর্ণনাকারীর বাড়তি কথা গ্রহণীয় হয় যদি তাঁর চাইতেও অধিক সিকাহ বর্ণনাকারী তার বিরোধিতা না করেন অথবা অথবা কালামে এমন কিছু না থাকে যা তার ভ্রান্তি বোঝায়। আবূ সায়ীদ প্রমুখ থেকে বহু সংখ্যক হাদীস এসেছে, যা প্রমাণ করে যে, সেকাল গম তাঁদের খাদ্য ছিল না। তার কিছু কিছু পরে উল্লেখ করব। তবে যে ইবনে ইসহাক থেকে বর্ণনা এসেছে তিনি সমালোচকদের দৃষ্টিতে تدليس করেন বলে খ্যাত – যদি হাদীস স্পষ্ট ভাষায় না বলেন। এখানে عن-عن ধারায় বর্ণনা এসেছে, মুস্তাদরাক গ্রন্থে তাই আছে। এ সবকিছু প্রমাণ করে যে,হাদীসকে সহীহ বলেছেন এবং যাহরী তা মেনে নিয়েছে, তা আসলে ভ্রান্তি। ফল কথা, ইমাম ইবনুল মুনযির নবী করীম (স) থেকে গম সম্পর্কিত কথা নির্ভরযোগ্য সূত্রে পাওয়া যায়নি বলে যে দৃঢ়তা প্রকাশ করেছেন, তা যথার্থ, তাতে আপত্তির কিছু নেই। হাফেজ বায়হাকীরও তাঁর সুনান গ্রন্থে (৪র্থ খণ্ড ১৭০ পৃ.) তাই বলেছেন। এক ছা’ গম পর্যায়ে হাদীস রাসূলে করীম (স) থেকে এসেছে। আর অর্ধ ছা’ পর্যায়ের হাদীস বটে; কিন্তু তা কোনটিই সহীহ নয়। তার কারণ خلافيات এ বলা হয়েছে। আবূ সায়ীদ খুদরীর হাদীস এবং ইবনে উমর থেকে প্রমাণিত হাদীসে আমাদের দেখানো হয়েছে যে, এক ছা’ গম দুই মদ্দে অর্ধ ছা’- বিনিময় হওয়ার ঘটনা রাসূলে করীম (স) এর পরে সংঘটিত।] আর তখনকার সময়ে মদীনায় গম ছিল অত্যন্ত সহজলভ্য (قمح অপেক্ষা)। সাহাবীদের সময় যখন তা বিপুল হয়, তখন তাঁরা দেখলেন যে, অর্ধ ছা’ بر (ময়দা) এক ছা’ شعير (উন্নতমানের গম) সমান হয়। আর তাঁরাই তখন নেতৃবৃন্দ। অতএব তাঁদের কথা বাদ দেয়া যেতে পারে কেবল তখণ যখন তাঁদেরই মত লোকদের কথা গ্রহণ করা হবে। পরে ইবনুল মুনযির হযরত উসমান, আলী, আবূ হুরায়রা, জাবির, ইবনে আব্বাস, ইবনুজজুবাইর – তাঁর মা আসমা বিনতে আবূ বকর (রা) থেকে সহীহ সনদে উদ্ধৃত করেছেন – যেমন ইবনে হাজার লিখেছেনঃ “তাঁরা মনে করেন, ফিতরের যাকাত হচ্ছে অর্থ ছা’ قمح (গম)। এ কথার পরিণতিই হচ্ছে ইমাম আবূ হানীফার মত। কিন্তু আবূ সায়ীদ (রা) বর্ণিত হাদীস প্রমাণ করেযে, তিনি সেই কথা সমর্থন করেন নি। ইবনে উমর (রা) ও তাই। অতএব এক্ষেত্রে কোন ইজমা হয় নি বলেই মনে করতে হবে যদিও তাহাভী ভিন্ন মত পোষণ করেন। [(আরবী************)] হানাফী মতের লোকেরা বলেছেন, আবূ সায়ীদ খুদরী বর্ণিত হাদীসে ওয়াজিব হওয়ার কোন দলিল নেই। সেটা এ কাজের বর্ণনামাত্র। অতএব তা জায়েযমাত্র। আমরাও তাই বলি। তাহলে ওয়াজিব পরিমাণ হল অর্থ ছা’। আর বেশী দিলে তা হবে নফল দান। [(আরবী************)] আবূ সায়ীদ বর্ণিত হাদীসে طعام বা খাদ্য বলতে حنطه বা গমই বোঝায় বলে বলা হয়েছে, তা সমর্থনযোগ্য নয়। ইবনুল মুনযির বলেছেনঃ আমাদের কেউ কেউ ধারণা করেছেন- আবূ সায়ীদ বর্ণিত হাদীসে ساعامن طعام এক ছা’ পরিমাণ খাদ্য তাঁদের পক্ষের দলিল, যারা এক ছা পরিমাণ গম ফিতরা দেয়ার মত পোষণ করেন। কিন্তু এটা ভুল। কেননা আবূ সায়ীদ সংক্ষেপে খাদ্য এর উল্লেখ করেছেন। পরে তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন।...... পরে হাফস ইবনে মাইমারাতা সূত্রে বুখারী প্রমুখ উদ্ধৃত হাদীস তুলেছেন এই মর্মে যে, আবূ সায়ীদ বলেছেনঃ আমরা রাসূলে করীম (সা) এর সময়ে ঈদের দিনে এক ছা পরিমাণ খাদ্য ফিতরা বাবদ প্রদান করতাম। আবূ সায়ীদই বলেছেনঃ তখন আমাদের খাদ্য ছিল গম, কিশমিশ পনির ও খেজুর। পূর্ব কথার একটা ব্যাখ্যা। তাহাভী প্রমুখ অন্য সূত্রে অনুরূপ বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন। তাতে এ কথাটুকুও রয়েছেঃ আমরা তা ছাড়া আর কিছু দিতাম না। [(আরবী************)] বরং ইবনে খুজায়মা তাঁর সহীহ গ্রন্থে ইবনে উমর (রা) থেকে বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন। তিনি বলেছেনঃ রাসূলে করীম (স) এর সময়ে খেজুর, কিশমিশ ও গম ছাড়া আর কিছু দিয়ে সাদকায়ে ফিতর আদায় করা হতো না। حنطه তখন প্রচলিত ছিল না। মুসলিম শরীফে অপর এক সূত্রে আবূ সায়ীদ থেকে বর্ণনা উদ্ধৃত হয়েছে। তিনি বলেছেনঃ আমরা তিন প্রকারের জিনিস দিয়ে ফিতরা দিতাম- একছা খেজুর অথবা এক ছা’ পনির, অথবা এক ছা’ গম। এ বর্ণনাটিতে কিশমিশ সম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি- অপর তিনটির তুলনায় তার প্রচলন কম বলে। ইবনুল হাজার বলেছেনঃ এসব কয়টি সূত্রই প্রমাণ করে যে, আবূ সায়ীদের বর্ণনায় যে, খাদ্যের উল্লেখ হয়েছে, তা حنطه ছাড়া অন্য কিছু। হতে পারে তা ذره হবে। কেননা তা হিজাজবাসীদের কাছে এখন পর্যন্ত পরিচিত এবং তা তাদের প্রধান খাদ্য। জাওজাকী ইবনে আজলান-ইয়াজ সূত্রে আবূ সায়ীদের হাদীসেই এ অংশটুকু বর্ণিত আছেঃ এক ছা খেজুর এক ছা রুটি অথবা ذره। [দেখুন- (আরবী*************)] পর্যালোচনা ও অগ্রাধিকার দান উপরিউদ্ধৃত সমস্ত হাদীস একত্রিত করলে সুস্পষ্ট হয়ে উঠে যে, গম قمح তাদের খুব সাধারণ খাদ্যের মধ্যে শামিল ছিল না রাসূলে করীমের সময়ে। আর নবী করীম (স) ও তার এক ছা ধার্য করেন নি, যেমন গম ও খেজুর এবং কিশমিশ ও পনির থেকে ধার্য করেছেন। বুখারী ও মুসলিম গ্রন্থদ্বয়ে আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা) থেকে যে বর্ণনাটি উদ্ধুত হয়েছে, তা উপরিউক্ত কথাকে বলিষ্ঠ করে। তিনি বলেছেনঃ রাসূলে করীম (স) ফিতরের যাকাত বাবদ দেবার আদেশ করেছেন এক ছা’ খেজুর বা এক ছা গম। বলেছেন, পরে লোকেরা তার বদলে দুই মদ্দ (গম) দিতে শুরু করে। অপর বর্ণনায় রয়েছেঃ পরে লোকেরা তার বদলে অর্থ ছা’ ময়দা দিতে শুরু করল। [(আরবী*************)] ইবনুল কাইয়্যেম বলেছেনঃ এটা সুপরিচিত ও জ্ঞাত যে, উমর ইবনুল খাত্তাব এক ছা’ এর পরিবর্তে অর্থ ছা’ মায়দার প্রচলন করলেন। আবূ দাউদ এ কথাটি উদ্ধৃত করেছেন। [ইবনে হাজার বলেছেনঃ ইবনে উমর লোকেরা বলে মুয়াবিয়া ও তাঁর অনুসারীদের বুঝিয়েছেন। নাফে’ থেকে বর্ণিত আইউবের হাদীসে একথা স্পষ্ট ভাষায় উদ্ধৃত হয়েছে। হুমাইদী তাঁর মুসনাদে সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা সুত্রে উদ্ধৃত করেছেন। তাতে বলেছেনঃ ইবনে উমর বলেছেন, পরে মুয়াবিয়ার সময়ে লোকেরা এক ছা’ গমের বদলে অর্ধ ছা’ ময়দা দিতে শুরু করল। ইবনে খুজায়মা তাঁর সহীহ গ্রন্থে এরূপ উদ্ধৃত করেছেন। অপর এক সূত্রে- তা সূফিয়ান এবং নির্ভরযোগ্য। তা আবূ সায়ীদের কথার সমর্থন এবং তার চাইতেও সুস্পষ্ট। ইবনুল কাইয়্যেম আবূ দাউদের যে বর্ণনার দিকে ইঙ্গিত করেছেন, ইবনে হাজার তার উল্লেখ করেছেন। তা হচ্ছে মুসলিম (আরবী*********) বর্ণনাকরীর বিভ্রান্তী হওয়ার কথা বলেছেন। তিনি তার রদ্দ করেছেন স্পষ্টভাবে দেখুন (আরবী*************)] বুখারী মুসলিমে উদ্ধৃত, মুয়াবিয়াই তা চালু করেছেন। তাতে নবী করীম (স) থেকে বহু মুরসাল আসার উপস্থাপিত হয়েছে যা সনদযুক্ত এবং পরস্পর দ্বারা শক্তিশালী। [(আরবী*************)] ইবনুল কাইয়্যেম ইবনে আবূ চায়াইর প্রমুখের হাদীস উল্লেখ করেছেন এবং হাসান বসরীর হাদীসও। বলেছেনঃ ইবনে আব্বাস বসরার মসজিদের মিম্বরের ওপর দাঁড়িয়ে রমজানের শেষে ভাষণ দিলেন। বললেন, তোমরা তোমাদের রোযার সাদকা প্রদান কর। কিন্তু লোকেরা তা জানতে (বা বুঝাতে পারল না)। পরে বললেনঃ এখানে মদীনার কোন লোক আছে কি? তোমরা ওঠ, তোমাদের ভাইদের কাছে চলে যাও এবং তাদের শিক্ষা দান কর। কেননা তারা জানেনা। রাসূলে করীম (স) এ ফিতরা সাদকা বাবদ এক ছা’ খেজুর বা গম অথবা অর্থ ছা’ (আরবী********) ধার্য করেছেন প্রত্যেক মুক্ত বা দাস, পুরুষ বা মহিলা, ছোট বা বড় সকলের ওপরে........ পরে হযরত আলী যখন এলেন এবং তিনি জিনিসপত্রের সস্তা মূল্য দেখলেন। তখন বললেনঃ আল্লাহ তোমাদের প্রতি প্রশস্ততা এনে দিয়েছেন। এখন তোমরা যদি তার জন্যে প্রত্যেক জিনিসের এক ছা’ পরিমাণ চালু করতে (তাহলে কতোই না ভালো হত)- আবু দাউদ বর্ণনাটি উদ্ধৃত করেছেন। উপরে তাঁরই বক্তব্য। নাসাইও উদ্ধৃত করেছেন।[নাসায়ী বলেছেনঃ হাসান ইবনে আব্বাস থেকে শুনতে পাননি। অনুরূপ বলেছেন আহমাদ ইবনুল মদীনী প্রমুখ ইমামগণ। এ দৃষ্টিতে হাদীসটি (আরবী******) তাঁরা এরূপ বলেছেন, এজন্যে ইবনে আব্বাস হযরত আলীর সময়ে বাসরায় অবস্থান করতেন। আর হাসান আলী ও উসমান উভয় আমলে মদীনায় রয়েছেন। শায়খ আহমাদ শাকের এ কথার সমালোচনা করে বলেছেনঃ এসব বিভ্রান্তি ছাড়া কিছুই নয়। কেননা হাসান ইবনে আব্বাসের সময় অবশ্যই বেঁচে ছিলেন। তিনি মদীনায় ছিলেন সে দিনগুলোতে যখন ইবনে আব্বাস বসরাতে শাসনকর্তা ছিলেন। কাজেই এ সময়ের পূর্বে ও পরে তাঁর নিকট হাদীস শোনা হাসানের পক্ষে অসম্ভব কিছু ছিল না। হাদীসে পারদর্শীগণ শুধু সমসাময়িকতার ভিত্তিকেও যথেষ্ট মনে করেছেন। পরে তার কাছ থেকে হাদীস শোনা এবং তাঁর সাথে সাক্ষাত নিশ্চিত প্রমাণ করে আহমাদ কর্তৃক তাঁর মুসনাদে সহীহ সনদে উদ্ধৃত হাদীস (৩১২৬)। তা ইবনে সিরীন থেকে বর্ণিতঃ একটি জানাজা হাসান ও ইবনে আব্বাসের সম্মখ দিয়ে চলে গেল। তা দেখে হাসান দাঁড়িয়ে গেল, কিন্তু ইবনে আব্বাস দাঁড়ালেন না। তখন হাসান ইবনে আব্বাসকে বললেনঃ রাসূলে করীম (স) তো জানাযা দেখলে দাঁড়াতেন? ইবনে আব্বাস বললেনঃ হ্যাঁ দাঁড়িয়েছেন, বসেও রয়েছেন? সাক্ষাত এবং শ্রবন প্রমাণকারী এ চাইতে বড় দলিল আর কি হতে পারে..... (আরবী*************) দেখুনঃ আমি বলব, শুধু এক সময়ের লোক হলেই বসরার মিম্বরে দেয়া একটা ভাষণ শোণবার জন্যে যথেষ্ট প্রমাণ নয়। এটা এমন সময়ের ব্যাপার, যখন হাসান নিশ্চই বসরাতে ছিলেন না। তা হলে তিনি সাক্ষাতে শুনতে পাওয়া কোন লোকরে মাধ্যমে উদ্ধৃত করেছেন। হাদীসের ক্ষেত্রে সমসাময়িকতা যথেষ্ট হয় যদি তাতে কোন স্থান বা সময়ের বিশেষভাবে উল্লেখ না থাকে। অবশ্য এটা বলা যেতে পারে যে, এ ধরনের ভাষণ অবশ্যই বসরাবাসীদের কাছে সুপরিচিত ছিল। হাসানের তা ইবনে আব্বাস থেকে সরাসরি শোনা জরুরী ছিল না। মুয়ায থেকে তায়ুমের বর্ণনা প্রসঙ্গে হাদীসবিদগণ এ কথাই বলেছেন। কেননা তায়ুম মুয়ায সম্পর্কিত যাবতীয় বিষয়ে অবহিত, তবে সাক্ষাত হয়নি। ইবনে আব্বাসের এ ভাষনে এক ছা’ খাদ্য উদ্ধুত ছিল। দেখুনঃ (আরবী*************)] তাতে আছেঃ অতপর আলী (রা) বলেছেনঃ আল্লাহই যখন তোমাদের জন্যে প্রশস্ততা এনে দিয়েছেন, তখন তোমরা উদরতার সঙ্গে দিতে তাক- ময়দা ইত্যাদি থেকে এক ছা’ পরিমাণ দাও। ইবনুল কাইয়্যেম বলেছেনঃ আমাদের শায়খ ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রা) এ মতটিকেই শক্তিশালী মনে করতেন। বলতেনঃ আহ্মদ কাফ্ফারা পর্যায়ে যা বলেছেন, এটা তার ওপর কিয়াস। তিনি বলেছেনঃ সাদকায়ে ফিতর বাবদ যে পরিমাণ ময়দা ওয়াজিব, তা অন্য ক্ষেত্রে ওয়াজিব পরিমাণে অর্ধেক। [(আরবী**************)] উপরে উল্লিখিত সব কথা থেকে আমাদের সম্মুখে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, যেসব হাদীসে অর্ধ ছা’ গমের কথা এসেছে, তা প্রত্যাখ্যাণ করার মত যয়ীফ নয়। বিশেষ করে ইবনে আব্বাস থেকে হাসানের বর্ণনা যখন সহীহ প্রমাণিত। কিন্তু তা সাহাবীদের মধ্যে এতটা খ্যাত ও সহীহ ছিল না যে, খেজুর, গম, পনির, ও কিশমিশের এক ছা’ পরিমাণের মত অকট্যভাবে প্রমাণিত বলে মনে করা যেতে পারে। তা যদি সহীহ হতো, তা তাহলে ইবনে উমর, আবূ সায়ীদ, মুয়াবিয়া এবং যেসব সাহাবী ও তাবেয়ী তাঁর কথা শুনেছেন, তাদের মত লোকদের কাছে তা গোপন থাকতে পারত না। মুয়াবিয়ার কাজ তো স্পষ্ট। তিনি এক ছা’ পরিমাণ খেজুরের বিকল্প ঠিক করেছেন অর্ধ ছা’ গম قمح। এটা বিনিময়ে ও মূল্যের ভিত্তিতে করা হয়েছে। এ কারণে আবূ সায়ীদ বলেছেন, এটা মুয়াবিয়ার মূল্য নির্ধারণ- আমি গ্রহনও করি না, তদানুযায়ী আমলও করি না।’ [ইবনে খুজায়মা ও হাকেম নিজ নিজ গ্রন্থে হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন। ইবনে ইসহাকের সূত্রে ফতহুল বারী, গ্রন্থে তাই বলা হয়েছে (২য় খণ্ড- ৩৭৩ পৃ.) এবং দেখুন আল-মুস্তাদরাক- (১ম খণ্ড ط سلفيه- ৪১১ পৃ; আল মুহাল্লা ৬ষ্ঠ খণ্ড, ১৩০ পৃ, نصب الريه ২য় খণ্ড, ৪ ৭-৪১৮ পৃ;] অন্য সাহাবীগণও তাঁদের সময়ে গমের প্রাচুর্য দেখা দিলে এরূপই করতেন। তাঁরা মনে করেছেন, অর্ধ ছা’ قمح এক ছা’ গমের স্থলাভিসিক্ত হতে পারে। ইবনুল মুনযির যেমন বলেছেন। এসব বর্ণনার ওপরে ভিত্তি করে চিন্তা করলে মন আশ্বস্ত হয় এ কথায় যে, খেজুর, গম, কিশমিশি, পনির- এ চার প্রকারের খাদ্যবস্তুর ক্ষেত্রে এক ছা’ পরিমাণটা অকাট্য দলিল দ্বারা প্রমাণিত; কিন্তু সেই রকম দলীল দ্বারা এক ছা’ পরিমাণ قمح প্রমানিত হয়নি। এটা সত্যানুসন্ধানের ফলশ্রুতি। যেমন অর্ধ ছা’ সংক্রান্ত হাদীসমূহ সহীহ হওয়ার মানে পর্যন্ত পৌছায়নি। যে লোক অর্ধ ছা’ পরিমাণ ঠিক করেছেন- যেমন মুয়াবিয়া ও তাঁর সমর্থক সাহাবীগণ- এক ছা’ গম বা খেজুরের বিকল্প, তা তিনি করেছেন ইজতিহাদের সাহায্য। এ ইজতিহাদের ভিত্তি হচ্ছে এই যে, قمح ছাড়া অন্যান্য সবজিনিসের মূল্য সমান। قمح তখন খুব বেশী মূল্যে পাওয়া যেত। কিন্তু তাঁদের কথানুযায়ী প্রত্যেক যুগের ও প্রত্যেক জায়গার সাধারণ মূল্যকেই গণ্য করতে হবে। কিন্তু তাতে অবস্থা বিভিন্ন হয়ে যাবে, তা নিয়ন্ত্রিত ও সুবিন্যস্ত করা যাবে না। অনেক সময় কয়েক ছা’ قمح দেয়ার প্রয়োজনও হতে পারে। [(আরবী**************)] পাকিস্তান সফরকালে সেখানকার কোন কোন আলিম আমাকে বলেছেন, তাদের দেশে قمح এর মূল্য খেজুরের তুলনায় অনেক কম। তাহলে সেখানে খেজুরে যা ওয়াজিব পরিমাণ তার অর্ধেক দিয়ে ওয়াজিব কি করে আদায় করা যেতে পারে? কিশমিশের অবস্থাও অনরূপ। এ কালে বহু দেশেই قمح ও খেজুরের তুলনায় তার মূল্য অনেক গুণ বেশী। এ প্রেক্ষিত সমস্যার সমাধান কেবল তখনই হতে পারে, যদি এক ছা’ পরিমাণকে ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করা হয়। এই যা বললাম, সাহাবায়ে কিরাম (রা) মূল্যের প্রতি নজর দিতেন মূল্যের হিসাবটাই গণ্য করতেন, তা প্রমাণ হচ্ছে, হযরত আলী (রা) যখন বাসরাতে সস্তা মূল্য দেখতে পেলেন সব জিনিসের, তখন তিনি লোকদের বললেনঃ তোমরা গম ও অন্যান্য জিনিসের এক ছা’ পরিমাণই দিতে থাক। অতএব বোঝা গেল, হযরত আলী (রা) এ ব্যাপারে মূল্যের ওপর দৃষ্টি রেখেছিলেন। হাফেয ইবনে হাজার এ কথাই বলেছেন। [(আরবী**************)] এ পরিপ্রেক্ষিত অবশ্যই বাঞ্ছনীয় হচ্ছে, ব্যক্তির অথবা দেশের সাধারণ বা প্রধান খাদ্যের এক ছা’ পরিমাণকে ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করা। পরে এ বিষয়ে আলোচনা করা হবে। যদি قمح গম প্রধান খাদ্য হয়, এবং তা দিয়ে ফিতরা দেয়ার ইচ্ছা করা হয়, তাহলে তার অর্ধ ছা’ পরিমাণ দেয়া জায়েয হবে- যদি তার মূল্য স্থানীয় লোকদের প্রধান খাদ্যের এক ছা’ পরিমাণের মূল্যের সমান হয়। قمح গমের মূল্য প্রদানের ব্যাপারে সাহাবীদের যে ইজতিহাদের কথা পূর্বে বলা হয়েছে এটা তারই ভিত্তিতে হবে। তবে সর্বাবস্থায় এক ছা’ পরিমাণ দেয়াটাই সর্বাধিক সতর্কতামূলক নীতি। তাহলে মত বিরোধ থেকে বাচা যাবে এবং নিঃসন্দেহে প্রমাণিত দলিল মেনে চলা যাবে। এর ফলে মুসলিম ব্যক্তি সংশয় পূর্ণ ব্যাপার থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে সে কাজ করতে সক্ষম হবে, যাতে কোন রূপ সংশয় নেই। আর যাকে আল্লাহ প্রশস্ততা দান করেছেন, তার কর্তব্য সে প্রশস্ততা অনুযায়ী কাজ করা- যেমন হযরত আলী (রা) বলেছেন। এক ছা’ পরিমাণের বেশী দেয়া কি জায়েয আমার জন্যে এটা বিস্ময়কর যে, মালিকী মাযহাবের কোন কোন গ্রন্থে আমি এ কথা লিখিত দেখতে পাচ্ছি যে, ফিতরা দানকারীর জন্যে মুস্তাহাব নীতি হচ্ছে এক ছা’ পরিমাণের বেশী না দেয়া। বরং তার অধিক দেয়া মুকরূহ বলা হয়েছে। কেননা তাঁরা বলেছেন, শরীয়াত তো এ পরিমাণটাই সীমিত করে নির্ধারিত করে নিয়েছে। অতএব তার বেশী দেয়াটা যেমন বিদয়াত হবে, তেমনি মাকরূহ। যেমন তেত্রিশ বারের বেশী বার তাসবীহ- সুবহানাল্লাহ- পড়া। মাকরূহ ও বিদয়াত হবে যদি জেনে শুনে তা করা হয়। ভুলবশত করা হলে তা বিদয়াত বা মাকরূহ হবে না। [(আরবী*************)] আমি মনে করি, এ দৃষ্টান্ত বা নজীর দেখানো সমর্থনযোগ্য নয়। কেননা যাকাত বা সাদকা তো নামাযের ন্যায় নিছক ইবাদত পর্যায়ের কাজ নয়। আর যিকির- তাসবীহ ইত্যাদিতে ওয়াজিব পরিমাণের অধিক করায় কোন দোষ হওয়ার কথা নয়- বরং তা খুবই উত্তম ও পছন্দনীয়। যেমন কুরআন মজীদে বলা হয়েছেঃ (আরবী**************) যে লোক নফলস্বরূপ কোন কাজ করবে, তা তার জন্যে ভালো হবে। [(আরবী*************)] রোযার ফিতরার ব্যাপারে এ আয়াত খুবই প্রযোজ্য। কেননা তা হচ্ছে মিসকীনের খাদ্য। ইমাম আহমদ ও আবূ দাউদ উবাই ইবনে কায়াব (রা) থেকে উদ্ধৃত করেছেন, এক ব্যক্তির মালের যাকাতস্বরূপ একটা এক বছরে উপনীতা উষ্ট্রী ফরয হয়েছিল। কিন্তু সে তা যাকাত সংগ্রহকারীকে দিতে রাযী হল না। কেননা তা এখনো দুধওয়ালী হয়নি এবং বোঝা বহন ও সওয়ারী বহনেরও যোগ্য হয়নি। তখন তার পরিবর্তে মাটির টিবির মত উঁচু একটা উষ্ট্রী ছাড়া আর কিছু দিতে রাযী হল না। উবাইও রাযী হলেন না তা গ্রহণ করার জন্যে। কননা তা ফরয পরিমাণের অনেক বেশী অতিরিক্ত। তারা দুজনই নবী করীম (স) এ কাজে বিচার চাইলেন। তিনি তাকে বললেনঃ তোমার ওপর ফরয তো ঐটা। এক্ষণে তুমি যদি নফলস্বরূফ তা বেশি দিতে চাও তাহল আল্লাহ তোমাকে এর শুভ ফল দান করবেন। আমরা তোমার কাছ থেকে তা গ্রহণ করে নিলাম। পরে তিনি সেটি নিয়ে নেয়ার আদেশ দিলেন এবং তার মালে বরকত হওয়ার জন্যে তিনি দো’আ করলেন। [আহমদ, আবূ দাউদ ও হাকেম এ বর্ণনাটি নিজ নিজ গ্রন্থে উদ্ধৃত করেছেন, এটাকে সহীহ বলেছেন। যাহবী তা সমর্থন করেছেন। নবম অধ্যায়ে ৬ষ্ঠ পরিচ্ছেদে এর সম্পূর্ণ বর্ণনা উল্লেখ করা হবে।] ওয়াজিব পরিমাণের বেশিও যে গ্রহন করা যেতে পারে, উপরিউক্ত বর্ণনা তার অকট্য দলিল। তাতে বেশি সওয়াব পাওয়ারও ওয়াদা রয়েছে, তাতে কোন অসন্তুষ্টিরও লক্ষণ নেই। হযরত আলী (রা) বলেছেনঃ আল্লাহই যখন তোমাদের প্রতি প্রশস্ততা দেন তখন তোমরাও তদানুযায়ী দান কর প্রশস্ততা সহকারে। তবে বেশি দান করে নফল ইবাদত করা যদি বিদয়াত প্রমিণিত হয়, তাহলে তো সম্পুর্ণ হারাম হতো শুধু মাকরূহ নয়। কেননা বিদায়াতমাত্রই গুমরাহী। হ্যাঁ, শুধু বাড়াবাড়ি, দেখানোপানা ও সূক্ষ্মতা অবলম্বনসরূপ- দানে উদারতা ও নফলস্বরূপ নয়- এক ছা’ পরিমাণের বেশি যে দেবে তাকে বলা যেতে পারে সে বিদায়াত করেছে আর সহীহ হাদীসে বলা হয়েছেঃ বাড়াবাড়িকারীরা ধ্বংস হোক। [আহমাদ, মুসলিম] এক ছা’ এর পরিমাণ পূর্বে আমরা বিশ্লেষণ করে দেখিয়াছি, এক ছা’ ওজনে মিশরীয় মাপের হয় অর্থাৎ এক পাত্র এ এক-তৃতীয়াংশ। শরহিদ দারদীর গ্রন্থেও তাই বলা হয়েছে। আর তা ২১৭৬ গ্রামের ওজনের সমান। (সেটা قمح এর ওজন হিসেবে)। এক ছা’ قمح এর ওজন যদি তাই হয় তাহলে ফিকাহবিদগণ বলেছেন, ওটা ছাড়া অপরাপর প্রকারের জিনিস তার তুলনায় হালকা হবে। তার এ পরিমাণ মাল দেয়া হলে তা এক ছা’র বেশী হয়ে যাবে। সেখানে যদি লোকদের ওজন করে বিক্রি করার অন্য কোন প্রকারের জিনিস থাকে যা قمح এর তুলনায় ভারী যেমন চাউল, তাহলে উল্লিখিত ওজনের পার্থক্যের তুলনাস্বরূপ বেশি পরিমাণ ওয়াজিব ধারা হবে। এ প্রেক্ষিতেই কোন কোন আলিম পাল্লায় ওজনের পরিবর্তে পাত্র দিয়ে পরিমাণ করার ওপর বেশি নির্ভর করা যুক্তিযুক্ত মনে করেন, কেননা শস্য দানার মধ্যে হালকা- ভারী উভয় ধরনেরই রয়েছে। ইমাম নববী الروضه গ্রন্থে লিখিছেনঃ ছা কে উতন দ্বারা চিহ্নিত করা কঠিন। কেননা রাসূলের জামানায় যে ছা’ দ্বারা মেপে দেয়া হতো তা একটা পরিচিত পরিমাপ মাত্র। কিন্তু যে জিনিস দেয়া হয় তা বিভিন্ন হওয়ার কারেণ তার পরিমাণটাও বিভিন্ন হয়ে যায়। যেমন জনার বা ভূট্টা (maize) ও চনা প্রভৃতি। এ পর্যায়ে দীর্ঘ কথা বলার প্রয়োজন রয়েছে। যিনি সেই বিস্তারিত ও গবেষণাপূর্ণ কথা জানতে চান, তিনি (আরবী*******) পাঠ করবেন। তার সংক্ষিপ্ত কথা আমাদের মতের ইমাম আবুল ফারজ দারেমী যা বলেছেন, তাই ঠিক কথা। তা হচ্ছে, এ পর্যায়ে পাত্র দ্বারা পরিমাপের ওপর নির্ভর করতে হবে- পাল্লায় ওজনের ওপর নয় এবং রাসূলে করীম (স) এর সময়ে যে মুয়ায়ার معاير ছা’ দিয়ে পরিমাপ করে দেয়া হতো সেই রকম ছা’ দিয়ে পরিমাপ করেই দেয়া উচিত। এরূপ ছা’ বর্তমানেও আছে। তা যে পাবে না তার উচিত এমন একটা পাত্র দিয়ে পরিমাপ করা যে সম্পর্কে এ নিশ্চিয়তাবোধ হবে যে, তা সে ছা’র চাইতে কম বা ছোট হবে না। এ প্রেক্ষিতে পরিমাণ নির্ধারণ হবে রতল এবং এক-তৃতীয়াংশ প্রায়। (সম্ভবত সঠিক কথা হচ্ছে, কাছাকাছি বা নিকটবর্তী) কিছু সংখ্যক আলিম বলেছেন, এক ছার পরিমাণ হচ্ছে মধ্যম ধরনের দুই সমান হস্তের কোষ ভর্তি চারবারে যা হয় তাই। সঠিক কথা তো আল্লাহই ভালো জানেন। [(আরবী************)] ইমাম নববীর এ কথা আমাদের এ যুগে মেনে নেয়া খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে। কেননা এখানকার সময়ে দুনিয়ার সর্বত্রই সব জিনিসই প্রায় পাল্লায় ওজন করা হয়। ইবনে হাজাম বলেছেনঃ আমি মদীনাবাসীদের মধ্যে দুইজন লোককেও এই ব্যাপারে মতপার্থক্য করতে দেখিনি যে, নবী করীম (স) যে মদ্দ দ্বারা পরিমাণ করে সাদকাসমূহ দিতেন তা এক রতল ও অর্থরতলের অধিক ছিল না যেমন, তেমনি এক রতল ও এক-চতুর্থাংশ রতলেরও কম নয়। অনেকে বলেছেন, তা এক ও এক-তৃতীয়াংশ রতল ছিল। বলেছেন, এটা বিশেষ কোন পার্থক্যের বিষয় নয়। তবে তা গম, খেজুর ও شعير এর পাত্র মাপের গাম্ভীর্য অনুপাতে। [আরবী**************)] আল-মুগনী গ্রন্থে ইমাম আহমাদ থেকে উদ্ধৃত হয়েছে, ইবনে আবূ যিবের ছা’ পাঁচ রতল ও এক-তৃতীয়াংশ মাপের ছিল। আবূ দাউদ বলেছেন, সেটাই হচ্ছে রাসূলে করীম (স) ব্যবহৃত ছা’ মাপ। বলেছেন, যে লোক ভারী খাদ্য সাদকায়ে ফিতর বাবদ দেবে, তার উক্ত মাপের ওপর সতর্কতাস্বরূপ কিছুটা বেশী দেয়া উচিত। [(আরবী****************)] হানাফীদের কাছে এক ছা’ হয় আট ’রতলে’ কৃষি ফসলের যাকাত পর্যায়ে আমরা তার উল্লেখ করে এসেছি। তার জমহুর ফিকাহবিদদের পরিমাণ এক ছা’ ও অর্থ ছা’ এর সমান হয়। তার অর্থেক ২/৩ এক ছা’ এর দুই তৃতীয়াংশ অন্যদের কাছে এক ছা’। এই অর্ধ ছা’- এর পরিমাণ কোন কোন হানাফী শায়খ করেছেন একপাত্র এ তার ষষ্ঠ ভাগ- মিশরীয় নিয়মে। আর কেউ কেউ তার পরিমাণ করেছেন একপাত্র ও এক তৃতীয়াংশ।[(আরবী***************)] এ দৃষ্টিতে উভয়ের কাছে قمح গম এর ওয়াজিব পরিমাণ এক ও অভিন্ন হয়ে যায় পরিণামে এত সব মতপার্থক্য সত্ত্বেও। তবে قمح ছাড়া অন্য কোন শস্য ফিতরা হিসেবে দিতে গেলে সেক্ষেত্রে পার্থক্যটা প্রকট হয়ে উঠে। সেখানে হানাফীরা যে মাপের কথা বলেন, অন্যরা তাকে যয়ীফ বলেন। এরূপ এর বিপরীতটাও। আর যার কাছে পরিমাণের পাত্র বা ওজন করার দাড়ি পাল্লা নেই, তার উচিত চার মদ্দ- পরিমাণ দেয়া। ফিকাহবিদদের মতে এক মদ্দ (Bushel) হচ্ছে মধ্যম আকার-আকৃতির এক ব্যক্তির দুই হাতের ভরা কোষ। আর এভাবে চার হাত কোষ পরিমাণ এক ছা’র সমান হবে। কেউ তার অধিক পরিমাণ দিলে তা তার নফল দান এবং তার জন্যে কল্যাণকর হবে। যেসব জিনিস ফিতরা বাবদ দেয়া হয় ফিতরার যাকাত প্রদান পর্যায়ে যত হাদীস এসেছে, তা বিভিন্ন প্রকারের নির্দিষ্ট খাদ্যদ্রব্যকে চিহ্নিত করেছে। সেগুলো হচ্ছেঃ খেজুর, গম, বার্লি, কিশমিশ ও পনির। (পনির হচ্ছে পানি নিষ্কাষিত শুষ্ক দুধ-যার মাখন বের করা হয়নি) কোন কোন বর্ণনায় অতিরিক্ত হিসেবে قمح এর উল্লেখ রয়েছে। আবার কোন কোনটিতে যব বা দানারও উল্লেখ করা হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এ জিনিসগুলোর কোন একটা দেয়া কি নির্দিষ্ট এবং ইবাদত পর্যায়ের? এই অর্থে যে, এগুলোর বাইরে অন্যান্য খাদ্যশস্যের কোন একটি দেয়া মুসলমানের জন্যে জায়েযই হবে না? মালিকী ও শাফেয়ী মাযহাবের আলিমগণ এ প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, এ সব জিনিস দেয়াই ইবাদত পর্যায়ে নির্দিষ্টভাবে লক্ষীভুত নয়। এগুলোর কোনটি ছাড়া দেয়াই যাবে না, দিলে ইবাদত হবে না, এমন নয়। বরং মুসলমানের কর্তব্য হচ্ছে, দেশের সাধারণ খাদ্য থেকে তার ফিতরা আদায় করা। আর অন্য এক মতে ব্যক্তির সাধারণ খাদ্য ব্যক্তি বেশির ভাগ যে খাদ্য খায়, তা থেকেই দেয়া। এর ওপর দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে, সারা বছরের মধ্যে বেশীর ভাগ সময় যে খাদ্য খাওয়া হয় তাই লক্ষ্য, না বিশেষভাবে রমযান মাসে যা বেশির ভাগ সময়ে খায় অথবা ফিতরা দেবার দিনে বেশীর ভাগ যা খায় কিংবা ওয়াজিব হওয়ার দিন যা বেশির ভাগ খাবার হয়, তাই দেয়া লক্ষ্য? মালিকী মাযহাবের লোকেরা এস সম্ভাবনার কথাই বলেছেন, তাঁদের কেউ কেউ অবশ্য ফিতরা দেবার দিনের কথা বলেছেন। কিন্তু অন্যরা রমযান মাসের বেশীর ভাগ খাদ্যকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। [(আবরী**********)] শাফেয়ীদের সম্পর্কে ইমাম গাযযালী الوسيط গ্রন্থে লিখেছেনঃ ফিতরা ওয়াজিব হওয়ার সময়ে সারা বছরের নয়-দেশের লোকদের বেশীল ভাগ খাদ্য যা হবে, তাই দিতে হবে। আর (আরবী*********) গ্রন্থে লিখেছেন, ঈদুল ফিতরের দিনে দেশের বেশীর ভাগ লোকের যে খাদ্য থাকে, তাই দিতে হবে। [(আরবী**************)] মালিকী মাযহাবের লোকেরা শর্ত করেছেন যে, সাধারণ ও বেশীর ভাগ খাদ্যশস্য হতে হবে সীমিতভাবে এ নয় প্রকারের খাদ্যের মধ্যে বার্লি, খেজুর, কিশমিশ, গম, যাররা, ছোলমুক্ত যব, চাল, বাজরা ও পনির। যখন এই নয়টি বা এর কোন কোনটি পাওয়া যাবে আর খাদ্য হিসেবে তা সমানভাবে গৃহীত হবে, তখন এর মধ্যে যে কোন একটি থেকে ফিতরা দেয়ার ইখতিয়ার থাকবে- ব্যক্তি যে যেটা ইচ্ছা দিতে পারবে। আর এর মধ্যে কোন একটি প্রাধান্য পেলে তা থেকেই দিতে হবে। যেমন কোন একটি এককভাবে প্রাধান্য পেয়ে থাকলে, তাই দিতে হবে। যদি তার পাওয়া যায় বা তার কোন একটি পাওয়া যায়- কিন্তু তা ছাড়া অন্যটাই যদি বেশী খাওয়া হয়, তাহলে সেটি দেয়াই নির্দিষ্ট উত্তমকে গ্রহণ করার দিক দিয়ে। আমি কিন্তু খুঁটিনাটি ও দূরবর্তী শাখা-প্রশাখা পর্যায়ের কথাবর্তার সমর্থনে নির্ভরযোগ্য কোন দলিল পাইনি। এ কারণে উক্ত মাযহাবের কোন কোন সত্যসন্ধানী ব্যক্তি বলেছেন, এ নয়টি ছাড়া অন্য জিনিস যখন খাদ্য হিসেবে গ্রহীত হবে, তখন সেই খাদ্য হিসেবে গৃহীত দ্রব্যই ফিতরা বাবদ দিতে হবে। সেই নয়টির সব বা তার কোন একটি পাওয়া গেলেও। এ কারণে ফিকাহবিদদের মতে গোশত, দুগ্ধ ও এ ধরনের জিনিস খাদ্য হয়ে থাকলে তা দেয়াও ওয়াজিব হবে। তখন তা ওজন করে দিতে হবে। তবে ছাতু দেয়ার ব্যাপারে তাদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। মালিকী মতের লোকেরা এ পর্যায়ে একটি বিষয় উপস্থাপিত করেছেন। তাহলে, ব্যক্তি যদি নিম্নমানের খাবার গ্রহণ করে তার অক্ষমতার দরুন, তাহলে সেই খাদ্য থেকে ফিতরা দেয়া জায়েয হবে। এতে কোন দ্বিমত নেই। আর যদি সে কার্পণ্য ও অর্থ লোভের দরুন এরূপ করে, তাহলে তা সর্বসম্মতভাবে না জায়েয হবে। যদি তার হজম শক্তির কারণে অথবা তার অভ্যাসের দরুন এরূপ হয়, যেমন মরুবাসী শহরে গিয়েও নিম্নমানের গম شعير খায়, অথচ শহরবাসীরা قمح উচ্চমানের গম। এরূপ অবস্থায় মতভেদ রয়েছে। তাতে নির্ভযোগ্য কথা হল তার নিজের খাদ্য –যা ই হোক তা দিয়ে ফিতরা আদায় করা জায়েয হবে। [(আরবী***********)] শাফেয়ীদের মতে যেসব শস্যদানা ও ফলে ‘ওশর’ ধার্য হয়- যা কেবল ঠেকায় পড়ে নয়, ইচ্ছামূলকভাবে ও সাধারণ অবস্থায় খাদ্য হিসেবে গৃহীত হয়ে থাকে, তাই ফিতরা হিসেবে দেয়ার যোগ্য। ইমাম শাফেয়ী থেকে তাঁর একটি প্রাচীন কথা এই বর্ণিত হয়েছেঃ ছোলামুক্ত ভুট্টা, পিঁয়াজ ফিতরা হিসেবে দেয়া জায়েয হবে না। তবে প্রসিদ্ধ মত প্রথমটি। পনির সম্পর্কে তারা স্থির নিশ্চিত নন। নববী বলেছেন, ফিতরা হিসেবে তাদেয়া জায়েয হওয়া সম্পর্কে নিঃসন্দেহে হওয়া বাঞ্ছনীয়। কেননা সে বিষয়ে যে হাদীস এসেছে তা সহীহ এবং তার প্রতিবাদী কিছু নেই। সহীহতম কথা হচ্ছে, দুগ্ধ ও পনির একই অর্থের। কিন্তু ফিকাহবিদগণ বলেছেন, পনির থেকে মাখন টেনে নেয়া হয়েছে, তা দেয়া জায়েয হবে না, যেমন জায়েয হবে না লবণাক্ত পনির দেয়া যা বেশী লবনের দরুন খারাপ হয়ে গেছে। ঘুণে ধরা ও দোষযুক্ত শস্যদানাও দেয়া যাবে না। যে সব দ্রব্য ফিতরা বাবদ দেয়া জায়েয, তা ওয়াজিব হওয়ার তিনটি দিক রয়েছে। জমহুরের মতে তার মধ্যে সহীহতম কথা হচ্ছে, দেশের সাধারণ ও বেশীর ভাগ খাদ্য যা দ্বিতীয় ব্যক্তির নিজের খাদ্য। আর তৃতীয় দিক হচ্ছে, উক্ত জিনিসগুলোর মধ্য থেকে যে কোন একটিকে বাছাই করে নেবে। ফিকাহবিদগণ বলেছেন, ব্যক্তির খাদ্য কিংবা দেশের খাদ্য বাদ্যতামুলকভাবে চিহ্নিত হলে কেউ যদি তার চেয়ে নিম্নমানের খাদ্য দেয় তা হলে তা জায়েয হবে না। তবে উচ্চমানের দিলে তা সর্বসম্মতভাবে জায়েয হবে। আর যদি ব্যক্তির নিজের খাদ্য গণ্য করি, আর দেখি যে, তার তো بر (উন্নতমানের গম) খাওয়া উচিত; কিন্তু সে কার্পণ্যের কারণে নিম্নমানের গম খায়, তাহলে তার সেই উন্নতমারের গমই দেয়া উচিত। আর অবস্থার কারণে যদি নিম্নমানের গমই তার জন্যে শোভন হয়ে থাকে, কিন্তু সে বিলাসিতাসরূপ উন্নতমানের গম খেতে অভ্যস্ত হয়ে থাকে, তাহলে সহীহ মত হচ্ছে, নিম্নমানেরটা দেয়াই তার জন্যে যথেষ্ট হবে। আর দ্বিতীয় মতে উন্নত মানেরটাই নির্দিষ্ট করতে হবে। [(আরবী***********)] যদি দেশের বেশীর ভাগ লোকের খাদ্য বাধ্যতামুলক করে দিই আর সেখানকার লোকেরা বহু প্রকারের খাদ্য গ্রহণ করতে অভ্যস্ত হয়ে থাকে যে, তার মধ্যে কোন একটাকে প্রধান খাদ্য রূপে চিহ্নিত করা সম্ভব না হয়, তাহলে সেখানকার লোকেরা যেটা ইচ্ছা দিতে পাবে। তবে যেটা উন্নতমানের সেটা দেয়াই উত্তম। [ঐ (আরবী****************)] ইমাম আহমাদের মাযহাব হচ্ছে, যে পাঁচ প্রকারের খাদ্যের নাম হাদীসে সুস্পষ্ট ভাষায় উদ্ধৃত হয়েছে, তা পাওয়া সম্ভব হলে তা বাদ দিয়ে অন্য কিছু দেয়া আদৌ জায়েয নয়। যেটি দেবে সেটি দেশের লোকদের খাদ্য হোক আর নাই হোক। [(আরবী*************)] ইমাম আবূ হানীফা ও আহমাদের মতে সূক্ষ্ম আটা ও ছাতু দেয়াও জায়েয। কেননা তাও খাওয়া হয়। তা পেলে গরীব মিসকীনরা উপকৃত হতে পারে। আটা পেষা চাক্কির মজুরী হিসেবেও তা দেয়া যেতে পারে।[ঐ ৩য় খণ্ড, ৬২ পৃ.] যে বোঝা যায়, নবী করীম (স) যেসব জিনিসের উল্লেখ করেছেন, তাই নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। কেননা তখনকার সময়ে সেগুলোই ছিল আরব পরিবেশের সাধারণ খাদ্য। এখন যদি কোন দেশের লোক কেবল চাল খেয়েই জীবন ধারণে অভ্যস্ত হয়ে থাকে- যেমন জাপান-এশিয়া এলাকার লোকদের অবস্থা। তাদের প্রকৃতি তাদের সেই খাদ্য থেকেই গড়ে উঠেছে, অতএব তা থেকেই তাদের ফিতরা দেয়া হবে। আর কোন দেশের লোকেরা যদি اذرة খাদ্যে জীবন ধারণ করতে থাকে-যেমন মিশরীয় রীফ তাদের উচিত হচ্ছে সেই খাদ্য থেকেই ফিতরা দেয়া; অতএব আমার দৃষ্টিতে এ মতটাই অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য যে, প্রত্যেক ব্যক্তিই তার দেশের জনগনের সাধারণ খাদ্য দিয়েই তার ফিতরা আদায় করবে অথবা তার নিজের সাধারণ খাদ্য যদি দেশের সাধারণ খাদ্য থেকে উন্নতমানের হয়, তাহলে তা থেকেই ফিতরা দেবে। ইবনে হাজমের মতে খেজুর ও গম বা বর্লি ছাড়া অন্য কোন জিনিস আদৌ জায়েয হবে না। কিশমিশ, قمح মিহি আটা, পনির ইত্যাদি কোন কিছুই নয়। এ কথার দলিল দিতে গিয়ে তিনি দীর্ঘ আলোচনার অবতারণা করেছেন এবং এর বিপরীত মতের সব হাদীসই তিনি রদ্দ করেছেন। তার মতের বিরোধী লোকদের তিনি তীব্র ভাষায় সমালোচনা করেছেন। এটাই তাঁর চিরাচরিত অভ্যাসও বটে। [(আরবী****************)] তিনি যেসব হাদীস দলিল হিসেবে উদ্ধৃত করেছেন, তার মধ্যে ইবনে মুজলিজ থেকে। তাঁর সনদে বর্ণিত একটি হয়; তিনি বলেছেনঃ আমি ইবনে উমর (রা) কে বললাম, আল্লাহ তো অনেক প্রশস্ত করে দিয়েছেন ব্যাপারটি। بر (উন্নত মানের গম) কি খেজুরের তুলনায় উত্তম সাদকায়ে ফিতর দেয়ার জন্যে? তিনি তাঁকে বললেনঃ আমাদের সঙ্গীরা একটা পন্থা অনুসরণ করেছেন, আমিও সেই পন্থা অনুসরণ করা পছন্দ করি। [(আরবী***************)] একজন সাহাবীর এ উক্তিটিকে দলিল হিসেবে উপস্থাপিত করে ইবনে হাজম খুব বাড়াবাড়ি করেছেন বলতে হবে। এমন কি তিনি এটাকে সাহাবীদের ইজমারূপেও গণ্য করেছেন অথচ তার বিপরীত মতের সমর্থনে সাহাবিগণের বিপুল সংখ্যক উক্তি বা মন্তব্য উদ্ধৃত হয়েছে। ইবনে হাজমের উক্ত মতের ওপর আল্লামা শায়খ আহমদ শাকের যে টিকা লিখেছেন আল-মুহাল্লা’ গ্রন্থের ওপর, এখানে তার উল্লেখ করাই আমাদের জন্যে যথেষ্ট হবে। তিনি লিখেছেনঃ ফিতরার যাকাত পর্যায়ে যত হাদীসই উদ্ধৃত হয়েছে, সেগুলোর সূত্র সম্পর্কে সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে চিন্তা করলেই তার তাৎপর্য বোঝা যাবে যে, সাহাবীগণ (স) এর এসব উক্তিতে শব্দের বিভিন্নতা রয়েছে। একথাও জানা যাবে যে, ইবনে হাজম যে কেবলমাত্র খেজুর ও বার্লি ছাড়া অন্য কিছু ফিতরা বাবদ দেয়া আদৌ সমর্থন করেছেন না তাঁর সপক্ষে সত্যই কোন দলিল নেই। হযরত মুয়াবিয়া সাহাবীগণের উপস্থিতিতে এক ছা’ পরিমাণ বার্লি ইত্যাদির বদলে সিরীয় গমের দুই মদ্দ পরিমাণ দেয়া উত্তম বলে মনে করলেন অথচ তাঁদের কেউই এ বার্লির পরিবর্তে উন্নত মানের গম দেয়ার কথায় আপত্তি জানালেন না। হযরত আবূ সায়ীদ শুধু পরিমাণটার ওপর আপত্তি করেছিলেন ও উন্নতমানের গম ও এক ছা’ পরিমাণ দেয়াটাকেই সমর্থন করেছেন। ইবনে উমর (রা) নিজে তো বিশেষভাবে সেই জিনিস দিয়েই ফিতরা আদায় করতেন যা দিয়ে তিনি আদায় করেছিলেন রাসূলে করীম (স) এ সময়ে। সেই জিনিস ছাড়া অন্য কিছু দিতে তিনি এখনও আপত্তি করেন নি। তিনি যদি লোকদেরই আমল বাতিল মনে করতেন তারা তো সাহাবী ও তাবেয়ীনই ছিলেন তাহলে তিনি নিশ্চয়ই কঠোরভাবে প্রতিবাদ জানাতেন ও নিষেধ করতেন। তিনি তো এ ধরনের বহু ব্যাপরেই তীব্র ভাষায় প্রতিবাদ করেছেন কেবল বিধান প্রণয়নের লক্ষ্যেই নয়, রাসূলের সুন্নাত অনুসরণের তীব্র আগ্রহে। যেমন তিনি সে সব স্থানে যেতে ও অবস্থান করেছিলেন সেসব স্থানে স্বয়ং রাসূলে করীম (স) গেছেন ও অবস্থান করেছেন অথচ কোন একজন মুসলমানও তা ওয়াজিব বলে মনে করেন নি। ফিতরা ওয়াজিব করা হয়েছে ঈদের দিনে গরীব জনগণের বাড়ী বাড়ী ভিক্ষা করে বেড়ানো থেকে বিরত রাখার লক্ষ্যে যেহেতু এ দিনে ধনী লোকরা নিজেদের ধনমাল ও পরিবার-পরিজন নিয়ে খুবই আনন্দ স্ফূর্তিতে মশগুলে থাকে। এরূপ অবস্থায় প্রত্যেক ব্যক্তিরই নিজস্বভাবে চিন্তা ভাবনা করা আবশ্যক যে, সে কি কোন গরীব ব্যক্তিকে এক ছা; পরিমাণে খেজুর বা এক ছা; পরিমাণ বার্লি দিয়ে ভিক্ষা থেকে বিরত রাখতে পারে?..... এ দিনে..... এদেশে? গরীব ব্যক্তি ও দুটি নিয়ে কি করতে পারে?....... পারে শুধু এই যে, সে দুটি কম মূল্যে কে ক্রয় করবে তাই তালাশ করে বেড়াবে, যেন সে তার ও তার সন্তানের জন্যে খাদ্য ক্রয় করতে পারে। [(আরবী*************)] মূল্য প্রদান তিনজন ইমাম ফিতরার যাকাত ও অন্যান্য সব যাকাতেই মূল জিনিসের মূল্য দেয়া জায়েয মনে করেন নি। ইমাম আহমাদকে সাদকায়ে ফিতর বাবদ পয়সা প্রদান করা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেলেনঃ আমি ভয় করছি যে, তাতে আদায় হবে না। তাছাড়া তা রাসূল (স) এ সুন্নাতের পরিপন্থীও। তাঁকে বলা হল, লোকেরা বলে, উমর ইবনে আবদুল আজিজ মূল্য গ্রহণ করতেন। বললেনঃ এ লোকেরা তো দেখছি রাসূল (স) এর কথাকে বাদ দিয়ে অমুক-অমুকের কথাকে দলিল হিসেবে নিচ্ছে। ইবনে উমর বলেছেনঃ রাসূলে করীম (স) ফরয (ধার্য করেছেন........হাদীস) আর আল্লাহ তাআলা নির্দেশ দিয়েছেনঃ তোমরা অনুগত্য কর আল্লাহর এবং মেনে চল রাসূলকে। [(আরবী*************)] এর অর্থ, তিনি দ্রব্যের মূল্য প্রদানকে রাসূলের বিরোধিতা মনে করতেন। ইমাম মালিক ও শাফেয়ীর কথাও তাই। [(আরবী*************)] ইবনে হাজমও এরূপ কথাই বলেছেনঃ মূলত দ্রব্যের মূল্য প্রদানে ফিতরা আদায় হবে না। কেননা তা রাসূলে করীম (স) এর ধার্য করা জিনিস ছাড়া অন্য কিছু। তবে জনগণের অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে মূল্য দেয়া জায়েয হবে কেবলমাত্র পারস্পরিক সম্মতি সন্তুষ্টির ভিত্তিতে। আর যাকাতের ফিতরার নির্দিষ্ট কোন মালি নেই বলে তার অনুমতি বা সম্মতি পাওয়ারও প্রশ্ন ওঠে না। [(আরবী*************)] সওরী, আবূ হানীফা ও তাঁর সঙ্গিগণ বলেছেনঃ মূল্য প্রদান জায়েয। উমর ইবনে আবদুল আজিজ ও হানানুল বসরী থেকে এ কথা বর্ণিত হয়েছে। [(আরবী*************) গ্রন্থে লিখিত রয়েছে, উমর ইবনে আবদুল আজিজ থেকে তা সহীহ সূ্ত্রে বর্ণিত হয়েছে।] বাসরায় অবস্থানরত (গভর্ণর) আদীর প্রতি লেখা উমর ইবনে আবদুল আজিজের চিঠি পড়তে আমি শুনেছিঃ দিওয়ানভুক্ত প্রতিটি ব্যক্তি থেকে তাদের দানসমূহ থেকে অর্ধ দিরহাম গ্রহণ করা হবে। [(আরবী*************)] হাসানুল বসরী থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেনঃ ইবনে আবূ শাইবা আউন থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেন, সাদকায়ে ফিতর আদায়ে পয়সা (নগদ মূল্য) দেয়ার কোন দোষ নেই। [(আরবী*************)] আবূ ইসহাক থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, আমি লোকদের (সম্ভবত সাহাবীদের) এ অবস্থায় পেয়েছি যে, তাঁরা রমযানের সাদকা খাদ্যের মূল্য প্রদান করে আদায় করতেন। [(আরবী*************)] আতা থেকে বর্ণিত, তিনি সাদকায়ে ফিতর বাবদ একটি রৌপ্য মুদ্রা দিতেন। [(আরবী*************)] ক. নবী করীম (স) এর কথাঃ এ দিন মিসকীনদের সচ্ছল বানিয়ে দাও থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, মূল্য দিলেও তাদের সচ্ছ্বল বানাবার উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হয় যেমন খাদ্যবস্তু দিলে তা হয়। আর অনেক সময় মূল্য দেয়াটা উত্তমও হয়। কেননা ফিতরা বাবদ পাওয়া বিপুল খাদ্য সম্ভার ফকীর মিসকীনের কাছে জমা হলে তা বিক্রয় করার প্রয়োজন দেখা দিতে পারে অথচ নগদ পয়সা পেলে সে তার দ্বারা প্রয়োজন মত খাদ্যবস্তু ও অন্য দ্রব্য ক্রয় করতে পারে। খ. ইবনে মুনযিরের কথা ইতিপূর্বে উদ্ধৃত হয়েছে মূল্য দেয়া জায়েয হওয়ার পক্ষে। খোদা সাহাবিগণই অর্ধ ছা’ উন্নত মানের গম দেয়া জায়েয বলে মত দিয়েছেন। কেননা তাঁরা তাকে এক ছা’ পরিমাণ খেজুর বা বার্লির মূল্য হিসেবে বিকল্প মনে করেছেন। এ কারণেই মুয়াবিয়া (রা) বলেছেনঃ আমি মনে করি, সিরীয় গমের দুই মদ্দ পরিমাণ এক ছা’ খেজুরের বদল হতে পারে। গ. আমাদের এ যুগের দৃষ্টিকোন দিয়ে বিচার করলেও এটাই সহজ মনে হবে। বিশেষ করে শিল্পোন্নত দেশ ও এলাকাসমূহে তো নগদ পয়সাই হয় বিনিময়ের একমাত্র মাধ্যম। অনেক দেশ অনেক শহর এবং অনেক সময়ই তা গরীব লোকদের জন্যে খুবই সুবিধাজনক হয়। আমার যা মনে হয়, নবী করীম (স) ফিতরার যাকাত দেয়ার জন্যে খাদ্যবস্তু দেয়া নির্ধারিত করেছেন দুটি কারণেঃ প্রথম সেই সময়কার আরবে নগদ অর্থ ছিল বিরল। ফলে খাদ্যবস্তু দেয়াটাই ছিল লোকদের পক্ষে সহজ। আর দ্বিতীয়, নগদ মূল্যের ক্রয়ক্ষমতা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন হয়ে থাকে। কিন্তু এক ছা পরিমাণ খাদ্য সেরূপ নয়। তা মানবীয় প্রয়োজন খুব সীমিতভাবে পূরণ করতে পারে মাত্র। সেকালে খাদ্যসষ্য দেয়া যেমন দাতার পক্ষে সহজতর ছিল, গ্রহণকারীর পক্ষেও তা ছিল অধিক উপকারী (একালে নগদ মূল্য দেয়াটা ঠিক তেমনি।) আল্লাহই সঠিক কথা ভালো জানেন। যাকাত আলোচনায় যাকাত আদায়ের পন্থা পর্যায়ে প্রদান। সম্পর্কে আমি বিস্তারিতভাবে আলোচনা করছি। তা আবার দেখে নেয়া যেতে পারে। মূল্য প্রদান সম্পর্কিত বিষয়াদি নগদ মূল্য প্রদানের সাথে কতগুলো বিষয় জড়িত। হানাফী আলিমগণ তার উল্লেখ করেছেন। প্রথম, মূল্য প্রদান অর্থ গম অথবা বার্লি কিংবা খেজুরের মূল্যদান। এ তিনটির যেকোন একটির মূল্য দেয়া যেতে পারে ইমাম আবূ হানীফা ও আবূ ইউসুফের মত অনুযায়ী আর ইমাম মুহাম্মাদ বলেছেনঃ কেবলমাত্র গমের মূল্যই দেয়া যাবে। [(আরবী **********)] আমার বিবেচনায় হচ্ছে, দেশের সাধারণ খাদ্যশস্যের এক ছা’ পরিমাণের মূল্যদান। শস্যটা মধ্যম মানের হওয়া উচিত। আর উত্তম মানের কলে তা আরও উত্তম। দ্বিতীয়, হাদীসে যে সব জিনিসের উল্লেখ হয়েছে, মূল্য হিসেবে তার মধ্যে পারস্পরিক বিনিময় করে ফিতরা দেয়া জায়েয হবে না যেমন গমের মূল্য হিসেবে গম দেয়া জায়েয নয়,- এভাবে যে, মধ্যম মানের এক ছা’ পরিমাণের মূল্য বাবদ অর্ধ ছা’ উত্তমমানের গম দেয়া যাবেনা। তেমনি মূল্য হিসেবে গমের পরিবর্তে খেজুর বা বার্লি দেয়াও জায়েয হবে না বরং মূল জিনিসটির মূল্যটা দিতে হবে। অবশিষ্ট দ্রব্যাদি। সম্পর্কেও এরই ভিত্তিতে ধারণা করতে হবে। কেননা মূল্য গণ্য হবে যেসব জিনিসের উল্লেখ হাদীস হয়নি, তার দ্বারা। [(আরবী*****************)] তৃতীয়, হানাফীদের মধ্যে – মূল্য প্রদান না হাদীস উল্লিখিত দ্রব্য দিয়ে ফিতরা আদায় করা- এ দুটোর মধ্যে কোনটি উত্তম তা নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। তাদের কেউ বলেছেন, গম দেয়া সর্বাবস্থায় উত্তম। তা কঠিন কষ্টের সময় হোক কিংবা অন্য কিছু। কেননা তাতে সুন্নাতের সাথে সাদৃশ্য ও সমতা রক্ষা করা হবে। অন্যদের কথা হচ্ছে, সময়টা যদি খুব কষ্টের ও খাদ্যভাবের হয়, তাহলে তখন মূল খাদ্যটা দেয়াই উত্তম। আর প্রশস্ততা ও সচ্ছলতাকালে মূল্য দেয়া উত্তম। কেননা তা গরীব মানুষের প্রয়োজন পূরণে অধিক সক্ষম। এ থেকে আমাদের সম্মুখ সুস্পষ্ট হয়ে উঠে যে, উত্তম সাব্যস্ত করার ভিত্তি হচ্ছে গরীব ব্যক্তির পক্ষে কেনটা দিলে অধিক সুবিধাজনক হয়, সেই জিনিসটি দেয়া। যদি খাদ্যশস্য দিলে মূল্যের তুলনায় তার পক্ষে অধিক ভাল হয়, তাহলে সেটি দেয়া উত্তম। যেমন দুর্ভিক্ষ ও কষ্টের সময় তা ভাল। আর নগদ পায়সা পেলে তার যদি বেশী সুবিধা হয়, তাহলে তাই দেয়া উত্তম। হিসেবে গরীব ব্যক্তির একার সুবিধাটা না দেখে গোটা পরিবারের সুবিধাটার বেশী গুরুত্ব পাওয়া উচিত। কেননা দেখা গেছে, অনেক পারিবরিক দায়িত্ব সম্পন্ন দরিদ্র ব্যক্তি নগদ পায়সা নিয়ে তা নিজের বাজে অভ্যাস ব্যয় করে ফেলে অথচ তখন তার স্ত্রী ও সন্তান-সন্তুতি হয়ত িএকবেলা খাবার বঞ্চিত হয়ে রয়েছে। এরূপ অবস্থায় খাদ্যশস্য দেয়াই অধিক ভালো। চতুর্থ পরিচ্ছেদ ফিতরা কখন ওয়াজিব হয় এবং তা কখন প্রদান করতে হবে ফিতরা কখণ ওয়াজিব হয় মুসলমানগণ এ ব্যাপার সম্পূর্ণ একমত যে, রমযানের রোযা শেষ করার সঙ্গে সঙ্গেই ফিতরা ওয়াজিব হয়ে পড়ে। ইবনে উমর (রা) এর পূর্বোল্লিখত হাদীস রমযানে ফিতরার যাকাত রাসূলে করীম (স) ফরয (ধার্য) করেছেন। এটাই তার বড় দলিল।...... ওয়াজিব হওয়ার সঠিক সময় নির্ধারণে ফিকাহবিদদের মত বিভিন্ন প্রকারের। ইমাম শাফেয়ী, আহমাদ, ইসহাক, সওরী এবং একটি বর্ণনায় ইমাম মালিকের মত হচ্ছে, রমযানের শেষ দিনের সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে ফিতরা ওয়াজিব হয়। কেননা তা রোযাদারের পবিত্রতা বিধানের উদ্দেশ্যে ওয়াজিব করা হয়েছে। সূর্যাস্তের সাথে সাথে রোযাও শেষ হয়ে যায়। অতএব তখনই তা ওয়াজিব হয়ে যায়। আবূ হানীফা এবং তাঁর সঙ্গীরা, লাইস, আবূ সওর এবং মালিকের দুটো বর্ণনার একটির বক্তব্য হচ্ছে, ঈদের দিনের সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে ফিতরা ওয়াজিব হয়। কেননা তা এমন নৈকট্য মাধ্যম ঈদের দিনের সাথে সংশ্লিষ্ট। কাজেই তা ঈদের দিনের আগে হতে পারে না- যেমন কুরবানী ঈদুল আযহার দিনেই করতে হয়। [(আরবী*************)] আসলে ব্যাপারটি সহজবোধ্য। পার্থক্যের ফলশ্রুতি প্রকাশিত হয় রোযার শেষ দিনের সূর্যাস্তের পর এবং ঈদের দিনের সূর্য উদয় হওয়ার পূর্বে জন্মগ্রহণকারী শিশুর ব্যাপারে, - তার ওপর ফিতরা ওয়াজিব হবে কি-না এ নিয়ে। অনুরূপভাবে ’শরীয়াত পালনে বাধ্য المكلف ব্যক্তি যদি উক্ত সময় মৃত্যুবরণ করে তবে তার ব্যাপারেও। [(আরবী*************)] কখন প্রদান করা হবে বুখারী ও মুসলিম ইবনে উমর (রা) থেকে উদ্ধৃত করেছেনঃ (আরবী*****************) রাসূলে করীম (স) লোকদের নামাযের জন্যে রওয়ানা হওয়ার পূর্বেই ফিতরা দিয়ে দিতে নির্দেশ দিয়েছেন। এখানে নামায অর্থ ইদের নামায ইকরামা থেকে বর্ণিত বলেছেনঃ প্রত্যেক ব্যক্তি তার ফিতরা তার নামাযের আগেই পেশ করবে। কেননা আল্লাহ তাআলা বলেছেনঃ (আরবী*************) প্রকৃত সাফল্য লাভ করল সে, যে পরিশুদ্ধতা গ্রহণ করল এবং তার আল্লাহর নাম স্মরণ করল- অতপর নামায পরল।[(আরবী*************)] ইবনে খুজায়মা কাশরী ইবনে আবদুল্লাহ- তার পিতা থেকে- তাঁর দাদা থেকে- এ সূত্রে বর্ণনা উদ্ধত করেছেন। রাসূলে করীম (স) কে এ আয়াতটি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। জবাবে তিনি বলেছিলেনঃ আয়াতটি ফিতরার যাকাত পর্যায়ে অবতীর্ণ হয়েছে। [(আরবী*************)] কিন্তু হাদীসটি সনদের দিক দিয়ে দুর্বল। কেননা, কাসীর, নামের বর্ণনাকারী হাদীসের ইমামগণের বিচারে খুব বেশী যয়ীফ, ব্যক্তি বলে চিহ্নিত।[বরং আবূ দাউদ ও শাফেয়ী বলেছেন, এ লোকটি মিথ্যুক গোষ্ঠীর একজন সদস্য। ইবনে হাব্বান বলেছেন, এ লোকটি খুব বেশী মুনকারুল হাদীস। সে তার পিতা তার দাদা সূত্রে মওজু হাদীস বর্ণনাকরে। কিতাবসমূহে তার উল্লেখ কেবল বিস্ময়বোধ হিসেবেই হতে পারে। তবে তিরমিযী তার হাদীস সহীহ বলেন। যাহবী উল্লেখ করেছেন, আলিমগণ তিরমিযীর এ সাক্ষ্যর ওপর নির্ভর করে তার হাদীস গ্রহণ করবেন না। দেখুন (আরবী*************)] মুলত আয়াতটি মক্কায় অবতীর্ণ সূরার। আর ফিতরার যাকাত শরীয়াতবদ্ধ হয়েছে মদীনায় রমযানের রোযা ফরয হওয়া ও দুই ঈদের শরীয়াতবদ্ধ হওয়ার পর। ফিতরার যাকাত সম্পর্কে নাযিল হয়েছে, রাসূলে করীম (স) এর এ কথাটির ব্যাখ্যা এই হতে পারে যে, আয়াতটি ভাষা ও বর্ণনাভঙ্গী থেকে ফিতরার যাকাত বোঝায়।’ ফিতরার যাকাতের কারণে পারিভাষিক তাৎপর্যের দিক দিয়ে তা নাযিল হয়নি। বুখারী ও মুসলিম আবূ সায়ীদ খুদরী (রা) থেকে বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেনঃ ‘আমরা রাসূলে করীম (স) এর সময়ে ঈদুল ফিতরের দিনে এক ছা’ পরিমাণ খাদ্য প্রদান করতাম।’ বাহ্যত মনে হয়, সারাটি দিন ধরে এ ফিতরা দেয়া হত। কিন্তু ব্যাখ্যাকারগণ দিনের প্রথমাংশেই দেয়ার কথা বলেছেন। আর এ সময়টি হচ্ছে ফযরের নামায ও ঈদের নামাযের মধ্যবর্তী সময়। ফতহুল বারী গ্রন্থে তাই লেখা হয়েছে। শাফেয়ী (র) মনে করেছেন, নামাযের পূর্বে দেয়া শর্ত মুস্তাহাবস্বরূপ আরোপ করা হয়েছে। কেননা নবী করীম (স) এর কথাঃ ‘তোমরা এদিনে মিসকীনদের সচ্ছল বানিয়ে দাও’ এর এদিন বলতে সারাটি ঈদের দিনে বোঝায়।[(আরবী*************)] জমহুর ফিকাহবিদগণ মনে করেন, নামাযের পর পর্যন্ত বিলম্বিত করা মাকরূহ। কেননা ফিতরা দানের প্রথম লক্ষ্য হচ্ছে, এ দিনে লোকদের নিকট চাওয়া- ভিক্ষা করা থেকে ফকীর মিসকীনকে বিরত রাখার এবং তাদের সচ্ছল করে দেয়া। কাজেই তা দেয়া বিলম্বিত হলে দিনের একটি অংশ এ সচ্ছলকরণ কার্যসূচী, অবাস্তবায়িত থেকে যাবে।[(আরবী*************)] ইবনে হাজম মনে করেন, সূর্যের তাপ বৃদ্ধি পাওয়া ও ঈদের নামাযের সময় উপস্থিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফিতরা দানের সময়টাও শেষ হয়ে যায়। অতএব বিলম্ব করাটা তাঁর হতে হারাম। বলেছেন, ফিতরা দেয়ার সময় শেষ হওয়ার পূর্বে যে তা দেবে না, তা তার যিম্মায় ও তার মালের ওপর ধার্য হয়েই থাকবে। এটা তার একটা ঋণ বিশেষ। লোকদের জন্যে স্বীকৃত একটা অধিকার, তার মাল থেকে তা দিয়ে দেয়া তার জন্যে ওয়াজিব। তার মালের মধ্যে তা আটকে রাখা হারাম। অতএব তা আদায় করা তার জন্যে একটা চিরন্তন কর্তব্য হয়ে থাকবে। দিয়ে দিলে মিসকীনদের হক আদায় হয়ে যাবে বটে; তবে তার জন্যে নির্দিষ্ট সময়ে না দেয়া- সময় নষ্ট করার দরুন আল্লাহর হকটা অবশিষ্ট থেকে যাবে। আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া ও লজ্জিত অনুতপ্ত হওয়া ছাড়া এ ক্ষতির পূরণ করা তার পক্ষে কখনই সম্ভবপর হবে না। [(আরবী*************)] শাওকানীর ঝোঁক হচ্ছে এদিকে যে, ঈদের নামাযের পূর্বেই ফিতরা দিয়ে দেয়া ওয়াজিব- হযরত ইবনে আব্বাসের হাদীসের কারণে। তা হলঃ যে তা নামাযের পূর্বে দিয়ে দেবে, তা গৃহীত যাকাত হবে আর যে তা নামাযের পর দেবে, তখন তা হবে একটা সাধারণ দান পর্যায়ের।’ সাধারণ দান পর্যায়ের কথাটির অর্থ, সে প্রদানের ফলে ফিতরার যাকাত দানের যে সওয়াব সেই বিশেষ সওয়াব সে পাবে না তার আসল নৈকট্যমূলক গুণসহকারে যা পেতে যথাসময়ে প্রদান করলে। আর ঈদের দিন গত হয়ে যাওয়ার পর তা দিলে কি হবে?...... এ পর্যায়ের ইবনে রাসলান বলেছেন, তা সর্বসম্মতভাবে হারাম। কেননা তা যখন ওয়াজিব যাকাত, তখন তা তার জন্যে নির্দিষ্ট সময় ছাড়িয়ে দিলে গুনাহ ওয়াজিব হয়ে পড়ে- যেমন সময় ছাড়িয়ে নামায পড়া হলে হয়। [(আরবী*************)] আল-মুগনী গ্রন্থে বলা হয়েছে, ঈদের দিন ছাড়িয়ে ফিতরা দিলে গুনাহগার হবে এবং তার কাযা করা বাধ্যতমূলক হবে। [(আরবী*************)] ইবনে সীরীন ও নখয়ী ঈদের অতিবাহিত করার পরও তা দেয়ার রোখসত আছে বলে মত দিয়েছেন, এটা বর্ণনা করা হয়েছে। ইবনুল মুনযির আহমাদ থেকেও এ কথা বর্ণনা করেছেন। কিন্তু সুন্নাত অনুসরণ করা যে উত্তম, তাতে সন্দেহ নেই। [দরদীর (আরবী********) গ্রন্থে এ কথাই বলেছেন। সময়মত না দিলে ফিতরা দেয়ার দায়িত্ব বাতিল হয়ে যায় না। তা তার যিম্মায় থেকে যায়- ১ম খণ্ড, ৫০৮ পৃ.] আর তা করতে হলে নামাযের আগেই দিতে হবে। কিন্তু তা অগ্রিম দেয়া- ঈদের দিনেরও পূর্বে দেয়া সম্পর্কে হাজম নিষেধবাণী উচ্চারণ করেছেন এবং ঈদের দিনের সূর্যোদয়ের এক দিন বা তার কম সময়ও আগাম আদায় করা সমীচীন মনে করেন নি। বলেছেন, তার জন্যে নির্দিষ্ট সময়ের অল্পক্ষনে পূর্বে দেয়াও মুলত জায়েয নয় বলে মত প্রকাশ করেছেন। [(আরবী*************) ইবনে হাজমের এ মত ইমামীয়া ফিকাহরও মত। ইমাম জাফরের ফিকাহ্ কিতাবে (২য় খণ্ড, ১০৬ পৃ.) তাই লেখঅ রয়েছে। তিনিও শওয়ালের চাঁদের পূর্বে দেয়া জায়েয মনে করেন নি।] এ কথাটির ভিত্তি হচ্ছে, ফিতরা অগ্রিম দেয়াকে তিনি আদৌ জায়েয মনে করেন নি। এ মত সাহাবীগণের মতের বিপরীত। তাঁরা আগাম দেয়া জায়েয হওয়ার যে মত দিয়েছেন তা সহীহ সূত্রে প্রমাণিত। বুখারী ইবনে উমর (রা) থেকে বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন। তিনি বলেছেন- সাহাবিগণ ঈদুল ফিতরের এক বা দুই দিন পূর্বেই যাকাতুল ফিতর দিয়ে দিতেন। আর তাঁরাই হচ্ছেন মুসলমানদের জন্যে শরীয়াত পালনের ক্ষেত্রে আদর্শ, অনুসরণীয় পথ প্রদর্শনকারী। আহমাদও এ মত দিয়েছেন। বলেছেন, উক্ত সময়ের বেশী সময় পূর্বে ফিতরা প্রদান জায়েয নয় অর্থাৎ একদিন বা দুইদিন পূর্বে। মালিকীরাও এ মতের ধারক। তাঁদের কেউ কেউ অবশ্য তিন দিন আগে দেয়াও জায়েয বলেছেন। [(আরবী***********)] হাম্বলী মাযহাবের কেউ কেউ বলেছেন, অর্ধমাসকাল পূর্বে দেয়াও জায়েয। আর শাফেয়ী বলেছেন, রমযান মাসের শুরু থেকেই দিতে শুরু করা জায়েয। কেননা ফিতরা ব্যবস্থার কারণই হল রোযা রাখা ও রাখা শেষ করা। এই দুটি কারণের একটি পাওয়া গেলেই তা অগ্রিম দেয়া জায়েয হবে- যেমন নিসাব পরিমাণ মালের মালিক হওয়ার পর অগ্রিম যাকাত দেয়া জায়েয। [(আরবী*************)] ইমাম আবূ হানাফী বলেছেন, বছরের শুরু থেকেই অগ্রিম দেয়া জায়েয। কেননা এটাও যাকাত পর্যায়ের। অতএব তা মালের যাকাত সদৃশ। আর যায়দীয়া ফিকাহ্র মতে মালের যাকাতের মত দুই বছর পূর্বেও অগ্রিম দেয়া হলে তা জায়েয হবে। [(আরবী********) মালিক ও আহমদের মত অধিক সতর্কতাপূর্ণ এবং হাসিলের খুব নিকটবর্তী। সে লক্ষ্যটি হচ্ছে, মূলত ঈদের দিনে গরীবদের সচ্ছলকরণ। একমাস পরও তা দেয়া জায়েয হওয়াটা জনগণের জন্যে অবশ্য খুবই সহজসাধ্য ও সুবিধাজনক। বিশেষ করে রাষ্ট্রই যদি ফিতরা সংগ্রহ কাজের দায়িত্ব পালন করে, তাহলে। কেননা তা সংগ্রহ করা ও পাওয়ার যোগ্য লোকদের মধ্যে বণ্টন করার সংগঠন গড়ে তুলতে যথেষ্ট সময়ের প্রয়োজন। তা এমনও হতে পারে যে, ঈদের দিনের সূর্যোদয় হল, ঠিক তখনই গরীব লোকদের কাছে তাদের প্রাপ্যটা পৌছে গেল। তাতে তারা ঈদের আনন্দ ও সুখ অনুভব বা উপভোগ করতে পারবে- ঠিক অন্যান্য সমস্ত লোকের মত। কোন ইসলামী সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান যাকাতুল ফিতরা আদায় ও বণ্টনের দায়িত্ব পালন করতে গেলে তার জন্যেও একথাই অনুসরণীয়। পঞ্চম পরিচ্ছেদ ফিতরা কাদের দেয়া হবে ফিতরা মুসলমান গরীবকে দিতে হবে ইবনে রুশদ লিখেছেনঃ ফিতরা কাকে দেয়া হবে, এ প্রশ্নের জবাব হচ্ছে- ফিকাহবিদগণ এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ একমত যে, ফিতরা কেবলমাত্র মুসলিম ফকীর মিসকীনকেই দেয়া হবে। কেননা নবী করীম (স) ইরশাদ করেছেন, ......... তাদের সচ্ছল বানিয়ে দাও। যিম্মী মিসকীনদের ব্যাপারে মতানৈক্য বলেছেন, যিম্মী (অমুসলিম) ফকীর মিসকীনদের দেয়া জায়েয কিনা। এ বিষয়ে ফিকাহবিদদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। কিন্তু জমহুর ফিকাহবিদদের মত হচ্ছে, তা তাদের জন্যে জায়েয নয়। ইমাম আবূ হানীফা বলেছেনঃ হ্যাঁ, তাদের জন্যেও তা জায়েয। এ মতপার্থক্যের কারণ হচ্ছে এ প্রশ্নে যে, তা দেয়া জায়েয হওয়ার ভিত্তি কি শুধু দারিদ্র্য? না দারিদ্র্য ও মুসলিম হওয়া- উভয়ই ভিত্তি। তাঁরা বলেছেন, যিম্মিদের জন্যে তা জায়েয নয়। পক্ষান্তরে যারা দারিদ্রকেই একমাত্র ভিত্তি মনে করেছেন, তাঁরা তাদেরকেও ফিতরা দেয়া জায়েয বলেছেন। কিছু লোক আবার শর্ত আরোপ করেছেন যে, তা কেবল সে সব যিম্মির জন্যে জায়েয, যারা রাহেব পাদ্রী পর্যায়ের লোক। [(আরবী*************)] ইবনে আবু শাইবা আবূ মাইসারা থেকে বর্ণনা করেছন, তিনি রাহেবদেরকে ফিতরা বা সাদকা দিতেন। [(আরবী********)] আমর ইবনে মাইমুন, আমর ইবনে শারাহবীল ও মুররাতুল হাযাদানী থেকে বর্ণিত, তাঁরা রাহেবদেরকে ফিতরা দিতেন। [(আরবী*************)] আসলে এ হচ্ছে মানবীয় বদান্যতা, ইসলামের ক্ষমাশীল ভাবধারার প্রকাশ। শুধু বিরোধিতাই কারোর প্রতি সদাচরণ গ্রহণ করতে নিষেধ করে না- যদি সে মুসলমানদের সাথে শত্রুতা ও যুদ্ধ না করে। তাই ইসলামী পরিবেশে বসবাসকারী সব মানুষকেই ঈদের নির্মল আনন্দে পুরোপুরি অংশীদার করা অবশ্যই কর্তব্য হবে, তারা কারোর বিবেচনায় কাফির হলেও। তবে সে জন্যে শর্ত হচ্ছে প্রথমে মুসলিম ফকীর-মিসকীনদের সচ্ছল বানাতে হবে। তারপর উদ্ধৃত্ত থাকলে যিম্মীকে তা দেয়া যাবে। যাকাত ব্যয়ের ক্ষেত্র’ পর্যায়ে আমরা এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করে এসেছি। ফিতরাও কি যাকাতের আটটি খাতে বণ্টনীয় ফিতরা কেবলমাত্র ফকীর ও মিসকীনকেই দিতে হনে, না যাকাতের নির্দিষ্ট আটটি ব্যয় খাতে তা বণ্টন করে খরচ করতে হবে?..... এ একটি প্রশ্ন। শাফেয়ী মাযহাবের প্রসিদ্ধ মত হচ্ছে, মালের যাকাত যে আটটি খাতে ব্যয় করা নিয়ম, ফিতরাও সে খাতসমূহেই ব্যয় করা ওয়াজিব। এ আটটি খাতের উল্লেখ (আরবী*************) সুচক আয়াতে করা হয়েছে। এ আটটি খাতে তা সমানভাবে বণ্টন করতে হবে।[(আরবী*************)] ইবনে হাজমের মতও তাই। ফিতরার যাকাতদাতা নিজেই যদি তা বণ্টন করে, তাহলে যাকাত সংস্থায় নিয়োজিত কর্মচারী ও ময়াল্লাফাতু কুলুবুহম খাতে কিছুই ব্যয় করতে হবে না। কেননা এ দুটো খাতে যাকাত ব্যয় করা তো রাষ্ট্র প্রধানের কাজ, অন্য কারোর নয়। [(আরবী*************)] ইবনুল কাইয়্যেম এ মতের বিরোধিতা করেছেন। তিনি বলেছেন, সাদকায়ে ফিতর কেবলমাত্র এবং বিশেষভাবে মিসকীনদের মধ্যে বণ্টন করাই ছিল রাসূলে করীম (স) এর নীতি। এটা তিনি আটটি খাতে মুঠি-মুঠি করে কখনই বণ্টন করেননি। সেরূপ করা কোন নির্দেশও তিনি দেননি। সাহাবীদের মধ্যে কেউ এরূপ বণ্টন করেননি। তাবেয়ীরাও কেউ না। বরং আমাদের দুটো কথার একটা হচ্ছে, ফিতরা কেবলমাত্র মিসকীন ছাড়া অন্য কাউকে দেয়াই জায়েয নয়। এ মতটি আটখাতের বণ্টন করার মতের তুলনায় অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য। [(আরবী*************)] মালিকীদের মতে, ফিতরা ফকীর মিসকীনদের দেয়া হবে, এ কাজে নিযুক্ত কোন কর্মচারী বা কারোর দিন সন্তুষ্টকরণের জন্যে কাউকে কিছু দেয়া যাবেনা। দাস মুক্তির কাজেও তা ব্যয় করা যাবে না। ঋণগ্রস্ত মুজাহিদ, নিঃস্ব পথিককে তার বাড়িতে পৌছানো ইত্যাদি কোন খাতেই তা ব্যয়িত হবে না; বরং দেয়াই হবে দারিদ্র্যগুণ থাকলে। কোন স্থানে দরিদ্র লোক পাওয়া না গেলে নিকটবর্তী যেখানে গরীব লোক রয়েছে, সেখানে পাঠিয়ে দেয়া হবে। পাঠানোর খরচ কিন্তু ফিতরা দাতার নিজ থেকে বহন করতে হবে- ফিতরা থেকে নয়। তা ফিতরা থেকে দেয়া হলে এক ছা’ পরিমাণে ঘাটতি পড়বে। [(আরবী*************)] এ আলোচনা থেকে স্পষ্ট হল যে, এখানে তিনটি মত রয়েছেঃ ১. আটটি খাতে ফিতরা বণ্টন ওয়াজিব হওয়ার মত কিংবা তাদের মধ্যে যে যে খাতে লোক পাওয়া যাবে তাকে সমান পরিমাণে দিতে হবে। এটা শাফেয়ীদের প্রসিদ্ধ মত। ২. আটটি খাতে ফিতরা বণ্টন করা জায়েয হওয়ার মত। আর কেবল মাত্র দরিদ্রজনকে বিশেষভাবে দেয়ার মত। এটা জমহুর ফকাহবিদদের মত। কেননা সেটা সেই সাদকা যা কুরআনের কথাঃ ‘সাদকাত কেবল মাত্র ফকীর-মিসকীনদের জন্যে........ সাধারণত এর অন্তর্ভুক্ত। ৩. কেবলমাত্র এবং বিশেষভাবে ফকীরদের দেয়া ওয়াজিব হওয়ার মত। এটা মালিকী মাযহাবের মত- যেমন পূর্বে বলেছি। ইমাম আহমাদের দুটো মতের একটা এই। ইবনুল কাইয়্যেম এ মতকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। তাঁর উস্তাদ ইবনে তাইমিয়াও। আল-হাদী, আল-কাসেম এবং আবূ তালেবও এ মতই গ্রহণ করেছেনঃ ফিতরা কেবলমাত্র ফকীর-মিসকীনদের মধ্যে বণ্টন করতে হবে- অন্য কোন লোকের মধ্যে নয়। যাকাতের আটটি খাতের কোন একটিতেও নয়। কেননা হাদীসে উদ্ধৃত হয়েছেঃ ফিতরা মিসকীনদের খাদ্য।’ আর হাদীসঃ এ দিনে তাদের সচ্ছল বানিয়ে দাও। [(আরবী*************)] এ কথার গাম্ভীর্য গুরুত্ব অনস্বীকার্য। তা ফিতরার যাকাতের প্রকৃতির সাথে সঙ্গতিসম্পন্নও বটে। তার মৌল লক্ষ্যও তাই। কিন্তু তা সত্ত্বেও দ্বারা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেয়ার এবং প্রয়োজনকালে ও অন্যান্য খাতে তার কল্যাণকর অবদান হতে দেয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা উচিত নয় বলে আমি মনে করি। তাঁরা যেসব হাদীসের উল্লেখ করেছেন, তা থেকে স্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে, বিশেষভাবে সেই দিনের জন্যে ফকীর-মিসকীনদের সচ্ছল বানিয়ে দেয়াই ফিতরার সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য। অতএব তাদের পাওয়া গেলে অন্যদের ওপর তাদেরকেই অগ্রাধিকার দেয়া কর্তব্য। কিন্তু তা প্রয়োজন ও কল্যাণের দৃষ্টিতে অন্যান্য ব্যয় খাতেও তা ব্যয় করতে নিষেধ করে না। যেমন নবী করীম (স) মালের যাকাত পর্যায়ে উল্লেখ করেছেনঃ তা সমাজের ধনীলোকদের কাছ থেকে গ্রহণ করা হবে এবং সেই সমাজেরই দরিদ্র লোকদের মধ্যে তা বণ্টন করেদেয়া হবে। কিন্তু এ ঘোষণা কুরআনের যাকাত সংক্রান্ত আয়াতে যে সব খাতের উল্লেখ রয়েছে, তাতে তা ব্যয় করতে নিষেধ করছে না। এ আলোচনা থেকে সুস্পষ্ট হয়ে উঠে যে, আমাদের বিবেচনায় উত্তম মত হচ্ছে, ফকীর মিসকীনকে অন্যদের ওপর অগ্রাধিকার দিতে হবে। তবে বিশেষ প্রয়োজন ইসলামী কল্যাণ বিবেচনায় অন্য কিছু গ্রহণীয় বিবেচিত হলে ভিন্ন কথা। অধিকাংশ ফিকাহবিদের দৃষ্টিতে সহীহ মত হচ্ছে- একজন ব্যক্তির জন্যে করণীয় হল সে তার ফিতরা একজন বা বহু কয়েকজন মিসকীনকে দেবে। অনুরূপভাবে একটি সমাজ সংস্থার পক্ষে তাদের ফিতরা একজন মিসকীনকে দেয়াও জায়েয হবে। কেননা দলিল এর মধ্যে কোন পার্থক্য করা হয়নি। [(আরবী*************)] কেউ কেউ একজনের ফিতরা অনেক কয়েকজনকে দেয়া অপসন্দ করেছে। কেননা তাতে হাদীসে দরিদ্র ব্যক্তিদের যে সচ্ছল করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তা বাস্তবায়িত হতে পারে না। অনুরূপভাবে বহু লোকেরা ফিতরা একজন লোককে দিলে তারই মত বা তার চাইতেও অধিক বেশী অভাবগ্রস্ত ব্যক্তিদের বর্তমান থাকা সত্ত্বেও তাকে অন্যদের ওপর অধিক গুরুত্ব দেয়া হয় অথচ এরূপ অধিক গুরুত্ব দানের কোন যৌক্তিকথাই থাকতে পারে না। ফিতরা যাকে দেয়া যাবে না সাদকায়ে ফিতরা যতক্ষণ পর্যন্ত যাকাত থাকবে, ততক্ষণ তা মালের যাকাত যাদের দেয়া জায়েয নয়, তাদেরকে দেয়া জায়েয হবে না। ইসলামের দুশমন কাফির বা মুর্তাদ অথবা যে লোক তার ফিসক ফুজুরী দ্বারা মুসলমানদের চ্যালেঞ্জ করে, যে লোক স্বীয় মাল বা উপার্জনের দরুন ধনী অথবা উপার্জনে সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও শ্রম করে না বলে বেকার, তাছাড়া পিতামাতা, সন্তান-স্ত্রী, এদেরকে ফিতরা দেয়া যাবে না। কেননা মুসলমান যদি এ লোকদের ফিতরা দেয়, তাহলে কার্যত তা নিজেকেই দেয়া হবে। - এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা যাকাত ব্যয়ের খাত’ পর্যায়ে আমরা করে এসেছি। স্থানীয় দরিদ্র ব্যক্তি বেশী অধিকারী মালের যাকাত স্থানান্তর করা সম্পর্কে আমরা যা বলে এসেছি, এখানেও তাই বলব। তা হচ্ছে, যে স্থানের লোকদের ওপর ফিতরা ওয়াজিব- যেখানে ফিতরাদাতা বসবাস করে, তাদের ফিতরা সেখানকার দরিদ্র ব্যক্তিদের মধ্যেই বিতরণ করতে হবে। তার কারণসমূহও সেখানেই উল্লেখ করে এসেছি। আরও এজন্যে যে, ফিতরার যাকাত বিশেষভাবে দ্রুত সাহায্য দানের ব্যবস্থা-একটা বিশেষ সময়ের জন্যে। আর সময়টা হচ্ছে রমযানের ঈদ, কাজেই পাড়া-প্রতিবেশীরা স্থানীয় লোকেরাই তা পাওয়ার অধিক অধিকারী। তবে তাদের মধ্যে কেউ দরিদ্র না থাকলে ভিন্ন কথা। তখন তা নিকটবর্তী স্থানে পাঠিয়ে দিতে হবে। মালিকীদের এ মত আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি। আল-বহর, গ্রন্থে লিখিত আছেঃ কোন মহত্তর উদ্দেশ্য ছাড়া স্থানীয় দরিদ্র লোকদের পরিবর্তে অন্যদের মধ্যে ফিতরা বণ্টন করা মাকরূহ। [(আরবী*************)] পঞ্চম অধ্যায় যাকাত ছাড়া ধন-মালে কোন অধিকার কি স্বীকৃতব্য ধম-মালে যাকাত ছাড়া আরও কোন অধিকার স্বীকৃত না হওয়ার মত। যারা বলেন যে, ধন-মালে যাকাত ছাড়াও অধিকার আছে তাঁদের মত। বিরোধের বিষয় নির্ধারণ এবং অগ্রাধিকার দান। ধনমালে যাকাত ছাড়াও কোন অধিকার আছে কি কোন কোন বিষয়ে বহু মতের বিশেষ একটি মত ব্যাপক খ্যাতি ও বিপুল প্রসিদ্ধি লাভ করে- এটা প্রায়ই লক্ষ্য করা যায়। এমন কি অনেকে শেষ পর্যন্ত এ ধারণা পোষণ করতে থাকে, যে, এ পর্যায়ে এটাই একক ও অনুরূপ মত। এ ছাড়া ভিন্ন কোন মতই নেই। তার পক্ষের যুক্তি-প্রমাণ যতই দুর্বল হোক এবং বলার মত কথা কিছু নাই থাকে, যে দিকে তখন কিছুমাত্র ভ্রূক্ষেপ করা হয় না। এ পর্যায়ের একটি মত উল্লেখ্য। মতটি ফিকাহবিদদের মধ্যের শেষের দিকের লোকদের কাছে খুবই ব্যাপকভাবে প্রচারিত। আর তা হচ্ছে, ধন-মালে যাকাত ছাড়া আর কিছুই পাওয়ার নেই। কেউ তার যাকাত হিসেবে করে দিয়ে দিলে সে সর্বপ্রকার অর্থনৈতিক দায়-দায়িত্ব থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত হয়ে গেল। তার কাছে আর কিছু দাবি করা যেতে পারে না। এমন কি দ্বীনী ইলমের চর্চাকারী বহু লোকের কাছেও এ ব্যাপারটি যেন সর্ববাদীসম্মত চূড়ান্তভাবে স্বীকৃত হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ অধ্যায়টি তিনটি পরিচ্ছেদ বিভক্তঃ প্রথমত ধন-মালে যাকাত ছাড়াও কোন প্রাপ্য আছে- একথা যাঁরা স্বীকার করেন না, তাঁদের মতের ব্যাখ্যা। দ্বিতীয়ত, যাঁরা বলেন-ধন-মালে যাকাত ছাড়াও অধিকার আছে, তাদের মতের বিশ্লেষণ। এবং তৃতীয়ত, দুই পক্ষের মধ্যে বিরোধীয় স্থান উন্মুক্তকরণ এবং যেটি অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য, সেটিকে অগ্রাধিকার দান। প্রথম পরিচ্ছেদ ধন-মালে যাকাত ছাড়া আরও কিছু অধিকার থাকার বিরোধী মত বহু সংখ্যক ফিকাহবিদ এ মত গ্রহণ করেছেন যে, ধন-মালের ওপর একমাত্র অধিকার হচ্ছে যাকাত। যে লোক যাকাত দিয়ে দিল, সে তার ধন-মালকে পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করে নিল। তার দায়িত্ব পালিত হল এবং সে দায়িত্বমুক্ত হয়ে গেল। অতঃপর তার কাছে আর কিছুই চাওয়া বা দাবী করার সুযোগ থাকতে পারে না। তবে সে নিজে নফল দান-সদকা করে আল্লাহর কাছে অধিক সওয়াব পাওয়ার ও সওয়াবের বিপুলতা লাভের আশায়, তা হলে সেটা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র কথা। শেষের দিকে ফিকাহবিদদের কাছে এ মতটাই অধিকতর খ্যাতি ও প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। এমন কি তাঁরা মনে করে নিয়েছেন যে, এ ব্যাপারে ভিন্ন কোন মতই নেই। এ মতের সমর্থনে উপস্থাপিত হদীসসমূ (১) এ মতের ধারকগণ হযরত তালহা (রা) থেকে বর্ণিত ও বুখারী মুসলিম প্রমুখের গ্রন্থাবলীতে উদ্ধৃত হাদীসটির ওপরই একান্তভাবে নির্ভর করেছেন। তা হচ্ছে, নযদের অধিবাসী েএক ব্যক্তি রাসূলে করীম (স) এ খেদমতে উপস্থিত হল। তার মাতার চুল বিদ্ধস্ত, এলোমেলো, তার আওয়াজের প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছিল কিন্তু কি বলছিল, তা ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না। লোকটি শেষ পর্যন্ত রাসূল (স) এ নিকটবর্তী হয়ে গেল এবং সে ইসলাম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছিল। তখন রাসূল (স) বলেছেনঃ রাত দিনের মধ্যে পাঁচ ওয়াক্ত নামায। বললঃ এছাড়াও কি আমার কিছু করণীয় আছে? বললেনঃ না, তবে তুমি যদি নফল পড় তাহলে সে কথা আলাদা। রাসূলে করীম (স) বললেন, আর রমযান মাসের রোযা। বলল, তা ছাড়াও কি রোযা রাখতে হবে আমাকে? বললেন, না, তবে তুমি যদি নফল রোযা থাক, তাহলে সে স্বতন্ত্র কথা। অতপর তিনি যাকাতের উল্লেখ করলেন। লোকটি বললঃ যাকাত ছাড়াও কিছু দেয় আছে? বললেনঃ না, তবে তুমি যদি নফল দান কর, সে আলাদা কথা। তখন লোকটি পিছনে সরে আসতে আসতে বলতে লাগলঃ আমি এর অতিরিক্তও কিছু করব না আর এর চাইতে কমও করব না। তখন নবী করীম (স) বললেনঃ লোকটি যা বলছে তা সত্য হলে সে নিশ্চয়ই সফল হবে অথবা বললেনঃ লোকটি যা বলছে তা সত্য প্রমাণ করলে জান্নাতে প্রবেশ করবে। [হাদীসটি তিরমিযী ছাড়া অন্য ছয়খানি গ্রন্থে উদ্ধৃত। (আরবী************) গ্রন্থে তাই বলা হয়েছে।] (২) অনুরূপ আর একটি হাদীস হযরত আবূ হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত ও বুখারী শরীফে উদ্ধত। এক বেদুঈন নবী করীম (স) এর কাছে উপস্থিত হল। সে বললঃ আমাকে এমন একটা কাজের ধারা বলে দিন, যা করল আমি জান্নাতে দাখিল হতে পারব। তখন নবী করীম (স) বললেনঃ আল্লাহর বন্দেগী কর, তাঁর সাথে কোন কিছুই শরীক বানাবে না, ফরয নামায পড়বে, নির্দিষ্ট ধার্যকৃত যাকাত আদায় করবে এবং রমযান মাসের রোযা থাকবে। লোকটি বললঃ যার হাতে আমার প্রাণ, তাঁর কসম করে বলছি, এর অধিক কিছু আমি করব না। লোকটি যখন চলে গেল, তখন রাসূলে করীম (স) বললেনঃ সে কেউ একজন জান্নাতী লোক দেখতে চায় সে যেন এ লোকটিকে দেখে। [তিরমিযী (আরবী************) উদ্ধৃত (আরবী************) তিনি বলেছেন’ হাদীসটি (আরবী************) হাকিমও উদ্ধৃত করেছেন এবং বলেছেন (আরবী************) যাহবী এ কথার যথার্থতা মেনে নিয়েছেন – ১ম খণ্ড ৩৯০ পৃ. কিন্তু ইবনে হাজার (আরবী************) গ্রন্থের ১৭৭ পৃষ্ঠায় লিখেছেনঃ এর সনদ যয়ীফ।] (৩) তাদের আর একটি দলিল হচ্ছে আবূ হুরায়রা (রা) বর্ণিত তিরমিযী উদ্ধৃত হাদীসটি। নবী করীম (স) বলেছেন, তুমি যখণ তোমার মালের যাকাত দিয়ে দিলে, তখন বুঝবে তোমার ওপর যা দেয় বর্তিয়েছে তা তুমি দিয়ে ফেলেছ। [ইবনে খুজায়মা ও হাকেম উদ্ধত করেছেন, ১ম খণ্ড- ৩৯০ পৃ. বলেছেন, মুসলিমের শর্তে হাদীসটি সহীহ। যাহবী এ কথা সমর্থন করেছেন। ইবনে হাজার ফতহুল বারী গ্রন্থের (৩য় খণ্ড, ১৭৫ পৃ.) বলেছেনঃ আবূ জুমরা ও বায়হাকী প্রমুখ হাদীসটির موقوف হওয়া- কোন সাহাবীর উক্তি হওয়াটাকে অধিক ঠিক মনে করেছেন। বাজ্জারও সে মত দিয়েছেন। দুনিয়ার নিকৃষ্টতম মাল- তা থেকে বরকত ধ্বংসকারী এবং পরকালে আযাবের ব্যবস্থাকারী হচ্ছে তা-ই যা আল্লাহর অধিকার বিনষ্টকারীর জন্যে প্রস্তুত হয়ে রয়েছে।] আর যে লোক তার মালের ওপর ধার্য অধিকার আদায় করল, তার ওপর সে ব্যাপারে কোন হক ধার্য নেই মনে করতে হবে এবং বাধ্যতামূলকভাবে আরও কিছু দেয়ার জন্যে তার কাছে দাবি করা যাবে না। (৪) হাকিম হযরত জাবির থেকে রাসূলের কথা হিসেবে যা উদ্ধত করেছেন, তাও এ পর্যায়ের আর একটি দলিল। তা হচ্ছেঃ তুমি যখন তোমার মালের যাকাত আদায় করে দিলে, তখন তুমি তার খারাপ অংশটা তা থেকে দূর করে দিলে। বস্তুত মালের ওপর যে সব হক-হক্ক ধার্য হয়, তা সব আদায় করে দিয়ে দিলে দুনিয়া ও আখেরাতে মালের খারাপ অংশটা মানুষটি থেকে দূরে সরে যায়। (৫) হাকিম উম্মে সালমা থেকে যা উদ্ধৃত করেছেন, তাও একটি দলিল। উম্মে সালমা স্বর্ণালংকার পরতেন। তিনি এ বিষয়ে রাসূলে করীম (স) এর কাছে জিজ্ঞেস করলেনঃ এতে কি তা নিষিদ্ধ পুঁজিকরণ হয়? নবী করীম বললেনঃ তুমি যদি ওর যাকাত দিয়ে দাও তাহলে তা নিষিদ্ধ পুঁজিকরণ হবে না তাতে। [হাকিম লিখেছেনঃ (১ম খণ্ড, ৩৯০ পৃ.) হাদীসটি বুখারীর শর্তের ভিত্তিতে সহীহ। যাবরী তা সমর্থন করেছেন। হাদীসটির সনদে আপত্তি আছে। তৃতীয় অধ্যায়ের আলোচনায় অলংকারের যাকাত পর্যায়ে এ বিষয়ে কথা বলে এসেছি, তা দ্রষ্টব্য।] তার অন্যান্য বর্ণনায় এ কথা রয়েছেঃ যে মালের পরিমাণ যাকাত হওয়ার যোগ্য হবে তার যাকাত দিয়ে দেয়া হলে তা নিষিদ্ধ পুঁজি হবে না। [হাদীসটি আবূ দাউদ কর্তৃক উদ্ধত।] এ কথায় একথা প্রমাণিত হয় যে, মাল-সম্পদ পুঁজিকরণের ওপর আযাবের যে সব ধমক এসেছে, তা যাকাত আদায়কারীর পক্ষে প্রযোজ্য নয়। যাকাত ছাড়া মালে অন্য কোন ফরযও যদি থাকত, তাহলে তা আযাবের ধমক থেকে সে নিষ্কৃতি পেত না। এ মতের কোন কোন লোক উপরিউক্ত আলোচনার পর অতিরিক্ত কথাও বলেছেন। তাঁরা নবী করীম (স) থেকে একটা সুস্পষ্ট ঘোষণকারী হাদীসও উদ্ধৃত করেছেন। বলেছেনঃ ধন-মালের ওপর যাকাত ছাড়া আর কোন হক নেই। [হাদীসটি ইবনে মাযাহ কর্তৃক উদ্ধত। কিন্তু নববী তাঁর (আরবী************) গ্রন্থে লিখেছেনঃ হাদীসটি খুবই যয়ীফ অপরিচিত (৫ম খণ্ড ৩৩২ পৃ.)