ইসলামী অর্থনীতি নির্বাচিত প্রবন্ধ

চতুর্থ সংস্করণের ভূমিকা

 

আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ সুবহানাতায়ালার অসীম অনুগ্রহে ইসলামী অর্থনীতি: নির্বাচিত প্রবন্ধ-এর চতুর্থ সংস্করণ প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। প্রায় ছয় মাস পূর্বেই বইটির তৃতীয় সংস্করণের সব কপি শেষ হয়ে যায়। এরপর প্রকাশক বইটি প্রকাশের উদ্যোগ নিলেও আমার জন্যেইা এই বিলম্ব হয়ে গেল। বইটির বেশ কিছু প্রবরেন্ধর পরিমার্জনার প্রয়োজন ছিল। সেই সাথে প্রয়োজন ছিল আরও দু-একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় জনসংযোগ দপ্তরের প্রশাসক ও বিভাগের চেয়ারম্যানের যৌথ দায়িত্ব পালন করতে যেয়ে প্রয়োজনীয় সময় করে উঠতে পারিনি। জনসংযোগ দপ্তরের কার্যকাল শেষ হওয়ার পর কিছুটা ফুরসত পাই।

 

বর্তমান সংস্করণে তিনটি নতুন প্রবন্ধ সন্নিবেশিত হলো: সুদবিহীন অর্থনীতি বনাম ইসলামী অর্থনীতি, ইসলামী ভোক্তার স্বরূপ এবং ইসলামী অর্থনীতি চিন্তার ক্রমবিকাশ। এছাড়া দারিদ্র বিমোচন ও মানব সম্পদ উন্নয়নে যাকাত, ইসলামী উন্নয়ন ব্যায়ক, ইসলামী বীমা বা তাকাফুল: বৈশিষ্ট্য ও কর্মপদ্ধতি এবং ইসলামী অর্থনীতি পটাঠসহায়ক বই-পত্র শীর্ষক প্রবন্ধগুলোর পুনর্বিন্যাস ও বহু নতুন তথ্য সংযোজিত হয়েছে। আশাকরি এই সংযোজন ও পরিমার্জন পাঠকদের কাজে আসবে। সারণীগুলেঅও যথাসাধ্য সংশোধিত হয়েছে। এরপরও ভুলত্রুটি থেকে যেতেই পারে। আগ্রহী পাঠক নিজগুণে তা ক্ষমা করে দেবেন।

 

বইটির চাহিদা ও গুরুত্বের কথা বিবেচনা করে দি রাজশাহী স্টুডেন্ট’স ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন চতুর্থ সংস্কণ প্রকাশের জন্যে উদ্যোগ নেয়ায় তাদেরকে মুবারকবাদ জানাই। বইটিতে পরিবর্তন পরিবর্ধন পরিমার্জনা ও প্রুফ সংশোধনের সময়ে পরিবারের প্রতি যথাযোগ্য মনোযোগ দেয়া সম্ভব হয়নি। পরম করুণাময় আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এজন্যে তাদের জাযায়ে খায়ের দান করুন। এই সংস্করণটি পূর্বের মতোই পাঠক সমাদর পেলে এবং ইসলামী অর্থনীতি বুঝবার ক্ষেত্রে কিছুমাত্র সহায়ক হলে আমার শ্রম সার্থক হবে।

 

শাহ্‌ মুহাম্মদ হাবীবুর রহমান

 

১২রবিউল আওয়াল, ১৪২৬

 

২২ এপ্রিল, ২০০৫

 

প্রসঙ্গ কথা

 

ইসলামী অর্থনীতি সম্বন্ধে আমার প্রথম কৌতুহল সৃষ্টি হয় ১৯৬০-এর দশকের মাঝামাঝি, ছাত্রজীবনে। সে সময়ে ইসলামী অর্থনীতি প্রসঙ্গে দু-একটা বই ও প্রবন্ধ পড়লেও বিষয়টি সম্বন্ধে গভীরভাবে জানার আগ্রহের সৃষ্টি হয়নি। এ ব্যাপারে সত্যিকার অনুসন্ধিৎসু হয়ে উঠি ১৯৭০-এর দশকে, বিশেষতঃ ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার পর। এরপর বাংলা ভাষায় যেসব বই-পত্র পাওয়া গেল সেসব পড়ে কৌতূহলে নিবৃত্ত হলা না, বরং বেড়ে গেল। সেই সঙ্গে সৃষ্টি হলো অনেক প্রশ্নেরও। তার উত্তরের জন্যে হাত বাড়াতে হলো অন্যত্র। কিন্তু আরবী ও উর্দূ ভাষা না জানা এক্ষেত্রে হয়ে দাঁড়ালো বিরাট প্রতিবন্ধক। সেই সময়ে কয়েকজন সহৃদের সৌজন্যে আধুনিক অর্থনীতির আঙ্গিকে ইংরেজী ভাষায় লেখা বেশ কয়েকটি মূল্যবান বই পেলাম। সেগুলি পড়ে চমৎকৃত হলাম। বস্তুত: তখন হতেই ইসলামী অর্থনীতি বিষয়ে আমার সত্যিকার পড়া-লেখা ও চিন্তা-ভাবনা শুরু।

 

ইতিমধ্যেই আমাদের চেষ্টায় গড়ে উঠলো ইসলামিক ইকনমিকস্ রিসার্চ ব্যুরো। এর মাধ্যমে আরও গভীরভাবে ইসলামী অর্থনীতি জানার ও চর্চার সুযোগ হলো। সেই সঙ্গে দেশের বিভিন্ন স্থানে সেমিনার ও সম্মেলনে বক্তৃতার আহবান আরও পড়াশুনা ও লেখালেখির সুযোগ করে দিল। ফলশ্রুতিতে ১৯৮০-১৯৮৬ সালের মধ্যে চারটি বই সমাজে সমাদৃতও হলো। এরপরও দেশের বিভিন্ন সাময়িক, মাসিক ও দৈনিক পত্রিকায় লেখাপ্রকাশিত হতে থাকলো। বাংলা ভাষার পাশাপাশি ইংরেজীতেও কিছু গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হলো দেশী-বিদেশী জার্নাল ও সংকলণ গ্রন্থে।

 

বিগত এক যুগ ধরে প্রকাশিত সেসব প্রবন্ধ হতে নির্বাচিত তেরটি প্রবন্ধ এই বইয়ে সন্নিবেশ করা হয়েছে। িএর মধ্যে চারটি প্রবন্ধ প্রায় পূর্বের অবয়বে রয়েছে। আটটি প্রবন্ধ নতুন সংজোনসহ ব্যাপকভাবে পরিমার্জিত ও পুনর্লিখিত হয়েছে। একটি প্রায় পুরোটাই নতুন করে লেখা হয়েছে। এছাড়া পূর্বের কোথাও প্রকাশিত হয়নি এমন তিনটি বড় প্রবন্ধ সংযুক্ত হলো। গুরুত্ব বিবেচনা করে প্রকাশিত ইংরেজী প্রবন্ধ থেকেও একটির অনুবাদ সংযোজিত হলো। উল্লেখ্য, সকল ক্ষেত্রেই সাম্প্রতিক তথ্য সন্নিবেশের সাধ্যমত চেষ্টার ত্রুটি হয়নি।

 

এ ধরনের একটি বই প্রকাশের জন্যে আমার স্ত্রী, বন্ধু-বান্ধব, শুভানুধ্যায়ী এবং অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রীর কাছ থেকে নিরন্তন অনুরোধ পেয়েছি। বিশেষ করে এদেশের শিক্ষাঙ্গনে যারা ইসলামী আন্দোলনের নেতা-কর্মী তাদের দাবী ছিল প্রবল। কিন্তু সময় ও সুযোগ, বিশেষ করে প্রকাশকের অভাব ছিল এক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধক। শেষ পর্যন্ত তাদের ইচ্ছা পূর্ণ হলো। এ জন্যে মহান রাব্বুল আলামীনের শুকরিয়া আদায় করছি। বইটি দেখে যাঁরা সবচেয়ে বেশী খুশি হতেন সেই আব্বা-আম্মা আজ আর দুনিয়াতে নেই। আল্লাহ গাফুরুর রহীম তাঁদের চির শান্তি দান করুন। ইসলামী অর্থনীতির বিবিধ প্রসঙ্গ বুঝতে ও জানতে বইটি তরুণ প্রজন্মের কাজে আসলে আমার শ্রম সার্থক বিবেচনা করবো।

 

শাহ্মুহাম্মদ হাবীবুর রহমান

 

১২ রবিউল আওয়াল, ১৪১৭

 

২৯ জুলাই, ১৯৯৬

 

 

ইসলামী অর্থনীতির সংজ্ঞা মূলনীতি

 

ইসলামী অর্থনীতি কি?

 

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ও তাঁর রাসূল (স) প্রদত্ত জীবন বিধানই ইসলাম। যেহেতু ইসরাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান সেহেতু এর অনুসারীদের জন্যে রয়েছে ব্যক্তিজীবন, গোষ্ঠী জীবন তথা রাষ্ট্রীয় জীবনের দায়-দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা ও উপযুক্ত নীতিমালা। এর মধ্যে অন্তর্বুক্ত রয়েছে পরিবার, সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, প্রশাসন, আইন ও বিচার প্রভৃতি। অর্থনীতি যে কোন জাতি বা রাষ্ট্রের জন্যে একটি অপরিহার্য প্রসঙ্গ। ইসলামী জীবন বিধানের অনুসারীদের জন্যেও একথা সত্য। তাই ইসলামী অর্থনীতি বলতে অর্থনীতিকেই বোঝায় যার আদর্শ, উদ্দেশ্য লক্ষ্য, কর্মপদ্ধতি এবং পরিণাম ফল ইসলামী আকিদা মুতাবিকই নির্ধারিত হয় এই অর্থনীতির মূলনীতি ও দিক-নির্দেশনা বিধৃত রয়েছে আল-কুরইান ও সুন্নাহতে।

 

ইসলামী অর্থনীতির ভিত্তি বা দর্শন

 

প্রত্যেক জাতি বা সমাজের একটি জীবন দর্শন থাকে। সেই জীবন দর্শন অনুসারেই তার জীবন তথা জাগতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়ে থাকে। মুসলমানদরে জীবনে সেই দার্শনিক ভিত্তি হচ্ছে তৌহিদ, রিসালাত ও আখিরাত। পক্ষান্তরে ধনতান্ত্রিক বা পুঁজিবাদী অর্থনীতির দার্শনিক ভিত্তি হচ্ছে বস্তুবাদ তথা ভোগবাগ। অধুনা ধ্বংসপ্রাপ্ত সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির ভিত্তি দ্বান্দ্বিক বাস্তবাদ। মুসলিম উম্মাহর আকীদা হচ্ছে এই বিশ্বচরাচরের একজন মহান স্রষ্টা আছেন। তিনি এক, অদ্বিতীয় ও সর্বশক্তিমান। একমাত্র তাঁরই নির্দেশিত পথে চ ললে মিলবে কল্যাণ ও মুক্তি। এই নির্দেশিত পথটি কি এবং কেমন করে সেপথে চলতে হবে তা জানাবার জন্যে সেই বিশ্বস্রষ্টাই আবার যুগে যুগে পাঠিয়েছেন নবী-রাসূলদের। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (স) সেই ধারায় সর্বশেষ রাসুল এবং তাঁরই মাধ্যমে দ্বীনের পূর্ণতা প্রদান করা হয়েছে।

 

আল্লাহর এই একত্ব ও নিরংকুশ ক্ষমতার মালিকানাকেই ইসলামে বলা হয়েছে তৌহিদ এবং তাঁর পাঠানো নবী-রাসূলদের দায়িত্ব ও কর্তব্যকেই রিসালাত হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। অধিকন্তু এই জীনই শেষ নয়, এর পরে রয়েছে এক অনন্ত জীবন বা আখিরাত। সেই জীবনে ইহকালীন সুকৃতির জন্যে রয়েছে পুরস্কার এবং দুষ্কৃতির জন্যে রয়েছে শাস্তি। তৌহিদ, রিসালাত ও আখিরাতের এই সামষ্টিক বিশ্বাস মুসলমানের ঈমানের পূর্ণতা দান করে। এর তিলমাত্র ব্যতিক্রম শুধু তার ঈমন নয়, তার সমগ্র কর্মজীবনেই এনে দেয় নানা সংশয়, সন্দেহ ও অপূর্ণতা। শয়তান সেই সন্দেহের মধ্যে দিয়ে তাকে টেনে নেয় ধ্বংসের দিকে। মুসলমানের সমগ্র জীবন ও কর্মকাণ্ড তাই তৌহিদ, রিসালাত ও আখিরাতের বিশ্বাসকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত। অর্থনীতি যেহেতু সেই জীবন ও কর্মকাণ্ডেরই এক গুরুত্বপূর্ণ ও বৃহৎ অংশ জুড়ে রয়েছে সেহেতু এ ক্ষেত্রেও তৌহিদ, রিসালাত ও আখিরাতের বিশ্বাস ও তার দাবী সমভাবেই প্রযোজ্য, এই দর্শনের উপর ভিত্তি করেই আবর্তিত হয় মুসলিমদের জীবনের সার্বিক অর্থনৈতিক কার্যক্রম। গড়ে উঠে সমৃদ্ধ ও গতিশীল অর্থনীতি।

 

ইসলামী অর্থনীতির সংজ্ঞা

 

এই দার্শনিক ভিত্তিভূমিকে কেন্দ্র করে বর্তমান সময়ের কয়েকজন প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ ইসলামী অর্থনীতির একটি সুসংবদ্ধ ও গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা প্রদানের চেষ্টা করেছেন। সেসবের মধ্যে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য কয়েকটি সংজ্ঞা এখানে উল্লেখ করা হলো।

 

ড. এস. এম. হাসানউজ্জামানের মতে- “Islamic Economics is the knowledge and application of injunctions and rules of the Shariah that prevent injustice in the acquisition and disposal of material resources in order to provide satisfaction to human beings and enable them to perform their obligations to Allah and the society.”[ Hassanuz Zaman, S.M., “Definition of Islamic Economics”]

 

অর্থাৎ, ইসলামী অর্থনীতি হচ্ছে শরীয়াহর বিধি-নির্দেশ সম্বন্ধীয় জ্ঞান ও তার প্রয়োগ যা বস্তুগত সম্পদ আহরণ ও বিতরণের ক্ষেত্রে অবিচার প্রতিরোধে সমর্থ যেন এর ফলে মানবমণ্ডলীর সন্তুষ্টি বিধান করা যায়। ফলে আল্লাহ ও সমাজের প্রতি তারা দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে সক্ষম হবে।

 

আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অর্থনীতিবিদ ডা এম. উমার চাপরার মতে- “Islamic economics is that branch of knowledge which helps realize human wellbeing through an allocation and distribution of scarce resources that is in conformity with Islamic teachings without unduly curbing individual freedom or creating continued macroeconomic and ecological imbalabces.”[Chapra, M. Umer, What is islamic Economics? Islamic Research and Training Institute, Islamic Development Bank, Jeddah, 1996, p. 33]

 

অর্থাৎ, ইসলামী অর্থনীতি জ্ঞানের সেই শাখা যা ইসলামের শিক্ষার সাথে সংগতি রেখে দুষ্প্রাপ্য সম্পদের বন্টন ও বরাদ্দের মাধ্যমে এবং ব্যক্তির স্বাধীনতা অযথা খর্ব ও সমষ্টি অর্থনীতি এবং পরিবেশগত ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি না করে মানবীয় কল্যাণ অর্জনের সহায়তা করে।

 

ইসলামী অর্থনীতি সম্পর্কে প্রখ্যাত গবেষক-অর্থনীতিবিদ ডঃ এম. নেজাতুল্লাহ সিদ্দিকীর মত হলো- “Islamic economics is the Muslim thinkers’ response to the economic challenges of their times. In this endeavour they are aided by the Quran and the Sunnah as well as by reason and experience.” [Siddiqui, M. Nejatullah, “History of Islamic Economic Thouht” in Ausaf Ahmad and K.R. Awan (eds.), Lectures on Islamic Economic, IRTI/IDB, Jeddha, 1992 p. 69.] অর্থাৎ, সমকালীন সময়ের অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুকাবিলায় মুসলিম চিন্তাবিদদের জবাবিই হচ্ছে ইসলামী অর্থনীতি। এই প্রয়াসে তারা কুরআন ও সুন্নাহ এবং যুক্তি ও অভিজ্ঞতার সহায়তা নিয়ে থাকেন।

 

ইসলামী অর্থনীতির অন্যতম পথিকৃত ডঃ এম.এ. মান্নান তাঁর যুগান্তকারী বই Islamic Economics: Theory and Practice- এ একটি সরল অথচ কার্যকর সংজ্ঞা প্রদান করেছেন বলে প্রতীয়মান হয়। তিনি বলেন- “Islamic economics is a social science which studies the economic problems of a people imbued with thevalues of Islam” [Mannan, Muhammad Abdul, Islamic Economics; Theory and Practice, TheIslamic Academy; Cambridge, (Rev. Edb.) 1986, p. 18] অর্থাৎ, ইসলামী অর্থনীতি হলো একটি সামাজিক বিজ্ঞান যা ইসলামী মূল্যবৈাধে উজ্জীবিত মানুষের অর্থনৈতিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা করে থাকে।

 

ইসলামী অর্থনীতির চর্চা ও বিকাশে অসামান্য অবদানের জন্যে যিনি সম্মানিত ও মর্যাদাপূর্ণ ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক পুরস্কারে প্রথম ভূষিত হয়েছেন সেই প্রফেসর খুরশীদ আহমদ ইসলামী অর্থনীতিকে সংজ্ঞায়িত করেছেন এভাবে- “Islamic economics represents a systematic eftort to try to understand the economic problem and man’s behaviour in relationto that problem from an Islamic perspective.”[Ahmed, Khurshid, “Nature and Significance of Islamic Economics” in Ausaf Ahmed & K.R. Awan (eds.) Lectures on Islamic Economics; Jeddah: IRTI/IDB, 1992, p. 19.] অর্থাৎ, ইসলামী অর্থনীতি হলো অর্থনৈতিক সমস্যা ও ঐসব সমস্যার প্রেক্ষিতে মানবীয় আচরণকে ইসলামী দৃষ্টিকোণ হতে উপলব্ধি করার এক পদ্ধতিগত প্রয়াস।

 

প্রখ্রাত শিক্ষাবিদ এবং ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া ও দারুল ইসহান বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর মুহাম্মদ আব্দুল হামিদের মতে ইসলামী অর্থনীতি হলো “ইসলামী বিধানের সেই অংশ যা প্রক্রিয়া হিসেবে দ্রব্য ও সেবা সামগ্রী উৎপাদন, বন্টন ও ভোগের প্রসঙ্গে মানুষের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও নৈতিক আচরণকে সমন্বিতভঅবে অধ্যয়ন করে।” [হামিদ, েএম. এ., ইসলামী অর্থনীতি: একটি প্রাথমিক বিশ্লেষণ, অনুঃ শাহ্‌ মুহাম্মাদ হাবীবুর রহমান, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়, ২য় সং, ২০০২, পৃ. ১৯।]

 

কুরআন ও সুন্নাহর শাশ্বত নির্দেশাবলীর পাশাপাশি উপরের সংজ্ঞাগুলো বিশ্লেষণ করলে ইসলামী অর্থনীতির যে মূলনীতিসমূহ সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয় সেগুলো সম্পর্কে পরবর্তী অংশে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো। এখানে গভীর পরিতাপের সাথে উল্লেখ করতে হয় যে, কুরআন ও হাদীস সম্পর্কে আমাদের অজ্ঞতা এবং সেই সাথে প্রচলিত সেক্যুলার শিক্ষা ব্যবস্থা ইসলামী অর্থনীতি সম্পর্কে আমাদের অন্ধকারে রেখেছে। উপরন্তু এদেশের দীর্ঘদিন ইংরেজ শাসনের ফলে এবং পরবর্তীকালে পাকিস্তানী শাসকদের অবিমৃষ্যকারিতার জন্যে ইসলামী অর্থনীতির দর্শন, মূলনীতি, রূপরেখা বা বৈশিষ্ট্য এবং এর প্রয়োগিক দিক সম্বন্ধে ধারণা প্রসার লাভ করেনি।

 

ইসলামী অর্থনীতির মূলনীতি

 

ইসলামী অর্থনীতির রয়েছে সাতটি অনন্যধর্মী ও কালজয়ী মূলনীতি। এই মূলনীতিগুলোর নিরিখেই ইসলামী অর্থনীতির সকল স্ট্রাটেজি বা কর্মকৌশল, কর্মপদ্ধতি ও কর্মদ্যোগ নির্ধারিত ও পরিচালিত হয়ে থাকে। এগুলো যথাক্রমে:

 

১. সকল ক্ষেত্রে আমর বিল মারুফ এবং নেহী আনিল মুনকার-এর বাস্তবায়নের মাধ্যমে তাযকিয়া ও তাকওয়া অর্জন;

 

২. সকল কর্মকাণ্ডেই শরীয়াহর বিধান মান্যকরা;

 

৩. আদল (বা ন্যায়বিচার) ও ইহসান (বা কল্যাণ)-এর প্রয়োগ;

 

৪. ব্যক্তির সম্পদে সমাজের অধিকার প্রতিষ্ঠা;

 

৫. ভারসাম্যপূর্ণ জীবন যাপনের প্রয়াস;

 

৬. যুগপৎ দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ অর্জন।

 

. সকল ক্ষেত্রে আমর বিল মারুফ নেহী আনিল মুনকার-এর বাস্তবায়নের মাধ্যমে তাযকিযা তাকওয়া অর্জন

 

আমর বিল মারুফ বা সৎকাজে আদেশ (অন্য কথায় সুনীতির প্রতিষ্ঠা) এবং নেহী আনিল মুনকার বা অন্যায় কাজে নিষেধ (অন্য কথায় দুর্নীতির উচ্ছেদ) ইসলামী অর্থনীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য বা মূলনীতি। যে অর্থনীতি ও সমাজ ব্যবস্থায় যুগপৎ সুনীতির প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতির উচ্ছেদের জন্যে বলিষ্ঠ ও কার্যকর পদক্ষেপ নেই সেই অর্থনীত ও সমাজ ব্যবস্থায় অসহায় ও মজলুমের আর্তনাদে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। শোষিত ও বঞ্চিত মানুষের ফরিয়াদে দিগন্ত হয়ে ওঠে সচকিত। আমর বিল মারুফ ও নেহী আনিল মুনকারের বিধান নেই বলেই পুঁজিবাদ মানুষের কাংখিত কল্যাণ অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। উপরন্তু সেই অর্থনীতি সচল রাখার উদ্দেশ্যে কৌশল বদলানো হচ্ছে বারবার। কখনও বা মার্কেন্টাইলিজমকে দেয়া হচ্ছে সর্বোচ্চ গুরুত্ব, কখনও বা ‘অদৃশ্য হস্ত’কে। কখনও গুরুত্ব পেয়েছে কল্যাণ অর্থনীতির (Welfare Economics) ধারণা, আবার কখনও বা প্রাধান্য পেয়েছে উন্নয়ন অর্থনীতি।

 

কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি। নৈতিকতা বিবর্জিত ও ব্যক্তিস্বার্থকেন্দ্রিক মানুষের সৃষ্ট সংকট মোচনেও দায়িত্ব শেষ অবধি রাষ্ট্রকে নিতে হয়েছে। এখন বলা হচ্ছে কাঠামোগত পুনর্বিন্যাসের (Structural adjustment) কথা। কিন্তু ইতিমধ্যেই এর বিপক্ষেও তীব্র সমালোচনা শুরু হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে যে সমাজে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন নেই সে সমাজ ধ্বঙস হয়ে গেছে। ইতিহাস তার সাক্ষী। এরই প্রতিবিধানের জন্যে ইসলামের সুনীতির প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতির উচ্ছেদের জন্যে কঠোর তাগিদ দেয়া হয়েছে। বস্তুতঃপক্ষে মানুষের মধ্যে, সমাজেরসকল স্তরে সত্য ও মিথ্যার যে দ্বন্দ্ব রয়েছে তারই প্রতিবিধানের জন্যে সুনীতির সপক্ষে ও দুর্নীতির বিপক্ষে অবস্থান নিতে ইসলাম নির্দেশ দিয়েছে। মানুষের চূড়ান্ত কল্যাণ ও শান্তিপূর্ণ সমাজ বিনির্মাণ ইসলামের এই নির্দেশ অমোঘ ও কালজয়ী। অর্থনীতির ক্ষেত্রে একথা বেশী করে প্রযোজ্য।

 

এই নীতি প্রয়োগের মৌল উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষকে পরিশুদ্ধ করা। তার জীবন ও সমাজকে পবিত্র করা। খোদাভীতি বা তাকওয়া এরই ভিত্তি। কুরআন সুন্নাহর সকল বিধানের মুল লক্ষ্য হলো ইহকালীন জীবনে মানুষকে সঠিক ও সত্য পথে পরিচালনার মাধ্যমে তাকে আল্লাহর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি বা আশরাফুল মাখলুকাতের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করা। এজন্যে তাকে অবশ্যই পরিশুদ্ধ বা পবিত্র হতে হবে। খোদাভীতি এর অপরিহার্য সোপান। যার মধ্যে খোদাভীতি রয়েছে সে চারিত্রিক পরিশুদ্ধি বা তাযকিযা অর্জনে সক্ষম হয়েছে। তার দ্বারা দুনিয়ার কোন অকল্যাণ সংঘটিত হবে না। আখিরাতেও সে আল্লাহর বা তার রবের সন্তুষ্টি অর্জনে সক্ষম। খোদায়ী বিধানের লক্ষ্যই হলো ও পবিত্রতা ও পরিপূর্ণতা অর্জনে মানুষকে সাহায্য করা। এজন্যে খোদাভীতি বা তাকওয়া সৃষ্টি জরুরী। এর অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য হলো সকল অপরাধমূলক, নাশকতামূলক, হিংসাত্মক ও চরিত্রবিধ্বংসী কাজসহ খোদাদ্রোহিতা থেকে বিরত থাকা যেন মানুষ মানসিক, চারিত্রিক ও শারীরিক পরিশুদ্ধি অর্জনের মাধ্যমে উসওয়াতুন হাসানা ও ইনসানে কামিলের প্রতিবিম্ব হতে পারে। তাকওয়া ছাড়া এই লক্ষ্যে পৌঁছানো অসম্ভব।

 

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় কোন জাগতিক আইন, বিধি-নিষেধ এমনকি জেল যুলুমও মানুষকে অন্যায় ও কলুষতা হতে বিরত রাখতে সমর্থ হয়নি। এই বিশ্বচরাচরের স্রষ্টা নিছক খেয়াল-খুশীর বশে মানুষ সৃষ্টি করেন নি। তার একটি মহৎ উদ্দেশ্য এর পিছনে অন্তর্নিহিত ছিল। প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সবই তার গোচরীভূত। সকল কাজের পুরস্কার বা তিরস্কারের তিনিই মালিক, এই বোধ-বিশ্বাস অন্তরে সৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত শুধু শাস্তিমূলক ব্যবস্থা কাউকে অসৎ কাজ হতে স্থায়ীভাবে বিরত রাখতে সমর্থ হয়নি। এজন্যেই ইসলামে আমর বিল মারুফ ও নেহী আনিল মুনকারের সঙ্গেই তাযকিয়া ও তাকওয়ার উপর এত বেশী গুরুত্ব আরোপিত হয়েছে, জোর দেয়া হয়েছে। ইসলামী অর্থনীতর মূলনীতিসমূহের মধ্যে একটি সর্বাগ্রগণ্য স্থান পেয়েছে এ কারণেই।

 

. সকল কর্মকাণ্ডেই শরীয়হা বিধান মান্য করা

 

ইসলামী জীবন ব্যবস্থায় কিছু কিছু পেশা, খাদ্য ও পানীয় এবং কর্মকাণ্ডকে হারাম বা অবৈধ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। ঐসব কাজ করা এবং খাদ্র ও পানীয়ের ভোগ উৎপাদন, বিপণন ইত্যাদি সকল কিছুই হারাম বা নিষিদ্ধ। অনুরূপ শরীয়াহর সীমার মধ্যে বেশ কিছু কাজকে হালাল বা বৈধ বলেও অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। পৃথিবীর অন্য কোন অর্থনীতিতেই এই ধরনের বৈধ-অবৈধ বা হালাল-হারামের এই বিধান নেই। বরং সরকার বা আইন পরিষদ বা অনুরূপ প্রতিষ্ঠান নিজেদের স্বার্থ বা প্রয়োজনের তাগিদেই কোন কাজকে বৈধ আবার কোন কাজকে অবৈধ বলে চিহ্নিত করে থঅকে। মানুষের মনগড়া মতবাদেই কেবল এই সুযোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে একই ধরনের কাজ একবার আইনতঃ নিষিদ্ধ আবার অন্য সময়ে আইনতঃ সিদ্ধ হয়। উদাহরণস্বরূপ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মদ পান ও মদ বৈরী নিষিদ্ধকরণ ও পরবর্তীকালে পুনরায় অনুমোদনের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।

 

ইসলামে এই ধরনের মনগড়া সিদ্ধ-নিষিদ্ধের সুযোগ রাখা হয়নি। যা সিদ্ধা বা বৈধ তা চিরকালের জন্যে ও সকলের জন্যেই বৈধ এবং যা নিষিদ্ধ বা অবৈধ তা চিরকারে জন্যে ও সকলের জন্যে অবৈধ। উদাহরণস্বরূপ পুনরায় মদের উল্লেখ করা যেতে পারে। গোটা পশ্চিমা বিশ্বে আঠারো বছর বয়সের নীচে মদপান নিষিদ্ধ। কিন্তু যদনি পরিবারের ছেলেমেয়ের কারো বয়স আঠারো বছর পূর্ণ হয় সেদিন ঘটা করে মদপানের উৎসব করা হয়। এই ধরনের দ্বিমুখী আচরণ ও মানসিকতার সুযোগ ইসলামে নেই। পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রে রাষ্ট্রের অনুমতি থাকলে বা আইনের বিধান করে নিলে যেকোন সমাজবিধ্বংসী ও মানবতার জন্যে অবমাননাকর কাজও বৈধতার রূপ পেয়ে যায়। জুয়াখেলা ও পতিতাবৃত্তি এর জাজ্জ্বল্যমান উদাহরণ। প্রথমটি সমাজবিধ্বংসী এবং পরবর্তীটি মানবতার জন্যে অবমাননাকর। কিন্তু যথোপযুক্ত ফি দিয়ে লাইসেন্স করে নিলে কি পুঁজিবাদী অর্থনীত, কি সমাজতান্ত্রিক অর্থনতি উভয় ক্ষেত্রেই এ দুটি কাজ শুধু বৈধতা নয়, সমাজেরও অনুমোদন পেয়ে যায়। বিপরীতক্রমে যা হালাল বা বৈধ তা প্রাপ্তির বা অর্জনের চেষ্টা করা এবং যা হারামবা অবৈধ তা পরিত্যাগ বা বর্জনের চেষ্টা করা ইসলামী জীবন বিধান তথা ইসলামী অর্থনীতির দাবী।

 

ইসলামী বিধান অনুযায়ী যেকোন ব্যক্তি হালাল বা বৈধ পদ্ধতিতে ধন-সম্পদ উপার্জনের পূর্ণ স্বাধীনতা রাখে। এজন্যে সে নিজের যোগ্যতা ও সামর্থ অনুসারে যেকোন উপায় অবলম্বন করতে পারে এবং যেকোন পরিমাণ অর্থও উপার্জন করতে পারে। তার এই বৈধ মালিকানা থেকে তাকে বঞ্চিত করার কেউ নেই। তবে হারাম বা নিষিদ্ধ পন্থায় এক কপর্দকও উপার্জন করার তার অনুমতি নেই। বরং হারাম পদ্ধতিতে উপার্জন থেকে আইন প্রয়োগ করেই বিরত রাখা হবে। এক্ষেত্রে অপরাধের পর্যায় বা গুরুত্ব অনুসারে তাকে অবশ্যই কারাদণ্ড ও/বা অর্থদণ্ড দেওয়া যেতে পারে; এমনকি তার ধনসম্পদ বাজেয়াপ্ত পর্যন্ত করা যেতে পারে।

 

. আদল (ন্যায় বিচার) ইহসান (কল্যাণ)-এর প্রয়োগ

 

আদল বা ন্যায়বিচার এবং ইহসান বা কল্যাণ প্রতিষ্ঠা ইসলামের আরেকটি তাৎপর্যপূর্ণ বিধান। ইসলামী অর্থনীতির ক্ষেত্রেও তা সমভাবেই প্রযোজ্য। পুঁজিবাদ, সমাজতন্ত্র বা অন্য কোন ইজমের অর্থনীতিতে সুবিচারের এই প্রসংগটি একেবারেই অনুপস্থিত। সেখানে বরং মানুষের স্বাভাবিকতা বা ফিতরাতের বিরোধী নীতিই কার্যকর রয়েছে। ঐ সব অর্থনীততে দুর্বলের, দরিদ্রের, বঞ্চিতের তথা সমাজের মন্দভাগ্য লোকদের জন্যে স্বীকৃত কোন অর্থনৈতিক অধিকার ছিল না। পর পর দুটি বিশ্বযুদ্ধ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মহামন্দা এবং শিল্পসমৃদ্ধ দেশসমূহের ট্রেড ইউনিয়নগুলোর প্রচণ্ড চাপের মুখে পরবর্তীকালে কিছু কিছু কল্যাণধর্মী পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছে। এই সমাজে একচেটিয়া কারবারী, মুনাফাখোর ব্যবসায়ী, ঘৃণ্য চোরাকারবারী, ধনী মজুতদার ও দুর্নীতিপরায়ণ আমলার কথাই আইনের মর্যাদা পেয়ে থাকে। দেশের আইনের আশ্রয় ও আনুকূল্য তাদেরই জন্যে। ফলে দরিদ্র আরও দরিদ্র হচ্ছে, ধনী হচ্ছে আরও ধনী। ধনবৈষম্য হচ্ছে আরও প্রকট। ইউএনডিপির সম্প্রতি প্রকাশিত এক রিপোর্টে বিলম্বে হলেও এই সত্য স্বীকার করে নেয়াহয়েছে।

 

অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার স্বার্থে সমাজে জবাবদিহিতার উপস্থিতি অপরিহার্য। ইসলামের দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমার ইবনে খাত্তাবের (রা) আমলে মদীনার জনগণের মধ্যে বিলিকৃত কাপড় সকলেই পেয়েছিলেণ এক খণ্ড করে। কিন্তু তিনি কিভাবে দুখণ্ড কাপড় ব্যবহারের সুযোগ পেয়েছিলেন তার জবাব দিতে হয়েছল জনতার সামনে খুতবা দেওয়ার পূর্বেই। আদল ও ইহসান প্রতিষ্ঠার স্বার্থে রাসূল (স) জামাতা ইসলামের চতুর্থ খলীফা হযরত আলীকে (রা) হাজির হতে হয়েছিল কাযীর এজলাসে সাধারণ নাগরিকের মতোই। বর্মের মালিকানার সেই মামলায় তিনি হেরে গিয়েছিলেন। ‍উমাইয়া ও আব্বাসীয় খিলাফতের যুগেও বিচারের এই ব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল। ন্যায়বিচারের অন্য অর্থ সমাজ হতে অন্যায় ও জুলুমের উচ্ছেদ এবং সবল প্রতিরোধ্ ইসলামী শরীয়াহ ব্যত্যয় যুলুমকেই ডেকে আনে। তার সময়োচিত প্রতিরোধ ও উচ্ছেদ না হলে দুর্বল ও দরিদ্র শ্রেণীই প্রতরিত ও নিদৃহীত এবং বঞ্চিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এজন্যেই ইসলামী অর্থনীতিতে এর প্রতিবিধানের উদ্দেশ্যে আদল ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা অন্যতম মূলনীতি হিসেবে গৃহীত হয়েছে। আদল বা সুবিচারের স্বার্থে আইনে তাৎক্ষনিক ও যথাযথ প্রয়োগ ইসলামী বিধানের অপরিহার্য অঙ্গ।

 

এই সঙ্গে ইহসান বা কল্যাণের প্রসঙ্গটি ইসলামী অর্থনীতিতে যতখানি গুরুত্বের সাথে বিবেচিত হয়ে থঅকে অন্য কোনও অর্থনীততে তা অনুপস্থিত। দুর্বলের প্রতি, অর্থনৈতিক দিক থেকে বঞ্চিতের প্রতি কল্যাণের হাত প্রসারিত করা ইসলামী অর্থনীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। মূলতঃ এই কারণেই যাকাতের মতো একটি বাধ্যতামূলক ব্যবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে উশর, সাদাকাতুল ফিতর ও করযে হাসানা। সমাজে যারা মন্দভাগ্য ও অর্থনৈতিক দিক থেকে দুর্বল তাদের সমস্যার কিছুটা হলেও সুরাহা হয় যদি যথোচিতভাবে যাকাত ও উশর আদায় ও বন্টন হয়, ফিতরা প্রদান করা হয় এবং করযে হাসানার দুয়ার উন্মুক্ত রাখা হয়। দুর্বল, বঞ্চিত, ইয়াতীম, ঋণগ্রস্ত মুসাফির, পীড়িত ও আর্তজনেরা অর্থনৈতিক এই কল্যাণ ইসলামী সমাজে পায় তাদের অধিকার হিসেবেই, দয়অর দান হিসেবে নয়।

 

. ব্যক্তির সম্পদে সমাজের অধিকার প্রতিষ্ঠা

 

ইসলাম ব্যক্তির সম্পদে সমাজের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছে এবং এজন্যে বিভিন্ন পদ্ধতির কথাও উল্লেখ করেছে। আল-কুরআনে নিকট আত্মীয়দের অধিকারের বর্ণনা রয়েছে। এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য হচ্ছে কোন ব্যক্তির উপার্জিত অর্থে তার নিজের ছাড়া আত্মীয়-স্বজনেরও হক রয়েছে। সমাজে কোন ব্যক্তি যদি প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদের অধিকারী হয় এবং তার আত্মীয়দের কেউ ন্যূনতম প্রয়োজন পূরণে অসমর্থ হয় তাহলে সামর্থ্য অনুযায়ী ঐ আত্মীয়কে সহায়তা করা তার সামাজিক দায়িত্ব। এভাবে কোন জাতির বা দেশের এক-একটি পরিবার যদি স্ব স্ব আত্মীয়-স্বজনকে সাহায্য-সহযোগিতার হাত বাড়িযে দেয় তাহলে দেশ হতে দারিদ্র্য যেমন দূল হবে তেমনি পরমুখাপেক্ষী পরিবারের সংখ্যাও হ্রাস পাবে।

 

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আল-কুরআনে ঘোষণা করেছেন-

 

“তাদের (সম্পদশালীদের) ধন-সম্পদে হক রয়েছে যাঞ্চাকারী ও বঞ্চিতদের।” (সূরা আল-যারিয়াত: ১৯ আয়অত)

 

“তুমি আত্মীয়-স্বজন এবং অভাবগ্রস্ত ও মুসাফিরকেও তোমার নিকট হতে তাদের পওনা দিয়ে দাও।” (সূরা বনি ইসরাইল: ২৬ আয়াত)

 

উপরর আয়াত দুটি হতে সুস্পষ্টভাবে এই সত্য প্রতিভাত হয় যে, বৈধ পন্থায় উপার্জিত অর্থ-সম্পদে অন্যদেরও অধিকার রয়েছে। বিশেষতঃ আত্মীয়-স্বজন েএবং সমাজে যারা মন্দভাগ্য তাদের প্রতি সহযোগিতা ও সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া ঈমানী দায়িত্ব। যাকাতের অর্থ প্রদান সাহেবে নিসাব ব্যক্তিদের জন্যে বাধ্যতামূলক। একই সঙ্গে কুরআনুল করীমের নির্দেশ অনুসারে প্রয়োজনীয ব্যয় নির্বাহের পর যাদের বঞ্চিত, ভাগ্যহত লোকদের ন্যূনতম প্রয়োজন পূরণের উদ্দেশ্যে এই অর্থ ব্যয় বাধ্যতামূলক। পৃথিবীর অন্য কোনও অর্থনীতিতে সমাজের বিত্তহীন ও অভাবগ্রস্ত লোকদের প্রয়োজন পূরণ ও কল্যাণ সাধনের জন্যে এ ধরনের নির্দেশ দেওয়া হয়নি। বঞ্চিতের হতাশা ও কর্মদ্যোগে তাদের অংশগ্রহণ না থাকার ফলে দেশের অর্থনৈতিক কর্মতৎপরতা অনেকখানি স্তিমিত হয়ে পড়ে। সমাজে সর্বোচ্চ বিনিয়োগ এবং পূর্ণ কর্মসংস্থান যে পুঁজিবাদী অর্থনীতির কাঙ্খিত লক্ষ্য সেই লক্ষ্য অর্জিত হয়নি সমাজের নীচতলার লোকেরা সকলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ গ্রহণ করতে পারেনি বলেই। অর্থনীতির নিয়ম অনুসার যখন প্রান্তিক ভোগপ্রবণতা সর্বোচ্চ হয় তখন বিনিয়োগ চাহিদা, উৎপাদন ও কর্মসংস্তান একই সংগে বৃদ্ধি পেতে থাকে। ভোগপ্রবণতা বৃদ্ধি পায় তখনই যখন সমাজের অধিকাংশ লোকের ক্রয়ক্ষমতা থাকে। সেই অবস্থায় সৃষ্টি হতে পারে আল্লাহ প্রদত্ত উপরের নির্দেশের যথাযথ বাস্তবায়নের মধ্যে দিয়েই।

 

. ভারসাম্যপূর্ণ জীবন যাপনের প্রয়াস

 

ইসলাম সর্বস্ব ত্যাগের বা সন্যাসের ধর্ম নয়, আকন্ঠ ভোগের বা চরম আসক্তিরও ধর্ম নয়। বরং ত্যাগ ও ভোগ-এ দুয়ের মাঝামাঝি জীবন যাপনের জন্যেই ইসলাম তাগিদ দেওয়া হয়েছে। সে সংসারত্যাগী সে দুনিয়ার অর্থনৈতিক কোন কর্মকাণ্ডে অংশ গ্রহণ করার জন্যে আদৌ আগ্রহ বোধ করে না। তাই দুনিয়ার লোকদের কোন উপকার করা তার সাধ্য বা ক্ষমতা বহির্ভূত। অপরপক্ষে যে ভোগী, যে কোন উপায়ে ভোগলিপ্সা চরিতার্থ করাই তার একান্ত বাসনা। ভোগ করার জন্যে, নিজের বিলাস-বাসনা চরিতার্থ করার জন্যে সব রকম উপায়ে সে ধন-সম্পদ উপার্জনে সচেষ্ট থাকবে। এক্ষেত্রে তার কাছে ন্যায়নীতি বা বৈধতা-অবৈধতার প্রশ্ন যেমন তুচ্ছ তেমনি পরের কল্যাণে অরথ-সম্পদ ব্যয় করা তার কাছে মূর্খতা। নিজে তো সে কৃপণতা করেই অন্যকেও কৃপণতা করতে প্ররোচিত করে। কৃপণতার অর্থনৈতিক তাৎপর্য হলো ব্যয় সংকুচিত হওয়া, ফলে চাহিদা সংকুচিত হওয়া এবং পরিণামে কর্মসংস্থান ও উৎপাদন সংকুচিত হওয়া। অর্থনীতিতে এর পরিণাম নিদারুণ অশুভ।

 

ইসলামের ভারসাম্যপূর্ণ জীবনের মূল বক্তব্যই হলো নিজে সৎ সুন্দরভাবে বাঁচতে চেষ্টা করা, অন্যকেও সেভাবে বাঁচতে সহযোগিতা করা। প্রকৃত মুসলমান আড়ম্বরপূর্ণ জীবনের জন্যে না নিজের সব মূল্যবোধ ও ঈমানী চেতনাকে বিসর্জন দেবে, না অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করবে। বরং কল্যাণ ও মঙ্গলের পথে তার যাত্রার সহযোগী করে নেবে আত্মীয়-স্বজন পাড়া-প্রতিবেশী বন্ধু-বান্ধব ও সমাজের মন্দভাগ্য লোকদের। পক্ষান্তরে ধনলিপ্সা মানুষকে অন্যায়ের পথে প্ররোচিত করে। পরিণামে ডেকে আনে নিজের ও সমাজের অশেষ অমঙ্গল। অপব্যয় ও অপচয়ের মাধ্যমে নিজের দন জাহির করা এদের অনেকেরই কুৎসিৎ অভ্যাস। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে এসবই নিন্দিত ও ঘৃণিত।

 

মহান আল্লাহ তায়ালা আল্‌-কুরআনে দ্ব্যার্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেছেন-

 

“সেই সব লোককে আল্লাহ পছন্দ করেন না যারা নিজেরা কার্পণ্য করে, অন্য লোককেও কার্পণ্য করার পরামর্শ দেয় এবং আল্লাহ স্বীয় অনুগ্রহে যা তাদের দান করেছেন তা লুকিয়ে রাখে।” (সূরা আন-নিসা: ৩৭ আয়াত)

 

তিনি আরও বলেন- “নিশ্চয়ই অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই।” (সূরা বনি ইসরাঈল: ২৭ আয়াত)

 

বরং তিনি ব্যয়ের ব্যাপারে সঠিক পথ নির্দেশনা দিয়েছেন এভাবে-

 

“তারাই আল্লাহর নেক বান্দা যারা অর্থ ব্যয়ের ব্যাপারে না অপচয় ও বেহুদা খরচ করে, না কোনরূপ কৃপণতা করে। বরং তারা এই উভয়ের মাঝখানে মজবুত হয়ে চলে।” (সূরা আল-ফুরকান: ৬৭ আয়াত)

 

সামাজিক জীব হিসেবে মানুষ অবশ্যই ধন-সম্পদ উপার্জনের চেষ্টা করবে। নিজের ও পরিবার-পরিজনের প্রয়োজন পূরণের দায়িত্ব তার। সেই সঙ্গে সমাজের অন্যান্য সদস্যদের প্রয়োজনের ব্যাপারেও তার সতর্ক দৃষ্টি থাকবে। আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী এবং অন্যান্য অবাবগ্রস্ত বা সাময়িকভাবে দুর্দশায় নিপতিত মানুষের জন্যে তার থাকবে আন্তরিক দরদ। সাধ্যমতো সাহায্য-সহযোগিতা প্রদানের মাধ্যমে ঘটবে তার বহিঃপ্রকাশ। ব্যক্তি নিজে যেমন উচ্ছৃংখল ও বিলাসী জীবন যাপন করবে না তেমনি পরের দুঃখেও সে মুখ ফিরিয়ে নেবে না। এই দুয়ের মধ্যবর্তী আচরণই ভারসাম্যপূর্ণ জীবনের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এজন্যেই অর্থনৈতিক সকল কর্মকাণ্ডে ভারসাম্যপূর্ণ আচরণের উপর ইসলাম এত বেশী গুরুত্ব আরোপ করেছে।

 

. মৌলিক মানবিক প্রয়োজন পূরণ নিশ্চিত করা

 

সমাজের সকল মানুষের মৌলিক প্রয়োজন পূরণের নিশ্চয়তা বিধান ইসলামী অর্থনীতির অন্যতম মূলনীতি। মানুষের মৌলিক প্রয়োজন পাঁচটি- অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা। এই প্রয়োজন পূরণ করার জন্যে ইসলাম ব্যক্তি ও রাষ্ট্রকে যে তাগিদ দিয়েছে তার নজীর আর কোন অর্থনীতিতে নেই। মূলতঃ এই প্রয়োজন পূরণের অপরিহার্যতা ও গুরুত্ববোধ থেকেই ইসলাম বায়তুল মাল হতে প্রত্যেক নাগরিকের ন্যূনতম মৌলিক চাহিদা মেটাবার জন্যে ব্যয় করার বিধান রয়েছে।

 

ইবনে হাযম তাঁর সুবিখ্যাত গ্রন্থ আল-মুহাল্লাতে বলেন- “প্রতি এলাকার ধনীরা তাদের নিজ নিজ এলাকায় বসবাসরাত অসহায় ও নিঃসম্বলদের মৌলিক চাহিদা পূরণে বাধ্য। যদি বায়তুল মালে মজুদ সম্পদ এজন্যে পর্যাপ্ত না হয় তাহলে দুঃস্থ ও দরিদ্রদের প্রয়োজন পূরণের জন্যে রাষ্ট্রপ্রধান বিত্তশালীদের উপর অতিরিক্ত কর আরোপ করে তা আদায়ে বাধ্য করতে পারেন।”

 

অন্ন বস্ত্র বাসস্থান ও স্বাস্থ্যের মতো অপরিহার্য মৌলিক মানবিক প্রয়োজন পূরণ না হলে একদিকে মানুষ যেমন অসুস্থ ও রুগ্ন হয়ে পড়বে তেমনি শিক্ষার অভাবে সে খাঁটি মানুষ হতে পারবে না। ইসলামে জ্ঞান অর্জন ফরয করা হয়েছে। নবী মুস্তফা (স) বদরের যুদ্ধে শিক্ষিত যুদ্ধবন্দীদের প্রত্যেকের মুক্তিপণ নির্ধারণ করেছিলেন মদীনার দশ জন বালক-বালিকাকে শিক্ষাদান করা। দীর্ঘ চৌদ্দশত বছর পরে আজ বিশ্ববাসীর কাছে গণশিক্ষার প্রয়োজন অনুভূত হচ্ছে। অথচ এই প্রয়োজন পূরণের জন্যে ইসলামে কত আগেই না তাগিদ দেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও চিকিৎসার জন্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ ও নির্দেশনা তো মাত্র হাল আমলের। পক্ষান্তরে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ ও পদ্ধতি নিয়ে রাসূলে করীম (স) গাইড লাইন দিয়ে গেছেন সেই কতকাল আগে। অজ্ঞতার জন্যে সেসব শিক্ষা হতে আমরা বঞ্চিত রয়েছি।

 

যে কোন সমাজে আপামর জনসাধারণের নূ্যনতম মানবিক প্রয়োজন পূরণ না হলে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিশৃংখলা অবচশ্যম্ভাবী। চুরি-ডাকাতি ব্যভিচার মাদকাসক্তি হতে শুরু করে এইডসের মতো ঘাত ব্যধি সমাজে ছড়িয়ে পড়বে মহামারীর মতো। লক্ষ লক্ষ বনি আদম ঠাঁই নেবে ফুটপাতে বস্তিতে। কিশোর অপরাধ হতে শুরু করে ছিনতাই, রাহাজানি, ধর্ষন, সন্ত্রাস, হত্যা প্রভৃতি সামাজিক অপরাধ ও নৈরাজ্যের সূতিকাগার এসব বস্তি। এসব সর্বনাশ হতে পরিত্রাণ পেতে হলে চাই মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের যথার্থ ব্যবস্থা। ইসলাম তার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে দিয়ে এই প্রয়োজন পূরণের নিশ্চয়তা বিধান করেছে। যাকাত ব্যবস্থার বাস্তবায়ন, বায়তুল মালের প্রতিষ্ঠা, ব্যক্তির সম্পদে সমাজের Have-nots-দের অধিকার স্বীকৃতি, সামাজিক কল্যাণ ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা এবং রাষ্ট্রের ন্যায়সঙ্গত হস্তক্ষেপ একযোগে এই গ্যারান্টিই দেয়।

 

. যুগপৎ দুনিয়া আখিরাতের কল্যাণ অর্জন

 

ইসলাম ব্যতীত অন্য কোন অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ইহকালীন কর্মকাণ্ডের জন্যে পরকালীন মুক্তি বা শাস্তির এমন দ্ব্যার্থহীন ‍ও দৃঢ় ঘোষণা দেওয়া হয়নি। বৌদ্ধ ধর্মে দুনিয়াকে জীর্ণ বস্ত্রের মতো ত্যাগের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, পক্ষান্তরে ইসলামে কর্মবীর হতে বলা হয়েছে। খৃষ্ট ধর্মে সকল পাপের ভারবহনকারী হবেন যীশু। পরকালে তিনিই হবেন পরম পরিত্রাতা। সুতরাং, তাঁর উপর বিশ্বাস ও দায়িত্ব অর্পণ করে দুনিয়ার সকল বৈধ-অবৈধ ভোগ-বিলাসে মত্তা হওয়ার যেমন বাধা নেই, তেমনি বাধ্য-বাধকতা নেই উপায়-উপার্জনের এবং সম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে হালাল-হারামের বিধি-বিধান মেনে চলার। হিন্দু ধর্মে কোন সুনির্দিষ্ট ও সুলিখিত অর্থনৈতিক আচরণ বিধিই নেই। খৃষ্টধর্ম পুঁজিবাদকে সাদরে বরণ করে নিয়েছে। ইহুদী হিন্দু বৌদ্ধ ধর্মের তো কথাই নই। রাব্বী আচার্য ও পুরোহিতরা যাই বলুক না কেন এসব ধর্মের সাধারণ অনুসারীরা পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে জীবন ব্যবস্থা বলে সাদরে গ্রহণ করেছে। অন্যান্য ধর্মের অবস্থাও অথৈবচঃ।

 

এরই বিপরীতে সম্পীর্ণ ভিন্ন ও ভারসাম্যপূর্ণ জীবনাদর্শ ইসলামে অর্থনৈতিক সুকৃতি বা হালাল কাজের জন্যে ইহকালীন কল্যাণের সুসংবাদের পাশাপাশি পরলৌকিক জীবনেও আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পুরস্কারের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। আল-কুরআনে ইরশাদ হয়েছে- “তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন কর এবং তিনি তোমাদেরকে যার উত্তরাধিকারী করেছেন তা থেকে ব্যয় কর। তোমাদের মধ্যে যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও ব্যয় করে তাদের জন্যে রয়েছে মহাপুরস্কার।” (সূরা আল-হাদীদ: ৭ আয়াত)

 

অপরদিকে যারা আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করবে, গরীব-দুঃখীদের উপকারে সচেষ্ট হবে না বরং হারাম কাজে অংশ নেবে তাদের জন্যে রয়েছে কঠিন শাস্তির সংবাদ। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন-

 

“অতি পীড়াদায়ক আযাবের সুসংবাদ দাও সেই লোকদের যারা স্বর্ণ-রৌপ্য পুঁজি করে রাখে এবং তা আল্লাহর পথে খরচ করে না।” (সূরা: আত-তাওবা: ৩৪ আয়াত)

 

মুমিন মুসলমান অদৃশ্য বা গায়েবে বিশ্বাস করে বলেই আখিরাতে বিশ্বাস তার ঈমানের অংগ। তাই ইসলামী জীবন বিধান তথা ইসলামী অর্থনীতিতে আখিরাতের কল্যাণ অর্জনের প্রতি এত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায়ের শেষে মুনাজাতেও বান্দাহ আল্লাহর কাছে ‍যুগপৎ দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণই প্রার্থনা করে। আখিরাত যে মুসলমানের জীবনে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তা অনুধাবনের জন্যে রাসূলে করীমের (স) একটি মাত্র উক্তিই যথেষ্ট। তিনি বলেন- এই দুনিয়া আখিরাতের জন্যে শস্যক্ষেতস্বরূপ। এর অন্তর্নিহিত অর্থই হচ্ছে এখানে যে যেমন বীজ বুনবে অর্থাৎ কাজ করবে আখিরাতে সে তেমন শস্য বা প্রতিফল পাবে। আখিরাতের শাস্তি ও পুরস্কার প্রাপ্তি সম্বন্ধে যার মনে এতটুকু ভয় ও আগ্রহ নেই তার দ্বারা ‍দুনিয়ার যেকোন অকল্যাণ ও অসমঙ্গল সম্ভব। অপরপক্ষে তার দ্বারা হালালকে অর্জন ও হারামকে বর্জন, সুনীতির প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতির উচ্ছেদ এবং আদল ও ইহসানের প্রতিষ্ঠা-কোনটাই সম্ভব নয়। প্রকৃতপক্ষে তাযকিয়া অর্জন ও তাকওয়ার মানসিকতা সৃষ্টি হলে এবং আখিরাতকে মনে-প্রাণে বিশ্বাস করে নিলে ইহকালের জীবনধারা খোদায়ী বিধান অনুসারে পরিচালিত হতে বাধ্য এবং এই পথেই যুগপৎ দুনিয়া ও আখিরাতর কল্যাণ অর্জন সম্ভব।

 

 

ইসলামী অর্থনীতির রূপরখা

 

যখন নৈতিকতা বিবর্জিত এবং আদল ও ইহসানবিরোধী পুঁজিবাদ আপন বিষে জর্জরিত এবং মানবতাবিরোধী সমাজতন্ত্রের শব ভূতলশায়িত তখন স্বাভাবিকভাবেই বিশ্ব মানবের মনে প্রশ্ন জেগেছে- এখন বিকল্প কি? এই প্রশ্নের জবাব বহু শত বছর পূর্বেই মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর প্রেরিত ঐশীগ্রন্থ আল-কুরআনের মাধ্যমেই মানবমণ্ডলীকে জানিয়ে দিয়েছেন। অনাদরে অবহেলায় সাময়িক লঅভের বা মোহের তাড়নায় বা বিবেককে চোখ রাঙানোর ফলে দিকনির্দেশনার সেই মহান গ্রন্থ আল-কুরআনের শিক্ষাকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে। এই অপচেষ্টায় বরাবর ইন্ধুন যুগিয়েছে সব ধরনের খোদাদ্রোহী শক্তি। কিন্তু সত্যসন্ধানী মানুষ তার দৈনন্দিন জীবনদারাকে সচল ও অর্থবহ করে তোলার জন্যে পুনরায় আল-কুরআনের দিকেই ফিরে আসছে। আহ সময়ের দাবীই হচ্ছে মানবতার শাশ্বত মুক্তির পয়গাম ইসলামের আলোকে গোটা সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা পরিচালনা। ইসলামী অর্থনীতি এরই একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য দিক। বক্ষ্যমান আলোচনায় এই অর্থনীতির রূপরেখা তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। বলা বাহুল্য, এই অর্থনীতি রাসূলে করীমের (স) মদীনার জীবন হতে শুরু করে আব্বাসীয় খিলাফত পরবর্তী যুগেও বিশ্বের এক বিশাল ভূখণ্ডে সাফল্যের সঙ্গে কার্যকর ছিল।

 

ইসলামী অর্থনীতির দার্শনিক ভিত্তি হলো তাওহীদ, রিসালাত ও আখিরাত। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর একত্ব ও প্রভুত্ব স্বীকার করে না নেওয়া পর্যন্ত অ্থাৎ, খোদাভীতি সৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত কোন কর্মকাণ্ডেই- সে অর্থনৈতিক হোক বা সামাজিক হোক—সততা ও সৃংখলা আসতে পারে না। অনুরূপভাবে দুনিয়ার এই জীবনে চলার জন্যে পথ প্রদর্শক হিসেবে তিনি যে নবী-রাসূলদের প্রেরণ করেছেন তাঁদের অনুসরণ ও ইহকাল পরবর্তী জীবন অর্থাৎ আখিরাতে ইহজীবনের সকল কর্মকাণ্ডের জন্যে জবাবদিহি করতে হবে এবং সেই অনুযায়ী পুরস্কার বা শাস্তি প্রাপ্য হবে এবং এই বোধ-বিশ্বাস না হওয়া পর্যন্ত কোনভাবেই আমরা মুসলমান বিবেচ্য হতে পারি না। মানুষের মনগড়া মতবাদ যে মানুষের কল্যাণের পরিবর্তে বিপুল অকল্যাণ ডেকে এনেছে, মানবতাকে ধ্বংসেরমুখে ঠেলে দিয়েছে তা প্রমাণের জন্যে ইতিহাসের পাতা ওল্টাবার দরকার নেই। সমকালীন সময়ই এর সেরা সাক্ষী।

 

ইসলামী অর্থনীতির বারটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। নীচে সংক্ষেপে সেগুলো সম্পর্কে আলোচনা করা হলো। কোন অর্থনীতি ইসলামী অর্থনীতি হিসেবে বিবেচিতহতে হলে সেই অর্থনীতিতে এই বৈশিষ্ট্যগুলো থাকা অপরিহার্য। এই বৈশিষ্ট্যসমূহের সমষ্টিই ইসরামী অর্থনীতরি রূপরেখা।

 

. হালাল উপায়ে উপার্জন হালাল পথেই ব্যয়

 

ইসলামী বিধানে ব্যবহারিক জীবনে কিছু কাজকে হালাল বা বৈধ এবং কিছু কাজকে হারাম বা অবৈধ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। উপার্জন, ভোগ, বন্টন, উৎপাদন প্রভৃতি সকল ক্ষেত্রেই ঐ বিধান প্রযোজ্য। ইসলামী বিধান অনুযায়ী যে কেউই স্বাধীন ও অবাধ প্রচেষ্টার মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করতে পারে। যে সমস্ত বিষয় শরীয়াহর দৃষ্টিতে হালাল বা বৈধ সেসবের উৎপাদন ভোগ বন্টন ও সেসব উপায়ে উপার্জনের পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। ইসলামী জীবনাদর্শের অন্যতম চালিকা শক্তি হলো আমর বিল মারুফ বা সৎকাজে আদেশ অর্থাৎ, সুনীতির প্রতিষ্ঠা এবং নেহী আনিল মুনকারবা অসৎ কাজে নিষেধ অর্থাৎ দুর্নীতির উচ্ছেদ। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আল কুরআনে ঘোষণা করেছেন-

 

“তারা (মুমিন মুসলমান) এমন ভাল লোক যে যদি আমি (আল্লাহ) তাদেরকে দুনিয়াতে ক্ষমতা দান করি তবে তার নামায কায়েম করে, যাকাত আদায় করে, সৎকাজ করতে নির্দেশ দেয় এবং অসৎ কাজ হতে লোকদের ফিরিয়ে রাখে।” (সূরা আল-হজ্জ্ব: ৪১ আয়াত)

 

আল-কুরআনের অন্যত্র বলা হয়েছে- “মুমিন নর-নারী পরস্পর পরস্পরের বন্ধুন। তারা ভাল কাজের উপদেশ দেয এবং মন্দ কাজ করতে নিষেধ করে।” (সূরা আত্‌-তাওবা: ৭১ আয়াত)

 

হালাল বা বৈধ পদ্ধতিতে যে কেউ অর্থ উপার্জনের পূর্ণ স্বাধীনতা রাখে। এজন্যে সে নিজের পছন্দসই যে কোন উপায় ও পথ অবলম্বন করতে পারে। এর সাহায্যে যে কোন পরিমাণ অর্থও রোজগার করতে পারে। কিন্তু হারাম উপায় ও পদ্ধতিতে একটি পয়সাও উপার্জন করার অধিকার ইসলাম স্বীকার করেনি। ইসলামী অর্থনীতিতে সে সুযোগ কারো জন্যেই উন্মুক্ত থাকে না। যেসব সামগ্রীর ভোগ নিষিদ্ধ সেসবের উৎপাদন বিপণন ও বাণিজ্যও নিষিদ্ধ।সুদ যেমন নিষিদ্ধ মদ জুয়াও তেমনি নিষিদ্ধ। অনুরূপভাবে অনৈসলামী পদ্ধতিতে ব্যবসা-বাণিজ্যও নিষিদ্ধ। দুর্ভাগ্যের বিষয়, বর্তমান যুগে ইসলাম বহির্ভূত সকল মতাদর্শ বা ইজমাভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় উপার্জন ভোগ বন্টন উৎপাদন বিনিয়োগ প্রভৃতি কোন ক্ষেত্রেই বৈধ বিচার বা হালাল-হারামের পার্থক্য নেই। সেখানে সরকারের অনুমোদন সাপেক্ষে অর্থাৎ লাইসেন্স করে নিলে বা উপযুক্ত ট্যাক্স দিলে সব ধরনের উপার্জনের পন্থাই বৈধ। সরকারকে ধার্যকৃত নির্ধারিত কর ফি শুল্ক ইত্যাদি প্রদান সাপেক্ষে যে কোন পরিমাণ আয়ই বৈধ গণ্য হওয়ার সুযোগ রয়েছে।

 

পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে উৎপাদন ভোগ বন্টন উপার্জন বিনিয়োগ প্রভৃতি ক্ষেত্রে কোন শেষ সীমা বা নীত-নৈতিকতার প্রশ্ন নেই। ভোগবাদী এই ব্যবস্থায় যেসব পন্থায় উৎপাদন বা যেসব অর্থনৈতিক কার্যক্রম সমাজের জন্যে ক্ষতিকর বা শ্রেণী বৈষম্য সৃষ্টিকারী এবং যেসব পন্থায় ভোগ সমাজের জন্যে বিপর্যয় সৃষ্টিকারী সেসবও সমাজ ও অর্থনীতিতে অপ্রতিহতভাবে চলতে পারে। সমাজতন্ত্রেও অবস্থা প্রায় একই রকম ছিল। তফাৎ এই যে, সেখানে উপার্জন ও ভোগের স্বাধীনতা বিনিয়োগ ও বন্টনের দায়িত্ব রাষ্ট্র দ্বারা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত ছিল। এখন অবশ্য সেই অবস্থা আর নেই। পুঁজিবাদের বিলাসী জীবন ও ইন্দ্রিয় আসক্তির মোহের জোয়ারে সমাজতন্ত্র ভেসে গেছে। ইসলাম এই দুই ধরনের নীতির কোনটিই সমর্থন করে না। বরং ইসলামের দাবীই হলো অর্থনৈতিক সকল কর্মকাণ্ডে শরীয়াহর বিধান মান্য করা। যা বৈধ ও যে পরিমাণ বৈধ তা সকলের জন্যেই সমভাবে বৈধ। অনুরূপভাবে যা হারাম বা নিষিদ্ধ তা সকলের জন্যেই সমভাবে নিষিদ্ধ।

 

অবৈধ বা হারাম উপায়ে উপার্জন, বন্টন, বিনিয়োগ প্রভৃতি অর্থনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধের কারণ প্রধানতঃ ‍তিনটি। প্রথমতঃ অবৈধ উপায়ে আয়ের উদ্দেশ্যে জনগণের উপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুলুম চালানো হয়। দ্বিতীয়তঃ চারিত্রিক নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী ও সমাজবিধ্বংসী কার্যক্রমসমূহ এসব অবৈধ বা হারাম অর্থনৈতিক কার্যক্রমের ফসল। এবং তৃতীয়তঃ অবৈধ উপায়ে অর্জিত ধন সম্পদ সাধারণতঃ অবৈধ কাজেই ব্যয় হয়। অবৈধ কাজে ব্যয়ের অর্থই হচ্ছে সামাজিক অনাচার ও অত্যাচারের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়া।

 

. ধন-সম্পদের ইনসাফভিত্তিক বন্টন

 

আয় ও সম্পদের সুষ্ঠু বন্টনের উপরেই নির্ভর করে একটি জাতির বা দেশের সমৃদ্ধি ও উন্নতি। দেমের জনসাধারণের কর্মসংস্থান, উৎপাদন বৃদ্ধি, বিনিয়োগের সুযোগ এবঙ সেই সাথে কারো হাতে যেন সম্পদ পুঞ্জীভূত হতে না পারে তা নির্ভর করে সমাজে বিদ্যমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উপর। বস্তুতঃ সমাজে কি ধরনের অর্থনীতি বা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু রয়েছে তার উপরই নির্ভর করে আয় ও সম্পদ বন্টন সুষ্ঠু হবে, না বৈষম্যপূর্ণ হবে। ইসলামী অর্থনীতিতে সমাজে আয় ও ধনবন্টন কিভাবে হবে তার মূলনীতিগুলো কুরআন ও সুন্নাহতে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। ইসলামী আকিদা মুতাবিক সমস্ত সম্পদের মালিকানা আল্লাহরই। তিনিই এর স্রষ্টা। মানুষকে সীমিত সময়ের জন্যে তিনি এর শর্তাধীন মালিক করে দিয়েছেন। এখানে স্বেচ্ছাচারিতামূলক আয় ও ভোগের যেমন সুযোগ নেই তেমনি ইচ্ছামতো ব্যয়েরও সুযোগ নেই। এই মূল দৃষ্টিভংগীর প্রেক্ষিতেই কুরআন ও হাদীসের সম্পদ উপার্জন, ব্যবহার ও বন্টনের ক্ষেত্রে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ এসেছে। সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ কয়েকটি এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে।

 

“হে ঈমানদারগণ! তোমরা একে অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না। কিন্তু ব্যবসা-বাণিজ্য যদি পরস্পরের সম্মতিক্রমে হয় তবে আপত্তি নেই।” (সূরা আন্‌ নিসা: ২৯ আয়াত)

 

“সম্পদ যেন কেবল তোমাদের ধনীদের মধ্যে আবর্তিত না হয়।” (সূরা আল-হাশর: ৭ আয়াত)

 

“নিশ্চয়ই অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই।” (সূরা বনি ইসরাঈল: ২৭ আয়াত)

 

“তাদের (সম্পদশালীদের) ধন-সম্পদে হক রয়েছে যাঞ্চাকারী ও বঞ্চিতদের।” (সূরা আল-যারিয়াত: ১৯ আয়াত)

 

সুতরাং, ধন-সম্পদ বন্টনের ক্ষেত্রে ইসলামী নীতিমালার আলোকেই উপযুক্ত কর্মপদ্ধতি ও পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। তবেই একাধারে অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য এবং বেইনসাফী হতে জনগণ রক্ষা পাবে।

 

. যাকাত উশর ব্যবস্থার বাস্তবায়ন

 

যাকাত আদায় ও তার যথোচিত ব্যবহার সমাজে আয় ও সম্পদের সুবিচারপূর্ণ বন্টনের ক্ষেত্রে একটি বলিষ্ঠ ও গুরুত্বপূর্ন হাতিয়ার। যাকাতের মাধ্যমে সম্পদের একটি সুনির্দিষ্ট অংশ এমন কয়েকটি নির্দিষ্ট খাতে বন্টিত ও ব্যবহৃত হয় যাদের প্রকৃতই বিত্তহীন শ্রেণীভুক্ত গণ্য করা হয়। এদের মধ্যে রয়েছে গরীব মিসকিন ঋণগ্রস্ত মুসাফির ক্রীতদাস এবং ক্ষেত্রবিশেষে নও মুসলিম। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্র, মুষ্টিমেয় ব্যতিক্রম বাদে মুসলিম বিশ্বে আজ রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে বাধ্যতামূলকবাবে যাকাত আদায় এবং তা বিলিবন্টনের ব্যবস্থা নেই। যাকাত আদায় এখন ব্যক্তিগত ইচ্ছা বা মর্জির উপর নির্ভরশীল হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ খুলাফায়ে রাশিদূন (রা) ও তা৭দের পরবর্তী যুগেও বায়তুল মালের যাকাত অংশ পরিচালনার জন্যে আটটা দপ্তর ছিল। রাষ্ট্রের কঠোর ও নিপুণ ব্যবস্থা ছিল যথাযথভাবে যাকাত আদায় ও তা উপযুক্তভাবে বন্টনের জন্যে। রাসূলে করীমের (স) মৃত্যুর পর বিরাজমান দুঃসময়ে মিথ্যা বনী দাবীকারীদের বিদ্রোহীদের মুখেও ইসলামের প্রথম খলীফা হযরত আবু বকর (রা) দৃঢ়কণ্ঢে ঘোষণা করেছিলেন- “যদি কারও কাছে উট বাধার রশি পরিমাণ যাকাত প্রাপ্য হয় আর সে তা দিতে অস্বীকার করে, তাহলে তার বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করছি।” এই ঘোষণার সুফল পাওয়া গিয়েছিল কয়েক বছরের মধ্যেই। গোটা জাযিরাতুল আরবে যাকাত নেওয়ার লোক খুঁজে পাওয়া যেত না। এর অন্তর্নিহিত অর্থই হলো সেদিনের আরবে সর্বহারা শ্রেণীর বিলুপ্তি ঘটেছিল।

 

উশরের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। উশর আদায়ের মাধ্যমে কৃষি ক্ষেত্রে ধনী-দরিদ্রের পার্থক্য যেমন হ্রাস পায় গ্রামীন জীবনে ক্ষুধা ও দারিদ্রের মাত্রাও হ্রাস পায়। এই ব্যবস্থায় কৃষি পণ্যের আয়ের সুষ্ঠু বন্টন নিশ্চিত হয়। এই পদ্ধতি এজন্যেই আরও উত্তম যে, নিসাব পরিমাণ ফসল না হলে উশর আদায় করতে হয় না। আজকের খাজনা ব্যবস্থায় বড় চাষীদের বিপুল বিত্তের মালিক হওয়ার অবাধ সুযোগ বিদ্যমান। কারণ তাদের প্রদেয় খাজনা ও উৎপন্নের সঙ্গে ব্যবধান রয়েছে দুস্তর। পক্ষান্তরে উশর আদায় পদ্ধতিতে প্রান্তিক চাষী, ক্ষুদে চাষী এমনকি বর্গচাষীরাও রেহাই পায় সঙ্গতঃ কারণেই। এর ফলে সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠাই নিশ্চিত হয়।

 

. বায়তুল মালের প্রতিষ্ঠা

 

বিভিন্ন উৎস হতে অর্জিত ও রাষ্ট্রের কোষাগারে জমাকৃত অর্থ-সম্পদই বায়তুল মাল হিসাবে অভিহিত হয়ে থাকে। ইসলামী রাষ্ট্রের সকল নাগরিকেরই এতে সম্মিলিত মালিকানা স্বীকৃত। অর্থাগমের উৎস ও ব্যবহার বিধির বিচারে প্রচলিত রাষ্ট্রীয় কোষাগার বা রাজকীয় ধনাগারের সাথে এর মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। ইসলামী রাষ্ট্রের বায়তুল মালের অর্থ সম্পদের উপর ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-ভাষা-লিঙ্গ-এলাকা নির্বিশেষে আপামর জনসাধারণের প্রত্যেকেরই অধিকার রয়েছে। রাষ্ট্রের সীমার মধ্যে কোন ব্যক্তি যেন তার মৌলিক মানবিক প্রয়োজন পূরণ হতে বঞ্চিত না হয় সেজন্যে বায়তুল মালহতেই পদক্ষেপ গৃহীত হয়ে থাকে। রাসূলে করীম (স) মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সাথে সাথে বায়তুল মালেরও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। খুলাফায়ে রাশিদূন (রা) একে আরও সুসংহত করেছিলেন।

 

বায়তুল মালের অর্থ যেসব ক্ষেত্রে ব্যয়ের জন্যে নির্দেশ রয়েছে সেগুলো হলো;

 

১. সরকারী কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন;

 

২. বন্দী ও কয়েদীদের ভরণ-পোষণ;

 

৩. ইয়াতীম ও লা-ওয়ারিশ শিশুদের প্রতিপালন;

 

৪. অমুসলিমদের আর্থিক নিরাপত্তা বিধান;

 

৫. জনগণের মৌলিক মানবিক প্রয়োজন পূরণ;

 

৬. করযে হাসানা প্রদান; এবং

 

৭. দারিদ্র বিমোচন ও সমাজকল্যাণ।

 

বায়তুল মালহতে কোনক্রমেই অর্থ-সম্পদ ব্যক্তি বা শাসকের ভোগ-বিলাসের জন্যে ব্যয় করার বিধান নেই। অথচ আজ একদিকে বনি আদম ক্ষুৎপিপাসায়, বিনা চিকিৎসায়, শীতে ধুঁকে ধুঁকে মারা যাচ্ছে, অন্য দিকে উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মকর্তারা জনগণের দেওয়া টাকায় ভোগ-বিলাসে যা ভাসিয়ে দিয়েছে। ইসলামী অর্থনীতি এর প্রতিরোধ করতে এগিয়ে এসেছে। খলীফা হযরত উমার (রা), তাঁর গভর্নরদের নির্দেশ দিয়েছিলেন কলমের নিব সরু করে নিতে আর কাগজের মার্জিনেও লিখতে। উদ্দেশ্য ছিল সরকারী অর্থের ব্যবহারে মিতব্যয়ী হওয়া। অথচ আজ সরকারী অর্থ তছরূপের পাশাপাশি অপচয় ও অপব্যয়ের প্রতিযোগিতা চলেছে। এর প্রতিবিধানকল্পে আক্ষরিক অর্থেই বায়তুল মালের প্রতিষ্ঠা একান্ত প্রয়োজন। একই সঙ্গে জনগণের তহবিল ব্যবহারের ক্ষেত্রে জবাবদিহিতার প্রসঙ্গ অবশ্যই বাধ্যতামূলক হতে হবে যেমন ছিল খুলাফায়ে রাশেদার (রা) যুগে।

 

. ইসলামী ফাইন্যান্সিয়াল প্রতিষ্ঠান স্থাপন

 

আজকের অর্থনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ব্যাংক ও বীমা ব্যবস্থা। বিশেষ করে ব্যাংকিক ব্যবস্থার মাধ্যমে অর্থনৈতিক কার্যক্রমের বিরাট একটা অংশ সম্পন্ন হচ্ছে। এই ব্যাংক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে দুশ বছরের বেশী সময় ধরে এবং সুদই হচ্ছে এর প্রধান চালিকা শক্তি। সুদ সমাজ শোষণের নীরব অথচ বলিষ্ঠ হাতিয়ার। সুদের মারাত্মক যেসব অর্থনৈতিক কুফল ইতিমধ্যেই ইসলামী অর্থনীতিবিদগণ চিহ্নিত করেছেন সেসব রীতিমত ভীতিপ্রদ। এসবের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে:

 

১. সুদের কারণে দ্রব্যমূল্য ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকে;

 

২. সামাজিক শোষণ বিস্তৃত, ব্যাপক ও অব্যাহত থাকে;

 

৩. ধনী-গরীবের বৈষম্য ক্রমাগত বৃদ্ধি পায়;

 

৪. মুষ্টিমেয় লোকের হাতে সম্পদ পূঞ্জীভূত হয়;

 

৫. সম্পন্ন ও সচ্ছল কৃষকেরা সুদভিত্তিক ঋণ গ্রহণ করে পরিণামে ভূমিহীন কৃষকে রূপান্তরিত হয়;

 

৬. একচেটিয়া কারবারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পায়, ক্ষুদে ব্যবসায়ীরা দুর্বল ও পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে;

 

৭. সুদের হার কখনও স্থির থাকে না, ক্রমেই এইহার বেড়ে যায়, ফলে শোষণের মাত্রাও বাড়ে;

 

৮. ব্যবসায় চক্র (Business Cycle) সুদেরই সৃষ্টি যার ফলে ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতা ও সুস্থ বাজার ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যায়;

 

৯. সমাজে বিলাসপ্রিয়, অকর্মণ্য ও ভোগী লোকের সৃষ্টি হয়;

 

১০. কর্মসংস্থান ক্রমাগত সংকুচিত হয়, সুলভে মূলধন না পাওয়ার বিনিয়োগ ও কর্মোদ্যোগে ভাটা পড়ে;

 

১১. মজুদ বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও সুদ অন্যতম প্রতিবন্ধক;

 

১২. সুদী ব্যাংক ব্যবস্থার মাধ্যমে শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের খেলাপী ঋণের বিপুল বোঝা শেষ অবধি জনসাধারণের কাঁধেই চাপে;

 

১৩. জনসাধারণের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পেতে থাকে;

 

‘৪. বৈদেশিক ঋণের বোঝা বৃদ্ধি পায় সুদের কারণেই;

 

১৫. অর্থনীতিতে অস্থিতিশীলতার অন্যতম মুখ্য কারণ সুদ; এবং

 

১৬. অর্থনীতির কল্যাণকর খাতে বিনিয়োগের অন্যতম প্রতিবন্ধকও সুদ।

 

এসব কারণেই রাসূলে করীম (স) মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর হতেই সুদ উচ্ছেদের জন্যে জিহাদ করে গেছেন। বর্তমান সময়ে সুদ উচ্ছেদ করতে হলে অন্যতম প্রধান কাজ হবে ইসলামী ব্যাংক ও ফাইন্যান্সিং ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। আলহামদুলিল্লাহ। বিগত ত্রিশ বছরেরও বেশী সময় ধরে পৃথিবীর প্রায় সব মুসলিম দেশে তো বটেই, এমনকি অমুসলিম দেশেও ইসলামী পদ্ধতির ব্যাংক ও বিনিয়োগ ব্যবস্থা সফলতার সাথে চালূ হয়েছে। সুদভিত্তিক ব্যাংকগুলোর বিপরীতে এই ব্যাংক ও ফাইন্যান্সিং ব্যবস্থা অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক কার্যক্রমে প্রতিযোগিতামূলকভাবে কাজ করে চলেছে। ইসলামী পদ্ধতির ব্যাংক প্রতিষ্ঠা ব্যতিরেকে ইসলামী অর্থনীতি বাস্তবায়ন করা অসম্ভব। তাই ইসরামী অর্থনীতি চালু করতে হলে ইসলামী ব্যাংক ও ফাইন্যান্সিং ব্যবস্থা বাস্তবায়ন একেবারে অপরিহার্য কর্মসূচীর পর্যায়ে পড়ে। ব্যবসা ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে শরীয়াহর আলোকে হালাল-হারামের পার্থক্য অনুসরণ, অংশীদারীত্বমূলক অংশগ্রহণ, শরীয়াহ বোর্ড দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়া, যাকাত আদায় করা, লাভ-ক্ষতির অংশীদারীত্বের শর্তে বিনিয়োগ কার্যক্রম পরিচালনা করা এই ব্যাংক ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যসমূহের অন্যতম।

 

বীমার ক্ষেত্রেও ইসলামী পদ্ধতি উদ্ভাবিত হয়েছে। কারণ ইসলামী অর্থনীতি বাস্তবায়ন করতে হলে অতি অবশ্যই ইসলামী পদ্ধতির বীমা ব্যবস্থা চালু করতে হবে। মানুষ তার ব্যবসায়ের, নিজের জীবনের ও পণ্যের নিরাপত্তা চায়। নিরাপত্তার এই প্রয়োজনকে কেনদ্র করে গড়ে উঠেছে সুদভিত্তিক বীমা ব্যবস্থা। এই অবস্থার অবসানকল্পে গড়ে উঠেছে শরীয়াহসম্মত ইসলামী বীমা বাতাকাফুল কোম্পানী।

 

. করযে হাসানা মুদারিবাতের প্রবর্তন

 

ইসলাম প্রবর্তিত বৈপ্লবিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাসমূহের মধ্যে করযে হাসানা ও মুদারিবাত অন্যতম। বৈশিষ্ট্য ও কার্যকারিতার দিক থেকে এ ছিল সমকালীন অর্থনীতিতে এক বলিষ্ঠ ও ভিন্নতর পদক্ষেপ। পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে লগ্নী কারবার বা ঋণভিত্তিক ব্যবসায়ে যত শোষণ ও যুলুমের অবকাশ রয়েছে তা দূর করার মানসেই করযে হাসানা ও মুদারিবাতের প্রবর্তন ইসলামী অর্থনীতির এক বৈপ্লবিক ও বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। রাসূলে করীমের (স) মদীনার জীবন হতে শুরু করে আব্বাসীয় খিলাফতের পরেও সুদীর্ঘ তিনশত বছরের বেশী এ দুটি বিষয় ইসলামী সমাজে যথাযথ চালু ছিল বলেই সুদ এই অর্থনীতির ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে পারেনি। এখনও সুষ্ঠুভাবে এই ব্যবস্থার প্রবর্তন করতে পারলে সুদ সমাজ হতে বিদায় নিতে বাধ্য।

 

ব্যক্তিগত প্রয়োজন ছাড়াও ব্যবসায়িক বিনিয়োগ, কৃষিকাজের জন্যে সমাজের সম্পদশালী ব্যক্তিদের নিকট হতে করযে হাসানা নেবার প্রথা চালু হয় ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার শুরু হতে। এজন্যে সমাজে বিত্তশালী ব্যক্তিগণ মন-মানসিকতার দিক থেকে প্রস্তুত ছিলেন। এছাড়া বায়তুল মাল হতেও করযে হাসানা দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল। এক্ষেত্রে স্ত্রী-পুরুষের মধ্যে কোন পার্তক্য বা পক্ষপাতিত্ব করা হতো না। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আল-কুরআনে বলেন-

 

“কে সেই লোক যে আল্লাহ তায়ালাকে করযে হাসানা দিতে প্রস্তুত আছে? কেউ যদি দেয় তবে আল্লাহ তা বহুগুণ বৃদ্ধি করে দেবেন।” (সূরা আল-বাক্বারাহ: ২৪৫ আয়াত)

 

মুদারিবাত বা অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ব্যবসা ও উৎপাদন পরিচালনা ইসলামী অর্থনীতির এক অনন্য অবদান। মুদারিবাতের গুরুত্ব এজন্যে যে, এই পদ্ধতিতে ব্রবসায় বা উৎপাদন প্রতিষ্ঠান হতে যে মুনাফা অর্জিত হয় তা পূর্ব নির্ধারিত অংশ বা হার অনুযায়ী উভয়ের মধ্যে ভাগ হবে। কিন্তু মুনাফা না হলে কেউ কিছু পাবে না। যদি কোন কারণে লোকসান হয় তাহলে তা বহন করবে সাহিব আল-মাল বা মূলধন বিনেোগকারী। অংশীদারীত্বের ভিত্তিতে যদি ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণ করা যায়, কল-কারখানা গড়ে ওঠে তাহলে মূলধনের সংকট হ্রাস পাবে। ফলে সুদী ব্যাংক ও পুঁজিপতির অত্যাচার হতেও রেহাই পাওয়া যাবে। সম্প্রতিককালে মুসলিম, এমন কি অমুসলিম দেশে পর্যন্ত ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং হচ্ছে মূলতঃ এই প্রয়োজন পূরণের তাগিদেই। তবুও ব্যাংক ব্যবস্থার বাইরে সাধারণভাবে করযে হাসানা ও মুদারিবাতের সুযোগ থাকা আবশ্যক।

 

. ইসলামী শ্রমনীতির প্রয়োগ

 

শ্রমিক ও মালিক পরস্পর ভাই ভাই—এই বিপ্লবাত্মক ঘোষণাই ইসলামী শ্রমনীতির মূল উপজীব্র। “দুনিয়ার মজদুর এক হও” –শোলাগনসর্বস্ব সমাজতন্ত্রের বাধ্যতামূলক শ্রমদান এখানে যেমন অনুপস্থিত, তেমনি পুঁজিবাদের কল-কারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য ও কৃষি জমির মালিকের অবমাননাকর শর্ত ও লাগামহীন শোষণও এখানে নেই। ইসলামী শ্রমনীতির মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে রয়েছে:

 

১. উদ্যোক্তা বা শিল্প মালিক শ্রমিককে নিজের ভাইয়ের মতো মনে করবে;

 

২. মৌলিক মানবিক প্রয়োজনের ক্ষেত্রে শ্রমিকক ও মালিক উভয়ের মান সমান হবে;

 

৩. কাজে নিযুক্তির পূর্বে শ্রমিকের সাথে যথারীতি চুক্তি হবে এবং তা যথাসময়ে পালিত হবে;

 

৪. শ্রমিকের অসাধ্য কাজ তার উপর চাপানো যাবে না;

 

৫. শ্রমিকদের স্বাস্থ্য, শক্তি ও সজীবতা বজায় রাখার জন্যে ন্যূনতম প্রয়োজনীয় ব্যয়ের নীচে মজুরী নির্ধারিত হবে না;

 

৬. উৎপন্ন দ্রব্রের অংশবিশেষ অথবা লভ্যাংশের নির্দিষ্ট অংশ শ্রমিকদের দিতে হবে;

 

৭. পেশা বা কাজ নির্বাচন ও মজুরীর পরিমাণ বা হার নির্ধারণ সম্পর্কে দর-দস্তুর করার পূর্ণ স্বাধীনতা শ্রমিকের থাকবে;

 

৮. অনিবার্য কারণ বা নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত ঘটনার প্রেক্ষিতে কাজে কোন ত্রুটি-বিচ্যুতি ঘটলে শ্রমিকের উপর নির্যাতনমূলক আচরণ করা চলবে না;

 

৯. মালিকপক্ষ দুর্ঘটনা ও ক্ষয়-ক্ষতি িএড়ানোর সব ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করবে;

 

১০. দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থাসহ উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে;

 

১১. অক্ষম ও বৃদ্ধ হয়ে পড়লে তাদের জন্যে উপযুক্ত ভাতার ব্যবস্থা করতে হবে;

 

১২. পেশা পরিবর্তনেরঅধিকার শ্রমিকের থাকবে;

 

১৩. পরিবার গঠনেরও অধিকার তার থাকবে;

 

১৪. স্বাধীনতভাবে ধর্মীয় অনুশাসন পালনের অধিকার থাকবে;

 

১৫. শ্রমিকের স্থানান্তরে গমনের অধিকার থাকবে; এবং

 

১৬. শ্রমিকের স্বাস্থ্য সংরক্ষণ ও চিকিৎসার উপযুক্ত সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।

 

এই নীতিমালার আলোকে দ্বিধাহীন চিত্তে বলা যেতে পারে যে, ইসরামী অর্থনীতিতে মজুরের যে মর্যাদা ও অধিকার স্বীকৃত হয়েছে এবং শ্রমিক ও মালিকের মধ্যে যে প্রীতির সম্পর্ক সৃষ্টির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তাতে শ্রমিক-মালিক দ্বন্দ্ব ও সংঘাত সৃষ্টির কোন অবকাশই থাকে না। দুইয়ের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও আন্তরিকতাপূর্ণ সহযোগিতার ফলে শিল্পের ক্রমাগত উন্নতি ও শ্রীবৃদ্ধি হওয়াই স্বাভাবিক। অন্য কোন অর্থনীতিতে এই ধরনের নীতিমালা অনুসরণ তো দূরের কথা, এই জাতীয় নীতিমালা প্রণয়নের বা গ্রহণেরই প্রশ্ন ওঠে না। ইসলামী অর্থনীতির সাথে এখানেই অন্যান্য অর্থনীতির মৌলিক তফাৎ।

 

. ইসলামী ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থার বাস্তবায়ন

 

দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে নানা ধরনের ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থা চালু রয়েছে। ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের পূর্বে ভূমির মালিকানা মুষ্টিমেয় কয়েকটি পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কৃষি বিপ্লবের ফলে জমির উৎপাদন যখন বৃদ্ধি পায় তখন বহু বড় শিল্পপতি হাজার হাজার একর জমি সস্তায় কিনে একই সঙ্গে ভূস্বামী হয়ে বসে। নব্য জমিদাররা বহু ক্ষেত্রেই শক্তির দ্বারা চাষীদের জমি থেকে উচ্ছেদ করে। কৃষি কাজে জমির পূর্ণ ব্যবহারে ক্রমশঃ ভাটা পড়ে বহু দেশেই। একই সঙ্গে ব্যারণ লর্ড মার্কুইস পীয়র মনসবদার জমিদার জায়গীরদার তালুকদার প্রভৃতি ভূস্বামীদের শোষণ বাড়তে থাকে।

 

এই অবস্থায় প্রতিক্রিয়াস্বরূপ সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জমির ব্যক্তি মালিকানা শুধু অস্বীকারই করা হয়নি, ব্যক্তিকে জমি থেকে বল প্রয়েঅগে উচ্ছেদ করা হয়েছে। সমস্ত জমি রাষ্ট্রের একচ্ছত্র মালিকানায় আনা হয়েছে। এজন্যে লক্ষ লক্ষ লোককে নির্বাচনে পাঠানো হয়েছে। বন্দী শিবিরবা কনসেনট্রেন ক্যাম্পে পাঠানো হয়েছে আরও বহু সহস্রকে। নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে হাজার হাজার ভূস্বামীকে। মালিকানা বঞ্চিত কৃষকদের রাষ্ট্রীয় ও যৌথখামারে জবরদস্তি করে কাজ করতে বাধ্য করা হয়েছে। বিনিময়ে তাদের ভরণ-পোষণের ন্যূনতম পারিশ্রমিকও জোটেনি।

 

এই উভয় প্রকার ভূমিস্বত্ব ব্যবস্থাই বঞ্চনামূলক ও স্বভাবরোধী। এই অবস্থা যেন আদৌ সৃষ্ট না হয় সেজন্যে ইসলাম তার অনন্য ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিস্বত্ব নীতি ঘোষণা করেছিল। আল-কুরআনে আল্লাহ্‌ ঘোষণা করেছেন-

 

“জমি আল্লাহ তায়ালার। তাঁর বান্দাহদের মধ্যে তিনি যাকে ইচ্ছা তার উত্তরাধিকারত্ব দান করে থাকেন।” (সূরা আল-আরাফ: ১২৮ আয়াত)

 

ইসলামী অর্থনীতিতে মাত্র এক প্রকার ভূমিস্বত্বই স্বীকৃত-রাষ্ট্রের সঙ্গে সরাসরি ভূমি মালিকের সম্পর্ক। কোন প্রকার মধ্যস্বত্বের অবকাশ ইসলামী অর্থনীতিতে নেই। সে কারণে শোষণও নেই। জমি পতিত রাখাকে ইসলাম সমর্থন করেনি। সে জমি রাষ্ট্রেরই হোক আর ব্যক্তিরই হোক। জমির মালিক যদি বৃদ্ধ পংগু অসুস্থ শিশু বা স্ত্রীলোক হয় অথবা নিজে চাষাবাদ করতে অনিচ্চুক বা অসমর্থ হয় তবে অন্যের দ্বারা জমি চাষ করা হবে। এ প্রসঙ্গে রাসূলে করীমের (স) নির্দেশ হচ্ছে-

 

“যার অতিরিক্ত জমি রয়েছে সে তা হয় নিজে চাষ করবে, অন্যথায় তার কোন ভাইয়ের দ্বারা চাষ করাবে অথবা তাকে চাষ করতে দেবে।” (ইবনে মাজাহ)

 

“যে লোক পোড়ো অনাবাদী জমি আবাদ ও চাষযোগ্য করে নেবে সে তার মালিক হবে।” (আবু দাউদ)

 

আজ কিছু দেশ প্রতি ইঞ্চি জমি চাষের আওতায় আনার জন্যে অপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার মত দেশে ফসলের দাম কমে যাবার ভয়ে হাজার হাজার একর জমি ইচ্ছাকৃতভাবে অনাবাদী ও পতিত রাখা হচ্ছে। এর প্রতিবিধানের জন্যেই ইচ্ছাকৃতভাবে অনাবাদী ও পতিত না রাখতে ইসলামে জোর তাগিদ দেওয়া হয়েছে। জমি চাষের জন্যে এতদূর হুকুম দেওয়া হয়েছে যে, ইচ্ছাকৃতভাবে কোন আবাদী জমি পর পর তিন বছর চাষ না করলে তা রাষ্ট্রের দখলে চলে যাবে। রাষ্ট্রই তা পুনরায় কৃষকদের মধ্যে বিলি-বন্টন করে দেবে। উন্নত কৃষি ব্যবস্থার মূখ্য শর্ত হিসেবেই উন্নত ভূমিস্বত্ব ও ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছে ইসলাম।

 

. উত্তরাধিকার বা মীরাসী আইনের পূর্ণ বাস্তবায়ন

 

মানবতার মুক্তিদূত মহানবী মুহাম্মাদ মুস্তাফার (স) আবির্ভাবের পূর্বে সারা বিশ্বে উত্তরাধিকার আইন ছিল অস্বাভাবিক। কোন কোন দর্মে পুরুষানুক্রমে পরিবারের জ্যেষ্ঠ পুত্রই সমস্ত সম্পত্তির উত্তরাধিকারিত্ব লাভ করতো। বঞ্চিত হতো পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা। হিন্দু ধর্মে চালু ছিল যৌথ পরিবার প্রথা। এই প্রথা দুটির মূর বক্তব্য হচ্ছে সম্পত্তি গোটা পরিবারের হাতেই থাকবে। সম্পত্তি যেন বিভক্ত না হয় তার প্রতি তীক্ষ্ণ নজর ছিল হিন্দু, খৃষ্টান ও ইহুদী ধর্মের। কেননা সম্পত্তি বাঁটোয়ারা হয়ে গেলে পুঁজি পুঞ্জীভূত হয়ে উঠবে না বিশেষ একটি শ্রেণীর হাতে যারা অর্থ বলেই সমাজের প্রভুত্ব লাভে সমর্থ হবে। এরাই বিপুল ক্ষমতার অধিকারী হয়ে অত্যাচার, অবিচার, অনাচার ও নানা ধরনের সমাজবিধ্বংসী কাজে লিপ্ত হয়।

 

এরই প্রতিবিধানের জন্যে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন স্বয়ং আল্‌-কুরআনে সম্পত্তির উত্তরাধিকারের আইন ও নীতিমালা ঘোষণা করেছেন (দ্রষ্টব্য: সূরা আন্‌-নিসা ১১-১২ আয়াত)। দুর্ভাগ্যের বিষয়, মুসলিম বিশ্বের অধিকাংশ দেশে এই আইন যথাযথ প্রতিপালিত হচ্ছে না। ছলে-বলে-কৌশলে ন্যায্য প্রাপ্য সম্পত্তি হতে বঞ্চিত করা হচ্ছে ইয়াতীমদের, বিধবা ভ্রাতৃবধুদের, ভাগ্নে-ভাগ্নীদের, বোনদের, খালা-ফুফুদের। ফলে মুষ্টিমেয় লোকের হাতে সম্পত্তি পুঞ্জীভূত হয়ে চলেছে। এর প্রতিবিধান না হওয়া পর্যন্ত সমাজে যুলুম ও বঞ্চনা চলতেই থাকবে। অর্থনৈতিক অধিকার ও স্বাধীনতা হতে বঞ্চিত হয়ে রইবে হাজার হাজার বনি আদম। এই অবস্থা নিরসনের জন্যে ইসলামী মীরাসী আইনের পূর্ণ বাস্তবায়ন হওয়া বাঞ্ছনীয় তার সঠিক প্রেক্ষিতেই।

 

১০. ব্যবসায়িক অসাধুতা সব ধরনের জুয়া উচ্ছেদ

 

সকল প্রকার ব্যবসায়িক অসাধুতা ইসলামী অর্থনীতিতে শুধু নিন্দনীয় নয়, কঠোর শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বর্তমানে দেখা যায় ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে দেশের সরকার খুবই উদার মনোভাব গ্রহণ করে থাকে। কারণ এসব ব্যবসায়ীরা হয় সরকারের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলে সহায়তা ক রে অথবা দেশের প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে বিশেষ ভূমিকা রেখে থাকে। কোন কোন দেশে তা ব্যবসায়ীরা অবৈধ সুযোগ লাভের জন্যে সরকারকে প্রচণ্ড চাপ দিয়ে থাকে অথবা মোটা অংকের ঘুষ দেয়। অবস্থার আজ এতদূর অবনতি হয়েছে যে কয়েকটি দেশে অবৈধ ও নিষিদ্ধ পণ্যের ব্যবসায়ীরা রীতিমতো ছোট-খাট সেনাবাহিনী পুষে থাকে এবং সরকারের নিয়মিত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধেও লিপ্ত হয়। ইসলামে মাদক দ্রব্য ও নেশার সামগ্রীর ব্যবসায় শুধু নিষিদ্ধ নয় বরং চোরাকারবারী, কালোবাজারী, মজুতদারী, মুনাফাখোরীও নিষিদ্ধ। ওজরে কারচুপি, ভেজাল দেওয়া, নকল করা প্রভৃতি জঘন্য ধরনের অপরাধ। মজুতদারীর মাধ্যমে দেশে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে তোলা হয় এবং হেন বস্তু নেই যা ব্যবসায়ীরা সুযোগ পেলেই মজুত কেরে না। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে জনগণের এই অভিজ্ঞতা হয়েছে বারবার। ব্যবসায়িক অসাধুতার ফলেই জনসাধারণের জীবনে নেমে আসে নিদারুণ দুর্ভোগ। এমকি বুলেটের আঘাতে জীবন পর্যন্ত দিতে হয়। পণ্য সামগ্রীর উৎপাদনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ে, সরকারের রাজস্ব হ্রাস পায়।

 

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ঘোষণা করেছেন- “যারা ওজনে কম দেয়, পরের জিনিস ওজন করে নিলে পুরো গ্রহণ করে কিন্তু অপরকে যখন ওজন করে দেয় তখন পরিমাণে কমদেয় এরা নিশ্চিতভাবে ধ্বংস হবে।” (সূরা আল-মুতাফফিফীন: ১-৩ আয়াত)

 

মজুতদারী থেকে ক্রমেই মুনাফাখোরীর মানসিকতা সৃষ্টি হয়। ব্যবসায়িক অসাধুতা হতেই নৈতিকতাবিরোধী মনোবৃত্তি গড়ে ওঠে। উপরন্তু একথাও সর্বজনস্বীকৃত যে চোরাকারবার ও কালোবাজারের যোগফল যে কোন দেশের অর্থনৈতিক অবস্থাকে তলাহীন পাত্রের মতো করে ফেলতে সক্ষম। তাই ইসলামী অর্থনীতিতে সব ধনের ব্যবসায়ক অসাধুতা শুধু নিষিদ্ধ নয়, বরং যারা এসব গণস্বার্থবিরোধী ও সামাজিক বিশৃংখলা সৃষ্টিকারী কাজে লিপ্ত তাদের সমুচিত শাস্তিরও বিধান রয়েছে। কেননা কেবলমাত্র এভাবেই আদল ও ইহসানের প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত হতে পারে।

 

অনুরূপভাবে জুয়াকে তার সর্ববিধ রূপে ইসলামে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। রাষ্ট্র হতে এর উচ্ছেদ না হলে ইসলামী অর্থনীতি তার প্রকৃত কল্যাণকর্মী রূপ বাস্তবায়নে পুরোপুরি সমর্থ হবে না। আল-কুরআনে আল্লাহ তায়ালা সুস্পষ্টভাবে দ্ব্যার্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেছেন-

 

“হে মুমিনগণ! জেনে রাখ, মদ, জুয়া, মূর্তি এবঙ (গায়েব জানার জন্যে) পাশা খেলা, ফাল গ্রহণ ইত্যাদি অতি অপবিত্র জিনিস ও শয়তানের কাজ। অতএব, তোমরা তা পরিত্যাগ কর। তবেই তোমরা কল্যাণ লাভ করতে পারবে।” (সূরা আল মায়েদা: ৯০ আয়াত)

 

মূখ্যতঃ তিনটি কারণে ইসলামী অর্থনীতিতে সব রকমের জুয়া ও ফটকাবাজী (Speculation) নিষিদ্ধ করা হয়েছে। প্রথমতঃ জুয়ার কারণে প্রভূত অর্থের অপচয় ও মূল্যবান সময়ের অপব্যয় হয়। দ্বিতীয়তঃ জুয়া সামাজিক বিশৃংখলা ও নৈতিক অপরাধের জন্ম দেয়। শুধুমাত্র জুয়ার কারণেই মানুষের মধ্যে কলহ-বিবাদ, মারামারি এবং খুন-জখম সংঘটিত হচ্ছে এরকম উদাহরণ রয়েছে ভুরি ভুরি। তৃতীয়তঃ জুয়ার মাধ্যমে বিপুল সংখ্যক লোককে প্রতারণা করে মুষ্টিমেয় কিছু লোক বিনাশ্রমে বিপুল অর্থ উপার্জন করে। সুতরাং, বৃহত্তর সামাজিক কল্যাণ নিশ্চিত করার স্বার্থেই ইসলামেরসকল ব্যবসায়িক অসাধুতা নিষিদ্ধ ও সব ধরনের জুয়া উচ্ছেদের জন্যে সুস্পষ্ট ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। নেহী আনিল মুনকারের এই নির্দেশ বাস্তবায়নের মধ্যে দিয়েই ইসলামী অর্থনীতি দুনিয়ার কল্যাণের সাথে সাথে আখিরাতেরও কল্যাণ ও নাযাতও নিশ্চিত করে।

 

১১. ন্যায়সঙ্গত রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ

 

ইসলামী অর্থনীতির মৌল উদ্দেশ্য হচ্ছে সামাজিক সুবিচার তথা আদল ও ইহসান প্রতিষ্ঠা করা। অন্যসব অর্থনৈতিক বিবেচনাকে সামাজিক সুবিচার এবং আদল ও ইহসান প্রতিষ্ঠার আলোকেই বিচার-বিশ্লেষণ ও গ্রহণ করতে হবে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যক্তি ও রাষ্ট্রকে অবশ্যই ‘মারুফ’ বা সুনীতির প্রতিষ্ঠা ও ‘মুনাফা’ বা দুর্নীতির প্রতিরোধ করতে হবে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সুবিচার প্রতিষ্ঠার অর্থই হচ্ছে সম্ভাব্য সমস্ত উপায়ে সুনীতিমূলক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে ব্যক্তি ও সমাজের স্বার্থ রক্ষা েএবং একই সঙ্গে আদল ও ইহসানের প্রতিষ্ঠা করা। অন্যদিকে দুর্নীতি প্রতিরোধের অর্থ হচ্ছে সব ধরনের অর্থনৈতিক যুলূম ও শোষণের পথ রুদ্ধ করা। রাষ্ট্র এই উপায়েই সুদ ঘুষ মুনাফাখোরী মজুতদারী চোরাচালানী কালোবাজারী পরদ্রব্য আত্মসাৎ সব ধরনের জুয়া হারাম সামগ্রীর উৎপাদন এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রচলিত সকল প্রকারের অসাধুতা প্রভৃতি অর্থনীতি সংশ্লিষ্ট সকল নিপীড়ন ও শোষণমুলক কাজ সমূলে উৎপাটন করতে পারে।

 

অনুরূপভাবে যে সমস্ত সম্পদের সামাজিক মালিকানা থাকলে তার ব্যবহার সর্বোত্তম হবে এবং সমাজের সকল শ্রেণীর লোকই তা থেকে সুবিধা বা উপকার পাবে সে সকল উপায় উপকরণই রাষ্ট্রের জিম্মাদারীতে থাকতে পারে। রাষ্ট্র যাকাত ও উশর আদায় এবং তার উপযুক্ত বিলিবন্টন, বায়তুলমালের সংগঠন ও ব্যবস্থাপনা, উত্তরাধিকার বা মীরাসী আইনের পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন, ইসলামী শ্রমনীতির যথাযথ প্রয়োগ, করযে হাসানা ও মুদারিবাত ব্যবস্থার জন্যে আইন তৈরী এবং নারীদের অর্থনৈতিক অধিকার পরিপূর্ণভাবে আদায় ও প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে অতি অবশ্যই বলিষ্ট ও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। একাজে রাষ্ট্র যদি ব্যর্থ হয় তাহলে আদলও ইহসান প্রতিষ্ঠা হবে না, বরং সমাজে যুলুম ও বঞ্চনার সয়লাব বয়ে যাবে। একারণেই উপযুক্ত ক্ষেত্রে সীমিত মাত্রায় রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের বিধান রয়েছে ইসলামী অর্থনীতিতে। একই সাথে বেশ কিছু সম্পদের সামাজিক মালিকানাও স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে জনসাধারণের বৃহত্তর স্বার্থে।

 

১২. সমাজকল্যাণ আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চয়তা

 

যেকোন উত্তম অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পরিচায়ক হচ্ছে তার সমাজকল্যাণ কর্মসূচী ও জনগণের আর্থিক নিরাপত্তার জন্যে গৃহতি ব্যবস্থা। প্রচলিত সমস্ত অর্থনৈতিক, এমনকি রাজনৈতিক মতাদর্শসমূহে এজন্যেই সমাজকল্যাণের কথা বলা হয়ে থাকে। কিন্তু সে সবের কোনটিই ইসলামী অর্থনীতির সমকক্ষ নয়। প্রকৃতপক্ষে ইসলামেই জনকল্যাণের জন্যে সর্বপ্রথম ও সর্বাত্মক জোর এবঙ সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, বিভিন্ন সমাজকল্যাণমূলক পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছে। দরিদ্র জনগণের মৌলিক মানবিক প্রয়োজন পূরণের পাশাপাশি ক্ষেত্রবিশেষে বায়তুল মাল হতে ন্যূনতম মাসেহারা দেওয়ার ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে। কর্মসংস্থান বৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টির সাথে সাথে চিকিৎসা ও সুন্নাহতে যে নির্দেশ রয়েছে তা যথাযথ প্রয়োগ করতে পারলে গোটা সমাজদেহে এক বিরাট পরিবর্তন সূচিত হওয়ার সম্ভবপর।

 

জনকল্যাণের জন্যে ইসলামে রাষ্ট্রীয় কর্তব্য ছাড়াও ব্যক্তির বাধ্যতামূলক দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। ব্যক্তিকেও নিজস্ব সামর্থ ও যোগ্যতা অনুযায়ী এগিয়ে আসতে হবে। ব্যক্তির ধন-সম্পদে সমাজের অধিকার স্বীকৃত হয়েছে। আল্লাহতায়ালা আল-কুরআনে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেছেন-

 

“তাদের (সম্পদশালীদের) ধন-সম্পদে হক রয়েছে যাঞ্চনাকারী ও বঞ্চিতদের।” (সূরা আল-যারিয়াত: ১৯ আয়াত)

 

“তুমি আত্মীয়-স্বজন েএবং অভাবগ্রস্ত ও মুসাফিরকেও তোমার নিকট হতে তাদের পাওনা দিয়ে দাও।” (সূরা বনি ইসরাঈল: ২৬ আয়াত)

 

“তোমাদের ধন-সম্পদে (যাকাত ছাড়াও) সমাজের অধিকার রয়েছে।” (তিরমিযী)

 

সুদভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সমাজকল্যাণের তথ্য জনসাধারণের হক আদায়ের জন্যে এই রকম জোরলো তাগিদ বা নির্দেশনা নেই। সেখানে রাষ্ট্র বা সরকার জনকল্যাণ কর্মসূচী গ্রহণ করে মর্জিমাফিক। কিন্তু ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় শরীয়াহর দাবী অনুসারেই রাষ্ট্র ও জনগণ বাধ্যতামূলকভাবেই দেশ ও দশের কল্যাণের জন্যে এগিয়ে আসতে বাধ্য। এই সমাজে অর্থনীতির সকল ক্ষেত্রে যেমন বৈধ ও অবৈধের বা হালাল-হারামের প্রশ্ন তুলে সীমারেখা নির্ধারণ কর দেওয়া হয়েছে তেমনি সুনীতির প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতির উচ্ছেদের কথা ঘোষণা করে সমাজে সব বিশৃংখলা দূর করে শান্তি ও নিরাপত্তা বিধানও নিশ্চিত করা হয়েছে। বস্তুতঃ সমাজকল্যাণ ও আর্থিখ নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রবর্তন ইসলামী অর্থনীতির এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এই বিশেষ দিকটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব যৌথভাবে সরকার ও জনগণের।

 

উপরে খুবই সংক্ষিপ্তভাবে ইসলামী অর্থনীতির রূপরেখার বারটি বিষয়ের উল্লেখ করা হলো। এ থেকে ইসলামী অর্থনীতির স্বরূপ ও প্রকৃতি বোঝা যাবে। তবে বিচ্ছিন্নভাবে শুধু ইসলামী অর্থনীতি কোন দেশে কোন অবস্থাতেই বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। এজন্যে সামগ্রিকভাবে ইসরামী জীবন ব্যবস্থাকে অর্থাৎ ইসলামের রাষ্ট্রনীতি সমাজনীতি আইন-বিচার-প্রশাসন ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমসহ সবকিছুই যুগপৎ বাস্তবায়ন করতে হবে। সেই সঙ্গে দরকার সেই মুসলমানেরও ঈমান ও আকীদার দিক দিয়ে, তাকওয়ার দৃষ্টিকোণ হতে যার তুলনা হতে পারে একমাত্র সে নিজেই। প্রকৃত মুসলমানের পরিচয় পাওয়া যায় তো তারই মধ্যে, প্রত্যয় দৃঢ় কণ্ঠে যে ঘোষণা করে:

 

“নিশ্চয়ই আমার নামায, আমার রোযা, আমার জীবন এবং আমার মরণ সব কিছুই আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের জন্যে।” (সূরা আল-আনআম: ১৬২ আয়াত)

 

 

সুদবিহীন অর্থনীতি বনাম ইসলামী অর্থনীতি

 

আমাদের সমাজে কিছু বুদ্ধিজীবী রয়েছেন যারা পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিপরীতে সুদবিহীন অর্থনীতির বাস্তবায়নের কথা বেশ জোরে-শোরে বলে থাকেন। তারা জেনে বুঝে এমন বলেন, না এর মধ্যে কোন কূটচাল রয়েছে তা বোঝা ভারী মুশকিল। কারণ ইসলামী অর্থনীতি প্রসঙ্গে এরা রীতিমত নির্বাক। বাস্তবে সুদবিহীন অর্থনীতি কোনক্রমেই ইসলামী অর্থনীতির বিকল্প হতে পারে না। ইসরামী জীবন বিধান সম্পর্কে অস্বচ্ছ ধারণার কারণেই সুদবিহীন অর্থনীতির পক্ষ নিয়ে কথা বলেন এসব বুদ্ধিজীবীরা। ইসলাম যে এক সামগ্রিক জীবন ব্যবস্থা এবং আমর বিল মা’রুফ এবং নেহী আনিল মুনকার যে জীবন ব্যবস্থার ভিত্তিপ্রস্তুর বা Comer Stone, তাওহীদ, রিসালাত আর আখিরাত যার মুল দর্শন, সেই মৌলিক বিষয়ে অস্পষ্টতা থাকার কারণেই প্রধানতঃ চিন্তার এই দুর্বলতা বা ভ্রান্তি দেখা দেয়। যথাযথ জ্ঞানের অভাব বিশেষতঃ মূল উৎস হতে না জানার কারণে পরের শেখানো বুলি আওড়াতে এদের সংকোচ বা আড়ষ্টতা দেখা দেয় না। বরং বাহাদুরী করে নিজেদের ‘নতুন কথা’ জাহির করার প্রবণতাই এক্ষেত্রে প্রবল হয়ে দাঁড়ায়।

 

অনেকে মনে করেন এবং জোর গলায় বলেনও- সেক্যুলার বা প্রচলিত অর্থনীতি হতে সুদ প্রত্যাহার করে নিলে ইসলামের সঙ্গে তার দূরত্ব দূর হয়ে যাবে। সুদ বিবর্জিত এই অর্থনীতিই হবে ইসলামী অর্থনীতি। এ ধরনের কথা সবচেয়ে বেশী শোনা যেত যখন সমাজতন্ত্র বেশ কয়েকটি দেশে পেশীশতির জোরে ক্ষমতায় ছিলো। কেউ কেউ আবার সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি ও ইসলামী অর্থনীতি প্রায় একই রকম এমনও মত প্রকাশ করতোত। তবে এসব প্রচারণা যে এক অর্থে গভীর দুরভিসন্ধিমূলক তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ যুগে যুগে মুরতাদরা ও ইহাদী-খৃস্টানদের কাছে বিবেক বিক্রি করে দেওয়া তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা েইসলামের লেবাস ধরে ভিতর থেকেই তার শিকড় কেটে তাকে তিলে তিলে দুর্বল তথা ধ্বংস করে দেয়ার অপচেষ্টা চালিয়ে গেছে।

 

িইসলামী অর্থনীতি বলতে কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে সামগ্রিক এক জীবন ব্যবস্থার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকেই বুঝায়। পক্ষান্তরে সুদবিহীন অর্থনীতি বলতে যা বোঝানোর চেষ্টা করা হয় তাহলো, প্রচলিত অর্থনীতি হতে শুধু সুদকে প্রত্যাহার করে নেওয়া। অর্থনীতির অন্যান্য প্রসঙ্গে ইসলামের যে নির্দেশ তথা শরীয়াহর বিধি-নিষেদ প্রতিপালিত হবে কিনা সে ব্যাপার কোন সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা সেখানেই নেই। তাই সেই অর্থনীতি যে প্রকৃতই ইসলামী অর্থনীতি হয়ে উঠতে অক্ষম তা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলেই ধরা পড়বে। এই দুইধরনের অর্থনীতিরমধ্যে রয়েছে মেরুপরিমাণ ব্যবধান। নিচে সেই ব্যবধানের কারণ ও বৈশিষ্ট্যসমূহ তুলে ধরা হলো।

 

প্রথমতঃ ইসলামী অর্থনীতির দার্শনিক ভিত্তির সাথে সুদবিহীন অর্থনতির দর্শনের কোনই মিল নেই। কারণ তওহীদ রিসালাত ও আখিরাত ইসলামী অর্থনীতির মৌল দর্শন। কিন্তু সুদবিহীন অর্থনীতির প্রবক্তারা এ ধরনের কোন দর্শনের কথা বলেন না। প্রকৃতপক্ষে তারা প্রচুলি পুঁজিবাদী অর্থনীতি থেকে সুদকে উচ্ছেদ করাই যথেষ্ট বলে মনে করেন। কিন্তু প্রচলিত অর্থনীতিতে যে ভোগবাদী দর্শন সতত কার্যকর, ব্যক্তিপূজা তথা ইন্দ্রিয় বাসনা চরিতার্থতা যার সকল কাজের কেন্দ্রবিন্দু তা পরিত্যাগ বা উচ্ছেদের কোন কথা তারা বলেন না। পরকালনি মুক্তি অর্জনের জন্যেই যে ইহকালীন প্রচেষ্টা চালানো অতি আবশ্যক এই সত্য সম্বন্ধে তারা রহস্যজনকভাবে নীরব। বস্তুতঃ দার্শনিক ভিত্তির ভিন্নতাই দুই অর্থনীতির মধ্যে বিশাল ব্যধান সৃষ্টি করেছে। কোনভাবই এ দুয়ের মধ্যে সাযুজ্য যা যোগসূত্র স্থাপন সম্ভব নয়।

 

দ্বিতীয়তঃ ইসলামী অর্থনীতির সকল কার্যক্রমের ভিত্তি হলো যুগপৎ আমর বিল মাৎ’রুফ এবং নেহী আনিল মুনকার-এর প্রতিষ্ঠা। অর্থাৎ, সুনীতি প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতি উচ্ছেদের সর্ববিধ প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা। অর্থনীতির যে কোন পদক্ষেপে, কর্মমৌশলে বা নীতিমালায় এর ব্যত্যয় ঘটলে তা হবে ইসলামী শরীয়াহর সাথে সাংঘর্ষিক। ন্যায় প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি অন্যায় ও যুলুমের উচ্ছেদ ইসলামী অর্থনীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কিন্তু সুদবিহীন অর্থনীতিতে এমন বৈশিষ্ট্য আদৌ লক্ষ্য করা যায় না। শুধুমাত্র সুদ বর্জনই তার লক্ষ্য, সমাজরে সর্বস্তরে কল্যাণ ও মঙ্গলবোধের প্রতিষ্ঠা তার কর্মকাণ্ডের অন্তর্নিহিত লক্ষ্য নয়। ফলে ইসলামী অর্থনীতি যে সামগ্রিক কল্যাণ ও মঙ্গলময় এবং সুবিচারপূর্ণ অর্থনীতি তথা সমাজ জীবনের পরিচয় দেয় সুদবিহীন অর্থনীতিতে তার লেশমাত্রও লক্ষ্য করা যায় না।

 

তৃতীয়তঃ বর্তমান কালের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি যে ব্যাংক ব্যবস্থা তা থেকে শুধু সুদ প্রত্যাহার করে নিলেই কাঙ্খিত কল্যাণ লাভ আদৌ সম্ভব নয়। কারণ ইসলামী জীবন বিধানের অনুসারী হওয়ার কারণেই ইসলামীব্যাংক ও ফাইন্যান্সিং প্রতিষ্ঠানগুলো হারাম ও সমাজবিধ্বংসী কোন কাজে অংশ নেবে না বা সে ধরনের কোন কাজে বিনিয়োগও করবে না। কিন্তু সুদবিহীন অর্থব্যবস্থায় এ ধরনর কোন নিশ্চয়তার সুযোগ নেই। ব্যাংক বা ফাইনান্সিয়াল ইনস্টিটিউশন সুদ না নিয়েও মুনাফার অংশীদারীত্বের ভিত্তিতে সিনা হল তৈরী বা মদের কারখানা পরিচালনার জন্য অর্থ বিনিয়োগ করলে তাতে বাধা দেবার কেউ নেই। এখানে ইসলামী অর্থনীতির সাথে সুদবিহীন অর্থনীতিরি মৌলিক তফাৎ।

 

চতুর্থতঃ ইসলামী অর্থনীতিতে সকল ক্ষেত্রেই হালাল-হারামের সীমারেখা মেনে চলার প্রতি দৃঢ় লক্ষ্য রাখা যায়। হালাল বা বৈধ উপায়ে উপার্জন এবং বৈধ উপায়েই তা ব্যয়ের প্রতি বিশেষ তাগিদ দিয়ে থাকে এই অর্থনীতিতে। এই অর্থনীততে হারাম উপায়ে উপার্জন তো পরিত্যাজ্যই, সেই সঙ্গে বৈধ উপায়ের উপার্জনও হারাম পথে ব্যয়ের কোন সুযোগ নেই। পক্ষান্তরে সুদবিহীন অর্থনীতিতে ‍সুদের উচ্ছেদই একমাত্র বিবেচ্যে বিষয়, অন্য কিছু নয়। পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে উৎপাদন ভোগ বন্টন উপার্জন বিনিয়োগ প্রভৃতি ক্ষেত্রে কোন নীতি-নৈতিকতা বা শেষ সীমার প্রশ্ন নেই। ভোগবাদী এই ব্যবস্থায় যেসব পন্থায় উৎপাদন বা যেসব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সমাজরে জন্য ক্ষতিকর ও শ্রেণীবৈষম্য সৃষ্টিকারী এবং যেসব পন্থায় ব্যয় বা ভোগ সমাজের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টিকরী সেসবও ভাববার কোন কারণ নেই। এ বিষয়ে সুদবিহীন অর্থনীতির প্রবক্তাদের নীরবতা এক কথায় রহস্যজনক।

 

প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য, অবৈধ বা হারাম উপায়ে উপার্জন বন্টন বিনিয়োগ প্রভৃতি অর্থনৈতিক কার্যক্রম ইসলামী অর্থনীতিতে নিষিদ্ধ হওয়ার কারণ প্রধানঃ তিনটি। প্রথমতঃ অবৈধ উপায়ে আয়ের উদ্দেশে জনগণের উপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নানা পদ্ধতিতে যুলুম চালানো হয়। দ্বিতীয়তঃ চারিত্রিক নৈরাজ্য সৃষ্টিকরী ও সমাজবিধ্বংসী কার্যক্রমসমূহ মূলতঃ এ ধরনের অবৈধ বা হারাম অর্থনৈতিক কার্যক্রমেরই ফসল। তৃতীয়তঃ অবৈধ উপায়ে অর্জিত ধন-সম্পদ অবৈধ উপায়েই ব্যয় হয়। অবৈধ কাজে ধন-সম্পদ ব্যবহারের অর্থই হলো সামাজিক অবিচার ও পীড়নের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়া। পরিণামে সমাজ ধীরে ধীরে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়। এজন্যেই ইসলামী অর্থনীতিতে হারাম উপায়ে উপার্জন নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। রাসূলে করীম (স) বলেছেন- হালাল রুজী ঈমানের দশ ভাগের নয় ভাগ। তিনি আরো বলেন- হারাম রুজী হতে উৎপন্ন রক্ত ও মাংস দোজখের আগুনের খোরাক।

 

পঞ্চমতঃ ইসলামী অর্থনীতির অন্যতম মৌলিক বৈশিষ্ট্য ও দাবী হলো যাকাত ব্যবস্থার বাস্তবায়ন। যাকাত ইসলামের পাঁচটি রোকন বা স্তম্ভের অন্যতম। এটি যথাযথভাবে পালিত না হলে ইসলামের ভিত্তি ধ্বংস হয়ে যাবে। এজন্যে রাসূলে আকরামের (স) মৃত্যুর অব্যবহিত পরে যখন ভণ্ড নবীদের চাপের মুখে হযরত উমার (রা) পর্যন্ত সাময়িকভাবে যাকাত আদায় রহিত করার প্রস্তাব করেছিলেন সে সময় মুসলিম উম্মাহর প্রতম আমীরুল মুমিনীন হযরত আবু বকর (রা) খুব স্পষ্ট ভাষায় দৃঢ়তার সাথে যাকাত আদায়ের অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেছিলেন। যাকাতের মাধ্যমে যেমন সমাজে ধনবৈষম্য হ্রাস পায় তেমনি দরিদ্র ও অভাবগ্রস্ত জনগণ সামাজিক নিরাপত্তা লাভের সুযোগ পায়। সুদবিহীন অর্থ ব্যবস্থার প্রবক্তরা যাকাত আদায় ও রাষ্ট্রীয়ভাবে তার ব্যবস্থাপনার বিষয়ে কোনই মন্তব্য করেননি। এর প্রবক্তারা যেন ধরেই নিয়েছেন সুদ উচ্ছেদ হলেই গোটা অর্থনীতি ইসলামী হয়ে যাবে।

 

ষষ্ঠতঃ ইসলামী অর্থনীতিতে কৃষিনীতি, ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা, বর্গাচাষ ও উশর আদায় সম্বন্ধে যে সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা ও তাগিদ রয়েছে সুদবিহীন অর্থনীতিতে তার লেশমাত্রও নেই। অথচ সমাজের বৃহত্তম অংশ কৃষি কাজের সাথে সম্পৃক্ত। যাকাতের মত উশর আদায়ের মাধ্যমে কৃষি ক্ষেত্রে ধনবৈষম্য দূরীকরণ ও দারিদ্র বিমোচন সম্ভব। নিম্নবিত্ত, প্রান্তিক ও ভূমিহীন কৃষকদের কল্যাণ ও আর্থিক বুনিয়াদের নিশ্চয়তা না থাকলে শুধু গ্রাম অঞ্চলে নয়, সমগ্র সমাজ কাঠামোতেই বিপত্তি নেমে আসে। ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য তীব্রতর হয়। ফলশ্রুতিতে দেশের অর্থনীতি হয়ে দাঁড়ায় ভারসাম্যহীন। এর উপযুক্ত প্রতিবিধান করতে হলে কৃষি জমির মালিকানা, বর্গাচাষ, ভূমি রাজস্ব এবং উশর আদায় বিষয়ে ইসলামের নীতি-নির্দেশনা মানতে হবে। ইসলামী অর্থনীতিতে কোন প্রকার মধ্যস্বত্বের অবকাশ নেই। জমি পতিত রাখাকে ইসলাম সমর্থন করেনি-সে জমি রাষ্ট্রেরই হোক বা ব্যক্তিরই হোক। উন্নত কষি ব্যবস্থার মূখ্য শর্ত হিসেবেই উন্নত ভূমিস্বত্ব ও ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছে ইসলাম। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সুদবিহীন অর্থনীতির তাত্ত্বিকরা এ ব্যাপারে একেবারেই নিশ্চুপ।

 

সপ্তমতঃ ইসলামী অর্থনীতির অপর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো কুরআন ও সুন্নাহর ঘোষণা অনুসারে উত্তরাধিকার নীতি বাস্তবায়ন। ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে সারা বিশ্বের উত্তরাধিকার আইন ছিলে অস্বাভাবিক। পুরুষানুক্রমে পরিবারের জ্যেষ্ঠ পুত্রই সমস্ত বিষয়-সম্পত্তির উত্তরাধিকারিত্ব লাভ করতো। বঞ্চিত হতো পরিবারের অন্যান্য সদস্যগণ। খৃস্টান ইহুদী হিন্দু বৌদ্ধ সকল ধর্মেই মোটামুটিভাবে একই ধরনের প্রথা বিরাজমান ছিলো। এর পিছনে যে দর্শন কাজ করতো তা হলো সম্পত্তি গোটা পরিবারের হাতেই থঅকবে। তা যেন বিভক্ত হয়ে অন্য মালিকানায় চলে না যায়। এভাবে পুরুষানুক্রমে সম্পত্তি একই পরিবারের দখলে থাকায় তাদের সামাজিক প্রভাব প্রতিপত্তি তথা শোষণ ও পীড়নের সুযোগ থাকতো অব্যাহত ও অটুট। উপরন্তু মহিরারা ছিলো সর্বদাই বঞ্চিত। তারা যে সমাজের দায়িত্বশীল ও গুরুত্বপূর্ণ অর্ধাংশ এই সত্যটি ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে স্বীকারই করা হতো না। ইসলামই সর্বপ্রথম সম্পত্তিতে উত্তরাধিকারী হিসেবে পুরুষের পাশাপাশি কন্যা স্ত্রী ও মা হিসেবে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে। সুদবিহীন অর্থনীতির আলোচনায় এ প্রসঙ্গে কোন দিক নির্দেশনাই নেই। অর্থাৎ, প্রকারান্তরে তারা পুঁজিবাদী উত্তরাধিকার পদ্ধতিরই স্বীকৃতি দিয়েছে যা যুলুমের নামান্তর।

 

অনুরূপভাবে অর্থনীতিতে আদল ও েইনসাফের প্রয়োগ, শ্রমিকদের অধিকার আদায়, রাষ্ট্রের ক্ষমতার পরিধি ও প্রয়োগ, বায়তুল মালের প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি ব্যাপারেও সুদবিহীন অর্থনীতিতে কোন দিক নির্দেশনা নেই। এমনকি জনগণের মৌলিক পাঁচটি প্রয়োজন অন্ন বস্ত্র স্বাস্থ্য বাসস্থান ও শিক্ষা বিষয়েও সুদবিহীন অর্থনীতিতে কোন পস্তুাবনা নেই, কোন কোন নীতি নির্ধারণী কৌশল। অথচ ইসলামী অর্থনীতিতে জনগণের মৌলিক প্রয়োজন পূরণের জন্যে কঠোর তাগিদ রয়েছে। হাদীসে বলা হয়েছে, উপায় থাকতেও যে স্বেচ্ছায় ভিক্ষা করে, কিয়ামতের দিন তার জঠর জাহান্নামের আগুনে ভরে যাবে। এরই বিপরীতে উপায়হীন ক্ষুধাতুর মানুষের দুঃসহ যাতনার কথা মনে রেখেই দয়ার নবী মুহাম্মদ (স) বলেছেন, জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচতে চাইলে আধখানা খেজুর হলও মিসকিনের হাতে তুলে দিও। নিরন্ন-বুভুক্ষ মানুষের প্রয়োজন পূরণের জন্য প্রখ্যাত মুজাদ্দিদ ইমাম ইবনে তাইমিয়া বলেছেন, বায়তুল মালের তহবিল হতে দরিদ্র-নিরন্ন মানুষের এই প্রয়োজন মিটানো সম্ভব না হলে ধনীদের উপর আরো কর আরোপ করতে। তাতেও সংকুলান না হলে তাদের কাছ থেকে ধার নিতে। এ দরনের সুপারিশ বা নীতিমালা গ্রহণের নির্দেশনার লেশমাত্র লক্ষ্য করা যায় না সুদবিহীন অর্থনীতির প্রবক্তাদের লেখায়-আলোচনায়।

 

বস্তুতঃ কল্যাণধর্মী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও ইহকালের জীবনকে পরকালের জন্যে পাথেয় উপার্জনের উপায় হিসেবে ব্যবহারই ইসলামী অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য। এই নশ্বর জীবন যেন শুধু ভোড়-বিলাসেই শেষ না হয়ে যায়, বরং আল্লাহর বান্দা হিসেবে ইহকালীন জীবন যেন শান্তি ও সমৃদ্ধির হয় এবং পরকালে জীবনে মুক্তি লাভ ও আল্লাহর কাছে পুরষ্কৃত হওয়া যায় মুমিনের এই বাসনা চরিতার্থ করাই ইসলামী অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য। দুনিয়ার কোন অর্থনীতিরই –তা সে পুঁজিবাদই হেহাক বা সেক্যুলারই হোক কিংবা হোক সুদবিহীন- এই বৈশিষ্ট্য নেই। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় আন্দালুশিয়া হতে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত পৃথিবীর অর্ধেকেরও বেশী বিশাল ভূখণ্ডে দীর্ঘ নয়শত বছর ইসলামী শাসন ব্যবস্থা গৌরবোজ্জ্বল যুগে ইসলামী অর্থনীতির কল্যাণময় স্পর্শে তখন না ছিলো শ্রেণীবৈষম্য, না ছিলো ক্ষুধাতুর মানুষের মিছিল। আজও সেই ইসলাম রয়েছে, রয়েছে মুসলমানরাও। তাদের মোট সংখ্যা বিশ্বজনসংখ্যার প্রায় এক-চতুর্থাংশ। কিন্তু মুষ্টিমেয় উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বা দিলে তারা আজ পাশ্চাত্যের ভোগবাদী জীবনের দাসানুদাস। উপরন্তু মাযহাবী ভিন্নতা ও নানা ধরনের শিরক ও বিদআত আজ ইসলামের প্রাণশক্তিকে গ্রাস করেছে। ইসলাম আজ ভ্রান্তির বেড়াজালে আবদ্ধ। তাকে শৃংখলমুক্ত করতে পারলে আবারো মুসলিম জাহাহনে ফিরে আসবে তার হৃত গৌরব, সৃষ্টি হবে নতুন এক স্বর্ণোজ্জ্বল অধ্যায়।

 

ইসলামী ভোক্তার স্বরূপ

 

. ইসলামী ভোক্তা কে?

 

“আমি তাদের পরে তোমাদেরকে পৃথিবীতে স্থলাভিষিক্ত করেছি, তোমরা কি প্রকার আচরণ কর তা পরীক্ষা করার জন্যে।” (সূরা ইউনুস: ১৪ আয়াত)

 

এই আয়াতেই স্পষ্ট হয়ে গেছে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পূর্ববর্তী জাতিসমূহকে ধ্বংস করে আর একটি জাতিকে তাদের স্থলাভিষিক্ত করেছেন মূলতঃ তাদের আচরণ পরীক্ষা করার জন্যে, আল্লাহর খলীফা বা প্রতিনিধি হিসেবে তাদের দায়িত্ব পালনের দায়বদ্ধতা পরীক্ষা করার জন্যে।

 

মানুষের পার্থিব জীবনে যত ধরনের আচরণ রয়েছে ভোগের ক্ষেত্রে আচরণ সেসবের মধ্যে অতীব গুরুত্বপূর্ণ। দৈনন্দিন জীবনে প্রত্যেককেই কিছু না কিছু ভোগ করতেই হয় তার জীবন যাপনের জন্যে। আবার তার পরিবার পরিজন রয়েছে, রয়েছে আত্মীয়-স্বজন। তাদের প্রতিও তার দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। সব মিলিয়ে তার সামষ্টিক ভোগের পরিধি বেশ বড়ই। এক্ষেত্রে ইসলামী শরীয়াহর সুস্পষ্ট দিক-নির্দেশনা রয়েছে, রয়েছে শরীয়াহর আহকাম। সেসব মেনে চলাও একজন মুমিনের জন্যে মৌলিক পরীক্ষা।

 

ভোগ হয় রিযিক বা সাধারণ অর্থ খাদ্যবস্তু, কাপড়-চোপড়, আসবাবপত্র ইত্যাদি ব্যয় ও ব্যবহারের মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রে হালাল-হারামের বিধি-বিধান মেনে চলার জন্যে জোর তাগিদ রয়েছে ইসলামী শরীয়াহতে। রাসূলে কারীম (স) বলেছেন- “হালাল রুজী ঈমানের দশ ভাগের নয় ভাগ।”

 

আরেক হাদীসে বলা হয়েছে –“আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দরবারে দোয়অ কবুলের অন্যতম শর্ত হালাল রুজীর উপর বহাল থাকা।” (মুসলিম)

 

একজন মুমিন ভোক্তা সম্পূর্ণ সচেতনভাবে সব সময় শুধুমাত্র হালাল দ্রব্য ও সেবা ভোগ করবে এবং হারাম দ্রব্য ও সেবা বর্জন করবে। ইসলামী পরিভাষার আলোকে ঐসব দ্রব্যকে হালাল দ্রব্য বরা হয় যার নৈতিক ও আদর্শগত গুণাগুণ থাকে, যেগুলোর ভোগ উপকার ও কল্যাণই বয়ে আনে। আজকের দিনে মুসলমানরনা সাধারণভাবে হালাল ‍রুজী বা রিযিকের তথা ভোগের উৎসের ব্যাপারে কতখানি মনোযোগী বা সতর্ক সে প্রশ্নে না গিয়ে সাহাবায়ে কিরাম এবং ইমামরা কেমন আমল করতন, কতটা সতর্ক ছিলেন এ ব্যাপারে তার দু’ একটা উদাহরণ আমাদের চোখে খুলে দিতে পারে।

 

সিদ্দীকে আকবর আমীরুল মুমিনীন হযরত আবু বকর (রা) খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণের পর তাঁকে একজন খাদেম দেওয়া হয়েছিলো রাষ্ট্রের পক্ষ হতে তার ব্যক্তিগত কাজে সহায়তার জন্যে। এই খাদেমের অন্যতম দায়িত্ব ছিলো খলীফার খাবারের প্রতি মনোযোগ রাখা ও তা পরিবেশন করা। খলীফারও অভ্যাস ছিলো খাবার সম্বন্ধে খোঁজ-খবর নিয়ে তারপর খাওয়া। একদিন খাবারের শুরুতে খাদেমকে জিজ্ঞেস করতে ভুলে গিয়েছিলেন সেদিনের খাবার কোথা হতে কিভাবে সংগ্রহ করা হয়েছে। খাওয়ার শেষ পর্যায়ে তিনি যখন খাদেমকে জিজ্ঞাসা করলেন তখন সে জবাবে জানালো আজকের খাবারে উৎকৃষ্ট মধু ও দুধ রয়েছে। এগুলো তাকে দিয়েছে এক গোত্রের লোকেরা। কারণ হিসেবে জানালো সে যখন কাফির ছিলো তখন যাদুমন্ত্র জানতো। তাতে অনেকের উপকারও হতো। এই গোত্রের লোকেরা তার কুফরী কালের যাদুমন্ত্রে উপকৃত হয়েছিলো। তাদের সাথে আজ হঠাৎ দেখা হওয়ায় তারা কৃতজ্ঞতাবশতঃ উৎকৃষ্ট মধু ও উটের দুধ দিয়েছে উপঢৌকন হিসেবে। সেটাই সে খলীফার আজকের খাবার প্রস্তুতের কাজে লাগিয়েছে।

 

একথা শুনে খলীফা খুব রাগতস্বরে বললেন, তুমি তো আমাকে বরবাদ করে দিয়েছ। এরপর গলার মধ্যে আঙুল ঢুকিয়ে তিনি বমি করতে চেষ্টা করলেন এবং এক সময়ে তিনি গলা থেকে রক্ত বের করে ফেললেন। এই সংবাদ হযরত উমার ইবনুল খাত্তাবের (রা) কাছে পৌঁছালে তিনি দেখতে এলেন আমীরুল মুমিনীনকে। সব শুনে তিনি বললেন, সন্দেহজনক খাদ্য বমি করে ফেলে দিয়েছেন সেটা ভালোই হয়েছে। কিন্তু রক্ত বের করার মতো ক্লেশ তিনি না করলেই পারতেন। তার উত্তরে হযরত আবু বকর (রা) জবাব দিয়েছিলেন “উমার তুমি কি শোন নি রাসুলে আকরাম (সা) বলেছেন হারাম খাদ্যবস্তু হতে শরীরে যে রক্ত-গোশত পয়দা হয় তা দোযখের আগুনের খোরাক।” এরপর হযরত উমার নিরুত্তর হয়ে গেলেন।

 

ইমামে আযম হযরত আবু হানীফঅ (রহ) একজন বড় মাপের বস্ত্র ব্যবসায়ী ছিলেন। একদিন তিনি তাঁর দোকানের কর্মচারীদের একটা কাপড় দেখিয়ে বললেন সেটাতে একটা খুঁত রয়েছে। বিক্রির সময়ে সেটা নেয অবশ্যই ক্রেতাকে দেখানো হয়। দিনশেষে হিসাব নেয়ার সময়ে তিনি কর্মচারীদের জিজ্ঞেস করলেন ঐ খুঁতযুক্ত কাপড়টিও বিক্রি হয়ে গেছে কিনা। তারা হাঁ সূচক উত্তর দিলো। তিনি জানতে চাইলেন তারা খুঁতটার কথা উল্লেখ করেছিলো কি না? তারা নিরুত্তর রইলো। হযরত আবু হানীফঅ (রহ) সেদিনের বিক্রয়লব্ধ সমুদয় অর্থ দানি করে দিলেন। তাঁর মনে প্রশ্ন- খুঁতযুক্ত কাপড়টার জন্যে যে উচিৎমূল্য আদায় করা হয়েছে সেই দিরহাম কোনগুলো? যেহেতু সেগুলো চিহ্নিত করার সুযোগ নেই তাই সন্দেহযুক্ত আয় পারিবারিক কাজে লাগিয়ে তিনি ঈমান ও আমল বরবাদ করতে চাননি। সত্যিকার ইসলামী ভোক্তার স্বরূপ তো এটাই। আমাদের দেমের মুসলমান ব্যবসায়ীদের কতজন এই ঘটনা জানেন?

 

গভীর পরিতাপ ও দুঃখের বিষয়, ইসলামী মূল্যবোধ বিবর্জিত ভোগলিপ্সা আজ মুসলমানদের চরম দুনিয়ামুখী করে তুলেছে। আখিরাতের চাইতে দুনিয়াতে আঁকড়ে ধরার অশুভ প্রবণতা তার ঈমানের শক্তিকে দুর্বল করে ফেলেছে। তাই একদা যে বিশ্ব তার বশীভুত ছিল আজ সেই-ই বিশ্বের বশীভূত হয়ে পড়েছে। এর পরিবর্তন প্রয়োজন। সেজন্যেই চাই সচেতন ও সক্রিয় উদ্যোগ। ইসলামী অর্থনীতি তথা একজন মুসলমানের অর্থনৈতক জীবনাচরণ সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান অর্জন ছাড়া তা অসম্ভব।

 

ইসলামের দাবী হলো প্রকৃত মুসলমান সচেতনভাবেই তার সকল আচরণের দ্বারা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা করবে। এজন্যে আপাতঃ বা বাহ্যিক দৃষ্টিতে ক্ষতি মনে হলেও সেতা হৃষ্টচিত্তে মেনে নেবে। সে হালাল রিযিক অর্জনের জন্যে যেমন সর্বাত্মক চেষ্টা চালাবে তেমনি হারাম বর্জনের জন্যেও তার মধ্যে বিরাজ করবে জিহাদী জযবা। দুনিয়ার এই নশ্বর জীবনে ক্ষণিকের সুখভোগের জন্যে সে কোনক্রমেই অনন্ত আখিরাতের জীবনকে বরবাদ করবে না। েএকমাত্র মরদুদ শয়তানের কুহকে পড়লেই সে এটা করতে পারে। মনে রাখতে হবে, একজন মুসলমানের তথা ইসলামী ভোক্তার আচরণ তাওহীদ, রিসালাত ও আখিরাতের বিশ্বাস দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হবে। এর কোনো ব্যত্যয় হলে তওবা করে তা থেকে ফিরে না আসলে কঠিন শাস্তিময় দোযখ তার জন্যে অপেক্ষা করছে।

 

. ইসলামী ভোক্তার বৈশিষ্ট্য

 

বস্তুতঃ একজন ইসলামী ভোক্তার প্রধান ও মূল বৈশিষ্ট্য হলো তার ভোগসম্পর্কিত আচরণের মাধ্যমে সব সময়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা চালানো। অন্যভাবে দেখলে ভোগ আচরণকে সে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের একটা পন্থা হিসেবে গণ্য করে। তার এই লক্ষ্য অর্জনে ভোগ আচরণ ইসলামী যুক্তিশীলতা (rationalism) দ্বারা পরিচালিত ইসলামী শরীয়াহ দ্বারা নির্দেশিত। অপরপক্ষে একজন অমুসলমান বা পুঁজিবাদী ভোক্তার আচরণ অর্থনৈতিক যুক্তিশীলতা দ্বারা পরিচালিত, যা তার নিজ স্বার্থের দ্বারাই প্রভাবান্বিত। প্রখ্যাত ইসলামী অর্থনীতিবিদ মনযের কা’ফ ভোক্তার আচরণ বিশ্লেষণে ভোক্তার ইসলামী মূল্যবোদকেই সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়েছেন। যথা:

 

(১) শেষ বিচারের দিনের প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস;

 

(২) ইসলামী সাফল্যের উপর বিশ্বাস; এবং

 

(৩) ইসলামী ধন-সম্পতের প্রতি বিশ্বাস।

 

শেষ বিচারের দিনের তথা আখিরাতের প্রতি একজন ভোক্তা যখন পূর্ণ বিশ্বাস রাখে অর্থাৎ পরকালের অনন্ত শান্তি ও পুরষ্কার প্রাপ্তি অথবা ভয়াবহ শাস্তি সম্পর্কে নিশ্চিত থাকে তখন তার আর শরীয়াহর নির্দেশ লঙ্ঘন করার সুযোগ থাকে না। ইসলামী সাফল্যের উপর বিশ্বাসের অর্থ হলো ইসলামী সাফল্য অর্জিত হয় আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমে, নিছক ধন-সম্পদ অর্জনের মধ্য দিয়ে নয়। তাই ইসলামী ভোক্তার মূল লক্ষ্যই থাকে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের প্রয়াস। ইসলামী ধন-সম্পদের প্রতি বিশ্বাসের অর্থ হলো ইসলামের ধন-সম্পদের সুনির্দিষ্ট পৃথক কিছু তাৎপর্য রয়েছে। এক হাদীসেই তার উল্লেখ রয়েছ। রাসূল (স) বলেন-

 

“তুমি যা খাও তা নিঃশেষ করে ফেলো, যে পোশাক পরো তা ব্যবহার কর ফরিয়ে ফেলো, আর যা দান করো তা তোমার পরকালের জন্যে সঞ্চয়। এছাড়া তুমি প্রকৃতপক্ষে আর কোন ধন-সম্পদের অধিকারী নও।” (মুসলিম)

 

একজন ইসলামী ভোক্তার দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হলো সে তার মোট ব্যয়কে দুই অংশে ভাগ করে- পার্থিব ব্যয় ও আল্লাহর রাস্তায় ব্যয়। পার্থিব ব্যয় বলতে নিজের ও পরিবার-পরিজনদের জন্যে ব্যয়কে বোঝানো হয়েছে। অপরদিকে আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় বলতে প্রতিবেশী ও আত্মীয়-স্বজনদের জন্যে ব্যয় এবং গরীব-মিসকীন অসহায় ও দুঃস্থজনদের জন্যে ব্যয়কে বুঝানো হয়েছে। বস্তুতঃপক্ষে বিত্তশালীদের ধন সম্পদে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন গরীব-দুঃখীদের হক বা অধিকার নিশ্চিত কর দিয়েছেন। তিনি বলেন-

 

“তাদের (সম্পদশালীদের) ধন-সম্পদে হক রয়েছে যাঞ্চাকারী ও বঞ্চিতদের।” (সূরা আল-যারিয়াত: ১৯ আয়াত)।

 

আল-কুরআনের অন্যত্র বলা হয়েছে- “আত্মীয়-স্বজনদের তার হক দান কর এবং অভাবগ্রস্ত মুসাফিরকেও।” (সরা বনি ইসরাঈল: ২৬ আয়াত)

 

ইসলামী ভোক্তার তৃতীয় বৈশিষ্ট্য হলো সে সম্পদ মজুদ করে না। তাকে সংসারির ব্যয় নির্বাহের জন্যে অবশ্যেই উপার্জন করতে হবে এবং আপৎকালীন খরচ মেটাবার জন্যে তাকে সঞ্চয়ও করতে হবে। এই সঞ্চয় তাকে উৎপাদনশীল কাজে বিনিয়োগও করতে হবে। কারণ বিনিয়োগে ব্যর্থ হলে সঞ্চিত অর্থের যাকাত আদায় করতে গিয়ে তার সঞ্চয় নিসাব এর নিচে চলে আসতে পারে।

 

মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের শুরুতেই মুমিন হওয়ার যে শর্তাবলী আল্লাহ উল্লেখ করেছেন সেখানেও আল্লাহ প্রদত্ত রিযিক হতে তারই ব্যয়ের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে (দ্রষ্টব্য: সূরা আল-বাকারাহ: ৩ আয়াত।) ইনফাক ফি সাবিল আল্লাহর মোট ব্যয়ের ঐ অংশকে বোঝায় যা একজন ভোক্তা কোনও প্রকার পার্থিব সুবিধা বা প্রতিদানের আশা না করেই আল্লাহর পথে ব্যয় করে শুধুমাত্র তারই সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যে। অবশ্য এজন্য সে আখিরাতে পুরস্কৃত হবে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ স্বয়ং আল-কুরআনে বলেছেন, তারা আল্লাহ প্রেমে অভাবগ্রস্ত, ইয়াতীম ও বন্দীদের আহার্য দান করে। তারা বলে:

 

“কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে আমরা তোমাদেরকে আহার্য দান করি এবং তোমাদের কাছে কোনো প্রতিদান ও কৃতজ্ঞতা কামনা করি না।” (সরা আদ দাহর: ৮-৯ আয়াত)

 

একজন ইসলামী যুক্তিশীল ব্যক্তি চিন্তা করবে তার নিকট যা কিছু রয়েছে তা সবই আল্লাহর দান বা আমানত। যদি সমস্ত ধন-সম্পদ তাঁর প্রতি ব্যয় করা হয় তবেই মাত্র তাঁর প্রদত্ত নিয়ামতের হক আদায় হবে। যাকাত সাদাকাহ ফিতরা ইত্যাদির বাইরে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ও তাঁর দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্যে স্বেচ্ছাধীন দানই ইনফাক ফি সাবিল আল্লাহ বলে বিবেচিত।

 

এর বিপরীতে একজন অমুসলিম ভোক্তার লক্ষ্য হচ্ছে: “Eat, Drink and be merry”। অর্থাৎ, খাও-দাও পান করো আর ফূর্তি করো। কারণ তার বোধ-বিশ্বাসে পরকালীন জীবনের জবাবদিহিতার প্রসঙ্গই নেই। নম্বর এই জীবনে সে বোগ করবে চূড়ান্ত বাবে এবং সেখানে হালাল-হারাম বা বৈধ-অবৈধতার প্রশ্ন নেই। ভারতীয় জীবন দর্শমেনর সাথে পাশ্চাত্যের এই জীবন দর্শনের খুব একটা অমিল নেই। সেখানেও জীবনকে আকণ্ঠ ভোগ করতে বলা হয়েছে। এমনকি ঋণ করে হলেও। ভারতীয় দার্শনিক চার্বাক বলেন-

 

“যাবৎ জীবেৎ সুখং জীবেৎ

 

ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পীবেং।”

 

অর্থাৎ, যতদিন বাঁচো, সুখেই বাঁচো, আর ঋণ করে হলেও ঘি খাও।

 

একজন ইসলামী ভোক্তার চতুর্থ বৈশিষ্ট্য হলো ভোগের ক্ষেত্রে অবশ্যই মধ্যম পন্থা অবলম্বন করবে। তার আচরণ কৃপণের মতোও হবে না, আবার সে অমিতব্যয়ীও হবে না। আল্লাহ নিজেই এ সম্বন্ধে বলেন- “তারা যখন ব্যয় করে তখন অযথা ব্যয় করে না, কৃপণতাও করে না, এবং তাদের পনথা হয় এ দুয়েল মধ্যবর্তী।” (সূরা আল-ফুরকান: ৬৭ আয়াত)। উপরন্তু ইসলামী ভোক্তা অপব্যয়কারীও হবে না। কারণ আল্লাহ অপব্যয়কারীকে শয়তানের ভাই হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। (দ্রষ্টব্য: সূরা বনি ইসরাঈল: ২৭ আয়াত)

 

ইসলামী অর্থনীতিতে কঠোর কৃচ্ছ্রতা অবলম্বন কিংবা লাগামহীন ভোগের কোন সুযোগ নেই। আল-কুরআনে ইরশাদ হয়েছে-

 

. ইসলামের দৃষ্টিতে অভাব প্রয়োজন

 

সনাতন অর্থাৎ অনৈসলামী ভোক্তার আচরণে ধরে নেওয়া হয় মানুষের অবাব অসীম এবং সকল ভোক্তাই তাদের সকল অবাব মেটাবার সর্বাত্মক চেষ্টা করে। অভাবই ভোক্তার আচরণের প্রেরণা বা শক্তি যোগায়। এটা আবার উপযোগের উপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ কোনো দ্রব্যের উপযোগ থাকলে মানুষতা ভোগ বা অর্জন করার চেষ্টা করে। ইসলামী অর্থনীতিতে কিন্তু অভাব ও উপযোগের এরকম ধারণা গ্রহণ করা হয়নি। এখানে প্রয়োজন অভাবেরএবং মাসলাহ উপযোগের স্থান দখল করেছে। প্রয়োজন ও অভাবের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য হলো- প্রয়োজন সসীম কিন্তু অভাব অসীম। প্রয়োজন মাসলাহ দ্বারা নির্ধারিত আর অভাব উপযোগ দ্বারা নির্ধারিত। মাসলাহ শব্দটি আরবী। এর অর্থ কল্যাণ। কল্যঅণ ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়। কল্যাণেল মধ্যে অন্তর্নিহিত রয়েছে পার্থিব ও আখিরাতের কল্যাণ।

 

ইমাম আল-শাতিবীর মতে এ মাসলাহই জীবনের অপরিহার্য মৌলিক উপাদানগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করে। তিনি মানুষের জীবনের অপরিহার্য পাঁচটি উপাদানের কথা উল্লেখ করেছেন। যথা:

 

১. আল-ঈমান (বিশ্বাস)(

 

২. আন-নফস (জীবন);

 

৩. আল-মাল (সম্পদ);

 

৪. আল-আকল (বুদ্ধিমত্তা) এবং

 

৫. আল-নসল (বংশধর)

 

যে সমস্ত দ্রব্য ও সেবার এই পাঁচটি মৌলিক উপাদান বিকাশের ক্ষমতা রয়েছে সেগুলোর মাসলাহ আছে বলে ধরে নেওয়া হয়। এই মাসলাহধর্মী দ্রব্য ও সেবাই ইসলামী অর্থনীতিতে প্রয়োজন হিসাবে চিহ্নিত।

 

একজন ভোক্তার কাছে কোন দ্রব্য বা সেবার মাসলাহা রয়েছে কিনা তা নির্ধারণের জন্যে সে নিজেই সর্বোত্তম বিচারক। উপযোগের সাথে এর পার্থক্য এই যে, একজন ভোক্তা কোন দ্রব্যের উপযোগ রয়েছে কিনা তা নির্ধারণের জন্যে যেসব মানদন্ডের প্রয়েঅজন তা সে নিজেই নির্বাচন করতে পারে। কিন্তু মাসলাহ্‌র ক্ষেত্রে সেসব মানদন্ড বাছাইয়ের ক্ষমতা কোন ব্যক্তির ইচ্ছার উপর ছেড়ে দেওয়া হয়নি। এগুলো এক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট ও স্থির। পক্ষান্তরে ব্যক্তির মাসলাহ সামাজিক মালাহের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। উপরে মানব জীবনের যে পাঁচটি মৌলিক উপাদানের কথা বলা হয়েছে তা যেমন একজন ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য তেমনি তা গোটা সমাজের জন্যেও প্রযোজ্য।

 

সনাতন অর্থনীতিতে কোন দ্রব্যের উপযোগ অর্থাৎ পার্থিব কল্যাণ থাকলে ভোক্তারা তার অভাব অনুভব করে। পক্ষান্তরে কোনো দ্রব্যেল মাসলাহ অর্থাৎ পার্থিব ও পারলৌকিক কল্যাণ উভয়ই থাকলে একজন ইসলামী ভোক্তা তার প্রয়োজন অনুভব করে। ইমাম আল-শাতিবী ইসলামী শরীয়াহর পুংখানুপুংখু পর্যালোচনা করে প্রয়োজনকে তিন স্তরে ভাগ করেছেন। যথা-

 

(ক) যরুরয়াত বা অত্যাবশ্যকীয়;

 

(খ) হাজিয়াত বা পরিপূরক, এবং

 

(গ) তাহসানিয়াত বা উন্নতিমূলক।

 

ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে সমাজে যে বস্তুগুলো যরুরীয়াত বা অত্যাবশ্যক বলে বিবেচিত সেগুলো হলো-

 

১. জীবনের মৌলিক চাহিদা পূরণ। অর্থাৎ খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষার দাবী মেটানো;

 

২. সম্পত্তি সংরক্ষণ, সম্পদের অপচয়রোধ ও অন্যের সম্পত্তি গ্রাস করা থেকে বিরত রাখা;

 

৩. যাবতীয় নেশার সামগ্রী এবং বিচার শক্তিকে কলুষিত করে এমন সব দ্রব্যের উৎপাদন, বন্টন ও ভোগ নিষিদ্ধকরণ;

 

৪. যাকাত আদায় ও বন্টনের ব্যবস্থা করা।

 

হাজিয়াতের মধ্যে ঐসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত যেগুলোর সরবরাহ বা ব্যবনহার ব্যক্তি মানুষের জীবনকে কঠোরতা হতে কিছুটা আরাম বা স্বস্তির দিকে নিয়ে যায়। তাহসানিয়াত তার চেয়ে আরও এক ধাপ উপরে। এখানে যেসব দ্রব্যসামগ্রী ভোগ করা হয়, ব্যবহার করা হয় অথবা সেবা পাওয়া যায় তা জীবন-যাপনের গুণগত মান বৃদ্ধি করে। বিশেষতঃ পেশাদারী জীবন বা বিশেষজ্ঞদের জন্যে যা হাজিয়াত বলে বিবেচ্য সাধারণ লোকের জন্যে তাই-ই তাহসানিয়াত বলে বিবেচ্য হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ এয়ারকুলার কোন গবেষণাগারের জন্য যরুরীয়াত, প্রতিষ্ঠানের জন্যে হাজিয়াত এবং বাসগৃহের জন্যে তাহসানিয়াত হিসেবেই গণ্য হবে।

 

মনে রাখা দরকার প্রকৃত ইসলামী ভোক্তার আচরণ ইসলামী জীবনেরই বাস্তব প্রতিচ্ছবি। আমাদের চরিত্রে ও বাস্তব জীবনে এর প্রতিফলন যত বেশী গটবে ততই আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে সক্ষম হবো। হালাল রুজী উপার্জন ও মাসলাহ প্রাপ্তির মাধ্যমে আমাদের নশ্বর জীবনহোক কল্যাণময় এবং আখিরাতে আল্লাহর সন্তুষ্টি প্রাপ্তির মাধ্যমে হোক চরম সফলতাময়। এজন্যে আমাদের জীবন যাপনে তথা অর্থনৈতিক কার্যক্রমে প্রতিফলিত হতে হবে ইসলামী ভোক্তার সঠিক স্বরূপ।

 

ইসলামী অর্থনীতিতে আয় সস্পদ বন্টন

 

.

 

আয় ও সম্পদের সুষ্ঠু বন্টনের উপরই নির্ভর করে একটি জাতির বা দেশের সমৃদ্ধি ও উন্নতি। দেশের জনসাধারণের কর্মসংস্থান, উৎপাদন বৃদ্ধি, বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি এবং সেই সাথে কারা হাতে যেন সম্পদ পুঞ্জীভূত হতে না পারে তা নির্ভর করেসমাজে বিদ্যমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উপর। সমাজে কি ধরনের অর্থনীতি বা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু রয়েছে তার উপরেই নির্ভর করে আয় ও সম্পদ বন্টন সুষ্ঠু হবে, না বৈষম্যপূর্ণহ হবে। সম্পদের মালিকানার ধরন, আইনগতভাবে তার পরিচালনা এবং রাষ্ট্রীয়ভাবেতার যথাযথ নিয়ন্ত্রণের উপরে আয় ও বন্টনের সাম্য বা বৈষম্য নির্ভর করে। রাষ্ট্র শুধুমাত্র কিছু আইন প্রণয়ন ও কর আরোপ করে থাকে। ক্ষেত্রবিশেষে কিছু কিছু খাত রাষ্ট্রের নিজস্ব জিম্মাদারীতেও থাকে। কিন্তু ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সততা এবং নৈতিকতার উপর কিছুমাত্র নজর দেয় না। যেহেতু নৈতিকতার প্রতিষ্ঠা এবং পরকালে আল্লাহর নিকট পুঁজিবাদী দর্শনের ভিত্তি নয় সেহেতু পুঁজিবাদী সমাজ ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় মানুষ নানা কৌশলে, সাধারণতঃ অসৎ ও অবৈধ উপায়ে আয়-উপার্জনের চেষ্ট করে।

 

অপরদিকে সমাজতন্ত্রে ব্যক্তি মালিকানার সীমারেখা খুবই সংকুচিতহ। কোন ক্ষেত্রে একেবারেই নেই। সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহে আয় ও সম্পদ বন্টন পুরোপুরি রাষ্ট্রের কর্ণধারদের খেয়াল-খুশীর উপর নির্ভরশীল। এই খেয়াল-খুশী যে কতখানি ব্যক্তিনির্ভর তা আজকের দুটি বৃহৎ সমাজবাদী দেশ-সোভিয়েত রাশয়া ও গণচীনের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে সহজেই উপলব্ধি হবে। ইসলাম এই দুই চরমধর্মী প্রান্তের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থান নিয়েছে। অর্তা, ইসলামে ব্যক্তি মালিকানার স্বীকতি রয়েছে; আয়, ভোগ, বন্টন ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক সাফল্যের অঙ্গীকার রয়েছে। কিন্তু কোনটিই লাগামহীন নয়, নিরংকুশভাবে ব্যক্তির ইচ্ছাধীন বা রাষ্ট্রের এখতিয়ারভুক্ত নয়। ব্যক্তি, গোষ্ঠী এবং রাষ্ট্র আল-কুরআন ও সুন্নাহ নির্দেশিত পথেই সম্পদ উপার্জন ও ভোগ করবে; সমাজে আয়-ব্যয় নিয়ন্ত্রিত হবে, বৈধতার ভিত্তিতেই উপায়-উপার্জন করবে এবং সম্পদের মালিকানা ও বন্টন নির্ধারিত হবে।

 

মূলতঃ অসৎ ও অবৈধ উপায়ে উপার্জনের ফলেই সমাজে ধনবন্টন বৈষম্য দেখা দেয়। এসব অসৎ ও অবৈধ উপায়কে তিনটি বড় ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমতঃ অবৈধ উপায়ে আয়ের সুযোগের মধ্যে রয়েছে মজুতদারী, মুনাফাখোরী, ঘুষ, কালোবাজারী, ফটকাবাজারী প্রভৃতি। এসব অবৈধ ও অনৈতিক উপায়ে ব্যক্তির হাতে সম্পদের পাহাড় জমে ওঠে। যে সমাজে নৈতিক দিক দিয়ে এসব অবৈধ পন্থা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নেই সে সমাজে শুধু আইন প্রয়োগ করে কোন সাফল্য অর্জিত হয়নি, হওয়ার সম্ভাবনাও নেই। দ্বিতীয়তঃ সম্পদ পুঞ্জীভূত করে রাখার সুযোগ। এক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি হচ্ছে ধনসম্পদ উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বন্টিত হতে না দেওয়া। সম্পদ এখানে শধুমাত্র বিত্তশালীদের মধ্যেই আবর্তিত হতে থাকে এবং সেনা-রূপা-হীরা-জহরত, বিপুল জমি, প্রাসাদোপম বাড়ী অলংকারের মাধ্যমে বিত্ত ক্রমাগত মুষ্টিমেয় লোকের হাতে মজুদ হয়। কোনক্রমেই এই সম্পদ বিত্তহীন বা কম সৌভাগ্যবান লোকদের কাজে আসে না। শোষণের ও ধনবন্টনের ক্ষেত্রে বৈষম্য সৃষ্টির তৃতীয় যে বড় অবৈধ উপায় সমাজে বিদ্যমান তা হলো সুদ এবং মহাজনী প্রথার ঋণ। সুকৌশলে সমাজের সর্বস্তরের লোকদের শোষণর সবচেয়ে মোক্ষম হাতিয়ার সুদ। সুদের কারণেই অর্থনীতিতে মারাত্মক বিপর্যয়, ভারসাম্যহীনতা, মন্দা ও অস্থিরতা দেখা দেয়। অথচ সুদই পুঁজিবাদের জীয়নকাঠি বা Lifeblood।

 

.

 

ইসলামী অর্থনীতি তথা ইসলামী সমাজে আয় ও ধনবন্টন কিভাবে হবে তার মূলনীতিগুলো করআন ও সুন্নাহতে সুস্পষ্টভাবেই উল্লেখ করা হয়েছে। ইসলামী আকিদা মুতাবিক সমস্ত সম্পদের মালিকানা আল্লাহরই। তিনিই এর স্রষ্টা। মানুষকে সীমিত সময়ের জন্যে তিনি শর্তাধীন মালিক করে দিয়েছেন। তাকে নিরংকুশ মালিকানা দেওয়া হয়নি। ব্যাপারটা অনেকটা বাড়ীর মালিক ও ভাড়াটিয়ার মধ্যের সম্পর্কের মতো। বাড়ীর মালিকই হলো প্রকৃত মালিক, ভাড়াটিয়া বা ইজারা গ্রহীতা কতকগুলো শর্তপূরণ সাপেক্ষে সেই বাড়ীর বসবাস বা অন্য কাজে ব্যবহার করতে পারেন। শর্তের মধ্যে নিয়মিত ভাড়া পরিশোধ করা ছাড়াও থাকতে পারে দেয়াল ভাংগা বা জানালা বদলানো যাবে না, গাছ কাটা যাবে না, ছাদে বাগান করা যাবে না ইত্যাদি। অনুরূপভাবে কতকগুলো শর্ত পালন সাপেক্ষে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর প্রতিনিধি মানুষ বা ইনসানকে তাঁর সম্পদ ব্যবহার করার অধিকার দিয়েছেন।

 

ইসলামে স্বেচ্ছাধীনভাবে আয়ের যেমন সুযোগ নেই তেমনি ইচ্ছামত ভোগ ও ব্যয়েরও কোন সুযোগ নেই। এই মূল দৃষ্টিভংগীর প্রেক্ষিতে কুরআন ও হাদীসে সম্পদ উপার্জন, ব্যবহার ও বন্টনের ক্ষেত্রে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ এসেছে। সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ কয়েকটি এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে।

 

“হে ঈমানদারগণ! একে অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না। কিন্তু ব্যবসা-বাণিজ্য যদি পরস্পরের সম্মতিক্রমে হয় তবে আপত্তি নেই।” (সূরা আন-নিসা: ২৯ আয়াত)

 

“অতি পীড়াদায়ক আযাবের সুসংবাদ দাও সেই লোকদের যারা স্বর্ণ-রৌপ্য পুঁজি করে রাখে এবং তা আল্লাহর পথে খরচ করে না।” (সূরা আত-তাওবা: ৩৪ আয়াত)

 

“ইহা জীবন যাপনের ব্যবস্থা সেই মুত্তাকীনদের জন্যে যারা অদৃশ্যে বিশ্বাস করে, নামায কায়েম করে এবং তাদেরকে যে রিযিক দিয়েছি তা থেকে (আল্লাহর পথে) ব্যয় করে।” (সূরা আল-বাকারা: ২-৩ আয়াত)

 

“আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে করেছেন হারাম।” (সূরা আল বাকারা: ২৭৫ আয়াত)

 

“সম্পদ যেন কেবল তোমাদের ধনীদের মধ্যেই অবর্তিত না হয়।” (সূরা আল-হাশর: ৭ আয়াত)

 

“নিশ্চয়ই অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই।” (সূরা বনি ইসরাইল: ২৭ আয়াত)

 

“তাদের ধন-সম্পদের মধ্যে প্রার্থী ও অভাবগ্রস্তদের অংশ নির্ধারিত রয়েছ।” (সূরা আল-যারিয়াত: ১৯ আয়াত)

 

অনুরূপভাবে হাদীস শরীফেও প্রচুর নির্দেশ রয়েছে। যেমন:

 

“যারা দাম বৃদ্ধির উদ্দেশ্রে প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি চল্লিশ দিনের বেশী মজুদ রাখে তাদের সাথে আমার (অর্থাৎ রাসূলের) কোন সম্পর্ক নেই।” (মিশকাত)

 

“যে ব্যক্তি প্রতিবেশীকে অভুক্ত রেখে নিজে পেট পুরে খায় সে প্রকৃত মুমিন নয়।” (বুখারী)

 

“যারা অন্যকে ঠকায় ও অন্যের সাথে প্রতারণা করে তাদের আমাদের (অর্থাৎ মুমিনদের) মধ্যে নেই। (বুখারী)

 

“বর্গাদারী প্রথায় যদি কোন পক্ষের তাদের ন্যায্য অংশ থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশাংকা থাকে তবে তা নিষিদ্ধ হবে।” (মিশকাত)

 

উপরোক্ত নির্দেশসমূহের আলোকে রাসুলে করীম (স) তাঁর জীবদ্দশাতেই মদীনার ইসলামী রাষ্ট্রে ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কায়েম করেন। তাঁর মৃত্যুর পর মহান খুলাফায়ে রাশিদূনও (রা) সেই একই পথ অনুসরণ করেছিলেন। সে সময়ে ইসলামী দুনিয়ার বিস্তৃতি ঘটেছিল অবিশ্বাস্যরকম দ্রুতগতিতে। সুদূর স্পেনে কর্ডোভা হতে দূর প্রাচ্রের ইন্দোচীন (আজকের ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া) পর্যন্ত েইসলামের সুশীতল বাতাস প্রবাহিত হচ্ছিল। সোভিয়েত রাশিয়ার উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, আজারবািইজান, কাজাখাস্তান পার হয়ে সুদূর চীনের কাশগড়, জিনিজিয়াং, গানসু প্রভৃতি অঞ্চল পর্যন্ত ইসলামের জীবন বিধান বাস্তবায়িত হয়েছিল। সেই আমলে রাষ্ট্রের বিস্তৃত কর্মকাণ্ড, নতুন নতুন এলাকার বিশেষ বিশেষ অবস্থা ইত্যাদির প্রেক্ষিতে ইসলামী চিন্তাবিদরা ইসলামী অর্থনীতি সম্বন্ধে আল-কুরআন ও সহীহ হাদীসের আলোকে বিস্তৃত গবেষণা করেন। আয় ও সম্পদ বন্টনের ক্ষেত্রে যেসব মুসলিম অর্থনীতিবিদ বক্তব্য রেখেছেন তাঁদের মধ্যে আবু ইউসুফ, ইবনে তাইমিয়া, আবু ইসহাক আল-শাতিবী, নাসিরুদ্দীন তুসী, ইবনে খালদুন প্রমুখ ব্যক্তিত্বের নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

 

.

 

আবু ইউসুফ তাঁর কিতাবুল খারাজ বইয়ে সম্পদ কিভাবে সমাজে বন্টিত হবে তার পদ্ধতি ও কর্মকৌশল সম্বন্ধে বিশদ আলোচনা করেছেন। তাঁর আলোচনায় কৃষি জমির উশর ও খারাজ আদায় চাড়াও জমির মালিকানার ধরন ও পদ্ধতি বিষয়েও মতামত ব্যক্ত করেছেন। তাঁর মতে জমি যেমন অনাবাদী রাখা যাবে না তেমনি কেউ এত বেশী জমির মালি হতে পারবে না যা তার পক্ষে সুষ্ঠুভাবে চাষাবাদ করা দুরূহ হয়ে দাঁড়ায়। এছাড়া তিনি আনুপাতিক হারে কর বৃদ্ধিরও কথা বলেছেন। সম্পদ বন্টনের ক্ষেত্রে তিনি উত্তরাধিকার আইরে যথাযথ প্রয়োগের উপরও সমধিক জোর দিয়েছেন।

 

ইবনে তাইমিয়া তাঁর সুবিখ্যাত গ্রন্থ আল-হিসবাহ ফি আল-ইসলাম বইয়ে জনগণের উপার্জন ও কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সরকারের আবশ্যিক ও দায়িত্বশীল ভূমিকার কথা বলেছেন। জনসাধারণের কর্মসংস্থানের মাধ্যমে তাদের আয়-উপার্জনের সুযোগ সৃষ্টির জন্যে রাষ্ট্র একদিকে যেমন উপায়-উপকরণ সরবরাহ করবে তেমনি অন্যদিকে তাদেরকে কাজের উপযোগী হয়ে গড়ে ওঠারও সুযোগ সৃষ্টি করবে। গর মৌসুম বা Slack Season-এ যখন ক্ষেতে-খামারে কাজ মেলে না সে সময়ে রাষ্ট্র জনকল্যাণমূলক কাজ যেমন রাস্তা ও সেতু তৈরী ও মেরামত, মুসাফিরখানা সংস্কার, রাস্তার ধরে গাছ লাগানো প্রবৃতি কাজের মাধ্যমে বেকার ও ছদ্মবেকার লোকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারে। এভাবেই সমাজে সাধারণ লোকের আয়ের নিশ্চয়তার সৃষ্টি হবে। অনুরূপভাবে সরকার সকল অবৈধ উপায়ে আয়ের পথ রুদ্ধ করে দেবে এবং ধনী ব্যক্তি ও বিত্তশালী ব্যবসায়ীদের উপর নজর রাখবে। প্রয়োজনে ন্যূনতম হস্তক্ষেপ করে বন্টন ও বাজার ব্যবস্থাকে সঠিক পথে পরিচালিত করার দায়িত্বও সরকারেরই। ইবনে হাযমের মতে উপযুক্ত কর আরোপের মাধ্যমে ধনীদের আয়হ্রাস ও গরীবদের কল্যাণের দায়িত্বও সরকারেরই।

 

প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী ও আধুনিক ধনবিজ্ঞানের জনক হিসাবে পরিচিত ইবনে খালদূনও তাঁর সুপ্রসিদ্ধ বই আল-মুকাদ্দামা-তে সমাজে আয় আবর্তন ও সম্পদ বন্টনের বিষয়ে কুরআন ও হাদীসের আলোকে আলোচনা করেছেন। উপরন্তু সমকালীন সমাজে সে সবের প্রয়োগ পদ্ধতি ও তার সুফল সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন। তিনি বিশেষ করে বেতনভোগী শ্রেণীর পদ্ধতি ও তার সুফল সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন। উপরন্তু সমকালীন সমাজে সে সবের প্রয়োগ পদ্ধতি ও তার সুফল সম্পর্কে উল্লেখ করেছন। তিনি বিশেষ করে বেতনভোগী শ্রেণীর ক্রয় ক্ষমতার নিশ্চয়তা বিধান, কৃষিজীবিদের উৎপাদিত পণ্যের মূলের স্থিতিশীলতা ও সৈনিকদের বেতন নির্ধারণ বিষয়েও আলোচনা করেছেন। এই প্রসঙ্গে তিনি শহরাঞ্চল ও গ্রামীণ েএলাকার মধ্যে আয় বৈষম্য ও তা দূর করার উপায় সম্বন্ধে উল্লেখ করেছেন।

 

একেবারে সাম্প্রতিক কালের কথা যদি ধরা যায় তাহলে দেখা যাবে হিজরী চতুর্দশ শতকের শেষ ভাগ হতে যে ইসলামী পূনর্জাগরণ শুরু হয়েছে সে ক্ষেত্রে ইসলামী অর্থনীতিবিদরাও পিছিয়ে নেই। শহীদ সাইয়েদ কুতুব হতে শুরু করে সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী, খুরশীদ আহমদ, উমর চাপরা, নেজাতুল্লাহ সিদ্দিকী, ইউসুফ কারযাবী, বাক্কীর আল-সদর, হাসান আবু রুকবা, মনযের কা’ফ, আনাস জারকা, এস.এন.এইচ. নকভ, িআবুল হাসান এম. সাদেক প্রমুখ প্রখ্যাত ইসলামী অর্থনীতিবিদগণ তাঁদের বিভিন্ন মুখী আলোচনায় দেখাবার প্রয়াস পেয়েছেন যে, যতক্ষণ না আমরা হযরত মুহাম্মদ (স) প্রদর্শিত আমর বিল মারুফ (বা সুনীতির প্রতিষ্ঠা) এবং নেহী আনিল মুনকার (বা দুর্নীতির উচ্ছেদ) এর পথ বাস্তবিকই অনুসরণ করছি এবং উপার্জনের ও ধনবন্টনের সকল ক্ষেত্রে হালালকে গ্রহণ ও হারামকে বর্জন না করছি ততক্ষণ সমাজে শান্তি ও স্বস্তি, নিরাপত্তা ও কল্যাণ আসতে পারে না। অর্থনতি তার স্বাভাবিক গতিধারায় চলতে পারে না।

 

.

