যাকাতের হাকীকত

যাকাতের গুরুত্ব

 

নামাযের পর ইসলামের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হচ্ছে যাকাত। সাধারণত নামাযের পরই রোযা উল্লেখ করা হয় বলে অনেকের মনে এ বিশ্বাস জন্মেছে যে, নামাযের পরই বুঝি রোযার স্থান। কিন্তু কালামে পাক থেকে জানা যায় যে, নামাযের পর যাকাতই হচ্ছে সবচেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এ দুটি ইসলামের প্রধান স্তম্ভ-এটা বিধ্বস্ত হয়ে গেলে ইসলামের প্রাসাদও ধূলিসাৎ হয়ে যায়।

 

‘যাকাত’ অর্থ পবিত্রতা এবং পরিচ্ছন্নতা। নিজের ধন-সম্পদের একটি নির্দিষ্ট অংশ গরীব-মিসকীন ও অভাবী লোকদের মধ্যে বন্টন করাকে ‘যাকাত’ বলা হয়। কারণ এর ফলে সমগ্র ধন-সম্পত্তি এবং সেই সাথে তার নিজের আত্মার পরিশুদ্ধি হয়ে থাকে। যে ব্যক্তি আল্লাহ প্রদত্ত ধন-সম্পদ তাঁর বান্দাদের জন্য নির্দিষ্ট অংশ ব্যয় করে না, তার সমস্ত ধন অপবিত্র এবং সেই সাথে তার নিজের মন ও আত্মা পংকিল হতে বাধ্য। কারণ, তার হৃদয়ে কৃতজ্ঞতার নাম মাত্র বর্তমান নেই। তার দিল এতদূর সংকীর্ণ, এতদূর স্বার্থপর, এবং এতদূর অর্থ পিশাচ যে, যে আল্লাহ অনুগ্রত পূর্বক তাকে প্রয়োজনাতিরিক্ত ধন-সম্পদ দান করেছেন তাঁর কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতেও তার মন কুন্ঠিত হয়। এমন ব্যক্তি দুনিয়ায় খালেছভাবে আল্লাহর জন্য কোনো কাজ করতে পারবে, তার দীন ও ঈমান রক্ষার্থে কোনোরূপ আত্মত্যাগ ও কুরবানী করতে প্রস্তুত হতে পারবে বলে মনে করা যেতে পারে কি? কাজেই একথা বলা যেতে পারে যে, যে ব্যক্তি যাকাত আদায় করে না তার দিল নাপাক, আর সেই সাথে তার সঞ্চিত ধন-মালও অপবিত্র, তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।

 

‘যাকাত’ ফরয করে আল্লাহ তাআলা প্রত্যেকটি মানুষকে এক কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন করেছেন। যে ব্যক্তি নিজ ইচ্ছানুক্রমেই প্রয়োজনতিরিক্ত ধন-মাল হতে আল্লাহর নির্দিষ্ট হিস্যা আদায় করে এবং আল্লাহর বান্দাহদের যথাসাধ্য সাহায্য করে, বস্তুত সেই ব্যক্তিই আল্লাহর কাজ করার উপযুক্ত, ঈমানদার লোকদের মধ্যে গণ্য হওয়ার যোগ্যতা তারই রয়েছে। পক্ষান্তরে যার দিল এতদূর সংকীর্ণ যে, আল্লাহর জন্য এতটুকু কুরবানী করতে প্রস্তুত হয় না, তার দ্বারা আল্লাহর কোনো কাজই সাধিত হতে পারে না-সে ইসলামী জামায়াতে গণ্য হবার যোগ্য নয়। প্রকৃতপক্ষে তাকে মানব দেহের একটি পঁচা অংগ মনে করা যেতে পারে, আর পঁচা অংগকে যত শীঘ্র কেটে বিচ্ছিন্ন করা যায় শরীরের অন্যান্য অংগ-প্রত্যংগের পক্ষে ততই মংগল। অন্যথায় সমগ্র দেহেই পচন শুরু হবে। এ জন্যই হযরত মুহাম্মদ (সা) এর ইন্তেকালের পর যখন আরবের কোনো এক গোত্রের লোক যাকাত আদায় করতে অস্বীকার করেছিল, তখন (প্রথম খলীফা) হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহু তাদের বিরুদ্ধে-কাফেরদের বিরুদ্ধে যেমন করতে হয় ঠিক তেমনি-যুদ্ধের কথা ঘোষণা করেছিলেন। অথচ তারা নামায পড়তো, আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূলের প্রতি তাদের ঈমানও বর্তমান ছিল। এত নিসন্দেহে প্রমাণিত হয় যে, যাকাত আদায় না করলে নামায-রোযা ইত্যাদি তার কোনো কাজই আল্লাহর কাছে গৃহীত হতে পারে না, আর এরূপ ব্যক্তির ঈমানদার হওয়ার দাবী করার আদৌ কোনো মূল্য নেই।

 

কুরআন মজীদ থেকে নিঃসন্দেহে জানতে পারা যায়, প্রাচীনকাল থেকে প্রত্যেক নবীর উম্মাতের প্রতিই সমানভাবে নামায ও যাকাত আদায় করার কঠোর আদেশ করা হয়েছিল-দীন ইসলামের কোনো অধ্যায়েই কোনো নবীর সময়ে কোনো মুসলমানকেই নামায ও যাকাত থেকে রেহাই দেয়া হয়নি। হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম এবং তাঁর বংশের নবীদের কথা আলোচনা করার পর কুরআন পাকে বলা হয়েছে:

 

وَجَعَلْنَاهُمْ أَئِمَّةً يَهْدُونَ بِأَمْرِنَا وَأَوْحَيْنَا إِلَيْهِمْ فِعْلَ الْخَيْرَاتِ وَإِقَامَ الصَّلَاةِ وَإِيتَاءَ الزَّكَاةِ ۖ وَكَانُوا لَنَا عَابِدِينَ

 

আমরা তাদেরকে মানুষের নেতা বানিয়েছি, তারা আমাদেরই বিধান অনুযায়ী পরিচালিত করে-পথপ্রদর্শন করে। আমরা ওহীর সাহায্যে তাদেরকে ভালো কাজ করার, নামায কায়েম করার এবং যাকাত আদায় করার আদেশ করেছি, তারা খাঁটিভাবে আমরা ইবাদাত করতো-হুকুম পালন করতো। সূরা আল আম্বিয়া : ৭৩

 

হযরত ইসমাঈল (আ) সম্পর্কে বলা হয়েছে:

 

وَكَانَ يَأْمُرُ أَهْلَهُ بِالصَّلَاةِ ص وَالزَّكَاةِ وَكَانَ عِندَ رَبِّهِ مَرْضِيًّا

 

“তিনি তাঁর লোকদেরকে নামায এবং যাকাত আদায় করার আদেশ করতেন এবং আল্লাহর দরবারে তিনি বিশেষ মর্যাদা সম্পন্ন ছিলেন।” সূরা মরিয়ম : ৫৫

 

হযরত মূসা আলাইহিস সালাম তাঁর নিজের সম্পর্কে দোয়া করেছিলেন- “হে আল্লাহ! এ দুনিয়ায় আমার মঙ্গল দাও, পরকালেও কল্যাণ দান কর।” এর উত্তরে আল্লাহ সূরা আল আরাফের ১৫৬ আয়াতে বলেছিলেন:

 

عَذَابِي أُصِيبُ بِهِ مَنْ أَشَاءُ ۖ وَرَحْمَتِي وَسِعَتْ كُلَّ شَيْءٍ ۚ فَسَأَكْتُبُهَا لِلَّذِينَ يَتَّقُونَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَالَّذِينَ هُم بِآيَاتِنَا يُؤْمِنُونَ

 

 “যাকে ইচ্ছা হবে, তাকে আমার আযাবে নিক্ষেপ করবো। যদিও আমার রহমত সকল জিনিসের ওপরই পরিব্যাপ্ত আছে; কিন্তু তা কেবল সেই লোকদের জন্যই নির্দিষ্ট করবো যারা আমাকে ভয় করবে এবং যাকাত আদায় করবে, আর যারা আমার বাণীর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে।” সূরা আরাফ : ১৫৬

 

হযরত মূসা আলাইহিস সালামের জাতির লোকদের দিল অত্যন্ত সংকীর্ণ ছিল। ধন-সম্পদ লাভের জন্য প্রাণ দিতেও তারা কুণ্ঠিত হতো না। বর্তমানকালের ইয়াহুদীরাই তার বাস্তব উদাহরণ। এজন্য আল্লাহ তাআলা এ মহান সম্মানিত পয়গম্বরের প্রার্থনা উত্তরে স্পষ্ট ভাষায় বলে দিলেন যে, তোমার উম্মাত যথারীতি যাকাত আদায় করলে আমার রহমত পেতে পারবে অন্যথায় পরিষ্কার জেনে রাখ, তারা আমার রহমত হতে নিশ্চয়ই বঞ্চিত হবে এবং আমার আযাব তাদেরকে পরিবেষ্টন করে নেবে। হযরত মূসা (আ) এর পরেও বনী ইসরাঈলগণকে বার বার এ সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে। বার বার তাদের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করা হয়েছে: আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো বন্দেগেী করবে না এবং রীতিমত নামায ও যাকাত আদায় করবে। (সূরা আল বাকারা, রুকূ : ১০)। শেষ পর্যন্ত তাদেরকে সুস্পষ্ট নোটিশ দেয়া হয়েছে এই বলে :

 

وَقَالَ اللهُ اِنِّي مَعَكُمْ لَئِنْ اَقَمْتُمُ الصًّلوةَ وَاتَيْتُمْ الزَّكوةَ وَامْنْتُمْ بِرُسُلِىِ وَعَزَّرتُمُوْهُمْ وَاَقْرَضْتُمْ اللهَ قَرْضًا حَسَنًا لاَّكَفِّرَنَّ عَنْكُمْ سَيَّاتِكُمْ ـ المائِدة : ١٢

 

আল্লাহ বললেন, “হে নবী ইসরাঈল! তোমরা যদি নামায কায়েম কর, যাকাত আদায় করতে থাক, আমার রাসূলদের ওপর ঈমান আন; তাদের সাহায্য কর এবং আল্লাহকে করযে হাসানা দাও, তাহলে আমি তোমাদের সাথী এবং তোমাদের দোষ-ত্রুটিগুলো দূর করে দেব (অন্যথায় রহমত লাভের কোনো আশাই তোমরা করতে পার না)।” সূরা মায়েদা : ১২

 

হযরত রাসূলে করীম (সা) এর পূর্বে হযরত ঈসা আলাইহিস সালামই সর্বশেষ নবী ছিলেন। আল্লাহ তাআলা তাঁকেও একই সাথে নামায এবং যাকাতের হুকুম দিয়েছেন। সূরা মারিয়ামে বলা হয়েছে:

 

وَّجَعَلّنِى مُبرَكًا اَيْنَا مَاكُنْتُ وَاَوْضنِى بَالصَّلوةِ وَالزَّكوْةِ مَادُمْتُ حَيًا ـ مريم : ٣١

 

“আল্লাহ আমাকে মহান করেছেন-যেখানেই আমি থাকি এবং যতদিন আমি জীবিত থাকবো ততদিন নামায পড়া ও যাকাত আদায় করার জন্য আমাকে নির্দেশ করেছেন।” সূরা মরিয়াম : ৩১

 

এ থেকে নিঃসন্দেহে জানতে পারা যায় যে, দীন ইসলাম প্রত্যেক নবীর সময়ই নামায ও যাকাত এ দুটি স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়েছিল। আল্লায় বিশ্বাসী কোনো জাতিকেই এ দুটি কর্তব্য থেকে কখনও নিষ্কৃতি দেয়া হয়নি।

 

হযরত রাসূলে কারীম (সা) এর উপস্থাপিত শরীয়াতে এ দুটি ফরযকে কিভাবে পরস্পর যুক্ত ও অবিচ্ছেদ্য করে দেয়া হয়েছে, তা অনুধাবন যোগ্য। কুরআন পাকের প্রথমেই যে আয়াতটি উল্লেখিত রয়েছে, তা এই :

 

ذَلِكَ الْكِتبُ لاَرَيْبَ فِيْهِ هُدًى لِّلْمُتَّقِيْنَ ـ الَّذِيْنَ يُؤِْنُوْنَ بِالْغِيْبِ وَيُقِيْمُوْنَ الصَّلوةَ وَمِمَّا رَزَقْنَهُمْ يُنْفِقُوْنَ ـ البقرة :

 

٢ -٣

 

“এ কুরআন আল্লাহর কিতাব-এতে কোনো প্রকার সন্দেহের অবকাশ নেই। এটা পরহেযগার, আল্লাহভীরু লোকদেরকে দুনিয়ার জীবনের সঠিক ও সোজা পথপ্রদর্শন করে। পরহেযগার তারাই যারা অদৃশ্যকে বিশ্বাস করে, নামায কায়েম করে এবং আমরা তাদেরকে যে রিয্ক দিয়েছি তা থেকে খরচ করে।” সূরা আল বাকারা: ২-৩

 

অতপর বলা হয়েছেঃ

 

أُوْلَـٰٓٮِٕكَ عَلى هُدًى مِّنْ رَّبِهِمْ وَاُولئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ ـ البقرة : ٥

 

“বস্তুত এরাই রব প্রদত্ত হেদায়াত লাভ করেছে এবং এরাই সফলকাম।” সূরা আল বাকারা : ৫

 

অর্থাৎ যাদের ঈমান নেই এবং নামায ও যাকাত আদায় করে না তারা শুধু আল্লাহর হেদায়াত থেকেই বঞ্চিত নয়, কল্যাণ ও সাফল্য তাদের ভাগ্যে জুটবে না। তারপর এ সূরা আল বাকারা পড়তে পড়তে সামনে এগিয়ে যান, কয়েক পৃষ্ঠা পরই আদেশ হয়েছে:

 

وَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَآتُوا الزَّكَاةَ وَارْكَعُوا مَعَ الرَّاكِعِينَ ـ البقرة : ٤٣

 

“নামায কায়েম কর, যাকাত আদায় কর এবং রুকূ’কারীদের সাথে একত্রিত হয়ে রুকূ কর (জামায়াতের সাথে নামায আদায় কর) । সূরা আল বাকারা : ৪৩

 

অতপর কিছুদূর অগ্রসর হয়ে এ সূরায় বলা হয়েছে:

 

لَيْسَ الْبِرَّ اَنْ تُوْلُّوْا وَجُوْهَكُمْ الْمَشْرِقِ وَالْمَغْرِبِ وَلكِنَّ البِرَّ مَنْ امَنَ بِاللهِ وَالْيُوْمِ الاخِرِ وَالْمَلئِكَةِ وَالْكِتبِ وَالنَّبِيْنَ وَاَتَى الْمَالَ عَلى حُبِّه ذَوِى الْقُرْبى وَالْيَتمى وَالْمَّسْكِيْنَ وَاَبْنَ السَّآئِلِيْنَ وَفِى ارِّقَابِ وَاَقامَ الصَّلوةَ وَاَتَى الزَّكوةَ وَالْمُؤْفُوْنَ بَعَهْدِهِمْ اِذَا عَهدُوْا الرِّقَابِ وَاَقَامَ الصَّلوَةَ وَاَتَى الزَّكوَةَ وَالْمُؤْفُوْنَ بَعَهْدِهِمْ اِذَا عَهدُوْا وَالصَّبِرِيْنَ فِى الْبَاسَآءِ وَالضَّرَّاءِ وَحَيْنَ الْبَاسِ اُوْلئِكَ الَّذِيْنَ صَدَقُوْا وَاُوْلئِكَ هُمْ الْمُتَّقُوْنَ ـ البقرة : ٧ ١٧

 

“পূর্ব কিংবা পশ্চিমমুখী হয়ে দাঁড়ালেই কোনো পূণ্য লাভ হয় না বরং যে ব্যক্তি আল্লাহ, পরকাল, ফেরেশতা, আসমানী কিতাব এবং পয়গাম্বরদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে, আল্লাহর প্রেমে তার অভাবী আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতিম-মিসকীন, পথিক ও প্রার্থীকে নিজেদেরকে ধন-সম্পদ দান করে, অন্য লোকদেরকে তাদের ঋণ, দাসত্ব কিংবা কয়েদ থেকে মুক্তি লাভের ব্যাপারে সাহায্য করে এবং নামায কায়েম করে ও যাকাত আদায় করে, বস্তুত একমাত্র তারাই পূণ্য লাভ করতে পারে। আর যারা প্রতিশ্রুতি পূরণ করে, বিপদ, ক্ষতি-লোকসান এবং যুদ্ধের সময় যারা ধৈর্যধারণ করে আল্লাহর সত্য পথে দৃঢ়তার সাথে দাঁড়িয়ে থাকে, তারাই পূণ্যবান। তারাই খাঁটি মুসলমান, মুত্তাকী ও পরহেযগার।” সূরা আল বাকারা : ১৭৭

 

এরপর সূরা আল মায়েদায় এ সম্পর্কে যা বলা হয়েছে তাও প্রণিধানযোগ্য :

 

اِنَّمَا وَلَيُّكُمُ اللهُ وَرَسُوْلُهُ وَالَّذِيْنَ امَنُوْا الَّذِيْنَ يُقِيْمُوْنَ الصَّلوةَ وَيُؤْتُوْنَ الزَّكوةَ وَهُمْ رِكِعُوْنَ ـ وَمَنْ يَّتَوَلَّ اللهَ وَرَسُوْلَهُ وَالَّذِيْنَ امَنُوْا فِانَّ حِزْبَ اللهِ هُمُ الْغلِبُوْنَ ـ المائِدَة : ٥٥-٥٦

 

“মুসলমান‍‍‍! তোমাদের প্রকৃত বন্ধু সাহায্যকারী হচ্ছে শুধু আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং ঈমানদার লোকগণ মাত্র। ঈমানদার লোক বলতে তাদেরকে বুঝায়, যারা নামায কায়েম কবে, যাকাত আদায় করে এবং আল্লাহর সামনে মাথা নত করে। অতএব যারা আল্লাহ, রাসূল এবং ঈমানদারদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করবে, তারা আল্লাহর দল বলে বিবেচিত হবে এবং আল্লাহর দলই নিশ্চিতরূপে বিজয়ী হবে।”- সূরা মায়েদা : ৫৫-৫৬

 

এ আয়াতে একটি গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতমত, এ আয়াত থেকে জানা গিয়েছে যে, যারা নামায কায়েম করে, যাকাত আদায় করে তারাই মুসলমান। ইসলামের এ দুটি রুকন যে ব্যক্তি যথাযথরূপে আদায় করে না, তার ঈমানদার হওযার দাবী মূলত মিথ্যা। দ্বিতীয়ত, এ আয়াত থেকে একথাও প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ, রাসূল এবং ঈমানদার লোকগণ একটি দলভুক্ত। অতএব ঈমানদার ব্যক্তিগণের অন্যান্য সকল প্রকার সম্পর্ক ছিন্ন করে এ পার্টিতে শামিল হতে হবে। এ দলের বাইরের কোনো ব্যক্তিকে সে পিতা হোক, ভাই হোক, পুত্র হোক, প্রতিবেশী, স্বদেশবাসী কিংবা অন্য যে কেউ হোক না কেন- কোনো মুসলমান যদি তাকে নিজের বন্ধুরূপে গ্রহণ করে এবং তার সাথে ভালোবাসা ও সহানুভূতির সম্পর্ক স্থাপন করে তাহলে আল্লাহ তাআলা যে তার প্রতি সহানুভূতিশীল হবে, এমন আশা কিছুতেই করা যেতে পারে না। সর্বশেষে এ আয়াত থেকে একথাও জানা গেল যে, ঈমানদার লোকগণ দুনিয়ায় কেবল তখনই জয়ী হতে পারে যখন তারা একনিষ্ঠ হয়ে শুধু আল্লাহ, রাসূল এবং ঈমানদার লোকদেরকেই নিজেদের পৃষ্ঠপোষক, বন্ধু, সাহায্যকারী এবং সাথী হিসেবে গ্রহণ করবে।

 

আরও খানিকটা অগ্রসর হয়ে তাওবায় আল্লাহ তাআলা মুসলমানদেরকে কাফের ও মুশরিকদের বিরুদ্ধে লড়াই করার নির্দেশ দিয়েছেন এবং ক্রমাগত কয়েক রুকূ পর্যন্ত এ যুদ্ধ সম্পর্কে হেদায়াত দিয়েছেন। এ প্রসংগে বলা হয়েছে:

 

فَاِنْ تَابُوْا وَاَقَامُوْا الصَّلوةَ وَاتَوُا الزَّكوةَ فَاِخْوَانَكُمْ فِىْ الدِّيْنِ ـ

 

“তারা যদি কুফর ও শিরক থেকে ‘তাওবা’ করে খাঁটিভাবে ঈমান আনে এবং নামায কায়েম করে ও যাকাত আদায় করে তবে তারা তোমাদের দীনি ভাইয়ে পরিণত হবে।”- সূরা আত তাওবা : ১১

 

অর্থাৎ শুধু কুফর ও শিরক থেকে ‘তাওবা’ করা এবং ঈমান আনার কথা প্রকাশ করাই যথেষ্ঠ নয়, সে যে কুফর ও শিরক থেকে তাওবা করেছে এবং প্রকৃতপক্ষেই ঈমান এনেছে, তার প্রমাণের জন্য যথারীতি নামায আদায় করা এবং যাকাত দেয়াও অপরিহার্য। অতএব, তারা যদি তাদের এরূপ বাস্তব কাজ দ্বারা একথার প্রকাশ পেশ করে, তাহলে নিশ্চয়ই তারা তোমাদের দীনি ‘ভাই’, অন্যথায় তাদেরকে ভাই মনে করা তো দূরের কথা, তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধও বন্ধ করা যাবে না। এ সূরায় আরও স্পষ্ট করে বলা হয়েছে:

 

وَالْمُؤْمِنُوْنَ وَالْمُؤْمِنتُ بَعْضُهُمْ اَوْلِيْآَءُ بَعْضٍ يَامُوْرُونَ بِامُرُوْنَ بَالْمَعْرُوْفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَيُقِيْمُوْنَ الصَّلوةَ وَيُؤْتُوْنَ الزَّكوةَ وَيُطِيْعُوْنَ اللهَ وَرَسُوْلَهُ اُوْلئِكَ سَيَرْحَمُهُمُ اللهُ ـ التوبية : ٧١

 

“ঈমানদার পুরুষ এবং ঈমানদার স্ত্রীলোকেরাই প্রকৃতপক্ষে পরস্পর পরস্পরের বন্ধু ও সাহায্যকারী। এদের পরিচয় এবং বৈশিষ্ট্য এই যে, এরা নেক কাজের আদেশ দেয়, অন্যায় ও পাপ কাজ থেকে বিরত রাখে, নামায কায়েম করে এবং যাকাত আদায় করে, আল্লাহ ও রাসূলের বিধান মেনে চলে। প্রকৃতপক্ষে এদের প্রতিই আল্লাহ রহমত বর্ষণ করবেন।” সূরা আত তাওবা : ৭১

 

অন্য কথায় কোনো ব্যক্তি যতক্ষণ পর্যন্ত ঈমান এনে কার্যত নামায ও যাকাত আদায় না করবে, ততক্ষণ সে মুসলমানদের দীনি ভাই রূপে পরিগণিত হতে পারবে না। বস্তুত ঈমান, নামায ও যাকাত এই তিনটি জিনিসের সমন্বয়েই ঈমানদার লোকদের জামায়াত গঠিত হয়। যারা এ কাজ যথারীতি করে, তারা এ পাক জামায়াতের অন্তর্ভূক্ত এবং তাদেরই পরস্পরের মধ্যে বন্ধুত্ব, ভালবাসা ও সহানুভূতির সম্পর্ক স্থাপিত হবে। আর যারা এ তিনটি কাজ করে না, তারা এ জামায়াতের অন্তর্ভূক্ত নয়। তাদের নাম মুসলমানদের ন্যায় হলেও ইসলামী জামায়াতের মধ্যে শামিল হতে পারে না। এখন তাদের সাথে বন্ধুত্ব, প্রেম ও ভালবাসার সম্পর্ক স্থাপন করলে আল্লাহর আইন ভংগ করা এবং তাতে আল্লাহর পার্টির শৃংখলা নষ্ট করা হবে। তাহলে এসব লোক দুনিয়ায় জয়ী হয়ে থাকার আশা কি করে করতে পারে?

 

আরও সামনে অগ্রসর হলে সূরা হজ্জ-এ দেখা যায়, আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন:

 

وَلَيَنْصُرَنَّ اللهُ مَنْ يَّنْصُرُهُ اِنَّ اللهَ لَقَوِي عَزِيْزٌ ـ اَلَّذِيْنَ اِنْ مَّكَّنّهُمْ فِى الاَرْضِ اَقَامُوْا الصَّلوةَ وَاَتَوُا الزَّكوةَ وَاَمَرُوْنَ بِالْمَعْرُوْفِ وَنَهَوْا عَنِ الْمُنْكَرِۗ وَلِلهِ عَاقِبَةُ الاُمُوْرِ ـ الحج ـ ٤٠-٤١

 

“যে আল্লাহর সাহায্য করবে, আল্লাহ নিশ্চয়ই তার সাহায্য করবেন। আল্লাহ তাআলা বড়ই শক্তিশালী এবং সর্বজয়ী। (আল্লাহর সাহায্য তারাই করতে পারে) যাদেরকে রাষ্ট্র ক্ষমতা দান করলে তারা নামায আদায়ের (সামাজিক) ব্যবস্থা কায়েম করবে এবং সামগ্রিকভাবে যাকাত আদায় করবে, লোককে সৎকাজের আদেশ করবে এবং অসৎ ও অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখবে। বস্তুত সকল জিনিসের পরিণাম আল্লাহর ওপরই নির্ভর করে।”- সূরা আল হজ্জ : ৪০-৪১

 

বনী ইসরাঈলদের ইতিপূর্বে যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, এ আয়াতে মুসলমানদেরকেও ঠিক সেই নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ইতিপূর্বে বনী ইসরাঈলদেরকে বলা হয়েছিল যে, তারা যতদিন নামায কায়েম করবে ও যাকাত আদায় করবে এবং নবীদের কাজে সাহায্য করতে থাকবে অর্থাৎ আল্লাহর আইন জারি করবে, ততদিন আল্লাহ তাদের সাথী ও সাহায্যকারী থাকবেন। আর যখন এ কাজ ত্যাগ করবে, তখনই আল্লাহ তাদের প্রতি সকল সাহায্য বন্ধ করে দেবেন। ঠিক একথাই এ আয়াতে মুসলমানদেরকে বলা হয়েছে। আল্লাহ তাদেরকে পরিষ্কার বলে দিয়েছেন যে, দুনিয়ার শক্তি লাভ করে যদি তারা নামায আদায়ের সামাজিক ব্যবস্থা এবং যাকাত আদায়ের সামগ্রিক পন্থা প্রতিষ্ঠা করে আর ভালো কাজের প্রচার ও মন্দ কাজের প্রতিরোধ করে, তাহলে আল্লাহ তাদের সাহায্যকারী হবেন। বস্তুত, আল্লাহ অপেক্ষা শক্তিমান সাহায্যকারী আর কেউ হতে পারে না। কিন্তু মুসলমান যদি নামায ও যাকাত আদায় করা পরিত্যাগ এবং দুনিয়ার শক্তি লাভ করে সৎকাজের পরিবর্তে অসৎকাজের প্রচার করে, অন্যায়কে নির্মূল না করে সৎকাজের পথ বন্ধ করতে থাকে, আল্লাহর কালেমাকে বিজয়ী করার পরিবর্তে নিজেদের প্রভুত্ব কায়েম করতে শুরু করে আর কর আদায় করে নিজেদের জন্য দুনিয়ার বুকে স্বর্গ রচনা করাকে রাজত্বের একমাত্র উদ্দেশ্য বলে মনে করে, তাহলে আল্লাহর সাহায্য তাদের ভাগ্যে কখনো জুটবে না। তারপর শয়তানই হবে তাদের সাহায্যকারী। ভাবতে অবাক লাগে, এটা কত বড় শিক্ষার কাজ! বনী ইসরাঈল আল্লাহ প্রদত্ত এ বাণীকে অমূলক ও মৌখিক মাত্র মনে করেছিল। ফলে তার বিপরীত কাজ করতে তাদেরকে দুনিয়ার দিকে দিকে অপমানিত ও লাঞ্ছিত হয়ে ঘুরে মরতে হচ্ছে। বিভিন্ন স্থান থেকে তাদেরকে বহিষ্কার করা হচ্ছে, কোথাও তারা স্থায়ীভাবে আশ্রয় লাভ করতে পারছে না। এরা দুনিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ ধনী সম্প্রদায়, কোটি কোটি টাকা তাদের ভান্ডারে স্তুপীকৃত হয়ে আছে, কিন্তু এ টাকা তাদের কোনো কাজেই লাগছে না। নামাযের পরিবর্তে অসৎকাজ এবং যাকাতের বদলে সুদখোরীর অভিশপ্ত পন্থাকেই অবলম্বন করে তারা একদিকে নিজেরা আল্লাহর কাছে অভিশপ্ত হচ্ছে, অপর দিকে তারা প্লেগের ইঁদুরের ন্যায় দুনিয়ার দিকে দিকে এ অভিশাপ সংক্রমিত করে ফিরছে। মুসলমানদেরকেও এ হুকুমই দেয়া হয়েছে। কিন্তু মুসলমানগণ সে দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে নামায আদায় ও যাকাতদানের ক্ষেত্রে উদাসীন হয়েছে এবং আল্লাহ প্রদত্ত শক্তি প্রয়োগ করে সত্য প্রচার এবং মিথ্যা ও অন্যায় প্রতিরোধের দায়িত্ব পালন করা ভুলে বসেছে। আর এর তিক্ত ফলও তারা নানাভাবে ভোগ করেছে। (দুনিয়ার শ্রেষ্ঠতম ও মহাশক্তিধর) রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা থেকে তাদেরকে বঞ্চিত করা হয়েছে। সমগ্র দুনিয়ায় তারা সকল যালেম শক্তির নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। তারা দুর্বল ও পরাভূত। নামায ও যাকাত ত্যাগ করার কুফল তো দেখলেন। এখন এদের (বনী ইসরাঈলদের মধ্যে) এমন একটি দল সৃষ্টি হয়েছে যারা মুসলমানদের মধ্যে লজ্জাহীনতা, অশ্লীলতা, পর্দাহীনতা এবং কুৎসিত কাজের প্রবর্তন করতে বদ্ধপরিকর। তারা মুসলমানদেরকে বলছে, “তোমাদের আর্থিক অসচ্ছলতা দূর করতে হলে ব্যাংক ও ইন্সুরেন্স কোম্পানী খুলে পেট ভরে সুদ খাও।” কিন্তু সত্য কথা এই যে, মুসলমানগণও যদি এতেই লিপ্ত হয়ে থাকে, তবে তাদেরকেও ইয়াহুদীদের ন্যায় চরম লাঞ্ছনার এক কঠিন বিপদে নিক্ষেপ করা হবে এবং চিরন্তন অভিশাপে অভিশপ্ত হবে।

 

যাকাত কি জিনিস এতে আল্লাহ তাআলা কত বড় শক্তি নিহিত রেখেছেন, যদিও মুসলমানগণ এটাকে একটি অতি সাধারণ জিনিস বলে মনে করছে, অথচ তাতে যে কত বিরাট লাভের সম্ভবনা রয়েছে এসব বিষয়ে পরবর্তী প্রবন্ধগুলোতে আমি বিস্তারিত আলোচনা করবো, এ প্রবন্ধটিতে আমি শুধু একথাই বলতে চাচ্ছি যে, নামায ও যাকাত ইসলামের একান্ত বুনিয়াদী জিনিস। ইসলামে এ দুটির গুরুত্ব এত অধিক যে, এটা যেখানে নেই সেখানে আর যাই থাক, ইসলাম যে নেই তা সন্দেহতীত। অথচ অনেক মুসলমান আজ নামায কায়েম না করে এবং যাকাত আদায় না করেও মুসলমান হিসেবে গণ্য হতে চায় এবং তাদের তথাকথিত কিছু ধর্মগুরুও এ বিষয়ে তাদেরকে নিশ্চয়তা দান করেছে। কিন্তু কুরআন তাদের দাবীর তীব্র প্রতিবাদ করে। মানুষ যদি কালেমায় তাইয়্যেবা পড়ে তার সত্যতা প্রমাণের জন্য নামায এবং যাকাত আদায় না করে, তাহলে কুরআনের দৃষ্টিতে তার এ কলেমা পড়া একেবারেই অর্থহীন। এজন্যই হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু যাকাত দিতে অস্বীকারকারী ব্যক্তিদের কাফের মনে করে তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেছিলেন। যারা আল্লাহ ও রাসূলকে মানে এবং নামাযও পড়ে তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা জায়েয কিনা সাহাবায়ে কেরামের মনে তখন এ সন্দেহ জাগ্রত হয়েছিল। কিন্তু যখন হযত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু যাকে আল্লাহ তাআলা নবুয়াতের কাছাকাছি সম্মান দান করেছিলেন-সুদূঢ়ভাবে ঘোষণা করলেন : আল্লাহর শপথ, রাসূলে কারীম (সা) এর জীবন যারা যাকাত দিত, আজ যদি কেউ তার উট বাঁধার একটি রশিও দিতে অস্বীকার করে, তবে তার বিরুদ্ধে আমি অস্ত্র ধারণ করবো। শেষ পর্যন্ত সকল সাহাবীই একথার যৌক্তিকতা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন এবং সকলে একমত হয়ে ঘোষণা করলেন যে, যারা যাকাত দিবে না তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা অপরিহার্য। কুরআন শরীফ সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছে যে, যাকাত না দেয়া কেবল পরকালে অবিশ্বাসী মুশরিকদেরেই কাজ:

 

وَوَيْلٌ لِّلْمُشْرِكِيْنَ ـ الًّذِيْنَ لاَيُؤْتُوْنَ الزَّكوَةَ وَهُمْ بِالاخِرَةِ هُمْ كفِرُوْنَ ـ

 

“যেসব মুশরিক যাকাত দেয় না, যারা আখেরাতকে অস্বীকার করে, তাদের ধ্বংস অনিবার্য।”- সূরা হা-মীম-আস-সাজদা : ৬-৭

 

যাকাতের মর্মকথা

 

পূর্বে বলা হয়েছে, নামাযের পর ইসলামের সর্বপ্রধান রুকন হচ্ছে যাকাত। আর তার গুরুত্ব এতবেশী যে, নামাযকে অস্বীকার করলে যেমন কাফের হতে হয়, অনুরূপভাবে যাকাত দিতে অস্বীকার করলে তাকে শুধু কাফেরই হতে হয় না, সমস্ত সাহাবায়ে কেরাম একমত হয়ে তার রিরুদ্ধে জিহাদও করেছেন।

 

এখানে আমি যাকাতের প্রকৃত রূপ এবং এর অর্ন্তনিহিত তত্ত্ব আলোচনা করতে চেষ্টা করবো। যাকাত মূলত কি জিনিস এবং ইসলাম এর এতবেশী গুরুত্ব দেয় কেন তা আলোচনা থেকে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠবে।

 

আমাদের মধ্যে অনেক লোকই যার তার সাথে বন্ধুত্ব সম্পর্ক স্থাপন করে থাকে। অথচ কাউকে বন্ধু বলে স্বীকার করার সময়ে সে বাস্তবিকই বন্ধুত্বের ব্যাপারে তারা প্রায়ই প্রতারিত হয়ে থাকে। পরে তাদের বড় দু:খ এবং অনুতাপ করতে হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে যারা বুদ্ধিমান তারা যাদের সাথে মেলামেশা করে তাদেরকে খুব ভালো করে যাচাই ও পরীক্ষা করে নেয় এবং পরীক্ষার ভিতর দিয়ে যাদেরকে তারা খুব ভালো লোক, নির্ভরযোগ্য, নিষ্ঠাবান ও বিশ্বাসভাজন বলে মনে করে, কেবল তাদের সাথেই বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্থাপন করে, আর অন্যান্যের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে।

 

আল্লাহ তাআলা সর্বশ্রেষ্ঠ বুদ্ধিমান ও সর্বাভিজ্ঞ। তিনি যাকে তাকে নিজের বন্ধু বানাবেন, নিজের দলভুক্ত করে নিবেন এবং তাঁর দরবারে সম্মান ও নৈকট্যের মর্যাদা দান করবেন তা কি করে আশা করা যেতে পারে? সাধারণ বুদ্ধিমান মানুষ যখন পরীক্ষা ও যাচাই না করে কারো সাথে বন্ধুত্ব করতে রাযী হয় না, তখন সকল জ্ঞান ও বুদ্ধির একচ্ছত্র অধিকারী আল্লাহ তাআলা খুব ভালভাবে যাচাই ও পরীক্ষা না করে কাউকে বন্ধু বলে স্বীকার করতে পারেন না। দুনিয়ায় এই যে কোটি কোটি মানুষ ইতস্তত ছড়িয়ে রয়েছে, যাদের মধ্যে ভাল-মন্দ সকল প্রকার মানুষই রয়েছে, নির্বিচারে ও নির্বিশেষে এদের সকলকেই আল্লাহর দলে শামিল করে নেয়া সম্ভব নয়। তাই আল্লাহ তাআলা যাদেরকে দুনিয়ায় তাঁর খলীফা বানাতে এবং আখেরাতে তাঁর নৈকট্য দান করতে চান, তাদেরকে সুনির্দিষ্ট মানদন্ডে বিশেষ পরিস্থিতি ও পরীক্ষার ভিতর দিয়ে যাচাই করে নিতে চান। যাঁরাই সেই পরীক্ষায় যথাযথাভাবে উত্তীর্ণ হবেন, তাঁরাই আল্লাহর দলে গণ্য হতে পারবেন, আর যারা তা পারবে না তারা নিজেরাই তা থেকে দূরে সরে যাবে এবং তারা পরিষ্কাররূপে জানতে পারবে যে, তারা আল্লাহর দলে শামিল হবার যোগ্যতা প্রমাণ করতে সমর্থ হয়নি। মানুষের পরীক্ষা করার সেই কষ্টি পাথরটি কি? আল্লাহ নিজে যেহেতু সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান তাই তিনি সর্বপ্রথম মানুষের বুদ্ধি-জ্ঞানকেই পরীক্ষা করতে চান। মানুষের মধ্যে বুদ্ধিমত্তা কিছু আছে কিনা, না নিরেট নির্বোধ তা তিনি বিশেষভাবে লক্ষ্য করে থাকেন। কারণ নির্বোধ লোকেরা কখনও বুদ্ধিমান ও জ্ঞানী ব্যক্তিদের বন্ধু হতে পারে না। (আর মূর্খ ও নির্বোধ লোকেরা তো কিছুতেই এবং কখনই আল্লাহর বন্ধু হতে পারে না।) আল্লাহর অস্তিত্বের নিশানা দেখে যে বুঝতে পারে যে, তিনিই আমার মালিক ও সৃষ্টিকর্তা, তিনি ছাড়া কোনো মাবুদ কোনো পরোয়ারদিগার, দোয়া শ্রবণকারী এবং সাহায্যকারী আর কেউ নেই। আল্লাহর কালাম দেখ যে তাকে আল্লাহর কালাম বলেই চিনতে পারে এবং তা অন্য কারো কালাম হতে পারে না বলে দৃঢ়রূপে বিশ্বাস করে, সত্য নবী এবং মিথ্যা নবীদের জীবন চরিত, কাজ-কর্ম ও শিক্ষা-দীক্ষার মৌলিক পার্থক্য সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারে এবং নবী হওয়ার দাবীদারগণের মধ্যে প্রকৃত নবীকে আল্লাহর প্রেরিত নবী এবং সত্যের পথ নির্দেশকারী নবী বলে চিনতে পারে, আর মিথ্যা নবীকে দাজ্জাল ও প্রতারক বলে চিহ্নিত করতে পারে সেই ব্যক্তিরই এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার যোগ্যতা রয়েছে। আল্লাহ তাআলা তাকে লক্ষ কোটি লোকের মধ্যে থেকে বেছে নিয়ে নিজের দলের মনোনীত প্রার্থীদের মধ্যে গণ্য করেন। অবশিষ্ট যারা প্রথম পরীক্ষায় ব্যর্থ হয় তাদেরকে তিনি পরিত্যাগ করেন।