। পূর্বে বায়হাকী এ হাদীসটি সম্পর্কে বলেছেনঃ আমাদের লোকেরা এ হাদীসটি (আরবী************) এর মধ্যে বর্ণনা করেন। আমি ওর কোন সনদ মুখস্থ করিনি (আরবী************) হাফেয আল এর ওপর আপত্তি তুলেছেন ইবনে মাযাহর বর্ণনা দিয়ে যে, তাঁর সুনানে ও ভাষায়ই উদ্ধৃত হয়েছে। তার পুত্র হাফেয আবূ জুরয়া উল্লেখ করেছেনঃ হাদীসটি তাঁর মতে ইবনে মাযাহয় এ ভাষায় রয়েছেঃ ধন-মালের যাকাত ছাড়া আর কোন হক নেই। (আরবী************) তার অর্থ ’নেই’ কথাটি হাদীসে লেখকের পক্ষ থেকে বাড়িয়ে লেখা হয়েছে। পরে এই ভুলটা ব্যাপক প্রচার লাভ করে। আল্লামা শায়খ আহমদ শাকের (র) (আরবী************) গ্রন্থেল তাফসীরে তাবারীর (৩য় খণ্ড, ৩৪৩-৩৪৪ পৃ. আল –মায়ারিফ) লিখেছেনঃ ইবনে মায়াহর গ্রন্থে এ ভুলটি সংঘটিত হওয়ার প্রমাণসমূহ এইঃ (ক) তাবায়ী উক্ত হাদীসটি (২৫২৭ নম্বর) মূল ইয়াহইয়া ইবনে আদমের র্সূত্রে- যে সূত্রে ইবনে মাজাহ হাদীসটি নিয়েছেন উদ্ধুত করেছেন। সেখানে হাদীসটির ভাষা হচ্ছেঃ ধন-মালের যাকাত ছাড়াও হক রয়েছে। খ. ইবনে কাসীর তাঁর তাফসীর হাদীসটি তিরমিযী ও ইবনে মাজা উভয় থেকে নিয়েছেন বলে উল্লেখ করেছেন। তাতে এ দুটির মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। নাবলিসী তাঁর (আরবী************) ১১৬৯৯ গ্রন্থে তাই করেছেন। একই হাদীস হিসেবে উভয়ের প্রতি নিসবাত করেছেন। গ. বায়হাকীর কথা- যেমন পূর্বে উদ্ধৃত হয়েছে- আমি এর সনদ মুখস্থ করিনি- ইবনে মাজাতে যদি এ ভাষায়ই উদ্ধৃত যাকাত তাহলে তিনি নিশ্চয়ই এরূপ বলতেন না। নববীর কথা- পরিচিত নয়- এ পর্যায়েরই আবূ জুররা যা বলেছেন, শায়খ শাকের সেদিকে উঙ্গিত করেন নি। সম্ভবত তিনি তা জানতেই পারেন নি। হাদীসটিতে ওলট পালট (আরবী************) হয়েছে, বলার পরিবর্তে উপরিউক্ত বিশ্লেষণই অধিক যথার্থ ও সঠিক। কেননা দেখা যায় হাদীসটি একই সূত্রে দুই রকম পরস্পর বিপরীত ভাষায় উদ্ধৃত হয়েছে। এটাই প্রচারিত।] এ সমস্ত হাদীসের বাহ্যিক অর্থ এ গ্রহণ করা হয় যে, ধন-মালের ওপর যাকাত ছাড়া। আর কোন হক ধার্য নেই। আর প্রথমোক্ত হাদীস দুটো সহীহ হাদীসসমূহের অন্যতম। আর যথার্থতার ওপর কোন দোষারোপ নেই। তৃতীয় হদীসটির সনদ যয়ীফ বলা হয়েছে। আর চতুর্থ হাদীসটি সাহাবীর ওপর (আরবী************) কোন সাহাবীর উক্তি হওয়াটাই ঠিক। আর পঞ্চম হাদীসটির সনদে আপত্তি আছে। তবে যে হাদীসটি ধন-মালে যাকাত ছাড়া কোন হক্ক নেই’ বলছে, সেটি যারপরনাই রকমের যয়ীফ, প্রত্যাখ্যাত নিঃসন্দেহ। বরং তা ভুল এবং বিকৃত, পরিবর্তিত। সহীহ হাদীস দুটিই তার প্রতিবন্ধক। বিপরীতধর্মী দলিলসমূহ সম্পর্কে তাদের বক্তব্য যে সব হাদীস ধন-মালের ওপর যাকাত ছাড়াও হক আছে বলে প্রমাণ করছে, উক্ত মতের লোকেরা তার ব্যাখ্যা করেছেন। বলেছেন যে, এগুলোতে মুস্তাহাব হিসেবে যাকাত বহির্ভুত দানের কথা বলা হয়েছে, তা ওয়াজিব নয় এবং বাদ্যতামূলক নয়। অথবা তাঁরা বলেছেন, হ্যাঁ, যাকাত ফরয হওয়ার পূর্বে যে হক ছিল, যাকাত ফরয হওয়া পর বাতিল ও মনসূখ হয়ে গেছে পূর্বে যত অধিকার ছিল তা সবই। ঠিক যেমন আল্লাহর কথাঃ (আরবী************) ’এবং দাও তার হক তা কর্তনের দিন।’ অথবা তাঁরা তার কোন-না-কোন ব্যাখ্যা করেছেন এই বলে যে, তা ওয়াজিব হবে নিতান্ত প্রয়োজন কালে। লোকেরা الماعون সম্পর্কে বলেছেন। কেউ কেউ الماعون এর তাফসীর করেছেন যাকাত। কোন কোন সাহাবী থেকে তা বর্ণিত। কিন্তু তাতে যাকাতের পরও কোন হক ধার্য হতে পারে, তার প্রমাণ নেই। তিরমিযী ফাতিমা বিনতে কাইস থেকে রাসূলে করীম (স) এর কথা হিসেবে যে হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন তা হচ্ছেঃ ধন-মালে যাকাত ছাড়াও অধিকার আছে। [এ হাদীসটি সম্পর্কে তিরমিযী বলেছেনঃ এটির সনদ ওরূপ নয়। আবূ মামুন আল-আওয়ার হাদীসটিকে যয়ীফ করেছে। তাবায়ীর এ হাদীসটি এনেছেন (৩য় খণ্ড, ১৭৬-১৭৭ পৃ.) ২৫২৭ ও ২৫৩০ উভয় হাদীসে। দারেমী (১ম খণ্ড, ৩৮৫ পৃ.) ইবনে মাজা ১৭৮৬ ইয়াহিইয়া ইবনে আদম সূত্রে। আর বায়হাকী (আরবী************) (৪র্থ খণ্ড, ৮৪ পৃ.)] তিরমিযী এই হাদীসটিকে যয়ীফ বলেছেন। কেননা এটি আর হামজী মাইসুন আল-আওযার আল-কাসসাবে সূত্রে বর্ণিত। [ইবনে হাজার (আরবী************) গ্রন্থে এবং বুখারী (আরবী************) তে। আর ইবনে আবূ হাতিম (আরবী************)] আর হাদীসবিদদের নজরে লোকটি খুব বেশী যয়ীফ। ফলে তার বর্ণনা দলিল হতে পারে না। দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ ধন-মালের যাকাত ছাড়া অধিকার আছে-এই কথায় বিশ্বাসীদের মত সাহাবী ও তায়েয়ীনের সময় থেকেই কিছু লোক এ মত পোষণ করে আসছেন যে, লোকদের ধন-মালে যাকাত ছাড়াও অধিকার রয়েছে। হযরত উমর, আলী, আবূযর আয়েশা, ইবনে উমর, আবূ হুরায়রা, হাসান ইবনে আলী এবং ফাতিমা বিনতে কাইম প্রমুখ সাহাবী (রা) এ মত পোষণ করতেন। আর শবী, মুজাহিদ, তায়ূস, আতা প্রমুখ তাবেয়ীরও এ ব্যাপারে এ মতই ছিল। তাঁদের দলিল তাঁরা দলিল হিসেবে প্রথমত পেশ করেছেন আল্লাহ তাআলার এ আয়াতঃ (আরবী************) পূর্ব ও পশ্চিম দিকে তোমরা মুখ করে থাকবে এটাই কোন পূণ্যময় কাজ নয়। প্রকৃত পূণ্যময় কাজ সে করেছে, যে ঈমান এসেছে আল্লাহর প্রতি, পরকালের প্রতি, ফেরেশতার প্রতি, কিতাবের প্রতি, নবীগণের প্রতি, এবং দিয়েছে মাল তাঁরই ভালোবাসায় নিকটাত্মীয়, ইয়াতিম, মিসকীন, নিঃস্ব পথিক, প্রার্থী ভিক্ষুক ও দাসদের জন্যে আর কায়েম করেছে নামায, দিয়েছে যাকাত এবং নিজেদের ওয়াদা পূরণকারী হয়েছে যখন তারা ওয়াদা করেছে আর ধৈর্যধারণকারী হয়েছে স্বাচ্ছন্দ্যকালে ও অভাব অনটনের সময়ে এবং ঠিক স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে। এ লোকেরাই সত্যতা প্রমাণকারী এবং এরাই মুত্তাকী। তিরমিযী প্রমুখ বর্ণনা করেছেন, নবী করীম (স) নিজে এ আয়াত কয়টি পাঠ করে উল্লিখিত বিধানের দলিল পেশ করেছেন। ফাতিমা বিনেত কাইস (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, আমি অথবা কেউ রাসূল করীম (স) কে যাকাত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেনঃ (আরবী************) নিশ্চয়ই ধন-মালের যাকাত ছাড়াও হক রয়েছে। পরে সূরা আল-বাকারার উপরিউক্ত আয়াতসমূহ পাঠ করেছেন। এ হাদীসে যদি কোন দুর্বলতা থেকে থাকে- যেমন তিরমিযী বলেছেন – তাহলেও উপরিউক্ত আয়াতটি তাকে শক্তিশালী করে তুলছে। দাবিটাকে অনস্বীকার্য বানাচ্ছে। এ আয়াতই এককভাবে চূড়ান্ত পর্যায়ের দলিল। কেননা আয়াতে পরম পূণ্যময় কাজের (আরবী************) শাখা ও উপকরণ বানানো হয়েছে তার ভালোবাসায় নিকটাত্মীয় ইয়াতীম মিসকীন নিঃস্ব পথিক ইত্যাদিকে অর্থদানের কাজকে।’ এরই ওপর ভিত্তি করে বলা হয়েছে নামায কায়েম করা ও যাকাত প্রদান করার কথা। বলার ভঙ্গীরই দুটো আলাদা জিনিসরূপে দাঁড় করে দিচ্ছে। ফলে প্রমাণিত হল, প্রথমে মাল দান ও পরে যাকাত দান- এক নয় ভিন্ন ভিন্ন কাজ। কুরতুবী উক্ত হাদীসের ওপর মন্তব্য করতে গিয়ে বললেণঃ হাদীসটিতে আপত্তি থাকলেও তার বক্তব্য যে সহীহ তামূল আয়াতে বলা এবং নামায কায়েম করা ও যাকাত প্রদান কথাটিই প্রমাণ করছে। এখানে নামাযের সাথে সাথে যাকাতের কথা বলা হয়েছে। এটা প্রমাণ করছেঃ (আরবী************) আল্লাহর ভালোবাসায় মাল দান ও ফরয যাকাত এ দুটো জিনিস। অন্যথায় একই কথার পুনরাবৃত্তি হয়। (আর কুরআনে তা শোভণ বা সম্ভব নয়) [তাবারী লিখেছেন, কেউ যদি প্রশ্ন করে যে, ধন-মালের যাকাত ছাড়াও ফরয হিসেবে দান করার কোন বাধ্যবাধকতা আছে কি? বলা হয়েছে, এ ব্যাপারে ব্যাখ্যাকারগণ বিভিন্ন কথা বলেছেন। কেউ কেউ বলেছেঃ ধন-মালের যাকাত ছাড়াও এমন সব অধিকার আছে যা দেয়া ওয়াজিব। তাঁরা উপরিউক্ত আয়াতকে দলিল রূপে পেশ করেছেন। আল্লাহই যখন বললেনঃ (আরবী************) এবং অন্যান্য যার যার নাম তিনি উল্লেখ করেছেন এ সাথে তার পরে বলেছেনঃ নামায কয়েম করে ও যাকাত দিয়েছে। এ থেকে আমরা জানতে পারলাম যে, মুমিনদের পরিচিতিস্বরূপ নিকটাত্মীয় ও অন্যান্যদের যে মালদানের কথা বলা হয়েছে, তা সেই যাকাত নয় যার কথা উল্লেখ করা হয়েছে শেষে। কেননা এ যদি একই মাল হতো তাহলে এভাবে দুবার বলার কোন অর্থ হতো না। তারা এও বলেছেনঃ আল্লাহর অর্থহীন কোন কথা বলবেন, এটা যখন জায়েয নয়। তখণ আমরা জানতে পারলাম যে, প্রথম মাল দানের কথাটি যাকাত থেকে ভিন্নতরও স্বতন্ত্র একটা জিনিস। আর তারপরে যে যাকাতের কথা হয়েছে তা ভিন্ন জিনিস। তাঁরা এও বলেছেনঃ পরন্তু আমরা যা বলেছি, ব্যাখ্যাকারগণ তার সত্যতা স্বীকার করেছেন। অন্যরা বলেছেনঃ প্রথমে যে মালের কথা বলা হয়েছে তা যাকাত।..... ইমাম তাবারীর উক্ত কথা থেকে বোঝা যায় যে, তিনি প্রথম কথটি সমর্থনের প্রবণতা রাখেন। দেখুনঃ (আরবী*************)] প্রথমে যে দান করার- দেয়ার কথা- বলা হয়েছে তা নিতান্ত নফল দান, আত্মীয়তা রক্ষা করার দান, ওয়াজিব নয়, এরূপ কথা বলা যেতে পারে না। কেননা আয়াতটি হচ্ছে বাহ্যিক প্রকাশ ও সূরত ধারণকারী ইয়াহুদীদের নীতির প্রতিবাদ এবং প্রকৃত সত্য পরম পূণ্য কাজ ও সত্য দ্বীন বর্ণনা। এরূপ ক্ষেত্রে কেবল মৌলিক বিষয়েরই অবতারণা করা শোভন, সম্পূরক বিষয়াদি বলার ক্ষেত্র এটা নয়। কেবল ফরয কাজের কথাই বলতে হয়, নফল, ওয়াজিব ও মুস্তাহাব বিষয়ের কথা নয়। প্রকৃত بر পরম পুণ্যময় কাজেরও ব্যাখ্যাস্বরূপ। আয়াতটিতে যে সব বিষয়ের উল্লেখ করা হয়েছে, তা হচ্ছেঃ আল্লাহ ও পরকালে, ফেরেশতা, কিতাব ও নবীগণের প্রতি ঈমান এবং নামায কায়েম করা, যাকাত প্রদান করা, ওয়াদা পুরণ করা, সুখ-দুঃখে ও শক্তি-সামর্থ্যকালে ধৈর্য ধারণ- এ সবগুলোই মৌলিক উপাদান পর্যায়ের। এগুলো ছাড়া আকিদা বা ইবাদত অথবা নৈতিক চরিত্র- কোন একটি দিক দিয়েও ‘পরম পুণ্যময় কাজ البر বাস্তবায়িত হতে পারে না। তাহলে শুধু নিকটাত্মীয়দের ধন-মাল দেয়া আল্লাহর ভালোবাসায়ই একটি একক নফল বা মুস্তাহাব কাজ গণ্য হবে- গোটা আয়াতটির মধ্যে?........ এটা মেনে নেয়া যায় না। আবূ উবাইদ উল্লেখ করেছেন, তাবেয়ীনের মধ্যে কোন কোন লোক- যেমন দহহাক- মনে করে যে, এ আয়াতটি মনসুখ হয়ে গেছে। যাকাত কুরআনে উল্লিখিত সব ‘সাদকা’কেই প্রত্যাহার করিয়ে দিয়েছে। [(আরবী*************)] কিন্তু এ ধরনের কথা বলা অত্যন্ত দুঃসাহসিকতার দাবি। কোন দলিল বা প্রায় দলিলও এ কথার সমর্থন দেবে না। কেবল মৌলিক দাবির জোরেই তো আল-কুরআন মনসূখ করা যায় না; দহহাকের কথাই যদি সহীহ হত তাহলে আয়াতের (আরবী*************) কথাটাই মনসুখকারী হত (আরবী*************) এ কথার। তাতে আয়াতের একটা অংশ অপর অংশের মনসূখ হওয়ার হুকুমদাতা মনে করা হত। কিন্তু এসম্পূর্ণ অযৌক্তিক। তাছাড়া আয়াতটিতে একটি আছে সংবাদ আর আছে বির ও তাকওয়াধারী লোকদের গুণ পরিচিত। সংবাদ কখনও মনসুখ হতে পারে না। মনসুখ হলে তা সংবাদদাতাকে মিথ্যাবাদী প্রমাণ করবে। আল্লাহ তাঁর ঊর্ধ্বে মহান পবিত্র এই দোষারোপ থেকে। আবূ উবাইদ এ আয়াত প্রসঙ্গে ইবনে আব্বাস (রা) এর এ কথাটি উদ্ধৃত করেছেনঃ উক্ত আয়াত মদীনায় নাযিল হয়েছিল যখন ইসলামের ফরযসমূহ নাযিল হয়েছিল, দণ্ড বিধান কার্যকর হয়েছিল এবং লোকদেরকে তদানুযায়ী আমল করার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল।[(আরবী*************)] দ্বিতীয় দলিলঃ কাটাকালে ফসলের হক তাদের আর একটি দলিল হচ্ছে সূরা আনআমের একটি আয়াত। আল্লাহ তাআলা বাগ-বাগিচা, খেজুর বাগান, কৃষি ফসল, জয়তুন ও আনার- পরস্পর সদৃশ ও অসদৃশ- সৃষ্টি করে তাঁর বান্দাদের প্রতি যে অসীম-অশেষ অনুগ্রহ প্রদর্শন করেছেন, সেই কথার উল্লেখ করার পর বলেছেঃ (আরবী*************) তোমরা খাও তার ফল, যখন তা ধারণ করবে এবং দাও তার হক কাটার দিন এবং সীমা লঙ্ঘন করো না। কেননা আল্লাহ সীমা লঙ্ঘনকারীদের পসন্দ করেন না। তাঁদের বক্তব্য হচ্ছে, এ আয়াতে যে হক দিতে হয়েছে তা যাকাত থেকে স্বতন্ত্র ও ভিন্নতর। এ কথাটি কয়েকটি দিক দিয়েই সুস্পষ্ট ও প্রকটঃ ১. এ আয়াতটি মক্কী, মদীনায় ওশর ফরয হওয়ার পূর্বেই নাজিল হয়েছে। তার মক্কী হওয়ার প্রমাণ এই যে, গোটা সূরাই মক্কায় এক সাথে নাযিল হয়েছিল। এ পর্যায়ে বহু কয়টি প্রসিদ্ধ বর্ণনাও উদ্ধৃত হয়েছে। (পূর্বে সে কথা আমরা বলে এসছি) কেবলমাত্র এই আয়াতটি মাদানী এ কথা বলা দলিলহীন দাবিমাত্র। ২. আয়াতটির দাবি হচ্ছে, ফল ও ফসলের হক দাও তা কাটার দিন। কিন্তু তা ওশর যাকাতের বেলায় হয় না। ওশর তো ফল পরিচ্ছন্ন ও ঝারা-পোছার পর। অন্যকথা প্রকৃত প্রাপ্তি পরিমাণ নির্ভুলভাবে জানা যাবে না। তার পরই ওশর দিতে হয়- অথবা অর্ধ ওশরে। ৩. আয়াতে আল্লাহর কথাঃ এবং সীমালঙ্ঘন করোনা, কেননা আল্লাহ সীমা লঙ্ঘনকারীকে পসন্দ করেন না, যাকাতে তো কোন সীমালঙ্ঘন নেই। কেননা তা তো শরীয়াতদাতা কর্তৃক পরিমাণ নির্দিষ্ট, সুপরিচিত। তার একবিন্দু কম করা বেশী করার কোন অধিকার নেই করোর। [দেখুনঃ (আরবী*************)] যিনি বলেন, উক্ত আয়াত যে হক টি দিতে বলা হয়েছে, তা প্রথমে ওয়াজিব ছিল, পরে তা মনসুখ হয়ে গেছে। তার প্রতিবাদ করে এ লোকেরা বলেছেন, মনসুখ হওয়াটা শুধু সম্ভাব্যতা ও মৌখিক দাবির ভিত্তিতে প্রমাণিত হয় না। ইবনে হাজম বলেছেনঃ যে লোক দাবি করে যে, তার মনসুখ হয়ে গেছে, তার এ কথা সত্য হতে পারে কেবলমাত্র এমন এক অকট্য দলিলের ভিত্তিতে, যার রাসূল করীম (স) এর কাছে থেকে পাওয়া গেছে। অন্যথায় যে কোন ব্যক্তি যে কোন আয়াত সম্পর্কে এরূপ দাবি করে বসতে পারে, যে কোন হাদীসকে মনসুখ বলে তা মানতে অস্বীকার করতে পারে। কোন কিছুর মনসুখ হওয়ার দাবি সেই দলিলের মধ্যমে আল্লাহর দেয়া আদেশ মানার বাধ্যবাধকতা প্রত্যাহার করা শামিল। এটা কোন সহীহ সনদে প্রমাণিত অকট্য দলিল ছাড়া জায়েয হতে পারে না। [(আরবী*************)] ইবনে হাজম বলেছেন, যদি বলা হয় যে, উক্ত আয়াতে কোন কাজটি ফরয করা হয়েছে? আমরা বলব ফরয করা হয়েছে এমন একটি হক দেয়া যা যাকাত ছাড়া অন্য কিছু। আর তা হচ্ছে এ যে, ফসল কাটাইকারী ফসল কাটার সময় যা মন চায় তাই দান করবে। এটা জরুরী কিন্তু পরিমাণে নির্দিষ্ট নয়। এটা আয়াতের বাহ্যিক তাৎপর্য। আগেরকালের বেশ কিছু মনীষী এ কথাই বলেছেন।[(আরবী*************)] এ কারণে ইবনে উমর (রা) থেকে এ হক حق এর ব্যাখ্যায় বর্ণিত হয়েছেঃ তখনকার লোকেরা এমন পরিমাণ দিত যা যাকাত ওশর থেকে আলাদা। আতা বলেছেনঃ সেই সময় উপস্থিত গরীব-মিসকীনদের যা সম্ভব হয়দেবে। কিন্তু তা ওশর গণ্য হবে না। মুজাহিদ বলেছেনঃ মিসকীন লোকেরা উপস্থিত হলে তা থেকে (যা সম্ভব) তাদের প্রতি নিক্ষেপ করে দেবে। তিনি আরও বলেছেনঃ ফসল ফেলার সময় একমুঠি দেবে, কাটার সময় এক মুঠি দেবে এবং কাটাইকালে যা পড়ে থাকবে তা কুড়িয়ে নেবার তাদের সুযোগ দেবে। ইবরাহীম নখয়ী বলেছেনঃ পার্সেল পাঠাবার মত দেবে। [(আরবী*************)] আবূল আলীয়া, সায়ীদ ইবনে জুবাইর, আলী ইবনে হুসাইন, রুবাই, ইবনে আনাস প্রমুখও উপরিউক্ত ধরনের কথা বলেছেন। [(আরবী*************)] ইবনে কাসীর বলেছেন, আল্লাহ তাআলা তিরস্কার করেছেন সেই লোকদের যারা ফসল কাটে কিন্তু তা থেকে সাদকা করে না। যেমন সূরা ن এ বাগান মাকিলদের সম্পর্কে বলা হয়েছে। [দেখুনঃ (আরবী*************)] এ আয়াতে হক বলতে কি বোঝানো হয়েছে তা নির্ধারণে এবং যাকাতের দ্বারা তার মনসুখ হয়ে যাওেয়ার ব্যাপারটিকে অগ্রাধিকার দান পর্যায়ে যে মত পার্থক্য রয়েছে, তা ইতিপূর্বে সবিস্তার উল্লেখ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে মনসূখ হওয়ার তাৎপর্য হচ্ছে এবং ইবনে উমর (রা) এ ন্যায় একজন মহাসম্মানিত সাহাবী এবং আতা মুজাহিদ ও নখয়ী প্রমুখ তাবেয়ী ফিকাহ বিশারদগনের এক বিরাট জামায়াত এ আয়াত থেকে যে তাৎপর্য গ্রহণ করেছেন, তা হচ্ছেঃ ধন-মালে যাকাত ছাড়াও অধিকার আছে। তৃতীয় দলিলঃ গবাদি পশুর ও ঘোড়ার হক তাঁদের তৃতীয় দলিল হচ্ছে সে সব সহীহ হাদীস যাতে উট ও ঘোড়ার বিশেষ অধিকারের কথা বলা হয়েছে। তন্মধ্যে একটি হাদীস হযরত আবূ হুরায়রা (রা) বর্ণিত ও বুখারী কর্তৃক উদ্ধৃত। তা হচ্ছে, নবী করীম (স) বলেছেনঃ (কিয়ামতের দিন) উট তা মালিকের কাছে আসবে তা সুস্থ সবল দেহ নিয়ে। দেখা যাবে যে, তার ব্যাপারে হক ধার্য ছিল, তা আদায় করা হয়নি। তখণ সে তার ক্ষুর দিয়ে সেই মালিককে দলন করবে। এ ছাড়া ছাগল আসবে তা সুস্থ সবল দেহ নিয়ে। সহসা দেখা যাবে, তার ব্যাপারে যে হক ধার্য ছিল তা দেয়া হয়নি। তখণ সে তার ক্ষুর দিয়ে তাকে দলন করবে ও শিং দিয়ে তাকে গুতোবে। বললেনঃ তার হক ছিল, দুধ দোহানের সময়ে উপস্থিত মিসকীনদেরকে তার অংশ দান। [বুখারী (আরবী***************) দেখুন ফতহুল বারী ৩য় খণ্ড ১৭২-১৭৩ পৃ.] তার অধিকার এই যে, তার দোহন করা হবে পানির উপর’ কথাটি উট ও ছাগল উভয়কে শামিল করে। মুসলিম ও আবূ দাউদের বর্ণনায় তা উটের উল্লেখের পর স্পষ্ট ভাষায় উদ্ধৃত হয়েছেঃ বর্ণনাটি এইঃ উটের মালিকই তার হক দেবে না.......আর তার হক হচ্ছে তার পানির কাছে আসার নির্দিষ্ট দিনে দোহন করা। [বুখারী কিতাবুল যাকাত(আরবী***************) অধ্যায় দেখুনঃ ফতহুল বারী ৩য়খণ্ড ১৭২-১৭৩ পৃ.] এই শেষের ব্যক্যটি আবূ হুরায়রার শামিল করা অংশ নয়, যেমন কেউ কেউ ধারণা করেছে। আসলে তা রাসূলে করীম (স) এর হাদীসেরই অংশ। বুখারী একটি বর্ণনা থেকে স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, এ বাক্যটি স্বয়ং রাসূলে করীম (স) এর উক্তির মধ্যে শামিল রয়েছে। যেমনঃ বুখারী (আরবী***************) এর (আরবী***************) হযরত আবূ হুরায়রা (রা) এর সনদে নবী করীম (স) থেকেই বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেনঃ উটের অধিকার হচ্ছে, তা দোহন করতে হবে পানির স্থানে। [(আরবী***************)] নাসায়ী জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা) বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন। রাসূলে করীম (স) বলেছেনঃ উট, গরু ও ছাগলের যে মালিক তার হক দেয় না, আল্লাহ তাকে কিয়ামতের দিন একটি সমতল রুক্ষ স্থানে দাড় করিয়ে দেবেন। দুই ভাগ বিভক্ত ক্ষুরধারীরা তাকে পদদলিত করেব এবং শিংধারী জন্তুরা তাকে শিং দিয়ে গুতোবে। সেদিন কোন জন্তুই শিংহীন হবে না, কোনটি শিং ভাঙ্গাও হবে না। আমরা বললামঃ ইয়া রাসূলল্লাহ! ওদের হক কি? বললেনঃ তার বদলকে যে চাইবে তাকে ধারস্বরূপ দেয়া তার বালতিটা ধার দেয়া এবং আল্লাহর পথে তার ওপর বোঝা চাপানো।........... [(আরবী***************) দেখুনঃ (আরবী***************)] মুসলিম শরীফেও হযরত জাবির থেকেই অনুরূপ হাদীস উদ্ধৃত হয়েছে। তাঁরই থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, রাসূলে করীম (স) কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলঃ উটের হক কি? বললেনঃ তার গলায় নহর করা, তার বলদকে ধার দেয়া এবং তা দোহানো পানি খাওয়ার দিন।[(আরবী***************) গ্রন্থে বলা হয়েছে (৩য় খণ্ড, ১০৭ পৃ.) তাবরানী এ হাদীসটি الاوسط গ্রন্থে উদ্ধৃত করেছেন। তার বর্ণনাকারীরা সহীহ সিকাহ তাবরানী শায়খ ছাড়া ইবনে আবূ হাতিম তাঁর থেকে বর্ণনা করেছেন কিন্তু তাকে কেউই যয়ীফ বলেনি।] শরীদ থেকে বর্ণিত, বলেছেন, এক ব্যক্তি নবী করীম (স) এর কাছে উপস্থিত হয়ে উট সংক্রান্ত কেন বিষয়ে জিজ্ঞেস করল। তখন নবী করীম (স) বললেনঃ তার গলায় নহর করা (ছুরি মেরে জবাই করা) তার মধ্যে যেটা উত্তম স্বাস্থ্যবান সেটিতে চড়- বোঝা চাপাও এবং তা যবেহ কর তার পানি খাওয়ার দিন। [তাবরানী হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন (আরবী********) গ্রন্থে, সনদ উত্তম। (আরবী***************)] এসব কয়টি বর্ণনাই স্পষ্টভাবে প্রমাণ করছে যে, এই কথাটি স্বয়ং রাসূলে করীম (স) এর। অন্য কারোর কোন কথা তাতে যুক্তি হয়নি। হাফেয ইরাকী একে আবূ হুরায়রা (রা) এ উক্তি বলে যে মত প্রকাশ করেছেন, এতে তার সুস্পষ্ট প্রতিবাদও রয়েছে। বালতি ধার দেয়ার অর্থ, কারো যদি বালতি না থাকে এবং কুপ থেকে পানি তোলার জন্য বালতি ধার চায়, তাহলে তা দিতে হবে। আর আল্লাহর পথে তার ওপর বোঝা চাপানের অর্থ, সে সব মুজাহিদের জিহাদে যাওয়ার সওয়ারী নেই, তাদের বহন করে নিয়ে যাওয়ার জন্যে দেয়া। এ সব হাদীস মুল উদ্দেশ্য প্রমাণ করছে যথার্থভাবে। যেসব অধিকারের কথা বলা হয়েছে, তা পালন না করলে সেজন্যে কঠোর আযাবের ধমকও আছে তাতে। এ থেকে প্রমাণিত হল, এ সব হক আদায় করা ওয়াজিব। আর এ সব হক যাকাত ছাড়া ভিন্নতর জিনিস। এ কারণে, ইবনে হাজম বলেছেন, [(আরবী***************)] প্রত্যেক উট-গরু-ছাগলের মালিকের কর্তব্য হচ্ছে, তা দোহাবে তার পানির স্থানে উপস্থিত হওয়ার দিন এবং তার দুধ থেকে যা তার মন চাইবে সাদকা করে দেবে। ইবনে হাজম বুখারী উদ্ধৃত ও আবূ হুরায়রা বর্ণিত হাদীসটি দলিল হিসেবে পেশ করেছেন। পরে বলেছেন, যে লোক বলবে, ধন-মালে যাকাত ছাড়া আর কোন হক নেই, সে বাতিল কথা বলবে। তার কথার সত্যতা প্রমাণের কোনই দলিল নেই, কুরআন হাদীসের কোন সহীহ দলিল বা কোন ইজমাও তার পক্ষে উল্লেখ করার মত নেই। আর রাসূলে করীম (স) ধন-মালে বাধ্যতামূলক করেছেন তা ওয়াজিব। বালতি ধার বাবদ দেয়া এবং বলদকে অন্য লোকের প্রয়োজনীয় কাজে দেয়া এ দুটিই আল্লাহর কথা (আরবী***************) অর্থাৎ পরকালে অবিশ্বাসী সে সব ব্যক্তি যারা নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি পারস্পরিক দেয়া নেয়া বন্ধ করে [(আরবী***************)] এর অন্তর্ভুক্ত। উট ও ছাগলের হক পর্যায়ে যেমন হাদীসমূহ সহীহ প্রমাণিত হয়েছে, অনুরূপভাবে ঘোড়ার হক পর্যায়েও সহীহ হাদীসসমূহ উদ্ধত হয়েছে। বুখারী আবূ হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন; রাসূলে করীম (স) বলেছেনঃ ঘোড়া তার মালিকের জন্যে শুভ পূণ্যফল, তার মালিকের আবরণ এবং অপর ব্যক্তির ওপর তা পাপ, যার জন্যে তা শুভ পূণ্যফল, সে সেই ব্যক্তি যে তা আল্লাহর পথে, অর্থাৎ জিহাদের কাছে নিযুক্ত করল। শেষ পর্যন্ত বললেনঃ এবং সেই ব্যক্তি যে তা নিযুক্ত করল সম্পদস্বরূপ, আত্মমর্যাদা রক্ষার্থে, পরে তার গলায় দিকে ও পিঠের দিকে আল্লাহর যে হক ধার্য রয়েছে তা সে ভুলে যায়নি। তার জন্যে তা আবরণ। আর যে লোক তার গৌরব প্রকাশের কাজে নিযুক্ত করবে, লোকদের বাহাদুরী দেখানোর উদ্দেশ্য ব্যবহার করবে মুসলিমদের বিরোধিতায়, তার ওপর তা পাপের বোঝাস্বরূপ।[বুখারী হাদীসটি তার সহীহ গ্রন্থর (আরবী***************) এর (আরবী***************) উদ্ধৃত করেছেন। দেখুনঃ (আরবী***************)] চতুর্থ দলিলঃ অতিথির অধিকার সেই ফিকাহবিদগণ চতুর্থ পর্যায়ে দলিলস্বরূপ পেশ করেছেন সে সব হাদীস, যাতে মেহমানের হক- যার কাছে মেহমান আসে- তার ওপর ওয়াজিব হওয়া পর্যায়ে উদ্ধৃত হয়েছে। আবূ শুরাইহ খুয়াইলদ ইবনে আমর (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূলে করীম (স) বলেছেন, যে লোক আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমানদার সে যেন তার মেহমানের সম্মান করে। এ সম্মান পাওয়া তার বৈধ অধিকার একদিন ও এক রাত। আর মেহমানদারীতে শেষ ‍মুদ্দাত তিন দিন। তার পরও যা হবে, তা হবে তার সাদকা। [হাদীসটি উদ্ধতৃ করেছেন মালিক, বুখারী, মুসলিম, আবূ দাউদ, তিরমিযী ও ইবনে মাজা (আরবী***************)] মেহমানকে সম্মান দেখাবার এ আদেশ ওয়াজিব প্রমাণ করে। কেননা ঈমানকে তার সাথে সম্পর্কশীল বা নির্ভরশীল বানানো হয়েছে। আরও দলিল, এই যে, তিনদিনের পর এ পর্যায়ের যা হবে, তা হবে সাদকা বলা হয়েছে (যা নফল)। রাসূলে করীম (স) আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা) কে যা বলেছিলেন তাও উক্ত কথার সমর্থন করে। তা হচ্ছে- নিশ্চয়ই তোমার দেহের হক রয়েছে তোমার ওপর [বুখারী ও মুসলিম প্রণীত।] এবং তোমার সাথে সাক্ষাতকারীরাও তোমার মেহমান। আবূ হুরায়রা (রা) বর্ণিত হাদীসেও তা সমর্থন করে। নবী করীম (স) বলেছেনঃ যে মেহমানই কোন লোকের কাছে আসবে, সে মেহমান যদি বঞ্চিত হয়, তাহলে তার অধিকার আছে তার এক বেলার খোরাক সে গ্রহণ করবে, তাতে তার কোন দোষ হবে না।[আহমাদ উব্ধৃত করেছেন, তাঁর বর্ণনাকারীর সকলেই সিকাহ। হাকেম উদ্ধৃত করেছেন এবং বলেছেনঃ হাদীসটি সহীহ সনদসম্পন্ন। (আরবী********)] মিকদাম ইবনে সা’দী করচ আল কিন্দী বর্ণনা করেছেন, রাসূলে করীম (স) বলেছেনঃ যে ব্যক্তিই কোন লোকের কাছে মেহমান হলো- পরে সে তার অধিকার থেকে বঞ্চিত হল, এ ব্যক্তির সাহায্য করা প্রত্যেক মুসলিমেরই দায়িত্ব। শেষ পর্যন্ত সে তার রাতের খাবার পরিমাণ তার ‍কৃষি ফসল ও মাল থেকে নিতে পারবে। [আবূ দাউদ ও হাকেম উদ্ধৃত করেছেন। বলেছেনঃ হাদীসটি সনদ সহীহ।] তার মাধ্যমেই নবী করীম (স) থেকে বর্ণিত মেহমানের এক রাত প্রত্যেক মুসলমানের হক। তাই যে লোক তার আঙ্গিনায় সকাল বেলা পৌছল, তখন সে তার ওপর ঋণ- হাদীস। [আবূ দাউদ ও ইবনে মাজাহ উদ্ধৃত করেছেন। দেখুনঃ (আরবী***************)] ইবনে হাজম মুসলিমের সূত্রে উকবা ইবনে আমের (রা) থেকে বর্ণনা করেছেনঃ আমরা বললামঃ হে রাসূল! আপনি আমাদের বিভিন্ন স্থানে পাঠান। তখন আমরা বিভিন্ন লোকদের কাছে অবস্থান করি, কিন্তু তারা আমাদের মেহমানদারী করে না। এমতবস্থায় আমরা কি করব, আপনি আমাদের কি উপদেশ দেন? রাসূলে করীম (স) তখন বললেন, তোমরা যদি কোন লোকের গ্রামে বা শহরে গিয়ে উপস্থিত হও এবং তারা যদি তোমদের জন্যে সেই সব ব্যবস্থাই গ্রহণ করে যা মেহমানের জণ্যে করা বাঞ্ছনীয় তাহলে তা গ্রহণ কর। আর যদি তারা তা গ্রহণ না করে তাহলে তাদের কাছ থেকে মেহমানের হক নিয়ে নাও- যা তাদের পক্ষে সম্ভব হতে পারে। বুখারীর সূত্রে আবদুর রহমান ইবনে আবূ বকর পর্যন্তকার সনদে বলা হয়েছে, সুফফার লোকেরা খুবই দরিদ্র ছিলেন নবী করীম (স) বলেছেন, যার কাছে দুজনের খাদ্য আছে সে যেন তৃতীয় একজন সঙ্গে নিয়ে যায়। আর যার কাছে পাঁচ জনের খাবার আছে সে যেন ষষ্ঠ জনেকে সাথে নিয়ে যায় অথবা যেমন তিনি বলেছেন, একদা হযরত আবূ বকর (রা) তিনজনকে সাথে করে নিয়ে গেলেন। আর রাসূলে করীম (স) দশজনকে সঙ্গে নিয়ে নিজের ঘরে গেলেন। এসব হাদীসের সমষ্টি সুস্পষ্টরূপে প্রমাণ করে যে, সমাগত মেহমানের একটা হক আছে খুবই তাকীদ পূর্ণ তার সে মুসলিম ভাইয়েরা ধন-মালে, যার কাছে সে মেহমান হয়েছে। এমন কি গোটা সমাজের ওপর তার সাহায্য-সহযোগিতা করা কর্তব্য যেন সে তাগিদ পূর্ণ হকটা সে পেয়ে যেতে পারে। সেই সাথে একথাও স্পষ্ট যে, এ হক যাকাতের বাইরে- যাকাত ছাড়া অন্য হক। কেননা যাকাত একটা বিশেষ সময় ধার্য হয় ও ফরয হয়-বছর পূর্তির ফসল কাটা ইত্যাদির সময়ে অথচ মেহমান তো যে কোন সময়ে এসে যেতে পারে। এ জন্যে ইবনে মাজাহ বলেছেনঃ মেহামানদারী তো ফরয শহর-নগরবাসী-মরুবাসী-ফিকহবিদ ও মূর্খ সকলেরই ওপর- এক দিন একরাত পুণ্যময় আচরণ ও উপঢৌকন হিসেবে। পরে তিন দিন মেহমানদারী হিসেবে। এর অধিক নয়। তার পরও যদি কেউ থাকে তাহলে তখন আতিথ্য রক্ষা করা জরুরী বা বাধ্যতামূলক বলা যায় না। তবে সে নিজেই মেহমানদারী উত্তমভাবে দীর্ঘায়িত করতে চায়, তাহলে তা ভালই। কিন্তু ওয়াজিব মেহমানদারী যদি করতে অস্বীকার করে, তাহলে তা জোর করে বা যেমন করেই সম্ভব গ্রহণ করার তার অধিকার আছে। তাতে তার পক্ষেই রায়ও দেয়া হবে। [(আরবী*********)] ইমাম শাওকানী লিখেছেনঃ মেহমানের অধিকার পর্যায়ে আলিমগণ বিভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। তা ওয়াজিব কিংবা মুস্তাহাব। জমহুর ফিকাহবিদগণ বলেছেনঃ মেহমানদারী করা ভাল নৈতিকতার শুভ আচরণের অন্তর্ভুক্ত কাজ। দ্বীন দারীর সৌন্দর্যও তাই। তা ওয়াজিব বা বাধ্যতামুলক নয়। লাইস ইবনে সায়াদ ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, এক রাতের জন্যে মেহমানদারী ওয়াজিব। জমহুর ফিকাহবিদদের দলিল হচ্ছে সেই হাদীস যা বুখারী মুসলিমে উদ্ধৃত। তা হচ্ছেঃ যে লোক আল্লাহর ও পরকালে বিশ্বাসী, সে যেন তার মেহমাকে যথোপযুক্ত সম্মান প্রদর্শন করে। লোকেরা জিজ্ঞেস করলেনঃ যথোপযুক্ত’ বলতে কি বোঝায় হে রাসূল? বললেনঃ এক দিন ও রাত। আর মেহমানদারী তিনদিন পর্যন্ত চলতে পারে। এর বেশী হলে তা হবে সাদকা-সাধারণ দান বিশেষ। (আল-হাদীস) হাদীসের শব্দ جائزته বলতে বোঝায়, মেহমানদারী একটা মুস্তাহাব কাজ কেননা তা হচ্ছে একটা দান, আত্মীয়তা রক্ষা- যা মূলত মুস্তাহাব। এ শব্দটি ওয়াজিব বোঝাবার জন্যে খুব কমই ব্যবহৃত হয়। উক্ত হাদীসটির তাৎপর্য হচ্ছে, মেহমানকে আদর যত্ন করতে হবে প্রথম দিন ও রাত। আর তাকে উপহার উপঢৌকন সাধ্যমত দান করা অতীব উন্নতমানের দানশীলতা, বদান্যতা ও অনুগ্রহ স্নেহ বাৎসল্যের ব্যাপার। [(আরবী***************)] তারা সে সব হাদীসকেও দালিল হিসেবে নিয়েছেন, যে সব হাদীস থেকে অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয় যে, কোন মুসলিম ব্যক্তির ধন-মাল তাঁর সন্তুষ্টি ছাড়া গ্রহণ করা সম্পূর্ণ হারাম। সে সব হাদীসকেও তাঁরা পেশ করেছেন, যা প্রমাণ করে যে, ধন-মালে যাকাত ভিন্ন আর কিছু প্রাপ্য নেই। মেহমানের অধিকার পর্যায়ে যে সব হাদীস উদ্ধৃত হয়েছে, সে সব বিষয়ে তাঁদের ভিন্ন মত রয়েছে। খাত্তাবী বলেছেন, আসলে তা রাসূলে করীম (স) এর জীবদ্দশায় বাধ্যতামূলক ছিল। কেননা তখন বায়তুলমাল ছিল না। কিন্তু আজকের দিনে তাদের রিযিক যোগানের দায়িত্ব বায়তুলমালের ওপর অর্পিত। মুসলমানদের ধানমালে তাদের অধিকার নেই। অনেকই মনে করেছেন, এসব হাদীস ইসলামের প্রাথমিক যুগে কার্যকর ছিল। তখন পারস্পরিক সহানুভুতি ও সহমর্মিতা ছিল ওয়াজিব। পরে ইসলাম যখন সর্বত্র প্রচারিত হয়ে গেল, তখন তা বাতিল হয়ে গেছে।[(আরবী***************)] শাওকানী বলেছেনঃ সত্যি কথা হচ্ছে, মেহমানদারী কয়েকটি কারণে ওয়াজিবঃ প্রথমঃ যে লোক মেহমানদারী করল না, তার শাস্তিস্বরূপ তার মাল গ্রহণ জায়েয। ওয়াজিব নয়- এমন কাজে এরুপ শাস্তির বিধান হয়নি। দ্বিতীয়ঃ মেহমানদারীকে আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান শাখা বানিয়ে ব্যাপারটিকে চূড়ান্ত মাত্রায় তাগিদপূর্ণ করে দেয়া হয়েছে। তা থেকে বোঝা যায় যে, যে লোক তা করল না সে আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমানদার নয় বলে মনে হয়। আর একথা তো জানাই আছে যে, ঈমানের শাখা-প্রশাখারূপে চিহ্নিত কার্যাবলীও আদেশকৃত। তা ছাড়া তাকে সম্মান প্রদর্শনের সাথে যুক্ত করে দয়া হয়েছে। তা সাধারণ মেহমানদারীরও উর্ধ্বের এক বিশেষ কাজ। তা থেকে বোঝা যায় যে, তা অবশ্যই বাধ্যতামূলক হবে। তৃতীয়ঃ রাসূলের কথাঃ তার অতিরিক্ত সাধারণ সাদকা স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, পূর্ববর্তী কথা সাধারণ সাদকার পর্যায়ের নয়, বরং তা শরীয়াতের দৃষ্টিতে ওয়াজিব। চতুর্থঃ তাঁর কথা (আরবী***************) মেহমানের রাত ওয়াজিব অধিকার। এ থেকেও নিঃসন্দেহে ওয়াজিব প্রমাণিত হয়। এর অপর কোন ব্যাখ্যা পেশ করা হয়নি। পঞ্চমঃ রাসূলে করীম (স) এর কথাঃ কেননা তার সাহায্য করা প্রত্যেক মুসলমানেরই দায়িত্ব’ স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, তার সাহায্য করা ওয়াজিব। আর এ কথাই মেহামানদারী ওয়াজিব হওয়ার ফলশ্রুতি। বলেছেনঃ এ কথা যখন অকাট্যভাবে স্পষ্ট হল, তখন জমহুর ফিকাহবিদদের মাযহাবের দুর্বলতা প্রকট হয়ে উঠল। আর মেহমানদারী সংক্রান্ত হাদীসমূহ বিশেষত্ব প্রমাণকারী সন্তুষ্টি ছাড়া-ধন মাল নেয়া হারাম হওয়া সংক্রান্ত হাদীসসমূহের তুলনায়। আর মালে যাকাত ছাড়া আর কোন অধিকার নেই’ এ হাদীসের তুলনায়ও। মেহমানদারী সংক্রান্ত হাদীসসমূহকে শুধু জান বাঁচানো পরিমাণের মধ্যে সীমিত মনে করা অত্যন্ত দুঃখজনক ব্যাপার। কেননা তা প্রমাণকারী কোন দলিলই পাওয়া যায়নি। আর তা প্রয়োজনও কিছু নেই। কেবল গ্রাম-মরুবাসীদের জন্যে তা খাস করা এবং শহর-নগরবাসীদের তা থেকে নিষ্কৃতি প্রদানের ব্যাপারটিও অনুরূপ। [(আরবী***************)] পঞ্চম দলিলঃ নিত্য ব্যবহার্য জিনিসের হক পঞ্চম পর্যায়ে তাঁর দলিলরূপে উপস্থাপিত করেছেন কুরআন মজীদের সে আয়াতটি, যাতে নিত্যপ্রয়োজনীয় সাধারণ দ্রব্যাদি পরস্পরের মধ্যে আদান-প্রদান করতে অসম্মত লোকদের প্রতি আযাবের হুমকি ধ্বনিত হয়েছে। আল্লাহ বলেছেনঃ (আরবী***************) ’সে সব নামাযীদের জন্যে দুঃখ- আযাব, যারা নিজেদের নামাযের ব্যাপারে উপেক্ষা-আলস্য প্রদর্শন করে, তারা সে লোকই যারা লোক দেখানো কাজ করে ও তা নিত্যপ্রয়োজনীয় সাধারণ দ্রব্যাদিও পারস্পরিক আদান-প্রদান করে না। [(আরবী********)] আবূ দাউদ কিতাবুল যাকাতের (আরবী***************) অধ্যায়ে আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) এর বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেনঃ রাসূলে করীম (স) এ জামানায় মা-য়ূন বলতে আমরা বুঝতাম পানি তেলার বালতি ও তৈজসপত্র ধার দেয়া। [আবু দাউদ ও মুনযেরী হাদীসটি সম্পর্কে কোন মন্তব্য করেননি। (আরবী************) বায়হাকীও তা উদ্ধৃত করেছেন।] তার অর্থ, সামাজিক জীবনে মানুষ পরস্পরের কাছে যেসব ছোট- খাটো জিনিসের জন্যে মুখাপেক্ষী হয়ে পড়ে, তা ধার বাবদ দেয়া ওয়াজিব। সে সব জিনিস দিতে যে লোক অস্বীকার করে সে নিন্দিত ও আযাব পাওয়ার যোগ্য সে লোকের মতই যে নামাযের প্রতি উপক্ষা প্রদর্শন করে ও লোক দেখানো নামায পড়ে। আর কেবলমাত্র কোন ওয়াজিব কাজ তরক করলেই যে আযাব বা তিরস্কার পাওয়ার যোগ্য বিবেচিত হতে পারে, একথা সকলেরই জানা। এসব জিনিস ধার বাবদ দেয়া ওয়াজিব প্রমাণিত হচ্ছে, অথচ তা যাকাতের বাইরের কাজ, তখন একথা অকাট্যভাবে প্রামাণিত হল যে, নিশ্চয়ই ধন-মালের যাকাত ছাড়াও হক বা অধিকার আছে। ইবনে হাজম তাঁর সনদে ইবনে মাসউদ (রা) থেকেও বর্ণনা করেছেনঃ الماعون হচ্ছে সে সব জিনিস যা সামাজিক মানুষ পারস্পরিকভাবে ধার, বাবদ দেয়া নেয়া করে থাকে সাধারণভাবে। তা হচ্ছে কোদাল, ভাণ্ড-পাত্র-তৈজসপত্র ও এ ধরনের অন্যান্য জিনিস। [ইবনে হাজম এ কথার উল্লেখ করেছেন (আরবী***************) গ্রন্থেল ইবনে আবূ শায়বার সত্রে।] আয়াতে উদ্ধৃত الماعون এর তাফসীরে ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তা হচ্ছে ঘরের জিনিসপত্র। তার থেকে এও বর্ণিতঃ ধার দেয়া-নেয়া। [ঐ- বায়হাকীঃ ৪র্থ খণ্ড, ১৮৩-১৮৪ পৃ.] আলী ইবনে আবূ তালিব থেকেও অনুরূপ বর্ণনা পাওয়া যায়। [(আরবী***************)] উম্মে আতীয়া বর্ণিতঃ তা হচ্ছে কাজ ও ব্যবসায়, যা লোকেরা পারস্পরিকভাবে নেয়া দেয়া করে।[(আরবী***************)] ইবনে উমর (রা) থেকে বর্ণিতঃ তা হচ্ছে সেই মাল, যার হক দিতে অস্বীকার করা হয়। ইবনে হাজম বলেছেনঃ আমরা যা বলে এসেছি তা এ কথার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। তা ইকরামা ও ইবরাহীম প্রমুখেরও মত। কোন সাহাবী থেকেই তার বিপরীত কথা আমরা জানতে পাইনি। [(আরবী***************)] ইবনে হাজম যেমন বলেছেন, এ সব কিছুই আভিধানিক প্রমাণ। الماعون এর তাফসীরে তাঁদের সকলের মতই সম্পূর্ণরূপে অভিন্ন-যেমন পূর্বে বলেছি। ইবনে হাজম বলেছেন, যদি বলা হয়, হযরত আলী (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তা যাকাত, তা হলে আমরা বলল, হ্যাঁ তবে তা ধার বাবদ দেয়া নয় এমন কথা বলেনিনি। তাছাড়া তাঁর থেকেই বর্ণনা পাওয়া গেছে যে, তা ধার বাবদ দেয়া-নেয়া। অতএব তাঁর দুটি কথার মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে হবে।[(আরবী***************)] আবূ দাউদে ইবনে মাসউদ বর্ণিত হাদীসটি কার্যত মরফু রাসূলের কথা হিসেবে গণ্য মুহাদ্দিসীনের কাছে। কেনান তাতে রাসূলের সময়ে الماعون এর তাফসীরের কথাই উদ্ধৃত হয়েছে। যদি তখণ এতে কোন ভুল করা হয়, তাহলে অহী, তা নিশ্চয়ই সংশোধন করে দিত। কেননা আল্লাহর কিতাব অনুধাবনে ভুল অংসংশোধিত থাকতে পারত না। ষষ্ঠ দলিলঃ মুসলিম সমাজে পারস্পারিক দায়িত্ব গ্রহণ কর্তব্য ষষ্ঠ পর্যায়ে তাঁরা দলিল হিসেবে এনেছেন সে সব অকট্য প্রমাণ, যা মুসলমানদের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগীতা, একের অপরের দায়িত্ব গ্রহণ ও দয়া অনুগ্রহকে ওয়াজিব প্রমাণ করে এবং মিসকীনকে খাবার দেয়া ও দিতে উৎসাহিত করা ফরয করে। আর এ কাজকে ভ্রাতৃত্বের ফলশ্রুতি- ঈমান ও ইসলামের স্বাভাবিক দাবি গণ্য করে। তন্মধ্যে একটি হচ্ছে আল্লাহর কথাঃ (আরবী***************) তোমরা পরস্পরের সাথে সহযোগীতা কর পরম পূণ্যময় আল্লাহ ভীতির কাজে এবং কোনরূপ সহযোগিতা করো না গুনাহ ও আল্লাহদ্রোহিতার কাজে। [(আরবী***************)] আল্লাহ তা’আলা মুমিনদের গুণ পরিচিতি প্রসঙ্গে বলেছেনঃ (আরবী***************) তারা পরস্পরের প্রতি অত্যন্ত দয়াশীল ও অনুগ্রহসম্পন্ন। [(আরবী***************)] সেই ঘাঁটির কথাও বলা হয়েছে, যা আল্লাহর সন্তুষ্টি পাওয়ার উদ্দেশ্য অতিক্রম করা প্রত্যেকটা মানুষেরই কর্তব্য যেন তারা ডানপন্থী গণ্য হতে পারে। বলেছেনঃ (আরবী***************) কিন্তু সে ‍দুর্গম বন্ধুর ঘাটি পথ অতিক্রম করার সহসা করেনি। তুমি কি জানো সেই দুর্গম ঘাঁটির পথ কি?...... কোন গলা দাসত্ব শৃংখল থেকে মুক্ত করা কিংবা উপবাসের দিনে কোন নিকটবর্তী ইয়াতীম বা ধুলি-মলিন মিসকীনকে খাবার খাওয়ানো। সেই সঙ্গে শামিল হওয়া সেই লেকদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে, যারা পরস্পরকে ধৈর্য ধারণ ও (সৃষ্টিকুলের প্রতি) দয়া প্রদর্শনের উপদেশ দেয়।....... সেই লোকই দক্ষিণপন্থী।[(আরবী***************)] আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেনঃ (আরবী***************) এবং দাও নিকটাত্মীয়কে তার হক এবং মিসকীন ও ইবনে সাবীলকে। [(আরবী***************)] আল্লাহ সুবহানাহু আরও বলেছেনঃ (আরবী***************) এবং পিতামাতার সাথে সদাচরণ, নিকটাত্মীয় ইয়াতীম, মিসকীন, আত্মীয় প্রতিবেশী, পার্শ্বে থাকা প্রতিবেশী, পার্শ্ববর্তী সঙ্গী, নিঃস্ব পথিক, এবং দক্ষিণ হস্ত যাদের মালিক হয়েছে (ক্রীতদাস) এর সাথে।[(আরবী***************)] ইতিপূর্বে আমরা এমন বহু সংখ্যক আয়াতের উদ্ধৃতি দিয়েছি, যা মিসকীনকে খাবার দেয়া ও সেজন্যে উৎসাহদান ঈমানের নিদর্শন হিসেবে ঘোষণা করেছে এবং তা না করাকে কুফর ও পরকাল অবিশ্বাসের লক্ষণ বলে নির্দিষ্ট করেছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ আল্লাহর এ কথাটিঃ (আরবী**********) তুমি কি দেখেছ সেই লোককে, যে পরকালকে অবিশ্বাস করে? সে তো সেই, যে ইয়াতীমকে গলা ধাক্কা দেয় এবং মিসকীনকে খাবার দিবার জন্যে উৎসাহ দেয়না। [(আরবী***********)] অপরাধী লোকদের জাহান্নামী হওয়ার কারণ বর্ণনা প্রসঙ্গে বলা হয়েছেঃ (আরবী************) তারা বলবে, আমরা নামাযীদের মধ্যে ছিলাম না, আমরা মিসকীনকে খা্ওয়াতাম না। [(আরবী*********)] যে লোক বাম হাতে আমলনামা পাওয়ার দরুন জাহান্নামে যা্ওয়ার ও আযাব পা্ওয়ার উপযুক্ত সাব্যস্ত হয়েছে, তাদের সম্পকে বলা হয়েছেঃ (আরবী***********) সে মহান আল্লাহর প্রতি ঈমানদার ছিল না এবং সিমকীনকে খাবার দেবার জন্যে উৎসাহ্ও দিত না। [বুখারী ও মুসলিম] রাসূলে করীম (স) ইসলামী সমাজের প্রকৃত ও যথার্থ রুপ এবং একে অপরের দয়িত্ব গ্রহণ পারস্পরিক সম্পকের্র ঘনিষ্ঠ এবং সংহতির চূড়ান্ত মান তুলে ধরেছেন তাঁর হাদীসসমূহের মাধ্যমে। বলেছেনঃ (আরবী***********) মুমিন মুমিনের জন্যে প্রাচীরের ইটের মত- একজন অপরজনকে শক্তিশালী করে। [বুখারী ও মুসলিম] তার অর্থ মুসলমানদের সমাজ স্বতন্ত্র বিচ্ছিন্ন- নিঃসম্পর্ক ইটের মত নয়। অন্য কথায়, মুসলিম জাতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে পড়ে থাকা লোকদের সমষ্ট নয়। সেখানে কেউ অন্য একজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাস করে না। বরং (আরবী***********) মুসলমানদের পাস্পরিক বন্ধুত্ব, ভালোবাসা, স্নে-বাৎসল্য ও পারস্পরিক দয়া-সহানুভূতির দৃষ্টান্ত যেমন একটা ভিন্ন্ দেহ। তার কোন অঙ্গ অসুস্থ হয়ে পড়লে সমগ্র দেহে সেই কারনে জ্বর ও অনীদ্রায় আক্রান্ত হয়ে পড়ে। একটি দেহের অঙ্গ-প্রতঙ্গের পাস্পরিক সম্পর্ক ও সংহতির তুলনায় অধিক কোন শক্তিশালী সংহতি সম্পর্ক হতে পারে কি? এগুলো পূর্ণ সহযোগিতা ও একত্মাতার মাধ্যমের পরস্পরের সাথে সহযোগিতা করে কাজ করছে, একটি অপরটির কাছ থেকে শক্তি পাচ্ছে, উপকৃত হচ্ছে। তার একটিতে যন্ত্রণার উদ্ধেক হলে গোটা দেহ সত্তাই তদ্দরুন যন্ত্রণাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। নবী করীম (সা) বলেছেনঃ যে লোক খেয়ে পরিতৃপ্ত হয়ে ঘুমায় আর তার প্রতিবেশী তার পাশে থাকলেও অভুক্ত অবস্তায় রাত কাটায় সে মুমিন নয়। [(আরবী*************)] হযরত আলী ইবনে আবূ তালিব (রা) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (স) বলেছেনঃ আল্লাহ তা আলা মুসলিম ধনী লোকদের ধন- সম্পদে অতটা পরিমাণই র্ধায্য করেছেন, যতটা তাদের গরীব লোকদের জন্যে সংকুলান হয়। দরিদ্ররা ক্ষুধার্ত ও বস্ত্রহীন হয়ে যে কষ্ট পায় তা কেবলমাত্র তাদের ধনী লোকদের কৃতকর্মের দরুন। সাবধন হ্ও, আলাহ তাদের কঠিনভাবে হিসেব নেবেন এবং তাদের উৎপীড়ক আযাবে নিমজ্জিত করবেন। [আল-মনযেরী (আরবী***********) গ্রন্থে লিখেছেন, হাদীসটি তাবরানী (আরবী***********) গ্রন্থে উদ্বৃত করেছেন এবং বলেছেন। মুনযেরী বলেছেনঃ সাবিত ইবনে মুহাম্মদ জাহেদ এককভাবে হাদীসটি বর্ণনা করেছন। এর অন্যান্য বর্ণনাকরীদের্ কো্ন ক্রটি নেই। হাদীসটি হযরত আলীর কথা হিসাবে্ও বণির্ত হয়েছে এবং তা-ই সম্ভব (আরবী********) ইবনে হাজম হাদীসটি মএকুফ হিসেবে (আরবী***********) গ্রন্থে উদ্বত করেছেন (আরবী***********) সায়ীদ ইবনে মনসুরের সূত্রে।] ইবনে হাজম এ মতটির পক্ষাবলম্বন করেছেন এ মাযহাবের পক্ষ সমর্থন করেছেন এবং কুরআন-হাদীস-সাহাবী-তাবেয়ীনের মত ইত্যাদি অসংখ্য দলিল দিয়ে এ মতটিকে অধিকতর শক্তিশালী করে তুলেছেন, আমরা এমন কাউকে পাইনি। কেবলমাত্র ইবনে হাজম এর ব্যতিক্রম। তি্নি তাঁর (আরবী) গ্রন্থে লিখেছেনঃ [(আরবী***********)তিনি যে সব হাদীস উদ্বৃত করেছেন, আমরা ত সনদ ছাড়াই সংখক্ষেপে উদ্বৃত করেছে।] প্রত্যেক দেশ-স্থানের ধনী লোকদের ওপর ফরয করা হয়েছে যে, তার সেখানকার গরীব জনগণের পৃষ্ঠপোষক হয়ে দাঁড়াবে। সরকার তাদের এজন্যে বাধ্য করবে।যাকাত যদি তারে জন্যে যথেষ্ট না হয় এবং মুসলমানদের ফাই সম্পদ যদি প্রয়োজন পূরণে অসমর্থ হয়, তাহলে তাদের জন্যে অপরিহায যে খাদ্য তারা খায়, শীত ও গ্রীষ্মের যে পোশাক তারা পরে, যে ঘর তাদেরকে বৃষ্টি, শীত. সূযর্তাপ ও পথিকদের দৃষ্টি থেকে রক্ষা করতে পারে, তাই দিয়ে তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করতে হবে। কুরআনী দলিল এ কথার কুরআনী দলিল হলঃ (আরবী***********) এবং দাও নিকটাত্মীয়কে –মিসকীন ও নিঃস্ব পথিককে –তার হক। [(আরবী***********)] আল্লাহর বাণীঃ (আরবী***********) এবং পিতামাতার সাথে অতীব ভালো ব্যবহার এবং নিকটাত্মীয়, ইয়াতীম,মিসকীন, নিকটাত্মীয় প্রতিবেশী, পার্শ্ববর্তী প্রতিবেশী, সঙ্গী প্রতিবেশী, নিঃস্ব পথিক এবং ক্রীতদাসেরও। আল্লাহ তাআলা মিসকীন ও নিঃস্ব পথিকের হক নিকটাত্মীয়ের হকের সাথে সমান মানের গুরুত্বপূর্ণ বানিয়ে দিয়েছেন এবং পিতামাতার প্রতি অতীব উত্তম ব্যবহার- নিকটাত্মীয়, মিসকীন, প্রতিবেশী ও ক্রীতদাসদের সাথে ভালে আচরণ গ্রহণ একান্ত কর্তব্য বলে ঘোষণা করেছেন। এ ভালো আচরণ বলতে সে সবই বোঝায়, যা পূর্বে বলেছি এবং তা না করা নিঃসন্দেহে খুবই খারাপ কাজ। আল্লাহ তা’আলা বলেছেনঃ (আরবী***********) তোমাদেরকে কোন জিনিস জাহান্নামে পৌছিয়ে দিল? তারা বলবেঃ আমরা নামাযী ছিলাম না এবং আমরা মিসকীনকে খাবার খা্ওয়াতাম না। [ (আরবী***********)] এআয়াতে আল্লাহ তা’আলা নামায হ্ওয়ার সঙ্গে মিলিয়ে মিসকীনকে খাবার খা্ওয়ানোর কথা বলেছেন। হাদীসের দলিল রাসূলে করীম (স) থেকে চূড়ান্ত মাত্রার বহু সুত্রে হাদীস বর্ণিত হয়েছে; তিনি বলেছেনঃ যে লোক লোকদেরপ্রতি দয়া করে না, আল্লাহ্ও তার ওপর দয়া রহম করেন না। [ হাদীসটি আহমদ, বুখারী, মসলিম ও তিরমিযী জরীর ইবনে আবদুল্লাহ থেকে এবং আহমাদ ও তিরমিযী আবূ সায়ীদ থেকে উদ্বৃত করেছেন। বিভিন্ন শব্দে এ হাদীস সহীহ প্রমাণিত। এর সূত্র্ও অনেক, তা মুতা্ওয়াতির র্মযাদা পযর্ন্ত পৌছে গেছে। (আরবী***********)] আর যে লোক প্রয়োজনাতিরিক্ত ধন-মালের মালিক এবং সে তার এক মুসলমান ভাইকে ক্ষুধার্ত বস্ত্রহীন ধ্বংসমুখী দেখতে পেল; কিন্তু তাত্ত্বে ও সে তার সাহায্য এগিয়ে এল না, সিঃন্দেহে বলা যায়, আল্লাহ তার প্রতি রহম করবেন না। আবদুর রহমান ইবনে আবূ বকর সিদ্দীক (রা) থেকে বর্ণিত, ছুফফা বাসীরা ছিল খুবই দরিদ্র লোক। রাসূল করীম (স) ঘোষণাদিয়ে দিয়েছেলেন, যার কাছে দুইজনের খাবার আছে সে য়যন তৃতীয় একজন নিয়ে যায়. আর যার কছে চারজনের খাবার আছে সে যেন পঞ্চাম কিংবা ষষ্ঠ জনকে নিয়ে যায়। [ হাদীসটি আহমাদ উদ্বৃত করেছেন ১ম খন্ড-১৯৭,১৯৮,১৯৯ পৃষ্ঠায় এবং বুখারী তা উদ্বৃত করেছেন বিতাবুল মা্ওয়াকীত ও কিতাবুল মানাকিব তার প্রন্হের এ দুই অধ্যায়ে।] ইবনে উমর থেকে বর্ণিত, রাসূলেক করীম (সা) বলেছেনঃ মুসলমান মুসলমানের ভাই, সে তার ওপর জুলুম করে না, তাকে ধ্বংস হ্ওয়ার জন্যে ছে্ড়ে ও দেয় না। [ হাদীসটি আহমাদ তাঁর মুসনাদ গ্রন্থে ২য় খন্ডের ১৯ পৃষ্ঠায় এবং ৪র্থ খন্ডের ১০৪ পৃষ্ঠায়, বুখারী তাঁর সহীহ গ্রন্থের আল-মাজালিস ও ইকরাহ অধ্যায়ে, মুসলিম আল-বির-এ, আবূ দাউদ আল-আদব-এ এবং তিরমিযী সিফাতুলকিয়ামাহ অধ্যায়ে ইবনে উমর থেকে বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন।] যে লোক তাকে না খেয়ে বা বস্ত্রহীন হয়ে মরে যা্ওয়ার জন্যে অসহায় করে ছেড়ে দিল- তাকে খাবার ও পরার বস্ত্র দিতে সক্ষম হ্ওয়া সত্ত্বে ও, সে তাকে চরম ভাবে লজ্জিত করল। আবূ সায়ীদ খুদরী থেকে বর্ণিত, রাসুলে করীম (সা) বলেছেনঃ যার কাছে দুপুরবেলার খাবার আছে সে যেন তাতে সে ব্যক্তিকে শরীক করে যার দুপুর বেলার খাবার নেই। আর যার কাছে অতিরিক্ত পাথেয় রয়েছে, সে যেন তা পাথেয়হীন ব্যক্তিকে দিয়ে দেয়। বলেছেনঃ অতঃপর রাসূলে করীম (স) কয়েক প্রকারের নিজেদের কারোর কোন হক নেই। [ মুসলিম আন-নিকাহ ওআল-লুকতাহ অধ্যায়ে, আবূ দাউদ কিতাবুযযাকাত –এ এবং আহমাদ তাঁর মুসনাদের ৩ য় খণ্ডের ৩৪ পৃষ্ঠায় উদ্ধৃত করেছেন।] তার অর্থ এটা সাহাবাগণ (রা) এর ইজমা। আবূ সায়ীদ এ সংবাদ জানিয়েছেন। আর প্রত্যেকটি সংবাদেই আমরা তাই বলি। আবূ মূসা (রা) এর সূত্রে নবী করীম (স) এর কথা এসেছে। তিনি বলেছেনঃ তোমরা সকলে বুভুক্ষুকে খাবার দা্ও এবং বন্দীকে মুক্ত কর। [বুখারী ও হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন। তাতে অতিরিক্ত কথা বুভুক্ষুকে খাবার দা্ও-এর পর রয়েছেঃ রোগীকে দেখতে যা্ও।] বলেছেনঃ এ র্পযায়ে কুরআন্ও সহীহ হাদীস অসংখ্য রয়েছে। সাহাবিগণের উক্তি হযরত উমর (রা) বলেছেনঃ আমি যদি আমার কোন কাজে অগ্রসর হই তাহলে কখনই ছপছনে হাটব না। আমি নিশ্চয়ই ধনী লোকদের উদ্বৃত্ত ধন-মাল নিয়ে তা গরীব মুহাজিরদের মধ্যে বন্টন করে দেব। [ ইবনে হাজম এ উক্তির সনদ সম্পর্কে বলেছেনঃ এ উক্তির সনদ চূড়ান্তভাবে সহীহ ও গাম্ভীর্যপূর্ণ।] এবং হযরত আলী ইবনে আবূ তালিব (রা) বলেছেনঃ আল্লাহ তাআলা ধনী লোকদের ধন-মালে সে পরিমাণ ফরয করে দিয়েছেন, যা তাদের গরীব লোকদের জন্যে যথেষ্ট হয়।এক্ষণে এ দরিদ্র লোকরা যদি অভুক্ত থাকে কিংবা বস্ত্রহীন নগ্ন হয়ে থাকে এবং এভাবে কষ্ট পায়, তাহলে তা শুধু ধনী লোকদের সেই পরিমাণ সম্পদ তাদের কে না দেয়ার কারনেমাত্র। আল্লাহ তাআলার সিদ্ধান্ত রয়েছে, কিয়ামতের দিন তিনি তাদের কাছে কৈফিয়ত চাইবেন, হিসেব নেবেন এবং সেজন্যে তিনি তাদের আযাব দেবেন। ইবনে উমর (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেনঃ ধন-মালের যাকাত ছাড়া্ও প্রাপ্য রয়েছে। উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা (রা), হাসান ইবনে আলী ও ইবনে উমর (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তাঁরা সকলে বলেছেনঃতাদের সকলেই তার জন্যে যে তাদের কাছে জিজ্ঞেস করবে। তুমি যদি জিজ্ঞাসিত হ্ও কোন বেদনাদায়ক রক্তে কিংবা কোন লজ্জাকর জরিমানার অথবা কষ্টদায়ক দারিদ্যের ব্যাপারে, তা হলে বুঝবে, তোমার প্রাপ্রটা ওয়াজিব হয়ে গেছে। আবূ উবায়দাতা উবনূল জা্ররাহ ও তিনশ জন সাহাবী (রা) থেকে সহীহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, একবার বিদেশ সফরে তাদের পাথেয় নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল। তখন আবূ উবায়দাহ তাদের সকলের পাথেয় দুটি পাত্রে একত্র করে তাদের সকলকে সমান মানে ও পরিমাণে খাবার দিতে শুরু করেছিলেন। এ থেকে প্রমাণিত হলো যে, এটা সাহাবায়ে কিরামের (রা) সামষ্টিক ইজমা, এর বিপরীত মতের কেউ নেই। শবী, মুজাহিদ, তায়ূস ও অন্যান্যদের থেকে সহীহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, তাঁর সকলেই বলেছেনঃ ধন-মালে যাকাত ছাড়া্ও প্রাপ্য রয়েছে। ভিন্ন মতের লোকদের ইবনে হাজমের সমালোচনা আবূ মুহাম্মাদ বলেছেন, উপরিউক্ত মতের বিপরীত মতের কোন লোক আছো বলে আমরা জানি না। তবে দহহাক ইবণে মুজাহিম ভিন্ন মত পোষণ করেন। তিনি বলেছেনঃ ধন-মালে অন্য যত প্রাপ্যই (হক্) ছিল, যাকাত তা সবই মনসুখ করে দিয়েছে। কিন্তু দহাকের বর্ণনাই সহীহ নয় যখন, তখন তাঁর মত কি করে গ্রহণ করা যেতে পারে?[ আমি যদ্দূর জানি, দহতাককে কেউ যরূফ বলেনি, একমাত্র ইয়াহইয়া ইবনে মুয়ীন ছাড়া। আহমাদ তাকে সিকাহ বলেছেন, ইবনে মুয়ীন, আবূজ্জরয়া, আল-আজালী, ওদারে কুতনী্ও তাঁকে সিকাহ বলেছেন, ইবনে হাব্বান তাঁকে সিকাহ বর্ণনাকারীদের মধ্যে গণ্য করেছেন। ইবনে হাজার (আরবী***********)গ্রন্থে বলেছেনঃ সত্যবাদী বটে, তবে খুব বেশী মুরসাল হাদীসের বর্ণনাকারী অর্থাৎ সাহাবীর নাম উল্লেখ না করেই রাসূলের কথা বর্ণনা করেছেন। (আরবী***********)তা ছাড়া কোন বর্ণনা যয়ীফ প্রমাণিত হলেই অভিমতের ও যয়ীফ প্রমাণিত হয়ে যায় না। ইবনে হজম তিই দাবি করেছেন। হাদীসবিশারদগন ইবনে আবূ লাইলাকে যয়ীফ বলেছেন; অথচ ফিকাহ শস্ত্রে তিনি ইমাম রুপে মান্য।] অথচ আশ্চযের্র বিয়য়, এটাকে যে লোক দলিল হিসেবে পেশ করেছেন, তিনিই এর প্রথম নম্বরের বিরোধী। তিনি ধন-মালে যাকাত ছাড়া্ও প্রাপ্য আছে বলে মনে করেন সে প্রাপ্য যেমন, অভাবগ্রস্ত পিতামাতার খরছ বহন,স্ত্রীর, ক্রীতদাস-দাসীর, গবাদি পশুর জন্যে ব্যয় করা, ……….ণ ও জখম করার প্রতি মূল্য দান ইত্যাদি। দেখা গেল, এদের মধ্যে পারস্পর বৈপরীত্য রয়েছে। তাঁর বলেন, যার পিপাসা লেগেছে এবং আংশকা দেখা দিয়েছে যে, সে এখনই পানি পান না করলে তার মৃত্য অনিবায,তাহলে তার যেখান থেকেই সে পারে পানি পান করার তার অধিকার রয়েছে। এমন কি সেজন্যে যুদ্ধ করতে হলে ও তা সে করবে। অর্থাৎ পিপাসার দরুন মৃত্যু ঘনিয়ে এলে যে তাকে পানি দেবে না, তার বিরুদ্ধে লড়াই করা যদি জয়েয হয়েত থাকে, তাহলেযে খাদ্য বস্ত্র না হলে তা নিবৃত্তকারী জিনিস- যারা দিতে চাচ্ছে না, তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা তার পক্ষে জায়েয় হবে না নে যার তা নেই ?........ এ দুটি অবস্থার মধ্যে পার্থক্যটা কোথায়?.......... এটা ইজমা, কুরআন, সুন্নাত ও কিয়াসের ও পরিপন্হী। আবূ মুহাম্মাদ বলেছেনঃ ক্ষুধায় মৃত্যুমুখে পৌছে যা্ওয়া মুসলমানের পক্ষে তার সঙ্গী মুসলমান বা বিম্মীর কাছে অতিরিক্ত খাদ্য পা্ওয়া সত্ত্বে ও মৃত লাশ কিংবা শূকরের গোশত ভক্ষণ করে প্রাণ বাঁচানো জায়েয হতে পারে না। কেননা খা্দ্য যার কাছে আছে তার ওপর ফরয হচ্ছে সে বুভুক্ষুকে খাবার দেবে। কিন্তু ব্যাপার যদি উপরিউক্ত রুপ হয়, তাহলে ক্ষুধায় প্রাণ ওষ্ঠাগত ব্যক্তির মৃত লাশ বা শূকরের গোশত খা্ওয়া কিছুতেই জায়েয হতে পারে না। ত্ওফীক দেয়ার মালিক আল্লাহ। এ ব্যাপারে তার যুদ্ধ করার ও অধিকার আছে। তাতে যদি য়ে নিহত হয়, তাহলে হত্যাকারীর কিসাস করতে হবে আর দিতে অস্বীকারকারী নিহত হলে সে আল্লহ্ র অভিসম্পাতে পড়বে। কেননা সে একটা হক্ দিতে অস্বীকার করেছে, সে বিদ্রোহী দলে গণ্য। আল্লাহ বলেছেনঃ (আরবী***********)তাদের দুই পক্ষের এক পক্ষ যদি অপর পক্ষের ওপর সীমালঙ্ঘনেমূলক কাজ করে, তাহলে তোমরা সে পক্ষের বিরদ্ধে লড়াই কর, যে পক্ষ সীমালঙ্ঘন করেছে-যদ্দিন না সে পক্ষ আল্লাহ্ র মীমাংসার দিকে ফিরে আসে। [ (আরবী***********)] অধিকার দিতে অস্বীকারকারী তার সে ভাইয়ের ওপর সীমালঙ্ঘনকারী, যার হক্ তার ওপর ধায হয়ে আছে। এ কারণেই হযরত আবূ বকর সিদ্দীক (রা) যাকাত দিতে অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। [(আরবী***********)শায়খ আহমাদ শাকের ইবনে হামের এমতের ওপর দীর্ঘ টীকা লিখেছেন। খু্বিই মূল্যবান সে টীকা।তা এখানে উল্লেখ করা উত্তম হবে। তাতে যেমন শিক্ষা আছে, তেমনি উপদেশ নসীহত্ও। তিনি বলেছেন-এ কথা ও ইসলামী শরীয়াতের অনুরুপ কথার ভিত্তিতে গ্রন্হকার মনে করেন; ইসলামী আইন প্রণয়ন খুবই উচ্চতর মানে যুক্তিবত্তা ও ন্যায় পরায়ণতার ভিত্তিতে বাস্তবয়িত হয়েছে। আমাদের ভাই মানব রচিত আইন পেয়ে খুবই মুগ্ধ ও গৌরবন্বিত মনে করেন- যাদের মন- মগজ তাতেই ডুবে আছে, তারা যদি ইসলামী আইন সম্পর্কে অবহিত হত ও তার মূলে নিহিত গভীর সূক্ষ্ম তত্ত্ব ও সৌন্দয অনুধাবন করতে সক্ষম হত. তাহলে কতই না ভালো হত! তাহলে তারা বুঝতে পারত যে, ইসলামী শরীয়াত পৃতথবীর বুকে সবচাইতে উন্নত এ উত্তম আইন বিধান। তাতে হৃদয়্ও মগজ পূর্ণ মাত্রায় পরি তৃপ্তি লাভ করতে পারে। তা প্রত্যক যুগে ও প্রত্যেক দেশেই বাস্তবায়িত হতে ও কল্যাণ দান করতে সক্ষম। কেননা আসলে তা অহীর মাধ্যমে অবতীর্ণ। মুসলমানগণ যদি দ্বীন-ইসলামরে আইন বিধানের গভীর সূক্ষ্ম তাৎপয বুঝতে পারত ও নির্মল উৎস- সুমিষ্ট-সুস্বাদু পানীয় –কুরআন ও সুন্নাহ থেকে তা করতে ] তৃতীয় পরিচ্ছেদ মুক্তকরণ ও অগ্রধিকার দান দুই পক্ষের মধ্যকার দ্বন্দের ক্ষেত্র উদ্ঘাটন দুই পক্ষের বক্তব্য এবং তাদের প্রত্যকের মতের সমর্থনে উপস্থাপিত দলিল প্রমাণ পেশ ও পেশ ও পর্যাচলোনার পর আমার মনে হচ্ছে, তাদের দুই দলের মধ্যকার বিরোধ-বিভক্তি অতটা বিশাল নয়, যতটা আমরা মনে করি। সন্দেহ নেই, তাদের মধ্যে ঐক্যের ক্ষেত্র্ও বহু রয়েছে। তাতে উভয়ের কেউই পরস্পরের সাথে বিরোধ ও মতপার্থক্য করে না। ক. পিতামাতা অভাবগ্রস্ত হয়ে পড়লে এবং তাদের সন্তান সচ্ছল থাকলে তাদের খরচ বহন সন্তানের কর্তব্য এবং তাদের অধিকার সর্বজনস্বীকৃত। এ ব্যাপারে কো দ্বন্দ্ব বা মত পার্থক্য নেই। খ. নিকটবর্তীর হক্ ও অনুরুপভাবে মতপার্থক্য মুক্ত-সূচনা হিসেবে। অবশ্য কৈট্যের মাত্রায় বাধ্যতা সৃষ্টিকারী মাত্রায় সচ্ছল ও অসচ্ছল লোকদের পার্থক্যের দরুন তাদের মত্ও ভিন্ন ভিন্ন হয়ে গেছে। গ. খাদ্যাভাবে আক্রান্ত বা বস্ত্রহীনদের নগ্নতা অথবা আশ্রয় বঞ্চিত ব্যক্তির অধিকার আছে খাবার পা্ওয়ার, এ ব্যাপার্ওে কোন মতপার্থক্য নেই। আল-জাসসাস আহকামুল কুরআন গ্রন্থে লিখেছেনঃ আসলে পরয হচ্ছে যাকাত দেয়া। তবে সেখানে এমন কিছু ঘটনা সংঘটিত হয় যা পারস্পরিক সহানুভতি ও দান-প্রদান ওয়াজিব করে দেয়। যেমন সচেষ্ট হত, আদেশসমূহ যথাযথ পালন করত, তাদের হৃদয়ের মনিকোঠায় তা লালন-পালন করত, যাবতীয় কাযার্বলীতে তা অসুসরণ করে চলত এসং তাদের সমাষ্টিক জীবন-পরিবেশে তা বাস্তায়িত করত, তাহলে তারাই হত দুনিয়ার সেরা জাতি! প্রশ্ন হচ্ছে, দুনিয়ায় যত ব্বংসাত্মক ও বিপযর্য়কারী বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে-সর্বাত্মক বিধ্বংসী ঘটনা বলী সংঘটিত হয়েছে তা প্রায় সবই কি গরীবদের ওপর ধনীকুলের জুলুম-জীড়ন-বঞ্চনার ফলে হয়নি? এক শ্রেণীর লোক দুনিয়ার ধন-সম্পদ করায়ত্ত করে সুখ, মাধুয লুঠছে আর তারই পাশে তাই ভাই উলংগ থকছে ও না খেয়ে ধুকে ধুকে মরছে।এর দৃষ্টন্ত তো ভুরি ভুরি দেয়া যায়। এমতাবস্থায় ধনী লোকরা যুদ অবস্থার নাজুকতা অনুধাবন করত তাহলে তারা নিঃসন্দেহে জানতে ও বুঝতে পারত যে, গরীব জনগণের কল্যাণ সাধনিই হতে পারে তাদের জানমালেন প্রথম রক্ষা কবচ। আল্লাহ তাদের জন্যে যা কিছু দেয়া ফরয করেছেন তাদের ওপর, ত যদি তার যতারীতি আদায় করতে থাকে তাহলেই তারা রক্ষা পেতে পারে।অতএব তাদের একথা বোঝা উচিত, জানা উচিত দুনিয়ায় আবর্তন বির্তনের কথা এবং আগে থেকেই সতর্কতা অবলম্বন করা আবশ্যক। আল্লাহ আমাদের সবাইকে হেদায়েত দিন!............. এ একটি সত্যের আ্ওয়াজ, শায়খ আ্ওয়াজ তুলেছেন। অন্যান্য বহু মানব দরদীরা যেমন আহমানকাল ধরেই এ আ্ওয়াজ দিচ্ছেন। কিন্তু তা শোনা হয়নি। তাই পরণাম যা হবার তাই হয়েছে। বুভক্ষু- চূড়ান্ত মাত্রার এবং বস্ত্রহনি- চূড়ান্ত মাত্রার অথবা এমন মৃত ব্যক্তি, যার কাফণ–দাফনের কেউ নেই। [(আরবী******)] এরূপ ঠেকায় পড়া ব্যক্তির দৃষ্টান্ত বালতি, কোদাল ও তৈজষপত্র ইত্যাদি ধার বাবদ ল্ওয়ার জন্যে যে ঠেকায় পড়ে সে এ জিনিস গুলো (আরবী******)পযার্য় ভুক্ত। কেননা মুসলিম ব্যাক্তির ক্ষতি ঠেকা দূর করা সর্বসম্মতভাবে ফরয। ঘ. মুসলিম সমাজ সমষ্টিকে সাধারণভাবে ঘনীভূত হয়ে আসা সর্বান্মক বিপদ আপদ থেকে রক্ষা করা-শত্রুর আক্রমণের আশংকা, কাফিরদের হাত থেকে মুসলিম বন্দীদের উদ্ধারনরণ, মহামারী ও দুর্ভিক্ষ ইত্যাদির প্রতিরোধ প্রভৃতি এ বিপদের পযার্য়ে পড়ে। এ সব অবস্থায় ব্যক্তি অধিকারের ওপর সমষ্টির অধিকর সর্বাগ্রগণ্য, এতে কোন সন্দেহ থাকতে পারে না। আর এসব কঠিন অবস্থার মধ্যে পারস্পরিক অংশ ভাগাভাগি করে নেয়াই যে ওয়াজিব, ত সমন্ত মুসলিম আলিমগণের কাছে সর্সম্মত। আল-মিনহাজ –এর প্রতিরোধ-যেমন বস্ত্রহীনকে বস্ত্রদান, বুভুক্ষুকে খাদান ইত্যাদি। যদি যাকাত ও বায়তুলমালের সম্পদ তা প্রতিরোধে ব্যর্থ হয়, তাহলে সক্ষম- লোকদের জন্যে ফরযে কেফায়া। আ সক্ষম সমর্থ লোক বলতে বোঝায় সে সব লোককে, যাদের কাছে এক বছরকালের জন্যে তাদের ও তাদের ওপর নির্ভরশীলদের জন্যে যথেষ্ট পরিমাণের অধিক সম্পদ স্ওজুদ আছে। আর উল্লিখিত ক্ষতি প্রতিরোধ বলতে কি বোঝায়? তা কি শুধু প্রাণটা বাঁচানের পরিমাণ খাদ্য দান, ন সর্ববিচারে যথেষ্ট পরিমাণ দিতে হবে?..... এর জবাবে দুটি কথা বলা হয়েছে। তন্মধ্যে সহীহতম কথা হচ্ছে এ শোয়োক্তিটি। কাপড় দান এমনপিরিমাণ হতে হবে যা শীত –গ্রীষ্মজনিত অবস্থায় প্রয়োজনীয় মানে গোটা দেহ আবৃত করতে সক্ষম হয়। আর খাদ্য ও ব্স্ত্র বলতে যা বোঝায় তাই দিতে হবে। চিকিৎসকের ভিজিট, ঔষধের মূল্য, কাজে সাহায্যকারী একজন খাদেম ইত্যাদি ও তার অন্তর্ভুক্তি হবে। একথা সকলের কাছে স্পষ্ট। [ (আরবী***********)] পূর্বে যাকাত ব্যয়ের ক্ষেত্র পযার্য়ে সাবলিল্লাহর অংশ সম্পর্কে ইমাম নববী ও শাফেয়ী মায়হাবের অন্যান্য আলিমের মতের উল্লেখ আমরা করেছি। তা হচ্ছে সুশৃংখল সেনাবাহিনীর বেতন দান যদি বায়তুলমাল থেকে সম্ভবপর না হয়, তাহলে তা দেয়া সমাজের ধনী লোকদের দয়িত্ব হবে। তা যাকাতের বাইরে থেকে দিতে হবে। মালিকী ফিকাহবিদ কাযী আবূ বকর ইবনুল আরাবী তাঁর (আরবী***********)গ্রন্থে লিখেছনঃ ধন-মালে যাকাত ভিন্ন আর কিছু পা্ওনা নেই। কিন্তু যাকাত দিয়ে পর যদি কোন প্রয়োজন দেখা দেয়, তাহলে সেজন্যে অর্থদান করা ধনী লোকদের কর্তব্য হবে, এতে সমস্ত আলিম একমত। ইমাম মালিক বলেছেনঃ সমন্ত মুসলমারেন ওপর কর্তব্য, ওয়াজিব হচ্ছে কাফিরদের হস্তে তাদের লোক বন্দী হলে তা মুক্ত করা। তাতে তাদের সমস্ত ধন-মাল ও তা করতে হবে। অনুরূপভাবে প্রশাসক যদি যাকাত সংগ্রহ করার পর তা পা্ওয়ার যোগ্য লোকদের মধ্যে বণ্টন না করে, তখন ও কি গরীরদের সচ্ছল বানানো কর্তব্য হবে ধনী লোকদের?............ খুবই বিবেচ্য বিষয়। আমার মতে, হ্যাঁ, তা তাদের ওপর ওয়াজিব হবে। [ (আরবী *********)] কুরতুবী তাঁর তাফসীরে এ বিষয়টির ওপর খুব বেশী গুরুত্ব আরোফ করেছেন। লিখেছেনঃ মুসলিম জনসমষ্টির ওপর কোন বিপদ বা অভাব দেখা দিলে – যাকাত দিয়ে দেয়ার পর- সেজন্যে অর্থ ব্যয় করা ধনী লোকদের জন্যে ওয়াজিব।ইমাম মালিক (র) ও এ কথা উদ্ধৃত করেছেনঃ লোকদের ওপর ওয়াজিব তাদের বন্দীদের ফেদিয়া দিয়ে মুক্ত করা। তাতে তাদের সব মাল ঃশেষ হয়ে গেলে ও। তারপরে বলেছেনঃ এটা ইজমা ও বটে! তাতে আমাদের মতই শক্তি পায়। [(আরবী *********)] মালিকী পন্হী শাতেব তাঁর অনন্য গ্রন্হ (আরবী *********) এ লিখেছেনঃ বায়তুল মাল যখন শূন্য হয়ে বাবে, তখন যদি সেনাবাহিনীর জন্যে আর ও ধন-মালের প্রয়োজন দেখা দেয়, তাহলে সুবিচারক রাষ্ট্র- নায়কের অধিার আছে, সে ধনী লোকদের মাসিক বায়তুলমালে নতুন করে সম্পদ আসা পযর্ন্ত চলতে থাকবে। [(আরবী……….)] এসব অকাট্য স্পষ্ট মত হচ্ছে সে ফিকাহবিদদের, যাঁরা ধন-মালের ওপর যাকাত-বহির্ভূত কোন হক্ ধায হতে পারে বলে মনে করেন না। এ থেকে একথাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, যাঁরা এ মত পোষণ করেন, তাঁরা আসলে অত্যাচারমূলক কর ধাযকরণেরই বিরোধিতা করেছেন। কেননা শাসক প্রশাসকরা সাধারণত এরূপ করই ধায করে থাকে তাদের নিজেদের এবং তাদের অনুসারীদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের বিপুলতা ও বিশালতা বিধানের উদ্দেশ্যে। কিন্তু তার ফলে গোটা জাতির জীবন কঠিনভাবে সংকীর্ণ হয়ে পড়ে। যদি ও এরূপ কর ধাযর্করণের ফলে বিশেষ কোন প্রয়োজন পূরণ হয় না, সর্বসাধারণের কল্যাণের জন্যে ও তা প্রয়োজনীয় হয় না। সম্ভবত এ আলিমগণ ভয় পেয়েছেন এই ভে যে, যাকাতের বাইরে ও প্রাপ্য বা দেয় আছে, এ মত দিলে অত্যাচারী শাসকরা অনধিকারভাবে কর ধায র্ধায করা ও অত্যাচার মূলক অর্থ আদায়ে তাদের এমকে একটা মাধ্যম বনিয়ে নেবে। এ করণে তার তাদের এ জলুম মূলক কাযের্র পথ বন্ধ করার উদ্দেশ্যে বলে দিয়েছেন যে, না যাকাতের বাইরে কিছুই নেয়ার বা পা্ওযার কোন অধিকর নেই। [ নবম অধ্যায়ে-যাকাত ও কর শীর্ষক সপ্ত পরিচেছদে বিস্তারিত আলোচনা দেয়া হয়েছে।] কিন্তু এখানে এমন কয়েকটি ক্ষেত্র রয়েছে, যেখানে উভয় পক্ষ প্রকৃত মতদ্বৈততার মধ্যে পড়ে গেছে। কয়েকটি ক্ষেত্রের ও নাম উল্লেখ করা যাচ্ছেঃ ক. কাটা কালে কৃষি ফসল ও কলের ওপর হক; খ মেহমানে অধিকার; গ. সধারণ ব্যাবর্হায ও নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের (আরবী*****) হক। দ্বিতীয় কতের লোকদের দৃষ্টিতে উপরিউক্ত সব গুলোই ধন-মালে ওয়াজিব হক। তা আদায় করতে ক্রটি করা হলে মুসলাম গুনাহগার হবে এবং সেজন্যে আল্লহর কাছে কঠিন আযাব পা্ওয়ার যোগ্র বিবেচিত হবে। পক্ষান্তরে প্রথম মতের লোকদের দৃষ্টিতে ওগুলো মুস্তাহাব হক্।করলে আল্লাহর কাছে স্ওয়অব পা্ওয়া যাবে আর না কররৈ কোন গুনাহ হবে না যতক্ষন পযর্ন্ত তার বাস্তবিক প্রয়োজন দেখা নো দেবে। তা দেখা দিলে তো তা ওয়াজিব হয়ে পড়বে। জাসসাস বালতি তৈজসপত্র, ভাণ্ড- বাটি,কোদাল ইত্যাদি ধার বাবদ দেয়া পযার্য়ে এ কথাই বলেছেন। [ (আরবী***********)]এসব জিনিষ ধার বাবদ দেয় প্রয়োজনকালে তো ওয়াজিব।দিতে অস্বীকার করলে সে ঘৃণা ও তিরস্কারের যোগ্য হবে। প্রয়োজন ব্যতিরেকে তা দিতে অস্বীকার করা হলে নিশ্ছয়ই তা অপরাধ এবং মুসলিম সমাজের রীতিনতি চরিত্রের বিরোধিতা হবে অথচ নবী করীম(স) বলেছেনঃ আমি তো উত্তম ও মহান চরিত্রাবলীকে পূর্ণত্ব দানের উদ্দেশ্য প্রেরিত হয়েছি। [বুখারী এ হাদীসটি (আরবী***********)এ উদ্ধৃত করেছেন এবং ইবনে সায়াদ (আরবী*********)গ্রন্থে হাকেম (আরবী***********)গ্রন্থে, বায়হাকী (আরবী*********)এ আবূহুরায়রা থেকে বর্ণিত। হাদীসটির সনদ সহীহ ব্যাখ্যা (আরবী*********)] ঙ. এ পযর্ন্ত আংশিক অধিকার পযার্য়ে যা কিছুই বলেছি, তা ধনীদের ধন-সম্পদে গরীব লোকদের অধিকর সম্পর্কে বলেছি। দ্বিতীয় মাযহাব পন্হীদের দৃষ্টিতে্ এ অধিকার গুলো ওয়াজিব। প্রত্যেক দেশ-শহর স্থানের ধনীলোকদের খাদ্য, পানীয়, বস্ত্র ও বাসস্থান ইত্যাদি যথেষ্ট পরিমাণে দিয়ে গরীবদের পর্শ্বে দাঁড়াবে। এ ছাড়া্ও আর ও যা যা প্রয়োজন তা্ও এর মধ্যে গণ্য। এজন্যে প্রশাসন ধনীদেরকে বাধ্য করবে, যদি যাকাত বায়তুলমালের অন্যান্য আয় তেকে তা পূরণ না হয়। পযার্লোচনা ও অগ্রাধিকার দান এ অধিকার সমূহ যথেষ্ট বিরোধী- বিশেষ করে এ শেষোক্তটি।এ জন্যে সম্মুখে অগ্রসর হ্ওয়ার পূর্বে এখানে কিছুটা স্থিতি গ্রহণ করা আবশ্যক। ১. কাটাইর সময় ফসল ও ফলের হক্ পযার্য়ে ফসল ও ফলের যাকাত শীর্ষক আলোচনায় এমতকেই অগ্রাধিকার দিয়ে এসেছি যে, এ হকের অর্থ হচ্ছে ওশর ও অর্ধ ওশর। পূর্বের কিছু লোক এমতই দিয়েছেন, তাতে আয়াতটির মক্কী হ্ওয়ার পথে কোন প্রতিবন্ধকতা নেই। মক্কী যুগে আল্লাহ তা আলা উক্ত হক্ আদায় সংক্ষিপ্ত ও মোটামুটি নির্দেশ দিয়েছেন। পর মদীনায় এসে রাসূলে করীম (স) এর জবানীতে তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা প্রদান করিয়েছেন। ফলে তা এমন সংক্ষিপ্ত ও মোটামুটি কথা যার বিস্তারিত আল্লাহই বলে দিয়েছেন। আগের কালের কেউ কেউ যে মনসূখের কথা তুলেছেন, এটা তার ও ব্যাখ্যা। ২. মেহমানের হক্ পযার্য়ের হাদীসসমূহ থেকে একথা সুস্পষ্ট যে, তার অর্থ, এমন বিদেশী লোক, যে কোন দূরবর্তী স্থান থেকে এখানে এসেছে। সে তখন ঃনিঃস্ব পথিক (ইবনুস সাবীল) পযার্য়ে গণ্য। এ কারণে ইবনে আব্বাস ও তাবেয়ীদের একটি দল বলেছেনঃ ইবনুস সাবীল বলতে মেহমান বুঝিয়েছে। [দেখনঃ (আরবী*********)] হাদীসসমূহ স্পষ্ট করে বলে দিয়েছে যে. মেহমানের আসলে তার মেহমানদারী পা্ওয়ার অধিকার আছে। আর এটা নিঃসন্দেহ যে, এ ব্যবস্থা যাকাতের বাইরে এবং অতিরিক্ত। ৩. (আরবী********) সাধারণ ব্যবহায জরুরী জিনিসপত্রের অধিকার বা তার ওপর জনগণের হক সম্পর্কে যা বলা হয়েছে তার যৌক্তিকতা এই যে, যদি তা ওয়াজিব না তহ, তাহলো তা তরক করার দরুন আযাবের ভয় প্রদর্শন করা হত না. কুরআনে জাহান্নামের হুমকি দেয়া হত না। যাঁরা এ (আরবী********) এর অর্থ যাকাত করেছেন, তাঁরা্ও একথা বলেন নি যে, ঘরের সাধারণ জিনিসপত্র, যা লোকরা পারস্পরিক ধার ও দেয়া-নেয়া করে। এ থেকে তা বোঝা যায় না। ৪. ধনী লোকদের ধন-মালে ফকীর-মিসকীনের যে হক্ আছে এবং তাদের প্রতি দয়া-অনগ্রহের ব্যবহার করাকে আল্লাহ তা আলা যে ওয়াজিব করেছেন, তাদের খা্ওয়া-পরা ইত্যাদি প্রয়োজন সমূহ পূরণের যে তাগিদ আছে ত এতই স্পষ্ট ও প্রকট যে. তা একটা দটো আয়াতে কিংবা একটা বা দুটো হাদীসের উদ্ধৃতি দিয়ে বলিষ্ঠ করে তোলার কোন প্রয়োজনই নেই। তবে আলিমগণ (আরবী**********) আয়াতটি এবং ধন-মালে যাকত ছাড়া্ও হক্ আছে-এ হাদীস উল্লেখ করার পদক্ষেপ নিয়েছেন, তা শুধু প্রথম ভি্ত্তি স্থাপন ও স্বরূপ নির্ধারণের উদ্দেশ্যে মাত্র্। আর তা হচ্ছে ধন-মালে যাকাত ছাড়া্ও হক্ আছে। কিন্তু মূল বিষয়টি সম্পর্কে দলিল- প্রমাণসমূহ নবীন ঊষার রক্তিম আলোকছটার ছাইতে এ অধিক স্পষ্ট এ প্রকট। কেননা ইসলামী ব্যবস্থার প্রকৃতি কুরআনের মাক্কী ও মাদানী আয়াত সমূহের আলোরক যে ভাবে গড়ে উঠেছে এবং রাসূলে করীম (স) এ সহীহ হাসান হাদীসসমূহ যেভাবে তার লালন করেছে, তাতে সমাজে পারস্পরিক দায়িত্ব গ্রহণ ও নিরাপত্তা বিধান অবশ্য কর্তব্য হয়ে গেছে। পারস্পরিক সহানুভূতি ও সহৃদয়তা- ওয়াজিব, রক্ষা করা একান্তই কর্তব্য। তার এ সমজে শক্তিমান দুর্ধর্ষ দুর্বল হতে বাধ্য। প্রতিবেশীদের পারস্পরিক অনগ্রহের আদান-প্রদান অনিবায। যে লোক ইসলামের এসব মহান উচ্চশিক্ষার এ আদর্শ অগ্রাহ্য করবে, তার জন্যে ইসলামে ও কিছু নেই, রাসূল (স) এর কাছে ও কিছু নেই। সে আল্লাহ থেকে নিঃসম্পর্ক আল্লাহ ও নিঃসম্পর্ক তর সাথে। বনু তামীম গোত্রের এক ব্যক্তি রাসূলে করীম (স) এর কাছে উপস্থিত হয়ে বললঃ ইয়া সাসূলুল্লাহ, আমি বিপুল ধন-সম্পদের মালিক। আমার পরিবারবর্গ ও আছে, আমার কছে উপস্থিত এ হয় অনেক লোক। এখন বলুন, আমি আমার ধন-সম্পদ কিভাবে ব্যয় করব? আমাকে জানিয়ে দিন, আমি কেমন করন? তিনি বললেনঃ তোমার মালেন যাকাত দিয়ে দেবে। কেননা তা পবিত্রকারী তোমাকে পবিত্র করবে। তোমার নিকটাত্মীয়দের সাথে ছেলায়ে মেহমী কর,ভিক্ষা প্রার্থীর, প্রতিবেশীর ও মিসকীনের হক্ আছে জানবে। [ আহমদ আনাস থেকে হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন। এর বর্ণনাকরী সকলেই সিকাহ সহীহ। (আরবী*******) আবূ উমাইদ ও ইবনুল মুনযির ও তা উদ্ধৃত করেছেন। (আরবী********)] এ বাণীতে ভিক্ষাপ্রার্থী, প্রতিবেশ ও মিসকীনের হক্ আছে বলে ঘোষণা করা হয়েছে এবং ত যাকাতের পরের কথা। যাকাতের পর নিকটাত্মীয়দের হকের কথা বলা হয়েছে। এ কথাটি ঠিক কুরআরে আয়াতের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণঃ এবং দা্ও নিকটাত্মীয়কে তা হক্ এবং মিসকীন ও নিঃস্ব পথিকের। অন্য হাদীসের সাথে্ও তার পূর্ণ সঙ্গতি বিদ্যমান- ভিক্ষাপ্রার্থীর অধিকার আছে- অবশ্যই স্বীক্রতব্য, সে অশ্বারোহী হলে এলে ও। [হাদীসটি আহমদ মুসনাদুল হুসাইন ইবনে আলীতে উদ্ধৃত করেছেন। আবূ দাউদ কিতাবুযযাকাত –এ (আরবী******) হাফেয ইরাকী বলেছেন, এ সনদ খবই উত্তম। বর্ণনাকারীরা এ সিকাহ (আরবী*******) এ শায়খ আহমদ শাকের তাঁর মুসনাদের ওপর লিখিত টীকায় হদীসটিকে সহীহ বলেছেন। (আরবী********)] রাসূল ররীম (স) বলেছেনঃ যে লোক মানুষের প্রতি দয়া করে না, আল্লাহ ও তার প্রতি রহম করেন না। [ বখারী, মুসলিম এ তিরমিযী জরীর ইবনে আবদুল্লাহ থেকে বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন। পূর্বে ও হাদীস উদ্ধত হয়েছে এ গ্রন্থে।] রাসূলে করীম(স) বলেছেনঃ তোমরা কখ্খনই ঈমানদার হতে পারবে না, যদি ন তোমরা পরস্পর দয়া ও অনুগ্রহ কর। সাহাবায়ে কিরাম বললেনঃ হে রাসূল আমরা প্রত্যেকেই দয়া সম্পন্ন। বললেনঃ তোমাদের পারস্পরিক দয়া-অনুগ্রহের কথাই বলছিলাম। [তাবারানী হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন আবূমূসা থেকে। সহীহ হাদীসের বর্ণনাকরীরাই এ বর্ণনাকারী। মনযেরী তাই বলেছেন (আরবী***********)৩য় খন্ড (আরবী***********)–তে।] এধরনের আর ও অনেক হাদীস। উপরিউক্ত আয়াত ও হাদীসসমূহ যে পারস্পরিক দয়া-অনুগ্রহ, সহযোহিতা, দায়িত্ব গ্রহণ ও সমর্মিতার নির্দেশ দেয়, তা বাস্তবায়িত হতে পারে কেবল তখন, যখন এ সমাজের সমান মানের অনুকূল অর্থ ব্যবস্থায় প্রত্যেকটি ব্যক্তিই তার ও তার পরিবারবর্গে খাদ্য, পানীয, পরিধেয়, বাসস্থান, শিক্ষা ও অন্যান্য যাবতীয় মৌলিক প্রয়োজনীতা জিনিস পায়- তার কেন একটি থেকে ও বঞ্চিত না হয়। রাষ্ট্রের যাকাত সম্পদ ও বায়তুলমালের আয় যদি এরূপ সমানের অর্থ ব্যবস্থা কার্যকর করার জন্যে যথেষ্ট হয়, তাহলে তো ভালই। তখন মুমিন লোকেরা গরীব-মিসকীনের অপরাপর অধিকার আদায়ের জন্যে চেষ্টিত হবে। কিন্তু যাকাত সম্পদ ও ন্যায্য আয় যদি দারিদ্র মোচনে যথেষ্ট মাত্রায় সক্ষম না হয়, গরীব লোকদের সচ্ছল বানাতে না পারে, তা হলে সক্ষম ধনী লোকদের দায়িত্ব হচ্ছে এ গরীবদের প্রয়োজন যথেষ্ট মাত্রায় পূরনণর জন্য তারা ছেষ্চানুবর্তী হবে। প্রত্যেকই তার নিকটাত্মীয়তার মীমার মধ্যে কাজ করবে, ছেলাযয় রেহমী রক্ষা করবে। তাদের কিছু লোক যখন এ কর্তব্য পালন করে তাদের ঈমান রক্ষায় উঠে পরড় লাগবে, যার ফলে অভাবগ্রস্ত লোকেরা তাদের প্রয়োজন পূরণ করতে সক্ষম হবে, তখন অন্যরা ও গুনাহ থেকে রক্ষা পাবে। অন্যথায় রাষ্ট্রশাসকের দয়িত্ব হবে ইসলামের নামে এ কাজে হস্তক্ষেপ করা এবং অক্ষম গরীব লোকদের প্রয়োজন পূরণের ব্যবহস্থাস্বরূপ ধনী লোকদের ওপর মাসিক হারে সাহায্য ধার্য করে দেয়া। দুনিয়ার বহ লোকই যখন এই অগ্রবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, তখন্ও ইউরোপ এ ব্যবস্থ সম্পর্কে অনবহিত ছিল। ইউরোপ এ সেদিন মাত্র এ ধরনের কল্যাণকর ব্যবস্থা সম্পর্ক অবিহিত হতে পেরেছে অথচ ইসলামের কুরআন ও সুন্নাহ এ ব্যবস্থা সেদিন থেকেই কর্যকর ভাবে চালু করেছে, যেদিন ইসলামের সূর্য দিহন্ত উদ্ভাসিত করেছিল, রাসূলো করীম (স) এর সাহাবী এবং তাবেয়ীগণ কোনপূপ অস্পষ্টতা ও দারণাহীনতা ছাড়াই এক কাজকে চালু করে দিয়েছিলেন। ভিন্ন কতের লোকদের দলিল হিসেবে উপস্থাপিত হাদীসসমীহের তাৎপর্য এক্ষণে প্রশ্ন জাগে, সে সব হাদীসের কি ব্যাখ্যা হতে পারে, যা বাহ্যতা প্রকাশ করছে যে,ধন-মালে যাকাত ছাড়া আর কিছুই প্রাপ্য নেই নফল দান-সাদকা ছাড়া এবং যে লোক যাকাত দিয়ে দিল সে তার দায়িত্ব সম্পূর্ণরূপে পালন করে বসেছে?এসব হাদীসের মধ্যে যে কয়টি সহীহ প্রমাণিত হয়েছে। তা থেকে আমাদের সম্মুখে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, যাকাত হচ্ছে অবর্তনশীল দায়িত্ব এ কর্তব্য- তা সুনির্দিষ্ট ও স্থায়ী ভোবে ধন-মাল ধার্য হয়। প্রত্যক্ষ ভাবে স্থায়ী রূপ নিয়ে তা সরাসরি ধন-মালের ওপর ধার্য হয়। তা দিয়ে আল।লাহর নিয়ামত দানের শোকর আদায় করা হয়। ব্যাক্তির ওপর কর্যকর।তা দিযে আল্লাহর নিয়ামত দানের শোকর আদায় করা হয়। ব্যক্তির নিজের মন-মানসিকতা এ ধন-মালের পবিত্রতা এ পরিশুদ্ধতা অর্জন করা হয়। এটা এমন একটা হক্ যা আদায় না করে কোন উপায় নেই। কখন্ও যদি এমন হয় যে, যাকাত গ্রহণের জন্যে একজন ফকীর বা মিসকীন এ পাএয়া যাচ্ছে না, যার প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করা যেথে পারে কিংবা যাকাতের অংশ ব্যয় করার যদি আদৌ কোন প্রয়োজনই না থাকে, তবুই তা দিতে হবে। ১. এ অধ্যায়ের শুরীতে এ হাদীসসমূহের মর্যাদা সম্পর্কে আমরা আলোচনা করেছি। এ পর্যায়ে নিসাব পরিমাণ সম্পদরে মালিক মুসলিম ব্যক্তির কাছে সধারণ এ স্বাভাবিক অবস্থায় যাকাত ছাড়া আর কিছুই দাবি করা যাবে না, একথা ঠিক এবং সে যখন এ যাকাত দিয়ে দিল, তখন তার ধন-মলের এপর ধার্যকৃত দায়িত্ব পালন করে বসল তার ধন-মলের ওপর থেকে অন্যায় এ পাপকে ধর করে দিল। অতঃপর সে যদি নফলস্বরূপ কিছু দান –সদকা করে তা হলে সে কথা স্বতন্ত্র, তাছাড়া তার আর কোন দায়ত্ব থাকে না হাদীসে যেমন বলা হয়েছে, এট সাধারণ এবং স্বাভাবিক অব্থার স্থায়ী ব্যবস্থা। কিন্তু অন্যান্য যেসব হক –হকুকের কথা বলা হয়েছে, তা যাকাতের কত স্থায়ী ভাবে ধার্যকৃত কোন জিনিস নয়। তার সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট কোন পরিমাণএ নেই—যেমন যাকাতের পরিনাণ সুনির্দিষ্ট এ স্থয়ী, অপরিবর্তনীয়। এ শেয়োক্ত হক-হকুক অবস্থার এ প্রয়োজনের পার্থক্যর দরুন বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে এবং অবস্থ,যুগ-কাল ও পরিবেশ- পরিস্থিতির পরিবর্তনে তা পরিবর্তিত এ হয়। এসব হক- হকুক সাধারণত মূলা সম্পদের ওপর ধার্য হয় না, সেই হিসেবে এ হয় না।তা হয় সামর্থ্যানুপাতে এবং কিছু লোক যখন তা্ও পালন করে –আদায় করে, তখন অন্যাদের ওপর থেকে ও সে দায়িত্ব পালিত হয়ে যায়। অনেক সময় ত নির্দিষ্ট হয় এভাবে যে, একজন এক ব্যক্তিকে খুব সাংঘাতিক দূরবস্থায় পড়ে দেখতে পেল, সে তার এ দূরস্থা দূর ররতে পারে বলে; মনে করল তখন তা রা তর জন্যে কর্তব্য অথবা কারোর প্রতিবেশী অভুক্ত কিংবা বস্ত্রীন থাকলে এবং তাকে খাদ্য ও বসত্র সে দিতে সক্ষম হলে তাএ তার করা কর্তব্য। সাধারণভাবে এসব হক-হককি আদায় করার ব্যাপারটি ব্যক্তিদের ঈমান এ দায়িত্ব জ্ঞানের ওপর নির্ভর করা হয়- কোনরূপ রাষ্ট্রীয় হস্থক্ষেপ বা প্রভাব বিস্তার ছাড়াই ব্যক্তিরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে তা আজ্ঞাম দেয়, সেটি ই চাওয়া হয়। কিন্ত কোন মুসলিম শসক যদি মনে করে যে, এ ঈমানী ওয়াজিব কাজটিকে আইনের শক্তিতে কর্যকর করা কর্তব্য- বিশেষ করে ব্যক্তিগণেল অভাব য়খন তীব্যতর হয়ে দেখা দেয় কিংবা রাষ্ট্রের ব্যয় ভার ও দায়িত্ব –পরিধি বেঢ়ে যায়-একালে যেমন ঘটছে-এরূপ অবস্থায় রাষ্ট্রকে তাতে হস্তক্ষেপ করতে হবে। এটা তার জন্যে একটা বাধ্যবাধকতা বিশেষ।ইবনে তাইমিয়ি ধন-মালে যাকাত ছাড়া আর কিছু প্রাপ্য নেই কথাটির ব্যাখ্যায় বলেছেনঃ এর আর্থ ধন-মালে এমন কোন হক্ বাং প্রাপ্য নেই যাকাত ঃছাড়া, যা বেলমাত্র ধন-মালের দরুনই ওয়াজিব হয়ে থাকে। অন্যথায় এমন বহ দায়িত্ব এ কর্তব্যই রয়েছে, যা কেবলা ধন-মালের দররন ওয়াজিব হয় না। মেন কিটাত্মীয়,স্ত্রী, দাস এ গবাদিপশুর প্রতি কর্তব্য অবশ্য পালনীয় হয়ে পড়ে। আনেক সময় রক্ত মূল্য দেয়ার এ দায়িকত্ব আসে। রিণ শোধ করার প্রয়োজন হয়ে পড়। বুভুক্ষুকে খাবার খ্ওয়ানো, বস্ত্রহীনকে পরেধেয় দেয়া পরযে কেফায়া হিসেবে জরুরী হয়ে পড়ে। এগুলো্ও অর্থনৈতিক দায়দায়িত্ব হলে ও তা অস্থায়ী কারণের দরুন। ধন-মাল হলা এয়াজিব হ্ওয়ার শর্ত-যেমন হজ্জ পালনে সামর্থ্য একটা শর্ত। এখানে দেহ বা স্বাস্থ্য হজ্জ ফরয হ্ওয়ার জন্যে জরুরী আর যাকাত ফরয হ্ওয়ার জন্য নিসাব পরিমাণ ধন-মাল থাকা শর্ত। তা কারণ্ও বটে। মন কি, সে স্থানে যাকাত পা্ওয়ার য়োগ্য লোক পা্ওয়া না গেল্ওে তা ফরযই থাকবে, তবে অন্যত্র নিয়ে বন্টন বরতে হবে। এটা আল্লাহর হক-আল্লাহরই নির্দেশে তা ফরয হয়েছে। [(আরবী********)] ষষ্ঠ অধ্যায় যাকত ও কর কর –এর মৌল তত্ত্ব এ যাকাতের মৌল তত্ত্ব। কর ধরার আদর্শিক ভিত্তি এবং যাকাত ধার্য করার ভিত্তি।ৎকর এর কেষত্র এবঙ যাকতের ক্ষেত্র। কর ও যাকাতের মধ্যে ন্যায় পরতার প্রাথমিক নীতি। কর ও যাকাতের মধ্যে ন্যায়পরতার প্রাথমিক নীতি। কর ও যাকাতের মধ্যে আপেক্ষিকতা ও হার উচ্চাতা। কর এর নিরাপত্তা। যাকাতের সঙ্গে কর ধার্যকরণ কি বিধিসম্মত? কর ধার্যকরণে যাকাত ফরয হ্ওয়ার প্রয়োজন কি ফরিয়ে যায়? যাকাত ও কর এ অধ্যায়ে আমরা ইসলামী মরীয়াতের বিধান করা যাকাত এবং মানুষ প্রবর্তিত কর এর মধ্য তুলনামূলক অধ্যয়ন করতে ইচ্ছা করেছি। আধনিক চিন্তাধারা ও অর্থ তুলনা করব না রোমান ও পারস্য সভ্যতার বা মধ্য যুগের অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে। কেননা সেসব যুগের প্রক্ষিতে যাকাত এ ক এর মধ্যে তুলনা করার কোন সাধ্যই আমাদের নেই। আমরা যাকাতের যুলনা করব কর-এর সাথে তার আধনিক অবস্থা ও রূপের পরিপ্রেক্ষিতে বহু বিবর্তন ও পরিবর্তনের স্তর পার হয়ে আসার পর। এখন তাতে বহু সুসমতা, সমঞ্জস্য ও সৌর্দর্য বিধানের কাজ সম্পাদিত হয়েছে। যগোন্তরের অভি।জ্ঞতা তো ওদাষ-ক্রটি জঞ্জাল অনেক কিছুই দূরীভূত করে তাকে অধিকতর পরিচ্ছন্ন করে দিয়েছে। নিয়অর বিভিন্ন অঞ্চল ও পরিবেশ পরিস্থিতি থেকে বহু বড় বড় বিদ্ধান- দুদ্ধিমান ব্যক্তিরা তার বিরাট খিদমত আজ্ঞাম দিয়েছে। শেষ পর্যন্ত তা পরিপক্কতা লাভ করে নিজের শ্কত কন্ডের ওপর মাথা ও তুলে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে। এ অধ্যায়ের বিভিন্ন পরিচ্ছেদে যাকাত ও আধনিক কর-ব্যবসহথার মধ্যে সাদৃশ্য ও অভিন্নতার দিকগেুলো তুলে ধরব, যার ফল ভয়েল।প্রকৃত নিগূড় তত্ত্ব উদঘাটিত হবে। যাকাত একাট অর্থনৈতিক ও শেষ প্রকৃতিসম্পন্ন পরয় হিসেবে প্রতিভাত হবে। জানা যাবে, তার মূল দর্শন্ও সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। তার প্রকৃতি ও মৌল ভিত্তি অন্য সব খিছু থেকে সম্পূর্ণ আলাদা তার আয়েল সূত্র এবং ব্যয়ের খাতসমূহ ও তার মাত্রার পরিমাণ। অনুরূপভাবে তা স্বতন্ত্র তার সূচনা বা প্রিাথমিক পদক্ষেপ ও চূড়ান্ত লক্ষ্য সমূহ, নিরাপত্তা দানের যোগ্যতা বা ততোধিক শতাব্দী পূর্বে বিধ্বদ্ধ হয়েছে, এ যুগের অর্থনৈতিক ও কর সংক্রান্ত চিন্তা মুলনীতি ও বিধি-বিধানের দিক দিয়ে যতদূর উন্নীত হয়েছে, যাকাত তা্ও ছাড়িয়ে গেছে। যাকাতে নিহিত তৎপর্য- বিশেষত্ব লাভ করতে কর চিরদিনই অসমর্থ থাকবে। কিন্তু তা বি করে সম্ভব হল? তা্ও আলোচিত হবে। এই অধ্যায়ে আটটি পরিচ্ছেদ সংযোজিত হচ্ছে ১. কর-এ মৌল তত্ত্ব ও যাকতের মৌল তত্ত্ব ২. কর ধার্য করণ ও যাকাত ধার্য করণেল দার্শনিক ভিত্তি কার –এর ক্ষেত্র সমর্থ্য ও যাকাতের ক্ষেত্র –সামর্থ্য ৪. কর ও যাকাতের মধ্যে সুবিচারের মৌল নীতি ৫. কর ও যাকাতের মধ্যে আরপক্ষিক ও ঊর্ধ্বতার হার ৬. কর এর নিরাপত্তা বিধান এবং যাকতের নিরাপত্তা বিধান ৭. যাকাতের পাশে কর বিধিদ্ধকরণ ৮. কর ধার্য করণ যাকাতকে অপ্রয়োজনীয় প্রমাণ করে না প্রথম পরিচ্ছেদ কর এর মৌল তত্ত্ব ও যাকাতের মৌল তত্ত্ব অর্থনীতিবিদগণ জানেন, কর হচ্ছে একটা অর্থনৈতিক বাধ্যবধকতা। ধনী ব্যক্তি তা রাষ্ট্রের কাছে দিয়ে ওযতে থাকে। অবষ্য দেয়অল মত সামর্থ্য যদি তার থাকে। রাষ্ট্র সাধারণ ভাবে যেসব কল্যাণ মূলক কাজ করে তার মাধ্যমে যে সব সুযোগ সুবিধা করদাতা লাভ করে, সেদিকে তেমনটা দৃষ্টি দেয়া হয়না। অবশ্য রাষ্ট্র সরকান তার আয়ের দ্বারা একদিকে যেমন প্রশাসনিক ব্যয় ভার বহন করে তেমনি অিপরদিক দিয়ে রাষ্ট্র যেসব অর্থনৈতিক রাজনৈতিক ও সামাজিক উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বাস্তবায়িত করার সিদ্ধান্ত নেয় তার বাস্তবায়ন করে অপরিদিকে। [ ডঃ মুহম্মাদ ফুযাদ ইবরাহীম লিখিত আরবী গ্রন্থে(আরবী************) এর প্রথম খন্ড ২৬১ পৃষ্ঠা থেখে উদ্ধৃত। তাতে এ সংজ্ঞাটি গ্রহণ করা হয়েছে কর প্রভৃতি গগে ওঠার রূপ এবং তার লক্ষ্য সম্পর্কিত আলাচনার সার হিসেবে।] আর যাককত শরীয়াত পারদর্শীদের বিশ্লেষণ অনুযায়ী একটা সুনির্দষ্ট অধিকার যা আল্লাহ তা আলা মুসলমাদের ধন-মালে ধার্য করেছেন। তাঁর কিভাবে ঘোষিত ফকীর-মিসকীন ওঅন্যান্য পা্ওযার যোগ্য লোকদের জন্যে, আল্লাহর নিয়ামতের শোকর এবং তাঁর কৈকট্য লাভের জন্যে এবঙ মালের মালিকের মন-মানকিতার এবঙ তার ধন-মালেন পরিশুদ্ধকরণের লক্ষ্যে। যাকাত ও কর এর পারষ্পরিক একত্বের কতিপয় দিক উপরে যাকাত ও কর এর যে সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে তার থেকে স্পষ্ট হয় যে, এদুটিরমেধ্যে পারস্পরিক বৈপরীত্যের কতগুগুলো দক রয়েছে এবং রয়েছৈ কর ও যাকাতের মধ্যে কতিফয় সাদৃশ্যের দিক্ও। প্রথমে সাদৃশ্য এ অভিন্নতার দিক কয়টি তুলে ধরছিঃ ক. সাধ্যকরণ ও জোরপূর্বক আদায় করা যা না হলে সাধারণত কর আদায় হয় না এর ব্যবস্থা বা সুযোগ যাকাতে ও রয়েছে, যদি কেউ ঈমান ও ইসলামের দাবি ও তগিদে স্বতঃস্ফূর্তভাব না দেয়। যাকাত দিতে অস্বীকারকরীদের বিরুদ্ধে অসত্য শক্তি প্রয়োগ করে ও তা আদয় করার বিধান ইসলামে রয়েছে। এর চাইতে অধিক জোর –জবরদস্তির ও বাধ্যকরণের উপায় আর কিত হতে পারে? যাকাত দিতে অস্বীকারকারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্যে তলোয়ারের খাপ মক্ত করতে যিনি পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, তিনি অতি বড় শক্তির অধিকারী ছিলেন। খ. কর এর বিশেষত্ব হল, তা সাধারণ ধান ভান্ডা কেন্দ্রীয় সরাকারের তহবিলে অর্পণ রা হয় স্থানীয় সরকার ও বাদ যায় না। [ কর প্রসংগে এ শর্তটি আরোপ করা হয়েছে মধ্য যুগে ইউরোপে কৃষকরা জমির মালিককে কর দিত সে অবস্থা এড়াবার লক্ষ্যে।] যাকাত ও এ রকমই। কেননা যাকাত সূলত সরকারের কাছেই দেয়। তা দিতে হয় কুরআন ঘেষিত (আরবী***************) যাকাত কাজে নিয়েজিত কর্মচারীদের মাধ্যমে। এ বিষয়ে যাথাস্থানে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। গ. কর ব্যবস্থার মেীলনীতি হচ্ছে তার বিনিময়ে বিশেষ ও সুনির্দিষ্ট কিছু না পা্ওয়া।যার ওপর কর ধার্য হয়েছে সে বিশেষ সমাজ সমষ্টির অংশ হিসেবেই কর দেবে। সে উপকৃত হয় কর এর বিভিন্ন ব্যবহার ও তৎপরতার দরুন। যাকাত দানের মুকাবিলায়্ও দাতা কোন বিশেষ ফায়দা পা্ওয়অর লক্ষ্যে তা দেয় না। সে যেহেতু এমন একটি মুসলিম সমাজের অংশ যার সাহায্য সমর্থন দায়িত্ব গ্রহণ ভ্রাতৃত্বের সে লাভ করে। এ কারনে সমাজের লোকদের নিরাপত্তা দিয় দারিদ্র অক্ষমতা ওজীবনের দুর্বিপাকের বিরুদ্ধে। কেননা এ উম্মতের মাধ্যমেই তো আল্লাহর কালেমা বুলন্দ হবে, দুনিয়ার ইসলামের দা্ওয়াত সম্প্রসারিত হবে। যাকাত দানের ফলে সে নিজে কোন ফায়দা বা সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে কিনা সে প্রশ্ন কিছুতেই সমনে আসবে না। ঘ. আধুনিক প্রবণতায় কর এ একটা সামষ্টিক অর্থনৈতিক এ রাজনৈতিক দুনির্দিষ্ট লক্ষ্য রয়েছে। তা নিছক আর্থিক লক্ষ্যের অনেক ঊর্ধ্বে। যাকাতের ও একটা সুদূর প্রসারী লক্ষ্য রয়েছে যা দিগন্ত পরিব্যাপ্ত। তার শিকড় খুব বেশী গভীরে নিহিত।উপরোল্লেখিত দিকগুলোতে ওযমন তেমনি তা ছাড়া্ও শিকড় খুব বেশী গভীরে নিহিত। উপরোল্লেখিত দিকগুলোতে যেমন তেতমনি তা ছাড়া্ও আর্ও অনেক দিকে। ব্যক্তি ও সমষ্টির জীবনে তার প্রভাব্ও অন্যন্ত প্রকটি ও সক্রিয়। যাকাত ও কর এর মধ্যে পার্থ্যকের দিকসমূহ উপরে সাদৃশ্য ও অভিন্নতার দিকগুলো তুলো ধরা হয়েছে। এর পর অনৈক্য ও পাএথক্যের দিকগুলো তুলে ধরছি। এ পার্থক্যের দিকসমূহ অনেক। নিম্নোদ্ধৃত বিষয় অধিক গুরত্ব পূর্ণ বিধায় তা এখানে উদ্ধৃত করছি। ১. নাম ও শিরোনাম যাকাত ও কর এ দুটির মধ্যকার পার্থক্য প্রথম দৃষ্টিতেই প্রতিভাত হয়ে পড়ে উভয়ের নাম ও শিরোনাম দর্শনে। প্রত্যেকটি নামেরই একটা তাৎপর্য আছে, একটা ইঙ্গিত ইশারা এ রয়েছে। যাকাত শব্দটিই আভিধানিক অর্থে পবিত্রতা প্রবৃদ্ধি ও বাড়তি প্রবণতা বোঝায়। বলা হয় (আরবী**********)তার আত্মা পরিশুদ্ধ হয়েছে। (আরবী*********)কৃষি চাড়া বড় হয়েছে। (আরবী*********) স্থানটি পবিত্র হয়েছে। ইসলামী মরীয়াত যাকাতের এ নামকরণ করেছে এ উদ্দেশ্যে যে, ফকির মিসকীনকে যে মাল দেয়া ফরয করা হয়েছে শরীয়াত সম্মত কাজে যা কিছু ব্যয় করা হয় তা সবই যেন এ নাম দ্বারা বোঝা যায় এবং নামটি শোনা মাত্রই যেন মনে একটা পবিত্রতার ভাবধারা জেগে ওঠে। কিন্তু কর রা ট্যাক্স শব্দটি এরূপ নয়। কর বলতেই সাধারণত জরিমানা খারাজ ভূমিকর কিংবা জিযিয়া ইত্যাদি বোঝা যায় অর্থাৎ তা পওপ থেকে চাপিয়ে দেয়াএক প্রকারের বাদ্যবাধকতা বিশেষ। প্রত্যেকই বুঝে নেয় যে, এ বোঝা তাকে অনিছ্চা সত্ত্বে এ বহন করে যেতে হবে।যেমন তাদের ইয়াহুদীদের ওপর লাঞ্জ্না দারিদ্র্যতচাপিয়ে দেয়া হয়েছে-কুরআনের আয়াত। [আল বাকারা ঃ৬১ আয়াত।] একারণে মানুষমাত্রই তাকে জরিমানা র মত চাপিয়ে দেয়া দর্বহ বোঝা মনে করে। কিন্তু যাকাত (আরবী**********) শব্দটি এবং তার পবিত্রকরণ, প্রবৃদ্ধি সাধন এ বরকত দানের ভাবধারা মানুষের মনে এ অনুভতির সৃষ্টি করে যে, মালিক যে মাল পুঁজি করে রাখে কিংবা নিজের ভোগ ব্যবহারে লাগায় এবং তা থেকে আল্লাহর ধার্য করা হক্ আদায় কারে না, লোভ ও কার্পণ্যের মলিনতা ধুয়ে মুছে পরিচ্ছন্ন পবিত্র ও স্বচ্ছ নির্মল করতে পারে। সেই সাথে এ মনে জাগিয়ে দেয় যে, যাকাত বাহ্যত মাল হ্রাস প্রাপ্ত হয়। কিন্তু তা তার মনে জাগে যে, এটা কেবল চর্মচোক দিয়েই দেখা। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাই পবিত্র করে, প্রবৃদ্ধি প্রদান করে এ পরিমাণের বেড়ে যায়। এটা তার ধরা পড়ে যে অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেখে সে দৃষ্টিতে। আল্লাহ তাআলা এ কথাই বলেছেন এ আয়াতেঃ (আরবী**********) আল্লাহ সুদকে নিঃশেষ করেন এবঙ দান সমূহকে বাড়িয়ে দেন। [আল বাকারা ঃ২৭৬ আয়াত।] বলেছেনঃ তোমরা যা (আল্লাহর পথে) ব্যয় কর তিনিই তার স্থলাভিষিক্ত এনে দেন। [(আরবী********)] রাসূলে করীম (স) বলেছেনঃ যাকাত দেয়ার মাল কখনেই কমে যায় না। [হাদীসটি তিরমিযী উদ্ধৃত করেছেন।] অনুরূপভাবে মনে এ ভাব্ও জাগিয়ে দেয় যে, পবিত্র, প্রবৃদ্ধি ও বরকত কেবল মালেই পায় না; বরং যাকাত দাতা ব্যাক্তি এ পায়, তার গ্রহণকারী ও সেই ভাবধারায় সিক্ত হয়।যাকাত পাএয়ার যোগ্য ও গ্রহণকারী লোকের মন যাকাতের দারুন হিংসা ও শক্রতার ভাব থেবে পবিত্র হয এবং তার জীবিকা প্রবৃদ্ধি লাভ করে। কেননা তা্ও তার পরিবারবর্গের জন্যে প্রয়োজন পরিমাণ সে পেয়েই গেছে। আর যাকাতদাতার মন নিষ্কৃতি পায় লোভ এ কার্পণ্যের কলুষতা থেকে। ত্যাগ তিতিক্ষা দান ও ব্যয় বহন দ্বারা তার মন পবিত্র হয়ে ওঠে। এর করণে তার মনে পরিবারে ও দান-মালে বিপুলতা এসে যায়। কুরআন মজীদ একথা বোঝাবরা জন্যই বলেছেঃ তাদের ধন-মাল থেকে যাকাত গ্রহণ কর, তুমি তাদের পবিত্র কর, পরিশুদ্ধি কর তার দ্বারা। [(আরবী*********)] ২. মৌলতত্ত্ব এ প্রয়োগের ক্ষেত্র যাকাত এ কর এর মধ্যে পার্থক্যের দিকগুলোর মধ্যে ইল্লেখ্য হচ্ছে যাকাত হচ্ছে একটা ইবাদত যা মুসীলিম ব্যক্তির ওপর ফরয করা হয়েছে আল্লাহর শোকের আদায়স্বরূপ তাঁর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে। কিন্তু কর এরূপ নয়। তা নিছক একটা সামাজিক বাধ্যাবাধকতা,ইবাদত বা আল্লাহর নৈকট্য লাভের কোন ভাধারাই তাতে নেই। এ একটা জরুরী শর্ত। কেননা নিয়ত ছাড়া কোন ইবাদতই হয় না। আমলসমূহের মূল্যায়ন নিয়তের ভিত্তিতেই হয়- তাহীসের কথা এবং লোকদের শুধু এ আদেশই করা হয়েছে যে, তারা আল্লাহর ইবাদত করবে আনুহত্য কেবল তাঁরই জন্যে খালেছ ও একনিষ্ঠ করে। কুরআনের ঘোষণা। [(আরবী*********)] এ কারণেই বলা হয় যে, যাকাত ইসলামী ফিকাহয় এক প্রকারের ইবাদত বিশেষরূাপে গণ্য। এ কথা কুরআন এ সুন্নাহর কথার তাৎপযের সাথে সঙ্গতিসম্পন্ন। কেননা উভয় দলিলেই যাকাতকে নামযের পাশেই উল্লেখ করা হয়েছে। কুরআনের মাক্কী ও মাদনী সূরাসমূহের প্রায় বিশটি স্থানে এরূপ লক্ষ্য করা যায়। আর হাদীসের যে কত স্থানে তা রয়েছে তা মুনে শেষ করা যায় না। প্রস্ধি হাদনে জিবরীল এ তাই রয়েছে।ঃ ইসলামের ভিত্তি পাঁচটি জিনিসের টওপর সংস্থাপিত এ হাদীসে এবঙ এরূপ অন্যান্য হাদসে ও তাই হয়েছে। এ দুটোই ইসলামের পাঁচটি রুকন এর মধ্যে শামিলক এবং ইসলামের চারচি মৌলিক ইবাদতের অন্যতম। আর যাকাত যখন একটা ইবাদত, একট বিশেষ বিশেষ্তবসম্পন্ন সংস্কৃতি, ইসলামের সকিনসমূহের মধ্যে এটা দ্বীনী রুরন যা কেবল মুসলমানের ওপরই ফরয করা হয়েছে। এ জন্যে মহান শরীয়াত অসুসলিম নাগরিকদের এপর ইবাদতের প্রকৃত দ্বীনী বিশেষত্বসম্পন্ন একটা আর্থিক দায়িত্ব অমুসলমানের ওপর চাপানে হয়নি। কিন্তু কর সেরূপ নয়। তা মুসলিম আমুসলিম উভয়ের তাদের দেয়ার সামর্থ্যানুপাতে ধার্য হয়ে থাকে। ৩.নিসাব পরিনাণ নির্ধারণে যাকাত একটা পরিমিতি সম্পন্ন এ মরীয়াত নির্ধারিত ব্যবস্থা। প্রত্যেকটি মালের একটা নিসাব নির্দিষ্ট রয়েছে। সেই পরিমাণের কম মালেন মালিকদের তা থেকে অব্যাহতি দয়ো হয়েছে। তা থেকে দেয় পরিমাণটা এ নির্দিষ্ট রয়েছে পাঁচ ভাগের এক ভাগ থেকে শুরু কররে দশ ভাগের এক ভাগ পর্যন্ত তার অর্ধেক এ হতে পারে। দশ তাগের এক ভাগের এক দশামংশ এ একটা পরিমাণ। শরীয়াত এই যে পরিমণ নির্দিষ্ট করে দিয়েছে অকাট্য দলিলের ভিত্তিতে, তাতে এক বিন্দু পরিবর্তন করার করোর কিছুমাত্র অধিকার নেই। না তার বেশী ধার্য করা যায়, না কম। যারা যাকাতের ফরয পরিমাণ বৃদ্ধির ডাক দিয়েছে, আধনিক কালের অর্থনৈতিক এ সামষ্টিক সামাজিক মধ্যে ফেলে দিয়ৈছে। কর এরূপ নয়। তার ক্ষেত্র, তার নিসাব পরিমাণ,তার মূল্যায়ন ও পরিমাণ নির্ধারণ প্রভৃতি সব কাজই রাষ্ট্র সরকারের চিন্ত ভাবনা ও প্রশাসকদের পরিমাণ নির্ধারণের মাধ্যমেই মম্পন্ন হয়ে থাকে। বরং রাষ্ট্র সরকারের প্রয়োজন অনুপাতে পরিমাণ নির্ধারণের ওপরই তার অস্থিতি একান্তভাবে নির্ভরশীল। ৪. স্থিতি ও স্থায়িত্বের দিক দিয়ে এক আলোকে বলা যায়, যাকাত একটি স্থিতিশীল ও চিরন্তন ব্যবস্থা। এ পৃথিবীর বুকে যদ্দিন ইসলাম ও মুসলমান থাকবে, এ ব্যবস্থা এ ততদিন কর্যকর থাকবে।কোন অত্যাচারী প্রাশসক ও তা নাকচ করতে পারে না, সুবিচারের নাম করে এ তাতে কেউ কোন পরিবর্তন আনবার অধিকরী নয়। তা নামযের বিশেষত্বসম্পন্ন। নামায হচ্ছে দ্বীনের ভিত্তি স্তম্ভ আর যাকাত হচ্ছে ইসলামের পুলযোগসূত্র। কিন্তু কর ব্যবস্থায় এরূপ স্থিতিশীলতা ও চিরন্তন তার কো বৈশিষ্ট্য নেই। তার প্রকার, তার নিসাব এ পরিমাণ নির্ধারণে ও কোন স্থিতিশীলতা নেই। প্রত্যেকটি সরকারই তাতে হস্থক্ষেপ করতে, তার পরিনাণ যেমন ইচ্ছা নির্ধারণ করতে পারে অথবা সরকারী দায়িত্ব শীল কর্মকর্তারা তাতে যে কোন পরিবর্তন ও আনতে পারে। তাকে চালু রাখা্ও তাদেরই ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে। পূর্বে এ বিষয়ে বলা হয়েছে। তা অস্থায়ী ব্যবস্থা। তা প্রয়োজনের দৃষ্টিতে ধর্য হয়, প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে তাই শেষ হয়ে যায়। ৫. ব্যয়ের ক্ষেত্রে যাকাতের ব্যয়ক্ষেত্র বিশেষভাবে নির্দিষ্ট। আল্লাহ তা আলা নিজেই তার কিভাবে তা নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। রাসূলে করীম (স) তাঁর কথা দিয়ে তার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন এবং কাজ দিয়ে তা বাস্তবায়িত করেছেন- এ সুস্পষ্ট সুনির্দিষ্ট ব্যয় খাত সমূহ। মুসলিম ব্যক্তির মা্ত্রই তা জানতে ও বুজতে পারে, পারে নিজস্বভাবে তার সব অথবা তার একটা বড় অংশ বিতরণ করে দিতে যখন তার প্রয়োজন দেখা দেবে। এ ব্যয়খাত সমূহ যেমন মানবিক তেমনি ইসলাম সম্মত এ। কিন্তু কর রাষ্ট্রের সাধারণ প্রয়াজনসমূহ পূরণার্থে ব্যয় করা হয়ে থাকে এবং সে খাতসমূহ সরকারই নির্ধারণ করে থাকে। ১. সূরা ত্ওবার ৬ আয়াতে তাই বলা হয়েছে। সাধারণ ভাবে। যদি তারা ফাঁকি না্ও দেয় তবু তারা দেয় অনচ্ছা সত্ত্বে ও যেন তার কাছ থেকে জোর পূর্বক আদায় করা হচ্ছে। না দিয়ে পারলেই যেন বাঁচত এমনি ভাব। কিন্তু যাকাতের ব্যাপার ভিন্ন। মুসলমানরা যতটা যাকাত ফরয, তার চাইতে ও অনেক বেশী দিয়ে থাকে আল্লাহর সম্তষিট লাভের আশায়, তাঁর কাছ তথেকে স্ওযাব পা্ওয়ার উদ্দেশ্যে।নবী করীম (স) এ যুগে এবং তার পরে ও এ ধরওেনর ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে। কর ও যাকাতের মধ্যে নিরাপত্তা ব্যবস্থা পর্যায়ে আমরা এ বিষয়ে আলোচনা করব। ৭.লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের দিক দিয়ে যাকাতের আধ্যত্মিক ও নৈতিক লক্ষ্য সূস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট। কর ব্যবস্থা সে পর্যন্ত পৌছার কথা চিন্তা ও করতে পারে না। আমাদের যাকাত শব্দ সংক্রান্ত আলোচনায় এসব উচ্চ মহান লক্ষ্যের দিকে উঙ্গিত করেছি। তার তৎপর্য ও ভাবধারার কথা্ও বলেছি। যাকাতের লক্ষ্য তার প্রভাব পর্যায়ে ও আমরা বিস্তারিত কথা বলে এসেছি। আখানে আল্লাহ তাআলা তাঁর কিতাবে যাকাত দিতে বাধ্য ধন-মলে মালিকের সম্পর্কে যা কিছু বলেছেন যা কিছু বলেছেন যাকাতের লক্ষ্য নির্ধারণে তার উল্লেখৈই যথেষ্ট। আল্লাহ বলেছেঃ তাদের ধনমাল থেকে যাকাতের নি ও তাদের পবিত্র ও পরিশুদ্ধ কর তার দ্বারা এবংতাদের জন্যে পূর্ণ রহমতের দোআ কর। কেননা তোমার এ দোআ তাদের জন্যে সান্ত্বনার কারণ। এ কারণেই নব করীম (স) যাকাত দাতার জন্যে সব সময় দোআ করতেন তার মন ও ধনমালে বরকত আসার জন্যে। যাকাত বিভাগের প্রত্যেক কর্মচারীর জন্যে এ পসন্দনীয় নব করীম (স) এর অনুসরণ করতে গিয়ে অনুরূপ দোআ করবে।এমন কি কোন কোন ফিজহবিদ তটা বলেছেন যে, এ দে্া আ করা ওয়াজিব। কেননা উক্ত আয়াতে সেজন্যে স্পষ্ট নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আর এরূপ নির্দেশ তো ওয়াজিব্ প্রমাণ করে। কিন্তু ক র ব্যবস্থা এরূপ লক্ষের দিকে তাকাতে ও পারে না।অর্থনীতিবিদরা তো দীর্ঘকাল রাষ্ট্রের কোষাগারের জন্যে অর্থ সংগ্রহ করা ছাড়া কর এর আর ও কোন লক্ষ্য থাকতে পারে বরে বিশ্বাসই করতে পারে নি। তারা এটার নাম দিয়েছেন কর সংক্রান্ত প্রবনতার মত। পরে চিন্তার বিবর্তন ঘটেছে সামাজিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবেশ পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। লক্ষ্যহীনতার মতের পরাজয় ঘটেছে এবং কর কে একটা সুনির্দিষ্ট অর্থনৈতিক ও সামাজিক লক্ষ্য অর্জনের উপায় মনে করার এবং সেই কাজে তা বিনিয়োগ করার আহবান প্রবল হয়ে ওঠেছে। যেমন ব্যয়ের জন্যে উৎসাহ দান কিংবা পূর্ণত্ব ব্যয় কম বা সঞ্চয়ের জন্য উৎসাহ দান করার উপদেশ দান অথবা সমাজের লোকদের মধ্যকার পার্থক্য দূর করণ ইত্যাদি। এটা কর এর অর্থনৈতিক লক্ষ্যের কাছাকাছি কথা। আর এটা ই প্রথম লক্ষ্য। কিন্তু কর ধর্যকারীরা সাধারণ অর্থনীতিবিদরা এবং চিন্তাবিদগণ তাকে বস্তু বাদী লক্ষ্যের বাইরে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়নি। তার চাইতে প্রশস্ততর ও সুদূর লক্ষ্যাভিসারী পরিমন্ডল নিয়ে আসা সম্ভব হয়নি অর্থাৎ যে আধ্যাত্মিক ও নৈতিক লক্ষ্যকে সামনে রেখে যাকাত ফরয করা হয়েছে, সে লক্ষ্যে কর ব্যবস্থার পুনর্গঠন এখনো সুদূরপরাহত ব্যাপার। ৮. এ দুটির ধার্যকরণে চিন্তাগত ভিত্তির দিক দিয়ে যাকাত ও করা এর মধ্যে অধিক স্পষ্ট ও প্রকট পার্থক্যের দিক হচ্ছে তার ভিত্তির দিক, যার ওপর নির্ভর করে এ দুটির প্রত্যেকটি ধার্য করা হয়। কর ধার্যকরণের আইনগত বা চিন্তাগত ভিত্তি নির্ধারণে যে মতভেদের সৃষ্টি হয়েছে তা চিন্ত ও মতবাদের পার্থরক্যের কারণে। পরে আমরা তার উল্লেখ করব। কিন্তু যাকাতের ভিত্তি তো সুস্পষ্ট। তার ফরযরূপে ধার্যকারী ও পরিমাণ নির্ধারণকারী হচ্ছেন স্বয়ং আল্লাহ তাআলা। চারটি মতবাদের মাধ্যমে আমরা তা স্পষ্ট করে তুলব। কিন্ত এর মধ্যে কোন বৈপরীত্য নেই। বরং তার কোনটি অপর কোনটিকে শক্তিশালী করে তোলে। আমি অবশ্য এ বিষয়ে আলোচনা জন্যে একটা স্বতস্ত্র পরিচ্ছেদ গ্রহণের পক্ষপাতী, তাহলেই সম্যক আলোচনা কর সম্ভব হবে বলে মনে করি। যাকাত, ইবাদত এ কর এক সাথে এখানে আমরা বলতে পরি যে, যাকাত যেমন ইবাদত তেমনি একটি কর্ও বটে।তা কর এ হিসেবে যে, তা একটা সুপরিজ্ঞাত অর্থনৈতিক অধিকার বিশেষ। রাষ্ট্রেই তা আদায় করার অধিকারী। ইচ্ছা করে না দিলে রাষ্ট্র জোর করে তা নেবে ও তা ব্যয় করবে এমন সব লক্ষ্যে যার কল্যাণ গোট সমাজই পাবে। তার পূর্বে তা হচ্ছে একট ইবাদত ইসলমের বিশেষত্বসম্পন্ন ব্যবস্থা। মুসলমান তা দিয়ে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করে এবং আদায় করলে তার মনে এ চেতনা জেগে ওঠে যে, সে ইসলামের রুকন পালন করছে। তা ঈমানের একটা অন্যতম শাখা বিশেষ। সে যাকে তা প্রদান করে, তাকে প্রদান করে আল্লাহর ইবাদতের কাজে তাকে সাহায্য করার লক্ষ্যে। এজন্যে তা প্রদান করা আল্লাহনগত্য এ কল্যাণকর কাজ সম্পাদন তা না দেয়া সুস্পষ্পটনরূপে আল্লাহর বিধান লংঘন। আর তার ফরয হ্ওয়ার কথা অস্বীকার করা সুস্পষ্ট কুফরী। তা আল্লাহর হক। তার আদায়করী তা আদয়ে বিলম্ব করলে প্রশাসক তার প্রতি উপেক্ষা দেখাল্ওে তা দেয়ার কর্তব্য থেকে নিষ্কৃতি পা্ওয়া যাবে না ক্রমাগত কয়ক বছর না দিল্ওে তা ফরয এবং অবশ্য দেয়ই থেকে যাবে।তা কর এর মত নয়।কর তো সরকার চাইলে দেযা কর্ব্য হয় আর না চাইলে তা নাকচ হয়ে যায়। এখানে যে কথাটি উল্লেখ করা জরুরী মনে হয়, তা হচ্ছে, আমাদের আলিমগণ (রা) নিজেরা অবহিত ছিলেন লোকদের ও অবহিত করেছেন যে, যাকাত এ দুটি অর্থেরেই সমন্বয় কর হ্ওয়া ও ইবাদত হ্ওয়া ও ইবাদত হ্ওয়া। যদি ও তাঁরা স্পষ্ট ভাষায় যাকাতকে কর বলেন নি কখন্ও। কেননা এটা শেষেরদিকে পা্ওয়া পরিভাষা।তবে তারা এটাকে হক্ক বলেছেন এ অর্থে যে, তাধনীদের ধন মালে গরীব মিসকীনদের প্রাপ্য ও অবশ্য দেয় অধিকার। [দেখুনঃ (আরবী***********)] তারা অবশ্য যাকতকে সিলায়ে রেহমী র অর্থাৎ মানবতা ও ইসলামিকতসম্পন্ন ব্যবস্থা বলেছেন আর এ দিক দিয়ে তা ইবাদতের ভাবধারাসম্পন্ন। আমরা এই যে তাৎর্পেযর কথা বললাম (আরবী***********) গ্রস্থ প্রণেতো যা বলেছেন তা থেকে উক্ত কথার যৌক্তিকতা অধিক স্পষ্ট করে বোঝায়। তাতে যাকাতের তত্ত্ব এ যৌক্তিকতা পর্যায়ে বিশেষ আলিমগণের এ উক্তি উদ্ধৃত করা হয়েছে। তারা বলেছেনঃ আল্লাহ তা আলা ধনীদের ধন মালে যাকাত ফরয় করেছেন তাদের গরীব ভইদের প্রতি সহানিুভূতি প্রদর্শনস্বরূপ, ভাইদের প্রাপ্য অধিকার আদায় এবং প্রীতি ও ভালৈাবাসা বৃদ্ধির উদ্দেশ্য ওযাজিব কাজ করা হিসেবে। আল্লাহ তাআলা যে সাহায্য দান ও ব্যক্তিদের পারস্পারিক সহানুভূতির নিধেশ দিয়েছেন, তদনুযায়ী আমল করাই এর লক্ষ্য। তা ছাড়া এতে ধন মালের মালিকদের পরীক্ষা করা ও উদ্দেশ্য। কেননা ধন মালা হচ্ছে মালিকদের কলিজার টুকরা। দৈহিক ইবাদতের হুকুম দিয়ে যেমন দৈহিক পরীক্ষার্ও একটা ব্যবস্থা। তাতে ও ইবাদতের দিকটি লক্ষ্যণীয়। আর ইবাদতের দিকটির কারণেই তাতে নিয়তের শর্ত আরোপিত হয়েছে। তাতে কোনরূপ নাফরমানী ইত্যাদির সংযোগ হ্ওয়া নিষিদ্ধ। তা সম্পর্ক রক্ষার একটা মাধ্যম বলে তাতে প্রতিনিধি নিয়োগের সুযোগ রয়েছে। সেজন্যে বল প্রয়োগ করা ও সহহী। রাষ্ট্রপ্রধান যখন তা মালেন মালিকের কাছ থেকে জোর করে গ্রহণ করে তখন সেই মালিকের নিয়তের প্রতিনিধিত্ব করবে। মরে যা্ওয়া ব্যক্তি অসিয়ত করে না গেলে ও তার মাল থেকে তা গহণ করবে তাতে সম্পর্ক রক্ষার দিকটি প্রকট হ্ওযার দরুন তাতে ফকীর মিসকনের অধিকতর কল্যাণের দিক লক্ষ্য রাখা আবশ্যক। না বালেগের মাল থেক্ওে তা নেয়া হবে। আর যেহেতূ সত্যানুভূতি জানানোই বড় লক্ষ্য বলে আল্লাহ তা আলা তা কেবল বিপল সম্পদের ওপরই ফরয করেছেন। তাঁর নির্ধরিত নিসাবেই হচ্ছে সেই পরিমাণের সম্পদ। বর্ধনশীল মাল ছাড়া অন্য জিনিসের ওপর তা ধার্য করা হয়নি। আর তা হচ্ছে নগদ টাকা, ব্যবসায় পণ্য, গবদি পশু, জমির ফসল। শরীয়াতে প্রত্যেকটি ধরনের মালে নিসাব আলাদা আলাদাভাবে নির্ধারিত হয়েছে, যা দ্বারা সহানুভূতি জ্ঞাপন সম্ভব হয়। শ্রম ওকষ্ট স্বীকারের দিকে লক্ষ্য রেখেই ওয়াজিব পরিমাণ নির্ধরণ করা হয়েছে। তাই অ সেছ ব্যবস্থার অধীন জমির ফসলের এক দশমাংশ আর সেছ ব্যবস্থাধীন জমির ফসলে তার অর্ধেক ধার্য হয়েছে। [(আরবী***********)] এ এক অতবি উত্তম বিশ্লেষণ। পূর্ববর্তী অধ্যায়সমূহে আমরা তা বিস্থারিত বলেছি। দ্বিতয়ি পরিচ্ছেদ কর ধর্যকরণ ও যাকাত ফরযকরণের দার্শনিক ভিত্তি সম্ভবত যাকাতের নিগুঢ় তত্ত্ব স্পষ্ট করে তোলার জন্যে এ কালের অর্থনীতি বিদগণ কর ব্যবস্থ রূপায়ণ ও প্রবর্তন পর্যায়ে যা কিছু বলেছেন, তার উল্লেখ এখানে করা যথেষ্ট হবে। আইনত যে ভিত্তির ওপর নির্ভর করে তার উল্লেখ ও প্রয়োজন। এ তুলনামূরক আলোচনার ফলে যাকাতের প্রকৃতি এবং তার আল্লাহ প্রদত্ত ফরয হ্ওয়ার পবিত্র কর হ্ওয়ার গুণ ও বৈশিষ্ট্য প্রতিভাত হয়ে উঠবে। যাতাতের যে একটা বিশিষ্ট প্রকৃতি রয়েছে, একটা বিশেষ দর্শন তা্ও স্পষ্ট হবে। কর ধার্য করণের আইনগত ভিত্তি আলোচনাকারী ও চিন্তাবিদগণ আইনহত প্রকৃতি সম্পর্কে বিভিন্ন কথা বলেছেন। অন্য কথায়, লোকদের ওপর কর ধার্যকরণের আইনগত ভিত্তি সম্পর্কে তাঁদের মধ্যে মতপার্থক্যের সৃষ্টি হয়েছে। সমাজিক চুক্তি সংক্রান্ত মতবাদ অষ্টাদশ শতাব্দীর দার্শনিকগণ এ মত প্রকাশ করেছেনযে কর ধার্যকরণের ব্যাপারটি সম্পূর্ণ রূপে রাষ্ট্র ও ব্যক্তির মধ্যকার চুক্তির ওপর ভিত্তিশীল। এমতের সমর্থকরা মনে করেন, রাষ্ট্র জনকল্যাণমূলক যেসব কাজ করে দেশবাসী ও রাষ্ট্রের মধ্যকার অকাট্য চু্ক্তির দরুন এবং যার ফয়দা ধনশালী লোকেরা পেয়ে থাকে, তারই বিনিময়স্বরূপ এ কর দেয়া হয়। এ মতটি জন লক রুশোর রাষ্ট্রের ভিত্তি হিসেবে উপস্থাপিত সামাজিক চুক্তির এর সাথে সংগতিসম্পন্ন। রাষ্ট্র ও করদাতাদের মধ্যে অকাট্য চুক্তি রূপায়ণে সামাজিক চুক্তি মতের সমর্থকরা বহু মত প্রশাশ করেছেন। মিরাবু কলেছেনঃ কর হচ্ছে নগদ মূল্যাদান। ব্যক্তি এর মাধ্যমে সমাজ সমষ্টির সমর্থন ও প্রতিরোধ ক্রয় করে। তার অর্থ, ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের মধ্যাকার অকাট্য চুক্তিটি আসলে ক্রয় বিক্রয়ের চুক্তি। অ্যাডাম স্মিথ বলেছেন, এ চু্ক্তিটা আসলে কাজ ভাড়ায় লাগনোর চুক্তি। রাষ্ট্র দেশবাসীর কল্যাণমূলক কাজকর্ম আঞ্জাম দেয় আর দেশ বাসী এসব কাজের মজুরী হিসেবে কর দিয়ে থাকে। মন্টস্কো ও হবস বলেছেনঃ এটা আসলে একটা বীমা চুক্তি বিশেষ। কর হচ্ছে এ বীমার কিস্তি, টাকার মালিক তার ধন মালোর অবশিষ্ট অংশের সংরক্ষণ মজুরী হিসেবে কর দিয়ে থাকে। অবশ্য সমালোচকগণ স্পষ্ট করে বলেছেন, কর সম্পর্কে এ ধারণা মূলতই ভূল। কেননা রাষ্ট্র যেসব জনহিতকর কাজের আঞ্জাম দিয়ে থাকে এবং যার ফায়দটা করদাতা পায় এ দুটোর মধ্যে ভরসাম্যপূর্ণ বিনিময় হ্ওয়াটা সম্পর্ণ অসম্ভব্। যেহেতু দেশেরজনগণের জন্যে যে সাধারণ কল্যাণমূলক কাজ রাষ্ট্র আঞ্জাম দেয়, তাতে ভিন্নভাবে এক একজন নাগরিক কতটা কল্যাণ পেল, তার মূল্য নির্ণয় করা আদৌ সম্ভব নয়। যেমন নিরাপত্তা সংরক্ষণ,বিচার বিভাগ পরিচালন,শিক্ষা বিস্তারের ব্যবস্থা সর্বোপরি দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষা। এসব কল্যাণমুলক নির্ধারণ তো আদৌ সম্ভব নয়। যদি তা সম্ভব হত তাহলে ও এ মতবাদটি অত্যাচারময় ফলাফলের পরিণতি পর্যন্ত পৌঁছে দিত।কেননা গরীব শ্রেনীর লোকেরাই রাষ্ট্রের কণ্যাণময় আনুকূল্য পা্ওয়ায় ধনীদের তুলনায় অধিক মুখাপেক্ষী। বিনিময় বা মজুরী প্রদান এমতাদর্শের সাথে সঙ্গতি রেখে রক্ষার জন্য কর এর বিরাট বোঝা বহন করা তাদের জন্যে ও কর্তব্য হয়ে পড়ে। ওযমন বমিা মতাবাদটি দুটো দিক দিয়ে ক্রটিপূর্ণ। একটি এ মতটি রাষ্ট্রের কাজকে নিছক শান্তিরক্ষা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ করে দেয়। কিন্তু তা বস্তবতা পরিপন্হী। আর দ্বিতীয় দিক হচ্ছে বীমা চু্ক্তি বীমাকারীর স্কন্ধে সমস্ত খেসরতের বিনিয়ে বোঝা হবনের দযিত চাপিয়ে দেয়।অথচ রাষ্ট্রের যা কিছু ক্ষতি লোকসান হয় তার বিনিময় দেয়ার জন্যে ব্যক্তিগণকে বাধ্য করা হয় না। রাষ্ট্রের প্রাধান্যের মতবাদ উপরিউক্ত কথা থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, সামাজিক চুক্তি মতবাদটি কর ধার্যকরণের ভিত্তি হতে পারে না। ও কারণেই দ্বিতীয় মতাদর্শটি আত্মপ্রকাশ করেছে তা হচ্ছে রাষ্ট্রের প্রাধান। এ মতবাদটির ভিত্তি হচ্ছে রাষ্ট্র তার দয়িত্ব পালন করে সমাজিক সামষ্টিক প্রয়োজন পূরণার্থে। তাতে বিশেষ ব্যক্তিদের কল্যাণ সাধনইতার লক্ষ্যভূত হয় না কেননা সাধারণ জনকল্যাণ বিশেষ ব্যক্তিদের ওপর অধিক প্রভাব শালী ও ব্যাপক এবং বর্তমানের জনগণ এ ভবিষ্যতের জনগণের মধ্যে জাতীয় দায়িত্ব গ্রহণ ব্যবস্তার ওপর বিজয়ী হচ্ছে সংরক্ষণ ব্যবস্থা। এ সব দায়ত্ব পালনের জন্যে বিপুল অর্থ ব্যয়ের প্রয়োজন হয়। তাই রাষ্ট্রের এ অধিকার আছে যে, তার ছায়াতলে বসবাসকারী সমস্ত সমুষকেই এ ব্যয়বার বহনের জন্যে বাধ্য করবে। কেননা তার রয়েছে শ্রেষ্ঠত্বও প্রাধান্যের অধিকার। রাষ্ট্র এ বোঝা জনহণের মধ্যে বন্টন করে দেবে প্রত্যেকেরই পক্ষে সহজ বহনের মাত্র অনুযায়ী। তা হলেই সামষ্টিক নিরাপত্ত ব্যবস্থা কার্যার হবে, আধুনিককালের রানৈতিক সমাজ এ দায়িত্বই পালন করে থাকে। [এ আলোচনা লেখার জন্য আমরা ডাঃ মুহাম্মাদ হলমী মুরাদ লিখিত বই (আরবী***********) এর ওপর বির্ভর করেছি (আরবী***********) কর্তৃক ১৯৫৫ সনে গ্রন্হখানি প্রকাশিত হয়েছে। সংশ্লিষ্ট আলোচনা শিরোনাম হচ্ছেঃ (আরবী***********)] যাকাত ফরয করার ভিত্তি যাকাত ফরয করা এবং সর্ভপ্রকারের অর্থনৈতিক অধিকার নির্ধারণ সম্পূর্ণ ভিন্নতর দৃষ্টিকোণ প্রসূত। এখানে তার বিশ্লেষণ দিচ্ছিঃ শরীয়াত পালনে বাধ্য করার সাধারণ দৃষ্টিকোণ প্রথম, শরীয়াত পালনে বাধ্য করার সাধারণ দৃষ্টিকোণ। এ দৃষ্টিকোণ বা মাতদশের ভিত্তি হচ্ছে নেয়ামতদাতা সৃষ্টিকর্তার অধিকার আছে তিনি তার বান্দাহগণকে নিজের ইচ্ছামত দৈহিক ও অর্থৈনৈতিক দায়িত্ব পালনে বাধ্য করবেন। তাতে তাঁর হাক আদায় হবে ও তাঁর প্রদত্ত নেয়ামতের শোকর ও আদায় করা যাবে। তাদের মধ্যে কে উত্তম মর্মঠ, তা আল্লাহ তাআলা পরীক্ষা করতে পারবেন। তাদের মনে ও মানসিকতায় এক ভাবধারা রয়েছে তার ও যাচাই চাছাই হয় যাবে। তাদের অন্তরে নিহিত গোপন কথা প্রকাশিত হয়ে পড়বে। কে সাসূল (স) এর অনূসরণ করছে, আর কে তা করছে না তা্ও দিবালোকের মত স্পষ্ট প্রতিভাত হয়ে যাবে। এতে করে আল্লাহ ভালোকে মন্দ থেকে, অনুগতকে পারী থেকে আলাদা করে নিতে পারবেন। তাদের আমলেন পূর্ণ ফল দিতে পারবেন তাতে তাদের একবিন্দু ঠকানো হবে না। বস্তুর মাসুষকে তো উদ্দেশ্যহীন লক্ষ্যহীন করে সৃষ্টি করেন নি, বেকার ছেড়ে দেয়া হয়নি তাদের এ পৃথিবীর উম্মক্ত প্রান্তরে। আল্লহই বলেছেন; (আরবী**********) তোমরা কি মনে করে নিয়েছ, আমরা তোমাদের নিরর্থক ও উদ্দেশ্যহীন ভাবে সৃষ্টি করেছি এবং শেষ পর্যন্ত তোমাদেরকে আমাদের নিকট ফিরে আসতে হবে না?[ (আরবী*********) ] (আরবী*********) মানুষ কি মনে করেছে, তাকে খুব সহজেই ছেড়ে দেয়া হবে?[ (আরবী***********) ] না, তা কখনই হতে পারে না। আল্লাহ তো তাদের প্রতি নবী সাসূলগণকে পাঠিয়েছেন, তাঁরা সুসংবাদ দিয়েছেন, আযাবের ভয় দেখিয়েছেন। ফলে তারা আল্লাহর আদেশ ও নিষেধ জানতে সক্ষম হয়েছে। তাঁর কি অধিকার বান্দাদের ওপর, বান্দাদের কর্তব্য কি তাঁর প্রতি এ সবই জানা সম্ভব হয়েছে। এক্ষণে যারা খারাপ আমল করবে, তাদরে তিনি শস্তি দেবেন এবং যারা নেক আমল করেছে তাদের তিনি উত্তম শুভ ফল দেবেন। [ (আরবী***********)] এটাই শুভনীতি। আল্লাহ তাআলা মুসলমান মাত্রকেই নামায কড়ার নির্দেশ দিয়েছেন, এটা হচ্ছে দৈনিক পালনীয় ফরয। দিন রাতের মধ্যে পাঁচবার তা পড়তে হয তার জন্য নির্দিষ্ট সময়ে। তা যেমন অলসতা ভাংগে, তেমনি খাহেশে নফসের উত্তেজনা ও দমন করে। উপেক্ষা ও অসতর্কতার অন্ধকার দূর করে। দুনিয়ার ঝামেলা থেকে মানুষকে মুক্ত করে। আল্লাহ তাআলা নিজেই বলেছেনঃ (আরবী***********) নামায অবশ্য খুব বড় কঠিন কাজ তবে আল্লাহর ভয়ে ভীত লোকদের জন্যে ত নয়। [(আরবী***********)] আল্লাহ তাআলা রোযা পালন ফরয করেছন্। এটা বার্ষিক প্রতিবর্ষে আবর্তিত হ্ওয়া ফরয। একটি পূর্ণ মাস মানুষদিনের বেলা জঠর ও যৌন কামনা লোভ চরিতার্থ করা থেকে বিরত থাকে। হাদীসে কুদসীতে বলা হয়েছেঃ বান্দা আমারই জন্যে খাবার ত্যাগ করে আমরই জন্যে পানীয় করিহার করে এবং আমারই জন্যে যৌন স্বাদ আস্বাদন ত্যাগ করে। [ইবনে খুজায়ামা হাদীসটি তাঁর সহীহ গ্রন্থে উদ্ধৃত করেছন। আসলে খুবারী মুসলিম উদ্ধৃত।দেখুনঃ (আরবী***********)] হজ্জ পালনও ফরয করেছেন। তা সারা জীবনের জন্যে একবার ফরয। মুসলমান হ্জ্জ করার জন্যে নিজের পরিবার পরিজন ও ঘরবাড়ি ও স্বদেশ ত্যাগ করে গাছপালা শস্যক্ষেত শুন্য মরু প্রন্তরের দিকে যাত্র করে আল্লাহর নিদর্শনসমূহের তাজীম করা, আল্লাহর ঘরের ত্ওয়াফ করাই রক্ষ্য। ফলে সে সদ্য জাত শিশুর মতই নিষ্পাপ হয়ে যায়। হ্যাঁ, আল্লাহ তাআলা মুসলমানকে নামায ও রোযা পালনের নির্দেশ দিয়েছেন। এ দুটির প্রত্যেকটিই দৈহিক ইবাদত। ফরয করেছেন হ্জ্জ পালন, তা যেমন শারীরিক ইবাদত, তেমনি অর্থনৈতিক্ও। হুকুমদিয়েছেন যাকাত দেয়ার জন্যে। তা খালেসভাবে অরথনৈতিক ইবাদত। তাতে নিজের কলিজার টুকরা ধন মাল ব্যয় করতে হয়। তা জীবনের সার নির্যাস তাই আবার দুনয়ার ফিতনা। এসবের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা জনতে চান তাঁর প্রকৃত বান্দকে,কে তার নিজের সবকিছু আল্লাহর জন্যে ত্যাগ করতে প্রস্তুত আরকে ধন মালের বন্দেগী করে দুনয়ার বন্দেগীতে লিপ্ত। আল্লাহর সন্তষ্ট লাভের ঊর্ধ্বে দুনিয়াকে গুরূত্ব ও অগ্রাধিকার দেয়। তাই আল্লাহ বলেছেনঃ (আরবী***********) যে লোক তার নফসের লোভ লারসাকে দমন করেতে পারল,প্রকৃত পক্ষে তারাই সফলকাম। [(আরবী*******)] খলিফা বানানোর মত দ্বিতয়ি মতাদর্শ হচ্ছে, আল্লাহর ধন মালে খলীফানিয়োগ। এ মতাদর্শের ভিত্তি হচ্ছে, পৃথিবীর যাবতীয় ধন মালের নিরংকুশ ও মৌলিক মালিক হচ্ছেন মহান বিশ্যস্রষ্টা আল্লাহ তাআলা। মানুষ তাতে তাঁরই নিয়োজিত খলীফা বিশ্বলোকের সব কিছুই এর জমি, এর আখাশমণ্ডল সবই আল্লাহর মালিকানা। তিনিই ঘোষণা করেছেনঃ (আরবী*********) যা কিছু আকাশ মণ্ডলে রয়েছে এবং যা কিছু পৃথিবীতে আছে তার সবই আল্লাহরই জন্যে। [(আরবী******)] (আরবী********) যা কিছু আকাশ মণ্ডলে, যা কিছু পৃথবীতে এবং যা মাটির তলায় তা সবই আল্লাহরই জন্যে। [(আরবী******)] এক কথায় যা কিছু আছে, ঊর্ধ্বলোকে কি নিম্নের দিকে, তা সবই খালেসভাবে আল্লাহর মালিকানা।তার কোন একবিন্দতে ও তাঁর শরীক কেউ নেই। বলেছেনঃ (আরবী***********) বল, তোমরা ডাক সে সব লোকদের, যাদেরকে আল্লাহ ছাড়া প্রভু মালিক মনে কর, তারা আসমান জমিনের এক বিন্দু জিনিসের ও মালিক নয়, তাতে তাদের কোন অংশীদারীত্ব ও নেই এবং তাদের থেকে তার কোন পৃষ্পপোষাক্ও নেই। [(আরবী***********)] এ মালিকত্ব এই ভিত্তিতে যে, তিনিই এ সবের সৃষ্টিকর্তা, তিনিই এসব কিছুর সংরক্ষক্ওঃ (আরবী********) আল্লাহই সব কিছুর সৃষ্টিকর্তা,তিনিই সব জিনিসের সংরক্ষক, প্রষ্ঠপোষক। [(আরবী***********) ] তিনি প্রত্যকটি জিনিসই সৃষ্টি করেছেন এবঙ তার পরিমাণ নির্দিষ্ট করেছেন। [(আরবী*********) ](আরবী*********) তোমরা আল্লাহ ছাড়া আরা যাদের ডাক, তারা কস্মিন কালে ও একটি মাছি ও সৃষ্টি করতে পারবে না তার সকলে একত্রিত হলে ও। [(আরবী***********)] সমস্ত ধন মালের মালিক এক আল্লাহ, তিনিই তা তাঁর বান্দাদের দান করেছেন নিয়ামত হিসেবে। তিনিই সে সবের একক ও অনন্য স্রষ্টা ও উদ্ভাবকম উৎপত্তিকারক। মানুষের কাজ হচ্ছে উৎপাদন। এ উৎপাদন তো আল্লাহর সৃষ্টি বস্তুকে কেন্দ্র করে যে বস্তুকে আল্লাহ তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন বানিয়ে দিয়েছেন। এ কারণে অর্থনীতিবিদগণ বলেছেনঃ উৎপাদন হচ্ছে বস্তুর ব্যবহারিক মূল্য সৃষ্টি, বস্তু সৃষ্টি নয়। তার অর্থ, মানুষের শ্রম বস্তুতে রূপান্তরিত করে প্রয়োজনে ব্যবহারের লক্ষ্যে, তার পরই তা ব্যবহার করা বা তা থেকে উপকৃত হ্ওয়া সম্ভাবপর। [দেখনঃডঃ রফয়াত আল মাহজুব লিখিত (আরবী***********)১ম খণ্ড ১৯১-১৯২ পৃ.] মানুষ যা কিছুই উৎপাদন করে, তাতে মূল বস্তুর প্রকৃতি ও প্রাকিৃতিক গুণকে পরিবর্তিত করতে পারে না। বড়জোর তা তার আসল স্থান থেকে বের করে নিয়ে আসে উদ্ভাবন বা শিকারের মাধ্যমে অথবা যেখানে একটির বস্তু প্রয়োজনতিরিক্ত বিধায় তা এমন স্থানে নিয় যা্ওয়া হল যেখানে তার প্রয়োজন রয়েছে অথবা তা রংরক্ষণ করে, গুদামজাত রাখে ভবিষ্যতে উপকৃত হ্ওয়ার লক্ষ্যে অথবা তা কোন কোন অগ্রাধিকার প্রাপ্ত ব্যাপারের জন্যে সেই বিশেষ প্রয়োজন মেটানোর উদ্দেশ্যে তা রেখে দেয়া অথবা তা একটি আকৃতি ও বাহ্যিক রূপ থেকে পরিবর্তিত ক ভিন্নতর রূপদান করে তূলোধুনো করে বা বয়নে লাগিয়ে, অংকন বা পেষণ করে গুড়া বানানোর মাধ্যমে। অথবা দ্রব্য সামগ্রীকে একত্র করে একটা নতুন জিনিস তৈরী করা হল। এটা উপাদনসমুহে নিছক পরবর্তন সাধনমত্র স্থানান্তর রূপান্তরকরণ। এমন কি এমন এক নতুন সম্পদ সৃষ্টি যা পূর্বে ছিল না। যেমন কৃষি ফসল, পশু পালন। এক কথার মানুষ বাহ্যিকভাবে অপর জিনিস উৎপাদান করার ক্ষেত্রেই কাজ করে, শ্রম লাগায়। [দেখুনঃ ডঃআলী আবদুল ওয়াহিদ ওয়াফীকৃত (আরবী***********) গ্রন্থে ৭৪-৭৬পৃ. পঞ্চম সংস্করণ।] উৎপাদনে মানুষের ভূমিকা কতটা অর্থদরশনের দিকপাল তার বর্ণনা এভাবেই দিয়েছেন। তা হেচ্ছে নিছক মুক্তকরণ, অবস্থাস্তর, রূপান্তর ও স্থানান্তর মাত্র। কিন্তু সে জিনিসের উদ্ভাবক কে? তিনি হচ্ছেনঃ (আরবী***********) আমাদের সেই রব্ব যিনি প্রত্যেকটি জিনিসিই সৃষ্টি করেছেন এবং পরে তার ব্যবহার ওপ্রয়োগ বিধি দিয়েছেন। [(আরবী***********)] (আরবী***********) আল্লাহ তো তিনি যিনি আকামণ্ডল ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং ঊর্ধ্বলোক থেকে পানি বর্ষিয়েছেন, তার দ্বারা বিভিন্ন ফল ফসর উৎপাদন করান তোমাদের রিষিকস্বরূপ। তিনি তোমাদের জন্যে নিয়ন্ত্রত করেছেন নৌকা জাহাজ, যেন তা নদী সমুদ্রে তাঁর নির্দেশ অনূযায়ী চলতে পারে। তিনি তোমাদের জন্যে খাল নদী ও নিয়ন্ত্রিত করেছেন, তিনি তোমাদের জন্যে সূর্য এরং চন্দ্রকে ও নিয়ন্ত্রি করেছেন আবর্তনশীল আবস্থায় রাত এরং দিনকে ও তোমাদের জন্যে নিয়কিন্ত্রত করেছেন এবং তোমাদের সেসব জিনিসই তিনি দিয়েছেন যা তোমরা চেয়েছিলে, যার প্রয়োজন তোমরা বুঝেছিল। তোমরা যদি আল্লাহর দেয়া নেয়ামতসমূহ গণনা করতে চা্ও, তাহলে তা কখনই পারবে না। এমন কি এ পরিবর্তন ও মুক্ত করন কর্মের সহজ পন্হাগ্রহণ ও তা করার শক্তি বৃদ্ধি ও ক্ষমতা দান এবং এ পথে প্রয়োজনীয় সাহায্য সহযোগিতা পা্ওয়ার ব্যবস্থা ও সেই আল্লাহই করে দয়েছেন,যিনি আমদের রব্ব, যিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন অথচ মানুষ এরং পূর্বে উল্লেখযোগ্য কিছুই না্ মানুষ যা জানতো না, তা্ও তাকে তিনিই জানিয়ে দিয়েছেন্। এ কাথাটি স্পষ্ট করার উদ্দেশ্যে এখানে দৃষ্টান্তের অবতরণা করা হচ্ছেঃ মানুষ যখন চাষাবাদ করে বীজ বপন করে, সে বীজে গাছ হয় ও দানার ছড়া বের হয়ে আসে অথবা বৃক্ষরোপণ করে, তাতে ফল ধরে। এক্ষণে প্রশ্ন এ ফসল ফালানোয় ও ফল দারানোয় পানি নষ্কাশন ইত্যাদিতে মানুষের শ্রম কতট লেগেছে আল্লাহর কাজের মুকাবিলায় তুলানামূলকভাবে যেখানে আল্লাহ জমিনকে বিনয়ী চাষযোগ্য বানিয়ে দিয়েছেন, বাতাসের প্রবাহ চালিয়েছেন, মেঘ নিয়ন্ত্রণ করে ঊর্ধ্বলোক থেকে বৃষ্টি বর্ষিয়েছেন অথবা জমিনে খাল ঝর্ণা প্রবাহিত করেছন, প্রয়োজন পরিমাণ রৌদ্র ও তাপ দান করিয়েয়েন, চন্দ্রের জ্যোতি প্রতিফলিত করেছেন, বাতস প্রবাহিত করেছেন, দানাকে মাঠির অভ্যন্তর থেকে খাদ্য গ্রহণে সক্ষম বানিয়েছেন বহু প্রকারের উপাদান থেকে। শেষ পর্যর্ত এক একটা গাছ গড়ে ওঠেছে শাখা প্রশাখা পত্র পল্লব ফুল ও ফল সমন্বিত। স্পষ্ট দেখা যায়, মহান আল্লাহর অবদানের তুলনায় মানুষের কাজ ও শ্রমের যোগ তো খুব সমান্যই। তাছাড়া মানুষ যে কাজ করে, আল্লাহ যদি তাকে বিবেক বুদ্ধি চিন্তাশাক্তি ও ব্যবস্থাপনা যোগ্যতা না দিতেন, কার্যকর করার ক্ষমাতা না দিতেন কাজ করার তাতিয়ার না দিতেন তা হলে মানুষকি করে কাজ করত কি করে উৎপাদন করত? মানুষের ওপর আল্লাহর এ অশেষ দয়া ও অনুগ্রহের কথা কুরআন মজীদে বলা হয়েছে। তাদের সম্মুখে মহাসত্য উদঘাটিত করার প্রসঙ্গে বলেছেনঃ (আরবী***********) তোমরা যে চাষাবাদ কর, সে বিষয়টি কি কখনো ভেবে দেখছ? তোমরা চাষাবাদ কর, ফসল ফলা্ও, না আমরা প্রকৃত পক্ষে চাষাবাদ করে ফসল ফলানোর কাজ টি আঞ্জাম দিই? আমরা চাইলে সমস্ত ফসলকে ভুসি ও টুকরা টুকরা বানিয়ে দিতাম, তখন তোমরা নানারূপ কথা রটাতে থাকতে যে, আমরদের ওপরই চাবুকটাপড়ল। বরং বলবে আমাদের ভাগ্যটাই খারাপ হয়ে গেছে। তোমরা কি কখন্ও চোখ মেলে তাকিয়ে দেখছ, যে পানি পান কর, তা কি তোমরাই মেঘ থেকে বর্ষিয়েছ বিংবা তার বর্ষণকারী আমরা? আমরা ইচ্ছা করলে তা লবণাক্ত বানাতে পারতাম।কিন্তু বানাই নি)তা সত্ত্বে ও তোমরা শোকর কর না কেন?[ (আরবী***********)] অপর একটি আয়াতে বলা হয়েছেঃ (আরবী***********) মানুষের উচিত তার খাদ্যের প্রতি দৃষ্টি পাত করা। আমরাই পানি ঢেলেছি, পরে জমিকে আমরাই দীর্ণ করেছি, তার ফলে তাতে উৎপাদন করেছি দানা, আংগুর তরিতরকারি। [(আরবী***********)] তৃতীয় একটি আয়াতে বলা হয়েছেঃ (আরবী***********) তাদের জন্যে একটা নিদর্শন হচ্ছে মৃত জমি, আমরাই তা পুনরুজ্জীবিত করি এবং তা থেকে বের করি দানা,তার কোনটি তারা খায়। আর পৃথিবীতে খেজুর ও আংগুরের গন সন্নিবেশিত বাগান বানিয়েছি এবং তার বুকে খাল ঝর্ণা প্রবাহিত করেছি, যেন তারা তার ফল ও তাদের হাতের কাজের ফসল খেতে পারে, তারা কি শোকর করবে না। [(আরবী***********)] হ্যাঁ এটাই প্রশ্ন,তারা শোকর করবে কিনা ? তারা তো এমন সব ফল পকড়া্ও খায়, ফলানোর জন্যে তারা কোন শ্রম করেন্।তা ফলেছে সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর উৎপাদন ব্যবস্থার অধীনে। তিনিই মৃত জমিন পুনরুজ্জীবিত করেছেন, তা থেকে দান বের করেছেন, বাগান রছনা করেছন এবং ঝর্ণাধরা সমূহ প্রবাহিত করেছেন। কেবল কৃষিক্ষেত্রেই আল্লাহর কুদরতী কাজ করেনি করেছে সর্বব্যাপারে সর্বক্ষেত্রে, জীবনের সব দিকে ্ও বিভাগে। তা কৃষি হোক, কি ব্যবসায় অথবা শিল্প কিংবা অন্য কিছু। দৃষ্টান্তস্বরূপ শিল্পের কথা বলা যায়। আল্লাহর সৃষ্টি হিসেবে কাঁচা মাল আমরা পাই, তা মানুষের উৎপাদন নয়। যেমন আল্লাহ তাআলা লৌহ বা উস্পাত বস্তু হিসেবে সৃষ্টি করে দিয়েছেন। বলেছেনঃ (আরবী***********) এবং আমরা লৌহ নামিয়ে দিয়েছি,তাতে কঠিন শক্তি নিহিত এবং জনগণের জন্যে অশেষ কল্যাণ। [(আরবী*********)] আয়াতের (আরবী*********) শব্দের শাব্দিক বা আভিধানিক অর্থ নাযিল করেছি। তার ব্যবহারিক অর্থ আল্লাহর কোন নৈসার্গিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে লৌহ সৃষ্টি করেছেন, তাতে মানুষের কিছু করবার ছিল না ক্ষমতা্ও নেই। আল্লাহর কুদরতের সৃষ্টি করেছে, না পেট্রোল, না বিদ্যুৎ। মানুষ এগুলো আবিষ্কার করেছে মাত্র। কিন্তু বিশ্বলোক গর্ভে তা নিহিত করে রেখেছেন তো একমাত্র মহান আল্লাহই। শিল্পোদ্ভাবনের পন্হা মানুষ আল্লাহর কাছ থেকে ইলহাম হিসেবে জানতে পেরেছে।তিনিই মানুষকে এসব কিছু শিখিয়েছেনঃ অথচ মানুষ এ সবের কিছুই জানতো না।আল্লাহ নিজেই হযরত দাঊদ সম্পর্কে বলেছেনঃ (আরবী***********) এবং তাকে আমরা পোশাক নির্মাণ শিল্প শিক্ষা দিলাম তোমাদের জন্যেই, যেন তোমাদেরকে তা রক্ষা করতে পারে তোমাদের অসুবিধা থেকে। তোমরা কি শোকর গুজার হবে?[ (আরবী***********)] এ থেকে আমরা এ সিদ্ধান্তে পৌছতে পারি যে, সর্ব প্রকারের ধানমাল আল্লাহর সৃষ্ট, তিনি তা স্বীয় অনুগ্রহ ও দানস্বরূপ মানুষকে দিয়েছেন। তা আল্লাহর দেয়া রিযিক। তাই মানুষ যখনই স্বীয় কর্ম ও শ্রমের কথা স্মরণ করবে, তার পূর্বে স্মরণ করা উচিত এ সব জিনিসের সৃষ্টি ও উদ্ভাবনে আল্লাহর কুদরতের অবাদনকে। (আরবী***********) তোমাদের কাছে যে নিয়ামতইত রয়েছে, তা তো আল্লাহর কাছ থেকে পাওয়া। [(আরবী***********)] এরূপ অবস্থায় আল্লাহর বান্দারা আল্লাহর কাছ থেকে বিপুল ধন সম্পদ পেয়ে তার কিছুটা অংশ সে আল্লাহরই পথে, আল্লাহর কালেমা বুলন্দ ও প্রচারের কাজে এবং তারই অপর ভাই আল্লাহর বান্দদের জন্যে ব্যয় করবে, তা আর বিচিত্র কি? তাহলেই দাতার শোকর আদয় করা সম্ভবপর হবে।