শহীদ হাসানুল বান্নার ডায়েরি

সূচীপত্র

বিষয়

রাশাদ মাদ্রাসার স্মৃতি

মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি

চরিত্র শুদ্ধি সংস্থা

নীল নদের তীরে

ছোট মসজিদের চাটায়েল উপর

হারাম প্রতিরোধ সমিতি

শিক্ষক প্রশিক্ষণ স্কুল অভিমুখে হোসাইফিয়া সিলসিলার প্রতি আগ্রহ

কবরস্থানের কথা

তাসাউফ সম্পর্কে আমার অভিমত

দামান হুরের দিনগুলি

মসজিদুল জায়শের রজনী

ওলী আউলিয়াদের যেয়ারত

নীরবতা আর নির্জনতার দিনগুলি স্কুলে ইসলামী রীতিনীতি মেনে চলা

জাতীয় আযাদী আন্দোলনের সূচনা

কিছু স্মৃতি, কিছু কথা

হরতাল আর বিক্ষোভ

মাহমুদিয়া আর দামান হুরের মধ্যস্থলে

গ্রীষ্মের ছুটি

ভোরের আযান

দারুল উলূমে ভর্তির প্রস্তুতি

শিক্ষা আর ডিগ্রী সম্পর্কে আমার অভিমত

দুটি স্মৃতি

কায়রোর পথে

মেডিকেল পরীক্ষা

আল-আযহারের এক সপ্তাহ

সত্য স্বপ্ন

পরীক্ষার হলে

দারুল উলূমের প্রথম বৎসর

চিত্তের স্বাধীনতা

নতুন বাসা

কায়রোর দিনগুলো

ঘটনা না দুর্ঘটনা

কায়রোয় বাসা স্থানান্তর

মনের অবস্থা

মাহমুদিয়ায় ঘড়ির দোকান

একটি অনুকরণীয় আদর্শ

কায়রোয় প্রত্যাবর্তন এবং ইসলামী সংগঠনে যোগদান

ইসলামের প্রচারক প্রস্তুত করার প্রস্তাব

কপি শপে দাওয়াতের কাজ

শ্রেণী কক্ষে

পোশাক পরিবর্তন

মিশরে ধর্মহীনতা নাস্তিক্যবাদের ঢেউ

প্রতিক্রিয়া

ইতিবাচক চেষ্টা

শায় দাজবীর খেদমতে

রচনার বিষয়বস্তু

দারুল উলূমের স্মৃতি

স্কলারশীপ না চাকুরী

ইসমাঈলিয়ার উদ্দেশ্যে

হোটেলে অবস্থান

বিদ্যালয় আর মসজিদে

ধর্মীয় বিরোধ

পুনরায় কপি শপ অভিমুখে

বিশ্বাসের প্রতি গুরুত্বারোপ

আলহা্জ্ব মুস্তফার আঙ্গিনায়

ওসিলা সম্পর্কে জনাবের মতামত কি?

একটি উদাহরণ

শহরের সম্মানিত ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে

ক্লাবের জগত

জমিয়তে শুব্বানুল মুসলিমিন

একটি চিত্তাকর্ষক ঘটনা

ইসমাঈলিয়ার প্রতিচ্ছবি

ইখওয়ানুল মুসলিমুল প্রতিষ্ঠা

তাহযীবব-তরবিয়ত মাদ্রাসা

তরবিয়তের ফলাফল

দলের স্থপতিদের চরিত্রের কিছু নমুনা

হেযাজ স্থপতিদের চরিত্রের কিছু নমুনা

হেযাজ গমনের প্রোগ্রাম

ওয়াজ আর প্রচারের পরিকল্পনা

ইসমাঈলিয়ায় ইখওয়ানের কেন্দ্রীয় মসজিদ

কুরবানির একটি দৃষ্টান্ত

মসজিদের জন্য এক খন্ড জমি দান

কাঁটা আর প্রতিবন্ধকতা

শায়খ হামেদ আস কারিয়ার শুবরাখীত বদলী

ভিত্তি প্রস্থর স্থাপন

শুবরাখীত একটা শাখা স্থাপন

রাখে আল্লাহ মারে কে?

গোপন পুলিশ

সরকারের বিরোধীতার অভিযোগ

অভিযোগের তদন্ত

একটা স্বাক্ষ্য

ইখওয়ানের সদস্য হলেন শিক্ষা পরিদর্শক

ধর্মীয় ফের্কা বাজীর অভিযোগ

ইখওয়ান মসজিদ উদ্বোধন

প্রধানমন্ত্রী সেদকী পাশার সিনাই সফর

সুয়েজ ক্যানেল কোম্পানীর বদান্যতা

বিরুদ্ধবাদীদের রটনা

আলহেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান

শায়খ মুহাম্মদ সাঈদ ওরফী

আবু ছবিরে দাওয়াতের সূচনা

আল বাহর আছ স্বগীর- দাওয়াতের প্রসার

সুয়েজে দাওয়াতের ইতিহাস

কায়রোয় দাওয়াতের ইতিহাস

উম্মাহাতুল মুমেনীন মাদ্রাসা

আল-আখওয়াত আল মুসলিমাত

স্কাউটস গ্রুপ

জাবাসাত আল-বালাহ- ইখওয়াতের দাওয়াত

শায়খ ফারগালী আর বিদেশী কোম্পানীর সংঘাত

ঘৃণা চক্রান্তের কয়েকটি দৃষ্টান্ত

কাজীর বাসভবনে বিতর্কের কাহিনী

মিরাজের ঘটনা সম্পর্কে আমার ভাষণ এবং আলীমদের হৈ চৈ

আল-বাহরুছ ছগীরে দাওয়াতের কাজ

একটি অভিযোগঃ হাসানুল বান্নার পূজা করা হয়!

ইয়ামানের জনৈক দায়িত্বশীল ব্যক্তিত্বের সঙ্গে যোগাযোগ

সম্পদ আর পদমর্যাদার ফেতনা

ইসমাঈলিয়ায় ইখওয়ানের কর্মকর্তা নিয়োগ

আন্দোলনের বিরুদ্ধে প্রথম আভ্যন্তরীণ ষড়ডন্ত্র

আরো একটি ষড়যন্ত্র

প্রসিকিউটিং-এর নিকট ষড়যন্ত্রকারীদের প্রত্যাবর্তন

স্মরণীয় মুর্হর্তে

বিরোধী প্রচার পত্র পুস্তিকা

একটি দারস এবং তার প্রভাব

সত্য বাণী

আসল আদালতে

ষড়যন্ত্রের হোতা মৌলবী সাহেবের পরিণতি

মৌলবী সাহেব দেওয়ানী আদালতে

বিবাহ বদলী

 

অনুবাদকের আরয

অবশেষে ইমাম হাসানুল বান্নার ডাইরী প্রকাশিত হওয়ায় আমরা মহান আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করছি। হাসানুল বান্নার ডাইরী অনুবাদ করা আমার দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ছি। ইতিপূর্বে মরহুম আব্দুল খালেক একটি অনুবাদের কাজে হাত দেন এবং সিলেটের আল-আমীন লাইব্রেরীর মালিক বন্ধবর ফরীদ উদ্দিন চৌধুরী তা প্রকাশের উদ্যোগ নেন। কিন্তু তার সে উদ্যোগ সফল হয়নি। আমি হাসানুল বান্নার ডাইরী পাঠ করে নিতান্ত প্রীত হই এবং অনুবাদের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করি। কিন্তু প্রকাশক সংগ্রহ করতে না পারায় এর স্বত্বাধিকারী এ, এম, আমিনুল ইসলাম এটি ছাপতে রাজী হয় এবং অনুবাদ সম্পন্ন করার জন্য পুনঃপুন তাগাদা দেয়। ইতিমধ্যে ডাইরীর দ্বিতীয় খন্ড সংগ্রহ করার জন্য লাহোরে যোগাযোগ করি। লাহোরস্থ ইসলামীক পাবলিকেশন্স এর বর্তমান ম্যানেজার জনাব মুনীর আফজাল এক পত্রে জানান যে, ডাইরীর দ্বিতীয় খন্ড প্রকাশিত হয়নি। এমতাবস্থায় কোন পাঠক এর দ্বিতীয় খন্ড মূল কপি (আরবী মুনাককেরাত) বা এর অনুবাদ আমাকে সরবরাহ করতে পারলে যথাসময়ে তা অনুবাদ করে সহ্নদয় পাঠক মহলের নিকট উপস্থাপন করা হবে ইনশাআল্লাহ।

ইখওয়ানুল মুসলিমুন এবং জামায়াতে ইসলামী বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ইসলামী আন্দোলন। জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা মওলানা মওদুদী আত্মজীবনী মূলক কোন গ্রন্হ রচনা না করলেও সংগঠনকে জানা এবং বুঝার জন্য অসংখ্য গ্রন্হ রচনা করেছেন। কিন্তু ইখওয়ান এ থেকে ব্যতিক্রম। সাইয়েদ কুতুব শহীদ এবং মুহাম্মদ কুতুব রচিত গ্রন্হ বাদ দিলে ইখওয়ানের সাহিত্যের পরিমান খুবই নগণ্য। ইমাম হাসানুল বান্না এ ডাইরী রচনা করে সংগঠনকে জানা এবং বুঝার বিশেষ করে প্রতিকূল পরিবেশে সংগঠন গড়ে তোলা আর দ্বীনের দাওয়াত দেয়া উভয়ই উদ্ভাবন করে গেছেন। হারাম প্রতিরোধ কমিটি থেকে শুরু করে বৃহত্তর ক্ষেত্রে কিভাবে দীনের দাওয়াত দিতে হয়, কিভাবে জনতাকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করতে হয়, তা চমৎকার, আকর্ষণীয় এবং হৃদয়গ্রাহী ভাষায় এ ডাইরীতে তিনি বিবৃত করেছেন। ব্যক্তিকে দারুণভাবে আন্দোলিত করবে হাসানুল বান্নার এ ডাইরী। এ থেকে পাঠক এটাও জানতে পারবেন যে, আন্দোলনের নেতা বা পরিচালকের মধ্যে কোনসব গুণের সমাবেশ আবশ্যক। কফি শপ তথা হোটেল রেস্টুরেন্ট থেকে শুরু করে রাজপথ পর্যন্ত সর্বত্র এক গণজোয়ার সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন ইমাম হাসানুল বান্না। শৈশব থেকেই সৎ প্রকৃতি আর নেক সীরাতের অধিকারী ছিলেন মহান ব্যক্তিত্ব। সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ে তিনি যেভাবে সংশোধনের চেষ্টা করেছেন তাঁর সে পথ ধরে আজো যে কোন সমাজে সংস্কার সাধন করা যায়। তার ডাইরী পাঠে পাঠক মহলের সম্মুখে এ সত্য উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে ইনশাআল্লাহ।

গোলাম সোবহান সিদ্দীকী

১২- /৩৮ মিরপুর ঢাকা ১২২১

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

ইমাম হাসানুল বান্নার ডাইরী

রাশাদ মাদ্রাসার স্মৃতি

আমাদের ওস্তাদ শায়খ মুহাম্মদ যাহরানের প্রতি আল্লাহ তা’আলা রহমতের বৃষ্টি বর্ষণ করুন। তিনি ছিলেন আর রাশাদ দ্বীনী মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল। নিতান্ত প্রাজ্ঞ-বিচক্ষণ এবং খোদা পোরোস্ত আলেমে দ্বীন এবং অতিশয় বু্দ্ধিমান ব্যক্তি ছিলেন তিনি। মানুষের মধ্যে তিনি এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, যিনি জ্ঞানের আলোক দ্বারা সর্বত্র আলো বিকিরণ করে চলেছিলেন। প্রথাগত জ্ঞানের বিচারে তিনি প্রথাসিদ্ধ আলেমদের স্তরে পৌঁছেননি ঠিক, কিন্তু প্রজ্ঞা-বিচক্ষণতা, যোগ্যতা এবং শিষ্টাচার ও জিহাদের বদৌলতে জ্ঞানবত্তা আর জনসেবার কাজে তিনি অনেক অগ্রসর ছিলেন। সাধারণ মানুষের জন্য তিনি একটা মসজিদে দারসের ব্যবস্থা করেছিলেন। এ ছাড়া নারীদের মধ্যেও গৃহে গৃহে তিনি দ্বীন প্রচার করতেন। এসব কিছুর পরও ১৯১৫ সালের দিকে তিনি শিশুদের শিক্ষার জন্য ‘মাদ্রাসা আর রাশাদ আদ দ্বীনিয়্যাহ’ নামে একটা সংস্কারমূলক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। সেকালে গ্রামে-গঞ্জে যেসব মক্তব চালূ ছিল এবং সাধারণ মানুষের সাহায্যের উপর নির্ভল করে চলতো, এটা সে ধরনের একটা মাদ্রাসা হলেও এর শান-শওকত ছিল উন্নত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনুরূপ। এখানে ছাত্রদেরকে কেবল শিক্ষাই দেয়া হতো না, বরং তাদের প্রতিপালন এবং মন-মানসিকতাও গঠন করা হতো। পাঠ্যসূচী আর পাঠদান রীতি উভয় দিক থেকে এ প্রতিষ্ঠান ছিল ব্যতিক্রমধর্মী। তৎকালের মাদ্রসাগুলোতে প্রচলিত পাঠ্যসূচীতে পড়ানো হতোই, উপরন্তু নবীজীর হাদীসও মুখে মুখে পড়ানো হতো, সেগুলো ছাত্রদেরকে মুখস্ত করানো হতো এবং তার অর্থ এবং তাৎপর্যও তাদের হৃদয়ঙ্গম করানো হতো। প্রতি সপ্তাহে বৃহস্পতিবার ছাত্রদেরকে একটা হাদীস শিক্ষা দেয়া হতো, তাদের সম্মুখে হাদীসটি ব্যাখ্যা করা হতো। ছাত্ররা সকলে মিলে এক সঙ্গে হাদীসটি আবৃত্তি করতো, যার ফলে হাদীসটি তাদের মুখস্থ হয়ে যেতো। এর সঙ্গে তার আগের সপ্তাহে পড়া হাদীসটিও পুনরাবৃত্তি করতো।

এভাবে এক বৎসরের মধ্যে ছাত্ররা হাদীসের এক বিরাট ভান্ডার মুখস্থ করে ফেলতো। আমার মনে পড়ে, আজ যেসব হাদীস আমার মুখস্থ আছে, তার অধিকাংশই তখন আমার মানসপটে অংকরিত হয়। অনুরূপভাবে রচনা লিখা, আরবী ব্যাকরণ, আরবী সাহিত্যের নির্বাচিত অংশ, চমৎকার গদ্য-পদ্যের নির্বাচিত অংশ, শ্রুতলিপি এবং বাস্তত অনুশীলনও সে মাদ্রাসার পাঠ্যসূচীর অন্তর্ভুক্ত ছিল। অথচ অন্যান্য মক্তবে এসব পড়ানো হতো না।

শায়খ যাহরানের রীতি-পদ্ধতি ছিন নিতান্ত হৃদগ্রাসী ও ফলপ্রসূ। অথচ তিনি কোন প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহন করেননি। মনস্তাত্ত্বিক দর্শনও শিক্ষা  লাভ করেননি। তিনি এ বিষয়টার প্রতি সবচেয়ে বেশী গুরুত্বারোপ করতেন, যাতে ছাত্রদের সঙ্গে তাঁর মানসিক ঐক্য আর সাযুজ্য প্রতিষ্ঠিত হতে পা রে। তিনি অত্যন্ত সুক্ষ্মভাবে ছত্রদের সমস্ত কর্মকাণ্ড সমস্ত আচার-আচরণ পর্যবেক্ষণ করতেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি ছাত্রদেরকে এটাও ভালোভাবে বুঝাতেন যে, তাদের উপর তাঁর পরিপূর্ণ আস্থা রয়েছে। তিনি ছাত্রদেরকে ভালো-মন্দ কাজের জন্য নৈতিক পুরস্কারও দান করতেন। ছাত্ররা ভালো কাজ করলে সে জন্য তিনি এমন পুরস্কার দিতেন, যা আনন্দে তাদের মনকে ভরে তুলতো। পক্ষান্তরে খারাপ কাজের জন্য কঠোর তিরস্কার করতেন। ফলে ছাত্ররা সে জন্য অনুতাপ করতো। ভালো কাজ কলে তিনি তাদের জন্য ভালো দোয়া করতেন, ভালো কবিতা পাঠ করে শোনাতেন। আর মন্দ কাজ করলে সেজন্য টিপ্পনী কাটতেন। একটা কবিতা এখনো আমার মনে পড়ে। একজন ছত্র বাস্তব অনুশীলনকালে একটা প্রশ্নের এমন জবাব দেয়, যা তাঁর বেশ পছন্দ হয়। তিনি তাকে খাতায় একটা কবিতা লিখে নিতে বলেন। কবিতাটি ছিল এইঃ

**********************************

-বেশ জবাব দিয়েছে এবং জবাবে কৃতিত্ব দেখিয়েছে।

আল্লাহ তাকে সন্তুষ্টি আর হিদায়াতে ধন্য করুন।

এরকম আর একটা কবিতাও আমার মানসপটে গেঁথে আছে। আমার এক সঙ্গীকে অপছন্দনীয় জবাবের জন্য ‘পুরস্কার’ স্বরূপ তিনি এ কবিতাটি উপহার দেন। তাকেও খাতায় জবাবের নীচে কবিতাটি লিখে নিতে বলেনঃ

**********************************

-হে খোদার পাকড়াও, দ্রুত ছুটে এসো আর এ ছোকরাবে ছোঁ মেরে নিয়ে যাও।

এ কবিতাটি প্রবাদ বাক্যে পরিণত হয় এবং ‘গারাতুল্লাহ’ পদবীটা সে ছাত্রের নামে পরিণত হয়। আমরা তাকে চটাবার জন্য ‘গারাতুল্লাহ’ নামে ডাকতাম। তাঁর দৃষ্টিশক্তি রহিত ছিল। এ কারণে তিনি নিজ হাতে ছাত্রদেরকে কিছু লিখে দিতে পারতেন না। বরং তিনি মুখে মুখে বলতেন আর ছাত্ররা খাতায় তা লিখে নিতো। তাঁর দৃষ্টিশক্তি ছিল না বটে, তবে তাঁর দর্শন শক্তি ছিল দৃষ্টিশক্তির চেয়েও তীব্র এবং প্রখর। কারণ আল্লাহ বলেনঃ

**********************************

“যার চক্ষুর দৃষ্টিশক্তি রহিত, সে অন্ধ নয়। অন্ধ হচ্ছে সে ব্যক্তি, যার পাঁজরের অন্তর আলোক থেকে বঞ্চিত”। তখন থেকেই ছাত্র আর শিক্ষকের মধ্যে মানসিক সাযুজ্য এবং ভাব আর আবেগের মিল সম্পর্কে আমার ধারণা জন্মেছে। যদিও সে সম্পর্কে পূর্ণ অনুভূতি জাগ্রত হয়নি তখন। তিনি আমাদেরকে হাঁড় ভাঙ্গা কাজে খাটাতেন। তা সত্ত্বেও তাঁর প্রতি আমাদের অন্তরে ছিল অকুণ্ঠ ভালোবাসা আর ভক্তি-শ্রদ্ধা। আমার মনে হয়, আত্মিক প্রেরণা ছাড়াও আমি তাঁর নিকট থেকে অধ্যয়ন আর জ্ঞান-গবেষণার স্পৃহাও লাভ করেছি। কারণ তিনি অধিকন্তু আমাকে তাঁর লাইব্রেরীতে নিয়ে  যেতেন। সেখনে বেশ মূল্যবান গ্রন্হরাজীর বিপুল সমাহার ছিল। তাঁর দরকার মতো আমি বইগুলো ঘাটাঘাটি করতাম এবং প্রয়োজনীয় অংশ তাঁকে পাঠ করে শোনাতাম। কোন কোন সময় তাঁর বাসায় জ্ঞানী-গুণীজনদের সমাবেশ হতো এবং নানা বিষয়ে আলোচনা, বিতর্ক এমনকি বিতণ্ডাও চলতো। আমি মনোযোগ দিয়ে সেসব শুনতাম। ছাত্র আর শিক্ষকের মধ্যে এ ধরনের সরাসরি সম্পর্ক শুভ ফল বয়ে আনে। শিক্ষক সমাজ এ ধরনের সম্পর্কের গুরুত্ব  অনুধাবন করতে পারলে মঙ্গল হবে। এদিকে তাঁদের বিশেষ গুরুত্ব দেয়া দরকার। ইনশাআল্লাহ এতে বেশ কল্যাণ হবে। ৮ বৎসর বয়স থেকে ১২ বৎসর বয়স পর্যন্ত সময়টা আমি এই মুবারক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অতিবাহিত করেছি।

মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি

এরপর ওস্তাদ মরহুদ মাদ্রাসা ছেড়ে অন্য কাজে নিয়োজিত হন। মাদ্রাসা অন্য পরিচালকদের হাতে ন্যস্ত করা হয়। নতুন পরিচালকরা ওস্তাদ যাহরানের মতো মনোবল, বিপুল জ্ঞান আর আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ও নৈতিক শক্তির অধিকারী ছিলেন না। ওস্তাদ যাহরানের আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ-অভিভূত ছিলাম আমি। সুতরাং নতুন শিক্ষকদের সংসর্গ আমার মনঃপুত হয়নি। তখনো আমার গোটা কুরআন মজীদ হিফয করা হয়নি। কেবল সূরা ইসরা পর্যন্ত ইয়াদ করা হয়েছে। আর আব্বাজান তাঁর সন্তানকে হাফেযে কুরআন হিসাবে দেখতে আগ্রহী। একদিন আমি দৃপ্ত কণ্ঠে আব্বাজানকে জানালাম যে, এহেন মক্তবে পড়ে থাকা এখন আমার কাছে ভীষণ অসহ্য। এখন আমাকে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে যেতে হবে। তখন মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ধারায় আসতো। অবশ্য তখনো মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বিদেশী ভাষা পড়ানো হতো না। তার পরিবর্তে দেশের আইন, অর্থনীতি এবং বাগান পরিচর্যা শিক্ষা দেয়া হতো। উপরন্তু জাতীয় ভাষা এবং দ্বীনিয়াত পড়ানো হতো বেশ গুরুত্ব দিয়ে।

পিতা মনেপ্রাণে কামনা করতেন তাঁর ছেলে হাফেযে কুরআন হোক। তাই তিনি আমার প্রস্তাবের বিরো্ধিতা করেন। কুরআন মজীদের অবশিষ্টাংশ ঘরে হিফয করার আশ্বাস দিলে পিতা আমাকে স্কুলে ভর্তি করার প্রস্তাব মেনে নেন। সে সপ্তাহেই এ অধম মাধ্যমিক স্কুলের ছাত্র হয়েছে। তার দিনের সময়টা কাটতো স্কুলে। স্কুল থেকে ফিরে এসে এশা পর্যন্ত সে ঘড়ি মেরামতের কাজ শিখে আর এশার পর থেকে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত সে স্কুলের পড়া শেষে আর ভোরে শয্যা ত্যাগ করে ফজরের নামাজের পর থেকে স্কুলে গমনের আগ পর্যন্ত সে কুরআন মজীদ হিফয করার কাজে আত্মনিয়োগ করে।

চরিত্র শুদ্ধি সংস্থা

স্কুলের শিক্ষকদের একজন ছিলের মুহাম্মদ আফেন্দী আব্দুল খালেক। তিনি ছিলেন অংকের শিক্ষক। উন্নত চারিত্রিক গুণাবলীর অধিকারী ছিলেন ওস্তাদ আফেন্দী। তিনি উপরের শ্রেণীর ছাত্রদের নিকট প্রস্তাব করেন তাদের নিজস্ব একটা সংস্থা গড়ে তোলার জন্য। তিনি তার নামকরণ করেন ‘জমিয়তে আখলাকে আদরিয়্যাহ’। সংস্থার কর্মসূচী তিনি নিজে প্রণয়ন করেন এবং তিনি ছিলেন এর পৃষ্টপোষক। সংস্থার পরিচালনা পরিষদ গঠন করার জন্য তিনি ছাত্রদেরকে নির্দেশ দেন। এ সংস্থার লক্ষ্য উদ্দেশ্য আর নীতিমালার সারকথা ছিল এইঃ

যে ছাত্র তার ভাইকে গালি দেবে, তাকে এক মিলিয়ন জরিমানা দিতে হবে। আর যে ছাত্র পিতাকে গালমন্দ দেবে, তাকে দু মিলিয়াম জরিমানা দিতে হবে। মায়ের সঙ্গে বেয়াদবী করলে এক ক্রোশ জরিমানা দিতে হবে। দ্বীন সম্পর্কে অশালীন কথাবার্তা বললে দু’ ক্রোশ জরিমানা দিতে হবে। অপরের সঙ্গে দাঙ্গা-ফ্যাসাদ করলেও দু’ ক্রোশ জরিমানা দিতে হবে। পরিচালনা পরিষদের সভাপতি আর সদস্যদেরকে উপরোক্ত অসদাচরণের জন্য দ্বিগুণ জরিমানা দিতে হবে। কোন ছাত্র এ নীতিমালা মেনে না চললে সঙ্গীরা তাকে বয়কট করবে এবং নীতিমালা মেনে না নেয়া পর্যন্ত এবং বয়কট অব্যাহত থাকবে। জরিমানা লব্ধ অর্থ কণ্যাণমূলক কাজে ব্যয় করা হবে। দ্বীনের অনুসরণে একে অপরকে উপদেশ  দান, যথা নামায আদায়ে উৎসাহ দান, আল্লাহর আনুগত্য, পিতামাতার বাধ্যতা এবং বয়স অনুপাতে বড়দেরকে সম্মান করার জন্য উদ্বদ্ধ-অনুপ্রাণিত করার সংস্থার সদস্যদের কর্তব্য।

রাশাদ দ্বীনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে এ অধম যে রুহানী পুঁজি সঞ্চয় করতে পেরেছিল, তার বরকতে ছাত্রদের মধ্যে এসব কাজে সে ছিল অগ্রসর। অতি অল্পদিনের মধ্যে সে সকলের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। সংস্থার পরিচালনা পরিষদের নির্বাচনে তাকে সভাপতি করা হয়। সংস্থা তার কার্যক্রম শুরু করে। সংস্থার নীতিমালা লংঘনের দায়ে অনেক সদস্যকে অভিযুক্ত করা হয় এবং বিষয় অনুযায়ী তাদের নিকট থেকে জরিমানা আদায় করা হয়। জরিমানা বাবদ উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ সংগৃহীত হয়। এ অর্থের কিছু অংশ ব্যয় করা হয় লবীব ইসকান্দার নামে জনৈক সঙ্গীর বিদায়ী অনুষ্ঠানে। ছাত্রটা ছিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জনৈক চিকিৎসকের ভাই। চিকিৎসককে অন্যত্র বদলী করা হলে বাধ্য হয়ে লবীবকে বিদায় নিয়ে চলে যেতে হয়। জরিমানার কিছু অংশ জনৈক অসহায় ব্যক্তির দাফন-কাফনের কাজে ব্যয় করা হয়। লোকটি নীলনদে ডুবে মারা গেলে তার লাশ ভেসে আসে। সংস্থার বায়তুল মাল থেকে তার দাফন-কাফনের সমস্ত খরচ চালানো হয়। এ ধরনের সংস্থা দ্বারা এমন ফল পাওয়া যায়, যা অনেক তাত্ত্বিক ওয়ায মাহফিল দ্বারা সম্ভব নয়। এ ধরনের সংস্থ-সংগঠন গড়ে তোলার  প্রতি অধিক মাত্রায় গুরুত্বারোপ করা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানদের উচিত।

নীল নদের তীরে

এ সংস্থা কচি শিশুদের মনে বেশ রেখাপাত করে। একদিন আমি নীল নদের তীরে দিয়ে যাচ্ছিলাম। সেখানে বিপুল সংখ্যক শ্রমিক বাদামওয়ালা নৌকা বানাবার কাজে নিয়োজিত ছিল। মাহমুদিয়ায় এ শিল্পের বেশ বিস্তার ঘটেছে। সেখানে আমি দেখতে পাই যে, জনৈক ব্যক্তি তার নৌকার মাস্তুলের উপর একটা অশ্লীল নগ্ন মূর্তি ঝুলিয়ে রেখেছে। এমন উলঙ্গ মুর্তি ঝুলিয়ে রাখা সাধারণ নৈতিকতারও পরিপন্হী। বিশেষ করে নীল নদের তীরের এ অংশে বিপুল সংখ্যক নারী আগমন করে পানি নেওয়ার জ ন্য। এ দৃশ্য দেখে আমার অন্তর কেঁপে উঠে। আমি তৎক্ষণাৎ পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জের কাছে গিয়ে এ অশ্লীল দৃশ্যেল বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাই। ইনচার্জ আমার এ আবেদকে গালমন্দ দিয়ে তৎক্ষণাৎ মূর্তিটা নামিয়ে ফেলার নির্দেশ দেন। নির্দেশ তৎক্ষণাৎ কার্যকর হয়। পরদিন ফাঁড়ির ইনচার্জ আমাদের স্কুলে আসেন এবং প্রধান শিক্ষককে এ ঘটনা সম্পর্কে অবহিত করেন। স্কুলের প্রধান শিক্ষক ওস্তাদ মাহমুদ আফেন্দীও ছিলেন বেশ গুণী ব্যক্তি। পরবর্তীকালে তিনি শিক্ষা বিভাগের বড় কর্মকর্তা হয়েছিলেন। এ কাহিনী শুনে তিনিও আনন্দিত হন। পরদিন তিনি স্কুলের সমস্ত ছাত্রকে এ ঘটনা জানান। মানুষকে সদুপদেশ দেয়ার জন্য তিনি ছাত্রদেরকে উৎসাহিত করেন। তিনি ছাত্রদেরকে বলেন, অন্যায়-অশ্লীল কিছু দেখলে ছাত্রদের উচিত তার প্রতিবাদ করা। শৈশবে ওস্তাদ যাহরানের নিকট  য শিক্ষা পেয়েছি, তার বরকতেই আমি এ প্রতিবাদ করতে পেরেছি নারী-পুরুষের যুগল ছবির বিরুদ্ধে। বর্তমানে এসবের প্রতি মনোযোগ দেয়ার গরজ বোধ করে না কেউই। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান আর পুলিশ কর্মকর্তা সকলেই এ দয়িত্ব এড়িয়ে চলেন।

ছোট মসজিদের চাটাইয়ের উপর

স্কুলের অধিকাংশ ছাত্র-ছাত্রীরা মসজিদে নামায আদায় করতো। মসজিদটি ছিল স্কুলের নিকটে। বিশেষ করে ছাত্ররা এখানে যোহরের নামায আদায় করতো। দুপুরে খাবার পর মসজিদের প্রশস্ত আঙ্গিনায় ছাত্ররা জড়ো হতো। মসজিদটি ওয়াকফ বিভাগের অধীনে ছিল না। এ প্রসঙ্গে এক চিত্তাকর্ষক কৌতুকের কথা আমার মনে পড়ে। এই মসজিদের ইমাম ছিলেন শায়খ মুহাম্মদ সাঈদ। একদিন তিনি মসজিদে এসে দেখেন তাতে ছাত্রদের মধ্য থেকে একজন আযান দিয়েছে। এরপর জামায়াত। ইমমা সাহেবের ভয় হলো, মসজিদের পানি অপচয় হবে। চাটাইও ভেঙ্গে যাবে। নামায শেষ হলে তিনি গায়ের জোরে ছাত্রদেরকে বের করে দেন। তাদেরকে ভয় দেখান, ধমক দেন। ভয়ংকর শাস্তিরও ভয় দেখান। তাঁর কথায় কিছু ছাত্র পালিয়ে যায়। আর কিছু ছাত্র ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। আমার মনে শিশুসুলভ চপলতা জেগে উঠে। আমি সিদ্ধান্ত নেই, ইমাম সাহেবের নিকট থেকে এ আচরণের প্রতিশোধ অবশ্যই নিতে হবে। আমি তাঁকে এক পত্র লিখি। পতে এই আয়াত উল্লেখ করিঃ

**********************************

“যারা আপন প্রভুর সন্তুষ্টি কামনায় সকাল-সন্ধা তাদের পালনকর্তাকে ডাকে, তুমি তাদেরকে তাড়িয়ে দেবে না। তাদের হিসাব নেয়া তোমার দায়িত্ব নয়। আর তোমার হিসাব নেয়াও তাদের কাজ নয়। তাদেরকে তাড়িয়ে দিলে তুমি যালিমের অন্তর্ভূক্ত হবে”। (সূরা আন’আমঃ ৫২)

আমি তাঁর কাছে এ চিঠি বেয়ারিং করে প্রেরণ করি এবং মনে করি য, জরিমানা হিসাবে এক ক্রোশই যথেষ্ট। এ চিঠি পেয়ে তিনি বুঝতে পারেন, কোথা থেকে তাঁর উপর এ আঘাত এসেছে। তিনি আমার পিতার সঙ্গে দেখা করে তাঁর কাছে আমার বিরুদ্দে নালিশ করেন এবং ক্ষোভ প্রকাশ করেন। কিন্তু আব্বাজান তাঁকে উপদেশ দিয়ে বলেন যে, শিশুদের সঙ্গে সদাচার করতে হয়। তাদের ব্যাপারে উত্তম পন্হা অবলম্বন করা উচিত। এরপর তিনি আমাদের সঙ্গে হাসিখুশী করেছেন। সদাচার করেছেন। তিনি আমাদের উপর শর্ত আরোপ করেন যে, মসজিদ থেকে বের হওয়ার আগে পানির টাংকী ভরে দিতে হবে এবং  চাটাই ভেঙ্গে গেলে চাঁদা আদায় করে চাটাই কিনে দিতে হবে। আমরা এ শর্ত মেনে চলেছি।

হারাম প্রতিরোধ সমিতি

বিদ্যালয়ের চৌহাদ্দির মধ্যে সীমাবদ্ধ সংস্কারমূলক তৎপরতা যুব সমাজের আগ্রহের আগুন নিবাতে পারেনি। তাই তাদের মধ্যে কয়েকজন একত্র হয়ে ‘হারাম প্রতিরোধ সমিতি’ নামে একটা সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এসব আগ্রহী যুবকদের মধ্যে কয়েকজনের নাম উল্লেখযোগ্য। যেমন ওস্তাদ মোহাম্মদ আলী বেদাইর। যিনি পরবর্তীকালে শিক্ষা বিভাগে যোগদান করেন। লবীব আফেন্দী নাওয়ার। ইনি পরবর্তীকালে ব্যবসায় আত্মনিয়োগ করেন। আব্দুল মুতাআল আফেন্দী ও ওস্তাদ আব্দুর রহমান। ইনি শিক্ষা জীবন শেষে রেলওয়ে বিভাগে চাকুরী নেন। ওস্তাদ সাঈদ বুদাইর। ইনি পরবর্তীকালে ইঞ্জিনিয়ার হয়েছেন। এদের উদ্যোগে হারাম প্রতিরোধ সমিতি গঠিত হয়। সমিতির সদস্যপদের চাঁদা ছিল সপ্তাহে পাঁচ মিলিয়াম থেকে দশ মিলিয়াম। সদস্যদের মধ্যে কাজ ভাগ করে দেয়া হয়। কারো দায়িত্ব ছিল কুরআন-হাদীস এবং ফিকহ থেকে প্রয়োজনীয় আয়াত, হাদীস এবং ফিকহের উদ্ধৃতি খুঁজে বের করে পত্রের খসড়া প্রস্তুত করা। কারো দায়িত্ব ছিল পত্র লিখা আর কারো দায়িত্ব ছিল পত্রগুলো মুদ্রণ করা। অন্যান্য সদস্যরা এসব পত্র লোকদের মধ্যে বন্টন করতো। যাদের সম্পর্কে সমিতি জানতো যে, এরা কোন গুনাদের কাজে লিপ্ত আছে বা ইবাদাত বিশেষ করে যারা সঠিকভাবে নামায আদায় করে না, সেসব লোকের নিকট এ পত্র প্রেরণ করা হতো। যে ব্যক্তি রমযান মাসে রোযা রাখতো না এবং সমিতির কোন সদস্য তাকে দিনের বেলা পানাহার করতে দেখতে পেতো, তার সম্পর্কে তৎক্ষণাৎ সমিতিকে অবহিত করা হতো। সমিতির পক্ষ থেকে এমন লোককে চিঠি দেয়া হতো। যাতে রোযা না রাখার কঠোর গুনাহের প্রতি তার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হতো। যে ব্যক্তি অনিয়মিত নামায আদায় করে, বা নামায আদায়ের প্রয়োজনীয়  শর্তাবলী পালন কনে না, ঠিকমতো বিনয় আর দীনতার সাথে নামায আদায় করে না, বা নামায আদায়ে শৌথিল্য করে, এমন লোকের নিকট পত্র প্রেরণা করে এদিকে তার দৃষি।ট আকর্ষণ করা হয়। কোন পুরুষকে স্বর্ণ ব্যবহার করতে দেখা গেলে পত্র মারফত এ হারাম কাজ থেকে তাকে বারণ করা হতো এবং এ ব্যাপারে শরীয়তের বিধান সম্পর্কে তাকে অবহিত করা হতো। শোকে-দুঃখে কোন নারীকে মাথা কুটতে দেখলে তার স্বামী বা অভিভাবকের নিকট পত্র প্রেরণ করে এহেন জাহেলী রসম থেকে বিরত থাকার জন্য দীক্ষা দেয়া হতো।

মোটকথা, বড়-ছোট এমন ব্যক্তি ছিল না, যাকে পাপ কাজে লিপ্ত হতে দেখা গেছে; অথ সমিতি পত্র মারফত তাকে সংশোধন করার চেষ্টা চালায়নি। যেহেতু সমিতির সদস্যরা বয়সে ছিল তরুণ। সাধারণতঃ তারা মানুষের চোখে ধর্তব্য হতো না, আর এ ধরনের কাজ তারা করতে পারে বলে মানুষ মনেও করতো না, এ কারণে মানুষ তাদের থেকে নিজেদেরকে লুকাতো না। ফলে যুবকরা তাদের সব কাজ জানতে পারতো। মানুষ মন করতো এটা ওস্তাদ শায়খ যাহরানের কাজ। এ কারণে লোকেরা তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বলতো, যা কিছু বলার আছে আপনি মুখে বলবেন। এসব পত্র প্রেরণ কেন? এ কাজের সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক নেই- এ কথা তিনি বললেও মানুষ তা বিশ্বাস করতো না। শেষ পর্যন্ত একদিন সমিতির পক্ষ থেকে শায়খ যাহরানের নিকটও পত্র প্রেরণ করা হয় যে, অমুক দিন আপনি যোহরের ফরয নামায আদায় করেছেন খাম্বার মধ্যখানে। অথচ এটা মাকরূহ। শায়খ যাহরান শহরের নামকরা আলেমে দ্বীন। মাকরূহ কাজ থেকেও তাঁর বিরত থাকা উচিত। তবেই তো সাধারণ মানুষ হারাম কাজ থেকে বিরত থাকবে। এ সময় আমি শায়খ যাহরানের লাইব্রেরী ত্যাগ করলেও তাঁর দারসে আমি শরীক থাকতাম। ফলে তাঁর সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিল। একদিন তিনি আমাকে ডেকে পাঠান। যাতে আমরা উভয়ে মিলে উপরোক্ত মাসআলা বোখারী শরীফের ব্যাখ্যা গ্রন্হ ‘ফাতহুল বারী’তে অনুসন্ধান করতে পারি। এ প্রসঙ্গটা এখনো আমার মনে জাগে। আমি শায়খের সম্মুখে ফাতহুল বারীর এবারত পড়ছিলাম আর তাঁর ওষ্ঠে হাসির রেখা ফুটে উঠছিল। তিনি জানতে চাইলেন, কে যুবকদেরকে এই মাসআলা অবহিত করেছে। অনুসন্ধান দ্বারা প্রমাণ হয়েছে যে, যুবকরাই ঠিক। তাদের মতই বিশুদ্ধ। আমি গোটা ঘটনা সমিতির সদস্যদেরকে অবহিত করলে তাদের আনন্দের সীমা ছিল না।

৬ মাসেরও বেশী সময় ধরে সমিতি এ অভিযান অব্যাহত রাখে। মানুষ এ  অভিযানে বিস্মিত এবং কেউ কেউ আতঙ্কিত হয়ে উঠে। অবশেষে এক কফি হাউসের মালিকের হাতে সমিতির রহস্য উদঘাটিত হয়। তিনি জনৈকা নর্তকীকে কফি হাউসে নিমন্ত্রণ করে নাচ-গানের আয়োজন করেন। এতে সমিতির পক্ষ থেকে তাকে একটা পত্র দেয়া হয়। অর্থ শ্রাদ্ধ করার জ্য সমিতির পত্র ডাকযোগে প্রেরণ না করে হাতে হাতে পাঠানো হতো। সমিতির সদস্যরা হাতে হাতে পত্র নিয়ে যেতো এবং এমন স্থানে ফেলে আসতো,  যেখান থেকে সহজেই তা প্রাপকের নজর পড়তো। কফি হাউসের মালিক ছিল বেশ চতুর। তিনি পত্রবাহকের আগমন আঁচ করতে পেরে পত্রসহ তাকে ধরে ফেলেন এবং কফি হাউসে নিয়ে সকলের সামনে তিরস্কার করেন। ফলে সমিতি উন্মোচিত হয়ে পড়ে। এরপর সমিতির সদস্যরা তৎপরতা শিথিল করার সিদ্ধান্ত নেয়। হারাম প্রতিরোধের দায়িত্ব পালনের জন্য অন্য কোন পন্হা অবলম্বন করার বিষয় তারা চিন্তা করে।

শিক্ষক প্রশিক্ষণ স্কুল অভিমুখে

এ ছত্রগুলোর লেখক তার ওয়াদা পূরণ করেছে। যে যথারীতি কুরআন মজীদ হিফয করে চলেছে। রাশাদ মাদ্রাসায় সে যতটুকু হিফয করেছিল, তার সঙ্গে আরো এক চতুর্থাংশ যোগ করে সূরা ইয়াসীন পর্যন্ত হিফয সম্পন্ন করেছে। মাহমুদিয়ার জেলাবোর্ডে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচী পরিবর্তন করে সেগুলোকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পরিণত করার সিদ্ধান্ত নেয়। এ সিদ্ধান্তের পর তার সামনে দুটি পথ খোলা রয়েছে, তন্ম্যে যে কোন একটা তাকে বাছাই করে নিতে হয়। হয় তাকে আলেকজান্দ্রিয়ার দ্বীনী শিক্ষা কেন্দ্রে ভর্তি হতে হবে এবং সেখান থেকে সে আযহারী শায়খ হবে, অন্যথায় তাকে দামানহুরের শিক্ষক প্রশিক্ষণ স্কুলে ভর্তি হতে হবে। এতে তার পথ সংক্ষিপ্ত হবে এবং তিন বৎসরের মধ্যে সে শিক্ষক হতে পারবে। শেষ পর্যন্ত দ্বিতীয়টির পাল্লা ভারী হয় এবং আবেদন করার সময়ও ঘনিয়ে পড়ে। সে নামমাত্র আবেদন পত্রও পেশ করে। কিন্তু এখন তাকে দু’টি বড় প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়। এরমধ্যে একটা হচ্ছে বয়সের বাধা। কারণ এখন তার বয়স সাড়ে ১৩ বৎসর। অথচ ভর্তির জন্য বয়স রাখা হয়েছে পূর্ণ ১৪ বৎসর। দ্বিতীয়তঃ কুরআন মজীদ হিফয সমাপ্ত করা্ কারণ এটাও ভর্তির জন্য অন্যতম শর্ত। ভর্তি হতে হলে কুরআন মজীদের মৌখিক পরীক্ষা বাধ্যতামূলক। শিক্ষক প্রশিক্ষণ স্কুলের প্রিন্সিপাল ছিলেন ওস্তাদ বশীর মূসা। ইনি ছিলেন বেশ ভদ্র  ও নরম মানুষ? লেখকের সঙ্গে তিনি কোমল ব্যবহার করেন। বয়সের শর্ত তিনি শিথিল করেন এবং কুরআন মজীদের অশিষ্টাংশ হিফয করার ওয়াদাও তিনি মেনে নেন। তিনি ভর্তির জন্য লিখিত এবং মৌখিক পরীক্ষার অনুমতি দান করেন, যাতে লেখক সফল হয়। সেদিন থেকে সে দামানহুরস্থ শিক্ষক প্রশিক্ষণ স্কুরের ছাত্র।

হোছাফিয়া সিলসিলার প্রতি আগ্রহ

আগে ছোট মসজিদের কথা বলা হয়েছে। সেখানে আমি হোছাফী ইখওয়ানদেরকে দেখতে পাই। তারা প্রতিদিন এশার নামাজের পর আল্লাহর যিকির করতেন। আমিও সেখানে শায়খ যাহরানের দারসে মাগরিব এবং এশার মধ্যবর্তী সময়ে নিয়মিত উপস্থিত থাকি। যিকরের এই মাহফিল আমার জন্য ছিল বড়ই আকর্ষণীয়। ছোট-বড় সব বয়সের লোক এবং শিক্ষিত অশিক্ষিত সর্বস্তরের মানুষ এতে যোগ দিতো, এমনকি শিশুরাও বাদ যেতো না। শিশুদের প্রতি বড়দের স্নেহের আচরণ আমাকে বেশ আকৃষ্ট করে। আমি ও নিয়মিত এ মাহফিলে যোগ দিতে শুরু করি। ধীরে ধীরে হোছাফী ইখওান-এর যুব সমাজের সঙ্গে আমার বেশ হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক গড় উঠে। এদের মধ্যে তিনজনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য; শায়খ শালবীর রিজাল, শায়খ মুহাম্মদ আবু শোশা এবং শায়খ মুহাম্মদ ওসমান। যাকেরীনদের মধ্যে যেসব যুবক বয়সে আমার কাছাকাছি ছিলেন, তাদের মধ্যে মুহাম্মদ আফেন্দি দিমাইয়াতী, সাবী আফেন্দী সাবী আব্দুল মোতাআল আফেন্দী এবং এমন আরো অনেক ছিল। এ পূর্ণবানদের দলে ওস্তাদ আহমদ সাকারী (যিনি পরে ইখওয়ানের সেক্রেটারী জেনারেল হয়েছিলেন) এর সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ হয়। এ সাক্ষাৎ আমাদের দু’জনের জীবনেই এক গভীর রেখাপাত করেছে। যে মুহূর্ত থেকে শায়খ হোছাফীর নাম কানে আসে এবং তাঁর নামটাই মনের উপর দারুণ শুভ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। তাঁকে দেখার, তাঁর মজলিশে বসার এবং তাঁর কাছে থেকে উপকৃত হওয়ার আগ্রহ প্রতি মুহূর্তে বৃদ্ধি পেতে থাকে। আমি সকাল-সন্ধা নিয়মিত ‘রযুকী ওযীফা’, পড়তে শুরু করি। এ ওযীফার প্রতি আমার আগ্রহ এজন্য বৃদ্ধি পায় যে, মরহুম আব্বাজান এর চমৎকার ব্যাখ্যা গ্রন্হ রচনা করেছেন। এতে তিনি স্পষ্ট বলেছেন যে, এর সমস্ত শব্দ হাদীস থেকে গৃহীত। মরহুম আব্বাজান এ ব্যাখ্যা গ্রন্হের নামকরণ করেনঃ

**********************************

সকাল-সন্ধ্যা যেসব দোয়া পড়া মাসনূন, সেসব আয়াত আর হাদীসের সমন্বয়ে এই ওযীফা প্রণীত হয়েছে। কুরআন-হাদীসের বাইরের কোন শব্দ এই ওযীফার নেই। এ সময় আমার হাতে আসে একটা কিতাব, যার না-

**********************************

হাসনাইন আল হোছাফী সিলসিলার প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রাণ পুরুষ। এ সিলসিলার বর্তমান নেতা মুহতারাম শায়খ আব্দুল ওয়াহাবের তিনি পিতা। আল্লাহ তাঁর হায়াত দারাজ করুন এবং তাঁর ফয়েজকে ব্যাপক করুন। হিপরী ১৩২৮ সালের ১৭ই জুমাদাসসানী যখন তাঁর ইনতিকাল হয়, তখন আমার বয়স মাত্র চার বৎসর। এ কারণে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার সুযোগ আমার ভাগ্যে জুটেনি। অবশ্য আমাদের এলাকায় তাঁর বেশ যাতায়াত ছিল। আমি কিতাবটি অধ্যয়নে ডুবে যাই। এ গ্রন্হ পাঠে আমি জানতে পারি যে, হোছাফী (র) আল-আযহারের শিক্ষাপ্রাপ্ত আলেম ছিলেন। শাফেয়ী মযহাবে তাঁর অগাধ পান্ডিত্য ছিল। গভীর অভিনিবেশ সহকারে তিনি দ্বীনী ইলম হাসিল করেছেন। নিতান্ত ইবাদাত ও বুযুর্গ আল্লাহর যিকরে ডুবে থাকতেন। রাসূলের আনুগত্য আর দুনিয়া ত্যাগের রীতিতে তিনি অটল ছিলেন। কয়েক দফা হজ্ব করেছেন আর প্রতিবারই হজ্বকালে কয়েক দফা ওমরা করেছেন। তাঁর সঙ্গী সাথীরা সকলেই এক কথায় এক ভাষায় বলেন যে, পাবন্দীর সঙ্গে ফরয, সুন্নাত এবং নফল আদায় করা তথা আল্লাহর আনুগত্যে আমরা তাঁর চেয়ে বেশী আগ্রহী অন্য কাউকে দেখিনি। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি এ পথে অটল ছিলেন। অথ তখন তার বেশ বয়স হয়েছে, ষাট বছরেরও বেশী। তরীকতপন্হীদের রীতি-পন্ধতি অনুযায়ী আল্লাহর দিকে ডাকার কাজও করতেন। অবশ্য তিনি তা করতেন তরীকত আর নূরে  ডুবে থেকে এবং সঠিক ও পবিত্র মূলনীতি অনুযায়ী। জ্ঞান ও তরবিয়াত, ফিকহ ও ইবাদাত এবং আনুগত্য ও যিকরের ভিত্তিতে তাঁর দাওয়াত প্রণীত ছিল। তাসাউউফ ও তরীকতের অনুরক্তদের মধ্যে যেসব বেদায়ত আর বিকৃতি বিস্তার লাভ করেছে, তিনি সে সবের ঘোর বিরোধী ছিলেন। সবসময় এবং সর্বাবস্থায় তিনি কেবল কিতাব ও সুন্নাহকেই মশাল হিসাবে গ্রহণ করতেন। ভূল ব্যাখ্যা আর বিভ্রান্তিকর বিকৃতি থেকে দূরে থাকতেন। ভালো কাজের নির্দেশ দিতেন আর মন্দ কাজ থেকে বারণ করতেন। উপদেশ আর শুভ কামনার কাজ প্রতি মুর্হর্তে জারী রাখতেন। তাঁর মতে কিতাব ও সুন্নাহবিরোধী এমন অনেক ক্ষেত্রে তিনি পরিবর্তন সাধন করেন, যা স্বয়ং তাঁর শায়খ আর ওস্তাদরা মেনে চলতেন। তাঁর চরিত্রের যে দিকটি  আমাকে সবচেয়ে বেশী আকৃষ্ট করেছে, তা হচ্ছে আমর বিল মারূফ ও নাহী আনিল মুনকার সম্পর্কে তাঁর কড়াকড়ি। এটাই আমার মনকে আপ্লুত করেছে। তিনি এ ব্যাপারে কারো তিরস্কার-ভর্ৎসনাকে ভয় পেতেন না এবং যতবড় মহান ব্যক্তিত্বই তাঁর সামনে থাকুক না কেন, ভালো কাজের নির্দেশ আর মন্দ কাজে নিষেধ তিনি ত্যাগ করতেন না। এর অনেক উদাহরণ পেশ করা যায়:

রিয়াজ পাশা প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে একদিন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যান। এ সময় পাশার নিকট একজন আলেম আসেন এবং তাঁর সামনে এমনভাবে ঝুঁকে পড়েন, যেন রুকু করছেন আর কি! শায়খ ক্রুব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন এবং মওলবী সাহেবের মুখে এক চড় বসিয়ে দেন। কঠোর ভাষায় তাকে নিষেধ করে বলেন:

মিয়া সাব সোজা হয়ে দাঁড়াও। আল্লাহ ছাড়া কারো সামনে মাথানত করা জায়েয নেই। নিজের দ্বীন আর জ্ঞানকে কলংকিত করবে, তাহলে আল্লাহ তোমাকে কলংকিত করবেন। মওলবী সাহেব এবং পাশা উভয়ে অবাক হয়ে যায়। শায়খকে কোনভাবেই কিছু বলার সাহস কারো হয়নি। তিনি তখনো মজলিশে বসে আছেন, এমন সময় আরেকজন পাশা আসেন, যিনি রিয়াজ পাশার বন্ধু। তার হাতে ছিল স্বর্ণের আংটি। হাতে একটা লাঠি ছিল, যার হাতল ছিল স্বর্ণের। শায়খ তাঁকে লক্ষ্য করে বলেন: ভাই সাহেব, এভাবে অলংকার হিসেবে স্বর্ণের ব্যবহার পুরুষের জন্য হারাম। নারীর জন্য হালাল। এ দুটি কোন নারীকে দান করে নবীজীর স্পষ্ট নির্দেশের বিরুদ্ধাচরণ থেকে বিরত থাকুন। পাশা সাহেব কিছু আপত্তি করতে চাইলেন, কিন্তু রিয়াজ পাশা হস্তক্ষেপ করে অন্য একজনকে পরিচয় করালেন। এরপর শায়খ পীড়াপীড়ি করতে থাকেন যে, আংটি এবং হাতলটা খুলে ফেলা উচিত, যাতে নিষিদ্ধ কাজ না করা হয়।

একদা বিশেষ কোন অনুষ্ঠান উপলক্ষে আলেমদের সঙ্গে খেদিভ তাওফীক পাশার নিকট গমন করেন। খেদিভকে উচ্চস্বরে সালাম করেন। খেদিত হাতের ইশারায় সালামের জবাব দেন। শায়খ দৃঢ়তার সঙ্গে তাকে বললেনঃ

সালামের অনুরূপ বা তার চেয়ে উত্তম জবাব দেয়া উচিত। ওয়ালাইকুমুস সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু বলা উচিত। কেবল হাতের ইশারায় জবাব দেয়া জায়েয নেই। খেদিভকে নিরূপায় হয়ে মুখে সালামের জবাব দিতে হয়।  শায়খের সত্যপ্রীতি এবং দ্বীনের ব্যাপারে কড়াকড়ির প্রশংসা করেন তিনি।

একবার সার্ভে বিভাগের কর্মচারীদের মধ্যে তাঁর জনৈক মুরীদের নিকট গমন করেন। তার অফিসে একটা মূর্তি দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করেন, এটা কি? মুরীদ বললেন, এটা প্রতিকৃতি, কাজের সময় দরকার হয়। শায়খ বললেন, এটা হারাম। তিনি প্রতিকিৃতি হাতে নিয়ে তা ভেঙ্গে ফেলেন। সে সময় জনৈক ইংরেজ পরিদর্শক আসে। এ দৃশ্য দেখে শায়খের কাজের ব্যাপারে বিতণ্ডা শুরু করে দেয়। শায়খ তাকে উত্তম উপায়ে জবাব দেন। তিনি তাকে বুঝিয়ে বলেন যে, নির্ভেজাল তাওহীন  প্রতিষ্ঠার জন্য ইসলামের আগমন হয়েছে। ইসলাম যে কোন আঙ্গিকে মূর্তিপূজার চিহ্ন খতম করতে চায়। ইসলাম প্রতিকৃতিকে এ কারণে হারাম করেছে, যাতে এসব প্রতিকৃতি পূজা-উপাসনার মাধ্যম না হয়ে পড়ে। শায়খ এ বিষয়ে এতটা আলোকসম্পাৎ করেন যে, পরিদর্শক মাথা ঠুকতে থাকে। কারণ, তার ধারনা ছিল, ইসলামেও মূর্তিপূজার সংমিশ্রণ রয়েছে। সে শায়কের কথা মেনে নেয় এবং তাঁর প্রশংসা করে।

একবার এক মুরীদের সঙ্গে মসজিদে হোসাইনে গমন করেন (আল আযহার এলাকায় এ মসজিদ অবস্থিত। এখানে হোসাইন (রা)-এর রওজা রয়েছে। ঐতিহাসিক দিক থেকে হযরত ইমাম হোসাইনের লাশ এখানে এনে দাফন করা প্রমাণ সিদ্ধ নয়-খলীল হামেদী)। কবরের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি সুন্নাত দোয়া পড়েন:

**********************************

-কবরবাসী মু’মিনদের প্রতি সালাম..... জনৈক মুরীদ বলে উফলোঃ আমাদের গুরু! সাইয়েদুনা হোসাইনকে বলূন, তিনি যেন আমাদের প্রতি সন্তুষ্ট হন। শায়খ হোছাফী বিস্মিত হয়ে তার দিকে তাকান এবং বলেন: তাঁর প্রতি আমাদের এবং তোমাদের প্রতি আল্লাহ সন্তুষ্ট হোন। মসজিদ পরিদর্শন আর কবর জিয়ারতের পর তিনি মুরীদদেরকে নিয়ে বসেন। তাদের সম্মুখে কবর জিয়ারতের বিধান ব্যাখ্যঅ করেন এবং স্পষ্ট করে বলেন, শরীয়তসম্মত আর বেদায়াতী জিয়ারতের মধ্যে কি পার্থক্য রয়েছে।

আব্বাজান আমাকে বলেছেন যে, মাহমুদিয়ার সম্মানিত ব্যক্তি হাসান বেক আবু সৈয়দ হাসান-এর গৃহে তিনি শায়খ হোছাফীর সঙ্গে মিলিত হন। অন্যান্য বন্ধু এবং হাছাফী ইখওয়ানরাও ছিল। গৃহের যুবতী সেবিকা কফি নিয়ে আসে। তার দুই বাহু এবং মাথা সম্পূর্ণ উলঙ্গ ছিল। শায়খ ক্রুব্ধ হয়ে তার দিকে তাকিয়ে বললেন, যাও, দেহের নগ্ন অংশ ঢেকে এসো। তিনি কফি পান করতেও অস্বীকার করেন। মেজবানকে উদ্দেশ্য করে তিনি জ্বালাময়ী ওয়াজ করেন। এতে তিনি বলেন, যুবতীরা সেবিকা হলেও দেহের এসব অংশ ঢেকে রাখা তাদের জন্যও ফরয! তাদেরকে কখনো বেগানা পুরুষদের সামনে আসা উচিৎ নয়।

মোটকথা, শায়খ হোছাফীর জীবনে এ ধরনের ঘটনা  অনেক। এসব ঘটনা অনেক তাৎপর্যপূর্ণ। গোটা জীবনে তাঁর এমনই ভূমিকা ছিল। তাঁর এসব সৌন্দর্য আমার অন্তরে তাঁর প্রতি ভক্তিশ্রদ্ধার অদম্য জোয়ার সৃষ্টি করে। হোছাফী ইখওয়ানরা সব সময় তাঁর কেরামতির কথা প্রচার করতো। কিন্তু আমার অন্তরে যেসব কেরামতির তেমন প্রভাব ছিল না,  যেমনটা ছিল তাঁর কর্মের।  আমার বিশ্বাস ছিল, আল্লাহ তা’আলা শায়খকে সবচেয়ে বড় কারামাতে ধন্য করেছেন, তা হচ্ছে সঠিক পদ্ধতিকে ইসলামী দাওয়াত পেশ করার তাওফীক ও সাহস। এবং হারামের ব্যাপারে তাঁর মনে জেগে ওঠা এক অস্বাভাবিক আবেগ-অনুভূতিও ছিল তাঁর এক বড় কারামাত। এর ফরেয ও বরকতেই তিনি ভালো কাজের নির্দেশ আর মন্দ কাজ  থকে বিরত রাখার তিক্ত ও কঠিন দায়িত্ব পালন করতে পেরেছেন। আমি যখন শায়খেখর সঙ্গে যুক্ত হই, তখন আমার বয়স ১৮ বৎসরের বেশী হবে না।

আমি তাঁর রচিত গ্রন্হ কয়েকবার পড়েছি। এ সময় আমি স্বপ্নে দেখি যে, আমি শহরের কবরস্তানে গিয়েছি। আমি দেখি, কবরস্তানের একটা কবর শূন্যে ঝুলছে। কবরের কম্পন আর অস্থিরতা বেড়ে চলেছে। শেষ পর্যন্ত কবরটি ফেটে গেছে এবং কবর থেকে আগুন বের হচ্ছে। আগুন এত উপরে উঠছে যে, আসমান ছুঁই ছুঁই করছে। পরে তা একজন মানুষের রূপ ধারণ করেছে। এক বিশেষ মানুষ। লোকটি ভয়ংকর লম্বা। এক ভয়াল দৃশ্য। চারদিক থেকে লোকজন ছুটে এসে তার চতুর্দিকে জড়ো হচ্ছে। লোকটি জোরে জোরে চিৎকার করে সকলকে বলছে; লোক সকল!‍ তোমাদের জন্য যেসব বিষয় হারাম ছিল, আল্লাহ তা মোবাহ করে দিয়েছেন। এখন তোমরা যা ইচ্ছা করতে পার। আমি সে বিশাল জনতার ভিড় থেকে বেরিয়ে এসে তার বিরোধিতা করে চিৎকার জুড়ে দিয়ে তার মুখের উপর বলছি; তুমি মিথ্যা বলছো। সকলের দৃষ্টি আমার দিকে নিবদ্ধ। আমি তাদেরকে বলছি; ভাইসব! এ লোকটা হচ্ছে ইবলীস। তোমাদেরকে প্ররোচনা দিয়ে দ্বীন থেকে দূরে সরিয়ে নেয়ার জন্য এসে এসেছে। তার কথায় তোমরা মোটেই কর্ণপাত করবে না। এতে লোকটা রাগন্বিত হয়ে আমাকে বলছৈ, এখন সকলের সামনে আমাদের দু’জনকে দৌড় প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতে হবে। তুমি যদি আমার আগে যেতে পার এবং আমি তোমাকে ধরতে না পারি, তবে তুমিই সত্য্ আমি তার এ শর্ত মেনে নিয়ে তার আগে দ্রুত ছুটে যাচ্ছি। কিন্তু কোথায় আমি আর কোথায় তার লম্বা লম্বা পা। এ সময় এক কোণা থেকে শায়খ হোছাফী দেখা দেন। তিনি আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। তিনি বাম হাত দিয়ে আমাকে ধরে রেখেছেন আর ডান হাত উপরে তুলে একটা কিছুর দিকে ইঙ্গিত করে বলছেন, মরদূদ, দূর হও। সে কোথাও গিয়ে আত্মগোপন করে। শায়খও চলে যান। আমি ফিরে এসে লোকজনকে বলি; তোমরা দেখতে পেলে, এ মরদুদ কেমন করে তোমাদেরকে আল্লাহর দ্বীন থেকে গোমরাহ করতে চেয়েছিল! এরপর আমার চক্ষু খলে যায়। এখন আমি অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষার প্রহর গুনছি, কখন শায়খ হোছাফী (র)-এর সুযোগ্য সন্তান সৈয়দ আব্দুল ওয়াহাব হোছাফী উপস্থিত হবেন এবং তাঁর দর্শন লাভে আমি জীবনকে ধন্য করবো, তাঁর নিকট থেকে তরীকতের রীতিনীতি শিক্ষা করবো। কিন্তু এ সময়ের মধ্যে তার আগমন হয়নি। এ ঘটনার পর থেকে শায়খ হোছাফীর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা আরো গভীর হয়।

কবরস্থানের কথা

কবরস্থানের কথা প্রসঙ্গে মাহমুদিয়ার ব্যবসায়ী শায়খ মোহাম্মদ আবু শোশার কথাও আমার মনে পড়ে। আমার রুহানী তরবিয়তে তাঁরও বিরাট ভূমিকা রয়েছে। তিনি ৮/১০ জন ছাত্র যোগাড় করে আমাদেরকে করবস্তানে নিয়ে যেতেন। সেখান আমরা কবর জিয়ারতের সুন্নাত আদায় করে শায়খ নজিলীর মসজিদে বসে ওযীফা পাঠ করতাম। শায়খ মুহাম্মদ আবু শোশা আমাদেরকে ওলী আল্লাহদের কাহিনী শোনাতেন। এসব কাহিনী শ্রবণ করে আমাদের অন্তর বিগলিত হতো আর চক্ষু থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়তো। এরপর তিনি আমাদেরকে খোঁড়া কবর দেখিয়ে স্মরণ করিয়ে দিতেন যে, শেষ পর্যন্ত এই কবরেই আমাদেরকে ঠাঁই নিতে হবে। কখনো কখনো তিনি আমাদের মধ্যে একজনকে কবরে নেমে কিছুক্ষণ নিজের শেষ পরিণতি স্মরণ করার জন্য বলতেন। কবরের অন্ধকার আর ভয়াবহতার কথা স্মরণ করতে বলতেন। শায়খ আবু শোশা নিজেও অঝোরে কাঁদতেন এবং আমাদের চক্ষুও অশ্রুসিক্ত হতো। আমরা বিনয় আর দীনতার সঙ্গে তওবা করতাম। কোন কোন সময় তিনি স্মৃতিস্বরূপ আমাদের বাহুতে সূতা বেঁধে দিতেন। তিনি আমাদেরকে বুঝাতেন যে, আমাদের কারো অন্তরে যদি মন্দ ভাব জাগে বা কারো উপর যদি শয়তান সওয়ার হয় তখন সে যেন তওবার কথা স্মরণ করে। আল্লাহর আনুগত্য এবং পাপ কাজ ত্যাগ করার প্রতিশ্রুতির কথা যেন স্মরণ করে। শায়খের এ উপদেশ আমাদের অনেক উপকার হয়েছে। আল্লাহ তাঁকে শুভ প্রতিদানে ধন্য করুন।

আমার অন্তর সর্বদা শায়খ হোছাফীর সঙ্গে আটকা ছিল। এ অবস্থায় আমি দামানহুরস্থ শিক্ষক প্রশিক্ষণ স্কুলে ভর্তি হই। এ শহরেই রয়েছে তাঁর কবর আর অসমাপ্ত মসজিদ। তখন পর্যন্ত যার কেবল ভিত্তি স্থাপন করা হয়েছে। অবশ্য পরে মসজিদ সম্পূর্ণ করা হয়েছে। আমি প্রতিদিন নিয়মিত তাঁর কবর জিয়ারত করতে যেতাম। আমি হোছাফী ইখওয়ানদের সংসর্গ করি এবং ‘তাওবা মসজিদের’ যিকরেরর মাহফিলে নিয়মিত যোগদান করি। আমি হোছাফী ইখওয়ানদের যিকরের মাহফিলের আমীর সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেই। তাঁর নাম শায়খ বাসইউনী। নিতান্ত নেক মানুষ, ব্যবসা করেন। শায়খ হোছাফীর নিকট আমাকে বায়য়াত করাবার জন্য আমি তাঁর কাছে আবেদন জানাই। তিনি আমার আবেদন মঞ্জুর করতঃ আমাকে কথা দেন যে, সৈয়দ আবদুল ওয়াহাব দামানহুরে আগমন করলে আমি তোমাকে তাঁর সম্মুখে উপস্থিত করবো। এ যাবৎ আমি তাসাউউফের পন্হায় কারো হাতে সরাসরি বায়য়াত করিনি। তাদের পরিভাষায় তখনো আমি কেবল প্রেমিকই ছিলাম। তখন পর্যন্ত কারো মুরীদ হইনি। (একটা কবিতা থেকে এ পরিভাষাটি গৃহীত হয়েছে। কবিতাটি এ রকমঃ

**********************************

“আমি নেককারদেরকে ভালোবাসি, তবে আমি নিজে নেককার নই। আশা করা যায়, আল্লাহ আমাকে নেকীর তাওফীক দান করবেন”।

হাছাফী ইখওয়ানরা দামানহুরে সৈয়দ আব্দুল ওয়াহহাবের আগমন সম্পর্কে আমাকে অবহিত করলে আমার আনন্দের সীমা থাকে না। আমি শায়খ বাসইউনীর নিকট গমন করে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আমাকে শায়খ আবদুল ওয়াহহাবের খেদমতে নিয়ে যাওয়ার জন্য আবেদ করি। তিনি আমাকে নিয়ে যান। দিনটি ছিল হিজরী ১৩৪১ সালের রমযান মাসের চার তারিখ। আসরের নামাজের পর তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। আমার স্মরণশক্তি প্রতারণা না করলে দিনটা ছিল রবিবার। এ সাক্ষাতে আমি সৈয়দ আব্দুল ওয়াহাহাবের হাতে হোছাফী এবং শাযেলী সিলসিলায় বায়য়াত করি। তিনি আমাকে এ সিলসিলার সমস্ত ওযীফা-কালামের অনুমতি দেন।

আল্লাহ তা’আলা সৈয়দ আব্দুল ওয়াহহাবকে শুভ প্রতিদান দান করুন। তাঁর সোহবাত থেকে আমি প্রভূত কল্যাণ আহরণ করেছি। তাঁর তরীকতে কল্যাণ ছাড়া অন্য কিছু আমি দেখতে পাইনি। ব্যক্তিগত জীবন এবং রুশদ আর সুলুকের বিচারেও তিনি অনেক পূত-পবিত্র স্বভাবে বিভূষিত ছিলেন। বরং এসব ক্ষেত্রে তাঁর স্থঅন ছিল অনন্য। মানুষের ধন-দৌলতের প্রতি তাঁর কোন মোহ ছিল না। লেনদেন, আচার-আচরণে তিনি একান্ত্র পবিত্রতা-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতেন। তিনি একা থাকেন বা মুরীদ পরিবেষ্টিত, সর্বাবস্থায়, গঠন-পাঠন, ইবাদাত, আনুগত্য বা যিকর-ফিকর ব্যতীত অন্য কোন কাজে তিনি সময় ব্যয় করতেন না। তিনি অতীব উত্তম উপায়ে ইওয়ান তথা মুরীদদের পথ প্রদর্শন করতেন। ভ্রাতৃত্ব, জ্ঞান অর্জন এবং আল্লাহর আনুগত্যের বাস্তব অনুশীলন করাতেন তিনি। আমার মনে পড়ে, তরবিয়ত আর তাযকিয়ার যে বিজ্ঞজনোচিত পন্হা তিনি অবলম্বন করতেন, তার আলোকে তিনি সাধারণ মুরীদদের সম্মুখে বিতর্কিত বা সন্ধিগ্ধ বিষয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করার অনুমিত দিতেন না শিক্ষিত ইখওয়ান তথা মুরীদদেরকে। তাদের সামনে নাস্তিক-জিন্দীক আর খৃস্টান মিশনারী ইত্যাদির প্রসঙ্গ উত্থাপন করারও অনুমতি দিতেন না। তিনি বলতেন, এ ধরনের কথাবার্তা বলবে একান্ত্র নিজেদের আসরে-মজলিশে। সেসব আসরে তোমরা এ নিয়ে বিতর্কও করতে পার। এসব অশিক্ষিত লোকদের সম্মুখে এমনসব কথাবার্তা বলবে, যা তাদেরকে আল্লাহর বন্দেগীল প্রতি উদ্বুদ্ধ-অনুপ্রাণিত করে। হতে পারে তোমাদের কথাবার্তা শুনে তাদের মনে সন্দেহ সৃষ্টি হবে আর সে সন্দেহের জবাব তার বুঝে আসবে না। আর এ কারণে শুধু শুধু তার বিশ্বাস নড়বড়ে হয়ে পড়বে।আর তোমরাই হবে এর কারণ। এক মজলিশে তিনি আমাকে এবং ওস্তাদ আহমদ সাকারীকে উদ্দেশ্য করে যে কথাগুলো বলেছিলেন, তা আজও আমার মনে পড়ে। তিনি বলেছিলেন; আমি এমন অনেক আলামত দেখতে পাচ্ছি যে, আল্লাহ তা’আলা অনেক লোকের অন্তর তোমাদের দিকে ঘুরায়ে দেবেন, অনেক লোককে তোমাদের সঙ্গী করবেন। ভালোভাবে জেনে রাখবে, যেসব লোক তোমাদের আশপাশে জড়ো হবে, তাদের সময় সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা তোমাদেরকে জিজ্ঞাস করবেন, তোমরা কি তাদের সময়কে ভালো কাজে ব্যয় করেছিলে, না সময়ের অপচয় করেছিলে। প্রথমটি করলে তারাও প্রতিদান পাবে এবং তাদের মতো তোমরাও পাবে। আর দ্বিতীয়টা হলে তোমরাও ধরা পড়বে এবং তারাও। এভাবে তাঁর সকল আদেশ-উপদেশ নেকী ও কল্যাণের জন্য উদ্বুদ্ধ করতো। মোটকথা, আমরা তাঁর মধ্যে নেকী ও কল্যাণ ছাড়া অন্য কিছুই দেখতে পাইনি।

**********************************

আমরা যা কিছু জানতে পেয়েছি, তারই সাক্ষ্য দিচ্ছি। গায়েব সম্পর্কে আমরা পর্যবেক্ষক নই। (সূরা ইউসুফ, আয়াত: ৮১)

এ সময় মাহমুদিয়ায় একটা সংস্কারমূলক সংগঠন গড়ে তোলার চিন্তা আমাদের মনে জাগে। এ সংগঠন ছিল।

**********************************

হোছাফী কল্যাণ সংগঠন। মাহমুদিয়ার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আহমদ আফেন্দী সাকারী ছিলেন এ সংগঠনেনর সভাপতি আর আমি ছিলাম সেক্রেটারী। এ সংগঠন দু’টি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে নিজের চেষ্টা-সাধনা নিয়োজিত করে। প্রথম ক্ষেত্রটি ছিল সচ্চরিত্রের প্রতি আহ্বান, ক্রমবর্ধমান অপরাধ আর হারাম কার্য যেমন- মদ-জুয়া ও শোক পালনে বেদয়াত ইত্যাদির মূলোৎপাটন। আর দ্বিতীয় ক্ষেত্রটি ছিল বাইবেল মিশন প্রতিরোধ, যা শহরে শিকড় গেড়ে বসেছিল। তিনজন যুবতী ছিল সে মিশনের প্রাণশক্তি, যাদের কর্মকর্তা ছিল মিসেস ওয়েস্ট। এ মিশন চিকিৎসা সেবা, হস্তশিল্প এবং অনাথ বালক-বালিকাদের সেবার আড়ালে খৃষ্টবাদ প্রচার শুরু করেছিল। হোছাফী কল্যাণ সংগঠন উক্ত মিশনের তৎপরতার তীব্র মোকাবিলা করে, সকল মহল থেকে যা প্রশংসিত হয়। পরবর্তীকালে ইখওয়ানুল মুসলিমুন এ সংঘাতে হোছাফী সংগঠনের প্রতিনিধিত্ব করে।

ইখওয়ানুল মুসলিম মুসলিমুন প্রতিষ্ঠা এবং সারা দেশে তা বিস্তার লাভ করা পর্যন্ত সৈয়দ আব্দুল ওয়াহহাব হোছাফীর সঙ্গে আমাদের হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক বজায় ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে ইখওয়ানুল মুসলিমুন সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি হয়ে পড়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ভিন। তিনি এবং আমরা নিজ নিজ মতে অটল থাকি। কিন্তু এখনো আমি তাঁর সম্পর্কে মনে মনে শ্রদ্ধা পোষণ করি, যা একজন নিষ্ঠাবান মুরীদ তাঁর শায়খ সম্পর্কে  পোষণ করতে পারে। তিনি নিঃস্বার্থভাবে ওয়াজ ও উপদেশ দানের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।

তাসাউউফ সম্পর্কে আমার অভিমত

আমার ডাইরীতে ইসলামী দাওয়াতের ইতিহাসে তাসাউউফ ও তরীকতের নানা সিলসিলার কীর্তি সম্পর্কে আমার অনুভূতি ব্যক্ত করলে তা কল্যাণকর হবে। তাসাউউফের সূচনা কিভাবে হয়েছে, এর প্রভাব-পরিণতি কি ছিল এবং ইসলামী সমাজের অভ্যন্তরে তরীকতের নানা সিলসিলা কতটা কল্যাণকর- এসব বিষয়ে আমি পাণ্ডিত্যপূর্ণ আলোচনার অবতারণা করবো না,’ পারিভাষিক তত্ত্বের গভীরে প্রবেশ করার চেষ্টাও আমি করবো না। আমি স্মৃতিকথা লিখতে বসেছি। স্মৃতিকথায় মনের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া লেখা হয়, মনের কোণে যেসব বিষয় উঁকি-ঝুঁকি মারে, যেসব আবেগ-অনুভূতি দোলা খায়, তা স্মৃতিকথায় লিপিবদ্ধ করা হয়। আমার ব্যক্ত করা মনোভাব সঠিক হলে এটা হবে আল্লাহর তাওফীকেরই দান। আল্লাহই হচ্ছেন প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য। আর যদি তা সঠিক না হয় তবে লেখকের অভিপ্রায় মঙ্গল ও কল্যাণ ছাড়া অন্য কিছুই নয়।

**********************************

“শুরুতে এবং শেষে হুকুমের মালিক আল্লাহ”। (সূরা রূমঃ ৪)

প্রথম শতাব্দীর সূচনায় যখন ইসলামী রাষ্ট্রের সীমা দূর-দুরান্ত পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে বিপুল বিজয় সাধিত হয়, যখন চতুর্দিক থেকে লোকজন মুসলমানদের দিকে ধাবিক হতে শুরু করে, যখন সব রকম সম্পদ মুসলমানদের ধন-ভাণ্ডারে প্রবেশ করতে শুরু করে; তখন খলীফাতুর মুসলিমীন আকাশের মেঘনালাকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন- প্রাচ্য আর প্রতীচ্যের যেখানেই বারি বর্ষিত হোক না কেন, সেখানকার রাজস্ব আমার কাছে আসবেই। এ সময় দুনিয়ার প্রতি মুসলমানদের ঝুঁকে পড়া, দুনিয়ার নিয়ামত উপভোগ করা এবং সেসবের স্বাদে-গন্ধে নিজেদেরকে পরিতৃপ্ত করা-কখনো ভারসাম্য রক্ষা আর মধ্যপন্হা অবলম্বন করে, আবার কখনো বা অপব্যয়-অপচয় করে-এটা ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার। সমাজ যখন নবুওয়াতের উজ্জ্বল যুগের কষ্ট-ক্লেশ আর সরলতাকে বিসর্জন দিয়ে জাগতিক স্বাচ্ছন্দ্য আর আরাম-আয়েশের দিকে দ্রুত ছুটে যাচ্ছিল, তখন এহেন সামাজিক পরিবর্তনের সামনে তাকওয়া ও কল্যাণের বাহক একদল জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তি এবং তাদের মধ্য থেকে একটা প্রভাবশালী দল দাওয়াত ও তাবলীগ তথা প্রচার ও প্রসারের জন্য সম্মুখে এগিয়ে আসবেন- এটাও ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার। এ দলটি এগিয়ে এসে দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী ভোগের বস্তুর প্রতি মানুষের ভালোবাসা আর আকর্ষণ হ্রাস করাবেন এবং তাদেরকে পরকালের কথা স্মরণ করাবেন- এটাও খুবই স্বাভাবিক। তাঁরা এসে লোকদেরকে বলবেনঃ

**********************************

“আর পরকালের গৃহই হচ্ছে চিরন্তন, যদি তারা জানতে পারতো”। (সূরা আনকাবুত: ৬৪)

দাওয়াত ও সংস্কারের এ কাজ করার জন্য যারা সর্বপ্রথম দাঁড়ান, তাঁদের মধ্যে প্রথম ব্যক্তিত্ব ছিলেন বিশিষ্ট ইমাম ও ওয়অজকারী হযরত হাসান বসরী (র)। তাঁরপর তাঁর মতো আরো অনেক সত্যের আহ্বানকারী এবং উম্মতের সাধু সজ্জন উত্থিত হয়েছেন। মানুষের মধ্যে এঁরা এই হিসাবেই পরিচিত হয়েছেন যে, এরা আল্লাহর যিকর এবং আখিরাতকে ভয় করার প্রতি আহ্বান জানান। দুনিয়া সম্পর্কে অল্পে তুষ্টি আর বর্জন করে চলার দীক্ষা দেন এবং মানুষের অন্তরকে আল্লাহর আনুগত্য ও তাকওয়অর লালন দ্বারা আলোকিত করে তোলেন।

কিন্তু এহেন পবিত্র আর বিশুদ্ধ বিষয়ের সঙ্গেও তাই ঘটটেছে, যা ঘটেছে অন্যান্য ইসলামী জ্ঞান আর চিন্তা-ধারার ক্ষেত্রে। ফলে এ বিষয়গুলো একটা যথারীতি জ্ঞানের রূপ ধারণ করে নেয়। আর এ জ্ঞঅনের আলোচ্য বিষয় সাব্যস্ত করে বলা হয় যে, এটা হচ্ছে সে জ্ঞান, যা মানুষের চরিত্র আর আচরণকে পরিশীলিত করে এবং মানুষের জন্য জীবনের একটা ধারণা প্রবর্তন করে। সে বিশেষ ধারার পর্যায়গুলো হচ্ছে যিকর, ইবাদাত এবং আল্লাহর মারিফাত বা সঠিক পরিচয় আর এর চরম লক্ষ্য হচ্ছে জান্নাত এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ। ইলমে তাসাউউফের এ অংশটা, আমি যার নামকরণ করি তরবিয়ত ও সুলুকের জ্ঞান নিঃসন্দেহে এটা ইসলামের সার নির্যাস এবং তারই মূল প্রাণসত্ত্বা। সন্দেহ নেই যে, সুফিয়ায়ে কিরাম এ জ্ঞানের মাধ্যমে অন্তরের চিকিৎসা ও সংশোধন এবং পরিশীলন-পরিশুদ্ধির ক্ষেত্রে এমন উঁচু স্থানে হাসিল করেছেন, ইছলাহ ও তরবিয়ত তথা লালন আর সংস্কারের অন্যান্য বিশেষজ্ঞরা সে মর্তবায় কখনো পৌঁছতে পারেননি। সুফিয়ায়ে কিরাম এ রীতির সাহায্যে আল্লাহর নির্দেশিত ফরয সম্পর্কে মানুষকে অবহিত করা, আল্লাহর নিষিদ্ধ কাজ থেকে বিরত থাকা এবং আল্লাহর প্রতি সত্যিকার মনোনিবেশের একটা বাস্তব পরিকল্পনা প্রণয়ন করে তদনুযায়ী পরিচালিতও করেছেন। যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রে ও প্রক্রিয়া বাড়াবাড়ি থেকে মুক্ত নয় এবং যেসব যুগ আর কালের দাবী দ্বারা তা প্রভাবিত হয়েছে, সেসব যুগের সঙ্গে তারা দ্বন্দ্ব ও সংঘাতে লিপ্ত ছিলেন। যেমন নীরবতা সম্পর্কে বাড়াবাড়ি; উপোষ সম্পর্কে বাড়াবাড়ি, অনিদ্রা সম্পর্কে বাড়াবাড়ি এবং নির্জন বাস বিষয়ে বাড়াবাড়ি। দ্বীনে এসব আমলের ভিত্তি বর্তমান আছে। যেমন নীরবতার ভিত্তি হচ্ছে বাজে কথা থেকে বিরত থাকা। উপোষ ব্রতের ভিত্তি হচ্ছে নফল রোযা। বিনিদ্র রজনী যাপনের ভিত্তি হচ্ছে কিয়ামূল লাইল তথা রাত্রিতে দাঁড়িয়ে নামায আদায় করা আর নির্জন বাসের ভিত্তি হচ্ছে কষ্টদায়ক বিষয় থেকে নফসকে নিবৃত করা আর নাফসের সঠিক পরিচর্যা করা। শরীয়তের নির্ধারিত সীমার মধ্যে এসব বিষয়ের বাস্তব প্রয়োগ সীমিত রাখা হলে তা হতো আগাগোড়া কল্যাণকর।

কিন্তু সুফীবাদ সুলূক আ তরবিয়্যতের জ্ঞান পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকেনি। এ সীমার মধ্যে সীমিত থাকলে তা তার জন্যও ভালো হতো। আরো ভালো হতো মানুষের জন্যও। কিন্তু পরবর্তীকালের তা নিজের সীমা অতিক্রম করে যায় এবং মনস্তাত্ত্বিক আর দার্শনিক তত্ত্বের জটিলতা নিরসনের প্রবৃত্ত হয়। দর্শন, তর্কশাস্ত্র এবং অতীত জাতির অন্যান্য দর্শন আর চিন্তাধারার সংমিশ্রণ ঘটে তাতে। তা দ্বীনের মধ্যে এমনসব বিষয়কে ঘুলিয়ে ফেলে, যেসব বিষয়ের কোনই সম্পর্ক নেই দ্বীনের সঙ্গে। নাস্তিক-যিন্দিীকরা বক্র চাল আর বক্র চিন্তার অধিকারী মানুষের সম্মুখে এমন বিস্তীর্ণ সুযোগ করে দিয়েছে, যাতে তারা তাসাউউফের নামে এবং দরবেশী ও আরাম-আয়েশ ত্যাগের আড়ালে এবং রূহানী পরিচ্ছন্নতা অর্জনের আগ্রহের অন্তরালে দ্বীনের বিকৃতি সাধনের কাজ করছে। ব্যাপারটা এতটুকু গড়িয়ে গেছে যে, এ বিষয়ে লিখিত বা ঐতিহ্যগত যে সমস্ত ভান্ডার সন্নিবিষ্ট হয়ছে, তা এতটা অবিশ্বাস্য যে, সত্য দ্বীনের সমঝদার ব্যক্তি আর দ্বীনকে স্বচ্ছ-পরিচ্ছন্ন দেখতে আগ্রহী ব্যক্তিবর্গের জন্য তাকে সূক্ষ্মদর্শী দৃষ্টির কষ্টিপাথরে তুলে আসল আর নকল পৃথক করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।

এরপর শুরু হয়েছে সূফীবাদের কার্যতঃ বিভক্তির যুগ। সৃষ্টি হয়েছে সূফীদের নানা ফের্কা আর নানা সিলসিলা। প্রত্যেকে নিজস্ব বিশেষ তরবিয়ত রীতির অধীনে নিজের একটা ফের্কা সৃষ্টি করেছে। পরবর্তীকালে এ ক্ষেত্রে রাজনীতিও অনুপ্রবেশ করতে থাকে। আর তা সূফীদের দলনে নিজের উদ্দেশ্য সিদ্ধির আশ্রয় হিসাবে ব্যবহার করে। কখনো এসব ফের্কাকে সামরিক কায়দায় সংগঠিত করা হয় (তুরস্কের ওসমানী যুগে ইনিচেরী ব্যবস্থা মূলত: তাসাউউফকে ভিত্তি করেই প্রতিষ্ঠা করা হয়, পরবর্তীকালে যাকে নিয়মিক সামরিক সংগঠনে পরিণত করা হয়- খলীল হামেদী)। আবার কখনো তাকে প্রাইভেট সংগঠনের রূপ দেয়া হয়। শেষ পর্যন্ত তাসাউউফ নানা পর্যায়ে অতিক্রম করে এমন এক চিহ্নিত রূপ ধারণ করেছে, যা আমাদের সম্মুখে বর্তমান রয়েছে। তাসাউউফের দীর্ঘ ইতিহাসে সৃষ্ট নানা রঙের অবশিষ্ট নিদর্শনই এই চিত্রে দেখা যায়। তরীকতের বিভিন্ন সিলসিলার শায়খ আর তাঁদের মুরীদ আর ভক্তদের মাধ্যমে অধুনা মিশরে এ দর্শনের প্রতিনিধিত্ব চলছে।

সন্দেহ নেই যে, অনেক দেশে ইসলামের প্রচার-প্রসার এবং দূরান্ত পর্যন্ত ইসলামকে নিয়ে যাওয়ার কাজে তাসাউউফ ও তরীকত বিরাট ভূমিকা পালন করেছে। সূফীয়ায়ে কেরামের চেষ্টা-সাধনা ব্যতীত যেসব অঞ্চলে ইসলাম পৌঁছানো সম্ভব ছিল না। উদাহরনস্বরূপ বলা যায়, আফ্রিকার বিভিন্ন শহর আর মরু অঞ্চল এবং মধ্য আফ্রিকায় ইসলামের প্রবেশ সূফিয়ায়ে কেরামের বদৌলতেই সম্ভব হয়েছে এবং বর্তমানেও এ কাজ চলছে। এশিয়ার অনেক দেশে (বিশেষ করে উপ-মহাদেশে) এ অবস্থাই হয়েছে। উপরন্তু এ কথাও সন্দেহ-সংশয়ের অতীত যে, তরবিয়ত আর সুলুকের ক্ষেত্রে তাসাউউফের রীতি-নীতির উপর আমল করা মন-মানসের উপর বিরাট ছাপ মুদ্রিত করে। এ ক্ষেত্রে সুফিয়ায়ে কেরামের বাণী এমন উদ্যম আর আবেগ-উচ্ছাসের সঞ্চার করে, যা অন্য কোন বাণী করতে পারে না। কিন্তু তাসাউউফের মধ্যে বিভিন্ন দর্শন আর চিন্তাধারার সংমিশ্রণ-এর বেশীরভাগ কল্যাণকে বিনষ।ট করে দিয়েছে।