 

এ প্রথম পরীক্ষায় যে সকল প্রার্থী উত্তীর্ণ হয় তাদেরকে অতপর দ্বিতীয় পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়। দ্বিতীয়বারে মানুষের বুদ্ধির সাথে সাথে তার নৈতিক চরিত্র বলেরও যাচাই করা হয়। সত্য এবং পূণ্য কাজের পরিচয় লাভ করে তা গ্রহণ করা এবং তদনুযায়ী কাজ করা এবং অন্যায় ও পাপ কাজের পরিচয় লাভ করার পর তা পরিত্যাগ করার যোগ্যতা ও শক্তি তার আছে কিনা তা জেনে নেয়া এ পরীক্ষার উদ্দেশ্য। যাচাই করে দেখা হয় যে, এ ব্যক্তি নিজের প্রবৃত্তির দাস, বাপ-দাদার অন্ধ অনুসারী এবং পারিবারিক প্রথা এ দুনিয়ার সাধারণ রীতিনীতির গোলাম তো নয়? একটি কাজকে আল্লাহর বিধানের বিপরীত জেনে এবং তাকে খারাপ মনে করেও তার মধ্যে লিপ্ত থাকার মত দুর্বলতা তার মধ্যে নেই তো? পক্ষান্তরে একটি জিনিসকে আল্লাহর মনোনীত এবং সত্য জেনে তা গ্রহণ করার মনোবল আছে কিনা তাও যাচাই করা হয়। এ পরীক্ষায়ও যারা বিফল হয় তাদেরকে আল্লাহর দলভুক্ত করা হয় না। আল্লাহর দলভুক্ত কেবল তারাই হতে পারে, যাদের সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেছেন:

 

فَمَنْ يَّكْفُرْ بِالطَّاغُوْتِ وَيُؤْمِنْ بِاللهِ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرُوةِ الْوُثقى لاَ اَنْفِصَامَ لَهَا ـ

 

অর্থাৎ আল্লাহর বিধানের বিরোধী বিধান ও পথ এবং বিধানদাতাকে যারা সাহসের সাথে পরিত্যাগ করে-সেই ব্যাপারে কারো পরোয়া করে না এবং নির্ভীকভাবে কেবল আল্লাহর দেয়া বিধান অনুসারেই জীবন যাপন করতে প্রস্তুত হয়-তাতে কেউ খুশী হোক আর নারায হোক সেই দিকে মাত্রই ভ্রুক্ষেপ করে না, তারা একটি মজবুত জিঞ্জির দৃঢ়তার সাথে ধারণ করে নিয়েছে যা কখনো ছিড়বে না।

 

এ পরীক্ষায় যারা উত্তীর্ণ হয় তাদেরকে তৃতীয় পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হতে হয়। একবার পরীক্ষা হয় আল্লাহর অনুসরণ ও আনুগত্য স্বীকারের প্রবণতার। এই সময়ে হুকুম দেয়া হয় যে, আমার তরফ থেকে যখনই কোনো নির্দেশ দেয়া হবে, তখনই তোমরা নিদ্রা ত্যাগ করে আমার সামনে হাজির হবে; কাজ-কর্ম পরিত্যাগ করে, নিজের স্বার্থ ও মন:পুত কাজ ছেড়ে, আনন্দ আর খুশী ত্যাগ করে আসবে এবং নির্দিষ্ট কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করবে, গ্রীষ্ম হোক, শীতহোক-যাই হোক না কেন, সকল সময়েই ডাক শোনা মাত্র হাজির হবে-সকল দু:খ-কষ্ট সহ্য করে আমার দরবারে উপস্থিত হবে এবং কর্তব্য পালন করবে। আবার যখন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পানাহার না করতে বলবো এবং নফসের খাহেশ পূরণ করতে নিষেধ করবো, তখন তোমাকে এ হুকুম পুরোপুরি পালন করতে হবে, ক্ষুধা-তৃষ্ণায় যত দু:সহ কষ্টই হোক না কেন; আর যত সুমিষ্ট পানীয়, স্বুস্বাদু খাদ্য তোমার সামনে স্তুপীকৃত হোক না কেন। এই পরীক্ষায় যারা অনুত্তীর্ণ হয় তাদেরকেও বলে দেয়া হয়, তোমাদের দ্বারা আমার কাজ সম্পন্ন হতে পারে না। আর তৃতীয় পরীক্ষায়ও যারা উত্তীর্ণ হয় কেবল তাদেরকেই নির্বাচন করা হয়। কারণ এদের সম্পর্কেই এ আশা করা যেতে পারে যে, আল্লাহর তরফ থেকে যে বিধান নাযিল করা হবে তাই তারা গোপনে ও প্রকাশ্যে স্বার্থ এবং লাভ, সুখ ও দু:খ-কষ্ট সকল অবস্থায়ই যথাযথরূপে পালন করতে পারবে।

 

অতপর চতুর্থ পরীক্ষা নেয়া হয় মানুষের ধন-সম্পদ কুরবানী করার। তৃতীয় পরীক্ষায় উত্তীর্ণ লোকগণও আল্লাহর কর্মচারী পদে স্থায়ীভাবে নিযুক্ত হওয়ার যোগ্য প্রমাণিত হতে পারেনি। কেননা তাদের দিল ছোট, সংকীর্ণ, হীন সাহস ও বীর্যহীন এবং নীচ কিনা-মুখে বন্ধুত্ব ও ভালবাসার বড় বড় দাবী করার লোক তো অসংখ্য পাওয়া যায়, কিন্তু বন্ধুর ও ভালবাসার বড় বড় দাবী করার লোক তো অসংখ্য পাওয়া যায়, কিন্তু বন্ধুর খাতিরে পকেটের পয়সা খরচ করতে প্রস্তুত কিনা, তার পরীক্ষা নেয়া এখনও বাকী রয়েছে। তারা তো সেই সকল লোকদের মত নয় যারা মুখে মুখে মা মা করে ভক্তিতে গদগদ এবং সেই মায়ের জন্য দাংগা করতেও পিছপা নয়, কিন্তু সেই মা যখন জন্তুর বেশে শস্যক্ষেত্র প্রবেশ করে তখন লাঠি নিয়ে তাকে তাড়িয়ে দেয়-পিটিয়ে ছাল উঠিয়ে দেয়। এমন স্বার্থপর, অর্থপূজারী সংকীর্ণমনা ব্যক্তিকে কোনো সাধারণ বুদ্ধির মানুষও নিজের বন্ধু বলে গ্রহণ করতে পারে না। আর বড় উদার আত্মা বিশিষ্ট লোকও এমন ব্যক্তিকে নিজের কাচে কোনোরূপ মর্যাদা দিতেও প্রস্তুত হবে না। তাহলে যে মহান আল্লাহর দেয়া ধন-সম্পদ আল্লাহরই পথে খরচ করতে প্রস্তুত করতে পারেন, যে আল্লাহর দেয়া ধন-সম্পদ আল্লাহরই পথে খরচ করতে প্রস্তুত নয়? আর যে আল্লাহ এতবড় বুদ্ধিমান এবং বিজ্ঞ তিনি কেমন করে এমন ব্যক্তিকে নিজের দলভুক্ত করতে পারেন, যার বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা মৌখিক জমা-খরচ মাত্র এবং যার ওপর কোনো কাজেই বিন্দুমাত্র ভরসা করা যায় না? কাজেই এ চতুর্থ পরীক্ষায় যারা ব্যর্থ হয় তাদেরকেও পরিষ্কার বলে দেয়া হয় যে, আল্লাহর দলে তোমাদের কোনো স্থান নেই, তোমরাও অকর্মণ্য-আল্লাহর খলীফার ওপর যে বিরাট দায়িত্ব অর্পণ করা হয় তা পালন করার যোগ্যতা তোমাদের নেই। এ দলে কেবল তাদেরকেই শামিল করা যেতে পারে যারা আল্লাহর ভালোবাসায় জীবন-প্রাণ ধন-সম্পদ, সন্তান-সন্ততি, বংশ-পরিবার, দেশ-সবকিছুর ভালবাসাকে অকুন্ঠিত চিত্তে কুরবান করতে পারে:

 

لَنْ تَنَالُوْا الْبِرَّ حَتّى تُنْفِقُوْا مِمَّا تُحِبُّوْنَ ـ ال عمران : ٩٢

 

“তোমরা নিজ নিজ প্রিয় জিনিসগুলো যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহর উদ্দেশ্যে ব্যয় না করবে ততক্ষণ পর্যন্ত তোমরা পুণ্য ও মহত্বের উচ্চতম মর্যাদা লাভ করতে পারবে না।”- সূরা আলে ইমরান : ৯২

 

আল্লাহর এ দলে সংকীর্ণমনা লোকদের কোনোই স্থান নেই, কেবল উদার উন্নত হৃদয়বান ব্যক্তিরাই এই দলে শামিল হতে পারে।

 

وَمَنْ يُّوْقَ شُحَّ نَفْسِه فَأُوْلئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ ـ التغابن : ١٦

 

“মনের সংকীর্ণতা এবং কৃপণতাকে যারা অতিক্রম করতে পেরেছে কেবল তারাই সর্বাঙ্গীন কল্যাণ লাভ করতে পারে।”- সূরা আত তাগাবুন: ১৬

 

আল্লাহর দলে কেবল এমন লোকদের ভর্তি করা যেতে পারে, যারা কেউ তাদের শত্রুতা করলেও, তাদেরকে দু:খ দিলেও, তাদের ক্ষতিসাধন করলেও এবং তাদের কলিজাকে টুকরো কুকরো করলেও-কেবলমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যেই তারা পেটের খাদ্য এবং পরণের কাপড় দিতে অস্বীকার করবে না এবং বিপদের সময় তার সাহায্য করতেও কুণ্ঠিত হবে না:

 

وَلاَ يَاتَلِ اُوْلُوْا الْفَضْلِ مِنْكُمْ وَالسَّعَةِ اَنْ يُّؤْتُوْا اُوْْلِى الْقُرْبى وَالْمَسكِيْنَ وَالْمُهجِرِيْنَ فِى سَبِيْلِ اللهِ وَلْيَعْفُوا وَاْيَصْفَحُوْا اَلاَ تَحِبُّوْنَ اَنْ يَّغْفِرَ اللهُ لَكُمْ وَ اللهُ غَفُوْرٌ رَّحِيْمٌ ـ النور : ٢٢

 

“তোমাদের মধ্যে যারা বড় এবং সংগতি সম্পন্ন লোক তারা যেন নিজেদের প্রিয়জনদের, নিকটাত্মীয়দের, গরীব-দু:খীদের এবং আল্লাহর পথে হিজরতকারীদের (কোনো অপরাধের জন্য বিরক্ত হয়ে তাদেরকে) সাহায্য দান বন্ধ না করে। বরং তাদেরকে মাফ করে দেয়াই বাঞ্ছনীয়। আল্লাহ তোমাদের মাফ করে দেন তা কি তোমরা দাও না? অথচ আল্লাহ তাআলা সবচেয়ে বড় ক্ষমাশীল এবং দয়াবান।”১- সূরা আন নূর : ২২

 

এ দলে এমন লোকদের আবশ্যক, যারা আল্লাহর দেয়া ধন-সম্পদ থেকে বেছে বেছে ভাল ভাল জিনিস আল্লাহর জন্যই খরচ করে:

 

يَآ يُّهَا الَّذِيْنَ امَنُوْا اَنْفِقُوْا مِنْ طَيِّبتِ مَاكَسَبْتُمْ وَمِمَّا اَخْرَجْنَا لَكُمْ مِّنْ الاَرْضِ وَلاَ تَيْمَّمُوْا الْخَبِيْثَ مِنْهُ تُنْفِقُوْنَ ـ الرقرة : ٢٦٧

 

“হে ঈমানদারগন! তোমরা নিজেরা যে ধন-সম্পত্তি উপার্জন করেছ এবং আমি তোমাদের জন্য যমীন থেকে যে রিযক দিয়েছি তা থেকে ভাল ভাল সামগ্রী (আল্লাহর পথে) ব্যয় কর। খারাপ দ্রব্য থেকে কিছু সেই পথে খরচ করো না।”- (সূরা আল বাকারা : ২৬৭)

 

১. হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর জনৈক প্রিয় লোক যখন তাঁর কন্যা হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার চরিত্র সম্পর্কে অপবাদ দেয়ার ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করেছিল এবং হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু তার প্রতি অসন্তষ্ট হয়ে তার আর্থিক সাহায্য বন্ধ করে দিয়েছিলেন তখন এই আয়াতটি নাযিল হয়। আয়াতটি নাযিল হওয়ার সাথে সাথে তিনি কম্পিত ও ভীত হয়ে বললেন : আমি আল্লাহর দরবারে ক্ষমা চাই এবং তখনই তিনি সেই লোকটির আর্থিক সাহায্য পুনরায় জারি করলেন।

 

এখানে এমন বড় আত্মার লোকদের আবশ্যক, যারা নিজেদের অভাব-অনটন, দারিদ্র ও রিক্ততার দু:সহ অবস্থায় নিজেদের অপরিহার্য প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও আল্লাহর পথে অর্থ ব্যয় করাকে তারা নিষ্ফল মনে করবে না। বরং তারা একান্তভাবে বিশ্বাস করবে যে, আল্লাহর পথে যা কিছু খরচ করা যায়, দুনিয়া এবং আখেরাত তিনি তার উত্তম ফল দান করবেন। এজন্য তারা কেবল আল্লাহর সন্তোষ লাভের উদ্দেশ্যেই খরচ করে। তাদের এ দানশীলতার কথা দুনিয়ার প্রচার হোক না হোক কিংবা কেউ তার দানের শুকরিয়া আদায় করুক বা না করুক সে দিকে কিছুমাত্র ভ্রুক্ষেপ করে না:

 

وَمَا تُنْفِقُوْا مِنْ خَيْرٍ فَلاَنْفُسِكُمْ وَمَا تُنْفِقُوْنَ اِلاَّ ابْتِغَاءَ وَجْهِ اللهِ وَمَا تُنْفِقُوْا مِنْ خَيْرٍ يُّوْفَّ اِلَيْكُمْ وَاَنْتُمْ لاَتُظْلَمُوْنَ ـ البقرة : ٢٧٢

 

“তোমরা আল্লাহর পথে যা কিছু খরচ করবে তা তোমাদেরই কল্যাণ সাধন করবে- অবশ্য যদি তোমরা সেই খরচের ব্যাপার আল্লাহ ছাড়া আর কারো সন্তুষ্টি পেতে না চাও। এভাবে তোমরা ভাল কাজে যা কিছু দান করবে তার পূর্ণ ফল তোমরা লাভ করবে। সে দিক দিয়ে তোমাদের প্রতি বিন্দু পরিমাণও যুলুম করা হবে না।”- সূরা আল বাকারা : ২৭২

 

ধনী হয়ে সুখের মধ্যে ডুবে থেকেও যারা আল্লাহকে ভুলে যায় না, আল্লাহর দলে এ ধরনের ধীর প্রকৃতির লোকদেরই দরকার। তারা বড় বড় প্রাসাদে সুখ ও সম্ভোগের ভিতরে থেকেও আল্লাহকে ভুলে যাবে না:

 

يَآيُّهَا الَّذِيْنَ امَنُوْا لاَتُلْهِكُمْ وَلاَ اَوْلاَدُكُمْ عَنْ ذِكْرِ اللهِ وَمَنْ يَّفْعَلِ ذلِكَ فَاوُلئِكَ هُمُ الْخسِرِوْنَ المنفقون : ٩

 

“হে ঈমানদারগণ! তোমাদের সম্পদ আর সন্তান যেন তোমাদেরকে কখনও আল্লাহর যিকর থেকে বিরত না রাখে। এসবের জন্য যারা আল্লাহকে ভুলে যাবে তারা বড়ই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”- সূরা মুনাফিকূন: ৯

 

ওপরে বর্ণিত গুণাবলী আল্লাহ তাআলার দলের লোকদের মধ্যে বর্তমান থাকা অপরিহার্য। এছাড়া কোনো ব্যক্তি আল্লাহর বন্ধুদের মধ্যে গণ্য হতে পারে না। বস্তুত এটা মানুষের শুধু নৈতিক চরিত্রেরই নয়, তার ঈমানেরও বড় কঠিন এবং তিক্ত পরীক্ষা। আল্লাহর পথে খরচ করতে যে ব্যক্তি কুণ্ঠিত হবে, এরূপ খরচকে যে নিজের ওপরে জরিমানা বলে মনে করবে, কৌশল ও শঠতা করে তা থেকে যে আত্মরক্ষা করতে চায়, আর কিছু খরচ করলেও সে জন্য লোকের প্রতি নিজের অনুগ্রহ প্রকাশ করে মনের জাল মিটাতে চায় কিংবা নিজের বদান্যতার কথা দুনিয়ায় প্রচার করতে চায়, প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ ও পরকালের প্রতি এমন লোকদের আদৌ ঈমান থাকতে পারে না। সে মনে করে, আল্লাহর জন্য সে যা কিছু করেছে, তা একেবারে নিষ্ফল হয়েছে। তার নিজের সুখ-শান্তি, আরাম-আয়েশ, নিজের স্বার্থ ও খ্যাতিকেই সে আল্লাহ এবং তাঁর সন্তষ্টি অপেক্ষাও বেশী প্রিয় বলে মনে করে। তার মতে এ দুনিয়াটাই সবকিছু। টাকা-পয়সা খরচ করলেও এ দুনিয়ায়ই সে জন্য সুনাম ও খ্যাতি লাভ হওয়া আবশ্যক। কারণ তাহলে সে টাকার বিনিময় এখানেই পাওয়া যেতে পারে। নতুবা টাকাও খরচ করলো আর কেউ জানতেও পারলো না যে, অমুক ব্যক্তি ভাল কাজে এতগুলো টাকা দিয়ে দিয়েছে, তবে তা সবই অর্থহীন হয়ে যায়। কুরআন মজীদে পরিষ্কার বলে দেয়া হয়েছে যে, এ ধরনের মানুষ আল্লাহর কোনো কাজেই আসতে পারে না। সে যদি নিজেকে ঈমানদার বলে প্রচার করে তথাপি সে ঈমানদার তো নয়ই বরং সে প্রকাশ্য মুনাফিক নিম্নের আয়াতগুলো তার প্রমাণ:

 

يَآيُّهَا الَّذِيْنَ امَنُوْا صَدْقتِكُمْ بَالْمَنَ وَالاَذي كَالَّذِى يُنْفِقُ مَالَهُ رِئَآ ءَ النَّاسِ وَلاَ يُؤْمِنُ بِاللهِ وَالْيُوْمِ الاخِرِ ـ البقرة : ٢٦٤

 

“হে ঈমানদারগণ! তোমাদের দানকে অন্যের ওপরে নিজের অনুগ্রহ প্রচার করে বা কাউকে কষ্ট দিয়ে তার মতো নিষ্ফল করে দিও না, যে ব্যক্তি শুধু অন্যকে দেখাবার জন্য কিংবা সুনাম কিনার জন্য অর্থ ব্যয় করে এবং আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিন্দুমাত্র বিশ্বাস রাখে না।”

 

وَاَلَّذِيْنَ يَكْنِزُوْنَ الذَّهَبَ وَالْفِضَّةَ وَلاَيُنْفِقُوْنَهَا فِىْ سَبِيْلِ اللهِ فِبَشّرِهُمْ بِعَذَابِ اَلِيْمٍ ـ التوبة : ٣٤

 

“যারা স্বর্ণ এবং রৌপ্য সঞ্চয় করে রাখে এবং তা আল্লাহর পথে খরচ করে না, তাদেরকে কঠিন শাস্তির সুসংবাদ দাও।”- সূরা তাওবা : ৩৪।

 

لاَيَسْتَاْذِنُكَ الَّذِيْنَ يُؤْمِنُوْنَ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الاخِرِ اَنْ يُّجَاهِدُوْنا يَاَمْوَالِهِمْ وَاَنْفٌسِهِمْ وَاللهُ عَلَيْمٌ بِالْمُتَّقِيْنَ ـ اِنَّمَا يَسْتَاذِنُكَ الَّذِيْنَ لاَيُؤْمِنُوْنَ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الاخِرِ وَارْتَابَتْ قُلُبُهُمْ فَهُمْ فِىْ رَيْبِهِمْ يَتَرَدَّدُوْنَ ـ

 

“হে নবী‍! যারা আল্লাহ ও পরকালকে বিশ্বাস করে, তারা নিজেদের জান-মালসহ জিহাদে যোগদান করার কর্তব্য থেকে দূরে সরে থাকার জন্য কখনও অনুমতি চাইবে না। আল্লাহ তাআলা প্রকৃত মুত্তাকী বান্দাহগণকে খুব ভাল করেই জানেন। অবশ্য সেসব লোক ওজর আপত্তি করতে পারে, আল্লাহ ও পরকালের প্রতি যাদের আদৌ বিশ্বাস নেই-যাদের মনের মধ্যে সন্দেহ জমাট বেঁধে রয়েছে এবং নিজেদের সন্দেহের মধ্যে নিমজ্জিত থেকেই ইতস্তত করে।”- সূরা আত তাওবা : ৪৪-৪৫

 

وَمَا مَنَعَهَمْ اَنْ تُقْبَلَ مِنْهُمْ نَفَقّهُمْ اِلاَّ اَنَّهُمْ كَفَرُوْا بِاللهِ وَرَسُوْلِه وَلاَ يَاتُوْنَ الصَّلوةَ اِلاَّ وُهُمْ كُسَالى وَلاَ يُنْفِقُوْنَ اِلاَّ وَهُمْ كرِهُوْنَ ـ

 

“আল্লাহর পথে তাদের দান শুধু এজন্যই কবুল করা যায় না যে, মূলত আল্লাহ এবং রাসূলের প্রতি তাদের ঈমান নেই; নামাযের জন্য তারা আসে বটে; কিন্তু মনক্ষুণ্ন হয়ে; আর টাকা-পয়সাও তারা দান করে, কিন্তু বড়ই বিরক্তি সহকারে ।”- সূরা আত তাওবা : ৫৪

 

اَلْمُنفِقُوْنَ وَالْمُنفِقّتُ بَعْضُهُمْ مِّنْ بَعْضٍ يَامُرُوْنَ بِالْمُنْكَرِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمَعْرُوْفِ وَيقْبِضُوْنَ اَيْدِيْهِمْ نَسُوْا اللهَ فَنَسِيْهُمْ اِنَّ الْمُنفِقِيْنَ هُمْ الْفسِقُوْنَ ـ التوبة : ٦٧

 

“মুনাফিক পুরুষ আর মুনাফিক স্ত্রী সব একই দলের লোক-একে অন্যের সাহায্যকারী। এরা সকলেই মিলে অন্যায়ের আদেশ করে, ন্যায় ও সত্যকে নির্মূল রাখে। এরা সকলেই আল্লাহকে ভুলে গেছে। তাই আল্লাহ তাদেরকে ভুলে গেছেন। এসব মুনাফিক যে ফাসেক (আল্লাহর নির্ধারিত সীমালংঘনকারী) তাতে সন্দেহ নেই।”- সূরা আত তাওবা : ৬৭

 

وَمَنْ الاَعْرَابِ مَنْ يَّتَّخِذُ مَايُنْفِقُ نَغْرَمًا ـ التوْبة : ٩٨

 

“এ আরাব (মুনাফিকদের) অনেকেই আল্লাহর রাস্তায় কিছু খরচ করলেও তা করে একান্তভাবে ঠেকে-যেন জরিমানা আদায় করছে।”

 

هآَ نْتُمْ هؤْلاَءٍ تُدْعَوْنَ لِتُنْفِقُوْا فِىْ سَبِيْلِ اللهِ فِمِنْكُمْ مَّنْ يَّبْخَلُ وَمَنْ يَّبْخَلْ فَانِّمَا يَبْخَلُ عَنْ نَّفْسِه وَاللهُ الْغَنِىُّ وَاَنْتُمْ الفُقَرَآءُ وَاِنْ تَتَوْلَّوْا يَسْتَبْدِلْ قَوْمًا غَيْرَكُمْ تُمَّ لاَيَكَوْنُوْا اَمْثَالَكُمْ ـ محمد : ٣٨

 

“জেনে রাখ, তোমাদের অবস্থা এতদূর খারাপ হয়ে গিয়েছে যে, তোমাদের আল্লাহর রাস্তায় কিছু খরচ করতে বললে তোমরা সেজন্য মোটেই প্রস্তুত হও না বরং তোমাদের অনেকেই তখন কৃপণতা করতে থাকে। অথচ যে ব্যক্তি এসব কাজে কৃপণতা করে সেই কৃপণতায় তার নিজেরই ক্ষতি হয়। মূলত আল্লাহ একমাত্র ধনশালী আর তোমরা সকলেই দরিদ্র-তাঁরই মুখাপেক্ষী। আল্লাহর রাস্তায় যদি তোমার আদৌ অর্থ ব্যয় করতে প্রস্তুত না হও তবে এ অপরাধের অনিবার্য ফলস্বরূপ আল্লাহ তাআলা তোমাদের স্থানে এক ভিন্ন জাতিকে প্রতিষ্ঠিত করবেন। তারা নিশ্চয়ই তোমাদের মত (কৃপণ) হবে না।”- সূরা মুহাম্মাদ : ৩৮

 

মোটকথা, যাকাত ইসলামের একটি স্তম্ভ এবং এটাই তার মূল কথা। একে প্রচলিত সরকারী ট্যাক্সের মত মনে মারাত্মক ভুল। কারণ আসলে এটা ইসলামের প্রাণ, ইসলামের জীবনী শক্তি। যাকাত ফরয করার মূলে ঈমানের পরীক্ষা করাই হচ্ছে প্রধান লক্ষ্য। ক্রমাগত পরীক্ষা দিয়ে ডিগ্রী লাভ করে, অনুরূপভাবে আল্লাহও মানুষের ঈমান যাচাই করার জন্য কতগুলো পরীক্ষা নির্দিষ্ট করে দেন; প্রত্যেক মানুষকেই এ পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়। একজন মানুষ যখন এরূপ পরীক্ষা দিয়ে চতুর্থ পরীক্ষা-অর্থাৎ অর্থদানের পরীক্ষায়ও সাফল্য লাভ করে, তখনই সে খাঁটি মুসলমান হয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, এটা নিশ্চয়ই সর্বশেষ পরীক্ষা নয়।

 

এরপরে আসে প্রাণের পরীক্ষা। সেই সম্পর্কেও আমি পরে আলোচনা করবো। কিন্তু ইসলামের সীমার মধ্যে আসার জন্য-অন্য কথায় আল্লাহর দলভুক্ত হবার যে কয়টি প্রবেশিকা পরীক্ষা নির্দিষ্ট করা হচ্ছে, তার মধ্যে যাকাত হচ্ছে সর্বশেষ পরীক্ষা। বর্তমানে অনেকেই বলে বেড়াচ্ছে যে, টাকা-পয়সা খরচ বা দান করার অনেক ওয়াজই মুসলমানকে শুনান হয়েছে, বর্তমানে এ অভাব ও দারিদ্রের কঠিন মুহূর্তে তাদেরকে খানিকটা উপার্জন ও সঞ্চয় করার ওয়াজ শুনানো উচিত; কিন্তু তারা বুঝতে পারে না যে, যে জিনিসটির প্রতি তারা নাক ছিটকাচ্ছে তা হচ্ছে ইসলামের এ প্রাণ বস্তুটি। আর এ জিনিসটির অভাবই মুসলমানকে নৈতিক ও আর্থিক অধ:পতনের চরম সীমায় নিয়ে পৌঁছিয়েছে। এ প্রাণ বস্তুটি তাদেরকে অধপতিত করেনি। তাদের সর্বব্যাপী পতন হয়েছে শুধু এজন্য যে, এ প্রাণ বস্তুটিই তাদের দেহ থেকে নির্গত হয়ে গেছে।

 

সমাজ জীবনে যাকাতের স্থান

 

কুরআন মজীদের বিভিন্ন স্থানে যাকাত-সদকা ইত্যাদির কথা বুঝার জন্য ইনসাফ ফী সাবিলিল্লাহ (আল্লাহর রাস্তায় খরচ করা) বাক্য ব্যবহৃত হয়েছে। কোনো কোনো স্থানে আবার বলা হয়েছে যে, তোমরা আল্লাহর রাস্তায় যা-ই খরচ করবে তা আল্লাহর কাছে করযে হাসান (ধার) হিসেবে মওজুদ থাকবে। এক কথায় এটা দ্বারা ঠিক আল্লাহকে ধার দেয়া হয়, আর আল্লাহ মানুষের কাছে ঋণী হন। অনেক স্থানে একথাও বলা হয়েছে যে, আল্লাহর রাস্তায় তোমরা যা কিছু দেবে তার বিনিময় দেয়ার দায়িত্ব আল্লাহর তিনি তোমাদের শুধু ততটুকু পরিমাণই ফিরিয়ে দেবেন না; তদপেক্ষা অনেক বেশী পরিমাণ দান করবেন।

 

কুরআন মজীদের উল্লেখিত কথাগুলো বাস্তবিকভাবেই প্রণিধানযোগ্য। আকাশ ও পৃথিবীর মালিক কি কখনও মুখাপেক্ষী হতে পারে? মানুষের কাছে থেকে সেই মহান পবিত্র আল্লাহর টাকা ধার নেয়ার কি প্রয়োজন থাকতে পারে? সেই রাজাধিরাজ সীমাসংখ্যাহীন ধন ভান্ডারের একচ্ছত্র মালিক আল্লাহ কি মানুষের কাছে নিজের প্রয়োজন ধার চান? কখনও নয়, তা হতেই পারে না। তাঁর দানেই দুনিয়ার জীব-জন্তু বস্তুনিচয় জীবন ধারণ করছে, তাঁর দেয়া জীবিকা দ্বারাই মানুষ বাঁচে। দুনিয়ার প্রত্যেক ধনী ও গরীবের কাছে যা কিছু আছে, তা সব তাঁরই দান। একজন অসহায় গরীব থেকে শুরু করে কোটিপতি পর্যন্ত প্রত্যেকেই তাঁর অনুগ্রহের মুখাপেক্ষী। কিন্তু তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন। তিনি মানুষের কাছে ধার চাইবেন এবং নিজের জন্য মানুষের সামনে হাত প্রসারিত করবেন- তার আদৌ কোনো প্রয়োজন নেই। মূলত মানুষেরই কল্যাণের জন্য, মানুষের কাজে ব্যয় করার জন্যই তিনি আদেশ করেন। আর সে ব্যয়টাকেই তিনি তাঁর পথে খরচ কিংবা ধার বলে গণ্য করেন। বস্তুত এটাও তাঁর আর এক কল্যাণ কামনার বাস্তব প্রকাশ-এটাও তাঁর এক প্রকার বড় অনুগ্রহ বিশেষ। তিনি বলেন, তোমরা তোমাদেরই সমাজের অভাবগ্রস্ত গরীব এবং আর এক কল্যাণ কামনার বাস্তব প্রকাশ-এটাও তাঁর এক প্রকার বড় অনুগ্রহ বিশেষ। তিনি বলেন, তোমরা যেসব লোককে অর্থ সাহায্য কর, এর বিনিময় তারা কোথা থেকে দেবে? এর প্রতিদান আমিই দান করবো। তোমরা ইয়াতিম, বিধবা, অসহায়, বিপদগ্রস্ত এবং নিসম্বল পথিক ভাইদেরকে যা কিছু দান করবে তার হিসেব আমার নামে লিখে রেখো এর তাগাদা তাদের কাছে নয় বরং আমার কাছে কারো। আমি তা পরিশোধ করবো। তোমরা তোমাদের গরীব ভাইদের ধার দাও কিন্তু তাদের কাছ থেকে সুদ গ্রহণ করে না, এর তাগাদা করে তাদেরকে অপ্রস্তুত ও বিব্রত করো না। তারা ঋণ শোধ করতে না পারলে সে জন্য তাদেরকে সিভিল জেল পাঠিয়ো না, তাদের কাপড়-চোপড় এবং ঘরের আসবাবপত্র ক্রোক করো না, তাদের অসহায় সন্তানদেরকে ঘর থেকে বের করে আশ্রয়হীন করে দিও না। কারণ তোমাদের ঋণ আদায়ের দায়িত্ব তাদের নয়- আমার, তারা যদি মূল টাকা আদায় করে দেয়, তবে তাদের পক্ষে থেকে সুদ আমি আদায় করবো আর তারা যদি আসল টাকাও না দিতে পারে, তাহলে আসল ও সুদ সবই আমি শোধ করবো। এভাবে নিজেদের সামাজিক কল্যাণমূলক কাজে মানুষের উপকারার্থে তোমরা যা খরচ, করবে, তার লাভ যদিও তোমরাই পাবে; কিন্তু সেই অনুগ্রহ আমার ওপর করা হবে, আমিই তার লাভ সহ পূর্ণ হিসেব করে তোমাদেরকে ফেরত দেব।

 

একমাত্র দয়াময়, রাজাধিরাজ আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহের যথার্থতা এখানেই মানব জাতির কাছে যা কিছু আছে, তা সব তাঁরই দান- অন্য কোথাও থেকে বা অন্য কারো কাছ থেকে তোমরা তা পাও না। তাঁরই ভাণ্ডার থেকে তোমরা নিয়ে থাক, কিন্তু যা কিছু দাও, তাঁকে নয়-তোমাদেরই আত্মীয়, এগানা, ভাই, বন্ধু ও নিজ জাতির লোকদেরকেই দিয়ে থাক। কিংবা নিজেদের সামাজিক কল্যাণমূলক কাজে ব্যয় কর, যার ফলও শেষ পর্যন্ত তোমরাই পেয়ে থাক। কিন্তু সেই মহান দাতার অসীম বদান্যতা লক্ষ্য কর, তিনি এ সকল দান সম্পর্কে বলেন যে, এটা তাঁকে ঋণ দেয়া হয়েছে, তাঁরই পথে খরচ করা হয়েছে, তাঁকে দেয়া হয়েছে-এর ফল আমিই তোমাদেরকে দেব। বস্তুত বদান্যতার এ অতুলনীয় পরাকাষ্ঠা একমাত্র আল্লাহ তাআলারই পক্ষে শোভা পায়, কোনো মানুষ এর ধারণাও করতে পারে না।

 

ভাবার বিষয় এই যে, আল্লাহ তাআলা মানুষের মধ্যে দানশীলতা ও বদান্যতার উৎস সঞ্চার করার জন্য এ পন্থা অবলম্বন করলেন কেন? এ বিষয়ে যতই চিন্তা করা যায়, ইসলামের উন্নত শিক্ষার অন্তনির্হিত পবিত্র ভাবধারা ততই সুস্পষ্টরূপে হৃদয়ঙ্গম করা যায়; মন উদাত্ত কন্ঠে বলে উঠে –এ অতুলনীয় শিক্ষা আল্লাহ ছাড়া আর কারো হতে পারে না।

 

মানুষ যে স্বভাবতই কিছুটা যালেম এবং জাহেল হয়ে জন্মগ্রহণ করে, তা সকলেরই জানা কথা। তার দৃষ্টি অত্যন্ত সংকীর্ণ। বেশী দূর পর্যন্ত তা পৌঁছায় না। তাদের দিল খুবই ক্ষুদ্র, তার মনে বড় এবং উচ্চ ধারণার খুব কমই সংকুলান হয়ে থাকে। মানুষ ভয়ানক স্বার্থপর, কিন্তু সেই স্বার্থপরতা সম্পর্কেও কোনো ব্যাপক ও বিরাট ধারণা তার মন-মস্তিষ্কে স্থান পায় না। মানুষ অবিলম্বেই সবকিছু পেতে চায়: خَلَقَ الاِنْسَانَ مِنْ عَجَلٍ ـ প্রতিটি কাজের ফল এবং পরিণাম যত তাড়াতাড়ি সম্ভব লাভ করতে সে প্রয়াসী। যে ফল তার সামনে অবিলম্বে আসে এবং নিজের চোখ দ্বারা দেখতে পায়, তাই তার কাছে একমাত্র ফল ও পরিণাম। সুদূরপ্রসারী ফলাফল পর্যন্ত তার দৃষ্টি মোটেই পৌঁছায় না। উপরন্তু যে ফল খুব বড় আকারে সামনে আসে এবং যে ফলের ক্রিয়া বহুদূর পর্যন্ত পৌঁছায়, মানুষ তা অনুভব পর্যন্ত করতে পারে না। বস্তুত এটা মানুষের এক স্বাভাবিক দুর্বলতা বিশেষ। এ দুর্বলতার কারণে মানুষ নিজের স্বার্থ ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায় না। আর তাও আবার যেসব স্বার্থ ছোট আকারে এবং খুব দ্রুত লাভ করা যায়, তারই প্রতি তার দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকে। সে বলে আমি যা উপার্জন করেছি বা আমার বাপ-দাদার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে যা পেয়েছি তা একান্তভাবে আমার, অন্য কারো কোনো অংশ বা অধিকার তাতে নেই। কাজেই আমি কেবল নিজের প্রয়োজনে, নিজের ইচ্ছায় এবং নিজের আরাম আয়েশের কাজে খরচ করবো। কিংবা যেসব কাজের ফল অবিলম্বে আমার হাতে ফিরে পাব কেবল সেই কাজে নিয়োগ করবো। আমি যদি টাকা খরচ করি তবে এর বিনিময় আমার মান-সম্মান বৃদ্ধি পাওয়া কিংবা কোনো খেতাব লাভ করা একান্তই আবশ্যক। মানুষ যেন আমার সামনে মাথা নত করে, লোকের মুখে যেন আমার নামের চর্চা হয়। এসব জিনিসের কোনোটাই যদি আমি না পাই, তবে আমি টাকা খরচ করবো কেন? আমরা নিকটবর্তী কোনো গরীব-দু:খী বা ইয়াতীম মিসকিন যদি না খেয়ে মরে যায়, তবুও আমি কেন তাঁকে খাদ্য যোগাড় করে দেব? তার প্রতি তার পিতার কর্তব্য ছিল নিজের সন্তানের জন্য কিছু রেখে যাওয়া। আমার পাড়ার কোনো বিধবার যদি দু:খে দিন কাটে তবে আমার তাতে কি আসে যায়? তার জন্য তার স্বামীর চিন্তা করা উচিত ছিল। কোনো প্রবাসী যদি সম্বলহীন হয়ে পড়ে, তবে তার সাথে আমার কি সম্পর্ক থাকতে পারে? সে পথের ব্যবস্থা না করেই ঘর থেকে বের হয়ে বড় নির্বুদ্ধিতার কাজ করেছে। অন্য কোনো ব্যক্তি যদি দূরবস্থায় পড়ে তবে তার প্রতি আমার কী করণীয় থাকতে পারে? আমার ন্যায় তাকেও আল্লাহ তাআলা হাত-পা দিয়েছেন। নিজের প্রয়োজন পরিমাণ উপার্জন করা তার নিজেরই কর্তব্য। আমি তার সাহায্য করবো কেন? আর একান্তই আমি তাকে যদি কিছু টাকা-পয়সা দেই তবে ঋণ হিসেবেই দেব এবং আসল টাকার সাথে এর সুদও নিশ্চয়ই আদায় করবো। কারণ, বিনা পরিশ্রমে তো টাকা উপার্জিত হয়নি। সেই টাকা আামার কাছে থাকলে কত কাজেই না লাগাতে পারতাম-দালান-কোঠা তৈরি করতে পারতাম, মোটর গাড়ি কিনতে পারতাম কিংবা অন্য কোনো লাভজনক কাজে খাটাতে পারতাম। সে যদি আমার টাকা দিয়ে কোনো উপকার লাভ করতে পারে, তবে আমি আমার টাকা দ্বারা কিছু না কিছু লাভ করতে পারবে না কেন? তা থেকে আমার অংশই বা আমি আদায় করবো না কেন?