এ কারণেই আল্লাহ তাআলা তাঁ গ্রন্থে নির্দেশ দিয়েছেনঃ (আরবী***********) তোমরা সেসব ধন মাল থেকে আল্লাহর পথে ব্যয় কর, যা আমরা রিযিক হিসেবে তোমাদের দিয়েছি। [(আরবী*********)] (আরবী********) এবং আমরা তাদের যে রিযিক দিয়েছি, তা থেকে তারা আল্লাহর নিয়োজিত খলীফা ছাড়া আরা কিছুই নয় অথবা বলা যায়, এসব ধন মালের প্রবৃদ্ধি সাধন ও তা ব্যয় ব্যবহারের জন্যে নির্ভর যোগ্য দায়িত্বশীল মাত্র। আল্লাহ বলেছেনঃ (আরবী***********) দা্ও তাদের আল্লাহর সেই মাল থেকে, যা তিনি তোমাদেরকে দান করেছেন। (আরবী***********)] বলেছেনঃ (আরবী*********) আল্লাহর অনুগ্রহস্বরূপ ধন সম্পদে যারা কার্পণ্য করে, তারা যেন মনে না করে যে, তাদের জন্যে ভালো। না, বরং তা তাদের জন্যে খুব খারাপ হয়েছে, আল্লাহর স্বীয় অণূগ্রস্বরূপ দেয়া মালে কার্পণ্য করে যেন মানুষ এ সত্য সব সময়ই মনে রাখে যে, ধন মাল তার নয়, আল্লাহর এবং সে তা আল্লাহর অনুগ্রহের অবদান হিসেবেই পয়েছে। বলেছেনঃ (আরবী***********) এবং ব্যয় কর সে মাল থেকে যাতে আল্লাহ তোমাদেরকে খলীফা বানিয়েছেন। [(আরবী***********)] প্রমাণিত হল, মানুষ আসলে ধন মালের মালিক নয়, সে প্রকৃত মালিকের খলীফা মাত্র। প্রকৃত মালিক আল্লাহ। মানুষ তার রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবহারকারী মাত্র। মানুষ আল্লাহর উকীল। [ ইবনুল কাইয়্যেম প্রশ্ন তুলেছেন, কোন লোককে আল্লাহর উকীল বলা যায় কিনা? তিনি নিজে এ প্রশ্নের জবাব দিয়েছে না সূচক। কেননা উকীল মোয়াক্কেলের স্থলাভিষিক্তি হয়ে কর্তৃত্ব করে। কিন্তু আল্লাহর কোন কর্তৃত্বসম্পন্ন নায়েব নেই। তাঁর স্থলাভিষিক্ত কেউ হতে পারে না। তিনিই বরং বান্দার স্থালাভিষিক্ত। যেমন নব করীম (স) এর একটি দোআর ভাষা হচ্ছেঃ হে আল্লাহ তুমি সফরে সঙ্গী এবং বংশ পরিবারে খলীফা। পরে বলেছেন, তবে এ কথাটি যদি এ অর্থে নেয়া হয় যে, মানুষ নির্দেশিত আল্লাহর অর্পিত জিনিসগুলোর সঙরক্ষণে তার দেখাশুনা এ লালন পারনের পন্যে, তাহলে তা যথার্থ কাথা। (আরবী***********)] তাফসীরুল কাশশাফ লেখক আর তোমরা ব্যবয় কর সেই জিনিস থেকে যাতে তিনি তোমাদেরকে খলীফা বানিয়েছেন, আল্লাহর এ কথার তাফসীরে লিখিছেনঃ তোমাদের হাতে যে সব ধন মাল রয়েছে, তা সবই আল্লাহর সৃষ্টি, তাঁরই উদ্ভাবিত বলে তা সবই আল্লাহর। তিনিই তা তোমাদের দানকারী। তা ব্যবহার করার ও তা থেকে উপকৃত হ্ওয়ার জন্যে তিনিই তোমাদের সুযোগ দিয়েছেন অর্থাৎ তিনি সেসব ধন মালে হস্তক্ষেপ ও ব্যয় ব্যহার করার জন্যে খলীফা বানিয়েছেন তোমাদেরকে। অতএব তা প্রকৃত পক্ষে তোমরা তা থেকে আল্লাহর অধিকার আদায়ে ব্যয় কর, তা থেকে ব্যয় করার তোমাদের অধিকার রয়েছে। যেমন অপর কারোর ধনা মাল ব্যয় ব্যবহার করার সেইপেতে পারে, যাকে তা করার জন্যে অনুমতি দেয়া হবে। [ (আরবী***********)] ধন মাল আল্লাহর মানুষতাতে নয়েব বা উকীলমাত্র একথাটুকু জেনে নেয়াই যথেষ্ট নয়। তা ব্যয় ও দান করা সহজ হ্ওয়ার জন্যে অনুমতি পেলে অপরের ধন মালে হস্থক্ষেপ করা সাধারণত সহজই হয়ে থাকে। বরং সে সাথে এ নিগূঢ় তত্ত্ব ও জানতে হবে যে, মানুষ ধন মালের প্রকৃত মালিকের ইচ্ছাকে মেনে চলতে বাধ্য্ কেননা উকীল তো তাকেই বলা হয়, যে মোয়াক্কেলের ইচ্ছায় প্রতিভূ হয়ে থাকে। তিনি যা চান, তাকে কার্যকর করা ও তার দায়িত্ব। তার মন যা বা যে রকম চাইবে, সেরকম হস্তক্ষেপ করার কোন ব্যক্তিগত বা স্বতন্ত্র অধিকার কারোরই নেই। অন্যথায় তার উকিল হ্ওয়াটাই বাতিল হয়ে যাবে। সুযোগ পেয়ে খারাপ আচরণ গ্রহণের দরুন অতঃপর সে খলীফা হ্ওয়ার যোগ্যই বিবেচিত হবেনা। আমাদের মনীষী ও বিশেষজ্ঞগনণ ধন মালে আল্লাহর হক বা অধিকার কি, তা খুবই উন্নত ও বলিষ্ঠ ভাষায় বিবৃত করেছেন। ইমাম রাযী তাঁর তাফসীর যা লিখেছেন, তা এখানে উদ্ধৃত করছিঃ গরীব দরিদ্র লোকেরা আল্লাহর পরিবারভুক্ত। ধনী লোকেরা হচ্ছে আল্লাহর ধন ভাণ্ডারের ধারক বা রক্ষী কেননা তাদের কাছে যেসব ধন মাল রয়েছে, তা সবই আল্লাহর ধন মাল। এরূপ অবস্থায় ধন মালের মালিক যদি তার রয়েছে, তা সবই আল্লাহর ধন-মাল। এরূপ অব্স্থায় ধন-মালের মালিক যদি তার ধন রক্ষীকে বলে যে ভাণ্ডারের ধারক বা রক্ষী কেননা তাদের কাছে যেসব ধন মাল রয়েছে, তার একটা অংশ আমার পরিবারের অভাবগস্ত লোকদের জন্যে ব্যয় কর, তবে তা বিচিত্র কিছু নয়। [(আরবী***********)] কাযী ইবনুল আরাবী লিখেছেনঃ আল্লাহ তা আলা তাঁর উচ্চতর বুদ্ধিসত্তা এবং মহান কর্যকর আইন বিধানের ভিত্তিতে কিছু লোককে বিশেষভাবে ধন মাল দিয়েছেন, অপর খিছু লোককে দেন নি। এ দেয়াটা হচ্ছে তাদের প্রতি আল্লাহর নেয়ামত। আর এ নেয়ামতের শোকরের পন্হা বানিয়েছেন এই যে, তার মালের একটা অংশ তাকে দেবে যার ধন মাল নেই। এটা মহান আল্লাহর প্রতিনিধিত্বস্বরূপ সেক্ষেত্রে যেখানে তিনি তাদের প্রতি অনুগ্রহ দান করেছেন। (আরবী***********) পৃথিবীর বুকে যত প্রাণিই আছে, সকলেরই রিযিক দেয়া দায়িত্ব আল্লাহর। [(আরবী***********)] ধনী লোক আল্লাহর খাজাঞ্চী ধন মালের আমানতদার। সে এ মাল আল্লাহরক পরিবারের জন্যে ব্যয় জন্যে দায়ী। এক্ষণে সে যদি আল্লাহর এ ধন-মাল নিজেই ভক্ষণ করতে শুরু করে, অন্য কাউকে এ নেয়ামতের শরীক না করে, তাহলে সে আল্লাহর আযাব ও শাস্তি পা্ওয়ার যোগ্য হয়ে পড়বে। আল্লাহর কথাহিসেবে বর্ণিত একটি হাদীসে কুদসী জনগণের মধ্যে ব্যাপাক প্রচার লাভ করেছ। তা হচ্ছেঃ মাল আমার গরীবরা সব আমার পরিবার, ধনী লোকেরা আমার উকিল ভারপ্রাপ্তপ্রতিনিধি। আমার উকলরা যদি কার্পণ্য করে আমার পরিবারবর্গের প্রয়োজন পূরণে, তাহলে আমি তাদের আমার আযাবের স্বাদ আস্বাদন করার, তাতে আমি কারোই পরোয়া করব না। [অনেক অনুসন্ধান করে ও এ কথার সত্যতার প্রমাণ আমি পাইনি। এ কথাটি কার তা ও জানা যায়নি। গ্রন্হকার] উপরিউক্ত হাদীসটি সনদের দিক দিয়ে অপ্রমাণিত হলে ও এর তাৎপর্য মোটামুটি যথার্থ এবং সঠিক। হাদীস টি সমদের দিক দিয়ে অপ্রমণিত হলে ও এর তাৎপর্য মোটামুটি যথার্থ এবং সঠিক। হাদীসটি সর্বাসাধারণ মুসলমানের কাছে খুব বেশী পরিচিত বলে মনে করা যায়, আল্লাহর ধন মালে মানুষের খলীফা হ্ওয়ার ধারণাটি খুব বেশী মজবুত এবং সুদৃঢ়। চিন্তার ক্ষেত্রে তা খুব বেশি আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। তার গভীর শিকড় পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে আল্লাহর কুরআন ও রাসূলের সুন্নাতে। মজারা ব্যাপার হচ্ছে, মুসলিম দেশগুলোর বহু ভিক্ষাপ্রার্থী ও দার চা্ওয়ার লোক এ মতামতটির সাথে খুব বেশী পরিচিত এবং তারা সক্ষম সমর্থ লোকদের অনুগ্রহের দৃষ্টি আকর্ষণে, তাদের কাছ থেকে মোটা রকমের দান সাদকা হাসিল করার উদ্দশ্যে খুব বেশী ব্যবহার বা উচ্চরণ করে থাকে। তাদের অনেকেরই মুখেধ্বণিত হয়ঃ ধন মাল তো আল্লাহর। ……. কথাটা তো ঠিক, কিন্তু তা ব্যবহার করা হয মন্দ উদ্দেশ্য্ হোদসে বলা হয়েছেঃ কিয়ামতের দিন ফকরিদর মুকাবিলায় ধনী লোকদের জন্যে হবে অয়ল দোযখ। সেদিন গরীব লোকেরা ফরিয়াদ করবেঃ হে আমাদের রব্ব। ধনীরা আমাদের হক না দিয়ে আমাদের ওপর জুলুম করেছে, তুমিইেএ সব হক তাদের ওপর ফরয় করে দিয়েছিলে আমাদের দেয়ার জন্যে। তখন আল্লাহ তাআলা বলবেনঃ আমার মর্যাদা, আমার মহানত্বের শপথ! আজ আমি তোমাদেরকে আমার কাছে স্থান দেব এবং ্ওদেরকে দূবে সরিয়ে রাখব। [কাবারানী হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন (আরবী***********) গ্রন্থে আনাস থেকে। হাদীসটির সনদ যয়ীফ। (আরবী***********)] ব্যক্তি ও সমষ্টির মধ্যকার দায়্ত্বি গ্রহণের মতবাদ তৃতীয় মতাদর্শ হচ্ছে ও সমষ্টির মধ্যে দায়ত্ব গ্রহণ ব্যবস্থা সংক্রান্ত মতবাদ। সমাজ দার্শনিকদের কাছে এটা সর্ববাদীসমর্থিত যে, মানুষ স্বভাবতই সামাজিক। প্রাচীন দর্শনিকরা বলেছেন, মানুস সামাজিক জীব। আর আধকিরা বলেছেন, মানুষ সমাজের মধ্যে বসবাস ছাড়া যথার্থ মানব জীবন যাপন করতে সক্ষম হতে পারে না। একথা ও ছূড়ান্তভাবে সমর্থিত যে, ব্যক্তি সমষ্টির কাছে ঋণী তার বহু প্রকারের জ্ঞান, তত্ত্ব ও মর্যাদা বিশেষত্ব লাভের জন্যে। কেননা ব্যক্তি জীবনের সূচনা থেকেই সমাজ সমষ্টির প্রত্যক্ষ সাহয্য সহয়োগিতা ছাড়া বাঁচতে ও জীবন জাপন করতে পারে না। সমাজই হয় ব্যক্তির বীবন ও স্থিতির ধারক অতন্দ্র প্রহরী। তা না হলে মানুষতার দোলনাতেই মরে পড়ে থাকত। সমাজ সমষ্টিই ব্যক্তিকে সভ্যতার উপাদান ও নিয়ম কানুন সম্পর্কে অবহিত করে। তার আচার আচরণ মালীন ও দায়িত্বপূর্ণ বানায়, সামষ্টিক উত্তরাধিকারের মৌল নীতিসমূহ ও সমাজই তাকে জানিয়ে দেয়। ভাষা, আচার আচারণ, প্রচলন অনুসরণের প্রবণতার রীতি নীতি, বিভিন্ন সভ্যতা ও সঙস্কৃতি, ধর্মীয় বিধি বিধান ও পারস্পরিক লেন দেন, কর্যকলাপ ইত্যাদি সবই তো সমাজসমষ্টি ব্যাক্তিকে শক্ষাদান করে। বস্তুত সামজিক ও সামাষ্টিক জীবন না হলে ব্যক্তিরা বোবা পশু হয়ে যেত। বৈষয়িক বিষয়াদি সম্পর্কে সে কিছুই জানতে পারত না অথবা হত এমন শিশু যে, তার জন্যে ক্ষতিকর কি আর উপকারী কি, তা জানতেই পারত না। সমাজ সমষ্টিই তার আচার আচরণ ভারসাম্যপূর্ণ তখন তার বিবেক বুদ্ধি থাকে সাদ দাগ চিহ্ন হীন প্রস্তর ফলকের মত। পরে সমাজ সমষ্টি সামাজিক উত্তরাধিকারের কার্যকারণ দিয়ে তাকে লালন পালন করতে তাকে। আর তা পূর্বসূরিয়া উত্তরসূরিদদের জন্যেই রেখে গেছে। ভাষা, সংস্কৃতি,আকীদা বিশ্বাস অনুসরণ, এ সবই এ পর্যয়ে পড়ে। [দেখুন ডঃ আহমাদ আলখাশশাব লিখিত প্রন্হ (আরবী***********)] অতএব ব্যক্তি সমাজ সমষ্টির কাছে ঋণী, এতে আর কোন সন্দেহ নেই। এ কথা যেমন সত্য হয় ব্যক্তির আত্মিক,সাংস্কৃতিক ও সভ্যতা সংক্রান্ত উপার্জনের ক্ষেত্রে, তেমনি সত্য হয় তার বস্তুগত ও অর্থনৈতিকি আয় উপার্জনের ব্যাপার ও। কাজেই ব্যক্তি যদি ও বহু স্বভাবজাত গুণ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হয়ে তাকে, তবু্ও এ কথায় সন্দেহ নেই যে, সে যা কিছু উপার্জন করে তা তার একক চেষ্টা সাধনার ফলেই উপার্জন করে না। তাতে শরীক রয়েছে বহ মানুষের চেষ্টা, চিন্ত ও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ হাতের শক্তি, যা গুণে শেষ করা যাবে না কোনটি অংশগ্রহণ করেছে কাছে থেকে এবং কোনটি করেছে দূর থেকে, কোনটি স্বেচ্ছায় আবার কোনটি অনিচ্ছায় ও অজ্ঞাতসারে। ধন মাল তার মালিকের হাতে পৌছানের এসব হচ্ছে কার্যকারণ আর এ কার্যকারণ সমূহই তাতে পুরামাত্রায় শরীক রয়েছে। যে কৃষক গমের ফসল কেটে ঘরে নিয়ে এলো সে কি করে তা লাভ করল, তা চিন্তা করলেই উপরের কথার যথার্থতা বোঝা যায়। ক্ষেত্রে সমাজ সমষ্টির চেষ্টার তুলনায় ব্যক্তির চেষ্টা সাধানার মুল্য কত? সমাজই খাল কেটেছে, জমিতে দখল দিয়েছে, সেচের ব্যবস্থা করেছে, চাষ যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করেছে এবং এ সময় যে খোরাক পোশাক ও বাসস্থানের প্রয়োজন হয়েছিল, তা তকেব যোগড় করে দিয়েছে। সর্বোপরি দেশে ও সমাজে শান্তি শৃংখলা ইত্যাদি সামাজিক আনুকুল্য এত বেশী পেয়েছে, যা গুণে শেষ করা যাবে না। একজন ব্রবসায়ীর কাথা চিন্তর করা যায়। সেকি করে মুলধন সংগ্রহ করল? কি করে সে কামাই রোজগার করল? তার ওপর ও তো সমাজের বহু অনুগ্রহের অবদান রয়েছে। সে অবাদান বিরাট,অসামন্য। কে তার কাছে পণ্য বিক্রয় করে, তার কাছ থেকে কে তা ক্রয় করে? কে সেসব পণ্য তৈয়ার করে? সমাজ সমষ্টির আনূকুল্য না পেলে তার কোন কাজটা চলত? কৃষক, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি বেতনভুক কর্মচারী, প্রত্যেক পেশা ও প্রত্যেক ধরনের মালের মালিক মস্পর্কেই এ কথা সত্য। ও সম্পত্তি তখন সমাজ সমষ্টির চেষ্টা সাধনার ব্যাপরটি অধিক প্রকাশমান এবং বড় হয়ে ওঠে। ব্যক্তির অংশ সেখানে খুব সামন্য এবং ক্ষীণ পরিলক্ষিত হয়। কেননা ব্যক্তির কর্মক্ষমতা তো সমিাবদ্ধ। তাকে তার শক্তি সমার্থ্যের সময়ের ও প্রয়োজনের স্বাভাবিক সমিাবদ্ধতা নিয়েই থাকতে ও চলতে হয়। বিশাল কৃষি খামার বা বিরাট শিল্প কারখানা অথবা বহু শাখা প্রশাখা সমন্বিত ব্যবসার প্রতিষ্ঠানের মালিক কতখানি চেষ্টা চালিয়ে থাকে? কাজটা যখন প্রাতিষ্ঠনিক হয়, তখন ব্যক্তির ব্যক্তিগত চেষ্টার স্থান তো খব নগণ্যই হয়ে থাক। অপরদিকে থাকে তার সাথে কাজে শরীক শত সহস্র,মানুষের চষ্টোর সংযোগ। সেজন্যে তাদের মাথার ঘাম, চোখের দৃষ্টি এবং চিরন্তন শক্তি ব্যয় হয়ে থাকে অপরিমেয়। এ করণে এক ব্যক্তি যে ধন মাল রোজগার করে, যাকে সে নিজেরর ধান মাল বলে দাবি করে ও সেজন্যে অহম বোধ করে, তা আসলে সমাজ ও সমষ্টির সম্পদ। সমাজের সম্পদবলে ও তা গণ্য হবে, তার হিসেব সমাজের খাতায় ও লেখা হবে। তার সংরক্ষণের দায়িত্ব পালনের জন্যে সামজকেই দায়ী করা হবে। একারণেই কুরআন মজীদে মুসলিম সমাজকে সম্বোধন করে বলা হয়েছেঃ (আরবী***********) এবং তোমরা তোমাদের ধনমাল কম বুদ্ধির লোকদেরে দি ও না,যে ধন মালকে আল্লাহ তোমাদের জন্যে স্থিতির মাধ্যম বানিয়েছেন। [(আরবী***********)] ফিকাহবিদগণ এ আয়াতের ভিত্তিতেই নির্বোধ ও বহুদা খরচকারী, অপচয়কারীদের ওপর তাদের ধন সম্পদ ব্যয়ে নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিধান বের করেছেন। বহ্যত সে ধন মাল তাদের কতৃত্ব ও দখলে ও থাকলে ও এর্ং তার মালিক হলে ও প্রকৃত পক্ষে তা সমষ্টির মালিকানা সম্পদ। তা বৃদ্ধি পেয়েছে, সংরক্ষিত হয়েছে সমাজের ব্যবস্থাপনায়। তা ধ্বংস প্রাপ্ত হলে তার ক্ষতিটা সমাজ সমষ্টিকেই ভোগ করতে হয়। এ দুষ্টিকোণ দিয়ে আল্লাহ তাআলার উপরিউক্ত কথা এবং তাতে সমাজ সমষ্টিকে সম্বোধন করার তাৎপর্য খুব পরিষ্কার বুঝতে পারা যায়। তোমরা তোমাদের ধন মাল নির্বোদ মালিকানা স্বত্বের অধিকরী সম্পর্কে একটা আল্লাহর ঘোষনা পা্ওয়া যাচ্ছে। পরে ও যা আল্লাহ তাআলা তাদের জন্যে স্থিতির মাধ্যম বানিয়েছেন বলা হয়নি, বরং বলা হয়েছেঃ যাকে আল্লাহ তাআলা তোমাদের জন্যে স্থিতির মাধ্যম বানিয়েছেন। তার অর্থ ধন মাল যদ্ওি তাদের ও মালিকনাধীন তবু ও তা গোটা সমাজ সমষ্টির জন্যে স্থিতির মাধ্যম সামষ্টিক বীবনের মেরুদণ্ড। কুরআন আর ও বলছেঃ (আরবী***********) হে ঈমানদার লোকেরা। তোমরা তোমদেরধন মাল পারষ্পরিক ক্ষেত্রে বাতিল পন্হায় ভক্ষণ করো না। তবে যদি তোমাদের পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে ব্যবসায় হয এবং তোমরা নিজেদের হত্যা করো না। আল্লাহ নিশ্চয়ই তোমাদের প্রতি দয়াবান। [ (আরবী***********)] এ আয়াত মুমিনদের পারস্পরিক ভাবে ধন মাল বাতিল পন্হায় ভক্ষণ করতে নিষেধ করছে। যেমন নিষেধ করছে পরষ্পকে হত্যা করতে। আয়াতে তোমাদের ধন মাল এবং তোমাদের নিজেদের বরঅ হয়েছে। উদ্দেশ্য হচ্ছে এ চেতনা জাগিয়ে দা্ও যে, তাদের কতিপয়ের ধন মাল আসলে তাদের সমষ্টির ধন মাল। একজনের নফস সত্তাসমষ্টির আত্মসত্তার মতই। মুসলিম উম্মত তাদের অধিকার রক্ষা, তাদের কল্যাণ তাদের নফস ও ধন মাল সব কিছুর জন্যে দায়িত্বশীল। এমতাবস্থায় কেউ যদি অন্য কারোর মালা ভক্ষণ করে, সে যেন তার নিজের ধন মাল ভক্ষণ করে অথবা ভক্ষণ করে গোটা সমাজ সমষ্টির ধন মাল। এক্ষণে কেউদ যদি তা ভাইয়ের জনের ওপর হামলা করে তাকে হত্যা করে সে যেন নিজেকেই হত্যা করল অথবা গোটা সমাজকে হত্যা করল। অন্য আয়াতে সেকথাই বলা হয়েছেঃ (আরবী***********) যে লো কোন মানুষেকে হত্যা করল অন্য কোন ব্যক্তিকে হত্যার শাস্তির বিসেব ছাড়াই অথবা পৃথিবতে বিপর্যয় সৃষ্টি ব্রতিরেকেই সে যেন সমস্ত মানুষকে হত্যা করল। পক্ষান্তরে যে লোক একটি মানুষকে বাঁচালো সে যেন সমস্ত মানুষকেই বাঁচাল। [(আরবী***********)] কুরআন মজীদের মর্যাদা মাহাত্ম্য এবং তার মুজিযা অসাধারণ। তার একটি কথা বা তার অংশ দ্বারা এক মহা্ ও বিরাট সত্যের দিকে ইঙ্গিত করে যদ্দারা এক মহামূল্য মৌলনীতি উদ্ঘাটিত হয়।যেমন সূরা নিসার উপরিউক্ত আয়াতটি ঃতোমরা খেয়ো না তোমাদের মালকপারস্পরিকভাবে বাতিল উপায়ে। এখানে ধন মালকে সমস্ত মুসলমানের মুল করে ঘোষণা করা হয়েছে। তার যেন পরস্পর পরস্পারের মাল না খায় একথা বলা হয়নি। এ থেকে জানিয়ে দেয়া হল যে, গোট মুসলিম সমাজ এক অবিভাজ্য ইউনিট, প্রতিটি ব্যাপারেই তারা পরস্পরের ধারক ও রক্ষক। যেন বলা হলঃ আমাদের ধন মাল প্রকৃত পক্ষে তোমাদেরই ধন মাল।তোমাদের ধন মাল। তোমাদের প্রত্যেক ব্যক্তির ধন মাল, প্রকৃত পক্ষে তোমাদেরই ধন মাল। তোমাদের প্রত্যেক ব্যক্তির ধন মাল, প্রকৃত পক্ষে গোটা সমাজের ধনমাল। সাইয়্যেদ রশীদ রিজা এ আয়াতের তাফাসীরে লিখেছেনঃ এ ধরনের সম্পর্ক স্থাপন ইসলামে রংশীদারিত্বের নীতি নির্ধারণ করে, যার দিকে একালের কমিউনিস্ট সমাজ তন্ত্রীরা ইংগিত করে থাকে অথচ এ ক্ষেত্রে ইসলামের যে সুবিচারমুলক নীতি রয়েছে, তা তারা জানতে ও বুঝতে পারে না। তারা যদি ইসলামে জিনেসের সন্ধান করে তাহলে তারা তা অবশ্যেই পাবে। কেননা ইসলাম তার অনুসারী প্রত্যেক ব্যক্তির ধন মালকে সম্পূর্ণরূপে গোটা উম্মতের ধন মাল বলে ঘোষণা করেছে যদি ও ব্যক্তিগত দখন ও মালিকানা পূর্ণমাত্রায় স্বীকৃত, ব্যক্তির অধিকার সংরক্ষিত। তা প্রত্যেক বিপুল মালের অধিকারীর ওপর সমষ্টির কল্যাণে সুনির্দিষ্ট অধিকার আদায়ের দায়িত্ব অর্পণ করেছে, যেমন তার ও প্রত্যেক অল্প মালের মালিকের ওপর অপর কিছু বিপগ্রস্ত জনগণের অধিকার ধার্য করা হয়েছে। এভাবে গোটা মানবজাতিকে অধিকারের দৃঢ় রজ্জুতে পরস্পরের াসাথে কঠিন ভাবে বেধে দেয়া হয়েছে। আর সর্বোপরি সমস্ত সানুষকে পরম পূণ্য ময় কাজ, সর্বোচ্চ কল্যাণ ও অনুগ্রহ স্থায়ী ও সাময়িক সাদকা ও হাদিয়া দানের জন্যে উৎসাহিত করা হয়েছে। [(আরবী***********)] উপরোদ্ধৃত সমস্ত কথার সার নির্যাস হচ্ছে, ব্যক্তির ধন মালে সমষ্টির খুব বেশী তগিদপূর্ণ অধিকার রয়েছে। তা এমন অধিকার, যা আাদায় করার পথে কারোর শরীয়াত সম্মত মালিকত্ব ও বাধা হয়ে দাড়াতে পারে না। বরং ব্যক্তির মালিকানাতেই সমষ্টির কল্যাণের জন্যে একটা বাধা হয়ে দাড়াতে পারে না। বরং ব্যক্তির মালিকানাতেই সমষ্টির কল্যাণের জন্যে একটা নির্দিষ্ট অংশ সব সময়ই ধার্য হয়ে থাকে। তার চাইতে ও বড় কথা, প্রয়োজনের সময় সামগ্রিক কল্যাণের তাগিদে সমষ্টির অধিকার অগ্রাধিাকারপ্রাপ্ত হয়ে থাকে। রাষ্ট্রিই সমষ্টির ওপর কর্তৃত্বসমম্পন্ন প্রতভু, সমষ্টির কল্যাণের ব্যবস্থা রাষ্ট্রেই করে। প্রত্যেক মালদারের ধান মালে সেই সমষ্টির জন্যে একটা অংশ নির্দিষ্ট থাকা আবশ্যক। সে অংশ খরচ হেব এমন এমন কাজে যার প্রত্যক্ষ ফায়দা সমষ্টির কল্যাণে নিয়োজিত হবে। সমষ্টির অস্তিত্ব রক্ষা পাবে ও দায়িত্ব পালিত হবে, সর্বপ্রকারের বিদ্রোহ ও সীমালংঘন প্রতিরুদ্ধ হবে। মুসলিম সমাজে যদি অভাবগ্রস্ত ও দারিদ্র্য পীড়িত ব্রক্তি না থাকে, তাহলে ও মুসলিম ব্যক্তিকে তার যাকাত দিতে হবে অবশ্যম্ভাবীরূপে। তখন তা গোটা ইসলামী সমাজ মুসলিম মিল্লাতের সম্পদ হবে। সে পর্যয়ের প্রয়োজনে তা ব্যয় করা হবে, আল্লাহর পথে গুণসম্পন্ন কার্যাবলীতে তা ব্যয় হবে। আর তা এমন একটা ব্যয় খাত, সাধারণভানে কার্যকর থাকবে ততিদিন, যতদিন প্রথিবীর বুকে ইসলাম থাকবে। মুসলামদের মধ্যে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব চতুর্থ মতাদর্শঃ ভ্রাতৃত্বের মতবাদ ব্যক্তি ও সমষ্টির মধ্যে পরষ্পরের দয়িত্ব গ্রহণের তুলানায় ভ্রাতৃত্ব একটা গভীর তাৎপর্য ও সুদূর প্রসারী লক্ষ্যে অধিকারী। ভ্রাতৃত্ব কথাটিতে স্বার্থ ও সুবিধার পারস্পরিক বিনিময়ের স্থান নেই। গ্রহণের মুকাবিলায় দানের প্রশ্ন ও নয় এটা। এটা গভীর মানবিক আধ্যত্মিক তাৎপর্য পরিপূর্ণ। তা মৌল মানবিকতার অন্তর্নিহিত ভাবধারা থেকে উৎসারিত। ভ্রাতৃত্বের দাবি হচ্ছে, ভাই কে দা্ও তার কাছ থেকে না যেয়া হলে ও দা্ও। ভাইকে নিজের ও ওপর অগ্রাধিকার দা্ও। ইসলামা দুই ধরনের ভ্রাতৃত্ব উপস্থাপিত করেছে অথবা বলা যায়, ইসলাম উপস্থাপিত। ভ্রাতৃত্বের দুটি পর্যায়। একটি ভ্রাতৃত্বের ভিত্তি হচ্ছে মানবিকতায় অংশীদারিত্ব। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে আকীদা বিশ্বাসে একাত্মতার ভ্রাতৃত্ব। প্রথমটি মানষের বর্ণ, ভাষা,দেশ শ্রেণী প্রভৃতি দিক দিয়ে তারা যতই বিভিন্ন ও পরস্পর সাংঘর্ষিক হোক না কেন, সমস্ত মানুষ এক ও অভিন্ন মূলের শাখা প্রশাখা। একই পিতার সন্তান। এ দৃষ্টিতে আল্লাহ তাআলা গোটা মানব জাতিকে সম্বোধন করেছেন (আরবী***********) হে আদম সম্তান আদম বংশজাত বলে। [ এ ডাকটি কুরআনে পাঁচটি স্থানে এসেছে। ;চারটি হচ্ছে সুরা আরাফে এবং সূরা ইয়াসনে।] যেমন সম্বোধন এসেছে (আরবী***********) হে মানুষ বলে[ সূরা নিসাতে প্রথম। পরে বারে বারে ] অর্থাৎ তাদের মধ্যে একটা সূক্ষ্ম রক্ত সম্পর্ক এবং ব্যাপক ভ্রাতৃত্ব রয়েছে। আল্লাহ তাআলা কুরআন মজীদে এ রক্ত সম্পর্কের মানবিকতার অধিকারের কথা উদাত্ত কন্ঠে ঘোষণা করেছেন। এটা হচ্ছে মনুষ্যত্বের মানবিকতার ভ্রাতৃত্ব। আল্লাহ তাআলা সূরা আন নিসার শুরুতেই বলেছেনঃ (আরবী***********) হে মানুষ ! তোমরা ভয় কর তোমাদের সেই রব্বকে, যিনি তোমাদের সৃষ্টি করেছেন একই প্রাণত্তা থেকে তা থেকেই সৃষ্টি করেছেন তার জুড়ি এবং এ উভয় থেকে ছড়িয়ে দিয়েছেন বিপুল সংখ্যক পুরুষ ও নারী। আর ও তোমরা ভয় কর আল্লাহকে, যাঁর দোহাই দিয়ে তোমরা পরস্পরের কাছে চা্ওয়ার কাজ কর এবং ভয় কর রক্ত সম্পর্ক। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের ওপর প্রহরী। [ সূরা আন নিসা শুরু।] হে মানুষ বলে ডাক দেয়ার পর (আরবী*********) এর উল্লেখ এবং তাদের একই প্রাণীসত্তা আদম সত্তা থেকে সৃষ্টি করার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়ার স্পষ্ট তাৎপর্য হচ্ছে মাধারণ মানবিক নৈকট্য ও একত্মতা। ইসলামের নবী (স) এ ভ্রাততের ওপর যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করেছেন।তিনি এ ভ্রাতৃত্বকে উদ্বুদ্ধ করার জন্যেই আহবান জানিয়েছেনঃ (আরবী***********) তোমরা সকলে আল্লাহর বন্দা ভাই হ্ও। [বুখারী মুসলিম] শুধু তাই নয়, নবী করীম (স) এ মানবিক ভ্রাতৃত্বকে একটা অন্যতম আকীদার মধ্যে গণ্য করেছেন, যার সাক্ষ্য স্বয়ং আল্লাহ তাআলা দিয়েছেন। নবী করীম (স) সমস্ত মানুষকে সেই আকীদা গ্রহণের আহবান জানিয়েছেন। তিনি প্রত্যেক নামাযের পরে এই বলে দোআ করতেনঃ হে আমাদের আল্লাহ! আমাদের রব্ব, রব্ব সব জিনিসের মালিক সে সব জিনিসেরেই। আমি সাক্ষী তুমিই আল্লাহ একক, তোমার শরীক কেউ নেই। হে আমাদের আল্লাহ, আমাদের রব্ব সব জিনিসের, মালিক ও আমাদের রব্ব,রব্ব সব জিনিসেরই মালিক্ও আগামী সাক্ষী সমস্ত বান্দাই পরস্পর ভাই। [আহমাদ ও আবূ দাঊদ উদ্ধৃত করেছেন।] মানুষ ও মানুষের মধ্যকার সম্পর্কে শিরোনাম ও পরিচিতি হচ্ছে ভ্রাত্রত্ব,পাস্পরের ভাই হ্ওয়া। ভ্রাতৃত্বের কতগুলো ফলশ্রুতি আছে, কতগুলো দাবি। এ ভ্রতৃত্বের অন্যতম দাবি হচ্ছে কোন মানুষই তার অন্য ভাইকে বাদ দিয়ে বঞ্চিত করে সর্বপ্রকার কল্যাণ ও নিয়ামতের নিজেকেই একমাত্র অধিকরী মানে করবে না। অন্য ভাইয়ের তুলানায় নিজেকে অগ্রাধিাকর প্রাপ্ত মনে করে নেবে না। বস্তুত যে লোক নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত, এ দুনিয়ায় তার জন্ম নেয়ারই কোন অধিকার নেই। আরব কবি আল মুয়াররা কি সুন্দুর বলেছেনঃ আমি যদি ও চিরন্তন তাকে একক ভাবে ভালোবাসি না। নিশ্চয়ই আমার একার চিরশন্যতা ভালোবাসি না। মেষ বৃষ্টি বর্ষণ করে শহর নগর গড়ল না, সে আমার ওপর বৃষ্টি বর্ষালো না, আমার জমিনের ওপর। এই সাধারণ ভ্রাতৃত্বের ঊর্ধ্বে আর একটি ভ্রাতৃত্ব রয়েছে, যা এর চাইতে ও অধিক গভীর প্রভাব শালী, অধিক মর্মস্পর্শী। তা হচ্ছে আকীদা বিশ্বাসের একাত্নতার ভ্রাতৃত্ব।এটাকে ই ইসলামী ভ্রতৃত্ব বলা হয়। এ ইসলামী ভ্রাতৃত্ব মুমিন লোকদেরকে চিন্তা ও আধ্যাত্মিক দিক দিয়ে পরস্পরের সাথে এমন ভাবে বাঁধে, যা কখনই ছিন্ন হয় না। এ ভ্রাতৃত্ব আকীদা বিশ্বাসের একত্বের এ ভ্রাতৃত্ব অন্তর, হদয় ও চিন্তার দিক দিয়ে,অধিকতর নিকটবর্তী। পারস্পারিক সাহায্য ও ঔদার্য গ্রহণে প্রত্যেককে অধিক আগ্রহী বানায় এবং এ আগ্রহের ব্যাপারটি রক্ত বংশের ভাইয়ের প্রতি যা হয় তার চাইতে ও অধিক তীব্র, বেশী প্রভাবশালী হয়ে থাকে। একারণেই আল্লাহ তাআলা কুরআন মজীদে বলেছেনঃ (আরবী***********) মুমিনরা পরস্পরের ভাই এ ছাড়া কিছু নয়। [ (আরবী***********) ] এ আধ্যাত্নিক ভ্রাতৃত্ব ও এ বিশ্বাসগত সৌহার্দ্য সৌহদ্যপূর্ণ সম্পর্কের অধিকার হচ্ছে, কার্যত পরস্পরের দাযত্ব গ্রহণ এবং সামাজিক অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বিধানের ক্ষেত্রে তার প্রতিফলন ঘটতে হবে। অন্যথায় সেভ্রাতৃত্ব অর্থহীন ও অন্তঃসারশূন্য হয়ে পড়বে। এ ভ্রাতৃত্বের অধিকার আর ও তাগিত পূর্ণ হয়ে পড়ে যখন মুমিন গণ একই সমাজভুক্ত হয়ে বসাবাস করতে থাকে। এক্ষেত্রে একই দেশের দেশে বসবাসজনিত সম্পর্কটা সমন্বয়কারী্ ঈমানী ভ্রাতৃত্বের সাথে যুক্ত হবে। আর একথা পূর্বেই সপ্রমাণিত যে, দারুল ইসলাম ইসলাম রাজ্য তার বিশাল বিস্তৃতি সহ সমগ্র মুসলিমের এক ও অভিন্ন আবাসভূমি। ইসলামে বিশ্বাসী সব মানুষই এ দেশে সমাজভুক্ত সর্বতোভাবে অভিন্ন। রাসূলে করীম(স) এ ভ্রাতৃত্বের অধিকারের কথা অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভাষায় বলেছেন, যা বহ কয়টি হদীসে সন্নিবেশিত রয়েছে। এখানে তার কয়েকটি হাদীস উদ্বৃত করা যাচ্ছেঃ (আরবী***********) একজন মুমিন অপর একজন মুমিনের জন্যে ঠিক সেরূপ যেমন একটি প্রাচীরে একটি ইট অপর ইটকে শক্ত করে। [বুখারী মুসলিম, আবূ মূসা বণিত। ] মুমিনদের পারস্পরিক বন্ধুতা দয়া সহানুভুতির দৃষ্টান্ত একটি অখণ্ড দেহের মত। দেহের একটি অংগ যদি অসুস্থ হয়, সে কারণে গোটা দেহ উত্তাপ্ও অনিদ্রায় ভোগে। [বুখারী, মুসলিক নূমান ইবনে বশীর বর্ণিত।] মুসলমান মুসলমানের ভাই। সে তার ওপর জুলুম করতে পারে না সে তাকে অসহায় করে ছেড়ে ও দিতে পারে না। [বুখার,মুসলিম আবূ দাউদ তারগীব তারহীব, ৩য় খণ্ড ৩৮৯ পৃ.হালবী প্রকাশিত।] যে ব্যক্তি তার ভাইকে ক্ষুধার্ত বস্ত্রহীন ও রোগাক্রান্ত অবস্থায় ফেলে রাখে অথচ সে তাকে এ ক্ষুধা বস্ত্রহনিতা এ রোগ থেকে নিস্কৃতি দিতে সক্ষম,সে তাকে বাস্তবিকভাবেই অসহায় করে ছেড়ে দিল, তাকে লাঞ্চিত অপমানিত করল। নবী করীম(স) বলেছেনঃ যে লো খেয়ে পতিৃপ্ত হয়ে রাতে ঘুমালো অথচ তার প্রতিবেশী তার পাশেই রাত কাটাল অভুক্ত অবস্থায়, এ কথাতার জানা ও ছিল সে তো আমার প্রতি ঈমানই আনেনি। [তাবারানী এ বাজ্জার আনাস থেকে হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন। এর সনদ উত্তম। তাবারানী ও আবূ ইয়ালা ও তা উদ্ধৃত করেছেন ইবনে আব্বাস থেকে। হাকেম উদ্ধৃত করেছেন আয়েশা থেকে। (আরবী***********) এ সব হাদীসে ইসলামী সমাজের যথার্থ চিত্র অংকিত হয়েছে। এ সমাজের ব্যক্তিরা সিসা ঢেলে সুদৃঢ় বাঁধনে তৈরি করা প্রাচীনসদৃশ। একজন অপরজনকে দুর্বল করে না, শক্ত ও দৃঢ় করে। গোটা ইসলামী সমাজ একটি অখণ্ড পরিবার। এখানে প্রত্যেকটি ভাই অপর প্রত্যেকটি ভাইয়ের দাযত্বশীল হয়ে দাঁড়ায়। এ একটি অখণ্ড দেহ সত্তা যেন। তার একটি অঙ্গ ব্যক্তি অসুস্থ হলে গোটা দেহ সত্তা সমাজ সমষ্টি অসুস্থ বোধ করে। অতএব যে মুসলিম ব্যক্তি কাজ করতে পারে না কিংবা কাজ তো করতে পারে; কিন্তু কাজ পায় না অথবা কাজ তো করে ঃ কিন্তু সে কাজ দ্বারা প্রয়োজন পরিমাণ উপার্জন করতে পারে না বা সবিই ঠিক কিন্ত এমন বিপদ ঘটেছে যা তাকে সাহায্যের মুখাপেক্ষী বানিয়েছে হয় তার ঘর জ্বলে গেছে, ধন মাল বা শস্য বন্যায় ভেসে গেছে, ফসল নষ্ঠ হয়ে গেছে, ব্যবসা অচল বা মন্দা হয়ে পড়েছে অথবা পথের মধ্যেই সে তার ঘর বাড়ি ও ধন মাল থেকে সম্পর্কহীন হয়ে পড়েছে এ সকল লোকেরই অধিকার আছে সাহায্য পা্ওয়ার। তখন তাকে সাহায্য করা তাদের ভেঙ্গে পড়া মেরুদণ্ডকে সোজা ও শক্ত করা, তাকে হাত ধরে দাঁড় করে দেয়া যেন উঠতে ও চলতে পারে জীবনের চলমন কাফেলার সাথে শরীক থেকে আল্লাহর সম্মানিত মানুষহিসেবে, গোটা সমাজ সমষ্টিরিই দায়িত্ব ও কর্তব্য। নতুবা মানুষ যখন তারই ভাই, তারই মত অপর একজন মানুষকে লাঞ্চিত করে, লাঞ্চিত হতে দেয় এবং মঙ্গল বলতে কোথা্ও কিছু থাকে না। এ সব কিছু থেকেই আমাদের সম্মুখে যাকাত ফরয হ্ওয়ার দার্শনিক ভিত্তি সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। আর তা যে কর ধার্য করার দার্শনিক ভিত্তির তুলনায় আনেক বেশী ব্যাপক ও গভীর এবং চিরস্থায়ী ও শাশ্বত তাতে কেন সন্দেহ থাকে না। অবশ্য সামাজিক নিরাপত্তা বিধানের ক্ষেত্রে যাকাত ও কর এর দৃষ্টি কোণ অভিন্ন হতে পারে; কিন্তু অপর তিনটি মতাদর্শের দিক দিয়ে যাকাত ফরয করার ব্যাপারটি অ্ত্যন্ত বিশিষ্টতা পূর্ণ ও স্বতন্ত্র মর্যাদার অধিকারী, তা সর্বতোভাবে সন্দেহাতীত। তৃতীয় পরিচ্ছেদ কর ধাযের ক্ষে্ত্র বনাম যাকাত দাযের ক্ষেত্র কর ধাযের ক্ষেত্র যা কর ধাযের সুযোগ করে দেয়, কেউ কেউ বলেন উৎস,আবার কেউ কেউ বলেছেন নিক্ষেপ স্থান। রাষ্ট্রীয় অর্থনীতিবিদগণ উল্লেখ করেছেনঃ কর সমূহের গুরুত্বপূর্ণ বিভক্তি আর ক্ষেত্রের দিক দিয়ে তা নিম্নলিখিভাবে বিভক্তঃ ১.মূলধনের ওপর কর ২. আয় ও আমদানীর ওপর কর ৩.ব্যক্তিদের ওপর মাথাপিছু কর ৪. ভোগ্য ব্যহার্য জিনিসের ওপর কর অবশ্য ইসলামে এ শেষোক্ত ভোগ্য ব্যবহার্য জিনিসের ওপর কর ধার্য করণ যাকাত অধ্যায়ে পরিচিত নয়। কেননা প্রকৃত পক্ষে যাকাত ধনী লোকদের কাছ থেকে গ্রহণীয় কর, যা গরীব মিসকীন এবং দ্বীন ও জাতির জন্যে সাধারণ কল্যাণের নিমিক্ত তা ব্যয় হয়। আর ভোগ ব্যবহার কারী যেমন গরীব লোক হয়, তেমনি হয় ধনী লোকেরা ও।তখন এ করের যারা আশ্রয় গ্রহণ করে, তারা তা করে প্রাপ্তির বিপুলত্য ও প্রাচুযের জন্যে। কিন্তু তার ও অন্যান্য ক্ষেত্রের মধ্যে বৈপরীত্য দেখা দিলে ইসলামে অন্যান্য প্রকারের কর পরিচিত। মূলধনের ওপর যেমন আয়ের ওপর ও তেমন এবং ব্যক্তিদের ব্যাপারে ও তাই। এ পরিচ্ছেদের আলোচনাসমূহে আমরা এ তিন ধরনের যাকাতের উল্লেখ করার ইচ্ছ রাখি। সাথে সাথে সে কয়টির ও তার মত অন্যান্য করসমূহের মধ্যে তুলনা করা হবে, কিন্তু তাতে খুব বিরক্তিকর দীর্ঘতা যেমন গ্রহণ করা হবে না, তেমনি অঙ্গহানিকর সংক্ষিপ্ততাকে ও প্রশ্রয় দেয়া হবে না। প্রথম আলোচনা মূলধনে যাকাত যে সব ধন মালে যাকাত ধার্য হয় এবং ইসলাম তার যে পরিমাণ সমূহ নির্ধারণ করেছে সে বিষয়ে যে লোকই সামান্য চিন্তা করবে তার সম্মুখে একথা স্পষ্ট হয়ে ওঠবে যে, ইসলামী শরীয়াত কেবলমাত্র কর ধার্যকরণের ব্যবস্থাই গ্রহণ করে নি বিভিন্ন যুগের কোন কোন অর্থনীতি চিন্তাবিদ যেমন মনে করেছেন। বরং যাকাতের অধ্যায়ে অধ্যায়ে বিভিন্ন ধরনের কর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। যাকাত কখন্ওে ধার্য হয় মুলধনের ওপর,যেমন গৃহপালিত পশু সম্পদ স্বর্ণ ও রৌপ্য নগদ সম্পদ এবং ব্যবসায় সম্পদের ওপর ধার্য হয়ে থাকে। কখন ও আবার তা ধার্য হয় আয় আমদানির ওপর, কিন্তু সর্ব প্রকারের আয় আমদানীর ওপর নয়ঃ বিভিন্ন ধরনের আয়ের শাখা প্রশাখার ওপর।তার প্রথম হচ্ছে,কৃষি ফসলের আমদানির ওপর তারপর খনিজ উৎপাদনের আয়ের ওপর তারপর কার্যত ভাড়ায় লাগানো নির্মিত প্রতিষ্ঠানসমূহের ওপর, তারপর কল কারখানা ও যন্ত্রপাতির ওপর মুনাফাদায়ক প্রত্যেক মূলধনের আয়ের ওপর অব্যবসায়ূ। তার পর শ্রম ও উপার্জনের ওপর নিয়মিত মাসিক বা সাপ্তাহিক বার্ষিক বেতন, বেতনভুকদের ও শ্রমিকদের মজুরীর ওপর।স্বাধীন পেশার লোকদের আয়ের ওপর ও তা ধর্য হয়। এ গ্রন্থের যথাস্থানে এসব খাতের কথাই সুবিন্যন্তভাবে আমরা লিপিবদ্ধ করেছি। যাকাতে মূলধন করের বৈশিষ্ট্য আছে দোষ ক্রটি নেই ইসলামী শরীয়াত মূলধনের পশু, ব্যবসায় পণ্য ও নগদ সম্পদের ওপর যখন যাকাত ধার্য করে তখন তা খুব অভিনব ও বিস্ময়োদ্দীপক ব্যাপার হয় না। কেননা কমিউস্টি সমাজতন্ত্রবাদী ও অপরাপর অর্থব্যবস্থাপন্হীরা তার বহু পূর্বেই মূলধনের ওপর নানা প্রকারের ধার্য করে বসেছে। আনেকে তো এতখানি বাড়াবাড়ি করেছে যে, তারা দাবি করেছে যে, এটাই হবে একমাত্র করা যার ওপর গোটা অর্থ ব্যবস্থা সীমিত থাকবে এবং মূলধন পরিব্যাপ্ত হবে অন্য কিছু ছাড়া। [আরবী************] মূলধনের ওপর কর ধাযের বৈশিষ্ট্য তার সমর্থকদের দৃষ্টিতে মূলধনের ওপর কর ধার্য করার সমর্থন করা তার পক্ষে বহু যুক্তি প্রমাণ উপস্থাপিত করেছে। এখানে তার কিছু অংশ পেশ করা হচ্ছেঃ ১.মূলধনের মালিকত্ব তার মালিককে বহু প্রকারের সামাজিক ও অর্থনৈতিক মর্যাদা এবং সুযোগ সুবিধা দান করে। তন্মধ্যে উপার্জনের অবাধ সুযোগ সুবিধা সুবিধা দান করে। তন্মধ্যে উপার্জনের অবাধ সুযোগ সুবিধা অন্যদের তুলানায় সে ই অনেক বেশী পেয়ে থাকে। তাছাড়া ধন সম্পদের কারণ তাদের মানে একটা নিশ্চিন্ততা ও মানসিক স্বস্তি লাভ করে থাকে, যা মূলধনহীন লোকদের বেলা সম্পর্ণ অকল্পনীয়। এ সুফল মূলধনের আবর্তনশীল আমাদানী একটা বড় অবদান। ২. মূলধনের ওপর কর ধার্য করা হলে সকল ব্যক্তির ভিন্ন ভিন্ন ধন সম্পদকে ও পরিব্যপ্তি করে। এমন কি যে মূলধন কোন আয় না এবং পরবর্তী পর্যায়ে আয়ের ওপর কর ধার্যর ও সুযোগ করে দেয় না হয় স্বভঅবতই কোন আয় আমদানী আনে না যেমন মহামূল্যবান উপঢৌকনের বিলাস দ্রব্যাদি উৎকৃষ্ট হীরা জহরতের অলংকারাদি কিংবা তার মালিকদের কারণে যেমন নগদ নগদ ধন মাল। ৩. এ করের আ্ওতায় পড়ে ধন সম্পদের সবপ্রকারের উপাদান। যেসব ধন সম্পদ বেকার পড়ে আছে (আজকের ভাষায় কালো টাকা) তার ওপর ও এ আঘাত পড়ে এবং তার মুনাফা আনয়নকে ত্বরান্বিত করে।ফলে বারবারের কর ধার্য করণের সে মূলধনকে নিঃশেষ করে দেয় না। কিন্তু আয় আমদানীর ওপর ধার্য কর ভিন্ন রকমের। তা কেবলমাত্র মুনাফা লাভের কাজে নিয়োজিত ধন মালের ওপরই ধার্য হয়। লুকিয়ে রাখা মূলধন তার আঘাত থেকে বেমালুম রক্ষা পেয়ে যায়। ৪. মূলধনের ওপর ধার্য এ কর ধনমালের মালিকদের বেশী বেশী উৎপাদনে বিপুলভাবে উৎসাহিত করে। কেননা তাদের কর দিতে হবে এ চেতনা তাদের ওপর চাবুকের মত কাজ করে তাদের মূলধন উৎপাদন বাড়েল কি বাড়ল না অথবা উৎপাদন কম হল কি বেশী হর, কর তাদের দিতেই হবে এচেতনা। ৫. এ কর ব্যবস্থার বাস্তাবায়ন উচ্চতর হার ও সেই দুর্বহ পরিমাণ যে পর্যন্ত আমদানী কর পৌছতে পারে পশ্চাতে থেকে যে বিপল ও প্রচুর পরিমাণ আয় হয়, তার কারণে যে হ্রাস প্রাপ্তি ঘটে তাতে বিরাট অংশ গ্রহণ করে থাকে। তার ফলে অর্থনৈতিক কর্তৃত্ব আমদানী কর এর অত্যধিক ঊর্ধ্বমুখিতা থেকে একটা মান পর্যন্ত কমিয়ে আনে। ৬. মূলধনের ওপর কর ধার্যকরণ তার নামটা দ্বারা যেমন বোঝা যায় মালিকানাহীন বা বিত্ত সম্পত্তিহীন শ্রেণী কে স্পর্শকরে না। কেননা এ শ্রেণীর লোকেরা শ্রমজীবীমাত্র। এ কারণে তা সংস্কারবাদী কমিউনিজম (সমাজতন্ত্র) এ দার্য কররূপে গণ্য হতে পারে। [এসব বিশেষত্ব পর্যায়ে দেখুনঃ ডঃ রশদি দকর লিখিত (আরবী*************) গ্রন্থের ২য় মুদ্রণ জামে সুরীয় প্রেস ৩৪৭ পৃ গ্রন্থের ২য় মুদ্রণ জামে সুরীয় প্রেস ৩৪৭ পৃ. এবং ডঃ সাযাদ মাহের হামজা লিখিত (আরবী*************) গ্রন্থে ১৬৬ ও তৎপরবর্তী পৃষ্ঠ।] মূলধনের ওপর কর ধার্যকরণ সমর্থরকারীদের মতে এগুলোই হলো এ ব্যবস্থার বিশেষত্ব এবং এসব কারণেই তারা সমর্থন করে থাকে। আর এরা সকলে হচ্ছে সমাজতান্ত্রিক চিন্তা ভাবনা লোক।সূলধনের ওপর কর ধার্যকরণ বিরোধীদের বক্তব্য উপরিউক্ত লোকদের প্রতিকুলে রয়েছে সেসব লোক, যারা মূলধনের ওপর কর ধার্যকরণের পরিপন্হী। তাদের অধিকাংশই হচ্ছে পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার সমর্থক। তারা উপরিউক্ত যুক্তিসমূহ অর্থহীন মানে করে বর্ণিত বিশেষত্বসমূহ থেকে দৃষ্টি ভিন্ন দিকে ফিরিয়ে নিতে চেষ্টা পেয়েছে। তারা বলেছেঃ ১. মূলধনের ওপর যে কোন বলেছে ধরনের কর ধার্যকরণের ফলেই প্রায়শই এবং সাধারণভাবেই সঞ্চয়ের আগ্রহ এবং উৎসাহ স্নান ও ক্ষীণ হয়ে যাবে। শুধু তাই নয়, উৎপাদনের শক্তিই হ্রাসপ্রাপ্তি হবে। আর তার পরিণতি হবে খুবইভয়াবহ। কেননা জমি ও কারখানা প্রভৃতি চলমান মূলধনকে কর ধার্যকরণের ক্ষেত্র বানালে তা সঞ্চয়কারীদের উৎসাহে ভাটা লাগিয়ে দেবে এবং দৃঢ় মৌল খাতে সঞ্চয় বৃদ্ধির পরিবের্তে তা সমস্ত আয় ব্যয় করে নিঃশেষ করে দিতে আগ্রহী বানাবে। ২. কর ধার্যকরণ উপযোগী মূলধনকে কোন একটি স্থানে সীমিতকরণ খুবই কঠিন ব্যাপার হয়ে হয়ে দাঁড়াবে ্ কেননা মূলধনের সংজ্ঞা ও তার প্রকৃতি নির্ধারণে আবহমান কাল থেকেই বিভিন্ন প্রকারের মতামত চলে এসেছে। এক ব্যক্তির মালিকানাধীন সম্পদ সম্পত্তির পরিমাণ নির্ধারণ ও খুবই কঠিন ব্যাপার। অনেক সময় সে পরিমাণ নির্ধারণ বস্তবের সাথে সঙ্গতিসম্পন্ন হতে পারে খুব বেশী কষ্ট স্বীকারের পর কখন ও না ও হতে পারে, কিন্তু তা আদৌ যথেষ্ট নয়। অনেক হয়ত অসত্য নির্ভর করা ছাড়া গত্যম্ভর থাকে না, কিন্তু তা আদৌ যথেষ্ট নয়। অনেক হয়ত অসত্য হিসেবে অগ্রিম পেশকরার পন্হার আশ্রয় নিতে পারে। তা ছাড়া এমন মূলধন রয়েছে যা গোপন রাখা খুবই সহজ। ৩. মূলধনের ওপর বার্ষিক নিয়মে কর ধার্য করা হলে গোটা মূলধনই নিঃশেষ হয়ে যেতে পারে অথচ তা আয়ের একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উৎস। অতএব আয় নয় মূলধন খুব সুস্ংদ্ধভাবে নিত্য নতুন রূপ বা আকার ধারণ করে না। বরং তা থেকে যে অংশটাই কর্তিত হবে, সেই পারিমাণ সঞ্চয় করে তা পূর্ণ করা অম্ভব হবে। আর কোন রাষ্ট্র যদি কেবল এ ধরনের কর ধার্যকরণের ওপর নিরূন্তর ভাবে নির্ভরশীল হয় তাহলে তা নিঃসন্দেহে বিশেষ ধন মাল তার নিজের দায়িত্বে নিয়ে যা্ওয়ার পূর্বাভাস হব্ আর তার পরিণতিতে করলব্ধ আয় খু্বই কম হয়ে পড়বে এবং ব্যক্তিগত উৎপাদন তৎপরতা নির্মূল হয়ে যাবে। [(আরবী*************) গ্রন্থের ১৬৮ ও তার পরবর্তী প্রষ্ঠা।] মূলধনের ওপর কর ধার্যকরণ কালে আবশ্য গ্রহণীয় সতর্কতা এ প্রেক্ষিতে কোন কোন অর্থনীতিবিদ মুলধনের ওপর কর ধার্যকরণকালে তার যেসব বিশেষত্ব রয়েছে তার কোন কোনটি থেকে ফায়দা লাভের উপদেশ দিয়েছেন এবং সেজন্যে নিম্মোদ্ধৃত বিষয়গুলোর প্রতি লক্ষ আরোপ করতে বলেছেনঃ ১.মূলধনের একটা বিরাট অংশকে আলাদা করে তার ওপর এ কর ধার্য ন করাই উত্তম,তার হার ভরস্ম্যপূর্ণ হওয়াই উত্তম। এবং এভাবে যে, মূলধন থেকে প্রাপ্ত আমদানী থেকেই তা দিয়ে দেয়া হবে পুরামাত্রায় এবং মূলধনের ওপর হস্তক্ষেপ করা হবে না। ২. কর ব্যবস্থায় কেবলমাত্র কর ধার্য না করা কর ধাযের অন্যান্য দিকের ওপর সম্পূরক কর ধার্য করা বাঞ্চনীয়। বিশেষ করে আয়ের কর। [ডঃ রশীদ দকর রচিত(আরবী**********) গ্রন্থের ৩৫৫ পৃ, ২য় মুদ্রণ] ৩. একটা নিদিষ্ট পরিমাণের কম সম্পদের মালিককে কর অব্যাহতি দিতে হবে অথবা একটা নির্দিষ্ট পরিমাণের আয়ের কম পরিমাণের আয়শীল ব্যক্তিকে নিষ্কুতি দিতে হবে করের বোঝা থেকে। ৪. ঋণ বা বন্ধক ইত্যাদি ধরনের সম্পদের ওপর কর ধার্যকরণ থেকে দূরে থাকা কর্তব্য হব।যাকাত ফরয়করণের এই বিষয়গুলোর ওপর লক্ষ্য আরোপে ইসলামের অগ্রবর্তীতা মূলধনের ওপর ইসলামের আররোপিত যাকাত ব্যবস্থার ওপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে আল্লাহর শোকর আমরা উপরিউক্ত বিশেষত্ব সমূহের ওপর বিশেস দুষ্টি রাখা হয়েছে বলে বুঝতে পারি। আর অর্থনীতিবিদরা যেসব দোষক্রটির সমালোচনা করেছেন, তা থেকে তাকে মুক্ত এপবিত্র পাচ্ছি এবং তাঁরা সেসব উত্তম উপদেশ দিয়েছে কেবলমাত্র প্রবৃদ্ধিশীল এমুনফাদায়ক মূলধনের ওপর। প্রবৃদ্ধিশীল বলতে সেসব মূলধনই ধরা হয়েছে যার মধ্যে প্রবৃদ্ধি লাভের বিশেষত্ব আছে তার মালিক তা বেকার ফেলে রাখলে এ তাকে অব্যাহতি দেয়া হয়নি।। আর প্রবৃদ্ধির শর্ত করা হয়েছে সম্পদে যেন বাড়াতি ও বৃদ্ধি থেকে যাকাত গ্রহণ করা যায় এবং ঠিক আসলটা অক্ষত অবস্থায় থেকে যেতে পারে। আরবী ভাষায় যাকাত শব্দটির আভিধানিক অর্থই হচ্ছে প্রবৃদ্ধি। এ করণে অর্থনীতি বিদগণ এ অর্থনৈতিক কর ধার ধার্যকরণে তার প্রয়োগকরণে যে কারণ দেখিয়েছেন,তর হচ্ছে তার আ্ওতায় কেবলমাত্র ক্রমবর্ধনশীল ধন মালই আসে। [দেখুনঃ (আরবী*************)] এপ্রেক্ষিতে ব্যবহহ মুবাহ অলংকারাদির ওপর যাকাত ধার্য না করার মত যাঁরা দিয়েছেন তাঁদের মত আমরা য়থার্থ মনে করছি। কেননা এ জিনিস তো আর প্রবৃদ্ধি লাব করছে না। কিন্তু তা যদি পুঁজি করা হয় কিংবা তাতে যদি অতিরিক্ত মাত্রায় অপচয় লক্ষ্য করা যায়, তা স্বাভাবিক অবস্থা ও রীতিনীতি লংঘনকারী হয় তাহলে ভিন্ন কথা। পুরুষরা নিজেদের অলংকার হিসেবে যা ব্যবহার করে অথবা তৈজসপত্র উপঢৌকন, প্রতিকৃতি ইত্যাদি ব্যবহূত হলে ও অনূরূপ নীতি অবলম্বিত হবে অর্থাৎ তার সব কিছুর ওপর যাকাত ধার্য হবে। কেননা উপরিউক্ত অবস্থাসমূহে বিপুল পরিমাণ মহামূল্য মূলধন সম্পূর্ণ বেকার ও অনুৎপাদক করে ফেলে রাখা হয়, যার কোন প্রয়োজনইথাকতে পারে না। এ কারণে ফিকাহবিদগণেএ বিষয়ে ও একমত হয়েছেন যে, বসবাসের ঘরবাড়ির ওপর দেহের পোশাক পরিচ্ছদের ওপর ঘরের আসবাব পত্রের ওপর, যানবাহন ও কোন যাকাত ধার্য হবে না। কেননা ওগুলো বর্ধনশীল নয়, এগুলো মালিকের কোন না কোন মৌলিক প্রয়োজন পূরণে ব্যাপৃত। [দেখুনঃ (আরবী*************] অবশ্য কারোর কারোর মত বসবাসের ঘরকে কর ধার্যকরণ থেকে অব্যহতি না দেয়াই য়থার্থ নীতি হতে পারে। কোন কোন রাষ্ট্রের বিভিন্ন আয়ের ওপর তো বটেই সমস্ত অস্তাবর সম্পদ সম্পত্তি এবং মূল্য নির্ধারণ সম্ভব এমন সমস্ত জিনিস প্ত্র ও ঘরের আসবাবপত্রের ওপর ও কর ধার্য হয়ে থাকে। [ (আরবী*************)] ২. মূলত স্থিতিশীল মূলধনের ওপর ইসলামী শরীয়াত যাকাত ধার্য করেনি যেমন কল কারখানা জমি জায়গা ইত্যাদি। কর ধার্য করেছে আবর্তনশীল মুলধনের ওপর। তবে স্থিতিশীল মূলধনের আয় ও প্রবৃদ্ধি থেকে অবশ্যই যাকাত গ্রহণ করা হবে।যেমন কৃষি জমি এ বিষয়ে কুরআন হাদীসের অকাট্য দলিল বর্তমান।তার সাথে যু্ক্ত হবে সে সব নির্মিত প্রতিষ্ঠানাদি যার মুনাফা হয়। এর ফলে যাকাত সঞ্চায়কারীদের উৎসাহ বিনষ্ট করবে না তাদের আয় খরচ করে ফেলার ব্যাপাকতা সাধন করতে ও বলবে না স্থিতিশীল মুলধনে রূপান্তরিত হ্ওয়ার আশংকায়। যেমন কোন কোন কর ধার্য করেণের পরিণতিতে তা হেত দেখা যায়। ৩. সর্বপ্রকারের মূলধনে তা কম হোক কি বেশী ইসলামী শরীয়াত যাকাত ধার্য করেনি। বরং সেজন্যে একটা বিশেষ নিসাব নির্ধারণ করেছে সর্বপ্রথম। সেই নিসাবকে ধনাঢ্যতার নিন্মতম পরিমাণ গণ্য করা হয়েছে।তার কম পরিমাণ সম্পদকে যাকাত থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। তাবে মালিক নিজে নফলভাবে দান সাদকা করলে ভিন্ন কথা। পূর্বে যেমন বলেছি, এ নিসাবের পরিমণ ধরা হয়েছে স্বর্ণের ৭৫ গ্রাম নগদ এ অতিবহিত হলে তবেই অনুপাতে এ পরিমাণের মালিকানার ওপর একটি বছর অতিবাহিত হলে তবেই তার ওপর যাকাত ধার্য হয়। তার পর ও শর্ত এই যে, তা তার মৌল প্রয়োজনের অতিরিক্ত হতে হবে। আর মৌল প্রয়োজন যে সময় দেশ স্থান অবস্থার পার্থক্যের দরুন বিভ্ন্নি রূপ ধারণা করতে পারে তা পূর্বে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ৪. ইসলামী মূলধন যাকাত ধার্য করে তার মূল্য বাড়িয়ে দেয়নি তা থেকে একটা বিরাটরঅংশ বিছিন্ন েকরে আলাদা ধরা হয বলে। তা একটা ভারসাম্যপূর্ণ হরে২ ১/২% হারে নগদ ও ব্যবসায় সম্পদ পরিামণ নির্ধারণে নির্ধারিত হয়েছে। গাবাদি পশুর ক্ষেত্রে প্রায় এরূপ, যেন তার প্রবৃদ্ধি উপঃপাদন আয় থেকে তা সহজেই গ্রহণ করা সম্ভব পর হয়। আর ও বিশেষ কথা হচ্ছে, এ যাকাতটি আবর্তণশীল। সত্য কথা হচ্ছে, ইসলাম মূলধনের ওপর কর ধার্য করেছে নগদ ও ব্যবসায় সম্পদ ও পশু সম্পদে সূলধনটিকেই ক্ষেত্র হিসেবে গ্রহণ করার উদ্দেশ্য নয়, বরং তা থেকে প্রপ্ত আয়কেই সেভাবে গ্রহণ করার উদ্দেশ্য। এখানে উল্লেখ্য, আমাদের ফিকাহবিদগণ সুস্পষ্ট ভাষায় এ কথার অকাট্যতা ঘোষণা করেছেনঃ শায়খুল ইসলাম ইবনে কুদামাহ আলমুগনী গ্রন্থে যে সব ধন মালে যাকাত ফরয হ্ওয়ার জন্যে এক বছর কাল অতিবাহিত হ্ওয়া শর্তরূপে গণ্য হয়েছে এবং যে সব ধন মালে তা হযনি, এ দুটির মধ্যকার পার্থক্য নির্ধারণ প্রসঙ্গে বলেছেনঃ যেসব মালে এক বছর অতিবাহিত হ্ওয়া নির্ধারিত তা হচ্ছে প্রবদ্ধি লক্ষ্য করার ক্ষেত্র । গাবদি পশু ধুগ্বদান ্ও বংশবৃদ্ধির ক্ষেত্র, ব্যবসায়ের পণ্য মুনাফা লাভের ক্ষেত্র। নগদ মুলধন ও তাই। তাতে একটি বছরের শর্ত করা হয়েছে। কেননা এ সময়টার মধ্যে প্রবৃদ্ধি লাভঃ সম্ভব যেন যাকাতটা মুনাফা থেকে আদায় করা যায়। আর তাই সহজ ও সুগম যেন সময়কালে বহুবার যাকাত ধার্য ঘটনা সংঘটিত না হতে পারে।কারণ তাতে মালিকের সব মালই নিঃশেষ হয়ে যাবে। [ (আরবী*************) এবং দেখুন ঃএ গ্রন্থের ১৬২ পৃ.] হানাফী ফিজাহর প্রখ্যাত গ্রন্হ আল হিদায়ার গ্রন্হকার লিখেছেনঃ মালিকানার একটি বছর পূর্ণ হ্ওয়া আবশ্যক (যাকাত ফরয হ্ওয়ার জন্য) কেননা এমন একটা সময়ের অবকাশ তাকে দিতেই যার মধ্যে তাতে প্রবৃদ্ধি বাস্তবায়িত হতে পারে। শরীয়াতে এ সময়কাল নির্ধারত হয়েছে একটি পূর্ণ বছর। কেননা এ সময়কালের মধ্যেই তা বাস্তবায়িত ওবিকাশিত হতে পারে বলে মানে করা যায়। এ সময় ভিন্ন পর্যায়ে সমন্বিত মূল্যের পার্থক্য প্রায়ই এসময়ের সধ্যে লক্ষ্য করা যায়।তাতেই হুকুম আবরর্তিত হবে। মহামনীষী ইবনুল হতহুল কাদরী গ্রন্থে শরীয়াতে যাকাত ফরয হ্ওয়ার জন্যে একটি বছর শর্ত করার যৌক্তিকতা ও বৈজ্ঞানিকতা পর্যায়ে অতিরিক্তি ভাবে বলেছেনঃ তার নিগঢ় তাৎপর্য হল াযাকাতের বিধান করার মৌল লক্ষ্য পরীক্ষা ও যাচাই হ্ওয়া সত্ত্বে ও তার ব্যবহারিক লক্ষ্য গরীব মিসকনের সহায্য সমানুভূতি এমন ভাবে করা, যেন সেনিজে ফকরি হয়ে না যায় বরং তা করা বিপুল ধন মালের একটাকম পরিমেয় অংশ দান করার মাধ্যমে। কিন্তু যে মাল ক্রমবর্ধনশীল নয় তার ওপর যাকাত ফরয করা হলে প্রতি বছর যাকাত দেয়ার ফলে তার উল্টো ফল দেখা দেব্।সেই সাথে তার নিজের বিশেষ ব্যয়ের ব্যাপাটি ও রয়েছে। অতেএব ব্যবসায় ক্রমবৃদ্ধি ও মুনাফা লাভের উদ্দেশ্যে গড়া ব্যবসায়ে এক বছরের শর্ত করা হয়েছে বান্দ থেকে অথবা বিশেষ করে তার জন্যে আল্লাহর সৃষ্টির সাথে যেন তার৫৫৬ বাস্তবে অস্তিত্ব লাভ করার সমভবপর হয়, ক্রমবৃদ্ধি প্রাপ্ত হয় এবং লক্ষ্যের বিপরীত অবস্থা সৃষ্টর পথে প্রতিবন্ধকতা দাঁড় করানো সম্ভব হয়। [(আরবী*************)] ওপরের আলোচনা থেকে আমাদের সম্মুখে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, মূলত মূলধন থেকে যাকাত গ্রহণই লক্ষ্য ছিল না, যাকাত গ্রহণ করা হবে তার আয় ওপ্রবৃদ্ধি থেকে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে যাকাতটা আয় ও প্রবৃদ্ধি থেকে নেয়া হবে কোন কারণে…………… এজবার ইবনে কুদামাহ লিখেছেন[(আরবী*************)]ঃপ্রকৃত প্রবৃদ্ধিকে গণ্য করা হয়নি। কেননা তাত বিভিন্ন এবং তার গণনা সম্ভব। আর ও এজন্য যে, যার বাহ্যিক দিকটা গণ্য করা হয়েছে, তা প্রকৃত অবস্থার দিকে ভ্রক্ষেপ করা হয়নি ঠিক যেমন কার্য কারণের অনুপাতে কোন বিষয়ে সিন্ধান্ত গ্রহণ। [ এ কথাটি বলে ইঙ্গিত করা হয়েছে এদিকে যে, শরীয়াত তার হুকুম নির্ধরণের নির্ভর সুসংবদ্ধ বাহ্যিক গুণ পরিচিতির ওপর। ফিকাহবিদরা তার নাম দিয়েছেন কারণ্ ও নিমিত্ত (আরবী***********)হুকমটাই শরীয়াতের বিধান হ্ওয়ার আসল কারণ নয়। তার দৃষ্টান্ত যেমন ইসলাম মুসাফিরকে রমযানের রোযা ভঙ্গ করা বা রোযা না রাখার অনুমতি দিয়েছে, চার রাকআতে নামায দুই রাকাত পড়ার অনুমতি আছে। এ অনমতির যৌক্তিকতা বা কারণ কষ্ট। ব্যাপারটি যদি অনির্দিষ্ট ও অসংবদ্ধ হয় তাহলে সেদিকে ভ্রক্ষেপ করা যাবে না।শরীয়াত শুধু কষ্টের কারণটি অর্থাৎ সফরের প্রতিই লক্ষ্য রেখে এ সিদ্ধান্ত দিয়েছে।] দ্বিতীয় আলোচনা আয় ও উৎপন্নের ওপর যাকাত আধনিককালো আয় ও উৎপন্ন কে রকরক ধার্য কারণের অধিক গুরুত্ব পূর্ণ ক্ষেত্র বলে মনে করা হয়। আয় আয়ের প্রাচীনতম উৎস যখন ভুমি মালিকানা তখন এ কালে আয়ের বহু নতুন ও অভিনব দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে। এ দ্বারা সমূহ হচ্ছে কাজ বা শ্রম কিংবা মূলধন অথবা দুটোই এক সাথে। শিল্প উৎপাদনের গতি যখন সম্মুখের দিকে অগ্রসর হল এবং অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বিনিময় স্রোত তীব্র হল তখন কাজ ও মূলধনের আয় আমদানী পরিমাণ ও অনেক বৃদ্ধি পেল, বিচিত্র ধরনের হয়ে দাড়াল। ব্যবসায়ী ও শৈর্পিক তৎপরতা খব লাভবান হয়ে উঠল। শেয়ার ও সার্টিফিকেটের হস্তান্তরযোগ্য মূল্যের আয়্ও বৃদ্ধি পেল। অপরদিকে পেশার মুনাফা এবং নির্দিষ্ট বেতনের লোক ও বিভিন্ন ব্যস্ততার কর্মচারীদের বিপুল সংখ্যককে দেয় মজরী এ নির্দিষ্ট বেতন ও ব্যাপক ভাব বৃদ্ধি পেয়ে গেল। এদিক দিয়ে আধনিক রাষ্ট্রের বিশেষত্বে সৃষ্ট ব্যাপকতা ও প্রশস্ততা একদিকে এবং অপরদিকে জমির আয় বহির্ভুত বহু নতুন উৎসের আত্মপ্রকাশ দেখে রাষ্ট্র সমূহ আয় আমদানীকে রাষ্ট্রীয় ভাণ্ডারের একটা আয় সূত্র ধরে নিয়ে একালে তার ওপর অব্যাহত করা ধার্য করতে শুরু করেছে। এ কারণে অনব্যাহত কর এর তুলনামূলক গুরিুত্ব অনেখানি হ্রাস পেয়েছে। এ পর্যায়ের কর হিষেবে গুল্ক কর ও ভোগ্য কর ইত্যাদি উল্লেখ্য। এ ছাড়া ও অর্থনীতিবিদদের দৃষ্টিতে আয়কর সমূহ আধুনিক পরিস্থিতি পরিবেশে সুবিচার ও ন্যায়পরতা প্রতিষ্ঠার অতীব নিকটবর্তী ব্যবস্থারূপে গণ্য।কেননা এ কর ব্যবস্থায় জমি বহির্ভূত আয়ের অীধকারী লোকদের অংশীদারিত্ব অপরিহার্য হয়ে পড়ে। সেই সাথে সাধারণের বোঝা বহনে জমির আমদানীর মালিকরা ও শরীক থাকবে। [ ডঃ সায়াদ সাহের কৃত (আরবী*************)] আয় এর তাৎপর্য আয় বলতে বোঝায় সেই নতুন ধন সম্পদ যা কোন স্থিতিশীল পরিজ্ঞাত উৎস থেকে নিঃসৃত বা অর্জিত ও হন্তগত হয়। ক. তা হলে আয়ের একটা উৎসের প্রয়োজন। তা জমি, অস্থাবর ও নগদ প্রভতি ধরনের বস্তুগত হোক বিংবা অবস্তুগত যেমন শ্রম বা কর্মক্ষমতা (নগদ পারিশ্রমিক দিয়ে যা পরিমাণ নির্ধারণ করা সম্ভব)। আথবা এ দুইয়েল সমন্বয়ে গড়ে ওঠা উৎস অতএব আয়ের উৎস হচ্ছে হয় মূলধন, অথবা কাজ বা শ্রম কিংবা এই উভয়ই এক সাথে। আর মুলধন জমি ও অস্থাবর সম্পদ উভয়ই হতে পারে।তাই এ উভয় উৎস থেকে যা আয় হবে াত পমি সম্পদ থেকে আয় হবে যেমন, তেমনি স্থানান্তরযোগ্য সম্পদের ও আয় গণ্য হবে। কিন্তু কাজ বা শ্রমের উৎস থেকে যে আয়টা হবে তার মালিক নিজেই ব্যবহার করবে, অন্য কারোর কাছে অর্পণের সম্পর্কের সাথে জড়িত না হয়েই এবং হাতের কাজ বা বুদ্ধি খাটানোর কাজ দ্বরা সে অগ্রসর হবে। এরূপ অবস্থায় তার এ আয়টা পেশাগত কাজের আয় সে যে পেশায় অভ্যন্ত তা দিয়েই সে তা লাব করবে। সে যদি অন্য কারোর সাথে ব্যক্তি বিনিয়োগের চুক্তিতে জড়িত হয় তাহলে তখন তার এই আয়টা মসিক নির্ধারিক বেতন বা মজুরী কিংবা ভরণ পোষণের দায়িত্ব পালনমুলক হবে। তৃতীয় উৎসটি যখন মূলধন ও শ্রম উভয়ে মিশ্রিত হবে তখন তার আয়টা সাধারণ মুনাফা বলে পরিচিত হবে। [ ডঃ মুহাম্মাদ ফুয়াদ ইবরাহীম কৃত (আরবী*********) গ্রন্থের ১ম খণ্ড ৩২২পৃ.] আর এ উৎসমূহ ভিন্ন ভিন্ন হলে অর্থনীতি বিদদের মতে আয়টা উৎপন্ন, সুবধা (Benefit), মজুরী ও মুনাফা এ চারটি ভিন্ন ভিন্ন নামে অভিহিত হবে। খ. এসব উৎস সম্পর্কে মূল কথা হল, এগুলোর স্থায়িত্ব ও স্থিতি গুণে গুণান্বিত। তুলনামূলক স্থিতি স্থয়িত্বের কথাই বলা হচ্ছে। স্থিতির নিম্নতম মান হচ্ছে উৎপাদনের দিকে ফিরে যা্ওয়ার সম্ভাবনা। তবে স্থিতি ্ও স্থায়িত্বের সম্ভানার দিক দিয়ে এ উৎসমূহ পরস্পর বিভিন্ন। মূলধন এ দিকগুলোর মধ্যে কাজ বা শ্রমের তুলনায় স্থিতি লাভে অধিক বেশী ক্ষমতা শালী। [পূর্বোল্লিখিত সুত্র ]আয়ের উৎসের স্তিতির মানের এই আপেক্ষিক পার্থক্যসমূহ স্বভাবতই একই কর এর পার্থক্যপূর্ণ ক্ষেত্র রচনা করে। কাজেই আয়ের উৎসে শুধু ধন মাল হলে তাতে মুল্য বৃদ্ধি পাবে। আর তা হ্রাস প্রাপ্ত হবে যখন উৎস হবে শুধু কাজ বা শ্রম। অপরদিকে মূলধন এবং কাজ উভয়ই উৎস হলেবোঝা টা মাঝামাঝি ধরনের হবে। তবে মূলধনের প্রকার অনুপাতে কর মূল্য পার্থক্য পূর্ণ এ হতে পারে তখন কৃষি জমির আয়েল ওপর ধার্যকর এর মূল্য উচ্চতর হতে পারে প্রতিষ্ঠানের আয়ের ওপ ধার্য কর এর তুলনায়। কেননা প্রতিষ্ঠান তো কিছু কালের পর ধ্বংস ও বিলীত হয়ে যেতে পার……… এমনিই চলবে। [(আরবী*************)] ইসলামী শরযিাতে আয়ের যাকাত ইসলাম যেমন পশু সম্পদ, ব্যবসায় ও নগদ প্রভৃতি মূলধনের ওপর যাকাত ধার্য করেছে, তেমনি যাকাত ধার্য করেছে আয় আমদানীর ওপর ও। তার উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত হচ্ছে, ইসলাম কৃষি উৎপাদনের আয়ের ্ওপর ধার্য করেছে ফল ও ফসলের যাকাত

অর্থাৎ তাতেত ওশর ও অর্ধ ওশর ধার্য হয়েছে। এ পার্থক্যটা জমি সেচের পার্থক্যের দরুন হয তা স্বাভাবিক ভাবে হয়, না হয় সেজন্যে সেচ ব্যবস্থা করতে হয় পয়সা ও শ্রম লাগিয়ে এ কারণে। ইসলাম এখানে আমদেরকে এমন একটা মৌলনীতি দিয়েছে কর সংক্রান্ত আইন প্রণয়নে যার একটা বিশেষ গুরত্ব রয়েছে। আর হচ্ছে ব্যয় করা শ্রম বা কষ্ট অনুযায়ী ধার্য দেয়কে বিভিন্ন প্রকারে বিভক্ত করা। ফলে যেখানেই কষ্টের মাত্রা কম সেখানিই করা এ হার উচ্চ হবে। পক্ষান্তরে যেখানে কষ্টের মাত্র বেশী হবে, যেখানে এ হার কম হয়ে যাবে। এই প্রেক্ষাপটে বুঝতে হবে মাটির তলায় প্রোথিত ধন সম্পদ যা যখন পা্ওয় যাবে তার এক পঞ্চামাংশ ২০% দেয় ধার্য করার মাহত্ম্য এবং আকাশ বা খালের পানিতে সেচ করা ক্ষেত বা বাগানের ফসল ও ফলে ধার্য হয়েছে পাঁচ ভাগের এক ভাগের অর্ধেক অর্থাৎ এক দশমাংশ আর বিশেষ সেচ ব্যবস্থার সাহায্যে সেচ করা জমির ফসলে ফলে অর্ধ ওশর ৫% এবং কঠিন শ্রম ও কাজের ফলে অর্জিত যেমন ব্যবসায় করে পা্ওয়া নগদ সম্পদ একদর্মাশের এক চতুর্থাংশ অর্থাৎ ২.৫% ধার্য করা হয়েছে এ সাবের যথার্থতা ও। এ সিদ্ধান্তে্র ভিত্তিতে কোন কোন ফিকাহবিদ এ মত গ্রহণ করেছেন যে, খনিজ সম্পদে দেয ধার্য এক পঞ্চামাংশ থেকে শুরু করে একদমাংশের এক চতুর্থাংশ পর্যন্ত বিভিন্ন হারে হতে পারে কষ্ট ও শ্রম অনুপাতে, যেমন যথাস্থানে বিস্তারিত বলা হয়েছে। [এ গ্রন্থের তৃতীয় অধ্যায়ের সপ্তম পরিচ্ছেদ দ্রষ্টব্য।] ইসলামে আয়ের যাকাত কয়েক প্রকারের। তন্মধ্যে একটি হচ্ছে বহু সংখ্যক বিকাহ পারদর্শী ইমামের মতে মধুর যাকাত পরিমাণ ওমর এক দশমাংশ। এ মাতকেই আমরা অগ্রাধিাকর দিয়েছি।এর ওপরই আমরা জান্তব উৎপাদনকে ও কিয়াস করেছি। খনিজ সম্পদের উৎপাদন থেখে প্রাপ্ত আয়ের যাকাত ও বিভিন্ন পরিমাণের হবে।সামুদ্রিক সম্পদের মুক্তা আম্বর ও মৎস্য ইত্যাদি থেকে ও অনুরূপ হারে যাকাত দিতে হবে।বহু প্রাচীন কালীন ফিকাহবিদ এমত দিয়েছেন।আমরা ও এ মাতকে পছন্দ করেছি এ সমর্থন ও দিয়েছি। যেসব জমি চাষকারীকে নির্দিষ্ট নগদ অথের বিনিময়ে ভাড়া দেয়া হয় সে ভাড়া থেকে লব্ধ আয়ের যাকাত ও এই হারে দিতে হবে, মালিক দেবে ভাড়ার যাকাত আর চাষী দেবে জমি থেকে লব্ধ ফল ও ফসলের যাকাত ওশর কিংসা অর্ধ ওশর। মালিকানা ভুক্ত দালান কোঠা গাড়ী যানবাহন এ ধানের যে সব জিনিস ভাড়া দেয়া হয় এবং যা থেকে আবর্তন শীলাভাবে মালিক ভাড়া পেতে থাকে, সে বাবদ প্রচণ্ড আয়ের যাকাত ও অনুরূপেই হবে। কোন কোন আলিম তাই বলেছেন, আমরা ও যথাস্থানে এ মতকে অগাধিকার দিয়েছি। শ্রম বা কাজ ও সাধীন পেশা থেকে উপার্জিত আয়ের যাকাত ও এমনি হবে। মাসিক তারে প্রাপ্ত বেতন,মজুরী ও লালন পালন এবং বিভিন্ন পেশা ও কায়কারবের মালিক যা কিছু উপার্জন ও আয় করে সেই অর্জিত সম্পদ ও এ পর্যায়ে গণ্য। এ সব ক্ষেত্রে যথাযথ শর্তানুযায়ী যাকাত ধার্য হবে যেমন আমরা পূ্র্বে অগ্রাধিকার দিয়েছি ও বিশ্লেষণ করেছি। তৃতীয় আলোচনা ব্যক্তিদের ওপর ধার্য যাকাত ব্যক্তিদের ওপর ধার্য কর আমরা উল্লেখ করে এসেছি যে কর ব্যবস্থা পারদর্শিগণ ক্ষেত্রের পার্থক্য বিসেবে করকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করেছেনঃ মূলদনের ওপর কর আয় আমদানীর ওপর কর এবং ব্যক্তিদের ওপর কর। যাকাত হচ্ছে মূলধনের ওপর কর সে বিষয়ে এবং আয় আমদানীর ওপর কর সম্পর্কে আমরা আলোচনা করেছি। ব্যক্তিগণের ওপর কর পর্যায়ের যে যাকাত সে সম্পর্কিত আলোচনা এখন ও অবশিষ্ট বা বাকী রয়ে গেছে। ব্যক্তিগণের কর সরাসরি মালদরের ওপর বর্তে এ হিসেবে যে, সে কর ধার্য হ্ওয়ার একটা উপযুক্ত ক্ষেত্র। তাতে তার ব্যক্তিগত অবস্থা বিচার্য নয় সেধনী কি গরীর। এ কর মাথাপিছু কর নামে পরিচিত। কেননা তা মাথা পিছু হিসেবে প্রত্যেক ব্যাক্তির কাছ থেকেই গ্রহণ করা হবে অর্থাৎ কোন ব্যক্তিই তা থেকে বাদ যাবে না। মাথা পিছু এর ধার্য করণের ওপর রাষ্ট্র নির্ভর শীল হয়ে থাকে। কেননা তা পুরুষ, মেয়েলোক ও শিশু সকলের ওপর সমানভাবে পড়ে। অথবা যাদের মধ্যে বিশেষ শর্ত বিপুলভাবে পা্ওয়া যায় সে সব লোকের ওপর ধার্য হয়। এ বিশেষ শর্ত হতে পারে রাজনৈতিক যোগ্যতার শর্ত অথবা তা সংখ্যালঘুর ওপর কিংবা আশেপাশের লোকদের ওপর ধার্য ওয়ার নির্দিষ্ট কর। বিশেষত্র ও দোষ ক্রটি এ কর এর বিশেষত্ব বা সুবিধা হচ্ছে করা ধার্য করার উপকরণ নির্ধারণ করায় অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানকে এরূপ ক্ষেত্রে বিশেষ কোন কষ্ট স্বীকার করতে হয় না। সকলকে কর ধার্যর ক্ষেত্ররূপে নির্ধারণ নিরংকুশ সাধারণ নিয়মের সাথে সঙ্গতি রক্ষা করে যাতে লব্ধ সম্পদ বিপুল হয় তার কোন প্রয়োজনদেখা দেয় না। তবে তার ্ওপর এ কথা ধরে নিতে হবে যে, তা কর বহন ও তা আদায় করার শক্তি, সামর্থের পরিপন্হী হবে যদি সমস্ত মালদার শ্রেণীর লোকদের থেকে একটি পরিমাণ গ্রহণকরা হয়। কেননা তাদের আয় ও সম্পদ একই পরিমাণের নয়। এ কারণে আধুনিক কালের রাষ্ট্র ব্যক্তিগণের ওপর কর ধার্যকরণ নীতি প্রত্যাহার করেছে। তার পরিবর্তে ধন মালের ওপর কর ধার্য করণের প্রতি অধিক গুরত্ব আরোপকরেছে; কিন্তু তা সত্ত্বে ও এখন পর্যন্ত কোন কোন আধুনিক রাষ্ট্র এ প্রকারের কর আরোপের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে তখন তার উদ্দেশ্য হয় সামজিক সামিষ্টিকতার চেতন তীব্র করে তোলার উদ্দেশ্যে যেন তারা সকলেই এ চেতনা লাভ করতে পারে যে, তারা সকলেই সামষ্টিক বোঝা বহনে অংশীদার রয়েছে। আরা তার পরিণতিতে রাজনৈতিক অবস্থা ও কার্যকলাপের গুরুত্ব এবং তারা বহু বিদেশে ছড়িয়ে থাকলে দেশী হ্ওয়ার চেতনা জাগানেরর লক্ষ্যে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ। লক্ষ্যণীয়, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের অনেক কয়টি অঙ্গরাজ্যের প্রায়ই মাথাপিছু কর ধার্য করা হয়ে থাকে যদি তা লব্ধ সম্পদ বিশেষ কাজে নির্দিষ্ট করা হয়।হয় তা দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় ব্যব করার জন্যে অথবা সামজিক সাহা্য্য কাজের অগ্রতি সাধনের লক্ষ্যে কিংবা রাস্তা ঘাটের অবস্থা উন্নয়নের জন্যে ধার্য করা হয়। ফ্রান্সে ও এ মাথাপিছু কর অব্যাহত নিয়মে ধার্য হয়ে তাকে। যেমন স্থানীয় কর; আর মালদার মাত্রের ওপর কর। শর্ত এরূপ থাকে যে, বছরের তিনটি দিন রা্স্তা নির্মাণ বা সমানকরণ সংরক্ষণের জন্যে প্রত্যেক ব্যক্তিকে করতে হবে। [ডঃ মুহাম্মাদ ফুয়াদ ইবরাহীম কৃত (আরবী**********) ১ম খণ্ড ৩০৫-৩০৭ পৃ. মাথাপিছু কর শীর্ষক আলোচনা।] ফিতরার যাকতে ব্যক্তিগণের কর এর মতই সুবিধা ইসলাম যে ফিতরার যাকাত ধার্য করেছে তার ওপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করা হলে দেখা যাবে প্রতি বছর ফরয রোযা থেকে অবসর গ্রহণ এবং ঈদের আগমন কালে একবার করে এ যাকাত দিতে হয়। এ যাকাত ব্যক্তিদের মাথাপিছু ধার্য করা একপ্রকারের কর বিশেষ। এর সুবিধা এবং বিশেষত্ব হচ্ছে তা ধার্য করা যেমন সহজ তেমিন আদায় করা ওঝঞ্ঝাটমুক্ত। আর তা সকল মুসলমান পরিব্যাপ্ত অথচ এ ধানের কর এর ব্যাপারে সাধারণত যেসব শ্রম ও অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়, এ ফিতরার যাকাতে তার আদৌ কোন আশংকা নেই। কেননা তার পরিমাণটা খুবই হাল্কা। প্রত্যেক ব্যক্তির পক্ষেই মনের খুশীতে তা দিয়ে দিয়া ও খুবই সহজ। বিশেষ করে তা একটা ফরয ইবাদতের সাথে যুক্ত বলে তা মর্যদা অনেক বেশী।তাতে একটা পবিত্রতার তাৎপর্য নিহিত। সেই সাথে আধ্যত্মিক ও নৈতিক লক্ষ্য ও তা সাথে জড়িত। তবে কেউ যদি তা আদৌ দিতে না পারে তা হলে সমস্ত সুসলমানের সর্বসম্মত মতে সে ক্ষমা ও নিষ্কৃতি পা্ওয়ার যোগ্য। ইসলামী শরীয়াত এ যাকাত বার্ষিক হিসেবে প্রত্যেকটি মুসলিমের ওপর ধার্য করেছে পুরুষ স্ত্রী বা অর্প বয়স্ক বেশী বয়স্ক নির্বিশেষে। এর মূলে একটা বড় লক্ষ্য হচ্ছে, মুসলিম ব্যক্তি সচ্চলতা ও দারিদ্র্য উভয় অবস্থায়ই দরিদ্র জনের জন্যে অর্থ ব্যয় করতে ও ত্যাগ স্বীকারা করতে অভ্যস্ত হোক। তা হলে যেমন সুখ স্বাচ্ছন্দ্যকালে মানুষের জন্যে অর্থ ব্যয় করবে, তেমনি করবে অভাব অনটনকালে ও। প্রত্যেকে অপর সকলের ও প্রত্যেকের জন্যে চিন্তা ভাবনা করতে, অভাবগ্রস্ত ও দারিদ্র্যপীড়িত লোকদের জন্যে স্বীয় দায়িত্বের অনুভূতি রাখতে অভ্যস্ত হবে। বিশষ করে ঈদ ও ফরয রোযা পালন সমাপ্তিকালীন আনন্দ উৎসবকালে তাদে কথা বেশী করে স্মরণ করবে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য কোন লোক নিজে ও যদি ফিতরা পা্ওয়ার যোগ্য হয়, তা ও ফিতরা দেয়ার পথে ইসলামকোন প্রতিবন্ধকতা দেখতে পায় না হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে। (আরবী**********) তোমাদের মধ্যে যারা ধনীলোক, আল্লাহ তাআলা তাদের তাযকীরা পবিত্র পরিশুদ্ধ করবেন ফিতরা দেয়ার দরুন। আর যারা দরিদ্র তারা যা দিল, আল্লাহর তা আলা তার চাইতে ও বেশী তাদের ফিরিয়ে দেবেন। [ফিতরার যাকাত আলোচনায় এ হাদীসটি উদ্ধৃত হয়েছে।] দুনিয়ার মুসলিম এ ফিতরা আদায় করতে খুব বেশী আগ্রহী লক্ষ্য করা যায়। রোযা পালনে বেহুদা কথা কাজ এবং গর্হিত আচার আচারণ বা ক্রটি বিচ্যুতি যা ঘটেছে, এ ফিতরা দিয়ে তার ক্ষতি পূরণ করাই সকলের লক্ষ্য। যদি ও তাদের অনেকেই তাদের ধন মালের যাকাত দিতে খুবই অমনোযোগী পাওয়া যায়(যা একন্তই অবঞ্চনীয়)। চতুর্থ পরিচ্ছেদ কর ও যাকাতের মধ্যে সুবচারের ভুমিকা কর একটা বাধ্যতামূলক ধার্যকৃত ব্যবস্থা। যার ওপর তা ধার্য হবে সে স্বতঃস্ফুর্তভাবে তা দেতে প্রস্তুত না হলে, জোনপূর্বকই তা তার কাছে থেকে আদায় করে নেয়া হবে। এ প্রেক্ষিতে আধুনিক কালের বহু অর্থনীতিবিদ ও করবিশারদ এআহবান জানিয়েছেন যে এ কর কোনরূপ জোর জবরদস্তি রুঢ় ব্যবহার ঃছাড়াই তা আদায় করার কতগুলো নিয়ম ও কায়দা অবলম্বন করতে হবে এবং কর সংক্রান্ত আইন কানুন এমন ভাবে পুনর্গঠিত করতে হবে যেন তা ধার্যকরণ ব্যাপারটি সুবিচার নীতির সাথে পুরাপুরি সংগতিপূর্ণ হয়। যেমন, তা আদায় করার কাজটা একটা অনূকূল সময়ে সম্পন্ন করতে হবে, যাতে করে করদাতা কোন ভাবেই নির্যাতিত হবে না এসব হচ্ছে, সেই মৌলনীতি একদিক দিয়ে কর নির্ধারণে বিধায়কের কর্ত্যেরূপে নির্দিষ্ট করতে হবে কর সংক্রান্ত আিইন প্রণয়নকালে এবং অপর দিক দিয়ে অর্থনেতিক প্রতিষ্ঠানের ওপর দায়িত্ব অর্পণ করে তা দিকে দিকে এ সব মৌলনীতির প্রতি লক্ষ্য রেখে কাজ ক রতে হবে, তা যখনই কর ও তা আদায় করার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের ইচ্ছা করবে। প্রখ্যাত অর্থনৈতিক দার্শনিক আদমস্মীথ, ফাজিঞ্জস এবং সিসামুন্ডী উপস্থাপিত উপরিউক্ত মৌলনীতসমুহের তাৎপর্য অনুধাবনে যে লোকই আত্মানিয়োগ করবে, সে ই জানতে পারবে যে, তা হচ্ছে চারটিঃন্যায়পরতা দৃঢ় প্রত্যয়, আনুকূল্য এবং মধ্যম নীতি অবলম্বন। এ চারচি মৌলনীতি প্রধানত আদম স্মীথের উদ্ভাবিত বলে জানা যায়। এ মৌল ভিত্তি, নীতি, নিয়মসমূহ হচ্ছে অর্থনীতির সংবিধান,যা পালন করা একান্তই কর্তব্য। এর কোন একটির ও বিরোধিতা অর্থনীতির সংবিধান,যা পালন করা একান্তই কর্তব্য।এর কোন একটির ও বিরোধিতা অর্থনীতিতে বাঞ্ছনীয় নয় বিশেষ করে আইন প্রণয়নকারী ব্যক্তিদের এবং অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালকদের পক্ষে। [ দেখুনঃডঃ মুহাম্মদ ফয়াদ ইবরাহীম কৃত গ্রন্হ (আরবী******)১ম খণ্ড, ২৬২-২৬৩ পৃ.] সত্যি কথা হচ্ছে যাকাত ফরযকরণে ইসলাম এ মৌলনীতি সমূহের প্রতি সর্বাগ্রে ও পূর্ণমাত্রা লক্ষ্য রেখেছে। রেখেছে এমন সময়, যখন আদম স্মীথ দুনিয়ায় আত্মপ্রকাশ করেননি বরং তাঁর ও প্রায় এক হাজার বছর পূর্বে। পরবর্তী আলোচনা পর্যায়সমূহে আমরা তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা পেশ করব। প্রথম আলোচনা সুবিচার ও ন্যায়পরতা ক্ষেত্রে লোকদের ওপর কর ধার্যকালে যে প্রথম মৌলনীতি অনুসরণ ও পূর্ণমাত্রায় সংক্ষরণ একান্তই অপরিহার্য, তা হচ্ছে সুবিচার ও ন্যায়পরতা। আর আদম স্মীথ[ইংরেজী অর্থনৈতিক দার্শনিক। অষ্টাদশ শতকের বড় অর্থনীতি মনীষী। তাঁর গ্রন্থের নাম(আরবী**********) জাতীয় সম্পদ। তিনি ক্লাসিক্যাল বা স্বাদীন অর্থনীতির আর্দিপিতা নামে খ্যাত।] এ মৌলনীতির ব্যাখ্যা করে বলেছেনঃ সরকারী ব্যয় বহনে রাষ্ট্রের প্রজা সাধারণের অংশীদারিত্ব একান্তই আবশ্যক। প্রত্যেককেই দিতে হবে তার শক্তিসামর্থ্যের সম্ভাব্যতা অনুপাতে অর্থাৎ রাষ্ট্রের সাহায্য সহযোগিতায় যে যতটা আয় ভোগ করে সে অনুপাতে। [দেখুনঃ ডঃ আহমাদ সাব উয়াইজাহ উপস্থাপিত(আরবী**********) শীর্ষক সেমিনার রচনা।] উপরিইক্ত মৌলনীতি সাধারণ ভাবে ইসলামী শরীয়াতের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। আর বিশেষভাবে সঙ্গতিপূর্ণ যাকাত কর ধার্যকরণের সাথে। কেননা ইসলামের যাবতীয় ব্যাপার সুবচার ও ন্যায়পরতা একান্তভাবে কাম্য। তা মহান আল্লাহ তা আলার অসংখ্য গুণাবলীর মধ্যকার একটি বিশেষ গুণ ও।তাঁর বহ পবিত্র নামের মধ্যকার একটি নাম ও তাই। আল্লাহর সৃষ্টি এ আসমান জমিন এ ন্যায়পরতা ওসুবচারের ওপরই প্রতিষ্ঠিত।নবী রাসূলগণ এ আদর্শসহ প্রেরিত, আসমানী গ্রন্হসমূহ এ আদর্শের বাহন বিসেবে অবতীর্ণ।