নবীদের সংগ্রামী জীবন

রাসুলদের পাঠানো হয়েছে কেন?

 

‘‘আমরা আমাদের রাসুলদের স্পষ্ট নির্দশন ও সঠিক পথের নির্দেশিকাসহ পাঠিয়েছি। আর তাহাদের সাথে অবতীর্ণ করেছি আল কিতাব ও পক্ষপাতহীন সুষম জীবন ব্যবস্থা, যাতে করে মানুষ সুবিচার (justice) এর উপর প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। তাছাড়া আমরা লোহা অবতীর্ণ করেছি, যার মধ্যে র‍য়েছে বিরাট শক্তি আর মানুষের জন্য না না কল্যাণ ও উপকারীতা। এটা করা হয়েছে এ জন্যে যে, আল্লাহ বাস্তবে যেনে নিতে চান, না দেখেও তারা তাঁকে আর তাঁর রাসুলদেরকে সাহায্য করে? নিশ্চয়ই আল্লাহ অত্যন্ত শক্তিধর ও মহা পরাক্রমশালী। ’’ সুরা ৫৭ আল হাদীদ আয়াত ; ২৫

 

বিসমিল্লাহির রাহমানীর রাহীম

 

এই বই সম্পর্কে কিছু কথা

 

নবী রাসুলগন সেরা মানুষ। তাঁরা আল্লাহর মনোনীত ও নিযুক্ত। তাঁদের কাছে মহান আল্লাহ অহী পাঠিয়েছেন, কিতাব পাঠিয়েছেন। তাঁরা ছিলেন নিষ্পাপ ও আদর্শ মানুষ। তাঁরা মানুষকে আল্লাহর দেয়া বিধান অনুযায়ী জীবন যাপন করতে বলেছেন।

 

মহান আল্লাহ আল-কুরানে হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) সহ পঁচিশ জন নবী-রাসুলের নাম উল্লেখ করেছেন। তাঁদের অনেকের কথা বার বার উল্লেখ করেছেন। তাঁদের আদর্শ ও সেরা জীবনের কথা উল্লেখ করেছেন। তাঁদের আদর্শ অনুসরনের আহবান জানিয়েছেন। তাই নবীদের পথই মানুষের মুক্তির একমাত্র পথ।

 

 আল-কুরানের আলোকে নবীগনের জীবন কথা ও জীবনাদর্শ লেখার বাসনা আমার অনেক দিনের। অবশেষে লেখার কাজে হাত দিলাম। কিশোর ও তরুণদের কথা সামনে রেখেই লেখার কাজ শুরু করেছি এর দশকে ‘কিশোর কণ্ঠ’ পত্রিকায় জীবনীগুলো ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ হয়েছে। অতঃপর হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর পূর্বেকার চব্বিশজন নবীর জীবনী দুই খণ্ডে প্রকাশ হয়। কিন্তু দুই খণ্ডে প্রকাশ করলে গ্রন্থটি পাঠকদের জন্য সহজলভ্য হয় না। এখন তাই পাঠকগণের সুবিধার্থে তিন খণ্ডের পূর্ণাঙ্গ জীবনী একত্র করে এক ভলিউমে প্রকাশ করা হল। হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর জীবনী সংক্ষিপ্ত আকারে প্রকাশ করা হল। তবে তাঁর জীবনীর উপরে আলাদা একটি বইও লেখা হয়েছে। এ বইয়ের ধারাবাহিকতায় লেখা হয়েছে হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর জীবনীর উপর সে বইটি। সেই বইটির শিরোনাম; বিশ্ব নবীর শ্রেষ্ঠ জীবন।

 

হ্যাঁ, যে কথাটি বলছিলাম, নবীগনের জীবনী লেখা সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা পবিত্র কুরানের আলোকে। কুরআনের আলোকেই লিখেছি। তবে কয়েকজন নবীর জীবন কথা কুরানে একেবারে সংক্ষেপে আলোচনা হয়েছে। তাঁদের ক্ষেত্রে হাদীস, তাফসীর ও ইতিহাস গ্রন্থের সাহায্য নিয়েছি।

 

আমরা এ গ্রন্থে নবীগনের ক্রমতালিকা সাজিয়েছি কুরান, হাদীস ও ঐতিহাসিক তথ্য প্রমান অনুযায়ী তাঁদের আগমন ও জীবন কালের ক্রমধারার ভিত্তিতে।

 

নবীগনের জীবনী লেখার ক্ষেত্রে রং চং লাগিয়ে গল্প কাহিনী লেখার চেস্টা করা হয় নি। কুরআনের আলোকে নিরেট জীবন কথাই লেখা হয়েছে। তাই এ বইতে কাহিনীগত রস পরিবেশনের পরিবর্তে জীবনাদর্শ পরিবেশনের প্রতি অধিক লক্ষ্য রাখা হয়েছে।

 

বস্তুনিষ্ঠ জীবন কথা জানতে জারা আগ্রহী, বিশেষ করে কিশোর ও তরুন সমাজের কাছে আশা করি এ বই অনেক ভালো লাগবে। কারন এতে তাঁরা কেবল ইতিহাসই জানবে না, সেই সাথে নিজেদের জীবনাদর্শ ও শ্রেষ্ঠ জীবন গড়ার এবং জীবন চলার পথও খুজে পাবে।

 

এ বই পড়ে নবী গনের আদর্শে যদি উদ্বুদ্ধ হয় আমার দেশের কিশোর- তরুন আর যুবকেরা, তবেই পূর্ণ হবে আমার দীলের তামান্না, মনের স্বপ্ন স্বাধ। প্রভু, তুমি এই গ্রন্থটিকে কবুল করো। আমীন।

 

আব্দুস শহীদ নাসীম।

 

 

 

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

 

আম্বিয়ায়ে কেরামের জীবন কথা

 

মানুষকে সঠিক পথ দেখানোর জন্যে আল্লাহ যুগে যুগে অনেক নবী- রাসূল নিযুক্ত করেছেন। নবীরা মানুষ ছিলেন। (সুরা ইবরাহীম-আয়াত ১১, সুরা আল কাহাফ-আয়াত ১১০)। তবে তাঁদেরকে নবী নিযুক্ত করে তাঁদের কাছে আল্লাহ নিজের বানী পাঠিয়েছেন। তাঁদেরকে তিনি সবকিছু সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান দান করেছেন।

 

সুতরাং তাঁরা একদিকে ছিলেন সত্য ও সঠিক জ্ঞানের অধিকারী। অন্নদিকে ছিলেন উন্নত চরিত্র ও নিষ্পাপ জীবনের অধিকারী। ছিলেন আদর্শ মানুষ। তাঁরা অহীর মাধ্যমে আল্লাহড় বাণী লাভ করতেন। তাঁরা কখনো আল্লাহর হুকুম অমান্য করতেন না।

 

আল্লাহ পৃথিবীতে মানুষ সৃষ্টি করেছেন তাঁর দাসত্ব করার জন্যে। তাঁর হুকুম পালন করার জন্যে। তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী জীবন যাপন করার জন্যে। সেই সাথে পৃথিবীটাকে তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী পরিচালনা করার জন্যে। এই হল মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য। মহান আল্লাহ নবীদের পাঠিয়েছেন মানুষকে তাঁদের সৃষ্টির উদ্দেশ্য জানিয়ে দিতে এবং কথাটা বার বার স্মরণ করিয়ে দিতে।

 

মহান আল্লাহ যাদের নবী নিযুক্ত করেছেন, তাঁরা সারা জীবন মানুষকে আল্লাহর পথে ডেকেছেন। মানুষকে আল্লাহ প্রদত্ত জীবন বিধান অনুযায়ী জীবন যাপন করতে বলেছেন। নফসের তাড়না এবং শয়তানের পথ পরিহার করে আল্লাহর সন্তুষ্টির পথে চলতে তাঁদের অনুপ্রানিত করেছেন।

 

নবীরা আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষকে জানিয়ে দিয়েছেন, মানুষ যদি আল্লাহর বিধান অনুযায়ী তাঁর সন্তুষ্টির পথে জীবন যাপন করে, তবে মৃত্যুর পর যে চিরন্তন জীবন আছে, সেখানে তাঁরা মহা সুখে জান্নাত লাভ করবে। কিন্তু যারা আল্লাহর বিধান অনুযায়ী জীবন ধারন করবেন না। মৃত্যুর পরের জীবনে তাঁদের জন্যে রয়েছে কঠিন শাস্তি আর শাস্তি।

 

নবী শব্দের অর্থ হল ‘সংবাদ বাহক’। রাসুল শব্দের অর্থ ‘বানী বাহক’। নবী- রাসুল গন আল্লাহর বানী এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে সঠিক পথের সংবাদ মানুষের কাছে পৌছে দিয়েছেন বলেই তাঁদেরকে নবী ও রাসুল বলা হয়। সকল রাসুলই নবী ছিলেন। তবে সকল নবী রাসুল ছিলেন না। অনেক নবীর কাছে আল্লাহ তায়ালা শুধু অহী পাঠিয়েছেন। আবার অনেক নবীর কাছে অহী এবং কিতাবও পাঠিয়েছেন। যারা সাধারনভাবে অহী লাভ করা ছাড়াও কিতাব লাভ করেছেন, তারাই ছিলেন রাসুল।

 

প্রথম নবী ছিলেন পৃথিবীর প্রথম মানুষ হযরত আদম (আঃ)। সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি

 

ওয়াসসালাম। তাঁর পরে পৃথিবীতে আল্লাহ আর কোন নবী নিযুক্ত করবেন না। পৃথিবীতে আল্লাহ তায়ালা ঠিক কত জন মানুষকে নবী নিযুক্ত করেছেন, তা মানুষের পক্ষে কখনোই জানা সম্ভব নয়। একটি বর্ণনা থেকে জানা যায়, আল্লাহ তায়ালা এক লক্ষ বিশ হাজার নবী পাঠিয়েছেন। এদের মধ্যে তিনশত পনের জন ছিলেন রাসুল। তবে তাঁদের প্রকৃত সংখ্যা মহান আল্লাহই ভালো জানেন।

 

আল্লাহ কুরানে পচিশজন নবীর নাম উল্লেখ করেছেন। তাঁরা সকলেই রাসুল ছিলেন। কুরআনে উল্লেখিত নবী-রাসুলগন হলেনঃ ১। আদম, ২। নূহ, ৩। ইদ্রিস, ৪। হুদ, ৫। সালেহ, ৬। ইব্রাহীম, ৭। লুত, ৮। ইসমাঈল, ৯। ইসহাক, ১০। ইয়াকুব, ১১। ইউসুফ, ১২। শুয়াইব, ১৩। আইউব, ১৪। যুল কিফল, ১৫। মূসা, ১৬। হারূন, ১৭। দাউদ, ১৮। সুলাইমান, ১৯। ইলিয়াস, ২০। আল ইয়াসা, ২১। ইউনুস, ২২। জাকারিয়া, ২৩। ইয়াহিয়া, ২৪। ঈসা, ২৫। মুহাম্মদ (সাঃ)

 

বাকী নবী রাসুলগনের নাম কুরআনে উল্লেখ করা হয় নি। তবে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, তিনি সকল জাতির কাছেই নবী পাঠিয়েছেন এবং প্রতিটি মানব বসতিতেই নবী পাঠিয়েছেন। (সুরা ফাতির – আয়াত ২৪, সুরা আর রায়াদ – আয়াত ৭)

 

নবী-রাসুলগনের প্রতি অবশ্যি ঈমান আনতে হবে। কুরআনে যে পঁচিশজনের নাম উল্লাখ আছে, তাঁদের প্রত্যেকের প্রতি পৃথকভাবে ঈমান আনতে হবে। তাঁদের কারো প্রতি ঘৃনা বিদ্বেষ পোষণ করা যাবে না। আর যেসব নবী রাসুলের নাম কুরানে উল্লেখ করা হয় নি, তাঁদের প্রতি সামগ্রিকভাবে ঈমান আনতে হবে।

 

সকল নবী একই দ্বীনের বাহক ছিলেন। তাঁরা সকলেই আল্লাহর নিযুক্ত ছিলেন। তাঁরা মানুষকে-

 

১। আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার দাওয়াত দিয়েছেন।

 

২। আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করতে নিষেধ করেছেন।

 

৩। এক আল্লাহর আনুগত্য ও দাসত্ব করতে বলেছেন।

 

৪। আল্লাহর দেয়া বিধান অনুযায়ী জীবন যাপন করতে বলেছেন।

 

৫। আল্লাহর দেয়া বিধান অনুযায়ী সমাজ জীবন পরিচালনা করতে বলেছেন। সুবিচার করতে বলেছেন।

 

৬। ঈমানের ভিত্তিতে ভ্রাতৃত্ব গড়তে ও হানাহানি পরিহার করতে বলেছেন।

 

৭। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে এবং তাঁর অসন্তুষ্টি থেকে আত্নরক্ষা করতে বলেছেন।

 

৮। জাহান্নাম থেকে বাঁচতে এবং জান্নাতের পথে চলতে বলেছেন।

 

নবীগন মানুষকে কল্যাণের পথে ডেকেছেন। কিন্তু মানুষ দুনিয়ার অন্ধ মোহে লিপ্ত হয়ে নবীদের বিরোধিতা করেছে। তাঁদের অনেক দুঃখ কষ্ট দিয়েছে। অত্যাচার নির্যাতন করেছে। অনেক নবীকে লোকেরা নিজের মাতভূমি ত্যাগ করতে বাধ্য করেছে। আল্লাহর এই মহান নবীগণকে মানুষ হত্যা করার কূট কৌশল করেছে। অগনিত নবীকে তাঁরা হত্যা করেছে। কাউকে অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করেছে। কাউকে তারা হত্যা করার জন্যে তাড়া করেছে। কাউকে হত্যা করার জন্যে বাড়ী ঘেরাও করেছে।

 

এত চরম বিরোধিতা স্বত্তেও নবীগন সত্য পথের দিকে দাওয়াত দান থেকে কখনই বিরত থাকেন নি। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করা পর্যন্ত তাঁরা প্রত্যেকেই মানুষকে সত্য পোঠে আসার আহবাণ জানিয়ে গেছেণ। তাঁরা আল্লাহর বিধান অনুযায়ী সমাজ গরার জন্য আজীবোণ সংগ্রাম কোড়ে গেছেণ। শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সাঃ)। তাঁর পরে আর কোন নবী রাসুল আসবেন না। সুতরাং আল্লাহ তাঁর অনুসারীদেরকে দায়িত্ব দিয়েছেন মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকবার। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর উম্মতের জ্ঞানী লোকেরা নবীর সত্যিকার উত্তরাধিকারী। তাঁরা মানুষকে আল্লাহর দাসত্ব করার, আল্লাহর ইচ্ছা অনুযায়ী জীবন যাপন করার এবং আল্লাহর বিধান অনুযায়ী জীবন যাপন করার এবং আল্লাহর বিধান মাফিক পৃথিবীকে সুন্দর করে গড়ার ও পরিচালিত করার দায়িত্ব পালন করবে।

 

এখন আমাদের কাছে এ কথা স্পস্ট হল যে, পৃথিবীতে মানুষের চলার পথ দুটি। একটি হল নবীদের দেখানো পথ। এটিই বিশ্ব জগতের স্রস্টা মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের পথ। এ পথের প্রতিদান হল জান্নাত বা বেহেশত।

 

অপরটি হল আল্লাহদ্রোহীতার পথ। এটি আল্লাহকে অমান্য করার পথ। আল্লাহর অসন্তুষ্টির পথ। নবীদের অমান্য করার পথ। শয়তানের পথ। আত্নার দাসত্বের পথ। এ পথের পরিনাম হল জাহান্নাম, চির শাস্তি, চির লাঞ্ছনা, চির অকল্যান আর ধংস। আমাদেরকে চলতে হবে আল্লাহর পথে। চলতে হবে নবীদের পথে। নবীদের দেখানো পথই হল আল্লাহর সন্তুস্টির পথ। নবীদের পথই দুনিয়ার কল্যানের পথ।

 

নবীদের পথই জান্নাতের পথ। নবীদের পথ শান্তির পথ। নবীদের দেখানো পথ সুন্দর পৃথিবী গড়ার পথ। নবীদের দেখানো পথ আদর্শ মানুষ হবার পথ। নবীদের পথ উন্নতির পথ, শ্রেষ্ঠত্বের পথ। তাই আসুন আমরা নবীদের জীবনী পড়ি। তাঁদের আদর্শকে জানি। তাঁদের ভালোবাসি। তাঁদের আদর্শের অনুসরন করি এবং তাঁদের দেখানো পথে চলি।

 

 

প্রথম মানুষ প্রথম নবী আদম

 

আলাইহিস সালাম

 

মহাবিশ্ব ও পৃথিবী

 

এই মহা বিশ্বে রয়েছে লক্ষ কোটি গ্রহ নক্ষত্র। মেঘমুক্ত আকাশে মাথার উপর শুন্যলোকে তাকিয়ে দেখুন, বলুনতো কী দেখতে পান? হ্যাঁ, দিনে প্রচণ্ড তেজদীপ্ত সূর্য। রাতে ঝলমল মিটমিটে তাঁরার আলো। এইতো আমরা দেখি দিবানিশি। বাপও দেখেছেন। দাদা দেখেছেন। পরদাদা দেখেছেন, পূর্বপুরুষরা সবাই দেখেছেন। কবে থেকে ওদের শুরু আর কবে যে হবে শেষ, কেউ জানে না তা। একই পথে, একই নিয়মে ওরা চলছে তো চলছেই। কে ওদের সৃষ্টি করেছেন? আপনি নিশ্চয়ই বলবেন, এক আল্লাহ ছাড়া আবার কে? হ্যাঁ তিনি গোটা বিশ্ব জগত সৃষ্টি করেছেন মাত্র ছয়দিনে। (দেখুন আল কুরআনঃ সুরা আরাফঃ ৪৫, সুরা ইউনুসঃ ৩, সুরা হুদঃ ৭, সুরা ফুরকানঃ ৫৯, সুরা সাজদাঃ ৪, সুরা কাহাফঃ ৩৮, সুরা হাদিদঃ ৪) ছয় দিনে মানে ছয়টি কালে। তিনিই গোটা বিশ্ব জগতের স্রস্টা, শাসক ও পরিচালক। তিনিই সমস্ত ক্ষমতার উৎস।

 

মহা বিশ্বে এই যে লাখো কোটি গ্রহ নক্ষত্র, ওদের আবার ভিন্ন ভিন্ন পরিবার আছে। একেক পরিবারের অনেক অনেক সদস্য আছে। ওদের যে মোট কয়টি পরিবার আছে, আর একেক পরিবারে যে কতজন সদস্য আছে, সে কথা কেউ বলতে পারবে না। আমাদের এই পৃথিবীও কিন্তু একটা গ্রহ। একটি নক্ষত্র পরিবারের সদস্য। এবার নিশ্চয়ই আপনি বুঝতে পেরেছেন, মহান আল্লাহর গোটা সৃষ্টিলোকের অতি ক্ষুদ্র একটি অংশই মাত্র আমাদের এই পৃথিবী।

 

তিনি এই পৃথিবীকে সৃষ্টি করেছেন মনের মত সুন্দর করে। সাজিয়েছেন অপরূপ সাজে। এখানে শান্ত সাগর গতিমান। চঞ্চল নদী বহমান। পর্বতমালা শিরতুলে উঁকি মারে আকাশে। দিনে সূর্যের আলো। রাতে মিষ্টি হাসি চাঁদের। সবুজের বন। গাছের ছায়া। পাখির কলতান। ফুলের গন্ধ। ফলের সমারোহ। সবকিছু আছে অফুরান। নেই শুধু সেই-----।

 

প্রতিনিধি পাঠাবার সিদ্ধান্ত

 

নেই শুধু সেই মানুষ। সেই মানুষ, যার জন্যে এই পৃথিবীর সবকিছু বানিয়েছেন তিনি।(সুরা ২ আল বাকারাঃ আয়াত ২৯) তিনি পৃথিবীতে তাঁর নতুন প্রতিনিধি পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। আর সিদ্ধান্ত নিলেন, মানুষ সৃষ্টি করে তাঁকেই পৃথিবীতে তাঁর নতুন প্রতিনিধি বানিয়ে পাঠাবেন। যেই সিদ্ধান্ত সেই কাজ। কে আছে তাঁর সিদ্ধান্ত নাড়াবার? তিনি তাঁর সিদ্ধান্তের কথা ফেরেস্তাদের জানিয়ে দিলেন। বললেন, ‘‘হে ফেরেস্তারা, পৃথিবী নামের নতুন যে গ্রহটি আছে, সেখানে আমি এক নতুন প্রজন্মকে প্রতিনিধি নিয়োগ করবো।’’

 

ঘোষণাটি শুনে তাঁরা আঁতকে ওঠে।

 

ফেরেস্তা কারা? হ্যাঁ, তারাও আল্লাহর সৃষ্টি। তাঁর দাস। তাঁর সাম্রাজ্যের একান্ত বিনীত বাধ্যগত কর্মচারী। আল্লাহর নির্দেশে তাঁরা গ্রহ নক্ষত্র পরিচালনা করে। পানি, বাতাস, মেঘমালা পরিচালনা করে। জীবন মৃত্যু দান করে। তাঁরই নির্দেশে আরো করে হাজারো রকমের কাজ। মোট কথা তাঁরা তাঁর দাস কর্মচারী। দাসত্ব করা ছাড়া তাঁরা আর কিছু জানে না,বুঝে না।

 

তাইতো তাঁরা প্রভুর বক্তব্যে ‘প্রতিনিধি’ শব্দটি শুনে আঁতকে ওঠে। কারন এ শব্দটির মধ্যে ‘স্বাধীনতার’ গন্ধ আছে। আর স্বাধীনতা পেলে স্বেচ্ছাচারীতার আশংকা থাকে। তাইতো তাঁরা বলে উঠলোঃ

 

‘‘আপনি কি সেখানে এমন কাউকেও পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যে সেখানকার ব্যবস্থাপনায় বিপর্যায় সৃষ্টি করবে, আর করবে হানাহানি রক্তপাত? আপনার প্রশংশা আর গুনগান করার জন্যেতো আমরাই নিযুক্ত রয়েছি।’’ (সুরা ২ আল বাকারা-আয়াত ৩০)

 

আল্লাহ তাঁদের বলে দিলেনঃ ‘‘আমি যা জানি, তোমরা তা জান না।’’ (সুরা ৬ আনয়ামঃ আয়াত ২, সুরা মুমিনুনঃ আয়াত ১২, সুরা সাজদাঃ আয়াত ৭)

 

সৃষ্টি করলেন আদমকে

 

তারপর কি হল? তারপর তিনি সৃষ্টি করলেন প্রথম মানুষ। সৃষ্টি করলেন তাঁকে মাটি দিয়ে। (সুরা ২ আল বাকারাঃ আয়াত ৩০) মাটির দেহ তৈরি হয়ে যাবার পর তার মধ্যে ঢুকিয়ে দিলেন জীবন। তিনি হয়ে গেলেন এক জ্যান্ত মানুষ। আল্লাহ তাঁর নাম দিলেন ‘আদম’। তিনি আদমকে শুধু জ্যান্ত মানুষই বানান্ নি। বরং ‘‘খালাকাল ইনসান, আল্লামাহুল বাইয়ান’’-তাঁকে মানুষ বানালেন এবং কথা বলা শিখালেন।

 

আদম পৃথিবীর সব মানুষের পিতা।

 

জ্ঞানী আদম

 

তারপর মহান আল্লাহ ‘আদমকে সব কিছুর নাম শিখালেন’। (সুরা আল বাকারাঃ আয়াত ৩১)

 

নাম শিখানোর মানে কী? নাম শিখানোর মানে পরিচয় শিখানো। গুনবৈশিষ্ট এবং ব্যাবহার বিধি জানানো। অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা আদমকে সব কিছুর পরিচয় জানিয়ে দিলেন। জানিয়ে দিলেন ব্যাবহার করার নিয়ম কানুন। প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করবার জন্যে এ শিক্ষা লাভ করার প্রয়োজন ছিল অনিবার্য। এবার ফেরেশতাদের দেকে বললেনঃ

 

‘‘তোমরা যে ধারনা করছিলে, তা যদি সঠিক হয়ে থাকে, তবে বল দেখি এই জিনিসগুলির নাম।’’ (সুরা ২ আল বাকারাঃ আয়াত ৩১)

 

কী করে বলবে তাঁরা? তাঁদের তো এগুলি সম্পর্কে কোন জ্ঞানই দেয়া হয় নি। তাঁরা বিনীত কয়ে বললো –‘‘ প্রভূ, ত্রুটিমুক্ত পবিত্র তোমার স্বত্বা। আমরা তো কিছুই জানি না। কেবলমাত্র তুমি যতটুকু শিখিয়েছ, ততটুকুই আমরা জানি। সমস্ত জ্ঞান ও বিজ্ঞতার মালিক তো তুমিই।’’ (সুরা আল বাকারাঃ আয়াত ৩২)

 

এবার তিনি আদমকে নির্দেশ দিলেন, ‘‘আদম, তুমি ওদেরকে এ জিনিসগুলির পরিচয় বলে দাও।’’ আদম (আঃ) সবগুলি জিনিসের পরিচয় তাঁদেরকে বলে দিলেন। (আল বাকারাঃ আয়াত ৩৩)

 

আদমের প্রতি সাজদাবনত হবার হুকুম

 

এই আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে ফেরেশতারা যা সন্দেহ করেছিলো, তারই জবাব দেয়া হয়েছে। তাঁদের বুঝিয়ে দেয়া হল, মানুষকে কেবল ক্ষমতা আর সাধীনতাই দেয়া হবে না, বরং তাঁদের ক্ষমতা ও স্বাধীনতা প্রয়গের জন্যে জ্ঞানও দেয়া হবে।

 

এবার আল্লাহ্‌ ফেরেশতাদের হুকুম দিলেনঃ ‘‘আদমের সামনে নত হও। ’’

 

আল্লাহর নির্দেশে সবাই আদমের সামনে অবনতো হলো। (আল বাকারাঃ আয়াত ৩৪)

 

ইবলিসের কাণ্ড

 

কিন্তু ইবলিস অবনতো হতে অস্বীকার করলো। সে অহংকার করে বললোঃ ‘‘আমি আদমের চাইতে উত্তম। কারন তুমি আমাকে আগুন দিয়ে সৃষ্টি করেছ। আর আদমকে তো মাটি দিয়ে তৈরি করেছ। ’’

 

এভাবে ইবলিস তিনটি অমার্জনীয় অপরাধ করলো। সেঃ

 

১। আল্লাহর হুকুম অমান্য করলো,

 

২। অহংকার করলো এবং

 

৩। নিজেই নিজেকে উত্তম বলে ঘোষণা করলো।

 

এই তিনটির চাইতে নিকৃষ্ট অসৎগুন আর হয় না। সুতরাং আল্লাহ্‌ তাঁকে ‘‘অভিশপ্ত শয়তান’’ বলে আখ্যা দিলেন। বললেনঃ ‘ তুই এখান থেকে নেমে যা। এখানে থেকে অহংকার করবার কোন অধিকার তোর নেই। যা, তুই বেরিয়ে যা। এখন থেকে তুই অপমানিত ও লাঞ্ছিতদেরই একজন।’’ (আল আরাফঃ আয়াত ১৩)

 

এবার সে সমস্ত কল্যাণ ও অনুগ্রহ থেকে নিরাশ হল। আর ‘ইবলিস’ মানেই নিরাশ। কিন্তু সে অহংকার ত্যাগ করলো না। সে ভাবল, আদমের কারনেই তো আমি বঞ্চিত আর অভিশপ্ত হয়েছি। সুতরাং আদম ও আদমের সন্তানদের ক্ষতি করার জন্য আমি সর্বশক্তি নিয়োগ করবো। সে আল্লাহকে বললোঃ ‘আমাকে পূনরুথ্যান দিবস পর্যন্ত অবকাশ দিন।’’ এই ‘অবকাশ দিন বলতে শয়তান আল্লাহর কাছে দুটি সুযোগ চাইলোঃ

 

১। কিয়ামত পর্যন্ত বেঁচে থাকার সুযোগ এবং

 

২। আদম সন্তানদের পথভ্রষ্ট করার সুযোগ।

 

‘‘আল্লাহ্‌ বললেন- যা তোকে সুযোগ দিলাম।’’ (আল আরাফঃ আয়াত ১৫, সুরা আল হিজরঃ আয়াত ৩৭) শয়তান বলল-

 

‘‘আদম সন্তানদের পথভ্রষ্ট করার জন্যে এখন থেকে আমি তোমার সরল সঠিক পথের বাঁকে বাঁকে ওঁৎ পেতে বসে থাকবো। সামনে পিছে, ডানে বামে, সব দিক থেকে আমি তাঁদের ঘিরে ফেলব। ফলে তাঁদের মধ্যে থেকে খুব কম লোককেই তুমি তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ পাবে।’’ (সুরা ৭ আল আরাফঃ আয়াত ১৬-১৭)

 

আল্লাহ বল্লেনঃ আমার বান্দাদের উপর তোর কোন প্রভাব প্রতিপত্তি চলবে না। তুই জোর করে তাঁদের সঠিক পথ থেকে ফেরাতে পারবি না। তুইতো পারবি কেবল চালবাজি করতে। মিথ্যা আশার লোভ দেখাতে। পাপের কাজকে চাকচিক্যময় করে দেখাতে। আর ভ্রান্ত পথের আকর্ষণ সৃষ্টি করতে। এই সুযোগই তো কেবল তোকে দেয়া হয়েছে। লোকদের জোর করে হেদায়েতের পথ থেকে গোমরাহির পথে টেনে নেবার ক্ষমতা তোকে দেয়া হয় নি। তবে যে সব মানুষ তোর প্রলোভনে পড়বে, আমি তাঁদেরকে আর তোকে দিয়ে জাহান্নাম ভর্তি করবো। (ইসরাঃ আয়াত ৬২-৬৫, সুরা হিজরঃ আয়াত ৪২)

 

এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছি, যে সব মানুষ আল্লাহর হুকুম মেনে চলবে, শয়তান তাঁদের পথভ্রষ্ট করতে পারবে না। সে ক্ষমতা শয়তানের নেই। শয়তান কেবল তাদেরই বিপথগামী করতে পারবে, যারা আল্লাহর হুকুম মেনে চলে না। কিংবা তাঁর হুকুম পালনে গাফলতি করে।

 

আদম ও হাওয়া জান্নাতে

 

তারপর কি হল? –তারপর মহান আল্লাহ্‌ শয়তানকে লাঞ্ছিত করে তাড়িয়ে দিলেন। আর আদমকে থাকতে দিলেন জান্নাতে। প্রথমত আদম ছিলেন একা। তারপর আল্লাহ্‌ আদমের (পাঁজরের হাড়) থেকে তাঁর স্ত্রী হাওয়াকে সৃষ্টি করলেন। (আন নিসাঃ আয়াত ১)

 

এবার তিনি আদমের কাছে কিছু নির্দেশ পাঠালেন। বল্লেনঃ ‘‘হে আদম, তুমি আর তোমার স্ত্রী দুজনেই জান্নাতে থাকো। যা খুশি ইচ্ছামত খাও। তবে শুনো ঐ যে গাছটি, সেটির কাছেও যেও না। সেটির ফল খেও না। খেলে জালিমদের মধ্যে গণ্য হবে।’’ (আল বাকারাঃ আয়াত ৩৫)

 

বাবা আদম আর মা হাওয়া দারুন সুখে জান্নাতে থাকতে লাগলেন। কী চমৎকার জায়গা জান্নাত। সুখ আর আনন্দের অন্ত নেই এখানে। কিন্তু আদম হাওয়ার এই আনন্দ, এই সুখ শয়তানের সহ্য হয় না। সে ভাবলো, আদমের কারনেই তো আমার এই লাঞ্ছনা। যে করেই হোক, আমি যেমন আল্লাহর হুকুম অমান্য করে লাঞ্ছিত হয়েছি। এস রকমভাবে আদমকে দিয়েও আল্লাহর হুকুম অমান্য করাতে হবে। তখন সেও হবে আমারত মত লাঞ্ছিত ও অপদস্থ।

 

শয়তান প্রতারনা করলো

 

আদম ও হাওয়া তখন পর্যন্ত শয়তানের ধোকা প্রতারনা সম্পর্কে কোন অভিজ্ঞতা লাভ করেন নি। এই সুযোগে শয়তান খুব ভালো মানুষের বেশে এসে তাঁদের ধোঁকা দিল। সে বললোঃ তোমাদের প্রভূ তোমাদের এই গাছের নিচে যেতে নিষেধ করেছেন কেন জান? আসলে এই গাছের ফল খেলে উচ্চ মর্যাদা লাভ করা যায়। ফেরেশতা হওয়া যায়। তাছাড়া চিরদিন বেঁচে থাকা যায়। তোমরা যেন আবার ফেরেশতা না হয়ে বস, যেন চিরকাল বেঁচে না থাকো, সে জন্যই তোমাদের প্রভূ এ গাছের ফল খেতে নিষেধ করেছেন। সে কসম করে বললোঃ ‘আমি তোমাদের ভালো চাই’। এভাবে সে দুজনকেই তার প্রতারনার জালে বন্দী করে ফেললো।(আল আরাফঃ আয়াত ২০-২২)

 

তাঁরা দুজনেই নিষিদ্ধ গাছের ফল খেয়ে বসলেন। আল্লাহর নিষেধের কথা ভুলে গেলেন তাঁরা। শয়তানের ধোঁকায় পড়ে তাঁরা অমান্য করে বসলেন মহান আল্লাহর নির্দেশ।

 

সাথে সাথে তাঁদের জান্নাতি পোশাক খশে পড়লো। তাঁরা গাছের পাতা দিয়ে নিজেদের লজ্জা আবৃত করতে থাকেন। এসময় আল্লাহ্‌ পাক তাঁদের দেকে বললেন- আমি কি তোমাদের নিষেধ করিনি এ গাছটির কাছে যেতে? আমি কি তোমাদের বলিনি শয়তান তোমাদের সুস্পষ্ট দুশমন।? (আল আরাফঃ আয়াত ২২)

 

আদম ও হাওয়ার অনুতাপ

 

আদম ও হাওয়া দুজনেই তাঁদের ভুল বুঝতে পারলেন। চরম অনুতপ্ত হলেন তাঁরা। অপরাধবোধ তাঁদের ভীষণ ব্যাকুল করে তুললো। কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন তাঁরা। অনুতপ্ত মনে কাতর কণ্ঠে তাঁরা ফরিয়াদ করলেন প্রভূর দরবারেঃ

 

‘‘ওগো প্রভূ, আমরা তো নিজেদের উপর অবিচার করে বসেছি। এখন তুমি যদি আমাদের ক্ষমা না করো, আমাদের প্রতি রহম না করো, তবে তো আমরা ধ্বংস হয়ে যাবো।’’ (সুরা ৭ আল আরাফঃ আয়াত ২৬)

 

আল্লাহ ক্ষমা করে দিলেন তাঁদের

 

তাঁদের এই আন্তরিক অনুশোচনা ও তওবা আল্লাহ কবুল করলেন। (আল বাকারাঃ আয়াত ৩৭)

 

ফলে আদম ও হাওয়া শয়তানের প্রতারনার জালে আবদ্ধ হয়ে যে অপরাধ করে ফেলেছিলেন, মহান আল্লাহ্‌ তা মাফ করে দিলেন। তাঁরা পূনরায় আগের মত নিষ্পাপ হয়ে গেলেন।

 

এখানে একটি জরুরি বিষয় বুঝে নেয়া দরকার। সেটা হলো, প্রথমে আমরা দেখেছি, ইবলিস আল্লাহর হুকুম অমান্য করে অভিশপ্ত হয়েছে। আর এখানে দেখলাম, আদম (আঃ) এবং তাঁর স্ত্রীও আল্লাহর হুকুম অমান্য করলেন। কিন্তু তাঁরা রয়ে গেলেন নিষ্পাপ ও আল্লাহর প্রিয়, এর কারন কি? – এর কারন হল, শয়তান আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করেছেঃ

 

১। বুঝে শুনে ইচ্ছাকৃতভাবে।

 

২। সে নিজেকে বড় মনে করেছে।

 

৩। সে নিজেকে উত্তম মনে করেছে।

 

৪। সে অহংকার করেছে।

 

৫। সে প্রকাশ্যে বিদ্রোহ করেছে।

 

৬। এই অপরাধের জন্যে সে মোটেও অনুতপ্ত হয় নি এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে নি।

 

অন্যদিকে আদম (আঃ) ও তাঁর স্ত্রী হাওয়াঃ

 

১। ইচ্ছাকৃতভাবে বুঝে শুনে আল্লাহর হুকুম অমান্য করেন নি।

 

২। তাঁরা বিদ্রোহও করেন নি।

 

৩। তাঁরা অহংকারও করেন নি।

 

৪। তাঁরা সচেতনভাবে মূলত আল্লাহর একান্তই আনুগত্য ছিলেন।

 

৫। তাঁরা অপরাধ করেছেন শয়তানের ধোঁকায় পড়ে।

 

৬। তাঁরা ভুল বুঝবার সাথে সাথে অনুতপ্ত হন। আল্লাহর ভয়ে কম্পিত হন এবং ক্ষমা প্রার্থনা করেন।

 

খেলাফতের দায়িত্ব নিয়ে পৃথিবীতে এলেন আদম

 

এভাবেই আদম (আঃ) আল্লাহর দাস ও খলিফা হবার মর্যাদা রক্ষা করেন। আল্লাহ্‌ তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হন। তাই আল্লাহ্‌ তাঁর মূল সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ইচ্ছা করলেন। অর্থাৎ তিনি আদম (আঃ) কে পৃথিবী নামক তাঁর প্রতিনিধি বানিয়ে দিলেন।কারন এ জন্যইতো তিনি তাঁকে সৃষ্টি করেছিলেন। মাঝখানে কিছুদিন জান্নাতে রেখে একটা পরীক্ষা নিলেন মাত্র। এ পরীক্ষার মাধ্যমে আসলে এক বিরাট অভিজ্ঞতা অর্জন করলেন হজরত আদম (আঃ)। প্রতিনিধি বানিয়ে পাঠাবার কালে, মহান আল্লাহ্‌ তাঁকে বলে দিলেনঃ যাও পৃথিবীতে অবতরন করো। তোমার শত্রু শয়তানও সেখানে যাবে। সেখানে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তোমরা বসবাস করবে। সেখানে তোমাদের জীবন সামগ্রীরও ব্যাবস্থা আছে। সেখানেই তোমাদের বাচতে হবে। সেখানেই তোমাদের মরতে হবে। আবার সেখান থেকেই তোমাদের বের করে আনা হবে, পুনরুত্থিত করা হবে। (আল আরাফঃ আয়াত ২৪-২৫)

 

এ প্রসঙ্গে তিনি হজরত আদম (আঃ) কে আর বলে দিলেন, আমার পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে জীবন পদ্ধতি যাবে। যে আমার দেয়া জীবন পদ্ধতির অনুসরন করবে, তাঁর কোন ভয় থাকবে না। থাকবে না, কোন দুঃখ, কোন বেদনা। অর্থাৎ সে অনায়াসে আবার জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং চিরকাল সুখে থাকবে। (আল বাকারাঃ আয়াত ২৮)

 

আল্লাহ আরো বলে দিলেনঃ তবে যারা আমার জীবন পদ্ধতি অমান্য করবে আর মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেবে আমার আয়াতকে, চিরদিন তাঁদের আগুনে ফেলে রাখবো। তাঁরা তাঁদের চির শত্রু অভিশপ্ত শয়তানের সাথে অনন্ত জীবন জাহান্নামের আগুনে জ্বলবে। (আল বাকারাঃ আয়াত ২৯)

 

এভাবে পৃথিবীর জন্যে সৃষ্টি করা মানুষ হজরত আদম (আঃ) –কে আল্লাহ্‌ তাঁর খলীফা ও নবী বানিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দিলেন। তিনি এবং তাঁর স্ত্রী আল্লাহর বিধান অনুযায়ী জীবন যাপন করতে থাকেন। আদম (আঃ) তাঁর সন্তানদেরকে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী জীবন যাপন করতে শিখান। শয়তানের ধোঁকা প্রতারনা সম্পর্কে সতর্ক করেন। তাঁর শয়তানের বিরদ্ধে সংগ্রাম করেই জীবন কাটান।

 

আদম (আঃ) ছিলেন পৃথিবীর প্রথম মানুষ। তিনিই ছিলেন পয়লা নবী। তিনি ছিলেন অত্যন্ত জ্ঞানী ভদ্র ও রূচিবান। ছিলেন উন্নত নৈতিক চরিত্রের অধিকারী। ছিলেন অত্যন্ত সঞ্জমশীল, আল্লহভীরু ও আল্লাহর প্রতি আত্মসমপির্ত। পোশাক ছিল তাঁর ভূষণ। এইসব মহান গুনাবলীর অধিকারী একজন সভ্য মানুষের মাধ্যমেই পৃথিবীতে শুরু হয় মানুষের শুভযাত্রা। আমরা এবং আমাদের আগের ও পরের সমস্ত মানুষই হজরত আদম (আঃ) এর সন্তান। মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ

 

‘হে মানুষ, তোমাদের প্রভূকে ভয় করো। তিনিইতো তোমাদেরকে একটি মাত্র প্রান থেকে সৃষ্টি করেছেন। তাঁর থেকেই তাঁর জুড়ি তৈরি করেছেন। আর তাঁদের দুজন থেকেই বিশ্বময় ছড়িয়ে দিয়েছেন অসংখ্য পুরুষ আর নারী। (আন নিসাঃ আয়াত ১)

 

জেনে রাখুন

 

শেষ করবার আগে কয়েকটি জরুরী কথা জানিয়ে দেই। জেনে রাখলে কাজে আসবে। কুরআন মাজীদে –

 

১। আদম (আঃ) এর নাম উচ্চারিত হয়েছে পঁচিশবার।

 

২। আট স্থানে মানুষকে আদমের সন্তান বলা হয়েছে।

 

৩। ইবলিস শব্দটি উল্লেখ রয়েছে এগারো বার।

 

৪। ৮৮ বার শয়তান শব্দের উল্লেখ হয়েছে। এর মধ্যে ৭০ বার এক বচনে আর আঠারো বার বহুবচনে। আল্লাহদ্রোহী মানব নেতাদেরকেও কুরানে শয়তান বলা হয়েছে। তাঁদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে বলা হয়েছে।

 

৫। নিম্নোক্ত সুরা গুলোয় হজরত আদম (আঃ) এর ইতিহাস আলোচনা করা হয়েছেঃ সুরা আল বাকারা, আল আরাফ, বনি ইসরাইল, আল কাহাফ, তোয়াহা, আল হিজর, সোয়াদ।

 

হজরত আদম (আঃ) এর জীবন কথা থেকে আমরা এই স্লোগান নিতে পারিঃ

 

আল্লাহর হুকুম মানতে হবে,

 

শয়তানের পথ ছাড়তে হবে।

 

জান্নাতে মোদের যেতে হবে,

 

শয়তানের বিরুদ্ধে লড়তে হবে।

 

 

উচ্চ মর্যাদার নবী ইদ্রীস

 

(আঃ)

 

আল কুরআনে যে পঁচিশ জন নবীর নাম উল্লেখ আছে, তাঁদেরই একজন ইদ্রিস (আঃ)। মহান আল্লাহ্‌ তাঁকে অনেক উচ্চ মর্যাদা দান করেছেন। আল কুরআনে তিনি ইদ্রিস (আঃ) সম্পর্কে বলেনঃ

 

‘‘এই মহাগ্রন্থে ইদ্রিসের কথা স্মরণ করো। সে ছিল একজন বড় সত্যপন্থী মানুষ ও নবী। আমি তাঁকে অনেক বড় উচ্চস্থানে উঠিয়েছি।’’ (সুরা মরিয়মঃ আয়াত ৫৬-৫৭)

 

দেখলেন তো, স্বয়ং আল্লাহ্‌ পাকই তাঁকে অনেক উচ্চ মর্যাদা দান করেছেন। আর মহান আল্লাহ্‌ যাকে উচ্চ মর্যাদা দান করেন, তাঁর চেয়ে বড় ভাগ্যবান ব্যাক্তি আর কে?

 

তিনি কোন সময়কার নবী?

 

ইদ্রিস (আঃ) প্রাগৈতিহাসিক যুগের নবী। তাই তিনি কোন সময়কার নবী, সে বিষয়ে মতভেদ আছে। তবে অনেক মুফাসসির বলেছেন, কুরআনের বর্ণনা থেকে বুঝা যায়, তিনি নূহ (আঃ) এর পূর্বেকার নবী ছিলেন এবং আদম (আঃ) এর সন্তান বা নিকট বংশধরদের একজন ছিলেন। ইতিহাসবিদ ইবনে ইসহাক লিখেছেন, আদম (আঃ) এক হাজার বছর বেঁচে ছিলেন। ইদ্রিস (আঃ) তাঁর জীবনের তিন শত আট বছর পেয়েছিলেন।

 

তিনি কোন দেশের নবী ছিলেন?

 

তিনি কোন সময়কার নবী ছিলেন, কুরআনে যেমন সে কথা বলা হয় নি, ঠিক তেমনি তিনি কোন দেশের নবী ছিলেন সে কথাও কুরআনে বলা হয় নি। তবে কোন কোন ঐতিহাসিক বলেছেন, তিনি বেবিলনের লোক। আবার কেউ কেউ বলেছেন- তিনি মিশরের লোক। আসলে দুটি কথাই ঠিক। তিনি বেবিলনে জন্ম গ্রহন করেন। এখানে নবুয়ত লাভ করেন, মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকেন। এখানে কিছু লোক ঈমান আনে, আর বাকী লোকেরা ঈমান আনতে অস্বীকার করে। শুধু তাই নয়, বরং তাঁরা হজরত ইদ্রিস ও তাঁর সঙ্গীদের বিরুদ্ধে চরম শত্রুতা আরম্ভ করে। ফলে ইদ্রিস (আঃ) তাঁর সংগী সাথীদেরকে নিয়ে মিশরের দিকে হিজরত করেন। এখানে এসে তিনি নীল নদের তীরে বসতি স্থাপন করেন এবং এখানকার মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকতে থাকেন।

 

ইদ্রিস (আঃ) এর নবুয়ত

 

হজরত আদম ও হজরত শীষ (আঃ) এর পরে আল্লাহ্‌ তায়ালা হজরত ইদ্রিসকে নবুয়ত প্রদান করেন। তিনি বড় জ্ঞানী লোক ছিলেন। তাঁকে প্রাচীনতম বিজ্ঞানী বলা হয়ে থাকে। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায় তিনিই সর্বপ্রথম কলম ব্যবহার করেন।

 

ইসরাইলী বর্ণনায় ইদ্রিস (আঃ) কে ‘হনোক’ বলা হয়েছে। তালমূদে বলা হয়েছে- ‘হনোক’ তিন শত তিপ্পান্ন বছর পর্যন্ত মানব সন্তানদের উপর শাসনকার্য পরিচালনা করেন। তাঁর শাসন ছিল ন্যায় ও সুবিচারপূর্ণ শাসন। তাঁর শাশনামলে পৃথিবীতে মহান আল্লাহর অফুরন্ত রহমত বর্ষিত হতে থাকে। (The Talmud Selections, pp. 18-21)

 

হজরত ইদ্রিস (আঃ) একসময় খারাপ লোকদের থেকে নিঃসম্পর্ক হয়ে আল্লাহর ইবাদাত বন্দেগী করছিলেন। এরি মধ্যে তাঁর কাছে আল্লাহর ফেরেশতা এসে তাঁকে ডেকে বললেন, ‘হে ইদ্রিস, ওঠো একাকি থাকার জীবন ত্যাগ করো। মানুষের মাঝে চলা ফেরা করো এবং তাঁদের সঠিক পথ দেখাও।’ এ নির্দেশ পেয়ে হজরত ইদ্রীস বের হয়ে আসেন এবং মানুষকে ডেকে উপদেশ দিতে শুরু করেন।

 

বেবিলনের লোকেরা খুবই খারাপ হয়ে গিয়েছিল। অবশ্য কিছু লোক হজরত ইদ্রিসের দাওয়াত কবুল করে আল্লাহর পথে চলতে আরম্ভ করেন। কিন্তু অধিকাংশ লোক আল্লাহর পথে আস্তে অস্বীকার করে। তাঁরা হজরত ইদ্রিস ও তাঁর সাথীদের সাথে খুবই খারাপ আচরন করে। তিনি যখন দেখলেন এদের আর সৎ পথে আসার আর কোন সম্ভাবনা নেই, তখন তিনি তাঁর সাথীদেরকে নিয়ে মিশরের দিকে হিজরত করেন এবং নীল নদের তীরে বসতি স্থাপন করেন। হজরত ইদ্রিস এখানকার লোকদেরকে সৎ পথে চলার উপদেশ দিতে আরম্ভ করেন। লোকেরা তাঁর প্রচেষ্টায় ব্যাপকভাবে আল্লাহর পথে আসতে থাকে। তিনি এসব লোকদের উপর আল্লাহর আইন অনুযায়ী শাসনকার্য পরিচালনা করেন। ফলে পৃথিবীর বুকে নেমে আসে শান্তি আর সুখের ফোয়ারা। হজরত ইদ্রিস (আঃ) মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকার কাজে এবং মানুষকে আল্লাহর আইন অনুযায়ী চালাবার কাজে যত বিরোধিতার এবং দুঃখ মুসিবতেরই সম্মুখীন হয়েছেন, তাতে তিনি চরম ধৈর্য ও সবর অবলম্বন করেন। তাইতো মহান আল্লাহ্‌ তায়ালা তাঁর প্রশংসা

 

করে পবিত্র কুরআনে বলেনঃ

 

‘‘আর ইসমাঈল, ইদ্রিস, যুলকিফল এরা প্রত্যেকেই ছিল ধৈর্যশীল। আমি তাঁদের প্রবেশ করিয়েছি আমার রহমতের মাঝে। তাঁরা ছিল সৎ এবং সংশোধনকামী।’’ (সুরা ২১ আল আম্বিয়াঃ আয়াত ৮৫)

 

হজরত ইদ্রিস (আঃ) এর উপদেশ

 

ইসরাইলী সূত্র এবং কিংবদন্তী আকারে হজরত ইদ্রিস (আঃ) এর বেশ কিছু উপদেশ এবং জ্ঞানের কথা প্রচলিত আছে। এখানে বলে দিচ্ছি তাঁর কিছু উপদেশ ও জ্ঞানের কথা-

 

১। আল্লাহর প্রতি ঈমানের সাথে যদি সংযোগ থাকে ধৈর্য ও সবরের, তবে বিজয় তাঁর সুনিশ্চিত।

 

২। ভাগ্যবান সে, যে আত্মসমালোচনা করে। আল্লাহ্‌ প্রভূর দরবারে প্রত্যেক ব্যাক্তির সুপারিশ হল তাঁর নেক আমল।

 

৩। সঠিকভাবে কর্তব্য পালনের মধ্যেই আনন্দ। শরিয়া দ্বীনের পূর্ণতা দান করে। আর যে ব্যাক্তি দ্বীনের দিক থেকে পূর্ণ, সেই ব্যাক্তিত্তশালী।

 

হজরত ইদ্রিস (আঃ) মানুষকে আল্লাহর হুকুম পালন করতে বলতেন। তাঁরই ইবাদাত ও দাসত্ব করতে বলতেন। তিনি মানুষকে উপদেশ দিতেনঃ পরকালে নিজেকে আল্লাহর আযাব থেকে বাঁচাতে, দুনিয়াতে নেক আমল করতে এবং এই ক্ষনস্থায়ী দুনিয়ার মোহ ত্যাগ করতে। তিনি নির্দেশ দিতেন সালাত কায়েম করতে, সিয়াম পালন করতে, যাকাত পরিশোধ করতে এবং পবিত্রতা অবলম্বন করতে।

 

কথিত আছে, হজরত ইদ্রিস (আঃ) এর সময়কালে বিরাশিটি ভাষা চালু ছিল। তিনি সবগুলি ভাষা জানতেন এবং সবগুলি ভাষাতেই কথা বলতে পারতেন। তিনি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের লোকদেরকে তাঁদের নিজেদের ভাষায় উপদেশ দিতেন। আল কুরআনে মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ

 

‘‘আমি যখনই কোন রাসুল পাঠিয়েছি, সে নিজ কওমের ভাষায় তাঁদের দাওয়াত দিয়েছে।’’ (সুরা ইব্রাহীমঃ আয়াত ৪)

 

জানা যায় হজরত ইদ্রিস (আঃ)- ই সর্বপ্রথম নগর রাজনীতির চালু করেন এবং নগর সভ্যতার ভিত্তি স্থাপন করেন। তাঁর সময় ১৮৮ টি নগর গড়ে উঠেছিলো।

 

তাঁর মৃত্যু ও তাঁর মর্যাদা

 

আল কুরআনে আল্লাহ্‌ তায়ালা ইদ্রিস (আঃ) সম্পর্কে বলেছেনঃ

 

‘আমি তাঁকে অনেক উচ্চ স্থানে উঠিয়েছি।’ এ আয়াতাংশের ব্যাখ্যায় অনেক তাফসীরকার বলেন- পৃথিবীতে হজরত ইদ্রিস (আঃ) এর মৃত্যু হয়নি, বরং আল্লাহ্‌ তায়ালা তাঁকে উঠিয়ে নিয়ে গেছেন। হতে পারে মহান আল্লাহ্‌ তায়ালা তাঁকে জীবন্ত উঠিয়ে নিয়ে গেছেন এবং অনেক উচ্চ মর্যাদা দান করেছেন। তবে আসল কথা আল্লাহই ভালো জানেন।

 

হ্যাঁ, এ প্রসঙ্গে আর একটি কথা বলে দিচ্ছি। তাহলো আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মাদ (সঃ) যখন মি’রাজে গিয়েছিলেন, তখন চতুর্থ আকাশে হজরত ইদ্রিস (আঃ) এর সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। হজরত ইদ্রিস তাঁকে দেখে বলে ওঠেনঃ ‘শুভেচ্ছা স্বাগতম, হে আমার মহান ভাই।’

 

কুরআন মাজীদে হজরত ইদ্রিস (আঃ) এর নাম দুইবার উল্লেখ হয়েছে। একবার সুরা মরিয়মে আর একবার সুরা আম্বিয়াতে। উভয় স্থানেই আল্লাহ্‌ তায়ালা ইদ্রিস (আঃ) এর উচ্চ গুনাবলীর এবং বড় মর্যাদার কথা উল্লেখ করেছেন। এই মহাপুরুষ ও মহান নবীর উপর বর্ষিত হোক চির শান্তি ও করুনাধারা।

 

৩।

 

হাজার বছরের সংগ্রামী নূহ

 

(আঃ)

 

অনেক অনেক বছর হলো আদম আলাইহিস সালাম বিদায় নিয়েছেন পৃথিবী থেকে। তাঁর স্ত্রী হাওয়াও আর বেঁচে নেই। তাঁদের মৃত্যুর পর শত শত বছরের ব্যবধানে অনেক বেড়ে গিয়েছিল তাঁদের বংশধারা। এখানে সেখানে ছড়িয়ে পড়ে অসংখ্য নারী পুরুষ আদম সন্তান। ইরাকসহ বর্তমান আরব দেশগুলিই ছিল তাঁদের বসবাসের এলাকা।

 

আদম (আঃ) এর মৃত্যুর পর দীর্ঘ দিন তাঁর সন্তানেরা ইসলামের পথেই চলে। চলে আল্লাহর পথে। মেনে চলে আল্লাহর বিধান। অনুসরন করে আল্লাহর নবী আদমের পদাংক। তাঁদের মাঝে জন্ম নেয় অনেক ইসলামী নেতা ও আলেম। তাঁরাও তাঁদেরকে সৎ পথে পরিচালিত করার চেষ্টা সাধনা করে যান। এরি মধ্যে হজরত ইদ্রিস (আঃ) ও অতীত হয়ে যান। কিন্তু কালক্রমে আদম সন্তানরা আদম আলাইহিস সালামের শিক্ষা ভুলে যান। ভুলে যান ইদ্রিস আলাইহিস সালামের উপদেশ। শয়তানের ধোঁকায় পড়ে যায় তাঁরা। ইসলামের পথ থেকে তাঁরা সড়ে পড়ে দূরে। বাঁকা পথে চলতে শুরু করে তাঁরা। বিপথে এগিয়ে যায় অনেক দূর।

 

ফলে তাঁরা শয়তানের অনুসারী হয়ে যায়। পরিনত হয় আত্নার দাসে। তাঁরা অহংকারি হয়ে পড়ে। দুনিয়ার জীবনটাকেই বড় করে দেখতে শুরু করে। এখানকার লাভ ক্ষতিকেই তাঁরা আসল লাভ ক্ষতি মনে করে। শুধু তাই নয়। বরং সব চাইতে বড় অপরাধটিও তাঁরা করে বসে। সেটা হল শিরক। তাঁরা শিরকে নিমজ্জিত হয়। মানে মনগড়া দেবদেবীদের তাঁরা আল্লাহর অংশীদার আর প্রতিপক্ষ বানিয়ে নেয়। পূজা করার জন্যে তাঁরা মূর্তি তৈরি করে নেয়। তাঁদের কয়েকটি মূর্তির নাম বলছি।

 

হ্যাঁ, তাঁদের বড় মূর্তিটির নাম ছিলপ ‘অদ্দ’। এ ছিল পুরুষ দেবতা। একটি মূর্তির নাম ছিল ‘সূয়া’। এটি ছিল দেবী। একটির নাম ছিল ‘ইয়াগুস’। এটির আকৃতি ছিল সিংহের মত। একটি মূর্তি ছিল ঘোড়ার আকৃতির। এটির নাম ছিল ‘ইয়াউক’। আরো একটি বড় মূর্তি ছিলো। ঈগল আকৃতির এই মূর্তিটির নাম ছিল ‘নসর’। (সুরা নূহ আয়াত ২৩)

 

এইসব মূর্তির তাঁরা পূজা করতো। এসব অসহায় দেবদেবীকে তাঁরা আল্লাহর অংশীদার বানিয়েছিলো। এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন মানুষ হয়েও তাঁরা দুবে গিয়েছিলো তাঁরা কতটা অন্ধকারে। তাঁদেরই এক উঁচু ঘরে জন্ম নেয় এক শিশু। সে বড়ো হয়ে ওঠে তাঁদেরই মাঝে। কৈশোর, তারুণ্য পার হয়ে যৌবনে এসে উপনীত হয়। তাঁর জ্ঞান, বুদ্ধি, যোগ্যতা, দক্ষতা দেখে সবাই ভাবে, ভবিষ্যতে সেই হবে তাঁদের নেতা। নেতৃত্বের সকল যোগ্যতাই উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে তাঁর মধ্যে। সে কখনো মিথ্যা বলে না। অন্যায় অপরাধে জড়িত হয় না। কারো প্রতি অবিচার করে না। উন্নত পবিত্র চরিত্রের সে অধিকারী।

 

ফলে সকলেরই সে প্রিয় পাত্র। তাঁর মতো বিশ্বস্ত দ্বিতীয় আর কেউ তাঁদের মধ্যে নেই। কী সেই যুবকটির নাম? নাম তাঁর নূহ। নূহ তাঁদের আশা ভরসার স্থল। তাঁদের পরিকল্পনা মতো নূহ- ই হবে তাঁদের প্রিয় নেতা। কিন্তু আল্লাহর পরিকল্পনা ভিন্ন। আল্লাহ্‌ নূহকে নবী মনোনীত করেন। তাঁর কাছে অহী পাঠানঃ ‘‘কঠিন শাস্তি আশার আগেই তুমি তোমার জাতির লোকদেরকে সাবধান করে দাও।’’ (সূরা নূহঃ আয়াত ১)

 

আল্লাহ্‌ নূহের কাছে তাঁর দ্বীন নাযীল করেন। দ্বীন মানে জীবন যাপনের ব্যবস্থা। আল্লাহর দ্বীনের নাম ‘ইসলাম’। আল্লাহর দ্বীন অনুযায়ী জীবন যাপন না করলে যে কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে, নিজ জাতিকে সে ব্যাপারে সতরক করার জন্যে আল্লাহ্‌ নূহ –কে নির্দেশ প্রদান করেন।