 

এরূপ স্বার্থপর মনোবৃত্তির কারণে প্রথমত মানুষ ধনপিশাচে পরিণত হয়। সে তা খরচ করলে ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্যই করবে। যে কাজে কোনো স্বার্থ দেখতে পাবে না, সেখানে এক পয়সাও খরচ করবে না। কোনো গরীবের সাহায্য যদি সে করেও, তবে মূলত তা দ্বারা সেই গরীবের কোনো সাহায্য হবে না, বরং তাকে আরো বেশী করে শোষণ করবে এবং তাকে যা দেবে তদপেক্ষা অনেক বেশী আদায় করবে। কোনো মিসকীনকে কিছু দান করলে সে এ ব্যক্তির প্রতি নিজের অনুগ্রহ দেখিয়ে তাকে কাতর করে ছাড়বে এবং তাকে এতদূর অপমানিত ও লাঞ্চিত করবে যে, তার মধ্যে আত্মসম্মানবোধটুকুও অবশিষ্ট থাকতে দেবে না। কোনো জাতীয় কাজে অংশ গ্রহণ করলে এ ধরনের মানুষ সর্বপ্রথম নিজের স্বার্থের প্রতি দৃষ্টি দেবে। যেসব কাজে নিজের স্বার্থ লাভের সম্ভবনা থাকবে না, সেই কাজে একটি পয়সাও দিতে প্রস্তুত হবে না।

 

এধরনের মনোবৃত্তির পরিণাম কত ভয়াবহ তা ভেবে দেখেছেন কি? এর ফলে গোটা সমাজ জীবনই যে চুরমার হয়ে যাবে তাই নয়, বরং শেষ পর্যন্ত সেই ব্যক্তির অবস্থাও অত্যন্ত মারাত্মক হয়ে পড়বে, সন্দেহ নেই। কিন্তু এদের দৃষ্টি অত্যন্ত সংকীর্ণ এবং তারা অতীব মূর্খ বলে এটা থেকেও তাদের নিজেদেরই উপকারিতার আশা করে থাকে। এ ধরনের উপার্জনহীন মনোবৃত্তি যখনই মানুষের মধ্যে সক্রিয় হয়ে ওঠে তখন সমাজের খুব অল্প সংখ্যক লোকের হাতে সমগ্র জাতীয় সম্পদ কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ে এবং অসংখ্য লোক একেবারে নিরুপায় ও উনহীন হয়ে পড়তে বাধ্য হয়। অর্থশালী লোক অর্থের বলে আরও বেশী পরিমাণ অর্থ শোষণ করে, গরীব লোকদের জীবন ক্রমশ আরও বেশী খারাপ হয়ে যায়। যে সমাজে দারিদ্র একটা সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। সামাজিক স্বাস্থ্য-ধৈর্য চূর্ণ হয়, নানা প্রকার দুরারোগ্য ব্যাধি সমাজ দেহে আক্রমণ করে, ফলে তারা কাজের ও উৎপাদনের শক্তি হারিয়ে ফেলে। তাদের মধ্যে মূর্খতা ও অশিক্ষা বৃদ্ধি পায়, নৈতিক স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়ে। তারা নিজেদের প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্য অপরাধ প্রবণ হতে বাধ্য হয় এবং শেষ পর্যন্ত লুটতরাজ করতেও পশ্চাৎ পদ হয় না। সমাজে এক সর্বব্যাপী বিশৃংখলার সৃষ্টি হয়, ধনী লোক গরীবদের হাতে নিহত হতে শুরু করে, তাদের ঘর-বাড়ী লুণ্ঠিত হয়, অগ্নিদগ্ধ হয় এবং তারা চিরতরে ধ্বংস হতে বাধ্য হয়।

 

সমাজ বিজ্ঞানীদের দৃষ্টিতে প্রত্যেকটি মানুষের ব্যক্তিগত কল্যাণ তার সামাজিক বৃহত্তর কল্যাণের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একজনের কাছে যে অর্থ আছে তা যদি অন্য এক ভাইয়ের সাহায্যার্থে ব্যয়িত হয় তবে এ অর্থই আবর্তিত হয়ে অভাবিতপূর্ব কল্যাণ নিয়ে পুনরায় তার হাতেই ফিরে আসবে। পক্ষান্তরে নিতান্ত সংকীর্ণ দৃষ্টির বশবর্তী হয়ে যদি সে তার নিজের কাছেই সঞ্চয় করে রাখে, কিংবা নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থজনিত কাজে ব্যয় করে, তবে ফলত সে অর্থ ক্ষয়প্রাপ্ত হবে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, একটি ইয়াতীম শিশুকে আপনি যদি লালন-পালন করে এবং উপযুক্ত শিক্ষা-দীক্ষা দিয়ে উপার্জনক্ষম করে দেন, তবে তাতে সামাজিক সম্পদ বৃদ্ধি পাবে। আপনিও তা থেকে অংশ লাভ করতে পারবেন। কারণ, আপনিও সেই সমাজেরই একজন লোক। হতে পারে সেই ইয়াতীমের বিশেষ যোগ্যতার ফলে আপনি যে অর্থ লাভ করেছেন তা কোনো হিসেবের সাহায্যে হয়ত আপনি আদৌ জানতে পারেননি। কিন্তু প্রথমেই তার লালন-পালন করতে এবং তাকে শিক্ষা-দীক্ষা দিতে আপনি যদি অস্বীকার করেন এবং বলেন যে, আমি তার সাহায্য করবো কেন, তার পিতারই কিছু না কিছু ব্যবস্থা করে যাওয়া উচিত ছিল, তবে তো সে উদভ্রান্তের ন্যায় ঘুরে বেড়াবে, ছন্নছাড়া হয়ে নিরুদ্দেশ হাতড়িয়ে মরবে, অকর্মণ্য হয়ে যাবে এবং সামাজিক সম্পদ বৃদ্ধি করার মতো কোনো যোগ্যতাই সে লাভ করতে পারবে না। বরং সে অপরাধ প্রবণ হয়ে একদা স্বয়ং আপনার ঘরেই সিঁদ কাটতে প্রস্তুত হবে। এর অর্থ এ দাঁড়ায় যে, আপনি সমাজেরই এক ব্যক্তিকে অকর্মণ্য ও অপরাধ প্রবণ বানিয়ে কেবল তারই নয়-আপনার নিজেরও ক্ষতি সাধন করবেন। এ একটি মাত্র উদাহরণ সামনে রেখে দৃষ্টি প্রসারিত করলে পরিষ্কার দেখতে পাওয়া যাবে যে, নিস্বার্থভাবে যে ব্যক্তি সামাজিক বৃহত্তর কল্যাণের জন্য অর্থ খরচ করে, বাহ্য দৃষ্টিতে তা তার নিজ পকেট থেকে নির্গত হয় বটে; কিন্তু বাইরে এসে তাই বৃদ্ধি পেয় স্ফীত হতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত তাই অসংখ্য রূপ উপকার ও স্বার্থকতা নিয়ে আবার তার পকেটেই ফিরে যায়। আর যে ব্যক্তি বাহ্য দৃষ্টিতে তার অর্থ তার নিজের বাক্সে থেকে যায় বা সুদ খেয়ে তাকে আরও স্ফীত করে তোলে; কিন্তু প্রকতপক্ষে নিজের নির্বুদ্ধিতার দরুনই নিজের সম্পদ নষ্ট করে-নিজেরই ধ্বংসের ব্যবস্থা করে।

 

আল্লাহ তাআলা এ তত্ত্ব কথাই বলেছেন নিম্নলিখিত আয়াতে:

 

يَمۡحَقُ ٱللَّهُ ٱلرِّبَوٰاْ وَيُرۡبِى ٱلصَّدَقَـٰتِ‌ۗ ـ البقرة : (٢٧٦)

 

“আল্লাহ সুদ নিশ্চিহ্ন করে দেন এবং দানকে ক্রমবৃদ্ধি প্রাপ্ত করেন।”

 

وَمَا اتَيْتُمْ مِّنْ رٍّبًا لِّيَرۡبُوَاْ فِىٓ أَمۡوَٲلِ ٱلنَّاسِ فَلَا يَرۡبُواْ عِندَ ٱللَّهِ‌ وَمَآ ءَاتَيۡتُم مِّن  زَكوْةٍ تُرِيْدُوْنَ وَجْهَ اللهِ فَاُوْلئِكَ هُمُ الْمُضْعِفُوْنَ ـ الروم : ٣٩

 

“মানুষের সম্পদ বৃদ্ধি করবে বলে তোমরা যে সুদ দাও, মূলত আল্লাহর কাছে তাতে সম্পদ মোটই বৃদ্ধি পায় না কিন্তু তোমরা যে যাকাত আদায় কর-একমাত্র আল্লাহর সন্তোষ লাভ করার উদ্দেশ্য তা অবশ্য দ্বিগুণ বৃদ্ধি পায়।”- সূরা আর রূম : ৩৯

 

কিন্তু এ গভীর তত্ত্ব কথা বুঝতে এবং তদানুযায়ী কাজ করতে মানুষের দৃষ্টি সংকীর্ণতা এবং চরম মূর্খতা বিরাট বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরা ইন্দ্রিয়ের দাস। যে টাকা তাদের পকেটে আছে তা দিয়ে তারা অনুভব করতে পারে এবং বুঝতে পারে যে, তা নিশ্চয়ই আছে। তাদের হিসেবের খাতায় যে পরিমাণ টাকা বেড়ে চলেছে তার ক্রম বৃদ্ধি সম্পর্কেও তারা নিসন্দেহ; কিন্তু যে টাকা তাদের কাছ থেকে চলে যায়; তা যে বাড়ছে এবং তাদের হাতে যে ফিরে আসতে পারে; সে কথা মোটেই বুঝতে ও দেখতে পায় না। তারা শুধু বুঝে এত টাকা আমার হাত থেকে চলে গিয়েছে এবং তা চিরকালের জন্যই গেছে।

 

মূর্খতার এ বন্ধনকে মানুষ নিজের বুদ্ধি বা চেষ্টার দ্বারা অদ্যাবধি খুলতে পারেনি। সারা দুনিয়ার অবস্থাই এরূপ। একদিকে পুজিঁবাদীদের দুনিয়া-সকল কাজই সেখানে সুদ প্রথার ওপর চলছে এবং ধন-সম্পদের প্রাচুর্য সত্ত্বেও সেই দেশে দু:খ দারিদ্র আর অভাব অনটন ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে এদের বিরোধী আর একটি দল ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে ওঠেছে। তাদের মনে হিংসার আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে। এর পুঁজিবাদীদের ধন-ভান্ডার লুটে তো নেবেই সেই সাথে মানুষের তাহযীব-তমুদ্দুনের গোটা ইমারতকেও ধূলিসাৎ করে দিতে বদ্ধপরিকর হয়ে ওঠেছে।

 

মানুষ এ সমস্যার সমাধান করতে পারেনি। এর সুষ্ঠ সমাধান করেছে মানুষের স্রষ্টা-মহীয়ান গরীয়ান আল্লাহ তাআলা। তিনি এসব মানুষের অন্যান্য যাবতীয় সমস্যার সুষ্ঠ সমাধানসহ যে কিতাব নাযিল করেছেন, তার নাম কুরআন মজীদ। এ সমস্যার সমাধান করতে হলে মানুষকে আল্লাহ এবং পরকালের প্রতি ঈমান আনতে হবে। মানুষ যদি আল্লাহর এবং পরকালের প্রতি ঈমান আনতে হবে। মানুষ যদি আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে পারে এবং সন্দেহাতীতরূপে জেনে নেয় যে, আকাশ ও পৃথিবীর সমগ্র ধন-ভান্ডারের প্রকৃত মালিক হচ্ছেন আল্লাহ তাআলা : আর মানুষের সকল কাজের ব্যবস্থাপনা একান্তভাবে আল্লাহর ওপর নির্ভর করে, তার কাছে প্রত্যেকটি অণু-পরমাণুর হিসেব বর্তমান আছে; মানুষের ভালো বা মন্দ কাজের পুরুস্কার বা শাস্তি আখেরাতে ঠিক তদনুযায়ী হবে। তাহলে নিজের স্থুলদৃষ্টির ওপর নির্ভর না করে আল্লাহর ওপর ভরসা করে নিজের ধন-সম্পদ আল্লাহর বিধান অনুসারে ব্যয়-ব্যবহার করা এবং লাভ-ক্ষতি আল্লাহর ওপর ছেড়ে দেয়া মানুষের পক্ষে খুবই সহজ হয়ে পড়ে। এরূপ ঈমান নিয়ে সে যা কিছু খরচ করবে তা একান্তভাবে আল্লাহর জন্যই খরচ করা হবে। তার হিসেবেও আল্লাহর দফতরে যথাযথভাবে লিখিত হবে। তার এ খরচের খবর দুনিয়ার কোনো মানুষ জানতে না পারলেও আল্লাহ তাআলা সেই সম্পর্কে পূর্ণরূপে অবহিত থাকেন। আর দুনিয়ার মানুষ তার কৃতজ্ঞতা স্বীকার না করলেও আল্লাহ নিজেই যখন তার প্রতিদান দেয়ার ওয়াদা করেছেন তখন পরকালেই হোক কিংবা ইহকাল ও পরকাল উভয় স্থানেই হোক-সেই ওয়াদা যে পূর্ণ হবে তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।

 

আল্লাহর পথে খরচ করার জন্য সাধারণ নির্দেশ

 

আল্লাহ তাআলা ইসলামী শরীয়াতের এ নিয়ম করেছেন যে, প্রথমে তিনি ভালো এবং পূণ্য কাজের একটা সাধারণ হুকুম জারী করেন, যেন মানুষ নিজের জীবনে সাধারণভাবে ভালো ও কল্যাণকর পন্থা অবলম্বন করতে পারে। তারপর সেই ভালো কাজসুসম্পন্ন করার জন্য একটি বিশেষ পন্থা নির্দেশ করা হয়। সেই বিশেষ পন্থাটি সকলেরই যথাযথ রূপে পালন করা কর্তব্য। উদারহণ স্বরূপ বলা যেতে পারে যে, আল্লাহকে স্মরণ করা একটি অত্যন্ত ভালো কাজ এবং সর্বাপেক্ষা অধিক ভালো কাজ। শুধু তাই নয়- বস্তুত সমস্ত ভালো কাজেরই মূল উৎস এটাই। সেজন্য আল্লাহকে সকল সময় ও সকল অবস্থায়ই স্মরণ করা এবং এক মুহূর্তও তাকে ভুল না যাওয়ার জন্য তাঁর নিদেশ রয়েছে:

 

فَاذْكُرُوْا اللهَ قِيْمًا وَّقُعُوْدُا وَّعَلى جُنُوْبِكُمْ ـ النساء : ١٠٣

 

“দাঁড়িয়ে, বসে এবং শুয়ে (সকল সময় ও সকল অবস্থায়ই) আল্লাহকে স্মরণ কর।” সূরা আন নিসা : ১০৩

 

وَاَذْكُرُوْا اللهَ كَثِيْرَ لَّعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ ـ الانفال : ٤٥

 

“খুববেশী করে তাঁর স্মরণ করতে থাক, কারণ একাজেই তোমাদের কল্যাণ হবে আশা করা যায়।”- সূরা আল আনফাল : ৪৫

 

اِنِّ فِىْ خَلْقِ السَّموتِ وَالاَرْضِ وَاَخْتِلاَفِ الَّيْلِ وَالنَّهَارِ لاَيْتٍ لاَوْلِىْ الاَلْبَابِ ـ الَّذِيْنَ يَذْكُرُوْنَ اللهَ قِيْمَامًا وَّقُعُوْادًا وَّعَلى جُنُوْبِهِمْ وَيَتَفَكَّرُوْنَ فِىْ خَلْقِ السَّموتِ وَالاْرْضِ رَبُّنَا مَا خَلَقْتَ هَذَا بَاطِلاً ـ

 

“আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টির ব্যাপারে এবং রাত ও দিনের আবর্তনে (আল্লাহর অস্তিত্বের) বহু নিদর্শন রয়েছে, এবং চিন্তাশীল লোকদের জন্য- যাঁরা দাঁড়িয়ে, বসে এবং শুয়ে আল্লাহকে স্মরণ করে, আর আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি ও গঠন রহস্য সম্পর্কে চিন্তা করতে থাকে এবং (গভীরভাবে চিন্তা করার পর প্রত্যেকটি জিনিসের মহাত্ম্য বুঝতে পেরে উদাত্ত কন্ঠে) বলে উঠে- হে আল্লাহ! তুমি এর কোনো একটিও নিরর্থক সৃষ্টি করনি।”- সূরা আলে ইমরান : ১৯০-১৯১

 

وَلاَ تَطِعْ مَنْ اَغْفَلْنَا قَلْبَه عَنْ ذِكْرِنَا وَاتَّبَعَ هَوَٮٰهُ وَكَانَ اَمْرَهُ فُرُطًا ـ الكهاف : ٢٨

 

“যাদের দিলে আল্লাহর স্মরণ নেই, যারা নিজেদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে এবং যারা প্রত্যেকটি কাজের নির্দিষ্ট সীমালংঘন করে থাকে, তোমরা তাদের আনুগত্য বা অনুসরণ করো না।”- (সূরা আল কাহাফ :২৮)

 

এ আয়াতসমূহে এবং এ ধরণের আরও অনেক ও অসংখ্য আয়াতে পরিস্কার নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, হে মানুষ! তোমরা সকল সময় সকল অবস্থায়ই আল্লাহকে স্মরণ কর। কারণ, প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর স্মরণই মানুষের সকল কাজ-কর্ম সুষ্ঠু এবং সুন্দর করে দেয়। মানুষ যখনই এবং যে কাজেই তাঁকে ভুলে যাবে; সেখানেই প্রবৃত্তি (নফসের খাহেস) এবং শয়তানের প্রতারণা তাকে পরাভূত করবে। এর অনিবার্য পরিণামে মানুষ সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে নিজেদের জীবন যাপনের ব্যাপারে সীমালংঘন করতে শুরু করবে।

 

এটা ছিল আল্লাহকে স্মরণ করার একটি সাধারণ নির্দেশ। অতপর আল্লাহকে স্মরণ করার একটি বিশেষ উপায় নির্ধারণ করা হয়েছে। সে জন্য দিন-রাতের মধ্যে পাঁচবার কয়েক রাকাআত করে নামায পড়া ফরয করা হয়েছে। এ নামাযসমূহে একবার পাঁচ-সাত মিনিটের বেশী সময় অতিবাহিত হয় না। পাঁচ মিনিট এখন, আর পাঁচ মিনিট তখন এভাবে আল্লাহকে স্মরণ করা ফরয করে দেয়ার অর্থ এই যে, অন্ততপক্ষে এতটুকু সময়ের জন্য তো মুসলমানকে আল্লাহর স্মরণের কাজে আত্মনিমগ্ন হতেই হবে। তারপর তারা নিজ নিজ কাজ করে যাবে এবং সেই অবস্থায়ও আল্লাহকে স্মরণ করতে থাকবে।

 

ইসলামে যাকাতের ঠিক এ অবস্থা। এখানেও একটি বিশেষ হুকুম এবং একটি সাধারণ হুকুম রয়েছে। একদিকে সুস্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে যে, কৃপণতা ও মনের সংকীর্ণতা থেকে দূরে থাক, কারণ এটাই সকল অনর্থের মূল এবং সকল বিপর্যয়ের উৎস। তোমাদের নৈতিক জীবনে আল্লাহর রং ধারণ কর। কারণ তিনি প্রতিটি মুহূর্তে গোটা সৃষ্টিজগতের ওপর অফুরন্ত অনুগ্রহ ও রহমত বর্ষণ করে থাকেন, যদিও তাঁর ওপর কারো বিশেষ কোনো অধিকার বা দাবী নেই। আবার বলা হয়েছে, আল্লাহর রাস্তায় যত এবং যা কিছুই খরচ করতে পার, তা করতে থাক, নিজেদের প্রয়োজন পূর্ণ করে যা উদ্ধৃত্ত রাখতে পার রাখ এবং আল্লাহর অন্যান্য অভাবগ্রস্ত বান্দাদের প্রয়োজন মিটাবার জন্য যত পার দান কর। দীনের খেদমত এবং আল্লাহর কালেমা প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যে জান-মাল দিয়ে চেষ্টা করতে বিন্দুমাত্র কুন্ঠিত হইও না। আল্লাহর প্রতি যদি তোমার ভালবাসা থাকে, তবে ধন-সম্পত্তির প্রেমকে সে জন্য উৎসর্গ কর।

 

আল্লাহর পথে অর্থ দান করার জন্য এটা সাধারণ হুকুম। কিন্তু সেই সাথে বিশেষ নির্দেশ এই যে, এত পরিমাণ অর্থ তোমাদের কাছে সঞ্চিত হলে তা থেকে কমপক্ষে এত পরিমাণ অবশ্যই আল্লাহর রাস্তায় খরচ করবে। তোমাদের ক্ষেতে এত পরিমাণ ফসল হলে তা থেকে এত পরিমাণ আল্লাহর পথে অবশ্যই দান করবে। নির্দিষ্ট কয়েক রাকাআত মাত্র নামায ফরয করার অর্থ যেমন এই নয় যে, ঐ কয় রাকাআত মাত্র আদায় করলেই আল্লাহকে স্মরণ করার কর্তব্য সম্পন্ন হয়ে গেল, অতএব তা ভিন্ন অন্যান্য সময় আল্লাহকে ভুলে যেতে পারবে। অনুরূপভাবে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ আল্লাহর রাস্তায় দান করা যে ফরয করা হয়েছে, তার অর্থও এটা নয় যে, যাদের কাছে এত পরিমাণ অর্থ আছে কেবল তারাই আল্লাহর রাস্তায় খরচ করত বাধ্য। আর যারা তদপেক্ষা কম অর্থের মালিক, তাদের মুঠি বন্ধ করে রাখবে। এমনকি, তার অর্থ এটাও নয় যে, ধনীদের ওপর যে পরিমাণ যাকাত ফরয হয়েছে, তারা কেবল সেই পরিমাণ অর্থ আল্লাহর রাস্তায় খরচ করেই নিষ্কৃতি পেয়ে যাবে, অতপর কোনো অভাবগ্রস্ত ব্যক্তি আসলে তাকে তাড়িয়ে দেবে-দীন ইসলামের কোনো বৃহত্তর কাজের তাগীদ আসলে বলবে, একমাত্র যাকাতই আমার প্রতি ফরয হয়েছিল, আমি তা আদায় করেছি। অতএব এখন আর আমার কাছে কিছুই পেতে পারে না। বস্তুত যাকাত ফরয করার অর্থ মোটেই এটা নয়। যাকাত ফরয করার প্রকৃত তাৎপর্য এই যে, প্রত্যেক ধনী ব্যক্তি অন্ততপক্ষে এ নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ অবশ্যই আল্লাহর পথে খরচ করতে বাধ্য। আর তার অধিক ব্যয় করার সামর্থ্য থাকলে তাও তাকে অবশ্যই করতে হবে।

 

আল্লাহর রাস্তায় অর্থ খরচ করার সাধারণ হুকুম এবং তার বিশ্লেষণ এখানে করা যাচ্ছে:

 

কুরআন মজীদ কোন কাজের নির্দেশ দেয়ার সাথে সাথে তার অন্তনির্হিত যৌক্তিকতাও স্পষ্ট করে বলে দেয়। এটা কুরআন মজীদের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। এর সাহায্যে মানুষ আল্লাহর আদেশের মূল লক্ষ্যে ও যৌক্তিকতা সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারে।

 

কুরআন মজীদের শুরুতে যে আয়াতটি চোখে পড়ে তা এই:

 

ذَلِكَ الْكِتبُ لاَرَيْبَ فِيْه هُدًى لِّلْمُتَّقِيْنَ ـ الَّذِيْنَ يُؤْمِنُوْنَ بِالْغَيْبِ وَيُقِيْمُوْنَ الصَّلوةَ وَمِمَّا رَزَقْنهُمْ يُنْفِقُوْنَ ـ البقرة : ٢-٣

 

“এ কুরআন আল্লাহর কিতাব, এতে কোনো প্রকার সন্দেহের অবকাশ নেই। এটা সেই সব সত্যনিষ্ঠ মুত্তাকী লোকদেরকে সত্য পথের সন্ধান করে দেয়, যারা অদৃশ্যে বিশ্বাসী, নামায কায়েম করে এবং আমার দেয়া জীবিকা থেকে (আমার পথে) খরচ করে।”- সূরা আল বাকারা : ২-৩

 

এ আয়াতে একটি মূলনীতি বলে দেয়া হয়েছে। পার্থিব জীবনে সোজা পথে চলার জন্য তিনটি জিনিস অপরিহার্য। প্রথম, ঈমান বিল গায়েব অদৃশ্যে বিশ্বাস স্থাপন: দ্বিতীয়, নামায কায়েম করা এবং তৃতীয়, আল্লাহ তাআলা যে রিযক দান করেছেন, তা থেকে আল্লাহর রাস্তায় খরচ করা। অন্যত্র বলা হয়েছে:

 

لَنْ تَنَالُوْا الْبِرَّ حَتّى تُنْفِقُوْنَ مِمَّا تَحِبُّوْنَ ـ ال عمران : ٩٢

 

“তোমাদের প্রিয় জিনিসগুলো আল্লাহর পথে অকাতরে খরচ না করা পর্যন্ত পুণ্যশীলতার উচ্চ মর্যাদা তোমরা কিছুতেই লাভ করতে পারো না।”

 

আবার বলা হয়েছে:

 

اَلْشَّيْطنُ يَعِدُكُمْ الْفَقْرَ وَيَامُرُكُمْ بِالْفَحْشَآَءِ ـ البقرة : ٢٦٨

 

“টাকা-পয়সা খরচ করলে শয়তান তোমাদেরকে গরীব হয়ে যাওয়ার ভয় দেখায় এবং তোমাদেরকে লজ্জাকর কাজ-কৃপণতার জন্য উদ্বুদ্ধ করে।”

 

এরপর ইরশাদ করা হয়েছে:

 

وَاَنْفِقُوْا فِىْ سَبِيْلِ اللهِ وَلاَ تُلْقُوْا بِاَيْدِيْكُمْ اِلَى التَّهْلُكَةِ ـ ١٩٥

 

“আল্লাহর রাস্তায় খরচ কর এবং নিজের হাতেই নিজেকে ধ্বংসের মুখে নিক্ষেপ করো না (আল্লাহর রাস্তায় খরচ না করলেই নিজকে ধ্বংসের মুখে নিক্ষেপ করা হয়)।”- সূরা আল বাকারা : ১৯৫

 

সর্বশেষ বলা হয়েছে:

 

وَمَنْ يُّوْقَ شُحَّ نَفْسِه فَاُوْلَئْكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ ـ الحشر : ٩

 

“মনের সংকীর্ণতা হতে যারা বাঁচতে পারবে তাঁরাই পরম কল্যাণ লাভ করবে।”- সূরা আল হাশর : ৯

 

উল্লেখিত আয়াতসমূহ থেকে পরিষ্কার জানতে পারা যায় যে, দুনিয়ায় মানুষের জীবন যাপনের দুটি মাত্র পথ বিদ্যমান। একটি আল্লাহর পথ-যার পরিণামে চিরন্তন সুখ শান্তি এবং পরম কল্যাণ রয়েছে। এ পথে মানুষের দিল উদার-উন্মুক্ত হয়ে থাকাই স্বাভাবিক। আল্লাহ তাকে কম কিংবা বেশী যে পরিমাণ রিযকই দান করেছেন, তা থেকে সে নিজের যাবতীয় প্রয়োজন পূর্ণ করবে, অন্যান্য ভাইদেরকেও যথাসম্ভব সাহায্য করবে এবং আল্লাহর কালেমা বুলন্দ করা বা আল্লাহর দ্বীন ইসলামকে কায়েম করার কাজেও ব্যয় করবে। অপরটি হচ্ছে শয়তানের পথ। এ পথে বাহ্য দৃষ্টিতে মানুষ খুব আনন্দ এবং সুখ দেখতে পায়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এ পথে ধ্বংস এবং বিপর্যয় ভিন্ন আর কিছুই নেই। এ পথে স্বাভাবিকভাবেই অর্থ-সম্পদ শোষণ করে সঞ্চয় করতে চেষ্টা করে এবং অর্থের জন্য মন ও প্রাণ দিতেও কুন্ঠিত হয় না। আর তা করতেও প্রস্তত হয় না। একান্তই যদি খরচ করে, তবে তা কেবল নিজের প্রয়োজন এবং নিজের মনের লালসা চরিতার্থ করার জন্য মাত্র।

 

আল্লাহর পথের যাত্রীদেরকে আল্লাহর রাস্তায় ধন-সম্পদ খরচ করার যে নিয়ম ও পন্থা বলে দেয়া হয়েছে, এখানে ধারাবাহিকভাবে তা উল্লেখ করা হয়েছে:

 

এক: সর্বপ্রথম কথা এই যে, কেবলমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্যই খরচ করবে, কারো প্রতি অনুগ্রহ প্রদর্শন করা বা দুনিয়ায় নাম ও খ্যাতি লাভ করার জন্য খরচ করবে না।

 

وَمَا تُنْفِقُوْنَ اِلاَّ اِبْتِغَاءَ وَجْهِ اللهِ ـ البقرة : ٢٧٢

 

“তোমরা যা কিছু খরচ কর, তাতে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ ছাড়া তোমাদের যেন আর কিছুই লক্ষ্য না থাকে।”

 

يَآ يُّهَا الَّذِيْنَ امَنُوْا لاَتُبْطِلُوْا صَدَقتِكُمْ بِالْمَنِّ وَاَلاَذى كَالَّذِيْ يُنْفِقُ مَالَهُ وِئَآءَ النَّاسِ وَلاَيُؤْمِنُ بِاللهِ وَالْيُوْمِ الاخِرِ فَمَثَلُه’ كَمَثَلِ صَفْوَانٍ عَلَيْهِ تُرَابٌ فَاصَابَه وَابِلٌ فَتَرَكَاهُ صَلْدًا البقرة : ٢٦٤

 

“হে ঈমানদারগণ! তোমরা তোমাদের দান-খয়রাতকে অনুগ্রহ প্রকাশ করে এবং মন:কষ্ট দিয়ে সেই ব্যক্তির ন্যায় কষ্ট দিও না-যে ব্যক্তি কেবল পরকে দেখাবার জন্য খরচ করে এবং আল্লাহ ও পরকালকে বিশ্বাস করে না। তার দান-খয়রাত ঠিক তেমনি যেমন একটি প্রস্তর খন্ডের ওপরে মাটি পড়ে আছে, এমতাবস্থায় তার ওপর যদি প্রবল বৃষ্টিপাত হয় তবে সমস্ত মাটিই ধুয়ে-মুছে প্রস্তর খণ্ডটি একেবারে ছাফ ও মাটিহীন হয়ে যাবে।”- সূরা আল বাকারা : ২৬৪

 

দুই : কাউকে কিছু দান করলে তার কাছে অনুগ্রহ প্রকাশ করতে পারবে না এবং এমন কোনো কাজ করতে পারবে না যাতে তার মনে কিছু মাত্র কষ্ট লাগতে পারে:

 

اَلَّذِيْنَ يُنْفِقُوْنَ اَمْوَالَهُمْ فِىْ سَبِيْلِ اللهِ ثُمَّ لاَيُتْبِعُوْنَ مَآاَنْفَقُوْا مَنَّا وَّلاَ اَذّى لَّهُمْ اَجْرَهُمْ عِنْدَ رَبَّهِمْ وَلاَ خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلاَهُمْ يَحْزَنُوْنَ ـ قَوْلٌ مَعْرُوْفٌ وَّمَغْفِرَةٌ خَيْرٌ مِنْ صَدَقَةَ يَّتْبَعُهَآ اّذّى : البقرة : ١٦٢-١٦٣

 

“আল্লাহর পথে যারা খরচ করে এবং খরচ করার পর নিজের অনুগ্রহ প্রকাশ করে না এবং কাউকে মন:কষ্ট দেয় না, তাদের জন্য আল্লাহর কাছে বড়ই সওয়াব আছে এবং কোনো প্রকার ভয় ও ক্ষতির আশংকা তাদের নেই। কিন্তু যেসব দানের পর কষ্ট দেয়া হয় সেসব দান অপেক্ষা প্রার্থীকে নম্রতার সাথে ফিরিয়ে দেয়া এবং ‘ভাই’, ক্ষমা কর’ বলে বিদায় করাই উত্তম।”- সূরা আল বাকারা : ২৬২-২৬৩

 

তিন: আল্লাহর পথে সবসময়ই ভালো জিনিস দান করা উচিত। বেছে বেছে কেবল খারাপটাই যেন দেয়া না হয়। গরীবকে দেয়ার জন্য যারা ছিন্ন জামা-কাপড় তালাশ করে এবং কোনো দরিদ্রকে খাওয়াবার জন্য নিকৃষ্টতর খাদ্য প্রদান করে, আল্লাহর কাছ থেকে তারা অনুরূপ নিকৃষ্ট ফলই পাবে:

 

يَآيُّهَا الَّذِيْنَ امَنُوْا مِنْ طَيِّبَةُ مِنْ طَيّبِتِ مَاكَسَبَتُمْ وَمِمَّآ اَخْرَجْنَا لَكُمْ مِّنْ الاَرْضِ وَلاَ تَيْمَّمُوْا الْخَبِيْثَ مِنْهُ تُنْفِقُوْنَ ـ البقرة : ١٦٧

 

“হে ঈমানদারগণ! তোমরা যা উপার্জন করেছ এবং আমরা তোমাদের জন্য মাটির বুক থেকে যা নির্গত ও উৎপন্ন করেছি, তা থেকে ভালো ভালো জিনিস আল্লাহর রাস্তায় খরচ কর-আল্লাহর পথে খরচ করার জন্য নিকৃষ্ট মাল তালাশ করে ফিরো না।”- সূরা আল বাকারা : ২৬৭

 

চার : যতদূর সম্ভব আল্লাহর রাস্তায় গোপনভাবেই খরচ করতে হবে, লোক দেখানোর বিন্দুমাত্র ভাব যেন তাতে স্থান না পায়। প্রকাশ্যভাবে খরচ করায় যদিও দোষের কিছু নেই কিন্তু তবুও গোপনে খরচ করা উত্তম।

 

اِنْ تُبْدُوْا الصَّدَقتِ فَنْعِمًا هِىَ وَاِنْ تُخْفُوْنَ وَتُؤْتُوْهَا الْفُقَرَاءَ فُهُمْ خَيْرَ لَّكُمْ وَيُكَفِّرُ عَنْكُمْ مِنْ سَيَّاتِكُمْ ـ البقرة: ١٧١

 

“প্রকাশ্যভাবে খরচ করলে তা ভালো: কিন্তু লুকিয়ে গরীবদের দান করলে তোমাদের পক্ষে অতি ভালো এবং তাতে তোমাদের গুনাহ দূর হয়ে যাবে।”- সূরা আল বাকারা : ২৭১

 