কুরআন মজীদ এ কথা অতীব সুস্পষ্ট ভায়ায় ঘোষণা করেছেঃ (আরবী**********) নিংসন্দেহে আমরা আমাদের সাসূলগণকে পাঠিয়ে অকাট্য সুস্পষ্ট যুক্তি প্রমাণ সহকারে। এবং তাঁদের সাথে নাযিল করেছি আল কিতাব ও মানদণ্ড, যেন লোকেরা সুবচার সহকারে বসবাস করতে পারে। [(আরবী**********)] এ সুবিচারই কাম্য ওকাঙ্ক্ষিত। ইসলামে এ সুবচার নীতির গুরুত্ব যে কতখানি তা উপরিউক্ত ঘোষণায়ই সুস্পষ্ট। এ নীতিকে যাকাতের ক্ষেত্রে সন্ধান করা হলে আমরা তা এখানে পূর্ণমাত্রায় স্পষ্টরূপে বিরাজিত দেখতে পাব। ইসলামের বহু আইন বিধানেই তা লক্ষ্যণীয়। প্রথমঃ যাকাত ফরয হ্ওয়ায় সমতা ও সম্য যাকাত প্রত্যেক ধনশালী মুসলিমের ওপরই পরয হিসেবে ধার্য, তার জাতিত্ব, গায়োর বর্ণ, বংশ তালিকা বা সামাজিক শ্রেণী মর্যাদা যা ই হোক না কেন। নারী পুরুষ, সাদা কালো অভিজাত উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন,দুর্বল-নিম্নবংশ,শাসক প্রজা সাধারণ, রাজা দাস ণফল ধার্মিক মানুষ আর দুনিয়াদার মানুষ যা িই হোক। এ অকাট্য শরীয়াতী ফরয পালনে সকলে সমান ভাবে বাধ্য। কিন্তু পাশ্চাত্য জগতের প্রাচীনকালীন আইন প্রণয়নে এ নিরংকুশ সমতা ও সাম্য সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। তথায় ধার্মিক ও সাদচারী লোকেরা করা অব্যাহতি পেয়ে আসছে সব সময়। কেননা যেমন বলা হয়েছে তারা তাদের রক্ত ও নামায সমূহ উপস্থিত করছে। [ডঃ সাবিত উয়াইজা রচিত ইসলাম ও কর সম্পর্কিত সেমিনার রচনা। (সে কারণে তাদের ওপর কর ধার্য করা হয় না)] ইবনে হাজম বলেছেনঃ যাকাত ফরয় পুরুষ ও মহিলা, অপ্রাপ্ত রয়স্ক, পূর্ণ বয়স্ক, সুস্থ বিবেক বুদ্ধিসম্পন্ন ্ও পাগল নির্বিশেষে সকল মুসলিমের ওপর। আল্লাহ তা আলা বলেছেন ঃতাদের ধন মাল থেকে যাকাত গ্রহণকর, তুমি তদের পবিত্র করা ও তাদের পরিশুদ্ধ কর তদ্দারা। এনির্দেশ ছোট বড়, সুস্থ বিবেকসম্পন্ন ও পাগল সকলের প্রতিই প্রয়োজ্য। কেননা তারা সকলেই আলাহর পবিত্রকরণের মুখাপেক্ষী। পরিশুদ্ধতা লাভ তাদের সকলের জন্যেই অপরিহার্য। এরা সকলেই ঈমানদার লোক। রাসূলে করীম (স) হযরত ময়ায (রা) কে বলেছিলেনঃ তুমি তাদের জানিয়ে দা্ও যে, আল্লাহ তা আলা তাদের ওপর যাকাত ফরয করেছেন, যা তাদের ধনীদের কাছ থেকে গ্রহণ করা হবে এবং তাদের দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করা হবে। এ কথা ও বির্বিশেষে সব মুসলমান ধনী লোকদের ওপর প্রযোজ্য। [(আরবী**********)] দ্বিতীয়ঃনিসাবের কম পরিমাণ ধন মাল বাদ যাবে যাকাত ধার্যকরণে ইসলামের সুবিচার নীতি হচ্ছে,স্বল্প পরিমাণের ধন মালকে তা থেকেঅব্যাহতি দেয়া হয়েছে। যাকাত ফরয করা হয়েছে কেবলমাত্র পূর্ণ ;নিসাব পরিমাণ ধন মালের ওপর। তার ক করণ হচ্ছে, লোকদের পক্ষে কষ্ট না হয় এমন অতিরিক্ত ধন মাল থেকে যাকাত গ্রহণ। মানব প্রকৃতির ওপর দঃসহচাপ প্রয়োগ শরীযাতের লক্ষ্য নয়্ এ কারণে আল্লাহ তা আলা তাঁর রাসূল (স) কে নির্দেশ দেয়েছেনঃ (আরবী********) অতিরিক্ত ধন মাল (থেকে যাকাত) গ্রহণকর। [অনেক (আরবী*********) এর তাফসীর করেছেন যাকাত। কেননা তা বিপুল ধান মাল থেকে খুব সমান্য নেয়া হয়।] এবং লোকদের নির্দেশ দাও প্রচালিত ও সর্বজন পরিচিত ভাল কাজ করার। [(আরবী********) ] আল্লাহ তা আলা আরও বলেছেনঃ(আরবী**********) লোকেরা তোমাকে জিজ্ঞেস করে তারা কি ব্যয় করবে। হে নবী! তুমি বলঃ প্রয়োজননাতিরিক্ত পরিমাণ। [(আরবী********) ] হযরত ইবনে আব্বাস (রা) থেকে (আরবী**********) এর তাপসীর বর্ণিত হয়েছেঃ ধনাঢ্যতার অতিরিক্ত পরিমাণ। তৃতীয়ঃ জোড়া যাকাত নিষিদ্ধ ন্যায়পরতা ও সুবচারের নীতি বড় প্রকাশমান বস্তবায়ন হচ্ছে রাসূলে করীম(স) ঘোষিত সে বিধান, যাতে তিনি বলেছেনঃ যাকাত ধার্যকরণে দ্বৈততা নেই। [আবূ উবাইদের উদ্ধুতি(আরবী**********)] এ কথার অর্থ বিসেবে আবূ উবাইদ বলেছেনঃ এক বছরের দু বার যাকাত নেয়া হবে না। [(আরবী**********)] ইবনে কুদামাহ প্রমুখ এ হাদীসের ওপর ভিত্তি করে ঘোষণা করেছেনেঃ একই কারণে ও একই বছর দুই যাকাত ধার্য করা জায়েয নয়। [(আরবী**********) ] আধুনিক কালে কর ও নব্য অর্থব্যবস্থা অধ্যয়নে এ কথাটি জোড়া নিষিদ্ধ নানে পরিচিত। নবী করীম (স) এর উপরিউক্ত আইনটির কারণে ইসলামের ফিকাবিদগণ তাঁদের দৃষ্টি যাবতীয় আইন বিধানে মৌলনীতি এ কারণ নির্ধারণে পুরোপুরি নিবদ্ধ রেখেছেন।এটা এমন একটা অগ্রবর্তিতা, যার দৃষ্টান্ত বিরল। নিম্মে কয়েকটি উল্লেখ করা যাচ্ছেঃ ক. ইমাম আবূ হানীফা;বলেছেনেঃ ধন মালের মালিক উট, গরু বা ছাগল যার যাকাত দেয়া হয়েছে নগত সম্পদের নিসাব পরিমাণের সাথে মিলিয়ে গণনা করবে না।তার কারণ এই বলা হয়েছেঃ মিলানো হলে যাকাতে দ্বৈততা দেখা দেবে। একই বছরে একই ধন মালের মালিকের ওপর দুবার যাকাত ধার্যকরণই এবং হাদীস দ্বারা তা নিষিদ্ধ হয়েছে। [(আরবী*********) ] খ. যে লোক তা নগদ সম্পদের যাকাত দিয়ে দিল, পরে সে তা দিয়ে একটা উট কিংবা অন্য কোন গবাদি পশু ক্রয় করল অথচ যাকাত দিয়ে দেয়া নগদ অর্থ দ্বারা যে ধরনের গবাদি পশু সে ক্রয় করল, অনুরূপ গবাদি পশু তার কাছে আগে থেকেই বর্তমান রয়েছে তখন তার সাথে এই শেষে ক্রয় করাটাকে মেলাবে না তার যাকাত আবার দেবে না যখন বছরান্তে সমস্ত গবাদি পশুর যাকাত দেয়া হবে। কেননা সেটিতো সেই নগদ সম্পদেরা বিকল্প, যার যাকাত ইতিপূর্বেই দিয়ে দেয়া হয়েছে। অতএব সেই বছরই সেটির যাকাত পুনরায় দিতে হবে না। [ ঐ ;এবং দেখুনঃ (আরবী *******) ] গ.ব্যবসায়ের লক্ষ্যে নিসাব সংখ্যক গবাদি পশু উট গরু ছাগল ইত্যাদি ক্রয় করা হলে ইমাম আবূ হানীফা ও সওরী ও আহমদের মতে তার ব্যবসায়ী যাকাত দিতে হবে।আর মালিক ও শাফেয়ীর নতুন মত হচ্ছে, তার যাকাত দিতে হবে গবাদি পশুর যাকাত, তার কারণ হিসেবে বলেছেন, তার গবাদি পশু গণ্য হ্ওয়াই অধিক শক্তিশালী কথা। এ মতের ইজমা অনুষ্ঠিত হয়েছে, তা প্রত্যক্ষ হ্ওয়ার বিশেষত্বের অধিকারী ও। অতএব তাই উত্তম। প্রথমোক্ত মতের লোকেরা যুক্তি দেখিয়েছেন যে, ব্যবসায়ী যাকাত দেয়া হলে মিসকীনরা বেশী পরিমাণ পেতে পারবে। কেননা তা ফরয হয় সেই মালে, যা হসেবে অনেক বেশী। [(আরবী *******)] উপরিউক্ত দুটি মতের প্রেক্ষিতে আমার মনে হচ্ছে,তারা সকলেই একমত হয়েছেন এ কথায় যে, যাকাত কেবলমাত্র একটি দিকের বিচারেই ফরয হয়ে থাকে। হয় ব্যবসায়েল দৃষ্টিতে না হয় কাজের জন্যে ঘরে স্বাধীন মুক্ত ভাবে পালিত গবাদি পশু হ্ওয়ার কারণে। এখন আলাদা আলাদা উভয় দিকের বিবেচনা করা হলে একই নিসাবের দুটি যাকাত ধার্য হতে হয় অবশ্যম্ভাবীরূপে।কিন্তু তা জয়েয নয়। কেননা তা পূর্বোদ্ধৃত হাদীসের পরিপন্হী। ঘ. উট ও গরু সম্পর্কে ফিকাহবিদগণ যা বলেছেন, তা্ও এ পর্যায়ে গণ্য। এ পশু চাষাবাদ, পানি উত্তোলন ও কৃষি কাজে নিযুক্ত থাকে। এ কারণে জমহুর ফিকাহবিদগণ তার ওপর যাকাত ধার্য ন হ্ওয়ায় মত প্রকাশ করেছেন। তার কারণ প্রদর্শন সম্পর্কে তাঁরা বলেছেনঃ গমে তো যাকাত ধার্য হয়। আর গম গরুথেকেই। [(আরবী *******)] আবূ উবাইদ এ অর্থটির ওপর তাগিদ জানিয়ে বলেছেনঃ গরু যখন চাষবাদের কাজ করে, পানি উত্তোলন করে বা টানে, তখন যে দানার ওপর যাকাত ধার্য হয়, তা তো সেই গরুর চাষ, পানি উত্তোলন ও মলনেরই ফসল। এখন ফসলের সাথে সাথে সাথে যুদি গরুর ওপর ও যাকাত ধার্য হয় তাহলে লোকদের ওপর দ্বিগুণ বা দ্বৈত যাকাত ধার্য করা হবে। [(আরবী *******)] ঙ. সুবিচার নীতি প্রয়োগ ও দ্বৈত যাকাত ধার্য নাকরা মতের হানীফা বিকাহবিদগণ বলেছেনঃ খারজী জমি (যার গোটা খণ্ডের ওপর বার্ষিক সুনির্দিষ্ট কর ধার্য হয়) থেকে ওশর নেয়া হবে না। এভাবেই একই জমির ওপর ওশর ও কারাজ উভয়ই একত্রে ধার্য হওয়া থেকে রক্ষা পা্ওয়াযেতে পারে। সেমন একই মালে ব্যবসায় যাকাত ও গবাদি পশুর যাকাত একত্রিত হতে পারে না। [(আরবী *******)] চ. উক্ত মৌলনীতির আর ও প্রয়োগ এভাবে হয়েছে যে, জমহুর ফিকাহবিদগণ শর্ত করেছেন, নিসাব পরিমাণ সম্পদ ঋণমুক্ত হলে তবেই তার ওপর বান্দ হিসেবে দাবি দা্ওয়অ চাপানো যায়।কেননা যে মাল ঋণ বাবদ দেয় তা না থাকার সমতুল্য। ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি ঋণ শোধ করে দিলে তার পর তা নিসাবের পরিমাণ সম্পদের মালিকত্ব অবশিষ্ট না থাকলে সেধনী ব্যক্তি গণ্য হবে না বরং তখন সে অভাবগ্রন্ত গণ্য হবে। এতে প্রকাশমান ও অপ্রকাশমান ধন মাল অভিন্ন হবে যেমন আগেই অগ্রাধিকার পেয়েছে। ঋলগ্রন্ত ব্যক্তি ঋণেল কারণ যাকাত থেকে অব্যাহতি পাওয়অর কারণ প্রদর্শনস্বরূপ কোন কোন ফিকাহবিদ যা বলেছেন, তা অবশ্যই স্মরণীয়। কেই বলেছেন, ঋণদাতা তার উপর চেপে;বসে বলে ঋণগ্রস্থের মালিকত্ব দুর্বল হয়ে পড়ে। আবার কেউ বলেছেন, ঋণের টাকা ফেল পা্ওয়ার অধিকারী লোককে বাধ্যতামূলকভাবে যাকা দিতে হবে। এরূপ অবস্থায় ঋণগ্রস্তের উপর ও যাকাত ফরয করা হলে একই মালে দুবার যাকাত ধার্য হয়ে পড়ে। আর হাদীস তা নিষেধ করেছে। এ থেকে বোঝা যায় যে, কোন অবস্থায়ই দ্বৈত যাকাত ধার্য হতে পারে না। চতুর্থঃ কষ্টের পার্থক্যের দরুন যাকাত পারিমাণে পার্থক্য ইসলামের সুবচারমূলক অবদান এ ও যে, সম্পদ উৎপাদনে মানুষের নিয়োজিত কষ্টের পরিমাণ বা মাত্রায় পার্থক্যের দরুন যাকাতের ধার্য পরিমাণেও পার্থক্য করা হয়। তবে উজ্জ্বলতম দৃষ্টিান্ত হচ্ছে,যে জমি স্বতন্ত্র সেচ ব্যবস্থা ছাড়াই ফল ও ফসল দেয়, তাতে ওশর ধার্য হয় এবং জমিতে স্বতন্ত্রভাবে অর্থ ও শ্রম ব্যয় করে সেচ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয় ফসল ফলানোর জন্যে তাতে অর্ধ ওশর ধার্য হয়। যেমন এক-পঞ্চমাংশ ধার্য হয় মানুষ যে সব গচ্ছিত ও খনিজ সম্পদ লাভ করে শ্রম ছাড়াই তাতে। কেননা তাতে নিয়োজিত শ্রম ও কষ্ট সে সম্পদের তুলনায় কম যা দিয়ে তা হাসিল করা হয়। বস্তুতঃইসলামী শরীয়াত ছাড়া এ মৌল ন্যায় পতাপূর্ণ নীতির প্রতি আর কেউই ভ্রক্ষেপ মাত্র করেনি। অথচ আমাদের জ্ঞানমতে তা অবশ্য রক্ষণীয় ও লক্ষ্যণীয় একটা গুরুর্বপূর্ণ বিষয়। সাধারণত অর্থনীতিবিশরিদ ব্যক্তিবর্গের অবশ্য কর্তব্য সেদিকে নজর দেয়া, তা দিয়ে উপকৃত হ্ওয়া। কিন্তু তারা তা রক্ষা বা প্রয়োগ করেছেন আয়ের ওপর কর ধার্য করণে কেবল তার উৎসের প্রতি ;কিন্তু তাতে যে কষ্ট ও চেষ্টা নিয়োজিত হয়, তার প্রতি একবিন্দু গুরুত্ব দেয়া হয়নি। তার পার্থক্যকে ও যথাযথ মূল্য দেয়া হয়নি। পঞ্চামৎকরদাতার ব্যক্তিগত অবস্থার প্রতি লক্ষ্য দান যাকাত অন্যান্য সব দিকক দিয়ে ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার জন্যে কাজ করেছে। ধন শালী লোকদের পরস্পরের মধ্যে সুবিচার প্রতিষ্ঠার দিক দিয়ে তার খুব বেশী গুরুত্ব রয়েছে। তম্মধ্যে একটি হচ্ছে যাকাতদাতা ব্যক্তির ব্যক্তিগত অবস্থার প্রতি যাথাযাথ লক্ষ্য রাখা। যাকাত শুধুমাত্র ধনের পরিমাণের ওপর ই দৃষ্টি কেন্দ্রীভূত রাখেনি। অর্থনীতি বিশারদ গণ দুই প্রকারের কর এম মধ্যে পার্থক্য করেছেন। একটি হচ্ছে প্রত্যক্ষ কর, য মূলধন মালের ওপর ধার্য করা হয়।মালদারের ব্যক্তিগত অবস্থার ওপর কোন দৃষ্টিই দেয়া হয় না।তার ওপর কি বোঝা চাপানো হচ্ছে সিদিকেও লক্ষ্য রাখা হয় না। তার ঋণ বা অন্যান্য আর ও বহু প্রকারের দায়িত্ব কর্তব্য থাকলে তা্ও কোন গুরুত্ব পায় না।আর একটি হচ্ছে ব্যক্তিগত কর। তাতে নিন্মোক্ত বিষয়গুলোর ওপর নজর রাখা হয়ঃ ১. ব্যক্তির জন্যে প্রয়োজন পরিমাণকে কর থেকে অব্যাহতি দেয়া ২. আয়ের উৎসের প্রতি খেয়াল রাখা; ৩. যাবতীয় জরুরী করচ ও দায়দায়িত্ব বাদ দিয়ে তার পর খালেস আয় থেকে কর গ্রনণ; ৪. পারিবারিক দায় দায়িত্ব ও বোঝাকে রেয়াত দান ৫.ঋণসমূহকে ও রেয়াত দান। ইসলাম যাকাত ফরযকরণের এ সব কয়টি বিষয়ের ওপর বিশেষ লক্ষ্য রেখেছে সবকিছিুর আগে। আর তার চাইতে ্ও সব কয়টি বিষয়ের ওপর বিশেষ লক্ষ্য রেখেছে সবকিছুর আগে। আর তা চাইতেও বড় কথা, ইসলাম তা করেছে তখন মানুষ প্রত্যক্ষ কর ও ব্যক্তি গত কর এর মধ্যে কোনুরূপ পার্থকের কথা আদৌ জানতো না। ক. তন্মধ্যে একটি হচ্ছে, নিসাব পরিমাণের কম বিত্তের ওপর যাকাত ফরয করা হয়নি। তারা ভিত্তি হচ্ছে, নিসাব পরিমাণের কম বিত্তের ওপর যাকাত ফরয করা হয়নি। তার ভিত্তি হচ্ছে এ যে ইসলাম তো যাকাত ফরয করেছে কেবল ধনী লোকদের ওপর,যেন তা তাদেরই দরিদ্রদের মধ্যে বন্টন করা হয়। নিসাব হচ্ছে নিম্মতম পরিমাণ সম্পদ, শরীয়াতের দৃষ্টিতে যার ওপর যাকাত হতে পারে। যে লোকেএ নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক নয়, সে যাকাত ফরয হতে পারে এমন পরিমাণ সম্পদের মালিক নয় বলে তার ওপর তা ধার্য হবে না। সীমিত পরিমাণ সম্পদের মালিকদের ওপর কর এর বোঝঅ না চাপানোর মানবয়ি চিন্তার বহু শতাব্দী পূর্বে ইসলাম এ অবদান রেখেছে। [ এ গ্রন্থের তৃতীয় অধ্যায়ের প্রথম পরিচ্ছেদ দ্রষ্টব্যঃ যে ধনের ওপর যাকাত ফরয হয় তার শর্ত;১২৬-১৬৩পৃ.] খ. ব্যক্তির ও তার পরিবারের নিম্নতম পরিমাণক জবিকাকে অব্যাহতি দান এ পরিমাণটা নির্ধারিত হয় তার মৌল প্রয়োজণবলীর ভিত্তিতে। বিশেষজ্ঞ আলিমগণ শর্ত করেছন যে নিসাব পরিমাণ সম্পদ মালিককে মৌল প্রয়োজনের অতিরিক্ত হতে হবে। এ পর্যায়ে আমরা কুরআন সুন্নাহ ও উম্মাতের ফিকাহবিদদের উক্তি প্রভৃতি থেকে অকাট্য দলিলের ভিত্তিতে ইতিপূর্বে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। সেই সাথে চিন্ত বিবেচনা পূর্ণযুক্তি দিয়েও তার সমর্থন যুগিয়েছি। যদিও আল্লাহর এ কথাটিই আমাদের জন্যে যথেষ্টঃ (আরবী *******) লোকেরা হে নবী আপনাকে জিজ্ঞেস করে তারা কি ব্যয় করবে? আপনি বলে দিনঃ যা কিছু প্রয়োজনাতিরিক্ত,তা। আয়াতের (আরবী *******) শব্দটির অর্থজমহুর আলিমগণেল তাফসীর অনুযায়ী মৌল প্রয়োজনের অতিরিক্ত। ১ রাসূলে করীম (স) বলেছেনঃ যাকাত দিতে হবে শুধু ধনাঢ্যতার প্রকাশ থেকে। এবং শুধু কর তোমার ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তিদের থেকে। গ. ঋলগ্রস্তকে অব্যাহতি দান এ পর্যায়েরই উল্লেখ্য ব্যাপার। আর তা হবে যদি ঋলটা নিসাবের সমান হয় অথবা ঋণের দরুন নিসাব পরিমাণ সম্পদ না হয়। জমহুর আলিমগণের এটাই মত। শরীয়াতের অকাট্য দলীল তার নিয়ামলীর এবং তার সাধারণ ভাবধারা ও তারই সমর্থন করে। পূর্বে তা আমরা স্পষ্ট করে আলোচনা করেছি।২ এপর্যায়ে হানাফী আলিমগণের বক্তব্য সুবন্যস্তভাবে উল্লেখ করাই যথেষ্ট হবে মনে করি। তাঁরা বলেছেন, যার ঋণ এতটা হবে যতাটা তার ধন মাল বান্দা হিসেবে তার ওপর আরও দায় দায়িত্ব আছে তা আল্লাহর জন্যে হোক যেমন যাকাত কিংবা মানুষের জন্যে হোক যেমন ঋণ,ক্রয়ের মূল্য, হারারোর ক্ষতিপুরণ,স্ত্রীর মোহরানাপ্রভৃতি। অথচ নগদ অর্থ হোক কি অন্য কিছু তাতে কোন পার্থক্য নেই। ওপরন্তু তাৎক্ষণিক হোক বিলম্বিত মেয়াদের হোক তাহলে তার ওপর যাকাত ধার্য হবে না। তা এ জেন্যে যে, নিসাব পরিমাণ সম্পদ তো ঋণগ্রস্তের মৌল প্রয়োজন পূরণেই নিয়োজিত অর্থাৎ তা প্রস্তুত হয়ে আছে তাকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্যে প্রকৃতেই হোক অথবা পরিমাণগতভাবেই হোক। কেননা সে তা তার ঋণ শোধের জন্যে তারই ওপর নির্ভর শীল। পা্ওনাদারের তাগাদার চাপেএবং পরিণতিতে কারাবরণ থেকে নিজেকে রক্ষা করার তার আর কোন উপায় নেই। অপরদিকে আল্লাহর কাছে পাকড়া ও থেকেই রেহাই পা্ওয়ারও এটাই তার এক মাত্র উপায়। কেননাপ তার এ ঋণ তার ও জান্নতের মাঝে প্রতিবন্ধক হয়ে রয়েছে। তাহলে এর চাইতেও বড় প্রয়োজন তার আর কি হতে পারে? এক্ষণে তা পিপাসা নিবৃত্তকারী পানি, ব্যবহার্য পোশাক ইত্যাদির মত হয়ে গেছ। আর এরূপ অবস্থায় তা না থাকার মতই। কেননা এরূপ হলে পানি থাকা সত্ত্বে তৈয়ম্মুম করা জায়েয। অত এব এ লোকের ওপর যাকাত ফরয হবে না। দানের পোশাক যদি নিসাব পরিমাণ হয় তবুও। [তৃতীয় অধ্যায়ের প্রথম পরিচ্ছেদ যাকাত ফরয হয় যে মালে, তার সাধারণ শর্ত শীর্ষক আলোচনা।] চ. জরুরী ব্যয় ও দায় দায়িত্ব ও দিতে হবে, যেন যাকাতটা খালেস আমদনী বা সম্পদ থেকে দেয়া সম্ভব হয়, আমরা এ মতটি গ্রহণ করেছি। আতার মতও তাই।তিনি জমির ফসল বা ফল সম্পর্কে বলেছেনঃ তোমরা খরচাদি বাদ দাও, তার পর যা থাকে তা থেকেই যাকাত দাও। ইবনে উমর ও ইবনে আব্বাস (রা) ও খরচ বাদ দেয়ার যদি তা ঋণ করে করা হয়ে থাকে পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন্ ইমাম আহমদ থেকেও খরচটা ঋণ হয়ে থাকলে উক্তরূপ মতই বর্ণিতদ হয়েছে। যেমন বীজের মূল্য যদি বাকি থেকে থাকে বাকিতে নেয়া হয়ে থাকে ব্যাংক থেকে, তাহলে সে ঋণ পরিমাণ সম্পদ থেকে বাদ যাবে। অনুরূপ ভাবে খারাজ বাদ দেয়ার পরেই ফসল ওফলের যাকাত বা ওশর দিতে হবে বলে তিনি মত দিয়েছেন। খারাজকে জমির ওর ঋণ ধরা হয়েছে। কৃষি ফসল ইত্যাদিকে দালান কোঠা ও শিল্প কারখানা ইত্যাদির ওপর কিয়াস করা হয়েছে।১ ব্যবসায়ে তো কার্যত খরচাদি বাদ দেয়াই হবে। কেননা যাকাত নেয়া হবে বছরের শেষে যে আসল ওমুনাফা অবশিষ্ট থাকবে, তা থেকে। যা খরচ তা তো পষিয়ে নেয়া হয়েছে অবশ্য ;যদি তা ঋণ হয়ে না থাকে,যেমন দোকান ভাড়া যা দেয়া হয়নি। তখন হিসেবে তা বাদ দিয়ে ;অবশিষ্টের যাকাত দিতে হবে। ঙ. র্পর্ববর্তী পরিচ্ছেদ আয়ের উৎসের প্রতি লক্ষ্য রাখার কথা যা উল্লেখ করেছি, তা্ও এখানে উল্লেখ্য। অতএব যে আয়ের উৎস স্থায়ী অ আবর্তনশীল মূলধন যেমন কৃষিজমির আয় তো থেকে ওশর বা অর্ধ ওশর গ্রহণ করা হবে। আর যে আয়ের উৎস শ্রম বা কাজ যেমন মাসিক বেতন,মজুরী,স্বাধীন পেশার লোকদের আয় ইত্যাদি, তা থেকে এক-দশমাংশের এক-চতুর্থাংশ যাকাত বাবদ গ্রহণ করা হবে। ষষ্ঠঃসঙ্গতি বিধানে সুবিচার ইসলামের শরীয়াত সুবিচার রক্ষার ব্যাপারে তার অকাট্য দলিল সমূহ যতটা পরিব্যাপ্ত, ইসলাম সে উজ্জলতম দিকগুলোর মধ্যে সীমাদ্ধ হয়ে থাকাকেই যথেষ্ট মনে করেনি। তাৎপযের দিক দিয়ে তা আরও অনেক দূরে পৌছে গেছে। এ আইন প্রণয়নের বস্তবায়নের সাথে সুবচারের প্রতি লক্ষ্য রাখাকেও যোগ করেছে। তাকে খুবেই উত্তমভাবে বাস্তবয়িত করেছে ও কার্যকর করে তুলেছে। এ কারণে যাকাতের জন্যে কর্মচারী নিয়োগের ও বাছাইকরণের জন্যে খুব বেশী উৎসাহ দান করেছে।তাদেরকে ঈমানী শক্তির বলে বলীয়ান হ্ওয়ার ্ওনিজেদের কে তার আবরণে সুরক্ষিত করার জন্যে ও উপদেশ দিয়েছ।তাদের জানিয়েছে ও বুঝিয়েছে যে আইনের মজবুত ধারায় সুবচারের নীতি যদি স্বকিৃত থাকে, কিন্তু সে আইন যারা কার্যকর করার জন্যে দায়িত্বশীল তাদের মনে মগজে চরিত্রে যদি তা প্রকট না থাকে, তাহলে তা লক্ষ তারিয়ে ফেলবে, সাদা কাগজে লেখা থাকবে অথচ বাস্তবতাশূন্য হয়ে দাঁড়াবে। এ পর্যায়ে ইমাম আবূ ইউসুফ খলীফা হারুন অর রশীদকে বলেছিলেনঃ হে খলীফাতুল মুসলেমীন! আপনি এমন একজন লোক নিযক্ত করার আদেশকরুন, যে হবে বিশ্বস্ত, নির্ভরযোগ্য, অতীব পবিত্র চরিত্রের অধিকারী কল্যাণ কামী, আপনার ও আপনার ১. এ পর্যায়ে কৃষি সম্পদের যাকাত শীর্ষক আলোচনা দ্রষ্টব্য। শেষ পর্যন্ত আমি অবহিত হয়েছি যে, জাফরী মাযহাবেই হচ্ছে ফিকাহবিদ আতার মত(আরবী *******) গ্রন্হদ্বয় থেকে এ কথা (আরবী *******) গ্রন্থের ২য় খণ্ড, ৮০-৮১ পৃষ্টায় উদ্ধৃত হয়েছে। প্রজা সাধারণের পক্ষে বিপদ আশংকামুক্ত।এবং এ ব্যক্তিকে বিভিন্ন স্থানে যাকাত সংদগ্রহের দায়িত্ব দিন। তাকে এ আদেশ করুর, যেন সে বিভিন্ন স্থানে এমন সব লোক নিয়োজিত করে যারা হবে তার পসন্দনীয়, মনোনীত। তাদের ধর্মীয় আচার আচারণ, নিয়ম পদ্ধতি ও আমনতদারী সম্পর্কে জানতে চাইবে। তবেই তারা নানা স্থান থেকে যাকাত সংগ্রহ করে তার কাছে জমা করে দেবে। আমিজানতে পেরেছি, কারাজ আদায়ে নিযক্ত ব্যক্তিরা নিজেদের পক্ষ থেকে এমন সব লোককে যাকাত আদায়ের জন্যে পাঠিয়ে থাকে, যারা জনগণের ওপর জুলুম করে, খুব রুঢ় ওঅশালীন ব্যবহার করে এবং মাল নিয়ে আসে যা হালাল নয়, যা সংকলন ও হয় না। আসলে যাকাত আদায়ের জন্যে পবিত্র চরিত্রের কল্যাণকামী লোক নিযুক্ত হ্ওয়া একান্তই বাঞ্চনীয়। [(আরবী *******)] রাসূলে করীম (স) যাকাতের জন্যে ভারসাম্য পূর্ণ চরিত্রের ও শরীয়াতের বিধান পালন কারী নিযুক্ত করতেন। এজেন্যে তিনি বলেছেনঃ যাকাতের কাজে নিযুক্ত লোক যদি ন্যায়পরতা ও সমতার সাথে কাজ করে তবে সে আল্লাহর পথের গাজীর মর্যাদাশীল হবে। [আহমাদ আবূ দাউদ, তিরমিযী,ইবনে মাজা ও ইবনে খুজায়মা উদ্ধৃত। তিরিমিযী হাদীসটি কে হসন বলেছেন। (আরবী *******) হাদীসটিকে মুসলিমের শর্তানুযায়ী সহীহ বলে অবিহিত করেছিন এবং যাহরী তা সমর্থন করেছেন।] নবী করীম (স) তাঁর একজন কর্মচারীকে বলেছিলেনঃ আল্লাহকে ভয় কর, হে আবুল অলীদ! কিয়ামতের দিন তুমি যেন এমন উট বহন করে নিয়ে না আস, যা বিকট ধ্বনি করবে, বা এমন গরু নিয়ে না আস যা হাম্বা রব তুলবে এবং এমন ছাগী নিয়ে না আস যা চ চ করবে। [ তাবারানী (আরবী *******)গ্রন্থে উদ্ধৃত করেছেন। এর সনদ সহীহ(আরবী *******)] দ্বিতীয় আলোচনা দৃঢ় প্রত্যয় কর আরোপে সুবিচার প্রতিষ্ঠার দ্বিতীয় মৌলনীতি হচ্ছে দৃঢ় প্রত্যয়। এখানে দৃঢ় প্রত্যয় বলতে বোঝায়, যার ওপর কর ধার্য হয়, যে সচ্ছল লোককে কর দিতে বাধ্য করা হয় তার মতে এ কর পক্ষে একটা দৃঢ় প্রত্যয় বিরাজমান থাকা একান্তই আব্শ্যক। তাতে যেন কোনরূপ অজ্ঞতার অন্ধকার বা অস্পষ্টতা থাকা উচিত নয়। তেমনি নিছক জবরদস্তিমূলক ও হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। করা দেয়ার মেয়াদ পন্হা ও সময়াদি সকলের কাছে সুস্পষ্টরূপে জানা থাকতে হবে এবং শেষ কদ্দিনে চলবে, তাও অজানা থাকলে চলবে না কর সংশ্লিষ্ট সকল লোকেরই এ বিষয়ে পূর্ণমাত্রায় অবহিত থাকতে হবে। অর্থনীতির শুরু আদম স্মীথ এ দৃঢ় প্রত্যয়ের গুরুত্ব স্পষ্ট করে প্রকাশ করেছেন। তিনি লিখেছেনঃ ধনশালী ব্যক্ত্রি যা কিছু বাধ্যবাদকাত এবং তার ওপর যে কর্তব্য আরোপিত, সেই বিষয়ে তার মনে অকাট্য সন্দেহমুক্ত জ্ঞান থাকার গুরুত্ব বাস্তবিকই অনস্বীকার্য। কেননা যে কোন কর ব্যবস্থায় দৃঢ় প্রত্যয়ের অনুপস্থিতি করা বোঝা বন্টনের সুবিচার না হ্ওয়ার কঠিন বিপদ ডেকে আনতে পারে। উপরস্তু কর ব্যবস্থার স্থিতির সাথে দৃঢ় প্রত্যয় খুব বেশি গভীর ভাবে সংযুক্ত ও সম্পর্কশীল, এতে দ্বিমতের অবকাশনেই। ধনশালী ব্যক্তি যদি একটা বোঝা যাবে,সে তার দায়িত্ব ও কর্তব্যের ব্যাপারে দৃঢ় প্রত্যয় পোষণ করে। এই প্রেক্ষিতে কানার প্রভৃতি ব্যাখ্যাকার এতদূর বলেছেন, প্রত্যেকটি প্রাচীন করেই খুবই উত্তম পবিত্র কর। পারস্পরিক ব্যাপারসমূহের সম্পর্কে ও এরূপ কিয়াস করা যায়। তাতে খুব বেশী ও বারবার পরিবর্তন কর বিধানকে ভেঙ্গে চুরে দেয় এবং তা সন্দেহের পর্যায় অতিক্রম করে স্থিতি ও প্রত্যয়কে চূর্ণবিচূর্ণ করে দেয়া পর্যন্ত পৌছে দেয়। উপরর্ন্ত কর আরোপকারীর মনোভাব সম্পর্কে জনমনে প্রবল সংশয় জেগে ওঠে। [ ড. ফুয়াদ ইবরাহীম লিখিত (আরবী *******) গ্রন্থে থেকে ২৬৭ পৃ.] বস্তুতঃ এ দৃঢ় প্রত্যয়ের যাবতীয় নিয়ম কানুন যাকাত ফরযকরণে পূর্ণমাত্রায় বাস্তবায়িত। আল্লাহ তাআলা তা তাঁর কিতাবে সুস্পষ্ট ঘোষণার মাধ্যমে ফরয করেছেন। তার রাসূলে করীম(স) এ জবানীতে তার পরিমাণ সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। তা ব্যাখ্যা ্ও বিস্তারিত বিশ্লেষণে ইমাম সাহেবগণ বিরাট মহামূল্য ফিকহী জ্ঞানের সমাহার রেখে গেছেন। তােই প্রত্যেক মুসলিমের কর্তব্য হচ্ছে তৎসংক্রান্ত যাবতীয় হুকুম আহকাম ও স্থিতিশীল ফরয, তাতে খুব বেশী পরিবর্তন পরিবর্ধনের অবকাশ নেই। এ কালের অন্যান্য সমাজের বিবিধ কর এর সততা নিত্য পরিবর্তনশীল নয়। যাকাতের কোন কোন আইনে যে ফিকাহবিদদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে, রাষ্ট্র যখন যাকাত সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করবে, তখন তন্মাধ্যে যে কোন একটি মতকে অগ্রাধিকার দিতে পারে। তৃতীয় আলোচনা আনুকূল্য রক্ষায় আদম স্মীথ কর ব্যবস্থার সুবিচার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে তৃতীয় যে মৌলনীতি উপস্থাপিত করেছেন, তা হচ্ছে আস্থার সাথে আনুকূল্য রক্ষা। এ মৌলনীতির সারনির্যাস হচ্ছে, কর নির্ধারণ বা আরোপে ধন শালী ব্যক্তির দিকটির প্রতি লক্ষ্য রাখা এবং তর প্রতি নম্রতা ও সহানুভুতি প্রদর্শন যেন সে স্বীয় মনের ঐকান্তিক সন্তুষ্টি ও স্বতঃস্ফূর্ততা সহকা কর আদায় করে দিতে প্রস্তুত হয়। এ ব্যাপারে তার যেন কোনরূপ অভিযোগ না থাকে। অথবা কোন রূঢ়তা ও কষ্টদানের শিকারে পরিণত না হয়। ইসলামী আইন প্রণয়ন ও তা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে যা আমরা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছি ও স্পষ্ট করে তুলেছি কোন দৃষ্টি সম্পন্ন ব্যক্তি লক্ষ্য করবেন যে, ইসলাম এ দিকটির ওপর খুব বেশী গুরুত্ব আরোপ করেছে। নিম্নে আমরা তা বিভিন্ন দিক তুলে ধরছি, তা থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠবেঃ প্রথমত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা) থেকে ইমাম আহমাদ বর্ণনা করেছেন যে, নবী করীম (স) বলেছেন, মুসলমানদের যাকাত তাদের পানির স্থানসমূহেই আদায় করা হবে। আহমদ ও আবূ দাউদ উদ্ধৃত অপর বর্ণনায় কথাটি এইঃ টানাটানি নেই, পার্শ্বে রেখে দেয়া নেই,তাদের যাকাত তাদের স্থান ছাড়া অন্য কোন খানে নেয়া হবে না। [ইমাম শাওকানী লিখেছেনঃ আবূ দাউদ মুনযেরী ও হাফেস তালখীচ গ্রন্থে এ হাদীসটি সম্পর্কে কিছুই বলেননি। এর সনদে মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক রয়েছেন, তিনি(আরবী *******) করে হাদীস নর্ণনা করেছেন।এ অধ্যায়ের ইমরান ইবনে হুসাইন থেকে বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন আহমদ আবূ দাউদ নাসয়ী, তিরমিযী ইবনে হাব্বান আবদুর রাজ্জাক। নাসয়ী তাঁর থেকে অপর এক সূত্রে হাদীসটি এনেছেন। (আরবী *******) তাবারানী(আরবী *******) গ্রন্থে হযরত আব্বাস থেকে বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেনঃ মরুবাসীদের যাকাত তাদের পানির কাছে এবং তাদের আঙিনায় লওয়া হবে। তার সনদ উত্তম। যেমন (আরবী *******)এ রয়েছে।] হাদীসে টানাটানি নেই বলে বোঝানো হয়েছে যে, গবাদি পশুর যাকাত সেগুলোর অবস্থান স্থান থেকেই নেয়া হবে। তা যাকাত গ্রহণকারী কর্মচারী পর্যন্ত টেটে নেয়া যাবে না। খাত্তাব্ উল্লেখ করেছেনঃ পার্শ্বে রেখে দেয়া নেই বলে বোঝানো হয়েছে যে, ধন মালের মালিকদেরকে তাদের অবস্থান স্থাল থেকে সরিয়ে দিয়ে যাকাতের হিসাব করা বা যাকাতের মাল ল্ওয়অ হবে না।এ ও হতে পারে যে তাদের কে পশুর অবস্থান স্থল থেকে দূরে সরিয়ে দেয়া;চলবে না, যার ফলে যাকাত আদায় করীকে তাদের পিছনে পিছনে দৌড়াতে ও তাদের খোঁজার শ্রম করতে হতে পারে। সোজা কথা, যাকাত আদায় যেমন আদায়কারীর সুবিধা আসুবিধা দেখতে হবে, তেমনি দেখতে হবে যাকাদাতার সুবিধা আসুবিধা। [(আরবী**********)] কেউ কেউ পার্শ্বে রেখে দেয়া নেই এর ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে যে, যাকাত গ্রহণকারী ব্যব্তি থাকবে যাকাতদাতাদের থেকে অনেক অনেক দুরে আর তখন তাদেরকে যাকাত গ্রহণকারীর কাছে ডেকে ডুবে হাজির করা হবে হাদসে এ কাজ নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে। [(আরবী**********)] শা্ওকানী লিখেছেনঃ হাদীসটি থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, যাকাত গ্রহণকারী যে যাকাত নিয়ে যেতে এসেছে, সে যাকাতদাতাদের পানির স্থানে সেখানে তারা অবস্থান করে উপস্থিত হয়ে যাকাত নেবে। কেননা যাকাতদাতাদের পক্ষে সেটাই সুবধাজনক। [(আরবী**********)] দ্বিীতীয়ঃ মধ্যমমানের জিনিস গ্রহণ ও উত্তম বাছাই করা মাল না নেয়ার নির্দেশ। হযরত মায়াযকে ইয়মেন প্রেরণকালে রাসূলে করীম (স) কর্তৃক প্রদত্ত ভাষণে এ কথটি ও ছিলঃ তুমি নিজেকে বাছাই করা উত্তম মালসমূহ থেকে দূরে রাখব। কেননা যাকাতদাতা লোকেরা সাধারণত এই বাছাই করা উত্তম মালসমূহ খুশীর সাথে দিতে প্রস্তুত হয় না। উত্তম উষ্ট্রী গ্রহণকারী জনৈক যাকাত কর্মচারীর প্রতি নবী করীম (স) অস্বীকৃতি ও অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত প্রমাণ করতে হয়েছিল যে, আসলে সেটি দুটি উঠেল বদলে গ্রহণ করা হয়েছে উটের বিরাট পালের মধ্য থেকে। অবশ্য যাকাতদাতা মুসলিমকেও বেছে বুড়ো অক্ষম ও রোগাক্রন্ত উট যাকাত বাবদ দিতে নিষেধ করা হয়েছে, বলেছেনঃ হ্যাঁ, তোমাদের ধন মালের মধ্যে মধ্যম মানের জিনিস যাকাত বাবদ দেবে। কেননা আল্লাহ তাআলা বাছাই করা উত্তম মালই দিতে বলেননি যেমন, তেমনি খারাপ নিকৃষ্ট মাল দবোর আদেশ ও দেন নি। [ প্রথম খণ্ডের আলোচনা দ্রষ্টব্য] তৃতীয়ঃ কৃষি ফসল ও ফল ফাঁকড় পরিমাণ আন্দাজকরণের কম সে কম পরিমাণ ধরার নির্দেশ। আবূ দাঊদ তিরমিযী ও নাসায়ী উদ্ধৃত রাসূলে করীম (স) এর হাদীস ইতি পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছেঃ তোমরা যখন আন্দাজ করে পরিমাণ ধরবে তখন ধার্য পরিমাণ থেকে এক-তৃতীয়াংশ বাদ দিয়ে নেবে। যদি এক তৃতীয়াংশ বাদ দেয়া সমীচীন মনে না করা তা হলে অন্তত এক চতুর্থাংশ অবশ্যই বাদ দেবে। রাসূল (স) এর কথা আন্দাজকররে বোঝা হালকাকরণ নীতি গ্রহণ করা। কেননা ধন মালের অনেক পরিমাণ গাছ থেকেই খেয়ে ফেলঅ হয়, ঝড়ে পড়ে যায় ও পোকায় কেয়ে ফেলে। [ কৃষি ফসল ও ফলের যাকাত পরিচ্ছেদ দ্রষ্টব্য] ইমাম খাত্তাবী লিখেছেন ঃ রাসুলের এক তৃতীয়াংশ বাদ এক চতুর্থাংশ বা দা্ও কথাটির ব্যাখ্যা কোন কোন আলিম বলেছেনঃ মালের যে অংশ বাদ দেয়া হবে, তা যাকাত দাতার সুবিধা বিধানস্বরূপ। কেননা যদি পুরোমত্রার প্রাপ্যটা পরোপুরি নিয়ে নেয়া তাহলে তাতে তাদের ক্ষতি সাধিত হবে অথচ ফল ফসলের অনেক জিনিস পড়ে যায়, পাখী খেয়ে ফেলে, লোকেরা খাবার জন্যে পেড়ে নিয়ে যায়। এরূপ অবস্থায় পরিমাণ আন্দাজের সময় এক চতুর্থাংশ বাদ দিয়ে ধরলে তাতে যাকাতদাতাদের পক্ষে খুবই প্রশস্ত ও সুবিধা হয়। হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা) এরূপ আন্দাজ ধারারই নির্দেশ দিয়েছিলেন। ফিকাহবিদদের মধ্যে অনেকে এ মতও দিয়েছেন যে, সমস্ত খেজুর সম্পদই ধরতে হবে, কিছুই বাদ দেয়া চলবে না বরং কিছু পরিমাণ খেজুর আলাদা করে তাদের নেয়া হবে, যার পরিমাণ অনুমানের সাহয্যে জানা গেছে। [(আরবী**********)] চতুর্থঃ যাকাত দেয়ার নির্দিষ্ট তারিখ ছাড়িয়ে তার পরে বিলম্ব করে তা দেয়া জায়েয আছে। অবশ্য তা পারা যাবে মালের মালিকের খুব বেশী প্রয়োজন দেখা দিলে। যেমন হযরত উমর (রা) দুর্ভিক্ষের বছর তাই করেছিলেন। এসবই করদাতাদের প্রতি আনুকূল্য দানের অন্তর্ভক্ত নীতি।

চতুর্থ আলোচনা মধ্যম নীতি অনুসরণে কর ব্যবস্থায় পযোজ্য প্রখ্যাত সুবিচার নীতির এটা চতুর্থ নিয়ম। অর্থনতিবিদরা কর আদায়ের বাধ্যকতায় মধ্যম নীতি অবলম্বনের প্রয়োজন মনে করেছেন। সর্বপ্রকারের বাড়াবাড়ি পরিহার করার গুরুত্ব ও তাঁরা স্বীকার করেছেন। কর সংগ্রহের বাধ্যবাধকতা পর্যায়ে এখানে মনে করা হয়েছেঃ রাষ্ট্র বেতনভুক্ত কর্মচারীদের মজুরীদানে এবং অর্থ বিভাগের জন্য পরিহার্য প্রয়োজনীয় গরুত্বপূর্ণ কার্যাবলী ও ভাণ্ডবাটি যা খরিদ করা হয় তাতে যা কিছু ব্যয় করে তা। এসব অর্থ ব্যয় অর্থনৈতিক কেন্দ্রস্থলে তা বহন করে নিয়ে যা্ওয়ার কষ্ট ইত্যাদিত যা ব্যয় করা হয়, তাও এর মধ্যে শামিল। তা হয় তাদের দেয় পৌছানোর লক্ষ্যে হোক অথবা তাদের বক্তব্য শোনা ও হিসেব নিয়ে তাদের সাথে বোঝাপড়া করা ইত্যাদির জন্য হোক অথবা তাদের জুলুম পীড়ন দূর করা বা প্রতিষ্ঠনগত সিদ্ধান্তে দোয় ধরার জন্যই হোক। এ ধানের বহু কারণেই তাদের স্থানান্তরিত হওয়ার প্রয়োজন দেখা দিতে পারে এবং সেজন্যে তাদের একটা মূল্যবান সময়ও অতিবাহিত হতে পারে। প্রয়োজন হতে পারে কোন কোন ব্যয়বার বহনে কষ্ট স্বীকার করার। এতে কোন ভয়ের কারণ নেই যে, সাধারণ মালদার লোকেরা তাদের ওপর ধার্য কর যাথারীতি আদায় করে দেবে। যেন রাষ্ট্র সরকার তৎলব্ধ সম্পদ দ্বারা সে সাধারণ ব্যায়াদি সম্পন্ন করতে পারে, যার কিছুটা ফায়দা শেষ পর্যন্ত তাদের দিকেই ফিরে আসবে। মালদার ব্যক্তি যুদ অনুভব করে যে, তার নিকট থেকে যে মাল নেয়া হচ্ছে, তা উক্ত লক্ষ্য বাস্তবায়নের কোন বিশেষ ভুমিকা পালন করবে না বরং তার একটা বিরাট অংশ বিনকষ্ট হয়ে যাবে, তখন তা অর্থ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জনগণের ভাণ্ডারের দিকে যাওয়ার পথে থাকবে, তখন সে তা আদায় করবে নিতান্ত অীনচ্ছা ও বিরক্তি সহকারে। নাফরমানির পতাকা বহন করতে সে কখনই কুন্ঠিত হবে না এবং ভবিষ্যতে ও সে কর দেয়ার দায়িত্ব এড়িয়ে যেতেই চেষ্টা করবে প্রাণপণে[দেখুনঃ (আরবী**********)] কর ব্যবস্থা সম্পর্কে অর্থনীতি বিদরা এসব যা কিছুর উল্লেখ করেছেনে, ইসলামে এ দিকটি স্মপর্কে আমরা যখন বিবেচনা করি, তখন আমরা সাধারণভাবেই দেখতে পাই যে, তা সর্বক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষা ও মধ্যম নীতি অবলম্বনের নির্দেশ দেয় এবং সীমালংঘন ও কার্পণ্য সংকীর্ণতা প্রদর্শন করতে স্পষ্ট ভাষায় নিষেধ করছে। ব্যক্তির বিশেষ ধান মালের ক্ষেত্রে যখন এরূপ গুরুত্ব আরোপ, যখন সাধারণ ধন মালের বিশেষ করে যাকাত সম্পদে অধিক বেশী গরুত্ব আরোপিত হবে, সে তো স্বাভাবিক কথা। নবী করীম (স) যাকাত সংগ্রহে ও যাকাত আদায়কারী কর্মচারীদের ব্যাপার কত তীব্র কঠোরতা ও অনমীয় নীতি অবলম্বন করেছেন এবং যারা লোকদের কাছ থেকে হাদীয়া তোহফা গ্রহণ করে তা নিজের মাল মনে করেছে তাদের প্রতি যে কি সাংঘাতিক ভাবে ক্রুদ্ধ ও রাগান্বিত হয়েছেন, তা কারুরেই অজানা নেই! যাকাত স্থানান্তরকরণ শীর্ষক আলোচনায় আমরা দেখেছি, কর্মচারীরা কিভাবে মফস্বলে চলে গেছে, যাকাতের মাল সংগ্রহ করেছে এবং ঠিক হাতে কেবল তাদের নিয়ে যাওয়া চাবক ও ক ম্বল সঙ্গে নিয়ে ফিবে এসেছে। তার রাষ্টের ওপর শুধু ততটুকুর বোঝাই চাপিয়েছে, যতটুকু তারা মজুরী হিসেবে গ্রহণ করেছে। তা ই তাদের জন্যে যথেষ্ট ছিল হত, কোনরূপ অবমূল্যায়ণ বা বাড়াবাড়ি ও সীমালংঘন ছাড়াই। ইমাম শাফেয়ী শর্ত আরোপ করেছেন তার সমর্থকরাও যে, যাকাত সংস্থার কর্মচারীদের আট ভাগের এক ভাগের অধিক দেয়া যাবে না। কেননা কুরআন মজীদই তাদের জন্যে এ অষ্টমাংশ নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। অতেএব তারা তার চাইত েবেশী পাবে না। এ কথাটি ইমাম শাফেয়ী বলেছেন এজন্য যে, তাঁর মাযহাবে কুরআনে উল্লেখিত আটটি খাতের মধ্যে লব্ধ যাকাত সম্পদ সমান হারে বন্টন করা অপরিহার্য। পঞ্চম পরিচ্ছেদ কর ও যাকাতের মধ্যে স্থিতি ও ঊর্ধ্বগামিতা স্থিতিশীল কর ও ঊর্ধ্বগামী কর স্থিতি শীল কর বলতে বোঝায় সেই কর, যার মূল্য স্থিতিশীল থাকে তার অধীন বস্তুর যতই পরিবর্তন হোক না কেন। যেমন আয়ের ওপর বা কোন সম্পদের ওপর কর ধার্য হল, তার মূল্য হচ্ছে ১০%। এ মূল্যটা সকল প্রকারের আয় ও সম্পদের প্রযোজ্য হবে তা বড় হোক কি ছোট। আর ঊর্ধ্বগামী বা বাড়তি প্রবণতসম্পন্ন কর হচ্ছে তাই, যার মূল্য বৃদ্ধি পায় তার অধীন বস্তুর পরিমাণ বৃদ্ধির সাথে সাথে। যেমন আয়ের ওপর কর ধার্য হল প্রথম একশত জনীহ (মিশরীয় মুদ্রা) এর ১০% দুই শতের ওপর ১২% তিন শতের ওপর ১৫% ইত্যাদি। [(আরবী**********)] ন্যায়পরতা আছে, তা বর্ণনায় বহু যুক্তি প্রমাণেরও অবতারণা করেছেন তাঁরা যদিও পাপত্তি উত্থানকারীদের কোন অপত্তির প্রতিই তাঁরা ভ্রক্ষেপ করেননি; তন্মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি যুক্তি এইঃ ১. একজন সম্পদশালী ব্যক্তি ক্রমবৃদ্ধিশীল ফসল আইনের অনুগত। সে যখনই ধন লাভ করল, তার সম্পদ বৃদ্ধি ও প্রবৃদ্ধি অনুপাতে তা ক্ষমতাও বৃদ্ধি পেল। বরং এ সামর্থটা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হবে বহু কয়টি পরপর হারের চাইতওে অনেক বেশী। এ ধনবান ব্যক্তি উর্ধ্বগামী কর দেয়ার জন্যে কিছুমাত্র কম প্রস্তুত হবে না। কেননা কর এর বোঝা ঝামেলা বহনের শক্তি তার অনেক বৃদ্ধি পেয়ে গেছ। ২. সম্পদ ও আয়ে লক্ষ্যণীয় পার্থক্য দূর করার একটা খুব সার্থক ও নিকট বর্তী উপায় হচ্ছে ঊর্ধ্বগামী হারের কর। অতএব যেখানে পরিস্থিতির সুস্থতা বিধানের উদ্দেশ্যে ঊর্ধ্বগামী হারের কর ধার্য করে তা করা একান্তই কর্তব্য। এর দ্বারাই এ দূরিতক্রম্য পার্থক্য সীমিত করা এবং ধনী ও গরীবদের মধ্যকার ব্যবধান ও দূরত্ব কম সে কম করা সম্ভব হবে। আমাদের পূর্ববর্তী অধ্যয়নে আমাদের সম্মুখে এ কথা স্পষ্ট প্রতিভাত হয়ে গেছে, যাকাত কোন ঊর্ধ্বগামী কর চিন্তার ফসল নয়। ফলে যাকাতের মূল্য বা হার মাত্র বৃদ্ধি শীল নয়। অন্য কথায় যাকাতের ফরয পরিমাণের হার তখনই বৃদ্ধি প্রাপ্ত হবে যখন ধন সম্পদের আ আয়েল পরিমাণ যার ওপর যাকাত ধার্য হয় বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হবে।বস্তুর এ এক স্থিতিশীল ও স্থায়ীভাবে ফরযকৃত যাকাত। কেননা যাকাতে দেয় পরিমাণটা স্থায়ী ও স্থিতিশীল। উপাদান উপকরণের পরিমাণ বাড়তির দিকে বা কমতির দিকে যতই পরিবর্তিত হোক না কেন। অতএব যে লোক বিশটি স্বর্ণ দনিারের মালেক, সে তার দশভাগের এক ভাগের এক চতর্থাংশ দেবে। অনুরূপভাবে যে লোক বিশ হাজার স্বর্ণ দীনারের মালিক হবে, সেও ঠিক সেই এক দশমাংশের এক চতর্থাংশ যাকাত বাবদ প্রদান করবে। যার জমি পাঁচ অসক পরিমাণ শস্য উৎপান্ন করল অথবা যার খেজুর বাগানে পাঁচ অসাক খেজুরের ফসল ফলল, সে উভয় অবস্থায়ই এক দশমাংশ বা তার অর্ধেক যাকাত বাবদ দেবে। তেমনি যার হাজার অসাক বা ততোধিক পরিামাণের ফসল লাভ হল, সেও সেই হারেই দেবে। প্রথম প্রথম দৃষ্টিতে অনেকের মনে হতে পারে যে, বিভিন্ন প্রকারের গবাদি পশুতে যাকাত বুঝি বিপরীতভাবে ঊর্ধ্বমুখিতা প্রবণ,ছাগলের যাকাতেও বুঝি তাই। যেনম সহীহ হাদীসে উদ্ধৃত হয়েছেঃ প্রতি চল্লিশটি ছাগীতে একটি ছাগী একশ বিশটি পর্যন্ত এ হার। তার পরে সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে দুশটি পর্যন্ত দুটি চাগী। আরও অধিক হলে তিনশ পর্যন্ত তিনটি ছাগ।অতঃপর প্রতি একশতে একটি। এ থেকে এ কালের কোন কোন আলোচনাকারী চিন্তাবিদ মনে করেছেন যে, পশুর ক্ষেত্রে যাকাত বিপরীত দিকসম্পন্ন ঊর্ধ্বগামী এবং তার পশু সম্পদ বৃদ্ধির ব্যাপারে উৎসাহদানস্বরূপ বিশেষ করে আরব উপদ্বীপে। অবশ্য এরূপ ব্যাখার একটি তাৎপর্য রয়েছে। তবে গভীল সূক্ষ্ম অধ্যয়নকারী স্পষ্ট দেকতে পারেন যে, এ সিদ্ধান্তটা অগ্র্হণযোগ্য। আর এক দশামাংশের এক চতুর্থাংশ হার যা ইসলাম সাধারণভাবে গ্রহণ করে থাকে নগদ ও ব্যবসায়ী মূলধনের যাকাত ঠিক সেই হারই পশুর যাকাতেও গ্রহণীয়। এটা স্বভাবিকতার দিক দিয়ে নৈকট্য বিধানমূলক ব্যব্স্থা গরু ও উটেরবেলা এ কথা স্টষ্ট। এজন্যে হাদীসমূহে প্রতি ত্রিশটি গরুর জন্যে একটি করে এক বছর বয়স্ক পুরুষ বা সস্ত্রী বাছুর এবং প্রতি চল্লিশটিতে একটি করে মুসান্না যেমন উট বিপুল সংখ্যক হলে প্রতি চল্লিশটিতে একটি দুই বছরে উপনীত বাচ্চা, প্রতি পঞ্চাশটিতে একটি করে চার বছরে উপনীত বাচ্চা। অতএব ত্রিশটি গরুতে একটি এক বছঃর বয়স্ক বাছুর ও চল্লিশটিতে একটি করে মুসান্নাহ আর চল্লিশটিতে চিনতে লবুন, পঞ্চাশটি উটে হুক বা যখন লক্ষ্য করা যাবে যে, এ সংখ্যার মধ্যে ছোট আছে, মধ্যম আছে, বড় আছে। এ সবই আমাদের কে নৈকট্য বিধানকারী একটি হার দেয়। আর তা হলে এক দশমাংশের এক চতুর্থাংশ। আর ছাগলের পুরুষ স্ত্রী যা ই হোক প্রথন চল্লিশটি বাবদ একটি ছাগী দিতে হবে। কেননা শর্ত এই করা হয়েছে যে, নিসাবটা এমন পরিমাণের হতে হবে যেন তার মালিক বড় ধনী বলে পরিচিত হতে পারে। যথাস্থানে আমরা এ কথাকে অগ্রাধিকার দিয়ে এসেছি এবং বলেছি যে, চল্লিশটি বা পাঁচটি এর কম সংখ্যকের মালিক ধনী বিবেচিত হয় না, যার ওপর যাকাত ফরয হতে পারে। তার অর্থ প্রথম চল্লিশটিতে দেয় ফরযের পরিমাণ একদশমাংশের এক চতুর্থাংশ। অন্যান্য ক্ষেত্রে ও সেই ব্যবস্থা।ছাগলের মালিকানা পরিমাণ বিপুল হলে দেয় ফরযের পরিমাণ কম হওয়অর তত্ত্ব আগেই বলেছি যে, এ ধারনের ক্ষেত্রে অল্প বয়স্ক ছাগল বিপুল সংখ্যক হতে পারে। কেননা ছাগীরা বছরের একাধিকবার বাচ্চা প্রসব করে, আর একবারে একাধিক সংখ্যক বাচ্চ জন্ম দেয়। তার এ সব বাচ্চই তো হিসেবে ধরতে হয়। হযরত উমর (রা) থেকে সেই বর্ণরা পাওয়া গেছে, তিনি তাঁর কর্মচারীদের নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, তারা যেন ছাগলের বাচ্চা গুলোর হিসেবে গণ্য করে, রাখাল যদি কোনটিকে হাতে করে বহন করে নিয়ে আসে তুবও। পশুর যাকাতে গ্রহীত হার হচ্ছে এক দশমাংশের এক চতুর্থাংশ। তার একটি প্রমাণ হচ্ছে, ইবরাহীম নখয়ী ও আবূ হানীফা থেকে ঘোড়ার যাকাত পর্যায়ে বর্ণিত হয়েছে, তার মূল্য ধরা হবে এবং তার মূল্যের এক দশরাংশের এক চতুর্থাংশ যাকাত বাবদ দিতে হবে। যাকাত ঊর্ধ্বমুখী নীতিতে গ্রহণ করা হয় না কেন প্রশ্ন হচ্ছে, যাকাত একটা স্থায়ী ও স্থিতি শীল হারের কর হল কেন? ঊর্ধ্বমুখী কর হল ন কেন? এ প্রশ্নের জবাব হচ্ছে, এ যুগে এ ধরনের কর ধার্যকরণের একটা প্রবণতার সৃষ্টি হয়েছে। বহু লোকই এর সমর্থনে ঘোষনা দিয়েছে যে, এর ফলে পার্থক্য দূরীভুত হবে এবং সমাজে অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষিত হবে। আমি মনে করি উর্ধ্বমুখী চিন্ত প্রসূত নীতিতে যাকাত ধার্য না হওয়ার কতগুলো কারণ রয়েছে তার মধ্যে অধিক গুরুত্বপূর্ণ কারণসমূহের উল্লেখ করা যাচ্ছেঃ প্রথমঃ যাকাত স্বপ্রকৃতিতে একটা দ্বীনী ফরয এবং তা স্থায়ী যদ্দিন মানুষ এ পৃথিবতে আছে, তদ্দিন। ততদিন ইসলাম্ও টিকে থাকবে, টিকে থাকবে েইসলাম উপস্থাপিত এ যাকাত ব্যবস্থা। ক্ষেত্র, অবস্থা ও প্রয়োজনের পরিবর্তনের কারণে তা কখনই পরিবর্তিত হবে না। তা চিরদিনই ফরয থাকবে এবং সেজন্যে বান্দা হওয়ার কারণে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হিসেবেও। প্রত্যেক ধনশালী মুসলিম ব্যক্তিই প্রত্যেক যুগে প্রত্যেক অবস্থায় ও পরিবেশেই তা দিতে প্রস্তুত থাকবে। কিন্তু ঊর্ধ্বমুকীতাপ্রবণ কর এরূপ নয়। রাষ্ট্র বিশেষ ক্ষেত্রে এবং বিশেষ দেশে বিশেষ অবস্থায় বিশেষ সমষ্টিক ও অর্থনৈতিক লক্ষ্য বস্তবায়নের উদ্দেশ্য তা ধার্য করে থাকে। এ কারণে তা হার কখনের ঊর্ধ্বমুখী হতে পারে যেমন, তেমনি হতে পারে নিম্নমুখীপ্রবণও। আর প্রয়োজন না থাকলে তা কখনও সম্পূর্ণ প্রত্যাহুত ও হতে পারে। ইসলামী শরীয়াত প্রয়োজন দেখা দিলে তার যোগ্য লোকদের ওপর কর ধার্য করতে রাষ্ট্র প্রধানকে নিষেধ করে না। এ প্রয়োজন দেখা দিতে পারে অর্থনৈতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেলে, জনগণের মধ্যে অর্থনৈতিক পার্থক্য অনেক বেশি িএবং বিশাল হয়ে গেল কিংবা বার্ষিক বাজেটের বিরাটত্ব রক্ষ্রর আবশ্যকত দেখা দিলে। এরূপ অবস্থায় যাকাত ছাড়াও ঊর্ধ্বমুখী বা অ ঊর্ধ্বমুখী করা ধার্য করা যেতৈ পারে য জুলুম কেও প্রতিরোধ করবে, সুবচার প্রতিষ্ঠত করবে এবং রাষ্ট্রের প্রয়োজন ও ফূর্ণ করবে। তবে তার শর্ত হচ্ছে, তা প্রয়োজন পরিমাণ অনুযায়ী হতে হবে তার অধিক নয় এবং বিবেচক ও উজদেষ্ট পরিষদ তার প্রয়োজন কনে করবে। শুদু তাই নয়, তা হবে, আল্লাহর নযিল করা কিতাব ও মানদণ্ডের সাথে পুরোপুরি সঙ্গতিপূর্ণ যাক তিনি রাসূলগণের মাধ্যেমেনযিাল করেঃছেন জনগণের সাধ্য ইসাফ ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য। দ্বিতীয়ঃ যাকতের ব্য ক্ষেত্র এবং অন্যান্য যে সাব দিকে তা ব্যয় বরা হয় সেদিকে লক্ষ্য রেখে বলা যায়, জনগণের মধ্যকার অর্থনৈতিক পার্থক্য বিদূরণ দুর্বল শ্রেণীর লোকদের্ উচ্চমানে উন্নীত করণে যাকাত ঊর্ধ্বমুখী রক এর লক্ষ্য বাস্তবায়িত করে থাকে। কেননা যাকাত থেকে উপকৃত হয়ে বেশীর ভাগ য়েসব লোক যাদের কোনরূপ আয় নেই, যারা সীমিত আয়ের লোক যেমন ফকীর, মিসকীন, ক্রীতাদস, ঋণগ্রস্ত, নিঃস্ব পথিক। কর যখন বেশীর ভাগ ধনী লোকদের কাছ থেকেই গ্রহণ করা হবে প্রকারান্তরে অপ্রতাক্ষ হলেও না জনকল্যাণ মূলক কাজে ব্যয় করে তাদের দিকেই তা ফিরিয়ে দেয়ার জন্য, তখন সরকারই তা তাদের প্রতি আদায় করে তাদের দিকেই তা ফিরিয়ে দেয়ার জন্য, তখন সরকার কৃষিজমির মালিকের কাছ থেকে করা নিচ্ছে, সে তা তাদের দিকিই ফিরিয়ে দিচ্ছে পানি সেছের ব্যবস্থা ও কটিনাশক ছিটিয়ে িইত্যাাদিভাবে যদ্দারা জমি আপদমুক্ত হতে পারে। অনেক সময় প্রাপ্ত কর এর চাইতে ও অনেক বেশীই ফেরত দেয়। কিন্তু যাকাত তো এমন কর, যা ধনী লোকদের নিকট থেকে থেকে গৃহীত হয় দরিদ্র ও অভাগ্রস্ত লোকদের কাছে তাফিরিয়ে দেয়ার লক্ষ্যে এবং দ্বীন ইসলামের ও ইসলামী রাষ্ট্রের কোন কোন সাধারণ জনকল্যাণমূলক কাজ আঞ্জাম দেয়ার জন্যে। এক্ষণে যাকাত নেয়া দরিদ্র জনগণের জীবন মান উন্নত করার উদ্দেশ্যে। যাকাত বিশেষ ভুমিকা পালন করে পারস্পরিক অর্থনৈতিক দূরত্ব কম করা ও এক ধরনের ভারসাম্য প্রতিষ্ঠর জন্যে। আর তার ফসল ঊর্ধ্বমুখী লক্ষ্য অর্জিত হয়, যদিও তার শিরোনামও আনষ্ঠানিক বা সরমারী পরিচিত তা হয় না। তৃতীয়ঃ ঊর্ধ্বমুখী কর এর পক্ষে যারা বড় বড় কথা বলেন ভারসাম্য রক্ষ, পারস্পরিক মালিকানা পরিমাণ কাছাকাছি নিয়ে আসা এবং আয়ের পূনর্বন্টন ইত্যাদি,এ লক্ষ্যের বেশীর ভাগ অর্জনে ইসলাম ভিন্নতর ও বিশেষ ধরনের পন্হা উদ্ভাবন ও অবলম্বর করেছে। ইসলাম সেজন্যে মীরাস বন্টন ও অসীয়তকরণের পন্হা গ্রহণে করেছে। হারাম উপায়ে অর্জিত সম্পদের প্রতিরোধ করা, সুদ ও সম্পদ মওজুদকরণের হারাম করা ইত্যাদি ব্যবস্থার সাহায্য নেয়া হয় যাকাত ফরয করা ছাড়াও। এর প্রত্যেকটিই মালিকত্বকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেয়ার পক্ষে সার্থকভাবে কাজ করে, সম্পদর মালিকত্ব সমান মানে আসে, লোকদের মধ্যে ইনসাফ ্ও সুবিচার কায়েম করে। চতুর্থঃ ঊর্ধ্বমুখিতারা চিন্তর ওপরও বহু আপত্তি রয়েছে। অধিক সংখ্যক লেখকও অর্থনৈতিক চিন্তাবিদ তা উত্থাপিত করেছেন। তন্মধ্যে প্রকট ধরনের কতিপয় আপত্তি এখানে উল্লেখ করা যাচ্ছেঃ ১. ঊর্ধ্বমুখিতার হার নির্ধারণ সম্পন্ন হয় জবরদস্তিমূলকভাবে তা কোন সস্থ কর্মোপযোগী ভিত্তির ্ওপর স্থাপিত নয়। তার পরিণতি সংঘটিত হয় অত্যন্ত রূঢ়তায় যার নিয়ন্ত্রক যেমন কিছু নিই, তিমনি নেই কোন বাধা সন্ধন। ঊর্ধ্বমুখী সংক্রান্ত মতবাদের মধ্যে উজ্জ্বলতম দিক হচ্ছে ত্যাগ স্বীকারের সমতা বিধান।তা কোন স্থিতিশীল ও স্থায়ী প্রতিষ্ঠিত নিয়ম কানুন ভিত্তিক নয়। প্রশ্ন হচ্ছে, ১বা২ কিংবা ততোধিক হারে মূল্য বৃদ্ধির ফলে কি এ সাম্য ও সমতা অর্জিত হবে? ঊর্ধ্বমুখিতা কি আয়ের বৃদ্ধিহারের সাথে পা মিলিয়ে চলবে, না তার তুলনায় মন্হর গতি হবে? করা দিতে বাধ্য লোকেরা কি বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত হবে? কিংবা আয় বণ্টিত হবে নানা খণ্ডের ও অংশেঃ?..........এগুলো বাস্তব অসুবিধা, ঊর্ধ্বমুখী ব্যবস্থার এসব পরিপন্হী এবং তাতে নির্যাতন ও অবিচারের ক্ষেত্রটিকে প্রশস্ত করে দেবে। [ডঃ রশীদ দকর রচিত(আরবী**********)] ২. ক্রমাগত ও অব্যাহত ঊর্ধ্বমুখিতা হিসেবেরে দিক দিয়ে একটি বাস্তব অসম্ভবতা পর্যন্ত পৌছে যায়। তা এভাবে যে ঊর্ধ্বমুখী কর ১% হারের আয় কখনই ১০০০ লীরা পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে, তখন ১২৯% হারে হয়ে যাবে, যখন আয় ১,০০০,০০০ মিলিয়ন লীরা পর্যন্ত উঠে যাবে, তখন তার মূল ও আসল আয়টাওা অতিক্রম করে চলে যাবে এ কর এবং কার্যত ও বাস্তবভাবে তা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। [(আরবী**********)]] ৩.কর ব্যবস্থা ঊর্ধ্বমুখী পদ্ধতি ধনী শ্রেণীকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংসের পরিণতি পর্যন্ত পৌছে দেয় বিশেষ করে কমিউনিস্ট রাষ্ট্রসমূহ যেখানে শ্রেণী সংগ্রাম পারস্পরিক সাংঘর্ষিক হয়ে থাকে এবং এলোমেলোভাবে স্তূপীকৃত মূল ধনসমূহ গলিয়ে প্রবাহিত করে দেবে। [(আরবী**********)]] ৪.ঊর্ধ্বমুখী কর ধার্যকরণ ব্যবস্থা স্বভাবতই সে পরিমাণ সম্পদ আলাদা করে কেটে নেয়া, যা ধনশালী ব্যক্তি পুঁজিকরণ ও উৎপাদনে পুনর্নিয়োগের জন্যে নির্দিষ্ট করে রাখে। তা ভোগব্যবহার করা হলে তাহ্রাসপ্রাপ্ত হয় না। জনগণের সঞ্চয় ও উৎপাদনে পুনর্নিয়োগের উৎসাহে ভাটা পড়ে। এসবেরই পণিতিতে উৎপাদন তৎপরতা এমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে যে, তার পরিমাণ করোর নিকট অস্পষ্ট থাকার কথা নয়। ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ কর এর নিশ্চয়তা যাকাতের নিশ্চয়তা কর ফাঁকি দেয়া কর মানুষের অতীব প্রিয় জিনিসের ওপর ধার্য করা হয়ে থাকে, তা এমন ধন মাল, যার ভালোভাসা মানুষের কাছে খুবই চাখচিক্যপূর্ণ বানিয়ে দেয়া হয়েছে। এ কারণে বহু মানুষই নানাভাবে নানা উপায়ে ও কৌশলেক কর ফাঁকি দতে চেষ্টা করে। এমনকি স্বাভাবিকভাবেও যারা পারস্পরিক লেন দেন আমানত রক্ষার শুভ গুণে অলংকৃত, তারা পর্যন্ত সরকারের সাথে লেন দেনে এ সত্তার অস্তিত্ব অননুভূতভাবে স্বীকৃতব্য। কর ফাঁকি দেয়ার কারণ কর ফাঁকি দেয়ার কারণসমূহের অধিকাংশেই মনস্তাত্ত্বিক। যেমন মালের মালিকের মনে ধন মালের মায়া।সকলেই চায় তার ধনমাল তার হাতেই থাকুক অথবা হয়ত মানে করে যে, কর ধার্য করাই অন্যায় অবিচারমূলক কিংবা সে হয়ত মনে করে, কর দেয়ার বিনিময়ে রাষ্ট্রীয় কর্মতৎপরতার যে ফায়দা সে পাবে তা খুবই সামন্য। কেউ কেউ এমন দারণা পোষণ করতে পারে যে, প্রদত্ত কর সাধারণ জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করা হবে না অথবা এমন ধারণ হতে পারে যে রাষ্ট তাকে যা দেয়,তার চাইতে বেশী তার কাছে দাবি করা হচ্ছে। কেউ আবার।অন্য লোকদের করা ফাঁকি দিতে দেখে সে ও কর না দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, যেন করা না দে্য়ার ব্যাপারে তাদের মধ্যে পুর্ণ সাম্য ও সমতা বজায় থাকে। এরূপ অবস্থা ও লক্ষ্য করা যায় যে, একটা সুনির্দিষ্ট কর ফাঁকি দেয় শুধু এজন্যে যেন অপর একটি জুলুমমূলকভাবে দেয়া কর এর ক্ষতি পূরণ হয়ে যায়। এ ধানের বহু কারণই হতে পারে। কর ফাঁকি দেয়ার ধরন ও পদ্ধতি কর যদি ভারী ও দুর্বহ হয় তাহলে কর ফাঁকি দেয়ার ক্ষেত্র অনেক প্রশস্ত হয়ে পড়ে? কর কে সুবচারপূর্ণ মনে না করা এদিকের কারণ। আর আপরদিকের কারণ হচ্ছে, করলব্ধ সম্পদ উত্তমভাবে ব্যয় হওয়ার ব্যাপারো করদাতার মনে আস্থাও নিশ্চিন্ততা না থাকা। কর ফাঁকি দেয়ার পন্হা ও পদ্ধতি অনেক বিভিন্ন। কর দাতা ব্যক্তি অনেক সময় কর সংক্রান্ত ইনে যেসব ফাকি রয়েছে, তারই আশ্রয় নিয়ে থাকে। এটাকে বিধিবদ্ধভাবে কর এড়ানো কলা চলে অর্থাৎ এ ফাঁকের ফলে লোকটি আনের প্যাঁচে পড়ে না।অনেক সময় আগাম অসত্য হিসেব দিয়েও কর এড়িয়ে যাওয়া হয়। তাতে ভুল বিবৃতি দেয়া থাকে, যেন তার ওপর ভিত্তি করে কর এর পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়। এ আগাম স্বীকৃতি দেয়া থেকে বিরত থেকে ও অনেক সময় কর এড়ানো হয় এ আশায় যে, কর ধার্যকারী প্রতিষ্ঠনের লোকেরা তার প্রতি ভ্রক্ষেপও করবে না, তার ওপর কর ধার্যই হবে না অথবা তার ওপর যে পরিমাণ ধার্য হওয়া উচিত, তার চাইতে কম ধার্য করা হবে। অনেক সময় যন্ত্রপাতির ক্ষয় তার মূল্যের; চাইতে ও বেশী হয়ে যায় এবং অনেক সময় কর ধার্য করার ক্ষেত্র বিষয়ে গোপিন করেও কর এড়ানো হয়ে থাকে। কর ফাঁকি দেয়ার ক্ষতি কর ফাঁকি দেয়ার কারণ বা পন্হা পদ্ধতি যা ই হোক বহু কয়টি কারণে তার পণিীত অত্যস্ত মারাত্মক হয়ে থাকেঃ ক. তা রাজ ভান্ডারকে ক্ষতি গ্রস্ত করে। কেননা কর বাবদ আয় কম হয়ে পড়ে। খ. অন্যান্য মালদার লোকদের ও তা ক্ষতি করে যার ফাঁকি দিতে পারে না কিংবা ফাঁকি দিতে প্রস্তুত হয় না। ফলে তারা এককভাবে কর এর বোঝা ঝামেলা বহন করতে বাধ্য হয় অথচ অন্য কিছু লোক কর এড়াতে সক্ষম হয়। তার ফলে দেশের সকলের ওপর অর্থনৈতিক বোঝা বহনের দায়িত্ব বন্টনে সুবিচার প্রতিষ্ঠা সম্পূর্ণ ব্যাহত হয়। গ. অনেক সময় তদ্দরুণ বর্তমান কর এর মূল্য বৃদ্ধির কারণ ঘটায়, অথবা নতুন করে কর ধার্যকরণের প্রয়োজন সৃষ্টি করে যে কর ফাঁকি দেয়ার দারুন সৃষ্ট ক্ষতি পূরণ হয়। ঘ. একট চরিত্রবান পরিশুদ্ধ সমাজের পক্ষেও তা ক্ষতিকর।কেননা জাতীয় ধন ভাণ্ডার শূন্য বা অপূর্ণ থাকে বলে বহু জনকল্যাণমূলক প্রকল্প প্রত্যাহর করা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। ঙ. এ সবের পরে সবচেয়ে মারত্মক হচ্ছে নৈতিক চরিত্রের ক্ষতি। কেননা ফাঁকি দান তৎপরতা মান সমসিকতার চরমতম বিপর্যয় সুষ্টি করে। বিশ্বস্ততা ও আমানতদারী থাকে না, এক অভিন্ন উম্মতের ব্যক্তিগণের পারস্পরিক সম্পর্ক দুর্বল হয়ে পড়ে। ফাঁকি প্রতিরোধ ও কর দেয়া নিশ্চিত করণ উপরিউক্ত করণে আধুনিক অর্থনৈতিক আেইন প্রণয়ন করীর কর ফাঁকি প্রথা রোধ কল্পে কতিপয় নিরাপত্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। তন্মাধ্যে কয়েকটির উল্লেখ কর যাচ্ছেঃ ১. অর্থবিভাগের ব্যক্তিদের কে ধনীদের গোপনকৃত সম্পদ এবং তাদের প্রতিষ্ঠনিক দলিল দস্তাবেজ সম্পর্কে পূর্ণমাত্রায় অবহিতকরণ। ২. প্রত্যেক অবস্থাপন্ন ব্যক্তিকে তার সেসব ধন মাল সম্পর্কে অগ্রিম জনান দিতে বাধ্য করা সে সব ধন মালের ্ওপর কর ধার্য হতে পারে। প্রকৃত পক্ষে সেসব ধনমালের বর্তমান থাকে জরুরী শর্ত বটে। কোন রাষ্ট্রের আইনে হলফ করে স্বীয় স্বীক্রতির সমর্থন জানানোরও বিধান রাখা হয়েছে। যদি সে হলফ অসত্য প্রমাণিত হয়, তাহলে তাকে মিথ্যা হলফ করারা বিশেষ দণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। ৩. মিথ্যা স্বীকৃতিদাতা সম্পর্কে নির্ভূল সংবাদদানকারীকে পুস্কৃত করণ। ৪. কর কে তার উৎসে আটকে দেয়া। যেমন বেতন ভুক্ত কর্মচারীদের বেতনের ওপর ধার্য কর প্রাপকদের হাতে সে বেতন পৌছার পূর্বেই কর্তন করে রাখা। ৫. কর ফাঁকিদাতাদের ওপর জরিমানা ও শাস্তি বিধান করা। ৬. ঋণগ্রস্তদের ধন মালে কর ধার্য করে জাতীয় ধন ভাণ্ডারের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠা করা, তা অপরাপর প্রাপকের পূর্বে আদায় করার ব্যবস্থা করা। [এ আলোচনার জন্যে আমরা ডঃআবদুল হাকীমরিফায়ী ও ডঃ হুসাইন খাল্লাফ লিখিত (আরবী*********) নহদাতুল মিসরীয়া কর্তক প্রকাশিত গ্রন্থের সাহায্য নিয়েছি।] এসব সত্ত্বেও অর্থ বিভাগের লোকেরা অনেক সময় কর ফাঁকি দানের প্রতিরোধে সম্পূর্ণ অক্ষমতার কথা ঘোষণা করে থাকে। বিশেষ করে যখন সুনির্দিষ্ট ধন মাল সবটাই অথবা অংশিক গোপন করা সম্ভব হয়। এরূপ অবস্থায় এ রোগের চিকিৎসার জন্যে আেইন প্রয়োগের পূর্বে মান মানসিকতার পরিবর্তন অপরিহার্য ইসলামী শরীয়াতে যাকাতের নিশ্চয়তা কর ধার্যকরণের পরিণতি যখন এরূপ শরীয়াত পালনে বাধ্য বহু লোক যখন যথেষ্ট রাজনৈতিক পরিপক্কতা পায়নি এবং সাধারণ কল্যাণমূলক কাজের যথাযথ মূল্য ও মর্যাদাও জানতে পারেনি ও প্রেক্ষিতে যাকাত ধার্যকরণের অবস্থাটা কর ধার্যকরণের অবস্থা থেকে বহুদিক দিয়েই সম্পূর্ণ ভিন্নতার ও স্বতন্ত্র। মানুষ যে দৃষ্টিতে কর কে দেখে, সেই দৃষ্টিতে যাকাতকে কেউ দেখে না। দ্বীনী ও নৈতিক নিশ্চয়তা মুসলিম ব্যক্তিমাত্রই অনুভব করে যে, যাকাত তার ও তার সরকার বা আদায়করী প্রতিষ্ঠানের মধ্যবর্তী সম্পর্কেই ব্যাপার নয়। বরং সবকিছুর পূর্বে তা তার ও তার আল্লাহর মধ্যকার সম্পর্কের ব্যাপার। আর বস্তুত তাই ইবাদতের প্রকৃত তাৎপর্য, যে সম্পর্কে আমরা ইতপূর্বে ইতপূর্বে একাধিক স্থানে বিস্থারিত কথা বলেছি। আমাদের ফিকাহবিদগণ এ তাৎপযের ব্যাখ্যা দিয়েছেন সুস্পষ্ট ও বলিষ্ঠ ভায়ায়। কাযী আবূ বকর ইবনুল আরাবী আল মালিকী লিখেছেনঃ প্রকৃত পাওনাদার তো স্বয়ং আল্লাহ তাআলা। কিন্তু তিনি তাঁর এ পাওনার অধিকারটা তাদের জন্য তাদের জন্য নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন, যাদের রিযিকের দায়ত্ব তিনি নিজে গ্রহণ করেছেন এই বলেঃ(আরবী**********) পৃথিবীতে যে কোন প্রাণীই রয়েছে, তার ই রিযিকের দায়িত্ব স্বয়ং আল্লাহর ওপর বর্তেছে। [(আরবী*********] আলিমকুল শিরোমনি উপাধি প্রাপ্ত হানাফী ফিকাহবিদ আল কাসানী লিখেছেনঃ যাকাতের মূল কথা হচ্ছে ধন মালের নিসাব পরিমাণ থেকে একটা অংশ আল্লাহর জন্যে বের করে দেয়া এবং তা তারই উদ্দেশ্যে সমর্পিত করা। আর তাতে মালিকের হাত তার ওপর থেকে তুলে নিয়ে কোন ফকীরকে তা মালিক বানেয়ে, তা হন্তান্তর করা আথবা আল্লাহর প্রতিনিধিত্বকারী হস্তে সোপর্দ করা ফকীরকে মালিক বানানো ও তার কাছে সমর্পণ করার লক্ষ্যে। তার দলিল হচ্ছে আল্লাহর বাণীঃ (আরবী**********) এ লোকেরা কি জানে না যে, আল্লাহ নিজেই ত্ওবা কবুল করে থাকেন তাঁর বান্দগণের পক্ষ থেকে এবং সাদকা দান গ্রহণ করেন। [(আরবী**********)] নবী করীম (স) বলেছেনঃ দান আল্লাহর হাতে পড়ে ফকীরের হাতে পড়ার আগেই। [ ইবনে জরীর এ হাদীসটি তাঁর তাফসীরে উদ্ধৃত করেছেন েইবনে মাসউদের উক্তি হিসেবে বিভিন্ন কাছাকাছি ভাষা ও শব্দে যেমন ১৭১৬৩-১৭১৬৬ নম্বর আসার, তাফসীরে তাবারী ১৪ খণ্ড ৪৫৯-৪৬১ পৃ. (আরবী*********) হযরত আয়েশা থেকে রাসূল (স) এর উক্তি হিসেবেঃ এক ব্যক্তি তার পবিত্র উপার্জন থেকে একটা দান করে। আর আল্লাহ তো পবিত্র জিনিসি ছাড়া গ্রহণই করেণই না।তখন আল্লাহ মহান তা নিজ হাতে কবুল করে থাকেন। পরে সে তা দেখতে পায় তার পুরুষ অশ্ব শাবক বা তার ভৃত্যকে বা তার প্রাচীন। হাদীসটি েউদ্ধৃত করেছেন বাহার, বর্ণনাকারী সকলে সিকাহ। (আরবী**********) গ্রন্থেও তা উদ্ধুত হয়েছে।] আর যেহেতু যাকাত একটি ইবাদত আর ইবাদত হচ্ছে একান্তভাবে আল্লাহর জন্যেই যবাতীয় কাজ সম্পন্ন করা। [(আরবী**********)] এ কারণে তা এড়াতে খুব কম লোকই চাইতে পারে। যাকাত দিতে বাধা ব্যক্তি তার ওপর কোনরূপ জুলুম করা হচ্ছে এমন কথা আনুভর করে না। মনে করে না যে, যাকাত দিতে বাধ্য করে তার ওপর কোন রূপ অবিচার করা হয়েছে। কেননা এ বিধান প্রবর্তনকারী কোন মানুষ তো নয় যে, সে পক্ষপাতিত্ব করবে বা অবিচার করবে। তিনি সুবিচারপূর্ণ বিধান প্রবর্তক, যিনি বান্দারেদর ওপর জুলুম করেন না। কেননা তিনিই তো রব্বুল ইবাদ সমস্ত মানুষের ও রব্ব। আর যাকাত যখন ব্যক্তি ও তার আল্লাহর মধ্যকার সম্পর্কের মাধ্যম সর্বোচ্চ পর্যায়ে, তখন সে লোক কি করে যাকাত দিতে পারে তাঁর বিধান অমান্য করে, যাঁর কাছে কোন কিছুই গোপন থাকতে পারে না, যিনি গোপন প্রকাশ্য সব কিছুই জানেন, সে লোক এও জানে যে আল্লাহ তার হিসেব নেবেন পুংখানুপুংখভাবে সেইদিন, যেদিন মানুষ রাব্বুল আলামনের সমীপে দাড়িয়ে যাবে? সহীহ ইসলামী প্রশিক্ষণ মুসলিম ব্যক্তির মনে মগজে যে ইসলামী চরিত্রের বীজ বপন করে, তাই হচ্ছে রীতিমত যাকাত আদায় হওয়ার অত্যন্ত বলিষ্ঠ ও নির্ভরযোগ্য সূত্র। মুসীলিম ব্যক্তির লালন প্রশিক্ষণ হয় দুনিয়ার প্রতি অনাসক্তির ভাবধারায় এবং পরকালীন কল্যাণের প্রতি আগ্রহ উৎসাহ সৃষ্টির মাধ্যমে। আল্লাহর কাছে যা আছে তা পাওয়াই হয় তাঁর বড় কামনা ও বাসনা। এজন্যে আল্লাহর পথে ব্যয় করতে আল্লাহর ও তাঁর রাসূলের ভালোবাসাকেও সবকিছুর ওপর অগ্রাধিকার দিতে সে সব সময়ই প্রস্তুত থাকে। কোন সময় যদি এমন হয় যে, দুনিয়া ও তাতে কল্যাণ, সম্পর্ক স্বাদ আনন্দ স্ফূর্তি মানুষের লোভনীয়, আকর্য়ণীয় সমস্ত কিছু একদিকে আর আল্লাহ ও তাঁর রাসূলর ভালোবাসা এবং তার পথে জিহাদ অপরদিকে দুটির একটি মাত্র গ্রহণ করা যাবে তাহলে মুমিন বান্দ আল্লাহর রাসূল এবং পরকালের দিকটি গ্রহণ করতে কখনই কণ্ঠিত হবে না ইতস্তত করবে না। কুরআনের বিপ্লবী সুস্পষ্টরূপে ও চূড়ান্তভাবে সম্পর্ক ছিন্নকারী ঘোষণা এই প্রেক্ষিতে অনুধাবনীয়। তাতে আল্লাহর তাআলা মুমিনদের সম্বোধন করে বলেছেনঃ (আরবী**********) বল. তোমাদের বাপ দাদা তোমাদের ভাই বেরাদর, তোমাদের স্বামী স্ত্রী, তোমদের বংশ গোত্র, ধন মাল যা তোমরা সংগ্রহ সঞ্চয় করেছ ও ব্যবসায় যার মন্দ ভাবকে তোমরা সব সময় ভয়,ঘর বাড়ী যা তোমরা পসন্দ কর যদি অধিক প্রিয় হয় তোমদের কাছে আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং তাঁর পথে জিহাদের তুলনায় তাহলে তোমরা অপেক্ষা কর যতক্ষণ না আল্লাহ তাঁর চূড়ান্ত ফায়সালা নিয়ে আসেন। আর আল্লাহ ফাসিক লোকদেরে হেদায়েত দান করেন না। [(আরবী**********)] এ প্রশিক্ষণ মুসলিম ব্যক্তিকে এই চেতনায় সমৃদ্ধ করেছে যে, তার কাছে যে ধন মাল রয়েছে তা আমানতদার মাত্র্। সে এক্ষণে প্রশ্ন করছে, সে কি ব্যয় করবে? তার কাছে রক্ষিত ধন মাল নিয়ে সে কি করবে? কোন কাজে লাগাবে? কুরআন মজদেই বলা হয়েছে মুমিন লোকেরা রাসুলে করীম (স) কে দুই দুইবার জিজ্ঞেস করেছে, তারা কি ব্যয় করবে? কুরআন একবার তার জবাব দিয়েছে খরচের জিনিস সম্পর্কে বলে আ দ্বিতীয়বার তার ব্যয়ের খাত বলে দিয়ে। (আরবী**********) লোকেরা তোমার কাছে জানতে চায়, তারা কি ব্যয় করবে? বলঃ যা কিছু প্রঃয়োজনতিরিক্ত [(আরবী*******)] (আরবী*********) লোকেরা জানতে চায়, তারা কিসে ব্যয় করবে? বলঃ যে ধন মাল তোমরা ব্যয় করবে তা পিতামাতা নিকটত্মীয়, ইয়াতীম, মিসকীন ও নিঃস্ব পথিকের জন্যে।আর তোমরা যে ভাল কাজই করবে আল্লাহ সে বিষয়ে পরামাত্রায় অবহিত। [(আরবী**********)] হাদীসে উদ্ধৃত হয়েছে আনাস ইবনে মালিক বর্ণিত, তিনি বলেছেনঃ বনূ তামীম গোত্রের এক ব্যাক্তি রাসূলে করীম (স) এর কাছে এসে বললেঃ হে রাসূল আমার বিপুল ধন সম্পদ রয়েছে।সেই সাথে আছে অনেক পরিজন, ধন মাল ও উপস্থিত লোকজন।