 

নূহ তাঁর জাতির লোকদের বললেন- ‘‘হে আমার জাতির ভাইয়েরা, তোমরা আল্লাহর দাসত্ব করো। তাঁর হুকুম মেনে চলো। তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোন ইলাহ নেই। তোমরা কেবল তাকেই ভয় করো। আর আমার কথা মেনে চলো। আমার আনুগত্য করো। যদি তাই না করো, আমার ভয় হচ্ছে, তবে তোমাদের উপর একদিন কথি শাস্তি এসে পড়বে। আমি কিন্তু তোমাদের স্পষ্ট ভাষায় সাবধান করে দিচ্ছি।’’

 

নূহ তাঁদের আর বলেনঃ ‘‘আমি তোমাদের যেভাবে চলতে বলছি, তোমরা যদি সেভাবে চলো, তবে আল্লাহ্‌ তোমাদের অপরাধ ক্ষমা করে দেবেন। আর একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তোমাদের বাঁচিয়ে রাখবেন। নইলে কিন্তু আগেই ধ্বংস হয়ে যাবে।’’ (সূরা নুহঃ আয়াত ২৪-২৫)

 

নূহের এই কল্যাণময় হিতাকাঙ্ক্ষী আহবানের জবাবে তাঁর জাতির নেতারা বললোঃ তুমি কেমন করে হলে আল্লাহর রাসুল? তুমি তো আমাদেরই মতো একজন মানুষ।(সূরা ১১ হুদঃ আয়াত ২৭)

 

সাধারন মানুষের উপর কিন্তু নূহের ছিলো দারুন প্রভাব। তাঁরা জাতির স্বার্থপর নেতাদের চাইতে নূহ-কেই বেসি ভালোবাসতো। নেতারা যখন দেখলো জনগন তো নূহের কথায় প্রভাবিত হয়ে পড়ছে। তাঁর সাথী হয়ে যাচ্ছে। তাঁদের সমস্ত কায়েমি স্বার্থ বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তখন তাঁরা জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্যে কূটকৌশলের আশ্রয় নেয়। তাঁরা জনগণকে বলেঃ

 

‘‘দেখো নূহের কাণ্ড, সে তো তোমাদের মতই একজন মানুষ মাত্র। কিন্তু সে নিজেকে আল্লাহর রাসুল বলে দাবী করছে। আসলে ওসব কিছু নয়। সে এভাবে দেশের প্রধান নেতা এবং করতা হতে চায়। কোন মানুষ যে আল্লাহর রাসুল হতে পারে, এমন কথা তো বাপদাদার কালেও শুনি নি। আল্লাহ্‌ যদি আমাদের মাঝে কোন রাসুল পাঠাতেনই তবে নিশ্চয়ই কোন ফেরেশতা পাঠাতেন। তোমরা ওর কথায় কান দিও না। ওকে আসলে জীনে পেয়েছে।’’ (সূরা আল মুমিনুনঃ আয়াত ২৩-২৫)

 

এভাবে বৈষয়িক স্বার্থের ধারক এই নেতারা জনগণকে বিভ্রান্ত করে দিলো। তাঁরা নূহের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হলো। নূহ দিন রাত তাঁদের সত্য পথে আসার জন্যে ডাকতে থাকেন বুঝাতে থাকেন। নূহ তাঁদের আল্লাহর পথে আনবার জন্যে যে কী আপ্রান চেষ্টা করেছেন, তা আমরা নূহ (আঃ) এর কথা থেকেই জানতে পারি। তিনি মহান আল্লাহর কাছে তাঁর কাজের রিপোর্ট দিতে গিয়ে বলেনঃ

 

‘‘হে আমার প্রভূ, আমি আমার জাতির লোকদের দিনরাত ডেকেছি তোমার দিকে। কিন্তু আমার আহবানে তাঁদের এড়িয়ে চলার মাত্রা বেড়েই চলেছে। আমি যখনই তাঁদের ডেকেছি তোমার ক্ষমার দিকে, তাঁরা তাঁদের কানে আঙুল ঢেসে দিয়েছে। কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকে দিয়েছে। এসব অসদাচরনে তাঁরা অনেক বাড়াবাড়ি করে চলেছে। তাঁরা সীমাহীন অহংকারে ডুবে পড়েছে। পরে আমি তাঁদের উঁচু গলায় ডেকেছি। প্রকাশে দাওয়াত দিয়েছি। গোপনে গোপনেও বুঝিয়েছি। আমি তাঁদের বলেছি, তোমরা তোমাদের মালিকের কাছে ক্ষমা চাও। তিনি বড় ক্ষমাশীল। তিনি আকাশ থেকে তোমাদের জন্যে পানি বর্ষণ করবেন। ধনমাল আর সন্তান দিয়ে তোমাদের সাহায্য করবেন। তোমাদের জন্যে বাগবাগিচা সৃষ্টি করে দেবেন। নদী-নালা প্রবাহিত করে দেবেন।” (সূরা ৭১ নূহঃ আয়াত ৫-১২)

 

নূহ তাঁদের বুঝালেন, কেন তোমরা আল্লাহর পথে আসবে না? তিনি তাঁদের বললেনঃ

 

“দেখনা, আল্লাহ্‌ কিভাবে স্তরে স্তরে সাতটি আকাশ বানিয়েছেন? চাঁদকে বানিয়েছেন আলো আর সূর্যকে প্রদীপ? আল্লাহই তো তোমাদেরকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন। আবার তিনি এই মাটিতেই তোমাদের ফিরিয়ে নেবেন। তারপর তোমাদের বের করবেন এই মাটি থেকেই। আল্লাহই তো পৃথিবীটাকে তোমাদের জন্যে সমতল করে বিছিয়ে দিয়েছেন, যাতে করে তোমরা উন্মুক্ত পথ ঘাট দিয়ে চলাচল করতে পার।” (সূরা ৭১ নূহঃ আয়াত ১৫-২০) এত করে বুঝাবার পরেও তাঁরা নূহের কথা শুনলনা। তাঁরা নিজেদের গোঁড়ামি আর অহংকারে অটল রইল। তাঁরা নূহকে বললোঃ

 

আমরা কেমন করে তোমার প্রতি ঈমান আনি? তোমার অনুসারী যে কয়জন হয়েছে, ওরা তো সব ছোট লোক। আমরা তোমাদেরকে আমাদের চাইতে বেশী মর্যাদাবান মনে করি না। বরং আমরা তোমাদের মিথ্যাবাদীই মনে করি।(সূরা ১১ হুদঃ আয়াত ২৭)

 

তারা আর বললোঃ “আমরাতো তোমাকে দেখছি স্পষ্ট মিথ্যাবাদী।” (সূরা আল আরাফঃ আয়াত ৬০)

 

নূহ তাদের আবারো বুঝালেন, “হে আমার জাতির ভাইয়েরা, আমি মোটেও বিপথে চলছি না। আমি তো বিশ্বজগতের মালিকের বানীবাহক। আমি তো কেবল আমার প্রভূর বানীই তোমাদের কাছে পৌছে দিচ্ছি। আমি তো কেবল তোমাদেরই কল্যাণই চাই। আমি আল্লাহর পক্ষ এমন সব জিনিস জানি, যা তোমরা জানো না। হে আমার দেশবাসী, তোমরা একটু ভেবে দেখো, আমি যদি মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে পাওয়া সুস্পষ্ট প্রমানের উপর থাকি আর তিনি যদি আমাকে তাঁর বিশেষ অনুগ্রহও দান করে থাকেন, কিন্তু তোমরা যদি তা না দেখতে পেলে, তবে আমার কি করবার আছে? তোমরা মেনে নিতে না চাইলে আমি তো আর তোমাদের উপর তা চাপিয়ে দিতে পারিনা। হে আমার ভাইয়েরা, আমি যে দিন রাত তোমাদের আল্লাহর পথে ডাকছি, তার বিনিময়ে তো আমি তোমাদের কাছে কিছুই চাই না। আমি তো কেবল আল্লাহর কাছে এর বিনিময় চাই। এতেও কি তোমরা বুঝতে পারছোনা যে, তোমাদের ডাকার এ কাজে আমার কোন স্বার্থ নেই?” (সূরা ৭ আল আরাফঃ আয়াত ৬১-৬২, সূরা ১১ হুদঃ আয়াত ২৮-২৯)

 

এভাবে আল্লাহর মহান ধৈর্যশীল নবী হজরত নূহ (আঃ) কয়েক শত বছর পর্যন্ত তাদের আল্লাহর পথে ডাকেন। তাদের সত্য পথে আনার অবিরাম চেষ্টা করেন। ধ্বংস ও শাস্তির হাত থেকে তাদের বাঁচাবার চেষ্টা করেন। কিন্তু তারা তাঁর এই মহৎ কাজের জবাব দেয় তিরস্কার, বিরোধিতা আর ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে। তাদের সমস্ত বিরোধিতা আর ষড়যন্ত্রের মোকাবেলায় হাজার বছর ধরে তিনি পরম ধৈর্যের সাথে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চালিয়ে যান। অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ভাষায় তাদের বুঝাবার চেষ্টা করেন।

 

কিন্তু তাঁর হাজারো মর্মস্পর্শী আবেদন নিবেদনের পর তারা তাঁর কথা শুনলো না। আল্লাহর দ্বীন কবুল করলো না তারা। স্বার্থপর নেতারা জনগণকে বলে দিলোঃ “তোমরা কিছুতেই নূহের কথায় ফেসে যাবে না। তাঁর কথায় কোন অবস্থাতেই তোমরা দেব দেবীদের ত্যাগ করতে পারবেনা। ত্যাগ করতে পারবেনা ‘অদ্দ’ আর ‘শুয়া’ কে। ইয়াগুস, ইয়াউক আর নসরকেও পরিত্যাগ করতে পারবে না। এভাবে তারা অধিকাংশ জনগণকে সম্পূর্ণ বিপথগামী করে দিলো।” (সূরা ৭১ নূহঃ আয়াত ২৩-২৪)

 

শুধু কি তাই? বরং তারা এর চাইতেও বড় ষড়যন্ত্র করলো। কি সেই ষড়যন্ত্র? তাহলো, তারা আল্লাহর নবী নূহ (আঃ) –কে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিলো। কুরআনের ভাষায়- ‘ওয়া মাকারু মাকরান কুব্বারা’ – তারা এক বিরাট ষড়যন্ত্র পাকালো। (সূরা ৭১ নূহঃ আয়াত ২২) তারা নূহ (আঃ) কে অহংকারী ভাষায় শাসিয়ে দিলোঃ “নূহ, তুমি যদি বিরত না হও, তবে বলে দিচ্ছি, তুমি হতভাগ্যদের অন্তর্ভুক্ত হবে।”১০ (সূরা ২৬ শুয়ারা” আয়াত ১১৬)

 

শুধু তাই নয়, তারা নূহ (আঃ) কে ধমকের সুরে আরো বললোঃ

 

“তুমি তো এতদিন আমাদের সাথে বড় বেশী বিবাদ করেছ। শুনো, তুমি যে আমাদের ধমক দিচ্ছিলে, তোমার কথা না শুনলে আমাদের উপর বিরাট শাস্তি নেমে আসবে, কোথায় সেই শাস্তি? তুমি যদি সত্যবাদী হয়ে থাকো, তবে শাস্তিটা নিয়ে এসে দেখাও।” (সূরা হুদঃ আয়াত ৩২)

 

নূহ (আঃ) বললেন, দেখো তোমাদের শাস্তি দেয়া তো আমার কাজ নয়। সেটা আল্লাহর কাজ। তিনি চাইলে তোমাদের শাস্তি দেবেন। আর তিনি শাস্তি দিতে চাইলে টা তোমরা কিছুতেই আটকাতে পারবেনা। শুধু তাই নয়, তখন যদি আমিও তোমাদের কোন উপকার করতে চাই, করতে পারবোনা। আল্লাহর ফায়সালা পরিবর্তন করার সাধ্য কারো নাই।” (সূরা হুদঃ আয়াত ৩৩-৩৪)

 

এবার মহান আল্লাহ্‌ অহীর মাধ্যমে তাঁর প্রিয় দাস নূহকে জানিয়ে দিলেন, “হে নূহ, তোমার জাতির যে কয়জন লোক ঈমান এনেছে, তাদের পর এখন আর কেউ ঈমান আনবে না। সুতরাং তুমি তাদের কার্যকলাপে দুঃখিত হইও না।” (সূরা হুদঃ আয়াত ৩৬)

 

আল্লাহর বিচক্ষন বান্দাহ ও নবী হজরত নূহ (আ) এটাকে তাঁর অবাধ্য ও চরম অধপতিত জাতির উপর অচিরেই আল্লাহর আজাব আসবার সবুজ সংকেত মনে করলে। তিনি আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করলেন, “আমার প্রভূ, তুমি এই কাফিরগুলির একজনকেও বাঁচিয়ে রেখো না। তুমি যদি তাদের ছেড়ে দাও, তাহলে তারা তোমার বান্দাদেরকে বিপথগামী করে ছাড়বে। আর তাদের ঔরসের প্রজন্মও দূরাচারী আর কাফিরই হবে। হে প্রভূ, তুমি আমাকে আর আমার বাবা মাকে মাফ করে দাও। আর সেসব নারী পুরুষকেও মাফ করে দাও, যারা মুমিন হয়ে আমার ঘরে প্রবেশ করেছে।” (সূরা ৭১ নূহঃ আয়াত ২৬-২৮)

 

 নূহ আরও বললেন, “প্রভূ, এই লোকগুলির মোকাবেলায় তুমি আমাকে সাহায্য করো। ওরা আমাকে মিথ্যা সাব্যস্ত করছে। আমাকে অস্বীকার করছে। এখন আমার আর তাদের মাঝে তুমি চুড়ান্ত ফায়সালা করে দাও। তবে আমাকে আর আমার সাথী মুমিনদের তোমার পাকড়াও থেকে বাঁচাও। ১১ (সূরা আল মুমিনুনঃ আয়াত ২৬, সূরা ২৬ শুয়ারা” আয়াত ১১৭-১১৮)

 

আপনারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, এবার চুড়ান্ত একটা ফায়সালা হয়ে যাবে। কী সেই ফায়সালা? ফায়সালাটা হলো, আল্লাহ্‌ নূহের জাতির এই দুষ্ট লোকগুলিকে ধ্বংস করে দেবার সিদ্ধান্ত নিলেন। এটাই আল্লাহর নিয়ম। কোন জাতি বিপথগামী হলে, আল্লাহ্‌ তাদের সত্য পথ দেখানোর জন্যে নবী বা সংশোধনকারী পাঠান। নবীরা তাদের সত্য পথে আনার জন্যে সর্বোত্তম প্রচেষ্টা চালান। অসৎ লোকদের সাংঘাতিক বিরোধিতাড় মূখেও তাঁরা জনগণকে সংশোধন করবার চেষ্টা সাধনা চালিয়ে যান। কিন্তু তাদের সকল চেস্টার পরও যখন আল্লাহ্‌ বাস্তবে দেখে নেন যে, এই লোকগুলি আর সত্য পথে আসবে না। তখন তিনি তাদের ধ্বংস করে দেন। নূহ (আঃ) এর জাতির বাস্তব অবস্থাও তাই ছিলো। আল্লাহর নবী নূহ (আঃ) হাজার বছর ধরে তাদের আল্লাহর পথে আনার চেষ্টা করেন। দিনরাত তিনি তাদের বুঝান। গোপনে গোপনে বুঝান। জনসভা, আলোচনা সভা করে বুঝান। তারা শুনতে চায় না, তবু তিনি জোড় গলায় তাদের ডেকে ডেকে বুঝান। তাঁকে দেখলে তারা কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকে নিত। তিনি কথা বলতে গেলে তারা কানে আঙ্গুল চেপে ধরত। হাজারো রকমের তিরস্কার তারা তাঁকে নিয়ে করতো। বলত এতো ম্যাজেসিয়ান। কিন্তু তিনি তাদের সত্য পথে আনার অবিরাম চেষ্টা সাধনা চালিয়েই যান। কিছু যুবক অবশ্য ঈমান আনে। কিন্তু জাতির সর্দার নেতারা পরবর্তী সময়ে জনগনের আল্লাহর পথে আসার সকল পথ বন্ধ করে দেয়। তখন তারা সবাই আল্লাহর চরম বিরোধী হয়ে যায়। তাদের সত্য পথে আসার আর কোন সম্ভাবনাই আর বাকী থাকে না। এমনকি তারা আল্লাহর নবীকে হত্যা করার পর্যন্ত ষড়যন্ত্র করে। অবশেষে আলাহ তাদের পৃথিবী থেকে ধ্বংস করার ফায়সালা করেন। তিনি নূহ (আ)-কে নির্দেশ দেন, “নূহ, আমার তদারকীতে তুমি একটি নৌযান তৈরি করো।”১২ (সূরা হুদঃ আয়াত ৩৭)

 

আল্লাহ্‌ নূহ (আ)-কে আর বলে দিলেন, “চুলা ফেটে যখন পানি উঠবে, তখন তুমি নৌযানের মধ্যে সব রকমের জীবজন্তু এক জোড়া এক জোড়া করে উঠাবে। তবে তাদের উঠাবেনা যাদের ব্যাপারে আমি ফায়সালা দিয়ে দিয়েছি, যে তারা ডুবে মরবে।”১৩ (সূরা আল মুমিনুনঃ আয়াত ২৭)

 

আল্লাহর নবী নূহ (আঃ) আল্লাহর নির্দেশে তৈরি করতে লাগলেন এক বিশাল নৌযান। জাতির অসৎ নেতারা যখন সেখান দিয়ে যাতায়াত করতো, তারা নৌযান তৈরি নিয়েও নূহের প্রতি বিদ্রুপ করতো। তারা তাঁকে তিরস্কার করতো।”১৪ (সূরা হুদঃ আয়াত ৩৮) আসলে তাদের আল্লাহর ক্ষমতার প্রতি ঈমানই ছিলো না। তারপর কি হলো? তারপর একদিন নৌযান তৈরি শেষ হলো। নূহ (আঃ) আল্লাহর নির্দেশের দিকে তাকিয়ে রইলেন। এরপর? এরপর একদিন হঠাৎ দেখা গেলো চুলা ফেটে মাটির নিচ থেকে অনর্গল পানি বেরুতে লাগলো। নূহ (আঃ) বুঝতে পারলেন আল্লাহর নির্দেশ এসে গেছে। নূহ ঈমানদারদের ডেকে বললেন, তোমরা জলদি করে নৌযানে ওঠে পড়ো। তিনি তারাতারি করে সমস্ত ঈমানদার লোকদের নৌযানে তুলে দিলেন। সব রকমের জীব জন্তু একেক জোড়া তুলে নিলেন। দুজন ছাড়া তাঁর পরিবারের সকলকে তুলে নিলেন।

 

কে সেই দু’জন? এদের একজন নূহ (আঃ) এর স্ত্রী। এই মহিলা কিন্তু বাপদাদার জাহেলি ধর্ম অনুসারীদের পক্ষ অবলম্বন করে। ফলে আল্লাহও তাঁকে প্লাবনের পানিতে ডুবিয়ে মারলেন। আরেক জন কে? আরেকজন হলো স্বয়ং নূহ (আঃ) এর হতভাগ্য পুত্র। সেও ঈমান আনে নি। নির্দেশমতো সবাই যখন নৌযানে উঠে গেল, তখন কি হলো? দেখতে দেখতে তখন ঘটে গেল এক অবাক কাণ্ড। চারিদিকে যমিন ফেটে সৃষ্টি হলো অসংখ্য ঝর্ণাধারা। প্লাবনের বেগে মাটির নিচে থেকে উঠতে শুরু করলো পানি আর পানি। সাথে সাথে শুরু হলো মুষলধারে বৃষ্টি। নিচে থেকেও উঠছে পানি। উপর থেকেও পড়ছে পানি। চারিদিকে পানি আর পানি। পানির উপরে ভাসতে শুরু করলো নৌযান। নূহ (আঃ) দোয়া করলেনঃ

 

“আল্লাহর নামে শুরু হচ্ছে এর চলা আর আলাহর নামেই থামবে এ নৌযান। আমার প্রভূ অবশ্যি অতিশয় ক্ষমাশীল দয়াময়।” (সূরা হুদঃ আয়াত ৪১)

 

অদূরেই নূহের কাফির পুত্রটি দাঁড়িয়ে ছিলো। নূহ দেখলেন, পাহারের মতো উঁচু হয়ে এক বিরাট ঢেউ এগিয়ে আসছে। তিনি চিৎকার করে ছেলেকে ডেকে বললেন, এখনো সময় আছে ঈমান এনে আমাদের সাথী হয়ে যা। কাফিরদের সাথী হইসনে। এক্ষুনি ডুবে মরবি।”

 

অসৎ ছেলেটি বললোঃ “আমি পাহাড়ে উঠে যাবো, পানি আমাকে কিছুই করতে পারবেনা।” নূহ (আঃ) বললেন- একমাত্র আল্লাহর অনুগ্রহ ছাড়া আজ কেঊ রক্ষা পাবে না।” এরি মধ্যে এক বিরাট ঢেঊ এসে ছেলেকে তলিয়ে নিয়ে গেলো।১৫ (সূরা হুদঃ আয়াত ৪২-৪৩)

 

আপনারা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন, নবীর পথে না চলার পরিনতি কতো ভয়াবহ। ঈমানের পথে না এলে নবীর ছেলে হলেও আল্লাহর পাকড়াও থেকে রক্ষা পাওয়া যায় না। নবীর স্ত্রী হলেও মুক্তি পাওয়া যায়না। দুনিয়া ও আখিরাতে মুক্তির একমাত্র পথ হলও ঈমানের পথ, নবী দেখানো পথ। এরপর ঘটনা কি হলো? এরপর পানিতে সমস্ত কিছু ভেসে গেলো। বড় বড় পাহাড় পানির মধ্যে তলিয়ে গেলো। দিন যায়, রাত আসে। মাস যায়, মাস আসে। আকাশ আর পাতালের পানিতে পৃথিবী তলিয়েই চলেছে। নূহ (আঃ) এর নৌযানের মানুষ আর প্রাণীগুলো ছাড়া সমস্ত জীবজন্তু মরে শেষ। একটি মানুষও আর বেঁচে নেই। সব দুষ্ট লোক আর আল্লাহর নবীর শত্রুরা ধ্বংস হয়ে শেষ হয়ে গেছে। আল্লাহ্‌ তায়ালা এভাবে তাঁর প্রিয় নবী নুহ (আঃ) ও তাঁর সাথীদেরকে রক্ষা করলেন যালিমদের অত্যাচার ষড়যন্ত্র থেকে। তাই তিনি নূহ (আঃ)- কে নির্দেশ দিলেন এই ভাষায় শোকর আদায় করতেঃ

 

“শোকর সেই মহান আল্লাহর, যিনি যালিমদের হাত থেকে আমাদেরকে রক্ষা করেছেন।” (সূরা আল মুমিনুনঃ আয়াত ২৮)

 

সেই সাথে আল্লাহ্‌ নূহ (আ)-কে এই দোয়া করতেও নির্দেশ দিলেনঃ

 

“প্রভূ, আমাকে বরকতপূর্ণ স্থানে অবতরন করাও, আর তুমিইতো সর্বোত্তম স্থানে অবতরন করিয়ে থাকো।” (সূরা আল মুমিনুনঃ আয়াত ২৯)

 

অবশেষে আলাহ একদিন হুকুম দিলেনঃ “হে পৃথিবী সমস্ত পানি গিলে ফেলো, হে আকাশ বর্ষণ বন্ধ করো।’’১৬ (সূরা হুদঃ আয়াত ৪৪)

 

মহান আল্লাহর নির্দেশে আকাশ পানি বর্ষণ বন্ধ করলো। পৃথিবী তাকে ডুবিয়ে রাখা সমস্ত পানি চুষে খেয়ে ফেললো। তারপর কি হলো? তারপর নূহ (আঃ) এর নৌযানটি জুদি১৭ (সূরা হুদঃ আয়াত ৪৪) পাহাড়ের চুড়ায় এসে ঠেকলো। জুদি পাহাড় কোথায় জানেন? আর্মেনিয়া থেকে কুর্দিস্তান পর্যন্ত রয়েছে এক দীর্ঘ পর্বতমালা। এই পর্বতমালারই একটি নাম হলো জুদি পর্বত। এটি কুর্দিস্তান অঞ্চলে ইবনে উমর দ্বীপের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত। মুসলমানরা হজরত উমর (রাঃ) এর খিলাফত আমলে যখন ইরাক ও আল জাজিরা বিজয় করেন, তখন মুসলিম সৈনিকদের অনেকেই জুদি পাহাড়ের উপর নূহ (আঃ) এর নৌযান দেখতে পান।

 

নৌযান জুদি পর্বতে ঠেকার পর কি হলো? এবার আল্লাহ্‌ নির্দেশ দিলেনঃ “হে নূহ, নেমে পড়ো। নেমে আসো পৃথিবীতে। এখন থেকে তোমার প্রতি আর তোমার সংগী সাথীদের প্রতি আমার নিকট হইতে রইলো শান্তি আর প্রাচুর্য।”১৮ (সূরা হুদঃ আয়াত ৪৮)

 

তাঁরা নেমে আসেন পৃথিবীতে। সুখে শান্তিতে বসবাস করতে থাকেন আল্লাহর অনুগত দাস হিসেবে। এভাবেই আল্লাহ্‌ সৎ লোকদেরকে প্রতিষ্ঠিত করে দেন পৃথিবীর বুকে।

 

সবশেষে কয়েকটি খবর জানিয়ে দিচ্ছি

 

১। কুরআনে নূহ (আঃ) এর নাম উচ্চারিত হয়েছে তিতাল্লিশ বার।

 

২। যে সব সুরায় নূহের কথা ও কাহিনী উল্লেখ হয়েছে। সেগুলো হলোঃ আলে ইমরান, আনয়াম, নিসা,আরাফ, তাওবা, ইউনুস, হুদ, ইবরাহীম, বনি ইসরাইল, মরিয়ম, আম্বিয়া, হজ্জ, মুমিনুন, ফুরকান, শুয়ারা, আন কাবুত, আহযাব, সাফফাত, সোয়াদ, মুমিন, শুরা, কাফ, যারিয়াত, নাজম, কামার, তাহরীম, নূহ।

 

৩। নূহ (আঃ) এর কাহিনী বিস্তারিত জানা যাবে সূরা আরাফ, হুদ, মুমিনুন, শোয়ারা এবং নূহে।

 

 

 

৪।

 

আদ জাতির নবী হুদ (আঃ)

 

নূহ (আঃ) এর পরে

 

আমরা আগেই জেনেছি, নূহ (আঃ) এর সময় আল্লাহ্‌ তাঁর দ্বীনের শত্রুদের প্লাবন দিয়ে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। বাঁচিয়ে রেখেছিলেন কেবল হযরত নুহ (আঃ) আর তাঁর ঈমানদার সাথিদের। এই বেঁচে থাকা মুমিনরা আর তাদের বংশধরেরা অনেকদিন আল্লাহর বিধান আর নবীর আদর্শ মাফিক জীবন যাপন করেন।

 

কিন্তু দীর্ঘদিন পর লোকেরা আবার ভুল পথে চলতে শুরু করে। তাঁরা নবীর আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়। এক আল্লাহকে ভুলে গিয়ে বহু মনগড়া খোদা বানিয়ে নেয়। এমনি করে তাঁরা ডুবে পড়লো শিরক আর মূর্খতার অন্ধকারে।

 

আদ জাতি

 

সেকালে আরবের সবচে’ শক্তিশালী জাতি ছিলো আ’দ জাতি। ইয়েমেন, হাজরামাউত ও আহকাফ অঞ্চল নিয়ে এরা এক বিরাট রাজ্য গড়ে তুলেছিলো। তাদের ছিলো অগাধ দৈহিক শক্তি আর ছিলো বিরাট রাজশক্তি। তাঁরা গড়ে তুলেছিলো বড় বড় শহর, বিরাট বিরাট গম্বুজধারী অট্টালিকা আর বিলাস সামগ্রী। নূহ (আঃ) এর পর আল্লাহ্‌ তায়ালা আ’দ জাতিকে ক্ষমতা প্রদান করেন। তাদের পৃথিবীতে প্রতিনিধি বানান। নিজের অপার অনুগ্রহে তাদের চরম উন্নতি দান করেন। ফলে গোটা আরবের উপর চলতে থাকে তাদের দাপট। কিন্তু এ উন্নতির ফলে তাঁরা গর্ব ও অহংকারে নিমজ্জিত হয়। নূহ (আঃ) এর দেখানো পথ থেকে তাঁরা দূরে সরে যায়। মহান আল্লাহকে ভুলে গিয়ে তাঁরা নিজেদের স্বার্থে বহু মনগড়া খোদা বানিয়ে নেয়। নূহ (আঃ) এর তুফানের পর তারাই সর্বপ্রথম মূর্তি পূজা শুরু করে। তাদের জাতীয় নেতাগন ছিলও যালিম, স্বৈরাচারী। জনগনকে তাঁরা নিজেদের হুকুমের দাস বানিয়ে নিয়েছিলো। তাঁরা এতই অহংকারী হয়ে উঠেছিলো যে, কাউকেই পরোয়া করতো না। তাঁরা ঘোষনা করলো, “আমাদের চেয়ে শক্তিশালী আর কে আছে?” (সূরা ৪১ হামিম আস সিজদাঃ আয়াত ১৫)

 

অথচ তাঁরা ভুলে গেলো যে, আলাহই সর্বশক্তিমান। আল্লাহই তাদের এতো উন্নতি দান করেছেন।

 

মুক্তির বার্তা নিয়ে এলেন হুদ

 

আদ জাতীকে সুপথ দেখাবার জন্যে আল্লাহ্‌ তাদের মাঝে একজন নবী পাঠাবার সিদ্ধান্ত নেন। এ জাতির সবচে’ ভালো লোক হুদকে আল্লাহ্‌ তাদের নবী মনোনীত করেন। মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ “আমি আদ জাতির কাছে তাদের ভাই হুদকে রাসুল বানিয়ে পাঠালাম। হুদ আমার বানী পেয়ে তাঁর জাতির লোকদের ডেকে বললোঃ

 

“হে আমার জাতির ভাইয়েরা, তোমরা আল্লাহর হুকুম পালন করো। তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোন ইলাহ নেই। তোমরা কি তোমাদের পাপ কাজের অশুভ পরিনতির ভয় করো না?” (সূরা ৭ আল আরাফঃ আয়াত ৬৫)

 

আল্লাহর নবী হুদ (আঃ) তাদের বুঝালেন-

 

“ভাইয়েরা আমার, তোমরা তোমাদের দয়াময় প্রভূর কাছে ক্ষমা চাও। তাঁর দিকে ফিরে এসো। তাহলে তিনি তোমাদের বৃষ্টি বর্ষীয়ে পানি দেবেন। তোমাদের বর্তমান শক্তিকে আরো শক্তিশালী করবেন। দেখো। তোমরা অপরাধীদের মতো তাঁকে উপেক্ষা করো না।” (সূরা ১১ হুদঃ আয়াত ৫২)

 

দরদভরা হৃদয় নিয়ে হজরত হুদ তাদের আর বললেনঃ

 

“তোমরা কি আল্লাহকে ভয় করবে না? দেখো, আমি তোমাদের জন্যে একজন বিশ্বস্ত রাসুল। সুতরাং আল্লাহকে ভয় করো। আর আমার কথা মেনে চলো। আমি যে তোমাদের বুঝাবার এতো চেষ্টা করছি, এর বিনিময়ে আমি তো তোমাদের কাছে কোন প্রতিদান চাইনা। এতে কি তোমরা বুঝতে পারছো না, এ কাজে আমার কোন স্বার্থ নেই? আমিতো কেবল তোমাদের কল্যাণ চাই। আমাকে প্রতিদান দেবেন তো আল্লাহ রাব্বুল আল আমীন।” (সূরা ২৬ শুয়ারা” আয়াত ১২৪-১২৭)

 

হুদ (আঃ) তাঁদের আরো বুঝালেনঃ

 

“তোমাদের এ কি হলো? প্রতিটি স্থানেই কেন তোমরা অর্থহীন স্মারক ইমারত (ভাস্কর্য) বানাচ্ছো? কেনই বা এতো অট্টালিকা গড়ে তুলছো? এগুলো কি তোমাদের চিরদিন বাঁচিয়ে রাখবে ভাবছো? তোমরা যখন কাউকেও পাকড়াও করো, তখন কেন নির্বিচারে অত্যাচারীর ভূমিকা পালন করো? এবার এসো আল্লাহকে ভয় করো আর আমার কথা মেনে নাও। সেই মহান প্রভূকে ভয় করো যিনি তোমাদের সবকিছুই দিয়েছেন। তোমরাতো জানোই তিনি তোমাদের দিয়েছেন অগনিত পশু, অসংখ্য সন্তান-সন্তুতি। দিয়েছেন কতোনা বাগ-বাগিচা, নদ-নদী, ঝর্ণাধারা। তোমাদের ব্যাপারে এক গুরতর দিনের শাস্তির আশংকা আমি করছি।” (সূরা ২৬ শুয়ারাঃ আয়াত ১২৮-১৩৫)

 

এভাবে হুদ (আঃ) তাঁর জাতির লোকদেরকে সঠিক পথে আনার চেষ্টা করেন। তাঁদের তিনি মহান প্রভূ আল্লাহর কথা স্মরণ করিয়ে দেন। বস্তুগত উন্নতির আল্লাহকে ভুলে থাকতে নিষেধ করেন। পরকালের খারাপ পরিনতির কথা তাঁদের স্মরণ করিয়ে দেন। তাঁদের ক্ষমা চাইতে বলেন। আল্লাহর দিকে ফিরে আসতে বলেন। আল্লাহর হুকুম পালন করতে এবং নবীর পথে চলতে বলেন। তিনি তাঁদের বলেনঃ এটাই পার্থিব কল্যাণ আর পরকালীন মুক্তির একমাত্র পথ।

 

নেতারা নবীর প্রতিপক্ষ হলো

 

এতো আন্তরিক আহবান আর কল্যাণময় উপদেশ সত্ত্বেও আদ জাতি নবীর কথা শুনলো না। আল্লাহর পথে এলো না। দুনিয়ার মোহ ত্যাগ করতে পারলো না। উল্টো তাঁরা নবীর সাথে বিতর্ক শুরু করলো। তাঁদের শাসকরা নবীকে বললোঃ

 

“আমরা মনে করি তুমি বোকা। তোমার কোন বুদ্ধি নেই। তাছাড়া আমাদের ধারনা, তুমি এসব মিথ্যা কথা বলছো।” (সূরা ৭ আল আরাফঃ আয়াত ৬৬)

 

তাঁরা আল্লাহর রাসুলকে আরো বললোঃ

 

“তোমার উপদেশ আমরা মানিনা। তোমার এসব উপদেশ সেকেলে লোকদের অভ্যাস ছাড়া আর কিছুই নয়। আসলে আমাদের উপর কোন শাস্তিই আসবে না।” (সূরা ২৬ শুয়ারাঃ আয়াত ১৩৬-১৩৮)

 

তাঁদের প্রতিবাদের জবাবে আল্লাহর নবী বললেনঃ

 

“হে আমার জাতির ভাইয়েরা, আমি কোন বোকা নির্বোধ ব্যাক্তি নই। বরং আমি বিশ্ব জগতের মালিক মহান আল্লাহর রাসুল। আমিতো কেবল তোমাদের কাছে মহান আমার আল্লাহর বার্তাই পৌছে দিচ্ছি। আর আমি তোমাদের একজন বিশ্বস্ত কল্যাণকামী। ” (সূরা ৭ আল আরাফঃ আয়াত ৬৭-৬৮)

 

হজরত হুদ তাঁদের আর বললেনঃ

 

“তোমাদের সতর্ক করার জন্যে তোমাদের জাতিরই এক ব্যাক্তির কাছে তোমাদের প্রভূর পক্ষ থেকে ‘উপদেশ বার্তা’ এসেছে বলে কি তোমরা বিস্মিত হচ্ছো? স্মরণ করো নূহের জাতির পর আল্লাহ্‌ তো তোমাদেরকেই পৃথিবীর প্রতিনিধি বানিয়েছেন। তোমাদের জনবল ও দেহবলের অধিকারী করেছেন। সুতরাং আল্লাহর দানশীলতাকে স্মরণ রেখো। আশা করা যায়, তাহলে তোমরা কল্যাণ লাভ করবে। ” (সূরা ৭ আল আরাফঃ আয়াত ৬৯)

 

পার্থিব কায়েমি স্বার্থ আর শয়তানের ধোঁকা আদ জাতির নেতাদের প্রতারিত করলো। তাঁরা আল্লাহর নবীকে বললোঃ

 

“হে হুদ, তুমি কি এ জন্যে নবী হয়ে এসেছো যে, আমরা কেবল এক খোদার ইবাদাত করবো আর আমাদের বাপদাদারা যে সব মা’বুদের (দেব দেবীর) পূজা করতো, তাঁদের ত্যাগ করবো? তুমি তো আমাদের কাছে কোন দলিল প্রমান নিয়ে আসো নি। আমরা কখনো তোমার কোথায় আমাদের খোদাগুলোকে ত্যাগ করবোনা। আমরা বলছি, আমাদের খোদাদের কোন একটির গজব তোমার উপর আপতিত হয়েছে।” (সূরা ৭ আল আরাফঃ আয়াত ৭০, সূরা ১১ হুদঃ আয়াত ৫৩-৫৪)

 

এবার আল্লাহর নবী হুদ (আঃ) তাঁদের বললেনঃ

 

“তোমাদের উপর তোমাদের মালিক আল্লাহর অভিশাপ আর গজব এসে পড়েছে। তোমরা কি আমার সাথে সেই সব মনগড়া খোদাদের ব্যাপারে বিতর্ক করছো, যেগুলোর নাম তৈরি করেছো তোমরা নিজেরা আর তোমাদের বাপ দাদারা? অথচ সেগুলোর পক্ষে আল্লাহর পক্ষ থেকে কোন প্রমান নেই। তোমরা যদি আমার কথা না শোনো, তবে অপেক্ষা করতে থাকো। আমিও তোমাদের সাথে অপেক্ষা করছি। ” (সূরা ৭ আল আরাফঃ আয়াত ৭১)

 

হজরত হুদ (আঃ) এর দীর্ঘ দাওয়াতের ফলে জনগনের মধ্যে একটা নাড়া পড়েছিল। তাঁরা শিরক করছিলো ঠিকই কিন্তু আল্লাহকে তাঁরা জানতো। আর হুদ (আঃ) যেহেতু তাঁদের আল্লাহর দিকেই ডাকছিলেন, সুতরাং তাঁর দাওয়াতের একটা বিরাট প্রভাব জনগনের উপর পড়ছিল। তাই জনগণ হজরত হুদের প্রতি ঈমান এনে ফেলতে পারে এই ভয়ে ক্ষমতাসীন শাসক ও নেতারা ময়দানে নেমে এলো। জনসভা করে তাঁরা হজরত হুদ (আঃ) এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ উপস্থাপন করতে লাগলো। তাঁরা জনগণকে বললোঃ

 

“এ ব্যাক্তি তো তোমাদেরই মতো একজন মানুষ। তোমরা যা খাও, সেও তাই খায়। তোমরা যা পান করো, সেও তাই পান করে। কেমন করে সে নবী হতে পারে? তবে তাঁর কথা মেনে নিলে তোমাদের দারুন ক্ষতি হবে। হুদ যে তোমাদের বলছে, তোমরা যখন মরে গিয়ে মাটির সাথে হাড়-গোড়ে পরিণত হবে, তখন তোমাদের আবার কবর থেকে বের করে আনা হবে। তাঁর এই অঙ্গীকার অসম্ভব। আমাদের এই পৃথিবীর জীবনটাই তো একমাত্র জীবন। আমাদের মরন বাচন সব এখানেই শেষ। আসলে আমাদের আর কখনো উঠানো হবে না। আল্লাহর নাম নিয়ে হুদ মূলতঃ মিথ্যে বলছে। আমরা তাঁর কথা মানি না। ”(সূরা আল মুমিনুনঃ আয়াত ৩৩-৩৮)

 

কিছু লোক ঈমান আনলো

 

বিবেকবান লোকদের মনে সত্যের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হলেও যালিম অত্যাচারী শাসকদের ভয়ে তাঁরা সত্য গ্রহন করতে এগিয়ে আসেনি। কেবল কিছু সংখ্যক সাহসী যুবক যুবতীই আল্লাহর পথে এগিয়ে এলো। তাঁরা নবীর সাথি হলো। জীবন বাজী রেখে তাঁরা আল্লাহর পথে কাজ করতে থাকলো। এখন জাতি সুস্পষ্টভাবে দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে গেলো। এক পক্ষে রয়েছেন আল্লাহর নবী আর তাঁর সাথী একদল যুবক যুবতী। গোটা জাতির তুলনায় এদের সংখ্যা ছিলো খুবই কম। প্রতিপক্ষে ছিল শাসক গোষ্ঠী আর ঐ সব লোক, বাতিল সমাজের সাথে জড়িয়ে ছিলো যাদের স্বার্থ। নবীর নেতৃত্বে এ সমাজ ভেঙ্গে নতুন সমাজ গঠিত হলে এদের স্বার্থ নষ্ট হবে বলে এরা সবাই নবী ও নবীর সাথীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুললো।

 

সময় ঘনিয়ে এলো

 

আল্লাহর নবী হুদ (আঃ) অবশেষে তাঁদের চরম বিরোধিতা ও প্রতিরোধের মোকাবেলায় বলে দিলেনঃ “আমি তোমাদের সামনে সাক্ষী হিসেবে স্বয়ং আল্লাহকেই পেশ করছি। আর তোমরা সাক্ষী থাকো, আল্লাহর সার্বভৌম ক্ষমতায় তোমরা যাদের অংশীদার বানাচ্ছো আমি তাঁদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করছি। তোমরা সবাই মিলে আমার বিরুদ্ধে যা করার করো। আমার ভরসা তো মহান আল্লাহর উপর। তিনি আমারো মালিক, তোমাদেরও মালিক। সমস্ত জীবের ভাগ্য নিয়ন্তা তো তিনিই। তিনি যা করেন, তাই সঠিক। ” (সূরা ১১ হুদঃ আয়াত ৫৪-৫৬)

 

হজরত হুদ তাঁদের আর বলে দিলেনঃ

 

“তোমরা যদি মুখ ফিরিয়ে নিতে চাও, নাও। কিন্তু জেনে রেখো, আল্লাহ্‌ আমাকে যে বার্তা নিয়ে পাঠিয়েছেন তা আমি তোমাদের কাছে পুরোপুরি পৌছে দিয়েছি। এখন আমার প্রভূ তোমাদের স্থলে অন্য জাতিকে বসাবেন এবং তোমরা তাঁর কোনই ক্ষতি করতে পারবে না। ” (সূরা ১১ হুদঃ আয়াত ৫৭)

 

অতঃপর সবধরনের চেষ্টা শেষ করার পর হজরত হুদ (আঃ) যখন দেখলেন এদের সৎ পথে আসার আর কোন সম্ভাবনা নাই, তখন মনে বড় কষ্ট নিয়ে তিনি দোয়া করলেনঃ

 

“আমার প্রভূ, এরা তো মিথ্যা বলে আমাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। এখন তুমিই আমাকে সাহায্য করো। ” (সূরা আল মুমিনুনঃ আয়াত ৩৯)

 

জবাব এলোঃ

 

“ অচিরেই এরা নিজেদের কৃতকর্মের (নিষ্ফল) অনুশোচনা করবে। ” (সূরা আল মুমিনুনঃ আয়াত ৪০)

 

ধ্বংস হলো আ’দ জাতি

 

আল্লাহর নবী হুদ (আঃ) আল্লাহর পক্ষ থেকে সংকেত পেলেন যে, তিনি এখন এ জাতিকে ধ্বংস করে দেবেন। বড় মনোবেদনার সাথে তিনি তাঁদের জানিয়ে দিলেনঃ “আল্লাহর রোষ এবং আযাব তোমাদের জন্যে অবধারিত হয়ে পড়েছে। ” জাতির শাসকরা অহংকার করে বললো, “আমাদের চাইতে শক্তিশালী আর কে আছে? ” তাঁরা হজরত হুদকে আরো বললো- “তুমি যে আমাদের শাস্তি দেয়ার অংগীকার করছো, তুমি সত্যবাদী হলে সেই শাস্তি দিয়ে দেখাও। ”

 

অবশেষে তাঁদের উপর আল্লাহর আযাব এসে পড়লো। উপত্যকার দিক থেকে আযাব তাঁদের দিকে ধেয়ে আসছিলো। তাঁরা বললো- এতো মেঘ, অনেক বৃষ্টি হবে। হুদ বললেনঃ

 

“এই সেই অংগীকার, যার জন্যে তোমরা তাড়াহুড়ো করছিলে। এটা প্রচণ্ড ঝড়। এতে রয়েছে চরম যন্ত্রনাদায়ক আযাব। এটা প্রতিটা বস্তুকে ধ্বংস করে রেখে যাবে। ” (সূরা ৪৬ আহকাফঃ আয়াত ২৪)

 

অল্প পরেই ধেয়ে এলো মেঘ। ধ্বংস করে দিয়ে গেলো সব কিছু। ধ্বংস হয়ে গেলো আল্লাহদ্রোহী শক্তি। আল কুরআনে তাঁদের ধংশের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে এভাবে-

 

“আর আ’দ জাতিকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে ঠাণ্ডা ঝড় বায়ু দিয়ে। সে বায়ু তিনি তাঁদের উপর দিয়ে চালিয়ে দেন একাধারে সাত রাত আট দিন। অতঃপর সেখানে তাঁরা চিৎপাত হয়ে পড়ে থাকলো যেন উপড়ানো খেজুর গাছের কাণ্ড। কোন পাপীই তা থেকে রক্ষা পায়নি। ” (সূরা ৬৯ আল হাক্কাহঃ আয়াত ৬-৮)

 

“এক বিকট ধ্বনি এসে তাঁদের পাকড়াও করলো। আর আমি তাঁদের ধ্বংস করে দিলাম খড় কুটোর মতো। ” (সূরা আল মুমিনুনঃ আয়াত ৪১)

 

এভাবে ধ্বংস হয়ে গেলো তৎকালীন বিশ্বের মহা শক্তিশালী আ’দ জাতি। আল্লাহ্‌ তাঁদের ধ্বংস করে দিলেন, ধ্বংস করে দিলেন তাঁদের দেশ ও সুরম্য শহর। ধূলিস্যাত হয়ে গেলো তাঁদের অহংকার। বিরান হয়ে গেলো তাঁদের জনবসতি। তাঁদের শহর ‘আহকাফ’ এখন এক বিরাট মরুভূমি। এখনো সেই ভূতুরে মরুভূমি অতিক্রম করতে লোকেরা ভয় পায়। শোনা যায়, সেই মরুভূমিতে যা কিছু পড়ে সবই তলিয়ে যায়।

 

প্রাচীনকালে এতই নাম করা ছিলও যে, এখনো লোকেরা তাঁদের নাম অনুযায়ী যে কোন প্রাচীন জাতিকে ‘আদি জাতি’, ‘আদি বাসী’ বলে থাকে। প্রাচীন ভাষাকে ‘আদি ভাষা’ বলে থাকে। এতো প্রতাপশালী একটি জাতিকেও মহান আল্লাহ্‌ ধ্বংস করে দিলেন তাঁর আয়াতকে অস্বীকার করা ও তাঁর নবীকে অমান্য করার ফলে। তাঁদের ধ্বংসের ইতিহাসের মধ্যে পৃথিবীর সকল জাতির জন্যেই রয়েছে উপদেশ।

 

হজরত হুদ ও তাঁর সাথিরা বেঁচে গেলেন

 

কিন্তু এই সর্বগ্রাসী ধ্বংস থেকে আল্লাহ্‌ হুদ (আঃ) ও তাঁর সাথিদের (ঈমানদার) বাঁচিয়ে দিলেন। মহান আল্লাহ্‌ বলেন-

 

“ যখন আমার হুকুম এসে গেলো, তখন আমি নিজ রহমতে হুদ ও তাঁর সাথে ঈমান গ্রহনকারীদের রক্ষা করলাম আর এক কঠিন আযাব থেকে তাঁদের বাঁচালাম। ” (সূরা ১১ হুদঃ আয়াত ৫৮)

 

আযাব আসার পূর্বক্ষণে আল্লাহ্‌ পাকের নির্দেশে হুদ (আঃ) তাঁর সাথিদের নিয়ে নিরাপদ এলাকায় আশ্রয় নেন। এভাবেই আল্লাহ্‌ তাঁদের ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেন। মহান আল্লাহ্‌ আ’দ জাতির যে সব পাপিষ্ঠদের ধ্বংস করে দিয়েছেন, তাঁরা ছিলো প্রথম আ’দ। ” (সূরা ৫৩ আন নাজমঃ আয়াত ৫০)। আর হজরত হুদ (আঃ) এর সাথে যারা বেঁচে গিয়েছিলেন তাঁরা ছিলেন দ্বিতীয় আ’দ। পরবর্তীকালে এই দ্বিতীয় আদ’ই আবার বড় আকার ধারন করে।

 

হুদ (আঃ) কিসের দাওয়াত দিয়েছেন?

 

হুদ (আঃ) তাঁর জাতিকে কি দাওয়াত দিয়েছেন? আসুন কুরআন মাজীদ দেখি। কুরআন বলে হজরত হুদ (আঃ) তাঁর জাতিকে বলেছিলেনঃ

 

১। হে আমার জাতি, তোমরা কেবল এক আল্লাহর হুকুম পালন করো।

 

২। আল্লাহ্‌ ছাড়া তোমাদের আর কোন ইলাহ নাই।

 

৩। নিজেদের অপরাধের জন্যে তোমরা আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও।

 

৪। তোমরা আল্লাহর দিকে ফিরে এসো।

 

৫। আমি তো কেবল আমার প্রভূর বার্তা তোমাদের কাছে পৌছে দিচ্ছি।

 

৬। আমি কেবল তোমাদের কল্যাণ চাই।

 

৭। আমি বোকা নই আমি আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামিনের রাসুল।

 

৮। কল্যাণ চাও তো মহান আল্লাহর দান সমূহকে স্মরণ করো।

 

৯। আমার প্রভূ সঠিক পথে পরিচালিত করেন।

 

১০। সমস্ত প্রানীর ভাগ্য আল্লাহর হাতে।

 

১১। আমি আমার মালিক ও তোমাদের মালিক আল্লাহর উপর ভরসা রাখি।

 

১২। তোমরা বিবেক খাটিয়ে চলো।

 

১৩। তোমরা মুখ ফিরিয়ে নিলে আল্লাহ্‌ অন্য কোন জাতিকে তোমাদের স্থানে বসাবেন।

 

১৪। আল্লাহর সার্বভৌম ক্ষমতায় তোমরা যাদের শরীক করছো, আমি তাঁদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করছি।

 

১৫। আমি তোমাদের জন্যে একজন বিশ্বস্ত রাসুল। সুতরাং আল্লাহকে ভয় করো আর আমার আনুগত্য করো।

 

১৬। আমি তোমাদের উপর এক কঠিন দিনের শাস্তির ভয় করছি।

 

১৭। মহান আল্লাহই সমস্ত জ্ঞানের উৎস।

 

১৮। এ কাজের বিনিময়ে আমি তোমাদের কছে কোন প্রতিদান চাই না। আমাকে প্রতিদান দেয়ার দায়িত্ব মহান আল্লাহর। (হুদ আলাইহিস সালামের এই আহবানগুলি কুরআন থেকে নেয়া হয়েছে)

 

কুরআনে হজরত হুদ ও আ’দ জাতির উল্লেখ

 

কুরআন মাজীদে হিজরত হুদ (আঃ) এর নাম উল্লেখ আছে সাত বার। আ’দ জাতির নাম উল্লেখ হয়েছে চব্বিশ বার। হুদ (আঃ) এর নাম উল্লেখ হয়েছে সূরা আ’রাফ আয়াত ৬৫ ; হুদ আয়াত ৫০,৫৩,৫৮,৬০, ৮৯ এবং সূরা শোয়ারা; আয়াত ১২৪। হজরত হুদ হজরত হুদ (আঃ) ও আ’দ জাতির কথা উল্লেখ যে সব সুরায় – সূরা আরাফ, সূরা তাওবা, সূরা হুদ, সূরা ইবরাহীম, সূরা হাজ্জ, সূরা শোয়ারা, সূরা ফুরকান, সূরা আনকাবুত, সূরা সোয়াদ, সূরা মুমিনুন, সূরা হামিম আস সিজদা, সূরা আহকাফ, সূরা কাফ, সূরা যারিয়াত, সূরা আন নাজম, সূরা আল কামার, সূরা আলহাক্কাহ এবং সূরা আল ফজরে। এসব সূরা থেকেই হজরত হুদ (আঃ) এর জীবন কথা লেখা হলো।

 

৫।

 

সামুদ জাতির নবী সালেহ

 

(আঃ)

 

আগেই বলেছি নবীকে অমান্য করার ফলে কি ভয়াবহ ধ্বংস নেমে এসেছিলো আ’দ জাতির উপর। সে জাতি অহংকারী লোকেরা পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে যায়। বেঁচে থাকেন কেবল হজরত হুদ (আঃ) আর তাঁর গুটি কয়েক অনুসারী। এঁরা এবং এদের সন্তানরা অনেক দিন আল্লাহর পথে চলতে থাকেন। কিন্তু ধীরে ধীরে তাঁরা মহান আল্লাহকে ভুলে যেতে থাকে। পার্থিব মোহ তাঁদের বিপথে পরিচালিত করে। দুনিয়ার আকর্ষণ তাঁদের পরকালীন সাফল্যের কথা ভুলিয়ে রাখে। ফলে পার্থিব উন্নতির জন্যে তাঁরা নবীর পথ থেকে বিচ্যুত হয়। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় সুবিধা ভোগীরা সমাজের স্বার্থকে নিজেদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করে নেয়। এরা মহান আল্লাহকে বাদ দিয়ে ‘যেমনী নাচাও তেমনী নাচি’ ধরনের অনেক দেব দেবীর মূর্তি বানিয়ে নেয়। এভাবে একদিকে তাঁরা শিরক, কুফর ও জাহেলিয়াতের চরম অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। অন্যদিকে জৈবিক ভোগ বিলাসের জন্যে পাহাড় খোঁদাই করে প্রাচীন ভারতীয় ইলোরা অজন্তার মতো অসংখ্য মনোহরী প্রাসাদ গড়ে তোলে। এই আল্লাহ্‌ বিমুখ বৈষয়িক উন্নতি তাঁদেরকে চরম হঠকারি ও অহংকারী বানিয়ে তোলে। এই হঠকারী জাতির নাম কি আপনারা জানেন?