পাঁচ : নির্বোধ ও অজ্ঞ লোকদেরকে তাদের প্রয়োজনতিরিক্ত সম্পদ কখনও দেয়া যাবে না। কারণ অধিক অর্থ পেয়ে তাদের বিভ্রান্ত হয়ে যাওয়ার এবং তাদের হাতে সম্পদ নষ্ট হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে। আল্লাহর ইচ্ছা এটা যে, খাদ্য ও বস্ত্র সকল মানুষকেই দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে, সে যত বড় পাপী আর আল্লাহদ্রোহী হোক না কেন। কিন্তু মদপান, গাঁজা, আফিম খাওয়া এবং জুয়া খেলার জন্য কাউকে এক পয়সাও দেয়া যেতে পারে না।

 

وَلاَ تُؤْتُوْا السُّفَهَآَءَ اَمْوَالَكُمْ الَّتِىْ جَعَلَ اللهُ لَكُمْ قِيْمًا وَّارزٌقُوْهُمْ فِيْهَا وَاكْسُوْهُمْ ـ النساء : ٥

 

“তোমাদের ধন-সম্পত্তিকে আল্লাহ তাআলা জীবনযাপনের উপায় করে দিয়েছেন, কাজেই তা কখনও অজ্ঞ-মূর্খতার হাতে ছেড়ে দিও না। অবশ্য তা দ্বারা তাদের খাওয়া-পরার ব্যবস্থা নিশ্চয়ই করে দিতে হবে।”

 

ছয় : কারো প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্য তাকে ধার দেয়া হলে বার বার তাগাদা করে তাকে বিরক্ত করো না। তা আদায় করার জন্য তাকে যথেষ্ট অবকাশ দিতে হবে। আর তা ফিরিয়ে দেয়ার ব্যাপারে তার অক্ষমতা যদি নিসন্দেহে জানা যায় এবং ঋণদাতারও যদি ক্ষমা করার মতো সঙ্গতি থাকে, তবে তাকে মাফ করে দেয়াই বাঞ্ছনীয়ঃ

 

وَاِنْ كَانَ ذُوْ عَسْرَةً فَنَظِرَةٌ اِلى مَيْسَرَةٍ وَاَنْ تَصَدَّقُوْا خَيْرَ لٌكُمْ اِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُوْنَ ـ البقرة : ٢٨٠

 

“ঋণী ব্যক্তির আর্থিক অবস্থা খারাপ হলে সচ্ছল হওয়া পর্যন্ত তাকে অবশ্যই সময় দিতে হবে। আর তাকে ক্ষমা করে দেয়া আরও ভালো—অবশ্য যদি তোমরা এর স্বার্থপরতা বুঝতে পার।”- সূরা আল বাকারাঃ ২৮০

 

সাতঃ  মানুষকে দান করারও একটা সীম আছে। সেই সীমা কখনও লংঘন করা যেতে পারে না। নিজেকে এবং নিজের সন্তান-সন্তুতিকে বঞ্চিত করে পরকে দান কারার আদেশ আল্লাহ তাআলা করেননি-তাঁর উদ্দেশ্যও তা নয়। আল্লাহর ইচ্ছা এই যে, সহজ ও সাধারণভাবে জীবনযাপনের জন্য যা কিছুর প্রয়োজন হবে তা তো খরচ করতেই হবে, তারপরে যা উদ্বৃত্ত থাকবে তা হতেই আল্লাহর রাস্তায় খরচ করবে:

 

وَيَسْئَلُوْنَكَ مَاذَا يُنْفِقُوْنَ قُلِ الْعَفْوَ ـ البقرة : ٢١٩

 

“তারা জিজ্ঞেস করে: কি খরচ করবো? (হে নবী! আপনি) বলে দিন যে, প্রয়োজনের অতিরিক্ত যা তাই খরচ করবে।”- সূরা বাকারা: ২১৯

 

وَاَلَّذِيْنَ اِذَا اَنْفَقُوْآ لَمْ يُسْرِفُوْا وَلَمْ يُقتُرُوْا وَكَانَ بَيْنَ ذَلِكَ قَوَامًا ـ الفرقان : ٦٧

 

“আল্লাহর নেক বান্দাহ তারাই-যারা খরচ করে; কিন্তু অনর্থক খরচ করে না এবং খুব বেশী কার্পণ্যও করে না। বরং এ দু প্রান্তসীমার মধ্যবর্তী পন্থাই হয় তাদের আদর্শ।” সূরা আল ফুরকান : ৬৭

 

وَلاَ تَجْعَلْ يَدَكَ مَغْلُوْلَةً اِلى عُنُقِكَ وَلاَ تَبْسُطْهَا كُلَّ الْبَسْطِ فَتَقْعُدَ مَلُوْمًا مَّحْسُوْرًا ـ بنى اسرايل : 29

 

“তোমাদের (দানের) হাত গুটিয়ে একেবারে গলার সাথে বেঁধে নিও না এবং তা বেশী ছড়িয়েও দিও না, কারণ তার ফলে তোমাকে অনুতপ্ত এবং লোকদের কাছে তিরস্কৃত হতে হবে।” সূরা বনী ঈসরাঈল : ২৯

 

আট : এ দানের উপযুক্ত পাত্র কে? সর্বশেষে একথাও জেনে নেয়া আবশ্যক। তার এক পূর্ণ তালিকাও আল্লাহ তাআলা পাক কালামে পেশ করেছেন। কে কে আপনার সাহায্য পেতে পারে এবং আপনার উপার্জনে আল্লাহর তরফ থেকে কার কার অধিকার নির্ধারিত হয়েছে, এ তালিকা দৃষ্টে তা পরিষ্কাররূপে বুঝতে পারা যায়।

 

وَاتِ ذَا الْقُرْبى حَقَّهُ وَالْمِسْكِيْنَ وَابْنَ السَّبِيْلِ ـ بنى اسرائيل : ٢٦

 

“গরীব নিকটাত্মীয়দেরকে তাদের প্রাপ্য দাও এবং মিসকীন ও গরীব প্রবাসীকেও।”- সূরা বনি ঈসরাঈল :২৬

 

وَاتِ الْماَلَ عَلى جُيَِه ذَوِى الْقُرْبى وَالْيَتَمى وَالْمَسْكِيْنَ وَابْنَ السَّبِيْلِ وَالسًَّآئِلِيْنَ وَفِىْ الرِّقَابِ ـ البقرة : ١٧٧

 

“তার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে যারা নিকাত্মীয়, ইয়াতীম, মিসকীন, পথিক ও প্রার্থীকে এবং দাস ও কয়েদীদের মুক্তি বিধানের জন্য অর্থ দান করে, তারা আল্লাহর প্রিয়।”- সূরা আল বাকারা : ১৭৭

 

وَّبِالْوَالِدَيْنِ اَحْسَانًا وَّبِذِى القُرْبى وَالْيَتمى وَالْمَسكِيْنَ وَالْجَارِذِى الْقُرْبِى وَالْجَارِ الْجُنُبِ وَالصَّاحِبِ بِالْجَنْبِ وَابْنِ السَّبِيْلِ وَمَا مَلَكَتْ اَيْمَانُكُمْ ـ النساء : ٣٦

 

“নিজের পিতা-মাতা, নিকটাত্মীয়, ইয়াতীম, মিসকীন, আত্মীয় প্রতিবেশী ও অনাত্মীয় প্রতিবেশী, চলার সাথী, প্রবাসী এবং নিজের দাস-দাসীদের সাথে ভাল ব্যবহার কর।” সূরা আন নিসা : ৩৬

 

وَيُطْعِمُوْنَ الطّعَامَ عَلى حُبِّه مِسْكِيْنًا وَّيَتِيْمًا اِنَّمَا نُطْعِمُكُمْ لِوَجْه الله لاَنُرِيْدُ مِنْكُمْ جَزَآءً وَّلاَ شُكُوْرًا ـ اِنَّا نَخَافُ مِنْ رَّبِّنَا يُوْمًا عَبُوْسًا قَمْطَرِيْرًا ـ الدهر : ٨ - ١٠

 

“আল্লাহর নেক বান্দাহগণ ইয়াতীম, মিসকীন এবং কয়েদীকে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও প্রেম লাভ করার উদ্দেশ্যে খাদ্যদান করে। তারা বলে যে,আমরা তোমাদেরকে শুধু আল্লাহর জন্য খানা খাইয়ে থাকি। আমরা তোমাদের কাছে কোনো বিনিময় ও কৃতজ্ঞতা চাই না। আমরা কেবল আল্লাহর কাছে সেই দিনেরই ভয় করছি, যে দিনের কঠিন বিপদে মানুষের মুখ শুকিয়ে যাবে এবং কপালে ভাঁজ পড়ে যাবে।”- সূরা আদ দাহর : ৮-১০

 

وَفِىْ اَمْوَالِهِمْ حَقٌ لِّلْسَّآئِلِ وَالْمَحْرُوْمِ ـ الذّريت : ١٩

 

“এবং তার ধন-সম্পদে প্রার্থী ও বঞ্চিত জনের অধিকার রয়েছে।”

 

لِلْفُقَرَآءِ الَّذِيْنَ اُحْصِرُوْا فِىْ سَبِيْلِ اللهِ لاَيَسْتَطِيْعُوْنَ ضَرْبًا فِىْ الاَرْضِ يَحْسَبُهُمُ الْجَاهِلُ اَغْنِيَآءَ مِنَ التَّعَفُّفْ تَعْرِفُهُمْ بِسْيْمهُمْ لاَيَسْئَلُوْنَ النَّاسَ اِلْحَافًأ وَمَا تُنْفِقُوْا مِنْ خِيْرِ فَاِنَّ اللهَ بِه عَلِيْمٌ ـ

 

“যারা সকল সময়ে আল্লাহর কাজে লিপ্ত থাকে বলে নিজেদের জীবিকা উপার্জনের জন্য কোনো কাজ করতে পারে না, দান-খয়রাত তাদেরই প্রাপ্য। তাদের আত্মসম্মান জ্ঞান দেখে অন্তত মূর্খ লোকেরা তাদেরকে ধনী বলে মনে করে। কিন্তু তোমরা তাদের বেশ ও রূপ দেখেই বুঝতে পার, তারা কতো কষ্ট করছে। তোমাদের নিজেদেরই অগ্রসর হয়ে তাদের দান করা উচিত। কারণ, তারা মানুষকে জড়িয়ে ধরে সাহায্য চাওয়ার মত লোক নয়, গোপনভাবে তোমরা তাদেরকে যা কিছু দেবে আল্লাহ তা নিশ্চয় জানাবেন এবং তিনি তার বিনিময় নিশ্চয়ই দেবেন।” সূরা আল বাকারা : ২৭৩

 

যাকাত আদায়ের নিয়ম

 

পূর্বের প্রবন্ধে আল্লাহর রাস্তায় খরচ করার সাধারণ হুকুম বিবৃত হয়েছে। এখন যাকাত প্রসংগে যাবতীয় হুকুম বিস্তারিতভাবে আলোচিত হবে।

 

যাকাত সম্পর্কে কুরআন মজীদে আল্লাহ তাআলা তিন স্থানে ভিন্ন ভিন্নভাবে হুকুম দিয়েছেন। সূরা আল বাকারায় বলা হয়েছে:

 

اِنْفِقُوْا مِنْ طَيِّبتِ مَاكَسَبْتُمْ وَمِمَّا اَخْرَجْنَا لَكُمْ مِنَ الارْضِ ـ

 

“তোমরা নিজেরা যে পবিত্র ধন-সম্পদ উপার্জন করছেো এবং জমি থেকে যে ফসল আমি তোমাদের দান করেছি-এসব কিছু থেকে তোমরা আল্লাহর রাস্তায় খরচ করো।”- সূরা আল বাকারা : ২৬৭।

 

সূরা আল আনআমেও এ প্রসংগে বলা হয়েছে যে, আমিই তোমাদের জন্য যমীনে বাগিচা এবং ক্ষেত-খামার তৈরি করেছি। অতএব: ১৪১

 

كَلُوْ مِنْ ثَمَرِه اَثْمَرَ وَاتُوْا حَقَّه يَوْمَ حَصَادِه ـ الانعَام ـ ١٤١

 

“(বাগান এবং ক্ষেতে) যখন ফল বা ফসল ফলবে তখন তোমরা তা থেকে নিজেদের খাবার সংগ্রহ কর এবং ফল বা ফসল কাটার দিন তা থেকে আল্লাহর প্রাপ্য আদায় করো।”- সূরা আল আনআম: ১৪১

 

এ উভয় আয়াতেই জমির ফসলের যাকাত সম্পর্কে বলা হয়েছে। হানাফী মাযহাবের ফিকাহ শাস্ত্রবিদগগণের মতে প্রাকৃতিক সম্পদ-কাঠ, ঘাস এবং বাঁশ ইত্যাদি ভিন্ন সকল প্রকার শস্য তরকারী ও ফলে আল্লাহর পাওনা রয়েছে এবং তা অবশ্যই আদায় করতে হবে। হাদীস শরীফে সুস্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে যে, বৃষ্টি, নদী ও সমুদ্রের পানি থেকে যেসব ফসল জন্মে তাতে মোট ফসলের এক-দশমাংস আল্লাহর প্রাপ্য এবং যে জমিতে মানুষকে কৃত্রিম উপায়ে পানি সেচের ব্যবস্থা করতে হয়েছে তাতে আল্লাহর অংশ নির্ধারিত হয়েছে মোট ফসলের বিশ ভাগের এক ভাগ। এ উভয় প্রকার অংশই শস্য কর্তনের সাথে সাথেই আদায় করা ওয়াজিব।

 

এর পর সূরা তাওবায় বলা হয়েছে:

 

وَالَّذِيْنَ يَكْنِزُوْنَ الْذِّهَبَ وَالْفِصَّةَ وَلاَ يُنْفِقُوْنَهَا فِىْ سَبِيْلِ اللهِ فَبَشِّرْهُمْ بِعَذَابٍ اَلَيْمٍ ـ يَّوْمَ يَحْمى عَلَيْهَا فِىْ نَارِ جَهَنَّمَ فَتُكْوْى بِهَا جِبَاهُهُمْ وَجُنُوْبُهُمْ وَظُهُوْرُهُمْ هَذّا مَاكَنَزْتُمْ لاَنْفُسِكُمْ فَذُوْقُوْا مَا كُنْتُمْ تَكْنِزُوْنَ ـ التوبة : ٣٤-٣٥

 

“যারা সোনা ও রূপা জমা করে রাখে এবং তা থেকে আল্লাহর রাস্তায় মোটেই খরচ করে না, তাদেরকে কঠিন শাস্তির সুসংবাদ দাও। সেই দিনের আযাবের কথা জানিয়ে দাও যেদিন সোনা ও রূপা আগুনে উত্তপ্ত করে তাদের ললাটে, পাঁজরে ও পৃষ্ঠদেশে দাগ দেয়া হবে। আর তাদেরকে বলা হবে যে, এটাই হচ্ছে তোমাদের নিজেদের জন্য সঞ্চিত সেই ধন-সম্পদ। তোমরা যা কিছু সঞ্চয় করেছিলে এখন তারই স্বাদ গ্রহণ করো।”- সূরা আত তাওবা : ৩৪-৩৫

 

অতপর বলা হয়েছে:

 

اِنًَّمَا الصَّدَقتُ لِلْفُقََرَآءِ وَالْمَسْكِيْنَ وَالْعمِلِيْنَ عَلَيْهَا وَالْمُؤْلَّفَةِ قُلُوْبُهُمْ وَفِىْ الرَّقَابِ وَالْغَارِمِيْنَ وَفِىْ سَبِيْلِ اللهِ وَاَبْنِ السَّبيْلِ فَرِيْضضةٌ مِّنْ اللهِ ـ التوبة : ٦٠

 

“যাকাত আল্লাহর নির্ধারিত ফরয। এটা দেয়া হবে ফকীর, মিসকীন এবং যাকাত উসুলকারী কর্মচারীদেরকে, ভিন্ন ধর্মের লোকদের মন জয় করা, দাসত্ব শৃংখলে আবদ্ধ লোকদের মুক্তির ব্যবস্থা করা, ঋণী লোকদের ঋণ শোধ করা, আল্লাহ নির্ধারিত সার্বজনীন কাজে এবং নি:স্ব পথিকদের সাহায্যার্থেও এটা খরচ করা হবে।”- সূরা আত তাওবা : ৬০

 

এরপর আল্লাহ বলেছেন:

 

خَذُ مِنْ اَمْوَالِهِمْ صَدَقَةً تَطَهِّرُهُمْ وَتُزْكِّهِمْ : التورة : ١٠٣

 

“তাদের ধন-সম্পদ থেকে যাকাত উসুল করে তাদেরকে পবিত্র এবং পরিচ্ছন্ন করে দাও।” সূরা আত তাওবা : ১০৩

 

উল্লেখিত তিনটি আয়াত থেকেই জানা যায় যে, যেসব সম্পদ সঞ্চয় করা হবে এবং পরিমাণে বৃদ্ধি করা হবে তা থেকে যদি আল্লাহর পথে খরচ করা না হয়, তবে তা নাপাক হবে, তা পবিত্র করার একমাত্র উপায় হচ্ছে তা থেকে আল্লাহর প্রাপ্য অংশ উপযুক্ত লোকদের মধ্যে বন্টন করা। হাদীসে উল্লেখিত হয়েছে যে, সোনা ও রূপা সঞ্চয়কারীদের সম্পর্কে যখন এ আযাবের সংবাদ আসলো, তখন মুসলমান জনসাধারণ অত্যন্ত ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। কারণ এ আয়াতে অনুসারে তারা মনে করেছিল যে, কারো কাছে এক পয়সাও জমা রাখা অন্যায়, সব খরচ করে দিতে হবে। অবশেষে হযরত উমর ফারুক (রা) নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খেদমতে উপস্থিত হয়ে মুসলমানদের এ উৎকণ্ঠার কথা জানালেন। হযরত রাসূল (সা) উত্তরে এরশাদ করলেন: ‘আল্লাহ তোমাদের প্রতি যাকাত এজন্যই ফরয করেছেন যে, তা আদায় করলে অবশিষ্ট ধন তোমাদের জন্য পবিত্র ও হালাল হয়ে যাবে।’ হযরত আবু সায়ীদ খুদরী (রা) থেকেও এরূপ একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। রাসূলে পাক (সা) বলেছেন, তোমার মাল থেকে যখন যাকাত আদায় করে দিলে, তখন তোমার প্রতি যা অবশ্য কর্তব্য (ওয়াজিব) ছিল তা তুমি আদায় করলে।

 

উল্লেখিত আয়াত থেকে শুধু সোনা-রূপার যাকাতের নির্দেশ জানতে পারা যায়; কিন্তু হাদীস থেকে জানা যায় যে, ব্যবসায়ের পণ্য, উট, গরু-ছাগলেরও যাকাত আদায় করতে হবে। রূপার সাড়ে বায়ান্ন তোলায় এবং স্বর্ণের সাড়ে সাত তোলায় যাকাত ফরয হয়। চল্লিশটি ছাগল এবং ত্রিশটি গরুতে যাকাত দিতে হবে এবং ব্যবসায়ের পণ্যের মূ্ল্যে সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার মূ্ল্যের সমান হলে যাকাত দিতে হবে। অর্থাৎ এ নির্দিষ্ট পরিমাণ যার কাছে বর্তমান থাকবে এবং এভাবে তার একটি বছর সময় অতীত হবে, তাকে এ চল্লিশ ভাগের একভাগ যাকাত বাবদ আদায় করতে হবে। হানাফী মাযহাবের ইমামগণ বলেছেন যে, আলাদা আলাদাভাবে সোনা ও রূপার যাকাত ফরয হওয়ার নির্দিষ্ট পরিমাণ যদি বর্তমান না থাকে, কিন্তু দুটিরই সমষ্টিগত মূল্যে যাকাতের পরিমাণ(নেসাব) পর্যন্ত পৌছে তবে তা থেকেও যাকাত আদায় করতে হবে।

 

হযরত উমর ও ইবনে মাসউদ (রা) এর মতে সোনা রূপার অলংকারের যাকাত আদায় করা ফরয। ইমাম আবু হানীফা রাহমাতুল্লাহহি আলাইহহিও এ মত-ই গ্রহণ করেছন। হাদীসে উল্লেখিত হয়েছে যে, রাসূলে (সা) দুজন স্ত্রীলোকের হাতে স্বর্ণের কংকন দেখে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তারা যাকাত আদায় করে কিনা। একজন উত্তরে বললো-না। হযরত (সা) বললেন, আজ যাকাত আদায় না করলে কিয়ামতের দিন তোমার হাতে আগুনের কংকন পরতে তুমি রাজী হবে কি? হযরত উম্মে সালমা রাদিয়াল্লাহু আনহা থকে বর্ণিত হয়েছে, তাঁর কাছে ‘পাঁজেব’ নামক এক প্রকার স্বর্ণের অলংকার ছিল। তিনি রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে জিজ্ঞেস করেছিলেন, এটা কি সঞ্চিত ধনের শামিল? হযরত রাসূল (সা) বললেন, এর পরিমাণের ওপর যদি যাকাত ফরয হয় আর তা থেকে যাকাত আদায় করা হয়; তবে ওটা নিষিদ্ধ সঞ্চয় নয়। এ উভয় হাদীস থেকে জানা যায় যে, সোনা-রূপার অলংকার হলেও তাতে যাকাত ফরয হবে – যেমন মওজুদ সোনা-রূপার ওপর ফরয হয়। অবশ্য হীরা-জহরত বা আংটির কারুকার্যের জন্য যাকাত দিতে হয় না।

 

কালামে পাকে যাকাত পাবার যোগ্য আট শ্রেণীর লোকের কথা উল্লেখিত হয়েছে। এখানে তাদের বিবরণ দেয়া হচ্ছে:

 

গরীব: যাদের কাছে কিছু না কিছু ধন-সম্পদ আছে কিন্তু তা তাদের যাবতীয় প্রয়োজেন পূর্ণ করার পক্ষে যথেষ্ট নয়, খুবই টানাটানির ভেতর দিয়ে যাদের জীবন অতিবাহিত হয়, তদুপরি কারো কাছে কিছু চাইতেও পারে না, এরা গরীব। ইমাম জুহুরী, ইমাম আবু হানীফা, ইবনে আব্বাস, হাসান বসরী, আবুল হাসান করখী এবং অন্যান্য ফকীহগণ এদেরকেই ফকীর বা গরীব বলে অভিহিত করেছেন।

 

মিসকীন: যেসব লোকের অবস্থা আরও খারাপ, পরের কাছে হাত পাততে বাধ্য হয়, নিজের পেটের অন্নও যারা যোগাড় করতে পারে না তারা মিসকীন। যারা সক্ষম কিন্তু বেকার অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে হযরত উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু তাদেরকেও মিসকীনদের মধ্যে গণ্য করেছেন।

 

যাকাত বিভাগের কর্মচারী: ইসলামী রাষ্ট্র যাকাত আদায়ের জন্য যাদেরকে কর্মচারী নিযুক্ত করবে, তাদেরকেও যাকাতের অর্থ থেকেই বেতন দেয়া হবে।

 

যাদের মন রক্ষা করতে হয় : ইসলামের সহায়তার জন্য কিংবা ইসলামের বিরোধিতা বন্ধ করার জন্য যাদেরকে টাকা দেয়ার প্রয়োজন তারা এর অন্তর্ভূক্ত। সেই সকল নও-মুসলিমও এর অন্তর্ভূক্ত যাদেরকে সমস্যা মুক্ত করা একান্ত অপরিহার্য। নও-মুসলিমগন অমুসলিম জাতির সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করে মুসলমানদের সাথে মিলিত হবার কারণে বেকার সমস্যা বা আর্থিক অনটনে পড়ে গেলে তাদের সাহায্য করা মুসলমানদের একটি জাতীয় কর্তব্য। এমনকি তারা ধনী হলেও তাদেরকে যাকাত দেয়া উচিত। এতে তারা ইসলামের ওপর অধিকতর আস্থাবান হবে। হোনাইনের যুদ্ধে জয়ের পর হযরত নবী করীম (সা) নও-মুসলিমদের গনীমতের বহু সম্পদ দান করেছেন। ফলে প্রত্যেক ব্যক্তির ভাগে একশ উট পড়েছিল। আনসারগণ এর বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: ‘এরা সম্প্রতি ইসলাম গ্রহণ করেছে বলে আমি তাদেরকে খুশী করতে চাই।’ এ হাদীসের ভিত্তিতে ইমাম জুহুরী বলেছেন, যেসব ইয়াহুদী-খৃষ্টান মুসলমান হবে বা অন্য কোনো ধর্মাবলম্বী ইসলাম কবুল করবে, তারা ধনী হলেও তাদের যাকাত দেয়া হবে।১

 

গোলাম ও কয়েদীদের মুক্তি বিধান: যে ব্যক্তি দাসত্ব শৃংখলে বন্দী হয়ে আছে এবং যে মুক্তি পেতে চায়, তাকেও যাকাতের অর্থ দেয়া যায়। উক্ত অর্থের বিনিময়ে সে মালিকের দাসত্ব শৃংখলা থেকে নিজেকে মুক্ত করে নেবে। বর্তমান যুগে দাস প্রথার প্রচলন নেই। তাই আমি মনে করি যেসব লোক কোন ব্যাপারে জরিমানা আদায় করতে অক্ষম বলে কয়েদ ভুগতে বাধ্য হয়, যাকাতের অর্থ দিয়ে তাদের মুক্তি বিধান করা যেতে পারে-করলে তাও এ বিভাগই গণ্য।

 

ঋণী ব্যক্তির ঋণ শোধ : যেসব লোক ঋণী অথবা ঋণ আদায় করার সম্বল যাদের নেই, তাদেরকেও যাকাতের টাকা দ্বারা ঋণ ভার থেকে মুক্তি দেয়া যাবে। কিন্তু তাই বলে একজনের কাছে হাজার টাকা থাকলেও সে যদি একশ টাকার ঋণ হয় তাহলে তাকে কিছুতেই যাকাত দেয়া যাবে না। তবে যে ব্যক্তির ঋণ শোধ করার পর যাকাত ফরয হতে পারে, এপরিমাণ অর্থ যদি তার কাছে না থাকে তবে তাকে যাকাত দেয়া যেতে পারে। ফিকাহ শাস্ত্রবিদগণ এটাও বলেছেন যে, যারা অপচয় এবং বিলাসিতা ও কু-কাজ করে ঋণী হয়, তাদেরকে যাকাত দেয়া মাকরূহ। কারণ এমতাবস্থায় তাদেরকে যাকাত দিলে সে ধন-সম্পদের আরও অপচয় করবে এবং যাকাত নিয়ে ঋণ শোধ করার ভরসায় সে আরও অধিক ঋণ গ্রহণ করবে।

 

আল্লাহর পথে : আল্লাহর পথে শব্দটি অত্যন্ত ব্যাপক। মুসলমানদের সমস্ত নেক কাজেই যাকাতের টাকা ব্যয় করা যেতে পারে। কিন্তু বিশেষ করে এর অর্থ হচ্ছে-আল্লাহর পথে জিহাদকারীদের সাহায্য করা। নবী করীম (সা) বলেছেন যে, ধনী ব্যক্তির পক্ষে যাকাত গ্রহণ জায়েয নয় কিন্তু ধনী ব্যক্তিই যদি জিহাদের জন্য সাহায্য গ্রহণ করতে বাধ্য হয়, তবে তাকেও যাকাত দিতে হবে: কারণ এই যে, এক ব্যক্তি ধনী হতে পারে ; কিন্তু জিহাদের জন্য যে বিরাট ব্যয় আবশ্যক, তা সে শুধু নিজের অর্থ দ্বারা পূরণ করতে পারে না। তার এ কাজের জন্য তাকে যাকাতের টাকা সাহায্য করা যাবে।

 

১. এ বিষয়ে ইসলামী আইনের বিস্তৃত বিবরণ দেয়া এখানে সম্ভব নয়। এজন্য তাফহীমুল কুরআনের সূরা তাওবা তাফসীর দ্রষ্টব্য।

 

পথিক-প্রবাসী: পথিক বা প্রবাসীর নিজ বাড়ীতে যত ধন-সম্পদ থাকুক না কেন, কিন্তু পথে বা প্রবাসে সে যদি অভাবগ্রস্ত হয়ে পড়ে তবে তাকে যাকাতের টাকা দিতে হবে।

 

এখন প্রশ্ন এই যে, ওপরে যে আট শ্রেণীর লোকের উল্লেখ করা হলো তাদের মধ্যে কাকে কোন অবস্থায় যাকাত দেয়া উচিত আর কোন অবস্থায় না দেয়া কর্তব্য- এ সম্বন্ধে এখানে আলোচনা করা যাচ্ছে:

 

এক: কোন ব্যক্তি নিজের পিতা বা পুত্রকে যাকাত দিতে পারে না, স্বামী স্ত্রীকে এবং স্ত্রী স্বামীকে যাকাত দিতে পারবে না। এ সম্পর্কে ইসলামী শরীয়াতবিদগণ সম্পূর্ণ একমত। কোনো কোনো ফিকাহ শাস্ত্রকার এটাও বলেছেন যে, যেসব নিকটাত্মীয়ের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব তোমার ওপর; যারা শরীয়াত অনুসারে তোমার উত্তরাধীকারী, তুমি তাদেরকে যাকাত দিতে পার না; অবশ্য দূরবর্তী আত্মীয় তোমার যাকাত পাবার অধিকারী হবে। বরং অন্যান্য লোকদের অপেক্ষা তাদের অধিকার বেশী স্বীকৃত হবে। কিন্তু ইমাম আওজায়ী বলেছেন যে, যাকাত দেবার জন্য কেবল নিজের আত্মীয় এগানাই তালাশ করো না।

 

দুই : যাকাত কেবল মুসলমানই পেতে পারে। অমুসলমানগণ যাকাত পেতে পারে না। যাকাতের সংজ্ঞা সম্পর্কে হাদীসে বলা হয়েছে : تُؤْخَذُ مِنْ اَغْنِيَاءَ كُمْ وَتُرَدُّ عَلى فُقَرَاءَ كُمْ ـ যাকাত তোমাদের ধনীদের কাছ থেকে গ্রহণ করা হবে এবং তোমাদের গরীবদের মধ্যে বন্টন করে দেয়া হবে। অমুসলমান গরীবকে সাধারণ দান-খয়রাত অবশ্যই দেয়া হবে। বরং সাধারণ দানের ক্ষেত্রে মুসলমান-অমুসলমানের মধ্যে পার্থক্য করে মুসলমানকে দেয়া এবং অমুসলামানকে না দেয়া আদৌ সমীচীন নয়।

 

তিন : ইমাম আবু হানীফা, ইমাম আবু ইউছুফ এবং ইমাম মুহাম্মাদ(সা) বলেন যে, প্রত্যেক এলাকার যাকাত সেই এলাকার গরীবদের মধ্যেই বন্টন করতে হবে। এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় যাকাতের অর্থ প্রেরণ করা ঠিক নয়। কিন্তু কোনো এলাকায় যাকাত গ্রহণ করার মত লোকই যদি না থাকে কিংবা অন্য এলাকায় যদি এমন কোনো বিপদ এসে পড়ে, যে জন্য দূরবর্তী এলাকা থেকে যাকাতের অর্থ সেখানে প্রেরণ করা অত্যন্ত জরুরী বোধ হয়, যথা-প্লাবন, দুর্ভিক্ষ ইত্যাদি; তবে তদনুযায়ী যাকাত বন্টন করা কোনো দোষের কাজ নয়। ইমাম মালেক ও ইমাম সুফিয়ান সাওরীর মতও প্রায় এরূপ। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় যাকাত প্রেরণ একেবারেই অসংগত বা নাজায়েয নয়।

 

চার: কোনো কোনো লোকের মতে যারা দু বেলা খাবার ব্যবস্থা আছে, তার পক্ষে যাকাত গ্রহণ করা উচিত নয়। আবার কেউ কেউ বলেছন, যার কাছে দশ টাকা মওজুদ আছে,অন্য একজনের মতে যার কাছে সাড়ে বার টাকা আছে তার যাকাত নেয়া উচিত নয়। কিন্তু ইমাম আবু হানীফা এবং হানাফী মাযহাবের অন্যান্য আলেমগণ বলেছেন যে, যার কাছে পঞ্চাশ টাকার কম নগদ সম্পত্তি থাকবে সে যাকাত গ্রহণ করতে পারবে। বাড়ী ঘরের জিনিসপত্র এবং ঘোড়া ও চাকর এর মধ্যে গণ্য হবে না। অর্থাৎ এসব দ্রব্যাদি থাকা সত্ত্বেও যার পঞ্চাশ টাকার কম সম্পত্তি আছে, সে যাকাত পেতে পারে। এ ব্যাপারে একটি জিনিস হলো আইন আর অপরটি হলো ফযীলতের মান। এ দুটি জিনিসের মধ্যে পার্থক্য আছে।

 

ফযীলতের মান সম্পর্কে হযরত রাসূল (সা) বলেছেন, যার সকাল ও সন্ধ্যার খাদ্যের ব্যবস্থা আছে সে যদি লোকদের কাছে প্রার্থনা করে তবে সে নিজের জন্য আগুন সঞ্চয় করে। অন্য হাদীসে নবী করীম (সা) বলেছেন, মানুষের কাছে ভিক্ষার হাত প্রসারিত করা অপেক্ষা কাঠ কেটেও যদি নিজের অন্ন সংস্থান করা হয়, তবে তাই আমার কাছে অধিক মনোনীত। তৃতীয় একটি হাদীসে বলা হয়েছে যে, যার কাছে খাদ্য আছে কিংবা যার উপার্জন করার শক্তি আছে তার পক্ষে যাকাত গ্রহণ করা উচিত নয়। মানুষের মধ্যে আত্মসম্মানবোধ জাগাবার জন্যেই এটা হযরতের শিক্ষা-এটা আইন নয় আইনের একটি শেষ সীমা নির্দেশ করা হয়েছে এবং কতদূর পর্যন্ত মানুষ যাকাত নিতে পারে তা বলে দেয়া হয়েছে । একটি হাদীসে রাসূলে পাক (সা) করেছেন-

 

لِلسَّائِلِ حَقٌ وَاِنْ جَاءَ عَلَى الْفَرَسِ ـ

 

“ভিক্ষাপ্রার্থী ঘোড়ায় চড়ে আসলেও তাকে ভিক্ষা দিতে হবে।”

 

এক ব্যক্তি হযরতের কাছে জিজ্ঞাসা করলো, আমার কাছে দশ টাকা থাকলে আমি মিসকীনদের মধ্যে গণ্য হবো? হযরত বললেন, হাঁ। একবার দু ব্যক্তি হযরতের কাছে যাকাত চেয়েছিল। হযরত রাসূল (সা) তাদেরকে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে দেখতে লাগলেন এবং বললেন: “তোমরা নিতে চাইলে আমি তোমাদেরকে দেব বটে, কিন্তু মূলত ধনী এবং সক্ষম লোকদের এতে কোনো অংশ নেই।” এসব হাদীস থেকে পরিষ্কার জানা যায় যে, যাকাত ফরয হওয়া নির্দিষ্ট পরিমাণের অর্থ যাদের নেই তারাও গরীবদের মধ্যে গণ্য হয় এবং তাদেরকেও যাকাত দেয়া যেতে পারে। বলাবাহুল্য যাকাত পাওয়ার প্রকৃত অধিকারী কেবল যথার্থ অভাবগ্রস্ত লোক হতে পারে।

 

যাকাতের জরুরী নিয়ম-কানুন এখানে বর্ণিত হলো; কিন্তু এ প্রসংগে একটি অত্যন্ত জরুরী এবং গুরুত্বপূর্ণ কথা দিকে পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা আমি বিশেষ আবশ্যক বলে মনে করি। কারণ যে কথাটি আমি বলতে চাই, বর্তমান মুসলমানগণ তা ভুলে গেছে। তা এই যে, ইসলামের সমস্ত কাজই দলগত ও সমষ্টিগতভাবে সম্পন্ন করতে হয়। ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যমূলক বিচ্ছিন্নতা ইসলাম সমর্থন করে না। মসজিদ থেকে দূরে অবস্থিত কোনো মুসলমান যদি একাকী নামায পড়ে, তবে নামায হবে বটে, কিন্তু ইসলামী শরীয়াতে জামায়াতের সাথে নামায পড়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে-মুসলমান জামায়াতের সাথেই নামায আদায় করুক, এটাই শরীয়াতের কাম্য। কালামে পাকে এ দিকে ইংগিত করে বলা হয়েছে:

 

خُذْ مِنْ اَمْوَالِهِمْ صَدَقَةٌ تُطَهِّرُ هُمْ وَتُزَكِّيْهِمْ بِهَا : التوبة : 103

 

অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা হযরত রাসূলে করীম (সা) মুসলমানদের কাছ থেকে যাকাত উসূল করতে আদেশ দিয়েছেন। মুসলমানদেরকে স্বতন্ত্র ও ব্যক্তিগতভাবে যাকাত আদায় করতে বলা হয়নি। উপরন্তু যাকাত আদায়ের কর্মচারীদের জন্যও যাকাতের অর্থ অংশ নির্দিষ্ট করার অর্থ এই যে, মুসলমানদের ইমাম বা রাষ্ট্রপ্রধান সকলের কাছ থেকে যাকাত আদায় করবে এবং সমষ্টিগতভাবে তা খরচ করবে। নবী করীম (স) একথা বলেছেন:

 

اُمِرْتُ اَنْ اَخَذَ الصَّدَقَةَ مِنْ اغْنِيْاَءِ كُمْ وَاَرُدُّهَا فِىْ فُقَرَاءِ كُمْ ـ

 

অর্থাৎ তোমাদের ধনীদের কাছ থেকে যাকাত আদায় করে তোমাদের গরীবদের মধ্যে বন্টন করার জন্যই আমি আদিষ্ট হয়েছি। নবী করীম (সা) এবং খেলাফায়ে রাশেদীনের আমলেও যাকাত আদায়ের এ পদ্ধতি কার্যকর ছিল। ইসলাম রাষ্ট্রের কর্মকর্তাগণ সমস্ত যাকাত উসুল করতেন এবং কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে তা রীতিমত বন্টন করা হতো।

 

--- সমাপ্ত ---

', 'যাকাতের হাকীকত', '', 'publish', 'closed', 'closed', '', '%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%95%e0%a6%be%e0%a6%a4%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%b9%e0%a6%be%e0%a6%95%e0%a7%80%e0%a6%95%e0%a6%a4', '', '', '2019-10-26 16:16:07', '2019-10-26 10:16:07', '

 

 

যাকাতের হাকীকত

 

সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী

 


 

 

 

স্ক্যান কপি ডাউনলোড

 


বইটির অডিও শুনুনhttp://shibircloud.com/audio/lq/zakater_hakikot.mp3

লো কোয়ালিটি ডাউনলোডহাই কোয়ালিটি ডাউনলোড

 


 

যাকাতের গুরুত্ব

 

নামাযের পর ইসলামের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হচ্ছে যাকাত। সাধারণত নামাযের পরই রোযা উল্লেখ করা হয় বলে অনেকের মনে এ বিশ্বাস জন্মেছে যে, নামাযের পরই বুঝি রোযার স্থান। কিন্তু কালামে পাক থেকে জানা যায় যে, নামাযের পর যাকাতই হচ্ছে সবচেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এ দুটি ইসলামের প্রধান স্তম্ভ-এটা বিধ্বস্ত হয়ে গেলে ইসলামের প্রাসাদও ধূলিসাৎ হয়ে যায়।

 

‘যাকাত’ অর্থ পবিত্রতা এবং পরিচ্ছন্নতা। নিজের ধন-সম্পদের একটি নির্দিষ্ট অংশ গরীব-মিসকীন ও অভাবী লোকদের মধ্যে বন্টন করাকে ‘যাকাত’ বলা হয়। কারণ এর ফলে সমগ্র ধন-সম্পত্তি এবং সেই সাথে তার নিজের আত্মার পরিশুদ্ধি হয়ে থাকে। যে ব্যক্তি আল্লাহ প্রদত্ত ধন-সম্পদ তাঁর বান্দাদের জন্য নির্দিষ্ট অংশ ব্যয় করে না, তার সমস্ত ধন অপবিত্র এবং সেই সাথে তার নিজের মন ও আত্মা পংকিল হতে বাধ্য। কারণ, তার হৃদয়ে কৃতজ্ঞতার নাম মাত্র বর্তমান নেই। তার দিল এতদূর সংকীর্ণ, এতদূর স্বার্থপর, এবং এতদূর অর্থ পিশাচ যে, যে আল্লাহ অনুগ্রত পূর্বক তাকে প্রয়োজনাতিরিক্ত ধন-সম্পদ দান করেছেন তাঁর কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতেও তার মন কুন্ঠিত হয়। এমন ব্যক্তি দুনিয়ায় খালেছভাবে আল্লাহর জন্য কোনো কাজ করতে পারবে, তার দীন ও ঈমান রক্ষার্থে কোনোরূপ আত্মত্যাগ ও কুরবানী করতে প্রস্তুত হতে পারবে বলে মনে করা যেতে পারে কি? কাজেই একথা বলা যেতে পারে যে, যে ব্যক্তি যাকাত আদায় করে না তার দিল নাপাক, আর সেই সাথে তার সঞ্চিত ধন-মালও অপবিত্র, তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।

 

‘যাকাত’ ফরয করে আল্লাহ তাআলা প্রত্যেকটি মানুষকে এক কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন করেছেন। যে ব্যক্তি নিজ ইচ্ছানুক্রমেই প্রয়োজনতিরিক্ত ধন-মাল হতে আল্লাহর নির্দিষ্ট হিস্যা আদায় করে এবং আল্লাহর বান্দাহদের যথাসাধ্য সাহায্য করে, বস্তুত সেই ব্যক্তিই আল্লাহর কাজ করার উপযুক্ত, ঈমানদার লোকদের মধ্যে গণ্য হওয়ার যোগ্যতা তারই রয়েছে। পক্ষান্তরে যার দিল এতদূর সংকীর্ণ যে, আল্লাহর জন্য এতটুকু কুরবানী করতে প্রস্তুত হয় না, তার দ্বারা আল্লাহর কোনো কাজই সাধিত হতে পারে না-সে ইসলামী জামায়াতে গণ্য হবার যোগ্য নয়। প্রকৃতপক্ষে তাকে মানব দেহের একটি পঁচা অংগ মনে করা যেতে পারে, আর পঁচা অংগকে যত শীঘ্র কেটে বিচ্ছিন্ন করা যায় শরীরের অন্যান্য অংগ-প্রত্যংগের পক্ষে ততই মংগল। অন্যথায় সমগ্র দেহেই পচন শুরু হবে। এ জন্যই হযরত মুহাম্মদ (সা) এর ইন্তেকালের পর যখন আরবের কোনো এক গোত্রের লোক যাকাত আদায় করতে অস্বীকার করেছিল, তখন (প্রথম খলীফা) হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহু তাদের বিরুদ্ধে-কাফেরদের বিরুদ্ধে যেমন করতে হয় ঠিক তেমনি-যুদ্ধের কথা ঘোষণা করেছিলেন। অথচ তারা নামায পড়তো, আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূলের প্রতি তাদের ঈমানও বর্তমান ছিল। এত নিসন্দেহে প্রমাণিত হয় যে, যাকাত আদায় না করলে নামায-রোযা ইত্যাদি তার কোনো কাজই আল্লাহর কাছে গৃহীত হতে পারে না, আর এরূপ ব্যক্তির ঈমানদার হওয়ার দাবী করার আদৌ কোনো মূল্য নেই।

 

কুরআন মজীদ থেকে নিঃসন্দেহে জানতে পারা যায়, প্রাচীনকাল থেকে প্রত্যেক নবীর উম্মাতের প্রতিই সমানভাবে নামায ও যাকাত আদায় করার কঠোর আদেশ করা হয়েছিল-দীন ইসলামের কোনো অধ্যায়েই কোনো নবীর সময়ে কোনো মুসলমানকেই নামায ও যাকাত থেকে রেহাই দেয়া হয়নি। হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম এবং তাঁর বংশের নবীদের কথা আলোচনা করার পর কুরআন পাকে বলা হয়েছে:

 

وَجَعَلْنَاهُمْ أَئِمَّةً يَهْدُونَ بِأَمْرِنَا وَأَوْحَيْنَا إِلَيْهِمْ فِعْلَ الْخَيْرَاتِ وَإِقَامَ الصَّلَاةِ وَإِيتَاءَ الزَّكَاةِ ۖ وَكَانُوا لَنَا عَابِدِينَ

 

আমরা তাদেরকে মানুষের নেতা বানিয়েছি, তারা আমাদেরই বিধান অনুযায়ী পরিচালিত করে-পথপ্রদর্শন করে। আমরা ওহীর সাহায্যে তাদেরকে ভালো কাজ করার, নামায কায়েম করার এবং যাকাত আদায় করার আদেশ করেছি, তারা খাঁটিভাবে আমরা ইবাদাত করতো-হুকুম পালন করতো। সূরা আল আম্বিয়া : ৭৩

 

হযরত ইসমাঈল (আ) সম্পর্কে বলা হয়েছে:

 

وَكَانَ يَأْمُرُ أَهْلَهُ بِالصَّلَاةِ ص وَالزَّكَاةِ وَكَانَ عِندَ رَبِّهِ مَرْضِيًّا

 

“তিনি তাঁর লোকদেরকে নামায এবং যাকাত আদায় করার আদেশ করতেন এবং আল্লাহর দরবারে তিনি বিশেষ মর্যাদা সম্পন্ন ছিলেন।” সূরা মরিয়ম : ৫৫

 

হযরত মূসা আলাইহিস সালাম তাঁর নিজের সম্পর্কে দোয়া করেছিলেন- “হে আল্লাহ! এ দুনিয়ায় আমার মঙ্গল দাও, পরকালেও কল্যাণ দান কর।” এর উত্তরে আল্লাহ সূরা আল আরাফের ১৫৬ আয়াতে বলেছিলেন:

 

عَذَابِي أُصِيبُ بِهِ مَنْ أَشَاءُ ۖ وَرَحْمَتِي وَسِعَتْ كُلَّ شَيْءٍ ۚ فَسَأَكْتُبُهَا لِلَّذِينَ يَتَّقُونَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَالَّذِينَ هُم بِآيَاتِنَا يُؤْمِنُونَ

 

 “যাকে ইচ্ছা হবে, তাকে আমার আযাবে নিক্ষেপ করবো। যদিও আমার রহমত সকল জিনিসের ওপরই পরিব্যাপ্ত আছে; কিন্তু তা কেবল সেই লোকদের জন্যই নির্দিষ্ট করবো যারা আমাকে ভয় করবে এবং যাকাত আদায় করবে, আর যারা আমার বাণীর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে।” সূরা আরাফ : ১৫৬

 

হযরত মূসা আলাইহিস সালামের জাতির লোকদের দিল অত্যন্ত সংকীর্ণ ছিল। ধন-সম্পদ লাভের জন্য প্রাণ দিতেও তারা কুণ্ঠিত হতো না। বর্তমানকালের ইয়াহুদীরাই তার বাস্তব উদাহরণ। এজন্য আল্লাহ তাআলা এ মহান সম্মানিত পয়গম্বরের প্রার্থনা উত্তরে স্পষ্ট ভাষায় বলে দিলেন যে, তোমার উম্মাত যথারীতি যাকাত আদায় করলে আমার রহমত পেতে পারবে অন্যথায় পরিষ্কার জেনে রাখ, তারা আমার রহমত হতে নিশ্চয়ই বঞ্চিত হবে এবং আমার আযাব তাদেরকে পরিবেষ্টন করে নেবে। হযরত মূসা (আ) এর পরেও বনী ইসরাঈলগণকে বার বার এ সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে। বার বার তাদের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করা হয়েছে: আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো বন্দেগেী করবে না এবং রীতিমত নামায ও যাকাত আদায় করবে। (সূরা আল বাকারা, রুকূ : ১০)। শেষ পর্যন্ত তাদেরকে সুস্পষ্ট নোটিশ দেয়া হয়েছে এই বলে :

 

وَقَالَ اللهُ اِنِّي مَعَكُمْ لَئِنْ اَقَمْتُمُ الصًّلوةَ وَاتَيْتُمْ الزَّكوةَ وَامْنْتُمْ بِرُسُلِىِ وَعَزَّرتُمُوْهُمْ وَاَقْرَضْتُمْ اللهَ قَرْضًا حَسَنًا لاَّكَفِّرَنَّ عَنْكُمْ سَيَّاتِكُمْ ـ المائِدة : ١٢

 

আল্লাহ বললেন, “হে নবী ইসরাঈল! তোমরা যদি নামায কায়েম কর, যাকাত আদায় করতে থাক, আমার রাসূলদের ওপর ঈমান আন; তাদের সাহায্য কর এবং আল্লাহকে করযে হাসানা দাও, তাহলে আমি তোমাদের সাথী এবং তোমাদের দোষ-ত্রুটিগুলো দূর করে দেব (অন্যথায় রহমত লাভের কোনো আশাই তোমরা করতে পার না)।” সূরা মায়েদা : ১২

 

হযরত রাসূলে করীম (সা) এর পূর্বে হযরত ঈসা আলাইহিস সালামই সর্বশেষ নবী ছিলেন। আল্লাহ তাআলা তাঁকেও একই সাথে নামায এবং যাকাতের হুকুম দিয়েছেন। সূরা মারিয়ামে বলা হয়েছে:

 

وَّجَعَلّنِى مُبرَكًا اَيْنَا مَاكُنْتُ وَاَوْضنِى بَالصَّلوةِ وَالزَّكوْةِ مَادُمْتُ حَيًا ـ مريم : ٣١

 

“আল্লাহ আমাকে মহান করেছেন-যেখানেই আমি থাকি এবং যতদিন আমি জীবিত থাকবো ততদিন নামায পড়া ও যাকাত আদায় করার জন্য আমাকে নির্দেশ করেছেন।” সূরা মরিয়াম : ৩১

 

এ থেকে নিঃসন্দেহে জানতে পারা যায় যে, দীন ইসলাম প্রত্যেক নবীর সময়ই নামায ও যাকাত এ দুটি স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়েছিল। আল্লায় বিশ্বাসী কোনো জাতিকেই এ দুটি কর্তব্য থেকে কখনও নিষ্কৃতি দেয়া হয়নি।

 

হযরত রাসূলে কারীম (সা) এর উপস্থাপিত শরীয়াতে এ দুটি ফরযকে কিভাবে পরস্পর যুক্ত ও অবিচ্ছেদ্য করে দেয়া হয়েছে, তা অনুধাবন যোগ্য। কুরআন পাকের প্রথমেই যে আয়াতটি উল্লেখিত রয়েছে, তা এই :

 

ذَلِكَ الْكِتبُ لاَرَيْبَ فِيْهِ هُدًى لِّلْمُتَّقِيْنَ ـ الَّذِيْنَ يُؤِْنُوْنَ بِالْغِيْبِ وَيُقِيْمُوْنَ الصَّلوةَ وَمِمَّا رَزَقْنَهُمْ يُنْفِقُوْنَ ـ البقرة :

 

٢ -٣

 

“এ কুরআন আল্লাহর কিতাব-এতে কোনো প্রকার সন্দেহের অবকাশ নেই। এটা পরহেযগার, আল্লাহভীরু লোকদেরকে দুনিয়ার জীবনের সঠিক ও সোজা পথপ্রদর্শন করে। পরহেযগার তারাই যারা অদৃশ্যকে বিশ্বাস করে, নামায কায়েম করে এবং আমরা তাদেরকে যে রিয্ক দিয়েছি তা থেকে খরচ করে।” সূরা আল বাকারা: ২-৩

 

অতপর বলা হয়েছেঃ

 

أُوْلَـٰٓٮِٕكَ عَلى هُدًى مِّنْ رَّبِهِمْ وَاُولئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ ـ البقرة : ٥

 

“বস্তুত এরাই রব প্রদত্ত হেদায়াত লাভ করেছে এবং এরাই সফলকাম।” সূরা আল বাকারা : ৫

 

অর্থাৎ যাদের ঈমান নেই এবং নামায ও যাকাত আদায় করে না তারা শুধু আল্লাহর হেদায়াত থেকেই বঞ্চিত নয়, কল্যাণ ও সাফল্য তাদের ভাগ্যে জুটবে না। তারপর এ সূরা আল বাকারা পড়তে পড়তে সামনে এগিয়ে যান, কয়েক পৃষ্ঠা পরই আদেশ হয়েছে:

 

وَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَآتُوا الزَّكَاةَ وَارْكَعُوا مَعَ الرَّاكِعِينَ ـ البقرة : ٤٣

 

“নামায কায়েম কর, যাকাত আদায় কর এবং রুকূ’কারীদের সাথে একত্রিত হয়ে রুকূ কর (জামায়াতের সাথে নামায আদায় কর) । সূরা আল বাকারা : ৪৩

 

অতপর কিছুদূর অগ্রসর হয়ে এ সূরায় বলা হয়েছে:

 

لَيْسَ الْبِرَّ اَنْ تُوْلُّوْا وَجُوْهَكُمْ الْمَشْرِقِ وَالْمَغْرِبِ وَلكِنَّ البِرَّ مَنْ امَنَ بِاللهِ وَالْيُوْمِ الاخِرِ وَالْمَلئِكَةِ وَالْكِتبِ وَالنَّبِيْنَ وَاَتَى الْمَالَ عَلى حُبِّه ذَوِى الْقُرْبى وَالْيَتمى وَالْمَّسْكِيْنَ وَاَبْنَ السَّآئِلِيْنَ وَفِى ارِّقَابِ وَاَقامَ الصَّلوةَ وَاَتَى الزَّكوةَ وَالْمُؤْفُوْنَ بَعَهْدِهِمْ اِذَا عَهدُوْا الرِّقَابِ وَاَقَامَ الصَّلوَةَ وَاَتَى الزَّكوَةَ وَالْمُؤْفُوْنَ بَعَهْدِهِمْ اِذَا عَهدُوْا وَالصَّبِرِيْنَ فِى الْبَاسَآءِ وَالضَّرَّاءِ وَحَيْنَ الْبَاسِ اُوْلئِكَ الَّذِيْنَ صَدَقُوْا وَاُوْلئِكَ هُمْ الْمُتَّقُوْنَ ـ البقرة : ٧ ١٧

 

“পূর্ব কিংবা পশ্চিমমুখী হয়ে দাঁড়ালেই কোনো পূণ্য লাভ হয় না বরং যে ব্যক্তি আল্লাহ, পরকাল, ফেরেশতা, আসমানী কিতাব এবং পয়গাম্বরদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে, আল্লাহর প্রেমে তার অভাবী আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতিম-মিসকীন, পথিক ও প্রার্থীকে নিজেদেরকে ধন-সম্পদ দান করে, অন্য লোকদেরকে তাদের ঋণ, দাসত্ব কিংবা কয়েদ থেকে মুক্তি লাভের ব্যাপারে সাহায্য করে এবং নামায কায়েম করে ও যাকাত আদায় করে, বস্তুত একমাত্র তারাই পূণ্য লাভ করতে পারে। আর যারা প্রতিশ্রুতি পূরণ করে, বিপদ, ক্ষতি-লোকসান এবং যুদ্ধের সময় যারা ধৈর্যধারণ করে আল্লাহর সত্য পথে দৃঢ়তার সাথে দাঁড়িয়ে থাকে, তারাই পূণ্যবান। তারাই খাঁটি মুসলমান, মুত্তাকী ও পরহেযগার।” সূরা আল বাকারা : ১৭৭

 

এরপর সূরা আল মায়েদায় এ সম্পর্কে যা বলা হয়েছে তাও প্রণিধানযোগ্য :

 

اِنَّمَا وَلَيُّكُمُ اللهُ وَرَسُوْلُهُ وَالَّذِيْنَ امَنُوْا الَّذِيْنَ يُقِيْمُوْنَ الصَّلوةَ وَيُؤْتُوْنَ الزَّكوةَ وَهُمْ رِكِعُوْنَ ـ وَمَنْ يَّتَوَلَّ اللهَ وَرَسُوْلَهُ وَالَّذِيْنَ امَنُوْا فِانَّ حِزْبَ اللهِ هُمُ الْغلِبُوْنَ ـ المائِدَة : ٥٥-٥٦

 

“মুসলমান‍‍‍! তোমাদের প্রকৃত বন্ধু সাহায্যকারী হচ্ছে শুধু আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং ঈমানদার লোকগণ মাত্র। ঈমানদার লোক বলতে তাদেরকে বুঝায়, যারা নামায কায়েম কবে, যাকাত আদায় করে এবং আল্লাহর সামনে মাথা নত করে। অতএব যারা আল্লাহ, রাসূল এবং ঈমানদারদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করবে, তারা আল্লাহর দল বলে বিবেচিত হবে এবং আল্লাহর দলই নিশ্চিতরূপে বিজয়ী হবে।”- সূরা মায়েদা : ৫৫-৫৬

 

এ আয়াতে একটি গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতমত, এ আয়াত থেকে জানা গিয়েছে যে, যারা নামায কায়েম করে, যাকাত আদায় করে তারাই মুসলমান। ইসলামের এ দুটি রুকন যে ব্যক্তি যথাযথরূপে আদায় করে না, তার ঈমানদার হওযার দাবী মূলত মিথ্যা। দ্বিতীয়ত, এ আয়াত থেকে একথাও প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ, রাসূল এবং ঈমানদার লোকগণ একটি দলভুক্ত। অতএব ঈমানদার ব্যক্তিগণের অন্যান্য সকল প্রকার সম্পর্ক ছিন্ন করে এ পার্টিতে শামিল হতে হবে। এ দলের বাইরের কোনো ব্যক্তিকে সে পিতা হোক, ভাই হোক, পুত্র হোক, প্রতিবেশী, স্বদেশবাসী কিংবা অন্য যে কেউ হোক না কেন- কোনো মুসলমান যদি তাকে নিজের বন্ধুরূপে গ্রহণ করে এবং তার সাথে ভালোবাসা ও সহানুভূতির সম্পর্ক স্থাপন করে তাহলে আল্লাহ তাআলা যে তার প্রতি সহানুভূতিশীল হবে, এমন আশা কিছুতেই করা যেতে পারে না। সর্বশেষে এ আয়াত থেকে একথাও জানা গেল যে, ঈমানদার লোকগণ দুনিয়ায় কেবল তখনই জয়ী হতে পারে যখন তারা একনিষ্ঠ হয়ে শুধু আল্লাহ, রাসূল এবং ঈমানদার লোকদেরকেই নিজেদের পৃষ্ঠপোষক, বন্ধু, সাহায্যকারী এবং সাথী হিসেবে গ্রহণ করবে।

 

আরও খানিকটা অগ্রসর হয়ে তাওবায় আল্লাহ তাআলা মুসলমানদেরকে কাফের ও মুশরিকদের বিরুদ্ধে লড়াই করার নির্দেশ দিয়েছেন এবং ক্রমাগত কয়েক রুকূ পর্যন্ত এ যুদ্ধ সম্পর্কে হেদায়াত দিয়েছেন। এ প্রসংগে বলা হয়েছে:

 

فَاِنْ تَابُوْا وَاَقَامُوْا الصَّلوةَ وَاتَوُا الزَّكوةَ فَاِخْوَانَكُمْ فِىْ الدِّيْنِ ـ

 

“তারা যদি কুফর ও শিরক থেকে ‘তাওবা’ করে খাঁটিভাবে ঈমান আনে এবং নামায কায়েম করে ও যাকাত আদায় করে তবে তারা তোমাদের দীনি ভাইয়ে পরিণত হবে।”- সূরা আত তাওবা : ১১

 

অর্থাৎ শুধু কুফর ও শিরক থেকে ‘তাওবা’ করা এবং ঈমান আনার কথা প্রকাশ করাই যথেষ্ঠ নয়, সে যে কুফর ও শিরক থেকে তাওবা করেছে এবং প্রকৃতপক্ষেই ঈমান এনেছে, তার প্রমাণের জন্য যথারীতি নামায আদায় করা এবং যাকাত দেয়াও অপরিহার্য। অতএব, তারা যদি তাদের এরূপ বাস্তব কাজ দ্বারা একথার প্রকাশ পেশ করে, তাহলে নিশ্চয়ই তারা তোমাদের দীনি ‘ভাই’, অন্যথায় তাদেরকে ভাই মনে করা তো দূরের কথা, তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধও বন্ধ করা যাবে না। এ সূরায় আরও স্পষ্ট করে বলা হয়েছে:

 

وَالْمُؤْمِنُوْنَ وَالْمُؤْمِنتُ بَعْضُهُمْ اَوْلِيْآَءُ بَعْضٍ يَامُوْرُونَ بِامُرُوْنَ بَالْمَعْرُوْفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَيُقِيْمُوْنَ الصَّلوةَ وَيُؤْتُوْنَ الزَّكوةَ وَيُطِيْعُوْنَ اللهَ وَرَسُوْلَهُ اُوْلئِكَ سَيَرْحَمُهُمُ اللهُ ـ التوبية : ٧١

 

“ঈমানদার পুরুষ এবং ঈমানদার স্ত্রীলোকেরাই প্রকৃতপক্ষে পরস্পর পরস্পরের বন্ধু ও সাহায্যকারী। এদের পরিচয় এবং বৈশিষ্ট্য এই যে, এরা নেক কাজের আদেশ দেয়, অন্যায় ও পাপ কাজ থেকে বিরত রাখে, নামায কায়েম করে এবং যাকাত আদায় করে, আল্লাহ ও রাসূলের বিধান মেনে চলে। প্রকৃতপক্ষে এদের প্রতিই আল্লাহ রহমত বর্ষণ করবেন।” সূরা আত তাওবা : ৭১

 

অন্য কথায় কোনো ব্যক্তি যতক্ষণ পর্যন্ত ঈমান এনে কার্যত নামায ও যাকাত আদায় না করবে, ততক্ষণ সে মুসলমানদের দীনি ভাই রূপে পরিগণিত হতে পারবে না। বস্তুত ঈমান, নামায ও যাকাত এই তিনটি জিনিসের সমন্বয়েই ঈমানদার লোকদের জামায়াত গঠিত হয়। যারা এ কাজ যথারীতি করে, তারা এ পাক জামায়াতের অন্তর্ভূক্ত এবং তাদেরই পরস্পরের মধ্যে বন্ধুত্ব, ভালবাসা ও সহানুভূতির সম্পর্ক স্থাপিত হবে। আর যারা এ তিনটি কাজ করে না, তারা এ জামায়াতের অন্তর্ভূক্ত নয়। তাদের নাম মুসলমানদের ন্যায় হলেও ইসলামী জামায়াতের মধ্যে শামিল হতে পারে না। এখন তাদের সাথে বন্ধুত্ব, প্রেম ও ভালবাসার সম্পর্ক স্থাপন করলে আল্লাহর আইন ভংগ করা এবং তাতে আল্লাহর পার্টির শৃংখলা নষ্ট করা হবে। তাহলে এসব লোক দুনিয়ায় জয়ী হয়ে থাকার আশা কি করে করতে পারে?

 

আরও সামনে অগ্রসর হলে সূরা হজ্জ-এ দেখা যায়, আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন:

 

وَلَيَنْصُرَنَّ اللهُ مَنْ يَّنْصُرُهُ اِنَّ اللهَ لَقَوِي عَزِيْزٌ ـ اَلَّذِيْنَ اِنْ مَّكَّنّهُمْ فِى الاَرْضِ اَقَامُوْا الصَّلوةَ وَاَتَوُا الزَّكوةَ وَاَمَرُوْنَ بِالْمَعْرُوْفِ وَنَهَوْا عَنِ الْمُنْكَرِۗ وَلِلهِ عَاقِبَةُ الاُمُوْرِ ـ الحج ـ ٤٠-٤١

 

“যে আল্লাহর সাহায্য করবে, আল্লাহ নিশ্চয়ই তার সাহায্য করবেন। আল্লাহ তাআলা বড়ই শক্তিশালী এবং সর্বজয়ী। (আল্লাহর সাহায্য তারাই করতে পারে) যাদেরকে রাষ্ট্র ক্ষমতা দান করলে তারা নামায আদায়ের (সামাজিক) ব্যবস্থা কায়েম করবে এবং সামগ্রিকভাবে যাকাত আদায় করবে, লোককে সৎকাজের আদেশ করবে এবং অসৎ ও অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখবে। বস্তুত সকল জিনিসের পরিণাম আল্লাহর ওপরই নির্ভর করে।”- সূরা আল হজ্জ : ৪০-৪১

 

বনী ইসরাঈলদের ইতিপূর্বে যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, এ আয়াতে মুসলমানদেরকেও ঠিক সেই নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ইতিপূর্বে বনী ইসরাঈলদেরকে বলা হয়েছিল যে, তারা যতদিন নামায কায়েম করবে ও যাকাত আদায় করবে এবং নবীদের কাজে সাহায্য করতে থাকবে অর্থাৎ আল্লাহর আইন জারি করবে, ততদিন আল্লাহ তাদের সাথী ও সাহায্যকারী থাকবেন। আর যখন এ কাজ ত্যাগ করবে, তখনই আল্লাহ তাদের প্রতি সকল সাহায্য বন্ধ করে দেবেন। ঠিক একথাই এ আয়াতে মুসলমানদেরকে বলা হয়েছে। আল্লাহ তাদেরকে পরিষ্কার বলে দিয়েছেন যে, দুনিয়ার শক্তি লাভ করে যদি তারা নামায আদায়ের সামাজিক ব্যবস্থা এবং যাকাত আদায়ের সামগ্রিক পন্থা প্রতিষ্ঠা করে আর ভালো কাজের প্রচার ও মন্দ কাজের প্রতিরোধ করে, তাহলে আল্লাহ তাদের সাহায্যকারী হবেন। বস্তুত, আল্লাহ অপেক্ষা শক্তিমান সাহায্যকারী আর কেউ হতে পারে না। কিন্তু মুসলমান যদি নামায ও যাকাত আদায় করা পরিত্যাগ এবং দুনিয়ার শক্তি লাভ করে সৎকাজের পরিবর্তে অসৎকাজের প্রচার করে, অন্যায়কে নির্মূল না করে সৎকাজের পথ বন্ধ করতে থাকে, আল্লাহর কালেমাকে বিজয়ী করার পরিবর্তে নিজেদের প্রভুত্ব কায়েম করতে শুরু করে আর কর আদায় করে নিজেদের জন্য দুনিয়ার বুকে স্বর্গ রচনা করাকে রাজত্বের একমাত্র উদ্দেশ্য বলে মনে করে, তাহলে আল্লাহর সাহায্য তাদের ভাগ্যে কখনো জুটবে না। তারপর শয়তানই হবে তাদের সাহায্যকারী। ভাবতে অবাক লাগে, এটা কত বড় শিক্ষার কাজ! বনী ইসরাঈল আল্লাহ প্রদত্ত এ বাণীকে অমূলক ও মৌখিক মাত্র মনে করেছিল। ফলে তার বিপরীত কাজ করতে তাদেরকে দুনিয়ার দিকে দিকে অপমানিত ও লাঞ্ছিত হয়ে ঘুরে মরতে হচ্ছে। বিভিন্ন স্থান থেকে তাদেরকে বহিষ্কার করা হচ্ছে, কোথাও তারা স্থায়ীভাবে আশ্রয় লাভ করতে পারছে না। এরা দুনিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ ধনী সম্প্রদায়, কোটি কোটি টাকা তাদের ভান্ডারে স্তুপীকৃত হয়ে আছে, কিন্তু এ টাকা তাদের কোনো কাজেই লাগছে না। নামাযের পরিবর্তে অসৎকাজ এবং যাকাতের বদলে সুদখোরীর অভিশপ্ত পন্থাকেই অবলম্বন করে তারা একদিকে নিজেরা আল্লাহর কাছে অভিশপ্ত হচ্ছে, অপর দিকে তারা প্লেগের ইঁদুরের ন্যায় দুনিয়ার দিকে দিকে এ অভিশাপ সংক্রমিত করে ফিরছে। মুসলমানদেরকেও এ হুকুমই দেয়া হয়েছে। কিন্তু মুসলমানগণ সে দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে নামায আদায় ও যাকাতদানের ক্ষেত্রে উদাসীন হয়েছে এবং আল্লাহ প্রদত্ত শক্তি প্রয়োগ করে সত্য প্রচার এবং মিথ্যা ও অন্যায় প্রতিরোধের দায়িত্ব পালন করা ভুলে বসেছে। আর এর তিক্ত ফলও তারা নানাভাবে ভোগ করেছে। (দুনিয়ার শ্রেষ্ঠতম ও মহাশক্তিধর) রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা থেকে তাদেরকে বঞ্চিত করা হয়েছে। সমগ্র দুনিয়ায় তারা সকল যালেম শক্তির নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। তারা দুর্বল ও পরাভূত। নামায ও যাকাত ত্যাগ করার কুফল তো দেখলেন। এখন এদের (বনী ইসরাঈলদের মধ্যে) এমন একটি দল সৃষ্টি হয়েছে যারা মুসলমানদের মধ্যে লজ্জাহীনতা, অশ্লীলতা, পর্দাহীনতা এবং কুৎসিত কাজের প্রবর্তন করতে বদ্ধপরিকর। তারা মুসলমানদেরকে বলছে, “তোমাদের আর্থিক অসচ্ছলতা দূর করতে হলে ব্যাংক ও ইন্সুরেন্স কোম্পানী খুলে পেট ভরে সুদ খাও।” কিন্তু সত্য কথা এই যে, মুসলমানগণও যদি এতেই লিপ্ত হয়ে থাকে, তবে তাদেরকেও ইয়াহুদীদের ন্যায় চরম লাঞ্ছনার এক কঠিন বিপদে নিক্ষেপ করা হবে এবং চিরন্তন অভিশাপে অভিশপ্ত হবে।

 

যাকাত কি জিনিস এতে আল্লাহ তাআলা কত বড় শক্তি নিহিত রেখেছেন, যদিও মুসলমানগণ এটাকে একটি অতি সাধারণ জিনিস বলে মনে করছে, অথচ তাতে যে কত বিরাট লাভের সম্ভবনা রয়েছে এসব বিষয়ে পরবর্তী প্রবন্ধগুলোতে আমি বিস্তারিত আলোচনা করবো, এ প্রবন্ধটিতে আমি শুধু একথাই বলতে চাচ্ছি যে, নামায ও যাকাত ইসলামের একান্ত বুনিয়াদী জিনিস। ইসলামে এ দুটির গুরুত্ব এত অধিক যে, এটা যেখানে নেই সেখানে আর যাই থাক, ইসলাম যে নেই তা সন্দেহতীত। অথচ অনেক মুসলমান আজ নামায কায়েম না করে এবং যাকাত আদায় না করেও মুসলমান হিসেবে গণ্য হতে চায় এবং তাদের তথাকথিত কিছু ধর্মগুরুও এ বিষয়ে তাদেরকে নিশ্চয়তা দান করেছে। কিন্তু কুরআন তাদের দাবীর তীব্র প্রতিবাদ করে। মানুষ যদি কালেমায় তাইয়্যেবা পড়ে তার সত্যতা প্রমাণের জন্য নামায এবং যাকাত আদায় না করে, তাহলে কুরআনের দৃষ্টিতে তার এ কলেমা পড়া একেবারেই অর্থহীন। এজন্যই হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু যাকাত দিতে অস্বীকারকারী ব্যক্তিদের কাফের মনে করে তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেছিলেন। যারা আল্লাহ ও রাসূলকে মানে এবং নামাযও পড়ে তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা জায়েয কিনা সাহাবায়ে কেরামের মনে তখন এ সন্দেহ জাগ্রত হয়েছিল। কিন্তু যখন হযত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু যাকে আল্লাহ তাআলা নবুয়াতের কাছাকাছি সম্মান দান করেছিলেন-সুদূঢ়ভাবে ঘোষণা করলেন : আল্লাহর শপথ, রাসূলে কারীম (সা) এর জীবন যারা যাকাত দিত, আজ যদি কেউ তার উট বাঁধার একটি রশিও দিতে অস্বীকার করে, তবে তার বিরুদ্ধে আমি অস্ত্র ধারণ করবো। শেষ পর্যন্ত সকল সাহাবীই একথার যৌক্তিকতা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন এবং সকলে একমত হয়ে ঘোষণা করলেন যে, যারা যাকাত দিবে না তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা অপরিহার্য। কুরআন শরীফ সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছে যে, যাকাত না দেয়া কেবল পরকালে অবিশ্বাসী মুশরিকদেরেই কাজ:

 

وَوَيْلٌ لِّلْمُشْرِكِيْنَ ـ الًّذِيْنَ لاَيُؤْتُوْنَ الزَّكوَةَ وَهُمْ بِالاخِرَةِ هُمْ كفِرُوْنَ ـ

 

“যেসব মুশরিক যাকাত দেয় না, যারা আখেরাতকে অস্বীকার করে, তাদের ধ্বংস অনিবার্য।”- সূরা হা-মীম-আস-সাজদা : ৬-৭

 

যাকাতের মর্মকথা

 

পূর্বে বলা হয়েছে, নামাযের পর ইসলামের সর্বপ্রধান রুকন হচ্ছে যাকাত। আর তার গুরুত্ব এতবেশী যে, নামাযকে অস্বীকার করলে যেমন কাফের হতে হয়, অনুরূপভাবে যাকাত দিতে অস্বীকার করলে তাকে শুধু কাফেরই হতে হয় না, সমস্ত সাহাবায়ে কেরাম একমত হয়ে তার রিরুদ্ধে জিহাদও করেছেন।

 

এখানে আমি যাকাতের প্রকৃত রূপ এবং এর অর্ন্তনিহিত তত্ত্ব আলোচনা করতে চেষ্টা করবো। যাকাত মূলত কি জিনিস এবং ইসলাম এর এতবেশী গুরুত্ব দেয় কেন তা আলোচনা থেকে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠবে।

 

আমাদের মধ্যে অনেক লোকই যার তার সাথে বন্ধুত্ব সম্পর্ক স্থাপন করে থাকে। অথচ কাউকে বন্ধু বলে স্বীকার করার সময়ে সে বাস্তবিকই বন্ধুত্বের ব্যাপারে তারা প্রায়ই প্রতারিত হয়ে থাকে। পরে তাদের বড় দু:খ এবং অনুতাপ করতে হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে যারা বুদ্ধিমান তারা যাদের সাথে মেলামেশা করে তাদেরকে খুব ভালো করে যাচাই ও পরীক্ষা করে নেয় এবং পরীক্ষার ভিতর দিয়ে যাদেরকে তারা খুব ভালো লোক, নির্ভরযোগ্য, নিষ্ঠাবান ও বিশ্বাসভাজন বলে মনে করে, কেবল তাদের সাথেই বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্থাপন করে, আর অন্যান্যের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে।

 

