কুরআনের চারটি মৌলিক পরিভাষা

সূচনা

ইলাহ, রব, দীন ও ইবাদত -কোরআনের পরিভাষায় এ চারটি শব্দ মৌলিক গুরুত্বের অধিকারী। কোরআনের সার্বিক দাওয়াত এই যে, একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই একক রব ও ইলাহ; তিনি ব্যতীত অন্য কোন ইলাহ নেই, নেই কোন রব। উলুহিয়্যাত ও রুবুবিয়্যাত -এ কেউ তাঁর শরীক নেই। সুতরাং তাঁকেই তোমাদের ইলাহ ও রব মেনে নাও; তিনি ব্যতীত অন্য সকলের উলুহিয়্যাত – রুবুবিয়্যাতকে অস্বীকার করো। তাঁর ইবাদাত করো, তিনি ছাড়া অপর কারো ইবাদাত করো না। দীনকে একান্তভাবে তাঁর জন্যেই খালেস করো, অন্য সব দীনকে প্রত্যাখান করো।

——————-ছুরা-আন-নিসাঃ-২৫——————– আমরা তোমার পূর্বে যে রসূলই পাঠিয়েছি, তাকে ওহী দান করেছি, আমি ছাড়া কোন ইলাহ নেই। সুতরাং আমারই ইবাদাত করো। – আন-নিসাঃ ২৫

———————ছুরা-তওবাঃ-৩১——————— এই ইলাহ’র ইবাদাত ব্যতীত তাদেরকে অপর কিছুর হুকুম দেয়া হয় নি, তিনি ব্যতীত অন্য কোন ইলাহ নেই। তারা যে শরীক করেছে, তা থেকে তিনি মুক্ত।- তওবাঃ ৩১

——————–ছুরা-আল-আম্বিয়াঃ- ৯২—————– নিশ্চয়ই তোমাদের (অর্থাৎ সকল নবীর) এ দল একটি মাত্র দল আর আমি তোমাদের রব। সুতরাং আমার ইবাদাত করো। আল-আম্বিয়াঃ- ৯২

———————ছুরা-আল-আনআমঃ-১৬৪ ————– বল, আমি কি আল্লাহ ছাড়া অপর কোন রব তালাশ করবো? অথচ তিনিই হচ্ছেন সব কিছুর রব। আল-আনআমঃ-১৬৪

——————–ছুরা-আল-কাহাফঃ ১১০ —————- সুতরাং যে ব্যক্তি আপন রব-এর সাক্ষাৎ লাভের আশা পোষণ করে, সে যেন ভাল কাজ করে এবং আপন রব-এর ইবাদাতে অন্য কাউকে শরীক না করে। আল – কাহাফঃ ১১০

——————-ছুরা-আন্ -নাহালঃ৩৬ ——————- আল্লাহ্ র ইবাদাত করো এবং তাগুত-এর ইবাদাত থেকে বিরত থাকো-এ নির্দেশ দিয়ে আমরা প্রত্যেক উম্মতের মধ্যে একজন রসূল প্রেরণ করেছি। আন্ -নাহালঃ ৩৬

——————ছুরা – আলে ইমরানঃ ৮৩ —————— তবে কি তারা আল্লাহর দীন ব্যতীত অপর কোন দীন তালাশ করে? অথচ আসমান-যমীনে যা কিছু আছে, সব কিছু ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় তাঁর-ই অনুগত। তাদেরকে তাঁর নিকটেই ফিরে যেতে হবে। -আলে ইমরানঃ ৮৩

———————-ছুরা-আয-যমারঃ ১১ ————— বল, আল্লাহ্ র ইবাদাত করার জন্যে আমাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, একান্তভাবে নিজের দীনকে তাঁরই জন্যে নিবেদিত করো। -আয-যুমারঃ ১১

——————–ছুরা-আলে ইমরানঃ ৫১ —————– নিশ্চয় আল্লাহ আমার ও রব, তোমাদেরও রব। সুতরাং তোমরা তাঁরই ইবাদাত করো। এটাই সহজ সরল পথ। -আলে ইমরানঃ ৫১

উদাহরণ স্বরূপ এ কয়টি আয়াত পেশ করা হলো। কোরআন অধ্যয়নকারী প্রত্যেক ব্যক্তি প্রথম দৃষ্টিতেই অনুভব করবে যে, কোরআনের সমগ্র আলোচনাই এ চারটি পরিভাষাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে। মহাগ্রন্থ আল কোরআনের কোন্দ্রীয় চিন্তাধারা (Central idea) এইঃ

আল্লাহ্ হচ্ছেন রব ও ইলাহ্।

আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো রবুবিয়্যাত-উলুহিয়্যাতের অধিকার নেই।

সুতরাং কেবল তাঁরই ইবাদাত করতে হবে।

দীন হবে একনিষ্ঠ ভাবে তাঁরই জন্যে।

পরিভাষা চুতষ্টয়ের গুরুত্ব

এটা স্পষ্ট যে, কোরআনের শিক্ষা অনুধাবন করার জন্যে পরিভাষা চুতষ্টয়ের সঠিক ও পরিপূর্ণ তাৎপর্য অনুদাবন করা একান্ত অপরিহার্য। ইলাহ শব্দের অর্থ কি, ইবাদাতের সংজ্ঞা কি, দীন কাকে বলে- কোন ব্যক্তি যদি তা না জানে তবে তার কাছে সম্পূর্ণ কোরআনই অর্থহীন হয়ে পড়েবে। সে তাওহীদ জানতে পারবে না, শের্ক বুঝতে পারবে না, ইবাদাতকে একান্তভাবে আল্লাহ্ র জন্যে নিবেদিত করতে পারবে না, দীনকে করতে পারবে না আল্লাহ্ র জন্যে নির্দিষ্ট। অনুরূপভাবে কারো মানসপটে যদি এ পরিভাষাগুলোর তাৎপর্য অস্পষ্ট ও অসম্পূর্ণ থাকে, তাবে তার কাছে কোরআনের গোটা শিক্ষাই অস্পষ্ট থাকবে। কোরআনের প্রতি ঈমান রাখা সত্ত্বেও তার আকীদা ও আমল-বিশ্বাস ও কর্ম-উভয়ই থেকে যাবে অসম্পূর্ণ। সে মুখে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ আল্লাহ ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই বলবে আর তা সত্ত্বেও অনেককে ইলাহ বানাবে। ‘আল্লাহ ছাড়া আর কোন রব নেই’ – মুখে এ কথা ঘোষণা করলেও কার্যত অনেকেই তার রব সেজে বসবে। সে একান্ত সদুদ্দেশ্যে বলবে, আল্লাহ ছাড়া আর কারো ইবাদাত করি না, কিন্তু এতদসত্ত্বেও আরো অনেক মাবুদের ইবাদাতেই সে মশগুল থাকবে। সে একান্ত জোর দিয়ে বলবেঃ আমি আল্লাহর দীনে আছি, ‘অন্য কোনো দীনে আছে’ বলা হলে সে লড়তে উদ্যত হবে কিন্তু তা সত্ত্বেও অনেক দীনের শিকলই তার গলায় ঝুলবে। কোন গায়রুল্লাহ্ র জন্যে তার মুখ থেকে ‘ইলাহ’ ‘রব’ শব্দ তো কোন সময়ই বেরুবে না; কিন্তু যে অর্থের জন্যে এ শব্দগুলি গঠিত, সে প্রেক্ষিতে তার অনেক ইলাহ ও রব থাকবে। আর বেচারা জানতেও পারবে না যে, সে কার্যত আল্লাহ ছাড়াও বহু রব- ইলাহ বানিয়ে রেখেছে। তাকে যদি বলা হয়ঃ তুমি অন্যের ‘ইবাদাত’ করছো, ‘ দীন’-এ শের্ক করছো, তা হলে প্রস্তর নিক্ষেপ করার জন্যে ছুটে আসবে, কিন্তু ইবাদাত ও দীনের তাৎপর্যের বিচারে সে কার্যত অন্যের ইবাদাত করছে, দীন পালন করছে। সে জানতেও পারবে নাঃ আমি যা করছি, আসলে তা অন্যের ইবাদত ভিন্ন কিছুই নয়। যে ব্যক্তি এমন অবস্থায় পতিত হয়েছে, তাকে গায়রুল্লাহর দীন ব্যতীত আর কিছুই বলা যায় না।

ভুল ধারণার মূল কারণ

আরবে যখন কোরআন পেশ করা হয়, তখন প্রত্যেকেই জানতো ইলাহ অর্থ কি, রব কাকে বলা হয়। কারণ তাদের কথাবার্তায় এ শব্দদ্বয় পূর্ব হতে প্রচলিত ছিল। তারা জানতো এ শব্দগুলোর অর্থ কি, কি এর তাৎপর্য। তাই তাদের যখন বলা হলো যে, আল্লাহ-ই একক রব ও ইলাহ, উলুহিয়্যাত ও রুবুবিয়্যাতে আদৌ কারো হিসসা নেই, তারা তখন ঠিক ঠিকই বুঝতে পেরেছিল। স্পষ্টতই তারা বুঝতে পেরেছিল, অন্যের জন্যে কোন্ জিনিসটি নিষেধ করা হচ্ছে আর আল্লাহ্ র জন্যে কোন জিনিসটি করা হচ্ছে নিদিষ্ট। যারা বিরোধিতা করছিল, গায়রুল্লার উলুহিয়্যাত-রুবুবিয়্যাত অস্বীকৃতির আঘাত কোথায় কোথায় লাগে, তা জেনেশুনেই তারা বিরোধিতা করেছিল। এ মতবাদ গ্রহণ করে আমাদেরকে কি বর্জন করতে হবে আর কি গ্রহণ করতে হেব তা জেনেশুনেই তারা ঈমান এনেছিলো। অনুরূপভাবে ইবাদাত ও দীন শব্দও তাদের ভায়ায় প্রচালিত ছিলো পুর্ব হতে। তারা জানতো, আব্দ কাকে বলে, উবদিয়্যাত কোন্ অবস্থার নাম। ইবাদাতের উদ্দেশ্য কোন্ ধরনের আচরণ, দীনের তাৎপর্য কি? তাই তাদের যখন বলা হলো, সকলের ইবাদাত ত্যাগ করে আল্লাহ্ র ইবাদাত করো, সকল দীন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আল্লাহর দীনে দাখিল হও, তখন কোরআনের দাওয়াত বুঝতে তাদের ভুল হয় নি। এ শিক্ষা আমাদের জীবন ব্যবস্থায় কোন্ ধরনের পরিবর্তন চায়, শোনামাত্রই তারা তা বুঝতে পেরেছিলো।

কিন্তু কোরআন অবতীর্ন হওয়ার সাময় এ শব্দগুলোর যে মৌল অর্থ প্রচালিত ছিল, পরবর্তী শতকে ধীরে ধীরে তা পরিবর্তিত হতে তাকে। শেষ পর্যন্ত এক- একটি শব্দ তার সম্পূর্ণ ব্যাপকথা হারিয়ে একান্ত সীমিত বরং অস্পষ্ট অর্থের জন্যে নিদিষ্ট হয়ে পড়ে। এর এক কারণ ছিলো আরবী ভাষার প্রতি সঠিক স্পৃহার অভাব, দ্বিতীয় কারণ ছিলো ইসলামী সমাজে যেসব ব্যক্তির উদ্ভব হয়েছে, তাদের কাছে ইলাহ, রব, দীন, ইবাদাতের সে অর্থ অবশিষ্ট ছিলো না, যা কোরআন নাযিল হওয়ার সময় অমুসলিম সামজে প্রচলিত ছিলো। এ কারণে পরবর্তী কালের অভিধান ও তাফসীর গ্রন্থে অধিকাংশ কোরানিক শব্দের ব্যাখ্যা করা হয়েছে আভিধানিক অথ্যের পরিবর্তে এমন সব অর্থে যা পরবর্তী কালের মুসলমানরা বুঝতো। যেমনঃ

ইলাহ শব্দকে মূর্তি ও দেবতার প্রায় সমার্থক করা হয়েছে। লালন-পালন কর্তা বা পরওয়ারদেগার-এর প্রতিশব্দ করা হয়েছে রবকে, ইবাদাতের অর্থ করা হয়েছে পূজা-উপাসনা, ধর্ম, মযহাব এবং রিলিজিয়ান (Religion) -এর সমার্থজ্ঞাপক শব্দ করা হয়েছে দীনকে। তাগুত- এর তর্জমা করা হয়েছে মূর্তি বা শয়তান।

ফল দাঁড়ালো এই যে, কোরআনের মৌল উদ্দেশ্য অনুধাবন করাই লোকের পক্ষে কষ্টসাধ্য হয়ে পড়লো। কোরআন বলছে, ‘আল্লাহ ছাড়া কাউকে ইলাহ বানাবে না।’ লোকে মনে করছে, আমারা মূর্তি ও দেবতাকে ত্যাগ করেছি। সুতরাং কোরআনের উদ্দেশ্য পূর্ণ করেছি। অথচ ইলাহ এর অর্থ আরও যেসব ব্যাপারে প্রযোজ্য, তারা সে সবকে আঁকড়ে ধরে রয়েছে। গায়রুল্লাহকে যে ইলাহ বানাচ্ছে সে খবরও তাদের নেই। কোরআন বলছেঃ আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে রব স্বীকার করো না। লোকে বলছেঃ আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে আমরা পরওয়ারদেগার বলে স্বীকার করি না; সুতরাং আমাদের তাওহীদ পরিপুর্ণ হয়েছে। অথচ আরো যে সকল অর্থে রব শব্দ ব্যাবহৃত হয়, সে প্রেক্ষিতে অধিকাংশ ব্যক্তিই আল্লাহর পরিবর্ততে অন্যান্যের রুবুবিয়্যাত স্বীকার করে নিয়েছেন। কোরআন বলছেঃ তাগুত-এর ইবাদাত ত্যাগ করে শুধু আল্লাহর ইবাদাত কর। লোকেরা বলছেঃ আমরা মুর্তি পূজা করি না শয়তানের ওপর লানত করি, কেবল আল্লাহকেই সিজদা করি, সুতরাং আমরা কোরআনের এ দাবীও পূর্ণ করেছি। অথচ পাথরের মুর্তি ছাড়া অন্যান্য তাগুতকে তারা আঁকড়ে ধরে আছে, পূজা ব্যতীত অন্যান্য রকমের যাবতীয় ইবাদাত গায়রুল্লার জন্যে নিদিষ্ট করে রেখেছে। দীনের অবস্থাও তাই। আল্লাহর জন্যে দীনকে খালেস করার অর্থ মনে করা হয় শুধু এই যে, মানুষ ‘ইসলাম ধর্ম’ কবুল করবে, হিন্দু বা ইহুদী-খৃস্টান থাকবে না। এ ভিত্তিতে ‘ইসলাম ধর্মের সকল ব্যক্তিই মনে করে আমি দীনকে আল্লাহর জন্যে খালেস করে রেখেছি। অথচ দীন-এর ব্যাপকতর অর্থের দৃষ্টতে এমন ব্যক্তির সংখ্যাই বেশী, যাদের দীন আল্লাহর জন্যে খালেছ নয়।

ভুল দারণার ফল

এটা সত্য যে, কেবল এ চারটি মৌলিক পরিভাষার তাৎপর্যে আবরণ পড়ে যাওয়ার কারণে কোরআনের তিন-চুর্থাংশের চেয়েও বেশী শিক্ষা বরং তার সত্যিকার স্পিরিটই দৃষ্টি থেকে প্রচ্ছন্ন হয়ে যায়। ইসলাম কবুল করা সত্ত্বেও মানুষের আকীদা-আমল-বিশ্বাস ও কর্মে যে সকল ত্রুটি পরিলক্ষিত হচ্ছে, এটা তার অন্যতম প্রধান কারণ। সুতরাং কোরআনুল করীমের মৌল শিক্ষা এবং তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা একান্ত জরুরী।

ইতিপূর্বে অনেক নিবন্ধে আমি এসব শব্দের তাৎপর্য তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। কিন্তু এ যাবৎ আমি যা আলোচনা করেছি, একদিকে তা সকল ভ্রান্ত ধারণা অপনোদনের জন্যে যথেষ্ট নয়, অপরদিকে তা দ্বারা লোকদের পূর্ণ তৃপ্তি হতে পারে না। কারণ অভিধান ও কোরআনের আয়াত উল্লেখ ছাড়া লোকেরা আমার সকল ব্যাখ্যাকেই নিজস্ব মত বলে মনে করে। যারা আমার সাথে একমত নন, আমার মত অন্তত তাদের পরিতৃপ্তির কারণ হতে পারে না। আলোচ্য গ্রন্থে এ চারটি পরিভাষার পরিপূর্ণ অর্থ অত্যন্ত স্পষ্ট করে তুলে ধরার চেষ্টা করবো। অভিধান ও কোরআনে প্রমাণ পাওয়া যায় না এমন কোন কথাই আমি এ গ্রন্থে বলবো না।

ইলাহ

 

আভিধানিক তত্ত্ব

শব্দটির মূল অক্ষর আলিফ -লাম-হা (——-)। এ মূল অক্ষর থেকে অভিধানে যেসব শব্দ পাওয়া যায়, তার বিবরণ এইঃ

——– সে ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে পড়েছে।

——– তার আশ্রয়ে গিয়ে বা তার সাথে সর্ম্পক স্থাপন-করে আমি শান্তি ও তৃপ্তি লাভ করেছি।

—————————— কোন দুঃখ -কষ্টে পড়ে লোকটি ভীত-সন্ত্রস্ত হয়েছে, অতপর অপর কোন ব্যক্তি তাকে আশ্রয় দান করেছে।

—————————— প্রবল আগ্রহ বশত লোকটি অপর ব্যক্তির প্রতি মনোযোগ দিয়েছে।

———————– মাতৃহারা উষ্ট্রীর বাচ্চা মাকে পেয়েই তার কোলে আশ্রয় নিয়েছে।

—————————– আচ্ছাদিত বা প্রচ্ছন্ন হয়েছে, বুলন্দ হয়েছে, ওপরে উঠেছে।

————-ইবাদাত করেছে।

————– এর অর্থ ইবাদাত (পুজা) ও ইলাহ অর্থ মাবুদ কোন্ কারণে কি সম্পর্কে হয়েছে, এসকল ধাতুগত অর্থের প্রতি লক্ষ করলে তা জানা যায়।

একঃ প্রয়োজনের তাগিদেই মানুষের অন্তরে ইবাদাতের প্রাথমিক প্রেরণা সৃষ্টি হয়। তার প্রয়োজন পূরণ করতে পারে, বিপদাপদে তাকে আশ্রয় দিতে পারে এমন একটা দারণা মানুষের মনে জাগার আগে সে কারো ইবাদাতের কথা কল্পনাও করতে পারে না।

দুইঃ কাউকে নিজের চেয়ে উন্নততর মনে না করে মানুষ তাকে অভাব পূরণকারী বলে ধারণাও করতে পারে না। কেবল পদ-মর্যাদার দিক থেকে তার শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করাই যথেষ্ট নয়, বরং শক্তি -সামর্থের দিক থেকেও তার শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করতে হবে।

তিনঃ একথাও সত্য যে, কার্যকারণ পরস্পরার অধীন যেসব বস্তু দ্বারা সাধারনত মানুষের প্রয়োজন পুরণ হয়; যার প্রয়োজন পূরণের সকল কার্য মানুষের চক্ষুর সম্মুখে বা তার জ্ঞান-সীমার পরিমন্ডলে থাকে, তার পূজা-অর্চনার কোন প্রেরণা মানুষের মনে জাগে না। উদাহরণ স্বরূপ ব্যয় করার জন্য আমার টাকার প্রয়োজন, আমি কোন ব্যক্তির নিকট গিয়ে চাকুরী বা মজুরীর জান্যে আবেদন করি। সে ব্যক্তি আমার আবেদন গ্রহণ করে আমাকে কোন কাজ দেয়, আর সে কাজের বিনিময়ও আমাকে দেয়। এসব কার্য যেহেতু আমার পঞ্ঝ ইন্দ্রিয় ও জ্ঞান -সীমার মধ্যে সংঘটিত হয়েছে, আমি জানি সে কিভাবে আমার প্রয়োজন পূরণ করেছে। তাই তার পূজনীয় হওয়ার কোন ধারণাও আমার অন্তরে উদয় হয় না। যখন কারো ব্যক্তিত্ব, শক্তি -সামর্থ বা প্রয়োজন পূরণ এবং প্রভাব বিস্তারের প্রক্রিয়া রহস্যাবৃত তাকে-কেবল তখই কোন ব্যক্তিকে পূজা করার ধারণা আমার অন্তরে জাগতে পারে। এজন্যই মা’বুদের জন্যে এমন শব্দ চয়ন করা হয়েছে, যার মধ্যে প্রাধান্যের সাথে প্রচ্ছন্নতা ও অস্থিরতা-চঞ্ঝলতার অর্থও শামিল রয়েছে।

চারঃ যার সম্পর্কেই মানুষ ধারণা করে যে, অভাবের সময় সে অভাব দূর করতে পারে, বিপদের সময় আশ্রয় দিতে পারে, অস্থিরতার সময় শান্তি দিতে পারে, আগ্রহের সাথে তার প্রতি মনোযোগী হওয়া মানুষের জন্যে অপরিহার্য।

উপরিউক্ত আলোচনা থেকে জানা যায় যে, যে সকল ধারণার ভিত্তিতে মা’বুদের জন্য ইলাহ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, তা এইঃ প্রয়োজন পূরণ করা, আশ্রয় দান করা, শান্তি-স্বস্তি দান করা, উচ্চতর ক্ষমতার অধিকারী হওয়া, প্রভাব-প্রতিপত্তির মালিক হওয়া, যে সকল অধিকার ও ক্ষমতার ভিত্তিতে এ আশা করা যেতে পারে যে, মা’বুদ অভাব পূরণকারী এবং আশ্রয় দানকারী হতে পারে এমন সব ক্ষমতা, অধিকারের মালিক হওয়া, তার ব্যক্তিত্ব রহস্যাবৃত হওয়া বা সাধারণ দৃশ্যপটে না থাকা, তার প্রতি মানুষের আগ্রহী হওয়া।

ইলাহ ম্পর্কে জাহেলী যুগের ধারণা

এ আভিধানিক তত্ত্ব আলোচনার পর আমরা দেখবো, উলুহিয়্যাত সম্পর্কে আরববাসী এবং প্রাচীন জাতিসমূহের এমন কি ধারণা ছিলো, যা কোরআন রদ করতে চায়।

—————————– তারা আল্লাহ ছাড়া আরও ইলাহ বানিয়ে রেখেছে, যেন তা তাদের জন্যে শক্তির কারণ হতে পারে (বা তার আশ্রয়ে এসে তারা নিরাপদ হতে পারে) ছুরা: মারিয়ামঃ ৮১

একঃ ———————————— তারা আল্লাহ ছাড়া আরও ইলাহ বানিয়ে রেখেছে, এ আশায় যে, তাদের সাহায্য করা হবে (অর্থাৎ সে সকল ইলাহ তাদের সাহায্য করবে) ছুরা: ইয়াছিনঃ ৮৪

এ আয়াতদ্বয় থেকে জানা যায় যে, জাহেলী যুগের লোকেরা যাকে ইলাহ বলতো, তার সম্পর্কে তাদের ধারণা ছিলো এই যে, সে তাদের নায়ক, চালক,বিপদাপদে তাদেরকে হেফাযত করে, তার সাহায্য পেয়ে তারা ভয় ও অনিষ্ট থেকে নিরাপদ থাকে।

দুইঃ —————————– অতঃপর যখন তোমার রব-এর ফয়সলার সময় উপস্থিত হলো, তখন আল্লাহ ব্যতীত যে ইলাহকে তারা ডাকতো, তা তাদের ধ্বংস ব্যতীত অন্য কোন ব্যাপারে সংযোজনের কারণ হতে পারে নি। -ছুরা হুদঃ ১০১

——————————————– আল্লাহ্ র পরিবর্তে এরা যাকে ডাকে, সে তো কোন জিনিসেরই স্রষ্টা নয়, বরং সে তো নিজেই সৃষ্ট জীব। জীবন্ত নয়, মৃত সে। কবে নব জীবন দিয়ে তাদের পুনরুত্থিত করা হবে, তারও কোন খবর নেই, তাদের এক ইলাহ -ই তো হচ্ছেন তোমাদের ইলাহ। _ আন-নাহালঃ ২০-২২

———————— আর আল্লাহ্ র সাথে অপর কোন ইলাহকে ডেকো না। তিনি ব্যতীত আর কোন ইলাহ নেই।১ -ছুরা-কাসাসঃ ৮৮

(১)(এখানে স্মর্তব্য যে, কোরআনে ইলাহ শব্দ দু’টি অর্থে ব্যবহৃত হয়। একঃ এমন মা’বুদ (উপাস্য) কার্যত যার ইবাদাত করা হচ্ছে, সে মাবুদ সত্য হোক বা মিথ্যা। দুইঃ মা’বুদ,মুলত যিনি ইবাদাতের যোগ্য। এ আয়াতে দু’স্থানে এই দুই পৃথক পৃথক অর্থে ইলাহ শব্দটি ব্যাবহৃত হয়েছে।)

———————— যারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য শরীকদের ডাকছে, তারা নিছক কল্পনা ব্যতীত আর কিছুরই অনুসরণ করছে না। তারা কেবল ধারনা-কল্পনার অনুসরণ করে কল্পনার পেছনেই ছুটে চলে। -ইউনুসঃ ৬৬

এ আয়াতগুলোতে কয়েকটি বিষয়ের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে। একঃ জাহেলী যুগের লোকেরা যাকে ইলাহ বলতো, অসুবিধা দূরীকরণ এবং অভাব পূরণের জন্যে তারা তাকে ডাকতো। অন্য কথায়, তারা তার নিকট দোয়া করতো।

দুইঃ তাদের এই ইলাহ শুধু জিন, ফেরেশতা বা দেবতা-ই ছিল না, বরং মৃত ব্যক্তিও ছিল। কোরআনের এ আয়াত থেকে একথা স্পষ্ট জানা যায়-

——————- তারা মৃত, জীবিত নয়। কবে পুনরুথ্থিত হবে, তাও তারা জানে না।

তিনঃ যে সকল ইলাহ সম্পর্কে তারা ধারণা করতো যে, তারা ওদের দোয়া শুনছে তাদের সাহায্যে হাজির হতেও তারা সক্ষম।

দোয়ার তাৎপর্য এবং তাদের কাছ থেকে যে সাহায্য আশা করা হয়। তার ধরন-প্রকৃতিও এখানে স্মরণ রাখা দরকার। আমার যদি পিপাসা পায়, আর আমি খাদেমকে পানি আনার জন্যে ডাকি অথবা আমি যদি অসুস্থ হয়ে চিকিৎসার জন্যে ডাক্তার ডাকি,তবে তাকে দোয়া বলা চলে না।খাদেম বা চিকিৎসককে ইলাহ বানানোও এর অর্থ নয়। কারণ এসব কিছুই কার্যকারণ পরস্পরার অধীন-তার ঊর্ধ্বে নয়। কিন্তু আমি পিপাসার্ত বা অসুস্থ অবস্থায় খাদেম-চিকিৎসককে না ডেকে যদি কোন ওলী-বুযুর্গ বা কোন দেবতাকে ডাকি তবে তা হবে তাকে ইলাহ বানানো এবং তার নিকট দোয়া চাওয়া কারণ যে ওলী-বুযুর্গ ব্যক্তি আমার থেকে হাজার মাইল দূরে কবরে শুয়ে আছেন, তাঁকে ডাকার অর্থ, আমি তাঁকে শ্রোতা-দ্রষ্টা মনে করি। তাঁর সম্পর্কে আমি এ ধারণা পোষণ করি যে, কার্যকারণ জগতের ওপর তাঁর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত, যার ফলে তিনি আমার কাছে পানি পৌছাতে পারেন, পারেন আমার অসুখ দূর করার ব্যবস্থা করতে। অনুরূপভাবে এমতাবস্থায় কোন দেবতাকে ডাকার অর্থ হচ্ছেঃ পানি বা সুস্থতা-অসুস্থতার উপর তার কর্তৃত্ব রয়েছে। অতি প্রাকৃতিকভাবে আমার অভাব পূরণ করার জন্যে তিনি কার্যকারণকে সক্রিয় করতে পারেন। সুতরাং যে ধারণার ভিত্তিতে ইলাহর নিকট দোয়া চাওয়া হয়, তা অবশ্যই এক অতি প্রাকৃতিক শক্তি (Supernatural Authority) আর এর সাথে রয়েছে অতি প্রাকৃতিক শক্তির অধিকরী হওয়ার ধারণা।

তিনঃ —————————————————- তোমাদের আশে-পাশে যেসব জনপদের চিহ্ন দেখতে পাওয়া যায় তার বাসিন্দাদের আমরা ধ্বংস করেছি। তারা যাতে প্রত্যাবর্তন করতে পারে এজন্যে আমরা তাদেরকে বারবার পর্যায়ক্রমে আমাদের নিদর্শন দেখিয়েছি। আল্লাহ্ কে ত্যাগ করে তারা যাদেরকে নৈকট্য লাভের মাধ্যমে মনে করে ইলাহ বানিয়ে নিয়েছিলো, তারা কেন তাদের সাহায়্য করে নি? সাহায্য করা তো দূরে থাক, বরং তারা তাদেরকে ছেড়ে উধাও হয়ে গিয়েছিলো। তাদের মিথ্যা মনগড়া আচরণের এটাই ছিলো স্বরূপ। – -ছুরা: আল আহকাফঃ ২৭-২৮

———————————————— যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন, আমি কেন তাঁর ইবাদাত করবো না, যাঁর দিকে তোমাদের সকলকে ফিরে যেতে হবে? তাঁকে ত্যাগ করে আমি কি ওদেরকে ইলাহ বানাবো, যাদের অবস্থা হচ্ছে এই যে, রহমান যদি আমার কোন ক্ষতি করার ইচ্ছা করেন, তখন তাদের সুপারিশ আমার কোন কাজেই আসবে না, পারবে না তারা আমাকে মুক্ত করতে? – ছুরা: ইয়াছিনঃ ২২-২৩

———————————————– আল্লাহ ছাড়াও যারা অন্যকে সহযোগী কর্মকুশলী বানিয়ে রেখেছে এবং বলে যে, তারা আমাদেরকে আল্লাহ্ র নিকটবর্তী করবে, এজন্যই আমরা তাদের ইবাদাত করছি। যে বিষয়ে তারা মতভেদ করছে, আল্লাহ (কেয়ামতের দিন) তাদের মধ্যে ফয়সালা করবেন। – জুমারঃ ৩

——————————————- তারা আল্লাহ ছাড়া এমন শক্তিরও ইবাদাত করছে, যারা তাদের উপকার- অপকার কোনটাই করতে পারে না। তারা বলেঃ এরা আল্লাহ্ র কাছে আমাদের জন্য সুপারিশ করবে।- ইউনুসঃ ১৮

এ আয়াতগুলোতে আরও কতিপয় বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। এসব আয়াত থেকে জানা যায় যে, জাহেলী যুগের লোকেরা তাদের ইলাহ সম্পর্কে একথা মনে করত না যে, সমস্ত খোদায়ী তাদের মধ্যে বিলি-বন্টন করা হয়েছে, তাদের ওপরে কোন উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ নেই। তারা স্পষ্টত এক উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের ধারণা পোষণ করতো। এজন্যে তাদের ভাষায় ছিলো আল্লাহ শব্দটি। অন্যান্য ইলাহ সম্পর্কে তাদের মৌল বিশ্বাস ছিলো এই যে, উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের খোদায়ীতে তাদের এ সকল ইলাহর কিছুটা দখল ও প্রভাব আছে। এদের কথা মেনে নেয়া হয়, এদের মাধ্যমে আমাদের কার্য সিদ্ধি হতে পারে, এদের সুপারিশ দ্বারা আমরা উপকৃত হতে পারি, বাঁচতে পারি অনিষ্ট থেকে। এসব ধারণার ভিত্তিতেই তারা আল্লাহর সাথে এ সবকেও ইলাহ মনে করতো। তাই তাদের পরিভাষা অনুযায়ী কাউকে আল্লাহর নিকট সুপারিশকারী মনে করে তার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা, তার সামনে সম্মান -শ্রদ্ধা প্রদর্শন এবং নযর-নেয়ায পেশ করা মানে তাদেরকে ইলাহ বানানো।১

টিকাঃ(১) ( এখানে জেনে নেয়া দরকার যে, সুপারিশ দু’প্রকার। একঃ এমন ধরনের সুপারিশ, যা কোন-না-কোন রকম শক্তি বা প্রভাবের ওপর প্রতিষ্ঠিত। যে কোন রকমে হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত তা মানিয়ে নিয়ে তবেই ছাড়া হয়। দুইঃ যার ধারণা নিছক আবেদন -নিবেদনের অনুরূপ জোর পূর্বক মানিয়ে নেয়ার মতো কোন ক্ষমতা যার পেছনে কার্যকর থাকে না। প্রথম অর্থ অনুযায়ী কাউকেও সুপারিশকারী মনে করা, তাকে ইলাহ বানানো, খোদার খোদায়ীতে অংশীদার করা এক কথা। কোরআন এ ধরনের সুপারিশ অস্বীকার করে। দ্বিতীয় অর্থ অনুযায়ী নবী-রসূল, ফেরেশতা, সাধু -সজ্জন, মোমেন ও সব বান্দা অন্য বান্দাদের জন্যে সুপারিশ করতে পারে। কারো সুপারিশ কবুল করা না করার পূর্ণ ইখতিয়ার রয়েছে আল্লাহর। কোরআন ও ধরনের সুপারিশ স্বীকার করে।)

———————————————————————————- আর আল্লাহ বলেনঃ দুই ইলাহ গ্রহণ করো না। ইলাহ তো কেবল একজনই। সুতরাং তোমরা কেবল আমাকেই ভয় করো। ছুরা-নহরঃ ৫১

——————————————————————————— (ইব্রাহীম বলেন), তোমারা যাদেরকে আল্লাহর শরীক করছো আমি তাদেরকে আদৌ ভয় করি না। অবশ্য আমার রব যদি কিছু চান তবে তা অবশ্যই হতে পারে। – আল-আনআম-৮০

———————————————————————- (হুদ -এর জাতির লোকেরা তাঁকে বললো) আমরা বলবো, আমাদের কোনও এক ইলাহ তোমাকে আভিশাপ করেছে। ছুরা -হুদঃ ৫৪