 

প্রসঙ্গতঃ মনে রাখা দরকার, ইসলামী অর্থনীতির মূল বুনিয়াদ তৌহিদ, রিসালাত ও আখিরাত এবং এই অর্থনীতি একটি ব্যবস্থাপনা নির্ভর অর্থনীতি (Managed economy)। পক্ষান্তরে পুঁজিবাদী বা ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি মূলতঃ উন্মুক্ত বা অবাধ অর্থনীতি (Open economy) এবং সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি হচ্ছে সর্বাত্মক নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতি (Totally controlled economy)। সুতরাং, আদর্শগত ও প্রয়োগগত পার্থক্যের কারণেই ইসলামী অর্থনীতির কর্মধারা এবং তার বাস্তব রূপও ভিন্নতর হতে বাধ্য। সে কারণেই সামাজিক সাম্য অরজন, ইনসাফপূর্ণ বন্টন, দরিদ্র শ্রেণীর হক আদায় ও অধিকতর মানবিক জীবন যাপনের সুযোগ প্রদান এবং ধনীদের বিলাসিতা, অপচয় ও অপব্যয় বন্ধের জন্যে আয় ও বন্টনের ক্ষেত্রে ইসলাম যে মূলনীতিগুলোর আবেদন ও প্রয়োগ সার্বজনীন ও সর্বকালীন। ইসলামের ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, যতদিন মুসলিম দেশসমূহ ইসলামী ভাবধারা ও নীতিমালা অনুসরণ করেছে ততদিন তার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ঘটেছে; জনজীবনে স্বস্তি, নিরাপত্তা ও কল্যাণ নিশ্চিত হয়েছে। পক্ষান্তরে এর ব্যতিক্রম মুসলিম সমাজের পতন ডেকে এনেছে।

 

এতক্ষণে একথা পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, ইসরামী অর্থনীতিতে আয় ও সম্পদ বন্টনের ক্ষেত্রে অনুসৃতব্য মূলনীতিসমূহের ভিত্তি হচ্ছে আমর বিল মারুফ ও নেহী আনিল মুনকার। বস্তুতঃ সামাজিক সাম্য অর্জনের জন্যে চাই কুরআন ও সুন্নাহর ভিত্তিতে সম্পদের ইনসাফপূর্ণ বন্টন ও ব্যবহার এবং প্রকৃত আন্তরিক প্রয়াস। উপরন্তু ইসলামী অর্থনীতি বাস্তবায়নের জন্যে চাই ইসলামী আইন ও সমাজ ব্যবস্থা। এই সমাজে মানুষ যা উপার্জন করবে তা অবশ্যই বৈধ পন্থায় হবে-একথা স্বীকার করে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই অবৈধ উপায়ে আয়ের তথা ভোগ বন্টনের সকল পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। প্রত্যেকেই যা হালাল তা অর্জনের জন্যে যেমন সচেষ্ট থাকবে তেমনি যা হারাম তা বর্জনের জন্যেও সর্বাত্মক প্রয়াস চালাবে।

 

কাজে ফাঁকি দেওয়া, পণ্যে ভেজাল দেওয়া, ওজনে কম দেওয়া, অন্যের জমি ও সম্পদ জবরদখল করা চোরাচালান মজুতদারী মুনাফাখোরী কালোবাজারী দামে হেরফের করা কর ফাঁকিত দেওয়া, মাদক দ্রব্যের ব্যবসা, টেন্ডার ছিনতাই, ঘুষ ও চাঁদাবাজি প্রভৃতি সকল ধরনের অসাধুতার পথ ইসলামে সকলের জন্যেই চিরতরে বন্ধ। কিন্তু মানুষ যেহেতু প্রকৃতিগতভাবে দুর্বল, শয়তানের প্ররোচনা নিরন্তন তাকে হাতছানি দেয়, তাড়া করে বেড়ায় তাই অসৎ ও অবৈধ উপায়ে আয়ের প্রবণতা তার মধ্যে থাকতে পারে। এই অবস্থা থেকে মানুষকে নিবৃত্ত করার জন্যেই রাসূলে করীম (স) ও তাঁর পরবর্তী যুগেও হিসবাহ ও হিজর নামে দুটি প্রতিষ্ঠান কার্যকর ছিল। প্রতিষ্ঠান দুটির দায়িত্বই ছিল উপরে উল্লেখিত অসৎ কাজ হতে সমাজের লোকদের বিশেষতঃ ব্যবসায়ীদের নিরস্ত্র রাখা এবং প্রয়োজনে শাস্তির ব্যবস্থা করা। প্রতিষ্ঠান দুটির এতদূর ক্ষমতা ছিল যে, তারা আধ ও দুর্বিনীত ব্যক্তির সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে পারতো।

 

বেহুদা ব্যয় বা অপব্যয়, বিলাস-ব্যসনেও সামাজিক বৈষম্য সৃষ্টির অন্যতম কারণ। তাই সৎ বা বৈধভাবে অর্জিত অর্থও বেহুদা ব্যয় করা নিষেধ। বেহুদা খরচ সম্পর্কে মহান খুলাফায়ে রাশিদুন (রা) েএতদূর সতর্ক ছিলেন যে, মিষরের গভর্ণর তার সরকারী বাসভবনের প্রাচীর তৈরী করালে তা ভেঙ্গে ফেলার জন্যে লোক পাঠানো হয় এবং গভর্ণরকে পদচ্যূত করা হয়। সরকারী কর্মকর্তাদের মিতব্যয়ী হতে বলা হতো, তাদেরকে কলমের নিব সরু করে নিতে এবং কাগজের মার্জিনেও লিখতে পরামরশ দেওয়া হতো। এ থেকেই বোঝা যায় তাঁরা কি অপরিসীম নিষ্ঠার সাথে বেহুদা ব্যয় নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালাতেন। অথচ আজকের সমাজে নানা সামাজিক অনুষ্ঠাননে যে অর্থ অপচ্যয় হয় তা দিয়ে কয়েকটা পরিবারের সারা মাসের খরচ নির্বাহ হতে পারে।

 

যে কোন সমাজে আয় ও সম্পদে বন্টনে বৈষম্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে সুদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যে দেশে যে সমাজে, যে অর্থনীতিতে একবার সুদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে সে অর্থনীতি পঙ্গু হয়ে গেছে, সে সমাজ ধ্বংস হয়ে গেছে। ধনী-গরীবের পার্থক্য হয়েছে বিপুল আর নির্যাতিত বঞ্চিত মানুষের আহাজারিতে ভরে গেছে আকাশ, বাতাস, জনপদ। সুদের বিদ্যমানতার ফলে অর্থনীতিতে যেসব প্রত্যক্ষ কুফল লক্ষ্য করা গেছে সে সম্বন্ধে বিস্তারিত জানা যাবে সুধঃ অর্থনৈতিক কুফল ও উচ্ছেদের উপায় শীর্ষক প্রবন্ধ হতে।

 

ঐসব কুফলের জন্যেই ইসলামে সুদকে এত কঠোরভাবে হারাস বলে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং রাসূলে করীম (স) মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর হতেই সুদের বিরুদ্ধে জিহাদ করে গেছেন। বিদায় হজ্বের অমর বাণীতেও তিনি এ ব্যাপারে মুসলিম উম্মাহকে কঠোরভাবে সতর্ক করে দিয়েছেন। তাঁরই চেষ্টায় প্রথমে মদীনা হতে ও পরবর্তকিালে সমগ্র ইসলামী বিশ্ব হতে সুদ নির্মুল হয়ে যায়। সুদের ভয়াবহ পরিণাম ও আখিরাতে তার শাস্তি সম্পর্কেও তিনি উল্লেখ করেছেন। দুর্ভাগ্যের বিষয়, ইসলামী হুকুমাতের পতন দশা শুরু হওয়ার পর যখন খৃস্টান শাসকগোষ্ঠী তথা পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যলিপ্সু শক্তি একের পর এক মুসলিম দেশে তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা শুরু করে তখন তাদের সহযোগিতায় ও তাদেরই তৈরি আইনের আওতায় সুদভিত্তিক লেনদেন শুরু হয়ে যায়। অবশ্য বিলম্বে হলেও সুদনির্ভর অর্থনীতির দেশে এর মারাত্মক অর্থনৈতিক ও সামাজিক কুফল সম্বন্ধে সচেতনতা সৃষ্টি শুরু হয়েছে।

 

ধনবন্টনে সাম্য স্থাপনের ক্ষেত্রে ইসলামী মীরাস বা উত্তরাধিকারীদের মধ্যে স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির বাঁটোয়ারা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি। ইসলাম-পূর্ব যুগে বিশ্বে সম্পদ বন্টনের কোন বৈজ্ঞানিক ও স্বাভাবিক পন্থা বিদ্যমান ছিল না। ইসলামের সর্ব প্রথম মৃতের সম্পদ তার আত্মীয়-পরিজনদের মধ্যে ভাগ করে দিয়ে একদিকে যেমন তাদের তাৎক্ষণিক অসহায় অবস্থা দুল করতে সমর্থ হয়েছে তেমনি অন্যদিকে ব্যক্তিবিশেষের হাতে সকল সম্পদ কুক্ষিগত হওয়ার বিপদও দূর করেছে। উপরন্তু সম্পত্তিতে নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে তাদেরকে নিজের পায়ে দাঁড়াবার সুযোগ করে দিয়েছে। কিভাবে ও কাদের মধ্যে স্থাপর-অস্থাবর সম্পদ বাঁটোয়ারা হবে সে বিষয়ে সূরা আন-নিসায় ব্যাপক ও বিস্তৃত নির্দেশনা রয়েছে। এত ব্যাপক ও বিস্তৃত নির্দেশ আর কোন ধর্ম বা ইজমে নেই।

 

পসঙ্গতঃ যুক্তি হিসাবে বলা যেতে পারে সম্পদের অধিকতর সুষ্ঠু বন্টনের জন্যে মৃতের সম্পত্তি সর্বহারাদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া যেত অথবা নির্দেশ দেওয়া যেত রাষ্ট্রয়াত্তব করে নেওয়ার। কিন্তু সেক্ষেত্রে প্রত্যেক ব্যক্তিই নিজের নিকট আত্মীয়দের বঞ্চিত হওয়ার সম্ভাবনায় স্বীয় জীবদ্দশাতে সব সম্পদ ব্যয় করার চেষ্টা করতো। তার ফলে সমাজে দেখা দিত আরও বেশী বিশৃংখলা। পক্ষান্তরে মৃতের সম্পত্তি তার স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি ও নিকট আত্মীয়েরা লাভ করায় সম্পদের বন্টন যেমন সার্থক ও অর্থবহ হয় তেমনি তারাও রাতারাতি সর্বহারাদের কাতারে গিয়ে শামিল হওয়া থেকে বেঁচে যায়।

 

এখানে উল্লেখ করা আদৌ অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, আমাদের দেশে বেআইনী বা জবরদস্তিমূলক স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি দখল করা বর্তমানে একটা রেওয়াজ বা দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছে। আত্মীয়-স্বজনের জমি, ইয়াতীম ও নাবালকদের সম্পত্তি, এমন কি প্রতিবেশীর জমি-বাগান-দালান ছাড়াও শত্রু সম্পত্তি কিংবা সরকারী সম্পত্তি (খাস জমিসহ), বাড়ীঘর, প্রতিষ্ঠান জবর দখল করে, কিংবা জাল/ভূয়া দলির করে এক শ্রেণীর মানুষ রাতারাতি বিত্তশালী (এবং একই সাথে প্রতিপত্তিশালী) হওয়ার সুযোগ নিচ্ছে। এদের যেন কেউ রুখবার নেই। আইন এদের কাছে বড়ই অসহায়। এই অবস্থা চলতে থাকলে ইসলামের দোহাই পেড়ে বা রাষ্ট্রধর্মের বরাত দিয়ে দেশে শ্রেণী বৈষম্য দূর করা কখনই সম্ভব হবে না। বরং বৈষম্যই শুধু বাড়বে না, সেই সঙ্গে বাড়বে নির্যাতন, নিপীড়ন, যার পরিণাম কোটি বনি আদমে বেদনাক্লিষ্ট ও হতাশাপূর্ণ জীবন।

 

.

 

যাকাত আদায় এবং তার যথোচিত ব্যবহার সম্পদের সুবিচারপূর্ণ বন্টনের ক্ষেত্রে আর একটি বলিষ্ঠ ও গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। যাকাতের মাধ্যমে সম্পদের একটি সুনির্দিষ্ট অংশ এমন কয়েকটি নির্দিষ্ট খাতে বন্টিত ও ব্যবহৃত হয় যাদের প্রকৃতই বিত্তহীন শ্রেণীভুক্ত বা Have-notes বলা হয়। এদের মধ্যে রয়েছে গরীব, মিসকীন, ঋণগ্রস্ত, মুসাফির, ক্রীতদাস এবং ক্ষেত্রবিশেষে নও মুসলিম। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, কয়েকটি উজ্জ্বল ব্যতিক্রম ছাড়া অধিকাংশ মুসলিম দেশেই রাষ্ট্রীয়ভাবে যাকাত আদায় এবং তা বিলি-বন্টনের ব্যবস্থা নেই। যাকাত আদায় এখন ব্যক্তিগত ইচ্ছা বা পরবর্তী যুগেও বায়তুল মালের যাকাত অংশ পরিচালনার জন্যে আটটা দপ্তর বা Directorate ছিল। রাষ্ট্রের কঠোর ও নিপুণ ব্যবস্থা ছিল যথাযথভাবে যাকাত আদায় ও তা উপযুক্ত উপায়ে বন্টনের জন্যে। সেজন্যেই গোটা জাযিরাতুল আরবে যাকাত নেবার লোক খুঁজে পাওয়া যেত না সে সময়ে। এর অন্তর্নিহিত অর্থই হলো সেদিনের আরবে দরিদ্র শ্রেণীর বিলুপ্তি ঘটেছিল।

 

ইসলামী হুকুমাত তথা ইসলামী অর্থনীতিতে উশরের মাধ্যমেও সম্পদ বন্টনের ব্যবস্থা চালু ছিল। পদ্ধতি হিসাবে এটি যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি বিজ্ঞানসম্মতও। যে জমিতেসেচ না দিয়ে ফসল উৎপন্ন করা যায় সেই জমির এক-দশমাংশ বা ১০% এবং জে জমিতে সেচ দিয়েসফল উৎপাদন করতে হয় সেই ফসলের এক-বিংশতি অংশ বা ৫% উশর হিসেবে প্রদানের শরীয় বিধান রয়েছে। জমির মালিক হয তা সরাসরি যারা যাকাতের হকদার তাদের মধ্যে বিলিবন্টন করে দেবে অথবা বায়তুল মালে জমা করে দেবে। সেই ব্যবস্থার ফলে সম্পদের, বিশেষতঃ কৃষি পণ্যের/আয়ের সুষ্টু বন্টন নিশ্চিত হতো।

 

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এদেশে বিদ্যমান বর্গাদারী প্রথার কুফল সম্বন্ধে দু’একটি কথা উল্লেখ এখানে অপ্রাসঙ্গিক হবে না। এদেশে ভূমিহীনদের সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ বর্গাদারী প্রথা। দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ কারণ মহাজনী ঋণ ও ব্যাংকের সুদ। বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দেখা যায় এদেশে ১৯৬০ সালে যেখানে ভূমিহীনদের সংখ্যা ছিল ১৭%, ১৯৭৩-৭৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৭.৬% েএ। ১৯৮৭-৮৮ সালে এই পরিমাণ ছিল ৫০% এরও বেশী। বাংলাদেশে প্রায় ৩৯% পরিবার কোন-না-কোন শর্তে বর্গাচাষ করে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায় যদিও ফসলের হিসাবে বর্গাদাররা অর্ধেক পায় প্রকৃতপক্ষে টাকার হিসাবে (খরচসহ) সহ তারা এক-চতুর্থাংশের বেশী পায় না। উপরন্তু তাদের নিজস্ব শ্রমের মুল্য যদি ধরা হয় তাহলে তাদের প্রকৃত আয় অনেক ক্ষেত্রেই ঋণাত্বক হয়ে দাঁড়ায়। এই অবস্থায় বর্গাদাররা কোন দিনও নিজেদের পায়ে দাঁড়াবার স্বপ্ন দেখতে পারে না।

 

৬.

 

ইসলামী অর্থনীতি সমাজ ব্যবস্থা তথা ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থারই অন্তর্ভুক্ত। ফলে ইসলামী অর্থনতির রূপরেখা বাস্তবায়ন করতে হলে সরকারকে অবশ্যই প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। নেতিবাচক পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে কখনও ধনবন্টনে সাম্য আসে না, আসতে পারে না। ইসলামী সোনালী দিনেও মহান খলীফারা কঠোরভাবে তদারক করতেন ইসলামী বিধি-বিধানসমূহ যথাযথ প্রতিপালিত হচ্ছে কিনা। প্রকৃত অর্থেই তাঁরা আমর বিল মারুফ ও নেহী আনিল মুনকারের বাস্তবায়নে সচেষ্ট ছিলেন।

 

আয় ও সম্পদ বন্টনের ক্ষেত্রে সাম্য অর্জনের জন্যে ইসলামে সম্পদ ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনারও বিধান রয়েছে। যে সমস্ত সম্পদের সামাজিক মালিকানা থাকলে তার ব্যবহার সর্বোত্তম হবে এবং সমাজের সকল শ্রেণীর লোকই তা থেকে সুবিধা বা উপকার পাবে সে সকল উপায়-উপকরণই রাষ্ট্রের জিম্মাদারীতে থাকতে পারে। ব্যক্তিবিশেষ ভুলভাবে এসবের মালিক হয়ে গেলেও রাষ্ট্র তা নিজের জিম্মাদারীতে ফিরিয়ে নিতে পারে। অনুরূপভাবে আবাদী জমি ইচ্ছাকৃত ভাবে পতিত রেখে জাতীয় উৎপাদনে বিঘ্ন ঘটালে রাষ্ট্র তাও বরদাশত করবে না। কেননা এর ফলে সমাজে খাদ্য সংকট ও কর্মসংস্থানের অভাব ঘটবে। এই দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে ইসলামের মহান খলীফারা (রা) প্রকৃত চাষীদের মধ্যে প্রচুর আবাযোগ্য অব্যবহৃত জমি বিলি কর দেন। তাছাড়া স্থায়ী সামজিক মূলধন উন্নয়নের মাধ্যমেম অর্থাৎ শিক্ষা স্বাস্থ্য যাতায়া গৃহায়ন প্রভৃতি সবিধার সম্প্রসারণ ও নিশ্চয়তা বিধান করেও ধনবন্টনে অধিকতর সাম্য নিশ্চিত করা সম্ভব। মহান খলীফা রা এবং মুসলিম শাসকগণ তা করেছেনও। এভাবেই ইসলামী শাসন ব্যবস্থার স্বর্ণযুগে আয় ও সম্পদের সঞ্চালন এবং বন্টন সুনিশ্চিত হয়েছে, দারিদ্র দূর হয়েছে সমাজ হতে। পরিণামে একটি কালজয়ী সমৃদ্ধ সভ্যতা হিসাবে ইসলাম নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হয়েছে।

 

মৌলিক চাহিদা পূরণ সমাজে ভারসাম্যপূর্ণ আয় ও সম্পদ বন্টনের ক্ষেত্রে সাম্য অর্জনের অন্যতম উপায়। মৌলিক কপ্রয়োজন পূরণের পথ ধরেই সমাজের বিভিন্ন স্তরের, বিশেষতঃ দরিদ্র জনসাধারণের মধ্যে সম্পদ আবর্তিত হতে শুরু করে। ফলে চাহিদা বৃদ্ধি- উৎাদন ও যোগান বৃদ্ধি- কর্মসংস্থান বৃদ্ধি- আয় বৃদ্ধি পুনরায় চাহিদা বৃদ্ধি িএকটি কাংখিত চক্র আবর্তিত হতে শুরু করে। পরিণামে অর্থনীতিতে েএকটি স্থিতিশীল তেজীভাব সৃষ্টি হয়। এ কারণেই ইসলাম জনগণের প্রত্যেকের মৌলিক চাহিদা পূরণের গ্যারান্টির বিষয়টি সরকারের জন্যে বাধ্যতামূলক করে দিয়েছে। জনগণের প্রত্যেকের মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্যে সরকারী তহবিল হতে ব্যয় সংকুলান না হলে যাকাত উশর ও বর্ধিত কর সংগ্রহ ছাড়াও সম্পদশালীদের নিকট হতে বাধ্যতামুলক অর্থ সংগ্রহের এখতিয়ার সরকারের রয়েছে। এভাবেই ধনীদের সম্পদ দরিদ্রদের ন্যূনতম মৌলিক মানবিক প্রয়োজন পূরণে ব্যবহৃত হয়ে ধনবন্টনে ভারসাম্য অর্জিত হতে পারে।

 

উপরন্তু দরিদ্র শ্রেণীর আয়েল নিরাপত্তা ও ক্রয় ক্ষমতার নিশ্চয়তা বিধানের স্বার্থে সরকারকে মজুরী ও দ্রব্যমূল্যও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সমাজে বিরাজমান ধনবৈষম্য হ্রাসের জন্যে সরকারের আর্থিক ও রাজস্ব নীতিমালাও বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে থাকে। সুতরাং, এই নীতিমালা দরিদ্র্রদের কল্যাণেরর স্বার্থেই প্রণীত হওয়া উচিৎ। কিন্তু গভীর পরিতাপের বিষয়, সরকারের গৃহীত নীতিমালার সুবিধা ও প্রাপ্তির পাল্লা সাধারণতঃ বিত্তবানদের দিকেই ঝুঁকে থাকে। এছাড়া ক্ষমতাসীন সরকারের মন্ত্রী ও পারিষদবর্গ এবং উচ্চপদস্থ আমলারা সরকারী অর্থের সিংহভাগ ব্যয় করে থাকে নিজেদের আরাম-আয়েসে, বিলাস-ব্যসনে। জনগণের দুঃখ-দুর্দশা দূর করার জন্যে মৌখিক প্রতিশ্রুতি ও কাগুজে পরিকল্পনা ছাড়া আর কিছুই বাস্তবে লক্ষ্য করা যায় না। অথচ ইসলামী নীতি অনুসারে রাষ্ট্রীয় সম্পদে কারোরই, এমনকি রাষ্ট্র বা সরকার প্রধানেরও অন্যের চেয়ে বেশী অধিকার ভোগের সুযোগ নেই। বরং খলীফা উমার (রা)-এর অনুসৃত নীতি অনুযায়ী দূর পর্বতবাসী মেষ পালককেও রাষ্ট্রীয় সম্পদ হতে তার ন্যায্য অংশ আদায় করে দেওয়ার নিশ্চয়তা বিধানের দায়িত্ব সরকারেরই।

 

৭.

 

যে-কোন সমাজে আয় ও সম্পদ বন্টনের ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ। এ ব্যাপারে রাষ্ট্রের করণীয় কি সে বিষয়ে ইসলামী অর্থনীতিবিদদের চিন্তাধারা ইতিপূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। তার পরেও কথা থেকে যায়। ইসলামের গৌলবোজ্জল দিনগুলোতে মুসলিম সমাজে তার উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় না। উদাহরণস্বরূপ মুদারাবা মুশারাকা মুরাবাহা বায়-ই-মুয়াজ্জল বায়-ই-সালাম শিরকাত আল-মিলক ইজারা বিল-বায়ই ইত্যাদি পদ্ধতির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এসব পদ্ধতিতে মুসলিম সমাজে বিত্তশারী ও বিত্তহীন কিন্তু কর্মদক্ষ মানুষ, অল্পবিত্ত ও অধিক বিত্তের মানুষ যৌথভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারে, যে কোন নতুন কর্মদ্যোগে অংশ নিতে পারে। দুঃখের বিষয়, সুদভিত্তিক ব্যাংক ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর হতে মুনাফাভিত্তিক এবং লাভ-লোকসানের অংশীদারীভিত্তিক কর্মসংস্থানের ও বিনিয়োগের পথ মুসলিম দেশগুলোতে ক্রমাবলুপ্ত হয়েছে। অথচ নবীমুস্তাফার (স) যামানা হতেই মুদারাবা মুশারাকা মুরাবাহা বায়-ই-মুয়াজ্জল বায়-ই-সালাম ইত্যাদি পদ্ধতিতে সমাজের বিত্তশালী বা ধনবান ব্যক্তিরা যারা কম বিত্তশালী বা শুধুমাত্র ব্যবসায়িক যোগ্যতা রাখে তাদের সাথে একত্রে উৎপাদনমুখী ও বাণিজ্যিক কার্যক্রমে অংশীদার হতেন। এছাড়াও বহুক্ষেত্রে করযে হাসানার মাধ্যমেও ব্যক্তিবিশেষের জরুরী প্রয়োজন পূরণের সুযোগ ইসলামী সমাজে বিদ্যমান ছিল। সেই করযে হাসানার নামই এখন অনেক মুসলমানের অজানা।

 

এই অবস্থা নিরসনের জন্যে তথা সুদভিত্তিক ঋণেল বিকল্প ব্যবস্থা চালু করে সমাজে কর্মসংস্থান, বিনিয়োগ ও উৎপাদনের মাধ্যমে আয় ও সম্পদের সুচারু বন্টন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিশ্বের অনেকগুলো মুসলিম দেশে সাম্প্রতিককালে ইসলামী ব্যাংকিং ও ফাইন্যান্সিং পদ্ধতি চালু হয়েছে। বাংলাদেশ তার অন্যতম। এদেশে ১৯৮৩ সালে ইসলামী ব্যাংকিং পদ্ধতি চালু হয় এবং জনগণের কাছ থেকে আশাতীত সাড়া পায়। বিগত বছরগুলোতে এই ব্যাংকিং পদ্ধতি বাংলাদেশের বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও উৎপাদনমুখী কর্মকাণ্ড উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে সমর্থ হয়েছে। পৃথিভীর যেসব দেশে ইসলামী ব্যাংক ও বিনিয়েঅগ সংস্থঞা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেসব দেশে এই পদ্ধতিতে কর্মসংস্থঞান, উৎপাদন ও বিনিয়োগ যে জনসাধারণেল মধ্যে বিপুল সাড়া জাগাতে সমর্থ হয়েছে তা বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিককালে বার্ষিক রিপোর্টসমূহ হতে জানা যায়। উদাহরণস্বরূপ মিশরের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। সমাজতন্ত্রের ধ্বজাধারী এই মুসলিম দেশটির ইসলামী ব্যাংকগুলো একত্রে সেদেশের মোট বিনিয়োগ ও বিনিয়োগযোগ্য তহবিলের এক-চতুর্থাংশ বা ২৫% নিয়ন্ত্রণ করছে। সুদের অভিশাপ মুক্ত হয়ে নিজেদের ক্ষুদ্র সাধ্য ও সামর্থ্যকে সততা ও নিষ্ঠার সাথে কাজে লাগাবার জন্যে অধুনা ইসলামী ব্যাংকিং ও ফাইন্যান্সিং পদ্ধতি যে সুযোগ করে দিয়েছে তার ফলে সমাজে আয় ও সম্পদ বন্টনে একটি লক্ষ্যণীয় সুপ্রভাত অনুভব করা যাচ্ছে।

 

৮.

 

ইসলামী অর্থনীতিতে আয় ও সম্পদ বন্টনে ভারসাম্য অর্জনের জন্যে যে সব উপায় বা পদধতি আলোচিত হলো সে সব বাস্তবায়নের জন্যে যুগপৎ ব্যক্তি ও সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে সর্বোচ্চ আন্তরিকতা ও নিষ্ঠাসহ তৎপর হতে হবে। প্রকৃতপক্ষে আদল ও ইহসান প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়েই উপার্জন ও সম্পদ সংগ্রহের ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর হতে পারে; আয় ও কর্মসংস্থানের পথ সকলের জন্যে উন্মুক্ত হতে পারে। এর ফলে অর্থনৈতিক বৈষম্য ও ভারসাম্যহীনতা দূর হয়ে একটি সমৃদ্ধ, গতিশীল ও সুস্থ অর্থনীতি বিনির্মাণের পথ সুগম হয়। দুর্ভাগ্যের বিষয়, ইসলামী ব্যাংক ও ফাইন্যান্সিং প্রতিষ্ঠানসমহের ব্যতিক্রমধর্মী প্রয়াস বাদ দিলে আজকের মুসলিম বিশ্বে রাষ্ট্রীয়ভাবে এ পর্যন্ত আলোচিত উপায়সমূহের কোন একটিও পুরোপুরি অনুসৃত হচ্ছে না। ফলে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে আয় ও সম্পদ বন্টনের ক্ষেত্রে প্রকট বৈষম্য বিদ্যমান। এই অবস্থা নিরসনের জন্যে আমাদের অবশ্যই প্রত্যাবর্তন করতে হবে শাশ্বত সুন্দর ও স্থায়ী সমাধানকারী ইসলামের দিকেই। ব্যক্তি জীবন, সমাজ জীবন তথা রাষ্ট্রীয় জীবনে ইসলামের সত্যিকার শিক্ষাকে গ্রহণ করতে হবে। বিদ্যমান সমস্যা সমাধানের সেটাই প্রকৃষ্ট ‍উপায়।

 

দারিদ্র বিমোচন মানব সম্পদ উন্নয়নে যাকাত

 

. ইসলামে যাকাতের গুরুত্ব

 

যাকাত ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের একটি। আল-কুরআনে বারংবার নামায কায়েমের পরেই যাকাত আদায়ের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বারংবার বলা হয়েছে- “সালাত কায়েম করো এবং যাকাত আদায় করো।” (দ্রষ্টব্য: সূরা আল-বাকারাহ: ৪৩, ৮৩, ১১০ ও ২৭৭ আয়াত; সূরা আন-নিসা ৭৭ ও ১৬২ আয়াত; সূরা আন নুর: ৫৬ আয়াত; সূরা আল-আহযাব ৩৩ আয়াত, সূরা মুয্‌যামম্মিল: ২০ আয়াত)

 

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আরও বলেন- “তাদের অর্থসম্পদ থেকে যাকাত উসুল করো যা তাদের পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করবে।” (সূরা আত্‌-তাওবা: ১০৩ আয়াত)

 

“মুশরিকদের জন্যে রযেছে ধ্বংস, তারা যাকাত দেয় না।” (সূরা হামীম: ৬-৭ আয়াত)

 

“আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে তোমরা যে যাকাত দাও মূলতঃ তা যাকাত দানকারীরই সম্পদ বৃদ্ধি করে।” (সূরা আররুম: ৩৯ আয়াত)

 

রাসূলে করীম (স) নির্দেশ দিয়েছেন- “তোমাদের সম্পদে যাকাত পরিশোধ করো।” (তিরমিযী, হিদায়া)

 

প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য, যাকাদের বিধি-নির্দেশ শুধু উম্মাতে মুহাম্মাদীর উপরই নাযিল হয় নি, অতীত কালে অন্যান্য নবীদের উম্মতের উপরেও এই হুকুম ছিল আল্লাহর পক্ষ হতেই। হযরত ইসমাঈল (আঃ) ও হযরত ঈসার (আঃ) সময়েও যাকাতের বিধান প্রচলিত ছিল। (সূরা মরিয়ম: ৩১ ও ৫ আয়াত এবং সূরা আল আম্বিয়া: ৭৩ আয়াত)।

 

কেন যাকাতের এই গুরুত্ব? ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় যাকাত সম্পদ বন্টনের তথা সামাজিক সাম্য অর্জনের অন্যতম মৌলিক প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা হিসেবেই বিবেচিত হয়ে থাকে। সমাজে আয় ও সম্পদ বন্টনের ক্ষেত্রে বিরাজমান ব্যাপক পার্থক্য হ্রাসের জন্যে যাকাত অত্যন্ত উপযোগী হাতিয়ার। কিন্তু যাকাত কোন স্বেচ্ছাসেবক দান নয় বরং দরিদ্র ও অভাবগ্রস্তদের জন্যে আল্লাহ নির্ধারিত বাধ্যতামূলক প্রদেয় অল্থ-সম্পদের নির্দিষ্ট অংশ। যাকাতের সংগে প্রচলিত অন্যান্য সকল ধ রনের করের মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। কারণ, ইসলামের এই মৌলিক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একাধারে নৈতিক, ধর্মীয ও সামাজিক মূল্যবোধ অন্তর্নিহিত রয়েছে। কিন্তু করের ক্ষেত্রে এই ধরনের কোন নৈতিক, ধর্মীয় ও সামাজিক তাগিদ নেই।

 

যাকাত ও প্রচলিত করের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। প্রথমতঃ কর হচ্ছে বাধ্যতামূলকভাবে সরকারকে প্রদত্ত নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ যার করদাতা কোন প্রত্যক্ষ উপকার প্রত্যাশা করতে পারে না। সরকারও করের মাধ্যমে অর্জিত অর্থ দরিদ্র ও অবাবী জনসাধারণের মধ্যে ব্যয়ের জন্যে বাধ্য থাকে না। পক্ষান্তরে যাকাতের অর্থ অবশ্যই আল-কুরআনে নির্দেশিত নির্ধারিত লোকদের মধ্যেই মাত্র বিলি-বন্টন করতে হবে।

 

দ্বিতীয়তঃ যাকাতের অর্থ রাষ্ট্রীয় সাধারণ উদ্দেশ্য সাধনের জন্যে ব্যয় করা যাবে না। কিন্তু করের অর্থ যেকোন কাজে ব্যয়ের ক্ষমতা ও পূর্ণ স্বাধীনতা সরকারের রয়েছে।

 

তৃতীয়তঃ যাকাত শুধুমাত্র সাহেবে নিসাব মুসলিমদের জন্যেই বাধ্যতামূরক। কিন্তু কর, বিশেষতঃ পরোক্ষ কর, সর্বসাধারণের উপর আরোপিত হয়ে থাকে। অধিকন্তু প্রত্যক্ষ করেরও বিরাট অংশ জনসাধারণের উপর কৌশলে চাপিয়ে দেওয়া হয়।

 

চতুর্থতঃ যাকাতের হার পূর্ব নির্ধারিত ও স্থির। কিন্তু করের হার কোনক্রমেই স্থির নয়। যেকোন সময়ে সরকারের ইচ্ছানুযায়ী করের হার ও করযোগ্য বস্তু সামগ্রীর পরিবর্তন হয়ে থাকে। সুতরাং, যাকাতকে প্রচলিত অর্থে সাধারণ কর হিসেবে যেমন কোক্রমেই গণ্য করা যায় না। তেমনি তার সঙ্গে তুলনীয়ও হতে পারে না।

 

যাকাত ইসলামী অর্থনীতির কত বড় গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ তা বুঝতে হলে ইসলামের প্রথম খলীফা হযরত আবু বকরের (রা) সময়ের ঘটনা জানতে হবে। তিনি খলিফা হওয়ার পর পরই কিছু ভণ্ড নবীর প্ররোচনায় কয়েকটি গোত্র যাকাত দিতে অস্বীকার করে। খলীফার নিকট তারা যাকাত প্রদান হতে অব্যাহতি চাইল। হযরত আবু বকর (রা) তাদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেণ- “যদি কারো কাছে ‍উট বাধার রশি পরিমানও যাকাত প্রাপ্য হয় আর সে তা দিতে অস্বীকার করে তবে তার বিরুদ্ধেই আমি জিহাদ ঘোষণা করব।” ইতিহাস সাক্ষী, তিনি তা করেছিলেনও। এরই ফলশ্রুতিতে খলীফা উমর ইবন আব্দুল আযীযের সময়ে জাযিরাতুল আরবে যাকাত গ্রহণের সন্ধান পাওয়া ছিল দুর্ভল। সেই যাকাত মুসলিম বিশ্বের অধিকাংশ দেশে আজ শুধু প্রথা হিসেবে চালু রয়েছে। সেজন্যেই মুসলিম বিশ্বের দুঃস্থ অভাবী ও নিঃস্ব লোকের সংখ্যা ক্রমশঃই বৃদ্ধি পাচ্ছে। যাকাতরে অর্থ ব্যয়ের বিদ্যমান প্রথায না সমাজের প্রকৃত কল্যাণ হচ্ছে, না অভাবী ও দরিদ্র জনগণের সমস্যার স্থায়ী সুরাহা হচ্ছে।

 

. যাকাতের খাত হকদার

 

ইসলাম শরীয়হা অনুসারে যে সমস্ত সামগ্রীর যাকাত দিতে হবে সেগুলো হলো-

 

ক) সঞ্চিত বা জমাকৃত অর্থ,

 

খ) সোনা, রূপা সোনা-রূপা দ্বারা তৈরী অলংকার,

 

গ) ব্যবসায়ের পণ্য সামগ্রী,

 

ঘ) কৃষি উৎপন্ন,

 

ঙ) খনিজ উৎপাদন, এবং

 

চ) সব ধরনের গবাদি পশু

 

উপরোক্ত দ্রব্য সামগ্রীর একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ যখন কোন মুসলমান অর্জন করে তখন তাকে যাকাত দিতে হয়। এই পরিমাণকে ‘নিসাব’ বলে। নিসাবের সীমা বা পরিমাণ দ্রব্য হতে দ্রব্যের ভিন্নতর। একইভাবে যাকাতের হারও দ্রব্য হতে দ্রব্যে ভিন্নতর। যাকাতের সর্বনিম্ন হার শতকরা ২.৫% হতে শুরু করে সর্বোচ্চ ২০.০%।

 

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যাকাত কাদের প্রাপ্য অর্থাৎ কাদের মধ্যে যাকাতের অর্থ বন্টন করে দিতে হবে সে সম্পর্কে আল-কুরআনে সুস্পষ্ট ভাষায় নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন-

 

“দান খয়রাত তো পাওনা হলো দরিদ্র ও অভাবীগণের, যে সকল কর্মচারীর উপর আদায়ের ভার আছে তাদের, যাদের মন সত্যের প্রতি সম্প্রতি অনুরাগী হয়েছে, গোলামদের মুক্তির জন্যে, ঋণগ্রস্তদের জন্যে, আল্লাতর পথে (মুজাহিদদের জন্যে) এবং মুসাফিরদের জন্যে। এটি আল্লাহর তরফ হতে ফরয এবং আল্লাহ সব জানেন ও সব বুঝেন।” (সূরা আত্‌-তাওবা: ৬০ আয়াত)

 

উপরের আয়াত হতে সুস্পষ্টভাবে আট শ্রেণীর লোকের জন্যে যাকাতের অর্থ ব্যবহারের জন্যে নির্দেশ পাওয়া যায়। এগুলো হচ্ছে:

 

(ক) দরিদ্র জনসাধারণ (ফকীর),

 

(খ) অভাবী ব্যক্তি (মিসকীন),

 

(গ) যাকাত আদায়ে নিযুক্ত ব্যক্তি,

 

(ঘ) মন জয় করার জন্যে,

 

(ঙ) ক্রীতদাস বা গোলাম মুক্তি,

 

(চ) ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি,

 

(ছ) আল্লাহর পথে, এবং

 

(জ) মুসাফির।

 

এই আটটি খাতের মধ্যে ছয়টিই দারিদ্রের সংগে সম্পৃক্ত। অন্য দুটি খাতও (গ ও ছ) অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যাকাত আদায় ও এর বিলিবন্টন এবং আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠা কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের এটাই সার্বক্ষণিক দায়িত্ব। সুতরাং, তাদের বেতনও এই উৎস হতেই দেওয়া বাঞ্ছনীয়।

 

প্রসঙ্গতঃ যাদেরকে যাকাতের অর্থ-সম্পদ দেওয়া যাবে না তাদের কথাও জেনে রাখা ভাল। এদের মধ্যে রয়েছে (১) নিসাবের অধিবারী ব্যক্তি, (২) স্বামী-স্ত্রী, (৩) পুত্র-কন্যা ও তাদের সন্তান-সন্ততি, (৪) মাতা-পিতা ও তাদের উর্দ্ধতন পুরুষ, (৫)বনি হাশেমের লোকজন, (৬) উপার্জনক্ষম ব্যক্তি, (৭) যাদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব রয়েছে (৮) অমুসলিম।

 

. যাকাতের নিসাব

 

যাকাতের নিসাব সম্পর্কেও অনেকেরই সম্যক ধারণা নেই। সেজন্যে সংক্ষেপে যেসব পণ্য ও সম্পদের যাকাত আদায় করার শরয়ী হুকুম রয়েছে সেসব নিসাব যাকাতের হারসহ এখানে উল্লেখ করা হলো।

 

১. সাড়ে সাত ভরি পরিমাণ সোনা বা এর তৈরী অলংকার অথবা সাড়ে বায়ান্ন ভরি পরিমাণ রূপা. বা তার তৈরী অলংকার অথবা সোনা-রূপা উভয়ই থাকলে উভয়ের মোট মূল্য ৫২.৫ ভরি রূপার সমান হলে তার বাজার মূল্যের উপর ১/৪০ অংশ বা ২.৫% হারে যাকাত দিতে হবে।

 

২. হাতে নগদ ও ব্যাংকে সঞ্চিত অর্থের পরিমান ৫২.৫ ভরি রূপার মূল্যেল সমান হলে তার উপর ২.৫% হারে যাকাত দিতে হবে।

 

৩. ব্যবসায়ের মজুদ পণ্যের মূল্য ৫২.৫ ভরি রূপার মূল্যের বেশী হলে তার উপর ২.৫% হারে যাকাত প্রদেয়।

 

৪. গরু ও মহিষের ক্ষেত্রে প্রথম ৩০টির জন্যে ১ বছর বয়সী ১টা বাছুর দিতে হবে এবং উর্দ্ধের হার ভিন্ন।

 

৫. ছাগল ও ভেড়ার ক্ষেত্রে প্রথম ৪০টির জন্যে ১টা এবং পরবর্তী ১২০টির জন্যে ২টা ছাগল/ভেড়ার যাকাত দিতে হবে। [দ্রষ্টব্য: বুখারী শরীফ, যাকাত অধ্যায়]

 

যাকাত প্রদানের জন্যে ফল-ফসলাদি, খনিজ সম্পদ, গুপ্তধন, মধু এবং বাণিজ্যিক খামারের মাছের ক্ষেত্রে বছর পূর্ণ হওয়ার শর্ত প্রযোজ্য নয়। বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য উট ও ঘোড়া পালন করলে তার যাকাত আদায় করতে হবে। খনিজ সম্পদেরও যাকাত প্রদেয। তবে বর্তমান সকল দেশেই খনিজ সম্পদ রাষ্ট্রীয় মালিকানায় থাকার কারণে তার বিধান উল্লেখ নিষ্প্রয়োজন।

 

যেসব সামগ্রী বা সম্পদের যাকাত দিতে হবে না সে সম্পর্কেও সুস্পষ্ট ধারণা থাকা বাঞ্ছনীয়। এসবের মধ্যে রয়েছে: (১) নিসাব অপেক্ষা কম পরিমণ অর্থ-সম্পদ, (২) নিসাব বছরের মধ্যেই অর্জিত ও ব্যয়িত সম্পদ (৩) ঘর-বাড়ী, দালান-কোঠা যা বসবাস, দোকান-পাট ও কল-কারখানা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, (৪) ব্যবহার্য সামগ্রী (কাপড়-চোপড়, আসবাপত্র, গৃহস্থালীর তৈজসপত্র, বই-পত্র, (৫) যন্ত্রপাতি ও সাজ-সরঞ্জাম, (৬) শিক্ষার সমুদয় উপকরণ, (৭) ব্যবহার্য যানবাহন (৮) পোষা পাখী ও হাঁস-মুরগী, (৯) ব্যবহারের পশু (ঘোড়া, গাধা, খচ্চর, উট) ও যানবাহন এবং (১০) ওয়াক্‌ফকৃত সম্পত্তি।

 

. উশরের বিধান

 

ধনসম্পদ গবাদিপশু, স্বর্ণ ও রৌপ্যের অলংকার, ব্যবসায়িক পণ্য ও খনিজ সামগ্রীর উপর যেমন যাকাত আদায় ফরয তেমনি ফসলের উপর উশর আদায়ও ফরয। আল্‌-কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে-

 

“তোমরা এগুলোর ফল ও ফসল খাও যখন ফল ধরে এবং আল্লাহর হক আদায় করো ফসল কাটার (বা আহরণ) করার দিন।” (সূরা আল-আনআম: ১৪১ আয়াত)

 

“তোমাদের জন্যে জমি থেকে যা কিভু বের করেছি তা থেকে খরচ করো (আল্লাহর পথে)”। (সূরা আল-বাকারাহ: ১৬৭ আয়াত)

 

তাফ্‌সীরকারীদের মতে আল্লাহর এই নির্দেশ অলংঘনীয়। তাফসীরে তাবারী অনুযায়ী এটা আল্লাহর নির্দেশ... ফল বা শস্রের ফরয যাকাত আদায় কতেই হবে। তাফসীরে কাশশাফ অনুসারে এই আয়াতে উল্লেখিত ‘হক’ শব্দ দ্বারা কৃষিজাত ফসলের উপর ফরয যাকাতকেই বোঝানো হয়েছে।

 

উশরের বিধান সম্পর্কে রাসূলে করীম (স) বলেন-

 

“যে সব জমি বৃষ্টির পানিতে সিক্ত হয় তাতে উশর (বা দশ ভাগের একভাগ) আর যেসব জমি সেচের সাহায্যে সিক্ত হয় তাতে নিসফ উশর (বা বিশ ভাগের একভাগ) আদায় করতে হবে।” (বুখারী, আবু দাউদ)।

 

সুতরাং, জমিতে ফল-ফসল উৎপন্ন হলে সেচ বা অসেচ জমিভিত্তিতে উৎপন্ন ফসলের ১০% বা ৫% যাকাত আদায় করা মুমিন মুসলমান নর-নারীর শরয়ী দায়িত্ব। যাকাতের অর্থ সম্পদ ব্যয়ের জন্যে যে আটটি খাত নির্ধারিত, উশরের ক্ষেত্রেও সেই খাতগুরো নির্ধারিত। অবশ্য যাকাতের সঙ্গে উশরের বেশ কিছু পার্থক্য বা বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। িএসব বৈশিষ্ট্যের মধ্যে রয়েছে:

 

১. উশর আদায়ের জন্যে ফসলের িএক বছর অতিক্রান্ত হওয়া শর্ত নয়। বরং প্রতি বছর প্রতিবার উৎপন্ন ফসলেরই উশর আদায় করতে হবে।

 

২. উশর আদায়ের জন্যে ঋণমুক্ত হওয়া শর্ত নয়।

 

৩. নাবালক ও পাগলের জমির ফসলেও উশর আদায় করতে হবে।

 

৪. উশর আদায়ের জন্যে জমির মালিক হওয়াও শর্ত নয়।

 

ফল ও ফসলের ক্ষেত্রে নিসাবের পরিমাণ হলো পাঁচ ওয়াসাক। অর্থাৎ, পাঁচ ওয়াসাক পরিমাণ ফসল উৎপন্ন হলে উশর (বা উশরের অর্ধেক) আদায় করতে হবে। ওয়াসাকের দুটি মাপ রয়েছে- একটি ইরাকী, অপরটি হিজাযী। ইরাকী মাপ অনুসারে পাঁও ওয়াসাকের পরিমাণ ৯৮৮.৮ কেজি এবং হিজাযী মাপ অনুসারে পরিমাণ ৬৫৩.০ কেজি। এই উপমহাদেশের ওলামা-মাশায়েখগণ ইরাকী মাপটি গ্রহণ করেছেন। অর্থাৎ এই পরিমাণ ফসল উৎপন্ন হলেই উশর দিতে হবে। তবে ইমাম আবু হানিফার মতে কৃষি ফসল ও ফলে কোন নিসাব নেই। যা উৎপন্ন হবে তার উপরই উশর বা অর্ধেক উশর ধার্য হবে। (মুহাম্মাদ রুহুল আমীন-ইসলামের দৃষ্টিতে উশর: বাংলাদেশ প্রেক্ষিতে: ১৯৯৯, পৃ:৩৩)

 

. যাকাত উসুল রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব

 

যাকাত উসুল ও তার বিলি-বন্টন ব্যক্তির খেয়াল খুশীর উপর ছেড়ে দেওয়া হয়নি। বরং রাষ্ট্রীয়ভাবে এর আদায় ও বন্টনের হুকুম দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর রাসূলকে (স) নির্দেশ দিচ্ছেন-

 

“তাদের অর্থ-সম্পদ থেকে যাকাত উসুল করো যা তাদেরকে পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করবে।” (সূরা আত্‌-তাওবা: ১০৩)

 

আল-কুরআনে আল্লাহ আরও বলেছেন-

 

“আমরা তাদেরকে মানুষের নেতা বানিয়েছি, তারা আমাদের বিধান অনুযায়ী পরিচালিত করে।... আমরা ওহীর সাহায্যে তাদেরকে ভাল কাজ করার, নামাজ কায়েম করার ও যাকাত আদায় করার আদেশ দিয়েছি।” (সূরা আল-আম্বিয়া: ৭৩)

 

“তারা এমন লোক যদি তাদেরকে আমি পৃথিবীতে ক্ষমতা দান করি তাহলে তারা নামায কায়েম করে ও যাকাত আদায় করে এবং সৎ কাজে আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ করে।” (সূরা হজ্ব: ৪১)

 

উপরের আয়াতগুলো হতে পরিষ্কারভাবে বোঝা যায় যে আল্লাহর অভিপ্রায়ই হলো রাষ্ট্রই যাকাত আদায় করবে এবং তা যাকাতের হকদারদের কাছে যথাযথভাবে পৌঁছেও দেবে। আল্লাহ যাদেরকে রাষ্ট্রক্ষমতা প্রদান করেছেন, মানুষের নেতা বানিয়েছেন অন্যান্য কাজের মধ্যে তাদের অন্যতম অপরিহার্য দায়িত্ব হলো যাকাত আদায় করা ও আদায়কৃত যাকাত তার হকদারদের মধ্যে পৌঁছে দেওয়া। এজন্যেই রাসূলে করীম (স) ও খুলাফায়ে রাশিদূনের (রা) সময়ে যাকাতের অর্থ, সামগ্রী ও গবাদি পশু সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বিতরণের জন্যে আট শ্রেণীর লোক নিযুক্ত ছিল এরা হলো:

 

ক) সায়ী= গবাদি পশুর যাকাত সংগ্রাহক

 

খ) কাতিব= যাকাতের খাতাপত্র লেখার করণিক,

 

গ) ক্বাসাম- যাকাত বন্টনকারী,

 

ঘ) আশির- যাকাত প্রদানকারী ও যাকাত প্রাপকদের মধ্যে সম্বন্ধ স্থাপনকারী;

 

ঙ) আরিফ- যাকাত প্রাপকদের অনুসন্ধানকারী,

 

চ) হাসিব- যাকাতের হিসাব রক্ষক,

 

ছ) হাফিজ- যাকাতের অর্থ ও দ্রব্যসামগ্রী সংরক্ষক,

 

জ) ক্বায়াল- যাকাতের পরিমাণ নির্ণয়কারী ও ওজনকারী।

 

[দ্রষ্টব্যঃ এস. এ. সিদ্দকী (১৯৬২) পাবলিক ফিন্যান্স ইন ইসলাম, পৃ. ১৬০]

 

আমাদের বিস্ময়ে হতবাক হতে হয় যে আজকের যুগেও কর আদায়ের জন্যে এত বিভিন্ন পদের লোক নিযুক্ত হয় না, অথচ প্রায় চৌদ্দশত বছর পূর্বে যাকাত আদায় ও তার বিলি-বন্টনের জন্যে কত নিখুঁত ও বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়েছিল।

 

এভাবেই তখন ধনীদের সম্পদের একাংশ গরীব ও অভাবীদের হাতে পৌঁছতো, দ্বীন প্রতিষ্ঠার কাজে খরচ হতো, মুসাফিরে কষ্ট লাঘব হতো। উপরন্তু ব্যক্তির খেয়াল খুশীর উপর উসুল নির্ভরশীল না থাকায় আদায়কৃত যাকাতরে পরিমাণ হবে যেমন বিপুল তেমনি তার দারদ্র্য বিমোচন ও মানব কল্যাণের ক্ষমতাও ছিল বিপুল। কিন্তু এই দায়িত্ব ও কর্তব্য যথাযথ পালিত না হওয়ায় অধিকাংশ মুসলিম দেশের জনসাধারণ আজ দারিদ্র্যপীড়িত এবং কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও ভয়াবহ দুরবস্থার শিকার।

 

. সামাজিক কল্যাণে যাকাত উশর

 

যাকাতের নানাবিধ ইতিবাচক উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য রয়েছে। সেসবের মধ্যে ধর্মীয়, নৈতিক ও রাজনৈতিক প্রসঙ্গ থাকলেও যাকাতের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উদ্দেশ্য বিশেষ গুরুত্ববহ। তার মধ্যে সবচেয়ে প্রধান িএবং মুখ্য হচ্ছে মুষ্টিমেয় ব্যক্তির হাতে সম্পদ কেন্দ্রীভূত হতে না দেওয়া। ইসলাম সামাজিক শ্রেণী বৈষম্যকে শুধু অপছন্দই করে না, বরং তা দূরীভূত করার কথাও বলে। তাই একটি সুখী সুন্দর এবং উন্নত সামাজিক পরিবেশ সৃষ্টির জন্যে বিত্তশালী মুসলিমদের অবশ্যই তাদের সম্পদের একটা অংশ দরিদ্র ও অভাবগ্রস্তদের দুর্দশা মোচনের জন্যে ব্যয় করতে হবে। এর ফলে যে শুধু অসহায় ও দুঃস্থ মানবতারই কল্যাণ হবে তাই নয়, সমাজে আয় বন্টনের ক্ষেত্রেও বৈষম্য অনেকখানি হ্রাস পাবে।

 

দ্বিতীযতঃ যাকাত মজুতদারী বন্ধ করারও এক বলিষ্ঠ উপায়। মজুতকৃত অর্থ-সম্পদের উপরেই যাকাত হিসাব করা হয়ে থাকে। অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ এবং মজুত সম্পদ যে কোন অর্থনৈতিক কার্যক্রম গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রধান প্রতিবন্ধক হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। এই ধরনের অর্থের জন্যেই সরকার ফটকাবাজারী বন্ধ, মূল্যবৃদ্ধি রোধ প্রভৃতি কার্যক্রম গ্রহণে ব্যর্থ হয়ে থাকেন। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে সৃষ্ট নিদারুণ অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিশৃংখলা তার প্রকৃষ্ট নজীর। মুষ্টিমেয় লোকের হাতে অবৈধ ও কালো টাকা জমছে প্রভুত পরিমাণে। উৎপাদনমুখী কোন কাজেই তা বিনিয়োগ হচ্ছে না। সরকারের নিকট এমন কোন কৌশল বা পদ্ধতি নেই যার দ্বারা এই অবৈধ অর্থের সঠিক পরিমাণ জানা সম্ভব। এ সবের উপর কোন প্রকার কর বসানো যাচ্ছে না। উৎপাদন ও কর্মসংস্থানমুখী উদ্যোগ গ্রহণেও তাদের প্ররোচিত বা বাধ্য করা সম্ভব হচ্ছে না। এজন্যে কোন কার্যকর আইনও নেই। পরিণামে নিরুপায় দর্শক হিসেবে সরকারকে ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতি ও অর্থনৈতিক ধ্বস দেখতে হচ্ছে।

 

মানুষের মনগড়া কোন পদ্ধতিই সার্থকভাবে এই সমস্যার মোকাবিলা করতে সক্ষম নয়। একমাত্র ইসলামেই এর সমাধান রয়েছে। কারণ, বিত্তবানদের জন্যে তাদের মজুতকৃত অর্থ বা সম্পদের একটা অংশ নিছক বিলিয়ে দেবার মতো কোন পার্থিব কারণ নেই। কিন্তু ইসলামে একজন মুসলমানের আল্লাহ ও আখিরাতের ভয় রয়েছে। ফলে বিত্তবানদের সামনে দুটি পথই খোলা রয়েছে- হয় মজুতদকৃত অর্থ শিল্প বা ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করা অথবা ইসরামী অনুশাসন অনুযায়ী তা ব্যয় করা। যার ফলে অর্থনীতির চাকা ঘুরবে, সমাজে কর্মসংস্থান ও উৎপাদনের বিস্তৃতি ঘটবে।

 

যাকাতের তৃতীয অর্থনৈতিক ও সামাজিক উদ্দেশ্র হচ্ছে দারিদ্র বিমোচন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। এতে শুধু সমাজই নয়, রাষ্ট্রও উপকৃত হয় সমানভাবে। দারিদ্র্য মানবতার পয়লা নম্বরের দুশমন। ক্ষেত্র বিশেষে তা কুফরী পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারে। যেকোন সমাজ ও দেশের জন্যে এটা সবচেয়ে জটিল ও তীব্র সমস্যা। সমাজে হতাশা ও বঞ্চনার অনুভূতির সৃষ্টি হয় দারিদ্রের ফলে। পরিণঅমে দেখা দেয় মারাত্মক সামাজিক সংঘাত। অধিকাংশ সামাজিক অপরাধও ঘটে দারিদ্রের জন্য। এর প্রতিবিধানের জন্যে যাকাত ইসলামের অন্যতম মুখ্য হাতিয়ার হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে ইসলামের সেই সোনালী যুগ হতেই। যাকাতের অর্থ-সম্পদ প্রাপ্তির ফলে দরিদ্রদের জবিন যেমন আনন্দ ও নিরাপত্তা হয় তেমনি কর্মসংস্থানেরও সুযোগ সৃষ্টি হয়।

 

যাকাতের অর্থ-সামগ্রী যখন সমাজের দরিদ্র ও অভাবী শ্রেণীর লোকদের মধ্যে বন্টন করে দেওয়া হয় তখন শুধু যে অর্থনৈতিক সুবিচার প্রতিষ্ঠিত হয় তা নয়, বরং অর্থনৈতিক কার্যক্রমেও গতিবেগ সঞ্চারিত হয়। দরিদ্র ও দুর্গত লোকদের ক্রয় ক্ষমতা থাকে না। বেকারত্ব তাদের নিত্য সঙ্গী। যাকাতের অর্থ প্রাপ্তির ফলে তাদের হাতে অর্থাগম হয়। ফলশ্রুতিতে বাজারে কার্যকর চাহিদার পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। দরিদ্র জনসাধারণের প্রান্তিক ভোগ প্রবণতা (Marginal Propensity to Consume) সচারচর একের অধিক। অধিকাংশ মুসলিম দেশে এরাই জনসংখ্যার বৃহত্তম অংশ। তাদের হাতে যা আসে তার সবটুকুই খরচ করে ফেলে ভোগ্যপণ্য ক্রয়ের জন্যে। এর ফলে দীর্ঘ মেয়াদী সময়ে উৎপাদন ও কর্মসংস্থানের পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে থাকে। প্রকৃতপক্ষে সমাজের বিপুল সংখ্যক লোকের যদি ক্রয় ক্ষমতা ঠিক মতো চালু থাকে তাহলে অর্থনৈতিক কার্যক্রমে নতুন প্রেরণার সৃষ্টি হয়, ব্যবসা-বাণিজ্য, নির্মাণ ও সেবার ক্ষেত্রেও সৃষ্টি হয় অনুকূল পরিবেশের। পরিণামে সামাজিক শ্রেণীসমূহের মধ্যেই আয় বা ধনবন্টনগত পার্থক্য হ্রাস পেতে থাকে। তাই যাকাত শুধু অর্থনৈতিক সুবিচারই প্রতিষ্ঠা করে না, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতিশীলতাও এনে দেয়। এটি যাকাতের চতুর্থ ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য।

 

যাকাতের অপর হিতকর ও কল্যাণধর্মী দিক হলো ঋণগ্রস্তদের ঋণমুক্তি ও প্রবাবে বিপদকালে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা লাভ। প্রাকৃতিক দুর্বিপাক, দুর্ঘটনা বা অন্য কোন প্রয়োজন মুকাবিলার কারণে যদি কেউ ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং সেই ঋন পরিশোধের সামর্থ হারিয়ে ফেলে তাহলে যাকাতের অর্থ দিয়েই সংকট মোচন করা যায়। দেউলিয়া হয়ে সমাজে অসম্মানিত জীবন যাপনের গ্লানি মোচনে যাকাত এক মোক্ষম হাতিয়ার।

 

উপরন্তু যারা দিবেশ-বিভুঁইয়ে সহায়-সম্বল হারিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে তারা যাকাতের অর্থ হতেই সেই সংকট হতে পরিত্রাণ লাভ করতে পারে। শরীয়াহর বিধান অনুসারেই তারা সামাজিক নিরাপত্তা পাওয়ার হকদার। স্বদেশে বিত্তশালী হ লেও নিঃস্ব মুসাফির বিদেশে যাকাতের দাবীদার আল-কুরআনের বিধান অনুসারেই। মুসলমাননা যে দেশ-কাল-পাত্র নির্বিশেষে এক উম্মাহরই অংশ এই ঐশী নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা তারই বাস্তব প্রতিফলন।

 

. মুসলিম দেশসমূহের অভিজ্ঞতা

 

প্রসঙ্গতঃ মুসলিম দেশসমূহে বিরাজমান অবস্থার একটা চিত্র তুলে ধরা যেতে পারে। বর্তমানে মাত্র মুষ্টিমেয় কয়েকটি দেশে সরকারী আেইন বা নির্দেশে ও প্রশাসনিকভাবে যাকাত আদায় হয়। এসব দেশের মধ্যে রয়েছে সউদী আরব, পাকিস্তান, ইরান, মালয়েশিয়া, লিবিয়া, জর্দান, বাহরাইন, সুদান ও কুয়েত ও ইয়েমেন। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগেই বাধ্যতামূরকভাবে যাকাত আদায়ের জন্যে সৌদী আরবে ১৯৫১ সালে, লিবিয়ায় ১৯৭১ সালে, জর্দান ১৯৭৮ সালে, বাহরাইনে ১৯৭৯ সালে, কুয়েতে ১৯৮২ সালে এবং লেবাননে ১৯৮৪ সালেই যাকাত আইন প্রণীত হয়। গবেষকদের মতে রাসূলে করীম (স) কর্তৃক রাষ্ট্রীয়ভাবে যাকাত আদায় শুরু হওয়ার পর থেকে আজও ইয়েমেনে সেই বিধানই চালু রয়েছে।

 

ইন্দোনেশিয়া, ইরাক, বাংলাদেশ, ওমান, কাতার প্রভৃতি দেশে যাকাত সংগ্রহের জন্যে সরকারের কিছু উদ্যোগ পরিলক্ষিত হলেও এসব দেশে এজন্যে বাধ্যতামূলকভাবে পালনীয় কোন আইন আজ অবধি প্রণীত হয়নি। সরকারী উদ্যোগে গঠিত যাকাত বোর্ডের তহবিলে লোকেরা স্বেচ্ছাধীনভখাবে তাদের যাকাতের অর্থ জমা দিতে পারে। এই অর্থ ব্যবহারের জন্যে একটা উপদেষ্টা কমিটি রয়েছে। বাংলাদেশে যাকাত বোর্ড প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৮২ সালে। এই বোর্ডের তহবিলে যাকাতের অর্থ জমা দেওয়া সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাধীন। তাই এ পর্যন্ত এর গড় বার্ষিক আদায় কুড়ি লক্ষ টাকার বেশী নয়। সেই তুলনায় চট্টগ্রামের বায়তুশ শরফ কমপ্রেক্সের গড় বার্ষিক যাকাত সংগ্রহের পরিমাণ ছয় লক্ষ টাকার উপর এবং হাটহাজারী মুইনুল ইসলাম মাদরাসার বার্ষিক যাকাত প্রাপ্তির পরিমাণ পঞ্চাশ লক্ষ টাকার বেশী।

 

প্রতিবেশী দেশ ভারতে মুসলিমপ্রধান বহু এলাকায় রাজনৈতিক দল ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনসমূহ পরিকল্পিতভাবে যাকাত আদায ও বন্টন করে থাকে। দাঙ্গা উপদ্রুত এলাকার মুসলমানদের জন্যে এই অর্থের সিংহভাগ ব্যয় হয়। সউদী আরবে যাকাত প্রদানে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান নির্বিশেষে অবহেলাকারীদের বিরুদ্ধে জরিমানা ও অন্যান্য নিবর্তনমুরক পদক্ষেপ নেওয়া হয়ে থাকে। সউদী আরব ও কুয়েতে যাকাত আদায়ের রশিদ গেঁথে না দিলে কোন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স মঞ্জুর করা বা নবায়নের আবেদন গৃহীত হয় না।

 

মালয়েশিয়াতে রাজ্যসমূহে State Council of Releigion-এর নির্দেশে প্রশাসনিকভাবে যাকাত আদায়ের বিধি রয়েছে। এটি চালু হয় ১৯৮০ হতে। তবে এ ব্যাপারে ফেডারেল সরকারের কোন আইন নেই। বিধি অনুসারে ব্যক্তির মোট যাকাতরে দুই-তৃতীয়াংশ নিজ ইচ্ছা অনুসারে দান করা হয়। সরকারী হিসাব অনুসারে মালয়েশিয়ার ১৯৮৮ সালে যাকাতের প্রাক্কলিত পরিমাণ ছিল ৪৭৫.১৫ কোটি টাকা। পক্ষান্তরে রাজ্যসমূহের তহবিল এ বাবদে মোট জমা দেওয়া অর্থের পরিমাণ ছিল মাত্র ৩৯.৩০ কোটি টাকা। তাই সম্প্রতি সেদেশে যাকাতবিধি লংঘনকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে।

 

সুদানে যাকাত তহবিলের আইন পাশ হয় আগস্ট, ১৯৮০তে। তখন যাকাত প্রদান বাধ্যতামুলক করা হয়নি। পরবর্তীকালে সেপ্টেম্বর, ১৯৮৪ সালে প্রণীত আইনে সাহেবে নিসাব সকল মুসলমানের জন্যে যাকাত প্রদান বাধ্যতামূলক করা হয়। ইরানে আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনীর সফল ইসলামী বিপ্লবের (১৯৭৯) অব্যবহিত পরে যাকাত প্রদান বাধ্যতামূলক করা হয়েছে এবং এর বন্টন ও ব্যবহারের জন্যে সরকারী দপ্তরের সৃষ্টি হয়েছে।

 

পাকিস্তানে সার্বক যাকাত আদায়ের অধ্যাদেশ কার্যকর হয় ২০জুন, ১৯৮০ হতে। উল্লেখ্য, ইরান ও পাকিস্তানে ব্যাংকসমূহ হতে উৎসমূলেই যাকাত আদায় করে নেওয়া হচ্ছে। হিজরী ১৪০৯-১০ সালে যাকাত তহবিলে পাকিস্তান সরকারের আয় ছিল ২৬৮.৬০ কোটি টাকা। এই আইনের বিধানে স্থানীয় যাকাত কমিটি প্রশাসনিক কাজে মোট আদায়কৃত অর্থের ১০%-এর বেশী ব্যয় করতে পারবে না। পক্ষান্তরে পুনর্বাসন ও কর্মসংস্থানমূলক কর্মসূচীর জন্যে কমপক্ষে ৪৫% ব্যয় করার ও জীবন ধারণের প্রয়োজন পূরণের জন্যে ৪৫%-এর বেশী ব্যয় না করার বিধি রয়েছে। পাকিস্তানে উশর আদায়ের অধ্যাদেশ কার্যকর হয় ১৫ মার্চ, ১৯৮৩ হতে।

 

এসব তথ্য হতে কয়েকটি বিষয় সুস্পষ্টভাবে উপলব্ধি করা যাবে:

 

১. বাংলাদেশসহ সকল মুসলিম দেশে সরকারীভাবে যাকাত আদায়ের আইন থাকলে এবং তা যথাযথ প্রতিপালিত হলে দেশীয় উৎস হতেই বিপুল পরিমাণ অর্থ আদায় হতে পারে এবং দারিদ্র্য বিমোচনসহ দুঃস্থ জনগণের ন্যূনতম মৌলিক মানবিক প্রয়োজন পূরণের জন্যেই তা কার্যকরভাবে ব্যবহৃত হতে পারে। ফলে বিদেশী এনজিও নির্ভরশীলতা হ্রাস পাবে।

 

২. বিশ্বব্যাপী ইসলামী পুনর্জাগরণের প্রেক্ষিতেই কয়েকটি মুসলিম দেশে যাকাতের আইন গৃহীত হয়েছে। প্রসঙ্গটি বিশেষ গুরুত্ব লাভ করেছে ১৯৮০ এর দশক হতে। তা সত্ত্বেও মাত্র পাঁচ-ছয়টি দেশ ছাড়া অন্য কোথাও যাকাত আদায় বাধ্যতামূলক নয়।

 

৩. প্রাক্কলিত ও প্রকৃত আদায়কৃত যাকাতরে মধ্রে রয়েছে দুস্তর ব্যবধান। যাকাত আদায়ে ফঅঁকি দেওয়াই এর প্রধান কারণ। এর প্রতিবিধানের জন্যে সরকারের পূর্ণ হস্তক্ষেপ ও কঠোর নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন।

 

এজন্যেই খুলাফায়ে রাশিদূন (রা) এ ব্যাপারে এত সতর্ক ও কঠোর ছিলেন। পরবর্তীকালেও ইবনে তাইমিয়া, ইবনে হাযম, আবু ইসহাক আল-শাতিবী, আল-গাজ্জালী প্রমুখ প্রখ্যাত সমাজ সংস্কারক ও চিন্তাবিদগণ এ প্রসঙ্গে সরকারের ভূমিকার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করছেন।

 

. বাংলাদেশে দারিদ্র্য বিমোচন

 

. বিদ্যমান অবস্থা

 

আমাদের দেশে প্রবাদ রয়েছে, অভাবে স্বভাব নষ্ট। তাই সমাজ থেকে দরিদ্র্য দূর করা জরুরী। কিন্তু এজন্যে যেসব বাধা প্রধান সেসবের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের সুযোগের অভাব, প্রযুক্তি ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অভাব। এছাড়া রয়েছে প্রাকৃতিক দূর্বিপাকের ফলে ফসলহানি, বন্যা, অগ্নিকান্ড ও ভূমিকম্পে গৃহহানি, পরিবারর একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির মৃত্যুতে গোটা পরিবারের ভিক্ষুক হওয়ার অবস্থা। রয়েছে রোগ-ব্যাধি। দুর্ঘটনায় বিকলাঙ্গ হওয়া বা অসুস্থতায় শারীরিকভাবে পঙ্গু ও অক্ষম হওয়া তো রয়েছেই। ফলে আমাদের বেকারত্ব ও দারিদ্র্যের পরিমাণ দুটোই বিশ্বের শীর্ষস্থানীয়। অথচ বাংলাদেশের অবস্থা এমন হবার কথা নয়। এদেশের ৮৬৳ লোক মুসলমান। ব্যক্তি জীবনে নিষ্ঠাবান এবং খোদাভীরু মুসলমানদের উপর আল্লাহর তরফ হতেই কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য নির্দিষ্ট রয়েছে যা যথারীতি অনুশীলন করলে ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে দারিদ্র্য থাকার কথা নয়। ইসলামের সোনালী যুগে তা ছিলও না। বরং ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, জাযিরাতুল আরবে যাকাতের অর্থ নেবার লোক না থাকায় সেই অর্থ নতুন বিজিত দেশসমূহের জনগণের কল্যাণেই ব্যয় হতো।

 

অনেকেই মনে করেন দরিদ্র জনগণের অবস্থার পরিবর্তন করতে হলে চাই সরকারী সাহায্য নয়তো বিদেশী অনুদান। বস্তুতঃপক্ষে এদেশে এখন বহু এনজিও বিদেশী অনুদান নিয়েই দরিদ্র জনগণ, বিশেষতঃ গ্রামাঞ্চলের গরীব জনসাধারণের মধ্যে কাজ করে চলেছে। তারা প্রধানতঃ সুদের ভিত্তিতে অর্থ ঋণ দিয়ে কর্মসংস্থানমূলক কর্মসূচী গ্রহণের মাধ্যমে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছে। বাস্তবে এরা দারিদ্র্য বিমোচনের নামে দারিদ্র্যের চাষ করছে। এদের সৃষ্ট গোলক ধাঁধাঁ হতে বেরিয়ে আসতে পারছে না ঋণ গ্রহীতারা। এ কাজে খৃষ্টান মিশনারী এনজিওগুলো কম তৎপর নয়। অনেক বুদ্ধিজীবী ও সমাজহিতৈষী ব্যক্তি হতাশা প্রকাশ করে থাকেন, তাদের হাতে নগদ অর্থ নেই বলেই দরিদ্র জনসাধারণের ভাগ্যের চাকা ঘোরানো যাচ্ছে না। একটু তলিয়ে বিচার করলে দেখা যেত এদেশে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ যাকাত হিসেবে বিতরণ করা হয় তার সুষ্ঠু, সংগঠিত ও পরিকল্পিত ব্যবহার হলে এসব দরিদ্র লোকদের অবস্থা হয় তার সুষ্ঠু, সংগঠিত ও পরিকল্পিত ব্যবহার হলে এসব দরিদ্র লোকদের অবস্থার পরিবর্তন করা খুবই সম্ভব ছিল।

 

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বহু ধনী ব্যক্তি লক্ষাধিক টাকার উপর যাকাত দিয়ে থাকেন। কিন্তু তারা সাধারণতঃ এই অর্থের বড় অংশ দশ-বিশ টাকার নোটে পবিত্র রমযান মাসের মেষ দশ দিনে বাড়ির গেটে উপস্থিত গরীব নারী-পুরুষের মধ্যে বিলিয়ে দেন অথবা শাড়ী-লুঙ্গি আকারে বিতরণ করে থাকেন। কখনও কখনও এরা এলাকার মাদরাসার লিল্লাহ বোর্ডিং বা ইয়াতিমখানাতে এই অর্থের কিছুটা দান করে থাকেন। এরা মুসাফির ঋণগ্রস্ত অসুস্থ লোকদের কথা আদৌ বিবেচনায় আনেন না। বিবেচনায় আনেন না আল্লাহর পথের মুজাহিদদের কথা্ অথচ এরাই যদি পরিকল্পিতভাবে এলাকার দুঃস্থ, বিধবা, সহায়-সম্বলহীন পরিবারের মধ্যে থেকে বাছাই করে প্রতি বছর অন্তরঃ তিন-চারটি পরিবারকে নিজের পায়ে দাঁড়াবার জন্যে রিক্সা নৌকা সেলাই মেশিন অথবা কয়েকটা ছাগল কিনে দিতেন তাহলে দেখা যেত তার একার প্রচেষ্টাতেই পাঁচ বছরে অন্তত এলাকায় অন্ততঃ কুড়িটি পরিবার নিজের পায়ে দাঁড়াতে পেরেছে। ভিক্ষুক ও অভাবী পরিবারের সংখ্যাও কমে আসছে।

 

সমাজে বিদ্যমান অসহনীয় দারিদ্র্য ও বেকরাত্ব নিসরনকল্পে বর্তমান সময়ে যাকাতের অর্থ দিয়ে একটি তহবিল গঠন এবং সেই তহবিল হতেই দারিদ্র্য বিমোচন ও মানব সম্পদ উন্নয়নের কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণ করে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে ইসলামী ব্রাংক বাংলাদেশ লিমিটেড। ব্যাংকটি তার নিজস্ব তহবিলের যাকাত দিয়ে গড়ে তুলেছে ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশন। মূলতঃ তিনটি উদ্দেশ্রে এই তহবিলের অর্থ ব্যবহৃত হচ্ছে: (ত) নগদ সাহায্য, (খ) শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ এবং (গ) কর্মসংস্থান ও পুনর্বাসন। অভাবী ও অসহায় লোকদের আশু প্রয়োজন পূরণের জন্যে (যেমন- বন্যা, খরা, জলোচ্ছাস, অগ্নিকাণ্ড, ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত) নগদ সাহায্য প্রদান ছাড়াও চিকিৎসা সুবিধা দরিদ্র ছাত্র-ছাত্রীদের বৃত্তি প্রদান, কর্মসংস্থানের জন্যে প্রশিক্ষণ ও বিভিন্ন পেশার প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম (বিশেষতঃ মিশুক, সেলাই মেশিন, ওয়েল্ডিং সরঞ্জাম, রিক্সা ভ্যান, রিক্সা, হাঁস-মুরগী, নৌকা ইত্যাগি) সরবরাহ করাই এই কর্মসূচীর উদ্দেশ্য।

 

. বাংলাদেশের দারিদ্রে্যর চিত্র

 

বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর প্রায় ৫০% লোক দারিদ্র্য সীমার নীচে বাসকরে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে যারা দৈনিক ১,৮০৫ কিলো ক্যালোরী বা তার কম গ্রহণ করতে বাধ্য হয় তারাই চরম দারিদ্র্য সীমায় রয়েছে। পক্ষান্তরে যারা দৈনিক ২,১১২ কিলো ক্যালোরী বা তার কম গ্রহণ করতে পারে তারা রয়েছে দারিদ্র্য সীমায়। ক্রয় ক্ষমতার অভাবই এর মূল কারণ। তাই হয় এদেরকে খাদ্য সাহায্য দিতে হবে অথবা ক্রয় ক্ষমতা বাড়াবার উপযুক্ত কৌশল উদ্ভাবন করতে হবে। নইলে এরা সম্পদের পরিবর্তে দেশের বোঝা বা দায় হয়ে রইবে। বাংলাদেশে দারিদ্র্যের পরিমাণ প্রকৃতপক্ষে কত? বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো প্রথমবারের মতো ২০০ সালে মৌলিক চাহিদার ব্যয় পদ্ধতি [Cost of Basic Needs (CBN) Method] ব্যবহার করে Household Income and Expenditure Survey (HIES) পরিচালনা করে। এই পরিমাপ পদ্ধতিতে উচ্চ দারিদ্র্য রেখা ব্যবহার করে জাতীয় পর্যায়ে দারিদ্র্যের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৯.৮ শতাংশ। শহর অঞ্চলে এর পরিমাণ ৩৬.৬ শতাংশ হলেও পল্লী এলাকায় এর পরিমাণ ৫৩.১ শতাংশ (বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০০৪; পৃ. ১৫৬)।

 

এই ভয়াবহ দারিদ্র্য বিমোচনের জন্যে সরকারের গৃহীত সাধারণ কর্মসূচী যেমন কোনক্রমেই স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারে না, তেমনি একাজ বিদেশী সাহায্যপুষ্ট এনজিওদের উপরও ফেলে রাখা যায় না। সমকালীন সুদী ব্যাংক ব্যবস্থা বেকার দুঃস্থ ও গরীব জনগণকে কর্মসংস্থানের জন্যে সত্যিকার কোন সাহায্য করতে অপারগ। কোলেট্যারোল বা জামানত ছাড়া তারা ঋণ দেয় না। যেসব বেকার যুবক, দুঃস্থ মহিলা, বিকলাঙ্গ মানুষ সমাজের জন্যে দায়, যারা নিজেদেরকে অন্যের গলগ্রহ মনে করে সদা সর্বদা মানসিকভাবে সংকুচিত থাকে তাদের অবস্থার উন্নতিকল্পে সুদী ব্যাংক ব্যবস্থার কোন অবদান নেই।

 

সমাজকে গভীরভাবে নিরীক্ষণ করলে দেখা যাবে যখনই ব্যক্তি নিজ উদ্যোগে কাজে নিয়োজিত হতে পেরেছে, নিজের চেষ্টায় রুটি-রুজীর ব্যবস্থা করতে পেরেছে তখন শুধু তারই পারিবারিক উন্নতি হয়নি, গোটা সমাজের চেহারাও বদলাতে শুরু করেছে। কিন্তু এদের সহায়তা করার জন্যে সুদী এনজিওর কোন উদ্যোগ নেওয়া সঙ্গত কারণেই সম্ভব নয়। উপরন্তু সুদের ভিত্তিতে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে যেসব এনজিও তারা এই দারিদ্র্য দূর করতে তো পারেই নি বরং এর পরিধি আরও বাড়িয়ে তুলেছে।

 

মনে রাখা দরকার, দারিদ্র্য বিমোচনের জন্যে প্রদত্ত মাইক্রো ফাইন্যান্স ও মাইক্রো ক্রেডিট সমার্থক নয়। ফাইন্যান্সের সাথে মুনাফার সম্ভাব্যতা যুক্ত থাকলে তা হয়ে দাঁড়ায় ইনভেষ্টমেন্ট বিনিয়োগ। পক্ষান্তরে ফাইন্যান্সের সাথে সুদ যুক্ত হলে তা ক্রেডিট বা ঋণের রূপ লাভ করে। এই ক্রেডিট বা ঋণ নিয়ে কোন বেকার নারী-পুরুষ কর্মসংস্থানের সুযোগ করে নিতে পারে ঠিকই কিন্তু তার আয়ের সিংহভাগই চলে যায় কিস্তিতে সুদসহ ঋণ শুধতে। পরিণঅমে স্বামলম্বী হতে পারা তার জন্যে দুরূহ হয়ে দাঁড়ায়। এজন্যেই বিশ্ব জুড়ে মাইক্রো ক্রেডিটের এত বন্দনা চললেও এর দ্বারা স্বাবলম্বী মানুষের সংখ্যা বাড়েনি, দারিদ্র্য দূর হয়নি। বরং অনেকেরই মতে এত দ্বারা প্রকৃতপক্ষে দারিদ্র্যকে জিইয়ে রাখা হচ্ছে। কারো কারো অভিমত মাইক্রো ক্রেডিটের মাধ্যমে এনজিওগুলো আসলে দারিদ্র্যেরই চাষ করছে।

 

সমাজের যে বিপুলসংখ্যক লোক কর্মজীবী হলে দেশের সার্বিক উন্নয়নের গতিধারা সচল হয়, কীন্‌সের ভাষায় পূর্ণকর্মসংস্থানস মাত্রা অর্জিত হয়, সেই স্তরে পৌঁছুতে হলে দারকার একটা Big Push বা প্রবল ধাক্কা। সুদী এনজিওগুলো এই ধাক্কা দিতে কখনই সমর্থ নয়। বরং তারা যদি কখনও উদ্যোগ নেয়ও পরিণামে শুরু হয়ে যায় ব্যবসায় চক্র বা Buisiness cycle যা অর্থনীতির জন্যে খুবই অশুভ। তাই যদি বিনা সুদে বা কোনও রকম মুনাফার অংশ দাবী না করে কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেওয়া যায়, কাজের বা উৎপাদনের উপকরণ সরবরাহ করাযায় তাহলে সমাযে যে ইতিবাচক পরিবর্তন সূচিত হয় তার চেইন রিঅ্যাকশন চলে দীর্ঘদিন ধরে। এক্ষেত্রে লাভের গুড় পিঁপড়েয় খায় না বলে উদ্যোক্তারা প্রকৃত অর্থেই স্বাবলম্বী হতে পারে।

 

প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য, উদ্যোক্তা উন্নয়ন তথা ভিখারীর হাতকে কর্মীর হাতিয়ারে রূপান্তরের মধ্যে দিয়েই দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচী তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পেওঁছাতে সক্ষম। এজন্যেই ভিখারী তথা অভাবগ্রস্তকে কর্মীতে রূপান্তরের যথাযথ কৌশল উদ্ভাবন ও ত ার ব্যবহারই হবে যথোচিত পদক্ষেপ। এই কর্ম কৌশলই হলো মানব সম্পদ উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড। দারিদ্র্য বিমোচনের পাশাপাশি মানব সম্পদ উন্নয়নমূলক দীর্ঘমেয়াদী কর্মসূচী গৃহীত না হলে সমাজে স্থায়ী কল্যাণ ও মঙ্গল সাধন অসম্ভব। জনগোষ্ঠীকে জনশক্তিতে রূপান্তর তথা মানব সম্পদে উন্নীত করার জন্যে যেসব মৌলিক প্রয়োজন পূরণ করতে হবে সেসবের মধ্যে রয়েছে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, স্বাস্থ্যরক্ষা ও চিকিৎসা এবং গৃহায়ন। অন্নবস্ত্রের প্রয়োজন পূরণের পাশাপাশি এগুলো পূরণ না হলে জাতি যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই রয়ে যাবে। এজন্যে উপযুক্ত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দানের মাধ্যমে শিশু-কিশোরদেরকে ভবিষ্যতের যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা, যুবক-যুবতীদের স্বউদ্যোগে কর্মসংস্থানের জন্যে প্রয়োজনীয় পুঁজি সরবরাহ এবং একটি সুস্থ, সুখী ও সমৃদ্ধ জীবনের জন্যে যে মননশীলতার প্রযোজন তার উপযুক্ত পরিচর্যাই হলো মানব সম্পদ উন্নয়ন কৌশল।

 

. বাংলাদেশে আদায়যোগ্য যাকাতের পরিমাণ

 

প্রশ্ন উঠতে পারে, বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশে যাকাত ও উশরের মাধ্যমে কত টাকাই বা আদায় হতে পারে? এ প্রসঙ্গে সঠিকধারণার জন্যে নিচে উল্লেখিত বিষয়গুলোর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়।

 

(ক) বেসরকারী এক হিসাব মতে এদেশে এখন রাজধানী শহর হতে ‍শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ গঞ্জ/বাণিজ্যিক এলাকাতে যেসব কোটিপতি বাস করে তাদের সংখ্যা ১০,০০০ ছড়িয়ে যাবে। এদের মধ্যে অন্ততঃ ১০০ জন ১০০ কোটি টাকা বা তারও বেশী অর্থের মালিক। এরা সকলেই তাদের সঞ্চিত সম্পদ, মজুত অর্থ ও বিভিন্ন ধরনের কারবারের সঠিকভঅবে যাকাত হিসেব করলে এবং প্রতিজন গড়ে ন্যূনতম টাকা ২.৫০ লক্ষ হিসেবে যাকাত আদায় করলে বার্ষিক ২৫০ কোটি টাকা যাকাত আদায় হতে পারে।

 

(খ) এদেশের ব্যাংকিং সেক্টর হতে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ যাকাত হিসেবে আদায় হতে পারে তা কখনও খতিয়ে দেখা হয়নি। উদাহরণতঃ ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড ২০০৩ সালে যাকাত আদায় করেছে টা. ৪.৯৬ কোটিরও বেশী। দেশে চালু অর্থ হতে সমগ্র ব্যাংক ব্যবস্থায় যে নগদ টাকা জমা হয় এবং ব্যাংকগুলো তা অর্থনৈতিক কার্যক্রমে ব্যবহার করে তার মধ্যে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিঃ –এর অংশ মাত্র ০.৪% (অর্থাৎ প্রতি টাঃ ১,০০০-তে টাঃ ৪/- মাত্র)। এই ০.৪% অর্থ কাজে লাগিয়েই যদি ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিঃ টাঃ ৪.৯৬ কোটি টাকা যাকাত দিতে পারে তাহলে সমগ্র ব্যাংকিং সেক্টটর হতে হিসেব মতো ১,২৪০ কোটি টাকা যাকাত আদায় হওয়ার কথা। উল্লেখ্য, বীমা কোম্পানীগুলোকে এই হিসেবের আওতায় ধরা হয়নি।

 

(গ) যেসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও কলকারখানা সরকারকে আয়কর দিয়ে থাকে শরীয়াহ মুতাবিক তাদের সকলেরও যাকাত আদায় করা প্রয়োজন। এরা সঠিকভাবে যাকাত আদায় করলে এর পরিমাণ ১,০০০ কোটি টাকা ছড়িয়ে যাবে।

 

(ঘ) যারা আয়কর দিয়ে থাকে তারা সকলেই সাহেবে নিসাব। এদের একটা অংশ ব্যক্তিগতভাবে যাকাত আদায় করে থাকে। কিন্তু সকলেই সঠিক হিসাব মুতাবিক যাকাত আদায় করলে তার পরিমাণও শত কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।

 

(ঙ) যেসব কোম্পানী (ঔষধ রসায়ন জ্বালানি প্রকৌশল খাদ্য বস্ত্র গার্মেন্টস সিরামিক সিমেন্ট নির্মাণ ইত্যাদি) সরকারকে আয়করদেয় তাদেরও যাকাত দেওয়া উচিত। দেশের বিদ্যমান আইনে এই বাধ্যবাধকতা নেই। এরা যাকাত আদায় করলে তার পরিমাণ ১০০ কোটি টাকা ছড়িয়ে যাবে বলে অভিজ্ঞ মহলের হিসাব।

 

(চ) যেসব মহিলা ব্যাংকের লকারে স্বর্ণ অলংকার রাখেন তারাও শরীয়াহ অণুসারে যাকাত আদায়ে বাধ্য। কিছু উজ্জ্বল ব্যতিক্রম ছাড়া এদের অধিকাংশই যাকাত আদায় করেন না।

 

(ছ) শহরতলী ও মফঃস্বল এলাকার ছোট ব্যবসায়ী আড়ৎদার হোটেল মালিক ঠিকাদারদের অনেকর মধ্যে যাকাত দেবার কোন উদ্যোগ দেখা যায় না। অথচ এসব ব্যক্তির অধিকাংশই সাহেবে নিসাব। এছাড়া পরিবহন ব্যবসা িইটের ভাটা হিমাগার কনসালটিং ফার্ম ক্লিনিক বিভিন্ন সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠানও যাকাতের আওতাভুক্ত। এদের যাকাতের পরিমাণ বার্ষিক শত কোটি টাকা হওয়া মোটেই অসম্ভব নয়।

 

(জ) যারা সরকারের বিভিন্ন ধরনের মেয়াদী সঞ্চয়পত্র কিনে রেখেছেন, যারা ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট টাকা জমা রেখেছেন ও বিভিন্ন কোম্পানীর শেয়ার কিনেছেন, যারা পোস্টাল সেভিংস িএকাউন্টে মেয়াদী আমানত রেখেছেন অথবা যারা আইসিবির ইউনিট ফান্ড ও মিউচ্যুয়াল ফান্ডের সার্টিফিকেট কিনেছেন তারাও শরীয়াহ অনুসারে যাকাত আদায়ে বাধ্য। এ খাত হতে বছরে ৩,০০০ কোটি টাকা যাকাত আদায় হতে পারে।

 

এক্ষেত্রে একটি তথ্য বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। বাংলাদেশ সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী দেশের ব্যাংকসমূহে ২০০২-২০০৩ সালে মেয়াদী আমানতের পরিমাণ ছিল ৮৭,২৫১ কোটি টাকা (বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা, ২০০৪; পৃ. ২১৯)। মেয়াদী আমানত যেহেতু এক বছরের বেশী সময়ের জন্যে হয়ে থাকে এবং আমানতকারী স্বেচ্ছায় সঞ্চয়ির উদ্দেশ্যেই জমা রাখে সেহেতু এর যাকাত উসুল করা ফরয। এই অর্থের ২.৫% হারে যাকাতের পরিমাণ দাঁড়াবে ২,১৮১ কোটি টাকার বেশী।

 

. বাংলাদেশে প্রাপ্ত উশরের পরিমাণ

 

যেসব কৃষি জমির মালিকের নিসাব পরিমাণ ফসল হয় তাদের মধ্যে কতিপয় উজ্জ্বল ব্যতিক্রম ছাড়া অন্যান্যরা ফসলের উশর আদায় করে না। বাংলাদেশের ভূমি মালিকানার দিকে তাকালে দেখা যাবে সমগ্র উত্তর অঞ্চল তো বটেই, দক্ষিণ ও পূর্ব অঞ্চলেও চাষাধীন জমির বৃহৎ অংশের মালিক মোট কৃষকের ১৭%-২০%। অথব এরা ফসলের উশর আদায় করে না। এদেশের সাহেবে নিসাব পরিমাণ ফসলের অধিকারী জমির মারিক নিজ উদ্যোগেই যদি উশর আদায় করতো তাহলে এর পরিমাণ কম করে হলেও ১,০০০ কোটি টাকার বেশী হতো।

 

উদাহরণের সহায্যে বিষয়টা স্পষ্ট করা যায়। বাংলাদেশের গত ২০০০-২০০৩ বছরে গড়ে ২ কোটি ৬৬ লক্ষ একর জমিতে যা চাষকৃত জমির ৩৫.৩০%। বিগত ২০০০-২০০৩ সালে এদেশে ধান উৎপাদনের গড় পরিমাণ ছিল ২ কোটি ৪৯ লক্ষ মেট্রিক টন। এ থেকে সেচকৃত জমির অংশ বাদ দিলে উৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ কোটি ২৯ লক্ষ মেট্রিক টন। এর মধ্যে থেকে ক্ষুদে ও প্রান্তিক মালিক চাষী (৪০%) এবং মাঝারী চাষীদের অর্ধেককেও (২০%) যদি বা দেওয়া যায় তাহলে বাকীদের (৪০%) কাছ থেকে উশর আদায়যোগ্য ফসলের পরিমাণ দাঁড়াবে ৫১ লক্ষ ৫৫ হাজার মেট্রিক টন।

 

প্রতি মেট্রিক টন চাউলের গড় দাম টাঃ ১৫,০০০/- ধরলে এ থেকে উশর আদায় হবে ৭৭২ কোটি ৫০ লক্ষ টাকা (মূল্যের ১০% হারে)। একইভাবে সেচকৃত জমির উৎপাদন হতে পূর্বে উল্লেখিত শ্রেণরি কৃষকদের অংশ বাদ দেওয়া হলে উশর আদায়যোগ্য ফসলের পমিরণ দাঁড়াবে ৪৭ লক্ষ ৮৮হাজার মেট্রিক টন। পূর্বে উল্লেখিত মূল্যে এক্ষেত্রে উশরের পরিমাণ (মূল্যের ৫% বা নিষপে উশর হারে) দাঁড়াবে ৩৫৮ কোটি ৫০ লক্ষ টাকা। ফলে সেচবিহীন ও সেচকৃত জমির ধানের আদায়যোগ্য উশরের পরিমাণ দাঁড়াবে সর্বমোট ১,১৩১ কোটি টাকা। এছাড়া গম, আলু আখ প্রভৃতি ফসলের উশর আদায় করলে এই পরিমাণ যে উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যাবে তা বলাই বাহুল্য।