 

হ্যা, এদের নামই সামুদ জাতি।

 

সামুদ জাতির আবাস

 

হুদ (আঃ) এঁর সাথে আ’দ জাতির যে লোকগুলো বেঁচে গিয়েছিলেন, সামুদ জাতি তাঁদেরই উত্তর পুরুষ। পরবর্তী কালে এ বংশের কোন প্রভাবশালী নেতার নামে এরা সামুদ জাতি নামে পরিচিত হয়। প্রথমে ‘আ’দের’ ধ্বংসের পর উত্তর দিকে সরে এসে এরা নিজেদের আবাস ও বসতি গড়ে তোলে। সেকালে এদের আবাস এলাকার নাম ছিল ‘হিজর’। এ কারনে কুরআনে এদেরকে ‘আসহাবুল হিজর’ বা হিজরবাসী নামেও অভিহিত করা হয়েছে। (সূরা ১৫ আল হিজর” আয়াত ৮০-৮৪)। তাঁদের সেই ঐতিহাসিক এলাকার বর্তমান নাম হলো ‘ফাজ্জুন্নাকাহ’ এবং ‘মাদায়েনে সালেহ’। এ স্থানটির অবস্থান হিজাজ ও সিরিয়ার গোটা মধ্যবর্তী অঞ্চল জুড়ে।

 

বৈষয়িক উন্নতি ও নৈতিক অধঃপতন

 

সামুদ জাতির বৈষয়িক ও নৈতিক অবস্থা ছিল আ’দ জাতিরই অনুরুপ। সামুদ জাতি সমতল ভুমি আর পাহাড়ের গাত্র খোদাই করে গড়ে তোলে ভুরি ভুরি সুরম্য অট্টালিকা। এগুলোর প্রযুক্তিগত কারুকাজ ছিল খুবই উন্নত। তাছাড়া এগুলো ছিল অত্যন্ত বিলাসবহুল। ছিল ঝর্নাধারা, বাগবাগিচা, থরে থরে খেজুরের বাগান। এতো সব প্রাসাদ, মনোরম উদ্যান আর স্মৃতিসৌধ তাঁরা কেন গড়ে তুলেছিল? কুরআন বলছে ‘ফারেহীন’ অর্থাৎ তাঁরা এগুলো গড়ে তুলেছিল গর্ব- অহংকার, ক্ষমতা, অর্থ আর প্রযুক্তিগত উন্নতি দেখানোর জন্যে। (সূরা ৪০ আল মুমিনুনঃ আয়াত ৮৩)

 

কুরআন আরো বলছে, তাঁরা সাধারন মানুষের উপর যুলুম ও শোষন করে তাঁদের দুর্বল করে রেখেছিল। গোটা জনগনের তুলনায় অল্প সংখ্যক লোকের হাতেই কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়েছিল রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় নেতৃত্ব।

 

মূর্তি পূজাকে তাঁরা তাঁদের ধর্ম বানিয়ে নিয়েছিল। আর মূর্তিগুলোর উপর পৌরোহিত্য করতো এসব নেতারা। দেব দেবীর মূর্তির নামেই জনগণকে করা হত শোষন। মনগড়া পূজা অর্চনা করার মধ্যেই ছিল তাঁদের যাবতীয় সুবিধা। ধর্মের মুখোশ পরেই তাঁরা আল্লাহদ্রোহীতার নেতৃত্ব দেয়।

 

এঁর পয়লা সুবিধা ছিল এই যে, দেব দেবীর নামে নেতাদের পক্ষে নিজেদের মনগড়া আইনই জনগনের উপর চাপিয়ে দেয়া ছিল অত্যন্ত সহজ। দ্বিতীয় সুবিধা ছিল, অসাড় দেব দেবীর পক্ষে ঠাকুরগিরি করে জনগণকে শোষণ করার পথ ছিল অত্যন্ত সুগম। তাছাড়া পুরোহিত সেজে জনগনের উপর কৃতিত্ব করা ছিল খুবই সহজ। এভাবে জনগন ছিল সমাজপতিদের দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ। অর্থাৎ জনগন ছিল সমাজপতিদের হুকুমের দাস। সমাজপতিরা ছিলো যালিম, প্রতারক আর শোষক। এই ঘুনে ধরা নোংরা নৈতিক ভিত্তির উপরই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তাঁদের শিল্প, কারিগরি ও প্রযুক্তিগত উন্নতির বাহার। বাইরের চাকচিক্য দিয়ে ঢেকে রেখেছিল তাঁদের ভেতরের কলুষতা।

 

আলোর মশাল নিয়ে এলেন সালেহ

 

এই অধঃপতিত জাতিকে মুক্তির পথ দেখানোর জন্যে মহান আল্লাহ্‌ সামুদ জাতির সবচাইতে সৎ ও যোগ্য ব্যাক্তি সালেহ কে তাঁদের নবী নিযুক্ত করলেন। আল্লাহর বানী আর হিদায়েতের আলো নিয়ে হজরত সালেহ আলাইহিস সালাম হাজির জনগন এবং জাতির নেতৃবৃন্দের কাছে। অত্যন্ত দরদ ভরা হৃদয় নিয়ে তিনি তাঁদের আহবান জানালেন কল্যাণ ও মুক্তির দিকে। আহবান জানালেন তাঁদের মালিক ও প্রভু মহান আল্লাহর দিকে। বললেন-

 

“হে আমার জাতির ভাইয়েরা, তোমরা এক আল্লাহর হুকুম পালন করো। তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোন ইলাহ নাই। নেই কোন হুকুমকর্তা। তিনিই তো যমীন থেকে তোমাদের সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর এখানেই তোমাদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সুতরাং তোমাদের অপরাধের জন্যে তাঁর কাছে ক্ষমা চাও আর তাঁর দিকে ফিরে এসো। তিনি অবশ্যই তোমাদের দাকে সাড়া দেবেন।” (সূরা ১১, হুদ আয়াত ৬১)

 

তাঁদের ভাই সালেহ তাঁদের আর উপদেশ দিলেন-

 

“তোমরা কি ভয় করবেনা? আমি তোমাদের জন্যে একজন বিশ্বস্ত রাসুল। সুতরাং আল্লাহকে ভয় করো আর আমার কথা মেনে নাও। তোমাদের বুঝাবার জন্যে আমি যে এতো কস্ট করছি, এর বিনিময়ে আমি তো তোমাদের কাছে কোন পারিশ্রমিক চাইনা। আমার পারিশ্রমিক তো আল্লাহর দায়িত্বে। তোমাদের এই সব উদ্যান, ঝর্নাধারা, ক্ষেত-খামার, বাগান ভরা রসাল খেজুর আর অহংকার প্রদর্শনের জন্যে পাহাড় গাত্রে নির্মিত বালাখানাসমূহের মধ্যে কি তোমাদের চিরদিন নিরাপদে থাকতে দেয়া হবে? সুতরাং আল্লাহকে ভয় করো আর আমার কথা মেনে নাও। এই সীমালংঘনকারী নেতাদের হুকুম মেনোনা। তাঁরা তো পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করছে। কোন সংস্কার সংশোধনের কাজ তাঁরা করছেনা।” (সূরা ২৬ আশ-শোয়ারা, আয়াত ১৪২-১৫২)

 

এসব মর্মস্পর্শী উপদেশের জবাবে জাতির নেতারা বললো –

 

“হে সালেহ, এতোদিন তোমাকে নিয়ে আমাদের কতই না আশা ভরশা ছিল। আর এখন কিনা তুমি আমাদেরকে আমাদের দেব দেবীদের পূজা উপাসনা থেকে বিরত রাখতে চাও। তোমার কোথায় আমাদের সন্দেহ- সংশয় রয়েছে।” (সূরা ১১, হুদ আয়াত ৬২)

 

সালেহ বললেনঃ

 

“ভাইয়েরা আমার, তোমরা একটু ভেবে দেখো। আমি যদি আমার প্রভূর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত এক উজ্জ্বল প্রমানের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকি আর তাঁর বিশেষ অনুগ্রহেও ধন্য হওয়া থাকি, তবে কে আমাকে তাঁর পাকড়াও থেকে রক্ষা করবে যদি তাঁর নির্দেশের খেলাফ করি? (সূরা ১১, হুদ আয়াত ৬৩)

 

তাঁদের কল্যাণের পথে আনার জন্যে হজরত সালেহ তাঁদের এতো করে বুঝালেন। কিন্তু তাঁরা বুঝলোনা। তারা শলা পরামর্শ করলোঃ “আমাদের সবার মাঝে সে একজন মাত্র লোক। আমরা সবাই তাঁর অনুসরন করবো? তাহলে আমরা তো ভ্রান্তি আর অগ্নিতে নিমজ্জিত হবো। আমাদের সবার মাঝে কেবল তাঁরই উপর উপদেশ অবতীর্ণ হলো? আসলে সে মিথ্যাবাদী।”

 

সাধারন জনগনের মন হজরত সালেহ (আঃ) এর উপদেশে বিগলিত হচ্ছিলো। কিন্তু এইভাবে তারা জনগণকে ডেকে এনে আবার বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করলো।

 

নিদর্শন দেখাবার দাবী

 

জাতির নেতারা এবার হজরত সালেহ (আঃ) এর প্রতি এক বিরাট চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলো। তারা বললো-

 

“তোমার উপর কেউ যাদু করেছে। নইলে তুমি তো আমাদেরই মতো একজন মানুষ। হ্যাঁ তবে তুমি যদি সত্য নবী হয়ে থাকো, তাহলে কোন নিদর্শন দেখাও।” (সূরা ২৬ আশ-শোয়ারা, আয়াত ১৫৩- ১৫৪)

 

কেউ কেউ বলেছেন, এ কথা বলে তারা একটি বড় পাথর খণ্ডের প্রতি ইঙ্গিত করে বললো- এই পাথরের ভেতর থেকে যদি গাভীন উটনী বের করে আনতে পারো, তবে আমরা তোমার প্রতি ঈমান আনবো এবং তোমার আনুগত্য করবো। তারা মনে করেছিলো, তাঁদের এ দাবী পূরন করা হজরত সালেহ (আঃ) এর জন্যে অসম্ভব। তারপর কি হলো? তারপর হজরত সালেহ তাঁদেরকে নিদর্শন দেখানোর জন্যে আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন। তাঁর বুক ভরা আশা ছিলো, নিদর্শন দেখালে হয়তো তারা ঈমান আনবে।

 

আল্লাহ বললেন- “হে সালেহ, আমি উটনী পাঠাচ্ছি ঠিকই। তবে এই উটনী হবে তাঁদের জন্যে চুড়ান্ত পরীক্ষা স্বরূপ। তুমি স্থির থাকো আর তাঁদেরকে বলে দাওঃ “কূপের পানি পান করার জন্যে তাঁদের মাঝে পালা ভাগ করে দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ একদিন পুরো পানি পান করবে সেই উটনী আর একদিন পান করবে তাঁর সবাই আর তাঁদের পশুরা।” (সূরা ২৬ আশ-শোয়ারা, আয়াত ১৫৫)

 

আল্লাহর নিদর্শনের উটনী

 

ব্যাস, আল্লাহর নির্দেশে সমস্ত মানুষের সামনে পাথর থেকে উটনী বেরিয়ে এলো। হজরত সালেহ এবার উটনীর ব্যাপারে মহান আল্লাহর ফরমান তাঁদের জানিয়ে দিলেন। একটি ছোট্ট ভাষন তিনি তাঁদের সামনে পেশ করলেন –

 

“হে আমার জাতির ভাইয়েরা, সত্যিই আল্লাহ ছাড়া তোমাদের আর কোন ইলাহ নাই। সুতরাং তোমরা কেবল তাঁরই হুকুম পালন করো। দেখো তোমাদের প্রভূর পক্ষ থেকে তোমাদের সামনে সুস্পষ্ট প্রমান এসে পড়েছে। এটি আল্লাহর উটনী। এটি তোমাদের জন্যে চুড়ান্ত নিদর্শন। সতরাং একে স্বাধীনভাবে ছেড়ে দাও। আল্লাহর যমীনে সে মুক্তভাবে চড়ে বেড়াবে। কেউ তার বিন্দুমাত্র ক্ষতি করার চেষ্টা করো না। তাহলে চরম পীড়াদায়ক শাস্তি তোমাদের গ্রাস করে নেবে। তোমরা সে সময়টার কথা স্মরণ করো, যখন মহান আল্লাহ আ’দ জাতির উপর তোমাদেরকে স্থলাভিষিক্ত করেন এবং এমনভাবে এ ভূখণ্ডে তোমাদের প্রতিষ্ঠিত করেন যে, তোমরা মুক্ত ময়দানে প্রসাদ নির্মাণ করছো আর পাহাড় কেটে বিলাস গ্রহ করছো। সুতরাং মহান আলাহর অনুগ্রহকে স্মরণ করো। দেশে বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের মতো সীমালঙ্ঘন করোনা।” (সূরা ৭ আল আরাফ, আয়াত ৭৩-৭৪)

 

জাতি বিভক্ত হয়ে গেলো দুইভাগে

 

মহান নবী হজরত সালেহ (আঃ) এর আহবানে সত্য উপলব্ধি করতে পেরে জাতির কিছু লোক ঈমান আনলো। আল্লাহর পয়হে এলো। নবীর সাথী হলো। তবে এদের সংখ্যা খুবই কম। কিন্তু জাতির নেতারা এবং তাঁদের অধিকাংশ অনুসারী ঈমান গ্রহন করলোনা। এই হঠকারী নেতারা ঐ নির্যাতিত মুমিন্দের লক্ষ্য করে বললো – ‘তোমরা কি সত্যি যানো যে, সালেহ তাঁর প্রভুর রাসুল?’ (সূরা ৭ আল আরাফ, আয়াত ৭৫)

 

মুমিনরা বললেন –‘আমরা অবশ্যই জানতে পেরেছি এবং তাঁর প্রতি ঈমান এনেছি।’ (সূরা ৭ আল আরাফ, আয়াত ৭৫)

 

অহংকারী নেতারা বললো- ‘তোমরা যে বিষয়ের প্রতি ঈমান এনেছ, আমরা তা মানিনা।’ (সূরা ৭ আল আরাফ, আয়াত ৭৬)

 

তারা হত্যা করলো উটনীকে

 

দেখলেন তো, লোকগুলো কত বড় গাদ্দার। তারাই নবীর কাছে নিদর্শন দাবী করেছিলো। তারাই বলেছিল প্রমান স্বরূপ নিদর্শন দেখাতে পারলে তারা ঈমান আনবে। নবী নিদর্শন দেখালেন। তাঁদের চোখের সামনে এতো বড় ঘটনা ঘটে গেলো। আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত নিদর্শন তাঁদের চোখের সামনে ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু অঙ্গীকার করেও তারা ঈমান আনলোনা। আসলে সকল নবীর সমকালীন লোকেরাই এভেবে নবীর কাছে নিদর্শন দাবী করতো। কিন্তু তা দেখার পর তারা আর ঈমান আনতোনা। এ জন্যেই আল্লাহ তায়ালা আমাদের নবী হজরত মুহাম্মাদ (সাঃ) –কে বলে দিয়েছেন, তোমার বিরোধীরা যতই নিদর্শন দাবী করুক, নিদর্শন দেখার পর আর তারা ঈমান আনবেনা। ফেরেস্তা এসেও যদি বলে, এমনকি মৃত ব্যক্তিও যদি ঘোষনা দেয়, ইনি আল্লাহর নবী, তবু তারা মানবেনা। যাই হোক আসল কথায় আসা যাক।

 

আল্লাহর উটনী স্বাধীনভাবে চরে বেড়াতে লাগলো। একদিনের সমস্ত পানিই উটনী পান করতো। তাঁদের ক্ষেত-খামারে সে অবাধে বিচরন করতো। এভাবে বেশ কিছুকাল অতিবাহিত হয়। ঈমান না আনলেও এই অলৌকিক উটের ব্যাপারে তাঁদের মনে ভয় ঢুকে গিয়েছিলো। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও উটনীকে তারা অনেকদিন বরদাশত করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা আর ধৈর্য ধরে থাকতে পারলোনা। তারা শলা পরামর্শ করলো। সিদ্ধান্ত নিল উটনীকে তারা হত্যা করবে। কিন্তু কে নেবে উটনীকে হত্যা করার দায়িত্ব? এক চরম হতভাগা এগিয়ে এলো। জাতির নেতারা তাঁর উপরে এ দায়িত্ব সপে দিলো। এক চরম ভয়াবহ পরিনতির ভয় তারা করলোনা। শেষ পর্যন্ত আল্লাহর উটনীকে তারা হত্যা করলো। এভাবে দ্রুত এগিয়ে এলো তারা নিজেদের করুন পরিনতির দিকে। তারপর কি হলো?

 

আর মাত্র তিন দিন

 

উটনী হত্যার খইবর পেয়ে, হজরত সালেহ কম্পিত হলেন। কিন্তু আফসোস, তাঁর জাতি বুঝলনা। তাঁর আর কিছুই করার নেই। তিনি দৌড়ে এলেন। তারা বললো- সালেহ, তুমি তো অংগীকার করেছিলে একে হত্যা করলে আমাদের উপর বিরাট বিপথ নেমে আসবে। কোথায় তোমার সেই বিপদ? যদি সত্যি তুমি রাসুল হয়ে থাকো, তবে এনে দেখাও দেখি সেই বিপদ। আল্লাহর নবী সালেহ এবার তাঁদের জানিয়ে দিলেন-

 

‘এখন তোমাদের শেষ পরিনতির সময় আর মাত্র তিনদিন বাকী আছে। নিজেদের সুরম্য প্রাসাদগুলোতে বসে এই তিনদিন ভালো করে ভোগ বিলাস করে নাও। এ এক অনিবার্য অংগীকার।”(সূরা ১১, হুদ আয়াত ৬৫)

 

এবার নবীকে হত্যার ষড়যন্ত্র

 

উটনীকে হত্যা করার পর এবার সামুদ জাতির নেতারা স্বয়ং হজরত সালেহ (আঃ)-কেই সপরিবারে হত্যা করার ফায়সালা করলো। তারা ভাবলো, সালেহই তো আমাদের পথের আসল কাঁটা। সে-ই তো আমাদের ভোগ বিলাসে বাধা দিচ্ছে। আমাদের জীবন পদ্ধতি বদলে দিতে চাচ্ছে। আমাদের ক্ষমতা হাতছাড়া করতে চাইছে। আমাদের সমালচোনা করছে। জনগণকে আমাদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলছে। তাঁর কারনেই তো এখন আমাদের উপর বিপদ আসার আশংকা দেখা দিয়েছে। সুতরাং তাঁর ভবলীলা সাঙ্গ করে দিলেই সব চুকে যায়। সামুদ জাতির নয়টি সম্প্রদায়ের নেতারা বসে শেষ পর্যন্ত ঐ তিন দিনের মধ্যেই নবীকে হত্যা করার চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়। তারা আরো সিদ্ধান্ত নেয়, হত্যার পরে সালেহর অলী-অভিভাবক হিসেবে যিনি তাঁর রক্তমূল্যের দাবীদার হবেন, তাঁকে বলবো, আমরা এ হত্যাকান্ডে জড়িত নই। এ ঘটনা কুরআন মাজীদে এভাবে বর্ণনা করেছে-

 

“শহরে ছিলো নয়জন দলপতি। তারা দেশকে অন্যায় অনাচারে বিপর্যস্ত করে তুলেছিলো। কোন প্রকার ভালো কাজ তারা করতোনা। তারা একে অপরকে বললো- আল্লাহর কসম খেয়ে অংগীকার করো, রাতেই আমরা সালেহ আর তাঁর পরিবারবর্গের উপর আক্রমন চালাবো। তারপর তাঁর অলীকে বলবো, তোমার বংশ ধ্বংস হবার সময় আমরা ওখানে উপস্থিতই ছিলাম না। আমরা সত্য সত্য বলছি।” (সূরা আন নামল ২৭ আয়াত ৪৮-৪৯)

 

ওদের এই ষড়যন্ত্র সম্পর্কে মহান আল্লাহ্‌ বলেন- “তারা একটা ষড়যন্ত্র পাকালো আর আমরাও একটা পরিকল্পনা বানালাম। যা তারা টেরই পেলোনা।” (সূরা আন নামল ২৭ আয়াত ৫০)

 

ধ্বংস হলো সামুদ জাতি

 

আল্লাহর সে পরিকল্পনাটি কী? তা হলো সামুদ জাতির ধ্বংস। আল্লাহ্‌ বলেন-

 

“এখন চেয়ে দেখো, তাঁদের ষড়যন্ত্রের পরিনতি কি হলো? আমি তাঁদের ধ্বংস করে দিলাম, সেই সাথে তাঁদের জাতিকেও। ” (সূরা আন নামল ২৭ আয়াত ৫১)

 

আল্লাহ্‌ সামুদ জাতিকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিলেন। তাঁদের গর্ব অহংকার ও ভোগ বিলাস সব তলিয়ে গেলো। মুফাসসিরগন তাঁদের ধ্বংসের বিবরন দিতে গিয়ে বলেছেন- হজরত সালেহ যে তাঁদের তিন দিনের সময় বেধে দিলেন, তাতে তাঁদের অন্তরে ভয় ঢুকে গেলো। প্রথম দিন তাঁদের চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে যায়। দ্বিতীয় দিন তাঁদের চেহারা লালবর্ণ হয়ে যায়, আর তৃতীয় দিনে তাঁদের চেহারা হয়ে যায় কালো। অতঃপর তিনদিন শেষ হবার পরপরই রাত্রিবেলা হঠাৎ এক বিকট ধ্বনি এবং সাথে সাথে ভুমিকম্প শুরু হয়ে যায়। বজ্রধ্বনি আর ভুকম্পনে তারা সম্পূর্ণ বিনাস হয়ে গেলো। মহান আল্লাহ্‌ বলেন-

 

“হঠাৎ বজ্রধ্বনি এসে তাঁদের পাকড়াও করলো। যখন ভোর হলো, তখন দেখা গেলো, তারা নিজেদের ঘর দোরে মরে উপর হয়ে পড়ে রইলো, যেনো এসব ঘরে তারা কোন দিনই বসবাস করেনি।”(সূরা ১১, হুদ আয়াত ৬৭-৬৮)

 

তাঁদের উন্নত প্রযুক্তির সুরম্য অট্টালিকা সমূহের ধ্বংসাবশেষ আজো তাঁদের অঞ্চলে শিক্ষনীয় হয়ে পড়ে আছে।

 

বেঁচে গেলেন সালেহ এবং তাঁর সাথীরা

 

তারা হজরত সালেহ- কে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেছিলো যে রাতে, সে রাতেই মহান আল্লাহ্‌ তাঁদের ধ্বংস করে দিলেন। সে ধ্বংস থেকে আল্লাহ্‌ পাক হজরত সালে এবং তাঁর সাথীদের রক্ষা করেছিলেন। তাঁদের নিরাপদে বাঁচিয়ে রাখলেন। মহান আল্লাহ্‌ বলেন-

 

“অতঃপর যখন ওদের দ্ধংশ হবার নির্দিষ্ট সময়টি আসলো, তখন আমরা সালেহ এবং তাঁর সাহে যারা ঈমান এনেছিল, তাঁদেরকে আমাদের বিশেষ রহমতের দ্বারা রক্ষা করলাম। সেদিনকার লাঞ্ছনা থেকে নিরাপদ রাখলাম। নিশ্চয়ই তোমার প্রভু দুর্দান্ত ক্ষমতার অধিকারী এবং মহাপরাক্রমশীল।” (সূরা ১১, হুদ আয়াত ৬৬)

 

সামুদ জাতি কেন ধ্বংস হলো?

 

সামুদ জাতি বৈষয়িকভাবে চরম উন্নতি লাভ করার পরও কেন ধ্বংস হলো? কেন তারা বিলীন হয়ে গেলো? কেন হলো তাঁদের এই অপমানকর বিনাশ? এর কারন খুব সহজ। এর কারন হলো-

 

১। তারা শিরকে লিপ্ত হয়েছিলো।

 

২। তারা এক আল্লাহর আইন ও বিধান মেনে নিতে অস্বীকার করেছিলো।

 

৩। তারা নবী ও নবীর পথকে প্রত্যাখ্যান করেছিলো।

 

৪। তারা দুষ্কৃতকারী ও দুর্নীতিবাজ নেতাদের অনুসরন করেছিলো।

 

৫। পরকালের তুলনায় বৈষয়িক জীবনকে তারা অগ্রাধিকার দিয়েছিল।

 

৬। লাগামহীন ভোগ বিলাসে তারা নিমজ্জিত হয়ে পড়েছিল।

 

৭। তারা সৎ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় বাধা দিয়েছিল।

 

৮। আল্লাহর নিদর্শন দাবী করেও তা তারা প্রত্যাখ্যান করেছিলো।

 

৯। তারা আল্লাহর নিদর্শন উটনীকে হত্যা করেছিল।

 

১০। তারা আল্লাহর নবীকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেছিলো।

 

১১। তারা অহংকার ও স্বেচ্ছাচারিতার মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিলো।

 

কুরআনে সালেহ ও তাঁর জাতির উল্লেখ

 

এবার জানিয়ে দিচ্ছি কুরআনে হজরত সালেহ (আঃ) ও তাঁর জাতি সামুদের কথা কোথায় উল্লেখ আছে। হ্যাঁ, আল কুরআনে হজরত সালেহ (আঃ) এর নাম উল্লেখ আছে ৯ বার। যেসব সুরায় উল্লেখ আছে সেগুলো হলো- সূরা আল আরাফ, আয়াত ৭৩,৭৫,৭৭, সূরা হুদ, আয়াত ৬১,৬২,৬৬,৮৯, সূরা শোয়ারা, আয়াত ১৪২, সূরা নামল, আয়াত ৪৫।

 

আল কুরআনে সামুদ জাতির নাম উল্লেখ আছে ২৬ স্থানে। সেগুলো হলো- সূরা আল আরাফ,আয়াত ৭৩, তাওবা, ৭০, হুদ ৬১,৬৮,৬৮,৯৫, ইবরাহীম ৯, ইস্রা ৫৯, হজ্জ ৪২, ফুরকান ৩৮, শোয়ারা ১৪১, নামল ৪৫, আন কবুত ৩৮, সোয়াদ ১৩, মুমিন ৩১, হামিমুস সাজদা ১৩-১৭, কাফ ১৩, যারিয়াত ৪৩, আন নাজম ৫১, আল কামার ২৩, আল হাক্কাহ ৪,৫, বুরুজ ১৮, আল ফজর, আশ সামস ১১।

 

কুরআনের সুরাগুলো জানিয়ে দিলাম। সরাসরি কুরআন পড়লে আপনারা নিজেরাই এ ঘটনার আরো অনেক শিক্ষণীয় দিক জানতে পারবেন।

 

৬।

 

অগ্নী পরীক্ষায় বিজয়ী বীর ইবরাহীম

 

(আঃ)

 

জন্ম ও কৈশোর

 

হাজার হাজার বছর আগের কথা। আজ থেকে প্রায় চার হাজার বছর আগের কথা। নমরূদীয় ইরাকের ঊর নগরীতে জন্ম হয় এক শিশুর। একদিন সেই শিশুটিই হন কালের সাক্ষী এক মহাপুরুষ। ওর বাবা আজর ছিলেন বড় একজন ধর্মীয় পুরোহিত। তিনি নিজের হাতে মূর্তি তৈরি করতেন। আর ঐ মূর্তিগুলোকেই সারা দেশের মানুষ দেবতা বলে মানতো। ওদের পূজা উপাসনা করতো। ছেলে জন্ম হওয়ায় বাবা আজর দারূন খুশি। ভাবেন, আমার পরে আমার এই ছেলেই হবে ধর্মীয় পুরোহিত। নিজ হাতে সে দেবতা বানাবে। সে রক্ষা করবে আমার ধর্মীয় ঐতিহ্য। মনের খুশিতে আজর তাঁর পুত্রের নাম রাখেন ইব্রাহিম। কিন্তু আল্লাহর পরিকল্পনা ভিন্ন। তিনি ইব্রাহীমকে দিয়ে মূর্তি ভাংগার পরিকল্পনা করেন। আল্লাহর পরিকল্পনা অনুযায়ী ইব্রাহিম বড় হতে থাকে। ইব্রাহীমকে তিনি নিজ ভান্ডার থেকে দান করেন অগাধ জ্ঞান, বুদ্ধি আর দূরদৃষ্টি। কারন তিনি তো তাঁকে নবী বানাবেন। তিনি তো তাঁকে এক বিরাট নেতৃত্বের আসনে বসাবেন। তাই ছোট বেলা থেকেই তাঁর জ্ঞান বুদ্ধি দ্রুত বৃদ্ধি হতে থাকে। কিশোর বয়স থেকেই ইব্রাহিম সব কিছু যুক্তি দিয়ে বুঝার চেষ্টা করতে থাকেন।

 

চিন্তা করেন ইব্রাহিম

 

ইব্রাহিম ভাবেন, নিজেদের হাতে মূর্তি বানিয়ে সেগুলোকে খোদা মানা তো বিরাট বোকামি। যারা কারো উপকার করতে পারে না, কারো অপকারও করতে পারে না, তারা খোদা হয় কেমন করে? কেউ যদি ঐ দেবতাগুলির ক্ষতি করতে চায়, তা থেকেও দেবতাগুলি আত্মরক্ষা করতে পারেনা। তিনি বুঝতে পারেন, তাঁর পিতা ও সমাজের লোকেরা বিরাট ভুলের মধ্যে রয়েছে। তিনি তাঁর বাবাকে বলেন-

 

“বাবা, আপনি কি মূর্তিকে খোদা মানেন? আমিতো দেখছি, আপনি এবং আপনার জাতির লোকেরা পরিস্কার ভুলের মধ্যে আছেন।” (সূরা আল আনাম, আয়াত ৭৪)

 

ইব্রহীম দেখলেন, তাঁর জাতির লোকেরা চন্দ্র-সূর্য, নক্ষত্রেরও পূজা করছে। তারা মনে করলো, এগুলো তো শক্তিশালী দেবতা। কিন্তু এরা যে খোদা হতে পারেনা, তা তিনি যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন। রাত্রি বেলা নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে ইব্রাহিম বলেন- তোমরা বলছো এ আমার প্রভু, অতঃপর নক্ষত্র যখন ডুবে গেলো, তখন তিনি বলে দিলেন, অস্তমিত হওয়া জিনিসকে আমি পছন্দ করিনা। এরপর উজ্জ্বল চাঁদ উদয় হলো। তিনি বললেন- তবে এই হবে প্রভু, কিন্তু যখন চাঁদও ডুবে গেলো, তিনি তখন বললেন- এতো খোদা হতে পারেনা। আসল প্রভু মহাবিশ্বের মালিক নিজেই যদি আমাকে পথ না দেখান, তবে আমিতো বিপথগামীদের দলভুক্ত হয়ে পড়বো।

 

অতপর সকাল হলে পুবাকাশে ঝলমল করে সূর্য উঠলো। তবে তো এই হবে খোদা। কারন এতো সবার বড়। তারপর সন্ধ্যায় যখন সূর্য ডুবে গেলো, তখন তিনি তাঁর কওমকে সম্বোধন করে বললেন- তোমরা যাদেরকে মহান সৃষ্টিকর্তার অংশীদার ভাবছো, আমি তাঁদের সকলের দিক থেকে মুখ ফেরালাম। আমি সেই মহান প্রভুর নিকট আত্মসমর্পণ করছি, যিনি আসমান আর জমিনকে সৃষ্টি করেছেন। আমি তাঁর সাথে কাউকেও অংশীদার বানাবোনা।

 

শুরু হলো বিবাদ

 

এ সিদ্ধান্ত ঘোষণা করার পর জাতির লোকেরা তাঁর সাথে বিবাদে লিপ্ত হলো। তিনি তাঁদের বললেন- “তোমরা কি মহান আল্লাহর ব্যাপারে আমার সাথে বিতর্ক করছো? তিনি তো সঠিক পথ দেখিয়েছেন। তোমরা যাদেরকে আল্লাহর আংশীদার মানো, আমি ওদের ভয় করিনা। আমি জানি ওরা আমার কোন ক্ষতি করতে পারবেনা।

 

ইব্রাহিম তাঁর বাবাকে বললেন- “বাবা আপনি কেন সেই সব জিনিসের ইবাদাত করেন? যেগুলো কানে শুনেনা, চোখে দেখেনা এবং আপনার কোন উপকার করতে পারেনা। বাবা আমি সত্য জ্ঞান লাভ করেছি, যা আপনি লাভ করেননি। আমার দেখানো পথে চলুন, আমি আপনাকে সঠিক পথ দেখাবো। বাবা, কেন আপনি শয়তানের দাসত্ব করছেন? শয়তান তো দয়াময় আল্লাহর অবাধ্য।” (সূরা মরিয়ম, আয়াত ৪২-৪৪)

 

জবাবে ইব্রাহীমের পিতা বললেন- “ইব্রাহিম, তুই কি আমার খোদাদের থেকে দূরে সরে গেলি? শোণো, এই পথ থেকে ফেরত না এলে, আমি তোকে পাথর মেরে হত্যা করবো।” (সূরা মরিয়ম, আয়াত ৪৬)

 

মূর্তি ভাংগার পালা

 

কোন কিছুতেই যখন জাতির লোকেরা সত্য গ্রহনে প্রস্তুত হলোনা, তখন ইব্রাহিম একদিন ঘোষণা করলেন- তোমাদের অনুপস্থিতিতে একদিন তোমাদের এই মিথ্যা খোদাদের বিরুদ্ধে একটা চাল চালবো। ইব্রাহীমের কোথায় তারা তেমন একটা গুরুত্ব দিলোনা। একদিন সব লোক এক ধর্মীয় উৎসবে যোগ দিতে চলে গেলো। ইব্রাহীমকেও তারা উৎসবে যেতে বলে। ইন্তু অনেক পীড়াপীড়ি সত্ত্বেও তিনি গেলেন না। নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে বললেন- আমি পীড়িত। আমি যাবোনা। সুতরাং তাঁকে রেখেই তারা চলে গেলো। শহর পুরুষ শুন্য হয়ে পড়লো। এই সুযোগে ইব্রাহিম ওদের ঠাকুর ঘরে এলেন। দেখলেন, সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে ওদের মূর্তি দেবতাগুলো। ওদের সামনে রয়েছে দামি দামি খাবার জিনিস। ইব্রাহিম ওদের বললেন- “তোমাদের কি হয়েছে? এসব স্বাদের জিনিস খাওনা কেন? কি হলো, কথা বলছোনা কেন? তারপর তিনি মূর্তিগুলোকে আঘাত করে ভেঙ্গে ফেললেন। কিন্তু ঠাকুর দেবতাটিকে ভাংলেন না। ওকে ওর যায়গায়ই রেখে দিলেন।

 

উরসব শেষে লোকেরা ফিরে এলো। দেবতাদের অবস্থা দেখে সবার মাথায় হাত। তারা বলাবলি করতে লাগলো- কোন যালিম আমাদের খোদাদের সাথে এই ব্যাবহার করলো? কেউ কেউ বললো – আমরা যুবক ইব্রাহীমকে এদের ব্যাপারে সমালোচনা করতে শুনেছি।

 

নেতারা গোস্বায় ফেটে পড়লো। বললো – অপরাধীকে ধরে নিয়ে এসো সবার সামনে। ইব্রাহীমকে আনা হলো। তারা বললো- ‘ইব্রাহিম, আমাদের খোদাদের সাথে এই ব্যাবহার কি তুমি করেছো?” ইব্রাহিম ভাবলেন, ওদের খোদাদের অক্ষমতা প্রমান করার এটাই বড় সুযোগ। তিনি বললেন- নয়তো ওদেরকেই জিজ্ঞেস করুন, কে মেরেছে ওদের? ঐ বড়টাকেই জিজ্ঞেস করুন, সে-ই ভেঙ্গেছে নাকি?

 

ইব্রাহীমের কথা শুনে তারা লজ্জিত হলো। মনে মনে ভাবলো, আসলে আমরাই তো অন্যায়কারী। তারপর মাথানত করে তারা বললো- ‘ইব্রাহিম, দেবতাগুলো যে কথা বলতে পারেনা, তাতো তুমি ভালো করেই জানো।’

 

ইব্রাহিম সবাইকে সম্বোধন করে বললেন – “তোমরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে এমন সব জিনিসের পূজা উপাসনা করো, যেগুলো তোমাদের ভালোও করতে পারেনা, আবার মন্দও করতে পারেনা? দুঃখ তোমাদের জন্যে, কেন তোমরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে এগুলোর ইবাদাত করো? তোমাদের কি একটুও বিবেক বুদ্ধি নেই?” এবার তারা ইব্রাহীমকে ঘিরে ফেললো। চারদিকে হৈ হট্টগোল শুরু করে দিলো। ইব্রাহিম জোর গলায় বললেন – ‘তোমরা কি তোমাদের নিজেদের হাতে বানানো মূর্তির ইবাদাত করবে? অথচ তোমাদেরকে তো সৃষ্টি করেছেন আল্লাহ্‌।’

 

রাজ দরবারে আনা হলো

 

তারা ইব্রাহীমকে নিয়ে খুব চিন্তায় পড়লো। কী করবে তাঁকে নিয়ে? সে তো দেবতাদের আর কোন মান-ইজ্জতই বাকী রাখলোনা। তারা বিভিন্ন রকম শলা পরামর্শ করতে লাগলো। শেষ পর্যন্ত ইব্রাহীমের বিষয়টি তারা রাজ দরবারে তুললো। তাঁদের রাজা ছিলো নমরুদ। নমরূদকে তারা বুঝালো, ইব্রাহীমের ব্যাপারে বড় কোন সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে সে আমাদের ধর্মও বিনাশ করবে, আপনার রাজত্বও বিনাশ করবে।

 

রাজা বললেন- ইব্রাহীমকে আমার কাছে নিয়ে এসো। অতঃপর ইব্রাহীমকে নমরূদের সামনে হাজির করা হলো। নমরূদ তাঁর সাথে কথা বললেন। ইব্রাহিম তাঁকে আল্লাহর দিকে আহবান জানান। কিন্তু নমরূদ ইব্রাহীমের সাথে আল্লাহর ব্যাপারে বিতর্ক শুরু করলো। বললো- তোমার প্রভু কে?

 

ইব্রাহিম- আমার প্রভু তিনি জীবন দান করেন এবং মৃত দান করেন।

 

নমরূদ- আমিও মানুষকে মারতে পারি, আবার জীবিত রাখতে পারি। (নমরূদ মৃত্যুদন্ড দেউয়া দুজন কয়েদীকে এনে একজনকে হত্যা করলো, আর একজনকে ছেড়ে দিলো।)

 

ইব্রাহিম- ‘আমার আল্লাহ্‌ সূর্যকে পূর্বদিক থেকে উঠান, তুমি যদি সত্যি সত্যি প্রভু হয়ে থাকো, তবে সূর্যকে পশ্চিম দিক থেকে উঠাও তো দেখি।’ (সূরা ২ আল বাকারা, আয়াত ২৫৮)

 

একথা শুনে রাজা হতভম্ব, হতবাক ও নিরুত্তর হয়ে গেলো। আল্লাহ্‌ তো যালিমদের পথ দেখান না। এভাবে ইব্রাহীমের যুক্তির কাছে রাজা প্রজা সবাই পরাস্থ হলো। ইব্রাহিম যুক্তির মাধ্যমে মূর্তিকে খোদা মানার অসারতা প্রমান করে দিলেন। চন্দ্র, সূর্য ও নক্ষত্রকে খোদা মানা ভুল প্রমান করে দিলেন। রাজা বাদশাহকে প্রভু মানার ভ্রান্তি স্পষ্ট করে দিলেন। তাঁদের ধর্ম ও সব দেবতাই যে মিথ্যা, সেকথা দিবালোকের মতো স্পষ্ট করে দিলেন। সাথে তিনি তাঁদেরকে এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার আহবান জানালেন। আল্লাহর পয়গাম তিনি তাঁদের কাছে পৌছে দেন।

 

অগ্নীকুন্ডে নিক্ষেপ

 

কিন্তু তারা কিছুতেই ঈমান আনলো না। বরং নৈতিকভাবে ইব্রাহীমের কাছে পরাজিত হয়ে তারা তাঁর উপরে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো। অন্ধ বর্বরতায় মেতে উঠলো তারা। সিদ্ধান্ত নিলো ইব্রাহীমকে হত্যা করার। কিন্তু কিভাবে হত্যা করবে তাঁকে? তারা ফায়সালা করলো বিরাট অগ্নীকুন্ড বানাবে। তারপর তাতে পুড়িয়ে মারবে ইব্রাহীমকে। যে কথা সে কাজ। এক বিরাট অগ্নীকুন্ড বানালো তারা। এটা ছিলো ইব্রাহীমের জন্যে এক বড় পরীক্ষা। আল্লাহও ইব্রাহিমকে বাজিয়ে নিতে চাইলেন। তিনি দেখতে চাইলেন ইব্রাহিম কি জীবন বাঁচানোর জন্যে ঈমান ত্যাগ করে, নাকি ঈমান বাঁচানোর জন্যে জীবন কুরবানী করে? কিন্তু ইব্রাহিম তো অগ্নী পরীক্ষার বিজয়ী বীর। তিনি তো জীবন বাঁচানোর জন্যে কিছুতেই আল্লাহকে এবং আল্লাহর দ্বীনকে ত্যাগ করতে পারেননা। তিনি তো আল্লাহ্‌ এবং আল্লাহর দ্বীনকে জীবনের চাইতে অনেক অনেক বেশী ভালোবাসেন। কাফিররা তাঁকে অগ্নীকুন্ডে নিক্ষেপ করার জন্যে নিয়ে এলো। তিনি তাঁদের কাছে নতো হননি। জীবন ভিক্ষা চাননি। জীবন বাঁচানোর জন্যে নিজের দীন এবং ঈমান ত্যাগ করেননি। তাঁর তেজোদীপ্ত ঈমান তাঁকে বলে দিলো- ইব্রাহিম, জীবন মৃত্যুর মালিক তো তোমার মহান প্রভু আল্লাহ্‌। তাঁর ঈমান তাঁকে বলে দেয়, আল্লাহ্‌ যদি আমার কোন ক্ষতি করতে না চান, তবে গোটা পৃথিবী এক হয়েও তা থেকে আমাকে রক্ষা করতে পারবেনা।

 

নিশ্চিত মনে আল্লাহর উপর ভরসা করে তিনি অগ্নীকুন্ডের দিকে এগিয়ে গেলেন। ওরা তাঁকে নিষ্ঠুরভাবে নিক্ষেপ করলো নিজেদের তৈরি করা নরকে। আল্লাহ্‌ ইব্রাহীমের প্রতি পরম খুশি হয়ে আগুনকে বলে দিলেন- “হে আগুন, ইব্রাহীমের প্রতি সুশীতল এবং শান্তিময় হয়ে যাও।”

 

আগুনের কি সাধ্য আছে সৃষ্টিকর্তার হুকুম অমান্য করার?

 

সুতরাং অগ্নীকুন্ডে ইব্রাহিম সম্পূর্ণ নিরাপদ থেকে গেলেন। আগুন তাঁর কোনই ক্ষতি করলোনা। বরং আল্লাহর হুকুমে সে ইব্রাহীমের সেবায় নিয়োজিত হলো। ইব্রাহীমের জাতি আবার তাঁর কাছে পরাজিত হলো। ইব্রাহিম আবার তাঁদের কাছে প্রমান করে দিলেন, তাঁদের দেবতারা নিজেদের রক্ষা করতেই অক্ষম। আর তিনি যে মহান প্রভুর প্রতি তাঁদের ডাকছেন, তিনি যে কোন ক্ষতি থেকে বান্দাদের রক্ষা করতে সক্ষম। তিনি সর্বশক্তিমান। তিনিই একমাত্র সত্তা যার হুকুম পালন করা উচিত। যার ইবাদাত উপাসনা করা উচিত।

 

হিজরত করেন ইব্রাহিম

 

অগ্নিকুণ্ড থেকে রক্ষা পেয়ে ইব্রাহিম আল্লাহর পথে আসার জন্যে তাঁদেরকে অনেক বুঝান। কিন্তু তারা কিছুতেই নিজেদের পূর্বপুরুষদের ভুল পথ ত্যাগ করতে রাজি হয়নি। বরং ইব্রাহীমের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র পাকাতে থাকে। ইব্রাহিম দেখলেন, এ মানুষগুলোর আর হিদায়াতের পথে আসার সম্ভাবনা নেই। তখন তিনি আল্লাহর হুকুমে হিজরত করার সিদ্ধান্ত নিলেন। নিজের প্রিয় মাতৃভূমি ছেড়ে রওয়ানা করলেন। সাথে ছিলেন স্ত্রী সারাহ আর ভাতিজা লূত। জাতির লোকদের মধ্যে কেবল ভাতিজা লুতই ঈমান এনেছিলেন। প্রিয় জন্মভূমি থেকে হিজরত করেন ইব্রাহিম। এবার তিনি উন্মুক্ত বিশ্বে দাওয়াতী কাজ বিস্তার করা শুরু করেন। মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকতে ডাকতে তিনি সিরিয়ার দিকে যাত্রা করেন। সেখান থেকে চলে যান ফিলিস্তিন এলাকায়। আল্লাহর বার্তা বইয়ে নিয়ে যান তিনি মানুষের দুয়ারে দুয়ারে। দীর্ঘ পথের ভ্রমন, মানুষের বিরোধিতা, অত্যাচার নির্যাতন আর হাজারো রকমের কষ্ট তাঁকে ক্লান্ত করতে পারেনি। তিনি মানুষকে দাওয়াত দিয়েই চলেছেন।

 

এবার তিনি ফিলিস্তি থেকে যাত্রা শুরু করেন মিশরের দিকে। কেবল মানুষকে আল্লাহর দিকে আহবান জানানোর জন্যেই এ মহামানব ঘুরে বেড়ান দেশ থেকে দেশান্তরে। পাড়ি দেন মরু-প্রান্তর, সমুদ্র পাথার। এসব কিছুই করেন তিনি তাঁর মহান প্রভু দয়াময় আল্লাহকে খুশি করার জন্যে। তাইতো জন্মভূমি ত্যাগের সময় প্রশান্ত দীল ইব্রাহিম বলেছিলেন-

 

“আমি আমার প্রভুর উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। তিনিই আমাকে পথ দেখাবেন।” (সূরা ৩৭ আস সাফফাত, আয়াত ৯৯)

 

মিশরে এসে তিনি এখানকার মানুষকে দাওয়াত দিতে থাকেন আল্লাহর দিকে। সাথে তাঁর স্ত্রী সারাহ আর ভাতিজা লুত। মিশরে এসে দেখেন এখানকার বাদশাহ বড়ই স্বৈরাচারী-যালিম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাদশাহ হজরত ইব্রাহিম আর তাঁর স্ত্রীর আল্লাহ ভক্তিতে মুগ্ধ হন এবং ইব্রাহিম ও সারাহর সেবা করার জন্যে নিজ কন্যা হাজেরাকে ইব্রাহীমের নিকট বিয়ে দেন। ইব্রাহীমকে অনেক ধন-দৌলত প্রদান করেন।

 

আবার ফিলিস্তিনে

 

মিশর থেকে ইব্রাহিম (আঃ) আবার ফিরে আসেন ফিলিস্তিনে। এবার ফিলিস্তিনকেই তিনি তাঁর দাওয়াতী কাজের মূল কেন্দ্র বানান। ভাতিজা লুতকে জর্ডান এলাকায় নিজের প্রতিনিধি নিয়োগ করেন। আল্লাহ তায়ালা তাকেও নবুয়ত দান করেন।

 

ইব্রাহীমের মনে বড় দুঃখ, তিনি বৃদ্ধ বয়সে এসে উপনীত হয়েছেন, কিন্তু তাঁর কোন সন্তানাদী নেই। স্ত্রী সারাহ ছিলেন একজন বন্ধ্যা মহিলা। তাঁর কোন সন্তানাদী হতো না। ইব্রাহিম আল্লাহর কাছে দোয়া করেন-

 

“হে প্রভু, আমাকে একটি সৎ সন্তান দান করো।”(সূরা ৩৭ আস সাফফাত, আয়াত ১০০)

 

পরম দয়াময় আল্লাহ্‌ তাঁর দোয়া কবুল করেন। স্ত্রী হাজেরার ঘরে তাঁর এক সুন্দর ফুটফুটে ছেলের জন্ম হয়। তিনি পুত্রের নাম রাখেন ইসমাঈল। বৃদ্ধ বয়সে শিশু পুত্রের হাসিতে তাঁর মন ভরে উঠে। কিন্তু এই পুত্রের ভালবাসা নিয়েও আল্লাহ্‌ তাঁকে পরীক্ষায় ফেলেন। আল্লাহ্‌ তাঁকে বাজিয়ে দেখতে চান, তিনি পুত্রের ভালবাসার চেয়ে আল্লাহর হুকুম পালন করাকে বড় জানেন কী-না? ঈশমাঈলকে মক্কায় রেখে আসার নির্দেশ

 

এবার আল্লাহ্‌ ইসমাঈল আর তাঁর মা হাজেরাকে মক্কার জনমানব ও ফল পানি শস্যহীন মরুভূমিতে রেখে আসার নির্দেশ দেন। কিন্তু ইব্রাহিম যে, আল্লাহকে সবার চেয়ে বেশী ভালবাসেন। তিনি যে জানেন, আল্লাহর হুকুম অমান্য করা যায়না। তাইতো তিনি হাজেরা আর শিশু পুত্র ইসমাঈলকে নিয়ে শত শত মাইল পথ পাড়ি দিয়ে মক্কায় এসে উপস্থিত হন। আল্লাহর ইংগীতে তিনি তাঁদেরকে একটি নির্দিষ্ট স্থানে রেখে আবার ফিলিস্তিন অভিমুখে রওয়ানা করেন। হাজেরাকে বলে যান, আমি আল্লাহর হুকুমে তোমাদেরকে এখানে রেখে গেলাম। হাজেরাকে কিছু খাদ্য ও এক মশক পানি দিয়ে আসেন। প্রশান্ত সমুদ্রের মতো প্রশস্ত হৃদয় আর হিমালয়ের মতো অটল ধৈর্যশীল ইব্রাহিম আল্লাহ্‌ প্রদত্ত পরীক্ষায় বিজয়ী হয়ে ফিরে আসেন ফিলিস্তিনে।

 

আল্লাহর দীনের দাওয়াত নিয়ে ইব্রাহিম ঘুরে বেড়ান ফিলিস্তিন, জর্ডান আর হিজাযের বিভিন্ন এলাকায়। একাজ করাই তাঁর মূল দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালনের ফাকা ফাকে তিনি মক্কায় যান। স্ত্রী পুত্রকে দেখে আসেন। হাটি হাটি পা পা করে ছেলে বড় হয়ে ওঠে। সাথে সাথে ছেলের প্রতি ইব্রাহীমের মহব্বতও উপচে উঠে। ফলে আল্লাহ্‌ ইব্রাহীমকে আবার বাজিয়ে নিতে চান।

 

পুত্র কুরবানীর হুকুম

 

ইসমাঈলের এখন বুঝ বুদ্ধি হয়েছে। ইব্রাহীমের সাথে এখন পুত্র ইসমাঈল ঘরে বাইরে যাতায়াত করেন। পিতা যদি বৃদ্ধ বয়সে উদীয়মান কিশোর পুত্রকে নিজের সাহায্যকারী হিসেবে পান, তবে তাঁর প্রতি যে পিতার মহব্বত কতটা বেড়ে যায়, তা ভাষায় প্রকাশ করা যায়না। ঠিক এমনই এক সময়ে আল্লাহ্‌ পাক ইব্রাহীমকে স্বপ্নে ইসমাঈলকে কুরবানী করার নির্দেশ প্রদান করেন। বলে দেন, ‘ইব্রাহিম, তোমার প্রিয়তম পুত্রকে কুরবানী করো।’ আল্লাহর হুকুম লংঘন করা যায়না। তাঁর হুকুম পালন করা অবধারিত।

 

পুত্রের প্রতি ভালোবাসার বন্ধন ইব্রাহীমকে আল্লাহর হুকুম পালন করা থেকে বিরত রাখতে পারেনা। তিনি পুত্রকে ডেকে নিয়ে জানালেন- ‘পুত্রয়ামার, আল্লাহ্‌ আমাকে স্বপ্নে হুকুম করেছেন তোমাকে কুরবানী করার জন্যে। এ ব্যাপারে তোমার মতামত কি? ’

 

‘যেমন বাপ, তেমন ছেলে।’ উর্দু ভাষায় বলা হয় ‘বাপকা বেটা’।   আর আরবী ভাষায় বলা হয় ‘হওয়া ইবনু আবিহী’। কথাটি যেন ইসমাঈলের জন্যে একশো পারসেন্ট প্রযোজ্য। আল্লাহর হুকুমের কাছে তিনি পিতার মতই নুইয়ে দিলেন মাথা। বললেন- ‘আব্বু, আল্লাহর হুকুম কার্যকর করুন। ইনশা’য়াল্লাহ আপনি আমাকে অটল ধৈর্যশীল পাবেন।’ দয়া ও করুনার সাগর মহান আল্লাহ্‌ তো তাঁদের পিতা পুত্র দু’জনের কথা শুনছিলেন। এসময় তাঁদের প্রতি যে তাঁর মহব্বত ও রহমতের স্রোতধারা কিভাবে বইয়ে আসছিলো তা একমাত্র তিনিই জানেন। প্রভু রহমান এ সময়টির কথা নিজ ভাষায় এভাবে বর্ণনা করেন-

 

“ওরা দু’জনেই যখন আমার হুকুমের কাছে মাথা নত করে দিলো আর ইব্রাহিম পুত্রকে (জবাই করার জন্য) উপুড় করে শুইয়ে দিলো, তখন আমি তাঁকে ডাক দিয়ে বললাম, ইব্রাহিম তুমি স্বপ্নে দেখা তুমি স্বপ্নে দেখা হুকুমকে সত্যে পরিনত করে দেখালে পুণ্যবানদের এভাবেই আমি প্রতিফল দান করি। এটা ছিলো একটা বিরাট পরীক্ষা। অতঃপর একটি বড় কুরবানীর বিনিময়ে আমি তাঁর পুত্রটিকে ছাড়িয়ে নিলাম। আর পরবর্তী লোকদের মাঝে একথা স্থায়ী করে দিলাম যে, ইব্রাহীমের উপর শান্তি বর্ষিত হোক।” (সূরা ৩৭ আস সাফফাত, আয়াত ১০৩-১০৯)

 

ব্যাপারতো বুঝতেই পেরেছেন। বাপ ছেলে দুজনই আল্লাহর হুকুম পালন করার জন্যে তৈরি হয়ে গেলেন। ইব্রাহিম পুত্রকে কুরবানী করার জন্যে উপুড় করে শুইয়ে দিলেন। চোখ বন্ধ করে পুত্রের গলায় ছুরি চালিয়ে দিতে উদ্যত হলেন। ঠিক এমনই সময় তাঁর প্রিয়তম প্রভু ডাক দিয়ে বললেন- ইব্রাহিম থামো, তুমি আমার হুকুম পালন করেছো বলে প্রমান দিয়েছ। ইব্রাহিম চোখ খুলে দেখলেন সামনে একটি দুম্বা দাড়িয়ে আছে। আল্লাহ্‌ বলে দিলেন পুত্রের পরিবর্তে এবার এই দুম্বাটিকে কুরবানী করে দাও। আর তোমার এই কুরবানী হবে বিরাট এক ঐতিহাসিক কুরবানী।

 

এবার ইব্রাহিম দুম্বাটিকে যবেহ করে দিলেন। প্রিয় পুত্রকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। আল্লাহ্‌ ইব্রাহীমের ঐ বিরাট কুরবানীকে চির স্মরণীয় করে রাখার জন্যে মুসলিমদের মাঝে প্রতি বছর কুরবানী করার নিয়ম চালু করে দিলেন। আজো আমরা ইব্রাহিম (আঃ) এর সেই মহান কুরবানীর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রতি বছর ঐ তারিখে পশু কুরবানী করি। এভাবেই আল্লাহ্‌ ইব্রাহীমকে বানিয়েছেন কালের সাক্ষী এক মহাপুরুষ।

 

এই চরম পরীক্ষাটিতেও ইব্রাহিম যখন উত্তীর্ণ হলেন, তখন আল্লাহ্‌ একদিকে তাঁকে নিজের খলিল বা বন্ধু বানিয়ে নিলেন। আল কুরআনে তাঁর নেতৃত্বের বিষয়টি এভাবে তুলে ধরা হয়েছে –

 

“স্মরণ করো সেই সময়ের কথা, যখন ইব্রাহীমকে তাঁর প্রভু বেশ কয়েকটি বিষয়ে পরীক্ষা করলেন আর সব ক’টিতেই সে উত্তীর্ণ হলো, তখন তিনি তাঁকে বললেন- আমি তোমাকে সন মানুষের নেতা বানাতে চাই। ইব্রাহিম জানতে চাইলো- এই প্রতিশ্রুতি কি আমার সন্তানদের ব্যাপারেও প্রযোজ্য হবে? তিনি বললেন- আমার প্রতিশ্রুতি যালিমদের ব্যাপারে প্রযোজ্য হবেনা। (সূরা ২ আল বাকারা আয়াত ১২৪)

 

এটাই আল্লাহর নীতি। তিনি কাউকেও বড় কোন দায়িত্ব ও নেতৃত্ব দিতে চাইলে তাঁকে ভালোভাবে বাজিয়ে নেন। সব পরীক্ষায় বিজয়ী হওয়ার পরে তিনি ইব্রাহীমকে শুধু নেতৃত্বই দেননি, সেই সাথে বৃদ্ধ বন্ধ্যা স্ত্রী সারাহর ঘরেও একটি পুত্র সন্তান দান করেন। তাঁর নাম ইসহাক। শুধু তাই নয় মহান আল্লাহ্‌ তাঁর দুই ছেলেকেই নবী মনোনীত করেন।

 

আল্লাহর কুদরত দর্শন

 

ইব্রাহিম (আঃ) এর প্রতি আল্লাহর এতো বড় অনুগ্রহের কারন কি? তা হলো, আল্লাহর প্রতি তাঁর পরম আস্থা ও প্রত্যয়। মহান আল্লাহ্‌ তাঁকে আসমান ও যমীনের সমস্ত নিদর্শন দেখিয়ে দিয়েছিলেন। সে কারনেই তাঁর মধ্যে সৃষ্টি হয় আল্লাহর প্রতি মজবুত ও অটল প্রত্যয়। আল্লাহর প্রতি নিজের পরম আস্থাকে আরো মজবুত করে নেবার জন্যে তিনি আল্লাহর কাছে একটা আবদার করেন। সে আবদারটি কুরআনের বর্ণনায় শুনুন-

 

“সে ঘটনাটি স্মরণ করো, যখন ইব্রাহিম বলেছিল, আমার প্রভু, তুমি কেমন করে মৃত্যুকে জীবিত করো আমাকে একটু চোখের সামনে দেখিয়ে দাও। তিনি বললেন- তুমি কি তা বিশ্বাস করোনা? ইব্রাহিম বললো- অবশ্যি বিশ্বাস করি, তবে আমার মনের সান্ত্বনার জন্যে নিজের চোখে দেখতে চাই। তিনি বললেন- তবে তুমি চারটি পাখি ধরো। সেগুলোকে নিজের কাছে ভালোভাবে পোষ মানিয়ে নাও। তারপর সেগুলিকে (যবাই করে) সেগুলোর একেকটি অংশ একেক পাহাড়ে রেঝে এসো। অতঃপর তুমি ওদের ডাকো। দেখবে ওরা তোমার কাছে দৌড়ে আসবে। জেনে রাখো, আল্লাহ্‌ বড় ক্ষমতাশীল মহাবিজ্ঞানী।” (সূরা ২ আল বাকারা আয়াত ২৬০)

 

কুরআনের বিবরন থেকে ঘটনাটি নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন। ইব্রাহিম পাখিগুলোকে টুকরো টুকরো করে বিভিন্ন পাহাড়ে রেখে এসে ওদেরকে ডাক দেন। সাথে সাথে ওরা জীবিত হয়ে ইব্রাহীমের কাছে উড়ে আসে। আল্লাহ্‌ তাঁকে চাক্ষুস দেখিয়ে দিলেন, তিনি কিভাবে মৃতকে জীবিত করতে পারেন। এভাবেই আল্লাহ্‌ কিয়ামতের দিন সব মানুষকে জীবিত করবেন এবং সবাই হাশরের ময়দানে দৌড়ে এসে একত্রিত হবে। বিষয়টি ইব্রাহিম স্বচক্ষে দেখে পরম প্রত্যয় ও প্রশান্তি লাভ করেন।

 

কা’বা ঘর নির্মাণ

 

এবার আল্লাহ্‌ তাঁর প্রিয় ইব্রাহীমকে আরেকটি বিরাট দায়িত্ব অর্পণ করেন। তিনি তাঁকে কা’বা ঘর নির্মাণের নির্দেশ প্রদান করেন। কোন জায়গাটিতে কা’বা ঘর নির্মাণ করতে হবে, তাও তিনি বলে দেন। সেই জায়গাটি তো এখন আমাদের সকলেরই জানা। কা’বা ঘর নির্মাণ করেছিলেন ইব্রাহিম (আঃ) পুত্র ইসমাঈলকে সাথে নিয়ে। এটিতো সেই জায়গা যেখানে তিনি রেখে এসেছিলেন শিশু পুত্র ইসমাঈল আর তাঁর মা হাজেরাকে। এটি তো সেই স্থান, যার পাশে মিনাতেই কুরবানী করতে গিয়েছিলেন প্রিয়তম পুত্র ইসমাঈলকে। আল্লাহর নির্দেশে পিতা-পুত্র দু’জনে মিলে নিপুন কারিগরের মতো কা’বার ভীত উঠালেন। তারপর নির্মাণ সম্পন্ন করলেন আল্লাহর ঘর কা’বা ঘরের। এ সময় দু’জনেই দয়াময় রহমানের দরবারে দোয়া করলেন-

 

“আমাদের প্রভু, তুমি আমাদের এই কাজ কবুল করো। তুমিতো সবই শোন এবং সবই জানো। প্রভু, আমাদেরকে তোমার অনুগত রাখো। আমাদের বংশ থেকে তোমার অনুগত একটি উম্মত সৃষ্টি করে দাও। তোমার হুকুম পালন করার নিয়ম আমাদের জানিয়ে দাও। আমাদের ভুলত্রুটি ক্ষমা করে দাও। তুমি তো মহাক্ষমাশীল দয়াবান। আমাদের প্রভু, এদের মধ্য থেকেই এদের মাঝে একজন রাসুল পাঠিয়ো----।” (সূরা ২ আল বাকারা আয়াত ১২৮-১২৯)

 

মহান আল্লাহ্‌ ইব্রাহীমের তৈরি ঘরকে নিজের ঘর বলে ঘোষণা দিলেন। এ ঘরকে তিনি চিরদিন বাঁচিয়ে রাখলেন। তিনি ইব্রাহীমকে বলে দিলেন-

 

“এই ঘরে হজ্জ পালন করার জন্যে মানুষকে সাধারনভাবে অনুমতি দিয়ে দাও। মানুষ বহু দূর দুরান্ত থেকে পায়ে হেঁটে উটে চড়ে তোমার কাছে আসবে। ---এই প্রাচীনতম ঘরের তাওয়াফ করবে।” (সূরা আল হাজ্জ আয়াত ২৭-২৯)

 

এভাবে মহান আল্লাহ্‌ ইব্রাহিম (আঃ) এর কীর্তিসমূহকে চির স্মরণীয় করে রাখলেন। তাঁর নির্মাণ করা ঘরকে কেন্দ্র করে হজ্জ, তাওয়াফ ও কুরবানীর নিয়ম চিরস্থায়ী করে দিলেন। এই মহান ঘর ও ঘরের কাছে রেখে যাওয়া নিজ পরিবারের জন্যে তিনি আল্লাহর কাছে দোয়া করেছিলেন-

 

“প্রভু, এই শহরকে শান্তি ও নিরাপত্তার শহর বানাও। আমার প্রভু, আমার সন্তানদের একটি অংশকে তোমার এই মহাসম্মানিত ঘরের কাছে এনে পুনর্বাসিত করেছি। এটাতো পানি ও তরুলতাশুন্য এক মরু প্রান্তর। প্রভু, ওদের এখানে রেখেছি যেন, এরা সালাত কায়েম করে। সুতরাং তুমি ওদের প্রতি মানুষের মনকে অনুরক্ত বানিয়ে দাও। শোকর সেই মহান আল্লাহর, যিনি এই বৃদ্ধ বয়সে আমাকে দুটি সন্তান ইসমাঈল ও ইসহাককে দান করেছেন। প্রভু, আমাকে এবং আমার সন্তানদেরকে সালাত কায়েমকারী বানাও।” (সূরা ১৪ ইব্রাহিমঃ আয়াত ৩৫-৪০)

 

কুরআনে হজরত ইবরাহীমের প্রশংসনীয় গুনাবলী

 

মহান আল্লাহ্‌ তাঁর কিতাব আল কুরআনে ইব্রাহিম (আঃ) এর গুনবৈশিষ্টের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। এখানে আমরা কয়েকটি উল্লেখ করলাম-

 

১। “পৃথিবীর কাজের জন্যে আমি ইব্রাহীমকে বাছাই করেছিলাম।”

 

২। “তাঁর প্রভু যখন বললেন- ‘আত্মসমর্পণ করো’। সে বললো- ‘সারা জাহানের প্রভুর নিকট আমি আত্মসমর্পণ করলাম।’’

 

৩। “সে বললো- পুত্র আমার, মৃত্যু পর্যন্ত আলালহর কাছে আত্মসমর্পিত থাকো।”

 

৪। “তোমরা খাটিভাবে ইবরাহীমের পথ অনুসরন করো।”

 

৫। “আল্লাহ্‌ ইব্রাহীমকে তাঁর বন্ধু বানিয়েছেন।”

 

৬। “আমি ইব্রাহীমকে আসমান ও যমীনের সমস্ত নিদর্শন দেখিয়েছি।”

 

৭। “সে বললো- আমি আসমান ও যমীনের স্রষ্টার দিকে মুখ ফিরালাম।”

 

৮। “ইব্রাহিম ছিলো বড়ই ধৈর্যশীল কোমল হৃদয় ও আমার প্রতি অনুরক্ত।”

 

৯। “ইব্রাহিম নিজেই ছিলো একটি উম্মাহ। সে একমুখী হয়ে আল্লাহর অনুগত ছিল।”

 

১০। “আল্লাহর অনুগ্রহরাজির প্রতি সে ছিলো শোকরগুজার। তিনি তাঁকে পছন্দ করেছেন এবং সঠিক পথে পরিচালিত করেছেন।”

 

১১। “ইব্রাহিম ছিলো এক অতি সত্যবাদী মানুষ এবং নবী। ”

 

১২। “ইব্রাহীমকে আমি সতর্কবুদ্ধি ও জ্ঞান দান করেছি।”

 

১৩।“আমি বললাম- হে আগুন, তুমি ইবরাহীমের প্রতি সুশীতল, শান্তিময় ও নিরাপদ হয়ে যাও।”

 

১৪। “আমি ডেকে বললাম- হে ইব্রাহিম, তুমি স্বপ্নে দেখা হুকুমকে সত্যে পরিনত করেছো।”

 

১৫। “তোমাদের জন্যে উত্তম আদর্শ রয়েছে ইবরাহীমের মধ্যে-----।”

 

জেনে নিন

 

এবার কয়েকটি তথ্য জেনে নিন। সেগুলো হলো- কুরআন মাজীদে ইবরাহীমের নাম উচ্চারিত হয়েছে ৬৯ বার। যেসব সুরাতে ইব্রাহিম (আঃ) সম্পর্কে আলোচনা হয়েছে- সূরা আল বাকারা, আন নিসা, আন-আম, তাওবা, হুদ, ইব্রাহিম, হিজর, আন নাহল, মরিয়ম, আম্বিয়া, আল হাজ্জ, শোয়ারা, আন কাবুত, সাফফাত, যুখরুফ, যারিয়াত, মুমতাহিনা।

 

৭।

 

জর্ডান অঞ্চলের নবী লুত

 

(আঃ)

 

হজরত লুতের পরিচয়

 

হজরত লুত (আঃ) আল্লাহর এক সম্মানিত নবী। তিনি সেই সব নবীদের একজন, যাদের জাতি ঈমান আনেনি। হজরত লুতের জাতি যে কেবল ঈমান আনেনি, তা নয়, বরং তাঁর জাতির লোকেরা ছিলো সেকালের সবচেয়ে পাপিষ্ঠ লোক। হজরত লুত (আঃ) সেইসব নবীদেরও একজন, যাদের জাতিকে আল্লাহ্‌ ইসলামের বিরোধিতা করার কারনে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। হজরত নূহ, হজরত সালেহ ও হজরত হুদ (আঃ) এর জাতির মতোই লুত (আঃ) এর জাতিকেও আল্লাহ্‌ পাক ধ্বংস করে দিয়েছিলেন।

 

হজরত লুত (আঃ) ছিলেন মহান নবী হজরত ইব্রাহিম (আঃ) এর ভাতিজা। হজরত ইব্রাহিম (আঃ) যখন নিজ দেশ ইরাকে ইসলাম প্রচার করছিলেন, তখন সেখানে মাত্র দু’জন লোক ঈমান এনেছিলেন। এদের একজন ছিলেন হজরত ইব্রাহিম (আঃ) এর স্ত্রী সারাহ আর অন্নজন ছিলেন তাঁর ভাতিজা হজরত লুত (আঃ)। তিনি যখন ইরাক থেকে হিজরত করতে বাধ্য হন, তখন কেবল এ দু’জনই তাঁর হিজরতের সাথী হন।

 

হিজরত ও নবুয়্যত লাভ

 

রাজা নমরূদের অত্যাচারে যখন নিজ দেশে ইসলাম প্রচার করা অসম্ভব হয়ে পড়ে, তখন লুত চাচা ইব্রাহিম (আঃ) এর সাথে দেশ ত্যাগ করেন। চাচার সাথে দীন প্রচারের কাজে তিনি ফিলিস্তিন, সিরিয়া হয়ে আফ্রিকার মিশরে পাড়ি জমান। মহান নবী হজরত ইব্রাহীমের ইসলাম প্রচারের সাথী হিসেবে লুত অগাধ জ্ঞান ও প্রশিক্ষন লাভ করেন। ফলে আল্লাহ্‌ তায়ালা তাকেও নবুয়্যত দান করেন এবং জর্ডান এলাকায় একটি পাপিষ্ঠ জাতির কাছে ইসলাম প্রচারের গুরু দায়িত্বে নিযুক্ত করেন।

 

কোন সে জাতি?