এসব আয়াত থেকে জানা যায় যে, জাহেলী যুগের লোকেরা তাদের ইলাহ সম্পর্কে আশংকা করতো যে, আমারা যদি তাদেরকে কোনভাবে নারাজ করি বা আমরা যদি তাদের শুভ দৃষ্টি থেকে বঞ্ঝিত হেয়ে পড়ি তাহলে আমাদের উপর রোগ-শোক, অভাব -আনটন, জান-মালের ক্ষয়-ক্ষতি এবং অন্যান্য রকমের বিপদ আপতিত হবে।

পাঁচঃ ——————————————————————————– তারা আল্লাহর পরিবর্তে নিজেদের ওলামা ও পাদ্রীদেরকে তাদের রব বানিয়ে নিয়েছে। মসীহ ইবনে মরিয়ামকেও রব বনিয়েছে। অথচ তাদেরকে বেবল এক ইলাহর ইবাদাতের নির্দেশ দেয়া হয়েছিলো, তিনি ভিন্ন আর কোন ইলাহ নেই। ছুরা-তওবাঃ ৩১

———————————————————————————- যে ব্যক্তি তার মনের লোভ-লালসাকে ইলাহ বানিয়ে নিয়েছে, তার সম্পর্কে তোমার কি ধারণা? তুমি কি তার দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারো?আল-ফোরানঃ ৪৩

——————————————————————————– এমনি করে অনেক মুশরেকদের জন্যে তাদের মনগড়া শরীকরা (অর্থাৎ ইলুহিয়াতের ব্যাপারে অংশীদাররা) নিজেদের সন্তান হত্যার কাজকে কতই না সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছে। -আল-আনআমঃ ১৩৭

—————————————————————————- তাদের কি এমন শরিক (অর্থাৎ উলুহিয়াতের ব্যাপারে অংশীদার) রয়েছে, যারা তাদের জন্যে এমন শরীয়ত নির্ধারণ করেছে, যার আল্লাহ অনুমতি দেন নি। আশ-শুরাঃ ২১

এ সকল আয়াতে ইলাহর আর একটি অর্থ পাওয়া যায়। পূর্বের অর্থগুলো থেকে এ অর্থ সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। এখানে এমন কোন অতি-প্রাকৃতিক ব্যক্তির ধারণা অনুপস্থিত। যাকে ইলাহ বানানো হয়েছে, তা হয় কোন ব্যক্তি বা ব্যক্তির প্রবৃত্তি। তার নিকট দোয়া করা হতো বা তাকে হিতাহিতের অধিকারী মনে করা হতো এবং তার আশায় প্রার্থনা করা হতো-এ সকল অর্থে এখানে ইলাহ বানানো হয় নি, বরং তাঁকে ইলাহ বানানো হয়েছে এ অর্থে যে, তাঁর নির্দেশকে আইন হিসাবে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে, তার আদেশ-নিষেধ মেনে নেয়া হয়েছে তার হালালকে হালাল এবং হারামকে হারাম বলে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে। এ ধারণা করে নেয়া হয়েছে যে, তাঁর নির্দেশ দেয়ার বা নিষেধ করার ইখতিয়ার রয়েছে; তাঁর চেয়ে উর্ধ্বতন এমন কোন অথরিটি (Authority) নেই যার অনুমেদন গ্রহণ বা যার দিকে প্রত্যাবর্তনের প্রয়োজন পড়তে পারে।

প্রথম আয়াত ওলামা ও পাদ্রীদেরকে (কোরআনের ভাষায় আহবার ও রোহবান) ইলাহ বানাবার উল্লেখ রয়েছে। এর স্পষ্ট ব্যাখ্যা পাই আমরা হাদীসে। হযরত আদী ইবনে হাতেম (রাঃ) এ আয়াত সম্পর্কে, রসূলুল্লাহ্ (স) কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেনঃ তোমাদের ওলামা ও রাহেব-পাদ্রীরা যে জিনিসকে হালাল করেছে, তোমরা তাকে হালাল মনে করতে, আর তারা যাকে হারাম করতো, তোমরা তাকে হারাম বলে স্বীকার করে নিতে। এ ব্যাপারে আল্লাহর হুকুম কি, তার কোন পরওয়াও করতে না তোমরা।

দ্বিতীয় আয়াতটির অর্থ অত্যন্ত স্পষ্ট। যে ব্যক্তি তার প্রবৃত্তির আনুগত্য করে তার নির্দেশকেই সর্বোচ্চ স্থান দেয়, মূলত সে ব্যক্তি তার প্রবৃত্তিকেই ইলাহ বানিয়ে নিয়েছে। আলোচ্য আয়াত থেকে একথা সহজেই জানা যায়।

অবশ্য পরবর্তী আয়াতদ্বয়ের ইলাহর পরিবর্তে ‘শরীক’ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। আমরা আয়াতের তরজমায় স্পষ্ট করে দিয়েছি যে, শরীক এর অর্থ উলুহিয়াত-এর অংশীদার করা। এ আয়াতদ্বয় স্পষ্ট ফয়সালা করছে যে, আল্লাহর নির্দেশের প্রমাণ ছাড়াই যারা কোন প্রথা বা নিয়ম -বিধানকে বৈধ আইন বলে মনে করে, সে আইন প্রণেতাকে তারা উলুহিয়াতে আল্লাহর শরীক করে।

ইলাহ বনাম ক্ষমতা

ইলাহ-এর যতগুলো অর্থ ওপরে আলোচিত হয়েছে, তার সবগুলোর মধ্যে এক যুক্তিপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। যে ব্যক্তি অতি-প্রাকৃতিক অর্থ কাউকে সাহায্যকারী, সহযোগী, অভাব দূরকারী, প্রয়োজন পূরণকারী, দোয়া শ্রবণকারী, ইষ্ট বা অনিষ্ট সাধনকারী বলে মনে করে, তার এমনটি মনে করার কারণ এই যে, তার মতে সে ব্যক্তি বিশ্ব-জাহান পরিচালনায় কোন-না-কোন প্রকার ক্ষমতার অধিকারী। অনুরূপভাবে কেউ যদি কোন ব্যক্তকে ভয় করে এবং মনে করে যে, তার অসন্তুষ্টি আমার জন্যে ক্ষতির কারণ এবং সন্তুষ্টি কল্যণকর। তার এ বিশ্বাস ও কর্মের কারণও এছাড়া আর কিছুই নয় যে, তার মনে সে ব্যক্তি সম্পর্কে এক ধরনের শক্তির ধারণা রয়েছে। অপরপক্ষে কোন ব্যক্তি মহান আল্লাহ রাব্বুল-আলামীনকে স্বীকার করা সত্ত্বেও অভাবে অন্যের দিকে প্রত্যাবর্তন করে, তার এহেন কর্মের কারণও শুধু এই যে, খোদার খোদায়ীতে সে অন্যকে কোন-না-কোন প্রকার অংশীদার বলে মনে করে। অনুরূপভাবে যে ব্যক্তি কারো নির্দেশকে আইন এবং কারো আদেশ-নিষেধকে অবশ্য পালনীয় বলে মনে করে, সেও তাকে সবোর্চ্চ ক্ষমতার অধিকারী স্বীকার করে। সুতরাং উলুহিয়াতের প্রকৃত স্পিরিট হচ্ছে ক্ষমতা। বিশ্ব-জাহানের ব্যবস্থাপনায় তার কর্তৃত্ব অতি-প্রাকৃতিক ধরনের বা বৈষয়িক জীবনে মানুষ তার নির্দেশের অধীন; আর তার নির্দেশ যথাস্থানে অবশ্য পালনীয়- এর যে কোন অর্থেই সে ক্ষমতাকে স্বীকার করে নেয়া হোক না কেন।

কোরআনের যুক্তি

ক্ষমতার এ ধারনার ভিত্তিতেই গায়রুল্লার অস্বীকার এবং কেবল আল্লাহর ইলাহিয়াত প্রতিষ্ঠা করার জন্যেই কোরআন সর্বশক্তি নিয়োজিত করে।কোরআনের যুক্তি এই যে, আসমান-যমীনে একক সত্তাই সকল ক্ষমতা ইখতিয়ারের মালিক। সৃষ্টি করা,নিয়ামত দান করা,নির্দেশ দেয়া,শক্তি-সামর্থ্য-সব কিছুই তাঁর হস্তে নিহিত।সব কিছুই ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় তাঁর আনুগত্য করছে।তিনি ব্যতিত কারো কোন ক্ষমতা নেই, নেই কারো নির্দশ দানের অধিকার, সৃজন, ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার রহস্য সম্পর্কেও কেউ অবগত নয়, তাঁর শাসন-ক্ষমতায় কেউ সামান্যতম অংশীদারও নয়। সুতরাং প্রকৃতপক্ষে তিনি ব্যতীত অপর কোন ইলাহ নেই। আসলে যখন অন্য কোন ইলাহ নেই, তবে অন্যদেরকে ইলাহ মনে করে তোমরা যেসব কাজ করছো মূলত ভুল ও অন্যায়। সে কাজ দোয়া-প্রার্থনা করা, সুপারিশকারী বানানো বা নির্দেশ পালন এবং আনূগত্য করার-যে কোন কার্যই হোক না কেন, তোমরা অন্যের সাথে যে সকল সম্পর্ক স্থাপন করে আছো তা সবই কেবল আল্লাহর জন্যে নির্দিষ্ট হওয়া উচিত। কারণ তিনিই হচ্ছেন একক ক্ষমতার অধিকারী।

এ ব্যাপারে কোরআন যেভাবে যুক্তি উপস্থাপনা করছে, তা কোরআনের ভাষায়ই শুনুনঃ

————————————————————————————- আর তিনি হচ্ছেন এমন এক সত্তা, যিনি আসমানেও ইলাহ, আর যমীনেও ইলাহ এবং তিনি হাকীম ও আলীম-অতি কৌশলী, মহাজ্ঞানী (অর্থাৎ আসমান-যমীনে রাজত্ব করার জন্যে যে জ্ঞান ওকৌশল দরকার, তা সবই তাঁর আছে)- ছুরা-আয-যুখরুফঃ ৮৪

—————————————————————————— তবে কি যে সৃষ্টি করে আর যে সৃষ্টি করে না, দু’জনে সমান হতে পারে? —— এ সামান্য কথাটুকুও কি তোমাদের উপলব্ধিতে আসে না? —– আল্লাহকে বাদ দিয়ে এরা অন্য যাদেরকে ডাকে, তারা তো কোন কিছুই সৃষ্টি করতে পারে না, বরং তারাই তো অন্যের সৃষ্টি। —– তোমাদের ইলাহ তো এক- ই -ইলাহ। -আন-নাহালঃ ১৭-২২

—————————————————————— মানব জাতি, তোমাদের প্রতি আল্লাহর যে অনুগ্রহ করয়েছে, তোমরা তা স্মরণ করো। আল্লাহ ব্যতীত এমন কোন স্রষ্ট্রা আছেন কি যিনি আসমান-যমীন থেকে তোমাদেরকে রিজিক দেন/ তিনি ব্যতীত আর কোন ইলাহ নেই। তবুও তোমরা কোথায় ছুটে বেড়াচ্ছ? – ছুরা- ফাতিরঃ ৩

———————————————————— বল, তোমরা কি চিন্তা করে দেখছো যে, আল্লাহ যদি তোমাদের শ্রবণ ও দর্শন শক্তি রহিত করেন আর অন্তরের ওপর চাপ মেরে দেন (অর্থাৎ জ্ঞান-বুদ্ধি ছিনিয়ে নেন) তবে আল্লাহ ব্যতীত কোন্ ইলাহ আছে, যে তোমাদেরকে এসব কিছু এনে দেবে? আনআম-৪৬

—————————————————————– তিনিই আল্লাহ, তিনি ব্যতীত অপর কোন ইলাহ নেই, দুনিয়া ও আখেরাতে প্রশংসা কেবল তাঁরই জন্যে। তিনি একাই নির্দেশ দান এবং সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী। তাঁরই নিকট তোমাদেরকে ফিরে যেতে হবে। বল, তোমরা কি কখনো চিন্তা করে দেখছো যে, আল্লাহ যদি কেয়ামতের দিন পর্যন্ত তোমাদের জন্যে রাতকে স্থায়ী করে দেন, তবে তোমাদেরকে আলো এনে দিতে পারে, এমন কোন ইলাহ আছে কি? তোমরা কি শুনতে পাও না/ বল, তোমরা কি ভেবে দেখনি, আল্লাহ যদি তোমাদের ওপর স্থায়ীভাবে দিন চেপে দেন, তবে তোমাদের শান্তি লাভের জন্যে রাত এনে দিতে পারে, এমন কোন ইলাহ আছে? তোমরা কি দেখতে পাওনা! -আল-কাসাস-৭০-৭২

———————————————————————— বল, আল্লাহ ছাড়া যাদেরকে তোমরা কিছু মনে করে বসে আছো, তাদের ডেকে দেখো। আসমান-যমীনে তারা অণুমাত্র বস্তুরও মালিক নয়, আসমান-যমীনের ব্যবস্থাপনায় তাদের কোন অংশ নেই, এতে কেউ আল্লাহ্ র সাহায্যকারীও নেই। যার পক্ষে আল্লাহ নিজে সুপারিশের অনুমতি দেন, তিনি ব্যতীত আল্লাহর কাছে আর কারো সুপরারিশও কোন কাজে আসে না। (ছুরা আস-সাবা-২২-২৩)

———————————– তিনি আসমান রাজি ও যমীন সৃষ্টি করেছেন যথাযথভাবে। তিনিই রাতের পর দিন এবং দিনের পর রাতকে আবর্তিত করেন। চন্দ্র ও সূর্যকে তিনি অনুগত করে রেখেছেন। সকলেই নির্ধারিত সময়ের দিকে ধাবিত হয়। …. তিনি এক ব্যক্তি থেকে তোমাদের সৃষ্টির সূচনা করেছেন (অর্থাৎ মানব জীবনের সূচনা করেছেন)। অতপর সে ব্যক্তি থেকেই তার যুগল বানিয়েছেন। আর তোমাদের জন্যে চতুষ্পদ জন্তুরও করেছেন আটটি জোড়া। তিনি মাতৃগর্ভে তোমাদের এমনভাবে সৃষ্টি করেছেন যে, তিনটি পর্দার (তিন পর্দা অর্থ -পেট, গর্ভাশয় ও জরায়ু। ) অভ্যন্তরে তোমাদের সৃষ্টির উপর্যযুপরি কয়েকটি স্তর অতিক্রান্ত হয়। এ আল্লাহই তোমাদের রব। শাসন ক্ষমতা তাঁরই জন্যে। তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই। তাহলে তোমরা কোন্ দিকে ধাবিত হচ্ছ? (ছুরা আয-যুমার-৫-৬)

————————————– কে তোমাদের জন্য আকাশরাজি ও যমীন সৃষ্টি করেছেন? অতপর আকাশ থেকে তোমাদের জন্যে বারি বর্ষণ করেছেন; আর সৃজন করেছেন সুদৃশ্য বাগান, যার গুল্ম-লতা সৃষ্টি করা তোমাদের আয়ত্তাধীন ছিল না। এ সকল কাজে আল্লাহর সাথে আরও কি কোন শরীক আছে? এরা সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। কে এ যমীনকে বসবাসের উপযোগী করেছেন, আর তার জন্যে পাহাড়কে করেছেন নোঙ্গর, আর দুটি সমুদ্রের মধ্যবাগে অন্তরায় সৃষ্টি করেছেন। এ সকল কাজে আল্লাহর সাথে অপর কোন ইলাহ কি শরীক আছে? কিন্তু অধিকাংশ মুশরেকদেরই কোন জ্ঞান-বুদ্ধি নেই। এমন কে আছেন, যিনি অস্থিরতার সময় মানুষর দোয়া শোনেন, তার কষ্ট দূর করেন? কে তিনি, যিনি তোমাদেরকে দুনিয়ার খলীফা করেন (অর্থাৎ ভোগ – ব্যবহারের অধিকার দান করেন)? এ সকল কাজেও কি আল্লাহর সাথে অপর কোন ইলাহ অংশিদার আছে কি? তোমরা খুব সামান্যই চিন্তা কর। জল-স্থলের অন্ধকারে কে তোমাদের পথ দেখান; অতপর তাঁর রহমত (অর্থাৎ বৃষ্টির) পুর্বে সুসংবাদ দানকারী বায়ু প্রবাহিত করেন? এ সকল কাজেও কি আল্লাহর সাথে অপর কোন ইলাহ অংশীদার আছে? ওরা যে সব শিরক করছে, তা থেকে আল্লাহ অনেক ঊর্ধ্বে। কে তিনি, যিনি সৃষ্টির সূচনা করেন এবং তার পুনরাবৃত্তি করেন? কে তোমাদেরকে আসমান-যমীন থেকে রিজিক দান করেন? আল্লাহর সাথে অন্য ইলাহও কি এ সকল কাজে শরীক আছে? বল, তোমরা যদি শিরকের ব্যাপারে সত্যাশ্রয়ী হও, তবে প্রমাণ দাও।১ ছুরা আন-নামল-৬০-৬৪

(১)(অর্থাৎ তোমার যদি স্বীকবার করো যে, এ সকল কাজ আল্লাহর এবং এতে তাঁর কোন শরীক নেই, তাহলে কোন্ ইলাহিয়াতের ব্যাপারে তাঁর সাথে অন্যদেরকে শরীক করছো? যাদের কোন ক্ষমতা নেই, আসমান-যমীনে যাদের কোন স্বেচ্ছাপ্রণোদিত কার্য নেই, তারা কিভাবে ইলাহ সেজে বসেছে? ) ——————————— যিনি আসমান – যমিনের রাজত্বের অধিকারী। তিনি কাউকে সন্তান হিসাবে গ্রহন কেন নি, শাসন-ক্ষমতায় তাঁর কোন শরীকও নেই। তিনি সকল বস্তু সৃষ্টি করেছেন এবং তার জন্যে যথার্থ পরিমানও নির্ধারণ করেছেন। মানুষ তাকে ত্যাগ করে এমন ইলাহ বানিয়ে নিয়েছে, যারা কিছুই সৃষ্টি করতে পারে না, বরং তারা নিজেরাই হয় সৃষ্ট, যারা নিজের জন্যেও কোন লাভ-ক্ষতির মালিক নন, জীবন-মৃত্যু এবং পুনরুথানের ব্যাপারে যাদের কোন ক্ষমতাই নেই। – আল-ফোরকান-২৩

——————————— তিনিই তো অসমান যমীনকে অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্ব প্রদানকারী। তাঁর পুত্র কি করে হতে পারে? অথচ তাঁর তো স্ত্রীই নেই? তিনিই তো সকল বস্তুকে সৃষ্টি করেছেন; তিনি সব বস্তুর জ্ঞান রাখেন। তিনিই আল্লাহ, তোমাদের রব। তিনি ব্যতীত অপর কোন ইলাহ নেই। তিনি সব কিছুর স্রষ্টা। অতএব, তোমরা কেবল তাঁরই ইবাদাত করো। সব কিছুর সংরক্ষণ এবং তত্ত্বাবধানের জন্যে তিনিই যথেস্ট। ছুরা আনআম- ১০১-১০২

—————————————— এমন কিছু লোক আছে, যারা আল্লাহ ব্যতীত অন্যদেরকেও খোদায়ীতে শরীক-সহায়ক স্থাপন করে, আল্লাহর মতো তাদেরকেও ভালোবাসে। অথচ ঈমানদাররা আল্লাহকে ভালবাসেন সবচেয়ে বেশী। আযাব নিযিল হওয়ার সময় এই যালিমরা যে সত্যটি উপলব্ধি করবে, তা যদি তারা আজই উপলব্ধি করতো যে, সর্বময় ক্ষমতা -সব রকম শক্তি আল্লাহরই হাতে নিহিত! ছুরা আল-বাকারা-১৬৫

——————————— বল, আল্লাহ ব্যতীত যে সব মাবুদকে তোমরা অভাব পূরণের জন্যে ডাক, তাদের অবস্থা সম্পর্কে তোমরা কি কখনো চিন্তা করে দেখেছো? যমীনের কতটুকু অংশ তাদের সৃষ্টি বা আসমানের সৃষ্টিতে তাদের কতটুকু অংশ আছে, আমাকে একটু দেখাওতো!…. যারা আল্লাহকে ছেড়ে এমন সবকে ডাকে, যারা কিয়ামত পর্যন্ত তাদের ডাকে সাড়া দিতে পারে না, তাদের চেয়ে বেশী গোমরাহ আর কে হতে পারে?১ (১)টিকা: (অর্থাৎ তাদের আবেদনের জবাবে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনা। ) ————————————- আসমান- জমীনে যদি আল্লাহ ছাড়া আরও ইলাহ থাকতো, তবে বিশ্বের ব্যবস্থাপনা ওলট -পালট হয়ে যেতো। সুতরাং আল্লাহ, যিনি আরশ (অর্থাৎ বিশ্বের শাসন-ক্ষমতা) – এর মালিক, তাঁর সম্পর্কে ওরা যা কিছু বলছে, তা থেকে তিনি মুক্ত -পবিত্র। তিনি তাঁর কোন কাজের জন্যে জবাবদিহি করতে বাধ্য নন; অন্য সকলেই (তাঁর কাছে) জবাবদিহি করতে বাধ্য।

——————————— আল্লাহ কোন পুত্রও গ্রহণ করেন নি, তাঁর সাথে অন্য কোন ইলাহও নেই। যদি এমন হতো, তাহলে সকল ইলাহ তার নিজের সৃষ্ট বস্তু নিয়ে পৃথক হয়ে যেতো, আর একে অন্যের ওপর চড়াও হতো। (ছুরা আল-মুমেনুন -৯১)

——————————— – বল, আল্লাহ্র সাথে যদি অন্য ইলাহ হতো, যেমন লোকেরা বলছে, তাহলে তারা আরশ-অধিপতির রাজত্ব দখল করার জন্যে অবশ্যই কৌশল অবলম্বন করতো। তিনি পাক; ওরা যা বলছে, তা থেকে তিনি অনেক উর্ধে। – বনী ইসরাইল – ৪২-৪৩

এ সকল আয়াতে আদ্যোপান্ত একই কেন্দ্রীয় ধারনা দেখতে পাওয়া যায়। আর তা এইঃ ইলাহিয়াত ও ক্ষমতা অবিচ্ছেদ্যভাব সম্পৃক্ত -ওতপ্রোতভাব জড়তি। স্পিরিট ও তাৎপর্যের দিক থেকে উভয়ই এক জিনিস। যার ক্ষমতা নেই, সে ইলাহ হতে পার না- ইলাহ হওয়া উচিৎ নয় তার। যার ক্ষমতা আছে, কেবল সে-ই ইলাহ হতে পারে- ইলাহ তাঁরই উচতি হওয়া। কারণ ইলাহর নিকট আমাদের যতো প্রকার প্রয়োজন রয়েছে, অন্য কথায়; যে সব প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে কাউকে ইলাহ স্বীকার করার আমাদের প্রয়োজন পড়ে, তার কোন একটি প্রয়োজনও ক্ষমতা ছাড়া পূরণ হতে পারে না। সুতরাং ক্ষমতাবিহীনের ইলাহ হওয়া অর্থহীন, অবান্তর। আর তার দিকে প্রত্যাবর্তন নিষ্ফল।

এ কেন্দ্রীয় ধারণাটি কোরআন যেভাবে উপস্থাপন করেছে, নিন্মোক্ত ধারায় তার ভুমিকা ও ফলাফল ভালোভাবে হৃদয়ঙ্গম করা যায়।

একঃ অভাব পূরণ, জটিলতা দূরীকরণ, আশ্রয় দান, সাহায্য- সহযোগিতা প্রদান, তত্ত্বাবধান ও সংরক্ষণ এবং আহবানে সাড়া দান – এ সবকে তোমরা মামুলী কাজ মনে করছো, আসলে এগুলো কোন মামুলী কাজ নয়, বরং সমগ্র বিশ্ব-জাহানের সৃষ্টিধর্ম এবং ব্যবস্থাপনা শক্তির সাথে এ সবের যোগসূত্র নিহিত। তোমাদের সামান্যতম প্রয়োজন যেভাবে পূরণ হয়,তা নিয়ে চিন্তা করলে জানতে পারবে যে, আসমান যমীনের বিশাল কারখানায় অসংখ্য-অগণিত কার্য- কারণের সার্বিক ক্রিয়া ছাড়া তা পূরণ হওয়া অসম্ভব। তোমাদের পান করার এক গ্লাস পানি, আহার্যের একটি কণার কথাই চিন্তা করো; এ সামান্য জিনিস সরবরাহের জন্যে সূর্য, যমীন, বায়ু ও সমুদ্রকে কতো কাজ করতে হয়, তা আল্লাহ্ -ই জানেন। তবেই তো এসব জিনিস তোমাদের কাছে পৌছায়। সুতারাং তোমাদের দোয়া শ্রবণ এবং অভাব অভিযোগ দূরীকরণের জন্যে কোন মামুলী ক্ষমতা নয়,বরং এমন এক ক্ষমতা দরকার; আসমান-যমীনের সৃষ্টি, গ্রহ-নক্ষত্রের আবর্তন, বায়ু প্রবাহ এবং বারি বর্ষণের জন্যে-এক কথায়, সমগ্র বশ্বি-জাহানের পরিচালনা ও শৃংখলা বিধানের জন্যে যে ক্ষমতা দরকার।

দুইঃ এ ক্ষমতা অবিভাজ্য। সৃষ্টি করার ক্ষমতা একজনের হাতে থাকবে আর জীবিকা সরবরাহের ক্ষমতা থাকবে অন্য জনের হাতে, সূর্য একজনের অধিকারে থাকবে, যমীন অন্যজনের অধিকারে, সৃষ্টি করা করো ইখতিয়ারে থাকবে, সুস্থতা- অসুস্থতা অন্যকারো ইখতিয়ারে, জীবন ও মৃত্যু কোন তৃতীয় জনের ইখতিয়ারে- এটা কিছুতেই সম্ভব নয়। এমন হলে বিশ্ব-জাহানের ব্যবস্হাপনা কিছুতেই চলতে পারতো না। সুতরাং সকল ক্ষমতা ইখতিয়ার একই কেন্দ্রীয় শাসকের অধিকারে থাকা একান্ত জরুরী। এমনটি হোক, তা বিশ্বজাহানের ব্যবস্থাপনারও দাবি। মূলত হয়েছেও তাই।

তিনঃ যেহেতু একই শাসকের হস্তে সমস্ত ক্ষমতা নিহিত, ক্ষমতায় বিন্দুমাত্র কারো কোন হিস্যা নেই, সুতরাং উলুহিয়াতও সর্বতোভাবে সে শাসনকর্তার জন্যেই নিদির্ষ্ট, তাতেও কেউ অংশীদার নেই। তোমাদের ফরিয়াদে সাড়া দিতে পারে, দোয়া কবুল করতে পারে-এমন ক্ষমতা কারো নেই। সুতরাং ইলাহর যে অর্থ-ই তোমাদের মানস-পটে আছে, তার প্রেক্ষিতে অন্য কোন ইলাহ নেই। এমন কি বিশ্ব-জাহানের নিয়ন্তা-পরিচালকের নৈকট্য লাভের প্রেক্ষিতে তার কিছুটা ক্ষমতা চলবে এবং তার সুপারিশ কবুল করা হবে-এ অর্থেও কোন ইলাহ নেই। তার রাজ্য পরিচালন ব্যবস্থায় কারও বিন্দুমাত্র হস্তক্ষেপের অধিকার নেই। তাঁর কার্যাবলীতে কেউ দখল দিতে পারে না। সুপারিশ কবুল করা না করা সম্পূর্ণ তাঁর ইখতিয়ারে। কারো এমন কোন ক্ষমতা নেই, যার ভিত্তিতে সে তার সুপারিশ কবুল করাতে পারে।

চারঃ একক সর্বোচ্চ ক্ষমতার দাবি এই যে, সার্বভৌমত্ব ও নেতৃত্ব কতৃর্ত্বের যত শ্রেণী বিভাগ আছে, একক সার্বিক ক্ষমতার অধিকারীর অস্তিত্বের মধ্যে তা সবই কেন্দ্রীভূত হবে। সার্বভৌমত্বের কোন অংশও অন্য কারো দিকে স্থানান্তরিত হবে না। তিনিই যখন স্রষ্টা, সৃষ্টি-কর্মে কেউ তাঁর শরীক নেই, রিজিকদাতা তিনি, রিজিক দানে কেউ তাঁর অংশীদার নেই, বিশ্ব জাহানের ব্যবস্থাপনায় তিনি একক চালক, ব্যবস্থাপক- পরিচালনায় কেউই তাঁর সাথে শরীক নেই। সুতরাং নির্দেশদাতা এবং আইনদাতা-বিধাদাতারও তিনিই। ক্ষমতার এ পর্যায়েও কারো অংশীদার হওয়ার কোন কারণ নেই। যেমনি করে তাঁর রাজ্যের পরিসীমায় অন্য কারো ফরিয়াদে সাড়া দানকারী, অভাব পুরণকারী এবং আশ্রয়দাতা হওয়া মিথ্যা, তেমনি করে স্বতন্ত্র নির্দেশদাতা, স্বাধীন স্বেচ্ছাচারী নৃপতি এবং স্বাধীন আইন-বিধানদাতা হওয়াও ভুল-মিথ্যা। সৃষ্ট করা এবং জীবিকা দান, জীবন মৃত্যু দান, চন্দ্র সূর্যের বশীকরণ, রাত দিনের আবর্তন-বিবর্তন, পরিমাণ নির্ধারণ, নির্দেশ দান এবং একক রাজত্ব-কর্তৃত্ব, আইন বিধান দান- এ সবই হচ্ছে একক ক্ষমতা ও সার্বভৌমিকথার বিভিন্ন দিক। এ ক্ষমতা এবং সার্বভৌমত্ব অবিভাজ্য। কোন ব্যক্তি যদি আল্লাহ্র নির্দেশের অনুমোদন ছাড়াই কাউকে আনুগত্যের যোগ্য মনে করে, তবে সে তেমনি শির্ক করে, যেমনি শির্ক করে গায়রুল্লার কাছে প্রার্থনাকারী ব্যক্তি। কোন ব্যক্তি যদি রাজনৈতিক অর্থে রাজাধিরাজ (——) সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী এবং নিরংকুশ শাসক (—) বলে দাবী করে, তবে তার এ দাবী সরাসরি আল্লাহ্র দাবীর অনুরূপ; যেমন, অতি-প্রাকৃতিক অর্থে কারো এ দাবী করা যে, আমিই তোমার পৃষ্ঠপোষক, কর্মকুশলী, সাহায্যকারী ও সংরক্ষক। এজন্যে যেখানেই সৃষ্টি বস্তুর পরিমাণ এবং বিশ্ব-জাহানের ব্যবস্থাপনা পরিচালনায় আল্লাহকে লা-শরীক বলে উল্লেখ করা হয়েছে, সেখানেই — নির্দেশ দেয়ার অধিকার একমাত্র তাঁর (–) বৈধ অধিকার কেবল তাঁরই এবং (–) কর্তৃত্ব-সার্বভৌমত্বে কেউই তাঁর শরীক নেই ইত্যাদিও বলা হয়েছে। এসব থেকে স্পষ্টই প্রমাণ পাওয়া যায় যে, রাজত্ব-কর্তৃত্বের অর্থও উলুহিয়াত (–) -এর তাৎপর্যের শামিল। এ অর্থের দিক থেকেও আল্লাহ্র সাথে অন্য কারো অংশীদারিত্ব স্বীকার না করা ইলাহর একত্বের জন্যে অপরিহার্য। নিন্মোক্ত আয়াতে এ কথাটি আরও স্পষ্ট করে ব্যক্ত করা হয়েছেঃ

বল, হে আল্লাহ। রাজত্বের মালিক। যাকে খূশী রাজ্য দান কর, যার কাছ থেকে খুশী রাজ্য ছিনিয়ে নাও। যাকে ইচ্ছা ইজ্জত দান করো, যাকে খুশী অপদস্তকরো। -আলে-ইমরান-২৬

সুতরাং প্রকৃত বাদশা আল্লাহ অতি মহান। তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই। মহান আরশ-এর অধিকারী। আল-মুমেনূন-১১৬

বল, মানুষের রব, মানুষের বাদশা, মানুষের ইলাহর নিকট আমি আশ্রয় প্রার্থনা করি। -আন-নাস-১-৩

সূরায়ে আল মুমিন -এর ১৬ নং আয়াতে এর চেয়েও স্পষ্ট করে বলা হয়েছেঃ

যেদিন সব মানুষই আবরণ মুক্ত হবে, তাদের কোন রহস্যই আল্লাহ্র কাছে গোপন থাকবে না। আজ কার রাজত্ব? নিশ্চই একক মহাপ্রতাপশালী আল্লাহর।

অর্থাৎ যেদিন সকল মানুষের নেকাব খুলে ফেলা হবে, কারো কোন রহস্যই আল্লাহর কাছে গোপন থাকবে না, তখন ডাক দিয়ে জিজ্ঞাসা করা হবেঃ আজ রাজত্ব কার? একমাত্র একক আল্লাহ্র, যাঁর ক্ষমতা সকলের ওপরে প্রবল-এ ছাড়া সেদিন অন্য কোন জবাব হবে না। ইমাম আহমদ (রঃ) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ (সঃ) ভাষণ দান প্রসঙ্গে বলেছেন : আসমান-যমীনকে মুষ্টি বদ্ধ করে আল্লাহ তায়ালা ডাক দিয়ে বলবেনঃ আমি বাদশা, আমি পরাক্রমশালী, আমি প্রবল প্রতিপত্তির অধিকারী, যমীনে যারা বাদশা সেজে বসেছিলো, তারা কোথায় প্রভাব-প্রতাপশালী দাম্ভিক নরপতিরা?

এ হাদীসটি আলোচ্য আয়াতের সর্বোৎকৃষ্ট ব্যাখ্যা। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমন (রাঃ) বলেন-হুজুর (সঃ) যখন ভাষণে এ শব্দগুলো উচ্চারণ করছিলেন, তখন তাঁর দেহে এমন কম্পন হচ্ছিলো, আমরা আশংকা করছিলাম তিনি যেন মিম্বর থেকে পড়ে না যান!