 

উপরে উপস্থাপিত তথ্য হতে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশ সব ধরনের উৎস মিলিয়ে প্রতি বছর চার হাজার কোটি টাকার মতো যাকাত আদায় হওয়া খুবই সম্ভব। তবে অবশ্য পালনীয় শর্ত হলো রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তা আদায়ের যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে। এজন্যে শরীয়াহর বিধানসমূহ জনসাধারণকে অবহিত করতে হবে। সেই সঙ্গে অন্যান্য কর আদায়ে সরকার যেমন কঠোর ও আইননানুগ পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকে এক্ষেত্রেও তা হুবহু অনুসরণ করতে হবে।

 

প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য, যাকাত আদায় তা বন্টনের শরীয় হুকুম সম্পর্কে এদেশের ইসলামপ্রিয় জনগণের মধ্যে কিছুটা হলৌ ধারণা রয়েছে। কিন্তু উশর সম্বন্ধে যে একেবারেই নেই তা বেশ জোর দিয়েই বলা যায়। অথচ যথাযথভাবে উশর ও অর্ধ-উশর আদায় ও তা হকদারদের মধ্যে সুচারুভাবে বন্টিত হলে গ্রামাঞ্চলে বিরাজমান নিদারুণ দারিদ্র্য ও চরম ধনবৈষম্য বিদ্যমান থাকার কথা নয়। এক্ষেত্রে নির্মম সত্য হলো এই যে উশর আদায়ের জন্যে উদ্যোগ গ্রহণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা আসবে বিত্তশালী জোতদার ও গ্রামীন মহাজনদের কাছ থেকেই। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, উপমহাদেশের অন্যতম মুজাদ্দিদ ইসলামী আন্দোলনের সিপাহসালার শহীদ সৈয়দ আহমদ বেরেলভীর উদ্দেশ্যে তাঁর হন্তারকের নিষ্ঠুর মন্তব্য ছিল- “এখন তোমার উশর বুঝে পেয়েছো তো মৌলানা?” এথেকেই বোঝা যায় তাঁর উশর আদায়ের আন্দোলনকে সেকালের ধনী জমিদার ও জোতদার মুসলমানরা কিভাবে গ্রহণ করেছিল।

 

বাংলাদেশে যাকাত খাত হতে প্রাপ্তব্য এই বিপুল অর্থ দিয়ে যেসব ত্রাণ ও পুনর্বাসনমূলক এবং প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থানমূলক কর্মসূচী গ্রহণ করা সম্ভব সে বিষয়ে নীচে আলোকপাত করা গেল। অবশ্য এটা একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ে Action Plan। প্রয়োজনে এর পরিবর্তন হবে এবং আরও লাগসই ও যথাযথ কর্মসূচী উদ্ভাবিত হবে। ত্রাণ ও কল্যাণধর্মী পদক্ষেপ গ্রহণের মূল লক্ষ্যই হবে দারিদ্র্য বিমোচন বা দারিদ্র্য দূরীকরণ। আশা করা যায়, এসব পদক্ষেপ গ্রহণ করার ফলে আদামী দশ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ হতে দারিদ্র্য সত্যিকার অর্থেই বিদা নেবে।

 

প্রসঙ্গতঃ মনে রাখা দরকার বাংলাদেশের দারিদ্র্য বিমোচন ও মানব সম্পদ উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু হওয়া উচিৎ পল্লী। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কারণেই এটি অপরিহার্য। তাই প্রস্তাবিত কর্মসূচীগুলো অবশ্যই শহরের বস্তির পরিবর্তে পল্লীকেন্দ্রিক হবে েএবং এর উপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপিত হতে হবে। যাকাতভিত্তিক কর্মকাণ্ডের মূল উদ্দেশ্যই হবে মানব কল্যাণ ও মানব সম্পদ উন্নয়ন।

 

. বাস্তবায়নযোগ্য কর্মপরিকল্পনা

 

ত্রাণ কল্যাণধর্মী কর্মসূচী:

 

বৃদ্ধদের জন্যে মাসোহারা: এদেশে সরকারী, আধা-সরকারী ও স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান হতে যারা অবসর নেয় শুধুমাত্র তারাই পেনশন পেয়ে থাকে। কিন্তু লক্ষ লক্ষ শ্রমজীবির বার্ধক্যে কোন আর্থিক সংস্থান নেই। এদের জন্যে কিচু করা খুবই জরুরী। অনেক সময়ে নিজেদের পরিবারের কাছেও এরা গলগ্রহ। এদের এই অসহায় অবস্থা দূর করার জন্যে প্রাথমিকভাবে দেশের সকল ইউনিয়ন (৪,৪৫১) এবং পৌর কর্পোরেশনের অধীনস্থ ওয়ার্ডের (৫৮৪) প্রতিটি হতে প্রতি বছর যদি অন্ততঃ পঞ্চাশ জনকে মাসিক টাঃ ১,০০০/- হিসেবে আর্থিক সহায়তা দেওয়া যায় তাহলে ২,৮১,৭৫০ জন উপকৃত হবে। তাদের ন্যূনতম প্রয়োজনের খানিকটা পূরণ হবে। এজন্যে প্রয়োজন হবে বার্ষিক ৩০২ কোটি ১০ লক্ষ টাকা।

 

সম্প্রতি সকল ইউনিয়ন ও পৌরসভার ওয়ার্ডপিছু পাঁচ জন সহায়-সম্বলহীন বৃদ্ধ ও বিধবাদের টাঃ ২০০/- হারে সরকারীভাবে মাসোহারা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু ইতিমধ্যেই খবরের কাগজে প্রকাশিত রিপোর্ট হতে জানা যায় জনকল্যাণের চেয়ে পরিটিক্যাল স্টান্টবাজিই এর পেছন বেশী কাজ করছে। সাহায্যপ্রার্থীরা বিশেষ এক রাজনৈতিক দলের সমর্থখ কিনা তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রে সেটাই প্রধান্য পাচ্ছে। যাকাতের অর্থ বন্টনের ক্ষেত্রে এধরনের উদ্দেশ্যে কোনক্রমেই কাঙ্খিত হবে না।

 

বিধবা/বিকলাঙ্গদের কল্যাণ: বাংলাদেশে বিধবা এবং নানাভাবে বিকলাঙ্গ হয়ে যাওয়া পরিবার প্রধানদরে পরিবারের দুর্দশার সীমা-পরিসীমা নেই। ভিক্ষুকের মতোই এদের জীবন যাপন অথবা ভিক্ষাবৃত্তিই এদের একমাত্র সম্বল। এদের এই অসহায় অবস্থা দূর করার জন্যে প্রাথমিকভাবে দেশের প্রতিটি ইউনিয়ন এবং পৌরৈ কর্পোরেশনের অধীনস্থ ওয়ার্ডের প্রতিটি হতে কমপক্ষে কুড়ি জন করে বিধবা/বিকলাঙ্গ পরিবার বেছে নেওয়া হয় তাহলে মোট সর্বমোট ১,০০,৭০০টি পরিবারকে সহায়তা প্রদান করা যাবে। এদেরকে মাসিক ন্যূনতম টাঃ ১,০০০/- করে সাহায্য করলে বার্ষিক ১৭০ কোটি ৮৪ লক্ষ টাকার প্রয়োজন হবে।

 

মৌলিক পারিবারিক সাহায্য: এদেশের গ্রামাঞ্চলে তো বটেই, শহরতলীতেও বহু পরিবার মশার আক্রমণ হতে রক্ষা পাওয়ার জন্যে যেমন মশারী নেই তেমনি শীতের প্রকোপ হতে বাঁচার জন্যে লেপ বা কম্পল নেই। শিশু ও বৃদ্ধদের কষ্ট শীতকালে অবর্ণনীয় হয়ে দাঁড়ায়। তীব্র শীতের কারণে প্রতি বছর বহু শিশু ও বৃদ্ধদের মৃত্যুবরণ করে। এ ছাড়া নানা অসুখের শিকার তো হয়ই। এর প্রতিবিধানের জন্যে যদি প্রতি ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড হতে প্রতি বছর কমপক্ষে পঞ্চাশটি পরিবারকে বেছে নিয়ে তাদের একটা করে বড় মশারী (৫×৭) ও একটা বড় লেপ (৬×৭.৫) কিনে দেওয়া যায় তাহলে তারা দীর্ঘদিনের জন্যে মশার আক্রমণ ও শীতের প্রকোপ হতে রক্ষা পাবে। এ জন্যে চাই সত্যিকার উদ্যোগ ও আন্তরিকতা। যদি প্রতিটি মশারীর গড় মূল্য টাঃ ২৫০/- ও লেপের মূল্য ৬০০ টাকা হয় তাহলে এজন্যে প্রয়োজন হবে ২১ কোটি ৩৯.৫ লক্ষ টাকার। এর ফলশ্রুতিতে দশ বছরে ২৫ লক্ষ ১৭ হাজারেরও বেশী পরিবার উপকৃত হবে।

 

কন্যাদায়গ্রস্তদের সাহায্য: আমাদের দেশে বিদ্যমান সামাজিক সমস্যাসমূহের অন্যতম কঠিন সমস্যা মেয়ের বিয়ে। যৌতুকের কথা বাদ দিলেও মেয়েকে মোটামুটি একটু সাজিয়ে শশুর বাড়ীতে পাঠাবার সাধ থাকলেও সাধ্য নেই হাজার হাজার পরিবারের। এছাড়া বিয়ের দিনে আপ্যায়ন ও অপরিহার্য কিছু খরচও রয়েছে যা যোগাবার সাধ্য অনেক পরিবারের নেই। এসব কারণে বিয়ের সম্বন্ধ এলেও মেয়ের বিয়ে দেওয়া হয়ে উঠে না। পিতা বেঁচে না থাকলে বিধবা মায়ের পক্ষে এই দায়িত্ব পালন করা আরও কঠিন হয়ে পড়ে। অভিজ্ঞতা হতে দেখা গেছে ন্যূনতম ৫,০০০/- সহযোগিতা করলে একটা মেয়েকে স্বামীর ঘরে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব। যদি দেশের সকল ইউনিয়ন ও ওয়ার্ডে প্রতি বছর পাঁচটি করে মেয়ের বিয়ের জন্যে এ ধরনের সহযোগিতা দেওয়া যায় তাহলে বছরে ব্যয় হবে ১২ কোটি ৫৮.৭ লক্ষ টাকা। দশ বছরে বিয়ে হবে ২,৫১,৭৫০টি মেয়ের। ফলে যে বিপুল সামাজিক কল্যাণ অর্জিত হবে অর্থমূল্যে তা পরিমাপ করা সম্ভব নয়।

 

ঋণগ্রস্ত কৃষকদের জমি অবমুক্তকরণ: বাংলাদেশের পল্লী এলাকায় এমন গ্রামের সংখ্যাই বেশী যেখানে বর্তমান ভূমিহীন কৃষকদের অনেকেই কয়েক বছর পূর্বেও ছিল মোটামুটি স্বচ্ছল এবং কৃষি জমির মালিক। কিন্তু পারিবারিক কোন বড় ধরনের ব্যয় নির্বাহের জন্যে ব্যাংক বা গ্রামীন মহাজনের নিকট হতে টাকা ঋণ নেওয়ার ফলে তার শেষ সম্বল চাষের জমিটুকু বেহাত হয়ে গেছে। প্রান্তিক ও ক্ষুদে কৃষকরাই এই তালিকায় সংখ্যাগুরু। ছেলে-মেয়ের বিয়ে, চিকিৎসা বা প্রাকৃতিক দুর্বিপাকের ফলে শস্যহানির ক্ষতিপূরণের জন্যে শেষ সম্বল দুই বা তিন বিঘা চাষের জমি তারা রেহেন বা বন্ধক রাখে। এসব ঋণ গ্রহীতাদের অধিকাংশই এ ঋণ আর শুধতে পারে না। ফলে তাদের জমি চলে যায় মহাজনের হাতে। এর প্রতিবিধানের জন্যে যাকাতের অর্থ হতেই এদের সাহায্য করা যায়। যদি সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার টাকা করে প্রতি ইউনিয়নে গড়ে কুড়ি জন কৃষককেও সাহায্য করা যায় তাহলে ৮৯,০২০ জন কৃষককে প্রতি বছর ঋণমুক্ত করা যায়। জমি ফেরত পেয়ে তারা আবার চাষ-আবাদ করতে ও জমির মালিক হিসাবে নিজেদের উপর আস্থা ফিরে পেতে পারে। এতে বার্ষিক ব্যয় হবে ৪৪কোটি ৫১ লক্ষ টাকা এবং দশ বছরের মধ্যে প্রায় সকল ক্ষুদে ও প্রান্তিক কৃষক ‍ঋণমুক্ত হয়ে যাবে।

 

দরিদ্র শিশুদের পুষ্টি সাহায্য: বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে তো বটেই, শহরেও বস্তি এলাকাতে অগণিত শিশু নিদারুণ পুষ্টিহীনতার শিকার। ফলে িএরা যৌবনেই নানা দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। অনেকে সারাজীবনের মতো রাতকানা স্কার্ভি রিকেট ম্যারাসমাস ঘ্যাগ পাইলস প্রভৃতি নানা রোগের শিকার হয়। এর প্রতিবিধানের জন্যে যাদের বয়স দুই থেকে পাঁচ বছরে মধ্যে তাদের ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল, ভিটামিন ‘সি’ ট্যাপলেট, আয়োডিনযুক্ত লবণের প্যাকেট ইত্যাদি সরবরাহ করতে হবে। এজন্যে প্রাথমিক পর্যায়ে যদি প্রতি ইউনিয়ন ও ওয়ার্ডে দুই হতে চার বছর বয়সের ১০০ জন শিশুকে বাছাই করা হয় তবে প্রতি বছর ৫,০৩,৫০০ শিশু এর আওতায় আসবে। শিশুর বয় পাঁচ বছর পূর্ণ হলে এই সাহায্য বন্ধ হয়ে যাবে। এজন্যে শিশুপ্রতি মাসিক ব্যয় নূন্যতম টাঃ ৬০/- ধরা হয় তাহলে বছরে খরচ হবে ৩৬ কোটি ২৫ লক্ষ টাকা।

 

প্রসবকালীন সহযোগিতা: প্রসূতি মাতা ও ৬ সপ্তাহ বয়সের মধ্যে শিশুর মৃত্যু উন্নয়নশীল বিশ্বে উঁচু মৃত্যু হারের অন্যতম কারণ। এদেশের গ্রামাঞ্চলে এখনও গর্ভবর্তী ও প্রসূতি মায়েদের যথাযথ পরিচর্যা, সেবা-যত্ন ও পুষ্টিকর খাবার যোগানের ব্যাপারে একদিকে যেমন বিপুল অমনোযোগিতা ও অশিক্ষা বিদ্যমান তেমনি সামর্থ্যের অভাবও স্বীকৃত। ফলে গর্ভবতী মায়েদের শেষের ছয় সপ্হাতে যখন পুষ্টিকর খাবারের বেশী প্রয়োজন তখন তারা তা যেমন পায় না প্রসবের পরেও সেই অবস্থার কোন উন্নতি ঘটে না। ঘটনাক্রমে যদি উপর্যুপরি দ্বিতীয় বা তৃতীয় কন্যা সন্তানের জন্ম হয় তাহলে প্রসূতির অনাদার-অবহেলার সীমা থাকে না। উপরন্তু প্রসবকালে যে পরিচ্ছন্ন ও জীবানুমুক্ত কাপড়-চোপড়, জীবানুনাশক সামগ্রী ও ঔষধপত্র প্রয়োজন দরিদ্র পরিবারে তার খুব অভাব। এর প্রতিবিধান করতে পারলে গর্ভবর্তী ও প্রসূতি মায়ের কল্যাণ হবে, তাদের অকাল মৃত্যুর হার কমে যাবে। একই সাথে নবজাতকের মৃত্যুর হারও কমে আসবে। এজন্যে ইউনিয়ন ও ওয়ার্ডপিছু যদি কুড়িটি দরিদ্র পরিবারে গর্ভবর্তী মাকে বেছে নেওয়া হয় এবং ন্যূনতম টাঃ ২০০০/- সহযোগিতা দেওয়া যায় তাহলে বছরে প্রয়োজন হবে মোট ২০ কোটি ১০ লক্ষ টাকা।

 

মুসাফিরদের সাহায্য: নিঃস্ব মুসাফিরের জন্যেও সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে আমাদের। কারণ এ হলো খোদায়ী বিধান। দেশের শহরগুলোর মসজিদে তো বটেই, থানা পর্যায়ের মসজিদেও প্রায়ই নামায শেষে দেখা যায় দু-একজন মুসাফির দাঁড়িয়ে যায় যার সব সম্বল শেষ। চিকিৎসা করতে এসে বাড়ী ফেরার মত অর্থ নেই, কাজের খোঁজে এসে কাজ না পেয়ে ফিরতে হচ্ছে কর্পদকশূন্য অবস্থায়, অথবা দুর্বৃত্তের খপ্পরে পড়ে সর্বস্ব খুইয়েছে। এদের বাড়ীতে ফিরে যাবার ব্যবস্থা করা আমাদের শরয়ী দায়িত্ব। এজসেন্য মসজিদের ইমাম সাহেবদের সাহায্য নিলে সবচেয়ে ভাল ফল পাওয়া যাব্ েএই উদ্দেশ্যে তাদের হাতে মাসে গড়ে টাঃ ২,০০০/- তুলে দিলে এধরনের মুসাফিরদের নিজ এলাকায় ফেরত যাওয়ার ব্যবস্থা করা সহজ হবে। দেশের ৬৪টি জেলা শহরে গড়ে পাঁচটি ও প্রতি থানা সদরে একটি করেম ‍মসজিদ বাছাই করা হলে মোট মসজিদের সংখ্যা দাঁড়াবে ৩২০+৪৬০=৭৮০। এসব মসজিদে মুসাফিরদের জন্যে মাগে গড়ে টাঃ ২,০০০/- ব্যয় করলে বছরে খরচ হবে ১ কোটি ৮৭ লক্ষ টাকা। এর ফলে যে বিপুল সামাজিক উপকার হবে তা বলে শেষ করার নয়।

 

ইয়াতীমদের প্রতিপালন: বাংলাদেশে প্রায় প্রতিটি জেলা সদরে সরকারী শিশুসদন রয়েছে। কিন্তু দেশের অগণিত ইয়াতীম শিশু-কিশোরদের স্থান সংকুলান এসব শিশুসদনে হওয়ার কথা নয়। উপরন্তু এখানে কিশোর নির্যাতন এবং তাদের আহার ও পোষাকের যে দুঃখবহ চিত্র মাঝে-মধ্যেই ফাঁক-ফোকর দিয়ে বেরিয়ে আসে তা হৃদয় বিদারক। তাছাড়া ভয়াবহ বন্যায় কত যে শিশু-কিশোর ও নিঃস্ব হয় তার সটিক চিত্র পাওয়া সম্ভব নয়। এদের অন্ন ব স্ত্র বাসস্থান ও শিক্ষার জন্যে যাকাতের অর্থ ব্যয় করার খুবই উপযুক্ত পদক্ষেপ হতে পারে। এজন্যে ইয়াতীমখানা তৈরী ও ইয়াতীমদের ভরণ-পোষণ ও সার্বিক তত্ত্বাবধান এবং সাধারণ শিক্ষাসহ বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। যদি ১০০ জন ইয়াতীমের একটি প্রতিষ্ঠানের জন্য বার্ষিক ন্যূনতম সার্বিক ব্যয় বারো লক্ষ টাকা ধরা হয় তবে এরকম পঞ্চাশটি ইয়াতীমখানার জন্যে বছরে ব্য হবে ছয় কোটি টাকা।

 

১০ ইউনিয়ন মেডিক্যাল সেন্টার: এদেশের পল্লী েএলাকায় চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবার সুবিধা যে কত অপ্রতুল ও অবহেলিত তা ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন। এদেশের গ্রামীন জনগণ সুচিকিৎসার সুযোগের অভাবে তাবিজ-তুমার, ঝাড়-ফুঁক ইত্যাদির উপর বিশ্বাস করে অথবা হাতুড়ে;রে হাতে জীবন সঁপে দিয়ে ধুঁকে ধুঁকে অকাল মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। দেশের এই বৃহৎ জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই দরিদ্র। এদেরকে সুস্থভাবে বাঁচার সুযোগ দিহে হলে আধুনিক চিকিৎসা সুবিধা পল্লী এলাকায় পেওঁছে দিতে হবে। এজন্যে দেশের প্রতিটি ইউনিয়নে ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন মেডিক্যাল সেন্টর গড়ে তোলা প্রয়োজন। এদেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও পরিবার পরিকল্পনার ব্যাপক প্রসারের উদ্দেশ্যে সরকার ‘স্যাটেলাইট ক্লিনিক’ নামে ইউনিয়নভিত্তিক কর্মসূচী চালু করেছেন আজ হতে দুই দশক আগে। সে ধাঁচেই প্রস্তাবিত ইউনিয়নকেন্দ্রিক এই সেন্টার গড়ে উঠতে পারে। এটি হবে মূলতঃ ভ্রাম্যমান বা মোবাইল। এখানে থাকবে একজন এমবিবিএস ডাক্তার, একজন করে পুরুষ মেডিক্যাল এসিট্যান্ট ও মহিলা স্বাস্থ্য কর্মী এবং পল্লী এলাকায় সব ঋতুতে ব্যবহার ও চলাচল উপযোগী বিশেষভাবে তৈরী ভ্যান।

 

এই ভ্যানেই থাকবে প্রয়োজনীয ঔষধপত্র ও চিকিৎসার অপরিহার্য সামগ্রী বা সরঞ্জাম। ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত গ্রামগুলোতে পালা করে নির্দিষ্ট দিনে হাজির হবে এই ভ্রাম্যমান মেডিক্যাল সেন্টার। জনসংখ্যা ও দূরত্বের বিচারে কোথাও এই সেন্টার একই দিনে দুই গ্রাম আবার কোথাও বা দুই দিন একই গ্রামে যাবে। বিনামূল্যে চিকিৎসা সুবিধা এবং স্বাস্থ্য ও পুষ্টি বিষয়ে পরামর্শ পাবে গ্রামীন দরিদ্র জনগণ। এখানে রেফারাল সুবিধার ব্যবস্থাও করা যেতে পারে। এর ফলে পরবর্তী পর্যায়ে একই উদ্দেশ্যে জেলা সদরে প্রতিষ্ঠিত উন্নতমানের হাসপাতালগুলোতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে রোগীর দ্রুত ও উপযুক্ত চিকিৎসা নিশ্চিত হবে। ইউনিয়নপিছু কেন্দ্রের গড় মাসিক ব্যয় (ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী, ভ্যানচালকের বেতন ও ঔষধসহ) ন্যূনতম কুড়ি হাজার টাকা ধরলে দেশের ৪,৪৫১টি ইউনিয়নের জন্যে বার্ষিক ব্যয় দাঁড়াবে ১০৬ কোটি ৮২ লক্ষ টাকা।

 

১১ মরণোত্তর ঋণ পরিশোধ: সহীত হাদীসে উল্লেখ রয়েছে, ঋণ রেখে মারাগেলে আল্লাহ শহীদকেও ক্ষমা করবেন না। ঋণ বান্দার হক, এই ঋণ পরিশোধ না করার গুনাহ আল্লাহও ক্ষমা করবেন না যতক্ষণ না ঋণদাতা তা ক্ষমা না করে দেয়। সুতরাং, ঋণ গ্রহীতা ঋণ পরিশোধ না করে মারা গেলে এবং তার সন্তান-সন্ততি বা উত্তরাধিকারীরা সেই ঋণ পরিশোধে অক্ষম হলে আখিরাতে ঐ ব্যক্তির অনন্ত আযাবের আশংকা রয়েছে। তাই, ঋণগ্রস্ত দরিদ্র কৃষকের জমি অবমুক্ত করার জন্যে যে ধরনের সহযোগিতার প্রস্তাব ইতিপূর্বে করা হয়েছে অনুরূপ সাহায্য এক্ষেত্রেও দেওয়া যেতে পারে। বরং এর ক্ষেত্র অধিক বিস্তৃত। কৃষি কাজ ছাড়াও নানা কারণে লোকে ঋণ নেয় এবং অনেকে তা সাধ্যমতে চেষ্টা সত্ত্বেও শুধতে পারে না। এদের মরণোত্তর ঋণ পরিশোধে এগিয়ে এলে অসহায় সন্তান-সন্ততি ও বিধবা স্ত্র িপীড়ন ও অসম্মান হতে রেহাই পাবে। উপরন্তু ঋণ যদি জমি বন্ধক রাখার কারণে হয়ে থাকে তাহলে ঋণ পরিশোধের ফলে জমি ফিরে পাবে ওয়ারিশরা। এতেও বিরাট কল্যাণ নিহিত রয়েছে।

 

১২ শরণার্থী সহায়তা উদ্ভাস্তু পুনর্বাসন: বর্তমান সময়ে বিশ্বজুড়ে মুসলমানরা সন্ত্রাসের শিকার। স্বদেশ ছেড়ে পার্শবর্তী দেশে আশ্রয় নিচ্ছে অসহায় হাজার হাজার নারী-পুরুষ শিশু-বৃদ্ধ। জীবন বাঁচাবার জন্যে নিরুপায় হয়ে অনেকেই শুধু পরনের কাপড়টুকু সম্বল করে অজানা গন্তব্যের দিকে যারা পাড়ি জমিয়েছিল তাদের বর্তমান বিভীষিকাময়, ভবিষ্যৎ অজানা ও অনিশ্চিত। চেচনিয়া বসনিয়া মায়ানমার মোসিডোনিয়া কাশ্মীর মিন্দানাও ইথিওপিয়া পূর্ব তিমুর নাইজেরিয়া এবং আফগানিস্তান এর জ্বাজ্বল্যমান উদাহরণ। জাতিসংঘের উদ্ভাস্তু হাইকমিশনের দেওয়া সাহায্য এবং মাঝে মাঝে মুসরিম বিশ্বের কোন কোন দেশের পাঠানো মানবিক সাহায্য বিপুল প্রয়োজনের সমুদ্রে গোষ্পদ মাত্র। লাখো লাখো বনি আদমের সাহায্যে মুসলিম মিল্লাতকেই এগিয়ে আসতে হবে। উম্মাহর এই দুর্দিনে রাষ্ট্রের পাশাপাশি ব্যক্তি মুসরমানকেও এগিয়ে আসতে হবে তার শক্তি সামর্থ নিয়ে। সেই সাথে যাকাতের অর্থও দিতে হবে অকাতরে এসব অভাবী ভাইবোনদের প্রয়োজন পূরণের জন্যে, তাদের পুনর্বাসনের জন্যে। ক্ষুধা-তৃষ্ণার খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের পাশাপাশি শীতের ঠান্ডা ও গ্রীষ্মের দাবদাহ হতে রক্ষার জন্যে চাই উপযুক্ত আশ্রয়স্থল। বাংলাদেশে এখনও মায়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমান এবং আটকেপড়া পাকিস্তানীদের অনেকেই মানবেতর জীবন যাপনে বাধ্য হচ্ছে। এদের প্রয়োজন পূরণ ও প্রত্যাবাসনেও যাকাতের অর্থে ইতিবাচক ভূমিকা রাখা সম্ভব। শুধু প্রয়োজনীয় উদ্রোগ ও যথাযথ পরিকল্পনা।

 

১৩ স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার: দেশের পল্লী এলাকায় তো বটেই, শহরতলীতেও স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগারের অভাব প্রকট। হাজার হাজার পরিবারের ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার বানাবার আর্থিক সামর্থ নেই। সেজন্যেই যেখানে সেখান প্রস্রাব ও পায়খানার কদর্য ও স্বাস্থ্যবিধি বহির্ভূত অভ্যাস আরও বেশী প্রসার লাভ করে চলেছে। ফলে সহজেই পানি দূষিত হচ্ছে, সংক্রামক ব্যাধি বিস্তার লাভ করছে, পুঁতিগন্ধময় পরিবেশের সৃষ্টি হচ্ছে। উপরন্তু গ্রামাঞ্জলে মহিলাদের পক্ষে ইজ্জত-আবরু বজায় রেখে প্রাকৃতিক এই প্রয়োজন পূরণ করা খুবই দুরূহ। দেশের উত্তরাঞ্চলে এই সমস্যা সবচেয়ে বেশী প্রকট। এর প্রতিবিধানের উদ্দেশ্যে দরিদ্র পরিবারসমূহের জন্যে স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগারের ব্যবস্থা করা জরুরী। এজন্যে প্রয়োজন একটা প্যানসহ স্লাব ও সিমেন্টের ২ বা ৩টা রিং। এজন্যে সর্বোচ্চ খরচ পড়বে সাড়ে তিনশ টাকা। গ্রহীতারা নিজেরাই পাটখড়ি, শুকনা কলাপাতা বা পলিথিন দিয়ে এটা ঘিরে নিতে পারে। যদি প্রতি ইউনিয়ন ও ওয়ার্ডে বছরে ৫০টি করে পরিবারকে এই সুবিধা দেওয়া যায় তাহলে প্রয়োজন হবে ৮ কোটি ৮১ লক্ষ টাকা। এভাবে ১০ বছরে ২৫,১৭,৫০০ পরিবার এই কর্মসূচীর আওতায় চলে আসবে। পর্দা, স্বাস্থ্যরক্ষা ও পরিবেশদূষন রোধে এর ফলাফল হবে সুদূরপ্রসারী।

 

১৪ নওমুসলিম পুনর্বাসন: দেশে প্রতি বছরই বিভিন্ন জেলায় কিছু কিছু ব্যক্তি বা পরিবার ইসলাম গ্রহণ করছে। ইসলাম গ্রহণের সাথে সাথেই এরা পারিবারিক সম্পদ ও সহযোগিতা হতে বঞ্চিত হয়। এদের সন্তান-সন্ততিরাও লেখা-পড়ার সুযোগ পায়না। এদের সম্মানজনক পুনর্বাসনের জন্যে সহযোগিতার উদ্যোগ নেওয়া আমাদের দ্বীনি দায়িত্ব। তবে ধর্মান্তরিত খৃষ্টানদের মতো এদের জন্যে পৃথক কোন অঞ্চল গড়ে তোলার চেষ্টা না করে বরং সমাজের মূল স্রোতধারার সাথে মিশে যেতে সাহায্য করাই শ্রেয়। যদি গোটা দেশে প্রতি বছর অন্ততঃ পঞ্চাশটি নওমুসলিম পরিবারকে এ উদ্দেশ্যে ন্যূনতম ;মাসিক টাঃ ৫,০০০/- হারে একবছর ভাতা প্রদান ও কর্মসংস্থানের জন্যে এককালীন দশ হাজার টাকা সাহায্য করা যায় তাহলে বছরে ব্যয় হবে ৩০ লক্ষ টাকা।

 

শিক্ষা প্রশিক্ষণমূলক কর্মসূচী

 

দ্বীনি শিক্ষা অর্জনে সহযোগিতা: ইসলামী শিক্ষা অর্জন ব্যতিরেকে প্রকৃত মুমিন হওয়া অসম্ভব। কিন্তু এদেশে ক্রমেই সেই সুযোগ সংকুচিত হয়ে আসছে। দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসাবে মাদরাসাগুলো কোনোক্রমে টিকে রয়েছে। সরকারী পরিসংখ্যান হতে দেখা যায় এদেশে ১৯৯১-৯২ সালে দাখিল মাদরাসার সংখ্যা ছিল ৪,৪৬৬। এ সংখ্যা ১৯৯৪-৯৫ সালে ৪,১২১ এ এসে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ তিন বছরে মাদরাসার সংখ্যা কমেছে ৩৪৫টি। সরকার প্রাথমিক শিক্ষা সম্প্রসারণের জন্যে প্রাইমারী স্কুল ও হাইস্কুলের প্রাইমারী অংশের ছাত্র-ছাত্রীদের পাঠ্যবই বিনামূল্যে সরবরাহ করে থাকে। উপরন্তু শিক্ষার বিনিময়ে খাদ্য (শিবিখা) কর্মসূচীও চালূ রয়েছে। কিন্তু মাদরাসাগুলো এসব সুযোগ হতে সম্পূর্ণ বঞ্চিত। মাদরাসাগুলোতে ছাত্র-ছাত্রী ধরে রাখতে হলে তাদের জন্যেও অনুরূপ সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করতে হবে। বিনামূল্যে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত বই প্রদানের পাশাপাশি প্রয়োজনীয় পোষাক যোগান দিতে হবে। এজন্যে যদি দাখিল মাদরাসাগুলোসহ আলিম ও ফাযিল মাদরাসার পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীদের বেভে নেওয়া হয় তাহলে এদের সংখ্যা দাঁড়াবে ১০ লাখের মতো। এদের বই সরবরাহ করতে গড়ে মাথাপিছু টাঃ ১৫০/- হিসাবে দরকার হবে ১৫ কোটি টাকা। এক সেট পোশাক সরবরাহ করলে খরচ পড়বে গড়ে মাথাপিছু টাঃ ২০০/- হারে ২০ কোটি টাকা। এছাড়া স্বাস্থ্যরক্ষার জন্যে ভিটামিন ও আয়রন ট্যাবলেট সরবরাহ করলে প্রয়োজন হবে আরও ১০ কোটি টাকার। সর্বসাকুল্যে এই ৪৫কোটি টাকার বিনিময়ে মানব সম্পদ উন্নয়নের যে স্থায়ী ভিত রচিত হবে তার ভবিষ্যৎ মূল্য অপরিসীম। এসবের পাশাপাশি মাদরাসার লিল্লাহ বোর্ডিংগুলোতেও খাদ্যমান বাড়াবার জন্যে যাকাতের অর্থ ব্যবহার অপরিহার্য।

 

ইসলামী সাহিত্য প্রকাশ: মনে রাখা দরকার, ইসলামের প্রচার ও প্রসার এবং ইসলামী জীবনব্যবস্থা কায়েমের জন্যে দ্বীনি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা ও সেসবের বিকাশের কোন বিকল্প নেই। যেকোন আন্দোলন বা জীবন ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা ও সাফল্য নির্ভর করে তার Institution building ক্ষমতার উপরে। সে জন্যেই মাদরাসাসহ অন্যান্য যেসব প্রতিষ্ঠান দ্বীনের কাজে সক্রিয়ভাবে লিপ্ত তাদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসতে হবে। একই সাথে ইসলামী চিন্তা ও বিশ্বাসের ধারক বই-পুস্তক ও পত্র-পত্রিকা প্রকাশের কাজে বিশেষস মনোনিবেশ করতে হবে। সহজবোধ্য করে লেখা ইসলামী জীবন ব্যবস্থার বুনিয়াদী শিক্ষার পাশাপাশি জ্ঞানগর্ভ, যুক্তিপূর্ণ অথচ স্বল্প আয়তনের বইয়ের আজ বিশেষ প্রয়োজন। এসব বই পৌঁছে দিতে হবে লক্ষ লক্ষ শিক্ষিত ‍যুবক-যুবতীদের হাতে। এছাড়া পাশ্চাত্যের ভোগবাদী দুনিয়াসর্বস্ব জীবনদর্শনের মুকাবিলা করা আদৌ সম্ভব নয়। এ প্রসঙ্গে বর্তমান শতাব্দীর প্রখ্যাত মনীষী ও ইসলামী চিন্তাবিদ ডঃ ইউসুফ আল-কারযাবীর বক্তব্য এখানে তুলে ধরা যেতে পারে। তিনি বলেন-

 

“যাকাত খাতের সমস্ত আয় সাংস্কৃতিক, প্রশিক্ষণমূলক ও প্রচারধর্মী কার্যাবলীতে ব্রয় করা িএ কালে উত্তম। .... সঠিক ইসলামী দাওয়াত প্রচারের কেন্দ্র স্থাপন এবং অমুসলিমদের মধ্যে ইসলাম প্রচারের দায়িত্ব পালন এ কালে সব কয়টি মহাদেশেই একান্ত কর্তব্য। কেননা এ কালে বিভিন্ন ধর্ম ও মতবাদের মধ্যে প্রচণ্ড দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষ চ লছে। একাজও জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ রূপে গণ্য হতে পারে। দেশের অভ্যন্তরে ইসলাম প্রচার কেন্দ্র গড়ে তোলা এবং মুসলিম যুবসমাজকে একাজে নিয়োজিত ও প্রতিপালন করা একান্ত আবশ্যক। .... খালেস ইসলামী মতবাদ ও চিন্তাধারামূরক বই-পুস্তক ও পত্র-পত্রিকা প্রচার করাও গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তা প্রতিহত করবে বিধ্বংসী ও বিভ্রান্তিকর চিন্তা-বিশ্বাসের ধারক বই-পুস্তক ও পত্র-পত্রিকার যাবতীয কারসাজি। তার ফলেই আল্লাহর কালেমা প্রাধান্য লাভ করতে পারে এবং সত্য সটিক চিন্তা সর্বত্র প্রচারিত হতে পারে। এ কাজও আল্লাহর পথে জিহাদ। .... ঘুমন্ত মুসলিম জনগণকে জাগ্রত করা এবং খৃস্টান মিশনারী ও নাস্তিকতার প্রচারকদের মুকাবিলা করা নিশ্চযই ইসলামী জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ।” (ইউসুফ আল-যারযাবী-ইসলামে যাকাত বিধান, ২য় খণ্ড, অনুবাদ- মুহাম্মদ আব্দুর রহীম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ১৯৮৩; পৃ. ১৭৫-১৭৬)

 

দাওয়াত তাবলীগের কাজ: স্বীকার করতে লজ্জা নেই, বাংলাদেশে ইসলামের প্রতি আহ্বান বা দাওয়াত এবং প্রচার বা তাবলীগের কাজ খুব অবহেলিত। ইসলামের শিক্ষা ও তার দাবী সম্বন্ধে অনবহিত হওয়ার কারণেই আজ যুব সমাজ বিপথগামী, ভিন্ন জীবন দর্শনের অনুরাগী। এই অবস্থার প্রতিবিধানের জন্যে দাওয়াত ও তাবলীগের কাজে যথাযোগ্য গুরুত্ব আরোপ করার বিকল্প নেই। প্রত্যেক ব্যক্তিকে দায়ী ইলাল্লাহ হিসেবে গড়ে তুলবার উদ্দেশ্যে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন, তাদের হাতে ইসলামী সাহিত্য পৌঁছে দেওয়া, খৃস্টান মিশনারী ও এনজিওদের অপতৎপরতার সম্বন্ধে ওয়াকিফহাল করা এবং ইসলামের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী যে অপপ্রচার ও শ্বেতসন্ত্রাস চলছে সে সম্বন্ধে অবহিত করার আশু পদক্ষেপ গ্রহণ নিতান্তই জরুরী। এই উদ্দেশ্যে ইসলামী সাহিত্যের প্রচার ও পাঠাগার গড়ে তোলার পাশাপাশি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যোগ্য ব্যক্তির প্রয়োজনও অনস্বীকার্য। দেশের সর্বত্র এই কাজের যথাযোগ্য আনজাম দেবার জন্যে কমপক্ষে থানাভিত্তিক লোক নিয়োগ করতে হবে। এজন্যে মাসিক পাঁচ হাজার টাকা খরচ করলে সারা দেশে বছরে খরচ হবে মাত্র তিন কোটি টাকা। দেশের ভবিষ্যৎ স্বার্থ বিবেচনায় এই অর্থ একেবারেই নগণ্য।

 

উপরন্তু দেশের প্রতিটি ইউনিয়ন ও ওয়ার্ডে যদি অন্ততঃ প্রথম পর্যায়ে পাঁচ ব ছরের জন্যেও ইসলামী সাহিত্য বিতরণ ও পাঠাগার স্থাপনের উদ্রোগ নেওয়া হয় এবং ইউনিয়ন/ওয়ার্ড পিছু ন্যূনতম পঞ্চাশ হাজার টাকা এই উদ্দেশ্যে ব্যয় করা হয় তাহলে বছরে খরচ হবে পঁচিশ কোটি টাকার কিছু বেশী। ইসলামবিরোধী শক্তির অগ্রাসন মুকাবিলার জন্যে এই অর্থ একেবারেই অকিঞ্চিৎকর। অথচ এই ব্যয় জাতির স্বার্থে অপরিহার্য। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে এই পরিমাণ অর্থ সাধারণভাবে সংগ্রহ করা খুবই কঠিন। তাই যাকাতের অর্থ ব্রবহার করে হলেও যুব সমাজকে চিন্তা ও মননশীলতার দিক থেকে ধ্বংসের পথ হতে ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যে তৎপরতা গ্রহণ একান্তই জরুরী।

 

৪। ছাত্রদের জন্যে বৃত্তি: দেশের মাদরাসা, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব ছাত্র-ছাত্রী পড়াশুনা করছে তাদের বিরাট অংশ ক্ষুদে ও মাঝারি কৃষক পরিবারের সন্তান। তারা দারুণ আর্থিক সংকটের শিকার। এদের লেখাপড়ার ব্যয় নির্বাহের জন্যে মাতাপিতাকে শেষ সম্বল চাষের জমিটুকু বিক্রী করতে হয় অথবা বন্ধক রাখতে হয়। অনেককে নিরুপায় হয়ে লেখাপড়া বন্ধ করে দিতে হয়। এদের মধ্যে থেকে উচ্চ মাধ্যমিক, সম্মান ও মার্টার্স শ্রেণী, মাদরাসার ক্ষেত্রে আলিম ফাজিল ও কামিল শ্রেণী, প্রকৌশল ও মেডিক্যাল কলেট এবং পলিটেকনিক ও ভকেশনাল ইনস্টিটিউটগুলোতে অধ্যয়নের ব্যয় নির্বাহের উদ্দেশ্যে যদি প্রতি বছর পঞ্চাশ হাজার ছাত্র-ছাত্রীকে বাছাই করা হয় এবং মাসিক টাঃ স১,৫০০/- হারে বৃত্তি দেওয়া হয় তাহলে বার্ষিক ব্যয় হবে ৯০ কোটি টাকা। এভাবে দশ বছরে পাঁচ লক্ষ ছাত্র-ছাত্রীকে শিক্ষার একটা পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া সম্ভব।

 

উল্লেখ্য, যেহেতু দ্বিতীয বছরে নতুন ছাত্র-ছাত্রীরা এ প্রকল্পের আওতায় আসবে এবং পুরাতনরাও অধ্যয়নরত থাকবে সেহেতু তখন প্রয়োজন হবে ১৮০ কোটি টাকা। তৃতীয় বছরে এর পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়াবে ২৭০ কোটি টাকা। চতুর্থ বছর হতে প্রয়োজন হবে ৩৬০ কোটি টাকার। সম্ভাব্য বৃত্তিভোগীদের বাছাই করার সময়ে মেধার পাশাপাশি প্রকৃতই পারিবারিক আর্থিক অনটন রয়েছে এমন প্রত্যয়নপত্রের প্রয়োজন হবে। এলাকার দুজন বিশিষ্ট ইসলামী ব্যক্তিত্ব সংশ্লিষ্ট ছাত্র-ছাত্রীর আমল-আখলাক ও তাকওয়া সম্বন্ধে গোপনে প্রত্যয়ন করবেন। উপরন্তু বৃত্তিভোগীরা কর্মজীবনে প্রবেশ করে প্রাপ্ত অর্থের অন্ততঃ ৫০% ওয়াকফ তহবিলে কিস্তিতে পরিশোধ করবে এরকম বিধান করাও সম্ভব।

 

মহিলাদের আত্মকর্মসংস্থানমূলক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র: মহিলাদের ঘরে বসেই জীবিকা উপার্জনের পথ করে দেবার জন্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা আবশ্যক। বিভিন্ন ধরনের সেলাই, কাটিং-নিটিং, এমব্রয়ডারী, বুটিক, ফেব্রিকস প্রিন্ট, ফুল, চামড়া ও কাপড়ের সৌখিন সামগ্রী, উলের কাজ ইত্যাদি শেখানোর জন্যে জেলা ও থানাভিত্তিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলা যেতে পারে। েএখানে শিক্ষিত-অশিক্ষিত সকল মহিলাই কাজ শেখার সুযোগ পাবে। এজন্যে বড় বড় শহরে একাধিক এবং ছোট জেলা ও বড় থানাগুলোতে প্রাথমিক পর্যায়ে একটি করে মোট ১০০টি কেন্দ্র গড়ে তোলা যেতে পারে। এসব কেন্দ্রে প্রশিক্ষকের বেতন, শিক্ষার উপকরণ সরবরাহ ও অন্যান্য আনুষাঙ্গিক ব্যয়সহ মাসিক ন্যূনতম গড় ব্যয় টাঃ ৮,০০০/= ধরলে ব্যয় হবে ৯৬ লক্ষ টাকা। বিনিময়ে হাজার হাজার মহিলা আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমে নিজেদের পায়ে দাঁড়াবার সুযোগ পাবে। তাদের আর্থিক শ্রীবৃদ্ধি ঘটবে, পরিবারের বিপর্যয়ও রোধ হবে।

 

কম্পিউটার প্রশিক্ষণ: ব্যাপক কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে বর্তমান কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন অতীব গুরুত্বপূর্ন পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বাংলাদেশে রয়েছে বিপুল সংখ্যক শিক্ষিত বেকার। যদি ডাটা এন্ট্রি অপরেটর হিসাবে এদের প্রশিক্ষণ দেওয়া যায় তাহলে এদের কর্মসংস্থানের সুযোগ খুলে যাবে। এ ব্যাপারে প্রতিবেশী দেশ ভারত ইতিমধ্যেই অনেক দূর এগিয়ে গেছে। সে দেশের সরকার উদ্যোগ নিয়ে V-sat চ্যানেলের সংযোগ নিয়েছে এবং শুধু ডাটা এন্ট্রি করেই প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করছে। আমাদেরও আগামী শতাব্দীর চাহিদা ও কর্মসংস্থানের প্রতি লক্ষ্য রেখে এখনই যুগপৎ প্রশিক্ষণ ও যোগাযোগ অবকাঠামো (Communication infrastructure) গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া উচিৎ। যদি প্রাথমিকভাবে দেশব্যাপী ১০০টি সঠিক মানের কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলা যায় তাহলে বছরে ন্যূনতম ১২,০০০ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া যাবে। এজন্যে প্রথম বছরে ৫কোটি টাকার মতো ব্যয় হলেও শেষে এটা বছরে দুই কোটি টাকার নীচে নেমে আসবে।

 

কর্মসংস্থান পুনর্বাসনমূলক কর্মসূচী

 

গরু/বলদ ক্রয়ে সাহায্য: গ্রাম বাংলায় কৃষি কাজের প্রধান অবলম্বন চাষের বলদ। একই সঙ্গে পুষ্টি ও উপার্জনের সহায়ক হলো দুধেল গাই। বহু কৃষকের জমি থাকলেও এক জোড়া বলদ নেই। কেনার সামর্থ্যও নেই। এদের হালের বলদ বা দুধেল গাই কিনে দিয়ে সাহায্য করা যেতে পারে। প্রতিটি গরু বা বলদের দাম যদি গড়ে টা: ৭,৫০০/- ধরা যায় িএবং প্রতি ইউনিয়নে গড়ে কুড়ি জনকেও এ ধরনের সাহায্য করা যায় তাহলে প্রতি বছর ব্যয় হবে ৬৬ কোটি ৭৬.৫ লক্ষ টাকা। এ কর্মসূচী দশবছর চালু থাকলে চাষাবাদ ও দুধের মাধ্যমে উপার্জন ও পুষ্টির ক্ষেত্রে বিপুল ইতিবাচক পরিবর্তন সূচিত হবে। গতিবেগে সঞ্চারিত হবে গ্রামীণ অর্থনীতিতে।

 

বিভিন্ন পেশাগত কর্মসংস্থান: শহরতলীসহ বাংলাদেশের গ্রামীন এলাকায় নিদারুণ বেকারত্ব বিদ্যমান। দেশে কর্মরত এনজিগুলো এসব বেকারদের, বিশেষতঃ মহিলাদের আত্মকর্মসংস্থানের জন্যে নানা ধরনের উপকরণ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ঋণ দিচ্ছে। দুঃখের বিষয়, এ ঋণ নিয়ে তারা স্বনির্ভর হতে পেরেছে, না সুকৌশলে তাদের শুষে নিয়ে এনজিওগুলো নিজেরাই ফুলে ফেঁপে বড় হচ্ছে সেই বিচার আজ বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর বিপরীতে যাকাতের অর্থ দিয়ে যদি নীচের খাতগুলোতে উপকরণ/সরঞ্জাম কিনে সাহায্য করা যেত তাহলে কি পরিমাণ উপকার হতে পারতো তার একটা সংক্ষিপ্ত চিত্র তুলে ধরা হলো।

 

গ্রামবাংলার ইউনিয়নসমূহ ও শহরতলীর এরাকাগুলোতে যেসব পেশায় অধিক সংখ্যক লোকের কাজের সুযোগ রয়েছে সেগুলো হলো:

 

ক) ক্ষুদ্র আকারে উৎপাদন: চাল/চিড়া/মুড়ি/খই তৈরী, পাটি তৈরী, চাটনী/আচার/মোরব্বা তৈরী, মিঠাই তৈরী, লুঙ্গি/তোয়ালা/গামছা বোনা, বাঁশ-বেতের কাজ, নকশী কাঁথা তৈরী, খেলনা তৈরী, হাঁস-মুরগী পালন, মাছের চাষ, সব্জী চাষ ইত্যাদি।

 

খ) পেশাগত সরঞ্জাম ক্রয়, সংযোজন ও মেরাতম: রিক্সা ও রিক্সাভ্যান তৈরী ও মেরামত, জাল তৈরী, গরু ও ঘোড়ার গাড়ীর চাকা তৈরী ও মেরামত, চাষাবাদের সরঞ্জাম তৈরী ও মেরামত, ইলেকট্রিক সামগ্রী মেরামত, স্যালো মেশিন মেরামত ইত্যাদি।

 

গ) ক্ষুদ্র আকারে ব্যবসা, মুদী দোকান, মনিহারী দোকান এ্যালুমিনিয়াম/মাটির তৈজসপত্রের দোকান, চায়ের দোকান, দর্জিন দোকান, মাছের ব্যবসা, সব্জীর ব্যবসা, মৌসুমী ফলের ব্যবসা, ফুলের দোকান, ফেরীওয়ালা ইত্যাদি।

 

উপরে উল্লেখিত চল্লিশ ধরনের কাজের মধ্যে যদি প্রতিটি ইউনিয়ন ও পৌরসভার প্রতিটি ওয়ার্ডে যেকোন দশটি পেশায় প্রতি বছর গড়ে দশ জন হিসাবে একশত জন বেকার অথচ উদ্যোক্তা পুরুষ ও নারীকে গড়ে পাঁচ হাজার টাকার উপকরণ দিয়ে সহযোগিতা করা যায় তাহলে বছরে প্রয়োজন হবে সর্বমোট ২৫১ কোটি ৭৫ লক্ষ টাকা। এ সুযোগ একজন লোক মাত্র একবারই পাবে। ফলে প্রতি বছর কর্মসংস্থান হবে ৫,০৩,৫০০ জনের। ‍উল্লেখ্য, ডিসেম্বর ১৯৯৭ পর্যন্ত গ্রামীন ব্যাংক বাদে উল্লেখযোগ্য এনজিওগুলোর প্রদত্ত ঋণের ক্রমপুঞ্জীভূত পরিমাণ ছিল ৪,৩৯৮ কোটি ৭৪ লক্ষ টাকা। পক্ষান্তরে শুধুমাত্র ১৯৯৭ সালে প্রদত্ত ঋণে পরিমাণ ছিল ১,৫০৯ কোটি ৯ লক্ষ টাকা। এবছরে ঋণগ্রহীতাদের গৃহীত মাথাপিচু ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র টা: ২,২৩৮/-। (তথ্যসূত্র: CDF Statics, Vol.56, December 1997, Credit and Development Forum, Dhaka, p. 6.)। এই ঋণ সবটাই শুধতে হয়েছে সুদসহ যার হার খুবই চড়া। গ্রামীন ব্যাংকের ক্ষেত্রেই এ হার ১২২% হতে ১৭৩%, এমনকি ক্ষেত্রেবিশেষে ২১৯% পর্যন্ত (ইনকিলাব, ৯ ও ১৬ নভেম্বর, ১৯৯৭)। এরই বিপরীত যাকাতের মাধ্যমে উপকরণ গ্রহীতাকে সাহায্য করা হচ্ছে সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থভাবে এবং প্রদত্ত অর্থও (যার পরিমাণ এনজিওগুলো প্রদত্ত গড় অর্থের দ্বিগুণেরও বেশ) তার কাছে রয়ে যাচ্ছে মূলধন আকারেই।

 

গৃহায়ন কর্মসূচী: বাংলাদেশে গ্রামাঞ্জলে প্রতি তিন জনের একজনেরই মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। প্রতি বছর অগ্নিকাণ্ড, বন্যা ও নদী ভাঙনের ফলে ক্রমেই এই সংখ্যা বাড়ছে। শহর রক্ষাকারী বাঁধ, রেল লাইনের দুপাশ, নদীর উঁচু পাড়, বেড়ী বাধঁ প্রভৃতি জায়গায় কোন রকমে খুঁটির মাথায় পলিথিন, চট, সিমেন্টের ব্যাগ দিয়ে আচ্ছাদন তৈরী করে বাস করছে দুর্গত বনি আদমরা। সেখানে না আছে আলো-বাতাস, না আছে পয়ঃনিষ্কাশনের ব্যবস্থা। লেখাপড়া বা চিত্ত বিনোদনের কথা নাই বলা হলো। এছাড়া অফিস-আদালত ও স্কুল-কলেজের বারান্দায়, রেল স্টেশন ও বাস টার্মিনালে বিপুল সংখ্যক ছিন্নমূল নারী-পুরুষ রাত কাটায়। এদের মাথা গোঁচার ঠাঁই করতে এগিয়ে আসতে হবে। সরকারী খাস জমি বা জেগে ওঠা নতুন চরে এাদের বহুজনেরই বাসস্থানের ব্যবস্থা করা সম্ভব। প্রয়োজন ন্যূনতম তিন বান টিন, গোটা দশেক বাঁশ ও অন্যান্য সরঞ্জাম। এছাড়া বেড়াও দিতে হবে। বিশুদ্ধ পানির জন্যে প্রয়োজন টিউওয়েলের। হাজার বিশেক টাকার মধ্যে এসব প্রয়োজন পূরণ সম্ভব। দেশের ৫,০৩৫টি ইউনিয়ন ও ওয়ার্ডে প্রতিবছর যদি অন্ততঃ পাঁচটি করে পরিবারকে ঘর বেঁধে দেওয়া যায় তাহলে উপকৃত হবে ২৫,১৭৫টি পরিবার, ব্যয় হবে ৫০ কোটি ৩৫ লক্ষ টাকা।

 

এভাবে কর্মসংস্থান ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা ছাড়াও দীর্ঘ মেয়াদী বৃহৎ বিনিয়োগ কর্মসূচী গ্রহণ করে স্থায়ী কর্মসংস্থানের যেমন সুযোগ সৃষ্টি করা যায় তেমনি এসব বিনিয়োগ হতে নিয়মিত ও স্থায়ী উপার্জনেরও সুযোগ হয়। এর ফলে পুরাতন ত্রাণ ও পুনর্বাসনমূলক কর্মসূচীগুলো অব্যাহত রাখা সম্ভব হবে। উদাহরণতঃ পরিবহন শিল্পের কথা ধরা যেতে পারে। দেশে সড়ক যোগাযোগের যে অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছে তার প্রেক্ষিতে আন্তঃজেলা ও রাজধানীর সাথে সড়ক পথে যাতায়াতের পরিমাণ বহুগুণ বেড়েছে, অদুর ভবিষ্যতে আড়ও বাড়বে। এই সুযোগ গ্রহণ করে যদি আধুনিক ২০০ বাস (এয়ার কন্ডিশন নয়) রাস্তায় নামানো যায় তাহলে সর্বসাকুল্যে ব্যয় হবে ১০০ কোটি টাকা। এথেকে যে আয় হবে তা যেমন পুনরায় বিনিয়োগ করা যাবে তেমনি বিপুল সংখ্যক লোকেরও কর্মসংস্থান হবে। ড্রাইভার কন্ডাকটর হেলপার ওয়েলম্যান মেকানিক ওয়ার্কশপ ইত্যাদি মিলে বিরাট সংখ্যক লোক কর্মব্যস্ত থাকার সুযোগ পাবে।

 

. সমস্যা

 

যাকাতের মাধ্যমে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে বিপুল উন্নয়নের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও জাতি তা থেকে বঞ্চিত। কারণ যাকাত ব্যবস্থা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে রয়েছে বিষম বাধা। এসব সমস্যা বা প্রতিবন্ধকতা সম্বন্ধে আলোকপাত করা অপরিহার্য। নীচে সংক্ষেপে এসব প্রসঙ্গ তুলে ধরা হলো।

 

প্রথমতঃ বাংলাদেশে ইসলামের মৌলিক যেসব প্রসঙ্গ নিয়ে জোরদার আলোচনা কম হয়েছে যাকাত সে সবের অন্যতম। যাকাত সম্বন্ধে পত্র-পত্রিকায় যদিও কিছু কিছু আলোচনা হয় ওয়াজ মাহফিল বা তাফসীরুল কুরআন মাহফিলে আলোচনা হয় তার চেয়ে অনেক কম। দেশে যতলোক পত্র-পত্রিকা পড়েন তার চেয়ে অনেকগুণ বেশী লোক ওয়াজ মাহফিলে জমায়েত হয় এবং ওলামায়ে কেরামের বক্তৃতা হতে শিক্ষা লাভ করে অনুপ্রাণিত হয়। ওলামা মাশয়েখগণ যদি জনগণকে যাকাতের হাকীকত ও ফযীলত এবং জনগণের আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনে এর সুদূরপ্রসারী ভূমিকা সম্বন্ধে যথাযথ বক্তব্য রাখতেন তাহলে এতদিনে যাকাতের উপযুক্ত ব্যবহার ও উসুল সম্পর্কে আরও বেশী সচেতনতা লক্ষ্য করা যেতো। রাষ্ট্রীয়ভাবে যাকাত আদায় ও ব্যবহার হলে যে কল্যাণ ও দীর্ঘমেয়াদী সুফল পাওয়া যেতো সে বিষয়েও জনগণের প্রায় কোন ধারণাই নেই।

 

দ্বিতীয়তঃ সাহেবে নিসাব ব্যক্তিদের কাছ থেকে যাকাত আদায়ের জন্যে েএদেশে কোন প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে ওঠেনি। প্রয়োজনীয় আইন বা রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ গৃহীত না হওয়াই এজন্যে প্রধানতঃ দায়ী। যারা যাকাত দিয়ে থাকেন তাদের কেউ কেউ অবশ্য সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্দ্যোগে বিভিন্ন দ্বীনি প্রতিষ্ঠান ও ইয়াতীমখানায় তাদের যাকাত পৌঁছে দেন। কখনও বা এসব প্রতিষ্ঠানের পক্ষ হতে লোক নিয়োগ করে যাকাত সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। কিন্তু বিপুলসংখ্যক যাকাত প্রদানকারী পুরুষ ও মহলিা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্তভাবে নিজেদের মার্জিমাফিক তাদের প্রদেয় যাকাতের অর্থ বিলি-বন্টন করে থাকেন। এই অবস্থার আশু পরিবর্তন খুব সহজসাধ্য নয়।

 

তৃতীযতঃ সরকার যদি যাকাত আদায় ও তার ব্যবহার সম্পর্কে আইন প্রণয়ন করেও তবু জনগণের পক্ষ হতে কাংখিত সাড়া বা সহযোগিতা লাভ খুব সহজ হবে না। কারণ এদেশের সরকারের আর্থিক লেনদেন ও অর্থব্যয়ের সাথে যারা সম্পৃক্ত তাদের আচরণ ব্যক্তিজীবন ও ইসলামের প্রতি তাদের কমিটমেন্টের প্রতি সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবে, পর্যবেক্ষণ করবে। বলাই বাহুল্য, সেই মাপকাঠিতে অনেক ঘাটতি, অনেক অপূর্ণতা ধরা পড়বে। দ্বীনদার মুসলমানরা চাইবে তাদের এই আর্থিক ইবাদাত আল্লাহর কাছে কবুল হোক, প্রকৃত হকদারদের হাতেই এই অর্থ পৌঁছুক। অর্থাৎ আত্মসাৎ বা দুর্নীতি দূরে থাক, এক্ষেত্রে সামান্য ত্রুটি বা অপূর্ণতাও তারা মেনে নেবে না। সুতরাং, এই উদ্দেশ্যে সঠিক জনশক্তি নিয়োগ ও প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো নির্মাণের কোন বিকল্প নেই।

 

কিন্তু এ কাজ যেমন সহজসাধ্য নয়, তেমনি স্বল্প সময়ে সম্পন্ন করারও নয়। এজন্যে যথাযথ আইন প্রণয়ন ও পরিকল্পনা গ্রহণের পূর্ব প্রয়েঅজন হবে একটা পাইলট স্কীম তৈরী করে তার বাস্তবায়ন, পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন। এই পাইলট স্কীম সফল হলে সেই আলোকেই প্রয়োজনীয পরিমার্জনা সাপেক্ষে এর সার্বজনীন রূপ দেওয়া যেতে পারে, আইন তৈরী হতে পারে এবং দেশব্যাপী তার প্রয়োগ হতে পারে। এজন্যে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে উপযুক্ত কর্মকৌশল নির্ধারণের কাজ এখনি শুরু হতে পারে।

 

. সম্ভাবনা

 

উপরের আলোচনা হতে এ সত্য দিবালোকের মতই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরই আল্লাহর দেওয়া বিপুল সম্পদ রয়েছে। এর সঠিক ব্যবহার করতে পারলে দারিদ্র্য বিমোচন ও মানব সম্পদ উন্নয়নের জন্যে কোন আলাউদ্দিনের চেরাগের দরকারনেই। দরকার নেই বিদেশী সাহায্যের। যা দরকার তা হলো ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা ও দাবী সম্বন্ধে জনগণের ওয়াকিবহাল হওয়া, যাকাত আদায় ও বিলি-বন্টন সম্পর্কে সাংগঠনিক প্রক্রিয়া ও সরকারী নতি-নির্দেশনা এবং একটি সুদূরপ্রসারী কার্যকর পরিকল্পনা। তাহলে এনজিওদের কবলমুক্ত এবং সুদের অভিশাপমুক্ত হয়ে সুখী ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়া সম্ভব।

 

দ্বিতীযতঃ ইতিপূর্বে বলা হয়েছে বাংলঅদেশের সাহেবে নিসাব ব্যক্তিরা যাকাত উসূর করে থাকে ব্যক্তিগত উদ্যোগে এবং তা বিলি-বন্টনও করে থাকে সম্পূর্ণ অপরিকল্পিতভাবে।। বহু ব্যক্তি প্রতিবছর লক্ষাধিক টাকা যাকাত আদায় করে থাকেন।কিন্তু তাদের কোন পূর্ব পরিকল্পনা না থাকায় ব্যয়িত এই অর্থ হতে দীর্ঘ মেয়াদী কল্যাণ বা দারিদ্র্য দূরকরণের কোনটাই হয় না। অথব এসব ব্যক্তিদের উদ্বুদ্ধ করে এদেরই দেয় যাকাতের অর্থ সংগ্রহ করে ক্ষুদ্র আকারে বা স্থানীয়ভিত্তিক পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা কঠিন বা অসম্ভব কাজ নয়। প্রয়োজন এদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করা এবং সুফল প্রত্যক্ষ করার সুযোগ দেওয়া। আশার কথা, ইতিমধ্যেই দেশের কোন কোন অঞ্চলে সাংগঠনিকভাবে এই উদ্যোগ গৃহীত হয়েছে এবং তার উপকারও চাক্ষুষ করা যাচ্ছে।

 

তৃতীযতঃ যাকাত আদায় ও তা বিলিবন্টনের জন্যে সরকার বা কোন সংস্থার বাড়তি অর্থ ব্যয়ের প্রয়োজন নেই। যাকাত আদায়কারীরাই যেহেতু আল-কুরআনের নির্দেশ অনুসারে যাকাতের অর্থ পেতে পারে (সূরা আত্‌-তাওবা: ৬০ আয়াত) সেহেতু আদায়কৃত যাকাত হতেই আদায়কারীকে এর একটা অংশ সম্মানী বা বেতন হিসেবে দেওয়া যেতে পারে। কোন প্রতিষ্ঠান একাজে এগিয়ে এলে তাকেও এ অর্থ দেওয়া সম্ভব। এর ফলে বেশ কিছু লোকের কর্মসংস্থান হবে। উপরন্তু দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত যাকাত সংগ্রহ ও অর্থ-সামগ্রী বিতরণ করার কাজটিও সহজ হবে।

 

চতুর্থতঃ এ ব্যাপারে দেশের ওলামা-মাশায়েখদের ঐক্যবদ্ধ, সক্রিয় ও বলিষ্ঠ ভূমিকা গ্রহণের প্রয়োজন। তাঁরা ঐক্যবদ্ধভাবে সঠিক পদ্ধতিতে যাকাত ও উশর আদায় এবং তার সর্বোচ্চ কল্যঅণমুখী ব্যবহারের জন্যে জনগণকে আহ্বান জানাতে পারেন। একই সঙ্গে সরকারকেও প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গঠনের জন্যে বলতে পারেন। অনুরূপভাবে দেশের বিভিন্ন দ্বীনি সংগঠন ও ইসলামপ্রিয় শিক্ষিত জনগণের সংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ তৎপরতা গ্রহণের প্রয়োজনও অনস্বীকার্য। তবে মনে রাখা দরকার, যাকাতই দেশের দারিদ্র্য বিমোচন তথা সমাজ কল্যাণের একমাত্র হাতিয়ার নয়, অন্যতম হাতিয়ার মাত্র। শরয়ী এই ইবাদাতের পাশাপাশি সচেতন দেশবাসী ও রাষ্ট্রকে েএই উদ্দেশ্যে অন্যান্য উৎস ও পদ্ধতির যথাযথ ব্যবহারে আন্তরিক ও বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখাও অপরিহার্য।

 

পঞ্চমতঃ অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যে ঐক্যজোটের সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছেন তারা ইসলামী মূল্যবোধ ও বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের বিশ্বাসী। কোটি কোটি তৌহিদী জনতার আশা-আকাঙ্খা পূরণ তারা তৎপর হবেন এই প্রত্যাশা দেশবাসীর। এই সরকার একটু উদ্যোগ নিলেই রাষ্ট্রীয়ভাবে যাকাত আদায়ের ব্যবস্থা গ্রহণ সম্ভব। বিশেষতঃ এই খাত হতে প্রাপ্ত অর্থ দারিদ্র্য বিমোচন ও মানব সম্পদ উন্নয়ন তথা বৃহত্তর সমাজকল্যাণের কাজেই যেহেতু ব্যয়িত হবে সেহেতু এই কাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রণালয়ও বিষয়টি নিয়ে সরকারের সাথে আলোচনা করতে পারে। তৈরী করতে পারে একটা প্রকল্পপত্র এবং সেটি সরকারের অনুমোদনের জন্যে উপস্থাপিত হতে পারে।

 

তবে এ ব্যাপার বাধা আসবে ইসলামবিরোধীদের চাইতে তথাকথিত ইসলাম দরদীদের কাছ থেকে। এসব বাধা জয় করার দৃঢ় মানসকিতা থাকতে হবে। সুদান, পাকিস্তান প্রভৃতি বৃটিশশাসিত দেশের মুসলিম বুদ্ধিজীবিরাই সেসব দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে যাকাত আদায় ও তার ব্যবহারের ক্ষেত্রে বৈরী ভূমিকা পালন করেছিল। কিন্তু জেনারেল জিয়াউল হকের মতো নেতারা তাদের কাছে মাথা নোয়ান নি। তাই ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী জনগণ সঙ্গতঃভাবেই আশা করতে পারে সরকার এ ব্যাপারে যথযোগ্য ভূমিকা রাখবেন এবং মুমিন মুসলিমের বহুদিনের অন্তরলালিত বাসনা পূরণে সমর্থ হবেন।

 

সরকারের যথোচিত উদ্যোগ, প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন এবং কার্যকর ভূমিকা ও ‍সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বারো কোটি তৌহিদী জনতা অধ্যুষিত এই দেশে যারা সাহেবে নিসাব তারা সকলেই যদি স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে নিয়মিত যাকাতের অর্থ পরিকল্পিতভাবে আল-কুরআনে উল্লেখিত খাতগুলো ব্যয়ের জন্যে উদ্যোগী হন তাহলে দেশে গরীব জনগণের ভাগ্যের চাকা যেমন ঘুরবে তেমনি অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের পরিধি হবে আরও বিস্তৃত। এজন্যে প্রয়োজন আজ সদিচ্ছার, সুষ্ঠু পরিকল্পনার এবং দরিদ্র জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্যে প্রকৃতই দৃঢ় অভিলাষের।

 

সুদ : অর্থনৈতিক কুফল উচ্ছেদের উপায়

 

“...এবং আল্লাহ ব্যবসাকে করেছেন হালাল ও সুদকে করেছেন হারাম।” (সূরা আল-বাকারাহ: ১৭৫ আয়াত)

 

আল্লাহতায়ালা কালাম-ই-পাকে এই দ্ব্যার্থহীন ঘোষণার মাধ্যমে সর্বকালেল এ সকল বনি আদমের জন্যে একদিকে যেমন ব্যবসাকে বৈধ ঘোষণা করেছেন অন্যদিকে সুদ ও সুদভিত্তিক সকল কার্যক্রমকে চিরতরে হারাম বা নিষিদ্ধ করেছেন। অর্থনীতিতে শোষণের অবসান ও যুলমতন্ত্রের বিলোপ সাধনের উদ্দেশ্যে সর্বপ্রথম ও সর্বপ্রধান যে মোক্ষম আঘাতটি ইসলাম হেনেছে তা হচ্ছে সুদের উচ্ছেদ। ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় ও অর্থনীতিতে যাবতীয অসৎ কাজের মধ্যে সুদকে সবচেয়ে পাপের জিনিস বলে গণ্য করা হয়েছে। বস্তুতঃ সুদের মত সমাজবিধ্বংসী অর্থনৈতিক হাতিয়ার আর দুটি নেই। সুদের কুফলগুলোর প্রতি একটু লক্ষ্য করলেই বোঝা যাবে কেন সুদ চিরতরে হারাম ঘোষিত হয়েছে।

 

সুদের অর্থনৈতিক কুফল

 

মানব জাতির ইতিহাস পর্যালোচনা করে ও বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক গবেষণা হতে সুদের নানাবিধ কুফলের সন্ধান পাওয়া গেছে। সুদের নৈতিক সামাজিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক আন্তর্জাতিক এমনকি মনস্তাত্তিবক কুফলও রয়েছে। কিন্তু সেসব আলোচনার সুযোগ এখানে নেই। শুধুমাত্র দৃশ্যমান ও বড় ধরনের অর্থনৈতিক কুফল সম্পর্কে নীচে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো।

 

১। সুদ সমাজ শোষণের সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম বা উপায়। একদল লোক বিনাশ্রমে অন্যের উপার্জনে ভাগ বসায় সুদের সাহায্যেই। ঋণ গ্রহীতা যে কারণে টাকা ঋণ নেয় সে কাজে তার লাভ হোক বা না হোক তাকে সুদের অর্থ দিতেই হবে। এর ফলে বহু সময়ে ঋণ গ্রহীতাকে স্থাপর-অস্থাবর সম্পদ বিক্রি করে হলেও সুদসহ আসল টাকা পরিশোধ করতে হয়্ সুদ গ্রহীতারা সমাজের পরগাছা। এরা অন্যের উপার্জন ও সম্পদে ভাগ বসিয়ে জীবন যাপন করে। উপরন্তু বিনাশ্রমে অর্থলাভের ফলে সমাজের প্রত্যক্ষ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে এদের কোন অবদান থাকে না।

 

২। সুদের কারণেই সমাজে দরিদ্র শ্রেণী আরও দরিদ্র এবং ধনী শ্রেণী আরও ধনী হয়। পরিণামে সামাজিক শ্রেণী বৈষম্য বেড়েই চলে। দরিদ্র এবং ধনী শ্রেণী আরো ধনী হয়। পরিণঅমে সামাজিক শ্রেণী বৈষম্য চলে। দরিদ্র অভাবগ্রস্ত মানুষ প্রয়োজনের সময়ে সাহায্যের কোন দরজা খোলা না পেয়ে, উপায়ন্তর না দেখে ঋণ নিতে বাধ্য হয়। সেই ঋণ উৎপাদনশীল ও অনুৎপাদনশীল উভয় প্রকার কাজেই ব্যবহৃত হয়ে থাকে। বিশেষ করে অনুৎপাদনশীল কাজে ঋণের অর্থ ব্যবহারের ফলে তার ঋণ পরিশোধের ক্ষমতাই লোপ পায়। পুঁজিবাদী সমাজে করযে হাসানার কোন সুযোগ না থাকায় অনুৎপাদনী খাতে ঋণ তো দূরের কথা, উৎপাদনী খাতেও বিনা সুদে ঋণ মেলে না। বোঝার উপর শাকের আঁটির মতো তাকে সুদ শোধ করতে হয়। এর ফলে সে তার শেষ সম্বল যা থাকে তাই বিক্রি করে উত্তমর্ণের ঋণ শুধরে থাকে। এই বাড়তি অর্থ পেয়ে উত্তমর্ণ আরো ধনী হয়। বৃদ্ধি পেতে থাকে সামাজিক শ্রেণী বৈষম্য।

 

বাংলাদেশে ধনীরা যে ক্রমাগত ধনী হচ্ছে তার অন্যতম প্রধান কারণ সুদভিত্তিক ব্যাংক ব্যবস্থার বিশেষ সহযোগিতা। যোগ্যতা ও আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও দরিদ্র বা মধ্যবিত্ত উদ্যোক্তারা প্রয়োজনীয জামানত দিতে না পারার কারণে সুদী ব্যাংকগুলো হতে ঋণ পায় না, অথচ বিত্তশালী ব্যবসায়ী বা শিল্প উদ্যোক্তারা সহজেই ঋণ পায়। ব্যাংক হাজার হাজার লোকের নিকট থেকে আমানত সংগ্রহ করে থাকে, কিন্তু ঐ অর্থ ঋণ আকারে পায় মুষ্টিমেয় বিত্তশালীরাই। এ থেকে উপার্জিত বিপুল মুনাফা তাদের হাতেই রয়ে যায়। ফলে সঞ্চয়কারী হাজার হাজার লোক তাদের অর্থের প্রাপ্য তা জনগণের কাছ থেকে দ্রব্যমূল্যের সাথেই তুলে নেয়। ফলে তাদের গায়ে আঁচড় লাগে না, কিন্তু অভ্যন্তরীন রক্তক্ষরণ হয় সাধারণ জনগণের। পরিণামে ধনীরা আরও ধনী হয়, গরীবরা হয় আরও গরীব। সমাজে হিতৈষীরা তাই যতই ‘গরীবি হঠাৎ’ বলে চিৎকার করুক সমাজের মধ্যেই এই দৃঢ়মূল সুকৌশল ও সর্বব্যাপী শোষণ পক্রিয়া বহাল থাকা অবস্থায় দারিদ্র্য দূরীকরণের কোন প্রেসক্রিপশনই কার্যকর হবে না।

 

৩। সুদ মানুষকে স্বার্থপর ও কৃপণ করে। অর্থলিপ্সা, কার্পণ্য ও স্বার্থপরতা সুদখোরদের অন্যতম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। বিনাশ্রমে উপার্জনের আকাংখা ও অর্থলিপ্সা হতেউ সুদ প্রথার জন্ম। সুদের মাধ্যমে নিশ্চিত ও নির্ধারিত আয়প্রাপ্তির লোভ সুদখোরদের বিচার-বিবেচনা, আবেগ-অনুভূতি এমনকি বিবেককে পর্যন্ত নিঃসাড় করে দেয়। সুদখোরদরে মধ্যে লোভ ও কৃপণতা ক্রমে ক্রমে এতদূর প্রসার লাভ করে, তাদের আচার-আচরণের এতখানি পরিবর্তন ঘটে যে তারা হয়ে ওঠে সমাজের ঘৃণিত জীব। তাদের প্রবাদতুল্য কৃপণতা গল্প-কাহিনীর খোরাক হয়ে ওঠে। ইংরেজী সাহিত্যের অবিসংবাদী সম্রাজ সেক্সপীয়রের অমর সৃষ্টি শাইলকের (The Merchant of Venice) নাম কে না জানে? ইটালীর সাহিত্যের মহাকবি দান্তে সুদখোরদরে ঠাঁই দিয়েছেন নরকের অগ্নিবৃষ্টিময় সপ্তম বৃত্তে (Divina Comedia)। মধ্য যুগে ইউরোপে চার্চ সুদখোরদরে আচরণ ও সীমাহীন লোভের জন্যে তাদেরকে দেহপসারিণীদের সাথে তুলনা করেছিল।

 

৪। সুদ শ্রমবিমুখতা ও অলসতার সৃষ্টি করে। ‍সুদভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ব্যাংকে অর্থ জমা রাখলে কোন পরিশ্রম ও ঝুঁকি ছাড়াই সুদের মাধ্যমে নির্ধারিত হারে অর্থ পাওয়া যায়। এই ব্যবস্থা যোগ্যতাসম্পন্ন, প্রতিভাবান ও কর্মঠ লোককেই অকর্মণ্য ও অলস বানিয়ে দেয়। ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প-কারখানা স্থাপন অর্থাৎ উৎপাদনধর্মী কাচে যে চিন্তা-ভাবনা, পরিকল্পনা, পরিশ্রম ও ঝুঁকি গ্রহণের দরকার সুদভিত্তিক সঞ্চয়কারীরা তা আর করে না। বরং ব্যাংকে সঞ্চিত অর্থ হতে বিনাশ্রমে নির্দিষ্ট ও নির্ধারিত হারে আয় পেয়ে তারা পরিতৃপ্ত থাকে। ধীরে ধীরে আলস্য তাদের গ্রাস করে। এভাবে সুদের কারণে যাদের হাতে অঢেল বিত্ত রয়েছে তাদের শ্রম, মেধা, দক্ষতা ও যোগ্যতার ফসল হতে সমাজ বঞ্চিত হয়। সৃষ্ট হয় শ্রমবিমুখতা ও অলসতা। এ দেশের সাহিত্য হতেই এর ভুরি ভুরি নজীর মিলবে। বাংলাদেশে বিদ্যমান সুদী ব্যবস্থায় কেউ ব্যাংকে দশ লাখ টাকা জমা রেখে কোন রকম ঝুঁকি বা দুঃশ্চিন্তা ছাড়াই ঘরে বসে প্রতি মাসে এগারো হাজার টাকা পেতে পারে।

 

৫। সুদভিত্তিক বিনিয়োগের ফলেই সামাজিক শোষণ সার্বিক ও সামষ্টিক, দীর্ঘস্থায়ী ও ব্যাপক হওয়ার সুযোগ হয়েছে। সুদভিত্তিক ব্যাংক ও বীমা ব্যবসার কারণে ছোট ছোট সঞ্চয় সমাবেশ ও সঞ্চালনের সুযোগ বিরাট পুঁজি গড়ে উঠছে। বীমা ও ব্যাংক ব্যবসায়ে নিযুক্ত মুষ্টিমেয় ব্যক্তি এই পুঁজি চড়া সুদে ঋণ দিয়ে বিপুল অর্থ উপার্জন করছে। একই সাথে ঋণ দেবার ক্ষেত্রে ধনী ও দারিদ্রের বাছ-বিচারের কারণে সৃষ্টি হচ্ছে ব্যাপক শ্রেণী বৈষম্য। অর্থাৎ, শ্রেণী বৈষম্য হ্রাস না পেয়ে আরও গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে। উপরন্তু বাংলাদেশের সুদী ব্যাংকগুলো তাদের প্রদত্ত সুদকে ক্ষেত্রবিশেষে মুনাফার লেবাস পরিয়ে চালিয়ে দেবার অপচেষ্টাও করছে। ফলে প্রতারিত হচ্ছে সরল প্রাণ ধর্মভীরু মানুষ।

 

সুদভিত্তিক ব্যাংকিং পদ্ধতিতে শোষণ যে কত সার্বিক ও কৌশলপূর্ণ একটা উদাহরণের সাহায্যে তা তুলে ধরা হলো। ব্যাংকে আমানতকারীরা যে অর্থ সঞ্চিত রাখে তার পুরোটা ব্যাংক কখনই গচ্ছিত রাখে না। সাধারণতঃ ঐ অর্থের ৯০% ঋণ দিয়ে থাকে ব্যবসায়ী-বিনিয়োগকারী-উদ্যোক্ততাদের। তারা এই অর্থের জন্যে ব্যাংককে যে সুদ দেয তা আদায় করে নেয় জনগণের নিকট হতেই তাদের প্রদত্ত সেবা ও পণ্যসামগ্রীর মূল্যেই সঙ্গেই। এদের মধ্যে ঐ সব আমানতকারীরাও রয়েছে যারা ব্যাংকে অর্থ রেখেছে সুদের মাধ্যমে নিশ্চিত নিরাপদ আয়ের উদ্দেশ্যে। আদায়কৃত সুদ হতে ব্যাংক েএকটা অংশ নিজস্ব ব্যয় নির্বাহের জন্যে রেখে বাকি অংশ আমানতকারীদের হিসাবে জমা করে দেয় তাদের প্রাপ্য সুদ বাবদ। এভাবেই ব্যাংক মাছের তেলে মাছ ভেজে নেয়। অন্যদিকে প্রতারিত হয় আমানতকারীরা। কিন্তু তারা কি কখনও তা তলিয়ে দেখার অবকাশ পায়? বরং বছর শেষে পাশ বই বা কম্পিউটারাইজট একান্ট শীটে যখন জমার বিপরীতে সুদ বাবদ প্রাপ্ত অর্থঞ দেখে তখন তারা দৃশ্যতঃ পুলকিত বোধ করে।

 

উদাহরণ-১

 

সুদ বাবদ আমানতকারী (=ভোক্তা) ব্যবসায়/উৎপাদনকারীকে মূল্যের আকারে প্রদান করে-সুদ বাবদ আমানতকারী ব্যাংক হতে পায় ১৬%৮%
=ব্যাংকে জমার বিপরীতে আমানতকারীর নীট লোকসান দাঁড়ায় ৮%

 

বিদ্যমান সুদভিত্তিক ব্যাংকিং পদ্ধতি ও আইন এবং সমষ্টি অর্থনীতির (Maroeconomics) কর্মকৌশলের প্রেক্ষিতে কোনভাবেই এই অদৃশ্য অথচ প্রকৃতই লোকসান তথা শোষণ প্রতিরোধের উপায় নেই। এর প্রতিবিধান রয়েছে একমাত্র ইসলামী বিনিয়েঅগ ও ব্যাংকিং পদ্ধতির কর্মকৌশলের মধ্যে।

 

৬। সুদের কারণেই ভূমিহীন কৃষকের সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। কৃষকেরা ফসল ফলাবার তাগিদেই নিজেরা খেতে না পেলেও ঋণ করে চমি চাষ করে থাকে। এই ঋণ শুধু যে গ্রামের মহাজনের কাছ থেকেই নেয় তা নয়। সরকারের কৃষি ব্যাংক থেকেও নেয় নেয় অন্যান্য বাণিজ্যিক ব্যাংক ও সমবায় প্রতিষ্ঠান থেকেও। যথোপযুক্ত বা আশানুরূপ ফসল হওয়া সব সময়েই অনিশ্চিত। তাছাড়া প্রাকৃতিক দুর্বিপাক তো রয়েছেই। যদি ফসল আশানুরূপ না হয় বা প্রাকৃতিক দুর্বিপাকের ফলে ফসল খুবই কম হয় বা মোটেই না হয় তবু কিন্তু কৃষককে নির্দিষ্ট সময়ান্তে সুদসহ ঋণ শোধ করতে হয়। তখন হয়তাকে আবার নতুন ঋণের সন্ধানে বের হতে হয় অথবা জমি-জিরাত বেচে কিংবা বন্ধক রেখে সুদ-আসলসহ শুধতে হয়। তা না হলে কি মহাজন, কি ব্যাংক সকলেই আদালতে নালিশ ঠুকে তার সহায়-সম্পত্তি ক্রোক করিয়ে নেবে। নীলামে চড়াবে দেনার দায়ে।

 

ধরা যাক, কৃষি ব্যাংক হতে আলু চাষের জন্যে কোন কৃষক ১৬% সুদে ২০০০/- টাকা ঋণ নিলো। তাকে অবশ্যই এজন্যে বছর শেষে বাড়তি ৩২০ টাকা পরিশোধ করতে হবে। অর্থাৎ, ঐ কৃষকের জমিতে আরও বেশী আলু উৎপন্ন হতে হবে। গড়ে আশি টাকা মণ হলে বাড়তি চার মণ আূ উৎপাদন হওয়া চাই। মজা হলো, আলু ফলন বেশী হলে তা সবারই ক্ষেতে হবে। ফলে দাম পড়ে যাবে। আলুর দাম যদি মণপ্রতি টাঃ ৮০/- হতে টাঃ ম৭০/-তে নেমে আসে তাহলে চাষীর মণপ্রতি টাঃ ১০/- অর্থাৎ মোট টাঃ ৪০/- ঘাটতি থেকে যাবে। ঋণের পরিমাণ যত বেশী হবে ঘাটতির পরিমাণও তত বেশী হবে। বাংলাদেশের বাস্তব চিত্র কী? ১৯৪৭ সালে ভঅরত বিভাগের সময়ে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের কৃষকদের ২৭% ভূমিহীন ছিল। কিন্তু মাত্র ৩৭ বছরের মধ্যে এই চিত্র পাল্টে গেছে। ১৯৮৩-৮৪ সালের কৃষি শুমারী হতে দেখা যায়, বাংলাদেশের ভূমিহীন কৃষক পরিবারের সংখ্যা মোট কৃষিনির্ভর পরিবারের ৬৮.৮% এ দাঁড়িয়েছে (সূত্র: স্ট্যাটিস্টিকাল পকেট বুক অব বাংয়লাদেশ ১৯৯৬, পৃ. ১৭৯)।

 

প্রসংগতঃ মনে রাখতে হবে, পাকিস্তান সৃষ্টির পর হতেই এদেশে কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক কৃষকদের অব্যাহতভাবে ঋণ দেওয়া শুরু করে। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আমলে তাঁর নির্দেশে দেওয়া একশ কোটি টাকার আই.আই.সি.পি. ঋণের প্রায় সবটাই আজও অনাদায় রয়ে গেছে। এরপরও বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর নির্বাচনী ওয়াদা মুতাবিক পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত কৃষি ঋণ মওকুফ করা হয়েছিল। রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবর রহমানের আমলে ২৫ বিঘা পর্যন্ত কৃষি জমির খাজনা প্রদান রহিত করা হয়। এরপরেও কেন দেশে ভূমিহীন কৃষকের সংখ্যা বাড়ছে? এর অন্যতম কারণ সুদভিত্তিক ঋণ প্রদান বা গ্রহণ। শুধু এদেশেই নয়, যে সমস্ত দেশে কৃষি উৎপাদনে ব্যাপক কৌশলগত কোন পরিবর্তন ঘটেনি অথবা মূল্য সহায়তা (Price support) বা উৎপাদন ভর্তুকী (Input subsidy) আকারে বিশেষ সরকারী সহায়তা দেওয়া হয়নি সেসব দেশে সুদনির্ভর লেনদেনে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষীরা ক্রমেই ভূমিহীন হয়ে যাচ্ছে।

 

৭। সুদের পরোক্ষ ফল হিসেবে একচেটিয়া কারবারের দৌরাত্ম্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। বড় বড় ব্যবসায়ীরা যে শর্তে ও যে সময়ের জন্যে ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রকিষ্ঠান হতে ঋণ পেতে পারে ছোট ব্যবসায়ীরা সেভাবে ঋণ পায় না। এজন্যে প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে তারতম্য ঘটে। সে প্রতিযোগিতায় অসম সুবিধা ভোগের সুযোগ নিয়ে বড় কারবারী বা ব্যবসায়ী আরো বড় হয়। ছোট কারবারী বা ব্যবসায়ী টিকতে না পেরে ধ্বংস হয়ে যায়। বৃহদায়তন শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও তাই। এই জাতীয় শিল্প প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে শুধু ব্যাংকই নয়, পুঁজিপতি ও অনৈসলামী সরকারসমূহ যে বিশেষ সুবিধা ও ন্যূনতম সুদের হারে টাকা ঋণ দিয়ে থাকে, ছোট বা ক্ষুদ্রায়তন শিল্পের জন্যে আদেও সে সুযোগ নেই। ফলে বড় শিল্পপতিরা প্রতিযোগিতাহীন বাজারে একচেটিয়া কারবারের সমস্ত সুযোগ লাভ করে। পরিণামে সামাজিক বৈষম্য আরো প্রকট হয়।

 

৮। সুদের ফলেই মুষ্টিমেয় লোকের মধ্যে পুঁজি সীমাবদ্ধ থাকার সুযোগ পায়। তাদের হাতেই পুঁজি আবর্তিত ও বৃদ্ধি পেতে থাকে। কেননা সুদের একটা বৈশিষ্ট্য এই যে, হাত গুটিয়ে বসে থাকা একটি শ্রেণী বিনাশ্রমে এর সাহায্যে উপার্জন করতে পারে। উত্তরাধিকার সূত্রে, অবৈধভাবে বা অন্য কোন উপায়ে কেউ প্রচুর অর্থ সঞ্চয় করতে পারলে সুদের বদৌলতেই সে তা ক্রমাগত বৃদ্ধি করে যেতে পারে। এজন্যে এদের মধ্যে অকর্মণ্যতা, বিলাসিতা ও দুষ্কর্মের প্রকার ঘটে। স্বাভাবিকভাবেই তখন সামাজিক শান্তি ও শৃংখলা বিঘ্নিত হয়।

 