 

কোন সে জাতি? যার কাছে ইসলাম প্রচারের দায়িত্ব অর্পিত হয় হজরত লুত (আঃ) এর উপর? কুরআনে এদেরকে ‘কওমে লুত বা লুতের জাতি’ বলা হয়েছে। এ জাতি যে অঞ্চলে বাস করতো, বর্তমানে সে অঞ্চলের নাম ট্রান্স জর্ডান। এ জায়গাটি ইরাক ও ফিলিস্তিনের মাঝামাঝি অবস্থিত। সেকালে এ জাতির প্রধান শহরের নাম ছিলো সাদুম। এছাড়াও তাঁদের আরো অনেকগুলো শহর ছিলো। চরম পাপাচারের কারনে আল্লাহ্‌ তায়ালা তাঁদেরকে ধ্বংস করে দেন। তাঁদের শহরগুলোকে তলিয়ে দেন। বর্তমানে যাকে লুত সাগর বা Dead Sea (মৃত সাগর) বলা হয়, তাঁদের শহরগুলো তলিয়ে এতেই মিশে গিয়েছিলো। লুত সাগরের পূর্ব-দক্ষিন অঞ্চলে আজো তাঁদের ধ্বংসাবশেষ বিদ্যমান আছে। হজরত ইব্রাহীম (আঃ) এর প্রতিনিধি হিসেবে এ এলাকাতেই হজরত লুত (আঃ) ইসলাম প্রচারের কাজে আত্মনিয়োগ করেন।

 

লুত জাতির পাপাচার

 

লুত (আঃ) এর জাতির মতো পাপিষ্ঠ জাতি খুব কমই ছিলো। তাঁদের চরিত্র এতো খারাপ ছিলো, যা ভাষায় প্রকাশ করা যায়না। তারা ছিলো সমকামী। তারা প্রকাশ্যে অশ্লীল কাজ এবং জনসমাবেশে কুকর্মে লিপ্ত হতো। ডাকাতি-রাহাজানি ছিলো, তাঁদের নিত্য দিনের কাজ।

 

তাঁদের এলাকায় কোন ভালো মানুষ এসে নিরাপদে ফিরে যেতে পারতোনা। কোনো ব্যাবসায়ী বণিক তাঁদের এলাকায় গেলে সব কিছু খুইয়ে আসতে হতো। তাঁদের মধ্যে সামান্যতম লজ্জা শরম পর্যন্ত ছিলোনা। তাঁদের মাঝে একজন সৎ লোকও ছিলোনা, যে পাপ কাজে বাধা দেবে। এমন একটি প্রানিও ছিলোনা, যে পাপকে ঘৃণা করতো। এমন একজন লোকও ছিলোনা, যে কোন অন্যায় কাজের প্রতিবাদ করতো।

 

হজরত লুতের আহবান

 

এই পাপিষ্ঠ লোকদের সত্য পথ দেখানোর জন্যেই মহান আল্লাহ্‌ হজরত লুত (আঃ) কে পাঠালেন। তিনি এসে তাঁদেরকে আল্লাহর দিকে ডাকলেন। মহান আল্লাহকে ভয় করতে বললেন, কুরআনের ভাষায়-

 

“লুতের জাতি রাসুলদেরকে অস্বীকার করেছিলো। লুত তাঁদের বলেছিল, তোমরা কি আল্লাহকে ভয় করবেনা? আমি তোমাদের জন্যে একজন বিশ্বস্ত রাসুল। সুতরাং তোমরা আল্লাহকে ভয় করো আর আমার কথা মেনে নাও।”

 

আল্লাহর পরম ধৈর্যশীল নবী তাঁদের আরো বললেন-

 

“তোমরা এমন পাপাচার করছো, যা তোমাদের আগে কোন জাতি করেনি। তোমরা একটি সীমালংঘনকারী জাতি।” (সূরা ৭ আল আরাফঃ আয়াত ৮০)

 

তিনি তাঁদের বলেছিলেন-

 

“কেন তোমরা নরদের সাথে নোংরা কাজ করো? কেন দাকাতি-রাহাজানি করো? আর জনসমাবেশে কুকাজে লিপ্ত হও।”

 

এভাবে লুত (আঃ) দীর্ঘদিন ধরে তাঁদের অনেক উপদেশ দিলেন, আল্লাহর পথে আসতে বললেন। পাপাচার থেকে বিরত হতে বললেন। কুকর্মের প্রতিবাদ করলেন। কিন্তু তাঁদের একটি লোকও উপদেশ গ্রহন করলোনা। বরং-------

 

হজরত লুতের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ

 

হ্যাঁ, ওরা হযরত লুতের উপদেশ তো গ্রহন করলোই না, সৎ পথে তো এলোই না, বরং হযরত লুতের সংশোধন কাজের বিরুদ্ধে গড়ে তুললো বিরাট প্রতিরোধ। কেউ তাঁদের ভালো হবার কথা বলুক এটা তারা সহ্য করতে পারতো না। পাপ কাজ ত্যাগ করার কথা তারা শুনতে পারতোনা। ফলে হযরত লুত (আঃ) এর বিরামহীন সংশোধন প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে তারা ক্ষেপে উঠলো। হযরত লুত যে তাঁদেরকে আল্লাহর আযাবের ভয় দেখিয়েছেন এর জবাবে তারা প্রথমে হযরত লুতকে বললো- আমরা তো তোমাকে আর তোমার খোদাকে প্রত্যাখ্যান করেছি। কই তোমার খোদার আযাব? তুমি যদি সত্যি খোদার নবী হতে তবে তো আল্লাহর আযাব এনে দেখাতে পারতে। তারা আল্লাহর নবী হযরত লুতকে শাসিয়ে বললো-

 

“লুত, যদি তুমি তোমার সংশোধন কাজ থেকে বিরত না হও, তবে তোমাকে অবশ্যই আমাদের দেশ থেকে বের করে দেব।” (সূরা ২৬ আশ-শোয়ারা, আয়াত ৬৭)

 

কিন্তু আল্লাহর কোন নবী তো আল্লাহর দ্বীন প্রচারের কাজে বিরত থাকতে পারেননা। মানুষকে সৎ পথে ডাকার ও সংশোধন করার কাজ থেকে বিরত হতে পারেননা। হযরত লুত তাঁর মিশন চালিয়ে যেতে থাকলেন। অবশেষে তারা আল্লাহর নবীর বিরুদ্ধে চরম সিদ্ধান্ত নিলো। নেতারা জনগণকে বললো –

 

“এই লুত আর তাঁর পরিবার পরিজনকে দেশ থেকে বের করে দাও। ওরা বড় পবিত্র লোক।”

 

এলো ধ্বংসের ফেরেস্তারা

 

আল্লাহর নবী হযরত লুত (আঃ) এর পুত পবিত্রতা নিয়ে ওরা যখন তিরস্কার করতে থাকলো, আর তাঁকে দেশ থেকে বের করে দেবার ষড়যন্ত্র পাকাপোক্ত করতে থাকলো, তখন সর্বশক্তিমান আল্লাহ্‌ ঐ জাতিটিকে পৃথিবীর বুক থেকে নির্মূল করার সিদ্ধান্ত নিলেন। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্যে ফেরেস্তা পাঠিয়ে দিলেন। ফেরেস্তারা প্রথমে হযরত ইব্রাহীমের কাছে এলো। তাঁর স্ত্রী সারাহর ঘরে তাঁর একটি পুত্র সন্তান হবার সুসংবাদ দিলো। বিদায় নেয়ার সময় ইব্রাহিম তাঁদের জিজ্ঞেস করলেন-

 

“হে দুতেরা, আপনারা কি কোন অভিযানে এসেছেন?

 

-হ্যাঁ, আমরা ঐ অঞ্চলকে (সাদুম) ধ্বংস করে দিতে এসেছি। আমাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে তাঁদেরকে পাথর মেরে ধংস করে দিতে। আপনার মহান প্রভু আল্লাহর পক্ষ থেকে পাথরে চিহ্ন লাগিয়ে দেয়া হয়েছে।

 

ইব্রাহিম বললেন- সেখানে তো লুত আছে, তাঁর কি উপায় হবে?

 

 ফেরেস্তারা বললেন- আমরা জানি সেখানে কারা আছে? লুত আর তাঁর পরিজনকে নিরাপদ রাখা হবে। অতপর ফেরেস্তারা সে এলাকায় চলে এলেন সুস্রী মানুষের বেশ ধরে। এসে হযরত লুতের ঘরে উঠলেন। লুত তাঁদের চিনতে পারেননি। বললেন- আপনাদের তো চিনতে পারছি না।

 

তারা বললো- আমরা আপনার কাছে এসেছি। এই লোকেরা যেই বিষয়ে সন্দেহ করছে আমরা সে বিষয়ে ফায়সালা করতে এসেছি। এতোক্ষনে হযরত লুতের বাড়িতে নতুন মেহমানদের আসার খবর পেয়ে গেছে শহরের সব মন্দ লোকেরা। বদমাশ লোকগুলো দৌড়ে এলো মেহমানদের সাথে খারাপ কাজ করার মতলবে। লুত তাঁদের বাধা দিলেন। আফসোস করে বললেন- তোমাদের মাঝে কি একজন ভালো মানুষও নেই?

 

ফেরেস্তারা হযরত লুতকে কানে কানে বলে দিলেন, আমরা আল্লাহর দূত ফেরেস্তা। এরা আমাদের কোনই ক্ষতি করতে পারবেনা। রাতের একটি অংশ পার হয়ে গেলে আপনি আপনার পরিবার- পরিজনকে নিয়ে এই এলাকা ত্যাগ করে চলে যাবেন। ওদের ধ্বংসের নির্ধারিত সময়টি হলো ভোর। ভোর তো ঘনিয়ে এলো। তারপর ক হলো? তারপর ভোর হয়ে এলো। ভোর হবার আগেই আল্লাহর নির্দেশে হযরত লুত এলাকা ছেড়ে চলে গেলেন। এদিকে ফেরেস্তারা গোটা এলাকার জমিনকে সম্পূর্ণ ওলট-পালট করে দিলেন। অবিরাম পাথর নিক্ষেপ করে সব কিছু ধ্বংস করে দিলেন। তাঁদের একটি লোককেও বাঁচিয়ে রাখা হলোনা। বিরান করে দেয়া হলো সবকিছু। সম্পূর্ণ বিনাশ হয়ে গেলো পাপিষ্ঠ জাতি। মহান আল্লাহ্‌ বলেন-

 

“আমি তাঁদের প্রচন্ড বর্ষণের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিলাম। সতর্ক করার পরও যারা সংশোধন হয়না, তাঁদের উপর এমন নিকৃষ্ট বর্ষণই করা হয়ে থাকে।”

 

নবীর দুর্ভাগা স্ত্রী

 

যারা ধ্বংস হয়েছে, তাঁদের সাথে হযরত লুত (আঃ) এর স্ত্রীও রয়েছেন। ইনি নবীর স্ত্রী হয়েও কুফরির পক্ষ ত্যাগ করেননি। নবীকে তাঁর দায়িত্ব পালনে সহযোগিতা করেননি। ফলে আল্লাহ্‌ তায়ালা কাফিরদের সাথে তাকেও ধ্বংস করে দেন। হযরত লুত যখন রাতে ঐ এলাকা ত্যাগ করেন, তখন তাঁর এই স্ত্রী তাঁর সাথে যাননি। কাফিরদের সাথে থেকে যান এবং আল্লাহর গযবে নিপতিত হয়ে ধ্বংস হয়ে যান। আল্লাহ্‌ বলেন-

 

“আমি লুত আর তাঁর পরিবার-পরিজনকে সেই ধ্বংস থেকে বাঁচালাম। তবে তাঁর বৃদ্ধা (স্ত্রী) কাফিরদের সাথে রয়ে গেলো। আর আমি তাঁদের সম্পূর্ণ ধংস করে দিলাম। ”

 

আল কুরআনের অন্য এক স্থানে মহান আল্লাহ্‌ বলেন-

 

“আল্লাহ্‌ কাফিরদের উপমা বানিয়েছেন নূহ আর লুতের স্ত্রীকে। তারা দু’জন আমার দুই নেক বান্দার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ ছিলো। কিন্তু তারা তাঁদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে। স্বামী নবী হয়েও আল্লাহর আযাব থেকে তাঁদের বাচাবার ব্যাপারে উপকারে আসলো না। তাঁদের নির্দেশ দেয়া হলো- দোযখীদের সাথে প্রবেশ করো দোযখে।” (সূরা ৬৬ আত তাহরিম। আয়াত ১০)

 

লুত জাতি কেন ধ্বংস হলো?

 

হযরত লুত (আঃ) এর জাতিকে আল্লাহ্‌ পাক কেন সমূলে ধংস করলেন? কারন, তারা-

 

১। আল্লাহর নবীকে অস্বীকার করেছিলো।

 

২। চরম অস্লীলতা ও নির্লজ্জতার মাঝে নিমজ্জিত হয়েছিলো।

 

৩। নিকৃষ্ট ধরনের পাপ কাজে (সমকামিতায়) ডুবে গিয়েছিল।

 

৪। ডাকাতি, রাহাজানি ও লুণ্ঠনের রাজত্ব গড়ে তুলেছিল।

 

৫। চরম কৃপণতা ও নিষ্ঠুরতা তাঁদের স্বভাবে পরিনত হয়েছিল।

 

৬। পুত পবিত্র জীবন যাপনকে তারা বিদ্রূপ ও ব্যাঙ্গ করতো।

 

৭। তারা নবীকে দেশ থেকে বের করে দেবার ষড়যন্ত্র করেছিলো।

 

৮। নবীকে বিদ্রূপ করে আল্লাহর আযাব আসার দাবী করেছিলো।

 

কুরআনে লুত (আঃ)

 

আল্লাহ্‌ তায়ালা আল কুরআনে ঘোষণা দিয়েছেন- “আমি ইসমাঈল, ইউশা, ইউনুস এবং লুতকে গোটা জগতবাসীর উপর মর্যাদা দান করেছি।’ সত্যিই মহান আল্লাহ্‌ তাঁর এই নবীকে বিরাট মর্যাদা দিয়েছেন। কুরআন মাজীদে লুত নামটি ২৭ বার উচ্চারিত হয়েছে। যেসব সুরায় উল্লেখ হয়েছে, সেগুলো বলে দিচ্ছি- আনআম-৮৬, আ’রাফ-৮০, হুদ-৭০,৭৪,৭৭,৮১, হিজর- ৫৯,৬১, আম্বিয়া- ৭১,৭৪, হাজ্জ-৪৩, শোয়ারা- ১৬০,১৬১,১৬৭, আন নামল-৫৪,৫৬, আনকাবুত- ২৬,২৭,৩২,৩, সাফফাত- ১৩৩, সয়াদ-১৩, কাফ-১৩, আল কামার- ৩৩,৩৪, আত তাহরিম-১০।

 

৮।

 

কুরবানীর নবী ইসমাঈল

 

(আঃ)

 

“এ কিতাবে ইসমাঈলকেও স্মরণ করো। সে ছিলো প্রতিশ্রুতি পালনকারী। ছিল একজন রাসূল ও নবী। সে তাঁর লোকজনকে সালাত ও যাকাতের নির্দেশ দিতো। আর সে ছিলো তাঁর প্রভুর অবারিত সন্তোষ প্রাপ্ত।” – (আল কুরআন ১৯- ৫৪,৫৫)

 

কে এই ইসমাঈল?

 

আল্লাহর অবারিত সন্তোষ প্রাপ্ত এই মানুষটি কে? কী তাঁর পরিচয়? কেনইবা আল্লাহ্‌ তাঁর উপর নিজ সন্তোষের দুয়ার খুলে দিয়েছেন? হ্যাঁ, আসুন আমরা তাঁকে জানি, খুজে দেখি আল্লাহর কিতাবে তাঁর কি পরিচয় দেয়া হয়েছে?

 

ইনি হলেন বিশ্বনেতা আল্লাহর নবী ইব্রাহিম (আঃ) এর পুত্র। তাঁর মায়ের নাম হাজেরা। ফিলিস্তিনে জন্মগ্রহন করেন। পরে মক্কায় মায়ের কোলে লালিত- পালিত হন। একটু বড় হলে আল্লাহ্‌ তাঁর পিতাকে নির্দেশ দেন তাঁকে কুরবানী করবার জন্যে। পিতার মতই তিনি আল্লাহর হুকুমের কাছে মাথা নত করে দেন।

 

এরপর তিনি পিতা ইব্রাহিম (আঃ) এর সাথে কা’বা ঘর নির্মাণ করেন। আল্লাহ্‌ তাঁকে নবয়্যত দান করেন। তিনি আরবের হিজাযে সালাত এবং যাকাত ভিত্তিক একটি সুন্দর সমাজ নির্মাণ করেন। ইনিই হলেন মহান আল্লাহর অবারিত সন্তোষ লাভকারী নবী হজরত ইসমাঈল (আঃ)।

 

মায়ের সাথে মক্কায় এলেন

 

ইব্রাহিম (আঃ) এর ছিলেন দু’জন স্ত্রী। বড়জন সারাহ আর ছোটজন হাজেরা। সারাহ বুড়ি হয়ে গেছেন, এখনো তাঁর কোন ছেলেমেয়ে হয়নি। কিন্তু আল্লাহ্‌ হাজেরাকে চাঁদের মতো ফুটফুটে একটি ছেলে দান করেন। বুড়ো বয়েসে ছেলে পেয়ে ইব্রাহীমের যে কি আনন্দ তা কি আর ভাষায় প্রকাশ করা যায়? তিনি ছেলের নাম রাখেন ইসমাঈল।

 

কিন্তু আল্লাহ্‌ ইব্রাহীমকে নিজের বন্ধু বানাবার জন্যে কতো যে পরীক্ষা করেছেন, তাঁর ইয়ত্তা নেই। শিশুপুত্রের ব্যাপারে তাঁকে পরীক্ষায় ফেললেন। বললেন- শিশু ইসমাঈল ও তাঁর মাকে মক্কার মরু প্রান্তরে রেখে এসো। ইব্রাহীমের কাছে আল্লাহর হুকুম শিরোধার্য। তিনি তাঁদের নিয়ে ফিলিস্তিন থেকে রওয়ানা করলেন মক্কার দিকে। সহীহ বুখারীতে এ ঘটনার বিবরন দিয়ে বড় একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে-

 

ইব্রাহিম হাজেরা ও শিশুপুত্র ইসমাঈলকে সাথে নিয়ে রওয়ানা করেন। পথে হজেরা শিশুকে দুধ পান করাতেন। অবশেষে একদিন তিনি তাদের নিয়ে মক্কায় এসে উপস্থিত হলেন। এখন যেখানে কা’বা ঘর ও যমযমের কূপ এখানেই একটি গাছের নিচে তাঁদের রাখেন। তখন মক্কায় কোন মানুষ ছিলোনা। পানিও ছিলো না। ইব্রাহিম তাঁদের এক থলে খেজুর আর এক মশক পানি দিয়ে ফিরে চললেন ফিলিস্তিনের দিকে। হাজেরা তাঁর পিছে পিছে দৌড়ে এলেন। বললেন- আপনি কি আল্লাহর হুকুমে আমাদের এখানে রেখে যাচ্ছেন? ইব্রাহিম জবাব দিলেন- হ্যাঁ। একথা শুনে হাজেরা বললেন- ‘ঠিক আছে, তাহলে নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ আমাদের ধ্বংস করবেননা।’ একথা বলে তিনি ফিরে এলেন যথাস্থানে। এদিকে ইব্রাহিম যে প্রিয়তম পুত্র স্ত্রীকে রেখে ফিরে চলেছেন, তাঁর বুক তো ফেটে যাচ্ছিলো। তাঁর হৃদয়ের কান্না তখন আল্লাহ্‌ ছাড়া আর কেউ দেখেননি। কিন্তু এ যে আল্লাহর হুকুম। আর তাঁর হুকুম পালন করাতো অপরিহার্য। আল্লাহর হুকুমে ইব্রাহিম এতো বড় বিরহের কাজও করতে পারেন। বুকের মধ্যে মনকে চেপে ধরে নীরবে তিনি ফিরে চলেছেন। পিছনে ফিরে তাকাননি। তাকালে ওদের চেহারা তাঁকে আল্লাহর নির্দেশ পালনে বাধা দিতে পারে। তাঁর হৃদয় যেন সমুদ্রের মতো উদার আর হিমালয়ের মতো অবিচল। সামনে অগ্রসর হয়ে চলেছেন তিনি। কিছুদূর এসে একটি টিলার উপরে উঠে ফিরে দাঁড়ালেন। এখান থেকে আর ওদের দেখা যায়না। এখানে দাঁড়িয়ে ইব্রাহিম দয়াময় প্রভু মহান আল্লাহর দরবারে দুহাত তুলে অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে দোয়া করলেন-

 

“আমার প্রভু, এই দানা-পানিহীন মরুভূমিতে তোমারই সম্মানিত ঘরের পাশে আমার সন্তানের বসতি স্থাপন করে গেলাম। প্রভু, ওদের এখানে রেখে গেলাম যাতে ওরা সালাত কায়েম করে। তাই তুমি মানুষের মনকে ওদের প্রতি আকৃষ্ট করে দিও আর ফলফলারি দ্বারা ওদের জীবিকার ব্যবস্থা করে দিও, যেন ওরা তোমার শুকোরগুজার হয়ে থাকে।” (সূরা ইব্রাহিম, আয়াত ৩৭)

 

অতঃপর আল্লাহর ইচ্ছার উপর মনকে অটল রেখে ধীরে ধীরে ইব্রাহিম চলে এলেন ফিলিস্তিনের দিকে। এ দিকে হাজেরা থলের খেজুর আর মশকের পানি খেয়ে দিন কাটাতে থাকেন। শিশু ইসমাঈল মায়ের বুকের দুধ পান করেন। কিন্তু অচিরেই মশকের পানি শেষ হয়ে গেলো। পিপাসায় তাঁর ছাতি ফেটে যায়। বুকে দুধ আসেনা। বাচ্চাও ক্ষুদায় পিপাসায় ধড়পড় করছে। মৃত্যু যেন হাতছানি দিয়ে তাঁদের ডাকছে। চোখের সামনে অনাহারে শিশুপুত্রের করুন মৃত্যু কোন মা কি সহ্য করতে পারে? পুত্রকে বাঁচানোর জন্যে তিনি পানির খোজে দৌড়ালেন। সামনেই একটি পাহাড়। এই পাহাড়ের নাম সাফা পাহাড়। তিনি দৌড়ে সাফা পাহাড়ের উপরে উঠে গেলেন। চারিদিকে তাকিয়ে দেখলেন কোন মানুষ দেখতে পান কিনা? উদ্দেশ্য হলো মানুষ দেখতে পেলে কিছু পানি চেয়ে নেবেন। কিন্তু না কোথাও কোন মানুষ দেখা যায়না।

 

এবার দ্রুত পাহাড় থেকে নেমে পড়লেন। সামনে মাঠের ওপাশেই আর একটি পাহাড়। এর নাম মারওয়া পাহাড়। হাজেরা দৌড়ে এসে মারওয়া পাহাড়ের উপরে উঠলেন। দুই পাহাড়ের মাঝে সাত চক্কর দৌড়াদৌড়ী করলেন। চারদিকে তাকিয়ে দেখলেন, কোন মানুষের সন্ধান পেলেন না। ছেলে মৃত প্রায় আর নিজের জীবন ওষ্ঠাগত। হাজেরা চোখের সামনে বাচার আর কোন উপায় দেখেন না। এখন তিনি সম্পূর্ণ অসহায়।

 

আল্লাহর উপহার যমযমের কূপ

 

কিন্তু আল্লাহ্‌ যে অসহায়ের সহায়, হাজেরা হঠাৎ একটি আওয়াজ শুনলেন। আশার আলো নিয়ে সেদিকে কান খাড়া করলেন। বললেন- তুমি যেই হওনা কেন, সম্ভব হলে আমাকে সাহায্য করো। হঠাৎ তিনি একজন ফেরেস্তাকে দেখতে পেলেন। এখন যেখানে যমযমের কুপ, ফেরেস্তা সেখানে দাঁড়িয়ে মাটির উপরে পায়ের গোড়ালি দিয়ে একটি আঘাত করলেন। সাথে সাথে মাটির নিচ থেকে উপচে উঠতে লাগলো পানি। হাজেরা দৌড়ে এসে চারপাশে বাধ দিলেন। অঞ্জলি ভরে পানি পান করলেন। মশকে পানি ভরে নিলেন। বুকে দুধ এলো। ইসমাঈলকে প্রান ভরে দুধ পান করালেন। এর নামই যমযম কূপ। সুপেয় অনাবিল পানির অবিরাম ধারা। ফেরেস্তা বলে গেলেন আপনার ভয়ের কোন কারন নেই। এখানেই আল্লাহর ঘর রয়েছে। আপনার পুত্র বড় হয়ে তাঁর পিতার সাথে আল্লাহর ঘর পুনর্নির্মাণ করবে। আপনারা নিরাপদ।

 

ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠেন

 

আল্লাহর অসীম সাহায্য পেয়ে হাজেরা আল্লাহর শোকর আদায় করলেন। দিন যায় রাত আসে। ইসমাঈল ধীরে ধীরে বড় হয়ে ওঠেন। এদিকে পানির সন্ধান পেয়ে মক্কার আকাশে পাখি এলো। পানির সন্ধান পেয়ে ইয়েমেন দেশের জুরহুম গোত্রের একদল লোক মক্কায় বসবাস করার জন্যে হাজেরার অনুমতি চাইলো। তিনি তাঁদের অনুমতি দিলেন। ফলে মক্কায় জনবসতি গড়ে উঠলো। পানির ছোঁয়াচ পেয়ে মরুভূমিতে ফল ফলারি উৎপন্ন হতে থাকলো। আল্লাহ্‌ ইসমাঈল ও তাঁর মায়ের সব অসুবিধা দূর করে দিলেন। এখানে যে জনবসতি গড়ে উঠেছে তাঁর কৃতৃত্ব কিন্তু ইসমাঈলের মায়ের হাতেই থাকলো। ইব্রাহিম (আঃ) প্রায়ই প্রানপ্রিয় পুত্র ইসমাঈল ও স্ত্রী হাজেরাকে দেখার জন্যে মক্কায় আসেন। ইসমাঈলের হাঁটাহাঁটি দৌড়াদৌড়ি দেখে ইব্রাহীমের মন ভরে যায়। ফুটফুটে টুকটুকে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি আনন্দে আল্লাহর শোকর আদায় করেন। যখন আসে পাশের মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকার জন্যে বের হন, ইসমাঈলকে সাথে নিয়ে যান। এভাবে কিছু দিন মক্কায় থেকে আবার চলে যান ফিলিস্তিনে। আবার ফিরে আসেন মক্কায়। ইসমাঈল দিন দিন বেড়ে ওঠেন। পিতা তাঁকে মনের মতো সুন্দর করে গড়ে তোলেন। যেমন বাপ, তেমনি আল্লাহর অনুগত হয়ে গড়ে উঠে ইসমাঈল। ফলে পিতার মহব্বত বেড়ে যায় পুত্রের প্রতি। আল্লাহর প্রতি তাঁদের পিতা পুত্রের ভালোবাসাকে আল্লাহ্‌ পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেন।

 

যবাই হবার হুকুম পেলেন

 

ইব্রাহিম একদিন স্বপ্ন দেখেন তিনি তাঁর প্রাণপ্রিয় পুত্রের গলায় ছুরি চালাচ্ছেন। নবীদের স্বপ্নও একপ্রকার অহী বা আল্লাহর আদেশ। আল্লাহর হুকুম শিরোধার্য। কিন্তু ইসমাঈল কি এ হুকুম মেনে নেবে? আসলে আল্লাহ্‌ তো সে পরীক্ষাই নিতে চান। আল্লাহতো দেখতে চান ইসমাঈল আল্লাহর হুকুমের সামনে মাথা পেতে দেয় কিনা? নিজের জীবনের চাইতেও আল্লাহর হুকুম পালন করাকে বড় কর্তব্য মনে করে কিনা? আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে সে নিজের জীবনকে কুরবানী করতে প্রস্তুত আছে কিনা?

 

কিন্তু ইসমাঈলতো তাঁর পিতার মতই আল্লাহর অনুগত। আল্লাহর সন্তুষ্টির চাইতে বড় কোন কাম্য তাঁর নেই। পিতা ইব্রাহিম আল্লাহর পক্ষ থেকে কুরবানী করার হুকুম জানিয়ে দেয়ার সাথে সাথে আল্লাহর অতি সম্মানিত দাস ইসমাঈল বলে উঠেন –

 

“আব্বা, আপনি আল্লাহর নির্দেশ পালন করুন। ইনশা’য়াল্লাহ আপনি আমাকে অটল অবিচল ও দ্রঢ় মনোবলের অধিকারী পাবেন।” (সূরা ৩৭ আসসাফফাত, আয়াত ১০২)

 

তারপর যখন পিতা পুত্র দুইজনই আল্লাহর হুকুমের সামনে মাথা নত করে দিলেন এবং ইব্রাহিম পুত্রকে উপুড় করে শুইয়ে দিয়ে ছুরি চালাতে উদ্যত হলেন, তখন নিজের দুই ‘প্রভু পাগল’ দাসের জন্যে আল্লাহর মহব্বতের দরিয়া উথলে উঠলো। সাথে সাথে তিনি ডাক দিয়ে বললেন-

 

‘ইব্রাহিম, থামো। স্বপ্নকে তুমি সত্য প্রমান করে দেখিয়েছ।” (সূরা ৩৭ আসসাফফাত, আয়াত ১০৫)

 

ব্যাস, বাপ বেটা দুইজনই আল্লাহর পরীক্ষায় পাশ করলেন। আর আল্লাহর পরীক্ষায় পাশ করার চাইতে বড় বিজয় কি হতে পারে? আল্লাহর ফেরেস্তারা ইব্রাহীমের সামনে একটি দুম্বা এনে রেখে দিলেন এবং সেটিকে কুরাবানী করে দিতে বললেন। ইব্রাহিম কৃতজ্ঞ মনে পুত্রের পরিবর্তে দুম্বাটি যবাই করে দিলেন। মহান আল্লাহ্‌ বলেন-

 

“আমরা একটি মহান কুরবানীর বিনিময়ে ইসমাঈলকে ছাড়িয়ে নিলাম।” (সূরা ৩৭ আসসাফফাত, আয়াত ১০৭)

 

সত্যি এটা ছিলো একটা বিরাট কুরবানী। আল্লাহর হুকুম মতো পিতা পুত্রকে কুরবানী করতে রাজি হয়ে যান। আবার পুত্রও আল্লাহর হুকুমে যবাই হবার জন্যে ছুরির নিচে গলা পেতে দেন। তাইতো এটা একটা বিরাট কুরবানী, বিরাট আত্মত্যাগ। সে জন্যই আল্লাহ্‌ তায়ালা এই বিরাট কুরবনীকে চিরদিন স্মরণীয় করে রাখার জন্যে সেই তারিখে যেনো মুমিনেরা আল্লাহর হুকুমে নিজেদের আত্মত্যাগের প্রমান স্বরূপ পশু কুরবানী করে, এ নিয়ম চালু রেখেছেন। বিগত প্রায় চার হাজার বছর থেকে মানুষ ইসমাঈল ও তাঁর পিতার সেই বিরাট কুরবানীকে স্মরণ করে। প্রতি বছর ঐ তারিখে মুসলিমরা আল্লাহর উদ্দেশে পশু কুরবানী করে। যারা মক্কায় হজ্জ পালন করতে যায়, ঐ তারিখে সেখানে কুরবানী করা তাঁদের জন্যে অবশ্য করনীয় কাজ। যারা আল্লাহর হুকুমের সামনে বিনীত হয়ে মাথা নত করে দেন, আল্লাহ্‌ তাঁদের এভাবেই পুরস্কৃত করেন। পরীক্ষায় পাশের পর আল্লাহ্‌ ইসমাঈলকে নবুয়্যত দান করেন।

 

এর আগে ইসমাঈলের মা পানির সন্ধানে সাফা ও মারওয়া পাহাড়ে সাতবার দৌড়াদৌড়ি করলেন মহান আল্লাহ্‌ সেই ঘটনাটিকেও চির স্মরণীয় করে রাখলেন। যারাই মক্কায় হজ্জ করতে যাবে, তাঁদের জন্যে সাফা ও মারওয়া পাহাড়ে সাতবার দৌড়াদৌড়ি করার নিয়ম আল্লাহ্‌ চালু করে দিলেন। মা হাজেরার সেই কষ্টকে আল্লাহ্‌ স্মরণীয় করে রাখলেন কেন?

 

কারন তিনি যে আল্লাহর ইচ্ছায় মক্কার জনমানবহীন মরুভূমিতে বসবাস করতে রাজি হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর স্বামী ইব্রাহিম যখন বললেন, আল্লাহর ইচ্ছায় তাঁকে এই মরুভূমিতে রেখে যাচ্ছেন, তখন তিনি একমাত্র আল্লাহর উপরে ভরসা করে সেখানে থেকে গেলেন। তাঁর এই যে বিরাট আল্লাহ্‌নির্ভরতা, এরি বিনিময়ে আল্লাহ্‌ পাক তাঁকে চির স্মরণীয় ও সম্মানিত করে রাখলেন।

 

বিয়ে করলেন পিতা হলেন

 

দিন যায় রাত আসে। বছর ঘুরে আসে নতুন বছর। ইসমাঈল বড় হয়ে উঠেন। পাশেই বসবাস করছে জুরহুম গোত্রের লোকেরা। ইসমাঈল তাঁর সুন্দর ও চমৎকার মানবীয় গুনাবলীর জন্যে তাঁদের খুব প্রিয় হয়ে উঠেন। ইসমাঈল যৌবনপ্রাপ্ত হলে তারা তাঁদের এক মেয়েকে ইসমাঈলের কাছে বিয়ে দেয়। বিয়ের কিছুকাল পরেই তাঁর মা হাজেরা ইহলোক ত্যাগ করেন। আল্লাহ্‌ পাক ইসমাঈলের মাকে নিজ রহমতের ছায়াতলে স্থান দিন। এরই মাঝে ইব্রাহিম এলেন প্রিয় পুত্র ও স্ত্রীকে দেখার জন্যে। ইসমাঈল এসময় মক্কার বাইরে ছিলেন। ইব্রাহিম এসে পুত্রকে বাড়িতে পেলেননা। স্ত্রী হাজেরাও মৃত। ঘরে শুধু পুত্রবধু। কিন্তু পুত্রবধু একজন সত্যিকার মুমিন মহিলার মতো আচরন করেননি। একজন নবীর স্ত্রী আর একজন নবীর পুত্র বধু হিসেবে তো তাঁর আদর্শ মুসলিম মহিলা হওয়া উচিত ছিলো। ফলে পিতার নির্দেশে ইসমাঈল এ মহিলাকে তালাক দেন এবং আরেকজন সত্যিকার মুমিন মহিলাকে বিয়ে করেন। এ ঘরে তাঁর কয়েকটি ছেলেমেয়ে জন্ম হয়। তাঁরাও আদর্শ মুসলিম হিসেবে গড়ে উঠেন।

 

কা’বা নির্মাণে অংশ নিলেন

 

একদিন পিতা ইব্রাহিম ইসমাঈলকে ডেকে বললেন- ‘আল্লাহ্‌ আমাকে একটি কাজের হুকুম দিয়েছেন। তুমি কি আমাকে সে কাজে সাহায্য করবে? ইসমাঈল বললেন- হ্যাঁ, নিশ্চয়ই করবো।’ ইব্রাহিম সাম্নের উঁচু টিলাটি দেখিয়ে বললেন- ‘মহান আল্লাহ্‌ আমাকে এখানে একটি ঘর বানাবার নির্দেশ দিয়েছেন।’

 

অতঃপর বার বেটা দু’জন মিলে আল্লাহর ঘর কা’বা ঘর নির্মাণ কাজ শুরু করলেন। ইসমাঈল পাথর যোগান দেন আর ইব্রাহিম গাঁথুনি গেঁথে দেয়াল নির্মাণ করেন, ছাদ নির্মাণ করেন। গাঁথুনি যখন উপরে উঠছিলো, তখন ইসমাঈল একটি বড় পাথর এনে দিলেন। ইব্রাহিম সে পাথরের উপরে দাঁড়িয়ে নির্মাণ কাজ সমাপ্ত করেন। আজও সে পাথরটি কা’বা ঘরের সামনে বিদ্যমান আছে। আপনি যখন হজ্জ বা উমরা করতে যাবেন সে পাথরটি দেখতে পাবেন। ওখানে দু’রাকাত নামাজ পড়তে হয়। সে পাথরটির নাম মাকামে ইব্রাহিম। বাপ ছেলে মিলে যখন বাইতুল্লাহ (আল্লাহর ঘর) নির্মাণ শেষ করলেন, তখন দু’জনে প্রভু দয়াময় মহান আল্লাহর দরবারে দোয়া করলেন, তিনি যেন তাঁদের এই খিদমত কবুল করে নেন। মহান আল্লাহ্‌ তাঁদের এই বিরাট খিদমত কবুল করে নেন। তাঁদের নির্মাণ করা ঐ ঘরকে চিরদিনের জন্যে হজ্জ ও তাওয়াফের কেন্দ্রে পরিনত করে দেন। সারা পৃথিবী থেকে মানুষ আল্লাহর এই ঘরকে তাওয়াফ করার জন্য মক্কায় ছুটে যায়। আপনি সেই ঘরের তাওয়াফ করার নিয়ত করে রাখুন। হয়তো আল্লাহ্‌ একদিন সুযোগ করে দিবেন। অতঃপর ঐ ঘরকে কেন্দ্র করে মক্কা একটি স্থায়ী শহরে পরিনত হয়। সারা পৃথিবী থেকে আল্লাহ্‌ ভক্ত লোকেরা ছুটে আসে সেখানে। আল্লাহর ঘর ধরে তারা রোনাজারি করে।

 

সালাত ও যাকাত ভিত্তিক সমাজ গড়লেন

 

ইসমাঈলের পিতা ইব্রাহিম (আঃ) মহান আল্লাহ্‌ তায়ালার দরবারে দোয়া করেছিলেন- ‘আমাকে নেক্কার সন্তান দান করো।’ সত্যিই আল্লাহ্‌ তাঁকে নেক পুত্র দান করেন। ইব্রাহিম আরো দোয়া করেছিলেন- ‘প্রভু, আমাকে সালাত কায়েমকারী বানাও, আমার সন্তানদেরকেও।’

 

ইসমাঈলকে আল্লাহ্‌ তায়ালা শুধু নেক্কারই বানাননি, শুধু সালাত কায়েমকারীই বানাননি, সেই সাথে একজন আদর্শ নবীও বানিয়েছিলেন। তাইতো মহান আল্লাহ্‌ বলেন-

 

“ইসমাঈল, আলয়াসা, ইউনুস, লুত এদের প্রত্যেককেই আমি বিশ্ববাসীর উপর মর্যাদা দান করেছি।” (সূরা আল আনাম, আয়াত ৮৬)

 

ইসমাঈল মক্কা ও হিজাযের লোকদেরকে আল্লাহর পথে ডাকেন। তাঁদের তিনি আল্লাহকে জানার, বুঝার ও আল্লাহর পথে চলার তা’লিম দেন। তিনি তাঁদের সালাত কায়েম করার নির্দেশ দেন। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যাকাত ভিত্তিক সমাজ গড়ার শিক্ষা দেন। সালাত ও যাকাত ভিত্তিক একটি আদর্শ সমাজ গড়ার কাজ করতে গিয়ে তাঁকে অনেক বিপদ মুসিবত ও বাধার সম্মুখীন হতে হয়। তিনি সবার সাথে এসব কিছুর মোকাবেলা করেন। তাইতো আল্লাহ্‌ তাঁর প্রশংসা করে বলেন-

 

“ইসমাঈল, ইদ্রীস, যুলকিফল এরা সবাই ছিল সবর অবলম্বনকারী। আমি তাঁদেরকে আমার রহমতের ছায়াতলে স্থান দিয়েছি। তারা ছিলো যোগ্য লোক এবং সততার প্রতীক।” (সূরা ২১ আল আম্বিয়া, আয়াত ৮৫)

 

ইসমাঈল (আঃ) তাঁর লোকদেরকে নিয়ে কা’বা কেন্দ্রিক একটি আদর্শ ইসলামী সমাজ গড়েন। জানা যায়, তাঁর বারোজন পুত্র ছিলো এবং তারা সকলেই ছিলেন ইসলামী সমাজের কাণ্ডারি।

 

তাঁরই বংশে জন্ম নিলেন মুহাম্মাদ রাসুলুল্লাহ

 

মহান আল্লাহ্‌ ইসমাঈল (আঃ) কে আরো একটি বড় মর্যাদা দান করেছেন। সেটা হলো, তাঁরই বংশে পাঠিয়েছেন শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে। কা’বা নির্মাণের পর ইসমাঈল পিতা ইব্রাহীমের সংগে আল্লাহর কাছে দোয়া করেছিলেন।

 

“প্রভু, আমাদের বংশ থেকে তাঁদের মাঝে একজন রাসুল পাঠিও, যিনি ওদেরকে তোমার আয়াত পাঠ করে শোনাবেন, কিতাব ও হিকমাহ শিক্ষা দেবেন আর তাঁদের জীবনকে পরিশুদ্ধ পরিচ্ছন্ন করবেন। ” (সূরা বাকারা, আয়াত ১২৯)

 

আল্লাহ্‌ ইসমাঈল ও তাঁর পিতার দোয়া কবুল করেন। ইসমাঈলের বংশেই মুহাম্মাদ রাসুলুল্লাহর আবির্ভাব ঘটান। মুহাম্মাদ রাসুলুল্লাহ এসে পৃথিবীতে আবার ইব্রাহিম ও ইসমাঈল (আঃ) এর মতই কা’বা কেন্দ্রিক ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। এই কা’বা এবং কা’বা কেন্দ্রিক হজ্জ, কুরবানী, তাওয়াফ, সাফা মারওয়া দৌড়াদৌড়ি মাকামে ইব্রাহীমে সালাত আদায় ইত্যাদির মাধ্যমে আল্লাহ্‌ পাক ইব্রাহিম (আঃ), ইসমাঈল (আঃ) ও তাঁর সম্মানিত মা হাজেরা আলাইহিস সালামকে চিরদিন পৃথিবীতে স্মরণীয় করে রাখার ব্যবস্থা করলেন। মহান আল্লাহ্‌ তাঁর অনুগত দাসদের এভাবেই পুরস্কৃত করেন।

 

কুরআনে ইসমাঈল (আঃ)

 

মহান আল্লাহ্‌ তাঁর প্রিয় নবী ইসমাঈল (আঃ)-কে বিরাট সম্মান ও মর্যাদা দান করেছেন। কুরআন মাজীদে মোট বারোটি স্থানে আল্লাহ্‌ পাক ইসমাঈলের নাম উল্লেখ করেন। কয়েকটি আয়াত তো আগেই উল্লেখ করেছি। আল্লাহ তায়ালা হজরত ইসমাঈল (আঃ) সম্পর্কে আরো বলেন-

 

“স্মরণ করো, ইসমাঈল, আলয়াসা, যুলকিফলকে। এরা সবাই ছিলো উত্তম আদর্শ।” (সূরা ৩৮ সোয়াদ, আয়াত ৪৮)

 

“হে মুহাম্মাদ, তোমার কাছে আমি অহী পাঠাচ্ছি, যেমন পাঠিয়েছিলাম নূহ এবং তাঁর পরবর্তী নবীদের কাছে, যেমন পাঠিয়েছিলাম ইব্রাহিম ও ইসমাঈলের কাছে।” (সূরা ২ আল বাকারা, আয়াত ১৩৬)

 

“হে মুহাম্মাদ, বলো- আমরা আল্লাহকে মানি আর ইসমাঈল ও ইব্রাহীমের কাছে যা অবতীর্ণ হয়েছে তাও মানি।” (সূরা ২ আল বাকারা, আয়াত ১৩৬)

 

যেসব সুরায় ইসমাঈল (আঃ) এর কথা উল্লেখ হয়েছে, সেগুলো হলো- সূরা আল বাকারাঃ ১২৫-১৪০, আলে ইমরানঃ ৮৪, আন নিসাঃ ১৬৩, আল আনআমঃ ৮৬, ইব্রাহীমঃ ৩৯, মরিয়মঃ ৫৪, আল আম্বিয়াঃ ৮৫, সোয়াদঃ ৪৮।

 

৯।

 

ইবরাহীম পুত্র ইসহাক

 

(আঃ)

 

পূর্ব কথা

 

আপনারা আগেই জেনে এসেছেন মহান রাসুল আল্লাহর বন্ধু ইবরাহীম (আঃ) এর কাহিনী। শুনেছেন তাঁর অগ্নীপরীক্ষার কথা, হিজরতের কথা এবং আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্যে দেশ থেকে দেশান্তরে ঘুরে বেড়ানোর কথা। শেষ বয়েসে মহান আল্লাহ তাঁকে দুটি পুত্র সন্তান দান করেন। দুজনকেই নবয়্যত দান করেন এবং আরো দান করেন উচ্চ মর্যাদা। তাঁদের একজন ইসমাঈল (আঃ) এবং অপরজন ইসহাক (আঃ)। ইসমাঈলের ইতিহাস তো আগেই বলে এসেছি। এবার শুনা যাক ইসহাকের কথা। হযরত ইব্রাহীমের ছিলেন দুই জন স্ত্রী। একজন সারাহ আর অপরজন হাজেরা। সারাহ প্রথম স্ত্রী। তাঁকে সাথে নিয়েই হযরত ইবরাহীম তাঁর মাতৃভূমি ইরাক থেকে হিজরত করেন। অনেক দেশ ঘুরে মিশরে যান। সেখানে বিয়ে করেন দ্বিতীয় স্ত্রী হাজেরাকে। সেখান থেকে ফিরে আসেন ফিলিস্তিনে। এখানে আসার পর হাজেরার ঘরে তাঁর একটি পুত্র সন্তান জন্মলাভ করেন। সে পুত্রই ছিলেন কুরবানীর নবী হযরত ইসমাঈল (আঃ)। আল্লাহর হুকুমে হযরত ইবরাহীম শিশুপুত্র ইসমাঈল ও তাঁর মাকে মক্কায় নিয়ে রেখে আসেন। সারাহ ফিলিস্তিনেই থেকে যান। হযরত ইবরাহীমও ফিলিস্তিনেই থাকতেন। আবার মক্কায় গিয়ে স্ত্রী ও পুত্র ইসমাঈলকে দেখাশুনা করে আসতেন।

 

সারাহর দুঃখ

 

কিন্তু সারার বড় দুঃখ। তিনি একজন বৃদ্ধা মহিলা। তাঁর সন্তানাদি হয়না। অথচ সব নারীই মা হতে চায়। সন্তানের মুখ দেখতে চায়। সন্তানকে বুকভরা আদর আর স্নেহ মমতা দিয়ে জড়িয়ে রাখতে চায়। মা ডাক না শুনলে কোন নারীরই বুক ভরেনা। সন্তান ছাড়া নারীর কোল থাকে শুন্য। বুকভরা আশা নিয়ে সারাহ সবসময় দয়াময় আল্লাহর কাছে দোয়া করেন সন্তান চেয়ে। কিন্তু আজো তাঁর সন্তান হয়নি। তিনি বৃদ্ধা হয়ে পড়েছেন। বয়েস হয়ে গেছে নব্বই। স্বামীও এখন শতায়ু বৃদ্ধ। সন্তান লাভের আর কি আশা? এ ঘরে সন্তান লাভের ব্যাপারে এখন দুজনই নিরাশ। কিন্তু হঠাৎ একটা কাণ্ড ঘটে গেলো। কী সে কাণ্ড?

 

সুসংবাদ পেলেন সারাহ

 

হঠাৎ একদিন হযরত ইব্রাহীমের বাড়িতে এলো কয়েকজন তাগড়া যুবক। অতি সুন্দর সুশ্রী হৃষ্টপুষ্ট ওরা। যেনো শক্তিশালী যোদ্ধা এবং বিরাট কোন সম্রাটের সৈনিক। তাঁদের আকস্মিক আগমনে ইবরাহীম ভয় পেয়ে গেলেন। তবে তারা এসেই হযরত ইব্রাহীমকে সালাম দেন এবং তিনিও সালামের জবাব দিয়ে তাঁদেরকে মেহমান হিসেবে গ্রহন করেন।

 

মেহমান এলে হযরত ইবরাহীম অত্যন্ত খুশি হতেন। কারন তিনি ছিলেন বড় মেহেমান নেওয়াজ। ওদের বসতে দিয়ে তিনি ভেতরে চলে গেলেন। অল্পক্ষনের মধ্যেই তাজা গরুর গোশত ভুনা করে নিয়ে আসলেন। সারাও পিছে পিছে এসে পর্দার আড়ালে দাঁড়ালেন। ইবরাহীম সারার ভুনা করা মজাদার গোশত তাঁদের পরিবেশন করতে থাকলেন। কিন্তু অবাক কাণ্ড। ওরা হাত গুটিয়ে রাখলো। খাবার স্পর্শ করছেনা। ইবরাহীম ভাবলেন- নিশচয়ই এরা শত্রু হতে পারে। বললেন- আপনারা কারা? আপনাদের তো চিনতে পারছিনা? আপনাদেরকে আমার ভয় হচ্ছে।

 

এবার তারা মুখ খুললো। বললো- আপনি ভয় পাবেননা। আমরা আল্লাহর দূত ফেরেস্তা। আমরা আল্লাহর কাছ থেকে আপনার জন্যে সুসংবাদ নিয়ে এসেছি। সারার ঘরে আপনার একটি বিজ্ঞ পুত্র সন্তান জন্ম হবে। একথা শুনে সারাহ বিস্মিত হয়ে সামনে এগিয়ে এলেন। কপালে হাত মেরে বললেন- এতো এক বিস্ময়ের খবর, আমি হয়ে গেছি বুড়ি থুরথুড়ি। তাঁর উপরে জনমের বন্ধ্যা। শুধু কি তাই? আমার স্বামীও শতায়ু বৃদ্ধ। কেমন করে হবে আমার ছেলে?