সূফীদের এসব দলের সংস্কার-সংশোধন আর পরিশুদ্ধির জন্য দীর্ঘ চিন্তা-ভাবনা করা উম্মতের সংস্কারকদের কর্তব্য। এদের সংস্কার-সংশোধন অতি সহজ। সংস্কার গ্রহণ করার পরিপূর্ণ যোগ্যতা এদের মধ্যে রয়েছে। বরং অন্যসব মানুষের চেয়ে বেশীই রয়েছে। শর্ত হচ্ছে সঠিকভাবে সংস্কারের প্রতি তাঁদের মনোযোগ আকর্ষণ করা। এ দায়িত্ব পালন করার জন্য কেবল এতটুকুই যথেষ্ট যে, কিছু সৎ আর সত্যনিষ্ট আমলদার আলেম এবং নিষ্ঠাবান ও সত্যাশ্রয়ী মোবাল্লেগকে অন্যসব কাজ ত্যাগ করে কেবল এদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং তাসাউউফের বিশাল জ্ঞান ভান্ডার থেকে কল্যাণ লাভ করতে হবে এবং এতে যেসব বিকৃতি অনুপ্রবেশ করেছে, তা পরিস্কার করতে হবে। এরপর এ ক্ষে্রের অভিসারীদের সঠিক নেতৃত্বের ব্যবস্থা করতে হবে। আমার মনে পড়ে যে, সাইয়্যেদ তাওফীক বেকরী (র), এ বিষয়টি নিয়ে বেশ চিন্তাভাবনা করেছিলেন এবং মাশায়েখে কেরাম সম্পর্কে তাত্ত্বিক আর বাস্তবিক দিক থেকে গবেষণাধর্মী চেষ্টা সাধনা করেছিলেন। তিনি এ বিষয়ে একটা গ্রন্হও প্রণয়ন করেছিলেন। কিন্তু তাঁর এ পরিকল্পনা সমাপ্তিতে উপনীত হতে পারেনি। এবং তাঁর পরে অন্য আলেমরা এ ব্যাপারে মনোযোগই দেননি। আমার মনে পড়ে, শায়খ আব্দুল্লাহ আফীফী (র) ও এ বিষয়ে বেশ মনোযোগ দিয়েছেন। কিন্তু এ চিন্তা কেবল তাত্ত্বিক দিক পর্যনত্ সীমাবদ্ধ ছিল, এতে বাস্তব পদক্ষেপের কোন আলামত ছিল না। আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞান-ক্ষমতা, সূফীদের সিলসিলার রূহানী ক্ষমতা এবং ইসলামী আন্দোলন সমূহের কর্ম-ক্ষমতা এ তিনটি শক্তি ঐক্যবদ্ধ হয়ে একে অপরের সঙ্গে মিশে যেতে পারলে এ জাতি এক নজিরবিহীন জাতির রূপ ধঅরণ করতে সক্ষম হতো। তারা এমন এক উম্মতে পরিণত হতো, যা অন্যদের অনুসারী নয়, বরং পথ প্রদর্শক, অন্যদের অনুগামী নয়, বরং নেতা হতো, অন্যদের দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে বরং অন্যদের উপর প্রভাব সৃষ্টিকারী হতো। আর সে জাতি বর্তমান মানব গোষ্ঠীকে সঠিক পথ প্রদর্শন করতে সক্ষম হতো। কিন্তু আল্লাহ যা চান, তা-ই হয়।

দামানহুরের দিনগুলো

দামানহুর আর শিক্ষক প্রশিক্ষণ স্কুলের দিনগুলো ছিল তাসাউউফ এবং ইবাদাতের সেবায় ডুবে থাকার সময়। বলা হয়ে থাকে যে, মানুষের জীবন কয়েকটা পর্যায়ে বিভক্ত। এসব পর্যায়ের অন্যতম ছিল মিশরের বিদ্রোহের অব্যবহিত পরে ১৯২০ থেকে ১৯২৩ সাল পর্যন্ত তিন বৎসর (মিশর জাতি ১৯১৯ সালে সা’আদ জগলুলের নেতৃত্বে ইংরেজদের মিশর অধিকারের বিরুদ্ধে গণবিদ্রোহ শুরু করে এবং মিশরের স্বাধীনতার দাবী তোলে। এ বিদ্রোহের ফলে বৃটেন মিশরের স্বাধীনতা স্বীকার করে নেয়-খলীল হামেদী)। এ বিদ্রোহ যখন শুরু হয় আমার বয়স তখন ১৪ বৎসরের চেয়ে কিছু কম ছিল। আর এ পর্যায় যখন শেষ হয় তখন আমার বয়স ১৭ বৎসরের চেয়ে কয়েক মাস কম। আমার জন্য এ পর্যায় ছিল তাসাউউফ আর ইবাদাতে নিমগ্ন থাকার পর্যায়। কিন্তু এরপরও ছাত্রদের উপর যে দায়িত্ব ন্যস্ত হয়েছিল, তাতে কার্যতঃ অংশগ্রহণ থেকে এ পর্যায় মুক্ত ছিল না মোটেই।

আমি যখন দামানহুর পৌঁছি, তখন আমি হোছাফী চিন্তা দ্বারায় আকষ্ঠ ডুবে ছিলাম। এ ধারার প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ হাসানাইন হোছাফীর কবর মোবারক ছিল দামানহুরেই। সেখানে বর্তমান ছিল শায়খের বাছাই করা মূরীদদের দল। এ পরিবেশে বিলীন হয়ে এ চিন্তা ধারায় সম্পূর্ণ ডুবে থাকা ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার। আমাদের ওস্তাদ আলহাজ্ব হালুমী সুলাইমান তখনো দামানহুরে শিক্ষক হিসেবে কাজ করছিলেন। তিনি ছিলেন ইবাদাত পালন, সততা, তাকওয়া আর তরীকতের আদব পারবন্দীর সঙ্গে পালন করার উত্তম নমুনা। এ কারণে তাঁর আর আমার মধ্যে রূহানীী সম্পর্ক বিশেষ গভীর ছিল, যার ফলে আমার তাসাউউফে নিমগ্ন থাকা আরো গভীলতর হয়ে উঠে। তাঁর সহকর্মী এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু ওস্তাদ শায়খ হাসান খাযবেকও তখন দামানহুরে শিক্ষক ছিলেন। তাঁর বাসায় বসতো জ্ঞান আর তাবলীগের আসর। ইনি রমযানুল মুবারকে মসজিদুল জায়শে ইমাম গাজ্জালীর এহইয়াউল উলূমের দারস দিতেন। এসব সমাবেশে আলহাজ হালমী আমাকে তাঁর সঙ্গে নিয়ে যেতেন। এমনিভাবে অল্প বয়সের ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও বড়দের সংসর্গ লাভের সুযোগ আমার হয়েছে। এদের মধ্যে আমার স্কুলের শিক্ষকরা ছাড়াও অন্যান্য জ্ঞানী গুণী ব্যক্তিরাও ছিলেন। এরা এবং অন্যান্য বুযুর্গরা আমাকে এবং আমার মতো অন্যান্য যুবকদেরকে আল্লাহর বন্দেগীর পথে অগ্রসর থাকার জন্য নিয়মিত উৎসাহিত করতেন। এসব কার্যকারণ সূফীসুলভ কর্মকাণ্ডে আমাকে নিয়োজিত রাখে।

আমার ওস্তাদ শায়খ আব্দুর ফাত্তাহ আবু আল্লামের সঙ্গে দীর্ঘ বিতর্কের কথা আমি কিছুতেই ভুলতে পারবো না। তিনি স্কুলে হাদীস- তাফসীর আর ফিকহ পড়াতেন। তাসাউউফের সিলসিলা আর সুফিয়া ও আওলিয়াদের সম্পর্কে আপত্তি প্রসঙ্গে এসব দীর্ঘ আলোচনা আর বিতর্কের সূচনা হতো। প্রিয় ওস্তাদ তর্কবিতর্ক করতে করতে শেষ পর্যায়ে হেসে পড়তেন। আনুগত্য আর দরবেশীর কর্মে আজীবন থাকার জন্য আমাকে উৎসাহিত করে গভীল অধ্যয়নের দীক্ষা দিতেন। তিনি বলতেন, গভীর অধ্যয়ন, ফিকহের বিভিন্ন মযহাব আর ইলমে কালামের নানা ফের্কা এবং তাসাউউফের সিলসিলার ইতিহাস সম্পর্কে গভীর অধ্যয়ন করলেই আমল তত্ত্ব উল্লাসিত হবে। আলোচনা আর তথ্যানুসন্ধান ছাড়া আমল তত্ত্ব আনুগত্য হওয়া যায় না। অধিকন্তু ওস্তাদদের সঙ্গে আমার মতবিরোধ ঘটতো; কিন্তু এরপরও আমি অনুভব করতাম যে, ওস্তাদের স্নেহ পুরোপুরি বহাল আছে এবং সঠিক পথ দেখাবার জন্য তাঁর মধ্যে সত্যিকার আগ্রহের অভাব নেই। আমাদের বিতর্ক আর যুক্তি প্রদর্শন সত্য উদ্ধারের আগ্রহ অতিক্রম করে যেতো না।

মসজিদুল জায়শের রজনী

দামানহুরের মসজিদুল জায়শ এবং ফূলাকা পুলের নিকট অবস্থিত হাতাতেবা মসজিদের রজনীগুলোর কথাও কিছুতেই ব্স্মিৃতি হতে পারব না। রমযান মাসে ফজর নামাযের পর শায়ক হাসান খাযবেক- এর দারসে শরীক হতাম। এখানেই উৎসাহ উদ্দীপনা আরো বৃদ্ধি পায়। এ মসজিদে হোছাফী ইখওয়ানদের একটা সত্যনিষ্ঠ দলের সঙ্গে গোটা রজনী এ’তেকাফে অতিহাহিত হতো। এখানে শায়খ মুহাম্মদ আমের ওস্তাদ হোসাইন ফাওজী আফেন্দীর সঙ্গে আমরা সামান্য আহার করে কিছুক্ষণ আল্লাহর যিকরে মশগুল হতাম। এরপর ঘন্টা দুয়েক ঘুমিয়ে ঠিক মধ্যরাতে তাহাজ্জুদের নামাযের জন্য উঠতাম এবং ফজরের নামায পর্যন্ত তাহাজ্জুদে নিমগ্ন থাকতাম। এরপর শুরু হতো ওযীফা কালামের ধারা। তারপর স্কুল অভিমুখে গমন করতাম। ছাত্ররা নিজ নিজ পাঠে মনোনিবেশ করতো, আর অছাত্ররা নিজ নিজ কাজের ধান্দায় গমন করতো। অধিকন্তু এমনও হতো যে, ঘরে থাকলে রাত্রে ফজরের অনেক আগে জেগে উঠতাম। তখনো মসজিদের দরজা খোলা হয়নি। তাই হাতাতেবা মসজিদে গমন করতাম। এ মসজিদটা ছিল হাতাতেবা নদীল তীল ফুলাকা পুলের নিকট অবস্থিত। ফজরের পূর্ব পর্যন্ত সেখানে ইবাদাত বন্দেগীতে ডুবে থাকতাম। এরপর ফজরের জামায়াতে শরীক হওয়ার জন্য দ্রুত ছুটে আসতাম মসজিদুল জায়শ অভিমুখে।

ওলী-আওলিয়াদের যিয়ারত

জুমার দিন দামানহুরে থাকলে অধিকন্তু আশপাশের কোন না কোন ওলীর যিয়ারতের প্রোগ্রাম করতাম। কোন কোন সময় এ উদ্দেশ্যে আমরা ‘ওসুক’ গমন করতাম। ফজরের নামাযের পরপরই পায়ে হেঁটে রওয়ানা হতাম এবং সকাল আটটা নাগাদ সেখানে পৌঁছতাম। ওসুকের দূরত্ব ২০ কিলোমিটার। তিন ঘন্টায় আমরা তা অতিক্রম করতাম। যিয়ারতের আনুষ্ঠানিকতা পালন করতাম, এরপর জুমার নামায আদায় করতাম। দুপুরের খাবার কেয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতাম। আসরের নামায পড়ে দাসানহুরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করতাম এবং প্রায় মাগরিবের সময় দামানহুরের কাছাকাছি পৌঁছতাম। কখনো কখনো চলে যেতাম আযবা আততাওয়াম অভিমুখে। সেখানে ছিল শায়খ সানজারের মাকবারা। ইনি ছিলেন হোছাফী তরীকার বাছাই করা বিশিষ্ট ব্যক্তিদের অন্যতম। দরবেশী আর নেককারীর জন্য ইনি ছিলেন প্রসিদ্ধ। যেখানে সারাদিন অবস্থান করে রাত্রে ফিরে আসতাম।

নীরবতা আর নির্জনতার দিনগুলো

আমরা এমন কিছুদিন নির্দিষ্ট করে রেখেছিলাম, যে দিনগুলোতে নীরবতা পালন এবং লোকজন থেকে দূরে থাকার মান্নত করতাম। এদিনগুলো আমরা কেউ কারো সঙ্গে কোন কথা বলতাম না। কথা বলার কোন প্রয়োজন দেখা দিলে আল্লাহর যিকর বা কুরআন মজীদের কোন আয়াত দ্বারা তা প্রকাশ করতাম। স্কুলের ছাত্ররা আমাদের এ অবস্থাকে তাদের অভ্যাস অনুযায়ী উত্যক্ত করার উপযুক্ত মওকা বলে মনে করতো এবং স্কুলের প্রিন্সিপাল বা শিক্ষকের নিকট গমন করে বলতো, অমুক ছাত্রের মুখ বন্ধ হয়ে গেছে। আসল অবস্থা জানার জন্য শিক্ষক আগমন করতেন। আমরা কুরআন মজীদের কোন উপযুক্ত আয়াত শুনালে তিনি চলে যেতেন। মনে পড়ে, ওস্তাদ শায়খ ফরহাত সলীম আমাদের এ অবস্থাকে (মুখ বন্ধ রাখা) বেশ সম্মানের চোখে দেখতেন এবং ছাত্রদেরকে শাঁষাতেন। আমাদের নীরবতার রোযা পালনকালে প্রশ্ন দ্বারা আমাদের বিঘ্ন না ঘটাবার জন্য অন্যান্য শিক্ষকদেরকে তিনি হিদায়াত করতেন। শিক্ষকরা ভালোভাবেই জানতেন যে, আমাদের এ পন্হা উত্তর দান থেকে বিরত থাকা বা পরীক্ষা থেকে অব্যহতির জন্য নয়, কারণ পাঠে আমরা সব সময় অন্যদের চেয়ে অগ্রসর ছিলাম এবং ভালোভাবে পাঠ শিখে আসতাম। এ ব্যাপারে শরীয়তের হুকুম কি, তা না জেনেই আমরা নীরবতা পালন করি। নাফসকে শিক্ষা দেয়া এবং আজেবাজে কথা থেকে বিরত থাকার জন্যই ছিল আমাদের এই খামুশী। এর দ্বারা আমরা ইচ্ছাশক্তিকে মজবুত করতাম, যাতে মানুষ নাফসের উপর কর্তৃত্ব করতে পারে এবং নাফস মানুষের উপর কর্তৃত্ব করতে না পারে।

কখনো কখনো আমাদের এ অবস্থা উন্নতি করে যেতো। এমনকি মানুষের প্রতি ঘৃণার ভাব জেগে উঠতো, যা আমাদেরকে নির্জনবাস আর সম্পর্ক ছিন্ন করার জন্য উদ্বুদ্ধ করতো। আমার মনে পড়ে এ সময় আমি কোন কোন বন্ধুর চিঠি পেতাম, কিন্তু আমি তা খোলার এবং পড়ার চেষ্টাও করতাম না। বরং চিঠিগুলো সে অবস্থায়ই ছঁড়ে ফেলে দিতাম। আর এটা করতাম এ আশংকার পরিপ্রেক্ষিতে যে, চিঠির কোন বিষয় মনের জন্য কাঁটা হতে পারে। আর সূফীকে তো হতে হবে সমস্ত বোঝা থেকে মুক্ত। আল্লাহ ছাড়া সবকিছুর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা তার কর্তব্য। আর যতদূর সাধ্যে কুলায়, এ পথে তাকে পুরাপুরি মুজাহাদা করতে হবে।

 

স্কুলে ইসলামী রীতিনীতি মেনে চলা

অধিকাংম সময় আমার উপর এ অবস্থা বিরাজ করতো। এরপরও দাওয়াত ও তাবলীগের জলসা অধিকন্তু প্রবল হয়ে দেখা দিতো। বিদ্যালয়ের মসজিদে যোহার আর আসরের আযান আমিই দিতাম। এজন্য আমাকে শিক্ষকের নিকট থেকে অনুমতি নিতে হতো। কারণ আসরের নামাযের সময় আমাদের ক্লাশ চলতো। নামাযের সময়ের সঙ্গে এ সংঘাত ছিল আমার পীড়াদায়ক। কোন কোন শিক্ষক সন্তুষ্টচিত্তে আমাকে অনুমতি দিতেন, আবার কেউ কেউ বিদ্যালয়ের শৃংখলা মেনে চলাকে প্রাধান্য দিতেন। সেক্ষেত্রে আমি তাঁকে স্পষ্ট জানিয়ে দিতাম।

**********************************

“সৃষ্টিকর্তার নাফরমানী করে কারো আনুগত্য করা যাবে না”।

এ বিষয়ে আমি তাঁর সঙ্গে একটা তিক্ত বিতর্কে প্রবৃত্ত হতাম, যে বিতর্ক থেকে প্রাণ বাঁচানো আর আমার থেকে নাজাত পাওয়ার জন্য তিনি অনুমতি দিয়ে দিতেন। যোহরের সময়ও আমি ঘরে যেতাম না; বিরতির এ সময়টা মসজিদে বা বিদ্যালয়ের বারান্দায় কাটাতাম। এ সময় আমি বিদ্যালয়ের সঙ্গীদেরকে নামাযের জন্য ডাকতাম। যোহরের নামাযের পর আমি ওস্তাদ মুহাম্মদ শরফের নিকট গিয়ে বসতাম, যিনি পরবর্তীকালে শিক্ষা বিভাগের চাকুরীতে যোগ দিয়েছিলেন। আমরা দু’জনে কুরআন মজীদ দায়ের করতাম। তিনি পড়লে আমি শুনতাম, আর আমি  পড়লে তিনি শুনতেন। ইতিমধ্যে ক্লাশ শুরু হলে আমরা ক্লাশে হাজির হতাম।

ইউনিফর্ম প্রসঙ্গ

মনে পড়ে, একদিন শিক্ষক প্রশিক্ষণ স্কুলের প্রিন্সিপালের কক্ষে গমন করি অনুপস্থিত ছাত্রদের তালিকা দেয়ার জন্য। কারণ, এটা ছিল আমারই দায়িত্ব। প্রিন্সিপালের কক্ষে ছিলেন ডিপিআই ওস্তাদ সৈয়দ রাগিব। পরবর্তীকালে তিনি শিক্ষা বিভাগে সহকার কন্ট্রোলার পদে উন্নীত হয়েছিলেন। আমার পোশাকের প্রতি তাঁর নজর পড়ে। তখন আমার মাথায় ছিল পাগড়ি, তার একাংশ পেছনের দিকে ঝুলানো ছিল। হজ্বকালে এহরাম অবস্থায় যে জুতা পরা হয়, পায়ে ছিল তেমন জুতা। আর ঢিলা-ঢোলা জামার উপর ছিল কালো রুমাল। ডাইরেক্টর আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি এমন লেবাস কেন পরিধান করেছ? এজন্য যে, এজন্য যে এটা সুন্নাত- আমি জবাব দিলাম। তিনি বললেন, তুমি কি অন্যসব সুন্নাত কায়েম করে ফেলেছ? কেবল এই একটা সুন্নাতই কি বাকী রয়ে গেছে? আমি আরয করলাম, না অন্য সুন্নাতগুলো কোথায় পালন করতে পারছি। এক্ষেত্রে অনেক ক্রটি হচ্ছে। কিন্তু যতটুকু আমার সাধ্যে কুলায় তা করার চেষ্টা করছি। ডাইরেক্টর সাহেব বললেন, কিন্তু এহেন অদ্ভূত রূপ ধারণ করে তুমি তো বিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছ। আমি বললাম: জনাব, তা কিভাবে? বিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা হচ্ছে নিয়মিত বিদ্যালয়ে উপস্থিত হওয়া এবং নিয়মিত পাঠ মুখস্থ করা। আমি কখনো অনুপস্থিত থাকি না। বিদ্যালয়ের শৃংখলা হচ্ছে ভালো স্বভাব চরিত্র। আমি আমার সেকশনে প্রথম। তাহলে বিদ্যালয়ের শৃংখলা কিভাবে ভঙ্গ হলো? তিনি বলতে লাগলেন, তুমি যখণ এখান থেকে পাশ করে বের হবে এবং এই ইউনিফর্ম কঠোরভাবে পরবে, তখন শিক্ষা অধিদপ্তর শিক্ষক হিসাবে নিযুক্তি অনুমদোন করবে না। কারণ, পোশাকে তুমি ছাত্রদের পরিহাসের বস্তু আর কিম্ভুৎকিম্বাকার হিসাবে চিত্রিত হবে। আমি বললাম, এখনো সে সময় হয়নি। সময় হলে অধিদফতর তার সিদ্ধান্তে স্বাধীন থাকবে আর আমিও আমার সিদ্ধান্তে স্বাধীন থাকবো। জীবিকা অধিদফতরের হাতেও নয়, মন্ত্রণালয়ের হাতেও নয়। এটা কেবল আল্লাহর হাতে। ডাইরেক্টর সাহেব চুপ করে গেলেন এবং প্রিন্সিপাল সাহেবও কথায় বাধা দিয়ে অন্য কথা জুড়লেন। তিনি ডাইরেক্টরেরর নিকট ভালোভাবে আমাকে পরিচয় করালেন। তিনি আমাকে ক্লাশে ফেরত পাঠালেন। আমি তাঁর কক্ষ থেকে বেরিয়ে এলাম আর ভালোভাবেই প্রসঙ্গটা শেষ হলো।

জাতীয় আজাদী আন্দোলনের সুচনা

১৯১৯ সাল মিশরের প্রসিদ্ধ বিদ্রোহের বৎসর। আমি তখন মাহমুদিয়ায় মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র। বয়স ১৩ বৎসর। সে সময় কিভাবে বিরাট বিক্ষোভ হয়েছে, কিভাবে সর্বাত্মক হরতাল হয়েছে, যা এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত গোটা শহরকে গ্রাস করছিল- এসব দৃশ্য এখনো আমার চোখের সামনে ভাসছে। শহরের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা এসব বিক্ষোভ মিছিলে নেতৃত্ব দিতেন। তাদের হাতে থাকতো পতাকা। একে অপরকে ছাড়িয়ে যাওয়ার জন্য তাদের মধ্যে কী প্রতিযোগিতা। বিক্ষোভকারীরা আগ্রহ সহকারে যে গান গাইতো, এখনো তা আমার মনে গেঁথে আছে।

**********************************

স্বদেশ প্রেম ঈমানের অঙ্গ

আল্লাহর ফেরেশতা ডাকছে আমাদেরকে

আজাদীর ছায়াতলে জমা হতে না পারলেও

জান্নাতুল ফিরদাউসে সাক্ষাৎ হবে নিশ্চয়ই।

ইংরেজ সৈন্যদের দৃশ্যও আমার স্মৃতিতে সংরক্ষিত আছে। এরা গ্রামে গঞ্জে আর শহর-জনপদে শিবির স্থাপন করতো। তারা জনগণের উপর নির্যাতন চালাতো। আর জনগণও কোন ইংরেজ সৈন্যকে একা পেলে তার খবর নিয়ে ছাড়তো। ফলে মুখ কালো করে তাদের শিবিরে ফিরে যেতে হতো। ন্যাশনাল গার্ড (*****************)-এর কথাও আমার মনে আছে। জনতা নিজেদের পক্ষ থেকে এ বাহিনী গঠন করেছিল। ন্যাশনাল গার্ডের স্বেচ্ছাসেবীরা রাত্রিবেলা এলাকা পাহারা দিতো, যেন ইংরেজ সৈন্যরা গৃহে প্রবেশ করে লুটপাট আর সম্ভ্রমহানী করতে না পারে।

এসব গোলযোগে ছাত্র হিসাবে আমাদের কেবল এতটুকু অংশ ছিল যে, কখনো কখনো আমরা হরতাল ডাকতাম, বিক্ষোভে যোগ দিতাম। দেশের সমস্যা আর পরিবর্তিত বিষয়ে রাজনৈতিক নেতাদের বক্তৃতা শুনতাম।

কিছু স্মৃতি, কিছু কবিতা

এ সময় একদিন আমদের ওস্তাদ শায়খ মুহাম্মদ খালফ নূহ- যিনি পরবর্তীকালে আলেকজান্দ্রিয়ায় শিক্ষক নিযুক্ত হয়েছিলেন- আমাদের নিকট আগমন করেন। তাঁর চক্ষু থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। আমরা জানতে চাইলাম, কী হয়েছে, তিনি বললেন, আজ ফরীদ বেক ইনতিকাল করেছেন। এরপর তিনি ফরীদ বেকের জীবনী এবং দেশের জন্য তাঁর জিহাদ আর কুরবানীর কথা বলতে লাগলেন। এমনভাবে তিনি বলতে শুরু করেন, যাতে আমরা সকলেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়ি। এ ঘটনা প্রভাবিত হয়ে আমি কয়েকটা কবিতা রচনা করি। এ কবিতার অংশবিশেষ এখনো আমর মনে পড়ে:

**********************************

হে ফরীদ! শান্তি আর ঈমানের সঙ্গে ঘুমিয়ে থাকো,

হে ফরীদ! দেশের জন্য বিচলিত হবে না।

হে ফরীদ‍! সকল পরীক্ষা তোমার জন্য কোরবান হোক।

মিলস কমিশন সম্পর্কে লোকজনের মন্তব্য আর কথাবার্তাও আমার মনে আছে (১৯১৯ সালে মিশরে যে বিদ্রোহ দেখা দেয়, সে সম্পর্কে তদন্ত করার জন্য মিঃ মিলস- এর নেতৃত্বে বৃটেন যে কমিশন গঠন করে, এখানে সেদিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। গোটা মিশর জাতি এ কমিশন বয়কট করে- খলীল হামেদী)। কমিশনের বিরুদ্ধে জাতির ঘৃণা বণ্যার মতো উপচে পড়ে। একজন তরুণ ছাত্র, যার জীবনের মাত্র ১৩টি বসন্ত অতিবাহিত হচ্ছে, সেও কবিতার মাধ্যমে জাতির প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেঃ

**********************************

হে মিলস! ফিরে যাও আর জিজ্ঞেস করো,

প্যারিসে অবস্থানরত প্রতিনিধি দলকে,

স্বজাতির নিকট ফিরে যাও এবং তাদেরকে বল,

রে কমিনার দল! ওদেরকে ধোঁকা দেবে না।

দীর্ঘ কবিতার মাত্র দু’টি ছত্রই এখন মনে আছে। যৌবনে আমি জাতীয় উদ্দীপনামূলক অনেক কবিতা রচনা করি। একটা বড় খাতায় লিপিবদ্ধ এসব কবিতা পরবর্তীকালে পুড়িয়ে ফেলি। আর এ কাজটা করেছি তাসাউউফে উদ্বুদ্ধ হওয়ার ফলে। শিক্ষক প্রশিক্ষণ স্কুলের গোটা সময়টা তাসাউউফে ডুবে থাকার সময়, চার মযহাবের ফিকহ সম্পর্কেও আমি কিছু লিখেছিলাম এবং তথা কুমারীর প্রেম গ্রন্হের অনুকরণে কিছু সাহিত্যও সৃষ্টি করেছিলাম। ওস্তাদ মুহাম্মদ আলী বুদাইর- এর সঙ্গে ছোট মসজিদের অভ্যন্তরীণ চবুতরায় বসে আমি এসব লিখেছিলাম। কিন্তু এসব কিছুই অবহেলার শিকার হয়েছে এবং বর্তমানে এসবই নষ্ট হয়ে গেছে। আমি সে যুগকে কর্মের যুগ বলি। এ যুগে আমি মনে করতাম, বেশী জ্ঞান অর্জনে নিমগ্ন হওয়া কল্যাণকর আমল আর আল্লাহর ইবাদতে নিমগ্ন হওয়া থেকে বারণ করে। দ্বীন সম্পর্কে মানুষের এতটুকু জ্ঞান লাভ করা যথেষ্ট, যাতে দ্বীনের বিধানের শুদ্ধাশুদ্ধি সে স্মরণ করতে পারে আর দুনিয়ার জন্যও তার এতটুকু জ্ঞানই যথেষ্ট, যদ্বারা রুটি-রুজির ব্যবস্থা করতে পারে। এরপর তার কর্তব্য হচ্ছে কায়োমনোবাক্যে সদা আমল আর ইবাদতে নিমগ্ন থাকা। এটা ছিল আমার সে সময়ের চিন্তা।

হরতাল আর বিক্ষোভ

আমি যখন প্রশিক্ষণ স্কুলে ভর্তি হই, তখন বিদ্রোহ অনেকটা স্তিমিত হয়ে গেছে। অবশ্য আন্দোলনের স্মৃতি তখনো তাজা ছিল। তবে হরতাল বিক্ষেঅভ তখনো চলতো, পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষও হতো। এহেন পরিবেশেই আমার দামানহুরের দিনগুলো অতিবাহিত হয়। এক্ষেত্রে প্রথম দায়িত্ব ন্যস্ত হতো সেসব ছাত্রদের উপর, যারা ছিল বিশিষ্ট এবং যাদেরকে শীর্ষস্থানীয় মনে করা হতো। এ সময় আমি তাসাউউফ ও সুলুকে ডুবে থাকলেও আমার স্বদেরশের সেবা করা জিহাদ। এটা এমন এক কর্তব্য, যা থেকে অভ্যাহতির কোন অবকাশ নেই। এ বিশ্বাসের ভিত্তিতে এবং ছাত্রদের মধ্যে আমার স্থান ও মর্যাদার কারণে জাতীয় আন্দোলনে আমি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতাম। কারণ, আমি ছিলাম ছাত্রদের প্রথম সারিতে।

স্কুলের প্রিন্সিপাল শায়খ দাসূতী মূসার কথা আমি ভূতে পারবো না। তিনি আমাদের এসব তৎপরতায় ভীষণ সন্ত্রস্ত ছিলেন। একদিন তিনি আমাদেরকে ধরে নিয়ে যান বাহীরার পরিচালকের নিকট (তখন পরিচালক ছিলেন মাহমুদ পাশা আব্দুর রাজ্জাক)। ছাত্রদের হরতালের জন্য আমাকে দায়ী করে তিনি বলেন, এখন এরাই ছাত্রদেরকে হরতাল থেকে বিরত রাখতে পারে। মাহমুদ পাশা কখনো লোভ, কখনো হুমকী আবার কখনো উপদেশের মাধ্যমে আমাদেরকে এসব কাজ থেকে বিরত রাখার ব্যর্থ প্রয়াস চালান। বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনা করার কথা বলে তিনি আমাদেরকে ছেড়ে দেন। এ ব্যাপারে একটা উপায়ও আমরা অবলম্বন করি। ছাত্রদেরকে বুঝায়ে বলি যে, আজ ১৮ ই ডিসেম্বর ইংরেজদের মিশর অধিকারের কালো দিবস (১৮৮২ সালে আরবী পাশার আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ায় এই দিনে ইংরেজরা মিশর অধিকার করে নেয়। তখন মিশর শাসন করতেন মোহাম্মদ আলী পাশার পুত্র ইসমাঈল পাশা- খলীল হামেদী)। আমরা সিদ্ধান্ত নেই যে, সারাদিন ছাত্ররা আশপাশের ক্ষেত-খামারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকবে। অবশ্য আমি নিজে স্কুলে গমন করি। স্কুল প্রশাসন এবং আমি নিজে ছাত্রদের আগমনের অপেক্ষায় থাকি, কিন্তু কোন ছাত্রই আসেনি। কিছুক্ষণ পর আমি নিজেও স্কুল ত্যাগ করি। এভাবে হরতাল সফল হয় এবং শান্তিপূর্ণভাবে কালো দিবস পালিত হয়।

গোলযোগপূর্ণ দিনগুলোর কথা। একদিন ছাত্ররা হরতাল করে। ছাত্রদের এ্যাকশন কমিটি আমার বাসভবনে এক সমাবেশের আয়োজন করে। তখন আমি থাকতাম দামানহূরের হাজন খাযরা শায়ীরার বাসায়। হঠাৎ পুলিশ বাসা অবরোধ করতঃ ভেতরে প্রবেশ করে বাসার মালিক হাজন শায়ীরাকে জিজ্ঞাসা করে অধিবেশনে যোগদানকারী ছাত্র নেতাদের সম্পর্কে। তিনি বললেন, তারা তো ভোরে ভোরেই এখান থেকে বেরিয়ে গেছে, আর ফিরে আসেনি। হাজন শায়ীরা তখন তরকারী কুটছিলেন। পুলিশও তা দেখতে পায়। হাজনের এই অসত্য জবাব আমার কাছে অসহ্য ঠেকে। আমি জিজ্ঞাসাবাদকারী পুলিশ অফিসারের নিকট গমন করতঃ প্রকৃত অব্সথা সম্পর্কে তাকে অবহিত করি। যদিও এতে হাজন শায়ীরার পজিশন খুবই নাজুক হয়ে পড়েছিল, কিন্তু আমি নিতান্ত জোশের সঙ্গে পুলিশ অফিসারের সঙ্গে তর্ক করে তাকে বলি: আমাদের সঙ্গে যোগ দেয়া আপনার জাতীয় কর্তব্য। আমদের চেষ্টা ভন্ডুল করে ধরপাকড় করা আপনার উচিত নয়। আমার কথার ফল এই হয়েছে যে, তিনি আমার আবেদন মেনে নিয়ে পুলিশদেরকে ফেরত পাঠান এবং আমাদেরকে আশ্বস্ত করে তিনি নিজেও স্থান ত্যাগ করেন। আমি লুকিয়ে থাকা সঙ্গীদের কাছে এসে বলি, এটা হচ্ছে সত্য কথা বলার বরকত। আমাদেরকে অবশ্যই সত্যবাদী হতে হবে এবং নিজেদের কাজের দায়িত্ব নিজেদেরকেই বহন করতে হবে। অবস্থা আর পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, মিথ্যার আশ্রয় নেয়ার আদৌ কোন প্রয়োজন নেই।

মাহমুদিয়া আর দামানহুরের মধ্যস্থলে

আমি পড়াশুনার দিনগুলো কাটাতাম দামানহুরে এবং বৃহস্পতিবার যোহরের সময় চ লে আসতাম মাহমুদিয়ায় এবং শুক্র ও শনিবার রাত মাহমুদিয়ায় কাটাতাম। শনিবার ভোরে সোজা স্কুলে গমন করতাম এবং প্রথম পিরিয়ডে যথাসময় উপস্থিত থাকতাম। মাহমুদিয়ায় আমার অনেক কাজ থাকতো। এ সময় সেসব কাজ সারাতাম। ভাই আহমদ আফেন্দী সাকারীর সঙ্গে ভালোবাসার সম্পর্ক এমনই গভীর হয়েছিল যে, সারা সপ্তাহে একেবারেই সাক্ষাৎ হবে না, আমরা কেউই তা সহ্য করতে পারতাম না। উপরন্তু শুক্রবার রাত্রে শায়খ শালবীল রিজালের বাসায় আসর বসতো এবং তাসাউউফের কিতাব যথা এহইয়াউল উলূম, আহওয়ালূল আওলিয়া, আল ইয়াকুত ওয়াল জাওয়াহের ইত্যাদির সামষ্টিক পাঠ হতো। এরপর ভোর পর্যন্ত আল্লাহর যিকির হতো। এসব ব্যস্তথা ছিল আমাদের জীবনের পবিত্রতার প্রোগ্রাম। ঘড়ি মেরামত আর পুস্তক বাঁধাইয়ের কাজেও আমি উন্নতি করেছিলাম। দিনের কিছু সময় দোকানে এসব কাজে কাটাতাম আর রাত্রি কাটাতাম হোছাফী ইখওয়ানদের সঙ্গে আল্লাহর স্মরণে। এসব ব্যস্ততা আর উদ্দেশ্যের কারণে কোন অপরিহার্য প্রয়োজন ছাড়া বৃহস্পতিবার মাহমুদিয়ায় না এসে পারতাম না। আমি ডেলটা মিল থেকে নেমে সোজা দোকানে গমন করতাম। সোমবার আর বৃহস্পতিবার রোজা রাখা আমার অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। এরপর ছোট মসজিদে গমন করে দারস আর মজলিশে যোগদান করতাম। সেখান থেকে যেতাম শায়খ শালবীর রিজাল বা আহমদ আফেন্দী সাকারীর বাসভবনে কুরআন মজীদ দায়ের করা বা যিকর ও দোয়া-দরুদ পাঠের উদ্দেশ্যে। এরপর ফজনের নামায আদায় করার জন্য মসজিদে গমন করতাম। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে দোকানে যেতাম। দুপুরের খাবার খেতাম এবং জৃমার নামায আদায় করতাম। মাগরিব পর্যন্ত দোকানে বসতাম। এরপর যথানিয়মে মসজিদে আর ঘরে। অতঃপর ভোরে ভোরে স্কুলের উদ্দেশ্যে দামানহুরের পথে। পরবর্তী সপ্তাহেও একই নিয়মে এই প্রোগ্রামে চলতো। কোন জরুরী আর অস্বাভাবিক প্রয়োজন ছাড়া মাহমুদিয়ায় উপস্থিতি কামাই হয়েছে বলে আমার মনে পড়ে না।

গ্রীষ্মের ছুটি

গ্রীষ্মের ছুটি ছিল এ কর্মসূচী মেনে চলার উপযুক্ত সময়। অবশ্য এক নতুন ব্যস্ততা যোগ হতো। আর তা ছিল এই যে, প্রতিদিন ভোরে সূযোর্দয় থেকে অস্ত পর্যন্ত সময়টা মুহতারাম ওস্তাদ শায়খ মুহাম্মদ খালফ নূহ-এর বাসায় আলোচনায় কাটতো। আরবী ব্যাকরণের প্রসিদ্ধ গ্রন্হ ইবনে মালেক রচিত আলফিয়া আমি মুখস্থ করা শুরু করি। আলফিয়ার ব্যাখ্যা গ্রন্হ ইবনে আকীল- এর পাঠও নিতে শুরু করি। ফিকহ, উসূল এবং হাদীসের অনেক কিতাবও অধ্যয়ন শুরু করি। এসব কিতাব নিয়ে ওস্তাদ নূহ-এর সঙ্গে আলোচনা করি। এই অতিরিক্ত অধ্যয়ন ছিল একটা বড় কারণ, যার ফলে আমি দারুল উলূমে ভর্তি হওয়ার যোগ্য হই। অন্যথায় সে সময়ে দারুল উলূমে ভর্তি হওয়ার কথা ধারণাও করা সম্ভব ছিল না। আমরা বলতাম, কেবল নামকা ওয়াস্তেই আমরা জ্ঞঅন লাভ করছি।

ভোরের আযান

গ্রীষ্মের ছুটিতে মাহমুদিয়ায় আমাদের কাজের একটা অংশ এটাও যে, জুমার দিন ভোরে গোটা জনপদকে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিতাম। আমরা নিতজন বা ততোধিক ছিলাম- আমি নিজে, ভাই মুহাম্মদ আফেন্দী দিমইয়াতী এবং ভাই আব্দুল মুতা’আল। আমরা মহল্লায় বেরিয়ে পড়তাম। ফজরের কিছু আগেই নামাযের জন্য লোকজনকে জাগাতাম। বিশেষ করে হোছাফী ভাইদেরকে জাগাতাম। আমি যখন মুয়াযযিনকে ফজরের আযানের জন্য জাগাতাম, তখন এক বিরাট স্বাদ অনুভব করতাম এবং গভীর আনন্দে ডুবে যেতাম। তাদেরকে জাগবার পর আমি এহেন বিস্ময়কর অবস্থায় নীলনদের তীরে গিয়ে দাঁড়াতাম এবং আযান শুনার জন্য কান পেতে দিতাম।

প্রায় কাছাকাছি দূরত্বে ছিল মাহমুদিয়ার মসজিদগুলো। এ কারণে যখন আযানের আওয়াজ বুলুন্দ হতো, তখন মনে হতো যেন একই আযান বিভিন্ন মুয়াযযিনের কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে। একই সঙ্গে আকাশ-বাতাস মুখরিত করে তুলতো সে আযানের ধ্বনি। আমার অন্তর বলছে, বিপুল সংখ্যক মুসল্লী জোগাবার আমিই উপলক্ষ এবং রাসূলে খোদার মুবারক বাণী অনুযায়ী নামাযীদের সমান পূর্ণ আমিও লাভ করবো।

**********************************

“যে ব্যক্তি কোন হিদায়াতের দিকে আহ্বান জানায়, সে এজন্র পুণ্য পাবে এবং কিয়ামত পর্যন্ত সে ব্যক্তির আমলের পূণ্যও পাবে, যে ব্যক্তি তদনুযায়ী আমল করবে। এতে তার পুণ্য একটুও হ্রাস করা হবে না”।

এরপর আমি যখন মসজিদে গমন করতাম, তখন এ স্বাদ আরো বহুগুণে বৃদ্ধি পেতো। মসজিদে যারা আসতেন, তাদের মধ্যে আমি থাকতাম সবচেয়ে কম বয়সের। সমস্ত প্রশংসা কেবলমাত্র আল্লাহরই প্রাপ্য আর তাঁর কাছেই চিরন্তন তাওফীক কামনা করছি।

দারুল উলূমে ভর্তির প্রস্তুতি

টিচার্স ট্রেনিং স্কুলের গোটা তিন বৎসরের সময়টা ছিল তাসাউউফ আর ইবাদাতে ডুবে থাকার সময়। এহেন ব্যস্ততা সত্ত্বেও এ সময়টা স্কুলের নির্ধারিত পাঠ্যপুস্তক ছাড়াও অতিরিক্ত জ্ঞান অর্জনের আগ্রহ থেকে মুক্ত ছিল না। আমার ধারণায় এর দুটি কারণ রয়েছে। এর প্রথম কারণ ছিল আব্বাজানের লাইব্রেরী এবং অধ্যয়ন আর জ্ঞানচর্চার জন্য আমাকে উদ্বুদ্ধ অনুপ্রাণিত করা। তিনি আমাকে ভালো কিতাব উপহার দিতেন, যার মধ্যে কয়েকটা আজও আমার মুখস্থ আছে। এসব কিতাবের মধ্যে যে কয়টা আমার মনের উপর গভীল ছাপ মুদ্রিত করেছে, তার মধ্যে কয়েকটি হচ্ছে নাবহানী প্রণীত *********** এটা কাসতালানী রচিত ************* গ্রন্হের সংক্ষিপ্তসার; অপর গ্রন্হটা হচ্ছে শায়খ মুহাম্মদ খাজরী বেক প্রণীত ************* (উভয়ই রাসূলের পাকের জীবনী গ্রন্হ)। আব্বাজানের অনুপ্রেরণায় আমার মধ্যে অধ্যয়নের অদম্য আগ্রহ সৃষ্টি হয় এবং এর ফলে আমি স্বতন্ত্র একটা বিসয়ের এক বিপুল গ্রন্হ ভাণ্ডার গড়ে উঠে। আমার মধ্যে অধ্যয়নের আগ্রহ এতটা তীব্র হয়ে উঠে যে, আহমুদিয়ায় অবস্থানকালে আমি যখন মাধ্যমিক স্তরের ছাত্র ছিলাম, তখন বাজারের দিন আমি শায়খ কুতুবীর জন্য অধীর আগ্রহে অপেকষা করতাম, যাতে কিছু পয়সার বিনিময়ে সারা সপ্তাহের জন্য আমি তাঁর নিকট থেকে কিছু কিতাব ধার নিতে পারি। এ কিতাবগুলো পড়া শেষ করে ফেরত দিয়ে অন্য কিতাব নিতাম। এ ধারা দীর্ষদিন চালু ছিল।

এ সময় যে গ্রন্হগুলো আমার উপর সবচেয়ে বেশী প্রভাব ফেলেছে, তন্মধ্যে একটা ছিল ************ বাহাদুর শাহজাদী। আমার যখন মনে হয় যে, সেদিনগুলোতে আমরা যেসব কিচ্ছা-কাহিনী আর গল্পের বই পড়তাম, তাতে থাকতো আত্মমর্যাদা, বীরত্ব, দেশ রক্ষা, দ্বীনের অনুসরণ, জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ আর শওকত-শ্রেষ্ঠত্বের পাঠে পরিপূর্ণ। আর বর্তমানে আমি যখন দেখতে পাই যে, অধুনা আমাদের যুবক শ্রেণী যেসব গল্প আর উপন্যাস পড়ে, তা আগাগোড়া অশ্লীলতা-নির্লজ্জতা, নারীপনা, হীন-নীচ চরিত্রের প্রতি আহ্বান ছাড়া আর কিচুই নয়, তনক আমি অনুমান করতে পারি নিটবর্তী অতীতকালের গনসংস্কৃতি আর বর্তমানকালের গণ সংস্কৃতিতে কতই না বিস্ময়কর পার্থক্য সূচিত হয়েছে। আমার মতে এই সাংস্কৃতিক খাদ্য ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করা ্মাদের জন্য একান্ত প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে, গল্প-কাহিনী আর পত্র-পত্রিকার আকারে যে সাংস্কৃতিক খাদ্য আমাদের নতুন প্রজন্মকে গলধঃকরণ করানো হচ্ছে।

আমার অধ্যয়নের আগ্রহ বৃদ্ধিতে অপর একটা কারণও সহায়ক হয়েছে। তখন টিচার্স ট্রেনিং স্কুলে বাছা বাছা যোগ্য শিক্ষকের ভিড় ছিল। যেমন মুহতারাম ওস্তাদ আব্দুল আযীয আতিয়্যা। পরবর্তীকালে ইনি আলেকজান্দ্রিয়ার চিচার্স ট্রেনিং স্কুলের প্রিন্সিপাল এবং তথাকার ইখওয়ানুল মুসলিমুনের নেতা হয়েছিলেন। মহান ওস্তাদ শায়খ ফরহাত সলীম, শায়খ আব্দুল ফাত্তাহ আবু আল্লাম, ওস্তাদ আলহাজ্ব আলী সোলায়মান এবং ওস্তাদ শায়খ বাসইউনী। আল্লাহ তা’আলা এঁদের সকলকে নেক প্রতিদান দিন। সততা, সরলতা আর সাধুতায় এঁরা ছিলেন অনন্য। ছাত্রদেরকে এঁরা সবসয় অধ্যয়ন আর গবেষণার উৎসাহিত করতেন। এঁদের সঙ্গে আমার রূহানী সম্পর্ক ছিল, যা আমার জন্য উৎসাহ-উদ্দীপনার কারণ  হয়েছে। আমার আজও মনে পড়ছে ওস্তাদ আব্দুল আযীয আতিয়্যাহ আমাদের প্রাকটিক্যাল ক্লাশ করতেন। একবার তিনি আমার মাসিক পরীক্ষা নেন। আমার জবাব তাঁর বেশ পছন্দ হয়। আমার খাতায় তিনি লিখেন; তুমি বেশ ভালো জবাব দিয়েছ। পূর্ণ নম্বরের অতিরিক্ত নম্বর দেওয়া গেলে তাও আমি তোমাকে দিতাম। উত্তর পত্র ফেরত দেয়ার সময় তিনি আমার খাতাটা রেখে দেন এবং পরে আমাকে ডেকে নিয় হাতে হাতে নিয়ে আমাকে উদ্দেশ্য করে কিছু কথা বলেন, যাতে উপদেশ ছিল, উৎসাহ ছিল, আরো ছিল অধ্যয়ন আর গবেষণার দীক্ষা। তাঁর রচিত ‘আল মুয়াল্লিম’ গ্রন্হের প্রুফ দেকার জন্য তিনি আমাকেই বাছাই করেন। তখন দামানহুরের আল-মুসতাকুবিল প্রেস থেকে গ্রন্হটি ছাপা হচ্ছিল।

এসব কার্যকারণ আমার উপর বিরাট প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এ সময় পাঠ্য পুস্তুকের বাইরর অনেক গ্রন্হ আমি মুখস্থ করে ফেলি। হারীরীর মিলহাতুল এ’রাব মুখস্থ করি। ইবনে মালেক রচিত আলফিয়া ইয়াদ করি।

হাদীসের পরিভাষা বিষয়ে আল-ইয়াকূতিয়া, তাওহীদ বিষয়ে আল-জাওহারা, ফরায়েয বিষয়ে আল রজবিয়া এবং তর্কশাস্ত্রের সুল্লামুল উলমের অংশবিশেষ মুখস্থ করি। হানাফী ফিকহের গ্রন্হ কুদুরীর অধিকাংশ, ফিকহে শাফেয়ীর আল-গায়াহ ওয়াত তাকবীর-এর কিছু অংশ, মালেকী মযহাবে ইবনে আমের রচিত মানযূমা গ্রন্হের কিচু অংশও আমি মুখস্থ করি। মুহতারাম আব্বাজানের উপদেশ আমি কিছুতেই ভুলতে পারবো না। তিনি বলতেনঃ

**********************************

“যে আসল মতন (গ্রন্হের মূল পাঠ) মুখস্থ করে নেয়, সে নানা বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করে”।

তাঁর এ দীক্ষা আমার মনের উপর এত গভীর ছাপ মুদ্রিত করে যে, আমি কেরায়াত বিষয়ের গ্রন্হ শাতেবিয়া পুরোপুরি হিফয করার চেষ্টা করি। অথচ তখন এ গ্রন্হের পরিভাষাগুলো ছিল আমার কাছে দুর্বোধ্য। এরপরও আমি এ গ্রন্হের দীর্ঘ ভূমিকা মুখস্থ করে ফেলি। যা অধ্যবধি আমার মুখস্থ আছে।

এ সময় একটা মজার ঘটনা ঘটে। জনৈক পরিদর্শক আমাদের ক্লাশে আগমন করেন। তখন আরবী ভাষার ক্লাশ চলছিল। আমি তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। এ সময় হারীরীর মিলুহাতুল এ’রাব আমার মুখস্থ ছিল। পরিদর্শন সাহেব প্রশ্ল করেন; আরবী ব্যকরণে ইসম, ফেয়েল এবং হরফের আলামত কি? তখন যে ওস্তাদ আমাদের ক্লাশ নিচ্ছিলেন, তাঁর নাম ছিল শায়খ মুহাম্মদ আলী নাজ্জার। তিনি জবাব দেয়ার জন্য আমাকে বাছাই করেন। জবাবে আমি মিলহাতুল এ’রাবের এ কবিতাটা.......

**********************************

হরফ হচ্ছে তাই, যার কোন আলামত নেই। আমার এ কথায় অনুমান করে নাও, তাহলে তুমি হতে পারবে আল্লামা-মহাজ্ঞানী। ইন্সপেক্টর সাহেব আমার কথায় হেসে পড়েন এবং বলেন; বেশত। আমি যাতে আল্লামা হতে পারি, সেজন্য তোমার কথামতো অনুমান করবো। এরপর তিনি ওস্তাদকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে চলে যান।

জ্ঞানের এ দৌলত কিছু কিচু বন্ধুর দৃষ্টি আমার প্রতি আকৃষ্ট করে। এসব বন্ধু দারুল উলূমে ভর্তিল জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। আর এরা সকলেই টিচার্স ট্রেনিং স্কুলের অধীন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিল। তারা আমার নিকট প্রস্তাব পেশ করে যে, আমরা সকলে মিলে এক সঙ্গে প্রস্তুতি নেবো এবং দারুল উলূমে ভর্তি হবো। এদের মধ্যে সবচেয়ে অগ্রসর ছিল শায়খ আলী নওফল, পরবর্তীকালে ওস্তাদ আলী নওফল বলে খ্যাত। তারই প্রস্তাব ছিল যে, এক সঙ্গে প্রস্তুতি নেবো এবং একই সঙ্গে ভর্তি হবো। তখন দারুল উলূ দুটি বিভাগে বিভক্ত ছিল। একটা বিভাগ ছিল প্রস্তুতিমূলক। আল-আযহারের ছাত্র এবং টিসার্চ ট্রেনিং স্কুলের ছাত্রদের মধ্যে যাদের ইচ্ছা এ বিভাগে ভর্তি হতে পারতো। অপরটি ছিল উচ্চতর ঐচ্ছিক বিভাগ। এ বিভাগে সাধারণতঃ আযহারের ছাত্ররাই ভর্তি হতো, যারা আল-আযহার থেকে মাধ্যমিক সার্টিফিকেট লাভ করেছে। ১৯২৩-২৪ শিক্ষা বর্ষেই কেবল এ বিভাগে ভর্তি হওয়া যাবে। এরপর এ বিভাগ বন্ধ করে প্রস্তুতিমূলক বিভাগের ছাত্রদের ভর্তির জন্য তা নির্ধারিত করা হবে। আমাদের বিদ্যালয়ের কোন কোন ছাত্র প্রস্তুতিমূলক বিভাগে ভর্তির ইচ্ছা পোষণ করে। কিন্তু উচ্চতর বিভাগে ভর্তি হওয়ার দিকেই বেশীর ভাগ ছাত্রের ঝোঁক। কারণ, এ বিভাগে ভর্তি হওয়ার এটাই শেষ সুযোগ।

শায়খ আলী নওফল আমার সঙ্গে মিলে প্রস্তুতি নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। আমি তখন তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। অর্থাৎ এ বৎসর আমার প্রাইমারী শিক্ষায় ডিপ্লোমা-মিশরীয় পরিভাষায় শাহাহাতুল কাফায়াহ লাভের জন্য পরীক্ষা দেয়ার কথা। আর শায়খ আলী নওফল ছিলেন টিচার্স ট্রেনিং স্কুলের প্রাথমিক শাখার শিক্ষক। তাই সামষ্টিক পাঠে আমি অক্ষমতা প্রকাশ করি। কিন্তু তিনি অন্য দরজা দিয়ে প্রবেশ করেন। বলেন, ভ্রাতৃত্বের কিছু হক আছে। বন্ধুদের সহায়তা করা কর্তব্য এবং তাদের পরামর্শ গ্রহণ করা জরুরী। এবার তার কথাকে গুরুত্ব দেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না।

শিক্ষা আর ডিগ্রী সম্পর্কে আমার অভিমত

সে সময় জ্ঞান অর্জন আর ডিগ্রী লাভ করা সম্পর্কে আমার একটা বিশেষ মতামত ছিল। আমার এ বিশেষ মতামত ছিল ইমাম গাযালী (র)এর এহইয়াউল উলূম অধ্যয়নের ফল। জ্ঞানের প্রতি আমার ছিল তিব্র ভালোবাসা। অধ্যয়নের প্রতি আমার ছিল অস্বাভাবিক ঝোঁক আর জ্ঞান-বৃদ্ধির প্রতি ছিল অসীম আগ্রহ। ব্যক্তি আর দল উভয়ের জন্য জ্ঞানের উপকারিতা আমি স্বীকার করতাম এবং মানুষের মধ্যে জ্ঞানের বিস্তারকে আমি ফরয মনে করতাম। এমনকি মনে পড়ে, ‘আশ শামস নামে একটা মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করার দৃঢ় সংকল্পও আমি করেছিলাম, বরং এর প্রথম দু’টি সংখ্যা আমি ঠিকঠাকও করে রেখেছিলাম”। এটা করেছিলাম শায়খ মুহাম্মদ যাহরানের অনুকরণে। তিনি ‘আল ইসআদ’ নামে ‘আল মানার’-এর স্টাইলে একটা মাসি পত্রিকা প্রকাশ করেন। আমি তাঁর পত্রিকাটি বেশী বেশী পড়তাম। কিন্তু জ্ঞান-বিজ্ঞঅন আহরণ আর অন্বেষণ সম্পর্কে ইমাম গাযালীর দর্শন আমার মনে বিরাট প্রবাব বিস্তার করে বসেছিল। এর ফলে আমি এক তীব্র মানসিক দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ি। একদিকে অতিরিক্ত জ্ঞান অর্জনের আগ্রহ আমাকে টানছিল, অন্যদিকে ইমাম গাযালীর উক্তি এবং প্রয়োজনীয় জ্ঞান সম্পর্কে তাঁর এই সঙ্ঘা- “ফরয কার্যাদি পালন এবং জীবিক অর্জনের জন্য যতটুকু জ্ঞান অর্জন করা আবশ্যক, কেবল ততটুকু জ্ঞান অর্জন করাই ফরয। এটুকু জ্ঞান অর্জনের পর তাকে আমল তথা কর্মের দিকে আসতে হবে”। তাঁর এ দর্শন আমাকে বাধ্য করছিল কেবল প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জন করতঃ সময়ের অপচয় না করে অন্যসব জ্ঞান পরিত্যাগ করতে।

দারুল উলূমের শিক্ষাপ্রাপ্ত ছাত্রদের মধ্যে যারা উচ্চতর ডিপ্লোমা অর্জন করে, বৃত্তি দিয়ে তাদেরকে বিদেশে প্রেরণ করা হয়-এ কথা মনে করে দারুল উলূম এবং তার অধীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার কথা মনে জাগ্ এখন মানসিক দ্বন্দ্ব আরো চরমে উঠে। আমি সবসময় আমার মনকে বলতাম, কেন তুমি দারুল উলূমে ভর্তি হতে চাও? পদমর্যাদা লাভ করার জন্য, যাতে মানুষ বলে যে, তুমি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নও, বরং উচ্চতর বিদ্যালয়ের শিক্ষক? কিন্তু এটাতো হারাম। আর পদ-পর্যাদার লোভ-লালসা নাফসের অন্যতম ব্যধি। এটা নাফসের খায়েশের একটা অংশ। এটা উৎপাটন করা ফরয। নাকি অর্থ-সম্পদের জন্য? যাতে তোমার ভাতা দ্বিগুণ হয়ে যায়, যাতে তুমি বেশী সম্পদ আহরণ করতে পার, গর্ব করার মতো পোশাক পরিধান করতে পার, ভালো ভালো খাবার খেতে আর দামী গাড়ী দৌড়াতে পার- এ জন্য কি? কিন্তু এটাতো মানুষের চেষ্টা-সাধনার সবচেয়ে নিকৃষ্ট ফল। ধ্বংস হয়েছে দীনারে দাস, হালাক হয়েছে দিরহামের গোলাম। ধ্বংস হোক রেশম আর মখমলের গোলাম। বিনাশ হোক তার। সে যদি বিপদে পতিত হয় তবে তার তাওবা করার তাওফীক না হোক। (এগুলো হাদীসের কথা। বোখারী শরীফে হযরত আবু হোরায়রা থেকে হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে।)

আল্লাহ তা’আলা যথার্থই বলেছেন-

**********************************

নারী, সন্তান, রাশিকৃত স্বর্ণ, রৌপ্য, আর চিহ্নিত অশ্বরাজি, গবাদিপশু এবং ক্ষেত-খামারের প্রতি আসক্তি মানুষের নিকট মনোরম করা হয়েছে। এসব হচ্ছে ইহজীবনের ভোগ্য বস্তু। আর আল্লাহ, তাঁর নিকট রয়েছে উত্তম আশ্রয়স্থল। বল, আমি কি তোমাদেরকে এসব বস্তুর চেয়ে উৎকৃষ্টতর কোন কিছুর সংবাদ দেবো? যারা তাকওয়া অবলম্বন করে চলে, তাদের জন্য রয়েছে উদ্যানরাজি, যার পাদদেশে নহর প্রবাহিত। সেখানে তারা স্থায়ী হবে। (সূরা আলে-ইমরানঃ ১৪-১৫)

নাকি জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিপুল সম্ভার আহরণ করার জন্য? যাতে তুমি আলেমদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতে পার, জাহেল, অজ্ঞ-মূর্খদের সঙ্গে বাক-বিতণ্ডায় মত্ত হতে পার এবং নিজের অধিকার স্বীকার করাবার জন্য মানুষের উপর বিজয়ী হতে পার? কিন্তু কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম যে ব্যক্তির জন্য জাহান্নামের আগুন প্রজ্জ্বলিত করা হবে, সে হবে ঐ ব্যক্তি, আল্লাহর সন্তুষ্টি ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্যে যে জ্ঞান অর্ঝন করেছে এবং অর্জিত জ্ঞান অনুযায়ী যে ব্যক্তি আমল করেনি। যে আলেমের জ্ঞানকে আল্লাহ তা’আলা তার জন্য কল্যাণকর করেননি, কিয়ামতের দিন তাকে কঠিনতর আযাব দেয়া হবে। আমি নিজেকে বলি: তোমার নফস তোমাকে এটাও বুঝাতে পারে যে, তুমি এজন্য জ্ঞান অর্জন করছো, যাতে তুমি আলেম হয়ে মানুষের উপকার করবে এবং আল্লাহ তা’আলাও তাঁর ফেরেশতারা মানুষকে কল্যাণের শিক্ষাদানকারীদের প্রতি দরূদ পাঠায় এবং এটাও যে, স্বয়ং নবীজীকে শিক্ষক করে প্রেরণ করা হয়েছে-নাফস তোমাকে এসব বাহানা শিক্ষ দিতে পারে। কিন্তু তুমি নাফসকে জিজ্ঞেস করো, তুমি যদি সত্য বলে থাক যে, কেবল মানুষের কল্যাণের জন্যই তুমি জ্ঞান অর্জন করছো, কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যই তুমি ইলম হাসিল করছো, তবে দারুল উলূমে ভর্তি হতে কেন যিদ ধরেছ? অথচ জ্ঞান তো পুস্তকের মধ্যে নিহিত রয়েছে, নিহিত রয়েছে ওলামা-মাশায়েখের আঁচলের তলে। সনদ-সার্টিফিকেটতো একটা ফেৎনা। দুনিয়ার দিকে লম্ফ দিয়ে ছুটা আর বিত্ত-বিভব অর্জনের জন্য এটা একটা হাতিয়ার। আর এ দুটি বস্তু-দুনিয়া পূজা এবং টাকা কড়ি অন্বেষণ করা- গ্রাণ সংহারক বিষ। এটা আমল বিনাশ করে, অন্তর আর দেহকে বিকৃত করে। সুতরাং জ্ঞান অর্জন করতে হলে গ্রন্হ থেকে অর্জন কর। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সনদ আর প্রথাগত ডিপ্লোমার প্রতি ছুটবে না।

এ দর্শন আমার মন-মানসে পুরাপুরি বিস্তার করতে বসেছিল, বরং কার্যত বিস্তার করেছিলও। এ কারণে ঘৃণাবশত: ওস্তাদ আলী নওফলের সঙ্গে সহ-পাঠ শুরু করিনি। কিন্তু মুহতারাম ওস্তাদ শায়খ ফরহাত সলীম (র) আমাকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন এবং সকল উপলক্ষে আমার প্রতি স্নেহ-ভালোবাসা প্রকাশ করতেন আর আমার অন্তরেও তাঁর উঁচু স্থান ছিল। তিনি অত্যন্ত প্রজ্ঞা- বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে অতি সুন্দরভাবে এক সঙ্গে মিলে অধ্যয়নের জন্য আমাকে উদ্বুদ্ধ করেন এবং দারুল উলূমের দরজা খটখটাবার জন্য আমার মধ্যে কার্যত আগ্রহ সৃষ্টি করেন। তিনি আমাকে বলেন: এখনতো তুমি ডিপ্লোমা লাভের কাছাকাছি এসে গেছ। জ্ঞান কোন ক্ষতিকর বস্তু নয়। দারুল উলূমের পরীক্ষার জন্য তোমার অগ্রসর হওয়া আরো বড় পরীক্ষার জন্য একটা অভিজ্ঞতা হবে। এটা এমন এক সুযোগ, যা হাতছাড়া হয়ে গেলে আর পাওয়া যাবে না। ভর্তি হও এবং নিজের অধিকার সংরক্ষণ কর। তোমার সাফল্য অর্জন সম্পর্কে আমি সম্পূর্ণ নিশ্চিত- ইনশাআল্লাহ। উপরন্তু ভর্তি হওয়ার পরও ব্যাপারটা নিজের হাতেই থাকবে। তোমার যেমন খুশী, চিন্তা করে দেখতে পার। মন চাইলে ইচ্ছা ত্যাগ করতে পার, আাবর মন চাইলে ভর্তিও হতে পার। এভাবে মুহতারাম ওস্তাদ ভীষণ জোর দিয়ে অন্যদের সঙ্গে আমাকেও দরখাস্ত পেশ করতে উদ্বুদ্ধ করেন। ডিপ্লোমা পরীক্ষার কিছুদিন পর ভর্তি পরীক্ষঅ হওয়ার কথা।

দুটি স্মৃতি

এখানে আমি দু’টি স্মৃতির কথা উল্লেখ করতে চাই। এ দু’টি স্মৃতির একটি হচ্ছে বাস্তবিক, অপরটি তাত্ত্বিক। এ দু’টি স্মৃতি আমার মনে গেঁখে যায় এবং দীর্ঘদিন তা আমার অন্তরকে সেদিকে আকৃষ্ট করে রাখে।

প্রথমটি হচ্চে মহান আল্লামা শায়খ আহমদ শারকাবী আল হুরীনী (র)-এর। এ মহান ব্যক্তিকে আমি কেবল একবার দেখেছি। সন্তান, ছাত্র, মুরীদ এবং বন্ধুদেরকে দেখার জন্য একবার তিনি দামানহুরে আগমন করেন। সকলের সঙ্গে ঘরে ঘরে গিয়ে তিনি দেখা করেন। সকলের খোঁজ-খবর নেন। তাঁর সঙ্গে একটা রজনী অতিবাহিত করার সুযোগ আামার হয়েছে। এ রজনীতে তিনি স্বভাবসিদ্ধ আচরণ থেকে একটুও সরে দাঁড়াননি। আমি তাঁর সম্পর্কে এমনসব বিষ অবগত হতে পেরেছি, যা আমার অন্তরে তাঁর জন্য স্থায়ী আসন করেছে এবং আমার মন তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে নিয়েছে। আজও তাঁর স্মৃতি আমার অন্তরে গেঁথে আছে। তাঁর সম্পর্কে আমি জানতে পেরেছি যে, জ্ঞান আর শিক্ষার প্রতি তাঁর ছিল অন্তরের আকর্ষণ। তিনি তাঁর শহরের অধিবাসীদেরকে শিক্ষার প্রতি ধাবিত করেন। শিক্ষার ব্যয়ভার বহন করার সাধ্য যাদের নেই, তাদের শিক্ষঅ সমাপ্ত করার জন্য নিজের পকেটের টাকা দিয়ে সাহায্য করতেন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির প্রতি তিনি শর্ত আরোপ করেন যে, নিজের শিক্ষা সমাপ্ত করে কোন অসহায় ব্যক্তির শিক্ষার দায়িত্ব নেবে। আর এভাবে নগদে নাহলেও শিক্ষা বিস্তারের আকারে এ ঋণ শোধ করতে হবে। এ কর্মসূচীর ফলে তাঁর অঞ্চল ‘হুরীন’ এলাকায় শিক্ষা লাভে বঞ্চিত কোন ব্যক্তি ছিল না, সে যতই দরিদ্র পরিবারের সন্তান হোক না কেন। শিক্ষা ক্ষেত্রে এই পারস্পরিক সহযোগিতা সকলকে শিক্ষালাভে ধন্য করে তোলে। উপরন্তু এসব ব্যক্তিদের মধ্যে এক সুদূর আত্মিক সম্পর্কও গড়ে উঠতো। শায়খ আহমদ শারকাবীর একমাত্র চিত্ত বিনোদন ছিল এই যে, গ্রীষ্মের ছুটিতে ‘হুরীন’ অঞ্চলের ছাত্ররা তাঁর চতুষ্পার্শে দল বেঁধে বসে আছে আর তিনি দেখতে পাচ্ছেন আযহারী ছাত্রদের পাশাপাশি দেরআমী (দারুল উলূমের সংক্ষিপ্ত রূপ। দারুল উলূমের ছাত্রদেরকে তিনি দেরআমী বলতেন) ছাত্ররাও বসেছে। প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ স্কুলের ৫০ জন ছাত্রও বসে আছে। অন্যান্য শিক্ষঅ প্রতিষ্ঠানের কিছু ছাত্রও বসা আছে মজলিশে আর তিনি সকলের সঙ্গে কথা বলছেন, গল্প করছেন। কেউ তাঁর সমালোচনা করছে। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে। এতে তাঁর মন পরিচ্ছন্ন হচ্ছে এবং শিক্ষা আর জ্ঞানের আলো বিস্তারের জন্য তাঁর মনোবল আরো দৃঢ় হচ্ছে। দামাননুরস্থ প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ বিদ্যালয়ে ‘হুরীন’-এর ছঅত্রদের সংখ্যাধিক্যের এটাই হচ্ছে রহস্য। এখন শায়খ শারকাবী তাদেরকে দেখতে এসেছেন, এসেছেন তাদেরকে আরো উদ্বুদ্ধ-অনুপ্রাণিত করতে। জ্ঞানের আলোচনা আর হাসি-কৌতুকের মধ্য নিয়ে এ সংক্ষিপ্ত সফর তিনি অতিবাহিত করেন। তাঁর প্রশ্ন, আপত্তি আর কৌতুক থেকে এ লেখকও রেহাই পায়নি। আল্লাহ তা’আলা নিজ রহমতের ছায়ায় তাঁকে আশ্রয় দিন এবং জান্নাতকে তাঁর জন্য প্রসারিত করুন।

আর অপর স্মৃতি শায়খ ছাবী দারাজ (র) সম্পর্কে। শায়খ ছাবী এক সৎ যুবক চাষী। তখন তাঁর বয়স ২৫ বৎসরের বেশী ছিলনা। কিছু দিন পরে এ অল্প বয়সে তিনি ইনতিকাল করেন। প্রজ্ঞা- বিচক্ষণতা, সম্ভ্রম, জৌলূস আর ঘটনা বর্ণনায় তিনি ছিলেন এক বিস্ময়। একদা আমি আওলিয়া আর ওলামা সম্পর্কে তাঁর সঙ্গে আলোচনা শুরু করি। সাইয়্যেদ ইবরাহীম দাসূতী- শহরের নিকটেই যার মাজার রয়েছে, থেকে সাইয়েদ আহমদ বাদবী পর্য্ত, তানতায় যাঁকে দাফন করা হয়েছে- আলোচনা চলে। শায়খ ছাবী দারায বললেন: সাইয়্যেদ আহমদ বাদবীর ঘটনা কি জানা আছে? আমি বলি: তিনি ছিলেন বড় বুযুর্গ, ওলী, পরহেযগার, মুত্তাকী এবং জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তি। শায়খ বললেন, কেবল এতটুকুই জান? বললাম, আমি তো কেবল এটুকুই জানি তাঁর সম্পর্কে। শায়খ ছঅবী বললেন, শুন আমি তোমাকে বলছি।

সাইয়্যেদ বাদবী মক্কা থেকে হিজরত করে মিশরে আগমন করেন। আসলে তিনি ছিলেন মরক্কোর অধিবাসী। মিশরে যখন দাশ বংশের শাসন চলছিল, তখন তিনি আগমন করেন (তিনি ছিলেন মিশরের প্রসিদ্ধ আওয়াদের অন্যতম।পাকিস্তানে হযরত আলী ওরফে দাতা গঞ্জ বখশ যেমন প্রসিদ্ধ, অনুরূপ মিশরে তিনিও খ্যাত ছিলেন। মূলতঃ তিনি ছিলেন মরক্কোর অধিবাসী, সেখান থেকে মক্কা শরীফ গমন করেন। মক্কা শরীফ থেকে চলে যান ইরাক, ইরাকে দীর্ঘদিন অবস্থান করে ইসলামী সংস্কারের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। ইরাক থেকে পুনরায় তিনি মক্কায় ফিরে যান, অবশেষে হিজরী ১২৩১ সালে তিনি মিশর গমন করে ‘তানতা’য় অবস্থঅন গ্রহণ করেন-খলীল হামেদী)। তাঁর মতে মামলূক তথা দাসদের শাসন শুদ্ধ নয়। কারণ, তারা স্বাধীন নয়, পরাধীন- গোলাম, আর সৈয়দ বাদাবী ছিলেন হযরত আলীর বংশধর সৈয়দ। সব রকম শ্রেষ্ঠত্ব তাঁর মধ্যে ছিল- বংশের শ্রেষ্ঠত্ব, জ্ঞানের শ্রেষ্ঠত্ব এবং বেলায়াত তথা শাসন করার যোগ্যতা। আহলে বায়ত খিলাফতকে নিজেদের অধিকার মনে করতো। খিলাফাতে আব্বাসিয়ার অবসান ঘটেছে এবং বাগদাদে তাঁদের গদী উল্টে গেছে। মুসলমানরা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত। এমন সব লোকেরা তাদের উপর কর্তৃত্ব করছিল, যারা বাহুবলে ক্ষমতায় এসেছে। মিশরের মামলূক শাসকরাও ছিল এদের অন্তর্গত। সাইয়্যেদ বাদবীর সম্মুখে দুটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল, সেজন্য তাঁকে সংগ্রাম করতে হয়েছে। এক. খিলাফত পুনর্বহাল করা। দুই. মামলূকদের শাসন শরীয়ত অনুযায়ী শুদ্ধ নয়। এদের থেকে শাসন ক্ষমতাকে মুক্ত করানো। এ দুটি কাজ কিভাবে সাধন করতে হবে? এ জন্য কাজের বিশেষ নকশা আঁকা প্রয়োজন ছিল। এ উদ্দেশ্যে তিনি তাঁর বিশিষ।ট বন্ধুবর্গ এবং পরামর্শদাতাদেরকে একত্র করেন। এদের মধ্যে সাইয়্যেদ মুজাহিদ এবং সাইয়্যেদ আব্দুল ‘আল প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। এসব বুযুর্গরা সিদ্ধান্ত নেন যে, দাওয়াত দিয়ে যেতে হবে এবং যিকর আর তিলাওয়াতের  মাধ্যমে লোকজনকে সমবেত করতে হবে। এ যিকর- এর জর্ন িতন কিছু প্রতীকও নির্ণয় করেন। যেমন কাঠের তরবারী বা মজবুত লাঠি, এটাকে তরবারী আর তবলার স্থলাভিষিক্ত জ্ঞান করে তিনি সমাবেশের আয়েঅজন করেন। একটা ঝান্ডা, যা ছিল তাঁর বিশেষ পতাকা আর একটা চামড়ার ঢাল। এসবকে বাদাবীর প্রতীক বা বিশেষ চিহ্ন সাব্যস্ত করা হয়। যিকর ও তিলাওয়াতের উদ্দেশ্যে সকলে সমবেত হতো এবং দ্বীনের বিধি-বিধানের জ্ঞান লাভ করার পর তাদের মধ্যে আপনা আপনি এ অনুভূতি জাগ্রত হতো যে, সরকারের বিকৃতির শিকার হয়েছে তাদের সমাজ এবং খিলাফাত ব্যবস্থারও অবসান ঘটেছে। দ্বীনের চেতনা আর ভালো কাজের নির্দেশ আর মন্দ কাজের নিষেধের কর্তব্য তাদের মধ্যে অবস্থার পরিবর্তনের জন্য জিহাদের জযবা সৃষ্টি করতো। সাইয়্যেদ বাদাবীর অনুসারীরা প্রতি বৎসর একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করতো। তিনি ‘তানতা’কে আন্দোলনের কেন্দ্রে পরিণত করেছিলেন। কারণ, জমজমাট আর আলোয় ঝলমল শহরগুলোর মধ্যস্থলে ছিল তানতা’র অবস্থান এবং রাজধানী কায়রো থেকে তা ছিল দূরে। মীলাদুন্নবী উপলক্ষে লোকজন বার্ষিক সমাবেশে সমবেত হলে সাইয়্যেদ বাদাবীর পক্ষে অনুমান করা সহজ হতো যে, তাঁর দাওয়াত ও আন্দোলন মানুষের মনে কেমন প্রবাব বিস্তার করেছে। তিনি নিজেকে মানুষের সামনে প্রকাশ করতেন না; বরং তিনি বালাখানায় অবস্থান করতঃ চেহারা ঢেকে রাখতেন। তাঁর এ অবস্থা মানুষের মনে ভীতির সঞ্চার করতো। সে যুগে এমন রীতিরই রেওয়াজ ছিল। আর তাঁর অনুসারীরা মানুষের মধ্যে এ কথা ছড়াতো যে, তাঁকে দেখার অর্থই হচ্ছে মৃত্যু। যারা কুতুবকে এক নজর দেখতে চায়, এর ফলে তাদেরকে নিজেদের জীবন বিসর্ঝন দিতে হবে। এভাবে তাঁর দাওয়াত বেশ প্রসার লাভ করে এবং এক বিমাল জনগোষ্ঠী তাঁর আশপাশে জড়ো হয়।

কিন্তু পরিস্থিতি এ আন্দোলনের সাফল্যের পক্ষে অনুকূল ছিল না। মিশরের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল আযযাহের বায়বার্স আলবন্দ কেদারী। আর ক্রশেড় শক্তির বিরুদ্ধে কয়েকবার সে বিজয়ও অর্জন করে। এবং মুযাফফর কতয-এর সহযোগিতায় তাতারীদের উপরও সে বিজয় লাভ করে। সুতরাং তার নাম বেশ ছড়িয়ে পড়ে আর তার ভাগ্য নক্ষত্র উচ্চ শিখরে পৌঁছে। জনগণ হয়ে উঠে তার ভক্ত। কেবল এখানেই তার শেষ নয়; বরং আব্বাসী রাজবংশের জনৈক শাহযাদাকে মিশর ডেকে এনে তার হাতে সে খিলাফতের বায়য়াতও গ্রহণ করে। এভাবে সে সাইয়্যেদ বাদাবীল সঙ্গে রাজনৈতিক সমঝোতাও স্থাপন করে। তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করে এবং তাঁর মর্যাদাও বৃদ্দি করে। শক্র অঞ্চল থেকে মুক্ত হয়ে যুদ্ধবন্দীরা ফিরে এলে তাদের বন্টনের দায়িত্বও তাঁর উপর ন্যস্ত করে। এটাকে বেশ সম্মান ও মর্যাদার কাজ মনে করা হতো। সাইয়্যেদ বাদাবীর পরিকল্পনা সম্পূর্ণ করার পূর্বেই এসব ঘটে। আর শাসন কর্তৃত্ব কার্যত মামলূক তথা দাশ বংমের হাতেই থেকে যায়। আর নাম নেয়া হতো নামকাওয়াস্তে খলীফার। দীর্ঘদিন এ পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। সাইয়্যেদ আহমদ বাদাবীর ইতিহাস সম্পর্কে শায়খ ছাবী দারায-এর ধারাবাহিক বিবরণ আর ব্যাখ্যা আমি কান পেতে শুনছিলাম এবং একজন যুবক কৃষকের প্রজ্ঞা-বিচক্ষণতায় স্তম্ভিত হচ্ছিলাম। গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের উর্ধ্বে শিক্ষা গ্রহণ করার কোন সুযোগ তাঁর হয়নি। মিশরে প্রজ্ঞা-বিচক্ষণতা আর যোগ্যতা- প্রতিভার অনেক গুপ্ত ভান্ডার রয়েছে। এমন কোন আল্লাহর বান্দা যদি তাঁর ভাগ্যে জুটতো, যিনি তাকে উর্ধ্ব তুলে ধরতে পারেন এবং মানস জগৎ থেকে কর্মের জগতে নিয়ে আসতে পারেন- শায়খ ছাবী দারায-এর এ কথাগুলো এখনো আমার কানে বাজে। তাঁর এ কথাগুলোর মধ্যে শিক্ষণীয় বিষয় আছে। আছে নতুনত্বও। সব কিছুই আল্লাহর হাতে নিহিত।

**********************************

দুনিয়ার মালিক আল্লাহ। তিনি যাকে ইচ্ছা পৃথিবীর উত্তরাধিকারী করেন। আর শুভ পরিণতি মু্ত্তাকীদের জন্য। (সূরা আ’রাফ: ১২৮)।

কায়রোর পথে

হ্যাঁ, আমি বলছিলাম যে, দারুল উলূমে ভর্তির জন্য দরখাস্ত দাখিল করেছি। এরপর ডাক্তারী পরীক্ষা আর ভর্তি পরীক্ষার তারিখের নোটিশও আমি পেয়েছি। নোটিশ অনুযায়ী এখন আমাকো কায়রো যেতে হবে ডাক্তারী পরীক্ষার আর ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য। তখন ছিল রমযান মাস। আব্বাজান সঙ্গে যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আমি তাঁর প্রয়োজন অনুভব করিনি। তিনি শুভ কামনা আর নেক দোয়ার সম্বল সঙ্গে দিয়েছিলেন- আমার জন্য এটাই ছিল যথেষ্ট। সমস্ত পথও তিনি আমাকে ভালোভাবে বলে-বুঝিয়ে দিয়েছিলেন এবং তাঁর এক বন্ধুর নামে একটা চিঠিও দিয়েছিলেন, যিনি ছিলেন কায়রোর অন্যতম সুখী মানুষ এবং খ্যাতনামা পুস্তক বিক্রেতা। আব্বাজান তাঁর অনেক উপকার করেছিলেন এবং তাঁকে সদগুণে বিভূষিত মনে করতেন।

জীবনে প্রথমবারের মতো আমি কায়রো গমন করি। তখন আমার বয়স ১৬ বৎসর কয়েক মাস। প্রায় আসরের সময় আমি ‘বাবুল’ হাদীদে অবতরণ করি। আর সেখান থেকে ‘আতবার’ উদ্দেশ্যে ট্রামে সওয়ার হই। ‘আতবা’ থেকে টমটম যোগে ‘সাইয়্যেদুনা হুসাইন’ গমন করি। টমটম থেকে নেমে সোজা কিতাব বিক্রেতার কাছে যাই এবং তাঁর হাতে আব্বাজানের চিঠি দেই। তিনি চিঠি দেখেনওনি, কেবল এটুকু করেন যে, জণৈক কর্মচারীকে বলেন, আমার প্রতি লক্ষ্য রাখতে। কর্মচারী ছিল বেশ ভদ্র ও নেক মানুষ। পূর্ব থেকেই তিনি আব্বা এবং আমার সম্পর্কে জানতেন। কর্মচারী আমাকে অভিভাদন জানিয়ে বাসায় নিয়ে যায়। আমি সেখানে ইফতার করি। এরপর আমি শহরে বেরিয়ে পড়ি এবং সাহরীর সময় ফিরে আসি। ফজরের নামাযের পর কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে উঠে মেযবানকে বলি, দারুল উলূমের অবস্থান সম্পর্কে আমাকে বলূন। আমার বিশেষ বন্ধু ওস্তাদ মুহাম্মদ শরফ হাজ্জাজ এক বৎসর পূর্বে দারুল উলূম এসেছেন। পরে তিনি শিক্ষা বিভাগে চাকুরীতে যোগদান করেন। ইচ্ছা ছিল তাঁর সঙে।গ দখঅ করে ডাক্তারী পরীক্ষা আর ভর্তি পরীক্ষা সম্পর্কে জেনে নেবো। মেযবান আমাকে দারুল উলূম পৌঁছার গোটা পথ বাতলে দেন। তাঁর পথ নির্দেশ সামনে রেখে আমি টমটমে চড়ে ‘আতাবা’ পৌঁছি। সেখান থেকে ট্রামযোগে গমন করি ‘শারেয়ে কাছরুল আইনী’- কাছরুল আইনী সড়কে। সামনেই ছিল দারুল উলূমের ইমারত। সেখানে দাঁড়িয়ে ছাত্রদের বেরিয়ে আসার অপেক্ষা করি। ইতিমধ্যে আমার বন্ধু উপস্থিত হয়। আমরা পরস্পর আলিঙ্গন করি এবং বন্ধু আমাকে বারাকাতুল ফীল-এ অবস্থিত আব্দুল বাকী মহল্লার বাসায় নিয়ে যায়। তার বাসা ছিল দোতলায়। একদল ছাত্রের সঙ্গে সেখানে সে থাকতো।

পরদিন ভোরে আমার বন্ধু দারুল উলূম গমন করলে আমি সে কিতাব বিক্রেতার কাছে যাই। এরপর তাঁর কাছে একজন চশমা মেকারের সন্ধান নেয়া, যার নিকট থেকে আমি চশমা তৈয়ার করাতে পারি এবং মেডিক্যাল পরীক্ষার জন্য ভালোভাবে প্রস্তুত হতে পারি। কিন্তু অভ্যাস অনুযায়ী এবারও তিনি মুখ ঘুরায়ে নেন, আর আমিও সময় নষ্ট করতে চাই না। তাই তৎক্ষণাৎ আমি আল আযহার গমন করি। আল-আযহারে এ প্রথম আমার প্রবেশ। সেখানকার প্রশস্ততা আর সরলতা দেখে আমি বিস্মিত হই। ছাত্রদের নানা দল স্থানে স্থানে পঠন-পাঠনে নিমগ্ন। আমি এক এক করে সব দলের কাছে ঘুনি। অবশেষে একটা দল পাই, যেখানে ছাত্ররা দারুল উলূমে ভর্তি হওয়ার ব্যাপারে আলোচনা করছিল। আমি বুঝতে পারি যে, এরা দারুল উলূমে ভর্তি পরীক্ষা দেবে। প্রায় ১০ দিন পরে এ ভর্তি পরীক্ষা হবে। এ উদ্দেশ্যে তিনবার তাদের মেডিক্যাল পরীক্ষা হবে। আমিও তাদের মধ্যে ঢুকে পড়ি। তাদের কাছে আমার আগ্রহ ব্যক্ত করি। তাদেরকে বলি, এমন একজন লোক আমার দরকার, যে আমাকে একজন চশমা মেকারের সন্ধান দিতে পারে। একজন ছাত্র স্বেচ্ছায় এ দায়িত্ব গ্রহণ করে এবং তখনই আমাকে নিয়ে যায় একজন মহিলা ডাক্তারের ক্লিনিকে। আমার ধারণা, এ মহিলা ডাক্তার গ্রীক দেশের। অবশ্য সে মিশরের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছে। ছাত্রটি ডাক্তারের যোগ্যতা- অভিজ্ঞতার অনেক প্রশংসা করে। বলে, আমি নিজেও এ মহিলা ডাক্তারের নিকট থেকে চশমা নিয়েছি। ডাক্তারের কাছে যাওয়া মাত্রই তিনি চক্ষু পরীক্ষা করেন। পরীক্ষা ফী নেন ৫০ ক্রোশ। এরপর নাম্বার দিয়ে চশার দোকানে প্রেরণ করেন। দোকানদার ১শ ৫০ ক্রোশ নিয়ে তৎক্ষণাৎ চশমা বানিয়ে দেয়। এখন মেডিক্যাল পরীক্ষার জন্য দু’নি অপেক্ষা করা ছাড়া আমার অন্য কোন ব্যস্ততা নেই।

মেডিক্যাল পরীক্ষা

আমি মেডিক্যাল পরীক্ষায় বিস্ময়করভাবে সফল হয়েছি- এ কথা বললে বেশী বলা হবে না। কারণ, অনেক বন্ধু দুর্ভাগ্যের শিকার হয়েছে।

**********************************

“পবিত্র সে স্বত্ত্বা, যিনি কিসমত বন্টন করেছেন। সুতরাং কারো প্রতি অসন্তুষ্টি নেই, নেই কারো প্রতি দোষারোপ”। তিনজন ডাক্তার ছিলেন। আমি প্রথম ডাক্তারের তালিকার শেষ ব্যক্তি। তিনজনের মধ্যে ইনি সবচেয়ে ভালো এবং কোমল প্রকৃতির। ওস্তাদ আলী নওফলের ভাগে পড়ে তৃতীয় ডাক্তার। ইনি ছিলেন পাষাণ হৃদয়ের এবং পরীক্ষার ক্ষেত্রেও ভীষণ বেরহম। আমার ডাক্তারের কাছে সফল ব্যক্তিদের হার যত উঁচু ছিল, তৃতীয় ডাক্তারের কাছে এ হার ছিল তত নীচু। আমার সাফল্য সম্পর্কে বেশ সন্দেহ ছিল, কিন্তু আমি সফল হলাম। আর ওস্তাদ আলী নওফল হলেন বিফল। অথচ চক্ষুর সুস্থতা, দেহের সুস্থতা এবং পুরো প্রস্তুতির পরিপ্রেক্ষিতে সাফল্য সম্পর্কে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ নিশ্চিত। ডাক্তার তাকে চশমা বানানোর পরামর্শ দিয়ে বলেন, পুনঃপরীক্ষা করা হবে। তৎক্ষণাৎ তিনি পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করেন। কিন্তু ডাক্তারের বদমেজাজী আলী নওফলের সাফল্যে আবারও অন্তরায় হয়। এভাবে তার হাতছাড়া হয়ে যায় এ সোনালী সুযোগ। পরবর্তীকালে তিনি আর্টস কলেজের আরবী সাহিত্য বিভাগে ভর্তি হয়ে লেসানস তথা বিএ ডিগ্রী লাভ করেন। সত্য বটে, প্রবল ইচ্ছা থাকলে কোন কিছু বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না।

আল-আযহারে এক সপ্তাহ

মেডিক্যাল পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হলো। অপ্রত্যাশিতভাবে সফল ছাত্রদের তালিকায় আমার নামও ছিল। এবার সব কিছু ছেড়ে ভর্তি পরীক্ষার জন্য ভালোভাবে প্রস্তুত হতে থাকি। পরীক্ষার এক সপ্তাহ বাকী। একান্ত অভিনিবেশই এখন কেবল কাজে আসতে পারে। প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র আর বই পুস্তক নিয়ে আমি আল-আযহারে গমন করি। আলোয় ঝলমল আর মনমাতানো আল-আযহার। সেখানে ঠিক ‘মেহরাবে কাদীম’- এর নিকটে ডেরা ফেলি। অনেক সঙ্গীর সঙ্গে পরিচয় হয়। আমরা সকলে নিয়ত করি, ইলম আর বরকত লাভের উদ্দেশ্য আমরা এ’তেকাফ করবো। পালাক্রমে আমরা সাহরী আর ইফতারের  খানা পাকাবো। আমরা পালাক্রমে ঘুমাবো এবং সবচেয়ে কম সময় ঘুমাবো। আল্লাহ ইলমুল আরূজ তথা ছন্দ বিদ্যার বিনাশ করুন। এর মাথামুন্ড কিছুই আমার বুঝে আসছিল না। আমি কেবলই তা আওড়াতে শুরু করলাম। কারণ, এটা আমার জন্য সম্পূর্ণ একটা নতুন বিষয়। আওড়ানো ছাড়া অন্য কোন উপায় ছিল না। অংক আর সমাজ বিদ্যা সম্পর্কেও আমার কোন শংকা ছিল না। অবশ্য আরবী ব্যাকরণ- ছরফ এবং নাহু সম্পর্কে কিছু শংকা জাগতো। কারণ, আামার ধারণা ছিল, এ ক্ষেত্রে আযহারের যেসব ছাত্র দারুল উলূমে ভর্তি হতে চায়, আমি তাদের ধারে কাছেও ঘেষতে সক্ষম হবো না। এরা ‘শাহাদাতুল আহলিয়্যার’ চেয়েও অগ্রসর (এটা আল আযহারের একটা সার্টিফিকেট)। তারা আরো উঁচু শ্রেণীতে পড়াশুনা করেছে। অবশ্য এটা ঠিক যে, আমি ইবনে মালেক প্রণীত ‘আলফিয়্যাহ’ পড়েছি। আর ইবনে আকীল প্রণীত আলফিয়্যার ব্যাখ্যা গ্রন্হও আমি নিজে নিজে পড়েছি। কোন কোন বিষয়ে আব্বাজানও সহায়তা করেছেন। কিন্তু নিয়মসিদ্ধ শিক্ষার অধীনে এসব করা হয়নি, যাতে মন নিশ্চিত হতে পারে।