৯। সুদের জন্যে দ্রব্যমূল্য ক্রমেই বৃদ্ধি পায়। সুদবিহীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় উৎপাদনকারী ও ব্যবসায়ী উৎপাদন খরচর উপর পরিবহন খরচ, শুল্ক (যদি থাকে), অন্যান্য আনুষঙ্গিক ব্যয় এবং স্বাভাবিক মুনাফা যোগ করে পণ্যসামগ্রীর বিক্রি মূল্য নির্ধারণ করে থাকে। কিন্তু সুদভিত্তিক অর্থনীতিতে দ্রব্যের এই স্বাভাবিক মূল্যের উপর উপর্যুপরি সুদ যোগ দেওয়া হয়। দ্রব্য বিশেষের উপর তিন থেকে চার বার পর্যন্ত, ক্ষেত্রবিশেষে তারও বেশীবার সুদ যুক্ত হয়ে থাকে।

 

উদাহরণস্বরূপ আমাদের দেশের বস্ত্র শিল্পের কথাই ধরা যেতে পারে। এই শিল্পের প্রয়োজন আমদানীকারকরা ব্যাংক হতে যে ঋণ নেয় বিদেশ থেকে তুলা আমদানীর জন্যে তার সুদ যুক্ত হয় ঐ তুলার বিক্রি মূল্যের উপর। এরপর সূতা তৈরীর কারখানা ব্যাংক হতে যে ঋণ নেয় তারও সুদ যুক্ত হয় ঐ তুলা থেকে তৈরী সূতার উপর। ‍পুনরায় ঐ সূতা হতে কাপড় তৈরীর সময়ে বস্ত্রকল সংস্থা বা কোম্পানী যে ঋণ নেয় সেই সুদ যুক্ত হয় কাপড়ের উপর। এরপর কাপড়ের এজেন্ট বা ডীলার তার ব্যবসার উদ্দেশ্যে ব্যাংক হতে যে ঋণ নেয় তারও সুদ যোগ করে দেয় ঐ কাপড়েরর কারখানা মূল্যের উপর। এভাবে চারটি স্তর বা পর্যায়ে সুদের অর্থ যুক্ত হয়ে বাজারে কাপড় যখন খুচরা দোকানে আসে বা প্রকৃত ভোক্ত ক্রয় করে তখন সে আসল মূল্যের চেয়ে বহুগুণ বেশী দাম দিয়ে থাকে।

 

একটা নমুনা হিসাবের সাহায্যে বিষয়টি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হলো। ধরা যাক, বিদেশ হতে তূলা আমদানীর জন্যে কোন ব্যবসায়ী ব্যাংক হতে এক লক্ষ টাকা ঋণ নিলো। এরপর বিভিন্ন পর্যায়ে পার হয়ে তা থেকে তেরী কাপড় বাজারে ভোক্তার কাছে পৌঁছানো পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে পার হয়ে তা থেকে তৈরী কাপড় বাজারে ভোক্তার কাছে পৌঁছানো পর্যন্ত সুদজনিত মূল্যবৃদ্ধির চিত্রটি কেমন দাঁড়াবে? দুটো অনুমিতি (assumption) এখানে ধরা হয়েছে: (ক) উৎপাদন, বিপণন, গুদামজাতকরণ প্রভৃতি প্রতিটি ক্সেত্রেই ব্যাংক হতে ঋণ নেওয়া হয়েছে, এবং (খ) সুদের হার সকল ক্ষেত্রেই ১৬%। এউ উদাহরণে বিভিন্ন পর্যায়ে অন্যান্য আবশ্যকীয় ব্রয় (যেমন-জাহাজ ভাড়া, কুলি খরচ, বিদ্যুৎ/জালানী ব্যয়, গুদাম ভাড়া, পরিবহন ব্যয়, শ্রমিকের বেতন/মজুরী, সরকারী কর/শুল্ক ইত্যাদি) ধরা হয়নি।

 

উদাহরণ-২

 

ক) আমদানীকারীর বিদেশী তূলার ক্রয়মূল্য টা: ১,০০,০০০/০০ হলে তূলার বিক্রয়মূল্য দাঁড়ায় টা: ১,১৬,০০০/০০;

 

খ) সূতা তৈরীর মিলের তুলার ক্রয়মূল্য টা: ১,১৬,০০০/০০ হলে সূতার বিক্রয়মূল্য দাঁড়ায় টাঃ ১,৩৪,৫৬০/০০;

 

গ) কাপড় তৈরীর মিলের সুতার ক্রয়মূল্য টা: ১,৩৪,৫৬০/০০ হলে কাপড়ের বিক্রয়মূল্য দাঁড়ায় টা: ১,৫৬,০৮৯/০০;

 

ঘ) মিল হতে এজেন্ট/ডিলারের কাপড়ের ক্রয়মূল্য টা: ১,৫৬,০৮৯/০০ হলে বিক্রয়মূল্য দাঁড়ায় টা: ১,৮১,০৬৪/০০;

 

ঙ) এজেন্টের কাছ থেকে পাইকারী বিক্রেতার কাপড়ের ক্রয়মূল্য টা: ১,৮১,০৬৪/০০ হলে বিক্রয়মূল্য দাঁড়ায় টা: ২,১০,০৩৪/০০।

 

এখানে দেখা যাচ্ছে যে, যে তূলার মূল ক্রয়মূল্য ছিল টা: ১,০০,০০০/০০ সেই তূলা হতে তৈরী কাপড় ভোক্তার নিকট পর্যন্ত পৌঁছাতে সুদ বাবদেই মূল্যের সাথে অতিরিক্ত টা: ১,১০,০৩৪/০০ যুক্ত হয়েছে যা ভোক্তাকেই দিতে হবে। কারণ চূড়ান্ত বিচারে শেষ অবধি প্রকৃত ভোক্তাইা মোট সুদের ভার বহন করে। এর অন্তর্নিহিত অর্থই হচ্ছে সুদ দিতে না হলে অর্থাৎ সুদ উচ্ছেদ হলে এই অতিরিক্ত অর্থঘ (টাকাপিছু ১.১০ টাকা) ভোক্তাকে দিতে হতো না।

 

এভাবে সমাজে দৈনন্দিন জীবনে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির প্রত্যেকটিতেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সুদ জড়িয়ে আছে। নিরুপায় ভোক্তাকে বাধ্য হয়েই সুদের জন্যে সৃষ্ট এই চড়া মূল্য দিতে হয়। কারণ সুদনির্ভর অর্থনীতিতে এছাড়া তার গত্যন্তর নেই। অথচ সুদ না থাকলে অর্থাৎ, সুদবিহীন অর্থনীতি চালু থাকলে এই যুলুম হতে জনসাধারণ রেহাই পেত। এতে শুধু তাদের জীবন যাত্রার ব্যয়ই কম হতো না, জীবন যাপনের মান হতো আরো উন্নত।

 

১০। সুদ মজুরী বৃদ্ধির অন্যতম বড় প্রতিবন্ধক। কারণ সুদের হার উচ্চ থাকলে বিনিয়োগ থাকে ন্যূনতম কোঠায়। তখন শিল্প উদ্যোক্তার পক্ষে মুনাফা অর্জনই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। সে সময়ে মজুরী বৃদ্ধি মানেই লোকসানে;র ঝুঁকি নেওয়ংা। সুদের হার কম থাকলে বিনিয়োগকারীর সংখ্যা বেশী হতে পারে কিন্তু পুঁজির সরবরাহ বৃদ্ধি পায় না। সেক্ষেত্রে বিনিয়োগ কম হওয়ার ফলে শ্রমিকের চাহিদাও কম থাকে। অন্যদিকে চাহিদার তুলনায় শ্রমিকের যোগান অনেক বেশী থাকার ফলে তাদের দিক থেকে মজুরী বৃদ্ধির দাবী উত্থাপন আদৌ সহজ হয় না। উপরন্তু কম মজুরীতেই চাহিদার চেয়ে শ্রম সরবরাহ বেশী হওয়ায় উদ্যোক্তারা মজুরী বৃদ্ধির দাবী মেনে নিতে চায় না। ফলে অনিবার্যভাবেই সংঘাত দেখা দেয়। কর্মবিরতি ঘেরাও ধীরে চলে ধর্মঘট হরতাল অবস্থান ধর্মঘট এরই বাস্তব রূপ। পরিমাণে মালিক পক্ষ ছাঁটাই, লক আউট ইত্যাদি কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকে। পূর্বেই বলা হয়েছে সুদের কারণে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়। ফলে বিক্রীও হ্রাস পায়। এই অবস্থায় মজুরী বৃদ্ধি পেলে মুনাফার হ্রাস পেয়ে সুদের হারের চেয়েও নীচে নেমে যেতে পারে। তাই মজুরী বৃদ্ধির কোন দাবীই শিল্প মালিকদের পক্ষে বিবেচনায় আনা সম্ভব হয় না।

 

এই কারণেই জাপানে মেইজী শাসন আমলে মজুরী বৃদ্ধির জন্যে শ্রমিকদের জোর দাবী থাকলেও যাইবাৎসু গোষ্ঠী তা মেনে নেয়নি, সরকারও এ ব্যাপারে শ্রমিকদের সমর্থনে এগিয়ে আসেনি। বৃটেনেও কৃষকদের স্বার্থে প্রণীত ১৮১৫ সালের শস্য আইন (Cmo Law) ত্রিশ বছর পরেই বাতিল করা হয় শিল্পপতিদের স্বার্থে। শস্য আইন বহাল থাকলে গমের দাম বৃদ্ধি পেতো। এতে কৃষকেরা লাভবান হতো। কিন্তু শিল্প শ্রমিকদের মজুরী বৃদ্ধি করা অপরিহার্য হয়ে পড়তো যার ফলে শিল্পপতিদের মুনাফা হ্রাস পেতো।

 

১১। সুদ দীর্ঘ মেয়াদী ও স্বল্প লাভজনক ক্ষেত্রে বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করে।সুদনির্ভর ব্যাংক ব্যবস্থায় ব্রাংকগুলো দীর্ঘ সময় ধরে পুঁজি আটকে থাকার সম্ভাবনা রয়েছে এমন ধরনের বিনিয়োগ আদৌ উৎসাহ দেখায় না। এ জন্যেই দেশে ব্যয়বহুল বড় শিল্প-কারখানা গড়ে উঠতে পারে না। এসব শিল্প-কারখানা স্থাপনে যে বিপুল অর্থের প্রয়োজন হয় তা সুদের ভিত্তিতে যোগান দিলে প্রতি বছর বিপুল অর্থ সুদ হিসেবে পরিশোধ করতে হবে। বড় বড় কারখানা সাধারণতঃ প্রতিষ্ঠিত হয়ে চালু হতে দুই হতে তিন বছরের gestation period প্রয়োজন হয়। এই দীর্ঘ সময়ে সুদের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে এমন অংক দাঁড়াবে যে সে বোঝা বহন করা লাভজনক শিল্পের পক্ষেও সম্ভব নয়। আর লোকসান হলে সুদে-আসলে ঋণের যে অংক দাঁড়ায় তা পরিশোধ করা কখনো সম্ভব হয় না। স্বাভাবিকভাবেই উদ্যোক্তা তখন দেউলিয়া হতে বাধ্য হয়।

 

১২। সুদ সঞ্চয়কে অনুিৎপাদনশীল বিনিয়োগে উৎসাহিত করে। সুদী অর্থনীতির ব্যাংক ব্যবস্থায় ব্যাংকাররা ঝুঁকিমুক্ত, নিশ্চিত ও নির্ধারিত আয় পাওয়ার উদ্দেশ্যে জনগণের গচ্ছিত আমানতের বিরাট এক অংশ ট্রেজারী বিল ক্রয়, বিনিময় বিল ভাঙানো, সরকারী সিকিউরিটি বা ঋণপত্র ক্রয় ইত্যাদি অনুৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করে থাকে। ফলে উৎপাদনশীল কালে বিনিয়োগের জন্যে প্রয়োজনীয় পুঁজির অভাব দেখা দেয়। পরিণামে সুদের হার বৃদ্ধি পায় এবং পুঁজির প্রান্তিক দক্ষতা আরো হ্রাস পায়। ফলশ্রুতিতে বিনিয়োগ ও উৎপাদনের পরিমাণ হ্রাস পায়। কর্মসংস্থানের সংকোচন ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ঘটে। অর্থনীতিতে সৃষ্টি হয় সংকটের। এই অবস্থায় সরকারকেই এগিয়ে আসতে হয় সংকট মোচনের জন্যে।

 

১৩। সুদ বৈদেশিক ঋণের বোঝা বাড়ায়। উন্নয়নশীল দেশের সরকার প্রায়শঃ শিল্প ও অন্যান্য ভৌত অবকাঠামো বিনির্মাণেল জন্যে বিদেশ থেকে ঋণ গ্রহণ করে থাকে। ঐ সব ঋণ নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে সুদসহ পরিশোধযোগ্য। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, প্রায়ই দেখা যায় ঐসব ঋণ না নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ফেরত দেওয়া যায়, না উপযুক্তভাবে কাজে লাগিয়ে কাংখিত উন্নতি অর্জন করা যায়। ফলে ঋণ পরিশোধ তো দূরের কথা, অনেক সময় শুধু সুদ শোধ দেওয়াই দায় হয়ে ওঠে। এই অবস্থায় পূর্বের ঋণ পরিশোধের জন্যে এসব দেশ আবার নতুন করে ঋণ গ্রহণ করে। এই নতুন ঋণ সুদে-আসলে পূর্বের ঋণকে ছাড়িয়ে যায়।

 

অনুরূপভাবে দেশে কোন বিপর্যয় বা সংকট দেখা দিলে অথবা খাদ্য শস্যের মতো অপরিহার্য পণ্যের ঘাটতি ঘটলে তা পূরণের জন্যে সরকারকে বন্ধ দেশ বা ঋণদানকারী কনসার্টিয়াম থেকে ঋণ নিতে হয়। ভোগের জন্যে গৃহীত এই ঋণেল বিপরীতে যেহেতু কোন উৎপাদন বা কর্মসংস্থান হয় না, সেহেতু এই ঋণের আসল পরিশোধ তো দূরের কথা সুদই পরিশোধ করা সম্ভব হয় না্ সুদ-আসলে সমুদয় ঋণই জনগণের কাছ থেকে আদায় করতে হয়, নয়ত আবারও ঋণ নিতে হয়।

 

১৪। সুদের বিদ্যমানতার ফলে জনসাধারণের ক্রয়ক্ষমতা ক্রমশঃ হ্রাস পেতে থাকে। পূর্বেই দেখানো হয়েছে যে, সুদের কারণেই দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায় অবশ্যম্ভাবীভাবে ও অপ্রতিহত গতিতে। উপরন্তু অব্যাহত মুদ্রাস্ফীতি ঘটার অন্যতম কারণও সুদ। এই দুইয়ের যোগফলে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস ওঠে। নির্দিষ্ট আয়ের শ্রমজীবী, সাধারণ কৃষিজীবী, নানা ধরনের পেশাজীবী ও বেতনভুক্ত কর্মচারীরা এই সাধারণ মানুষের কাতারে শামিল। এদের আয়ের স্তর ও পরিমাণ যেহেতু মোটামুটি একটা দীর্ঘ সময় ধরে একই রকম থাকে সেহেতু দ্রব্যসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধির ফলে ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পায়। ফলে একদিকে যেমন জীবন যাপনের মানের অবনতি ঘটে অন্যদিকে বাজারে কার্যকর চাহিদার সংকোচন ঘটে। এরই চূড়ান্ত পরিণাম হিসাবে কলকারখানার মুনাফার পরিমাণ হ্রাস পায়, কর্মসংস্থান সৃষ্টির সম্ভাবনাও রুদ্ধ হয়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রে মুনাফার পরিমাণ ঠিক রাখার জন্যে এক্ষেত্রে পুনরায় মূল্যবৃদ্ধি ঘটায় শিল্প-উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা। জনসাধারণের ক্রয় ক্ষমতা তখন কমে যায় আরও এক ধাপ।

 

১৫। সুদভিত্কি ঋণে তৈরী প্রতিষ্ঠান কোন ক্ষতির সম্মুখীন হলে উদ্যোক্তা সম্পূর্ণ পর্যদুস্ত হয়ে পড়ে। উদ্যোক্তা যতক্ষণ ব্যাংকের সুদ পরিশোধ করে ততক্ষণ যখনই কারবারে লোকসান দেখা দেয় তখন ব্যাংক নতুন অর্থ লগ্নি করা দূরে থাক পূর্বের ঋণ ফেরত দেবার জন্যেই চাপ দেয়। এই অবস্থায় উদ্যোক্তা মাথায় হাত দেয়। কারণ তার নিজের পুঁজি ছিল সামান্যই, পুরো ব্যাপারটাই ছিল পরের ধনে পোদ্দারী। ফলে এই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া তার পক্ষে সম্ভব হয় না। পরিণামে গোটা কারবারটি বন্ধ বা ধ্বংস হয়ে যায়।

 

১৬। সুদভিত্তিক ব্যাংকিং ও ব্যবসা-বাণিজ্যের কারণে ব্যক্তির বা প্রতিষ্ঠানের দেউলিয়াত্বের বোঝা চাপে সমগ্র জাতির ঘাড়ে। বাংলাদেশ এর উজ্জ্বলতম উদাহরণ। ধনী ব্যবসায়ী বা শিল্পপতিরা নির্দিষ্ট হার সুদ প্রদানের অঙ্গীকারে ব্যাংক হতে তাদের দেওয়া Collateral বা জামানতের বিপরীতে দশগুণ বা তারও বেশী পরিমাণ ঋণ পেয়ে থাকে। অর্থাৎ, নিজেদের দশ লক্ষ টাকা থাকলে তারা এক কোটি টাকা ঋণ পায়। এক্ষেত্রে অনেক সময় রাজনৈতিক প্রভাব বা সম্পৃক্তাতও বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। কোটি টাকারও বেশী এই অর্থের ব্যবসা বা শিল্পে যে মুনাফা হয় তার সবটুকুই ভোগ করে ঐ ঋণগ্রহণকারী উদ্যোক্তা। ব্যাংকে অর্থ আমানতকারীরা সুদ পেলেও মুনাফার কোন অংশই তারা পায় না। অথচ লোকসানের কারণে ঐ প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হলে তার দায়ভার চাপে গোটা জাতির উপর। জনগণের সঞ্চয় তখন আর ফেরত হলেও (যদিও পূর্বের মুনাফা সে পুরোটা একাই ভোগ করেছে) জনসাধারণের লোকসান পুরো কোটি টাকাই। কষ্ট করে এই টাকা যারা সঞ্চয় করে ব্যাংকে আমানত রেখেছিল তাদেরই এখন ফতুর হবার পালা।

 

বাংলাদেশের ঋণ খেলাপী শিল্প উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের সমুদয় সম্পত্তি বিক্রী করে দিলেও ব্রাংক হতে তাদের গৃহীত ঋণ শোধ হবার নয়। কারণ এর পিছনে অদৃশ্য হাতের কারসাজি কাজ করেছিল। রাজনৈতিক মদদে ঋণ পাইয়ে দেওয়া হয়েছে অথবা ব্যাংকের বোর্ড অব ডিরেক্টরসের সদস্যরই নামে-বেনামে ঋণ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশের কোন তোয়াক্কা না করেই। অনেক ক্ষেত্রে যথাযথ প্রকল্প সমীক্ষাও করা হয় না। শুধুমাত্র সুদের হিসাব কষেই কল্পিত মুনাফার লোভনীয় টোপ দিয়ে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকা যা আর কোন দিনই ব্যাংকে ফিরে আসবে না। রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলো সরকারী তহবিলের মদদ পেলেও বেসরকারী ব্যাংকগুলো এই দায় উদ্ধারের জন্যে কার মদদ পাবে?

 

১৭। সুদ অর্থনীতিতে অস্থিতিশীলতার অন্যতম মুখ্য কারণ। একথা সর্বজনবিদিত যে পুঁজি বাজার মূলধনের চাহিদা হ্রাস পেলে সুদের হার হ্রাস পায়, আবার মূলধনের চাহিদা বৃদ্ধির সাথে সাথে সুদের হারও বৃদ্ধি পায়। বিভিন্ন দেশের সুদের হারের ওঠানামা কালীন সারির তথ্য (Time series data) বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, কোন দেশে সুদের হার দীর্ঘকাল স্থিতিশীল থাকতে পারে না। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে কোন কারণে তেজীভাব শুরু হলে মূলধনের চাহিদা বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। পুঁজির যোগানদার তখন সুদের হার বাড়িয়ে দেয়। ফলশ্রুতিতে পুঁজির চাহিদা হ্রাস পেতে শুরু করে, এমন কি কোন কোন ক্ষেত্রে তা পূর্বের চেয়েও হ্রাস পায়। এর মুকাবিলায় সুদের হার আবারও হ্রাস করা হয়। পুনরায় মূলধনের চাহিদা বৃদ্ধির সাথে সাথে সুদের হার বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। এভাবে সুদের হারের ঘন ঘন ওঠা-নামার কারণে বিনিয়োগকারীরা নিক্ষিপ্ত হয় অনিশ্চয়তার মধ্যে। এরই ফলে বিনিয়োগ, শেয়ার, পণ্য ও মুদ্রা বাজারে দারুণ অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। মারাত্মক বিরূপ প্রতিক্রিয়ার শিকার হয় দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ মিলটন ফ্রীডম্যান বলেছেন সুদের হারের অনিশ্চিত ও অনির্ধারিত ওঠানামার ফলে যেকোন দেশের অর্থনীতিতে মারাত্মক অস্থিরতার সৃষ্টি হতে পারে।

 

১৮। সুদের কারণে অর্থনীতির কল্যাণকর খাতে বেসরকারী বিনিয়োগ হ্রাস পেতে বাধ্য। পরিণঅমে সামাজিকভাবে কাম্য সেবা ও দ্রব্য সামগ্রীর সরবরাহ সংকোচন ঘটে অনিবার্যভাবেই। সকল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে, তা উৎপাদনমুখীই হোক আর সেবামূলকই হোক, একই হারে মুনাফা হয় না। কোন ক্ষেত্রে মুনাফা হার সুদের হারের চেয়ে বেশী, কোথাও সমান, আবার কোথাও বা কম। সাধারণভাবে বিলাস সামগ্রী ও সমাজের জন্যে অকল্যাণকর খাতে উৎপাদন ও ব্যবসায়ে মুনাফার হার হয়ে থাকে সর্বোচ্চ। প্রসাধন ও বিলাস সামগ্রী, সৌখিন দ্রব্য, মদ ও নেশার বস্তু ইত্যাদি তার পকৃষ্ট উদাহরণ। পক্ষান্তরে সমাজের জন্যে অত্যাবশ্যকীয় ও কল্যাণকর দ্রব্য সামগ্রী ও সেবার ক্ষেতে মুনাফার হার প্রায়শঃই খুব কম থাকে। এমন কি তা প্রদেয় সুদের হারের চেয়েও বেশী সেখানেই বিনিয়োগ হয় সর্বাধিক। অপর দিকে যেসব অত্যাবশ্যকীয় খাতে মুনাফার হার সুদের হারের সমান বা কম সেখানে কোন বিনিয়োগকারী এগিয়ে আসতে আগ্রহী হয়না। কারণ সুদ প্রদানের পর তার আর কিছু অবশিষ্ট থাকবে না। অথচ সমাজের বৃহত্তর স্বার্থে এই খঅতে বিনিয়োগ সবচেয়ে জরুরী। যদি অর্থনীতিতে সুদ নাথাকতো তাহলে বিনিয়োগকারীরা (এবং মূলধনের যোগানদাদরেরাও) প্রাপ্তব্য মুনাফাতেই (তার হার যত কমই হোক না কেন) পুঁজি বিনিয়োগে দ্বিধা করতো না। ফলে সমাজের অপরিহার্য ও কল্যাণকর খাতের সম্প্রসারণ ও কর্মদ্যোগের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা সম্ভব হতো।

 

১৯। সুদের কারণেই অর্থনীতিতে ব্যবসায় চক্রের (Business Cycle) সৃষ্টি হয়। অর্থনীতিতে বারবার মন্দা ও জেতীভাবের আবর্তন হতে থাকে। যার ফলে সব সময় অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা বিরাজ করে। যেকোন অর্থনীতির জন্যে এ অবস্থা অনাকাংখিত। অর্থনীতিতে যখন তেজীভাব থাকে তখনসুদের হার বৃদ্ধি পেতে থাকে। এভাবে সুদের হার যখন অতিরিক্ত বৃদ্ধি পায় তখন ঋণ গ্রহীতারা হিসেব করে যদি দেখে যে অতিরিক্ত সুদের হারের কারণে লাভের সম্ভাবনা খুব কম তখন তারা ঋণ নেওয়া বন্ধ কর দেয়। িএর ফলে পুঁজি বিনিয়োগে ভাটা পড়ে, উৎপাদন কমে যায়, শ্রমিক ছাঁটাই হয়, ব্যবসায়ে সৃষ্টি হয় মন্দা। এভাবে পুঁজির চাহিদা খুব কমে যাওয়ায় ব্যাংক সুদের হার কমিয়ে দেয়। ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা নতুন করে ‍ঋণ নিয়ে তখন উৎপাদন ও ব্যবসা-বাণিজ্যে মন দেয়। ক্রমে মন্দা কেটে গিয়ে পুনরায় তেজীভাবে সৃষ্টি হয়। এভাবে বারবার মন্দা ও তেজীর সৃষ্টি অর্থনীতির জন্যে যে অত্যন্ত অশুভ ও ভয়াবহ পরিণতির জন্য দেয় সে বিষয়ে পুঁজিবাদী অর্থনীতির শ্রেষ্ঠ প্রবক্তরাও একমত।

 

অনেকের ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে সঞ্চয় বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সুদের ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সুদ আসলেই অর্থনীতির জন্যে অপরিহার্য নয়, সঞ্চয়ের জন্যে তো নয়ই। বরং তা অর্থনৈতিক অগ্রগতির প্রতিবন্ধক। সুদনির্ভর পুঁজিবাদী অর্থনীতির অন্যতম প্রবক্তা বিশ্ববিশ্রুত অর্থনীতিবিদ লর্ড জেন মেনার্ড কেইনস তার সুবিখ্যাত গ্রন্থ The General Theory of Emplyment Interest and Money-তে প্রমাণ করেছেন সঞ্চয়ে সুদের কোন ভূমিকা নেই। সুদ বিদ্যমান না থাকলেও লোকে ব্যক্তিগত কারণে অর্থ সঞ্চয় করবে। দুর্দিনে খরচও আকস্মিক বড় ধলনের ব্যয় মেটাবার প্রয়োজনেই তারা সঞ্চয় করে।

 

২০। সুদ ধনবন্টনের অসহায়তার কারণ ও পূর্ণ কর্মসংস্থানের পথে বিরাট প্রতিবন্ধক। কীনস দেখিয়েছেন সুদের জন্যেই বরং বিনিয়োগ সীমিত হয়ে পড়ে। যেকোন দেশের অর্থনীতির পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে সুদের উচ্চ হারের সময়ে বিনিয়েঅগের পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে, অর্থনৈতিক কর্মপ্রয়াস সংকুচিত হয়েছে। অপরদিকে সুদের হার যখন ন্যূনতম তখনই বিনিয়োগের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। একইসঙ্গে অর্থনৈতিক কর্মপ্রয়াসও বেড়ে গেছে। এসব হতে বুঝতে বাকি থাকে না যেসুদ অর্থনৈতিক সাম্যেরই বিরধী নয়, অগ্রগতিরও বিরোধী।

 

সুতরাং, দেখা যাচ্ছে ব্যক্তি, সমাজ ও অর্থনীতির জন্যে সুদ কি ভয়াবহ পরিণাম ডেকে আনে।সুদের যে সব অকল্যাণকর দিক সম্বন্ধে বলা হলো সেসব ছাড়াও সুদের ণৈতিক সামাজিক মনস্তাত্বিক রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক ক্ষতিকরদিক রয়েছে। এখানে সেসব আলোচনার সুযোগ নেই। সুদনির্ভর অর্থনীতি প্রকৃতপক্ষে কতদূর বিপর্যয় সৃষ্টিকারী হতে পারে তা তুলে ধরাই ছিল এই সংক্ষিপ্ত আলোচনার উদ্দেশ্য।

 

অর্থনীতি সুদবিহীন হলে বিনিয়োগের জন্যে যেমন অর্থের অব্যাহত চাহিদা থাকবে তেমনি সঞ্চয়েরও সদ্ব্যবহার হবে। এর ফলে নতুন নতুন কলকারখানা স্থাপন ও ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণের মাধ্যমে অধিক উৎপাদন কর্মসংস্থান ও সম্পদের সুষম বন্টন ঘটবে। প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পাবে। একচেটিয়া কারবার হ্রাস পাবে। অতি মুনাফার সুযোগ ও অস্বাভাবিক বিনিয়োগ প্রবণতা দূর হবে। এই সমস্ত উদ্দেশ্য সাধন ও বড় ধরনের শোষণের পথ বন্ধ করেদেওয়ার জন্যেই ইসলাম সুদকে হারাম বা অবৈধ ঘোষণা করছে। বস্তুতঃ যুলুম ও বঞ্চনার অবসান ঘটাতে হলে তার উৎসকেই সমূলে বিনাশ করতে হয়। সেটাই বৈজ্ঞানিক পন্থা্

 

সুদ উচ্ছেদের উপায়

 

প্রশ্ন উঠতে পারে, বাংলাদেশের মতো একটি দেশে যেখানে দীর্ঘদিন ধরে সুদভিত্তিক অর্থনীতি চালু রয়েছে সেদেশে কিভাবে সুদ উচ্ছেদ করা সম্ভব? সুদের অভিশাপ মু্ত হয়ে কিভাবে ইসলামের অর্থনৈতিক সুবিচারের ছায়াতলে আশ্রয় পাওয়া যেতে পারে? এজন্যে নীচে উল্লেখিত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা যায়। আমাদের বিশ্বাস যদি প্রচেষ্টায় আমরা আন্তরিক ও যত্নবান হই তাহলে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর অসীম রহমতের ছায়াতলে আমাদের ঠাঁই দেবেন।

 

. ইসলামী পদ্ধতির ব্যাংক বীমা প্রতিষ্ঠান স্থাপন

 

এ কথা আজ অবিসংবাদী সত্য রূপে প্রতিষ্ঠিত যে বর্তমান প্রচলিত সুদভিত্তিক ব্যাংক ব্যবস্থার বিপরীতে ইসলামী ব্যাংকিং পদ্ধতি শুধু সফলই প্রমাণিত হয়েছে তাই নয়, বরং কোন কোন ক্ষেত্রে সুদভিত্তিক ব্যাংকগুলোর চাইদে অধিকতর যোগ্যতার সাথে কাজ কর যাচ্ছে। এজন্যে আজ অমুসলিম দেশে, এমনকি অমুসলিম পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় ইসলামী ব্যাংক ও ফাইন্যান্সিং সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। এর বড় উদাহরণ লুক্সেমবার্গ, ডেনমার্ক, ইংল্যাণ্ড এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশে প্রথম ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দুই দশকেরও বেশী আগে এবং সাফল্যেল সাথে ব্যাংকটি কাজ করেযাচ্ছে। আরও দুটি ব্রাংক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৯৯৫ সালে। সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার হলো এদেশের জনগণের মন মানসিককাত প্রবলভাবে ইসলামমুখী অথচ বিদ্যমান আইন কাঠামো, সমাজব্যবস্থা এমনকি ব্যবসায়ীদের অধিকাংশই মন-মানসিকতা ইসলামবিরোধী। পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা ও রোমান-বৃটিশ আইন দ্বারা আজও এদেশের ব্যবসায়ীরা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। এই প্রতিকূল অবস্থার কথা বিবেচনায় রেখেই বলা যায়, বাংলাদেশে আরও ইসলামী পদ্ধতির ব্যাংক ও ফাইন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশন প্রতিষ্ঠিত হওয়া প্রয়োজন এবং সেসবের সেবা গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত হওয়া আবশ্যক।

 

. করযে হাসানাও মুদারিবাত ব্যবস্থার প্রবর্তন

 

সমাজে কর্মচাঞ্চল্য সৃষ্টি এবং বিত্তহীন দক্ষ ও যোগ্য লোকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিতে পারে করযে হাসানা ও মুদারিবাত পদ্ধতি। ইসলামী সমাজের এই অপরিহার্য বিধানটি এদেশে অনুপস্থিত। অথচ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, এমনকি সংখ্যালঘু মুসলমানের দেশ শ্রীলংকাতেও মসজিদভিত্তিক করযে হাসানা প্রদান ও সোসাইটিভিত্তিক মুদারিবাত ব্যবস্থা চালু রয়েছে। এ দেশেও এই ব্যবস্থা চালু করা প্রয়োজন। সমাজের বিত্তশালী লোকদের করযে হাসানা দেওয়ার জন্যে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। এই উদ্যোগ যদি মসজিদকেন্দ্রিক হয় তাহলে সত্যিকার যোগ্য লোককে যেমন সুযোগ দেওয়া যাবে তেমনি এলাকাভিত্তিক উন্নয়নের মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণের পাশাপাশি সমাজ সচেতনতা ও সমাজকল্যাণ নিশ্চিত হবে।

 

মুদারাবা পদ্ধতি এদেশে চালু করতে সময়ের প্রয়োজন হবে। প্রয়োজন হবে আইন কাঠামো বদলানোর পাশাপাশিউত্তম চরিত্রের লোক সৃষ্টির। ‍ুত্তম ও যোগ্য লোকেরা মুদারাবার মাধ্যমে কর্মসংস্থান ও উৎপাদন বৃদ্ধি উভয়বিধ উপায়েই দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করতে পারে। উপরন্তু সমাজের বিত্তশালী লোকদের মনোভাব পরিবর্তনের জন্যে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এজন্যে প্রয়োজন তাদের ইসলামী অনুশাসন জানতে ও অনুসরণ করতে উদ্বুদ্ধ করা। করযে হাসানা দিলে সেই অর্থের জন্যে আয়কর দিতে হবে না এবং মুদারাবার ক্ষেত্রে সাহিব আল-মালকে মুনাফার নির্দিষ্ট পরিমাণ উর্ধের জন্যে আয়কর দিতে হবে এমন আইন করে বিত্তশালী মুসলিমদের মনোযোগ আকর্ষণ করা সম্ভব।

 

. পাঠ্যসূচীতে ইসলামী অর্থনীতি চালু করা

 

বাংলাদেশের সংখ্যাগুরু জনগণের তথা মুসলমান জনগোষ্ঠীর সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্য এই যে শিক্ষার বিষয়বস্তুর সঙ্গে তাদের ঈমানও আকীদার কোন সংশ্রব নেই। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে শিক্ষার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে প্রবর্তিত ইসলামী শিক্ষার কথা বাদ দিলে উচ্চতর শিক্ষা এবং বিশেষ শিক্ষার কোন পর্যায়েই ইসলাম যে একটা পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা তাজানার ও অনুশীলনের কোনও সুযোগ নেই। এই অবস্থার নিরসন হওয়া দরকার। দেশের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের পাঠ্যসূচীতে দেশের বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর ঈমান-আকীদার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ বিষয়সমূহ অন্তর্ভুক্ত হতে হবে। মাদরাসা শিক্ষার পাশাপাশি সকল শিক্ষাক্রমে ইসলামী অর্থনীতি পাঠ্য হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

 

পৃথিবীর বহু মুসলিম দেশেতো বটেই, অমুসলিম দেশের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহেও ইসলামী অর্থনীতির পাঠ দেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ এদের সবার পেছনে। দু-একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের পাঠ্যক্রমে বিক্ষিপ্তভাবে কোন কোন পত্রে ‘ইসলাম’ শব্দ জুড়ে দিয়ে দায় সারা হচ্ছে। অথচ প্রয়োজন গোটা পাঠ্যসূচীর সংস্কার। যারা আগামী দিনে এদেশের প্রশাসন বিচার আইন ব্যবসা-বাণিজ্য ও কল-কারখানার কর্ণধার হবে তাদের যদি এখনই সুদী অর্থনীতির কুফল ও ধ্বংসাত্মক দিক সম্বন্ধে অবহিত করা না যায় এবং পাশাপাশি ইসলামী অর্থনীতির গঠনমূলক ও হিতকর দিকগুলো জানানো না যায় তাহলে জাতি যে তিমীরে রয়েছে সেই তিমিরেই রয়ে যাবে।

 

. গণসচেতনতা সৃষ্টি

 

ব্যাপক গণসচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমেই কে বল ইসলামী অর্থনীতি অর্জনের লক্ষ্য বাস্তবায়িত হতে পারে। জনগণের চাহিদা এবং তার দৃঢ় বহিঃপ্রকাশ ছাড়া সরকার নিজ থেকে খুব কমই তাদের উপযোগী ও প্রয়োজনীয় কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়েথাকে। ইসলামী অর্থনীতি চালু বা বাস্তবায়ন করা হবে প্রচলিত ব্যবস্থার সম্পূর্ণ বিপরীত।এজন্যে সবার আগে চাই গণসচেতনতা। আমাদের দেশের অধিকাংশ জনগণ নিরক্ষর। সেজন্যে কাজটা একটি কঠিন ও আয়াসসাধ্য বটে তবে অসম্ভবনয়। কারণ এদেশের জনগণ ধর্মভীরু এবং সরল প্রকৃতির। তাদের যদি যথাযথভাবে ইসলামের দাবী কি এবং তা অর্জনের উপায় কি এটা বোঝানো যায়, প্রকৃতই উদ্বুদ্ধ করা যায় তাহলে এদেশের অর্থনীতি ও সমাজ কাঠামোয় ইসলামী অর্থনীতি বাস্তবায়ন সময়সাপেক্ষ হতে পারে কিন্তু অসম্ভব নয়। এজন্যে দুটো উপায় অনুসরণ করা যেতে পারে।

 

প্রথমতঃ মসজিদে খুতবার সাহায্য গ্রহণ। বছরে বায়ান্ন দিন এলাকার জনগণ মসজিদে জুম’আর নামাযে শামিল হন। এই নামাযের খুতবায় নানা বিষয়ের অবতারণা করা হয়। সেসব বিষয়ের পাশাপাশি যদি খতিব বা ইমাম সাহেব সুদী অর্থনীতির কুফল এবং দেশ ও জাতির জন্যে তা কতখানি ক্ষতিকর বুজিয়ে বলেন তাহলে ধীরে ধীরে জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি হবে।

 

দ্বিতীয়তঃ দেশের বিভিন্ন স্থানে ওয়াজ মাহফিলে, তাফসীর মাহফিল ও ইসলামী জলসায় ওলামায়ে কেরাম ও মুফাসসীরে কুরআনগণ বক্তৃতা করে থাকেন। ঐসব অনুষ্ঠানে হাজার হাজার লোকের সমাপন হয়। ঐসব অনুষ্ঠানে যদি ইসলামী অর্থনীতির উপযোগিতা এবং সুদী অর্থনীতির কুফল সম্বন্ধে বিশাদভাবে বুঝিয়ে বক্তব্য রাখা যায়তাহলে যে আলোড়ন সৃষ্টি হবে, জনমত গড়ে উঠবে তার ধাক্কাতেই সুদী অর্থনীতি উৎখাত হতে পারে, বাস্তবায়িত হতে পারে ইসলামী অর্থনীতি। এর জন্যে চাই দীর্ঘ মেয়াদী সুচিন্তিত ও সুবিন্যস্ত পরিকল্পনা।

 

. গণপ্রতিরোধ গঠন

 

উপরে বর্ণিত উপায়গুলো ছাড়াও সুদ নির্মূলকরার আরও কয়েকটি ছোট-খাট উপায় রয়েছে। এগুলো সবই অবশ্য জনগণনির্ভর। জনগণ গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে সুদের বিরুদ্ধে, সুদী অর্থনীতির বিরুদ্ধে। এই প্রতিরোধ যতই ব্যাপক ও দুর্বার হবেসুদরে নাগপাশ ততই দ্রুত খসে পড়তে বাধ্য। এসব পদক্ষেপের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি উল্লেখ এখানে করা গেল।

 

১. সুদখোরদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ। সমাজে যারা সুদখোর বলে পরিচিত, তাদের পরিচিত যাই হোক না কেন ধীরে ধীরে তাদের সম্পর্ক ছেদ করতে হবে। তারা যেন বুঝতে পারে যে সুদের সঙ্গে সংশ্রব থাকার কারণেই জনগণ তাদের সংগ বর্জন করেছেন বা তাদের এড়িয়ে চলছেন। কাজটা কঠিন মনে হতে পারে কিন্তু সকলে মিলে এগিয়ে এলে মোটেই দুঃসাধ্য নয়।

 

২. সুদখোরদরে জনপ্রতিনিধি না বানানো। জনপ্রতিনিধিত্বমূলক কোন কাজে সুদখোরদের নির্বাচিত হতে দেওয়া হবে না। তারা ভোটপ্রার্থী হলে যেন ভোট না দেওয়া হয় সেজন্যে জোর প্রচারণা চালাতে হবে। জনগণকে বুঝাতে হবে এই সব লোককের কার্যক্রমের জন্যেই সমাজে শোষণ নির্যাতন নিপীড়ন জগদ্দল পাথরের মতো চেপে থাকবে।

 

৩. সুদখোরদরে সামাজিকভাবে বয়কট করা। যারা সুদের ব্যবসা করে, গ্রামে মহাজনী কারবারের (গ্রামাঞ্জলে সুদী ব্যবসার প্রচলিত নাম) সাথে যারা যুক্ত তাদের ছেলে-মেয়ের সাথে নিজেদের ছেলে-মেয়ের বিয়ে না দেওয়া এবং তাদের জানাযা না পড়ানোও উত্তম প্রতিষেধকের কাজ করতে পারে। বাংলাদেশেই আজ হতে পঞ্চাশ ষট বছর পূর্বে গ্রামাঞ্জলে সুদখোরের দাওয়াত কেউ সহজে গ্রহণ করতে চাইতো না। কিন্তু পুঁজিবাদী অর্থনীতির দাপটে এবং দ্বীনি শিক্সা বঞ্চিত হওয়ার কারণে সেই অবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটেছে।

 

৪. সরকার যেসব ক্ষেত্রে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে সুদ প্রদান বাধ্যতামূলক করে রেখেছে সেগুলো রহিত করার জন্যে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলা যেতে পারে। উদাহরণতঃ জমির খাজনা যথাসময়ে দিতে না পারলে তার উপর সুদ দিতে হয়।সুদের বদলে সরকার জরিমানা আরোপ করতে পারে। ঈমান ও আকীদাবিরোধী সুদ কেন দিতে হবে? অনতিবিলম্বে সরকার যেন খাজনার খাত থেকে সুদ প্রত্যাহার করে নিতান্তই অপরিহারয ক্ষেত্রে জরিমানার ব্যবস্থা চালু করে সেই লক্ষ্যে জনগত গঠন করা উচিৎ।

 

আশা করা যায়, এসব উপায় অনুসরণের মধ্যে দিয়ে এদেশের সুদের বিরুদ্ধে ব্যাপক গণসচেতনতা সৃষ্টি হবে, আল্লাহ ঘোষিত হারামবর্জনের জন্যে সর্বাত্মক প্রয়াস সূচিত হবে। পাশাপাশি ইসলামী অর্থনীতি বাস্তবায়নের জন্যে আপামর জনসাধারণ অনুপ্রাণিত হয়ে নিজ নিজ সাধ্যমতো দায়িত্ব পালনে উদ্বুদ্ধ হবে। বস্তুতঃ আমাদের দায়িত্বই হচ্ছে চেষ্টা করাএবং তার মধ্যে দিয়ে আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন করা। এই প্রয়াসেতিনি আমাদের সহায় হোন এবং হোক আমাদের ফরিয়াদ।

 

ইসলামী ব্যাংকিংএর রূপরেখা

 

. বৈশিষ্ট্য

 

মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আল-কুরআনে সুস্পষ্ট ভাষায় সর্বকালের জন্যে, সকল বনি আদমের জন্যে একদিকে যেমন ব্যবসাকে বৈধ ঘোষণা করেছেন অন্য দিকে সুদ ও সুদভিত্তিক সকল কার্যক্রমকে চিরতরে নিষিদ্ধ করেছেন। অথচ আজকের দুনিয়ায় সুদের সর্বগ্রাসী সয়লাব চলছে। সব ধরনের অর্থনৈতিক লেনদেন, ব্যবসায়িক কায়-কারবার সর্বত্রই সুরেদ অপ্রতিহত ও অবারিত গতি। সুদ সমাজ শোষণের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার, যুলুমের সবচেয়ে মারাত্মক অস্ত্র। সুদের মাধ্যমে সমাজকে সবচেয়ে সুকৌশলে ও বেশী শোষণ করছে আজকের সনাতনী ব্যাংক ব্যবস্থা। কি পুঁজিবাদী দেশ, কি সমাজতন্ত্রী দেশ, কি মুসলিমপ্রধান দেশ সর্বত্রই সনাতনী ব্যাংকগুলো সুদী কারবারে লিপ্ত। যারা ব্যাংক হতে নানা প্রয়োজনে ঋণ নেয় তারা তো সুদ দিতে বাধ্য হয়ই, এমন কি যারা শুধু নিরাপত্তা ও সঞ্চয়ের জন্যেই ব্যাংকে টাকা আমানত রাখে তাদেরও মুনাফার লেবাস পরিয়ে ব্যাংক সুদ নিতে প্ররোচিত করে।

 

সমাজবিধ্বংসী, যুলুমকারী এবং শোষণের সকল মাধ্যম এই সুদের হাত থেকে মুসলিম মিল্লাতকে রক্ষা করার জন্যেই বর্তমানকালে সৃষ্টি হয়েছে ইসলামী ব্যাংকের। ইসলামী সম্মেলন সংস্থার (OIC) জেনারেল সেক্রেটারিয়েট ইসলামী ব্যাংকের সংজ্ঞা দিয়েছে এভাবে- “Islamic bank is a financial institution whose states, rules and procedures expressly state its commitment to the principles of Islamic Shariah and to the banning of the receipt and payment of interest on any of its opeations”.

 

অর্থাৎ, ইসলামী ব্যাংক এমন একটি অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান যা তার বিধি, আইন-কানুন এবং কর্মপদ্ধতির মধ্যে দিয়ে ইসলামী শরীয়াহর নীতিমালার প্রতি সুস্পষ্ট আনুগত্য প্রকাশ করে এবং তার কোন কার্যক্রমেই সুদের কোনও রকম লেনদেন করে না।

 

যেহেতু ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান সেহেতু ইসলামে অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, পারস্পরিক লেন-দেন প্রভৃতি সব কিছুরই সুস্পষ্ট বিধি-বিধান রয়েছে। অথচ সুদ প্রথা চালু থাকার কারণে ইসলামী বিধি-বিধান মেনে এসব কাজে অংশ গ্রহণ করা মুসলমানদের পক্ষে অসম্ভব। ইসলামী ব্যাংক এই সমস্যা পূরণের জন্যেই এগিয়ে এসেছে। এর কাজের পদ্ধতি অন্যান সব ধরনের ব্যাংক হতে পৃথক এবং কিভাবে এই ব্যাংক তার কার্যপদ্ধতি পরিচালনা করে থাকে সে সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো। এই পার্থক্যগুলো ইসলামী ব্যাংকিং-এর বৈশিষ্ট্য।

 

ইসলামী ব্যাংকের রয়েছে পাঁচটি অনন্য বৈশিষ্ট্য। যথা- (১) সুদ বর্জন, (২) শরীয়াহ্‌সম্মত উপায়ে শিল্পোদ্যোগ ও ব্যবসায়ে অংশ গ্রহণ, (৩) শরীয়াহ সুপারভাইজারী বোর্ড, (৪) যাকাত ব্যবস্থা বাস্তবায়ন, এবং (৫) সমাজ উন্নয়নে অংশ গ্রহণ।

 

. সুদ বর্জন: ইসলামী ব্যাংকের প্রথম ও মৌলিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই ব্যাংক সুদের ভিত্তিতে কোন প্রকার লেন-দেন বা ব্যবসা-বাণিজ্য করবে না। যে সুদ হারাম, ঘৃণ্য ও সমাজবিনাশী সেই সুদের অনুপ্রবেশ যেন ইসলামী সমাজে ঘটতে না পারে সেজন্যে এই ব্যাংক নিজেই শুধু সুদী কারবার হতে বিরত থাকবে না, অন্যকেও বিরত থাকতে সহায়তা করবে। সুদ নেবে না, দেবে না, খাবে না এবং খাওয়াবে না। সুতরাং সুদের হিসাব রাখা বা সাক্ষী থাকারও প্রয়োজন হবে না। সহীহ হাদীস অনুসারে সুদের হিসাব রাখা ও সুদের সাক্ষী থাকাও কবীরা গুণাহ। তাই সুদের পাপ হতে মুসলিমদের মুক্ত রাখার জন্যে সাধ্যমত চেষ্টা করবে এই ব্যাংক। ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কল-কারখানা স্থাপন, বৈদেশিক লেন-দেন সব ক্ষেত্রেই এই ব্যাংকের নীতি ও কৌশল হচ্ছে সুদ বর্জন করা এবং ধীরে ধীরে সমাজ হতে এর উচ্ছেদ করা।

 

. শরীয়াহসম্মত শিল্পোদ্যোগহ ব্যবসায়ে অংশ গ্রহণ: ইসলামী ব্যাংকের দ্বিতীয বৈশিষ্ট্য হচ্ছে শরীয়াহসম্মত শিল্পোদ্রোগ ও ব্যবসায়ে অংশগ্রহণ। শিল্পোদ্রোগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যে পুঁজি বিনিয়োগের সময় ঐসব উদ্যোগ শরীয়াহর বিচারে হালাল না হারাম তাও ইসলামী ব্যাংক বিচার করে থাকে। প্রচলিত পদ্ধতিতে কোন ঋণ দেওয়ার সময় আদৌ বিচার করা হয় না যে, উদ্দেশ্রে ঋণ দেওয়া হচ্ছে সেই কাজটি সমাজের জন্যে কল্যাণকর না ক্ষতিকর। সমাজের তাতে মঙ্গল হবে, না সর্বনাশডেকে আনচে? সমাজের বিপর্যয় ও সর্বনাশ সৃষ্টিকারী মদ ও মাদক দ্রব্যের ব্যবসা, চরিত্রবিধ্বংসী নানা ধরনের উপকরণসহ সিনেমা, নাচ-গান, তামাক ও সিগারেটের মতো জনস্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর সামগ্রী উৎপাদন, মজুতদারী, মুনাফাখোরী প্রভৃতি নানা কাজে সুদী ব্যাংকগুলো ঋণ দিয়ে থাকে। েএতে সমাজের সর্বনাশ আরও বেশী ডেকে আনা হয়। আগুনে পেট্রোল চাললে যেমন আগুন আরও দাও দাউ করে জ্বলে ওঠে এও ঠিক তেমনি। সমাজ হতে অনাচার, পাপাচার, অশ্লীলতা প্রভৃতি দূর করার চেষ্টা করা দূরে থাকা সুদী ব্যাংকগুলো নির্বিচার ঋণ দেওয়ার ফলে এসব বরং আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইসলামী ব্যাংক এর প্রতিরোধ করতে চায়। এ জন্যেই শুধু শরীয়াহসম্মত শিল্প-কল-কারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রভৃতিতে এই ব্যাংক সহযোগিতা করে। ব্যাংক দুভাবে একটি করে থাকে: (ক) লাভ-লোকসানের অংশীদারীত্বের চুক্তিতে অংশ গ্রহণ এবং (খ) প্রত্যক্ষ অংশ গ্রহণ

 

() লাভ-লোকসানের অংশীদারীত্বের চুক্তিতে অংশ গ্রহণ: ইসলামী ব্যাংক বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প, কল-কারখানা প্রভৃতি তৈরীতে তার মূলধন বা তহবিল দিয়ে অংশ গ্রহণ করে থাকে। ব্যাংক এক্ষেত্রে উদ্যোক্তার সাথে লাভ-লোকসানে অংশগ্রহণের চুক্তিকে পুঁজির অংশবিশেষ বা পুরোটাই সরবরাহ করতে পারে। এসব কাজে লাভ-লোকসান যাই হোক না কেন পূর্ব নির্ধারিত শর্ত অনুসারেই ব্যাংক তা ভাগাভাগি করে নেবে। অর্থাৎ, লাভ হলে ব্যাংক যেমন তার পূর্ব নির্ধারিত অংশ পাবে, তেমনি লোকসান হলে তারও অংশ ব্যাংক বহন করবে।

 

() প্রত্যক্ষ অংশ গ্রহণ: ইসলামী ব্যাংক তার নিজস্ব তহবিল এবং আমানতকারীদের সম্মতিক্রমে তাদের তহবিল হতে সম্পূর্ণ নিজের উদ্যোগে নিজস্ব মালিকানাতেই শরীয়াহ অনুমোদিত ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প-কারখানা প্রভৃতি গড়ে তুলবে। এ ক্ষেত্রে লাভ-লোকসান যাই হোক না কেন তার দায়-দায়িত্ব ব্যাংকেরই। সুদভিত্তিক ব্যাংকগুলো এরকমকোন উদ্যোগ নেয় না।

 

সুদভিত্তিক ব্যাংক ব্যবস্থার কোথাও এমন পদ্ধতি নেই। প্রচলিত ব্যাংকগুলো ব্যবসায়ী বা উদ্যোক্তাদের ঋণ দেয় ঠিকই কিন্তু ব্যাংক নিজে এসব প্রকল্প ও ব্যর্থতা নিয়ে ব্যাংকের কোন মাথা ব্যাথা নেই। বরং লোকসানের কোন রকম সম্ভাবনা দেখলেই সুদনির্ভর ব্যাংকগুলো তাদের দেওয়া ঋণ দ্রুত পরিশোধের জন্যে চাপ দেয় কিংবা ঋণ প্রত্যাহার করে নেয়। ফলে ঐ ব্যবসা বা কারবারটি আরও সংকটের সম্মুখীন হয়, এমন কি ধ্বংসও হয়ে যায়।

 

শরীয়াহ সুপারভাইজরী বোর্ড: ইসলামী ব্যাকসমূহের একটি প্রধান ও ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্র হচ্ছে এর শরীয়াহ সুপারভাইজারী বোর্ড। ব্রাংকের লেন-দেন ব্যবসা-বাণিজ্য, অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে মূলধন বা তহবিল বিনিয়োগ, নিজস্ব প্রকল্প স্থাপন ইত্যাদি কোন কিছুতেই যেন সুদের স্পর্শমাত্র না থাকে, কোন কাজেই যেন শরীয়াহর বরখেলাপ না হয় তা দেখার জন্যে প্রতিটি ইসলামী ব্যাংক তার প্রতিষ্ঠার শুরুতেই গঠন করে শরীয়াহ বোর্ড।ঠ কোন কোন ইসলামী ব্যাংকে এর নাম শরীয়াহ সুপাইজরী কাউন্সিল। এই বোর্ডের সদস্য সংখ্যা সাধারণত পাঁচ বা সাত জন হয়ে থাকে। এদের মধ্যে সংখ্যাগুরু থাকেন সুবিজ্ঞ আলেম ও ফকিহগণ। বাকীদের মধ্যে থাকেন একজন প্রখ্যাত প্রবীণ ব্যাংকার। এরা শুধু যে ব্যাংককে শরীয়াহসম্মতভাবে চলতে পরামর্শই দেন তা নয়, ব্যাংক ভুল পথে চলতে চাইলে ব্যাংকের আর্টিকেলস অব এগ্রিমেন্টেই তাতে বাঁধা দেবার ক্ষামতাও এই বোর্ডের রয়েছে।

 

যাকাত ব্যবস্থার বাস্তবায়ন: ইসলামী ব্যাংকের চতুর্থ ও অন্যতম তাৎপর্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হ চ্ছে যাকাত ব্যবস্থার বাস্তবায়ন। যাকাত ইসলামের পাঁচটি রুকুনের অন্যতম এবং গুরুত্বের দিক দিয়ে নামাযের পরেই এর স্থান। ইসলামী ব্যাংক তার উদ্ধৃত্ত তহবিল ও অব্যবহৃত অর্থের উপর যাকাত দিয়ে থাকে। ব্যাংক তার গ্রহকদের নিকট থেকেও যাকাত সংগ্রহ করে থাকে। যাকাত তহবিলের এই টাকা ব্যাংক শরীয়াহসম্মত খাতেই ব্যয় করা হয়। আজকের সমাজে মুসলমানরা বিক্ষিপ্ত বিচ্ছিন্ন ও উদ্দেশ্যহীনভাবে যাকাত প্রদান করে থাকে। এতে সমাজের কোন স্থায়ী কল্যাণ সাধন হয় না। দরিদ্র ও সমাজের কম ভাগ্যবানদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয় না। তাই ইসলামী ব্যাংক চেষ্টা করে যাকাত তহবিলের অর্থ দিয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান, কর্মসংস্থানমুখী উপকরণ সরবরাহ ও শিক্ষা কার্যক্রমে সহায়তা করার পাশাপাশি স্কুল, মক্তব ও হাসপাতাল প্রভৃতির মতো সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠান ও নিয়মিত আয়ের একটা নিশ্চয়তা গড়ে তুলতে ইসলামী ব্যাংকগুলো বদ্ধপরিকর। সমাজে ধনী-দরিদ্রের-শ্রেণী বৈষম্য হ্রাস করার জন্যে এটি একটি কার্যকর ও বলিষ্ঠ পদক্ষেপ।

 

সমাজ উন্নয়নে অংশগ্রহণ: ইসলামী ব্যাংকের সর্বশেষ উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হলো, অর্থনৈতিক উন্নতির সাথে সামাজিক উন্নতি অর্জন করা। দুইয়ের মধ্যে সমন্বয় ও সম্পর্ক না থাকলে কারোরই প্রকৃত উন্নতি সম্ভব নয়। তাই ইসলামী ব্যাংক কি অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ব্যবসায়ে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে, কি নিজস্ব প্রকল্প নির্মাণের ক্ষেত্রে সব সময়েই এই লক্ষ সামনে রাখে যে, এসব কাজ সমাজের উন্নতিতে কতটা সহায়ক হবে? ব্যক্তির অর্থনৈতিক উন্নতির সাথে সাথে জনসাধারণের উন্নতি কতটা হবে?

 

সমাজের প্রয়োজন ব্যাপক ও ব হুমুখী। অর্থনৈতিক উন্নতির সাথে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। এজন্যেই সুদভিত্তিক ব্যাংকগুলো সিনেমা হল নির্মাণ বা সিনেমা শিল্পে অর্থ ঋণ দেওয়া ইসলামী ব্যাংক তা আদৌ চাইবে না। কারণ সিনেমার প্রসারের ফলে সমাজের ণৈতিক অবক্ষয় আরও দ্রুত ও ব্যাপক হবে। সুদভিত্তিক ব্যাংকগুলোর আদৌ এ বিষয়ে মাথা ব্যাথা নেই। আবার ইসলামী ব্যাংকগুলো সৎ ও যোগ্যতাসম্মপন্ন বিত্তহীন লোককে করযে হাসানা বা মুদারাবার ভিত্তিতে অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করবে, কিন্তু সুদভিত্তিক ব্যাংকগুলো এই উদ্যোগ নেবে না। ইসলামী ব্যাংকের লক্ষ্য হলো ব্যক্তির কর্মসংস্থানের মাধ্যমে তার ও তার পরিবারবর্গের ভরণ-পোষণের সুযোগ সৃষ্টি ক রা। ফলে সমাজে সুস্থ ও কল্যাণধর্মী পরিবেশ সৃষ্টি হবে। পক্ষান্তরে সুদভিত্তিক ব্যাংকগুলো শুধু স্ব স্ব স্বার্থ সিদ্ধির জন্যে তৎপর। তাই নিঃসন্দেহে বলা যায় আদর্শ, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের ক্ষেত্রে সুদভিত্তিক ব্যাংক ও ইসলামী ব্যাংকের মধ্যে দুস্তর ও দুরতিক্রম্য ব্যবধান রয়েছে। বিশেষ করে সমাজকলাণ ও সমাজের সুস্থ ও সুষ্ঠু উন্নয়নের জন্যে সুদভিত্তিক ব্যাংকগুলোর কোন পরিকল্পনা নেই। এদিক দিয়ে ইসলামী ব্যাংকগুলো একটি স্বস্তিকর ও মহৎ ব্যতিক্রম। এটি এই ব্যাংকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যও বটে।

 

এ সব বৈশিষ্ট্য অর্জনের সাথে সাথে নিচের উদ্দেশ্যগুলো অর্জনেও ইসলামী পদ্ধতির ব্যাংকগুলোকে তৎপর থাকতে হবে। তাহলে একাধারে ইসলামী বৈশিষ্ট্য অর্জন ও দেশের অর্থনীতিতে কাঙ্খিত অবদান রাখার পাশাপাশি বর্তমান সময়ে অর্থণৈতিক কর্মকাণ্ডে যারা অবহেলিত ও পশ্চাৎপদ তাদের কল্যাণ সাধনের মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংক সত্যিকার কল্যাণধর্মী প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা ও গুরুত্ব অর্জনে সক্ষম হবে। এসবের মধ্যে রয়েছে:

 

১। ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতিতে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা;

 

২। বিত্তহীন ও স্বল্প আয়েল লোকদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন;

 

৩। মানব সম্পদ উন্নয়ন ও আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি;

 

৪. ইসলামী অর্থনীতি বাস্তবায়নে উদ্যোগ গ্রহণ; এবং

 

৬. মানব কল্যাণের সাথে পরিবেশ উন্নয়ন।

 

. বিনিয়োগ কৌশল

 

সুদী ব্যাংকের সাথে ইসলামী ব্যাংকের যে বিপুল পার্থক্য তার প্রায় সবটাই কাজের প্রকৃতির ক্ষেত্রে। ব্যাংককে যেমন তহবিল ও আমানত সংগ্রহ করতে হয় তেমনি তা কাজে লাগিয়ে অর্থ উপার্জনও করতে হয়। আমানত সংগ্রহ ও সংগৃহীত অর্থ ব্যবহার দুটি ভিন্নধর্মী কাজ। প্রথমটির ক্ষেত্রে ইসলামী ব্যাংকের পদ্ধতির সাথে সুদী ব্যাংকিং পদ্ধতির সাথে যথেষ্ট মিল রয়েছে। পার্থক্য যা তা অধিকাংশই আমানতের শিরোনাম ও ব্যবহারগত। দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে সুদী ব্যাংকের সাথে রয়েছে তার আমুল পার্থক্য।

 

একথা বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, অর্থনৈতিক দিক থেকে চালু ও সফল প্রতিষ্ঠান হিসেবে টিকে থাকতে হলে এবং অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে চাইলে ইসলামী ব্যাহক ও বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠানসমূহকে যথেষ্ট পরিমাণ মুনাফা অর্জন করতে হবে। এথেকে তার নিজস্ব পরিচালনা ব্যয় নির্বাহ এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচ মেটানো ছাড়াও শেয়ারহোল্ডার, বিনিয়োগকারী ও আমানতকারীরে সন্তোষজনক হারে ডিভিডেণ্ড ও মুনাফা দিতে হবে। এই সমুদয় কাজই করতে হবে শরীয়াহসম্মত উপায়ে। কিন্তু কিভাবে?

 

প্রচলিত সুদী ব্যাংকগুলো এমন অনেক উপায়ে উপার্জন করে যেগুলো শরীয়াহর দৃষ্টিতে বৈধ। কিন্তু যেহেতু সেই আয় পৃথক করে না রেখে অন্যান্য সুদী আয়ের সাথে সঙ্গে মিশিয়ে ফেলা হয় সেহেতু তা শরীয়াহর দৃষ্টিতে আর হালাল বা বৈধ থাকে না। সুদী ব্যাংকের এসব আয়ের মধ্যে রয়েছে নির্দিষ্ট সার্ভিস চার্জ বা ‘উজরার’ (ফি ও কমিশন) বিনিময়ে জনসাধারণের জন্যে নানা ধরনের সেবামূলক কাজ। উদাহরণস্বরূফ ডিমাণ্ড ড্রাফট, পে-অর্ডার, ক্রেডিট কার্ড প্রবৃতি ইস্যু, বিভিন্ন বিলের অর্থপ্রদান, অর্থ সম্পদ হস্তান্তর, লকার সার্ভিস, স্থাপর-অস্থাবর সম্পত্তি ক্রয়ে সাহায্য প্রভৃতির উল্লেখ করা যেতে পারে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের পরিসংখ্যান নিয়ে দেখা গেছে সুদভিত্তিক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো তাদের মোট আয়ের ৩০%-এর বেশী এই ধরনের সেবামূলক কাজ হতে আয় করে থাকে। ইসলামী পদ্ধতির ব্যাংকও জনগণকে এইধরনের সেবা দিয়ে যাবে এবং সঙ্গতঃভাবেই তার মোট আয়ের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ এই প্রথাগত কিন্তু হালাল উপায়ে উপার্জন করবে।

 

প্রশ্ন হলো: ইসলামী ব্যাংক কিভাতে তার তহবিল বিনিয়োগ করবে? সুদের ভিত্তিতে বিনিয়োগ ইসলামে নিষিদ্ধ, কিন্তু লাভ-লোকসানের অংশীদারীত্বের ভিত্তিতে বিনিয়োগ শরীয়াহ্‌ সম্মত। সুতরাং, ইসলামী ব্যাংক সুদের পরিবর্তে লাভ-লোকসানের অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে বিনিয়োগ করেই উপার্জনের চেষ্টা করবে। বস্তুঃপক্ষে ইসলামী ব্যাংকের সকল ধরনের আর্থক সহযোগিতাই বিনিয়োগমূলক, সুদী ব্যাংকের মতো ঋণমূলক নয়। এভাবে বিনিয়োজিত অর্থ হতে প্রাপ্ত মুনাফা থেকেই ইসলামী ব্যাংক তার পরিচালনা ব্যয় নির্বাহ ছাড়াও শেয়ারহোল্ডার, বিনিয়োগকারী ও আমানতকারীদের মুনাফা দেবে। বিভিন্ন দেশের ইসলামী ব্যাংকগুলো ইতিমধ্যে এ ব্যাপারে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছে এবং তাদের গৃহীত পদক্ষেপসমূহের মধ্যে কুড়িটি পদ্ধতি আর্থিক দিক দিয়ে সফল বলে প্রমানিত হয়েছে। এই ব্যাংকগুলো শুধু যে আজ নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে তাই নয়, বরং উত্তরোত্তর সাফল্য অল্জন করে চলেছে। তাদের সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে আরও ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। শুধু মসিলম দেশসমূহেই নয়, অমুসলিম দেশগুলোতে প্রতিষ্ঠিত ইসলামী ব্যাংকগুলোও একই পদাংক অনুসরণ করে চলেছে। এই পদ্ধতিগুলো সম্পূর্ণ শরীয়াহসম্মত। নিম্নে এগুলোর সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া গেল।

 

. মুদারাবা: এই পদ্ধতিতে ব্যাংক কোন যৌথ ‍উদ্যোগ ব্যবসায় বা কারবারে একাই সমুদয় অর্থ সরবরাহ করে এবং উদ্যোক্তা তার শ্রম, সময় ও অভিজ্ঞতা বিনিয়োগ করে থাকে। এখানে ব্যাংককে বলা হয় সাহিব আল-মাল এবং তহবিল ব্যবহারকারী বা উদ্যোক্তাকে বলা হয় মুদারিব। এই পদ্ধতিতে ব্যাংক সরাসরি ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে অংশ নেয় না অথবা মুদারিবের কাজে হস্তক্ষেপ করে না। মুদারাবা পদ্ধতিতে ব্যাংক ও উদ্যোক্তা পূর্ব নির্ধারিত হারে (৭৫%: ২৫%; ৭০%:৩০%; ৬০%:৪০%; ৫০%:৫০%; ৪৫%:৫৫%; ৪০%:৬০%; ইত্যাদি) লাভের অংশ ভাগ করে নেয়। মূলধনের পরিমাণের সাথে লাভের অংশ কোনক্রমেই সম্পর্কযুক্ত নয়। উপরন্তু কোনপক্ষই মুনাফার পরিমাণ নির্দিষ্ট করে নিতে পারবে না। তবে লোকসান হলে তার পুরোটাই ব্যাংক বহন করবে। এক্ষেত্রে মুদারিব বা উদ্যোক্তাকে হারাতে হয় তার শ্রম ও সময়, কোন আর্থকলোকসান তাকে বহন করতে হয় না। অবশ্য যদি নিরপেক্ষ তদন্তে নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয় যে, মুদারিবের গাফলতির জন্যেই লোকসান হয়েছে তাহলে ব্যাংক লোকসানের পুরো দায়ভার বহনে সম্মত নাও হতে পারে।

 

মুদারাবা পদ্ধতিতে ব্যবসা বৈধ হতে হলে নীচের শর্তগুলো পূরণ করা অত্যাবশ্যক। যথা:

 

ক) সাহিব আল-মাল ও ‍মুদারিবের মধ্যে লিখিত চুক্তি হতে হবে। চুক্তিতে মূলধনের পরিমাণ সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকবে।

 

খ) মুলধন নগদ অর্থের মাধ্যমে নির্ধারণ করতে হবে; পণ্য সামগ্রীকেই মূলধন হিসাবে গণ্য করা যাবে না।

 

গ) সমুদয় মূলধন মুদারিবের কাছে হস্তান্তর করতে হবে যেন মুদারিব নিজেই তা বিনিয়োগ করতে পারে।

 

ঘ) যদি সাহিব আল-মাল মুদারিবের সাথে সরাসরি ব্যবসায়িক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে তাহলে চুক্তি বাতিল হয়ে যাবে।

 

ঙ) কারবারে মুনাফায় মুদারিবের সুনির্দিষ্ট অংশের উল্লেখ থাকবে কোন সুনির্দিষ্ট অংকের উল্লেখ থাকবে না।

 

চ) মুদারিব কারবারের মুনাফা হতেই তার অংশ পাবে, মূলধন হতে নয়। যদি কারবারে লোকসান হয় তবে কোন অবস্থাতেই মুদারিব মূলধন থেকে কিছু দাবী করতে পারবে না।

 

এই পদ্ধতি স্বনির্ভর সমাজ গঠনে উৎসাহ যোগায়। দক্ষ কিন্তু অসচ্ছল ব্যক্তিরা মুদারাবা পদ্ধতিতে নিজেদের কর্মসংস্থান করতে পারে। ফলে বেকার জনসংখ্যা জনসম্পদে পরিণত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। ব্যাংকও বিনা ঝামেলায় পুঁজি বিনিয়োগ ও মুনাফা উপার্জনের সুযোগ পায়। এসব সুবিধার জন্যেই মুসলিম দেশ ছাড়াও পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে সম্প্রতি বহু মুদারাভিত্তিক বিনিয়োগ কোম্পানী গড়ে উঠছে। এগুলো ক্রমেই সংখ্যায় বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসব কোম্পানী ব্যবসায় সফল প্রতিষ্ঠান হিসাবে ইতিমধ্যে পরিচিতও লাভ করেছে।

 

. মুশারাকা: এই পদ্ধতিতে ব্যাংক ও উদ্যোক্তার বা উদ্যোক্তাদের মধ্যে অংশীদারী ভিত্তিতে চুক্তি অনুসারে সুনির্দিষ্ট কারবার পরিচারিত হয়। আরবী পরিভাষায় একে বলা হয় শিরকাতুল উকুদ। ব্যাংকসহ সকল অংশীদারই পরস্পর সম্মত অংশ অনুসারে মূলধন সরবরাহ করে এবং স্বীকৃত অনুপাত অনুসারে মুনাফা ভাগ করে নেয়। লোকসান হলে অবশ্য প্রত্যেক মূলধনের অনুপাতেই তার ভাগ নেবে। এই পদ্ধতিতে লোকসান হলে অবশ্য প্রত্যেকে মূলধনের অনুপাতেই তার ভাগ নেবে। এই পদ্ধতিতে বিনিয়োগের কিছু পূর্বশর্ত রয়েছে। যথা: অংশীদারগণ তাদের কারবারের যাবতীয হিসাব সুষ্ঠুভাবে সংরক্ষণ করবে, অংশীদারদের ণৈতিক মান উন্নত হবে এবং কারবারের/প্রকল্পের যথাযথ তদারকী ও পর্যবেক্ষণের জন্যেও উপযুক্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পর্যাপ্ত সংখ্যক জনশক্তিও থাকতে হবে। পুঁজির প্রকৃতি অনুসারে উপযুক্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পর্যাপ্ত সংখ্যক জনশক্তিও থাকতে হবে। পুঁজির প্রকৃতি অনুসারে শিরকাতুল উকুদ চার ধরনের হয়ে থাকে: (ক) শিরকাত আল-মুফাওয়াদা (সমঅংশীদারী কারবার); (খ) শিরকাত আল-ইনান (অসমঅংশীদারী কারবার); (গ) শিরকাত আল-সানায়ী (পেশাভিত্তিক অংশীদারী কারবার); এবং (ঘ) শিরকাত আল-ওয়াজুহ (সুনামভিত্তিক অংশীদারী কারবার)। মধ্যম শ্রেণীর বিত্তবান লোকেরা বা বিভিন্ন সংস্থা এই পদ্ধতিতে ব্যাংকের সহায়তা লাভের সুযোগ নিতে পারে। ফলে ব্যাংক যেমন বিস্তৃত পরিসরে বিনিয়োগের সুযোগ পায় তেমমনি অর্থনীতিতে কর্ম উদ্যোগের পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে থাকে।

 

. বায়ই মুরাবাহা: ইসলামী অর্থনীতিতে পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে এটি একটি সাধারণ ও সর্বজনগ্রাহ্য পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে ইসলামী ব্যাংক বিভিন্ন ধরনের পণ্য সামগ্রীর আমদানী-রপ্তানী ও ক্রয়-বিক্রয়ের ব্যবসায়ে সরাসরি অংশগ্রহণ করতে পারে। ব্যাংক সাধারণত আগ্রহী ক্রেতার চাহিদামাফিক পণ্য ক্রয় করে তার সাথে একটা মুনাফা (মার্ক আপ নামে পরিচিত) যুক্ত করে তার কাছেই এটা বিক্রয় করে দেয়। ইসলামের দৃষ্টিতে এটি সম্পূর্ণ বৈধ। তবে পদ্ধতিটিকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেওয়ার জন্যে নীচের শর্তগুলো আরোপ করা হয়েছে।

 

ক) ক্রেতা ও বিক্রেতা উভফপক্ষই দ্রব্য সামগ্রীর মূল ক্রয়মূল্য সম্বন্ধে অবহিত থাকবে;

 

খ) উভয়পক্ষের অন্তর্নিহিত মুনাফার পরিমাণ বা হার সম্বন্ধে অবহিত থাকবে;

 

গ) মূল ক্রয় মূল্য এবং নির্ধারিত মূল্যের মধ্যে সুদের কোন অংশ বা সংশ্রব থাকবে পণ্যের প্রকৃতি, পরিমাণ, গুণাগুণ সরবরাহের স্থান ও সময় প্রভৃতির সুনির্দিষ্ট উল্লেখ থাকবে, এবং

 

ঘ) ব্যাংক গ্রাহকের নিকট বিক্রির উদ্দেশ্য পণ্যের মূল্য নির্ধারণের সময়ে ক্রয়মূল্য ছাড়াও অন্যান্য আনুষাঙ্গিক খরচও যোগ করার এখতিয়ার রাখে।

 

ক্রেতা একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ব্যাংকের নিকট থেকে একেবারে কিংম্বা কিস্তিতে পণ্যটি পূর্ব নির্ধারিত মূল্যের ক্রয় করে। চুক্তিতে পণ্যটি পূর্ব নির্ধরিত মূল্যেই ক্রয় করে। চুক্তিতে নির্ধারিত মুনাফা কোনভাবেই বৃদ্ধি করা যাবে না, এমনকি গ্রাহক যদি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পণ্যটির ডেলিভারী নাও নেয়। এই পদ্ধতিতে যদি পণ্য সামগ্রী তাৎক্ষণিক ক্রয়-বিক্রয় হয় তাহলে হবু ক্রেতাকে কোন সিকিউরিটি বা জামানত দিতে হয় না, অথবা মূল্যের কোন অংশ পূর্বাহ্নেই আমানত হিসাবে ব্যাংকের জমা রাখতে হয় না। শুধু একটা চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করতে হয় যেন হবুক্রেতার পক্ষে ব্যাংকই বিক্রয়ের ঝামেলা বা দায় সম্পন্ন করতে পারে এবং সঙ্গত কোন কারণে হবু ক্রেতা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পণ্যটি কিনতে অপারগ হয়ে ব্যাংক পণ্য অন্যের কাছে বিক্রী করে দিতে পারে।

 

এদেশে বিদ্যমান ব্যাংকিং আইনের আওতায় কোন ব্যাংকই সরাসরি পণ্য বাণিজ্যে নিয়োজিত হতে পারে না। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপের ইসলামী ব্যাংকগুলো অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক পণ্য বাণিজ্য সরাসরি অংশগ্রহণ করছে। েএটি ইসলামী ব্যাংকের আয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। অধিকাংশ ইসলামী ব্যাংকের আর্ধক কর্মকাণ্ডের বড় একটা অংশ জুড়ে রয়েছে এই পদ্ধতি।

 

. ব্যয়--সালাম: (অগ্রিম ক্রয়): এই পদ্ধতিতে ব্যাংক কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সাথে পণ্য সামগ্রী ক্রয়ের চুক্তি করতে পারে এই শর্তে যে বিক্রেতা আগাম মূল্য নেবে এবং নির্ধারিত সময়ে ও নির্দিষ্ট স্থানে পণ্যটি সরবরাহ করবে। ব্যাংক পণ্যটি পরে নিজের পছন্দমতো সময়ে ও মূল্যে বিক্রয় করতে পারবে। অগ্রিম ক্রয় চুক্তি সম্পাদনের সময়েই বিক্রেতার নিকট মূল্য হস্তান্তরিত হবে। চুক্তি বৈধ হওয়ার স্বার্থে চুক্তিপত্রে পণ্যের ধরণ, পরিমাণ, গুণাগুণ বা বৈশিষ্ট্য সরবরাহের স্থান, পরিবহন খরচ, গুদামভাড়া ইত্যাদি যাবতীয শর্ত স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকতে হবে। কৃষিজাত পণ্য ও কুটিরশিল্পের ক্ষেত্রে এই ব্যবস্থা খুবই উপযোগী। ইসলামী ব্যাংকগুলো সাফল্যেল সাথে পদ্ধতিটি ব্যবহার করে আসছে এবং প্রভূত মুনাফা অর্জন করছে। কৃষিপ্রধান দেশে এই পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষকদরেও স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা করা হচ্ছে।

 

. ব্যয়--মুয়াজ্জাল (বাকীতে বিক্রয়): এই পদ্ধতিতে বিক্রেতা (ব্যাংক বা বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান) ক্রেতার পক্ষে পণ্য সামগ্রী ক্রয় বা সংগ্রহ করে নির্দিষ্ট মূল্যে তার কাছে বিক্রয়ের চুক্তি করে। ক্রয়মূল্য পরিশোধের পূর্বেই পণ্য সামগ্রী ক্রেতার মালিকানায় চলে যায়। এ পদ্ধতিতে বিক্রেতা ক্রেতাকে পণ্যের ক্রয়মূল্য, লাভের পরিমাণ ও অন্যান্য আনুষাঙ্গিক খরজ জানাতে বা চুক্তিপত্রে উল্লেখ করতে বাধ্য নয়। কেবল বিক্রয়মূল্য উল্লেখই যথেষ্ট। এই ব্যবস্থার নির্ধারিত বিক্রয়মূল্য নির্দিষ্ট সময়ের পরে একসাথে বা কিস্তিতে পরিশোধ করার সুযোগ রয়েছে। চুক্তিপত্রে পণ্যের ধরণ, গুণাগুণ, পরিমাণ সরবরাহের স্থান ও সময়, গ্রাহক কর্তৃক মূল্য পরিশোধের সময়সীমা ও পদ্ধতি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা যাবে না। অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অর্থ যোগানোর জন্যেও এ পদ্ধতিটি বিশেষ ফলপ্রসূ। শিল্প ও কৃষিক্ষেত্রেও এ পদ্ধতি উপযোগী। ব্যাংক কৃষকদের সার, বীজ, কীটনাশক ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী এই ব্যবস্থায় সরবরাহ করতে পারে। কৃষকরা শস্য কাটার পর বা অন্য কোন নির্দিষ্ট সময়ে এই অর্থ পরিশোধ করতে পারে। বিভিন্ন দেশের ইসলামী ব্যাংক সাফল্যের সাথে পদ্ধতিটি ব্যবহার করছে।

 

. ইজারা: মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগের জন্যে ইজারা একটি বিশেষ কৌশল। এই পদ্ধতিতে সম্পদের মালিকানা ইজারাদারেরই (এক্ষেত্রে ব্যাংকের) থাকে। ইজারাগ্রহীতা নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে নির্দিষ্ট অর্থ প্রদানের চুক্তিতে ইজারাকৃত সম্পত্তি ব্যবহার ও ভোগ দখল করে থাকে। এই পদ্ধতিতে ইজারাদাতা প্রতিষ্ঠান নির্ধারিত সময়ে পণ্যের সূত্রে প্রাপ্ত অর্থ থেকে তার মূলধন ব্যয় পুরণ করে মুনাফা অর্জন করতে সক্ষম হয়। এ প্রক্রিয়ায় ঝুঁকিও অনেক কম। ইসলামী ব্যাংকসমূহ বিশেষ সাফল্যেল সাথে এই পদ্ধতিটি ব্যবহার করে আসছে। এর ফলে শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহও পুঁজিনিবির মূলধন সামগ্রী ব্যবহার করার সুযোগ পায়। উদাহরণস্বরূপ ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক পণ্যবাহী জাহাজ, তেলবাহী ট্যাংকার, রেলওয়ে ওয়াগন, মাছ ধরার ট্রলার, দামী ও অথ্যাধুনিক ইলেক্ট্রনিক সরঞ্জাম প্রভৃতি আগ্রহী প্রতিষ্ঠানের কাছে, ক্ষেত্রবিশেষে উন্নয়নশল দেশের সরকারের কাছেও ইজারা দিচ্ছে।

 

. ইজারা বিল-বায়ই (ক্রয়ের চুক্তির ভাড়া): এ পদ্ধতিতে ব্যাংক সম্পূর্ণ নিজস্ব তহবিল দিয়ে গ্রাহকের ফরমায়েশ অনুযায়ী কোন সামগ্রী ক্রয় করে এবং তার নিকট এই শর্তে ভাড়া দেয় যে, গ্রাহক যদি কিস্তিতে সামগ্রীর মূল্য ও নির্ধারিত হারে ভাড়া পরিশোধ করে তাহলে চুক্তি মুতাবিক নির্ধারিত সময় শেষে গ্রাহক সামগ্রটির মালিক হয়ে যাবে। সম্পদের মূল্য সম্পূর্ণ পরিশোধ না হওয়া পর্যন্ত ব্যাংক নির্ধারিত হারে ভাড়া পেতে থাকবে। চুক্তি সম্পাদন হওয়ার সাথে সাথে চুক্তিবদ্ধ সম্পদ গ্রাহকের নিকট হস্তান্তর করা হয়। কিন্তু সম্পদটির মালিকানা থাকে ব্যাংকের হাতেই। এক্ষেত্রে গ্রাহকের ব্যবহার ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হয়, মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয় না। বিক্রিত সম্পতের পূর্ণ মূল্য ও নির্ধারিত ভাড়া পরিশোধের সাথে সাথে সম্পদের মালিকানা গ্রাহকের নিকট হস্তান্তরিত হয়। বিভিন্ন ধরনের যানবাহন ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে ইসলামী ব্যাংকগুলো সাফল্যের সাথে পদ্ধতিটি ব্যবহার করে আসছে।

 

. হায়ার পারচেজ আন্ডার শিরকাতুল মিলক (যৌথ মালিকানাভিত্তিক ভাড়ায় ক্রয়-বিক্রয়): এ পদ্ধতিতে ব্যাংক গ্রাহকের আবেদন অনুযায়ী তার নিকট বিক্রী করার চুক্তিতে অংশীদারী ভিত্তিতে পুঁজির যোগান দিয়ে গাড়ী, যন্ত্রপাতি, বাড়ী ইত্যাদি ক্রয় করে থাকে। এরপর নির্ধারিত কিস্তিতে বিক্রীমূল্য পরিশোধের শর্তে গ্রাহক পণ্যটি ক্রয়ের জন্যে চুক্তিবদ্ধ হয়। একই সাথে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত নির্ধারিত হারে ভাড়া প্রদানের জন্যেও অঙ্গীকার করে। যৌথভাবে পুঁজির যোগান দেবার কারণে ব্যাংক ও গ্রাহক নির্ধারিত ভাড়া তাদের স্ব স্ব পুঁজির অংশ অনুপাতে ভাগ করে নেয়। সামগ্রীটির ব্যাংকের মালিকানাভুক্ত অংশের বিক্রয় ম্যূ ও ভাড়ার অংশ কিস্তিতে পরিশোধিত হয়ে গেলে চুক্তির শর্তানুযায়ী নির্ধারিত সময়ের পর গ্রাহক সামগ্রীটির নিরংকুশ মালিকানা লাভ করে। পদ্ধতিটি বর্তমানে খুব জনপ্রিয়।

 

. কিস্তিতে বিক্রয়: ইসলামী ব্যাংকসমূহের বিনিয়োগের অপর অন্যতম কৌশল হলো কিস্তিতে বিক্রয়। এ পদ্ধতিতে স্বল্প আয়ের লোকদের, বিশেষতঃ চাকুরীজীবিদের কিস্তিতে মূল্য পরিশোধের ভিত্তিতে ব্যাংক গৃহসামগ্রী, কম্পিউটার, এয়ারকুলার ইত্যাদি সরবরাহ করে থাকে। ফলে স্বল্প আয়ের লোকেরা যেমন উপকৃত হয় তেমনি ব্যাংকও তহবিল বিনিয়োগের মাধ্যমে উপার্জন করতে পারে।

 

১০. ইসতিসনা: এ পদ্থতিতে ব্যাংক কোন প্রতিষ্ঠান বা উৎপাদনকারীকে ফরমায়েশ মত কোন জিনিস নির্দিষ্ট মূল্যে নির্ধারিত সময়ে তৈরী বা উৎপাদন করে সরবরাহের প্রস্তাব করলে এবং সংশ্লিষ্ট পক্ষ তা মেনে নিলে ক্রয়-বিক্রয় চুক্তির সম্পাদিত সবলে গণ্য হয়। িএ ক্ষেত্রে ফরমায়েশকৃত দ্রব্য সামগ্রীর দাম, পরিমাণ, প্রকৃতি, গুণাগুণ ইত্যাদি চুক্তিপত্রে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকে। ফলে ভবিষ্যতে উৎপাদনকারী (সানী) এবং ফরমায়েশ দাতার (মুসতাসনি) মধ্যে বিরোধ দেখা দেওয়ার পথ রুদ্ধ হয়। চুক্তি সম্পাদনের পর কোন পক্ষই এক তরফাভাবে শর্তের পরিবর্তন, পরিবর্ধন, পরিমার্জন বা এককভাবে চুক্তি বাতিল করতে পারবে না। প্রকৃতিগতভাবে তাই ইসতিসনা চুক্তির চূড়ান্ত ও অপরিবর্তনীয়। ইসতিসনায় সাধারণতঃ অগ্রিম কোন অর্থ প্রদান করতে হয় না।

 

১১. জুআলাহ: ‍জু’আলাহ প্রকৃতিতে অনেকটাই ইসতিনার মতো। ইসতিসনায় বিক্রেতা দ্রব্য সামগ্রী বা পণ্য সরবরাহ করে, জু’ৎআলাহতে বিক্রেতা সেবা সরবরাহ করে থাকে। বিক্রেতা নির্দিষ্ট মূল্যের বিনিময়ে নির্দিষ্ট সময় ধরে সেবা প্রদান বা সরবরাহ করে থাকে। এক্ষেত্রে নিয়োগকারীকে বলা হয় জায়েল, স্বীকৃত মজুরী বা দেয় অর্থকে বলা হয় জোআল এবং সরবরাহকারী বা ঠিকাদারকে বলা হয় আমেল। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে প্রয়োজনীয় বাণিজ্যিক বা অন্যান্য সেবামূলক কাজ সম্পাদনের দায়িত্ব গ্রহণ করে ব্যাংক নিজেই আমেল-এর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে। যেক্ষেত্রে ব্যাংক এধরনের ভূমিকা নেবে সেক্ষেত্রে জো’আলাহ চুক্তিতে অন্য কাউকে ব্যাংক আমেল হিসেবে নিয়োগের ক্ষমতা রাখে এমন ব্যবস্থাও থাকতে পারে। এটি হতে পারে মূল চুক্িতর আওতায় সহযোগী চুক্তি। অনুরূপভাবে ব্যাংক যখন জায়েল তখন মূল আমেল ব্যাংকের পূর্ণ অনুমতি নিয়ে কাউকে সহযোগী আমেল হিসেবে নিয়োগ দিতে পারে। সেবা প্রদানের জন্যে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও উপায়-উপকরণ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে আমেল বা জা’য়েল যে সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব গ্রহণ করবে তাও সংশ্লিষ্ট চুক্তিতে উল্লেখ থাকতে পারে।

 

১২. মুজারাহ: এই পদ্ধতিতে ব্যাংক যদি কোন কৃষি জমির মালিক বা অন্য কোনভাবে স্বত্তাধিকারী হয় তাহলে তা চাষ করার জন্যে কৃষকদের সাথে চুক্তি করতে পারে। এক্ষেত্রে ব্যাংক (মোজারে) নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে নির্দিষ্ট ভূখণ্ডটি কৃষককে (আমেল) চাষের জন্যে দেবে। বিনিময়ে ব্যাংক নির্ধারিত হারে উৎপাদিত ফসলের অংশ পাবে। চুক্তির মধ্যেই উৎপাদনের পরিমাণ ও গুণাগুণ বৃদ্ধির জন্যে উন্নতমানের বীজ সার সেচসুবিধা পরিবহন ও কৃষি সরঞ্জাম সরবরাহের ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। অবশ্য এজন্যে ফসলের প্রাপ্য হারেরও তারতম্য হবে।