এখন আমরকে জানান, আমি কি করব? বিভাবে তা ব্যয় করব? তখন রাসুলে করীম (স) বললেন ঃ তোমার ধন মালের যাকাত দিয়ে দেবে। তা তোমাকে পবিত্র করবে। তোমার নিকটাত্মীয়দের সাথে ছেলায়ে রেহমী রক্ষা করবে এবং মিসকীন, প্রতিবেশী ও ভিক্ষাপ্রার্থীর যে হক আছে তা অবশ্যই জানবে। লোকটি বললঃ হে রাসূল! আমার জন্যে ব্যাপারটি কম করে দিন। তখন রাসূলে করীম (স) বললেনঃ নিকটাত্মীয়কে তার হক দাও মিসকীন নিংস্ব পথিককেও। আর বেহুদা খরচ করো না। লোকটি বললঃ হে রাসূল ! আমি যদি আপনার প্রতিনিধির কাছে যাকাত আদায় করে দিই, তাহলে কি আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কাছে দায়িত্বমক্ত হতে পারব? রাসূলে করীম (স) বললেনঃ হ্যাঁ তুমি তা আমার প্রতিনিধির হাতে দিয়ে দিলে তার দায়ত দায়িত্ব থেকে তুমি মুক্ত হয়ে যাবে। এ ব্যাপারে কোন গুনাহ হলে তা হবে তার যে তা পরিবর্তন করবে। [ হায়সামী বলেছেনঃ (আরবী*****) ৩য় খণ্ডের ৬৩ পৃষ্ঠায়ঃ হাদীসটি আহমাদ এবং তাবরানী (আরবী*****)গ্রন্থে উদ্ধৃত করেছেঃন। এর বর্ণনাকারী সকলেই সহীহ সিকাহ।] ব্যাপারটি কেবল বিপুল ধন সম্পদের মালিকদের পর্যন্তই ঠেকে থাকেনি। বহু সংখ্যক অল্প ধন মালের মালিকও রাসূলের করীম (স) এর কাছে এসে তা নিয়ে কি করা যাবে? বলে প্রশ্ন করেছে। আবূ হুরায়রা (রা) বর্ণনা করেছেনঃ এক ব্যক্তি বললঃ হে রাসূল! আমার কাছে একটি স্বর্ণ মুদ্রা আছে। আমি তা কি করব? বললেনঃ তুমি সেটি তোমার নিজের জন্যে ব্যয় কর। বললেঃ আমার কাছে আরও একটি আছে এখন ? বললেন তা ব্যয় কর তোমার সন্তানের জন্য। বলল, আমার কাছে আরও একটি রয়েছে? বললেন, সেটি ব্যয় কর তোমার খাদেমের জন্যে। বললাঃ আমার কাছে আরও একটি আছে, বললেনঃ তখন তুমি বিবেছন করে যা করার করবে। [হাদীসটি আবূ দউদ নাসায়ী ও হাকেম উদ্ধত করেছেন এবং মুসীলিমের শর্তনুযায়ী সহীহ বলে মত দিয়েছেন। যাহবী তা সমর্থন করেছেন। (আরবী**********)১মখণ্ডের ৪১৫ পৃষ্ঠায় বর্ণনা আছ্] শুধু তাই নয়, যার কাছে ধন মাল জমেছে, এমন ব্যক্তি ও সব কিছু সঙ্গে নিয়ে রাসূলে করীম (স) এর কাছে এলে তা উপযুক্ত ব্যয় ক্ষেত্রে তা ব্যয় করার উদ্দেশ্যে, যদিও তা তার নিজের জন্যেই প্রয়োজন। তখন নবী করীম (স) তাকে এ ধরনের কাজ থেকে বিরত রাখার উদ্দেশ্যে তাকে ধমক দিয়েছেন। হযরত জাবির (রা) ব লেছেন ঃ আমরা রাসূলে করীম (স) এর কাছে উপস্থিহ ছিলাম। এমন সময় এক ব্যক্তি একটি ডিমের মত স্বর্ণপিণ্ড নিয়ে তাঁর কাছে উপস্থিত হল। বললঃ হে রাসূলঃ আমি এইটা খনি; থেকে পেয়েছি। আপনি এটি গ্রহণ করুন। এটি আমি দান করলাম। অবশ্য এটি ছাড়া আমার আর কিছু নেই। নব করীম (স) তাঁর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। পরে লোকটি তাঁর দক্ষিণ পাশ দিয়ে তাঁর সম্মুখে এলো ও পূর্বরূপ কথা বলল। তখনও তিনিও তিনি তার কথার দিকে ভ্রক্ষেপ করলেন না। পরে আবার বাম দিক থেকে তাঁর সম্মুখেএসে সেই কথা বললে। তখনও তিনি মুখ ফিরিয়ে নিলেন। পরে পিছন থেকে বলল। তখন নবী করীম (স) পিণ্ডটি তার হাত থেকে নিয়ে লোক টিকে লক্ষ্য করে আহত করত। পরে তিনি বললেনঃ তোমাদের এক একজন তার সব মালিকানা সম্পদ নিয়ে আসে, বলে এটা দান। পরে সেই লোকদের ধর পাকড় করতে থাকে ভিক্ষা পাওয়ার জন্যে। আসলে উত্তম দান তো তা যা ধনাঢ্যতার প্রকাশ থেকে দেয়া হয়। [২আহমাদ ও তাবারানী (আরবী**********) গ্রন্থে উদ্ধৃত করেছেন বর্ণনাকারী সকলে সিকাহ। যেমন (আরবী********) এতে উ্দ্ধৃত করেছেন (আরবী**********) হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন। যহব তা সমর্থন করেছেন। (আরবী**********)] বস্তুত এ হচ্ছে সহীহ সঠিক সত্য ঈমানের লক্ষণ আর তা ইসলামী প্রশিক্ষণেরই ফসল। তা মুসলিমকে এমন বানিয়েছে যে, সে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই দায়িত্বশীলের কাছে উপস্থিত হয়েত দাবি জানিয়েছে, তা মালের যাকাত যার কেউ দাবি জানায়নি গ্রহণ করা ও নিয়ে নেয়া হোক। কিছু সংখ্যক সিরিয়াবাসী নিজেদের িইচ্ছায় হযরত উমরের কাছে উপস্থিত হয়ে দাবি জানাচ্ছো, তাদের কাছ থেকে ঘোড়ার যাকাত নিয়ে নেয়া হোক। তারা বলেঃ আমরা বহু ধন মাল পেয়েছি ঘোড়া ও ক্রীতাদাস থেকে। আমরা পসন্দ করি, তাতে যাকাত ধার্য হোক ও তা আমাদের জন্যে পবিত্রতার মাধ্যম হোক। [আহমাদ ও তাবারানী ২আহমাদ ও তাবারানী (আরবী**********) গ্রন্থে উদ্ধৃত করেছেন বর্ণনাকারী সকলে সিকাহ। যেমন (আরবী********) এতে উ্দ্ধৃত করেছেন (আরবী**********) হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন। যহব তা সমর্থন করেছেন। (আরবী**********) গ্রন্থে উদ্ধৃত করেছেন বর্ণনাকারী সকলে সিকাহ। যেমন ২আহমাদ ও তাবারানী (আরবী**********) গ্রন্থে উদ্ধৃত করেছেন বর্ণনাকারী সকলে সিকাহ। যেমন (আরবী********) এতে উ্দ্ধৃত করেছেন (আরবী**********) হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন। যহব তা সমর্থন করেছেন। (আরবী**********)এতে উদ্ধৃত করেছেন ২আহমাদ ও তাবারানী (আরবী**********) গ্রন্থে উদ্ধৃত করেছেন বর্ণনাকারী সকলে সিকাহ। যেমন (আরবী********) এতে উ্দ্ধৃত করেছেন (আরবী**********) হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন। যহব তা সমর্থন করেছেন। (আরবী**********) হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন। যাহবী তহা সমর্থন করেছেন। [আহমাদ ও তাবারানী (আরবী**********) গ্রন্থে উদ্ধৃত করেছেন বর্ণনাকারী সকলে সিকাহ। যেমন (আরবী********) এতে উ্দ্ধৃত করেছেন (আরবী**********) হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন। যহব তা সমর্থন করেছেন। (আরবী**********)] একজন এল মধুর যাকাত সঙ্গে নিয়ে। সে বললে যে মালের যাকাত দেয়া হয়নি, তাতে কোন কল্যাণ নেই। [বাজ্জার ও তাবারানী (আরবী**********) গ্রন্থে উদ্ধৃত বলেছেন। মুনীর ইবনে আবদুল্লাহ এর একজন বর্ণনাকারী যয়ীফ। যেমন (আরবী**********) তে বলা হয়েছে।] ইবনে মাসউদ আর একজনক লোক। তিনি তাঁর কৃষি কসলের ওশর কিংবা অর্ধ ওশর দিয়েই ক্ষান্ত হননি। তিনি ফল ভাগ করেন। এক ভাগ পরিবাবর্গের জন্যে জমা রাখেন। এক ভাগ জমির বীজ হিসেবে ফিরিয়ে দেন। আ অপর একভাগ দান করে দেন। [তাবরানী উদ্ধৃত করেছেন (আরবী********) গ্রন্থে, মাসরুক থেকে। এর বর্ণনাকারী যেমন(আরবী********) গ্রন্থে (আরবী********) উল্লিখিত হয়েছে।] মুসলিম ব্যক্তি বিশ্বাস করেন, তিনি যাকাত দিয়েই নিজেকে এবং তাঁর ধন-মাল পবিত্র করে নিতে পারেন। এ যাকাতই হচ্ছে তা ধন-মাল ও তার প্রবৃদ্ধির রক্ষা দুর্গ, বাহ্যত, তাতে পরিমাণ হ্রাস যতই সূচিত হোক না কেন। এ পর্যায়েই কুরবান মাজীদ বলেছে (আরবী********) তোমরা যে যাকাত দিচ্ছ আল্লাহর সন্তষ্টি লাভের লক্ষ্যে, জেনে রাখ, এরাই সম্পদ বৃদ্ধিকারী(আরবী********) শয়তান তোমদেরকে দারিদ্র্যের ভয় দেখায় এবং নিজেই কাজের আদেশ করে অথচ আল্লাহ তোমদেরকে ওয়াদা দেন তাঁর কাছ থেকে ক্ষমা ও অনুগ্রহ পাওয়ার। (আরবী********) তোমরা যা ব্যয় কর, তার পরিপূরক তিনিই এনে দেন এবং তিনি উত্তম রিযিক দানকারী। আসল ব্যাপার হচ্ছে,বহু মুসলিমেই এমন আছে, যাদের কাছে যা চাওয়া হয়, মনের খুশীতে তাঁরা চাইতেও অনেক বেশী দিতে থাকেন। এতেই তাদের চক্ষুর শীতলতা। এ পর্যায়ে রাসূলে করীম (স) এর যুগের দুটি বাস্তব দৃষ্টান্ত এখানে তুলে ধরা যথেষ্ট হবে বলে মনে করি। তা থেকে ঈমান ও আকীদাহ প্রসীত দ্বীনী নিশ্চয়তার প্রমাণ পা্ওয়া যাবে অবিলম্বে ফরয যাকাত আদায় করার ব্যাপারে। বরং যা ফরয, তার চাইতে ও বেশী দিয়ে দেয়ার উজ্জ্বলতাম নিদর্শন। আবূ দউদ তাঁর সনদে সুয়াইদ ইবনে গাফালাহ থেকে বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেনঃ আমি ভ্রমণ করেছি (অথবা বলেছেন, তিনি ভমণ করেছেন< তিনি আমাকে জানিয়েছেন), নবী করীম (স) নিয়োজিত একজন যাকাত আদায়কারীর সঙ্গী হয়ে। নবী করমি(স) এর সময়ই দেখলামঃ তুমি দুগ্ধদানকারী জন্তু) গ্রহণ করবে না, দুই বিছিন্ন কে একত্রিত করবে না এবং একত্রিতকে বিচ্ছিন্ন করবে না।আর সে পানির কাছে উপস্থিত হত, যখন ছাগলগুলো তথায় উপস্থিত করা হত। বলতঃ তোমরা তোমাদের মালের যাকাত দিয়ে দাও। তখন একজন লোক তার ঝুটি ধারী উষ্ট্রীকে দেবার সংকল্প করল। বললেন, আমি বললামঃ সে আবূ সালেহদ, ঝুটিধারী কি? বললেনঃ বড় ঝুটিধারী উষ্ট্রী। বললেনঃ পরে সে লোক তো গ্রহণ করতেহ অস্বীকার করল। পরে তার চাইতে নিম্ন মানের একটাকে লাগাম বেঁধে দিল। সে সেটি গ্রহণ করল বললঃ আমি এটি গ্রহণ করছি। আমি ভয় করছি, রাসূলে বাছাই করা উট ইচ্ছা করে নিয়েছ। [ মুনযেরী বলেছেন, নাসয়ী ও ইবনে মাজাহ এটি উদ্ধৃত করেছেন। এর সনদে হিলাল ইবনে হুবাব রয়েছেন, একাধিক বিশেষজ্ঞ তাকে সিকাহ বলেছেন। তবে কেউ কেউ তা সম্পর্কে আপত্তিও তুলেছেন। (আরবী***) দারে কুতনী ও বায়হাকীও উদ্ধৃত করেছেন, যেমন (আরবী*******) ত বলা হয়েছে।] উবাইদ ইবনে কায়াব (রা) থেকে বর্ণিত, বলেছেনঃ রাসূলে করমি (স) আ মাকে যাকাত আদয়কারী বনিয়ে পাঠালেন। আমি এক ব্যক্তির কাছে পৌঁছলাম। আমার সম্মুখে তার সব মাল যখন একত্রিত করা হল তখন তাতে একটি দুই বছরে উপনীত উষ্ট্রী শাবক ছাড়া আরো কিছুই গ্রহণীয় পেলাম না তখন আমি তাকে বললামঃ তুমি এ শাবকটি দিয়ে দাও, এটিই তোমার যাকাত। লোকটি বললঃ এটি? এটির তো দুধও নেই পিঠও নেই। কিন্ত অপর একটি যৌবন বয়সের বিরাট চর্বিদার উট আছে। বললঃ আপনি বরং সেটি নিন। আমি বললামঃ আমি সেটি নেব না, যতক্ষণ পর্যন্ত গ্রহণ করার জন্যে আমি আদিষ্ট হচ্ছি। নবী করীম (স) তোমার কাছেই রয়েছেন। তুমি ইচ্ছা করলে এটি রাসূলে করীম (স) এর কাছে নিয়ে যাও এবং আমাকে যেমন দেখিয়েছ ও নিতে বলছ তেমনি তাঁকে ও দেখাও এবং নিতে বল। তিনি যদি এটি তোমার কাছ থেকে গ্রহণ করতে প্রস্তুত হন, তাহলে আমি তা নিয়েক যাব। অতঃপর লোকটি আমার সাথে; চলল। যে উচটি আমাকে দেখিয়েছিল সেটিও সঙ্গে নিয়ে রওয়অন হল। শেষ পর্যন্ত আমরা রাসূলে করীম (স) এর কাছে উপস্থিত হলাম। লোকটি বললঃ হে রাসূল (স)!আমার কাছে আপনার প্রেরিত লোক আমার মালের যাকাত নেবার জন্যে এসেছিল। এস দাঁড়ায়নি কখনই। আমি তার সম্মুখে আমার সব মাল উপস্থিত করেছিলাম। লোকটি মনে করল সে মালে আমার আছে একটি দুই বছরে উপনীত শাবকমাত্র ফরয। কিন্তু সেটির যেমন দুধ নেই, তেমনি িপঠ্ও নেই। তার সম্মুখে আমি একটি বিরাঠ যুবক বয়সের চর্বিদার উট পেশ করলাম ও উদ্দশ্যে যে, সে সেটি গ্রহণ করবে। কিন্তু সে অস্বীকার করল ও আমাকে ফিরিয়ে দিল। সেই কথিত উটটি এখানে আপনার সম্মখে রয়েছে। আমি ওটিকে আপনার কাছে নিয়ে এসেছি, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি গ্রহণ করুণ। তখন নবী করীম (স) তাকে বললেনঃ এটিই তোমার দেয়। তুমি যদি অতি উত্তম জিনিস নফল হিসেবে দান কর, তাহলে আল্লাহই তোমাকে সেজন্যে পুরস্কৃত করবেন। আমি ওটিক তোমার পক্ষ থেকে গ্রহণ করলাম। বললঃ ঠিক আছে, ওটি আপনার সম্মখেই রয়েছে হে রাসূল। আমি দেবার জন্যেই নিয়ে এসেছি, আপনি ওটি গ্রহণ করুন। পরে রাসূলে করীম (স) সেটি নিয়ে নেয়ারজন্যে আদেশ করলেন। এবং তার জন্যে তার জন্যে, তার ধন-মালের বরকতের জন্যে দোআ করলেণ। [ হাদীসটি আহমদ আবূ দাউদ ও হাকেম উদ্ধৃত করেছেন। হাকেম হাদীসটিকে মুসলিমের শর্তে সহীহ বলেছেন। যাহবী তা সমর্থন করেছেন (আরবী********) হাদীসটির সমদে মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক রয়েছেন। তাঁর বর্ণত তাদীসকে দলিল হিসেবে গ্রহণ করণে ইমাম গণেল মধ্যে মত পার্থক্যের সৃষ্টি হয়েছে যখন তা (আরবী********) করে বর্ণনা করা হয়। কিন্তু এখানে স্পষ্ট ভাষায় (আরবী********) বলে বর্ণনা করেছেন। (আরবী********) নববী (আরবী******) গ্রন্থে (আরবী********) লিখেচেনঃ আহমাদ ও বাড়াতি বলেছেন ঃ বর্ণনাকারী উবাউদ ইবনে কায়ব থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি হচ্ছেন উমারাতা ইবনে আমর ইবনে হাজম। মুয়াবিয়ার খিলাফতকালে তাঁকে যাকাত সংগ্রহের দায়িত্বশীল বানানো হয়েছিল। তখন সে ব্যক্তির কাছ থেকে এক হাজার পাঁচশত উষ্টে্র যাকাত বাবদ ত্রিশটি উষ্ট্য গ্রহণ করা হয়েছিল। আল্লাহ ধান-মালে বরকতের জন্যে তাঁর রাসূলের দোআ কবূল করেছিলেন।] আহমাদ হাদীসের বর্ণনা এনেছেন এভাবেঃ লোকটি বললঃ আমি আল্লাহকে এমন জন্তু করয দেব না, যার দুধ নেই পিঠও নেই। [ হাদীসটি আহমদ আবূ দাউদ ও হাকেম উদ্ধৃত করেছেন। হাকেম হাদীসটিকে মুসলিমের শর্তে সহীহ বলেছেন,। যাহবী তা সমর্থন করেছেন(আরবী********) হাদীসটির সমদে মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক রয়েছেন। তাঁর বর্ণত তাদীসকে দলিল হিসেবে গ্রহণ করণে ইমাম গণেল মধ্যে মত পার্থক্যের সৃষ্টি হয়েছে যখন তা (আরবী********) করে বর্ণনা করা হয়।কিন্তু এখানে স্পষ্ট ভাষায় (আরবী********) বলে বর্ণনা করেছেন। (আরবী********) নববী (আরবী********) গ্রন্থে (আরবী********) লিখেচেনঃ আহমাদ ও বাড়াতি বলেছেন ঃ বর্ণনাকারী উবাউদ ইবনে কায়ব থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি হচ্ছেন উমারাতা ইবনে আমর ইবনে হাজম। মুয়াবিয়ার খিলাফতকালে তাঁকে যাকাত সংগ্রহের দায়িত্বশীল বানানো হয়েছিল। তখন সে ব্যক্তির কাছ থেকে এক হাজার পাঁচশত উষ্টে্র যাকাত বাবদ ত্রিশটি উষ্ট্য গ্রহণ করা হয়েছিল। আল্লাহ ধান-মালে বরকতের জন্যে তাঁর রাসূলের দোআ কবূল করেছিলেন।] সে লোক বিশ্বাস করত যে, তার ও আল্লাহর মধ্যকার সম্পর্ক সর্বাগ্রে। সে আল্লাহকে সে উট করয দিতে লজ্জাবোধ করছিল, যার দ্বারা কোন ফায়দা পাওয়া যাবে না। সেটির পিঠনেই বলে পষ্ঠে সওয়ার চলবে না, ওলান নেই বলে দুধও দোহানো যাবে না। বস্তুত ওদ্বীনী নিশ্চয়তাই হচ্ছে যাকাত ফাঁকি দেয়া থেকে বাঁচাতে নির্ভরযোগ্য রক্ষাকবচ অথচ পাশ্চাত্য দেশসমূহে এ ফাঁকিই হচ্ছে এখান কার একমাত্র গৌরবের বিষয়। ফ্রান্সের মঁসিয়ে ফাসান উরিতন ১৯৩৬ সনে ঘোষণা করেছিলেন, যদি ফাঁকি না চলত, তাহলে কর এর হার অনেক হ্রাস পেত। মঁসি সিরী বলেছিলেন, ফাঁকি দানের দিকে ইঙ্গিত করে ইল্লেখ করেছিলেনঃ যারা কর ফাঁকি দেয় তারা এমন সব উপানের আশ্রয় নেয় যার কতকটা আইনসম্মত আর অপরা কতকটা আইন বিরোধী। তিনি মনে করেন, এ সব উপায় ইনের মৌল ইঙ্গিত করেছেনঃ অর্থনৈতিক ফাঁকিরোধ করার বস্তুব পন্হা উদ্ঘাটনে অর্থমন্ত্রী সক্ষম হলে বাজেটের অক্ষমতা অনেকখানি দূর করা সম্ভব পর হত। [(আরবী********)] আইনগত ও সংগঠনিক নিশ্চয়তা এসব দ্বীনী ও নৈতিক নিশ্চয়তার প্রধানত নির্ভর হচ্ছে মানুষের মন মানসিকতা ও ঈমানের ওপর। ইসলামী শরীয়াত এসব ছাড়াও অন্যান্য আইন গত ও সাংগঠনিক নিশ্চয়তার বিধান করেছে। ইসলামী রাষ্ট্র যাকাতের নিশ্চয়তার জন্যে তাও কাজে লাগায়। বিশেষ করে কিছু লোকের ঈমান যদি দুর্বল হয়ে পড়ে তাহলে এ উপায়েও নিশ্চয়তার বিধান করতে হবে। তন্মাধ্যে উল্লেখ্যঃ যাকাত সংগ্রহকারীদের সহযোগিতা করা ও কোন জিনিস গোপন না করার নির্দেশ এপর্যায়ে বহু সংখ্যক হাদীস এসেছে, যার কোন কোনটি আমরা ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি। এ পর্যায়েরই একটি হাদীস হচ্ছে রাসূলে করীম (স) বলেছেন, তোমাদের কছে এমন সব অশ্বারোহিরা আসবে, যাদের ওপর তোমরা অসন্তুষ্ট ওক্রুদ্ধ থাকবে। তারা যখনই তোমাদের কাছে আসবে তাদের প্রতি শুভাগমন জানাবে এবং তারা যে উদ্দেশ্য আসবে তার ও তাদের মধ্যে প্রতিবন্ধক দূর করে দেবে। তারা যডিদ সুবিচার করে তবে তাদের নিজেদের জন্যেই কল্যাণ হবে। আ তারা জুলুম করলে তার খারাপ পরিণতি তাদেরই ভোগ করতে হবে। তোমাদের যাকাত পূর্ণ মাত্রার দিয়ে দিলে তাদের সন্তুষ্টি ঘটবে, তখন তারা অবশ্যই তোমাদের কল্যাণের জন্যে দোআ করবে। [আবূ দাউদ তাঁর সুনান গ্রন্থে হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেনঃ (আরবী********) হাদীসটির সনদে আবুল গবন তিনি হচ্ছেন সাবিত ইবনে কাইস আল মাদনী আল গিফারী স্মরণ শক্তির দিক দিয়ে সমালোচিত বর্ণনাকারী। তা সত্ত্বে ও ইমাম আহমাদ তাঁকে সিকাহ বলেছেন। (আরবী********) জারীর ইবনে আবদুল্লাহ (রা) থেকে বর্ণত, তিনি বলেছেনঃ আরব বেদুঈনদের কিছু লোক রাসূলে করীম (স) এর কাছে উপস্থিত হয়ে বললঃ যাকাত আদায়কারী সংগ্রহকারী লোকেরা আমাদের কাছে আসে তার আমদের ওপর জুলুম করে। নবী করীম (স) বললেনঃ তোমরা তোমাদের কাছে আগত যাকাত আদায়কারী লোকদের সন্তুষ্ট করে দাও। তারা বললঃ তারা আমাদের ওপর জুলুম করলেও কি আমার তাই করব? রাসূলে করীম (স) বললেন ঃ হ্যাঁ তোমরা যাকাত আদয়কারী লোকদের সন্তষ্ট করে দাও জরীর বললেনঃ রাসূলে করীম (স) এর এ কথা শোনার পার যে যাকাত আদায়করীই আমাদের কাছে এসেছে, সেই আমাদের প্রতি সন্তষ্ট হয়ে গেছে। [হাদীসটি আবূ দাউদ উদ্ধৃত করেছেন, উপরে সে আর্ণনারই তরজমা দেয়া হয়েছে। মুসলিম ও নাসায়ী হাদীস উদ্ধৃত করেছেন। (আরবী********)] বুশাইর ইবনে খাচাচিয়া থেকে বর্ণিতঃ আমরা বললাম, হে রাসূল! যাকাত আদায়কারীদের কিছু লোক আমাদের ওপর অনেক বাড়াবাড়ি করে। তারা যে পরিমাণ বাড়াবাড়ি করে সেই প রিমাণ ধন-মাল কি আমরা তাদের থেকে গোপন করব? বললেন, না। [ হাদীস উদ্ধৃত আবূ দাউদ উদ্ধৃত করেছেন, তিনি বা আল মুনযেরীএ সম্পর্কে কোন মন্তব্য করেননি। আবদুর কাজ্জাকও হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন। তাঁর সনদে দাইসম সদসী রয়েছেন। ইবনে হাব্বাস তাঁকে সিকাহ বর্ণনাকারীদের মধ্যে গণ্যা করেছেন। (আরবী********) গ্রন্থে বলেছেনঃ তিনি গ্রহণযোগ্য। (আরবী********)] এ সব কয়টি হাদীস স্পষ্ট ভাষায় বলছে যে, কতিপয় সরকারী কর্মচারীর যাকাত আদায়ে কঠোরতা কিংবা আংশিক জোর জুলুম তাদের দায়িত্ব পালনে সহযোগিতা করা থেকে বিরত থাকাকে কিছুমাত্র সমর্থনযোগ্য বানায় না। তাদের থেকে মাল গোপন করা বৈধ হয় না। কেননা তা রাষ্ট্রের অর্থ ভাণ্ডারকে শূন্যতার মধ্যে ঠেলে দেবে। তার বাজেট ভারসাম্য হারিয়ে ফেলকে। কি শে তরে এহন্যে যে, কিছু লোক তাদের মতের মূল্যায়নের খুব বেশী বাড়াবাড়ি ও সীমালঙ্ঘনমূলক কাজ করে থাকে।অপর লোকের মূল্যায়নের প্রতি তারা ভ্রাক্ষেপমাত্র করে না। এ সবক কথাই প্রযোজ্য, আনুসরণীয় যুদ তা সুস্পষ্ট জুলুমের রূপ পগ্রিহ না করে, যার কোন ব্যাখ্যা দেয়া যায় না বা জুলুম হওয়অর ব্যাপারে সন্দেহের কোন অবকাশ থাকে না। যদি তাই হয়ে পড়ে, তাহলে অতিরিক্ত পরিমাণ আদায় না করারও জুলুম সহ্য না করার পূর্ণ অধিকার রয়েছে ব্যক্তির। হযরত আনাসের যাকাত পরিমাণ পর্যায়ে ইর্ণত হাদীসে তাই বলা হয়েছে। তাহলঃ যে লোক মুসলমানদের কাছে তা চাইবে যথাযথভাবে তাকে যেন তা অবশ্যই দেয়া হয়। আর যে তার অতিরিক্ত চাইবে, তা সে দেবে না। এটা এজন্যে যে নবী করীম (স) তো প্রত্যেকটির ফরয পরিমাণ সুস্পষ্টভাবে নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। সকল মুসলমানিইতা জানেন। তা সত্ত্বে ও যদি কেউ তা লঙ্ঘন করে তাহলে তা গ্রাহ্য করা চলবে না। যাকাত এড়ানোর কৌশল অবলম্বন নিষিদ্ধ যাকাত এড়ানোর লক্ষ্যে যে কোন প্রকারের কৌশল অবলম্বন ইসলামে সম্পূর্ণ হারার করে দেয়া হয়েছে বাহ্যত সে কৌশলঅবলম্বন যতই শরীয়াত সম্মত ও জায়েয মানে করা হোক না কেন। একটি প্রচলিত কৌশল এ রকম হতে পারে যে, একটি বছর পূর্ণ হওয়ার প্রক্কালে মালিক তার যাবতহীয় ধন সম্পদ তার স্ত্রীকে হেবা করে দিল- যেন বছরটা অতিক্রান্ত হয়ে যায়। পরে স্ত্রী আবার তাকেই সব হেবা করে দিল এবং সে তা সব তার কাছ থেকে ফিরিয়ে নিয়ে নিল। এ ধরনের পন্হা অবলম্বনকে পাশ্চাত্যে আইনসম্মত পন্হায় কর ফাঁকি বলে অভিহিত করা হয়। আর কোন কোন ফিকাহবিদ একে শরীয়াতমসম্মত হীলা গ্রহণ নামে অভিহিত করেছেন। এটা যে হারাম তার অকাট্য দলিল হচ্ছে, এ সহীহ হাদীসঃ সমস্ত আমলের মূল্যায়ন হবে নিয়ত আনুযায়ী। প্রত্যকেই তাই পাবে যা পাওয়ার সে নিয়ত করেছে। ইমাম বুখারী এ সব হীলা অবলম্বনকে বাতিল পন্হা বলে অভিহিত করেছেন এবং তার দলিল হিসেবে যাকাত ফরয করণ পর্যায়ে হযরত আনাস (রা) বর্ণিত হাদীস উদ্ধৃত করেছেনঃ একত্রিতকে ভিন্ন বিছিন্ন করা যাবে না এবং বিচ্ছিন্ন কে একত্রিত করা যাবে না যাকাত ফরয হওয়ার ভয়ে। [ ইবনুল কাইয়্যেম এ হাদীসটি (আরবী*********) গ্রন্থে (আরবী*********)উদ্ধৃত করেছেন। এ গ্রন্থে এবং (আরবী*********) গ্রন্থে আবনুল জাওযীর হীলা মতের অকাট্য দলিল প্রমাণ দ্বারা প্রতিবাদ শীর্ষক আলোচনা করেছেন। [ ইমাম মালিক বলেছেন ঃ তার অর্থ তিন ব্যক্তির প্রত্যেকরেই মালিকানায় চল্লিশটি করে ছাগল থাকবে। ফলে তর ওপর যাকাত ফরয হবে, কিন্ত তার সবগুলো একত্রিত করা হলে সে সবের ওপর মাত্র একটি ছাগী ফরয হেব অথবা দুই শরীকের প্রত্যেকেরই একশ একটি করে ছাগল আছে, তাতে তাদের উভওয়র ওপর তিনটি ছাগী ধার্য হবে। কিন্তু হিসেবের সময় তা বিভক্ত করে গণনা করা হলে উভয়ের প্রত্যেকের ওপর মাত্রি একটি করে ছাগী ফরয হবে। [ (আরবী*********) কিতাবুযযাকাত(আরবী*********)] ইমাম আবূ ইউসূফের কথা পূর্বে আমরা উল্লেখ করেছি। তাহলঃ আল্লাহও পরকালের প্রতি ঈমানদার কোন ব্যক্তির পক্ষে যাকাত না দেয়া যাকাত দিতে অস্বীকার করা আদৌ জায়েয বা হালাল নয়। তা নিজেহর মালিকানা থেকে বের করে কোন সামষ্টিক মালকানায় দিয়ে দেয়া যেন তা ভিন্ন ভিন্ন হিসেবে করা হয় এবং যাকাত ফরয হতে না পারে তা করাও জায়েয নয়। যেমন উট গরু ছাগলের এমন সংখ্যার মালিক প্রত্যেক হবে, যার ফলে যাকাত ফরয হতে পরবে না কোনভাবে ও কোন কারণ সৃষ্টি করে যাকাত বাতিল করার জন্যে হীলা করা যাবে না। [(আরবী*********)] ইমাম আবূ ইউসূফ লিখিত কিতাবুল খারাজ থেকে কৌশল অবলম্বন করা জায়েয, উক্ত উদ্ধৃতি তার তীব্র প্রতিবাদ করে। এ কাজটা সম্পূর্ণ হারাম, এ ব্যাপারে উক্ত বক্তব্য পূর্ণভাবে সুস্পষ্ট। কিন্তু সম্ভবত আইনের ভিত্তিতে এ কাজকে বাতিল প্রমাণ করা সম্ভব পা হবে না। কেননা বিচারক তো বহ্যিক অবস্থানুযায়িই বিচার করবে। কারোর নিয়ত বা গোপন তত্ত্বকথার দিকে কোন কৌতুহল দেখাবে না, তা বের করারও চেষ্ট করবে না। অতএব সে ব্যাপাটি সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর কাছে সোপর্দ করা ছাড়া গত্যন্ত নেই। হাম্বলী ও মালিক মাযাহাবের ফিকাহবিদগণ এ ধরনের হীলা কৌশল ও তার প্রভাব প্রতিক্রিয়া আইনের বলে বন্ধ করার পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন। হাম্বলী ফিকাহর কিতাবে লিখিত রয়েছে, যাকাত এড়ানোর উদ্দেশ্যে যে লোক বেশী বেশী জমি ক্রয় করবে, তার মূল্যের ওপর যাকাত ধার্য করতে হবে, তার উদ্দেশ্যটা বানচাল করার লক্ষে। যেমন বিক্রয় বা অন্য কিছুর সাহয্যে যাকাত এড়ানো। [(আরবী*********)] আর মালিকী মাযহাবের কিতাবেও আনুরূপ কাথাই লিখিত রয়েছে। পঞ্চম অধ্যায়ের যষ্ঠ পরিচ্ছেদে এসব কথা আমরা আলোচনা করে এসেছি। যাকাত দিতে অস্বীকারকারীর অপরাধ ও আর্থিক দণ্ড যাকাত দিতে অস্বীকারকারী কিংবা যাকাত আদায় থেকে বিরত থাকা লোককে আর্থিক শাস্তি দেয়ার কথা হাদীসে উদ্ধৃত হয়েছে। আহমাদ, আবূ দাউদ ও নাসায়ী উদ্ধৃত করেছেনঃ প্রতি গৃহপালিত উটের প্রতি চল্লিশটিতে একটি করে দুই বছরের উপনীত উষ্ট্রী শাবক দতি হবে। হিসেবে কোন একটি উট আলাদা করা যাবে না। আর যদি কেউ তা দেয় শুভ ফল পা্ওয়ার আশায়, সে শুভ ফল সে পাবে। আর যে তা দেয়া থেকে বিরত থাকবে, আমি তার কাছে থেকে তা অবশ্যআ আদায় করে নেব এবং তার উটের অর্ধেক আমাদের মহান আল্লাহর ধার্য করা অধিকারসমূহের মধ্যে থেকে একটি অধিকার হিসেবে। মুহাম্মাদের বংশের লোকদের জন্যে তার এক বিন্দু হালাল নয়।শুনতাকাল আখবার গ্রন্থে বরঅ হয়েছে, এ হাদীসটি যাকাত দিতে অস্বীকারকারীর কাছ থেকে তা নিয়ে নেওয়ার ও যথাস্থানে তা পৌছাবার অকাট্য দলিল। [(আরবী*********)] দিতে অস্বীকৃত উটের অর্ধেক নেয়া, অন্য কথায় যে মালের যাকাত দিতে অস্বীকার করা হয়েছে তার অএধক বাজেয়াপ্ত করা এক ধরনের আর্থিক দণ্ডেকরণ। এটা তাদের কৃতপাপের শাস্তি প্রদানের জন্যে রাষ্ট্র প্রধানের একটা অবলম্বন। রাষ্ট্রপ্রধান এ দ্বারাই সে সব লোককে উচিত শিক্ষা দিতে পারেন যারা যাকাত দিতে অস্বীকার করে কিংবা ফাঁকি দিতে চেষ্টা করে। এটাকে তাজীরী শাস্তি বলা হয়, যা সুনির্দিষ্ট নয়। বরং দায়িত্বশীল ও উপদেষ্টা পরিষদের লোকেরা ইসলামী সমাজে থেকে তার পরিমাণ নির্দিষ্ট করবে। তার অর্থ, এ একটা অবাধ্যতামূলক শাস্তি, সাধারণভাবে প্রচলিত ও নয়। বরং এ শাস্তি যেমন দেয়া যায়, তেমনি নাও দেয়া যেতে পারে। কোন কোন ইমান এ মত গ্রহণ করেছেন যে, মাল নিয়ে শাস্তি দেয়া জায়েয বা শুভ কাজ নয়। প্রথমদিকে এ নিয়ম চালু করা হয়েছিল, পরে তা বাতিল হয়ে গেছে। আসলে এটা মালিকত্বের মর্যাদা ও সম্ব্রম রক্ষার জন্যে কজঠোরতা মাত্র। একটি হাদীসের ওপর র্ভিরতার ও আছে, যাতে বলা হয়েছেঃ আল্লাহ তাআলা তোমাদের ওপর হারাম করেছেন তোমাদের রক্ত এবং তোমাদের ধন মাল পারস্পরিক। [(আরবী*********)] যেহেতু সাহাবায়ে কিরাম (রা) যাকাত দিতে অস্বীকারকারী লোকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। তাদের কাছ থেকে প্রাপ্যের অতিরিক্ত নেননি কেউ কেউ হাদীসের সনদে দোষ ধরেছেন অথবা তার সনদে ধরবার মত কোন ক্রটি নেই।কেউ কেউ হাদীসটিকে মনসুখও বলেছেন; কিন্তু তারও কোন দলিল নেই। বহু দলিলেই আর্থিকভাবে শাস্তি দানের কথার প্রমাণ রয়েছে। [ ইবনুল কাইয়্যেম (আরবী***********) গ্রন্থে নবী করীম (স) এর খলীফাগণের ১৫ টি বিচারের উল্লেখ করেছেন। তাতে আর্থিক জরিমানার শাস্তি দেয়া হয়েছে ২৮৭ পৃ. (আরবী***********) এবং এ কিতাবের ৭৭৯-৭৮২ পৃ,দ্রষ্টব্য।] যাকাত দিতে অস্বীকারকারীদের কেবল জরিমানা দণ্ডে দণ্ডিত করেই ক্ষান্ত হওয়া হয়নি, অস্ত্র চালানো হয়েছে এবং যুদ্ধের অিগ্নি প্রজ্বলিত করা হয়েছ। আল্লাহর এবং প্রার্থী ও বঞ্চিতের হক আদায়ের পথে বাধাদানকরীদের দমন করাই ছিল তার লক্ষ। হযরত আবূ বকর এবং তাঁর সঙ্গের সাহবীবৃন্দ (রা) ও যাকাত অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন এবং বলেছেন ঃ আল্লাহর কসম ওরা যদি রাসূলের সময়ে দেয়া একটি রশি দিতেও অস্বীকার করে তাহলে আমি তাদের বিরুদ্ধে সে জন্যে যুদ্ধ করব। [ প্রথম অধ্যায়ের যাকাত দিতে অস্বীকারকারীদের বিরুদ্বে যুদ্ধ করা আলোচনা দ্রষ্টব্য।] ইবনে হাজম বলেছেনঃ যাকাত দিতে অস্বীকারকারীর জন্যে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হচ্ছে তার কাছ থেকে তা অবশ্যিই নিতে হবে। সে তা পছন্দ করুক আর না ই করুক। কেননা যে লোক তা অস্বীকার কের, সে তা যুদ্ধ ঘোষণাকারী। আর সে যদি মিথ্যা বলে, তাহলে সে মর্তদা দ্বীন ত্যাগকারী। আর যদি সে মাল গোপন করে সরাসরি ভাবে দিতে অস্বীকার নাও করে, তাহলেও সে একটা বড় পাপ করে সে জন্যে তাকে শিক্ষা দিতে হবে, প্রয়োজন হলে মারতে হবে, যেন সে দিয়ে দেয় অথবা মার খেতে খেতে মরে যায় আল্লাহর হক না দেয়ার অপরাধে নিহত হয়ে আল্লাহর কাছে অভিশপ্ত হবে সে। রাসূলে করীম(স) বলেছেনঃ তোমাদের যে লোক কোন পাপ কাজ হতে দেখবে, সে যেন তা শিক্তি বলে বদলে দেয় যদি তা সামর্থ্য থাকে। আর যাকাত ন দেয়া সে একটি বড় অপরাধ, এ অপরাধ যে করবে, যার সামর্থ্য আছে সে তা শক্তি বলে বদলে দেবে, আদায় করে নেবে। এটাই স্বাভাবিক। যেমন পূর্বে বলেছি। আর তওফীক দান তো আল্লাহর হাতে।২যাকাত আদায়ের পন্হা অধ্যায়ের আমরা বলে এসেছি যাকাত একটি প্রমাণিত অধিকার। অগ্রবর্তিতা বা বছর অতিক্রান্ত হওয়ার দরুন তা প্রত্যাহুত হতে পারে না। যার ওপর তা ফরয হয়েছে, তার মৃত্যু হলেও নয়। মৃতের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে তা ঋণ হিসেবে গণ্য হবে এবং অপরাপর ঋণের আগেই তা আদায় করে নেয়া হবে। কেননা না দেয়া যাকাতে দুটি ব্যাপার জড়িত হয়ে পড়েছে। একে তো তা আল্লাহর হক, দ্বিতীয়ত, তা আল্লাহর ফরীর মিসকীন অভাগ্রস্ত বান্দাদের হক। সপ্তম পরিচ্ছেদ যাকাতের পরও কি কর ধার্য হবে ইসলাম মুসলমানেদের ধন-মালে একটা সুস্পষ্ট সুপরিজ্ঞাত হক হিসেবে ধার্য করেছে যাকাত। তা একটা কর বিশেষ, মুসলিম সরকার তা সংগ্রহ ও ব্যয় উভয় কাজের জন্যেই দায়িত্বশীল। এক্ষণে প্রশ্ন হচ্ছে, ধনী লোকদের ওপর যাকাতের পাশাপাশি জাতীয় সাধারণ কল্যাণমূলক কাজের জন্যে অন্যান্য করও কি ধার্য করা যাবে যা রাষ্ট্রের সাধারণ ব্যয় প্রয়োজন পূরণে বিনিয়োগ করা হবে কিংবা যাকাতই হচ্ছে একক ও অনন্য অর্থনৈতিক দায় দায়িত্ব যে, এ ছাড়া আর কিছুই মুলমানদের কাছ থেকে গ্রহণ করা যাবে না? ইসলামী মরীয়াতের বিধান সম্পর্কে চিন্তা করলেই ব্যাপারটি সম্পষ্ট হয়ে ওঠে পূর্ণমাত্রায়। আমরা তিনটি আলোচনা পর্যায়ে এ বিষয়ে কথা বলতে চাইঃ প্রথম আলোচনাঃ কর কার্যকরণ জায়েয হওয়ার দলিল; দ্বিতীয় আলোচনা ঃ কর ধার্যকরণ অবশ্য লক্ষ্যণীয় শর্তাবলী তৃতীয় আলোচনাঃ কর ধার্য করার বিরোধদের সংশয় এবং তার জবাব; পর্যায়ক্রমে আমরা এ তিনটি বষয়ের ব্ক্তব্য পেশ করছি। প্রথম আলোচনা যাকাতের পাশাপাশি কর ধার্যকরণ জায়েয হওয়ার দলিল ন্যায়পরতাভিত্তিক কর ধার্যকরণ বৈধ হওয়ার দলিলসমূহ আমরা নিম্মোক্তভাবে সুস্পষ্ট করে তলিতে চাচ্ছিঃ প্রথম ঃ সামষ্টিক দায়িত্ব গ্রহণ কর্তব্য ধম-মালে যাকাত ছাড়াও কোন অধিকার আছে কি অধ্যায়ের আলোচনা আমরা যে সব দলিল প্রমাণ উপস্থাপিত করেছি, তার পুনরাবুত্ত নিষ্প্রয়োজন। শুধু একুকু কথা বলাই যথেষ্ট যে, মুসলমান জনগণের প্রয়োজন দেখা দিলে যাকাতের পরও কর ধার্য করা জায়েয, এক বিষয়ে ফিকাহবিদগণ সম্পূর্ণ একমত।কেননা সামষ্টিক প্রয়োজন কখনই অপর্ণ রাখা যেতে পারে না। তাতে যত ধন-মালই লগুক না কেন। এমন কি, যাঁরা বলেন ধন-মালে যাকাত ছাড়া আর কিছুই প্রাপ্য নেই তাঁরা পর্যন্ত স্বীকরা করেছেন যে, প্রয়োজন দেখা দিলে যাকাতের বাইরেও অর্থ আদায় করা যাবে। সামষ্টিক অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বিধান ও ভ্রাতৃত্ব সংক্রান্ত মতাদর্শের ব্যবস্থায় আমরা যা বলে এসেছি তাও এ মতকেই বলিষ্ঠ করে। কেননা তাই হচ্ছে যাকাত ফরয় হওয়ার আদর্শিক ভিত্তি। ধন-মালে যাকতের পরও কোন হক ধার্য় হওয়ার জন্যে তাই ভিত্তি হিসেবে গণ্য হতে পারে দ্বিতীয়ঃ যাকাত ব্যয় ক্ষেত্র সুনির্দিষ্ট, রাষ্ট্রের আর্থিক দায়িত্ব বহু একথাও আমরা জানি যে, যাকাত সামষ্টিক , নৈতিক দ্বীনী ও রাজনৈতিক লক্ষ্য ও বটে। প্যর্বে যেমন বলে এসেছি। আর যাকাতের লক্ষ্য নিছক অর্থনৈতিকই নয় অর্থাৎ শুধু ধন-মাল সংগ্রহ করা রাষ্ট্রের সুবিধা মত ব্যয় করার উদ্দেশ্যে তাও নয়। যদিও কারো কারো মতে তার সাবলিল্লাহ খাতটি সর্বপ্রকারের অল্লাহনুহত্য ও জনকল্যাণ মূলক কাজে পরিব্যাপ্ত বটে। কিন্তু তা আয়াত ও হাদীসের বক্তব্যের পরিপন্হী, জমহুর ফিকাহবিদগণও সে মত গ্রহণ করেননি। তাই বলতে হচ্ছে, যাকাত ব্যায়ের খাত আটটি ভাগে বিভক্ত।কুরআন মজীদই তা দৃঢ়ভাবে নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। তাতে এক সাথে দুটি দিক সমন্বিত। মুসলমানদের মধ্যকার অভাবগ্রস্ত ও দারিদ্র্য পীড়িত ফকীর, মিসকীন, ক্রীতদাস, নিজেদের দরুন ঋণগ্রন্ত ও নিঃস্ব পথিক লোকেরা একদিকে। আর অপরদিক মুসলামানরা যাদের মুখাপেক্ষী আল্লাহর পথে মুজাহিদ, মুয়াল্লাফাত কুলুবুহু, যাকাত সংস্থার নিয়োজিত কর্মচারী এবং সামষ্টিক কল্যাণে ঋণগ্রস্ত লোকজন। এ কারণে যাকাতের জন্যো স্বতন্ত্র ও বিশেষ বায়তুলমাল গঠন করা হয়েছিল, তার বাজেট সম্পূর্ণ আলাদা। যাকাতের মাল রাষ্ট্রের অন্যান্য আয়ের ধন মালের সাথে মিশ্রিত করা ফিকাহবিদ মতে জায়েয নয়। কেননা যাকাত তো শরীয়াত কর্তৃক সৃনির্দিষ্ট খাতেই শুধু ব্যয় করা যাবে, অন্য কোন খঅতে নয়। আর সামষ্টিক দায়িত্ব গ্রহণ ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলাই হবে তার প্রথম দায়িত্বের কাজ। এ কারণে ইমাম আবূ ইউসূফ বলেছেন, খারাজের মাল যাকাতের মালের সাথে মিশ্রিত কর জায়েয নয়। কেননা খারাজ হচ্ছে মুসলিম জনগণের সামষ্টিক সম্পদ আর যাকাত হচ্ছে আল্লাহ কর্তৃক সুনির্দিষ্ট ব্যক্তিগণের জন্যে ব্যয় করার সস্পদ। [(আরবী***********)] এ জন্যে তাঁরা আরও বলেছেন, পুল বা রাস্তা নির্মাণে যাকাত সম্পদ ব্যয় করা যাবে না। খাটা, মসজিদ, মুসাফিরখানা, মাদ্রাসা, পানি পানের জন্যে ঝর্ণধারা প্রবাহিতকরণ প্রভৃতি কাজেও ব্যয় করা হবে না। [(আরবী***********)] অথচ এ কাজগুলো ইসলামী রাষ্ট্রই শুধু নয়, সকল রাষ্ট্রের জন্যেই একান্তভাবে জরুরী। তাহলে এসব কাজে অর্থ ব্যয় করা যাবে কোত্থেকে, যখন এ সব কল্যাণমূক কাজেও যাকাত ব্যয় জায়েয হচ্ছে না? জবাব এই যে, আগের কালে এসব জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করা যুদ্ধমান শক্রর কাছ থেকে মুসলমানদের অর্জিত গনীমতের মালের এক পঞ্চমাংশ বাবদ প্রাপ্ত সম্পদ থেকে অথবা যদ্ধ ও রক্তপাত ছাড়াই মুশরিকদের ধন-মালথেকে ফাই বাবদ যা কিছু আল্লাহ তাআলা দিয়ে দিতেন তা থেকে। প্রথম যুগের ইসলাম বিজয়কালে এ দুটো আয় উৎস বা আয় সূত্র জাতীয় ধনভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করে দিত। ফলে তখন যাকাত ছাড়া ভিন্নতর কর লোকদের ওপর ধার্য করার কোন প্রয়োজনই দেখা দিত না। তাছাড়া একথাও স্মরণীয় যে, তখন কার সময়ে রাষ্ট্রের দায়-দায়িত্ব ও কর্তব্য ছিল অনেক সীমিত। কিন্তু আমদের এ যুগে উপরিউক্ত সূত্রদ্বয় সম্পূর্ণকূরপ নিঃশেষ ও বন্ধ হয়ে গেছে। এক্ষণে জাতীয় কল্যাণমূলক কাজের জন্যে অন্য কোন ছাড়া এজন্যে আর কোন উপায়ই থাকতে পারে না।তাই সার্বিক কল্যাণমূলক কাজ বস্তবায়নের জন্যে প্রয়োজন পরিমাণ কর অবশ্যই ধার্যকরতে হবে, যা ব্যতীত কর্তব্য পূর্ণভাবে পালিত হয়ে না,তা দেয়া ওয়াজিব এ মৌলনীতি আনুযায়ীই এ কর ধার্য করা হবে। শাফেয়ী ফিকাহবিদদের এ মত আমরা পূর্বেই জানতে পেরেছি যে, রিযিকপ্রাপ্ত যোদ্ধা ফাই সম্পদে যাদের জন্যে নির্দিষ্ট অংশ রয়েছে কিংবা শৃংখলাবদ্ধ সৈন্যবাহিনীর যেসব লোক জাতীয় ধনভাণ্ডার থেকে মাসিক বেতন পায় তাদের জন্যে যাকাত সম্পদ থেকে এক পয়সাও ব্যয় করা যাবে না। তবে সাবীলিল্লাহ খাতের সম্পদ পাবে নফল হিসেবে জিহাদে যোগদানকারী মুজহিদরা। কিন্তু এই শাফেয়ী ফিকাহবিদরাই এ- আলোচনাও তুলেছেন যে, জাতীয় ধনভাণ্ডার নিয়মিত ও বেতন ভূক সেনাবহিনীর জন্যে ব্যয় করার যখন কিছুই থাকবে না অথচ কাফির শক্রদের উসকানী প্রতিরোধের জন্যে লোক তৈরী রাখা মুসলমানদের জন্যে প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে,তখন মুসলমানদের এ প্রয়োজন পূরণে দাড়িয়ে যাওয়া লোকদের ভরণ-পোষণ ইত্যাদির ব্যয়েোকত্থেকে চালানো হবে? নববী প্রমখ শাফেয়ী ইমানগণ অগ্রাধিকার নীতির আলোকে বলেছেন, এ রূপ অবস্থায় মুসলমান ধনী ব্যক্তিদের কর্তব্য হচ্ছে যাকাতের মালের বাইরের সম্পদ দিয়ে তাদের সাহায্য করা। [ দেখুন (আরবী***********)] তৃতীয়ঃ শরীয়অতের সর্বাত্মক নিয়ম যা ব্যতীত ওয়াজিব কাজ সম্পন্ন হয় না, তা ওয়াজিব এ মূলনীতির ওপরই গোটা ব্যাপার একান্তভাবে নির্ভরশীল নয়। এ পর্যায়ে রয়েছে একটা সর্বাত্মক মৌলনীতি শরীয়াতের সাধারণ নিয়ম। শরীয়াতের অকাট্য সম্পষ্ট দলিলসমূহের আলোজে ইসলামের বিশেষজ্ঞা মণীষিগণ তার ভিত্তি রচনা করেছেন। সেজন্যে খুঁটিনাটি হুকুম আহকামও নিঙড়ানো হয়েছে। ্তার পরিনতিতে আইন প্রণয়নের একটা মৌলনীতি গড়ে উঠেছে,যার ওপর ভিত্তি করা চলে, তার ভিত্তিতে কর্মনীতি নির্ধারণ সম্ভব। আইন প্রণয়ন কিংবা ফতোয়া দান অথবা বিচার কালে তা থেকে হেদায়েত পাওয়া যেতে পারে। প্র পর্যায়ের মৌলনীতি হচ্ছেঃ জনকল্যাণের দাবি পূরণ বিপর্যয়েোধ কল্যাণ প্রতিষ্ঠার ওপরে অগ্রাধিকার পাবে। দুটি কল্যাণেল মধ্যে সাধারণ বা নিম্মমানেরট বিনষ্ট করা উচ্চমানেরটা লাভের উদ্দেশ্যে, সাধারণ ক্ষতি প্রতিরোধের জন্যে বিশেষ ক্ষতি গ্রাহ্য হবে। [এ মৌলনীতির জন্যে দেখুনঃ (আরবী***********) এবং (আরবী***********)] শরীয়াতের এ মৌলনীতি কার্যকর করা হলে শুধু কর ধার্যকরণই বৈধ প্র মাণিত হবে না, জাতীয় ও রাষ্ট্রী কল্যাণ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তা ধার্যকরণ ও গ্রহণ অকাট্য ও অপরিহার্যও প্রমণিত হবে। কেননা জাতীয় বিপর্যয় ক্ষতি ও বিপদ প্রতিরোধ এ ছাড়া সম্ভব নয়। তবে অন্যান্য সূত্রের যেমন পেট্রোল বা অন্য কিছুর আয় যদি সেজন্যে যথেষ্ট হয়, তবে সে স্বতন্ত্র কথা। কিন্তু তাও যদি কিছু না থাকে এবং এরূপ অবস্থায় আধুনিক ইসলামী রাষ্ট্রকে কর ধার্য করার অধিকার দেয়া না হয়, তাহলে কিছুদিন চলার পর সে রাষ্ট্রটি যে ধড়াষ করে ভুমিসাৎ হবে, চতুর্দিক থেকে তার অক্ষমতা প্রকট হয়ে সম্পূর্ণ অচলাবস্থা দেখা দেবে এবং সর্বোপরি সামরিক অভ্যুত্থানের বিপদ ঘণীভূত হবে, তাতে আর কোনই সন্দেহ থাকতে পারে না। এ কারণে; বিভিন্ন যুগের আমিলগণ ফতোয়া দিয়েছেন যে, বায়তুলমালকে শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যে মুসলিম প্রশাসক যে করই ধার্য করবে, তা যতারীতি দেয়া একান্তই কর্তব্য। অন্যতায় বিপদ প্রতিরোধ ও প্রযোজন পূরণ অসম্ভব থেকে যাবে। শাফেয়ী মতের ইমাম গাযযালী সাধারণ কল্যাণে অতিরিক্ত ধন-মাল নেয়ার বিপক্ষে। কিন্তু তিনিও লিখেছেনঃ হাত যখন ধান মাল শূন্য হয়ে পড়বে, সাধারণ কল্যাণের ধন-মাল ততটা অবশিষ্ট থাকবে না যদ্দারা সাময়িক ব্যয়ভার বহন করা চলে এবং এ সময় ইসলামী রাজ্যে শক্রর ঢুকে পড়ার আশংকা দেখা দিলে কিংবা দুষ্কৃতকারীদের পক্ষ থেকে ধন মাল ধনী লোকদের কাছ থেকে নিয়ে নেয়া রাষ্ট্রপ্রধানের জন্যে জায়েয হবে। কেননা আমরা জানি দুই দুষ্কৃতি বা ক্ষতি এক সাথে দেখা দিলে ও সাংঘষিক হলে দুটির মধ্যে কঠিনতর ও অধিক বড় দৃষ্কৃতি দমন করাই শরীয়াতের লক্ষ্য। কেননা এরূপ অবস্থায় প্রত্যেক ধনী ব্যক্তি যা কিছু দেবে তা জানমালের ওপর ঘুনিয়ে আসা বিপদের তুলনায় খুবই সামান্য। ইসলারেম দেশে যদি শক্তিশালী প্রশাসক না থাকে, যে সামষ্টিক প্রশাসন ব্যবস্থা সুষ্ঠুরূপে পরিচালিত করবে ও দুষ্কৃতির মূল উৎপঠিত করবে, (তাহলে তো বিপদটা অত্যস্ত কঠিন হয়ে পড়বে) [(আরবী***********)] মালিকী মতের ইমাম শাতেবী লিখেছেনঃ আমরা যদি এমন রাষ্ট্রপ্রধান দাঁড় করাই, যার আনুগত্য করা হবে, সে যদি বিপ্লব দমনের জন্যে বিপুল সংখক সেনাবহিনী সংগ্রহ করা এবং বিপুল বিস্তীর্ণ রাষ্ট্রের সঙরক্ষণের জন্যে অভাগ্রস্ত হয়ে পড়ে- বায়তুলমাল শূন্য হয়ে যায় এবং সৈন্যদের জন্যে যথেষ্ট পরিমাণ ধন-মালের প্রয়োজন হয়ে পড়ে, তাহলে ন্যায়পন্হী রাষ্ট্রপ্রধানের পক্ষে তাৎক্ষণিক প্রয়োজন পূরণের উদ্দেশ্যে যথেষ্ট হয় এমন পরিমাণ ধন মাল ধনী লোকদের ওপর ধার্য করা জায়েয হবে এবং যতদিন ন বায়তুলমাল ধন-মালে সমৃদ্ধ হচ্ছে, তা নিতে পারবে। উত্তরকালে তা ফসল ও ফল ইত্যাদির ওপর ধার্য করা তার জন্যে জায়েয হবে। তবে এ কথা প্রাথমিক ইসলামী যুগের লোকদের থেকে আমরা জানতে পারিনি। কেননা সে যুগে বায়তুলমাল স্বতঃই সমৃদ্ধ ছিল, যা আমাদের যুগে নেই। এক্ষণে রাষ্ট্রপ্রধান যদি নএ নীতি গ্রহন না করেন তাহলে তার জাঁকজমক ও দাপট প্রতাপ সবই নিঃশেষ হয়ে যাবে এবংত আমাদের দেশ কুফরী শক্তির অভ্যুত্থানের শিকারে পরিণত হবে। তা প্রতিরোধ করতে সক্ষম হতে রাষ্ট্রের প্রধানের শক্তি ও দাপট। এমাতাবস্থায় ও যারাধার্য কর ফাঁকি ;দেয় যার ফলে রাষ্ট্রের শক্তি ও দাপট লোপ পেয়ে যেতে পারে তাদের এমন ক্ষতি সাধিত হবে যার তুলনায় ধান মাল দেয়ার ক্ষতিকে তারাই নগণ্য মনে করবে। তার পরিমাণ সামান্য হলে তো বটেই। এ বিরাট ক্ষতির মুকাবিলায় সামন্য মাল গ্রহণজনিত ক্ষতি যখন খুবই নগণ্য হবে, তখন প্রথমটিকে দ্বিতীয়টির ওপর অগ্রাধিকার দানের প্রয়োজনীয়তায় কারোরই একবিন্দু সন্দেহ থাকবে না। [(আরবী***********)] বস্তুত গাযাযালী ও শাতেবী উভয়ের বক্তব্য হল,উপরিউক্ত অবস্থায় ধনী লোকদের ওপর কর বা মাসিক দেয় ধঅর্য করা সম্পূর্ণ জায়েয। এ ঘোষণাটি একটি মৌলনীতির ওপরভিত্তিশীল। আর তা হচ্ছেঃ সাধারণ বা নগণ্য ক্ষতি সহ্য করে কঠিন ও মারাত্মক ক্ষতি প্রতিরোধ করা। চতুর্থ ঃ মাল দিয়ে জিহাদ এবং বড় পরিমাণ ব্যয়ের দাবি ইসলাম মুসলমানদের জন্যে ধন-মাল জান প্রাণ দিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদ করাকে ফরয করেছে। আল্লাহর নির্দেশঃ(আরবী***********) তোমরা সকলে বের হয়ে পড় হালকাভাবে,কি ভারীভাবে এবং তোমাদের জান ও মাল দিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদ কর। (আরবী***********) মুমিন কেবলমাত্র তারাই, যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান এনেছে, অতঃপর কোনরূপ সন্দেহে পড়েনি এবং তাদের জান ও মাল দিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদ করেছে, তারাই সত্যবাদী। (আরবী***********) তোমরা আল্লাহর ও রাসূলের প্রতি ঈমান আর এবং আল্লাহর পথে জিহাদ কর তোমাদের ধন-মাল ও জান প্রাণ দিয়ে। (আরবী***********) এবং তোমরা ব্যয় কর আল্লাহর পথে এবং তোমরা নিজেরাই নিজেদের হাতে ধ্বংসের মধ্যে নিক্ষিপ্ত হবে না। আর অতীব উত্তম নীতি অবলম্বন কর। কেননা আল্লাহ এ অতীব উত্তম নীতি অবলম্বনকারীদের ভালোবাসেন। [(আরবী***********] সন্দেহ নেই মাল দ্বারা জিহাদ করার এ আদেশ পালন করা ফরয এবং তা যাকতের বাইরে আর একটি কর্তব্য। মুসলিম সমাজের মধ্যে অর্থ দ্বারা জিহাদ করার বোঝা বহনের সামার্থ্য কে কতটা রাখবে কে কতটা অংশ বহনের দায়িত্ব নেবে, তা নির্ধারণ করা রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব এবং অধিকারের ব্যাপারে। ইবনে তাইমিয়া উপরিউ্ক্ত কথাটি (আরবী***********)গ্রন্হকার থেকে উদ্ধৃত করেছেন- পরে এ বিষয়ে বলা হবে। আমাদের এ যুগের সশস্ত্র সেনাবহিনী গঠন ও তাদের ব্যয়ভার বহনের জন্যে বিরাট ও ভয়াবহ পারিমাণের অর্থ সম্পদের প্রয়োজন, তা সত্ত্বেও শক্তি সঞ্চয় শুধু মাত্র অস্ত্র ও সৈন্য সংগ্রহের ওপর র্ভিরশীল নয়। সেই সাথে বৈজ্ঞানিক শৈল্পিক ও অর্থনৈতিক প্র ভৃতি জীবনের বহুবিধ দিকে ও বিভাগে শক্তি, প্রাধান্য ও আধিত্য লাভও একান্ত অপরিহার্য। আর এসবই ব্যাপক অর্থ সম্ভার ও সমৃদ্ধির ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু তা অর্থ দ্বারা জিহাদ হিসেবে ব্যাপক কর ধার্যকরণের মাধ্যমে বিপুল অর্থ সম্পদ সংগ্রহ ভিন্ন উপায়ন্তর থাকে না। ব্যক্তি এ কর দিয়েই সমষ্টিকে সমৃদ্ধি ও শক্তিশালী করতে পারে। পারে রাষ্ট্রকে প্রকৃত সহায়তা দিতে। তার ফলে সে নিজেও শক্তিশালী হয়ে উঠবে, তার দ্বীন, রক্ত, ধন-মাল ও ইজ্জত সংরক্ষিত হবে। পঞ্চমঃ জনসম্পদে লাভবান হ্ওয়া কর প্রভৃতি বাবদ যে সম্পদ সংগৃহীত হবে, তা ব্যয় করা হবে সামষ্টিক কল্যাণকর কার্যবলীতে। তার ফায়দাটা সমাজের সমস্ত ব্যক্তিদের কাছেই প্রত্যবর্তিত হয়ে আসবে। এ পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য,পানি সরবরাহ ও সেচ ব্যবস্থা ইত্যাদি এ সবই এমন সামষ্টিক কল্যাণমূলক কাজ, যদ্দারা সমষ্টিগত ঘোটা মুসলিম জনতাই ব্যাপকভাবে উপকৃত হয়। থেকে বা দূর থেকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে। রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ও তার প্রভাব প্রতিপত্তি থেকে ব্যক্তি বিশেষ ভাবে উপকৃত হয় এবং তারই কর্তৃত্ব ও ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত এবং তার অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক শান্তি –শৃংখলা নিরাপত্তা প্রভৃতি সামষ্টিক কল্যাণকর কাজের সুফল ভোগ করে। অতএব ব্যক্তির কর্তব্য ধন মাল দিয়ে রাষ্ট্রকে সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী করে তোলা ও রাখা- যে তা তার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারে। ব্যক্তি যেমন সমষ্টি থেকে উপকৃত ও সমৃদ্ধ হয় এবং বিভিন্ন আশা –আকাংখা প্রতিফলিত হয রাষ্ট্রে, তা মুকাবিলায় প্রতিদানস্বরূপ কর ও অন্যান্য সর্বপ্রকার সাহায্য সহযোগিতা দিয়ে এই মৌলনীতি বাস্তবায়ন করা একান্ত কর্তব্য, যা ফিকাহবিদগণ পরিভাষা হিসেবে বলেছেন। (আরবী***********) দ্বিতীয় আলোচনা কর ধার্যকরণে অবশ্য পালনীয় শর্তাবলী কিন্তু যে ধরনের কর ধার্য করার আনুমতি্ ইসলামী শরীয়াত দিয়েছে, যে ধরনের কর এর প্রতি ইসলাম সন্তুষ্ট তাতে নিরম্মোদ্ধৃত শর্তাবলী অবশ্যই রক্ষিত হতে হবেঃ প্রথমত শর্তঃ অর্থের প্রকৃত প্রয়োজন অন্য কোন আয়সূত্র না থাকা। প্রথম শর্ত হচ্ছে, রাষ্ট্রের প্রকৃত পক্ষেই অর্থের প্রয়োজন হবে, যা পূরণের জন্যে অপর কোন আয়ের সূত্র ও নেই যদ্দারা সরকার তার লক্ষ্য বাস্তবায়িত করতে পারে। লোকদের ওপর অতিরিক্ত করভার চাপিয়ে কষ্ট না দিয়েও জনকল্যাণমূলক কার্যাবলী সম্পন্ন করা তার পক্ষে সম্ভব(অর্থাৎ এরূপ যদি না হয়) কেবলমাত্র তখনই অতিরিক্ত কর ধার্য করাকে ইসলাম সমর্থন করে। তা এ কারণে যে, ধন-মালের ক্ষেত্রে মূল কথা হচ্ছে, তা নেয়া হারাম। লোকদের ওপর অর্থনৈতিক কি অ-অর্থনীতিক অতিরিক্ত অনাহুত চাপ দেয়া থেকে নিষ্কৃতি দান কাজেই কারো মালিকানার মর্যাদা অকারণ বিনষ্ট করা,তার মালিকানা থেকে ধন-মাল নিয়ে নেয়া এবং তার ওপর অর্থনৈতিকবোঝা চাপিয়ে দেয়া কোনক্রমেই জায়েয হতে পারে না তবে যদি অব্শ্য বাধ্যকারী কোন প্রয়োজন তীব্র হয়ে আছে বটে, কিন্তু তা পরিপূরণের জন্যে স্বয়ং সরকারের হাতেই ধান মাল রয়েছে, আয়ের সূত্র বা আমদানী এমন আছে যদ্ধারা তার প্রয়োজন পূরণ হতে পারে এবং লোকদের কর ধার্য করার বাস্তবিকই অপেক্ষা না থাকে, তাহলে এরূপ অবস্থায় কর ধার্য করা বৈধ হবে না। মুসলিম মনীষী ও ফতোয়াদানকারী বিশেষজ্ঞগণ এ শর্তটি রক্ষার ্ওপর খুব বেশী গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তাঁরা এ জন্যে শেষ পর্যন্ত যাওয়ার কথা ও বলেছেন। কেউ কেউ শর্ত করেছেন, বায়তলমাল সম্পূর্ণপূপে শূন্য হয়ে যেতে হবে, তখনই কর ধার্য করা যুক্তিসঙ্গত হতে পারে। তাঁদের এরূপ মত হওয়ার কারণ সাধারণত শাসক-প্রশাসকগণ প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে অর্থ সংগ্রহে মত্ত হয়ে থাকে। জনগণকে এমন সব অর্থনৈতিক চাপে জর্জরিত করে তোলে, যা বহন করার সাধ্য-সামর্থ্য তাদের প্রকৃত পক্ষেই থাকে না। এটা অত্যন্ত জুলুমমূলক আচরণ সন্দেহ নেই। সত্যি কথা, ইসলামের ইতিহাস এ পর্যায়ে আমাদের সম্মুখে উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্তাবলী উপস্থাপিত করেছে। আমাদের আলিমগণ সব সময়ই জাতীয় কল্যাণের চিন্ত করেছেন, তাদের অন্যায় ও বাড়াবাড়িমূলক নীতি আনুসরণ করতে তাঁরা সব সময়ই অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। মিসর অধিপতি কতজ (আরবী***********)যখন তদানীন্তন হলব ও সিরিয়া অধিপতি মালিক নাসেরের দাবিতে সাড়া দিয়ে তাতারদের বিরীদ্ধে লড়াই করার লক্ষ্যে যুদ্ধ প্রস্তুতি নিতে চেয়েছিলেন, তখন তিনি িএ ব্যাপারে পরামর্শ দেয়ার জন্যে বিচারপতি, আইন বিদ ও নগর প্রধানদের একত্রিত করেছিলেন। তিনি ছেয়েছিলেন তাতারদের মুকাবিলার যুদ্ধ করতে এবং এজন্যে প্রয়োজনীয় ধনসম্পদও লোকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করার ইচ্ছ করেছিলেন।এ উদ্দেশ্যে তিনি উপরিউক্ত লোকদেরকে পর্ত –দুর্গে একত্রিত করেছিলেন।তখন সেখানে শায়খ ইজ্জুদ্দীন ইবনে আবদুস সালাম,কাযী বদরুদ্দীন বাসৃয়ঞ্জারী মিসর অঞ্চরের প্রধান বিচার প্রমুখ বহু আলিম ও প্রখ্যাত ব্যক্তি উপস্থিত হয়েছিলেন। তাঁরা বিষয়টি সম্পর্কে ব্যাপক পর্যালোচনা করলেন, ইবনে আবদুস সালামের মতে সকলেই একত্রিত ও একমত হলেন। তিনি বাগশাহ কতজ কে বলেছিলেন তার সারনির্যাস হচ্ছে, শক্র বাহিনী যখন মুসলমানদের ওপর চড়াও হয়ে এসেছেঠ, তখন সকলেরই কর্তব্য হয়ে পড়েছে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা,তাতে সন্দেহ নেই এবং এ জিহেদের প্রয়োজন অর্থ সম্পদও আপনি জনগণের কাছ থেকে গৃহণ করতে পানের, তাপূর্ণভঅবে জায়েযও বটে। তাবে সেজন্যে শর্ত হচ্ছে, বায়তুলমালে যদি কিছুই অবশিষ্ট না থেকে থাকে, তবেই জনগণের কাছ থাকে অর্থ সাহয়্য নেয়ার প্রশ্ন দেখা দিতে পারে।এ জন্যে প্রেয়োজন হলে আপনি স্বর্ণখচিত পরিচ্ছদাদি এবং মহামূল্য দ্রব্য সামগ্রী বিক্রয় করে দিতে পানের। [মূলের শব্দ হেচ্ছে (আরবী*********) এক বচনে (আরবী*********)তা স্বর্ণখচিত এক প্রকার মূল্যবান পরিচ্ছদ, যা বাদশাহ বিভিন্ন উৎসব উপলক্ষ্যে রাপন্যেবর্গের মধ্যে বিতরণ করেন।] প্রত্যেকটি সৈনিক স্বীয় যানবাহন ও অস্ত্রশস্ত্রেই ব্যবহার করবে। তাদের জীবনমাণ জনসধারণের সাথে সমান ও পার্থক্যশুন্য হতে হবে। সৈনিকদের হাতে ধন-মাল ও মুল্যবান জাঁকজমকপর্ণ সমঞ্জামাদি বর্তমান থাকা অবস্থায় জনসাধারণের কাছ থেকে অর্থ গ্রহণ কিছুতেই জায়েয হতে পারে না। এ কথার পাই বৈঠক শেষ হয়ে যায়। [ দেখুনঃ (আরবী*********)] অসমসাহসী ইমাম নববী ঠিক আনুরূপ কথাই বলেছিলেন জাহের বেবিরসের সম্মুখে। উত্তরকালে জাহের যখন সিরিয়ায় তাতার শক্তির মুকাবিলায় যদ্ধ করতে ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়লেন, কিন্তু বায়তুলমাল ছিল সম্পূর্ণ শূন্য ; সৈন্য সজ্জিতকরণ এবং যোদ্ধদের জন্যে ব্যয় করার মত অর্থ সম্পদ কিছুই ছিলনা। তাখন তিনি জনগণের ওপর কর ধার্য করা সম্পর্কে সিরীয় আলিমগণের কাছে ফতোয়া চাইলেন। কেননা বাদশাহকে সাহায্য করা শক্রদের বিরূদ্ধে সৈন্যদের যুদ্ধ করার এবং তাতে প্রয়োজনীয় অর্থ-সম্পদ সংগ্রহের এছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। তাই আলিমগণ প্রেয়োজনীয় অর্থ সম্পদ সংগ্রহের এছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। তাই আলিমগণ প্রয়োজন পূরণ ও কল্যাণমূলক কার্যাবলী সম্পাদনের প্রেক্ষিতে তা জায়েয বলে ফতোয়া দিয়েছিলেন। এ মর্মে ফতোয়া লিখেও দিয়েছিলেন। এ সময় ইমাম নববী উপস্থিত ছিলেন। বাদশাহ যখন আলিমগনকে জিজ্ঞেস করলেন, ফতোয়ায় স্বাক্ষর করতে কেউ বাকী রয়ে গেছেন কি না? তাঁরা বললেন ঃ হ্যাঁ শায়খ মুহীউদ্দীন আন –নববী এখনও রয়ে গেছেন। পরে তাঁকে ডেকে উপস্থিত করা হয এবং তাঁকে বলা হয়ঃ আপনিও অন্যান্য আলিম ফিকাহবিদদের সাথে স্বাক্ষর দিন। শায়খ নববী স্বাক্ষর দিতে অস্বীকৃতি জানালেন। বাদশাহ তার কারণ জিজ্ঞেস করায় তিনি বললেন, আমি জানি আপনি আমীর বন্দকদারের ক্রীতদাস ছিলেন। আপনার ধন-মাল কিছুই ছিল না। পরে আল্লাহ আপনার ওপর অনেক আনুগ্রহ করেছেন, তিনি আপনাকে বাদশাহ বানিয়েছেন। আমি শুনেছি আপনার মালিমায় িএক সহস্র ক্রীতদাস রয়েছে, তাদের প্রত্যেকেরই স্বর্ণখচিত পরিচ্ছদ রয়েছে। আপনার কাছে আরও দুই শত ক্রীতদাসী রয়েছে, তাদের রয়েছে মহামূল্য স্বর্ণলংকার। আপনি যদি এ সবকিছু বিক্রয় করে দেন এবং আপনার ক্রীতাদাসরা স্বর্ণখচিত পোশাকের পরিবর্তে মোটা পশমের পোশাক ধারণ করে- ক্রীতাদাসীরা শুধু কাপড় পরে, অলংকারহীনা থাকে, তাহলেই আমি প্রজা সাধারণের কাছ থেকে কর ধরে অর্থ প্রহণের সমর্থনে দেয়া ফতোয়ায় স্বাক্ষর দিতে পারি। জাহের তাঁর একতা শুনে ক্রুদ্ধ হনে এবং তাঁকে নিদের্শ দেনঃ এ দামেশক শহন থেকে তুমি এখনই বের হয়ে যাও। ইমাম নববী বললেনঃ আপনার নির্দেশ অবশ্য পালনীয়া এই বলে তিনি তার নাওয়া গ্রামের চলে গেলেন। তখন ফিকাহবিদগণ বাদশাহকে বললেনঃ এ লোকটি দেশের বড় আলিম ও শ্রেষ্ট লোকদের একজন। সকলেই তাকে মানে। তাঁকে দামেশকে ফিরিয়ে আনুন। তখন জাহের তাকে ফিরে ফিরে আসার আনুমতি দেন। কিন্তু শায়খ ফিরে আসতে অস্বীকার করেন এবং বলেনঃ জাহের ওখানে থাকা অবস্থায় আমি কিছুতেই সেখানে যাব না। প্রায় একমাসকাল পর জাহের মৃত্যুমুখে পতিত হন। [. আল উস্তায মুহাম্মাদ আল-গাযালী লিখিত (আরবী*********) গ্রন্থের ২২২-২২৩ পৃষ্ঠা থেকে, পঞ্চশ ছাপা।] ইমাম নববী সলতান জাহের বেবিরসকে উপদেশ দিয়ে একটি চিঠি লিখেছিলেন। তাতে নিনি শরীয়াতের বিধান ব্যাখ্যাকরেছিলেন। লিখেছিলেন; বায়তুলামলে কিছু বর্তমান থাকা অবস্থায়- নগদ সম্পদ হোক,সামগ্রী হোক, জমি হোক বিক্রয়যোগ্য সরঞ্জাম বা অন্য কিছু প্রজা সাধারণের কাছ থেকে আর কিছু গ্রহণ করা হালাল নয়। বাদশাহর দেশের আল্লাহ তা সাহয্যকারীদের সম্মনিত করুন সব মুসলিম আলিমেই এ মতে সম্পূর্ণ এক ও অভিন্ন। বায়তুলমাল তো এখন আল্লাহ শোকর খুবই সমৃদ্ধ ভরপুর। আল্লাহ তার প্রতিষ্ঠা, সমৃদ্ধি,প্রশস্ততা এবং খায়র ও বরকত আরও বাড়িয়ে দিন। [ হাফেয সালাভী লিভিত ইমাম নববীর জীবনী। (আরবী*********)] দ্বিতীয় শর্তঃকর এর বোঝা ইনসাফ সহকারে বন্টন অতিরিক্ত ধন-মাল অর্থ সংগ্রহের প্রয়োজন যখন সন্পষ্ট ভাবে প্রমাণিত হেবে এবং করধার্য করা ছাড়া ও প্রয়োজন পূরণের আর কোন সূত্র বা উপায় থাকবে না, তখন কর ধার্য করা শুধু জায়েযিই নয়. ফরযও। তবে শর্ত এই যে, লোকদের ওপর কর এর বোঝা সুবিচার ও ন্যায়পরতার ভিত্তিতে বন্টন করতে হবে নে এক শ্রেণীর লোক অপর শ্রেণীর লোকদেরই দ্বিগুণ তিনগুণ বেশী চাপের নীচে পড়তে না হয়- তা দাবি কারী কোন প্রয়োজন ছাড়াই। সুবিচার বা ন্যায়পরতা বলতে আমরা সমান –পরিমাণ মনে করছি না। কেননা দুই পার্থক্যপর্ণ ব্যক্তির মধ্যে সমতা করতে যাওয়া জুলুম ছাড়া কিছু নয়। তাই সকলের কাছ থেকে গ্রহণীর একই হারের হওয়া উচিত নয়্ বরং অর্থনৈতিক সামাজিকতার দিক দিয়ে ও হার বিভিন্ন হওয়া উচিত। ফলে কারো কাছ বেশী আর কারো কাছ থেকে তুলনামূলক ভাবে কম নেয়া বঞ্ছনীয়। আবূ উবাইদ তার সনদে হযরত ইবনে উম র (রা) থেকে বর্ণিত হাদীস উপরিউক্ত কথার সমর্থন করে। বর্ণনাটি এই ঃহযরত উমর (রা) নবত গোষ্ঠীর লোকদের কাছ থেকে জয়তুন ও গম বাবদ অর্ধ ওশর গ্রহণ করতেন- যেন মদীনার দিকে পরিবেশন বেশী বেশী হযেএবং কুতনীয় থেকে ওশর গ্রহণ করতেন। [(আরবী********)] নবত বলতে একদল ব্যবসায়ী বোঝায়,যারা যুধ্যমান লোকদেরদ মধ্য থেকে ইসলামী রাজ্যে এসে আশ্রয় গ্রহণ করেছিল। তারা বিভিন্ন পণ্য –দ্রব্য ও খাদ্য মদীনার আমদানী করত। হযরত উমর (রা) নিয়ম করেছিলেন যেমন আনাস ইবনে মালিক তাঁর থেকে বর্ণনা করেছেন, যুধ্যমান ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে এক-দমাংশ শল্ক গ্রহণ করতেন আর যিম্মী ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে শুল্ক নিতেন অর্ধ-ওশর। আর মুসলমান ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে নিতেন এক-দশাংশের এক –চতুর্থাংশ। [(আরবী********)] এটা হতো একদেশ থেকে দেশান্তরে পণ্যদ্রব্য নিয়ে যাওয়া বা আনার সময়ে। সীমান্তে শুল্ক আদায়ে দায়িত্বশীলরূপে নিয়োজিত লোকেরা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে এ কর গ্রহণ করত।তারা এক বছর কাল ব্যবসা করার সুযোগ পেত। এটা আধুনিককালের শল্ক কর এর মত ব্যবস্থা। বিদেশী আশ্রয় গ্রহণকারী ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে এক-দশমাংশ শুল্ক গ্রহণ করা হতো সমান সমান নীতি গ্রহণ আনুযায়ী।কেননা বিদেশী যুধ্যমানরা মুসীলিম ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে এই এক এক-দশমাংশই গ্রহণ করত হযরত আবূ মূসা হযরত উমর ফারুক (রা)কে তা-ই লিখে জানিয়েছিলেন। [(আরবী********)] তিনি যিম্মী ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অর্ধ –ওশর গ্রহণ করতেন, কেননা তাদের সাথে এ শর্তে সন্ধি হয়েছিল এবং তাতেই তারা রাজী ছিল। [(আরবী********)] তবে তাদের কাছ থেকে তা গ্রহণ করা হতো কেবলমাত্র একদেশ থেকে দেশান্তরে নিয়ে যাওয়অর সময়। মুসলমানদের অবস্থা ছিল ভিন্নতর, তারা নিজ দেশে ব্যবসা চালালেও তাদের ব্যবসার যাকাত দিতে হতো্ যেমন যিম্মীদের কৃষি ফসল,ফল গবাদি পশু ও অন্যান্য এমন সব মালের মুসলমানদের কাছ থেকে যার ওপর যাকাত নেয়া হয়- কোন অংশ দাবি করা হতো না। তবে এ ব্যবস্থও খৃস্টান বনূ তগলব গোত্র ছাড়া অন্যদের ক্ষেত্রে কার্যকর ছিল। কেননা এ খৃস্টান গোত্রটি হযরত উমরের সাথে বিশেষ শর্তে সন্ধি করেছিল বলে তারা স্বতন্ত্র ও বিশেষ আচারণ পেত। [ এ জন্যেক দ্বিতীয় অধ্যায়ের প্রথম আলোচনা দ্রষ্টব্য] মুসলিম ব্যবসায়ূ সম্পদের যাকাত।উদ্দেশ্য হচ্ছে, উপরিউক্ত নবত গোত্রের লোকদের কাছ থেকে এক –দশমাংশ নেয়াই ছিল নিয়ম-যেমন সায়েব ইবনে ইয়াজীদ বলেছেনঃ আমি হযরত উমরের যুগে মধীনার বাজারে কর্মকর্তানিযুক্ত ছিলাম। তখন আমি নবত গোত্রের লোকদের কাছ থেকে ওশর গ্রহণ করতাম। [ (আরবী********)] কিন্তু হযরত উমর (রা) কর এর মূল্য হ্রাস করার ইচ্ছা করলেন এবং অর্থনৈতিক বিচার বিবেচনায় তা ১০% থেকে৫% পর্যন্ত নামিয়ে দিলেন। এটা ছিল তদানীন্তন ইসলামী রাজ্যের রাজধানী মদীনা নগরের জন্যে প্রয়োজনয় খাদ্য ইত্যাদি অন্যান্য পণ্যের তুলনায় বেশী বেশী আমদানী কাজে তাদের উৎসাহিত করার লক্ষ্যে গৃহতি সিদ্ধান্ত। তখনকার সময়ে সদীনায় জয়তুন ও গম আমদানী করার বিশেষ প্রয়োজন ছিল কলাইর ডাল,গোশত খণ্ড ইত্যাদির তুলনায়। একালের প্রায় সব রাষ্ট্রেই শল্ক নীতি এমনিভাবেই গড়ে তুলে থাকে। তাই কোন কোন ক্ষেত্রে শুল্কের হারকম করে কখনও উঁচুও করে দেয়। সুনির্দিষ্ট আমদানীকে উৎসাহিত করার লক্ষ্যেই তা করা হয়, দেশী শিল্পজাত পণ্যকে সংরক্ষণ দেয়া অথবা পূর্ণ পরিপক্ক শিল্প-পণ্যের আমদানী হ্রাস করার সিদ্ধান্তের ফলেই তা করা হয়। এভাবে আর অনেক উদ্দেশ্য থাকতে পারে। আবূ উবাইদ ইবনে উমর (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেনঃ হযরত উমর নবত লোকদের থেকে জয়তুন ও গম বাবদ অর্ধ –ওশর গ্রহণ করেতেন –যেন মদীমায় আমদানী বেশী হয় এবং কুতনিয়ার কাছ থেকে নিতেন ওশর। [ (আরবী********)] হযরত উমরের এ নীতি আমদেরকে শল্ক কর এর হার বাড়ানো বা কমানের একটা দলিল বা পথপ্রদর্শন দিচ্ছে। রাষ্ট্র পরিচলকের বিবেচনা মত জাতীয় কল্যাণ চিন্তার ভিত্তি তেই তা করাপ যাবে। পূর্বে আমরা বলে এসেছি, সমাজ জীবনে ও অর্থনীতিতে ইসলামের লক্ষ্য হচ্ছে, জাতীয় সম্পদ তার মধ্য থেকে মুষ্টিময় লোকদের হস্তে পুঞ্জীভূত হয়ে যাবে না, অন্যদের তো কোন প্রশ্নই উঠতে পারে না। এ কারণে ইসলাম অধিকাংশ সক্ষম লোকদের মধ্যে জাতীয় সম্পদ বিতরণের নীতি আনুযায়ী কাজ করে, লোকদের পরস্পরের বড় বড় ফাঁক ও পার্থক্য দূর করা এবং জনগণেকে আর্থিক অবস্থায় দিক দিয়ে পরস্পরের সমান ও নিকটতর মানে নিয়ে আসা তারই দায়িত্ব। এ কারণে আল্লাহ তাআলা ফাই সম্পদ বণ্টনের এ মৌল নীতি ঘোষণা করেছেনঃ (আরবী********) যেন ধন সম্পদ কেবল তোমাদের মধ্যকার ধনী লোকদের মধ্যেই আবর্তিত হতে না থাকে। [(আরবী*******)] তাই উর্ধ্বমুখী কর ছাড়া অন্য কোন উপায় যখন থাকবে না তখন পরিণতি এই দেখা দেবেঃ ধন-সম্পদ কেবলমাত্র ধনী লোকদের মধ্যেই আবর্তিত হচ্ছে না। ধনী একটা মানে নেমে আসবে এবং দরিদ্ররা একটি মানে উন্নীত হবে, উভয়ই পরষ্পরের কাছাকাছি এসে যাব্ ইসলাম এই নীতিকেই সমর্থন করে, এ নীতিরই আনুকুল্য করতে প্রস্তুত। তা করা হবে ব্যক্তির ব্যক্তিগত জীবন-জীবিকা, পরিবাররের দায়-দায়িত্ব এবং ঋণসমূহ ফেরত দান ইত্যাদি যথাযথভাবে পালনের সুযোগ দেয়ার। এছাড়াও পূর্বে যে সব কথার উল্লেখ করেছি, তার প্রতি লক্ষ্য রেখে। তৃতীয় শর্তঃ জাতীয় কল্যাণে ব্যয় করতে হবে, পাপ ও নির্লজ্জতার কাজে নয় কর ইনসাফ সহকারে গ্রহণ করাই যথেষ্ট নয়, তার বোঝাসহ লোকের ওপর ইনসাফ সহকারে করাই একমাত্র দায়িত্ব নয়। সে বাবদ লব্ধ সম্পদ জাতীয় সাধারণ কল্যাণমূলক কার্যবলীতে ব্যয় ও নিয়োগ করতে হবে। শাষক প্রশাসকদের অভিলাষ–লালসা ও ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধারের কাজে ব্যয় করা চলবে না।তাদের পরিবারের সুখ সুবধা-বিলসিতা পূরণের জন্যেও নয়। তাদের আনুসারী দলীয় লোক এবং সহযাত্রী সাথীদের আনন্দস্ফূর্তি বিধানের জন্যেও নয়। এ কুরআন মজীদ যাকাত ব্যয়ের খাত সম্পষ্ট ও অকাট্যভাবে নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। তাতে কোনরূপ দলীয় রাজনীতির খেলা বার একবিন্দু অবকাশ রাখা হয়নি। পাওয়ার যোগ্য লোক ছাড়া অন্যদের জন্যে তার এক ক্রান্তিও ব্যয় করা চলবে না। খুলাফায়ে রাশেদুণ এবং তাঁদের সাথে সাথে সাহাবায়ে কিরাম ও জনগণের ধন-সম্পদগ তার জন্যে শরীয়াত নির্ধারিত খাতে ব্যয় করার ওপর খুব বেশী কঠোরতা অবলম্বন করেছেন। খিলাফতে রাশেদা ও অত্যাচারী রাজা বাদশাহর মধ্যে এটা ই তো পার্থক্য। প্রথমোক্তরা দেশ শাসন করেন আল্লাহর দেয়া বিধানের ভিত্তিতে আর শেষোক্তরা দুনিয়ার প্রচলন বা নিজেদের ইচ্ছা কামনা আনুযায়ী। ইবনে দুনিয়ার (আরবী********) গ্রন্থে সালমান থেকে বর্ণনা করেছেন। হযরত উমর (রা) তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি বাদশাহ না খলীফা? সালমান তাঁকে বললেন, আপনি যদি মুসলমানের জমি থেকে একটি বা কম কিংবা বেশী দিরহাম কর গ্রহণ করেন, অতঃপর তা তার উপযুক্ত ক্ষেত্র ছাড়া অন্যত্র ব্যয় বা বিনিয়োগ করেন, তাহলে আপনি বাদশাহ খলীফা নন। এ কথা শুনে হযরত উমর কেঁদে ফেললেন। [(আরবী********)] সুফিয়ান ইবনে আবুল আওজা থেকে বর্ণিত, হযরত উমর ইবনুল কাত্তাব বলেছেনঃ আল্লাহর কসম আমি জানি না আমি খলীফা না বাদশাহ। আমি যদি বাদশাহ হই, তাহলে এটা একটা ভয়ানক ব্যাপার। একজন বললঃ খলীফা ন্যায়সঙ্গতভাবেই গ্রহণ করে এবং ব্যয় রেক শুধু উপযুক্ত স্থানে। আল্লাহর শোকর,আপনি তো তোই করেন। আর বাদশাহ তো সীমালঙ্ঘন করে। সে নিজ ইচ্ছামত গ্রহণ করে ও ইচ্ছামতোই ব্যয় করে। হযরত উমর এ কথা শুনে চুপ হয়ে গেলেন। [(আরবী********)] তাবারী বর্ণনা করেছেন, হযরত উমারের সাথে এক ব্যক্তির নিকটাত্মীয়তা ছিল। সে তাঁর কাছে কিছু চাইল। হযরত উমর তাকে ধমক দিয়ে বের করে দিলেন। এ নিয়ে কথা হয়। পরে একজন বললেন ঃ হে আমীরুলমুনিনীন !অমুক ব্যক্তি আপনার কাছে কিছু চেয়েছিল। কিন্তু আপ নর তাকে তা না দিয়ে বের করে দিয়েছেন? তখন তিনি বললেনঃ হ্যাঁ লোকটি আমার কাছে আল্লাহর –(সামষ্টির, রাষ্ট্রের) মাল চেয়েছিল। আমি যদি তাকে তা দিতাম,তাহলে আল্লাহর কাছে আমার ওজর পেশ করার কিছুই থাকত না। আমি বিশ্বাসভঙ্গকারী বাদশাহ হিসেবেই তাঁর সাথে সাক্ষাত করতে বাধ্য হতাম। [(আরবী********)] চতুর্থ শর্তঃ উপদেষ্টা পরিষদ ও জনমতের সামঞ্জস্য রক্ষা রাষ্ট্রপ্রধান প্রধান তাঁর প্রতিনিধি ও বিভিন্ন আঞ্চলিক কর্মকর্তাদের মতকে অগ্রাহ্য করে তার প্রতি গুরুত্ব না দিয়ে কেবলমাত্র নিজের মতের ভিত্তিতে কর ধার্য করবেন, তা আদৌ জায়েয নয়। তার পরিমাণও একক মতের জোরে করতে পারেবেন না। জনগণের ওপর কোনরূপ কর ধার্য করতে হলে উপদেষ্টা পরিষদের লোকজন এবং গণপ্রতিনিধিদের সাথে মতের সামঞ্জস্য বিধান করেই তা করতে হবে। আমরা বলেছি, ব্যক্তিগণের ধন-মালের ব্যাপারে মৌলিক কথা হল তা গ্রহণ করা হারাম।এটা ব্যক্তি মালিকানার মর্যাদা রক্ষার ব্যবস্থা। আর জনগণের ওপর কোনরূপ দায়িত্ব না চাপানো সর্বপ্রকারে বোঝা থেকে দখল থেকে ছিু মাল নিয়ে নিতে বাধ্য করবে, তাদের ওপর খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়ে। তখন আনুরূপ সিদ্ধান্ত গ্রহণের নিমিত্ত মতামত দানের জন্যে দায়িত্বশীল ও কর্মকর্তাদের রায়ের মধ্যে পূর্ণ সমঞ্জস্য সৃষ্টি করেই পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে্ তারাই পূর্বোদ্ধৃত শর্তসমূহের প্রতি নজর রেখে কাজ আঞ্জাম দিতে পারে। তারা ধার্য করার প্রয়োজনের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করবে। অন্যান্য আয়ের সূত্রে এ প্রয়োজন পূরণে যথেষ্ট কিনা, তাও তারাই আনুধাবন করতে পারবে এবং জনগণের মধ্যে করের বোঝা সুবচারপূর্ণ নীতিতে বন্টন করতে সক্ষম সংগঠন কায়েম করাও তাদের পক্ষেই সম্ভব হবে।তারাই সংবাদদাতা বাঅবস্থা সস্পর্কে অবিহিত ও বিশেষত্বসম্পন্ন লোকদের সাহায্য ও নিতে পারবে। উপরস্ত যে উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে এ ধার্যকৃত কর বাবদ লব্ধ সম্প সংগ্রহ করা হয়েছে- যে জনকল্যাণমূলক, উৎখেদমতের কাজ করার ইচ্ছা, সেই কাজেই তা ব্যয় হচ্ছে কিনা তার প্রতি লক্ষ্য রাখাও তাদেরই দায়িত্ব। পরামর্শ করা কুরআন সন্নাহর প্রমাণে ফরয পরামর্শের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের কথাটি যা আমরা বলেছি, তা আমাদের নিজস্ব কথা নয়। কুরআন ও সুন্নাহ থেকে তাই প্রমাণিত হয়। কুরআনের আয়াতে তো পরামর্শ গ্রহণকে ইসলামী সমাজ গঠনের একটা মৌল ও ভিত্তিগত উপরকণ হিসেবে উপস্থাপিত করেছে। আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেনঃ(আরবী******) আর যারা তাদের আল্লাহর আহ্বানে সাড়া দিয়েছে, নামায কায়েম করেছে এবং যাদের জাতীয় ব্যাপারাদি পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে সম্পন্ন হয় এবং আমরা যা রিযিক বাবদ তা থেকে ব্যয় করে…..। [(আরবী********)] আয়াতটিতে পারস্পরিক পরামর্শেকে আল্লাহর আহবানে সাড়া দেয়ার, নামায কায়েম করা এবং আল্লাহর দেয় রিযিক থেকে ব্যয় করার সাথে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। এটা মাক্কী যুগের কথা। এ যুগে ইসলামের মৌল নীতিসমূহই প্রতিষ্ঠত হচ্ছিল। সাধারণ স্বাভাবিক পদ্ধতি হিসেবে গুণ ও প্রশংসাকীর্তন স্বরূপ সে বিষয়ে বলা হয়েছে। কুরআনে কখনও মন্দ বলা ও তিরস্কারস্বরূপও এ পর্যায়ের কথা বলা হয়। পরে মদীনর যুগে নাযিল হয়েছে আল্লাহ তাআলার এ নির্দেশ (আরবী******) এবং তুমি তাদের সাথে পরামর্শ করা জাতীয় সামষ্টিক ব্যাপারাদিতে। পরে তুমি যখন সংকল্প করে ফেললে,তখন আল্লাহর ওপরই ভরসা কর। [(আরবী********)] মাদানী যুগটি হচ্ছে ইসলামী সমাজের জন্যে আইন প্রণয়ন ও সংগঠন গড়ে তোলা পর্যায়। এখানে আয়াতটিতে নি্র্দেশের ভঙ্গি গ্রহণ করেছে। আর সাধারণ স্বাভাবিক রীতি হচ্ছে হয় আদেশ হবে, না হয় নিষেধ হবে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে,উক্ত আয়াতটি ওহোদ যুদ্ধের পর অবতীর্ণ হয়েছে। এ যু্দ্ধের সূচনাতেই রামূলে করীম (স) সাহাবাদের সাথে একত্রিত হয়ে পরামর্শ করেছিলেন এ বিয়য়ে যে, শহরের মধ্যে অবস্থান গ্রহণ করা হবে, না অগ্রসর হয়ে শক্রদের মুকাবিলা করা হবে? সাধারণভাবে সাহবিগণ শহর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পক্ষেই মত দিয়েছিলেন। ফলে তিনি বের হয়েছিলেন কিন্ত এটা তার একার মতের ভিত্তিতে ছিল না।যদিও পরিণামে সত্তরজন সাহাব আল্লাহর পথে জীবন উৎসর্গ করিছিলেন। এরূপ পরিণতি সত্ত্বে ও উক্ত আয়াতটি নাযিল হয়ে পরামর্শ করারই তাগিদ করেছে। স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছে সেজন্যে এবং তাদের পরামর্শ কর বলে অর্থাৎ তোমাকে এ পরামর্শ করা নীতি অব্যাহতভাবে চালিয়ে যেতে হবে। পরামর্শের পরিণতি যতিই মর্মান্তিক হোক তা পরিহার করা চলবে না। কেননা একথা স্বতঃসিদ্ধ যে, যে পরামর্শ করেছি সে কখনও লজ্জিত হয়নি। সুন্নাত বা হাদীস ও এব্যাপারে স্পষ্টভাষী। নবী করীম (স) যাবতীয় জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে সাহবিগণের াসাথে পরামর্শ করতেন বিশেষ করে সে ব্যাপারে, যে বিষয়ে আল্লাহ কোন নির্দেশ বা সিদ্ধন্ত নিয়ে অহীনাযিল হয়নি।