 

ফেরেস্তারা বললেন- “এতো আল্লাহর সিদ্ধান্ত। আপনি কি আল্লাহর ফায়সালার ব্যাপারে বিস্ময় প্রকাশ করছেন? এ সুসংবাদ নির্ঘাত সত্য। এর কোন নড়চড় হবেনা। আপনার গর্ভে ইসহাক জন্ম নেবেই। শুধু তাই নয়, ইসহাক একজন নবী হবে আর তাঁর ঘরেও জন্ম নেবে আরেক নবী ইয়াকুব। এ হচ্ছে আল্লাহর রহমত। পথভ্রান্তরা ছাড়া কি কেউ আল্লাহর রহমাত থেকে নিরাশ হয়? আল্লাহ মহাজ্ঞানী, মহাকৌশলী, সপ্রসংশিত, অতিশয় মর্যাদাবান। তিনি যা চান তাই হয়। হে ঘরবাসী, আল্লাহর রহমত আর বরকতের ধারা বর্ষিত হোক আপনাদের প্রতি।” (সূরা ১১ হুদ-৭২,৭৩)

 

জন্ম নিলেন ইসহাক

 

আল্লাহর হুকুমের নড়চড় নেই। হযরত ইবরাহীম আর সারার ঘর উজ্জ্বল করে জন্ম গ্রহন করলেন ইসহাক। চাঁদের মতো ফুটফুটে ছেলে। বুড়ো বয়েসে ছেলে হলে আদরের সীমা থাকেনা। বাবা মার আদরে লালিত পালিত হয়ে বড় হতে থাকলেন ইসহাক। যেমন বাপ তেমন ছেলে। মহান আল্লাহ ইসহাককে দান করেছেন দারুন মেধা, জ্ঞান এবং বুঝ ও বুদ্ধি।

 

নবুয়্যত লাভ

 

বড় হলে ইসহাককে আল্লাহ তায়ালা নবুয়্যত দান করেন। একজন প্রশংসিত নবী হিসেবে কুরআন মাজীদে বার বার তাঁর নাম উল্লেখ হয়েছে। ফিলিস্তিন অঞ্চলে তিনি তাঁর পিতা হযরত ইবরাহীম (আঃ) প্রতিনিধি ও স্থলাভিষিক্ত হিসেবে দ্বীন ইসলামের প্রচার ও প্রসারের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। হযরত ইবরাহীম যে বিরাট অঞ্চলে ইসলাম কায়েম করে গিয়েছিলেন, পরবর্তীতে তারা দুই ভাই ইসমাঈল ও ইসহাক তার দায়িত্ব গ্রহন করেন। হিজায অঞ্চলে দায়িত্ব পালন করেন বড় ভাই ইসমাঈল (আঃ)। আর ফিলিস্তিন অঞ্চলের দায়িত্ব পালন করেন ছোট ভাই ইসহাক (আঃ)।

 

হযরত ইসহাকের বংশ

 

হযরত ইসহাককে আল্লাহ তায়ালা এক ঐতিহাসিক গোত্রের পূর্বপুরুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর পুত্র ইয়াকুবকে আল্লাহ তায়ালা নবী মনোনীত করেন। ইয়াকুবের আরেক নাম ছিলো ইসরাইল। তাঁর সন্তানরা বনী ইসরাইল (ইসরাইলের বংশধর) হিসেবে খুবই খ্যাতি অর্জন করেছে। মূলত এ বংশের ধারাবাহিকতা হযরত ইসহাক (আঃ) থেকেই আরম্ভ হয়। এ বংশে আল্লাহ অসংখ্য নবী প্রেরন করেছেন। ইসলামের সঠিক আদর্শ থেকে বিচ্যুত অবস্থায় এ বংশের লোকেরা আজো পৃথিবীতে বর্তমান আছে।

 

হযরত ইসহাকের প্রশংসনীয় গুনাবলী

 

আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআন মাজীদে তাঁর দাস ও নবী হযরত ইসহাক (আঃ) এর ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। এবার কুরআন থেকে তাঁর প্রশংসা আর গুনাবলী জেনে নেয়া যাক। মহান আল্লাহ বলেন-

 

১। “আমার দাস ইবরাহীম, ইসহাক আর ইয়াকুবের কথা স্মরণ করো। তারা ছিলো বড় কর্মঠ আর দুরদৃষ্টি সম্পন্ন। একটি খাঁটি গুনের কারনে আমি তাঁদের মর্যাদাবান করেছিলাম। আর টা হলো পরকালের চিন্তা। তারা আমার কাছে বাছাই করা আদর্শ মানুষ।” (সূরা সোয়াদ, আয়াত ১০২)

 

২। “অতপর আমি ইব্রাহীমকে ইসহাকের সুসংবাদ দিলাম। বললাম- সে হবে একজন নবী ও উন্নত আমলের সুযোগ্য লোক।” (সূরা আস সাফফাত, আয়াত ১১২)

 

৩। “আর আমি তাঁকে দান করেছি ইসহাককে। তাছাড়াও ইয়াকুবকে। তারা প্রত্যেকেই ছিলো সৎ সুযোগ্য। আমি তাঁদের নেতা বানিয়েছি। তারা আমার নির্দেশ মতো মানুষকে সঠিক পথ প্রদর্শন করতো। আমি তাঁদের কাছে অহী করেছিলাম কল্যাণমূলক কাজ করার, সালাত কায়েম করার ও যাকাত পরিশোধ করার। তারা ছিলো আমার একান্ত অনুগত। ” (সূরা আল আম্বিয়া, আয়াত ৭৩)

 

৪। “অতপর আমি তাঁকে ইসহাক ও ইয়াকুবের মতো সন্তান দান করলাম। আর তাঁদের প্রত্যেককেই বানালাম নবী। নিজ রহমতে তাঁদের ধন্য করলাম আর মানুষের মাঝে তাঁদেরকে সত্যিকার সুনাম ও সুখ্যাতি দান করলাম।” (সূরা মরিয়ম, আয়াত ৪৯-৫০)

 

৫। “হে মুহাম্মাদ, আমি তোমার প্রতি তেমনই অহী নাযিল করেছি, যেমন করেছিলাম নুহ এবং তাঁর মধ্যবর্তী নবীদের উপর। যেমন আমি অহী পাঠিয়েছি ইব্রাহীন, ইসমাঈল, ইসহাক---এর প্রতি--- এরা সবাই ছিলো সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী রাসুল।” (সূরা নিসা, আয়াত ১৬৩-১৬৫)

 

 কুরআন মাজীদের এ আয়াতগুলো থেকে আমরা হযরত ইসহাক (আঃ) এর অনেকগুলো প্রশংসিত গুনাবলীর কথা জানতে পারি। মহান আল্লাহ নিজেই তাঁর এসব গুনাবলীর কথা উল্লেখ করেছেন। গুনগুলো হলো-

 

১। পরকালের চিন্তা। অর্থাৎ পরকালমুখী চিন্তা ও পরকালমুখী কাজ।

 

২। কর্মঠ। অর্থাৎ দক্ষতা ও কর্মমুখীতা।

 

৩। দূরদৃষ্টি।

 

৪। সততা ও যোগ্যতা।

 

৫। উন্নত আমল।

 

৬। আল্লাহর আনুগত্য ও বাধ্যতা।

 

৭। সুসংবাদদাতা। অর্থাৎ মুমিনদের জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন।

 

৮। সতর্ককারী। অর্থাৎ আল্লাহর পাকড়াও সম্পর্কে মানুষকে সতর্ক করেছেন।

 

৯। সামাজিক নেতৃত্ব দান।

 

১০। নেতৃত্ব লাভের পর-

 

     ক. আল্লাহর বিধান মতো মানুষকে সঠিক পথ প্রদর্শনের ব্যবস্থা করেছেন।

 

     খ. জনকল্যাণমূলক সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছেন।

 

     গ. সালাত কায়েম করেছেন এবং

 

     ঘ. যাকাত ভিত্তিক অর্থনৈতিক সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছেন।

 

এসব কারনে আল্লাহ তাঁকে উচ্চ মর্যাদা ও সুনাম সুখ্যাতি দান করেছেন।

 

কুরআনে উল্লেখ

 

কুরআন মাজীদে হযরত ইসহাকের নাম উল্লেখ হয়েছে ১৭ বার। যেসব সুরাতে উল্লেখ হয়েছে, সেগুলো হলো –

 

সূরা আল বাকারাঃ ১৩৩,১৩৬,১৪০। আলে ইমরানঃ ৮৪। নিসাঃ ১৬৩। আল আনআমঃ ৮৪। হুদঃ ৭১। ইউসুফঃ ৬,৩৮। ইব্রাহীমঃ ৩৯। মরিয়মঃ ৪৯। আল আম্বিয়াঃ ৭২। আন কাবুতঃ ২৭। আস সাফফাতঃ ১১২,১১৩। সোয়াদঃ ৪৫।

 

১০।

 

ইসরাইলিদের পিতৃপুরুষ ইয়াকুব

 

(আঃ)

 

নাম ও বংশ পরিচয়

 

মহাকালের সাক্ষী এক মহাপুরুষ ইয়াকুব (আঃ)। পৃথিবীর এক ঐতিহাসিক বংশের তিনি আদি পুরুষ। সেকালে ইবরানী ভাষা নামে একটি ভাষা চালু ছিলো। বহ নবীর মুখের ভাষা ছিলো এই ইবরানী ভাষা। এ ভাষায় আল্লাহ তায়ালা কিতাবও নাযিল করেছেন। হযরত ইয়াকুব (আঃ) এর ভাষাও ছিলো এই ইবরানী ভাষা। এ ভাষায় তাঁর নাম ছিলো ইসরাইল। এর অর্থ কি? ইসরাইল মানে আল্লাহর দাস। অন্য সকল নবীর মতো তিনিও আল্লাহর দাসই ছিলেন। তবে সেই সাথে তাঁর নামটিও ছিলো ‘আল্লাহর দাস’। এর আরবী অনুবাদ হল ‘আব্দুল্লাহ’। হযরত ইয়াকুব (আঃ) ছিলেন অত্যন্ত মর্যাদাবান একজন নবী। পূর্বপুরুষের দিক থেকে তিনি এক সম্মানিত নবীর পুত্র আরেক সম্মানিত নবীর নাতি। অর্থাৎ তিনি ছিলেন হযরত ইব্রাহীমের নাতি আর হযরত ইসহাকের পুত্র। অন্যদিকে তাঁর বংশেও জন্ম নিয়েছেন অসংখ্য নবী। তিনি ইসরাইল নামে পরিচিত হবার কারনে তাঁর বংশধরদের বলা হয় ‘বনী ইসরাইল’ বা ইসরাইলের বংশধর।

 

কোন কোন সুত্র থেকে জানা যায় তাঁর বংশধরদের মধ্যে চার হাজার নবী জন্মগ্রহন করেন। হযরত ইউসুফ, মুসা, হারুন, দাউদ, সুলাইমান, যাকারিয়া, ইয়াহিয়া, ঈসা আলাইহিস সালাম প্রমুখ বিখ্যাত নবী রাসুলগন ছিলেন তাঁরই বংশধর।

 

জন্ম ও শৈশব

 

আপনারা আগেই জেনেছেন হযরত ইবরাহীম (আঃ) তাঁর প্রথম স্ত্রী সারাকে নিয়ে ফিলিস্তিনের কেনান শহরে বসবাস করতেন। এখানে সারার ঘরে জন্ম নেন হযরত ইসহাক (আঃ)। আর এ শহরেই জন্ম হয় ইসহাকের পুত্র হযরত ইয়াকুব (আঃ) এর। নবীর পুত্র শৈশব থেকেই জ্ঞানে গুনে নবীর মতো হয়ে গড়ে উঠতে থাকেন। তাঁর উন্নত জ্ঞান বুদ্ধি সুন্দর স্বভাব চরিত্র আর অমায়িক ব্যবহার দেখে ছোট বেলা থেকেই বুঝা যাচ্ছিলো, তিনি হবেন একজন মহামানব।

 

যৌবনকালে খালার বাড়ি

 

ইয়াকুব যখন যৌবনে পদার্পণ করেন, তখন একদিন তাঁর মা রিফকাহ তাঁকে তাঁর খালার বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। বললেন- তুই সেখানে গিয়ে থাকগে। যুবক ইয়াকুব মায়ের নির্দেশে খালার বাড়ি চলে এলেন। আপনারা নিশ্চয়ই ব্যবিলন শহরের নাম শুনেছেন। হ্যাঁ, এখন এই শহরটি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। শহরটি ছিলো ইরাকে। এই ব্যবিলনের ‘ফুদ্দানে আরাম’ নামক স্থানেই ছিলো ইয়াকুবের খালার বাড়ি। এখানে এসে ইয়াকুব শারীরিক ও মানসিক যোগ্যতা আর মেধা বৃদ্ধির বিরাট সুযোগ পেলেন।

 

বিয়ে করলেন ইয়াকুব

 

খালার বাড়িতে ইয়াকুব সতের বা বিশ বছর অবস্থান করেন। এখানেই তিনি বিয়ে শাদি করেন। তিনি চারটি বিয়ে করেন। বড় স্ত্রীর নাম ছিলো লিয়া, দ্বিতীয় স্ত্রী রাহিল, তৃতীয় স্ত্রী যুলফা আর চতুর্থ স্ত্রী ছিলেন বলুহা। তাঁর কোন স্ত্রীর ঘরে কয়টি ছেলে হয়েছিলো, ইতিহাসে তাও উল্লেখ আছে। আসুন তাঁর পুত্রদের নাম আপনাদের জানিয়ে দেই- লিয়ার ঘরে জন্ম হয় ছয়টি পুত্রের। ওদের নাম হলো- রুবিল, শামউন, লাভি, ইয়াহুযা, ইসাখার ও যাবলুন।

 

রাহিলের ঘরে জন্ম নেন দুইজন পুত্র সন্তান। তারা হলেন- ইউসুফ ও বনী ইয়ামীন।

 

যুলফার ঘরে জন্ম হয় দুই ছেলে জাদ ও আশির।

 

বলুহার ঘরেও দুইটি পুত্র সন্তান জন্মলাভ করে। তারা হলেন- দান ও নাফতালি।

 

এবার বলুনতো হযরত ইয়াকুবের মোট কয়টি ছেলে ছিলো? গুনে দেখুন, সব মিলে হলো- বারোটি। এই বারো ছেলে থেকেই জন্ম নেয় বনী ইসরাইলের বারোটি শাখা গোত্র। এদের মধ্যে লাভির বংশে জন্ম নেন হযরত মুসা ও হারুন (আঃ)। ইয়াহুযা ছিলেন ধর্মীয় দিক থেকে খুবই প্রভাবশালী। পরবর্তীকালে তাঁর নাম অনুসারেই আসল ধর্ম বিকৃত হয়ে জন্ম নেয় ইয়াহুদি ধর্মের। একপুত্র ইউসুফ (আঃ) তো পরে মিশরে গিয়ে সেখানকার শাসক হন।

 

ফিরে এলেন কেনানে

 

অনেক দিন হয়ে গেলো খালার বাড়ি। এবার ডাক পড়েছে নিজের বাড়ি ফিরে আসার। বিনিয়ামিন ছাড়া তাঁর এগারটি পুত্রের জন্ম খালার বাড়িতেই হয়। বিবি বাচ্চা সবাইকে নিয়ে ইয়াকুব রওয়ানা করলেন ফিলিস্তিনের দিকে। অনেক দিন দূরে থাকার পর এবার এসে পৌঁছে গেলেন নিজ মাতৃভূমি কেনানে। কেনানে আসার পর ছোট ছেলে বিনইয়ামিনের জন্ম হয়। এতোগুলো নাতি পেয়ে দাদা দাদি দারুন খুশি। বাড়ি ফিরে ইয়াকুব আল্লাহর পথে নিজের জানমাল পুরোপুরি নিয়োজিত করেন।

 

নবী হলেন ইয়াকুব

 

ইয়াকুব ছিলেন আল্লাহর জন্যে নিবেদিতপ্রান। আল্লাহও তাঁকে নিজের জন্যে বাছাই করে নেন। দান করেন নবুয়্যত। ফিলিস্তিন অঞ্চলে আল্লাহর দ্বীন প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করার জন্যে হযরত ইবরাহীম (আঃ) পুত্র ইসহাকের উপরে দায়িত্ব দিয়ে যান। ইসহাক (আঃ) বৃদ্ধ বয়েসে উপনীত হবার পরে স্বয়ং আল্লাহর পক্ষ থেকেই পুত্র ইয়াকুব তাঁর প্রতিনিধি মনোনীত হন। কিছুকাল পর হযরত ইয়াকুব (আঃ) এর পিতা হযরত ইসহাক (আঃ) ইহলোক ত্যাগ করেন। হযরত ইয়াকুব গোটা ফিলিস্তিন অঞ্চলে আল্লাহর দীনের পতাকা উড্ডীন করেন। মানুষের দুয়ারে দুয়ারে বয়ে নিয়ে যান আল্লাহর বানী। মানুষকে সমবেত করেন আল্লাহর দীনের পতাকাতলে।

 

ধৈর্য জ্ঞান ও আল্লাহ নির্ভরতার প্রতীক

 

প্রিয় নবী ইয়াকুব (আঃ) ছিলেন পরম ধৈর্যশীল ও ধৈর্যের পাহাড়। তাঁর প্রিয়তম পুত্র ইউসুফকে তাঁর ভাইয়েরা যখন অন্ধকূপে ফেলে বাড়ি এসে তাঁর কাছে বলেছিলো, ইউসুফকে বাঘে খেয়ে ফেলেছে। তখন এই চরম দুঃখ ও বেদনার সংবাদ শুনে তিনি কেবল এতোটুকুই বলেছিলেন-

 

“বরং তোমাদের নফস তোমাদের জন্যে একটি অসম্ভব কাজকে সম্ভব করে দিয়েছে। আমি ধৈর্য ধরবো, উত্তম ধৈর্য। তোমরা যে কথা সাজিয়েছ, তাঁর জন্যে কেবল আল্লাহর কাছেই সাহায্য চাওয়া যেতে পারে।” (সূরা ১২ ইউসুফঃ আয়াত ১৮)

 

ছোট ছেলে বিন ইয়ামিনকে যখন তাঁর ভাইয়েরা চুরির ঘটনার জন্যে মিশরে রেখে আসতে বাধ্য হয়েছিলো, তখনো তিনি একই ভাষায় বলেছিলেন-

 

“আমি উত্তমভাবেই ধৈর্য ধারন করলাম। মহান আল্লাহ হয়তো ওদের সবাইকেই আমার কাছে এনে দিবেন।” (সূরা ১২ ইউসুফঃ আয়াত ৮৩)

 

“আমি আমার দুঃখ বেদনার ফরিয়াদ কেবল আল্লাহর কাছেই করবো। আল্লাহর ব্যাপারে আমি যততুকু জানি তোমরা তা জানোনা। হে আমার ছেলেরা, তোমরা যাও, ইউসুফ ও তাঁর ভাইকে (বনিয়ামিন) খুজে দেখো। আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়োনা।” (সূরা ১২ ইউসুফঃ আয়াত ৮৬-৮৭)

 

হযরত ইয়াকুবের ঐ দুষ্ট প্রকৃতির দশটি ছেলে যখন মিশর শাসকের পরিচয় পেলো, তখন তারা দেখলো, এতো তাঁদেরই সেই ভাই ইউসুফ, যাকে তারা অন্ধকূপে ফেলে দিয়েছিলো। ইউসুফ তাঁদের ক্ষমা করে দিলেন। ইউসুফের জন্যে চিন্তা করতে করতে হযরত ইয়াকুবের দুটি চোখ অন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। ইউসুফ তাঁর ভাইদের কাছে নিজের জামা দিয়ে বললেন- এটি নিয়ে আমার আব্বার মুখমণ্ডলে রাখো, তাতে তিনি দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাবেন। তারা যখন ইউসুফের সসংবাদ আর তাঁর জামা নিয়ে কেনানের উদ্দেশে রওয়ানা করলো, তখন হযরত ইয়াকুব বাড়ির লোকদের বললেন-

 

“আমি ইউসুফের সুবাস পাচ্ছি।”(সূরা ১২ ইউসুফঃ আয়াত ৯৪)

 

অতপর সুসংবাদ বহনকারীরা যখন ইউসুফের জামাটি এনে তাঁর মুখমণ্ডলে রাখলো, সাথে সাথে তিনি দৃষ্টিশক্তি লাভ করলেন। তখন তিনি তাঁর ঘরের লোকদের বললেন-

 

 “আমি না তোমাদের বলেছিলাম, আমি আল্লাহর পক্ষ থেকে এমন সব কথা জানি, যা তোমরা জানোনা।” (সূরা ১২ ইউসুফঃ আয়াত ৯৬)

 

বৃদ্ধ বয়েসে মিশর এলেন

 

কি সৌভাগ্য হযরত ইয়াকুব (আঃ) এর। মহান আল্লাহ তাঁর হারানো ছেলে ইউসুফকে মিশরের শাসক বানিয়েছেন। ইউসুফ তাঁর ভাইদের বলে পাঠিয়েছেন পরিবারের সবাইকে মিশর নিয়ে আসতে। হযরত ইয়াকুবের সেই অপরাধী ছেলেগুলো বাড়ি এসে বললো-

 

“আব্বাজান, আপনি আমাদের অপরাধ মাফির জন্যে দোয়া করুন। সত্যিই আমরা অপরাধী ছিলাম।” (সূরা ১২ ইউসুফঃ আয়াত ৯৭)

 

হযরত ইয়াকুব বললেন-

 

“আমি আমার প্রভুর দরবারে তোমাদের ক্ষমা করে দেবার জন্যে আবেদন জানাবো। তিনি বড়ই ক্ষমাশীল ও পরম করুনাময়।” (সূরা ১২ ইউসুফঃ আয়াত ৯৮)

 

অতপর হযরত ইয়াকুব সপরিবারে মিশর চলে এলেন। এ সময় তিনি বৃদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন। তারা যখন মিশরে এসে পৌঁছলেন, তখন হযরত ইউসুফ বিরাট শোভাযাত্রা সহকারে তাঁর পিতা মাতাকে অভ্যর্থনা জানালেন। অত্যন্ত সম্মানের সাথে ইউসুফ তাঁর বাবা মাকে নিজের কাছে সিংহাসনে উঠিয়ে বসালেন।

 

মিশরে হিজরত করে আসার পর হযরত ইয়াকুব (আঃ) আরো সতের বছর বেঁচে ছিলেন। এ হিজরতের সময় তাঁর বয়স ছিলো একশো ত্রিশ বছর। একশো সাতচল্লিশ বছর বয়সে তিনি মিশরে ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি ছেলেদেরকে অসিয়ত করে যান, তাঁকে যেন ফিলিস্তিনে নিয়ে তাঁর পিতা মাতার পাশে সমাহিত করা হয়।

 

পুত্রদের প্রতি উপদেশ

 

হযরত ইয়াকুব জনগন ও তাঁর পুত্রদের যে উপদেশ দিয়েছিলেন, কুরআনের দুটি স্থানে তাঁর কিছু অংশ বর্ণিত হয়েছে। যখন তাঁর দশ ছেলে ছোট ছেলে বিনইয়ামিনকে সাথে নিয়ে খাদ্য শস্য আনার জন্যে মিশর যাত্রা করেছিলে, তখন তিনি তাঁদের উপদেশ দিলেন-

 

“হে আমার ছেলেরা, তোমরা মিশরের রাজধানীতে একটি প্রবেশ পথে ঢুকো না। বিভিন্ন গেইট দিয়ে প্রবেশ করো। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছা থেকে আমি তোমাদের রক্ষা করতে পারবোনা। সমস্ত কৃতিত্ব তো আল্লাহর হাতে। আমি তাঁরই উপর ভরসা করছি। সকল ভরসাকারীকে তাঁরই উপরে ভরসা করতে হবে।” (সূরা ১২ ইউসুফঃ আয়াত ৬৭)

 

আল্লাহর নবী ইয়াকুবের এই উপদেশটিতে কয়েকটি মৌলিক কথা রয়েছে। সেগুলো হলো-

 

১. যাবতীয় কাজে কর্মকৌশল (tactics) অবলম্বন করা উচিত।

 

২. কর্মকৌশল অবলম্বন করার পরই আল্লাহর ইচ্ছা ও ফায়সালার উপর সন্তুষ্ট থাকা উচিত।

 

৩. আল্লাহকেই সমস্ত ক্ষমতা ও কর্তিতের উৎস মনে করতে হবে।

 

৪. সকল বিষয়ে আল্লাহর উপর ভরসা করা উচিত।

 

সূরা বাকারায় হযরত ইয়াকুবের উপদেশগুলো এভাবে উল্লেখ হয়েছে-

 

“ইয়াকুব তাঁর সন্তানদের এই উপদেশ দিয়েছিলোঃ হে আমার সন্তানেরা, আল্লাহ তোমাদের জন্যে মনোনীত করেছেন ‘আদ দীন’ (অর্থাৎ দ্বীন ইসলাম) সুতরাং তোমরা মুসলিম (আত্মসমর্পণকারী) থাকো। সে মৃত্যুকালে তাঁর সন্তানদের জিজ্ঞেস করেছিলো- আমার মৃত্যুর পর তোমরা কার ইবাদাত ও দাসত্ব করবে? জবাবে তারা বলেছিল, আমরা সেই এক আল্লাহর ইবাদাত ও দাসত্ব করবো। যাকে আপনি ও আপনার পূর্বপুরুষ ইবরাহীম, ইসমাঈল এবং ইসহাক ইলাহ হিসেবে মেনেছেন। আমরা তাঁরই অনুগত হয়ে থাকবো।” (সূরা ২ আল বাকারাঃ আয়াত ১৩২-১৩৩)

 

হযরত ইয়াকুব (আঃ) এর এই উপদেশটিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি থেকে আমরা জানতে পারি-

 

১. ইসলামই হলো আল্লাহর মনোনীত দ্বীন বা জীবন ব্যবস্থা।

 

২. আল্লাহর মনোনীত দীনের অনুসারীরা মুসলিম।

 

৩. সকল নবী একই দীনের বাহক ও প্রচারক ছিলেন।

 

৪. আমৃত্যু আল্লাহর অনুগত বাধ্যগত হয়ে থাকাই প্রকৃত মুমিনের কাজ।

 

৫. মুসলিম হওয়া মানে আল্লাহর দাসত্ব করা।

 

আল কুরআনে উল্লেখ

 

কুরআন মাজীদে মহান আল্লাহ তাঁর দাস ও নবী হযরত ইয়াকুবের ভুয়সী প্রশংসা করেছেন। আল কুরআনে ১৬ বার তাঁর নাম উল্লেখ হয়েছে। যেসব আয়াতে তাঁর নাম উল্লেখ হয়েছে সে আয়াতগুলো এবং সেগুলোর তাফসির পড়লেই আপনারা তাঁর সম্পর্কে আরো জানতে পারবেন। এবার জেনে নিন কোথায় কোথায় উল্লেখ হয়েছে তাঁর নাম –

 

সূরা আল বাকারা- ১৩২, ১৩৩, ১৩৬, ১৪০।

 

সূরা আলে ইমরান- ৮৪।

 

সূরা আন নিসা- ১৬৩।

 

সূরা আল আনয়াম- ৮৪।

 

সূরা হুদ- ৭১।

 

সূরা ইউসুফ- ৬, ৩৮, ৬৮।

 

সূরা মরিয়ম- ৬, ৪৯।

 

সূরা আল আম্বিয়া- ৭২।

 

সূরা আল আনকাবুত- ২৭।

 

সূরা সোয়াদ- ৪৫।

 

 মহান আল্লাহ হজরত ইয়াকুব (আঃ) সম্পর্কে বলেন-

 

“সে (ইয়াকুব) ছিলো আমার দেয়া শিক্ষায় জ্ঞানবান। কিন্তু অধিকাংশ লোক প্রকৃত সত্য জানেনা।” (সূরা ইউসুফঃ আয়াত ৬৮)

 

১১।

 

মিশর শাসক ইউসুফ

 

(আঃ)

 

পূর্বাভাস

 

“আব্বু, আজ রাতে আমি স্বপ্ন দেখেছি, এগারটি তারা এবং সূর্য আর চাঁদ আমাকে সাজদা করছে।” (সূরা ১২ ইউসুফঃ আয়াত ০৪)

 

“পুত্র আমার, এ স্বপ্নের কথা তোমার ভাইদের বলোনা। ওরা জানতে পারলে তোমার ক্ষতি করার চিন্তা করবে। আর শয়তান তো মানুষের ঘোরতর শত্রু আছেই।” (সূরা ১২ ইউসুফঃ আয়াত ০৫)

 

ছোট্ট কচি ইউসুফ যেদিন এ স্বপ্ন দেখেন, সেদিনই তাঁর বিজ্ঞ পিতা বুঝতে পারেন, মহান আল্লাহ তাঁর এই পুত্রটিকে নবুয়্যত দান করবেন। তাই তো তিনি সতর্ক করে দিলেন। সেই সাথে আরো বললেন-

 

“তোমাকে তোমার প্রভু তাঁর কাজের জন্যে নির্বাচিত করবেন, কথার মর্ম বুঝতে শেখাবেন আর তোমার প্রতি ও ইয়াকুবের পরিবারের প্রতি ঠিক তেমনি করে তাঁর নিয়ামত পূর্ণ করবেন, যেমনটি করেছিলেন তোমার পিতামহ ইসহাক ও ইব্রাহীমের প্রতি।” (সূরা ১২ ইউসুফঃ আয়াত ৫-৬)

 

বংশ পরিচয়

 

সহীহ বুখারীতে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ (সা) বলেছেন- “করিম ইবনে করিম ইবনে করিম-ইউসুফ ইবনে ইয়াকুব ইবনে ইবনে ইসহাক ইবনে ইবরাহীম।” ‘করিম’ মানে সম্মানিত। অর্থাৎ সম্মানিত নবী হযরত ইউসুফ মহাসম্মানিত নবী ইবরাহীম (আঃ এর প্রপুত্র সম্মানিত নবী ইসহাকের পৌত্র আর সম্মানিত নবী ইয়াকুবের পুত্র।

 

হযরত ইউসুফ (আঃ) যেমনি ছিলেন মহান নবীদের সন্তান, তেমনি ছিলেন অত্যন্ত উন্নত চরিত্র ও পবিত্র জীবনের অধিকারী এক মহান নবী। আল্লাহ তাঁর সম্পর্কে বলেন-

 

“ইন্নাহু কা-না মিন ইবাদিনাল মুখলাসিন- সে ছিলো আমার একান্ত বাছাই করা দাসদের একজন। ” হযরত ইউসুফের জন্ম হয় নানার বাড়িতে। জন্মের পর পিতার সারহে দাদুর বাড়িতে চলে আসেন। দাদুর বাড়ি কোথায়? হ্যাঁ, তাঁর দাদুর বাড়ি মানে নিজের বাড়ি ছিলো ফিলিস্তিনের হেবরন শহরে। তাঁর মায়ের নাম ছিলো রাহিল। হযরত ইউসুফের পিতা ইয়াকুব (আঃ) চার বিয়ে করেছিলেন। চার ঘরে তাঁর ছিলেন মোট বারো ভাই। তবে হযরত ইউসুফের সহোদর ভাই ছিলেন মাত্র একজন, বিনয়ামিন। বারো ভাইদের মধ্যে বিনয়ামিন ছিলেন সর্ব কনিষ্ঠ। ইউসুফ ছিলেন সোনার ছেলে। যেমন বাপ তেমনি ছিলেন পুত্র ইউসুফ। নবীর ছেলে ঠিক নবীর মতো জ্ঞান বুদ্ধি আর চমৎকার আচার আচরন। ইবাদাত বন্দেগীতে অগ্রগামী। আল্লাহ ভীরু, আলালহ পরায়ন। বাপ দেখলেন আল্লাহর কাছে এই ছেলেই হবে তাঁর প্রকৃত উত্তরাধিকারী। বাব এমন ছেলেকে বেশি আদর করবেন না তো কাকে আদর করবেন?

 

দশ ভাইয়ের ষড়যন্ত্র

 

ইউসুফ আর বিনয়ামিনকে পিতা নিজেই দেখাশুনা করতেন। তাছাড়া অত্যন্ত সুস্বভাবের অধিকারী হবার কারনে তিনি তাঁদের নিজের কাছে কাছে রাখতেন। অপরদিকে তাঁর অন্য দশটি ছেলে ছিলো দুষ্ট প্রকৃতির। তাঁরা বাপের মতো হয়ে গড়ে উঠেনি। তাছাড়া অন্যায় স্বভাব চরিত্রের কারনে তাঁরা পিতার বিশ্বাসভাজনও হতে পারেনি। তাঁরা একজোট হয়ে একদিন ষড়যন্ত্র পাকালো। তাঁরা বলাবলি করলো-

 

“ইউসুফ আর তাঁর ভাই বিনয়ামিন আমাদের চেয়ে বাবার কাছে অধিক প্রিয়। অথচ আমরা দশজন একটি শক্তিশালী দল। বাবা খুব ভুল করছেন। চলো আমরা ইউসুফকে মেরে ফেলি বা কোথাও নিয়ে ফেলে আসি। তখন বাবার দৃষ্টি আমাদের দিকে ফিরে আসবে। এই অপরাধটা করার পর তোমরা আবার ভালো হয়ে যেও।” (সূরা ১২ ইউসুফঃ আয়াত ৮-৯)

 

যে কথা সে কাজ। তাঁরা তাঁদের পিতার কাছে এসে বললো- বাবা, আপনি ইউসুফের ব্যাপারে আমাদের উপর আস্থা রাখেননা কেন? আমরা তো সব সময় তাঁর ভালোই চাই। আগামীকাল ওকে আমাদের সাথে দিন। আমাদের সাথে গিয়ে ফলমূল খাবে আর দৌড়াদৌড়ি করে মন চাংগা করবে। আমরা তাঁর পূর্ণ হিফাজত করবো।

 

বাবা বললেন- তোমরা তাঁকে নিয়ে গেলে আমি চিন্তাগ্রস্ত থাকবো। আমার শংকা হয়, তোমরা ওর প্রতি অমনোযোগী হয়ে পড়বে আর এ ফাকে ওকে বাঘ খেয়ে ফেলবে।

 

দশ ভাই বললো- আমরা এতগুলো লোক থাকতে ওকে বাঘে খাবে? তবে তো আমরা বড় অকর্মণ্য বলে প্রমানিত হবো। তারপর কি হলো? ইনিয়ে বিনিয়ে বাবাকে এটা ওটা বুঝিয়ে ওরা পরদিন ইউসুফকে বনের দিকে নিয়ে গেলো।      আলালহভক্ত এই ছেলেটিকে ওদের হাতে ছেড়ে দিয়ে দারুন চিন্তার মধ্যে সময় কাটাতে থাকেন ইয়াকুব।

 

কূপে ফেলে দিলো ইউসুফকে

 

সে এলাকা দিয়ে ছিলো একটি আন্তর্জাতিক পথ। এ পথে মিশর থেকে সিরিয়া আর সিরিয়া থেকে মিশরে বাণিজ্য কাফেলা যাতায়াত করতো। ব্যবসায়ীদের পানি পানের সুবিধার্থে লোকেরা পথিমধ্যে এখানে সেখানে পানির কূপ খনন করে রাখতো। ব্যবসায়ীরা কূপের কাছে বিশ্রাম নিতে আর বালতি ফেলে কূপ থেকে পানি উঠিয়ে পান করতো।

 

ইউসুফের দুরাচার নিষ্ঠুর ভাইয়েরা তাঁকে নিয়ে গিয়ে এমনই একটি কূপে ফেলে দিলো। আল্লাহ ছাড়া সেখানে ইউসুফকে সাহায্য করবার আর কেউই ছিলোনা। ইউসুফ সকল ক্ষমতার মালিক একমাত্র আল্লাহর উপর ভরসা করলেন। তাঁর মহান প্রভু আল্লাহ অহীর মাধ্যমে তাঁকে শান্তনা দিলেন এবং ভবিষ্যতের সুসংবাদ জানিয়ে দিলেন।

 

বাপের কাছে বানোয়াট কাহিনী

 

এবার দশ ভাই ফন্দি আঁটলো বাপের কাছে এসে কি বলবে? যারা মিথ্যা বলতে পারে, তাঁদের জন্যে কোন একটা ফন্দি এঁটে নেয়া তো কঠিন নয়। ইউসুফকে কূপে ফেলে দেয়ার সময় তাঁরা তাঁর জামাটা রেখে দিয়েছিলো। একটা পশু যবাই করে এবার ইউসুফের জামায় সেটার রক্ত মেখে নিলো। সন্ধ্যার পর ভান করে কাঁদতে কাঁদতে দশ ভাই বাড়ি ফিরে এলো। ইউসুফের রক্তমাখা জামা বাপের সামনে রেখে দিয়ে বললো- “বাবা, আমরা দশভাই দৌড় প্রতিযোগিতা করছিলাম। এদিকে ইউসুফকে বসিয়ে রেখেছিলাম আমাদের জিনিসপত্রের কাছে। হঠাৎ এক নেকড়ে এসে ওকে খেয়ে ফেলে। আমরা সত্য কথা বলছি বাবা, জানি, আমরা যতই সত্য বলিনা কেন আপনি আমাদের কথা বিশ্বাস করবেননা।” (সূরা ১২ ইউসুফঃ আয়াত ১৭)

 

দেখলেন তো মিথ্যাবাদীদের সত্য বলার ধরন। তাঁদের পিতা মহান নবী হযরত ইয়াকুব এতো বড় ঘটনা ঘটে যাবার পরও কেবল আল্লাহর সাহায্য চেয়ে ধৈর্য ধারন করলেন।

 

রাখে আল্লাহ মারে কে?

 

এদিকে ইউসুফের কি হলো? ইউসুফ কি বেঁচে আছেন, না কূপে ডুবে মারা গেছেন? আল্লাহ যাকে বাচান তাঁকে মারার শক্তি কার আছে? আল্লাহ কূপের মধ্যে ইউসুফের বেঁচে থাকার ব্যবস্থা করেন। ইউসুফ সুস্থ শরীরে বেঁচে আছেন। ইতোমধ্যে সেখানে একটি বাণিজ্য কাফেলা এসে অবতরন করলো। তাঁরা তাঁদের একজনকে কূপ থেকে পানি উঠাতে পাঠালো। সে যখন পানির জন্যে বালতি ফেললো, ইউসুফ তাঁর বালতি ধরে উঠে এলেন। লোকটি চিৎকার করে উঠলো- কি চমৎকার, এ যে এক বালক। তাঁরা তাঁকে নিয়ে গিয়ে পণ্যদ্রব্য হিসেবে বিক্রি করে দিলো। বিক্রি করলো মাত্র সামান্য কয়েক দিরহামে।

 

মিশরে ইউসুফ

 

মিশরের ‘আযিয মিশর’ উপাধিধারী এক বড় মন্ত্রী ইউসুফকে বিনিকদের কাছ থেকে কিনে নেন। তিনি ইউসুফকে বাড়ি নিয়ে গিয়ে তাঁর স্ত্রীকে বললেন- ‘একটি ছেলে কিনে এনেছি। ওকে যত্ন করে রেখো। ও আমাদের উপকারে আসতে পারে, আর নয়তো তাঁকে আমরাই পুত্র বানিয়ে নেবো।’

 

এবার দেখুন আল্লাহর ক্ষমতা। তিনি কিভাবে ইউসুফকে বাঁচিয়ে নিয়ে এলেন সেকালের শক্তিশালী রাজ্য মিশরের ক্ষমতাবানদের ঘরে। আল্লাহ বলেন-

 

“এভাবে আমি ইউসুফের জন্যে সে দেশে প্রতিষ্ঠিত হবার পথ বের করে দিলাম। সেই সাথে আমি তাঁকে সবকিছুর মর্ম বুঝার শিক্ষাও দান করলাম।”

 

এ ঘরে ইউসুফ রাজপুত্রের সমাদরে বড় হতে থাকলেন। এখানেই তিনি যখন পূর্ণ যৌবনপ্রাপ্ত হলেন, তখন আল্লাহ তাঁকে নবুয়্যত দান করেন। তাঁকে নবুয়্যত দান করে আল্লাহ বলেন – “আমি নেক লোকদের এভাবেই প্রতিদান দিয়ে থাকি। ” (সূরা ১২ ইউসুফঃ আয়াত ২২)

 

জেলে যাবো তবু পাপ করবোনা

 

তখনকার মিশরের লোকদের নৈতিক চরিত্র ছিলো খুবই খারাপ। তাঁদের নারী পুরুষ সবাই নির্লজ্জের মতো পাপ কাজ করে বেড়াতো। কেউ পাপ কাজ করলে অন্যেরা সেটাকে খারাপ মনে করতোনা। ইউসুফ যেমন ছলেন জ্ঞানী, গুনী, বুদ্ধিমান, ঠিক তেমনি ছিলেন অত্যন্ত সুন্দর, সুশ্রী এক বলিষ্ঠ যুবক। সেই ‘আযিয মিশরের’ স্ত্রী এবং অন্যান্য শহুরে মহিলারা ইউসুফকে চারিদিক থেকে পাপ কাজে নামাবার জন্যে ফুসলাতে থাকে। আযীয মিশরের স্ত্রী জুলেখা একপক্ষীয়ভাবে ইউসুফের সাথে পাপ কাজে লিপ্ত হবার জন্যে পাগল হয়ে যায়। একদিন সে ঘরের সব দরজা বন্ধ করে দিয়ে ইউসুফকে বলে- ‘আসো’

 

ইউসুফ বলেন- “এমন কর্ম থেকে আমি আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই। আমার প্রভু আমাকে উচ্চ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছেন। যারা পাপ কাজ করে তাঁরা কখনো সাফল্য অর্জন করেনা।” (সূরা ১২ ইউসুফঃ আয়াত ২৩)

 

একথা বলে ইউসুফ ঘর থেকে বের হয়ে যাবার জন্যে দরজার দিকে দৌড়ালেন। মহিলাটিও তাঁকে ধরার জন্যে তাঁর পেছনে পেছনে দৌড়ালো। মহিলাটি পেছন থেকে ইউসুফের জামা টেনে ধরে। ইউসুফ দৌড়াতে থাকেন। ফলে টানাটানিতে তাঁর জামা ছিড়ে যায়। ইউসুফ দরজা পর্যন্ত চলে আসেন এবং দরজা খুলে ফেলেন। দরজা খুলতেই তাঁরা দু’জনে মহিলার স্বামী আযীয মিশরকে দরজার সামনে দাঁড়ানো দেখতে পায়। পাপিষ্ঠ মহিলাটি হন্তদন্ত হয়ে ইউসুফের প্রতি ইংগিত করে তাঁর স্বামীকে বলে উঠে- ‘যে আপনার স্ত্রীর সাথে বদ কাজ করতে চাইছে, তাঁকে কারাগারে নিক্ষেপ করুন অথবা কঠিন শাস্তি দিন।’

 

ইউসুফ বললেন- আমি নই, তিনিই আমাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছেন। দুই ধরনের কথার প্রেক্ষিতে আযিয মিশর বেকায়দায় পড়ে যান। এমতাবস্থায় মহিলার ঘরেরই একজন সাক্ষী দিয়ে বললো- ‘দেখুন, ইউসুফের জামা যদি সামনের দিক থেকে ছেড়া হয়ে থাকে, তাহলে ইউসুফ মিথ্যাবাদী এবং আপনার স্ত্রী সত্যবাদী। আর ইউসুফের জামা যদি পেছনের দিক থেকে ছেড়া থাকে, তাহলে ইউসুফ সত্যবাদী এবং আপনার স্ত্রী মিথ্যাবাদী।’ তাঁর স্বামী যখন দেখলেন, ইউসুফের জামা পেছন দিক থেকে ছেড়া, তখন তিনি তাঁর স্ত্রীকে বলেন- “এটা তোমারই চক্রান্ত। নারীদের ছলনা চক্রান্ত খুবই শক্তিশালী। হে ইউসুফ, তুমি বিষয়টা উপেক্ষা করো। হে আমার স্ত্রী, তুমি ক্ষমা চাও, কারন তুমিই দোষী।”

 

আযীয মিশরের স্ত্রীর এই ছিনালির খবর ছরিয়ে পড়ে চারিদিকে। কানাঘুষা চলতে থাকে উপরের তলার মহিলাদের মধ্যে। তাঁদের কথা হলো- ছিনালি করবি তো কর উপরের তলার কোন পুরুষের সাথে, ক্রীতদাসের করতে গেলি ক্যান?

 

তাঁদের এসব কথাবার্তার খবর এসে পৌঁছে যায় আযীয মিশরের স্ত্রী জুলেখার কানেও। তাঁর কথা হলো- ওরা আমার কাংখিত যুবকটি সম্পর্কে না জেনেই ওরা আমাকে দোষারোপ করছে।

 

ফলে জুলেখা তাঁদের ভুল ধারনা দূর করার সিদ্ধান্ত নেয়। সে উপর তলার মহিলাদের জন্যে আয়োজন করে এক ভোজ সভার। তাঁদেরকে নিমন্ত্রন জানায় নির্দিষ্ট দিন। খাবার টেবিলে খাবার সাজিয়ে রাখে। কেটে কেটে খাবার জন্যে তাঁদের প্রত্যেকের জন্যে সরবরাহ করে একটি করে ছুরি। সবাই ছুরি দিয়ে ফল কেটে কেটে খাচ্ছে, এমনি সময় জুলেখা ইউসুফকে তাঁদের সামনে আসতে আদেশ করে। ইউসুফ ডাইনিং হলে ঢুকতেই সবগুলো নারী বিস্ময়ে হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে ইউসুফের দিকে। তাঁরা আত্মভোলা হয়ে কেটে ফেলে নিজেদের হাত। তাঁরা স্বগত স্বত্বস্ফ্রত বলে উঠে- ‘আল্লাহর কসম, এতো মানুষ নয়, সাক্ষাত এক সম্মানিত ফেরেশতা।’ এবার জুলেখা বলে উঠে, দেখো, তোমরা না জেনে এমন একজন যুবকের ব্যাপারেই আমাকে তিরস্কার করছিলে। আমি অবশ্যি তাঁকে নিবেদন করেছি। কিন্তু সে আমার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। এখন থেকে সে যদি আমার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে তাহলে অবশ্যি আমি তাঁকে হীন ও লাঞ্ছিত করে কারাগারে নিক্ষেপ করবো। আল্লাহর একান্ত অনুগত দাস ইউসুফ তো কিছুতেই পাপ কাজে নিমজ্জিত হতে পারেননা। এখন তাঁদের সবার জালাতনে তিনি অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। উপর তলার সব মহিলার দৃষ্টি এখন ইউসুফের দিকে। নাগিনীদের চতুর্মুখী ছোবলের মুখে ইউসুফ এক মুহূর্তের জন্যেও তাঁর মহামনিব আল্লাহর অসন্তুষ্টির পথে পা বাড়াননি। ইউসুফ আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন-

 

“ওগো আমার প্রভু, এরা আমাকে যে কাজের দিকে ডাকছে তাঁর চাইতে কারাগারই আমার কাছে অধিকতর প্রিয়। আমার প্রভু, এদের চক্রান্ত থেকে তুমি যদি আমাকে না বাঁচাও, তাহলে তো আমি এদের ফাঁদে আঁটকে যাবো।’’ (সূরা ১২ ইউসুফঃ আয়াত ৩৩)

 

কারাগারে ইউসুফ

 

আল্লাহ ইউসুফের ফরিয়াদ কবুল করলেন। নারীদের চক্রান্ত থেকে তাঁকে রক্ষা করলেন। যাদের নারীরা ইউসুফের জন্যে উন্মাদ হয়ে পড়েছিলো, তাঁরা একটি মেয়াদের জন্যে ইউসুফকে কারাগারে পাঠিয়ে দিলো। অথচ তাঁরা জানতো ইউসুফ সম্পূর্ণ নির্দোষ। এভাবে ইউসুফ নৈতিক পরীক্ষায় মহাবীরের বেশে বিজয়ী হলেন। আর মিশরের অভিজাত মহল তাঁর চারিত্রিক আদর্শের কাছে চরমভাবে পরাজিত হলো।

 

দুই কয়েদীর স্বপ্ন এবং ইউসুফের দাওয়াতী কাজ

 

ইউসুফ জেলে এসে কৌশলের সাথে আল্লাহর দ্বীন প্রচারের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর জ্ঞান, বুদ্ধি, উন্নত চরিত্র আর দাওয়াতী কাজে আকৃষ্ট হয়ে কয়েদীরা তাঁর ভক্ত হয়ে পড়ে। এক রাতে দু’জন কয়েদী স্বপ্ন দেখলো। তাঁরা ভাবলো, ইউসুফ ছাড়া আর কেউ তাঁদের স্বপ্নের মর্মার্থ বলে দিতে পারবেনা। ছুটে এলো তাঁরা ইউসুফের কাছে।

 

একজন বললো- ‘আমি স্বপ্ন দেখেছি, আমি মদ তৈরি করছি’।

 

অপরজন বললো- ‘আমি স্বপ্ন দেখেছি, আমার মাথায় রুটি রাখা আছে আর পাখি তা থেকে খাচ্ছে।’

 

এরা দু’জন ছিলো মিশর রাজের কর্মচারী। একজন ছিলো রাজার মদ প্রস্তুতকারক, আর অপরজন ছিলো রাজার রুটি প্রস্তুতকারক।

 

ইউসুফ ওদের স্বপ্নের কথা শুনে বললেন- তোমাদের খাবার আসার আগেই আমি তোমাদের স্বপ্নের ব্যাখ্যা বলে দেবো। এই ফাকে তোমরা আমার কিছু কথা শুনো। আমি মহান প্রভু আল্লাহর দেয়া জ্ঞানের ভিত্তিতে তোমাদের বলছি-

 

“আল্লাহর সাথে কাউকেও শরীক করা উচিত নয়। এটা আমাদের এবং গোটা মানবজাতির উপর আল্লাহর বিরাট অনুগ্রহ, তিনি আমাদেরকে তাঁর ছাড়া অন্য কারো দাসত্ব করার জন্যে সৃষ্টি করেননি। কিন্তু অধিকাংশ লোক তাঁর শোকর আদায় করেনা।”

 

“হে আমার কারাসাথীরা, চিন্তা করে দেখো, ভিন্ন ভিন্ন বহু খোদা ভালো, নাকি একজন সর্বশক্তিমান আল্লাহ ভালো? তাঁকে বাদ দিয়ে তোমরা যার ইবাদাত করছো, তাঁরা তো মাত্র কতগুলো নাম। এ নামগুলো তো তোমরাই রেখেছো।”

 

“আসলে সকল ক্ষমতার উৎস একমাত্র মহান আল্লাহ। কৃতিত্ব শুধুমাত্র তাঁর। তিনি হুকুম দিয়েছেন তোমরা তাঁর ছাড়া আর কারো দাসত্ব করবেনা। এটাই হলো সঠিক সরল জীবন পদ্ধতি। কিন্তু অধিকাংশ লোক তা জানেনা।” (সূরা ১২ ইউসুফঃ আয়াত ৩৮-৪০)

 

ব্যাস, একটি মোক্ষম সময় বেছে নিলেন হজরত ইউসুফ ওদেরকে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেওয়ার জন্যে। এটি মোক্ষম সময় এ জন্যে ছিলো যে হজরত ইউসুফ দেখলেন-

 

১. তাঁরা তাঁর অত্যন্ত ভক্ত অনুরক্ত হয়েছে এবং

 

২. এ সময় তাঁরা মনোযোগ দিয়ে তাঁর কথা শুনবে।

 

হজরত ইউসুফ তাঁদেরকে কিসের দাওয়াত দিলেন? তিনি তাঁদের যে দাওয়াত দেন, তাঁর মৌলিক কথা হলো-

 

১. আল্লাহ এক, তাঁর কোন শরীক নাই।

 

২. আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন একমাত্র তাঁর দাসত্ব করার জন্যে। অন্য কারো দাসত্ব করার জন্যে নয়।

 

৩. আল্লাহ সর্বজয়ী, সর্বশক্তিমান।

 

৪. সমস্ত ক্ষমতা ও কৃতিত্বের মালিক একমাত্র আল্লাহর।

 

৫. তিনি মানুষকে কেবল তাঁর হুকুম মেনে চলার নির্দেশ দিয়াছেন।

 

৬. এক আল্লাহর নির্দেশ মতো জীবন যাপন করাই সত্য সঠিক ও বাস্তব দ্বীন বা জীবন পদ্ধতি।

 

এমনি চমৎকার ভাবে দাওয়াত পেশ করার পর এবার তিনি তাঁদের স্বপ্নের ব্যাখ্যা বলে দিলেন। বললেন-

 

“তোমাদের প্রথমজন তাঁর মনিবকে মদ পান করাবার চাকুরিতে ফিরে যাবে। আর দ্বিতীয়জনকে শুলে চরিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে এবং পাখি তাঁর মাথা ঠুকে ঠুকে মগজ খাবে। এই হলো তোমাদের স্বপ্নের ব্যাখ্যা।” (সূরা ১২ ইউসুফঃ আয়াত ৪১)

 

সত্যি তাই হলো। একজন মুক্তি পেলো এবং নিজের পূর্বের চাকুরিতে ফিরে গেলো। অপরজনকে শুলে করে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় এবং পাখি তাঁর মাথায় বসে মগজ খুঁটে খুঁটে খায়।

 

স্বপ্ন দেখেন রাজা

 

কারাগারে হজরত ইউসুফের আরো কয়েকটি বছর কেটে যায়। তিনি সেখানেই দীনের কাজ করতে থাকেন। এরি মধ্যে মিশরের রাজা এক স্বপ্ন দেখেন। তিনি স্বপ্ন দেখেন-

 

“সাতটি মতা তাজা গাভীকে সাতটি শুকনো হালকা পাতলা গাভী খেয়ে ফেলছে। আরো দেখেন সাতটি সবুজ শস্যের ছড়া আর সাতটি শুকনো ছড়া।”

 

রাজা তাঁর পারিষদবর্গকে এ স্বপ্নের ব্যাখ্যা করতে বললেন। কিন্তু তাঁরা কেউই এর ব্যাখ্যা করতে পারলোনা। এ সময় হঠাৎ ইউসুফের সেই কারা সাথিটির মনে পড়লো ইউসুফের কথা। সে বললো- আমাকে ইউসুফের কাছে পাঠিয়ে দিন, আমি স্বপ্নের ব্যাখ্যা এনে দিচ্ছি। তাই করা হলো। সে ছুটে এলো কারাগারে। ইউসুফের কাছে এসে বললো-

 

“হে মহাসত্যবাদী ইউসুফ, আমাদের রাজা এই স্বপ্নে দেখেছেন। আপনি এর ব্যাখ্যা বলে দিন।” ইউসুফ রাজার স্বপ্নের মর্ম বলে দিলেন। তিনি বললেন- “তোমরা সাত বছর লাগাতার চাষাবাদ করবে। এ সময় যে ফসল কাটবে, তা থেকে আহারের পরিমান ছড়া (শীষ) থেকে বের করবে, বাকিটা ছড়া সমেত রেখে দেবে। তারপর তোমাদের দেশে আসবে দুর্ভিক্ষের সাত বছর। এ সময় খুব কমই ফসলাদি হবে। এ সময় আগের সাত বছরের সংরক্ষিত ফসল খাবে। অতপর একটি বছর আসবে, তখন প্রচুর বৃষ্টিপাত হবে এবং প্রচুর ফসল উঠবে।”

 

(সূরা ১২ ইউসুফঃ আয়াত ৪৭-৪৯)

 

লোকটি এই স্বপ্নের ব্যাখ্যা নিয়ে গিয়ে রাজাকে বললো। এ ব্যাখ্যা রাজার মনের মতো হলো। তিনি ব্যাখ্যাটি দারুন পছন্দ করলেন আর কারাগারে লোক পাঠিয়ে দিলেন ইউসুফকে নিয়ে আসার জন্যে। রাজার দূত যখন ইউসুফকে কারাগার থেকে বের করে নিতে এলো, ইউসুফ তাঁকে বললেন, ফিরে যাও। রাজাকে গিয়ে বলো, আগে সেই মহিলাদের বিচার করতে, যারা চক্রান্ত করে আমাকে কারাগারে পাঠিয়েছে।

 

রাজা সেই মহিলাদের ডেকে পাঠালেন এবং তাঁদের কাছে কৈফিয়ত চাইলেন। তাঁরা বললো- “আল্লাহর কসম, ইউসুফ কোন অন্যায় করেনি, কোন পাপ করেনি। আমরাই তাঁকে ফাসাতে চেষ্টা করেছিলাম। সে সম্পূর্ণ নিষ্পাপ, নির্দোষ এবং সে অত্যন্ত সৎ ও সত্যবাদী।”

 

এ সত্য উদঘাটিত হবার পর ইউসুফ বললেন- আমি তো চেয়েছিলাম, এ সত্য প্রকাশিত হোক আর আযীয জানতে পারুক, আমি বিশ্বাস ঘাতকতা করিনি। আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ।

 

ইউসুফের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা লাভ

 

রাজা নির্দেশ দিলেন যাও, এবার ইউসুফকে আমার কাছে নিয়ে এসো। আমি তাঁকে একান্তভাবে নিজের জন্যে নিয়োগ করবো। ইউসুফ জেল থেকে বেরিয়ে এলেন। রাজা যখন তাঁর সাথে কথা বললেন, তিনি তাঁর অগাধ জ্ঞান, বুদ্ধিমত্তা আর বলিষ্ঠ নৈতিক চরিত্র দেখে অভিভূত হলেন। তিনি বললেন- আপনি এখন আমাদের এখানে পূর্ণ সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী। আপনি অত্যন্ত বিশ্বস্ত। ইউসুফ বললেন- আপনি দেশের অর্থ ভাণ্ডারের দায়িত্ব আমার উপর ন্যস্ত করুন। আমি তা যথাযথ সংরক্ষণ করবো। এ ব্যাপারে আমি জ্ঞান রাখি। রাজা তাই করলেন। আর এভাবেই মহান আল্লাহ ইউসুফের জন্যে রাষ্ট্রীয় কৃতিত্বের পথ পরিস্কার করে দিলেন। তিনি সৎলোকদের প্রতিদান কখনো বিনষ্ট করেননা। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে পৃথিবীতেও তাঁদের পুরস্কৃত করেন আর পরকালের প্রতিদান তো রয়েছেই। শেষ পর্যন্ত রাজা ইউসুফের সততা, দক্ষতা ও আন্তরিক নিষ্ঠার জন্যে গোটা দেশের শাসনভারই ছেড়ে দেন ইউসুফের উপর এবং নিজে তাঁর পৃষ্ঠপোষকতা করেন।

 

ইউসুফের ভাইয়েরা এলো মিশরে

 

হযরত ইউসুফ (আঃ) অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাবার পর সাত বছর খুব ফসল হয়। তিনি সুন্দরভাবে ফসল সংরক্ষন করেন। এরপর আসে পরবর্তী দুর্ভিক্ষের সাত বছর। এ সময় সংরক্ষিত ফসল ভাণ্ডার দিয়ে দুর্ভিক্ষের মোকাবেলা করেন। ফিলিস্তিনের দিকেও দেখা দেয় দুর্ভিক্ষ। মিশরে খাদ্য মজুদ থাকার খবর শুনে বিভিন্ন দেশের লোকেরা খাদ্য শস্যের জন্যে ছুটে আসে মিশরে। ইউসুফের ভাইয়েরাও খাদ্য কেনার জন্যে ছুটে আসে মিশরে। হ্যাঁ, ইউসুফের সেই দশভাই মিশরে এলো। তাঁরা অর্থকড়ি নিয়ে এসেছে খাদ্য শস্য কেনার জন্যে।

 

তাঁরা এসে অর্থমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করতে চাইলো। ফলে তাঁদেরকে নিয়ে যাওয়া হলো ইউসুফের কাছে। তাঁরা ইউসুফকে মোটেও চিনতে পারেনি। কিন্তু ইউসুফ তাঁদের চিনে ফেললেন। তাঁদের সাথে কথাবার্তা বললেন। খোঁজ খবর নিলেন। বললেন, একটি ভাইকে আবার বাড়িতে রেখে এলেন কেন? আবার আসার সময় তাকেও নিয়ে আসবেন। ছোট্টভাইটিকে অর্থাৎ বিনয়ামিনকে দেখার জন্যে ইউসুফের মন ছটফট করছিলো। তিনি তাঁদের বিদায় দেয়ার সময় বলে দিলেন, দেখুন আমি খুবই অতিথি পরায়ন। দেখছেন না আমি কি রকম পাত্র ভরে দিচ্ছি? আপনাদের ছোট ভাইটিকেও নিয়ে আসবেন। ওকে নিয়ে না এলে আপনাদের আর এখানে আসার দরকার নেই। আর আপনাদের খাদ্য শস্য দেয়া হবেনা। ইউসুফ এদিকে তাঁর কর্মচারীদের গোপনে বলে দিলেন, ওরা খাদ্য শস্যের বিনিময়ে যে অর্থ দিয়েছে সেগুলো চুপিসারে, তাঁদের শস্যের বস্তায় ঢুকিয়ে ফিরিয়ে দাও। বাড়ি ফিরে এসে তাঁরা তাঁদের পিতাকে বললো- আব্বা, বিনয়ামিনকে নিয়ে না গেলে এরপর আমাদের আর খাদ্যশস্য দেবেনা। এবার ওকে আমাদের সাথে দিন। আমরা অবশ্যি তাঁর হিফাজত করবো। বস্তা খোলার পর খাদ্যশস্যের সাথে অর্থকড়ি ফিরিয়ে দিয়েছে দেখে তাঁরা খুশিতে বাগবাগ হয়ে উঠলো। তাঁরা বলল- আব্বাজান, আমাদের আর কি চাই। এই দেখুন, আমাদের অর্থকড়ি ফিরিয়ে দিয়েছে। আমরা আবার যাবো। আমাদের ভাইয়ের হিফাজত করবো। তাঁদের পিতা হযরত ইয়াকুব বললেন- তোমাদের তো বিশ্বাস করা যায়না। আল্লাহই সত্যিকার হিফাজতকারী। আমি ততক্ষন পর্যন্ত ওকে তোমাদের সাথে দেবোনা, যতক্ষন না তোমরা আল্লাহর নামে ওকে ফিরিয়ে আনার শপথ না করবে। সুতরাং তাঁরা বিনয়ামিনকে ফিরিয়ে আনবে বলে আল্লাহর নামে শপথ করলো। এবার হযরত ইয়াকুব ওকে তাঁদের সাথে দিলেন। আর তাঁদের বলে দিলেন, তাঁরা যেন বিভিন্ন পথে মিশরে প্রবেশ করেন। একত্রে একই পথে যেনো না ঢুকে। এরপর কি হলো? এরপর তাঁরা মিশরে এলো। ইউসুফের কার্যালয়ে প্রবেশ করলো। ইউসুফ বিনয়ামিনকে একান্তে ডেকে নিয়ে নিজের পরিচয় দিলেন। ওহ, তখন দুই সহোদর ভাইয়ের কী যে আনন্দ, কিন্তু দশভাইকে তাঁরা এটা বুঝতে দেননি। তাঁদের মালপত্র প্রস্তুত করে দেউয়া হলো। এ সময় ইউসুফ নিজ ভাইয়ের মালের সাথে একটি সোনার পেয়ালা ঢুকিয়ে দিলেন। তাঁরা মালপত্র নিয়ে রওয়ানা করলো। কিছুদূর যেতে না যেতেই পিছে থেকে ডাক পড়লো। তাঁদের বলা হলো, তোমরা চোর।

 

তাঁরা জিজ্ঞেস করলো- কেন, আপনাদের কি হারিয়েছে?

 

 কর্মচারীরা বললো- বাদশাহর পানপাত্র হারিয়েছে। তাঁরা বললো- আল্লাহর কসম আমরা অনাসৃষ্টি করতে আসিনি। আর আমরা চোরও নই।

 

‘তোমাদের কথা মিথ্যা প্রমান হলে চোরের কি শাস্তি হবে?’

 

‘যার কাছে পেয়ালা পাওয়া যাবে, আপনারা তাঁকে রেখে দেবেন। আমাদের ওখানে যালিমদের শাস্তির বিধান এটাই।’

 

এবার তল্লাশি শুরু হলো। প্রথমেই দশভাইয়ের মাল তল্লাশি করা হলো। সবশেষে বিনয়ামিনের মালপত্র থেকে উদ্ধার করা হয় পেয়ালা।

 

দশভাই বললো- ‘এ যদি চুরি করে থাকে তাহলে অবাক হবার কিছু নেই। ইতিপূর্বে তাঁর সহোদর ইউসুফও চুরি করেছিলো।’ ইউসুফ তাঁদের অপবাদ নীরবে হজম করেন। সত্য তাঁদের কাছে এখনো প্রকাশ করলেননা। মনে মনে বললেন- তোমরা বড় বদ। আল্লাহ প্রকৃত সত্য অবগত আছেন। তাঁরা আবদার করলো, বিনয়ামিন ধরা পড়লেও তাঁর পরিবর্তে তাঁদের কোন একজনকে রেখে দিতে। ইউসুফ তা অন্যায় বলে অস্বীকার করলেন। ফলে তাঁরা নিরাশ হয়ে বাইরে গিয়ে ভাবতে থাকে এখন কী করবে?