রব

আভিধানিক তত্ত্ব

—— -ধাতু থেকে শব্দটি নিষ্পন্ন। এর প্রাথমিক ও মৌলকি অর্থ প্রতিপালন। তারপর তা থেকে ভোগ-ব্যবহার, তত্ত্বাবধান, অবস্থান পরিবর্তন সাধন, সমাপ্তিকরণ ও পরিপূর্ণতা বিধানের অর্থ সৃষ্টি হয়েছে। এরই ভিত্তিতে সৃষ্টি হয়েছে প্রাধান্য, নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব, অধিপত্য ও প্রভুত্বের অর্থ। অভিধানে এর ব্যবহারের কয়েকটি উদাহরণ এইঃ

একঃ প্রতিপালন করা, ক্রমবিকাশ ও ক্রমোন্নতি সাধন এবং বর্ধিত করণ। উদাহরণস্বরূপ-পালক পুত্রকে রবীব (–) ও পালক কন্যাকে (–) রবীবা বলা হয়। বিমাতার গৃহে প্রতিপালিত শিশুকেও রবীবী (–) বলা হয়। লালন-পালনকারী দাইকেও রবীবা (–) বলা হয়। বিমাতাকে বলা হয় রাব্বাহ(–)। কারণ তিনি মাতা না হলেও শিশুর লালন-পালন করেন। এ কারণেই সৎ-পিতাকে বলা হয়— (রাব্বুনা)। যে ঔষধ হেফাযত করে রাখা হয়, তাকে বলা হয় মোরাব্বাব বা মোরাব্বা (—)। ———-এর অর্থ সংযোজন করা, বর্ধিত করা এবং সমাপ্তিতে নিয়ে যাওয়া। যথাঃ —এর অর্থ -অনুগ্রহে সংযোজন করেছে বা অনুগ্রহের শেষ সীমায় পৌছেছে।

দুইঃ সংকুচিত করা, সংগ্রহ করা এবং একত্র করা। যেমন, বলা হয় —- অর্থাৎ অমুক ব্যক্ত লোকদেরকে একত্র করে বা তার কাছে সব লোক জড়ো হয়। একত্রে মিলিত হওয়ার স্থানকে বলা হবে(–) মারাব্ব সংকুচিত হওয়া এবং সংগৃহীত হওয়াকে বলা হবে তারাব্বুব (–)

তিনঃ তত্ত্বাবধান করা, অবস্থার সংশোধন ও পরিবর্তন সাধন করা, দেখাশোনা করা এবং জামিন হওয়া। যেমন, —- এর অর্থ হবে অমুক ব্যক্তি তার সম্পত্তির দেখাশোনা এবং তত্ত্বাবধান করেছে। আবু সুফিয়ানকে সাফওয়ান বলেছিলেনঃ

হাওয়াজেনের কোন ব্যাক্ত আমাকে লালন-পালন করার চেয়ে কোরাইশের কোন ব্যক্তি আমাকে পৃষ্ঠপোষকতায় গ্রহণ করা আমার কাছে অধিক প্রিয়।

আলকামা ইবনে ওবায়দার একটি কবিতাঃ

————————– তোমরা পূর্বে যে সত্তারা আমার মুরুব্বী ছিলো, আমি তাকে খুইয়ে বসেছি, অবশেষে আমার লালন-পালনের ভার তোমার হাতে এসেছে।

কবি ফরযদাক বলেনঃ

————————– এ কবিতায় ———- এর অর্থ, যে চামড়ার লোম পৃথক করা হয় নি, যে চামড়াকে দাবাগত করে পরিষ্কার করা হয়নি। ———————- এর অর্থ হবে-অমুক ব্যক্তি অমুক ব্যক্তির কাছে আপন পেশার কাজ করে অথবা তার কাছে কারিগরী শিক্ষা লাভ করে।

চারঃ প্রাধান্য, কর্তৃত্ব, সর্দারী, হুকুম চালানো, ব্যবহার করা, যথাঃ —————- অর্থাৎ অমুক ব্যক্তি আপন জাতিকে নিজের অনুগত করে নিয়েছে। ——- আমি জাতির ওপর হুকুম চালিয়ে কর্তা সেজে বসেছি। লবীদ ইবনে রবীয়া বলেনঃ

——————- এখানে —- মানে কিন্দার সর্দার, সে কবীলায় যার হুকুম চলতো। এ অর্থেই নাবেঘা যুবইয়ানীর কবিতাঃ

পাঁচঃ মালিক হওয়া। যেমন হাদীস শরীফে আছে, নবী (স) এক ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করেছেন ——- তুমি কি বকরির মালিক, না উটের? এ অর্থে ঘরের মালিককে —- (রব্বুদ্দার) উষ্ট্রীর মালিককে —- (রব্বুন্নাকাহ) এবং সস্পত্তির মালিককে ——– (রববুয-যাইয়াহ) বলা হয়। মুনিব অর্থেও রব শব্দটি ব্যবহৃত হয় এবং আব্দ (–) বা গোলামের বিপরীত অর্থে বলা হয়। অজ্ঞতাবশত রব শব্দকে শুধু পরওয়ারদিগার, প্রতিপালকের অর্থের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। রুবুবিয়াতের সংজ্ঞা দিয়ে বলা হয়েছে- ————— একটি জিনিসকে পর্যায়ক্রমে তরক্কী দিয়ে পূর্ণ অর্থ নয়। এর পূর্ণ ব্যাপকতা পর্যালোচনা করলে জানা যায় যে, শব্দটি নিম্নোক্ত অর্থ সমূহ প্রকাশ করেঃ

একঃ প্রতিপালক, প্রয়োজনীয় বস্তু সরবরাহকারী, তরবিয়ত ও ক্রমবিকাশ দাতা।

দুইঃ জিম্মাদার, তত্ত্বাবধায়ক, দেখাশোনা এবং অবস্থার সংশোধন- পরিবর্তনের দায়িত্বশীল।

তিনঃ যিনি কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেন। যাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন লোক সমবেত হয়।

চারঃ নেতা- সর্দার, যার আনুগত্য করা হয়, ক্ষমতাশালী কর্তা ব্যক্তি, যার নির্দেশ চলে, যার কর্তৃত্ব স্বীকার করে নেয়া হয়, হস্তক্ষেপ ও বল প্রয়োগের অধিকার আছে যার।

পাঁচঃ মালিক-মুনিব।

কোরআনে রব শব্দের ব্যবহার

কোরআন মজীদে রব শব্দটি এসব অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। কোথাও এসবের কোন এক বা দুই অর্থ উদ্দেশ্য; কোথাও এর চেয়েও বেশী, আর কোথাও পাঁচটি অর্থই এক সাথে বোঝান হয়েছে। কোরআনের আয়াত বিভিন্ন উদাহরণ দিয়ে আমরা ও বিয়য়টি স্পস্ট করবো।

প্রথম অর্থেঃ সে বললো, আল্লাহ্র আশ্রয়! যিনি আমাকে ভালোভাবে রেখেছেন, তিনিই তো আমার রব।১-ইউসুফ-২৩

(১) কেউ যেন ধারনা করে না বসে যে, হযরত ইউসুফ (আঃ) আজীজ মিসরকে তাঁর রব বলেছেন। কোন কোন তফসীরকার এমন সন্দেহও করেছেন। মূলত ‘সে’ বলে আল্লাহর দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে, তিনি যাঁর আশ্রয় চেয়েছেন। বলেছেন- ——— আল্লাহ্কে ইঙ্গিত করা হয়েছে তা যখন নিকটে উল্লিখিত রয়েছে, তখন অনুল্লিখিত ‘মুশারুন ইলাইহে’ খুঁজে বেড়াবার দরকার বা কিসের?

দ্বিতীয় অর্থেঃ প্রথম অর্থের ধারণাও যাতে অল্প-বিস্তর শামিল রয়েছেঃ

——————————————————————- বিশ্ব জাহানের রব, যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন, আমাকে পথ প্রদর্শন করেন, পানাহার করান, আমি পীড়িত হলে আরোগ্য দান করেন, তিনি ব্যতীত তোমাদের এ সকল রব তো আমার দুশমন।-শোয়ারা-৭৭-৮০

তোমরা যে নিয়ামত সম্ভোগই লাভ করেছো, তা লাভ করছো আল্লাহর তরফ থেকে। তারপর তোমাদের ওপর কোন বিপদ আপতিত হলে হতচকিত হয়ে তোমরা তাঁর হুজরেই প্রত্যাবর্তন করো। কিন্তু তিনি যখন তোমাদের বিপদ কেটে নেন, তখন তোমাদের মধ্যে এমন কিছু লোক আছে, যারা (নিয়ামত দান ও দুর্যোগ মুক্তিতে) আপন রব-এর সাথে অন্যদেরকেও শরীক করতে শুরু করে। আন- নাহাল-৫৪

——————————————- বল, আল্লাহ ছাড়া আমি কি অপর কোন রব তালাশ করবো? অথচ তিনিই তো হচ্ছেন সব কিছুর রব। -আল-আন আম-১৬৪

————————————– তিনি মাশরিক-মাগরিব-প্রাচ্য-প্রতীচ্যের রব। তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই, সুতরাং তাঁকেই তোমার উকিল (নিজের সকল ব্যাপারে জামিন ও জিম্মাদার) হিসাবে গ্রহণ করো। -আল-মুজ্জাম্মিল- ৯

———————- তিনিই তো তোমাদের রব, তোমরা ঘুরে ফিরে তাঁরই দিকে প্রত্যাবর্তিত হবে।

—————————————— অতপর তোমাদের রব- এর কাছেই তোমাদের প্রত্যাবর্তন।- যুমার-৭

————————- বল, আমাদের উভয় দলকেই একত্র করবেন। -সাবা-২৬

———————————– ———————- যমীনের বুকে বিচরণশীল যতো প্রাণী রয়েছে, আর দুটো পাখায় ভর করে যেসব পাখী উড়ছে, সে সবের মধ্যে এমন কিছুই নেই, যা তোমাদের মতো দল নয়। আমার দপ্তরে কোন বিষয়ে সন্নিবেশেই ত্রুটি করি নি। অবশেষে তাদের সকলকেই আপণ রব-এর দিকে হাঁকিয়ে নেয়া হবে। -আল-আনআম-৩৮

———————————————– সিঙ্গায় ফুঁক দেয়া মাত্রই তারা নিজ নিজ ঠিকানা থেকে আপণ রব-এর দিকে বেরিয়ে পড়বে।-ইয়াসীন-৫১

তৃতীয় ও চতুর্থ অর্থে:

————————- তারা আল্লাহ্র পরিবর্তে নিজেদের দরবেশ, ওলামা-পাদ্রী-পুরোহিতদেরকে নিজেদের রব বানিয়ে নিয়েছে। (তওবা-৩১)

—————- আর আমাদের কেউ যেন আল্লাহ ছাড়া কাউকে নিজের রব না বানায়।

দুটি আয়াতেই আরবাব (রব-এর বহুবচন) অর্থ সে সব ব্যক্তি, জাতি ও জাতির বিভিন্ন দল, যাদেরকে সাধারণভাবে নিজেদের পথ প্রদর্শক ও নেতা স্বীকার করে নেয়া হতো, যাদেরকে রীতিমত আদেশ- নিষেধের অধিকারী মনে করা হতো।

—————————————————- (ইউসুফ বললেন) অবশ্য তোমাদের একজন তার রবকে শরাব পান করাবে-। তাদের দু’জনের মধ্যে যার সম্পর্কে ইউসুফের ধারণা ছিল, সে মুক্তি লাভ করবে। ইউসুফ তাকে বললেনঃ তোমরা রব- এর কাছে আমার কথা বলো। কিন্তু শয়তান তাকে ভুলিয়ে দিলো, তাই আপন রব-এর কাছেইউসুফের কথা উল্লেখ করতে তার স্মরণ ছিল না। (ইউসুফ-৪১-৪২)

———————- বার্তাবাহক ইউসুফের কাছে হাযির হলে ইউসুফ তাকে বললোঃ তোমার রব-এর কাছে ফিরে যাও এবং তাকে জিজ্ঞেস করো, যেসব মহিলারা নিজেরাই নিজেদের হাত কেটেছিল, তাদের কি অবস্থা। আমার রবতো তাদের চক্রান্ত সম্পর্কে ওয়াকিফহাল আছেনই।-ইউসুফ-৫০

এসব আয়াতে হযরত ইউসুফ (আঃ) মিসরীয়দের সাথে কথাবার্তাকালে মিসরের শাসনকর্তা ফিরাউনকে তাদের রব বলে বারবার উল্লেখ করেছেন। কারণ তারা তখন তার কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ব, সার্বভৌমত্ব স্বীকার করতো, তাকে আদেশ-নিষেধের মালিক মনে করেন।

পঞ্চম অর্থেঃ ——————————————————— সুতরাং তাদের উচিত, এ ঘরের মালিকের ইবাদত করা, যিনি তাদের রিজিক সরবরাহের ব্যবস্থা করেছেন এবং ভয়-ভীতি থেকে তাদের নিরাপদ রেখেছেন। কোরাইশ-৩-৪

————– তোমার রব- যিনি সম্মান ও ক্ষমতার মালিক-ওরা তাঁর সম্পর্কে যেসব দোষ- ত্রুটির কথা বলছে, তিনি সেসব থেকে মুক্ত-পবিত্র।

————————- আল্লাহ, যিনি আরশের মালিক-তারা যেসব দোষ-ত্রুটির কথা বলছে তিনি সে সব হতে মুক্ত পবিত্র। আল-আম্বিয়া-২২

———– জিজ্ঞেস কর, সপ্ত আসমান ও মহান আরশের মালিক কে?

——————— তিনি আসমান-যমীন এবং আসমান-যমীনে যা কিছু আছে, তৎসমুদয়ের মালীক। যেসব বস্তুর ওপর সূর্য উদয় হয়, তিনি তারও মালিক।

———— আর তিনিই তো শি’য়রা (নক্ষত্র বিশেষের নাম)-এর মালিক, রব।

রুবুবিয়াত সম্পর্কে পথভ্রষ্ট জাতিসমুহের ভ্রান্ত ধারণা

এসব সাক্ষ্য -প্রমাণ দ্বারা রব শব্দের অর্থ একান্ত সন্দেহাতীতভাবে নির্ণীত হয়েছে। এখন আমাদের দেখা উচিত, রুবুবিয়াত সম্পর্কে গোমরাহ জাতিসমূহের কি সব ভ্রান্ত ধারণা ছিলো, যার অপনোদনের জন্যে কোরআনের আবির্ভাব ঘটেছে এবং কোন্ জিনিসের দিকে কোরআন ডাকছে। কোরআন যেসব গোমরাহ জাতির উল্লেখ করেছে, পৃথক পৃথকভাবে সেসব বিষয়ে আলোচনা করা এ ব্যাপারে অধিক সমীচীন হবে, যাতে বিষয়টি সম্পূর্ণ স্পষ্ট হয়ে ফুটে ওঠে।

নূহ (আঃ) -এর জাতি

কোরআন সর্বপ্রথম যে জাতির উল্লেখ করেছে, তা হচ্ছে হযরত নুহ (আঃ)-এর জাতি। কোরআনের বর্ণনা থেকে স্পষ্ট জানা যায় যে, এরা আল্লাহ্র অস্তিত্বে অবিশ্বাসী ছিল না- তাঁর অস্তিত্ব অস্বীকার করতো না। হযরত নুহ (আঃ) -এর দাওয়াতের জবাবে তাদের এ উক্তি স্বয়ং কোরআনই নকল করছেঃ

————————————————– এ ব্যক্তি তো তোমাদেরই মতো একজন মানুষ বৈ কিছুই নয়, মূলত সে তোমাদের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করতে চায়। তা না হলে আল্লাহ যদি কোন রাসূল প্রেরণ করতে চাইতেন তবে ফেরেশতাই পাঠাতেন।

আল্লাহ যে খালেক-স্রষ্টা, প্রথম ও দ্বিতীয় অর্থে তিনি যে রব তাও তারা অস্বীকার করতো না। হযরত নূহ (আঃ) যখন তাদেরকে বলেছিলেনঃ

——————————– তিনিই তোমাদের রব। তাঁরই নিকট তোমাদের ফিরে যেতে হবে।

——————————————– তোমাদের রব-এর নিকট ক্ষমা চাও; তিনি বড়ই ক্ষমাশীল।

———————————————————————————– তোমরা কি দেখছো না যে, আল্লাহ কিভাবে স্তরে স্তরে সপ্ত আসমান সৃষ্টি করেছেন, আর তার মধ্যে চন্দ্রকে নূর ও সূর্যকে চেরাগ করেছেন, তোমাদেরকে পয়দা করেছেন যমীন থেকে। -নূহ-১৫-১৬

তখন তাদের কেউ এমন কথা বলেনি- আল্লাহ আমাদের রব নয় অথবা আসমান-যমীন ও আমাদেরকে তিনি সৃষ্টি করেন নি অথবা আসমান-যমীনের এসব ব্যবস্থাপনা তিনি পরিচালনা করছেন না।

আল্লাহ তাদের ইলাহ-একথাও অস্বীকার করতো না। এজন্যেই হযরত নূহ (আঃ) তাদের সামনে তাঁর দাওয়াত পেশ করেছেন এ ভাষায়ঃ

———— ‘তিনি ব্যতীত তোমাদের অন্য কোন ইলাহ নেই’;

অন্যথায় তারা যদি আল্লাহ্কে ইলাহ বলে স্বীকার না করতো- তাহলে দাওয়াতের ভাষা হতোঃ

——————- ‘তোমরা আল্লাহকে ইলাহ বলে স্বীকার করো’।

এখন প্রশ্ন দাঁড়ায়, তাহলে তাদের সাথে হযরত নূহ (আঃ) -এর বিরোধ ছিলো কি নিয়ে-কোন বিষয়ে? কোরআনের আয়াত সন্ধান করে জানা যায় যে, বিরোধের কারণ ছিলো দুটিঃ

একঃ হযরত নূহ (আঃ) এর শিক্ষা ছিলো এই যে, যিনি রব্বুল আলামীন, তোমরাও যাকে তোমাদের ও সমগ্র বিশ্ব-জাহানের স্রষ্টা বলে স্বীকার করো, যাকে তোমরা সকল প্রয়োজন পূরণকারী বলে বিশ্বাস করো, কেবল তিনিই তোমাদের ইলাহ-অন্য কেউ নয়। তিনি ব্যতীত আর কোন ইলাহ নেই। তোমাদের অভাব-অভিযোগ পূরণ করতে পারে, সংকট-সমস্যা দূর করতে পারে, দোয়া শুনতে পারে এবং সাহায্যে এগিয়ে আসতে পারে-এমন কোন সত্তা নেই। সুতরাং তোমরা কেবল তাঁরই সামনে মস্তক অবনত করো-তাঁকেই আনুগত্য লাভের যোগ্য বলে স্বীকার করোঃ

————– হে আমার জাতির লোকেরা! তোমরা আল্লাহ্র ইবাদত করো; তিনি ব্যতীত তোমাদের অন্য কোন ইলাহ নেই। ……….. কিন্তু আমি রাব্বুল আলামীনের তরফ থেকে রাসূল। আপন রব-এর পয়গাম তোমাদের নিকট পৌছাই।-আল-আরাফ-৫৯-৬০

অপর পক্ষে তারা জিদ ধরে বসেছিলো, আল্লাহ্র ব্যবস্থাপনায় অন্যদেরও কম-বেশী দখল আছে। তাদের সাথেও আমাদের নানাবিধ প্রয়োজন জড়িত রয়েছে। সুতরাং আমরা আল্লাহ্র সাথে অন্যদেরকেও ইলাহ স্বীকার করবোঃ

————————– তাদের নেতা-কর্তারা বললো, লোক সকল!তোমাদের ইলাহকে কিছুতেই ছাড়বে না-ছাড়বে না ওয়াদ্দ, সুয়া, ইয়াগুস, ইয়াউক ও নাসর-কে।-নূহ-২৩

দুইঃ আল্লাহ তাদের স্রষ্টা-খালেক, আসমান-যমীনের মালিক এবং বিশ্বজাহানের প্রধান ব্যবস্থাপক-নিয়ন্ত্রক-পরিচালক – কেবল এ অর্থেই তারা আল্লাহ্কে রব স্বীকার করতো। কিন্তু তারা এ কথা স্বীকার করতো না যে, নৈতিক চরিত্র, সমাজ, তমুদ্দুন, রাজনীতি ও জীবনের সকল ব্যাপারেও সার্বভৌমত্ব ও সর্বোচ্চ ক্ষমতা লাভের অধিকার একমাত্র তাঁরই, তিনিই পথ প্রদর্শক, আইন প্রণেতা, আদেশ-নিষেধের অধিকার একমাত্র তাঁরই, তিনিই পথ প্রদর্শক, আইন প্রণেতা, আদেশ-নিষেধের অধিকারী; আনুগত্যও হবে একমাত্র তাঁরই, এসব ব্যাপারে তারা নিজেদের সর্দার ও ধর্মীয় নেতাদেরকে রব বানিয়ে নিয়েছিলো। পক্ষান্তরে হযরত নূহ (আঃ) -এর দাবী ছিলো-রুবুবিয়াত অবিভাজ্য, তাকে বিভক্ত ও খন্ডিত করো না। সকল অর্থে কেবল আল্লাহ্কেই রব স্বীকার করো। তাঁর প্রতিনিধি হিসাবে আমি তোমাদের যেসব আইন- বিধান পৌছাই, তোমরা তা মেনে চলোঃ

————————————————- আমি তোমাদের জন্যে আল্লাহ্র বিশ্বস্ত রাসূল। সুতরাং আল্লাহ্ কে ভয় করো এবং আমার আনুগত্য করো। -আশ-শোয়ারা-১০৭-১০৮

আদ জাতি

নূহ (আঃ) -এর জাতির পরে কোরআন আদ জাতির কথা আলোচনা করেছেন। এ জাতিও আল্লাহর অস্তিত্ব অস্বীকার করতো না। হযরত নূহ (আঃ)-এর জাতি যে অর্থে আল্লাহ্কে রব স্বীকার করতো, সে অর্থে এরাও আল্লাহ্কে মানত। অবশ্য দুটি বিষয় বিরোধের ভিত্তি ছিলো, যা ওপরে নূহ (আঃ)-এর জাতির প্রসঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে, কোরআনের নিম্নোক্ত স্পষ্ট ঘোষণা এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট প্রমাণ দিচ্ছেঃ

—————————————– এবং তাদের প্রতি আমরা তার ভাই হূদকে পাঠিয়েছি। তিনি বললেন, হে আমার জাতির লোকেরা! তোমার আল্লাহ্র ইবাদত করো। তিনি ব্যতীত তোমাদের কোন ইলাহ নেই।………… তারা বললো! আমরা কেবল আল্লাহ্র ইবাদত করবো, আমাদের বাপ-দাদার যুগ থেকে যেসব মাবুদের ইবাদত চলে আসছে, তাকে পরিত্যাগ করবো-এর জন্যই কি তোমার আগমন?- আল- আরাফ-৬৫-৭০

—————————– তারা বললো, আমাদের রব ইচ্ছা করলে ফেরেশতা প্রেরণ করতেন।

———————————- এরাই তো আদ, যারা তাদের রব-এর বিধান মানতে অস্বীকার করেছিলো, তাঁর রাসূলের আনুগত্য কবূল করে নি এবং সত্যের দুশমন ঔদ্ধত্যপরায়ণের অনুসরণ করেছিল। হূদ-৫৯

সামুদ জাতি

এবার সামুদ জাতি সম্পর্কে শুনুন। আদের পর এরা ছিলো সবচেয়ে ঔদ্ধত্যপরায়ণ জাতি। নূহ (আঃ) ও আদ জাতির গোমরাহীর কথা আলোচনা করা হয়েছে। মূলত এদের গোমরাহীও ছিলো সে ধরনেরই। আল্লাহ-ই একমাত্র ইলাহ, কেবল তিনিই ইবাদতের অধিকারী, রুবুবিয়াত সকল অর্থে কেবল আল্লাহ্র জন্যেই নির্দিষ্ট – এ কথা তারা স্বীকার করতো না। তারা আল্লাহ ছাড়া অন্যকেও ফরিয়াদ গ্রহণকারী, সংকট মুক্তকারী এবং অভাব পূরণকারী বলে স্বীকার করতে জিদ ধরে বসেছিলো। নিজেদের নৈতিক ও তমুদ্দুনিক জীবনে আল্লাহ ছাড়া সর্দার, মাতব্বর এবং নেতা-কর্তা ব্যক্তিদের আনুগত্য করতে এবং তাদের কাছ থেকে নিজেদের জীবন বিধান গ্রহণ করতে তারা বদ্ধপরিকর ছিলো। শেষ পর্যন্ত এটাই তাদের ফাসাদকারী জাতি-বিপর্যয় সৃষ্টিকারী কওম এবং পরিণামে আজাবে নিপতিত হওয়ার কারণ হয়েছে। নিম্নোক্ত আয়াতসমুহ থেকে এর স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়ঃ

————- (হে মুহাম্মদ !) এরা যদি তোমার আনুগত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় তবে তাদের বলে দাও যে, আদ-সামুদ যে শাস্তি পেয়েছিলো, তেমনি এক ভয়ংকর শস্তি সম্পর্কে আমি তোমাদের ভয় প্রদর্শন করছি। সেসব জাতির নিকট যখন তাদের অগ্র-পশ্চাৎ থেকে রাসূল এসেছিলেন আর বলেছিলেন, আল্লাহ ছাড়া আর কারো ইবাদত-বন্দেগী করো না, তখন তারা বলেছিলো, আমাদের রব ইচছা করলে ফেরেশতা পাঠাতেন; সুতরাং যা কিছু নিয়ে তোমাদের আগমন, আমরা তা মানি না- স্বীকার করি না।

————————————- আর সামুদের প্রতি প্রেরণ করেছিলাম আমরা তাদের ভাই ছালেহকে। তিনি বললেন; হে আমার জাতির ভাইয়েরা! আল্লাহর ইবাদত করো, তিনি ছাড়া তোমাদের কোন ইলাহ নেই। তারা বললো; ছালেহ! আগে তো তোমার সম্পর্কে আমাদের বিরাট আশা ভরসা ছিলো। বাপ -দাদার যুগ থেকে যাদের ইবাদত চলে আসছিলো, তুমি কি আমাদেরকে তাদের ইবাদত থেকে বারণ করছো?- (ছুরা হূদ-৬১-৬২)

———————————————- যখন তাদের ভাই ছালেহ তাদেরকে বলছিলো; তোমাদের কি নিজেদেরকে রক্ষা করার কোন চিন্তা নেই? দেখ, আমি তোমাদের জন্যে আল্লাহর নির্ভরযোগ্য রাসূল। সুতরাং আল্লাহর অসন্তুষ্টি থেকে নিবৃত্ত থাকো, আর আমার আনুগত্য করো। ……. সেসব সীমা লংঘনকারীর আনুগত্য করো না, যারা পৃথিবীতে বিপর্যয় র্সৃষ্টি করে, কোন কল্যাণই সাধন করে না।

ইবরাহীম (আঃ) — এর জাতি ও নমরূদ

এরপর আসে হযরত ইবরাহীম (আঃ) -এর জাতির কথা। এ জাতির ব্যাপারটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সাধারণ্যে একটি ভুল ধারণা প্রচলিত আছে যে, তাদের বাদশা নমরূদ আল্লাহ অস্বীকার করতো এবং নিজেকে খোদা বলে দাবী করতো। অথচ সে আল্লাহর অস্তিত্ব স্বীকার করতো, তাঁকে খালেক-স্রষ্টা এবং বিশ্ব-নিয়ন্তা বলে বিশ্বাস করতো। কেবল তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম অর্থে নিজেকে রব বলে দায়ী করতো। এ ভূল ধারণাও ব্যাপক দেখা যায় যে, এ জাতি আল্লাহ সম্পর্কে সম্পুর্ণ অনবহিত ছিল-তাঁকে রব ও ইলাহ বলে আদৌ স্বীকারই করতো না, অথচ নূহ, আদ-সামুদ থেকে এদের ব্যাপার মোটেই ভিন্ন ছিল না। তারা আল্লাহর অস্তিত্ব স্বীকার করতো। তিনি যে রব, আসমান-জমীনের স্রষ্টা ও বিশ্ব জাহানের নিয়ন্তা-তাও তারা জানতো, তাঁর ইবাদতকেও তারা অস্বীকার করতো না। অবশ্য তাদের গোমরাহী ছিল এই যে, রুবুবিয়াতের প্রথম ও দ্বিতীয় অর্থে তারা গ্রহ-নক্ষত্রকেও অংশীদার মনে করতো, আর এ ভিত্তিতে সে সবকেও আল্লাহর সাথে মাবুদ বলে ধরে নিতো। রুবুবিয়াতের তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম অর্থে তারা নিজেদের বাদশাদেরকে রব বানিয়ে রেখেছিল। এ ব্যাপারে কোরআনের স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন উক্তি সত্ত্বেও মানুষ কি করে আসল ব্যাপারটি বুঝতে পারল না তা দেখে অবাক হতে হয়। সর্বপ্রথম হযরত ইবরাহীম (আঃ) -এর বোধেদয়ের ঘটনাটি দেখুন। এতে তাঁর নবুয়াত-পূর্ব জীবনের সত্যানুসন্ধানের চিত্র অংকিত হয়েছেঃ

——————————————–

রাত যখন তাঁর উপর আঁধারের আবরণ ছড়িয়ে দিলো, তিনি একটি তারকা দেখতে পেলেন, বলে উঠলেন; এই তো আমার রব; কিন্তু তা ডুবে গেলে তিনি বললেন; ডুবন্ত জিনিসকে আমি পছন্দ করি না। আবার যখন দেখলেন, চাঁদ ঝলমল করছে, বললেন; এই তো আমার রব ! কিন্তু তাও যখন ডুবে গেলো, তখন বললেন; আমার রব যদি আমাকে হেদায়েত না করেন তাহলে আশংকা হচ্ছে আমিও সেসব গোমরাহ লোকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়বো। আবার সূর্যকে রওশন দেখে বললেন; এই তো আমার রব-এতো দেখছি সবচেয়ে বড়! কিন্তু তাও যখন ডুবে গেলো তখন তিনি চিৎকার করে বলে উঠলেন; হে আমার জাতির লোকেরা। তোমরা যে শিরক করেছো, তার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। আমি সকল দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে সে মহান সত্তার দিকে একাগ্র মনে নিবিষ্ট হলাম, যিনি আসমান-যমীন সৃষ্টি করেছেন। আমি মুশরিকদের পর্যায়ভুক্ত না। -আল-আনআম-৭৭-৮০

রেখা চিহ্নিত বাক্যাংশগুলো থেকে স্পষ্টত জানা যায় যে, যে সমাজে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) চক্ষু খুলেছিলেন, সে সমাজে আসমান-যমীনের স্রষ্টা মহান সত্তার রব হওয়া এবং সেসব গ্রহ-নক্ষত্রের রুবুবিয়াতের ধারণা এক ছিলো না। এরূপ হবে না কেন, যেসব মুসলমান হযরত নূহ (আঃ) -এর ওপর ঈমান এনেছিলো, তারা ছিলো সে বংশেরই লোক। তাদের নিকটাত্মীয়, প্রতিবেশী জাতিসমূহ (আদ-সামুদা)-এর মধ্যে উপর্যুপরি আম্বিয়া আলাইহিমুস সালামের মাধ্যমে দীন ইসলামের নবায়নের কাজও চলছিলো।

——————————–

সুতরাং আল্লাহ্র আসমান-যমীনের স্রষ্টা এবং রব হওয়ার ধারণা হযরত ইবরাহীম (আঃ) আপন সমাজ থেকেই লাভ করেছিলেন। অবশ্য তাঁর মনে যেসব প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছিলো, তা ছিলো এই যে, প্রতিপালন ব্যবস্থায় আল্লাহ্র সাথে চন্দ্র-সূর্য ও গ্রহ-নক্ষত্রের অংশীদার হওয়ার যে ধারণা তাঁর জাতির মধ্যে পাওয়া যেতো এবং যার ভিত্তিতে তারা ইবাদতেও আল্লাহ্র সাথে শরীক করতো, তা কতটুকু বাস্তবানুগ।১ নবুয়াতের পূর্বে তিনি এ সত্যেরই সন্ধান করে বেড়িয়েছেন, উদয়-অস্ত বিধান তাঁর জন্যে এ বাস্তব তত্ত্বে উপনীত হতে সহায়ক হয়েছে যে, আসমান-যমীনের স্রষ্টা ছাড়া আর কোন রব নেই। এ কারণে চন্দ্রকে ডুবতে দেখে তিনি বলেন, আমার রব অর্থাৎ আল্লাহ্ যদি আমাকে পথ প্রদর্শন না করেন তবে আশংকা হচ্ছে আমিও বাস্তব সত্যে উপনীত হতে ব্যর্থ হবো। আমার আশেপাশের লাখ লাখ মানুষ যেসব দৃশ্য দেখে প্রতারিত হচ্ছে, আমিও তা দ্বারা প্রতারিত হয়ে পড়বো।

অতপর হযরত ইবরাহীম (আঃ) নবুয়াতের পদে অভিষিক্ত হলেন এবং তিনি আল্লাহ্র পথে আহ্বানের কাজ শুরু করেনঃ তখন যে ভাষায় তিনি দাওয়াত পেশ করেন, তা নিয়ে চিন্তা করলে আমাদের উপরিউক্ত উক্তি আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তিনি বলেনঃ

১. এখানে একটি বিষয়ের উল্লেখ অপ্রাসঙ্গিক হবে না। হযরত ইবরাহীম (আঃ) -এর দেশ ‘উর’ সম্পর্কে প্রত্বতাত্ত্বিক খোদাই করে যেসব তথ্য উদঘাটিত হয়েছে, তা থেকে জানা যায় যে, সেখানে চন্দ্র-দেবতার উপাসনা হতো। তাদের ভাষায় একে বলা হতো নান্নার (–) আর তাদের আশেপাশের এলাকায়-যার কেন্দ্র ছিলো লারসা (–) সূর্য দেবতার পূজা হতো। তাদের ভাষায় একে বলা হতো শামাশ (—-)। সে দেশের শাসক বংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিল আরনামু (—)। আরবে গিয়ে তার নাম হয়েছে নমরূদ। তার নামানুসারে সেখানকার উপাধি হয়েছে নমরূদ, যেমন নিযামুল মূলক-এর স্থলাভিষিক্তকে বলা নিযাম।

———————————————- তোমরা যাকে আল্লাহ্র শরীক করছো, শেষ পর্যন্ত আমি তাকে কি করে ভয় করতে পারি? অথচ তোমরা আল্লাহ্র সাথে তাদেরকে শরীক করতে ভয় করছো না, উলুহিয়াত-রুবুবিয়াতে তাদের অংশীদারিত্বের ব্যাপারে আল্লাহ্ তোমাদের প্রতি কোন প্রমাণ নাযিল করেন নি।