বদর যুদ্ধে ঈর পর্বত পর্যন্ত যাওয়ার ব্যাপপরেও তিনি পরমর্শ করেছিলেন। কেবল মহাজির সাহাবীদের পরমর্শকেই তিনি যথেষ্ট মনে করেননি। আনাসার সাহাবিগণের মতের সাথে সঙ্গতি হওয়ার ফলেই তিনি স্বস্তি পেয়েছিলেন। মনযিল কোথায় হবে তা নিয়ে ও পরার্শ করেছেন। হুবার ইবনুল মুনযিরের পরামর্শের ভিত্তিতে সে মনযিল ঠিক করা হয়। ওহোদের দিন- যেমন বলেছি শহরের বাইরে যাওয়াটা পরামর্শের ভিত্তিতে গৃহীত সিদ্ধান্ত আনুযায়ী হয়েছিল। খন্দকের দিন আহজাবের সাথে এক বছরের জন্যে মদীনার ফলের এক তৃতীয়াংশ নেয়ার ভিত্তিতে সন্ধি করার ব্যাপারেও পরামর্শ করেছেন। কিন্তু সাযাদ ইবনে উবাদা ও সায়াদ ইবনে মুয়ায তা মেনে নিতে অস্বীকার করেছিলেন। ফলে তাপরিত্যক্ত হয়। হুদায়বিয়ার দিনও পরামর্শ করেছিলেন মুশরিকদের সমআনদের প্রতি দৃষ্টি দেয়ার ব্যাপারে বি করা যাবে, তা নিয়ে। তখন হযরত সিদ্দীক (রা) বললেনঃ আমরা কারো সাথে যদ্ধ করতে আসিনি। আমরা এসেছি উমরা করার নিয়তে। তিনি একথা দিয়েই জবাব দিয়েছিলেন হযরত আয়েশা(রা) এর প্রতি মিথ্যা আরোপের ঘটনায়ও নবী করীম (স) প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছিলেনঃ হে মুসলিম জনগণ, যি লোকরা আমার পরিবারেরে ওপর দোষারোপ করেছে,[ (আরবী******) অর্থ তুহমাত –দোষ আরোপ করেছে। কেই যখন কেউ যখন কাউকে খার।] খারাপ কথা চালিয়ে দিয়েছে, তাদের ব্যাপারে করণীয় সম্পর্কে তোমরা আমাকে পরাপমর্শ দাও। হযরত আলী ও উসমান (রা) এর কাছে হযরত আয়েশা (রা) এর সাথে বিচ্ছেদ ঘটানের ব্যাপারেও পরামর্শ চেয়েছিলেন। [(আরবী******)] ইবনে কাসীর এ সব পরামর্শ সংক্রান্ত ঘটনাবলীর উল্লেখ করে বলেছেনঃ নবী করীম (স) যুদ্ধ ইত্যাদি ব্যাপারে পরামর্শ করতেন। এ প্রেক্ষিততে ফিকাহবিদগণ এ ব্যাপোরে মতভেদে পড়েছেন যে, পরামর্শ গ্রহণ তাঁর জন্যে ফরয ছিল কিংবা লোকদের মন রক্ষার্থে তা করা মুস্তাহাব ছিল। ফিকাহবিদদের কথা এ দুভাগে বিভক্ত। রাসূলে করীম (স) মাসুম ও অহীর মাধ্যমে সাহায্যপ্রাপ্ত ছিলেন। তাঁর অন্য পরামর্শের ব্যাপার কি ছিল, তা নিয়ে মতভেদ জায়েয হলেও তাঁর পরবর্তী খলীফা ও ইমাম রাষ্ট্রপ্রধান গণের ব্যাপারে এ নিয়ে কোন কোনরূপ মতভেদ করা আদৌ সঙ্গত নয়। কেননা আয়াতটি এ বিষয়ে সম্পষ্ট। এ সুস্পষ্ট আদেশ ফরয প্রমাণ করে। নবী করীম (স) নিজে সর্বপ্রকারের জাতীয় গুরুত্বপুর্ণ ব্যাপারে পরামর্শ কার্যকর করার জন্যে উৎসাহিত করেছেন। তাতেও তা ওয়াজিব বা ফরয প্রমাণিত হয়। বিশেষ করে মুসলিম উম্মাতের দীর্ঘ ইতিহাসের অভিজ্ঞতা স্বৈরতন্ত্রীদের আচরণের প্রক্ষিতে স্বৈরতন্ত্রের যে অভিশাপ ও দুঃখ বিপর্যয়ে মুসলিম জনগণ বিধ্বস্ত ও বিপর্যস্ত হয়েছে, সে দৃষ্টিতেও কুরআনের আয়াতের নির্দেশ আমাদের জন্যে অবশ্য পালনীয় বানিয়ে দেয়। পরামর্শ কি জ্ঞানদানকারী না বাধ্যতামূলক এখানে একটি প্রশ্ন থেকে যায়। তা হচ্ছে এ পরামর্শ কি রাষ্ট্রপ্রধানের জন্যে বাধ্যতামূলক। এর জবাব হচ্ছে, হ্যাঁ তাতে কোন সন্দেহ নেই। তার দলিল হচ্ছে, বনী করীম (সা) নিজে পরামর্শ গ্রহণেল পরা নিজের মত পরিহার করে অধিকাংশ সাহাবীর পরামর্শ আনুযায়ী কাজ করতেন। পূর্বে বহু কয়েকটি স্থানে আমরা তার উল্লেখ করেছি। ইবণে কাসীর উল্লেখ করেছেন, ইবনে মারদুইয়া হযরত আলী ইবনে আবূ তালিব (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেনঃ তিনি বলেছেনঃ তুমি যখন দৃঢ় সংকল্প করলে তখন আল্লাহর ওপর ভরসা কর। এ আয়াতে যে (আরবী********) বা দৃড় সংকল্প এর কথা বলঅ হয়েছে, তার তাৎপর্য সম্পর্কে রাসূরে করীম (সা) বলেছিলেনঃ মত দিতে পারে এমন লোকদের সাথে পরামর্শ করা এবং পরে তাদের পরামর্শ মেনে নেয়াই হচ্ছে তার তাৎপর্য। [ (আরবী********)] পরামর্শের ফল যদি বাধ্যতামূলক না হয়, তাহলে তার কোন গুরুত্ব বা মূল্যই থাকে না।দুনিয়ার স্বৈরতন্ত্রীরা এ পরামর্শকে একটা হাস্যকর বস্তুতে পরিণত করেছে। তারা তা নিয়ে লোকদের সামনে হাস্যরস ও তামাসা করে। তারাও পরামর্শ করে বটে, কিন্তু কাজ করে নিজেদের ইচ্ছেমত অথবা পরমর্শ করে কিন্তু বিরোধিতা করে যেমন তারা মেয়েদের ব্যাপারে ধারণা পোষণ করে। [কতক লোকের মুখে একটি খুব শোনা যায়ঃ মেরেদের সাথে পরমর্শ কর; কিন্তু করে তার বিপরীত।তারা মনে করে এটা বুঝি রাসুলের হাদীস। কিন্তু তা যে সত্য নয়, তাপ্রমাণের জন্যে দলিল হিসেবে আল্লাহর একথাটিই যথেষ্ট যা তিনি বলেছেন পিতা মাতা সম্পর্কে দুগ্ধপোষ্য সন্তান প্রসঙ্গেঃ তাদের দু জনের পারস্পরিক পরামর্শ ও সন্তুষ্টির ভিত্তিতে যদি দুধ ছাড়াতে ইচ্ছা করে, তাহলে তাদের কোন দোষ হবে না (আল-বাকারা; ২৩৩ আয়াত)। সত্তরী প্রমুখ বলেছেনঃ তাদের একজনের পক্ষে অপরাজনের সাথে পরামর্শ না করে স্বৈরাচার চালায়, তবে তা জায়েয হবে না।ইবনে কাসীর, ১ ম খণ্ড, ৫৮৪পৃ.)] তাছাড়া জাতির দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের এরূপ শর্ত করার অধিকার আছে যে, রাষ্ট্র প্রধান তাদের সাথে প্রতিটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে বাধ্যতামূলকভাবে পরামর্শ করবে। কর ধার্য করা এ পর্যায়েরেই একট কাজ এবং এ শর্তের ওপর বয়আত পূর্ণত্ব পাবে, তখন তা ভঙ্গ করা তার পক্ষে জায়েয হবে না, সম্ভব হবে না। হাদীসে বলা হয়েছেঃ (আরবী********) মুসলমানরা তাদের শর্তের ওপর থাকবে। [ হাদীসটি আবূ দাউদ উদ্ধৃত করেছেন (আরবী********) তে। ইবনে মাজাহ (আরবী********) এ এবং হাকেম আবূ হুরায়রা থেকে। বুখারী ও মুসলিমের উদ্ধৃত করেছেন কাসীর ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আউফ আল-মুজানী তাঁর পিতা থেকে তাঁর দাদা থেকে –এ সূত্রে। তিনি বলেছেন, হাদীসটি সহীহ। তার ভাষা এইঃ (আরবী********) মুসলমানরা তাদের শর্তের ওপর স্থির থাকবে। তবে কোন শর্ত হালালকে হারাম করে যা হারামকে হালাল করে (তবে তাক্ষা করা যাবে না।) এর আপত্তি তলেছেন যে, বর্ণনারাকারী কাসীর খুব বেশী যয়ীফ।ইবনে হাজার তার ওশর পেশ করেছেনঃ বলেছেন সম্ভবত তিনি হাদীসটি বহু সূত্রে বর্ণিত হওয়াকে গণ্য করেছেন। তা তাবারানী বর্ণনা করেছেন রাফে ইবনে খাদীজ থেকে। তার সনদ উত্তম –যেমন আল-মুভীক আত তাইমীর গস্থে বলা হয়েছে ২য় খণ্ড, ৪৫৭ পৃ.) শাওকানী তাঁর বহুকয়টি বর্ণনা উদ্ধৃত করার পর লিখেছেনঃ একথা স্পষ্ট যে, এ হাদীসমূহ ও সূত্রসমূহ পরস্পরের সাক্ষ্য দিচ্ছে। তাই এর কম যে কম অবস্থা হচ্ছে এই যে, যে মূল দেখুন (আরবী********)] ওয়াদা পূরণ করা সুনশ্চিতভাবে ওয়াজিব। এখন আমরা পরামর্শ ওয়াজিব না মুস্তাহাব তা বাধ্যতামূলক না জ্ঞান দানকরী-এ কথা িবলা পার্থক্যহীন।এ হাদীস এবং উপরিউক্ত কোন সব বিষয়ে পরমর্শ করতে হবে, তা চিহ্নিত করে দেননি। শুধু একটা ব্যাপক অর্থবোধক শব্দ (আরবী********) এর উল্লেখ হয়েছে। এ শব্দটি শামিল করে সর্বপ্রকারের সাধারণ ব্যাপার যা জনসাধারণের সাথে সংশ্লিষ্ট এবং তাদের কল্যাণ ও অবস্থার সাথে সম্পুক্ত ও তার ওপর প্রভাব শালী যেমন যুদ্ধ ও বিভিন্ন রাষ্ট্রের সাথে চুক্তি এবং এ পর্যায়ের অন্যান্য যাবতীয় ব্যাপার।সন্দেহ নেই, কর ধার্য করা জাতির জনগণের ওপর একটা অতীব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। জাতীয় জীবনে তা প্রভাব সুদুর প্রসারী। এ কারণে সকল আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে প্রতিনিধি পরিষদের সদস্যদের মতের সাথে সঙ্গতি স্থাপন করে জনগণের ওপর কোন প্রকারেরই কর ধার্য করে না। তৃতীয় আলোচনা কর ধার্যর বিরোধীদের সংশয় বেশ কিচু লোক মনে করেন, যাকাত ধার্য হওয়ার দরুন আর কোন কর ধার্যর আদৌ প্রয়োজন নেই। অতঃপর অন্য কোন কর ধার্য করা জায়েযও নয়। তাদের এ কথার সমর্থনে ও প্রমাণের জন্যে যে সব সন্দেহ সংশয় প্রকাশ করেছেন, তার কতিপয়ের সংক্ষিপ্ত উল্লেখ এখানে করা যাচ্ছে। প্রথম সংশয়ঃ ধন –মালেন যাকাত ছাড়া আর কিছু প্রাপ্য নেই ফিকাহবিদদের ব্যাপারে একথা সর্বজনবিদিত যে, তাঁরা এ মত পোষণ করেন যে, ধন- মালে যাকাত ছাড়া আর কিছু প্রাপ্য নেই এবং ধন-মালের ওপর হক বা প্রাপ্য হিসেবে চিরকাল এ যাকাতই শুধু ধার্য হতে পারবে। এছাড়া আর কিছু্ ধার্য করা যাবে না। অতএব কর বা অন্য কিছুর নানে জনগণের ধনমাল থেকে কিছুই নেয়া জায়েয হবে না। দ্বিতীয় সংশয়ঃ ব্যক্তিগত মালিকানার মর্যাদা রক্ষা ইসলাম ব্যক্তিগত মালিকানাকে যথার্থ মর্যাদা দিয়েছে। প্রত্যেক ব্যক্তিকেই তার ধন-মালের ওপর অন্য সকলের তুলানায় অধিকারী বানিয়ে দিয়েছে। ধন-মাল পারস্পরিক নেয়া হারাম করে দিয়েছে, যেমন হারাম করেছে কক্ত ও মান-সম্মান। এমন কি হাদীসে উদ্ধৃত হয়েছে, যে লোক তার ধন-মাল রক্ষা করতে গিয়ে নিহতত হবে, সে শহীদ গণ্য হবে। [ বহু কয়কজন মুহদ্দিস হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন।] অতএব কোন ব্যক্তির স্বতঃস্ফূর্ত অনুমতি বা সন্তুষ্টি ব্যতিরেকে কারো ধন-মাল নেয়া হালাল নয়। কর সম্পর্কে তার সমর্থকরা তার দোষমুক্ত হওয়া ও তার ব্যাখ্যায় যত কিছুই বলুক না কেন, তা ধন-মালের একটি অংশ তার মালিকদের হাত থেকে জোরপুর্বক ও তাদের মনে আঘাত দিয়ে নিয়ে নেয়া ছাড়া আর তা কিছুই নয়। তৃতীয় সংশয়ঃ কর ও শুল্ক ধার্যকরণের বিরুদ্ধে বর্ণিত হাদীস নব করীম (স) এর বহিু সংখ্যক হাদীসে শুল্ক ইত্যাদি ধার্য করণ ও তা আদায়ে নিযুক্ত লোকদের মন্দ বলা হয়েছে এবং তার জাহান্নামে যাওয়ার ও জান্নাত থেকে বঞ্চিত হওয়ার হুমকি দেয়া হয়েছে। আবূ খায়ের (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেনঃ মুসলিমা ইবনে মুখাল্লাদ মিসরে নিযুক্ত আমীর (শাসনকর্তা) ছিলেন। তিনি রুয়াইফা ইবনে সাবেত (রা) এর কাছে দাবি করলেন যে, তাঁকে দশমাংশ কর আদায়ের দায়িত্বশীল নিযুক্ত করা হোক। তখন তিনি বললেনঃ আমি শুনেছি, রাসূল করীম (স) বলছিলেনঃ কর আদায়কারী জাহান্নামী। [আহমাদ উদ্ধৃত করেছেন ইবনে লাহিয়ার বর্ণনা থেকে। তাবারনীও অনুরূপ উদ্ধৃত করেছেন। তিনি অতিরিক্ত শব্দ ব্যবহার করেছেন। (আরবী********)] উকবা ইবনে আমের থেকে বর্ণিত, তিনি রাসূল করীম (স) কে বলতে শুনেছেনঃ কর আদায়কারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না। [আবূ দাউদ ও ইবনে খুজায়মা তাঁর সহীস গ্রন্থে এবং হাকেম হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন। তাঁরা সকলেই মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাকের বর্ণনা দয়েছেন। হাকেম বলেছেনঃ হাদীসটি মুসলিমের শর্তে সহীহ।মুনযেরী বলেছেনঃ এ কথাই বলেছেন আর মুসলিম মুহাম্মাদ েইবনে ইসহাক থেকে (আরবী********)এর উদ্ধৃত করেছেন (আরবী********)] এ হাদীসটি এবং তার পূর্বে উদ্ধৃত হাদীসটি সম্পর্কে যদিও কথা উঠেছে, তবু এ দুটির সমর্থন করছে মুসলিমের গ্রন্থে উদ্ধৃত হাদীসটি। সেটি গামেদীয়া মহিলার প্রসঙ্গে বর্ণিত। মেয়েলোকটি জ্বেনার ফলে গর্ভবতী হয়েছিল। নবী করীম(স) তার ওপর শরীয়াতের দণ্ড কার্যকর করেছিলেন। কেননা সে নিজেই তা স্বীকার করেছিল। এ দন্ড কার্যকর করা হয়েছিল সম্তান প্রসব ও তার দুধ ছাড়ানোর পর। এ হাদীসটিতে যদি এ রূপ তওবা করত, তাহলে তাকে ও মাফ করা হত। এ তাদীসটি প্রমাণ করছে যে, কর আদায়কারীর গুনাহ বিবাহিতা হয়ে জ্বেনা দরুন গর্ভবতী হলে যে গুনাহ হয়, সে রকম কঠিন গুনাহ। আর এটা কর আদায় প্রসঙ্গে অত্যস্ত কঠিন আযারেব ধমক। (আরবী********) অতিরিক্ত কর আদায়কারীদের তিরস্কার করে বলা হদীসসমূহ সহীহ বা হাসান নানে অভিহিত হতে না পারলেও তা পরস্পরকে শক্তিশালী করছে। তাবরানী (আরবী********) গ্রন্থে উসমান ইবনে আবুল আচ থেকে নবী করীম (স) থেকে এ সনদে যে হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন, তাও এ পর্যাযে গণ্য। তাতে বলা হয়েছেঃ আল্লাহ তাআলা তাঁর সৃষ্টির কাছে আসেন। অতঃপর ক্ষমা করেন, যে তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে। কিন্তু যে লোক তার যৌন স্থানের সীমা লঙ্ঘন করেছে এবং যে অতিরিক্ত কর আদায়কারী এ দুজন ছাড়া। [ হাদীসটি (আরবী********) গ্রন্থের ৩য় খণ্ডের ৮৮ পৃষ্ঠায়ক উদ্ধৃত হয়েছে এমন ভাষায় যা (আরবী********) এবং আহমাদ থেকেও আলাদা। আহমাদেরক বর্ণনাকারীরা সহীহ তবে তাদের মধ্যে রয়েছে আলী ইবনে যায়দ। তার ব্যাপারে আপত্তি থাকলেও তাকে সিকাহ বলাক হয়েছে-] ইবনুল আসীর (আরবী********) গ্রন্থে বলেছেনঃ হাদীসের শব্দ (আরবী********) একটা কর বিশেষ, যা কর আদায়কারীক গ্রহণ করে থাকে। আর (আরবী********) বলতেও তাই বোঝায়। [(আরবী********)] বগাভী বলেছেনঃ কর আদায়কারী বলতে এ সব হাদীসে সে লোক বুঝিয়েছে, যে লোক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে যখন তারা এক স্থান থেকে অন্যত্র যায়-এক–দশমাংশের নামে এ (আরবী********) আদায় করে। [ (আরবী********)]আল মুনযেরী বলেছেনঃ এক্ষণে বা একালে (আরবী********) গ্রহণ করে ওশর এর নামে। এছাড়া নাম ছাড়াও বাহু কর গ্রহণ করা হয়ে থাকে। এভাবে যা যা গ্রহণক করা হয়, তা সবই হারাম। এবং ঘুষ বিশেষ। এসব নিয়ে তারা আসলে পেটের মধ্যে আগুন ভরছেঠ। তাদের পক্ষের সব দলিল প্রমাণ তাদের আল্লাহর কাছে গ্রহনযোগ্য এবং তাদের ওপর ক্রোধ এবং তাদের জন্যে রয়েছে কঠিন আযাব্[৩ ঐ ৫৬৭ পৃ.] কর আদায়কারী সম্পর্কে আল মুনভী লিখেছেনঃ তারাই হচ্ছে ওশর –এক-দশমাংশ কর আদায়কারী। এরা লোকদের থেকে তা (জোরপূর্বক ওঅন্যায়ভাবে) গ্রহণ করে থাকে। তাইয়্যেবীর কথা উদ্ধৃত করেছেনঃঅতিরিক্ত ও অন্যায়ভাবে নেয়া কর বড় বড় ধ্বংস কারী গুনাহের মধ্যে একটা। যাহবী এ কাজকে কবীরা গুনাহ বলেছেন। [যাহবীর (আরবী********) গ্রন্থের ১১৯ পৃষ্ঠার তাই উল্লেখ করা হয়েছে। (আরবী********) কিন্তু যাহবী (আরবী********) কি তা কোন সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা লেখননি। বরং বলেছেনঃ অতিরিক্ত কর আদায়কারী জালিম লোকদের বড় বড় সহায়কদের মধ্যে গণ্য। আসলেক সে নিজেই বড় জালিম। কেননা সে এমন জিনিস আদায় করে নেয়, যা পাওয়ার অধিকারীক সে নয় এবং তা দেয় এমন লোককে, যে তা পেতে পারে না্। (১১৯ পৃ.) ইবনে হাজার আল –হায়সামীক এ কথা গুলোকে ধমক ও ভয় প্রদর্শন পর্য়ায়ে গণ্য করেছেন।] পরে বলেছেন এরূপ কর আদায় ডাকাতির মত কাজ। আদায়কারী;চোরের চাইতেও নিকৃষ্ট ও দৃষ্কৃতকারী। সে যদি লোকদের ওপর অবিচার করে ও নিত্য নতুন কর তাদের ওপর ধার্য করে তাহলে সে বড় জালিম। যে লোক ধার্যকৃত কর-এর অর্ধেক গ্রহণ করে প্রজাগণের সাথে দয়অর আচারণ করে তার অপেক্ষাও সে অধিক জুলুম কারী। আর অন্যায়ভাবে কর আদায়কারী তার লেখক, হিসাবরক্ষক এবং পুলিশ বা সৈন্যদের মধ্য থেকে যে তা গ্রহণ করে, যে তার মুরব্বীগিরি করে ও পার্শ্বের সমর্থক হয়, মূলক গুনাহে এরা সকলেই শরীক, এরা সবাই ঘুষখোর। [(আরবী********)] উপরোদ্ধৃত হাদীসসমূহের সাথে যুক্ত হচ্ছে সে সব হাদীসও যাতে মুসলমানদের কাছ থেকে (আরবী*******) অন্যায়ভাবে এক-দশমাংশ গ্রহণ পর্যায়ে উদ্ধৃত হয়েছে। যেমন সায়ীদ ইবনে যায়েদের বর্ণনা। তিনি বলেছেনঃ আমি রাসূল করীম (স) কে বলতে শুনেছিঃ হে আরব জনগণক, তোমরা মহান আল্লাহর প্রশংসা ও শোকর আদায় কর, যিনি তোমাদের (আরবী********) থেকে নিষ্কৃতি দিয়েছেন। [(আরবী********) এর ২য় খণ্ড, ৮৭ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছেঃ হাদীসটি আহমাদ,আবূ ইয়ালা ও বাজ্জার উদ্ধৃত করেছেন। তাতে একজন বর্ণনাকারীর নাম বলা হয়নি। তা ছাড়া অবশিষ্ট সকলেই সিকাহ। ] আর এক ব্যক্তি রাসূলে করীম (স) থেকে বর্ণনা করেছেনঃ (আরবী********) অতিরিক্ত করভার ধার্য হেব ইয়াহুদ খৃস্টানদের ওপর। মুসলমানদের ওপর (আরবী********) ধার্য হতে পাবে না অন্য এক সূত্রের বর্ণনার ভাষা ইসলামী সামাজের লোকদের উপরে (আরবী********) ধার্য হতে পারে না। [ হাদীসটি আহমাদ ( ৩য় খণ্ড, ৪৭৪ পৃ.) আতা ইবনুস সায়ের থেকে বকর ইবনে ওয়ায়েল গোত্রের এক ব্যক্তি থেকে-তার খালু থেকে এ সূত্র উদ্ধৃত করেছেন। বলেছেন, আমি বললামঃ হে রাসূল! আমি কি আমার লোকজনের ওপর অতিরিক্ত কর ধার্য করব? তিনি বললেনঃ অতিরিক্ত কর ধার্যকরণ…..।উক্ত আতা হরব ইবনে ইবায়দুযল্লাহ আসসাকাফী থেকে তার খালু থেকে এ সূত্রেও উদ্ধৃত হয়েছে। আর আতা হরব ইবনে হিলাল আস-সাকাফী আবূ উমাইয়্যাতা থেকে –(অনুরূপ) বনূ তগলবের এক ব্যক্তি তিনি নবী করীম(স) কে বলতে গুনেছেনঃ মুসলমানদের ওপর (আরবী********) নেই …… আবূ দাউদ তাঁর সুন্নান গ্রন্থে হরব ইবনে উবায়দুল্লাহ ইবনে উমাইর তার না মায়েরবাপ থেকে, তার বাবা থেকে যিনি রাসূল থেকে বর্ণনা করেছেন- এ সূত্রে হাদীসটি উদ্ধৃত করেছেন। দেখুনঃ (আরবী********) আবাদুল হক বলেছেনঃ এ হাদীসটি সনদ সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে। তা এমন সূত্রে আমার কাছে আসেনি যাকে দলিল বানানো যেতে পারে। ইনবুল কাতান বলেছেনঃ এ হরব সম্পর্কে ইবনে মুয়ূনকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। তিনি বলেছেনঃ প্রখ্যাত, সর্বপরিচিত। কিন্তু তাকে প্রমাণিত করার জন্যে এইটুকু কথা যথেষ্ট নয়।কত প্রখ্যাত ব্যক্তিই আছেন, যার বর্ণনা গ্রহণ করা হয় না। তবে তার নানা তার মায়ের পিতা –আদৌ পরিচিত নয়। তাহলে তার পিতা সম্পর্কে বলা যায়? আল মুসাভী লিখেছেনঃ হাদীসটি ইমাম বুখারী তাঁর তারীখুল কবীর গ্রন্থে উদ্ধৃত করেছেন। তাতে বর্ণনাকারীদের ওলট-পালট অবস্থা রয়েছে। বলেছেনঃ এর সমর্থক নেই।তিরমিযী হাদীসটি যাকাত গ্রসঙ্গে। (আরবী********) এ উদ্ধৃত করেছেন সনদ ছাড়া, আহমাদ তাঁর মুসনাদে উক্ত ব্যক্তি থেকে বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন। করেছেন। অন্যান্য সব বর্ণনাকারী সিকাহ। বিস্ময়েল কথা, আর মুসাভীক এটি (আরবী********) এ উদ্ধৃত করেছেন। (আরবী********)] এ হাদীস টি শরাহ আল-মুসাভী (আরবী********) গ্রন্থে লিখিছেনঃ (আরবী********) (শুল্ক) তো কেবল ইয়াহুদী ও খৃস্টানদের ওপর ধার্য হতে পারে তারা যখন সন্ধি সংঘটিত হওয়ার সময় সিদ্ধান্ত করবে কিংবা আমাদের দেশে ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে প্রবেশ করবে, তখন এ দশমাংশ তারা দেবে। এটা তাদের জন্যে বাধ্যতামূকলক। কিন্ত মুসলমানদের ওপর (আরবী********) ধার্য করা যাবে না–যাকাত কর ব্যতীত । মুসলমানদের কাছ থেকে কর গ্রহণ হারাম হওয়ার এটাই মূল ভিত্তি[(আরবী********)] এগুলোই সংশয়ের কারণ। এজন্যেইতারা যাকাতের পাশাপাশি কর ধার্য করা জায়েয মনে করেন না। এ পর্যায়ে আমরা বিস্তারিত ও সুস্পষ্ট আলোচনা করছি। এক্ষণে আমরা এর জবাব দেব। প্রথম সংশয়ের জবাব প্রথম সংশয়টি সম্পর্কে আমাদের বক্তব্য এই যে, পূর্বের অধ্যায়ে আমরা এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করে এ মতটি প্রত্যাখ্যান করেছি। এ জন্যে আমরা অকাট্য দলিলসমূহ পেশ করেছি। আমরা প্রমাণ করেছি ধন-মালে যাকাত ছাড়া হক প্রাপ্য আছে। এ কথাটি প্রকৃতপক্ষেই সর্বসম্মত। দ্বিতীয সংশয়ের জবাব ইসলাম ব্যক্তি মালিকানার মর্যাদা স্বীকার করেছে। তাতে তার ওপর অন্যান্য হক ধার্য হওয়া নিষিদ্ধ হয়ে যায়নি। দরিদ্র অক্ষম লোকদের হক রয়েছে মালদার লোকদের ধন-মালে তাদের ভ্রাতৃত্বের এবং দ্বীনী ও মানবিক সম্পর্কের দিক দিয়েও। তাদের যারা উপার্জনে অক্ষম বা যারা উপার্জন করে অভাব থেকে মুক্ত হয় না, যাদের কোন আয় নেই, এসব লোকের যে হক আছে, তা আমরা ইতিপূর্বে অকাট্যভাবে প্রমাণ করে এসেছি। বস্তুত ব্যক্তির ধন-মালে সমষ্টির অধিকার আছে- অবশ্য স্বীকৃতব্য।কেননা ব্যক্তি সমষ্টির সহায়তা ছাড়া তা উপার্জন করতে পারেনি। এ সমষ্টিই তার সাথে সহযোগিতা করেছে কাছে থেকে কিংবা দূরে থেকে ইচ্ছা করে কিংবা কোনরূপ ইচ্ছা ছাড়াই। ধনীর সম্পদ এমনিভাবেই পুঞ্জীভূত হয়ে উঠেছে। সমষ্টি ছাড়া ব্যক্তির জীবন ও জীবিকা কখনই পূর্ণত্ব পায়নি। সামাজিক মানুষের অবস্থাই তাই। আর মানুষ যে সামাজিক জীব, তা তো জানা কথাই। সব সমাজ বিজ্ঞানীই তা বলেছেন। এসবের উপরে পূর্বে ধন-মালে আল্লাহ্র হক স্বীকৃতব্য। তিনিই তার স্রষ্ট, দাতা-উদ্ঘাতা। তার পথ সুগমকারী। সকল ধন-মাল প্রকৃতপক্ষেই তাঁরই।মানুষ তো তার আমানতদার, তাঁর প্রতিনিধি। আর আমানতদার বা প্রতিনিধি বা দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি কখনই সে জিনিসের নিরংকুশ কর্তা হয়না, যার দায়িত্ব বা আমানত তার কাছে অর্পণ করা হয়েছে। বরং সে তো আসলে মালিকের দাবি বা নির্দেশ অনুযায়ী ব্যয় করতে বাধ্য, তার পরিমাণ কম হোক, কি বেশী। ইসলামী রাষ্ট্রেএমন অভাবগ্রস্ত লোক যদি থাকে, যাকাতও যাদের সচ্ছল করতে পারেনি; সামাজিক কল্যাণের দাবি প্রচণ্ড হয়ে দেখা দিলে অথবা সামরিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে রাষ্ট্রকে বিপদমুক্ত করার লক্ষ্যে অধিক অর্থের প্রয়োজন হলে কিংবা আল্লাহ্র দ্বীনের দাওয়াত ব্রঅপকভাবে প্রচারের জন্যে বেশি টাকার দরকার হলে, ইসরাম এ দৃঢ় ও বাধ্যতামূলক ঘোষণা দিয়েছে যে, ধনী লোকদের কাছ থেকে এতটা পরিমাণ অর্থ নিতে হবে, যা এসব কাজের জন্যে একান্তই অপরিহার্য বিবেচিত হবে। কেননা উপরিউক্তি কাজগুলো বাস্তাবায়িত করা মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধান ও দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের জন্যই একান্ত জরুরী। কিন্তু এসব কাজ সমাধা করা বিপুল অর্থ সম্পদ ছাড়া সম্ভবপর নয়। আর সে অর্থ কর ধার্য করা ছাড়া কোথাও থেকে পাওয়ার উপায় নেই। পরন্তু প্রকৃত করত্ব্য পালন যে জিনিস ছাড়া সম্ভব নয়, সে জিনিস ওয়াজিব-অবশ্য দেয় হয়ে দাঁড়ায়। তৃতীয সংশয়ের জবাব: শুল্ক কর শরীয়াতসম্মত কর নয় (****) শুল্ক বা নগর শুল্ক ইত্যাদির দোষ বর্ণনায় যে সব হাদীস উদ্ধৃত হয়েছে, তার অধিকাংশই সহীহ প্রমাণিত হয়নি। পূর্বে আমরা তা দেখেছি। যা-ও বা সহীহ প্রমাণিত হয়েছে, তা কর ধার্যকরণের প্রতিবন্ধক নয়। কেননা (***) বলতে অভিধান ও শরীয়াতের দিক দিয়ে একটা সুনির্দিষ্ট অর্থ মনে করা যায় না। ‘লিসানুল আরব’ অভিধান গ্রন্থে (****) এর পরিচিত স্বরূপ লিখিত হয়েছে: সে সব অর্থ যা জাহিলিয়াতের যুগে হাট-বাজারে পণ্য বিক্রয়কারীর কাছ থেকে গ্রহণ করা হতো। তাতেই লিখিত আছে: (***) তা যা কর আদায়কারীরা গ্রহণ করে।ইবনুল এরাবীবলেছেন: (***)হচ্ছে সে অর্থ, যা যাকাত সংগ্রহকারী কাজ সম্পন্ন করার পর গ্রহণ করে। এরপর এ হাদীসটির উল্লেখ করা হয়েছে: (***) গ্রহণকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না। তাতে এ-ও রয়েছে: (***) সে কর বা ট্যাক্স, যা ট্যাক্স আদায়কারী নিয়ে থাকে। তার মূল হল জোরপূর্বক সংগ্রহ করা। তাতে আরও বলা হয়েছে: (****) অর্থ (***) আর (***) হচ্ছে বিক্রয় মূল্য খাটো বা ক্ষতিগ্রস্ত করা (***)-এ ধরনেরই কথা। [(আরবী **********)] বায়হাকী বলেছৈন: (***) মানে ক্ষতি বা হ্রাস করা। কর্মচারী যদি যাকাত প্রাপকদের কম করে, তাহলে সে (****) নামে অভিহিত হবে। [(আরবী **********)] এই প্রেক্ষিতে যাকাত আদায়ে নিযুক্ত বেতনভুক্ত কর্মচারীকে (***) বলা চলে- যে তার কাজে জুলুম করে এবং মালদার লোকদের ওপর খুব বেশী বাড়াবাড়ি ও সীমালঙ্ঘন করে, তাদের কাছ থেকে তা নেয়, যা তার পাওনা নয় অথবা আল্লাহ্র মালে ধোঁকাবাজি করে, এমন মাল সংগ্রহ ও সঞ্চয় করে, যা তার নয় যা গরীব-মিসকীন ও পাওয়ার যোগ্য অন্যান্য লোকদের প্রাপ্য। (***)-এর ব্যাখ্যায় কোন কোন বর্ণনাকারী থেকে যা বর্ণিত হয়েছে (***) সে, যে যাকাত গ্রহণ করে বিনা অধিকারে- এ কথাও তা সমর্থন করে। [দেখুন: (আরবী **********)] যেমন আবূ দাউদ তাঁর গ্রন্থের (আরবী **********) এর একটি হাদীস উদ্ধৃত করেছে। যে সব হাদীসে যাকাতের ক্ষেত্রে সীমালঙ্ঘনকারী কর্মচারীদের সম্পর্কে কঠোর হুকমকির বাণী উচ্চারিত হয়েছে, তাও উপরিউক্ত কথার সমর্থনে স্মরণীয়। আমরা যাকাত ব্যয়ের খাত- যাকাত কর্মচারীদের পর্যায়ের আলোচনায় এ সম্পর্কে অনেক কথাই বলে এসেছি। এ কারণে হযরত সায়াদ ইবনে উবায়দা, আবূ মাসউদ, উবাদাতা, ইবনুসসামেত প্রমুখ সাহাবী (রা) নবী করীম (স) এর কাছে যাকাত আদায়ের দায়িত্বশীল কর্মচারী হওয়া থেকে অব্যাহতি প্রার্থনা করেছিলেন। কেননা এ কাজে যে সব কঠোর বাণী উচ্চারিত হয়েছে, তা তাঁরা শুনতে পেয়েছিলেন। ফলে তাদের জাহান্নামী হতে হবে, এ ভয়ে খুব বেশী ভীত হয়ে পড়েছিলেন। রাসূলে করীম (স) তাঁদের মনোবাসনা পূর্ণ করেছিলেন এবং অব্যাহতি দিয়েছিলেন। (****) শব্দের আরও একটি ব্যবহার রয়েছে, সম্ভবত তা অধিক প্রকাশমান। তার অর্থ সে সব অত্যাচারমূরক কর, যা ইসলামের অভ্যুদয় কালে সমগ্র পৃথিবীতে ব্যাপকভাবে জারী ছিল। তখন তা নিতান্ত অন্যায়ভাবে কোনরূপ অধিকার ছাড়াই নেয়া হতো এবং তা ব্যয়ও দেয়া হতো না। এ সব কর বাবদ সঞ্চিত সম্পদ জনগণের কল্যাণে আদৌ ব্যয় বা প্রয়োগ-নিয়োগও করা হতো না। ব্যয় করা হতো রাজা-বাদশাহ্, প্রশাসক ও রাজন্যবর্গের কল্যাণে, তাদের অনুসারী সমর্থকরাও তার অংশ পেত। দেশবাসীর কাছ থেকে তা তাদের দেয়ার সাধ্য ও ক্ষমতা অনুপাতে নেয়া হতো না। ইচ্ছামত বহু ধনী লোককেই তা থেকে অব্যাহতি দেয়া হতো। আর নিতান্ত শত্রুতাবশত গরীব লোকদের কাছ থেকে জোরপূর্বক আদায় করে নেয়া হতো। বহু আলিমই (****)-এর এ ব্যাখ্যাই দিয়েছেন। হানাফী মাযহাবের কিতাব (****) গ্রন্থে বলা হয়েছে: ‘কর’ আদায়কারীদের খারাপ পরিণতি যা কিছু বলা হয়েছে, তার প্রয়োগ হবে সেই লোকের ওপর, যে জুলুম করে লোকদের ধন-মাল নিয়ে নেয়। আজকের দিনের জালিমরা তাই করছে। [(আরবী **********)] ‘দুররুল মুখতার’ প্রভৃতি গ্রন্থে বলা হয়েছে। [(আরবী **********)] এ সব ধরনের ‘কর’ ‘আল-মাক্স’ নামে অভিহিত হওয়াই উত্তম। কেননা এ (***) সম্পর্কেই কঠিন আযাবের ধমক এসেছে। (***) অতিরিক্ত কর আদায়কারীদের তিরস্কার পর্যায়ে যা বলা হয়েছে, তা ঠিক সেই কর সংগ্রহকারীদের সম্পর্কে, যারা জুলুম করে নেয় বলে তাদের জন্যে আযাবের চাবুক তৈরী হয়ে আছে। কেননা তারা জনগণের ওপর এমন আর্থিক বোঝা চাপিয়ে দেয় যা বহন করার সাধ্য তাদের নেই। জালিম লোকেরা তাই করে এবং সংগৃহীত সম্পদ নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেয় এবং চেষ্টাকারী ও মজলুম জনতার নামে উড়ানো হয়। ইমাম যাহবী কবীরা গুনাহ সম্পর্কে যা বলেছেন, উপরিউক্ত কথাতার সঙ্গতিপূর্ণ। তিনি বলেছেন, অত্যাচারী কর আদায়কারী জালিমদের বড় সাহায্যকারী, বরং তারা নিজেরাই জালিম। কেননা তারা এমন সব ধন-মাল নেয়, যা নেয়ার কোন অধিকার তাদের নেই এবং তা দেয় এমন লোককে, যার তা পাওয়ার কোন অধিকার নেই। [(আরবী **********)] তবে আমাদের পূর্বোদ্ধৃত শর্তের ভিত্তিতে যে সব কর ধার্য হবে জাতীয় বাজেটের ব্যয়-প্রয়োজন পূরণ এবং উৎপাদন ও জনসেবামূলক কার্যাবলীতে দেশের অভাব মোচনের লক্ষ্যে, যা সামরিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রভৃতি ক্ষেত্রের জাতীয় কল্যাণসমূহ কাজে ব্যয় করা হবে, প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে জাতীয় অগ্রগতি সাধন, মূর্খকে জ্ঞান শিক্ষাদান, বেকারের কর্মসংস্থান, ক্ষুধার্তের ক্ষুণ্ণিবৃত্তি, ভীত-সন্ত্রস্তকে নিরাপত্তা দান, রোগীর চিকিৎসা, প্রসূতির তত্ত্বাবধানের জন্যে যেসব কর ধার্য করা হবে- ইসলামের জ্ঞানসম্পন্ন প্রত্যেক ব্যক্তিই স্বীকা করবে যে, এ কর সম্পূর্ণ জায়েয। শুধু জায়েয নয়, তাওয়াজিব- দেয়া একান্ত কর্তব্য। ইসলামী সরকারের তা ধার্য করার অধিকার আছে, তেমনি তা কল্যাণ ও প্রয়োজনানুরূপ গ্রহণ করারও অধিকার আছে। মুসলমানদের (****) মুক্তি সংক্রান্ত হাদীসের তাৎপর্য যে হাদীসটিতে (******) অর্থাৎ নানাবিধ করের বোঝা থেকে মুসলমানদের নিষ্কৃতি দানের কথা বলা হয়েছে, একে তো সে হাদীসটি সহীহ নয় এবং তাদের বক্তব্যে তা খুব স্পষ্টও নয়। তার অনেক কয়টি সহীহ অর্থ হতে পারে এবং তা অতি সহজেই গ্রহণ করা যেতে পারে কোনরূপ কৃত্রিমতা বা অবিচার ছাড়াই। আবূ উবাইদের ব্যাখ্যা কর আদায়কারী (****) সম্পর্কে আযাবের হুমকির উল্লেখসহ যে সব হাদীস উদ্ধৃত হয়েছে, সাহাবীদের কথায় তার যে সমর্থন পাওয়ার যায় তা সবই উল্লেখ করার পর ইমাম আবূ উবাইদ বলেছেন: ‘আমরা এই যে সব হাদীসের উল্লেখ করলাম, যাতে কর আদায়কারীর উল্লেখ রয়েছে, যাতে কর আদায় করাকে অপসন্দ করার কথা বলা হয়েছে ও কঠোরতা প্রকাশ করা হয়েছে আসলে এগুলোর মূল রয়েছে জাহিলিয়াতের যুগ। তখনকার আরব-অনারব রাজা-বাদশা সকলেই এ ধরনের কর আদায় করত। তাদের নিয়মছিল তারা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে তাদের ধন-মালের এক-দশমাংশ নিত, যখন তারা তাদের দেশে ব্যবসা করার জন্যে আসত। নবী করীম (স)-এর লিখিত প্রেরিত পত্রাদি থেকেও আমরা এরই প্রমাণ পাই। এ সব চিঠি তিনি বিভিন্ন এলাকা ও দেশের লোকজনের প্রতি পাঠিয়েছিলেন। তাতে তিনি লিখেছিলেন: তাদেরকে একত্রিত করা হবে না, তাদের কাছ থেকে এক-দশমাংশ নেয়া হবে না- এ থেকে আমরা জানতে পারি যে, এটা জাহিলিয়াতের জামনার রীতি ছিল। এ পর্যায়ে অবশ্য বহু সংখ্যক হাদীস উদ্ধৃত হয়েছে। পরবর্তীকালে আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর রাসূল ও ইসলামের সাহায্যে তা বাতিল করিয়ে দিয়েছেন এবং যাকাত ফরয করেছেন এক-দশমাংশের এক চতুর্থাংশ ধার্য করে। প্রতি দুইশত দিরহামে পাঁচ দিরহাম। যে লোক তাদেরকাছ থেকে এ ফরয বাবদ ধার্য অংশ নেবে, সে হাদীসে কথিত কর আদায়কারী গণ্য হবে না। কেননা সে এক-দশমাংশ নিচ্ছে না। সে যা গ্রহণ করেছে, তা এক-চতুর্থাংশ। হাদীসে এই ব্যাখ্যাই দেয়া হয়েছে এই বলে যে, মুসলমানদের ওপর (****) নেই। (***) হবে ইয়াহুদী ও খৃস্টানদের ওপর। যে হাদীস মরফু উদ্ধৃত হয়েছে, তাতেও এ কথাই বলা হয়েছে। তাতে উল্লেখ করা হয়েছে, (****) বলা হয়েছে তাকে, ‘যে লোকদের কাছ থেকেসাদকা গ্রহণ করে কোনরূপ অধিকার ছাড়াই। ইবনে উমর বর্ণিত হাদীসটির ব্যাখ্যাও তাই। তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল: আপনি কি জানেন হযরত উমর মুসলমানদের কাছ থেকে ‘এক-দশমাংশ’ গ্রহণকরী ছিলেন? বললেন: না, আমি তা জানি না। জিয়াদ ইবনে হুদাইর বর্ণিত হাদীসও অনুরূপ। তিনি বলেছেন: আমরা মুসলমান ও চুক্তিবদ্ধ লোকদের কাছ থেকে এক-দশমাংশ নিতাম না। একথা বলে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন: আমরা মুসলমানদের কাছ থেকে এক-দশমাংশের এক-চতুর্থাংশ নিতাম। আর যিম্মীদের কাছ থেকে অর্ধ-ওশর। এ প্রেক্ষিতে মুসলমানদের ওপর থেকে (***) তুলে নেয়ার অর্থ দাঁড়ায়- তাদের ওপর অবশ্য যে দেয় হিসেবে ধার্যের পরিমাণ হ্রাস করা হয়েছে সেইহার থেকে, যা জাহিলিয়াতের যুগের আরব-অনারব রাজা-বাদশাহরা আদায়করত এবং এক্ষণে তার পরিমাণ এক-দশমাংশের এক-চতুর্থাংশ ধার্য হয়েছে, ইসলাম ব্যবসাপণ্যে যাকাত হিসেবে এ পরিাণটা ধার্য করেছে। হাদীসে এ ইয়াহুদী ও খৃস্টান বলতে সেকালের বিশেষ করে যুদ্ধরত লোকদেরকেই বুঝিয়েছে। যেমন আবূ উবাইদ আবদুর রহমকান ইবনে মাকাল থেকে বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন। তিনি বলেছেন: আমি জিয়াদ ইবনে হুদাইরকে জিজ্ঞেস করলাম: আপনার এক-দশমাংশ নিতের কাদের কাছ থেকে? বললেন: আমরা মুসলমান কিংবা চুক্তিবদ্ধ লোকদের কাছ থেকে এক-দশমাংশ নিতাম না। বললাম: তাহলেকাদের কাছ থেকে নিতেন? বললেন: অমুসলিম যুদ্ধরত (জাতির যে সব লোক দারুল ইসলামে ব্যবসা করে সেই) ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে- যেমন করে তারা আমাদের কাছ থেকেনিত, যখন আমরা তাদের দেশে যেতাম। [(আরবী **********)] এটা বিজাতীয় লোকদের প্রতি গৃহীত আচরণ পর্যায়ের ব্যাপারে অর্থাৎ লোকদের সাথে সেরূপ আচরণ গ্রহণ, যেমন ভাইদের রাষ্ট্রসমূহ মুসলমানদের প্রতি আচরণ করত। এ এমন একটা মৌল নীতি, যা আজ পর্যন্ত অনুসরণ করা হচ্ছে। তবে ইয়াহুদী-খৃস্টানদের মধ্যে যারা যিম্মী হয়েছিল, তাদের কাছ থেকেও এক-দশমাংশ নেয়া হত না, যেমন নেয়া হত যুদ্ধরত জাতির লোকদের কাছ থেকে। তার এক-চতুর্থাংশও নেয়া হত না, যেমন তা নেয়া হত মুসলমানদের কাজ থেকে। তাদের কাছ থেকে নেয়া হত অর্ধ-ওশর। আবূ উবায়েদের কাছে এটা দুর্বোধ্য হয়ে পড়েছে। প্রথমত তিনি এর তাৎপর্য বুঝতে পারেন নি। পরে আমি গভীরভাবে হযরত উমর সংক্রান্ত হাদীসটি বুঝতে চেষ্টা করি। আমি দেখতে পাই, তিনিতাদের সাথে এইশর্তে একটা চুক্তি করেছিলেন। এটা মাথাপিছু জিযিয়া ও জমির খারাজ দেয়ার বাইরের ব্যাপার। এমনিভাবে হাদীসটি চলেছে।পরে বলেছেন: আমি দেখলাম, তাদের ব্যবসায়ীদের কাছ তেকে গ্রহণটাই ছিল সন্ধির মূল কথা। এক্ষণে তা তাদের ওপর মুসলমানদের প্রাপ্ত অধিকার। [(আরবী **********)] সম্ভবত এ বৃদ্ধিকরণ যা তাদের ব্যবসায়ীরা বহন করত,-এটা ছাড়া তাদের গবাদি পশু ও সঞ্চিত নগদ সম্পদ থেকে কিছু কিছুই নেয়া হত না বলেই হয়েছিল অথচ মুসলমানদের এ সম্পদেরও যাকাত দিতে হয়। [দেখুন: (আরবী **********)] তিরমিযীর ব্যাখ্যা হাদীসে (***) উল্লেখিত হয়েছে, তার আরও একটি ব্যাখ্যা রয়েছে। তা হল, এটা জিযিয়া। আবূ দাউদ কর্তৃক উদ্ধৃত কোন কোন বর্ণনায় সে কথা এসেছে এভাবে: মুসলমানদের ওপর খারাজ নেই। কেননা জিযিয়াকেও ‘মাথা পিছু খারাজ’ বলা হত তখনকার সময়ে। ইমাম তিরমিযী তাঁর ‘সুনান’ গ্রন্থে লিখেছেন: নবী করীম(স) এর কথা: ‘মুসলমানদের ওপর (***) নেই’ তার অর্থ ‘মাথা পিচু জিযিয়া’। এ ব্যাখ্যাটা মুল হাদীসেই রয়েছে। তিনি বলেছৈন: (****) কেবলমাত্র ইয়াহুদী খৃস্টানদের ওপর, মুসলমানদের ওপর (***) নেই। [(আরবী **********)] এ দলিলের ভিত্তিতে বলা হয়েছে যে, যিম্মী যদি ইসলাম কবুলকরে তাহলেতার ওপর থেকে জিযিয়া প্রত্যাহৃত হবে। আল-মুনতাভীর অভিমত ও তার পর্যালোচনা আশ্চর্যের বিষয়,আল্লামা আল-মুনাভীর তাঁর (***) গ্রন্থে হাদীসটিকে মুসলমানের কাছ থেকে ‘কর গ্রহণ হারাম হওয়ার মূলভিত্তি’ ঘোষণা করার পর লিখেছেন: সম্ভবত এ হাদীসটি হযরত উমর পাননি। তাই তিনি (***) গ্রহণ করেছেন। মুকারেজী প্রমুখ বলেছেন: হযরত উমর জানতে পারলেন যে, যে মুসলমান ব্যবসায়ীরা ভারত আগমন করে, তাদের কাছ থেকে এক-দশমাংশ নেয়া হয়। তখন তিনি বসরার শাসনকর্তা হযরত আবূ মূসা আল-আশআরীকে লিখছেন: তোমার এলাকায় যে মুসলিম ব্যবসায়ী আসে তাদের কাছ থেকে প্রতি দু’শ দিরহামে পাঁচ দিরহাম এবং চুক্তিবদ্ধ যিম্মী ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে প্রতি বিশ দিরহামে এক দিরহাম গ্রহণ কর। পরে উমর ইবনে আবদুল আজীজ তা লোকদের ওপর থেকে প্রত্যাহার করে নেন। [(আরবী **********)] এ বর্ণনা থেকে জানা গেল, তিনি জানতে পেরেছেন, হযরত উমর তাঁর একজন প্রাদেশিক গভর্ণরকে লিখেচিলেন: লোকদের ওপর থেকে (***) প্রত্যাহার করা হোক। আর অপর একজনের কাছে লিখেচিলেন, ‘সওয়ার হয়ে (****) ‘ট্যাক্স ঘরের’ দিকে যাও এবং সেটিকে ধুলিসাৎ করে দাও।’ [(আরবী **********)] সত্যি কথা এই যে, আল-মুনাভীর উপরিউক্ত বক্তব্য সম্পর্কে গভীর সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে বিন্তা-ভাবনা, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও সত্যানুসন্ধানের বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে। ক. তিনি (***) সংক্রান্ত হাদীসকে সহীহ বা হাসান বলেছেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা সহীহ নয় হাসানও নয়। তিনি নিজেই তা (****) গ্রন্থে বিশ্লেষণ করেছেন। খ. তিনি ধরে নিয়েছেন যে, তাঁর দৃষ্টিতে যে হাদীসটি সহীহ ও সপ্রমাণিত, হযরত উমর তার বিপরীত কাজ করেছেন এবং তাঁর সময়ে কোন সাহাবীই তাঁকে এ বিষয়ে অবহিত করেন নি। যদিও তখন বিপুল সংখ্যক সাহাবী বর্তমান ছিলেন এবং দ্বীনী ব্যাপারে তাঁরা খুবই সচেতন দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন ছিলেন। রাষ্ট্রীয় ব্যাপারাদির সাথেও তারা গভীর ও ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। তা ছিল বিপুল জনগণের সাথে কোনক্রমেই গোপন থাকতে পারে না। গ. হযরত উমর (রা) যা করেছেন, সাহাবিগণও যার প্রতিবাদ করেন নি- বহাল রেখেছেন, লেখক তাকে একটা অন্যায়-বরং কবীরা গুনাহ গণ্য করেছেন। কেননা তিনি (***) নিয়েছেন, যা নিলে সে লোক জান্নাতে প্রবেশ করবে না। এ কথাটি বিরোধী হয়ে পড়ে খুলাফায়ে রাশেদিনের সুন্নাতের অনুসরণ করার যে নির্দেশ আমাদেরকে দেয়া হয়েছে তার। কেননা হযরত উমর (রা) সর্বসম্মতভাবেই তাঁদেরই একজন। ঘ. তাঁর বক্তব্যের তাৎপর্য হচ্ছে, উমর ইবনে আবদুল আজীজ হযরত উমর ফারুক প্রবর্তিত একটি জুলুমের ব্যবস্থা লোকদের ওপর থেকে প্রত্যাহার করেছেন অথচ ঐতিহাসিক সত্য প্রমাণ করে যে, উমর ইবনে আবদুল আজীজ হযরত উমরের সুন্নাত পুনরুজ্জীবিত করার দায়িত্ব পালন করেছেন। এ কারণে তাঁর সংশয়ের সৃষ্টি হযেছে। উমর ইবনে আবদুল আজীজ তো বনু উমাইয়া প্রবর্তিত জুলুম ও শোষনমূলক ব্যবস্থাবলীল মূলোৎপাটন করেছেন। তারা তাঁরই বংশের লোক ছিল। কেননা তাঁর কাছে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ওদের তুলনায় অধিক প্রিয় ছিলেন। এ আলোচনা থেকে আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, উমর ইবনে আবদুল আজীজ যা উৎখাত করেছেন, তা হচ্ছে অবিচার, জুলুম, মানুষকে কষ্টদান, শরীয়াত অর্পিত দায়িত্ব ও অধিকার লঙ্ঘন এবং যে সব শর্ত ও সীমা স্বীকার করে নেয়া হতো তা রক্ষা না করা। কার কাছ থেকে কি নেয়া হবে, কি কাজে নেয়া হবে, কখন নেয়া হবে কি ভাবে নেয়া হবে- এ বিষয়ে পূর্বে কিছুই ঠিক-ঠিকানা ছিল না। ফলে জনগণ খুব খারাপভাবে কর আদায় করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে, কর আদায়কারীদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে ফরিয়াদ করে। পঞ্চম খলীফায়ে রাশেদ এগুলো শক্ত হস্তে দূর করেছিলেন। ইবনে হাজম উদ্ধৃত একটি কাহিনী- যার উল্লেখ আমরা ইতিপূর্বে একবার করেছি- উপরিউক্তি কথার সত্যতা প্রমাণ করে। জুরাইক [(****) পেশ (**) জবর- আবঊ উবাইদ (***) গ্রন্থের ১৬৬১ পৃষ্ঠায় এ পাঠই গ্রহণ করছেন। কেনা মির ও সিরিয়াবাসীরা এভাবেই বলে, তারাই এ বিষয়ে ভাল জানে। বুখারী, যাহবী প্রমুখ প্রথমে (***) লিখেছেন।] ইবনে হায়ান আদ-দেমাশকী মিসরের প্রবেশ পথে দায়িত্বশীল কর্মচারী ছিলেন। তিনি বলেন: উমর ইবনে আবদুর আজীজ আমাকে লিখেছেন: নজর দাও তোমার কাছে যে মুসলমানই যাবে, তাদের প্রকাশমান ধন-মাল যা তারা ব্যবসায়ে আনা-নেয়া করে, তার প্রতি চল্লিশ দীনারের এক দীনার গ্রহণ করবে। তার কম হলে অনুরূপ হিসেবে হার নিতে হবে। [দেখুন: (আরবী **********)] এখানে আমার মনে হচ্ছে, ‘মুসলমানদের ওপর (***) নেই’ এ হাদীসটি সনদের দিক দিয়ে একথা পম্রাণ করে না যে, মুসলমানদের কাছ থেকে সুবিচারপূর্ণকর গ্রহণও হারাম- মুসলিম রাষ্ট্রের প্রয়োজন দেখা দিলেও। তা প্রমাণের দি দিয়েও যথার্থ নয়। এবং তাৎপর্যের দিক দিয়েও তা প্রমাণ করে না। চার মাযহাবের ফিকাহ্বিদগণ সুবিচারপূর্ণ কর জায়েয মনে করেন পূর্ববর্তী আলোচনায় সব শোবাহ সন্দেহ দূর হয়ে গেছে বলে মনে করি। সুবিচারপূর্ণ কর ধার্যের বিরোধীরা এ সব শোবাহ ও সন্দেহেরই আশ্রয় নিত। এ পরিচ্ছেদে আমরা যা বিশ্লেষণ করেছি তার তাগিদ অনুযায়ী এ কথা বলা প্রয়োজন যে, ইসলামী ফিকাহ্ যাকাত ছাড়াও- যাকাতের বাইরেও কর ধার্যকরণের সাথে যথার্থভাবে পরিচিত অর্থাৎ সুবিচারমূলক কর ধার্যের বৈধতা চার অনুসৃত মাযহাবের ফিকাহি্বিদগণ স্বীকার করেছেন। অবিচারমূলক কর সম্পর্কেও তাঁরা অবহিত। সে বিষয়ে তাঁরা বিভিন্ন হুকুম-আহকাম প্রণয়ন ও সংকলন করেছেন। কিন্তু তাঁরা এটি ওটির ওপর (***) ‘কর’ নাম আরোপ করেননি। মালিকী ফিকাহ্র কেউ কেউ তার নাম দিয়েছেন (***) অথবা (***) ‘আল-খারাজ’ হানাফীদের কেউ কেউ তার নাম দিয়েছেন (****) এক বচনে (***) ব্যক্তি শাসকেরদিক থেকে যে প্রতিনিধিত্ব করে- সত্যভাবে কিংবা বাতিল ভাবে, তারই নাম হচ্ছে: (****) হাম্বলী মাযহাবের কেউ কেউ তার নাম দিয়েছেন (*****) ‘রাষ্ট্র অর্পিত দায়িত্ব’ অর্থাৎ সে সব অর্থনৈতিক দায়িত্ব, যা রাষ্ট্র বাধ্যতামূলক জনগণের ওপর কিংবা এক শ্রেণীর লোকের ওপর জারী করে দেয়। হানাফী ফিকাহ্তে হানাফী ফিকাহতে তাদের প্রাচীন ও শেষের দিকের ফিকাহ্বিদগণ এ সুবিচারমূলক কর ধার্য করা এবং তার শরীয়াতসম্মত হওয়ার কথা স্বীকার করেছেন, দেখতেই পাই। আল্লামা ইবনে আবেদীন উল্লেখ করেছেন: ‘নাওয়ায়েরব’ সত্যভিত্তিকও হয়েথাকে। যেমন, সংযুক্ত খালের ভাড়া লওয়া, মহল্লার পাহারাদারের মজুরী- মিসর দেশে তার নাম ‘আল-খফীর’, রাষ্ট্রপতিকে ‘অযায়েফ’ দেয়া, যেন সে সেনাবাহিনীকে সুসজ্জিত করতে পারে, বন্দীদের মুক্তিপণ দেয়া যদি তার প্রয়োজন দেখা দেয়, বায়তুলমালে কিছুই যদি না থাকে, তাহলে তা জনগণের কাছ থেকেই পেতে হবে। (*******) অর্থ তাদের ওপর আবর্তিত ভাবে ফরয করে দেয়া হবে। কোন কোন ‘নাওয়ায়েব’ অকারণ ও অন্যায়ভাবেও হয়ে থাকে। ইবনে আবেদীন বলেন: যেমন আমাদের একালের বিভিন্ন নামে ও খাতে কর আদায় করা। [(আরবী **********)] হানাফী কিতাব ‘আল-ফন্নিয়া’য় বলা হয়েছে: আবূ জাফর আল-বালখী বলেছেন: রাষ্ট্র জনগণের ওপর তাদের কল্যাণার্থে যা কিছু ধার্য করে [(****) শব্দটি (***) থেকে এবং তা থেকেই (****) নিষ্কৃত কর ধার্য করা।], তা দ্বীনী কর্তব্য হয়ে পড়ে এবং সত্যভিত্তিক অধিকার বলে বিবেচিত হবে- যেমন খারাজ। আমাদের মাশায়েখগণ বলেছেন: রাষ্ট্রপ্রধান জনগণের ওপর যা কিছু ধার্য করবে, তা তাদের কল্যাণের জন্য হয়েছে মনে করতে হবে। তার জবাবও অনুরূপ হওয়া বাঞ্ছনীয়। এমন কি রাস্তাঘাটে চোর-ডাকাতের আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্যে নিযুক্ত পাহারাদারদের মজুরী, রাস্তাঘাট নির্মাণ, পথসমূহের দ্বারা নির্মাণ এ কথা শুধু জানতে হবে, প্রচার করা চলবে না, ফেতনার ভয় আছে। সামষ্টিক কল্যাণের কাজ। পরে লিখেছেন: এই আলোকে বলা যায়, খাওয়ারিজমে জীহুন বারবজ নদী সংস্কারের জন্যে জনগণের কাছ থেকে যা কিছু নেয়া হয়, তা সাধারণের কল্যঅণের জন্যে অবশ্য দেয়। তা দিতে অস্বীকার করা জায়েয নয়। এটা জুলূম নয়। কিনতউ জানা যায়, এ জবাব তদানুযায়ী আমল করার উদ্দেশ্যে,রাষ্ট্র ও এ কাজে নিয়েঅজিত তার কর্মচারীদের সম্পর্কে মানুষকে মুখকে বিরত রাখার জন্যে- ব্যাপক প্রচারের জন্যে নয় যেন প্রকৃত প্রয়োজন পরিমাণের চাইতে বেশী নেবার দুঃসাহস না দেখায় অর্থাৎ উক্ত ফতোয়াটি ব্যাপকভাবে প্রচার করা এবং জনগণকে সাধারণভাবে জানানোই উদ্দেশ্য নয়। ইবনে আবেদীন তাঁর (***) টীকায় উপরিউক্ত কথা উদ্ধৃত করেছেন। পরে বলেছেন, উক্ত কথাটিকে এ শর্তের মধ্যে রাখা আবশ্যক যে, তা ধার্য করা যাবে এবং দেয়া ওয়াজিব হবে যদি বায়তুলমালে তার জন্যে প্রয়েঅজন পরিমাণ সম্পদ মওজুদ না থাকে। [(আরবী **********)] উপরে যে প্রমাণটা উদ্ধৃত হল, তা আমাদের বক্তব্যের সুস্পষ্ট প্রমাণ। উপরিউক্ত ফিকাহ্বিদগণ এইটুকু বলাই যথেষ্ট মনে করেছেন যে, রাষ্ট্র জনগণের কল্যাণে যা কিছু কর ধার্য করে তা দ্বীনী ওয়াজিব, ন্যায্য অধিকার হিসেবেই তা প্রাপ্য। এতদসত্ত্বেও তাঁরা উক্ত কথার সাথে সংশ্লিষ্ট করেছেন তাদের এ কথা: এ ব্যাপারটি বুঝতে হবে, ব্যাপক প্রচার করা যাবে না। কেননা ফেতনা ফাসাদের ভয় আছে। তার অর্থ-তাঁরা মনে করেন, উক্ত ফতোয়াটি ফিকাহ্বিদ এবং তাঁদের ছাত্রদের বিশেষ পরিমণ্ডলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। শাসক এবং তাদের সাঙ্গ-পাঙ্গ সমর্থক-সাহায্যকারীদের মধ্যেতা প্রকার করা যাবে না। কেননা তারা প্রকৃত প্রাপ্য পরিমাণের ওপর অধিক চাপিয়ে দেয়ার দুঃসাহস করতে পারে। তাতে জনগণ অর্থনৈতিক চাপে কষ্ট পাবে- কারণ বা অকারণে। অবশিষ্ট তিন মাযহাবের ফিকাহ্তে মালিকী মাযহাবের শায়খ আল-মালিক বলেছেন: মুসলিম জনগণের ওপর ‘খারাজ’ ধার্যকরণ সাধারণ জনকল্যঅণমূরক পদক্ষেপের মধ্যে গণ্য। তা জায়েয হওয়ার ব্যাপারে আমাদের কোনই সন্দেহ নেই। আমাদের এ কালে অধিক প্রয়োজন দরুন আন্দালুসীয় দেশে তা ধার্য করার কল্যাণ প্রকাশিত হয়েছে। শত্রুরা মুসলমানদের কাছথেকেতা এক্ষণে আন্দালুসিয়ায় নিঃসন্দেহে জায়েয। যে পরিমাণ প্রয়েঅজন, তার ওপর নজর রাখতে হবে, তা রাষ্ট্র প্রধানের ওপর সমর্পিত। [(আরবী **********)] পূর্বে আমরা দুজন ইমামের (আল-গাযযালী ও শাতেবীর) মত উদ্ধৃত করেছি।তাঁরা দুজনই এ খারাজ ধার্য করা জায়েয বলেছেন- যদি বায়তুলমাল শূন্য হয় এবং রাষ্ট্রপ্রধান তার প্রয়োজন মনে করে। সরকার কর্তৃক চাপানো দায়িত্ব এবং যুক্তভাবে করা জুলুম পর্যায়ে ইমাম ইবনে তাইমিয়ার কালাম একটু পরই উদ্ধৃত করা হবে। তিনি রাষ্ট্র যা গ্রহণ করে তার অনেকটা মাল দ্বারা জিহাদ হিসেবে জায়েয মনে করেছেন। তা ধনীদের ওপর দেয় কর্তব্য হবে। যেমন (***) গ্রন্থকারের উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে। [(****) কাশফুজুনুন ২-১২১৩ তে যেমন উদ্ধৃত হয়েছে। (আরবী **********)] শেষ পর্যন্ত চারটি মাযহাবের প্রত্যেকটি মাযহাবের আলিম ও সম্মানিত ইমামগণ সুবিচারপূর্ণ কর ধার্য করাকে জায়েয বলে ফতোয়া দিয়েছেন যদিও তাঁদের কেউ সরকারী কর্মচারীদের বাড়াবাড়ি করার ও জনগণের ওপর জুলুম করার ভয়ে এ ফতোয়াকে ব্যাপক প্রচার সংরক্ষিত রাখার পক্ষপাতী। অত্যাচারমূলক কর পর্যায়ের ফিকহী খুঁটিনাটি রাষ্ট্র সরকার জুলুমমূলক ও অন্যায়ভাবে যে সব কর ধার্য করে, তা ‘নাওয়ায়েব’ কিংবা সরকার চাপানো দায়িত্ব বা ‘অযায়েফ’ বলে পরিচিত। এ জুলুমমূলক কর সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে, তার বহু খুঁটিনাটিও প্রকাশিত হয়েছে। তন্মধ্য থেকে কয়েকটির উল্লেখ এখানে করা যাচ্ছে: ক. এ ধরনের কর দ্বারা দায়িত্ব গ্রহণের কাজ করা যেতে পারে যদিও তা না হক ভাবে ধার্য হয়েছে অর্থাৎ কোন লোক যদি কর বাবদ প্রাপ্ত সম্পদ দ্বারা অন্য কারোর ভরণপোষণের দায়িত্ব গ্রহণ করে, সে তা ফিরিয়ে দিতে পারে। কেননা জালিমতা তার কাছ থেকে নিয়েছে। এ অর্থে নয় যে, জালিম দায়িত্ব গ্রহণকারীর কাছ থেকে তা দাবি করে নেয়ার অধিকার রাখে- তা প্রমাণিত হচ্ছে না। [(আরবী **********)] খ. যে লোক কর- এর বোঝা বণ্টন করে দেয়ার ব্যবস্থা করবে, তাকে সেজন্যে সওয়াব দেয়া হবে, যদি মূলত তা গ্রহণ বাতিল ও জুলুম হয়, তবুও। তাঁরা বলেছেন: ফিকাহ্ ভাষায় (***) অর্থ পারস্পরিক সুবিচারমূলক আচরণ অর্থাৎ প্রত্যেক ব্যক্তির ওপর তার সাধ্য অনুপাতে আর্ধিক বোঝা চাপানো। কেননা কর পরিমাণ নির্ধারণের দায়িত্ব যদি জালিমেরহাতে ছেড়ে দেয়া হয় তাহলে অনেক সময় তাদের কেউ কেউ জনগণের ওপর তাদের সাধ্যের অধিক বোঝা চাপিয়ে দিতে পারে। তখন জুলুমের ওপর জুলুম করা হবে। এমতাবস্থায় যদি কোন ওয়াকিফহাল ব্যক্তি কর-বোঝা সুবিচারের সাথে বণ্টন করার দায়িত্ব নেয়, তাহলে জুলূমের মাত্রা কম হবে বলে আশা করা যায়। এ কারণে তাকে সওয়াব দেয়া হবে বলে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। [(আরবী **********)] গ. এসব ‘নওয়ায়েব’ ও কর আদায় ইত্যাদি যা অন্যায়ভাবে চাপানো হয়, তার প্রতিরোধ করা- কোনরূপ কৌশল বা সুপারিশ কিংবা এ ধরনের অন্য কিছুর সাহায্যে তা এড়িয়ে যাওয়া জায়েয হবে- যদি তার ভাগের করটা অবশিষ্টদের ওপর চাপানো না হয়। যদি অবশিষ্টদের তার বোঝা বহন করতে হয়, তাহলে তা এড়ানো উচিত হবে না। কেউ কেউ একটা সমস্যা হিসেবে বলেছেন, এভাবে ধার্য করা কর দেযা হলে তাতে বরং জালিমের জুলুম কাজে সাহায্য করা হবে। তাই যার পক্ষে জুলুমকে নিজের থেকে প্রতিরোধ করা সম্ভব, তা করাই তার পক্ষে মঙ্গলজনক হওয়া উচিত। অন্যরা এ সমস্যার সমাধান দিয়েছেন এই বলে যে, তাঁর নিজের থেকে এ জুলুম প্রতিরোধের ফলে সমাজের দুর্বল ও অক্ষম লোকদের ওপর নানাবিধ জুলূম নির্যাতন চালানোর আশংকা দেখাদিতে পারে, যা থেকে নিজেদের রক্ষা করার কোন কৌশল উপায় বা সুপারিশ অর্জন করা তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না। [(আরবী **********)] একথাটি খুবই যথার্থ। এ অত্যাচারমূলক কর-বোঝা বহন করার ব্যাপারে ধনী লোকদের মধ্যে সমতা ও সাম্য প্রতিষ্ঠা ওয়াজিব হওয়ার বিষয়ে ইমাম ইবনে তাইমিয়া অতীব উত্তম কালাম পেশ করেছেন। তিনি ‘সামষ্টিক ও সম্মিলিত জুলুমমূলকত কর’ –যা একটা গ্রাম বা শহরের শরীক সব মানুষের কাছ থেকেই দাবি করা হবে- সে বিষয়ে তিনি লিখেছেন: ‘যখন তাদেরসকলের কাছ থেকে কোন জিনিস দাবি করা- নিতে চাওয়া হবে, যা তাদের ধন-মাল থেকে মাথাপিছু গ্রহণ করা হবে- যেমন সরকারী আর্থিক চাপ, যা তাদের সকলের ওপর চাপানো হবে- হয় তাদের মাথা গুণতি হিসেবে অথবা তাদের যানবাহনের সংখ্যানুপাতে কিংবা তাদের গাছের সংখ্যা হিসেবে বা তাদের ধন-মালের পরিমাণ হিসেবে- যেমন তাদের অধিকাংশ থেকে শরীয়াতের ফরয যাকাত নেয়া হয়, শরীয়াতী ওয়াজিব খারাজ নেয়া হয় কিংবা শরীয়াতী জিনিসের বাইরে সরকারের চাপানো অর্থ নেয়া হয়- যেমন খাদ্য-পোশাক-যানবাহন ফল-ফাকড়া ইত্যাদি ক্রয়কারী ও বিক্রেতার ওপর ধার্য করা হয়- যদিও বলা হয়েছে যে, এটা তাদের মাল দ্বারা জিহাদ করা স্বরূপ ধার্য করা হয়েছে- জিহাদের এসব জিনিসযদি প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে- যেমন (****)-এর লেখক উল্লেখ করেছেন, তাতে যে জুলুম প্রবেশ করেছে, যার কোন যৌক্তিকতাই আলিমগণের কাছে স্বীকৃত নয় এবং যেমন সম্রাটের আগমন বা তার সন্তান হওয়া প্রভৃতি সাময়িক কাজ উপলক্ষে যা সংগ্রহ করা হয়- হয় তাদের ওপর একটা পণ্য নিক্ষেপ করা হবে তার মূল্যের চাইতেও বেশী দামে- তার নাম রাখা হয়েছে (***) এবং যেমন একটি কাফেলার লোকদের মাথা পিচু পিছু দাবি করা হবে অথবা তাদের জন্তুর সংখ্যা বা ধন-মালের পরিমাণ অনুযায়ী অথবা তাদের সকলেরই কাছ থেকে চাওয়া হবে- .... এসব নিপীড়ত লোকেরা যারা এসব খাতে মাল দিতে বাধ্য হয়, তাদের কাছ থেকে যা চাওয়া হবে তাতে সুবিচারকে অপরিহার্য করে নেয়া। এ ব্যাপারে তাদের পারস্পরিকভাবে একের অপরের ওপর জুলুম করা উচিত নয়। বরং তাদের উচিত কাছ থেকে অন্যায়ভাবে যা নেয়া হচ্ছে তাতে বাধ্যতামূলকভাবে সুবিচর প্রতিষ্ঠা করা।যেমন উচিত ন্যায়সঙ্গতভাবে যা নেয়া হচ্ছে তাতে সুবিচার প্রতিষ্ঠা করা। কেননা এই যা কিছু সরকারী অর্থনৈতিক দাবি তাদের কাছ থেকে আদায় করে নেয়া হচ্ছে তাদের লোকসংখ্যা ও তাদের ধন-মালের দরুন, তাদের তুলনায় ভিন্নতর। তার অবস্থা বিভিন্ন হয় গ্রহণের দিক দিয়ে। কখনও গ্রহণকারী ন্যায়সঙ্গতভাবে নেয় আর কখনও তা বাতিলভাবে গ্রহণ করে। কিন্তু যাদের কাছে তা দাবি করা হয়েছে, এসব সরকারের অর্পিটত দেয় তাদের কাছ থেকে গ্রহণ করা হবেচ তাদের লোকসংখ্যা ও ধন-মালের কাণে। অতএব তাদের পরস্পরের উচিত নয় পরস্পরের ওপর জুলুম করা। বরং সর্বাবস্থায় পরস্পরের ওপর সুবিচার করাই প্রত্যেকের কর্তব্য। জুলুম কোন অবস্থায়ই বিধিসম্মত হতে পারে না। অতএব উপরিউক্তি শরীক লোকদের এ অধিকার নেই যে, অন্যরা যেভাবে নিপীড়িত ও অত্রাচারিত হয়েছে, তারাও তা-ই হবে। বরং হয় সে তার অংশের দেয় দেবে- তাহলে সে সুবিচারকারী বিবেচিত হবে অথবা তার অংশের চাইতে অতিরিক্ত দেবে- তাহলে সে তার শরীক লোকদের সাহায্য করতে পারবে তাদের কাছ থেকে যা নেয়া হয়েছে, তাতে এবং সে অতীব ন্যায়কারী গণ্য হবে। তার পক্ষেসেই মালে তার জন্যে নির্দিষ্ট অংশ দিতে অস্বীকার করা ঠিক হবে না, যা অন্য সমস্ত শরীক থেকে নিয়ে নেয়া হবে। তাহলে তাদের ওপর দ্বিগুণ জুলুম করা হবে। কেননা ধার্য মাল তো নেয়া হবেই অনিবার্যভাবে। তাই কেউ যদি স্বীয় মর্যাদাবা ঘুষ বা এ ধরনের অন্য কিছুর সুযোগ তাদেয়া থেকে বিরত থাকে, তাহলে তার জন্যে নির্দিষ্ট অংশের মাল যার কাছ থেকে নেয়াহবে, সেতার ওপর জুলুমকারী হবে। তার ওপর থকে জুলুম প্রতিরোধ করার ফলে অন্য ব্যক্তির ওপর জুলুমকরা হবে অনিবার্যভাবেযদি অন্যদের ওপর জুলুম না হয়, তাহলে তা হবে তার জন্যে নির্দিষ্ট অংশ দেয়া থেকে বিরত থাকার মত। তাহলে তা তার কাছ থেকে যেমন নেয়া হবে না তেমনি নেয়া হবে না অন্যদের কাছ থেকেও। তাহলে এটা জায়েয হবে। এমতাবস্থায় সমস্ত শরীকেরই ধার্য মাল দিয়ে দেয়া ওয়াজিব হবে। প্রত্যেকেই তার সে অংশ দেবে যার সে প্রতিনিধিত্ব করে- যখন না- দেয়া অংশ শরীকদের মধ্যে ন্যয়বিচারের ভিত্তিতে বন্টন করে দেয়া হবে। আর যে লোক অনেক্যর অংশ তার পক্ষ থেকে দিয়ে দেবে কোনরূপ জোর-জবরদস্তি ছাড়াই, তা তার কাছ থেকে ফেরত নেয়া তার অধিকার আছে। তার পক্ষথেকে সে যে দিয়ে দিল, এ কারণেই সে অতব নেক আমলকারী গণ্য হবে। তখন সে যে দিয়েছে, তা তাকে ফিরিয়ে দেয়া উচিত হবে।ঠিক যেমন কর্জে হাসানা দাতা। আর যে লোক অনুপস্থিত থাকল, দিল না, ফলে উপস্থিত লোকেরাই তা দিয়ে দিল, তারা যে পরিমাণ দিয়েছে সে পরিমাণ তাদেরকে তার দেয়া কর্তব্য হবে। আর যে লোক তার পক্ষ থেকে আদায়কারীর কাছ থেকে নিয়ে নিল এবং আদায়কারীকে দিয়ে দিল, তার তা গ্রহণ করা জায়েয হবে- যার জন্যে আদায় করা বাধ্যতামূলক সে প্রথম জালিম হোক, কি অন্য কেউ। এ কারণে সে যা অন্যের পক্ষ থেকে দিয়ে দিয়েছে, তার দাবি করার তার অধিকার আছে। যেমন ঋণ ফেরত দেয়ার জন্যে নির্দেশ দেয়া হয় আর তার মালের বিকল্প গ্রহণে গ্রহণকারীর জন্যে কোন সন্দেহের কারণ নেই। অষ্টম পরিচ্ছেদ যাকাতরে পর কর ধার্যের প্রয়োজন হবে না একটি প্রশ্ন, যার জবাব চাওয়া হচ্ছে- বহু মুসলমানের চিন্তায় ঘুরপাক খাচ্ছে, তাদের কণ্ঠে উচ্চারিত হচ্ছে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এ প্রশ্নের জবাব একান্তই জরুরী হয়ে পড়েছে। সে জবাব না দিয়ে নিস্তার নেই্ প্রশ্নটি সংক্ষেপে এই যে, ধন-মালের মালিকরা সরকারী ভাণ্ডারে আপেক্ষিক ও ঊর্ধ্বমুখী উভয় প্রকারের কর এত পরিমাণের দিয়ে থাকে, যা অনেক সময় শরীয়াতের ফলয করা যাকাতের পরিমাণ অপেক্ষা অনেক গুণ বেশী হয়ে থাকে। এভাবে বিপুল ধন-মাল সরকারের ভাণ্ডারে চলে যায়, যা বাজেটে বর্ণিত খাতসমূহে ব্যয়িত হয়। আর বাজেটের কোন কোন ব্যয়খাত যাকাতেরই ব্যয় খাতরূপে গণ্য হয়েথাকে, তাতে সন্দেহ নেই। যেমন অক্ষম লোকদের সাহায্য, বেকর লোকদের কর্মসংস্থান বাস্তুহারা, বাসমান ও পড়ে পাওয়া লোকদের আশ্রয়দান ইত্যাদি সরকারী জনকল্যাণ বিভাগের কাজ বলে গণ্য হয়। দরিদ্রদের জন্যে বিনামূল্যে শিক্ষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থাও এ পর্যায়ের কাজ। মুসলমানরা এসব কাজের জন্যে সরকারকে যে কর দেয়, তার পরও কি যাকাত দেয়ার প্রয়োজন থাকে? সরকার কি দরিদ্রদের প্রয়োজন পূরণ এবং যাকাতরে খাতসমূহে সাধারণভাবে ব্যয় করার জন্যে দায়ী হবে অথবা এসব বিপুল পরিমাণের হওয়া সত্ত্বেও এবং তা দেয়ার পরও যাকাত থেকে নিষ্কৃতি নেই যাকাত তবুও দিতে হবে? মুসলমানরা যাকাতের নামে তার বিশেষ খাতে এবং বিশেষ পরিমাণেই তা আদায় করতে বাধ্য থাকবে? এ প্রশ্নের যথার্থ জবাব দেয়ার জন্যে একথা উল্লেখ করা একান্ত আবশ্যক যে, ‘যাকাত’ যাকাত হয়েছে তিনটি কারণে: ১. সে বিশেষ পরিমাণ, যা শরীয়াত নির্দিষ্ট করেছে- এক-দশমাংশ থেকে অর্ধ-ওশর ও এক-দশমাংশের এক-চতুর্থাংশ পর্যন্ত নিয়ে এসেছে। ২. বিশেষ নিয়ত- আল্লাহ্র নৈকট্য অর্জনের ইচ্ছা ও সংকল্প এবং আল্লাহ্র ফরয করা যাকাত- যে বিষয়ে তিনি তাঁর বান্দাদেরকে আদেশ দিয়েছেন, সে আদেশ পালন করা। ৩. বিশেষ ব্যয় খাত- তা আট প্রকারের, কুরআনুল করীমই তা নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। সাধারণভাবে সরকার কর্তৃক ধার্যকৃত কর দ্বারা কি এ তিনটি কারণ বাস্তাবয়িত হয়? প্রথমে পরমাণের কথাই বলা যাক। একথা প্রমাণিত যে, কর কোন শরীয়াত নির্ধারিত পরিমাণের বাধ্যবাধকতা স্বীকার করে না। অনেক সময় তা অনেক বেশী নিয়ে নেয়। কখনও আবার তার চাইতে কম। কখনও এমন পরিমাণ মাল থেকে কিছুই গ্রহণ করা হয় না, যাকাত ফরয হওয়ার শর্তসমূহ যাতে পূর্ণমাত্রায় বর্তমান। যেমনকৃষি ফসল ও ফল ফাঁকড়া। কখনও এমন পরিমাণ মাল থেকেও কর নেয়া হয়, যা যাকাত ফরয হওয়ার জন্যে শরীয়াতসম্মত ও উপযুক্ত পরিমাণ নয়। কেননা তাতে যাকাত ফরয হওয়ার শর্তাবলী পূর্ণ হয়নি। এ পর্যায়ে বলা হয়ে থাকে, বিশেষভাবে কথা হচ্ছে নগদ সম্পদ থেকে যা কিছু নেয়া হয় সে বিষয়ে। তা এক-চতুর্থাংশ ফরযেরও বেশী। বেশী হলে তো কোন ক্ষতি হওয়ার কথা নয়। আর যদি ধরে নিই তা তার চাইতে কম, তাহলে অবশিষ্ট পরিমাণ ব্যয় করা মুসলমানের কর্তব্য। আর নিয়ত কি বাস্তাবায়িত হবে শুধু এভাবে যে, করদাতা মনে করবে যে, এটা কর নয়- যাকাত? একথার ওপর প্রশ্ন তোলা হয় যে, এরূপ স্থানে ইবাদতের নিয়ত করা খালের ও একনিষ্ঠ হতে পারে না অথচ যাকাত একটা ইবাদত বিশেষ। তাই তার জন্যে খালের নিয়তের শর্ত করা হয়েছে। কুরআনে তাই বলা হয়েছে: (আরবী **********) তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে শুধু এই যে, তারা আল্লাহ্র ইবাদত করবে খালেস মনোভাব এবং অন্য সব দিক থেকে মনকে ফিরিয়ে আল্লাহ্রই জন্যে আনুগত্য সুনির্দিষ্ট করে। উপরিউক্তি প্রশ্নের জবাবে বলা হয়, নিয়তে গণনার বিষয় হচ্ছে, ফরয আদায়ের উদ্দেশ্যে মাল বের করে দিয়ে দেয়া।এখানে তা অর্জিত। প্রত্যেক ব্যক্তি তো তা-ই কপারে, যার সে নিয়ত করবে। আর ব্যয়েল খাত পর্যায়ে বক্তব্য হচ্ছে, মুসলমান তার যাকাত পাওয়ার যোগ্য আটটি খাতের যে কোন একটিতে ব্রয় করবে প্রত্যক্ষভাবে অথবা যাকাত আদায়ে নিযুক্ত কর্মচারীকে দিয়ে দেবে- এটাই ফরয। এ কর্মচারী সে, যাকে রাষ্ট্রপ্রধান যাকাত গ্রহণ ও তার জন্যে নির্দিষ্ট খাতসমূহে তা ব্যয় করার দায়িত্বে নিযুক্ত করেছে। ফলে রাষ্ট্রপ্রধান হবেন পাওয়ার যোগ্য লোকদের উকীল। সে ধনী লোকদের কাছ থেকে তা গ্রহণ করে তাদের মধ্যে বণ্টন করবে- করার ব্যবস্থা কার্যকর করবে। তার অর্থ, রাষ্ট্রপ্রধান ও তাঁর প্রতিনিধি যাকাত যথানিয়মে ও তার নামেই গ্রহণকরবে, যেন তা শরীয়াত নির্ধারিত বিশেষ খাতসমূহে ব্যয় করা যায়। তা যথানিয়মে ও তাঁর নামেই যাকাত গ্রহণের শর্ত করেছে এজন্যে যে, যাকাত হচ্ছে ইসলামের বড় বড় নিদর্শেনের মধ্যে একটি। আর নিদর্শনাদিকে অবশ্যই তার নাম-পরিচিতিসহ চালু, কার্যকর ও জীবন্ত থাকতে হবে। অন্যথায় নিদর্শন হওয়ার তাৎপর্যন্ত বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এ কারণে- পূর্বে যেমন বলেছি- মালিকী মাযহাবের ফিকাহ্বিদগণ দৃঢ় মত প্রকাশ করেছেন যে, অত্যাচারী শাসকগণ যা কিছুই গ্রহণ করে, তাতেই যাকাত আদায় হয়ে যাবে- যদি তা যাকাতের নামে গ্রহণ করা হয়। তাঁদের ছাড়া অন্যান্য ফিকাহ্বিদের কথা থেকেও তা-ই বোঝা যায়- যদিও অনেকে স্পষ্ট তা বলেন নি। এ কথার তাৎপর্য হচ্ছে, সরকারসমূহ প্রাচীন (***) অন্যায়ভাবে ধার্যকৃত কর হিসেবে যা কিছুই নেয়, আর আধুনিক সরকারসমূহ কর বা ট্যাক্স নামে যা গ্রহণ করে, তা যাকাতের স্থলাভিষিক্ত- যাকাতের বিকল্প হতে পারে না। তা যাকাতের হিসেবেও গণ্য হবে না। কেননা তা যাকাতের নামে গ্রহণ করা হয়নি, গ্রহণ করা হয় অন্য নামে, অন্যখাত হিসেবে। তা নিশ্চয়ই ইসলামেরপাঁচটি স্তম্ভের- যা আল্লাহ তা’আলা ঘোষণা করেছেন- একটি নিদর্শন হিসেবে গ্রহণ করা হচ্ছে না। আর তা ব্যয়ও করা হয় এমন সব খাতে, যার সব কয়টাই কুরআন সুন্নাহ নির্ধারিত ও শরীয়াতসম্মত ব্যয় খাত নয়। প্রথমোক্ত সওয়াবের জবাবে এ বক্তব্যই আমার। কিন্তু এ জবাবের ওপর আবার কতগুলো প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। দ্বীনদার মুসলমান এককভাবেই বহু বিচিত্র ধরনের অর্থনৈতিক দায-দায়িত্বের সম্মুখীন হয়ে থাকে। সেও সরকার নির্ধারিত কর দেয় যেমন অন্যরা তা দিয়ে থাকে। পরে আরও ধার্য হয়, তাও সে দেয়- একাই এবং তা হচ্ছে তার মালের যাকাত। এ ব্যাপারটা তার পক্ষে খুবই দুঃসহ, কঠিন ও কষ্টদায়ক সন্দেহ নেই, অথচ ইসলামী শরীয়াত গনহণের ওপর থেকে সর্বপ্রকার অসুবিধা ও কষ্টদায়ক ব্যবস্থা দূরীভূত করার জন্যে প্রবর্তিত হয়েছে। মানুষের জীবনে সহজতা বিদান ও ক্ষতি কষ্ট প্রতিরোধই তার লক্ষ্য। এই অর্থনৈতিক দায়িত্ব পালনের কষ্ট বহু মুসলমানকে বারবার এ কথা উত্থাপিত করতে বাধ্য করে যে, কর বাবদ দেয়া অর্থকেই ফরয যাকাতরে খাতে গণ্যকরা হোক।.... তা হবে না কেন? মুসলিম জীবনের বাস্তব বৈপরীত্য মুসলিম জীবনে বাস্তব বৈপরীত্য না থাকলে এরূপ কথা বলা হত না, একথা জোর করেই বলা চলে। কেননা তারা একটি জাতি হিসেবে চিরকালই ইসলামকে একটি পূর্ণাঙ্গ দ্বীন হিসেবে গ্রহণ করতে ও তা পালন করে চলতে প্রস্তুত ছিল। তারা চিরদিনই এ বিশ্বাসের ধারক ছিল যে, যাকাত ফরয এবং ইবাদত। বরং বহু মুসলিম রাষ্ট্রেরই রাষ্ট্রীয় দ্বীন ছিল এ ইসলাম। কিন্তু তা সত্ত্বেও ইসলামী বিধান সেখানে কার্যকর ও অর্থবহ নয়। সে সব অঞ্চলে ইসলামী আইন প্রণয়ন একটা অপরিচিত ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। তারা জনগণের জীবন থেকে তা আজ বহিষ্কৃত, পরিত্যক্ত, অবশ্য বর্তমান যুগের পূর্বে এরূপ বৈপরীত্য তাদের জীবনে কখনই ছিল না। যাকাত সম্পর্কে পর্যালোচনা করলেই আমরা দেখতে পাই, তা সর্বকালে প্রায়সব দেশে ও সমাজেই একটি মহান পবিত্র ও বাধ্রতামূলক ফরয হিসেবে গণ্য হয়ে এসেছে। বহু ধন-মাল থেকে সরকার-প্রশাসক তা সংগ্রহ ও আদায় করে নিয়েছে। মুসলিম জনগণ যাকাত ধার্য হতে পারে- এমন সব ধন-মাল থেকেই তা বাধ্যতামূলকভাবে ও নিয়মিত আদায় করে দিয়েছে। সেইসাথে একথাও অবশ্য সত্য যে, কোন কোন দেশ ও সমাজ এ ব্যাপারে আদর্শচ্যুত হয়েছে, তা সংগ্রহ বা ব্যয় অথবা উভয় ক্ষেত্রেই চরম দুর্নীতি ও অত্রাচারের আশ্রয় নিয়েছে। অনেক মুসলিম ব্যক্তি এমন দেখা গেছে, যাদের ধন-মালের মায়া ও প্রেম ফরয যাকাত আদায় করতে বাধা দিয়েছে। আল্লাহ্র দেয়া অনুগ্রহের প্রতি তারা কার্পণ্য করেছে। যাকাত দেয়া থেকে বিরত রয়েছে, দিতে অস্বীকার করেছে অথবা তা দিতে চরম গাফিলতি প্রদর্শন করেছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও কোন মুসলিমরাজ্য ফরয যাকাতের গোটা ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণরূপে অকেজো অচল করে রেখেছে- ইসলাম একটা মনঃপূত দ্বনি হওয়ার মর্যাদা মুসলিম জনগণেরকাছে হারিয়ে ফেলেছে এবং প্রকাশ্যভাবে যাকাত পরিহার বা অস্বীকার করেছে, এমনটা বড় একটা দেখা যায়নি। এই বৈপরীত্য সৃষ্টিতে সাম্রাজ্রবাদের প্রভাব কিন্তু আমাদের এ যুগে অবস্থার আমুল পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। বহু ইসরামী দেশেই যাকাত সরকারীভাবে প্রতিষ্ঠানের মাধ্রমে আদায় করা হচ্ছে না। এ অবস্থা ইচ্ছা করে সৃষ্টি করা হয়নি। পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্রবাদী ব্যবস্থার অধীন হয়ে পড়েছে সমগ্র মুসরিম জাহান। তারই পরিণতিতে এরূপ অবস্থা দেখা দিয়েছে। পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদের অধীনতা ও তার বস্তুবাদী প্রভাব-প্রতিপত্তি তাৎপর্যগতভাবেই ইসলাম জগতের জনজীবনকে পাশ্চাত্য নাস্তিক্যবাদী ভিত্তিতে গড়ে তুলেছে। বহু সংখ্যক মুসলমানই ইসলামী পুনর্জাগরণে ও পুনঃপ্রতিষ্ঠায় সংশয়বাদী হয়ে পড়েছে। বহু লোকের জীবনে ইসলামের আকীদা-বিশ্বাস ও ফরযসমূহ দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করেছে, পরিত্যক্ত হয়েছে। এমন কি, শেষ পর্যন্ত মুসলিম দেশ থেকে সাম্রাজ্যবাদ বিদায় নিয়ে চলে যাওয়অর পরও তার কুপ্রভাব থেকে দেশ ও দেশবাসী মুক্ত হতে পারেনি। তার কারণষ, সাম্রাজ্যবাদের শুধুদ সেনাবাহিনীই হয়ত দেশ ত্যাগ করে চলে গেছে; কিন্তু তার চিন্তা, মনস্বতাত্বিক ও বাস্তব কার্যের মধ্যে বিরোধী ভাবধারা প্রবলভাবে এখনও বিরাজ করছে। কেননা সাম্রাজ্রবাদী শক্তি রেখে গেছে গভীর ব্যাপক সাংস্কৃতিক, শিক্ষা বিষয়ক, আইনগত ও প্রশাসনিক, নৈতিক ও আচার-আচরণমূলক কুপ্রভাব- যা ইসলামের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। ইসলামের ফৌজদারী আইন সম্পূর্ণরূপে বাতিল করে রাখা হয়েছিল। ফলে লাম্পট্য, জ্বেনসা-ব্যভিচার, মদ্যপান ও সর্বপ্রকারের ফিসকে-ফুজুরী মুসলিম সমাজেই ব্যাপকভাবে প্রচলিত হয়ে পড়েছিল। ইসরামের তমদ্দুনিক আইন-বিধান সম্পূর্ণরূপে পরিত্যক্ত হয়েছিল। ফলে সুদ, ঘুষ এখনও ব্যাপকভাবে চালু হয়ে রয়েছে। ইহুদী সংশয়বাদীরা মুসলিম মানসে জাগিয়ে দিয়েছে ইসলামের প্রতি সংশয়, অবিশ্বাস। মুসলিম উম্মতের লোকেরাই আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। অনুরূপভাবে ইসলামের সামাজিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থাও সম্পূর্ণরূপে রহিত হয়ে গেছে। ফলে ইসলামের তৃতীয় স্তম্ভ যাকাত-ব্যবস্থা-অকার্যকর হয়ে পড়েছে। তাদের ওপর চেপে বসেছে বিচিত্র ধরনের তমদ্দুনিক কর ব্যবস্থা। এমন কি যাকাত আইনের খসড়া কোন কোন যুগে পার্লামেন্টে উপস্থাপিত করা হলে নামধারী মুসলমানরাই তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেছে। তারাই তার প্রতিবাদ করেছে। কেননা তাতে করে ধর্মনিরপেক্ষবাদের পরিবর্তে ধর্মের ভিত্তিতে রাষ্ট্র চালানোর প্রচেষ্টা সফল হয়ে যাবার উপক্রম হচ্ছিল। আর তা আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রকৃতির সাথে সাংঘর্ষিক হচ্ছিল্ কেননা এরা ছিল ইউরোপীয় সভ্যতার অন্ধ অনুসারী। আর তথায় বহুদিন পূর্বেই রাষ্ট্র থেকে ধর্ম বহিষ্কৃত এবং রাষ্ট্র ধর্মচ্যুত হয়ে গিয়েছে। আজ একথা সত্য যে, সাম্রাজ্যবাদী সামরিক শক্তি আরবও মুসলিম জাহান থেকে বিলুপ্ত হয়েছে, কিন্তু পশ্চাতে রেখে গেছে তাদের অসংখ্য একনিষ্ঠ শিষ্য শাগরিদ। তাদেরকে তারা নিজেদের মতই গড়ে তুলেছিল, তাদের চোখের সামনে তাদের বিশেষ ও যত্ন লালনে তাদেরকে তাদের প্রতিনিধিত্বের গুণে গুণান্বিত করে গড়েছিল। তাদের নাস্তিক্যবাদী দর্শন, সংস্কৃতি ও চিন্তা-বিশ্বাসের খাঁটি দুগ্ধ তাদের সেবন করিয়েছিল। তাদের পরিত্যক্ত আসনে তাদের বসিয়ে দিয়ে তাদের পন্থা ও পদ্ধতিতে কাজ চ ালিয়ে যাওয়ায় অভ্যস্ত করে- তারা চলে গেছে। আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষতা ইসলাম ও তার মূল্যমানকে সম্পূর্ণ অকেজো, পশ্চাদপদ ও প্রতিক্রিয়াশীল বলে গণ্য করে। পক্ষান্তরে যা কিছুই পশ্চিম দেশসমূহ থেকে আসে- সে সব দেশে ও সমাজে সম্পূর্ণ পুরাতন ও পরিত্যক্ত হওয়ার পরই আসুক না-কেন- তা-ই আধুনিকতা, অগ্রবর্তিতা, সভ্যতা ও ক্রমোন্নতি বলে বিবেচিত হয় ও সাদরে সযত্নে অক্ষরে অক্ষরে অনুসৃত হয়। ফল দাঁড়িয়েছে যে, যাকাত সম্পূর্ণরূপে পরিত্যক্ত হয়েছে। আমাদের আর্থিক ও সামষ্টিক আইন প্রণয়নে ও পরিকল্পনা রচনায় তার কোন স্থান- কোন ভূমিকাই স্বীকৃত হচ্ছে না। আর কোন কোন মুসলিম ব্যক্তির এবং কোন কোন দ্বীনী প্রতিষ্ঠানের অবিরাম চেষ্টা কার্যকর না থাকলে মুসলিম জীবন থেকে তা সম্পূর্ণরূপে যে বিলীন, নিঃশেষ ও নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত, তাতে কোনই সন্দেহ নেই। যাকাতের ব্যাপারে ইসলামী সরকারের দায়িত্ব সত্যি কথা- যাতে কোন সংশয় নেই, মতপার্থক্র নেই- হচ্ছে, যাকাত একটি ইসলামীফরয, দ্বীন-ইসলমে তার স্থান অতিশয় পবিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ। মুসলিম মানসে তার গুরুত্ব তীব্রভাবে স্বীকৃত। তাদের জীবনে ইতিহাসে তার প্রভাব অত্যন্ত ব্যাপক এবং সুদূরপ্রসারী। অন্যান্য ধার্যকৃত কর-এর পাশাপাশি যাকাতও স্থায়ী হয়ে থাকবে তার স্ব-নামে, স্ব-পরিচিতিতে, স্ব-পরিমাণ ও স্ব-ব্যয় খাতসমূহ সহকারে। তা কখনই পরিত্যক্ত হতে পারে না। সরকারের অন্যান্য সাধারণ ব্যয়ভার বহনের জন্রে যে কর ধার্য করে- ব্যাপক ও বিচিত্র ব্যয়ের বাজেট অনুযায়ী প্রয়োজন পূরণের লক্ষ্যে, তা থেকেও অব্যাহতি পাওয়া যাবে না। এ যুগের ইসলামী বিধানভিত্তিক প্রত্যেকটি সরকারকে যাকাতরে ব্যাপারে বিশেষ দায়িত্বশীল ও কর্মতৎপর হতে হবে। সর্বত্র এমন একটা প্রতিষ্ঠান, কল্যাণ ব্যবস্থা যা ফাউন্ডেশন গড়ে তোলা আবশ্যক- তার নাম যা-ই দেয়াহোক- যা আল্লাহ্র বিধান হিসেবেই যাকাত সংগ্রহ করা এবং আল্লাহ্র শরীয়াত নির্দেশিত পথে ও পন্থায় তা ব্যয় ও বন্টন করার দায়িত্ব পালনকরবে। এ বাবদ সংগৃহীত সম্পদ স্বতন্ত্র মর্যাদায় রাখতে হবে। অন্যান্য খাতের জন্যে সংগৃহীত অর্থ বা সম্পদের সাথে তা জড়িত বা মিশ্রিত হতে পারবে না। সাধারণ বাজেটে শামিলহয়ে গিয়ে তার স্বাতন্ত্র্য বিনষ্ট হতেও দেয়া যাবে না। সর্বশেষ কথা, শরীয়াতের ফিকাহ্বিদ ও অর্থনীতিবিদ, সাংগঠনিক পারদর্শিতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটা সূক্ষ্ম কার্যকর ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। এই ব্যক্তিরা বিভিন্ন ধরনের কর ও ফরয যাকাতের মধ্যে সম্পর্ক নির্ধারণ করবে। তারা উভয়ের সংমিশ্রমণ ও অরাজকতা প্রতিরোধ করবে। অবস্থা যেন এমন না হতে পারে যে, দ্বীনদার মুসলমান তো এককভাবে যাকাতের বোঝা বহন করতে বাধ্য হবে, আর দ্বীনী দায়িত্ব পালনে প্রস্তুত নয় এমন মুসলমানরা যাকাত আদায়ের বাধ্যবাধকতা থেকে অব্যাহতি পেয়ে যাবে। ইসলামের দিকে অগ্রগতি গ্রহণকারী রাষ্ট্রমাত্রের জন্যেই এটা একান্ত পালনীয় ফরয। গোটা মুসলিম জাতিরও তা-ই করতব্য- তা পালন করতে হবে তার প্রতিনিধি সভা ও সংসদের মাধ্যমে যাকাত আদায়কারী বণ্টনকারী প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে। এটা কেবল যাকাতের বেলায়ই কর্তব্য নয়। আল্লাহ তা’আলার নির্দেশ অনুযায়ী ইসলামী শরীয়াতের প্রতিটি বিধান বাস্তবায়িত করার জন্যেই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রত্যেকটি মুসলিম রাষ্ট্রেরই কর্তব্য। সরকার যাকাত না নিলে ব্যক্তির দায়িত্ব কি সরকার যদি যাকাত সংগ্রহ ও বণ্টনের দায়িত্ব পালন না করে- অন্য কথায়, সরকার যদি ইসলামী জীবন বিধান অনুসরণ করে না চলে যাকাত আদায ও বণ্টনের সুষ্ঠু ব্যবস্থা কার্যকর না করে, সরকার যদি ধর্মনিরপেক্ষবাদী ও ইসলামী শরীয়অতকে পৃষ্ঠপ্রদর্শনকারী হয়, যাকাতকে তার হিসেবের খাতা থেকে সম্পূর্ণ বর্জন ও বহিষ্কার করে দেয় এবং নিজ ইচ্ছেমত কর ধার্যকরণের ওপরই একান্তভাবে নির্ভরশীল হয়, তবে তার দ্বারাই যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করে ও রাষ্ট্রের কল্যাণমুখী কার্যাদি সম্পন্ন করে- যেমন আধুনিককালের রাষ্ট্রগুলো করছে, তা হলে এখানে এ প্রশ্নটি তীব্র হয়ে দেখা দেয় যে, মুসলিম ব্যক্তিকে যেখানে বহু প্রকারের কর দিতে হচ্ছে, তা সত্ত্বেও তাকে যাকাত দিয়ে যেতে হবে কিংবা এ সব কর দেযার মাধ্যমে যাকাত আদায় করা হয়ে যাবে ও আলাদাভাবে যাকাত দেয়ার দায়িত্ব থেকে মুক্তি পেয়ে যাবে?.... তাহলেই না মুসলিম ব্যক্তি একই মাল থেকে দুই ধরনের অধিকার দেয়ার দয়িত্ব ও ঝামেলা থেকে নিষ্কৃতি পেতে পারে। কর দিয়েই যাকাতের দায়িত্ব থেকে মুক্তির ফতোয়া এখানে একটি ফতোয়ার উল্লেখ করা যেতে পারে। কোন কোন যুগে কোন কোন ফিকাহ্বিদদের দেয়া ফতোয়ার সাথে তার মিল রয়েছে। আর তা হচ্ছে, হ্যাঁ, কর দিয়েই যাকাত দেয়ার দায়িত্ব থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে- এ পর্যায়ে উল্লেখ্য মত হচ্ছে ইমাম নববীর। তিনি লিখেছেন: শাফেয়ী ফিকাহ্বিদগণ এ বিষয়ে একমত যে, জুলূমস্বরূপ যে খারাজ গৃহীত হয়, তা ওশর-এর বিকল্প ও স্থলাভিষিক্ত হতে পারে না। শাসক যদি তা ওশর-এর বিকল্প হিসেবে গ্রহণ করে, তাহলে তাতে ফরয ওশরথেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার ব্যাপারে বিভিন্ন মত রয়েছে। সহীহ কথা হচ্ছে, তাতে ফরয খারাজ আদায়ের দায়িত্বথেকে মুক্তি হবে। কিন্তু তাতে যদি ওশর পরিমাণের কম দেয়া হয়, তাহলে অবশিষ্ট্যটা দিতে হবে।