 

তাঁদের মধ্যে যে ভাইটি সবচে বড়, সে বললো- তোমাদের কি মনে নেই তোমরা তোমাদের পিতার সাথে কি অংগীকার করে এসেছো? তোমরা বিনয়ামিনকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে বলে আল্লাহর নামে অংগীকার করে আসোনি? ইতোপূর্বে ইউসুফের ব্যাপারেও তোমরা বাড়াবাড়ি করেছো, তাও তোমাদের মনে আছে। এখন আমি এখানেই থেকে যাবো। আল্লাহর কোন ফায়সালা না হলে অথবা বাবা অনুমতি না দিলে আমি এখান থেকে ফিরে যাবোনা। তোমরা বাবার কাছে গিয়ে সব ঘটনা খুলে বলোগে।

 

ওরা বাড়ি ফিরে এসে যখন তাঁদের পিতা হজরত ইয়াকুবের কাছে ঘটনা বললো, তখন তিনি বললেন- আমি সবর করবো। মহান আল্লাহ ওদের দুই ভাইকেই আমার কাছে ফিরিয়ে আনতে পারেন। তিনি তো সবকিছু জানেন।

 

এদিকে দুঃখ বেদনায় হজরত ইয়াকুব জর্জরিত হয়ে পড়েন। কাঁদতে কাঁদতে তাঁর চোখ অন্ধ হয়ে যায়। তিনি ছেলেদের বলেন- যাও, ইউসুফ আর তাঁর ভাইকে অনুসন্ধান করো। আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না।

 

ইউসুফের সন্ধান লাভ

 

তাঁরা আবার ফিরে এলো মিশরে। ইউসুফের সাথে দেখা করে বললো- “হে আযীয, আমরা এবং আমাদের পরিবার পরিজন কঠিন বিপদের সম্মুখীন হয়েছি। সামান্য পুঁজি নিয়ে এসেছি। আপনি দয়া করে পুরো মাত্রায় খাদ্যশস্য দিন। আমাদের দান করুন। আল্লাহ দানকারীদের অবশ্যি প্রতিদান দিয়ে থাকেন।”

 

ওদের বক্তব্য শুনে ইউসুফ বললেন- “তোমাদের কি মনে নেই তোমরা যখন অজ্ঞ ছিলে তখন ইউসুফ আর তাঁর ভাইয়ের সাথে কি ব্যবহারটা করেছিলে?”

 

একথা শুনে তাঁরা আঁতকে উঠলো। বললো- “হায়, তুমিই কি ইউসুফ?”

 

“হ্যাঁ, আমিই ইউসুফ আর এই বিনয়ামিন আমার ভাই। মহান আল্লাহ আমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। যারাই আল্লাহকে ভয় করবে আর সবর অবলম্বন করবে, আল্লাহ সেই সৎ লোকদের কর্মফল নষ্ট করবেন না।”

 

ওরা দশভাই বললো- আল্লাহর কসম, আল্লাহ তোমাকে আমাদের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন। সত্যিই আমরা বড় অপরাধ করেছি।

 

ইউসুফ বললো- “আজ আর তোমাদের প্রতি আমার কোন অভিযোগ নেই। আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করুন। তিনি সব দয়ালুর বড় দয়ালু।”

 

এরপর ইউসুফ তাঁর গায়ের জামা তাঁদের দিয়ে বললেন- এ জামাটি নিয়ে বাড়ি চলে যাও। এটি আমার আব্বাজানের মুখমণ্ডলে রেখো। এতে তিনি দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাবেন। আর আমাদের আব্বা আম্মাসহ তোমাদের সমস্ত পরিবার পরিজনকে মিশরে নিয়ে এসো। দশভাই এবার মনের সুখে ফিলিস্তিন অভিমুখে যাত্রা করলো। এদিকে এরা যাত্রা করেছে আর ওদিকে হজরত ইয়াকুব বাড়ির লোকদের বললেন- আমি ইউসুফের সুবাস পাচ্ছি, তোমরা আমাকে বুড়ো বয়েসের বুদ্ধিভ্রষ্ট বলোনা।

 

ইতোমধ্যে ওরা ইউসুফের সুসংবাদ নিয়ে বাড়ি পৌঁছে গেলো। ঐ জামাটি হজরত ইয়াকুবের মুখমণ্ডলে স্পর্শ করার সাথে সাথে তিনি দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেলেন। আনন্দে খুশিতে হজরত ইয়াকুব আল্লাহর শুক্রিয়া আদায় করলেন। ওরা দশভাই বাবার কাছে ক্ষমা চাইলো। বাবাকে ওদের জন্যে আল্লাহর কাছে দোয়া করতে বললো। তিনি তাঁদের জন্যে দোয়া করলেন।

 

ইয়াকুব পরিবারের হিজরত

 

হজরত ইয়াকুব সবাইকে হিজরতের প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দিলেন। সহসাই বিরাট পরিবার পরিজনের বহর নিয়ে তাঁরা মিশরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। জানা যায় এ এসময় হজরত ইয়াকুবের পরিবারের সদস্য সংখ্যা ছিলো ৬৭ জন। তাঁরা যেদিন মিশরের রাজধানীর কাছে পৌঁছলেন, সেদিন মিশরে ছিলো একটি উৎসবের দিন। উৎসব উপলক্ষে বিপুল সংখ্যক লোক এক যায়গায় একত্রিত হয়। হজরত ইউসুফ সেনাবাহিনী ও জনগনের বিরাট এক শোভাযাত্রাসহ তাঁর পিতা মাতাকে অভ্যর্থনা জানান। ইউসুফের বাবা মা ও পরিবারবর্গের মিশরে আগমনের খবর শুনে জনগনের মাঝে খুশির জোয়ার বয়ে আসে। স্বয়ং মিশরের রাজা ইউসুফকে নির্দেশ দেন, তাঁদের বড় আকারে সংবর্ধনা জানাবার। বাবা মা ও আপনজনদের মিশর আগমনে আজ ইউসুফের মনে যে কী খুশি আর কত যে আনন্দ, তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। ইউসুফ তাঁদের মহাসমারোহে এগিয়ে আনেন। বাবা মাকে নিজের আসনে বসান। তাঁরা সবাই ইউসুফের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।

 

সত্য হলো ইউসুফের স্বপ্ন

 

ভাইয়েরা সবাই ইউসুফের কাছে নত হলো। তাঁর কাছে ক্ষমা চাইলো। বাবা মা ইউসুফকে পেয়ে আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায় করলেন। এভাবেই ইউসুফ ছোট্ট বেলায় যে স্বপ্ন দেখেছিলেন তা সত্যে পরিনত হলো। ইউসুফ বললেন-

 

“আব্বাজান, আমি যা স্বপ্ন দেখেছিলাম, এ হলো সেই স্বপ্নের মর্ম। আমার প্রভু, আমার স্বপ্নকে সত্যে পরিনত করেছেন। তিনি আমার প্রতি বিরাট অনুগ্রহ দেখিয়ে আমাকে কারাগার থেকে বের করে এনেছেন। আপনাদের মরু অঞ্চল থেকে বের করে এনে আমার সাথে মিলিত করেছেন। অথচ শয়তান আমার ও আমার ভাইদের মাঝে বিরোধ সৃষ্টি করে দিয়েছিলো। আমার প্রভু অতি সূক্ষ্ম কৌশলে তাঁর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেন। তিনি অত্যন্ত জ্ঞানী ও সুকৌশলী।”(সূরা ১২ ইউসুফঃ আয়াত ১০০)

 

আল্লাহর শোকর আদায়

 

ইউসুফের আর কি চাই? মহান আল্লাহ তাঁকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছেন। দাসত্ব থেকে মুক্ত করেছেন। কারাগার থেকে মুক্ত করেছেন। নবুয়্যত দান করেছেন। রাষ্ট্র ক্ষমতা দান করেছেন। বিপুল জনপ্রিয়তা দান করেছেন। অবশেষে বাবা মা আর সকল আত্মীয় স্বজনকেও এনে তাঁর সাথে মিলিয়ে দিয়েছেন। মহান আল্লাহর কত যে অনুগ্রহ তাঁর উপর। তিনি অত্যন্ত বিনীত কণ্ঠে শোকর আদায় করেন তাঁর মহান আল্লাহ তায়ালার দরবারে-

 

“আমার প্রভু, তুমি আমাকে রাষ্ট্র ক্ষমতা দান করেছো। কথার মর্ম বুঝতে শিখিয়েছ। হে আসমান যমীনের স্রষ্টা, দুনিয়া এবং আখিরাতে তুমিই আমার অভিভাবক। তোমার অনুগত অবস্থায় আমাকে মৃত্যু দিও আর নেক্কার লোকদের সাথে মিলিত করো।” (সূরা ১২ ইউসুফঃ আয়াত ১০১)

 

হযরত ইউসুফের কালের মিশর

 

বিভিন্ন ঐতিহাসিক গবেষণা থেকে জানা যায়, হযরত ইউসুফ যখন মিশর যান, তখন মিশরে পঞ্চদশতম রাজ পরিবারের শাসন চলছিলো। এ বংশের রাজাদের বলা হতো ‘রাখাল রাজা’ (Hyksos Kings)। এরা মিশরীয় ছিলো না। তাঁরা ফিলিস্তিন ও সিরিয়া অঞ্চল থেকে গিয়ে মিশরের রাজত্ব দখল করে। এ বংশের রাজাদের ‘আমালিক’ রাজাও বলা হয়। এরা বিদেশী হবার কারনে তাঁরা হজরত ইউসুফকে সাদরে গ্রহন করেছিলো। ইয়াকুব (আঃ) এঁর বংশধর বনী ইসরাইলকে দেশের সব চাইতে উর্বর এলাকায় বসতি স্থাপন করতে দিয়েছিলো। হযরত ইয়াকুবের বংশধরদের বনী ইসরাইল বলা হয়। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, রাখাল রাজাদের ‘আপোসিস’ নামক রাজাই ছিলেন হযরত ইউসুফের সময়কার রাজা।

 

এ রাজা হযরত ইউসুফকে অত্যন্ত সম্মান দান করেন। প্রথমে ইউসুফকে তিনি অর্থমন্ত্রী বানান। পড়ে দেশ শাসনের বিরাট দায়িত্ব ভার ইউসুফের উপর অর্পণ করেন। হযরত ইউসুফ যে বিরাট যোগ্যতা ও অগাধ জ্ঞানের ভিত্তিতে দেশ শাসন করেন রাজা তাতে খুব সন্তুষ্ট ছিলেন। শেষ পর্যন্ত হযরত ইয়াকুবের বংশধরেরা অর্থাৎ বনী ইসরাইলের লোকেরা ব্যাপকভাবে ক্ষমতায় অংশগ্রহন করে। বিভিন্ন স্তরে তাঁরা দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে।

 

কুরআনে হযরত ইউসুফ

 

কুরআনের একটি সুরাই রয়েছে হযরত ইউসুফের নামে। সুরাটির নাম ‘ইউসুফ’। এটি আল কুরআনের দ্বাদশ সূরা। মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছে। গোটা সুরায় হযরত ইউসুফের কাহিনীই বর্ণিত হয়েছে। কুরআন মাজীদে এ কাহিনীকে ‘আহাসানুল কাসাস’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এর মানে ‘সর্বোত্তম কল্যাণকর কাহিনী’। সত্যিই হযরত ইউসুফের জীবনীতে রয়েছে তরুন ও যুবকদের জন্যে অএন শিক্ষণীয় বিষয়। রয়েছে আদর্শ জীবন গড়ার উপাদান। আল কুরআনে হযরত ইউসুফের নাম ২৭ বার উল্লেখ করা হয়েছে। এঁর মধ্যে ২৫ বারই উল্লেখ হয়েছে সূরা ইউসুফে। তাছাড়া সূরা আনয়ামের ৮৪ ও সূরা আল মুমিনের ৩৪ নম্বর আয়াতে একবার একবার করে উল্লেখ হয়েছে। বিস্তারিত জানার জন্যে সূরা ইউসুফ পড়ে নেবেন।

 

হযরত ইউসুফের চারিত্রিক আদর্শ

 

হযরত ইউসুফ (আঃ) এর কাহিনীতে রয়েছে আমাদের জন্যে অনেক শিক্ষা। তাঁর জীবনাদর্শ থেকে পাওয়া শিক্ষাগুলো আমরা এখানে লিখে দিচ্ছি। আসুন মনোযোগ দিয়ে সেগুলো পড়ে নেই-

 

১. তাঁর পিতা হযরত ইয়াকুব ছিলেন আল্লাহর নবী। ফলে ইউসুফ ছোট বেলা থেকেই নবীর অনুসারী হন। নবীর পথে চলেন।

 

২. তিনি ছিলেন অত্যন্ত জ্ঞান পিপাসু। ফলে আল্লাহ তাঁকে অনেক জ্ঞান দান করেন। কথার মর্ম উপলব্ধি করার যোগ্যতা দেন।

 

৩. তিনি সব সময় পিতামাতার সাথে ভালো ব্যবহার করতেন। ফলে পিতা মাতাও তাঁকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন।

 

৪. তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিশ্বাসী। যে কেউ তাঁর উপর আস্থা রাখতে পারতো।

 

৫. তিনি ছিলেন অত্যন্ত উন্নত চরিত্রের অধিকারী।

 

৬. তিনি গোপনে এবং সুযোগ পেয়েও পাপ কাজ করেননি।

 

৭. তিনি সব সময় আল্লাহকে ভয় করতেন।

 

৮. তিনি কারা নির্যাতন সয়েছেন, কিন্তু কোন প্রকার অন্যায় ও পাপ কাজ করতে রাজি হন নি।

 

৯. তিনি ছিলেন অত্যন্ত আমানতদার। কখনো বিশ্বাস ঘাতকতা করেননি।

 

১০. তিনি অত্যন্ত ধৈর্যশীল ছিলেন। কখনো ধৈর্যহারা হননি।

 

১১. তিনি সুযোগ পেলেই মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকতেন। দাওয়াত দিতেন।

 

১২. সকল বিষয়ে তিনি আল্লাহর উপর ভরসা করতেন। আল্লাহর কাছেই সাহায্য চাইতেন। তাঁর কাছেই ফরিয়াদ করতেন।

 

১৩. তিনি তাঁর জ্ঞান ও প্রতিভার মাধ্যমে মানুষের উপকার করতেন। তাঁদের সমস্যার সনাধান বলে দিতেন

 

১৪. যেসব নারী তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিলো, সামাজিকভাবে তিনি তাঁদের মুখোশ খুলে দিয়েছিলেন।

 

১৫. তিনি সামাজিকভাবে নিজের নির্দোষ, নিষ্পাপ ও বিশ্বস্ত হবার কথা প্রমান করে দেন।

 

১৬. তিনি সুযোগ পেয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতা গ্রহন করেন।

 

১৭. তিনি অত্যন্ত যোগ্যতা ও দক্ষতার সাথে তাঁর উপর অর্পিত রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করেন।

 

১৮. ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তিনি ভাইদের অপরাধের প্রতিশোধ নেননি।

 

১৯. সুযোগ পেয়েও প্রতিশোধ গ্রহন না করে ভাইদের ক্ষমা করে দেন।

 

২০. তিনি পিতামাতা ও ভাইদেরকে সম্মানের সাথে পুনর্বাসিত করেন।

 

২১. তিনি সকল সৌভাজ্ঞের জন্যে কেবল মহান আল্লাহর শোকর আদায় করেন। তাঁরই কৃতজ্ঞ হয়ে থাকেন।

 

২২. তিনি আল্লাহর একান্ত অনুগত ও বাধ্যগত দাসের মতো অবস্থায় মৃত্যু কামনা করেন।

 

২৩. পরকালে তিনি নেক লোকদের সাথী হবার জন্যে মহান আল্লাহর কাছে আকুতি জানান।

 

আসুন, আমরা হযরত ইউসুফ (আঃ) এর এসব মহান আদর্শের অনুসরন করি। নিজেদের আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলি।

 

কুরআনে ইউসুফের একটি দোয়া

 

ইউসুফ রাষ্ট্র ক্ষমতা লাভ করেন। পিতা আল্লাহর নবী ইয়াকুবকে পরিবারবর্গসহ নিজের কাছে নিয়ে আসেন। আল্লাহ সকল দিক থেকে ইউসুফের প্রতি নিজের নিয়ামত পূর্ণ করেন। এ সময় ইউসুফ মহান আল্লাহর দরবারে দোয়া করেন-

 

“আমার প্রভু, তুমি আমাকে রাষ্ট্র ক্ষমতা দান করেছো, আমাকে কথার মর্ম উপলব্ধি করার শিক্ষা দিয়েছ, তুমিই আসমান যমীনের স্রষ্টা। দুনিয়া এবং আখিরাতে তুমিই আমার অলি (বন্ধু, অভিভাবক, পৃষ্ঠপোষক)। মুসলিম (তোমার প্রতি আত্মসমর্পিত) হিসেবে আমার ওফাত দিও আর আমাকে মিলিত করো ন্যায়পরায়ণদের সাথে।” (সূরা ১২ ইউসুফঃ আয়াত ১০১

 

১২।

 

শুয়াইব

 

(আঃ)

 

মহান আল্লাহ আল কুরআনে যেসব সম্মানিত নবীর নাম উল্লেখ করেছেন হযরত শুয়াইব (আঃ) তাঁদেরই একজন। অন্য সকল নবীর মতো তিনিও এই মহা সত্যের প্রতিই মানুষকে আহবান করেছিলেন-

 

“হে আমার জাতির ভাইয়েরা, তোমরা কেবল এক আল্লাহর দাসত্ব, আনুগত্য এবং হুকুম পালন করো। তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোন ইলাহ নেই।”

 

শুয়াইব কোন জাতির নবী ছিলেন?

 

কুরআন মাজীদে শুয়াইব (আঃ) কে মাদইয়ান ও আইকাবাসীদের নবী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কোন কোন মুফাসসির বলেছেন- এই দুটি নাম মূলত একটি গোত্রের দুটি নাম। আবার কেউ কেউ বলেছেন- এ দুটি আসলে দুটি গোত্রেরই নাম। হযরত শুয়াইব (আঃ) এই দুটি কওমের কাছেই নবী হিসেবে প্রেরিত হয়েছিলেন।

 

ঐতিহাসিক ও মুফাসসিরগনের মতে, এই দুটি গোত্র ইবরাহীম (আঃ) এর বংশধর। তাঁদের বসবাসও ছিলো পাশাপাশি। কুরআনে বলা হয়েছে এ দুটি জাতি উম্মুক্ত রাজপথে অবস্থান করতো। মাদইয়ানবাসীদের বসবাস ছিলো উত্তর হিজায থেকে ফিলিস্তিনের দক্ষিনাঞ্চল জুড়ে এবং সেখান থেকে সিনাই উপত্যকার শেষ পর্যন্ত আকাবা উপসাগর এবং লোহিত সাগরের তীর জুড়ে। মাদইয়ান ছিলো তাঁদের প্রধান শহর।

 

বর্তমান তাবুক অঞ্চলের প্রাচীন নাম ছিলো আইকাহ। তাবুকের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে আইকাবাসীরা বসবাস করতো। মাদইয়ান এবং আইকাবাসীদের মধ্যে বৈবাহিক, বাণিজ্যিক এবং অন্যান্য সামাজিক সম্পর্ক বিদ্যমান ছিলো। এ ছাড়া উভয় জাতি একই ধরনের অসামাজিক কাজকর্ম এবং অন্যায় ও অপরাধে লিপ্ত ছিলো। সে কারনে আল্লাহ তাঁদের উভয় জাতির হেদায়েতের জন্যে একজন ব্যাক্তিকেই নবী নিযুক্ত করেন।

 

হযরত শুয়াইবের জন্ম হয় মাদইয়ান গোত্রে। কুরআন মাজীদে মাদইয়ানবাসীদের হজরত শুয়াইবের জাতি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি তাঁদেরকে ‘হে আমার জাতির ভাইয়েরা’ বলে সম্বোধন করতেন।

 

হযরত শুয়াইব কোন সময়কার নবী?

 

হযরত শুয়াইব (আঃ) যে ঠিক কোন সময়কার নবী ছিলেন, সে কথাটি একেবারে নির্দিষ্ট করে বলা কঠিন। তবে কুরআনের বর্ণনা ভঙ্গি থেকে বুঝা যায়, শুয়াইব (আঃ) হজরত মুসা (আঃ) এর পূর্বেকার নবী ছিলেন। তবে কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে, হযরত মুসা (আঃ), হযরত শুয়াইব (আঃ) এর সাক্ষাত লাভ করেছিলেন।

 

মাদইয়ান ও আইকাবাসীদের দুরাচার

 

মাদইয়ান ও আইকাবাসী তাঁদের পূর্বপুরুষ ইবরাহীম (আঃ) এর প্রচারিত দ্বীন ইসলামেরই উত্তরাধিকারী ছিলো। কিন্তু কয়েকশ বছরের ব্যবধানে তাঁরা ইসলামকে বিকৃত করে ফেলে এবং বাস্তবে ইসলামের আদর্শ থেকে অনেক দূরে সরে পড়ে। বিশ্বাস ও চরিত্রের দিক থেকে তাঁরা যেসব অপরাধে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছিলো সেগুলো হলো-

 

১. তারা আল্লাহর দিনকে বিকৃত করে ফেলেছিলো।

 

২. তারা আল্লাহর সাথে শিরক করতো। মূর্তি পূজা করতো।

 

৩. তারা জীবন যাপনের সঠিক পথ থেকে দূরে সরে পড়েছিলো।

 

৪. তারা মাপে কম দিতো। লেনদেনে হেরফের করতো। মানুষকে ঠকাতো। প্রতারনা করতো।

 

৫. ডাকাতি ও হাইজ্যাকি ছিলো তাঁদের নিত্য দিনের কাজ।

 

৬. এছাড়াও অন্যান্য পাপাচার এবং ধ্বংসাত্মক কাজে তারা লিপ্ত ছিলো।

 

হযরত শুয়াইবের সংস্কার আন্দোলন

 

এই দুটি অধঃপতিত কওমকে সংশোধন করার জন্যে আল্লাহ তায়ালা মাদইয়ানের মহান চরিত্র ও ব্যাক্তিত্বের অধিকারী শুয়াইবকে নবী নিযুক্ত করেন। শুয়াইব ছিলেন অত্যন্ত সুভাষী ও বলিষ্ঠ ব্যাক্তিত্বের অধিকারী। তিনি মর্মস্পর্শী দাওয়াত এবং আহনবানের মাধ্যমে আল্লাহর দিনের প্রচার ও জাতিকে সংশোধনের সংগ্রাম শুরু করেন। তাঁর কর্মধারা সম্পর্কে মহান আল্লাহ পবিত্র আল কুরআনে বলেন –

 

“আর আমি মাদইয়ানবাসীদের কাছে তাঁদের ভাই শুয়াইবকে পাঠিয়েছি। সে তাঁদের বলেছিল- হে আমার জাতির ভাইয়েরা, তোমরা এক আল্লাহর দাসত্ব ও আনুগত্য করো, তিনি ছাড়া তোমাদের অপর কোন ইলাহ নাই। তোমাদের কাছে তোমাদের প্রভুর নিকট থেকে সুস্পষ্ট প্রমান এসে গেছে। তাই তোমরা তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী মাপ ও ওজন পূর্ণ করে দাও। মানুষকে তাঁদের দ্রব্য সামগ্রীতে ঠকিওনা। দেশে বিপর্যয় সৃষ্টি করোনা। এতেই তোমাদের জন্যে রয়েছে কল্যাণ। প্রতি পথে ডাকাত হয়ে বসোনা। সন্ত্রাস সৃষ্টি করোনা। যারা ঈমান এনেছে তাঁদেরকে আল্লাহর পথ থেকে বিরত রেখোনা এবং সহজ সরল পথকে বাঁকা করার চেষ্টা করোনা। চোখ খুলে দেখো অতীতে যারা ধ্বংসাত্মক কাজ করেছে তাঁদের পরিনতি কী হয়েছে? ” (সূরা আরাফ-আয়াতঃ ৮৫-৮৬)

 

মাদইয়ানবাসীদের মতো আইকাবাসীদেরও সংশোধন করার জন্যে হজরত শুয়াইব (আঃ) আপ্রান চেষ্টা করেন। তাঁর এ প্রচেষ্টা সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহ বলেন-

 

“আইকাবাসীরা রাসুলদের অস্বীকার করে। শুয়াইব যখন তাঁদেরকে বললো- তোমরা কি ভয় করোনা? আমি তোমাদের জন্যে একজন বিশ্বস্ত রাসুল, সুতরাং আল্লাহকে ভয় করো আর আমার আনুগত্য করো। এই উপদেশ দানের কাজে আমি তো তোমাদের কাছে কোন পারিশ্রমিক চাইনা। আমাকে পারিশ্রমিক দেয়ার দায়িত্ব তো মহান আল্লাহর। ওজন পূর্ণ করে দাও, মানুষকে তাঁদের মাল কম দিওনা, পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করোনা। সেই মহান স্রষ্টাকে ভয় করো যিনি তোমাদেরকে এবং তোমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্মকে সৃষ্টি করেছেন।” (সূরা আশ শোয়ারা, আয়াত ১৭৬-১৮৪)

 

এভাবে মর্মস্পর্শী ভাষায় হজরত শুয়াইব (আঃ) এই দুইটি জাতিকে সংশোধন করার চেষ্টা করেন, কিন্তু তারা তাঁর দাওয়াতকে প্রত্যাখ্যান করে এবং তাঁর সাথে বিতর্ক ও দ্বন্ধ-সংঘাতে লিপ্ত হয়। তারা বললো- “হে শুয়াইব তোমার সালাত কি তোমাকে এই শিক্ষাই দেয় যে, আমরা সেই সব মাবুদদের পরিত্যাগ করবো, আমাদের পূর্বপুরুষরা যাদের ইবাদাত করতো? আর আমাদের অর্থ সম্পদ ইচ্ছামত ব্যয় করার অধিকার আমাদের থাকবেনা? তুমি একজন মহৎ হৃদয়ের বড় সদাচারী ব্যাক্তিই রয়ে গেলে। ” (সূরা হুদ, আয়াত ৮৭)

 

তারা আর বললো- “তুমি একজন যাদুগ্রস্থ মানুষ, তুমি তো আমাদের মতই একজন সাধারন মানুষ ছাড়া আর কিছুই নও। আমরা তোমাকে পরিস্কার মিথ্যাবাদী মনে করি। তুমি যদি সত্যবাদী হও তাহলে এক টুকরা আকাশ ভেঙ্গে আমাদের উপর ফেলো দেখি।” (সূরা আশ শোয়ারা, আয়াত ১৮৫-১৮৭)

 

শুয়াইব বললো- “আমি তো কেবল তোমাদের সংশোধন চাই। আমার সাধ্য অনুযায়ী সংশোধনের এই চেষ্টা আমি করে যাবো। আমার বিরুদ্ধে তোমাদের হঠকারীতা যেন সেই পর্যায়ে না যায়, যার ফলে নূহ, হুদ, ও সালেহ এর জাতির উপর আল্লাহর আযাব এসেছিলো। আর লুত জাতির ধ্বংসের ইতিহাস তো তোমাদের থেকে বেশী আগের নয়। তোমরা আল্লাহর কাছে মাফ চাও এবং তাঁর দিকে ফিরে ফিরে এসো। তিনি বড় দয়ালু, বড় বন্ধু সুলভ।” (সূরা হুদ ৮৮-৯০)

 

এসব কথার জবাবে তারা বলছিলো – “শুয়াইব, তোমার অনেক কথাই আমাদের বুঝে আসেনা। ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক না থাকলে তোমাকে আমরা পাথর মেরে হত্যা করতাম। আমাদের চাইতে তোমার ক্ষমতা বেশী নয়।”

 

তাঁদের এসব কথা শুনে শুয়াইব বললেন – “আমার সাথে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক কি আল্লাহর চাইতেও সম্মানিত? তোমরা ভ্রাতৃত্বের সম্পর্কের কথা বলছো, অথচ আল্লাহর ব্যাপারে মোটেই তোয়াক্কা করছোনা? তোমরা অবশ্যই আল্লাহর বেষ্টনীতে আছো।” তিনি আরো বললেন – “আমার কাজ আমি অবশ্যই করে যাবো, তোমরা অচিরেই জানতে পারবে, কার উপর অপমানকর আযাব আসে আর মিথ্যাবাদীই বা কে? তোমরা অপেক্ষা করো, আমিও অপেক্ষা করছি।”

 

চরম বিরোধিতার মুখেও একদল যুবক হযরত শুয়াইবের প্রতি ঈমান আনে। চরম নির্যাতনের মুখেও তারা আল্লাহর নবীর সাথে দীনের পথে চলতে থাকে। কিন্তু বিরোধীনেতারা কিছুতেই এদের সহ্য করতে পারেনা। তারা অবশেষে হুংকার ছেড়ে ঘোষণা দিলো – “হে শুয়াইব, আমরা তোমাকে এবং তোমার সাথে যারা ঈমান এনেছে তাঁদেরকে দেশ থেকে বের করে দেবো। অথবা তোমাদেরকে আমাদের প্রচলিত ধর্মে ফিরে আসতে হবে।” (সূরা আরাফ-আয়াতঃ ৮৮)

 

তারা জনসভা করে জনগনের মাঝে ঘোষণা করে দিলো – তোমরা যদি শুয়াইবের দলে যোগ দাও তাহলে তোমাদের ধ্বংস কেউ ঠেকাতে পারবেনা। এ সব হুংকারের জবাবে হজরত শুয়াইব মহান আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করলেন –

 

“ওগো আমাদের প্রভু, আমাদের মাঝে আর আমাদের জাতির মাঝে সঠিক ফায়সালা করে দাও। তুমি তো সর্বোত্তম ফায়সালাকারী।” (সূরা আরাফ-আয়াতঃ ৮৯)

 

মাদইয়ান ও আইকাবাসীর ধ্বংস

 

হযরত শুয়াইবের অনেক চেষ্টা সাধনার পরেও যখন এই দুইটি জাতি আল্লাহর পথে আসলনা এবং নবী ও তাঁর সাথীদের উৎখাত করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলো, তখন আল্লাহ তায়ালা এই উভয় জাতিকে ধংস করে দিলেন। মাদইয়ানবাসীদের ধংস করলেন প্রচণ্ড বজ্রধ্বনি দিয়ে। এমনভাবে তাঁদের বিরান করে দিলেন, যেনো ওখানে কোন দিনই কোন লোক বসবাস করেনি। অপরদিকে আইকাবাসীদের ধংস করে দিলেন ছাতার মতো মেঘমালা পাঠিয়ে। মেঘ থেকে আযাব বর্ষিত হলো আর আইকাবাসীরা সম্পূর্ণভাবে ধংস হয়ে গেলো। কিন্তু মহান আল্লাহ হযরত শুয়াইব এবং তাঁর সাথীদেরকে এসব ধংসের আযাব থেকে রক্ষা করলেন। তাঁদের বাঁচিয়ে রাখলেন এবং এই মুমিনদের ঘরেই জন্ম নিলো পরবর্তী প্রজন্ম।

 

কুরআনে উল্লেখ

 

কুরআন মাজীদে সূরা আরাফ ও সূরা হুদে মাদইয়ানবাসীদের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। সূরা শোয়ারায় বর্ণিত হয়েছে আইকাবাসীদের ঘটনা। কুরআন মাজীদে হজরত শুয়াইবের নাম উল্লেখ হয়েছে ১১ বার। সে আয়াতগুলো হলো – সূরা আরাফঃ ৮৫, ৮৮, ৯০, ৯২। সূরা হুদঃ ৮৫, ৮৭, ৯১, ৯৪। আন কাবুতঃ ৩৬। শোয়ারাঃ ১৭৭।

 

আপনি যদি কুরআন পড়েন এবং সরাসরি কুরআন থেকেই এসব ঘটনাবলী জানার চেষ্টা করেন, তাহলে অনেক কিছুই জানতে পারবেন এবং শিখতে পারবেন অনেক কিছুই। আসুন আমরা সবাই কুরআন পড়ি। নবীদের ঘটনাবলী জানি এবং নবীদের আদর্শ অনুযায়ী জীবন গড়ি।

 

১৩।

 

ধৈর্যের পাহাড় আইয়ুব

 

(আঃ)

 

“আর আইয়ুবের কথা চিন্তা করে দেখো। সে যখন ফরিয়াদ করলো –“ওগো আমার প্রভু, আমি কঠিন রোগে বড় কষ্টের মধ্যে আছি আর তুমি তো সবচেয়ে বড় করুনাময়। অতপর আমি তাঁর ফরিয়াদ কবুল করলাম আর দূর করে দিলাম তাঁর সব কষ্ট।”?(সূরা আল আম্বিয়া, আয়াত ৮৩-৮৪)

 

হযরত আইয়ুবের পরিচয়

 

আল্লাহর প্রিয় নবী হযরত আইয়ুব (আঃ) এর কথা পবিত্র কুরআন শরীফের চারটি স্থানে উল্লেখ হয়েছে। সেগুলো হলো সূরা আন নিসার ১৬৩ নম্বর আয়াত, সূরা আল আনয়ামের ৮৪ নম্বর আয়াত, সূরা আল আম্বিয়ার ৬৩-৬৪ নম্বর আয়াত এবং সূরা সোয়াদের ৪১-৪৪ নম্বর আয়াত। হযরত আইয়ুবের বংশ পরিচয় পরিস্কারভাবে জানা যায়নি। এ ব্যাপারে মতভেদ আছে। কেউ কেউ বলেছেন, তিনি ছিলেন বনী ইসরাইলের একজন নবী। কেউ বলেছেন, তিনি ছিলেন মিশরীয়। তবে ঐতিহাসিক ইবনে ইসহাকের মতকে অনেকে সঠিক বলেছেন। তাঁর মতে, হযরত আইয়ুবের বংশ পরিচয় হলো হযরত ইব্রাহীমের পুত্র ইসহাক, হযরত ইসহাকের পুত্র ঈশু, ঈশুর পুত্র আমুশ, আমুশের পুত্র আইয়ুব। হযরত আইয়ুব (আঃ) খ্রিষ্টপূর্ব নবম বা দশম শতকের লোক ছিলেন।

 

ধনী হযরত আইয়ুব

 

হযরত আইয়ুব (আঃ) ছিলেন এক বিরাট ধনী ব্যাক্তি। তাঁর ধন সম্পদ ছিলো অগাধ। তিনি ছিলেন অনেক অনেক ভূমি ও বাগ বাগিচার মালিক। তাঁর ছিলো অগাধ অর্থকড়ি। ছিলো অনেক সন্তান সন্তুতি। ছিলো সুস্বাস্থ্য। কিন্তু এতো বড় ধনী হলে কি হবে, এ জন্যে তাঁর ছিলনা কোন গর্ব, ছিলনা কোনো অহংকার। তিনি এগুলোকে আল্লাহর দান ও অনুগ্রহ মনে করতেন। আল্লাহ তাঁকে এতো ধনসম্পদ দিয়েছেন বলে তিনি সব সময় আল্লাহর শোকর আদায় করতেন, আল্লাহর কৃতজ্ঞ হয়ে থাকতেন।

 

কঠিন পরীক্ষা

 

কিন্তু আল্লাহর নিয়ম হলো, তিনি মানুষকে দিয়েও পরীক্ষা করেন, নিয়েও পরীক্ষা করেন। আর যেসব মানুষ আল্লাহর বেশী প্রিয়, তিনি তাঁদের অনেক বড় পরীক্ষা নেন। হযরত আইয়ুব (আঃ) ছিলেন আল্লাহর একজন অতিপ্রিয় দাস ও নবী। তিনি যেমন তাকে ভালবাসতেন, তেমন কঠিন পরীক্ষাও তাঁর উপর চাপিয়ে দেন। হযরত আইয়ুব (আঃ) চারটি বড় বড় পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছিলেন –

 

১. তাঁর সমস্ত ধন সম্পদ জমাজমি নষ্ট হয়ে যায়।

 

২. তাঁর সারা শরীরে কঠিন যন্ত্রনাদায়ক এক রোগ দেখা দেয়। বছরের পর বছর কাটে কিন্তু তাঁর রোগ ভালো হয়না।

 

৩. তাঁর স্ত্রী ছাড়া সকল আপনজন তাঁকে ছেড়ে দূরে চলে যান। তিনি সম্পূর্ণ নিঃসহায় হয়ে পড়েন।

 

৪. এ অবস্থায় আল্লাহর প্রতি বিমুখ হওয়ার জন্যে শয়তান তাঁকে অনবরত প্ররোচনা দিতে থাকে।

 

এতো বড় পরীক্ষায় পড়েও হযরত আইয়ুব (আঃ) সবর অবলম্বন করেন, ধৈর্য ধারন করেন। প্রতি মুহূর্তে আল্লাহর কৃতজ্ঞতাই প্রকাশ করেন। তিনি সুসময়ে যেমন তাঁর প্রভুর কৃতজ্ঞ ছিলেন, দুঃসময়েও ঠিক তেমনি কৃতজ্ঞ ছিলেন। তিনি তাঁর সমস্ত দুঃখ কষ্টের জন্যে কেবল মহান আল্লাহর কাছেই ফরিয়াদ করতেন। কেবল তাঁরই কাছে সাহায্য চাইতেন। তিনি বলতেন-

 

“প্রভু, আমি বড় কষ্টে আছি। আর তুমি তো সব দয়ালুর বড় দয়ালু। প্রভু, শয়তান আমাকে বড় কষ্ট ও যন্ত্রনা দিচ্ছে, তুমিতো আমার অবস্থা দেখছো।”

 

হযরত প্রায় সতের আঠারো বছর এই কঠিন রোগ ও অসহায় অবস্থায় পড়ে থাকেন। অবশেষে আল্লাহ তাঁর দোয়া কবুল করেন। তিনি তাঁকে পা দিয়ে মাটিতে আঘাত করতে বলেন। (সূরা সোয়াদ, আয়াত ৪২)। হযরত আইয়ুব তাই করলেন। কী আশ্চর্য, পা দিয়ে মাটিতে আঘাত করার সাথে সাথেই সেখান থেকে সচ্ছ পানির একটা ঝর্নাধারা প্রবাহিত হলো। আল্লাহ তাঁকে এ পানি পান করতে এবং এ পানি দিয়ে গোসল করতে বলেন। তিনি তাই করলেন। এর ফলে আল্লাহর দয়ায় তাঁর রোগ ভালো হয়ে গেলো।

 

বিবি রাহমা

 

রাহমা নামে হযরত আইয়ুবের একজন স্ত্রী ছিলেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত আল্লাহভীরু, সতী এবং স্বামী পরায়না। দীর্ঘ রোগের কারনে আপনজন সবাই হযরত আইয়ুবকে ছেড়ে চলে যান। কিন্তু রাহমা। তাঁর স্ত্রী রাহমা তাঁকে ছেড়ে যাননি। বছরের পর বছর ধরে তিনি স্বামীর সেবা যত্ন করেন। অসাধারন ধৈর্যগুণ থাকলেই কোন নারী এতো বছর ধরে কঠিন রোগেও স্বামীর সেবা করে যেতে পারেন। শয়তান হযরত আইয়ুবকে সরাসরি কোন ধোঁকা দিতে না পেরে রাহমার কাছে এলো। সে রাহমাকে এই বলে প্ররোচনা দিতে থাকে, তুমি আর কতকাল সহ্য করবে? দিনের পর দিন শয়তান তাঁকে এভাবে অসঅসা দিতে থাকে। তাঁকে প্ররোচিত করতে থাকে। অবশেষে একদিন এসে তিনি স্বামীকে বললেন – এভাবে আর কতকাল পরীক্ষা চলবে? আর কতকাল বিপদ মুসিবত সইয়ে যাবো?

 

একথায় হযরত আইয়ুব অত্যন্ত মনোক্ষুণ্ণ হলেন। তিনি স্ত্রীকে বললেন – যতদিন দুঃখ কষ্টের মধ্যে আছো, তাঁর চেয়ে বেশী দিন কি সুখের মধ্যে কাটাওনি? যতোদিন আমি সুখে ছিলাম ততোদিন দুঃখ ভোগের আগে এ অবস্থা দূর করে দেয়ার জন্যে আল্লাহর কাছে আবদার করতে আমার লজ্জা হয়। হযরত আইয়ুব স্ত্রী রাহমাকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন। কিন্তু তাঁর মুখে যখন অধৈর্যের কথা শুনলেন এটাকে তিনি আল্লাহর প্রতি অকৃতজ্ঞতা মনে করলেন এবং অত্যন্ত রাগান্বিত হলেন। রাগের মাথায় তিনি কসম খেয়ে বললেন, এ অধৈর্যের জন্যে আমি তোমাকে একশত বেত্রাঘাত করবো। রাগ স্তিমিত হলে তিনি পেরেশান হয়ে উঠলেন, যদি কসম বাস্তবায়ন করি তাহলে তো একজন নিরপরাধকে শাস্তি দেয়া হয়। আর যদি কসম বাস্তবায়ন না করি তাহলে তো গুনাহগার হতে হয়। এর সমাধান চেয়ে তিনি আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করলেন। তিনি যতগুলো বেত্রাঘাত করার অংগীকার করেছেন, আল্লাহ তাঁকে ততগুলো শলা দিয়ে একটি আটি বানাতে বললেন। (সূরা সোয়াদ, আয়াত ৪৪)

 

আর সেই আটি দিয়ে বিবি রাহমাকে একটি মৃদু আঘাত করতে বললেন। ব্যাস, তিনি তাই করলেন। তাঁর অংগীকার পূর্ণ হয়ে গেলো। মহান আল্লাহ তাঁদের দুজনের চিন্তা দূর করে দিলেন এবং তাঁদেরকে নিজের রহমত দ্বারা সিক্ত করলেন।

 

ফিরে এলো সুখের দিন

 

এবার হযরত আইয়ুব (আঃ) এর সুখের দিন ফিরে এলো। আল্লাহ তাঁকে রোগ ভালো করে দিলেন। আবার প্রচুর ধন সম্পদ দান করলেন। তাঁর সন্তান ও আত্মীয় স্বজনরা ফিরে এলো তাঁর কাছে। তিনি সুস্থ শরীরে মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকতে লাগলেন। বহু দুঃখ কষ্টের পর বিবি রাহমার জীবনে আবার সুখের দিন ফিরে এলো। কোথায় বলে ‘সবুরে মেওয়া ফলে’। হযরত আইয়ুব সবর করেছিলেন, বিবি রাহমা সবর করেছিলেন। তাই সুখের দিন ফিরিয়ে দিয়ে আল্লাহ তাঁদের সবরের প্রতিদান দিলেন।

 

আল কুরআনে তাঁর প্রশংসা

 

মহান আল্লাহ কুরআন মাজীদে হযরত আইয়ুব (আঃ) এর ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। তিনি বলেন-

 

১. আমি আইয়ুবকে পেয়েছি পরম ধৈর্যশীল। সে ছিলো আমার এক উত্তম গোলাম, ছিলো আল্লাহমুখী। (সূরা সোয়াদ, আয়াত ৪৪)

 

২. আইয়ুবের ব্যাপারটি ছিলো বুদ্ধিমান লোকদের জন্যে শিক্ষণীয়। (সূরা সোয়াদ, আয়াত ৪৪)

 

৩. আইয়ুবের ঘটনা ইবাদাতকারীদের জন্যে শিক্ষণীয়। (সূরা আম্বিয়া, আয়াত ৮৪)

 

৪. হে মুহাম্মাদ, আমি তোমার কাছে অহী পাঠাচ্ছি ঠিক সেভাবে, যেভাবে পাঠিয়েছিলাম নুহ এবং তাঁর পরবর্তী নবীদের কাছে------- ঈসা, আইয়ুব, ইউনুস, হারুন এবং সুলাইমানের কাছে। (সূরা আন নিসা, আয়াত ১৬৩)

 

শিক্ষণীয় বিষয়

 

বুদ্ধিমান লোকদের জন্যে যে হযরত আইয়ুবের জীবন চরিত থেকে অনেক শিক্ষণীয় বিষয় আছে, তাতো মহান আল্লাহ পাকই পবিত্র কুরআনে বলেছেন। সত্যি তাই। আসুন দেখি, আমরা তাঁর জীবন চরিত থেকে আমরা কি কি শিক্ষা পাই।

 

১. প্রাচুর্যের সময় আত্মহারা হয়ে আল্লাহকে ভুলে যেতে নেই।

 

২. ধন সম্পদ, সন্তান সন্ততি, মান ইজ্জত এই সবকে আল্লাহর দান মনে করা উচিত এবং এগুলোর জন্যে আল্লাহর শোকর আদায় করা উচিত।

 

৩, রোগ শোক, দুঃখ কষ্ট ও বিপদে মুসিবতে ধৈর্যহারা হতে নেই। বরং ধৈর্যের সাথে আল্লাহর উপর আশা ভরসা করে থাকা উচিত।

 

৪, বিপদ মুসিবত, দুঃখ কষ্ট রোগ শোক ও অসহায় অবস্থায় শয়তান মুমিনদের সাথে প্রতারনা করার সুযোগ নেয়। তাই এসব অবস্থায় শয়তানের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। এবং শয়তানের প্ররোচনা থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাইতে থাকতে হবে।

 

৫, সুখের সময় আল্লাহর শোকর আদায় করা এবং দুঃখের সময় সবর অবলম্বন করা নবীদের আদর্শ।

 

৬, রাগ বশত কোন ভুল করে ফেললে সেজন্যে অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা উচিত।

 

৭, রোগ শোক, দুঃখ কষ্ট, বিপদ মুসিবতে একজন মুমিন স্ত্রীর কোনো অবস্থাতেই স্বামীর কাছ থেকে দূরে সরে যাওয়া উচিত নয়। বরং পরম ধৈর্য ও সবরের সাথে স্বামীর সেবা করা উচিত।

 

১৪।

 

যুলকিফল

 

(আঃ)

 

কুরআন মাজীদে ‘যুলকিফল’ নামটি দুবার উল্লেখ হয়েছে। দু’বারই অন্যান্য নবীদের সাথে তাঁর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। একবার উল্লেখ হয়েছে সূরা আল আম্বিয়াতে। সেখানে বলা হয়েছে এভাবে-

 

“আর ইসমাঈল, ইদ্রীস ও যুলকিফল, এরা সবাই ছিলো ধৈর্যশীল। আমার রহমত দ্বারা এদের সিক্ত করেছিলাম। এরা ছিলো যোগ্য সৎ কর্মশীল।” (সূরা ২১, আল আম্বিয়াঃ ৮৫-৮৬)

 

সূরা সোয়াদে তাঁর কথা উল্লেখ হয়েছে এভাবে-

 

“ইষমাঈল, আলইয়াসা আর যুলকিফলের কথা স্মরণ করো। এরা সবাই ছিলো উত্তম মানুষ।” (আয়াত- ৪৮)

 

যুলকিফল ছিলেন বনী ইসরাইলের একজন নবী। আবার কেউ কেউ বলেছেন, তিনি ছিলেন হযরত আইয়ুব (আঃ) এর পুত্র। ‘যুলকিফল’ শব্দের অর্থ ভাগ্যবান। দুনিয়াবী দৃষ্টিতে নয়, পরকালীন দৃষ্টিতে ভাগ্যবান। এটি তাঁর আসল নাম নয়, বরং এটি ছিলো তাঁর উপাধি। তাঁর মূল নাম ছিলো ‘বিশর’। যুলকিফল যদি আইয়ুব (আঃ) এর পুত্র হয়ে থাকেন, তবে পিতার পরেই তিনি নবী হয়েছিলেন। অনেকে মনে করেন যুলকিফল আসলে বাইবেলে উল্লেখিত যিহিস্কেল নবী। যিহিস্কেল মুসলমানদের কাছে হিযকীইল নামে পরিচিত। তাঁর এই পরিচয়টি সঠিক মনে হয়।

 

বাইবেলের যিহিস্কেল পুস্তক থেকে জানা যায়, রাজা বখতে নযর যখন শেষবার জেরুজালেম ধংস করেন, তাঁর আগে তিনি বহু বনী ইসরাইলীদের বন্দী করে নিয়ে যান। বখতে নযর ইরাকের খাবুর নদীর তীরে বনী ইসরাইলী বন্দীদের একটি উপনিবেশ গড়ে তোলেন। এর নাম ছিলো তেলআবিব। এখানেই খ্রিষ্টপূর্ব ৫৯৪ অব্দে হযরত হিযকীইল নবুয়্যত লাভ করেন। এ সময় তাঁর বয়েস ছিলো ত্রিশ বছর। এখানে তিনি বাইশ বছর যাবত বনী ইসরাইলীদের মাঝে নবুয়্যতের দায়িত্ব পালন করেন। দ্বীন প্রচারের কাজকে তিনি সর্বাধিক গুরুত্ব দিতেন। তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রীর মৃত্যুর পর লোকেরা যখন তাঁর বাড়িতে শোক প্রকাশের জন্যে আসে, তখন তিনি এতো দুঃখের মাঝেও তাঁদেরকে আল্লাহর আযাবের ভয় দেখাতে থাকেন।

 

এই হিযকীইল বা যিহিস্কেলই ছিলেন হযরত যুলকিফল (আঃ)। তিনি সেই সব নবীদের একজন যারা নিজেদের জীবনের একটি অংশ বন্দী হিসেবে কাটিয়েছেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত সৎ ও নিষ্ঠাবান। দিনরাত আল্লাহর দীনের কাজে নিমগ্ন থাকতেন। মানুষকে আল্লাহর ভয় দেখাতেন। তিনি শাসকদের সবসময় সত্য সততা ও ন্যায়পরায়নতার ব্যাপারে সতর্ক করতেন।

 

১৫।

 

মুসা কালিমুল্লাহ (আঃ)

 

মূসা (আঃ)-এর পরিচয়

 

মূসা ইবনে ইমরান বিন ক্বাহেছ বিন ‘আযের বিন লাভী বিন ইয়াকূব বিন ইসহাক্ব বিন ইবরাহীম (আঃ)।অর্থাৎ মূসা হ’লেন ইবরাহীম (আঃ)-এর ৮ম অধঃস্তন পুরুষ। মূসা (আঃ)-এর পিতার নাম ছিল ‘ইমরান’ ও মাতার নাম ছিল ‘ইউহানিব’। তবে মায়ের নামের ব্যাপারে মতভেদ আছে।উল্লেখ্য যে, মারিয়াম (আঃ)-এর পিতার নামও ছিল ‘ইমরান’। যিনি ছিলেন হযরত ঈসা (আঃ)-এর নানা। মূসা ও ঈসা উভয় নবীই ছিলেন বনী ইসরাঈল বংশীয় এবং উভয়ে বনী ইসরাঈলের প্রতি প্রেরিত হয়েছিলেন (সাজদাহ- ৩২, ছফ -৬১)। মূসার জন্ম হয় মিসরে এবং লালিত-পালিত হন মিসর সম্রাট ফেরাঊনের ঘরে। তাঁর সহোদর ভাই হারূণ (আঃ) ছিলেন তাঁর চেয়ে তিন বছরের বড় এবং তিনি মূসা (আঃ)-এর তিন বছর পূর্বেই মৃত্যুবরণ করেন। উভয়ের মৃত্যু হয় মিসর ও শাম-এর মধ্যবর্তী তীহ্ প্রান্তরে বনী ইসরাঈলের ৪০ বছর আটক থাকাকালীন সময়ে। মাওলানা মওদূদী বলেন, মূসা (আঃ) পঞ্চাশ বছর বয়সে নবী হয়ে ফেরাঊনের দরবারে পৌঁছেন। অতঃপর তেইশ বছর দ্বন্দ্ব-সংগ্রামের পর ফেরাঊন ডুবে মরে এবং বনী ইসরাঈল মিসর থেকে বেরিয়ে যায়। এ সময় মূসা (আঃ)-এর বয়স ছিল সম্ভবতঃ আশি বছর। তবে মুফতী মুহাম্মাদ শফী বলেন, ফেরাঊনের জাদুকরদের সাথে মুকাবিলার ঘটনার পর ঐতিহাসিক বর্ণনা অনুযায়ী মূসা (আঃ) বিশ বছর যাবত মিসরে অবস্থান করেন। এ সময় আল্লাহ মূসা (আঃ)-কে নয়টি মু‘জেযা দান করেন।

 

উল্লেখ্য যে, আদম, ইয়াহ্ইয়া ও ঈসা (আঃ) ব্যতীত প্রায় সকল নবীই চল্লিশ বছর বয়সে নবুয়ত লাভ করেছিলেন। মূসাও চল্লিশ বছর বয়সে নবুয়ত লাভ করেছিলেন বলে অধিকাংশ বিদ্বান মত পোষণ করেছেন। সেমতে আমরা মূসা (আঃ)-এর বয়সকে নিম্নরূপে ভাগ করতে পারি। যেমন, প্রথম ৩০ বছর মিসরে, তারপর ১০ বছর মাদিয়ানে, তারপর মিসরে ফেরার পথে তূর পাহাড়ের নিকটে ‘তুবা’ উপত্যকায় ৪০ বছর বয়সে নবুয়ত লাভ। অতঃপর ২০ বছর মিসরে অবস্থান করে সেখানকার অধিবাসীদেরকে তাওহীদের দাওয়াত প্রদান। তারপর ৬০ বছর বয়সে বনী ইস্রাঈলদের নিয়ে মিসর হ’তে প্রস্থান এবং ফেরাঊনের সলিল সমাধি। অতঃপর আদি বাসস্থান কেন‘আন অধিকারী আমালেক্বাদের বিরুদ্ধে জিহাদের হুকুম অমান্য করায় অবাধ্য ইস্রাঈলীদের নিয়ে ৪০ বছর যাবত তীহ্ প্রান্তরে উন্মুক্ত কারাগারে অবস্থান ও বায়তুল মুক্বাদ্দাসের সন্নিকটে মৃত্যু সম্ভবতঃ ৮০ থেকে ১০০ বছর বয়সের মধ্যে। মূসা (আঃ)-এর কবর হয় বায়তুল মুক্বাদ্দাসের উপকণ্ঠে। আমাদের নবী (ছাঃ) সেখানে একটি লাল ঢিবির দিকে ইশারা করে সেস্থানেই মূসা (আঃ)-এর কবর হয়েছে বলে জানিয়েছেন। উল্লেখ্য যে, আদম (আঃ) থেকে ইবরাহীম (আঃ) পর্যন্ত ১০/১২ জন নবী বাদে শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর আগমনের পূর্ব পর্যন্ত পৃথিবীতে আগত সর্বমোট এক লক্ষ চবিবশ হাযার নবী-রাসূলের প্রায় সবাই ইস্রাঈল বংশের ছিলেন এবং তাঁরা ছিলেন সেমেটিক। কেননা ইব্রাহীম (আঃ) ছিলেন সাম বিন নূহ-এর ৯ম অধঃস্তন পুরুষ। এজন্য ইবরাহীমকে ‘আবুল আম্বিয়া’ বা নবীদের পিতা বলা হয়।

 

মূসা ও ফেরাঊনের কাহিনী

 

সুদ্দী ও মুররাহ প্রমুখ হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস ও আব্দুল্লাহ ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) এবং বহু সংখ্যক ছাহাবী থেকে বর্ণনা করেন যে, ফেরাঊন একদা স্বপ্নে দেখেন যে, বায়তুল মুক্বাদ্দাসের দিক হ’তে একটি আগুন এসে মিসরের ঘর-বাড়ি ও মূল অধিবাসী ক্বিবতীদের জ্বালিয়ে দিচ্ছে। অথচ অভিবাসী বনী ইস্রাঈলদের কিছুই হচ্ছে না। ভীত-চকিত অবস্থায় তিনি ঘুম থেকে জেগে উঠলেন। অতঃপর দেশের বড় বড় জ্যোতিষী ও জাদুকরদের সমবেত করলেন এবং তাদের সম্মুখে স্বপ্নের বৃত্তান্ত বর্ণনা দিলেন ও এর ব্যাখ্যা জানতে চাইলেন। জ্যোতিষীগণ বলল যে, অতি সত্বর বনী ইস্রাঈলের মধ্যে একটি পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করবে। যার হাতে মিসরীয়দের ধ্বংস নেমে আসবে’।

 

মিসর সম্রাট ফেরাঊন জ্যোতিষীদের মাধ্যমে যখন জানতে পারলেন যে, অতি সত্বর ইস্রাঈল বংশে এমন একটা পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করবে, যে তার সাম্রাজ্যের পতন ঘটাবে। তখন উক্ত সন্তানের জন্ম রোধের কৌশল হিসাবে ফেরাঊন বনী ইস্রাঈলদের ঘরে নবজাত সকল পুত্র সন্তানকে ব্যাপকহারে হত্যার নির্দেশ দিল। উদ্দেশ্য ছিল, এভাবে হত্যা করতে থাকলে এক সময় বনী ইস্রাঈল কওম যুবক শূন্য হয়ে যাবে। বৃদ্ধরাও মারা যাবে। মহিলারা সব দাসীবৃত্তিতে বাধ্য হবে। অথচ বনী ইস্রাঈলগণ ছিল মিসরের শাসক শ্রেণী এবং উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন জাতি। এই দূরদর্শী কপট পরিকল্পনা নিয়ে ফেরাঊন ও তার মন্ত্রীগণ সারা দেশে একদল ধাত্রী মহিলা ও ছুরিধারী জাল্লাদ নিয়োগ করে। মহিলারা বাড়ী বাড়ী গিয়ে বনী ইস্রাঈলের গর্ভবতী মহিলাদের তালিকা করত এবং প্রসবের দিন হাযির হয়ে দেখত, ছেলে না মেয়ে। ছেলে হ’লে পুরুষ জাল্লাদকে খবর দিত। সে এসে ছুরি দিয়ে মায়ের সামনে সন্তানকে যবহ করে ফেলে রেখে চলে যেত। এভাবে বনী ইস্রাঈলের ঘরে ঘরে কান্নার রোল পড়ে গেল। ইবনু কাছীর বলেন, একাধিক মুফাসসির বলেছেন যে, শাসকদল ক্বিবতীরা ফেরাঊনের কাছে গিয়ে অভিযোগ করল যে, এভাবে পুত্র সন্তান হত্যা করায় বনী ইস্রাঈলের কর্মজীবী ও শ্রমিক শ্রেণীর ঘাটতি হচ্ছে। যাতে তাদের কর্মী সংকট দেখা দিয়েছে। তখন ফেরাঊন এক বছর অন্তর অন্তর পুত্র হত্যার নির্দেশ দেয়। এতে বাদ পড়া বছরে হারূণের জন্ম হয়। কিন্তু হত্যার বছরে মূসার জন্ম হয়। ফলে পিতা-মাতা তাদের নবজাত সন্তানের নিশ্চিত হত্যার আশংকায় দারুণভাবে ভীত হয়ে পড়লেন। এমতাবস্থায় আল্লাহ মূসা (আঃ)-এর মায়ের অন্তরে ‘ইলহাম’ করেন। যেমন আল্লাহ পরবর্তীতে মূসাকে বলেন, ‘‘আমরা তোমার উপর আরো একবার অনুগ্রহ করেছিলাম’। ‘যখন আমরা তোমার মাকে প্রত্যাদেশ করেছিলাম, যা প্রত্যাদেশ করা হয়’। ‘(এই মর্মে যে,) তোমার নবজাত সন্তানকে সিন্দুকে ভরে নদীতে ভাসিয়ে দাও’। ‘অতঃপর নদী তাকে তীরে ঠেলে দেবে। অতঃপর আমার শত্রু ও তার শত্রু (ফেরাঊন) তাকে উঠিয়ে নেবে এবং আমি তোমার উপর আমার পক্ষ হ’তে বিশেষ মহববত নিক্ষেপ করেছিলাম এবং তা এজন্য যে, তুমি আমার চোখের সামনে প্রতিপালিত হও’’ (ত্বোয়াহা -৩৭-৩৯)। বিষয়টি আল্লাহ অন্যত্র বলেন এভাবে, “আমরা মূসার মায়ের কাছে প্রত্যাদেশ করলাম এই মর্মে যে, তুমি ছেলেকে দুধ পান করাও। অতঃপর তার জীবনের ব্যাপারে যখন শংকিত হবে, তখন তাকে নদীতে নিক্ষেপ করবে। তুমি ভীত হয়ো না ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ো না। আমরা ওকে তোমার কাছেই ফিরিয়ে দেব এবং ওকে নবীদের অন্তর্ভুক্ত করব”। মূলতঃ শেষের দু’টি ওয়াদাই তাঁর মাকে নিশ্চিন্ত ও উদ্বুদ্ধ করে। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘মূসা জননীর অন্তর (কেবলি মূসার চিন্তায়) বিভোর হয়ে পড়ল। যদি আমরা তার অন্তরকে সুদৃঢ় করে না দিতাম, তাহ’লে সে মূসার (জন্য অস্থিরতার) বিষয়টি প্রকাশ করেই ফেলত। (আমরা তার অন্তরকে দৃঢ় করেছিলাম এ কারণে যে) সে যেন আল্লাহর উপরে প্রত্যয়শীলদের অন্তর্ভুক্ত থাকে’।