পরীক্ষার দিন এসেছে এবং শান্তিতে কেটে গেছে। ইলমে আরূয তথা ছন্দবিদ্যার যে কবিতা দিয়ে আমার পরীক্ষা নেয়া হয়েছে, তা এখনো আমার মনে আছে। ছন্দ বিদ্যার আলোকে এ কবিতা সম্পর্কে আলোচনা করে তা ছন্দের কোন বাহর অনুযায়ী, তা বলার জন্য আমাকে বলা হয়। কবিতাটি ছিল এইঃ

**********************************

সত্য স্বপ্ন

এই মহান আল্লাহর বিরাট অনুগ্রহ যে, তিনি বান্দাহদের শান্তি-নিরাপত্তা দান করেন। আর তিনি কোন ইচ্ছা করলে তার কার্যকরণও করে দেন। আমার মনে পড়ে, যেদিন আমার নাহু-ছরফের পরীক্ষা হওয়ার কথা, সে রাত্রে আমি স্বপ্নে দেখি যে, কয়েকজন মহান আলেমের সঙ্গে আমি একটা নওকায় সওয়ার। নীলনদের বুকে মৃদুমন্দ বায়ূ আমাদের নৌকা ধীরে ধীরে নিয়ে চলেছে। আলেমদের একজন এগিয়ে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করেনঃ আলফিয়্যার শরাহ ইবনে অকীল কোথায়? আমি বললাম, এই তো। তিনি বললেন, এসো, এর কোন কোন অধ্যায় আমরা পুনরাবৃত্তি করি। অমুক অমুক পৃষ্ঠা খোল। আমি পৃষ্ঠাগুলো খুলি এবং বিষয়গুলো পুনরাবৃত্তি করি। এরি মধ্যে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। ভীষণ আনন্দেদ মন ভরে যায়। আর সকালে যখন পরীক্ষা দিতে যাই, তখন অধিকাংশ প্রশ্ন আসে সেসব পৃষ্ঠা থেকেই। এটা ছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে আমার জন্য সহজ করার বিশেষ ব্যবস্থা। সত্য স্বপ্ন মু’মিনের জন্য তাৎক্ষণিক সুসংবাদ। আলহামদুলিল্লাহ- সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর প্রাপ্য।

পরীক্ষার হলে

ভর্তি পরীক্ষার দেয়ার পর আমি কায়রো থেকে ফিরে আসি এবং কিছুদিন পরই টিচার্স ট্রেনিং স্কুলে ডিপ্লোমা পরীক্ষা দেই। পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হলে দেখা যায় স্কুলে আমি প্রথম হয়েছি, আর সারা দেশে হয়েছি পঞ্চম। দারুল উলূমে ভর্তি পরীক্ষার ফলও বের হয়েছে এবং আমি সফল হয়েছি। এ সাফল্যও ছিল আমার জন্য অপ্রত্যাশিত। এ মুহূর্তে আমার মনে পড়ছে ওস্তাদ আহমদ বুদাইর- এর কথা। তিনি মৌকি পরীক্ষঅ নেন। বেশ হাসিখুশী কৌতুকপ্রিয় মানুষ। নুতন লোক তাঁর কৌতুক বেশী অনুভব করতো। আমি পরীক্ষার জন্য তার সামনে বসলে বিজ্ঞেস করেন: দারুল উলূমের উচ্চতর বিভাগে ভর্তি হতে চাও? বললাম, জনাব, ইচ্ছা আছে। তিনি আমাকে বাঁকা চোখে বললেনঃ দারুল উলূম কি ছোট হয়ে গেছে> তোমার বয়স কত? বললাম: ১৮ বৎসর ৬ মাস। তিনি বললেন, বড় হওয়ার জন্য অপেক্ষা করলেন না কেন?  বললাম: সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাবে। বললেন: আচ্ছা জমাা তাকসীরের বাব শুনাও। আলফিয়্যাহ মুখস্থ আছে? বললাম: জি হ্যাঁ, আছে। বললেন: পড় দেখি। তাঁর সঙ্গে সহপরীক্ষক ছিলেন ওস্তাদ আব্দুল ফাত্তাহ আশূর। নতুন লোকের সঙ্গে এমন হাসি-কৌতুক করতে আমি অভ্যস্ত ছিলাম না। আমার কম বয়স হওয়াটা সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করছিল। কোন কোন সঙ্গীতো আমাকে দেখে বলতো: এখানে উচ্চতর বিভাগের পরীক্ষা হচ্ছে। আর নিম্ন বিভাগের পরীক্ষা সম্মুখে ওখানে নেয়া হচ্ছে। আমি যখন বলতাম, আমাকেও উচ্চতর বিভাগের পরীক্ষা দিতে হবে, তখন দৃষ্টি গেড়ে আমাকে দেখে চলে যেতো। ওস্তাদ বুদাইর-এর হাসি-কৌতুকে আমি ভারী আপ্লুত হই। এমনকি জবাবদানে বিরত থাকার উপক্রম হয়। কিন্তু উস্তাদ আশূর হস্তক্ষেপ করে ওস্তাদ বুদাইরকে এ ধরনের হাসি-কৌতুক করতে বারণ করেন। ওস্তাদ বুদাইর মনোযোগ দিয়ে আমার জবাব শুনেন আর আমি ফর ফর করে আলফিয়্যাহ শুনাতে থাকি। এরপর সাধারণ জ্ঞান, আরবী সাহিত্য এবং মৌখিক বিতর্কের পালা। সবশেষে ওস্তাদ বুদাইর আমার জন্য দোয়া করেন আর আমাকে উৎসাহিত করেন। আমি উঠে আসি। কুরআন মজীদের পরীক্ষা ছিল ওস্তাদ আহমদ বেক যানাতীর কাছে। তিনিও ছিলেন বেশ হাসিখুশী। এসব কারণে আমি সাফল্য সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলাম না। ফলাফল অপ্রত্যাশিতভাবে আমার সাফল্যের সুসংবাদ বহন করে আনে।

জীবিকা নয় জ্ঞানের অন্বেষণ

তৃতীয় অপ্রত্যাশিত একটা পরিস্থিতি সামনে আসে। তা হচ্ছে এই যে, বুহাইরা’র শিক্ষা বোর্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আমাকে শিক্ষক নিয়োগ করতঃ গ্রীষ্মের ছুটি শেষে আমাকে চার্জ বুঝে নিতে বলে। সুতরাং আমাকে দুটি পথের যে কোন একটি অবলম্বন করতে হবে- হয় চাকুরী গ্রহণ করতে হবে, না হয় জ্ঞান অন্বেষণ অব্যাহত রাখতে হবে। শেষ পর্যন্ত শিক্ষা গ্রহণের কাজে যোগদান করাকেই আমি প্রাধান্য দেই। এজন্য আমাকে কায়রো গমন করতে হবে। দারুল উলূম সেখানেই অবস্থিত আর শায়খ আব্দুল ওয়াহহাব হোছাফীর আসল ঠিকানাও কায়রোতেই। একটা বিষয় আমাকে অস্থির করে রাখে। আর তা হচ্ছে মাহমুদিয়া থেকে অনুপস্থিতির দীর্ঘ অনুভতি। মাহমুদিয়া হচ্ছে সেই প্রিয় শহর, যেখানে আমার প্রিয় বন্ধু আহমদ আফেন্দী সাকারী বাস করে। অবশ্য আমর এ ব্যাপারে একমত হই যে, যখন এ পদক্ষেপই উত্তম, তখন এটাই করতে হবে। পরবর্তীতে আমরা মিলিত হবো, বা চিঠিপত্রের মাধ্যমে যোগাযোগ অব্যাহত রাখবো। জ্ঞান অর্জনও এক ধরনের জিহাদ। এ পথে সবচেয়ে প্রিয় বস্তু উৎসর্গ করার জন্যও আমাদেরকে প্রস্তুত থাকতে হবে।

দারুল উলূমের প্রথম বৎসর

গ্রীষ্মের ছুটি শেষে আমি কায়রো গমন করি এবং সাইয়্যেদা যয়নব (রা)-এর মহল্লায় মারাসিনা সড়কের ১৮ নং বাসায় কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে অবস্থান করি। কায়রোয় এটা হচ্ছে আমার প্রথম বাসস্থান।

ক্লাশের প্রথম দিন আমি দারুল  উলূম গমন করি। তখন আমার মনে জ্ঞান অর্জনের তীব্র আকাংখা। পড়ালেখার প্রতি আল্লাহ তা’আলা আমাকে বেশ মনোযোগ দান করেন। প্রথম ঘন্টার কথা আমার বেশ ভালোভাবেই মনে আছে। তখনো বই-পুস্তক এবং অন্যান্য উপকরণ সংগ্রহ করা হয়নি। আমাদের শিক্ষক শায়খ মুহাম্মদ আব্দুল মুত্তালিক লম্বা পা ফেলে চবুতরায় ঝুলানো ব্লাকবোর্ডের সম্মুখে এসে দাঁড়ান। তিনি নতুন ছাত্রদেরকে অভিভাদন জ্ঞান করেন এবং তাদের সাফল্যের জন্য দোয়া করেন। এরপর ব্লাকবোর্ডে লিখেন এবায়দ ইবনে আবরাছ-এর কবিতাটিঃ

**********************************

এরপর চিরাচরিত অভ্যাস অনুযায়ী তিনি জুব্বা টেনে ধরে এমন সুর দিয়ে কবিতাটি আবৃত্তি করতে শুরু করেন, যা থেকে গর্ব আর আভিজাত্য প্রকাশ পায়। অতঃপর তিনি আমাকে বলেন, কবিতায় হযরকত, জের-জেবর, পেশ বসাতে। আমি মনে মনে বলি: ন্যাড়া মাথায় বেল পড়ে! আমি ভাবতে থাকি ******** কি জিনিস? কবি কেন ******** বললেন, তিনিতো ********** ও বলতে পারতেন। আমি হরকত বসাবার চিন্তায় বিভোর। এ সময় আলোচনার ধারা পাল্টে যায়। কবি ওবায়দ ইবনে আবরাছ-এর ব্যক্তিত্ব নিয়ে কথা উঠে। কথা উঠে, সে যুগে আরবদের জীবন-যাপনের ধারা কেমন ছিল। তাদের জীবনধারায় কষ্ট সহিষ্ণুতা আর সরলতা কেমন ছিল। আলোচনা শুরু হয় আরবদের প্রসিদ্ধ যুদ্ধ-বিগ্রহ, তাদের জাতীয় বৈশিষ্ট্য, শান্তি আর যুদ্ধকালে তাদের অস্ত্র, বর্শা, তরবারী আর তীন-ধনুকের নানা রকম আর প্রকার নিয়ে। বিশেষ করে ফলাযুক্ত তীর আর ফলাবিহীন তীর নিয়ে আলোচনা চলে। তীর নিক্ষেপের ক্ষেত্রে মুহতারাম ওস্তাদ নীচের প্রসিদ্ধ কবিতাটি প্রমাণ হিসাবে উপস্থাপন করেনঃ

**********************************

প্রেমিকা আমার প্রতি এমন এক তীর নিক্ষেপ করে,

যার ফলা শুর্মার। কিন্তু তা আমার চামড়ার

উপরিভাগকে আহত করেনি,

তবে আমার অন্তরকে আহত করেছে।

তিনি ব্লাকবোর্ডে নানা ধরনের তীরের ছবি আঁকা শুরু করেন। এহেন ব্যাপার আলোচনা শুনে আমি আনন্দে নেচে উঠি। বেশ আগ্রহ অভিনিবেশ নিযে তন্ময় হয়ে তাঁর লেকচার শ্রবণ করি। এ ধারার শিক্ষা আমার আগ্রহ আরো বহুগুণে বৃদ্ধি করে। দারুল উলূমের শিক্ষকদের প্রতি ভক্তি-সম্মান অনেক বৃদ্ধি পায়।

চিত্তের স্বাধীনতা

শায়খ আব্দুল মুত্তালিবের আলোচনা প্রসঙ্গে আমার মনে পড়ে কিতাব বিক্রেতার দোকানের কর্মচারীর কথা। কায়রোয় আগমন করে আমি প্রথমে তার কাছেই উঠেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, দারুল উলূমের শিক্ষকদের সঙ্গে, বিশেষ করে শায়খ আব্দুল মুত্তাবিল এবং ওস্তাদ আল্লামা সালামার সঙ্গে তার ভালো সম্পর্ক আছে। আমার ব্যাপারে তিনি তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে পারেন এবং ডাক্তারী পরীক্ষা আর ভর্তি পরীক্ষা এবং মৌখিক পরীক্ষা ইত্যাদির ব্যাপারে তাঁদের কাছে সুপারিশ করতে পারেন। আজ রাত্রেই তিন শায়খ আব্দুল মুত্তালিবের বাসায় যাবেন কিছু কিতাব নিয়ে। ইচ্ছা করলে আমিও তার সঙ্গে যেতে পারি। তখন শায়খ আব্দুল মুত্তালিব থাকতেন সানজার আলখাযেন সড়কের একটা বাসায়। আমি প্রথমবারের মতো সাজ্জার আলখাযেন-এর নাম শুনলাম। মনে মনে ভাবি, কে এই সাজ্জার আলখাযেন? মামলূক তথা দাস বংশের, না তুর্কি? মেযবানের পরমর্শের পরও আমি নিজের মনকে রাজী করাতে  পারিনি সুপারিশ গ্রহণ করার জন্য। তবে এ পরামর্শের জন্য আমি তাকে ধন্যবাদ জানাই। তবে তার কথায় শায়খ মূসা আবু কামার-এর কথা আমার মনে পড়ে। তিনি আমার আত্মীয় এবং দারুল উলূমের শিক্ষক ছিলেন। তখন শায়য়খ মূসা থাকতেন আল-খালীজ আল মিছরী সড়কে। পরীক্ষার দু’দিন আগে আমি অবসর ছিলাম। আমি এ সুযোগ কাজে লাগাই এবং শায়খ মুসা আবু কামার-এর বাসায় গমন করি। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে একবার নক করি। এ সময় আমার মনে একটা ভাবের উদয় হয় এবং এতই প্রবল হয় যে, ভেতর থেকে জবাবের অপেক্ষা না করেই তৎক্ষণাৎ আমি ফিরে আসি। আমার মনের সে ভাবটি ছিল এই যে, আমি গায়রুল্লাহর আশ্রয় নিচ্ছি, গায়রুল্লাহর উপর নির্ভর করা সম্পর্কে ভাবছি এবং মানুষের সামনে মাথা নত করছি। তখনই আমি দৃঢ় সংকল্প করি যে, আমি কেবল এক আল্লাহর কাছে সাহায্য চেয়েই ক্ষ্যান্ত করবো। ডাক্তারী পরীক্ষা আর ভর্তি পরীক্ষা দু’টা শেষ করে তবেই শায়খ মুসা আবু কামার-এর সঙ্গে দেখা করবো। আর মুলত তা-ই হয়েছে। পরবর্তীকালে দেখা করলে তাঁর বাসাঁ কেন উঠিনি, এ কারণে তিনি আমার উপর রুষ্ট হন। শায়খ আবু মুসা ছিলেন অত্যন্ত ভদ্র, বিনয়ী এবং দরাজ দিলের মানুষ। তাঁর বাসা কখনো অতিথি আর অভাবী মুক্ত থাকতো না। আমি তাঁকে আসল ঘটনা বলি যে, আমি তাঁর বাসায় এসে ফিরে গেছি। শুনে তিনি বেশ হাসেন এবং এহেন মনোভাবের জন্য আমার পিঠে হাত বুলান। তাঁর একজাও আমার মনে গেঁথে আছে। আল্লাহ তা’আলা তাঁর নেকী কবুল করুন এবং তাঁর জন্য জান্নাত প্রশস্ত করুন।

নতুন বাসা

নতুন বাসা সন্ধানের কাহিনীও ভুলবার মতো নয়। যে বাসায় আমরা অবস্থান গ্রহণ করেছিলাম, তা ছিল আলে আকেফের। কাগজ ব্যবসায়ী ইবরাহীম বেক-এর নিকট থেকে তিনি এ বাসাটি ক্রয় করে দেন। নতুন মালিক বাসাটা খালী করাতে বাধ্য। প্রয়োজনীয় মেরামতের পর তা ব্যবহার করবেন। নতুন বাসার সন্ধানে আমরা বেশ গলদঘর্ম হই। অবশেষৈ আল কাবাশ কেল্লায় দাহীরা সড়কে আমরা একটা বাসায় সন্ধান পাই। বৎসরের বাকী দিনগুলো আমরা এ বাসায়ই অবস্থান করি।

 

কায়রোর দিনগুলো

কায়রোয় আমার দিনগুলো বেশ ভালোভাবেই কাটছিল। পরীক্ষায় আমি প্রথম বিভাগ উত্তীর্ণ হই। দারুল উলূমের পক্ষ থেকে আমি বৃত্তি লাভ করি। মাসে এক পাউন্ড বৃত্তির এ টাকা অ-পাঠ্য পুস্তক ক্রমের কাজে ব্যয় করি। আমার বর্তমান লাইব্রেরীর অনেক কিতাবই বৃত্তির টাকায় কেনা। ছাত্রজীবনে এসব কিতাব আমার সঙ্গে ছিল। আমি প্রতি সপ্তাহ শুক্রবার জুমার নামাজের পর শায়খ হোছাফীর বাসায় গমন করে যিকরের মাহফিলে যোগ দিতাম। এখানে আমি লাভ করতাম এক অনাবিল স্বাদ ও আনন্দ। সপ্তাহের অধিকাংশ রাত কাটতো শায়খ হোছাফীর প্রথম খলীফা আল আফেন্দী গালেব-এর বাসভবনে। আমি তাঁকে ডাকতাম সাইয়্যেদুনা আফেন্দী উপাধীতে। ওদিকে ভাই আহমদ আফেন্দী সাকারীর নিকট  প্রায় প্রতিদিন পত্র লিখতাম আর সেও প্রায় প্রতিদিনই আমার কাছে চিঠি লিখতো। ছুটির দিনগুলোতে মাহমুদিয়া গমন, আহমদ সাকারী এবং হোছাফী ভাইদের সঙ্গে কাটাতাম। এভাবে সুন্দর রকমে কেটে যাচ্ছিল  আমার শিক্ষা, আমল আর রূহানী জীবন। আলহামদু লিল্লাহ, কোন কিছুই তা কলুষিত করতে পারেনি।

ঘটনা না দুর্ঘটনা

বৎসরেরর শেষদিকে বার্ষিক পরীক্ষার সময় সম্ভবত: পরীক্ষার দুদিন যেতে না যেতেই এক দুর্ঘটনা ঘটে যায়।  যা এক বিরাট দুঃখের কারণ হয়ে দেখা দেয়। অবশ্য এ ঘটনা আমার জন্য একদিক থেকে কল্যাণকরও ছিল। এ দুর্ঘটনার ফলে আমাদের গোটা পারিবার মাহমুদিয়া থেকে কায়রোয় স্থানান্তরিত হয়।

আমার এক সহপাঠী আমার সঙ্গেই থাকতো। আমার মতো সে-ও ছিল বহিরাগত। পরীক্ষায় আমি তার চেয়ে উপরে থাকবো, এটা সে সহ্য করতে পারছিল না। কারণ, বয়সে সে ছিল আমার চেয়ে বড় এবং বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বেশকটা বৎসর সে অতিবাহিত করে এসেছে।  সুতরাং তার বিবেচনায় প্রথম হওয়ার সে-ই বেশী হকদার। এটা তারই অধিকার। আমার মতো কম বয়সের ছাত্র প্রথম হবে- এটা সে কিভাবে মেনে নেবে। বিষয়টা তার মন-মানসে ভালোভাবে চেপে বসে। তাই পরীক্ষা থেকে আমাকে বিরত রাখার উপায় সম্পর্কে সে ভাবতে থাকে। সে একটা উপায় বের করে যে, আমরা যখন গভীর নিদ্রামগ্ন, তখন সে এক বোতল এসিড আমার মুখ আর ঘাড়ে ঢেলে দেয়্ আমি বিচলিত হয়ে জেড়ে উঠলে সে শুয়ে পড়ে ঘুমের ভান করে। অন্ধকারে আমি তাকে চিনতে পারিনি। আমি তৎক্ষণাৎ গোসলখানায় চলে যাই এবং ঝলসে দেয়ার উপকরণ ধুয়ে ফেরার চেষ্টা করি। ইতিমধ্যে মসজিদ থেকে ফজরের আযান ধ্বনিত হয়্ আমি তাড়াতাড়ি মসজিদে গমন করি। নামায পড়ে এসে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে থাকি। কারণ, অনেক রাত পর্যন্ত পড়াশুনা করারয় আমি ঘুমে অস্থির ছিলাম। ঘুম থেকে উঠে এসিড় হামলার লক্ষণ দেখতে পাই। ভোর বেলাই সে পালিয়ে যায়। একজন সঙ্গি বলে যে, আমি তার হাতে একটা শিশি দেখেছি ফিরে এলে জিজ্ঝেস করায় সে অপরাধ স্বীকার করে এবং এর কারণ তাই উল্লেখ করে, যা আমি পূর্বে বলেছি। বাসায় সব সঙ্গী তার প্রতি লেলিয়ে গিয়ে তাকে বেশ মারধর করে, তার সমস্ত আসবাবপত্র ছুঁড়ে ফেলে দেয় রাস্তার উপর। এবং তাকেও কক্ষ থেকে বের করে দেয়। কোন কোন বন্ধ পুলিশ আর দারুল উলূমের প্রশাসনকে জানাতে বলে আমিও তাই করার চিন্তা করেছিলাম। পরে ভাবি যে, আমি রক্ষা পেয়েছি। এটা আল্লাহর বিশেষ মেহেরবানী। এর শুকরিয়া আদায় করে শেষ করা যাবে না। আর আল্লাহর শোকর আদায়ের উপায় হচ্ছে হামলাকারীকে ক্ষমা করা।

“যে ব্যক্তি ক্ষমা আর সংশোধন করে নেয়, তার প্রতিদান আল্লার যিম্মায়”। (সূরা শূরাঃ ৪০)

তাই আমি বিষয়টি আল্লার উপর ছেড়ে দেই এবং তার বিরুদ্ধে আদৌ কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করিনি।

খবরটা মাহমুদিয়ায় পৌঁছে। পরীক্ষা শেষে আমিও মাহমুদিয়া গমন করি। পরীক্ষার ফলও বের হয়েছে। আলহামদু লিল্লাহ আমি প্রথম হয়েছি। এ সময় আম্মাজান চাপ দেন যে, দু’টি কাজের যে কোন একটি অবলম্বন করতে হবে। হয় আমাকে পড়ালেখা ছেড়ে চাকুরী গ্রহণ করতে হবে, অন্যথায় বাসা বদল করে আমার সঙ্গে তাঁকেও কায়রো চলে আসতে হবে।

কায়রোর বাসা স্থানান্তর

এ সময় ভাই আব্দুর রহমান প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে। তাকে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে হবে। ভাই মুহাম্মদও প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেছে। আব্বাজানের ইচ্ছা, তাকে আল আযহারে ভর্তি করাবেন। অন্যান্য ভাইদের জন্যও শিক্ষার ব্যবস্থা করা জরুরী। মাহমুদিয়ায় শিক্ষার তেমন সুযোগ ছিল না। পরিস্থিতির দাবী ছিল কায়রো গমন করা। যদিও দীর্ঘ সফর। শেষ পর্যন্ত তাই হয়েছে।

ছুটি শেষ হওয়ার কয়েকদিন আগে আব্বাজান কায়রো গমন করতঃ উপার্জনের সন্ধান করতে থাকেন। আল্লাহ তা’আলা তাঁর সন্ধান সফল করেন। তিনি মাহমুদিয়া ফিরে এলে গোটা পরিবার মাহমুদিয়া থেকে কায়রো বদলী হয়ে যায়। আব্দুর রহমান কমার্স স্কুলে ভর্তি হয়। মুহাম্মদ কায়রোয় আল-আযহারের মা’হাদুল কাহেরার সঙ্গে যুক্ত হয়। অন্যান্য ভাইয়েরাও উপযুক্ত বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়।

মনের অবস্থা

এভাবে গোটা পরিবার এক সঙ্গে বাস করার আনন্দকে কেবল একটা অনুভূতিই- যা ছিল কঠিন আর অস্বস্তিকর- ম্লান করে তুলছিল। আর সে অনুভূতি ছিল ভাই আহমদ আফেন্দী সাকারীর সঙ্গে আন্তরিক সম্পর্কচ্ছেদ। তার সঙ্গে আমার এ সম্পর্ক ছিল লিল্লাহ। প্রথমে তো আমরা এই বলে মনকে সান্ত্বনা দিতাম যে, ছুটির সময় এ বিচ্ছেদ পুষিয়ে নেবো। আর শেষ পর্যন্ত আমাদের ঠিকানা থাকবে একই শহরে। কিন্তু বর্তমানে আমরা সম্পূর্ণ একটা নতুন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছি। এখন তো এমনও হতে পারে যে, আমি আর কখনো মাহমুদিয়ায় ফিরে যাবো না। মনে দারুণভাবে এ খটকা জাগছিল। এ বিষয়ে অনেক ভাবতে হবে এবং এর একটা উপায় বের করতে হবে।

এ ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করার জন্য আহমদ আফেন্দীর সঙ্গে আমার কয়েক দফা বৈঠক হয়। এ চিন্তায় বেশ কিছু রজনী কাটে। কথাবার্তা হয়। বৈঠক বসে এবং ভাঙ্গে। আহমদ আফেন্দী ব্যবসায়ী। আর ব্যবসায়ীর নির্দিষ্ট কোন দেশ থাকে না। সে-ও তো আমাদের সঙ্গে কায়রো চলে আসতে পারে। কিন্তু তার পরিবারের লোকজন? তারা কি করবে? তারা আসতে চায় না, অবস্থা আর পরিবেশও তাদেরকে এ অনুমতি দেয় না। তাহলে এখন উপায় হবে? এ বিষয়ে আমরা অনেক চিন্তা করি। অবশেষে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছি যে, বর্তমান বৎসরটি হবে পরীক্ষামূলক। এরপর দেখবো, কি হতে পরে। আমরা কায়রোয় বদলী হয়ে যাই। নতুন বৎসর শুরু হয়। আহমদ আফেন্দী বৎসরের শুরুতে প্রায় এক বৎসর আমার সঙ্গে কায়রোয় কাটায়। এরপর সে মাহমুদিয়ায় ফিরে যায়। বৎসরের শেষ নাগাদ আমরা চিঠিপত্রের মাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষা করি। এরপর শুর হয় গ্রীষ্মের ছুটি।

মাহমুদিয়ায় ঘড়ির দোকান

হ্যাঁ, এখন দ্বিতীয় গ্রীষ্মের ছুটি শুরু হয়ে গেছে। ছুটির এ সময়টা আমি আহমুদিয়ায় কাটাতে চাই। কিন্তু ছুটির পুরো সময়টা সেখানে কাটাবার জন্য কোন উপায় বের করতে হবে। আমি আব্বাজানকে বলি যে, আমি মাহমুদিয়া যাবো। সেখানে একটা দোকান খুলে আমি স্বাধীনভাবে ঘড়ি মেরামতের কাজ করবো। ফলে এ পেশায় আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা হবে। আমার মাহমুদিয়া যাওয়ার আসল কারণ আব্বাজান ভালোই জানতেন। কিন্তু অধিকন্তু তিনি আমার ইচ্ছা মেনে নিতেন। আর আমিও সব সময় মনে করতাম যে, আমার কাজকর্মের প্রতি তাঁর পূর্ণ আস্থা রয়েছে। এ আস্থা অনুযায়ী তিনি আমাকে মাহমুদিয়া গমনের অনুমতি দেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি আমার কল্যাণ কামনাও করেন। আমি মাহমুয়িায় একটা দোকান নিয়ে কার্যত: ঘড়ি মেরামতের কাজ শুরু করি। এহেন জীবন ধারার আমার দু’ধরনের সৌভাগ্য লাভ হয়। একটা হচ্ছে আত্মনির্ভরশীলতা। আর দ্বিতীয়টা হচ্ছে নিজ হাতে জীবিকা উপার্জনের সৌভাগ্য। আহমদ আফেন্দী এবং হোছাফী ভাইদের সঙ্গে। আমরা আল্লাহর যিকর করতাম, ইলম আর ইরফান সম্পর্কে আলোচনা করতাম; কখনো মসজিদে, কখনো বাসাবাড়ীতে, আবার কখনো শহরের বাইরে খোলা ময়দানে। দিনে নীল নগে গোসল করারও সুযোগ হতো। আহমদ আফেন্দীর সঙ্গে বিশেষ সাক্ষাতেরও সুযোগ হতো। এসব সম্পর্কে অধিকন্তু আমাদের গোটা রাত অতিবাহিত হয়ে যেতো। ছুটির গোটা সময়টা আমি কাটাতাম আহমদ আফেন্দীর বাসায়। ফলে রাতদিন আমরা একই সঙ্গে থাকতাম।

যিকর আর ইবাদাতে আমরা সম্পূর্ণ নিমগ্ন থাকতাম। তরীকতের দরূদ আর ওযীফায় ডুবে থাকলেও জ্ঞান চর্চা আর অধ্যয়নে নিমগ্নতায়ও কোন কমতি ছিল না। বাহ্যতঃ দ্বীনের বিধি-বিধানের বিরোধী যে কোন কাজের প্রতি আমাদের ঘৃণা ছিল। তাসাউউফের নানা সিলসিলার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের সম্পর্কে আমরা বলতাম, এরা ইসলামের শিক্ষা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। আমরা হোছাফী তরীকার মুরীদ ছিলাম। যিকর-ইবাদাত এবং আদাব ও সুলূকের মূল্যও আমরা পূর্ণ ইখলামের সঙ্গে মেনে নিতাম। কিন্তু আমাদের চিন্তা ছিল স্বাধীন। তাই বলে আমরা অন্ধ ভক্ত আর অনুসারী ছিলাম না।

একটা অনুকরণীয় আদর্শ

আমার মনে পড়ে যে, রবিউল আউয়াল মাস এলে পয়লা রবিউল আউয়াল থেকে ১২ই রবিউল আউয়াল পর্যন্ত প্রতি রাত্রে অভ্যাস অনুযায়ী আমরা হোছাফী ভাইদের মধ্যে কোন একজনের বাসায় যিকরের মহফিলের আয়োজন করতাম এবং মীলাদুন্নবীর মিছিল নিয়ে বের হতাম। এক রাত শায়খ শালবীর রিজালের বাসায় সমবেত হওয়ার পালা ছিল। অভ্যাস অনুযায়ী এশার পর আমরা তাঁর বাসায় হাজির হই। দেখি, বাসা আলোয় ঝলমল করছে। গোটা বাসা ভালোবাভে সাজানো হয়েছে। বেশ পরিষ্কার- পরিচ্ছন্ন। শায়খ শালবী রেওয়াজ অনুযায়ী উপস্থিত লোকজনকে শরবত, কফি এবং খোশবু পরিবেশন করেন। এরপর মিছিল আকারে আমরা বের হই। অতীব আনন্দের সঙ্গে প্রচলিত ভক্তিমূলক কবিতা আবৃত্তি করি। মিছিল শেষে আমরা শায়খ শালবির রিজালের বাসায় ফিরে আসি। কিছু সময় তাঁর সঙ্গে কাটাই। আমরা যখন ফিরে আসতে উদ্যত হই, তখন শায়খ শালবী হাসিমুখে ঘোষণা করেন: কাল ভোরে আপনারা আমার বাসায় আসবেন রুহিয়াকে দাফন করার জন্য।

রুহিয়া শায়খ শালবীল একমাত্র কন্যা। বিয়ের প্রায় ১১ বৎসর পর আল্লাহ তাঁকে এ কন্যা সন্তান দান করেন। এ কন্যা সন্তানকে তিনি এতই ভালোবাসতেন যে, কাজের সময়ও তাকে দূরে রাখতেন না। মেয়েটি বড় হয়ে যৌবনের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে। শায়খ তার নামকরণ করেন রুহিয়া। কারণ, সে ছিল দেহের জন্য প্রাণস্বরূপ। তাঁর ঘোষনায় আমরা মর্মাহত হই। জানতে চাই, কখন রুহিয়ার ইনতিকাল হয়েছে। বললেন, আজই মাগরিবের একটু আগে। বললাম, আপনি আগে কেন বললেন না? তাহলে মীলাদুন্নবীর শোভাযাত্রা অন্য কারো বাসা থেকে বের করতাম। বললেন: যা হয়েছে, ভালোই হয়েছে। এতে আমার শোক-দুঃখ কিছুটা হালকা হয়েছে। শোক আনন্দে পরিণত হয়েছে। এ নিয়ামতের পরও কি আল্লাহ তা’আলার আর কোন নিয়ামতের দরকার আছে? আলোচনা তাসাউউফের শিক্ষার রূপ ধারণ করে। শায়খ শালবী নিজেই এ শিক্ষা দিচ্ছিলেন। তিনি তাঁর চক্ষের পুতুল আর কলিজার টুকরার মৃত্যুর এ ব্যাখ্যা করেন যে, মূলত: এ মৃত্যু দ্বারা আল্লাহ পরীক্ষা করেন। তিনি চান না যে, তাঁর বান্দাহদের অন্তর অন্য কিছুকে ভালোবাসুক, গায়রুল্লাহর সঙ্গে যুক্ত থাকুক। হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর ঘটনা থেকে তিনি প্রমাণ উপস্থাপন করেন যে, হযরত ইসমাঈল (আ:)-এর সঙ্গে যখন তাঁর অন্তর ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে যায়, তখন আল্লাহ তা’আলা তাঁকে হুকুম দেন হযরত ইসমাঈল (আ:) কে কুরবানী করার। হযরত ইয়া’কুব (আ:)-এর উদাহরণ দিয়েও তিনি বলেন যে, তাঁর অন্তরে হযরত ইউসুফ (আ:)-এর প্রতি অফুরন্ত ভালোবাসা সৃষ্টি হলে আল্লাহ তা’আলা কয়েক বৎসরের জন্য তাকে দূরে সরিয়ে রাখেন। সুতরাং বান্দাহর অন্তর গায়রুল্লাহর সঙ্গে লেগে থাকা কিছুতেই উচিত নয়। অন্যথায় মহান আল্লাহর সঙ্গে ভালোবাসার দাবীতে সে মিথ্যা হবে।

হযরত শালবী হযরত ফুযাইল ইবনে আয়াযের কাহিনীও উদাহরণ হিসাবে পেশ করেন। তিনি ছোট মেয়েটাকে হাত ধরে টনে কোলে তুলে চুমো খান। মেয়ে বলে: আব্বাজান! আপনি কি আমাকে ভালোবাসেন? হযরত ফুযাইল বললেন: কন্যা, নিশ্চয়ই। কন্যা বললো: খোদার কসম, ইতিপূর্বে আমি তোমাকে মিথ্যাবাদী মনে করতাম না। ফুযাইল বললেন: কি ব্যাপার, আমি কখন মিথ্যা বলেছি? বন্যা বলে: আমার ধারণা ছিল, আল্লাহর সঙ্গে তোমার যে সম্পর্ক, তা থাকতে অন্য কিছু তোমার কাছে প্রিয় হতে পারে না। এ কথা শ্রবণ  করে হযরত ফুযাইল কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন এবং চিৎকার করে উঠেন: তোমার বান্দাহ ফুযাইলের রিয়াকারীর বিষয়টা শিশুর কাছেও ধরা পড়েছে। এ ধরনের ঘটনা বর্ণনা করে শায়খ শালবীল রিজাল আমাদের দুঃখ হালকা করতে চান। তাঁর বিপদে আমরা যে দুঃখ পেয়েছি, তা দূর করার চেষ্টা করেন। তাঁর বাসায় মীলাদের কর্মসূচী পালন করে আমরা যে লজ্জা পেয়েছি, তিনি তা দূর করার চেষ্টা করেন। পরদিন ভোরে আমরা তাঁর বাসায় উপস্থিত হয়ে রুহিয়াকে দাফন-কাফনের আয়োজন করি। আমরা ঘর থেকে কোন কান্নার আওয়াজ শুনতে পাইনি। কোন মুখ থেকে অসমীচীন কোন কথা বের হয়নি। কেবল ছবর আর শোকরই আমরা দেখতে পেয়েছি। আমরা দেখতে পেয়েছি আল্লাহর ইচ্ছার সম্মুখে সকলকে আত্মসমর্পণ করতে। আমাদের ওস্তাদ শায়খ যাহরানের এক কন্যা সন্তানও ইনতিকাল করে; কিন্তু এ শোককে ওয়াজ-নছিহতের অনুষ্ঠানে পরিণত করা ছাড়া তিনি অন্য কিছুই করেননি। একাধারে তিন রাত তিনি এ কর্মসূচী পালন করেন। এভাবে শোক আর মৃত্যু উপলক্ষে বেদয়াত আর বদরসম মূলোৎপাটনের এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।

কায়রো প্রত্যাবর্তন এবং ইসলামী সংগঠনে যোগদান

আমি কায়রো প্রত্যাবর্তন করি। সেকালে কায়রোয় আজকের মতো এতো ইসলামী সংগঠন ছিল না। তখন কায়রোয় কেবল একটা ইসলামী সংগঠন ছিল। এর নাম ছিল জমিয়তুল মাকারিমিল ইসলামিয়াহ। শায়খ মাহমুদ ছিলেন এ সংগঠনের নেতা। বরকতুল ফীল মহল্লায় দারুস সাদাতে ছিল এ সংগঠনের সদর দফতর। এখানে বিভিন্ন ইসলামী বিষয়ে তত্ত্ব ও তথ্যপূর্ণ বক্তৃতা হতো। সংগঠনের কারী শায়খ আব্বাস তাঁর সূললীত কণ্ঠে কুরআন তিলাওয়াত দ্বারা সকলকে মুগ্ধ করতেন। সংগঠনের সমাবেশে আমি নিয়মিত যোগদান করি এবং যতদিন কায়রো ছিলাম এ সংগঠনের সদস্য হিসাবে অংশ গ্রহণ করেছি।

ইসলামের প্রচারক প্রস্তুত করার প্রস্তাব

কায়রোয় বহুস্থানে বিপথগামিতা আর ইসলামী নৈতিকতা বিরোধী কার্যকলাপের এমন অনেক দৃশ্য চোখে পড়ে, যা মিশরীয় গ্রামের শান্তিপূর্ণ পরিবেশে কখনো চোখে পড়েনি। উপরন্তু কোন কোন পত্র-পত্রিকায় এমন কিছু ছাপা হচ্ছিল, যা ইসলামী শিক্ষার সরাসরি পরিপন্হী। আর সাধারণ লোকেরাও ছিল দ্বীনের বিধি-বিধান সম্পর্কে অজ্ঞ। এসব কিছু দেখে আমি মনে মনে বলি, ইসলামের শিক্ষা জনগণের নিকট পৌঁছবার জন্য কেবল মসজিদই যথেষ্ট নয়। তখন বিজ্ঞ আলেমদের একটা দল স্বেচ্ছায় মসজিদে ওয়ায করতেন, দ্বীন প্রচার করতেন। এসব ওয়ায মানুষের মনে বিরাট ছাপ মুদ্রিত করতো। ওস্তাদ আব্দুল আযীয খাওলী, ওস্তাদ শায়খ আলী মাহফুয এবং ওয়াকফ বিভাগের ওয়ায ও তাবলীগ শাখার সাবেক ইন্সপেক্টর জেনারেল শায়খ মুহাম্মদ আল আদবী ছিলেন ওয়ায়েযদের অন্তর্ভুক্ত। আমি ভাবলাম, আযহারী ছাত্র এবং দারুল উলূমের ছাত্রদের সমন্বয়ে একটা গ্রুপ গড়ে তোলার প্রস্তাব করবো। এরা মসজিদে ওয়ায ও তাবলীগের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করবে এবং কফি শপ আর সাধারণ মানুষের সমাবেশে ওয়ায আর তাবলীগ করবে। আর এদের সমন্বয়ে একটা দল গড়ে তোলা হবে, যারা গ্রামে- গঞ্জে এবং গুরুত্বপূর্ণ শহরে-বন্দরে ছড়িয়ে পড়বে এবং মানুষকে ইসলামের দাওয়াত দেবে। আমি এ চিন্তাকে বাস্তব রূপ দেই এবং এ মহান পরিকল্পনায় অংশগ্রহণ করার জন্য একদল বন্ধু সংগ্রহ করি। এদের মধ্যে একজন ছিলেন ওস্তাদ মুহাম্মদ মাদকুর। ইনি ছিলেন আল আযহারের শিক্ষাপ্রাপ্ত কিন্তু তখনো আযহারের ক্যাম্পাস তিনি ত্যাগ করেননি। দ্বিতীয়জন ছিলেন ওস্তাদ শায়খ হামেদ আসকারিয়া আর তৃতীয়জন ছিলেন ওস্তাদ শায়খ আহমদ আব্দুল হালীম (ইনি পরবর্তীকালে ইখওয়ানুল মুসলিমুন এ যোগদান করেন এবং কেন্দ্রীয় সংসদের সদস্য হন)। এছাড়া আরো কিছু বন্ধু বান্ধবও ছিলেন। আমরা ছালিবিয়ার শায়খুন মসজিদে ছাত্রাবাসে সমবেত হতাম এবং মিশনের গুরুত্ব এবং এজন্য প্রয়োজনীয় বাস্তব অভিজ্ঞতা সম্পর্কে আলোচনা করতাম। এ কাজের জন্য আমি কিছু কিতাবপত্র যেমন ইমাম গাযালীর এহইয়াউল উলূম, নাবহানীর আনওয়ারুল মুহাম্মদীয়্যাহ এবং শায়খ কুর্দীর তানবীরুল কুলূব ফী মুয়ামালাতি আল্লামিল গুয়ুবও দান করেছিলাম আমার ব্যক্তিগত পাঠাগার থেকে। এসব কিতাব দ্বারা মুবাল্লিাগদের জন্য একটা ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরী গড়ে তোলা হয়। তারা এ লাইব্রেরী থেকে কিতাব ধার নেবে এবং বক্তৃতার জন্য প্রস্তুতি নেবে।

কফি শপে দাওয়াতের কাজ

জ্ঞানের প্রস্তুতির পর আসে কাজের পালা। বন্ধুদের নিকট আমি প্রস্তাব করি যে, আমার কফি শপে ওয়ায আর তাবলীগের জন্য গমন করবো। আমার এ প্রস্তাবে তারা ভীষণ বিস্ময় প্রকাশ করে বলে: কফি শপের মালিক কিছুতেই তাবলীগের অনুমতি দেবে না, বরং বিরোধিতাই করবে। কারণ, এতে তাদের কাজের ব্যাঘাত হবে। সব কিছুই তো অচল হয়ে যাবে। আর কফি শপে যারা যায়, তাদের অধিকাংশই এমন লোক, যারা নিজেকে নিয়েই নিমগ্ন থাকে। তাদের জন্য এর চেয়ে ভারী আর কিছু হতে পরে না। খেলাধুলা আর ক্রীড়া কৌতুক ছাড়া অন্য কিছুর যাদের কোন চিন্তাই নেই, আর এসব করার জন্যই যারা এখানে ছুটে এসেছে, এমন লোকদের কাছে আমরা কেমন করে দ্বীন আর নৈতিকতার কথা বলবো? আমি ছিলাম বন্ধুদের এ চিন্তাধারার বিরোধী। আমার বিশ্বাস ছিল, কফি শপে যারা বসে, তাদের অধিকাংশই অন্য সব লোকের চেয়ে এমনকি যারা মসজিদে  গমন করে, তাদের চেয়েও উপদেশ আর নছিহত শুনতে বেশী ভালোবাসে। কারণ, এটা তাদের জন্য একটা সম্পূর্ণ অভিনব বিষয়। আসল হচ্ছে ভালো আলোচ্য বিষয় চয়ন করা। আমরা এমন কোন বিষয়ে আলোচনা করবো না, যা তাদের আবেগ- অনুভূতিতে আঘাত  হানতে পারে। আর দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে কথা বলার সঠিক পদ্ধতি। আগ্রহ সহকারে আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে আমাদের কথা উপস্থাপন করতে হবে। আর তৃতীয় বিষয় হচ্ছে সময়। দীর্ঘ ওয়ায থেকে আমাদেরকে বিরত থাকতে হবে।

বিষয়টা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা এমনকি বিতন্ডাও চলে। আমি বন্ধুদেরকে বলি, বাস্তব অভিজ্ঞতাকে এ বিরোধের চূড়ান্ত সীমা নির্ণয় করাই কি উত্তম হবে না? ফলে সকলেই আমার পরামর্শ মেনে নেয় এবং আমরা বেরিয়ে সালাহুদ্দীন পার্কের কফি শপ থেকে কাজ শুরু করি। সেখান থেকে বের হয়ে সাইয়্যেদা আয়েশা মহল্লার কফি শপে গমন করি। এরপর গমন করি তুলুন চকে ছড়িয়ে থাকা কফি শপ অভিমুখে। শেষ পর্যন্ত আমাদের দলটা তরীকুল জাবাল হয়ে সালামা সড়কে গিয়ে পৌঁছে। এবং সাইয়্যেদা যয়নবের অলি-গলিতে ছড়িয়ে থাকা কফি শপও চষে বেড়ায়। আমার মনে পড়ে, একই রাত্রে আমরা ২০টির বেশী বক্তৃতা করি। প্রতিটি বক্তৃতা ছিল পাঁচ থেকে দশ মিনিট সময়ের।

শ্রোতাদের বিস্ময়কর অনুভূতি প্রত্যক্ষ করা যায়। তারা অতি আগ্রহ নিয়ে নিতান্ত মনোযোগ সহকারে আমাদের বক্তৃতা শ্রবণ করে। কফি শপের মালিক বক্তৃতার শুরুতে হাতে আঙ্গুল কামড়িয়ে আমাদের দিকে তাকায়। কিন্তু পরে আরো বলার জন্য অনুরোধ করে। তারা আমাদেরকে কসম খাইয়ে বলেন, আমাদেরকে অবশ্যই কিছু খেতে হবে, বা পছন্দসই কিছু নিতে হবে। কিন্তু সময়ের সংকীর্ণতার ওযর পেশ করে আমরা বলতাম- আমরা এ সময়টা আল্লাহর কাজের জন্য উৎসর্গ করেছি। সুতরাং অন্য কোন কাজে তা ব্যয় করতে পারি না। আমাদের এ ব্যাখ্যা তাদের অন্তরে আরো বেশী ক্রিয়া করে। অসম্ভব নয় যে, এ কথায় এ রহস্যও লুক্কায়িত রয়েছে যে, আল্লাহ তা’আলা যতোসব নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন, তাঁদের সকলের প্রথম ঘোষণা ছিল-

**********************************

লোকসকল! এ উপদেশের জন্য আমরা তোমাদের কাছে কোন বিনিময় চাই না (সূরা হুদ: ১৫১)।

কারণ নিঃস্বার্থভাবে কথা বললে শ্রোতাদের অন্তরে ভালো ক্রিয়া করে।

আমাদের প্রথম পরীক্ষা শতকরা একশ ভাগ সফল হয়। আমরা শায়খুন কেন্দ্রে ফিরে আসি। এ সফলতায় আমরা যার পর নাই আনন্দিত হই। এ ধরনের চেষ্টা অব্যাহত রাখার দৃঢ় সংকল্প করি আমরা। এটা অব্যাহত রাখা হবে বলে লোকজনের কাছেও আমরা ওয়াদা করি। মাহমূদিয়ার হোছাফী ভাইদের থেকে দূরে সরে যাওয়ার দুঃখও এতে কিছুটা হ্রাস পায়। এ সংস্থা এখন কার্যতঃ বিলূপ্ত হলেও সদস্যদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক এখনো অটুটস রয়েছে এবং এখনো তারা সকলে মিলে ইসলামের খেদমত করে যাচ্ছেন। যিকর- ইবাদাত এবং আমর বিন মারুফ আর নাহী আনিল মুনকার- এর কাজে হোছাফী তরীকা চেতনা চাঙ্গা করে তোলে। মাহমূদিয়ার মতো শান্ত শহরেও খৃষ্টান মিশনারীরা আখড়া গেড়ে বসেছে। ইতিপূর্বে এ শহরে এ মহামারী ছিল না। এদের জন্য উচিত হচ্ছে যেসব অঞ্চলে ধর্ম-কর্মের চর্চা নেই, সেখানে গমন করা এবং মুসলিম জনপদকে কলূষিত না করা। অন্য সমস্ত জাতির তুলনায় ঈমানের ব্যাপারে মুসলমানরা সত্যবাদী। তারা আল্লাহর সত্যিকার একত্ববাদের পতাকাবাহী। তাদের অন্তর পবিত্র আর বক্ষ নিষ্কুলষ।

শ্রেণী কক্ষে

তখন পর্যন্ত দারুল উলূমের শিক্ষা জড়তার শিকার হয়নি। বরং ছাত্র এবং শিক্ষকদের বয়স ও জ্ঞানের পর্যায়ের প্রতি লক্ষ্য রাখা হতো। অনেক সময় এমন হয়েছে যে, আমরা শ্রেণী কক্ষেই নানাবিধ সামাজিক এবং রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি; এমনকি ছাত্র এবং শিক্ষকদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ নিয়েও আলোচনা হয়েছে। সে কালে মিশরে রাজনৈতিক উদ্দীপনা চরমে পৌঁছে। ওয়াফদ পার্টি আর দস্তুর পার্টির মধ্যে ফাটল দেখা দেয়। আর এর পরিণতিতে নানা ঘটনা ঘটতে থাকে একের পর এক। রাজনীতিকরা একতাবদ্ধ হতো, এরপর আবার বিচ্ছিন্ন হতো এবং এদের মধ্যে সালিশ পালা চলতো। আর এ সালিশী কখনো সফল হতো, আাবর কখনো হতো ব্যর্থ। এসব ঘটনা আর বাস্তবতা নিয়ে ছাত্র আর শিক্ষকরা আলোচনা সমালোচনা করতো। শিক্ষকরাও ছাত্রদের সম্মুখে নিজেদের মতামত ব্যক্ত করতে কার্পণ্য করতেন না, রবং এমন অনেক ধর্মীয় বিষয়ও সামনে আসতো, যাতে ছাত্ররা শিক্ষকদের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করতো এবং তাদের মধ্যে বাক-বিতন্ডার দ্বার উন্মুক্ত হতো। কিন্তু এসব কথা যতটা আযাদীর সঙ্গে চলতো, ততটাই মেনে চলতো পরিপূর্ণ শিস্টাচারের সীমা। আামর মনে এ চিত্র এখনো অংকিত আছে যে, আমরা শিক্ষকদেরকে এতটা শ্রদ্ধা করতাম যে, তাঁদের কক্ষের সম্মুখ দিয়েও ছাত্ররা যেতো না। অথচ ছাত্রদের ক্লাশে যাওয়ার পথেই পড়তো তাদের কক্ষ। আমরা পরিপূর্ণ আযাদী ভোগ করতাম, তারপও তাঁরা আমাদের সঙ্গে সদয় ব্যবহার করতেন।শিক্ষকদের সঙ্গে আমাদের পরিপূর্ণ আত্মিক সম্পর্ক বজায় ছিল। আমরা শিক্ষকদের সম্মান এবং মর্যাদা কখনো বিসর্জন দেইনি। কখনো কখনো পাঠদান কালে কোন শিক্ষকের সঙ্গে দ্বিমতও হতো। আর শিক্ষক কৌতুক করতেন, বা দাতভাঙ্গা জবাবও দিতেন। আমার মনে আছে, আমাদের এক সহপাঠী ক্লাশ চলাকালে শিক্ষককে জিজ্ঞেস করে: আপনি কি বিবাহিত? শিক্ষক জবাব দেন, না। ছাত্র বলে: জনাব, কেন আপনি বিবাহ করেননি? আপনার তো বেশ বয়স হয়েছে। শিক্ষক বলেন: “অপেক্ষা করছি, বেতন যাতে এতটা বৃদ্ধি পায়, যা বিবাহের খরচ আর পরিবারের ভরণ-পোষণের জন্য যথেষ্ট হতে পারে এবং সন্তানদেরকে যেন ভালোভাবে লালন-পালন করতে পারি”। ছাত্র বলে: “কিন্তু আপনি যদি আরো বিলম্ব করেন, তবে আপনি তো নিশ্চয়তা দিতে পারেন না যে, আপনি বেঁচে থাকবেন এবং সন্তানদের লালন-পালন করবেন। জনাব, জীবিকা আর হায়াত তো কেবল আল্লাহরই হাতে। শিক্ষক নাজুক অবস্থায় পড়ে যান এবং বলেন, “তুমি কি বিবাহিত?” ছাত্রটি জবাব দেয়: “জি হ্যাঁ, আমার সন্তান প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাওয়ার জন্য প্রতিদিন আমার সঙ্গে গৃহ থেকে বের হয়। আমি আমার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গমন করি, আর সে গমন করে তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে”। এ কথা শুনে ছাত্ররা খিলখিল করে হেসে পড়ে আর এখানেই আলোচনার সমাপ্তি ঘটে।

পোশাক পরিবর্তন

দারুল উলূমের চতুর্থ বর্ষে- যা ছিল দারুল উলূমের শেষ বর্ষ- ইউনিফর্ম পরিবর্তনের আন্দোলন তীব্র হয়ে উঠে। সমস্ত ছাত্ররা এ পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত। দারুল উলূম থেকে পাশ করা গুরুজনরা সমর্থন করায় এ আগ্রহ আরো তীব্র হয়ে উঠে। কিন্তু আমি এবং মুষ্টিমেয় ছাত্র এ পরিবর্তনের পক্ষে ছিলাম না। কয়েক মাসের মধ্যে এমন অবস্থা দাঁড়ায় যে, দারুল উলূমে আগত ছাত্রদের এক বিরাট অংশ হয়ে উঠে স্যুটপরা বাবু আর কিছু অংশ মওলবী। প্রতিদিন ফেজ ক্যাপ পরিধানকারী ছাত্রের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে আর পাগড়ি পরিধানকারীর সংখ্যা হ্রাস পেতে থাকে। শেষ পর্যন্ত তো পাগড়ি পরিধানকারী কেবল দু’জন দাঁড়ায়। একজন শায়খ ইবরাহীম, যিনি পরবর্তীকালে শিক্ষা বিভাগে যোগদান করেন শিক্ষকের পদে আর দ্বিতীয়জন ছিল এ অধম লেখক। আর এ সময় বাস্তব শিক্ষারও সুযোগ ঘটে। দারুল উলূমের প্রিন্সিপাল ছিলেন অতি বিজ্ঞ-প্রাজ্ঞ ব্যক্তি ওস্তাদ মুহাম্মদ বেক সাইয়্যেদ। একদিন তিনি আমাদের দু’জনকে ডেকে বললেন: বাস্তব শিক্ষার জন্য আমরা এমন কোন প্রতিষ্ঠানে গমন করলে ভালো হয়, যেখানে নতুন ইউনিফর্মে আমরা শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি। এর ফলে ছাত্রদের সামনে নানা সুরতে আমাদেরকে উপস্থিত হতে হবে না। কিছু ছাত্র পাগড়ি পরিধান করবে আর বেশীরভাগ ছাত্র পরিধান করবে ফেজ ক্যাপ। শিক্ষকের এ উপদেশপূর্ণ কথার অর্থ বাধ্যতামূলক ছিল না। কিন্তু তাঁর জোরালো বক্তব্য আর তাঁর মতের প্রতি সম্মান প্রদর্শন পুর্বক আমরা পোশাক পরিবর্তনের ব্যাপারে তাঁকে প্রতিশ্রুতি দেই। আমরা আরয করি যে, আমরা অবশ্যই এ ওয়াদা বাস্তবায়িত করবো। জুব্বা আর পাগড়ি খুলে ফেলে স্যুট আর ফেজ ক্যাপ পরিধান করবো, তবে দারুল উলূম থেকে বের হওয়ার কয়েকদিন পূর্বে।

মিশনে ধর্মহীনতা ও নাস্তিক্যবাদের ঢেউ

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর এবং ঠিক সে সময়টাতে, যে সময়টা আমি কায়রোয় অতিবাহিত করি, মিশরে নাস্তিক্যবাদের ঢেউ শুরু হয়। বুদ্ধির মুক্তির নামে মনমানস আর চিন্তাধারায় এবং ব্যক্তি স্বাধীনতার নামে আাচার-আচরণ আর নীতি-নৈতিকতায় নাস্তিক্যবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। নাস্তিক্য, যথেচ্ছচারিতা, লাম্পট্য আর ভ্রষ্টতার এমন ভয়ংকর সয়লাব দেখা দেয়, যার সামনে কোন কিছুই টিকতে পারছিল না। ঘটনাপ্রবাহ আর পরিস্থিতির দমকা হাওয়ার তার তীব্রতা আরো বাড়িয়ে তুলছিল।

তুরস্কে মোস্তফা কামাল বিপ্লব ঘটায়। খিলাফাত বিলু্প্তির ঘোষণা দেয়। ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে পৃথক করে। আর এমন দেশে এ পরিবর্তন ঘটায়, কয়েক বৎসর পূর্বেও সারা দুনিয়ার দৃষ্টিতে যে দেশটা ছিল আমীরুল মু’মিনীনের কেন্দ্রস্থল ও আস্তানা। তুর্কী সরকার বিপ্লবের তোড়ে এতটা বয়ে যায় যে, জীবনের সমস্ত বিকাশই সে বদল করে ফেলে।

জামেয়া মিছরিয়া গণশিক্ষা কেন্দ্রের পরিবর্তে এখন সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়। এর শাসন-শৃংখলা এখন রাষ্ট্রের হাতে। এবং বেশ কিছু নিয়মিত কলেজকে এর অধীনে আনা হয়। এ সময় অনেক মন-মানসে উচ্চতর গবেশণা আর বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনের অভিনবত্ব সওয়ার হয়। আর এ ধারণার প্রাণসত্ত্বা ছিল এই যে, ধর্মের নাম-গন্ধ মুছে না ফেলে এবং ধর্ম থেকে গৃহীত সামাজিক ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা না করে বিশ্ববিদ্যালয় সেক্যুলার হতে পারে না। সুতরাং পাশ্চাত্য থেকে আমদানী করা বস্তুবাদী চিন্তাধারা পুরোপুরী গ্রহণ করতে বিশ্ববিদ্যালয় উদগ্রীব হয়ে উঠে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আর ছাত্র উভয়ই লিপ্ত হয়ে পড়ে নাস্তিকতায় এবং বিসর্জন দেয় সকল নৈতিক বন্ধন।

এ সময় ডেমোক্রেটিক পার্টিরও ভিত্তি স্থাপন করা হয়, কিন্তু জন্মের পূর্বেই তার গর্ভপাত ঘটে। এ পার্টির কর্মসূচী এ ছঅড়া আর কিছুই ছিল না যে, তৎকালের প্রচলিত অর্থে স্বাধীনতা আর গণতন্ত্রের বাণী ছড়াতে হবে অর্থাৎ নাস্তিকতা আর লাগামহীনতা ছড়াতে হবে।

আল মানাখ সড়কে তথাকথিত গবেষণা একাডেমী স্থাপন করা হয় আর এক দল থিওসফিষ্টের উপর এর দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয়। এতে এমনসব ভাষণ দেয়া হয়, যাতে সমস্ত প্রাচীন ধর্মের উপর আক্রমণ চালানো হয় এবং এক নতুন ধর্ম আর নতুন ওহীল সুসংবাদ শুনানো হয়। মুসলমান আর ইহুদী-খৃষ্টানদের সমন্বয়ে এক জগাখিঁচুড়ি ছিল এর বক্তা। সকল বক্তা এ নতুন দর্শন প্রচার করতো বিভিন্ন উপায়ে।

অনেক বই-পুস্তক আর পত্র-পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এসবের এক একটি সূত্র থেকে এমন দর্শন প্রকাশ পায়, যার লক্ষ্য ছিল দ্বীনের যে কোন প্রভাবকে দুর্বল করা, বা মানুষের মন থেকে তা সম্পূর্ণ মুছে ফেলা, যাতে এসব নতুন লেখক-সাহিত্যিকদের চিন্তাধারা অনুযায়ী জাতি সত্যিকার আযাদী ভোগ করতে পারে।

কায়রোয় বেশ কিছু বড় বড় বাড়ীতে ‘সেলুন’ খোলা হয়। এখানে যারা গমন করতো, তারা এসব চিন্তাধারাই ছড়াতো। যুব সমাজ এবং অন্যান্য শ্রেণীর মধ্যে তা ছড়ানো হতো।

প্রতিক্রিয়া

আল-আযহার এবং অন্যান্য ইসলামী কেন্দ্র আর সংস্থায় এসব চিন্তাধারার তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। কিন্তু সাধারণ মানুষ দু’শ্রেণতে বিভক্ত ছিল। যুব সমাজ নতুন চিন্তাধারার প্রতি ছুটে আসে। আর অজ্ঞ-মূর্খরা এ ব্যাপারে চিন্তাও করতে পারেনা। কারণ, তাদেরকে পথ দেখাবার লোকের অভাব। এ দৃশ্য দেখে আমি ভীষণ বিচলিত বোধ করি। আমার চক্ষু দেখতে পাচ্ছিল যে, আমার প্রিয় মিশরীয় জাতির সামাজিক জীবন দু’টি বস্তুর মধ্যখানে টলটলায়মান। একদিকে ছিল সেই প্রিয় আর মহামূল্যবান ইসলাম, যা তারা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছে। তারা ছিল যার হেফাযতকারী, যার ভালোবাসা তাদের রগ-রেশায় মিশে আছে, যার পরিবেশে তারা জীবন যাপন করেছে আর যার বদৌলতে চৌদ্দশ বৎসর থেকে তারা সম্মান লাভ করে আসছে। আর অন্যদিকে ছিল পাশ্চাত্যেল তীব্র হামলা, যা ছিল সব ধরনের কার্যকর আর ধ্বংসাত্মক অস্ত্রে সুসজ্জিত- অর্থ-সম্পদের অস্ত্র, বাহ্যিক চাকচিক্যের অস্ত্র, সুখ-সম্ভোগের অস্ত্র, শক্তি-সামর্থ্যের অস্ত্র এবং প্রোপাগান্ডার উপকরণের অস্ত্র।

দারুল উলূম, জামেয়ে আযহার এবং অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের কাছে প্রকাশ করে আমার মনের এ তীব্র জ্বালা কিছুটা হালকা হতো। শায়খ হামেদ আসকারিয়্যাহ, শায়খ হাসান আব্দুল হামীদ, হাসান আফেন্দী ফযলিয়া, আহমদ আফেন্দী আমীন, শায়খ মুহাম্মদ বাশার, মুহাম্মদ সলীম আতিয়অ, কামাল আফেন্দী লুব্বান (এরা তখন ছিল ল কলেজের ছাত্র), ইউসুফ আফেন্দী লূব্বান, আব্দুল ফাত্তাহ কীরশাহ, ইবরাহীম আফেন্দী মাদকুর, সৈয়দ আফেন্দী নছর হেজাযী, ভাই মুহাম্মদ আফেন্দী শারনূব এবং কায়রোয় হোছাফী ভাইদের মধ্যে শিক্ষিত শ্রেণী। এরা ছিলেন সেসব পবিত্র আত্মার অধিকারী ব্যক্তি, যারা নিজ নিজ মজলিশে উপরোক্ত পরিস্থিতি সম্পর্কে মত প্রকাশ করতেন। আর তা প্রতিরোধে এক তীব্র ইসলামী আন্দোলন গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতেন। এসব আলাপ-আলোচনা মনের ব্যাথা কিছুটা হালকা হরতো এবং মানসিক ব্যাকুলতা দূর করার উপকরণ সরবরাহ করতো।

মাফতাবা সালাফিয়ায় যাতায়াতও মনের জন্য সান্ত্বনার কারণ ছিল। তখন এ মাসতাবা ছিল আপীল কোর্টের নিকটে। মর্দে মু’মিন, মহান বীর আলেম, অনলবর্ষী বক্তা এবং ইসলাম প্রেমিক সাংবাদিক সাইয়্যেদ মুহিউদ্দীন আল খতীবের সঙ্গে সেখানে সাক্ষাৎ হতো। (‘আলফাতাহ’ নামে ইনি প্রথম শ্রেণীর একটা সাপ্তাহিক পত্রিকা নিজের সম্পাদনায় প্রকাশ করতেন। মিশরে সংস্কার আন্দোলন আর ইসলামী জাগরণ সৃষ্টিতে তাঁর বিরাট ভূমিকা রয়েছে। আমি ১৯৬৪ সালে মিশরে মাকতাবা সালাফিয়ায় তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। ১৯৬৬ সালে তিনি ইনতিকাল করেন- খলীল হামেদী)। সেখানে অন্যান্য বড় বড় আলেমদের সঙ্গেও সাক্ষাৎ হতো। যেমন মহান ওস্তাদ সাইয়্যেদ মুহাম্মদ আল-খিযির হুসাইন (তাঁকে মিশরের সবচেয়ে বিচক্ষণ আলেম মনে করা হতো। জেনারেল নজীবের শাসনামলে আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের রেক্টরও ছিলেন। ফিকহ এবং দাওয়াত বিষয়ে তিনি অনেক গ্রন্হ রচনা করেছেন। কাদিয়ানীদের সম্পর্কে এক দীর্ঘ প্রবন্ধ রচনা করেছেন। মিশরীয় আলেমদের মধ্যে ইনিই প্রথম এ বিষয়ে লিখনী ধারণ করেন- খলীল হামেলী)। ওস্তাদ মুহাম্মদ আহমদ আলগামরাবী, আহমদ তাইমুর পাশা, আব্দুল আযীয পাশা প্রমুখ। শেষোক্ত দু’ব্যক্তি ছিলেন আপীল আদালতের আইন উপদেষ্টা। এদের কথাবার্তা থেকেও মনের ক্ষোভ কিছুটা উপশম হতো। দারুল উলূমেও যাতায়াত ছিল। ওস্তাদ সৈয়দ রশীদ রেজার মজলিশেও উপস্থিত হতাম। শায়খ আব্দুল আযীয খাওলী এবং শায়খ মুহাম্মদ আল- আদবীল মতো মহান ব্যক্তিত্বের সঙ্গে সেখানে সাক্ষাৎ হতো। দেশ আর মিল্লাতের অবস্থা সম্পর্কেও এখানে আলাপ-আলোচনা হতো। ইসলাম বিরোধী ষড়যন্ত্র বানচাল করায় সাইয়্যেদ রশীদ রেজার বিরাট ভূমিকা রয়েছে। (তাঁকে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম মুজাদ্দিদ মনে করা হয় (খলীল হামেদী)।

ইতিবাচক চেষ্টা

কিন্তু এ পরিমাণ চেষ্টা যথেষ্ট ছিল না। বিশেষ করে নতুন ভাবধারা যখন তীব্র হয়ে দেখা দিয়েছে। আমি গভীরভাবে উভয় শিবির নিরীক্ষণ করছিলাম। নাস্তিকতা আর আধুনিকতার শিবির শক্তি সঞ্চয় করছিল আর ইসলামী শিবির দিন দিন দুর্বল হচ্ছিল। আমার অস্থিরতা তীব্র হয়ে উঠছিল। মনে পড়ে, সে বৎসর রমযান মাসের অর্ধেক সময় অনিদ্রায় কাটে। তীব্র অস্থিরতা আর পরিস্থিতি নিয়ে ক্রমাগত চিন্তা ভাবনার কারণে চোখের ঘুম উড়ে যায়। আমি কোন ইতিবাচক কাজ করার সংকল্প করি। মনে মনে বলি: মুসলিম নেতাদের উপর কেন এ দায়িত্ব অর্পন করবো না? কেন আমি তাদেরকে সজোরে ঝাঁকুনী দিয়ে বলবো না যে, এ সয়লাব রোধে ঐক্যবদ্ধভাবে তাদের এগিয়ে আসা উচিত। তাঁরা মেনে নিলে ভালো কথা, অন্যথায় আমি কোন ব্যবস্থা করবো।

শায়খ দাজবীর খেদমতে

আমি শায়খ ইউসুফ দাজবীর লেখা অধিকন্তু পড়তাম। ইনি ছিলেন সুন্দর চরিত্রের অধিকারী, মিষ্টভাষী এবং সরলমনা মানুষ। সূফী সুলভ মানসিকতার কারণে তাঁর সঙ্গে আমার আত্মিক সম্পর্ক ছিল, যার ফলে আমি তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে বাধ্য হতাম। কখনো কাছরুশ শাওক-এ তাঁর বাসভবনে, আবার কখনো আল-আযহার চত্বরে ‘আতফা আদ দুয়াইদারী’তে। আমি জানতাম যে, ইসলামী শিবিরের অনেক আলেম আর বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে শায়খের সম্পর্ক এবং শিবিরের অনেক আলেম আর বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে শায়খের সম্পর্ক এবং যোগাযোগ রয়েছে এবং তারা শায়খকে বেশ ভালোবাসেন। আমি সিদ্ধান্ত নেই যে, শায়খের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আমার মনের কথা বলবো এবং ইসলামী ঐক্য গড়ে তোলার জন্য তাঁর সহায়তা কামনা করবো। একদিন সন্ধ্যঅয় ইফতার করার পর তাঁর খেদমতে হাজির হই। সেখানে একদল আলেম এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গও উপস্থিত ছিলেন। তাদের মধ্যে একজন বিশিষ্ট ব্যক্তির নাম এখনো আমার স্মরণ আছে। তাঁর নাম আহমদ বেক কামেল। এরপর আর কখনো তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়নি।আমি শায়খের সম্মুখে পরিস্থিতির পূর্ণ চিত্র তুলে ধরি। তিনিও অনেক দুঃখ ও ক্ষোভ ব্যক্ত করেন এবং এই নতুন ব্যাধির লক্ষণগুলো এক এক করে উল্লেখ করেন এবং মুসলিম মিল্লাতের মধ্যে তা ছড়ানোর ফলে যেসব অশুভ ফল দেখা দেয়, তারও উল্লেখ করেন। এরপর ইসলামী শিবিরের কথাও বলেন, যারা ষড়যন্ত্রকারীদের সম্মুখে দুর্বল এবং অসহায় হয়ে পড়েছে। নয়া ভাবধারা রোধে আল আযহারের চেষ্টা-সাধনারও উল্লেখ করেন, কিন্তু তা রোধ করতে পারেনি।

‘নাহদাতুল ইসলাম’ তথা ইসলামের পুনর্জাগরণ সংগঠনের কথাও বলেন। অন্যান্য আলেমদেরকে নিয়ে শায়খ নিজেই এ সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন। কিন্তু সে চেষ্টাও ফলবতী হয়নি। খৃষ্টান মিশনারী এবং নাস্তিকদের বিরুদ্ধে আল-আযহারের চেষ্টা-সাধনার কথাও উল্লেখ করেন। জাপানে অনুষ্ঠিত ধর্ম সম্মেলন এবং এ সম্মেলনে প্রেরিত শায়খের পুস্তিকা সম্পর্কেও আলোচনা করা হয়। এসব কথার সারবস্তু এই যে, সব রকম চেষ্টা করে দেখা হয়েছে, কোন ফল হয়নি। মানুষ নিজেকে নিয়ে চিন্তা করবে এবং এ সয়লাব থেকে নিজেকে রক্ষা করবে এটাই এখন মানুষের জন্য যথেষ্ট। আমার মনে পড়ে, তিনি দৃষ্টন্তস্বরূপ একটা কবিতা পাঠ করেন। অনেক দৃষ্টান্তের ক্ষেত্রেই তিনি এ কবিতাটি উল্লেখ করেন। একবার একটা কার্ডে তিনি আমাকে কবিতাটি লিখেও দেন। কবিতাটি এইঃ

**********************************

কে মরলো আর কে ধ্বংস হলো। আামার কোন পরওয়া নেই, যদি আমার নাফস আমায় অনুসরণ করে, নিজের শক্তির জন্য।

সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য শায়খ আমাকেও দীক্ষা দেন। তিনি বলেন, কাজ করে যাও এবং ফলাফল আল্লাহর হাতে ছেড়ে দাও। আল্লাহ প্রত্যেককে কেবল ততটুকু দায়িত্ব দেন, যতটুকুর সাধ্য আর সামর্থ্য তার রয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই শায়খের কথা আমার ভালো লাগেনি। আমার মানসিক উত্তাপ বেড়ে যায়। আমার চোখের সম্মুখেই নেচে উঠে আমার মিশনের ব্যর্থতার ভয়ংকর চিত্র। এটা স্পষ্ট যে, এসব নেতাদের মধ্যে যার সঙ্গেই আমি সাক্ষাৎ করি, তার কাছ থেকে যদি এমন জবাবই শুনতে হয়, তবে ব্যর্থতা আর হতাশা ছাড়া অন্য কোন ফল পাওয়া যাবে না। আমি গর্জনের স্বরে শায়খকে বলি: জনাব, আপনি যা কিছু বলছেন, আমি তার তীব্র বিরোধিতা করি। আমার ধারণা, ব্যাপার ইচ্ছার দুর্বলতা, চেষ্টা না করা এবং দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া ছাড়া আর কিছুই নয়। আপনারা কোন বস্তুটাকে ভয় পান? সরকারকে? নাকি আল-আযহারকে? সরকারী পেনশন ভোগ করতে চাইলে ঘরে বসে আরামে তা ভোগ করুন। আর ইসলামের জন্য কাজ করতে চাইলে মাঠে নেমে দেখুন, জাতি আপনাদের সঙ্গে রয়েছে। এরা মুসলিম জাতি। আমি তাদেরকে দেখেছি মসজিদে, কফি শপে, সড়কে আর ফুটপাথে। সর্বত্র আমি তাদেরকে দেখতে পেয়েছি ঈমানে পরিপূর্ণ। কিন্তু এ বিরাট শক্তিকে উপেক্ষা করা হচ্ছে। এসব নাস্তিক আর আধুনিকতাবাদীদের এমনকি মূল্য রয়েছে? তাদের পত্র-পত্রিকা বের হচ্ছে এ জন্য যে, আপনারা অবচেতন হয়ে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছেন। আপনারা জেগে উঠলে তারা গর্তে প্রবেশ করবে। শ্রদ্ধেয় ওস্তাদ, আপনারা আল্লাহর জন্য কিছু করতে না চইলে অন্তত: দুনিয়ার জন্য কিছু করুন। যে রুটি আপনারা ভক্ষণ করছেন, তার জন্য কিছু করুন। কারণ, এ জাতির মধ্য থেকে ইসলাম নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলে আযহারও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে, নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে আলেম সমাজও। আপনারা ইসলামের বাগান রক্ষা করতে না পারলে অন্তত: নিজেদের স্বত্ত্বাতো রক্ষা করবেন। আখেরাত বানাতে না চাইলে অন্তত: দুনিয়াতো বানাবেন। অন্যথায় আপনাদের দুনিয়াও বরবাদ হবে, আর আখেরাতও হবে হাতছাড়া।

ভীষণ জোশ, উত্তেজনা আর তীব্র ভাষায় আমি কথা বলছিলাম। আমার কথাগুলো ছিল জ্বলেপুড়ে যাওয়া আর আহত হৃদয়ের প্রতিধ্বনী। উপস্থিত ব্যক্তিবর্গের মধ্যে জনৈক মওলবী সাহেব ক্ষিপ্ত হয়ে দাঁড়ান এবং তীব্রভাবে আমার বিরোধিতা শুরু করেন। তিনি আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন যে, আমি শায়খের সঙ্গে বেয়াদবী করেছি এবং তাঁর শানের পরিপন্হী বাকধারা অবলম্বন করেছি। বরং আমি আল-আযহারের আলেমদের শানেও বেয়াদবী করেছি। আর এভাবে আমি নিজেই ইসলামেরও অবমাননা করেছি। ইসলাম এক বড় শক্তিশালী এবং বিজয়ী দ্বীন। ইসলাম কখনো দুর্বল হবে না। কারণ, স্বয়ং আল্লাহ নিজেই ইসলামকে হেফাযত করার দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন।

আমি মওলবী সাহেবের কথার জবাব দেয়ার আগেই আহমদ বেক কামেল- যার কথা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে- উঠে দাঁড়ান এবং বলেন:

“মওলানা! না, তা হতে পারে না কিছুতেই। এই নওজোয়ান ঠিক কথা বলছে। আপনাদের কর্তব্য হচ্ছে জেগে উঠা এবং বেরিয়ে পড়া। আর কতকাল হাতের উপর হাত রেখে বসে থাকবেন? এ নওজোয়ান আপনাদের কাছে কেবল এটাই চাচ্ছে যে, ইসলামের খাতীরে আপনারা ঐক্যবদ্ধ হবেন। সমাবেশের জন্য আপনাদের কোন জায়গার প্রয়োজন হলে আমার ঘর হাজির আছে। তা আপনাদের দখলে দেবো। সেখানে আপনারা যা ইচ্ছা করতে পারেন। অর্থের প্রয়োজন হলে মুসলমানদের মধ্যে বিত্তবান লোকের অভাব নেই। কিন্তু আপনারা মিল্লাতের নেতা। আমরা আপনাদের পেছনে থাকবো। এসব অন্তসারশূন্য কথাবার্তায় এখন আর কোন কাঝ হবে না”।

আমি পাশে বসা একজনকে জিজ্ঞেস করি: এ কোন মর্দে মু’মিন? লোকটি আমাকে কেবল তাঁর নাম বলেছিলেন, যা আজও অন্তরে গেঁথে আছে। কিন্তু এরপর আর তাঁর দেখা পাইনি। আমাদের এ মজলিশ দু’টি দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। একদল ছিল হযরত মওলানার সমর্থক। আর অপর দল ছিল আহমদ বেক কামেল- এর সমর্থক। শায়খ দাজবী খামুশ হয়ে বসে থাকেন। এরপর তিনি এ ঝগড়া থামাবার চিন্তা করে বলেন: যাই হোক, আল্লাহর নিকট দোয়া করি, তিনি এমন কাজের তাওফীক দান করুন, যাতে তাঁর সন্তুষ্টি রয়েছে। সন্দেহ নেই যে, সকলের ইচ্ছা এটাই যে, কাজ করা হোক, সকল কাজের চাবিকাঠি তো আল্লাহর হাতে। আমার মনে হয় এখন শায়খ মুহাম্মদ সায়াদের সঙ্গে দেখা করার সময় হয়েছে। চলুন, তাঁর সঙ্গে দেখা করে আসি।

আমরা সকলে শায়খ মুহাম্মদ সায়াদের বাসায় গমন করি। তাঁর বাসা ছিল শায়খ দাজবীর বাসার নিকটেই। আমার চেষ্টা ছিল শায়খ দাজবীর কাছাকাছি বসার, যাতে প্রয়োজনে তাঁর সঙ্গে কথা বলা যায়। শায়খ মুহাম্মদ সায়াদ রমযানুল মুবারকের ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি সকলের মধ্যে বিতরণ করেন। শায়খ মিষ্টি নেয়ার জন্য এগিয়ে যান। আমিও তাঁর কাছে আসি। তিনি যখন দেখলেন যে, আমিও তাঁর কাছে বসেছি, তখন বললেন, কে তুমি? বললাম, আমি অমুক। তিনি বললেন: তুমিও এসেছ আমাদের সঙ্গে? বললাম: জ্বি, জনাব। কোন সিদ্ধান্তে না পৌঁছা পর্যন্ত আমি আপনাদের থেকে পৃথক হবো না। শায়খ এক মুষ্টি মিষ্টি আমার হাতে তুলে দিয়ে বললেন, “নাও। ইনশাআল্লাহ আমরা কিছু ভেবে দেখবো”। আমি বললাম, “সুবহানাল্লাহ। জনাব, এখন আর বেশী চিন্তা করার সময় নেই। কাজ করার দরকার। এটাই হচ্ছে সময়ের দাবী। এসব ফল আর মিষ্টির লোভ আমার থাকলে এক দুই ক্রোশ দিয়ে দোকান থেকেই তা কিনে নিতে পারতাম আর ঘরে বসেই আরামে তা খেতাম। আপনার সঙ্গে দেখা করার জন্য এত কষ্ট করতে হতো না। জনাব!  ইসলামের বিরুদ্ধে এক ঘোরতর যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে, কিন্তু ইসলামের সমর্থক আর নাম উচ্চারণকারী আর মুসলমানদের ইমাম ও নেতারা মিষ্টি নিয়ে ব্যস্ত। আপনারা কি মনে করছেন, যে কান্ড কারখানা আপনারা শুরু করেছেন, আল্লাহ সে জন্য হিসাব নেবেন না? আপনারা ছাড়া ইসলাম আর মুসলমানদের অন্য কোন নেতা থাকলে আমাকে তাদের নাম বলূন। তাদের ঠিকানা দিন। আমি তাদের কাছে যাবো। হতে পারে, আপনাদের কাছে পাইনি, এমন কিছু আমি তাদের কাছে পাবো”।

গোটা মহফিল নীরব। ভয়ংকর নীরবতা ছেয়ে গেছে। শায়খ দাজবীর চক্ষু অশ্রুবিগলিত। চক্ষের পানিতে তাঁর দাঁড়ি সিক্ত হয়ে গেছে। উপস্থিত ব্যক্তিদের মধ্যে আরো কেউ কেউ কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। শায়খ নীরবতা ভেদ করে দৃপ্তকণ্ঠে বললেন: ভাই আমি কি করবো? আমি বললাম, ব্যাপারটা সহজ। আল্লাহ তা’আলা কাউকে সাধ্যের অতীত কষ্ঠ দেন না। আমি কেবল এটুকু চাই যে, আলেম, প্রভাবশালী এবং সম্ভান্ত ব্যক্তিবর্গ, যাদের অন্তরে দ্বীনের দরদ আছে, এমন লোকদের একটা তালিকা আপনি প্রস্তুত করুন। তারা একত্রে বসে চিন্তা করবেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে তাঁদের কি করা উচিত। নাস্তিকতা আর ধর্মহীনতার ধ্বজাধারী পত্র-পত্রিকার বিরুদ্ধে কোন সাপ্তাহিক পত্রিকা হলেও প্রকাশ করুন। তাদের বিষাক্ত বইয়ের জবাবে কোন বই প্রকাশ করুন। এমন সংগঠন গড়ে তুলুন, যাতে যুব সমাজ যোগ দিতে পারে। ওয়ায আর প্রচারের অভিযান তীব্র করতে পারেন। এমন অনেক কাজ করা যায়”। শায়খ বললেন: বেশ ভালো কথা। এই বলে খাবার পাত্র সরিয়ে কাগজ-কলম তলব করে বললেন: লেখ। অনেক নাম নিয়ে আলোচনা করে শেষ পর্যন্ত বড় বড় আলেমদের এক দীর্ঘ তালিকা প্রস্তুত করি। এরমধ্যে কয়েকটা নাম এখনো আমার মনে আছে। স্বয়ং শায়খ দাজবী (১৯১৯ সালে মিশরে ইংরেজ বিরোধী বিদ্রোহে শায়খ দাজবীও অংশগ্রহণ করেন এবং আযহারী আলেদের মধ্যে এ বিদ্রোহ তাঁর নাম ছিল তালিকার শীর্ষে), শায়খ মুহাম্মদ খিযির হোসাইন, শায়খ আব্দুল আযীয জাবেশ (জামালূদ্দীন আফগানী এবং শায়খ মুহাম্মদ আব্দুহুর উত্তরসূরী মনে করা হয় তাঁকে। সাংবাদিকতা এবং শিক্ষা-দীক্ষার মাধ্যমে ইসলামী পুনর্জাগরণের ক্ষেত্রে তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। সারা জীবন তিনি মিশরের স্বাধীনতা এবং ওসমানী খেলাফতের অধীনে মুসলিম জাহানের ঐক্যের জন্য চেষ্টা করে গেছেন। আল ইসলাম দ্বীনুল ফিতরাহ (ইসলাম স্বভাবধর্ম) নামে তাঁর একটা চমৎকার গ্রন্হ রয়েছে- খলীল হামেদী)। শায়খ আব্দুল ওয়াহহাব নাজ্জার, শায়খ মুহাম্মদ আল খিযরী (ইনি বহু গ্রন্হের প্রণেতা। রাসূলের জীবনী বিষয়ে ‘নূরুল ইয়াকীন ফী সিরাতির রাসূলিল আমীন’ এবং ‘মুহাদারাতুন ফী তারীখিল উমামিল ইসলামিয়া’ নামে ইসলামের ইতিহাস বিষয়ে তাঁর একটা বিরাট বক্তৃতার সংকলন রয়েছে। এ ছাড়া ‘তারীখুত তাশরীইল ইসলামী’ নামে ইসলামী ফিকহের একটা নির্ভরযোগ্য গ্রন্হও তিনি প্রণয়ন করেছেন- খলীল হামেদী) শায়ক মুহাম্মদ আহমদ ইবরাহীম এবং শায়খ আব্দুল আযীয খাওলী প্রমুখ। আল্লাহ তা’আলা এদের সকলের প্রতি রহমত নাযিল করুন।

সৈয়দ মুহাম্মদ রশীদ বেজার নাম উল্লেখ করলে শায়খ দাজবী বলেন: লিখ লিখ। তাঁর নাম অবশ্যই লিখবে। এটা কোন খুঁটিনাটি বিষয় নয় যে, আমরা তাতে বিরোধ করবো। বরং এটা হচ্ছে ইসলাম আর কুফরের সমস্যা। শায়খ রশীদ রেজা তাঁর লিখনী, জ্ঞান আর পত্রিকার মাধ্যমে ইসলামকে রক্ষা করতে পারেন। শায়খ রশীদ এবং শায়খ দাজবীর মধ্যে কোন কোন বিষয়ে বিরোধ আর দ্বিমত রয়েছে। এরপরও শায়খ দাজবীর পক্ষ থেকে শায়খ রশীদের ইসলামী খেদমতের পক্ষে এটা একটা ভালো সার্টিফিকেট। সম্মানিত এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের মধ্যে যাদের নাম লিখা হয়; আহমদ তাইমুর পাশা, নাসীম পাশা, আবু বকর ইয়াহইয়া পাশা, মুতাওয়াল্লী বেক গানীম, আব্দুল আযীয বেক মুহাম্মদ- এখন যাকে আব্দুল আযীয পাশা মুহাম্মদ বলা হয় এবং আব্দুল হামীদ বেক সাঈদ। এরা ছাড়া আরো অনেকের নাম লিখা হয়। এরপর শায়খ বললেন: এখন এটা তোমার দায়িত্ব, এদের মধ্যে যাদেরকে তুমি জান, তাদের কাছে যাও। আর যাদেরকে আমি জানি, তাদের কাছে আমি যাবো। এক সপ্তাহ পরে আমরা পুনরায় মিলিত হবো ইনশাআল্লাহ।

আমরা বেশ কয়েক দফা মিলিত হই এবং এসব জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিদের সমন্বয়ে ইসলামী আন্দোলনের একটা ভিত রচিত হয়। ঈদুল ফিতরের পর এসব বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ পরস্পর বৈঠকে বসেন এবং ‘আল-ফাতাহ’ নামে একটা শক্তিশালী সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এ পত্রিকার প্রধান সম্পাদক ছিলেন শায়খ আব্দুল বাকী সারওয়ার নাঈম আর ম্যানেজার ছিলেন সাইয়্যেদ মুহিবুদ্দীন আল খতীব। পরবর্তীকালে এর সম্পাদনা এবং ব্যবস্থাপনা উভয় দায়িত্বই ন্যস্ত হয় সাইয়্যেদ মুহিব্বুদ্দীন আল খতীবের উপর। এবং তিনি পত্রিকাটিকে বেশ উন্নত করেন। মূলত: এ পত্রিকাটি ছিল শিক্ষিত যুব সমাজের জন্য আলোর মশাল।

আমার দারুল উলুম ত্যঅগ করার পরও এরা সক্রিয় ছিলেন। একদল নিষ্ঠাবান তরুণ ছিল এদের মূল শক্তি। এই প্রচেষ্টা আর তৎপরতাই পরবর্তীকালে ‘জমিয়তে শুব্বান আল মুসলিমীন’ বা ‘মুসলিম যুব সংগঠন’ নামে আত্মপ্রকাশ করে।

রচনার বিষয়বস্তু

আমাদের শ্রদ্ধেয় ওস্তাদ শায়খ আহমদ ইউসূফ নাজাতী- আল্লাহ তা’আলা তাঁকে নেক প্রতিদান দান করুন- রচনা লিখার জন্য মজাদার বিষয়বস্তু নির্বাচনে তিনি ছিলেন বেশ আগ্রহী। এ বিষয়ে তিনি আমাদের সঙ্গে বেশ কৌতুক করতেন এবং নানা মজার মজার কথা বলতেন। আমাদের দীর্ঘ রচনা সংশেঅধন করতে করতে তিনি ক্লান্ত হয়ে গেলে রচনার খাতাগুলো হাতে নিয়ে দাঁড়াতেন, যেন খাতার বোঝায় তিনি নুয়ে পড়ছেন। এ সময় তিনি বলতেন: মওলবীরা! এই নাও তোমাদের রচনার খাতা আর তা সকলের মধ্যে বন্টন করে দাও। বৎস্যগণ! মধ্যপন্হা অবলম্বন করবে। সংক্ষেপে লেখার মধ্যেই লেখার পান্ডিত্য। খোদার কসম করে বলছি, তোমাদের রচনার দৈর্ঘ্য-প্রস্থ আমি কখনো পরিমাপ করে দেখি না।

আমরা হাসিতে গড়িয়ে পড়তাম এবং কপিগুলো ছাত্রদের মধ্যে বন্টন করে দিতাম। ১৯২৭ সাল ছিল আমার শেষ শিক্ষাবর্ষ। এ উপলক্ষে শায়খ নাজাতী রচনা লিখার যে বিষয়গুলো আমাদের জন্য ঠিক করে দেন, তার একটা ছিল: শিক্ষা জীবন শেষ করার পর তোমার সবচেয়ে বড় আকাংখা কি? বিস্তারিত লিখ এবং সে আকাংখা বাস্তবায়িত করার জন্য তুমি কি উপায় অবলম্বন করবে, তা-ও আলোচনা কর।

এ বিষয়ে আমি লিখি:

যেসব সৎ স্বভাবের লোক মানুষের কল্যাণ আর পথ প্রদর্শনের মধ্যেই নিজের সৌভাগ্য সন্ধান, আমার বিশ্বাস, তারাই সর্বোত্তম মানুষ। মানুষের কষ্ট দুর করে তাদেরকে আনন্দ দান করার মধ্যেই তারা নিজের আনন্দ খুঁজে পায়। মানুষের সংস্কার- সংশোধনের পথে কোরবানীকেই তারা গনীমত মনে করে। আর সত্য ও হিদায়াতের পথে- এ কথা জেনেও যে, এ পথ কন্টকাকীর্ণ এবং কঠিন- পরীক্ষার মধ্য দিয়েই এ পথ পাড়ি দিতে হয়- জেহাদেই তারা আনন্দ পায়। এটাকেই তারা মনে করে সুখের। মানুষের অন্তরের গভীরে প্রবেশ করতঃ তাদের ব্যাধি সম্পর্কে জানার চেষ্টা করে। আর যেসব বিষয় মানব জীবনের স্বচ্ছ, ফোয়ারাকে কলূষিত করে এবং মানুষের আনন্দকে দুঃখে পর্যবসিত করে তোলে, সমাজের বাহ্যিক অবস্থায় উঁকি মেরে সেসব বিষয় সম্পর্কে জানার চেষ্টা করে। এরপর এমন ব্যবস্থাপত্র প্রণয়ন করে, যা মানুষের পবিত্রতায় সংযোজন করে এবং তার আনন্দ বৃদ্ধি করে। মানুষের প্রতি ভালোবাসার অনুভূতিই তার মধ্যে এসব কাজের আকর্ষণ সৃষ্টি করে। তাই সে চেষ্টা চালায় অসুস্থ ব্যক্তিদেরকে সুস্থ করে তোলার জন্য, সংকুচিত বক্ষকে প্রশস্ত করা আর মুষড়ে পড়া আত্মাকে সজীব করে তুলতে। যে মুহূর্তে সে মানুষকে স্থায়ী অস্থিরতার হাত থেকে উদ্ধার করতঃ সুখের পথে এনে দাঁড় করায়, তার চেয়ে সৌভার্গের মুহূর্ত তার জন্য আর কিছুই হতে পারে না।

 আমি বিশ্বাস করি, যে কাজের ক্রিয়অ কর্তার স্বত্ত্বা অতিক্রম করে না, যে কাজের ফল অন্যদের নিকট পৌঁছে না, সে কাজ অসম্পূর্ণ, অকিঞ্চিৎকর এবং তুচ্ছ। সর্বোত্তম আর সবচেয়ে মহৎ কাজ হচ্ছে তা, যার ফলাফল কর্তা নিজেও ভোগ করতে পারে এবং তার আত্মীয়-স্বজন আর স্বজাতির লোকরাও তার দ্বারা উপকৃত হতে পারে। কাজের ফলাফল যত ব্যাপক আর সুদূরপ্রসারী হবে, কাজটা হবে ততই মহৎ এবং মূল্যবান। এ বিশ্বাস আর দর্শনের ভিত্তিতেই আমি শিক্ষকতার পথ বাছাই করে নিয়েছি। আমার মতে, শিক্ষক শ্রেণী হচ্ছেন সে উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা, যা থেকে বিপুল জনগোষ্ঠী আলো লাভ করে এবং মানুষের ভিড়ের মধ্যেও তারা পথের সন্ধান খুঁজে পায়। যদিও শিক্ষকরা হচ্ছেন সে বাতির মতো, যা নিজে জ্বলে যায়, কিন্তু অন্যদের জন্য আলেঅর ব্যবস্থা করে যায়।

আমি বিশ্বাস করি, যে মহৎ উদ্দেশ্যকে মানুষের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা উচিত এবং যে মহত্তর লাভের জন্য তার সর্বাত্মক চেষ্টা-সাধনা করা উচিত, তা হচ্ছে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। অর্থাৎ আল্লাহ তা’আলা মানুষকে তার পবিত্র পরিমন্ডলে অন্তর্ভুক্ত করে নেবেন, যিনি মানুষকে তাঁর ভালোবাসার বিশেষ পোশাক পরাবেন এবং তাকে জাহান্নামের আযাব আর নিজের গযব থেকে দুরে রাখবেন। এ উচ্চতর লক্ষ্যপানে যে ব্যক্তি মুখ করে, তাকে সংঘাতের পথ অতিক্রম করতে হয়। এ সংঘাত দু’টি পথের। এ দু’টি পথের প্রতিটির রয়েছে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ও স্বকীয়তা। এ দু’টি পথের মধ্যে যেটি ইচ্ছা সে বাছাই করে নিতে পারে।

প্রথম পথটা হচ্ছে সঠিক তাসাউউফের পথ। এর সারকথা হচ্ছে: ইখলাস তথা নিষ্ঠা আর আমল তথা কর্ম। ভালো-মন্দ সব রকম মানুষের সঙ্গে অন্তরকে জড়িত করা থেকে বিরত রাখা। এ পথটি সংক্ষিপ্ততর এবং অধিক নিরাপদ।

দ্বিতীয় পথটা হচ্ছে শিক্ষা দান আর পথ প্রদর্শনের। ইখলাস আর আমলে প্রথম পথটার সঙ্গে এ পথের মিল রয়েছে। কিন্তু মানুষের সঙ্গে মেলামেশা, তাদের অবস্থা যাচাই করা, তাদের সমাজে অংশগ্রহণ এবং তাদের ব্যাধিকর জন্য কার্যকর ব্যবস্থা-গ্রহণ- এসব হচ্ছে এমন বিষয়, যা এ পথকে প্রথমোক্ত পথ থেকে পৃথক করে। কিন্তু এ দ্বিতীয় পথটা আল্লাহর নিকট বেশী উত্তম ও মহত্বপূর্ণ। কুরআন মজীদ এ পথকেই উত্তম বলে অভিহিত করে। আর রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ পথের ফযীলত ও গুরুত্ব স্পষ্ট করে ব্যক্ত করেছেন। তাসাউউফের পথ মাড়াবার পর অধিকতর কল্যাণ আর বেশী ফযীলতের কারণে এখন আমি এ দ্বিতীয় পথটাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছি। আর এ জন্য যে, যে ব্যক্তি জ্ঞানে ধন্য হয়েছে আর কিছুটা প্রজ্ঞা-বিচক্ষণতা যার মধ্যে আছে, তার জন্য দ্বিতীয় পথটা অবলম্বন করাই অধিক সমীচীন এবং অতি উত্তমঃ

**********************************

“যাতে তারা স্বজাতিকে সতর্ক করতে পারে, যখন তাদের কাছে ফিরে যায়, যেন তারা রক্ষা পেতে পারে”। (তাওবা: ১২২)।

আমি দেখতে পাচ্ছি যে, আমার জাতি-সামাজিক এবং রাজণৈতিক কারণে পাশ্চাত্য সভ্যতা, ইউরোপের অনুকরণ, ব্স্তুগত দর্শন আর ফিরিঙ্গীদের অনুকরণের প্রভাবের ফলে- নিজেদের দ্বীনের লক্ষ্য- উদ্দেশ্য এবং নিজেদের কিতাবের দাবী সম্পর্কে অজ্ঞতায় ডুবে যাচ্ছে। নিজেদের পুর্ব পুরুষের শান- শওকত আর কীর্তি ভূলে বসছে। অজ্ঞতা- মুর্খতার কারণে সত্য দ্বীনে অনেক অসত্য আকীদা-বিশ্বাস আর চিন্তা-ধারার সংমিশ্রণ ঘটানো হয়েছে। মুসলিম জাতি আজ গোলক ধাঁধায় নিমজ্জিত। দ্বীনের প্রোজ্জ্বল আলোক আর তার আসল এবং সাদাসিদা শিল্প আজ তাদের চোখের সম্মুখে প্রচ্ছন্ন। মধ্যখানে নানা আজেবাজে চিন্তার আবরণ অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসবের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে দৃষ্টি ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে আর চিন্তা হয়ে পড়ে স্থবির। সুতরাং সাধারণ মানুষ অজ্ঞতার অন্ধকারে হাবুডুবু খাচ্ছে। যুব সমাজ আর শিক্ষিত শ্রেণী বিস্ময় আর সংশয় তাদের আকীদা-বিশ্বাসকে বিকৃত করেছে এবং তাদের ঈমানকে করেছে অবিশ্বাসে পর্যবসিত।

আমার দর্শন এই যে, মানব মন স্বভাবতই ভালোবাসা প্রিয়। তার জন্য এমন সত্ত্বা অপরিহার্য, যার কাছে সে মনের আবেগ আর ভালোবাসা ব্যক্ত করতে পারে। আমি সে বন্ধুর চেয়ে অধিক ভালোবাসার কেন্দ্র অন্য কাউকে মনে করি না, যার হৃদয়ের সঙ্গে আমার হৃদয় একাকার হয়েছে। আমি তার জন্য ভালোবাসার ডালি পেতে দিয়েছি এবং তাকেই ভালোবাসার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছি।

এসব বিষয়ে আমার বিশ্বাস এমনই গভীর এবং সুদৃঢ় যে, আমার অন্তরের গভীরে তার শিকড় প্রোথিত। তার শাখা-পল্লব প্রসারিত আর তার পাতা সবুজ-সতেজ। এখন বাকী আছে কেবল তার ফলবান হওয়া। শিক্ষা জীবন শেষে সবচেয়ে বড় যে আকাংখাটা আমি কার্যকর করতে চাই, তা দু’ভাগে বিভক্ত।

বিশেষ আকাংখাঃ আমার পরিবার- পরিজন আর আত্মীয়-স্বজনের কল্যাণ সাধন এবং প্রিয় বন্ধর সঙ্গে সমান সমান সদ্ভাব বজায় রাখা, যতটা আমার সাধ্যে কুলায়, যতটা আমার অবস্থা অনুমতি দেয় এবং যে পরিমাণ আল্লাহ আমাকে শক্তি দেন। (এখানে, পূর্ববর্তী প্যারায় এবং অতীত পৃষ্ঠাগুলোর স্থানে স্থানে বন্ধু বলতে তিনি মাহমুদিয়অর আহমদ সাকারীকে বুঝিয়েছেন। আহমদ সাকারী ছিলের ছাত্রজীবনে ইমাম হাসানুল বান্নার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। পরবর্তীকালে ইখওয়ানুল মুসলিমুন প্রতিষ্ঠা লাভ করলে আমহদ সাকারীকে এর প্রথম সেক্রেটারী জেনারেল মনোনীত করা হয়। ৪/৫ বৎসরে মধ্যে একটা শক্তি হিসাবে ইখওয়ান আত্মপ্রকাশ করে এবং দেশের রাজনীতিতেও অংশগ্রহণ করে। এ সময় আহমদ সাকারী তলে তলে ওয়াফাদ পার্টির সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের ইঙ্গিতে ইখওয়ানের মারাত্মক ক্ষতি সাধনের পরিকল্পনা গ্রহণ করলে তাকে ইখওয়ান থেকে বহিষ্কার করা হয়- অনুবাদক)।

সাধারণ আকাংখা: আমি হবো একজন শিক্ষক এবং পথপ্রদর্শক। দিনের সময়টা এবং বৎসরের বেশীরভাগ অংশ আমি শিশুদের শিক্ষা দানের কাজে ব্যয় করবো আর রাত্রিবেলা ছাত্রদের পিতামাতাকে শিক্ষঅ দেবা যে, দ্বীনের লক্ষ্য উদ্দেশ্য কি? তাদের সৌভাগ্যের উৎস কোথায় এবং তাদের আনন্দের রহস্য কোথায় নিহিত। বক্তৃতা আর কথাবার্তার মাধ্যমে হোক বা গ্রন্হ রচনা এবং লিখনী চালনার মাধ্যমে, অথবা নানা স্তানে পরিভ্রমণের মাধ্যমে।

প্রথমোক্ত আকাংখাটি পূরণ করার জন্য আমি নিজের মধ্যে উপকার চেনার স্পৃহা এবং নেকীর কদর করার অনুভূতি প্রস্তুত করেছিঃ

**********************************

“অনুগ্রহের বিনিময় অনুগ্রহ ছাড়া কিছুই নেই”। (সূরা আর রাহমানঃ ৬০)।

আর দ্বিতীয় আকাংখাটি চরিতার্থ করার জন্য আমি দু’টি নৈতিক অস্ত্র প্রস্তুত করেছি: দৃঢ়তা এবং ত্যাগ ও কোরবানীর স্পৃহা। একজন সংস্কারকের জন্য এ দু’টি অস্ত্র সজ্জিত, সে কখনো এমনভাবে পরাভূত হতে পারে না, যা মর্যাদাকে ভূলুণ্ঠিত করতে পারে, বা করতে পারে তার চেহারাকে ধূলায় ধূসরিত। এছাড়া আমি কিছু বাস্তব উপকরণেরও ব্যবস্থা করেছি। যেমন উচ্চশিক্ষা। আমি চেষ্টা করবো, যাতে সরকারী কাগজপত্রের মাধ্যমে এ শিক্ষার সনদপত্র লাভ করা যায়। যারা এ দর্শন গ্রহণ করে এবং এ দর্শনের পতাকাবাহীদেরকে ভালোবাসে, তাদের সঙ্গে পরিচয় করা। মৃত্তিকার দেহ, যা জীর্ণ-শীর্ণ হওয়া সত্ত্বেও কঠোর পরিশ্রমে অভ্যস্ত এবং সামর্থ না থাকা সত্ত্বেও কষ্ট করতে ভালবাসে। জীবন, যা আমি আল্লাহর হাতে বিক্রয় করে দিয়েছি। ইনশাআল্লাহ এটা একটা সফল-স্বার্থক সওদা। আল্লাহর নিকট দরখাস্ত, তিনি এ সওদা কবুল করুন এবং তা পরিপূর্ণ করার হিম্মত দান করুন। উপরন্তু দেহ-প্রাণ উভয়কেই কর্তব্য অনুধাবন করার তাওফীক দান করুন এবং সে সাহায্য আর মদদ দ্বারা ধন্য করুন, যা আমি পাঠ করে থাকি তাঁর বাণীতে:

**********************************

তোমরা আল্লাহর সাহায্য করলে তিনিও তোমাদেরকে সাহায্য করবেন এবং তোমাদের পদযুগল দৃঢ় রাখবেন। (সূরা মুহাম্মদঃ ৭)।

এ রচনা আমার এবং আমার পালনকর্তার মধ্যে এক চুক্তিপত্র। নিজের উপর বাধ্যতামূলক করে আমি স্বহস্তে এ চুক্তিপত্র লিখছি। আর আমার ওস্তাদকে করছি এ চুক্তিপত্রের সাক্ষী। সেখানে বিবেক ছাড়া আর কিছুই প্রভাব বিস্তার করতে পারে না; আর রাতের অন্ধকারে থাকলেও যেখানে সূক্ষ্মদর্শী আর সর্বজ্ঞ স্বত্ত্বা ছাড়া আর কারোই জানার উপায় নেইঃ

**********************************

“আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে কৃত অঙ্গীকার পূরণ করবে, অবিলম্বে আল্লাহ তাকে দান করবেন মহা প্রতিদান”। (সূরা ফাতহ: ১০)। ওস্তাদ হাসান ইউসূফ নাজাতী আমার এ রচনা স্থানে স্থঅনে সংশোধন করেন। মনে পড়ে, এ রচনার জন্য তিনি আমাকে ভালো নাম্বার দিয়েছিলেন- দশের মধ্যে সাড়ে সাত।

রচনায় যে বন্ধর প্রতি ইঙ্গত করা হয়েছে তিনি হচ্ছেন ওস্তাদ আহমদ সাকারী। আমার আবেগ- অনুভূতিতে তিনি সর্বদা শরীক ছিলেন। এমনকি দোকান আর কাজ-কারবার দ্বারাও সহায়তা করেন। বাহীরার জেলা শিক্ষা বোর্ডে তিনি সরকারী চাকুরী গ্রহণ করেন এ চিন্তা করে যে, ছাত্রজবীন শেষে আমিও শিক্ষা বিভাগে চাকুরী নিয়ে সেখানে গমন করবো আর এভাবে আমরা একসঙ্গে বাস করবো। কিছুদিন পরে আল্লাহ তা’আলা এ কামনা পূরণ করেন। আমি শিক্ষা বিভাগে চাকুরী গ্রহণ করি। আহমদ সাকারীও বদলী হয়ে সেখানে গমন করেন। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর অবশেষে আমরা উভয়ে কায়রোয় একত্র হই।

দারুল উলূমের স্মৃতি

এটা আমার শেষ বর্ষ। দারুল উলূম থেকে ডিপ্লোমা পরীক্ষার প্রস্তুতিতে আমি পুরোদমে ব্যস্ত। কিছুদিনের মধ্যেই আমাকে এ বিদ্যাপীঠ ছাড়তে হবে- এ চিন্তা মনে জাগলে আমার মনে জাগতো এ প্রতিষ্ঠানের প্রতি ভয়ানক আকর্ষণ আর সহপাঠীদের ভালোবাসা খেলতো মনে। আমি কখনো এ কথা ভুলতে পারবো না যে, আমি কখনো কখনো দারুল উলূমের মসজিদে আল মুনীরা এবং দারুল উলূমের মধ্যখানে বা পাঠকক্ষের এক কোণে চিন্তিত মনে দাঁড়িয়ে থাকতাম এবং দারুল উলূম ও দারুল  উলূমের বাসিন্দাদের প্রতি এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকতাম ভীষণ আগ্রহ নিয়ে। আল্লাহর নবী যথার্থই বলেছেনঃ

**********************************

“তুমি যাকে ইচ্ছা ভালোবাসো। শেষ পর্যন্ত তোমাকে তা ছেড়ে যেতে হবে”।

শ্রেণীকক্ষে ওস্তাদ বুদাইর বেক-এর সঙ্গে যেসব মনোমুগ্ধকর কথাবার্তা চলতো, তাও ভুলবার মতো নয়। স্কুল কর্তৃপক্ষ আরবী সাহিত্য আর রচনা শিক্ষার ভার তাঁর উপর অর্পণ করলে তিনি অতীব বিষণ্ন হয়ে আমাদের কক্ষে আসেন। আমি তখন তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। তিনি বললেন, জান, আল্লাহ তা’আলা তোমাদেরকে এমন দুঃখজনক ঘটনায় জড়িত করেছেন, যার কোন তুলনা নেই। বললাম, তা কেমন? বললেন: তৃতীয় বর্ষের আরবী সাহিত্য পড়ানোর দায়িত্ব বুদাইর-এর গলায় লটকানো হয়েছে। বিশেষ করে আব্বাসী যুগের সাহিত্য। এটা আরবী সাহিত্যেরই একটা অংশ। এ সম্পর্কে আমার তেমন কিছুই জানা নেই। আমি কি তোমাদেরকে এমন ওস্তাদের কথা বলবো, যিনি এ বিষয়ে দক্ষ। তিনি হচ্ছেন ওস্তাদ নাজাতী। তোমরা তাঁর কাছে যাও এবং কর্তৃপক্ষের নিকট দাবী জানাও এ কাজ থেকে আমাকে অব্যাহতি দিতে। বিশ্বাস কর, আমি তোমাদেরকে ভালো পরামর্শ দিচ্ছি। আমরা ওস্তাদ বুদাইর-এর চাপলূসী শুরু করি, ঠিক সেভাবে, যেভাবে করতে পারে ছাত্র শিক্ষকের জন্য। কিন্তু তাঁর জবাব ছিল: আমার নাফসের ব্যাপারে আমাকে ধোঁকা দেবে না। আমি আমার নিজেকে তোমাদের চেয়ে বেশী জানি এবং তোমাদের স্বার্থও আমি ভালো করে জানি। তোমাদের জন্য মঙ্গল ছাড়া আর কিছুই আমি কামনা করি না। শেষ পর্যন্ত আমরা ওস্তাদ বুদাইর-এর পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করি। প্রিন্সিপালের নিকট গমন করে উপরের প্রস্তাব তাঁর নিকট পেশ করলে তিনি মেনে নেন। বাস্তবে হয়েছেও তাই। আমরা ওস্তাদ নাজাতী দ্বারা অনেক উপকৃত হতে পেরেছি এবং ওস্তাদ বুদাইর-এর এহেন ভদ্র ভূমিকার জন্য তাঁর অনেক শুকরিয়া আদায় করি। আল্লাহ তা’আলা তাঁর উপর রহমতের পুষ্প বর্ষণ করুন।

কায়রোয় ওস্তাদ ফরীদ বেক বেজদীল বাসভবনও একটা অবিস্মরণীয় স্মৃতি। আমি ছিলাম আল-হায়াত পত্রিকার পাঠক। ইসলাম এবং ইসলামী তমদ্দুন বিষয়ে তাঁর লেখা অনেক গ্রন্হ আমি পাঠ করেছি। বিশেষ করে আমি ছিলাম তাঁর দায়েরাতুল মা’আরফিল ইসলামিয়া (ইসলামী বিশ্বকোষ) গ্রন্হের একজন ভক্ত। কায়রোয় অবস্থানের পর থেকেই আমি তাঁর বাসায় গনম করা শুরু করি। তখন তাঁর বাসা ছিল খালীজ মিছরী এলাকায়। আব্বাজানের সঙ্গে ফরীদ বেজদীর ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। তাঁর বাসায় জ্ঞানী-গুণীজনদের সমাবেশ ঘটতো। আসরের পর অনেকেই সেখানে একত্র হতো। আগে নানা পান্ডিত্যপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা হতো। পরে সকলে মিলে বেড়াতে বের হতেন। অধিকন্তু এসব গুণীজনদের সমাবেশে আমিও উপস্থিত হতাম জ্ঞান লাভের আগ্রহ নিয়ে। এ মজলিশে একদিন একটা বিষয়ে ওস্তাদ ফরীদ বেক-এর সঙ্গে আমার মতবিরোধ হয়। ওস্তাদ ফরীদ বেক-এর বন্ধু ওস্তাদ আহমদ বেক আবু সাতীতও এ মতবিরোধে তাঁকে সমর্থন করে। বিষয়টা ছিল রূহ হাজির হওয়া সম্পর্কিত। ফরীদ বেক-এর মতে যেসব রূহ হাযির হয়, তা স্বয়ং মৃত ব্যক্তিদেরই রূহ। কিন্তু আমার মত ছিল এর বিপরীত। এ বিষয়ে আমাদের বিতর্কের মধ্য দিয়ে অনেক কিছু জানার সুযেগ হয়। অবশেষে উভয়ে স্ব-স্ব মতে অটল থেকে বিতর্কের অবসান ঘটাই। এসব মূল্যবান আসর থেকে আমি অনেক উপকৃত হয়েছি।

কায়রোয় এমনই ছিল আমার জীবনধারা। শায়খ হোছাফীর বাসা বা আলী আফেন্দী গালিব-এর বাসায় যিকর-এর মহফিলে অংশ গ্রহণ, মাকতাবা-ই সালফিয়া গমন এবং সাইয়্যেদ মুহিবুদ্দীন আল-খতীবের সঙ্গে সাক্ষাৎ, দারুল মানার এবং সৈয়দ রশীদ রেজার নিকট যাতায়াত, শায়খ দাজবীর বাসায় উপস্থিত এবং ফরীদ বেজদীর জ্ঞানের মজলিশে অংশগ্রহণ, আবার কখনো দারুল কুতুব- এর বিশাল চত্বরে আবার কখনো শায়কুন মসজিদের চাটাই-এ।

ডিপ্লোমা লাভ

পরীক্ষার দিন আসে এবং অতিক্রান্ত হয়ে যায়। ফলও প্রকাশিত হয়। ১৯২৭ সালের জুলাই মাসে আমি দারুল উলূম থেকে ডিপ্লোমা লাভ করি। মৌখিখ পরীক্ষার ঘটনা ভুলবার মতো নয়। পরীক্ষা দেয়ার জন্য আমি কমিটির সম্মুখে উপস্থিত হই। ওস্তাদ আবুল ফাতহ উলফতী আর ওস্তাদ নাজাতীর সমন্বয়ে এ কমিটি। পদ্য-গদ্যের বিশাল ভান্ডার আমি মুখন্ড করে নিয়েছিলাম। ১৮ হাজার কবিতা, গদ্যের কলেবরও ছিল প্রায় অনুরূপ। তোরফা ইবনে লবীদ-এর গোটা মোয়াল্লাকা আমার মুখস্ত ছিল। কিন্তু মুয়াল্লাকার একটা মাত্র কবিতা এবং নেপোলিয়ান সম্পর্কে শাওকীর ৪টা কবিতা সম্পর্কে আমাকে প্রশ্ন করা হয়। ওমর খাইয়্যম সম্পর্কেও কিছু জিজ্ঞাসা করা হয়। কেবল এটুকুই। পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য আমি যে কঠোর পরিশ্রম করেছি, সে জন্য আমার মনে কোন দুঃখ নেই। কারণ, পরীক্ষার জন্য নয়, জ্ঞান লাভের জন্য আমি এ পরিশ্রম করেছি।

স্কলারশীপ না চাকুরী

আমি দেখতে পাই, কিছু বন্ধু বৈদেশিক স্কলারশীপের জন্য দরখাস্ত করছে। এ স্কলারশীপ ছিল ডিপ্লোমা পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকারীর হক। কিন্তু দু’টি কারণে এ ব্যাপারে ইতস্তত ছিল। প্রথম কারণ: আরো জ্ঞান অর্জনের আগ্রহ। এ জন্য যদি ইউরোপ বা চীন দেশেও গমন করতে হয়। জ্ঞান মু’মিনের হারানো ধন। যেখানেই পাওয়া যায়, অন্যদের তুলনায় সে জ্ঞানের বেশী হকদার। দ্বিতীয় কারণ; বাহ্যিক জাঁকজমক থেকে দূরে থাকা। আর এ চিন্তা তাৎক্ষণিক বাস্তবায়নের জন্য যে আগ্রহ আমার মন-মগজে বিস্তার লাভ করেছিল, অর্থাৎ ইসলামের শিক্ষার দিকে ফিরে আসার আহ্বান এবং পাশ্চাত্য সভ্যতার অন্ধ অনুকরণ আর পাশ্চাত্য সংস্কৃতির বার্হ প্রকরণের সৃষ্ট বিকৃতি রোধে সুসংগঠিত আন্দোলন গড়ে তোলা। এ ইতস্তত: আর দোদুল্যপনা থেকে স্বয়ং দারুল উলূমই আমাকে মুক্তি দিয়েছে। কারণ এ বৎসর বৈদেশিক স্কলারশীপের জন্য দারুল উলুম কারো না প্রস্তাব করেনি। এখন কেবল চাকুরীর পথই অবশিষ্ট রয়েছে। আমার ধারণা ছিল সরকারী চাকুরী কায়রোর স্কুলের বাইরে যাবে না। কিন্তু এ বৎসর পাশ করা ছাত্রের সংখ্যা ছিল বেশী, আর শিক্ষা বিভাগ যে শিক্ষক চেয়েছে, তাদের সংখ্যা ছিল অনেক কম। শিক্ষা বিভাগ কেবল আটজন লোক চেয়েছে। আর বাকীদেরকে ছেড়ে দিয়েছে প্রাদেশিক বোর্ডের দয়ার উপর। এ অবস্থায় কায়রো কিসমতে জুটেনি। কেবল দুজনের ক্ষেত্রে- প্রথম এবং দ্বিতীয়- বিশেষ নির্দেশ জারী করা হয়েছে। এ হিসাবে ইসমাঈলিয়া আমার ভাগ্যে জুটেছে আর আলেকজান্দ্রিয়া ভাগ্যে জুটেছে ওস্তাদ ইবরাহীম মাদকূরের। ইনি পরে ড. ইবরাহীম মাদকূর বলে পরিচিত হন (পরবর্তীকালে তিনি কুয়েত বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিকহে ইসলামীর শিক্ষক হন। ফিকহ শাস্ত্রের মূলনীতি বিষয়ে রচিত তাঁর গ্রন্হাবলী বেশ প্রসিদ্ধি লাভ করেছে- খলীল হামেদী)। রাজনৈতিক ক্যরিশমার ফলে তিনি আলেকজান্দ্রিয়া থেকে ওদফুজা গমন করতে বাধ্য হন। কিন্তু তিনি ইস্তফা দিয়ে নিজের খরচে উচ্চতর ডিগ্রী লাভের জন্য ইউরোপ গমন করেন। অবশ্য পরবর্তীকালে তাঁকে সরকারী স্কলারশীফ প্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত করে নেয়া হয়। ভাগ্য আমাদের অপর ৬ জন বন্ধুকে দক্ষিণ মিশরের আবহাওয়ার হাতে ছেড়ে দিয়েছে।

আমার নিযুক্তিতে আমি হতভম্ব হই। কারণ, আমি ভালোভাবে এটাও জানতাম না যে, ইসমাঈলিয়অ কোনদিকে অবস্থিত। আমি শিক্ষা দফতরে গমন করতঃ এ নিযুক্তির জন্য আপত্তি জানাই। শ্রদ্ধেয় ওস্তাদ আব্দুল হামীদ বেক হাসানীর সঙ্গে মুখোমুখী বিতর্কও করি। তিনি হাসি-কৌতুক দ্বারা আমার ক্রোধ উপশম করেন। তিনি শায়খ আব্দুল হামিদ আল-খাওলীরও আশ্রয় নেন। এ সময় ইসমাঈলিয়ার কৃতি সন্তান ওস্তাদ আলী হাসবুল্লাহও উপস্থিত ছিলেন। ওস্তাদ আব্দুল হামীদ বেক এ দু’জন দ্বারা সাক্ষ্য দান করান যে, ইসমাঈলিয়া আল্লাহর ভালো শহরগুলোর অন্যতম। সেখানে অনেক সুখ-শান্তি আমার ভাগ্যে জুটবে। আমার বেশ ভালো লাগবে। শান্ত শহর। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা। অধিক খাদ্যশস্য উৎপাদনে ইসমাঈলিয়া নামকরা এলাকা। আমি দফতর থেকে ফিরে এসে আব্বাজানের সঙ্গে পরামর্শ করলে তিনি বললেন, আলা বারাকাতিল্লাহ- আল্লাহর নাম নিয়ে চলে যাও। আল্লাহ যা পছন্দ করেন, তা-ই উত্তম। তাঁর কথায় আমান মন ভরে যায় এবং আমি সফরের প্রস্তুতি গ্রহণ করি। এ সফরে আল্লাহর হেকমতের যে রহস্য লুক্কায়িত ছিল, পরে তা ভালোভাবে প্রকাশ পেয়েছে:

**********************************

“আল্লাহ তাঁর পয়গাম কোথায় রাখবেন, তা তিনিই ভালো জানেন”। (সূরা আনআমঃ ১২৪)

আমি আল্লাহর নাম নিয়ে রওয়ানা হই। সেখানে গিয়ে দাওয়াতের জন্য কোন রীতি অবলম্বন করবো- এ চিন্তায় আমার মন বিভোর ছিল। কারণ, আমার মনে এখন পাকা- পোক্ত ইচ্ছা যে, আমি ইসমাঈলিয়ায় দাওয়াত আর সংস্কারের কাজ শুরু করবো আর ভাই আহমদ আফেন্দী সাকারী মাহমুদিয়ায় এ মিশনের দায়িত্ব নেবেন। দু’জন বিজ্ঞ বন্ধু শায়খ হামেদ আসকারিয়া এবং শায়খ আব্দুল হামিদকে আমরা কায়রোর জন্য রেখে এসেছি। প্রথমোক্ত জন আল-আযহারের উচ্চ ডিগ্রী গ্রহণের পর যাকাযীক-এ ওয়ায়েয নিযুক্ত হন এবং সেখানে তিনি দাওয়াতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। আর শেষোক্ত জন আরো উচ্চতর ডিগ্রী নেয়ার পর কাফার আদ দাওয়ার-এ স্বাধীনভাবে চাষাবাদ কার্য শুরু করেন। এর সঙ্গে তিনি দাওয়াতের দায়িত্বও পালন করেন। আর এভাবে আমরা হয়ে যাই কবির কথার দৃষ্টান্তঃ

**********************************

আমার পরিবার-পরিজন শাম দেশে, অন্তর আমার বাগদাদে আর আমি,

রাকমাতাইন-এ পড়ে রয়েছি আর আমার প্রতিবেশী রয়েছে ফুসতাত-এ।

আমাদের প্রত্যেকে নিজ নিজ কর্মপন্হা অনুযায়ী, যার জ্ঞান আল্লাহ তাকে দান করেছেন- দাওয়াতের কাজে আত্মনিয়োগ করি। ইসমাঈলিয়া গমনের প্রায় এক বৎসর পর ইসমাঈলিয়ার মনমাতানো শান্ত-সমাহিত পরিবেশে এবং সেখানকার পূণ্যবান আর পুণ্যাত্ম্য ব্যক্তিবর্গের সহযোগিতায় ইখওয়ানুল মুসলিমূনের ভিত্তি স্থাপিত হয় এবং শাশাও খোলা হয়।

ইসমাঈলিয়ার উদ্দেশ্যে

১৯২৭ সালের ১৯ শে সেপ্টেম্বর সোমবার- আমি দুঃখিত যে, এ দিন হিজরী কোন তারিখ ছিল, তা এখন আর আমার মনে পড়ছে না- বন্ধুরা তাদের সঙ্গীকে বিদায় জানাবার জন্য সমবেত হয়। এ দিন তাদের সঙ্গী ইসমাঈলিয়া গমন করছিল। সেখানে গিয়ে অর্পিত দায়িত্বের (ইসমাঈলিয়ার সরকারী স্কুলের শিক্ষকতা) চার্জ বুঝে নেবে। তাদের এ সঙ্গী ইসমাঈলিয়া সম্পর্কে তেমন কিছু জানতো না। সে কেবল এতটুকু জানতো, এ শহরটা বদ্বীপের পূর্বে প্রান্তে অবস্থিত। তার আর কায়রোর মধ্যখানে রয়েছে পূর্ব সাহারার বিশাল বালূকাময় অঞ্চল। সুয়েজ খালের সঙ্গে লাগোয়া তিমসাহ ঝিলের নিকট অবস্থঅন এ ইসমাঈলিয়া অঞ্চলের। এ অধম বন্ধুদেরকি বিদায় জানায়। আর বন্ধুরা বিদায় জানায় এ অধমকে। বন্ধুদের মধ্যে কিছু কথাবার্তাও হয়। এদের মধ্যে মুহাম্মদ আফেন্দী শারনূবীও ছিল। বড়ই নেককার আর সৎ স্বভাবের মানুষ। কথা প্রসঙ্গে তিনি বললেন: ‘ভালো মানুষ যেখানেই অবস্থান করে, ভালো প্রভাব ফেলে। আমরা আশা করি, আমাদের বন্ধু ইসমাঈলিয়া শহরেও ভালো প্রভাব ফেলবে”। মুহাম্মদ আফেন্দী শারনূবীর এ কথাগুলো তার বন্ধুর মনে গেঁথে আছে।

সমস্ত বন্ধু বিদায় নিলে মুসাফির ভোরের ট্রেন ধরে। যোহরের সময় ইসমাঈলিয়া পৌঁছার কথা। লক্ষ্যাপানে ছুটে চলে গাড়ি। গাড়ীর মধ্যেই সাক্ষাৎ হয় একই পেশার কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে। অতি সম্প্রতিং তারাও নিযুক্তি লাভ করেছেন একই স্কুলে। আমার স্মৃতিশক্তি ভুল না করলে তাদের মধ্যে ছিলেন মুহাম্মদ বাহিউদ্দীন সনদ আফেন্দী, আহমদ হাফেয আফেন্দী, আব্দুল মজিদ ইজ্জত আফেন্দী এবং মাহমূদ আব্দুন নবী আফেন্দী। এরা সকলেই ছিলেন একই স্কুলের শিক্ষক। সুয়েজ প্রাইমারী স্কুলের জনৈক শিক্ষক বন্ধুর সঙ্গেও সাক্ষাৎ হয়। হামেদিয়অ শাযেলিয়া সিলসিলার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল। পথিক (বান্না নিজে) ইসলঅমের পুনর্জাগরণ এবং ইসলামী দাওয়াত সম্পর্কে তার নিজের চিন্তা আর আকাংখা সঙ্গীর কানে পৌঁছায়। আর এখন ডাইরীতে এ প্রতিক্রিয়া লিপিবদ্ধ করছেঃ

তার মনস্তাত্ত্বিক এবং আত্মিক অবস্থা সম্পর্কে মন্তব্য করার জন্য এ কয়েকটা মুহূর্ত যথেষ্ট নয়। অবশ্য যেটুকু ধারণা হয়েছে, তাতে বুঝা যায় যে, তাঁর বেঁচে থাকার উদ্দেশ্য হচ্ছে কাজকর্ম দ্বারা নিজের জীবনকে রক্ষঅ করা। পালনকর্তা, দ্বীন এবং আপন শায়খের সঙ্গে ভক্তি-আকীদাতকে তিনি জ্ঞান করেন সৌভাগ্যের প্রতীক বলে। তার আশপাশে ভক্তবৃন্দের ভক্তির লক্ষণ দেখে খুশী হন। অবশ্য এ অধম আদৌ এটা চায় না যে কাজকে বাঁচার উপায় করেই কেবল বেঁচে থাকতে হবে। পথচারী (বান্না নিজে) এটাও পছন্দ করে না যে, তার চিন্তাধারা কেবল নিজের স্বত্বা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকবে। ভাই-বন্ধুদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের মধ্যে সে জড়িয়ে যেতে চায় না। অন্য কিছু তাকে ব্যাকুল করে রেখেছে।

গাড়ী ইসমাঈলিয়া ষ্টেশনে পৌঁছে। মুসাফিররা চলে যায় নিজ নিজ গন্তব্যস্থলে। এ অধম সুন্দর শহর পানে উঁকি মারে। রেলওয়ে ষ্টেশনের পুল থেকে পথচারী যখন শহরের দিকে তাকায়, তখন বেশ মনোরম দেখতে পায় শহরটাকে। এ মনোরম দৃশ্য নবাগতের অন্তরকে করে তোলে বিমুগ্ধ-বিমোহিত। নবাগত মন ভরে তাকায়। এরপর ক্ষণেকের তরে চিন্তার জগতে ডুবে যায়। এ পবিত্র শহরের ললাটে তার জন্য ভালো কি লেখা রয়েছে, সে পড়ার চেষ্টা করে। সে কায়মনো বাক্যে বিনীত কণ্ঠে দোয়া করে:

“পরওয়ারদেগার! তার ভাগ্যে তাই জুটাও, যাতে কল্যাণ নিহিত রয়েছে, পাপ আর অকল্যাণ থেকে তাকে দূরে রাখ। সে মনের গভীরে অনুভব করছে। এ শহরে তার চলাফেরা সেসব লোকের চলাফেরা থেকে ভিন্ন হবে, যারা এখানে বসবাস করে বা বাইরে থেকে এখানে যাতায়াত করে”।

হোটেলে অবস্থান

পথচারী একটা হোটেলে গমন করে এবং ব্যাগটা হোটেল কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেয়। এ ব্যাগটা ছাড়া তার কাছে আর কোন মাল-সামান নেই। এখন তাকে যে স্কুলে কাজ করতে হবে, সে স্কুলে গমন করে। প্রধান শিক্ষক এবং অন্যান্য শিক্ষকদের সঙ্গে দেখা করে। তাদের সঙ্গে নানা রকম কথাবার্তা হয়। এরপর পুরাতন বন্ধু ওস্তাদ ইবরাহীম বানহাবীর সঙ্গে তার পরিচয় হয়। তিনি এ স্কুলের পুরাতন শিক্ষক। নবাগতের আগ্রহ, পুরাতন বন্ধুর সঙ্গেই সে অবস্থান করবে। তার বন্ধু নিজের পক্ষ থেকেই প্রস্তাব করেন যে, কোন সাধারণ হোটেলে অবস্থান করা-ই ঠিক হবে। অতিথি শিক্ষক তার মতের সঙ্গে একমত প্রকাশ করে। দু’বন্ধু একই কক্ষে অবস্থান করা শুরু করে। প্রথমে এক ইংরেজ মহিলা মিসেস এম গেমীর বিল্ডিং- এ একটা কক্ষ ভাড়া নেয়। এরপর সেখান থেকে জনৈকা ইটালীর মহিলা ম্যাডাম ববিনার বিল্ডিং-এ স্থানান্তরিত হয়।

বিদ্যালয় আর মসজিদে

নবাগত শিক্ষক বিদ্যালয়, মসজিদ আর কক্ষে সময় কাটায়। সে অন্য কারো সঙ্গে মেলামেশার চেষ্টা করে না। বিশেষ পরিমন্ডলের সহকর্মীদের ছাড়া অন্য কারো সঙ্গে মেলামেশার চেষ্টাও করে না সে। অবসর সময়ে সে রিয়াযাত- মুজাহাদা করে। নতুন দেশকে বুঝবার চেষ্টা করে। এখানকার অধিবাসী, এখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং এখানকার বৈশিষ্ট্য বুঝবার চেষ্টা করে। অথবা কুরআন মজীদ তিলাওয়াত এবং বই-পুস্তক পাঠে সময় কাটায়। পুরো চল্লিশ দিন এ ব্যস্ততায় সে অন্য কিছু যোগ করেনি। তার অন্তর থেকে বিদায়দাতা বন্ধর এ কথাটা ক্ষণেকের তরেও মুছে যায়নি: “ভালো মানুষ যেখানেই অবস্থান করে, ভালো প্রভাব বিস্তার করে। আমরা আশা করি, আমাদের বন্ধু ইসমাঈলিয়া শহরেও ভালো প্রভাব ফেলবে”।

ধর্মীয় বিরোধ

শহরে নবাগত এ ব্যক্তিটি মসজিদে অবস্থান করেই অনেকাংশে ইসমাঈলিয়া ধর্মীয় খবরাখবর সংগ্রহ করে। এখানকার সমাজ সম্পর্কে জানার চেষ্টা করে। সে এটাও জানতে পারে যে, এ শহরে ফিরিঙ্গীপনার প্রভাব রয়েছে। কারণ, এর পশ্চিম দিকে রয়েছে বৃটিশ শিবির আর পূর্বদিকে রয়েছে সুয়েজ ক্যানেল কোম্পানীর কর্মচারীদের কলোনী। আর শহর এ দু’য়ের মধ্যখানে আবদ্ধ। এখানকার অধিকাংশ লোক এ দু’টি স্থানে কাজ কারবার করে। ইউরোপীয় জীবনধারার সঙ্গে এদের রয়েছে ঘনিষ্ঠ সংযোগ। আর ইউরোপীয় জীবনধারার নমুনাই চতুর্দিক থেকে তাদেরকে আহ্বান জানায়।

কিন্তু এতসব কিছুর পরও এখানকার লোকজনের মনে রয়েছে মযবুত ইসলামী জযবা। এরা আলেমদের পেছনে জড়ো হয়, তাদের কথা শোনে-মানে। লেখক এটাও জানতে পেরেছে যে, ইতিপূর্বে জনৈক ইসলামপ্রিয় শিক্ষক এখানে ছিলেন। ইসলামের দর্শন সম্পর্কে শহরবাদীদের সামনে এমন কিছু কথাবার্তা ব্যক্ত করেছেন, যার সঙ্গে এদের অধিকাংশই ছিল অপরিচিত। সুতরাং শহরের কিছু আলেম এসব চিন্তাধারার বিরুদ্ধে কোমর বেঁধে দাঁড়ায়। ফলে মানুষের মধ্যে বিভেদ দেখা দেয়। এমনসব কথাবার্তার পক্ষপাতিত্ব শুরু হয়ে যায়, যার ফলে গড়ে উঠতে পারে না ঐক্য ও সংহতি। আর ঐক্য ও সংহতি ছাড়া কোন কাজ করা সম্ভব নয়।

পুনরায় কফি শপ অভিমুখে

লেখক ভাবতে থাকে, এখন কি করা যায়? বিভেদ কিভাবে দূর করা যায়। লেখক দেখতে পায়, কেউ ইসলামের কথা বলতে দাঁড়ালে এখানকার সমস্ত দল নিজ নিজ বিশ্বাসের কথা তার সামনে উপস্থাপন করে এবং সকল দলই চায় তাকে নিজেদের বোতলে ভরতে। অথবা কমপক্ষে তারা জানতে চায় যে, এ নতুন প্রচারক তাদের সমর্থক, না বিরোধী। অথচ সে চায়, সকলকে লক্ষ্য করে কথা বলতে, সকলের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করতে এবং সকলকে ঐক্যবদ্ধ করতে। কিন্তু পরিস্থিতি তার অনুকূল নয়।

এ অধম বিষয়টা নিয়ে অনেক চিন্তা করে। অবশেষে সে সিদ্ধান্ত নেয় যে, এসব দল আর ফের্কা থেকে দূরে থাকবে এবং যতদূর সম্ভব, মসজিদের ভেতরে লোকদের উদ্দেশ্যে কিছু বলা থেকেও বিরত থাকবে। মসজিদের লোকজনই বিরোধপূর্ণ কথাবার্তা ছড়ায়। সুযোগ পেলেই তারা এ বিরোধ চাঙ্গা করে তোলে। সুতরাং এ অধম মসজিদবাসীদেরকে দাওয়াতের কেন্দ্রবিন্দু করবেনা; বরং জনসংযোগের ভিন্ন উপায় সন্ধান করবে। যারা কফি শপে গনম করে, তাদেরকে কেন সম্বোধন করা হবে না?

কিছুকাল এ চিন্তা মনে জাগে। ধীরে ধীরে তা পাকাপোক্ত হয়। অতপর তাই কার্যকর করা হয়। এ উদ্দেশ্যে তিনটি বড় বড় কফি শপ বাছাই করা হয়। এসব কফি শপে হাজার হাজার লোক জড়ো হয়। প্রতিটি কফি শপে সপ্তাহে দু’টি দারস দেওয়ার প্রোগ্রাম করা হয়। এ তিনটি স্থানে নিয়মিত দারস দান শুরু হয়। শুরুতে ওয়াজ আর দারসের এহেন নুতন ধারা সকলের নিকট ছিল এক অবাক কান্ড। কিন্তু ধীরে ধীরে সকলে অভ্যস্ত হয়ে উঠে এবং বেশ আগ্রহ দেখাতে শুরু করে।

শিক্ষক তার এ নতুন ধারায় কথা বলায় বেশ মনোযোগ দেয়। সে সব সময় এমন শিরোনামকে প্রাধান্য দেয়, যাতে সে ভালোভাবে কথা বলতে পারে। উপরন্তু মৌলিক কথা থেকেও সে দূরে যায় না। আল্লাহ আর পরকাল স্মরণ করানো, নেকীর প্রতি উদ্বুদ্ধ করা এবং পাপ কাজে ভয় দেখানোর মধ্যেই সে সীমাবদ্ধ থাকে। কারো মনে কষ্ট দেয়া, কাউকে গাল-মন্দ দেয়া থেকে সে বিরত থাকে। উপস্থিত লোকজন যেসব অন্যায় আর খারাপ কাজে আসক্ত, সেসবকে সরাসরি সে মন্দ বলে না। সে চেষ্টা করে উপস্থিত লোকজনের মনে কোন না কোন উপায়ে প্রভাব বিস্তার করার। বলার ভঙ্গিও সে বেশ ছাটকাট করে এবং সহজ-সরল আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে কথা বলে সে আগ্রহ সৃষ্টি করতে চায়। প্রয়োজনে সে সহজবোধ্য ভাষারও সংমিশ্রণ ঘটায়। প্রত্যক্য অভিজ্ঞতা আর উদাহরণ দ্বারাও সে বক্তব্যকে হৃদয়গ্রাহী করে তোলে। কিচ্ছা-কাহিনীরও আশ্রয় নেয় এবং অধিকন্তু ওয়াযের ভঙ্গি অবলম্বন করে বক্তব্য বিষয়কে আকর্ষনীয় করে তোলে। এভাবে মানুষের মনকে আকৃষ্ট করার জন্য সে নানা উপায় অবলম্বন করে। তার কথার দিকে মানুষের আগ্রহ জাগ্রহত করে। মানুষকে বিরক্ত করে তোলার মতো দীর্ষ ভাষণ সে দেয় না। তার দারস দশ মিনিটের বেশী হতো না। প্রয়োজনে দীর্ষ করলে বড় জোর পনর মিনিট। এর বেশী নয়। অবশ্য সে চেষ্টা করতো এ সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে বক্তব্য বিষয়ের সব দিক তুলে ধরতে এবং শ্রোতাদের মনে তা ভালোভাবে বদ্ধমূল করতে। কুরআনের কোন আয়াত বা নবীজীর কোন হাদীস উল্লেখ করতে হলে পরিবেশ আর পরিস্থিতি অনুযায়ী তা বাছাই করতো। দরদ আর আবেগ নিয়ে তা পাঠ করতো। পারিভাষিক কথাবার্তা আর পান্ডিত্যপূর্ণ আলোচনার অবতারণা থেকে সে দূরে থাকতো। অতি সংক্ষেপে বক্তব্য স্পষ্ট করতো এবং প্রয়োজনীয় যুক্তিপ্রমাণ উপস্থাপন করই সে শেষ করতো।

ইসমাঈলিয়ার সাধারণ মানুষের মনে দাওয়াতের এ ধারা শুভ প্রভাব ফেলে। এ নিয়ে মানুষের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়। লোকজন সেসব কপিশপে ছুটে যায় এবং দারসের অপেক্ষায় থাকে। এ ধরনের কথাবার্তা শ্রোতাদের মনে আলোড়ন সৃষ্টি করে। যারা নিয়মিত শুনতো, তারা জেগে উঠে এবং চিন্তা-ভাবনা করতে বাধ্য হয়। ধীরে ধীরে অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে, তারা নিজেরাই এখন জানতে চায় যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে অর্পিত দায়িত্ব পালন এবং দ্বীন মিল্লাতের ব্যাপারে কর্তব্য পালনের জন্য এখন তাদেরকে কি করতে হবে? যার ফলে আল্লাহর আযাব থেকে তারা নাজাত পেতে পারে এবং জান্নাত লাভ নিশ্চিত হয়। শিক্ষক তাদের এসব কথার জবাব দিতে শুরু করে। কিন্তু এসব জবাব শেষ কথা ছিল না। তাদের মনের ব্যাকুলতা আরো বৃদ্ধি করার জন্য এ ধারা অবলম্বন করা হয়। সে চায় মনকে আরো প্রস্তুত করতে এবং স্পষ্ট কথা বলার জন্য উপযুক্ত সংযোগেরই অপেক্ষায় থাকতে।

বাস্তব শিক্ষা

কিন্তু সেসব পূত-পবিত্র এবং ঈমানে পরিপূর্ণ মানুষের পক্ষ থেকে শিক্ষকের উপর একের পর এক প্রশ্নের বৃষ্টি বর্ষিত হতে থাকে। এবং ভাসা ভাসা জবাব দ্বারা তাদের তৃষ্ণা দূর হয় না। বন্ধদের একটা দল পীড়াপীড়ি করতে থাকে যে, এমন কর্মপন্হা অবলম্বন করতে হবে, যা মেনে চলে তারা সত্যিকার মুসলমান হতে পারে এবং ইসলামের গুণাবলীতে নিজেদেরকে বিভূষিত করে তুলতে পারে। ইসলামের অনুভূতি তাদের অন্তরকে জাগ্রত করেছে। এখন তারা ইসলামের বিধান জানতে চায়। শিক্ষক তাদেরকে পরামর্শ দেয়- এমন কোন বিশেষ স্থান বাছাই করে নেয়ার, কফি শপের দারসের আগে বা পরে যেখানে বসে ইসলামের বিধি-বিধান সম্পর্কে সামষ্টিক পাঠ গ্রহণ করা যায়। এ উদ্দেশ্যের জন্য তাদের দৃষ্টি পড়ে এমন একটা দূরবর্তী স্থানের উপর, যে স্থানটা ব্যবহার করতে হলে কিছু মেরামত করা দরকার।

হে আল্লাহ! এ জাতির অন্তর কতইনা পূত-পবিত্র, মঙ্গল আর কল্যাণ পানে কতো দ্রুত তারা ছুটে আসতে প্রস্তুত। অবশ্য এ জন্য শর্ত হচ্ছে একজন নিষ্ঠাবান এবং পূত পবিত্র নেতা। সাথী আর বন্ধূদের মধ্যে নির্মাণ কাজের বিভিন্ন বিভাগের লোকজনও ছিল। তারা সে ঘরটির প্রয়োজনীয় মেরামতের কাজে গেলে যায় এবং তা ব্যবহারের উপযোগী করে তোলে। মাত্র দু’দিনের মধ্যে তারা এ কাজ সম্পন্ন করতঃ তাতে প্রথম সমাবেশের আয়োজন করে।

সমাবেশে যারা উপস্থিত হয়েছে, নামায আর ইবাদাত কক্ষে তাদের এই প্রথম প্রবেশ। অন্য কথায় তাদের অধিকাংশই ছিল নতুন। তারা শিখতে চায়। এ শিক্ষক তাদের সঙ্গে বাস্তব কর্মপন্হা অবলম্বন করে। তাদেরকে এবারত তথা মূল পাঠ পড়ে শুনাবার চেষ্টা করেনি, বা তাত্ত্বিক বিধঅন আর মাসআলা সারাক্ষণ তাদের সম্মুখে বলার চেষ্টাও সে করেনি; বরং সে সোজা তাদেরকে নিয়ে যায় পানির নলের দিকে। তাদের সকলকে এক সারিতে বসায় আর নিজে শিক্ষক হিসাবে তাদের সামনে দাঁড়ায়। ওযুর এক একটা বিষয় তাদেরকে শিক্ষা দেয়। তারা ভালোভাবে ওযু করা শিখে নিলে দ্বিতীয় দলকেও এভাবে শিক্ষা দেওয়া হয়। এ বাস্তব শিক্ষার ফলে ওযুর কাজ আর আদব সম্পর্কে সকলে ভালো রকমে অবগত হতে পরে। এরপর তাদের সম্মুখে ওযুর শারীরিক-মানসিক এবং পার্থিব ফযীলত বয়ান করা শুরু করে। আর হাদীস শরীফে ওযুর যেসব পূর্ণ আর সাওয়াবের কথা বলা হয়েছে, সকলের মনে তা অর্জন করার আগ্রহ জাগ্রত করে।

যেমন নবীজীর এ বাণীঃ

**********************************

“যে ব্যক্তি ভালভাবে ওযু করে, তার দেহ থেকে সমুদয়, পাপ-তাপ দুর হয়ে যায়; এমনকি তার নখের নীচ থেকেও পাপ দূর হয়ে যায়”।

অথবা নবীজীর এ হাদীসঃ

**********************************

“যে ব্যক্তি ওযু করে এবং তা ভালোভাবে সম্পন্ন করে অতঃপর দু’রাকাত নামায আদায় করে এবং নিজের অন্তর আর চেহারা তাতে নিয়োজিত রাখে, তার জন্য জান্নাত ওয়াজেব হয়ে যায়”।

এ ধরনের হাদীস দ্বারা শিক্ষক তার তরবিয়তের অধীন ভাইদের মনে মুস্তাহাব আর মুস্তাহসান কাজ করার আগ্রহ সৃষ্টি করে এবং তাদেরকে এ জন্য উদ্বুদ্ধ করে। অতঃপর শিক্ষক তাদেরকে নামাযের দিকে নিয়ে যায়। নামাযের এক একটা রোকন তাদের সামনে ব্যাখ্যা করে। এবং তাদের প্রতি আবেদন জানায় কার্যতঃ তার সামনে নামায আদায় করে দেখাবার জন্য। অতঃপর তাদেরকে নামাযের দিকে নিয়ে যায়। নামাযের এক একটা রোকন তাদের সামনে ব্যাখ্যা করে। এবং তাদের প্রতি আবেদন জানায় কার্যতঃ তার সামনে নামায আদায় করে দেখাবার জন্য। অতঃপর তাদেরকে নামাযের ফযীলত আর বরকত সম্পর্কে অবহিত করে। নামায তরক করার ভয় দেখায়। এসব কাজ করার সময় এক এক করে তাদের সঙ্গে সূরা ফাতেহা পাঠ করে মুখে মুখে এবং আগে থেকে তাদের যেসব ছোট ছোট সূরা মুখস্ত আছে, তাদের মুখ থেকে এক এক করে সূরাগুলো শুনে এবং সংশোধন করে। এসব নবাগতের সঙ্গে তার আলোচনা কেবল সেসব অবস্থা বর্ণনা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকে, যা পরিপূর্ণ থাকে আশা-নিরাশা আর ভয়-ভীতিতে। খুঁটিনাটি বিষয়ের তত্ত্ব নিয়ে সে আলোচনা করে না এবং দুর্বোধ্য পরিভাষার আশ্রয়ও সে নেয় না। ফল এ দাঁড়ায় যে, উপস্থিত লোকজনের অন্তর ইসলামের বিধান জানার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়ে যায় এবং প্রতিটি বিষয় তাদের মনে ভালোভাবে বদ্ধমূল হয়। এভাবে বিধি-বিধানের একান্ত ফিকহী দিকটাও তাদের জন্য শুষ্ক আর রসহীন থাকে না।

বিশ্বাসের প্রতি গুরুত্বারোপ

শিক্ষক তার প্রতিটি কথাবার্তা আর প্রতিটি বৈঠকেই ইসলামের সঠিক আকীদার প্রসঙ্গ তোলে, তা নিয়মিত পালন করে এবং মজবুত করে তোলার চেষ্টা চালায়। কুরআন মজীদের আয়াত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলঅইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস, সালফে সালিহীনের জীবনধারা আর ঈমানদারদের প্রসঙ্গ উত্থাপন করতঃ তাদের মন-মানসে তা বদ্ধমূলক করে তোলার উপায় অবলম্বন করে। এ ক্ষেত্রেও সে দার্শনিক তত্ত্ব আর যুক্তিবাদী দর্শনের প্রসঙ্গ উত্থাপন করে না, বরং সে সৃষ্টি লোকের মধ্যে আল্লাহ তা’আলার স্বত্ত্বার শ্রেষ্ঠত্ব- প্রাধান্য এবং মখলূকাতের মধ্যে আল্লাহর গুণাবলীর দীপ্তির প্রতি দৃষ্টি আকৃষ্ট করতঃ আখেরাতের কথা স্মরণ করায়ে দেয়। ওয়াজ-নছীহতের ধারায় এসব তত্ত্বকে সে এ পরিমাণে তুলে ধরে, যাতে এসব তত্ত্ব সম্পর্কে কুরআন মজিদের মহত্ব-শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিভাত হয়ে উঠে। উপরন্তু কোন তুল আকীদা সে তখন পর্যন্ত খন্ডন করে না, যতক্ষণ না সে মন-মানসে সঠিক ও নির্ভুল আকীদা বদ্ধমূল করে তোলে। গড়ার পর ভাঙ্গা যতটা সহজ হয়, গড়ার পূর্বে তা ততটাই কঠিন হয়। এ এক নিতান্ত সূক্ষ্মতত্ত্ব। অধিকাংশ সংস্কারক আর প্রচারকের বোধের অগম্য এ তত্ত্ব।

আলহাজ্ব মুস্তফার আঙ্গিনায়

অপর একটা আঙ্গিনাও ছিল আমাদের আশ্রয় স্থল। হাজী মুস্তফা আল্লাহর ওয়াস্তে এ আঙ্গিনা স্থাপন করেন। একদল জ্ঞানের অন্বেষক সেখানেও সমবেত হতো এবং ভ্রাতৃত্বসূলভ আর নাফসের পরিচ্ছন্নতার পরিমন্ডলে আল্লাহর আয়াত আর তাঁর সৃষ্টি তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা চলতো।

খুব বেশীদিন যেতে না যেতেই আমাদের এসব দারস আর সমাবেশের খবর দূর দূরান্তে ছড়িয়ে পড়ে। এ দারস চলতো মাগরিব আর এশার মধ্যবর্তী সময়ে। এ দারসের পর লেখক বেরিয়ে পড়তো কফি শপের অভ্যন্তরে জারী করা দারসের উদ্দেশ্যে। এখন এসব দারসে সকল স্তরের লোক বিপুল সংখ্যায় অংশ্রগহণ করতে থাকে। এদের মধ্যে বিরোধের ক্রীড়নক, তার্কিক এবং অতীত ফেৎনার চর্চাকারীরাও থাকে।

এক রাত্রে আমি উপস্থিত লোকজনের মধ্যে এক বিরল প্রাণ চাঞ্চল্য লক্ষ্য করি। ফের্কাবাযীল প্রাণচাঞ্চল্য আর লম্ফ ঝম্ফের অব্স্থা। আমি দেখতে পাই, শ্রোতারা নানা দলে বিভক্ত। এমনকি বসার আসনের ক্ষেত্রেও তারতম্য। আমি দারস শুরুই করেছি মাত্র। হঠাৎ আমাকে প্রশ্ন করা হয়ঃ

 

ওসীলা সম্পর্কে জনাবের মতামত কি?

আমি বললাম, “আমার মনে হয়, কেবল একটা বিষয়েই আপনারা আমাকে প্রশ্ন করছেন না। বরং আপনারা এটাও জিজ্ঞঅসা করবেন যে, আযানের পর দরুদ ও সালাম পড়তে হবে কিনা? জুমার বিন সূরা কাহফু তিলাওয়াত করা জায়েয কি না? তাশাহহুদে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নাম মুবারকের পর ‘সাইয়্যেদুনা’ শব্দ যোগ করা যাবে কিনা? নবীজীর পিতা-মাতা কি অবস্থায় আছেন? এখন তাঁদের ঠিকানা কোথায়? কুরআনখানীল সাওয়াব মুর্দার কাছে পৌঁছে কিনা? সুফিয়া আর তরীকতপন্হীদের বর্তমান মজলিশ পাপ, না আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাধ্যম?” আমি সেসব মতবিরোধপূর্ণ প্রসঙ্গ শুমার করা শুরু করি, অতীত ফেৎনায় যেসবকে কেন্দ্র করে ঝগড়া বাধে এবং যেসব নিয়ে মানুষের মধ্যে প্রচন্ড মাথা ফাটাফাটি হয়। প্রশ্নকর্তা আমার বক্তব্য শুনে আঙ্গুলে কামড়ায়। বলেঃ জি, আমি এ সমস্ত বিষয়ের জবাব জানতে চাই।

আমি আরয করি:

“আমার প্রিয় ভাই! আমি আলেম নই। আমি একজন শিক্ষক-দারস আর ওয়াযের প্রতি আকর্ষণ আছে, এমন একজন সাধারণ নাগরিক। কুরআন মজীদের কিছু আয়াত আমার মুখস্থ আছে। কিছু হাদীস শরীফও মুখস্থ আছে এবং কিতাব অধ্যয়ন করে দ্বীনের আহকাম আর মাসায়েল সম্পর্কে আমার কিছু জ্ঞান হয়েছে। আমি স্বেচ্ছায় মানুষকে দ্বীনের দারস দান করি। আপনারা আমাকে এসব চৌহদ্দী থেকে বাইরে নিয়ে খুবই নাজুক পজিশনে ফেলে দেবেন। কেউ যদি লা. আদরী- আমি কিছুই জানি না- বলে তবে এটাও তার একটা ফতওয়া। আমার কথা যদি আপনাদের ভালো লাগে এবং তাতে মঙ্গলের কোন দিক নজরে পড়ে, তবে দয়া করে তা শ্রবণ করবেন। আর যদি জ্ঞানে আরো সংযোজন করতে চান, তাহলে আমি ছাড়া অন্য আলেম-ফাযেল তথা বিজ্ঞ-প্রাজ্ঞ জ্ঞানী-গুণীজনের নিকট গমন করতে পারেন। যে বিষয়ে যে মাসালায় আপনাদের প্রয়োজন হয়, তারা আপনাদেরকে ফাতওয়া দেবেন। আমার জ্ঞানের দৌড় এতটা, যা আমি আপনাদের সামনে ব্যক্ত করেছি। আর আল্লাহ তা’আলা প্রত্যেক ব্যক্তি ততটা কষ্ট দেন, যতটা তার সাধ্য আর আয়ত্বের মধ্যে রয়েছে”।

প্রশ্নকর্ত আমার কৌশলের নাগালের মধ্যে এসে যায় এবং কোন জবাবই সে দিতে পারেনা। এভাবে এক অনুপম উপায়ে- যা নিতান্ত সাদাসিদা এবং কার্যকর- তাকে বিপর্যয় সৃষ্টি করা থেকে নিবৃত্ত করি। উপস্থিত শ্রোতাদের সকলে না হোক, অধিকাংশ আমার বক্তব্যে আশ্বস্ত ও তৃপ্ত হয়। কিন্তু আমিও সুযোগ হাত ছাড়া হতে দেই না। উপস্থিত জনতার প্রতি লক্ষ্য করে আমি আরয করিঃ

“প্রিয় ভাইয়েরা আমার! আমি ভালো করেই জানি যে, প্রশ্নকর্তা এবং আপনাদের মধ্যে অধিকাংশ লোক এ প্রশ্নের অন্তরালে মূলতঃ জানতে চায় যে, এ নতুন প্রচারক কোন দলের লোক? সে কি শায় মুসার দলের লোক? নাকি শায়খ আব্দুস সামী-এর দলের সঙ্গে তার সম্পর্ক রয়েছে? এ তত্ত্বানুসন্ধান আপনাদের জন্য আদৌ উপকারী নয়। এ ফেৎনা সৃষ্টি আর পার্টিবাজীতে আপনারা গোটা আটটা বৎসর ব্যয় করেছেন। এখন এখানেই শেষ করুন। এসব বিষয়ে মুসলমানরা শত শত বৎসর বিরোধ করে আসছে। এখনো তাদের মধ্যে বিরোধ বহাল আছে। আমাদের পরস্পরের ভালোবাসা এবং ঐক্য আল্লাহ তা’আলার পছন্দ। মতবিরোধ আর ফের্কাবাজী তাঁর নাপছন্দ। আমি আশা করি, আপনারা আল্লাহর সঙ্গে অঙ্গীকার করবেন যে, এসব বিতর্ক ত্যাগ করবেন এবং দ্বীনের মূলনীতি শিক্ষার চেষ্ঠা করবেন। দ্বীনের আখলাক অনুযায়ী কাজ করবেন। সাধারণ ফাযায়েলকে গলার হার বানাবেন এবং সর্বসম্মত শিক্ষা অনুযায়ী আমল করবেন। ফরয এবং সুন্নত অনুযায়ী আমল করবেন এবং খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে বিবাদ-বিসংবাদ পরিহার করবেন। এতে অন্তর আয়নার মতো পরিষ্কার হবে। আর সত্য জানাই আমাদের সকলের লক্ষ্যবস্তু হওয়া উচিত। বিশেষ কোন মতের সমর্থন করা আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত নয়। আমাদের মধ্যে এ স্পৃহা সৃষ্টি হলে আমরা এ সমস্ত বিষয়ে পারস্পরিক আস্থা আর ভালোবাসার পরিবেশে এবং ঐক্য আর নিষ্ঠার সঙ্গে মত প্রকাশ করবো। আমি আশা করি, আপনারা আমার অনুরোধ মেনে নেবেন এবং এতে দৃঢ় থাকার জন্য আমাদের মধ্যে একটা সুদৃঢ় অঙ্গীকার গড়ে উঠবে”।

আমার দরদভরা আপীল কার্যকর হয়। এ মহফিল থেকে আমরা এ অবস্থায় বিদায় নেই যে, আমরা পরস্পরে অঙ্গীকার করি সহযোগীতা আর সরল দ্বীনের খেদমতই হবে আমাদের লক্ষ্য। দ্বীনের জন্য আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করবো। বিরোধপুর্ণ বিষয় পরিত্যাগ করবো এবং এসব বিষয়ে প্রত্যেকে নিজ নিজ মতে অটল থাকবো। শেষ পর্যন্ত আল্লাহ তা’আলা তাঁর অটল ফয়সালা জারী করবেন। এরপর আল্লাহর মেহেরবানীতে দারস মতবিরোধ থেকে নিরাপদে অব্যাহত থাকে। এখন আমি প্রতিটি বিষয়ে ইমানদারদের পারস্পরিত ভ্রাতৃত্ব আর সম্প্রীতির নানা দিক নেয়েই আলোচনা করি, যাতে ভ্রাতৃত্বের অধিকার অন্তরে জাগরূক হয়। এমন অনেক বিরোধপূর্ণ বিষয়ও বাছাই করতাম, যা নিয়ে তাদের মধ্যে তেমন বিরোধ ছিল না। সকলেই যাকে সম্মানীত বিষয় বলে মনে করতো, এসব বিষয়ে আমি এ জন্য আলোচনা করতাম, যাতে সালফে সালেহীন তথা অতীতের সাধু-সজ্জনদের উদারতা আর চক্ষু এড়িয়ে চলার প্রমাণ উপস্থাপন করা যায় এবং এ কথা বলতে পারি যে, মতবিরোধপূর্ণ বিষয়ের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং তাতে একে অপরের প্রতি আমাদের উদারতা প্রদর্শন করা কর্তব্য।

একটা উদাহরণ

আমার মনে পড়ে, একদা আমি এ বিষয়ে তাদের সম্মুখে একটা বাস্তব উদাহরণ পেশ করি। আমি জিজ্ঞেস করি, আপনাদের মধ্যে কে হানাফী মযহাবের অনুসারী?

জনৈক ব্যক্তি উঠে আমার সামনে আসেন।

এরপর আমি জিজ্ঞেস করি, শাফেয়ী মযহাবের কে আছেন?

এ কথা শুনে অপর এক ব্যক্তি এগিয়ে আসেন।

আমিতাকে বলি, এরা উভয়ে এখনই আমার ইমামতিতে নামায পড়বেন। হে হানাফী, সূরা ফাতেহা পড়া সম্পর্কে তুমি কি মত অবলম্বন করবে?

হানাফী বললেন; আমি চুপ থাকবো, ফাতেহা সূরা পড়বো না।

শাফেয়কে জিজ্ঞেস করি: তুমি কোন পন্হা অবলম্বন করবে?

তিনি জবাব দেন: আমি অবশ্যই ফাতেহা পড়বো।

এরপর আমি বলি: যখন আমরা নামায শেষ করবো, তখন হে শাফেয়ী, বলুন তোমার ভাই হানাফী সম্পর্কে তোমার কি মত হবে?

তিনি বলেন: তার নামায বাতিল হবে। কারণ, সে ইমামের পেছনে ফাতেহা পড়েনি। আর ফাতেহা নামাযের অন্যতম রোকন বা অঙ্গ।

আমি হানাফীর প্রতি ইঙ্গিত করে বলি, হানাফী সাহেব, শাফেয়ী ভাইয়ের আমল সম্পর্কে আপনার কি মত?

তিনি জবাব দেন: সে মাকরূহ তাহরীমী কাজ করেছে। ইমামের পেছনে মোক্তাদীর ফাতেহা পড়া মাকরূহ তাহরীমী কাজ।

উভয়কে লক্ষ্য করে আমি বললাম: আপনারা কি একে অপরের কাজকে অন্যায় মনে করে তা নিশ্চিত করার চেষ্টা চালাবেন?

উভয়ে একমত হয়ে বলেন, কখনো না।

অন্য শ্রোতাদেরকে আমি জিজ্ঞেস করিব, আপনারা কি এদেরকে বারণ করবেন? সকলেই নেতিবাচক জবাব দেন।

আমি বলি, সুবহানাল্লাহ! এ ব্যাপারেতো আপনারা নীরবতা অবলম্বনের অবকাশ পান, অথচ: এটা নামায বাতেল হওয়া বা শুদ্ধ হওয়ার ব্যাপার। কিন্তু আপনারা এ ব্যাপারে কোন নামাযীর সঙ্গে উদারতা দেখাতে প্রস্তুত নন যে, সে নামাজে তাশাহহুদে আল্লাহুমা সাল্লি আলা মুহাম্মদ কেন পড়েছে, বা আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা সাইয়্যিদিনা মুহাম্মদ কেন পড়েছে। আর এতটুকু বিষয়কে আপনারা একটা বিরোধপূর্ণ বিষয়ে পরিণত করবেন এবং এক বিরাট হাঙ্গামা সৃষ্টি করবেন।

আমার দাওয়াতের এ ধারা বেশ কার্যকর হয়। সকলেই নিজ নিজ আচরণ পুনর্বিবেচনা করতে শুরু করে। তাদের মধ্যে এ ধারণা বদ্ধমূল হয় যে, আল্লাহর দ্বীন অনেক প্রশস্ত এবং অতি সহজ। আর এতে কোন ব্যক্তি বিশেষ বা দল বিশেষের ইজারাদারী নেই। আল্লাহ এবং রাসূলই হচ্ছেন সব কিছুর শেষকথা। অতঃপর মুসলিম দল বা ইমামের দিকে প্রত্যাবর্তন করা হবে। যদি বাস্তবিকই তাদের কোন দল বা ইমাম বর্তমান থাকে।

ইসমাইলিয়ার সমাজ

ইসমাইলিয়ায় শিক্ষকতা জীবনের প্রথম বর্ষের প্রথমার্ধের অধিকাংশ সময় এভাবেই কেটে যায়। অর্থাৎ ১৯৭২ সালের অবশিষ্ট মাসগুলো এবং ১৯২৮ সালের প্রথম দিক এভাবেই অতিবাহিত হয়। এ সময় আমার লক্ষ্য ছিল এখানকার জনগণ এবং শহরের অবস্থা সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করতঃ যেসব কার্যকারণ এ শহরে প্রভাব বিস্তার করে, তা অনুসদ্ধান করা। অনুসদ্ধান দ্বারা আমি জানতে পারি যে, এখানে চারটা শ্রেণীর কর্তৃত্ব চলছে। এক. আলেম সমাজ, দুই. তরীকতের মাশায়েখ, তিন. শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ এবং চতুর্থ. ক্লাব।

আলেম সমাজের সঙ্গে আমি বন্ধুত্ব আর পরিপূর্ণ সম্মান আর মর্যাদার রীতি অবলম্বন করি। আমি সবসময় এ চেষ্টা করি যে, দারস বা বক্তৃতা-ভাষণে কোন আলেমের সামনে আমি এগিয়ে যাই না। আমার দারস দানকালে কোন মওলবী সাহেব আগমন করলে আমি দারস ত্যাগ করে মওলবী সাহেবকে সকলের সম্মুখে উপস্থিত করি। আমার এ রীতি আলেম সমাজের মনে ভালো প্রভাব ফেলে এবং তাঁরা সব সময় আমার পক্ষে ভালো কথাই বলেছেন।

এ সময় একটা বেশ মজার ঘটনা ঘনে। জনৈক পূরাতন আযহারী শায়খ- যিনি আযহার শরীফে আযহারের প্রাচীন ব্যবস্থার অধীনে কয়েক বৎসর অতিবাহিত করেছেন, বহস আর মুনাযারায় তাঁর বেশ আগ্রহ ছিল, অজানা মাসআলা উত্থাপন করে ওয়ায়েযীন, আলেম আর দারস দানকারীদেরকে তিনি সবসময় ত্যক্ত-বিরক্তকরে তুলতেন এবং এমনসব বিষয় আর বক্তব্য নিয়ে আলোচনা করতেন, যা কিতাবের পুরাতন হাশিয়া আর সূক্ষ্ম ব্যাখ্যা থেকে গৃহীত। একদিন তিনি আমাকেও জড়াবার চেষ্টা করেন। আমি লোকদের সম্মুখে হযরত ইবরাহীম (আ)- এর কাহিনী বর্ণণা করছিলাম। উক্ত শায়খ আমার নিকট হযরত ইবরাহম (আ)-এর পিতার নাম জানতে চাইলেন। আমি হেসে তাঁকে বললাম, মওলানা শায়খ আব্দুস সালাম, আল্লাহ তা’আলা আপনার প্রতি রহম করুন, বর্ণনায় দেখা যায় যে, তার নাম ছিল তারেখ। আর আযর ছিল হযরত ইবরাহীম (আ:)-এর চাচার নাম। কুরআন বলে, আযর তাঁর পিতা। আযরকে চাচা ধরে নেয়া হলেও কোন অসুবিধা নেই। কারণ, আরবী ভাষায় চাচাকেও পিতা বলা হয়। কোন তাফসীরকার বলেন যে, আযর হচ্ছে মূর্তির নাম। হযরত ইবরাহীম (আ)-এর পিতা বা চাচার নাম নয়। উহ্য এবারতসহ আয়াতটি হবে এরকম

**********************************

“যখন ইবরাহীম আলাইহিস সালাম তাঁর পিতাকে বললেন, আযর মূর্তিকে পরিত্যাগ করুন, আপনি কি মূর্তিকে খোদা বানাবেন?”

আমি তারেখ শব্দটি রায় যের দিয়ে পড়ি। সংক্ষেপে এ কথাগুলো আমার মতো লোকের জন্য সান্ত্বনাদায়ক ছিল। তাই বলে শায়খ বিষয়টা এত সহজে ছেড়ে দিতে চাননি। তিনি বললেন:

“হযরত ইবরাহীম আলাইহিম সালামের পিতার নাম তারুখ (রা’য় পেশ দিয়ে) আর আপনি রায় যের দিয়ে তারেখ পড়েছেন”।

আমি বললাম, “ঠিক আছে। পেশ দিয়েই পড়লাম। নামটাতো আজমী- অ- আরবী শব্দ। এর সঠিক উচ্চারণ সে ভাষা জানার উপর নির্ভর করছে। আসল ব্যাপার হচ্ছে নছিহত আর শিক্ষা গ্রহণ”। উক্ত শায়খ প্রতিটি দারসেই আমার সঙ্গে অনুরূপ পরিহাস করতেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল, সাধারণ শ্রোতারা যাতে এসব অর্থহীন বিতর্কে বিরক্ত হয়ে চলে যায়। আর অর্থহীন বিতর্কের দায়-দায়িত্ব দু’জন মওলবীর উপর ন্যস্ত করা যায়। আমি শায়খের চিকিৎসার একটা উপায় অবলম্বন করি। একদিন তাঁকে আমার বাসায় দাওয়াত করি। তাঁর প্রতি ভক্তি দেখাই। ফিকহ এবং তাসাউউফ বিষয়ের দু’টি কিতাব হাদিয়া স্বরূপ তাঁর খেদমতে পেশ করি। তাঁকে আশ্বাস্ত করে বলি, যে কিতাব আপনার পছন্দ হয়, তা হাদিয়া স্বরূপ আপনাকে দান করতে আমি প্রস্তুত। হযরত শায়খ এ প্রস্তাবে আমার প্রতি বেশ সন্তুষ্ট হন। এরপর বেশ নিয়মিত তিনি দারসে শরীক হন এবং বেশ মনোযোগের সঙ্গে শোনেন। অন্যদেরকেও দারসে শরীক হওয়ার জন্য গুরুত্বের সঙ্গে দাওয়াত দেন। আমি মনে মনে বলি: রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাহ যথার্থই বলেছেনঃ

**********************************

“তোমরা পরস্পরে হাদিয়া বিনিময় করবে, একে অপরকে হাদিয়া দেবে; এর ফলে উভয়ের মধ্যে ভালোবাসার বিনিময় হবে”।

বেশ কিছুকাল এ পন্হা বেশ কার্যকর ছিল। কিন্তু মানুষের মন সবসময় ডিগবাজী খেলে।

এ শহরের অধিবাসীরা অতি সরলমনা মানুষ। এখানে আলেম আর পীরমাশায়েখদের বেশ প্রাচুর্য। আর বাইরে থেকে অনেক মাশায়েখও এখানে আগমন করেন। শায়খ হাসান আব্দুল্লাহ আল আসলামী, শায়খ আবূদ শাযেলী এবং শায়খ আব্দুল ওয়াহহাব দাদারাবী প্রমূখের মজলিশের কথা এখনো আমার মনে আছে। এ সময় শায়খ আব্দুর রহমান সা’আদ ইসমাঈলিয়া সফরে আগমন করেন। তিনি ছিলেন শায়খ হোছাফীর অন্যতম খলীফা এবং আমাদের পীরভাই। তাঁর নিয়ম ছিল এই যে, তিনি আগে দারস দিতেন, ওয়ায করতেন এবং সবশেষে যিকরের মাহফিলে নেতৃত্ব দিতেন। তিনি মসজিদে আগমন করেন। আমি তাঁকে চিনতাম না, তিনিও জানতেন না আমাকে। যিনি আগে মসজিদে দারস দেন, ওয়াজ করেন, এরপর লোকদেরকে যিকরের মহফিলে শরীক হওয়অর দাওয়াত দেন। আমি দেখতে পাই যে, এ যিকর হোছাফী তরীকার নিয়ম অনুযায়ী হচ্ছে। তাই তাঁর কাছে আমি নিজের পরিচয় দেই। কিন্তু সত্য কথা এই যে, একটা বিশেষ পদ্ধতিতে দাওয়াত বিস্তারের কোন আগ্রহ আদী আমার ছিল না। এর অনেক কারণ ছিল। সবচেয়ে বড় কারণ ছিল এই যে, অন্য সিলসিলার সমর্থকদের সঙ্গে শক্রতা-প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্ম দিতে চাই না আমি। আমি এটাও চাই না যে, আমাদের দাওয়াত মুসলমানদের কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকুক, অথবা ইসলামের সংস্কার মিশন কেবল একটা কেন্দ্রে কেন্দ্রীভূত থাকুক। বরং আমি পারিপূর্ণ চেষ্টা চালাই, যাতে আমার দাওয়াত ব্যাপক ভিত্তিক হয়। তার কেন্দ্রবিন্দু হয় জ্ঞান ও প্রজ্ঞা, তরবিয়ত আর তাযকিয়া, জিহাদ এবং আমল। আর এ তিনটি বিষয় হচ্ছে ইসলামী দাওয়াতের সবচেয়ে বড় স্তম্ভ। এরপরও যে ব্যক্তি কোন বিশেষ ধরনের তরবিয়তে তরক্কী করতে চায়, সে নিজের পছন্দ অনুযায়ী আমল করতে পারে। কিন্তু আমার এই দৃষ্টিভঙ্গি সত্ত্বেও আমি হোছাফী সিলসিলার একজন পথপ্রদর্শক শায়খ আব্দুর রহমান সা’দকে মেনে নেই, তাঁকে বিপুল অর্ভর্থনা জ্ঞাপন করি। এবং হোছাফী সিলসিলার ভক্তদেরকে দীক্ষা দেই তাঁর কাছ থেকে উপকৃত হওয়অর এবং তাঁর ওয়াজ-নছিহত শোনার জন্য। কিছুদিন অবস্থান করে শায়খ আব্দুর রহমান ফিরে যান।

এ সময় সাইয়্যেদ মুহাম্মদ হাফেয তীজানীর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। লোকজনকে বাহায়ীদের চক্রান্ত সম্পর্কে সতর্ক করার বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি ইসমাঈলিয়া আগমন করেন। কারণ, সে সময় ইসমাঈলিয়ার আশপাশে বাহায়ীরা চরমভাবে ছড়িয়ে পড়ছিল আর বাহায়ী প্রচারকরাও কোমর বেঁধে মাঠে অবতীর্ণ হয়েীছ। সাধারণ মানুষকে বাহায়ীদের সম্পর্কে সতর্ক করা, বাহায়ীদের চক্রান্তের জাল ছিন্ন করা এবং তাদের ভ্রান্ত চিন্তাধারার রহস্য উন্মোচনের ক্ষেত্রে সাইয়্যেদ মুহাম্মদ হাফেয মূল্যবান ভূমিকা পালন করেন। তাঁর জ্ঞান ও প্রজ্ঞা, দ্বীন-ইসলামের প্রতি তাঁর আগ্রহ দেখে আমি নিজেও অনেক প্রভাবিত হই। তীজানী সিলসিলা সম্পর্কে বাড়াবাড়ি আর শরীয়তের বিরুদ্ধাচরণের যেসব অভিযোগ মানুষ উত্থাপন করতো, এ প্রসঙ্গে আমি তাঁর সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করি এবং এসব কথাবার্তায় কয়েক রাত নিদ্রাহীন অবস্থায় কাটাই। এসব ফের্কার যেসব চিন্তাধারা সম্পর্কে ব্যাখখ্যার অবকাশ রয়েছে, তিনি তা ব্যাখ্যা করে কাটাতেন, আর যেসব চিন্তাধারা ইসলামের স্বচ্ছ আকীদা-বিশ্বাসের সঙ্গে সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটায়, সেসব সম্পর্কে বারণ করতেন এবং কঠোরভাবে সে সবের সঙ্গে তাঁর কোন সম্পর্ক নেই বলে প্রচার করতেন।

মোটকথা, যেসব পীর-মাশায়েখ সময়ে সময়ে ইসমাঈলিয়া আগমন করতেন, আমার নীতি এই ছিল যে, তরীকতের আদব অনুযায়ী আমি তাদের সম্মুখে নত হতাম এবং তরীকতের ভাষায়ই তাঁদের সঙ্গে কথা বলতাম। এরপর যখন তাঁদের সঙ্গে একান্তে মিলিত হতাম, তখন তাদেরকে মুসলমানদের দুঃখ ভরা কাহিনী শুনাতাম যে, কিভাবে মুসলমানরা দ্বীনের বুনিয়াদী বিষয় সম্পর্কেও বেখবর হয়ে পড়েছে। তাদের ঐক্য অনৈক্যের শিকারে পরিণত হয়েছে। দ্বীন এবং দুনিয়ার স্বার্থের হুঁশও তাদের নেই। তাদের দ্বীনও বিরাট বিপদের কবলে পতিত হয়েছে। কারণ, ধর্মদ্রোহিতা আর নাস্তিকতার সয়লাব তাদের আসল কেন্দ্রেই আঘাত হানছে। আর তাদের দুনিয়াও ধ্বংসের সম্মুখীন হয়েছে। কারণ, বিদেশী হামলাকারীরা তাদের দেশের সম্পদের উপরও অধিকার প্রতিষ্ঠা করে বসছে। ইসমাইলিয়ার পশ্চিম দিকে বৃটিশ সৈন্যদের শিবির আর পূর্বদিকে সুয়েজ ক্যানেল কোম্পানীর অফিস আমার রোদনের জীবন্ত উদাহরণ। আমি তরীকতের এসব পীরদেরকে স্মরণ করাতাম যে, আপনাদের অনুসারীদের পরিপূর্ণ আস্থা রয়েছে আপনাদের প্রতি। তারা নিজেদের রশি আপনাদের হাতে দিয়ে রেখেছে। সুতরাং তাদের পক্ষ থেকে আপনাদের স্কন্ধে এই ভারী দায়িত্ব ন্যস্ত হয় যে, আপনারা তাদেরকে আল্লাহর পথের সন্ধান দেবেন এবং মঙ্গল ও কল্যাণের পথ দেখাবেন। অতঃপর সব শেষে আমি এ দাবীও জানাতাম যে, আপনারা নিজেদের সমস্ত চেষ্টা-সাধনা এ ব্যাপারে নিয়োজিত করুন, যাতে মুরীদদের মন-প্রাণ জ্ঞান আর প্রজ্ঞার আলোকে আলোকিত হতে পারে। তারা যাতে ইসলামের সত্যিকার তরবিয়তে বিভূষিত হতে পারে। ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব আর ইসলামের শান-শওকত পুনর্বহাল করার জন্য তারা যেন এক দেহ এক প্রাণ হয়ে কাজ করতে পারে।

শায়খ আব্দুল ওয়াহহাব দান্দারাবী (র)-এর সঙ্গে সাক্ষাতের স্মৃতি এখনো আমার স্মরণ আছে। আমি তাঁকে প্রায় আমারই সমবয়সী নওজোয়ান হিসাবে দেখতে পেয়েছি। বয়স বড় জোর ২০/২১ বৎসর হবে। তাঁর মধ্যে পরিদৃষ্ট হয় সততা আর পূণ্যাত্ম। আদব আর সম্মানের সঙ্গে আমি তাঁর মজলিশে বসি, মজলিশ শেষ হলে একান্তে মিলিত হওয়ার জন্য আমি তাঁর কাছে আবেদন জানাই। আমি তাঁর কক্ষে প্রবেশ করে মাথা থেকে রুমী টুপি খুলে কুরসীর উপর রেখে দেই। টুপির উপর যে পাগড়ি বাঁধা ছিল, তা-ও খুলে টুপির সঙ্গে রেখে দেই। আমার এ কান্ড দেখে তিনি অবাক হন। কারণ, ইতিপূর্বে তাঁকে এ ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়নি কখনো। আমি তাঁকে বলি: ভাই, আমার এ কান্ডকে সমালোচনার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করবেন না। এ কাজ আমি এ জন্য করেছি, যাতে আপনার আর আমার মধ্যে যে বাহ্যিক পার্থক্য রয়েছে, তা দূর হয়ে যায়। যাতে আমি একজন মুসলমান নওজোয়ানের সঙ্গে কথা বলতে পারি, যাঁর নাম আব্দুল ওয়াহহাব দান্দরাবী। আর শায়খ আব্দুল ওয়াহহাবকে তো আমরা সাধারণ মজলিশে রেখে এসেছি। ভাই, আপনি জীবনের কুড়িটা বসন্ত অতিক্রম করছেন। আলহামদু লিল্লাহ, আপনি পরিপূর্ণ যুবক। আপনার মধ্যে রয়েছে উৎসাহ-উদ্দীপনা আর কর্মচাঞ্চল্য। মানুষের এসব সমাবেশ রয়েছে আপনার সম্মুখে। আল্লাহ তা’আলা আপনার আশপাশে এসব লোককে সমবেত করেছেন। এরা যিকর আর মুনাজাতে রাত অতিবাহিত করে। এ ছাড়া আর কিছুই এরা করে না। কিন্তু এদের অধিকাংশের অবস্থা অন্যান্য মুসলমান থেকে ভিন্ন নয়। দ্বীন সম্পর্কে সেই একই অজ্ঞতা, ইসলামের মর্যাদা আর শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে সেই অনুভূতিহীনতা, সেই অপরিচিতি। এ পরিস্থিতি কি আপনার পছন্দ?