——————————- আল্লাহ্ ছাড়া আর যাদের নিকট তোমরা দোয়া করো, আমি তাদের কাছ থেকে হাত গুটিয়ে নিচ্ছি। -মরিয়াম-৪৮

—————————————- সে বললো, তোমাদের রব তো শুধু আসমান যমীনের রব, যিনি এসব কিছু সৃষ্টি করেছেন।… বললো, তবে কি তোমরা আল্লাহ্কে বাদ দিয়ে এসব রবের ইবাদত করছো, তোমাদের কল্যাণ-অকল্যাণের কোন ইখতিয়ারই যাদের নেই?-আল-আম্বিয়া-৫৬-৬৬

———————————– যখন ইবরাহীম তাঁর পিতা এবং জাতিকে বললেন, এ তোমরা কার ইবাদত করছো? আল্লাহ্কে বাদ দিয়ে নিজেদের বানানো ইলাহ’র বন্দোগী করতে চাও? তাহলে রাব্বুল আলআমীন সম্পর্কে তোমাদের কি ধারণা?-সাফ্ফাত-৮৫-৮৭

——————————————- ইবরাহীম ও তাঁর সাথী মুসলমানরা তাঁর জাতির লোকদের পরিষ্কার বলে দিয়েছিলেন, তোমাদের এবং আল্লাহ্ ছাড়া আর যাদের তোমরা ইবাদত করো, তাদের সাথে আমার কোন সম্পর্কে নেই। আমি তোমাদের নিয়ম-নীতি মানতে অস্বীকার করছি। তোমরা যতক্ষন না এক আল্লাহ্র ঈমান আনবে, ততক্ষণ তোমাদের ও আমাদের মধ্যে চিরতরে শত্রুতা ও বিদ্বেষের বুনিয়াদ রচিত হলো।-মুমতাহেনা-৪

হযরত ইবাহীম (আঃ)- এর এসব উক্তি থেকেই স্পষ্ট জানা যায় যে, যারা আল্লাহ সম্পর্কে সর্ম্পূণ অনবহিত ছিলো, তাঁকে রব্বুল আলামীন ও মাবুদ বলে স্বীকার করতো না অথবা যাদের অন্তরে কোন ধারনাই বদ্ধমূল ছিলো না তিনি এমন লোকেদের সম্বোধন করেন নি, বরং তিনি সম্বোধন করেছেন সেসব লোকেদের, যারা আল্লাহ্র সাথে রুবুবিয়াত (প্রথম ও দ্বিতীয় অর্থে) ও উলুহিয়াতে অন্যদেরকেও শরীক করতো। এজন্যেই সমগ্র কোরআনের একটি স্থানেও হযরত ইবরাহীম (আঃ) -এর এমন উক্তিও বিদ্যমান নেই, যাতে তিনি তাঁর জাতিকে আল্লাহ্র অস্তিত্ব এবং তাঁকে ইলাহ-রব স্বীকার করবার চেষ্টা করেছেন, বরং সর্বত্রই তিনি এ দাওয়াত দিয়েছেন যে, আল্লাহ্-ই রব ও ইলাহ।

এবার নমরূদের ব্যাপারটি দেখুন। তার সাথে হযরত ইবরাহীম (আঃ) -এর যে কথাবার্তা হয়েছে, কোরআন তাকে উল্লেখ করেছে এভাবেঃ

————————————— তুমি কি সে ব্যক্তিকে দেখেছো, যে ইবরাহীমের সাথে তার রব-এর ব্যাপারে বিতর্ক করেছে? তা করেছিলো এ-জন্যে যে, আল্লাহ্ তাকে রাষ্ট্র-ক্ষমতা দান করেছিলেন। ইবরাহীম যখন বললেন, জীবন-মৃত্যু যাঁর হাতে তিনি আমার ইখতিয়ারাধীন।ইবরাহীম বললেন, সত্য কথা এই যে, আল্লাহ্ পূর্ব দিক থেকে সূর্য উদিত করেন এবার দেখি, তুমি তা পশ্চিম দিক থেকে উদিত করাও তো! একথা শুনে সে কাফের হতভম্ব হয়ে পড়লো।-বাকারা-২৫৮

এ কথাবার্তা থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, আল্লাহ্ আছেন বা নেই-তা নিয়ে বিরোধ ছিলো না, বরং বিরোধ ছিলো ইবরাহীম (আঃ) কাকে রব স্বীকার করেন, তা নিয়ে। যে জাতি আল্লাহ্র অস্তিত্ব স্বীকার করতো, প্রথমত, সে জাতির সাথে নমরূদের সম্পর্ক ছিলো। দ্বিতীয়ত, একেবারেই পাগল না হয়ে যাওয়া পযর্ন্ত সে এমন স্পষ্টত নির্বোধসুলভ উক্তি করতে পারে না যে,সে নিজেই আসমান-যমীনের স্রষ্টা, চন্দ্র-সূর্যের আবর্তন-বিবর্তনকারী। আমিই আল্লাহ্, আসমান যমীনের রব-মূলত তার এ দাবী ছিল না, বরং তার দাবী ছিল এই যে, আমি সে রাজ্যের রব, ইবরাহীম যে রাজ্যের সদস্য। রুবুবিয়াতের প্রথম ও দ্বিতীয় অর্থেও নিজের রব হওয়ার এ দাবী তার ছিলো না; কারণ এ অর্থের সে নিজেই চন্দ্র-সূর্য এবং গ্রহ-নক্ষত্রের রব আল্লাহ্কে স্বীকার করতো। অবশ্য তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম অর্থে সে নিজেকে নিজ রাজ্যের রব বলে দাবী করতো অর্থাৎ তার দাবী ছিলো এই যে, আমি এ রাজ্যের মালিক, রাজ্যের সকল অধিবাসী আমার বান্দা-দাসানুদাস। আমার কেন্দ্রীয় ক্ষমতা তাদের সম্মিলনের ভিত্তিমূল। আর আমার নির্দেশ -ফরমান তাদের জন্যে আইন-বিধান। তার রুবুবিয়াতের দাবীর ভিত্তি ছিলো বাদশাহীর অহমিকা,————– (এজন্যে যে, আল্লাহ্ তাকে রাজ্য-ক্ষমতা দান করেছেন) বাক্যটি এ দিকে স্পষ্ট ইঙ্গিত করছে। সে যখন জানতে পারলো যে, তার রাজ্যে ইবরাহীম নামক জনৈক নওজোয়ানের আবির্ভাব হয়েছে, সে চন্দ্র-সূর্য ও গ্রহ-নক্ষত্রের অতি প্রাকৃতিক রুবুবিয়াত স্বীকার করে না, স্বীকার করে না যুগসম্রাটের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক রুবুবিয়াত তখন অবাক-স্তম্ভিত হয়ে সে হযরত ইবরাহীম (আঃ) -কে ডেকে জিজ্ঞেস করলো, তাহলে তুমি কাকে রব বলে স্বীকার করো? হযরত ইবরাহীম (আঃ) প্রথমে বললেন, আমার রব তিনি, জীবনমৃত্যুর ইখতিয়ার যার হস্তে নিহিত। কিন্তু এ জবাব শুনে সে ব্যাপারটির গভীর প্রবেশ করতে পারলো না। এ বলে সে আপন রুবুবিয়াত প্রতিষ্ঠিত করতে চেষ্টা করলো যে, জীবন-মৃত্যুর ইখতিয়ার তো আমারও আছে; যাকে খুশী হত্যা করতে পারি, আর যাকে খুশী জীবন দান করতে পারি। তখন ইবারাহীম (আঃ) তাকে বললেন, আমি কেবল আল্লাহ্কেই রব বলে স্বীকার করি; রুবুবিয়াতের সকল অর্থের বিচারে কেবল আল্লাহ্ই আমার রব। বিশ্বজাহানের পরিচালনা ব্যবস্থায় অন্য কারো রুবুবিয়াতের অবকাশ-ই বা কোথায়? সূর্যের উদয়-অস্তে তাদের তো বিন্দুমাত্রও প্রভাব নেই-নেই কোন কর্তৃত্ব। নমরূদ ছিল ধূরন্ধর। এযুক্তি শোনে তার কাছে এ সত্য উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো যে, বস্তুত আল্লাহ্র এ রাজ্যে তাঁর রুবুবিয়াতের দাবী বাতুলতা বৈ কিছুই নয়! তাই সে হতভম্বঃ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লো। কিন্তু আত্মশ্লাঘা এবং ব্যক্তিগত ও বংশগত স্বার্থের মোহ স্বেচ্ছাচারী রাজত্ব-কর্তৃত্বের আসন ত্যাগ করে আল্লাহ্ ও তার রসূলের আনুগত্য গ্রগণ করার জন্যে উদ্বুদ্ধ হলো না। এ কারণেই কথাবার্তা উল্লেখ শেষে আল্লাহ্ তায়ালা বলেনঃ

————- কিন্তু জালেম জাতিকে আল্লাহ্ হেদায়েত দান করেন না। অর্থাৎ সত্য উদ্ভাসিত হওয়ার পর তার যে পন্থা অবলম্বন করা উচিত ছিলো, তা অবলম্বরন করতে সে যখন প্রস্তুত হলো না, বরং ঔদ্ধত্যপরায়ণ কৃর্তত্ব দ্বারা সে যখন দুনিয়া ও আপন আত্মার ওপর যুলুম করাই শ্রেয় জ্ঞান করলো, তখন আল্লাহ্ও তাকে হেদায়েতের আলো দান করলেন না। কারণ যে ব্যক্তি হেদায়েত লাভ করতে আগ্রহী নয়, তার ওপর জোর করে হেদায়েত চাপিয়ে দেয়া আল্লাহ নীতি নয়।

লুত জাতি

হযরত ইবরাহীম (আঃ) -এর জাতির পর আমাদের সামনে আসে এমন এক জাতি যাদের সংস্কার–সংশোধনের জন্য হযরত ইবরাহীম (আঃ) -এর ভাইপো হযরত লূত (আঃ) আদিষ্ট হয়েছিলেন। এ জাতি সম্পর্কেও আমরা কোরআন থেকে জানেত পারি যে, তারা আল্লাহ্র অস্তিত্ব অস্বীকার করতো না। আল্লাহ্ স্রষ্টা এবংপ্রথম ও দ্বিতীয় অর্থে রব-এ কথাও তারা অস্বীকার করতো না। অবশ্য তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম অর্থে তাঁকে রব স্বীকার করে তাঁর বিশ্বস্ত প্রতিনিধি হিসাবে রসূলের নেতৃত্ব গ্রহণ করতে তাদের আপত্তি ছিলো। নিজেদের মনের অভিলাষ অনুযায়ী যেভাবে খুশী তারা কাজ করতে চাইতো, এ -ই ছিলো তাদের মূল অপরাধ। এ কারণেই তারা আজাবে নিপতিত হয়েছিলো। কোরআনের নিম্নোক্ত স্পষ্টোক্তি তার প্রমাণঃ

———————————– যখন তাদের ভাই লূত তাদের বললো, তোমরা কি তাকওয়া অবলম্বন করবে না? দেখ, আমি তোমাদের জন্যে বিশ্বস্ত রসূল। সুতরাং আল্লাহ্র গজব থেকে বিরত থাকো এবং আমার আনুগত্য কর। এ কাজের জন্যে আমি তোমাদের কাছে কোন বিনিময় চাই না। আমার বিনিময় তো কেবল আল্লাহ্ রববুল আলামীনের জিম্মায়। দুনিয়ার মানুষের মধ্যে তোমরা কি কেবল ছেলেদের নিকটই ছুটে যাও? তোমাদের রব তোমাদের জন্যে যে নারী সৃষ্টি করেছেন, তাদের পরিত্যাগ কর? তোমরা তো দেখছি একান্তই সীমালংঘনকারী জাতি!-আশ-শোয়ারা-১৬১-১৬৬

এ কথা স্পষ্ট যে, আল্লাহ্র অস্তিত্ব তিনি যে স্রষ্টা ও প্রতিপালক তা অস্বীকার করে না- এমন জাতির উদ্দেশ্যই এ সম্বোধন হতে পারে। তাই আমরা দেখতে পাই, জবাবে তারাও বলে নি যে, আল্লাহ্ আবার কি জিনিস অথবা কে সে স্রষ্টা অথবা সে আবার কোথা থেকে আমাদের রব সেজে বসলো? বরং তারা বলছেঃ

————————- লূত! তুমি যদি তোমার বক্তব্য থেকে নিবৃত্ত না হও, তা হলে দেশ থেকে বিতাড়িত হবে। -আশ-শোয়ারা-১৬৭

অন্যত্র এ ঘটনা এভাবে বিবৃত হয়েছে:

——————————————— “ আর আমরা লূতকে প্রেরণ করেছি! য”খন তিনি নিজের জাতিকে বললেন; তোমরা এমন দুষ্কর্ম করছো, যা তোমাদের আগে দুনিয়ায় কেউ করে নি। তোমরা কি পুরুষদের সাথে যৌন-কর্ম করছো? রাস্তায় লুন্ঠন চালাও এবং প্রকাশ্য মজলিসে একে অন্যের সামনে কুকর্ম কর? তখন তাঁর জাতির জবাব এছাড়া আর কিছুই ছিলো না- তুমি সত্য হলে আমাদের ওপর আল্লার আজাব নিয়ে এসো। -আনকাবুত-২৮-২৯ কোন আল্লাহ্ বিরোধী জাতির কি এ জবাব হতে পারে? সুতরাং জানা কথা যে, উলুহিয়াত ও রুবুবিয়াত-অস্বীকার করা তাদের আসল ছিলো না, বরং তাদের মূল “অপরাধ ছিল এই যে, অতি- প্রাকৃতিক অর্থে তারা আল্লাহ্কে ইলাহ ও রব বলে স্বীকার করলেও নৈতিকথা, তমুদ্দুন ও সমাজ জীবনে আল্লাহ্র আনুগত্য রাসূলের হেদায়াত অনুযায়ী চলতে প্রস্তুত ছিলো না তারা।

শোয়াইব জাতি

এবার মাদইয়ান ও আইকাবাসীদের কথা ধরুন। এদের প্রতি হযরত শোয়াবই (আঃ) প্রেরিত হয়েছিলেন। এদের সম্পর্কে আমরা জানি এরা হযরত ইবরাহীম (আঃ) -এর বংশধর ছিলো। সুতরাং তারা আল্লাহ্র অস্তিত্বে বিশ্বাস করতো কিনা? তাঁকে ইলাহ-রব স্বীকার করতো কিনা? সে প্রশ্নই ওঠে না। বম্তুত তাদের পজিশন ছিলো এমন জাতির, ইসলাম থেকেই যাদের সূচনা হয়েছিলো, পরে আকীদা-বিশ্বাস ও কর্মের বিকৃতিতে পড়ে তারা পরিবর্তিত হয়ে যায় বরং তারা মুমিনের দাবীদারছিলো বলেও কোরআন থেকে অনেকটা মনে হয়। তাইতো আমরা দেখতে পাই, হযরত শোয়াইব (আঃ) তাদের বারবার বলেছেন, ‘তোমরা মুমিন হলে, তোমাদের এ করা উচিত।’ হযরত শোয়াইব (আঃ) -এর সকল বক্তৃতা এবং তাদের জবাবসমূহ দৃষ্টে স্পষ্টত প্রতীয়মান হয় যে, তারা এমন এক জাতি ছিল, যারা আল্লাহ্কে মানতো। তাঁকে মাবুদ-পরওয়ারদেগারও স্বীকার করতো। অবশ্য দু’ধরনের গোমরাহীতে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছিলো। একঃ অতি প্রাকৃতিক অর্থে তারা আল্লাহ্ ছাড়া অন্যদেরকেও ইলাহ ও রব মনে করে বসেছিলো, তাই তাদের ইবাদত নিছক আল্লাহ্র জন্যে নিদির্ষ্ট ছিলো না। দুইঃ তাদের মতে, মানুষের নৈতিক চরিত্র, সমাজ-নীতি, অর্থনীতি ও রাজনীতি-সংস্কৃতির সাথে আল্লাহ্র রুবুবিয়াতের কোন সম্পর্ক ছিল না। এজন্যেই তারা বলতো যে, তমুদ্দনিক জীবনে আমরা স্বাধীন। যেভাবে খুশী, নিজেদের কাজ-কর্ম আঞ্জাম দেবো।

কোরআনের নিম্নোক্ত আয়াতগুলো আমাদের এ উক্তির যথার্থতা প্রতিপন্ন করেঃ

——————– এবং মাদইয়ানের প্রতি আমরা তাদের ভাই শোয়াইবকে প্রেরণ করেছি। তিনি বললেন হে আমার জাতির ভাইয়েরা! আল্লাহ্র ইবাদত কর; তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোন ইলাহ নেই। তোমাদের রব-এর তরফ থেকে তোমাদের কাছে স্পষ্ট হেদায়েত এসেছে। সুতরাং ওজন-পরিমাপ ঠিক করে করবে। লোকেদেরকে তাদের জিনিস কম দেবে না। যমীনে শান্তি-শৃংখলা স্থাপিত হওয়ার পর বিপর্যয় সৃষ্টি করো না। তোমরা যদি মুমিন হও, এতেই তোমাদের জন্যে কল্যাণ নিহিত রয়েছে…. যে হেদায়েতসহ আমি প্রেরিত হয়েছি, তোমাদের একটি ক্ষুদ্র দলও যদি তার ওপর ঈমান আনে, আর অন্যরা ঈমান না আনে তবে অপেক্ষা কর যতক্ষন না আল্লাহ্ আমাদের মধ্যে ফয়সালা করেছেন। আর তিনিই তো হচ্ছেন উত্তম ফয়সালাকারী। আল-আরাফ ৮৫-৮৭ ——————————————————-

হে আমার জাতির লোকেরা! মাপে-ওজনে ইনসাফ কায়েম করো, ঠিক ঠিকভাবে মাপ-ওজন করো, লোকদেরকে জিনিসপত্র কম দেবো না। জমীনে বিপর্যয় সৃষ্টি করে বেড়ায়োনা। আল্লাহ্র অনুগ্রহে কাজ-কারবারে যা অবশিষ্ট থাকে তা-ই তোমাদের জন্যে উত্তম, যদি তোমরা মুমিন হও। আমি তো তোমাদের ওপর পাহারাদার -রক্ষক নই। তারা জবাব দিলোঃ শোয়াইব! বাপ-দাদার কাল থেকে যে সকল মাবুদের ইবাদত চলে আসছে, আমরা তাদের ইবাদত ত্যাগ করি-তোমর নামায কি তোমাকে এ নির্দেশই দিচ্ছি? আমাদের মর্জি মতো ধন-সম্পদ ভোগ-ব্যবহার করা ত্যাগ করবো? কেবল তুমিই তো একজন ধৈর্যশীল ও ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তি হিসাবে অবশিষ্ট রইলে! -সূরা-হুদ-৮৫-৮৬

রুবুবিয়াত ও উলুহিয়াতের ব্যাপারে তাদের আসল গোমরাহী কি ছিলো, শেষের চিহ্নিত লাইনগুলো তা স্পষ্ট করে তুলে ধরছে।

ফেরাঊন ও তার জাতি

এবার আমরা ফিরাঊন ও তার জাতির কথা আলোচনা করবো। এ ব্যাপারে নমরূদ ও তার জাতির চেয়েও বেশী ভুল ধারণা পাওয়া যায়। সাধরণ ধারণা এই যে, ফিরাউন কেবল আল্লাহ্র অস্তিত্বেই ছিলো না, বরং নিজে খোদা বলে দাবীও করেছিলো। অর্থাৎ তার মস্তিষ্ক এতো খারাপ হয়ে গিয়েছিলো যে, সে দুনিয়ার সামনে প্রকাশ্যে দাবী করেছিলো, আমি আসমান যমীনের সৃষ্টিকর্তা। আর তার জাতি এমন পাগল হয়ে গিয়েছিলো যে, তার এ দাবীর প্রতি তারা ঈমান এনেছিলো। অথচ কোরআন ও ইতিহাসের সাক্ষ্য থেকে প্রকৃত তত্ত্ব অবগত হওয়া যায়। তা এই যে, উলুহিয়াত ও রুবুবিয়াতের ব্যাপারে তার গোমরাহী নমরূদের গোমরাহীর চেয়ে স্বতন্ত্র ছিলো না, তার জাতির গোমরাহীও নমরূদের জাতির গোমরাহীরর চেয়ে ভিন্ন ছিলো না। পার্থক্য শুধু এটুকু ছিলো যে, রাজনৈতিক কারণে বনী ইসরাঈলদের সাথে জাতিপূজাসূলভ একগুঁয়েমী এবং পক্ষপাতমূলক হঠকারিতা সৃষ্টি হয়ে যায়। তাই নিছক বিদ্বেষবশত আল্লাহ্র রব ও ইলাহ বলে গ্রহণ করতে অস্বীকার করা হয়। অবশ্য অন্তরে তাঁর স্বীকৃতি লুক্কায়িত ছিলো। যেমন আজকালকার অধিকাংশ জড়বাদীরা করে থাকে।

আসল ঘটনা এই যে, হযরত ইউসুফ (আঃ) মিশরে ক্ষমতা লাভ করে ইসলামী শিক্ষা বিস্তারের জন্যে সর্বশক্তি নিয়োজিত করেন। তিনি মিশর ভূমিতে এত অধিক ছাপ অংকিত করেন, যা কিছুতেই কেউ নিশ্চিত করতে পারে না। তখন মিসরের সকল অধিবাসী হয়তো সত্য দীন কবুল করে নি, কিন্তু তাই বলে মিসরের কোন ব্যক্তি আল্লাহ্কে জানতে না, তিনিই আসমান-যমীনের স্রষ্টা একথা মানতো না, এটা অসম্ভব। শুধু তাই নয়, বরং তাঁর শিক্ষার অন্তত এতটুকু প্রভাব প্রত্যেক মিসেরবাসীর ওপর থাকবে যে, অতি প্রাকৃতিক অর্থে সে আল্লাহ্কে ‘ইলাহুল ইলাহ’ ও ‘রবুল আরবাব’ বলে স্বীকার করতো। কোন মিসরবাসীই আল্লাহ্র উলুহিয়াতের বিরোধী ছিলো না। অবশ্য তাদের মধ্যে যারা কুফরীতে অবিচল ছিলো তারা উলুহিয়াত ও রুবুবিয়াতে আল্লাহ্র সাথে অন্যদেরকেও অংশীদার করতো। হযরত মূসা (আঃ) -এর আবির্ভাব পর্যন্ত এর প্রভাব অবশিষ্ট ছিলো।১ ফিরাউনের দরবারে জনৈক কিবতী সরদার যে ভাষণ দিয়েছিলো, তা থেকেই এর স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। ফিরাউন হযরত মূসা (আঃ)-কে হত্যা করার অভিপ্রায় প্রকাশ করলে তার দরবারের এই আমীর-যিনি গোপনে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন- অস্থির হয়ে বলে ওঠলেনঃ

—————————————-

১ তাওরাতের ঐতিহাসিক বর্ণনায় নির্ভর করলে ধারণা করা যায় যে, মিসরের মোট জনসংখ্যায়র প্রায় এক পঞ্চমাংশ ইসলাম গ্রহণ করেছিলো। তওরাতে বনী-ইসরাঈলের যে আদমশুমারী সন্নিবেশিত হয়েছে তার আলোকে বলা চলে, হযরত মূসা (আঃ)-এর সাথে যারা মিসর ত্যাগ করেছিলো, তাদের সংখ্যা ছিলো প্রায় ২০ লক্ষ। মিসরের জনসংখ্যা তখন এক কোটির বেশী ছিলো না। তওরাতে এদের সকলকে বনী-ইসরাঈল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু হযরত ইয়াকুব (আঃ) -এর ১২ পুত্রের সন্তানরা পঁচিশ বছরে বৃদ্ধি পেয়ে ২০ লক্ষে পৌছেছিলো-কোন হিসাবেই তা সম্ভব বলে মনে হয় না। সুতরাং অনুমিত হয় যে, মিসরের জনগণের এক বিরাট অংশ ইসলাম গ্রহণ করে বনী-ইসরাঈলে শামিল হয়ে থাকবে। দেশ ত্যাগ কালে এ মিসরীয় মুসলমানরাও ঈসারাঈলীদের সাথে যোগ দিয়েছিলো। হযরত ইউসুফ (আঃ) ও তাঁর প্রতিনিধিরা মিসরে যে প্রচারমূলক কাজ করেছিলেন, এ থেকেই তা অনুমান করা যায়।

————————————

“আল্লাহ্ আমার রব”-একথা বলার অপরাধে তোমরা কি লোককে হত্যা করছো? অথচ সেতো তোমাদের সামনে স্পষ্ট নিদর্শনসমূহ নিয়ে এসেছে। সে যদি মিথ্যাবাদী হয়, তবে যেসব পরিণতি সম্পর্কে সে তোমাদের ভয় দেখাচ্ছে তার কিছু না কিছু তোমাদের ওপর অবশ্যই বর্তাবে। সীমাতিক্রমকারী মিথ্যাবাদীকে আল্লাহ্ কল্যাণের পথ দেখান না- একথা সত্য জানো। হে আমার জাতির লোকেরা! আজ রাষ্ট্র-ক্ষমতা তোমাদের হাতে, যমীনে আজ তোমরা প্রবল বিজয়ী। কিন্তু কাল আমাদের ওপর আল্লাহ্র আজাব আপতিত হলে কে আমাদেরকে রক্ষা করবো? হে আমার জাতির লোকেরা! আমি আশংকা করছি, বড় বড় জাতির ওপর যেদিন গজব আপতিত হয়েছিলো তাদের যে পরিণতি হয়েছিলো, তোমাদেরও যেন সে পরিণতি না হয়।…. এর পূর্বে ইউসুফ তোমাদের কাছে স্পষ্ট নিদর্শন নিয়ে হাযির হলে তাঁর উপস্থাপিত বিষয়ে তোমরা সংশয়ে পড়ে রইলে। পড়ে তাঁর তিরোধার হলে তোমরা বললে, আল্লাহ্ তার পরে কোন রসূলই পাঠাবেন না। …হে আমার জাতির লোকেরা! আমি তোমাদেরকে মুক্তির দিকে-এতো দেখছি এক অবাক কান্ড! তোমরা আমাকে ডাকছো, আল্লাহ্র সাথে আমি যেন কুফরী করি, তাঁর সাথে আমি যেন তাদেরকেও শরীক করি, যাদের শরীক হওয়ার আমার কাছে কোন বিজ্ঞানভিত্তিক প্রমাণ নেই। আর আমি তোমাদের ডাকছি তাঁর দিকে, যিনি মহা পরাক্রমশালী ও অতি ক্ষমাশীল। -(আল-মুমিন-২৮-৪২)

কয়েক শতাব্দী অতিবাহিত হওয়ার পরও হযরত ইউসুফ (আঃ) – এর মহান ব্যক্তিত্বের প্রভাব তখনও বিদ্যমান ছিলো – এ দীর্ঘ ভাষণ থেকে এ কথার প্রমাণ পাওয়া যায় এ মহান নবীর শিক্ষা দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার ফলে যে জাতি অজ্ঞতার এমন স্তরে ছিলো না, যাতে আল্লাহর অস্তিত্ব সম্পর্কেই তারা অনবহিত ছিলোও অথবা তারা জানতো না যে, আল্লাহই ইলাহ ও রব; প্রাকৃতিক শক্তির ওপর তাঁর প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত। তাঁর গজবও একটা ভয় করার বিষয়-একথাও যে তারা জানাতো না, তা নয়। সে জাতি যে, আল্লাহর উলুহিয়াত ও রুবুবিয়াতে আদৌ অবিশ্বাসী ছিলো না- ভাষণের শেষাংশ থেকে একথাও স্পষ্ট জানা যায়, বরং তাদের গোমরাহীর কারণ তা ছিলো, যা অন্যান্য জাতির গোমরাহী সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে অর্থাৎ উলুহিয়াত ও রুবুবিয়াতে আল্লাহর সাথে অন্যান্যের শরীক করা। যে কারণে সন্দেহ সৃষ্টি হয় তা এই যে, হযরত মূসা (আঃ) – এর ভাষায় ————————– -নিশ্চয়ই আমি রাব্বুল আ’লামীনের রাসুল -একথা শুনে ফিরাউন জিজ্ঞেস করেছিলো, ——– -রাব্বুল আলামীন আবার কি বস্তু? স্বীয় উজীর হামানকে সে বলেছিলো; আমি যাতে মূসার খোদাকে দেখতে পারি, আমার জন্য একটা উঁচু প্রাসাদ নির্মাণ করো। হযরত মূসা (আঃ) – কে ধমক দিয়ে বললো, আমি ছাড়া অন্য কাউকে ইলাহ বানালে তোমাকে বন্দী করবো। সারা দেশে ঘোষণা করে দিয়েছিলো যে, আমি তোমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ রব। আপন সভাসদদের বলেছিলো, আমি নিজেকে ছাড়া অন্য কাউকে তোমাদের ইলাহ বলে জানি না। এহেন বাক্যাবলী দৃষ্ট মানুষ ধারণা করে বসেছে যে, সম্ভবত ফিরাউন আল্লাহর অস্তিত্বই অস্বকার করতো, রব্বুল আলামীনের কোন ধারণাই তার মনে ছিলো না। কেবল নিজেকেই একমাত্র মাবুদ বলে মনে করতো। কিন্তু আসল ব্যাপার এই যে, তার এ সকল উক্তিই ছিলো জাতীয়তাবাদী হঠকারিতার কারণে। হযরত ইউসূফ (আঃ) এর যামানায় তাঁর প্রবল ব্যক্তিত্বের প্রভাবে ইসলামের শিক্ষা মিসরভুমিতে প্রসার লাভ করেছিলো, শুধু তাই নয়, বরং রাষ্ট্রের শাসন ক্ষমতায় তাঁর যে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠত হয়েছিলো, তার ফলে বনী-ইসরাঈল মিসরে বিরাট প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিল। বনী ইসরাঈলীদের এ ক্ষমতা দীর্ঘ তিন -চার শ’ বছর যাবৎ মিসরে প্রতিষ্ঠিত ছিলো। অতপর সেখানে বনী ইসরাঈলীদের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী ভাবধারা জন্মলাভ করতে থাকে। অবশেষে তাদের ক্ষমতা উৎপাটিত হয়। মিসরের জাতীয়তাবাদী একটি বংশ শাসকের আসনে অধিষ্টিত হয়। এই নয়া শাসকদল কেবল বনী-ইসরাইলদের দমন-মূলোৎপাটন করেই ক্ষান্ত হলো না বরং হযরত ইউসুফ (আঃ) – এর শাসনকালের এক একটি চিহ্ন বিলীন করে নিজেদের প্রাচীন জাহেলী ধর্মের ঐতিহ্যকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস পায়। এ অবস্থায় হযরত মূসা (আঃ) – এর আবিভাব ঘটলে তারা আশংকা করলো, আবার শাসন-ক্ষমতা যেন আমাদের হাতছাড়া হয়ে না যায়! এ বিদ্বেষ ও হটকারিতার কারণেই ফিরাউন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে হযরত মূসা (আঃ) -কে জিজ্ঞেস করেছিলো, রব্বুল আলামীন আবার কে? আমি ছাড়া আর কে ইলাহ হতে পারে? আসলে সে রব্বূল আলামীন সম্পর্কে অনবহিত ছিলো না। তার ও তার সভাসদদের যেমন কথোপকথন এবং হযরত মূসা (আঃ) -এর যে ভাষণ-বিবৃতি কোরআনে উল্লিখিত হয়েছে, তা থেকে এ সত্য একান্ত স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়। মূসা (আঃ) আল্লাহর পয়গম্বর নয়-দরবারের লোকদের এ ধারণা দেয়ার জন্যে একদা সে বলেছিলোঃ

————————————————————- তাহলে তার জন্যে সোনার কঙ্কন অবতীর্ণ হয় নি কেন অথবা দলবদ্ধ হয়ে তার সাথে কেন ফেরেশতা আগমন করে নি? – আয-যুখরোফ-৫৩

যার মনে আল্লাহ ও ফেরেশতার কোন ধারণা নেই – সে ব্যক্তি কি এমন কথা বলতে পারে? অপর এক প্রসঙ্গে ফিরাউন ও হযরত মূসা (আঃ) – এর মধ্যে নিম্মোক্ত কথোপকথন হয়ঃ

——————————————————————– তখন ফিরাউন তাকে বললো; মূসা! আমার মনে হচ্ছে, তুমি যাদুগ্রস্ত হয়ে পড়েছো, তোমার জ্ঞান-বুদ্ধি লোপ পেয়েছে! মূসা জবাব দিলেন; তুমি ভালভাবেই জানো যে, এসব শিক্ষাপ্রদ নির্দশনরাজি আসমান-যমীনের রব ছাড়া অন্য কেউ নাযিল করে নি। আমার মনে হচ্ছে, ফিরাউন! তোমার বিপদ ঘনিয়ে এসেছে। – বনী-ইসরাঈল-১০১-১০২

অন্যত্র আল্লাহ তায়ালা ফিরাউনের দলের লোকদের চিত্তের অবস্থা বর্ণনা করে বলেছেনঃ

——————————————————– তারপর তাদের সামনে আমাদের নিদর্শনসমূহ বাহ্যত স্পষ্ট হয়ে উঠলে তারা বললো, এ তো দেখছি স্পষ্ট যাদু! তাদের অন্তর ভেতর থেকে ভালভাবেই তা স্বীকার করতো, কিন্তু নিছক দুষ্টামি, অভিমান ও অবাধ্যতার কারণেই তারা তা মানতে অস্বীকার করলো। – আল-নামল-১৩-১৪

অপর একটি অধিবেশনের চিত্র অংকন করছে কোরআন এবাবেঃ —————————————————- মূসা তাদের বললেন; তোমাদের জন্যে আফসোস! তোমরা আল্লাহর ওপর মিথ্যা দোষারোপ করো না। এমন কাজ করলে তিনি কঠিন আজাবে তোমাদেরকে ধবংস করে ছাড়বেন। আল্লাহর ওপর যেই মিথ্যা দোষারোপ করেছে, সে ব্যর্থকামই হয়েছে। এ কথা শুনে তারা নিজেরা পরস্পরে বিবাদ-বিসম্বাদে পড়ে গেলো! গোপনে পরামর্শ করলো! এতে অনেকে বললো; এরা দু’জন (মূসা ও হারূন) তো যাদুকর! তারা যাদুবলে তোমাদেরকে দেশছাড়া করতে চায়, আর চায় তোমাদের আদর্শ (অনুকরণীয়) জীবন ব্যবস্থাকে নিশ্চিহ্ন করতে। -ত্ব-হা-৬১-৬৩