 

মূসা নদীতে নিক্ষিপ্ত হলেন

 

ফেরাঊনের সৈন্যদের হাতে নিহত হবার নিশ্চিত সম্ভাবনা দেখা দিলে আল্লাহর প্রত্যাদেশ (ইলহাম) অনুযায়ী পিতা-মাতা তাদের প্রাণাধিক প্রিয় সন্তানকে সিন্দুকে ভরে বাড়ীর পাশের নীল নদীতে ভাসিয়ে দিলেন। অতঃপর স্রোতের সাথে সাথে সিন্দুকটি এগিয়ে চলল। ওদিকে মূসার (বড়) বোন তার মায়ের হুকুমে সিন্দুকটিকে অনুসরণ করে নদীর কিনারা দিয়ে চলতে লাগল (ত্বোয়াহা -৪০)। এক সময় তা ফেরাঊনের প্রাসাদের ঘাটে এসে ভিড়ল। ফেরাঊনের পুণ্যবতী স্ত্রী আসিয়া বিনতে মুযাহিম ফুটফুটে সুন্দর বাচ্চাটিকে দেখে অভিভূত হয়ে পড়লেন। ফেরাঊন তাকে বনী ইস্রাঈল সন্তান ভেবে হত্যা করতে চাইল। কিন্তু সন্তানহীনা স্ত্রীর অপত্য স্নেহের কারণে তা সম্ভব হয়নি। অবশেষে ফেরাঊন নিজে তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। কারণ আল্লাহ মূসার চেহারার মধ্যে বিশেষ একটা মায়াময় কমনীয়তা দান করেছিলেন (ত্বোয়াহা-৩৯)। যাকে দেখলেই মায়া পড়ে যেত। ফেরাঊনের হৃদয়ের পাষাণ গলতে সেটুকুই যথেষ্ট ছিল। বস্ত্ততঃ এটাও ছিল আল্লাহর মহা পরিকল্পনারই অংশ বিশেষ। ফুটফুটে শিশুটিকে দেখে ফেরাঊনের স্ত্রী তার স্বামীকে বললেন, ‘এ শিশু আমার ও তোমার নয়নমণি। একে হত্যা করো না। এ আমাদের উপকারে আসতে পারে অথবা আমরা তাকে পুত্র করে নিতে পারি’। আল্লাহ বলেন, ‘অথচ তারা (আমার কৌশল) বুঝতে পারল না’। মূসা এক্ষণে ফেরাঊনের স্ত্রীর কোলে পুত্রস্নেহ পেতে শুরু করলেন। অতঃপর বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানোর জন্য রাণীর নির্দেশে বাজারে বহু ধাত্রীর কাছে নিয়ে যাওয়া হ’ল। কিন্তু মূসা কারুরই বুকে মুখ দিচ্ছেন না। আল্লাহ বলেন, “আমরা পূর্ব থেকেই অন্যের দুধ খাওয়া থেকে মূসাকে বিরত রেখেছিলাম’। এমন সময় অপেক্ষারত মূসার ভগিনী বলল, ‘আমি কি আপনাদেরকে এমন এক পরিবারের খবর দিব, যারা আপনাদের জন্য এ শিশু পুত্রের লালন-পালন করবে এবং তারা এর শুভাকাংখী’? রাণীর সম্মতিক্রমে মূসাকে প্রস্তাবিত ধাত্রীগৃহে প্রেরণ করা হ’ল। মূসা খুশী মনে মায়ের দুধ গ্রহণ করলেন। অতঃপর মায়ের কাছে রাজকীয় ভাতা ও উপঢৌকনাদি প্রেরিত হ’তে থাকল।এভাবে আল্লাহর অপার অনুগ্রহে মূসা তার মায়ের কোলে ফিরে এলেন। এভাবে একদিকে পুত্র হত্যার ভয়ংকর আতংক হ’তে মা-বাবা মুক্তি পেলেন ও নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া সন্তানকে পুনরায় বুকে ফিরে পেয়ে তাদের হৃদয় শীতল হ’ল। অন্যদিকে বহু মূল্যের রাজকীয় ভাতা পেয়ে সংসার যাত্রা নির্বাহের দুশ্চিন্তা হ’তে তারা মুক্ত হ’লেন। সাথে সাথে সম্রাট নিয়োজিত ধাত্রী হিসাবে ও সম্রাট পরিবারের সাথে বিশেষ সম্পর্ক সৃষ্টি হওয়ার ফলে তাঁদের পরিবারের সামাজিক মর্যাদাও বৃদ্ধি পেল। এভাবেই ফেরাঊনী কৌশলের উপরে আল্লাহর কৌশল বিজয়ী হ’ল। ফালিল্লাহিল হাম্দ।

 

আল্লাহ বলেন, ‘তারা চক্রান্ত করেছিল এবং আমরাও কৌশল করেছিলাম। কিন্তু তারা (আমাদের কৌশল) বুঝতে পারেনি’ (নমল, আয়াত ৫০)।

 

যৌবনে মূসা

 

দুগ্ধ পানের মেয়াদ শেষে মূসা অতঃপর ফেরাঊন-পুত্র হিসাবে তার গৃহে শান-শওকতের মধ্যে বড় হ’তে থাকেন। আল্লাহর রহমতে ফেরাঊনের স্ত্রীর অপত্য স্নেহ ছিল তাঁর জন্য সবচেয়ে বড় দুনিয়াবী রক্ষাকবচ। এভাবে ‘যখন তিনি যৌবনে পদার্পণ করলেন এবং পূর্ণবয়ষ্ক মানুষে পরিণত হ’লেন, তখন আল্লাহ তাকে বিশেষ প্রজ্ঞা ও জ্ঞান সম্পদে ভূষিত করলেন’। মূসা সমসাময়িক সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা সম্যকভাবে উপলব্ধি করলেন। দেখলেন যে, পুরা মিসরীয় সমাজ ফেরাঊনের একচ্ছত্র রাজনৈতিক কর্তৃত্বের অধীনে কঠোরভাবে শাসিত। ‘বিভক্ত কর ও শাসন কর’ এই সুপরিচিত ঘৃণ্য নীতির অনুসরণে ফেরাঊন তার দেশবাসীকে বিভিন্ন দলে বিভক্ত করেছিল ও একটি দলকে দুর্বল করে দিয়েছিল। আর সেটি হ’ল বনু ইস্রাঈল। প্রতিদ্বন্দ্বী জন্মাবার ভয়ে সে তাদের নবজাতক পুত্র সন্তানদের হত্যা করত ও কন্যা সন্তানদের বাঁচিয়ে রাখত। এভাবে একদিকে ফেরাঊন অহংকারে স্ফীত হয়ে নিজেকে ‘সর্বোচ্চ পালনকর্তা ও সর্বাধিপতি’ ভেবে সারা দেশে অনর্থ সৃষ্টি করছিল। এমনকি সে নিজেকে ‘একমাত্র উপাস্য’ বলতেও লজ্জাবোধ করেনি। অন্যদিকে মযলূম বনী ইস্রাঈলদের হাহাকার ও দীর্ঘশ্বাসে বাতাস ভারী হয়ে উঠছিল। অবশেষে আল্লাহ মযলূমদের ডাকে সাড়া দিলেন। আল্লাহ বলেন, ‘দেশে যাদেরকে দুর্বল করা হয়েছিল, আমরা চাইলাম তাদের উপরে অনুগ্রহ করতে, তাদেরকে নেতা করতে ও দেশের উত্তরাধিকারী করতে’। ‘এবং আমরা চাইলাম তাদেরকে দেশের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করতে এবং ফেরাঊন, হামান ও তাদের সেনাবাহিনীকে তা দেখিয়ে দিতে, যা তারা সেই দুর্বল দলের তরফ থেকে আশংকা করত’।

 

যুবক মূসা খুনী লেন

 

মূসার হৃদয় মযলূমদের প্রতি করুণায় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠলো। কিন্তু কি করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। ওদিকে আল্লাহর ইচ্ছা ছিল অন্য রকম। মূসা একদিন দুপুরের অবসরে শহরে বেড়াতে বেরিয়েছেন। এমন সময় তাঁর সামনে এক কান্ড ঘটে গেল। তিনি দুই ব্যক্তিকে লড়াইরত দেখতে পেলেন। যাদের একজন যালেম সম্রাটের ক্বিবতী বংশের এবং অন্যজন মযলূম বনু ইস্রাঈলের। মূসা তাদের থামাতে গিয়ে যালেম লোকটিকে একটা ঘুষি মারলেন। কি আশ্চর্য লোকটি তাতেই অক্কা পেল। মূসা দারুণভাবে অনুতপ্ত হলেন। এ বিষয়ে আল্লাহ বলেন, “একদিন দুপুরে তিনি শহরে প্রবেশ করলেন, যখন অধিবাসীরা ছিল দিবানিদ্রার অবসরে। এ সময় তিনি দু’জন ব্যক্তিকে লড়াইরত দেখতে পেলেন। এদের একজন ছিল তার নিজ গোত্রের এবং অপরজন ছিল শত্রুদলের। অতঃপর তার নিজ দলের লোকটি তার শত্রুদলের লোকটির বিরুদ্ধে তার কাছে সাহায্য চাইল। তখন মূসা তাকে ঘুষি মারলেন এবং তাতেই তার মৃত্যু হয়ে গেল। মূসা বললেন, ‘নিশ্চয়ই এটি শয়তানের কাজ। সে মানুষকে বিভ্রান্তকারী প্রকাশ্য শত্রু’। ‘হে আমার প্রভু! আমি নিজের উপরে যুলুম করেছি। তুমি আমাকে ক্ষমা কর। অতঃপর আল্লাহ তাকে ক্ষমা করলেন। নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমাশীল ও দয়াবান’।

 

পরের দিন ‘জনৈক ব্যক্তি ছুটে এসে মূসাকে বলল, হে মূসা! আমি তোমার শুভাকাংখী। তোমাকে পরামর্শ দিচ্ছি যে, এই মুহূর্তে তুমি এখান থেকে বের হয়ে চলে যাও। কেননা সম্রাটের পারিষদবর্গ তোমাকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করছে’। এই লোকটি মূসার প্রতি আকৃষ্ট ও তাঁর গুণমুগ্ধ ছিল। একথা শুনে ভীত হয়ে মূসা সেখান থেকে বের হয়ে পড়লেন নিরুদ্দেশ যাত্রাপথে। যেমন আল্লাহ বলেন,‘অতঃপর তিনি সেখান থেকে ভীত অবস্থায় বের হয়ে পড়লেন পথ দেখতে দেখতে এবং বললেন, হে আমার পালনকর্তা! আমাকে যালেম সম্প্রদায়ের কবল থেকে রক্ষা কর’। ‘এরপর যখন তিনি (পার্শ্ববর্তী রাজ্য) মাদিয়ান অভিমুখে রওয়ানা হ’লেন, তখন (দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে) বলে উঠলেন, ‘নিশ্চয়ই আমার প্রভু আমাকে সরল পথ দেখাবেন’।আসলে আল্লাহ চাচ্ছিলেন, ফেরাঊনের রাজপ্রাসাদ থেকে মূসাকে বের করে নিতে এবং সাধারণ মানুষের জীবনাচারের সঙ্গে পরিচিত করতে। সাথে সাথে আল্লাহ তাঁকে তৎকালীন একজন শ্রেষ্ঠ নবীর গৃহে লালিত-পালিত করে তাওহীদের বাস্তব শিক্ষায় আগাম পরিপক্ক করে নিতে চাইলেন।

 

মূসার পরীক্ষা সমূহ

 

অন্যান্য নবীদের পরীক্ষা হয়েছে সাধারণতঃ নবুঅত লাভের পরে। কিন্তু মূসার পরীক্ষা শুরু হয়েছে তার জন্ম লাভের পর থেকেই। বস্ত্ততঃ নবুঅত প্রাপ্তির পূর্বে ও পরে তাঁর জীবনে বহু পরীক্ষা হয়েছে। যেমন আল্লাহ মূসা (আঃ)-কে শুনিয়ে বলেন, ‘আর আমরা তোমাকে অনেক পরীক্ষায় ফেলেছি’ (ত্বোয়াহা, আয়াত ৪০)।

 

নবুঅত লাভের পূর্বে তাঁর প্রধান পরীক্ষা ছিল তিনটি। যথাঃ (১) হত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া (২) মাদিয়ানে হিজরত (৩) মাদিয়ান থেকে মিসর যাত্রা। অতঃপর নবুয়ত লাভের পর তাঁর পরীক্ষা হয় প্রধানতঃ চারটিঃ (১) জাদুকরদের মুকাবিলা (২) ফেরাঊনের যুলুমসমূহ মুকাবিলা (৩) সাগরডুবির পরীক্ষা (৪) বায়তুল মুক্বাদ্দাস অভিযান।

 

নবুঅত-পূর্ব ১ম পরীক্ষা : হত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া

 

মূসার জন্ম হয়েছিল তাঁর কওমের উপরে আপতিত রাষ্ট্রীয় হত্যাযজ্ঞের ভয়ংকর বিভীষিকার মধ্যে। আল্লাহ তাঁকে অপূর্ব কৌশলের মাধ্যমে বাঁচিয়ে নেন। অতঃপর তাঁর জানী দুশমনের ঘরেই তাঁকে নিরাপদে ও সসম্মানে লালন-পালন করালেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মা ও পরিবারকে করলেন উচ্চতর সামাজিক মর্যাদায় উন্নীত। অথচ মূসার জন্মকে ঠেকানোর জন্যই ফেরাঊন তার পশুশক্তির মাধ্যমে বনু ইস্রাঈলের শত শত শিশু পুত্রকে হত্যা করে চলছিল। এ বিষয়ে ইতিপূর্বে বর্ণিত হয়েছে।

 

২য় পরীক্ষা : মাদিয়ানে হিজরত

 

অতঃপর যৌবনকালে তাঁর দ্বিতীয় পরীক্ষা হ’ল- হিজরতের পরীক্ষা। মূলতঃ এটাই ছিল তাঁর জ্ঞানবুদ্ধি হবার পরে ১ম পরীক্ষা। শেষনবী সহ অন্যান্য নবীর জীবনে সাধারণতঃ নবুঅতপ্রাপ্তির পরে হিজরতের পরীক্ষা দিতে হয়েছে। কিন্তু মূসা (আঃ)-এর জীবনে নবুঅত প্রাপ্তির আগেই এই কঠিন পরীক্ষা উপস্থিত হয়। অনাকাংখিত ও আকস্মিক হত্যাকান্ডের আসামী হয়ে জীবনের ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত্র মূসা ফেরাঊনের রাজ্যসীমা ছেড়ে কপর্দকহীন অবস্থায় পার্শ্ববর্তী রাজ্য মাদিয়ানে গিয়ে উপস্থিত হ’লেন। ক্ষুধায়-তৃষ্ণায় কাতর মূসা এই ভীতিকর দীর্ঘ সফরে কিভাবে চলেছেন, কি খেয়েছেন সেসব বিষয়ে তাফসীরকারগণ বিভিন্ন চমকপ্রদ ঘটনাবলী উল্লেখ করেছেন। কিন্তু কুরআন এসব বিষয়ে চুপ থেকেছে বিধায় আমরাও চুপ থাকছি। তবে রওয়ানা হবার সময় যেহেতু মূসা নিজেকে সম্পূর্ণরূপে স্বীয় পালনকর্তা আল্লাহর উপরে সমর্পণ করেছিলেন এবং প্রত্যাশা করেছিলেন ‘নিশ্চয়ই আমার পালনকর্তা আমাকে সরল পথ দেখাবেন’, অতএব তাঁকে মাদিয়ানের মত অপরিচিত রাজ্যে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়া ও সসম্মানে সেখানে বসবাস করার যাবতীয় দায়িত্ব আল্লাহ নিয়েছিলেন। এর মধ্যে আমাদের জন্য শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে যে, সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর উপরে নিজেকে সঁপে দিলে আল্লাহ তাঁর নেককার বান্দাদের সব দায়িত্ব নিজে নিয়ে থাকেন। উল্লেখ্য যে, বর্তমান পূর্ব জর্দানের মো‘আন সামুদ্রিক বন্দরের অনতিদূরেই ‘মাদইয়ান’ অবস্থিত।

 

মাদিয়ানের জীবন : বিবাহ ও সংসার পালন

 

মাদিয়ানে প্রবেশ করে তিনি পানির আশায় একটা কূপের দিকে গেলেন। সেখানে পানি প্রার্থী লোকদের ভিড়ের অদূরে দু’টি মেয়েকে তাদের তৃষ্ণার্ত পশুগুলি সহ অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাঁর হৃদয় উথলে উঠলো। কেউ তাদের দিকে ভ্রুক্ষেপই করছে না। মূসা নিজে মযলূম। তিনি মযলূমের ব্যথা বুঝেন। তাই কিছুক্ষণ ইতঃস্তত করে মেয়ে দু’টির দিকে এগিয়ে গেলেন। তিনি তাদের সমস্যার কথা জিজ্ঞেস করলে তারা বলল, ‘আমরা আমাদের পশুগুলিকে পানি পান করাতে পারি না, যতক্ষণ না রাখালরা তাদের পশুগুলিকে পানি পান করিয়ে চলে যায়। অথচ আমাদের পিতা খুবই বৃদ্ধ’ (যিনি ঘরে বসে আমাদের অপেক্ষায় উদগ্রীব হয়ে আছেন)। ‘অতঃপর তাদের পশুগুলি এনে মূসা পানি পান করালেন’ (তারপর মেয়ে দু’টি পশুগুলি নিয়ে বাড়ী চলে গেল)। মূসা একটি গাছের ছায়ায় বসে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলেন, ‘হে আমার পালনকর্তা! তুমি আমার উপর যে অনুগ্রহ নাযিল করবে, আমি তার মুখাপেক্ষী’। হঠাৎ দেখা গেল যে ‘বালিকাদ্বয়ের একজন সলজ্জ পদক্ষেপে তাঁর দিকে আসছে’। মেয়েটি এসে ধীর কণ্ঠে তাকে বলল, ‘আমার পিতা আপনাকে ডেকেছেন, যাতে আপনি যে আমাদেরকে পানি পান করিয়েছেন, তার বিনিময় স্বরূপ আপনাকে পুরস্কার দিতে পারেন’।

 

উল্লেখ্য যে, বালিকাদ্বয়ের পিতা ছিলেন মাদইয়ান বাসীদের নিকটে প্রেরিত বিখ্যাত নবী হযরত শু‘আয়েব (আঃ)। মূসা ইতিপূর্বে কখনো তাঁর নাম শোনেননি বা তাঁকে চিনতেন না। তাঁর কাছে পৌঁছে মূসা তাঁর বৃত্তান্ত সব বর্ণনা করলেন। শু‘আয়েব (আঃ) সবকিছু শুনে বললেন, ‘ভয় করো না। তুমি যালেম সম্প্রদায়ের কবল থেকে মুক্তি পেয়েছ’। ‘এমন সময় বালিকাদ্বয়ের একজন বলল, আববা! এঁকে বাড়ীতে কর্মচারী হিসাবে রেখে দিন। কেননা আপনার কর্ম সহায়ক হিসাবে সেই-ই উত্তম হবে, যে শক্তিশালী ও বিশ্বস্ত’। ‘তখন তিনি মূসাকে লক্ষ্য করে বললেন, আমি আমার এই কন্যাদ্বয়ের একজনকে তোমার সাথে বিবাহ দিতে চাই এই শর্তে যে, তুমি আট বছর আমার বাড়ীতে কর্মচারী থাকবে। তবে যদি দশ বছর পূর্ণ করো, সেটা তোমার ইচ্ছা। আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাই না। আল্লাহ চাহেন তো তুমি আমাকে সদাচারী হিসাবে পাবে’। ‘মূসা বলল, আমার ও আপনার মধ্যে এই চুক্তি স্থির হ’ল। দু’টি মেয়াদের মধ্য থেকে যেকোন একটি পূর্ণ করলে আমার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ থাকবে না। আমরা যা বলছি, আল্লাহ তার উপরে তত্ত্বাবধায়ক’। মূলতঃ এটাই ছিল তাদের বিয়ের মোহরানা। সেযুগে এ ধরনের রেওয়াজ অনেকের মধ্যে চালু ছিল। যেমন ইতিপূর্বে ইয়াকূব (আঃ) তাঁর স্ত্রীর মোহরানা বাবদ সাত বছর শ্বশুর বাড়ীতে মেষ চরিয়েছেন। এভাবে অচেনা-অজানা দেশে এসে মূসা (আঃ) অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান এবং অন্যান্য নিরাপত্তাসহ অত্যন্ত মর্যাদাবান ও নির্ভরযোগ্য একজন অভিভাবক পেয়ে গেলেন। সেই সঙ্গে পেলেন জীবন সাথী একজন পতি-পরায়ণা বুদ্ধিমতী স্ত্রী। অতঃপর সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে মূসার দিনগুলি অতিবাহিত হ’তে থাকলো। সময় গড়িয়ে এক সময় মেয়াদ পূর্ণ হ’য়ে গেল। আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, তিনি চাকুরীর বাধ্যতামূলক আট বছর এবং ঐচ্ছিক দু’বছর মেয়াদ পূর্ণ করেছিলেন। কেননা এটাই নবী চরিত্রের জন্য শোভনীয় যে, কৃতজ্ঞতা স্বরূপ ঐচ্ছিক দু’বছরও তিনি পূর্ণ করবেন’।

 

আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাঃ) বলেন, ‘সর্বাধিক দূরদর্শী ব্যক্তি ছিলেন তিনজন: ১- ইউসুফকে ক্রয়কারী মিসরের আযীয (রাজস্বমন্ত্রী), যখন তিনি তার স্ত্রীকে বলেছিলেন, ‘একে সম্মানের সাথে রাখ, হয়তবা সে আমাদের কল্যাণে আসবে’ ২- মূসার স্ত্রী, যখন (বিবাহের পূর্বে) তিনি স্বীয় পিতাকে বলেছিলেন, ‘হে পিতা, এঁকে কর্মচারী নিয়োগ করুন। নিশ্চয়ই আপনার শ্রেষ্ঠ সহযোগী তিনিই হ’তে পারেন, যিনি শক্তিশালী ও বিশ্বস্ত’ এবং ৩- আবুবকর ছিদ্দীক, যখন তিনি ওমরকে তাঁর পরবর্তী খলীফা মনোনীত করেন’।

 

৩য় পরীক্ষা: মিসর অভিমুখে যাত্রা ও পথিমধ্যে নবুঅত লাভ

 

মোহরানার চুক্তির মেয়াদ শেষ। এখন যাবার পালা। পুনরায় স্বদেশে ফেরা। দুরু দুরু বক্ষ। ভীত-সন্ত্রস্ত্র মন। চেহারায় দুশ্চিন্তার ছাপ। তবুও যেতে হবে। পিতা-মাতা, ভাই-বোন সবাই রয়েছেন মিসরে। আল্লাহর উপরে ভরসা করে স্ত্রী-পরিবার নিয়ে বের হ’লেন পুনরায় মিসরের পথে। শুরু হ’ল তৃতীয় পরীক্ষার পালা। উল্লেখ্য, দশ বছরে তিনি দু’টি পুত্র সন্তান লাভ করেন এবং শ্বশুরের কাছ থেকে পান এক পাল দুম্বা। এছাড়া তাক্বওয়া ও পরহেযগারীর আধ্যাত্মিক প্রশিক্ষণ তো তিনি লাভ করেছিলেন বিপুলভাবে।

 

পরিবারের কাফেলা নিয়ে মূসা রওয়ানা হ’লেন স্বদেশ অভিমুখে। পথিমধ্যে মিসর সীমান্তে অবস্থিত সিনাই পর্বতমালার তূর পাহাড়ের নিকটবর্তী স্থানে পৌঁছলে হঠাৎ স্ত্রীর প্রসব বেদনা শুরু হ’ল। এখুনি প্রয়োজন আগুনের। কিন্তু কোথায় পাবেন আগুন। পাথরে পাথরে ঘষে বৃথা চেষ্টা করলেন কতক্ষণ। প্রচন্ড শীতে ও তুষারপাতের কারণে পাথর ঘষায় কাজ হ’ল না। দিশেহারা হয়ে চারিদিকে দেখতে লাগলেন। হঠাৎ অনতিদূরে আগুনের হলকা নজরে পড়ল। আশায় বুক বাঁধলেন। স্ত্রী ও পরিবারকে বললেন, ‘তোমরা এখানে অবস্থান কর। আমি আগুন দেখেছি। সম্ভবতঃ আমি তা থেকে তোমাদের জন্য কিছু আগুন জ্বালিয়ে আনতে পারব অথবা সেখানে পৌঁছে পথের সন্ধান পাব’ (ত্বোয়াহা-১০)। একথা দৃষ্টে মনে হয়, মূসা পথ হারিয়ে ফেলেছিলেন। পথিমধ্যে শাম অঞ্চলের শাসকদের পক্ষ থেকে প্রধান সড়কে বিপদাশংকা ছিল। তাই শ্বশুরের উপদেশ মোতাবেক তিনি পরিচিত রাস্তা ছেড়ে অপরিচিত রাস্তায় চলতে গিয়ে মরুভূমির মধ্যে পথ হারিয়ে ডান দিকে চলে তূর পাহাড়ের পশ্চিম প্রান্তে পৌঁছে গেলেন। মূলতঃ এ পথ হারানোটা ছিল আল্লাহর মহা পরিকল্পনারই অংশ।

 

মূসা আশান্বিত হয়ে যতই আগুনের নিকটবর্তী হন, আগুনের হল্কা ততই পিছাতে থাকে। আশ্চর্য হয়ে দেখলেন, সবুজ বৃক্ষের উপরে আগুন জ্বলছে। অথচ গাছের পাতা পুড়ছে না; বরং তার উজ্জ্বলতা আরও বেড়ে যাচ্ছে। বিস্ময়ে অভিভূত মূসা এক দৃষ্টে আগুনটির দিকে তাকিয়ে রইলেন। হঠাৎ এক গুরুগম্ভীর আওয়ায কানে এলো তাঁর চার পাশ থেকে। মনে হ’ল পাহাড়ের সকল প্রান্ত থেকে একই সাথে আওয়ায আসছে। মূসা তখন তূর পাহাড়ের ডান দিকে ‘তুবা’ উপত্যকায় দন্ডায়মান। আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর যখন তিনি আগুনের কাছে পৌঁছলেন, তখন আওয়ায এলো, হে মূসা!’ ‘আমিই তোমার পালনকর্তা। অতএব তুমি তোমার জুতা খুলে ফেল। তুমি পবিত্র উপত্যকা তুবায় রয়েছ’ (ত্বোয়াহা-১১-১২)। এর দ্বারা বিশেষ অবস্থায় পবিত্র স্থানে জুতা খোলার আদব প্রমাণিত হয়। যদিও পাক জুতা পায়ে দিয়ে ছালাত আদায় করা জায়েয।অতঃপর আল্লাহ বলেন, ‘আর আমি তোমাকে মনোনীত করেছি। অতএব তোমাকে যা প্রত্যাদেশ করা হচ্ছে তা মনোযোগ দিয়ে শুনতে থাক’। ‘নিশ্চয় আমিই আল্লাহ। আমি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। অতএব আমার ইবাদত কর এবং আমার স্মরণে ছালাত কায়েম কর’। ‘ক্বিয়ামত অবশ্যই আসবে, আমি তা গোপন রাখতে চাই; যাতে প্রত্যেকে তার কর্মানুযায়ী ফল লাভ করতে পারে’। ‘সুতরাং যে ব্যক্তি ক্বিয়ামতে বিশ্বাস রাখে না এবং নিজ প্রবৃত্তির অনুসরণ করে, সে যেন তোমাকে (ক্বিয়ামত বিষয়ে সতর্ক থাকা হ’তে) নিবৃত্ত না করে। তাহ’লে তুমি ধ্বংস হয়ে যাবে’ (ত্বোয়াহা-১৩-১৬)।

 

এ পর্যন্ত আক্বীদা ও ইবাদতগত বিষয়ে নির্দেশ দানের পর এবার কর্মগত নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ বলছেন, ‘হে মূসা! তোমার ডান হাতে ওটা কি?’ ‘মূসা বললেন, এটা আমার লাঠি। এর উপরে আমি ভর দেই এবং এর দ্বারা আমার ছাগপালের জন্য গাছের পাতা ঝেড়ে নামাই। তাছাড়া এর দ্বারা আমার অন্যান্য কাজও চলে’। ‘আল্লাহ বললেন, হে মূসা! তুমি ওটা ফেলে দাও’। ‘অতঃপর তিনি ওটা (মাটিতে) ফেলে দিতেই তা সাপ হয়ে ছুটাছুটি করতে লাগল’। ‘আল্লাহ বললেন, তুমি ওটাকে ধর, ভয় করো না, আমি এখুনি ওকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে দেব’ (ত্বোয়াহা, আয়াত ১৭-২১)। এটি ছিল মূসাকে দেওয়া ১ম মু‘জেযা। কেননা মিসর ছিল ঐসময় জাদুবিদ্যায় শীর্ষস্থানে অবস্থানকারী দেশ। সেখানকার শ্রেষ্ঠ জাদুকরদের হারিয়ে দেওয়ার মাধ্যমেই নবুঅতের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করা আবশ্যক ছিল। সেজন্যই আল্লাহ মূসাকে সবদিক দিয়ে প্রস্ত্তত করে দিচ্ছিলেন। এর ফলে মূসা নিজের মধ্যে অনেকটা শক্তি ও স্বস্তি লাভ করলেন।

 

১ম মু‘জেযা প্রদানের পর আল্লাহ তাকে দ্বিতীয় মু‘জেযা প্রদানের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘তোমার হাত বগলে রাখ। তারপর দেখবে তা বের হয়ে আসবে উজ্জ্বল ও নির্মল আলো হয়ে, অন্য একটি নিদর্শন রূপে’। ‘এটা এজন্য যে, আমরা তোমাকে আমাদের বিরাট নিদর্শনাবলীর কিছু অংশ দেখাতে চাই’ (ত্বোয়াহা, আয়াত ২২-২৩)।

 

নয়টি নিদর্শন

 

আল্লাহ বলেন,‘আমরা মূসাকে নয়টি নিদর্শন প্রদান করেছিলাম’ (ইসরা, আয়াত ১০১; নামল, আয়াত ১২)। এখানে ‘নিদর্শন’ অর্থ একদল বিদ্বান ‘মু‘জেযা’ নিয়েছেন। তবে ৯ সংখ্যা উল্লেখ করায় এর বেশী না হওয়াটা যরূরী নয়। বরং এর চেয়ে অনেক বেশী মু‘জেযা তাঁকে দেওয়া হয়েছিল। যেমন পাথরে লাঠি মারায় ১২টি গোত্রের জন্য বারোটি ঝর্ণাধারা নির্গমন, তীহ্ প্রান্তরে মেঘের ছায়া প্রদান, মান্না-সালওয়া খাদ্য অবতরণ প্রভৃতি। তবে এ নয়টি ছিল অধিক গুরুত্বপূর্ণ ও শ্রেষ্ঠ নিদর্শন সমূহের অন্তর্ভুক্ত, যা ফেরাঊনী সম্প্রদায়কে প্রদর্শন করা হয়েছিল।

 

আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) উক্ত ৯টি মু‘জেযা নিম্নরূপে গণনা করেছেন। যথা- (১) মূসা (আঃ)-এর ব্যবহৃত লাঠি, যা নিক্ষেপ করা মাত্র অজগর সাপের ন্যায় হয়ে যেত (২) শুভ্র হাত, যা বগলের নীচ থেকে বের করতেই জ্যোতির্ময় হয়ে সার্চ লাইটের মত চমকাতে থাকত (৩) নিজের তোতলামি, যা মূসার প্রার্থনাক্রমে দূর করে দেওয়া হয় (৪) ফেরাঊনী কওমের উপর প্লাবণের গযব প্রেরণ (৫) অতঃপর পঙ্গপাল (৬) উকুন (৭) ব্যাঙ (৮) রক্ত এবং অবশেষে (৯) নদী ভাগ করে তাকে সহ বনু ইস্রাঈলকে সাগরডুবি হ’তে নাজাত দান। তবে প্রথম দু’টিই ছিল সর্বপ্রধান মু‘জেযা, যা নিয়ে তিনি শুরুতে ফেরাঊনের নিকটে গিয়েছিলেন (সূরা নমল, আয়াত ১০, ১২)।

 

অবশ্য কুরআনে বর্ণিত আয়াত সমূহ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, প্রথমে ফেরাঊনের সম্প্রদায়ের উপরে দুর্ভিক্ষের গযব এসেছিল। যেমন আল্লাহ বলেন,‘আমরা পাকড়াও করেছিলাম ফেরাঊনের অনুসারীদেরকে দুর্ভিক্ষের মাধ্যমে এবং ফল-ফসলাদির ক্ষয়-ক্ষতির মাধ্যমে, যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করে’ (আ‘রাফ, আয়াত ১৩০)।

 

হাফেয ইবনু কাছীর ‘তোতলামী’টা বাদ দিয়ে ‘দুর্ভিক্ষ’সহ নয়টি নিদর্শন বর্ণনা করেছেন। অবশ্য ফেরাঊন সম্প্রদায়ের উপরে আরও একটি নিদর্শন এসেছিল ‘প্লেগ-মহামারী’ (আ‘রাফ, আয়াত ১৩৪)। যাতে তাদের ৭০ হাযার লোক মারা গিয়েছিল এবং পরে মূসা (আঃ)-এর দো‘আর বরকতে মহামারী উঠে গিয়েছিল। এটাকে গণনায় ধরলে সর্বমোট নিদর্শন ১১টি হয়। তবে ‘নয়’ কথাটি ঠিক রাখতে গিয়ে কেউ তোতলামি ও প্লেগ বাদ দিয়েছেন। কেউ দুর্ভিক্ষ ও প্লেগ বাদ দিয়েছেন। মূলতঃ সবটাই ছিল মূসা (আঃ)-এর নবুঅতের অকাট্ট দলীল ও গুরুত্বপূর্ণ মু‘জেযা, যা মিসরে ফেরাঊনী সম্প্রদায়ের উপরে প্রদর্শিত হয়েছিল। এগুলি সবই হয়েছিল মিসরে। অতএব আমরা সেখানে পৌঁছে এসবের বিস্তারিত বিবরণ পেশ করব ইনশাআল্লাহ।

 

সিনাই হতে মিসর

 

প্রসব বেদনায় কাতর স্ত্রীর জন্য আগুন আনতে গিয়ে মূসা এমন এক নতুন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হ’লেন, যা রীতিমত ভীতিকর, শিহরণমূলক ও অভূতপূর্ব। তিনি স্ত্রীর জন্য আগুন নিয়ে যেতে পেরেছিলেন কি-না বা পরিবারের সেবায় তিনি পরে কি কি ব্যবস্থা নিলেন- এসব বিষয়ে কুরআন চুপ রয়েছে। কুরআনের গৃহীত বাকরীতি অনুযায়ী এ সবের বর্ণনা কোন যরূরী বিষয় নয়। কেননা এগুলি সাধারণ মানবিক তাকীদ, যা যেকোন স্বামীই তার স্ত্রী ও পরিবারের জন্য করে থাকে। অতএব এখন আমরা সামনের দিকে আগাব।

 

আল্লাহ পাক মূসাকে নবুঅত ও প্রধান দু’টি মু‘জেযা দানের পর নির্দেশ দিলেন, হে মূসা! ‘তুমি ফেরাঊনের কাছে যাও। সে উদ্ধত হয়ে গেছে’। ভীত সন্ত্রস্ত মূসা বলল, ‘হে আমার পালনকর্তা! আমার বক্ষ উন্মোচন করে দিন’ ‘এবং আমার কাজ সহজ করে দিন’। ‘আমার জিহবা থেকে জড়তা দূর করে দিন’ ‘যাতে তারা আমার কথা বুঝতে পারে’ ‘এবং আমার পরিবারের মধ্য থেকে একজনকে আমার সাহায্যকারী নিযুক্ত করে দিন’। ‘আমার ভাই হারূণকে দিন’। ‘তার মাধ্যমে আমার কোমর শক্ত করুন’ ‘এবং তাকে (নবী করে) আমার কাজে অংশীদার করুন’। ‘যাতে আমরা বেশী বেশী করে আপনার পবিত্রতা ঘোষণা করতে পারি’ ‘এবং অধিক পরিমাণে আপনাকে স্মরণ করতে পারি’। ‘আপনি তো আমাদের অবস্থা সবই দেখছেন’ (ত্বোয়াহা, আয়াত ২৪-৩৫)।

 

মূসার উপরোক্ত দীর্ঘ প্রার্থনার জবাবে আল্লাহ বললেন, ‘হে মূসা! তুমি যা যা চেয়েছ, সবই তোমাকে দেওয়া হ’ল’। শুধু এবার কেন, ‘আমি তোমার উপরে আরও একবার অনুগ্রহ করেছিলাম’ (ত্বোয়াহা, আয়াত ৩৬-৩৭)। বলেই আল্লাহ মূসাকে তার জন্মের পর নদীতে ভাসিয়ে দেওয়ার ও ফেরাঊনের ঘরে লালন-পালনের চমকপ্রদ কাহিনী শুনিয়ে দিলেন।

 

আল্লাহর খেলা বুঝা ভার। হত্যার টার্গেট হয়ে জন্মলাভ করে হত্যার ঘোষণা দানকারী সম্রাট ফেরাঊনের গৃহে পুত্রস্নেহে লালিত-পালিত হয়ে পরে যৌবনকালে পুনরায় হত্যাকান্ডের আসামী হয়ে প্রাণভয়ে ভীত ও কপর্দকশূন্য অবস্থায় স্বদেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমালেন। অতঃপর সেখানে দীর্ঘ দশ বছর মেষপালকের চাকুরী করে স্ত্রী-পরিবার নিয়ে স্বদেশ ফেরার পথে রাহযানির ভয়ে মূল রাস্তা ছেড়ে অপরিচিত রাস্তায় এসে কনকনে শীতের মধ্যে অন্ধকার রাতে প্রসব বেদনায় কাতর স্ত্রীকে নিয়ে মহা বিপদগ্রস্ত স্বামী যখন অদূরে আলোর ঝলকানি দেখে আশায় বুক বেঁধে সেদিকে ছুটেছেন। তখন তিনি জানতেন না যে, সেখানে তার জন্য অপেক্ষা করছে এমন এক মহা সুসংবাদ যা দুনিয়ার কোন মানুষ ইতিপূর্বে দেখেনি, শোনেনি, কল্পনাও করেনি। বিশ্ব চরাচরের পালনকর্তা আল্লাহ স্বয়ং স্বকণ্ঠে, স্বশব্দে ও স্ব-ভাষায় তাকে ডেকে কথা বলবেন, এও কি সম্ভব? শংকিত, শিহরিত, পুলকিত মূসা সবকিছু ভুলে পুরা দেহ-মন দিয়ে শুনছেন স্বীয় প্রভুর দৈববাণী। দেখলেন তাঁর নূরের তাজাল্লী। চাইলেন প্রাণভরে যা চাওয়ার ছিল। পেলেন সাথে সাথে পরিপূর্ণভাবে। এতে বুঝা যায়, পারিবারিক সমস্যা ও রাস্তাঘাটের সমস্যা সবই আল্লাহর মেহেরবানীতে সুন্দরভাবে সমাধান হয়ে গিয়েছিল যা কুরআনে উল্লেখের প্রয়োজন পড়েনি।

 

ওদিকে মূসার প্রার্থনা কবুলের সাথে সাথে আল্লাহ হারূণকে মিসরে অহীর মাধ্যমে নবুঅত প্রদান করলেন (মারিয়াম, আয়াত ৫৩) এবং তাকে মূসার আগমন বার্তা জানিয়ে দিলেন। সেই সঙ্গে মূসাকে সার্বিক সহযোগিতা করার এবং তাকে মিসরের বাইরে এসে অভ্যর্থনা করার নির্দেশ দেওয়া হয়। তিনি বনু ইস্রাঈলের নেতৃবৃন্দকে নিয়ে এগিয়ে এসে যথাযথভাবে সে নির্দেশ পালন করেন। পালনকর্তা, আমি তাদের এক ব্যক্তিকে হত্যা করেছিলাম। তাই আমি ভয় করছি যে, তারা আমাকে হত্যা করবে’। ‘আমার ভাই হারূণ, সে আমার অপেক্ষা প্রাঞ্জলভাষী। অতএব তাকে আমার সাথে সাহায্যের

 

মূসা হলেন কালীমুল্লাহ :

 

তুবা প্রান্তরের উক্ত ঘটনা থেকে মূসা কেবল নবী হ’লেন না। বরং তিনি হ’লেন ‘কালীমুল্লাহ’ বা আল্লাহর সাথে বাক্যালাপকারী। যদিও শেষনবী (ছাঃ) মে‘রাজে আল্লাহর সঙ্গে কথা বলেছেন। কিন্তু দুনিয়াতে এভাবে বাক্যালাপের সৌভাগ্য কেবলমাত্র হযরত মূসা (আঃ)-এর হয়েছিল। আল্লাহ বিভিন্ন নবীকে বিভিন্ন বিষয়ে বিশিষ্টতা দান করেছেন। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘হে মূসা! আমি আমার বার্তা পাঠানোর মাধ্যমে এবং আমার বাক্যালাপের মাধ্যমে তোমাকে লোকদের উপরে বিশিষ্টতা দান করেছি। অতএব আমি তোমাকে যা কিছু দান করলাম, তা গ্রহণ কর এবং কৃতজ্ঞ থাক’ (আ‘রাফ, আয়াত ১৪৪)। এভাবে আল্লাহ পাক মূসা (আঃ)-এর সাথে আরেকবার কথা বলেন, সাগর ডুবি থেকে নাজাত পাবার পরে শামে এসে একই স্থানে ‘তওরাত’ প্রদানের সময় (আ‘রাফ, আয়াত ১৩৮, ১৪৫)। এভাবে মূসা হ’লেন ‘কালীমুল্লাহ’। মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর সাথে সরাসরি বাক্যালাপের পর উৎসাহিত ও পুলকিত মূসা এখানে তূর পাহাড়ের পাদদেশ এলাকায় কিছু দিন বিশ্রাম করলেন। অতঃপর মিসর অভিমুখে রওয়ানা হ’লেন। সিনাই থেকে অনতিদূরে মিসর সীমান্তে পৌঁছে গেলে যথারীতি বড় ভাই হারূণ ও অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন এসে তাঁদেরকে সাদর অভ্যর্থনা করে নিয়ে গেলেন।

 

মূসা (আঃ)-এর মিসরে প্রত্যাবর্তন

 

ফেরাঊন ও তার পারিষদবর্গের বিরুদ্ধে অলৌকিক লাঠি ও আলোকিত হস্ত তালুর দু’টি নিদর্শন নিয়ে মূসা (আঃ) মিসরে পৌঁছলেন। ফেরাঊন ও তার সভাসদ বর্গকে আল্লাহ ‘জাহান্নামের দিকে আহবানকারী নেতৃবৃন্দ’ হিসাবে এবং তাদের সম্প্রদায়কে ‘ফাসেক’ বা পাপাচারী বলে আখ্যায়িত করেছেন। আল্লাহ পাক মূসাকে বললেন ‘তুমি ও তোমার ভাই আমার নিদর্শনবলীসহ যাও এবং আমার স্মরণে শৈথিল্য করো না’। ‘তোমরা উভয়ে ফেরাঊনের কাছে যাও। সে খুব উদ্ধত হয়ে গেছে’। ‘তোমরা তার কাছে গিয়ে নম্রভাষায় কথা বলবে। তাতে হয়ত সে চিন্তা-ভাবনা করবে অথবা ভীত হবে’। ‘তারা বলল, হে আমাদের পালনকর্তা, আমরা আশংকা করছি যে, সে আমাদের উপরে যুলুম করবে কিংবা উত্তেজিত হয়ে উঠবে’। ‘আল্লাহ বললেন, ‘তোমরা ভয় করো না। আমি তোমাদের সাথে আছি। আমি তোমাদের (সব কথা) শুনবো ও (সব অবস্থা) দেখব’ (ত্বোয়াহা, আয়াত ৪২-৪৬)।

 

ফেরাঊনের নিকটে মূসা (আঃ)-এর দাওয়াত

 

আল্লাহর নির্দেশমত মূসা ও হারূণ ফেরাঊন ও তার সভাসদবর্গের নিকটে পৌঁছে গেলেন। অতঃপর মূসা ফেরাঊনকে বললেন, ‘হে ফেরাঊন! আমি বিশ্বপ্রভুর পক্ষ হ’তে প্রেরিত রাসূল’। ‘আল্লাহর পক্ষ থেকে যে সত্য এসেছে, তার ব্যতিক্রম কিছু না বলার ব্যাপারে আমি দৃঢ়চিত্ত। আমি তোমাদের নিকটে তোমাদের পালনকর্তার নিদর্শন নিয়ে আগমন করেছি। অতএব তুমি বনু ইস্রাঈলগণকে আমার সাথে পাঠিয়ে দাও’ (আ‘রাফ, আয়াত ১০৪-১০৫)। মূসার এদাবী থেকে বুঝা যায় যে, ঐ সময় বনী ইস্রাঈলের উপরে ফেরাঊনের ও তার সম্প্রদায়ের যুলুম চরম পর্যায়ে পৌঁছেছিল এবং তাদের সঙ্গে আপোষে বসবাসের কোন রাস্তা ছিল না। ফলে তিনি তাদেরকে সেখান থেকে বের করে আনতে চাইলেন। তবে এটা নিশ্চিত যে, মূসা তখনই বনু ইস্রাঈলকে নিয়ে বের হয়ে যাননি। মূসা ফেরাঊনকে বললেন,....‘তুমি বনু ইস্রাঈলদের উপরে নিপীড়ন করো না’। ‘আমরা আল্লাহর নিকট থেকে অহী লাভ করেছি যে, যে ব্যক্তি মিথ্যারোপ করে ও মুখ ফিরিয়ে নেয়, তার উপরে আল্লাহর আযাব নেমে আসে’ (ত্বোয়াহা, আয়াত ৪৭-৪৮)। একথা শুনে ফেরাঊন তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল, ‘মূসা! তোমার পালনকর্তা কে’? ‘মূসা বললেন, আমার পালনকর্তা তিনি, যিনি প্রত্যেক বস্ত্তকে তার যোগ্য আকৃতি দান করেছেন। অতঃপর পথ প্রদর্শন করেছেন’। ‘ফেরাঊন বলল, তাহ’লে অতীত যুগের লোকদের অবস্থা কি?’ ‘মূসা বললেন, তাদের খবর আমার প্রভুর কাছে লিখিত আছে। আমার পালনকর্তা ভ্রান্ত হন না এবং বিস্মৃতও হন না’। একথা বলার পর মূসা আল্লাহর নিদর্শন সমূহ বর্ণনা শুরু করলেন, যাতে ফেরাঊন তার যৌক্তিকতা মেনে নিতে বাধ্য হয়। তিনি বললেন, আমার পালনকর্তা তিনি, ‘যিনি তোমাদের জন্য পৃথিবীকে বিছানা স্বরূপ বানিয়েছেন এবং তাতে চলার পথ সমূহ তৈরী করেছেন। তিনি আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করেন এবং তা দ্বারা বিভিন্ন প্রকার উদ্ভিদ উৎপন্ন করেন’। ‘তোমরা তা আহার কর ও তোমাদের চতুষ্পদ জন্তুসমূহ চরিয়ে থাক। নিশ্চয়ই এতে বিবেকবানদের জন্য নিদর্শন সমূহ রয়েছে’ (ত্বোয়াহা, আয়াত ৪৯-৫৪)।

 

মুজেযা ও জাদু :

 

মু‘জেযা অর্থ মানুষের বুদ্ধিকে অক্ষমকারী। অর্থাৎ এমন কর্ম সংঘটিত হওয়া যা মানুষের জ্ঞান ও ক্ষমতা বহির্ভূত। (১) ‘মু‘জেযা’ কেবল নবীগণের জন্য খাছ এবং ‘কারামত’ আল্লাহ তাঁর নেককার বান্দাদের মাধ্যমে কখনো কখনো প্রকাশ করে থাকেন। যা ক্বিয়ামত পর্যন্ত জারি থাকবে। (২) মু‘জেযা নবীগণের মাধ্যমে সরাসরি আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়। পক্ষান্তরে জাদু কেবল দুষ্ট জিন ও মানুষের মাধ্যমেই হয়ে থাকে এবং তা হয় অদৃশ্য প্রাকৃতিক কারণের প্রভাবে। (৩) জাদু কেবল পৃথিবীতেই ক্রিয়াশীল হয়, আসমানে নয়। কিন্তু মু‘জেযা আল্লাহর হুকুমে আসমান ও যমীনে সর্বত্র ক্রিয়াশীল থাকে। যেমন শেষনবী (ছাঃ)-এর অঙ্গুলী সংকেতে আকাশের চন্দ্র দ্বিখন্ডিত হয়েছিল। (৪) মু‘জেযা মানুষের কল্যাণের জন্য হয়ে থাকে। কিন্তু জাদু স্রেফ ভেল্কিবাজি ও প্রতারণা মাত্র এবং যা মানুষের কেবল ক্ষতিই করে থাকে।

 

জাদুতে মানুষের সাময়িক বুদ্ধি বিভ্রম ঘটে। যা মানুষকে প্রতারিত করে। এজন্যে একে ইসলামে হারাম করা হয়েছে। মিসরীয় জাতি তথা ফেরাঊনের সম্প্রদায় ঐ সময় জাদু বিদ্যায় পারদর্শী ছিল এবং জ্যোতিষীদের প্রভাব ছিল তাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে অত্যধিক। সেকারণ তাদের চিরাচরিত ধারণা অনুযায়ী মূসা (আঃ)-এর মু‘জেযাকে তারা বড় ধরনের একটা জাদু ভেবেছিল মাত্র। তবে তারা তাঁকে সাধারণ জাদুকর নয়, বরং ‘বিজ্ঞ জাদুকর’ বলে স্বীকৃতি দিয়েছিল (আ‘রাফ, আয়াত ১০৯)। কারণ তাদের হিসাব অনুযায়ী মূসার জাদু ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির, যা তাদের আয়ত্তাধীন জাদু বিদ্যার বাইরের এবং যা ছিল অনুপম ও অনন্য বৈশিষ্ট্য মন্ডিত।

 

পরবর্তীকালে সুলায়মান (আঃ)-এর সময়ে ইরাকের বাবেল নগরী তৎকালীন পৃথিবীতে জাদু বিদ্যায় শীর্ষস্থান লাভ করে। তখন আল্লাহ সুলায়মান (আঃ)-কে জিন, ইনসান, বায়ু ও পশুপক্ষীর উপর ক্ষমতা দিয়ে পাঠান। এগুলিকে লোকেরা জাদু ভাবে এবং তার নবুঅতকে অস্বীকার করে। তখন আল্লাহ হারূত ও মারূত ফেরেশতাদ্বয়কে জাদু ও মু‘জেযার পার্থক্য বুঝানোর জন্য প্রেরণ করেন। যাতে লোকেরা জাদুকরদের তাবেদারী ছেড়ে নবীর তাবেদার হয়।

 

নবুঅত পরবর্তী ১ম পরীক্ষা : জাদুকরদের মুকাবিলা

 

মূসা (আঃ) ও ফেরাঊনের মাঝে জাদু প্রতিযোগিতার দিন ধার্য হবার পর মূসা (আঃ) পয়গম্বর সূলভ দয়া প্রকাশে নেতাদেরকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘দুর্ভোগ তোমাদের! তোমরা আল্লাহর প্রতি মিথ্যারোপ করো না। তাহ’লে তিনি তোমাদেরকে আযাব দ্বারা ধ্বংস করে দেবেন। যারাই মিথ্যারোপ করে, তারাই বিফল মনোরথ হয়’ (ত্বোয়াহা, আয়াত ৬১)। কিন্তু এতে কোন ফলোদয় হ’ল না। ফেরাঊন উঠে গিয়ে ‘তার সকল কলা-কৌশল জমা করল, অতঃপর উপস্থিত হ’ল’ (ত্বোয়াহা, আয়াত ৬০)। ‘অতঃপর তারা তাদের কাজে নিজেদের মধ্যে বিতর্ক করল এবং গোপনে পরামর্শ করল’। ‘তারা বলল, এই দু’জন লোক নিশ্চিতভাবেই জাদুকর। তারা তাদের জাদু দ্বারা আমাদেরকে আমাদের দেশ থেকে বহিষ্কার করতে চায় এবং আমাদের উৎকৃষ্ট জীবনধারা রহিত করতে চায়’। ‘অতএব (হে জাদুকরগণ!) তোমরা তোমাদের যাবতীয় কলা-কৌশল সংহত কর। অতঃপর সারিবদ্ধভাবে এসো। আজ যে জয়ী হবে, সেই-ই সফলকাম হবে’ (ত্বোয়াহা, আয়াত ৬৩-৬৪)।

 

জাদুকররা ফেরাঊনের নিকট সমবেত হয়ে বলল, জাদুকর ব্যক্তিটি কি দিয়ে কাজ করে? সবাই বলল, সাপ দিয়ে। তারা বলল, আল্লাহর কসম! পৃথিবীতে আমাদের উপরে এমন কেউ নেই, যে লাঠি ও রশিকে সাপ বানিয়ে কাজ করতে পারে (‘হাদীছুল কুতূন’ নাসাঈ, ইবনু জারীর, ইবনু কাছীর)। অতএব ‘আমাদের জন্য কি বিশেষ কোন পুরস্কার আছে, যদি আমরা বিজয়ী হই’? ‘সে বলল, হ্যাঁ। তখন অবশ্যই তোমরা আমার নিকটবর্তী লোকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে’ (আ‘রাফ, আয়াত ১১৩-১১৪)।

 

জাদুকররা উৎসাহিত হয়ে মূসাকে বলল, ‘হে মূসা! হয় তুমি (তোমার জাদুর লাঠি) নিক্ষেপ কর, না হয় আমরা প্রথমে নিক্ষেপ করি’ (ত্বোয়াহা, আয়াত ৬৫)। মূসা বললেন, ‘তোমরাই নিক্ষেপ কর। অতঃপর যখন তারা ‘তাদের রশি ও লাঠি নিক্ষেপ করল’ (শো‘আরা, আয়াত ৪৪), তখন লোকদের চোখগুলিকে ধাঁধিয়ে দিল এবং তাদের ভীত-সন্ত্রস্ত করে তুলল ও এক মহাজাদু প্রদর্শন করল’ (আ‘রাফ, আয়াত ১১৬)। ‘তাদের জাদুর প্রভাবে মূসার মনে হ’ল যেন তাদের রশিগুলো ও লাঠিগুলো (সাপের ন্যায়) ছুটাছুটি করছে’। ‘তাতে মূসার মনে কিছুটা ভীতির সঞ্চার হ’ল’ (ত্বোয়াহা, আয়াত ৬৬-৬৭)। এমতাবস্থায় আল্লাহ ‘অহি’ নাযিল করে মূসাকে অভয় দিয়ে বললেন, ‘তুমিই বিজয়ী হবে’ ‘তোমার ডান হাতে যা আছে, তা (অর্থাৎ লাঠি) নিক্ষেপ কর। এটা তাদের সবকিছুকে যা তারা করেছে, গ্রাস করে ফেলবে। তাদের ওসব তো জাদুর খেল মাত্র। বস্ত্ততঃ জাদুকর যেখানেই থাকুক সে সফল হবে না’ (ত্বোয়াহা, আয়াত ৬৮-৬৯)।

 

জাদুকররা তাদের রশি ও লাঠি সমূহ নিক্ষেপ করার সময় বলল, ‘ফেরাঊনের মর্যাদার শপথ! আমরা অবশ্যই বিজয়ী হব’ (শো‘আরা, আয়াত ৪৪)। তারপর মূসা (আঃ) আল্লাহর নামে লাঠি নিক্ষেপ করলেন। দেখা গেল তা বিরাট অজগর সাপের ন্যায় রূপ ধারণ করল এবং জাদুকরদের সমস্ত অলীক কীর্তিগুলোকে গ্রাস করতে লাগল’ (শো‘আরা, আয়াত ৪৫)।

 

এদৃশ্য দেখে যুগশ্রেষ্ঠ জাদুকরগণ বুঝে নিল যে, মূসার এ জাদু আসলে জাদু নয়। কেননা জাদুর সর্বোচ্চ বিদ্যা তাদের কাছেই রয়েছে। মূসা তাদের চেয়ে বড় জাদুকর হ’লে এতদিন তার নাম শোনা যেত। তার উস্তাদের খবর জানা যেত। তাছাড়া তার যৌবনকাল অবধি সে আমাদের কাছেই ছিল। কখনোই তাকে জাদু শিখতে বা জাদু খেলা দেখাতে বা জাদুর প্রতি কোনরূপ আকর্ষণও তার মধ্যে কখনো দেখা যায়নি। তার পরিবারেও কোন জাদুকর নেই। তার বড় ভাই হারূণ তো সর্বদা আমাদের মাঝেই দিনাতিপাত করেছে। কখনোই তাকে এসব করতে দেখা যায়নি বা তার মুখে এখনকার মত বক্তব্য শোনা যায়নি। হঠাৎ করে কেউ বিশ্বসেরা জাদুকর হয়ে যেতে পারে না। নিশ্চয়ই এর মধ্যে অলৌকিক কোন সত্তার নিদর্শন রয়েছে, যা আয়ত্ত করা মানুষের ক্ষমতার বাইরে। এ সময় মূসার দেওয়া তাওহীদের দাওয়াত ও আল্লাহর গযবের ভীতি তাদের অন্তরে প্রভাব বিস্তার করল। আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর সত্য প্রতিষ্ঠিত হ’ল এবং বাতিল হয়ে গেল তাদের সমস্ত জাদুকর্ম’। ‘এভাবে তারা সেখানেই পরাজিত হ’ল এবং লজ্জিত হয়ে ফিরে গেল’ (আ‘রাফ, আয়াত ১১৮-১১৯)। অতঃপর ‘তারা সিজদায় পড়ে গেল’। এবং ‘বলে উঠল, আমরা বিশ্বচরাচরের পালনকর্তার উপরে বিশ্বাস স্থাপন করলাম, যিনি মূসা ও হারূণের রব’ (শো‘আরা, আয়াত ৪৬-৪৮; ত্বোয়াহা, আয়াত ৭০; আ‘রাফ, আয়াত ১২০-১২১)।

 