তিনি তাৎক্ষণিক জবাব দেন: আমি কি করবো? আমি আরয করি: তাদের মধ্যে জ্ঞান ও চেতনার সহ্ছার করুন, তাদেরকে সংগঠিত করুন এবং মোহাসাবা করুন, তাদেরকে সাফলে সালেহীনের সীরাত-চরিত্র শিক্ষা দিন এবং ইসলামের নামকরা মুজাহিদদের ইতিহাস সম্পর্কে তাদেরকে অবহিত করুন।

মোটকথা, এসব বিষয় নিয়ে তাঁর সঙ্গে আমার দীর্ঘক্ষণ কথাবার্তা চলে। শায়খ আব্দুল ওয়াহহাব আমার কথায় বেশ প্রভাবিত হন। আমরা উভয়ে বাস্তব প্রচেষ্টা চালানের অঙ্গীকার করি। অর্থাৎ আমরা উভয়ে দ্বীনি ভাই হিসাবে ইসলামের সর্বাত্মক খেদমত করবো। মানুষের অন্তরে ইসলামের দাওয়াত অংকুরিত করবো। আমাদের মধ্যে প্রত্যেকে স্ব স্ব ক্ষেত্র আর পরিমন্ডলে এ দায়িত্ব পালন করবে। আমি এ কথার সাক্ষ্য দিতে পারি যে, এরপর যখনই তিনি ইসমাঈলিয়া আগমন করেন, সর্বপ্রথম আমার সঙ্গে দেখা করতেন এবং আমাকে আশ্বস্ত করতেন যে, তিনি তাঁর অঙ্গীকারে যথারীতি অটল আছেন এবং তদনুযায়ী কাজ করে যাচ্ছেন। ওফাত পর্যন্ত তিনি এ রীতি মেনে চলেন। আল্লাহ তা’আলা তাঁর প্রতি রহমত নাযিল করুন এবং ওফাদারীর নেক প্রতিদান তাঁকে দান করুন।

শহরের সম্মানিত ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে

সে সময়ে ইসমাঈলিয়ার সম্মানিত বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ দু’ধরনের চিন্তাধারার প্রতিনিধিত্ব করতেন। মূলতঃ এর পেছনে ছিল সে ধর্মীয় মতবিরোধ, নানা মাসআলা নিয়ে আলেম সমাজের মধ্যে যা দেখা দেয়। কিন্তু মূলতঃ এসব মতবিরোধ চাঙ্গা করায় ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক বিষয়ের বিরাট ভূমিকা ছিল। আর মিশরের সমাজে সাধারণতঃ এটাই দেখা যেতো। শহরে বাইরে থেকে কোন শ্রমিক এখানে আগমন করলে শহরের বিশিষ্ট ব্যাক্তিবর্গের সঙ্গে যোগাযোগ করা এবং তাদের গৃহে যাতায়াত করা তাদের জন্য অপরিহার্য ছিল। সরকারী কর্মচারী, শহরের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে যাদের যোগাযোগ ছিল, তারা দু’টি শিবিরে বিভক্ত ছিল। শহরে বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের দু’টি শিবিরের মধ্যে কোন একটা শিবিরের সঙ্গে প্রতিটি ব্যক্তির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। কিন্তু আমার অনুভূতি ছিল এই যে, দাওয়াতের সাধারণ মেজায-কারণ, এ দা’ওয়াত হচ্ছে ভ্রাতৃত্বের দা’ওয়াত এবং প্রীতি-ভালোবাসা দ্বারাই এর গাড়া তৈয়ার হয়েছে- একই সঙ্গে উভয় শিবিরের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা আমার জন্য অপরিহার্য। তাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক হওয়া উচিত সম্পূর্ণ স্পষ্ট এবং দ্ব্যর্থহীন। সুতরাং আমি যখন উভয় শিবিরের নেতাদের মধ্যে কারো বাসায় গমন করতাম, তখন আমি এ সিদ্ধান্ত নিয়ে গমন করতাম যে, প্রতিপক্ষ সম্পর্কে আমি অবশ্যই কিছু বলবো। আমি এ ধারণা সৃষ্টি করার চেষ্টা করবো যে, আপনার পক্ষে মঙ্গল আর কল্যাণ কামনা ছাড়া অন্য কোন স্পৃহাই তার নেই। সে সব সময় ভালো নামের সঙ্গেই আপনাকে স্মরণ করে। এখন উভয়ের উপর কর্তব্য বর্তায় তাদের শহরের মঙ্গল আর কল্যাণের কাজে একে অপরের সহযোগিতা করা। আর স্বয়ং ইসলামও তো ভালো কাজে সহায়তার নির্দেশ দেয়।

মোটকথা, এসব মহফিলে আমি এমনসব বিষয় উত্থাপন করতাম, যাতে অন্তর কাছাকাছি আসে, মনের ঐক্য গড়ে উঠে। অন্য কাউকেও প্রতিপক্ষের সমালোচনা করতে দেখলে আমি তৎক্ষণাৎ বাধা দিয়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করতঃ বলতাম, ঐক্য ও সংহতির দূত হওয়ার মধ্যেই কল্যাণ নিহিত। এ ভালো কাজে সহায়ক হয় না, এমন কোন কথাই এদিক সেদিক চালাচালী করা ঠিক নয়। গীবৎ আর বদ কথায় পংকীল হওয়ার কোনই প্রয়োজন নেই। আর গীবততো কবীরা গুনাহ। আমার এ কথাগুলো ভিন্ন শিবিরেও অবশ্যই পৌঁছানো হতো। একটা ছোট মাপের শঞরে এ ব্যাধি সাধারণতঃ পাওয়া যায়। ভিন্ন শিবিরে এটা আনন্দের কারণ হতো। এ কর্মপন্হার বদৌলতে আমি একই সময়ে উভয় শিবিরের বন্ধুত্ব ও শ্রদ্ধা অর্জনে সফল হই। আর পরবর্তীকালে যখন যথারীতি ইখওয়ানুল মুসলিমূন সংগঠন গড়ে উঠে, তখন ইখওয়ানের আহ্বানে বিভিন্ন চিন্তাধারার মানুষের সমবেত হওয়ায় আমার এ রীতি-পদ্ধতির বিরাট ভূমিকা ছিল।

ক্লাবের জগৎ

সে সময় ইসমাঈলিয়ার একটা লেবার ক্লাব ছিল। পারস্পরিক সহায়তা সমিতি এ ক্লাব প্রতিষ্ঠা করে। শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে এ ক্লাব ভালোভাবেই তাদের মিশন চালিয়ে যাচ্ছিল। এ ক্লাবে শিক্ষিত যুবকদের একটা বাছাই করা দলও ছিল। যারা ভালো কথা শুনতে প্রস্তুত ছিল। নেশা প্রতিরোধ সংগঠনের একটা শাখাও ছিল। যেখানে মাদক দ্রব্য সম্পর্কে আলোচনা আর লেকচার দেওয়া হতো। আমি এ সুযোগের পুর্ণ সদ্ব্যবহার করি এবং উভয় সংগঠনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলি। এখন সেখানে ধর্ম, সমাজ এবং ইতহাস বিষয়ে ধারাবাহিক বক্তৃতা শুরু করি। অনেক শিক্ষিত ব্যক্তির অন্তরকে ভবিষ্যৎ দাওয়অতের জন্য প্রস্তুত করায় আমার এসব বক্তৃতা কার্যকর ভূমিকা পালন করে।

কায়রোর সঙ্গে যোগাযোগ

যদিও ইসমাঈলিয়ায় আমার সর্বশক্তি নিয়োজিত ছিল চিন্তামূলক আহ্বান বদ্ধমূল করা এবং মন-মানসকে প্রস্তুত করার কাজে। কিন্তু এর পরও তখন কায়রোয় সে ক্ষীণ ইসলামী শ্রোত দেখা দিচ্ছিলো, তার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কেও আমি অনবহিত ছিলাম না। আলফাতাহ পত্রিকার সঙ্গে আমার পুরাপুরী যোগাযোগ ছিল। ইসমাঈলিয়ায় আমি সর্বশক্তি নিয়োগ করে আলফাতাহ পত্রিকার দাওয়াত ছড়াচ্ছিলাম এবং তার জন্য সর্বাধিক খরিদ্দার সংগ্রহ করছিলাম। কারণ, এ পত্রিকা ছিল আলোর সেই প্রথম কিরণ, যার আলোকে ইসলামী আন্দোলনের পতাকাবাহীরা সফর শুরু করেছিলেন।

জমিয়তে শুব্বানুল মুসলিমীন

নওজোয়ানদের সে গ্রুপটির সঙ্গে আমার যথারীতি যোগাযোগ ছিল, কায়রোয় যাদের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল এবং যাদের সঙ্গে এ অঙ্গীকার হয়েছিল যে, আমরা সকলে মিলে এক সঙ্গে ইসলামের সর্বাত্মক দাওয়াতের কাজ চালাবো।

একদিন ভোরে যখন সংবাদপত্রে এ খবর পাঠ করি যে, শুব্বানুল মুসলিমীন নামে একটা সংগঠন প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং মরহুম আব্দুল হামীদ বেক সাঈদকে এ সংগঠনের সভাপতি করা হয়েছে, তখন আমি খুবই খুশী হয়েছিলাম। এসব কিছু ছিল সেসব ঈমানদার নওজোয়ান ভাইদের প্রচেষ্ঠার ফল, যাদের সম্পর্কে পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে। মনে পড়ে খবর পাঠ মাত্রই আমি আব্দুল হামীদ বেক সাঈদকে একখানা পত্র লিখি, যাতে আমি ঘোষণা করেছিলাম যে, আমিও এ সংগঠনে শরীক আছি। আমি নিয়মিত চাঁদা দিতাম সংগঠনকে এবং তাঁর কাজের অগ্রগতি পর্যালোচনা করতাম নিয়মিত। বেশ মনোযোগ সহকারে সংগঠনৈর খবরাখবর পাঠ করতাম। কায়রোয় আমার ভাষণ হয়েছিল সংগঠনের ক্লাবে মজলিসুন নবাব সড়কে। আমার মনে পড়ে, সে ভাষণের শিরোনাম ছিল দু’টি সংস্কৃতির তুলনামুলক আলোচনা আমি সব সময় জমিয়তে শুব্বানুল মুসলিমীন-এর প্রতিষ্ঠাতা আর কর্মীদের সোনালী ইসলামী খেদমতের কদর করতাম এবং এখনো করি। তাদের মধ্যে কয়েকজনের নাম এখনো আমার মনে আছে: ডা. ইয়াহইয়া দারদীরী, ওস্তাদ মাহমুদ আলী ফযলী, ওস্তাদ মুহাম্মদ আল-গামরাবী এবং সাইয়্যেদ মুহিবুদ্দীন আল খতীব প্রমুখ। আল্লাহ তা’আলা এদের সকলকে ইসলাম এবং মুসলমানদের পক্ষ থেকে নেক প্রতিদান দান করুন।

একটা চিত্তাকর্ষক ঘটনা

একটা চিত্তাকর্ষক ঘটনা ঘটে। আমি ইসমাঈলিয়ায় এসেছি চল্লিশ দিন হয়ে গেছে। ছোট মাপের হোটেলগুলোতে (আমরা যাকে বলি বিনসিউনাত) আরো বেশীদিন অব্স্থান করতে ভালো লাগছিল না। তাই আমরা একটা প্রাইভেট বাসা ভাড়া নেই। ঘটনাক্রমে বাসার সবচেয়ে উঁচু তলায় আমারদের স্থান হয়। বাসার দোতলার সবটা ভাড়া নেয় মিশরীয় খৃস্টানদের একটা গ্রুপ এবং সেখানে তারা একটা ক্লাব এবং একটা গীর্জাও স্থাপন করে। আর গোটা নীচের তলাটা ভাড়া নেয় একদল ইহুদী। তারাও সেখানে কিছু অংশ ক্লাব আর কিছু অংশ গীর্জার জন্য নির্দিষ্ঠ করে রাখে। আমরা ছিলাম সবচেয়ে উপর তলায়। সেখানে আমরা যথারীতি নামায কায়েম করতাম এবং এ জন্য আমরাও একটা স্থান মসজিদের জন্য নির্দিষ্ট করি। এ ঘরটি যেন তিনটি ধর্মের প্রতিনিধিত্ব করছিল। গীর্জার চাবিধারক বৃদ্ধা উম্মে শালূমের কথা কিছুতেই ভুলা যাবে না। বৃদ্ধা প্রতি শনিবার রাত্রে আমাদের নিকট নিবেদ করতো বাতি জ্বালানো এবং গ্যাসের চুলা জ্বালানোর কাজে তার সহায়তা করার জন্য (কারণ, ইহুদীরা শনিবার রাত্রে কোন কাজ করা বৈধ মনে করে না)। আমরা তাকে উত্যক্ত করে বলতামঃ

এসব ভান-ভনিতা আর প্রতারণার কারবার আর কতকাল চালাবে? আল্লাহর সামনে এসব প্রতারণা চলবে না। আল্লাহ তা’আলা যদি শনিবার দিন তোমাদের জন্য আলো আর আগুন দু’টাই হারাম করে থাকেন, তোমরা যা দাবী কর, তবে কি আলো আর আগুন দ্বারা উপকৃত হওয়াও হারাম করেছেন?

বৃদ্ধা আমাদের কথা শুনে মাফ চাইতো। আর এভাবে আমাদের বিবাদ শান্তিতে নিষ্পত্তি হতো।

ইসমাঈলিয়ার প্রতিচ্ছবি

ইসমাঈলিয়া মন-মানসে এক বিস্ময়কর অবস্থা সৃষ্টি করে। তার পূর্বদিকে রয়েছে ইংরেজ সৈন্যদের ছাউনী। এ ছাউনী আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন দেশপ্রেমিক মানুষের মনে দুঃখ আর ক্ষোভের জন্ম দেয়। ঘৃণ্য সাম্রাজ্যবাদের ইতিহাস স্মরণ করতে তাদেরকে বাধ্য করে। তাদেরকে স্মরণ করতে হবে এ সাম্রাজ্যবাদ মিশরে কোনসব বিপদ ডেকে এনেছে। বস্তুগত আর জ্ঞানগত কোনসব সুবর্ণ সুযোগ থেকে মিশরকে কিভাবে বঞ্চিত করেছে। মিশরের উন্নতি-অগ্রগতির পথে কিভাবে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং ৬০ বৎসর থেকে আরব ঐক্য এবং মুসলিম সংহতিতে কিভাবে বাধা সৃষ্টি করছে।

সুদর্শন আর জাঁকজমকপূর্ণ দফতর- সুয়েজ ক্যানেল কোম্পানীর প্রশাসনিক দফতর দাঁড়িয়ে আছে তার গাম্ভীর্য নিয়ে। মিশরীরা এখানে আসে চাকুরীর সন্ধানে। আর এখানে তাদের সঙ্গে করা হয় দাসসূলভ আচরণ। কিন্তু বিদেশীদেরকে এখানে সম্মান করা হয়। তাদেরকে দেয়া হয় শাসক শ্রেণীর মর্যাদা। এ দফতর শহরের সমস্ত কর্মকাণ্ডের একক কর্তা আর ইজারাদার। আলো, পানি, পরিচ্ছন্নতা ইত্যাদি পৌরসভার যাবতীয় কর্মকাণ্ড কোম্পানী নিজ হাতে নিয়ে রেখেছে। এমনকি মিশরের ঐতিহ্যবাহী শহর ইসমাঈলিয়ায় যাতায়াতের সমস্ত রাস্তাঘাটও কোম্পানীর করায়ত্ত্ব। কোম্পানীর অনুমতি ছাড়া কেউ সেখানে প্রবেশ করতে পারে না এবং কোম্পানীর ছাড়পত্র ব্যতীত কেউ সেখান থেকে যেতেও পারে না।

ফিরিঙ্গী কলোনীতে ছড়িয়ে আছ বিশাল অট্টালিকা। এখানে বাস করে কোম্‌পানীল বিদেশী কর্মারীরা। এদের বিপরীতে রয়েছে আরব শ্রমিকদের সংকীর্ণ-অন্ধকার প্রকোষ্ঠ, যেখানে তারা বাস কর। বড় বড় সড়কগুলোর নামফলক পর্যন্ত অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদীদের ভাষায় লেখা। এমনকি মসজিদ সড়কের নাম পর্যন্ত লেখা হয়েছে এভাবে I RUE DELE MOSQUE. আর এসব ফলক দ্বারা এখানে বিদেশী নাম স্থায়ী করার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

এসব ঘটনা আর বাস্তবতা মনে প্রভাব ফেলে। বিশেষ করে এ প্রভাব আরো তীব্র হয়। যখন কোন ব্যক্তি ইসমাঈলিয়ার গহীন বন, মনমাতানো উদ্যান, কুমীর ঝিলের মনোরম তীর বা প্রাকৃতিক জঙ্গলে বসে এসব বিষয় নিয়ে চিন্তা করে। ইসমাঈলিয়ার পরিবেশ এ লেখকের মনে এমন অনেক প্রভাব ফেলেছে। মুদ্রিত করেছে অ-মুছণীয় ছাপ। দাওয়াত সংগঠন আর আহ্বানকারীর মনমানস গঠনে এসব ঘটনা আর বাস্তবতার বিরাট ভূমিকা রয়েছে।

ইখওয়ানুল মুসলিমুন প্রতিষ্ঠা

আমার যতদূর মনে পড়ে, ১৩৪৭ হিজরীর যিলকদ মাস, মোতাবেক ১৯৮ সালের মার্চ মাসের ঘটনা। নিম্নোক্ত ৬ জন বন্ধু আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করর জন্য বাসায় আগমন করেন; হাফেয আব্দুল হামীদ, আহমদ আল-হাছরী, ফুয়াদ ইবরাহীম, আব্দুর রহমান হাসবুল্লাহ, ইসমাঈল ইজ্জ এবং যাকী আল মাগরেবী। আমি সময় সময় ইসমাঈলিয়ায় যেসব দারস আর বক্তৃতা করতাম, এরা ছিলেন তার দ্বারা প্রভাবিত। তাঁরা আমার সঙ্গে দাওয়াতের প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা শুরু করেন। তখন তাঁদের আওয়াজে গর্জন, চোখে চমক আর চেহারায় ঈমান ও উদ্দীপনার আলো ফুটে উঠছিল। তাঁরা বলে চললেন:

“আমরা আপনার বক্তৃতা শুনেছি, মনের গভীরে তা গেঁথে রেখেছি। আর সেসব বক্তৃতার অসম্ভব প্রভাব পড়েছে আমাদের উপর। কিন্তু আমরা জানি না, ইসলামের মর্যাদা আর মুসলমানদের কোন স্থান নেই, নেই কোন মান-মর্যাদা। তারা কেবল বিদেশীদের অনুগত শ্রমিক। আমাদের কাছে আছে কেবল টগবগ করা রক্ত, খুদী আর আত্মমর্যাদার উষ্ণতা নিয়ে তা শিরা-উপশিরায় প্রবাহিত হচ্ছে। এ প্রাণগুলো ঈমান আর মর্যাদার অনুভূতিতে ভরপুর। আমাদের হাতে আছে এ কয়টা দিরহাম, যা আমরা নিয়ে এসেছি শিশুদের পেট কর্তন করে। কাজের পন্হা আপনি যতটা বুঝেন, আমরা ততটা বুঝি না। দেশ-জাতি আর মিল্লাতের খেদমতের উপায় আপনি যেমনটা জানেন, তেমনটা আমরা জানতে পারি না। আমরা এখন যে খাহেশ নিয়ে এখানে আগমন করেছি, তা হচ্ছে এই যে, আমাদের অধিকারে যা কিছু আছে, তা আপনার খেদমতে পেশ করে আমরা আল্লাহর নিকট নিজেদের দায়িত্ব থেকে মুক্ত হবো। আমাদেরকে কি করতে হবে, সে দায়িত্ব আপনারা। যে দল নিষ্ঠা সহকারে আল্লাহর সঙ্গে এ অঙ্গীকার করে যে, আল্লাহর দ্বীনের জন্য তারা বেঁচে থাকবে এবং দ্বীনের পথেই তারা মৃত্যুবরণ করবে এবং একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্ঠিই তাদের কাম্য, এমন দলই সফল হবে; তাদের সংখ্যা যতই নগণ্য এবং তাদের উপায়-উপকরণ যতই তুচ্ছ হোক না কেন?”

এ উদাত্ত আহ্বান আমার মনে গভীর প্রভাব ফেলে। যে বোঝা আমার উপর চাপানো হয়েছে, তা থেকে পলায়নের পথ ধরতে পারিনি। এতো সে বোঝা, যার দাওয়াত দিয়ে আসছিলাম আমি নিজেই, যে জন্য আমি নিজেই চেষ্টা-সাধনা চালিয়ে আসছিলাম। যার চারপাশে লোকজন জড়ো করার জন্য চেষ্টা করে আসছিলাম। আহ্বানে সাড়া দেয়ার উদ্দীপনায় ডুবে তাদেরকে বলি:

“আল্লাহ তা’আলা আপনাদের চেষ্টা কবুল করুন। আপনাদের নেক বাসনায় বরকত দান করুন এবং আমাদের সকলকে নেক আমল করার তাওফীক দান করুন, যাতে তাঁর সন্তুষ্ঠি অর্জিত হয় এবং সৃষ্টিকূলের উপকার হয়। আমাদের কর্তব্য হচ্ছে চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। সফলতা আল্লাহর হাতে। আসুন আমরা আল্লাহর সঙ্গে অঙ্গীকার করি যে, আমরা হবো ইসলামের দাওয়াতের সৈনিক। দেশ ও জাতির মঙ্গল এ দাওয়াতের মধ্যেই নিহিত”।

এরপর অঙ্গীকার আর বায়য়াত গৃহীত হয়। আমরা এ মর্মে শপথ করি যে, ভাই ভাই (ইখওয়ান) হয়ে আমরা জীবন যাপন করবো, ইসলামের জন্য কাজ করবো এবং ইসলামের পথে জিহাদ হবে আমাদের ব্রত।

একজন বন্ধু দাঁড়িয়ে বললেন, আমরা নিজেদেরকে কি নামে ডাকবো? আমরা কি কোন সংগঠন? কোন ক্লাব? না কোন সমিতি? আমাদেরকে কোন আনুষ্ঠানিক নাম ধারণা এবং একটা বিশেষ কর্মপন্হা। ইসলামের খেদমতের জন্য আমরা পরস্পরে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ। সুতরাং আমরা মুসলমান ভাই ভাই এবং আমাদের নাম হবে ‘আল ইখওয়ানুল মুসলিমুন’।

সকলের মুখে মুখে এ নাম উচ্চারিত হয়। পরে এটা প্রবাদ বাক্যে পরিণত হয়। ৬ জনের সমন্বয়ে ইখওয়ানুল মুসলিমূন গঠিত হয় উপরোক্ত লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্মুখে রেখে একটা অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে।

তাহযীব-তরবিয়ত মাদ্রাসা

কোথায় সমাবেশ করা হবে আর সমাবেশের প্রোগ্রাম কি হবে- অতঃপর তা নিয়ে আমরা পরামর্শ করি। শেষ পর্যন্ত আমরা এ বিষয়ে একমত হই যে, শাহ ফারুক সড়কে শায়খ আলী শরীফের নিকট থেকে মাসিক ৬০ ক্রোশ ভাড়ায় একটা সাদামাটা কক্ষ ভাড়া নেয়া হবে। এতে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রও রাখা যাবে এবং বিশেষ সমাবেশও করা যাবে। এখানে একটা মক্তব বসতো। আমরা একটা শর্ত দেই যে, ছাত্ররা গৃহে চলে গেলে আমরা আসর থেকে নিয়ে রাত পর্যন্ত মক্তবের সামান ব্যবহার করতে পারবো।এ স্থানের নাম দেয়া হবে ইখওয়ানুল মুসলিমুনের মাদ্রাসাতুত তাহযীব। এর পাঠ্যসূচী হবে ইসলামিয়াত শিক্ষা। যার বুনিয়াদী বিষয় হবে সহীহ-শুদ্ধভাবে কুরআন মজীদ তিলাওয়াত। এ মাদ্রাসার সঙ্গে অন্য কথায় এ দাওয়াতের সঙ্গে সম্পৃক্ত ভাইয়েরা তাজবীদের নিয়ম অনুযায়ী কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করবে। এরপর কতিপয় আয়াত আর সূরা মুখে মুখে হিফয করার চেষ্টা করা হবে এবং এসব আয়াত আর সূরার উপযুক্ত তাফসীরও করা হবে। কতিপয় হাদীসও মুখস্থ করা হবে এবং তার ব্যাখ্যাও করা হবে। আকাইদ-ইবাদাত সহীহ-শুদ্ধ করা হবে, ইসলামী আইন এবং ইসলামের সামাজিক বিধানের দর্শন ব্যাখ্যা করা হবে; ইসলামের ইতিহাস, রাসূলে করীমের জীবন চরিত এবং সালফে সালেহীনের জীবনধারা সরলভাবে শিক্ষা দেয়া হবে, যার লক্ষ্য হবে আমলী এবং রূহানী দিক স্পষ্ট করে তুলে ধরা। উপরন্তু যোগ্য ব্যক্তিদেরকে বক্তৃতা আর তাবলীগের প্রশিক্ষণও দেওয়া হবে। আর এ উদ্দেশ্যে তাদেরকে পদ্য এবং গদ্যের প্রয়োজনীয় অংশ মুখস্থ করানো হবে। এসব বিষয় মাদ্রাসার পার্ঠ তালিকার অন্তর্ভুক্ত হবে। উপরন্তু বাস্তব অনুশীলন হিসাবে মাদ্রাসার ভাইদেরকে প্র্রথমে নিজেদের পরিবেশে পাঠদান আর বক্তৃতা করতে দেয়া হবে। ধীরে ধীরে পরে তাদেরকে বৃহত্তর পরিবেশে এ কাজে লাগানো হবে। এ বিশেষ শিক্ষা দানের আওতায় ১৯২৭-২৮ সালের শিক্ষা বর্ষ শেষে ইখওয়ানুল মুসলিমূনের প্রথম গ্রুপের সংখ্যা ৭০-এর কাছাকাছি দাঁড়ায়।

তরবিয়তের ফলাফল

কিন্তু এসব শিক্ষাক্রমই আমাদের জন্য সবকিছু ছিল না। বরং তাদের পরস্পরে মেলামেশা, বাস্তব লেনদেন, কাজকারবার, ভালোবাসা-সম্প্রীতি, জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ সহযোগিতা এবং যে কোন ভালো কাজের জন্য তাদের অন্তরে যে প্রস্তুতি সৃষ্টি হয়, তার বাস্তব অনুশীলনের লক্ষণ ছিল এ দলের গঠন প্রকৃতিতে সবচেয়ে সুদূর এবং শক্তিশালী কার্যকারণ। আমার মনে পড়ে, একবার আমি ভাই সাঈদ আবূ সউদের দোকানে গমন করি। ভাই মুস্তফা ইউসুফ তাঁর দোকান থেকে এক বোতল সুগন্ধী তেল ক্রয় করেন। ক্রেতা দশ ক্রোশ মূল্য দিতে চায়, কিন্তু বিক্রেতা ৮ ক্রোশের বেশী গ্রহণ করতে রাজী নয়। দু’জনের কেউই নিজের জিদ ছাড়তে রাজী নয়। এ দৃশ্য আমার মনে বিরাট প্রভাব ফেলে। আমি এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করি। ক্রয়মুল্যের বিল দেখতে চাই। আমি দেখতে পাই ক্রয়মুল্য পড়েছে ডজন প্রতি ৯৬ ক্রোশ। আর ক্রয়মূল্যেই তিনি বিক্রী করতে চান ভাই সাঈদের নিকট। আমি ভাই সাঈদকে বললাম, আপনি যদি বন্ধুর নিকট থেকে লাভ কনা করেন এবং আপনার বিরোধীরা আপনার নিকট থেকে কিছু ক্রয় না করে, তবে আপনি খাবেন কি? তিনি বললেন:

আমার আর আমার ভাইয়ের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। তিনি আমার প্রস্তাব মেনে নিলেই আমি খুশী হবো।

আমি ভাই মুস্তফা ইউসূফকে বললাম, তুমি কেন তার প্রস্তাব মানছ না? তিনি বললেন: আমি যদি অন্য দোকানদারের নিকট থেকে দশ ক্রোশে এই জিনিস কিনতে পারি, তাহলে আমার ভাই এই মূল্যের বেশী হকদার। তিনি যদি আরো বেশী দাম নিতে রাজী হন, তাহলেও আমি দিতে প্রস্তুত আছি।

যাই হোক, আমি হস্তক্ষেপ করি এবং ৯ ক্রোশে নিশ্পত্তি করি। আসলে ব্যাপারটা এক ক্রোশ বা দুই ক্রোশের নয়। বরং আসল ব্যাপারটা হচ্ছে মানিসকতার। সে মানসিকতা যদি সকলের মধ্যে গড়ে উঠে, সকলেই যদি তা অনুভব করে এবং সকলের মন-মানসে তা বিস্তার লাভ করে, তবে তার বরকতে ব্যক্তিগত, সামাজিক এবং আন্তর্জাতিক সকল সমস্যার সমাধান হতে পারে। মানুষ শান্তি আর সৌভাগ্যের জীবন যাপন করতে পারে।

সে ভাইয়েরা জানতে পারে যে, তাদের এক সঙ্গীর কোন আয়-উপার্জন নেই, তাদের মধ্যে দশজনের বেশী সঙ্গেী তার কাছে গমন করতঃ একান্তে কানে কানে কিছু কথা বলে এবং নিজেদের সঞ্চিত অর্থের একটা অংশ তার নিকট পেশ করে, যাতে কিছু পুঁজি হাতে এলে তাদের বেকার ভাইটা একটা কিছু করতে পারে। আমি কয়েকজনের প্রস্তাব মেনে নিয়ে অন্যদেরকে ধন্যবাদ জানিয়ে অক্ষমতা প্রকাশ করি। তারা মনে দুঃখ নিয়ে ফিরে যায়। কারণ, সাহায্যে সাওয়াব থেকে তারা বঞ্চিত হয়েছে।

দলের স্থপতিদের চরিত্রের কিছু নমুনা

ইখওয়ানরা সকল কাজ-কারবারে ইসলামের বিধান মেনে চলে। সকল কথা আর কাজে, তা সঙ্গীদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হোক, বা অন্য লোকদের সঙ্গে ইসলামী চরিত্র আর অনুভূতি প্রকাশে উত্তম উদাহরণ আর পবিত্র নমুনায় পরিণত হয়েছিলেন তাঁরা।

সুয়েজ ক্যানেল কোম্পানীর চীফ ইঞ্জিনিয়ার মিঃ সভল্যান্ট ভাই হাফেযকে ডেকে তাঁর বাসার কিছু যন্ত্রপাতি তাঁর দ্বারা মেরামত করাতে চান। মিঃ সভল্যান্ট তাঁর কাছে মজুরী জানতে চাইলে ভাই হাফেয ১৩০ ক্রোশ মজুরী দাবী করেন।

মিঃ সভল্যান্ট শুনেই আরবী ভাষায় বললেন: তুমি কি লুটেরা?

ভাই হাফেয নিজেকে সংবরণ করতঃ শান্তকণ্ঠে বললেন: কিভাবে?

মিঃ সভল্যান্ট বললেন: তুমি অতিরিক্ত মুজুরী দাবী করছো।

ভাই হাফেয বললেন, আমি আপনার নিকট থেকে কিছুই নেবো না। আপনি কোন অধীনস্থ ইঞ্জিনিয়ারকে জিজ্ঞাসা করে নিন। কেউ যদি বলে যে, আমি ন্যায্য মজুরীর চেয়ে বেশী দাবী করেছি, তাহলে শাস্তি হিসাবে আমি বিনা পারিশ্রমিকে এ কাজ করে দেবো। আর যদি বলে যে, আমার দাবী ন্যায্যা, তবে এ বাড়াবাড়ির জন্য আমি আপনাকে কিছুই বলবো না।

মিঃ সভল্যান্ট একজন ইঞ্জিনিয়ারকে ডেকে এ কাজের মজুরী কতো হতে পারে জানতে চান। ইঞ্জিনিয়ার অনুমান কর বললেন, ২শ ক্রোশ হতে পারে। মিঃ সভল্যান্ট ভাই হাফেযকে বললেনঃ চলো কাজ শুরু কর।

ভাই হাফেয বললেনঃ আমি কাজ শুরু করবো, কিন্তু তুমি আমাকে অপমান করেছ। সুতরাং, আগে তোমাকে ক্ষমা চাইতে হবে এবং তোমার কথা প্রত্যাহার করে নিতে হবে।

ফরাশী অফিসার রাগে লাল হয়ে যায়। বিশেষ মেজাজ প্রকাশ পায় তার চেহারায়। কুরআন মজীদে আয়াতঃ

**********************************

“(পাপ তাকে অহংকারে উদ্বুদ্ধ করে), সে যেন এর প্রতীক হয়ে দেখা দেয়। সে বলতে থাকে: তোমার কাছে আমাকে ক্ষমা চাইতে বলছ। কে তুমি? স্বয়ং বাদশাহ ফুয়াদ এলেও আমি তার কাছে ক্ষমা চাইবো না।

ভাই হাফেয নিতান্ত শান্তভাবে বলেন: মি: সভল্যান্ট, এবার আপনি দ্বিতীয় ভুল করছেন। আপনি বাদশাহ ফুয়াদের দেশে আছেন। মেহমানদারী আর অনুগ্রহ স্বীকার করা- উভয়েরই দাবী হচ্ছে এমন কথা মুখে উচ্চারণ না করা। শিষ্টাচার আর সম্মান বিসর্জন দিয়ে বাদশাহ ফুয়াদের নাম উচ্ছারণ করার অনুমতি আমি কিছুতেই আপনাকে দেবো না।

মিঃ সভল্যান্ট ভাই হাফেয থেকে মুখ ফিরায়ে নেন এবং বিশাল হল ঘরে পায়চারী শুরু করেন। তার হস্তদ্বয় প্যান্টের পকেটে। ভাই হাফেয তাঁর যন্ত্রপাতি নিচে রেখে একটা চেয়ারে বসেন। কিছুক্ষণ পরিবেশে নিস্তব্ধতা বিরাজ করে। ক্রুব্ধ উদ্ভ্রান্ত মিঃ সভল্যান্টের পদচারণার শব্দই কেবল কানে ভেসে আসছিল। কিছুক্ষণ পর মিঃ সভল্যান্ট হাফেযের দিকে এগিয়ে গিয়ে বললেন: মনে কর আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইলাম না। তুমি আমার কি করতে পারবে?

হাফেয বললেন, ব্যাপারটা সোজা। প্রথমে তোমাদের কনস্যুলেট আর রাষ্ট্রদূতের নিকট রিপোর্ট করবো। এরপর প্যারিসে সুয়েজ কোম্পানীর ঊর্ধ্বতন প্রশাসনিক কর্মকর্তার দফতরকে অবহিত করবো। অতঃপর ফ্রান্সের স্থানীয় পত্রপত্রিকা এবং অন্যান্য বিদেশী পত্র-পত্রিকায় এ ব্যাপারে চিঠিপত্র লিখবো। এরপর প্রশাসনিক কাউন্সিলের যে সদস্যই এখানে আসবেন, তার কাছে এ অভিযোগ পেশ করবো। এতসব কিছুর পরও যদি আমার অধিকার ফেরত না পাই, তবে আমার সর্বশেষ কৌশল এ হতে পারে যে, প্রকাশ্য রাজপথে তোমাকে অপদস্থ করবো। সম্ভবতঃ এভাবে আমি আমার উদ্দেশ্য সিদ্ধ করতে সক্ষম হবো। আমার সিদ্ধান্তে আমি অটল। মনে করবেন না যে, আমি মিশর সরকারের কাছে তোমার বিরুদ্ধে নালিশ করবো। কারণ, তোমার বিদেশীরাতো মিশর সরকারের হাত-পা বেঁধে রেখেছ। কোন না কোন উপায়ে নিজের মর্যাদা পুনর্বহাল না করে আমি শান্ত হবো না।

মিঃ সভল্যান্ট বললোঃ মনে হচ্ছে যেন কোন সূত্রধরের সঙ্গে নয়, বরং একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে আমি কথা বলছি! তুমি কি জান না যে, আমি সুয়েজ কোম্পানীর চীফ ইঞ্জিনিয়ার? সুতরাং আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইবো, তুমি কেনম করে তা কল্পনা করতে পার?

ভাই হাফেয জবাব দেন: আপনার কি জানা নেই যে, সুয়েজ কোম্পানী আমার দেশে রয়েছে, তোমার দেশে নয়। সুয়েজ কোম্পানীর উপর তোমাদের অধিকার সাময়িক। শেষ পর্যন্ত তার মালিকানা আমাদের হাতে আসবে। তখন তুমি আর তোমার মতো এমন আরো অনেকেই হবে আমাদের কর্মচারী। সুতরাং আমি নিজের অধিকার ত্যাগ করবো, তুমি তা কেমন করে কল্পনা করতে পার?

এসব কথাবার্তার পর মিঃ সভল্যান্ট পুনারায় পায়চারী শুরু করে। কিছুক্ষণ পর পুনরায় সে ভাই হাফেযের কাছে আসে। এখন রাগে-ক্ষোভে তার চেহারা ঘর্মাক্ত। সে কয়েক দফা সজোরে টেবিলে করাঘাত করে। বলে: হাফেয, আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি এবং আমার কথাগুলো প্রত্যাহার করছি। ভাই হাফেয ধীরে সুঙ্গে উঠে দাঁড়ান এবং মিঃ সভল্যান্টকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে কাজ শুরু করেন। অল্পসময়ের মধ্যে তিনি কাজ শেস করেন।

কাজ শেষ হলে মিঃ সভল্যান্ট ভাই হাফেযকে একশ ৫০ ক্রোশ দান করেন। হাফেয একশ ৩০ ক্রোশ গ্রহণ করে বাকী ২০ ক্রোশ ফেরত দেন। সভল্যান্ট বললেন, এই ২০ ক্রোশও গ্রহণ কর। এটা তোমাকে বখশিখ দিলাম।

কিন্তু হাফেয বললেন: না, না, কিছুতেই হবে না। অধিকারের চেয়ে বেশ নিয়ে আমি ‘লূটেরা’ হতে চাই না।

মিঃ সভল্যান্ট এ জবাব শুনে হতভম্ব হয়ে যায়। বলে, আমার অবাক লাগে; সকল আরব কারিগর কেন তোমার মতো হয় না? তুমি কি মোহামেডান ফ্যামিলীর লোক?

হাফেয বললেন: মিঃ সভল্যান্ট, সব মুসলমানই মোহামেডান ফ্যামিলীর লোক। কিন্তু তাদের মধ্যে কিছু লোক ‘সাহেবদের’ সঙ্গে থেকে তাদের অনুকরণ করা শুরু করেছে। আর এভাবে তাদের স্বভাব-চরিত্র নষ্ট হয়ে যায়।

মিঃ সভল্যান্ট এ কথার কোন জবাব দেয় না। করমর্দন করার জন্য সে হাত বাড়ায়। বলে: মুতাশাককের, কাতুরা খায়রুন (শুকরিয়া, শুকরিয়া, তোমার অনেক মঙ্গল হোক)। এই বলে বিদায় নেয়।

ভাই হাসান মারসী এক জায়গায় কাজ করতেন এবং রেডিও বাক্সের উন্নতমানের নমুনা তৈরী করতেন। তখন একটা রেডিও বাক্স তৈয়ার করতে প্রায় এক পাউন্ড ব্যয় হতো। তিনি যার কাছে কাজ করতেন, তার নাম ছিল মানিও। মানিওর জনৈক বন্ধু তার নিকট আগমন করতঃ গোপনে তার সঙ্গে কথা বলে যে, ভাই হাসান তার জন্য কয়েকটা বাক্স তৈয়অর করে দেবেন অর্ধেক দামে। শর্ত হচ্ছে, এ সম্পর্কে মানিওকে কিছুই বলা যাবে না। এভাবে প্রতিটি বাক্সে ভাই হাসান পাবেন অর্ধেক পাউন্ড আর মানিওর লাভ হবে এই যে, অর্ধেক মূল্যে সে বাক্স পেয়ে যাবে। ভাই হাসানের উপর মানিওর ছিল অগাধ আস্থা। ওয়ার্কশপের সমস্ত কাঁচাকাল আর যন্ত্রপাতি সে ভাই হাসানের হাতে ছেড়ে দিয়েছিল। মানিওর বন্ধু এই আস্থার অবৈধ সুবিধা আদায় করতে চেয়েছিল। কিন্তু ভাই হাসান এর জবাবে তাকে একটা কড়া নৈতিক শিক্ষা দেন। তিনি বলেনঃ

কেবল ইসলামই নয়, বরং দুনিয়ার সকল ধর্মই খেয়ানত তথা অসাধুতাকে হারাম মনে করে। আমার প্রতি যার রয়েছে অগাধ আস্থা, তার সঙ্গে খেয়ানত করা আমার পক্ষে অসম্ভব। আমাকে অবাক হতে হচ্ছে যে, তাঁর বদ্ধু এবং তাঁর ধর্মের লোক হয়েও এমন খেয়ানতের কথা আপনি চিন্তা করতে পারছেন। আর এ জন্য আমাকেও উস্কানী দিচ্ছেন। এ জন্য আপনার লজ্জিত হওয়া উচিত। আপনি নিশ্চিত থাকবেন যে, আপনার এ আচরণ সম্পর্কে আমি মানিওকে কিছুই জানাবো না। এমনটা করলে আমি হবো আপনাদের দু’জনের বন্ধুত্ব নষ্ট করার কারণ। তবে একটা শর্ত দিচ্ছি যে, ভবিষ্যতে আর কখনো আপনি আমার সঙ্গে এমন আচরণ করবেন না।

লোকটার দুর্বুদ্ধি ছিল অনেক। সে বললো: আমি নিজেই মানিওকে বলবো যে, আপনার কারিগ র আমার কাছে এমন প্রস্তাব দিয়েছে, আমার বিশ্বাস, মানিও আমার কথা বিশ্বাস করবে। ফলে তোমাকে কানে ধরে ওয়ার্কশপ থেকে বের করে দেবে। তার কাছে তোমার যে আস্থা আর সম্মান রয়েছে, সবই শেষ হয়ে যাবে। সুতরাং তোমার জন্য মঙ্গলজনক হচ্ছে আমার কথা মতো কাজ করা।

ভাই হাসানের রাগ ধরে। তিনি বললেন, তোমার যা খুশী, করতে পার। ইনশাআল্লাহ তুমি অপদস্ত হবে।

লোকটা ভাই হাসানকে যে হুমকি দিয়েছিল, বাস্তবে তাই করলো। ওয়ার্কশপের মালিক ব্যাপারটা অনুসদ্ধান করলেন। সত্যের আলো মিথ্যার অন্ধকার দূরীভূত করলো। ভাই হাসান আসল ব্যাপারটা মানিওকে খুলে বললেন। মানিও ভাই হাসানের কথায় কোন রকম সন্দেহ করলো না। অবশেষে কপট বদ্ধুকে ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বের করে দিলেন এবং তার সঙ্গে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করলেন। আমানতদারী আর বিশ্বস্ততার জন্য ভাই হাসানের বেতন বৃদ্ধি করলেন।

আব্দুল আযীয গোলাম নবী ছিলেন আমাদের সাথী। মূলতঃ তিনি ছিলেন হিন্দুস্থানের লোক। ইংরেজ সেনানিবাসে তিনি দর্জীর কাজ করতেন। একজন বড় অফিসারের স্ত্রী তাঁকে কাজের কথা বলে বাংলোয় নয়ে যায় এবং নানা কৌশলে তাঁকে অপকর্মে প্ররোচিত করতে থাকে। কিন্তু তিনি প্রথমে তাকে উপদেশ দ্বারা বুঝাবার চেষ্টা করেন। পরে তাকে তিরস্কারও করেন। কিন্তু মেম সাহেব কখনো আব্দুল আযীযকে হুমকী দেন যে, আমি উল্টা সাহেবের কাছে তোমার হাত বাড়াবার নালিশ করবো। আবার কখনো তার প্রতি পিস্তল তাক করে ধরতেন। কিন্তু আব্দুল আযীয তার ভুমিকায় অটল। তিনি এতটুকুও নড়বড় করেন না। তিনি বললেনঃ

**********************************

“আমি আল্লাহ রাব্বুল আলামীনকে ভয় করি”।

উভয়ের বিবাদ একটা কৌতুককর, এমনকি একটা হাস্যকর দৃশ্যের অবতারণা করেছে। একদিকে সে লম্পট আর কপট রমণী নিতান্ত আস্থার সঙ্গে আব্দুল আযীযকে এ ধারণায় ফেলে, যার ফলে সে রমণী আব্দুল আযীযকে হত্যা করতে উদ্যত হতে পারে। আর এর যুক্তি খাড়া করায় যে, আব্দুল আযীয তার উপর হামলা চালিয়েছে এবং অসৎ উদ্দেশ্যে তাকে জাপটে ধরেছে। আর সে রমণী কার্যতঃ আব্দুল আযীযের প্রতি পিস্তল তাক করে ধরে। আব্দূল আযীযও নিশ্চিত যে, এটাই তার জীবনের শেষ মুহূর্ত। তাই তিনি চক্ষু বন্ধ করে চিৎকার দিয়ে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ পড়তে থাকেন। তাঁর চিৎকারে রমণীর অন্তর থরথর করে কেঁপে উঠে। পিস্তল তার হাত থেকে পড়ে যায়। উড়ে যায় তার হাতের পাখি। ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয় আব্দুল আযীযকে ঘর থেকে। আব্দুল আযীয বাংলো থেকে বেরিয়ে সোজা ইখওয়ানের অফিসে এসে সমস্ত ঘটনা খুলে বলে।

প্রথমদিকের ইখওয়ানরা ছিলেন এ ধরনের। তাদের নৈতিক পবিত্রতা আর রূহানী বলিষ্ঠতা সম্পর্কে অনেক ঘটনা উল্লেখ করা যায়। এই নিষ্ঠা, ইখলাস আর লিল্লাহিয়াতের বদৌলতে আল্লাহ তা’আলা এ দাওয়াতে অনেক বরকত দান করেছেন। অনেকেন অন্তরকে তিনি এমনই আলোকধন্য আর পূত-পবিত্র করেছেন। আল্লাহ বলেন,

**********************************

পবিত্র বাক্য হলেঅ পবিত্র বৃক্ষের মতো, যার শিকড় মজবুত এবং শাখা আকাশে উত্থিত। সে পালনকর্তার নির্দেশে অহরহ ফলদান করে। আল্লাহ মানুষের জন্য দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেন- যাতে তারা চিন্তা-ভাবনা করে (সূরা ইবরাহীমঃ ২৪-২৫)।

এরপর ছুটির সময় এসে পড়ে। আমি এ সময়টার কিছু অংশ কায়রোয় আর কিছু অংশ মাহমূদিয়ায় অতিবাহিত করি। এ সময়ে মাহমূদিয়ার হোছাফিয়া জামায়াত শৃংখলা আর লক্ষ্য- উদ্দেশ্যের দিক থেকে ঠিক অনুরূপ নতুনরুপ ধারণ করে, যেরূপ ধারণ করেছিল ইসমাঈলিয়ায় আমাদের দাওয়াত। অর্থাৎ ইখওয়ানুল মুসলিমূন-এর ধরনের রূপ আর সংগঠনে পরিণত হয় হোছাফিয়া জামায়াত। ছুটি শেষে আমি ইসমাঈলিয়া ফিরে আসি। আমার শিক্ষকতার দ্বিতীয় বর্ষ অসংখ্য আনন্দঘন আর ব্যক্তিগত ও দায়াতী গুণাবলীতে ভরপুর ছিল।

হেজায গমনের প্রোগ্রাম

এ দীর্ঘ সময়টায় জমিয়তে শুব্বানুল মুসলিমীন তথা মুসলিশ যুবদলের সঙ্গে আমার যথারীতি সম্পর্ক বহাল থাকে। আমিও নিজের পক্ষ থেকে জমিয়তকে অনেক রিপোর্ট, সমালোচনা আর পর্যালোচনা প্রেরণ করি। জমিয়তের দায়িত্বশীল মহলও আমাদের আত্মিক সম্পর্ক পুরোপুরি অনুভব করতেন। কায়রো থেকে দূরে অবস্থান করা সত্ত্বেও যা আমাদেরকে এক অপরের সঙ্গে যুক্ত করে রেখেছিল। বাদশাহ আব্দুল আযীয ইবনে সউদের উপদেষ্টা হাফেয ওয়াহাবা কায়রো আগমন করেন এবং তিনি শিক্ষা বিভাগের পক্ষ থেকে কিছু সংখ্যক শিক্ষক হেজায নিয়ে যেতে চান, যারা নব প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসাগুলোতে শিক্ষকতার দায়িত্ব পালন করবেন। মিশর সরকার তখনো সউদী সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি (সুলতান আব্দুল আযীয হেজাযে শরীফে মক্কার শাসনের অবসান ঘটিয়ে হেজাযকে তাঁর শাসনাধীন করে নেন। মিশর সরকার আব্দুল আযীয ইবনে সউদের সঙ্গে বিরোধের কারণে দীর্ঘদীন হেজায অধীকারকে স্বীকৃতি দেননি)। এটা ছিল ইংরেজদের কূটকৌশল। দু’ভাইয়ের মধ্যে বিচ্ছেদের নীতিই ইংরেজেদের রাজনীতির মূলকথা। মিশর জাতি ছিল এহেন অস্বাভাবিক পরিস্থিতির বিরোধী। মিশরের শিক্ষিত শ্রেণী হেজাযের নব জাগরণের মধ্যে নিজেদের আশা-আকাঙ্খার চমক এবং নিজেদের কামনার ব্যাখ্যা দেখতে পাচ্ছিলো। হাফেয ওয়াহাবা জমিয়তে শুব্বানুল মুসলিমীন-এর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন এবং শিক্ষক বাছাইয়ে জমিয়তের সহযোগিতা কামনা করেন। সাইয়্যেদ মুহিব্বুদ্দীন আল- খতীব আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এ বিষয়ে কথাবার্তা বলেন। আমি নীতিগতভাবে তাঁর সঙ্গে একমত হই। এরপর জমিয়তে শুব্বানুল মুসলিমীনের সেক্রেটারী ওস্তাদ মাহমূদ আলী ফযলী ১৯২৮ সালের ৩ই অক্টোবর আমাকে লিখেন:

প্রিয় বান্না‍! সালাম ও শুভেচ্ছা! আশা করি ভালো আছেন। ওস্তাদ মুহিব্বুদ্দীন আল-খতীব হেজাযে শিক্ষকতার ব্যাপারে আপনার সঙ্গে কথা বলেছেন। আব্দুল হামীদ বেক সাঈদ আমার নিকট পয়গাম প্রেরণ করেছেন আপনাকে অবহিত করার জন্য যে, আপনি শিক্ষামন্ত্রীর বরাবরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দরখাস্ত লিখবেন। তাতে এ আগ্রহ ব্যক্ত করবেন যে, মক্কা শরীফের আল-মা’হাদুস সউদীতে আপনি  শিক্ষক হিসাবে যোগ দিতে চান। এ শর্তে যে, মিশরের শিক্ষা বিভাগে চাকুরীর অধিকার সংরক্ষিত থাকবে এবং ফিরে আসার পর আপনার সমপেশার সঙ্গীরা যেসব ভাতা আর সুযোগ-সুবিধা লাভ করবে, তা আপনাকেও দেওয়া হবে। আমি আশা করছি আপনি এ মর্মে অতি সত্ত্বর দরখাস্ত করবেন, যাতে তা মন্ত্রিসভার বৈঠকে পেশ করা যায়। সবশেষে আমার উষ্ণ অভিনন্দন গ্রহণ করুন।

এরপর ১৯৮২ সালের ৬ই নভেম্বর আমি আরো একখানা পত্র পাই। এত জমিয়তে শুব্বানুল মুসলিমীন-এর প্রধান কর্মকর্তা ড. ইয়াহইয়া দারদীরী প্রাথমিক কথাবার্তার পর লিখেন:

আমি আশা করি আপনি দয়া করে আগামী বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাতটায় পত্রিকা অফিসে আগমন করবেন। সেখানে শাহ ইবনে সউদের উপদেষ্টা জাহাপনা হাফেয ওয়াহবার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। তাঁর সঙ্গে আলোচনা করে সফরের প্রোগ্রাম এবং মক্কা শরীফের মাদ্রাসায় শিক্ষকতার কাজের শর্তাবলী চূড়ান্ত করবেন। আমরা আপনার আগমনের অপেক্ষায় থাকবো। আমার চরম ভক্তি আর উষ্ণ অভিনন্দন গ্রহণ করুন।

নির্ধারিত সময় আমাদের সাক্ষাৎ হয়। আমি হাফেয ওয়াহাবার সম্মুখে গুরুত্বপূর্ণ যে শর্ত পেশ করি, তা হচ্ছে এই যে, আমাকে নিছক বেতনভূক কর্মচারী বিবেচনা করা যাবে না, যার কাজ হবে নির্দেশ গ্রহণ আর তা বাস্তবায়ন করা; বরং আমাকে একটা বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গির ধারক-বাহক মনে করতে হবে। আমি চেষ্টা করবো, যাতে একটা নব প্রতিষ্ঠিত রাষ্ঠ্রে আমার দর্শন সুন্দর পরিবেশে বাস্তবায়িত হতে পারে। যে রাষ্ট্র হচ্ছে ইসলাম আর মুসলমানদের আশা-আখাঙ্খার কেন্দ্রস্থল। যে নব প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের ব্রত হচ্ছে কিতাবুল্লাহ এবং সুন্নাতে রাসূলের অনুসরণ এবং সালফে সালেহীনের রীতি অনুসন্ধান। বাকী থাকে অন্যান্য বিষয়, যেমন বিনিময় কি হবে, আর বস্তুগত কি কি সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যাবে। আমরা আদপেই এসব প্রসঙ্গ তুলিনি। হাফেয ওয়াহাবা আমার এহেন আগ্রহে আনন্দ ব্যক্ত করেন এবং আমাকে কথা দেন যে, তিনি মিশরের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন এবং এ ব্যাপারে তাঁর সঙ্গে সমঝোতার পর আমাকে অবহিত করবেন। এরপর আমি ইসমাঈলিয়া ফিরে যাই। হাফেয ওয়াহাবা ১৯২৮ সালের ১২ই নভেম্বর আমাকে লিখেন:

শ্রদ্ধেয় ওস্তাদ হাসানুল বান্না! আমার শ্রদ্ধা আর অভিনন্দন গ্রহণ করুন। আমি আজ মহামান্য পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি এবং আপনার বিষয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি আমাকে বলেছেন যে, আপনি তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলে তিনি আনন্দিত হবেন এবং আপনার হাতে শিক্ষামন্ত্রীর নামে একখানা পত্রও দেবেন। আপনার সঙ্গে আরো যারা হেজায গমন করতে চান, শিক্ষামন্ত্রী সকলের সঙ্গে পরিপূর্ণ সহযোগিতা করতে প্রস্তুত আছেন। আমার উষ্ণ শ্রদ্ধা গ্রহণ করুন।

আমি ইসমাঈলিয়া থেকে কায়রো আগমন করি এবং হাফেয ওয়াহাবাকে নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। খুব সম্ভব তখন শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন আহমদ পাশা লুতফী। কিন্তু তাঁকে পাওয়া যায়নি। এরপর আমি ইসমাঈলিয়া ফিরে যাই। হাফেয ওয়াহাবা যথারীতি চেষ্টা অব্যাহত রাখেন। কিন্তু তিনি সফল হননি। মিশর সরকার তখন পর্যন্ত হেজায সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি- এ প্রতিবন্ধকতা অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।

আমি হাফেয ওয়াহাবাকে একখানা পত্র লিখি। তাতে জানতে চাই যে, তাঁর চেষ্টা কতদূর পৌঁছেছে। জবাবে তিনি লিখেনঃ

আসসালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু।

উচ্চতর সম্মান আর শ্রদ্ধা প্রদর্শনপূর্বক আরয এই যে, আপনার পত্র পেয়ে প্রীত হয়েছি। অতীব দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে যে, শিক্ষামন্ত্রী আমাদের আবেদন নাচক করে দিয়েছেন। অথচ পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং শিক্ষামন্ত্রী স্বয়ং আব্দুল হামীদ বেক সাঈদকে দরখাস্ত গ্রহণ করা সম্পর্কে আশ্বাস দিয়েছিলেন। যাই হোক, আমি আমার চেষ্টা অব্যাহত রাখবো। আল্লাহ তা’আলা আমাদের সকলকে তাঁর সন্তুষ্ঠি লাভের তাওফীক দান করুন। আমার সম্পর্কে আপনি যেসব পবিত্র অনুভূতি আর সৌহার্দপূর্ণ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন, সে জন্য আমি আন্তরিক শুকরিয়া জ্ঞান করছি। আমার উষ্ণ শ্রদ্ধা গ্রহণ করুন।

স্বাভাবিকভাবেই হাফেয ওয়াহাবার এসব চেষ্টা ফলপ্রসূ হয়নি (হাফেয ওয়াহাবা সউদী আরবের অন্যতম বিচক্ষণ রাজনীতিক। প্রথমে তিনি সুলতান আব্দুল আযীয ইবনে সউদের উপদেষ্টা ছিলেন। পরে তাঁকে ইংল্যান্ডে সউদী আরবের রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত করা হয়। সউদী আরবের আধুনিক ইতিহাস বিষয়ে একটা নজীরবিহীন গ্রন্হও রচনা করেছেন। যার নাম দিয়েছেন তিনি **********************************

বিংশ শতাব্দীতে জাযীরাতুল আরব। এই অধম ১৯৬৭ সালে আমীর আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুর রহমানের প্রাসাদে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছে। পরবর্তী কালে তিনি ইনতিকাল করেন- খলীল হামেদী)। আর এ মিশনের জন্য আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ওস্তাদ ইবরাহীম শূরার সহযোগিতাও গ্রহণ করা হয়।

তিনি ভালোভাবে এ মিশন পরিচালনা করেন (ওস্তাদ ইবরাহীম শূরা পরবর্তী কালে রাবেতায়ে আলমে ইললামী মক্কা মুকাররামায় ইসলামী সংস্কৃতি বিভাগে যোগদান করেন। দীর্ঘ দিন থেকে তিনি সউদী আরবে অবস্থান করছেন। রাবেতার মাসিক মুখপাত্রের প্রধান সম্পাদকও ছিলেন)। পর্যালোচনা করলে দেখতে পাবো, আগে আমরা কি ছিলাম, আর এখন আমাদের মধ্যে কি পরিবর্তন সূচীত হয়েছে। কারণ এখন মিশর সরকার উদার মনে আরয এবং ইসলামী দেশগুলোতে শিক্ষক আর প্রতিনিধি দল প্রেরণ করছে এবং সেসব দেশের সঙ্গে আমাদের সাংস্কৃতিক সহযোগিতা আশাপ্রদ উন্নতি লাভ করছে। আলহামদু লিল্লাহ।

ওয়ায আর প্রচারের পরিকল্পনা

ইসলামী দাওয়াতের প্রচার-প্রসারের অন্যতম কারণ এই ছিল যে, ওস্তাদ আল-মারাগী আল-আযহারের শায়খ থাকাকালে কোন কোন মর্যাদা সম্পন্ন সহযোগীর সহায়তায় স্বয়ং আল-আযহার জনগণের মধ্যে দীনী শিক্ষা-সংস্কৃতি প্রসারের এক পরিকল্পনা প্রণয়ন করে (আহমদ মুস্তফা আল-মারাগী ছিলেন আল আযহারের শায়খ বা রেক্টর। তিনি ছিলেন আধুনিক কালের অত্যন্ত দূরদৃষ্টি সম্পন্ন আলেমদের অন্যতম। ‘তাফসীরুল মারাগী’ নামে কুরআন মজীদের একখানা তাফসীর লিখেন। ভাষা আর বর্ণনাধারা বিচারে আধুনিক কালের জনপ্রিয় তাফসীল সমূহের অন্যতম তাঁর এ তাফসীর। ১৯৩৮ সালে ইনি ইনতিকাল করেন)। তাঁর প্রস্তাব অনুযায়ী আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ে ওয়ায ও প্রচার বিভাগ খোলা হয় এবং এ বিভাগের দায়িত্বে নিয়োজিত করা হয় বিশিষ্ট আলেম শায়খ আব্দুরাব্বিহী মিফতাহকে। এটা ছিল আমাদের দীর্ঘদিনের লালিত একটা আকাংখার প্রতিফলন। সে সময় দাওয়াতের কাজে আমার নবীন সহকর্মী এবং আল-আযহারের দায়িত্বশীল আলেমদের সঙ্গে এ বিষয়ে মতবিনিময় হয়। দাওয়াত ও প্রচারের দায়িত্ব পালনের জন্য শুরুতে যাদের নাম বাছাই করা হয়, তাদের মধ্যে প্রিয় ভাই শায়খ হামেদ আসকারিয়ার নামও ছিল। এটা আল্লাহর খাছ রহমত যে, তিনি ইসমাঈলিয়ায় নিযুক্ত হয়েছেন। ইসমাঈলিয়ায় দাওয়াতের ময়দানে আমরা একত্র হই। দাওয়াতের কাজে তিনি আমাদের জন্য বিরাট সহায়কের ভূমিকা পালন করেন।

ইসমাঈলিয়ায় ইখওয়ানের কেন্দ্র ও মসজিদ

ইখওয়ানের এক বিশেষ অধিবেশনে এ আলোচনা স্থান পায় যে, ইসমাঈলিয়ার মূল অধিবাসীদের মধ্যে আমাদের বাণী বিশেষভাবে ছড়ানো অত্যন্ত প্রয়োজন। এটা প্রয়োজন এ কারণে যে, যারা এখানে দাওয়াতের দায়িত্ব পালন করছেন, তাঁরা সরকারী কর্মচারী। তাঁরা নানা স্থানে বদলী হয়ে যান। সুতরাং জনৈক সহকর্মী দলের একটা কেন্দ্র স্থাপন করার প্রস্তাব পেশ করেন। অন্যজন এ প্রস্তাবে সংশোধনী এনে বলেন যে, কেন্দ্রের সঙ্গে একটা মসজিদও স্থাপন করা দরকার। একে তো শহরে মসজিদের অভাব। দ্বিতীয়তঃ এভাবে দলের কেন্দ্র স্থাপনে সাধারণ মানুষও আমাদের সহায়তা করবে। এ সমাবেশে উপস্থিতির সংখ্যা ছিল কুড়িজনের বেশী। সকলেই এ প্রস্তাবের পক্ষে আগ্রহ-উদ্দীপনা প্রকাশ করেন। আমি চুপচাপ এসব কথাবার্তা শুনছিলাম। এরপর আমাকে জিজ্ঞাসা করা হয় যে, এ ব্যাপারে তোমার কি মত? আমি আরয করলাম নীতিগতভাবে প্রস্তাবটা চমৎকার। কিন্তু তা বাস্তবায়ন করার জন্য কয়েকটা শর্ত প্রয়োজন। প্রথম শর্ত এই যে, এ কাজের নিয়ত হতে হবে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর জন্য। দ্বিতীয়তঃ কষ্ঠ আর ধৈর্য্য ও দৃঢ়তার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে। বিষয়টা গোপন রাখতে হবে এবং এ জন্য নীরবে একটানা কাজ করে যেতে হবে। বদান্যতার সূচনা করতে হবে নিজেদের থেকেই। এটা যদি একান্তই আপনাদের কাম্য হয়, তাহলে আলামতস্বরূপ প্রথমে আপনারা নিজেদের মধ্য থেকে ৫০ পাউন্ড সংগ্রহ করুন। এই পরিমাণ চলতি অধিবেশনেই নিজেদের মধ্যে বাঁটোয়ারা করে নিন। এরপর এক সপ্তাহের মধ্যে নিজ নিজ পরিমাণ আফেনদঈ আবু সউদের কাছে জমা করুন। এ পরিকল্পনার কথা আপনারা কারো কাছে ব্যক্ত করবেন না। কোন বিশেষ বা সাধারণ মহফিলে একথা মুখেও আনবেন না। আগামী সপ্তাহে এই রাত্রে আমরা পুনরায় মিলিত হবো। আপনার যদি তহবিল পুরা করতে পারেন এবং গোপনও রাখতে পারেন; তবে মনে করবেন যে, আল্লাহর ইচ্ছায় আপনাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হবে। নির্ধারিত রাত্রে আমরা পুনরায় মিলিত হই এবং আফেনদঈ আবু সউদের নিকট আমরা ৫০ পাউন্ড জমা করি। এ সূচনা ছিল একটা শুভ লক্ষণ এবং ইতিবাচক প্রচেষ্টার ইঙ্গিতবহ।

কোরবানীর একটা দৃষ্টান্ত

আমরা দেখতে পাই যে, ভাই আস্তী আলী আবুল আ’লা আমাদের রাত্রের বৈঠকে নির্ধারিত সময়ের আধা ঘন্টা পরে উপস্থিত হন। আমি তার কাছে এভাবে নিয়মিত বিলম্ব করার কারণ জানতে চাই। তিনি নানা ওযর দেখান, যা এ বিলম্বের কারণ হতে পারে না। তথ্যানুসন্ধান দ্বারা জানতে পারলাম যে, তিনি তহবিলে দেড়শ ক্রোশ দান করার ওয়াদা করেছিলেন। যেহেতু তাঁর কাছে এ পরিমাণ অর্থ ছিল না, তাই বাধ্য হয়ে তাঁকে সাইকেল বিক্রী করতে হয়। এখন তাঁকে অফিস থেকে ৬নং বাসে আসতে হয়। শহর থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে বাস থেকে নেমে তাঁকে পায়ে হেঁটে আসতে হয়। সাইকেলের মূল্য তিনি দারুল ইখওয়ান নির্মাণ তহবিলে দান করেন। ইখওয়ানদের অন্তরে তাঁর এ কোরবানীর বিরাট প্রভাব পড়ে। তাঁরা একটা নতুন সাইকেল ক্রয় করার জন্য চাঁদা সংগ্রহ করেন এবং এ নতুন সাইকেলটি তাঁদের ভাইয়ের নিষ্ঠাপূর্ণ ত্যাগের স্বীকৃতিস্বরূপ হাদিয়া হিসাবে পেশ করা হয়।

মসজিদের জন্য এক খন্ড জমি দান

এখন আমরা আসল অবস্থা সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে অবহিত করে তাদেরকে পরীক্ষা করতে মনস্থ করি। সুতরাং আমরা এক খন্ড জমি খুঁজতে শুরু করি; যা আমরা মূল্য দিয়ে খরীদ করবো, অথবা জমির মালিক ভালো কাজের জন্য তা দান করবে। তালাশ করতে গিয়ে আমরা জানতে পারি যে, হাজী আবদুল করীমের নিকট এমন এক খন্ড জমি আছে, যা আমাদের উদ্দেশ্যের জন্য বেশ উপযোগী। হাজী সাহেব ছিলেন বড়ই নেককার এবং মালদার মানুষ। আল্লাহ তাঁর প্রতি রহমত নাযিল করুন। আমরা এটাও জানতে পারি যে, তিনি নিজেই সেখানে মসজিদ স্থাপনের বাসনা পোষণ করেন। আমরা এ প্রসঙ্গে তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা বলি। তিনি বেশ খুশী হন এবং আমাদের আকাংখা মনযুর করেন। তাঁর সঙ্গে আমরা প্রাথমিক চুক্তি সম্পাদনাও করি। এ চুক্তির ফলে তিনি জমির মালিকানা ত্যাগ করেন। এ অভিযানকে প্রথম সাফল্য বিবেচনা করি।

কাঁটা আর প্রতিবদ্ধকতা

সব যুগে আর সব দেশেই সত্যের আহ্বানকে এমন সব বিরুদ্ধবাদীর সম্মুখীন হতে হয়, যারা সত্যের প্রতিন্ধকতা সৃষ্টি করে। সত্যের আহ্বানকে ব্যর্থ করার জন্য তারা সর্বশক্তি নিয়োজিত করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সফলতা সত্যের পদচুম্বন করে। এটাই আল্লাহর নীতি। আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ

**********************************

তোমরা আল্লাহর নীতিতে রদবদল পাবে না। (সূরা ফাতহ: ২৩)।

**********************************

তোমরা আল্লার রীতিতে পরিবর্তন পাবে না। (সূরা গাফের: ৪৩)।

**********************************

আর এভাবেই আমরা প্রত্যেক নবীর জন্য অপরাধীদের মধ্য থেকে দুশমন বানিয়েছি, হিদায়াতকারী আর সাহায্যকারী হিসাবে তোমার পালনকর্তাই যথেষ্ট। (আল ফুরকান: ৩১)।

**********************************

আর এভাবেই প্রত্যেক নবীর জন্য আমরা মানুষ আর জিনের মধ্য থেকে শক্র নিয়োজিত করে দিয়েছি। সুতরাং তারা এক অপরকে কারুকার্যখচিত কথাবার্তা শিক্ষা দেয়। তোমার পালনকর্তা চাইলে তারা তা করতে পরতো না। সুতরাং তুমি তাদেরকে আর তাদের অপরাধকে ত্যাগ কর (সূরা আন’আম: ১১২)।

**********************************

এবং আমরা তোমার পূর্বে যত নবী-রাসূলই প্রেরণ করেছি, যখনই তাঁরা কোন কিছু কল্পনা করেছেন, তখনই তাঁদের কল্পনায় শয়তান কিছু মিশ্রণ ঘটিয়েছে। অতঃপর আল্লাহ রহিত করেন শয়থানের মিশ্রণ, অতঃপর আল্লাহ সুপ্রতিষ্ঠিত করেন তাঁর আয়াতসমূহ। আর । আল্লাহ মহাজ্ঞানী, মহাপ্রজ্ঞাময়। (সূরা আল-হজ্জ: ৫২)।

ইসমাঈলিয়ায়ও ইসলামী দাওয়াতের ভাগ্যে এটাই জুটেছে। যখনই এ দাওয়াতের প্রতি মানুষের আসক্তি প্রকাশ পেয়েছে, লোকেরা যখন এর আশপাশে জড়ো হতে শুরু করেছে এবং এ দাওয়াতের কর্মীদেরকে ইজ্জত আর মর্যাদার চোখে দেখতে শুরু করেছে, তখনই কিছু স্বার্থান্বেষী লোকের মনে হিংসা-বিদ্বেষের সাঁপ দংশন করতে শুরু করেছে। তারা দাওয়াত আর দাওয়াতদাতাদের মনে নানা সংশয়-সন্দেহ সৃষ্টি করতে শুরু করে দিয়েছে। কখনো তারা বলে যে, এরা- ইখওয়ানুলম মুসলিমুন- পঞ্চম বাহিনীর রূপ নিচ্ছে। কখনো তারা বলেছে যে, এরা কতিপয় উদাসীন যুবকের দল, এদের দ্বারা কোন কাজ হবেনা; এরা কোন পরিকল্পনারও যোগ্য নয়। আবার কখনো এ অভিযোগ করা হয়েছে- এরা ভাগ্যান্বেষী আর ঠগের দল, অন্যায়ভাবে পরস্ব অপহরণ করে। এ ধরনের আরো অনেক অভিযোগ আমাদের বিরুদ্ধে উত্থাপন করা শুরু হয়। এরা যখন জানতে পারে যে, শায়খ আলী আব্দুল করীম আমাদেরকে মসজিদের জন্য এক খন্ড জমি দান করেছেন, তখনই এরা তাঁর পেছনে পড়ে এবং তাঁর জীবনকে অতিষ্ঠ করে তোলে। নানা রকম চোগলখোরী আর প্ররোচনা দ্বারা তাঁর মনকে বিষিয়ে তোলে। শায়খ আলী ছিলেন একজন সরল মনা মানুষ। তিনি তাদের কথায় প্রভাবিত হন। একটা ফেৎনা-ফাসাদের পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে শান্ত মনে ভূমি হস্তান্তরের কাগজ পত্র তাকে ফেরৎ দিয়ে আমি ফেৎনা দূর করি। কারণ, আমার মনে পূর্ণ বিশ্বাস ছিল যে, আল্লাহর সাহায্যে আমাদের পরিকল্পনা অবশ্যই সফল হবে।

কিন্তু অকল্যাণকামীরা আরো একটা মওকা পেয়ে যায়। তারা প্রোপাগান্ডা শুরু করে দেয়, আমাদের পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছে বলে। আমরাও এ সুযোগ কাজে লাগাই এবং লোকজন আমাদর দিকে ঝুকছে দে্খে পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে মানুষের মন থেকে সন্দেহ-সংশয় দূর করার চেষ্টা চালাই। আসল ব্যাপার তাদের সম্মুখে স্পষ্ট করি এবং যুক্তি-প্রমাণ দ্বারা তাদেরকে আমাদের সমর্থক করার চেষ্টা চালাই। আর এসব লোকের নিকট থেকে চাঁদা সংগ্রহের কাজও শুরু হয়। আল্লাহ তা’আলা ভাই হামেদ আসকারিয়াকে নেক প্রতিদান দিন এবং জান্নাতে তাঁর মনযিল প্রশস্ত করুন। তিনি এ ক্ষেত্রে অন্যদের চেয়ে অগ্রসর হন। এ অভিযানে তিনি এতটা শ্রম আর সময় দেন যে, তার সত্যিকার মর্যাদা কেবল আল্লাহই দিতে পারেন। তিনি অধিকাংশ রাত এশা থেকে ফজর পর্যন্ত জাগ্রত থাকেন এবং মানুষের ঘরে ঘেরে এবং দোকানে দোকানে ঘুরেন। বহুবার এমনও হয়েছে যে, এ কাজে তিনি এতটা নিমগ্ন হয়ে পড়েন যে, তিনি নিজেকেও ভুলে যান। রমযান মাসে সাহরী খাওয়ার কথাও তাঁর মনে থাকেনা। আরেকজন জিন্দা দিল সৎ স্বভাবের মানুষের কথাও আমি উল্লেখ না করে পারছি না। তিনি হচ্ছেন শায়খ মুহাম্মদ হোসাইন মামলুত। তিনিও অর্থ এবং বাস্তব সহায়তা দ্বারা আমার পরিকল্পনায় বিরাট সহায়তা করেছেন। তিনি নিজেই ৫শ পাউন্ড দান করেন। তখনো তিনি আমাদের অর্থ বিভাগের সেক্রেটারী হননি। তাঁর এ কাজ অন্যদের মনেও আস্থা আর উদ্দীপনার সঞ্চার করে। পরিকল্পনা বাস্তবায়িত না হওয়া পর্যন্ত তিনি এর পৃষ্ঠপোষকতা অব্যাহত রাখেন।

এরপর আমরা এক খন্ড জমি খুঁজতে থাকি। আরব মহল্লার শেষ মাথায় আমরা এক খন্ড জমি পাই। আমরা তা ক্রয় করি এবং দলীলে দু’জন নেককার মানুষের স্বাক্ষর নেই। একজন হচ্ছেন শায়খ মুহাম্মদ হোসাইন মামলূত আর অপর জন হাজী হোসাইন সূলী। আল্লাহ তা’আলা তাঁদেরকে প্রফুল্ল রাখুন এবং তাঁদের হায়াতে বরকত দান করুন। সংগঠনের পক্ষ থেকে তাঁরা দু’জন স্বাক্ষর করেন। সরকারের সংগঠন নীতি অনুযায়ী তখন সংগঠন গড়ে তোলা হয়। লক্ষ্য উদ্দেশ্য এবং গঠনতন্ত্রও গৃহীত হয়। একটা পরিচালক মন্ডলী এবং সাধারণ পরিষদও গঠন করা হয়।

শায়খ হামেদ আসকারিয়ার শুবরাখীত বদলী

অবশেষে স্বার্থান্বেষী মহলের শক্রতামূলক কর্মকান্ডের অবসান ঘটে। আর তা ঘটেছে এভাবে যে, তারা ওয়ায ও প্রচার বিভাগে বেনামী অভিযোগ প্রেরণ করে, যার ফলে ভাই হামেদ আসকারিয়াকে শুবরাখীত-এ বদলী করা হয়। একদিক থেকে এ বদলী দাওয়াতের জন্য কল্যাণ ও বরকতের কারণ হয়। ফলে শুবরাখীত-এও সংগঠনৈর একটা শাখা খোলা হয়। এ শাখা এতটা উন্নতি করে যে, হিফয- কুরআনের একটা মাদ্রাসাও জারী করে। সেখানে একটা বিরাট মসজিদ এবং একটা জাঁকজমকপূর্ণ ভবনও নির্মাণ করা হয় এবং মাদ্রাসা আর মসজিদের সাথে এ ভবন ওয়াকফ করা হয়। আল্লাহ তা’আলা শায়খ কাসেম জুবদকে আপনি রহমতে স্থান দান করুন। ইনি ছিলেন শুবরাখীতের একজন নেক ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিত্ব। এ প্রকল্প বাস্তবায়নে তিনি ছিলেন শায়খ হামেদ আসকারিয়ার দক্ষিণ হস্ত। সে সময় শায়খ হামেদ আসকারিয়অর ইসমাঈলিয়া ত্যাগ করে যাওয়া ছিল একটা প্রচন্ড দুঃখজনক ঘটনা। কিন্তু পরে এর বরকত ও রহস্য সকলের কাছেই প্রকাশ পেয়েছে।

সে দিনটির কথা আমি কিছুতেই ভুলতে পারবো না। সে দিনটা ছিল ভীষণ গরমের। প্রাণ বের হওয়ার উপক্রম হয়েছিল সেদিন গরমে। সেদিন বিকাল বেলা আমরা আরিশ-এ অবস্থিত বাসার সামনে বসে কাটাই। বেশ শীতল ছায়ায় আমরা বসেছিলাম। মৃদুমন্দ শীতল সমীরণ প্রবাহিত হচ্ছিল। নানা বিষয় নিয়ে আমরা কথা বলছিলাম, আমরা আকাংখার মহল নির্মাণ করছিলাম এবং নিতান্ত আত্মিক শান্তি-স্বস্তির পরিবেশে আস্থা আর দৃঢ়তার সঙ্গে সেসব আকাংখা বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করছিলাম। এ মাহফিল আমার অন্তরে চাপাপড়া একটা অনুভূতি জাগ্রত করে। আমি শায়খ হামেদ আসকারিয়া বললাম, যেমন আত্মিক শান্তি আর মানসিক সুস্থিতি আমি এখন অনুভব করছি, তা ইতিপূর্বে আর কখনো অনুভব করতে পারিনি, এ সময় আমার মনে একটা প্রবাদ বাক্য উঁকি মারে:

**********************************

(রজনী যখন মনোরম হয়, তখন তা পংকিল করার মতো বস্তুও সৃষ্টি হয়)।

আমার মানসিক প্রশান্তির স্বচ্ছ ঝণৃাকে কর্দমাক্ত করতে পারে যেসব বিষয়, তখন আমি তার গভীরে পৌঁছতে পারছিলামনা। শায়খ হামেদ আসকারিয়া আমাকে শান্তনা দিতে লাগলেন। আর এ সময় আমরা ‘দারুল ইখওয়ান’ অভিমুখে রওয়ানা হই। সেখানে গিয়ে হামেদ আসকারিয়ার বদলির চিঠি দেখতে পাই। আমরা একে অপরেও মুখপানে চেয়ে থাকি। আমরা একে অপরকে বলি, যা হয়েছে, ভালই হয়েছে। এ পরিবর্তনের ফলে নিঃসন্দেহে দাওয়াত উকৃত হবে। মু’মিন যেখানেই থাকে, কল্যাণের দূত হিসেবে কাজ করে। আমার এটাও স্মরণ আছে যে, এ ঘটনার আগে ইসমাঈলিয়ায় ওয়াজ ও প্রচার দফতরের পরিদর্শক শায়খ আব্দু রব্বিহী মিফতাহ আমাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য আগমন করেন এবং আরীশ এর বাসায় তিনি আমাদের সঙ্গে রাত্রি যাপন করেন। শায়খ মিফতাহ দেখতে পান যে, আমাদের প্রায় প্রত্যেক ভাইয়ের কাছেই বাসার চাবি ছিল। ভোরে প্রায় সকলেই নাশতা নিয়ে আসেন, কারণ সেখানে পাক করার কোন ব্যবস্থা ছিলনা। প্রীতি-ভালোবাসার এ দৃশ্য তাঁর মনে ক্রিয়া করে। তিনি অত্যন্ত মুগ্ধ হয়ে জিজ্ঞেস করেনঃ

আপনি এদের সঙ্গে কি করছেন? কিভাবে আপনি এদেরেকে এক দেহ এক প্রাণে পরিণত করে রেখেছেন? তাদের অন্তরে প্রীতি-ভালোবাসার এহেন উন্নত আত্মিক ক্রিয়ার যাদু কিভাবে আপনি সৃষ্টি করলেন?

আমি তাঁকে আরয করি; আমি কিছুই করিনি, এতে আমার কোন কীর্তির স্থান নেই। বরং এটা হচ্ছে আল্লাহ তা’আলার এ বাণীর প্রতফিলনঃ

**********************************

পৃথিবীতে যা কিছু রয়েছে, সবকিছুই ব্যয় করলেও তুমি তাদের মধ্যে ভালোবাসা সৃষ্টি করতে পারতেনা; কিন্তু আল্লাহই তাদের অন্তরে ভালোবাসা সৃষ্টি করেছেন। (সূরা আল আনফাল: ৬৩)।

গ্রীস্মের ছুটি এসে পড়ে। কিছু সময় কায়রো আর কিছু সময় মাহমূদিয়ায় অতিবাহিত হয়। স্কুল খোলা হলে আমি ইসমাঈলিয়ায় ফিরে যাই। মসজিদের পরিকল্পনা তখনো বাস্তবায়িত হয়নি। আমি লক্ষ্য করলাম, এ সম্পর্কে নানা কথাবার্তা হচ্ছে। সর্বত্র একই কথা। টিপ্পনি কেটে বলা হচ্ছে- মসজিদের পরিকল্পনা আরামের সঙ্গে ছুটি কাটাচ্ছ! এসব কথা শুনেও আমি কর্ণপাত করিনি। এ সবের জবাব দেয়ার কোন চেষ্টাও করিনি। আমি একটা মলূনীতি জানি। এ মূলনীতি দাওয়াতের কাজে অনেক উপকারে এসেছে। মুলনীতি এই:

জবাবী গুজব আর মিথ্যা দ্বারা গুজব প্রতিরোধ করা যায়না। বরং ইতিবাচক এবং কার্যকর পদক্ষেপই গুজবের অবসান ঘটাতে পারে। ইতিবাচক পদক্ষেপ মানুষের দৃষ্টি আকৃষ্ট করে এবং সকলে মুখে মুখে তা চর্চা করে। আর এভাবে নতুন গুজব, যা সত্য ও বাস্তব, মিথ্যা ও পুরাতন গুজবের স্থান গ্রহণ করবে।

এ মূলনীতি অনুযায়ী কাজ শুরু করা আমাদের জন্য প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। তাই ইখওয়ানদের সঙ্গে পরামর্শ ক্রমে আমি তখনই বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করি। আমরা দু গাড়ি পাথর ক্রয় করি। আমরা একমত হই যে, বন্দর থেকে মসজিদের স্থান পর্যন্ত নিজেরা এ এ পাথর বহন করে আনবো। আমরা তাই করেছি।

এদিনটি ইখওয়ানের পক্ষে এক মহান দিন বলে প্রমাণিত হয়েছে। সাধারণ মানুষ এ ঘটনা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা করে। তাদের বিশ্বাস জন্মেছে যে, এবার মসজিদ ঠিকই নির্মিত হবে। এটা কোন নিছুক ছেলেখেলা নয়। সাধারণ মানুষের মধ্যেও সাহস সঞ্চার হয় এবং তারাও মসজিদের জন্য চাঁদা দান করা শুরু করে। আমরা ভিত্তি প্রস্তর স্থাপনের ঘোষণা প্রচার করি। আমার মনে পড়ে যে, এ কাজের জন্য আমরা ১৩৪৮ হিজরীর ৫ই মহররম দিনটা নির্ধারণ করি। আল্লাহ তা’আলা মুহাম্মদ আফেন্দী সুলায়মানকে নেক প্রতিদান দিন। আমরা তাঁর নিকট থেকেই ভূমিখন্ড ক্রয় করেছিলাম। তিনি মসজিদের স্কীমে অংশ গ্রহণ করত: এর ন্যায্য মূল্য গ্রহণ করেন। যায়গার দখল নেওয়ার জন্যও তিনি সব রকম সহায়তা করেন। এসব ছিল আল্লাহ তা’আলার বিশেষ রহমতের প্রকাশ, আর এ স্কীমের প্রতি পদেপদে আল্লাহর তাওফীক শামিল ছিল।

ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন

মসজিদ আর মাদ্রাসা, আমরা যার নামকরণ করেছিলাম ‘দারুল ইখওয়ান’ বা ইখওয়ান ভবন-এর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপনের দিন ঘনিয়ে আসে। ইখওয়ানরা একটা সমাবেশ করে সিদ্ধান্ত নেয় যে, এ অধম ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করবে। আমি তাদেরকে বুঝবার চেষ্টা করি যে, আমি সামনে এলে স্কীমের কোন বস্তুগত লাভ হবে না। এ অনুষ্ঠানকেও স্কীমের কল্যাণে ব্যবহার করাই হবে উত্তম। তাই সকলেই বড় বড় সরকারী কর্মচারী এবং শহরের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের নাম নিয়ে ভাবতে থাকেন। মজার ব্যাপার এই দাঁড়ায় যে, আমি কোন বড় সরকারী কর্মচারীর নাম উল্লেখ করলে কোন কোন ইখওয়ান সমালোচনা করে বলতেনঃ তিনি কোন নেককার ব্যক্তি নয় যে, তাঁর দ্বারা বরকতের আশা করা যেতে পারে, আর তিনি কোন মালদার ব্যক্তিও নয় যে, তার দ্বারা কোন আর্থিক সহায়তা লাভের আশা করা যায়্ ইখওয়ানের নিকট কথাটা একটা প্রবাদ বাক্যে পরিণত হয়। অবশেষে তারা আমাকে জিজ্ঞেস করেন যে, আপনার মত কি? আমি বললাম, শায়খ মামলূত সম্পর্কে তোমাদের কি ধারণা? এ বুযুর্গ নেককার ব্যক্তিটি শুরু থেকেই তোমাদের সঙ্গে আছেন। নিজের যোগ্যতা আর টাকা পয়সা দ্বারা তিনি তোমাদের সহায়তা করেছেন। তিনি আল্লাহ তা’আলার নেককার বান্দা। তাঁর কাছে ধন-দওলাতও আছে। তাঁর হাতে তোমরা বরকত লাভ করবে এবং টাকা পয়সাও পাবে। সকলেই একবাক্যে বললো, বেশ ভালো প্রস্তাব। তাই ভিত্তি প্রস্তর স্থাপনের জন্য তাঁর ব্যাপারে সকলেই একমত হন।

নির্ধারিত তারিখে ইখওয়ানরা এক বিরাট প্যান্ডেল স্থাপন করে। সকল স্তরের লোকজনকে দাওয়াত দেওয়া হয়। বিরাট ধুমধামে বিপুল আয়োজন, শায়ক মুহাম্মদ হোসাইন যামলূত এগিয়ে এসে ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। ইখওয়ানরা এ ঘটনাকে শুভ লক্ষণ বলে মনে করে এবং ঘোষণা করে যে, আল্লাহর মেহেরবাণীতে রমযানের আগমনের পূর্বেই মসজিদ নির্মাণের কাজ সম্পন্ন হবে।

শাবরাখীত-এ একটা শাখা স্থাপন

শায়খ হামেদ আসকারিয়া শাবরাখীত-এ দাওয়াতের প্রসারে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। শাবরাখীত-এ তাঁর বদলী হওয়র কয়েক মাসের মধ্যেই সেখানে ইখওয়ানুল মুসলিম এর শাখা স্থাপন করা হয়। মুহররমের মাস এলে নবীজীর হিজরত উপলক্ষে, অনুষ্ঠান শুরু হলে এ দ্বারা আমরা বেশ উপকৃত হই এবং এ সময়েই আমরা শাবরাখীত শাখা উদ্বোধনের পরিকল্পনা গ্রহণ করি। আমরা ইসমাঈলিয়ার ভাইয়েরা একটা গাড়ীর ব্যবস্থা করি। গাড়ী চালাচ্ছিলেন ভাই হাসান আফেন্দী মুস্তফা। মহান আল্লাহর উপর ভরসা করে আমরা মাহমূদিয়া রওয়ানা হই। মাহমূদিয়ায় ভাইদের সঙ্গে রাত্রি যাপন শেষে ভোরে আমরা শাবরাখীত পৌঁছি। মাহমূদিয়ার ভাইয়েরা অপর একটি গাড়ীতে আমাদের সঙ্গে আগমন করেন এবং আমরা উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণ করি। অনুষ্ঠান শেষে আমরা ইসমাঈলিয়ায় ফিরে আসি। দশ ঘন্টায় এ সফর সম্পন্ন করি। ফেরার পথেও অনুরূপ সময় ব্যয় হয়। গাড়ীর গতি ছিল বেশ দ্রুত।

রাখে আল্লাহ মারে কে?