আল্লাহ তাআলা সর্বশ্রেষ্ঠ বুদ্ধিমান ও সর্বাভিজ্ঞ। তিনি যাকে তাকে নিজের বন্ধু বানাবেন, নিজের দলভুক্ত করে নিবেন এবং তাঁর দরবারে সম্মান ও নৈকট্যের মর্যাদা দান করবেন তা কি করে আশা করা যেতে পারে? সাধারণ বুদ্ধিমান মানুষ যখন পরীক্ষা ও যাচাই না করে কারো সাথে বন্ধুত্ব করতে রাযী হয় না, তখন সকল জ্ঞান ও বুদ্ধির একচ্ছত্র অধিকারী আল্লাহ তাআলা খুব ভালভাবে যাচাই ও পরীক্ষা না করে কাউকে বন্ধু বলে স্বীকার করতে পারেন না। দুনিয়ায় এই যে কোটি কোটি মানুষ ইতস্তত ছড়িয়ে রয়েছে, যাদের মধ্যে ভাল-মন্দ সকল প্রকার মানুষই রয়েছে, নির্বিচারে ও নির্বিশেষে এদের সকলকেই আল্লাহর দলে শামিল করে নেয়া সম্ভব নয়। তাই আল্লাহ তাআলা যাদেরকে দুনিয়ায় তাঁর খলীফা বানাতে এবং আখেরাতে তাঁর নৈকট্য দান করতে চান, তাদেরকে সুনির্দিষ্ট মানদন্ডে বিশেষ পরিস্থিতি ও পরীক্ষার ভিতর দিয়ে যাচাই করে নিতে চান। যাঁরাই সেই পরীক্ষায় যথাযথাভাবে উত্তীর্ণ হবেন, তাঁরাই আল্লাহর দলে গণ্য হতে পারবেন, আর যারা তা পারবে না তারা নিজেরাই তা থেকে দূরে সরে যাবে এবং তারা পরিষ্কাররূপে জানতে পারবে যে, তারা আল্লাহর দলে শামিল হবার যোগ্যতা প্রমাণ করতে সমর্থ হয়নি। মানুষের পরীক্ষা করার সেই কষ্টি পাথরটি কি? আল্লাহ নিজে যেহেতু সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান তাই তিনি সর্বপ্রথম মানুষের বুদ্ধি-জ্ঞানকেই পরীক্ষা করতে চান। মানুষের মধ্যে বুদ্ধিমত্তা কিছু আছে কিনা, না নিরেট নির্বোধ তা তিনি বিশেষভাবে লক্ষ্য করে থাকেন। কারণ নির্বোধ লোকেরা কখনও বুদ্ধিমান ও জ্ঞানী ব্যক্তিদের বন্ধু হতে পারে না। (আর মূর্খ ও নির্বোধ লোকেরা তো কিছুতেই এবং কখনই আল্লাহর বন্ধু হতে পারে না।) আল্লাহর অস্তিত্বের নিশানা দেখে যে বুঝতে পারে যে, তিনিই আমার মালিক ও সৃষ্টিকর্তা, তিনি ছাড়া কোনো মাবুদ কোনো পরোয়ারদিগার, দোয়া শ্রবণকারী এবং সাহায্যকারী আর কেউ নেই। আল্লাহর কালাম দেখ যে তাকে আল্লাহর কালাম বলেই চিনতে পারে এবং তা অন্য কারো কালাম হতে পারে না বলে দৃঢ়রূপে বিশ্বাস করে, সত্য নবী এবং মিথ্যা নবীদের জীবন চরিত, কাজ-কর্ম ও শিক্ষা-দীক্ষার মৌলিক পার্থক্য সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারে এবং নবী হওয়ার দাবীদারগণের মধ্যে প্রকৃত নবীকে আল্লাহর প্রেরিত নবী এবং সত্যের পথ নির্দেশকারী নবী বলে চিনতে পারে, আর মিথ্যা নবীকে দাজ্জাল ও প্রতারক বলে চিহ্নিত করতে পারে সেই ব্যক্তিরই এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার যোগ্যতা রয়েছে। আল্লাহ তাআলা তাকে লক্ষ কোটি লোকের মধ্যে থেকে বেছে নিয়ে নিজের দলের মনোনীত প্রার্থীদের মধ্যে গণ্য করেন। অবশিষ্ট যারা প্রথম পরীক্ষায় ব্যর্থ হয় তাদেরকে তিনি পরিত্যাগ করেন।

 

এ প্রথম পরীক্ষায় যে সকল প্রার্থী উত্তীর্ণ হয় তাদেরকে অতপর দ্বিতীয় পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়। দ্বিতীয়বারে মানুষের বুদ্ধির সাথে সাথে তার নৈতিক চরিত্র বলেরও যাচাই করা হয়। সত্য এবং পূণ্য কাজের পরিচয় লাভ করে তা গ্রহণ করা এবং তদনুযায়ী কাজ করা এবং অন্যায় ও পাপ কাজের পরিচয় লাভ করার পর তা পরিত্যাগ করার যোগ্যতা ও শক্তি তার আছে কিনা তা জেনে নেয়া এ পরীক্ষার উদ্দেশ্য। যাচাই করে দেখা হয় যে, এ ব্যক্তি নিজের প্রবৃত্তির দাস, বাপ-দাদার অন্ধ অনুসারী এবং পারিবারিক প্রথা এ দুনিয়ার সাধারণ রীতিনীতির গোলাম তো নয়? একটি কাজকে আল্লাহর বিধানের বিপরীত জেনে এবং তাকে খারাপ মনে করেও তার মধ্যে লিপ্ত থাকার মত দুর্বলতা তার মধ্যে নেই তো? পক্ষান্তরে একটি জিনিসকে আল্লাহর মনোনীত এবং সত্য জেনে তা গ্রহণ করার মনোবল আছে কিনা তাও যাচাই করা হয়। এ পরীক্ষায়ও যারা বিফল হয় তাদেরকে আল্লাহর দলভুক্ত করা হয় না। আল্লাহর দলভুক্ত কেবল তারাই হতে পারে, যাদের সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেছেন:

 

فَمَنْ يَّكْفُرْ بِالطَّاغُوْتِ وَيُؤْمِنْ بِاللهِ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرُوةِ الْوُثقى لاَ اَنْفِصَامَ لَهَا ـ

 

অর্থাৎ আল্লাহর বিধানের বিরোধী বিধান ও পথ এবং বিধানদাতাকে যারা সাহসের সাথে পরিত্যাগ করে-সেই ব্যাপারে কারো পরোয়া করে না এবং নির্ভীকভাবে কেবল আল্লাহর দেয়া বিধান অনুসারেই জীবন যাপন করতে প্রস্তুত হয়-তাতে কেউ খুশী হোক আর নারায হোক সেই দিকে মাত্রই ভ্রুক্ষেপ করে না, তারা একটি মজবুত জিঞ্জির দৃঢ়তার সাথে ধারণ করে নিয়েছে যা কখনো ছিড়বে না।

 

এ পরীক্ষায় যারা উত্তীর্ণ হয় তাদেরকে তৃতীয় পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হতে হয়। একবার পরীক্ষা হয় আল্লাহর অনুসরণ ও আনুগত্য স্বীকারের প্রবণতার। এই সময়ে হুকুম দেয়া হয় যে, আমার তরফ থেকে যখনই কোনো নির্দেশ দেয়া হবে, তখনই তোমরা নিদ্রা ত্যাগ করে আমার সামনে হাজির হবে; কাজ-কর্ম পরিত্যাগ করে, নিজের স্বার্থ ও মন:পুত কাজ ছেড়ে, আনন্দ আর খুশী ত্যাগ করে আসবে এবং নির্দিষ্ট কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করবে, গ্রীষ্ম হোক, শীতহোক-যাই হোক না কেন, সকল সময়েই ডাক শোনা মাত্র হাজির হবে-সকল দু:খ-কষ্ট সহ্য করে আমার দরবারে উপস্থিত হবে এবং কর্তব্য পালন করবে। আবার যখন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পানাহার না করতে বলবো এবং নফসের খাহেশ পূরণ করতে নিষেধ করবো, তখন তোমাকে এ হুকুম পুরোপুরি পালন করতে হবে, ক্ষুধা-তৃষ্ণায় যত দু:সহ কষ্টই হোক না কেন; আর যত সুমিষ্ট পানীয়, স্বুস্বাদু খাদ্য তোমার সামনে স্তুপীকৃত হোক না কেন। এই পরীক্ষায় যারা অনুত্তীর্ণ হয় তাদেরকেও বলে দেয়া হয়, তোমাদের দ্বারা আমার কাজ সম্পন্ন হতে পারে না। আর তৃতীয় পরীক্ষায়ও যারা উত্তীর্ণ হয় কেবল তাদেরকেই নির্বাচন করা হয়। কারণ এদের সম্পর্কেই এ আশা করা যেতে পারে যে, আল্লাহর তরফ থেকে যে বিধান নাযিল করা হবে তাই তারা গোপনে ও প্রকাশ্যে স্বার্থ এবং লাভ, সুখ ও দু:খ-কষ্ট সকল অবস্থায়ই যথাযথরূপে পালন করতে পারবে।

 

অতপর চতুর্থ পরীক্ষা নেয়া হয় মানুষের ধন-সম্পদ কুরবানী করার। তৃতীয় পরীক্ষায় উত্তীর্ণ লোকগণও আল্লাহর কর্মচারী পদে স্থায়ীভাবে নিযুক্ত হওয়ার যোগ্য প্রমাণিত হতে পারেনি। কেননা তাদের দিল ছোট, সংকীর্ণ, হীন সাহস ও বীর্যহীন এবং নীচ কিনা-মুখে বন্ধুত্ব ও ভালবাসার বড় বড় দাবী করার লোক তো অসংখ্য পাওয়া যায়, কিন্তু বন্ধুর ও ভালবাসার বড় বড় দাবী করার লোক তো অসংখ্য পাওয়া যায়, কিন্তু বন্ধুর খাতিরে পকেটের পয়সা খরচ করতে প্রস্তুত কিনা, তার পরীক্ষা নেয়া এখনও বাকী রয়েছে। তারা তো সেই সকল লোকদের মত নয় যারা মুখে মুখে মা মা করে ভক্তিতে গদগদ এবং সেই মায়ের জন্য দাংগা করতেও পিছপা নয়, কিন্তু সেই মা যখন জন্তুর বেশে শস্যক্ষেত্র প্রবেশ করে তখন লাঠি নিয়ে তাকে তাড়িয়ে দেয়-পিটিয়ে ছাল উঠিয়ে দেয়। এমন স্বার্থপর, অর্থপূজারী সংকীর্ণমনা ব্যক্তিকে কোনো সাধারণ বুদ্ধির মানুষও নিজের বন্ধু বলে গ্রহণ করতে পারে না। আর বড় উদার আত্মা বিশিষ্ট লোকও এমন ব্যক্তিকে নিজের কাচে কোনোরূপ মর্যাদা দিতেও প্রস্তুত হবে না। তাহলে যে মহান আল্লাহর দেয়া ধন-সম্পদ আল্লাহরই পথে খরচ করতে প্রস্তুত করতে পারেন, যে আল্লাহর দেয়া ধন-সম্পদ আল্লাহরই পথে খরচ করতে প্রস্তুত নয়? আর যে আল্লাহ এতবড় বুদ্ধিমান এবং বিজ্ঞ তিনি কেমন করে এমন ব্যক্তিকে নিজের দলভুক্ত করতে পারেন, যার বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা মৌখিক জমা-খরচ মাত্র এবং যার ওপর কোনো কাজেই বিন্দুমাত্র ভরসা করা যায় না? কাজেই এ চতুর্থ পরীক্ষায় যারা ব্যর্থ হয় তাদেরকেও পরিষ্কার বলে দেয়া হয় যে, আল্লাহর দলে তোমাদের কোনো স্থান নেই, তোমরাও অকর্মণ্য-আল্লাহর খলীফার ওপর যে বিরাট দায়িত্ব অর্পণ করা হয় তা পালন করার যোগ্যতা তোমাদের নেই। এ দলে কেবল তাদেরকেই শামিল করা যেতে পারে যারা আল্লাহর ভালোবাসায় জীবন-প্রাণ ধন-সম্পদ, সন্তান-সন্ততি, বংশ-পরিবার, দেশ-সবকিছুর ভালবাসাকে অকুন্ঠিত চিত্তে কুরবান করতে পারে:

 

لَنْ تَنَالُوْا الْبِرَّ حَتّى تُنْفِقُوْا مِمَّا تُحِبُّوْنَ ـ ال عمران : ٩٢

 

“তোমরা নিজ নিজ প্রিয় জিনিসগুলো যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহর উদ্দেশ্যে ব্যয় না করবে ততক্ষণ পর্যন্ত তোমরা পুণ্য ও মহত্বের উচ্চতম মর্যাদা লাভ করতে পারবে না।”- সূরা আলে ইমরান : ৯২

 

আল্লাহর এ দলে সংকীর্ণমনা লোকদের কোনোই স্থান নেই, কেবল উদার উন্নত হৃদয়বান ব্যক্তিরাই এই দলে শামিল হতে পারে।

 

وَمَنْ يُّوْقَ شُحَّ نَفْسِه فَأُوْلئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ ـ التغابن : ١٦

 

“মনের সংকীর্ণতা এবং কৃপণতাকে যারা অতিক্রম করতে পেরেছে কেবল তারাই সর্বাঙ্গীন কল্যাণ লাভ করতে পারে।”- সূরা আত তাগাবুন: ১৬

 

আল্লাহর দলে কেবল এমন লোকদের ভর্তি করা যেতে পারে, যারা কেউ তাদের শত্রুতা করলেও, তাদেরকে দু:খ দিলেও, তাদের ক্ষতিসাধন করলেও এবং তাদের কলিজাকে টুকরো কুকরো করলেও-কেবলমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যেই তারা পেটের খাদ্য এবং পরণের কাপড় দিতে অস্বীকার করবে না এবং বিপদের সময় তার সাহায্য করতেও কুণ্ঠিত হবে না:

 

وَلاَ يَاتَلِ اُوْلُوْا الْفَضْلِ مِنْكُمْ وَالسَّعَةِ اَنْ يُّؤْتُوْا اُوْْلِى الْقُرْبى وَالْمَسكِيْنَ وَالْمُهجِرِيْنَ فِى سَبِيْلِ اللهِ وَلْيَعْفُوا وَاْيَصْفَحُوْا اَلاَ تَحِبُّوْنَ اَنْ يَّغْفِرَ اللهُ لَكُمْ وَ اللهُ غَفُوْرٌ رَّحِيْمٌ ـ النور : ٢٢

 

“তোমাদের মধ্যে যারা বড় এবং সংগতি সম্পন্ন লোক তারা যেন নিজেদের প্রিয়জনদের, নিকটাত্মীয়দের, গরীব-দু:খীদের এবং আল্লাহর পথে হিজরতকারীদের (কোনো অপরাধের জন্য বিরক্ত হয়ে তাদেরকে) সাহায্য দান বন্ধ না করে। বরং তাদেরকে মাফ করে দেয়াই বাঞ্ছনীয়। আল্লাহ তোমাদের মাফ করে দেন তা কি তোমরা দাও না? অথচ আল্লাহ তাআলা সবচেয়ে বড় ক্ষমাশীল এবং দয়াবান।”১- সূরা আন নূর : ২২

 

এ দলে এমন লোকদের আবশ্যক, যারা আল্লাহর দেয়া ধন-সম্পদ থেকে বেছে বেছে ভাল ভাল জিনিস আল্লাহর জন্যই খরচ করে:

 

يَآ يُّهَا الَّذِيْنَ امَنُوْا اَنْفِقُوْا مِنْ طَيِّبتِ مَاكَسَبْتُمْ وَمِمَّا اَخْرَجْنَا لَكُمْ مِّنْ الاَرْضِ وَلاَ تَيْمَّمُوْا الْخَبِيْثَ مِنْهُ تُنْفِقُوْنَ ـ الرقرة : ٢٦٧

 

“হে ঈমানদারগন! তোমরা নিজেরা যে ধন-সম্পত্তি উপার্জন করেছ এবং আমি তোমাদের জন্য যমীন থেকে যে রিযক দিয়েছি তা থেকে ভাল ভাল সামগ্রী (আল্লাহর পথে) ব্যয় কর। খারাপ দ্রব্য থেকে কিছু সেই পথে খরচ করো না।”- (সূরা আল বাকারা : ২৬৭)

 

১. হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুর জনৈক প্রিয় লোক যখন তাঁর কন্যা হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার চরিত্র সম্পর্কে অপবাদ দেয়ার ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করেছিল এবং হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু তার প্রতি অসন্তষ্ট হয়ে তার আর্থিক সাহায্য বন্ধ করে দিয়েছিলেন তখন এই আয়াতটি নাযিল হয়। আয়াতটি নাযিল হওয়ার সাথে সাথে তিনি কম্পিত ও ভীত হয়ে বললেন : আমি আল্লাহর দরবারে ক্ষমা চাই এবং তখনই তিনি সেই লোকটির আর্থিক সাহায্য পুনরায় জারি করলেন।

 

এখানে এমন বড় আত্মার লোকদের আবশ্যক, যারা নিজেদের অভাব-অনটন, দারিদ্র ও রিক্ততার দু:সহ অবস্থায় নিজেদের অপরিহার্য প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও আল্লাহর পথে অর্থ ব্যয় করাকে তারা নিষ্ফল মনে করবে না। বরং তারা একান্তভাবে বিশ্বাস করবে যে, আল্লাহর পথে যা কিছু খরচ করা যায়, দুনিয়া এবং আখেরাত তিনি তার উত্তম ফল দান করবেন। এজন্য তারা কেবল আল্লাহর সন্তোষ লাভের উদ্দেশ্যেই খরচ করে। তাদের এ দানশীলতার কথা দুনিয়ার প্রচার হোক না হোক কিংবা কেউ তার দানের শুকরিয়া আদায় করুক বা না করুক সে দিকে কিছুমাত্র ভ্রুক্ষেপ করে না:

 

وَمَا تُنْفِقُوْا مِنْ خَيْرٍ فَلاَنْفُسِكُمْ وَمَا تُنْفِقُوْنَ اِلاَّ ابْتِغَاءَ وَجْهِ اللهِ وَمَا تُنْفِقُوْا مِنْ خَيْرٍ يُّوْفَّ اِلَيْكُمْ وَاَنْتُمْ لاَتُظْلَمُوْنَ ـ البقرة : ٢٧٢

 

“তোমরা আল্লাহর পথে যা কিছু খরচ করবে তা তোমাদেরই কল্যাণ সাধন করবে- অবশ্য যদি তোমরা সেই খরচের ব্যাপার আল্লাহ ছাড়া আর কারো সন্তুষ্টি পেতে না চাও। এভাবে তোমরা ভাল কাজে যা কিছু দান করবে তার পূর্ণ ফল তোমরা লাভ করবে। সে দিক দিয়ে তোমাদের প্রতি বিন্দু পরিমাণও যুলুম করা হবে না।”- সূরা আল বাকারা : ২৭২

 

ধনী হয়ে সুখের মধ্যে ডুবে থেকেও যারা আল্লাহকে ভুলে যায় না, আল্লাহর দলে এ ধরনের ধীর প্রকৃতির লোকদেরই দরকার। তারা বড় বড় প্রাসাদে সুখ ও সম্ভোগের ভিতরে থেকেও আল্লাহকে ভুলে যাবে না:

 

يَآيُّهَا الَّذِيْنَ امَنُوْا لاَتُلْهِكُمْ وَلاَ اَوْلاَدُكُمْ عَنْ ذِكْرِ اللهِ وَمَنْ يَّفْعَلِ ذلِكَ فَاوُلئِكَ هُمُ الْخسِرِوْنَ المنفقون : ٩

 

“হে ঈমানদারগণ! তোমাদের সম্পদ আর সন্তান যেন তোমাদেরকে কখনও আল্লাহর যিকর থেকে বিরত না রাখে। এসবের জন্য যারা আল্লাহকে ভুলে যাবে তারা বড়ই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”- সূরা মুনাফিকূন: ৯

 

ওপরে বর্ণিত গুণাবলী আল্লাহ তাআলার দলের লোকদের মধ্যে বর্তমান থাকা অপরিহার্য। এছাড়া কোনো ব্যক্তি আল্লাহর বন্ধুদের মধ্যে গণ্য হতে পারে না। বস্তুত এটা মানুষের শুধু নৈতিক চরিত্রেরই নয়, তার ঈমানেরও বড় কঠিন এবং তিক্ত পরীক্ষা। আল্লাহর পথে খরচ করতে যে ব্যক্তি কুণ্ঠিত হবে, এরূপ খরচকে যে নিজের ওপরে জরিমানা বলে মনে করবে, কৌশল ও শঠতা করে তা থেকে যে আত্মরক্ষা করতে চায়, আর কিছু খরচ করলেও সে জন্য লোকের প্রতি নিজের অনুগ্রহ প্রকাশ করে মনের জাল মিটাতে চায় কিংবা নিজের বদান্যতার কথা দুনিয়ায় প্রচার করতে চায়, প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ ও পরকালের প্রতি এমন লোকদের আদৌ ঈমান থাকতে পারে না। সে মনে করে, আল্লাহর জন্য সে যা কিছু করেছে, তা একেবারে নিষ্ফল হয়েছে। তার নিজের সুখ-শান্তি, আরাম-আয়েশ, নিজের স্বার্থ ও খ্যাতিকেই সে আল্লাহ এবং তাঁর সন্তষ্টি অপেক্ষাও বেশী প্রিয় বলে মনে করে। তার মতে এ দুনিয়াটাই সবকিছু। টাকা-পয়সা খরচ করলেও এ দুনিয়ায়ই সে জন্য সুনাম ও খ্যাতি লাভ হওয়া আবশ্যক। কারণ তাহলে সে টাকার বিনিময় এখানেই পাওয়া যেতে পারে। নতুবা টাকাও খরচ করলো আর কেউ জানতেও পারলো না যে, অমুক ব্যক্তি ভাল কাজে এতগুলো টাকা দিয়ে দিয়েছে, তবে তা সবই অর্থহীন হয়ে যায়। কুরআন মজীদে পরিষ্কার বলে দেয়া হয়েছে যে, এ ধরনের মানুষ আল্লাহর কোনো কাজেই আসতে পারে না। সে যদি নিজেকে ঈমানদার বলে প্রচার করে তথাপি সে ঈমানদার তো নয়ই বরং সে প্রকাশ্য মুনাফিক নিম্নের আয়াতগুলো তার প্রমাণ:

 

يَآيُّهَا الَّذِيْنَ امَنُوْا صَدْقتِكُمْ بَالْمَنَ وَالاَذي كَالَّذِى يُنْفِقُ مَالَهُ رِئَآ ءَ النَّاسِ وَلاَ يُؤْمِنُ بِاللهِ وَالْيُوْمِ الاخِرِ ـ البقرة : ٢٦٤

 

“হে ঈমানদারগণ! তোমাদের দানকে অন্যের ওপরে নিজের অনুগ্রহ প্রচার করে বা কাউকে কষ্ট দিয়ে তার মতো নিষ্ফল করে দিও না, যে ব্যক্তি শুধু অন্যকে দেখাবার জন্য কিংবা সুনাম কিনার জন্য অর্থ ব্যয় করে এবং আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিন্দুমাত্র বিশ্বাস রাখে না।”

 

وَاَلَّذِيْنَ يَكْنِزُوْنَ الذَّهَبَ وَالْفِضَّةَ وَلاَيُنْفِقُوْنَهَا فِىْ سَبِيْلِ اللهِ فِبَشّرِهُمْ بِعَذَابِ اَلِيْمٍ ـ التوبة : ٣٤

 

“যারা স্বর্ণ এবং রৌপ্য সঞ্চয় করে রাখে এবং তা আল্লাহর পথে খরচ করে না, তাদেরকে কঠিন শাস্তির সুসংবাদ দাও।”- সূরা তাওবা : ৩৪।

 

لاَيَسْتَاْذِنُكَ الَّذِيْنَ يُؤْمِنُوْنَ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الاخِرِ اَنْ يُّجَاهِدُوْنا يَاَمْوَالِهِمْ وَاَنْفٌسِهِمْ وَاللهُ عَلَيْمٌ بِالْمُتَّقِيْنَ ـ اِنَّمَا يَسْتَاذِنُكَ الَّذِيْنَ لاَيُؤْمِنُوْنَ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الاخِرِ وَارْتَابَتْ قُلُبُهُمْ فَهُمْ فِىْ رَيْبِهِمْ يَتَرَدَّدُوْنَ ـ

 

“হে নবী‍! যারা আল্লাহ ও পরকালকে বিশ্বাস করে, তারা নিজেদের জান-মালসহ জিহাদে যোগদান করার কর্তব্য থেকে দূরে সরে থাকার জন্য কখনও অনুমতি চাইবে না। আল্লাহ তাআলা প্রকৃত মুত্তাকী বান্দাহগণকে খুব ভাল করেই জানেন। অবশ্য সেসব লোক ওজর আপত্তি করতে পারে, আল্লাহ ও পরকালের প্রতি যাদের আদৌ বিশ্বাস নেই-যাদের মনের মধ্যে সন্দেহ জমাট বেঁধে রয়েছে এবং নিজেদের সন্দেহের মধ্যে নিমজ্জিত থেকেই ইতস্তত করে।”- সূরা আত তাওবা : ৪৪-৪৫

 

وَمَا مَنَعَهَمْ اَنْ تُقْبَلَ مِنْهُمْ نَفَقّهُمْ اِلاَّ اَنَّهُمْ كَفَرُوْا بِاللهِ وَرَسُوْلِه وَلاَ يَاتُوْنَ الصَّلوةَ اِلاَّ وُهُمْ كُسَالى وَلاَ يُنْفِقُوْنَ اِلاَّ وَهُمْ كرِهُوْنَ ـ

 

“আল্লাহর পথে তাদের দান শুধু এজন্যই কবুল করা যায় না যে, মূলত আল্লাহ এবং রাসূলের প্রতি তাদের ঈমান নেই; নামাযের জন্য তারা আসে বটে; কিন্তু মনক্ষুণ্ন হয়ে; আর টাকা-পয়সাও তারা দান করে, কিন্তু বড়ই বিরক্তি সহকারে ।”- সূরা আত তাওবা : ৫৪

 

اَلْمُنفِقُوْنَ وَالْمُنفِقّتُ بَعْضُهُمْ مِّنْ بَعْضٍ يَامُرُوْنَ بِالْمُنْكَرِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمَعْرُوْفِ وَيقْبِضُوْنَ اَيْدِيْهِمْ نَسُوْا اللهَ فَنَسِيْهُمْ اِنَّ الْمُنفِقِيْنَ هُمْ الْفسِقُوْنَ ـ التوبة : ٦٧

 

“মুনাফিক পুরুষ আর মুনাফিক স্ত্রী সব একই দলের লোক-একে অন্যের সাহায্যকারী। এরা সকলেই মিলে অন্যায়ের আদেশ করে, ন্যায় ও সত্যকে নির্মূল রাখে। এরা সকলেই আল্লাহকে ভুলে গেছে। তাই আল্লাহ তাদেরকে ভুলে গেছেন। এসব মুনাফিক যে ফাসেক (আল্লাহর নির্ধারিত সীমালংঘনকারী) তাতে সন্দেহ নেই।”- সূরা আত তাওবা : ৬৭

 

وَمَنْ الاَعْرَابِ مَنْ يَّتَّخِذُ مَايُنْفِقُ نَغْرَمًا ـ التوْبة : ٩٨

 

“এ আরাব (মুনাফিকদের) অনেকেই আল্লাহর রাস্তায় কিছু খরচ করলেও তা করে একান্তভাবে ঠেকে-যেন জরিমানা আদায় করছে।”

 

هآَ نْتُمْ هؤْلاَءٍ تُدْعَوْنَ لِتُنْفِقُوْا فِىْ سَبِيْلِ اللهِ فِمِنْكُمْ مَّنْ يَّبْخَلُ وَمَنْ يَّبْخَلْ فَانِّمَا يَبْخَلُ عَنْ نَّفْسِه وَاللهُ الْغَنِىُّ وَاَنْتُمْ الفُقَرَآءُ وَاِنْ تَتَوْلَّوْا يَسْتَبْدِلْ قَوْمًا غَيْرَكُمْ تُمَّ لاَيَكَوْنُوْا اَمْثَالَكُمْ ـ محمد : ٣٨

 

“জেনে রাখ, তোমাদের অবস্থা এতদূর খারাপ হয়ে গিয়েছে যে, তোমাদের আল্লাহর রাস্তায় কিছু খরচ করতে বললে তোমরা সেজন্য মোটেই প্রস্তুত হও না বরং তোমাদের অনেকেই তখন কৃপণতা করতে থাকে। অথচ যে ব্যক্তি এসব কাজে কৃপণতা করে সেই কৃপণতায় তার নিজেরই ক্ষতি হয়। মূলত আল্লাহ একমাত্র ধনশালী আর তোমরা সকলেই দরিদ্র-তাঁরই মুখাপেক্ষী। আল্লাহর রাস্তায় যদি তোমার আদৌ অর্থ ব্যয় করতে প্রস্তুত না হও তবে এ অপরাধের অনিবার্য ফলস্বরূপ আল্লাহ তাআলা তোমাদের স্থানে এক ভিন্ন জাতিকে প্রতিষ্ঠিত করবেন। তারা নিশ্চয়ই তোমাদের মত (কৃপণ) হবে না।”- সূরা মুহাম্মাদ : ৩৮

 

মোটকথা, যাকাত ইসলামের একটি স্তম্ভ এবং এটাই তার মূল কথা। একে প্রচলিত সরকারী ট্যাক্সের মত মনে মারাত্মক ভুল। কারণ আসলে এটা ইসলামের প্রাণ, ইসলামের জীবনী শক্তি। যাকাত ফরয করার মূলে ঈমানের পরীক্ষা করাই হচ্ছে প্রধান লক্ষ্য। ক্রমাগত পরীক্ষা দিয়ে ডিগ্রী লাভ করে, অনুরূপভাবে আল্লাহও মানুষের ঈমান যাচাই করার জন্য কতগুলো পরীক্ষা নির্দিষ্ট করে দেন; প্রত্যেক মানুষকেই এ পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়। একজন মানুষ যখন এরূপ পরীক্ষা দিয়ে চতুর্থ পরীক্ষা-অর্থাৎ অর্থদানের পরীক্ষায়ও সাফল্য লাভ করে, তখনই সে খাঁটি মুসলমান হয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, এটা নিশ্চয়ই সর্বশেষ পরীক্ষা নয়।

 

এরপরে আসে প্রাণের পরীক্ষা। সেই সম্পর্কেও আমি পরে আলোচনা করবো। কিন্তু ইসলামের সীমার মধ্যে আসার জন্য-অন্য কথায় আল্লাহর দলভুক্ত হবার যে কয়টি প্রবেশিকা পরীক্ষা নির্দিষ্ট করা হচ্ছে, তার মধ্যে যাকাত হচ্ছে সর্বশেষ পরীক্ষা। বর্তমানে অনেকেই বলে বেড়াচ্ছে যে, টাকা-পয়সা খরচ বা দান করার অনেক ওয়াজই মুসলমানকে শুনান হয়েছে, বর্তমানে এ অভাব ও দারিদ্রের কঠিন মুহূর্তে তাদেরকে খানিকটা উপার্জন ও সঞ্চয় করার ওয়াজ শুনানো উচিত; কিন্তু তারা বুঝতে পারে না যে, যে জিনিসটির প্রতি তারা নাক ছিটকাচ্ছে তা হচ্ছে ইসলামের এ প্রাণ বস্তুটি। আর এ জিনিসটির অভাবই মুসলমানকে নৈতিক ও আর্থিক অধ:পতনের চরম সীমায় নিয়ে পৌঁছিয়েছে। এ প্রাণ বস্তুটি তাদেরকে অধপতিত করেনি। তাদের সর্বব্যাপী পতন হয়েছে শুধু এজন্য যে, এ প্রাণ বস্তুটিই তাদের দেহ থেকে নির্গত হয়ে গেছে।

 

সমাজ জীবনে যাকাতের স্থান

 

কুরআন মজীদের বিভিন্ন স্থানে যাকাত-সদকা ইত্যাদির কথা বুঝার জন্য ইনসাফ ফী সাবিলিল্লাহ (আল্লাহর রাস্তায় খরচ করা) বাক্য ব্যবহৃত হয়েছে। কোনো কোনো স্থানে আবার বলা হয়েছে যে, তোমরা আল্লাহর রাস্তায় যা-ই খরচ করবে তা আল্লাহর কাছে করযে হাসান (ধার) হিসেবে মওজুদ থাকবে। এক কথায় এটা দ্বারা ঠিক আল্লাহকে ধার দেয়া হয়, আর আল্লাহ মানুষের কাছে ঋণী হন। অনেক স্থানে একথাও বলা হয়েছে যে, আল্লাহর রাস্তায় তোমরা যা কিছু দেবে তার বিনিময় দেয়ার দায়িত্ব আল্লাহর তিনি তোমাদের শুধু ততটুকু পরিমাণই ফিরিয়ে দেবেন না; তদপেক্ষা অনেক বেশী পরিমাণ দান করবেন।

 

কুরআন মজীদের উল্লেখিত কথাগুলো বাস্তবিকভাবেই প্রণিধানযোগ্য। আকাশ ও পৃথিবীর মালিক কি কখনও মুখাপেক্ষী হতে পারে? মানুষের কাছে থেকে সেই মহান পবিত্র আল্লাহর টাকা ধার নেয়ার কি প্রয়োজন থাকতে পারে? সেই রাজাধিরাজ সীমাসংখ্যাহীন ধন ভান্ডারের একচ্ছত্র মালিক আল্লাহ কি মানুষের কাছে নিজের প্রয়োজন ধার চান? কখনও নয়, তা হতেই পারে না। তাঁর দানেই দুনিয়ার জীব-জন্তু বস্তুনিচয় জীবন ধারণ করছে, তাঁর দেয়া জীবিকা দ্বারাই মানুষ বাঁচে। দুনিয়ার প্রত্যেক ধনী ও গরীবের কাছে যা কিছু আছে, তা সব তাঁরই দান। একজন অসহায় গরীব থেকে শুরু করে কোটিপতি পর্যন্ত প্রত্যেকেই তাঁর অনুগ্রহের মুখাপেক্ষী। কিন্তু তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন। তিনি মানুষের কাছে ধার চাইবেন এবং নিজের জন্য মানুষের সামনে হাত প্রসারিত করবেন- তার আদৌ কোনো প্রয়োজন নেই। মূলত মানুষেরই কল্যাণের জন্য, মানুষের কাজে ব্যয় করার জন্যই তিনি আদেশ করেন। আর সে ব্যয়টাকেই তিনি তাঁর পথে খরচ কিংবা ধার বলে গণ্য করেন। বস্তুত এটাও তাঁর আর এক কল্যাণ কামনার বাস্তব প্রকাশ-এটাও তাঁর এক প্রকার বড় অনুগ্রহ বিশেষ। তিনি বলেন, তোমরা তোমাদেরই সমাজের অভাবগ্রস্ত গরীব এবং আর এক কল্যাণ কামনার বাস্তব প্রকাশ-এটাও তাঁর এক প্রকার বড় অনুগ্রহ বিশেষ। তিনি বলেন, তোমরা যেসব লোককে অর্থ সাহায্য কর, এর বিনিময় তারা কোথা থেকে দেবে? এর প্রতিদান আমিই দান করবো। তোমরা ইয়াতিম, বিধবা, অসহায়, বিপদগ্রস্ত এবং নিসম্বল পথিক ভাইদেরকে যা কিছু দান করবে তার হিসেব আমার নামে লিখে রেখো এর তাগাদা তাদের কাছে নয় বরং আমার কাছে কারো। আমি তা পরিশোধ করবো। তোমরা তোমাদের গরীব ভাইদের ধার দাও কিন্তু তাদের কাছ থেকে সুদ গ্রহণ করে না, এর তাগাদা করে তাদেরকে অপ্রস্তুত ও বিব্রত করো না। তারা ঋণ শোধ করতে না পারলে সে জন্য তাদেরকে সিভিল জেল পাঠিয়ো না, তাদের কাপড়-চোপড় এবং ঘরের আসবাবপত্র ক্রোক করো না, তাদের অসহায় সন্তানদেরকে ঘর থেকে বের করে আশ্রয়হীন করে দিও না। কারণ তোমাদের ঋণ আদায়ের দায়িত্ব তাদের নয়- আমার, তারা যদি মূল টাকা আদায় করে দেয়, তবে তাদের পক্ষে থেকে সুদ আমি আদায় করবো আর তারা যদি আসল টাকাও না দিতে পারে, তাহলে আসল ও সুদ সবই আমি শোধ করবো। এভাবে নিজেদের সামাজিক কল্যাণমূলক কাজে মানুষের উপকারার্থে তোমরা যা খরচ, করবে, তার লাভ যদিও তোমরাই পাবে; কিন্তু সেই অনুগ্রহ আমার ওপর করা হবে, আমিই তার লাভ সহ পূর্ণ হিসেব করে তোমাদেরকে ফেরত দেব।

 

একমাত্র দয়াময়, রাজাধিরাজ আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহের যথার্থতা এখানেই মানব জাতির কাছে যা কিছু আছে, তা সব তাঁরই দান- অন্য কোথাও থেকে বা অন্য কারো কাছ থেকে তোমরা তা পাও না। তাঁরই ভাণ্ডার থেকে তোমরা নিয়ে থাক, কিন্তু যা কিছু দাও, তাঁকে নয়-তোমাদেরই আত্মীয়, এগানা, ভাই, বন্ধু ও নিজ জাতির লোকদেরকেই দিয়ে থাক। কিংবা নিজেদের সামাজিক কল্যাণমূলক কাজে ব্যয় কর, যার ফলও শেষ পর্যন্ত তোমরাই পেয়ে থাক। কিন্তু সেই মহান দাতার অসীম বদান্যতা লক্ষ্য কর, তিনি এ সকল দান সম্পর্কে বলেন যে, এটা তাঁকে ঋণ দেয়া হয়েছে, তাঁরই পথে খরচ করা হয়েছে, তাঁকে দেয়া হয়েছে-এর ফল আমিই তোমাদেরকে দেব। বস্তুত বদান্যতার এ অতুলনীয় পরাকাষ্ঠা একমাত্র আল্লাহ তাআলারই পক্ষে শোভা পায়, কোনো মানুষ এর ধারণাও করতে পারে না।

 

ভাবার বিষয় এই যে, আল্লাহ তাআলা মানুষের মধ্যে দানশীলতা ও বদান্যতার উৎস সঞ্চার করার জন্য এ পন্থা অবলম্বন করলেন কেন? এ বিষয়ে যতই চিন্তা করা যায়, ইসলামের উন্নত শিক্ষার অন্তনির্হিত পবিত্র ভাবধারা ততই সুস্পষ্টরূপে হৃদয়ঙ্গম করা যায়; মন উদাত্ত কন্ঠে বলে উঠে –এ অতুলনীয় শিক্ষা আল্লাহ ছাড়া আর কারো হতে পারে না।

 

মানুষ যে স্বভাবতই কিছুটা যালেম এবং জাহেল হয়ে জন্মগ্রহণ করে, তা সকলেরই জানা কথা। তার দৃষ্টি অত্যন্ত সংকীর্ণ। বেশী দূর পর্যন্ত তা পৌঁছায় না। তাদের দিল খুবই ক্ষুদ্র, তার মনে বড় এবং উচ্চ ধারণার খুব কমই সংকুলান হয়ে থাকে। মানুষ ভয়ানক স্বার্থপর, কিন্তু সেই স্বার্থপরতা সম্পর্কেও কোনো ব্যাপক ও বিরাট ধারণা তার মন-মস্তিষ্কে স্থান পায় না। মানুষ অবিলম্বেই সবকিছু পেতে চায়: خَلَقَ الاِنْسَانَ مِنْ عَجَلٍ ـ প্রতিটি কাজের ফল এবং পরিণাম যত তাড়াতাড়ি সম্ভব লাভ করতে সে প্রয়াসী। যে ফল তার সামনে অবিলম্বে আসে এবং নিজের চোখ দ্বারা দেখতে পায়, তাই তার কাছে একমাত্র ফল ও পরিণাম। সুদূরপ্রসারী ফলাফল পর্যন্ত তার দৃষ্টি মোটেই পৌঁছায় না। উপরন্তু যে ফল খুব বড় আকারে সামনে আসে এবং যে ফলের ক্রিয়া বহুদূর পর্যন্ত পৌঁছায়, মানুষ তা অনুভব পর্যন্ত করতে পারে না। বস্তুত এটা মানুষের এক স্বাভাবিক দুর্বলতা বিশেষ। এ দুর্বলতার কারণে মানুষ নিজের স্বার্থ ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায় না। আর তাও আবার যেসব স্বার্থ ছোট আকারে এবং খুব দ্রুত লাভ করা যায়, তারই প্রতি তার দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকে। সে বলে আমি যা উপার্জন করেছি বা আমার বাপ-দাদার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে যা পেয়েছি তা একান্তভাবে আমার, অন্য কারো কোনো অংশ বা অধিকার তাতে নেই। কাজেই আমি কেবল নিজের প্রয়োজনে, নিজের ইচ্ছায় এবং নিজের আরাম আয়েশের কাজে খরচ করবো। কিংবা যেসব কাজের ফল অবিলম্বে আমার হাতে ফিরে পাব কেবল সেই কাজে নিয়োগ করবো। আমি যদি টাকা খরচ করি তবে এর বিনিময় আমার মান-সম্মান বৃদ্ধি পাওয়া কিংবা কোনো খেতাব লাভ করা একান্তই আবশ্যক। মানুষ যেন আমার সামনে মাথা নত করে, লোকের মুখে যেন আমার নামের চর্চা হয়। এসব জিনিসের কোনোটাই যদি আমি না পাই, তবে আমি টাকা খরচ করবো কেন? আমরা নিকটবর্তী কোনো গরীব-দু:খী বা ইয়াতীম মিসকিন যদি না খেয়ে মরে যায়, তবুও আমি কেন তাঁকে খাদ্য যোগাড় করে দেব? তার প্রতি তার পিতার কর্তব্য ছিল নিজের সন্তানের জন্য কিছু রেখে যাওয়া। আমার পাড়ার কোনো বিধবার যদি দু:খে দিন কাটে তবে আমার তাতে কি আসে যায়? তার জন্য তার স্বামীর চিন্তা করা উচিত ছিল। কোনো প্রবাসী যদি সম্বলহীন হয়ে পড়ে, তবে তার সাথে আমার কি সম্পর্ক থাকতে পারে? সে পথের ব্যবস্থা না করেই ঘর থেকে বের হয়ে বড় নির্বুদ্ধিতার কাজ করেছে। অন্য কোনো ব্যক্তি যদি দূরবস্থায় পড়ে তবে তার প্রতি আমার কী করণীয় থাকতে পারে? আমার ন্যায় তাকেও আল্লাহ তাআলা হাত-পা দিয়েছেন। নিজের প্রয়োজন পরিমাণ উপার্জন করা তার নিজেরই কর্তব্য। আমি তার সাহায্য করবো কেন? আর একান্তই আমি তাকে যদি কিছু টাকা-পয়সা দেই তবে ঋণ হিসেবেই দেব এবং আসল টাকার সাথে এর সুদও নিশ্চয়ই আদায় করবো। কারণ, বিনা পরিশ্রমে তো টাকা উপার্জিত হয়নি। সেই টাকা আামার কাছে থাকলে কত কাজেই না লাগাতে পারতাম-দালান-কোঠা তৈরি করতে পারতাম, মোটর গাড়ি কিনতে পারতাম কিংবা অন্য কোনো লাভজনক কাজে খাটাতে পারতাম। সে যদি আমার টাকা দিয়ে কোনো উপকার লাভ করতে পারে, তবে আমি আমার টাকা দ্বারা কিছু না কিছু লাভ করতে পারবে না কেন? তা থেকে আমার অংশই বা আমি আদায় করবো না কেন?