স্পষ্ট যে আল্লাহ তায়ালার আজাব সম্পর্কে ভীতি প্রদশৃন এবং মিথ্যা আরোপের পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করার পর তাদের মধ্যে বাক-বিতন্ডা সৃষ্টি হয় -এজন্যে যে, তাদের অন্তরে আল্লাহর ভয়-ভীতি এবং তাহার মাহাত্ম্যের প্রভাব অল্পবিস্তর বিদ্যমান ছিলো। কিন্তু তাদের জাতীয়তাবাদী শাসকশ্রেণী রাজনৈতিক বিপ্লবের হুমকি দিয়ে যখন বললো যে, মুসা-হারুন (আঃ) এর বক্তব্য স্বীকার করে নেয়ার পরিনতি এ দাঁড়াবে যে, মিসর পুনরায় ইসরাঈলের করতলগত হয়ে পড়বে। এ কথা শুনে তাদের হৃদয় আবার কঠোর হয়ে গেলো। সকলেই রাসূলের বিরোধিতা করার জন্যে সংকল্পবদ্ধ হলো।

এ সত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর আমরা সহজে দৃঢ়তার সাথে বলতে পারি যে, হযরত মূসা (আঃ) ও ফিরাউনের মধ্যে কি নিয়ে মূল বিরোধ ছিলে, ফিরাউন ও তার কওমের আসল গোমরাহী-ই বা কি ধরনের ছিলো। কোন অর্থে ফিরাউন উলুহিয়াত -রুবুবিয়াতের দাবীদার ছিল। এ উদ্দেশ্যে কোরআনের নিম্নোক্ত আয়াতগুলো এক এক করে প্রণিধান করুনঃ

একঃ ফিরাউনের সভাসদদের মধ্যে যারা হযরত মূসা (আঃ) -এর দাওয়াতের মূলোৎপাটনের ওপর গুরুত্বারোপ করতো, তারা এই উপলক্ষে ফিরাউনকে সম্বোধন করে বলছেঃ

———————————- আপনি কি মুসা আর তার কওমকে ছেড়ে দেবেন যে, তারা আপনাকে ও আপনার ইলাহগুলোকে পরিত্যাগ করে দেশের অভ্যন্তরে বিপর্যয় সৃষ্টি করে বেড়াবে? -আল-আ’রাফ-১২৭

অপরদিকে সেসব সভাসদদের মধ্যে যে ব্যক্তিটি হযরত মূসা (আঃ) -এর প্রতি ঈমান এনেছিলো, সে তাদেরকে লক্ষ্য করে বলেছেঃ

———————————————– তোমরা কি আমাকে সেদিন ডাকছো, যাতে আমি আল্লাহ্র সাথে কুফরী করি;আর তাঁর সাথে এমন কাউকে শরীক করি, যার শরীক হওয়ার আমার কাছে কোন বৈজ্ঞানিক যুক্তি প্রমাণ নেই। -আল-মুমিন-৪২

ইতিহাস ও প্রত্নতাত্তিক নিদের্শনসমূহের সাহায্যে তদানীন্তন মিসরবাসীদের সম্পর্কে আমাদের লব্ধ জ্ঞানের সাথে আলোচ্য আয়াতদ্বয়কে মিলিয়ে দেখলে আমরা স্পষ্ট জানতে পারি যে, ফিরাউন নিজে ও তার কওমের লোকেরা রুবুবিয়াতে প্রথম ও দ্বিতীয় অর্থে কোন কোন দেবতাকে খোদায়ীতে অংশীদার করতো, তাদের ইবাদত করতো। এটা স্পষ্ট যে, অতি-প্রাকৃতিক (Supernatural) অর্থে ফিরাউন যদি খোদায়ীর দাবীদার হতো অর্থাৎ তার দাবী যদি এই হতো যে, কার্যকারণ-পরম্পরার ওপরও তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত, সে ছাড়া আসমান-যমীনের অপর কোন রব-ইলাহ নেই, তা হলে সে নিজে অন্য ইলাহ-র পূজা করতো না।১

দুইঃ ফিরাউনের এ বাক্যগুলো কোরআনে উল্লেখ করা হয়েছেঃ

———————————————– ১. ফিরাউন নিজে ‘ইলাহুল আলামীন’ (বিশ্ব-জাহানের ইলাহ) বলে দাবী করেছিলো- নিছক এ ধারণার বশবতী হয়ে কোন কোন তফসীরকার সূরায়ে আরাফের উপরিউক্ত আয়াতে ——— এর স্থলে —————- পাঠ (কেরাআত) গ্রহণ করেছেন। আর—- এর অর্থ নিয়েছেন ইবাদত। এ পাঠ অনুযায়ী আয়াতের তরজমা হবে-আপনাকে ও আপনার ইবাদতকে পরিত্যাগ করে। কিন্তু প্রথমত এ পাঠটি বিরল ও প্রসিদ্ধ-পরিচিত পাঠের পরিপন্থি। দ্বিতীয়ত, যে ধারণার ভিত্তিতে এ পাঠ করা হয়েছে, সে ধারণা আদপেই ভিত্তিহীন, অমূলক। তৃতীয়ত, – এর অর্থ ইবাদত ছাড়া মাবুদ বা দেবীও হতে পারে। জাহেলী যুগে আরবে সূর্যের জন্যে এ শব্দটি ব্যবহৃত হতো। এটা জানা কথা যে, সাধারণত মিসরীয়দের বড় মূর্তি ছিল সূর্য। মিসরী ভাষায় সূর্যকে বলা হতো রা (-)। আর ফিরাউনের অর্থ ছিল, রা’-এর কণ্যা-সন্তান, রা’-এর অবতার-অন্য কথায় সূর্যের অবতার। সুতরাং ফিরাউন যে জিনিসটির দাবি করতো, তা ছিলো এই যে, আমি সূর্য দেবতার কায়িক বিকাশ মাত্র।

অমাত্যবর্গ! আমি নিজেকে ছাড়া তোমাদের অন্য কোন ইলাহ সম্পর্কে অবহিত নই। -আল-কাসাস-৩৮

————————— মূসা! আমি ব্যতীত অন্য কাউকে তুমি যদি ইলাহ হিসাবে গ্রহণ করো, তবে আমি তোমাকে কয়েকদীদের মধ্যে শামিল করবো। -আশ-শোয়ারা-২৯

এ বাক্যগুলোর অর্থ এ নয় যে, ফিরাউন নিজেকে ছাড়া অন্য সব ইলাহকে অস্বীকার করতো, বরং তার আসল উদ্দেশ্য ছিলো, হযরত মূসা (আঃ)-এর দাওয়াত প্রত্যাখান করা। যেহেতু হযরত মূসা (আঃ) এমন এক ইলাহর দিকে দাওয়াত দিচ্ছিলেন, যিনি শুধু অতি- প্রাকৃতিক (Supernatural) অর্থেই মাবুদ নন, বরং তিনি রাজনৈতিক, তমদ্দুনিক অর্থেও আদেশ-নিষেধের মালিক এবং সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী। তাইতো সে আপন কওমকে বলেছিলো, আমি ছাড়া তো তোমাদের এমন কোন ইলাহ নেই। হযরত মূসা (আঃ) -কে ধমক দিয়ে বলেছিলো, এ অর্থে আমাকে ছাড়া অন্য কাউকে ইলাহ বলে গ্রহণ করলে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হবে।

কোরআনের আয়াত থেকে এও জানা যায় এবং ইতিহাস ও প্রত্নতাত্তিক নিদের্শন থেকে তার সমর্থন পাওয়া যায় যে, মিসরের ফিরাউন সম্প্রদায় কেবল নিরংকুশ সার্বভৌমত্বের (Absolute Sovereignty) দাবীদারই ছিলো না, বরং দেবতার সাথে সম্পর্কে স্থাপন করে এক ধরনের পবিত্রতাও দাবী করতো, যেন প্রজাদের দিল-দেমাগে তাদের শক্ত আসন গেড়ে বসতে পারে। এ ব্যাপারে কেবল মিসরের ফিরাউন সম্প্রদায়ই কোন বিরল দৃষ্টান্ত নয়, বরং দুনিয়ার অধিকাংশ দেশেই রাজকীয় খান্দান রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব (Political Sovereignty) ছাড়াও অতিপ্রাকৃতিক অর্থে (supernatural Meaning)উলুহিয়াত ও রুবুবিয়াতে ভাগ বসাবার অল্পবিস্তর চেষ্টা করেছে। প্রজারা যাতে তাদের সামনে দাসত্বের কোননা কোন রীতিনীতি পালন করে তা-ও তাদের জন্যে বাধ্যতামূলক করেছে। কিন্তু আসলে এটি নিছক প্রাসঙ্গিক বিষয়। আসল উদ্দেশ্য, রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব সুদৃঢ় কর। অতি-প্রাকৃতিক উলুহিয়াতের দাবীকে এর একটি উপায় হিসাবে ব্যবহার করা হয়। এজন্যে মিসরে ও জাহেলী ধ্যান-ধারণার পুজারী অন্যান্য দেশেও রাজনৈতিক পতনের সাথে সাথে রাজকীয় খান্দানের উলুহিয়াতও সব সময় নিঃশেষ হয়ে গিয়েছে। ক্ষমতার মসনদ যাদের হাতে গিয়েছে, উলুহিয়াতও আবর্তিত হয়েছে।

তিনঃ অতিপ্রাকৃতিক খোদায়ী ফিরাউনের আসল দাবি ছিল না, বরং রাজনৈতিক খোদায়ীই ছিল তার মূল দাবী। রুবুবিয়াতের তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম অর্থে সে বলতো যে, আমি মিসর ভূমি, তার অধিবাসীদের সব চেয়ে বড় রব (Over Lord) এ দেশ ও তার সকল-উপাদান- উপকরণের মালিক আমি। এ দেশের নিরংকুশ সার্বভৌমত্বের অধিকার কেবল আমারই; আমার সামগ্রিক ব্যক্তিসত্তাই এ দেশের সমাজ-সংগঠন ও সভ্যতা-সংস্কৃতির ভিত্তিমূল।এখানে আমি ছাড়া অন্য কারো আইন-বিধান চলবে না।

কোরআনের ভাষায় তার দাবীর ভিত্তি ছিলো এইঃ

——————– আর ফিরাউন তার কওমের মধ্যে ডাক দিয়ে বললো; হে আমার কওমের লোকেরা! আমি কি মিসর দেশের মালিক নই? মিসরের রাজত্ব কি আমার নয়? তোমরা কি দেখছো না যে, এসব নদী-নালা আমার নিদের্শ চলছে?-আয-যুখরুফ-৫১

নমরূদের রুবুবিয়াতের দাবীও প্রতিষ্ঠিত ছিলো এ ভিত্তির ওপর।

(———————) এ ভিত্তিতেই হযরত ইউসুফ (আঃ)-এর সমকালীন নৃপতিও আপন দেশবাসীর রব সেজে বসেছিলো।

চারঃ হযরত মূসা (আঃ) -এর দাওয়াত-যার কারণে ফিরাউন ও ফিরাউনের বংশের সাথে তার ঝগড়া ছিলো-মূলত এই ছিলো যে, আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন ছাড়া অন্য কেউ কোন অর্থেই ইলাহ নেই। অতি-প্রাকৃতিক অর্থেও তিনিই একমাত্র ইলাহ, বরং সামাজিক, রাজনৈতিক অর্থেও। অর্চনা ও বন্দেগী-আনুগত্য তাঁরই হবে; কেবল তাঁরই আইন-বিধান মেনে চলতে হবে। তিনিই আমাকে স্পস্ট নিদর্শনসমূহ দিয়ে তাঁর প্রতিনিধি নিয়োগ করেছেন; আমার মাধ্যমেই তিনি আদেশ-নিষেধের বিধি-বিধান দেবেন। সুতরাং তাঁর বান্দাদের ক্ষমতার রজ্জু তোমার হাতে নয়, বরং আমার হাতে থাকা ব্ঞ্ছনীয়। এর ভিত্তিতেই ফিরাউন ও তার রাজনৈতিক সহযোগীরা বারবার বলতো যে, এরা দু’ভাই আমাদেরকে দেশ থেকে বিতাড়িত করে নিজেরা ক্ষমতার সামনে অধিষ্ঠিত হতে চায়। আমাদের দেশের ধর্ম ও তম্মুদ্দুন ব্যবস্থাকে নিশ্চিহ্ন করে নিজেদের ধর্ম ও তমুদ্দুন প্রতিষ্ঠার জন্যে উঠে-পড়ে লেগেছে।

———————– এবং আমরা মূসাকে আমাদের আয়াত ও প্রত্যাদিষ্টের স্পষ্ট নিদর্শন সহকারে ফিরাউন ও তার কওমের সর্দারদের প্রতি প্রেরণ করেছি। কিন্তু তারা ফিরাউনের নির্দেশ অনুসরণ করলো। অথচ ফিরাউনের নির্দেশ ন্যায়সঙ্গত ছিলো না। -হুদ-৯৬-৯৭

——————– এবং তাদের পূর্বে আমরা ফিরাউনের কওমকে পরীক্ষায় ফেলেছিলাম। তাদের কাছে এসেছিলো একজন সম্মানিত রসূল। তিনি বললেন, আল্লাহ্র বান্দাদের আমায় সোপর্দে করো। আমি তোমাদের জন্যে আমানতদার রসূল। আল্লাহ্র মোকাবিলায় ঔদ্বত্য করো না। আমি তোমাদের সামনে প্রত্যাদিষ্টের স্পষ্ট নির্দশন পেশ করছি।-আদ-দোখান-১৭-১৯

——- (মক্কাবাসী) আমরা তোমাদের প্রতি একজন রাসূল প্রেরণ করেছি। তিনি তোমাদের ওপর সাক্ষ্যদাতা। ঠিক তেমনি, যেমন ফিরাউনের প্রতি একজন রসূল প্রেরণ করেছিলাম। অতপর ফিরাউন রসূলের নাফরমানী করলে আমরা তাকে কঠোরভাবে পাকড়াও করেছিলাম। -আল-মুয্যাম্মিল- ১৫-১৬

———————- ফিরাউন বললো, মূসা! (দেবতা, শাহী খান্দান-এর কোনটাকেই যদি তুমি স্বীকার না করো) তবে তোমার রব কে? মূসা জবাব দেন; যিনি প্রতিটি বস্তুকে বিশেষ আকার-আকৃতি দান করেছেন, অতপর তাকে কার্য সম্পাদনের পন্থা নির্দেশ করেছেন-তিনিই আমার রব।-ত্বাহা-৪৯-৫০

————————— ফিরাউন বললো; এ রব্বুল আলামীন আবার কি? মূসা জবাব দিলেন, আসমান-যমীন এবং তার অভ্যস্তরে যত সব বস্তু আছে, তার রব-যদি তোমরা বিশ্বাস করো। ফিরাউন তার আশপাশের লোকদের বললো; তোমরা শুনেছো? মূসা বললেন; তোমাদেরও রব, তোমাদের বাপ-দাদারও রব। ফিরাউন বললো; তোমাদের এ রসূল সাহেব-যে তোমাদের প্রতি প্রেরিত হয়েছে-একেবারেই পাগল। মুসা বললেন,মাশরিক-মাগরিব, প্রাচ্য-প্রতীচ্য এবং তার মাঝখানে যা কিছু আছে, সমুদয় বস্তুরই রব-অবশ্য যদি তোমাদের সামান্য জ্ঞানও থাকে। এতে ফিরাউন বলে উঠলো; আমি ছাড়া আর কাউকে যদি তুমি ইলাহ বানাও তাহলে তোমাকে কয়েদীদের শামিল করবো। -আশ-শায়ারা-২৩-২৯

— ফিরাউন বললো,মুসা! আপন যাদু বলে আমাদেরকে আমাদের ভুখন্ড থেকে বে-দখল করে দেয়ার জন্যেই কি তোমার আগমন?-ত্বাহা-৫৭

]——————— আর ফিরাউন বললো; ছেড়ে দাও আমাকে, মূসাকে হত্যা করি। সে তার রবকে সাহায্যের জন্যে ডেকে দেখুক। আমি আশংকা করছি, সে তোমাদের দীন (জীবন-যাপনের ধারা) কে পরিবর্তিত করে ফেলবে অথবা দেশে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে।-আল-মুমিন-২৬

—————————— তারা বললো; এরা দু’জন তো যাদুকর। নিজেদের জোরে তোমাদেরকে তোমাদের ভূখন্ড থেকে বে-দখল করতে চায়। চায় তোমাদের আদর্শ জীবন ব্যবষ্থাকে নিশ্চিহ্ন করতে।ত্বাহা-৬৩

এসব আয়াত পর্যায়ক্রমে দেখলে স্পষ্ট জানা যায় যে, রুবুবিয়াতের ব্যাপারে যে গোমরাহীটি শুরু থেকে দুনিয়ার বিভিন্ন কওমের মধ্যে চলে আসছিলো, নীল নদের দেশেও তারই ঘনঘটা ছেয়ে ছিলো। শুরু থেকে সকল নবী-রাসূল যে দাওয়াত দিয়ে আসছিলেন, মূসা ও হারুন (আঃ) -ও সে দিকেই ডাকছিলেন।

ইহুদী ও খৃস্টান

ফিরাউন জাতির পর আমাদের সামনে আসে বনী ইসরাঈল এবং অন্য সব জাতি, যারা ইহুদীবাদ ও খৃষ্টবাদ গ্রহণ করেছিলো। তারা আল্লাহ্র অস্তিত্ব স্বীকার করতো না বা তাঁকে রব-ইলাহ মানতো না-এদের সম্পর্কে এমন ধারণাতো করাই যায় না। কারণ তারা যে আহলে কিতাব ছিলো, স্বয়ং কোরআনই তার সত্যতা প্রতিপন্ন করেছে। তাহলে প্রশ্ন দাড়াঁয়, রুবুবিয়াতের ব্যাপারে তাদের আকীদা-বিশ্বাস ও কর্মধারায় এমন কি অসঙ্গতি, ত্রুটি-বিচ্যুতি ছিলো, যার কারণে কোরআন তাদেরকে গোমরাহ বলে অভিহিত করেছে? আমরা কোরআন থেকেই এর সংক্ষিপ্ত জবাব পাইঃ

—————————– বল! হে আহলে কিতাব! নিজেদের দীনের ব্যাপারে অন্যায় বাড়াবাড়ি করো না। তোমাদের পূর্বে যেসব কওম গোমরাহ হয়ে পড়েছে, তাদের বাতিল চিন্তাধারার অনুসরণ করো না। তারা অনেককে গোমরাহীতে নিমজ্জিত করেছে, আর নিজেরাও সত্যপথ হতে বিচ্যুত হয়েছে। -(আল-মায়েদা-৭৭)

এ থেকে জানা যায় যে, ইহুদী-খৃস্টান জাতিগুলের গোমরাহীও মূলত সে ধরনের ছিলো, তাদের পূর্ববর্তী জাতিগুলো শুরু থেকে যে গোমরাহীতে নিমজ্জিত হয়ে আসছিলো। তাছাড়া এ থেকে এ কথাও জানা যায় যে, তাদের মধ্যে এ গোমরাহী প্রবেশ লাভ করছিলো “গলু ফিদদীন”- দীনের ব্যাপারে অযথা অন্যায় বাড়াবাড়ির পথ ধরে। এবার দেখুন, কোরআন এ সংক্ষিপ্ত বর্ণনার ব্যাখ্যাটি কিভাবে পেশ করছেঃ

—————————————– ইহুদীরা বলে; ওজাইর আল্লাহর পুত্র, আর নাসারার বলে; মসীহ আল্লহর পুত্র। – তাওবা-৩০

———————————— যেসব খৃস্টানরা বলে যে, মসীহ ইবনে মরিয়ামই আল্লাহ-তারা কুফুরী করেছে। অথচ মসীহ বলেছেন; হে বনী ইসরাঈল! আল্লাহর ইবাদত কেরো যিনি আমারও রব তোমাদেরও রব। -আল-মায়েদা-৭২

——————————- যারা বলে, আল্লাহ তো তিনজনের তৃতীয় জন-তারা কুফুরী করেছে। অথচ এক ইলাহ ছাড়া আর কোন ইলাহ-ইতো নেই। – আল-মায়েদা-৭৩

————————————————– এবং আল্লাহ যখন জিজ্ঞেস করবেন, হে মরিয়াম তনয় ঈসা! তুমি কি লোকদেরকে বলেছিলে যে, আল্লাহকে ছেড়ে আমাকে ও আমার মাতাকেও ইলাহ বানিয়ে নাও? তখন তিনি জবাবে আরজ করবেন, (সুবহানাল্লাহ) যে কথা বলার আমার কোন অধিকার ছিলো না, এমন কথা বলি আমার সাধ্য কি!” – (আল-মায়েদা-১১৬)

——————————————————- এটা কোন মানুষের কাজ নয় যে, আল্লাহ তাকে কিতাব, বিধান ও নবুয়াত দান করবেন, আর সে লোকদের বলবে, তোমরা আল্লাহকে ত্যাগ করে আমার বান্দায় পরিণত হও, বরং সে তো এই বলবে, রাব্বানী (খোদা পোরোস্ত) হয়ে যাও, যেমন তোমরা খোদার কিতাব পঠন পাঠন করো, আর যার দরস দিয়ে থাকো। ফেরেশতা- পয়গম্বরদের রব বানিয়ে নাও – এমন কথা বলা নবীর কাজ নয়। তোমারা মুসলমান হওয়ার পরও তিনি কি তোমাদেরকে কুফরী শিক্ষা দেবেন? –আলে-ইমরান-৭৯-৮০

এসব আয়াতের আলোকে আহলে কিতাবের প্রথম গোমরাহী এই ছিলো যে, দীনের দৃষ্টিতে যেসব মহান ব্যক্তি-নবী রাসূল-সাধক পুরুষ ও ফেরেশতা প্রমুখ ছিলেন, তারা তাদের সত্যিকার মর্যাদা থেকে বাড়িয়ে তাদেরকে খোদায়ীর মর্যাদায় উন্নীত করেছিলো; আল্লাহর কার্যধারায় তাদেরকে করেছিলো শরীক-অংশীদার। তাদের পূজা-অর্চনা করেছে। তাদের হিসসাদার জ্ঞান করেছে এবং ধারণা করে বসেছিলো যে, ক্ষমা-সাহায্য-সহযোগিতা ও রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষমতাও তাদের রয়েছে। এরপর তাদের দ্বিতীয় গোমরাহী ছিলো এইঃ

———————————————- তারা আল্লাহ ছাড়া নিজের ওলামা-মাশায়েখ –পাদ্রী –পুরোহিতদেরকে রব বানিয়ে নিয়েছিলো। – সুরা -তওবা-৩১

অর্থাৎ ধর্মীয় ব্যবসায় যাদের পজিশন ছিলো শুধু এই যে, তারা আল্লাহর শরীয়তের বিধান বলে দেবে, আল্লাহর মর্জী অনুযায়ী চরিত্র গঠন করবে- ধীরে ধীরে তাদেরকে এমন পজিশন দেয়া হলো যে, নিজেদের ইখতিয়ার অনুযায়ী যা খুশী হারাম-হালাল করে বসে, দীন ও কিতাবের অনুমোদন ছাড়াই যা খুশী নির্দেশ দেয়, যা থেকে খুশী বারণ করে, যে পন্থাই খুশি বারণ করে, যে পন্থাই জারী করতে পারে। এমনি করে এরা দুটি বিরাট মৌলিক বিচ্যুতিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়লো। নূহ, ইবরাহীম, আ’দ, সামুদ, আহলে মাদইয়ান ও অন্যান্য কওম যে বিচ্যুতিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছিলো, পূর্ববর্তী জাতিসমূহের মতো এরাও অতি –প্রাকৃতিক অর্থে ফেরেশতা ও মহান ব্যক্তিদেরকে রুবুবিয়াতে আল্লাহর শরীক করছে। তাদের মতো এরাও আল্লাহর অনুমোদনের তোয়াক্কা না করেই মানুষের নিকট থেকে নিজেদের সভ্যতা, সংস্কৃতি, আচার –আচরণ, নীতি-নৈতিকতা ও রাজনীতির বিধি-বিধান গ্রহণ করতে থাকে। এমন কি শেষ পর্যন্ত অবস্থা এই দাঁড়ায়ঃ

—————————————————————- তুমি কি তাদের দেখেছো, যারা আল্লাহর কিতাবের অংশ বিশেষ লাভ করেছিলো? তাদের অবস্থা এই ছিলো যে, তারা জিবত ও তাগুতকে স্বীকার করে নিচ্ছে। -আন-নিসা-৫১

—————————– বল, আল্লাহর নিকট ফাসেকদের চেয়েও নিকৃষ্টতর পরিণতি কাদের, আমি কি তোমাদেরকে বলে দেবো? তারা, যাদের ওপর আল্লাহ লা’নত করেছেন, যাদের ওপর আল্লাহর গজব নিপতিত হয়েছে, যাদের অনেকেই তাঁর নির্দেশে বানর-শূকরে পরিণত হয়েছে, আর তারা তাগুতের ইবাদত-বন্দেগী করেছে। এরাই হচ্ছে নিকৃষ্টতর পর্যায়ের লোক। আর সত্য সরল পথ থেকে ওরা তো অনেক দূরে সরে গিয়েছে। -(আল মায়েদা-৬০)

কল্পনাপ্রসূত সর্বপ্রকার চিন্তা- ভাবনার জন্যে ‘জিবত’ শব্দটি অত্যন্ত ব্যাপক। যাদু-টোনা, টোটকা, ভাগ্য গণনা, ভবিষ্যত বর্ণনা, লক্ষ্মী-অলক্ষ্মীর ধারণা-কল্পনা, অতি-প্রাকৃতিক ক্রিয়াকলাপ-এক কথায় সকল প্রকার মনগড়া ধারণ কল্পনা এর পর্যায়ভুক্ত। আর ‘তগুতের’ অর্থ সে সব ব্যক্তি, দল বা সংগঠন-প্রতিষ্ঠান-যারা, আল্লাহর মোকাবিলায় ঔদ্ধত্য-অবাধ্যতা অবলম্বন করেছে, বন্দেগীর সীমাশর্ত লংঘন করে খোদায়ীর ধজাধারী সেজে বসেছে। ইহুদী-খৃষ্টানরা পূবোর্ক্ত দুটি গোমরাহীতে নিমজ্জিত হয়েছিলো। প্রথম প্রকার গোমরাহীর পরিণতি এই দাড়িয়েছিলো যে, সকল প্রকার ধারণা-কল্পনা তাদের মন-মগজে চেপে বসেছিলো। আর দ্বিতীয় প্রকার গোমরাহী তাদের ওলামা-মাশায়েখ, আলেম-সূফী, পাদ্রী-পুরোহিত, সুফী-সাধক ধর্মগুরুদের বন্দেগী থেকে এগিয়ে সে সব অত্যাচারী-অনাচারীর বন্দেগী-অনুগত্য পর্যন্ত তাদের নিয়ে গিয়েছিল, যারা ছিলো প্রাকশ্য খোদাদ্রোহী।

আরবের মুশরিক সমাজ

এবার আমরা আলোচনা করে দেখবো, এ ব্যাপারে আরবের মুশরিকদের গোমরাহী কোন ধরনের ছিলো। এদের প্রতি রাসূল (স) প্রেরিত হয়েছিলেন, আর এদেরকেই কোরআনে সর্বপ্রথম সম্বোধন করা হয়। তারা কি আল্লাহ সম্পর্কে অনবহিত ছিলো, তাঁর অস্তিত্বে অবিশ্বাসী ছিলো? তাদেরকে আল্লাহর অস্তিত্ব স্বীকার করাবার জন্যেই কি রাসূল প্রেরিত হয়েছিল? তারা কি আল্লাহকে রব-ইলাহ স্বীকার করতো না? তাদেরকে মহান আল্লাহ তায়ালার উলুহিয়াত ও রুবুবিয়াত স্বীকার করাবার জন্যেই কি কোরআন নাযিল হয়েছিলো? তারা কি আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগী অস্বীকার করতো? না তারা কি মনে করতো যে, মূলত লাত-মানাত ও হোবাল-ওযযা এবং অন্যান্য মাবুদই বিশ্বজাহানের সৃষ্টিকর্তা, মালিক, রিজিকদাতা ও নিয়ন্ত্রক-পরিচালক? না তারা তাদের এসব মাবুদকে আইনের উৎস, নৈতিক ও তমুদ্দুনিক সমস্যায় হেদায়াতের উৎসমূল বলে স্বীকার করতো?

আমরা কোরআন থেকে এসব প্রশ্নের এক একটি নেতিবাচক জবাব পাই। কোরআন আমাদেরকে বলছে যে, আরবের মুশরিকরা কেবল আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাসীই ছিলো না, বরং তাকে সমগ্র বিশ্ব-চরাচর এবং তাদের নিজেদের মাবুদের্ও স্রষ্টা, মালিক্ও মহান খোদা (Grand Lord) বলে স্বীকার করতো, স্বীকার করতো তাকে রব ও ইলাহ বলে। সংকট-সমস্যা ও দুর্যোগ –দুর্বিপাকে তারা যে দরবারে সর্বশেষ আপীল করতো, তা ছিলো তারই দরবার। তারা আল্লাহ্র ইবাদত-বান্দেগীও অস্বীকার করতো না। নিজেদের দেবতা-মাবুদ (উপাস্য) সম্পর্কে তাদের এ বিশ্বাস ছিলো না যে, তারা তাদের নিজেদের ও বিশ্ব-জাহানের স্রষ্টা-রিজিকদাতা, এসব উপাস্য জীবনের নৈতিক-তমুদ্দনিক সমস্যায় তাদের পথ-নির্দেশ দান করে-এ বিশ্বাসও তারা পোষণ করতো না। নিম্নের্ আয়াতগুলো এর ————————————– হে নবী! তাদের জিজ্ঞেস করো, যমীন এবং তাতে যা কিছু আছে, তা কার মালিকানায়? তোমরা জানলে বলো। তারা বলবে; আল্লাহ্র মালিকানায়। বলো; তবুও তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে না? জিজ্ঞেস করো; সাত আসমান ও মহান আরশের রব কে? তারা বলবে, আল্লাহ। তবুও তোমরা ভয় করবে না? বলো, সকল বস্তুর রাজকীয় ক্ষমতা কার হাতে ন্যস্ত? কে তিনি যিনি আশ্রয় দান করেন? অথচ তাঁর মোকাবিলায় আশ্রয় দানের ক্ষমতা কারুর নেই। বলো, যদি তোমরা জানো। তারা বলবে; এই গুন-বৈশিষ্ট্য শুধু আল্লাহর।বলো,তাহলে কোথেকে তোমরা প্রতারিত হচ্ছো? আসল কথা এই যে, আমরা তাদের সামনে বাস্তব সত্য তুলে ধরেছি্ আর তারা নিশ্চয়ই মিথ্যাবাদী। আল মুমিনুন-৮৪-৯০

তিনিই – তো আল্লাহ্, যিনি তোমাদেরকে জলে-স্থলে পরিভ্রমণ করান। এমন কি তোমরা যখন নৌকায় আরোহণ করে অনুকূল বাতাসে আনন্দে সফর করে বেড়াও; অতপর অকস্মাৎ প্রতিকুল বাতাস সজোরে প্রবাহিত হতে থাকে, আর চতুর্দিক থেকে ঢেউ খেলতে শুরু করে-তারা ভাবে ঝড়-ঝঞ্ঝা তাদেরকে বেষ্টন করে ফেলেছে, তখন সকলে আল্লাহ্কেই ডাকে। আপন দীনকে তাঁর জন্যে নিবেদিত করে দো্য়া করতে থাকে; আমাদেরকে এ বিপদমুক্ত করলে আমরা তোমার কৃতজ্ঞ বান্দা হবো। কিন্তু তিনি তাদেরকে বিপদমুক্ত করলে তারাই সত্য থেকে সরে দাঁড়িয়ে যমীনে নাহক বিদ্রোহ করে বসে। -ইউনুস-২২-২৩

————————————— সমুদ্রে তোমাদের কোন বিপদ দেখা দিলে এক আল্লাহ ব্যতীত আর যাদের যাদের তোমরা ডাকতে, তারা সকলেই গায়েব হয়ে যায়। কিন্তু তিনি যখন তোমাদের রক্ষা করে স্থলভাগে পৌছিয়ে দেন, তখন তোমরা তাঁর থেকে বিমুখ হয়ে যাও। সত্য কথা এই যে, ইনসান ব্ই অকৃতজ্ঞ-একান্ত না- শোকর বান্দা। বনী-ইসরাইল-৬৭

নিজেদের মাবুদ (উপাস্য) সম্পর্কে তাদের যে ধারনা ছিল, স্বয়ং তাদেরই জবানীতে কোরআন তা এভাবেই উল্লেখ করেছেঃ

————————————————————— আর যারা তাঁকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে বন্ধু ও কার্যোদ্ধারকারী হিসাবে গ্রহণ করে, তারা বলে; এরা আমাদের আল্লাহ্র নিকটবর্তী করবে-এজন্যেই তো আমরা তাদের ইবাদত করি। -আয-যুমার-৩

———————- আর তারা বলে, এরা আল্লাহ্র হুজুরে আমাদের জন্যে সুপারিশকারী।

নিজেদের মাবুদ (উপাস্য) সম্পর্কে তারা এমন ধারণাও পোষণ করতো না যে, তারা জীবন-সমস্যায় পথ-নির্দেশক। সূরা ইউনুস ৩৫ আয়াতে আল্লাহ আপন নবীকে নিদের্শ দিচ্ছেনঃ

——————————– তাদের জিজ্ঞেস করো, তোমাদের বানানো সেসব শরীকদের কেউ সত্যের দিকে পথ-প্রদর্শনকারীও রয়েছে কি?