আমার মনে পড়ে যে, রাত দু’টায় আমরা জাফতী পৌঁছে জানতে পারি যে, নদীর উপর পুল বন্ধ করে দেয়অ হয়েছে। এখন দাহতূরা ব্যারেজ হয়ে গমন করা ছাড়া আমাদের জন্য আর কোন উপায় নেই। পথটা ছিল উঁচু-নিচু এবং আঁকাবাঁকা। এ রাস্তা সম্পর্কে ড্রাইভারের কোন জ্ঞান ছিল না এমন রাস্তায় গাড়ী চালনার কোন অভিজ্ঞতাও ছিল না তার। আরবী মাসের ১০ তারিখ ছিল। পানির উপর চাঁদের আলো পড়ছিল। চাঁদের আলোয় সবকিছু সমান মনে হতো। দাহতূরা পুল অতিক্রম করেছি বলে আমাদের ভ্রম হয়। ড্রাইভার গাড়ী চালানায় নিমগ্ন। আমরাও নিশ্চিন্তে গাড়ীতে বসে আছি। হঠাৎ ড্রাইভার গাড়ী থামালে আমরা বিচলিত হয়ে পড়ি। ভালভাবে তাকিয়ে দেখে বুঝতে পারি যে, আমরা যেখানে পৌঁছেছি, তা একটা সরু পথ। পানির মধ্য দিয়ে চলে গেছে এ সরু পথ। এ পথের প্রস্থ গাড়ীল প্রস্থের চেয়ে বেশী নয়। এর অর্থ এই যে, আমরা গাড়ী থেকে নামার চেষ্টা করলে সোজা পানিতে গিয়ে পড়তে হবে আর গাড়ী পানিতে গিয়ে পড়ার আশংকা রয়েছে। উপরন্তু তাজ্জবের ব্যাপার এই যে, গাড়ীর অগ্রভাগ এতটা সামনে চলে গেছে যে, তার আর অবশিষ্ট শুষ্ক অংশের মধ্যে কেবল এক গজ ব্যবধান রয়ে গেছে।

কোন কোন ইখওয়ান ব্যকুলতা প্রকাশ করে। তারা স্বস্থান থেকে সরবার চেষ্টা করে, কিন্তু পরিস্থিতির দাবী ছিল নিতান্ত সতর্কতা অবলম্বন করা। আদৌ নড়াচড়া না করাই ছিল একান্ত প্রয়োজনীয়। কেবল এতেই গাড়ী টিকতে পারে এবং আমাদের মনেও শ্বস্তি অর্জিত হতে পারে। এরপর কি করা যায়, তা ভেবে দেখতে হবে। এ দৃশ্য দেখে আকস্মাৎ আমার হাসি পায়। আমি খাদ্য বিভাগের দায়িত্বশীলকে বললাম, আপনি যে চা বাঁচিয়ে রেখেছিলেন, তা কোথায়? তিনি বললেন, কেন? আমি বললাম, এখন আমরা এক দফা চা পান করবো। তিনি বললেন, এহেন নাজুক মুহূর্তে আপনি পরিহাস করার কথা ভাবছেন? ইনি ছিলেন ভাই মাহমূদ আফেন্দী জা’ফরী। বড়ই হাসিখুশী, মিষ্টভাষী, প্রশস্ত চিত্তের অধিকারী এবং ভদ্র মানুষ ছিলেন তিনি। আমি তাঁকে বললাম, মাহমুদ সাহেব, আমি আপনাকে নিতান্ত সুস্থ মনে বলছি যে, চা পান করান। তিনি হুকুম তামীল করেন এবং থার্মাস থেকে চা ঢেলে দেন। আর আমরা বেশ মজা করে চা পান করতে শুরু করি। অথচ তখন আমরা মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়িয়েছিলাম। কিন্তু রাখে আল্লাহ মারে কে? আমরা সকলে, ড্রাইভার আর গাড়ী সবই যখন নিঃসাড়, তখন আমাদের দলপতি ভাই হাসান ইউসুফ, যিনি ছিলেন আমাদের ড্রাইভার, তিনি ধীরে ধীরে পেছনে সরে আসার চেষ্টা করেন। পেছনে সরে আসার গতি কেঁচোর গতির চেয়ে বেশী ছিলনা। অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে তিনি পেছনে সরতে থাকেন। প্রায় অর্ধ ঘন্টা এ অবস্থায় কেটে যায়। এরপর আমরা উপযুক্ত প্রশস্ত পথে আমি এবং শেষ পর্যন্ত আমরা বড় সড়কে উঠি। আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে ভয়ংকর বিপদ থেকে নাজাত দেন। আরো তাজ্জবের ব্যাপার এই যে, ভোর দু’টার দিকে আমরা ইসমাঈলিয়ায় পৌঁছে দেখি যে, গাড়ীতে পেট্রোল একদম নেই। কিভাবে গাড়ী চলেছে, তা আল্লাহই ভালো জানেন। মনযিলে পৌছার পরই এ সম্পর্কে আমরা জানতে পেরেছি। আল্লাহ তা’আলার মেহেরবানীর জন্য লাখ লাখ শুকরিয়া। আল্লাহ তা’আলা বান্দাহদের প্রতি বড়ই অনুগ্রহশীল।

 

গোপন পুলিশ

আমার স্মরণ আছে যে, এ সফরে দীরব নজম-এর নিকট একটা স্থানে এসে আমরা দাঁড়াই। আমাদের সম্মুখে ছিল কয়েকটা আঁকাবাঁকা কাঁচা রাস্তা। কোন পথে যেতে হবে, আমরা বুঝে উঠতে পারছিলামনা। কাউকে জিজ্ঞেস করে নেয়ার জন্য এদিক সেদিক ছুটাছুটি করে আমরা লোক খুঁজছিলাম। কিন্তু রাস্তায় বা ক্ষেত খামারে আমরা কাউকেই পেলামনা। অবশেষে এক বন্ধু কর্পোরাল মুহাম্মদ শালাশ-এর কথা আমাদের মনে পড়লো। তখন তিনি রাওজুল ফারাজ ব্রাঞ্চে কর্মরত ছিলেন। এ সফরে আমাদের সঙ্গী হওয়ার আগ্রহ ছিল তাঁর। আমাদের মনে পড়লো যে, তাঁর কাছে পুলিশের হুইসেল আছে। তিনি হুইসেল বের করে বাজালেন। হুইসেলের আওয়াজ শুনে চতুর্দিক থেকে সিপাহীলা ছুটে আসে! একজন সেপাহী এগিয়ে এসে সেলুট দেয়। তিনি জানতে চান, কে আমরা? মুহাম্মদ শালাশ জবাব দেন, ইন্টেলিজেন্স। এরপর তাঁর কানে কানে কিছু বললেন। পরে তাঁর কাছে জানতে চাইলেন, পথ কোন দিকে? সিপাহী নিতান্ত সম্মানের সঙ্গে আমাদেরকে পথ বলে দেয়। আমরা সঠিক পথ ধরি। আমি ভাই শালাশকে বললাম, তুমি মিথ্যা বললে কেন? ভাই শালাশ মৃদু হেসে বললেন, আমি মিথ্যা বলিনি। আমরাতো সত্য ও কল্যাণের পথ প্রদর্শক। আমি তাকে অন্য কিছু বললে সে আমাদেরকে থানায় নিয়ে যেতো। এছাড়া অন্য কিছুতে সে মোটেই রাজী হতোনা। আর থানায় নিয়ে গেলে না জানি সেখানে কি আচরণ করা হতো। হয়তো সকাল পর্যন্ত আমাদেরকে থানায় বসে থাকতে হতো। আমাদের হাতে একেবারেই সময় নেই। এ ছিল একটা অবাক কান্ড। আর উদ্ধার পাওয়অর উপায় ছিল আরো বেশী অবাক করার মতো।

সরকারের বিরোধিতার অভিযোগ

মসজিদের নির্মাণ কাজে আমরা সাফল্যের সঙ্গে এগিয়ে যাই। ইমারত দাঁড়ায় এবং তা শেষ পর্যায়ে পৌঁছে। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের তীব্রতাও বৃদ্ধি পেতে থাকে। চারিদিক থেকে স্বার্থপর লোকেরা উঠে দাঁড়ায় এবং ভালো কাজ সম্পন্ন করায় অন্তরায় সৃষ্টি করতে শুরু করে। আমাদের বিরুদ্ধে চক্রান্ত আর ষড়যন্ত্র করা, চোগলখোরী করা এবং বেনামী দরখাস্ত লিখে ইসমাঈলিয়ার ডেপুটি পুলিশ কমিশনার এবং অন্যঅন্য ঊর্ধতন সরকারী কর্মকর্তার নিকট প্রেরণ করা ছাড়া অন্য কোন কৌশল অবলম্বন করার ছিলনা তাদের। এ সব চেষ্টা ব্যর্থ প্রমাণিত হলে তারা একটা স্মরক লিপি প্রস্তুত করে। তাতে ইসমাঈলিয়ার কিছু অধিবাসীর স্বাক্ষর নিয়ে সরাসরি তা প্রধানমন্ত্রীর নিকট প্রেরণ করে। তখন সেদকী পাশা ছিলেন মিশরের প্রধানমন্ত্রী। এ স্মারক লিপিতে অবাক করার মতো কথাবার্তা উল্লেখ করা হয়। যেমন, বলা হয় যে, এ শিক্ষক-হাসানুল বান্না-কমিউনিষ্ট। মস্কোর সঙ্গে তার যোগাযোগ আছে। সেখান থেকে আর্থিক সাহায্য লাভ করে। সাম্প্রতিক কালে তারা একটা মসজিদ এবং কেন্দ্র নির্মাণ করছে। নিজেদের দল আর প্রচার-প্রোপাগান্ডার কাজেও অর্থ ব্যয় করে। এরা মানুষের নিকট থেকে কোন আর্থিক সাহায্য গ্রহণ করে না। তাহলে এত টাকা তারা পায় কোথা থেকে? সেকালে একটা নতূন ফ্যাশন হিসাবে মিশরে কমিউনিজম প্রবেশ করছিল এবং সেদকী পাশাও কঠোর হস্তে তা দমন করছিলেন। স্মারক লিপিতে একথাও বলা হয় যে, এ শিক্ষক ওয়াফাদ পার্টির সমর্থক এবং বর্তমান সরকার অর্থাৎ সেদকী পাশার সরকারের বিরুদ্ধে তৎপরতা চালাচ্ছে। তারা বলে বেড়ায় যে, বর্তমান পরিস্থিতিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচন ঠিক হয়নি। ১৯৩০ সালের সংবিধানও ভুল। তাই এ লোকটা বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা করার জন্য রাহীরাও গমন করেছে এবং সেখানে লেবার ক্লাবে ১৯৩০ সালের অক্টোবর মাসে একটা বক্তৃতা দিয়েছে। বক্তৃতার বিষয় ছিল আবুবকর। বক্তৃতায় সে বলেছে যে, হযরত আবুবকর সিদ্দিক (রা) এর নির্বাচন ছিল সরাসরী। তা দু’পর্যায়ে বিভক্ত ছিলনা। সুতরাং, দু’পর্যায়ে অনুষ্ঠিত নির্বাচন বাতেল ও অবৈধ। স্মারক লিপিতে এ কথাও বলা হয় যে, এ ব্যক্তিটি আমাদের মহামান্য বাদশাহ ফুয়াদের নাম এমনভাবে উল্লেখ করে, যা এখানে বলতে আমাদের লজ্জা হচ্ছে। সে লোকটা অক্টোবর মাসে আরো একটা বক্তৃতা করেছে। যার বিষয় ছিল ওমর ইবনে আব্দুল আযীয, বক্তৃতায় সে বলেছেঃ

“হযরত ওমর ইবনে আব্দুল আযীয কখনো বায়তুল মাল থেকে এক পয়সাও গ্রহণ করেননি। কিন্তু বর্তমান কালের শাসকরা অবৈধভাবে প্রজাদের সম্পদ লুটে নিচ্ছে”।

এ সময় ওস্তাদ মাহমূদ আক্কাদকে কারাগারে আটক করা হয়। কারণ তিনি বাদশাহের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে সমালোচনা করেছেন (আব্বাস মাহমূদ আক্কাদ ছিলেন মিশরের নামকরা সাহিত্যিক, ঐতিহাসিক এবং দার্শনিক। বাদশাহ প্রথম ফুয়াদ তাঁকে গ্রেফতার করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু কিছুদিন পরই তাঁকে মুক্তি দেন এই বলে যে, ইতিহাস বাদশাহ ফুয়াদের ব্যাপারে মত প্রকাশ করবে যে, লোকটা একজন সাহিত্যিককে বন্দী করেছিল। ‘আবকারিয়াত’ নামে আক্কাকের একটা সিরিজ ইসলামের ইতিহাসের মহামূল্যবান গ্রন্হ। এতে রাসূলে করীম, খোলাফায়ে রাশেদীন অন্যান্য সাহাবী আর মহিলা সাহাবীদের জীবনী বিষয়ে মূল্যবান  আলোচনা স্থান পেয়েছে)। আর একই অভিযোগে আযযাহের প্রাইমারী স্কুলের চারজন শিক্ষককেও বরখাস্ত করা হয়। স্মারক লিপিতে একথাও বলা হয় যে, এ শিক্ষক শহরের অধিবাসীদের নিকট থেকে চাঁদা সংগ্রহ করে। আর এ চাঁদা মসজিদ-মাদ্রাসার প্রকল্পের কাজে ব্যয় করে। কিন্তু এসব সংগৃহীত চাঁদা কোথা ব্যয় করা হয়, তা কেউ জানেনা। একথা লিখার সময় তারা আগের কথা ভুলে যায়। স্মারক লিপিতে তারা উল্লেখ করে যে, সরকারী বিধান অনুযায়ী সরকারী কর্মচারীদের চাঁদা সংগ্রহ করা নিষিদ্ধ। লোকটা ঠিক সরকারের নাকের ডগার উপরই লংঘন করছে সরকারী আইন।

স্মারক লিপিত এ ধরনের আরো অনেক অভিযোগ করা হয়, যার সংখ্যা ১২ পর্যন্ত পৌঁছে। এ সমস্ত অভিযোগ ছিল সরাসরী মিথ্যা আর মনগড়া। এ স্মারক লিপির বদৌলতেই আমি আল্লাহ তা’আলার এ বানীর তাৎপর্য হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছিঃ

**********************************

“হে কিতাবধারীগণ! কেন তোমরা সত্যের সঙ্গে মিথ্যার সংমিশ্রণ করছ, আর কেন তোমরা জেনে শুনে সত্যকে গোপন করছ? (সূরা আলে ইমরানঃ ৭১)।

স্মারক লিপিতে যে ভাষণের কথা বলা হয়েছে, আসলে সে ভাষণ আমি ঠিকই দিয়েছি। উল্লেখিত তারিখ আর বিষয়ও ঠিকই আছে। কিন্তু যে বিশেষ অর্থ আর ব্যাখ্যার উল্লেখ করা হয়েছে, তা ঠিক নয়। এটা প্রচারণা আর ফেৎনা সৃষ্টিতে গভীল সিদ্ধহস্ততার একটা নমুনা। সত্যের সঙ্গে মিথ্যার সংমিশ্রণে একান্ত পারদর্শী ব্যক্তিই এ কাজ করতে পারে। - আর আল্লাহ কতো রকম মানুষইনা পয়দা করেছেন! *********************

অভিযোগের তদস্ত

একদিন ভোরে আমি ক্লাশে যাচ্ছিলাম, প্রথম বা দ্বিতীয় পিরিয়ডের ক্লাশ। আমি দেখতে পাই, আমাদের প্রিন্সিপাল ওস্তাদ আহমদ হাদী সাহেব তাঁর কক্ষের সম্মুখে দাঁড়িয়ে আমাকে বিশেষ দৃষ্টিতে দেখছেন। আমি কাছে এসে বললামঃ আসসালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহ, সুপ্রভাত প্রিন্সিপাল সাহেব।

তাঁর জবাবের ভঙ্গি এমন ছিল, যা থেকে আমি বুঝতে পারলাম যে, পর্দার অন্তরালে একটা কিছু আছে। আমি বললামঃ আল্লাহর মেহেরবানীতে ভালোত? তিনি বললেনঃ হ্যাঁ, ভালোই আছি বটে!

আমি আবার বললামঃ কিছু একটা হয়েছে মনে হয়?

তিনি বললেনঃ ওস্তাদ হাসান, কিচ্ছা ক্রিমিনাল কোর্টের। প্রিয় বন্ধু, ক্রিমিনাল কোর্টের। আমরা সকলেই এতে জড়িয়ে গেছি।

আমি বললাম, কিভাবে এ ক্রিমিনিাল কোর্টে তবল করা হয়েছে?

প্রিন্সিপাল সাহেব বললেনঃ প্রধানমন্ত্রী পক্ষ থেকে শিক্ষামন্ত্রীর নামে একটা পত্র এসেছে। এতে বলা হয়েছে যে, আপনি কমিউনিষ্ট এবং বর্তমান সরকারের বিরোধী। আপিনি শাহেরও বিরোধী এবং তামাম দুনিয়ার বিরুদ্ধে।

আমি বললামঃ কেবল এতুকুই! আলহামদু লিল্লাহ। আল্লাহর কসম করে বলছি, পাশা সাহেব, আমরা নিরপরাধ। আপনি আল্লাহর এ বাণী শুনে রাখুনঃ

**********************************

“আল্লাহ অবশ্যই মুমিনদেরকে হেফাযত করবেন। অকৃতজ্ঞ বিশ্বাস ঘাতকদেরকে আল্লাহ কিছুতেই জালোবাসেননা। (সূরা হজ্বঃ ৩৮)।

আর যদি আমাদের এ জিহাদ, দ্বীনের এ দাওয়াত লোকদেরকে ধোঁকা দেয়ার জন্য হয়ে থাকে, তবে আপনি নিশ্চিৎ থাকুন যে, যারা দুনিয়ার ভয়ে দ্বীনের অন্তরালে লোকজনকে ধোঁকা দেয়, ক্রিমিনিাল কোর্ট আর জাহান্নামও তাদের জন্য সামান্য শাস্তি। সুতরাং আপনি কোন পরোওয়া করবেননা। ব্যাপারটা আল্লাহর হাতে ছেড়ে দিনঃ

**********************************

“আর নিপীড়নকারীরা অবিলম্বে জানতে পারবে, কোন গন্তব্য স্থলে তারা প্রত্যবর্তিত হবে (সূরা শু’আরাঃ ২২৭)।

আমি আপনাকে কসম করে বলতে পারি যে, মঙ্গল ভিন্ন এর পরিণাম অন্য কিছুই হবেনা। অনুমতি চাইছি। আমার পিরিয়ডের কিছু সময় কেটে গেছে। এটা নিয়ম-শৃংখলার পরিপন্হী, যা আমি পছন্দ করি না।

আমি প্রিন্সিপাল সাহেবকে সেখানে রেখে ক্লাশরুমে গমন করি। প্রিন্সিপাল সাহেব আমার জবাব শুনে আঙ্গুলে কামড়ান। কিন্তু আমার মনে ছিল পূর্ণ আস্থা। আমি মনে করি যে, এটা শিশু খেলা ছাড়া আর কিছুই নয়। এহেন আচরণের যে ফল হয়ে থাকে, এর ফলও তাই হবে। অর্থাৎ ব্যাপারটাকে তুচ্ছ জ্ঞান করে আবর্জনার স্তুপে নিক্ষেপ করা হবে। প্রিন্সিপাল সাহেবকে নির্দেশ দেয়া হয় প্রধানমন্ত্রীর পত্রে যেসব বিষয়ের উল্লেখ করা হয়েছে, ভালোভাবে তা অনুসন্ধান করে দেকার জন। এ অনুসন্ধান কার্যে সব রকম উপায় অবলম্বন করার জন্যও তাঁকে বলা হয়েছে। যেসব কপিতে আমি পাঠ প্রস্তুত করি, তা-ও খুঁজে দেখতে বলা হয়েছে। ছাত্রদের মুখস্ত করা বা অধ্যয়ন করা এবং রচনা লেখার জন্য যেসব বিষয় আমি নির্ধারণ করে দেই, তারও খোজ-খবর নিতে বলা হয়েছে। সংগঠনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য-কর্মপন্হা এবং গতি-বিধির খোঁজ-খরব নিতেও বলা হয়েছে। এসব বিষয়ে তাঁকে স্পষ্ট রিপোর্ট আর মতামত দিতেও বলা হয়েছৈ। এ অভিযানে তিনি যা ভালো মনে করেন, তা করা ছাড়া তার কোন উপায় ছিল না। তিনি অনুসন্ধনে স্থানীয় আদালতের জজ, প্রসিকিউটিং অফিসার, পুলিশ ইন্সপেক্টর এবং ডেপুটি পুলিশ ইন্সপেক্টরের সহায়তাও গ্রহণ করেন। এসব পদের যেসব অফিসার অন্যত্র বদলী হয়ে গেছেন, চিঠি পত্রের মাধ্যমে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেও তিনি তথ্য সংগ্রহ করেন। তিনি এসব তথ্য সংগ্রহ করেন এবং সংগঠনের গঠনতন্ত্র, লক্ষ্য উদ্দেশ্য এবং তৎপরতাসহ একটা বিস্তারিত রিপোর্টও তৎসঙ্গে সংযুক্ত করেন। ছাত্রদের কপি ঘাটাঘাপি করে রচনা লিখার প্রথম যে বিষয়টা তিনি উদ্ধার করেন, তা ছিল বাদশাহ ফুয়াদের সুয়েজ খাল অঞ্চলে সফর বিষয়ে। পোর্ট সাঈদ থেকে সুয়েজ খাল পর্যন্ত এলাকায় এ সফর করেন। রচনায় বাদশাহ ফুয়াদের প্রশংসা করা হয় এবং তাঁর ভালো কীর্তির উল্লেখ করা হয়। প্রিন্সিপাল সাহেব তাঁর রিপোর্টে এ রচনাটা অক্ষরে অক্ষরে উল্লেখ করেন। আমার যতদূর মনে পড়ে, একজন ছাত্রের কপিও এর সঙ্গে যুক্ত করেন। তিনি বিষয়টার প্রতি অস্বাভাবিক গুরুত্ব দেন। কারণ, তাঁর বিরুদ্ধেও অভিযোগ ছিল যে, তিনি ওয়াফাদ পার্টির সমর্থক। আর সরকারী পতে এ বিষয়টাকেই বড় করে দেখা হয়েছে। এ সুযোগে তিনি সত্য উদ্ধারের সঙ্গে সঙ্গে নিজের প্রতিরোধও করেন।

একটা সাক্ষ্য

এ সময় একটা অবাক করার মতো ঘটনা ঘটে। তখন ইসমাঈলিয়ায় উর্ধতন পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন কাপ্তান হাসান শরীফ নাবায়ূসী। রিপোর্ট প্রণয়ন কালে সরকারী পত্রে যেসব মিথ্যা অভিযোগের উল্লেখ ছিল, তা দেখে তিনি বিস্মিত হন। একদিন সুয়েজ কোম্পানীর অ-মিশরীয় ক্লার্কদের মধ্যে কোন একজন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসে। উক্ত ক্লার্ক জিজ্ঞেস করে, আপনার চেহারায় অস্থিরতার ছায়া কেন? তিনি সব কথা খুলে বললেন। শুনে ক্লার্ক বললোঃ

এসব বাজে কথা। আমি নিজেই দেখেছি, যেদিন বাদশাহ ফুয়াদ ইসমাঈলিয়া হয়ে গমন করেন, সেদিন শায়ক হাসানুল বান্না শ্রমিকদেরকে বলেছিলেন, তোমাদেরকে উপস্থিত হয়ে বাদশাহকে অভিনন্দন জ্ঞাপন করতে হবে যাতে সেখানে অবস্থানুযায়ী বিদেশীলা বুঝতে পারে যে, আমরা বাদশাহকে সম্মান করি এবং তাঁকে পছন্দ করি। এর ফলে তাদের অন্তরে স্বয়ৃং আমাদের মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে। তিনি একথাও বলেন যে, আমার নিজের চক্ষে দেখা সাক্ষ্য ফরাশী ভাষায় লিখে দিতেও আমি প্রস্তুত।

আমার মনে পড়ে যে, তিনি লিখিত সাক্ষ্য দান করেছেন এবং তার সাক্ষ্যও ফাইলে নথিভুক্ত করা হয়েছে। খুব সম্ভব তাঁর নাম মসিও তাওফীক ক্রুজ। আমার শেষ সময় পর্যন্ত ইনি ইসমাঈলিয়ায় ছিলেন।

আরো অবাক করার মতো একটা ঘটনা ঘটে। এ প্রসঙ্গে অপর এক পুলিশ অফিসারের রিপোর্টে বলা হয়ঃ

পুলিশের শাস্তিমূলক কাজ যাদের কোন কাজে আসেনা, অপরাধ সংগঠন থেকে যাদেরকে বিরত রাখতে পারেনা, এমন লোকদের জন্য ইখওয়ানের অনুসৃত রূহানী পরিকল্পনা বেশ কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। ইখওয়ানের রূহানী তরবিয়তের বদৌলতে অনেক অপরাধী সরল পথে এসেছে এবং সরলতা আর দৃঢ়তার আদর্শে পরিণত হয়েছে। সুতরাং, তারা অর্থাৎ পুলিশ অফিসার প্রস্তাব পেশ করছে যে, সরকারের উচিৎ ইখওয়ানের সহায়তা করা এবং সারা দেশে ইখওয়ানের শাখা প্রসারিত করা। কারণ, তাদের দ্বারা জন নিরাপত্তা আর জনগণের সংশোধনের কাজ বেশী পরিমাণে সাধিত হতে পারে।

ইখওয়ানের সদস্য হলেন শিক্ষা পরিদর্শক

তদন্ত রিপোর্ট সম্বলিত বিরাট ফাইল ইসমাঈলিয়ার প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়। যতদূর আমার মনে পড়ে, তখন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন আলী মাহের। কিছুদিন পর ইসমাঈলিয়ার প্রাথমিক শিক্ষা ইন্সপেক্টর জেনরেল আলী বেক কীলানী আমাদের স্কুলে আগমন করেন। দ্বিতীয় পিরিয়ডে তিনি আমার ক্লাশে আগমন করেন। তাঁর সঙ্গে প্রিন্সিপাল সাহেবও ছিলেন। বেশ মনোযোগের সঙ্গে তিনি আমার পাঠদান শুনেন। এরপর হেসে প্রিন্সিপালকে বললেনঃ ইনি নাকি উস্তাদ হাসান?

প্রিন্সিপাল বললেনঃ জি-হ্যাঁ, ইনিই ওস্তাদ হাসান।

আমার হাসি পায়। বললামঃ জি জনাব, এ লোকটাই রহস্যজনক কাজকারবার করে। এরপর তাঁরা দু’জনেই চলে যান। ক্লাশ শেষে আমি কক্ষ থেকে বের হই। ইন্সপেক্টর জেনারেল প্রিন্সিপালের কক্ষে ছিলেন। আমি কক্ষে গিয়ে তাঁকে সালাম করি। তাঁর কাছে জানতে পেলাম, আজ রাত্রে তিনি ইসমাঈলিয়ায় অবস্থান করবেন। আমাকে বললেন, ওস্তাদজি, তোমার পত্রতো আমাদেরকে ব্যাকুল করে তুলেছে! প্রধানমন্ত্রী চিঠিটা শিক্ষা মন্ত্রীর কাছে প্রেরণ করেছেন আর শিক্ষামন্ত্রী প্রেরণ করেছেন আমার কাছে।

আমি বললামঃ আমিতো কমিউনিষ্ট, সন্ত্রাসী। লাখ লাখ লোক জড়ো করি; আর হাজার হাজার লোক তার অনুসারী। যেমন, স্মারক লিপিতে উল্লেখ করা হয়েছে। সুতরাং আমি পত্রখানা ইন্সপেক্টর জেনারেল আব্দুর রহীম বেক ওসমানীর কাছে পৌঁছাই। তিনি আমার নিকট আগমন করে বললেনঃ এ শিক্ষক যদি এমনই হয়ে থাকে, তবে আমরা তাঁর সঙ্গে কেমন আচরণ করতে পারি? এতো এক বিরাট আশংকার বিষয়। আমাদের তদন্তের বাইরেও গোপন কিছু থাকতে পারে। আমরা স্মারক লিপির বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা করে দেখছি। এত যেসব বৈপরিত্য রয়েছে, তাতেই বুঝা যায় যে, অভিযোগ মিথ্যা। আমাদের মনে হয়, সবচেয়ে উত্তম হচ্ছে কাজটা প্রিন্সিপালের উপর ন্যস্ত করা। এটাই সবচেয়ে নিরাপদ। তাঁর নিকট থেকে প্রাপ্ত রিপোর্ট বিস্তারিত এবং সন্তোস জনকও। কিন্তু যে লোকটা এত বিরাট কোলাহল সৃষ্টি করেছে, তাকে দেখার জন্য আমার কৌতুহল জেগেছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে আপনাকে দেখতে এসেছি। আমার আগমনকে অনুসন্ধান মূলক বা সরকারী কার্যক্রম মনে করবেননা। আমি আপনাকে কেবল এক নজর দেখতে এসেছি।

ইন্সপেক্টর জেনারেলের এ আচরণের জন্য আমি তাঁকে ধন্যবাদ জানাই এবং সুযোগ বুঝে বলিঃ

জনাব, আপনি ঠিকই বলেছেন। আপনার এই সাক্ষাৎ আর অনুগ্রহের পরিপূর্ণতার জন্য আপনার প্রতি আমার এ অধিকার বর্তায় যে, আপনি মসজিদ আর মাদ্রাসার নির্মাণ কাজও পরিদর্শন করুন, যাতে আপনি স্বচক্ষে আমাদের দাওয়াত আর সংগঠনের কর্মকান্ড প্রত্যক্ষ করতে পারেন।

তিনি বিকালে সেকানে যাওয়ার ওয়াদা করেন। ইখওয়ানরা নিজেদেরকে প্রস্তুত করে এবং ইমারতের অভ্যন্তরে একটা অনাড়ম্বর চায়ের অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। ইখওয়ানের বক্তা আর হামদ-না’ত পরিবেশকারীরাও প্রস্তুত হয়। তিনি ওয়াদত পুরা করেন এবং নির্ধারিত সময়ে উপস্থিত হন। তাঁর ধারনা ছিল, এটা হবে একটা নিছক সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠান। কিন্তু টি পার্টির আয়োজন করা হয়েছে দেখে তিনি অবাক হন। এ সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে শহরের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এবং বড় বড় সরকারী কর্মকর্তাদেরকেও আমি দাওয়াত দেই। স্বার্থপর মহল আর স্মারক লিপিতে স্বাক্ষর কারীদেরকেও বিশেষভাবে দাওয়াত করি, যাতে তারা উপস্থিত হয়ে নিজেদের প্রোপাগান্ডার ব্যর্থতা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করতে পারে। মহফিল বেশ জমজমাট, বক্তারা একের পর এক নিজেদের মনোভাব ব্যক্ত করেন। মেহমানতো এসব দেখে রীতিমতো অবাক। বিশেষ করে তিনি আরো বেশী অবাক হন, যখন দেখতে পান যে, অনুক বক্তা ছুতার মিস্ত্রী, অমুক বক্তা মালী, অমুক বক্তা ধোপা ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব দেখে তিনি বলে উঠলেনঃ

বেশ চমৎকার। আমি অবাক করার মতো একটা মাদ্রাসা দেখতে পেলাম। বক্তৃতার পালা শেষ হলে িতন আর থাকতে পরলেন না। তিনি উঠে দাঁড়ান এবং ইখওয়ানের ব্যাজ নিয়ে তা নিজের কোটে লাগালেন। তখন ইখওয়ানের ব্যাজ ছিল সবুজ রঙ্গের তমগা। তার উপর লিখা ছিল ইখওয়ানুল মুসলিমুন। এ ব্যাজ দারণ করে তিনি নিজেই ইখওয়ানে যোগদানের কথা ঘোষণা করেন। এরপর অতি সংক্ষেপে উপস্থিত ব্যক্তি বর্গের উদ্দেশ্যে তিনি কিছু কথা বললেন। তাঁর সংক্ষিপ্ত ভাষণের এ কয়টা কথা আমার আজও স্মরণ আছেঃ

এ মাদ্রাসা আর এ দলের প্রধানের প্রশংসায় আমি কেবল এটুকুই বলতে পারি যে, এ মাদ্রাসা একটা বিরল প্রতিষ্ঠান আর এ দলের প্রধন এক বিস্ময়কর ব্যক্তিত্ব। আমি এ মুহূর্ত থেকেই ইখওয়ানুল মুসলিমুনের সদস্য হচ্ছি, যদি তোমরা আমাকে সদস্য হিসাবে গ্রহণ কর। শিক্ষক বিভাগে আমার চাকুরীর আর কয়েকটা মাস বাকী আছে। এরপরই আমি অবসর গ্রহণ করবো। আমি আপনাদের সঙ্গে অঙ্গীকার করছি যে, আমি যতো দিন বেঁচে থাকবো, আমার সময় আর শ্রম এ দাওয়াতের জন্য উৎসর্গ করবো।

মনে হয়, সময় যে ঘনিয়ে আসছে, তিনি তা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। অবসর গ্রহণের অল্প পরই তিনি দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে আখেরাতের পথে পাড়ি জমান। আমরা তাঁকে বন্ধু সহকর্মী হিসাবে গ্রহণ করি এবং দাওয়াতের কাফেলায় তাঁকে অন্তর্ভুক্ত করি। জিহাদ বিন নিয়্যত আমার জিহাদের নিয়তের অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়েছে। আল্লাহ তাঁর প্রতি রহমতের বিপুল বৃষ্টি বর্ষণ করুন।

ধর্মীয় ফের্কাবাজীর অভিযোগ

ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষের নিকট আমাদের বিরুদ্ধে যেসব আবেদন পত্র প্ররণ করা হয়, তন্মধ্যে একটা ছিল জনৈক খৃষ্টানের স্বাক্ষর করা। এতে অভিযোগ করা হয় যে, এ গোঁড়া শিক্ষক হাসানুল বান্না- যিনি সাম্প্রদায়িক সংগঠন ইখওয়ানুল মুসলিমূনের প্রধান- ইনি ক্লাসে মুসলমান আর খৃষ্টান ছাত্রদের মধ্যে পার্থক্য করেন। তিনি জেনেশুনে খৃষ্টান ছাত্রদেরকে তুচ্ছ জ্ঞান করেন। তাদেরকে কোন পাত্তাই দেন না। খৃষ্টান ছাত্রদেরে শিক্ষার প্রতি তিনি আদৌ মনোযোগ দেন না। পক্ষান্তরে মুসলমান ছাত্রদেরকে সব দিক থেকে প্রাধান্য দেন। প্রশ্ন বলে দেয়া, সাধারণ উপদেশ আর দেখাশুনাও মুসলমান ছাত্ররাই তার চোখের পুতুল। শিক্ষা বিভাগ পরিস্থিতির পরিবর্তন সাধন না করলে এবং প্রতিষ্ঠানটা এখান থেকে না সরালে এ লোকটার আচরণ এক বিরাট বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।

তদন্তের জন্য এ আবেদনপত্র যকন প্রিন্সিপালের নিকট প্রেরণ করা হয়, তখন বিষয়টা চতুর্দিকে রাষ্ট্র হয়ে পড়ে। ইসমাঈলিয়ার খৃষ্টান অধিবাসীরা তীব্র ভাষায় নিন্দা জানায়। খৃষ্টানদের একটা প্রতিনিধি দল স্কুলে আগমন করতঃ এহেন আচরণের প্রতিবাদ জানায়। অর্থোডক্স চার্চের প্রধান কর্মকর্তা এ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন। চার্চ এসোসিয়েশনের সভাপতি জর্জেস সোরেল আফেন্দী, কিবাতী কল্যাণ সংগঠনের সভাপতি জোযেফ আফেন্দী, ঊর্ধ্বতন সরকারী কর্মকর্তা ফাহমী আফেন্দী আতিয়া এবং তাদের সঙ্গে খৃষ্টানদের নানা দলের নারী-পুরুষ সদস্য সকলেই লিখিতভাবে প্রিন্সিপালের নিকট প্রতিবাদ জানান। অনুরূপভাবে গীর্জার পক্ষ থেকেও এর বিরুদ্ধে লিখিত প্রতিবাদ জানানো হয়। অনেকে পত্র দ্বারাও প্রতিবাদ জানায়। প্রিন্সিপাল তাঁর রিপোর্টের সঙ্গে এসব সংযুক্ত করে তাঁর নিজস্ব মন্তব্যসহ রিপোর্ট প্রেরণ করেন। তিনি মন্তব্যে লিখেনঃ

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতি আবেদন, তাঁরা যেন এসব বেনামী চিঠির বোঝা আমাদের উপর না চাপান। তাঁরা নিজেরাই এসব অনুসন্ধান করে দেখতে পারেন। কারণ, এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, এসব আবেদনপত্র ষড়যন্ত্রমূলক। এসবের পেছনে কোন সত্যতা নেই এবং কারো কল্যাণ সাধন করা এর উদ্দেশ্য নয়।

ইখওয়ান মসজিদ উদ্বোধন

সমস্ত প্রতিবন্ধকতা স্বত্ত্বেও আল্লাহর ইচ্ছায় মসজিদের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। রমযানের আগমনের পূর্বেই মসজিদ নামায আদায়ের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। আমার স্মরণ শক্তি অনুযায়ী এটা ছিল হিজরী ১৩৪৮ সাল। ১৭ ই রমযান এশার নামায আদায় দ্বারা মসজিদ উদ্বোধন করা হয়। এ তারিখটা ছিল বদর  যুদ্ধের সূচনার রজনী। আর এটাই হচ্ছে কুরআন মজীদ নাযিলের রাত্রি। আল্লাহ  তা’আলা বলেনঃ

**********************************

“তোমরা জেনে রাখবে যে, যে গনীমতের মাল তোমাদের হস্তগত হয়েছে, তার এক পঞ্চমাংম আল্লাহ, তাঁর রাসূল, আত্মীয় স্বজন, এতীম, মিসকীন এবং মুসাফিরে জন্য- যদি তোমরা ঈমান আন আল্লাহ এবং ঐ বস্তুর উপর, যা আমরা নাযিল করেছি আমাদের বান্দার উপর ফুরকানের দিনে এবং দু’টি দলের মুখোমুখী হওয়ার দিনে (আনফালঃ ৪১)

এ আয়াত থেকে প্রমাণিত হয় যে, এ দিনটি হচ্ছে ফুরকান তথা কুরআনের দিন। আর এ দিনটিই বদর যুদ্ধে দু’টি দলের মুখোমুখী হওয়ার দিন। আল্লাহই ভালো জানেন। ঐতিহাসিক ইবনে ইসহাক এ মতই ব্যক্ত করেছেন।

এক আজিমুশশান মাহফিলের মাধ্যমে উদ্বোধনের কাজ সম্পন্ন  হয়। এ মাহফিলে ইসমাঈলিয়া ছাড়াও শাবরাখীতের ইখওয়ানদেরকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়। ইখওয়ানরা সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নেয় যে, মসজিদে প্রথম নামাযের ইমামতি আমি করবো। এ সিদ্ধান্তের প্রতি তারা বেশ জোর দেয়। উদ্বোধনও যেন আমার হাতে হয়, এজন্যও তারা চাপ দেয়-যাতে অযোগ্য লোভাতুর ব্যক্তিদের আকাংখা ধূলিস্যাৎ হয়। কিন্তু ওস্তাদ আহমদ সাকারী, তখন যিনি ছিলেন মাহমুদিয়ায় ইখওয়ানের প্রধান, তিনি উপস্থিত সকলকে বিস্মিত করে ফেলেন। হঠাৎ তিনি সম্মুখে এগিয়ে যান এবং দরজায় লাগানো ফিতা কেটে মসজিদের উদ্বোধন ঘোষণা করেন। তাঁর এ কাণ্ড ওঁৎ পেতে থাকা ব্যক্তিদের আকাংকা নস্যাৎ করে দেয়। তাদের জন্য এ ঘটনা ছিল একটা কার্যকর আঘাত। আর ওস্তাদ আহমদ সাকারী উদ্বোধন করার জন্য উপযুক্ত ব্যক্তিও ছিলেন। আমিও উপস্থিত ব্যক্তিবর্গের বিস্ময়ের সংযোজন ঘটাই। আমি ওস্তাদ হামেদ আসকারিয়াকে মেহরাবের দিকে ঠেলে দেই, যেন তিনি এ মসজিদের প্রথম ইমামতি করেন। মসজিদ নির্মাণ আর পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তাঁর বিরাট ভূমিকা ছিল। তাঁকে ইমাম বানিয়ে আমি তাঁর কীর্তির স্বীকৃতি দিয়েছি মাত্র। যাই হোক, উদ্বোধনের পালাও শেষ হয়।

মসজিদের পরিকল্পনা শহরের জন্য কল্যাণ ও বরকতের পয়গাম বহন করে আনে। এরপর শহরে আরো মসজিদ নির্মাণের ধারা শুরু হয়। ইসমাঈলিয়া এবং আরীশার নেককার বাসিন্দাদের মধ্যে আলহা ইউসুফ এবং আলে ফরাজ-এর মধ্যেও মসজিদ নির্মাণের আগ্রহ জাগে এবং তাঁরা শহরের অপর প্রান্তে আরো একটা মসজিদ নির্মাণ করেন। এ অঞ্চলে মসজিদ নিতান্ত জরুরী ছিল। তাঁদের সাহস এতটা বৃদ্দি পায় যে, ইখওয়ান মসজিদের সঙ্গে তাঁরা প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হন। উভয় মসজিদের নির্মাণ কাজ একই দিনে সমাপ্ত হয়। আলহাজ্ব ইউসুফের মসজিদ উদ্বোধনের জন্যও আমাদেরকে দাওয়াত দেওয়া হয়। এবং তিনি চাপ দেন আমাদের মসজিদের আগে তাঁর মসজিদ উদ্বোধন করার জন্য। সৌভাগ্য বশতঃ উদ্বোধনের দিন ছিল শুক্রবার। আমরা জুমার নামায তাঁর মসজিদে আদায় করি এবং একই দিন এশার নামায মসজিদে ইখওয়ানে আদায় করি। এভাবে একই দিনে দু’টা বিজয় অর্জিত হয়।

ইসমাঈলিয়ার অপর একজন নেককার মানুষ আলহাজ্ব মুহাম্মদ জাদুল্লাহ। তাঁর অন্তরেও আগ্রহ জাগে মসজিদ নির্মাণের। তিনি নিজের নামে তৃতীয় মসজিদ নির্মাণের জন্য প্রস্তুত হন। এ মহল্লায়ও ইবাদাতখানার প্রয়োজন ছিল্। এ মসজিদ নির্মাণের কাজও সুচারু রূপে সম্পন্ন হয়। আলহাজ্ব মুস্তফা সাহেব আরীশায় ইতিপূর্বেই একটা মসজিদ নির্মাণ করেন। এখন তিনি মসজিদটি আরো প্রশস্ত করার উদ্যাগ গ্রহণ করেন। বিরাট আয়তন মসজিদের অন্তর্ভুক্ত করেন এবং আরো অনেক দিক থেকে মসজিদের শোভা বর্ধন করেন। যেন ইখওয়ান মসজিদ ইসমাঈলিয়ার অভ্যন্তরে এমন পবিত্র পরিকল্পনার ফিরিস্তির সূচনা করেছে।

প্রধানমন্ত্রী সেদকী পাশার সিনাই সফর

এ সময় মিশরের প্রদানমন্ত্রী সেদকী পাশা সিনাই সফরে গমন করেন। এ জন্য তাঁকে যেতে হবে ইসমাঈলিয়া হয়ে। এ খবর পেয়ে সরকারের মেশিনারী সক্রিয় হয়। এবং তাঁকে অভ্যর্থনা জ্ঞাপনের প্রস্তুতি শুরু হয়। তাঁকে দেখার জন্য বিপুল সংখ্যক লোক স্টেশনে উপস্থিত হয়। ডেপুটি কমিশনার আর মেজিস্ট্রেটও আসেন। অভ্যর্থনা সভায় বক্তৃতার জন্য কাকে বাছাই করবে, সে বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা হচ্ছে। জানিনা, কোন খবীস আমার নাম দিয়েছে তাঁদের কাছে। তারা বলছেন, অমুক সরকারী কর্মচারী অভ্যর্থনা সভায় বক্তৃতা করবেন। আমাকে দফতরে ডাকা হয়। মেজিষ্ট্রেট সাবেক বেক তানতাবী এ প্রসঙ্গে আমার সাথে কথা বলেন। পুলিশ অফিসার আর অন্যান্য সরকারী কর্মচারীরাও তা সমর্থন করলো। আমার বেশ রাগ ধরলো। আমি তাঁকে বললাম, এখনি আমি চাকুরীতে ইস্তফা দেবো। আপনি কি মনে করেন যে, সরকারী কর্মচারীরা নিছক কাঠের পুতুল। তাদেরকে যেমন ইচ্ছা নাচানো যায়। আপনাদের জানা উচিৎ যে, আমার মূল্য আমার হাতে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের হাতে নয়। আমি নিজেকে এমন পজিশনে আনতে কিছুতেই প্রস্তুত নই। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আমার যে চুক্তি হয়েছে, সে সম্পর্কে আমি ভালোবাবেই অবগত আছি। তা কেবল এতটুকুই যে, শিক্ষা-দীক্ষার ক্ষেত্রে আমি উন্নত সেবা করে যাবো। চুক্তিতে এমন কথা কোথাও লিখা নেই যে, প্রধানমন্ত্রী সমীপে প্রশস্তিমূলক কাসীদা পাঠ করতে হবে। এ ধরনের একটা দীর্ঘ আলোচনা হয় তাদের সঙ্গে। আমার প্রচন্ড আপত্তিকর মুখে এ কাজের জন্য অপর কাউকে খোঁজা ছাড়া তাদের আর কোন উপায় থাকেনা।

সুয়েজ ক্যানেল কোম্পানীর বদান্যতা

মসজিদের কাজ সম্পন্ন করার কিছুদিন আগে এমন অবস্থা হয় যে, সহ্ছিত অর্থ প্রায় শেষ। অথচ আমাদের পরিকল্পনায় মসজিদের সঙ্গে মাদ্রাসা এবং কেন্দ্রও আছে। এ দু’টো ছিল মসজিদেরই পরিশিষ্ট। আসলে এসব মিলেই ছিল মূল পরিকল্পনা। এ সময় একদিন সুয়েজ কোম্পানীর ডাইরেক্টর ব্যারন ডা বেনো সে পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন তাঁর সচিব মসিও ব্লুমও। ব্যারন মসজিদের ইমারত দেখলেন। লোকজনকে জিজ্ঞেস করলেন। এ সম্পর্কে খোজ খবর দিলেন। আমি স্কুলে ছিলাম। কোম্পানীর জনৈক কর্মচারী আমাকে গিয়ে বললেন, আমি যেন দফতরে গিয়ে মিঃ ব্যারন এর সঙ্গে দেখা করি। আমি তাঁর কাছে গেলাম, তিনি দোভাষীল মাধ্যমে আমার সঙ্গে কথা বললেন। তিনি বললেন, আমি মসজিদের ইমারত দেখেছি। আমি তাই আপনাদের সাহায্য করতে চাই; কিচু চাঁদা দিতে চাই। এজন্য মসজিদের প্রকল্পের নকশা ও অন্যান্য বিষয় তাঁর প্রয়োজন। আমি তাঁকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে ফিরে আসি এবং মসজিদের নকশা ও অন্যান্য বিবরণ তাঁর কাছে প্রেরণ করি। এরপর কয়েকমাস কেটে যায়। মিঃ ব্যারন আর তাঁর প্রতিশ্রুতির কথা আমি প্রায় ভুলেই বসেছিলাম। আবার একদিন তাঁর পক্ষ থেকে নিমন্ত্রণ আসে। আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করি। তিনি আমাকে স্বাগত জানিয়ে বললেন, আপনাদের প্রকল্পের জন্য কোম্পানী পাঁচশ মিশরীয় পাউন্ড মঞ্জুর করেছে। আমি এজন্য ব্যারনকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলি যে, কোম্পানীল পক্ষে এ সাহায্য নিতান্ত অপ্রতুল। আমরা কোম্পানীর নিকট থেকে এত ক্ষুদ্র অংক আশা করিনি। কারণ, কোম্পানীর খরচে একটা চার্চ নির্মাণ করা হচ্ছে, যেখানে ব্যয় হচ্ছে ৫ লক্ষ পাউন্ড। সেখানে মসজিদের জন্য মঞ্জুর করা হয়েছে মাত্র পাঁচশ পাউন্ড। মিঃ ব্যারন আমার যুক্তি আর দৃষ্টিভঙ্গি সমর্থন করে বললেন, দুঃখের বিষয়, কোম্পানীল পক্ষ থেকে এ সিদ্ধান্তই হয়েছে। এ পরিমাণ গ্রহণ করার জন্য তিনি আমাকে অনুরোধ জানিয়ে ভবিষ্যতে আরো চেষ্টা করার আশ্বাস দেন। আমি তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে বললাম, এটা গ্রহণ করা না করা আমার কাজ নয়, কোষাধ্যক্ষ শায়খ মুহাম্মদ হোসাইন সমলূত এর কাজ। কোম্পানী যে পরিমাণ অর্থ দান করছে, তিনি নিজের পক্ষ থেকেও তার চেয়ে বেশী অর্থ ব্যয় করেছেন এ প্রকল্পে। আমার অনুরোধে শায়খ সামলূত তা গ্রহণ করেন। এরপর মিঃ ব্যারন কোন চেষ্টা চালাননি, আর আমরাও তাঁর কাছে দাবী করিনি।

বিরুদ্দবাদীদের রটনা

বিরুদ্ধবাদীরা এ খবর শুনে উম্মা প্রকাশ করে। তারা রটনা করে যে, ইখওয়ানরা অমুসলিমদের সাহায্য নিয়ে মসজিদ বানাচ্ছে। চতুর্দিক থেকে ফতুয়াবাজী শুরু হয়। বলা হয়, অমুসলিমদের সাহায্যে নির্মিত মসজিদে কেমন করে নামায জায়েয হবে? আমরা মানুষকে বুঝাবার চেষ্টা করি যে, এসব বাজে কথা। কোম্পানীর পুঁজি আমাদেরই সম্পদ অমুসলিমদের নয়। সুয়েজ আমাদের, সমুদ্র আমাদের, দেশ আমাদের। এসব অমুসলিমরা জবরদখলকারী এবং লুটেরা। আমাদের দুর্বলতার সুযোগে তারা আমাদের উপর জেঁকে বসেছে। আল্লাহর ইচ্ছায় মসজিদের কাজ সম্পন্ন হয় অমুসলিমদের সাহায্য খরচ না করেই। বরং তাদের দেয়া অর্থ ইখওয়ান কেন্দ্রের জন্য ব্যয় করা হয়েছে। আর এর ফলে বিরুদ্দবাদীদের রটনা কোন কাজে লাগেনি। সংকীর্নমনা মওলবীরা এমনই করে থাকে। আল্লাহ কত কিসিমের মানুষ পয়দা করেছেন।

আলহেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান

আল্লাহর সাহায্য, সহায়তার বদৌতে মসজিদের ইমরাতের উপর মাদ্রাসার ইমারত স্থাপন করা হয়। সেকালে শিশুদের শিক্ষার ব্যাপারে নানা উপায় অবলম্বন করা হতো, ব্যবহার করা হতো নানা ধরনের ছবি। নানা ধরনের শিক্ষা পদ্ধতিতে এসব পদ্ধতির উদ্ভাবকদের ছবিও ব্যবহার করা হতো। হার্বার্টা আর বেন্সটোর এর দর্শন আর পদ্ধতি অনুযায়ী শিশুদেরকে শিক্ষা দেওয়া হতো। এসব দর্শন আর পদ্ধতিকে আমরা এক নূতন ছাঁচে ঢালাই করি। ইসলামী রীতিতে শিশুদের শিক্ষার নিমিত্ত এসব পদ্ধতিকে পুনর্বিন্যাস করে নব পর্যায়ে ঢালাই করা হয়। বিদ্যালয় ভবনের নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হলে আমরা এজন্য একটা ইসলামী নাম প্রস্তাব করি। আমরা এর নাম করণ করি আলহেরা শিক্ষায়তন। ছাত্রদের জন্য ইউনিফর্মও ঠিক করি- দেশী কাপড়ের তৈরী লম্বা জামা আর কোট। দেশে তৈরী সাদা টুপি এবং জুতা। পাঠ দানের সময়ও ছিল অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ভিন্ন। সকাল থেকে পাঠ দান শুরু হয়ে জোহরের নামায পর্যন্ত চলতো। ছাত্ররা জামায়াতে জোহরের নামায আদায় করতো এবং খাওয়া দাওয়া শেষ করে আসরের পূর্বে ফিরে এসে জামায়াতের সঙ্গে আসরের নামায আদায় করতো। পাঠ্যসূচী ছিল তিন ধরনের। প্রথম ধরন ছিল আল-আযহারের প্রাথমিক শিক্ষার অনুরূপ। এ ধরনের পাঠ্যসূচীতে ছাত্রদেরকে আল-আযহার এবং অন্যান্য দ্বীনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রস্তুত করা হতো। দ্বিতীয় ধরনের পাঠ্য সূচীতে দিনের প্রথমভাগে আল-আযহারের পাঠ্যসূচী অনুযায়ী শিক্ষা দেওয়া হতো, এবং দিনের দ্বিতীয় ভাগে শিল্পকর্ম শিক্ষা দেওয়া হতো। দুপুরের খাবার পর ছাত্ররা শহরে ইখওয়ান কর্মীদের কারখানা আর ওয়ার্কশপে ট্রেনিং এর জন্য গমন করতো। এসব কারখানার মালিক ইখওয়ান কর্মীরা দায়িত্ব নিয়েছিলেন ছাত্রদেরকে কারিগরী শিক্সা দানের জন্য। আল-হেরা শিক্ষায়তনের তত্ত্বাবধানে একটা বিশেষ ব্যবস্থাপনায় এই কারিগরী শিক্ষা দেওয়া হতো। তৃতীয় ধরনের শিক্ষা ছিল সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অনুরূপ। এ ধরনের শিক্ষায় ছাত্রদেরকে মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার জন্য প্রস্তুত করা হতো। ছাত্রদের উপর ধার্যকৃত বেতনও ছিল যৌক্তিক। ছাত্রদের সামর্থ্যের বেশী বোঝা চাপানো হতো না। অভিভাবকদের অবস্থা বিচেনা করে বিনা বেতনের ছাত্রদের হারও বৃদ্ধি করা হয়। উচ্চশিক্ষিত এবং প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত বাছাই করা একদল শিক্ষকও নিয়োগ করা হয়। এ শিক্ষায়তনের প্রতি মানুষের বেশ আগ্রহ দেকা দেয়। এতে নতুন পদ্ধতি অনুসৃত হয়, যা আধুনিক শিক্ষা দর্শনের সঙ্গে সামঞ্জস্যশীল। ইসমাঈলিয়ার সুদর্শন পার্ক আর বাগানে গাছের তলেও ছাত্রদেরকে পাঠ দান হতো। মৃত্তিকা, প্রস্তর খন্ড আর কাগজের টুকরার সাহায্যে বর্ণমালা আর অংকের বুনিয়াদী বিষয় শিক্ষা দেওয়া হতো। ছাত্ররা যা খুশী শিক্ষককের জিজ্ঞাসা করতে পারতো। ছাত্রদের সঙ্গে শিক্ষকের সম্পর্ক ছিল সহযোগতিা আর ভালোবাসার। ইসামাঈলিয়ার অনেক নওজোয়ান আজও এ শিক্ষায়তনের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। এখানে ছাত্র এবং শিক্ষকের মধ্যে যে স্নেহ ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল, অনেকে আজও মনে মনে তার স্বাদ অনুভব করে।

আমি ইসমাঈলিয়া ছেড়ে আসার পর এ শিক্ষায়তন একটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের রূপ ধারন করেছে। শিক্ষামন্ত্রনালয় থেকে তা বজায় রাখার কোন চেষ্টা করা হয়নি, বরং তার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছে। আর এ বিরোধিতার ফলে এ আদর্শ শিক্ষায়তন একটা সাধারণ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পরিণত হয়। আমাদের এই আদর্শ শিক্ষায়তনের সাফল্যের পেচনে সবচেয়ে বড় বাধা ছিল এমন লোকের অভাব, যারা নিজেদেরকে চাকুরী সন্ধানী মনে না করে একটা মিশনের পতকাবাহী মনে করবেন। আমি শিক্ষকতা জীবনে যখনই কোন ঘন্টা খালি দেখতে পেয়েছি, তখনই ছুটে গেছি আল হেরায়। সেখানে শিক্ষকদের উপস্থিতিতে ছাত্রদের উদ্দেশ্যে লেকচার দিয়েছি। পাঠ দান কালে বা পাঠ দান শেষে স্বয়ং শিক্ষকদেরকেও দীর্ঘ হেদায়াত আর পরামর্শ দিয়েছি। অধিকন্তু পাঠ প্রস্তুতিতেও শিক্ষকদের সঙ্গে শরীক থাকতাম। ছাত্রদের সঙ্গে বাগানে চলে যেতাম, কখনো একা, আবার কখনো শিক্ষক আর পরিচালকদের সঙ্গে মাগরিব পর্যন্ত প্রায় দু’ঘন্টা ছাত্রদের সঙ্গে কাটাতাম। ভ্রমণ আর বিনোদনের পরিবেশ সৃষ্টি হতো। ছাত্রদের জন্য অনুমতি ছিল, যা খুশী তারা আমাকে জিজ্ঞাসা করতে পারে, যেদিকে ইচ্ছা ঘুরাফেরা করতে পারে। যা কিছু ইচ্ছা খেলাধুলা করতে পারে, যেমন খুশী কৌতুক আর খোশগল্প করতে পারে। এসব বিষয়ে আমি নিজেও তাদের সঙ্গে যোগ দিতাম। ফলে তাদের ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক কোন বিষয়ই আমার কাছে গোপন থাকতো না। তারাও মনে করতো আর আমিও এ অনুভূতিতে ডুবে থাকতাব যে, আমি তাদের পিতা বা বড় ভাইয়ের মতো। আমি নিজেই তাদের মধ্যে এ অনুভূতি জাগাবার চেষ্টা করতাম এবং শিক্ষকদেরকেও একথা বলার চেষ্টা করতাম যে, তাদেরকেও এরকম হতে হবে। তাদেরকে অনুভব করতে হবে যে, তারা এটা পয়গামের পতাকাবাহী, একটা বিশেষ মতবাদের আহবায়হক এবং একটা প্রজন্মের প্রতিষ্ঠাতা এবং মুরব্বী। এরফলে তাদের অধিকাংশের মধ্যে এ স্পৃহা জাগ্রত হয়। আবার অনেকে এমনও ছিলেন যাদের কাছে এ সব কিছুই অরণ্যে রোদন বলে পর্যবষিত হয়েছে। আমাদের সমাজে এমন লোকের ভীষণ প্রয়োজন, যারা দেহ আর অবয়ব দিয়ে নয়, বরং মনে-প্রাণে সমাজের সেবা করবে। যারা কাজ করবে বিবেকের তাড়নায়, অন্যের তত্তাবধানের ভয়ে নয়। মানুষের মনতো আল্লাহর হাতে, তিনি যেদিকে ইচছা সেদিকে মনকে ঘুরাতে পারেন।

শায়খ মুহাম্মদ সাঈদ ওরফী

আল হেরা শিক্ষায়তন প্রসঙ্গে আমার মনে পড়ে যে, আমাদের জনৈক আলেম ফাযেল এবং মুজাহিদ ভাই শায়খ মুহাম্মদ ওরফী এ নাম প্রস্তাব করেছিলেন। তিনি ছিলেন শিরিয়ার দিরযুর অঞ্চলের আলেম এবং পার্লামেন্টে মেম্বার। ফরাশীদের যুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে তিনি সংগ্রামে লিপ্ত হন। ফরাশীরা তাঁর সহায়-সম্পত্তি এবং লাইব্রেরী বাজেয়াপ্ত করে এবং তাঁকে দেশ থেকে নির্বাসনের নির্দেশ দেয়। এরপর তিনি মিশর আগমন করেন এবং কায়রোয় একটা সাধারণ ভাড়া বাষায় বসবাস করেন। কোনভাবে তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। আমি তাঁর মধ্যে ঈমান-একীনের শক্তি, বীরত্ব, শ্রেষ্ঠত্ব, সৎ সাহস এবং উক্তি আর যুক্তি ভিত্তিক জ্ঞানে তীক্ষ দৃষ্টি প্রত্যক্ষ করতে পারি। তিনি আলেম এবং তবীবও ছিলেন, সামরিক অফিসার এবং রাত্রি যাপনকারী ইবাদাতগুজার ছিলেন। স্বদেশে বড় বড় মাশায়েখদের নিকট তিনি ইলম হাসিল করেন এবং এরপর তুর্কী সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। প্রমোশন পেয়ে তিনি অফিসার পদে উন্নীত হন। সেনাবাহিনীতে মেডিক্যাল ইউনিটের সঙ্গে সম্পর্কের সুবাদে তিনি চিকিৎসা বিজ্ঞানেও জ্ঞান অর্জন করেন। চাঁদমারীতে তিনি ছিলেন পটু। ১০ রাউন্ডে ১০টা চাঁদমারী করতে পারতেন। উপরন্তু তিনি ছিলেন একজন সাহিত্যিক এবং ঐতিহাসিক। অনৈক পদ্য আর গদ্য তাঁর মুখস্থ ছিল। মিষ্টভাষী, ফুর্তিবাজ, সূক্ষ্ণতত্ত্ব জ্ঞানী এ মানুষটির উপস্থিত বুদ্ধি ছিল নযীর বিহীন। ইবাদগুজারী আর আরাম আয়েশ বিসর্জনে তিনি পবিত্র আত্মার সূফী। তাঁর চিন্তাধারা এবং দৃষ্টিভঙ্গী ছিল দার্শনিক সুলভ। তাঁর সংস্পর্শে আমি বেম ধন্য ও উপকৃত হয়েছি। ইসমাঈলিয়া এসে তিনি আমার সঙ্গে কয়েকদিন অতিবাহিত করেছেন। সেদিনগুলো ছিল জীবনের সোনালী দিন। সুখের দিন। তিনি জানতে পারেন যে, আমরা একটা মাদ্রাসা স্থাপন করতে যাচ্ছি এবং এর নাম নিয়ে চিন্তা ভাবনা করছি। তিনি বলেন, ইসমাঈলিয়া হচ্ছে আন্দোলনের কেন্দ্র আর আন্দোলনের পক্ষ থেকে এই প্রথম মাদ্রাসা স্থাপন করা হচ্ছে। আর আন্দোলনের দাওয়াত হচ্ছে কুরআনেরই দাওয়াত। আর কুরআন সর্ব প্রথম হেরা গুহায়ই নাযিল হয়েছে। সুতরাং তোমরা এ মাদ্রাসার নাম আল-হেরা রাখবে। দরবেশের প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। এ নামই রাখা হয়েছে। শায়খ ওরফী রাত্রে রড়জোর চার ঘন্টা ঘুমাতেন। ফজরের অনেক আগে জাগতেন এবং আমাদের দরজায় নক করে বলতেনঃ হুঁশে এসো, হুঁশে এসো। এ জীবন শেষে দীর্ষ নিদ্রার সুযোগ ঘটবে। আমাদের উঠা উচিৎ। আল্লাহর হুজুরে সাজদায় নত হওয়া উচিৎ। আমরা তাঁর প্রশংসা করি এবং তাঁর নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করি।

শায়খ ওরফী বলতেন, শুভ নাম আর উপাধীতে ধন্য করো।

আমি আরয করতামঃ জনাব, কাকে?

তিনি বলতেনঃ তোমার ভাই-বন্ধু, সঙ্গী এবং প্রতিষ্ঠানকে ভালো নাম আর উপাধীতে ধন্য করবে। অমুক সঙ্গীকে বলবে, তোমার মধ্যে হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা)-এর বৈশিষ্ট্যগুলো পাওয়া যায়। অমুক সঙ্গী হযরত ওমর (রা)-এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এসব কথা তাদের মধ্যে আত্ম মর্যাদা জাগায়ে তুলবে, আদর্শ চরিত্র আর সৎ নমুনার দিকে তাদেরকে নিয়ে যাবে।

আমি আরয করতামঃ এমন করলে লোকেরা আমাদেরকে সমালোচনা করবে তীব্র ভাষায়।

শায়খ বলতেনঃ লোকের সঙ্গে তোমার কি সম্পর্ক? তুমি আল্লাহর হয়ে জীবন যাপন করবে। যে কাজে মঙ্গল নিহিত, সে কাজ করতে থাকবে। তোমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর এ রকম নাম রাখবে, আল-হেরা বালক মাদ্রাসা, উম্মাহাতুল মুমিনীন বালিকা বিদ্যালয়, ফুন্দক ক্লাব ইত্যাদী। এভাবে ইতিহাসের এ সব মুবারক নাম অন্তরে স্থান করে নেবে।

তিনি সবসময় আমাকে বলতেন, যারা ইবাদাত-আনুগত্যে ক্রটি করে, বা সামান্য গুনাহের দিকে ঝুকে তাদেরকেও আন্দোলনে শরীক করে নিতে কোন দোষ নেই, যদি দেখতে পাও যে, তাদের মধ্যে আল্লাহর ভয় আছে। দেখতে হবে দলের শৃংখলার প্রতি শ্রদ্ধ আর আনুগত্য পরায়নতা। এমন লোকেরা খুব তাড়াতাড়ি তাওবা করবে। দাওয়াত একটা শেফাখানা, একটা আরোগ্য নিকেতন। এখানে চিকিৎসা করার জন্য ডাক্তার আর চিকিৎসা পাওয়ার জন্য রুগী আসে। এদের জন্য কখনো দরজা বন্দ করবে না। বরং যতোভাবে, যতো উপায়ে তাদেরকে নিজের দিকে টানতে পার, টানবে। আকৃষ্ট করবে। এটাই হচ্ছে আন্দোলনের প্রথম মিশন। অবশ্য দুধরনের লোক এমন আছে, যাদেরকে কঠোরভাবে দূরে রাখার প্রয়োজন রয়েছে। এদেরকে  কখনো আন্দোলনের ভিতরে প্রবেশ করার সুযোগ দেওয়া যাবে না।

এক. সেই নাস্তিক, যার কোন কিছুতেই বিশ্বাস নেই, নেই কোন দর্শন। সে নিজেকে সত্যাশ্রয়ী বলে যতই প্রচার করুক না কেন। এমন লোকের সংশোধন লাভ করার কোনই আশা নেই। মূল বিশ্বাসের দিক থেকে সে শত যোজন দূরে। এমন লোকের নিকট থেকে আপনি কি আসা পোষণ করতে পারেন?

দুই. সে যাহিদ দরবেশ লোক, যে নিয়ম-শৃঙ্খলাকে কোনই মর্যাদা দেয় না। আনুগত্যের তাৎপর্য সম্পর্কেই যে ব্যক্তি অবহিত নয়। এমন লোক ব্যক্তিগতভাবে কল্যাণকর হতে পারে, ব্যক্তিগতভাবে তার কাজ ফলপ্রসূ হতে পারে, কিন্তু দলের ভিতরে প্রবেশ করলে লোকদের মনে বিকৃতি সৃষ্টি করবে। নিজের তাকওয়ার মাধ্যমে দলকে নিজের ওক্ত-অনুরক্ করে তুলবে; কিন্তু দলের শৃঙ্খলা বিরোধী কর্মকাণ্ড দ্বারা দলের মধ্যে বিদ্রোহ আর ভাঙ্গন সৃষ্টি করবে। দলের অন্তর্ভুক্ত না করে এমন লোক দ্বারা উপকার লাভ করতে পারলে অবশ্যই করবে। কিন্তু নিজেদের সারীতে তাকে ঢুকালে নিয়ম-শৃঙ্খলা বিকৃতি-বিচ্যুতি আর অস্থিরতার শিকার হবে। মানুষ যখন কাউকে নিয়ম-শৃঙ্খলার বাইরে দেখতে পাবে, তখন তারা একথা বলবে না যে, অমুক ব্যক্তি দল থেকে বেরিয়ে গেছে; বরং তারা একথাই বলবে যে, এ দলই বাঁকা, ওরা বাঁকা পথেই চলে। সুতরাং এমন লোক থেকে সম্পূর্ণ দূরে থাকতে হবে।

তিনি একথাও বলতেন যে, আলেমে দ্বীনরা কাল্পনিক রশিতে বাঁধা থাকেন। কেবল ঈমানই মুমিনদের সম্মুখে আসল তত্ত্ব উদ্ভাসিত করতে পারে। ঈমান মযবুত হলে ঈমানদাররা দুর্বল আর অক্ষম হলেও সফল হবে। আর যাদের ঈমান মযবুত হবে না, তারা পরিপূর্ণ শক্ত-সামর্থ হওয়া স্বত্ত্বেও পরাজিত হবে। যেন জীবনের রণক্ষেত্রে আন্দোলনের কর্মীদের জন্য ঈমানই হচ্ছে সবচেয়ে মযবুত অস্ত্র।

তিনি বলতেনঃ আমি পরীক্ষা করে দেখেছি, সব ক্ষেত্রে উন্নতিও দেখা দেয়, আবার অবনতিও আসে। যখন উন্নতি দেখা দেয়, তখন সবকিছু পায়ের উপর লুটিয়ে পড়ে। এমনকি একজন ডাকাতও পথ চলতে গিয়ে সামনে পড়লে মাথানত করবে। আর যখন পতন আর দুর্ভাগ্যের ঘনঘটা ছেয়ে যায়, তখন সবকিছুই মুখ ফিরায়ে নেয়, এমনকি নিজের বশীভূত সওযারীও ঔদ্ধত্য- অবাধ্যতায় নেমে আসে। যদিও ঔদ্ধত্য-অবাধ্যতা তার স্বভাব নয়। আমি দু’বার মিশরে আগমন করি। প্রথম দফা আমি যখন মিশরে আসি, তখন আমি ছিলাম দীরযুর- এর বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব আর তথাকার নামকরা আলেম মুহাম্মদ সাঈদ ওরফী। তোমাদের শহরের বড় বড় ব্যক্তিবর্গ স্টেশনের প্লাটফর্মে আমাকে এমন বিপুল অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করেছেন যে, আমি আমার মনের কাছে লজ্জিত হ্ই। আর দ্বিতীয় দফা যখন আসি, তখনো আমি সেই মুহাম্মদ সাঈদ ওরফীই ছিলাম; কিন্তু এখন মুহাম্মদ সাঈদ ওরফীকে ফরাসী সাম্রাজ্যবাদের পক্ষ থেকে নির্বাসনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ধন-সম্পদ আর পদ-মর্যাদা সবই তার হাতছাড়া হয়েছে। তখন আমি স্টেশনে একজন লোককেও আামার জন্য অপেক্ষারত দেখতে পাইনা। কেউ এগিয়ে এসে আমি কেমন আছি, জানতে চায়নি। তখনো আমি লজ্জায় গলে যাই। অথচ দ্বিতীয়বার সহানুভূতি আর সমবেদনার ভীষণ প্রয়োজন ছিল আমার। আর প্রথম বারের তুলনায় অভ্যর্থনা পাওয়অর বেশী যোগ্য ছিলাম। কিন্তু আল্লাহ তা’আলা ইখওয়ানুল মুসলিম- এর সঙ্গে আমার পরিচয়ের বদৌলতে আমার জন্য উত্তম কল্যাণ ও পূর্ণ, উত্তম প্রতিদান আর তার চেয়েও উত্তম সহায়তা আর সহানুভূতির ব্যবস্থা করেছেন।

শায়খ মুহাম্মদ সাঈদ ওরফী ছিলেন তীব্র আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন, পরমুখাপেক্ষীহীন, দরিয়াদিল এবং পূত-পবিত্র আত্মার অধিকারী ব্যক্তি। তিনি যতদিন মিশরে অবস্থান করেছেন, নিজ হাতের উপার্জন দ্বারা বীবিকা নির্বাহ করেছেন। গ্রন্হাবলী সম্পাদনা আর সংশোধন দ্বারা তিনি কিছু না কিছু উপার্জনের ব্যবস্থা করতেন। তিনি কখনো কারো নিকট থেকে দান বা সাহায্য গ্রহণ করেননি। নিজের ব্যয় নির্বাহের পর যা কিছু অবশিষ্ট থাকতো, তা তিনি দান করতেন ইখওয়ানুল মুসলিমুন এবং অন্যান্য আগত ব্যক্তিদেরকে। দীর্ঘদিন পর তিনি পুনরায় সিরিয়ায় ফিরে যান এবং নিজের এলাকা থেকে পার্লামেন্টের মেম্বার নির্বাচিত হন। আর এভাবে সিরীয় পার্লামেন্ট সদস্যদের সমন্বয়ে একটা প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসাবে তৃতীয়বার তিনি মিশর আগমন করেন এবং ফিলিস্তীন সমস্যা সংক্রান্ত একটা পার্লামেন্টারী সম্মেলনে অংশ গ্রহণ করেন। আমার মনে পড়ে, তিনি হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে মালপত্র রেখে কিছুক্ষণ পর ইখওয়ানের কেন্দ্রে আগমন করেন। সরকারী কাজের সময় তিনি সঙ্গীদের সঙ্গে ব্যস্ত থাকতেন, আর অবশিষ্ট সময় কাটাতেন আমাদের সঙ্গে। আমার মনে পড়ে পরবর্তীকালে তিনি তিনি কাজী বা বিচারপতি পদে বরিত হন। আল্লাহ তাঁকে সর্বাবস্থায় সফল করুন এবং তাঁর দ্বারা মুসলমানদের কল্যাণ সাধন করুন।

আবু ছবীর-এ দাওয়াতের সূচনা

ইসমাঈলিয়ার অদূরে ইংরেজ ছাউনীর পরে আবু ছবীর স্টেশন অবস্থিত। স্থানটা ইসমাঈলিয়া থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে। আবু ছবীর শিবির আর এয়ার ট্রেনিং স্কুলে যেসব শ্রমিকরা কাজ করে, তারা এখানে বসবাস করে। এদের সঙ্গে বাস করে ব্যবসায়ী আর কৃষকদের এক বিরাট অংশ। এ উদ্দেশ্যে লোকদের চেহারা আমি নিরীক্ষণ করি। আমি আবু ছবীর সফর করি। কফি হাউস, সড়ক আর দোকানে লোকজনকে তালাশ করি। অবশেষে শায়খ মুহাম্মদ আল-আজরুদী এর দোকানে পৌছি। ইনি ছিলেন নিতান্ত মর্যাদাবান, ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন এবং উদারমনা ব্যক্তি। তাঁর মধ্যে সততা এবং কথা বলার যোগ্যতাও ছিল। আমি তাঁকে দোকান করতে এবং গ্রাহকদের সঙ্গে কথাবার্তা বলতেও দেখেছি। আমি তাঁর মধ্যে ভালো লক্ষণ দেখতে পাই। সালাম জানিয়ে তাঁর কাছে গিয়ে বসি। তাঁর সঙ্গে আরো কিছু লোকও বসা ছিলেন। আমি তাঁদের কাছে আমার পরিচয় দেই এবং যে উদ্দেশ্যে আবু ছাবীর-এ আমার আগমন, তাও ব্যক্ত করি। আামি তাঁকে বলি যে, আপনার মধ্যে শুভ লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি এবং আপনি আমাদের দাওয়াতের বোঝা বহন করতে পারেন। আমি কথাবার্তা বলার সময় তাঁর এবং তাঁর কয়েকজন সঙ্গীর দৃষ্টি আকর্ষণ করি দলের বুনিয়দী বিষয়ের প্রতি। অর্থাৎ ইসলামের উদ্দেশ্য কত মহ আর ইসলামের বিধান কতো পবিত্র, তাঁকে আমি তা বুঝানোর চেষ্টা করি। কিন্তু আমাদের সমাজে বিকৃতি অন্যায়-আচার কতোটা বিস্তার লাভ করেছে, তাও বুঝাই। এটা প্রমাণ করে যে, আমরা ইসলামের বিধানকে উপেক্ষা করে চলছি। এখন আমাদের কর্তব্য হচ্ছে এমন আন্দোলন সৃষ্টি করা, যাতে এসবের সংশোধন-পরিবর্তন হতে পারে। অন্যথায় আমরা সকলেই গুনাহগার হবো। কারণ, ভালো কাজের নির্দেশ আর মন্দ কাজের নিষেধ এবং হিদায়াত ও নছিহত করা ফরয। ব্যক্তিগত পর্যায়ে এ ফরয পালন করা যথেষ্ট হতে পারে না। বরং এমন জনমত সৃষ্টি করতে হবে, যা দাওয়াতের পৃষ্ঠপোষকতা করবে। প্রতিটি জনপদ থেকে ভালো লোকদেরকে সংগঠিত করতে হবে, দাওয়াতের প্রতি যাদের ঈমান আছে, দাওয়াতকে কেন্দ্র করে তাদেরকে সংগঠিত হতে হবে। আমরা এ দলটাকে ইখওয়ানুল মুসলিমুন বলতে পারি। দোকানদার আর তাঁর সঙ্গীরা বেশ মনোযোগের সঙ্গে আমার কথা শুনে। শুরুতে তিনি মনে করেছিলেন যে, আমি নিছক কোন সেবামূলক সংগঠনের দাওয়াত দিচ্ছি। অথবা আমি কেবল একটা বক্তৃতাই করতে চাইছি। দোকানদার দয়া করে আমাকে দুপুরে খাবার দাওয়াত দেন এবং আমার জন্য কফিও আনেন। আমি খাবার দাওয়াত গ্রহণ করতে অপারগতা প্রকাশ করে উঠে দাঁড়াই। কিন্তু তিনি জোর দিয়ে পীড়াপীড়ি করতে থাকেন যে, আমাকে মসজিদের ভিতরে বক্তৃতা করতে হবে, অথবা সমুদ্রের তীরবর্তী ক্ষুদ্র মসজিদে ওয়াযের মজলিসে ওয়ায করতে হবে। আমি কফি হাউসেদারস দান করার পসন্দ করি। আমার প্রস্তাব মনযুর করা হয়। লোকজন কফি হাউসে সমবেত হয় এবং মনোযোগের সঙ্গে আমার বক্তৃতা শ্রবণ করে। তারা যা কিছু দেখে এবং শ্রবণ করে, তাতে বিস্ময়বোধ করে। একজন প্রতিশ্রুতিশীল যুবক শিক্ষক এভাবে কফি হাউসে লোকজনকে দ্বীনি দারস দিতে দেখে তারা আঙ্গুলে কামড়ায়। অথচ এ যুবক শিক্ষক কোন মসজিদের ইমামও নয়। সে কোন পীরও নয়, আবার কোন তরীকতের শায়খও নয়। আমার কথাগুলো তাদের উপর বেশ ক্রিয়া করে। পুনরায় এখানে আগমন করার জন্য তারা বেশ জোর দেয়। তাদের দাবী অনুযায়ী আমি পুনরায় সেখানে গমন করি।

পরপর কয়েকবর সফর করার পর পরিস্থিতির বেশ উন্নতি হয়। একদিন আমরা আহমদ আফেন্দী দাসুতীর বাসায় সমবেত হয়ে আবু ছবীর-এ ইখওয়ানুল মুসলিমুনের শাখা স্থঅপন করার সিদ্ধান্ত নেই। এ ক্ষুদ্র জনপদটি ক্ষুদ্র হলেও পরস্পর প্রতিযোগিতা- প্রতিদ্বন্দ্বীতা আর হিংসা-বিদ্বেষ থেকে মুক্ত ছিল না। আমি এখানে থাকতাম না, আর আহমদ আফেন্দী দাসূতী, যাকে শাখা সভাপতি করা হয়েছে, তিনি কোন শিক্ষিত ব্যক্তি ছিলেন না, বরং তিনি ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। তিনি সবসময় ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। স্থানীয় বিবাদ-বিসংবাদ আর বাক-বিতণ্ডার মোকাবিলা করা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। তিনি এসবের কোন সমাধা দিতে না পারায় সংগঠন ভেঙ্গে পড়ে বা ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়। আমি পুনরায় সফরে এলে এসব দূর হয়ে সংগঠন কিছুটা চাঙ্গা হতো। অবশেষে শোধবোধ সম্পন্ন কিছু ইখওয়ান, যাদের অন্তরে দাওয়াত স্থান করে নিয়েছিল, এবং ইসমাঈলিয়ায়ও যাদের যাতায়াত ছিল, তারা বললেন যে, আন্দোলনের বোঝা আর দাওয়াতের দায়িত্ব পালনের জন্য সর্বোত্তম ব্যক্তি হতে পারেন ওস্তাদ আবদুল্লাহ বাদবী। তিনি আবু ছবীর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। প্রথমত, তিনি একজন শিক্ষিত লোক। সবসময় লোকজনকে ওয়ায ও দারস দান করেন। দ্বিতীয়ত, এখানে তাঁর রয়েছে বিশিষ্ট স্থান ও মর্যাদা। এখানকার সকলেই তাঁকে ভালোবাসে। জনগণের সঙ্গেও তাঁর মেলামেশা আছে। সকেলই তাঁকে শ্রদ্ধা আর সম্মান করে। তাঁর সঙ্গে রয়েছে জনগণের অন্তরের সম্পর্ক। তৃতীয়ত, তাঁর হাতে সময় আছে। স্কুল ছুটির পর তিনি যে সময় পান, ব্যবসায়ী আর কারিগররা তা পায় না।

ইখওয়ানদের এ মত আমার পছন্দ হয়। আমি আবু ছবীর গমনকরতঃ শায়খ আব্দুল্লাহ বদবীর সঙ্গে দেখা করি। লোকজন তাঁর সম্পর্কে যা বলতো, আমি তাঁর মধ্যে সেসব দেখতে পাই। বরং তার চেয়েও বেশি দেখতে পেয়েছি। আল- হামদুলিল্লাহ। আমি এটা দেখেও খুশী হই যে, তিনি বেশ খোঁজ-খবর রাখেন। তাঁর দারসের ধারাও অব্যাহত আছে। তিনি বেশ দৃঢ় ব্যক্তিত্বেরও অধিকারী। তাঁর চিন্তাধারাও সুস্থ এবং ভারসাম্যপূর্ণ। আমি তাঁর সম্মুখে আমার প্রয়োজনের কথা ব্যক্ত করি। তিনি এ দায়িত্ব গ্রহণ করতে বেশ ইতস্ততঃ করেন। অবশ্য আমার চাপের মুখে তিনি রাজি হন; তবে একটা শর্ত দেন। শর্তটা হচ্ছে এই যে, তাঁর সঙ্গে যেসব শিক্ষক কাজ করেন, তাদের দ্বারা শাখাটা গঠন করার স্বাধীনতা তাঁর থাকবে। এসব শিক্ষকরা তাঁকে ভালোবাসেন এবং বেশ শ্রদ্ধা আর সম্মানের চোখে দেখেন। আর এ শাখায় তিনি স্থানীয় শোধবোধ সম্পন্ন ব্যক্তিবর্গকেও অন্তর্ভুক্ত করবেন। আমি তাঁর দাবী মেনে নেই। তিনি বেশ পরিশ্রম সহকারে এ কাজ শুরু করেন এবং এ জন্য বেশ কোমর বেঁধেই নামেন। আল্লাহ তা’আলাও তাঁকে সফলতা দান করেন। তাঁর নেতৃত্বে এ জনপদে আমাদের বেশ শক্তিশালী শাখা গড়ে উঠে।

আবু ছবীর-এ ইখওয়ানের মসজিদ

তখন পর্যন্ত আবু ছবীর-এ কেবল একটা মসজিদ ছিল- মসজিদুল হারুন। নামাযীদের জন্য এ মসজিদটা ছিল সংকীর্ণ। ইসমাঈলিয়া শহরের তীরেও একটা ক্ষুদ্র মসজিদ ছিল। জুমার সমাবেশের জন্য তাও যথেষ্ট ছিল না। তৃতীয় একটা অসম্পূর্ণ মসজিদও ছিল, যা নির্মাণ করেন শায়খ ইবরাহীম আবু হারীশ নামে জনৈক ব্যক্তি। ইনি থাকতেন জনপদ থেকে বেশ দূরে এবং মসজিদের সঙ্গে তাঁর কোন সম্পর্ক ছিল না। এ কারণে মসজিদটা নামায আদায়ের উপযোগী ছিল না। শায়খ আব্দুল্লাহ বদবী এ মসজিদটা হস্তগত করে তাকে ইখওয়ানুল মুসলিমুনের কেন্দ্র বানাবার পরিকল্পনা করেন। সে মতে তিনি শায়খ ইবরাহীমের সঙ্গে কথাবার্তা বলে তাঁর মসজিদ নিয়ে মেরামতের কাজ শুরু করেন। আর আজ তা এক বিরাট মসজিদে পরিণত হয়েছে। মসজিদের সন্নিকটে ইখওয়ানের একটা ক্লাবও নির্মাণ করা হয়। এ মসজিদেই সমাবেশ অনুষ্ঠিত হতো। মসজিদের সম্মুখে ছিল একটা প্রশস্ত ময়দান। এখানে ইখওয়ানের স্কাউটসদেরকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। গ্রীষ্মের ছুটিতে এখানে বক্তৃতা আর দারসের পালা শুরু হতো। মসজিদটি একটা কল্যাণকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়, যেখান থেকে হিদায়াত আর জ্ঞানের আলো বিচ্ছুরিত হয়।

এই মোবারক অঙ্গনে আমরা আন্দোলনকে মযবুত করার পরিকল্পনা করি। আমরা শায়খ ঈদ আল আযহারীকে কিছুদিনের জন্য এখানে প্রেরণ করি। ইনি ছিলেন আল আযহারের সেসব ছাত্রদের অন্যতম, যারা সেখানে জীবনটা ভালোভাবে কাটিয়েছেন। তিনি সেখানে ভালো রকমে কুরআন মজীদ হিফয করেন। তিনি ইসমাঈলিয়া আগমন করে ইখওয়ানুল মুসলিমুনে অন্তর্ভুক্ত হন এবং ইখওয়অনের কেন্দ্রে ক্লার্ক হিসাবে কাজ শুরু করেন। তিনি ছিলেন কুরআনের কারীও। নামায আর খতীবের দায়িত্ব তিনি ভালোভাবে পালন করতে পারেন। আমরা সিদ্ধান্ত নেই যে, আবু ছবীর কেন্দ্রে ইমামতি, খতীবী, ওয়ায আর দফতরের শৃঙ্খলা- এসব কাজ তাঁর উপর ন্যস্ত করা হবে। তাঁকে বিনিময় দেওয়া হবে ইসমাঈলিয়া থেকে। কারণ ইসমাঈলিয়া হচ্ছে আন্দোলনের মূলকেন্দ্র। আবু ছবীর শাখা এখনো নূতন। নূতন লোকের নিকট শুরুতেই মোটা অংকের আর্থিক সহায়তা দাবী করা হলে তারা আঁতকে উঠবে। দাওয়াত আর আন্দোলনের ক্ষেত্রে আল্লাহর রীতি এই যে, আর্থিক দাবী থেকে দূরে থাকতে হবে। যারা দাওয়াত দেবেন, তারা মানুষের কাছে কোন বিনিময় বা প্রতিদান চাইতে পারবে না। আর চাইলেও মানুষ কার্পণ্য করবে। তখন দাওয়াতের জন্য তাদের বক্ষ হবে সংকীর্ণ। অবশ্য তাদের অন্তরে ঈমান ভালোভাবে বদ্ধমূল হলে তারা কেবল স্বেচ্ছায় নিজেদের অর্থই ব্যয় করবে না, বরং এ জন্য নিজেদের জীবনও উৎসর্গ করবে। আবু ছবীর-এ শায়খ আব্দুল্লাহ বদবীর নেতৃত্বে দাওয়াতের সূচনার জন্য শায়খ ঈদ আল আযহারীর অস্তিত্ব দাওয়াতের শিকড় মযবুত করায় বেশ উপকারী প্রমাণিত হয়েছে। আর এটা আমাদের জন্যও এক ধরনের স্বস্তির কারণ হয়েছে।

পোর্ট সাঈদে দাওয়াতের সূচনা

ইসমাঈলিয়ায় একজন নওজোয়ান ছিলেন আহমদ আফেন্দী মিছরী। বয়স ১৭/১৮ বৎসর। ইনি ছিলেন পোর্ট সাঈদের বাসিন্দা। নিজের কিছু কার্য উপলক্ষে সাময়িকভাবে ইসমাঈলিয়ায় অবস্থান করতেন। তিনি বেশ সময় ইসমাঈলিয়ায় কাটান এবং এ সুবাদে তিনি ইখওয়ানের কেন্দ্রে যাতায়াত করেন। সেখানে যেসব বক্তৃতা করা হতো, বা যেসব হিদায়াত দেওয়া হতো, তাও শ্রবণ করতেন। কিছুদিন পরই তিনি যথারীতি বায়য়াত করে দলে অন্তর্ভুক্ত হন। ইখওয়ানের যে দলটি ছিল দাওয়াতের জন্য নিষ্ঠাবান এবং দাওয়াতের শোধবোধে আগ্রসর, ইনি সে দলে শামিল হন। ইসমাঈলিয়ায় তাঁর আসল মিশন শেষ হলে তিনি স্বদেশ ভূমি পোর্ট সাঈদে প্রত্যাবর্তন করেন। সঙ্গে নিয়ে যান তিনি দাওয়াতের আলোও। দাওয়াতের উদাহরণ হচ্ছে সে পবিত্র ও ভালো বীজের মতো, যা যেখানেই বপন করা হোক না কেন ফল দান করবে। আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ

**********************************

“পবিত্র বাক্যের উদাহরণ হচ্ছে পবিত্র বৃক্ষের মতো। তার শিকড় মযবুত এবং শাখা আকাশে উত্থিত। পালনকর্তার নির্দেমে সে অহরহ ফল দান করে”। (ইবরাহীমঃ ২৪-২৫)

পোর্ট সাঈদে ভাই আহমদ আফেন্দী মিছরীর ভালো বন্ধু-বান্ধব এবং সেখানকার পূণ্যত্মা নওজোয়ানদের একটা দল তার পাশে জড়ো হয় এবং তারা দাওয়াত দ্বারা অস্বাভাবিকভাবে প্রভাতি হয়। ভাই আহমদের অনন্য ব্যক্তিত্ব, গভীর ঈমান, সুন্দর স্বভাব এবং দাওয়াতের পথে মূল্যবান কোরবানীর ফলে তাঁর যেসব বন্ধুরা দাওয়াতকে বুশেুনে তার প্রতি ঈমান এনেছিলেন, তারা তাঁল নেতৃত্বে একমত হয়ে তাঁকেই নিজেদের কেন্দ্রবিন্দু হিসাবে স্বীকার করে নেয়।

পোর্ট সাঈদে ইখওয়ানের শাখা স্থাপিত হয়। পোর্ট সাঈদের স্থানে স্থানে খালী যায়গায় শাখার সমাবেশ হয়। মাগরিব বা এশার নামাযের পর সকলে সমবেত হতো। নূতন দাওয়াতের অবস্থা আর দাবী নিয়ে তারা কথাবার্তা বলতো। ভাই হাসান আফেন্দী আমাকে অনুরোধ জানান পোর্ট সাঈদ আগমন করে এসব নূতন ভাইদের সঙ্গে মিলিত হবার জন্য। এ আহ্বানে আমি যার পর নাই আনন্দিত হই। প্রথম সুযোগেই আমি তথায় গিয়ে তাদের সঙ্গে মিলিত হই। একটা মামুলী স্থানে বসে আমি পোর্ট সাঈদের নওজোয়ানদের প্রথম দলের নিকট থেকে এ মর্মে বায়য়াত গ্রহণ করি যে, তারা দাওয়াতের পথে জিহাদ অব্যাহত রাখবে, যতক্ষণ না দুটি পরিণতির যেকোন একটি দেখা দেয়- হয় আল্লাহ তা’আলা এ দাওয়াতকে বিজয় দান করবেন, অথবা এ পথে আমরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবো। পরবর্তীকালে ইখওয়ান চিন্তা করে যে, তারা নিজেদের জন্য একটা বিশেষ স্থানের ব্যবস্থা করবে। তারা আল-মানইয়া সড়কে একটা মামুলী ঘর ভাড়া নেয় এবং সেখানে শাখা স্থাপন করে। এটাই পোর্ট সাঈদে দারুল ইখওয়ান নামে পরিচিত হয়। দলের লোকজনের কাছ থেকে যেসব চাঁদা পাওয় যেতো, একটা স্বতন্ত্র দফতরের প্রয়োজন পূরণ করার জন্য তা যথেষ্ট ছিল না। আর এটা ছিল ইখওয়ানের স্তির সিদ্ধান্ত যে, তারা লোকজনের নিকট আর্থিক সহায়তা চাইবে না। বরং তারা অপেক্ষা করতো যে, দাওয়াত লোকজনের অন্তরে স্থান করে নিক, এবং এ পথে তারা নিজেরা আর্থিক কোরবানীর প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করুক। ইখওয়ানরা ছিল অন্তরের সন্ধানী, পকেটের নয়। আন্দোলনের কেন্দ্র ইসমাঈলিয়া এখানকার ব্যয়ের একটা অংশ গ্রহণ করে এবং পোর্ট সাঈদের ইখওয়ানেরা নিজেদের দান দ্বারা নিজেদের যে প্রয়োজন পূরণ করতে পারতো না, ইসমাঈলিয়া তা পূরণ করতো।

পোর্ট সাঈদে ইখওয়ানের অব্স্থায় স্থিতি এলে তারা সিদ্ধান্ত নেয় যে, তারা দাওয়াতকে খোলাখুলী জনগণের নিকট পৌঁছাবে, পোর্ট সাঈদের গণমানুষের সামনে উপস্থাপন করবে। আমার স্মৃতি শক্তি অনুযায়ী ১৩৪৯ হিজরীর মহররম উপলক্ষে তারা একটা সাধারণ সমাবেশের আয়োজন করে। তারা এ সমাবেশের আয়োজন করে নতুন কেন্দ্রের সামনে শামিয়ানা টাঙ্গিয়ে। ইসমাঈলিয়া আর পোর্ট সাঈদের ইখওয়ান নেতৃবৃন্দ সমাবেশে বক্তৃতা করেন। বক্তৃতার বিষয় ছিল নবীজীর হিজরত। পোর্ট সাঈদে ছিল ইলম ও আলেমদের প্রতি ভালোবাসার পরিবেশ। নবীজীর জীবনী আর জীবন চরিত বর্ণনা এবং নবীজীর প্রতি ইশক ও ভালোবাসার জন্য যে মাহফিলের আয়োজন করা হতো, লোকেরা তাতে আগ্রহ-উদ্দীপনা নিয়ে অংশ গ্রহণ করতো। মানুষ ইখওয়ানের দাওয়াত সম্পর্কে সরাসরী অনবহিত ছিল। যারা দাওয়াত দিয়েছে, তাদেরকেও ভালোভাবে জাতে না- চিনতো না। কিন্তু তারপরও এ মহফিলে দলে দলে যোগদান করে। সেখানে এটাই ছিল ইখওয়ানের প্রথম সমাবেশ। সমাবেশটি ছিল আনন্দদায়ক এবং শুভ। উপস্থিতির সংখ্যাও বেড়ে যায় অনেক।

সমাবেশের দিন হঠাৎ আমার শরীর খারাপ হয়ে যায়। আমি গলার ভীষণ ব্যথায় ভোগী। দুর্বলতার কারণে ইসমাঈলিয়া থেকে পোর্ট সাঈদ পর্যন্ত আমি শুয়ে শুয়ে সফল করি। স্কুলে ডাইরেক্টর মাহমুদ বেক সাহেব আমার অবস্থা দেখে বললেনঃ আপনি যদি আজ সফর করেন আর রাত্রে বক্তৃতা করেন, তবে আপনি নিজের প্রতি যুলূম করবেন। আপনি কোন অব্স্থায়ই বক্তৃতা করতে পারেন না।  এতদস্বত্ত্বেও আমি সফরের দৃঢ় সংকল্প করি। ট্রেন থেকে নেমে আমি সোজা দারুল ইখওয়ান গমন করি। দুর্বলতার কারণে আমি বসে বসে মাগরিবের নামায আদায় করি। নামাযের পর আমার এক অদ্ভুদ মানসিক অবস্থা সৃষ্টি হয়। আমি ভাবি, পোর্ট সাঈদের ইখওয়ানদেরকে এ মহফিল উপলক্ষ্যে কতই না উৎফুল্ল দেখাচ্ছে। এ মাহফিল নিয়ে তাদের কতই না আশা-আকাঙ্খা। আর কিভাবে তারা নিজেদের পেট কেটে এ মহফিলের ব্যয়ের আয়োজন করেছে। লোকজনকে অংশগ্রহণের দাওয়াত দেওয়ার জন্য তারা কতই না কষ্ট করেছে। এতসব কিছুর পরও এর পরিণতি কি এই যে, আসল বক্তা বক্তৃতা করতে অক্ষমতা জ্ঞাপন করছে?