 

এরূপ স্বার্থপর মনোবৃত্তির কারণে প্রথমত মানুষ ধনপিশাচে পরিণত হয়। সে তা খরচ করলে ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্যই করবে। যে কাজে কোনো স্বার্থ দেখতে পাবে না, সেখানে এক পয়সাও খরচ করবে না। কোনো গরীবের সাহায্য যদি সে করেও, তবে মূলত তা দ্বারা সেই গরীবের কোনো সাহায্য হবে না, বরং তাকে আরো বেশী করে শোষণ করবে এবং তাকে যা দেবে তদপেক্ষা অনেক বেশী আদায় করবে। কোনো মিসকীনকে কিছু দান করলে সে এ ব্যক্তির প্রতি নিজের অনুগ্রহ দেখিয়ে তাকে কাতর করে ছাড়বে এবং তাকে এতদূর অপমানিত ও লাঞ্চিত করবে যে, তার মধ্যে আত্মসম্মানবোধটুকুও অবশিষ্ট থাকতে দেবে না। কোনো জাতীয় কাজে অংশ গ্রহণ করলে এ ধরনের মানুষ সর্বপ্রথম নিজের স্বার্থের প্রতি দৃষ্টি দেবে। যেসব কাজে নিজের স্বার্থ লাভের সম্ভবনা থাকবে না, সেই কাজে একটি পয়সাও দিতে প্রস্তুত হবে না।

 

এধরনের মনোবৃত্তির পরিণাম কত ভয়াবহ তা ভেবে দেখেছেন কি? এর ফলে গোটা সমাজ জীবনই যে চুরমার হয়ে যাবে তাই নয়, বরং শেষ পর্যন্ত সেই ব্যক্তির অবস্থাও অত্যন্ত মারাত্মক হয়ে পড়বে, সন্দেহ নেই। কিন্তু এদের দৃষ্টি অত্যন্ত সংকীর্ণ এবং তারা অতীব মূর্খ বলে এটা থেকেও তাদের নিজেদেরই উপকারিতার আশা করে থাকে। এ ধরনের উপার্জনহীন মনোবৃত্তি যখনই মানুষের মধ্যে সক্রিয় হয়ে ওঠে তখন সমাজের খুব অল্প সংখ্যক লোকের হাতে সমগ্র জাতীয় সম্পদ কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ে এবং অসংখ্য লোক একেবারে নিরুপায় ও উনহীন হয়ে পড়তে বাধ্য হয়। অর্থশালী লোক অর্থের বলে আরও বেশী পরিমাণ অর্থ শোষণ করে, গরীব লোকদের জীবন ক্রমশ আরও বেশী খারাপ হয়ে যায়। যে সমাজে দারিদ্র একটা সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। সামাজিক স্বাস্থ্য-ধৈর্য চূর্ণ হয়, নানা প্রকার দুরারোগ্য ব্যাধি সমাজ দেহে আক্রমণ করে, ফলে তারা কাজের ও উৎপাদনের শক্তি হারিয়ে ফেলে। তাদের মধ্যে মূর্খতা ও অশিক্ষা বৃদ্ধি পায়, নৈতিক স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়ে। তারা নিজেদের প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্য অপরাধ প্রবণ হতে বাধ্য হয় এবং শেষ পর্যন্ত লুটতরাজ করতেও পশ্চাৎ পদ হয় না। সমাজে এক সর্বব্যাপী বিশৃংখলার সৃষ্টি হয়, ধনী লোক গরীবদের হাতে নিহত হতে শুরু করে, তাদের ঘর-বাড়ী লুণ্ঠিত হয়, অগ্নিদগ্ধ হয় এবং তারা চিরতরে ধ্বংস হতে বাধ্য হয়।

 

সমাজ বিজ্ঞানীদের দৃষ্টিতে প্রত্যেকটি মানুষের ব্যক্তিগত কল্যাণ তার সামাজিক বৃহত্তর কল্যাণের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একজনের কাছে যে অর্থ আছে তা যদি অন্য এক ভাইয়ের সাহায্যার্থে ব্যয়িত হয় তবে এ অর্থই আবর্তিত হয়ে অভাবিতপূর্ব কল্যাণ নিয়ে পুনরায় তার হাতেই ফিরে আসবে। পক্ষান্তরে নিতান্ত সংকীর্ণ দৃষ্টির বশবর্তী হয়ে যদি সে তার নিজের কাছেই সঞ্চয় করে রাখে, কিংবা নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থজনিত কাজে ব্যয় করে, তবে ফলত সে অর্থ ক্ষয়প্রাপ্ত হবে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, একটি ইয়াতীম শিশুকে আপনি যদি লালন-পালন করে এবং উপযুক্ত শিক্ষা-দীক্ষা দিয়ে উপার্জনক্ষম করে দেন, তবে তাতে সামাজিক সম্পদ বৃদ্ধি পাবে। আপনিও তা থেকে অংশ লাভ করতে পারবেন। কারণ, আপনিও সেই সমাজেরই একজন লোক। হতে পারে সেই ইয়াতীমের বিশেষ যোগ্যতার ফলে আপনি যে অর্থ লাভ করেছেন তা কোনো হিসেবের সাহায্যে হয়ত আপনি আদৌ জানতে পারেননি। কিন্তু প্রথমেই তার লালন-পালন করতে এবং তাকে শিক্ষা-দীক্ষা দিতে আপনি যদি অস্বীকার করেন এবং বলেন যে, আমি তার সাহায্য করবো কেন, তার পিতারই কিছু না কিছু ব্যবস্থা করে যাওয়া উচিত ছিল, তবে তো সে উদভ্রান্তের ন্যায় ঘুরে বেড়াবে, ছন্নছাড়া হয়ে নিরুদ্দেশ হাতড়িয়ে মরবে, অকর্মণ্য হয়ে যাবে এবং সামাজিক সম্পদ বৃদ্ধি করার মতো কোনো যোগ্যতাই সে লাভ করতে পারবে না। বরং সে অপরাধ প্রবণ হয়ে একদা স্বয়ং আপনার ঘরেই সিঁদ কাটতে প্রস্তুত হবে। এর অর্থ এ দাঁড়ায় যে, আপনি সমাজেরই এক ব্যক্তিকে অকর্মণ্য ও অপরাধ প্রবণ বানিয়ে কেবল তারই নয়-আপনার নিজেরও ক্ষতি সাধন করবেন। এ একটি মাত্র উদাহরণ সামনে রেখে দৃষ্টি প্রসারিত করলে পরিষ্কার দেখতে পাওয়া যাবে যে, নিস্বার্থভাবে যে ব্যক্তি সামাজিক বৃহত্তর কল্যাণের জন্য অর্থ খরচ করে, বাহ্য দৃষ্টিতে তা তার নিজ পকেট থেকে নির্গত হয় বটে; কিন্তু বাইরে এসে তাই বৃদ্ধি পেয় স্ফীত হতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত তাই অসংখ্য রূপ উপকার ও স্বার্থকতা নিয়ে আবার তার পকেটেই ফিরে যায়। আর যে ব্যক্তি বাহ্য দৃষ্টিতে তার অর্থ তার নিজের বাক্সে থেকে যায় বা সুদ খেয়ে তাকে আরও স্ফীত করে তোলে; কিন্তু প্রকতপক্ষে নিজের নির্বুদ্ধিতার দরুনই নিজের সম্পদ নষ্ট করে-নিজেরই ধ্বংসের ব্যবস্থা করে।

 

আল্লাহ তাআলা এ তত্ত্ব কথাই বলেছেন নিম্নলিখিত আয়াতে:

 

يَمۡحَقُ ٱللَّهُ ٱلرِّبَوٰاْ وَيُرۡبِى ٱلصَّدَقَـٰتِ‌ۗ ـ البقرة : (٢٧٦)

 

“আল্লাহ সুদ নিশ্চিহ্ন করে দেন এবং দানকে ক্রমবৃদ্ধি প্রাপ্ত করেন।”

 

وَمَا اتَيْتُمْ مِّنْ رٍّبًا لِّيَرۡبُوَاْ فِىٓ أَمۡوَٲلِ ٱلنَّاسِ فَلَا يَرۡبُواْ عِندَ ٱللَّهِ‌ وَمَآ ءَاتَيۡتُم مِّن  زَكوْةٍ تُرِيْدُوْنَ وَجْهَ اللهِ فَاُوْلئِكَ هُمُ الْمُضْعِفُوْنَ ـ الروم : ٣٩

 

“মানুষের সম্পদ বৃদ্ধি করবে বলে তোমরা যে সুদ দাও, মূলত আল্লাহর কাছে তাতে সম্পদ মোটই বৃদ্ধি পায় না কিন্তু তোমরা যে যাকাত আদায় কর-একমাত্র আল্লাহর সন্তোষ লাভ করার উদ্দেশ্য তা অবশ্য দ্বিগুণ বৃদ্ধি পায়।”- সূরা আর রূম : ৩৯

 

কিন্তু এ গভীর তত্ত্ব কথা বুঝতে এবং তদানুযায়ী কাজ করতে মানুষের দৃষ্টি সংকীর্ণতা এবং চরম মূর্খতা বিরাট বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরা ইন্দ্রিয়ের দাস। যে টাকা তাদের পকেটে আছে তা দিয়ে তারা অনুভব করতে পারে এবং বুঝতে পারে যে, তা নিশ্চয়ই আছে। তাদের হিসেবের খাতায় যে পরিমাণ টাকা বেড়ে চলেছে তার ক্রম বৃদ্ধি সম্পর্কেও তারা নিসন্দেহ; কিন্তু যে টাকা তাদের কাছ থেকে চলে যায়; তা যে বাড়ছে এবং তাদের হাতে যে ফিরে আসতে পারে; সে কথা মোটেই বুঝতে ও দেখতে পায় না। তারা শুধু বুঝে এত টাকা আমার হাত থেকে চলে গিয়েছে এবং তা চিরকালের জন্যই গেছে।

 

মূর্খতার এ বন্ধনকে মানুষ নিজের বুদ্ধি বা চেষ্টার দ্বারা অদ্যাবধি খুলতে পারেনি। সারা দুনিয়ার অবস্থাই এরূপ। একদিকে পুজিঁবাদীদের দুনিয়া-সকল কাজই সেখানে সুদ প্রথার ওপর চলছে এবং ধন-সম্পদের প্রাচুর্য সত্ত্বেও সেই দেশে দু:খ দারিদ্র আর অভাব অনটন ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে এদের বিরোধী আর একটি দল ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে ওঠেছে। তাদের মনে হিংসার আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে। এর পুঁজিবাদীদের ধন-ভান্ডার লুটে তো নেবেই সেই সাথে মানুষের তাহযীব-তমুদ্দুনের গোটা ইমারতকেও ধূলিসাৎ করে দিতে বদ্ধপরিকর হয়ে ওঠেছে।

 

মানুষ এ সমস্যার সমাধান করতে পারেনি। এর সুষ্ঠ সমাধান করেছে মানুষের স্রষ্টা-মহীয়ান গরীয়ান আল্লাহ তাআলা। তিনি এসব মানুষের অন্যান্য যাবতীয় সমস্যার সুষ্ঠ সমাধানসহ যে কিতাব নাযিল করেছেন, তার নাম কুরআন মজীদ। এ সমস্যার সমাধান করতে হলে মানুষকে আল্লাহ এবং পরকালের প্রতি ঈমান আনতে হবে। মানুষ যদি আল্লাহর এবং পরকালের প্রতি ঈমান আনতে হবে। মানুষ যদি আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে পারে এবং সন্দেহাতীতরূপে জেনে নেয় যে, আকাশ ও পৃথিবীর সমগ্র ধন-ভান্ডারের প্রকৃত মালিক হচ্ছেন আল্লাহ তাআলা : আর মানুষের সকল কাজের ব্যবস্থাপনা একান্তভাবে আল্লাহর ওপর নির্ভর করে, তার কাছে প্রত্যেকটি অণু-পরমাণুর হিসেব বর্তমান আছে; মানুষের ভালো বা মন্দ কাজের পুরুস্কার বা শাস্তি আখেরাতে ঠিক তদনুযায়ী হবে। তাহলে নিজের স্থুলদৃষ্টির ওপর নির্ভর না করে আল্লাহর ওপর ভরসা করে নিজের ধন-সম্পদ আল্লাহর বিধান অনুসারে ব্যয়-ব্যবহার করা এবং লাভ-ক্ষতি আল্লাহর ওপর ছেড়ে দেয়া মানুষের পক্ষে খুবই সহজ হয়ে পড়ে। এরূপ ঈমান নিয়ে সে যা কিছু খরচ করবে তা একান্তভাবে আল্লাহর জন্যই খরচ করা হবে। তার হিসেবেও আল্লাহর দফতরে যথাযথভাবে লিখিত হবে। তার এ খরচের খবর দুনিয়ার কোনো মানুষ জানতে না পারলেও আল্লাহ তাআলা সেই সম্পর্কে পূর্ণরূপে অবহিত থাকেন। আর দুনিয়ার মানুষ তার কৃতজ্ঞতা স্বীকার না করলেও আল্লাহ নিজেই যখন তার প্রতিদান দেয়ার ওয়াদা করেছেন তখন পরকালেই হোক কিংবা ইহকাল ও পরকাল উভয় স্থানেই হোক-সেই ওয়াদা যে পূর্ণ হবে তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।

 

আল্লাহর পথে খরচ করার জন্য সাধারণ নির্দেশ

 

আল্লাহ তাআলা ইসলামী শরীয়াতের এ নিয়ম করেছেন যে, প্রথমে তিনি ভালো এবং পূণ্য কাজের একটা সাধারণ হুকুম জারী করেন, যেন মানুষ নিজের জীবনে সাধারণভাবে ভালো ও কল্যাণকর পন্থা অবলম্বন করতে পারে। তারপর সেই ভালো কাজসুসম্পন্ন করার জন্য একটি বিশেষ পন্থা নির্দেশ করা হয়। সেই বিশেষ পন্থাটি সকলেরই যথাযথ রূপে পালন করা কর্তব্য। উদারহণ স্বরূপ বলা যেতে পারে যে, আল্লাহকে স্মরণ করা একটি অত্যন্ত ভালো কাজ এবং সর্বাপেক্ষা অধিক ভালো কাজ। শুধু তাই নয়- বস্তুত সমস্ত ভালো কাজেরই মূল উৎস এটাই। সেজন্য আল্লাহকে সকল সময় ও সকল অবস্থায়ই স্মরণ করা এবং এক মুহূর্তও তাকে ভুল না যাওয়ার জন্য তাঁর নিদেশ রয়েছে:

 

فَاذْكُرُوْا اللهَ قِيْمًا وَّقُعُوْدُا وَّعَلى جُنُوْبِكُمْ ـ النساء : ١٠٣

 

“দাঁড়িয়ে, বসে এবং শুয়ে (সকল সময় ও সকল অবস্থায়ই) আল্লাহকে স্মরণ কর।” সূরা আন নিসা : ১০৩

 

وَاَذْكُرُوْا اللهَ كَثِيْرَ لَّعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ ـ الانفال : ٤٥

 

“খুববেশী করে তাঁর স্মরণ করতে থাক, কারণ একাজেই তোমাদের কল্যাণ হবে আশা করা যায়।”- সূরা আল আনফাল : ৪৫

 

اِنِّ فِىْ خَلْقِ السَّموتِ وَالاَرْضِ وَاَخْتِلاَفِ الَّيْلِ وَالنَّهَارِ لاَيْتٍ لاَوْلِىْ الاَلْبَابِ ـ الَّذِيْنَ يَذْكُرُوْنَ اللهَ قِيْمَامًا وَّقُعُوْادًا وَّعَلى جُنُوْبِهِمْ وَيَتَفَكَّرُوْنَ فِىْ خَلْقِ السَّموتِ وَالاْرْضِ رَبُّنَا مَا خَلَقْتَ هَذَا بَاطِلاً ـ

 

“আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টির ব্যাপারে এবং রাত ও দিনের আবর্তনে (আল্লাহর অস্তিত্বের) বহু নিদর্শন রয়েছে, এবং চিন্তাশীল লোকদের জন্য- যাঁরা দাঁড়িয়ে, বসে এবং শুয়ে আল্লাহকে স্মরণ করে, আর আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি ও গঠন রহস্য সম্পর্কে চিন্তা করতে থাকে এবং (গভীরভাবে চিন্তা করার পর প্রত্যেকটি জিনিসের মহাত্ম্য বুঝতে পেরে উদাত্ত কন্ঠে) বলে উঠে- হে আল্লাহ! তুমি এর কোনো একটিও নিরর্থক সৃষ্টি করনি।”- সূরা আলে ইমরান : ১৯০-১৯১

 

وَلاَ تَطِعْ مَنْ اَغْفَلْنَا قَلْبَه عَنْ ذِكْرِنَا وَاتَّبَعَ هَوَٮٰهُ وَكَانَ اَمْرَهُ فُرُطًا ـ الكهاف : ٢٨

 

“যাদের দিলে আল্লাহর স্মরণ নেই, যারা নিজেদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে এবং যারা প্রত্যেকটি কাজের নির্দিষ্ট সীমালংঘন করে থাকে, তোমরা তাদের আনুগত্য বা অনুসরণ করো না।”- (সূরা আল কাহাফ :২৮)

 

এ আয়াতসমূহে এবং এ ধরণের আরও অনেক ও অসংখ্য আয়াতে পরিস্কার নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, হে মানুষ! তোমরা সকল সময় সকল অবস্থায়ই আল্লাহকে স্মরণ কর। কারণ, প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর স্মরণই মানুষের সকল কাজ-কর্ম সুষ্ঠু এবং সুন্দর করে দেয়। মানুষ যখনই এবং যে কাজেই তাঁকে ভুলে যাবে; সেখানেই প্রবৃত্তি (নফসের খাহেস) এবং শয়তানের প্রতারণা তাকে পরাভূত করবে। এর অনিবার্য পরিণামে মানুষ সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে নিজেদের জীবন যাপনের ব্যাপারে সীমালংঘন করতে শুরু করবে।

 

এটা ছিল আল্লাহকে স্মরণ করার একটি সাধারণ নির্দেশ। অতপর আল্লাহকে স্মরণ করার একটি বিশেষ উপায় নির্ধারণ করা হয়েছে। সে জন্য দিন-রাতের মধ্যে পাঁচবার কয়েক রাকাআত করে নামায পড়া ফরয করা হয়েছে। এ নামাযসমূহে একবার পাঁচ-সাত মিনিটের বেশী সময় অতিবাহিত হয় না। পাঁচ মিনিট এখন, আর পাঁচ মিনিট তখন এভাবে আল্লাহকে স্মরণ করা ফরয করে দেয়ার অর্থ এই যে, অন্ততপক্ষে এতটুকু সময়ের জন্য তো মুসলমানকে আল্লাহর স্মরণের কাজে আত্মনিমগ্ন হতেই হবে। তারপর তারা নিজ নিজ কাজ করে যাবে এবং সেই অবস্থায়ও আল্লাহকে স্মরণ করতে থাকবে।

 

ইসলামে যাকাতের ঠিক এ অবস্থা। এখানেও একটি বিশেষ হুকুম এবং একটি সাধারণ হুকুম রয়েছে। একদিকে সুস্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে যে, কৃপণতা ও মনের সংকীর্ণতা থেকে দূরে থাক, কারণ এটাই সকল অনর্থের মূল এবং সকল বিপর্যয়ের উৎস। তোমাদের নৈতিক জীবনে আল্লাহর রং ধারণ কর। কারণ তিনি প্রতিটি মুহূর্তে গোটা সৃষ্টিজগতের ওপর অফুরন্ত অনুগ্রহ ও রহমত বর্ষণ করে থাকেন, যদিও তাঁর ওপর কারো বিশেষ কোনো অধিকার বা দাবী নেই। আবার বলা হয়েছে, আল্লাহর রাস্তায় যত এবং যা কিছুই খরচ করতে পার, তা করতে থাক, নিজেদের প্রয়োজন পূর্ণ করে যা উদ্ধৃত্ত রাখতে পার রাখ এবং আল্লাহর অন্যান্য অভাবগ্রস্ত বান্দাদের প্রয়োজন মিটাবার জন্য যত পার দান কর। দীনের খেদমত এবং আল্লাহর কালেমা প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যে জান-মাল দিয়ে চেষ্টা করতে বিন্দুমাত্র কুন্ঠিত হইও না। আল্লাহর প্রতি যদি তোমার ভালবাসা থাকে, তবে ধন-সম্পত্তির প্রেমকে সে জন্য উৎসর্গ কর।

 

আল্লাহর পথে অর্থ দান করার জন্য এটা সাধারণ হুকুম। কিন্তু সেই সাথে বিশেষ নির্দেশ এই যে, এত পরিমাণ অর্থ তোমাদের কাছে সঞ্চিত হলে তা থেকে কমপক্ষে এত পরিমাণ অবশ্যই আল্লাহর রাস্তায় খরচ করবে। তোমাদের ক্ষেতে এত পরিমাণ ফসল হলে তা থেকে এত পরিমাণ আল্লাহর পথে অবশ্যই দান করবে। নির্দিষ্ট কয়েক রাকাআত মাত্র নামায ফরয করার অর্থ যেমন এই নয় যে, ঐ কয় রাকাআত মাত্র আদায় করলেই আল্লাহকে স্মরণ করার কর্তব্য সম্পন্ন হয়ে গেল, অতএব তা ভিন্ন অন্যান্য সময় আল্লাহকে ভুলে যেতে পারবে। অনুরূপভাবে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ আল্লাহর রাস্তায় দান করা যে ফরয করা হয়েছে, তার অর্থও এটা নয় যে, যাদের কাছে এত পরিমাণ অর্থ আছে কেবল তারাই আল্লাহর রাস্তায় খরচ করত বাধ্য। আর যারা তদপেক্ষা কম অর্থের মালিক, তাদের মুঠি বন্ধ করে রাখবে। এমনকি, তার অর্থ এটাও নয় যে, ধনীদের ওপর যে পরিমাণ যাকাত ফরয হয়েছে, তারা কেবল সেই পরিমাণ অর্থ আল্লাহর রাস্তায় খরচ করেই নিষ্কৃতি পেয়ে যাবে, অতপর কোনো অভাবগ্রস্ত ব্যক্তি আসলে তাকে তাড়িয়ে দেবে-দীন ইসলামের কোনো বৃহত্তর কাজের তাগীদ আসলে বলবে, একমাত্র যাকাতই আমার প্রতি ফরয হয়েছিল, আমি তা আদায় করেছি। অতএব এখন আর আমার কাছে কিছুই পেতে পারে না। বস্তুত যাকাত ফরয করার অর্থ মোটেই এটা নয়। যাকাত ফরয করার প্রকৃত তাৎপর্য এই যে, প্রত্যেক ধনী ব্যক্তি অন্ততপক্ষে এ নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ অবশ্যই আল্লাহর পথে খরচ করতে বাধ্য। আর তার অধিক ব্যয় করার সামর্থ্য থাকলে তাও তাকে অবশ্যই করতে হবে।

 

আল্লাহর রাস্তায় অর্থ খরচ করার সাধারণ হুকুম এবং তার বিশ্লেষণ এখানে করা যাচ্ছে:

 

কুরআন মজীদ কোন কাজের নির্দেশ দেয়ার সাথে সাথে তার অন্তনির্হিত যৌক্তিকতাও স্পষ্ট করে বলে দেয়। এটা কুরআন মজীদের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। এর সাহায্যে মানুষ আল্লাহর আদেশের মূল লক্ষ্যে ও যৌক্তিকতা সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারে।

 

কুরআন মজীদের শুরুতে যে আয়াতটি চোখে পড়ে তা এই:

 

ذَلِكَ الْكِتبُ لاَرَيْبَ فِيْه هُدًى لِّلْمُتَّقِيْنَ ـ الَّذِيْنَ يُؤْمِنُوْنَ بِالْغَيْبِ وَيُقِيْمُوْنَ الصَّلوةَ وَمِمَّا رَزَقْنهُمْ يُنْفِقُوْنَ ـ البقرة : ٢-٣

 

“এ কুরআন আল্লাহর কিতাব, এতে কোনো প্রকার সন্দেহের অবকাশ নেই। এটা সেই সব সত্যনিষ্ঠ মুত্তাকী লোকদেরকে সত্য পথের সন্ধান করে দেয়, যারা অদৃশ্যে বিশ্বাসী, নামায কায়েম করে এবং আমার দেয়া জীবিকা থেকে (আমার পথে) খরচ করে।”- সূরা আল বাকারা : ২-৩

 

এ আয়াতে একটি মূলনীতি বলে দেয়া হয়েছে। পার্থিব জীবনে সোজা পথে চলার জন্য তিনটি জিনিস অপরিহার্য। প্রথম, ঈমান বিল গায়েব অদৃশ্যে বিশ্বাস স্থাপন: দ্বিতীয়, নামায কায়েম করা এবং তৃতীয়, আল্লাহ তাআলা যে রিযক দান করেছেন, তা থেকে আল্লাহর রাস্তায় খরচ করা। অন্যত্র বলা হয়েছে:

 

لَنْ تَنَالُوْا الْبِرَّ حَتّى تُنْفِقُوْنَ مِمَّا تَحِبُّوْنَ ـ ال عمران : ٩٢

 

“তোমাদের প্রিয় জিনিসগুলো আল্লাহর পথে অকাতরে খরচ না করা পর্যন্ত পুণ্যশীলতার উচ্চ মর্যাদা তোমরা কিছুতেই লাভ করতে পারো না।”

 

আবার বলা হয়েছে:

 

اَلْشَّيْطنُ يَعِدُكُمْ الْفَقْرَ وَيَامُرُكُمْ بِالْفَحْشَآَءِ ـ البقرة : ٢٦٨

 

“টাকা-পয়সা খরচ করলে শয়তান তোমাদেরকে গরীব হয়ে যাওয়ার ভয় দেখায় এবং তোমাদেরকে লজ্জাকর কাজ-কৃপণতার জন্য উদ্বুদ্ধ করে।”

 

এরপর ইরশাদ করা হয়েছে:

 

وَاَنْفِقُوْا فِىْ سَبِيْلِ اللهِ وَلاَ تُلْقُوْا بِاَيْدِيْكُمْ اِلَى التَّهْلُكَةِ ـ ١٩٥

 

“আল্লাহর রাস্তায় খরচ কর এবং নিজের হাতেই নিজেকে ধ্বংসের মুখে নিক্ষেপ করো না (আল্লাহর রাস্তায় খরচ না করলেই নিজকে ধ্বংসের মুখে নিক্ষেপ করা হয়)।”- সূরা আল বাকারা : ১৯৫

 

সর্বশেষ বলা হয়েছে:

 

وَمَنْ يُّوْقَ شُحَّ نَفْسِه فَاُوْلَئْكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ ـ الحشر : ٩

 

“মনের সংকীর্ণতা হতে যারা বাঁচতে পারবে তাঁরাই পরম কল্যাণ লাভ করবে।”- সূরা আল হাশর : ৯

 

উল্লেখিত আয়াতসমূহ থেকে পরিষ্কার জানতে পারা যায় যে, দুনিয়ায় মানুষের জীবন যাপনের দুটি মাত্র পথ বিদ্যমান। একটি আল্লাহর পথ-যার পরিণামে চিরন্তন সুখ শান্তি এবং পরম কল্যাণ রয়েছে। এ পথে মানুষের দিল উদার-উন্মুক্ত হয়ে থাকাই স্বাভাবিক। আল্লাহ তাকে কম কিংবা বেশী যে পরিমাণ রিযকই দান করেছেন, তা থেকে সে নিজের যাবতীয় প্রয়োজন পূর্ণ করবে, অন্যান্য ভাইদেরকেও যথাসম্ভব সাহায্য করবে এবং আল্লাহর কালেমা বুলন্দ করা বা আল্লাহর দ্বীন ইসলামকে কায়েম করার কাজেও ব্যয় করবে। অপরটি হচ্ছে শয়তানের পথ। এ পথে বাহ্য দৃষ্টিতে মানুষ খুব আনন্দ এবং সুখ দেখতে পায়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এ পথে ধ্বংস এবং বিপর্যয় ভিন্ন আর কিছুই নেই। এ পথে স্বাভাবিকভাবেই অর্থ-সম্পদ শোষণ করে সঞ্চয় করতে চেষ্টা করে এবং অর্থের জন্য মন ও প্রাণ দিতেও কুন্ঠিত হয় না। আর তা করতেও প্রস্তত হয় না। একান্তই যদি খরচ করে, তবে তা কেবল নিজের প্রয়োজন এবং নিজের মনের লালসা চরিতার্থ করার জন্য মাত্র।

 

আল্লাহর পথের যাত্রীদেরকে আল্লাহর রাস্তায় ধন-সম্পদ খরচ করার যে নিয়ম ও পন্থা বলে দেয়া হয়েছে, এখানে ধারাবাহিকভাবে তা উল্লেখ করা হয়েছে:

 

এক: সর্বপ্রথম কথা এই যে, কেবলমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্যই খরচ করবে, কারো প্রতি অনুগ্রহ প্রদর্শন করা বা দুনিয়ায় নাম ও খ্যাতি লাভ করার জন্য খরচ করবে না।

 

وَمَا تُنْفِقُوْنَ اِلاَّ اِبْتِغَاءَ وَجْهِ اللهِ ـ البقرة : ٢٧٢

 

“তোমরা যা কিছু খরচ কর, তাতে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ ছাড়া তোমাদের যেন আর কিছুই লক্ষ্য না থাকে।”

 

يَآ يُّهَا الَّذِيْنَ امَنُوْا لاَتُبْطِلُوْا صَدَقتِكُمْ بِالْمَنِّ وَاَلاَذى كَالَّذِيْ يُنْفِقُ مَالَهُ وِئَآءَ النَّاسِ وَلاَيُؤْمِنُ بِاللهِ وَالْيُوْمِ الاخِرِ فَمَثَلُه’ كَمَثَلِ صَفْوَانٍ عَلَيْهِ تُرَابٌ فَاصَابَه وَابِلٌ فَتَرَكَاهُ صَلْدًا البقرة : ٢٦٤

 

“হে ঈমানদারগণ! তোমরা তোমাদের দান-খয়রাতকে অনুগ্রহ প্রকাশ করে এবং মন:কষ্ট দিয়ে সেই ব্যক্তির ন্যায় কষ্ট দিও না-যে ব্যক্তি কেবল পরকে দেখাবার জন্য খরচ করে এবং আল্লাহ ও পরকালকে বিশ্বাস করে না। তার দান-খয়রাত ঠিক তেমনি যেমন একটি প্রস্তর খন্ডের ওপরে মাটি পড়ে আছে, এমতাবস্থায় তার ওপর যদি প্রবল বৃষ্টিপাত হয় তবে সমস্ত মাটিই ধুয়ে-মুছে প্রস্তর খণ্ডটি একেবারে ছাফ ও মাটিহীন হয়ে যাবে।”- সূরা আল বাকারা : ২৬৪

 

দুই : কাউকে কিছু দান করলে তার কাছে অনুগ্রহ প্রকাশ করতে পারবে না এবং এমন কোনো কাজ করতে পারবে না যাতে তার মনে কিছু মাত্র কষ্ট লাগতে পারে:

 

اَلَّذِيْنَ يُنْفِقُوْنَ اَمْوَالَهُمْ فِىْ سَبِيْلِ اللهِ ثُمَّ لاَيُتْبِعُوْنَ مَآاَنْفَقُوْا مَنَّا وَّلاَ اَذّى لَّهُمْ اَجْرَهُمْ عِنْدَ رَبَّهِمْ وَلاَ خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلاَهُمْ يَحْزَنُوْنَ ـ قَوْلٌ مَعْرُوْفٌ وَّمَغْفِرَةٌ خَيْرٌ مِنْ صَدَقَةَ يَّتْبَعُهَآ اّذّى : البقرة : ١٦٢-١٦٣

 

“আল্লাহর পথে যারা খরচ করে এবং খরচ করার পর নিজের অনুগ্রহ প্রকাশ করে না এবং কাউকে মন:কষ্ট দেয় না, তাদের জন্য আল্লাহর কাছে বড়ই সওয়াব আছে এবং কোনো প্রকার ভয় ও ক্ষতির আশংকা তাদের নেই। কিন্তু যেসব দানের পর কষ্ট দেয়া হয় সেসব দান অপেক্ষা প্রার্থীকে নম্রতার সাথে ফিরিয়ে দেয়া এবং ‘ভাই’, ক্ষমা কর’ বলে বিদায় করাই উত্তম।”- সূরা আল বাকারা : ২৬২-২৬৩

 

তিন: আল্লাহর পথে সবসময়ই ভালো জিনিস দান করা উচিত। বেছে বেছে কেবল খারাপটাই যেন দেয়া না হয়। গরীবকে দেয়ার জন্য যারা ছিন্ন জামা-কাপড় তালাশ করে এবং কোনো দরিদ্রকে খাওয়াবার জন্য নিকৃষ্টতর খাদ্য প্রদান করে, আল্লাহর কাছ থেকে তারা অনুরূপ নিকৃষ্ট ফলই পাবে:

 

يَآيُّهَا الَّذِيْنَ امَنُوْا مِنْ طَيِّبَةُ مِنْ طَيّبِتِ مَاكَسَبَتُمْ وَمِمَّآ اَخْرَجْنَا لَكُمْ مِّنْ الاَرْضِ وَلاَ تَيْمَّمُوْا الْخَبِيْثَ مِنْهُ تُنْفِقُوْنَ ـ البقرة : ١٦٧

 

“হে ঈমানদারগণ! তোমরা যা উপার্জন করেছ এবং আমরা তোমাদের জন্য মাটির বুক থেকে যা নির্গত ও উৎপন্ন করেছি, তা থেকে ভালো ভালো জিনিস আল্লাহর রাস্তায় খরচ কর-আল্লাহর পথে খরচ করার জন্য নিকৃষ্ট মাল তালাশ করে ফিরো না।”- সূরা আল বাকারা : ২৬৭

 

চার : যতদূর সম্ভব আল্লাহর রাস্তায় গোপনভাবেই খরচ করতে হবে, লোক দেখানোর বিন্দুমাত্র ভাব যেন তাতে স্থান না পায়। প্রকাশ্যভাবে খরচ করায় যদিও দোষের কিছু নেই কিন্তু তবুও গোপনে খরচ করা উত্তম।

 

اِنْ تُبْدُوْا الصَّدَقتِ فَنْعِمًا هِىَ وَاِنْ تُخْفُوْنَ وَتُؤْتُوْهَا الْفُقَرَاءَ فُهُمْ خَيْرَ لَّكُمْ وَيُكَفِّرُ عَنْكُمْ مِنْ سَيَّاتِكُمْ ـ البقرة: ١٧١

 

“প্রকাশ্যভাবে খরচ করলে তা ভালো: কিন্তু লুকিয়ে গরীবদের দান করলে তোমাদের পক্ষে অতি ভালো এবং তাতে তোমাদের গুনাহ দূর হয়ে যাবে।”- সূরা আল বাকারা : ২৭১