কিন্তু এ প্রশ্নটি শুনে তাদের ওপর নীরবতা ছেয়ে যায়। লাত-মানত, ওজ্জা বা অন্য মাবুদ-উপাস্যরা আমাদেরকে চিন্তা ও কর্মের সঠিক পথ নির্দেশ করে; পার্থিব জীবনে তারা আমাদেরকে শান্তি-স্বস্তি্ও ন্যায়ের মূলনীতি শিক্ষা দেয়, তাদের জ্ঞানধারা থেকে আমরা বিশ্বচরাচরের মূলতত্ত্ব সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করি-ওদের কেউই এমন জবাব দেয় নি। তাদের নীরবতা দেখে শেষ পযর্ন্ত আল্লাহ তার নবীকে বলেনঃ

————————————— বল, আল্লাহ্ কিন্তু সত্যের দিকে পথ প্রদর্শন করেন। তবে বল, অনুসরণীয় হওয়ার অধিক যোগ্য কে? যিনি সত্যের পথ প্রদর্শন করেন, না সে, যাকে পথ প্রদশর্ন না করা হলে সে নিজেই কোন সন্ধান লাভ করতে পারে না? তোমাদের হয়েছে কি? কেমন ফয়সালা করেছো তোমরা? ইউনুস-৩৫

এসব স্পষ্ট উক্তির পর এখন একটি প্রশ্নই অমীমাংসিত থেকে যায়। প্রশ্নটি এই যে, তাহলে রুবুবিয়াতের ব্যাপারে তাদের আসল গোমরাহী কি ছিল, যা সংশোধন করার জন্যে আল্লাহ্ তাঁর নবী পাঠিয়েছেন, কিতাব নাযিল করেছেন? এ প্রশ্নের মীমাংসার জন্যে কোরআনের প্র্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে তাদের আকীদা বিশ্বাস এবং কর্মেও আমরা দুটি বুনিয়াদী গোমরাহীর সন্ধান পাই; প্রাচীনকাল থেকে সকল গোমরাহ কওমের মধ্যেও যা পাওয়া যেতো অর্থাৎ একদিকে অতি প্রাকৃতিক অর্থে তারা আল্লাহ্র সাথে অন্যান্য রব-ইলাহকেও শরীক করতো এবং মনে করতো যে, কার্যকারণপরম্পরায় যিনি কর্তৃত্বশীল তাঁর ক্ষমতা ইখতিয়ারে ফিরেশতা, বুযুর্গ-ব্যক্তি ও গ্রহ-নক্ষত্র ইত্যাদির কোন না কোন কর্তৃত্ব রয়েছে। এ কারণেই দোয়া,সাহায্য কামনা ও ইবাদতের রীতি ও নীতি, আচারঅনুষ্ঠানে তারা কেবল আল্লাহ্র দিকেই প্রত্যাবর্তন করতো না, বরং সেসব কৃত্রিম খোদার দিকেও প্রত্যাবর্তন করতো।

অপরদিকে তমুদ্দুনিক-রাজনৈতিক রুবুবিয়াতের ব্যাপারে তারা ছিল একেবারেই শূণ্যমনা। এ অর্থেও কোন রব আছে, তা তাদের মনের কোণেও স্থান লাভ করে নি। এ অর্থে তারা তাদের ধর্মীয় নেতা-কর্তা ব্যক্তি, সর্দার মাতব্বর ও খান্দানের বুযুর্গ (মহান) ব্যক্তিদেরকে রব বানিয়ে বসেছিলো; তাদের কাছ থেকেই নিজেদের জীবন বিধান গ্রহণ করতো। তাদের প্রথম গোমরাহী সম্পর্কে কোরআন সাক্ষ্য দিচ্ছেঃ

————————– মানুষের মধ্যে এমন লোকও আছে, যে খোদাপোরোস্তীর প্রান্ত সীমানায় দাড়িয়ে তার ইবাদত করে। কল্যাণ লাভ হলে তা নিয়ে শান্ত-তুষ্ট হয়ে যায়। অবশ্য কোন অসুবিধা দেখলে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়ায়। এমন ব্যক্তি দুনিয়া-আখেরাত-দু-ই বরবাদ করলো। আর এটাই হচ্ছে স্পষ্ট ক্ষতি। সে আল্লাহ্কে বাদ দিয়ে এমন কাউকে ডাকে, যারা তার কোন অকল্যাণ করার ক্ষমতা রাখে না, ক্ষমতা রাখে না কোন কল্যাণ করারও। এটাই হচ্ছে বড় গোমরাহী-বিরাট পথ-ভ্রষ্টতা। সে সাহায্যের জন্যে এমন কাউকে ডাকে, যাকে ডাকায় লাভের তুলনায় ক্ষতি অনেক নিকটতর। কতই না নিকৃষ্ট বন্ধু আর কতই না নিকৃষ্ট সাথী।-আল-হাজ্জ-১১-১৩

———————– তারা আল্লাহ্কে ছেড়ে এমন কারো ইবাদত করছে, যারা অকল্যাণও করতে পারে না, পারে না কল্যাণও করতে। এবং তারা বলে; আল্লাহ্র হুজুরে তারা আমাদের সুপারিশকারী। বল, আসমান-যমীনে আল্লাহ্র জ্ঞানে নেই১ -তোমরা কি আল্লাহ্কে এমন কিছুর সংবাদ দিচ্ছো? তারা যে শিরক করছে, তা থেকে আল্লাহ্ পবিত্র- মুক্ত।-ইউনুস-১৮

——————————— হে নবী! তাদেরকে বলে দাও, যে আল্লাহ্ দু’দিনে যমীন পয়দা করেছেন, সত্যিই কি তোমরা তাঁর সাথে কুফরী করছো? আর অন্যদেরকে তাঁর সমকক্ষ-প্রতিপক্ষ করছো?-হা-মীম আস-সাজদা-৯

———————————

১. অর্থাৎ তোমরা এমন ভ্রান্ত ধারণায় পতিত হয়েছো যে, আমার কাছে সেসব মাবুদের এমন ক্ষমতা চলে যে, তারা আমার কাছে যে সুপারিশই করবে, তা-ই কবুল না হয়ে পারে না। আর এজন্যেই তোমরা তাদের আস্তনায় মাথা ঠুক, ভেট দাও। আমার দরবারে এত বড় ক্ষমতাধর অথবা আমার এত প্রিয়পাত্র যে, আমি তার সুপারিশ কবুল করতে বাধ্য হবো- আসামন-যমীনে এমন কোন সত্তা তো আমার জানা নেই। তবে কি আমি জানি না -আমাকে এমন সুপারিশকারীদের খবর দিচ্ছো? স্পষ্ট যে, আল্লাহ্র জ্ঞানে কোন জিনিস না থাকার অর্থ আদপে তার অস্তিত্বই নেই।

বল, তোমরা কি আল্লাহ্ ছাড়া এমন কারো ইবাদত করছো? তোমাদের কল্যাণের কোন ইখতিয়ারই যাদের নেই, নেই কোন অ-কল্যাণের ক্ষমতা অথচ একমাত্র আল্লাহ্রই তো শ্রোতা-জ্ঞাতা। -আল-মায়েদা-৭৬

—————————- আর যখন মানুষকে কোন বিপদ স্পর্শ করে তখন একাগ্রে চিত্তে আপন রবকেই ডাকে। কিন্তু তিনি যখন তাকে কোন নিয়ামতে সরফরাজ করেন, তখন যে বিপদে পড়ে ইতিপূর্বে তাঁকে ডেকেছিলো, তা বিস্মৃতি হয়ে যায়; আল্লাহ্র সমকক্ষ নির্ধারণ করতে থাকে১ যেন তাকে আল্লাহ্র পথ থেকে বিচ্যুত করে।-আযযুমার-৮

—————————– যে নিয়ামতই লাভ করেছো, তা করেছো আল্লাহ্র দান-বিখশিশের ফলে। অতপর কোন বিপদ স্পর্শ করলে আল্লাহ্র হুজুরেই ফরিয়াদ নিয়ে হাজির হও। কিন্তু তিনি যখন তোমাদের ওপর থেকে সে বিপদ বিদূরিত করেন, তখন তোমাদের কিছু লোক এ বিপদ মুক্তিতে অন্যদেরকেও শরীক করতে শুরু করে, অনুগ্রহ বিস্মৃতি দ্বারা অনুগ্রহের জবাব দেয়ার জন্যে। আচাছা! মজা লুটে নাও। অনতিবিলম্বে তোমরা এর পরিণতি জানতে পারবে। তোমরা যাদের জানো না, তাদের জন্যে আমাদের দেয়া রিজিকের অংশ নির্ধারণ করো।২ আল্লাহ্র

১. আল্লাহ্র সমকক্ষ করতে থাকে এর অর্থ, বলতে থাকে যে, অমুক বুযুর্গের বরকতে এ বিপদ কেটে গেছে, অমুক হযরতের এনায়াত অনুগ্রহে এ নিয়ামত লাভ হয়েছে।

২. অর্থাৎ যারা বিপদ মুক্তকারী এবং সংকট মোচনকারী ছিল-কোন জ্ঞান -তথ্য দ্বারা যাদের সম্পর্কে এ সত্য প্রতিষ্ঠিত হয় নি, কৃতজ্ঞতা স্বরূপ তাদের জন্যে নজর-নিয়াজ করে নৈবেদ্য নিবেদন করে। মজার ব্যাপার এই যে, এসব কিছুই করে আমাদের দেয়া রিজিক থেকে।

শপথ, তোমরা যেসব উৎকট-উদ্ভট ধারণা-কল্পনা করছো, সে সম্পর্কে তোমরা অবশ্যই খুটিয়ে খুটিয়ে জিজ্ঞাসিত হবে।-আন-নহল-৫৫-৫৬

অবশিষ্ট রইলো তাদের দ্বিতীয় গোমরাহী। সে সম্পর্কে কোরআনের সাক্ষ্য এইঃ ——————- আর এমনি করে অনেকে মুশরিকের জন্যে তাদের মনগড়া শরীকরা নিজেদের সন্তান হত্যাকে মনঃপুত করে দিয়েছে, যেন তাদেরকে ধ্বংসে নিপতিত করে, তাদের দীনকে করে দেয় তাদের জন্য সন্দেহপূর্ণ।

স্পষ্ট যে, এখানে শুরাকা (অংশীদারগণ)-এর অর্থ মূর্তি-দেবতা নয়, বরং যেসব নেতা-কর্তা ব্যক্তি সন্তান হত্যাকে আরববাসীদের দৃষ্টিতে কল্যাণ ও শোভা সৌন্দর্যের কার্য হিসাবে পেশ করেছিলো, এখানে শুরাকা অর্থ তাই। হযরত ইবরাহীম ও হযরত ইসমাঈল (আঃ)-এর দীনে এরাই এহেন উৎকট প্রথার সংমিশ্রণ করেছিলো। আরও স্পষ্ট যে, আরববাসীরা তাদেরকে কার্যকারণপরম্পরায় কর্তৃত্বশীল মনে করতো বা তাদের পূজা করতো অথবা তাদের নিকট প্রার্থনা জানাতো। এসব অর্থে তাদেরকে আল্লাহ্র শরীক বলা হয় নি। রুবুবিয়াত-উলুহিয়াতে তাদেরকে শরীক বলা হয়েছে-তার কারণ এই যে, তমুদ্দুনিক সামাজিক সমস্যা, নৈতিক ও ধর্মীয় বিষয় যেভাবে খুশী তারা প্রণয়ন করতে পারে-আরববাসীরা তাদের এ অধিকার স্বীকার করে নিয়েছিলো।

——————————— তারা কি এমন শরীক বানিয়ে বসেছে, যারা তোদের জন্যে দীনের ব্যাপারে এমন সব আইন-বিধান রচনা করেছে, আল্লাহ্ যার অনুমতি দেন নি, দেন নি কোনহুকুম।-আশ-শূরা-২১

দীন শব্দের ব্যাখ্যা পরে করা হবে। এ আয়াতের অর্থের পূর্ণ ব্যাপকতাও সেখানে সম্পূর্ণরূপে স্পষ্ট হবে। কিন্তু এখানে ন্যূনপক্ষে এতটুকু তো পরিষ্কার জানা যায় যে, আল্লাহ্র অনুমতি ব্যতীত তাদের নেতা-কর্তা ব্যক্তিদের এমন রীতিনীতি নির্ধারণ-যার ধরন-প্রকৃতি দীনের অনূরূপ-আর আরববাসীদের তাকে একান্তে অনুসরণীয় বলে স্বীকার করে নেয়া-এটাই রুবুবিয়াত-ইলাহিয়াতে আল্লাহ্র সাথে তাদের শরীক হওয়া; এটাই ছিলো আরববাসিগণ কর্তৃক তাদের অংশীদারিত্ব স্বীকার করে নেয়া।

কোরআনের দাওয়াত

গোমরাহ জাতিসমূহের ধারণা-কল্পনার যে বিশ্লেষণ ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, তা থেকে এ সত্য একেবারে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে কোরআনের অবতরণকাল পযর্ন্ত যতগুলো জাতিকে কোরআন-জালেম, ভ্রান্ত চিন্তাধারার অধিকারী এবং বিপদগামী বলে উল্লেখ করেছে, তাদের কোন একটি জাতিও আল্লাহ্র অস্তিত্ব অস্বীকার করতো না। অবশ্য তাদের সকলেই আসল ও যৌথ গোমরাহী এই ছিলো যে, তারা রুবুবিয়াতের পাঁচটি অর্থকে-অভিধান ও কোরআনের সাক্ষ্যপ্রমাণ দিয়ে শুরুতেই আমরা যা প্রতিপন্ন করেছি-দুটি ভাগে বিভক্ত করে ফেলেছিলো।

অতি প্রাকৃতিকভাবে তিনি সৃষ্ট জীবের প্রতিপালন, রক্ষণাবেক্ষণ, অভাবঅভিযোগ পূরণ ও দেখাশোনার জন্যে যথেষ্ট-রব এর এ অর্থ তাদের দৃষ্টিতে ভিন্ন অর্থজ্ঞাপক ছিলো। এ অর্থ অনুযায়ী যদিও তারা আল্লাহ্কেই সর্বশ্রেষ্ঠ রব বলে স্বীকার করতো, কিন্তু তার সাথে ফেরেশতা, দেবতা, জ্বিন,অদৃশ্য শক্তি, গ্রহ-নক্ষত্র,নবী-ওলী ও পীর পূরোহিতদেরকেও রুবুবিয়তে শরীক করতো।

তিনি আদেশ-নিষেধের অধিকারী, সর্বোচ্চ ক্ষমতার মালিক, হেদায়াত ও পথ নির্দেশের উৎস, আইন বিধানের মূল, রাষ্ট্রের কর্ণধার এবং সমাজ সংগঠনের কেন্দ্রবিন্দু-রবের এ ধারণা তাদের ছিলো সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। এ অর্থের দিক থেকে তারা হয় আল্লাহ্র পরিবর্তে মানুষকে রব মনে করতো অথবা মতবাদ হিসাবে আল্লাহ্কে রব মনে করলেও কার্যত মানুষের নৈতিক, তমুদ্দুনিক ও রাজনৈতিক রুবুবিয়াতের সামনে আনূগত্যের মস্তক অবনত করতো।

এ গোমরাহী দূর করার জন্যেই শুরু থেকেই নবী-রাসূলদের আবির্ভাব হয়েছে। এর এজন্যেই শেষ পর্যন্ত হযরত মুহাম্মদ (সঃ) আগমন করেছেন। তাঁদের সকলেরই দাওয়াত ছিলো এইঃ এ সকল অর্থে রব কেবল একজন। আর তিনি হচ্ছেন মহান আল্লাহ্ রব্বুল আলামীন। রুবুবিয়াত অবিভাজ্য। কোন অর্থেই কেউই রুবুবিয়াতের কোন অংশ লাভ করতে পারে না। বিশ্ব জাহানের ব্যবস্থাপনা এক পরিপূর্ণ ব্যবস্থার অধীন কেন্দীয় বিধান। এক আল্লাহ্ই তার স্রষ্টা। একই আল্লাহ্ তার ওপর কর্তৃত্ব করছেন। বিশ্ব জাহানের সকল ক্ষমতা ইখতিয়ারের মালিক এক আল্লাহ্। বিশ্ব জাহানের সৃষ্টিতে কারো কোন দখল নেই; পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায়ও নেই তাঁর শরীক। শাসনকার্যেও নেই কেউ তাঁর হিস্সাদার। কেন্দীয় ক্ষমতার অধিকার হিসাবে তিনি একাই তোমাদের অতি প্রাকৃতিক রব। নৈতিক, তমুদ্দুনিক ও রাজনৈতিক রবও তিনিই। তিনিই তোমাদের মাবুদ, তিনিই তোমাদের রুকু-সিজদা পাওয়ার যোগ্য। তিনিই তোমাদের দোয়া-প্রার্থনায় শেষ কেন্দ্রস্থল। তিনিই তোমাদের আশা-ভরসার অবলম্বন। তিনিই তোমাদের অভাব-অভিযোগ পূরণ কারী। এমনিভাবে তিনিই বাদশা, মালেকুল মুলক-রাজাধিরাজ। তিনিই আইন-বিধানদাতা, আদেশ-নিষেধের অধিকারী। রুবুবিয়াতের এ দুটি দিক- জাহেলিয়াতের কারণে তোমরা যাকে পৃথক করে নিয়েছিলে–আসলে আল্লাহ্র অপরিহার্য অংশ এবং আল্লাহ্র বৈশিষ্ট্য বিশেষ; এর কোনটিকেই একে অপর থেকে বিছিন্ন কার যায় না, এর কোন এক প্রকারেই কোন সৃষ্টি জীবকে আল্লাহ্র শরীক করা বৈধ নয়।

কোরআন যে ভাষায় এ দাওয়াত পেশ করেছে, তা স্বয়ং কোরআনের জবানীতেই শুননঃ

—————————————- বাস্তবে তোমাদের রব তো আল্লাহ্ তায়ালা। যিনি ছ’দিনে আসামন-যমীন পয়দা করেছেন, তারপর রাজ্য-সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। তিনি দিনকে রাতের পোশাকে আচ্ছাদিত করেন আর রাতের পেছনে দিন ছুটে চলছে দ্রুত। চন্দ্র-সূর্য-তারকা সব কিছুই তাঁর ফরমানের অধীন। শোন, সৃষ্টি তাঁর, কৃর্তৃত্বও কেবল তাঁই। আল্লাহ্ সারা জাহানের রব-বড়ই বরকতের অধিকারী। আরাফ-৫৪

———————– তাদের জিজ্ঞেস করো; আসমান-যমীন থেকে কে তোমাদের রিজিক দান করেন? কর্ণের শ্রবণ শক্তি এবং চক্ষের দর্শন শক্তি কার ইখতিয়ার-অধিকারে? কে তিনি, যিনি মৃতের মধ্য হতে জীবিত এবং জীবিতের মধ্য হতে মৃত বের করে আনেন? বিশ্ব জাহানের এ কারখানা কে পরিচালনা করছেন? তারা অবশ্যই বলবে, আল্লাহ্। বল, তবুও কি তোমরা ভয় করছো না? এ সবই যখন তাঁর, সুতরাং তিনি তোমাদের সত্যিকার রব। সত্য প্রকাশের পর গোমরাহী ব্যতীত আর কি-ই-বা অবশিষ্ট থাকতে পারে? তবে কোথা থেকে তোমরা এ ঠোকর খেয়ে সত্য থেকে দূরে সরে যাচ্ছো?

——————————– তিনি আসমান-যমীনকে যথাযথভাবে পয়দা করেছেন। তিনিই রাতকে দিনের ওপর এবং দিনকে রাতের ওপর মুড়িয়ে দেন। তিনি চন্দ্র-সূর্যকে এমন এক নিয়ম-শৃংখলার অধীন করে দিয়েচেন, যাতে সকলেই নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত অব্যাহত গতিতে চলছে। ………………. এ আল্লাহই তোমাদের রব। রাজত্ব তাঁরই। তিনি ব্যতীত তোমাদের অন্য কোন ইলাহ নেই। তাহলে তোমরা কোত্থেকে ঠোকর খেয়ে ফিরে যাচ্ছো? -আজ-জুমার-৫-৬

——————————————— তিনি আল্লাহ যিনি তোমাদের জন্যে রাত বানিয়েছেন, যেন তোমরা তাতে শান্তি লাভ করতে পারো। আর তিনি দিনকে করেছেন রওশন।….. সে আল্লাহই তোমাদের রব, সব বস্তুর স্রষ্টা। তিনি ব্যতীত অন্য কোন মাবুদ নেই। তবে কোথ্থেকে ধোঁকা খেয়ে তোমরা কোথায় ফিরে যাচ্ছ? ….. আল্লাহ, যিনি তোমাদের জন্যে যমীনকে বাসস্থান করেছেন, আসমানের ছাদ ছেয়ে রেখেছেন তোমাদের ওপর, তোমাদের খাদ্যের জন্যে পূত পবিত্র বস্তু সরবরাহ করেছেন। এ আল্লাহই তোমাদের রব। তিনি সারা জাহানের রব, বড়ই বরকতের অধিকারী। তিনি চিরঞ্জীব। তিনি ব্যতীত আর কোন মাবুদ নেই। সুতরাং দীনকে একান্তভাবে তাঁর জন্যে খালেস করে তোমরা সকলে তাঁকেইডাকো।-আল-মুমিন-৬১-৬৫

——————————————- আল্লাহ তোমাদেরকে মাটি থেকে পয়দা করেছেন। …. তিনি রাতকে দিনের মধ্যে প্রবিষ্ট করেন, আর দিনকে করেন রাতের মধ্য। তিনি চন্দ্র -সূর্যকে এমন এক শৃংখলার অধীন করেছেন যে, সকলেই আপন নির্ধারিত সময় পর্যন্ত চলছে। এ আল্লাহই তোমাদের রব। রাজত্ব তাঁরই। তাঁকে ছাড়া আর যাদের তোমরা ডাকো, তাদের হাতে অণুপরিমাণ বস্তুর ইখতিয়ারও নেই। তোমরা ডাকলেই তারা তোমাদের ডাক শুনতে পায় না; আর শুনতে পেলেও তোমাদের দরখাস্তের জবাব দেয়ার ক্ষমতা তাদের নেই। আর তোমরা যে তাদেরকে আল্লাহর শরীক করছো; তারা কিন্তু কেয়ামতের দিন নিজেরাই তার প্রতিবাদ করবে। -ফাতির-১১-১৪

————————————- আসমানের বাসিন্দা হোক বা যমীনের, সকলেই তাঁর গোলাম, সকলেই তাঁর ফরমানের অনুসারী। …. আল্লাহ তোমাদের নিজেদের মধ্য হতে তোমাদের জন্যে একটি উপমা দিচ্ছেন। আমরা তোমাদেরকে যেসব বস্তু দান করেছি তোমাদের কোন গোলাম কি সেসব জিনিসের মালিকানায় তোমাদের শরীক হতে পারে? এ সকল জিনিসের ভোগ-ব্যবহারে তোমরা আর তোমাদের গোলাম কি সমান? তোমরা কি তাদের তেমনি ভয় করো? যেমন করে থাকো তোমাদের সমস্তরের লোকদের? যারা জ্ঞানযুক্তি ছাড়াই নিজেদের ভিত্তিহীন অনুমানের পেছনে ছুটে চলছে। … সুতরাং তুমি একান্ত নিবিষ্ট চিত্তে সত্যিকার দীনের পথে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত-নিয়োজিত করো। আল্লাহর প্রকৃতির ওপর স্থির থাকো, যে প্রকৃতির ওপর তিনি সকল মানুষকেই সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর সৃষ্টিতে কোন পরিবর্তন নেই, এটাই সত্য-সঠিক পন্থা, কিন্তু অধিকাংশ লোকই জানে না। -আর-রুম-২৬-৩০

—————————————— আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব-মহত্ত্বের ধারণা যেমন করা উচিত ছিলো, তারা তেমন করে নি। কিয়ামতের দিন তারা দেখবে সম্পূর্ণ পৃথিবী তাঁর -মুঠোর মধ্যে আর আসমান তাঁর হাতে গুটানো পড়ে রয়েছে। তিনি পবিত্র। তাঁর সাথে ওরা যে শরীক করছে তা থেকে তিনি অনেক ঊর্ধ্বে। – আয-যুমার-৬৭

————————————- সুতরাং সমস্ত প্রসংসা আল্লাহর জন্যে, যিনি আসমান-যমীন ও বিশ্ব জাহানের রব। আসমান-যমীনে মহত্ত্ব-শ্রেষ্ঠত্ব কেবল তাঁরই। তিনি সকলের ওপর পরাক্রমশালী, মহাকুশলী অতি জ্ঞানী। -জাসিয়া-৩৬-৩৭

——————————————- তিনি আসমান যমীনের মালিক (রব), মালিক সেসব বস্তুর যা আসমান -যমীনে আছে। সুতরাং তুমি তাঁরই বন্দেগী কর আর তাঁর ওপর দৃঢ় থাকো। তোমার জানামতে আর কেউ কি আছে তাঁর মতো? সুরা-মারইয়াম -৬৫

————————————— আসমান-যমীনের সমুদয় গুপ্ততত্ত্ব আল্লার জ্ঞানে রয়েছে। সকল ব্যাপার তাঁর হুজুরেই পেশ হয়। সুতরাং তুমি তাঁরই বন্দেগী কর, তাঁরই ওপর ভরসা করো। -সুরা -হুদ-১২৩

———————————————– তিনি মাশরিক-মাগরিব -প্রাচ্য-প্রতীচ্যের রব। তিনি ছাড়া কোন মাবুদ নেই। সুতরাং তুমি তাঁকেই তোমার কর্মধারক কর। -মুজ্জাম্মিল-৯

————————————— বস্তুত তোমাদের এ উম্মত একই উম্মত। আর আমি তোমাদের রব। সুতরাং আমারই বন্দেগী করো। লোকেরা রবুবিয়াতের এই কার্য এবং জীবনের কার্যাবলীকে নিজেরাই নিজেদের মধ্যে বন্টন করে নিয়েছে। কিন্তু যা-ই হোক, তাদের সকলকে আমার নিকটেই ফিরে আসতে হবে। -সুরা আন-নিসা-৯৩-৯৬

—————————————- তোমাদের রব-এর পক্ষ থেকে যে কিতাব নাজিল হয়েছে, তোমরা তার অনুসরণ করো। তা ত্যাগ করে অন্য কাউকে কার্যোদ্ধারকারী হিসাবে অনুসরণ করো না। -আল-আ’রাফ-৩

———————————- বল, হে আহলে কিতাব! এমন একটি বিষয়ে অগ্রসর হও, যা আমাদের ও তোমাদের মধ্যে সমান। তা এইঃ আমারা আল্লাহ ছাড়া আর কারো বন্দেগী করবো না, তাঁর সাথে কাউকে শরীক করবো না, আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে আমাদের কেউ রব বানাবে না। -আল-ইমান-৬৪

————————— বল, যিনি মানুষের রব, মানুষের বাদশা এবং মানুষের মাবুদ-আমি তাঁর পানাহ চাই। -আননাস-১-৩

——————————- সুতরাং যে ব্যক্তি আপন রব -এর সাক্ষাতের আকাংখী, তার উচিত সৎ কাজ করা এবং আপন রব-এর বন্দেগীতে অন্য কারো বন্দেগীকে শরীক না করা। -আল-কাহাফ- ১১০

এ আয়াতগুলো পর্যায়ক্রমে অধ্যয়ন করলে স্পষ্ট জানা যায় যে, কোরআন রুবুবিয়াতকে সার্বভৌমত্বের সম্পূর্ণ সমার্থক বলে প্রতিপন্ন করছে। আর রব-এর এ ধারণা আমাদের সামনে পেশ করছে যে, তিনি বিশ্ব-জাহানের একচ্ছত্র অধিপতি, নিরংকুশ শাসক এবং লা-শরীক মালিক ও বিচারক।

এ হিসাবে তিনি আমাদের ও সারা জাহানের প্রতিপালক, মুরিব্বী এবং অভাব-অভিযোগ পূরণকারী।

এ হিসাবে তিনি আমাদের তত্ত্ববধায়ক, অভিভাবক, কর্মধারক এবং পৃষ্টপোষক।

এ হিসেবে তাঁর ওফাদারী এমন এক প্রাকৃতিক ভিত্তি, যার ওপর আমাদের সমাজ জীবনের প্রাসাদ সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। তাঁর কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্বের সাথে সংশ্লেষণ সকল বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি এবং দলের মধ্যে এক উম্মতের সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে।

এ হিসাবে তিনি আমাদের ও সমগ্র সৃষ্টিকুলের বন্দেগি, আনুগত্য ও অর্চনা পাওয়ার যোগ্য।

এ হিসাবে তিনি আমাদের ও সমুদয় বস্তুর মালিক, মুনিব ও একচ্ছত্র অধিপতি।

আরববাসী ও দুনিয়ার সকল অজ্ঞ-মূর্খ ব্যক্তিরা সকল যুগে এ ভুলে নিমজ্জিত ছিলো এবং বর্তমানে রয়েছে যে, রুবুবিয়তের এ ব্যাপক ধারণাকে তারা পাঁচটি ভিন্ন ধরনের রুবুবিয়াতে বিভক্ত করে ফেলে। নিজেদের ধারণা কল্পনা দ্বারা তারা সিদ্ধান্ত করেছে যে, বিভিন্ন ধরনের রুবুবিয়াত বিভিন্ন ব্যক্তির সাথে সম্পৃক্ত থাকতে পারে, রবং আছেও। কিন্তু কোরআন স্বীয় বলিষ্ঠ যুক্তি-প্রমাণ দ্বারা প্রতিপন্ন করেছে যে, সার্বভৌম ক্ষমতা যার হাতে ন্যস্ত থাকবে, তিনি ছাড়া রুবুবিয়াতের কোন কর্ম কোনও এক পর্যায়ই অন্য কোন সত্তার হাতে ন্যস্ত হবে- বিশ্বচরাচরের এ পরিপূর্ণ কেন্দ্রীয় ব্যবস্থায় তারা বিন্দুমাত্র অবকাশও নেই। এ ব্যবস্থার কেন্দ্রীকতা নিজেই সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, সকল প্রকার রুবুবিয়াত এক আল্লাহর জন্যে নিদিষ্ট- বিশেষিত, যিনি এ ব্যবস্থাকে অস্তিত্ব দান করেছেন। সুতরাং এ ব্যবস্থার অধীনে অবস্থান করে যে ব্যক্তি রুবুবিয়াতের কোন অংশও কোন অর্থেই আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো সাথে সম্পৃক্ত বলে মনে করে বা কার্যত সম্পৃক্ত করে, বস্তুত সে ব্যক্তি বাস্তবতার সাথে দ্বন্দ্ব -সংঘর্ঙে লিপ্ত হয়, সত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। সত্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং বাস্তবতার বিরুদ্ধে কার্য করে স্বয়ং নিজেকেই ধবংসের মধ্যে নিমজ্জিত করে।

ইবাদত

আভিধানিক তত্ত্ব

আরবী ভাষায়——————— এর আসল অর্থ——– এবং—— অর্থাৎ বাধ্য হওয়া, অনুগত হওয়া, কারো সামনে এমনভাবে আত্মসমর্পণ করা যেন তার মোকাবিলায় কোন প্রতিরোধ, অবাধ্যতা, অকৃতজ্ঞতা না হয়। সে তার মর্জী মতো যেভাবে খুশী সেবা গ্রহণ করতে পারে-কাজে লাগাতে পারে। এজন্যে আরববাসীরা আরোহীর পূর্ণ অনুগত উষ্ট্রকে বলে —– অধিক লোকের চলাচলের ফলে যে পথ সমান হয়ে পড়েছে, তাকে বলা হয় ——– অতপর এ মূল ধাতুতে গোলামী, আনুগত্য, পুজা, সেবা, কয়েদ বা প্রতিবন্ধকতার অর্থ সৃষ্টি হয়। আরবী ভাষার সর্ববৃহৎ অভিধান লিসানুল আরব-এ এ শব্দের যে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, তার সংক্ষিপ্তসার এইঃ

একঃ ———————- যে ব্যক্তি কারো মালিকানাধীন -স্বাধীন নয়, তাকে বলা হয় আব্দ। ইহা ‘হুর’ বা আজাদের বিপরীত। ——— লোকটিকে গোলাম বানিয়ে নিয়েছে, তার সাথে গোলামের অনুরূপ আচরণ করেছে। ——— এবং ——— রো এই একই অর্থ হাদীসে উক্ত হয়ছেঃ

——————————————– তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে কিয়ামতের দিন আমি ফরিয়াদ করবো, বাদী হবো। তাদের মধ্য একজন হচ্ছেন সে ব্যক্তি, যে কোন আজাদ-স্বাধীন মানুসকে গোলাম বানিয়ে নেয় অথবা গোলামকে আজাদ করার পর তার সাথে গোলামের অনুরূপ আচরণ করে।

হযরত মূসা (আঃ) ফিরাউনকে বলেছিলেনঃ —————————————————- তুমি আমাকে যে অনুগ্রহের খোঁটা দিচ্ছ, তার তাৎপর্য এই যে, তুমি বনী ইসরঈলকে গোলামে পরিণত করেছিলে।

দুইঃ ———— ইবাদত বলা হয় এমন আনুগত্যকে, যা পূর্ণ বিনয়ের সাথে করা হয়। ————- তাগুতে ইবাদত করেছে, মানে, তার বাধ্য-অনুগত হয়েছে।

————– আমরা তোমারই ইবাদত করি, মানে পূর্ণ আদেশানুবর্তিতার সাথে তোমার আনুগত্য করি।

———————— তোমাদের রব-এর ইবাদত করো অর্থাৎ তাঁর আনুগত্য করো।

———————————- অর্থাৎ ফিরাউন যে বলেছিল- মূসা ও হারুনের কওম আমাদের আবেদ গোলাম-এর অর্থ হচ্ছে, তারা আমার ফরমানের অনুগত। ইবনুল আম্বারী বলেনঃ —————- এর অর্থ হচ্ছে- সে তার মালিকের ফরমাবরদার, তার নির্দেশের অনুসারী।

তিনঃ ————————- তার ইবাদত করেছে অর্থাৎ তাকে পূজা করেছে। ——– তাআরুদ — এর অর্থ কারো পূজারী হওয়া। কবি বলেনঃ-

————————— আমি দেখি কৃপণের টাকা বেঁচে যায়।———————

চারঃ ————— এবং——————– বলার অর্থ, সে তার সাথে সংশ্লিষ্ট হয়েছে, পৃথক হয়নি; তার পিছু নিয়েছে, তাকে আর ত্যাগ করে নি।

পাঁচঃ ———- কোন ব্যক্তি কারো কাছে আসতে বিরত থাকলে বলা হবে—— -কোন জিনিস তোমাকে আমার কাছে আসতে বিরত রেখেছে, বারণ করেছে?