এসব দিক চিন্তা করে আমি আবেগে কেঁদে ফেলি। এক বিশেষ অভিপ্রায়ে অভিভূত হয়ে এশার নামায পর্যন্ত আল্লাহ তা’আলার নিকট কান্নাকাটি করতে থাকি সুস্থতার জন্য। এ সময় আমি নিজের মধ্যে কিছুটা সজীবতা অনুভব করি। এশার নামায দাঁড়িয়ে আদায় করি। সমাবেশের সময় হয়। কুরআন মজীদ তিলাওয়াতের মাধ্যমে সমাবেশের কার্যক্রম শূরু হয়। আমি বক্তৃতা করার জন্য দাঁড়াই। আমি যখন বক্তৃতা শুরু করি, তখন অবস্থা এমন ছিল যে, আমি নিজেই নিজের কথা শুনতে পাচ্ছিলাম না। কিন্তু হঠাৎ করে আমার মধ্যে এক বিস্ময়কর শক্তি সংক্রমিত হয়। যেন আমি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেছি। আমার আওয়াজ বিস্ময়করভাবে স্বচ্ছ, স্পষ্ট এবং গর্জন করে উঠে। শামিয়ানার নিচে যারা বসা ছিল,  তারাও। তখনো মাইক ব্যবহারের প্রচলন শুরু হয়নি। আওয়াজ এমনই সূরেলা হয়ে উঠে যে, স্বয়ংয আমার ঈর্ষা হয় নিজের প্রতি। এভাবে মহফিল ভালোভাবে শেষ হয়। প্রায় দু’ঘন্টার বেশী সময় ধরে আমার বক্তৃতা চলে। এটা ছিল আল্লাহর বিশেষ মেহেরবানী। প্রতি বৎসরই আমার এরকম হতো। কিন্তু এ পবিত্র রজনীর পর সারা জীবনে আমার আর এ রোগ হয়নি। ভীষণ ঠাণ্ডা আর অস্বাভাবিক পরিশ্রম করলে তা ভিন্ন কথা। আমার বিশ্বাস মতে এ সুস্থ পরিবর্তন ছিল পোর্ট সাঈদের ইখওয়ানদের নিষ্ঠা-আন্তরিকতা আর দোয়অর বরকত। দাওয়াতের প্রতি তাদের রয়েছে ঐকান্তিক আগ্রহ। জনগণের নিকট তা পৌঁছাবার জন্য তারা নিজেদেরকে বিলীন করে দিয়েছে।

দাওয়াতের ক্ষেত্রে পোর্ট সাঈদ একের পর এক অগ্রসর হতে থাকে, উত্তরোত্তর উন্নতি লাভ করে। এখন সেখানে ইখওয়ানের চারটা মযবুত শাখা খোলা হয়েছে। তাদের আছে একটা খেলার মাঠ। এই সীমান্ত শহরের বাছাইকরা নওজোয়ানদের মধ্যে ঈমানে সত্যবাদী মুজাহিদ আর সক্রিয় কর্মীদের এক বিপুল সংখ্যা দাওয়াতকে গ্রহণ করে নিয়েছে।

আল-বাহর আল ছগীর-এ দাওয়াতের প্রসার

পোর্ট সাঈদের একটা সমাবেশে বাহরুছ ছগীর-এর জামালিয়া অঞ্চলের অধিবাসীদের একটা প্রতিনিধি দল যোগদান করে। এ প্রতিনিধি দলে জামালিয়া অঞ্চলের ভাই মাহমুদ আফেন্দী আব্দুল লতীফ নামে এক নওজোয়ানও ছিল। ওয়াকহিলার সিঙ্গার কোম্পানীল এজেন্ট ভাই ওমর গানামও ছিল। কোন প্রোগ্রাম অনুযায়ী নয়, বরং নিছক সমাবেশের টানে ইনি অংশ গ্রহণ করেন। সমাবেশের বক্তৃতা তিনি শোনেন। সমাবেশ শেসে তিনি থেকে যান এবং আন্দোলনের লক্ষ্য উদ্দেশ্য এবং মৌলিক বিষয় সম্পর্কে কথাবার্তা বলেন। নিজ অঞ্চলে এ মহান কাজের দায়িত্ব গ্রহণ করার দৃঢ় সংকল্প নিয়ে তিনি সমাবেশ থেকে ফিরি যান। খুব বেশীদিন যেতে না যেতেই তাঁর পক্ষ থেকে আমরা পরপর পত্র পাই। অবশেসে বাহরে ছগীর এর আলমানষিলা অ্ঞ্চলে ইখওয়ানের একটা পাখা কোলা হয়। মহান ওস্তাদ শায়খ মুস্তফা তাইর এ শাখা সভাপতি মনোনীত হন। ইনি ছিলেন আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাপ্রাপ্ত। বর্তমানে তিনি কায়রোর ইসলামিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষক। এরপর আল-জামালিয়ায় আলে আবদুল লতীফের গৃহে অপর একটা শাখা খোলা হয়। জাদীদা আল মানযিলা নামে তৃতীয় শাখা খোলা হয় আলে তবীলার বাসায়।

মোটকথা, প্রিয় স্বদেশ ভূীমর এ অংশেও দাওয়াতের কাফেলা উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে কাজ শুরু করে। ইসমাঈলিয়ায় আমার শেষ দিনগুলোতে পোর্ট সাঈদের পথে বাহরে ছগীর ইখওয়ানের শাখাগুলোতে আমি সফর করেছি। এসব সফর বেশ বরকত আর কল্যাণের কারণ হয়েছে। এতে লোকদের অন্তরে বিরাট সাফল্যের আশার সঞ্চার হয়। এ সময় একটা মজার ঘটনাও ঘটে। আমি মাতরিয়া গমন করি। সেখানে আল মানযিলার বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের একটা দল আমাকে অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করার জন্য উপস্থিত ছিলেন। আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাদের ওষ্ঠে ফুটে ওঠতো তাৎপর্যপূর্ণ হাসির একটা রেখা। যখন আমরা আল মনযিলা পৌঁছি এবং দারুল ইখওয়ানে প্রবেশ করি, তখন দেখতে পাই যে, অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করার জন্য দারুল ইখওয়ানে আগত আলেম-ফাযেল আর সম্মানিত বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গে অফিস কানায় কানায় পরিপূর্ণ। জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিবর্গ ছাড়া সাধারণ মানুষও ছিল বিপুল সংখ্যায়। সেখানেও আমাকে দেখে সকলেই একটা তাৎপর্যপূর্ণ হাসি প্রকাশ করে। আমি শায়খ মুস্তফা তাইরকে একান্তে জিজ্ঞেস করি- এরা হাসছে কেন? শায়খ বললেন: আপনি তাদের ধারনার সম্পূর্ণ বিপরীত। তারা অপেক্ষায় ছিল হাসানুল বান্না নামের একজন প্রতাপশালী, বিশাল দেহধারী, বয়স্ক এবং শানদার একজন মওলানার চেহারা দেখতে পাবে। কিন্তু তারা দেখতে পেয়েছে একটা ছোকরা, যার বয়স বড় জোর ২৫ বৎসর হবে। শায়খ মুস্তফা তাইর একথা বলার পর বললেন, এখন আমাদেরকে জনগণের আস্থা বহাল করতে হবে, তাদের মনে শান্তি ফিরিয়ে আনতে হবে। তাদেরকে মানাবার জন্য যতটা বেশী চেষ্টা করা যায়, তা করতে হবে আজ রাতেই।

আমি বললামঃ তাওফীক আর সাফল্য আল্লাহর হাতে নিহিত। কেবল আল্লাহর স্বত্ত্বার নিকট থেকেই সাহায্য-সহায়তা পাওয়া যেতে পারে। তিনি যদি কোন মঙ্গল আর কল্যাণেল ফয়সালা করেই থাকেন, তা অবশ্যই হবে। দেহের দুটা ক্ষুদ্র অংশের নাম মানুষ: একটা যবান, আর অপরটা অন্তর। আর মুমিনের অন্তর  দয়াময়ের দুটি আঙ্গুলির মধ্যে নিহিত। তিনি যেমন ইচ্ছা আর যেদিকে ইচ্ছা হয়; তা পরিবর্তণ করান। এ সফরে আমার সঙ্গে ছিলেন মহান ভাই হামেদ আসকারিয়া রহমতুল্লাহ আলাইহি। আমি বললাম: তিনি একজন বরকতময় মানুষ। তিনি এ অপূর্ণতা পূর্ণ করবেন। আল্লাহর ইচ্ছা হলে পরিস্থিতির পরিবর্তন হতে পারে।

বিকালে আমি জলাসয় বক্তৃতা করি। শামিয়ানার নীচে জলসা অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। তা ছিল কানায় কানায় পরিপূর্ণ। যতদূর দৃষ্টি যায়, কেবল মানুষ আর মানুষই চোখে পড়ে। বক্তৃতা শেষ হওয়ার পর লোকজন আমার নিকট আগমন করে। তারা উচ্ছাসিত ভাষায় আমার নিকট তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন যে, বক্তৃতার পূর্ব পর্যন্ত তাদের ধারনা ছিল, তারা একজন বাহ্যিক শায়খকে দেখতে পাবে। কিন্তু এখন তারা একজন সত্যিকার শায়খকে দেখতে পেয়েছে। তাদের এ প্রতিক্রিয়া ছিল আল্লাহর এক বিশেষ অনুগ্রহের ফল।

পরবর্তীকালে এ অঞ্চলে বহুবার আমরা সফল করেছি। স্থানে স্থানে দলের শাখা খোলা হয়েছে আর এসব শাখার তত্ত্বাবধানের জন্য আল্লাহ তা’আলা ভালো মানুষের একটা বিরাট দল সরবরাহ করেছেন। মাতরিয়া, মীতে খামীর, মীত আল-বছরাত, মীতে সালীসাল, বরম্বাল আল-কাদীসা, মীতে আদ্দেস, কাফরে জাদীদ- এসব স্থানে আমাদের শাখা খোলা হয়েছে। এ অঞ্চলের দুটি জনপদের পুরোটাই ছিল ইখওয়ানের। এর একটা হলো আল-মানযিলা, আর অপরটা হচ্ছে মীতে আছেম। যেসব বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ আর পরিবারের সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়েছে, তাদের মধ্যে ছিলেন ড. হিলযী আল-জিয়ার, বারাম্বার এর আলে সুয়াইলিম পরিবার। মীতে সালীসাল-এর আলে কাদাহ এবং কাফরে জাদীদ-এর আলুল হাওয়ারী পরিবার। এগুলো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এরা সকলেই আমাদের দাওয়াতকে পসন্দ করেন, সমর্থন জ্ঞাপন করেন এবং অদ্যবধি এর পৃষ্ঠপোষকতা করে আসছেন। একথাও উল্লেখযোগ্য যে, ১৯৩২ সালে খৃষ্টান মিশনারীরদের তৎপরতা দমনে যে অভিযান পরিচালিত হয়, মূলতঃ আল মানযিলায়ই তার প্রথম বিস্ফোরণ ঘটে। এরপর পোর্ট সাঈদে আরো দুটি বিস্ফোরণ ঘটে এবং সেখান থেকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এ আগুন ছড়িয়ে পড়ে। এ অভিযানের পরিণতি এই দাঁড়াঁ যে, স্বয়ং মুসলমানদের পক্ষ থেকেই কয়েকটা এতীমখানা, চিকিৎসা কেন্দ্র এবং অন্যান্য সেবামূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে। এসব প্রতিষ্ঠান এখনো চালু আছে।

সুয়েজে দাওয়াতের ইতিহাস

আমি সুয়েজে সংক্ষিপ্ত সফরে গমন করি। উদ্দেশ্য ছিল ওস্তাদ সাঈয়্যেদ মুহাম্মদ হাফেয তীজানীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করা এবং সেখানকার অন্যান্য বন্ধু-বান্ধব আর শিক্ষকদেরকে দেখা। তখন শরীয়ত আদালতের বিচারপতি ওস্তাদ শায়খ মুহাম্মদ আবু সউদও সেখানেই অবস্থান করতেন। তিনি সেখানে একটা চমৎকার জ্ঞান ও আমলের আন্দোলন সৃষ্টি করে রেখেছিলেন। তাঁর মজলিসে জ্ঞাণী-গুণী ব্যক্তিবর্গের সমাবেশ ঘটতো। এরা নিজেদের মধ্যে মতবিনিময় করতেন, যিকির-ফিকিরে নিমগ্ন হতেন, পরস্পরে মতবিনিময় করতেন। মানুষকে ওয়ায-নছিহত করার দায়িত্বও পালন করতেন। আমি তাঁর মহফিলে হাযির হই। এ মহফিল অনুষ্ঠিত হতো আল-গরীব মসজিদে। কোন কোন ইমাম আর আলেমের সঙ্গে আমাদের দাওয়াত নিয়ে আমিও আলোচনা করি। শরীয়ত আদালতের উকীল হাজী আতিয়া এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু মুহাম্মদ হাসান সৈয়দ (র)-এর সঙ্গেও সাক্ষাৎ হয় পথিমধ্যে। দাওয়াত প্রসঙ্গে তাদের সঙ্গেও সংক্ষিপ্ত আলোচনা হয়। আমার ধারনা জন্মে যে, এদের মধ্যে দাওয়াত সম্পর্কে বর্তমানে বেশ আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। পুনরায় সুয়েজ সফর কার নিমন্ত্রণ জানানো হয় আমাকে। আমি গমন করি এবং পূর্বোক্ত দুজনের সঙ্গে ওস্তাদ মুহাম্মদ তাহের মুনীর, ভাই শায়খ আব্দুল হাকীম এবং ভাই শায়খ আফীফী আতওয়া শাফেয়ীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। এ সাক্ষাতের ফল এ দাঁড়ায় যে, ‘আরবাঈন’-এর অভ্যন্তরে ইখওয়ানের একটা শাখা খোলা হয়। শায়খ আফীফী শাফেয়ীকে এর সভাপতি নিযুক্ত করা হয়। এরপর যথারীতি দাওয়াতের অগ্রগতি সাধিত হয়। এমন কি এ অঞ্চলে একাধিক শাখা খোলা হয়। সেখানে প্রতিষ্ঠিত হয় ইখওয়ানের বিরাট কেন্দ্র আর স্থাপিত হয় বিশাল ইমারত। লোহিত সাগর এর সমস্ত অঞ্চল, যথা গাযুকা, রা’স গারেব, কাছীর, মাফাজা ইত্যাদী স্থানে শাখা খোলা হয়। আর এসব শাখা ছিল সুয়েজ কেন্দ্রের অধীন। এসব অঞ্চলে পূত-পবিত্র ব্যক্তিবর্গের একটা বাছাই করা দল দাওয়াতকে কেন্দ্র করে সমবেত হয়।

সুয়েজে ‘চাটাই-এর রজনী’র কথা আমি কিছুতেই ভুলতে পারবো না। মরহুম হাসান আফেন্দীর প্রতি আল্লাহ রহমতের বৃষ্টি বর্ষন করুন এবং তাঁর জন্য জান্নাতকে প্রশস্ত করুন। তাঁর বাসার সামনে চাটাইয়ের উপর আমরা বসেছিলাম। রজনীর শান্ত-স্নিগ্ধ পরিবেশে শুরু হয় একটা অনাবীল জ্ঞানগর্ভ আলোচনা। নানা তত্ত্ব-তথ্যসমৃদ্ধ বিষয়ে অতীব সূক্ষ্ম ও জটিল প্রশ্ন আলোচনায় স্থান পায়। আমার মনে পড়ে ভাই শায়খ আব্দুল হাফীয সূরা ছাদ-এর একটি আয়াতে হযরত সুলায়মান (আ)-এর এ উক্তি সম্পর্কে একটা ভীষণ সমস্যায় পড়েছিলেনঃ

**********************************

“তিনি বললেন: হে মোর পালনকর্তা! আমাকে ক্ষমা কর এবং এমন রাজত্ব দান কর, যার অধিকারী আমি ছাড়া অন্য কেউ না হয়। তুমি তো পরম দাতা” (৩৫)।

শায়খ আব্দুল হাফীয বললেন: আয়াতে ক্ষমা ভিক্ষা করা হয়েছে। যাতে অপরাধের অনুভূতি প্রকাশ পায়; আবার রাজত্বও কামনা করা হয়েছে, যাতে এ অনুভূতি কার্যকর হয় যে, তিনি যেন আল্লাহর সন্তোষ আর পরিতুষ্টি অর্জন করেছেন। একই সঙ্গে এ দ্বিবিধ অনুভূতি কিভাবে জাগ্রত হতে পারে? একই ব্যক্তি থেকে একই অবস্থায় এ দ্বিবিধ অনুভূতি কিভাবে প্রকাশ পেতে পারে?

আমার পক্ষ থেকে এ সংকটের জবাবে বলা হয়: হযরত সুলায়মান আলাইহিস সালাম বলেছিলেন যে, আজ রাত্রে আমি সকল স্ত্রীদের নিকট গমন করবো। তাদের প্রত্যেকের গর্ভে এক একজন সন্তান জন্মলাভ করবে, যারা হবে আল্লাহর ইবাদাত গুজার বান্দাহ। রাজত্বের পরিধি প্রশস্ত করায় এবং ইসলামী ক্ষমতা সংযোজনে এরা হবে সহায়ক। তখন যেন কেবল কার্যকরণের উপরই হযরত সুলায়মান আলাইহিস সালামের দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল। এর ফল দাঁড়িয়েছে এই যে, সে রাত্রে কেবল একজন স্ত্রী গর্ভধার করেন। আর তিনিও যে সন্তান প্রসব করেন, তা ছিল অপূর্ণ, অ-পরিণত। জন্মের পর ধাত্রী নবাগত শিশূকে দৈহিক ক্রটিপূর্ণ মনে করে হযরত সুলায়মান আলাইহিস সালামের তৎক্ষণাৎ মনে পড়ে যে, রাজত্বের সম্প্রসারণ আর সুস্থিতির নিমিত্ত সন্তান দ্বারা তিনি সাহায্য লাভ করতে চেয়েছিলেন। অথচ রাজত্ব হচ্ছে আল্লাহ তা’আলার একটা দান। তিনি যাকে ইচ্ছা তা দান করেন। হযরত সুলায়মান আলাইহিস সালাম তাঁর আগের অনুভূতির জন্য আল্লাহ তা’আলার নিকট ক্ষমা ভিক্ষা করেন। অতঃপর কোন উপায়-উপকরণ আর মাধ্যম ছাড়ই সরাসরী আল্লাহর নিকট রাজত্বের জন্য আবেদন করেন এবং বলেন যে, কেবল তুমিই হচ্ছ মহান দাতা। যে অনুভূতি তাঁর জন্য পরীক্ষার কারণ হয়েছিল, এমন রাজত্ব কামনা করা দ্বারা মূলতঃ সেই পূর্ব অনুভূতির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা ব্যক্ত করা হয়েছে। অধমের এ জবাব উপস্থিত সকলেই পছন্দ করেন।

এ জ্ঞানগর্ভ আলোচনা দীর্ঘক্ষণ অব্যাহত থাকে। অতঃপর এক বিস্ময়কর রূহানী আবহের মধ্য দিয়ে এ আলোচনার পরিসমাপ্তি ঘটে। সূচনা হয় ভোরে মৃদুমন্দ বায়ুর মনমাতানো প্রবাহ। আর প্রত্যেকেই নিয়োজিত হয় আপন আপন পালনকর্তা সমীপে কাতর মিনতিতে। কেউ অঝোরে রোদন করছিল, আবার কেউ আদো্যপান্ত ব্যাকুল-বিহ্বল ছিল তাওবা- অনুশোচনায়, আবার কেউ ডুবে ছিল দোয়া আর ক্ষমা ভিক্ষঅয়। এহেন পরিবেশে ফুটে উঠে উষার আভা। আমরা সকলেই তাওবা নবায়ন করি; অঙ্গীকার আর প্রতিশ্রুতিকে করি আরো শক্তিশালী এবং আনুগত্যের অঙ্গীকারের সাথে বিশ্বস্ততাকে করি আরো সংহত। এরপর আদায় করি সালাতুল ফাজর। আর এটা ছিল আল্লাহর অনুগ্রহ যে, এ রাত্রে যেসব বন্ধুরা বায়য়াতের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছিলেন, তাঁর এ পথে অবিচল রয়েছেন:

**********************************

“মু’মিনের মধ্যে কতক এমন আছেন, যারা আল্লাহর সঙ্গে কৃত অঙ্গীকার পূরণে সত্য প্রমাণিত হয়েছেন। আবার তাদের মধ্যে কেউ কেউ আপন মৃত্যু পূর্ণ করেছেন, আর কতক প্রতীক্ষার প্রহর গুণছেন। তারা নিজেদের সকল্পে কোনই পরিবর্তন সাধন করেননি”। (সূরা আহযানঃ ২৩)।

মেহেন্দি বৃক্ষের শাখার কথাও আমি বিস্মৃত হতে পারবো না। একবার আমি সুয়েজ খাল অঞ্চলে সফরে গমন করি। সুয়েজের ইখওয়ানদের মধ্যে জনৈক সাথীর গৃহে অবস্থান করি। কক্ষের ভিতরে টেবিলের উপর রাখা ছিল ফিরোজাবাদী প্রণীত ‘সিফরুস সাআদাহ’ গ্রন্হ। আমি তা হাতে তুলে নেই। খোলামাত্রই আমার নযর পড়ে একটা হাদীসের প্রতি, নবীজী মেহেন্দি পাতা পসন্দ করতেন। নবীজীর অনুসরণে আমার অন্তরেও মেহেন্দি পাতার তীব্র আগ্রহ জাগ্রত হয়; কিন্তু এখানে তা পাওয়া যাবে কেমন করে। আমি নিজ শহর আর পরিবার থেকে অনেক দূরে। কিছুক্ষণ পর আমরা ইখওয়ানের কেন্দ্রে গমন করি। সেখানে পৌঁছেই আমি ভাষণ শুরু করি। জানালা ছিল আমার পিছন দিকে। জানালা আর তার আশপাশে কিছু বালক উঁকি মারছিল। হঠাৎ জনৈক বালক শায়খ হাদী আতিয়াকে ডাক দেয়। শায়খ বালকটির নিকট গমন করলে বালকটি তাঁর হাতে মেহেন্দি গাছের একটা বড় শাখা তুলে দিয়ে আমার প্রতি ইঙ্গিত করে (যা আমি নিজেই দেখতে পেয়েছি) বলে, শাখাটা বক্তাকে দেয়া হোক। শায়খ হাদী শাখাটা আমার হাতে দিয়ে বলেন: আপনার জন্য এটা আরবাঈন (এটা স্থানের নাম) শিশুদের উপহার। আমি মৃদু হেসে বলি: এটা শিশুদের উপহার নয়, বরং এটা হচ্ছে রাসূলে খোদার ভালোবাসা আর স্মৃতির একটা সুরভিত ঝংকার। অপ্রত্যাশিত এহেন মোবারক ঘটনায় সারাটা দিন আমি আনন্দের হিল্লোলে ডুবে  ছিলাম।

কায়রোয় দাওয়াতের ইতিহাস

আল-ফালকী সড়কে বাণিজ্য বিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠা লাভ করে একটা দ্বীনী সংস্থা-জমিয়তে দ্বীনিয়্যহ। স্কুলের দুজন ছাত্রই হচ্ছে এ সংগঠনের পুঁজি। এরা হচ্ছে আব্দুর রহমান সায়াতী এবং মাহমুদ সা’দী আল-হাকীম। অবশ্য এদের সঙ্গে কয়েকজন সহপাঠিও রয়েছে। এরা নিয়মিত নামায আদায় করে। ইসলামের বরকত আর কল্যাণ স্বীকার করে এবং ইসলামের শিক্ষার সৌন্দর্য সম্পর্কেও এরা অবহিত। স্কুল ছুটি  হলে মসজিদ হয় তাদের সমাবেশের কেন্দ্র। এখানেই প্রকাশ পায় তাদের কর্মতৎপরতা। সহপাঠি ছাত্রদের উপহাসের পাত্র হতে হয়েছে তাদেরকে বহুবার। ছাত্ররা অবাক হয়ে তাদের প্রতি অঙ্গুলী সংকেত করতো। কিছু ছঅত্র এসব দৃশ্যকে কোন পাত্তাই দিতো না। স্কুলের কর্মচারীরাও এদের বিরোধিতা করতো। কিন্তু এরা নিতান্ত ভদ্রতার সঙ্গে ধৈর্য-স্থৈর্য অবলম্বন করে চলে।

এ দুজন সৎ যুবক স্কুল জীবন শেষ করে রেলওয়ের কারিগরী শাখায় একই সঙ্গে চাকুরী গ্রহণ করে। এদের অন্তরে ছিল ইসলামের প্রতি গভীর ভালোবাসা, ছিল ইসলামের অর্পিত দায়িত্বের অনুভূতি এবং ইসলামের জন্য কাজ করার ব্যাকুলতা। সত্য দ্বীনের তরে যেকোন ত্যাগ আর কোরবানীর জন্য তারা প্রস্তুত। সে সময়ে ইসলামের জন্য কাজ করার সবচেয়ে বড় প্রমাণ ছিল ইসলামী সংগঠন গড়ে তোলা। সে মতে তাদের মধ্যেও একটা উদ্দীপনা সৃষ্টি হয় একটা ইসলামী সংগঠন প্রতিষ্ঠা করার। যে সংগঠন ইসলামী দাওয়াত পেশ করবে। ইসলামকে উর্ধ্বে তুলে ধরার জন্য চেষ্টা-সাধনার চালাবে। আর এ উৎসাহ-উদ্দীপনার পরিণতিতেই প্রতিষ্ঠিত হয় জমিয়তে হাদারাতে ইসলামিয়া- ইসলামী সংস্কৃতি সংস্থা। শুরু হয় সংস্থার কার্যক্রম। রোম মহল্লায একটা ভবনের নিচের তলায় ভাড়া নেওয়া হয় একটা কক্ষ। কক্ষের সামনে ছিল একটা প্রশস্ত আঙ্গিনা। এ কক্ষটাই তাদের কর্মতৎপরতার কেন্দ্রে পরিণত হয়। এটাই হয়ত তাদের চেষ্টা-সাধনার আখড়া। আরো কতিপয় জ্ঞাণী-গুণী ব্যক্তিত্ব যোগ দেয় এ সংগঠনে।

এসব গুণী ব্যক্তিরা সেখানে আগমন করে ভাষণ দিতেন। সাধারণ লোকদের সম্মুখে নিয়মিত ওয়ায করতেন। দারস দান করতেন, হৃদয়গ্রাহী ভঙ্গিতে লোকদেরকে ইসলামের দিকে আহ্বান জানাতেন। এদের মধ্যে তালিকার শীর্ষে ছিলেন শায়খ মুহাম্মদ আহমদ শরীত, ওস্তাদ হামেদ শরীত (যিনি পরবর্তীকালে শিক্ষা বিভাগে চাকুরীতে যোগদান করেন), ওস্তাদ মাহমুদ বারাবী (যিনি পরবর্তীকালে ইখওয়ানের সংবাদপত্র বিভাগের প্রধান ছিলেন), শায়খ মুহাম্মদ ফারগালী (যিনি পরবর্তীকালে ইসমাঈলিয়ায় ইখওয়ানের প্রধান হন। জামাল নাসের ১৯৫২ সালে ইখওয়ানের যেসব নেতাকে মৃত্যুদণ্ড দান করেন, আল্লামা শায়খ মুহাম্মদ ফারগালীও ছিলেন তাঁদের অন্যতম) এবং শায়খ জামীল আক্কাদ (সিরিয়ার হলব বা আলেপেপো প্রদেশের অধিবাসী)। তৎকালে এর ছিলেন সেরা ছাত্র এবং বুদ্ধিমান যুবক হিসাবে খ্যাত।

এ সময় ইসলামী সংস্কৃতি সংস্থা ইসমাঈলিয়ার অভ্যন্তরে ইখওয়ানুল মুসলিমুন-এর কর্ম তৎপরতা পর্যবেক্ষণ করে এবং এই বরকতময় শহরের দিকে দিকে ইখওয়ানের শাখা ছড়িয়ে থাকতে দেখে  সংস্থার কর্মকর্তাদের মনে বিশ্বাস জন্মে যে, অনৈক্যের চেয়ে ঐক্য ভালো। দাওয়াতী কর্মকান্ডে সহযোগিতা আর একমুখীতা সর্বোত্তম এবং ফলপ্রসু বলেও তারা মনে করেন। তারা ইসমাঈলিয়ায় ইখওয়ানের দফতরের সঙ্গে যোগাযোগ স্তাপন করেন। ঐক্য স্থাপন সম্পর্কে তারা আলাপ-আলোচনা শুরু করেন। এসব আলাপ-আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে অবশেষে ইসলামী সংস্কৃতি সংস্থাকে ইখওয়ানের সঙ্গে একীভূত করা হয়। ফলে কায়রোস্থ সংস্কৃতি সংস্থার দফতরকে ইখওয়ানুল মুসলিমুনের শাখায় পরিণত করা হয়। এরপর ইখওয়ান কায়রোয় সালাখ বাজার সড়কে সলীম পাশা হেজাযীর ইমারতে একটা কক্ষ ভাড়া নিয়ে সেখানে দফতর স্থাপন করে। ইখওয়ান কর্মীরা নিজেরাই এর সংস্কার আর শোভা বর্ধনের কাজ করে। তারা এ নূতন দফতরকে এমনভাবে সুসজ্জিত করার চেষ্টা করে, যাতে তা মিশরের রাজধানী কায়রোয় আন্দোলনের উপযুক্ত কেন্দ্রে পরিণত হতে পারে। কায়রোয় ইখওয়ানের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিলো না। আধুনিক চাহিদা অনুযায়ী দফতর সাজানোর জন্য বিপুল অর্থ ব্যয় করার সঙ্গতি ইখওয়ানের ছিল না। এ কারণে কায়রোয় ইখওয়ানের আর্থিখ অবস্থা স্বচ্ছল না হওয়া পর্যন্ত ইসমাঈলিয়া আর্থিখ সহায়তার দায়িত্ব গ্রহণ করে। ১৯৩২ সালের প্রথম দিকে আমার কায়রোয় বদলী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইখওয়অনের সদর দফতরও কায়রোয় স্থানান্তর হয়।

কায়রোয় ইখওয়ানদের একটা ঘটনা চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে। কায়রোয় সবে মাত্র দাওয়াতের কাজ শুরু  হয়েছে। আর্থিক সহায়তার বেশ প্রয়োজন ছিল ইখওয়ানের জন্য। কেবল ইসমাঈলিয়াই নিয়মিত কায়রোয় আর্থিক সহায়তা প্রদান করে আসছিল। এহেন টানাটানি আর দুর্দিনে ইখওয়ানকে বিপুল আর্থিক সহায়তা দানের প্রস্তাব করা হয়। বিনিময়ে তাদের কাছে দাবী করা হয় সরকারের প্রতি সমর্থন করে তার পক্ষে প্রচার-প্রোপাগান্ডা চালাবার। সংবিধান রচনা আর নির্বাচন অনুষ্ঠানের যে উদ্যোগ-আয়োজন সরকার গ্রহণ করেছে, তার স্বপক্ষে কাজ করার জন্যও বলা হয় ইখওয়ানকে। তখন সিদকী পাশা প্রথমবারে মতো মন্ত্রীসভা গঠন করেছেন। ভাই আব্দুর রহমান সায়াতী বা ঘড়ির মেকার (ইনি ছিলেন ইমাম হাসানুল বান্না শহীদের ছোট ভাই এবং বয়সে তাঁর চেয়ে দুই বৎসরের ছোট)। তখন ইনি ছিলেন একজন সাধারণ সরকারী কর্মচারী মাত্র। এ প্রস্তাবের জবাবে ভাই আবদুর রহমান বলেন:

“আমাদের হস্ত কর্তন করা যেতে পারে, কিন্তু তা এমন কোন অর্থের দিকে অগ্রসর হতে পারে না, যাতে আমাদের কোন অধিকার নেই এবং যে অর্থের উদ্দেশ্য হচ্ছে ইসলামী আন্দোলনকে ব্যক্তিস্বার্থের অধীন করে নেয়া। বর্তমান রাজনৈতিক বিধানে আমরা সন্তুষ্ট থাকলে তার জন্য জান-মাল উৎসর্গ করে জিহাদ করা আমাদের নিজেদেরই কর্তব্য হতো। অর্থের বিনিময়ে সরকারের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়”।

মোটকথা সরকারী স্বার্থে ইখওয়ানকে ক্রয় আর ব্যবহারে সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ হয়। অথচ তখন ইখওয়ান কতিপয় যুবক আর সরকারী কর্মচারী ছাড়া আর কিছুই ছিল না। এভাবে আল্লাহ তা’আলা শুরু থেকেই ইসলামী আন্দোলনকে পংকীলতা থেকে রক্ষা করেছেন। এহেন পংকীলতা যে আন্দোলনে সংক্রমিত হয়, তার বিনাশ অনিবার্য। কোন ব্যক্তির মধ্যেও এটা প্রবেশ করলে সে ব্যক্তিও আল্লাহ থেকে দূরে সরে যেতে বাধ্য। কায়রোর ইসলামী আন্দোলন আর তার কর্মকর্তাদের প্রতি আল্লাহর বিশেষ মেহেরবানী যে, তারা এ পরীক্ষায় সফলভাবে উত্তীর্ণ হতে পেরেছেন। আলহামদুলিল্লাহ- সমস্ত প্রশংসা আল্লাহরই প্রাপ্য।

উম্মাহাতুল মু’মেনীন মাদ্রাসা

বালকদের জন্য প্রতিষ্ঠিত আল-হেরা মাদ্রাসা ভালোভাবে নিজের পায় দাঁড়াবার পর ইখওয়ান বালিকাদের জন্য একটা মাদ্রাসা স্থাপন করার কথাও চিন্তা করে। তারা এ মাদ্রাসার নাম ঠিক করে উম্মাহাতুল মু’মেনীন মাদ্রসা। আর এ জন্য এক বিশাল ইমারতও ভাড়া নেওয়া হয়। যুগোপযোগী একটা পাঠ্যসূচিও প্রণয়ন করা হয়, যা একদিকে ইসলামী আদর্শ এবং বালিকা, মাতা আর স্ত্রী হিসাবে নারীদের জন্য ইসলামের শিক্ষার আলোকে প্রণীত হয়েছিল, তেমনিভাবে যুগের দাবী আর চাহিদা অনুযায়ী বিজ্ঞান শিক্ষা দানের ব্যব্স্থাও ছিল এ পাঠ্যসূচিতে। আমার প্রস্তাব ছিল মাদ্রসার পরিবেশ সুস্থ ও নিরাপদ রাখার জন্য ইসমাঈলিয়ার শিক্ষিত আর দক্ষ-অভিজ্ঞ মহিলাদেরকে শিক্ষকতার কাজে নিযুক্ত করা হোক। আমার এ পরামর্শ মেনে নেওয়া হয। মাদ্রাসার প্রিন্সিপালের দায়িত্ব পালনের জন্য ওস্তাদ আহমদ আব্দুল হালীমের নাম প্রস্তাব করা হয়। ইনি ছিলেন একজন দ্বীনদার পরহেজগার ব্যক্তি। আন্দোলনের সঙ্গেও তাঁল ছিল গভীর সম্পর্ক।

আল-আখাওয়াত আল-মুসলিমাত

যে উদ্দেশ্যে উম্মাহাতুল মু’মিনীন মাদ্রাসা স্থাপন করা হয়, তা ভালোভাবে পূরণ হলে শিক্ষা বিভাগ মাদ্রাসাটির পরিচালনার ভার গ্রহণ করে। এ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার কিছুদনি পর ইখওয়ানুল মুসলিমুনের মহিলা শাখা-আল-আখাওয়াত আল-মুসলিমাত খোলা হয়। ইখওয়ান কর্মীদের স্ত্রী-বোন-কন্যঅ আর আত্মীয়স্বজন দ্বারা এ শাখা খোলা হয়। এ শাখার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন এ মাদ্রাসারই শিক্ষয়িত্রীরা। আমি এ শাখাকে বলতাম ফির্কাতুল আখাওয়াত আল মুসলিমাত- মুসলিম বোনদের গ্রুপ। এদের জন্য বিশেষ নীতিমালা আর কর্মসূচীও প্রণয়ন করা হয়। মুসলিশ নারীদের মধ্যে দাওয়াত প্রসারের কাজে তারা ক কি উপায়-উপকরণ ব্যবহার করবে, তাও চিহ্নিত করে দেওয়া হয়।

স্কাউটস গ্রুপ

উপরন্তু ইখওয়ান চিন্তা করে যে, শারীকির ব্যায়ামের অনুশীলনও শুরু করা উচিৎ। এ ধারণার ভিত্তি ছিল ইসলামী জিহাদের অনুপ্রেরণা। জিহাদের জন্য নিয়মত পরিপক্ক করা এবং জিহাদ সম্পর্কে ইসলামের নির্দেশ কার্যকর করার আগ্রহে ইখওয়ান ছিল উদগ্রবী। এ ব্যাপারে সে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হুঁসিয়ারী থেকেও রক্ষা পেতে চায়ঃ

**********************************

“যে ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করে এ অবস্থায় যে, সে জিহাদ করেনি, জিহাদের নিয়তও পোষণ করেনি, সে ব্যক্তি জাহিলিয়্যাতের মৃত্যুবরণ করে”।

এ কারণে ইখওয়ানুল মুসলিমুন স্কাউটিং-এর নীতিতে একটা গ্রুপ গড়ে তোলে, যার নাম দেওয়া হয় কিরআতুল রিছলাত-বা ট্যুরিস্ট স্কাউটস গ্রুপ। ইসমাঈলিয়ার পর ইখওয়ানের অন্যন্য শাখা এবং কেন্দ্রেও এ ব্যবস্থা ছড়িয়ে পড়ে। অধুনা ইখওয়ানের অভ্যন্তরে যে স্কাউটস গ্রুপ রয়েছে এটাই হচ্ছে তার পড়ে। অধুনা ইখওয়ানের অভ্যন্তরে যে স্কাউটস গ্রুপ রয়েছে এটাই হচ্ছে তার ভিত্তি (ইখওয়ান নওজোয়ানদেরকে জিহাদের যে দীক্ষা দান করে, তার ফলে ‌৯৪৭ সালে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে দশ হাজার ইখওয়ান মুজাহিদ জিহাদের জন্য বেরিয়ে পড়ে এবং তরা ইহুদীদেরকে নাকানী-চুবানী খাইয়ে দেয়। এ সময় আন্তর্জাতিক ষড়ন্ত্রে ইখওয়ানের উপর নির্যাতন নেমে না এলে এবং পরবর্তীকালে ইখওয়ানকে বেআইনী ঘোষণা না করা হলে ইসরাইল রাষ্ট্র অংকুরেই মূলোৎপাঠিত হতো- অনুবাদক)।

জাবাসাত আল বালাহ-এ ইখওয়ানের দাওয়াত

জাবাসাত-এর কিছু মজদূর এবং শ্রমজীবী মানুষ ইসমাঈলিয়ায় ইখওয়ানের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ পায়। এরা জাবাসাত এর শ্রমিক শ্রেণীর নিকট ইখওয়ানের দাওয়াত ও দর্শন পৌছায়। আমাকে নিমন্ত্রণ জানানো হয় জাবাসাত সফর করার। আমি সেখানে গমন করে শ্রমিক ইখওয়ানদের নিকট থেকে দাওয়াত ও আন্দোলনের প্রতি বায়য়াত গ্রহণ করি। দূরাঞ্চলে এ বায়য়াত ছিল চিন্তার রাজ্যে একটা বিপ্লবের পূর্বাবাস। খুব বেশী দিন যেতে না যেতেই শ্রমিকরা সুয়েজ কোম্পানীর নিকট একটা মসজিদ নির্মাণের বাদী উত্থাপন করে। কারণ, সেখানে মুসলমান শ্রমিকের সংখ্যা ছিল তিনশ’রও বেশী। সুতরাং এসব শ্রমিকদের জন্য কোম্পানীকে একটা মসজিদ নির্মাণ করতে হবে। কোম্পানী শ্রমিকদের দাবী মেনে নিয়ে একটা মসজিদ নির্মাণ করে। ইমামতি এবং দারসের দায়িত্ব পালন করতে পারে- এমন একজন আলেমে দ্বীন প্রেরণ করার জন্য কোম্পানী ইসমাঈলিয়ায় ইখওয়ানকে লিখে। এ কাজের জন্য বিশিষ্ট আলেম ভাই মুহাম্মদ ফারগালীকে মনোনীত করা হয়। তিনি তখন আল হেরা মাদ্রাসার শিক্ষক ছিলেন।

শায়ক ফারগালী জাবাসাত আল বালাহ গিয়ে মসজিদের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। মসজিদের নিকটেই তাঁর বাসস্থানের ব্যবস্থা করা হয়। শ্রমিকদের সঙ্গে শায়খের মনের মিল ঘটে। কয়েক সপ্তাহ যেতে না যেতেই শ্রমিকদের মানসিক এবং সামাজিক মান-মর্যাদার বিস্ময়কর পরিবর্তন সূচিত হয়। তারা জীবনের সত্যকার মূল্য উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়। জীবনের উন্নত লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কে তারা অবগত হতে পারে। মানবতার মর্যাদা আর গুণাবলী সম্পর্কে তারা সঠিক ধারণা লাভ করতে পার্ তাদের মন থেকে ভয় আর অপমানের অনুভূতি এবং দুর্বলতা আর আক্ষমতার ভাব বিদূরিত হয়। তারা ঈমানের দওলতে ধন্য হতে পেরেছে এবং জীবনের আসল কর্তব্য অর্থাৎ হুকমুতে এলাহী প্রতিষ্ঠা করার কথা তারা বুঝতে পেরেছে এ জন্য তারা গর্ব অনুভব করে। এ কারণে তারা বেশ পরিশ্রম করে অর্পিত দায়িত্ব পালন করে এবং অত্যন্ত পরিশ্রম দ্বারা রাসূলে খোদার এ বাণী কার্যকর করেঃ

**********************************

তোমাদের মধ্যে কেউ কোন কাজ করলে তা ভালোভাবে সম্পন্ন করাকে আল্লাহ পসন্দ করেন। অন্যদিকে যে বিষয়ে তাদের কোন অধিকার নেই, তা থেকে তারা নিজেদেরকে দুরে রাখতো, কোন নীচ লোভ-লালসা তাদেরকে আকৃষ্ট করতে পারতো না, আর তুচ্ছ বস্তুর প্রতি আকর্ষণও তাদেরকে টানতে পারতো না। একজন কর্মচারী তার অফিসারের সম্মুখে এমনভাবে দাঁড়াতো যে, তার শির উঁচু, কিন্তু তাই বলে সে শিষ্টাচার বিসর্জন দিতো না। সে আত্মমর্যাদায় পরিপূর্ণ, কিন্তু তাই বলে শালীনতার সীমা লংঘন করে না। কথা বলার সময় যে যুক্তি- প্রমাণ উপস্থাপন করে। আগের মতো কোন অসমীচীন শব্দ মুখ থেকে নির্গত করে না, অফিসারের নিকট থেকেও এমন কোন শব্দ শুনতে সে রাজি নয়। তুচ্ছ আর অপমানের কোন রীতি সে নিজের জন্যও পসন্দ করে না, অফিসের জন্যও নয়। ভ্রাতৃত্বের বন্ধন এসব শ্রমিকদেরকে এক স্থানে সমবেত করেছে। পরিশ্রম, ভালোবাসা আর বিশ্বস্ততা ছিল তাদের ঐক্যের ভিত্তি। কিন্তু কোম্পানীর কর্মকর্তারা শ্রমিকদের এ রীতি ভালো নজরে দেখতে পায় না। তারা শংকিত হয়ে উঠে। তারা ভাবে, এ অবস্থা চলতে থাকলে একদিন এ মওলবী শায়খ ফারপালীর হাতে কর্তৃত্ব চলে যাবে। এরপর কোন শক্তিই তাকে আর এ শ্রমিকদেরকে আয়ত্বে আনতে পারবে না।

শায়খ ফারগালী আর বিদেশী কোম্পানীর সংঘাত

সুতরাং কোম্পানীর কর্মকর্তারা এ ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে এহেন সাহসী শায়খকে যেকোনভাবে চাকুরীচ্যুত করার কথা চিন্তা করে। একনজ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে প্রেরণ করা হয় শায়খের নিকট। কর্মকর্তা শায়খকে বলে: পরিচালক আমাকে জানিয়েছেন যে, আপনার সেবার আর প্রয়োজন নেই কোম্পানীর। এখন কোম্পানী আপনার পরিবর্তে অন্য কাউকে মসজিদের দায়িত্ব দিতে চায়। এই নিন পরিচালকের নির্দেশ অনুযায়ী আজ পর্যন্ত আপনার পাওনা।

মায়খ ফারগালী অত্যন্ত ধৈয্য আর শান্তভাবে তাকে জবাব দেনঃ

মোসিও ফ্রান্সো! আমি নিজেকে জাবাসাত আলবালাহ –এর কোম্পানীর কর্মচারী বলে মনে করতাম না। এটা জানলে আমি আদৌ কোম্পানীর চাকুরী গ্রহণ করতাম না। আমি তো মনে করতাম যে, ইসমাঈলিয়ার ইখওয়ানুল মুসলিমুনের পক্ষ থেকে আমি এখানে প্রতিনিধিত্ব করছি। আমি বিনিময়ও তাদের নিকট থেকে গ্রহণ করি, যা আপনার মাধ্রমে আমার কাছে পৌঁছে। আমার চুক্তি আপনার সঙ্গে নয়, বরং ইখওয়ানের সঙ্গে। আমি আপনার নিকট থেকে কোন বেতনও নেবো না, হিসাবও চাই না। আমি মসজিদে যে দায়িত্ব পালন করছি, তা কিছুতেই ত্যাগ করবো না। এ জন্য শক্তি প্রয়োগ করা হলেও না। ইখওয়ান প্রধান, যিনি আমাকে এখানে প্রেরণ করেছেন, কেবল তিনিই আমাকে পদচ্যুতির নির্দেশ দিতে পারেন। তিনি ইসমাঈলিয়ায় আছেন। তাঁর সঙ্গে দেখা করে যা কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়ার আছে, নিতে পারেন।

শায়খ ফারগালীর এ জবাব শুনে কর্মকর্তা শায়খের অনুমতি নিয়ে ফিরে যান। শায়খের এ কঠোর ভূমিকায় কোম্পানীর প্রশাসন বিপাকে পড়ে। কোম্পানী কিছুদিন ধৈর্যধারণ করতঃ অপেক্ষায় থাকে যে, শায়খ হয়তো তাদের কাছে বেতন দাবী করবেন। কিন্তু শায়খ ইসমাঈলিয়ায় আমার নিকট আগমন করেন। আমিও তাঁকে বলি যে, আপনি নিজের ভূমিকায় অটল থাকুন। কোন অবস্থায়ই আপনি স্থান ত্যাগ করবেন না। আপনার যুক্তি ন্যায়সঙ্গত এবং বলিষ্ঠ। আপনার কাছে তাদের কিছুই নেই। এখন কোম্পানী কেন্দ্রীয় প্রশাসনের আশ্রয় নেয়। আর তার ডাইরেক্টর মোসিও মেনো ময়েজ গভর্নরের সঙ্গে যোগাযোগ করে। আর গভর্নর ইসমাঈলিয়ার পুলিশ পরিদর্শককে নির্দেশ দেন একদল পুলিশসহ জাবাসাত আলবালাহ গমন করে পরিস্থিতি শান্ত করার জন্য।

পুলিশ ইন্সপেক্টর সেপাহী নিয়ে তৎক্ষণাৎ সেখানে পৌঁছে এবং ডাইরেক্টরের দফতরে গিয়ে অবস্থান নেয়। শায়খকে ডেকে আনার জন্য একজনকে প্রেরণ করেন। শায়খ মসজিদে আশ্রয় নেন। শায়খ জবাব দেন, পুলিশ ইন্সপেক্টর বা ডাইরেক্টরের সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক নেই। আমার কাজ মসজিদের সঙ্গে যুক্ত। তাদের কারো প্রয়োজন থাকলে এখানে আমার কাছে আসতে পারে। ফলে পুলিশ ইন্সপেক্টর নিজেই শায়খের নিকট গমন করেন। ডাইরেক্টরের নির্দেশ মেনে নেওয়ার জন্য তিনি শায়খকে পীড়াপীড়ি করতে থাকেন। কাজ ছেড়ে ইসমাঈলিয়া গমন করার জন্য তিনি চাপ দিতে থাকেন। শায়খ পূর্বের জবাব পুনরাবৃত্তি করে বলেনঃ

আপনি ইসমাঈলিয়া থেকে আমাকে বরখাস্ত করার লিখিত  নির্দেশ এনে দিন, আমি তৎক্ষণাৎ চলে যাবো। কিন্তু আপনি যদি শক্তি প্রয়োগ করতে চান, তবে আপনি যা খুশী করতে পারেন। আমি কিছুতেই বের হবো না। এখান থেকে কেবল আমার লাশই বের হতে পারে।

খবরটা শ্রমিকদের নিকট পৌঁছে। তারা তখনই কাজ বন্ধ করে এবং দল বেঁধে শ্লোগান দিতে দিতে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়। পুলিশ ইন্সপেক্টর বিরোধের পরিণতি সম্পর্কে শংকিত হয়ে সে অবস্থায় ইসমাঈলিয়া গমন করে। সমস্যা সমাধানে সমঝোতার উপায় বের করার জন্য আমার সঙ্গে দেকা করে। আমি অক্ষমতা জ্ঞাপন করে বলি, বিষয়টা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা না করে আমি কোন মত ব্যক্ত করতে পারি না। আমি দলের কর্মপরিষদের বৈঠক ডাকবো, কর্মপরিষদ বিষয়টা বিবেচনা করে দেখবে। এর পর আমি আপনাকে কিছু বলতে পারবো। আমাকে দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে যে, এ সময় আমি কায়রো গমন করি এবং সুয়েজ কোম্পানীর প্রশাসনিক পরিষদের জনৈক মিশরীয় সদস্যের সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলি। আমি দেখতে পাই যে, তিনি শ্রমিকদের স্বার্থের ব্যাপারটা সম্পূর্ণ এড়িয়ে যাচ্ছেন। কোম্পানী আর তার ডাইরেক্টরের চিন্তা আগাগোড়া সমর্থন করছেন। জাতীয় স্বার্থের প্রতি তাঁর বিন্দুমাত্রও লক্ষ্য নেই। অত্যন্ত দুঃকের সঙ্গে আমাকে একথাগুলো বলতে হচ্ছে।

এরপর আমি নিজে কোম্পানীর ডাইরেক্টরের সঙ্গে দেখা করি এবং তাঁকে জিজ্ঞেস করি, কেন তিনি শায়খ ফারগালীর পিছনে আদা-নুন খেয়ে লেগেছেন? তাদের প্রয়োজন এমন লোকের, যে তাদের নির্দেশের সামনে মাথানত করবে- এছাড়া অন্য কোন জবাব তার কাছে ছিল না। ডাইরেক্টরের একথাগুলো এখনো আমার ভালোভাবে মনে আছেঃ

“আমি অনেক মুসলমান নেতার বন্ধু। আলজেরিয়াও আমি কুড়ি বৎসর অতিবাহিত করেছি। কিন্তু আমি তাদের মধ্যে শায়খের মতো একজন মুসলমানও দেখতে পাইনি, যে আমাদের উপর হুকম চালাতে পারে। তিন যেন একজন সামরিক কর্মকর্তা আর কি”।

আমি তার সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা ও বিতর্কে প্রবৃত্ত হই এবং তাকে বুঝাবার চেষ্টা করি যে, তার ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। আসলে এসব কোম্পানীরাই শ্রমিকদের প্রতি যুলুম-নির্যাতন চালায়। শ্রমিকদের অধিকার হরণ করে; এমনকি তাদেরকে মানুষই মনে করে না। তাদের সঙ্গে নিতান্ত সংকীর্ণতা এবং কৃপণতা করে। তাদেরকে পূর্ণ পারিশ্রমিক দেয় না। একদিকে হচ্ছে এ অবস্থা; আর অন্যদিকে কোম্পানীর মোনাফায় অঢেল সংযোজন হচ্ছে। এ বিকৃতির সুরাহা নিতান্তই জরুরী। এর প্রতিবিধান এভাতে হতে পারে যে, কোম্পানীর বিধান সংশোধন করতে হবে এবং স্বল্প মোনাফায় কোম্পানীকে তুষ্ট থাকতে হবে। অবশেষে আমি আর ডিরেক্টর এ ব্যাপারে একমত হই যে, শায়খ ফারগালী দু’মাস যথারীতি স্বপদে বহাল থাকবেন। এ মেয়াদ সমাপ্ত হলে ডিরেক্টর এবং তার কোম্পানী তাঁকে সসমআনে বিদায় দেবে। কোম্পানী যথারীতি ইখওয়ানের নিকট আবেদন জানাবে তাঁর পরিবর্তে অন্য কোন ব্যক্তিকে নিয়োগ করার জন্য। এবং নবনিযুক্ত মওলবী সাহেবকে দ্বিগুণ বেতন দিতে হবে। তাঁর জন্য বাসস্থান এবং অন্যান্য প্রয়োজনের উপযুক্ত ব্যবস্থা করতে হবে। দু’মাস সময় অতিক্রান্ত হলে শায়খ ফারগালী বিদায় নেন। তাঁর স্থান গ্রহণ করেন শায়খ শাফেয়ী আহমদ। এ মরু অঞ্চলে ইসলামী দাওয়াতের কাফেলা ভালোভাবে এগিয়ে চলে।

ঘৃণ্য চক্রান্তের কয়েকটি দৃষ্টান্ত

রমযানুল মুবারকে আমার নিয়ম ছিল আব্বাসী মসজিদে ফজরের পর নামাযের ইসলামী মাসায়েল বিষয়ে দারস দান করতাম। বেশীর ভাগ এসব মাসায়েল ছিল নামায-রোযা এবং রমযানের ফযীলত সম্পর্কিত। রমযানুল মুবারক শেষ হয়ে এলে আমি ঈদের নামাযের বিধান ও মাসায়েল শুরু করি। এসব মাসায়েল প্রসঙ্গে এ আলোচনাও স্থান পায় যে, ঈদের নামায জনপদের বাইর মুক্ত ময়দানে আদায় করতে হয়। নারী-পুরুষ সকলে বের হবে এবং ইসলামের শওকত আর মুসলমানদের ঐক্য ও সংহতি প্রকাশ করবে। ইসলামের সকল ইমাম এ ব্যাপারে একমত যে, বাইরে খোলা যায়গায় ঈদের নামায আদায় করা উত্তম। কেবল ইমাম শাফেয়ী এ ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করেন। তাঁর ফতোওয়া এই যে, ঈদের নামায মসজিদে আদায় করা উত্তম। অবশ্য এ জন্য শর্ত এই যে, শহরের ভিতরে এতবড় মসজিদ থাকতে হবে, যেখানে শহরের সমস্ত মানুষের স্থান সংকুলান হতে পারে।

আমি যখন এসব মাসায়েল বয়ান করছিলাম এবং যুক্তি প্রমাণ দ্বারা তা ব্যাখ্যা করছিলাম, তখন উপস্থিত জনতার মধ্য থেকে একজন প্রস্তাব করেন যে, এ সুন্নাত জীবন্ত করার আমাদের উচিৎ। বাইরে মাঠে ঈদুল ফিতরের নামায আদায় করা কর্তব্য। তখন ইসমাঈলিয়ায় তেমন বড় কোন মসজিদ ছিল না। সবই ছিল ছোট ছোট মসজিদ। শহরের সমস্ত লোকতো দূরের কথা, কয়েকশ লোকেরও স্থান সংকুলান হতো না সেখানে। শহরের আশপাশে এতোবড় উপযুক্ত প্রান্তর আছে, যেখানে ইংরেজ সৈন্যদের এক বিরাট দলেরও স্থান সংকুলান হতে পারে। উপস্থিত সকলে অতি উৎসাহের সঙ্গে এ প্রস্তাব সমর্থন করে এবং আমাকেও ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় তাদের প্রস্তাবে সম্মতি জ্ঞাপন করতে হয়। কিন্তু আমার ভাল করেই জানা ছিল যে, এ শহরে ধর্মীয় বিষয়ে দ্রুত মত পরিবর্তন ঘটে। নানামত প্রকাশ পায়। কারণ, ধর্মীয় বিষয়ে এরা অতিশয় স্পর্শকাতর এবং আবেগপ্রবণ। উপরন্তু এ শহরে মাত্র কিছুদিন আগে ধর্মীয় বিরোধ নিয়ে তুলকালামকাণ্ড ঘটে যায়। এ কারণে আমি শর্ত আরোপ করি যে, আলেম সমাজের সঙ্গে পরামর্শ না করে এবং এ প্রস্তাব কার্যকর করার ব্যাপারে ঐকম্যতে উপনীত না হয়ে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে না। আলেম সমাজ ঐক্যমত প্রকাশ করলে ভালো কথা, অন্যথায় কোন অনুত্তম বিষয়ে লোকদের একমত হওয়া কোন উত্তম বিষয় কার্যকর করতে গিয়ে অনৈক্যের শিকার হওয়ার চেয়ে উত্তম।

আমি এ বিষয়ে কেবলমাত্র পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি, এমন সময়  হঠাৎ করে আন্দোলনের অকল্যাণকামীদের পক্ষ থেকে আমার বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন আর অভিযান চালানো হয়। আর আমার বিরুদ্ধে উত্থাপিত হয় জঘন্য অভিযোগ। যেমন বলা হয় যে, খোলা যায়গায় ঈদের নামায আদায় করা বেদয়াত। এটা মসজিদকে উজাড় করার নামান্তর। এটা ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। এটা একটা ভুল ফতোওয়া। কে এমন কথা বলে যে, সড়ক মসজিদের চেয়ে উত্তম। বাপদাদার কালে তো আমরা এমন কথা শুনিনি। এ খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে শহরে। কফিশপ, চা দোকান, মসজিদ, সাধারণ সমাবেশ, একান্ত বৈঠক- মোটকথা সর্বত্র লোকদের মুখে মুখে এর চর্চা শুরু হয়। এটা ছিল এক ভয়ংকর অভিযান আর সময়টা ছিল রমযানের শেষ দশক। আমি আব্বাসী মসজদে এ’তেকাফে ছিলাম। লোকজন নামায শেষে আমার দিকে ছুটে আসতো আর বলতো- এ কি নূতন বেদয়াত শুরু করেছেন? আমি এহেন ভিত্তিহীন অভিযোগের সামনে বোকা বনে যাই। আমি সরলভাবে দ্বীনের বিধান বয়ান করতাম, ফিকহের কিতাবে যা কিছু উল্লেখ আছে, কেবল তাই বলতাম। বাকবিতন্ডা থেকে বিতর থাকতাম এবং ঐক্য-সংহতি বজায় রাখার উপদেশ দান করতাম আর বিরোধ বিতণ্ডা থেকে বিরত থাকার দীক্ষা দিতাম।

কিন্তু ব্যাপারটা সীমাতিক্রম করে যায় এবং আমার নিজের এবং আলেম সমাজেরও হাতছাড়া হয়ে যায়। জনগণ উত্তেজিত। তারা হক আর সুন্নার অনুসরণ করতে চায়। তারা ঘোষণা করে যে, ঈদের নামায শহরের বাইরে আদায় করা হবে। তারা নামাযের জন্য কার্যতঃ ময়দানও সমতল করেছে। ওদিকে আমি কায়রো গমন করতঃ পরিবার-পরিজনের সঙ্গে ঈদ উদযাপন করতে বাধ্য ছিলাম। ইসমাঈলিয়ায় লোকেরা নিজেরাই সবকিছুর ব্যবস্থা করেছে। আরাইশা মসজিদের ইমাম শায়খ মুহাম্মদ মাদইয়ান ঈদের নামায পড়ান। এ ইসলামী প্রদর্শণীতে মানুষ নিতান্ত আনন্দিত। তাদের অন্তরে নবীজীর পাক সুন্নাতের বরকত স্থান করে নিয়েছে। ঈদের ছুটি শেষে ফিরে এসে আমি সকলের চেহারায় খুশীর লক্ষণ দেখতে পাই। এভাবে স্বার্থান্বেষী মহলের পরিচালিত অনভিপ্রেত আন্দোলন স্তিমিত হয়। নবীজীর মোবারক সুন্নাহ জারী হয়। ইসমাঈলিয়ায় আজও ঈদের নামায আদায় করা হয় শহরের বাইরে মুক্ত ময়দানে নিতান্ত শানশওকতের সঙ্গে।

কাযীর বাসভবনে বিতর্কের কাহিনী

রমযানুল মুবারকের এক রাত্রে আমি ইসমাঈলিয়ায় শরীয়তী কাযীর বাসভবনে গমন করি। তখন সেখানে পুলিশ ইন্সপেক্টর, সিভিল জজ, প্রাইমারী স্কুলের একজন প্রধান শিক্ষক, শিক্ষা বিভাগের একজন পরিদর্শক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী এবং আইনজীবীসহ শহরের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। আসর বেশ জমে উঠে। কাযী সাহেব চা আনতে বলেন এবং রৌপ্য পাত্রে সকলকে চা পরিবেশন করা হয়। আমার পালা এলে আমি কাঁচের পাত্রে চা আনতে বলি। কাযী সাহেব মৃদু হেসে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, মনে হচ্ছে আপনি রৌপ্য পাত্রে চা পান করবেন না। আমি আরয করি, আলবত। সবচেয়ে বড় কথা, আমরা তো এখন শরয়ী কাযী বাসভবনে!

কাযী সাহেব বললেনঃ

বিষয়টি ইখতিলাফী বটে। কিন্তু রৌপ্যপাত্রে পানাহার সম্পর্কে যে বিধান রয়েছে, তাতে কোন দ্বিমত নেই। এ সম্পর্কে যে হাদীস বর্ণিত আছে, তা সর্ববাদী সম্মত। আর তাতে এসব পাত্র ব্যবহার সম্পর্কে কঠোর নিষেধবাণী রয়েছে। নবী করীম (স) তাঁর পবিত্র বাণীতে বলেছেনঃ

**********************************

তোমরা স্বর্ণ ও রৌপ্য পাত্রে খাবে না এবং তাতে পান করবে না। মহানবী (স) আরো বলেছেনঃ

**********************************

যে ব্যক্তি স্বর্ণ-রৌপ্য পাত্রে পানাহার করে, সে পেটে জাহান্নামের আগুন ঢুকায়। স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন নির্দেশ বর্তমান থাকতে কিয়াস ও ইজতিহাদের অবকাশ নেই। আর নবী করীম (স)-এর নির্দেশ পালন করা অপরিহার্য। সকলেই কাঁচের পাত্রে পান করবে- আপনি এ নির্দেশ দান করলে ভালো হতো। উপস্থিত ব্যক্তিবর্গের মধ্যে কিছু লোক বলার চেষ্টা করেন যে, যেহেতু বিষয়টা বিরোধপুর্ণ, সুতারাং এসব পাত্রে কফি পান করতে অস্বীকর করা তেমন জরুরী নয়। সিভিল জজ সাহেবও ময়দানে অবতীর্ণ হলেন। তিনি শরীয়তের কাযীকে বললেনঃ শ্রদ্ধেয় কাযী সাহেব! এ বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশ বর্তমান রয়েছে, সুতরাং তাই অবশ্যপালনীয়। এ নিষেধের রহস্য কি এবং সে রহস্য উন্মোচিত না হওয়া পর্যন্ত আমরা স্পষ্ট নির্দেশ বর্জন করবো- এমনটি করতে আমরা বাধ্য নই। সে রহস্য সন্ধান করা আমাদের কাজ নয়। আগে নির্দেশ শিরোধার্য করে নেয়া আমাদের কর্তব্য। এরপর যদি তাতে নিহিত রহস্য উন্মোচিত হয় তবে ভালো কথা। আর তা জানা না গেলে তা আমাদের অন্তর্দৃষ্টির ক্রটি এবং ব্যর্থতা হবে। দ্ব্যর্থহীন নির্দেশ মেনে চলা সর্বাবস্থায় অপরিহার্য।

সিভিল জজ সাহেবের এ বক্তব্যের পর আমি সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে যাই এবং তাঁর শুকরিয়া আদা করতঃ তাঁর আঙ্গুলির প্রতি ইঙ্গি করে তাঁর নিকট আরয করি, আপনি তো বিষয়টা ফয়সালা করে দিলেন। এখন আপনি হাতের আংটিটাও খুলে ফেলুন। এটা স্বর্ণের আংটি এবং স্পষ্ট নির্দেশ অনুযায়ী তা  পরিধান করা হারাম তিনি হেসে বললেন, ওস্তাদজী! আমার ফয়সালা তো নেপোলিয়ান কোড অনুযায়ী আর কাযী সাহেব ফয়সালা করেন কিতাব এবং সুন্নাহ অনুযায়ী। সুতরাং আমাদের সকলেই নিজ নিজ আইন মেনে চলতে বাধ্য। কাজেই আপনি আমাকে ক্ষমা করুন। অবশ্য কাযী সাহেবকে পাকড়াও করতে পারেন। আমি বললাম, ইসলামী শরীয়তের নির্দেশ সমস্ত মুসলমানদের জন্যই এসেছে। আর আপনিএ একজন মুসলমান। সুতরাং নির্দেশটি আপনার উপরও প্রয়োজ্য। সিভিল জজ সাহেব আংটি খুলে ফেলেন। বাস্তবিক পক্ষে আসরটি ছিল বেশ আনন্দদায়ক এবং সুখপ্রদ। সাধারণ মানুষের মধ্যেও এ আলোচনার প্রতিধ্বনি শোনা যায়। তারা এহেন সাধারণ উপলক্ষ্যকেও আমর বিল মা’রুফ নাহী আনিল মুনকার এবং লিল্লাহ নছীহতের মহান কীর্তি বলে মনে করেন।

মি’রাজের ঘটনা সম্পর্কে আমার ভাষণ এবং আলিমদের হৈচৈ

একবার শবে মি’রাজ উপলক্ষ্যে আমি ইসরা ও মি’রাজ বিষয়ে বক্তৃতা করি। বক্তৃতায় আমি বলি যে, ইসরা ও মি’রাজের সফর রাসূলুল্লাহ (স)-এর জন্য এক সহা সম্মান। আমরা যদি চিন্তা করি যে, দেহের উপর রূহের বিরাট শক্তি অর্জিত রয়েছে, তাহলে এর ভিত্তিতে বলা যায় যে, এ পবিত্র রজনীতে রাসূলে পাক (স)-এর মুবরাক রূহ শক্তি-ক্ষমতা আর শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রশস্ততার এমন এক স্তরে উন্নীত হয়েছিল যে, তা নবীজীর পূরো দেহের উপর বিজয় লাভ করে এবং তা দেহের সমুদয়া বস্তুগত বিধানকে বিকল করে দেয়। এবং তা দেহকে পানাহার, ক্ষুৎ পিপাসা, মানবীয় কামনা-বাসনা, চাওয়া-পাওয়া এবং দূরত্বের প্রভাব থেকে মুক্ত করে দেয়... এমন ধারণা করা অসম্ভব কিছু নয়। বরং এ ধারণা মি’রাজ ও ইসরার মু’জিযাকে সেসব লোকদের জন্য বোধগ্য করে তোলে, যারা মি’রাজের ঘটনা মুনে আঙ্গুলে কামড় দেয়। আমি একথও বলি যে, কবি সম্রাট শাওকী (রহ) এ সূক্ষ্ম তত্ত্বের প্রতি ইঙ্গিত করেই বলেছিলেনঃ

**********************************

-লোকেরা জিজ্ঞেস করে, তিনি তো সকল রাসূলদের সেরা রাসূল। তাঁর ইসরার সফর দেহযোগে হয়েছে, নার রূহযোগে?

সন্দেহ নেই যে, উভয়যোগে তিনি এ সফর করেছেন। উভয়ই হয়েছে অশেষ পাকপবিত্র। উভয়ই ছিল আদ্যোপান্ত রূহ, রূহানিয়্যাত এবং আলো।

মহফিল শেষ হয় এবং উপস্থিত লোকজন আমার ভাষণ শুনে বেশ আনন্দিত হয়। কিন্তু সুযোগ সন্ধানীরা আর একটা সুযোগ পেয়ে যায়। তারা প্রচার করে বেড়ায় যে, ইখওয়ানুল মুসলিমুন ইসরা ও মি’রাজ অস্বীকার করে। তারা বলে যে, এ ঘটনা কোন মু’জিযা নয়। মি’রাজ হয়েছিল কেবল আত্মিক, দৈহিক নয়। ইখওয়ানুল মুসলিমুনের এ আকীদা উম্মতের সর্বসম্মত সিদ্ধান্তের বিপরীত। কোন ইমাম থেকে এ ধরনের আকীদা বর্ণিত নেই ইত্যাদী ইত্যাদী।

ইখওয়অন এসব কথার জবাব দিতে চায়, কিন্তু আমি তাদেরকে কঠোরভাবে বারণ করি। আমি তাদেরকে বলি  যে, এহেন পরিস্থিতিতে   নেতিবাচক কর্মপন্হার চেয়ে ইতিবাচক কর্মপন্হা হাজার গুণ উপকারী আর কার্যকর প্রমাণিত হয়। আপনারা সাধারণ মানুষকে সঠিক চিন্তার দিকে নিয়ে আসুন, তখন তারা নিজেরাই ভুল চিন্তা পরিহার করবে। ইখওয়ানরা জিজ্ঞেস করে, তবে আমরা কি করবো? আমি প্রস্তাব করলাম যে, আপনারা আর একটা বক্তৃতার ঘোষণা দিন। এই বক্তৃতার বিষয়বস্তুত হবে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শ্রেষ্ঠত্ব। তারা তাই করলো, প্রোগ্রাম অনুযায়ী লোকেরা সমবেত হয়। আমি তাদের সম্মুখে মহানবী (স)-এর শ্রেষ্ঠত্বের বিভিন্ন দিক তুলে ধরি। যেমন দৈহিক দিক থেকে তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব, নৈতিক দিক থেকে তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব, আত্মিক দিক থেকে তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব, ইবাদাতের দিক থেকে তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব। উপরন্তু রাসূল হিসাবে তাঁর শ্রেষ্ঠত্বও বর্ণনা করি। তাঁর এ শ্রেষ্ঠত্ব সর্বব্যাপক, চিরন্তন, সর্বশেষ এবং পূর্ণা!ঙ্গও। আল্লাহ তা’আলার নিকট দুনিয়া এবং আখিয়ারাতে তাঁর যে স্থান ও মর্তবা রয়েছে, তাও বর্ণনা করি। লোকেরা যখন এ বক্তৃতা শ্রবণ করে মহফিল ত্যাগ করে, তখন তাদের সকলের মুখে মুখে ছিল এ বক্তৃতা সম্পর্কে আলোচনা। আল্লাহ তা’আলা সত্যেরা দ্বারা মিথ্যাকে প্রতিহত করলেন, মিথ্যার জারিজুরী ফাঁস করে দিলেন আর দেখতে না দেখতেই মিথ্যা পরাভূত হয়ে গেলো। আল্লাহ তা’আলা কালাম মজীদে বলেনঃ

**********************************

“আমরা সত্যকে মিথ্যার উপর ছুঁড়ে মারি আর সত্য মিথ্যার মস্তক চূর্ণ করে অতঃপর মিথ্যা তৎক্ষণাৎ বিলীন হয়ে যায় (সূরা আম্বিয়াঃ ১৮)।

আল-বাহরুছ ছগীরে দা’ওয়াতের কাজ

শায়খ আহমদ আলমাদানী ১৯৩০ সাল থেকেই মিত মিরজা সালাসিলা’-এ ইখওয়ানের অন্যতম দায়িত্বশীল ছিলেন। তিনি আমার নিকট  প্রেরিত এক পত্রে অসন্তোষ প্রকাশ করেন যে, সেখানে ইখওয়ানের বাণী প্রচার এবং ইখওয়ানের দৃঢ়তা সম্পর্কে আমি কোন আলোচনা করিনি (এ ডায়রী সংগঠনের সামরিক পত্রে ধারা্বাহকভাবে প্রকাশিত হয়।  এ যাবৎ ডায়রীর যে অংশ প্রকাশ পেয়েছে, তাতে তাদের সম্পর্কে কিছু উল্লেখ না করায় তারা এ অভিযোগ করে- অনুবাদক)। মিত মিরজা’র ইখওয়ানরা প্রথম দিকের ইখওয়ানের অন্তর্ভুক্ত এবং এখনো তারা সে পথে অটল রয়েছে। তাঁর এ অসন্তোষ পছন্দীয় এবং তা শুভ পরিণতি বয়ে আনবে। তিনি এবং তাঁর সহকর্মীরা উক্ত  অহ্ছলে ইখওয়ানের প্রচারকার্যে যে ত্যাগ তিতীক্ষার পরিচয় দিয়েছেন, তা সংঘাতমুখর মুজাহিদদের স্মৃতির কথা স্মরণ করায়ে দেয়। তারা অদ্যবধি সত্যপথে নিষ্ঠাবান সিপাহী এবং ঈমান—বিশ্বাসে সত্যিকার ইমানদারের মতো অটল-অবিচল রয়েছেন। আল্লাহ তাদেরকে শুভ প্রতিদান দান করুন।

ইখওয়ানের বাণী প্রচার পর্যায়ে আমি এ যাবৎ যা কিছু আলোচনা করেছি, তা ছিল নিতান্ত সংক্ষিপ্ত। আমার উদ্দেশ্য ছিল সংক্ষেপে একথা আলোচনা করা যে, বিগতকালে দাওয়াতের গতি কেমন ছিল এবং সেসব নূতন নূতন পর্যায়ে দাওয়াদের কাফেলা কোন গতিতে এগিয়ে গেছে। সেসব বিষয় সম্পর্কে জানার আগ্রহ ইখওয়ানের দীর্ঘদিনের। যদিও কেবল নীতিগত আলোচনা করাই আমার মতে যথেষ্ট। কোন নীতি আর বুনিয়াদকে ভিত্তি করে ইখওয়ানের পবিত্র বৃক্ষ গড়ে উঠেছে, সে সম্পর্কে কেবল ইশরা-ইঙ্গিত করাই যথেষ্ট হবে বলে আমার ধারণা। তা সত্ত্বেও শায়খ আমদ আল মাদানী এবং তাঁর বিজ্ঞ সহকর্মীদের হক আদায় করার নিমিত্ত এবং তাদের সবার আগে ইখওয়ানের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার স্বীকৃতি স্বরূপ এখানে তাঁদের উল্লেখ করেছি। আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে এবং তাদেরকে সত্যের পথে অটল রাখুন এবং আমাদরে সকলকে সোজা পথে চালিত করুন। আমি সসব বিজ্ঞ সহকর্মীদের নিকটও ক্ষমাপ্রার্থী, এ মুবারক দাওয়াতের সঙ্গে যাদের সংশ্লিষ্টতার বিস্তারিত বিবরণ পেশ করার এখান সুযোগ নেই। তাদের পক্ষে একটা যথেষ্ট যে, তাঁরা আল্লাহর ইলমে আছেন এবং আল্লাহই তাদেরকে নেক প্রতিদান দেবেন। আল্লাহই উত্তম এবং দীর্ঘস্থায়ী।

একটা অভিযোগঃ হাসানুল বান্নার পূজা করা হয়!