 

১৩. মুশাকাত: এই পদ্ধতিতে ইসলামী ব্যাংক তার মালিকানাধীন অথবা কোন না কোন ভাবে স্বত্তাধীন বৃক্ষ, ফলের বাগান ইত্যাদির পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষণের উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্যে কৃষককে দায়িত্ব অর্পণের জন্যে চুক্তি করে। ‍উৎপন্ন ফল বা কাঠ উভয়ের মধ্যে চুক্তি অনুসারে বন্টিত হয়। মুজারাহ পদ্ধতির মতো এ ক্ষেত্রে সেচ, পরিবহন বা অন্যান্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সরবরাহের সুবিধা প্রদান এবং সেই অনুসারে ফসলের অংশ প্রাপ্তির শর্তের তারতম্য হতে পারে।

 

১৪. শেয়ার ক্রয়-বিক্রয়: ইসলামী ব্যাংক শেয়ার বাজরে শেয়ার কেনা-বেচায় সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে পারে এবং কার্যত নিচ্ছেও। যথাযথভাবে পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হলে এটিও ব্যাংকের বিনিয়োগ ও আয়ের অন্যতম উৎস হওয়া সম্ভব। সুপ্রতিষ্ঠিত, সুপরিচালিত ও সন্তোষজনকহারে ডিভিডেন্ট দিতে বা কোম্পানীর স্টক ও শেয়ার ক্রয়ের মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংক তার তহবিল বিনিয়োগ করে মুনাফা অর্জন করতে পারে। তবে এই ব্যাংক যেহেতু তার তহবিল বিনিয়োগ করে মুনাফা অর্জন করতে পারে। তবে এই ব্যাংকে যেহেতু শুধুমাত্র হালাল ব্যবসায়ে অংশ গ্রহণ করতে পারে সেহেতু শেয়ার ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে এবং দেখতে হবে এসব কোম্পানীর কার্যক্রমে হালাল-হারামের বাছ-বিচার করে কি না। যদি তা না হয় তাহলে ঐসব কোম্পানীর শেয়ার কেনা-বেচায় অংশ নেওয়া যাবে না।

 

১৫. বৈদেশিক মুদ্রার উপস্থিত ক্রয়-বিক্রয়: ইসলামী ব্যাংক খোলা বাজার হতে বৈদেশিক মুদ্রা কিনে আবার তা খোলা বাজারেই বিক্রয় করতে পারে। এ থেকে প্রচুর মুনাফা অর্জনের সুযোগ রয়েছে। শরীয়াহর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ করার স্বার্থে বৈদেশিক মুদ্রা উপস্থত ক্রয় বা বিক্রয় করতে হবে এবং তা অবশ্যই নগদ মূল্যে হতে হবে। বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রা ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। কিন্তু অন্যান্য দেশে বিশেষতঃ মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপীয় দেশগুলোতে এ ধরনের নিয়ন্ত্রণ নেই। তাই সেসব দেশের ইসলামী ব্যাংক এই ব্যবসায়ে অর্থ বিনিয়োগ করছে এবং এ থেকে প্রচুর মুনাফা অর্জন করছে। কোন কোন ব্যাংকের মোট আয়ের এক-তৃতীয়াংশই অর্জিত হচ্ছে এই একটি মাত্র পদ্ধতি থেকেই।

 

১৬. মেয়াদী অংশগ্রহণকারী সার্টিফিকেট: ইসলামী ব্যাংকগুলো কখনও তারল্যের সমস্যায় পতিত হয়নি। বরং তাদের হাতে বিপুল অব্যবহৃত আমানত পড়ে থাকে। এই অর্থ অনায়াসে দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগের জন্যে ব্যবহার করা যায়। বহু ইসলামী ব্যাংক তাই বর্তমানে পাঁচ হতে দশ বছর মেয়াদী বিনিয়োগ সার্টিফিকেট ইস্যু করছে যেন গৃহ নির্মাণ, স্থাপর সম্পত্তির উন্নয়ন, শিল্প কারখানা স্থাপন প্রভৃতি কাজে এই অর্থ বিনিয়োগ করা যায়। এই ধরনের সার্টিফিকেট ন্যূনতম এক বছরের পূর্বে ভাঙানো যায় না। লাভ-লোকসানের অংশ নিতেও প্রস্তুত থাকে। দেখা গেছে এসব বিনিয়োগে মুনাফাই হয়ে থাকে। অভিজ্ঞতায় আরও লক্ষ্য করা গেছে, ইসলামী ব্যাংক এই ধরনের সার্টিফিকেট ক্রেতাদের সরকার ঘোষিত ন্যূনতম নিশ্চিত বা গ্যারান্টিযুক্ত সুদের চেয়েও বেশী হারে মুনাফা প্রদান করেছে। এ থেকে এই ধরনের বিনিয়োগ ইসলামী ব্যাংকের সাফল্য সন্দেহাতীতভাবে প্রমানিত হয়।

 

১৬. বিনিয়োগ নীলাম: বিনিয়োগ নীলামে ইসলামী পদ্ধতিতে বিনিয়োগের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়। শিল্পখাতে মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদী আর্থিক বিনিয়োগ বা সহযোগিতার জন্যে একটি কার্যকর পন্থা। এ পদ্ধতিতে ব্যাংক একা কিংবা অন্যের সাথে যৌথভাবে শিল্প প্রস্তুত করে এবং প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহের ব্যবস্থা নিশ্চিত করে। এরপর ঐ প্রকল্পটি নীলামের ব্যবস্থা করে। অবশ্য প্রকল্পটি তৈরীর কাজ সম্পূর্ণ করেও ব্যাংক নীলামে বিক্রয়ের ব্যবস্থা করতে পারে। যুক্তিসঙ্গত হারে লাভ ধরেই ব্যাংক প্রকল্পটির বিক্রয় মূল্য নির্ধারণ করে থাকে। যে কোন দরপত্র বা নীলাম ডাক গ্রহণ বা বর্জনের অধিকারও ব্যাংকের থাকে। কৃতকার্য ক্রেতার নিকট থেকে ব্যাংক সম্পূর্ণ অর্থ নগদে গ্রহন করতে পারে অথবা পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে ক্রেতাকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কিস্তিতে মূল্য পরিশোধের সুযোগ দিতে পারে। ইসলামী ব্যাংকের জন্যে এটি একটি লাভজনক বিনিয়োগ কৌশল। দ্রুত শিল্পায়ন, কর্মসংস্থাতন ও পুঁজি সংগঠনের জন্যেও পদ্ধতিটি নিঃসন্দেহে সহায়ক।

 

১৮. সরাসরি বিনিয়োগ: ইসলামী ব্যাংক কারো সাহায্য না নিয়ে নিজেই কোন লাভজনক প্রকল্প বা আর্থ-সামাজিক দিক দিয়ে প্রয়োজনীয় নানা ধরনের প্রকল্প স্থাপন করতে পারে। এ ক্ষেত্রে প্রকল্পের স্কীম তৈরী থেকে শুরু করে প্রকল্প বাস্তবায়ন, ব্যবস্থাপনা প্রভৃতি যাবতীয় কাজ ব্যাংক নিজস্ব উদ্যোগেই করে থাকে। প্রকল্পের মূলধন সরবরাহ, নিয়ন্ত্রণ, পরিচালনা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং স্থায়ী মালিকানা সকল কিছুই ব্যাংকের নিজের হাতে থাকে। প্রকল্প বাস্তবায়নের পর লাভ হলে তার পুরোটাই ব্যাংকের। লোকসান হলে তারও পুরোটাই ব্যাংক বহন করে। পৃথিবীর বহু ইসলামী ব্যাংকের এ ধরনের নিজস্ব প্রকল্প রয়েছে। এসবের মধ্যে ডেইরী ফার্ম হতে এলুমিনিয়াম ও ফাইবার গ্লাস ফ্যাক্টরী, মাছ ধরার ট্রলার হতে গৃহায়ন প্রকল্প সবই রয়েছে।

 

১৯. স্বাভাবিকমুনাফার হারে বিনিয়োগ: চায়ের দোকান, ফেরীওয়ালা, কামার, নাপিত, মুদীওয়ালা প্রভৃতি নানা ধরনের ছোট ছোট দোকানদার রয়েছে যাদের পুঁজির প্রয়োজন। তারা ব্যবসার দৈনন্দিন হিসাবপত্র রাখে না বা রাখতে পারে না। এজন্রে উপরের পদ্ধগিুলোর কোনটির মাধ্যমেই এদের আর্থিক সহযোগিতা করতে পারলে এরা কর্মসংস্থান ও ব্যাবসা-বাণিজ্যে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারে। এরা নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই ঋণ ফেরত দিয়ে থাকে। বরং বড় ঋণ গ্রহীতারাই ঋণ পরিশোধে দীর্ঘসূত্রীতা অবলম্বন করে। তাই ইসলামী ব্যাংক নির্ধারিত স্বাভাবিক হারে মুনাফা প্রদানের শর্তে এসব ছোট ছোট ব্যবসায়ীদের ব্যবসায়ের অর্থ বিনিয়োগ করে থাকে।

 

স্বাভাবিক মুনাফার হার নির্ধারণের পূর্বে ইসলামী ব্যাংকসমূহ এই ধরনের ব্যবসাসমূহের কমপক্ষে তিন বছরের লেন-দেনের হিসাব নেবে, লাভ-লোকসানের হিসাব করবে এবং এর গড় হারের ভিত্তিতেই মুনাফার স্বাভাবিক হার নির্ধারিত হবে। সুদের হারের মতো এই হার স্থির বা সুনির্দিষ্ট নয়। অবশ্য বিনিয়োগের সময় চুক্তিতে উল্লেখ থাকবে যে, যদি প্রকৃত লাভ নির্ধারিত স্বাভাবিক মুনাফার হারের চেয়ে বেশী হয় তাহলে ব্যবসায়ী স্বেচ্ছায় অতিরিক্ত লাভের অংশবিশেষ ব্যাংককে প্রদান করবে। অপরপক্ষে যদি অর্জিত মুনাফা নির্ধারিত স্বাভাবিক হারের চেয়ে কম হয় কিংবা লোকসান হয় এবং সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী তা সন্তোষজনকভাবে প্রমাণ করতে পারে তাহলে ব্যাংক মুনাফার ঐ নিম্নহার বা লোকসানই মেনে নেবে। সুতরাং, মুনাফার স্বাভাবিক হার আসলে একটি নিয়ন্ত্রণমূলক কৌশল মাত্র। সন্দেহ নেই, অর্থায়নের এই পদ্ধতি খুব আকর্ষনীয় ও সহজ। কিন্তু এর সঠিক বাস্তবায়ন খুবই দুরূহ। বিশেষতঃ ঐ সব ক্ষেত্র যেখানে ‘স্বাভাবিক’ মুনাফার হার নির্ধারণ ত্রুটিপূর্ণ বা বিতর্কিত। ইসলামী অর্থনীতিবিদদের মতে প্রাথমিক পর্যায়ে এ ধরনের পদ্ধতি ব্যাংকের ব্যবহার না করাই শ্রেয়।

 

২০. করযে হাসানা: দানের চেয়ে করযে হাসানার সওয়াব বেশী। সওয়াবের নিয়তে এবং গ্রহীতার সাময়িক প্রয়োজন পূরণের মাধ্যমে তার অসুবিধা দূর করার উদ্দেশ্যেই এবং কোন রকম প্রত্যুপকারের বিন্দুমাত্র আশা না করে করযে হাসানা প্রদানকারী অর্থ ঋণ দিয়ে থাকে। সুদনির্ভর ব্যাংকগুলো তো বটেই, বিত্তশালীরা পর্যন্ত এরকম ঋন দিতে নারাজ। অথচ সচ্ছল ব্যক্তিরও অনেক সময় ঋণের প্রয়োজন পড়ে সামযিক অভাব বা প্রযোজন পূরণের জন্যে। সে সময় যদি করযে হাসানার সুযোগ না থাকে তাহলে তাকে হয় সহায়-সম্বল বিক্রি করতে হবে অথবা নিরুপায় হয়েই সুদের ভিত্তিতে ঋণ নিতে হবে। ইসলামী ব্যাংক এই ধরনের সহযোগিতা পাওয়া কল্পনাতীত ব্যাপার। ইসলামী ব্যাংক তার গ্রহাকদের জরুরী ও স্বল্প মেয়াদী প্রয়োজন পূরণের উদ্দেশ্যে ন্যূনতম হারে সার্ভিস চার্জের বিপরীতে ঋণ দিয়ে থাকে। ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের ক্ষেত্রে এই হার ০.৫০% হতে সর্বোচ্চ ২.০% পর্যন্ত। পাকিস্তানে এই হার প্রায় ৩.০%। করযে হাসানা মঞ্জুরের সময়েই ঋণ গ্রহীতার সুবিধা অনুসারে ঋণ পরিশোধের সময় ও পদ্ধতিও নির্ধারিত হয়।

 

বিশ্বের ইসলামী ব্যাংকসমূহের বার্ষিক প্রতিবেদন ও ব্যালেন্সশীটসমূহ পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, উপরে উল্লেখিত কর্মকৌশলসমূহ ব্যবহার করে তারা শুধু বিপুল মুনাফাই অর্জন করেনি, সুদভিত্তিক ব্যাংকগুলোর তুলনায় আমানতকারীদের বেশী হারে মুনাফা প্রদান করছে। স্বরণ রাখা দরকার, সুদভিত্তিক ব্যাংকগুলোর বয়স যেখানে দুইশত বছরের বেশী ইসলামী ব্যাংকের বয়স সেখানে তিন দশকের কিছু বেশী। এখনও তার শৈশবকাল কাটিয়ে ওঠেনি ইসলামী ব্যাংক। আশার কথা, ইসলামী ব্যাংক ও ফাইন্যান্সিয়াল ইন্সটিটিউশনগুলো বিনিয়োগের জন্যে শরীয়াহ্‌র দৃষ্টিতে বৈধ নতুন নতুন উপায় উদ্ভাবনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এবং সম্মিলিতভাবে একে অন্যের অভিজ্ঞতা হতে শেখার চেষ্টা করছে। ইসলামী ব্যাংকের সাফল্য একদিকে যেমন তার কর্মীবাহিনীর ঐকান্তিকতা, পেশাগত কর্মকুশলতা এবং দক্ষতার উপর নির্ভরশীল তেমনি নির্ভরশীল তার অংশীদারী বিনিয়োগাকারীদের সততা, যোগ্যতা এবং ব্যবসায়িক দূরদর্শিতার উপর। বিশেষতঃ আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে প্রয়োজনীয় দক্ষতা, অভিজ্ঞতা এবং সততাসম্পন্ন ব্যবসায়ী পাওয়া খুবই দুরূহ। এই সমস্যা সমাধানের জন্যে ইসলামী ব্যাংকসমূহকে নিজ উদ্যোগে প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।

 

পরিশেষে এ কথা বলতেই হবে বর্তমান অনৈসলামী পরিবেশ, বিশেষতঃ প্রচলিত বাণিজ্যিক, রাজস্ব ও দেওয়ানী আইনের অনেকগুলোই ইসলামী ব্যাংকের সুষ্ঠু কার্য পরিচালনার পথে বিষম বাধা। এসব আইনের পরিবর্তন বা সংশোধন প্রয়োজন। যেহেতু সংশ্লিষ্ট সরকারের অনুমতিক্রমে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণাধীনের দায়-দায়িত্ব তাদের উপরও বর্তায়। ইসলামী ব্যাংক এসব প্রতিকূলতার মধ্যেই কাজ করে যাচ্ছে এবং ক্রমাগত সাফল্যের সোপারে উত্তরণ লাভ করছে। বস্তুতঃ সুদী ব্যাংক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ইসলামী ব্যাংক এক সাহসী ও ভিন্নধর্মী চ্যালেঞ্জ। সনাতন ব্যাংকগুলো যেখানে শুধুমাত্র আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ইসলামী ব্যাংকগুলো সেখানে একই সাথে আর্থিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের যোগফল। এই ব্যাঙক শরীয়াহ্‌সম্মত উপায়ে মুসলমানের রুটি-রুজীর ব্যবস্থার পাশাপাশি সমাজের বৃহত্তর কল্যাণ নিশ্চিত করার জন্যেও পদক্ষেপ গ্রহণ করে। ইসলামী ব্যাংক তাই মুমিন মুসলমানের জন্যে প্রয়োজনীয় এক প্রতিষ্ঠানই নয়, মুসলিম উম্মাহ্‌র জন্যেও অপরিহার্য এক ইন্সটিটিউশন।

 

বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং

 

. বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠা

 

সমগ্র বিশ্বে আজ ব্যতিক্রমধর্মী একটি ইসলামী অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান বা ইনস্টিটিউশন সম্পর্কে জানবার ও বুঝবার জন্যে বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়েছে। ইতিমধ্যেই ধনী-গরীব ও মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে নানা দেশে এই ইনস্টিটিউশনটি ক্রমাগত তার বিজয় পতাকা উড়িয়ে চলেছৈ। সুদনির্ভর অর্থনীতির দেশগুলোর আর্থ-সামাজিক কাঠামোয় প্রচণ্ড এক বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছে এই প্রতিষ্ঠান। বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই জনগণ অবাক বিস্ময়ে (খানিকটা সংশয় জড়িতও) তাকিয়ে দেখছে বহুল আলোচিত প্রতিষ্ঠানটি তাদের একেবারে দোরগড়ায় হাজির। প্রতিষ্ঠানটির নাম ইসলামী ব্যাংক।

 

অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে আল্লাহর বিধান কায়েম করা এবং এক্ষেত্রে বিরাজমান হারাম পদ্ধতি থেকে মুসলিম জনগোষ্ঠীকে মুক্ত করাই ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার মুখ্য উদ্দেশ্য। ইসলামী ব্যাংক ব্যবস্থা বাস্তবায়নের মাধ্যমে মুসলিম সমাজের দীর্ঘদিনের আকাংখা ইসলামী প্রক্রিয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা সমস্যার সমাধান হবে। জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন সাধিত হবে। আজকের সমাজ যেসব অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যায় ভুগছে সেসব সমস্যার সমাধানে ইসলামী অর্থনীতির কৃতিত্ব ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আবারো প্রমাণিত হবে। বস্তুতঃ সমাজের অর্থনৈতিক প্রয়োজন পূরণ এবং সার্বিক উন্নয়ন ও অগ্রগতিই হচ্ছে ইসলামী অর্থনীতির লক্ষ্য।

 

মিশরেই সর্বপ্রথম ১৯৬৩ সালে পুরোপুরি আল্লাহর নির্দেশ ও বিধি-বিধান অনুসারে পরিচালিত হবে এমন একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান স্থাপনের জন্যে বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এবছরেই মিশরের মিটঘামার নামক স্থানে ইসলামী সেভিংস ব্যাংক নামে আধুনিক কালের সর্বপ্রথম ইসলামী ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠিত হয়। অল্প সময়ের মধ্যেই ব্যাংকটি বিপুল সাফল্য অর্জন করে। কিন্তু ব্যাংকটি সে দেশের সুদনির্ভর ব্যাংকগুলোর চক্ষুশুল হওয়ায় ইসলামের দুশমন ও নিজেকে ফেরাউনের বংশধর বলে দাবীদার প্রেসিডেন্ট জামাল আব্দুল নাসেরের সরকার এটি বন্ধ করে দেয়। সাফল্যই ছিল ব্যাংকটির বড় শত্রু।

 

প্রায় এক দশক পর দ্বিতীয় প্রচেষ্টা হিসাবে সে দেশে ১৯৭১ সালে সউদী আরবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক এবং ঐ একই বছরে সংযুক্ত আরব আমীরাতে দুবাই ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭৭ সালে সুদানে ফয়সাল ইসলামী ব্যাংক, কুয়েতে কুয়েত ফাইন্যান্স হাউজ, মিশরে ফয়সল ইসলামী ব্যাংক এবং ১৯৭৮ সালে জর্দানে জর্দান ইসলামী ব্যাংক ফর ফাইন্যান্স এন্ড ইনভেস্টমেন্ট প্রতিষ্ঠিত হয়। তারপর হতে প্রায় প্রতি বছর বিশ্বের কোন-না-কোন দেশে ইসলামী ব্যাংক ও ফাইন্যান্সিং প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হচ্ছে। ইতিমধ্যেই এই সংখ্যা প্রায় তিন শতে পৌঁচেছে।

 

উল্লেখ্য, সুদভিত্তিক ব্যাংকগুলো আন্তর্জাতিক রূপ লাভ করতে সময় লেগেছে কয়েক শতাব্দী। কিন্তু আন্দের বিষয়, পদ্ধতি হিসাবে ইসলামী ব্যাংক ব্যবস্থা ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিক রূপ লাভে সমর্থ হয়েছে। শুধু তেলসমৃদ্ধ আরব দেশগুলোতেই নয়, কৃষিপ্রধান ও দরিদ্র দেশেও ইসলামী ব্যাংক ও বিনিয়োগ সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ও হচ্ছে। তেলসমৃদ্ধ মুসলিম দেশসমূহে যে কয়টি ইসলামী ব্যাংক স্থাপিত হয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশী ব্যাংক স্থাপিত হয়েছে অন্যান্য দেশে। উদাহরণস্বরূপ সুদান মিশর পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়ার নাম করা যেতে পারে। এ থেকেই প্রমানিত হয় যে ব্যবসা ও বিনিয়োগ কার্যক্রমের ইসলামী মডেল বিশ্বজনীনতা তথা ব্যাপক ও স্বীকৃতি আন্তর্জাতিক রূপ লাভে সক্ষম হয়েছে।

 

বাংলাদেশের জনসমষ্টির ৮৬% ইসলামের অনুসারী। ইসলামে সুদ নিষিদ্ধ একথা সকলেরই জানা। তাই সুদভিত্তিক ব্যাংক ব্যবস্থার সাথে দেশের বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর কখনও আত্মিক সংযোগ ঘটেনি। অথচ দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে তাদের অংশ গ্রহণ নিশ্চিত করতে না পারলে জাতীয় উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি অর্জন সম্ভব নয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন মহল থেকে তাই ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার দাবী উঠেছে স্বাধীনতা লাভের পর হতেই। এ জন্যে এযাবৎ গৃহীত পদক্ষেপসমূহ নীচে উল্লেখ করা গেল।

 

প্রথমেই সরকারের ভূমিকার কথা বলতে হয়। ইসলামী সম্মেলন সংস্থা ও ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য দেশ হিসেবে বাংলাদেশ িইসলামী অর্থনীতি ও ব্যাংক ব্যবস্থা প্রবর্তন করার জন্যে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এ ব্যাপারে সরকার যেসব উদ্যোগে অংশগ্রহণ ও সম্মতি প্রদান করেছেন তা িএই প্রতিশ্রুতি রক্ষারই প্রচেষ্টা। এসবের মধ্যে রয়েছে:

 

ক) আগষ্ট, ১৯৯৪ সালে জেদ্দায় অনুষ্ঠিত মুসলিম দেশসমূহের অর্থমন্ত্রীদের সম্মেলনে ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার সনদে স্বাক্ষরকারী ২২টি সদস্য দেশের অন্যতম বাংলাদেশ। এই সদন স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ সরকার নীতিগতভাবেই দেশের অর্থনৈতিক ও ব্যাংকিং তৎপরতাকে ইসলামী শরীয়াহর আলোকে পুনর্গঠিত করতে সম্মত হয়েছে।

 

খ) ১৯৭৮ সালের এপ্রিলে ডাকারে অনুষ্ঠিত ইসলামী পররাষ্ট্র মন্ত্রী সম্মেলনে বাংলাদেশ অংশ গ্রহণ করে। এই সম্মেলনে ইসলামী ব্যাংকের সংজ্ঞা গৃহীত হয় এবং পর্যায়ক্রমে মুসলিম দেশসমূহে ইসলামী অর্থনীতি ও ব্যাংক ব্যবস্থা চালু করার জন্যে প্রস্তাব গৃহীত হয়।

 

গ) ১৯৭৯ সালের নভেম্বর সংযুক্ত আরব আমীরাতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এ দেশে দুবাই ইসলামী ব্যাংকের মতো ব্যাংক প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি লেখেন। এরপর ডিসেম্বর, ১৯৭৯ সালে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং ও বিনিয়োগ বিভাগ এদেশে ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে মতামত চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দেয়।

 

ঘ) মে, ১৯৮০ সালে ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিত ইসলামী পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলনে বাংলাদেশের তদানীন্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রছেসর মুহাম্মদ শামস-উল-হক সকল ইসলামী দেশে শাখাসহ একটি আন্তর্জাতিক ইসলামী ব্যাংক চালুর পদক্ষেপ গ্রহণের প্রস্তাব করেন।

 

ঙ) এই প্রেক্ষিতে নভেম্বর, ১৯৮০ বাংলাদেশ ব্যাংক মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশের ইসলামী ব্যাংকের কার্যপদ্ধতি পর্যালোচনা করার উদ্যোগ নেয় এবং সে আলোকে জানুয়অরী, ১৯৮১ বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করে সরকারের কাছে রিপোর্ট প্রদান করে।

 

চ) ১৯৮১ সালে ঐতিহাসিক মক্কা সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানর প্রস্তাব অনুসারে মুসলিম দেশসমূহে তাদের নিজস্ব ধ্যান-ধারণার আলোকে ব্যাংক ব্যবস্থার প্রচলনের মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারের সুপারিশ অনুমোদিত হয়্ এজন্যে বেসরকারী খাতে যৌথ উদ্যোগে ব্যাংক ও ফাইন্যান্সিং প্রতিষ্ঠান স্থাপন এবং এর মাধ্যমে ইসলামী দেশসমূহে বিনিয়োগকে ফলপ্রসূ করে তোলার প্রস্তাব গৃহীত হয়।

 

ছ) ১৯৮১ সালের মার্চে খার্তুমে অনুষ্ঠিত ইসলামী সম্মেলন সংস্থার সদস্য দেশসমূহের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও মুদ্রা নিয়ন্ত্রণসংস্থা প্রধানদের সম্মেলনে ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে একটি সর্বসম্মত কাঠামো উদ্ভাবনের প্রস্তাব গৃহীত হয়।

 

ঝ) বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিংএর বাস্তব কার্যপদ্ধতি উদ্ভাবনের উদ্দেশ্যে নিয়মিত অনুশীলন ও সমীক্ষার জন্যে ১৯৭৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ওয়ার্কিং গ্রুপ ফর ইসলামী ব্যাংকিং ইন বাংলাদেশ। পরবর্তীকালে নভেম্বর, ১‘৯৮১তে এটি বাংলাদেশ ইসলামিক ব্যাংকার্স এ্যাসোসিয়েশন (BIBA) নামে পুনর্গঠিত হয়। এর মূল শ্লোগান ছিল ‘BIBA to fight against RIBA’। এর মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংকিং ও ফাইন্যান্সের উপর বেশ কয়েকটি প্রশিক্ষণ কোর্স পরিচালিত হয়।

 

ঞ) বেসরকারী পর্যায়ে এদেশে ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে গণসচেতনতা ও প্রাথমিক প্রস্তুতির কাজ শুরু হয় ১৯৭৯ সালের শুরু থেকে। এ বছরের জুলাই মাসে ইসলামিক ইকোনমিকস রিসার্চ ব্যুরোর উদ্যোগে দুদিনব্যাপী এই সেমিনারটি অনুষ্ঠিত হয়। সেমিনারে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন দেশী-বিদেশী গবেষক-অধ্যাপক ও চিন্তাবিদগণ অংশগ্রহণ করেন।

 

ঢাকার মুসলিম বিজিনেসমেন্‌স সোসাইটির সদস্যগণও সেমিনারের সুপারিশমালার ব্যাপারে বিশেষ উৎসাহ দেখান। দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার পর সোসাইটির সদস্যগণ এদেশে বেসরকারী খাতে ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে প্রস্তাব গ্রহণ করেন এবং এ উদ্দেশ্যে চূড়ান্ত চেষ্টা চালানোর জন্যে উদ্যোগ গ্রহণ করেন। একই সঙ্গে তারা ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিঃ নামে একটি কোম্পানীও গঠন করেন।

 

ট) ১৯৮১ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম)-এর উদ্যোগ ইসলামী ব্যাংকিং-এর উপর দুদিন ব্যাপী এক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। ঐ একই বছর এপ্রিল মাসে বায়তুশ শরফ ইসলামী গবেষণা ট্রাষ্টের উদ্যোগে চট্টগ্রামেও ইসলামী ব্যাংকের উপর এক সফল সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিটি সেমিনারেই সর্বস্তরের জনগণ বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনা নিয়ে অংশ গ্রহণ করে।

 

ঠ) ১৯৮১ সালের ২৬ অক্টোবর-২৪ নভেম্বর সোনালী ব্যাংক স্টাফ কলেজ ইসলামী ব্যাংকের উপর এক মাস মেয়াদী আন্তঃব্যাংক আবাসিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে। পরবর্তী সময়ে ইসলামিক ইকোনমিকস রিসার্চ ব্যুরো ও বাংলাদেশ ইসলামিক ব্যাংকার্স এসোসিয়েশন বিভিন্ন মেয়াদের প্রশিক্ষণ কোর্সের আয়োজন করেছে। বিআইবিএম-ও ১৯৮২ সালের ১৮-৩০ জানুয়ারী ইসলামী ব্যাংকিং এর উপর আবাসিক প্রশিক্ষণ কোর্সের আয়োজন করে। এসব প্রশিক্ষণ কোর্সে দেশের সিনিয়র ব্যাংকারসহ বিভিন্ন কর্মকর্তাগণ অংশগ্রহণ করেন।

 

ড) ইতোমধ্যে ইসলামী ব্যাংক স্থাপনের জন্যে সরকারের কাছে অনুমতি চেয়ে আবেদন পেশ করা হয়। ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। ১৯৮২ সালের নভেম্বর মাসে ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের একটি সমীক্ষা মিশন বাংলাদেশ সফর করে এবং এদেশে বেসরকারী খাতে ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার সম্ভাব্যতা যাচাই করে। এই মিশনের সুপারিশ অনুযায়ী ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক প্রস্তাবিত ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিঃ এর পরিশোধিত মূলধনে অংশগ্রহণ করে অন্যতম উদ্যোক্তা-শেয়ারহোল্ডার হিসাবে ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। শেষ পর্যন্ত সকল বাধা-বিপত্তি ও প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে আল্লাহ্‌র অসীম অনুগ্রহে বাংলাদেশ সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি লাভ করে বেসরকারী খাতে দেশে প্রথম ইসলামী ব্যাংক- ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিঃ। ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৮৩ সালের ৩০শে মার্চ।

 

ঢ) এদেশে ইসলামী পদ্ধতির ব্যাংক প্রতিষ্ঠার প্রথম পর্যায়ে যারা নানাভাবে অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছেন প্রসঙ্গতঃ তাদের কথাও উল্লেখের দাবী রাখে। তাঁদের অকুণ্ঠ ত্যাগ স্বকিার ও নিরলস প্রয়াস ছাড়া দেশের প্রথম ইসলামী ব্যাংকটির অগ্রযাত্রা দুরূহ ছিল। এঁদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য সোনালী ব্যাংক স্টাফ কলেজের সাবেক প্রিন্সিপ্যাল জনাব এম. আযীযুল হক। নতুন এই ব্যাংকের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ ও ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রায় কান্ডারীর ভূমিকা গ্রহণ করতে তিনি স্বেচ্ছায় ঐ পদ ছেড়ে চলে আসেন। ব্যাংকের শরীয়াহ্‌ কাউন্সিলের প্রথম সদস্য-সচিব হিসাবে দারুল ইফতার চেয়ারম্যান বাইয়েদ মুহাম্মদ আলী বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। এছাড়া ব্যাংকের প্রথম চেয়ারম্যান বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আলহাজ্জ্ব আবদুর রাজ্জাক লস্কর, চট্টগ্রামের বায়তুশ শরপ ফাউণ্ডেশনের চেয়ারম্যান আলহাজ্জ্ব মাওলানা জব্বার শাহ্‌, বগুড়ার প্রখ্যাত শিল্পপতি আলহাজ্জ্ব মফিজুর রহমান এবং বাংলাদেশে সৌদী আরবের তদানীন্তন মাননীয় রাষ্ট্রদূত ফুয়াদ আবদুল হামদি আল-খতীব প্রমুখের নাম শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করতে হয়।

 

বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে এদেশের জনগণের দীর্ঘদিনের আকাংখা বাস্তবায়িত হয়েছে। এ নতুন পদ্ধতি চালু হওয়ার ফলে প্রচলিত ব্যাংক ব্যবস্থা ও এদেশের কোটি কোটি তৌহিদী জনতার আকাঙ্খিত ব্যাংক ব্যবস্থার মধ্যে পার্থক্য নিরূপণের বাস্তব সুযোগও সৃষ্টি হয়েছে। আশার কথা, এদেশের প্রথম এই ইসলামী ব্যাংকটি ইতিমধ্যেই আশাতীত সাফল্য অর্জন করছে। পরবর্তী আলোচনা হতে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানা যাবে।

 

বাংলাদেশ ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেই ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিঃ ক্ষান্ত হয় নি। দেশের আপামর জনগণের মধ্যে ইসলামী ব্যাংকের উদ্দেশ্য, কর্মকৌশল, উপার্জন পদ্ধতি, বিনিয়োগের প্রকৃতি প্রভৃতি বিষয়ে প্রচার ও প্রসারের জন্যে ব্যাংকটি ক্রমাগত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এজন্যে নিজ উদ্যোগে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানের সেমিনার ও সম্মেলনের আয়োজন করেছে। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ১১-১২ মার্চ, ১৯৮৫ সালে অনুষ্ঠিত দুই দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক মানের সেমিনার। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য, এই সেমিনারের পরেই ১৯৮৭ সালের মে মাসে সউদী আরবের দাল্লাহ আল-বারাকা গ্রুপের সহযোগিতায় ঢাকাতে আল-বারাকা ব্যাংক বাংলাদেশ (বর্তমানে ওরিয়েন্টাল ব্যাংক) প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি ছিল দেশের দ্বিতীয় ইসলামী ব্যাংক।

 

দেশের ইসলামপ্রিয় জনগণের চাহিদা পূরণের জন্যে একটি বা দুটি ইসলামী ব্যাংক কোনক্রমেই যথেষ্ট বিবেচিত হতে পারে না। তাছাড়া ইতিমধ্যেই ইসলামিক ইকোনমিকস রিসার্চ ব্যূরোর সেমিনার-সিম্পোজিয়াম এবং ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিঃ আয়োজিত দেশের বিভিন্ন জেলা ও বিভাগীয় শহরে সেমিনার ও ইফতার মাহফিলের আলোচনা ইসলামী ব্যাংক ব্যবস্থার প্রতি জনমানসে ব্যাপক সাড়া জাগাতে সমর্থ হয়। এই প্রেক্ষিতেই ১৮ জুন, ১৯৯৫ প্রতিষ্ঠিত হয় আল-আরাফাহ্‌ ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড এবং ছয় মাসের কম সময়ের ব্যবধানে প্রতিষ্ঠিত হয় দেশের চতুর্থ ইসলামী ব্যাংক- সোস্যাল ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক লিমিডেট (২২ নভেম্বর, ১৯৯৫)।

 

এছাড়া ফয়সল ইসলামী ব্যাংক অব বাহরাইনের শাখা প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকায় ১১ আগষ্ট, ১৯৯৭। প্রাইম ব্যাংক ১৮ ডিসেম্বর, ১৯৯৫ ঢাকাতে তার প্রথম ইসলামী ব্যাংকিং শাখা প্রতিষ্ঠা করে। এর ঠিক দুবছর পরে (১৭.১২.৯৯) সিলেটে অনুরূপ আরেকটি শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়েছ। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে শাহজালাল েইসলামী ব্যাংক। উপরন্তু দেশের প্রথম ইসলামী বিনিয়োগ কোম্পানী –ইসলামিক ফাইন্যান্স এ্যাণ্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড কাজ শুরু করেছে ২০০০ সাল হতে।

 

. ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড

 

. প্রতিষ্ঠা

 

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রথম সুদমুক্ত ব্যাংক তথা ইসলামী শরীয়াহ অনুসারে ব্যাংক হিসাবে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড (আইবিবিএল) তার অগ্রযাত্রা শুরু করে ৩০শে মার্চ, ১৯৮৩ সালে। জেদ্দাস্থ ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকসহ মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি ইসলামী ফাইন্যান্সিয়াল প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা এবং দেশী উদ্যোক্তাদের মূলধন নিয়ে ব্যাংকটির কার্যক্রম শুরু হয়। তখন এর অনুমোদিত মূলধনের পরিমাণ ছিল ৫০ কোটি টাকা এবং পরিশোধিত মূলধনের পরিমাণ ছিল ৬.৭৫ কোটি টাকা যা ক্রমশঃ বৃদ্ধি পেয়ে ২০০৩ সালের শেষ নাগাদ দাঁড়িয়েছে ১৯২.০০ কোটি টাকায়।

 

. পরিচালনা ব্যবস্থাপনা

 

ব্যাংকটি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্যে চব্বিশ সদস্য বিশিষ্ট একটি বোর্ড অব ডাইরেক্টরস রয়েছে। এর মধ্যে দেশী উদ্যোক্তা ও শেয়ার হোল্ডারদের প্রতিনিধি রয়েছেন ষোলজন এবং বিদেশী উদ্যোক্তাদের মধ্যে থেকে আটজন। ব্যাংকটি ইসলামী শরীয়াহর আলোকে পরিচালনার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠার বছরই দশ সদস্য বিশিষ্ট একটি শরীয়অহ কাউন্সিল গঠিত হয়। এদের মধ্যে রয়েছেন দেশের সাতজন প্রখ্যাত ফকীহ/আলিম এবং একজন করে প্রথিতযশা ব্যাংকার, অর্থনীতিবিদ ও আইনজীবি। বর্তমানে এই সংখ্যা তেরো জনে উন্নীত করা হয়েছে। দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও কার্যক্রম পরিচালনার জন্যে বোর্ড অব ডাইরেক্টরসের স্থানীয় সদস্যদের মধ্যে থেকে আটজনের সমন্বয়ে গটিত একটি ব্যবস্থাপনা কমিটি ও শরীয়াহ কাউন্সিলের সদস্য-সচিব ব্যাংকের দৈনন্দিন কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে নির্বাহের জন্যে নির্বাহী প্রেসিডেন্টকে সহযোগিতা করে থাকেন।

 

আইবিবিএল যেসব পদ্ধতিতে আমানত গ্রহণ করে থাকে সেগুলো হলো:

 

১. আল-ওয়াদিয়াহ চলতি আমানত

 

২. মুদারাবা সঞ্চয়ী আমানত

 

৩. মুদারাবা মেয়াদী আমানত

 

৪. মুদারাবা স্বল্পমেয়াদী আমানত

 

৫. মুদারাবা হজ্জ সঞ্চয় আমানত

 

৬. মুদারাবা বিশেষ সঞ্চয়ী (পেনশন) আমানত

 

এছাড়াও অতি সম্প্রতি চালু হয়েছে:

 

১. মুদারাবা মোহর সঞ্চয় আমানত

 

২. মুদারাবা বৈদেশিক মুদ্রা আমানত

 

৩. মুদারাবা মাসিক মুনাফা আমানত

 

৪. মুদারাবা ওয়াকফ ক্যাশ সঞ্চয় আমানত

 

আইবিবিএল তার মূলধন ও আমানত বিনিয়োগের সময়ে যে সমস্ত বিষয়ের প্রতি সতর্ক ‍দৃষ্টি দেয় তা বাস্তবিকই প্রশংসনীয়। এসবের মধ্যে রয়েছে:

 

ক) শরীয়াহ অনুমোদন;

 

খ) সামাজিক কাম্যতা;

 

গ) দ্রুত তারল্য;

 

ঘ) অধিক সংখ্যক গ্রাহক;

 

ঙ) নিরাপত্তার নিশ্চয়তা; এবং

 

চ) মুনাফার সম্ভাব্যতা

 

. কর্মপদ্ধতি

 

আইবিবিএল যে প্রক্রিয়া বা পদ্ধতিতে তার তহবিল বিনিয়োগ করে থাকে সেসবের উল্লেখ করা জরুরী। প্রসঙ্গতঃ মনে রাখা বাঞ্ছনীয় যে সূদী ব্যাংকগুলো যেমন নানা ধরনের সেবামূলক কাজের মাধ্যমে তার মোট আয়ের ৩০%-৩৫% উপার্জন করে থাকে (ইসলামের দৃষ্টিতে যা সম্পূরণতঃ হালাল বা বৈধ) ইসলামী পদ্ধতির ব্যাংকও সেই সমুদয় সেবামূলক কাজ করে অনুরপ পরিমাণ অর্থ আয় করতে সমর্থ। বাকী ৬৫%-৭০% আয়ের উদ্দেশ্য ইতিপূর্বে আলোচিত ইসলামী ব্যাংকের উপার্জন কৌশলের মধ্যে নীচের কর্মপদ্ধতিসমূহ অনুসৃত হয়ে থাকে। এগুলো হচ্ছে:

 

ক) মুরাবাহা

 

খ) মুশারাকা

 

গ) বায়-ই-মুয়াজ্জাল

 

ঘ) হায়ার পারচেজ আন্ডার শিরকাতুল মিলক

 

ঙ) ক্রয় ও নেগেশিয়েশন

 

চ) করযে হাসানা

 

আইবিবিএল এদেশের জনসাধারণের ইচ্ছা ও চাহিদার প্রতি নজর রেখে এবং প্রকৃত সামাজিক কল্যাণের কথা বিবেচনা করে নতুন কতকগুলো বিনিয়োগ কার্য়ক্রম গ্রহণ করেছে। এতগুলো কর্মসূচী বাংলাদেশে অন্য কোনও ব্যাংক আজ অবধি একসংগে গ্রহণ করেনি। ব্যাংকের গৃহীত প্রকল্পসমূহ ইতিমধ্যেই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। এসবের মধ্যে রয়েছে:

 

১. গৃহসামগ্রী বিনিয়োগ

 

২. গৃহনির্মাণ বিনিয়োগ

 

৩. পরিবহন বিনিয়োগ

 

৪. মোটরকার বিনিয়োগ

 

৫. ডাক্তার বিনিয়োগ

 

৬. ক্ষুদ্র ব্যবসায় বিনিয়োগ

 

৭. কৃষি-সরঞ্জাম বিনিয়োগ

 

৮. পল্লী উন্নয়ন

 

৯. মিরপুর রেশম বয়ন বিনিয়োগ

 

১০. ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প বিনিয়োগ

 

এসব বিনিয়েঅগ কার্যক্রম ছাড়াও আইবিবিএল সার্ভিস চার্জের (ফি ও কমিশন) বিনিয়োগ যেসব সেবামূলক কাজ করে হালালভাবেই উপার্জন করে থাকে সেগুলো হলো:

 

১. স্পষ্ট রেটে বৈদেশিক মুদ্রা ক্রয়-বিক্রয়;

 

২. ঋণপত্র খোলা;

 

৩. নিশ্চয়তাপত্র প্রদান;

 

৪. বাণিজ্যিক দলিলপত্র জামানাতের বিপরীতে স্বল্প মেয়াদী অর্থ সরবরাহ;

 

৫. ড্রাফট, চেক, প্রমিসারী নোট, বিল অব লেডিং ইত্যাদি সংগ্রহ ও অর্থ প্রদান;

 

৬. শেয়ার বিনিয়োগ সার্টিফিকেট, বন্ড প্রভৃতি ক্রয়-বিক্রয়;

 

৭. নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্যে কৃষি, রিয়েন্স এষ্টেট ও সেবামূলক প্রকল্পে সহায়তা প্রদান;

 

৮. এজেন্ট নিয়োগ ও এজেন্ট হিসেবে কাজ করে বাণিজ্যিক কার্যক্রম চালানো;

 

৯. সম্ভাব্য ঘাটতি পূরণের জন্যে সলিডারিটি ও সিকিউরিটি তহবিল গঠন; এবং

 

১০. প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইপত্র (Feasibility study) তৈরী এবং ফাইন্যান্সিয়াল, টেকনিক্যাল, অর্থনৈতিক, বিপণন ও ব্যবস্থাপা সম্পর্কিত পরামর্শ প্রদান।

 

. সাফল্য

 

আইবিবিএল তার মূলধন ও আমানতকারীদের অর্থ ইসলামী পদ্ধতিতে বিনিয়োগ করে বিগত কুড়ি বছরে কতটুকু সাফল্য অর্জন করেছে তা পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। বিশেষতঃ প্রচলিত সুদনির্ভর ব্যাংকিং পদ্ধতির বিপরীতে ইসলামী ব্যাংকের বিনিয়োগ কর্মকৌশল সম্পূর্ণ ভিন্ন হওয়ায় এই বিবেচনা আরও গুরুত্ববহ হয়ে দাঁড়ায়। নীচে পর্যায়ক্রমে শাখাবৃদ্ধি ও আমানত সংগ্রহ, বিনিয়োগ, আয় ও মুনাফা, পদ্ধতি ও খাতওয়ারী বিনিয়োগ, শাখাপিছু আয়, ব্যয় ও মুনাফা অর্জন, বৈদেশিক বাণিজ্যে অংশ গ্রহণ ও গৃহীত প্রকল্পসমূহের সাফল্য সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।

 

প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য আন্তর্জাতিকভাবে বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহের র‌্যাংকিং প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ইংল্যান্ডের Reed Information Services-এর ১৯৯৫ সালের জানুয়ারী মাসের র‌্যাংকিং অনুসারে পৃথিবীর প্রথম শ্রেণীর চার হাজার ব্যাংকের মধ্যে আইবিবিএল-এর স্থান ছিল ২৩১৪ তম। [The Banker’s Almanac January 1995, vol. 1-4, (Reed Info9rmating Services 1995, Winder Court, East Grinstead House, West sussex, England.] উপরন্তু, আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত CAMEL rating (অর্থাৎ, C=Capital বা মূলধন, A=Asset বা সম্পদ, M=Management বা ব্যবস্থাপনা, E-Efficiencey বা দক্ষতা, L=Liquidity বা তারল্য) অনুসারেও এই ব্যাংকের মান A+। এই সম্মান শুধু ব্যাংকটির জন্যেই নয় দেশের জন্যেও গৌরবের। উপরন্তু সম্প্রতি লন্ডন হতে প্রকাশিত বিশ্বখ্যাত অর্থনৈতিক ম্যাগাজিন The Global Finace তাদের প্রকাশিত সমীক্ষায় ১৯৯৯ ও ২০০০ সালের জন্যে আইবিবিএলকেই উপর্যপুরি বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ বা বাণিজ্যিক ব্যাংক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।

 

(i) শাখা বৃদ্ধি আমানত সংগ্রহ

 

সারণী-১ হতে দেখা যাবে প্রতিষ্ঠার বছরে ব্যাংকটি মাত্র তিনটি শাখা স্থাপনে সমর্থ হয়েছিল। ক্রমে শাখার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ছয় বছরের ব্যবধানে ১৯৮৯ সালে ৪০ এবং পরবর্তী ছয় বছরের ব্যবধানে ১৯৯৫ সালে ৯০টিতে উন্নীত হয়েছে। এই সংখ্যা ২০০৩ সালে বৃদ্ধি পেয়ে ১৪১এ পৌঁছেছে। একটি সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী ব্যাংকের পক্ষে ভিন্ন অর্থনৈতিক ও আইন কাঠামোর মধ্যে এভাবে শাখা বিস্তারে সফলতা লাভ নিঃসন্দেহে গৌরবময় ও তাৎপর্যবহ।

 

এই সরণী হতেই দেখা যাবে আইবিবিএলের আমানতের পরিমাণ ১৯৮৩ সালে ছিল ১৪.৪০ কোটি টাকা। এই পরিমাণ ২০০৩ সালের শেষ নাগাদ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৬৯৯৪.১৭ কোটি টাকায়। অনুরূপভাবে শাখাপিছু আমানতের পরিমাণ ১৯৮৩-তে ছিল ৪.৮০ কোটি আকা। ১৯৮৬ সালে এই পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ১২.২০ কোটি টাকায় (প্রায় ৩ গুণ বৃদ্ধি)। এরপর তা কমতে থাকে এবং ১৯৮৯ সালে ৮.৬৪ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। ১৯৯০ সাল হতে ধীরে ধীরে অবস্থার উন্নতি হতে থাকে এবং ২০০৩ সালে শাখাপিছু আমানত ৪৯.৬০ কোটি টাকায় পৌঁছায়। তুলনামূলক বিচারে আমানত সংগ্রহের পরিমাণ ও হার অবশ্যই সন্তোষজনক।

 

(ii) বিনিয়োগ

 

আইবিবিএলের ১৯৮৩ সালে বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল মাত্র ৫.৬০ কোটি টাকা। এক দশকের মাথায় এই পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে ১৯৯২-এ দাঁড়িয়েছে ৫১৬.৪০ কোটি টাকা। (সারণী-১ দ্রষ্টব্য)। এক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার ৯২ গুণেরও বেশী। শাখাপিছু গড় বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ১৯৮৩-তে ১.৮৭ কোটি টাকা। এই হার ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়ে ১৯৮৭ সালে সর্বোচ্চ ৮.৮৭ কোটি টাকায় উন্নীত হয়। কিন্তু এরপর ১৯৮৮ সালে এই পরিমাণ হ্রাস পেয়ে দাঁড়ায় ৭.৮৯ কোটি টাকায় এবঙ ১৯৮৯ সালে ৫.৮৯ কোটি টাকায়। এই অবস্থার উন্নতি হতে শুরু করে ২০০৩ সাল হতে এবং ২০০৩ সালে শাখাপিছু বিনিয়োগের পরিমাণ ৪১.৮৭ কোটি টাকায় পৌঁছায়। (সারণী-১ দ্রষ্টব্য)।

 

সারণী-১

 

ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লি.-এর আমানত ও বিনিয়োগ চিত্র: ১৯৮৩-২০০৩ (কোটি টাকায়)

 

বছর শাখার সংখ্যা আমানতের পরিমাণ শাখাপিছু আমানত বিনিয়োগের পরিমাণ শাখাপিছু বিনিয়োগ মোট আয় শাখাপিছু আয় মোট আয় শাখাপিছু ব্যয়
১০
১৯৮৩ ১৪.৪ ৪.৮০ ৫.৬ ১.৮৭ ০,৩৪ ০.১১ ০.৫৯ ০.১৯
১৯৮৪ ৬৩.৬ ৯.০৮ ৪৫.৮ ৬.৫৪ ৪.৫০ ০.৬৪ ৩.৭২ ০.৫৩
১৯৮৫ ১৩ ১৫৬.৪ ১২.০৩ ৯৪.৮ ৭.২৩ ১০.০২ ০.৭৭ ৯.১৩ ০.৭০
১৯৮৬ ১৮ ২২৩,০ ১২.৩৮ ১৪১.২ ৭.৮৪ ১৩.৬৭ ০.৭৫ ১৩.৬৬ ০.৭৫
১৯৮৭ ২১ ২৪২.০ ১১.৫২ ১৮০.৯ ৮.৬১ ১৮.০৭ ০.৮৬ ১৭.৩৪ ০.৮২
১৯৮৮ ২৭ ২৩৮ ১০.৪৬ ২১৩.২ ৭.৮৯ ২৩.২৯ ০.৮৬ ২০.২২ ০.৭৪
১৯৮৯ ৪০ ৩৪৫.৬ ৮.৮৪ ২৩৫.৮ ৫.৮৯ ২৮.৫৮ ০.৭১ ২৬.৩২ ০.৬৫
১৯৯০ ৪৯ ৪৪৬.৬ ৯.১০ ৩২৫.৩ ৬.৬৪ ৪৫.২২ ০.৯২ ৩১.১৭ ০.৬৩
১৯৯১ ৬১ ৫৬৭.২ ৯.৩০ ৪২৮.৩ ৭.০২ ৫৪.১৮ ০.৮৮ ৪৩.৬০ ০.৭১
১৯৯২ ৭১ ৬৭০.৪ ৯.৪৪ ৫১৬.৪ ৭.২৭ ৫২.৭০ ০.৭৪ ৫২.৭০ ০.৭৪
১৯৯৩ ৭৬ ৮২৬.১ ১০.৮৬ ৫৫৪.২ ৭.৮০ ৬২.২৮ ০.৮২ ৫৪.২৮ ০.৭১
১৯৯৪ ৮৩ ১০২২.৬ ১২.৩২ ৮০৭.৬ ৯.৭৩ ৮২.৬৫ ০.৯৯ ৬০.৩৯ ০.৭২
১৯৯৫ ৯০ ১২৬৬.৯ ১৪.০৭ ১১৫১.২ ১২.৭৯ ১০৯.৭৬ ১.২২ ৭৮.৬২ ০.৮৭
১৯৯৬ ৯৫ ১৪৩২.৯ ১০.০৮ ১৩৫৩.৯ ১৪.২৫ ১২৩.২৩ ১.২৯ ৯৪.৮৩ ০.৯৯
১৯৯৭ ১০০ ১৬৮৭.৪ ১৬.৮৭ ১৩০৯.৫ ১৩.০৯ ১৩৬.৮৭ ১.৩৬ ১১৯.৮০ ১.১৯
১৯৯৮ ১০৫ ২০০২.২ ১৯.০৭ ১৩৪৫.৫ ১২.৮১ ১৬২.৯৩ ১.৫৫ ১৪৮.০৯ ১.৪১
১৯৯৯ ১১০ ২৫১৯.০ ২২.৯০ ১৮২৮.৩ ১৬.৬২ ১৯৬.৬২ ১.৭৮ ১৭৮.৭৯ ১.৬০
২০০০ ১১৬ ৩২১১.৩ ২৭.৬৮ ২৭৪৭.১ ২৩.৬৮ ৩২০.৭৮ ২.৭৬ ২৮৭.৭৬ ২.৪৮
২০০১ ১২১ ৪১৫৪.৭ ৩৪.৩৪ ৩৫২৭.২ ২৯.১৫ ৪২৫.১৫ ৩.৫২ ৩৬৮.৩৪ ৩.০৪
২০০২ ১২৮ ৫৪৪৬.১ ৪৩.৩৩ ৪৬৩১.৫ ৩৬.১৮ ৫২৩.৪০ ৪.৪০ ৪২৪.০০ ৩.৩১
২০০৩ ১৪১ ৬৯৯৪.২ ৪৯.৬০ ৫৯০৪.২ ৪১.৮৭ ৬৮৭.১৩ ৪.৮৫ ৬০৩.৯৩ ৪.২৮

 

উৎস : ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিঃ-এর বার্ষিক প্রতিবেদনসমুহ

 

(iii) আয় মুনাফা

 

আয়ের বিবেচনার আইবিবিএলের এ যাবৎ মোট ফলাফল সন্তোষজনকই বলা যায়। শুরুর বছরে ব্যাংকটির মোট আয় ছিল ০.৩৪ কোটি টাকা যা ক্রামাগত বৃদ্ধি পেয়ে ২০০৩ সালে ৬৮৭.১৩ কোটি টাকায় পৌঁছায়। পক্ষান্তরে একই সময়ে মোট ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ৬০৩.৯২ কোটি টাকা। (সারণী-২ দ্রষ্টব্য)। শুরুর বছরে মোট আয়ের তুলনায় মোট ব্যয়ের বৃদ্ধি ছিল ১৭৩%। পরবর্তী বছরে ঐ হার কমে ৮৩%-এ দাঁড়ায়।

 

কোন ব্যাংকের সার্বিক সাফল্য বা কৃতকার্যতা বিচারের ক্ষেত্রে মুনাফা অর্জনে সাফল্য গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে আইবিবিএলকে অনেক চড়াই উৎরাই পার হতে হয়েছে। সারণী-২ হতে তার প্রমাণ পাওয়া যাবে।

 

সারণী-২ হতে দেখা যাচ্ছে শুরুর বছরটিতে ব্যাংক লোকসান দিয়েছে টাকা ২৫.০ লক্ষ। অবশ্য তার পরের বছর হতেই ব্যাংক মুনাফার মুখ দেখেছে এবং পরবর্তী বছরে তা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু ১৯৮৬ সালে এই মুনাফা হ্রাস পেয়ে মাত্র ১.০ লক্ষ টাকায় নেমে এসেছে। পরবর্তী বছরে তা আবার টাকা ৭৩.০ লক্ষে উন্নীত হয়েছে। মুনাফার অংক কোটি টাকা অতিক্রম করেছে ১৯৮৮ সালে। এই বছর আয়কর ও রিজার্ভপূর্ব মুনাফার পরিমাণ দাঁড়ায় ৩.০৭ কোটি টাকা। পরবর্তী বছরেই আবার মুনাফা হ্রাস পেয়েছে। ১৯৯২ সালে ব্যাংক কোন মুনাফাই অর্জন করেনি। কিন্তু আশ্চর্য হতে হয় যে পরবর্তী বছরেই অর্থাৎ ১৯৯৩ সালে ব্যাংকের অর্জিত মুনাফার পরিমাণ ছিল ৮.০কোটি টাকা। ২০০২ সালে ব্যাংক রেকর্ড পরিমাণ ‍মুনাফা করেছে- আয়কর ও রিজার্ভ- পূর্ব মুনাফার পরিমাণ ছিল ৯৯.৪০ কোটি টাকা। বারবার এই মুনাফা হ্রাসের কারণ হিসাবে কু-বিনিয়োগ অবলোপন, মুশারাকা খাতে লোকসান ও মেয়াদ উত্তীর্ণ বিনিয়োগ ও তার বিপরীতে মুনাফা না পাওয়া প্রভৃতি সমস্যাকে চিহ্নিত করা হয়েছে।

 

সারণী-

 

ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লি. –এর মুনাফা: ১৯৮৩-২০০৩ (কোটি টাকায়)

 

বছর মুনাফা/লোকসান বছর মুনাফা/লোকসান
১৯৮৩ (০.২৫) ১৯৯৪ ২২.২৬
১৯৮৪ ০.৭৮ ১৯৯৫ ৩১.১৪
১৯৮৫ ০.৮৯ ১৯৯৬ ২৮.৩৫
১৯৮৬ ০.০১ ১৯৯৭ ১৭.০৭
১৯৮৭ ০.৭৩ ১৯৯৮ ১৪.৮৪
১৯৮৮ ৩.০৭ ১৯৯৯ ১৭.৮৩
১৯৯০ ১৪.০৫ ২০০০ ৩৩.০২
১৯৯১ ১০.৫৮ ২০০১ ৫৭.৬১
১৯৯২ ০.০০ ২০০৩ ৮০.২০
১৯৯৩ ৮.০০    

 

উৎস: ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিঃ-এর বার্ষিক প্রতিবেদনসমূহ

 

সারণী-

 

ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিঃ-এর খাতওয়ারী পদ্ধতিভিত্তিক বিনিয়োগ : ১৯৯৬-২০০৩

 

বিনিয়োগ/বছর ১৯৯৬ ১৯৯৭ ১৯৯৮ ১৯৯৯ ২০০০ ২০০১ ২০০২ ২০০৩
খাত পরিমাণ % পরিমাণ % পরিমাণ % পরিমাণ % পরিমাণ % পরিমাণ % পরিমাণ % পরিমাণ %
বাণিজ্য ৬১৩.২৩ ৪৫.৩৬ ৪৮৫.৭২ ৩৭.১৫ ৪০৬.৩৯ ৩০.২৫ ১১৪০.২০ ৫৫.৩৯ ১১৬৬.২৮ ৪২.৬১ ১১৫২.৬১ ৩২.৭১ ১৭৫৩.৪০ ৩৭.৮৯ ২০৪৬.৪০ ৩৭.৮৯
শিল্প ৪৫৮.৮১ ৩৩.৪২ ৫৭০.৭০ ৪৩.৬৫ ৫৪১.৭৩ ৪০.৩২ ৪১৫.৩৪ ২০.১৮ ৯৮৪.৯৮ ৩৫.৯০ ১৫৭২.২০ ৪৪.৬১ ১৯৬৯.২৬ ৪২.৫৫ ২৪৪৮.০২ ৪১.৪৯
কৃষি ৭.৭১ ০.৫৭ ৫.৫৭ ০.৪৩ ১০.৪১ ০.৭৮ ১৩.৪০ ০.৪৯ ২৩৪.৪৮ ৬.৬৫ ২৩৫.০৫ ৬.৬৫ ২৩৫.০৫ ৫.০৮ ২২৩.৫২ ৩.৭৯
রিয়াল এস্টেট ৪৮.২৬ ৩.৫৭ ২৬.৩০ ২.০১ ৫৫.৭৮ ৪.১৫ ১৩৮.৬২ ৬.৭৪ ২৫০.৬২ ৮.৭৭ ২৫৭.৬০ ৭.৩১ ৩৫৮.১৭ ৭.৭৪ ৫২০.৪১ ৮.৮২
পরিবহন ৬৭.০৫ ৪.৯৬ ৪৬.৯৮ ৩.৫৯ ৫৪.৫৩ ৪.০৬ ৮৫.২৭ ৪.১৪ ১১২.০৯ ৪.০৮ ১৩৯.৭০ ৩.৯৬ ১৮৫.১০ ৪.৩০ ২৪৭.৫১ ৪.১৯
অন্যান্য ১৬৩.৭৭ ১২.১২ ১৭২.২৬ ১৩.১৭ ২৭৪.৬৫ ২০.৪৪ ২৬৫.৭২ ১২.৯১ ২২৬.৩৫ ৮.২৫ ১৬৭.১৭ ৪.৭৫ ১২৭.০০ ২.৭৪ ৪১৪.৪৯ ৭.০২
মোট ১০৫১.৮৩ ১০০.০০ ১৩০৭.৫৩ ১০০.০০ ১৩৪৩.৪৫ ১০০.০০ ২০৫৮.৪৬ ১০০.০০ ২৭৪৩.৭৩ ১০০.০০ ৩৫২৩.৭৭ ১০০.০০ ৪৬২৮.০৬ ১০০.০০ ৫৯০০.৭৫ ১০০.০০

 

পদ্ধতি
মুরাহাবা ৬৭৯.৭৫ ৫০.২৮ ৫৫৫.৯১ ৪২.৫১ ৫৩৯.৭৭ ৪০.১৮ ৮৩২.১০ ৪০.৪২ ১২০০.৩৯ ৪০.৭৫ ১৭১১.২৫ ৪৮.৫৬ ১৩৫২.২৯ ৫০.৮৩ ৩১১৩.৮৮ ৫২.৭৭
মুদারাবা - - - - - - ৫.২০ ০.২৫ ৪.২০ ০.১৯ ৪.২০ ০.১৫ ৫.২০ ৫.১১ ১০.২০ ০.১৭
মুশারাকা ৪২.৯৭ ৩.১৮ ৩৪.২১ ২.৬২ ২৮.৯৮ ২.১৬ ৪৮.৯২ ২.৩৮ ৪২.৮৯ ১.৫৬ ৩৪.৬২ ০.৯৮ ৩.৭০ ০.০৮ ১.২১ ০.০২
বায়-ই-মুয়াজ্জাল ১৪৭.৯৪ ১৮.৩৪ ২৬০.২০ ১৯.৯০ ২৮২.৫৯ ২১.০০ ৪০৬.১৭ ১৯.৭৩ ৪৪৭.৮৩ ১৬.০২ ৪৭৫.৩৫ ১০.৭০ ৪৯৬.৫৭ ১০.৭০ ৫৫১.২১ ৯.৩৪
হায়ার পারচেজ ২২৫.১৭ ১৬.৬৬ ২৬৮.১৩ ২০.৫১ ২৯০.৮৬ ২১.৬৫ ৫৩৮.৮০ ২৬.১৮ ৮৪৮.৬৮ ৩০.৯৭ ১০৬৬.৪০ ৩০.২৭ ১৪১৩.১৪ ৩০.৫৩ ১৮৩৬.৫১ ৩০.৬২
পারচেজ ও নেগোশিয়েশন ৯৭.৬৫ ৭.২২ ১২৬.১৮ ৯.৬৫ ১৩৮.৯০ ১০.৩৪ ১৬২.৩৯ ৭.৮৯ ১৩৩.৭০ ৪.৮৭ ১৩৮.৬১ ৩.৯৩ ১৮৬.৫২ ৪.০০ ঙ১৮০.১০ ৩.০৫
অন্যান্য ১৮.৩৫ ৪.৩২ ৬২.৯০ ৪.৮১ ৬২.৩৫ ৪.৬৪ ৭৩.০৭ ৩.৪০ ৬৯.২২ ২.৫৩ ৯২.৩১ ২.৬২ ১৭০.৬২ ৩.৬৯ ২৩৭.৫৯ ৪.০৩
মোট ৬৭৯.৭৫ ১০০.০০ ১৩০৭.৫০ ১০০.০০ ১০৪০.৪৫ ১০০.০০ ২০৫৮.৪৬ ১০০.০০ ২৭৪৩.৭৩ ১০০.০০ ৩৫২৩.৭৭ ১০০.০০ ৫৯২৮.০৬ ১০০.০০ ৫৯০০.৭৫ ১০০.০০

 

উৎস: ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিঃ-এর বার্ষিক প্রতিবেদনসমূহ।

 

(iv) পদ্ধতিভিত্তিক বিনিয়োগ

 

আইবিবিএল যে সমস্ত পদ্ধতিতে অর্থ বিনিয়োগ করেছে তার মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্ব পেয়েছে মুরাবাহা। বিগত পাঁচ বছর ধরে মোট বিনিয়োগের অর্ধেকেরও বেশী এই পদ্ধতিতেই করা হয়েছে। (সারণী-৩ দ্রষ্টব্য)। এর পরই দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করেরছে হায়ার পারচেজ বা ইজারা বিল-বায়ই পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে বিনিয়োগের পরিমাণ ক্রমশঃ বৃদ্ধি পেয়ে গত চার বছরে ৩০% এর ঊর্দ্ধে রয়েছে। তৃতীয স্থানে রয়েছে রায়-ই মুয়াজ্জাল পদ্ধতি। লক্ষণীয়, মুশারাকা পদ্ধতিতে বিনিয়োগের পরিমাণ খুবই নগণ্য, ২০০৩ সালে মাত্র ০.০২%। অথচ পদ্ধতি হিসাবে গুরুত্ব আরও বেশী হওয়া উচিৎ ছিল। মুদারাবার অবস্থাও তাই। ১৯৯৯ হতে শুরু করে ২০০৩ পর্যন্ত কোন বছরেই এর পরিমাণ ০.২৫% এর উর্দ্ধে ওঠেনি। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য, বিশ্বের অন্যত্র ইসলামী ব্যাংকসমূহ বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অন্যান্য যেসব পদ্ধতি অনুসরণ করেছে আইবিবিএল এখনও সেসব পদ্ধতি অনুসরণ করার জন্যে পদক্ষেপ নিতে পারেনি। উদাহরণস্বরূপ মুদারাবা, বায়-ই-সালাম, ইজারা ইত্যাদির উল্লেখ করা যেতে পারে।

 

(v) খাতভিত্তিক বিনিয়োগ

 

সারণী-৩ এ প্রদত্ত আইবিবিএল-এর খাতওয়ারী বিনিয়োগ বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে বিগত পাঁচ বছর ধরে শিল্পে বিনিয়োগ হয়েছে আমানতের সিংহভাগ-গড়ে ৪০%। পক্ষান্তরে বাণিজ্যে বিনিয়োগ হয়েছে মোট বিনিয়োগের এক-তৃতীয়াংশ। সেই তুলনায় কৃষি খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় সর্বনিম্নে, গড়ে ৪%। এই অবস্থা মোটেই কাংখিত হতে পারে না। দেশের জাতীয় আয়ের বৃহৎ অংশ এখনও আসে কৃষিখাত হতেই। মোট কর্মসংস্থানের বৃহৎ অংশ কৃষি খাতেই। অথচ ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের বিনিয়োগ পরিকল্পনায় সেই খাতটি তেমন গুরুত্ব পায়নি।

 

(vi) বৈদেশিক বাণিজ্য

 

বৈদেশিক বাণিজ্যে অংশ গ্রহণ করে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে গতিশীল করে তুলতে সহায়তা করে থাকে। একই সঙ্গে নিজেদের উপার্জন বৃদ্ধিরও সুযোগ করে নেয়। আইবিবিএল এক্ষেত্রেও স্বীয় যোগ্যতা সাফল্যের সাক্ষর রেখেছে। সারণী-৪ হতে বিগত আঠারো বছরের বৈদেশিক বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডে ব্যাংকের সাফল্যের একটি চিত্র পাওয়া যাবে। চিত্রটি নিঃসন্দেহে উজ্জ্বল। আমদানী ও রফতানী খাতে ব্যাংকের অংশ গ্রহণের পরিমাণ ক্রমাগত বেড়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রেমিট্যান্সও ১৯৯০ এর পর হতে বৃদ্ধি পেয়ে উল্লেখযোগ্য হারে। সারণীটি হতে আরও দেখা যায় যে, ১৯৯১ সালে মোট বৈদেশিক বাণিজ্য ও রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে ব্যাংককে অগ্রগ্রতি পূর্ববর্তী বছরের তুলনা। +৫২.৬৭% বেশী। অনুরূপভাবে ১৯৯৪ সালেও পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় অগ্রগতির পরিমাণ ছিল +৫০.৪২%। রফতানীর ক্ষেত্রে ব্যাংক ১০০০ কোটি টাকার মাত্রা অতিক্রম করেছে ১৯৯৫ সালে। এরপর প্রবৃদ্ধির হার ১৯৯৬ সালে হ্রাস পায়। অবশ্য পরবর্তী বছরেই ব্যাংক তা কাটিয়ে উঠতে সমর্থ হয়।

 

সারণী-

 

ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিঃ-এর বৈদেশিক বাণিজ্যে অগ্রগতি: ১৯৮৬-২০০৩ (কোটি টাকায়)

 

বছর আমদানী রফতানী রেমিট্যান্স মোট বৃদ্ধির হার (%)
১৯৮৬ ১৮০.০৬ ৬২.২৪ ১১৭.২৭ ৩৫৯.৫৭ -
১৯৮৭ ১৫৭.৮৫ ৯৭.১১ ১৪২.৪৬ ৩৯৭.৪২ +১০.৫৩
১৯৮৮ ২০১.৫৩ ১৩৪.৯৭ ১১২.৫৪ ৪৪৯.০৪ )১২.৯৯
১৯৮৯ ৩৩৯.৪৯ ১৫৪.৩৮ ৯০.১৬ ৫৮৪.০৩ +৩০.০৬
১৯৯০ ৩৯১.৭৭ ২৫৮.৮৩ ১৩৩.৯৯ ৭৮৪.৯৯ +৩৪.৪১
১৯৯১ ৬২০.৪২ ৩৯৬.৬৬ ১৮১.৪১ ১১৯৮.৪৮ +৫২.৬৭
১৯৯২ ৮৭৭.৮৫ ৪৯৪.৮৮ ২০২.৮৬ ১৫৭৫.৫৯ +৩১.৪৭
১৯৯৩ ৮৬১.২৭ ৫৮৪.১৬ ২৪০.২৫ ১৬৮৫.৫৯ +৬.৯৯
১৯৯৪ ১৪৬২.৩৪ ৭৭৯.০৪ ২৯৪.০৪ ২৫৩৫.৮৬ +৫০.৪২
১৯৯৫ ২১২১.৮৩ ১১০১.৫৭ ২৪৪.৭২ ৩৪৬৮.১২ +৩৬.৭৭
১৯৯৬ ১৭৮৭.৪৮ ১১৭৬.৬৪ ৩৩২.৮৩ ৩২৯৬.৯৫ -.৯৪
১৯৯৭ ১৭৩৭.০০ ১৪৪৬.৯৪ ৪৮০.৬০ ৩৬৬৪.৫৪ +১১.১৫
১৯৯৮ ২০২৩.৮৩ ১৪৮৯.৪৩ ৬৩৬.০৬ ৪১৪৯.৩২ +১৩.২২
১৯৯৯ ২০৩৯.৬০ ১৪৭৯.৮০ ৮৪১.৫০ ৪৩৬০.৯০ +৫.০৯
২০০০ ২৫৩২১.৭০ ১৬৮৮.৯০ ৭৬৪.৪০ ৪৯৮৬.০০ +১৪.৩৩
২০০১ ২৫৯০.৭০ ১৬০৮.২০ ৯৮৭.৯০ ৫১৮৬.৮০ +৪.০২
২০০২ ৩৩৭৮.৮০ ১৬৬৭.৩০ ১৪৬৭.০০ ৬৫১৩.১০ +২৫.৫৮
২০০৩ ৪৬২৩.৭০ ২১৭৩.৮০ ১৬৬৬.৮০ ৮৪৬৪.৩০ +২৯.৯৫

 

উৎস : ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিঃ-এর বার্ষিক প্রতিবেদনসমূহ।

 

(vii) প্রকল্প সাফল্য

 

পূর্বেই বলা হয়েছে, আইবিবিএল স্বল্প পুঁজির লোকদের সহায়তা করার উদ্দেশ্যে নতুন নতুন প্রকল্প গ্রহণ করছে। এসব প্রকল্প গ্রহণের ফলে একদিকে যেমন ব্যাংকের বিভিন্ন ধরনের মুদারাবা আমানতের অর্থ ব্যবহার করে মুনাফা অর্জনের সুযোগ হয়েছে, অন্যদিকে দেশে বিদ্যমান ব্যাপক বেকারত্ব দূর করে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির পথ উন্মুক্ত হয়েছে। ডাক্তার বিনিয়োগ প্রকল্প, ক্ষুদ্র ব্রবসায় বিনিয়োগ প্রকল্প, ক্ষুদ্র পরিবহন প্রকল্প, ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প বিনিয়োগ প্রকল্প এসবের প্রকৃষ্ট পরিচায়ক। কৃষি সরঞ্জাম বিনিয়োগ প্রকল্প ও গৃহসামগ্রী বিনিয়োগ প্রকল্প ইতিমধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।

 

(viii) পল্লী উন্নয়ন স্কীম

 

পল্লী জনগোষ্ঠীর দারিদ্র বিমোচন, গ্রামীন বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান, উদ্যোগী ব্যক্তিদের আত্মকর্মসংস্থান ও গরীব কৃষকদের ভাগ্য উন্নয়নের মাধ্যমে গ্রামীন অর্থনীনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে আইবিবিএল ফেব্রুয়ারী, ১৯৯৬ হতে পল্লী উন্নয়ন স্কীম চালু করেছে। িএই প্রকল্পের আওতায় ফসল উৎপাদন, মৎস্য চাষ, কৃষি ও সেচ যন্ত্রপাতি, রিকসা ভ্যানসহ বিভিন্ন গ্রামীন পরিবহন, হস্তচালিত অগভীর নলকূপ, উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণ, ক্ষুদ্র ব্যবসা ও পশুপালনসহ বিভিন্ন আয়বর্ধনমূলক খাতে সহজ শর্তে বিনিয়োগ সুবিধা দিচ্ছে। প্রাথমিকভাবে দেশের ১৮টি জেলায় ব্যাংকের ২০টি শাখার প্রতিটি দশ কিলোমিটার পরিসীমার মধ্যে এক বা একাধিক গ্রামকে আদর্শ গ্রামে রূপান্তরের পরিকল্পনা নিয়ে এই প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছিল। বর্তমানে এই পরিসীমা ষোল কিলোমিটারে উন্নীত করা হয়েছে। গ্রাম বাছাইয়ের সময় সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা, নিম্ন আয়ের লোকের সংখ্যাধিক্য ও কৃষি/অকৃষিখাতের বিদ্যমানতাকে বিবেচনা করা হয়। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধানতঃ বায়ই মুয়াজ্জাল ও হায়ার পারচেজ আন্ডার শিরকাতুল মিলক পদ্ধতিই বেশী ব্যবহৃত হচ্ছে।

 

ডিসেম্বর, ২০০৩ পর্যন্ত দেশের ৫০টি জেলার ১২৬টি থানার ৩,৭০০টি গ্রামে কর্মসূচীটি বিস্তৃত লাভ করেছে। ক্রমান্বয়ে দেশের সকল এলাকাতেই স্কীমটি পরিব্যাপ্তি লাভ করবে বলে ব্যাংকের পরিকল্পনা রয়েছে। এই স্কীমের আওতায় ডিসেম্বর, ২০০৩ পর্যন্ত ৫,৫১৪টি কেন্দ্রে ২৬,০৯৩টি গ্রুপ তৈরী হয়েছে যার মোট সদস্য সংখ্যা ১ লক্ষ ৩০ হাজারেরও বেশি। দেশের পল্লী এলাকায় কর্মরত অন্যান্য এনজিওর মতো আইবিবিএলও মহিলাদের আর্থিক স্বচ্ছলতা অর্জনের মাধ্যমে পারিবারিক ক্ষমতায়নের উপর গুরুত্ব প্রদান করেছে। তাই সদস্যদের মধ্যে মহিলারাই ৯৪%। এ পর্যন্ত পুঞ্জীভূত বিনিয়োগকৃত অর্থের পরিমাণ ২৯২.৩৬ কোটি টাকার বেশী। গৃহীত অর্থ পরিশোধের হারও খুবই সন্তোষজনক। অপরদিকে খেলাপী ঋণের পরিমাণ খুব নগণ্য-মাত্র ২%। অপরদিকে গ্রুপের সদস্যদের ব্যক্তিগত সঞ্চয়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৯.৮২ কোটি টাকা। অন্যান্য এনজিওর সাথে আইবিবিএল এর গ্রহীত স্তীমের দুটি বড় পার্থক্য রয়েছে: (i) সদস্য/সদস্যাদের ইসলামী জীবনাদর্শ আচরণের জন্যে তাগিদ দেয় এবং এজন্যে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণও দেয় এবং (ii) মঞ্জুরীকৃত অর্থের পুরোটাই সামগ্রী আকারে গ্রহীতা হতে পেয়ে থাকে, তা থেকে নানা তহবিলের নামে অংশবিশেষ আগেই কেটে রাখা হয় না।

 

(ix) সামাজিক কল্যাণ

 

প্রতিষ্ঠার পরপরই আইবিবিএল তার প্রদেয় যাকাতের অর্থ এবং যেসব আয় সন্দেহজনক সেসবের সমন্বয়ে ‘সাদাকাহ তহবিল’ নামে একটি দাতব্য তহবিল গঠন করে। এই তহবিল হতে আর্ত-মানবতার সেবা এবং বঞ্চিত ও অভাবগ্রস্ত মানুষের কল্যাণের লক্ষ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। ক্রমান্বয়ে এর কার্যক্রমের পরিধির বিস্তৃতি ঘটলে ১৯৯১ সালের মে মাসে একে একটি ফাউণ্ডেশনে রূপান্তরিত করে ‘ইসলামী ব্যাংক ফাউণ্ডেশনের’ সৃষ্টি হয়। সেই থেকে এটি স্বতন্ত্র হিসাব ও ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হয়ে আসছে। এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো আর্তমানবতার সেবা, গণমুখী ও সার্বজনীন শিক্ষা সম্প্রসারণ, আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সুবিধা সম্প্রসারণ, শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি ক্রীড়া বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিকাশ, ইসলামী মতাদর্শের প্রচার, প্রসার ও গবেষণামূলক কর্মকাণ্ডের উৎসাহ দান এবং মানব সম্পদ উন্নয়ন।

 

ফাউন্ডেশনের আয়ের উৎস নিম্নরূপ:

 

১. আইবিবিএল এর নিজস্ব যাকাত;

 

২. ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠান প্রদত্ত যাকাত;

 

৩. ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠান প্রদত্ত অনুদান;

 

৪. শরীয়তের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ সুদমুক্ত নয় এমন আয়; এবং

 

৫. ফাউন্শেনের নিজস্ব প্রকল্প থেকে আয়।

 

ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম বহুমুখী। সেগুলোকে কয়েকটি বড় গ্রুপে ভাগ করা যায়। যেমন:-

 

(ক) আয়বর্ধনমূলক কার্যক্রম: এর মধ্যে রয়েছে ভিখারীর হাতকে কর্মীর হাতিয়ারে পরিনত করার উদ্দেশ্যে, রিক্সা, সেলাই মেশিন, হাঁস-মুরগী বিতরণ, গাভী পালন, আত্মকর্মসংস্থান, ক্ষুদ্র শিল্প প্রতিষ্ঠায় আর্থিক সহযোগিতা প্রদান।

 

(খ) শিক্ষামূলক কার্যক্রম: অশিক্ষার অভিশাপ থেকে আমাদের জনগোষ্ঠীকে বিশেষতঃ দরিদ্র জনসাধারণকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে ফাউন্ডেশান তার সীমিত সামর্থ্যের মধ্যে আদর্শ ফোরকারনিয়া মক্তব পরিচালনা, দরিদ্র ও মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের জন্যে শিক্ষা বৃত্তি প্রদান, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সহায়তা দান, ক্ষেত্রবিশেষে ছাত্র-ছাত্রীদের এককালীন সাহায্য দান কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে।

 

(গ) স্বাস্থ্য ও ‍চিকিৎসা কার্যক্রম: বাংলাদেশের অধিকাংশ লোকই স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও চিকিৎসার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। এই অবস্থার প্রেক্ষিতে সীমিত সামর্থ্যের মধ্যে ফাউন্ডেশন দাতব্য চিকিৎসালয়ে সহায়তাদান কর্মসূচী। চিকিৎসার জন্যে এককালীন আর্থিক সাহায্য প্রদান, নলকূপ স্থাপন এবং স্যানেটারী পায়খানা নির্মাণের মতো গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচী চালিয়ে যাচ্ছে।

 

(ঘ) মানবিক সাহায্য দান কার্যক্রম: দুঃস্থ ব্যক্তি যারা খাদ্য বস্ত্র বাসস্থানের মতো অপরিহার্য মৌলিক চাহিদা পূরণের অসমর্থ তাদের তাৎক্ষণিক সম্ভাব্য সাহায্য করার উদ্দেশ্যে এই কর্মসূচী পরিচালিত হচ্ছে। ঋণগ্রস্তদের ঋণপরিশোধ, কন্যাদায়গ্রস্তদের এককালীন সহায়তা প্রদান এবং ইয়াতীমখানা নির্মাণ ও পরিচালনাও এই কর্মসূচীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক।

 

(ঙ) ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম: বন্যা, ঘুর্ণিঝড়, খরা, জলোচ্ছ্বাস প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় ফাউন্ডেশন তার সামর্থ অনুায়ী ত্রাণকাজ পরিচালনা করে থাকে। নদী ভাঙ্গন ও অগ্নিকাণ্ডসহ অন্যান্য দুর্যোগেও ফাউন্ডেশন ত্রাণ তৎপরতা গ্রহণ করে। অধিকন্তু ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনার জন্যে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলসহ বিভিন্ন সংস্থাকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ আর্থিক অনুদান প্রদান করে থাকে ফাউন্ডেশন।

 

(চ) দাওয়াহ কার্যক্রম: এই কর্মসূচীর আওতায় দেশের বুদ্ধিজীবী মহলসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের বিশিষ্ট ব্যক্তিাদের মধ্যে গবেষণাধর্মী ইসলামী পত্র-পত্রিকা ও বই বিতরণ করা হয়। মাদরাসা ও মসজিদ নির্মাণ ও সংস্কারের সহায়তাদান, জাতীয় পুনর্গঠন কাজে নিয়োজিত বিভিন্ন সংস্থার অনুদান প্রদান এবং অডিও-ভিজ্যুয়াল পদ্ধতিতে দাওয়াহ কার্যক্রমের সম্প্রসারণে সাহায্য করাও এই কর্মসূচীর আওতাভুক্ত।

 

(ছ) বিশেষ প্রকল্প: ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশনের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে কয়েকটি বিশেষ প্রকল্পও পরিচালিত হচ্ছে। যথা:

 

১. ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল ও মেডিক্যাল কলেজ: মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত রোগীদের স্বল্প ব্যয়ে চিকিৎসা সুবিধা প্রদানের উদ্দেশ্যে ঢাকাতে ১৯৯৩ সালের এপ্রিল মাসে ৬০ শয্যাবিশিষ্ট এই হাসপাতা চালু করা হয়। পরবর্তীতে ঢাকাতে আরও একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। এখানে দিবা-রাত্রি জরুরী সেবা প্রদানের ব্যবস্থা রয়েছে। আধুনিক চিকিৎসা ও রোগ নির্ণয়ের সুযোগ্র ক্রমেই সম্প্রসারিত হচ্ছে। এছাড়া রাজশাহীতে ১৯৯৬ সালে এবং খুলনায় ১৯৯৯ সালে এবং ২০০১ সালে বরিশালে একই মানের আরও তিনটি ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সাতক্ষীরা, মানিকগঞ্জ ও রংপুরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কম্যুনিটি হাসপাতাল। পর্যায়ক্রমে দেশের অন্যান্য বিভাগীয় শহর ও জেলা শহরসমূহে এই সেবা সম্প্রসারণের পরিকল্পনা রয়েছে। এরই পাশাপাশি চিকিৎসা শিক্ষা সম্প্রসারণের জন্যে রাজশাহীতে একটি পূর্ণাংগ মেডিক্যাল কলেজও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ব্যাংক ফাউন্ডেশনের উদ্যোগেই এবং ২০০৩-২০০৪ শিক্ষাবর্ষে পাঠদান কার্যক্রমও শুরু হয়েছে।

 

২. ইসলামী ব্যাংক টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট: বেকার সমস্যা সমাধান ও দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ঢাকায় দুটি বগুড়া চট্টগ্রাম ও সিলেটে একটি করে বৃত্তিমূলক কারিগরী প্রশিক্ষণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছে ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশন। বাংলাদেশ সরকারের কারিগরী শিক্ষাবোর্ডের অনুমদোনক্রমে এগুলো পরিচালিত হচ্ছে। প্রাথমিক পর্যায়ে এখানে কম্পিউটার ট্রেনিং, সেক্রেটারিয়াল সায়েন্স, ইলেকট্রোনিক্স, ইন্ডাষ্ট্রিয়াল স্যুয়িং মেশিন অপরেশেন, িএয়ারকণ্ডিশনিং ও রেফ্রিজারেশান, মোটর ড্রাইভিং, রেডিও ও টেলিভিশন রিপেয়ারিং, পেইন্টিং প্রভৃতি ট্রেড কোর্সে প্রশিক্ষণ দেওযা হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে এই ইনস্টিটিউটকে মানব সম্পদ উন্নয়ন কেন্দ্রে পরিণত করার কর্মসূচী রয়েছে।

 

৩. মনোরম: মহিলাদের আত্মনির্ভরশীল করার জন্যে তাদের ঘরে তৈরি এমব্রয়ডারী করা ও নানা ডিজাইনের পোশাক-পরিচ্ছদ ও নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী বাজারজাতকরণের উদ্দেশ্যে এই প্রকল্প গৃহীত হয়েছে। এর আওতায় ইতিমধ্যে ঢাকায় একটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বিপণী কেন্দ্র চালু হয়েছে।

 

৪. বিবিধ: এছাড়া ইসলামী আদর্শে চরিত্র গঠনের উদ্দেশ্যে ১৯৯৯ সালে ঢাকায় ‘ইসলামী ব্যাংক মডেল স্কুল ও কলেজ’ নামে একটি ইংরেজী মাধ্যম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছে। একই মানের একটি বাংলা মাধ্যম প্রতিষ্ঠান ২০০০ সালের মধ্যে স্থাপনেরও উদ্যোগ গৃহীত হয়েছে। এছাড়া বিকলাঙ্গদের জন্যে ঢাকার কাকরাইলের ইসলামী ব্যাংক ফিজিওথেরাপী ও বিকলাঙ্গ পুনর্বাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছে এবং জাতীয় ঐতিহ্য এবং ইসলামী মূল্যবোধে উজ্জীবিত উন্নয়নকর্মীদের জন্যে ‘সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট ডায়ালগ’ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ হাতে নিয়েছে। অধিকন্তু (১) ঢাকা ও রাজশাহীতে বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র (২) কুরআন শরীফ শুদ্ধ পাঠ প্রশিক্ষণের জন্যে ‘তালীমুল কুরআন প্রজেক্ট’, (৩) ঢাকার মীরপুরে দুঃস্থ মহিলা পুনর্বাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা এবং (৪) মামলার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্তদের আইনের সহায়তা প্রদানের উদ্দেশ্যে ‘লিগ্যাল এইড প্রজেক্ট’-িএর মতো কর্মসূচীও ব্যাংক ফাউন্ডেশনের অর্থানুকূল্যে পরিচালিত হয়ে আসছে।

 

ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশন ১৯৯২ সালে উপরোক্ত খাতসমূহে তার তহবিল হতে ব্যয় করেছে ১.০২ কোটি টাকা, ১৯৯৩ সালে ১.৯৪ কোটি টাকা, ১৯৯৪ সালে ২.৩৯ কোটি টাকা, ১৯৯৫ সালে ২.৫০ কোটি টাকা, ১৯৯৬ সালে ২.৬৮ টাকা, ১৯৯৭ সালে ৪.২৯ কোটি টাকা এবং ১৯৯৮ সালে ৫.৭৯ কোটি টাকা, ২০০ সালে ২৯.৬০ কোটি টাকা, ২০০১ সালে ১০.০৫ কোটি টাকা, ২০০২ সালে ৭.৯২ টাকা এবং ২০০৩ সালে এর পরিমাণ ছিল ১০.৬৩ কোটি টাকা। এসব উদ্যোগ গ্রহণের ফলে গ্রাম পর্যায়ে অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা ও বিনামূল্যে চিকিৎসালাভের পাশাপাশি আয়বর্ধনমূলক কর্মকাণ্ড সমাজের দরিদ্র ও মন্দভাগ্য লোকদের জীবনে স্বস্তি ও নিরাপত্তার পরিবেশ সৃষ্টিতে সমর্থ হয়েছে। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ করা যেতে পারে দেশের সুদভিত্তিক বানিজ্যিক ব্যাংকসমূহ আজও এ ধরনের উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে আসতে পারেনি।

 

(x) তথ্য সেবার আধুনিকায়ন

 