 

পাঁচ : নির্বোধ ও অজ্ঞ লোকদেরকে তাদের প্রয়োজনতিরিক্ত সম্পদ কখনও দেয়া যাবে না। কারণ অধিক অর্থ পেয়ে তাদের বিভ্রান্ত হয়ে যাওয়ার এবং তাদের হাতে সম্পদ নষ্ট হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে। আল্লাহর ইচ্ছা এটা যে, খাদ্য ও বস্ত্র সকল মানুষকেই দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে, সে যত বড় পাপী আর আল্লাহদ্রোহী হোক না কেন। কিন্তু মদপান, গাঁজা, আফিম খাওয়া এবং জুয়া খেলার জন্য কাউকে এক পয়সাও দেয়া যেতে পারে না।

 

وَلاَ تُؤْتُوْا السُّفَهَآَءَ اَمْوَالَكُمْ الَّتِىْ جَعَلَ اللهُ لَكُمْ قِيْمًا وَّارزٌقُوْهُمْ فِيْهَا وَاكْسُوْهُمْ ـ النساء : ٥

 

“তোমাদের ধন-সম্পত্তিকে আল্লাহ তাআলা জীবনযাপনের উপায় করে দিয়েছেন, কাজেই তা কখনও অজ্ঞ-মূর্খতার হাতে ছেড়ে দিও না। অবশ্য তা দ্বারা তাদের খাওয়া-পরার ব্যবস্থা নিশ্চয়ই করে দিতে হবে।”

 

ছয় : কারো প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্য তাকে ধার দেয়া হলে বার বার তাগাদা করে তাকে বিরক্ত করো না। তা আদায় করার জন্য তাকে যথেষ্ট অবকাশ দিতে হবে। আর তা ফিরিয়ে দেয়ার ব্যাপারে তার অক্ষমতা যদি নিসন্দেহে জানা যায় এবং ঋণদাতারও যদি ক্ষমা করার মতো সঙ্গতি থাকে, তবে তাকে মাফ করে দেয়াই বাঞ্ছনীয়ঃ

 

وَاِنْ كَانَ ذُوْ عَسْرَةً فَنَظِرَةٌ اِلى مَيْسَرَةٍ وَاَنْ تَصَدَّقُوْا خَيْرَ لٌكُمْ اِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُوْنَ ـ البقرة : ٢٨٠

 

“ঋণী ব্যক্তির আর্থিক অবস্থা খারাপ হলে সচ্ছল হওয়া পর্যন্ত তাকে অবশ্যই সময় দিতে হবে। আর তাকে ক্ষমা করে দেয়া আরও ভালো—অবশ্য যদি তোমরা এর স্বার্থপরতা বুঝতে পার।”- সূরা আল বাকারাঃ ২৮০

 

সাতঃ  মানুষকে দান করারও একটা সীম আছে। সেই সীমা কখনও লংঘন করা যেতে পারে না। নিজেকে এবং নিজের সন্তান-সন্তুতিকে বঞ্চিত করে পরকে দান কারার আদেশ আল্লাহ তাআলা করেননি-তাঁর উদ্দেশ্যও তা নয়। আল্লাহর ইচ্ছা এই যে, সহজ ও সাধারণভাবে জীবনযাপনের জন্য যা কিছুর প্রয়োজন হবে তা তো খরচ করতেই হবে, তারপরে যা উদ্বৃত্ত থাকবে তা হতেই আল্লাহর রাস্তায় খরচ করবে:

 

وَيَسْئَلُوْنَكَ مَاذَا يُنْفِقُوْنَ قُلِ الْعَفْوَ ـ البقرة : ٢١٩

 

“তারা জিজ্ঞেস করে: কি খরচ করবো? (হে নবী! আপনি) বলে দিন যে, প্রয়োজনের অতিরিক্ত যা তাই খরচ করবে।”- সূরা বাকারা: ২১৯

 

وَاَلَّذِيْنَ اِذَا اَنْفَقُوْآ لَمْ يُسْرِفُوْا وَلَمْ يُقتُرُوْا وَكَانَ بَيْنَ ذَلِكَ قَوَامًا ـ الفرقان : ٦٧

 

“আল্লাহর নেক বান্দাহ তারাই-যারা খরচ করে; কিন্তু অনর্থক খরচ করে না এবং খুব বেশী কার্পণ্যও করে না। বরং এ দু প্রান্তসীমার মধ্যবর্তী পন্থাই হয় তাদের আদর্শ।” সূরা আল ফুরকান : ৬৭

 

وَلاَ تَجْعَلْ يَدَكَ مَغْلُوْلَةً اِلى عُنُقِكَ وَلاَ تَبْسُطْهَا كُلَّ الْبَسْطِ فَتَقْعُدَ مَلُوْمًا مَّحْسُوْرًا ـ بنى اسرايل : 29

 

“তোমাদের (দানের) হাত গুটিয়ে একেবারে গলার সাথে বেঁধে নিও না এবং তা বেশী ছড়িয়েও দিও না, কারণ তার ফলে তোমাকে অনুতপ্ত এবং লোকদের কাছে তিরস্কৃত হতে হবে।” সূরা বনী ঈসরাঈল : ২৯

 

আট : এ দানের উপযুক্ত পাত্র কে? সর্বশেষে একথাও জেনে নেয়া আবশ্যক। তার এক পূর্ণ তালিকাও আল্লাহ তাআলা পাক কালামে পেশ করেছেন। কে কে আপনার সাহায্য পেতে পারে এবং আপনার উপার্জনে আল্লাহর তরফ থেকে কার কার অধিকার নির্ধারিত হয়েছে, এ তালিকা দৃষ্টে তা পরিষ্কাররূপে বুঝতে পারা যায়।

 

وَاتِ ذَا الْقُرْبى حَقَّهُ وَالْمِسْكِيْنَ وَابْنَ السَّبِيْلِ ـ بنى اسرائيل : ٢٦

 

“গরীব নিকটাত্মীয়দেরকে তাদের প্রাপ্য দাও এবং মিসকীন ও গরীব প্রবাসীকেও।”- সূরা বনি ঈসরাঈল :২৬

 

وَاتِ الْماَلَ عَلى جُيَِه ذَوِى الْقُرْبى وَالْيَتَمى وَالْمَسْكِيْنَ وَابْنَ السَّبِيْلِ وَالسًَّآئِلِيْنَ وَفِىْ الرِّقَابِ ـ البقرة : ١٧٧

 

“তার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে যারা নিকাত্মীয়, ইয়াতীম, মিসকীন, পথিক ও প্রার্থীকে এবং দাস ও কয়েদীদের মুক্তি বিধানের জন্য অর্থ দান করে, তারা আল্লাহর প্রিয়।”- সূরা আল বাকারা : ১৭৭

 

وَّبِالْوَالِدَيْنِ اَحْسَانًا وَّبِذِى القُرْبى وَالْيَتمى وَالْمَسكِيْنَ وَالْجَارِذِى الْقُرْبِى وَالْجَارِ الْجُنُبِ وَالصَّاحِبِ بِالْجَنْبِ وَابْنِ السَّبِيْلِ وَمَا مَلَكَتْ اَيْمَانُكُمْ ـ النساء : ٣٦

 

“নিজের পিতা-মাতা, নিকটাত্মীয়, ইয়াতীম, মিসকীন, আত্মীয় প্রতিবেশী ও অনাত্মীয় প্রতিবেশী, চলার সাথী, প্রবাসী এবং নিজের দাস-দাসীদের সাথে ভাল ব্যবহার কর।” সূরা আন নিসা : ৩৬

 

وَيُطْعِمُوْنَ الطّعَامَ عَلى حُبِّه مِسْكِيْنًا وَّيَتِيْمًا اِنَّمَا نُطْعِمُكُمْ لِوَجْه الله لاَنُرِيْدُ مِنْكُمْ جَزَآءً وَّلاَ شُكُوْرًا ـ اِنَّا نَخَافُ مِنْ رَّبِّنَا يُوْمًا عَبُوْسًا قَمْطَرِيْرًا ـ الدهر : ٨ - ١٠

 

“আল্লাহর নেক বান্দাহগণ ইয়াতীম, মিসকীন এবং কয়েদীকে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও প্রেম লাভ করার উদ্দেশ্যে খাদ্যদান করে। তারা বলে যে,আমরা তোমাদেরকে শুধু আল্লাহর জন্য খানা খাইয়ে থাকি। আমরা তোমাদের কাছে কোনো বিনিময় ও কৃতজ্ঞতা চাই না। আমরা কেবল আল্লাহর কাছে সেই দিনেরই ভয় করছি, যে দিনের কঠিন বিপদে মানুষের মুখ শুকিয়ে যাবে এবং কপালে ভাঁজ পড়ে যাবে।”- সূরা আদ দাহর : ৮-১০

 

وَفِىْ اَمْوَالِهِمْ حَقٌ لِّلْسَّآئِلِ وَالْمَحْرُوْمِ ـ الذّريت : ١٩

 

“এবং তার ধন-সম্পদে প্রার্থী ও বঞ্চিত জনের অধিকার রয়েছে।”

 

لِلْفُقَرَآءِ الَّذِيْنَ اُحْصِرُوْا فِىْ سَبِيْلِ اللهِ لاَيَسْتَطِيْعُوْنَ ضَرْبًا فِىْ الاَرْضِ يَحْسَبُهُمُ الْجَاهِلُ اَغْنِيَآءَ مِنَ التَّعَفُّفْ تَعْرِفُهُمْ بِسْيْمهُمْ لاَيَسْئَلُوْنَ النَّاسَ اِلْحَافًأ وَمَا تُنْفِقُوْا مِنْ خِيْرِ فَاِنَّ اللهَ بِه عَلِيْمٌ ـ

 

“যারা সকল সময়ে আল্লাহর কাজে লিপ্ত থাকে বলে নিজেদের জীবিকা উপার্জনের জন্য কোনো কাজ করতে পারে না, দান-খয়রাত তাদেরই প্রাপ্য। তাদের আত্মসম্মান জ্ঞান দেখে অন্তত মূর্খ লোকেরা তাদেরকে ধনী বলে মনে করে। কিন্তু তোমরা তাদের বেশ ও রূপ দেখেই বুঝতে পার, তারা কতো কষ্ট করছে। তোমাদের নিজেদেরই অগ্রসর হয়ে তাদের দান করা উচিত। কারণ, তারা মানুষকে জড়িয়ে ধরে সাহায্য চাওয়ার মত লোক নয়, গোপনভাবে তোমরা তাদেরকে যা কিছু দেবে আল্লাহ তা নিশ্চয় জানাবেন এবং তিনি তার বিনিময় নিশ্চয়ই দেবেন।” সূরা আল বাকারা : ২৭৩

 

যাকাত আদায়ের নিয়ম

 

পূর্বের প্রবন্ধে আল্লাহর রাস্তায় খরচ করার সাধারণ হুকুম বিবৃত হয়েছে। এখন যাকাত প্রসংগে যাবতীয় হুকুম বিস্তারিতভাবে আলোচিত হবে।

 

যাকাত সম্পর্কে কুরআন মজীদে আল্লাহ তাআলা তিন স্থানে ভিন্ন ভিন্নভাবে হুকুম দিয়েছেন। সূরা আল বাকারায় বলা হয়েছে:

 

اِنْفِقُوْا مِنْ طَيِّبتِ مَاكَسَبْتُمْ وَمِمَّا اَخْرَجْنَا لَكُمْ مِنَ الارْضِ ـ

 

“তোমরা নিজেরা যে পবিত্র ধন-সম্পদ উপার্জন করছেো এবং জমি থেকে যে ফসল আমি তোমাদের দান করেছি-এসব কিছু থেকে তোমরা আল্লাহর রাস্তায় খরচ করো।”- সূরা আল বাকারা : ২৬৭।

 

সূরা আল আনআমেও এ প্রসংগে বলা হয়েছে যে, আমিই তোমাদের জন্য যমীনে বাগিচা এবং ক্ষেত-খামার তৈরি করেছি। অতএব: ১৪১

 

كَلُوْ مِنْ ثَمَرِه اَثْمَرَ وَاتُوْا حَقَّه يَوْمَ حَصَادِه ـ الانعَام ـ ١٤١

 

“(বাগান এবং ক্ষেতে) যখন ফল বা ফসল ফলবে তখন তোমরা তা থেকে নিজেদের খাবার সংগ্রহ কর এবং ফল বা ফসল কাটার দিন তা থেকে আল্লাহর প্রাপ্য আদায় করো।”- সূরা আল আনআম: ১৪১

 

এ উভয় আয়াতেই জমির ফসলের যাকাত সম্পর্কে বলা হয়েছে। হানাফী মাযহাবের ফিকাহ শাস্ত্রবিদগগণের মতে প্রাকৃতিক সম্পদ-কাঠ, ঘাস এবং বাঁশ ইত্যাদি ভিন্ন সকল প্রকার শস্য তরকারী ও ফলে আল্লাহর পাওনা রয়েছে এবং তা অবশ্যই আদায় করতে হবে। হাদীস শরীফে সুস্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে যে, বৃষ্টি, নদী ও সমুদ্রের পানি থেকে যেসব ফসল জন্মে তাতে মোট ফসলের এক-দশমাংস আল্লাহর প্রাপ্য এবং যে জমিতে মানুষকে কৃত্রিম উপায়ে পানি সেচের ব্যবস্থা করতে হয়েছে তাতে আল্লাহর অংশ নির্ধারিত হয়েছে মোট ফসলের বিশ ভাগের এক ভাগ। এ উভয় প্রকার অংশই শস্য কর্তনের সাথে সাথেই আদায় করা ওয়াজিব।

 

এর পর সূরা তাওবায় বলা হয়েছে:

 

وَالَّذِيْنَ يَكْنِزُوْنَ الْذِّهَبَ وَالْفِصَّةَ وَلاَ يُنْفِقُوْنَهَا فِىْ سَبِيْلِ اللهِ فَبَشِّرْهُمْ بِعَذَابٍ اَلَيْمٍ ـ يَّوْمَ يَحْمى عَلَيْهَا فِىْ نَارِ جَهَنَّمَ فَتُكْوْى بِهَا جِبَاهُهُمْ وَجُنُوْبُهُمْ وَظُهُوْرُهُمْ هَذّا مَاكَنَزْتُمْ لاَنْفُسِكُمْ فَذُوْقُوْا مَا كُنْتُمْ تَكْنِزُوْنَ ـ التوبة : ٣٤-٣٥

 

“যারা সোনা ও রূপা জমা করে রাখে এবং তা থেকে আল্লাহর রাস্তায় মোটেই খরচ করে না, তাদেরকে কঠিন শাস্তির সুসংবাদ দাও। সেই দিনের আযাবের কথা জানিয়ে দাও যেদিন সোনা ও রূপা আগুনে উত্তপ্ত করে তাদের ললাটে, পাঁজরে ও পৃষ্ঠদেশে দাগ দেয়া হবে। আর তাদেরকে বলা হবে যে, এটাই হচ্ছে তোমাদের নিজেদের জন্য সঞ্চিত সেই ধন-সম্পদ। তোমরা যা কিছু সঞ্চয় করেছিলে এখন তারই স্বাদ গ্রহণ করো।”- সূরা আত তাওবা : ৩৪-৩৫

 

অতপর বলা হয়েছে:

 

اِنًَّمَا الصَّدَقتُ لِلْفُقََرَآءِ وَالْمَسْكِيْنَ وَالْعمِلِيْنَ عَلَيْهَا وَالْمُؤْلَّفَةِ قُلُوْبُهُمْ وَفِىْ الرَّقَابِ وَالْغَارِمِيْنَ وَفِىْ سَبِيْلِ اللهِ وَاَبْنِ السَّبيْلِ فَرِيْضضةٌ مِّنْ اللهِ ـ التوبة : ٦٠

 

“যাকাত আল্লাহর নির্ধারিত ফরয। এটা দেয়া হবে ফকীর, মিসকীন এবং যাকাত উসুলকারী কর্মচারীদেরকে, ভিন্ন ধর্মের লোকদের মন জয় করা, দাসত্ব শৃংখলে আবদ্ধ লোকদের মুক্তির ব্যবস্থা করা, ঋণী লোকদের ঋণ শোধ করা, আল্লাহ নির্ধারিত সার্বজনীন কাজে এবং নি:স্ব পথিকদের সাহায্যার্থেও এটা খরচ করা হবে।”- সূরা আত তাওবা : ৬০

 

এরপর আল্লাহ বলেছেন:

 

خَذُ مِنْ اَمْوَالِهِمْ صَدَقَةً تَطَهِّرُهُمْ وَتُزْكِّهِمْ : التورة : ١٠٣

 

“তাদের ধন-সম্পদ থেকে যাকাত উসুল করে তাদেরকে পবিত্র এবং পরিচ্ছন্ন করে দাও।” সূরা আত তাওবা : ১০৩

 

উল্লেখিত তিনটি আয়াত থেকেই জানা যায় যে, যেসব সম্পদ সঞ্চয় করা হবে এবং পরিমাণে বৃদ্ধি করা হবে তা থেকে যদি আল্লাহর পথে খরচ করা না হয়, তবে তা নাপাক হবে, তা পবিত্র করার একমাত্র উপায় হচ্ছে তা থেকে আল্লাহর প্রাপ্য অংশ উপযুক্ত লোকদের মধ্যে বন্টন করা। হাদীসে উল্লেখিত হয়েছে যে, সোনা ও রূপা সঞ্চয়কারীদের সম্পর্কে যখন এ আযাবের সংবাদ আসলো, তখন মুসলমান জনসাধারণ অত্যন্ত ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। কারণ এ আয়াতে অনুসারে তারা মনে করেছিল যে, কারো কাছে এক পয়সাও জমা রাখা অন্যায়, সব খরচ করে দিতে হবে। অবশেষে হযরত উমর ফারুক (রা) নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খেদমতে উপস্থিত হয়ে মুসলমানদের এ উৎকণ্ঠার কথা জানালেন। হযরত রাসূল (সা) উত্তরে এরশাদ করলেন: ‘আল্লাহ তোমাদের প্রতি যাকাত এজন্যই ফরয করেছেন যে, তা আদায় করলে অবশিষ্ট ধন তোমাদের জন্য পবিত্র ও হালাল হয়ে যাবে।’ হযরত আবু সায়ীদ খুদরী (রা) থেকেও এরূপ একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। রাসূলে পাক (সা) বলেছেন, তোমার মাল থেকে যখন যাকাত আদায় করে দিলে, তখন তোমার প্রতি যা অবশ্য কর্তব্য (ওয়াজিব) ছিল তা তুমি আদায় করলে।

 

উল্লেখিত আয়াত থেকে শুধু সোনা-রূপার যাকাতের নির্দেশ জানতে পারা যায়; কিন্তু হাদীস থেকে জানা যায় যে, ব্যবসায়ের পণ্য, উট, গরু-ছাগলেরও যাকাত আদায় করতে হবে। রূপার সাড়ে বায়ান্ন তোলায় এবং স্বর্ণের সাড়ে সাত তোলায় যাকাত ফরয হয়। চল্লিশটি ছাগল এবং ত্রিশটি গরুতে যাকাত দিতে হবে এবং ব্যবসায়ের পণ্যের মূ্ল্যে সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার মূ্ল্যের সমান হলে যাকাত দিতে হবে। অর্থাৎ এ নির্দিষ্ট পরিমাণ যার কাছে বর্তমান থাকবে এবং এভাবে তার একটি বছর সময় অতীত হবে, তাকে এ চল্লিশ ভাগের একভাগ যাকাত বাবদ আদায় করতে হবে। হানাফী মাযহাবের ইমামগণ বলেছেন যে, আলাদা আলাদাভাবে সোনা ও রূপার যাকাত ফরয হওয়ার নির্দিষ্ট পরিমাণ যদি বর্তমান না থাকে, কিন্তু দুটিরই সমষ্টিগত মূল্যে যাকাতের পরিমাণ(নেসাব) পর্যন্ত পৌছে তবে তা থেকেও যাকাত আদায় করতে হবে।

 

হযরত উমর ও ইবনে মাসউদ (রা) এর মতে সোনা রূপার অলংকারের যাকাত আদায় করা ফরয। ইমাম আবু হানীফা রাহমাতুল্লাহহি আলাইহহিও এ মত-ই গ্রহণ করেছন। হাদীসে উল্লেখিত হয়েছে যে, রাসূলে (সা) দুজন স্ত্রীলোকের হাতে স্বর্ণের কংকন দেখে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তারা যাকাত আদায় করে কিনা। একজন উত্তরে বললো-না। হযরত (সা) বললেন, আজ যাকাত আদায় না করলে কিয়ামতের দিন তোমার হাতে আগুনের কংকন পরতে তুমি রাজী হবে কি? হযরত উম্মে সালমা রাদিয়াল্লাহু আনহা থকে বর্ণিত হয়েছে, তাঁর কাছে ‘পাঁজেব’ নামক এক প্রকার স্বর্ণের অলংকার ছিল। তিনি রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে জিজ্ঞেস করেছিলেন, এটা কি সঞ্চিত ধনের শামিল? হযরত রাসূল (সা) বললেন, এর পরিমাণের ওপর যদি যাকাত ফরয হয় আর তা থেকে যাকাত আদায় করা হয়; তবে ওটা নিষিদ্ধ সঞ্চয় নয়। এ উভয় হাদীস থেকে জানা যায় যে, সোনা-রূপার অলংকার হলেও তাতে যাকাত ফরয হবে – যেমন মওজুদ সোনা-রূপার ওপর ফরয হয়। অবশ্য হীরা-জহরত বা আংটির কারুকার্যের জন্য যাকাত দিতে হয় না।

 

কালামে পাকে যাকাত পাবার যোগ্য আট শ্রেণীর লোকের কথা উল্লেখিত হয়েছে। এখানে তাদের বিবরণ দেয়া হচ্ছে:

 

গরীব: যাদের কাছে কিছু না কিছু ধন-সম্পদ আছে কিন্তু তা তাদের যাবতীয় প্রয়োজেন পূর্ণ করার পক্ষে যথেষ্ট নয়, খুবই টানাটানির ভেতর দিয়ে যাদের জীবন অতিবাহিত হয়, তদুপরি কারো কাছে কিছু চাইতেও পারে না, এরা গরীব। ইমাম জুহুরী, ইমাম আবু হানীফা, ইবনে আব্বাস, হাসান বসরী, আবুল হাসান করখী এবং অন্যান্য ফকীহগণ এদেরকেই ফকীর বা গরীব বলে অভিহিত করেছেন।

 

মিসকীন: যেসব লোকের অবস্থা আরও খারাপ, পরের কাছে হাত পাততে বাধ্য হয়, নিজের পেটের অন্নও যারা যোগাড় করতে পারে না তারা মিসকীন। যারা সক্ষম কিন্তু বেকার অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে হযরত উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু তাদেরকেও মিসকীনদের মধ্যে গণ্য করেছেন।

 

যাকাত বিভাগের কর্মচারী: ইসলামী রাষ্ট্র যাকাত আদায়ের জন্য যাদেরকে কর্মচারী নিযুক্ত করবে, তাদেরকেও যাকাতের অর্থ থেকেই বেতন দেয়া হবে।

 

যাদের মন রক্ষা করতে হয় : ইসলামের সহায়তার জন্য কিংবা ইসলামের বিরোধিতা বন্ধ করার জন্য যাদেরকে টাকা দেয়ার প্রয়োজন তারা এর অন্তর্ভূক্ত। সেই সকল নও-মুসলিমও এর অন্তর্ভূক্ত যাদেরকে সমস্যা মুক্ত করা একান্ত অপরিহার্য। নও-মুসলিমগন অমুসলিম জাতির সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করে মুসলমানদের সাথে মিলিত হবার কারণে বেকার সমস্যা বা আর্থিক অনটনে পড়ে গেলে তাদের সাহায্য করা মুসলমানদের একটি জাতীয় কর্তব্য। এমনকি তারা ধনী হলেও তাদেরকে যাকাত দেয়া উচিত। এতে তারা ইসলামের ওপর অধিকতর আস্থাবান হবে। হোনাইনের যুদ্ধে জয়ের পর হযরত নবী করীম (সা) নও-মুসলিমদের গনীমতের বহু সম্পদ দান করেছেন। ফলে প্রত্যেক ব্যক্তির ভাগে একশ উট পড়েছিল। আনসারগণ এর বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: ‘এরা সম্প্রতি ইসলাম গ্রহণ করেছে বলে আমি তাদেরকে খুশী করতে চাই।’ এ হাদীসের ভিত্তিতে ইমাম জুহুরী বলেছেন, যেসব ইয়াহুদী-খৃষ্টান মুসলমান হবে বা অন্য কোনো ধর্মাবলম্বী ইসলাম কবুল করবে, তারা ধনী হলেও তাদের যাকাত দেয়া হবে।১

 

গোলাম ও কয়েদীদের মুক্তি বিধান: যে ব্যক্তি দাসত্ব শৃংখলে বন্দী হয়ে আছে এবং যে মুক্তি পেতে চায়, তাকেও যাকাতের অর্থ দেয়া যায়। উক্ত অর্থের বিনিময়ে সে মালিকের দাসত্ব শৃংখলা থেকে নিজেকে মুক্ত করে নেবে। বর্তমান যুগে দাস প্রথার প্রচলন নেই। তাই আমি মনে করি যেসব লোক কোন ব্যাপারে জরিমানা আদায় করতে অক্ষম বলে কয়েদ ভুগতে বাধ্য হয়, যাকাতের অর্থ দিয়ে তাদের মুক্তি বিধান করা যেতে পারে-করলে তাও এ বিভাগই গণ্য।

 

ঋণী ব্যক্তির ঋণ শোধ : যেসব লোক ঋণী অথবা ঋণ আদায় করার সম্বল যাদের নেই, তাদেরকেও যাকাতের টাকা দ্বারা ঋণ ভার থেকে মুক্তি দেয়া যাবে। কিন্তু তাই বলে একজনের কাছে হাজার টাকা থাকলেও সে যদি একশ টাকার ঋণ হয় তাহলে তাকে কিছুতেই যাকাত দেয়া যাবে না। তবে যে ব্যক্তির ঋণ শোধ করার পর যাকাত ফরয হতে পারে, এপরিমাণ অর্থ যদি তার কাছে না থাকে তবে তাকে যাকাত দেয়া যেতে পারে। ফিকাহ শাস্ত্রবিদগণ এটাও বলেছেন যে, যারা অপচয় এবং বিলাসিতা ও কু-কাজ করে ঋণী হয়, তাদেরকে যাকাত দেয়া মাকরূহ। কারণ এমতাবস্থায় তাদেরকে যাকাত দিলে সে ধন-সম্পদের আরও অপচয় করবে এবং যাকাত নিয়ে ঋণ শোধ করার ভরসায় সে আরও অধিক ঋণ গ্রহণ করবে।

 

আল্লাহর পথে : আল্লাহর পথে শব্দটি অত্যন্ত ব্যাপক। মুসলমানদের সমস্ত নেক কাজেই যাকাতের টাকা ব্যয় করা যেতে পারে। কিন্তু বিশেষ করে এর অর্থ হচ্ছে-আল্লাহর পথে জিহাদকারীদের সাহায্য করা। নবী করীম (সা) বলেছেন যে, ধনী ব্যক্তির পক্ষে যাকাত গ্রহণ জায়েয নয় কিন্তু ধনী ব্যক্তিই যদি জিহাদের জন্য সাহায্য গ্রহণ করতে বাধ্য হয়, তবে তাকেও যাকাত দিতে হবে: কারণ এই যে, এক ব্যক্তি ধনী হতে পারে ; কিন্তু জিহাদের জন্য যে বিরাট ব্যয় আবশ্যক, তা সে শুধু নিজের অর্থ দ্বারা পূরণ করতে পারে না। তার এ কাজের জন্য তাকে যাকাতের টাকা সাহায্য করা যাবে।

 

১. এ বিষয়ে ইসলামী আইনের বিস্তৃত বিবরণ দেয়া এখানে সম্ভব নয়। এজন্য তাফহীমুল কুরআনের সূরা তাওবা তাফসীর দ্রষ্টব্য।

 

পথিক-প্রবাসী: পথিক বা প্রবাসীর নিজ বাড়ীতে যত ধন-সম্পদ থাকুক না কেন, কিন্তু পথে বা প্রবাসে সে যদি অভাবগ্রস্ত হয়ে পড়ে তবে তাকে যাকাতের টাকা দিতে হবে।

 

এখন প্রশ্ন এই যে, ওপরে যে আট শ্রেণীর লোকের উল্লেখ করা হলো তাদের মধ্যে কাকে কোন অবস্থায় যাকাত দেয়া উচিত আর কোন অবস্থায় না দেয়া কর্তব্য- এ সম্বন্ধে এখানে আলোচনা করা যাচ্ছে:

 

এক: কোন ব্যক্তি নিজের পিতা বা পুত্রকে যাকাত দিতে পারে না, স্বামী স্ত্রীকে এবং স্ত্রী স্বামীকে যাকাত দিতে পারবে না। এ সম্পর্কে ইসলামী শরীয়াতবিদগণ সম্পূর্ণ একমত। কোনো কোনো ফিকাহ শাস্ত্রকার এটাও বলেছেন যে, যেসব নিকটাত্মীয়ের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব তোমার ওপর; যারা শরীয়াত অনুসারে তোমার উত্তরাধীকারী, তুমি তাদেরকে যাকাত দিতে পার না; অবশ্য দূরবর্তী আত্মীয় তোমার যাকাত পাবার অধিকারী হবে। বরং অন্যান্য লোকদের অপেক্ষা তাদের অধিকার বেশী স্বীকৃত হবে। কিন্তু ইমাম আওজায়ী বলেছেন যে, যাকাত দেবার জন্য কেবল নিজের আত্মীয় এগানাই তালাশ করো না।

 

দুই : যাকাত কেবল মুসলমানই পেতে পারে। অমুসলমানগণ যাকাত পেতে পারে না। যাকাতের সংজ্ঞা সম্পর্কে হাদীসে বলা হয়েছে : تُؤْخَذُ مِنْ اَغْنِيَاءَ كُمْ وَتُرَدُّ عَلى فُقَرَاءَ كُمْ ـ যাকাত তোমাদের ধনীদের কাছ থেকে গ্রহণ করা হবে এবং তোমাদের গরীবদের মধ্যে বন্টন করে দেয়া হবে। অমুসলমান গরীবকে সাধারণ দান-খয়রাত অবশ্যই দেয়া হবে। বরং সাধারণ দানের ক্ষেত্রে মুসলমান-অমুসলমানের মধ্যে পার্থক্য করে মুসলমানকে দেয়া এবং অমুসলামানকে না দেয়া আদৌ সমীচীন নয়।

 

তিন : ইমাম আবু হানীফা, ইমাম আবু ইউছুফ এবং ইমাম মুহাম্মাদ(সা) বলেন যে, প্রত্যেক এলাকার যাকাত সেই এলাকার গরীবদের মধ্যেই বন্টন করতে হবে। এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় যাকাতের অর্থ প্রেরণ করা ঠিক নয়। কিন্তু কোনো এলাকায় যাকাত গ্রহণ করার মত লোকই যদি না থাকে কিংবা অন্য এলাকায় যদি এমন কোনো বিপদ এসে পড়ে, যে জন্য দূরবর্তী এলাকা থেকে যাকাতের অর্থ সেখানে প্রেরণ করা অত্যন্ত জরুরী বোধ হয়, যথা-প্লাবন, দুর্ভিক্ষ ইত্যাদি; তবে তদনুযায়ী যাকাত বন্টন করা কোনো দোষের কাজ নয়। ইমাম মালেক ও ইমাম সুফিয়ান সাওরীর মতও প্রায় এরূপ। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় যাকাত প্রেরণ একেবারেই অসংগত বা নাজায়েয নয়।

 

চার: কোনো কোনো লোকের মতে যারা দু বেলা খাবার ব্যবস্থা আছে, তার পক্ষে যাকাত গ্রহণ করা উচিত নয়। আবার কেউ কেউ বলেছন, যার কাছে দশ টাকা মওজুদ আছে,অন্য একজনের মতে যার কাছে সাড়ে বার টাকা আছে তার যাকাত নেয়া উচিত নয়। কিন্তু ইমাম আবু হানীফা এবং হানাফী মাযহাবের অন্যান্য আলেমগণ বলেছেন যে, যার কাছে পঞ্চাশ টাকার কম নগদ সম্পত্তি থাকবে সে যাকাত গ্রহণ করতে পারবে। বাড়ী ঘরের জিনিসপত্র এবং ঘোড়া ও চাকর এর মধ্যে গণ্য হবে না। অর্থাৎ এসব দ্রব্যাদি থাকা সত্ত্বেও যার পঞ্চাশ টাকার কম সম্পত্তি আছে, সে যাকাত পেতে পারে। এ ব্যাপারে একটি জিনিস হলো আইন আর অপরটি হলো ফযীলতের মান। এ দুটি জিনিসের মধ্যে পার্থক্য আছে।

 

ফযীলতের মান সম্পর্কে হযরত রাসূল (সা) বলেছেন, যার সকাল ও সন্ধ্যার খাদ্যের ব্যবস্থা আছে সে যদি লোকদের কাছে প্রার্থনা করে তবে সে নিজের জন্য আগুন সঞ্চয় করে। অন্য হাদীসে নবী করীম (সা) বলেছেন, মানুষের কাছে ভিক্ষার হাত প্রসারিত করা অপেক্ষা কাঠ কেটেও যদি নিজের অন্ন সংস্থান করা হয়, তবে তাই আমার কাছে অধিক মনোনীত। তৃতীয় একটি হাদীসে বলা হয়েছে যে, যার কাছে খাদ্য আছে কিংবা যার উপার্জন করার শক্তি আছে তার পক্ষে যাকাত গ্রহণ করা উচিত নয়। মানুষের মধ্যে আত্মসম্মানবোধ জাগাবার জন্যেই এটা হযরতের শিক্ষা-এটা আইন নয় আইনের একটি শেষ সীমা নির্দেশ করা হয়েছে এবং কতদূর পর্যন্ত মানুষ যাকাত নিতে পারে তা বলে দেয়া হয়েছে । একটি হাদীসে রাসূলে পাক (সা) করেছেন-

 

لِلسَّائِلِ حَقٌ وَاِنْ جَاءَ عَلَى الْفَرَسِ ـ

 

“ভিক্ষাপ্রার্থী ঘোড়ায় চড়ে আসলেও তাকে ভিক্ষা দিতে হবে।”

 

এক ব্যক্তি হযরতের কাছে জিজ্ঞাসা করলো, আমার কাছে দশ টাকা থাকলে আমি মিসকীনদের মধ্যে গণ্য হবো? হযরত বললেন, হাঁ। একবার দু ব্যক্তি হযরতের কাছে যাকাত চেয়েছিল। হযরত রাসূল (সা) তাদেরকে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে দেখতে লাগলেন এবং বললেন: “তোমরা নিতে চাইলে আমি তোমাদেরকে দেব বটে, কিন্তু মূলত ধনী এবং সক্ষম লোকদের এতে কোনো অংশ নেই।” এসব হাদীস থেকে পরিষ্কার জানা যায় যে, যাকাত ফরয হওয়া নির্দিষ্ট পরিমাণের অর্থ যাদের নেই তারাও গরীবদের মধ্যে গণ্য হয় এবং তাদেরকেও যাকাত দেয়া যেতে পারে। বলাবাহুল্য যাকাত পাওয়ার প্রকৃত অধিকারী কেবল যথার্থ অভাবগ্রস্ত লোক হতে পারে।

 

যাকাতের জরুরী নিয়ম-কানুন এখানে বর্ণিত হলো; কিন্তু এ প্রসংগে একটি অত্যন্ত জরুরী এবং গুরুত্বপূর্ণ কথা দিকে পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা আমি বিশেষ আবশ্যক বলে মনে করি। কারণ যে কথাটি আমি বলতে চাই, বর্তমান মুসলমানগণ তা ভুলে গেছে। তা এই যে, ইসলামের সমস্ত কাজই দলগত ও সমষ্টিগতভাবে সম্পন্ন করতে হয়। ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যমূলক বিচ্ছিন্নতা ইসলাম সমর্থন করে না। মসজিদ থেকে দূরে অবস্থিত কোনো মুসলমান যদি একাকী নামায পড়ে, তবে নামায হবে বটে, কিন্তু ইসলামী শরীয়াতে জামায়াতের সাথে নামায পড়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে-মুসলমান জামায়াতের সাথেই নামায আদায় করুক, এটাই শরীয়াতের কাম্য। কালামে পাকে এ দিকে ইংগিত করে বলা হয়েছে:

 

خُذْ مِنْ اَمْوَالِهِمْ صَدَقَةٌ تُطَهِّرُ هُمْ وَتُزَكِّيْهِمْ بِهَا : التوبة : 103

 

অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা হযরত রাসূলে করীম (সা) মুসলমানদের কাছ থেকে যাকাত উসূল করতে আদেশ দিয়েছেন। মুসলমানদেরকে স্বতন্ত্র ও ব্যক্তিগতভাবে যাকাত আদায় করতে বলা হয়নি। উপরন্তু যাকাত আদায়ের কর্মচারীদের জন্যও যাকাতের অর্থ অংশ নির্দিষ্ট করার অর্থ এই যে, মুসলমানদের ইমাম বা রাষ্ট্রপ্রধান সকলের কাছ থেকে যাকাত আদায় করবে এবং সমষ্টিগতভাবে তা খরচ করবে। নবী করীম (স) একথা বলেছেন:

 

اُمِرْتُ اَنْ اَخَذَ الصَّدَقَةَ مِنْ اغْنِيْاَءِ كُمْ وَاَرُدُّهَا فِىْ فُقَرَاءِ كُمْ ـ

 

অর্থাৎ তোমাদের ধনীদের কাছ থেকে যাকাত আদায় করে তোমাদের গরীবদের মধ্যে বন্টন করার জন্যই আমি আদিষ্ট হয়েছি। নবী করীম (সা) এবং খেলাফায়ে রাশেদীনের আমলেও যাকাত আদায়ের এ পদ্ধতি কার্যকর ছিল। ইসলাম রাষ্ট্রের কর্মকর্তাগণ সমস্ত যাকাত উসুল করতেন এবং কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে তা রীতিমত বন্টন করা হতো।

 

--- সমাপ্ত ---

যাকাতের হাকীকত

সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী

book স্ক্যান কপি ডাউনলোড