একদিন দুজন নিষ্ঠাবান ইখওয়ানকার্মী নিতান্ত ব্যাথাতুর হয়ে আমার কাছে ছুটে আসে। তারা বলে, শহরে আমাদের বিরুদ্ধে এক ভয়ঙ্কর গুজব ছড়ানো হচ্ছে। আমরা এ ধরনের গুজব বরদাশত করতে পারি না। যারা আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ রটনা করছে, তাদেরকে শায়েস্তা করার জন্য আপিনি আমাদেরকে অনুমতি দিন। তাদের কথা শুনে আমি মৃদু হেসে বললাম, এতে কি কোন কল্যাণ আছে? আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ

**********************************

ধন-সম্পদ আর জনসম্পদে অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা হবে এবং পূর্ববর্তী আহলি কিতাব আর মুশরিকদের নিকট থেকে তোমাদেরকে শুনতে হবে অনেক অশোভন উক্তি। আর তোমরা যদি ধৈর্য ধারণ কর এবং তাকওয়া অবলম্বন কর, তবে তা হবে একান্ত সৎসাহসের কাজ (সূরা আলে ইমারানঃ ১৮৬)।

সুতরাং ছবর আর তাকওয়া আমাদের কখনো ত্যাগ করা উচিৎ  নয়। লোকেরা মিথ্যা প্রোপাগান্ডা করবে আর নানা মনগড়া কথা রটনা করবে- এটাতো দাওয়াতের সত্যতারই প্রমাণ। প্রথম ইসলামী আন্দোলনের বিরুদ্ধে বিরোধীদের পক্ষ থেকে কি কি বিষয় রটানো হয়েছে এবং স্বয়ং নবীজী সম্পর্কে কেমন  ব্যক্তিগত কুৎসা রটানো হয়েছে, তাতো আপনারা ভালো করেই জানেন। মোটকথা, এ সম্পর্কে আমি তাদের সম্মুখে ভালোভাবেই আলোকপাত করি। কিন্তু তারপরও তারা দুজনে নিতান্ত দুঃখ আর বেদনাবোধের সঙ্গে বললেন, যে নূতন অভিযোগ আমরা শুনে এসেছি, তাতে তো আমরা খামুশ থাকতে পারি না। এটা এক ভয়ংকর অভিযোগ আর এ অভিযোগ ছড়াচ্ছে এমনসব লোকেরা যারা বেশ পরিচিত এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে তাদের বেশ প্রভাব-প্রতিপত্তিও রয়েছে।

আমি জানতে চাইলাম, কি সে অভিযোগ? তারা বললেন, বিরুদ্ধবাদীরা বলছে, আপনি দারস আর ওয়াজে আমাদেরকে দীক্ষা দান করছেন, যাতে আমরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে আপনার ইবাদাত করি। সুতরাং আপনার কথা মতো ইখওয়ান বিশ্বাস করে যে, হাসানুল বান্না মানুষ নয়, নবী-ওলী বা কোন পীরও নয়; বরং সে হচ্ছে খোদা, পূজা-ইবাদাত পাওয়ার যোগ্য। আপনার নিকট আগমন করার আগে আমরা খোঁজ নিয়ে এসেছি এসব অপপ্রচারের উৎস কোথায়। আমরা জানতে পেরেছি, যিনি এসব অপপ্রচার চালাচ্ছেন, তিনি একজন আলেমে দ্বীন, একটা ধর্মীয় পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তি। আর তিনি যা বলেন, মানুষ তা সত্য বলে মনে করে। আমরা কেবল খোঁজ-খবরই নেইনি, বরং আমরা সে মওলবী সাহেবের নিকট গমন করে তাকে জিজ্ঞাসাও করছি যে, ইখওয়ানুল মুসলিমুন হাসানুল বান্নাকে মা’বুদ মনে করে, এমন কথা কে আপনাকে বললো? তিনি বললেন, তোমাদের ওস্তাদ হাসানুল বান্নার মুখে আনি নিজ কানে শুনেছি। তাঁর জবাব শুনে আমরা আঙ্গুলে কামড় দেই। তাঁকে বারবার একই প্রশ্ন করি। কিন্তু তিনি প্রতিবারই জবাব দেন- আমি নিজ কানে তাকে একথা বলতে শুনেছি। তবে আমরা তো এমন কথা সত্য বলে মেনে নিতে পারি না। আসল তত্ত্ব জানার জন্য আমরা আপনার কাছে এসেছি। সত্য বলতে কি, তাঁর কথায় আমরা বিস্মিত হয়েছি। এতদত্ত্বেও এ গুজবের উৎস আর তত্ত্ব সম্পর্কে আমরা জানতে চাই।

তাদের এসব কথা ছিল আমার জন্য বজ্রাঘাততুল্য। আমাকে অবাক হতে হয় এই ভেবে যে, কারো বিরেধিতা করতে গিয়ে মানুষ এতোটা নীচেও নামতে পারে! পারে এমন চক্রান্তের আশ্রয় নিতে। আমি চিন্তা করতে লাগলাম, কবে কোথায় এমন মওলবী সাহেবের সঙ্গে আমি একত্র হলাম। এমন কি ঘটনা ঘটলো, যার ফলে এসব ভিত্তিহীন অভিযোগ উঠতে পারে। কিন্তু এরকম কোন মজলিস বা ঘটনার কথা আমার মনে পড়লো না। তাই আ তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়ালাম। উপরোক্ত, সহকর্মীদ্বয় ছাড়াও ইখওয়ানের দুজন শিক্ষককেও সঙ্গে নিলাম। শিক্ষকদ্বয় সম্পর্কে আমি জানতাম যে, মওলবী সাহেবের সাথে তাদের সম্পর্ক গভীর। আমি এদেরকে সবকথা শুনালাম এবং বললাম, এখনই আমাদেকের যেতে হবে তাঁর কাছে। তাঁর নিকট গিয়ে আমাদেকের জানতে হবে, তিনি যেসব কথা ছড়াচ্ছেন, তার ভিত্তি কি? কারণ, ভ্রাতৃদ্বয়ের একথা শোনার পর তত্ত্ব নেওয়া ছাড়া আমার আর কোন উপায় থাকে না। হয় মওলবী সাহেব নিজে প্রতারিত হয়েছেন, অথবা তাঁর কথা এরা ভালোভাবে বুঝতেই পারেনি। আর এটা এমন এক অভিযোগ যে, এ বিষয়ে অলসতা করা বা উপেক্ষা করা উচিৎ হবে না। চলূন আমরা এখনই তাঁর কাছে যাই। আমরা পাঁচজনই তাঁর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। আমরা তাঁর বাসায় কড়া নেড়ে  ওয়েটিং রুমে গিয়ে বসি। তিনি বেরিয়ে এসে আমাদেরকে সালাম জানালেন। আমদেরকে দেখে তাঁর চেহারা বিবর্ণ হয়ে যায়। তাঁর কণ্ঠস্বর এবং গতিবিধি অসংলগ্ন হয়ে পড়ে। তিনি যেন বুঝতে পেরেছেন যে, তাঁর কোথায় কোন বিপদ পড়েছে।আমি সরাররি তাঁকে জিজ্ঞাসা করি, ওস্তাদজী! আমি এ মাত্র শুনতে  পেলাম যে, আপনি আমার সম্পর্কে এমন এমন কথা বলেছেন। আপিনি তাদেরকে অত্যন্ত আস্থার সঙ্গে একথাও বলেছেন যে, আপনি নিজ কানে আমার মুখ থেকে একথাগুলো শুনেছেন। তারা কি ঠিক বলেছে? সত্যি সত্যিই কি আপনি এমন কথা বলেছেন? তিন বললেন, হ্যাঁ, তারা ঠিকই বলেছে।তবে তো তাদের অবস্থান স্পষ্ট হয়ে গেলো। আমানত আদায়ে তারা কোন ক্রটি করেনি। আমি তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বললাম, এ আমানতদারীর জন্য আল্লাহ আপনাদেরকে উপযুক্ত প্রতিদান দিন।

এবার আমি মওলবী সাহেবের প্রতি লক্ষ্য করে আরয করলাম ওস্তাদজী! আপনি কবে এমন কথা শুনলেন যে, আমি মা’বূদ আর আমার অনুসারীদের কর্তব্য হচ্ছে আমার পূজা করা? তিনি বললেন, আমার মনে পড়ে, প্রায় এক মাস আগে একদিন আমি মসজিদের আঙ্গিনায় বসা ছিলাম। ইতিমধ্যে মুহাম্মদ লাইসী আফেন্দী নামে একজন শিক্ষক উপস্থিত হলেন। তিনি আমার কাছে এসে বসলেন। এক এক করে ইখওয়ান কর্মীরা উপস্থিত হতে থাকেন। তারা আপনাকে বেশ ভক্তি-শ্রদ্ধার সাথে সালাম করতে থাকে। এ অবস্থা দেখে মুহাম্মদ লাইসী আফেন্দী বললেনঃ ইখওয়ানরা আপনাকে পূজার পর্যায়ে ভালোবাসে। আপনি এর জবাবে বলেছিলেন, এমন ভালোবাসা যদি একান্তভাবে আল্লার জন্য হয়ে থাকে, তবে এ সম্পর্কে কি আর বলা যায়! আমরা আল্লাহর নিকট আবেদন জানাই, তিনি যেন আমাদের মধ্যে এমন ভালোবাসা বেশী বেশী সৃষ্টি করেন। আপনি উদাহরণ হিসাবে ইমাম শাফেয়ীর একটা কবিতাও উল্লেখ করেছেনঃ

**********************************

মুহাম্মদ (সা) এর পরিবার-পরিজনকে ভালোবাসা যদি রাফেয়ী মতাবলম্বী হওয়া বিবেচিত হয়, তবে জিন ও ইনসান সাক্ষী থাকুক যে, আমি একজন রাফেযী।

আমি তাঁকে বললাম, হ্যাঁ, এমন ঘটনার কথা আমার মনে পড়ছে। তিনি বললেন, তবে কি এর অর্থ এটা দাঁড়ায় না যে, এরা আপনাকে পূজা করে? তার যবান থেকে একথা উচ্চারিত হওয়া মাত্রই আমার সঙ্গে আগত একজন ইখওয়ান কর্মী, যিনি ছিলেন তাঁর মতই শিক্ষক এবং তাঁর বন্ধুও- ওঠে দাঁড়ালেন আর ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে তাকে গালমন্দ দেয়া শুরু করলেন। বরং তাঁর গৃহেই তাঁকে মারার জন্য উদ্যত হলেন। এবং তাঁকে উদ্দেশ্য করে বললেনঃ ওস্তাদ! এটাই আপনি শিখেছেন? আপনার জ্ঞানের দৌড় এ পর্যন্তই? কারো বক্তব্য অনুধাবন করার এই অবস্থা আপনার? মজলিসে কথা বলার ব্যাপারে এটাই আপনার আমানতাদারী? একজনের কথা অপরজনের কাছে পৌঁছাবার ব্যাপারে এটাই সততা বজায় রাখার সীমা? আমরা উভয়ের মধ্যে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াই এবং তাকে রক্ষা করার ব্যবস্থা করি।

মওলবী সাহেবকে উদ্দেশ্য করে আমি বললামঃ ওস্তাদজী‍! আপনিতো বচন নকল করেছেন এবং যা ইচ্ছা এর অর্থ করতে পারেন। তবে আপনি নিজের পক্ষ থেকে একথা যোগ করেছেন যে, আমি ইখওয়ানকে গায়রুল্লাহর ইবাদাত করার নির্দেশ দেই (এটা কখনো হতে পারে না। আল্লাহর দ্বীন এহেন প্রলাপোক্তি থেকে অনেক ঊর্ধ্বে)। আপনি একথাও বলেছেন যে, এটাই ইখওয়ানের আকীদা এবং একথা আপনি নিজ কানে আমার মুখ থেকে শুনেছেন। আপনি আমার কথার একটা অংশ বাদ দিয়েছেন যে, এ ধরণের ভাষা ব্যবহার করতে আমি মুহাম্মদ লাইছী আফেন্দীকে কঠোরভাবে বারণ করেছি। এ জন্য তাকে তিরস্কারও করেছি। আমি তাকে একথাও বলেছি যে, এ ধরনের কথাবার্তা ইসলাম অনুমোদন করে না। ইওরোপীয় সাহিত্য আর পাশ্চাত্যের চিন্তার দেউলিয়াপনা থেকে আমাদের মধ্যে এহেন অসংযত বাকধারাও অনুপ্রবেশ ঘটেছ। আর অন্ধ অনুকরণের পথধরে আমাদের ভাষা আর লেখনীতে তা চালূ হয়েছে। এ ধরণের শব্দমালা পরিহার করার প্রতিটি মুসলমানের কর্তব্য।

ওস্তাদজী! আপনি ঘটনাতো ঠিকই স্মরণ রেখেছেন। কিন্তু আমার সমালোচনার কথা ভুলে গেছেন। যাই হোক, আমার প্রতি আপনার এতটুকু দানই যথেষ্ট। এখন আসল ব্যাপার দ্বিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু আমার সঙ্গে আগত ব্যক্তিরা সকলেই তাঁর বন্ধু আর সাথী হওয়া সত্ত্বেও এটুকু কড়া কথা শোনানোকে যথেষ্ট মনে করছিল না। তারা ইখওয়ানের কোন গণসমাবেশে বিষয়টা খুলে বলা তাঁর জন্য কর্তব্য বলে স্থির করলেন। অন্যথায় কিভাবে তাকে শায়েস্তা করতে হবে, তা তাদের জানা আছে। তিনি তাদের প্রস্তাব মেনে নিলেন এবং বন্ধুদের নির্দেশের সামনে মাথানত করলেন। ইখওয়ানের পরবর্তী সাপ্তাহিক সমাবেশে দাঁড়িয়ে তিনি গোটা কাহিনী বিবৃত করেন এবং বলেন যে, তাঁর উদ্দেশ্য ছিল ঘটনাটা পুরাপুরী নকল করা। তিনি ইখওয়ানের নিকট কৃতজ্ঞ। ইখওয়ানের বাণী সাধারণ মানস, বিশেষ করে যুব মানসে শুভ প্রভাব ফেলছে। একটা বিপদ উপস্থিত হয়েছিল, যা ভালোয় ভালোয় কেটে গেল।

 

ইয়ামানের জনৈক দায়িত্বশীল ব্যক্তিত্বের সঙ্গে যোগাযোগ

১৩৪৮ হিজরীতে কায়রোস্থ আঞ্জুমানে শুব্বানুল মুসলেমীন রাসূলুল্লাহর হিজরত স্মরণে এক বিশাল সমাবেশের আয়োজন করে। এতে বিপুল সংখ্যক জ্ঞাণীগুণী ব্যক্তি বক্তৃতা করেন। সমাবেশে আমি সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা করি। আমার বক্তৃতার বিষয় ছিল নবীজীর হিজরত ও ইসলামী দাওয়াত। আঞ্জুমানের পক্ষ থেকে বক্তৃতার বাছাই করা যে সংকলন প্রচার করা হয়, তাতে আমার বক্তৃতাও অন্তর্ভুক্ত ছিল।

সমাবেশে উপস্থিত বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের মধ্যে ইয়ামানের সাইয়্যেদ মুহাম্মদ যাব্বারা আল-হাসানও ছিলেন। তিনি তখন ছানআর কাছরুস সাঈদ অঞ্চলের গভর্ণর ছিলেন। বক্তৃতার পর তিনি আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং মিশর আর ইয়ামানের পরিস্থিতি নিয়ে আমরা দীর্ঘক্ষণ কথা বলি। উভয় দেশে যে হারে নাস্তিক্যবাদ আর দর্শদ্রোহিতার বিষ ছড়াচ্ছে, তা রোধের উপায় নিয়েও আমরা দীর্ঘ আলাপ আলোচনা করি। এ আলোচনার পর আমাদের মধ্যে বন্ধুত্বেরও সম্পর্ক গভীর হয। তিনি ইয়ামানে শিক্ষক হিসাবে কাজ করার জন্য আমার নিকট প্রস্তাব করেন। এ বিষয়ে তিনি ইয়ামানের ইমাম এবং সাইফুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগও স্থাপন করেছিলেন (তখন ইয়ামানের ইমাম ছিলেন হামীদুদ্দীন ইয়াহইয়া। ইয়াহইয়া ছিল তাঁর আসল না এবং হামীদুদ্দীন আল মুতাওয়াক্কিল আলাল্লাহ তাঁর উপাধী। ১৩৩৬ হিজরী থেকে ১৩৬৭ হিজরী পর্যন্ত তিনি ইয়ামান শাসন করেন। স্বৈরা শাসন আর কঠোরতার জন্য তিনি খ্যাত ছিলেন। তাঁর পুত্র সাইফুল ইসলাম মুহাম্মদ ছিলেন অত্যন্ত দ্বীদার। মানসিক দিক থেকে ভারসাম্যপুর্ণ ধারার অধিকারী এবং ইসলাম দারদী। ইমাম ইয়াহইয়ার ইনতিকালের পর সাইফুল ইসলাম মুহাম্মদের স্থলে সাইফুল ইসলাম আহমদ ইয়ামানের ইমাম নিযুক্ত হন- খলীল হামীদী)

শেষোক্ত ব্যক্তি ছিলেন নিতান্ত সংস্কারবাদী। সংস্কার কর্মের প্রতি বেশ আগ্রহী ছিলেন। যত শীঘ্র সম্ভব ইয়ামানে সংস্কার সাধনে তিনি প্রয়াসী ছিলেন। আমার এবং সাইফুল ইসলাম মুহাম্মদের মধ্যেও উক্ত বিষয়ে সরাসরী পত্র বিমিনয় হয়। আমরা দূর থেকে একে অপরকে জানতাম। কিন্তু মধ্যস্থলে সরকারী প্রতিবন্ধকতার কারণে ইয়ামান গমনের ইচ্ছা সফল হতে পারেনি। কারণ, তখন মিশরে ইংরেজদের যে রাজনীতি চলছিল, তাতে কোন আরব দেশের সঙ্গে মিশরের গভীল সম্পর্ক গড়ে তোলার উপায় ছিল না।

সাইয়্যেদ মুহাম্মদ আযযাবারাহ ইসমাঈলিয়া আগমন করেন এবং আমাদের সঙ্গে তিনদিন অবস্থঅন করেন। তিনি ইখওয়ানের প্রতিষ্ঠান এবং পরিকল্পনা প্রত্যক্ষ করেন। আলহেরা ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও দেখেন। উম্মাহাতুল মুমিনীন মহিলা মাদ্রাসাও দেখেন। স্কাউটস-এর কর্মকাণ্ডগুলো প্রত্যক্ষ করেন। দারস আর বক্তৃতায়ও ইখওয়ানকে প্রত্যক্ষ করেন। আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা, ভ্রাতৃত্ব এবং ইসলামী প্রেরণায় ইখওয়ানের অন্তর কতটা উজ্জীবিত, তাও প্রত্যক্ষ করেন এবং সে সম্পর্কে ধারণা লাভ করেন। এসব দেখে তিনি বেশ পুলকিত বোধ করন। শেষ পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ বহাল ছিল। আল্লাহর উদ্দেশ্যে যে কাজ করা হয়, তা স্থায়িত্ব লাভ করে।

সম্পদ আর পদ-মর্যদার ফেতনা

এ দু;টি বস্তুই সবসময় বিরোধের কারণ হয়। পৃথিবীতে এ দু’টি বস্তুই সবময় বিরোধের উৎস ছিল। ইসমাঈলিয়ার ইখওনরা পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা, আন্তরিক সম্পর্ক এবং অন্তরের স্বচ্ছতার উত্তম নমুনা ছিল, যা কোন কিছুই কলুষিত করতে পারেনি। আল্লাহর বাস্তায় ব্যয় করা, কর্ম প্রেরণা, ইসলাম প্রচারের কাজে কষ্ট, ক্লেশ বরদাশত করায় একে অন্যের চেয়ে অগ্রসর হওয়ার প্রতিযোগিতায় অবর্তীর্ণ হওয়া- এগুলো ইখওয়ানের সাধারণ কাজ। দাওয়াতের কাজে যেসব প্রতিবন্ধকতা অন্তরায় হতো, তাকে তারা তুচ্ছ জ্ঞান করতো। কুরআন মজীদের নিম্নোক্ত আয়াতের বাস্তব প্রতিচ্ছবি ছিল তারাঃ

**********************************

তারা মুহাজিদেরকে ভালোবাসে, মুহাজিরদেরকে যা দেয়া হয়েছে, তাজ্জন্য তারা ঈর্ষা পোষণ করেনা এবং নিজেরা অভাবগ্রস্ত হয়েও তাদেরকে অগ্রাধিকার দেয়। আর মনের কার্পণ্য থেকে যারা মুক্ত, তারাই সফলকাম হয়েছে (সূরা হাশরঃ ৯)

যখন এসব বিদ্যালয় খোলা হয এবং নানা পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়, তখন এমন লোকদেরকে কাজে নিয়োজিত করা হয়, যাদের উচ্চ ডিগ্রী ছিল, প্রয়োজনীয় প্রথাগত যোগ্যতাও ছিল, কিন্তু অন্তরের শুভ্রতা এবং দাওয়াতের কাজের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ তাদের ছিল না। ইখওয়ানের সমাজ আর পরিবেশ ছিল লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, দর্শন আর উপায়-উপকরণের দিক থেকে অত্যন্ত ভারসাম্যপূর্ণ এবং এক সূত্রে গাঁথা একটা সমাজ। নতূন লোকদেরকে শিক্ষকতার কাজে নিয়োগ করার ফলে খাপছাড়া গোছের কিছু অংশ যোগ করা হয়। উপরন্তু এসব র্কজীবীরা ইখওয়ানী পরিমন্ডলের জন্য ছিল কিন্তুত কিম্বাকার গোছের। মন-মানসিকতা আর চিন্তাধারায় তারা ইখওয়ানী পরিবেশের উপযোগী ছিল না। এরা আন্দোলনের পদ-মর্যাদার লোভে পড়ে এবং সম্পদের প্রতিও তাদের দৃষ্টি পড়ে। ইখওয়ানের আন্দোলন কখনো বিত্তশালী ছিল না। তার দাবী আর চাহিদা সব সময়ই সীমাবদ্ধ উপকরণের মধ্যে সীমিত ছিল।

ইখওয়ানের বায়তুল মাল ছিল সব সময়ই নিঃস্বের নিবু নিবু বাতি। এত সবের পরেও কর্মীদের অর্থে আন্দোলনের সমস্ত প্রতিষ্ঠান আর পরিকল্পনা অব্যাহত ভাবে চলে আসছে। কর্মীদের পকেটের পয়সাই ইখওয়ানের আসল মূলধন। ইখওয়ান যখন এবং যেভাবে ইচ্ছা কর্মীদের পকেটের উপর হস্ত প্রসারিত করে। আর এতেই ইখওয়ান সাফল্য অর্জন করে। এসব নব নিযুক্ত কর্মচারীরা ছিল বাইরে থেকে আগত এবং সংগঠন সম্পর্কে অপরিচিত। ইখওয়ানের অভ্যন্তরে চোগলখুরী, কুৎসা রচনা আর গোপন কর্মকান্ড ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে তারা কেবল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আর সেবা ও কল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানেই নয়, বরং আন্দোলনের মূল কাঠামো আর বড় বড় পদ অধিকার করতে চায় আর এ সুবাদে আয়ের উৎসও তারা হস্তগত করতে চায়। এ ষড়যন্ত্রের হোতা ছিলেন একজন আলিম, ফকীহ, সাহিত্যিক এবং সুবক্তা। আলহেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাকে শিক্ষক নিযুক্ত করা হয়। তাঁর যোগ্যতার মূল্যায়ন করা হয়, কোন কোন কমিটির সভাপতি তাক বানানো হয় এবং ইখওয়ান মসজিদে দারস দেওয়ার দায়িত্বও তার উপর অর্পন করা হয়। প্রত্যেকেই তাকে সম্মানের চোখে দেখতো। তার মনে আকাংখা জাগে, তিনি ইসমাঈলিয়ায় সংগঠনের প্রধান হবেন।

তিনি জানতেন, আমি সরকারী কর্মচারী। অন্য কোথাও আমাকে বদলী করা হবে। ইসমাঈলিয়ায় আমার চার বছর কেটেছে। কাজেই যেকোন সময় বদলীর হুকুম হতে পারে। কিন্তু ভুলে যান যে, তিনি নিজেও একজন শিক্ষক। বদলী বা চাকুরীচ্যুতির সম্ভাবনা আমার চেয়েও তার বেশী। নিজের আকাংখ্যা চরিতার্থ করার জন্য তিনি স্বাভাবিক পন্হা অবলম্বন করেননি। এজন্য স্বাভাবিক পন্হা ছিল নিষ্ঠা-আন্তরিকতা প্রমাণ করা আর সংগঠনের জন্য নিজেকে বিলীন করে দেয়া। এজন্য তিনি বাঁকা পথ অবলম্বন করেন। চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র আর দলাদলী ও চোগলখুরীর ঘৃণ্য পথ ধরেন তিনি। তিনি ইখওয়ান কর্ম পরিষদের কোন কোন সদস্যের সঙ্গে ভালোবাসা স্থাপনের চেষ্টা করেন। তাঁর মতে ইখওয়ানের অভ্যন্তরে সেসব সদস্যদের বেশ প্রভাব-প্রতিপত্তি রয়েছে। তিনি উপরোক্ত সদস্যদের সঙ্গে গভীর ভালোবাসার সম্পর্ক সুদৃঢ় করে তোলেন, সব সময় তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা চলেন। আর তাদেরকেও তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য নিমন্ত্রণ জানাতেন। আমরা তার এসব কর্মতৎপরতাকে অনাবিল কাজ বলেই মনে করি। আর ইখওয়ানের বাণীও ছিল অনাবিল এবং নিস্কলুষ। সংশ্লিষ্ট ইখওয়ান কর্মীদের পারস্পরিক সম্পর্ক গভীর করা ছিল ইখওয়ানের অন্যতম কাজ।

ইসমাঈলিয়ায় ইখওয়ানের কর্মকর্তা নিয়োগ

ইখওয়ানের আশংকা ছিল তাদের মধ্যে কাউকে স্থলাভিষিক্ত না করে আমি যেন ইসমাঈলিয়া ত্যাগ না করি। এমন একজন ব্যক্তির উপর এ দায়িত্ব অর্পণ করতে হবে, যিনি সংগঠন পরিচালনা করতে সক্ষম। বিষয়টি নিয়ে সুস্থভাবে চিন্তা করার জন্য তারা আমার প্রতি আহবান জানায়, যাতে হঠাৎ করে আমার বদলীর নির্দেশে তারা কোন আকস্মিক বিপদে না পড়ে। কথাটা আমার কাছে বেশ মূল্যবান মনে হয়। দীর্ঘদিন আমার মন-মগজে কথাটা জেঁকে বসে। অবশেষে এ দায়িত্ব পালনের জন্য আমি শায়খ আলী আল-জাদাদীর নাম প্রস্তাব করি। ধর্মীয় এবং নৈতিক বিচেনায় তিনি ছিলেন ইখওয়ানের উত্তম ব্যক্তি। জ্ঞান আর প্রজ্ঞায়ও তাঁর ছিল বিপুল খ্যাতি। সুললিত কণ্ঠে তিনি কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করতেন। আলোচনা আর বিতর্কে অংশ গ্রহণ করতেন অতি সুস্থ-সুন্দর ভঙ্গিতে।

তাঁর বিপুল অধ্যয়ন ছিল। সবচেয়ে বড় কথা, যারা প্রথম দিকে ইখওয়ানের ডাকে সাড়া দেয়, তিনি ছিলেন তাদের অন্যতম। এ কারণে তিনি ছিলেন ইখওয়ানের আত্মার কাছের লোক এবং সকলের প্রিয়পাত্র। আমি ইখওয়ানের সাধারণ সভা আহ্বান করি এবং তাদের সম্মুখে কোন কোন বন্ধুর এ ধারণা পেশ করি যে, ইখওয়ানের একজন কর্মকর্তা নিয়োগ করা উচিৎ, যিনি হবেন মুরশিদে আম-এর সহকারী। আমার আকস্মিক বদলী বা অন্য কোন আকস্মিক দুর্বিপাকের পূর্বেই তাঁকে দায়িত্ব বুঝে নিতে হবে। সকলেই আমার এ ধারণা সমর্থন করলে আমি তাদের সম্মুখে শায়খ আলী-আল-জাদাদীর নাম প্রস্তাব করি। তারা এ মনোনয়নে সন্তোষ প্রকাশ করে এবং সকলে সর্ব সম্মতভাবে এ মত সমর্থন করে। বরং কেউ কেউতো উদ্দীপ্ত হয়ে এমন প্রস্তাবও করে বসে যে, শায়খ আলী তাঁর কর্মকান্ড ত্যাগ করুন এবং তাঁকে ইখওয়ান মসজিদের ইমাম নিযুক্ত করা হোক। এবং আন্দোলনের বায়তুল মাল থেকে তাঁর ভাতা নির্ধারণ করা হোক, যাতে তিনি ভালোভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারেন। তখন তিনি সূত্রদরের কাজ করতেন। তাঁর নিজের দোকানও ছিল। উপস্থিত সকলে এ ব্যাপারেও একমত হয়।

আর আমি নিজেও ছিলাম এ মতের সমর্থক। কারণ, আন্দোলনের জন্য সার্বক্ষণিক কর্মী নিয়োগ বেশ ফলপ্রশু। তাঁর জন্য নাম মাত্র ভাতা নির্ধারণ করা হয়। আর তাতেই তিনি রাযী হন। কারণ, ত্যাগের আদর্শেই তিনি আমাদের কাফেলায় শরীক হয়েছেন, ভোগের আশায় নয়। আলহামদু লিল্লাহ, ইসমাঈলিয়ার সকল ইখওয়ান কর্মীরাই এ নীতি। একটা অনুভূতি আমাদের আনন্দের স্বচ্ছ ফোয়ারাকে ঘোলা করে তুলেছিল। আর তা ছিল এই যে, এ পরিস্থিতি আমার বিচ্ছেদের পূর্বাভাষ। আমার বিচ্ছেদ যে নিকটবর্তী, এ ছিল তারই আলামত।

আন্দোলনের বিরুদ্ধে প্রথম আভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র

উপরোক্ত শায়খ, যিনি ইখওয়ানের নেতা হওয়ার খায়েশ পোষণ করতেন, তিনি যখন স্বচক্ষে দেখতে পেলেন যে, ইখওয়ানের নেতা হওয়ার স্বপ্ন থেকে তাকে বঞ্চিত হতে হয়েছে, এবং এখন কার্যতঃ ইখওয়ানের নায়েবে মুরশেদ ঠিক হয়েই গেছে, তখন তাঁর চুপ থাকা উচিৎ ছিল। অথচ তিনি নিজেকে এ পদের জন্য সবচেয়ে যোগ্য মনে করেন। তিনি একজন বড় আলিম। কোথায় একজন আলিম আর কোথায় একজন কাঠমিস্ত্রী। একদিকে তাঁর কাছে রয়েছে আল-আযহারের উচ্চতর ডিগ্রি এম এর সনদ। অন্য দিকে তিনি একজন উঁচু মানের কবি। তিনি জানেন, কি ভাবে আন্দোলনকে সম্প্রসারিত করা যায়, কি ভাবে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা যায়। সুতরাং এ পদ লাভের জন্য তাকে চেষ্টা করতে হবে। কাজেই পূর্ব থে যাদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ট যোগাযোগ ছিল, আগে তিনি সেসব বন্ধুদেরকে হাত করার চেষ্টা করলেন। তিনি তাদের বুঝাবার চেষ্টা করলেন যে, একজন সুত্রধর থেকে তিনি যোগ্য এবং এ পদের জন্য উপযুক্ত ব্যক্তি। ওস্তাদ হাসানুল বান্না তাঁর হক নষ্ট করেছেন এবং তাঁর ত্যাগ আর কুরবানীর মূল্যায়ণ করেননি।

তিনি মনে করলেন যে, আমি আন্দোলনের জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছি। অনেক অর্থ ব্যয় করেছি। আমার সংগ্রামের দীর্ঘ ফিরিস্তি রয়েছে। ওস্তাদের সঙ্গেও আমার সম্পর্ক ভালো। আমি আমার পুঁজি, জীবন, পরিবার- পরিজন এবং আমার ভবিষ্যৎ- সব কিছুই ওস্তাদ আর আন্দোলনের জন্য উৎসর্গ করেছি। কিন্তু শায়খ আলী এ সবের কোনটি করেছেন? কিছুইতো করেননি। অর্থ ব্যয় করেননি। ত্যাগ স্বীকার করেননি। আমার চেয়ে কম যোগ্য লোককে বাছাই করেছেন। এটাতো স্পষ্ট যুলুম। এছাড়া জেনারেল কাউন্সিলের বৈঠকও ছিল বেআইনী। হঠাৎ করে এ বৈঠক ডাকা হয়েছে। সকল সদস্য জানতেও পারেনি। সকলে উপস্তিত হতে পালে তাদের মতামত অন্য রকম হতো। এভাবে সকলকে মতামত ব্যক্ত করার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।

শায়খ আলীর জন্য মসজিদের ইমামতি বাবদ মাসিক তিন পাউন্ড ভাতা নির্ধারণ করা হয়েছে। সংগঠনের যেখানে ঋণ রয়েছে, সেখানে তিনি কেমন করে এ ভাতা গ্রহণ করতে পারেন? এছাড়া মসজিদ, মাদ্রসা এবং অন্যান্য ইমারত বাবতও অনেক ঋণ রয়েছে। সেসব ঋণের পরিমাণ ৩৫০ পাউন্ডেরও বেশী দাঁড়ায়। অন্যদিকে আকাংখী শায়খ স্বেচ্ছাসেবী হিসাবে ইমামতির দায়িত্ব পালন করতে প্রস্তুত। কেবল মাদ্রাসা থেকে ভাতা নিয়েই তিনি তুষ্ট থাকবেন। অথবা ভাগা গ্রহণ করলেও তা হবে খুবই নগণ্য-মাসিক ৫০ ক্রোশ এর বেশী হবেনা।

মওলবী সাহেব এমন সব চিকন চিকন কথা বলা শুরু করলেন, কুরআনের ভাষায় যাকে বলা হয়েছেঃ

**********************************

তার বাইরে রহমত আর ভেতরে আযাব তার এসব কথা বলার উদ্দেশ্য ছিল সিদ্ধান্তে ফাটল ধরানো, যাতে সিদ্ধান্ত অকার্যকর হয়ে যায়। তাঁল আসল উদ্দেশ্য ছিল যে কোন উপায়ে পদ দখল করা। আরো কয়েকজন সরলমনা সদস্যও তাঁর ফাঁদে পড়ে এবং তাকে সমর্থন করে।

আমি এ ষড়যন্ত্র সমূলে উৎপাটিত করতে দৃঢ় সংকল্প হই। তবে ষড়যন্ত্রে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা বা তাদেরকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করে তাদের এবং সংগঠের মধ্যে আমি দূরত্ব সৃষ্টি করতে চাইনা। আমি তাদেরকে আমার বাসায় সমবেত করে জানতে চাই যে, তারা কি চান? তারা বললেন, আমরা চাইনা যে, আপনি শায়খ আলীকে সহকারী মুরশিদে আম নিযুক্ত করেন। আমি বললাম, কিন্তু আপনাদের অন্যান্য ভাইয়েরাতো অন্য কিছু চাইছেন। তারা তো শায়খ আলীকে মনোনয়ন দিয়েছেন। আমি আপনাদের ইচ্ছা পূরণ করলে তাদের ইচ্ছা পূরণ করা হয়না। তারা বললেন, না, ঠিক নয়। সকলে বৈঠকে উপস্তিত থাকলে ফলাফল অন্য রকম হতো। আমি বললাম, পুনরায় বৈঠক ডাকলে আপনারা কি বৈঠকের সিদ্ধান্ত মেনে নেবেন? তারা ইতিবাচক জবাব দেন।

এদিকে বৈঠক ডাকার আগে শায়খ আলীকে ইঙ্গিতে বলে দেই যে, আপনার পক্ষে সিদ্ধান্ত হলে আপনি ঘোষণা দেবেনে যে, মসজিদ মাদ্রাসা কোন খাত থেকেই আমি ভাতা গ্রহণ করবোনা। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নতুন বৈঠক ডাকা হলো। ফলাফলে দেখা গেল, সে মুষ্টিমেয় কয়েকজন বাদে বাকী সকলেই শায়খ আলীর পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন। ফলাফল প্রকাশের পর শায়খ আলী ভাতা গ্রহণ না করার ঘোষণা দিলে সকলেই অবাক হন। লক্ষণীয় যে, মাত্র চার পাঁচজন লোক চর পাঁচশ লোকের উপর নিজেদেরকে চাপাতে চেয়েছিল। তাদের মত গ্রহণ না করা হলে সকলেই অন্যায়কারী সাব্যস্ত হয়। কারণ, তারা নিজেদেরকে সবচেয়ে যোগ্য এবং হকপন্হী বলে মনে করে। দলের অভ্যন্তরে এহেন পরিস্থিতি অত্যন্ত ভয়ংকর রূপ ধারণ করে। এ কারণে ইসলামের নির্দেশ এই যে, যারা দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আল্লাহর নবী বলেনঃ

**********************************

-যে ব্যক্তি তোমাদের নিকট আগমন করতঃ তোমাদের মধ্যে বিচ্ছেদ আর ফাটল ধরাবার চেষ্টা করে, অথচ তোমরা ঐক্যবদ্ধ, তবে সে ব্যক্তি যে কেউ হোকনা কেন, তরবারী দ্বারা তার গর্দান উড়িয়ে দেবে।

আরো একটি ষড়যন্ত্র

কিন্তু অন্তরের জগৎ এমন যে, একবার অন্তরে কোন খাহেশ পেষে বসলে তা মানুষকে অন্ধ ও বধির করে ছাড়ে। তখন মানুষ আর কল্যাণ দেখতে পায় না এবং ভালো কথা শুনতে পায় না। এ ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। আমরা সবেমাত্র বৈঠক শেষ করেছি। এমন সময় প্রতিপক্ষের লোকজন তাদের শায়খের নিকট গমন করে যা কিছু ঘটেছে, সে সম্পর্কে তাকে অবহিত করে এখন কি করা যায় ভাবতে লাগলেন। অনেক চিন্তা-ভাবনা করে তারা ঠিক করলেন যে, আন্দোলনের দুর্নাম রটনার কাজে তারা নিয়োজিত হবেন এবং তারা এ মিশনের নাম দেবেন কল্যাণ কামনা আর সহানুভূতি প্রকাশ। বর্তমান সময়ে অন্য কারো হাতে ইখওয়ানের দায়িত্ব ন্যাস্ত করা আন্দোলনের জন্য বিপজ্জনক। আন্দোলন বর্তমানে ব্যবসায়ীদের নিকট ঋণী। মসজিদ আর কেন্দ্রের নির্মাণ কাজে যা ব্যয় হয়েছে তাতে এখনো ৫০ পাউন্ড ঋণ রয়েছে। ঋণদাতারা জানতে পারলে তারা তৎক্ষণাৎ ঋণের টাকা ফেরৎ চাইবে। আর অনেকেই আন্দোলনকে সহায়তা করা বন্ধ করে দেবে। ফলে আন্দোলনের কলংক হবে। কারণ, আন্দোলনের তহবিলে বর্তমানে কানাকড়িও নেই। নূতন দায়িত্বশীল কি এসব বোঝা ঘাড়ে নিতে পারবে? বিশেষ করে এমন একটা পরিস্থিতিতে আন্দোলনের ঘাড়ে ঋণ চাপিয়ে ওস্তাদ হাসানুল বান্না যখন এখান থেকে বদলি হয়ে যাবেন। এহেন পরিস্থিতিতে একজন সাহসী এবং বিত্তবান ব্যক্তিকে দায়িত্ব দেয়া কি বুদ্ধিমানের কাজ নয়, যিনি আন্দোলনকে বিপর্যয় থেকে রক্ষা করতে পারবেন?

আমার কাছেও এ খবর পৌঁছেছে। কেবল ইখওয়ানের অভ্যন্তরে নয়, বরং সাধারণ মানুষের কানেও তা প্রবেশ করেছে। সকলের মুখে মুখে একই কথা। শুভ ধারণার বর্শবর্তী হয়ে আমি চিত্রের ভালো দিককে প্রাধান্য দেই এবং মিথ্যা অভিযোগে কলংকিত হওয়া থেকে বিরত থেকে প্রতিপক্ষের বক্তব্যকে সত্যি সত্যিই শুভ কামনা আর সহানুভূতি হিসাবে গ্রহণ করি। আর এ বিপর্যয়কেও আমি আমার নিজস্ব পদ্ধতিতে সমাধান করার সিদ্ধান্ত নেই। আমি পাওনাদার ব্যবসায়ীদেরকে ডাকি। তারা ছিলেন ৩/৪ জন। তাদের নিকট আবেদন জানাই। এ ঋণগুলো কোন একজনের নামে নিয়ে নিন। তারা আমার আবেদন মেনে নেন। বর্তমানে যার নামে ঋণ, তাঁর নিকট আরয করি যে, আমার পক্ষ থেকে দীর্ঘমেয়াদী কিস্তিতে ঋণ শোধ করা হবে। অর্থাৎ মাসে আট পাউন্ড পারিশোধ করা হবে।

তিনি আমার এ প্রস্তাবও মেনে নেন। আর আমি সমস্ত ঋণের জন্য আমার পক্ষ থেকে মুচলেকা লিখে দেই। আর তাঁর নিকট থেকেও অঙ্গীকার পত্র লেখাই নেই যে, আন্দোলনের কাছে তার কোন পাওনা নেই। অন্যান্য পাওনাদারদের নিকট থেকেও অনুরূপ অঙ্গীকারপত্র আদায় করি, যাতে সংগঠন কারো কাছে এক পাই ঋণীও না থাকে। এ কাজ করার পর আমি সমস্ত ইখওয়ান সদস্যকে ডাকি। তাদের মধ্যে বিরুদ্ধবাদী এ চারজনও ছিল। আমি তাদের নিকট গোটা বিবরণ প্রকাশ করি। আমার বক্তব্য শ্রবণ করে তারা হতাশ হয়ে পড়ে এবং নানা ছলচাতুরীরর আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করে। কখনো বলে, আপনি কেন নিজেকে এত কষ্টে ফেলবেন। কখনো বলে, এ কেমন কথা, আমরা আপনার একার উপর এ বোঝা চাপাবো? কখনো বলে, ভালো কাজের এ প্রতিদানই কি আপনার পাওনা ছিল? কখনো বলে, ধরে নিন, আপনার উপর এমন কোন আপদ আপতিত হলো যে, আপনি এ ঋণ শোধ করতে পারলেন না, তখন কি হবে? আমি তাদেরকে বললাম, আপনারা আমাকে আমার অবস্থার উপর ছেড়ে দিন। ঋণ পরিশোধের কিস্তি আমি এমনভাবে নির্ধারণ করেছি, যাতে ইনশাআল্লাহ আমার পক্ষে তা পরিশোধ করা সম্ভব হবে। আর সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীও তা মেনে নিয়েছেন। আর এ ব্যাপারে আমিও একজন সাধারণ মুসলমান হিসাবে অংশগ্রহণ করবো। দ্বীন ও মিল্লাতের পথে ব্যয় করাও আমার কর্তব্য। সুতরাং আমার জন্য আপনাদেরকে চিন্তিত হতে হবে না। আমি ঋণ পরিশোধ করবো না- এমন কথা না বলা হলেই আমি বাঁচি। আমাদের ঐক্য অটুট থাকুক, এটাই আমাদের জন্য যথেষ্ট।

আমার এ বক্তব্যের পর তাদের কিছু বলার বা করার অবকাশ ছিল না। তারা কেবল এতটুকুই করতে পরেছেন যে, তাদের মধ্যে একজন, যিনি ছিলেন অর্থ বিভাগের দায়িত্বশীল, তিনি এ দায়িত্ব অন্য কারো ওপর ন্যস্ত করার আগ্রহ প্রকাশ করলে তা গ্রহণ করা হয় এবং অন্য একজন সঙ্গীকে এ দায়িত্ব দেয়া হয়। আমার মনে পড়ে, তিনি দায়িত্ব হস্তান্তরকালে বলেছিলেন, এই নিন চাবি। এখন থেকে বায়তুলমাল শূণ্যই থাকবে। আমি গভীর আবেগে আপ্লুত হয়ে তাকে বলেছিলাম- না ভাই, এমনটি হবে না। ইনশাআল্লাহ বায়তুলমাল জমজমাট থাকবে। এরপর থেকে আল্লাহর মেহেরবাণীতে বায়তুলমাল জমজমাটাই ছিল।

ইসমাঈলিয়ার বিত্তবান ব্যক্তিরা এ বিষয়টা জানতে পেরে বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে শায়খ মুহাম্মদ হোসাইন যামলূতের বাসভবনে নিমন্ত্রণ জানানো হয়। তাঁরা সকলে এ ঋণ নিজেদের মধ্যে বন্টন করে নেন এবং তাৎক্ষণিকভাবে চারশ পাউন্ড চাঁদা সংগ্রহ করেন। ফলে সমস্ত ঋণ পরিশোধ করে অবশিষ্ট টাকা বায়তুল মালে জমা করা হয়। ইখওয়ানের পক্ষ থেকেও অব্যাহত ধারায় টাকা আসতে শুরু করে, যার ফলে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ তহবিল সংগৃহীত হয়।

**********************************

আসমান-যমীনের সমস্ত ধনভান্ডার আল্লাহরই, কিন্তু মুনাফিকরা বুঝতে পরে না। (সূরা মূনাফিকুনঃ ৭)।

প্রসিকিউটিং-এর নিকট ষড়যন্ত্রকারীদের প্রত্যাবর্তন

ষড়যন্ত্রকারীরা দেখতে পেয়েছে যে, তাদের সঙ্গী ইখওয়ানরা আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করার কাজে কতো অগ্রসর। আল্লাহর দ্বীনের জন্য সম্পদতো দূরের কথা, জীবন উৎসর্গ করতেও তারা দ্বিধা করে না। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে, এহেন উত্তম প্রদর্শণী দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার পরিবর্তে তারা উল্টা শক্রতা আর বিরোধিতায় এগিয়ে যায়। এ উত্তম মানবীয় দৃষ্টান্ত তাদের প্রতিহিংসার আগুন আরো তীব্র করার কারণ হয়। একথা প্রমাণ কারার অপেক্ষা রাখেনা যে, মানুষ যখন কেবল বিজয়ী হওয়াকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে নেয়, চাই তা অসত্যের জন্যই হোক না কেন, তখন সে এ ছাড়া অন্য কিছু চিন্তাও করতে পারে না। তেড়াবাঁকা কৌশল তাকে বারবার পরাভূত করলেও সে ফিরে আসবে না কখনো, যতক্ষণ সে সম্পূর্ণ পরাভূত না হয়। আল্লাহর সৃষ্টি কতো রকমারী। এখন তাদের সম্মুখে কেবল একটা উপায়ই ছিল। তাদের মধ্যে যে ব্যক্তিকে অর্থ বিভাগের দায়িত্ব থেকে বাদ দেয়া হয়েছে, তিনি প্রসটিউটারের নিকট গমন করে নিজের হাতে স্বাক্ষর করে একটা আরজী পেশ করনে। আমার দৃষ্টিতে তার এ কাজ প্রশংসনীয়। এ স্মৃতি ভুলবার মতো নয়। তিনি যখনই বিরোধিতা করছেন, তা করেছেন প্রকাশে এবং খোলাখুলিভাবে। এটা তার নৈতিক বীরত্ব এবং পৌরুষের একটা প্রমাণ। বরং এটা আন্দোলনেরই সৃষ্টি করা একটা চরিত্র। যদিও এখন তার অপব্যবহার হচ্ছে। তিনি ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট পেশ করা আর্জিতে লিখেনঃ

হাসান আফেন্দী আল বান্না- ইসমাঈলিয়ায় ইখওয়ান প্রধান এবং প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক দলের পুঁজি উজাড় করছে। সমস্ত পুঁজি কায়রোয় তার ভাইয়ের কাছে পাচার করছে আর সে সম্পর্কে তার ভাই বলছে যে, সে কায়রোয় দলের প্রধান। পোর্ট সাঈদ এবং আবু ছাবীরেও এ পুঁজি পাচার করা হচ্ছে। অথ এ সব পুঁজি ইসমাঈলিয়ার অধিবাসীদের নিকট থেকে সংগৃহীত। সুতরাং তা ইসমাঈলিয়াতেই ব্যয় করা উচিৎ ছিল। মানুষের জান-মাল আর ইজ্জত হেফাযত করার অধিকার পাবলিক প্রসিকিউটরের রয়েছে। এ কারণে আবেদনকারী এ ব্যপারে পাবলিক প্রসিকিউটরের হস্তক্ষেপ কামনা করছে এবং এসব খাতে অর্থ উজাড় রোধ করার দাবী জানাচ্ছে।

প্রসিকিউটিং অফিসার ছিলেন বেশ বিচক্ষণ এবং সূক্ষ্মদর্শী। যতদূর আমার মনে পড়ে, তিনি ছিলেন ওস্তাদ মাহমুদ মুজাহিদ, যিনি পরবর্তীকালে জজ হয়েছিলেন। তিনি আবেদনকারীকে ডেকে বিষয়টা সম্পর্কে খোঁজ খবর নেন। তিনি আবেদনকারীকে জিজ্ঞেস করেন, আপনি কি ইখওয়ানের নির্বাহী কমিটির সদস্য?

তিনি বললেন: আমি ইখওয়ানের সদস্য এবং অর্থ বিভাগের দায়িত্বশীল ছিলাম। পরে আমি পদত্যাগ করি এবং আমার পদত্যাগপত্র গৃহীত হয়েছে।

তিনি পুনরায় জিজ্ঞেস করেন: আবেদনপত্রে উল্লিখিত যেসব শাখার নামে অর্থ প্রেরণ করা হয, নির্বাহী কমিটি কি তা অনুমোদন করে?

তিনি জবাব দেন, জি, অনুমোদন করে।

প্রসিকিউটর প্রশ্ন করলেন, আপনি কি জেনারেল কাউন্সিলের সদস্য?

তিনি বললেন: আমি সবগুলো কমিটি আর প্রতিষ্ঠানের সদস্য ছিলাম। কিন্তু এখন আমি তাদেরকে দেখতে চাই না। এখন আর আমি নিজেকে তাদের কোন বিভাগের সদস্য মনে করি না।

প্রশ্নঃ আপনি কি মনে করেন যে, এসব ব্যয় জেনারেল কাউন্সিলে উত্থাপন করা হলে কাউন্সিল তা অনুমোদন করবে? হাসান আফেন্দীর সিদ্ধান্ত কাউন্সিল কি একমত হবে?

কি অবাককাণ্ড! হাসান আফেন্দী যদি তাদেরকে বলে যে, এ অর্থ আমি নিজের জন্য ব্যয় করেছি, তাহলেও তারা সানন্দে তা অনুমোদন করবে। হাসান আফেন্দী তাদের উপর যাদু করেছে।

এ জেরার পর প্রসিকিউটর বলেনঃ

নির্বাহী কমিটি যদি হাসান আফেন্দীর সমর্থক হয়, জেনারেল কাউন্সিলও যদি তাকে সমর্থন, করে, আপনি তো কোনটারই সদস্য নন, তবে কেন আপনি তাতে নাক গলান? এর সঙ্গে পাবলিক প্রসিকিউটিং-এর কি সম্পর্ক? ইখওয়ানের লোকেরা একটা সংগঠনে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। তারা টাকা সংগ্রহ করেছে, যা ব্যয় করার জন্য এক বা একাধিক ব্যক্তিকে দায়িত্ব দিয়েছে। আর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি যেভাবে টাকা ব্যয় করে, নির্বাহী কমিটি তা অনুমোদন করে। প্রসিকিউটিং অফিস কিসের ভিত্তিতে তাতে হস্তক্ষেপ করবে? তারা স্বাধীন, যেভাবে ইচ্ছা নিজেদের অর্থ নিজেরা ব্যয় করতে পারে। দেখ নওজোয়ান, তোমাকে ভালো মানুষ মনে হয়। কিন্তু তুমি বড় ভুল করছ। আমি তোমাকে বলবো, তুমি সংগঠনে ফিরে যাও। এদিক-সেদিক চিন্তা না করে তাদের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ কর। আর তারা তোমাকে সহ্য করতে না পারলে গৃহে গিয়ে বসে থাক। নিজের অন্য কোন ধান্দা কর। তারা যা করে, করতে দাও। তুমি নিজের মঙ্গল চাইলে এটাই তোমার জন্য উত্তম।

এসব কথা শুনে নওজোয়ান ফিরে যায়।

শায়খ হামেদ আসকারিয়া এসব ঘটনার খবর পেয়ে শাবরাখীত থেকে ইসমাঈলিয়া আগমন করে বিদ্রোহী ব্যক্তিদেরকে সংগঠনে ফিরায়ে আনার চেষ্টা করেন। কিন্তু তারা বাঁকা পথ ত্যাগ করতে রাজি হয়নি। এসব ব্যাপারে শায়খ হামেদ ছিলেন অত্যন্ত বিচক্ষণ তাদের সঙ্গে কথা বলে ফিরে এসে আমাকে বললেনঃ

তাদের মধ্যে কোন কল্যাণই আর অবশিষ্ট নেই। এরা আন্দোলনের গুরুত্ব-বৈশিষ্ট্য অনুধাবনত করতে অক্ষম। নেতার আনুগত্যের প্রতিও তাদের কোন আস্থা নেই। যারা এ দ্বিবিধ গুণ থেকে বঞ্চিত, আমাদের সারীতে তারা কোন ভালো কাজ করতে পারে না। সুতরাং আপনি তাদের বিরোধিতাকেও কল্যাণকর মনে করুন এবং নিজের কাজ করে যান। আল্লাহ সহায়।

শায়খ হামেদ আসকারিয়া নিজের ব্যক্তিগত অভিমত সম্পর্কে বিদ্রোহীদেরকে নির্ভীকভাবে সতর্ক করে দেন। নির্বাহী কমিটির বৈঠক ডেকে আমি তাদেরকে সংগঠন থেকে বের কিরে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তারা নিজেরাই এগিয়ে এসে পদত্যাগকরে। নির্বাহী কমিটি তাদের পদত্যাগপত্র অনুমোদন করে। বিরোধের এখানেই অবসান হয়।

নিজেদেরকে ইখওয়ানের পরিমণ্ডল থেকে অনেক দূরে দেখতে পেয়ে এবং ইখওয়ানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের কোন উপায় খুঁজে না পেয়ে তারা মনে মনে ক্ষব্ধ হয়। অবশেসে তারা ইখওয়ানের বিরুদ্ধে গুজবের বাজার গরম করে তোলে। সরকারি কর্মকর্তাদের নামে বেনামী দরখাস্ত প্রেরণ করা শক্র করে। কখনো শিক্ষা বিভাগে, কখনো পুলিশ আর জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট। অবশেষে শহরের সেসব বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে, যাদেরকে তারা ইখওয়ানের আন্দোলনের স্তম্ভ মনে করতো এবং আন্দালন সম্পর্কে তাদেরকে বীতশ্রব্ধ করে তোলার মতলবে অলীক আর কাল্পনিক কাহিনী তাদেরকে শুনাতো। শায়খ মুহাম্মদ হোসাইন যামলূতকে দিয়ে তাদের এ অভিযান শুরু হয়। তাঁর কাছে গিয়ে এরা বলে- ইখওয়ান একটা ভয়ংকর সংগঠন। তাদের গোপন তৎপরতা এমন যে, আপনার কাছে তা প্রকাশ পেলে আপনি প্রাণ বাঁচাবার জন্য তাদের থেকে দূরে পালাবেন। তাদের এসব গোপন তৎপরতা সম্পর্কে আমরা সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাদেরকে অবহিত করতে চাই। যাতে আপনি পূর্বাহ্নে সকর্ত হয়ে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক চিহ্ন করেন। নিজে থেকে ইস্তাফা দিয়ে সম্পর্ক ছিন্ন করার কথা ঘোষণা করেন। আপনি আমাদেরকে আশ্বস্ত করলে সরকারি কর্মকর্তাদের নিকট আমরা তাদের রহস্য উন্মোচিত করবো। ফলে আপনার ঘাড়ে কোন আপদ চাপবে না।

শায়খ যামলূত তাদেরকে বললেনঃ আপনারা যা বলছেন, তা যে সত্য, সে বিষয়ে আপনারা কি নিশ্চিত? তারা বললেন: আলবত। বরং সেসব গোপন কাজে আমরাও কার্যতঃ তাদের সঙ্গে ছিলাম। তাঁর হৃদয় ছিল ঈমানের দওলতে ভরপুর। স্পষ্ট উক্তি আর সৎসাহসও ছিল তাঁর। তিনি তাদেরকে বললেন, তোমাদের কথা সত্য হলে তোমরা গাদ্দার আর খিয়ানতকারী। আর মিথ্যা হলে তো তোমরা মিথ্যাবাদী। এহেন পরিস্থিতিতে তোমরা কেমন করে আশা করতে পার যে, আমি তোমাদের সত্যায়ন আর সম্মান করবো? অথচ তোমরা হয় মিথ্যাবাদী, নতুবা খিয়ানতকরী। আমার সম্মুখ থেকে চলে যাও। আর কোনদিন যেন তোমাদেরকে এখানে না দেখি।

স্মরণীয় মুহূর্ত

সে মুহূর্তের কথা আমি কখনো ভুলতে পারবো না, যখন শায়খ মুহাম্মদ হোসাইন যামলূত আমার স্কুলে উপস্থিত হন। তাঁর চেহারা বিবর্ণ। উম্মা আর অস্থিরতার লক্ষণ চেহারায় পরিস্ফূট। তিনি প্রিন্সিপালের অনুমতিক্রমে ক্লাশ থেকে আমাকে ডেকে নিয়ে ধীরে ধীরে শহর দূরে গমন করেন। আলোচনাকালে ষড়যন্ত্রকারীদের নিকট তিনি যা কিছু শুনতে পেয়েছেন, সে সম্পর্কে খুঁড়ে খুঁড়ে আমাকে জিজ্ঞেস করছিলেন। বললেন, মিয়া এক্ষুণই শহরে ফিরে যাও। এরা যেসব কথা বলছে, তা সত্য হলে এখনই নিজের ব্যবস্থা কর। তোমার এসব গোপন কর্মের কোন একটা দিক- যদি সত্যি সত্যি গোপন কিছু থেকে থাকে- যাতে প্রকাশ না পায়, সে চেষ্টা কর। কোন রহস্য প্রকাশ হয়ে ড়লে বা তোমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে স্পষ্ট বলবে যে, সে দলের সাথে আমার আদৌ কোন সম্পর্ক নেই। সে দলের সভাপতি মুহাম্মদ আবু হোসাইন যামলূত। মিয়া, তুমি এখনো যৌবনের পর্যায়ে। তোমার ভবিষ্যৎ আছে। তদুপরি তুমি সরকারি চাকুরীজীব। সরকার তোমাকে উত্যক্ত করতে পারে। তুমি আমাদের শরে একজন মেহরান। আন্দোলনের এ কাজ তুমি করছো আল্লাহর জন্য। যেকোন বিবেচনায় তুমি শুকরিয়া আর অনুগ্রহ পাওয়ার যোগ্য।

আমি শুনে যাচ্ছিলাম আর মর্দে মু’মিনের সাহসিকতা ও বীরত্বে স্তম্ভিত হচ্ছিলাম। আমি তাঁর সমীপে আরয করলামঃ গুরুজন! আপনি নিশ্চিত থাকুন, আমরা যা কিছু করছি, তা করছি দিনের আলোতে। সে দলটি সত্যবাদী হয়ে থাকলে অনেক পূর্ব থেকেই তারা আমাদের বিরুদ্ধে গোয়েন্দাগিরি করতো। তাদের আর আন্দোলনৈর মধ্যে যে বিরোধ, তা নতুন কিছু নয়। আসল ব্যাপার হচ্ছে, তারা দেখতে পায় যে, আপনি নিজের প্রভাব-প্রতিপত্তি আর অর্থের উপরকণ দ্বারা আন্দোলনের সহায়তা করছেন। আপনি একজন শরীফ ও সম্মানী ব্যক্তি। তারা আন্দোলনকে আপনার স্নেহের পরশ থেকে মুক্ত করতে চায়। চায় আপনাকে আন্দালন থেকে দূরে রাখতে। গণমানুষের সম্মুখে আন্দোলনকে একটা ভয়ঙ্কর রূপে উপস্থাপন করতে চায়। আপনি সহানুভূতির মনোভাব প্রকাশ করেছেন। এ জন্য আমি আপনার নিকট অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। আল্লাহ এ জন্য আপনাকে নেক প্রতিদান দিন।

এরপর সে আল্লাহর বান্দা যা কিছু বলেন, তাও আমার মনে গেঁথে রয়েছে। তিনি বললেনঃ প্রিয় ভাই, আল্লাহর কসম করে বলছি, আমার চাচা শায়খ ঈদকে বহুবার আমি বলতে শুনেছি, ইসলামের বিজয়, মুসলিম মিল্লাতের সাফল্য এবং ইসলামী বিধিবিধানের শ্রেষ্ঠত্ব না দেখে আমার যেন মৃত্যু না হয়, আল্লাহর নিকট এটাই আমার আবেদন। তিনি দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। ইসলামের বিজয় প্রত্যক্ষ করা তাঁর ভাগ্যে জুটেনি। ইসলামের বিজয় আর তাঁর ভাগ্যে জুটেনি। ইসলামের বিজয় আর অগ্রগতি স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করা ছাড়া আমার জীবনে অন্য কোন আকাঙ্ক্ষা নেই। সর্বদা আল্লাহর নিকট আমি এ দোয়াই করি, যেন ইসলঅমের বিজয় দেখার পরই আমার চক্ষু বন্ধ হয়। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, সে মনযিল এখনো অনেক দূরে। কারণ রক্তের ফোটা মুসলমানদের নিকট এখনো অনেক মূল্যবান। যতদিন তারা রক্তের ফোটাকে মূল্যবান মনে করবে, ততদিন কিছুই হাসিল হবে না। মর্যাদা আর স্বাধীনতার দাম কেবল রক্তের ফোটাই হতে পারে। কুরআন মজীদএ তত্ত্বই বিবৃত করে। নবীজীর সীরাত আর সাহাবায়ে কিরামের জেন্দিগী এ কথারই সাক্ষ্য দেয়, তাই নয় কি?

আমি বললামঃ নিঃসন্দেহে আপনি যথার্থই বলেছেন। কিন্তু আমি আপনাকে নিশ্চয়তা দিতে পারি যে, সত্যিকার ঈমানই কেবল মানুষের রক্তকে গরম করতে পারে। কারণ, ঈমানের রাস্তায় প্রবাহিত রক্তের মূল্য আল্লাহর নিকট সবচেয়ে বেশি। একদল আল্লা প্রেমিকের অন্তরে ঈমানের স্ফুলিঙ্গ ছলছল করচে বলে আমি প্রত্যক্ষ করছি। এ দলের হাতে মঙ্গল-কল্যাণ আর মুক্তি-সাফল্যের মহান কীর্তি সাধিত হবে ইনশাল্লাহ। ইখওয়ানের এ নওজোয়ানদেরকে যেকোন মঙ্গলের কাজে অগ্রসর প্রেমিক হিসাবে দেখত পাবেন। আল্লাহ আপনাকে দীর্ঘজীববী করুন এবং আপনি ইসলামের বিজয় দেখার সুযোগ লাভ করুন।

শায়খ যামূলত বললেনঃ কিন্তু সে দলটিতো সংখ্যায় অতি অল্প।

আমি আরয করলামঃ ভবিষ্যতে এ অল্প অনেকে পরিণত হবে। আর বরকততো এ অল্পে নিহিত রয়েছে।

**********************************

কতো ক্ষুদ্র দল বৃহৎ দলের উপর বিজয়ী হয়েছে আল্লাহর হুকুমে। যারা ধৈর্যশীল, আল্লাহ তাদের সঙ্গে রয়েছেন (সূরা বাকারাঃ ২৪৯)।

এতে উক্ত শায়খ বললেনঃ আল্লাহ তোমাদেরকে সুসংবাদে ধন্য করুন। আল্লাহর কাছে আমরা এ কামনা আর সওয়ালই করি।

পরে তিনি আমাকে জানান যে, প্রসিকিউটিং অফিসার আবেদনকারীদের ব্যাপারে আমাকে জিজ্ঞাসা করলে আমি তাঁকে বলি যে, এসব নামধামহীন আবেদনপত্রগুলো ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করুন। তাদের আবেদন সত্য হলে নাম-ধাম কেন গোপন করবে? আল্লাহ শায়খ যামলূতের প্রতি রহম করুন এবং তাকে নেক প্রতিদান দিন।

বিরোধী প্রচারপত্র ও পুস্তিকা

এ ৪/৫ জন বিরুদ্ধবাদী দলের ক্ষতিসাধনের আর কোন উপায় না দেখে অবশেষে মিথ্যা প্রচারপত্র, পুস্তিকা এবং অলীক কাহিনী ছেপে বিতরণ করার উপায় অবলম্বন করে। এসব প্রচারপত্র আর পুস্তিকায় তারা মিছেমিছি প্রচার চালায়। এ দলের মধ্যে ব্যক্তি স্বাধীনতার কোন মূল্য নেই এবং সুরাভিত্তিক বিধানও তারা মেনে চলে না ইত্যাদি ইত্যাদি। মজার ব্যাপার এই যে, তারা নিজেদের বক্তব্যকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে এই বলে যে, তাদের কর্মপরিষদ আর জেনারেল পরিষদ উভয়ই হাসানুল বান্নার কোন কথার বিরোধিতা করে না, বরং অন্ধভাবেই তাকে অণুসরণ করে। কিন্তু এটা স্পষ্ট যে, কর্মপরিষদ আর জেনারেল কাউন্সিলের পরামর্শই যদি গ্রহণ করা হয় তাহলে শূরার অস্তিত্বহীনতা কিভাবে প্রমাণ হয়? শূরা আর মতামতের স্বাধীনতার এ অর্থ কেমন করে হতে পারে যে, বিরোধিতা আর বিদ্রোহের পথই ধরতে হবে।

তারা বলতোঃ ইসমাঈলিয়ার অর্থ কায়রোয় ব্যয় করা হচ্ছে এবং ওস্তাদ এ অর্থ কায়রোয় তার ভাইয়ের কাছে প্রেরণ করছে। তেমনিভাবে ইসমাঈলিয়ার টাকাকড়ি পোর্ট সাঈদ আর আবূ ছবীরেও ব্যয় করা হচ্ছে। এর অর্থ যেন এ দাঁড়া যে, ইসলামী আন্দোলনের পতাকাবাদীর জন্য কোন আত্মীয়ের সহায়তা গ্রহণ করা নাজায়েয হবে- সে আত্মীয় ঈমান আর যোগ্যতায় যতই বিশিষ্ট মর্যাদার অধিকারী হোক না কেন। বরং তাদের কর্তব্য হ হচ্ছে অপবদা থেকেমুক্ত থাকতে হলে আত্মীয়স্বজনকে নিজের বৃত্ত থেকে বের করে দিতে হবে, সে আত্মীয়ের অস্তিত্ব আন্দোলনের জন্য যতই উপকারী ও কল্যাণকর হোন না কেন। কিন্তু আন্দোলনের নেতাদের ভাই-বন্ধু হওয়া কি সামান্য অপরাধ? আর এ আত্মীয়তা তাদের উপর এ বিপদও নিয়ে আসে যে, জীবনের প্রতিযোগিতায় তাদেরকে পেছনে ঠেলে দেয়া হয়। আমাদেরকে করা হয় অগ্রসর। বিরুদ্ধবাসীরা কখনো বলতোঃ মসজিদের হিসাব একনো সকলকে জানানো হয়নি। মসজিদের আমদানী সম্পর্কে আমরা জানি না কতো আমদানী হয়েছে টেন্ডার ছাড়াই। তা ক্রয় করা হয়েছে বেআইনিভাবে। এ সম্পর্কে জানার অধিকার সাধারণ মানুষের আছে।

এরা যে মনগড়া রিপোর্ট ছাপছে, তা জানতে পেরে আমি সে দলের মুল্য হোতার ঘরে গমন করি। তিনি বুদ্ধিমান লোক। বয়স আর আন্দোলনের কাজে প্রবীন বিধায় আমি তাকে শ্রদ্ধা করতাম। আমিতাকে জিজ্হেস করলাম, তোমরা নাকি এসব কিছু করছো? তিনি জবাব দানে বিরত থাকেন। আমি যন্ত্রস্থ রিপোর্টের অংশবিশেষ বের করে তাঁকে দেখালে বাধ্য হয়ে তাকে স্বীকার করতে হয় যে, বিপোর্টটা ছাপ হচ্ছে।

আমি বললাম, জনাব, কোন দোষ নেই, আপনারা যা ইচ্ছা, করতে পারেন। রিপোর্ট প্রকাশ না করার জন্য মিনতি জানাতে বা আন্দোলনের বিরুদ্ধে অভিযান চালনা থেকে বিরত থাকার জন্য অনুরোধ জানাতে আমি আপনার কাছে আসিনি। আপনার মতামতের মালিক আপনিক, যা ইচ্ছা করতে পারেন। কিন্তু আমি জানি এবং এখনো মনে করি যে, আপনি একজন বিজ্ঞ ব্যক্তি। শুভাশুভ বিচার করা হয় সমস্ত কাজের পরিণতি দিয়েই। প্রতিহিংসা কোন ফল বয়ে আনে না। এ রিপোর্ট প্রকাশ করে আপনারা কি আশা করতে পারেন?

তিনি বললেনঃ আমরা জনমত সৃষ্টি এবং প্রকৃত সত্য সম্পর্কে জনগণকে অবগত করাতে চাই।

বললামঃ আপনারা যাতে সত্য মনে করেন, আমি তাকে সরাসরি মিথ্যা মনে করি। কাজেই তা নিয়ে আমি বিতর্কে প্রবৃত্ত হতে চাই না। কিন্তু আমি জানতে চাই যে, আপনারা কি মনে করেন আমরা এ রিপোর্টের জবাব দিতে অক্ষম? অথবা আপনারা কি জনগণকে বুঝাতে পারবেন যে, আপনারা সত্য আর আমরা মিথ্যা? তোমাদের হাতে আছে কেবল অন্তসারশূণ্য দাবী আর আমাদের হাতে আছে আইনগত দলীল প্রমাণ। আসল ব্যাপার আপনিইতো সকলের চেয়ে ভালো জানেনঃ মসজিদের হিসাবপত্র আপনার হাতেই ছিল। মাদ্রাসার জন্য যেসব সরঞ্জাম ক্রয় করা হয়েছে, তাতে আপনিও জড়িত ছিলেন। মসজিদও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের জন্য বেশির ভাগ জিনিসপত্র আপনার মাধ্যমেই কেনা হয়েছে। সুতরাং আপনরা জনগণক অবহিত করলে তাতে আপনাদের নয়, বরং আমাদেরই লাভ হবে। তাছাড়া প্রচার-প্রসারের উপকরণও আমাদের রয়েছে। জনগণের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ ঘনিষ্ঠ। আমরা বিষয়টি জুম্মার ভাষণে প্রচার করতে পারি, লিখিতভাবে ছড়াতে পারি, জনগণের সঙ্গে কথাবার্তা প্রকাশ করতে পারি, সভা-সমাবেশ করতে পারি, দারস আর ওয়অজে এ সম্পর্কে আলোকপাত করতে পারি, মসজিদ, বাজার, চা দোকান এবং রাস্তাঘাটে ছড়াতে পারি। আসল কথা প্রকাশ করার জন্য আমাদের অনেক ভাষা আর অনেক কলম আছে। আর সত্য তো দিবালোকের মতো স্পষ্ট।

আমার কাছে এতে কেবল একটা বিষয়ই কষ্টদায়ক, আর তা হচ্ছে এই যে, গতকাল পর্যন্ত আমি আপনাকে পিতার মতো শ্রদ্ধা করতাম। আর এ যুবকদেরকে আমি পরিচয় করাতাম ইসলামের সূর্য সন্তান হিসাবে। আর এখন আপনারা যে ভূমিকা অবলম্বন করছেন, তাতে আমি অনিচ্ছা সত্ত্বেও আপনাদেরকে মন্দছন্দ বলতে বাধ্য হবো। ইসলামী আন্দোলন সম্পর্কে আপনাদের প্রলাপোক্তি, অপবাদ আরোপ, গাদ্দারী-খেয়ানত আর নিমকহারামী ইত্যাদি শব্দ এখন আমাকে ব্যবহার করতে হবে আপনাদের বিরুদ্ধে। এ দৃশ্যটা কল্পনা করতেও আমার কষ্ট হয়, আমার অন্তর কেঁপে উঠে। যদিএ মূলনীতি সাধারণ্যে প্রচলিত রয়েছে যে সূচনাকারী বড় যালিম। (************) জনৈক আরব কবি বলেনঃ

**********************************

যারা আমাদের নিকট অতীব প্রীয়, আমরা তাদেরও মাথার খুলী উড়িয়ে দেই। কারণ, তারা বড়ই নাফরমান ও যালিম হয়ে বসেছে।

এ শোক-দুঃখে আরো সংযোজন হয় একথা ভেবে যে, এসব প্রতিশোধমূলক চেষ্টার কোন ফল হবে না। কোন লাভ হবে না এত গলদঘর্ম হয়ে। এ সংঘাতে একে অপরের সম্ভ্রমহানীর কোন ফলই পাওয়া যাবে না। সবই হবে পণ্ডুশ্রম। এ সংঘাত থেকে আপনার দূরে থাকার মধ্যেই কল্যাণ নিহিত রয়েছে। আপনার জন্য এর পরিণতি কি হতে পারে, তা আপনার অজানা নয়। যদি নিছক প্রতিশোধ গ্রহণই উদ্দেশ্য হয়ে থাকে তবে এতে কোন কল্যাণ নেই। আর যদি উপদেশ ও কল্যাণ কামনা লক্ষ্য হয়ে থাকে, তবে তাতো আপনারা করেছেন। লোকেরা জানতে পরেছে যে, আপনারা কি বলতে চান। বরং এটাই তোমাদের জন্য যথেষ্ট যে, আল্লাহ সবকিছু জানেন এবং সব খবর রাখেন। মোটকথা তোমাদের চেষ্টা- চরিত্র আর বিরোধিতা ও শক্রতা যদি আল্লাহর সম্তুষ্টি কামনায় হয়ে থাকে তবে জেনে রাখবে যে, আল্লাহ অন্তর্যামী।

আমার কথাগুলো দ্বারা তিনি প্রভাতি হন। আমাকে তিনি কথা দেন যে, রিপোর্টটি তিনি প্রকাশ করতে দেবেন না এবং এর খসড়া পাণ্ডুলিপি তিনি প্রেস থেকে ফেরৎ আনাবেন। তাঁর কাছ থেকে এ প্রতিশ্রুতি নিয়ে আমি ফিরে আসি।

একটা দারস এবং তার প্রভাব

আমার মনে আছে, এসব ঘটনাকালে আমি সাধারণ শ্রোতাদের সম্মুখে একটা দারস পেশ করি। এর বিষয়বস্তু ছিল: অন্তর পবিত্র করার ফযীলত, সকল মানুষের কল্যাণ কামনা এবং বিবাদমান পক্ষদ্বয়ের মধ্যে সমঝোতা স্থাপন। দারস দান শেষে আমি নিভৃত কক্ষে গিয়ে বসি এবং অন্তরের সঙ্গে আমার তিক্ত কথাবার্তা হয। আমি অন্তরকে লক্ষ্য করে বলি: হাসান! তুমিতো অন্যদেরকে ভালো কাজের নির্দেশ দাও কিন্তু নিজেকে ভুলে যাও। এটা কি মোনাফেকী আচরণ নয়? যে ব্যক্তী কথা আর কাজে এক, এমন লোককে আল্লাহ পসন্দ করেন। আর হঠকারী এবং ঝগড়াটে ব্যক্তি তার নিকট সবচেয়ে বেশি ঘৃণ্য। আল্লাহর নবী বলেছেনঃ

**********************************

আমি কি তোমাদেরকে সে কাজের কথা বলে দেবো না, যা নামায-রোযা এবং ছদকার চেয়েও কয়েকগুণ উত্তম। সাহাবায়ে কেরাম আরয করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! অবশ্যই বলবেন। আল্লাহর নবী বললেনঃ মানুষের মধ্যে সমঝোতা স্থাপন করা। মানুষকে সংঘাতে জড়ানো এমন একটা ফেৎনা, যা মুন্ডন করে ছাড়ে। আমি বলছি না যে কেশ মুন্ডন করে, বরং দ্বীনকেই মুন্ডন করে ছাড়ে। (দ্বীনেরই বিনাশ সাধন করে)।

আর আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ

**********************************

তবে তাদের উভয়ের মধ্যে সন্ধি স্থাপন করায় কোন পাপ নেই। আর সন্ধি-সমঝোতা উত্তম (সূরা নিসাঃ ১২৮)।

নিঃসন্দেহে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল সত্য বলেছেনঃ কিন্তু আমি অন্যদেরকে উপদেশ দেই আর নিজেকে ভুলে যাই। এ রীতি কিছুতেই ঠিক নয়। অন্তরের পরিচ্ছন্নতা আর নাফসের পরিশুদ্ধি অপরিহার্য। ক্রোধ আর উম্মা দমন করতে হবে এবং নিজের স্বার্থে প্রতিশোধ গ্রহণের স্পৃহা ভস্ম করে দিতে হবে। সুতরাং সর্বপ্রথম এ সংশোধনমূলক কাজ আমাকে নিজের উপর পরীক্ষা করতে হবে। যদিও আমি কোন গুনাহের কাজ করিনি এবং বাড়াবাড়ির সূচনাও আমার পক্ষ থেকে হয়নি; কিন্তু তার পরও আমাকে এ পরীক্ষা চালাতে হবে। আমি কলম তুলে নেই এবং প্রতিপক্ষের হোতার নিকট একখানা পত্র লিখি। তাতে আমি লিখিঃ

অতীতকে সম্পূর্ণ বিস্মৃত হতে আমি পুরাপুরী প্রস্তুত। প্রতিপক্ষের লোকেরা চাইলে ইখওয়ানের সারীতে তাদেরকে ফিরায়ে নেয়া যায়। তারা উদারতার ভিত্তিতে আমার এ প্রস্তাব মেনে নিলে আল্লাহ তাদের আমল কবুল করবেন। আমি ক্ষমা করে দিয়েছি। তাদেরকেও ভুলে যেতে হবে, ক্ষমা করতে হবে। সত্যকে সত্য বলে প্রতিষ্ঠা করার মূলনীতি অনুযায়ীও তারা যদি পারস্পরিক শুভ্রতা- পরিশুদ্ধি চায়, সেজন্যও আমি প্রস্তুত আছি। সালিস নিযুক্তির অধিকারও তাদেরকে দিচ্ছি। তারা যাকে খুশী সালিশ নিযুক্ত করতে পারে। আমি তাদের সামনে বিষয়টা উত্থাপন করবো। এবং সালিশের রায় শিরোধার্য করে নেবো। এমন ঘোষণা পূর্বাহ্নেই দিয়ে রাখছি।

এ ভূমিকার পর আমি পতে আমার এ মতের কারণও স্পষ্ট উল্লেখ করেছি যে, একটি দারস দেয়ার পর আমার মনের এ অবস্থা হয়েছে। আমার আশঙ্কা হচ্ছে, যেন আমি সেসব লোকের অন্তর্ভুক্ত না হই, যাদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেছেনঃ

**********************************

ঈমানদারগণ! তোমরা যা কর না, তা কেন বল। তোমরা যা কর না, তা বলা আল্লাহর নিকট অত্যন্ত অসন্তোষজনক (সূরা ছাফঃ ২-৩)।

কিন্তু পত্রের এ একটি ছত্র থেকে আবেগ উৎসারিত হলেও তাদের উপর তা কোন ক্রিয়া করেনি। আমি নিজে গিয়ে এ পত্র দিয়ে আসতে চেয়েছিলাম প্রতিপক্ষের ক্রীড়নকের বাসায়। কিন্তু ইখওয়ানরা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে এবং পত্র প্রেরণ থেকে আমাকে বারণ করার সর্বাত্মক চেষ্টা চালায়। আমি নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকি এবং নিজে গিয়ে তার হাতে পত্র হস্তান্তর করতে পীড়াপীড়ি করি। ব্যাপারটা ইখওয়ানের কাছে ব্মিয়কর মনে হয়। কিন্তু সত্যকথা এই যে, আমি আমার এ দুর্বলতার মধ্যে- যাকে আমি সবলতা মনে করি এবং এখনো তাই মনে করছি- বিরাট স্বাদ অনুভব করছিলাম। কারণ, এ দুবর্লতা ছিল আল্লাহর নির্দেশের অধীনে।

সত্যবাণী

সে পত্রের আন্তরিকতা মাখা কথাগুলো পাষাণপ্রাণ ব্যক্তিদের অন্তরে স্থান পায়নি। আর রিপোর্ট প্রকাশ না করার প্রতিশ্রুতিও সে ‘বুদ্ধিমান’ ব্যক্তি রক্ষা করেননি। কারণ, তাদের একজন অন্যান্যদের বিরোধিতার মুখে রিপোর্ট নিজের নামে প্রকাশ করতে উদ্যত হয়। কার্যতঃ রিপোর্ট ছাপা আর বিলিও করা হয়। পোর্ট সাঈদ এবং আবু ছাবীর ইসমাঈলিয়া থেকে খুব একটা দূরে নয়। সেখানে তা বিলি করা হলে স্থানীয় ইখওয়ানের পক্ষ থেকে ‘সত্যের বাণী’ বা ‘কালেমাতুল হক’ নাম রিপোর্টেল প্রতিবাদ লেখা হয়। রিপোর্ট আর তার প্রতিবাদ সাধারণ মানুষের দৃষ্টি আন্দোলনের দিকে আকৃষ্ট করে। আন্দোলনের সকল কর্মকাণ্ডে জনগণ আগ্রহী হয়ে উঠে। ফলে বিরোধী প্রোপাগান্ডা আন্দোলনের প্রসারে বিরাট সহায়কের ভূমিকা পালন করে।

আসল আদালতে

ইখওয়ানের বিরুদ্ধে এসব মিথ্যা অভিযোগের প্রসঙ্গটি আদালতে উত্থাপন করবো না বলে কর্মপরিষদকে আমিকথা দিয়েছিলাম। একদিন এশার নামাযের পর মসজিদের ভিতরের বারান্দায় আমরা একত্র হই। আমি অধিবেশন উদ্বোধন করি। আমি আলোচ্য বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরু করবো, এমন সময় নামায শেষে বসে থাকা মুসল্লীদের একজন উচ্চস্বরে কুরআন তিলাওয়াত শুরু করেঃ

**********************************

এমনিভাবে আমরা প্রত্যেক নবীর জন্য শক্র করেছি মানব এবং জিন শয়তানকে। তারা ধোঁকা দেয়ার জন্য একে অপরকে কারুকার্যময় কথাবার্তা শিক্ষা দেয়। তোমার পালনকর্তা চাইলে তারা এ কাজ করতো না। অতএব তুমি তাদেরকে এবং তাদের মিথ্যা অপবাদকে মুক্ত ছেড়ে দাও, যাতে কারুকার্যখচিত বাক্যের প্রতি তাদের মন আকৃষ্ট হয়, আর পরকালে বিশ্বাস করে না তারা একেও পসন্দ করে নেয় এবং যাতে তারা ঐসব কাজ করে, যা তারা করছে। তবে কি আমি আল্লাহ ব্যতীত অন্যকোন বিচারক অনুসন্ধান করবো, অথচ তিনিই তোমাদের প্রতি বিস্তারিত গ্রন্হ নাযিল করেছেন। আমরা যাদেরকে গ্রন্হ প্রদান করেছি, তারা নিশ্চিত জানে যে, এটি হবে না। তোমার পালনকর্তার বাক্য পূর্ণ সত্য ও সুক্ষ্ম। তাঁর বাক্যের কোন রদবদলকারী নেই। আর তিনিই মহাশ্রবণকারী, মহাজ্ঞাণী (সূরা আল-আনআমঃ ১১২-১১৫)।

উক্ত মুসল্লী নিজে থেকে তিলাওয়াত করছিলেন। তাহলেও তার আওয়াজ ছিল বেশ বুলূন্দ। আমরা সকলে কান পেতে তার তিলাওয়াত শুনছিলাম। লোকটি তিলাওয়াত শেষ করে চুপ। এদিকে আমিও বোবা সেজে বসে আছি। ইখওয়ানরা বললেনঃ আমরা কেন এখানে বসেছি? আমি বললাম, আয়াতটি আমাদের সিদ্ধান করে দিয়েছে। আমি একত্র হওয়ার উদ্দেশ্যে সবিস্তারে আলোচনা করি এবং সব শেসে বলি, এখন আমি এজেন্ডা থেকে আদালতে মামলা দায়ের করার প্রস্তাবটি প্রত্যাহার করছি। বিচারক হিসাবে আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট। তাঁর ফয়সালা সুবিচারভিত্তিক এবং তিনি সবচেয়ে বড় ন্যায়বিচারক।

ষড়যন্ত্রের হোতা মওলবী সাহেবের পরিণতি

এসব ঘটনা ঘটছিল আর সে মওলবী সাহেব, যিনি ইসমাঈলিয়ায় ইখওয়ান কর্মকর্তা হওয়ার খাহেশ পোষণ করছিলেন, তিনি তখনো ইখওয়ানের একটা মাদ্রাসায় শিক্ষক হিসাবে কাজ করছিলেন। তিনি দূরে থেকে এ ষড়যন্ত্রের পৃষ্ঠপোষকতা করছিলেন। তিনি বেশ সূক্ষ্ম চাল চালছিলেন। কিন্তু তিনি এমনই সতর্ক ছিলেন যে, কোন অভিযোগ উঠলে তা থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিতেন। আর আমিও অনুমানের ভিত্তিতে তাঁর বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে চাইছিলাম না। কারণ, এর ফলে আসল ব্যাপারে কোন পার্থক্য দেখা দেবে না। তাঁর সমর্থক ইখওয়ানরা এ ঘটনায় জড়িত ছিলেন এবং তাদের কাজ শেষ  হয়েছে। আমি সবসময় এ আশা পোষণ করতাম যে, তার মতো একজন বিচক্ষণ আলিম এবং অপ্রতিদ্বন্দ্বী সাহিত্যিক সত্যপথে ফিরে আসবেন এবং অন্যদেরকেও ফিরায়ে আনার ব্যাপারে আমার সঙ্গে সহযোগিতা করবেন।

কিন্তু আমার এ আকাঙ্খা ছাইয়ে পর্যবসিত হয়েছে। তিনি ষড়যন্ত্রে ইন্ধন যোগাচ্ছিলেন। তবে এমনভাবে যে, সে জন্য তাদে দায়ী করা যায় না। শেষ পর্যন্ত ষড়যন্ত্র তীব্র হয়ে উঠে এবং বিষয়টা সীমাতিক্রম করে যায়। ঘটনাচক্রে একবার তিনি হাতেনাতে ধরা পড়ে যান। আর তা এভাবে যে, একবার সারা রাত আমার ঘুম হয়নি। ফজরের ঘন্টা দেড়ঘন্টা আগে নামাজের জন্য আমি আব্বাসী মসজিদের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। পথে ছিল বিরোধীদের একজনের বাসা। দেখলাম বাসায় বেশ আলো জ্বলছে। জানালা খোলঅ। ভেতরে বেশ আলঅপ আলোচনা চলছে। জোরে জোরে কথা শোনা যাচ্ছে। আমি তাকিয়ে দেখি, মওলবী সাহেব বসা। তার চারদিকে বিরোধীরা। আর মওলবী সাহেব তাদেরকে চক্রান্ত আর শক্রতার তত্ত্ব বুঝাচ্ছেন। এ অবস্থা দেখে আমি আমার পথে এগিয়ে যাই। সকালে আমি তাকে তলব করি। বেশ নম্রতার সঙ্গে নানাকথার ফাঁকে জানতে চাই, রাত কোথায় কাটালেন? জবাবে তিনি আমাকে এক দীর্ঘ কাহিনী শুনালেন, যার সমাপ্তি এরকম, তিনি নিজের বাসায় রাত কাটিয়েছেন।

এরপর আমি শুরু করা ফেৎনা আর তার প্রভাব-পরিণতির দিকে আলোচনার মোড় ঘুরাই। এদিকেও ইঙ্গিত করি যে, লোকে বলে এবং নানা বর্ণনাও পাওয়া যায় যে, এ ফেৎনায় আপনারও অংশ আছে। তিনি তৎক্ষণাৎ নিজেকে মুক্ত জাহির করেন এবং এ ‘অপবাদ’ মেনে নিতে অস্বীকার করেন। এবং এভাবে জাহির করতে লাগলেন যেন তিনি ধোয়া তুলসি পাতা। বরং তিনি যে নির্দোষ, তার স্বপক্ষে তিনি নানা রকম প্রমাণ উপস্থাপন করা শুরু করলেন। আমি শুনে আঙ্গুলে কামড় দেই যে, হেরফের করার কতো ক্ষমতা আর যোগ্যতা তার। শেষ পর্যন্ত নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য তিনি বিবি তালাকের কসম খেতেও উদ্যত হন।

এবার আমি আর সহ্য করতে পারলাম না। তার মুখ চেপে ধরে চিৎকার দিয়ে বললাম, আল্লাহ ভয় কর। মিথ্যা কসম করবে না। এরপর জিজ্ঞেস করলাম, রাত্রে এতক্ষণ সময় তুমি কোথায় ছিলে? এবার তার বীরত্ব শেষ। সে হতভম্ব। কোন জবাব বানাবার চেষ্টা করে; কিন্তু তার মুখ রুদ্ধ হয়ে যায়। আমি তাকে আর সুযোগ না দিয়ে আসল তত্ত্ব তার কাছে ফাঁস করি। এবং তার অনস্বীকার্য প্রমাণও দেই। আমি তাকে স্পষ্ট জানিয়ে দেই যে, কেউ আমাকে বলেনি, বরং আমি নিজেই তোমার চালবাজী প্রত্যক্ষ করেছি। এখন তাকে বাধ্য হয়ে অপরাধ স্বীকার করতে হয়েছে। বলতে লাগে, আমি নিতান্ত লজ্জিত এবং কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত। আপনি আমার প্রতি দয়া করুন।

আমি বললাম, ভয়ের কোন কারণ নেই। তুমি নিশ্চিত থাকতে পার যে, তোমার কোন ক্ষীত করার কথা আমি ভাবতেও পরি না। কারণ, আমার পক্সে এমন ধারণা করাও অসম্ভব। কাল পর্যন্ত তোমার প্রশংসায় আমি ছিলাম পঞ্চমুখ। তোমাকে এগিয়ে দিয়ে আমি তোমার পেছনে নামায পড়তাম। আমি নিজে তোমার দারসে হাযির হতাম এবং অন্যদেরকে হাযির হওয়ার জন্য বলতাম। আর আজ আমি তোমার বদনাম করবো, হাটে হাঁড়ি ভাঙবো, তোমার অপরাধের কথা প্রচার করবো। এমন অবস্থার কথা আমি ভাবতেও পারি না। তবে আমি এটা বরদাশত করতে পারি না যে, তুমি দাওয়াত আর বাস্তব জীবনে আমার সঙ্গী হবে। তোমার সম্মুখে দুটা রাস্তা আছে, এর যেকোন একটা অবলম্বন করবে। হয় তুমি ইসমাইলিয়ায় থাকবে, আমি আল্লাহ চাহেন তো তোমার জন্য কোন কাজের ব্যবস্থা করে দেবো। কিন্তু তা হবে ইখওয়ানের পরিমণ্ডলের বাইরে। এ অবস্থায় বর্তমান চাকুরী থেকে সরে দাঁড়াবার কোন যুক্তি সঙ্গত এবং গ্রহণযোগ্য কারণ উল্লেখ করতে হবে। আর দ্বিতীয় রাস্তা এই যে, তুমি নিজ শহরে ফিরে যাবে। আমি তোমাকে সেখান পর্যন্ত পৌঁছাবো। তুমি নিরাপদ স্থানে না পৌছা পর্যন্ত আমি তোমার সকল আরাম-আয়েশের দায়িত্ব নেবো। আল্লাহ আমাদের সকলের কর্মবিধায়ক। তিনি আমাদের সাক্ষী। তিনি দ্বিতীয়টি গ্রহণ করেন, তবে শর্ত দেন যে, তাঁর ঋণ আমাকে শোধ করতে হবে। আমি তার ঋণ শোধ করি। এরপর তিনি যথারীতি ইস্তফা দেন এবং একই সঙ্গে কেন্দ্র আর মাদ্রাসার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন।

মওলবী সাহেব দেওয়ানী আদালতে

কিন্তু প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তিনি নিজ শহরে ফিরে যাননি। একদিন আমি একটা ঘোষণা শুনতে পেলাম যে, ইসমাঈলিয়ায় তার পরিচালনায় একটা নতুন স্কুল খোলা হয়েছে। যে পাঁচজনের সঙ্গে তার গাঁটছাড়া ছিল, তাদের সমন্বয়ে একটা তত্ত্বাবধায়ক কমিটিও গঠিত হয়েছে। ঘোষণায় ইখওয়ানের চেষ্টা-সাধনা আর মাদ্রাসারও তীব্র সমালোচনা করা হয। আমি মনে মনে বলি: ভালই হলো। আমাদের থেকে তার দূরে থাকাই ছিল আসল দরকার। এরপর যা ইচ্ছা, তা করুন।

কিন্তু একদিন আমি স্থানীয় আদালত থেকে একটা নোটিশ পাই যে, মওলবী সাহেব ইখওয়ানের সঙ্গে যে সময়টা অতিবাহিত করেছেন, তার জন্য পারিশ্রমিক দাবী করছেন। তাঁর এ পারিশ্রমিক ছিল অতি নগণ্য পরিমাণ। কিন্তু এ সামান্য পরিমাণও আদালতের মাধ্যমে দাবী করতেই তাঁর আগ্রহ হয়েছে। অতচ আমার কাছে এমন কাগজ পত্র আছে, যা তার প্রাপ্যের চেয়ে কয়েকগুণ বেশী ঋণ প্রমাণ করে। যাই হোক, আমি নিজে আদালতে উপস্থিত হই। মওলবী সাহেব তার দাবী পেশ করেন। আমি তার দাবী মেনে নেই। তবে আমি জজের সামনে সেসব কাগজপত্রও উপস্থিত করি, যা আমার কাছে ছিল। জজ সেসব কাগজপত্র আইনতঃ গ্রাহ্য বলে রায় দেন এবং তার মামলা খারিজ করে দেন। মামলার খরচও তার উপর চাপান। যে মাদ্রসার জন্য ঢাকাঢোল পিটায়ে ঘোষণা প্রচার করা হয়, টিকে থাকার তার ভাগ্যে জুটেনি। বরং খোলার আগেই বন্ধ হয়ে যায়। মওলবী সাহেবও ইসমাঈলিয়ায় টিকতে পারেননি। তাকে সেখান থেকে চলে যেতে হয়।

এ দীর্ঘ কাহিনী ডাইরিতে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য আমি সে মওলবী সাহেবের নিকট ক্ষমাপ্রার্থী। আজ তিনি আমাদের দেশের উত্তম আলিমদের মধ্যে একজন। এবং আমাদেরও অন্যতম উত্তম বন্ধু। আমি যে সময়ের কথা বলছি, তা অতীত হয়ে গেছে আর তাঁর স্মৃতিও অতীত কাহিনী। হতে পারে তখনো তার কোন ওযর ছিল আর আমরা শুধু শুধু তাকে তিরস্কার করেছি। অন্তরের গোপন রহস্য আল্লাহই ভালো জানেন।

বিবাহ ও বদলী

দাওয়াতী জেন্দেগীর শুরু থেকে যেসব পরীক্ষা আর ফেৎনা আমার জন্য আস্মিক বিপদ হয়ে দেখা দিয়েছিল, হয়তো তার আঘাত হালকা করাই ছিল মহান আল্লাহর ইচ্ছা। এসব ফেৎনা আর পরীক্ষা ছিল আমার জন্য বিস্ময়কর সবক, বিস্ময়ের জগতে অবগাহন করে একের পর এক আমি যা হাসিল করেছি। আল্লাহর অনুগ্রহ সেসব ফেৎনার ক্ষতিকর প্রভাব দূর করে দিতো এবং তার মধ্য থেকে আমাদের জন্য এমন কল্যাণ উদগত করতো, যাতে আমরা চিৎকার করে উঠতাম: দুশমন যে অনিষ্ঠ ঘটায়, তাতেই আমাদের মঙ্গল নিহিত।

ইসলামী আন্দোলনকে চতুর্মুখী লড়াইয়ের সম্মুখীন হতে হয়। অজ্ঞ দুশনও তার বিরোধিতা করে, আন্দোলনৈর সঙ্গে যাদের কোন সম্পর্ক নেই। তারাও যুদ্ধে লিপ্ত হয়, যারা আন্দোলনকে জানে-বুঝে, তারাও তার বিরুদ্ধে মাঠে নামে। এমন কিছু বিরোধীও আছে, যারা কর্মী হিসাবে আন্দোলনে যোগ দেয়, কিন্তু তা করে স্বার্থবিদ্ধির জন্য। এ চতুর্মুখী লড়াইয়ের জন্য আমি অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করে আসছি। আমার সে অস্ত্র হচ্ছে ছবর, আত্মসংযম এবং উত্তম চরিত্র। যে সব নিষ্ঠাবান ব্যক্তির উপর আমাদের পরিপূর্ণ আস্থা রয়েছে, আর তাদেরকে ইন্ধন যোগানোর জন্য এমনকিছু লোক রয়েছে, যারা আন্দোলনের ছায়াতলে আন্দোলনের সংস্থাগুলোতেই প্রতিপালিত হচ্ছে। তারাও বিরোধিতার পতাকা তুলতে পারে আর এ বিরোধিতার কোন লক্ষ্য-উদ্দেশ্য থাকে না। এসব কিছুই হয় নিষ্ফল প্রয়াস, তখন এ পরিস্থিতিটা হয় বিস্ময়কর। আর আল্লাহর সৃষ্টি কতো বিচিত্র রঙ্গের।

আল্লাহ আমার জন্য বিবাহের সুযোগ করে দেন। নিতান্ত সহজ অনাড়ম্বরভাবে আমার বিবাহ সম্পন্ন হয়। প্রথম রমযান বিবাহ ঠিক হয় এবং ২৭ রমযান রাত্রে মসজিদে বিবাহ সম্পন্ন হয়। যিলকদের ১০ তারিখ ঘরে তুলে আনি। আর এভাবে আল্লাহর ইচ্ছা পুর্ণ হয়। আলহামদুলিল্লাহ।

বিবাহের পর আমি মনে করি যে, ইসমাঈলিয়ার অভ্যন্তরে এখন আমার মিশন পুর্ণ হয়েছে। আন্দোলন সৃষ্টি হয়েছে। আন্দোলনের অনেক প্রতিষ্ঠান আর সংস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। ইসমাঈলিয়ার সমস্ত অধিবাসী ইখওয়ান- ভাই ভাই হয়েছে। সুতরাং এখন আর কেন আমাকে এখানে বসে থাকতে হবে? কী তার প্রয়োজন? আমার অনুভূতি জাগলো, এবার এখান থেকে আমাকে বদলি করা হবে। ১৯৩২ সালের গ্রীষ্মের ছুটি শুরু হয়। আমি মহান ওস্তাদ শায়খ আব্দুল ওয়াহহাব নাজ্জার-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। আমরা দুজন দীর্ঘক্ষণ আলাপচারিতায় নিরত থাকি। ইসমাঈলিয়ায় আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি নিয়েও আলোচনা হয়। আমি তাঁকে একথাও বলে দেই যে, আমার মন বলছে, অবিলম্বে ইসমাঈলিয়া ত্যাগ করবো আমি তাঁর কাছে আবেদন জানাই যে, ওস্তাদ বাতরাবীর সঙ্গে আলোচনা করবেন যে, আমি কায়রোয় বদলী হতে আগ্রহী। ওস্তাদ নাজ্জার ওস্তাদ বাতরাবীর সঙ্গে কথা বলে আমাকে জানান যে, বদলীর জন্য আমাকে দরখাস্ত করতে হবে। আমি তখনই একটা দরখাস্ত লিখে দেই। আল্লাহ তা’আলা আমার খাহেশ পুর্ণ করের। ১৯৩২ সালের অক্টোবর মাসে আমাকে কায়রোয় বদলি করা হয়।

**********************************

ডাইরীর উর্দু অনুবাদক মরহুম খলীল হামেদী লিখেন।

মরহুম হাসানুল বান্নার ডাইরীর প্রথম অংশ এখানে শেষ। কায়রোর জীবন সম্পর্কে তিনি ব্যক্তিগত ডাইরী লিপিবদ্ধ করেননি। অক্টোবর ১৯৩২ সাল থেকে ফ্রেরুয়ারি ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত তিনি কায়রোয় অবস্থান করেন। আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে অবশেষে শাহাদাতের পেয়ালঅ পান করেন। ডায়রীর দ্বিতীয় অংশ ব্যক্তিগত ডায়রীর পরিবর্তে দলের রিপোর্ট, প্রোগ্রাম এবং অন্যঅন্য তৎপরতা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। ইনশাআল্লাহ দ্বিতীয় অংশও অদূর ভবিষ্যতে পাঠকদের সম্মুখে উপস্থাপন করা হবে।

লাহোরস্থ ইসলামিক পাবলিকেশন্স-এর বর্তমান ম্যানেজার জনাব আফযাল মুনীর এক পত্রে আমাকে জানান যে, ডাইরীর দ্বিতীয় খন্ড এখনো প্রকাশিত হয়নি। মূল আরবী ডাইরী কোন সহৃদয় পাঠক সরবরাহ করতে পারলে পাঠকদের আগ্রহের পরিপ্রেক্ষিতে তা যথাসময়ে অনুবাদ করে প্রকাশ করা হবে ইনশাআল্লাহ-অনুবাদক।

--০--

শহীদ হাসানুল বান্নার ডায়েরি

খলিল আহমদ হামেদী

book স্ক্যান কপি ডাউনলোড