আইবিবিএল তথ্য ও সেবার সর্বোচ্চ মান বজায় ও উন্নয়নকল্পে অব্যাহত প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। এই উদ্দেশ্যে পৃথক ইনফরমেশন টেকনোলজি বিভাগ স্থাপন করেছে। সকল শাখাকে কম্পিউটার সজ্জিত করে Local Area Network (LAN) এর আওতায় আনা হয়েছে। এছাড় প্রবর্তিত হয়েছে Integrated Masseging System (IMS)। বালাদেশ E-cash, ATM Network এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্যও আইবিবিএল। ব্যাংক তার নিজস্ব ওয়েবসাইট তৈরী করেছে এবং ১৯৯৯ সাল থেকে সুইফটেরও (Society for Worldwide Inter-Bank Financial Telecommunication) সদস্য রয়েছে। কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সময়মতেহা উপস্থিতি নিশ্চিত করতে প্রধান অফিসে স্থাপিত হয়েছে Automated Time Attendance System (ATAS)। ব্যাংকের নানা ধরনের হিসাব ও প্রকল্প সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা ও তদারকির জন্যে নিজস্ব সফটওয়্যার তৈরীর প্রয়াস অব্যাহত রয়েছে।

 

(xi) ইসলামী ব্যাংক ট্রেনিং এ্যান্ড রিসার্চ একাডেমী

 

আইবিবিএল একদল সুদক্ষ ও সুযোগ্য কর্মী বাহিনী গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে কার্যক্রম শুরুর বছরেই প্রতিষ্ঠা করেছে ইসলামী ব্যাংক ট্রেনিং এ্যান্ড রিসার্চ একাডেমী (IBTRA)। বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং ও ফাইন্যান্স সম্বন্ধে বিস্তারিত জানার ও হাতে কলমে প্রশিক্ষণ প্রদানের কোন প্রতিষ্ঠান ছিলনা। উপরন্তু প্রচলিত সুদী ব্যাংক হতে আগ্রহী ও দক্ষ ও সিনিয়র অফিসারদরে রিক্রুট করতে হয় সঙ্গত কারণেই। একই সঙ্গে রিক্রুটকৃত অফিসার ও কর্মীদের ইসলামী জীবনাদর্শ সম্পর্কে সম্যক ধারণা প্রদানের পাশাপাশি ইসলামী অর্থনীতি, ফাইন্যান্স ও ব্যাংকিং এবং বাণিজ্যনীতি ও কর্মকৌশল বিষয়ে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ প্রদান একাডেমীর মুখ্য লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। উপযুক্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ভিন্নধর্মী এই ব্যাংকের জন্যে যোগ্য ও দক্ষ জনশক্তি গঠনের উদ্দেশ্যে নিয়মিত ট্রেনিং কর্মসূচী, ওয়ার্কশপ, এক্সিকিউটিভ ডেভেলপমেন্ট কোর্স পরিচালনা ছাড়াও ঢাকাস্থ বিভিন্ন বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা, রাজশাহী ও চট্টগাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স ও ব্যাংকিং বিভাগ, মার্কেটিং এবং ব্যবস্থাপনা বিভাগের মাস্টার্স শেষ বর্ষের ছাত্র-ছাত্রীদের ইন্টার্নশীপ পোগ্রামও একাডেমী পরিচালনা করে আসছে। সেই সাথে একটি সমৃদ্ধ লাইব্রেরী তৈরী ও গবেষণার প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা প্রদানের জন্যেও সযত্ন প্রয়াস অব্যাহত রয়েছে। একাডেমীটির নিজস্ব গবেষণা-প্রকাশনাও রয়েছে।

 

(xii) জনসংযোগ উদ্বুদ্ধকরণ

 

বাংলাদেশের ইসলামপ্রিয় জনগণের কাছে আইবিবিএল-এর গৃহীত কর্মসূচী পৌঁছে দেওয়ার পাশাপাশি সুদের কুফল ও মারাত্মক পরিণতি সম্বন্ধে তাদের অবহিত করার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠার পর হতেই ব্যাংকটির ব্যাপক জনসংযোগ ও উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচী গ্রহণ করে চলেছে। এই সব উদ্যোগের মধ্যে রয়েছে বই-পুস্তিকা প্রকাশ, সেমিনার-সিম্পোজিয়ামের আয়োজন, ইফতার মাহফিল, সুধী সমাবেশ ও জার্নাল প্রকাশ।

 

ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিঃ-এর প্রথম প্রকাশিত বই ইসলামী ব্যাংক কি ও কেন? দেশব্যাপী ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল। এ পর্যন্ত বইটির দুইটি সংস্করণ (১৯৮৩ ও ১৯৮৪) প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া জনগণকে যাকাত প্রদানে উদ্বুদ্ধ করার জন্যে প্রকাশিত হয়েছে যাকাত কি ও কেন? পুস্তিকা (১৯৯২, ৬ষ্ঠ সং ২০০২)। ব্যাংক তার কার্যক্রমের বিভিন্ন দিক ও সাফল্যের বিবরণ জানাবার জন্যে প্রকাশ করেছে অগ্রগতির দুই বছর (১৯৮৫), ইসলামী ব্যাংকিং: সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত (১৯৮৬), ইসলামী ব্যাংকের পল্লী উন্নয়ন প্রকল্প (১৯৯৭), অগ্রগতির আট বছর (১৯৯১), ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশন: জনকল্যাণমূলক কার্যক্রম (১৯৯২), এবং হাজীদের সুবিধার্থে জিয়ারতের বায়তুল্লা (১৯৮৪, ৭ম সং ১৯৯৯), ইসলামী ব্যাংকিং: একটি উন্নততর ব্যাংক ব্যবস্থা (১৯৯৬), আদর্শ জীবন গড়ার প্রথম পাঠ (১৯৯৮) এবং ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড পরিচিত (২০০১) এবং ইসলামী ব্যাংকিং: মাসায়েল ও ফতওয়া ১৯৮৩-২০০১ (২য় সং ২০০৩)। ইংরেজীতে প্রকাশ করেছে Garments (n.d), Investment and Trade Opportunities in Bangladesh (1998), Islamic Band: on Road to Progress (1992), A Decade of Progress (1994), An Era of Progress (1995), Islami Bank Foundation : Welfare Programmes (1992, 1994, 1999), Rural Development Scheme (1992), Islami Bank : 16 Years of Progress (1999), Islami Bank : 18 Years of Progress (2001) প্রভৃতি তথ্য ও চিত্রসমৃদ্ধ পুস্তিকা। এছাড়া ব্যাংকের গৃহীত বিভিন্ন প্রকল্পের বিবরণ ও কর্মপদ্ধতি সম্বন্ধে জনসাধারণকে ওয়াকিফহাল করার জন্যে প্রকাশকরে চলেছে সুদৃশ্য ও তথ্যসমৃদ্ধ চাররঙা পরিচি৬তপত্র। উপরন্তু ইসলামী ব্যাংকিং শীর্ষক একটি তথ্য সমৃদ্ধ ও গবেষণাধর্মী জার্নাল, Islami Bank Newsletter এবং ইসলামী ব্যাংক পরিক্রমা নামে একটি ঘরোয়া ত্রৈমাসিক প্রত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে ব্যাংকের জনসংযোগ বিভাগ হতে।

 

আইবিবিএল বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সেমিনারেরও আয়োজন করেছে। এর মধ্যে ‘ইসলামী ব্যাংক ও বীমা’ (১৯৮৯), ‘ইসলামী কমন মার্কেট’ (১৯৯৩) এবং ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক ও ইসলামিক ইকোনমিকস্‌ রিসার্চ ব্যুরোর সাথে যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত Financial Mabagement in an Islamic Perspective, 2004 খুবই সফ ও ‍গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হয়েছে। এছাড়া ইসলামিক ইকোনমিকস রিসার্চ ব্যুরোর সহযোগিতায় রাজধানী ছাড়াও দেশের বিভাগীয় ও প্রধান জেলা শহরে কুড়িটিরও বেশী আঞ্চলিক সেমিনারের আয়োজন করেছে ১৯৯৩-১৯৯৫ সালে। জনাকীর্ণ এই সব সেমিনার দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অর্থনীতিবিদ ওলামাযে কেরাম ইসলামী ব্যাংক ব্যবস্থা তথা ইসলামী অর্থনীতির শ্রেষ্ঠত্ব ও সামাজিক কল্যাণমুখী দিকগুলো বিশদভাবে উপস্থাপন করেন। এই ধারা অব্যাহত রয়েছে।

 

প্রতি বছর বিশেষ গ্রাহক সমাবেশের আয়োজন ছাড়াও পবিত্র মাহে রমজানে আইবিবিএল এর সকল শাখায় আয়োজিত ইফতার মাহফিলে বক্তৃতা ও আলোচনার মাধ্যমে জনসাধারণের কাছে ইসলামী অর্থনীতি ও ফাইন্যান্স ব্যবস্থার শ্রেষ্ঠত্ব ও কল্যাণকর দিকগুলো তুলে ধরার ধারাবাহিক প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছে। এসব কর্মকাণ্ডের ফলে জনমনে যে বিপুল উদ্দীপনার সৃষ্টি হয় তারই ফলে ব্যাংকের শাখা বিস্তারের জন্যে গণদাবী উঠে। এজন্যেই ১৯৮৮ সালের ২৭টি শাখা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়ে পনের বছরের মধ্যে ২০০৩ সালে ১৪১-এ পৌঁচেছে। েইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের এই জনসংযোগ ও উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচীর ফলেই দেশে অন্যান্য ইসলামী ব্যাঙক প্রতিষ্ঠা বহুলাংশে সহজ হয়ে যায়। খুব অল্প দিনের ব্যবধানে দু-দুটি ইসলামী ব্যাংকের আত্মপ্রকাশ এবং একটি পুরোপুরি সুদী ব্যাংকের রাতারাতি ইসলামী ব্যাংকে রূপান্তর (এক্সিম ব্যাংক) এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

 

. আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড

 

প্রতিষ্ঠা

 

আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক লিমিডেট (এআইবিএল) প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮ই জুন, ১৯৯৫। তবে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয় ২৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৫। প্রতিষ্ঠার পর পরই ব্যাংকটি দেশের জনগণের মধ্যে সাড়া জাগাতে সমর্থ হয়েছে। এর অনুমোদিত মূলধনের পরিমাণ ১০০ কোটি টাকা। ব্যাংকটি যাত্রা শুরেু করে ১০ কোটি ১২ লক্ষ টাকার পরিশোধিত মূলধন নিয়ে। ২০০৩ সালে এই পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে ৫০ কোটি ৬০ লাখ টাকার পৌঁচেছে।

 

পরিচালনা ব্যবস্থাপনা

 

ব্যাংকের বোর্ড অব ডাইরেক্টরসের বর্তহমান সদস্য সংখ্যা ২৬। এরা সকলেই বাংলাদেশী। ইসলামী শরীয়াহ পালনের নিশ্চয়তা বিধানের উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠার সময় হতেই সাত সদস্য বিশিষ্ট একটি শরীয়াহ কাউন্সিলও গটিত হয়েছে। এদের মধ্যে রয়েছেন দেশের পাঁচজন প্রখ্যাত ফকীহ/আলিম এবং এজজন করে ব্যাংকার ও আনজ্ঞ।

 

কার্যপদ্ধতি

 

আইবিবিএল যেসব পদ্ধতিতে আমানত গ্রহণ ও বিনিয়োগ করে থাকে এই ব্যাংকটিও সেসব পদ্ধতি অনুসরণ করে থাকে। এছাড়াও মাসিক মুনাফা প্রদানভিত্তিক পাঁচ বছর মেয়াদী মুদারাবা আমানত, এককালীন হজ্জ্ব আমানত, মাসিক জমাভিত্তিক মেয়াদী সঞ্চয় আমানত ও বিবাহ সঞ্চয় আমানত নামে আরও কয়েক ধরনের আমানত গ্রহণ করে থাকে।

 

এআইবিএল তার মূলধন ও আমানতের মাধ্যমে সংগৃহীত তহবিল বিনিয়োগের উদ্দেশ্যে তার পূর্বসূরী আইবিবিএল অনুসৃত ইসলামী শরীয়াহভিত্তিক পদ্ধতিগুলো অনুসরণ করে থাকে। উপরন্তু আয়বর্ধন কর্মকাণ্ডসহ অর্থনীতির সকল দিককে আওতায় আনার উদ্দেশ্যে নতুন নতুন স্কমি গ্রহণ করে চলেছে। সীমিত আয়ের লোক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আয়বর্ধনমূলক কর্মকাণ্ডে অগ্রগতির উদ্দেশ্যে ব্যাংক নীচের প্রকল্পসমূহ চালু করেছে:

 

১) কাংখিত সামগ্রী বিনিয়োগ

 

২) ক্ষুদ্র ব্যবসায় বিনিয়োগ

 

৩) পরিবহন বিনিয়োগ

 

৪) বিশেষ পল্লী বিনিয়োগ

 

এসব বিনিয়োগ কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি ব্যাংকটি এদেশের মাদরাসা শিক্ষতিদের, মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিনদের, দ্বীনদার এবঙ আলেমদের জন্যে বিশেষ বিনিয়োগ প্রকল্প গ্রহণ করেছে। প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থায় এরা অবহেলিত ও অনাদৃত। এদেশে কর্মরত এনজিও গোষ্ঠী এবং অন্যান্য সাহায্যকারী সংস্থাগুলো মাদরাসাশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর প্রতি কোন দিন নজর দেয়নি। এর প্রতিবিধানের উদ্দেশ্যে এআইবিএল মাদরাসা শিক্ষিত লোকদের জন্যে সুবিধাজনক শর্তে বিশেষ বিনিয়োগ কর্মসূচী গ্রহণ করেছে।

 

সাফল্য

 

এআইবিএলের কার্যকাল আট ব ছরের কিছু বেশী। এত স্বল্প সময় কোন ব্যাংকেরই কার্যক্রম মূল্যায়নের জন্যে যথেষ্ট নয়। তাই এখানে শুধু মাত্র তার কর্মকাণ্ডের সংক্ষিপ্ত চিত্র তুলে ধরা হ লো।

 

. শাখা বৃদ্ধি আমানত সংগ্রহ

 

সারণী-৫ হতে দেখা যাবে প্রতিষ্ঠার বছরেই ব্যাংক পাঁচটি শাখা খুলতে সমর্থ হয়েছিল। পরবর্তী বছরে সেই সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে দ্বিগুণ হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধির হার ১০০%। তার পরবর্তী বছরেও অর্থাৎ ১৯৯৭ সালের প্রবৃদ্ধির হার একই ছিল- শাখার সংখ্যা ১০ হতে ২০-এ উন্নীত হয়েছে। এই সংখ্যা ১৯৯৮ সালে ৩০-এ পৌঁচেছে। প্রতিকূল পরিবেশে ভিন্নধর্মী আদর্শের একটা ব্যাংকের এই দ্রুতগতি শাখা বিস্তার নিঃসন্দেহে তার শক্তিমত্তা ও সাফল্যের পরিচায়ক। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য প্রতিষ্ঠার প্রথম চার বছরে আইবিবিএল-এর শাখার সংখ্যা ছিল মাত্র ১৮। অবশ্য দীর্ঘ পনের বছর ধরে আইবিবিএলের ব্যাপক জনসংযোগ, সাফল্য ও প্রেরণাই যে এআইবিবিএল-এর এই সম্প্রসারণের ভিত রচনা করে রেখেছিল তা স্বীকার করতেই হবে। ১৯৯৫ সালে ব্যাংকটির আমানতের পরিমাণ ছিল ২০.১৪ কোটি টাকা। ২০০৩ সালে এই পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে ৮৬৪.৩২ কোটি টাকায় পৌঁচেছে।

 

সারণী-

 

আল আরাফা ইসলামী ব্যাংক লি.-এর আমানত বিনিয়োগের চিত্র: ১৯৯৫-২০০৩ (কোটি টাকায়)

 

বছর শাখার সংখ্যা আমানতের পরিমাণ শাখাপিছু আমানত বিনিয়োগের পরিমাণ শাখাপিছু বিনিয়োগ মোট আয় শাখাপিছু আয় মোট ব্যয় শাখাপিছু ব্যয়
১০
১৯৯৫ ২০.১৪ ৪.০২ ১.২৪ ০.২৪ ০.১৩ ০.০২ ০.৩৩ ০.০৬
১৯৯৬ ১০ ১০৩.৫৬ ১০.৩৫ ৭৭.৯২ ৭.৭৯ ৫.০৯ ০.৫০ ৪.৬২ ০.৪৬
১৯৯৭ ২০ ২২৫.৬৬ ১১.২৮ ১৭৪.৫৫ ৮.৭৩ ১৯.৬২ ০.৯৮ ১২.৮৯ ০.৬৪
১৯৯৮ ৩০ ৪৫৩.৪৭ ১৫.১২ ২২৫.৯৮ ৭.৫৩ ৩২.২৯ ১.০৭ ২৪.০৯ ০.৮০
১৯৯৯ ৩৫ ৬৪১.৫৮ ১৮.৩৩ ৩৩০.৬৪ ৯.৪৭ ৫৩.৪৭ ১.৫৩ ৪৬.৪৩ ১.৩৩
২০০০ ৩৭ ৭৩০.৯১ ১৯.৬৯ ৫০৭.৯২ ১২.৬৯ ৮০.০৩ ২.০০ ৬৭.৮৮ ১.৬৯
২০০১ ৪০ ৭৮৭.৯১ ১৯.৬৯ ৫০৭.৯২ ১২.৬৯ ৮০.০৩ ২.০০ ৬৭.৮৮ ১.৬৯
২০০২ ৪০ ৭১৬.৩০ ১৭.৯০ ৬৪০.৩৬ ১৬.০০ ৮৩.৫৪ ২.০৮ ৬৭.১৪ ১.৬৭
২০০৩ ৪০ ৮৬৪.৩২ ২১.৬০ ৭৫৭.১৫ ১৮.৯২ ৯৮.৭৭ ২.৪৬ ৬৮.১৩ ১.৭০

 

উৎস : আল্‌-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক লিঃ বার্ষিক প্রতিবেদনসমূহ।

 

. বিনিয়োগ

 

শুরুর বচরে ছয় মাসেরও কম সময়ে এআইবিএল ১.২৪ কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে সমর্থ হয়েছিল। পরবর্তী বছরে এই পরিমাণ লাফিয়ে বৃদ্ধি পেয়ে ৭৭.৯২ কোটি টাকায় পৌঁছায়। ১৯৯৭ সালে এই পরিমাণ দাঁড়ায় ১৭৪.৫৫ কোটি টাকায়। (বৃদ্ধির হার ছিল +১২৪%) এবং ১৯৯৮-এ ২২৫.৯৮ কোটি টাকায়। এক্ষেত্রে পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় বৃদ্ধির হার ছিল +২৯.৪৬%। ২০০৩ সালে বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৭৫৭.১৫ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে শাখাপিছু গড় বিনিয়োগ ছিল ১৮.৯২ কোটি টাকা। (সারণী-৫ দ্রষ্টব্য)।

 

. বৈদেশিক বাণিজ্য

 

বৈদেশিক বাণিজ্যে অর্থায়নের ক্ষেত্রে এআইবিএলের অগ্রগতি প্রশংসনীয়। তবে আমদানী বাণিজ্যে অর্থায়নের চেয়ে অনেক পিছিয়ে রয়েছে রপ্তানী বাণিজ্যে অর্থায়ন। ১৯৯৬ সালে ব্যাংকটির আমদানী বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১০৩.০২ কোটি টাকা, ১৯৯৭ সালে ৩২২.২৪ কোটি টাকা এবং ১৯৯৮ সালে ৫২৭.৯৫ কোটি টাকা (বৃদ্ধির হার যথাক্রমে +২১২.৭৯% ও +৬৩.৮৩%)। সেই তুলনায় রপ্তানী বাণিজ্যের পরিমাণ এই একই বছরগুলোয় ছিল যথাক্রমে ৮.৩৬ কোটি টাকা, ৫৯.২১ কোটি টাকা এবং ১১০.৩০ কোটি টাকা (বৃদ্ধির হার যথাক্রমে +৬০৮% ও +৮৬.২৮%) ২০০৩ সালে ব্যাংকটির আমদানী বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৭৬৯.৮২ কোটি টাকা এবং রপ্তানী বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৩০৭.৫৫ কোটি টাকা।

 

. আয় মুনাফা

 

ব্যাংকটির আয় বৃদ্ধি পেয়েছে অবিশ্বাস্য দ্রুত হারে। ১৯৯৬ সালে যেখানে ব্যাংকটির আয় ছিল মাত্র ৫.০৯ কোটি টাকা, ১৯৯৭ সালেই তা বেড়ে ১৯.৬২ কোটি টাকায় পৌঁছায়। এক্ষেত্রে শাখাপিছু আয় ছিল ১৯৯৬ সালে ৫০ লক্ষ টাকা। এই আয়ই ২০০৩ সালে ২ কোটি ৪৬ লক্ষ টাকায় পৌঁছায়। লক্ষ্যণীয়, প্রথম দিকে শাখা পিছু ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় সমান দ্রুত তালে। ১৯৯৬ সালে শাখাপিছু ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ৪৬ লক্ষ টাকা। এই অংকই ২০০৩ এ এসে দাঁড়িয়েছে শাখাপিছু ১.৭০ কোটি টাকা (সারণী-৫ দ্রষ্টব্য)।

 

ব্যাংকটির ১৯৯৫ সালে ৬ মাসের কার্যকালে ২০ লক্ষ টাকা লোকসান দিলেও পরবর্তী বছর হতেই মুনাফা অর্জনে সক্ষম হয়। এর পরিমাণ অবশ্য স্বল্প ছিল, মাত্র ৪৭ লক্ষ টাকা। ১৯৯৭ সালে এই পরিমাণ দাঁড়ায় ৬.৭৩ কোটি টাকা এবং ২০০৩ সালে করপূর্ব মুনাফার পরিমাণ দাঁড়ায় ৩০.৬৩ কোটি টাকা। ২০০১ ও ২০০২ সালে এর পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৩.৯৪ কোটি টাকা ও ১৬.৩৯ কোটি টাকা।

 

. প্রশিক্ষণ প্রেরণা

 

জনশক্তির দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন ও দক্ষতা বৃদ্ধির জন্যে প্রশিক্ষণ ও প্রেরণা অপরিহার্য। যেকোন বাণিজ্যিক ব্যাংকের জন্যে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ জনশক্তি তার প্রাণমক্তি রূপে কাজ করে। এই উদ্দেশ্যে ব্যাংকটি নিজস্ব ট্রেনিং একাডেমীতে নিয়মিত প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। উপরন্তু ১৯৯৮ সাল হতে শুদ্ধভাবে কুরআন শরীফ পাঠের উদ্দেশ্যে কুরআন শিক্ষা অধিবেশন শুরু করেছে। এসব প্রশিক্ষণ ও প্রেষণামূলক কার্যক্রমের ফলে কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের আচার-আচরণের পরিবর্তন এসেছে এবং নৈতিক মূল্যবোধের পুনরুজ্জীবন ঘটেছে বলে দাবী করেছেন ব্যাংক কর্তৃপক্ষ (বার্ষিক প্রতিবেদন ১৯৯৮, পৃ. ২২)।

 

প্রসঙ্গতঃ জনশক্তি নিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যাংকের ঘোষিত নীতির উল্লেখের দাবী রাখে। এই ব্যাংকে অফিসার হতে শুরু করে সকল পর্যায়ে লোক নিয়োগের ক্ষেত্রে মাদ্রাসা শিক্ষিতদের সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়। ব্যাংকের চেয়ারম্যান এক অনুষ্ঠানে বলেছেন- “মাদরাসা শিক্ষিতদের দ্বারা ব্যাংক চালনাকে আমরা একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছি” (দৈনিক সংগ্রাম, ১৮ অক্টোবর ১৯৯৯)। নিঃসন্দেহে এদেশে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে এ এক নতুন মাত্রা।

 

. অন্যান্য কার্যক্রম

 

সমাজসেবামূলক কার্যক্রমে অংশ গ্রহণের জন্যে এআইবিএল একটি ব্যাংক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেছে। যাকাত এবং যে সন্দেহজনক আয় ব্যাংক মুনাফায় গ্রহণ করতে পারে না সেই অর্থ দিয়ে এটি পরিচালিত হয়। এর আওতায় ১৯৯৯ সালে ঢাকায় একটি সমৃদ্ধ আধুনিক লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি ১৯৯৯ সালেই ‘আল-আরাফাহ ইংলিশ মিডিয়াম মাদরাসা’ স্থাপন করে আধুনিক শিক্ষার সাথে মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থার সমন্বয় সাধনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। উপরন্তু ইসলামী জ্ঞান শিক্ষা ও ইসলামী মূল্যবোধ তৈরীর প্রতি জোর দেওয়া কর্মসূচীর আওতায় ১০৮৪ কপি তরজমানুল কুরআন বিনামূল্যে দেশের প্রতিটি উপজেলায় বিতরণ করেছে।

 

. সোস্যাল ইনভেষ্টমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড

 

প্রতিষ্ঠা

 

বাংলাদেশে ইসলামী পদ্থরি চতুর্থ ব্যাং হলো সোস্যাল ইনভেষ্টমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড (এসআইবিএল)। এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয় ২২ নভেম্বর, ১৯৯৫। ব্যাংকটির অনুমোদিত মূলধনের পরিমাণ ১০০ কোটি টাকা এবং পরিশোধিত মূলধনের পরিমাণ ২৬.০০ কোটি টাকা। ব্যাংকটির ৩৮ জন উদ্যোক্তার মধ্যে ৭ জন বিদেশী রয়েছে।

 

পরিচালনা ব্যবস্থাপনা

 

এর বোর্ড অব ডিরেক্টরসের সদস্য সংখ্যা ২৭। এদের মধ্যে ৩জন বিদেশী। অন্যান্য ইসলামী ব্যাংকের মতো এই ব্যাংকেরও একটা শরীয়াহ বোর্ড রয়েছে। এগারো সদস্যবিশিষ্ট এই শরীয়াহবোর্ডে রয়েছেন ছয়জন ফকীহ/আলিম, একজন ব্যাংকার, একজন আইনজ্ঞ ও দুজন অর্থনীতিবিদ।

 

কার্যপদ্ধতি

 

আইবিবিএল যেসব পদ্ধতিতে আমানত গ্রহণ ও বিনিয়োগ করে থাকে এই ব্যাংকও সেসব পদ্ধতি অনুসরণ করার পাশাপাশি দু-একটি অপ্রচলিত নতুন পদ্ধতিও উদ্ভাবন করেছে। সেসবের মধ্যে ক্যাশ ওয়াক্‌ফ ফান্ড উল্লেখযোগ্য।

 

অন্যান্য ব্যাংক হতে এসআইবিএল নিজেকে ভিন্নধর্মী বলে দাবী করে। এজন্যে এর কর্মপদ্ধতি ও কর্মপরিধিও অধিকতর বিস্তৃত হওয়ার কথা। তবে সময়ই বলে দেবে এর প্রস্তাবিত কর্মপদ্ধতি কতখানি সফলতা অর্জনে সক্ষম হবে। ব্যাংকটি ত্রিখাত মডেলের ভিত্তিতে কাজ করে যাচ্ছে। এগুলো হলো: (ক) আনুষ্ঠানিক (Fromal) (খ) অনানুষ্ঠানিক (Non-Fromal) এবং (গ) স্বেচ্ছামূলক (Voluntary)।

 

আনুষ্ঠানিক খাত: এ খাতের আওতায় অন্যান্য বাণিজ্যিক ব্যাংকের অনুরূপ সকল সাধারণ সেবা প্রদান করা হয়। এ খাতে সৃষ্ট ‘সামাজিক উদ্বৃত্ত’ দুঃস্থ মানুষের কল্যাণের জন্যে ব্যয়িত হবে। ফলে খাতটির ‘মানবিকীকরণ’ ঘটবে বলে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ প্রত্যাশা করেন।

 

অনানুষ্ঠানিক খাত: এ খাতে ব্যাংক কর্পোরেট বহির্ভূত কার্যক্রমে অর্থায়ন করবে। তবে এক্ষেত্রে যেসব বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান থাকতে হবে সেগুলো হলো: )১) সহজেই প্রবেশে সক্ষম, (২) স্থানীয় সম্পদের উপর নির্ভরশীল কর্মকাণ্ড, (৩) ক্ষুদ্রায়তন কর্মপরিধি, (৪) শ্রমনিবিড় উৎপাদন কৌশল, (৫) অনানুষ্ঠানিক স্কুলের বাইরে অর্জিত দক্ষতা এবং (৬) অনিয়ন্ত্রিত প্রতিযোগিতামূলক বাজার। বিশেষ করে শহর ও গ্রামীন এলাকার দরিদ্র পরিবারসমূহের ক্ষমতায়নের উদ্দেশ্যে গৃহীত কর্মসূচীর ফলে এখাতের প্রকৃতই ‘সামাজিকীকরণ’ ঘটবে বলে প্রত্যাশা করেন। প্রতিষ্টাতা চেয়ারম্যান।

 

স্বেচ্ছামূলক খাত: এ খাতের আওতায় রয়েছে ওয়াকপ ও মসজিদসমূহের সম্পত্তির ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়ন, উত্তরাধিকার সম্পত্তির ব্যবস্থাপনা, বিভিন্ন দাতব্য ট্রাষ্ট ও সংস্থা ও অলাভজনক ফাউন্ডেশনসমূহের ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়ন, অমুসলিমদের কল্যাণের জন্যে তহবিল গঠন প্রভৃতি কার্যক্রম। এসব উদ্যোগ গ্রহণের মাধমে ব্যাংক গোটা খাতটির ‘আর্থিকীকরণ’ করতে চায়।

 

উল্লেখ্য, আনুষ্ঠানিক খাতকে মানবিকীকরণের উদ্দেশ্যে প্রতিবেশী এ্যাউন্স স্কীম ও যৌতুকমুক্ত নববিবাহিত সম্পত্তিকে বিশেষ সুবিধাজনক হারে স্থায়ী ভোগ্যপণ্য ক্রয়ে অর্থায়ন, অনানুষ্ঠানিক খাতের সামাজিকীকরণের উদ্দেশ্যে আইএলও-র সহযোগিতায় টোকাইদের মধ্যে থেকে এগিয়ে আসা কিশোরদরে জন্যে ‘পরিবেশ বন্ধুসুলভ ব্যবসায় কর্মসূচী’ গ্রহণ এবং স্বেচ্ছামূলক খাতে আর্থিকীকরণ তথা সমাজে কল্যাণমুখী কর্মধারা জোরদার করার উদ্দেশ্যে ক্যাশ ওয়াক্‌ফ সার্টিফিকেট (যা ব্যবহারের ৩২টি খাত রয়েছে) প্রবর্তন সন্দেহাতীতভাবে ব্যাংকটির ব্যতিক্রমধর্মী উদ্যোগ। সত্যিকার ইসলামী জীবন ব্যবস্থা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে দেশের অন্যান্য ইসলামী ব্যাংকও এই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করতে এগিয়ে আসতে পারে

 

ক্যাশ ওয়াকফের অর্থ হলো সমাজের বিত্তশালী তথা সচ্ছল জনগোষ্ঠী তাদের সঞ্চয়ের একটা অংশ দিয়ে এই নামেই একটা সার্টিফিকেট কিনবে যার আয় ওয়াকপ সম্পত্তির আয়ের মতোই ধর্মীয়, শিক্ষামূলক ও সামাজিক সেবামূলক নানা ধরনের মহৎ কাচে ব্যবহৃত হবে। এ উদ্যোগ গ্রহণের পিচনে ব্যাংকের উদ্দেশ্য হলো সামাজিক সঞ্চয় আহরণ করে তা মুলধনে রূপান্তরের মাধ্যমে তা থেকে অর্জিত আয় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কল্যাণ সাধনে ব্যয় করতে বিত্তশালীদের উদ্বুদ্ধ ও সহযোগিতা করা। এজন্যেই ব্যাংকের প্রধান শ্লোগান হলো- ‘দরদী সমাজ গঠনে সমবেত অংশ গ্রহণৎ’।

 

সাফল্য

 

এসআইবিএলের কার্যকাল আট বছর পূর্ণ হয়েছে। এত স্বল্প সময়ের কার্যক্রমের ভিত্তিতে এর বিশদ মূল্যায়ন অর্থাৎ সাফল্য ও ব্যর্থতার চিত্র তুলে ধরা সম্ভব নয়। তাই শুধা মাত্র কর্মকাণ্ডের সংক্ষিপ্ত চিত্র তুলে ধরা হলো।

 

. শাকা বৃদ্ধি আমানত সংগ্রহ: সারণী-৬ হতে দেখা যাবে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত ব্যাংকটির শাখা পাঁচটিতেই সীমিত রয়েছে। অবশ্য ১৯৯৮ সালে ব্যাংক নতুন পাঁচটি শাখা খুলতে সমর্থ হয়েছে। ফলে শাখা সংখ্যা ১০ এ উন্নীত হয়েছে। ২০০৩ সালে এই সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ২৪-এ। ১৯৯৬ সালের ৪১.৭৮ কোটি৬ টাকার আমানত ১৯৯৭ সালে বৃদ্ধি পেয়ে ৬৪.৫৫ কোটি টাকায় পৌঁচেছে (বৃদ্ধির হার +৬৪.৪৯%)। পরবর্তী বছরে বৃদ্ধির পরিমাণ ছিল আরও সন্তোষজনক, ২০২.৯০ কোটি টাকা (বৃদ্ধির হার +২১৪.৩২%)। এর পর ক্রামাগত আমানত বেড়েছে এবং ২০০৩ সালে আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১,৯৭০.৯৩ কোটি টাকা।

 

. বিনিয়োগ: এসআইবিএল ১৯৯৬ সালে ২০.৬৩ কোটি টাকা বিনিয়োগে সমর্থ হয়। পরবর্তী বছরে এক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার ছিল +৭৮.৫২%। বিনিয়োগের পরিমাণ ১৯৯৮ সালে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ১১৭.১৪ কোটি টাকায়। ২০০৩ সালে বিনিয়োগের পরিমাণ প্রথমবারের মতো এক হাজার কোটি টাকার সীমা অতিক্রম করে। এ বছর শাখাপিছু বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৪১.৯১ কোটি টাকা (সারণী-৬ দ্রষ্টব্য)।

 

সারণী-

 

সোস্যাল ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক লিঃ-এর আমানত বিনিয়োগের চিত্র: ১৯৯৫-২০০৩ (কোটি টাকায়)

 

বছর শাখার সংখ্যা আমানতের পরিমাণ শাখাপিছু আমানত বিনিয়োগের পরিমাণ শাখাপিছু বিনিয়োগ মোট আয় শাখাপিছু আয় মোট ব্যয় শাখাপিছু ব্যয়
১০
১৯৯৫ ১২.৪২ ১২.৪২ ০.০২ ০.০২ ০.দ১৭ ০.১৭ ০.৬২ ০.৬২
১৯৯৬ ৪১,৭৮ ৮.৩৫ ২০.৬৩ ৪.১২ ১.৯২ ০.৩৮ ৩.৮২ ০.৭৬
১৯৯৭ ৬৪.৫৫ ১২.৯১ ৩৬.৮৩ ৭.৩৬ ৫.১৩ ১.০২ ৫.৬৮ ১.১৩
১৯৯৮ ১০ ২০২.৯০ ২০.২৯ ১১৭.১৪ ১১.৭১ ১৭.৩৯ ১.৭৩ ১৩.৪৭ ১.৩৪
১৯৯৯ ১২ ৩৮২.৬৬ ৩১.৮৮ ২১৬.৪৬ ১৮.০৪ ১৩.২২ ১.১০ ৫.৮২ ০.৪৮
২০০০ ১৪ ৪৮৬.৩২ ৩৪.৭৩ ২৫২.২২ ২৫.১৫ ১৮.২৪ ১.৩০ ৭.৬৭ ০.৫৪
২০০১ ১৫ ১০৫৬.৯৭ ৭০.৪৬ ৫৪৯.৯২ ৩৬.৬৬ ৩৯.৮৭ ২.৬৫ ৯.৬৭ ০.৬৪
২০০২ ১৯ ১৫১৪.১৩ ৭৯.৬৯ ৭৫০.৪০ ৩৯.৪৯ ৫৪.১৯ ২.৮৫ ১২.৯১ ০.৬৭
২০০৩ ২৪ ১৯৭০.৯৩ ৮২.১২ ১০০৫.৯১ ৪১.৯১ ৬৯.৪৮ ২.৮৯ ১৯.৪৩ ০.৮১

 

উৎস: সোস্যাল ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক লিঃ এর বার্ষিক প্রতিবেদনসমূহ।

 

. বৈদেশিক বাণিজ্য: বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ব্যাংকটির সাফল্য দেশে ইসলামী পদ্ধতির অন্যান্য ব্যাংকের মতোই। এই ব্যাংকও আমদানী বাণিজ্যের চেয়ে রপ্তানী বাণিজ্যে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। ১৯৯৭ সালে ব্যাংকের আমদানী বাণিজ্যে অর্থায়নের পরিমান ছিল ৫৩.৪৪ কোটি টাকা, ১৯৯৮ সালে ১৩৬.৪৩ কোটি টাকা এবং ১৯৯৯ সালে ১৭১.৮৬ কোটি টাকা সেই তুলনায় রপ্তানী বাণিজ্যে অর্থায়নের পরিমান ঐ একই বছরগুলোতে যথাক্রমে ৩.৮৬ কোটি, ৪.২৯ কোটি টাকা এবং ১৩.৯৮ কোটি টাকা। ২০০২ ও ২০০৩ সালে এই পরিমাণ ছিল আমদানীর ক্ষেত্রে যথাক্রমে ১১১২.১৮ কোটি ও ১৪৯০.৫৯ কোটি টাকা এবং রপ্তানী বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ২২৮.৭৬ কোটি টাকা ও ৪০৩.৫৯ কোটি টাকা।

 

. আয় মুনাফা: ব্যাংকটির আয়ের সাথে ব্যয় যেন পাল্লা দিয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৯৬ সালে ব্যাংকের আয় যেখানে ছিল ১.৯২ কোটি টাকা সেখানে ব্যয় ৩.৮২ কোটি টাকা, অর্থাৎ প্রায় দ্বিগুণ। পরবর্তী বছরেও ব্যয়ের পরিমাণ আয়ের মাত্রাকে অতিক্রম করে গেছে। ব্যাংকটি প্রথম মুনাফার মুখ দেখে ১৯৯৮ সালে। এ বছরে করপূর্ব মুনাফার পরিমাণ ছিল ৩.৯২ কোটি টাকা। কিন্তু পূর্ববর্তী বছরসমূহের লোকসান পূরণ, কর প্রদান, স্ট্যাটুটরী সঞ্চিতি ইত্যাদির জন্যে বরাদ্দ রাখার ফলে শেয়ার হোল্ডারদের কোন ডিভিডেন্ড দেওয়া সম্ভব হয়নি। ২০০৩ সালে ব্যাংকের আয় দাঁড়ায় ৬৯.৪৮ কোটি টাকা এবং ব্যয় দাঁড়ায় ১৯.৪৩ কোটি টাকা। এ বছরে করপূর্ব মুনাফার পরিমাণ ছিল ৫০.০৫ কোটি টাকা।

 

. প্রশিক্ষণ: অন্যান্য ইসলামী ব্যাংকের মতো এসআইবিএলও তার জনশক্তির মান উন্নয়ন ও দক্ষতা বৃদ্ধির জন্যে প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছে। শাখার সংখ্যা কম হেতু কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সংখ্যা কম হওয়ায় ব্যাংকের কোন অফিসেই প্রশিক্ষণ কর্মসূচী পরিচালিত হচ্ছে।

 

. বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং-এর সমস্যা

 

ইসলামী পদ্ধতির ব্যাংকগুলার প্রয়াস সম্পর্কে দেশবাসী যতখানি আগ্রহান্বিত ও উদগ্রীব ছিল বাস্তবে তা পূরণ হয়নি। অবশ্য আইবিবিএল ইতিমধ্যেই দেশের সেরা ব্যাংক হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে। তারপরেও বলতেই হবে ইসলামী পদ্ধতির ব্যাংকিং এদেশে পদে পদে হোঁচট খাচ্ছে, নানা রকম বাধা-বিপত্তির সম্মুখণ হচ্ছে। এজন্যে যে সব কারণ দায়ী তার কিছু ব্যাংকের নিজস্বব সীমাবদ্ধতা, কিছু দেশে বিদ্যমান আইন কাঠামেসা, প্রশান ব্যবস্থা এবং জনগণের মানসিকতার সাথে সংশ্লিষ্ট। নীচে এগুলো সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো।

 

প্রথম, প্রতিষ্ঠার পর থেকে ব্যাংকগুলো সীমিত কতকগুলো ক্ষেত্রেই শুধু বিনিয়োগ করে যাচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে ঝুঁকি খুবই কম কিন্তু মুনাফা প্রাপ্তি নিশ্চিত। ফলে অর্থনীতির অন্যান্য খাত অবহেলিত ও উপেক্ষিত রয়ে যাচ্ছে। উপরন্তু বিনিয়োগের অন্যান্য যেসব ইসলামী পদ্ধতি রয়েছে, বিশেষতঃ ইসলামী অর্থনীতির প্রাণশক্তি মুদারাবা ও মুশারাকার কোন চর্চাই হচ্ছে না।

 

দ্বিতীয়, ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিগণের অসততা ও মুনাফা গোপন করার প্রবণতার কারণে ব্যাংক সঠিক হিসাব পায় না। ফলে বাৎসরিক ঘোষিত মুনাফার হারও স্বভাবতঃই কম হয়। অপরদিকে যারা সৎ-অসৎ উপায় নির্বিশেষে মুনাফা অর্জনকেই সবচেয়ে গুরুত্ব দেয় তারাওইসরামী শরীয়অহর কড়াকড়ি অনুশাসনের আওতায় আসতে চায় না।

 

তৃতীয়, বিনিয়োগের জন্যে অর্থ গ্রহণের পর ঐ অর্থ পরিশোধে গ্রহীতাগণ নির্দিষ্ট সময়সীমা মেনে চলতে অনেক সময়ই ব্যর্থ হয়। এক্ষেত্রে সুদী ব্যাংকসমূহ চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ আদায় করে ঐ ক্ষতি পুষিয়ে নেয়। কিন্তু শরীয়াহর নিষেধের কারণে েইসলামী ব্যাংকগুলো এই পদক্ষেপ নিতে পারে না। এজন্যে জরিমানা আদায় করলেও তাতে শরীয়াহর অনুমোদন না থাকায় ব্যাংক তা নিজস্ব আয় হিসাবে দেখাতে পারে না। ফলে ঐ অর্থ চলে যায় সাদাকাহ তহবিলে।

 

চতুর্থ, ইসলামী ব্যাংকগুলো নিয়মিত যাকাত আদায় করে থাকে। এর পরিমাণ কোটি কোটি টাকা। এই অর্থ জনকল্যাণেই ব্যয়িত হচ্ছে। কিন্তু সুদী ব্যাংকসমূহকে যাকাত দিতে হয় না। তারা বরং িএর চেয়ে অনেক কম পরিমাণ অর্থ মাঝে-মধ্যে সরকারের বিভিন্ন ত্রাণমূলক কর্মকাণ্ডে দান করে যেমন সুনাম অর্জন করে তেমনি ঐ অর্থ খরচ হিসাবে দেখিয়ে আয়কর মওকুফের সুবিধা পায়। কিন্তু ইসলামী ব্যাংকগুলো যাকাত প্রদান করলেও এজন্যে কর মওকুফের কোন সুবিধা পায় না। অথচ তাদের এই সুবিধা পাওয়া উচিত ছিল যুক্তিসংগতভাবেই।

 

পঞ্চম, বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিংএর জন্যে এখনও উপযুক্ত ও পৃথক আইন কাঠামো তৈরী হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকিং এ্যাক্ট ১৯৯১ ও কোম্পানী আইন ১৯৯৪ ‍অনুযায়ী এদেশের ব্যাংক সমগ্র ব্যবস্থা পরিচালিত হচ্ছে। এদেশে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের বয়স তিন দশক পূর্ণ হয়েছে। কিন্তু তার জন্যে আজও ইসলামী শরীয়াহ আইন তৈরী হয়নি। ফলে প্রতি পদে তাকে বাধাগ্রস্ত হতে হচ্ছে।

 

ষষ্ঠ, ইসলামী ব্যাংকের জন্যে এখনও দক্ষ ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জনশক্তির অবাব প্রকট। প্রাথমিক পর্যায়ে আইবিবিএলকে অন্যান্য সুদী ব্যাংক হতে দক্ষ জনশক্তি সংগ্রহ করে কাজ শুরু করতে হয়েছিল। তাদেরকে অবশ্য ইসলামী ব্যাংকিং-এর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। তা সত্ত্বেও ইসলামী ব্যাংকগুলো শাখা সম্প্রসারণের জন্যে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও উদ্বুদ্ধ জনশক্তির অভাব প্রধান অন্তরায় বলে স্বীকৃত।

 

সপ্তম, ইসলামী ব্যাংকগুলো এখনও পুরোপুর ইসলামী পদ্ধতিতে তাদের হিসাব পরিচালানা করতে পারছে না। শরীয়াহ্‌ কাউন্সিল বার বার দৃষ্টি আকর্ষণ করা সত্ত্বেও এখনও পর্যন্ত বহু ক্ষেত্রে এ্যাক্রুয়াল পদ্ধতিতেই হিসাব রাকা হচ্ছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়-দায়িত্বও কম নয়। কিন্তু তারাও এ ব্যাপারে যথোচিত-দিক নির্দেশনা প্রদান করছে না।

 

অষ্টম, এদেশে সমাজ জীবনএখন এক সর্বব্যাপী ও সর্বগ্রাসী অবক্ষয়ের শিকার। ইসলামী পদ্ধতির ব্যাংক পরিচালনা এ অবস্থায় নিঃসন্দেহে দুরূহ কাজ। বিশ্বাস সততা আমানতদারী ওয়াদা রক্ষা ও সময়ানুবর্তিতা নিঃসন্দেহে যেকোন ব্যবসায় ও কার্যক্রমের প্রাণশক্তি। আমাদের সমাজে এখন এসবের নিদারুণ অভাব। উপরন্তু দাপটের সাথে বিদ্যমান দুর্নীতিপরায়ণ প্রশাসন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, চাঁদাবাজী, দীর্ঘসূত্রীতা, স্বজনপ্রিয়তা ও রাজনৈতিক জিঘাংসা। এর অবসান না হলে সটিক মানে ইসলামী ব্যাংকিং পরিচালনা এক দুরূহ কাজ।

 

নবম, ইসলামী ব্যাংকিং-এর অন্যতম উদ্দেশ্য দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবন যাপনের মান উন্নয়ন। এদেশের জনগোষ্ঠীর বিপুল অংশ পল্লীবাসী, কৃষিজীবি এবং একই সঙ্গে দরিদ্রও। পরিণাম ফল যাই হোক না কেন কৃষি ব্যাংকসমূহ সুদী ব্যাংকগুলো কৃষিঋণের ব্যবস্থা করে কৃষকদের সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছে। অথচ দরিদ্র কৃষকদের বিনিয়োগ সুবিধা প্রদানের জন্য ইসলামী ব্যাংকগুলো এখনও কার্যকর কোন বিনিয়োগ পদ্ধতি উদ্ভাবন করতে পারেনি। ফলে গ্রামীন জনগণ তথা দেশের কৃষককুলের জীবনের যেমনগুণগত পরিবর্তনের সুযোগ হচ্ছে না তেমনি তাদের মধ্যে ইসলামী ব্যাংকিং এর প্রসার ঘটেনি।

 

দশম, ইসলামী ব্যাংকগুলো এখনও পর্যন্ত দেশের পল্লী এলাকায় কোন শাখা প্রতিষ্ঠা করেনি। বেসরকারী সুদী ব্যাংকগুলোর মত এরাও মূলতঃ শহর এলাকাতেই শাখা সম্প্রসারণ সীমাবদ্ধ রেখেছে। এ অবস্থা আদৌ কাঙ্খিত হতে পারে না। ইসলামী ব্যাংকিং অবশ্যই গণমুখী হতে হবে। এক্ষেত্রে দুটো বাধা রয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। প্রথম, ব্যাংকের জনশক্তি গ্রামে থাকতে অনিচ্ছুক। কারণ গ্রামাঞ্চলে শহুরে জীবনে অভ্যস্ত সুযোগ-সুবিধার অভাব। দ্বিতীয়, শহরের তুলনায় পল্লীতে কম আয়ের সম্ভাবনা। কিন্তু ইসলামী ব্যাংকসমূহে কর্মরতদের মনে রাখা উচিৎ তারা এখানে শুধু চাকুরীইা করছে নরা, তাদের কার্যক্রম ইবাদাতের শামিল। ইসলামী ব্যাংকগুলোর জনশক্তির কাছ থেকে এদেশের ইসলামপ্রিয় জনগণ কিছুটা আরাম-আয়েশের কুরবানী আশা করতে পারে বৈ কি। একই সাথে শুধু মুনাফা অর্জনই একটা কল্যাণমুখী ব্যাংকং-এর মুখ্য কাম্য হতে পারে না। মুনাফা অর্জনের পাশাপাশি অর্থনৈতিক কল্যাণ ও গণমানুষের সাথে সম্পৃক্ততাকেও ইসলামী ব্যাংকগুলোর সমান গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিৎ।

 

একাদশ, একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ইসলামী ফাইন্যান্সিয়াল প্রতিষ্ঠানসমূহের সম্প্রসারণের প্রবল বিরোধিতা করছে এদেশের সরকারই। এজন্যেই ইসলামী ব্যাংকগুলো যতগুলো নতুন শাখা স্থাপনের অনুমতির জন্যে বাংলাদেশে ব্যাংকের কাছে আবেদন জানায় বহু দেন-দরবারের পর তার এক-তৃতীয়াংশ বা অর্ধেকের কম অনুমোদন পায়। ফলে ইচ্ছা ও সামর্থ থাকা সত্ত্বেও ইসলামী ব্যাংকগুলো তাদের শাখা সম্প্রসারণ করতে পারছে না। এর কয়েকটি তাৎপর্য রয়েছে। এদেশের সুদী ব্যাংকগুলো সাফল্য ও গ্রহণযোগ্যতার বিচারে ইসলামী ব্যাংকের চেয়ে পিছিয়ে পড়েছে। ফলশ্রুতিতে জনমনে ইসলামী ব্যাংকিং তথা ইসলামী অর্থনীতি যে আসলেই প্রগতিশীল ও কল্যাণময় অর্থনীতি বাস্তবায়নে সক্ষম তাই-ই সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এদেশে মুখে ইসলাম পছন্দ অথচ বাস্তবে প্রচণ্ড ইসলামী জীবনাদর্শবিরোধী সরকারগুলো কখনই ইসলামের কল্যাণের দিক বাস্তবায়নে স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসেনি।

 

উপসংহার

 

সংক্ষিপ্ত এই আলোচনা বাংলাদেশে ২০০০ সালের পূর্বে প্রতিষ্টিত ইসলামী ব্যাংকগুলোর কর্মপদ্ধতি ও সাফল্য সম্পর্কে একটা চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। এত অল্প সময় সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী একটি ব্যাংকিং পদ্ধতির কার্যক্রম মূল্যায়নের জন্যে আদৌ যথেষ্ট নয়। তাকে আরও অনেক পথ অতিক্রম করতে হবে, পার হতে হবে অনেক চড়াই-উৎরাই। তবু একথা বলা বাঞ্ছনীয় যে, অর্থনীতিরন মাত্র একটি বা দুটি খাতকে ক্রমাগত প্রাধানী দিয়ে গেলে বা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সম্পদশালী অংশকেই বরাবর সুযোগ দিতে থাকলে দীর্ঘকালীন সামষ্টিক উন্নতি ও কল্যাণধর্মী অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জন আদৌ সম্ভব নয়। এজন্যে চাই যুগপৎ সমাজের সকল শ্রেণীর বিশেষ করে গ্রামীন দরিদ্র শ্রেণীর ভাগ্য উন্নয়নের কর্মসূচী গ্রহণের পাশাপাশি অর্থনীতির সকল খাতেই বিচরণ করার যোগ্যতা অর্জন। এজন্যে ইসলামী পদ্ধতির ব্যাংকগুলোকে আরও গণমুখী, ব্যাপকভিত্তিক ও শেকড় সন্ধানী হতে হবে। তার বিনিয়োগ পরিকল্পনাকে হতে হবে বহুধা বিস্তৃত, সহযোগিতাধর্মী ও দরিদ্রদের জন্যে প্রকৃতই উপযোগী অর্থাৎ, আয়বর্ধন কর্মসংস্থানমূলক। তাহলেই নিশ্চিত হবে এদেশের জনগণের প্রকৃত আর্থঞ-সামাজিক শ্রীবৃদ্ধি ও কল্যাণ।

 

ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক

 

প্রতিষ্ঠা

 

আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যে ইসলামী ব্যাংকটি বিগত ত্রিশ বছর ধরে নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে কাজ করে চলেছে, যার সক্রিয় সহযোগিতায় আজকের মুসলিম দেশগুলোর অর্থনীতি ও বৈদেশিক বাণিজ্যের গতি সাবলীল রয়েছে এবং যার প্রত্যক্ষ অংশ গ্রহণের ফলে বিভিন্ন দেশে ইসলামী ব্যাংকসমূহের প্রতিষ্ঠা সহজ হয়েছে সেই ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক (Islamic Development Bank বা আইডিবি) সম্পর্কে এদেশে আলোচনা হয়েছে অতি অল্পই। মূলতঃ তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলো, যার অধিকাংশই মুসলিম, তাদের অর্থনীতিকে সচল রাখতে যে কয়টি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের উপর আজ খুব বেশী নির্ভরশীল ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক তাদের অন্যতম। ১৯৭৩ সালের ডিসেম্বর (জিলক্বদ, ১৩৯৩) মাসে সউদ িআরবের জেদ্দায় মুসলিম দেশসমূহের অর্থমন্ত্রীদের এক সম্মেলনে ইসলামী মডেলের েএই আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানটি স্থাপনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এরপর ১৯৭৫ সালের জুলাই মাসে জেদ্দাতেই প্রস্তাবিত ব্যাংকের পরিচালকমন্ডলী বা বোর্ড অব গভর্নরসের উদ্বোধনী সভায় মুসলিম উম্মাহর আশা-আকাংখার প্রতীক এই ব্যাংকের উদ্বোধন করা হয়। অবশ্য আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যাংকটি কাজ শুরু করে ১৫ শাওয়াল, ১৩৯৫ (২০ অক্টোবর, ১৯৭৫)।

 

উদ্দেশ্য

 

ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের উদ্দেশ্যসমূহ হলো:

 

১. সুদবিহীন লেন-দেন, বিনিয়োগ ও বাণিজ্য পরিচালনা;

 

২. সদস্য দেশগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও উৎপাদনমুখী প্রকল্পসমূহে আর্থিক সহায়তা প্রদান;

 

৩. সদস্য দেশসমূহের বৈদেশিক বাণিজ্যে অর্থায়ন;

 

৪. সদস্য দেশগুলোর সামাজিক উন্নয়নে অংশ গ্রহণ; এবং!

 

৫. দেশ নির্বিশেষে মুসলিম উম্মাহর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্যে যে কোন শরীয়তসম্মত প্রয়াসে সহযোগিতা প্রদান।

 

ব্যাংকের প্রধান অফিস সউদী আরবের জেদ্দায় অবস্থিত। যেকোন সদস্য দেশে আঞ্চলিক অফিস খুলবার জন্যে ব্যাংককে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। প্রধান অফিসের সাথেই সংযুক্ত রয়েছে ইসলামী গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (Islamic Research and Trainig Institute)। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যাংকের তৎপরতা অব্যাহত রাখা ও পরিবর্তনশীল প্রয়োজনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করার উদ্দেশ্যেই এই ইনস্টিটিউটটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এছাড়া ১৯৯৪ সালে মরক্কোর রাবাত ও ১৯৯৫ সালে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে ব্যাংকের দুটি আঞ্চলিক অফিস চালু হয়। মধ্য এশিয়ার রিপাবলিকসমূহের সাথে আইডিবির ঘনিষ্ঠ সমন্বয়ের জন্যে ১৯৯৭ সালে কাজাখাস্তানের আলামাতায় খোলা হয়েছে তৃতীয আঞ্চলিক অফিসটি। এছাড়া ইরান, ইন্দোনেশিয়া, কাজাখস্তান, গাম্বিয়া, গিনি বিসাউ, পাকিস্তান, মৌরতানিয়া, লিবিয়া, সেনেগাল, সুদান ও সিয়েরালিওনে মাঠ প্রতিনিধির অফিসও রয়েছে

 

হিজরী সালই এ ব্যাংকের আর্থিক বছর হিসাবে গণ্য হয়। আরবী ভাষা ব্যাংকেরসরকারী বা অফিসিয়াল ভাষা। এই ভাষাতেই ব্যাংকের সকল কাজ পরিচালিত হয়। তবে অধিকতর সুষঠু সেবা প্রদান এবং সদস্য দেশসমূহের মধ্যে যোগাযোগ অব্যাহত রাখার জন্যে ইংরেজী ও ফরাসী ভাষাকেও ‘কাজের ভাষা’ হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

 

মূলধন

 

আইডিবির অনুমোদিত মূলধনের পরিমাণ শুরুতে ছিল দুই শত কোটি ইসলামী দিনার। প্রতিটি ১০,০০০ ইসলামী দীনার মূল্যেল সর্বমোট ২,০০,০০০ শেয়ার এই অর্থকে ভাগ করা হয়েছে। ১৪২২ হিজরীতে আলজেরিয়ায় বোর্ড অব গভর্নরসের সভায় অনুমোদিত মূলধনের পরিমাণ বৃদ্ধি করে পনেরো শত কোটি ইসলামী দিনারে উন্নীত করা হয়েছে। বিলিকৃত (Subscribed) হয়েছে ৭৯৬.০ কোটি ইসলামী দীনার। [সারণী-১ দ্রষ্টব্য]। ব্যাংকের মুদ্রামান ১ ইসলামী দীনার ১ এসডিআর-এর সমমানের। এসডিআর বা Special Drawing Right আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (International Monetary Fund) কর্তৃক ব্যবহৃত মুদ্রামান। বাংলাদেশী মুদ্রায় ১ ইসলামী দীনার বর্তমানে ৮০.০০ টাকার সমান।

 

সদস্য

 

বর্তমানে মুসলিম বিশ্বের ৫৫টি দেশ এই ব্যাংকের সদস্য। শুরুতে বাইশটি দেশ মিলে ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠা করে। ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য দেশসমূহের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। ব্যাংকের সদস্য হওয়ার জন্যে দুটি শর্ত রয়েছে। প্রথমতঃ দেশটিকে েইসলামী সম্মেলন সংস্থার (ও.আই.সি) সদস্য হতে হবে এবং দ্বিতীয়তঃ ব্যাংকের বোর্ড অব গভর্নরস সময়ে সময়ে যে সমস্ত শর্ত নিয়ম নির্ধারণ করে দেবেন তা মেনে নিতে দেশটিকে সম্মত থাকতে হবে। সারণী-১ হতে সদস্য দেশসমূহের নাম ছাড়াও সদস্য হিসাবে তাদের অন্তর্ভূক্তির বছর ও বিলিকৃত মূলধনে তাদের শেয়ারের পরিমাণ জানা যাবে।

 

সারণী-১ হতে দেখা যায় বাইশটি দেশ নিয়ে ব্যাংটি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৯৭৬ সালেই আফগানিস্তান, ইযৈমেন, ক্যামেরুন, ও সিরিয়া এই চারটি দেশ এর সদস্য হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হয়। পরবর্তী বছরে আরও পাঁচটি দেশ- উগান্ডা, প্যালেস্টাইন, লেবানন, শাদ ও সেনেগাল এর সদস্য পদ লাভ করে। এরপর প্রায় প্রতি বছর একটি-দুটি করে দেশ ব্যাংকটির সদস্য হতে থাকে। সর্বশেষ সদস্য দেশগুলোর মধ্যে রেয়েছে ভেঙ্গে পড়া সোভিয়েত রাশিয়ার মুসলিম দেশগুলো।

 

কাজের প্রকৃতি

 

আইডিবি গৃহীত কাজের তালিকা বেশ দীর্ঘ। তবে সেসবই সদস্য দেশসমূহের সার্বিক আর্থ-সামাজিক কল্যাণের জন্যেই এসব কর্মসূচী অনুসৃত হয়ে থাকে। শুধু তাই নয়, অ-সদস্য দেশের মুসলিম অধ্যুষিত জনপদের কল্যাণের জন্যৌ এর কর্মসূচী রয়েছে। ব্যাংকের প্রস্তাবিত ও গৃহীত কর্মসূচী নিম্নরূপ:-

 

ক. সদস্য দেশসমূহে অর্থনৈতিক ও সামাজিক বুনিয়াদ গড়ে তোলার জন্যে সুনির্দিষ্ট প্রকল্পে অর্থ বিনিযোগ;

 

খ. সদস্য দেশসমূহের সরকারী বিনিয়োগ উদ্যোগসমূহে ঋণ মঞ্জুরীর মাধ্যমে মূলধন সরবরাহ;

 

ঘ. সদস্য দেশসমূহকে মহার্ঘ ব্যবহারিক সামগ্রী (যথা- তেলবাহী, মালবাহী ও মাছ ধরার জাহাজ, যন্ত্রপাতি, কারখানা, রেলগাড়ী ইত্যাদি) ইজারা দেওয়া;

 

ঙ. সদস্য দেশসমূহের আমানত গ্রহণ ও তহবিল বৃদ্ধি করা;

 

চ. ট্রাষ্ট তহবিল পরিচালনা;

 

ছ. অ-সদস্য দেশের মুসলিম জনসাধারণের সাহায্যের জন্যে বিশেষ তহবিল গঠন ও পরিচালনা;

 

জ. সবচেয়ে কম উন্নত সদস্য দেশসমূহের জন্যে বিশেষ প্রকল্প ও আর্থিক সাহায্যের ব্যবস্থা গ্রহণ;

 

ঝ. সদস্য দেশসমূহের বৈদেশিক বাণিজ্যের, বিশেষ করে মূলধনী পণ্য সংগ্রহে সহায়দা প্রদান;

 

ঞ. সদস্য দেশসমূহে কারিগরী সহায়দা প্রদান;

 

ট. সদস্য দেশগুলোতে উন্নয়নমুখী কাজে লিপ্ত ব্যক্তিদের প্রশিক্ষণ প্রদান;

 

ঠ. মুসরিম দেশসমূহের অর্থনৈতিক ও ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্ব স্ব দেশে শরীয়াহ মুতাবিক বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশ গ্রহণের জন্যে মূলধন সরবরাহ এবং গবেষণাকর্মে সহায়তা করা;

 

ড. ব্যাংকের পরিচালনা ও কার্য নির্বাহের জন্যে যে অর্থের প্রয়োজন হবেনা সেই উদ্বৃত্ত অর্থ উপযুক্ত খাতে বিনিয়োগ; এবং

 

ঢ. এমন সব কাজে অংশগ্রহণ করা যা ব্যাংকের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জনের জন্যে সহায়ক হবে।

 

পরিচালনা ব্যবস্থাপনা

 

ব্যাংকটি যথাযথ পরিচালনার জন্যে বোর্ড অব গভর্ণরসকে সহায়তা করে থাকে বোর্ড অব একজিকিউটিভ ডিরেক্টরস। সদস্য দেশসমূহের অর্থমন্ত্রী বা পরিকল্পনা মন্ত্রী অথবা কেন্দ্রী ব্যাংকের গভর্ণল পদাধিকার বলে ব্যাংকের বোর্ড অব গভর্নরসের সদস্য হয়ে থাকেন। এরাই চৌদ্দ সদস্যবিশিষ্ট বোর্ড অব একজিকিউটিভ ডিরেক্টরস (বা নির্বাহী পরিচালক পরিষদ)-িএর জন্যে প্রতিনিধি মনোনীত করে থাকেন। এদের কার্যকালের মেয়াদ তিন বছর। প্রতি তিন বছর পর পর বোর্ড অব একজিকিউটিভ ডিরেক্টরবৃন্দের সদস্য নির্বাচিত/মনোনীত হয়ে থাকেন।

 

সদস্য দেশসমূহ হতেই বোর্ড অব গভর্ণরস পাঁচ বছরের জন্যে বোর্ড অব একজিকিউটিভ ডিরেক্টরসের জন্যে একজন সভাপতি নিয়োগ করে থাকেন। তিনি ব্যাংকের প্রেসিডেন্ড হিসেবে গণ্য হন। এছাড়া রয়েছেন তিনজন ভাইস প্রেসিডেন্ট। তারা বাণিজ্য, অপরেশন এবং কর্পোরেট কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে থাকেন। একজিকিউটিভ ডিরেক্টরবৃন্দের সমন্বয়ে গটিত তিনটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি রয়েছে। সেগুলো হচ্ছে: ক) পরিচালনা কমিটি; খ) ফাইন্যান্স ও প্রশাসনিক কমিটি এবং গ) দীর্ঘমেয়াদী বাণিজ্য অর্থায়ন কমিটি। উপরন্তু কতকগুলো বিশেষ কমিটিও রয়েছে যেগুলো সল্পোন্নত সদস্য দেশ, ইসলামী ব্যাংক পোর্টফোলিও , ইউনিট ইনভেস্টমেন্ট ফাণ্ড, অমুসলিম দেশের মুসলিম ছাত্র-ছাত্রীদের বৃত্তি এবং পেনশন ব্যবস্থাপনা বিষয়ক দায়িত্ব পালন করে থাকে।

 

কার্যক্রম

 

আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ ফাইন্যান্সিয়াল ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ইতিমধ্যেই আইডিবি সকল মহলে পরিচিত লাভ করেছে িএবং মর্যাদপূরণ আসনে সমাসীন হতে পেরেছে। নানা বিষয়ে এর সহযোগিতা সদস্য দেশগুলোর অর্থনীতিকে যেন চাঙ্গা রেখেছে তেমনি ব্যাংক নিজেও প্রভূত মুনাফা অর্জন করেছে। ব্রাংকের যাবৎ গৃহীত কর্মতৎপরতার একটি সংক্ষিপ্ত খতিয়ান নিলেই এ সত্য ধরা পড়বে।

 

. তহবিল সংগ্রহ

 

ব্যাংক যেহেতু একটি ফাইন্যান্সিয়াল প্রতিষ্ঠান সেহেতু তাকে বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যমূলক কর্মকাণ্ডে অংশ গ্রহণ করতে হবে, পরিচালনা ব্যয় নির্বাহের জন্যে উপার্জন করতে হবে। মুনাফা অর্জনও তার অন্যতম লক্ষ্য থাকবে। এজন্যে চাই বিনিয়োগযোগ্য পর্যাপ্ত তহবিল। শেয়ারহোল্ডারদের পরিশোধিত মূলধন এই তহবিলের একটি বড় অংশ হলেও অন্যানৗ উৎস হতে ব্যাঙককে তহবিলসংগ্রহ করতে হয়। সাধারণ বাণিজ্যিক ব্যাংকের ক্ষেত্রে আমানতকারীদের জমাকৃত অর্থ এই তহবিলের যোগান দেয়। কিন্তু আইডিবি যেহেতু একটি বিশেষ ধরনের ব্যাংক সেহেতু প্রচলিত উৎস হতে তার তহবিল সংগ্রহের উপায় নেই। তাই একে বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণত করতে হয়েছে। ব্যাংকের ফাইন্যান্সের উৎসসমূহের মধ্যে রয়েছে সদস্য দেশসমূহের পরিশোধিত মূলধন, বিনিয়োগ আমানত স্কীমের প্রাপ্ত জমা এবং বিশেষ সাহায্য তহবিলে সদস্য দেশসমূহের প্রদত্ত চাঁদা। এভাবে ধীরে ধীরে তহবিলের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং ব্যাংক তা থেকে ফাইন্যান্সিং কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে। এছাড়া তহবিল বৃদ্ধির জন্যে তিনটি বিশেষ উদ্রোগ গৃহীত হয়েছে: (১) ইউনিট ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড, (২) ইসলামী ব্যাংকস পোর্টফোলিও ফর ইনভেস্টমেন্ট এন্ড ডেভেলপমেন্ট এবং (৩) আইডিবি ইনফ্রাস্ট্রাকচারাল ফান্ড।

 

. ইউনিট ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড (UIF): নিজস্ব তহবিল বৃদ্ধি ও সদস্য দেশগুলোতে মূল্যবান সামগ্রী সংগ্রহে সহযোগিতা প্রদানের উদ্দেশ্যে জানুয়ারী ১,১৯৯০ (১৪১০ হিজরী) হতে ব্যাংক ‘ইউনিট ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড’ নামে একটি নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করে। এটি ভিন্ন ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হবে তবে আইডিবির প্রেসিডেন্ট এর প্রেসিডেন্ট হিসেবে দাযিত্বশীল থাকবেন। দশ কোটি মার্কিন ডলারের প্রারম্ভিক অনুমোদন ও পরিশোধিত মূলধন নিয়ে এর তহবিল গঠিত হয়। তহবিলের অর্থকে ইউনিট এ ভাগ করা হয় এবং প্রতি ইউনিটের মূল্য ধার্য করা হয় ১.০ মার্কিন ডলার। বিনিয়োগে অংশ গ্রহণে ইচ্ছুক প্রতিষ্টানকে ন্যূনতম এক লক্ষ মার্কিন ডলার বা তার গুণিতক হারে ইউনিট কিনতে হয়। প্রথম পর্যায়ে পনেরোটি ইসলামী ফাইন্যান্সিং প্রতিষ্ঠান তহবিলের সমুদয় ইউনিট কিনে নেয়। এর মধ্যে কুয়েতের পাঁচটি, সউদী আরবের চারটি, মালয়েশিয়ার তিনটি এবং বাহরাইন, কাতার ও ডেনমার্কের একটি করে প্রতিষ্ঠান রয়েছে। চার বছরের মধ্যে উদ্যোগটি বিপুল সফলতা লাভ করে। ফলে জানুয়ারী, ১,১৯৯৪ (শাওয়াল ১৯,১৪১৪ হিজরী) অনুমোদিত মূলধনের পরিমাণ আও দশ কোটি মার্কিন ডলার বৃদ্ধি করা হয়ং এবং এবারেও সঙ্গে সঙ্গেই তা পরিশোধিত হয়ে যায়। এই প্রেক্ষিতে ১৯৯৫ সালে আরও ত্রিশ কোটি মার্কিন ডলার তহবিল বৃদ্ধির অনুমোদন দেওয়া হয়। ইতিমধ্যেই এই বর্ধিত তহবিলের সাড়ে সাত কোটি মার্কিন ডলার মূল্যের িইউনিট বিক্রি হয়ে গেছে। বর্তমানে মোট পরিশোধিত মূলধনের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩২.৫০ কোটি মার্কিন ডলার।

 

প্রধানতঃ ইজারা ও কিস্তিতে বিক্রয়যোগ্য সামগ্রী বা উপকরণ সংগ্রহের জন্যে এই তহবিলের অর্থ ব্যবহৃত হচ্ছে। এই নতুন উদ্যোগ গ্রহণের ফলে ব্যাংকের বিনিযোগযোগ্য তহবিল যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে তেমনি যেসব প্রতিষ্ঠানের হাতে উদ্বৃত্ত অর্থ রয়েছে শরীয়াহর সাথে সংগতি রেখে বিনিয়োগের মাধ্যমে তাদেরও উপার্জনের নতুন পথ উন্মুক্ত হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী নীট মুনাফার ৮৫% বন্টন করাহয় ইউনিট ক্রেতাদের মধ্যে; ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক ১০% মুদারিব হিসাবে এবং ৫% রিজার্ভ রাখা হয় মূলধনের মূল্যমান স্থির রাখার জন্যে। বিগত পাঁচ বছরে এই তহবিল হতে বিনিয়োগকৃত অর্থের পরিমাণ ছিল ৩২.৪৯ কোটি মার্কিন ডলার। ইতিমধ্যেই পূর্বের বিনিয়োগকৃত অর্থ হতে যে অংশ ফেরত পাওয়া গেছে তা পুনরায় বিনিয়োগ করার ফলেই পরিশোধিত মূলধনের চেয়ে বিনিয়োজিত মূলধনের পরিমাণ বেশী হয়েছে। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য, এই ফাণ্ড হতে বিনিয়োগ মুনাফার পরিমাণ খুবই সন্তোষজনক। হওয়ায় প্রাথমিক ইউনিট ক্রেতাদের বোনাজ শেয়ার ইস্যু করা হয়েছে।

 

. ইসলামী ব্যাংক পোর্টফোলিও (IBP): আইডিবি তহবিল বৃদ্ধির পাশাপাশি সদস্য দেশসমূহের ইসলামীব্যাংকের উদ্বৃত্ত তহবিল ব্যবহারের সুযোগ দিয়ে মুনাফা অর্জনে সহযোগিতা করার উদ্দেশ্যে ফেব্রুয়ারী, ১৯৮৭ সালে (জমাদিউস সানী, ১৪০৭) এই কর্মসূচী গ্রহণ করে। এর পুরা নামস Islamic Bank’s Portfolio for Investment and Development। এই স্কীমের আওতায় ইসরামী ব্যাংকগুলোকে প্রতিটি ১০০ মার্কিন ডলার মূল্যের সমপরিমাণ অর্থের ২৫ বছর মেয়াদী সার্টিফিকেট ইস্যু করা হয়। ব্যাংকগুলো প্রয়োজনে বাজার দরে এই সার্টিফিকেট নিজেদের মধ্যে কেনা-বেচাও করতে পারে। আইডিবির নিজের জন্যেও এ সুযোগ উন্মুক্ত রয়েছে। এই তহবিলের অর্থ ইজারা, ইকুইটি বিনিয়োগ ও সদস্য দেশসমূহের মধ্যে বৈদেশিক বাণিজ্যের জন্যে ব্যবহৃত হবে। বিনিয়োগকৃত অর্থ হতে যে মুনাফা অর্জিত হবে তার ৯০% শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে বন্টিত হবে। মুদারিব হিসাবে আইডিবি পাবে ৫%, বাকী ৫% রিজার্ভ হিসাবে গচ্ছিত থাকবে মূলধনের মূল্যমান স্থির রাখার জ ন্যে। আইডিবিসহ এ যাবৎ ২১টি ইসলামী ব্যাংক ও ফাইন্যান্সিং প্রতিস্ঠান এতে অংশ গ্রহণ করেছে।

 

েএই স্কীমের অনুমোদিত মূলধনের পরিমাণ ৩৮.০ কোটি মার্কিন ডলার, এবং পরিশোধিত মূলধনের পরিমাণ ৯.০ কোটি মার্কিন ডলার। এ ছাড়া আইডিবি ইজারার জন্যে ১৫.০ কোটি মার্কিন ডলার ও বাণিজ্যিক কার্যক্রমের জন্যে অতিরিক্ত আরও ৭.০ কোটি মার্কিন ডলার বরাদ্দ করেছে। শুরুর বছর হবে ১৪২৪ হিজরী পর্যন্ত এই কর্মসূচীর আওতায় ১৯টি সদস্য দেশে ২১৪টি প্রকল্পে ৩৩৯ কোটি মার্কিন ডলার মঞ্জুরী পেয়েছে। েএই উদ্যোগ হতে ইসলামী ব্যাংকসমূহ তিনটি উপকার পাচ্ছে:

 

১. ন্যূনতম ঝুঁকি নিয়ে পরোক্ষভাবে তারা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে অর্থায়নের সুবিধা ও অভিজ্ঞতা লাভ করছে;

 

২. উদ্বৃত্ত অর্থ কার্যকরভাবে ব্যবহার করে মুনাফা উপার্জনের সুযোগ পাচ্ছে, এবং

 

৩. ব্যাংকগুলো তাদের বড় গ্রাহকদের পণ্য নির্বাচনের ক্ষেত্র প্রশস্ত করার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় তহবিলের অভাব পূরণের জন্যে নতুন পদ্থরি সাথেও পরিচিত করিয়ে দেওয়ার সুবিধা লাভ করেছে।

 

. আইডিবি ইনফ্রাস্ট্রাকচারাল ফান্ড (IIF): সদস্য দেশসমূহের অর্থনৈতিক অবকাঠামোসমূহ বিনির্মাণের জন্যে বেসরকারী বিনিয়োগ স্বাগত জানাবার জন্যে আইডিবির পক্ষ হতে আইডিবি ইনফ্রাস্ট্রাকচারাল ফান্ড গঠন ছিল একটি ব্যতিক্রমী প্রয়াস। একশত কোটি মার্কিন ডলার ইকুইটি মূলধনের লক্ষ্যমাত্র নিয়ে ফান্ডটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৯৮ সালে। প্রধান উদ্যোক্তা হিসেবে মূলদনের ৫১ শতাংশের মালিকানা আইডিবির। তহবিলটির কার্যক্রম পরিচালিত হবে বাহরাইন হতে। ফান্ডের ন্যূনতম ইকুইটি বিনিয়োগের পরিমাণ হবে এক কোটি মার্কিন ডলার। কোন প্রকল্পে সর্বোচ্চ ইকুইটি হবে দশষ কোটি মার্কিন ডলার। এই ফান্ড বিভিন্ন দেশের িইসলামী ব্যাংক ও অন্যান্য ইসলামী ফাইন্যান্সিয়াল প্রতিষ্ঠানের সাথে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা সূত্রে বৃহৎ সিন্ডিকেট গড়ে তুলতে চেষ্টা করবে। টেলিকম্যুনিকেশন, পেট্রোকেমিক্যাল শিল্প, পরিবহন, প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ, বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রভৃতি খাতে বিনিয়োগে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে গুরুত্ব প্রদান করা হবে। এই তহবিল হতে ১৪২৪ হিজরীতে চারটি সদস্য দেশের পাঁচটি প্রকল্পে ২০.৮০ কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগ হয়েছে।

 

. প্রকল্প অর্থায়ন পদ্ধতি

 

আইডিবি তার তহবিল ব্যবহারের জন্যে শরীয়াহর অনুমোদিত পদ্ধতিসমুহের মধ্য থেকেই বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করে আসছে। তহবিল ব্যবহারের ক্ষেত্রে অনুসৃত নীতিমালাকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়: (১) প্রকল্প অর্থায়ন, (২) বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন এবং (৩) বিশেষ সহায়তামূলক কর্মকাণ্ড। প্রকল্প অর্থায়নের ক্ষেত্রে শুরুতে শুধুমাত্র ঋণ ও েইকুইটির ব্যবহার হতো। পরবর্তীকালে ক্রমে ক্রমে ইজারা (১৯৭৭), মুনাফার অংশীদারীত্ব (১৯৭৮), কিস্তিতে বিক্রয় (১৯৮৫), ইসতিসনা (১৯৯৬) প্রভৃতি পদ্ধতি গৃহীত হয়। এছাড়া প্রকল্প অর্থায়ন কর্মসূচীর আওতায় সদস্য দেশগুলোতে কারিগরি সহায়তা প্রদান কর্মসূচীও রয়েছে।

 

প্রকল্প অর্থায়নের আওতায় বিভিন্ন বিনিযোগ পদ্ধতি অনুযায ি২০০৪ (১৪২৪ হিজরী) পর্যন্ত মোট বরাদ্দ করা হয়েছে ৭৬১২.৭৯ কোটি ইসলামী দীনার। এর মধ্যে ঋণ খাতে রয়েছে ২৫১.১৩ কোটি ইসলামী দীনার (৩২.৯৬%), ইজারা খাতে ১৬৭.৫০ কোটি ইসলামী দীনার (২১.৯৯%), ইকুইটি খাতে ২৮.৪২ ইসলামী দীনার (৩.৭৩%) জাতীয় উন্নয়ন অর্থায়ন প্রতিষ্ঠানগুলোকে সহযোগিতা প্রদান ১৮.৭৮ কোটি ইসলামী দীনার (২.৪৬%), মুনাফার অংশীদারী কর্মকাণ্ডে ৬.২৪ কোটি ইসলামী দীনার (০.৮২%), ইসতিসনার জন্যে ১২০.৫২ কোটি ইসলামী দীনার (১৫.৮২%) এবং কারিগরি সহায়তার জন্যে ১৩.২৩ কোটি ইসলামী দীনার (১.৭৪%)। সারণী- হতে এই অর্থায়নের একটি চিত্র পাওয়া যাবে।

 

ঋণ: সদস্য দেশসমূহের আর্থিক বুনিয়াদ সৃদঢ় করার উদ্দেশ্যে সেসব দেশের অর্থনৈতিক অবকাটামোর বিকাশ ও উন্নয়নের জন্যে আই.ডি.বি তহবিল মঞ্জুরীর মাধ্যমে মূলবান বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহ করে আসছে। প্রতিষ্ঠার বছর হতে িএ পর্যন্ত এই খাতে ৪৩টি সদস্য দেশে সর্বমোট ২৫১.১৩ কোটি ইসলামী দীনার মঞ্জুর করা হয়েছে। সড়ক ও পোতাশ্রয় নির্মাণ ও উন্নয়ন, বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ ও বিতরণ ব্যবস্থার সম্প্রসারণ, সেচ সুবিধার সম্প্রসারণ, পয়ঃপ্রণালী নির্মাণ, গ্রামাঞ্জলে পানীয় জল সরবরাহ, সারকারখানা নির্মাণ, হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা, শিক্ষার সম্প্রসারণ প্রভৃতি প্রকল্পে উপরোক্ত পরিমাণ অর্থ ব্যবহার করা হয়েছে [সারণী-২ দ্রষ্টব্য]। এর ৬০% ব্যয়িত হয়েছে সল্পোন্নত দেশসমূহে সহযোগিতার ক্ষেত্রে।

 

এই স্কীমের আওতায় প্রকল্প মঞ্জুরীর অর্থ পরিশোধিত মেয়াদকাল বেশ দীর্ঘ-১৫ হতে ২৫ বছর। উপরন্তু শুরুতেই ৩-৭ বছরে রেয়াত দেওয়া হয়। ব্যাংক প্রকৃত ব্যয় নির্বাহের জন্যে বার্ষিক সর্বোচ্চ ২.৫% হারে সার্ভিস চার্জ গ্রহণ করে থাকে।  অবশ্য স্বল্পোন্নত সদস্য দেশসমূহের ক্ষেত্রে এই হার মাত্র ০.৭৫%। ব্যাংকের নির্বাহী পরিষদ ১৯৯২ সালে একক প্রকল্প অর্থায়নের পরিমাণও বৃদ্ধি করেছে। ফলে এখন এর পরিমাণ-১৯৯১ সালের ৩০.০ লক্ষ ইসলামী দীনার হতে ৪৯.০ লক্ষ ইসলামী দীনারে উন্নীত হয়েছে।

 

ইজারা: প্রতিষ্ঠার বছর হতেই আইডিবি সদস্য দেশসমূহকে নানা ধরনের মহর্ঘ ব্যবহারিক সামগ্রী ইজারা দেওয়ার ব্যবস্থা নিয়েছে। এসব সামগ্রীর মধ্যে রয়েছে তৈলবাহী, মালবাহী ও মাছ ধরার জাহাজ, যন্ত্রপাতি, রেল ওয়াগন, ফ্রিজার, গবাদি পশু পরিবহন যান, গৃহ ও সড়ক নির্মাণ সরঞ্জাম প্রভৃতি। প্রতিষ্ঠার বছর হতে আজ পর্যন্ত েএই খাতে ব্যাংক ১৬৪.৫০ কোটি ইসলামী দীনার মঞ্জুর করেছে। [সারণী-২ দ্রষ্টব্য] এই অর্থ দিয়ে ১২৭টি প্রকল্প সমাপ্ত হয়েছে। এর মধ্যে শুধুমাত্র ১৪২৪ হিজরীতেই ৮টি সদস্য দেশে ৮টি ইজারা বন্দোবস্ত দেওয়া হয়েছে। সাধারণতঃ ৭ হতে সর্বোচ্চ ১২ বছর মেয়াদের জন্যে ইজারা দেওয়া হয়। অবশ্য শুরুতে ২-৩ বছরের জন্যে রেয়াতী সময় দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে যে মার্ক আপ ধার্য হয় তা নির্ধারিত সময় সীমার মধ্যে পরিশোধ করলে সংশ্লিষ্ট দেশ মোট দেয় মার্ক-আপের উপর ১৫% হারে রেয়াত পেয়ে থাকে। মার্ক-আপের হার বার্ষিক ৮%-৯% হতে হ্রাস করে ১৯৯২ সালে ৭.৫%-৮.৫% এ নামিয়ে আনা হয়েছে।

 

কিস্তিতে বিক্রয়: এই কার্যক্রমের অধীনে গ্রহীতা সদস্য দেশকে মহার্ঘ সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতি [যেমন বিদ্যুৎ উৎপাদন, পানি সরবরাহ, তেলের পাই বসানো] কিস্তিতে মূল্য পরিশোধ সাপেক্ষে বিক্রী করা হয়। সাধারণতঃ ১০-১২ বছরের মধ্যেই নির্ধারিত মার্ক-আপসহ মূল্য পরিশোধ করতে হয়। সাধারণতঃ ১০-১২ বছরের মধ্যেই নির্ধারিত মার্ক-আপসহ মূল্য পরিশোধ করতে হয়। ইজারার মতো মার্ক-আপের হারও সম্প্রতি ৮%০৯% হতে হ্রাস করে ৭.৫%-৮.৫% এ নামিয়ে আনা হয়েছে। এই স্কীমের গ্রাহকের কাছে কোন সামগ্রী হস্তান্তরের সময়ে তার মালিকানাও দিয়ে দেওয়া হয়। এই পদ্ধতিতে বিনিয়োগ কার্যক্রম শুরু হয় ১৪০৫ হিজরীতে এবং আজ অবধি ১৬৪টি প্রকল্পে ১৫৫.৯১ কোটি ইসলামী দীনার বিনিয়োজিত হয়েছে।

 

সারণী-

 

ইসলাম উন্নয়ন ব্যাংকের পদ্ধতিভিত্তিক বিনিয়োগের চিত্র ১৪২১-১৪২৪ হি. (কোটি ইসলামী দীনার)

 

  পদ্ধতি ১৪২১ ১৪২২ ১৪২৩ ১৩৯৬-১২২৪
  সংখ্যা পরিমাণ সংখ্যা পরিমাণ সংখ্যা পরিমাণ সংখ্যা পরিমাণ সংখ্যা পরিমাণ
ঋণ ৫২ ২০.২৭ (৩৪.০৩%) ৪৯ ২০.৬৯ (২৯.১৪% ৪৮ ২২.০৯ (৩১.৩৯% ৫৩ ২৩.৬৫ (২৮.৬৩%) ৫৭৯ ২৫১,১৩ (৩২,৯৭%)
ইকুইটি ০.৫২ (০.৮৭%) (০.৩১) (০.৪৪%) ০.৪৪ (০.৬২%) ০.১৯ (০.২৩%) ১০৮ ২৮.৪২ (৩.৭৩%)
ইজারা ৩.৫৫ (৫.৯৬%) ১১.৮০ (১২.৩০%) ১০.৯১ (১৫.৫০%) ১৩.৭৮ (১৬.৬৮%) ১২৭ ১৬৭.৫৫ (২১.৯৯%)
কিস্তিতে বিক্রয় ৯.৪১ (১৫.৮০%) ১০ ৮.৭৩ (১২.৩০%) ১৪ ২০.৪৬ (২৯.০৯%) ১১ ৭.৯০ (৯.৫৬%) ১৬৪ ১৫৫.৯১ (২০.৪৭%)
মুনাফার অংশীদারিত্ব - - - - - - - - ৬.২৫ (০.৮২%)
ইসতিসনা ১৬ ২৩.৫৮ (৩৯.৬০%) ১৩ ২৫.৮৫ (৩৬.৪১%) ১৪.৭০ (২০.৮৮%) ১৯ ৩৬.৩০ (৪৩.৯৩%) ৭০ ১২০ (১৫.৮২%)
লাইন্স অব ফাইন্যান্সিং‘ ১.১০ (১.৮৪%) ২.৭৪ (৩.৮৬%) ১.০০ (১.৪২%) - - ১৯ ১৮.৭৮ (২.৪৬%)
করিগরি সহযোগিতা ৩৩ ১.১৩ (১.৯০%) ৩৯ ০.৮৭ (১.২২%) ২৯ ০.৭৮ (১.১০%) ২৪ ০.০৮ (০.৯৭%) ৪৩২ ১৩.২৩ (১.৭৪%)
মোট ১১৬ ৫৯.৫৬ (১০০%) ১২৯ ৭০.৯৯ (১০০%) ১০৪ ৭০.৩৮ (১০০%) ১১৭ ৮২.৬২ (১০০%) ১৫০৬ ৭৬১.৭৯ (১০০%)

 

উৎস: ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদন, ১৪২৪ হিঃ।

 

ইকুইটি ফাইন্যান্স: প্রতিষ্ঠার বছর হতে ব্যাংক এ পর্যন্ত এই খাতে ২৮.৪২ কোটি ইসলামী দীনার বিনিয়োগ করেছে। [সারণী-২ দ্রষ্টব্য]। সদস্য দেশসমূহের ননাবিধ প্রকল্পে এই অর্থ বিনিয়োজিত হয়েছে। প্রকল্পগুলোর অনেকগুলোই ইতিমধ্যে উৎপাদন শুরু করেছে। যেসব প্রকল্পে এই অর্থ বিনিয়োগ করা হয়েছে সেসবের মধ্যে রয়েছে সিমেন্ট কারখানা, সূতা ও কাপড়ের কল, বোর্ড ও কাগজের কল, পাইপ শিল্প, কাঠের আসবাব তৈরীর কারখানা, কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা প্রভৃতি। ইকুইটি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যাংক ডিভিডেনটড পেয়ে থাকে।

 