[(আরবী **********)] কথাটি বোঝা গেল এভাবে যে, ওশরী জমি থেকে- যার ওপর ওশর ফরয যাকাতরূপে ধার্য হয়েছে- যদি খারাজ নেয়া হয় ফরয ওশরের বিকল্প হিসেবে, তাহলে যে সব মালে যাকাত ফরয হয়, তা থেকে কর গ্রহণের মতই অবস্থাটা দাঁড়াবে এ হিসেবে যে, তা যাকাতের বিকল্প, যাকাত দেয়ার প্রয়োজন পূরণকারী। আর যে খারাজ বা করই সাধারণ জনকল্যাণে ব্যয়িত হবে, তা সবই সমাজ সমষ্টির জন্যে। কিন্তু এরূপ ধারণার ওপর প্রশ্ন জাগে যে, সরকার প্রজা-সাধারণের কাছ থেকে যে করাদি গ্রহণ করে, তা যাকাতের বিকল্প কিছুতেই গণ্য হতে পারে না। এজন্যেই তো তা মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সকলের কাছ থেকেই গৃহীতহয়ে থাকে এবংতা ব্যয় হয় এমন সাধারণ খাতসমূহে, যার অনেকটা যাকাতরে খাত নয় নিশ্চিতভাবেই। হাম্বলী মাযহাবের কিতাবসমূহে ইমাম আহমদ থেকে যে কথাটির উল্লেখ হয়েছে, তা প্রায় এরকমই। তা হচ্ছে, তাঁর কাছে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, যে চুক্তিবদ্ধ জমি থেকে সরকার অর্ধেক ফসল নিয়ে নেয়, তার সম্পর্কে কি হুকুম? তিনি জবাবে বলেছিলেন, ‘সরকারের এরূপ নেয়ার অধিকার নেই, এটা জুলুম।’ তাঁকে বলা হল, ‘জমির মালিকের হাতে যে ফসল অবশিস্ট থাকে, তার যাকাত সে দেবে?’ বললেন, ‘সরকার ‘যা নিচ্ছে তা-ই যাকাতরে বিকল্প গণ্য হবে অর্থাৎ মালিক যদি তার নিয়ত করে।’ [(আরবী **********)] এ পর্যায়ে ইবনে তাইমিয়ার বক্তব্য আরও সুস্পষ্ট। তিনি বলেছেন: রাষ্ট্রপ্রধান যা কর-এর নামে নিচ্ছে, তা-ই যাকাতের নিয়তে দিলে তা আদায় হয়ে যাবে। যাকাতের দায়িত্ব চলে যাবে, যদিও ঠিক যাকাত হিসেবে নেয়া হয় না। [ইমামম আহমাদ এ কথাটি মুহাম্মাদ আল মনসূর রচিত (আরবী **********) গ্রন্থের ১মখণ্ড, ১৫৪ পৃষ্ঠা থেকে উদ্ধৃত করেছেন (আরবী **********)] এ কথাটির সাথে স্মরণীয়, ইমাম তাঁর ফতোয়ায় স্পষ্ট করে লিখেছেন, তা উপরোদ্ধৃত কথার সাথে সাংঘর্ষিক। ফতোয়ায় লিখেছেন: রাষ্ট্রের শাসক-প্রশাসকরা যাকাতের নাম না নিয়ে যা কিছু নিচ্ছে, তা যাকাত হিসেবে গণ্য হবে না। [(আরবী **********)] এক্ষণে বিবেচ্য ও যাচাই করার যোগ্য- এ দুটি উদ্ধৃতির মধ্যে কোন্টি অধিক সহীহ এবং প্রমাণিত। যদি দুটিই সহীহ প্রমাণিত হয়, তাহলে প্রশ্ন কোন্টি তাঁর শেষ পর্যায়ের কথা? ব্যাপার যা-ই হোক এ একটা বিশেষ ফতোয়া। বহু ফিকাহ্বিদ নিজ নিজ সময়ে লোকদের তদানুযায়ী ফতোয়া দিতে বাধ্য হয়েছেন,- যেন মুসলমানদের কষ্ট দূর হয়ে যায়। তাদের ওপর এমন দায়িত্ব চাপানো না হয়, যা তাদের পৃষ্ঠকে ন্যুব্জ করে দেবে। আল্লাহ তো তাদের প্রতি সহজ করেই বিধান করতে চেয়েছেন, কঠোরতা ও কষ্ট আরোপ করতে চান নি। এ ফতোয়া সম্পর্কে এটা লক্ষ্যণীয় যে, তার ভিত্তি রাখা হয়েছে এমন সব কর ও (***) –এর ওপর যা শাসক জুলুম করেও না-হকভাবে নিয়েথাকে। এ কারণে ফতোয়াদাতা তা দেয়ার সময় যাকাত দিচ্ছে বলে মনে করলেযাকাত হয়ে যাবে বলে ফতোয়া দিয়েছেন। এরূপ নিয়ত করা জরুরী বলেছেন। মনেকরেছেন, এতে করে তাদের ওপর বোঝা হালকা হবে, তারা রাগ হতে পারে এবং মুসলমানদের ওপর থেকে জুলুম প্রতিরোধ করা হবে। কিন্তু আমাদের এখানকার আলোচ্য বিষয়ে ধরে নিচ্ছি, আমরা কথা বলছি সুবিচারমূলক কর সম্পর্কে, যা একালে একান্তই জরুরী হয়ে পড়েছে রাষ্ট্রীয় ব্যয়ভার বহনের জন্যে। শরীয়তে অনুসৃত মাযহাবগুলো সম্পর্কে ইতিপূর্বে আমরা যা বলেছি তা থেকে বোঝা যায় যে, সব কর, যা লোকদের ওপর চাপানো হয় ‘নাওয়ায়েব’ (***) নামে; কি খারাজ বা সরকার আরোপিত কর প্রভৃতির নামে তা বাধ্যতামূলক ব্যাপর, তা এমন একটা ঋণ যা ফেরত পাওয়ার অধিকারী- ফরয যাকাতের পাশাপাশি। অতৈএব তা যাকাতের বিকল্প নয়, তা যাকাতের বাধ্যবাধকতা বিলুপ্ত করে না, তা যাকাতের বদলে আরোপিত বলে গণ্য নয়। অধিকাংশ আলিমকর বা (***)-কে যাকাত পর্যায়ে মনে করেন না জনমহুর আলিমগণ (***)-কে কখনই এবং কোন অবস্থায়ই যাকাত পর্যায়েরজিনিস বলে মনে করেন না। মুসলমানদের মধ্য থেকে যে লোক এ (**) ধার্য করে কিংবা তা জায়েয বলে ফতোয়া দেয়, তার ওপর তাঁরা কঠোর ভাষায় আক্রমণ করেছেন। যেমন আল্লামা ইবনে হাজার আল হায়সামী শাফেয়ী কৃত (***) গ্রন্থে রয়েছে। তিনি বলেছেন: ইবনে হাজার হায়সামীর বক্তব্য ‘জেনে রাখ, কোন কোন ফাসিক ব্যবসায়ী মনে করে যে, তাদের কাছ থেকে শুল্ক ইত্যাদি কর বাবদ যা কিছু নেয়া হয়, তাতেই যাকাত আদায় হয়ে যাবে- যদি তার নিয়ত করা হয়, -এ ধারণাটা সম্পূর্ণ বাতিল। শাফেয়ী মাযহাবে এর কোন সনদ নেই। কেননা রাষ্ট্রপ্রধান শুল্ক আদায়কারীদেরকে যাদের ওপর যাকাত ফরয কেবল তাদের কাছ থেকেই যাকাত গ্রহণের কাজে নিযুক্ত করেনি। তাদেরকে নিযুক্ত করা হয়েছে (***) গ্রহেণর জন্যে, তা যে মালেরই তারা পাক-পরিমাণ কম হোক কি বেশী- তাতে যাকাত ফরয হোক, আ না-ই হোক। ধারণা করা হয়েছে যে, তাদেরকে তা গ্রহণের জন্যে নিযুক্ত করা হয়েছে মুসলমানদের কল্যাণে নিয়োজিত সেনাবাহিনীর ওপর ব্যয় করার উদ্দেশ্যে। কিন্তু আলোচ্য বিষয়ে এ ধারণা প্রয়োজ্য নয়। কেননা আমরা যদি ধরে নিই যে, তা তার শর্তের ওপর প্রতিষ্ঠিত অর্থাৎ বায়তুলমালে কিছুই থাকবে না যখন, রাষ্ট্রপ্রধান ধনীদের কাছ থেকে মাল নিতে বাধ্য হবে, এ অবস্থাও তা ফরয যাকাত প্রত্যাহকারী নয়। কেননাতা যাকাতের নামে গ্রহণ করা হয়নি। কোন কোন ব্যবসায়ী আমাকে বলেছে, কর আদায়কারীকে মাল দেয়ার সময় যদি নিয়ত করে যে, তাযাকাত বাবদ দিচ্ছে, তা হলে (***) আদায়কারীকে যাকাতরে মালিক বানিয়ে দেয়া হবে। তা সেঅন্যকে দিয়ে সেই জিনিসকেও বিনষ্ট করবে। এ কথাটিও আলোচ্য বিষয়ে কোন ফায়দা দিচ্ছে না। কেননা কর আদায়কারী এবং তাদের সাঙ্গ-পাঙ্গদের মধ্যে যাকাত পাওয়ার যোগ্য লোক পাওয়অর তো কোন প্রশ্ন উঠতে পারে না। কেননা তাদের সবাইর শিল্প কারখানা গড়া বিপুল উপার্জন করার ক্ষমতা রয়েছে। তাদের শক্তি আছে, জোর প্রয়োগ করতে পারে, তারা যদি হালাল উপার্জনে তাদের শ্রম নিয়োগ করে, তাহলে তারা এ নির্লজ্জ বীভৎস কুশ্রী কাজ তেকে বেঁচে যেতেপারে। এরূপ যাদের অবস্থা, তাদেরকে কি করে যাকাত দেয়া যেতে পারে- তারা তা নিতেই বা পারে কিভাবে? কিন্তু ব্যবসায়ীদের ধন-মালের প্রেম তাদেরকে অন্ধ বানিয়ে দিয়েছে। প্রকৃত সত্য তারা দেখতে পায় না শুনতে পায় না তারা সে সব কথা, যা তাদের দ্বীনের দিক দিয়ে তাদেরকে কল্যঅণ দিতে পারে- শয়তানের ফেরেবে পড়ে ভুলে গেছে তারা। শয়তান তাদের প্ররোচিত করেছে এই বলে যে, এই মাল তাদের কাছ থেকে জোরপূর্বক ও জুলুমমূলকভাবে নেয়া হচ্ছে। এরূপ অবস্থায় তারা যাকাত দেবে কিভাবে? আল্লাহ যে তাদের ওপর যাকাত ফরয করেছেন, তা তারা হয়ত টেরই পায়নি। তাই তারা খুব সহজ ও বৈধভাবে না দিয়ে দিলে তারা এ দায়িত্ব থেকে নিষ্কৃতি পেতে পারে না। আর তারা যে নির্যাতিত হয়েছে, সে জন্যে তাদের নামে অনেক নেকী লিখিত হওয়ার এবং তাদের মর্যাদা উচ্চ হওয়াই যথেষ্ট হবে। আলিমগণ এসব কর আদায়কারীদের চোর ডাকাত বলে- বরং তার চাইতেও খারাপভাবে অভিহিত করেছেন: কোন ডাকাত যদি তোমার মাল নেয়, আর তুমি নিয়ত করে যে, যাকাত দিলাম, তা হলে তাতে আদৌ কোন ফায়দা হবে কি? এটা যখন তোমাকে কোন ফায়দা দেবে না, কোন জিনিস তোমার বাড়িয়েও দেবে না, তখন সে বিষয়ে সাবধান হয়ে যাওয়াই ভাল। যেসব মুর্খ লোক মনে করে যে, জোরপূর্বক কর আদায়কারীদেরকে টাকা দিয়ে যাকাত দেয়ার নিয়ত করা হলে তা যাকাত বাবদই গৃহীত হবে, আলিমগণ তীব্র ভাষায় তাদের মন্দ বলেছেন। এ কথাটির প্রতিবাদে এবং তাদের নির্বুদ্ধিতা প্রমাণে তাঁরা দীর্ঘ আলোচনাও করেছেন। বাস্তবিকই উক্তরূপ মতের লোক নিশ্চয়ই মূর্খ, তাদের কথা না বলাই মঙ্গল। তার প্রতি ভ্রুক্ষেপ করার প্রয়োজন নেই। অতএব চিন্তা-বিবেচনা কর, আল্লাহ তোমাকে সমৃদ্ধ করবেন। [(আরবী **********)] ইবনে আবেদীনের বক্তব্য হানাফী ফিকাহ্বিদ ইবনে আবেদীন তাঁর (****)-এর ওপর লিখিত হাশিয়ায় ইবনে হাজারের কিছু কথা উদ্ধৃত করেছেন। তারপর তিনি বলেছেন: ‘তবে জুলুমমূলক কর গ্রহণকারী রাষ্ট্রপ্রধানের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে এমন জিনিস দিয়ে যা সে তাকেই দেয় এবং নিজের আমলনামায় জুলুমও আল্লাহ বিরোধিতা লিখিয়ে নেয়। ব্যবসায়ী তার বা অপর কোন অনুরূপ কর গ্রহণকারীর কাছে যাতায়াত করে, একই বছরের বহু কয়বার তা গ্রহণকরে, যদিও তার ওপর যাকাত ফরয হয়নি। এ থেকে এ-ও জানা গেল যে, তা হানাফীদের কাছে যাকাত বলে গণ্য হবে না। কেননা সে তো সেই দশমাংশ গ্রহণকারী নয়, যাকে রাষ্ট্র-প্রধান পথের ওপর কর্মে নিযুক্ত করেছেন যাকাত গ্রহণের উদ্দেশ্যে।.... বাজ্জাবিয়া উদ্ধৃত করছেন: (***)কে যাকাতরূপে নিয়ত করা হলে- স ত্যি কথা এই যে, তাতে যাকাত দেয়া হবে না। ইমাম সরখসীও তাই বলেছেন। ইবনে আবেদীন সহীহভাবে এ কথাটির দিকে ইশারা করেছেন যে, (***) দেয়ার সময় তা (***) আদায়কারীকে দান বলে নিয়ত করলেতা জায়েয হবে। কেননা সে তো ফকীর এজন্যে যে, তার ওপর অনেক দায়-দায়িত্ব রয়েছে।’ [(আরবী **********)] শায়খ আলী শের ফতোয়া শায়খ আলী শের মালিকী মাযহাব অনুযায়ী দেয়া ফতোয়ায় লিখিত হয়েছে যে লোক গবাদিপশুর নিসাব সংখ্যক মালিক, সে তার বিষয়ে ফতোয়া চেয়েছিলেন। প্রশাসক তার ওপর প্রতি বছর একটা নির্দিষ্ট পরিমাণে নগদ টাকা ধার্য করে দিয়েছিল। তা সে নিয়ে নিত যাকাতের নাম না করেই। এরূপ অবস্থায় কি তা যাকাত বলে নিয়ত করা শোভন ও সমচিীন হবে? এবং যাকাত আদায় হয়ে যাবে, কি যাবে না? শায়খ জবাবে বলেছেন: না, তাতে তার যাকাতের নিয়ত করার অনুমতি দেযা যেতে পারে না। আর তার নিয়ত করলেও তাতে যাকাত আদায় হয়ে যাবে না- নাচেরুল্লাকানী ও আল-হাত্তাব এরূপই ফতোয়া দিয়েছেন। [(আরবী **********)] সাইয়্যেদ রশীদ রিজার ফতোয়া তদানীন্তন ভারতীয় কোন মুসরমান ভরতে ইংরেজ শাসকরা জমিবাবদ যা আদায করে- তার ফসলের অর্ধেক বা এক-চতুর্থাংশ- তা শরীয়াত অনুযায়ী ফরযস্বরূপ দেয় বলে গণ্য করা যাবে কিনা, এ বিসয়ে মিসরীয় মনীষী সাইয়্যেদ রশীদ রিজাকে প্রশ্ন করেছিলেন। স্মরণীয় যে, শরীয়াত মত তো দেয়া হচ্ছে ওশর কিংবা অর্ধ-ওশর। সাইয়্যেদ রিজা তাঁর জবাব আল-মানার[(আরবী **********)] পত্রিকায় নিম্নোক্তভাবে প্রকাশ করেছিলেন: ‘জমির ফসলের ওশর বা অর্ধ-ওশর – যা ফরয হয়, তা যাকাত পর্যায়ের মাল। তা কুরআন ঘোষিত আটটি খাতে বা যে কয়টি পাওয়া যায়, তাতে ব্যয় করা ফলয। দারুল ইসলামে কোনসরকারী কর্মচারী তা গ্রহণকরে থাকলে তাতে জমির মালিক তা থেকে দায়িত্বমুক্ত হবে। তখন রাষ্ট্র প্রধানের বা তার কর্মচারীর দায়িত্ব হবে তা পাওয়ার যোগ্র লোকদের মধ্যে ব্যয় বা বণ্টন করা। আর সরকারী কর্মচারী যদি তা গ্রহণ না করে, তাহলে মালিকের করত্ব্য হবে আল্লাহ্র বিধান মুতাবিক তা যথাস্থানে স্থাপন করা। আর খৃস্টান শাসক বা অন্য কেউ বিজিত জমি থেকে যা নেয়, তা কররূপ গণ্যহবে, তা দিলে যাকাত আদায় হয়ে যাবে না- যাকাত দেযার দায়িত্ব পালিত হবে না। অতএব মুসলিম ব্যক্তির কর্তব্র হচ্ছে, অবশিষ্ট ফসল থেকে তার শর্তানুযায়ী যাকাত আদায় করে দেয়া। [(আরবী **********)] এ ফতোয়ার সাক্ষী হচ্ছে শায়খের কথা- যদিও তা অমুসলিম শাসকের গ্রহণের ব্যাপারে বলা হয়েছিল। কথাটি হচ্ছে খৃস্টান ও অন্যান্যরা যা নেয়, তা কররূপে গণ্য হবে, তাতে যাকাত আদায় হয়ে যাবে না। এ কথার তাৎপর্য হচ্ছে, যা কর পর্যায়ের, তা কখনই যাকাত গণ্য হবে না। শায়খ শাল্তুতের ফতোয়া প্রাক্তন শায়খুল-আজহার শায়খ শালতুতকে অন্যায়ভাবে ধার্য করা কর বাবদ দেয়া সম্পদকে যাকাত গণ্যকরা যায় কিনা, এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল। তিনি এ প্রশ্নের খুব সুন্দর জবাব দিয়েছিলেন। আল্লাত তাঁকে রহমত দান করুন- তিনি যাকাতরে নিগুঢ় সত্যতা পূর্ণাঙ্গভাবে বর্ণনা করার পর বলেছেন, যাকাত কোন প্রকার কর পর্যায়ের নয়, তা সব কিছুর পূর্বে একটা আর্থিক ইবাদত বিশেষ।তবে এটা সত্য যে, কোন কোন দিক দিয়ে তার ও কর-এর মধ্যে কতকটা সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়, কিন্তু তা অনেকগুলো দিক দিয়েই সম্পূর্ণ ভিন্ন ও স্বতন্ত্র। প্রথম আইনগত উৎসেরদিক দিয়েই তা ভিন্ন জিনিস। ফরয হওয়ার ভিত্তির দিক দিয়েও তা স্বতন্ত্র ব্যবস্থা। লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের দিক দিয়েও উভয়ের মধ্যে কোন মিল নেই। হার ও পরিমাণের ক্ষেত্রেও পূর্ণ বৈসাদৃশ্য বিদ্যমান। ব্যয়ের ক্ষেত্রেও উভয়ের আলাদা আলাদা। ... এ অধ্যায়ে প্রথম পরিচ্ছেদে যেমন আমরা বর্ণনা করেছি। পরে বলেছেন, যাকাত যখন স্বয়ং আল্লাহ প্রবর্তিত একটা ঈমানী ফরয বিশেষ, তার প্রয়োজনদেখা দিক আর না-ই দিক, তা আদায়করা ফরয। এরূপ অবস্থায় তা ফকীর মিসকীনদের জন্যে একটা স্থায়ী আয়ের উৎস সমতুল্য। কোন জাতি বা উম্মত কখনই ফকীর-মিসকীন শূন্য হয় না। পক্ষান্তরে কর হচ্ছে প্রয়োজন অনুযায়ী শাসক কর্তৃক প্রবরিত্ত। তাই একথা স্পষ্ট যে, দু’য়ের একটা অপরটার জন্যে যথেষ্ট নয়। আইনগত উৎসেরদকি দিয়েও এ দুটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ও ভিন্নতর হক। আর লক্ষ্য পরিমাণ, স্থিতিশীলতা ও স্থায়িত্বের দিক দিয়েও দুটি এক নয়। এ কারণে কর দেয়া তো বাধ্যতামূলক কর্তব্য। তা এমন একটা ঋণ পর্যায়ের যা নিয়ে ধন-মাল মশগুল হয়। যা অবশিষ্ট তা যদি যাকাতের নিসাব পরিমাণ হয় এবং তাতে যাকাতের শর্তাদি পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়- তা হচ্ছে মৌল প্রয়োজন পূরণথেকে অবসর পাওয়া এবং তার ওপর যদি একটা বৎসর অতিবাহিত হয়, তাহলে তার যাকাত দেয়া একটা দ্বীনী ফরয হয়ে দাঁড়ায়। জনগণের ওপর যে কর ধার্য হয়, তাতে মানুষ নিজেদেরকে নিষ্পেষিত ও অত্যাচারিত মনে করে। কেননা তৎলব্ধ সম্পদ ফকীর মিসকীনরা আল্লাহ্র ধার্য করা থেকে বঞ্চিত থাকার কারণ লাভ করে না। তার পথ হচ্ছে সরকারের অর্থনৈতিক দাবি, যা তার বিশেষ ব্যয়ক্ষেত্রে ব্যয়িত হবে। তার হিসেব-নিকেশ ও তার সংগ্রহ ও ব্যয়ের পথে চলবে। আর সরকার কর্তৃক তার সাধারণ কার্যক্রমের হিসেব গ্রহণের ব্যাপরটি সম্পর্কে ইসলামের মৌল নীতিসমূহ সাক্ষ্য দেয়। তাতে সাধারণ সামষ্টিক কল্যাণ সাধিত হয়। দ্বীন-ইসলাম তাকে প্রথম স্থানে বসিয়েছে। [(আরবী **********)] শায়খ আবূ জুহ্রার অভিমত শায়খ আবূ জুহরা তাঁর (আরবী **********) গ্রন্থে আলোচ্য বিষয়টি- যাকাতের সাথে কর-এর সম্পর্ক-শামিল করেছেন। তিনি লিখেছেন: কোন কোন আলোচনাকারী এ চিন্তাটি তুলে ধরেছেন: যাকাত কি ওসর কর-এর সাথে চিরকালই ফরয হয়ে থাকবে? তার জবাবে তিনি বলেছেন: আমরা বলব, এ সব কর এখানকার সময় পর্যন্ত সামষ্টিক দায়িত্ব গ্রহণের জন্যে কোন মূল্যবান পরিমাণ আলাদা করে বিশেষভাবে নির্দিষ্ট করে দেয়নি অথচ যাকাতের আসল লক্ষ্য হচ্ছে সামষ্টিক অভাব মেটানো। তা সব কিছুর পূর্বেই কাম্য। কোন কোন কর অবশ্র অপ্রয়োজনীয় হয়ে দেখা দেয়; কিন্তু কর যে স্থায়ীভাবেই থাবে, তা থেকে নিষ্কৃতি নেই। এ –ও সন্দেহাতীত কথা। কেননা আজ পর্যন্ত তা ফকীর মিসকীনের প্রয়োজন পূরণ করতে পারেনি অথচ তা পূরণ হওয়া আবশ্যক। [(আরবী **********)] শায়খ আবূ জুহরা এ জবাবে কিছুটা বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। কেননা তাঁর কথা থেকে বোঝা যাচ্ছে, তিনি হয়ত মনে করেন, কর যদি তার একটা বিশেষ মূল্যবান অংশ সামষ্টিক দায়িত্ব গ্রহণের জন্যে নির্দিষ্ট করে দেয় এবং ফকীর-মিসকীনের প্রয়োজন মিটে যায়, তা হলে আর যাকাত দেয়া প্রয়োজন অবশিষ্ট থাকবে না। অথচ প্রকৃত কথা হচ্ছে, যাকাতকে কোন কিচুই প্রত্যাহার করাতে পারে না। কোন জিনিসই তার বিকল্প হতে- তার প্রয়োজন খতম করতে পারে না। তা মহান আল্লাহ্র ধার্য করা বিশেষ ফরয। বান্দারা তা বাতিলও করতে পারে না, তাকে অচলকরেও রাখতে পারে না। যাকাত তার নামে তার নিয়ম-কানুন সহকারে, তার পরিমাণ ও শর্ত অনুযায়ী আদায় হতে হবে এবং আল্লাহ্র নির্দিষ্ট করা খাতসমূহেরই তা ব্যয় হতে হবে, যা তাঁর কিতাবে স্পষ্ট ভাষায় বলে দেযা হয়েছে। আমরা যদি এমন একটা দেশ বা স্থানের কথা মনে করি যার ধন- ঐশ্বর্যের বিপুলতা ও উৎপাদনের আধিক্যের কারণে গরীব জনগণও সচ্ছল হয়ে গেছে- অন্যান্য কারণেও তা হতে পারে- তাহলেও সেখানে ধনী মুসলমানদের কাছ থেকে ‘আল্লাহ্র পথে, আল্লাহ্র বাণী প্রচার এবং তাঁর দ্বীনের প্রতি লোকদের মন আকৃষ্ট করার কাজে ব্যয় করার লক্ষ্যে অবশ্যই যাকাত আদায় করতে হবে। কোন অবস্থায়ই তা প্রত্যাহৃত হবে না। তার একটা পূর্ণাঙ্গ দৃষ্টান্ত হচ্ছে, কোন সরকার যদি করলব্ধ সম্পদ থেকে একটা বিরাট পরিমাণ সামষ্টিক দায়িত্ব পালনের উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট করে দেয়, তাহলেও সেখানে যাকাত কিছুমাত্র অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়বে না। কেননা তা একটা ইবাদত সুনির্দিষ্ট নিদর্শন বিশেষ। অতএব যাকাত চিরকালই কার্যকর থাকবে, থাকবে যদ্দিন ও পৃথিবীতে কুরআন মজীদ থাকবে- কুরআন মুসলমান মাত্রকেই সম্বোধন করে বলতে থাকবে: (আরবী **********) তোমরা নামায কায়েম কর, যাকাত দাও। সম্ভবত শায়খ আবূ জুহ্রা খুব তাড়াহুড়া করে প্রশ্নের জবাব লিখেছেন। তিনি তাঁর উক্ত কথার গভীর তত্ত্ব ও তাৎপর্যের দিকে লক্ষ্য দিতে পারেন নি। সার কথা শায়খ শালতুত এবং তাঁর পূর্ববর্তী আলিমগণের ফতোয়া: ‘কর যাকাতের বিকল্প হতে পারে না’ –ফতোয়াদাতা ও ফতোয়াপ্রার্থী সকলেরই জন্যেই সান্ত্বনাদায়ক। কেননা তাতে সহীহ শরীয়াতের দৃষ্টিভঙ্গী পুরোপুরি বাস্তবায়িত। তা সর্বাবস্থায়ই মুসলিম ব্যক্তির দ্বীনদারীর পক্ষে সর্বাধিক নিরাপদ মত। সেই সাথে এই ফরযটি স্থায়িত্বেরও নিয়ামক। মুসলমানদের পারস্পরিক মধুর সম্পর্ক রক্ষার জন্যে তা অধিক কার্যকর। কর-এর নামে এ ফরযের কথা কখনই ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়। হাওয়া তা উড়িয়ে নিতে পারে না। অবশ্য একথা সত্য যে, মুসলমানদের এতে খুব বেশী কষ্ট এবং অসুবিধা ভোগ করতে হয়। অন্যরা যে অর্থনৈতিক বোঝা বহন করে না, মুসলমানকে তা বহন করতে হয়। কিন্তু সেটা তো ঈমানের দাবি। ইসলাম অর্পিত দায়িত্ব। বিশেষ করে ফেতনা-ফাসাদের দিকগুলোতে, যখন অত্যন্ত ধৈর্যশীল ব্যক্তিও দিশা হারিয়ে ফেলে। এ সময় দ্বীনী ব্যবস্থা ধারণকারী ব্যক্তির অবস্থা হয়- সে যেন জ্বলন্ত অঙ্গার মুঠোর মধ্যে চেপে ধরেছে। সর্বাবস্থায় মুসলিম ব্যক্তির অবস্থা হয়- সে যেন জ্বলন্ত অঙ্গার মুঠোর মধ্যে চেপে ধরেছে। সর্বাবস্থায় মুসলিম ব্যক্তির কর্তব্য হচ্ছে বিপর্যস্ত অবস্থাকে সুস্থ ও সঠিক করার জন্যে অবিশ্রান্ত কাজ করতে থাকা, জিহাদ করতে থাকা। বেঁকে যাওয়া সমাজ ব্যবস্থাকে সঠিক করে গড়ে তোলা- ইসলামী কর্মপন্থার দিকে সবকিছুকে ফিরিয়ে নিয়ে আসা, ইসলামী ব্যবস্থা- ইসলামী বিধান প্রতিষ্ঠিত করা। তা করা সম্ভব না হলে মুসলিম ব্যক্তি সব সময়ই অর্থনৈতিক মনস্তাত্বিক ও সামষ্টিক নির্যাতনে নিষ্পেষিত হতে থাকবে। কেননা এখন সে এমন একটা সামাজিক পরিবেশে বসবাস করছে, যেখানে সে সহযোগিতার পরিবর্তে প্রতিবাদে বিরোধিতার ও আঘাতের সম্মুখীন হচ্ছে। তার হাত ধরে এগিয়ে নেয়ার পরিবর্তে তার পথ রোধ করে দাঁড়াচ্ছে। এটা একটা সাধারণ ও ব্যাপক মুসিবত- জীবনের সর্বক্ষেত্রে। অথচ ইসলামের দাবি হচ্ছে তার বিশ্বাসীরা সর্বাবস্থায় শরীয়াত পালন করে চলবে, কেবল যাকাতের ব্যাপারেই নয়, সকল ক্ষেত্রে। মুসলমান যখন দেখবে যে, রাষ্ট্র গরীব-মিসকীনের জীবন-জীবিকার নিরাপত্তার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে এবং তার চারপাশে যাকাত পাওয়ার যোগ্য কোন অভাবগ্রস্ত মুসলমান বর্তমান নেই, -আমেরিকার মুসলমানদের এ পর্যায়ে গণ্য করা যায়- তবুও সে যেন মনে না করে যে, যাকাত তার প্রয়োজন ও গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছে। কেননা যাকাতের আরও তো বহু কয়টি ব্যয়খাত রয়েছে- ই এরপূর্বে বিশ্লেষিত হয়েছে- যেমন ইসলামের দাওয়াত প্রচার ইসলামের দিকে- ইসলাম গ্রহণ করার জন্যে দাওয়াত দেয়া, লোকদের মন ইসলামের দিকে আাকৃষ্ট করা ও রাখা, ইসলামী দাওয়াত প্রচারক সংগঠন এবং ইসলামী কেন্দ্র কায়েম ও পরিচালনা করা। আল্লাহ্র কালেমা সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে বাস্তব ও সুসংগঠিত জিহাদের সূচনা করা। এগুলো কুর্বান ঘোষিত ‘আল-মুয়াল্লাফাতু কুলুবুহুম’ পর্যায়ের ফী সাবিলিল্লাহ পর্যায়ের কাজ। এসব কাজও যদি কোন দেশে করা সম্ভবপর না হয়, তাহলেযাকাত নিকটবর্তী কোন দেশে- যেখানে তার নির্দিষ্ট ক্ষেত্রসমূহে ব্যয় করা সম্ভব- পাঠিয়ে দিতে হবে। ইবনে তাইমিয়া তাঁর পূর্বে নব্বী এবং এ দু’জনের পূর্বে ইমাম আহমদ থেকে বর্ণিত যে সব কথা ইতিপূর্বে উদ্ধৃত হয়েছে, তার সাথে আমাদের বাস্তবতার কোন সম্পর্ক নেই, তা আমাদের কালের ব্যাপারেও নয়। তা এমন সময়ের কথা, যখন ফরয যাকাত পূর্ণ মর্যাদা সহকারে কার্যকর ছিল। যখন দারুল ইসলামে রাষ্ট্রই যাকাত সংগ্রহ করার দায়িত্ব পালন করত এবং জাতির জনগণ সাধারণভাবেই তাদিয়ে দিত। তারা যদি আমাদরে একালে হতেন, তাহলেতাঁরা অন্য রকম ফতোয়া দিতেন। কেননা এমন অবস্থা ও কালের আমূল পরিবর্তন হয়ে গেছে। তখন তাঁরা জমতহুর ফিকাহ্বিদদের সাথেই একাত্মতা প্রকাশ করতেন। আমাদের ব্যক্তিগণের কাছ থেকে নানা নামে যা কিছু নেয়া হয়, তাকে যদি আমরা যাকাত গণ্য করে অনুমতি দিই তাহলে তো এ দ্বীনী ফরযটির চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার পক্ষে মত দেয়া হবে। আর তাহলে ব্যক্তি জীবনে যাও বা ইসলামের নামচিহ্ন আছে, তাও নিঃশেষ হয়ে যাবে- সরকারী পর্যায়ে ইসলামী জীবন যেমন করে বিলীন হয়ে গেছে। কিন্তু মুসলিম জাহানের কোন কালের কোন স্থানের কোন আলিমই তার সাথে ইকমত হতে পারে না। (আরবী **********) উপসংহার ইসলামের যাকাত এক অভিনব অনন্য ব্যবস্থা যকাতা সংক্রন্ত এ বিশাল বিস্তারিত আলোচনা থেকে এর বিভিন্ন অধ্যায় ও পরিচ্ছেদে লেখা কথাগুলো থেকে আমাদের সম্মুখে একথা স্পষ্ট হয়ে গেছে বলে মনে করি যে, ইসলাম মদীনা শরীফ পর্যায়ে যে যাকাত ফরয করেছে এবং তার সীমা, পরিমাণ ও বিধি-বিধান বর্ণনা করেছে, তা বিশ্বমানবতার ইতিহাস এক অভিনব ও অনন্য ব্যবস্থা। কোন আসমানী বিধানেই ইহিপূর্বে অনুরূপ কোন ব্যবস্থা গৃহীত হয়নি, কোন মানব রচিত মতবাদ বা জীবন বিধানেও তার কোন দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যাবে না। যাকাত একটা অর্থনৈতিক বিধান যেমন, তেমনি সামজিক, সামষ্টিক, রাজনৈতিক, নৈতিক ও দ্বীনী ব্যবস্থা- এক সাথে এ সবই। যাকাত একটা আর্থিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কেননা তা একটা সুনির্দিষ্ট আর্থিক কর বিশেষ। কখনও তা মাথাপিছু ধর্য হয়-যেমন ফিতরার যাকাত, কখনও ধন-মালের ওপর আরোপিত হয়, মওজুদ মাল ও আমদানীও ওপর। সাধারণ যাকাত ব্যবস্থার এটা নিয়ম। ইসলামে বায়তুলমালের আয়ের উৎস হিসেবে তা একটা চিরন্তন অর্থনৈতিক উৎস। ব্যক্তিদেরকে অভাব-দারিদ্র্য থেকে মক্তকরণ এবঙ তাদের অর্থনৈতিক প্রয়োজন পরিপূরণের জণ্রে ব্যয়িত হয়। উপরন্তু তা পুজিকরণ এবং ধন-মালের স্বাভাবিক আবর্তন ও উৎপাদনে বিনিয়োগ বন্ধকরণের বিরুদ্ধে এক কার্যকর আঘাত বিশেষ। তা একটা সামাজিক ব্যবস্থাও। কেননা তা সমাজের লোকদেরকে তাদের প্রকৃত ও সম্ভাব্য অক্ষমতার বিরুদ্ধে নিরাপওা দানের কাজ করে। আকস্মিক বিপদ ও দুর্দশার ক্ষেত্রেও তার ভূমিকা খুবিই কার্যকর। তা লোকদের মধ্যে একটা মানবিক নিরাপওা গড়ে তোলে, যেখানে ‘আছে’র দলের লোকেরা ‘নেই’ দলের লোকদেরকে সাহায্য করে। শক্তিশালী দর্বলের হাত ধরে ওপরে তোলে। মিসকীন, নিঃস্ব পথিক নিরাপওা লাভ করে। ধনী ও গরীবের মধ্রকার পার্থক্য-দূরত্ব হ্রাস করে। সক্ষম ও অক্ষমদের মধ্যকার পারস্পরিক হিংসা ও বিদ্বেষ এবং পরশ্রীকাতরতার অগ্নি নির্বাপিত করে। লোকদের মধ্যে যারা পারস্পরিক বিবাদ মীমাংসার কাজ করে এবং তা করতে গিয়ে অনেক আর্থিক ঝুঁকিতে পড়ে যায়, যাকাত ব্যবস্থা তাদের সাহায্য করে এবং তারা সাধারণ কল্যাণের পথে যে ঋণ মাথায় চাপিয়ে নেয়, তা শোধ করে দেয়ার ব্যবস্থা করে। অনুরূপভাবে বহু প্রকারের সামাজিক সমস্যার সমাধান করে দেয়, তার অতি উচ্চ কল্যাণকর লক্ষ্য বাস্তবায়নে, তার সম্মুখবর্তী পবিত্র উদ্দেশ্যাবলী পরিপূর্ণ কার্যকরভাবে অংশ গ্রহণ করে। তা একটা রাজনৈতিক ব্যবস্থা কেননা যাকাতের ব্যাপারে মূল কথা হচ্ছে, রাষ্ট্রই তা সংগ্রহ ও তার খাতসমূহে বণ্টনের জন্যে দায়িত্বশীল। তাতে তাকে সুবিচার ও ন্যায়পরতার নীতি কড়াকড়িভাবে অনুসরণ করতে হয়। প্রয়োজনসমূহের পরিমাণ নির্ধারণ ও বেশী গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারকে অগ্রাধিকার দান তার দায়িত্বের অনর্ভুক্ত। আর তা করতে হবে এটা নির্ভরযোগ্য বিশ্বস্ত ও শক্তিশালী ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে, যা হবে-কুরআনের ভাষায় সংরক্ষক, অভিজ্ঞ, অবহিত। এ ধরনের কর্মচারীও তাতে নিযুক্ত করে নিতে হবে। সরকারের নিজস্ব দায়িত্বে কয়েকটি ক্ষেত্রে যাকাত ব্যয়ের ব্যবস্থা করতে হবে, যেমন ‘মুয়াল্লাফাতু কুলুবুহুম’ এবং ‘ফী সাবীলিল্লাহ’। তা একটা নৈতিক ব্যবস্থাও কেননা তার লক্ষ্য হচ্ছে ধনী লোকদের মন-মানসকে ধ্বংসকারী লোভ-কার্পণ্য এবং কলূষিত আত্মম্ভবরিতার ময়লা ও আবর্জনা থেকে পবিত্র করা এবং বদান্যতা-দানশীলতা ও কল্যাণ-প্রেমে তাদের হৃদলকে পরিশুদ্ধতায় ভরপুর করে দেয়া। অন্য লোকদের দুঃখ-দুর্দশায় সাহানুভূতি ও দয়ামায়া সহাকরে তাদে সাথে একত্ম করে তোলা। বঞ্চিতদের অন্তরে যে হিংসার আগুন জ্বলে ওঠে তা নির্বাপনে বিরাট কাজ করে এবং অন্য লোকদেরকে আল্লাহ তা‘আলা যে জীবনের মহামূল্য সামগ্রী ও সুখ সম্পদ ভরে দিয়েছেন, তা দেখে তাদের চোখ টাটায়-যাকাত তা শীতল করে দেয়। লোকদের পরস্পরের মধ্যে ভালবাসা ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সুদৃঢ় করে। সর্বোপরি তা একটা দ্বীনী ব্যবস্থা কেননা যাকাত প্রদান করা ঈমানের দিক দিয়ে সাহায্যকারী কর্মসমূহের অন্যতম। ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রুকন। অতীব কার্যকর একটি ইবাদত, যা আল্লাহ্র নৈকট্য লাভের জন্যে খুবই শাণিত। কেননা অভাবগ্রস্ত লোককে তা দেয়ার প্রথম লক্ষ্য হচ্ছে দ্বীনের প্রতি তার ঈমানকে সুদৃঢ় ও স্থায়ী করা, আল্লাহ্র আনুগত্য ও ইবাদতকরণে, তাঁর নির্দেশাবলী কার্যকরেকরণে তার সাহায্য ও সহযোগিতা করা। কেননা যে দ্বীন এ মহান ব্যবস্থা উপস্থাপিত করেছে, সে দ্বীনই তৎসংক্রান্ত যাবতীয় আইন-বিধান, পরিমাণ ও তার ব্যয়ের ক্ষেত্রসমূহ সুস্পষ্টভাবে নির্দিষ্ট ও প্রতিভাত করে দিয়েছে। তার একটা অংশ অভাবগ্রস্ত লোকদের অভাব-দারিদ্র্য মোচনে ব্যবস্থার করার জন্যে নির্দিষ্ট করেছে। করার কাজে ব্যয় করার জন্যে। তার দ্বীনের কালেমা সর্বত্র প্রচার করা এবং পৃথিবীর বুকে দ্বীনের দাওয়াত ও বিধানকে প্রতিষ্ঠিত করার কাজে নিয়োগ করার জন্যে-যেন কোথাও আল্লাহহীন ব্যবস্থা ও আল্লাহ্র শক্তির আনুগত্য ও অধীনতা অবশিষ্ট না থাকে এবং সমগ্র পৃথিবীর বুকে একমাত্র আল্লাহ্র দ্বীন পুরামাত্রায় কার্যকর ও প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। বস্তুত এ-ই হচ্ছে যাকাত। ইসলামও এ যাকাতকেই জারী ও কার্যকর করেছে শরীয়াতসম্মতভাবে-যদিও আজকের এ শেষ যুগের মুসলমানরা তার এ নিগূঢ় তও্ব ও তাৎপর্যের কথা বেমালুম ভুলে গেছে। তা রীতিমত আদায় করা ছেড়ে দিয়েছে, বহুলোক অবশ্য এ পর্যায়ে এখনও গণ্য নয়; কিন্তু তুলনামূলকভাবে তাদের সংখ্যা বেশী নয়। এ যাকাতই এককভাবে প্রমাণ করেছে যে, এ দ্বীণ ও এ শরীয়াত বিশ্বস্রষ্টা মহান আল্লাহ্র কাছ থেকেই অবতীর্ণ। উম্মী মুহাম্মাদ (স)-এর কোন সাধ্যই ছিল না নিজস্বভাবে এ একক-অনন্য সুবিচারমূলক জীবন বিধান দুনিয়ায় পেশ করা ও বিশ্বমানবকে তা গ্রহণের জন্যে পথ দেখানো। এ দ্বীন তাঁর ব্যক্তিগত চিন্তার ফসল নয়, তাঁর জ্ঞন-তথ্য সমৃদ্ধ বা নিঃসৃত নয়-যদি না আল্লাহ তাঁকে বিশেষভাবে অহীযোগে এ ক্ষতমা ও সুযোগ দিতেন, তাহলে এটা সম্পূর্ণ অসম্ভব ছিল তাঁর পক্ষে। আল্লাহই তাঁর প্রতি আয়াত নাযিল করেছেন, লোকদের জন্যে হোদায়েতের বিধান দিয়েছেন, হেদায়েত ও সত্য-মিথ্যা পার্থক্যকারী অকাট্য নিদর্শনাদিও দিয়েছে। তিনি যা জানতেন না, আল্লাহ্ই তাঁকে জানিয়ে দিয়েছেন। তাঁর প্রতি ছিল আল্লাহ্র অফুরন্ত রহমত ও অতুলনীয় অনুগ্রহ। যাকাতের পক্ষে ভিন্নমতের লোকদের সাক্ষ্য যাকাতের এ তুলনাহীন ব্যবস্থার মাহাত্ম্য এবং মহও্ব বহু মুসলমানই হয়ত বুঝে উঠতে পারছে না। বরং যাকতকে বিকৃত করেছে এবং ইসলামে বিশ্বাসী বলে দাবি করা সও্বেও যাকাতকে তারা নানাভাবে গালমন্দ করেছে। তারা কিন্তু মুসলমানী নাম যথারীতি বহন করে চলেছে অথচ পাশ্চাত্য লেখকদের মধ্যেও এমন লোক প্রচুর রয়েছে যারা যাকাত ব্যবস্থার উচ্চ প্রশংসা করেছেন। শুধু তা-ই নয়, মানুষের কল্যাণের জন্যে এরূপ একটা মহান ব্যবস্থা কার্যকরকরণে সারা দুনিয়ার আধুনিক জীবন ব্যবস্থার সর্বাগ্রে ইসলামই যে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে, সে কথাও তাঁরা অকপটে স্বীকার করেছেন। অরনোল্ড তাঁর ‘ইসলামী দাওয়াত’ নামের গ্রন্থে ইসলামের প্রধান নিদর্শনাদি সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে ইসলামী হজ্জ এবং তার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে, তার মহান লক্ষ্য সম্পন্ন ব্যবস্থা হওয়া সম্পর্কে বলিষ্ঠ কণ্ঠে উল্লেখ করেছেন। পরে যাকাত সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে বলেছেনঃ হজ্জ ব্যবস্থা পাশাপাশি আমরা আর একটা ফরয কাজ হিসেবে পাচ্ছি যাকাত প্রদান ব্যবস্থা। মুসলমানরা আল্লাহ্র এ কথাটি স্মরণ করেঃ ‘মুমিনরা সব ভাই ভাই? এটি একটা দ্বীনী দৃষ্টিভঙ্গী, অতি ইজ্জ্বলরূপে তা বাস্তবায়িত হয় উক্ত ব্যবস্থার মাধ্যমে। তা খুব বিস্মিয়করভাবে হালকা বৃষ্টিবর্ষণ করে ইসলামী সমাজের মধ্যে। সমাজে সাদরে গৃহীত হয় এবং অন্যান্য মুসলিমদের সাথে সমান মর্যাদায় সে উপযুক্ত স্থান লাভ করে। [আরবী**********] লিউড্রোশ বলেনঃ যে দুটো কঠিন সামাজিক সমস্যা গোটা বিশ্বকে জর্জরিত করে তুলেছে, তার সমাধান আমি ইসলামে পেয়েছি। প্রথম-আল্লাহ্র ঘোষণা ‘সব মুমিন ভাই ভাই।’ সামাজিকভাবে মৌল বিধানের সংক্ষিপ্ত ঘোষণা এটা। আর দ্বিতীয়-প্রত্যেক মালদারের ওপরই যাকাত ফরয করা। এমনি পরীবদেরকে তাদের প্রাপ্য জোরপূর্বক নিয়ে নেয়ার সুযোগ দান- যদি ধনীরা তা দিতে ইচ্ছুক না হয়, দিতে অস্বীকার করে। এটাই প্রকৃত সাম্য প্রতিষ্ঠার পন্থা। অপর একজন বিজাতীয় ব্যক্তি কর্তৃক লিখিত গ্রন্থে যাকাত সম্পর্কে যা বলা হয়েছে, উস্তাদ কুরদে আলী তা আমাদের জন্যে উদ্ধৃত করেছেন। তা হচ্ছেঃ এ ‘কর’টি একটা দ্বীনী ফরয কাজ। সকলের পক্ষেই তা দেয়া বাধ্যতামূলক। তা দ্বীনী ফরয হওয়া ছাড়াও যাকাত একটা সামষ্টিক বিধান-সর্বসাধারণ ও নির্বিশেষ। এমন একটা উৎস, মুহাম্মাদী বিধান অনুসারী রাষ্ট্রের মাধ্যমে একটা সম্পদ সংগ্রহ করে এবং তদ্দারা গরীব, মিসকীনকে সাহায্য করে তাদের সচ্ছল বানায়। আর এটা করা হয় একটা সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার ভিওিতে, স্বৈরতান্ত্রিক বল প্রয়োগের মাধ্যমে নয়-নয় কেন অস্থায়ী উড়ন্ত পন্থার মাধ্যমে।[আবরী***********] ‘এ অভিনব ব্যবস্থা প্রবর্তনে ইসলামই প্রথম অবদানস রেখেছে। মানব ইতিহাসে সাধঅরণভাবেই তার ভিওি ইসলাম কর্তৃকই সর্বপ্রথম সংস্থাপিত হয়েছে। অতএব যাকাত কর, মালিক-ব্যবসায়ী ধনী শ্রেণী লোকদের তা দিতে বাধ্য করা হত, যেন সরকার বা রাষ্ট্র গরীব অক্ষম লোকদের জন্যে ব্যয় করতে পারে। এ ব্যবস্থা সেই প্রাচীরকে ধূলিস্মাৎ ও চূর্ণ বিচূর্ণ করে দিয়েছে, যা একই রাষ্ট্রের বিভিন্ন শ্রেণীল লোকদের মধ্যে বিরাট পার্থক্যের সৃষ্টি করত। আর এর দ্বারা সামাজিক সুবিচারের পরিমন্ডলের গোটা উম্মতকে ঐক্যবদ্ধ্য করেছে। এ কারণে ইসলামী ব্যবস্থা প্রমাণ করেছে যে, তা কোন বিদ্বেষ হিংসার প্রতিক্রিয়ার ভিওিতে গঠিত হয়নি। [ঐ ৭৬-৭৭ পৃ.] প্রখ্যাত ফরাসী প্রাচ্যবিদ মাসিনিউন-এর উক্তি উদ্ধৃত করেছেনঃ দ্বীন ইসলামের জন্যে যথেষ্ট ব্যবস্থা তা-ই, যা সাম্যের চিন্তাকে বাস্তবায়িত করার জন্যে খুব বেশী কঠোরতা অবলম্বন করা হয়। আর তা করা হয় যাকাত ফরয করার সাহায্যে,- যা প্রত্যেক ব্যক্তি বায়তুলমালে জমা করে। তা সুদী ব্যবস্থা ও অপ্রত্যক্ষ করসমূহ-যা জরুরূ ও প্রাথমিক প্রয়োজনের ভিওিতে ধার্য করা হয়-কে উৎপাটিত করে। সাময়িকভাবে ব্যক্তিগত মালিকানা ও ব্যবসায়ী মূলধনকে ঠেকিয়ে দেয় আর এর সাহায্যে ইসলাম দ্বিতীয়বার পুঁজিবাদী বুর্জোয়া ব্যবস্থা ও বলশোভিক কমিউনিস্ট ব্যবস্থার মাঝাখানে একটা সম্মানজনক স্থান দখল করে নেয়।[আবরী***********] ইটালী লেখিকা ডঃ ফাগ্লীরী তাঁর গ্রন্থে যা লিখেছেন, তা আরবী ভাষায় অনুদিত হয়েছে (আবরী***********) নামে। তাতে বলা হয়েছেঃ ‘আমি মোটামুটি সব ধর্মে আরোপিত নৈতিক মহান সামজিক গুরুত্ব-যা সাদকা দান দেয়ার ব্যবস্থা পেশ করেছে-স্বীকার করি এবং আমি তার ভাল দিককে দয়া-অনুগ্রহের বাস্তব ব্যাখ্যা বলে গণ্য করি। কিন্তু ইসলাম সাদকাকে বাধ্যতামূলককরণে একক আদর্শ মর্যাদা ভোগ করেছে-মসীহর শিক্ষাকে। দুনিয়ার ব্যাপারস্বরূপ এবং এখান থেকেই তা বাস্তবায়িত করার দরুন। তাই প্রত্যেকটি মুসলমান তার সম্পদের একটা অংশ ফকির পথিক মিসকীনের কল্যাণের জন্যে বিশেষভাবে নির্দিষ্ট করে দিতে বাধ্য। আর এ দ্বীনী ফরয পালন করানোর মাধ্যমে মুমিন ব্যক্তির মানবিকতার গভীর অনুভূতির যাচাই করা হয়। তার অন্তর ও আত্ম লোভ-কর্পণ্য থেকে পবিত্র হয় এবং মহান আল্লাহ্র কাছ থেকে শুভ কর্মফল লাভে আশা-আকাঙ্ক্ষার সফলতা পায়। [আবরী***********] মুসলিম সমাজ সংস্কারকদের কথা উপরে প্রাচ্যবিদ পাশ্চাত্য মনীষীদের যাকাতের সৌন্দর্য মাহাত্ম্য সংক্রান্ত ইনসাফপূর্ণ কথাসমূহ উদ্ধৃত করেছি। এখন আমরা কাতিপয় মুসলিম সামজ সংস্কারকে কথা উল্লেখ করাব। তাঁরা যাকাত সম্পর্কে এ সব উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন কথা বলেছেন। সম্ভবত এসব কথা থেকে অনেকে হেদায়েত এবং নসীহত লাভ করতে পারবেন। ইসলামের মর্যদা পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্যে যাকাত আদায় বাধ্যতামূলক করাই যথেষ্ট সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ রশীদ রিজা (র) তাঁর তাফসীরে লিখেছেনঃ ‘যাকাত দেয়া ফরয করার দরুন দ্বীন ইসলাম অন্যান্য সব ধর্ম ও মতের ওপর বিশিষ্ট মর্যাদার অধিকারী হয়েছে। সারা দুনিয়ার সুধী ও সমজ বিজ্ঞানীরা একথা স্বীকার করেছেন। মুসলমানরা যদি তাদে দ্বীনের এ রুকনটা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে, তা হলে আল্লাহ তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি করেছেন এবং রিযিকে বিপুল প্রশস্ততা দিয়েছেন-এ সও্বেও যে গরীব লোক পাওয়া যাচ্ছে, তা আদৌ দেখা যেত না। পাওয়া যেত না ভয়াবহ ঋণের ভারে ন্যুজ কোন লোক। কিন্তু তাদের অধিকাংশ লোকই এ ফরযটি পালন করা ত্যাগ করেছে। এর দরুন তারা তাদের দ্বীন ও জাতির কাছে মহা অপরাধ করছে। আর এর কারণে তারা তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কল্যাণের দিক দিয়ে দুনিয়ার জাতিসমূহের তুলনায় অত্যন্ত খারাপ এবং নিকৃষ্ট হয়ে আছে। তারা তাদের রাজত্ব হারিয়েছে, ইজ্জত খুইয়েছে, মর্যাদা হারা হয়েছে। ফলে অপরাপর জাতির ওপর তারা তখন বোঝা হয়ে দাড়িয়েছে। এমন কি তাদের সন্তানদের শিক্ষা-প্রশিক্ষণে পর্যন্ত এ অবস্থা বিরাজ করছে। তারা তাদেকে খৃষ্টধর্ম প্রচারকদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে ভর্তি করে দেয় অথবা নাস্তিকদের শিক্ষাকেন্দ্রে ভর্তি করা হয়। ফলে তাদের দ্বীনী বিপর্যন্ত হয় দুনিয়াও তাদে বিনষ্ট হয়। তাদের জতীয় ও মিল্লাতী সম্পর্ক ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। তারা বিজাতীয়দের কাছে নিকৃষ্টহীন দাস প্রমাণিত হয়। তাদের যখন বলা হয়ঃ তোমরা ওসব পাদ্রী মিশনারী এবং নাস্তিক কমিউনিষ্টদের মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোল না কেন? তখন তারা বলেঃ সেজন্যে যে অর্থের প্রয়োজন তা আমাদের নেই। কিন্তু একথা সত্য নয়। আসলে তাদের বিবেক-বুদ্ধি বলতে কিছু নেই। উচ্চতর সাহস-হিম্মত নেই। আত্মমর্যাদাবোধও তারা হারিয়েছে। ফলে তারা সে কাজ করতে সক্ষম হচ্ছে না। তারা অন্যান্য জাতির লোকদের দেখে, তারা শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান কল্যাণকর সংস্থা-সমিতি ও রাজনীতি গড়ে তুলছে, যা করতে তাদের ধর্ম তাদের বাধ্য করছে না। তাদের বিবেক-বুদ্ধি, জাতিত্ববো্ধ ও আত্মচেতনাই তাদের এজন্যে উদ্বুদ্ধ করেছে। তারা এসব দেখেও লজ্জাবোধ করছে না। তারা ওসব জাতির ওপর নির্ভরশীল হয়ে থাকতেই ভালবাসে। এরা এদের দ্বীন পরিহার করেছে, ফলে তারা দুনিয়াও হারিয়েছে। তারা আল্লাহ্কে ভুলে গেছে, ফলে ভুলে গেছে তারা নিজেদেরকেও। এরাই হচ্ছে নীতি সীমালংঘকারী লোক। অতএব মুসলিম সমাজ সংস্কারকদের কর্তব্য হচ্ছে তাদের দ্বীনদারী ও মর্যাদাবোধের যতটুকু এখনও অবশিষ্ট আছে, তার থেকেই সংশোধনী প্রচেষ্টার সূচনা করা। এজন্যে যাকাত সংগ্রহ করার এবং সর্বাগ্রে এ সংস্থার সাথে সংশ্লিষ্ট লোকদের অবস্থার সংশোধন এবং তাদের সর্বপ্রকার কল্যাণ সাধনে সর্বপ্রথম ব্যয় করা কর্তব্য, অন্যদের ব্যাপারে পরে দেখা যাবে। এরূপ একটা সংস্থা গড়ে তোলা ও তার কাজ চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে গুরুত্ব সহকারে লক্ষ্য রাখতে হবে যে, যাকাত, ‘মুয়াল্লাফাতুল কুলুবুহুম’ খাতের একটা বিশেষ ব্যয় ক্ষেত্রে হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদ কবলিত জাতিসমূহকে দাসত্বের শৃংখলমুক্ত করা যদি ব্যক্তিদের মুক্ত করার জন্যে ব্যয় করার সুযোগ না থাকে। আর ‘সাবীলিল্লাহ’ অংশের সঙগ্রাম পরিচালনা করা। এই জিহাদের চাইতেও অধিক গুরুত্বপূর্ণ-কুফরী শক্তির অত্যাচার জুলুম ও নিষ্পেষণ থেকে মুসলমানদের রক্ষা করার জন্যে। যখনী ও বক্তৃতা-ভাষণের সমুচিত জবাব দান ইসলামের প্রতিরক্ষা তার আর একটি ব্যয় ক্ষেত্রে।– যখন তরবারি ও অস্ত্রশস্ত্রের সাহায্যে প্রতিরক্ষার কাজ চালানোর কঠিন বা অসম্ভব হয়ে দাড়িয়েছে। জেনে রাখ, সমস্ত মুসলমানদের কিংবা তাদের অধিকাংশের যাকাত দান এবং তা একটা ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ব্যয় করাই ইসলামের মর্যাদা ফিরিয়ে আনার জন্যে যথেষ্ট। বরং অন্যরা দারুল ইসলাম থেকে যা কিছু হরণ করে নিয়ে গেছে তা ফিরিয়ে আনা এবং কাফিরদের দাসত্ব থেকে মুসলমানদের মুক্তিদানের জন্যে এটা একান্তই অপরিহার্য। বস্তুত ধনী লোকদের প্রয়োজনাতিরিক্ত সম্পদ থেকে শুধু ওশর বা ওশরের এক-চতুর্থাংশ দেয়াই যাকাত নয়। আমরা লক্ষ্য করছি, মুসলমানদের বিশ্বের সেরা জাতি হওয়ার মর্যাদা শেষ হয়ে যাওয়ার পর এক্ষণে যেসব জাতি মুসলমানদের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেছে, তারা তাদের জাতি ও মিল্লাতের জন্যে অনেক বেশী ব্যয় ও ত্যাগ তিতিক্ষা স্বীকার করছে অথচ তা তাদের ওপর তাদের আল্লাহ্র তরফ থেকে ফরয করা হয়নি। [(আরবী*************)] যাকাত উম্মতের কাছ থেকে ও তাদের প্রতি মরহুম শায়খ মাহমুদ শালতুত-জামে আজহারের প্রাক্তন শায়খ হযরত মুয়ায বর্ণিত হাদীসের ওপর টীকা লিখেছেন, যে হাদীস নবী করীম (স) তাঁকে বলেছেনঃ লোকদের জানিয়ে দেবে যে, আল্লাহ তা‘আলা তাদের ধন-মালে তাদের ওপর যাকাত ফরয করে দিয়েছেন, যা তাদের ধনী লোকদের কাছ থেকে নিয়ে তাদেরই দরিদ্রদের ওপর ব্যয় করা হবে। এ হাদীসের টীকায় তিনি লিখেছেনঃ নবী করীম (স)-এর এ মহান শিক্ষা আমাদের জানিয়ে দিচ্ছে যে, ইসলামের দৃষ্টিতে যাকাত উম্মতের ধনী লোকদের কাছ টাকা নিয়ে গরীবদের প্রতিনিধিত্বস্বরূপ সে জাতির জন্যেই ব্যয় করা ছাড়া আর কিছুই নয়। অন্য কথায় উম্মতের ধন-মাল তাদেরই কিছু লোকদের কাছ থেকে নিয়ে তাদেরই অন্যদের জন্যে ব্যয় করা। প্রথম হাত দাতার, আল্লাহ্ তাকে ধন-মালের সংরক্ষণ, তার প্রবৃদ্ধি সাধন এবং তা দিয়ে কাজ করার জন্যে খলীফা বানিয়েছেন। এটা ধনী লোকদের হাত। আর অন্য হাতটি হচ্ছে শ্রমজীবী কর্মীদের হাত। তাদের শ্রম ও কাজ তাদের প্রয়োজন পূরণের জন্যে যথেষ্ট পরিমাণ আয় করতে পারছে না কিংবা কাজ করতেই অক্ষম হয়ে পড়েছে এবং তার রিযিক ধনীদের ধন-মালে রেখে দেয়া হয়েছে। এটা হচ্ছে ফকীর-মিসকীনদের হাত।[(আরবী*************)] মুসলিম সমাজে যাকাতের ভূমিকা ইসলামী চিন্তাবিদ আল্লামা সাইয়্যেদ আবুল আ’লা আল-মওদূদী যাকাতের দায়িত্ব ও ইসলামী অর্থ ব্যবস্থায় তার স্থান ও ভূমিকা পর্যায়ে তাঁর (আরবী*************) নামের গন্থে [(আরবী*************)] লিখেছেনঃ পূর্বে যেমন বলেছি, প্রকৃতপক্ষে ইসলাম চায় সমাজের কোন স্থানেও যেন ধনসম্পদ পুঞ্জীভূত হয়ে না ওঠে। যারা ধন-সম্পদের উওম অংশ পাওয়া কিংবা তাদের প্রয়োজনাতিরিক্ত যথেষ্ট পরিমাণে লাভ করার দরুন সম্পদের অধিকারী হয়েছে, তারা যেন তা জমা করে না রাখে, তা ব্যয় করা বন্ধ করে না দেয়। বরং তাদের কর্তব্য হচ্ছে তা ব্যয় করা এমনভাবে ও পথে, যার ফলে যারা সমাজের সম্পদ থেকে তার আবর্তন ধারা তাদের জন্যে যথেষ্ট পরিমাণে লাভ করার সৌভাগ্য অর্জন করেনি তাদের তা পাওয়া সম্ভবপর হয়। এ উদ্দেশ্যে ইসলাম একদিকে তার উচ্চতর নৈতিক শিক্ষা ও প্রভাবশালী আগ্রহ সৃষ্টি ও ভয় প্রদর্শনের সাহায্যে জনগণের মধ্যে বাদান্যতা, দানশীলতা ও প্রকৃত সামাজিক সহযোগিতার ভাবধারা জাগিয়ে দিতে চায় যেন মানুষ তাদের প্রকৃতিগত প্রবণতার দরুন ধনসম্পদি একত্রিত ও পূঁজিকরণ থেকে বিরত থাকে এবং নিজেদের থেকেই তা ব্যয় করতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। আর অপরদিকে এমন আইনও রচনা করেছে যা লোকদের ধন-মাল থেকে একটা নির্দিষ্ট ও জানা পরিমাণ নিয়ে নেয়া বাধ্যতামূলক করে দিয়েছে সমষ্টির কল্যাণ ও সৌভাগ্য গড়ে তোলার জন্যে। এ জানা পরিমাণটা লোকদের কাছ থেকে নেয়া, এটাই যাকাত। আর ইসলামী অর্থ ব্যবস্থায় এ যাকাতের যে কি বিরাট ভূমিকা রয়েছে, তা কারো কাছে অস্পষ্ট থাকা উচিত নয়। তা নামযের পর ইসলামের অধিক গুরুত্বপূর্ণ রুকন। এমন কি, কুরআন স্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছে যে, যে লোক ধন-মল পুঁজি করবে, সে তার যাকাত না দেয়া পর্যন্ত তার জন্যে তা হালাল হবে না। বলেছেঃ তাদের ধন-মাল থেকে যাকাত নাও, তুমি তার দ্বারা তাদের পবিত্র করবে ও পরিশুদ্ধ করবে। [(আরবী*************)] ‘যাকাত’ শব্দটিই বোঝায় যে, মানুষ যে ধন-সম্পদ সংগ্রহ ও সঞ্চয় করে তাতে অপবিত্রতা ও ময়লা-আবর্জনা রয়েছে, তা থেক আড়াই পার্সেন্ট সম্পদ প্রতি বছর আল্লাহ্র পথে ব্যয় না করা পর্যন্ত তা কখনই পরিত্র হবে না। আল্লাহ্ নিজে তো মহাসম্পদশালী, তোমাদের ধন-মাল তাঁর কাচে পৌঁছায় না, তার কোন প্রয়োজনও নেই। তাই ‘সাবীলিল্লাহ’ হচ্ছে ফকীর-মিসকীনদের সচ্ছল-স্বাচ্ছন্দ্য বানানোর জন্যে চেষ্টা করা, এমন সব কল্যাণকর কাজের উৎকর্ষ সাধন, যার ফায়দাটা জাতির সর্বশ্রেণীর লোকেরােই পাবে্ এ কারণে বলেছেঃ ‘যাকাত কেবলমাত্র ফকীর, মিসকীন, তার জন্যে নিয়োজিত কর্মচারী, মুয়াল্লাফাতু কুলুবুহুম, ক্রীতদাস, ঋণগ্রস্তদের জন্যে এবং আল্লাহ্র পথে ও নিস্বঃ পথিকের জন্যে। [(আরবী*************)] সামাজিক সামষ্টিক সহযোগিতা গড়ে তোলার জন্যে এটাই হচ্ছে মুসলিমদের সংস্থা। সামাজিকভাবে নিরাপওা ব্যবস্থা কার্যকর করার জন্যে এটাই তাদের ঐক্যবদ্ধতা। আর এটাই তাদেরন সতর্কতামূলক ধন-মাল। এ ধন-সম্পদই সমাজের বেকার লোকদের জন্যে নিরাপওার ব্যবস্থাপক, তাদের ইয়াতীম, বিধাবা, অক্ষম ও রোগাক্রান্ত লোকদের সাহায্য করার জন্যে একটা বড় মাধ্যম। তাদের প্রতি সহানুভূতি জানানোর ও তাদের অবস্থার উন্নয়নের এটা একটা বড় উপায়। সর্বোপরি তা প্রত্যেক মুসলিমের ভবিষ্যৎ চিন্তা থেকে মুক্তির একমাত্র অবলম্বন। অতএব স্বভাবসম্মত ইসলামী নীতি হচ্ছেঃ তুমি যদি আজ ধনী ব্যক্তি হও, তা হলে অন্যকে সাহায্য কর। তাহলে কাল তুমি যখন দরিদ্র হয়ে পড়বে তখন সেই ‘অন্য লোক’ তোমাকে সাহায্য করবে। তাহলে ভবিষ্যতে তুমি যখন দরিদ্র হয়ে পড়বে, চরম, দুর্গতির মধ্যে পড়ে যাবে এ আশংকায় আজ তোমাকে অস্থির হওয়ার কোন কারণ থাকবে না কিংবা তুমি যখন মরে যাবে-পরকালের মহাযাত্রায় রওয়ানা হয়ে যাবে, তখন তোমার স্ত্রী-পুত্র-পরিজনের কি অবস্থা হবে অথবা তোমার ওপর যখন কঠিন বিপদ আপতিত হবে বা তুমি রোগাক্রান্ত হয়ে পড়বে-তোমার যথাসর্বস্ব জ্বলে পড়ে গেল, কি বন্যায় ভেসে গেল, তখন তুমি কিভাবে মুক্তি পাবে। তুমি যখন বিদেশ সফরে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়বে, তখন তুমি কি করবে, যাকাত তোমাকে এ সব বিপদাশংকা থেকে মুক্তি দিচ্ছে। যাকাত ব্যবস্থা যথাযথভাবে চালূ থাকলে কা্উকেই এরূপ চিন্তায় কাতর হতে হবে না। চিরদিনের তরে তা থেকে মুক্তি ও নিষ্কৃত পেয়ে যাবে। তোমার দায়িত্ব শুধু সঞ্চিত সম্পদের শতকরা আড়াই হারে নিরাপওার জন্যে আল্লাহ্র প্রতিষ্ঠানে জম করে দেয়া। তাতেই তুমি সর্বপ্রকারের বিপদ-আপদ- যা তোমার ওপর আসতে পারে-থেকে তুমি মুক্তি পেয়ে যাবে। আজ তোমার সম্পদের যে অংশটি তোমার প্রয়োজনীয় নয় তা দিয়ে দাও তাদের, যারা তার মুখাপেক্ষী। তারা তা ব্যয় করবে, নিজেদের প্রয়োজন পূরণ করবে। পরে তোমার কাছে এ সম্পদই ফিরে আসবে সম্পূর্ণ মাত্রায়। বরং তার তুলনায় অধিক পরিমাণে-যদি তুমি বা তোমার সন্তানরা দরিদ্র হয়ে পড়ে। এ ব্যবস্থাপনায়ও পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার মৌলনীতি এবং ইসলামী অর্থব্যবস্থার মৌলনীতির মধ্যকার পার্থব্য ও বৈপরীত্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পুঁজিবাদের দাবি হছ্ছে, ব্যক্তির সম্পদ পুঁজি করবে, তা সুদে বিনিয়োগ করবে, যেন তা শোষণ করে সমাজের অন্যদের হাতে সমস্ত সম্পদ তার পকেটে নিয়ে আসতে পারে। কিন্তু এ তৎপরতা ইসলামের প্রকৃতির সাথে সঙ্গতিসম্পন্ন নয়। ইসলাম তো নির্দেশ দেয়, কোন ঝিলে সম্পদ পুঞ্জিত হলে তা থেকে খাল কেটে তার ‘পানি’ চারপাশের মৃত ক্ষেত-খামারে প্রবাহিত করতে হবে, যেন তাতে জীবনের পুনরুদগম হয়। পুঁজিবাদে সম্পদের আবর্তন বন্ধ, স্তব্ধ। কিন্তু ইসলামী অর্থব্যবস্থায় তা উন্মুক্ত। পুঁজিবাদের বদ্ধকূপ থেকে পানি নিতে হলে তোমার কাছে পূর্বে থেকেই পানির ‘স্টক’ মওজুদ থাকা আবশ্যক। অন্যথায় তুমি কিছুই পেতে পারবে না-কোন অবস্থাতেই; একটা ফোটাও নয়। কিন্তু ইসলামের পানি ভান্ডারে মৌল নীতি হচ্ছে, যার কাছে প্রয়োজনাতিরিক্ত, ‘পানি’ রয়েছে সে যেন তা এ ভান্ডারে ঢেলে দেয়,. তখন যার যার প্রয়োজন সেসে এ ভান্ডার থেকে নিজ নিজ প্রয়োজন মত পানি পেয়ে যাবে-নিতে পারবে। অতএব বাহ্যতঃ এ দুটি ব্যবস্থাই পরস্পর ভিন্ন ভিন্ন, পরিপন্থী। এ দুটির মূল ও প্রকৃতি কোন দিক দিয়েই পরস্পরের সাথে একবিন্দু সঙ্গতিসম্পন্ন নয়। এ দুটি ব্যবস্থাকে একত্রিত বা সমন্বিত করতে চেষ্টা করা প্রকৃতপক্ষে দুটি সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী ব্যবস্থাকে একত্রিত করতে চাওয়ার চেষ্টা মাত্র। সুস্থ বিবেক-বুদ্ধির লোকই তা সম্ভব বলে মনে করতে পারে না। ইসলামে যাকাতের উজ্জ্বলতম দিক মহান ইসলামী চিন্তাবিদ সাইয়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভী তাঁর (আরবী***************) গ্রন্থে ইসলামী যাকাতের উজ্জ্বলতম দিকসমূহ সম্পর্কে লিখেছেনঃ যাকাতের উজ্জ্বলতম ও গভীরতম প্রভাবের দিক- যা এ ফরয কাজটির সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত, তা হচ্ছে ঈমান ও চেতনার দিক। তা সে প্রাণশক্তি যা সরকার ধার্যকৃত কর থেকে তাকে স্বতন্ত্র মর্যাদার অধিকারী বানায়। তার অপর গুরুত্বপূর্ণ ও গভীর স্পষ্ট দিকের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছেনঃ [(আরবী***************)] যাকাতের দ্বিতীয় উজ্জ্বলতম দিক-যার দরুন যাকাত সেসব কর ইত্যাদি থেকে স্বাতন্ত্র্য ও বিশিষ্টতা পায়, যা রাজা-বাদশাহর ‍যুগে, ব্যক্তিগত শাসনের যুগে বা আধুনিক গণতাস্ত্রিক ও জাতীয় সরকারের আমলে ধার্য হয়। সুচনা, চূড়ান্ত পরিণতি ও ফলশ্রুতি সর্বক্ষেত্রেই পরস্পর ভিন্ন ভিন্ন হয়ে দেখা দেয়, তা হচ্ছে যাকাত শরীয়াত প্রবর্তিত ব্যবস্থা। রাসূল করীম (স) তাঁর বিজ্ঞতাপূর্ণ মুজযিার ভাষায় সুক্ষ্ম নবুয়ত বিশ্লেষণ যাঁকে জামেউল কারাম’ গণ্য করা হয়- বলেছেন’ তা গ্রহণ করা হবে তাদের ধনী লোকদের কাছ থেকে এবং তা ফিরিয়ে দেয়া হবে তাদেরই গরীব লোকদের ওপর। শরীয়াত প্রবর্তিত যাকাতের মুল তত্ত্বই হচ্ছে তাই। এ ব্যবস্থা চিরদিনই চলবে- যদ্দিন না আল্লাহ পৃথিবী ও পৃথিবীর উপরস্থ সবকিছুর উত্তারাধিকারী হচ্ছেন। তা সে সব ধনী লোকের কাছ থেকে আদায় করা হবে, যাদের ওপর তা ফরয হওয়ার শর্তসমূহ পুরামাত্রায় পাওয়া যাবে, শরীয়াত নির্দিষ্ট নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হবে এবং তা ব্যয় করা হবে আল্লাহর নির্ধারিত ব্যয়খাতসমুহে- যা কুরআন শরীফে ঘোষিত হয়েছে। যা কোন মানবীয় বিধান রচয়িতা বা আইন প্রণয়নকারীর রায় বা অভিমতের ওপর নির্ভরশীল হয়নি, কোন মানবীয় প্রশাসন বা আলিম যা প্রবর্তিত করেন নি। কুরআনে উদ্ধৃত আল্লাহর ঘোষণা হচ্ছেঃ (আরবী***************) যাকাত কেবলমাত্র ফকীর মিসকীনদের জন্যে..... শরীয়াত ও নবী করীম (স) এর হাদীসসমূহ অগ্রাধিকার দিয়েছে এ যাকাত স্থানীয় গরীব-মিসকীনের মধ্যে বিতরণ, করাকে, যেখানে থেকে তা সংগৃহীত হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে যাকাত ব্যবস্থা এমনিভাবে কার্যকর ছিল। সে সব শাসন প্রশাসনেও যা খুব বেশী সূক্ষ্ম বা কঠিন ছিল না, পুরাপুরিভাবে শরীয়াতী বিধান বাস্তবায়নের দায়িত্বশীল বা আমানতদারও ছিল না, শাসন-আইন ও রাজনীতির দিক দিয়ে উচ্চতর ইসলামী আদর্শ হিসেবেও তা গন্য ছিল না। এ ধরনের রাষ্ট্রের ফকীর-মিসকীনরা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়নি। আল্লাহ নির্ধারিত দণ্ডবিধানসমূহ ও পুরাপুরিভাবে অকেজো করে রাখা হয়নি সেখানে।[বিচারপতি ইমাম আবূ ইউসূফ লিখিত (আরবী***************) তার ভূমিকা বিশেষভাবে আব্বসী শাসনে খারাজ, যাকাত ও সাদকাত সম্পর্কে যতটা গুরুত্ব সহকরের আদয় ও বন্টনের ব্যবস্থা করা হত, তা উপরিউক্ত, কথার স্পষ্ট উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এ কিতাবখানি আমিরুল মুমিনীন হারুন রশীদের প্রস্তাবক্রমে লিখিত হয়েছিল।] যদিও বহু স্বার্থান্বেষী ঐতিহাসিক এবং প্রাচ্যবিদ পর্যালোচক এসব শাসন ব্যবস্থার নিন্দাবাদে খুব বেশী বাড়াবাড়ি করেছেন। তখনকার সময়ে ইসলামের সুমহান শিক্ষা ও আদর্শ থেকে যে বহু বিচ্যুতি ঘটেছিল তারও তাঁরা উল্লেখ করেছেন। বরং ইসলামের বিরুদ্ধে স্পষ্ট বিদ্রোহের কথা উল্লেখ করতেও কসুর করা হয়নি- যেমন তাঁরা সাধারণত করেই থাকেন। যে সব কর, ট্যাক্স বা কাস্টম ডিউটি- যা আজকের সরকার ধার্য করে থাকে, তা তার বিপরীত। তা যাকাতের সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থা। এ কর যাকাতের বিপরীতমুখী, বিদ্বেষাত্মক- তার তুলনায় ক্ষুদ্র পরিসরও হয় এবং হয় তার চাইতে অনেক বিরাট। তা যেমন গরীব মানুষের কাছ থেকে নেয়া হয়, তেমনি মধ্যবিত্তদের কাছ থেকেও নেয়া হয় এবং ধনী সেরা শ্রেণী ও শক্তিশালী লোকদের কাছে তা ফিরিয়ে দেয়া হয়। তা সংগ্রহ করা হয় চাষী-কৃষক শ্রমিক-শিল্পিদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে উপর্জন করা সম্পদ। যে সব ব্যবসায়ী দিন-রাত তাদের ব্যবসায় কেন্দ্রে দোকানে ব্যতিব্যস্ত থেকে অর্থোপার্জন করে, তারাও এ থেকে নিস্কৃতি পায় না। এসব অর্থ খুবই উদার হস্তে ব্যয় করা হয়, অত্যন্ত নির্মমভাবে অত্যন্ত বেশী নির্লজ্জভাবে। প্রজাতন্ত্রের প্রধানরা দেশ-বিদেশে বিলাসভ্রমণে গিয়ে সে টাকার অপরচয় করেন। এক হাজার এর রাতের স্বাপ্নিক রূপকথার সাথে তুল্য বড় বড় দাওয়াত জিয়াফতে তা উড়ানো হয়। আর কখনও কখনও যে জাতীয় উৎসবাদি উনুষ্ঠিত হয়, তাতে ও তার আলোকসজ্জা-জাঁকজমকে ক্ষয় করা হয়। বিভিন্ন দেশে যেসব রাষ্ট্রদূত প্রেরণ করা হয় এবং তার যে দুতাবাস খোলা হয় সেখানে মদের বন্যা প্রবাহিত হয়, নারী পুরুষের যৌ নৃত্যের ঝড় ছোটে, তাতে ভেসে যায় তার বিরাট অংশ। সরকারী পর্যায়ে ঝগড়া-বিবাদে জাতীয় আয় নিঃশেষ হয়ে যায়। তার রক্ত শুষে নেয়, জাতির ব্যক্তি ও তার শক্তির মধ্যে এ দ্বন্দ্ব আবর্তিত হতে থাকে, বিদেশী পত্র-পত্রিকায় কৃত্রিম প্রচার-প্রোপাগান্ডায় সাংবাদিক ওকালতিতে উচ্চাঙ্গের প্রচারকদের- যারা সংবাদ রচনায় নির্দোষ ব্যক্তিদের দোষী সাব্যস্ত করেন, পক্ষের-বিপক্ষের লোকদের মধ্যে ব্যাখ্যাদানে, সংবাদপত্র যা সেনাবাহিনীর অপেক্ষাও অনেক শক্তিশালী ও উপকারী বলে বিবেচিত। পরিচালনায়, অস্ত্র শস্ত্র উদ্ভাবন-নির্মাণে জনগণের রক্ত পানি করে উপর্জন করা টাকা ব্যয় হয়ে যায়। প্রত্যেকটি জাতীয় গণতান্ত্রিক বা কমিউনিস্ট সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই জাতিরি রক্ত শোষণ করে, ব্লটিং কাগজ যেমন শুয়ে নেয কালি এবং জাতিটিকে ঝগড়া বিবাদ ও রাজনৈকিক ঘুষ-রিষওয়াতের মধ্যে নিক্ষেপ করে, সাংবাদিক মিথ্যা প্রবঞ্চনায় পড়ে, অপরাধী ও নিরাপরাধ বিরুদ্ধবাদীদের মুকাবিলাকরণে পড়ে গোটা জাতি ছটফট করতে থাকে। এসব কর আজকের সরকারসমূহ যার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে- সম্পর্কে অধিক সূক্ষ্ম লেখনী চিত্রাংকন এবং পরিচিতি অধিক সত্য প্রকাশক কথা এটাই হতে পারেঃ (আরবী****************) গরীব লোকদের কাছ থেকে তা নেয়া হয় এবং তূলে দেয়া হয় তাদেরই ধনী লোকদের হাতে। এ কারণে আল্লাহ তাআলা ইসলামী যাকাত ফরযরূপে ধার্য করেছেন তাঁর সচ্ছল বান্দাদের ওপর গোটা জাতির প্রতি অনুগ্রহ ও বাৎসল্যস্বরূপ। তা নবুয়তের নিয়ামতের ফসলও বটে, যে নিয়ামতের ওপরে আর কোন নিয়ামত হতে পারে না। এ যাকাতকে যদি প্রয়োজন হয় কর বলার তাহলে তা পরিমাণের দিক দিয়ে সর্বপ্রকারের কর এর তুলনায় অত্যন্ত স্বল্প পরিমাণ, অতি সামান্য কষ্টের ব্যাপার। কিন্তু বরকত ও প্রতিফলের দিক দিয়ে অতীব বিরাট। ফয়দা অনেক ব্যাপক। কেননা তা নেয়া হয় তাদের ধনী লোকদের কাছ থেকে এবং ফিরিয়ে দেয়া হয় তাদেরই গরীবদের হাতে। শেষ কথা আমি এ বিরাট পাঠ উপঢৌকনস্বরূপ উপস্থাপিত করছি দুনিয়ার চিন্তাবিদ এবং অর্থনৈতিক ও কর বিশারদ ব্যক্তিদের সমীপে। তাঁরা এ থেকে জানতে পারবেন, কর ও আধুনিক আর্থিক সংস্থা ও সংগঠন গড়ে তুলেছে সর্বাগ্রে। তাতে রয়েছে অতীব উত্তম সব মৌল নীতি। তার আইন বিধানসমূহ পুরাপুরিভাবে ভারসাম্যপূর্ণ। তার লক্ষ্য অতুলনীয় তার নিশ্চয়তা পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা করে, বাস্তাবভাবে যে পরিস্থিতির মধ্যে তারা জীবন যাপন করছে, তারও যেন যাচাই কর দেখে। তার পরে যেন সে জাতির আকীদা-বিশ্বাসগুলো পর্যবেক্ষণ করে, যাদের জন্যে তারা আেইন বিধান রচনা করছে। তারপরে তারা যেন তাদের প্রবর্তিত করসমূহের অগ্রভাগে রাখে এ মহান পবিত্র কর-যাকাত। অতপর উর্ধ্বমুখী ও স্থিতিশীল করসমূহের তুলনামূলকভাবে যাচাই করে দেখে। আমি এ বিরাট অধ্যয়ন উপঢৌকন দিচ্চি সামষ্টিক গ্রহণকারী ব্যক্তিদের, যেন তারা দৃঢ় প্রত্যয় সহকারে জানতে পারেন যে, এ ফরযটা মানুষের ইতিহাসের সমাজের অভাবগ্রস্থ লোকদের জন্যে সর্বপ্রথম সাহায্য ব্যবস্থা, যা সরকারের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। না, বরং তাদের জন্যে নির্দিষ্ট করা সর্বজনপরিজ্ঞাত অধিকার- মহান আল্লাহর ধার্যকৃত ফরয এটাই প্রথম। সরকারী ব্যবস্থাপনার অধীনে দুর্বল অক্ষম অভাবগ্রস্থ লোকদের সাহায্যের ইতিহাস যেমন বলা হয়েছে- সপ্তদশ শতকের পূর্বে শুরু হয়নি- অনুরূপভাবে সামষ্টিক দায়িত্ব গ্রহণ ব্যবস্থা পাশ্চাত্য প্রবর্তীত নয়, আধুনিক যুগের উদ্ভাবনও নয় তা। আসলে তা একটা ইসলামী ব্যবস্থা। ইসলামের তা ‍মুসলিম ও অমুসলিম সকলেরই জন্যে কার্যকর করেছে। আমি এ বিরাট বিশাল আলোচনা পেশ করছি একালের বিদগ্ধ ও সংস্কৃতিবান লোকদের সম্মুখে, যাঁরা সুনাম ও সুখ্যাতির অধিকারী হয়েছেন আরব দেশ ও প্রাচ্যের অন্যান্য দেশসমূহে কিংবা যারা ইউরোপীয়, আমেরিকান বা রাশীয়, চীনা বিবেক-বুদ্ধির অধিকার ও পরিচিতির দিক দিয়ে ইসলাম ধর্মের ধারক রয়েছেন। আসলে তারা ইসলাম সম্পর্কে পুরোপুরি অজ্ঞ। তাঁদের কাছে এ তত্ত্বও অগুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ পেশ করছি এ উদ্দেশ্যে, যেন তারা নিঃসন্দেহে জানতে পারেন যে, ইসলামী কোন সন্ন্যাসীর মত বা পাদ্রীর গীর্জার ধর্ম নয়। তা দ্বীন এবং রাষ্ট্র উভয়ই। আকিদা-বিশ্বাস এবং জীবন বিধান- এক সাথে ও অবিচ্ছিন্নভাবে। তা যেমন ইলম- জ্ঞান ও বিদ্যা তেমনি বাস্তব কর্মের বিধানও। তা ইহকাল ও পরকালব্যাপী প্রভাবসম্পন্ন জীবন বিধান। তাতে যেমন স্বাধীনতা স্বীকৃত, তেমনি সুবিচার ও ন্যায়পরতাও কার্যকর তাতে একদিকে অধিকার স্বীকৃত , সঙ্গে সঙ্গে দায়িত্ব ও কর্তব্যও ঘোষিত। আর তার উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত হচ্ছে এ যাকাত ব্যবস্থা। আমি এ গ্রন্থটি উপহার দিচ্ছি দুনিয়ার মুসলিম জাতি সমূহকে- তাদের সমসাময়িক রাষ্ট্র সরকারসমূহে যেন তাঁরা ইসলামী শরীয়াতের ও তার বিবিধ ব্যবস্থার প্রতি নিজেদের কর্তব্য পুনঃনির্ধারণ করতে পারেন। যাকাত তার মধ্যে প্রধান। এ ব্যবস্থা পূর্ণ মাত্রায় কার্যকর হলে তাদের জীবনে বৈপরীত্য ভয়াবহ ও প্রকট হয়ে রয়েছে তা দূরে হয়ে যাবে। তাদের শাসন সংবিধান ও আইন-কানুনের ক্ষেত্র হতে আইনের সাম্রাজ্যবাদ ও বৈদেশিক দাসত্ব দূরীভুত হবে- যেমন তদের ওপর থেকে রাজনৈতিক ও সামরিক সম্রাজ্যবাদ তিরোহিত হয়েছে এবং তথায় ইসলাম পূর্ণমাত্রায় প্রতিষ্ঠিত হবে প্রতিষ্ঠিত হবে তার দ্বীন, তর আইন-কানুন এবং কার্যকর ব্যবস্থাপনারসমূহ। সর্বশেষ আমি এ গ্রন্থখানি উপহার দিচ্ছি ইসলামী ব্যবহারিক আইন-বিধান-ফিকাহ শাস্ত্রে ও ইসলামী সংস্কৃতিতে আত্মনিয়োগকারী লোকদের- যাঁরা ইসলামী ব্যবস্থা বাস্তবায়নে সচেষ্ট। সম্ভবত তাঁরা কুরআন ও সুন্নাতের আলোকে তৈরী এ ফিকহী অধ্যয়নে এমন জিনিস পাবেন যা তাদের ঈমানকে শক্তিও সমৃদ্ধি দান করবে, এ বিশ্বাস তাদের মনে জন্মাবে যে, কালের বিবর্তনের মুকাবিলা করতে দ্বীন-ইসলাম পুরোপুরি সক্ষম, নতুন করে কালের নেতৃত্ব দানও সম্ভব তার পক্ষে। জীবনের গতিকে সত্য, কল্যাণ ও সুবিচারের দিকে ফিরিয়ে নেয়ার যোগ্যতা ও ক্ষমতা পুরোপুরি রয়েছে তর সবুজ শ্যামল সতেজ শরীয়াতের বিধান। তা সর্বকালের ও সকল স্থানের মানুষের জীবনের সমস্যার সমাধান করতে পূর্ণমাত্রায় উপযুক্ততার অধিকারী। (আরবী*************) ---------------

ইসলামের যাকাত বিধান ( ২য় খন্ড )

আল্লামা ইউসূফ আল-কারযাভী

book স্ক্যান কপি ডাউনলোড