এ ব্যাখ্যা থেকে এ কথা স্পষ্ট গিয়েছে যে, —- (আব্দ) ধাতুর মৌলিক অর্থ হচ্ছে কারো কর্তৃত্ব প্রাধান্য স্বীকার করে তার মোকাবিলায় আজাদী স্বেচ্ছাচারিতা ত্যাগ করা, ঔদ্ধত্য-অবাধ্যতা ত্যাগ করা, তার জন্যে অনুগত্ হয়ে যাওয়া। গোলামী-বন্দেগীর মূল কথাও এটাই। সুতরাং এ শব্দ থেকে প্রাথমিক যে ধারণাটি একজন আরবের মনে উদয় হয়, তা হচ্ছে গোলামী-বন্দেগীর ধারণা। গোলামের আসল কাজ যেহেতু আপন মুনিবের আনুগত্য আদেশানুবর্তিতা; তাই, কার্যত এ থেকে আনুগত্যে কেবল নিজেকে সোপার্দই করে না, বরং তার বিশ্বস্ততা শ্রেষ্ঠত্ব-কর্তৃত্বও স্বীকার করে, তাই তার সম্মান-মর্যদায় বাড়াবাড়ি ও করে। বিভিন্ন উপায়ে নেয়ামতের স্বীকৃতি প্রকাশ করে, এমনি করে বন্দেগীর অনুষ্ঠানিকতা পালন করে। এরই নাম পূজা। — (আবদিয়াত)- এর অর্থে এ ধারণা তখন স্থান লাভ করে, যখন গোলাম মুনিবের সামনে কেবল মাথা-ই নত করে না, বরং তার হৃদয়-মনও অবনত থাকে। বাকী রইল দুটি ধারণা। মূলত সে দুটি ধারণা – (আবদিয়াত) বা দাসত্বের প্রাসঙ্গিক ধারণা-বুনিয়াদী ধারণা নয়।

কোরআন ইবাদত শব্দের ব্যবহার

এ আভিধানিক তত্ত্বের পর আমরা কোরআনের প্রতি প্রত্যাবর্তন করলে জানতে পারি যে, এই পবিত্র গ্রন্থে এ শব্দটি সম্পূর্ণভাবে প্রথম তিন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। কোথাও প্রথম-দ্বিতীয় অর্থ একই সঙ্গে উদ্দেশ্য, কোথাও শুধু দ্বিতীয় অর্থ, আর কোথাও তৃতীয় অর্থ নেয়া হয়েছে, আর কোথাও যুগপ ৎ তিনটি অর্থই উদ্দেশ্য।

ইবাদত-দাসত্ব-আনুগত্য অর্থে

প্রথম ও দ্বিতীয় অর্থের উদাহরণ এইঃ

——————– অতপর মূসা ও তার ভাই হারূনকে আমরা নিজের নিদর্শন এবং সুস্পষ্ট প্রত্যাদিষ্টের দলীল-প্রমাণসহ ফিরাউন এবং তার সভাসদদের নিকট প্রেরণ করছি। কিন্তু তারা অহংকার করে এগিয়ে এলো। কারণ তারা ছিলো ক্ষমতার অধিকারী কওম। তারা বললো, আমরা কি আমাদেরই মতো দুজন মানুষের প্রতি ঈমান আনবো? তারা এমন কওমের লোক, যে কওম আমাদের আবেদ-তাবেদার।-আল-মুমিনুন-৪৫-৪৭

——————- (ফিরাউন মূসাকে খোটা দিয়ে বলছিলো, আমরা তোমাকে শৈশবে নিজের কাছে রেখে লালন-পালন করেছি, মূসা তার জবাবে বলেন) তুমি আমাকে যে অনুগ্রহের খোটা দিচ্ছ, তাতো এই যে, তুমি বনী ইসরাঈলকে তোমার ‘আব্দ’ বানিয়ে নিয়েছো।- আস্-শোয়ারা-২২

দুটি আয়াতেই ইবাদত অর্থ গোলামী, দাসত্ব, আনুগত্য ও আদেশানুবর্তিতা। ফিরাউন বললো, মূসা-হারুনের কওম আমাদের আবেদ। মানে আমাদের গোলাম এবং ফরমানের অনুসারী। আর হযরত মূসা বললেন; তুমিতো বনী ইসরাঈলকে তোমার ‘আব্দ’ বানিয়ে নিয়েছো। মানে তাদেরকে গোলাম বানিয়ে নিয়েছো, নিজের মর্জী মতো সেবা নাও তাদের কাছ থেকে।

————– হে ঈমানদাররা! যদি তোমরা আমারই ইবাদত করো, তবে আমি তোমাদের যেসব পবিত্র জিনিস দান করছি, তা খাও এবং আল্লাহ্র শোকর আদায় করো। -আল-বাকারা-১৭২

ইসলাম-পূর্বকালে আরবের লোকেরা তাদের ধর্মগুরুদের নির্দেশ ও বাপ-দাদার ধারণা কল্পনা মেনে চলতে গিয়ে খাদ্য-পানীয় বিষয়ে নানা ধরনের বিধি-নিষেধ মেনে চলতো। তারা ইসলাম গ্রহণ করলে আল্লাহ বলেন, “তোমরা যদি আমারই ইবাদত করো তবে এসব বিধিনিষেধ, বাধ্য-বাধকতার অবসান ঘটিয়ে আমি যা হালাল করেছি, তাকে হালাল মনেকরে নির্দ্বিধায় তা খাও।” এর স্পষ্ট দ্ব্যর্থহীন অর্থ এই যে, তোমাদের পন্ডিত-গুরুদের নয়, বরং তোমরা যদি আমারই বান্দাহ হয়ে থাকো, সত্যিই যদি তোমরা তাদের আনুগত্য-আদেশানুবর্তিতা ত্যাগ করে আমার আনুগত্য গ্রহণ করে থাকো, তাহলে হালাল-হারাম এবং বৈধ-অবৈধের ব্যাপারে তাদের মনগড়া বিধানের পরিবর্তে আমার বিধান মেনে চলতে হবে। সুতরাং এখানেও ইবাদত শব্দটি দাসত্ব-আনুগত্য অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে।

——————- বল, আল্লার নিকট এর চেয়েও মন্দ পরিণতি কাদের হবে-আমি কি তোমাদের বলে দেবো? তারা, যাদের ওপর আল্লাহ্র অভিসম্পাত হয়েছে, গজব নিপতিত হয়েছে। যাদের অনেককে বানর, শূকর বানিয়ে দেয়া হয়েছে এবং যারা তাগুতের ইবাদত করেছে।-আল-মায়েদা-৬০-

————————- আল্লাহ্র ইবাদত করো এবং তাগুতের ইবাদত থেকে বিরত থাকো-এ শিক্ষা দেয়ার জন্যে আমরা প্রতিটি কওমের মধ্যে একজন পয়গাম্বর প্রেরণ করেছি।-নাহাল-৩৬

———————– যারা তাগুতের ইবাদত পরিত্যাগ করে আল্লাহ্র ইবাদতের দিকে প্রত্যার্বতন করেছে, তাদের জন্যে সুসংবাদ।-যুমার-১৭

তিনটি আয়াতেই তাগুতের ইবাদত মানে তাগুতের দাসত্ব-আনুগত্য, ইতিপূর্বেও আমরা সে ইঙ্গিত করেছি। যে রাষ্ট্যক্ষমতা আল্লাহ্দ্রোহী হয়ে আল্লাহ্র যমীনে নিজের হুকুম চালায়, বল প্রয়োগ, লোভ-লালসা প্রদর্শন বা বিভ্রান্ত শিক্ষা দ্বারা আল্লাহ্র বান্দাদেরকে আপন নির্দেশানুসারী করে-কোরআনের পরিভাষায় তাকেই বলা হয় তাগুত। এমন কোন ক্ষমতা নেতৃত্বের সামনে মাথা নত করা, তার বন্দেগী গ্রহণ করে নির্দেশ শিরোধার্য করে নেয়া তাগুতেরই ইবাদত করা।

ইবাদত-আনুগত্য অর্থে

এবার নীচের আয়াতগুলোর প্রতি লক্ষ্য করুন। এসব আয়াতে ইবাদত শুধু দ্বিতীয় অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।

———— হে বনী আদম! আমি কি তোমাদেরকে তাগীদ করি নি যে, শয়তানের ইবাদত করো না? কারণ সে তো তোমাদের প্রকাশ্য দুশমন।

জানা কথা যে, দুনিয়ার কেউই তো শয়তানের পূজা করো না? বরং সব দিক থেকে তার ওপরতো অভিশাপ-অভিসম্পাতই বর্ষিত হয়। সুতরাং কিয়ামতের দিনবনী আদমের বিরুদ্ধে আল্লাহ্র তরফ থেকে যে অভিযোগ দায়ের করা হবে; তা শয়তানের কথা মতো চলেছিলো, তার বিধানের আনুগত্য করেছিলো। যে যে পথের প্রতি ইংগিত করেছে, সে পথে তারা ছুটে চলেছিলো।

——————— (কিয়ামত সংঘটিত হলে আল্লাহ্ বলবেন) যে সমস্ত জালেম, তাদের সাথী ও আল্লাহ্ ছাড়া যেসব মাবুদদের তারা ইবাদত করতো, তাদের সকলকে একত্র করে জাহান্নামের পথ দেখাও।…. অতপর তারা একে অপরের প্রতি দোষারোপ করতে থাকবে। ইবাদতকারী বলবে, যারা কল্যাণের পথে আমাদের কা”ছে আসতো তোমরাই তো তারা! তাদের মাবুদরা জবাব দেবে; আসলে তো তোমরা নিজেরাই ঈমান আনার জন্যে প্রস্তুত ছিলো না। তোমাদের ওপর আমাদের কোন জোর জবরদস্তি ছিলো না, বরং তোমরা নিজেরাই ছিলে নাফরমান।” (সাফ্ফাত-২২-৩০)

এ আয়াতে আবেদ-মাবুদের মধ্যে যে প্রশ্ন-উত্তর উল্লেখ করা হয়েছে, তা প্রণিধান করলে স্পষ্টত জানা যায় যে, যেসব প্রতিমা-দেবতার পূজা করা হতো, এখানে মাবুদের অর্থ তা নয় বরং যেসব দেবতা-কর্তা ব্যক্তি কল্যাণের ছদ্মাবরণে মানুষকে বিভ্রান্ত-বিপথগামী করেছে, যারা পবিত্রতার লেবাসে হাজির হয়েছিলো, জপমালা ও চাদর-আলখাল্লা দ্বারা আল্লাহ্র বন্দাদের ধোঁকা দিয়ে যারা নিজেদের ভক্ত অনুরক্ত করে তুলে ছিলো অথবা যারা সংস্কার সংশোধন এবং শুভানুধ্যায়ীর দাবী করে ধ্বংস, অকল্যাণ ও বিপর্যয় ছড়িয়েছে-এমন লোকদের অন্ধ অনুসরণ এবং বিনা বাক্যব্যয়ে তাদের নির্দেশ মেনে নেয়াকেই এখানে তাদের ইবাদত বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

———————– তারা নিজেদের ওলামা-মাশায়েখদেরকে আল্লাহ্র পরিবর্তে নিজেদের রব বানিয়ে নিয়েছিলো, এমনি করে মসীহ ইবনে মারিয়ামকেও। অথচ তাদেরকে এক ইলাহ ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করার নির্দেশ দেয়া হয় নি।(তওবা-৩১)

ওলামা -মাশায়েখ, প্রাদ্রী-পূরোহিতদেরকে বর বানিয়ে তাদের ইবাদত করার অর্থ এখানে-তাদের নির্দেশ শিরোধার্য করে নেয়া। অনেক বিশুদ্ধ বর্ণনায় রাসূলুল্লাহ (সঃ) নিজেও এ অর্থ স্পষ্টত ব্যক্ত করেছেন। তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিলোঃ আমরা তো কখনো ওলামা-মাশায়েখ, পাদ্রী পুরোহিতদের পূজা করি নি। জবাবে তিনি বলেছিলেন; আর তারা যে জিনিসকে হারাম করেছিলো, তোমরা কি তাকে হারাম বানিয়ে নাও নি?

ইবাদত-পূজা অর্থে

এবার তৃতীয় অর্থের আয়াতগুলো নিন। এ প্রসঙ্গে স্মরণ রাখা দরকার যে, কোরআনের মতো পূজা অর্থে ইবাদতে দুটি বিষয় শামিল রয়েছেঃ

একঃ কারো জন্যে রুকু-সিজদা করা, হাত বেধে দাঁড়ানো, তাওয়াফ, আস্তনায় চুম্বন, নজর-নেয়াজ এবং কোরবানীর সেসব অনুষ্ঠান পালন করা, যা সাধারণত পূজার উদ্দেশ্যো করা হয়ে থাকে-তাকে স্বতন্ত্র উপাস্য (মাবুদ) মনে করেই এমন কাজ করা হোক, তাতে কিছু যায় আসে না।

দুইঃ কার্যকারণপরস্পরা জগতে কাউকে ক্ষমতাশালী মনে করে নিজের প্রয়োজনে তার কাছে দোয়া করা, নিজের দুঃখ-কষ্টে তাকে সাহায্যের জন্যে ডাকা এবং ক্ষয়-ক্ষতি ও বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে তার কাছে আশ্রয় চাওয়া।

কোরআনের দৃষ্টিতে এ দু’ধরনের কাজই সমভাবে পুজার পর্যায়ভুক্ত। উদাহরণস্বরূপঃ

—————— বল, আমার রবের পক্ষ থেকে স্পষ্ট নির্দেশ লাভ করার পর তোমরা আল্লাহ্কে ত্যাগ করে যাদের পূজা করছো, তাদের পূজা করতে আমাকে নিষেধ করা হয়েছে।-আল-মুমিন-৬৬

——————– (ইবরাহীম বললো) তোমাদেরকে এবং আল্লাহ্ ছাড়া যাদেরকে তোমরা ডাকো, তাদের সকলকেই আমি ত্যাগ করছি এবং আমার রব-কে ডাকছি।.. তাদের এবং আল্লাহ্ ছাড়া যাদের তারা ইবাদত করতো। সে যখন তাদের সকল থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো, তখন আমরা তাকে ইসহাকের মতো পুত্র দান করলাম।-মরিয়াম-৪৮-৪৯

—————— যে ব্যক্তি আল্লাহ্কে ত্যাগ করে এমন কাউকে ডাকে, যে কিয়ামত পর্যন্ত তাঁদের ডাকে সাড়া দিতে পারে না, তাদেরকে ডাকা হচ্ছে-এ খবর পর্যন্ত যাদের নেই, এমন ব্যক্তির চেয়ে বেশী পথভ্রষ্ট আর কে হতে পারে? হাশরের দিন এরা নিজেরাই হবে আহ্বানকারীদের দুশমন। সেদিন তারা এদের ইবাদত অস্বীকার করবে।১ -আল-আহকাফ-৪-৪

তিনটি আয়াতে কেরআন নিজেই স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, এখানে ইবাদতের অর্থ দোয়া চাওয়া এবং সাহায্যের জন্যে ডাকা।

—— বরং তারা জ্বিনের ইবাদত করতো।আর তাদের অধিকাংশই এদের প্রতি ঈমানএনেছিলো।” -সাবা-৪১

এখানে জ্বিনের ইবাদত এবং তাদের প্রতি ঈমান আনার যে অর্থ, সুরা জ্বিন-এর ৬নং আয়াত তার ব্যাখ্যা করছেঃ

—– কোন কোন মানুষ কোন কোন জীনের নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করতো।জ্বিন-২

এ জানা যায় যে, জ্বিনের ইবাদতের অর্থ তাদের আশ্রয় চাওয়া, বিপদাপদ ও ক্ষতির মোকাবিলায় তাদের নিকট নিরাপত্তা প্রার্থনা করা; আর তাদের প্রতি ঈমান আনার অর্থ তাদের আশ্রয় দান করা এবং নিরাপত্তা বিধানের ক্ষমতা আছে-এমন বিশ্বাস পোষণ করা।-

———————– আল্লাহ্ যেদিন তাদেরকে হাযির করবেন, আর হাযির করবেন সেসব মাবুদকে, আল্লাহ্কে ত্যাগ করে তারা যাদের ইবাদত করতো, সেদিন তিনি তাদের জিজ্ঞেস করবেনঃ আমার এ বান্দাদের তোমরা গোমরাহ করেছিলো না তারা নিজেরাই সত্য-সরল পথ হারিয়ে বসেছিলো? তারা আরাজ করবে; সুবাহানল্লাহ! হুযুরকে ত্যাগ করে অন্য কাউকে সঙ্গীসাথী করা আমাদের জন্যে কখন সমীচীন ছিলো!-আল-ফোরকান-১৭-১৮

এখানে বর্ণনা ভঙ্গি থেকে স্পষ্ট জানা যায় যে, মাবুদের অর্থ সঙ্গীসাথী আর তাদের ইবাদতের অর্থ, তাদেরকে বন্দেগীর গুনাবলী থেকে উন্নত এবং খোদায়ীর গুণাবলীতে বিভূষিত মনে করা; তাদেরকে গায়েবী সাহায্য, মুশকিল দূরীকরণ, পালন করা, যা পূজার সীমা পর্যন্ত গিয়ে পৌছেছে।

—— যেদিন আল্লাহ্ তাদের সকলকে সমবেত করবেন, অতপর ফেরেশতাদের জিজ্ঞেস করবেন; এরা যাদের ইবাদত করতো, তোমরাই কি তারা? জবাবে তারা বলবে, সুবহান্নাল্লাহ! তাদের সাথে আমাদের কি সম্পর্ক? আমাদের সম্পর্কতো আপনার সাথে।-সাবা-৪০-৪১

এখানে ফেরেশতার ইবাদতের১ অর্থ, তাদের পূজা। এ পূজা করা হতো তাদের অবস্থান, আকৃতি ও কাল্পনিক প্রতিকৃতি তৈরী করে। এপূজার উদ্দেশ্য ছিলো, তাদেরকে খুশী করে নিজেদের অবস্থার প্রতি তাদের অনুগ্রহ-দৃষ্টি আকর্ষণ করা এবং নিজেদের পার্থিব ব্যাপারে তাদের সাহায্য লাভ করা।

———— এবং তারা আল্লাহ্কে ত্যাগ করে কিছুর ইবাদত করছে, যা তাদের কল্যাণ-অকল্যাণ কিছুই করতে পারে না। আর বলেঃ এরা আল্লাহ্র দরবারে আমাদের সুপারিশকারী।-ইউনুস-১৮

—– আর যারা আল্লাহ্কে ত্যাগ করে অন্যদের বন্ধু বানিয়ে রেখেছে, তারা বলে-এরা আমাদেরকে আল্লাহ্র নিকটবর্তী করবে-কেবল এজন্যেই তো আমরা তাদের ইবাদত করছি।-আজ-জুমার-৩

এখানেও ইবাদতের অর্থ পূজা। যে উদ্দেশ্যে এ পূজা করা হতো, তাও ব্যাখ্যা করে দেয়া হয়েছে।

ইবাদত-বন্দেগীত-আনুগত্য -পূজা অর্থে

ওপরের উদহারণগুলো থেকে এ কথা ভালোভাবে স্পষ্ট হয়েছে যে, ইবাদত শব্দটি কোরআনের কোথাও দাসত্ব-আনুগত্য অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে, কোথাও শুধু আনুগত্য এবং কেবল পূজা অর্থে। যেখানে এ শব্দটি এক সঙ্গে তিনটি অথেই ব্যবর্হত হয়েছে, তার উদাহরণ দেয়ার আগে আর একটা ভুমিকা স্মরণ করা দরকার।

ওপরের যতগুলো উদাহরণ দেয়া হয়েছে, তার সবগুলোতে আল্লাহ্ ছাড়া অন্যদের ইবাদতের উল্লেখ আছে। যেখানে ইবাদতের অর্থ দাসত্ব-আনুগত্য, সেখানে

১. অনান্য মুশরেক জাতিরা এ ফেরেশতাদেরকে দেবতা (Gods) বানিয়েছে। আর আরববাসীরা তাদেরকে বলতো আল্লাহ্র কন্যা-সন্তান।

মাবুদ হয় শয়তান অথবা সেসব বিদ্রোহী ব্যক্তি, যারা নিজেরা তাগুত সেজে আল্লাহ্র বান্দাদের দ্বারা আল্লাহ্র পরিবর্তে নিজেদের বন্দেগী-আনুগত্য করিয়েছে অথবা এমন সব নেতা-কর্তা ব্যক্তি যারা কিতাবুল্লার পরিবর্তে নিজেদের মনগড়া মত-পথে জনগণকে চালিত করেছিলো। আর যেখানে ইবাদতের অর্থ পূজা, সেখানে মাবুদ হচ্ছে আম্বিয়া-আওলিয়া-সালেহীন-সৎসাধূ পুরুষ, তাদের শিক্ষা ও হেদায়েতের বিরুদ্ধেই তাদেরকে মাবুদ বানানো হয়েছে অথবা ফেরেশতা ও জ্বিন নিছক ভ্রান্ত ধারণাবশত অতি প্রাকৃতিক রুবুবিয়াতে তাদেরকে শরীক মনে করা হয়েছে অথবা কাল্পনিক শক্তির মূর্তি -প্রতিমা নিছক শয়তানী প্ররোচনায় যা পূজার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। সেখানে মাবুদ হচ্ছে আম্বিয়া-আওলিয়া-সালেহীন-সৎসাধূ পুরুষ, তাদের শিক্ষা ও হেদায়েতের বিরুদ্ধেই তাদেরকে মাবুদ বানানো হয়েছে অথবা ফেরেশতা ও জ্বিন নিছক ভ্রান্ত ধারণাবশত অতি প্রাকৃতিক রুবুবিয়াতে তাদেরকে শরীক মনে করা হয়েছে অথবা কাল্পনিক শক্তির মূর্তি -প্রতিমা নিছক শয়তানী প্ররোচনায় যা পূজার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। কোরআন এই সব রকমের মাবুদকেই বাতিল এবং তাদের ইবাদতকে ভ্রান্ত প্রতিপন্ন করে। তাদের গোলামী, আনুগত্য পূজা- যা-ই করা হোক না কেন। কোরআন বলেঃ তোমাদের এসব মাবুদ-যাদের তোমরা পূজা করছো- আল্লাহ্র বান্দা ও গোলাম। তোমাদের ইবাদত পাওয়ার তাদের কোন অধিকার নেই। তাদের ইবাদত দ্বারা ব্যথর্তা ও লাঞ্ছনা-গঞ্জনা ছাড়া তোমাদের কিছুই ভাগ্যে জুটবে না-কিছু লাভ হবে না। আসলে তাদের এবং সারা বিশ্ব জাহানের মালেক আল্লাহ্। সকল ক্ষমতা ইখতিয়ার তাঁরই হাতে নিবদ্ধ। সুতরাং কেবল আল্লাহ্ ছাড়া আর কেউ-ই- ইবাদত পাওয়ার যোগ্য নয়।

——————— আল্লাহকে ত্যাগ করে তোমরা যাদের ডাকছো, তারা তো কেবল তোমাদের মতোই বান্দা। তাদের ডেকে দেখো, তাদের ব্যাপারে তোমাদের বিশ্বাস যদি সত্য হয় তবে তারা তোমাদের ডাকে সাড়া দিক।১…… আল্লাহ্ ছাড়া তোমরা যাদের ডাকছো, তারা তোমাদের কোন সাহায্য করতেও তারা সক্ষম নয়। -আল-আরাফ-১৯৪-১৭

১. জবাব দেয়ার অর্থ জবাবে সাড়া দেয়া নয়, বরং তার জবাবী ব্যবস্থা অবলম্বন করা। ইতিপূর্বে আমরা সেদিকে ইঙ্গিত করেছি।

————– ওরা বলে; রহমান কাউকে পুত্র হিসাবে গ্রহণ করেছেন! অথচ তাঁর কোন পুত্র সন্তান হবে -তা থেকে তিনি অনেক উর্ধ্বে। তারা যাদেরকে তাঁর পুত্র বলে-আসলে তার-হচ্ছে তাঁর বান্দা; যাদেরকে মর্যাদা দান করা হয়েছে। একটু এগিয়ে গিয়ে আল্লাহ্র দরবারে কিছু আরজ করার ক্ষমতাও তাদের নেই, বরং তার নির্দেশ মতই তারা কাজ করে। তাদের কাছে যা কিছু স্পষ্ট তাও আল্লাহ্ জানেন, আর যা কিছু তাদের কাছে অস্পষ্ট-লুকায়িত, তার খবরও তিনি রাখেন। আল্লাহ নিজে যার সুপারিশ কবুল করতে চান, তা ছাড়া তারা আল্লাহ্র দরবারে কারো জন্যে কোন সুপারিশই করতে পারে না। আর তাদের অবস্থা এই যে, আল্লাহ্র ভয়ে তারা নিজেরাই সদা সন্ত্রস্ত।১-আল-আম্বিয়া-২৬-১৮

————————– তারা ফেরশতাদেরকে-প্রকৃতপক্ষে যারা রহমানের বান্দা-দেবী বানিয়ে রেখেছে।-আয-যুখরূফ-১৯

———————————– তারা জ্বিন এবং আল্লাহ্র মধ্যে বংশগত সম্পর্ক ধারণা করে নিয়েছে। অথচ জ্বিনরা নিজেরা জানে যে, একদিন হিসেব দেয়ার জন্যে তাদেরকে আল্লাহ্র দরবারে হাযির হতে হবে। -আস-সাফ্ফাত-১৫৮

——————————– আল্লাহ্র বান্দা হওয়াকে মসীহ কখনো মনে করেন নি, দোষের মনে করেন নি নিকটতম ফেরেশতারাও। আর যে কেউ তাঁর বন্দেগী-গোলামীতে লজ্জাবোধ করে এবং অহংকার করে, (সে পালিয়ে যাবে কোথায়?) এমন সব মানুষকেই আল্লাহ্ তাঁর হুযুরে টেনে আনবেন।

—————————— চন্দ্র-সূর্য সবাই পরিক্রমণে নিয়োজিত। তারকা ও বৃক্ষ আল্লাহ্র সামনে আনুগত্যের শির নত করে আছে।-আর-রহমান-৫-৬

———————————— সাত আসমান-যমীন এবং তার মধ্যে যতসব বস্তু আছে-সকলেই আল্লাহ্র তসবীহ পড়ছে। এমন কোন বস্তু নেই, যা প্রশংসা- স্তুতির সাথে তাঁর তসবীহ পাঠ করে না কিন্তু তোমরা তাদের তসবীহ বুঝতে পারো না। -বনী-ইসরাঈল-৪৪

————————— আল্লাহ্র কুদরতের কব্জায় বাধা নয়-এমন কোন প্রাণীই নেই।-হূদ-৫৬

——————————— রহমানের সামনে গোলাম হিসাবে হাযির হবে না-আসামন-যমীনের বাসিন্দাদের মধ্যে এমন কেউ নেই। তিনি সকলকে শুমার করে রেখেছেন। আর কিয়ামতের দিন এক এক করে সকলেই তাঁর সামনে উপস্থিত হবে। -মরিয়াম-৯৩-৯৯৫

——————— বলঃ আল্লাহ্! রাজত্বের মালিক। যাকে খুশী তুমি রাজ্য দান করো, যার কাছ থেকে খুশী রাজ্য ছিনিয়ে নাও। যাকে ইচ্ছা ইজ্জত দাও, যাকে খুশী বেইজ্জত করো। মঙ্গর-কল্যাণ তোমার ইখতিয়ারে। নিশ্চই তুমি সব কি”ছুর ওপর ক্ষমতাবান।-আলে-ইমরান-২৬

কোননা কোন আকারে যাদের ইবাদত করা হয়েছে, এমনিভাবে তাদের সকলকে আল্লাহ্র গোলাম ও অক্ষম প্রমাণিত করার পর জ্বিন-ইনসান সকলের কাছে কোরআন দাবী জানায়-সকল অর্থের দৃষ্টিতে ইবাদত কেবল আল্লাহ্র জন্যে হওয়াই বিধেয়। গোলামী, আনুগত্য, পূজা-সব কিছুই হবে তারই জন্যে। আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারো জন্যে কোন ধরনের ইবাদতের লেশমাত্রও থাকতে পারবে না।

————– আল্লাহ্র ইবাদত করো এবং তাগুত থেকে বিরত থাকো-এ পয়গাম দিয়ে প্রত্যেক উম্মতের মধ্যে আমরা রাসূল পাঠিয়েছি।-আন-নহল-৩৬

———————————- যারা তাগুতের ইবাদত থেকে নিবৃত্ত থেকে আল্লাহ্র দিকে প্রর্ত্যাবতন করেছে-তাঁদের জন্যে সুসংবাদ।-আয-যুমার-১৭

———————- হে বনী আদম! আমি কি তোমাদেরকে তাগিদ করি নি যে, শয়তানের ইবাদত করো না? সে তোমাদের প্রকাশ্য দুশমন। এবং আমারই ইবাদত করবে। এটাই সোজা-সরলপথ।-ইয়াসিন-৬০-৬১

————————————– তারা আল্লার পরিবর্তে ওলামা-মাশায়েখ, পাদ্রী-পুরোহিতদেরকে রব বানিয়ে নিয়েছিলো।…. অথচ ইলাহ ছাড়া আর কারো ইবাদত না করার জন্যে তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিলো।-তওবা-৩১

—————————————– হে ঈমানদাররা! তোমরা যদি সত্যিই আমার ইবাদত অবলম্বন করে থাকো তাহলে আমি তোমাদেরকে যেসব পাক জিনিস দান করেছি, নির্দ্বিধায় তা খাও এবং আল্লাহ্র শোকর আদায় করো।-বাকারা-১৭২

বন্দেগী-গোলামী, আনুগত্য-ফরমাবরদারীর অর্থে যে ইবাদত, এসব আয়াতে তাকে আল্লাহ্র জন্যে নির্দিষ্ট করার নির্দেশ দেয়া হচ্ছে, এসব আয়াতে তার প্রমাণ রয়েছে।

——————————– বল! তোমার আল্লাহ্কে ত্যাগ করে যাদের ডাকছো, তাদের ইবাদত করতে আমাকে নিষেধ করা হয়েছে। এ জন্যে আমার রবের তরফ থেকে আমার কাছে স্পষ্ট নিদর্শনও পৌছেছে। এবং রাব্বুল আলামীনের সামনে মাথা নত করার জন্যে আমাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।-মুমিন-৬৬

———————————————— তোমাদের রব বলেছেন; আমাকে ডাকো, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেবো। যারা আমার ইবাদত করতে অহংকার করবে তারা অবশ্যই জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে।-মুমিন-৬০

——————————– সে আল্লাহ্ই তো তোমাদের রব, রাজত্ব তাঁর। তিনি ছাড়া তোমরা যাদের ডাকছো অণু পরিমান বস্তুও তাদের ইখতিয়ারে নেই। তোমরা তাদের ডাকলে তারা তোমাদের ডাক শুনতে পায় না, শুনতে পেলেও জবাব দিতে পারে না। কিয়ামতের দিন তারা তোমাদের শের্ক অস্বীকার করবে।

—————————- বল! তোমরা কি আল্লাহ্কে ত্যাগ করে এমন কিছুর ইবাদত করছো? যারা না পারে তোমাদের কোন ক্ষতি করতে, না পারে কোন উপকার! কেবল ই তো সব কিছুর শ্রোতা, সব জান্তা।

যে ইবাদতের অর্থ পূজা, এ সব আয়াতে তাকে আল্লাহ্র জন্যে বিশেষিত করতে হেদায়েত দেয়া হয়েছে। ইবাদতকে যে দোয়ার সমর্থক হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে তারও স্পষ্ট নিদের্শক রয়েছে। পূর্বাপর আয়াতসমূহে সেসব মাবুদের উল্লেখ দেখা যায়, অতি প্রাকৃতিক রুবুবিয়াতে যাদেরকে আল্লাহ্র শরীক করা হতো।

এখন কোন দিব্যদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তির জন্যে এটা অনুধাবন করা দুঃসাধ্য নয় যে, কোরআনের যে যে স্থানে আল্লাহ্র ইবাদতের উল্লেখ আছে, ইবাদতের বিভিন্ন অর্থের কোন একটির জন্যে তাকে নির্দিষ্ট করা হয়েছে-আশপাশে কোথাও এমন কোন প্রমাণও যদি না থাকে, এমন সব স্থানে ইবাদত অর্থ দাসত্ব, আনুগত্য এবং পূজা তিনটি হবে। উদাহরণস্বরুপ নীচের আয়াতগুলো লক্ষ্য করুন।

——————————- আমি-ই আল্লাহ্। আমি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই। সুতরাং তুমি কেবল আমারই ইবাদত করো।-ত্বাহা-১৪

———————– সে আল্লাহ্ই তোমাদের রব! তিনি ব্যতীত অন্য কোন ইলাহ নেই। তিনি সমুদয় বস্তুর স্রষ্টা। সুতরাং তোমরা কেবল তাঁরই ইবাদত করো এবং তিনি সব জিনিসের যথাযথ খবর রাখেন।-আনআম-১০২

———————————————————— বল, হে লোক সকল! আমার দীন কি, তা এখনও যদি তোমাদের অজানা থাকে,. তবে জেনে নাও যে, আল্লাহ্ ছাড়া তোমরা যাদের ইবাদত করো, আমি তাদের ইবাদত করি না, বরং আমি সে আল্লাহ্র ইবাদত করি, যিনি তোমাদের জান কবজ করেন। ঈমানদারদের মধ্যে শামিল হওয়ার জন্যে আমাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।-ইউনুস-১০৪

———————————— আল্লাহ্ ছাড়া আর যাদের তোমরা ইবাদত করছো, তোমাদের ও তোমাদের বাপ-দাদার রাখা কয়েকটি নাম ছাড়া তাদের তো আর কোন অস্তিত্ব নেই। তারা যে উপাস্য, এমন কোন দলীল -তো আল্লাহ্ নাযিল করেন নি। ক্ষমতা কেবল আল্লাহ্র জন্যে নির্দিষ্ট। তাঁরই নির্দেশ যে, তাঁর ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করা যাবে না। এটাই তো সোজা-সরল পথ।-ইউসুফ-৪০

———- আসমান-যমীনের যত তত্ত্ব বান্দাদের অজানা, সে সবের জ্ঞান কেবল আল্লাহ্রই রয়েছে। সকল বিষয় তাঁর হুজুরেই পেশ হয়। সুতরাং তুমি কেবল তাঁরই ইবাদত করো এবং তারই ওপর নির্ভর করো।-হৃদ-১২৩

——————————————————————————————– যা কিছু আমাদের সামনে আছে, আর যা কিছু আমাদের কাছে উহ্য, গোপন, আর যা কিছু রয়েছে এতদোভয়ের মধ্যখানে সব কিছুরই মালিক আল্লাহ্,তোমার রব। আর তোমার রব ভোলেন না। তিনি আসমান-যমীনের মালিক, মালিক সেসব বস্তুর, যেগুলো এতদোভয়ের মধ্যে রয়েছে। সুতরাং তুমি তারই ইবাদত কর এবং তাঁর ইবাদতের ওপর দৃঢ় থাকো।-মরিয়াম-৬৪-৬৫

————————– সুতরাং যে আপন রবের দীদার প্রত্যাশা করে, তার উচিত সৎ কর্ম করা এবং আপন রবের ইবাদতের সাথে অন্য কারো ইবাদতকে শরীক না করা।-কাহাফ-১১০

এসব আয়াত এবং এ ধরনের অন্যান্য আয়াতে ইবাদতকে নিছক পূজা,বন্দেগী বা আনুগত্যের জন্যে নির্দিষ্ট করে নেয়ার কোন কারণ নেই। এ ধরনের আয়াতে কোরআন মূলত পরিপূর্ণ দাওয়াত পেশ করে। স্পষ্ট কোরাআনের দাওয়াতই হচ্ছে এই যে, দাসত্ব-আনুগত্য-পূজা-যা কিছুই হবে,সবই হবে আল্লাহ্র জন্যে। সুতরাং এসব স্থানে ইবাদতকে সীমিত কোনও একটি অর্থে সীমিত করা মূলত কোরআনের দাওয়াতকে সীমিত করারই নামান্তর। আর এর অনিবার্য পরিণতি এই দাঁড়াবে যে, যারা কোরআনের দাওয়াতের এক সীমিত ধারণা নিয়ে ঈমান আনবে, তাঁরা তার অসমাপ্ত-অসম্পূর্ণ অনুসরণই করবে।

দীন

আভিধানিক তত্ত্ব

আবরী ভাষায় ‘দীন’ শব্দটি বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়।

একঃ শক্তি-ক্ষমতা, শাসন-কর্তৃত্ব, অপরকে আনুগত্যের জন্যে বাধ্য করা, তার ওপর সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়োগ করা, তাকে গোলাম ও আদেশানুগত করা। যেমন বলা হয়ঃ———— অর্থাৎ লোকেদেরকে আনুগত্যের জন্যে বাধা করেছে——— অর্থাৎ আমি তাদের পরাভূত করেছি, আর তারা অনুগত হয়ে পড়েছে।———- অর্থাৎ আমি অমুক দলকে বশীভুত করে গোলাম বানিয়ে নিয়েছি। ——–অমুক ব্যক্তি মর্যাদা ক্ষমতার অধিকারী হয়েছে,————– আমি তাকে এমন কাজের জন্যে বাধ্য করেছি, যার জন্যে সে রাজী ছিলো না, ———– অমুক ব্যক্তি সে কাজের জন্যে জোরপূর্বক বাধ্য হয়েছে, ———– আমি তার ওপর হুকুম চালিয়ে কর্তৃত্ব করেছি ——লোকের শাসন কর্তৃত্ব আমি অমুক ব্যক্তি সোপর্দ করেছি। এ অর্থে জনৈক কবি তার মাতাকে সম্বেধন করে বলছেঃ

—————————– তোমাকে স্বীয় সন্তানের রক্ষক-তত্ত্বাবধায়ক করা হয়েছিলো, শেষ যর্যন্ত তুমি তাদেরকে আটার চেয়েও সূক্ষ করে ছাড়লে।

হাদীস শরীফে উক্ত হয়েছেঃ-

———————— অর্থাৎ বুদ্ধিমান সে ব্যক্তি, যে তার নফসকে দমন করে এমন কার্য করেছে যা তার পরকালের জন্যে কল্যাণকর। এ অর্থের দৃষ্টিতে সে ব্যক্তিকে — (দাইয়ান) বলা হয়, যে কোন দেশ জাতি বা দলের ওপর বিজয়ী হয়ে কর্তৃত্ব চালায়। আশা আলহারমাযী নবী (সঃ) কে সম্বোধন করে বলছেঃ ———– (হে মানুষের নেতা, আরবের সর্দার)। এ অর্থে –(মাদীনুন) অর্থ গোলাম আর – (মাদীনাতুন) অর্থ বাদী-দাসী। আর —- অর্থ দাসী- তনয়। কবি আখতার বলছেঃ ————

আর কোরআন বলছেঃ

——————- অর্থাৎ তোমরা যদি কারো কর্তৃত্বাধীন, অনুগত ও বাধ্য না হয়ে থাকো তাহলে মৃতপ্রায় ব্যক্তিকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করো না কেন?