ইসতিসনা: ইসতিসনার অর্থ কেব্রতার সুনির্দিষ্ট স্পেসিফিকেশন বা ফরমায়েশ অনুযায়ী বিক্রেতা নির্ধারিত একটা সময়ের মধ্যে নির্দিষ্ট মূল্যে দ্রব্যসামগ্রী সরবরাহ করবে। পদ্ধতিটি চালু হয় ১৯৯৬ সালে। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল সদস্য দেশসমূহের মধ্যে মূলধনী পণ্যের বাণিজ্য সম্প্রসারণ ও উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি। বেসরকারী খাতে অবকাঠামো তৈরীর জন্যেও এটি ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। এ পর্যন্ত এখাতে ১২০.৫২ কোটি ইসলামী দীনার বরাদ্দ করা হয়েছে।

 

জাতীয় উন্নয়ন অর্থায়ন প্রতিষ্ঠানের সাথে সহযোগিতা: আইডিবি তহবিল বিনিয়োগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খাত হলো সদস্যসমূহের জাতীয় উন্নয়ন অর্থায়ন প্রতিষ্ঠানের সাথে যৌথভাবে অর্থ যোগান। শুরু হতেই এই পদ্ধতিতে সদস্য দেশসমসূহের নানা ধরনর প্রকল্পে ব্যাংক অংশ গ্রহণ করে আসছে। বিভিন্ন আরব দেশীয় তহবিল, আফ্রিকান উন্নয়ন ব্যাংক ও সদস্য দেশগুলোর সরকারেরসাথে যৌথভাবে অংশ গ্রহণ করে সামাজিক প্রয়োজনীয় গণউপযোগধর্মী প্রকল্পে ব্যাংক অর্থ বিনিয়োগ করছে। পরবর্তীকালে ১৯৯৩ সালে আইএমএফ ও বিশ্ব ব্যাংকের গ্রুপ বার্ষিক সভায় আইডিবি অংশ গ্রহণ করে এই পদ্ধতিতে বিনিয়োগ কর্মসূচী পুনর্বিন্যস্ত করে। এই কর্মসূচীর আতওতায় আইডিবি এ পর্যন্ত ২৫টি সদস্য দেশে মোট ১৮.৭৮ কোটি ইসলামী দীনার বিনিয়োগ অনুমোদন করেছে।

 

মুনাফার অংশীদারীত্ব: মুনাফার অংশীদারীত্বের ভিত্তিতে বিনিয়োগ আইডিবির অন্যতম কর্মসূচী। মাঝে কয়েক বছর ব্যাংক এই পদ্ধতিতে বিনিয়োগ স্থগিত রেখে ১৪২৪ হিজরী হতে পুনরায় বিনিায়োগ শুরু করেছে। ব্যাংক এ পর্যন্ত সাতটি প্রকল্পের মোট ৬.২৪ কোটি ইসলামী দীনার বিনিয়োগ করেছে। এর মধ্যে ১৪২৪ হিজরীতেই সংযুক্ত আরব আমীরাতের শারজাহতে আমীরাতে বাণিজ্যিক কমপ্লেক্স নির্মাণের জন্যে ব্যাংক ১.১৫ কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে।

 

কারিগরী সহায়তা: এই কর্মসূচীর অধীনে সদস্য দেশসমূহে কোন প্রকল্প গ্রহণের পূর্বে তার সম্ভাব্যতা নিরীক্ষা, জরীপ, গবেষণা, পরামর্শ বা উপদেশ গ্রহণ প্রভৃতি কাজের জন্যে অনুদান বা ঋণ অথবা আংশিক ঋণ বা আংশিক অনুদান উভয় আকারেই অর্থ সাহায্য করা হয়ে থাকে। প্রকল্প বাস্তবায়ন পর্যায়ের বিস্তারিত নকসা প্রস্তুত, উপদেষ্টা নিয়োগ প্রভৃতি কাজের জন্যেও করিগরী সহাযতা প্রদান করা হয়। প্রতিষ্ঠার বছর হতে ১৪২৪ হিজরী পর্যন্ত ব্যাংক ৩৯টি সদস্য দেশে এই ধরনের ৪৩২টি কার্যক্রমে সর্বমোট ১৩.২৩ কোটি ইসলামী দীনার প্রদান করেছে। শুধুমাত্র ১৪২৪ হিজরীতেই ২৪টি প্রকল্পে ৭২.০ লক্ষ ইসলামী দীনার অনুমোদন করা হয়েছে। এছাড়া বিশেষ বিবেচনায় ইউরোপে আলবেনিয়া ও মধ্য এশিয়ার পাঁচটি সদস্য দেশ আজারবাইজান, কিরঘিজিস্তান, তাজিকিস্তান কাজাখস্তান ও তুকর্কমেনিস্তানের ৮টি প্রকল্পে মোট ১৩.৬ লক্ষ ইসলামী দীনার (বা ১৮.৯ লক্ষ মার্কিন ডলার) মঞ্জুর করা হয়েছে।

 

এখানে উল্লেখ করা মোটেই অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, আইডিবি তার অনুসৃত নীতি, পদ্ধতি ও কর্মকৌশলের দ্বারা সদস্য দেশসমূহের তো বটেই, অসদস্য দেশের মুসলিম জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্যে অব্যাহত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সদস্য দেশসমূহের মধ্যে অগ্রাধিকার পেয়েছে স্বল্পোন্নত একুশটি দেশ। এসব দেশের মধ্যে রয়েছে আফগানিস্তান, ইয়েমেন, উগান্ডা, কমারো, গাম্বিয়া, গিনি, গিনি বিসাউ, জিবুতি, নাইজার, বারকিনা ফাসো, বাংলাদশ, বেনিন, মালদ্বীপ, মালি, মোজাম্বিক, মৌরিতানিয়া, শাদ, সেনেগাল, সিয়েরালিওন, সুদান ও সোমালিয়া। এসব দেশের কৃষির সম্প্রসারণ, শিল্পের বিকাশ, খনিজ সম্পদ আহরণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ, পরিবহন ও যাতায়াত, শিক্ষা ও সামাজিক উন্নয়ন, এবং গণ উযোগসমূহের স্থাপনা ও বিকাশের (বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণ, পানি সরবরাহ, হাসপাতাল স্থাপন প্রভৃতি) ক্ষেত্রে ব্যাংক যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছে।

 

. খাতভিত্তিক অর্থায়ন

 

প্রকল্প অর্থায়নের ক্ষেত্রে ব্যাংক পূর্বে সামাজিক প্রয়োজনীয়তার উপর তেমন গুরুত্ব না দিয়ে প্রকল্পের মুনাফা যোগ্যতাকেই অধিক গুরুত্ব দিয়েছে। এর পরিবর্তন ঘটে ১৯৯৫ হতে। এই সালে Strategic Agenda for the Medium Term Financing গৃহীত হওয়ার পর হতে আইডিবি যেসব খাতকে গুরুত্ব অনুসারে অগ্রাধিকার প্রদান করেছে সেগুলো হলো: কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি আয়তনের শিল্প, সামাজিক খাত এবং পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন। আইডিবির অর্থায়নে সমাপ্ত ও চালু প্রকল্পগুলোকে পাঁচটি বড় ভাগে ভাগ করাযায়। যথা: (ক) কৃষি ও কৃষিভিত্তিক শিল্প (খ) শিল্প ও খনি, (গ) সামাজিক উন্নয়ন, (ঘ) পরিবহন ও যোগাযোগ এবং (ঙ) গণউপযোগ। সারণী-৩ হতে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এসব খাতে বরাদ্দের বিবরণী জানা যাবে। নীচে এগুলোর সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ দেওয়া হলো।

 

 

 

সারণী-       

 

ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের সাধারণ কার্যক্রমে বিনিয়োগের চিত্র (১৪২৪-১৪২৪ হি) (কোটি ইসলামী দীনার)

 

খাত/বছর ১৪২১ ১৪২২ ১৪২৩ ১৪২৪ ১৩৯৬-১৪২৪
  সংখ্যা পরিমাণ সংখ্যা পরিমাণ সংখ্যা পরিমাণ সংখ্যা পরিমাণ সংখ্যা পরিমাণ
কৃষি ও কৃষি শিল্প ১৬ ৩.৫০ (৫.৮৮%) ১৫ ৩.৯৫ (৫.৫৭%) ১৫ ১১.১২ ২৩ ১৩.৩৭ (১৬.১৯%) ৩১০ ১১৪.১৬ (১৪.৯৯%)
শিল্প ও খনি - - ৪.২০ (৫.৯৩%) ৩.৪০ (৪.৮৩%) ২.৭৮ (০.০৩%) ১০৪ ৬০.৬৩ (৭.৯৬%)
পরিবহন ও যোগাযোগ ১৪ ১২.১২ (২০.৪৬%) ২৩ ১৭৪.৪১ (২৪.৫৭%) ১৮ ১৫.৬২ (২২.২০%) ১৭ ১৭.৬৫ (২১.৩৬%) ২৬১ ১৪৩.২০ (১৮.৮০%)
সামাজিক উন্নয়ন ৫৩ ১৯.১৩ (৩২.১২%) ৪৮ ২১.৬০ (৩০.৪৩%) ৩৯ ২০.৭৭ (২৯.৫২%) ৩৮ ২১.৬০ (২৬.১৪%) ৪০৮ ১৭৭.৮২ (২৩.৩৪%)
গণউপযোগ ২১ ২২.১৪ (৩৭.১৭%) ১৮ ২০.৫৭ (২৮.৯৮%) ১৪ ১৫.০২ (২১,৩৫%) ২২ ২৮.১৯ (৩৪.১৩%) ২৬১ ২১৮.১৩ (২৮.৬৩%)
অন্যান্য ১২ ২.৬০ (৪.৩৬%) ১৪ ৩.২০ (৪.৫২%) ১৭ ৪.৪৩ (৬.৩০) ১৬ ১.৫২ (১.৮৪%) ১৬২ ৪৭.৮৪ (৬.২৮%)
মোট ১১৬ ৫৯.৫৬ (১০০%) ১২১ ৭০.৯৯ (১০০%) ১০৪ ৭০.৩৮ (১০০%) ১১৭ ৮২.৬২ (১০০%) ১৫০৬ ৭৬.৭৯ (১০০%)

 

উৎস: ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের বার্ষিক রিপোর্ট, ১৪২০ হিঃ

 

গণ উপযোগ: ব্যাংকের গৃহীত কর্মসূচী ও প্রকল্প অর্থায়নের পরিমাণের দিক হতে বর্তমানে এটি প্রথম স্থানে রয়েছে। এ খাতে গৃহীত কর্মসূচীর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো নিরাপদ সুপেয় পানি সরবরাহের ব্যবস্থা, নবায়নযোগ্য শক্তির বিকাশ, স্যানিটেশন সুবিধা সম্প্রসারণ ও আধুনিকায়ন। পূর্বের তুলনায় ১৯৯৫ সাল হতে এ খাতে বরাদ্দ ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ পর্যন্ত মোট ২১৮.১৩ কোটি ইসলামী দীনার বরাদ্দ হয়েছে যা মোট বরাদ্দের ২৮.৬৩%।

 

সামাজি উন্নয়ন: শিক্ষা ও স্বাস্থ্য উন্নয়ন এ খাতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপখাত। কারিকুলাম উন্নয়ন, শিক্ষক প্রশিক্ষণ, পুস্তুক প্রকাশনা, স্কুলের পাঠ সহাযক উপকরণ সংগ্রহ, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার সুবিধা প্রদান প্রভৃতি খাতে ব্যাংক আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে চলেছে। এ জন্যে এ যাবৎ মোট ১৭৭.৮২ কোটি ইসলামী দীনার বরাদ্দ হয়েছে যা মোট বরাদ্দের ২৩.৩৪%। বিগত চার বছরে এর অবস্থান দ্বিতীয় হলেও এর গড় অবস্থান হ্রাস পেয়েছে পূর্ববর্তী বছরগুলোতে এই ধরনের গুরুত্ব প্রদান না করার কারণে।

 

কৃষি কৃষিভিত্তিক শিল্প: এ খাতে ব্যাংকের অর্থায়নের মুল লক্ষ্য হলো সদস্র দেশসমূহের কৃষি ব্যবস্থার উন্নয়নের সাথে সাথে খাদ্য সংকট মুকাবিলা করা এবং খাদ্যে স্বনির্ভর হতে সাহায্য করা। কৃষি খাতে অধিকতর কর্মসংস্থানের পাশাপাশি দারিদ্র্য বিমোচন ও কৃষিভিত্তিক শিল্প গড়ে তুলতে সাহায্য প্রদানের উদ্দেশ্য এযাবৎ ১১৪.১৬% কোটি ইসলামী দীনার বরাদ্দ করা হয়েছে। মোট প্রকল্প বরাদ্দের মধ্যে এই পরিমাণ ১৪.৯৯%। গুরুত্বের দিক দিয়ে গত ৩/৪ বছর ধরে খাতটি তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে।

 

শিল্প খনি: এক্ষেত্রে আইডিবির কৌশল হলো ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারে উদ্যোক্তাদের সহায়তার মাধ্যমে সদস্য দেশসমূহের শিল্পের ভিত মজবুত ও সম্প্রসারণ করা। সদস্য দেশের সরকারী ফাইন্যান্সিং প্রতিষ্ঠানসমূহের মাধ্যমেই ক্ষুদ্র ও মাঝারী উদ্যোক্তাদের সহায়তা করার পাশাপাশি ইজারার মাধ্যমেও প্রকল্প বাস্তবায়নে সহযোগিতা প্রদান করা হচ্ছে। খনিজ সম্পদ উত্তোলন এবং খনিভিত্তিক শিল্প (যেমন পেট্রোলিয়াম পরিশোধন প্লান্ট, খনিজ সার) স্থানও এই ফাইন্যান্সিংয়ের অন্যতম উদ্দেশ্য। ব্যাংকের পুঞ্জীভূত মোট বরাদেরদর মধ্যে এ খাতের অংশ ৬০.৬৩ কোটি ইসলামী দীনার বা ৭.৯৬%। সারণী-৩ হতে দেখা যাবে বিভিন্ন বছরে এই খাতের গুরুত্বের অবস্থান পরিবর্তিত হয়েছে।

 

পরিবহন যোগাযোগ: পরিবহনই সভ্যতা। উপরন্তু বিশ্বায়ন ও বাণিজ্যিক উদারীকরণের ধাক্কা লেগেছে আইডিবির সদস্য দেশগুলোতেও। বাণিজ্য সম্প্রসারণেল জন্যে তাদের চাই প্রশস্ত ও দীর্ঘ আধুনিক সড়ক, উন্‌নত পোশ্রয়, মালবাহী জাহাজ, রেলগাড়ী এবং বিমান। চাই ছোট শহর হতে রাজধানী এবং শিল্প এলাকা ও বন্দরের সাথে দ্রুত ও নিরাপদ পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা। তাই আইডিবি এ খাতের উন্নয়নের জন্যে বড় ধরনের অর্থ বরাদ্দ করবে এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। প্রশস্ত দীর্ঘ রাস্তা তৈরীর পাশাপাশি বন্দর উন্নয়ন, বিশেষতঃ মালামাল উঠানামা, নিরাপদ নৌপরিবহনের আধুনিক উপায়-উপকরণ সংগ্রহ প্রভৃতি এ ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব লাভ করেছে। এসব কাজে এযাবৎ মোট ১৪৩.২০ কোটি ইসলামী দীনার ব্যবহৃত হয়েছে মোট বরাদ্দে যার অংশ ১৮.৮০%।

 

অন্যান্য: পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নতুন প্রতিষ্ঠিত ইসলামী ব্যাংকসমূহকে তাদের প্রকল্প অর্থায়নে সংকট মোচনের ও বিভিন্ন দেশে যেসব ফাইন্যান্সিং প্রতিষ্ঠান শরীয়াহভিত্তিক বিনিয়োগ আগ্রহী তাদের বিশেষ প্রয়োজন পূরণের জন্যে ব্যাংক এ পর্যন্ত ৪৭.৮৪ কোটি ইসলামী দীনার (৬.২৮%) বরাদ্দ করেছে।

 

. বাণিজ্যিক কার্যক্রম

 

আমদানী বাণিজ্যে অর্থায়ন: সদস্য দেশসমূহের আমদানী বাণিজ্যে সহায়তার জন্যে এই কর্মসূচীটি শুরু হয় ১৯৭৭ সাল (১৩৯৭ হিজরী) হতে। পূর্বে এর নাম ছিল Foreign Trade Financing Operations। এর নতুন নামকরণ হয়েছে Import Trade Financing Operations (ITFO)। ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক এ পর্যন্ত এ প্রকল্পে ১,৬৮১.০ কোটি মার্কিন ডলার সহায়তা করেছে। যেসব পণ্যসামগ্রী আমদানীতে এই আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়েছে সেগুলো হচ্ছে: অপরশোধিত তেল, পরিশোধিত পেট্রোলিয়ামজাত দ্রব্য, ইউরিয়া সার, সিমেন্ট, গন্ধক, পাথুরে ফসফেট , ভোজ্য তেল, কাগজ ও মণ্ড, চিনি, জিপসাম, পাটজাত দ্রব্য, তুলা, সূর্যমুখীর বীজ, আকরিক সীসা, বিভিন্ন মধ্যবর্তী শিল্পজাত সামগ্রী, আকরিক লোহা, এ্যামোনিয়া, তামা, বাইসাইকেল, প্লাইউড, রবার, পেট্রোকেমিক্যাল, এ্যালুমিনিয়াম, কেওলিন প্রভৃতি। তেলসমৃদ্ধ ধনী সদস্য দেশ ছাড়া অন্যান্য সকলেই এই স্কীমের আওতায় বৈদেশিক মুদ্রার আকারে আর্থিক সহযোগিতা গ্রহণ করেছে।

 

রপ্তানী অর্থায়ন কার্যক্রম: এই বিশেষ কর্মসূচীটি শুরু হয় ১৯৮৭ সাল (১৪০৭ হিজরী) হতে। পূর্বে এর নাম ছিল Longer Term Trade Financing Scheme। এর নতুন নামকরণ হয়েছে Export Financing Scheme (EFS)। অপ্রচলিত পণ্য ও মূলধনী পণ্যের ক্রয়-বিক্রয়ে সহযোগিতা করাই এর মুখ্য উদ্দেশ্য। এক্ষেত্রে আমদানী ও রফতানীকারী উভয় দেশকে অবশ্যই ইসরামী উন্নয়ন ব্যাংক ও ইসলামী সম্মেলন সংস্থার সদস্য হতে হবে। এ পর্যন্ত ২৩টি সদস্য দেশ এই স্কীমে যোগ দিয়েছে। এসব দেশের মধ্যে রয়েছে সউদী আরব, মালয়েশিয়া, তিউনিসিয়া, কুয়েত, তুরস্ক প্রভৃতি। যেসব পণ্য ও মূলধনী সামগ্রী দীর্ঘ মেয়াদে মুল্য পরিশোধের ভিত্তিতে ক্রয়-বিক্রয় হয়েছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে টেলিফোন কেবল, প্লাইউড, টায়ার, ক্যালসিয়া কার্বনেট, পাম তেল, এ্যালুমিনিয়াম কন্ডাকটর, রোলিং মিল মেশিনারী ও সরঞ্জাম ইত্যাদি। এই কর্মসূচীতে এ পর্যন্ত সর্বমোট ১২৩.৩১ কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।

 

. মুনাফা

 

এই আন্তর্জাতিক ব্যাংকটির যাবতীয় কার্যক্রম সুদবিহীন। সেহেতু যে প্রধান ছয়টি উপায়ে ব্যাংক তার পরিচালনা ও অন্যান্য ব্যয় নির্বাহের জন্যে অর্থ উপার্জন করে থাকে সেগুলো উল্লেখের দাবী রাখে। এগুলো যথাক্রমে:-

 

১. বৈদেশিক বাণিজ্যিক কার্যক্রম অংশগ্রহণ হতে আয়;

 

২. প্রকল্প ফাইন্যান্সের জন্যে সার্ভিস চার্জ;

 

৩. সদস্য দেশসমূহে ইকুইটি ফাইন্যান্সিং হতে আয়;

 

৪. ইজারা হতে আয়;

 

৫. যৌথ অর্থায়ন হতে আয়; এবং

 

৬. কারিগরী সহায়তার জন্যে সার্ভিস চার্জ।

 

এসব উপায় বা পদ্ধতি ব্যবহার করে গৃহীত কার্যক্রমের মাধ্যমে ১৪১৫ হি. হতে ১৪২৪ হিজরী পর্যন্ত ব্যাংক যে মুনাফা অর্জন করেছে তার একটা তুলনামূলক চিত্র সারণী-৪ হতে পাওয়া যাবে। মুনাফঅ নির্ধারণের ক্ষেত্রে ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক নিয়ম অনুযায়ী মোট আয় হতে প্রশাসনিক ও পরিচালা ব্যয় এবং স্থির সম্পদে অপচয় বাদ দেওয়া ছাড়াও ইকুইটি বিনিয়োগের মূলধন মান স্থির রাখার জন্যে ১৪০৩ হিজরী হতে ১৪১১ হিজরী পর্যন্ত বিভিন্ন বছরে ন্যূনতম ২০ লক্ষ হতে সর্বোচ্চ ১ কোটি ৫০ লক্ষ ইসলামী দীনার আলাদা করে রেখেছে। অবশ্য ১৪১২ হতে ১৪১৫ হিজরী সালে এই ধরনের আলাদা অর্থ রাখা হয়নি। এ যাবৎ এই অর্থের মোট পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯.৫৫ কোটি ইসলামী দীনার। সদস্য দেশসমূহের প্রতিকূল অর্থনৈতিক অবস্থা, মুদ্রার অবমূল্যায়ন, অর্থনৈতিক মন্দা ইত্যাদি কারণে ইকুইটি অর্থের যে মান হ্রাস পায় তা পূরণ ও সম্ভাব্য লোকসান পুষিয়ে নেওয়অর জন্যে এই ব্যবস্থা। এই অর্থ হতে আদৌ আদায় হওয়ার সম্ভাবনা নেই এমন মোট ২.৩৯ কোটি ইসলামী দীনারের ইকুইটি অবলোপন করা হয়েছে।

 

এই সারণী হতে দেখা যাবে গত দশ বছরে ব্যাংকটির মুনাফার পরিমাণে হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটেছে। তবে খুব বড় ধরনের পরিবর্তন নেই। অবচয় ও প্রভিশন খাতে যে অর্থ রাখা হয়েছে তা সন্তোষজনক। তবে হঠাৎ করে ১৪২৪ হিজরীতে রাখা অবচয় ও প্রভিশনের অংক চোখে পড়ার মতো। এর কারণ হলো বিশ্বব্যাপী মুদ্রার অবমূল্যায়ন ও বিনিময় হারের অস্থিরতার জন্যে এ বছরে আইডিবির বিনিময়জনিত ক্ষতি (Exchange Loss) হয়েছে ২৯০ লক্ষ ইসলামী দীনার। প্রভিশনের সঙ্গে এই অর্থ যুক্ত করে দেখানো হয়েছে।

 

সারণী-

 

ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের মুনাফার বিবরণ: ১৪১৫ হি-১৪২৪ হি. (লক্ষ ইসলামী দীনার)

 

বছর আয় ব্যয় অবচয় ও প্রভিশন মুনাফা
১৪১৫ ১০২০ ২৫০ ১১০ ৬৬০
১৪১৬ ৯৬০ ২৬০ ১১০ ৫৯০
১৪১‘৭ ১০৯০ ৩১০ ১০০ ৬৮০
১৪১৮ ১১২০ ৩৫০ ১৮০ ৫৯০
১৪১৯ ১৩৬০ ৩৭০ ২৩০ ৭৬০
১৪২০ ১৪০০ ৪০০ ২৮০ ৭২০
১৪২১ ১৫১০ ৪৪০ ২৯০ ৭৮০
১৪২২ ১৭১০ ৫৩০ ৪৫০ ৭৩০
১৪২৩ ১৬১০ ৪৯০ ৩৯০ ৭৩০
১৪২৪ ২২২০ ৫৩০ ১১০০ ৫৯০

 

উৎস: ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদনসমূহ

 

. ওয়াকফ তহবিল কার্যক্রম

 

আইডিবির সদস্যভুক্ত দেশসমূহের মধ্যে বেশ কয়েকটি দেশ রয়েছে যাদের জনসাধারণ দারিদ্র্য সীমার নীচে বাস করে। তাদের মাথাপিছু আয়ও বিশেষ সর্বনিম্ন সেসব দেশের জনসাধারণের ভাগ্য উন্নয়নের জন্যে সরকারের গৃহীত নানা উন্নয়নমুখী কর্মসূচীতে এই ব্যাংক বিশেষ সাহায্যের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। ব্যাংকের বোর্ড অব গভর্নরস কর্তৃক ১৩৯৯ হিজরীতে গৃহীত েএক সিদ্ধান্ত অনুসারে তলবী ও আমানতের হিসাব খাত থেকে প্রাপ্ত আয় দিয়ে বি্যেশ্যষ সহায়তা তহবিল (Special Assistance Account) নামে একটি পৃথক তহবিল গঠিত হয়। পরবর্তীতে ১৪১৭ হিজরীতে এর নাম পরিবর্তন করে ওয়াকফ ফান্ড রাখা হয়। এই তহবিল গঠনের উদ্দেশ্য হলো:

 

১. সদস্য দেশসমূহের অর্থনীতি, ফাইন্যান্স ও ব্যাংকিং কার্যক্রমকে শরীয়াহর সাথে সঙ্গতিপূরণ করার উদ্দেশ্যে প্রশিক্ষণ ও গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা;

 

২. সদস্য দেশসমূহকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বিপর্যয়ে সহায়তা প্রদান;

 

৩. ইসলামী জীবনাদর্শ বাস্তবায়ন ও বিকাশে সহযোগিতা করা; এবং

 

৪. স্বল্পোন্নত সদস্য দেশসমূহকে বিশেষ টেকনিক্যাল সহযোগিতা প্রদান।

 

এই তহবিলের অর্থ হতে ব্যাংকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ইসলামী গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউট (IRTI) পরিচালিত হচ্ছে। আনন্দের কথা, প্রতি বছরই তহবিলের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বৃদ্ধি পাচ্ছে কর্মকাণ্ডও। উদাহরণস্বরূপ, ১৪০৯ হিজরীতে এই তহবিলের পরিমাণ ছিল ৬৭.৭৪ কোটি ইসলামী দীনার। পরবর্তী বছরে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৭২.৮১ কোটিতে। ১৪১৯ হিজরীতে এই তহবিলের পরিমাণ ছিল ৮৯.৪০ কোটি ইসলামী দীনার।

 

সদস্য দেশসমূহের যেসব ক্ষেত্রে বিশেষ সহায়তা প্রয়োজন কিন্তু বিধিবদ্ধ খাত হতে অর্থ মঞ্জুরী দেওয়া সম্ভব নয় সেসব ক্ষেত্রে এই তহবিল হতে অর্থ সাহায্য করার বিধান রয়েছে। উপরন্তু অ-মুসলিম দেশের মুসলিম জনসাধারণের শিক্ষা ও উন্নয়নের জন্যেও এই তহবিলহতে সাহায্য করা হয়। ১৩৯৯ হিজরীতে (১৯৭৯) প্রতিষ্ঠার পর হতে এ পর্যন্ত ১০১৭টি প্রকল্পে ৫৬.৫৫ কোটি মার্কিন ডলার সাহায্য অনুমোদন করা হয়েছে। এর মধ্যে সদস্য দেশসমূহের মুসলমানদের জন্যে ৬৪৩ কোটি মার্কিন ডলার মঞ্জুর করা হয়েছে। অমুসলিম দেশসমূহের মুসলমানদের জন্যে ৬৪৩টি প্রকল্প বরাদ্দ করা হয়েছে ১৯.৫৩ কোটি মার্কিন ডলার।

 

অমুসলিম দেশসমূহের মধ্যে সবচেয়ে বেশী মুসলমান বাস করে ভারতে, প্রায় বারো কোটি। তাদের সহায়তার জন্যে, বিশেষতঃ বেকার ও মেধাবী তরুণ-তরুণীদের জন্যে বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ ও সাধারণ শিক্ষা লাভের সুবিধার্থে আইডিবি ১৪০৫ হিজরীতে ৩.০ কোটি মার্কিন ডলারের একটি বিশেষ বরাদ্দ মঞ্জুর করে। এই বরাদ্দ হতে প্রতি বছর সুনির্দিষ্ট ও বাছাইকৃত প্রকল্পে সাহায্য করছে ব্যাংক। এযাবৎ ভারতীয় মুসলিমদের শিক্ষা ও বৃত্তিমূলক কর্মকাণ্ডে সাহায্যের জন্যে এ তহবিল হতে সর্বমোট ১৭০টি প্রকল্পে ২.৯৯ লক্ষ মার্কিন ডলার বরাদ্দ করা হয়েছে। উপরন্তু এগারোটি অমুসলিম দেশের সংখ্যালঘু মুসলমানদের ইসলামী শিক্ষা ও আরবী ভাষার চর্চার সুবিধার জন্যে ২৩টি বিশেষ প্রকল্পে ৫৫.৯০ লক্ষ মার্কিন ডলার সহায়তা মঞ্জুর করা হয়েছে। এসব দেশের মধ্যে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, দক্ষিণ আফ্রিকা, গণচীন, বুরুন্ডি, ইথিওপিয়া প্রভৃতি। পাকিস্তানে আগত আফগান মুহাজিরদের জন্যে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পুনর্বাসন কর্মসূচীতে ব্যাংকের সহযোগিতা সবিশেষ উল্লেখের দাবী রাখে।

 

স্কলারশীপ স্কীম: আইডিবি অমুসলিম দেশসমূহে বিশেষ করে পূর্ব ইউরোপীয় দেশ, বিলুপ্ত সোভিয়েত রাশিয়ার মুসলিম দেশ এবং আফ্রিকার মুসলিম অধ্যুষিত অসদস্য দেশসমূহের মেধাবী মুসলম ছাত্র-ছাত্রীদের বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে উচ্চ শিক্ষা ও পেশাদারী প্রশিক্ষণ লাভের সুবিধার্থে ১৯৮৩ সাল (১৪০৪ হিজরী) হতে স্কলারশীপ স্কীম চালু করেছে। মুসলিম ছাত্র-ছাত্রীরা তাদরে দেশেরেই খ্যাতিসম্পন্ন নির্বাচিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অথবা আইডিবির সদস্য দেশসমূহের নির্বাচিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উচ্চ শিক্ষার জন্যে এই স্কলারশীপ ভোগ করতে পারবে। এই অর্থ করযে হাসানা আকারে প্রদত্ত হয়। শিক্ষা জীবন শেষে ছাত্র-ছাত্রীরা কর্মজীবনে প্রবেশ করে ক্রমে ক্রমে এই অর্থ পরিশোধ করবে। শিক্ষার্থীদের নিজ নিজ দেশে আইডিবি সৃষ্ট ওয়াকফ তহবিলে এ অর্থ জমা দেবে এবং তা থেকে পুনরায় মেধাবী ছাত্র/ছাত্রীদের বৃত্তি মঞ্জুর করা হবে। স্বল্পোন্নত সদস্য দেশসমূহেও এ ব্যবস্থা চালু হয়েছে। বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই এই সুবিধা ভোগ করছে। চিকিৎসা, প্রকৌশল, কৃষি, পশুপালন, ফার্মেসী, হিসাববিজ্ঞান, ফাইন্যান্স, অর্থনীতি প্রভৃতি ক্ষেত্রে উচ্চ শিক্ষা ও পেশাদারী প্রশিক্ষণ লাভের জন্যে এই সুযোগ রয়েছে। এ পর্যন্ত ৫১টি দেশের ৬,৮২৭ জন মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীকে এই কর্মসূচীর আওতায় স্কলারশীপ প্রদান করা হয়েছে যার পরিমাণ ৫.০৫ কোটি মার্কিন ডলারেও বেশী।

 

সদস্য দেশসমূহে উচ্চতর প্রযুক্তি ও বৈজ্ঞানিক প্রশিক্ষণ সম্প্রসারণের জন্যে ১৪০৯ হিজরী হতে আইডিবি হাই টেকনোলজিতে তিন বছর মেয়াদী পি-এইচ.ডি. ডিগ্রী ও একবছর মেয়াদী পোষ্ট ডক্টরাল গবেষণার জন্যে স্কলারশীপ প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ১৯৯৩ সালে (১৪১৩ হিজরী) হতে স্কীমটি চালু হয়। প্রথম পর্যায়ে ৫ বছরের জন্যে প্রকল্পটি গৃহীত হলেও মেয়াদ শেষে এটি ‍পুনরায় ৭ বছরের জন্যে সম্প্রসারিত করা হয়েছে। স্বল্পোন্নত সদস্য দেশসমূহের মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের জন্যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে এম.এস-সি. ডিগ্রী অর্জনের সুবিধার্থে ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দ (১৪১৯ হিজরী) হতে আলাদা বৃত্তি কর্মসূচী চালু করেছে আইডিবি।

 

এনজিও মহিলা উন্নয়ন: ওয়াকফ তহবিলের আওতায় নতুন এই দুটি কর্মসূচীর কাজ শুরু হয় যথাক্রমে ১৪১৮ ও ১৪১৯ হিজরী হতে। সদস্য দেশসমূহের ইসলামী এনজিওসমূহ ও মহিলাদের উন্নয়নের জন্যে দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচী বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে তৃণমূল পর্যায়ে প্রশিক্ষণ ও সামর্থ্য সৃষ্টির উদ্দেশ্যে এই কর্মসূচীর আওতায় এযাবৎ ২৪টি প্রকল্পে ছয় লক্ষ ডলার ব্যয়িত হয়েছে।

 

কল্যাণধর্মী কর্মসূচী: এই কর্মসূচীর আওতায় সউদী আরবে প্রতি বছর হজ্জ মৌসুমে যে লক্ষ লক্ষ পশু কুরবানী হয় সেসব বিশেষ প্রক্রিয়ায় হিমাগারে সংরক্ষণ করে স্বল্পোন্নত ও দুর্ভিক্ষপীড়িত সদস্য দেশসমূহে বিতরণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। পূর্বে কুরবানীকৃত লক্ষ লক্ষ পশু বুলডোজার দিয়ে বালির নীচে পুঁতে ফেলা হত। কিন্তু মুসলিম উম্মাহর প্রয়োজন, বিশেষ করে স্বল্পোন্নত সদস্য দেশগুলোর জনগণের পুষ্টির কথা বিবেচনা করে ১৯৮৩ সাল (১৪০৩ হি) হতে এই কর্মসূচূ গৃহীত হয়। এ পর্যন্ত ব্যাংক এই কর্মসূচীর আওতায় এক কোটি চল্লিশ লক্ষেরও বেশি ভেড়া ও উটের গোশত স্বল্পোন্নত সদস্য দেশ ও অমুসলিম দেমের দরিদ্র মুসলিম জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে দিয়েছে।

 

. বিনিয়োগ রপ্তানী ঋণের বীমা

 

আইডিবির অপর অন্যতম অঙ্গসংস্থা বিনিয়োগ ও রপ্তানী ঋণের ইসলামী বীমা কর্পোরেশন (Islamic Corporation for the Insurance of Investment and Export Credit (ICIEC))। সদস্য দেশসমূহের রপ্তানী বৃদ্ধি ও রপ্তানীতে বিনিয়োজিত অর্থের বীমা করার উদ্দেশ্যেই ১৯৯৪ সালে (১৪১৫ হিজরী) প্রতিষ্ঠানটি স্থাপিত হয়। আইডিবির প্রেসিডেন্ট পদাধিকার বলে এই কর্পোরেশনেরও প্রেসিডেন্ট। এর অনুমোদিত মূলধনের পরিমাণ দশ কোটি ইসলামী দীনার। আইডিবি এর ৫০% পরিশোধ করেছে, বাকী ৫০% পরিশোধ করেছে তেইশটি দেশ। প্রতিষ্ঠানটি ১৯৯৫ সালের জুলাই হতে শরীয়াহ নীতিমালার আলোকে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রা বিনিয়োগ ঝুঁকি, যুদ্ধ, চুক্তি সম্পাদনকারী সরকারের সম্ভাব্য ওয়াদা খেলাপ, রাজনৈতিক গোলযোগ ইত্যাদির বিপরীতেও বিনিয়োগ বীমা স্কীম চালু করেছে।

 

. বেসরকারী খাত উন্নয়নের বিশেষ পদক্ষেপ

 

. আইসিডি (ICD) : আইডিবির বোর্ড অব গভর্ণরসের ২৫তম বার্ষিক সভায় (১৪২০ হিজরী) সদস্যদেশগুলোর বেসরকারী খাতের উন্নয়নের জন্যে ‘ইসলামী কর্পোরেশন ফর দি ডেভেলপমেন্ট অব প্রাইভেট সেক্টর’ নামে আরেকটি অঙ্গসংস্থা তৈরী হয়েছে। স্বতন্ত্র ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এটি পরিচালিত হবে তবে আইডিবির প্রেসিডেন্টই এই কর্পোরেশনের প্রেসিডেন্ট হবেন। এর অনুমোদিত মূলধনের পরিমাণ ’ ১০০ কোটি ডলার। আইডিবি মূলধনের ৫০% পরিশোধ করবে। সদস্য দেশগুলো মূলধনের ২০% শেয়ার ক্রয় করবে। বাকী ২০% ক্রয় করবে সদস্য দেশগুলোর সরকারী সংস্থাসমূহ। এই উদ্যোগের ফলে সদস্য দেশগুলোর বহুমুখী উন্নয়নে সরকারী খাতের পাশাপাশি বেসরকারী খাতেওএখন আইডিবির অংশগ্রহণ নিশ্চিত হলো।

 

. ওয়ার্লড ওয়াকফ ফাউন্ডেশন (WWF): বিশ্বব্যাপী ওয়াকফ কার্যক্রম পরিচালনা ও দানশীল ব্যক্তিদের দান গ্রহণের উদ্দেশ্যে এই তহবিল গঠিত হয়েছে ১৪২২ হিজরীতে (সেপ্টেম্বর ২০০১)। যে কেউ এই তহবিলে দশ লক্ষ মার্কিন ডলার দান করে এর সদস্য হতে পারেন। আইডিবি নিজেও এই তহবিলে প্রারম্ভিক মূলধন হিসেবে ২.৫০ কোটি মার্কিন ডলার দান করেছে। আইডিবির প্রেসিডেন্ট পদাধিকার বলে এই ফাউন্ডেশনেরও প্রেসিডেন্ট। সদস্য দেশসমূহের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে অর্থবহ উন্নয়নের জন্যে এই ফাউন্ডেশন কাজ করে যাবে।

 

. আওফাফ প্রোপার্টি ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড (APIF): ইসলামের বিশেষ ঐতিহ্য হিসাবে ওয়াকফের পুনর্জীবন ও আওকাফের ভূমিকা উন্নয়ন এবং সদস্য ও অসদস্য দেশসমূহের ওয়াকফঠকৃত স্থাপর সম্পত্তির ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি মুসলিম উম্মাহর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নের উদ্দেশ্যে ১৪১৮ হিজরীতে এই তহবিল গঠিত হয়। আইডিবি ইতিমধ্যেই এই তহবিলে ৫.০ কোটি মার্কিন ডলার প্রদান করেছে এবং সদস্যরা ৫.৫ কোটি মার্কিন ডলারের মূলধন পরিশোধের অঙ্গীকার করেছে।

 

. ইসলামী ব্যাংক প্রত্ঠিা

 

বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম দেশে ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক ও প্রত্যক্ষ বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছে। যে সমস্ত ইসলামী ব্যাংকের মূলধনের অংশ বিশেষ সরবরাহসহ বিভিন্ন পরামর্শ ও করিগরী জ্ঞান দিয়ে এই আন্তর্জাতিক ব্যাংকটি সহায়তা করেছে সেগুলো হচ্ছে:

 

১. দুবাই ইসলামী ব্যাংকের গৃহায়ণ প্রকল্পের জন্যে ৪২.৭০ লক্ষ ইসলামী দীনার মঞ্জুর করেছে; ২. বাহরাইন ইসলামী ব্যাংকের মোট শেয়ারের ১৫% আই.ডি.বি. কিনে নিয়েছে যার অর্থ মূল্য ৩০.৫ লক্ষ ইসলামী দীনার; ৩. ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের মোট পরিশোধিত মূলধনের ৭.৫% প্রদান করেছে; ৪. গাম্বিয়ার ইসলামী ব্যাংকের মোট পরিশোধিত মূলধনের ৭.৫% প্রদান করেছে।

 

এছাড়া মিশরের ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ব্যাংক ফর ইনভেস্টমেন্ট এ্যাণ্ড ডেভেলপমেন্ট, জর্দান ইসলামিক ব্যাংক ফর ফাইন্যান্স এ্যাণ্ড ইনভেস্টমেন্ট, কুয়েত ফাইন্যান্স হাউস, ফয়সাল ইসলামী ব্যাংক (সুদান এবং মিশর), ব্যাংক ইসলামিক দ্য নাইজার, ব্যাংক ইসলমিক দ্য সুদান এবং ব্যাংক ইসলামিক দ্য গিনি প্রভৃতিতির প্রতিষ্ঠালগ্নে কারিগরী পরামর্শ ও নানাবিধ সহায়তা প্রদান করেছে ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক। এই ব্যাংকের সাফল্য ও কার্যকারিতা অন্যান্য দেশেও ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠার জন্যে অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবেও কাজ করেছে।

 

উপরন্তু বিশ্বব্যাপী ইসলামী ব্যাংক ও ইসলামী ফাইন্যান্সিয়াল প্রতিষ্ঠানসমূহের বিকাশ, শরীয়াহ পরিপালন, হিসাব নিরীক্ষণ ও রেটিং নির্ধারণ ইত্যাদি উদ্দেশ্যে ইতিমধ্যেই আইডিবি যেসব প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে সেগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো: Auditing and Accounting Organization for Islamic Financial Institutions (AAOIFI). Islamic Financial Services Board (IFSB). International Islamic Financial Market (IIFM), Liquidity Management Centre (LMC), International Islamic Rating Agency (IIRA), General Council for Islamic Banks and Financial Institutions (GCIBFI).।

 

. আই আর টি আই

 

আইডিবির নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনাধীন ইসলামী গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (Islamic Research and Training Instituion বা আই. আর. টি. আই.) সম্বন্ধে আলোকপাত না করলে এই আলোচনা অসম্পূর্ন রয়ে যাবে। প্রতিষ্ঠার পর হতেই আইডিবি সদস্য দেশগুলোর উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সহযোগিতার পাশাপাশি তাদের দেশে দক্ষ ইসলামী জনশক্তি গড়ে তোলা এবং ইসলামী অর্থনীতির চ র্চা-চিন্তার সম্প্রসারণ ঘটানোও জরুরী বলে বিবেচনা করে। এই দায়িত্ব পালনের জন্যেই ১৪০১ হিজরীতে আই.আর.টি.আই.-এর প্রতিষ্ঠা। ইন্সটিটিউটটি পাঁচটি ক্ষেত্রে অব্যাহত তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। এসব তৎ]পরতা ও উদ্যোগ আইডিবির তহবিল বিনিয়োগ ও ব্যবহারের জন্যে নতুন কর্মকৌশল উদ্ভাবন ও মুসলিম উম্মাহর মধ্যে সহযোগিতার কাজে প্রভূত সহায়তা করছে। অন্যদিকে ইসলামী অর্থনীতি, ফাইন্যান্স ও ব্যাংকিং সম্বন্ধে উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা ও পরিচালকদের হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দানের পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী ইসলামের কালজয়ী জীবনাদর্শ সম্প্রসারণেও সহায়তা করছে।

 

. ওয়ার্কশপ: আইআরটিআই এযাবৎ পঞ্চাশটিরও বেশী সফল ওয়ার্কশপ পরিচালনা করেছে। জেদ্দার সদস দপ্তরে ছাড়াও সদস্য দেশসমূহের রাজধানীতে ইসলামী ব্যাংক ও বীমা ব্যবস্থা পরিচালনা, ইসলামী ফাইন্যান্স বিষয়ক কৌশল উদ্ভাবন, ওয়াকফ সম্পত্তি পরিচালনা, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সফলভাবে অংশ গ্রহণ প্রভৃতি বিষয়ে এসব ওয়ার্কশপ বা কর্মশালা সংঘটিত হয়েছে।

 

. সেমিনার: ইনস্টিটিউটটি সদস্য দেশগুলোর অর্থ ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক, আগ্রহী বিশ্ববিদ্যালয় ও অর্থনৈতিক গবেষণা ইনস্টিটিউটসমূহের সাথে যৌথ উদ্যোগে ‍নিয়মিতভাবে ইসলামী অর্থনীতির গঠন-পাঠন, যাকাতরে ব্যবস্থাপনা, ওয়াকফ প্রশাসন ও ভূমি সংস্কার, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সরকারী অর্থব্যবস্থা, মানব সম্পদ উন্নয়ন, ইসলামী ফাইন্যান্সিয়াল ইন্সট্রুমেন্টস তৈরী, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, ইসলামী কমন মার্কেট প্রভৃতি বিষয়ে তথ্যবহুল ও দিক-নির্দেশনামূলক সেমিনার ও কনফারেন্সের আয়োজন করছে।

 

. গবেষণা পুরষ্কার: আইআরটিআই নিজস্ব তত্ত্বাবধানে অর্থনীতিতে আধুনিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত উচ্চতর যোগ্যতাসম্পন্ন মুসলিম গবেষককদের দ্বারা ইসলামী অর্থনীতি, ফাইন্যান্স ও ব্যাংকিং-এর নির্বাচিত সমস্যা সম্বন্ধে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে যোগ্য গবেষকদেরও এ ব্যাপারে গবেষণা চালিয়ে যাবার জন্যে উৎসাহিত করে আসছে এবং প্রয়োজনীয় আর্থিক সহযোগিতা দিচ্ছে। ইন্সটিটিউট সম্প্রতি অর্থনীতি ও ব্যাংকিং ক্ষেত্রে মুসলিম বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিত্ব ও প্রখ্যাত গবেষকদরে আমন্ত্রণমূলক বক্তৃতামালার কর্মসূচীও চালু করেছে।

 

আইডিবি আইআরটিআই-এর সহযোগিতায় ১৪০৮ হিজরী (১৯৮৮) হতে ‘ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক পুরষ্কার’ নামে ইসলামী অর্থনীতি ও ব্যাংকিং এর উপর আন্তর্জাতিক পুরষ্কার প্রদানের প্রথা চালু করেছে। ইসলামী অর্থনীতির চর্চা, প্রচার ও প্রসার, গবেণা ও প্রশিক্ষণ এবং ইসলামী ব্যাংক ‍ও বিনিয়োগ সংস্থা প্রতিষ্ঠয় যাঁদের মেধা, শ্রম ও সাংগঠনিক অবদান অসাধারণ তাঁদের কাজের স্বীকৃতি ও সম্মাননা জানাবার জন্যে এই পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে। একক ও যুগ্ম উভয়ভাবেই পুরষ্কার দেওয়া হয়। পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে স্ব স্ব ক্ষেত্রে তাদের অবদানের উল্লেখসহ সনদপত্র ও নগদ ত্রিশ হাজার ইসলামী দীনার (প্রায় চল্লিশ হাজার মার্কিন ডলার সমান) প্রদান করা হয়। এ পর্যন্ত যাঁরা এই আন্তর্জাতিক মর্যাদাসম্পন্ন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন সারণী-৫ হতে তাঁদের নাম জানা যাবে।

 

. প্রকাশনা: বিভিন্ন ওয়ার্কশপ, সেমিনার ও কনফারেন্সে পঠিত প্রবন্ধসমূহের মধ্যে যেগুলো উন্নতমানের ও প্রাসঙ্গিক গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয় সেগুলো সম্পাদনা করে বই বা সংকলন আকারে প্রকাশের ব্যবস্থা করছে ইন্সটিটিউট। এছাড়া মানসম্মত গবেষণাপত্রসমূহের সম্পাদিত সংস্করণ বই আকারে প্রকাশ করে যাচ্ছে। এযাবৎ এরকম ছোট বড় ২৩২টি বেশী সংকলন ও গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য, আইডিবির সরকারী ভাষা যেহেতু আরবী এবং কাজের ভাষা ইংরেজী ও ফরাসী সেহেতু এসব বাই ও গবেষণাপত্র এই তিন ভাষাতেই প্রকাশিত হচ্ছে। অনেক সময় একই বই বা গবেষণাপত্র তিনটি ভাষাতেই প্রকাশিত হয়। সংখ্যার দিক দিয়ে ইংরেজী ভাষার প্রকাশনাই বেশী। উপরন্তু অত্যাধুনিক কম্পিউটার ডাটা প্রসেসিং সুবিধাসহ একটি সমৃদ্ধ লাইব্রেরীও গড়ে তোলা হচ্ছে। ইতিমধ্যে ২৮,৬৮০টি বই সদস্য দেশসমূহের ১৫,৪৪৮টি অর্থনৈতিক ও ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্ট এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার ১৯,২৭২টি মূল্যবান প্রকাশনা/মূল্যায়ন রিপোর্ট সংগৃহীত হয়েছে। এছাড়া ৫৩২টি সাময়িকীও নিয়মিত ক্রয় করছে।

 

. তথ্য সংগ্রহ: ইসলামী উম্মাহর স্বার্থে মুসলিম ও অমুসলিম দেশসমূহের মুসলমানদের সম্পর্কে নানাবিধ তথ্য সংগ্রহ এবং বিন্যাস ও বিশ্লেষণ করার দায়িত্বও পালন করে চলেছে আই.আর.টি.আিই। জনসংখ্যার বন্টন, শিক্ষা, পেশাগত অবস্থা, বিজ্ঞান ও কারিগরী গবেষণা ও উন্নয়ন, অর্থনৈতিক সূচক এবং বিবিধ সামাজিক প্রসঙ্গের উপাত্ত সংগ্রহ এই দায়িত্বের অংশ। মূলতঃ সদস্য দেশসমূহের মধ্যে আর্থ-সামাজিক, বাণিজ্যিক এবং বৈজ্ঞানিক ও কারিগরী তথ্য বিনিময়ের সুবিধার জন্যে নির্ভরযোগ্য নেটওয়ার্ক হিসাবে আইডিবি যেন কাজ করতে পারে সেই উদ্দেশ্যেই OIC Information Systems Network ও বিস্তারিত Muslim World Information Database তৈরীতে সাফল্য অর্জন করেছে।

 

প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ না করলেই নয় যে বিশ্বব্যাংকের আদলে মুসলিম উম্মাহর বহুমুখী প্রয়োজন পূরণ ও উন্নয়ন নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে আইডিবি নিজস্ব উদ্যোগে ইন্টরন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োস্যালাইন এগ্রিকালচার (ICBA) নামে একটি সম্পূর্ণ অলাভজনক ফলিত কৃষি গবেষণা ও উন্নয়ন কেন্দ্র গড়ে তুলেছে সংযুক্ত আরব আমীরাতের দুবাইয়ে। কেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৪২০ হিজরীতে (১৯৯৯ খৃঃ)। জেনেটিক বিষয়ক গবেষণা, লবণাক্ত জমি পুনুরুদ্ধার, প্রশিক্ষণ ও ওয়ার্কশপ পরিচালনা ইত্যাদি কর্মকাণ্ডের মধ্যে কেন্দ্রটি এগিয়ে চলেছে।

 

. আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সহযোগিতা

 

প্রতিষ্ঠার পর হতেই আইডিবি যেমন সদ্য দেশসমূহের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে আসছে তেমনি বিশ্বমানবাতর কল্যাণের স্বার্থে অংশগ্রহণ করে আসছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন ও ফেরামের সাথে। শুরু থেকেই আইডিবি বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (ADB), আফ্রিকান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (AFDB) এবং ইউরোপীয়ান ব্যাংক ফর রিকনস্ট্রাকশন এন্ড ডেভেলপমেন্ট (EBRD) এর সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। এছাড়াও ওআইসি এবং তার বিভিন্ন অংগসংগঠন যেমন Comstech, COMIAC, ICCI, ISESCO, IDDT, SESRTCIC, বিশেষ করে COMCEC এর সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখে চলেছে। আন্তঃআঞ্চলিক পর্যায়ে সহযোগিতা সম্প্রসারণ ও দৃঢ় করার উদ্দেশ্যে আইডিবি যেসব সংস্থার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে সেসবের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হলো আরব-মাগরেব ইউনিয়ন (AMU), গালফ কো-অপরেশন কাউন্সিল (GCC), পশ্চিম আফ্রিকার দেশসমূহের অর্থনৈতিক ইউনিয়ন (ECOWAS), কাস্টমস ইউনিয়ন অব সেন্ট্রাল আফ্রিকান স্টেটস (CU CAS), দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশসমূহের সংস্থা (ASEAN), সাউথ এশিয়ান এ্যাসোসিয়েশন ফর রিজওন্যাল কোঅপারেশন (SAARC), এবং আটটি মুসলিম দেশ নিয়ে গটিত ডি-৮। এছাড়া জাতিসংঘ এবং এর যেসব অংগ সংগঠনের সাথে আইডবি বিশেষ সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে সেসবের মধ্যে রয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO), বিশ্ব খাদ্য সংস্থা (FAQ), ইউএনডিপি, ইউনিসেফ, ইউনেস্কো, ইউনাইটেড নেশন্স কনফারেন্স অন ট্রেড এ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (UNCTAD) প্রভৃতি। উপরন্তু কমন মার্কেট ফর ইস্টার্ন এ্যান্ড সাউদার্ন আফ্রিকা (COMESA), এসোসিয়েশন ফর ন্যশনাল ডেভেলপমেন্ট ফাইন্যান্স ইন্সটিটিউশন (ADFIMI), বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (WTO), ইন্টারন্যাশনাল ফান্ড ফর এগ্রিকালচারাল ডেভেলপমেন্ট (IFAD), ওয়ার্ল্ড ইনটেলেকচুয়াল প্রোপার্টি অর্গানাইজেশন (WIPO) প্রভৃতির সাথেও সংযোগ রেখে চলেছৈ। ফলে অভিজ্ঞতা বিনিময়, উন্নয়নমূলক কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ ও বিশেষঞ্জদের পরামর্শের মাধ্যমে উভয় পক্ষই উপকৃত হওয়ার সুবর্ণ সুযোগ লাভ করছে।

 

মন্তব্য সুপরিশ

 

১. আইডিবির বার্ষিক প্রতিবেদনগুলো হতে দেখা যায় যে, ১৩৯৬-১৪২৩৪ সময়কাল মোট মঞ্জুরীর ৩৩% ছিল প্রকল্প ঋণ। নিঃসন্দেহে এইউদ্যোগ প্রশংসনীয়। ব্যাংকটির সদস্য দেশগুলোর মধ্যে প্রায় অর্ধেকই স্বল্পোন্নত। এদের আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো উন্নয়নের জন্যে এই কর্মসূচী আরও দশ বছর অব্যাহত রাখা প্রয়োজন।

 

২. মুনাফার অংশীদারীত্বের পদ্ধতি আইডিবির ফাইন্যান্সিং কার্যক্রমের মধ্যে একেবারে সর্বনিম্ন অবস্থান করছে। এমন হওয়া উচিৎ ছিল না। ইসলামী বিনিয়োগ পদ্ধতির ব্যাপক ব্যবহারের মাধ্যমে এর ত্রুটি-বিচ্যুতি দূর করার দায়িত্ব নেওয়া উচিত ছিল আইডিবির। কারণ শুধা মাত্র মুনাফা অর্জন কোনক্রমেই আইডিবির চূড়ান্ত লক্ষ্য হতে পারে না। আন্তর্জাতিক পর্যায়ের শীর্ষস্থানীয় এই ব্যাংক যেহেতু চূড়ান্ত লক্ষ্য হতে পারে না। আন্তর্জাতিক পর্যায়ের শীর্ষস্থানীয় এই ব্যাংক যেহেতু পদ্ধতিটি ব্যবহারের যথোচিত ‍গুরুত্ব দিচ্ছে না সেহেতু অন্যান্য ইসলামী ব্যাংক এ ব্যাপারে কার্যকর উদ্রোগ নেওয়া হতে বিরত রয়েছে।

 

৩. সদস্য দেশসমূহে আইডিবির মাইক্রো ক্রেডিট বা ক্ষুদ্র ঋণ কর্মসূচী চালু করার উদ্যোগ গ্রহণ এখন সময়ের দাবী। সংস্কৃতির সাথে ঋণের সম্পৃক্ততা না থাকলে সামাজিক সমস্যা আরও বিস্তৃত ও ঘনীভূত হয়; বিরোধ বাধে, সমাজে ভাঙন ধরে। বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো এর জ্বলন্ত উদাহরণ। এসব দেশে বিদেশী অর্থে পুষ্ট ও পরিচালিত এনজিওগুলো ইসলামী সংস্কৃতি তথা জীবনধারাবিরোধী কার্যক্রমকে উস্কে দিচ্ছে তাদের গৃহীত কর্মসূচীর মাধ্যমে। এর প্রতিরোধ ও প্রতিবিধানের জন্যে আইডিবির উদ্যোগ গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবী। তৃণমূল পর্যায়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আর্থিক সহযোগিতা পৌঁছে দিয়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের মাধ্যমে তাদের আর্থিক ভিত মজবুত করতে না পারলে পরিণামে যে অনিবার্য বিপর্যয় ঘটবে তা রুখবার কোন উপায় থাকবে না।

 

উপসংহার

 

আইডিবির বিভিন্ন কর্মকাণ্ড সম্পর্কে উপরে যে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলো তার আলোকে নিঃসন্দেহে বলা যায় বিগত ত্রিশ বছর ধরে ব্যাংকটি যে সাফল্য অর্জন করেছে তা বাস্তবিকই প্রশংসার দাবীদার। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য, আইডিবি বিশ্বব্যাংকের মতোই একটি উন্নয়নমুখী প্রতিষ্ঠান। বিশ্বব্যাংক সত্যিকার অর্থে কোন বাণিজ্যিক ব্যাংক নয়। সদস্য দেশসমূহের অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ও সামাজিক উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে এই ব্যাংক সুদ ও সার্ভিস চার্জের বিনিময়ে সহিযোগিতা করে থাকে। এরই বিকল্প ইসলামী মডেল আইডিবি। আই আর টি আই-র কর্মকাণ্ডসহ এই ব্যাংক যেসব কাজ ইতিমধ্যেই সম্পন্ন করেছে তা যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। মুসলিম উম্মাহর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এই ব্যাংকের অবদান তাই গুরুত্বের সঙ্গেই স্মরণ করতে হয়।

 

সারণী-

 

ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের বিলিকৃত মূলধনে সদস্য দেশসমূহের শেয়ার সদস্য হিসাবে অন্তর্ভুক্তির বছর

 

[২৯.১২.১৪২৪ হিজরী (২০.০২.২০০৪)]

 

দেশের নাম অন্তর্ভুক্তির বছর শেয়ার মূলধন (লক্ষ ইসলামী দীনার মোট শেয়ারের শতকরা অংশ
আজারবাইজান **১ ১৯৯২ ৯৭.৬ ০.১২
আফগানিস্তান ১৯৭৬ ৫০.০ ০.০৬
আলজিরিয়া ১৯৭৫ ২,৪৬৬.৭ ৩.১০
আলবেনিয়া ১৯৯৩ ২৫.০ ০.০৩
ইরাক ১৯৭৯ ১৩০.৫ ০.১৬
ইরান ১৯৮৯ ৬,৯৪৫.১ ৮.৭২
ইন্দোনেশিয়া ১৯৭৫ ১,৮৫৪.৭ ২.৩৩
ইয়েমেন ১৯৭৬ ৪৯৬.২ ০.৬২
উগান্ডা ১৯৭৭ ২৪৬.৩ ০.৩১
উজবেকিস্তান ২০০৩ ২৫.০ ০.০৩
ওমান ১৯৭৫ ২৭৩.৫ ০.৩৪
কমোরো ১৯৮০ ২৫.০ ০.০৩
কাজাখাস্তান ১৯৯৬ ৪৯.৬ ০.০৬
কাতার ১৯৭৫ ৯৭৭.০ ১.২৩
কিরঘিজিস্তান ১৯৯৪ ৪৯.৬ ০.০৬
কুয়েত ১৯৭৫ ৯,৮৬৮.৮ ১২.৩৮
কোৎ দ্য আইভরি ২০০২ ২৫.০ ০.০৩
ক্যামেরুন ১৯৭৬ ২৪৬.৩ ০.৩১
গাম্বিয়া ১৯৮০ ৪৯.৬ ০.০৬
গিনি বিসাউ ১৯৭৯ ৪৯.০৬ ০.০৬
গ্যাবন ১৯৮১ ২৯৩.২ ০.৩৭
জর্দান ১৯৭৫ ৩৯৪.৭ ০.৫ি০
জিবুতি ১৯৮০ ২৫,০ ০.০৩
টোগো ১৯৯৮ ৪৯.৬ ০.০৬
তাজিকিস্তান ১৯৯৫ ৪৯.৬ ০.০৬
তিউনিসিয়া ১৯৭৫ ১৯৫.৫ ০.২৫
তুরস্ক ১৯৭৫ ৬,২৬০.৫ ৭.৮৬
তুর্কমেনিস্তান ১৯৯৪ ২৫.০ ০.০৩
নাইজার ১৯৭৫ ২৪৬.৩ ০.৩১
পাকিস্তান ১৯৭৫ ২,৪৬৫.৯ ৩.১০
প্যালেষ্টাইন ১৯৭৭ ৯৮.৫ ০.১২
বারকিনা ফাসো ১৯৭৮ ২৪৬.৩ ০.৩১
বাহরাইন ১৯৭৫ ১৩৮.৯ ০.১৭
বাংলাদেশ ১৯৭৫ ৯৭৮.২ ১.২৩
বেনিন ১৯৮৪ ৯৭.৬ ০.১২
ব্রুনাই ১৯৮৬ ২৪৬.৩ ০.৩১
মরক্কো ১৯৭৫ ৪৯২.৪ ০.৬২
মালয়েশিয়া ১৯৭৫ ১,৫৭৮.৯ ১.৯৮
মালদ্বীপ ১৯৯৮ ২৫.০ ০.০৩
মালি ১৯৭৮ ৯৭.৬ ০.১২
মিশর ১৯৭৫ ৬,৮৬৮.৪ ৮.৬৩
মোজাম্বিক ১৯৯৬ ৪৯.৬ ০.০৫
মৌরতানিয়া ১৯৭৫ ৯৭.৬ ০.১২
লিবিয়া ১৯৭৫ ৭,৯৩৭.৯ ৯.৯৭
লেবানন ১৯৭৭ ৯৭.৬ ০.১২
শাদ ১৯৭৭ ৯৭.৬ ০.১২
সউদী আরব ১৯৭৫ ১৯,৭৮৮..৭ ২৪.৮৬
সেনেগাল ১৯৭৭ ২৪৬.৫ ০.৩১
সিরিয়া ১৯৭৬ ৯৯.২ ০.১২
সিয়েরালিওন ১৯৮২ ৪৯.৬ ০.০৬
সুদান ১৯৭৫ ৩৯০.৭ ০.৪৯
সুরিনাম ১৯৯৭ ৪৯.৬ ০.০৬
সোমালিয়া ১৯৭৭ ২৫.০ ০.০৩
সংযুক্ত আরব আমীরাত ১৯৭৬=৫ ৫,৬১৬.১ ৭.০৬
৫৫টি দেশ মোট ৭৯,৬০৭.১ ১০০.০০

 

উৎস: ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদনসমূহ, ১৪২৪ হি.

 

১. সদস্য দেশগুলোর নাম বাংলা বর্ণনাক্রম অনুসারে সাজানো

 

২. পূর্বর আপার ভোল্টা

 

সারণী-

 

ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক পুরষ্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান: ১৪০৮-১৪২৪ হিজরী

 

# ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানের নাম পুরস্কারের ক্ষেত্র হিজরী খ্রীষ্টাব্দ
১. প্রফেসর খুরশীদ আহমদ অর্থনীতি ১৪০৮ ১৯৮৮
২. ড. এম. উমারা চাপরা অর্থনীতি ১৪০৯ ১৯৮৯
৩. ড. সামী হাসান হামুদ ব্যাংকিং ১৪০৯ ১৯৮৯
৪. ড. এম. আনাস জারকা অর্থনীতি ১৪১০ ১৯৯০
৫. লেমবাগা উরুসান দান তাবুং হাজী, মালয়েশিয়া ব্যাংকিং ১৪১০ ১৯৯০
৬. ড. ইউসুফ আল-কারযাবী অর্থনীতি ১৪১১ ১৯৯১
৭. ড. জিয়াউদ্দীন আহমেদ ব্যাংকিং ১৪১১ ১৯৯১
৮. প্রফেসর সাবাহ আল-দীন যাইম অর্থনীতি ১৪১১ ১৯৯১
৯. সেন্টার ফর রিসার্চ ইন ইসলামিক ইকনমিকস, কিং আব্দুল আযীয ইউনিভার্সিটি, সউদী আরব অর্থনীতি ১৪১৩ ১৯৯৩
১০. ড. আহমদ মোহাম্মদ আলী ব্যাংকিং ১৪১৪ ১৯৯৪
১১. ড. মুহাম্মদ উমার যুবায়ের অর্থনীতি ১৪১৫ ১৯৯৫
১২. জনাব সালেহ আব্দুল কামেল ব্যাংকিং ১৪১৬ ১৯৯৬
১৩. ড. রফিক ইউনুস আল-মিসরীড. আবদুল রহমান ইউসরী অর্থনীতি ১৪১৭ ১৯৯৭
১৪. ড. তানজিলুর রহমান ব্যাংকিং ১৪১৮ ১৯৯৮৭
১৫. ড. মুহাম্মদ আল-হাবীব ইবন আল-খোজা অর্থনীতি ১৪১৯ ১৯৯
১৬. ইন্টারন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব ইসলামিক ইকনমিকস, পাকিস্তান ব্যাংকিং ১৪২০ ২০০
১৭. ড. মনযের কা’ফড. এস. এম. হাসানুজ্জামান অর্থনীতি ১৪২১ ২০০১
১৮. প্রফেসর জন প্রেসলেশেখ সাঈদ আহমদ লুতাহ ব্যাংকিং ১৪১২ ২০০২
১৯. ড. আব্বাস মিরাখরড. মোহসীন এস. খান অর্থনীতি ১৪২৩ ২০০৩
২০. ড. মোহাম্মদ আলী আল-কারী ব্যাংকিং ১৪২৪ ২০০৪

 

তথ্যসূত্র: ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক পুরস্কার সার্কুলারসমূহ।

 

ইসলামী বীমা বা তাকাফুল : বৈশিষ্ট্য কর্মপদ্ধতি

 

. ভূমিকা

 

আধুনিক সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা বীমা একটি অত্রন্ত গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক প্রতিষ্ঠান। ক্ষেত্রবিশেষে এর গুরুত্ব ব্যাংকের চাইতেও বেশী। কেননা দুর্ঘটনার কারণে কারো ব্যবসা-বাণিজ্য কিংবা যানবাহন ক্ষতিগ্রস্ত হলে অথবা বাণিজ্যিক পতিষ্ঠান কোন কারণে ধ্বংস হয়ে গেলে বীমা ব্যবস্থা যেভাবে তার পাশে দাঁড়াতে ও সহায়তার কার্যকর উদ্যোগ নিতে পারে ব্যাংকের সে ক্ষমতা বা সুযোগ নেই। মৃত্যুর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। পরিবারের প্রধান বা মূল উপার্জনকারীর দুর্ঘটনায় পঙ্গুত্ব বা মৃত্যু হলে পরিবারের যখন দুঃখের অমানিশা নেমে আসে ও আর্থিক নিরাপ্তাহীনতা দেখা দেয় তখন বীমাই তাদের কার্যকর সহায়তা দিতে পারে। মূলতঃ এই উদ্দেশ্যেই ব ীমা উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেছে। উপরন্তু ব্যাংকিং ব্যবস্থার সফলতার জন্যেও বীমার সহযোগিতা অপরিহার্য। আইনগত কারণেই ব্যাংকিং সেক্টর বীমার সাহায্য নিতে বাধ্য। তাছাড়া বীমা কোম্পানীর সংগৃহীত তহবিল ব্যাংকিং খাতে মূলধন যোগায়। এসব কারণে ব্যাংক ও বীমা ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত ও পরস্পর নির্ভরশীল।

 

. প্রচলিত বীমার বিরুদ্ধে ইসলামের আপত্তি

 

প্রচলিত সনাতন বীমা মুসলিম সমাজে গ্রহণযোগ্য নয় বলে ইসলামী শরীয়াহ বিশেষজ্ঞগণ সর্বসম্মত অভিমত ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু বিপদ-মুসিবত ও আকস্মিক দুর্যোগ মুকাবিলা ও সন্তান-সন্ততিদের জন্যে নিরাপদ ভবিষ্যত তৈরীর ক্ষেত্রে ইসরামে কোন আপত্তি নেই। স্বয়ং রাসূলে করীম (স) বলেছেন-

 

“তোমাদের উত্তরাধিকারীদের নিঃস্ব, পরমুখাপেক্ষী ও অপর লোকদের উপর নির্ভরশলী করে রেখে যাওয়া অপেক্ষা তাদেরকে সচ্ছল, ধনী ও সম্পদশালী রেখে যাওয়া তোমাদের পক্ষে অনেক ভাল।” (সহীহ আল্‌-বুখারী)

 

তিনি আরও বলেন- “যে ব্যক্তি কোন সংকটাপন্ন লোকের সংকট নিরসন করার উদ্যোগ নেয় আল্লাহ তা’য়ালা তাকে দুনিয়া ও আখিরাতে সংকট হতে অব্যাহতি দেবেন।” (মুসলিম)

 

আপাতঃ দৃষ্টিতে প্রচলিত সুদভিত্তিক বীমা ব্যবস্থা ভবিষ্যত প্রয়োজন মেটাবার ক্ষেত্রে একটি স্বেচ্ছাদীন সঞ্চয়ী ব্যবস্থা বলেই মনে হয়। কিন্তু এতে এমন পাঁচটি মৌলিক শরীয়াহবিরোধী উপাদান রয়েছে যার অপনোদন বা প্রতিবিধান না ঘটলে মুসলমানদের পক্ষে ঈমান-আকীদা বজায় রেখে এই বীমা পদ্ধতিতে অংশ গ্রহণ করা অসম্ভব। শরীয়াহবিরোধী এই উপাদানগুলো হচ্ছে: (১) আল্‌-ঘারার, (২) আল্‌-মাইসির, (৩) আল-রিবা, (৪) শরীয়াহবিরোধী নোমিনী মনোয়ন এবং (৫) প্রিমিয়াম প্রদানের বিদ্যমান শর্ত।

 

. আল্‌-ঘারার (অজ্ঞতা/অনিশ্চয়তা): প্রচলিত বীমা ব্যবস্থায় বীমা গ্রহীতা বীমা কোম্পানীর (সরকারী ও বেসরকারী উভয় ক্ষেত্রেই) সাথে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকার পলিসি গ্রহণের চুক্তি সম্পন্ন করার পর সেই টাকা অনেকগুলো সমান কিস্তিতে প্রিমিয়াম হিসাবে নির্দিষ্ট মেয়াদের মধ্যে জমা দিয়ে থাকেন। িএক্সেত্রে কয়েকটি প্রিমিয়াম জমা দেওয়ার পর বীমা গ্রহীতা দুর্ঘটনা কবলিত হলে বা মৃত্যুবরণ করলে বীমা কোম্পানী পলিসির চুক্তি মুতাবেক পুরো টাকাটাই বীমা গ্রহীতা বা তার নোমিনীকে প্রদান করে থাকে। কিন্তু এই টাকা কোথা থেকে কিভাবে প্রদান করা হলো তা বীমা গ্রহণকারীর কাছে অজানা বা অজ্ঞাত থাকে। প্রচলিত সাধারণ বীমা ও জীবন বীমা উভয় ক্ষেত্রেই এই অজ্ঞতা বা অনিশ্চয়তার উপাদান বিদ্যমান। শরীয়াহর পরিভাষায় একে বলা হয় আল-ঘারার।

 

. আল্‌-মাইসির (জুয়া): বীমার ক্ষেত্রে, বিশেষ করে জীবন বীমার ক্ষেত্রে আল-ঘারার বিদ্যমান থাকার কারণেই জুয়া বা আল-মাইসির-এর উদ্ভব ঘটে। উদাহরণতঃ যখন জীবন বীমার কোন পলিসি গ্রহীতা তার বীমার মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই মৃত্যুবরণ করেন তখন চুক্তিবদ্ধ প্রিমিয়ামের আংশিক পরিশোধ করা হলৌ তার নোমিনী বা মনোনীত ব্যক্তি চুক্তিবদ্ধ অর্থের পুরোটাই পেয়ে থাকেন। শরীয়াহর দৃষ্টিতে এটা জুয়া।

 

. আল-রিবা (সুদ): প্রচলিত বীমা কোম্পানীগুলোর কার্যক্রমে সুদের লেনদেন, সুদভিত্তিক বিনিয়োগ ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট আদান-প্রদান অব্যাহত থাকে যা শরীয়াহ আইন ও অনুশাসনের পরিপন্থী বলে ফকীহ্‌গণ সর্বসম্মত রায় দিয়েছেন।

 

. শরীয়াহবিরোধী নোমিনী মনোনয়ন: আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সুরা আল-নিসায় মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীদের চিহ্নিত এবং তাদের হক নির্ধারিত করে দিয়েছেন। কিন্তু প্রচলিত বীমা ব্যবস্থায় বীমা গ্রহীতা তার ইচ্ছামাফিক যে কোন ব্যক্তিকে নোমিনী নির্ধারণ করতে পারে। সকল ওয়ারিশকে বঞ্চিত করে এই নোমিনীই বীমার পুরো অর্থ পাবে যা শরীয়াহর সুস্পষ্ট বরখেলাপ। এটা আদল ও ইহসানবিরোধী।

 

. প্রিমিয়াম প্রদানের বিদ্যমান শর্ত: বিদ্যমান বীমা আইনে (জীবনবীমা ব্যতীত) বীমা পলিসি কার্যকর হওয়ার জন্যে নির্দিষ্ট একটি মেয়াদ নির্ধারিত রয়েছে। ঐ মেয়াদের মধ্যে একটি কিস্তিও যদি অনাদায়ী থাকে তাহলে বীমা গ্রহীতা ঐ সময় পর্যন্ত যত টাকা প্রিমিয়াম হিসাবে দিয়েছেন তার পুরোটাই মার যায়। উদাহরণস্বরূপ, প্রচলিত সাধারণ বীমা ব্যবস্থায় বীমা কার্য়কর হওয়ার জন্যে ন্যূনতম দুই বছর প্রিমিয়াম দেওয়া বাধ্যতামূলক। কোন বীমা গ্রহীতা যদি ত্রৈমাসিক কিস্তিতে প্রিমিয়াম দেন তাহলে তাকে দু’বছর মোট আটটি কিস্তি দিতে হবে। কিন্তু তিনি যদি সাতটি কিস্তি জমা দেওয়ার পর বাকী কিস্তিটি কোন কারণে দিতে না পারেন তাহলে ঐ পলিসিটি কার্যকর বলে গণ্য হবে না এবং সংশ্লিষ্ট বীমা গ্রহীতা বা তার নোমিনী কিছুই পাবেন না। অর্থাৎ, বীমা গ্রহীতার মূলধনই খোয়া যাবে। এটা আদল ও ইহসানের পরিপন্থী।

 

. ইসলামী তাকাফুল

 

উপরোক্ত সমস্যাগুলোকে সামনে রেখে এবং একই সাথে মুসলিম উম্মাহর প্রয়োজন পূরণ ও ইসলামে গ্রহণযোগ্য একটি বিকল্প বীমা ব্যবস্থার সন্ধানে ইসলামী আইনবেত্তা ও বীমা বিশেষজ্ঞগণ দীর্ঘদিন ধরে চিন্তা-ভাবনা, গভীর গবেষণা ও পর্যালোচনা করেন। শেষ পর্যন্ত তারা ইসলামী পদ্ধতির বীমা ব্যবস্থা উদ্ভাবনে সমর্থ হয়েছেন। ইসলামী শরীয়াহসম্মত বীমা পরিচালনা প্রসঙ্গে কয়েকটি আন্তর্জাতিক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে ১৯৬১ সালে দামেস্কে, ১৯৬৫ সালে কায়রোয়, ১৯৭৫ সালে মরোক্কো ও লিবিয়ায় এবং ১৯৭৫ সালে মরোক্কা ও লিবিয়ায় এবং ১৯৭৬ সালে মক্কায় অনুষ্ঠিত সম্মেলন বিশেষ উল্লেখযোগ্র। অবশেষে ১৯৮০ সালে মক্কায় অনুষ্ঠিত ওআইসি শীর্ষ সম্মেলনে সংস্থাভুক্ত দেশসমূহে ইসলামী বীমা চালূ করার সর্বসম্মত প্রস্তাব গৃহীত হয়। উল্লেখ্য বাহরাইনে সর্বপ্রথম ইসলামী বীমার কার্যক্রম শুরু হয়। এজন্যে সে দেশে পৃথক আইনও প্রণীত হয়েছে। এরপর ধীরে ধীরে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে ইসলামী বীমা বিস্তৃতি লাভ করে। আফ্রিকায় এর কার্যক্রম প্রথম শুরু হয় সুদানে। দূর প্রাচ্যে মালয়েশিয়া এ ব্যাপারে এগিয়ে রয়েছে। ইসলামী বীমার প্রসার ও প্রতিষ্ঠার জন্যে যে দেশে ‘মালয়েশিয়া তাকাফুল এ্যাক্ট, ১৯৮৪” নামে পৃথক আইন প্রণীত হয়েছে।

 

ইসলামী বীমা তাকাফুল নামেই বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। আরবী কাফালা শব্দ থেকে এটি উদ্ভূত। এর আভিধানিক অর্থ যৌথ জামিননামা বা সমষ্টিক নিশ্চয়তা, অর্থাৎ পারস্পারিক দায়িত্ব গ্রহণ। বাস্তব প্রয়োগের ক্ষেত্রে তাকাফুল হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট সদস্য গ্রুপের যৌথ নিশ্চয়তার অঙ্গীকার যা দুর্ঘটনা বা অন্য কোন কারণে ক্ষতিগ্রস্ত সদস্য বা সদস্যদের ক্ষতিপূরণে প্রয়োজনীয় সহযোগিতার নিশ্চয়তা প্রদান করে। গ্রুপের সদস্যগণ এমন একটি যৌথ নিশ্চয়তার চুক্তিকে আবদ্ধ হন যাতে কোন সদস্য দুর্ঘটনা বা দুর্যোগের শিকার হলে তার ক্ষতিপূরণের জন্যে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ লাভ করতে পারেন। বস্তুতঃ এটি হচ্ছে গ্রুপের সদস্যগণ তাদেরই একজনের বিপদে সাহায্য করার জন্যে সকলেই একযোগে সুনির্দিস্ট পরিকল্পনা অনুসারে এগিয়ে আসেন। তাকাফুল ব্যবস্থার ভিত্তি হলো ভ্রাতৃত্ব (Brotherhood), সংহতি (Solidarity) ও পারস্পরিক সহযোগিতা (Mutual Assistance)। ইসলামী তাকাফুল তাই একই সঙ্গে একটি সহায়তামূলক ও কল্যাণধর্মী প্রতিষ্ঠান এবং এক মুমিন ভাইয়ের আপদকাল তার সাহায্যে এগিয়ে আসার গোষ্ঠীবদ্ধ উপায়ই বটে।

 

এক্ষেত্রে মালয়েশিয়ায় গৃহীত তাকাফুল এ্যাক্টের সংজ্ঞাটি প্রণিধানযোগ্য। এতে বলা হয়েছে-

 

“Takaful means a scheme based on brotherhook, solidarity and mutual assistance which provides for mutual financial aid and assistance to the participants in case of need whereby the participants mutually agree to contribute for the purpose.... its aims and operations do not involve any element which is not approved by the Shariah.”

 

অর্থাৎ, ভ্রাতৃত্ব, সংহতি ও পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তির উপর গড়ে ওঠা তাকাফুল এমন এক স্কীম যেখানে প্রয়োজনের সময়ে অংশগ্রহণকারীরা পারস্পরিক আর্থিক সাহায্য ও সহযোগিতা যোগায়। এই উদ্দেশ্যে তারা পরস্পর সম্মত হয়েই দান কর থাকে..... শরীয়াহর অনুমোদন নেই এমন কোন উপাদান এর উদ্দেশ্য ও কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত থাকে না।

 

. ইসলামী বীমার বৈশিষ্ট্য

 

ইসলামী শরীয়াহ বিশেষজ্ঞগণ বিদ্যমান সুদী বীমা ব্যবস্থাকে ইসলামীকরণের জন্যে যেসব পরিবর্তনের সুপারিশ করেছেন সেগুলো এক কথায় যুগান্তকারী ও বীমা গ্রহীতার স্বার্থ সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রে খুবই বলিষ্ঠ ও কার্যকর। এসব পরিবর্তন ও সংযোজনই ইসরামী তাকাফুল ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য বলে বিবেচিত। যথা-

 

ক. কোম্পানী তার তহবিল শরীয়াহসম্মত উপায়ে বিনিয়োগ করবে। শরীয়াহতে নিষিদ্ধ ও সুদের সংশ্রব রয়েছে এমন কোন ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য বা কার্যক্রমে কোন অর্থ বিনিয়োগ বা লেনদেন করা চলবে না। তাকাফুল পরিকল্পনা ও কর্মকাণ্ডের বিধি-বিধানের উৎস হবে শরীয়াহ।

 

খ. প্রচলিত বীমা ব্যবসায়ে সৃষ্ট তহবিল বীমা কোম্পানীর মালিকানায় থাকে। কিন্তু ইসলামী বীমা কোম্পানীতে পলিসি গ্রহীতাদের অর্থে সৃষ্ট তহবিল তাদেরই মালিকানায় থাকে। বীমা গ্রহীতাগণকে কোম্পানীর শেয়ারহোল্ডারদের মতোই বিবেচনা করা হয় যেন তারা কোম্পানীর মুনাফা বা নীট উদ্বৃত্তের অংশীদার হতে পারেন।

 

গ. কোম্পানীর বোর্ড অব ডিরেকটর-এ বীমা গ্রহীতাগণের পক্ষ হতে পর্যাপ্ত প্রতিনিধি থাকবে। তারা কোম্পানীর নীতি নির্ধারণ থেকে শুরু করে সকল হিসাব পর্যবেক্ষণ করার ক্ষমতা রাখবে।

 

ঘ. কোন নির্দিষ্ট বছরে বীমা গ্রহীতাগণ যে প্রিমিয়াম প্রদান করেছেন তাতে যদি কোম্পানীতে তাদের অংশের লোকসান পূরণ না হয় তাহলে তারা অতিরিক্ত অর্থ প্রদানে বাধ্য থাকবেন।

 

ঙ. বীমা প্রতিষ্ঠানটির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবেই একটি শরীয়াহ সুপারভাইজারী বোর্ড থাকবে। এই বোর্ড শরীয়াহর আলোকে প্রতিটি কাজ তদারক এবং প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদান করবেন।

 

চ. ইসলামী তাকাফুল ব্যবস্থায় নোমিনী বা মনোনীত ব্যক্তি ট্রাস্টি বা অছি হিসাবে কাজ করবে। প্রাপ্ত অর্থ শরীয়াহ সম্মত ওয়ারিশদরে মধ্যে বন্টন করে দেওয়া তারই দায়িত্ব।

 

ছ. বীমা কোম্পানী দুটি পৃথক ও সুস্পষ্ট হিসাব (Accounts) রক্ষা করবে: (ক) শেয়ারহোল্ডারদের হিসাব ও (খ) পলিসি গ্রহীতাদের হিসাব। পলিসি গ্রহীতাদের হিসাবে তাদের জমাকৃত প্রিমিয়াম, চাঁদা এবং তাদের তহবিল বিনিয়োগ করার ফলে অর্জিত মুনাফায় তাদের যে অংশ সবই জমা হবে।

 

পলিসি গ্রহীতাদের হিসাব থেকে সার্ভিস চার্জ ও দাবী পূরণের পর উদ্বৃত্ত হতে প্রয়োজনীয় রিজার্ভ আলাদা রেখে অবশিষ্ট অর্থ তাদের মধ্যেই পুনঃবন্টিত হবে। যদি কখনো কোন ঘাটতি দেখা দেয় তাহলে তা সাধারণ রিজার্ভ তহবিল হতে পূরণ করা হবে। অবশ্য যদি সাধারণ রিজার্ভ তহবিল ঘাটতি পূরণের জন্যে যথেষ্ট বিবেচিত না হয় তাহলে শেয়ারহোল্ডারদের রিজার্ভ ও মূলধন হতে তা করযে হাসানা আকারে গ্রহণ করা হবে। ভবিষ্যতে পলিসি গ্রহীতাদের হিসাবে উদ্বৃত্ত হলে তা থেকে প্রথমেই এই করযে হাসানা পরিশোধিত হবে। শেয়ারহোল্ডারগণ কোনক্রমেই পলিসি গ্রহীতাদের তহবিল বা উদ্বৃত্ত গ্রহণ করতে পারবে না। শেয়ার মূলধন বিনিয়োগ হতে উপার্জিত আয় শেয়ারহোল্ডারদের একাউন্টেই দেখানো হবে এবং চলতি ব্যয় ও অন্যান্য দাবী পরিশোধের পর উদ্বৃত্ত অর্থ তাদের মধ্যেই বন্টিত হবে।

 

জ. একটি যাকাত বা সাদাকাহ তহবিল গটিত হতে হবে। শেয়ার মূলধন, রিজার্ভ ও মুনাফা হতে প্রতি বছর ২.৫% হারে গ্রহণ করে এই তহবিলে জমা করা হবে। পলিসি গ্রহীতাদের সম্মতি সাপেক্ষে তাদের হিসাবের নীট উদ্বৃত্ত হতেও বার্ষিক ২.৫% হারে যাকাত আদায় করে এই তহবিলে জমা দেওয়া যেতে পারে। তহবিলটি কোম্পানীর বোর্ড অব ডিরেক্টরসের গৃহীত উপবিধি অনুসারে বোর্ড ট্রাষ্টি দ্বারা পরিচালিত হবে।

 

. তাকাফুলের প্রকারভেদ

 

প্রচলিত বীমা ব্যবস্থার মত ইসলামী তাকাফুল বা বীমাও দুই ধরনের। যথা:-

 

ক. পারিবারিক তাকাফুল বা ইসলামী জীবন বীমা;

 

খ. সাধারণ তাকাফুল বা ইসলামী সাধারণ বীমা।

 

. পারিবারিক তাকাফুল বা ইসলামী জীবন বীমা

 

পারিবারিক তাকাফুল বা ইসলামী জীবন বীমা মূলতঃ একটি বিনিয়োগ কর্মসুচী যে বিনিয়োগ বীমা গ্রহীতাদের নিজেদের ও তাদের পরিবারের ভবিষ্যত আর্থিক নিরাপত্তা প্রদান সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালনা কর। এই কার্যক্রম পরিচালিত হয় দীর্ঘমেয়াদী মুদারাবা নীতি অনুসারে। এর আওতায় কোন ব্যক্তি নিয়মিত প্রিমিয়াম প্রদানের মাধ্যমে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ সঞ্চয় করন। এই সঞ্চয় লাভজনক কাজে বিনিয়োজিত হয় এবঙ মুনাফা তার হিসাবে জমা হয়। সমুদয় অর্থই বীমা গ্রহীতা ও তার পরিবারের আর্থিক সচ্ছলতা ও নিরাপত্তার কাজে আসে। উপরন্তু এই কর্মসূচীর আওতায় বীমা গ্রহীতাদের কারো মৃত্যু ঘটলে ঐ সদস্যের পরিবারবর্গ বীমা চুক্তির সমুদয় অর্থ ও অর্জিত মুনাফা পেয়ে থাকে।

 

. সাধারণ তাকাফুল বা ইসলামী সাধারণ বীমা

 

সাধারণ তাকাফুল বা ইসলামী সাধারণ বমিার আওতায় কোন ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ একক বা দলবদ্ধভাবে তাদের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের (কল-কারখানা, গুদামঘর, পণ্য, যানবাহন ইত্যাদি) সম্ভাব্য দুর্ঘটনা বা অগ্নিকাণ্ডজনিত কারণে ক্ষয়-ক্ষতি বা ধ্বংসের বিপরীতে বীমা সম্পাদন করতে পারে। ইসলামী জীবন বীমার অনুরূপ এ বীমার চুক্তি ও শর্তাবলী নির্ধারিত হয় মুদারাবা নীতির উপর ভিত্তি করে। সাধারণ তাকাফুলের মেয়াদকাল সাধারণতঃ এক বছর। মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পর পুনরায় নবায়ন করা যায়।

 

তাকাফুল ব্যবস্থার অধীনে বীমা গ্রহীতা যে প্রিমিয়াম প্রদান করে তার নির্দিস্ট একটি অংশ তাবাররু বা ডোনেশন হিসাবে গণ্য হয়। দুর্ঘটনা বা প্রাকৃতিক বিপর্যয়জনিত কারণে বীমা গ্রহীতাদের সম্পদের আংশিক বা সম্পূর্ণ ক্ষতিপূরণ প্রদানের জন্যে এই তাবাররু ও কোম্পানীর মুনাফার অংশবিশেষ সমন্বয়ের তহবিল গঠিত হয়। সাধারণত তাকাফুল কোম্পানী বীমা তহবিলের অর্থ বিনিয়োগ করে যে মুনাফা অর্জন করে তাও ঐ তহবিলে জমা হয়। পারস্পরিক সহযোগিতার নীতির ভিত্তিতেই বীমা কর্তৃপক্ষ ঐ তহবিল থেকেই বীমা গ্রহীতার যথাযথ ক্ষতিপূরণ প্রদান করে থাকে। মূলতঃ তাকাফুল কোম্পানী ঐ তহবিলের ট্রাস্ট্রী হিসাবে কাজ করে। তাকাফুল পদ্ধতির অভিন্ন লক্ষ্য ক্ষতিপূরণ প্রদান হলেও সাধারণত তাকাফুলে পারিবারিক তাকাফুলের অনুরূপ সঞ্চয়ের বিষয়টি প্রাধান্য রঅভ করে না।

 

তবে এই বীমার