দুইঃ দাসত্ব-অনুগত্য, সেবা, কারো জন্যে বশীভূত হয়ে যাওয়া, কারো নির্দেশাধীন হওয়া, কারো প্রভাব-প্রতাপে নিষ্পেষিত হয়ে তার মোকাবেলায় অপমান সহ্য করে নেয়া। বলা হয়ে থাকে ———- অর্থাৎ আমি তাদেরকে পরাভুত করেছি এবং তারা অনুগত হয়ে পড়েছে। ——- অর্থাৎ আমি অমুক ব্যক্তির খেদমত করেছি। হাদীসে উক্ত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেনঃ

——————- আমি কোরায়েশকে এমন এক বাক্যে অনুবতী করতে চাই যে, তারা তা স্বীকার করে নিলে সমগ্র আরব তাদের সামনে মাথা নত করবে। এ অর্থানুযায়ী আনুগত্যপরায়ণ জাতিকে বলা হয় —— (কওমুন দাইয়্যেনুন)। আর এ অর্থেই ‘হাদীসে খাওয়ারেজে’ দীন শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছেঃ১

১. এ হাদীসের অর্থ এ নয় যে, খারেজীরা দীন অর্থাৎ মিল্লাত থেকে বেড়িয়ে যাবে। কারণ হযরত আলী (রাঃ) -কে যখন তাদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলঃ- —-তারা কি কাফের? তখন তিনি বলেছিলেনঃ ——– অর্থাৎ কুফর থেকেইতো তারা পলায়ন করেছে। আবার তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হলোঃ ——– -তবে কি তারা মোনাফেক? তিনি বললেন, মনুফেকতো আল্লাহ্কে কম স্মরণ করে, আর তাদের অবস্থা এই যে, রাত-দিন আল্লাহ্কে স্মরণ করে আর তাঁর যিকির করে। সুতরাং এ থেকে প্রতিপন্ন হয় যে, এ হাদীসে দীনের অর্থ ইমামের আনুগত্য। ইবনুল আসীর তাঁর ‘নেহায়া’ গ্রন্থে এর অর্থ লিখিছেনঃ

—————

তিনঃ শরীয়ত আইন-কানুন, পথ-পন্থা, – ধর্ম, মিল্লাত, রসম-প্রথা, অভ্যাস। যেমন বলা হয়ঃ ———- চিরকাল আমার এ পথ -পন্থা রয়েছে। ———- অর্থাৎ মানুষ ভাল-মন্দ যে কোন পন্থাই অনুসারী হোক না কেন, উভয় অবস্থাতেই, সে যে পন্থার অনুসারী তাকে দীন বলা হবে। হাদীস শরীফে আছেঃ ————- কোরায়েশ ও যারা কোরায়েশের মত-পথের অনুসারী ছিলো। হাদীসে আরও আছেঃ ———- নবুয়াতের পূর্বে নবী (সঃ) তাঁর কওমের দীনের ওপর ছিলেন অর্থাৎ বিবাহ-তালাক, মীরাস এবং অনান্য সামাজিক-তমুদ্দুনিক ব্যাপারে তিনি সেসব রীতিনীতি মেনে চলতেন যা তাঁর কওমের মধ্যে প্রবর্তিত ছিল।

চারঃ কর্মফল, বিনিময়, প্রতিদান, ক্ষতিপূরণ, ফয়সালা, হিসাব-নিকাশ। আরবী ভাষায় প্রবাদ আছেঃ ——— -মানে যেমন কর্ম, তেমন ফল। তুমি যেমন কর্ম করবে তেমন ফল ভোগ করবে। কোরআনে কাফেরদের এ উক্তি উল্লেখিত হয়েছেঃ ———– -মৃত্যুর পর আমাদের কাছ থেকে কি হিসাব নেয়া হবে? আমরা কি প্রতিফল পাবো। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর- এর হাদীসে আছেঃ

——————– তোমরা শাসকদের গালি দিও না। যদি কিছু বলতেই হয়, তাহলে বলবেঃ আল্লাহ্! তারা আমাদের সাথে যেমন করছে, তুমি তাদের সাথে তেমন করো। এ অর্থেই ——- (দাইয়্যান) শব্দটি কাজী, বিচারক, আদালতের বিচারপতি অর্থেই ব্যবহৃত হয়। কোন বুযুর্গকে হযরত আলী (রাঃ) সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেনঃ ——- নবী (সঃ) -এর পরে তিনি উম্মতের সবচেয়ে বড় কাজী ছিলেন।

কোরআনে দীন শব্দের ব্যবহার

একঃ প্রভাব-প্রতিপত্তি, অধিপত্য-কোন ক্ষমতাসীনের পক্ষ থেকে।

দুইঃ এতায়াত -বন্দেগী দাসত্ব -আনুগত্য-ক্ষমতাসীনের সামনে মাথা নতকারীর পক্ষ থেকে।

তিনঃ নিয়ন-নীতি, পথ-পন্তা যা মেনে চলা হয়।

চারঃ হিসাব-নিকাশ ফয়সালা, প্রতিদান, প্রতিফলন।

আরবাসীরা এ শব্দটিকে কখনো এক অর্থে, কখনো ভিন্ন অর্থে বিভিন্নভাবে ব্যবহার করতো। কিন্তু যেহেতু এ চারটি বিষয়ে আরবদের ধারণা সম্পূর্ণ স্পষ্ট ছিল না; খুব একটা উন্নতও ছিল না, তাই শব্দটির ব্যবহারে অস্পষ্টতা ছিল। ফলে তা কোন বিধিবদ্ধ চিন্তাধারার পারিভাষিক শব্দ হতে পারে নি। কোরআন এ শব্দটিকে আপন উদ্দেশ্যের জন্যে উপযুক্ত বিবেচনা করে একেবারে স্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট অর্থের জন্য ব্যবহার করেছে। কোরআনের ভাষায় দীন শব্দটি একটি পরিপূর্ণ বিধানের প্রতিনিধিত্ব করে। চারটি অংশ নিয়ে সে বিধান গঠিতঃ

একঃ সার্বোভৌমত্ব, সবোর্চ্চ ও সার্বিক ক্ষমতা।

দুইঃ সার্বোভৌমত্বের মোকাবেলায় আত্মসমর্পণ ও আনুগত্য।

তিনঃ এ সার্বোভৌমত্বের প্রভাবধীনে গঠিত চিন্তা ও কর্মধারা।

চারঃ সে ব্যবস্থায় আনুগত্যের পুরস্কার বা বিদ্রোহ-বিরোধিতার শাস্তিস্বরূপ উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে প্রদত্ত প্রতিদান-প্রতিফল।

কোরআন কখনো প্রথম অর্থে, কখনো দ্বিতীয় অর্থে শব্দটি ব্যবহার করেছে। কখনো তৃতীয় অর্থে, আবার কখনো চতুর্থ অর্থে। কখনো ‘আদ-দীন’ বলে অংশ অংশচতুষ্টয়সহ পুরো ব্যবস্থাটাই গ্রহণ করেছে। তা স্পষ্ট করে জানার জন্যে কোরআনের নিম্মোক্ত আয়াতগুলো লক্ষ্য করুনঃ

দীন প্রথম ও দ্বিতীয় অর্থে

————————- তিনি আল্লাহ্, যিনি তোমাদের জন্যে যমিনকে বাসস্থান করেছেন, আর আসমানকে করেছেন ছাদ, তোমাদের আকৃতি দান করেছেন এবং তাকে কতই না সুন্দর করেছেন! যিনি পবিত্র বস্তু থেকে তোমাদের রিজিক সরবরাহ করেছেন। সে আল্লাহ্ই তোমাদের রব। রাব্বুল আলামীন, মহান মর্যাদার অধিকারী-বরকতের মালিক। তিনি চিরঞ্জীব। তিনি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই। সুতরাং দীনকে একান্তভাবে তাঁর জন্যে নিবেদিত করে তোমরা তাঁকেই ডাকো। সকল প্রশংসা আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের জন্যে। -আল-মুমিন-৬৪-৬৫

———————— বল, একান্তভাবে দীনকে তাঁর জন্যে খালেছ করে আল্লাহ্র ইবাদত করার জন্যেই আমি আদিষ্ট হয়েছি। সর্বোপ্রথম আনুগত্যের শির নত করার জন্যে আমাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। …….বল, আমার দীনকে আল্লাহ্র জন্যে খালেছ করে আমি তাঁর ইবাদত করবো। তোমাদের ইখতিয়ার আছে, তাঁকে বাদ দিয়ে যাকে খুশী তার বন্দেগী করে বেড়াতে পার। … আর যারা তাগুতের বন্দেগী হতে নিবৃত্ত থেকে আল্লাহ্র দিকে প্রত্যাবর্তন করে, তাদের জন্যে রয়েছে সুসংবাদ।-আজজুমার-১১-১৭

————————- আমরা তোমার প্রতি সত্য-সঠিক গ্রন্থ নাজিল করেছি। সুতরাং আল্লাহ্র জন্যে দীনকে খালেছ করে কেবল তাঁরই ইবাদত কর। দীন একনিষ্ঠভাবে আল্লাহ্র-ই-জন্যে নিবেদিত-নিদিষ্ট।-আজজুমার -২.৩

আসমান জমীনে যা কিছু আছে, সবাই আল্লাহ্র। দীন একান্তভাবে তাঁরই জন্যে নিবেদিত। তবুও কি আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কাউকে তোমরা ভয় করবে-তাকওয়া করবে? (অর্থাৎ আল্লাহ্ ব্যতীত এমন কেউ আছে কি, যার নির্দেশে অবাধ্যতা থেকে তোমরা বিরত থাকবে এবং যার অসন্তুষ্টিকে তোমরা ভয় করবে।-আন-নাহাল-৫২

—————– তারা কি আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারো দীন তালাশ করছো? অথচ আসমান-জমীনের সমূদয় বস্তুর ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় আল্লাহ্রই নির্দেশানুবর্তী।আর তাঁরই কাছে তাদেরকে ফিরে যেতে হবে।-আল-ইমরান-৮৩

——————– দীনকে একনিষ্টভাবে আল্লাহ্র জন্যে খালেছ করা ব্যতীত তাদেরকে অন্য কিছুর নির্দেশ দেয়া হয় নি। -আল-বাইয়েনা-৫

——————- এসব আয়াতে সবোর্চ্চ ক্ষমতা এবং সে ক্ষমতা স্বীকার করে তার বন্দেগী-আনুগত্য কবুল করার অর্থে দীন শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। আল্লাহ্র জন্যে দীনকে খালেছ করার অর্থ এই যে, মানুষ আল্লাহ্ ছাড়া আর কোন সাবোর্ভৌমত্ব, শাসন-কর্তৃত্ব ও আধিপত্য স্বীকার করবে না, আপন দাসত্ব-আনুগত্যকে এমনভাবে রর জন্যে খালেছ করবে, যাতে অন্য কারো সরাসরি আনুগত্যকে আল্লাহ্র আনুগত্যের সাথে শরীক করবে না মোটেই।১

দীন তৃতীয় অর্থে

————————— বল, হে লোক সকল! আমার দীন সম্পর্কে তোমাদের যদি কোন সন্দেহ থাকে (অর্থাৎ আমার দীন কি সে সম্পর্কে তোমাদের যদি স্পষ্ট জানা না থাকে) তবে শোনঃ তোমরা আল্লাহ্কে বাদ দিয়ে যাদের বন্দেগী আনুগত্য করছো, আমি ১. অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া যার -আনুগত্যই করবে, তা করবে আল্লাহ্র আনুগত্যের অধীনে এবং তাঁরই নির্ধারিত সীমা-রেখার মধ্যে। পুত্র কর্তৃক পিতার আনুগত্য, স্ত্রী কর্তৃক স্বামীর আনুগত্য, গোলাম-চাকর কর্তৃক মনিবের আনুগত্য এবং এ ধরনের অন্য সকল প্রকার আনুগত্য যদি আল্লাহ্র নির্দশের ভিত্তিতে হয়, হয় তাঁর নির্ধারিত সীমা রেখার ভেতরে, তবে তা হবে অবিকল আল্লাহ্রই আনুগত্য। আর যদি তা আল্লাহ্ বিধি-নিষেধ এবং সীমারেখা থেকে মুক্ত হয়, অন্য কথায় তা যদি স্বতন্ত্র আনুগত্য হয়, তা আনুগত্য হবে না; হবে আল্লাহ্র নির্দেশের সাথে প্রকাশ্য বিদ্রোহ-সরাসরি তাঁর নির্দেশের বিরোধিতা। রাষ্ট্র শাসন ব্যবস্থা যদি আল্লাহ্র আইনেরও ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত হয়, তাঁরই নির্দেশ জারি করে, তবে তার আনুগত্য ফরজ-বাধ্যতামূলক। আর যদি এমন না হয়, তবে তার আনুগত্য অপরাধ-এক ধরনের পাপ।

তাদের বন্দেগী আনুগত্য করি না, বরং আমি সে আল্লাহ্র বন্দেগী করি, যিনি তোমাদের জান কবজ করেন! যারা এ আল্লাহ্কে মানে, তাদের পর্যায়ভুক্ত হওয়ার জন্যে আমি আদিষ্ট- নির্দেশিত। আমাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে; একান্তভাবে এ দীনের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাক এবং কিছুতেই শিরকবাদীদের পর্যায়ভুক্ত হয়ো না।

——————— শাসন-কর্তৃক আল্লাহ্ ছাড়া আর কারো নয়। তাঁরই নির্দেশ, তিনি ব্যতীত আর কারো বন্দেগী করো না। এটাই সত্য-সঠিক দীন।

———————- আসমান-যমীনে যা কিছু আছে, সবই তাঁর। সকলেই তাঁর হুকুমের তাবেদার।……….. তোমাদের বোঝবার জন্যে তিনি স্বয়ং তোমাদের ব্যাপার থেকেই একটি উদাহরণ পেশ করছেন। বল, এই যে গোলাম তোমাদের অধীন, আমি তোমাদেরকে যে সব জিনিস দিয়েছি, তাদের কেউ কি সে সব বিষয়ে তোমাদের অংশীদার? তোমরা কি সম্পদের মালিকানায় তাদেরকে তোমাদের সমান অংশীদার কর? তোমরা কি নিজেদের সমপর্যায়ের লোকদের মতো তাদেরকে সমীহ করে থাকো?. সত্য কথা এই যে, এসব যালেমরা জ্ঞান-বুদ্ধি ছাড়াই নিছক নিজেদের খেয়ালখুশীর পেছনে ছুটে চলছে।.সুতরাং তুমি একান্তভাবে নিজেকে সে দীনের ওপর প্রতিষ্ঠিত করো; আল্লাহ্ যে ফিতরাত প্রকৃতির ওপর মানুষকে সৃষ্টি করেছেন, তুমি তাকেই অবলম্বন কর। আল্লাহ্র বানানো গঠন-আকৃতিতে যেন কোন পরিবর্তন না হয়।১ এটাই সত্য-সঠিক দীন। কিন্তু অধিকাংশ মানুষই অজ্ঞতার মধ্যে পড়ে আছে।

১. অর্থাৎ যে গঠন-প্রকৃতিতে আল্লাহ্ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন, তাতে এই যে, মানুষের সৃষ্টি, তার রিজিক সরবরাহ করণ, তার রুবুবিয়াত করণ, তার রুবুবিয়াতে স্বয়ং আল্লাহ্ ছাড়া আর কেউ শরীক নেই। আল্লাহ্ ছাড়া আর কেউ মানুষের খোদা নয়, নয় মালিক-মোক্তার-সত্যিকার আনুগত্য পাবার যোগ্য। সুতরাং প্রাকৃতিক নিয়ম এই যে, মানুষ শুধূ আল্লাহ্রই বান্দা হবে-অন্য কারো বান্দা হবে না।

————- ব্যভিচারী-ব্যভিচারিণী-উভয়কে একশো চাবুক মারো। রর দীনের ব্যাপারে তোমরা যেন তাদের ওপর দয়া না কর।-নূর-২

————————— যখন থেকে আল্লাহ্ আসমান-যমীন সৃষ্টি করেছেন, তখন থেকে তাঁর বিধানে মাসের সংখ্যা চলে আসছে ১২ টি। এর মধ্যে চারটি হচ্ছে হারাম-সম্মনার্হ। এটাই সত্য- সঠিক দীন।-তওবা-৩৬

———————- আর এমনি করে আমরা ইউসুফের জন্যে পথ বের করেছি। বাদশার বিধানে তার ভাইকে পাকড়াও করা তার জন্যে বৈধ ছিলো না।-ইউসুফ-৭৬

————————————— আর এমনি করে অনেক মুশরিকদের জন্যে তাদের বানানো শরীকরা১ তাদের সন্তান হত্যাকে একটি চমৎকার কার্যে পরিণত করে দিয়েছে, যেন তাদেরকে ধ্বংসের মধ্যে ফেলতে পারে। আর তাদের জন্যে তাদের দীনকে করে তোলে সন্দেহের বস্তু।২-আল-আনআম-১৩৭

———————————— তারা কি এমন কিছু শরীক বানিয়ে নিয়েছে, যারা তাদের জন্যে দীনের অনুরূপ এমন আইন রচনা করে, আল্লাহ্ যার অনুমতি দেন নি?-শূআরা-২১

১. শরীকের মানে প্রভুত্ব, আধিপত্য এবং আইন প্রণয়নের আল্লাহ্র শরীক।

২.দীনকে সন্দেহের বস্তু করার অর্থ এই যে, মিথ্যা শরীয়ত প্রণেতারা পাপকে এত সুদর্শন করে পেশ করে, যাতে আরবের লোকেরা সন্দেহ পড়ে যায় যে, সম্ভবত এ কাজটি সে দীনের অংশ বিশেষ যা প্রথমত তারা হযরত ইবরাহীম ও ইসরাঈল (আঃ) থেকে লাভ করেছিলো।

—————– তোমাদের জন্যে তোমাদের দীন, আর আমার জন্যে আমার দীন।-কাফেরুন-৬

এসব আয়াতে দীনের অর্থ-আইন-বিধান, নিয়ম-কানুন, শরীয়ত, পথ-পন্থা এবং সেসব চিন্তা এ কর্মধারা, মানুষ যা মেনে চলে জীবন যাপন করে। যে ক্ষমতার সনদ অনুযায়ী কোন বিধি-ব্যবস্থা মেনে চলা হয়, তা যদি আল্লাহ্র তরফ থেকে হয়, তবে মানুষ আল্লাহ্র দীনে আছে; আর তা যদি হয় কোন রাজা-বাদশার, তাহলে মানুষ হবে রাজা-বাদশার দীনে। তা যদি হয় পন্ডিত পুরোহিতের, তাহলে মানুষ হবে তাদের দীনে। আর তা যদি হয় বংশ-গোত্র, সমাজ বা গোটা জাতির, তবে মানুষ হবে তাদের দীনে। মোদ্দাকথা, যার সনদকে চূড়ান্ত সনদ এবং যার ফযসালাকে চূড়ান্ত ফয়সালা মনে করে মানুষ কোন ব্যবস্থা মেনে চলে, সে তার দীনেরই অনুসারী।

দীন চতুর্থ অর্থে

——– যে সংবাদ সম্পর্কে তোমাদেরকে অবহিত করা হচ্ছে (অর্থাৎ মৃত্যু পরপারের জীবন) তা নিশ্চিত সত্য এবং দীন অবশ্যই ঘটবে।

——————— তুমি কি তাকে দেখেছো, যে দীনকে অস্বীকার করে? এই সে ব্যক্তি, যে এতিমকে ধাক্কা দেয়, মিসকীনদের খাবার ব্যাপারে উৎসাহিত করে না।-মাউনঃ১-৩

—————————- তুমি কি জান, ইয়াওমুদ্দীন কি? হাঁ, তুমি কি জান, কি ইয়াওমুদ্দীন? ইয়াওমুদ্দীন সেদিন, যেদিন অন্যের কাজে আসার কোন ইখতিয়ারই থাকবে না কোন মানুষের। সেদিন সব ইখতিয়ারই থাকবে রবের হাতে। -আল-আনফিতার-১৭-১৯

এসব আয়াতে দীন শব্দটি হিসেব-নিকেশ, ফয়সালা ও কর্মফল অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।

দীন একটি ব্যাপক পরিভাষা

আরববাসীদের বোলচালে যেসব অর্থে এ শব্দটি ব্যবহৃত হতো, এ পর্যন্ত কোরআন এ শব্দটিকে প্রায় সে অর্থেই ব্যবহার করেছে। এরপর আমরা দেখেছি, কোরআন এ শব্দটিকে একটি ব্যাপক পরিভাষা হিসাবে ব্যবহার করছে। কোরআন এর অর্থ করছে। কোরআন এর অর্থ করছে, এমন এক জীবন ব্যবস্থা, যাতে মানুষ কারো সর্বোচ্ছ ক্ষমতা স্বীকার করে তার আনুগত্য-আধিপত্য কবুল করে। তার বিধি-বিধান ও আইনের অধীনে জীবন যাপন করে। তার নির্দেশ মেনে চলার জন্যে মর্যাদা, তরক্কী ও পুরস্কারের আশা করে আর তার নাফরমানী, অবধ্যতার জন্যে অপমান-লাঞ্ছনা ও শাস্তির ভয় করে। সম্ভবত দুনিয়ার কোন ভাষায় এত ব্যাপক শব্দ নেই, যা এর সম্পূর্ণ অর্থ জ্ঞাপন করতে পারে। আধুনিককালের স্টেট (State) শব্দটি অনেকটি এর কাছাকাছি পৌছেছে। কিন্তু ‘দীন’ শব্দের সম্পূর্ণ অর্থ জ্ঞাপন করার জন্যে এখনো অনেক সম্প্রসারণ প্রয়োজন।

নিম্মোক্ত আয়াতসমূহে এ ‘দীন’ পারিভাষিক শব্দ হিসাবেই ব্যবহৃত হয়েছে।

————————— আহলে কিতাবের মধ্যে যারা আল্লাহ্কে মানে না (১) (অর্থাৎ তাঁকে সর্বোচ্চ ক্ষমতার একক অধিকারী স্বীকার করে না) ইয়াত্তমূল আখেরাত-শেষদিন (অর্থাৎ হিসাব-নিকাশ ও প্রতিফলনের দিন মানে না) (২) আল্লাহ্ ও তার রাসূল যেসব জিনিসকে হারাম করেছেন, তাকে হারাম বলে স্বীকার করে না, (৩) দীনে-হককে নিজেদের দীন হিসেবে গ্রহণ করে না, (৪) তাদের সাথে যুদ্ধ করো, যতক্ষণ না তারা নিজেদের হাতে জিযিয়া দান করে এবং ছোট হয়ে বসবাস করে।-তওবা-২৯

এ আয়াতে ‘দীনে হক’ একটি পারিভাষিক শব্দ। পরিভাষার প্রয়োগকর্তা আল্লাহ্ তায়ালা নিজেই এ ব্যাখ্যা করে দিয়েছেন প্রথম তিনটি বাক্যাংশে। আমরা নম্বর দিয়ে দেখিয়েছি যে, দীন শব্দের চারটি অর্থই এ বাক্যাংশগুলোতে উল্লেখিত হয়েছে। আর তার সমষ্টিকেই ‘দীনে-হক’ বলে অভিহিত করা হয়েছে।

——————————— ফিরাউন বললোঃ ছেড়ে দাও আমাকে, আমি মূসাকে হত্যা করে ছাড়বো। এখন সে তার রবকে ডাকু্ক। আমার আশংকা, সে যেন তোমাদের দ্বীন বদলিয়ে না ফেলে এবং দেশে বিপর্যয় সৃষ্টি করে না বসে। -আল-মুমিন-২৬

কোরআনে মূসা ও ফিরাউনের কাহিনীর যতো বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে, তাকে সামনে রাখার পর এ ব্যাপারে কোন সন্দেহই থাকে না যে, এখানে ‘দীন’ নিছক ধর্মের অর্থে ব্যবহৃত হয় নি। বরং ব্যবহৃত হয়েছে রাষ্ট্র (State) ও তমুদ্দুন ব্যবস্থার অর্থে। ফিরাউনের বক্তব্য ছিলঃ মূসা যদি তার মিশনে জয়ী হয়, তাহলে ‘স্টেট’ বদলে যাবে। তদানীন্তন ফিরাউনদের শাসন-কর্তৃক এবং প্রচলিত আইন-প্রথার ভিত্তিতে যে জীবন ব্যবস্থা চলছে, তা সমূলে উৎপাটিত হবে। তার স্থলে হয় ভিন্ন ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হবে অথবা আদৌ কোন ব্যবস্থা-ই প্রতিষ্ঠিত হবে না, বরং সারা দেশে বিশৃংখলা ছিড়িয়ে পড়বে।

—————————— মূলত আল্লাহ্র কাছে ইসলামই হচ্ছে দীন। -আলে -ইমরান-১৯

—————————- আর যে ব্যক্তি ইসলাম ছাড়া অন্য কোন দীন তালাশ করবে, তার কাছ থেকে সে দীন কখনো গৃহীত হবে না।-আল-ইমরান-৮৫

——————————– তিনি আল্লাহ্, যিনি তাঁর রাসূলকে সঠিক পথ নির্দেশ এবং ‘দীন হক’ সহকারে প্রেরণ করেছেন, যেন তিনি তাকে সকল দীনের ওপর বিজয়ী করেন, যদিও মুশরিকদের কাছে তা অসহ্য। -তওবা-৩৩

—————- তুমি তাদের সাথে লড়াই করে যাও, যতক্ষণ না ফেতনা বিদূরিত হয়ে যায় এবং দীন সর্বতোভাবে আল্লাহ্র জন্যে হয়ে যায়।-আল-আনফাল-৩৯

————————————- যখন আল্লাহ্র সাহায্য উপস্থিত হয়, বিজয় লাভ হয়, আর তুমি দেখতে পাও, লোকেরা দলে দলে আল্লাহ্র দীনে দাখিল হচ্ছে; তখন তোমার রবের প্রশংসা-স্তুতি কর এবং তাঁর কাছে ক্ষমার আবেদন কর। তিনি বড়ই ক্ষমাশীল।-আন-নাসর

এসব আয়াতে দীনের অর্থ পরিপূর্ণ জীবন বিধান। চিন্তা, বিশ্বাস, নীতি ও কর্মের সকল দিকই এ পর্যায়ভুক্ত।

প্রথম দুটি আয়াতে বলা হয়েছে, আল্লাহ্র নিকট মানুষের জন্যে সঠিক জীবন ব্যবস্থা একমাত্র তা-ই, যা কেবল আল্লাহ্র আনুগত্য ও বন্দেগী (ইসলাম)-এর ওপর প্রতিষ্ঠিত। এ ছাড়া অন্য কোন জীবন ব্যবস্থা -কল্পিত ক্ষমতার আনুগত্যের ওপর যার ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত-বিশ্ব-জাহানের মালিকের নিকট কিছুতেই গ্রহনীয় নয়। স্বভাবত তা হতেও পারে না। কারণ মানুষ যাঁর সৃষ্ট, অধীন ও প্রতিপালিত, যাঁর রাজ্যে প্রজার মতো সে বসবাস করে, তাঁকে ছাড়া অন্য কোন ক্ষমতার বন্দেগী-আনুগত্যে জীবন যাপন করার এবং অন্য কারো নির্দেশমতো চলার অধিকার মানুষের রয়েছে-তিনি তা কিছুতেই মানতে পারেন না।

তৃতীয় আয়াতে বলা হয়েছে, আল্লাহ্ তাঁর রাসূলকে যে সত্য-সঠিক জীবন বিধান অর্থাৎ ইসলাম সহকারে পাঠিয়েছেন, আর তাঁর মিশনের চরম লক্ষ্য হচ্ছে, এ জীবন বিধানকে সকল জীবন বিধানের ওপর বিজয়ী করা।

চতুর্থ আয়াতে দীন ইসলামের অনুসারীদের নির্দেশ হয়েছেঃ দুনিয়ার বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যাও, ফেতনা অর্থাৎ খোদাদ্রোহী বিধানের অস্তিত্ব দুনিয়া থেকে নির্মূল -নিশ্চিহ্ন হয়ে আনুগত্য ও বন্দেগীর সকল বিধান আল্লাহ্র জন্যে নিবেদিত না হওয়া পর্যন্ত তোমরা শান্ত হয়ো না।

পঞ্চম আয়াতে রাসূলুল্লাহ (সঃ) কে সম্বোধন করা হয়েছে দীর্ঘ তেইশ বছরের নিরবচ্ছিন্ন সাধনার পর আরবে বিপ্লব সম্পন্ন হওয়ার পর এ সম্বোধন করা হয়েছে। ইসলাম তার পরিপূর্ণ বিস্তৃতরূপে একটি চিন্তা-বিশ্বাস, নীতি, শিক্ষা, সমাজ, তমুদ্দুন, অর্থনীতি, রাজনীতি-সব বিষয়ের পরিপূর্ণ বিধান হিসাবে কার্যত প্রতিষ্ঠিত। আরবের প্রত্যন্তর প্রান্ত থেকে দলে দলে সে বিধানের ছায়াতলে লোকেরা আশ্রয় নিচ্ছিলো। এমনিভাবে মুহাম্মদ (সঃ) যে কাজের জন্যে আদিষ্ট হয়েছিলেন, তার সমাপ্তি ঘটলে তাঁকে বলা হয়, এ কার্যকে নিজের কীর্তি মনে করে যেন গর্বিত হয়ে না পড়; ত্রুটিমুক্ত ও পরিপূর্ণ সত্তা একমাত্র তোমার রবের, অন্য কারো নয়। সুতরাং এ মহান কার্য সম্পাদনের জন্যে তাঁর প্রশংসা-স্তুতি প্রকাশ কর এবং তাঁর দরবারে আবেদন করঃ প্রভু পরওয়ারদেগার! দীর্ঘ তেইশ বছরের এ খেদমতকালে আমার দ্বারা যে সকল ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়ে গেছে, তা ক্ষমা করে দাও!

সমাপ্ত —-

কুরআনের চারটি মৌলিক পরিভাষা

সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী

book স্ক্যান কপি ডাউনলোড