পরাজয়ের এ দৃশ্য দেখে ভীত-বিহবল ফেরাঊন নিজেকে সামলে নিয়ে উপস্থিত লাখো জনতার মনোবল চাঙ্গা রাখার জন্য জাদুকরদের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো, ‘আমার অনুমতি দানের পূর্বেই তোমরা তাকে মেনে নিলে? নিশ্চয়ই সে (অর্থাৎ মূসা) তোমাদের প্রধান, যে তোমাদেরকে জাদু শিক্ষা দিয়েছে’ (ত্বোয়াহা, আয়াত ৭১; আ‘রাফ, আয়াত ১২৩; শো‘আরা, আয়াত ৪৯)। অতঃপর সম্রাট সূলভ হুমকি দিয়ে বলল,‘শীঘ্রই তোমরা তোমাদের পরিণাম ফল জানতে পারবে। আমি অবশ্যই তোমাদের হাত ও পা বিপরীত দিক থেকে কেটে ফেলব এবং তোমাদের সবাইকে শূলে চড়াব’ (শো‘আরা, আয়াত ৪৯)। জবাবে জাদুকররা বলল, ‘কোন ক্ষতি নেই। আমরা আমাদের পালনকর্তার কাছে প্রত্যাবর্তন করব’। ‘আশা করি আমাদের পালনকর্তা আমাদের ত্রুটি-বিচ্যুতি সমূহ ক্ষমা করবেন’ (শো‘আরা, আয়াত ৪৯-৫১; ত্বোয়াহা, আয়াত ৭১-৭৩; আ‘রাফ, আয়াত ১২৪-১২৬)।

 

ফেরাঊনের ছয়টি কুটচাল

 

জাদুকরদের পরাজয়ের পর ফেরাঊন তার রাজনৈতিক কুটচালের মাধ্যমে জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে ফিরিয়ে দিতে চাইল। তার চালগুলি ছিল, (১) সে বলল: এই জাদুকররা সবাই মূসার শিষ্য। তারা চক্রান্ত করেই তার কাছে নতি স্বীকার করেছে। এটা একটা পাতানো খেলা মাত্র। আসলে ‘মূসাই হ’ল বড় জাদুকর’ (ত্বোয়াহা, আয়াত ৭১)। (২) সে বলল, মূসা তার জাদুর মাধ্যমে ‘নগরীর অধিবাসীদেরকে সেখান থেকে বের করে দিতে চায়’ (আ‘রাফ, আয়াত ১১০) এবং মূসা ও তার সম্প্রদায় এদেশে আধিপত্য বিস্তার করতে চায়। (৩) সে বলল মূসা যেসব কথা বলছে ‘আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের মধ্যে সেসব কথা কখনো শুনিনি’। (৪) সে বলল, হে জনগণ! এ লোকটি তোমাদের ধর্ম পরিবর্তন করে দেবে ও দেশময় বিপর্যয় সৃষ্টি করবে’। (৫) সে বলল, মূসা তোমাদের উৎকৃষ্ট (রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক) জীবন ব্যবস্থা রহিত করতে চায়’ (ত্বোয়াহা, আয়াত ৬৩)। (৬) সে মিসরীয় জনগণকে বিভিন্ন দলে বিভক্ত করে দিয়েছিল এবং একটির দ্বারা অপরটিকে দুর্বল করার মাধ্যমে নিজের শাসন ও শোষণ অব্যাহত রেখেছিল। আজকের বহুদলীয় গণতন্ত্র বা দলতন্ত্র ফেলে আসা ফেরাঊনী তন্ত্রের আধুনিক রূপ বলেই মনে হয়। নিজেই সবকিছু করলেও লোকদের খুশী করার জন্য ফেরাঊন বলল, ‘অতএব হে জনগণ! তোমরা এখন কি বলতে চাও’? (শো‘আরা, ৩৫; আ‘রাফ, ১১০)। এযুগের নেতারা যেমন নিজেদের সকল অপকর্ম জনগণের দোহাই দিয়ে করে থাকেন।

 

জাদুকরদের সত্য গ্রহণ

 

ধূর্ত ও কুটবুদ্ধি ফেরাঊন বুঝলো যে, তার ঔষধ কাজে লেগেছে। এখুনি মোক্ষম সময়। সে সাথে সাথে জাদুকরদের হাত-পা বিপরীতভাবে কেটে অতঃপর খেজুর গাছের সাথে শূলে চড়িয়ে হত্যা করার আদেশ দিল। সে ভেবেছিল, এতে জাদুকররা ভীত হয়ে তার কাছে প্রাণভিক্ষা চাইবে। কিন্তু ফল উল্টা হ’ল। তারা একবাক্যে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলে দিল,

 

 ‘আমরা তোমাকে ঐসব সুস্পষ্ট নিদর্শন (ও মু‘জেযার) উপরে প্রাধান্য দিতে পারি না, যেগুলো (মূসার মাধ্যমে) আমাদের কাছে পৌঁছেছে এবং প্রধান্য দিতে পারি না তোমাকে সেই সত্তার উপরে যিনি আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন। অতএব তুমি যা ইচ্ছা তাই করতে পার। তুমি তো কেবল এই পার্থিব জীবনেই যা করার করবে’। ‘আমরা আমাদের পালনকর্তার উপরে বিশ্বাস স্থাপন করেছি, যাতে তিনি আমাদের পাপসমূহ এবং তুমি আমাদেরকে যে জাদু করতে বাধ্য করেছ, (তার পাপসমূহ) তা মার্জনা করেন। আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ ও চিরস্থায়ী’ (ত্বোয়াহা, আয়াত ৭২-৭৩)।

 

তারা আরও বলল, ‘আমরা (তো মৃত্যুর পরে) আমাদের পরওয়ারদিগারের নিকটে ফিরে যাব’। ‘বস্ত্ততঃ আমাদের সাথে তোমার শত্রুতা তো কেবল একারণেই যে, আমরা ঈমান এনেছি আমাদের পালনকর্তার নিদর্শন সমূহের প্রতি, যখন তা আমাদের নিকটে পৌঁছেছে। অতএব ‘হে আমাদের প্রভু! আমাদের জন্য ধৈর্যের দুয়ার খুলে দাও এবং আমাদেরকে ‘মুসলিম’ হিসাবে মৃত্যু দান কর’ (আ‘রাফ, আয়াত ১২৫-১২৬)। এটা ধারণা করা অযৌক্তিক হবে না যে, ইতিপূর্বে ফেরাঊনের দরবারে মূসার লাঠির মু‘জেযা প্রদর্শনের ঘটনা থেকেই জাদুকরদের মনে প্রতীতি জন্মেছিল যে, এটা কোন জাদু নয়, এটা মু‘জেযা। কিন্তু ফেরাঊন ও তার পারিষদবর্গের ভয়ে তারা মুখ খুলেনি। অবশেষে তাদেরকে সমবেত করার পর তাদেরকে সম্রাটের নৈকট্যশীল করার ও বিরাট পুরস্কারের লোভ দেখানো হয়। এগুলো নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক ও আর্থিক প্রলোভনের চাপ ভিন্ন কিছুই ছিল না।

 

জাদুকরদের মুসলমান হয়ে যাবার অন্যতম কারণ ছিল মুকাবিলার পূর্বে ফেরাঊন ও তার জাদুকরদের উদ্দেশ্যে মূসার প্রদত্ত উপদেশমূলক ভাষণ। যেখানে তিনি বলেছিলেন, ‘দুর্ভোগ তোমাদের! তোমরা আল্লাহর প্রতি মিথ্যারোপ করো না। তাহ’লে তিনি তোমাদেরকে আযাব দ্বারা ধ্বংস করে দেবেন। বস্ত্ততঃ তারাই বিফল মনোরথ হয়, যারা মিথ্যারোপ করে’ (ত্বোয়াহা, আয়াত ৬১)।

 

মূসার মুখে একথা শুনে ফেরাঊন ও তার সভাসদরা অহংকারে স্ফীত হ’লেও জাদুকর ও সাধারণ জনগণের মধ্যে দারুণ প্রতিক্রিয়া হয়। ফলে জাদুকরদের মধ্যে গ্রুপিং হয়ে যায় এবং তারা আপোষে বিতর্কে লিপ্ত হয়। যদিও গোপন আলোচনার ভিত্তিতে সম্ভবতঃ রাজকীয় সম্মান ও বিরাট অংকের পুরস্কারের লোভে পরিশেষে তারা একমত হয়।

 

জনগণের প্রতিক্রিয়া

 

আল্লাহ বলেন, ‘ফেরাঊন ও তার পারিষদবর্গের নির্যাতনের ভয়ে তার সম্প্রদায়ের কিছু লোক ব্যতীত কেউ তার প্রতি ঈমান আনেনি। আর ফেরাঊন তার দেশে ছিল পরাক্রান্ত এবং সে ছিল সীমালংঘনকারীদের অন্তর্ভুক্ত’ (ইউনুস, আয়াত ৮৩)। এতে বুঝা যায় যে, ক্বিবতীদের মধ্যে গোপনে ঈমান আনয়নকারীর সংখ্যা বেশী থাকলেও প্রকাশ্যে ঈমান আনয়নকারীর সংখ্যা নিতান্তই কম ছিল।

 

উল্লেখ্য যে, অত্র আয়াতে ‘তার কওমের কিছু লোক ব্যতীত’ বলতে ইবনু আববাস (রাঃ) ‘ফেরাঊনের কওমের কিছু লোক’ বলেছেন। কিন্তু ইবনু জারীর ও অনেক বিদ্বান মূসার নিজ কওম ‘বনু ইস্রাঈলের কিছু লোক’ বলেছেন। এর জবাবে হাফেয ইবনু কাছীর বলেন, এটা প্রসিদ্ধ কথা যে, বনু ইস্রাঈলের সকলেই মূসাকে নবী হিসাবে বিশ্বাস করত একমাত্র ক্বারূণ ব্যতীত। কেননা সে ছিল বিদ্রোহী এবং ফেরাঊনের সাথী। আর মূসার কারণেই বনু ইস্রাঈলগণ মূসার জন্মের আগে ও পরে সমানভাবে নির্যাতিত ছিল (আ‘রাফ, ১২৯)। অতএব অত্র আয়াতে যে মুষ্টিমেয় লোকের ঈমান আনার কথা বলা হয়েছে, তারা নিশ্চিতভাবেই ছিলেন ক্বিবতী সম্প্রদায়ের। আর তারা ছিলেন, ফেরাঊনের স্ত্রী আসিয়া, ফেরাঊনের চাচাতো ভাই জনৈক মুমিন ব্যক্তি যিনি তার ঈমান গোপন রেখেছিলেন এবং ফেরাঊনের খাজাঞ্চি ও তার স্ত্রী। যেকথা ইবনু আববাস (রাঃ) বলেছেন।

 

ফেরাঊনের স্ত্রীর প্রতিক্রিয়া

 

জাদুকরদের সঙ্গে মুকাবিলা তথা সত্য ও মিথ্যার এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার সময় ফেরাঊনের নেককার স্ত্রী ও মূসার পালক মাতা ‘আসিয়া’ উক্ত মুকাবিলার শুভ ফলাফলের জন্য সদা উদগ্রীব ছিলেন। যখন তাঁকে মূসা ও হারূণের বিজয়ের সংবাদ শোনানো হ’ল, তখন তিনি কালবিলম্ব না করে বলে ওঠেন, ‘আমি মূসা ও হারূণের পালনকর্তার উপরে ঈমান আনলাম’। নিজ স্ত্রীর ঈমানের এ খবর শুনে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে ফেরাঊন তাকে মর্মান্তিকভাবে নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করে। মৃত্যুর পূর্বে বিবি আসিয়া কাতর কণ্ঠে স্বীয় প্রভুর নিকটে প্রার্থনা করেন। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ ঈমানদারগণের জন্য দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেন ফেরাঊনের স্ত্রীর, যখন সে বলেছিল, ‘হে আমার পালনকর্তা! তোমার নিকটে জান্নাতে আমার জন্য একটি গৃহ নির্মাণ কর! আমাকে ফেরাঊন ও তার পারিষদবর্গের হাত থেকে উদ্ধার কর এবং আমাকে যালেম সম্প্রদায়ের কবল থেকে মুক্তি দাও’ (তাহরীম, আয়াত ১১)।

 

নবুঅত-পরবর্তী ২য় পরীক্ষা : বনু ইস্রাঈলদের উপরে আপতিত ফেরাঊনী যুলুম সমূহ

 

জাদুর পরীক্ষায় পরাজিত ফেরাঊনের যাবতীয় আক্রোশ গিয়ে পড়ল এবার নিরীহ বনু ইস্রাঈলগণের উপর। জাদুকরদের ঈমান আনয়ন, অতঃপর তাদের মৃত্যুদন্ড প্রদান, বিবি আসিয়ার ঈমান আনয়ন ও তাঁকে মৃত্যুদন্ড প্রদান ইত্যাদি নিষ্ঠুর দমন নীতির মাধ্যমে এবং অত্যন্ত নোংরা কুটচাল ও মিথ্যা অপবাদ সমূহের মাধ্যমে মূসার ঈমানী আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দেওয়ার চক্রান্ত করেছিল ফেরাঊন। কিন্তু এর ফলে জনগণের মধ্যে মূসার দাওয়াত দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল। তাতে ফেরাঊন ও তার অহংকারী পারিষদবর্গ নতুনভাবে দমন নীতির কৌশলপত্র প্রণয়ন করল। তারা নিজেরা বিধর্মী হ’লেও সাধারণ জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য ধর্মকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করল। অন্যদিকে ‘বিভক্ত কর ও শাসন কর’-এই কুটনীতির অনুসরণে ফেরাঊনের ক্বিবতী সম্প্রদায়কে বাদ দিয়ে কেবল বনু ইস্রাঈলদের উপরে চূড়ান্ত যুলুম ও নির্যাতনের পরিকল্পনা করল।

 

১ম যুলুমঃ বনু ইস্রাঈলের নবজাতক পুত্রসন্তানদের হত্যার নির্দেশ জারি

 

ফেরাঊনী সম্প্রদায়ের নেতারা ইতিপূর্বে ফেরাঊনকে বলেছিল, ‘আপনি কি মূসা ও তার সম্প্রদায়কে এমনি ছেড়ে দিবেন দেশময় ফাসাদ সৃষ্টি করার জন্য এবং আপনাকে ও আপনার উপাস্যদেরকে বাতিল করে দেবার জন্য? (আ‘রাফ, ১২৭)। নেতারা মূসা ও হারূণের ঈমানী দাওয়াতকে ‘ফাসাদ’ বলে অভিহিত করেছিল। এক্ষণে দেশময় মূসার দাওয়াতের ব্যাপক প্রসার বন্ধ করার জন্য এবং ফেরাঊনের নিজ সম্প্রদায়ের সাধারণ লোকদের ব্যাপকহারে মূসার দ্বীনের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার স্রোত বন্ধ করার জন্য নিজেদের লোকদের কিছু না বলে নিরীহ বনু ইস্রাঈলদের উপরে অত্যাচার শুরু করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে ফেরাঊন বলল, ‘আমি এখুনি টুকরা টুকরা করে হত্যা করব ওদের পুত্র সন্তানদেরকে এবং বাঁচিয়ে রাখব ওদের কন্যা সন্তানদেরকে। আর আমরা তো ওদের উপরে (সবদিক দিয়েই) প্রবল’ (আ‘রাফ, আয়াত ১২৭)। এভাবে মূসার জন্মকালে বনী ইস্রাঈলের সকল নবজাতক পুত্র হত্যা করার সেই ফেলে আসা লোমহর্ষক নির্যাতনের পুনরাবৃত্তির ঘোষণা প্রদান করা হ’ল।

 

দল ঠিক রাখার জন্য এবং সম্প্রদায়ের নেতাদের রোষাগ্নি প্রশমনের জন্য ফেরাঊন অনুরূপ ঘোষণা দিলেও মূসা ও হারূণ সম্পর্কে তার মুখ দিয়ে কোন কথা বের হয়নি। যদিও ইতিপূর্বে সে মূসাকে কারারুদ্ধ করার এমনকি হত্যা করার হুমকি দিয়েছিল (শো‘আরা,২৯; মুমিন ৪০)। কিন্তু জাদুকরদের পরাজয়ের পর এবং নিজে মূসার সর্পরূপী লাঠির মু‘জেযা দেখে ভীত বিহবল হয়ে পড়ার পর থেকে মূসার দিকে তাকানোর মত সাহসও তার ছিল না।

 

যাই হোক ফেরাঊনের উক্ত নিষ্ঠুর ঘোষণা জারি হওয়ার পর বনু ইস্রাঈলগণ মূসার নিকটে এসে অনুযোগের সুরে বলল, ‘তোমার আগমনের পূর্বেও আমাদেরকে নির্যাতন করা হয়েছে। আবার এখন তোমার আগমনের পরেও তাই করা হচ্ছে’ (আ‘রাফ, আয়াত ১২৯)। অর্থাৎ তোমার আগমনের পূর্বে তো এ আশায় আমাদের দিন কাটত যে, সত্বর আমাদের উদ্ধারের জন্য একজন নবীর আগমন ঘটবে। অথচ এখন তোমার আগমনের পরেও সেই একই নির্যাতনের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। তাহ’লে এখন আমাদের উপায় কি? আসন্ন বিপদের আশংকায় ভীত-সন্ত্রস্ত কওমের লোকদের সান্ত্বনা দিয়ে মূসা (আঃ) বললেন, ‘তোমাদের পালনকর্তা শীঘ্রই তোমাদের শত্রুদের ধ্বংস করে দেবেন এবং তোমাদেরকে দেশে প্রতিনিধিত্ব দান করবেন। তারপর দেখবেন, তোমরা কেমন কাজ কর’ (আ‘রাফ, আয়ত ১২৯)। তিনি বললেন,‘তোমরা সাহায্য প্রার্থনা কর আল্লাহর নিকটে এবং ধৈর্য ধারণ কর। নিশ্চয়ই এ পৃথিবী আল্লাহর। তিনি স্বীয় বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা এর উত্তরাধিকারী বানিয়ে দেন। বস্ত্ততঃ চূড়ান্ত পরিণাম ফল আল্লাহভীরুদের জন্যই নির্ধারিত’ (আ‘রাফ, আয়াত ১২৮)।

 

মূসা (আঃ) তাদেরকে আরও বলেন, ‘হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা যদি আল্লাহর উপরে ঈমান এনে থাক, তবে তাঁরই উপরে ভরসা কর যদি তোমরা আনুগত্যশীল হয়ে থাক’। জবাবে তারা বলল, আমরা আল্লাহর উপরে ভরসা করছি। হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদের উপরে এ যালেম কওমের শক্তি পরীক্ষা করো না’। ‘আর আমাদেরকে অনুগ্রহ করে কাফের সম্প্রদায়ের কবল থেকে মুক্তি দাও’ (ইউনুস, আয়াত ৮৪-৮৬)।

 

উপরোক্ত আয়াত সমূহে বুঝা যায় যে, পয়গম্বর সূলভ দরদ ও দূরদর্শিতার আলোকে মূসা (আঃ) স্বীয় ভীত-সন্ত্রস্ত কওমকে মূলতঃ দু’টি বিষয়ে উপদেশ দেন। এক- শত্রুর মোকাবেলায় আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করা এবং দুই- আল্লাহর সাহায্য না আসা পর্যন্ত সাহসের সাথে ধৈর্য ধারণ করা। সাথে সাথে একথাও স্মরণ করিয়ে দেন যে, সমগ্র পৃথিবীর মালিকানা আল্লাহর। তিনি যাকে খুশী এর উত্তরাধিকারী নিয়োগ করেন এবং নিঃসন্দেহে শেষফল মুত্তাক্বীদের জন্যই নির্ধারিত।

 

ফেরাঊনের বিরুদ্ধে মূসার বদ দো

 

‘মূসা বলল, হে আমাদের পালনকর্তা! তুমি ফেরাঊনকে ও তার সর্দারদেরকে পার্থিব আড়ম্বর সমূহ ও সম্পদরাজি দান করেছ, যা দিয়ে তারা লোকদেরকে তোমার রাস্তা থেকে বিপথগামী করে। অতএব হে আমাদের প্রভু! তুমি তাদের সম্পদরাজি ধ্বংস করে দাও ও তাদের অন্তরগুলিকে শক্ত করে দাও, যাতে তারা অতক্ষণ পর্যন্ত ঈমান না আনে, যতক্ষণ না তারা মর্মান্তিক আযাব প্রত্যক্ষ করে’। জবাবে আল্লাহ বললেন, তোমাদের দো‘আ কবুল হয়েছে। অতএব তোমরা দু’জন অটল থাক এবং অবশ্যই তোমরা তাদের পথে চলো না, যারা জানে না’ (ইউনুস, আয়াত ৮৮-৮৯)।

 

মূসা ও হারূণের উপরোক্ত দো‘আ আল্লাহ কবুল করলেন। কিন্তু তার বাস্তবায়ন সঙ্গে সঙ্গে করলেন না। বরং সময় নিলেন অন্যূন বিশ বছর। এরূপ প্রলম্বিত কর্মপদ্ধতির মাধ্যমে আল্লাহ মাযলূমের ধৈর্য পরীক্ষার সাথে সাথে যালেমেরও পরীক্ষা নিয়ে থাকেন এবং তাদের তওবা করার ও হেদায়াত প্রাপ্তির সুযোগ দেন। যাতে পরে তাদের জন্য ওযর পেশ করার কোন সুযোগ না থাকে। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ ইচ্ছা করলে তাদের কাছ থেকে প্রতিশোধ নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তোমাদের কতককে কতকের দ্বারা পরীক্ষা করতে চান’ (মুহাম্মাদ, আয়াত ৪৭)।

 

প্রশ্ন হ’তে পারে, এত যুলুম সত্ত্বেও আল্লাহ তাদের হিজরত করার নির্দেশ না দিয়ে সেখানেই পুনরায় ঘর বানিয়ে বসবাসের নির্দেশ দিলেন কেন? এর জবাব দু’ভাবে দেওয়া যেতে পারে।

 

এক- ফেরাঊন তাদেরকে হিজরতে বাধা দিত। কারণ বনু ইস্রাঈলগণকে তারা তাদের জাতীয় উন্নয়নের সহযোগী হিসাবে এবং কর্মচারী ও সেবাদাস হিসাবে ব্যবহার করত। তাছাড়া পালিয়ে আসারও কোন পথ ছিল না। কেননা নীলনদ ছিল বড় বাধা। নদী পার হওয়ার চেষ্টা করলে ফেরাঊনী সেনারা তাদের পশ্চাদ্ধাবন করত।

 

দুই- ফেরাঊনী সম্প্রদায়ের মধ্যে মূসা ও হারূণের দাওয়াত সম্প্রসারণ করা। মূলতঃ এটিই ছিল আল্লাহর মূল উদ্দেশ্য। কেননা যতদিন তারা মিসরে ছিলেন, সেখানকার অধিবাসীদের নিকটে দ্বীনের দাওয়াত পেশ করেছেন এবং তার ফলে বহু আল্লাহর বান্দা পথের সন্ধান পেয়ে ধন্য হয়েছেন। ফেরাঊন দেখেছিল তার দুনিয়াবী লাভ ও শান-শওকত। কিন্তু আল্লাহ চেয়েছিলেন তাওহীদের প্রচার ও প্রসার ও মানুষের হেদায়াত। সেটিই হয়েছে। ফেরাঊনেরা এখন মিসরের পিরামিডের দর্শনীয় বস্ত্ততে পরিণত হয়েছে। অথচ মিসর সহ বলা চলে পুরা আফ্রিকায় এখন ইসলামের জয়-জয়কার অব্যাহত রয়েছে।

 

ফেরাঊনী সম্প্রদায়ের উপরে আপতিত গযব সমূহ এবং মূসা (আঃ)-এর মুজেযা সমূহ

 

ঐতিহাসিক বর্ণনা অনুযায়ী ফেরাঊনের জাদুকরদের সাথে শক্তি পরীক্ষার ঘটনার পর মূসা (আঃ) অন্যূন বিশ বছর যাবত মিসরে অবস্থান করে সেখানকার অধিবাসীদেরকে আল্লাহর বাণী শোনান এবং সত্য ও সরল পথের দিকে দাওয়াত দিতে থাকেন। এ সময়কালের মধ্যে আল্লাহ মূসা (আঃ)-কে প্রধান ৯টি মু‘জেযা দান করেন। তবে প্লেগ মহামারী সহ (আ‘রাফ, আয়াত ১৩৪)। মোট নিদর্শনের সংখ্যা দাঁড়ায় ১০টি। যার মধ্যে প্রথম দু’টি শ্রেষ্ঠ মু‘জেযা ছিল অলৌকিক লাঠি ও আলোকময় হস্ততালু। যার পরীক্ষা শুরুতেই ফেরাঊনের দরবারে এবং পরে জাদুকরদের সম্মুখে হয়ে গিয়েছিল। এরপর বাকীগুলি এসেছিল ফেরাঊনী কওমের হেদায়াতের উদ্দেশ্যে তাদেরকে সাবধান করার জন্য। মূলতঃ দুনিয়াতে প্রেরিত সকল এলাহী গযবের মূল উদ্দেশ্য থাকে মানুষের হেদায়াত। যেমন আল্লাহ বলেন,‘কাফির ও ফাসিকদেরকে (জাহান্নামের) কঠিন শাস্তির পূর্বে (দুনিয়াতে) আমরা অবশ্যই লঘু শাস্তি আস্বাদন করাব, যাতে তারা (আমার দিকে) ফিরে আসে’ (সাজদাহ, আয়াত ৩২)।

 

মযলূম বনু ইস্রাঈলদের কাতর প্রার্থনা এবং মূসা ও হারূণের দো‘আ আল্লাহ কবুল করেছিলেন। সেমতে সর্বপ্রথম অহংকারী ফেরাঊনী কওমের দুনিয়াবী জৌলুস ও সম্পদরাজি ধ্বংসের গযব নেমে আসে। তারপর আসে অন্যান্য গযব বা নিদর্শন সমূহ। আমরা সেগুলি একে একে বর্ণনা করার প্রয়াস পাব। যাতে এযুগের মানুষ তা থেকে উপদেশ হাছিল করে।

 

মোট নিদর্শন সমূহ, যা মিসরে প্রদর্শিত হয়-

 

(১) লাঠি (২) প্রদীপ্ত হস্ততালু (৩) দুর্ভিক্ষ (৪) তূফান (৫) পঙ্গপাল (৬) উকুন (৭) ব্যাঙ (৮) রক্ত (৯) প্লেগ (১০) সাগরডুবি। প্রথম দু’টি এবং মূসার ব্যক্তিগত তোতলামি দূর হওয়াটা বাদ দিয়ে বাকী ৮টি নিদর্শন নিম্নে বর্ণিত হ’ল-

 

 তূফান

 

দুর্ভিক্ষের পরে মূসা (আঃ)-এর দো‘আর বরকতে পুনরায় ভরা মাঠ ও ভরা ফসল পেয়ে ফেরাঊনী সম্প্রদায় পিছনের সব কথা ভুলে যায় ও গর্বে স্ফীত হয়ে মূসা (আঃ)-এর বিরুদ্ধে অপবাদ রটাতে থাকে। তারা সাধারণ লোকদের ঈমান গ্রহণে বাধা দিতে থাকে। তারা তাদের প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে পুনরায় ঔদ্ধত্য প্রকাশ করতে থাকে। ফলে তাদের উপরে গযব আকারে প্লাবন ও জলোচ্ছ্বাস নেমে আসে। যা তাদের মাঠ-ঘাট, বাগান-ফসল, ঘর-বাড়ি সব ভাসিয়ে নিয়ে যায়। এতে ভীত হয়ে তারা আবার মূসা (আঃ)-এর কাছে এসে কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। আবার তারা ঈমান আনার প্রতিজ্ঞা করে ও আল্লাহর নিকটে দো‘আ করার জন্য মূসা (আঃ)-কে পীড়াপীড়ি করতে থাকে। ফলে মূসা (আঃ) দো‘আ করেন ও আল্লাহর রহমতে তূফান চলে যায়। পুনরায় তারা জমি-জমা আবাদ করে ও অচিরেই তা সবুজ-শ্যামল হয়ে ওঠে। এ দৃশ্য দেখে তারা আবার অহংকারী হয়ে ওঠে এবং বলতে থাকে, আসলে আমাদের জমির উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি করার জন্যেই প্লাবন এসেছিল, আর সেকারণেই আমাদের ফসল এবার সর্বকালের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে ও বাম্পার ফলন হয়েছে। আসলে আমাদের কর্ম দক্ষতার ফল হিসাবে এটাই উপযুক্ত। এভাবে তারা অহংকারে মত্ত হয়ে আবার শুরু করল বনী ইস্রাঈলদের উপরে যুলুম-অত্যাচার। ফলে নেমে এল তৃতীয় গযব।

 

 পঙ্গপাল

 

একদিন হঠাৎ হাযার হাযার পঙ্গপাল কোত্থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে এসে ফেরাঊনীদের সব ফসল খেয়ে ছাফ করে গেল। তারা তাদের বাগ-বাগিচার ফল-ফলাদি খেয়ে সাবাড় করে ফেলল। এমনকি কাঠের দরজা-জানালা, আসবাব-পত্র পর্যন্ত খেয়ে শেষ করল। অথচ পাশাপাশি বনু ইস্রাঈলদের ঘরবাড়ি, শস্যভূমি ও বাগ-বাগিচা সবই সুরক্ষিত থাকে।

 

এবারও ফেরাঊনী সম্প্রদায় ছুটে এসে মূসা (আঃ)-এর কাছে কাতর কণ্ঠে নিবেদন করতে থাকে, যাতে গযব চলে যায়। তারা এবার পাকা ওয়াদা করল যে, তারা ঈমান আনবে ও বনু ইস্রাঈলদের মুক্তি দেবে। মূসা (আঃ) দো‘আ করলেন ও আযাব চলে গেল। পরে ফেরাঊনীরা দেখল যে, পঙ্গপালে খেয়ে গেলেও এখনও যা অবশিষ্ট আছে, তা দিয়ে বেশ কিছুদিন চলে যাবে। ফলে তারা আবার শয়তানী ধোঁকায় পড়ে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করল ও পূর্বের ন্যায় ঔদ্ধত্য প্রদর্শন শুরু করল। ফলে নেমে এল পরবর্তী গযব ‘উকুন’।

 

 উকুন

 

‘উকুন’ সাধারণতঃ মানুষের মাথার চুলে জন্মে থাকে। তবে এখানে ব্যাপক অর্থে ঘুণ পোকা ও কেড়ি পোকাকেও গণ্য করা হয়েছে। যা ফেরাঊনীদের সকল প্রকার কাঠের খুঁটি, দরজা-জানালা, খাট-পালংক ও আসবাব-পত্রে এবং খাদ্য-শস্যে লেগেছিল। তাছাড়া দেহের সর্বত্র সর্বদা উকুনের কামড়ে তারা অতিষ্ঠ হয়ে উঠলো। এভাবে উকুন ও ঘুণপোকার অত্যাচারে দিশেহারা হয়ে এক সময় তারা কাঁদতে কাঁদতে মূসা (আঃ)-এর দরবারে এসে লুটিয়ে পড়ে ক্ষমা চাইতে লাগলো এবং প্রতিজ্ঞার পরে প্রতিজ্ঞা করে বলতে লাগলো যে, এবারে আযাব ফিরে গেলে তারা অবশ্যই ঈমান আনবে, তাতে বিন্দুমাত্র অন্যথা হবে না। মূসা (আঃ) তাদের জন্য দো‘আ করলেন এবং আযাব চলে গেল। কিন্তু তারা কিছু দিনের মধ্যেই প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করল এবং পূর্বের ন্যায় অবাধ্য আচরণ শুরু করল। আল্লাহর পক্ষ থেকে বারবার অবকাশ দেওয়াকে তারা তাদের ভালত্বের পক্ষে দলীল হিসাবে মনে করতে লাগল এবং হেদায়াত দূরে থাক, তাদের অহংকার ক্রমে বাড়তে লাগল। মূলতঃ এগুলো ছিল তাদের নেতৃস্থানীয় লোকদের অবস্থা। নইলে সাধারণ মানুষ মূসা ও হারূণের দাওয়াত অন্তরে কবুল করে যাচ্ছিল এবং তাদের সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছিল। আর এতেই ছিল মূসা (আঃ)-এর সান্ত্বনা। আল্লাহ বলেন, ‘যখন আমরা কোন জনপদকে ধ্বংস করার ইচ্ছা করি, তখন সেখানকার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদেরকে উদ্বুদ্ধ করি। অতঃপর তারা পাপাচারে লিপ্ত হয়। ফলে উক্ত জনগোষ্ঠীর উপরে আদেশ অবধারিত হয়ে যায়। অতঃপর আমরা উক্ত জনপদকে সমূলে বিধ্বস্ত করি’ (ইসরা, আয়াত ১৬)। ফেরাঊনীদের উপরে সেই অবস্থা এসে গিয়েছিল। তাদের নেতারা স্বাভাবিক বুদ্ধি-বিবেচনা হারিয়ে ফেলেছিল। তারা তাদের লোকদের বুঝাতে লাগলো যে, এসবই মূসার জাদুর খেল। আসলে আল্লাহ বলে কিছুই নেই। ফলে নেমে এল এবার ‘ব্যাঙ’-এর গযব।

 

ব্যাঙ

 

বারবার বিদ্রোহ করা সত্ত্বেও দয়ালু আল্লাহ তাদের সাবধান করার জন্য ও আল্লাহর পথে ফিরিয়ে আনার জন্য পুনরায় গযব পাঠালেন। এবার এল ব্যাঙ। ব্যাঙে ব্যাঙে ভরে গেল তাদের ঘর-বাড়ি, হাড়ি-পাতিল, জামা-কাপড়, বিছানা-পত্তর সবকিছু। বসতে ব্যাঙ, খেতে ব্যাঙ, চলতে ব্যাঙ, গায়ে-মাথায় সর্বত্র ব্যাঙের লাফালাফি। কোন জায়গায় বসা মাত্র শত শত ব্যাঙের নীচে তলিয়ে যেতে হ’ত। এই নরম জীবটির সরস অত্যাচারে পাগলপরা হয়ে উঠল পুরা ফেরাঊনী জনপদ। অবশেষে কান্নাকাটি করে ও কাকুতি-মিনতি করে তারা এসে ক্ষমা প্রার্থনা করতে লাগলো মূসা (আঃ)-এর কাছে। এবার পাকাপাকি ওয়াদা করল যে, আযাব চলে যাবার সাথে সাথে তারা ঈমান আনবেই। কিন্তু না, যথা পূর্বং তথা পরং। ফলে পুনরায় গযব অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠল। এবারে এল ‘রক্ত’।

 

রক্ত

 

তাদের অহংকার ও ঔদ্ধত্য চরমে উঠলে হঠাৎ একদিন দেখা গেল ‘রক্ত’। খাদ্য ও পানপাত্রে রক্ত, কূয়া ও পুকুরে রক্ত, তরি-তরকারিতে রক্ত, কলসি-বালতিতে রক্ত। একই সাথে খেতে বসে বনু ইস্রাঈলের থালা-বাটি স্বাভাবিক। কিন্তু ফেরাঊনী ক্বিবতীর থালা-বাটি রক্তে ভরা। পানি মুখে নেওয়া মাত্র গ্লাসভর্তি রক্ত। অহংকারী নেতারা বাধ্য হয়ে বনু ইস্রাঈলী মযলূমদের বাড়ীতে এসে খাদ্য ও পানি ভিক্ষা চাইত। কিন্তু যেমনি তাদের হাতে তা পৌঁছত, অমনি সেগুলো রক্তে পরিবর্তিত হয়ে যেত। ফলে তাদের খাওয়া-দাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। না খেয়ে তাদের মধ্যে হাহাকার পড়ে গেল। অবশেষে পূর্বের ন্যায় আবার এসে কান্নাকাটি। মূসা (আঃ) দয়া পরবশে আল্লাহর নিকটে প্রার্থনা করলেন। ফলে আযাব চলে গেল। কিন্তু ঐ নেতাগুলো পূর্বের মতই তাদের গোমরাহীতে অনড় রইল এবং ঈমান আনলো না। এদের এই হঠকারিতা ও কপট আচরণের কথা আল্লাহ বর্ণনা করেন এভাবে, ‘অতঃপর তারা আত্মম্ভরিতা দেখাতে লাগলো। বস্ত্ততঃ এরা ছিল পাপাসক্ত জাতি’ (আ‘রাফ, আয়াত ১৩৩)। ফলে নেমে এল এবার প্লেগ মহামারী।

 

 প্লেগ

 

রক্তের আযাব উঠিয়ে নেবার পরও যখন ওরা ঈমান আনলো না, তখন আল্লাহ ওদের উপরে প্লেগ মহামারী প্রেরণ করেন (আ‘রাফ, আয়াত ১৩৪)। অনেকে এটাকে ‘বসন্ত’ রোগ বলেছেন। যাতে অল্প দিনেই তাদের সত্তর হাযার লোক মারা যায়। অথচ বনু ইস্রাঈলরা ভাল থাকে। এলাহী গযবের সাথে সাথে এগুলি ছিল মূসা (আঃ)-এর মু‘জেযা এবং নবুঅতের নিদর্শন। কিন্তু জাহিল ও আত্মগর্বী নেতারা একে ‘জাদু’ বলে তাচ্ছিল্য করত।

 

প্লেগের মহামারীর ফলে ব্যাপক প্রাণহানিতে ভীত হয়ে তারা আবার এসে মূসা (আঃ)-এর নিকটে হাত জোড় করে ক্ষমা চাইতে লাগল। মূসা (আঃ) আবারও তাদের জন্য দো‘আ করলেন। ফলে আযাব চলে গেল। কিন্তু তারা পূর্বের ন্যায় আবারো ওয়াদা ভঙ্গ করল। ফলে তাদের চূড়ান্ত ধ্বংস অবধারিত হয়ে গেল। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই যাদের উপরে তোমার প্রভুর আদেশ নির্ধারিত হয়ে গেছে, তারা কখনো বিশ্বাস আনয়ন করে না, যদিও সব রকমের নিদর্শনাবলী তাদের নিকটে পৌছে যায়, এমনকি তারা মর্মান্তিক আযাব প্রত্যক্ষ করে’ (ইউনুস, আয়াত ৯৬-৯৭)।

 

 সাগর ডুবি

 

ক্রমাগত পরীক্ষা ও অবকাশ দানের পরও যখন কোন জাতি সম্বিত ফিরে পায় না। বরং উল্টা তাদের অহংকার বাড়তে বাড়তে তুঙ্গে ওঠে, তখন তাদের চূড়ান্ত ধ্বংস অনিবার্য হয়ে ওঠে। আল্লাহ পাক বলেন,

 

 ‘আমরা মূসার প্রতি এই মর্মে অহী করলাম যে, আমার বান্দাদের নিয়ে রাত্রিযোগে বের হয়ে যাও এবং তাদের জন্য সমুদ্রে শুষ্কপথ নির্ধারণ কর। পিছন থেকে এসে তোমাদের ধরে ফেলার আশংকা কর না এবং (পানিতে ডুবে যাওয়ার) ভয় কর না’ (ত্বোয়াহা, আয়াত ৭৭)।

 

আল্লাহর হুকুম পেয়ে মূসা (আঃ) রাত্রির সূচনা লগ্নে বনু ইস্রাঈলদের নিয়ে রওয়ানা হ’লেন। তাঁরা সমুদ্রের দিকে রওয়ানা হয়ে গেলেন। এ সমুদ্র কোনটা ছিল এ ব্যাপারে মুফতী মুহাম্মাদ শফী তাফসীর রূহুল মা‘আনীর বরাত দিয়ে ৮৬০ পৃষ্ঠায় লিখেছেন যে, ওটা ছিল ‘ভূমধ্যসাগর’। একই তাফসীরে ৪৭৯ পৃষ্ঠায় লিখেছেন ‘লোহিত সাগর’। কিন্তু মাওলানা মওদূদী খ্যাতনামা পাশ্চাত্য মনীষী লুইস গোল্ডিং-এর তথ্যানুসন্ধান মূলক ভ্রমণ কাহিনী IN THE STEPS OF MOSSES, THE LAW GIVER -এর বরাতে লিখেছেন যে, ওটা ছিল ‘লোহিত সাগর সংলগ্ন তিক্ত হরদ’। মিসরের আধুনিক তাফসীরকার তানতাভীও (মৃঃ ১৯৪০ খৃঃ) বলেন যে, লোহিত সাগরে ডুবে মরা ফেরাঊনের লাশ ১৯০০ খৃষ্টাব্দের মে মাসে পাওয়া গিয়েছিল’। যদিও তা ১৯০৭ সালে পাওয়া যায়।

 

উল্লেখ্য যে, হযরত ইয়াকূব (আঃ)-এর বারো জন পুত্র মিসরে এসেছিলেন। পরবর্তী চারশত বছরে তাদের বংশ বৃদ্ধি পেয়ে ইস্রাঈলী বর্ণনা অনুযায়ী ছয় লাখ ৩০ হাযার ছাড়িয়ে যায়। মাওলানা মওদূদী বলেন, ঐ সময় মিসরে মুসলিম অধিবাসীর সংখ্যা ছিল ১০ থেকে ২০ শতাংশের মাঝামাঝি। তবে কুরআন ও হাদীছ থেকে কেবল এতটুকু জানা যায় যে, তাদের বারোটি গোত্র ছিল এবং প্রত্যেক গোত্রের জনসংখ্যা ছিল বিপুল।

 

নবুঅত-পরবর্তী ৩য় পরীক্ষা ও নাজাত লাভ

 

মূসার নবুঅতী জীবনে এটি ছিল একটি চূড়ান্ত পরীক্ষা। ইবরাহীমের অগ্নি পরীক্ষার ন্যায় এটিও ছিল জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে এক মহা পরীক্ষা। পিছনে ফেরাঊনের হিংস্র বাহিনী, সম্মুখে অথৈ সাগর। এই কঠিন সময়ে বনু ইস্রাঈলের আতংক ও হাহাকারের মধ্যেও মূসা ছিলেন স্থির ও নিস্কম্প। দৃঢ় হিমাদ্রির ন্যায় তিনি আল্লাহর উপরে বিশ্বাসে অটল থাকেন এবং সাথীদের সান্ত্বনা দিয়ে আল্লাহর রহমত কামনা করেন। হিজরতের রাতে একইরূপ জীবন-মরণ পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছিলেন শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)। যাই হোক ফেরাঊন খবর জানতে পেরে তার সেনাবাহিনীকে বনু ইস্রাঈলদের পশ্চাদ্ধাবনের নির্দেশ দিল। আল্লাহ বলেন,

 

 ‘সূর্যোদয়ের সময় তারা তাদের পশ্চাদ্ধাবন করল’ (শো‘আরা, আয়াত ৬০)। ‘অতঃপর যখন উভয় দল পরস্পরকে দেখল, তখন মূসার সঙ্গীরা (ভীত হয়ে) বলল, ‘আমরা তো এবার নিশ্চিত ধরা পড়ে গেলাম’। ‘তখন মূসা বললেন, কখনই নয়, আমার সাথে আছেন আমার পালনকর্তা। তিনি আমাকে সত্বর পথ প্রদর্শন করবেন’। ‘অতঃপর আমরা মূসাকে আদেশ করলাম, তোমার লাঠি দ্বারা সমুদ্রকে আঘাত কর। ফলে তা বিদীর্ণ হয়ে গেল এবং প্রত্যেক ভাগ বিশাল পাহাড় সদৃশ হয়ে গেল’। ‘ইতিমধ্যে আমরা সেখানে অপরদলকে (অর্থাৎ ফেরাঊন ও তার সেনাবাহিনীকে) পৌঁছে দিলাম’। ‘এবং মূসা ও তার সঙ্গীদের সবাইকে বাঁচিয়ে দিলাম’। ‘অতঃপর অপর দলটিকে ডুবিয়ে দিলাম’ (শো‘আরা, আয়াত ৬০-৬৬)। এখানে ‘প্রত্যেক ভাগ’ বলতে তাফসীরকারগণ বারো গোত্রের জন্য বারোটি ভাগ বলেছেন। প্রত্যেক ভাগের লোকেরা পানির দেওয়াল ভেদ করে পরস্পরকে দেখতে পায় ও কথা বলতে পারে, যাতে তারা ভীত না হয়ে পড়ে। আমরা মনে করি এগুলো কল্পনা না করলেও চলে। মূসা ও বনু ইস্রাঈলকে সাগর পাড়ি দিয়ে ওপারে চলে যেতে দেখে ফেরাঊন সরোষে ঘোড়া দাবড়িয়ে সর্বাগ্রে শুষ্ক সাগর বক্ষে ঝাঁপিয়ে পড়ল। পিছনে তার বিশাল বাহিনীর সবাই সাগরের মধ্যে নেমে এলো। যখন তারা সাগরের মধ্যস্থলে পৌঁছে গেল, তখন আল্লাহর হুকুমে দু’দিক থেকে বিপুল পানি রাশি ধেয়ে এসে তাদেরকে নিমেষে গ্রাস করে ফেলল। আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর ফেরাঊন তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে তাদের পশ্চাদ্ধাবন করল। কিন্তু সমুদ্র তাদেরকে সম্পূর্ণরূপে গ্রাস করে ফেলল’ (ত্বোয়াহা, আয়াত ৭৮)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, ‘আর বনু ইস্রাঈলকে আমরা সাগর পার করে দিলাম। তারপর তাদের পশ্চাদ্ধাবন করল ফেরাঊন ও তার সেনাবাহিনী বাড়াবাড়ি ও শত্রুতা বশতঃ। অতঃপর যখন সে (ফেরাঊন) ডুবতে লাগল, তখন বলে উঠল, আমি ঈমান আনছি এ বিষয়ে যে, সেই সত্তা ব্যতীত কোন উপাস্য নেই, যার উপরে ঈমান এনেছে বনু ইস্রাঈলগণ এবং আমি আত্মসমর্পণকারীদের একজন’ (ইউনুস, আয়াত ৯০)। আল্লাহ বললেন,

 

‘এখন একথা বলছ? অথচ তুমি ইতিপূর্বে না-ফরমানী করেছিলে এবং ফাসাদ সৃষ্টিকারীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলে’। ‘অতএব আজ আমরা তোমার দেহকে (বিনষ্ট হওয়া থেকে) বাঁচিয়ে দিচ্ছি। যাতে তোমার পশ্চাদ্বর্তীদের জন্য তুমি নিদর্শন হ’তে পার। বস্ত্ততঃ বহু লোক এমন রয়েছে যারা আমাদের নিদর্শনাবলীর বিষয়ে বেখবর’ (ইউনুস, আয়াত ৯১-৯২)।

 

স্মর্তব্য যে, সাগরডুবির দৃশ্য স্বচক্ষে দেখার পরেও ভীত-সন্ত্রস্ত বনী ইস্রাঈলীরা ফেরাঊন মরেছে কি- না বিশ্বাস করতে পারছিল না। ফলে মূসা (আঃ) আল্লাহর নিকট দো‘আ করলেন। তখন আল্লাহ তার প্রাণহীন দেহ বের করে দিলেন। অতঃপর মূসার সাথীরা নিশ্চিন্ত হ’ল। উল্লেখ্য যে, ফেরাঊনের মমিকৃত দেহ অক্ষতভাবে পাওয়া যায় ১৯০৭ সালে এবং বর্তমানে তা মিসরের পিরামিডে রক্ষিত আছে।

 

এতে একথাও প্রমাণিত হয় যে, ফেরাঊনের সময় মিসরীয় সভ্যতা অনেক উন্নত ছিল। তাদের সময়ে লাশ ‘মমি’ করার মত বৈজ্ঞানিক কলাকৌশল আবিষ্কৃত হয়। পিরামিড, স্ফিংক্স হাযার হাযার বছর ধরে আজও সেই প্রাচীন সভ্যতার স্মৃতি ধারণ করে আছে, যা নিঃসন্দেহে বিস্ময়কর। আজকের যুগের কোন কারিগর প্রাচীন এসব কারিগরী কলা-কৌশলের ধারে-কাছেও যেতে পারবে কি-না সন্দেহ।

 

বনু ইস্রাঈলের অবাধ্যতা ও তাদের উপরে আপতিত পরীক্ষা সমূহের বিবরণ:

 

১. মূর্তি পূজার আবদার

 

বনু ইস্রাঈল কওম মূসা (আঃ)-এর মু‘জেযার বলে লোহিত সাগরে নির্ঘাত ডুবে মরা থেকে সদ্য নাজাত পেয়ে এসেছিল এবং গোটা ফেরাঊনী গোষ্ঠীকে সাগরে ডুবে মরার মর্মান্তিক দৃশ্য স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করে এসেছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও সিরিয়া আসার পথে কিছুদূর অগ্রসর হ’তেই তারা এমন এক জনপদের উপর দিয়ে অতিক্রম করল, যারা বিভিন্ন মূর্তির পূজায় লিপ্ত ছিল। তাদের পূজা-অর্চনার জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান দেখে তাদের মন সেদিকে আকৃষ্ট হ’ল এবং মূসা (আঃ)-এর কাছে গিয়ে আবেদন করল, ‘তাদের মূর্তিসমূহের ন্যায় আমাদের জন্যও একটা মূর্তি বানিয়ে দিন’। মূসা বললেন, ‘তোমরা দেখছি মূর্খতায় লিপ্ত জাতি’। তিনি বলেন, ‘এরা যে কাজে নিয়োজিত রয়েছে, তা ধ্বংস হবে এবং যা কিছু তারা করছে, তা সব বাতিল’। ‘তিনি আরও বললেন,‘আমি কি তোমাদের জন্য আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন উপাস্য সন্ধান করব? অথচ তিনি তোমাদেরকে সারা বিশ্বের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন’ (আ‘রাফ, আয়াত ১৩৮-১৪০)।

 

বস্ত্ততঃ মানুষ সর্বদা আনুষ্ঠানিকতা প্রিয় এবং অদৃশ্য সত্তার চেয়ে দৃশ্যমান বস্ত্তর প্রতি অধিকতর আসক্ত। ফলে নূহ (আঃ)-এর যুগ থেকেই অদৃশ্য আল্লাহর নৈকট্য হাছিলের অসীলা কল্পনা করে নিজেদের হাতে গড়া দৃশ্যমান মূর্তি সমূহের পূজা-অর্চনা চলে আসছে। অবশেষে আল্লাহ্কে ও তাঁর বিধানকে ভুলে গিয়ে মানুষ মূর্তিকে ও নিজেদের মনগড়া বিধানকে মুখ্য গণ্য করেছে। মক্কার মুশরিকরাও শেষনবীর কাছে তাদের মূর্তিপূজাকে আল্লাহর নৈকট্যের অসীলা বলে অজুহাত দিয়েছিল’ (যুমার, আয়াত ৩৯)। তাদের এই অজুহাত অগ্রাহ্য হয় এবং তাদের রক্ত হালাল গণ্য হয়। বদর, ওহোদ, খন্দক প্রভৃতি যুদ্ধসহ পরবর্তীকালের সকল জিহাদ মূলতঃ এই শিরকের বিরুদ্ধেই পরিচালিত হয়। মক্কা বিজয়ের দিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজ হাতে মূর্তি ভেঙ্গে অতঃপর পানি দিয়ে ধুয়ে কা‘বা গৃহ ছাফ করেন এবং আয়াত পাঠ করেন, ‘সত্য এসে গেল, মিথ্যা বিদূরিত হ’ল’ (ইসরা, আয়াত ৮১)।

 

কিন্তু দুর্ভাগ্য! মূর্তিপূজার সে স্থান আজ দখল করেছে মুসলমানদের মধ্যে কবর পূজা, ছবি-মূর্তি ও প্রতিকৃতি পূজা, স্মৃতিসৌধ, স্থানপূজা, শহীদ মিনার ও বেদী পূজা, শিখা ও আগুন পূজা ইত্যাদি। বস্ত্ততঃ এগুলি স্পষ্ট শিরক, যা থেকে নবীগণ যুগে যুগে মানুষকে সাবধান করেছেন। মূসা (আঃ) স্বীয় কওমকে তাদের মূর্খতাসূলভ আচরণের জন্য ধমকানোর পর তাদের হুঁশ ফিরলো এবং তারা বিরত হ’ল।

 

তওরাত লাভ

 

অতঃপর আল্লাহ মূসাকে অহীর মাধ্যমে ওয়াদা করলেন যে, তাকে সত্বর ‘কিতাব’ (তওরাত) প্রদান করা হবে এবং এজন্য তিনি বনু ইস্রাঈলকে সাথে নিয়ে তাকে ‘তূর পাহাড়ের দক্ষিণ পার্শ্বে’ চলে আসতে বললেন (ত্বোয়াহা, আয়াত ৮৩-৮৪)। অতঃপর মূসা (আঃ) আগে এসে আল্লাহর হুকুমে প্রথমে ত্রিশ দিন ছিয়াম ও এ‘তেকাফে মগ্ন থাকেন। এরপর আল্লাহ আরও দশদিন মেয়াদ বাড়িয়ে দেন (আ‘রাফ, আয়াত ১৪২)। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, এই দশদিন ছিল যিলহজ্জের প্রথম দশদিন, যা অতীব বরকতময়। ইবনু কাছীর বলেন, ১০ই যিলহজ্জ কুরবানীর দিন মূসার মেয়াদ শেষ হয় ও আল্লাহর সাথে কথা বলার সৌভাগ্য লাভ হয়। একই দিন শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর উপর দ্বীন পরিপূর্ণতার আয়াত নাযিল হয় (মায়েদাহ ৩)। যথাসময়ে আল্লাহ মূসার সঙ্গে কথা বললেন (আ‘রাফ, আয়াত ১৪৩)। অতঃপর তাঁকে তওরাত প্রদান করলেন, যা ছিল সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী ও সরল পথ প্রদর্শনকারী (বাক্বারাহ, আয়াত ৫৩)। দীর্ঘ বিশ বছরের অধিককাল পূর্বে মিসর যাওয়ার পথে এই স্থানেই মূসা প্রথম আল্লাহর সাথে কথোপকথনের ও নবুঅত লাভের মহা সৌভাগ্য লাভ করেন। আজ আবার সেখানেই বাক্যালাপ ছাড়াও এলাহী গ্রন্থ তওরাত পেয়ে খুশীতে অধিকতর সাহসী হয়ে তিনি আল্লাহর নিকটে দাবী করে বসলেন,

 

 ‘হে আমার পালনকর্তা! আমাকে দেখা দাও। আমি তোমাকে স্বচক্ষে দেখব। আল্লাহ বললেন, তুমি আমাকে (এ দুনিয়াতে) কখনোই দেখতে পাবে না। তবে তুমি (তূর) পাহাড়ের দিকে দেখতে থাক। সেটি যদি স্বস্থানে স্থির থাকে, তাহ’লে তুমি আমাকে দেখতে পাবে। অতঃপর যখন তার প্রভু উক্ত পাহাড়ের উপরে স্বীয় জ্যোতির বিকীরণ ঘটালেন, সেটিকে বিধ্বস্ত করে দিলেন এবং মূসা জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেল। অতঃপর যখন তার জ্ঞান ফিরে এল, তখন বলল, হে প্রভু! মহা পবিত্র তোমার সত্তা! আমি তোমার নিকটে তওবা করছি এবং আমি বিশ্বাসীদের মধ্যে অগ্রণী’ (আ‘রাফ, আয়াত ১৪৩)।

 

আল্লাহ বললেন, হে মূসা! আমি আমার ‘রিসালাত’ তথা বার্তা পাঠানোর মাধ্যমে এবং বাক্যালাপের মাধ্যমে লোকদের (নবীগণের) উপরে তোমাকে বিশিষ্টতা দান করেছি। সুতরাং যা কিছু আমি তোমাকে দান করলাম তা গ্রহণ কর ও কৃতজ্ঞ থাক’। ‘আর আমরা তার জন্য ফলক সমূহে লিখে দিয়েছিলাম সর্বপ্রকার উপদেশ ও সকল বিষয় বিস্তারিতভাবে। অতএব তুমি এগুলিকে দৃঢ়ভাবে ধারণ কর এবং স্বজাতিকে এর কল্যাণকর বিষয়সমূহ দৃঢ়তার সাথে পালনের নির্দেশ দাও। শীঘ্রই আমি তোমাদেরকে দেখাব পাপাচারীদের বাসস্থান’ (আ‘রাফ, আয়াত ১৪৪-১৪৫)।

 

উপরোক্ত আয়াত দ্বারা বুঝা যায় যে, তখতী বা ফলকে লিখিত অবস্থায় তাঁকে কিতাব প্রদান করা হয়েছিল। আর এই তখতীগুলোর নামই হ’ল ‘তওরাত’।

 

গো-বৎস পূজার শাস্তি

 

মূসা (আঃ) গো-বৎস পূজায় নেতৃত্ব দানকারী হঠকারী লোকদের মৃত্যুদন্ড দিলেন। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘আর যখন মূসা তার সম্প্রদায়কে বলল, হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা গো-বৎসকে উপাস্য নির্ধারণ করে নিজেদের উপরে যুলুম করেছ। অতএব এখন তোমাদের প্রভুর নিকটে তওবা কর এবং নিজেদেরকে পরস্পরে হত্যা কর। এটাই তোমাদের জন্য তোমাদের স্রষ্টার নিকটে কল্যাণকর’... (বাক্বারাহ, আয়াত ৫৪)। এভাবে তাদের কিছু লোককে হত্যা করা হয়, কিছু লোক ক্ষমাপ্রাপ্ত হয়।

 

তূর পাহাড় তুলে ধরা হ

 

এরপরেও কপট বিশ্বাসী ও হঠকারী কিছু লোক থাকে, যারা তওরাতকে মানতে অস্বীকার করে। ফলে তাদের মাথার উপরে আল্লাহ তূর পাহাড়ের একাংশ উঁচু করে ঝুলিয়ে ধরেন এবং অবশেষে নিরুপায় হয়ে তারা সবাই আনুগত্য করতে স্বীকৃত হয়। যেমন আল্লাহ বলেন,

 

‘আর যখন আমি তোমাদের কাছ থেকে অঙ্গীকার নিয়েছিলাম এবং তূর পাহাড়কে তোমাদের মাথার উপরে তুলে ধরেছিলাম এই বলে যে, তোমাদের যে কিতাব দেওয়া হয়েছে, তা মযবুতভাবে ধারণ কর এবং এতে যা কিছু রয়েছে তা স্মরণে রাখ, যাতে তোমরা আল্লাহভীরু হ’তে পার’ (বাক্বারাহ, আয়াত ৬৩)। কিন্তু গো-বৎসের মহববত এদের হৃদয়ে এমনভাবে বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিল যে, এতকিছুর পরেও তারা শিরক ছাড়তে পারেনি। আল্লাহ বলেন, ‘কুফরের কারণে তাদের অন্তরে গোবৎস প্রীতি পান করানো হয়েছিল’ (বাক্বারাহ, আয়াত ৯৩)। যেমন কেউ সরাসরি শিরকে নেতৃত্ব দিয়েছে, কেউবা মুখে তওবা করলেও অন্তরে পুরোপুরি তওবা করেনি। কেউবা শিরককে ঘৃণা করতে পারেনি। কেউ বা মনে মনে ঘৃণা করলেও বাহ্যিকভাবে মেনে নিয়েছিল এবং বাধা দেওয়ার কোন চেষ্টা করেনি। আল্লাহ যখন তূর পাহাড় তুলে ধরে ভয় দেখিয়ে তাদের আনুগত্যের প্রতিশ্রুতি নেন, তখনও তাদের কেউ কেউ (পরবর্তীতে) বলেছিল, ‘আমরা শুনলাম ও অমান্য করলাম’ (বাক্বারাহ, আয়াত ৯৩)। যদিও অমান্য করলাম কথাটি ছিল পরের এবং তা প্রমাণিত হয়েছিল তাদের বাস্তব ক্রিয়াকর্মে। যেমন আল্লাহ এইসব প্রতিশ্রুতি দানকারীদের পরবর্তী আচরণ সম্বন্ধে বলেন,

 

‘‘অতঃপর তোমরা উক্ত ঘটনার পরে (তোমাদের প্রতিশ্রুতি থেকে) ফিরে গেছ। যদি আল্লাহর বিশেষ করুণা ও অনুগ্রহ তোমাদের উপরে না থাকত, তাহ’লে অবশ্যই তোমরা ধ্বংস হয়ে যেতে’’ (বাক্বারাহ, আয়াত ৬৪)।

 

 (৩) আল্লাহকে স্বচক্ষে দেখার যিদ ও তার পরিণতি

 

মূসা (আঃ) তূর পাহাড়ে তওরাৎ প্রাপ্ত হয়ে বনু ইস্রাঈলের কাছে ফিরে এসে তা পেশ করলেন এবং বললেন যে, এটা আল্লাহ প্রদত্ত কিতাব। তোমরা এর অনুসরণ কর। তখন কিছু সংখ্যক উদ্ধত লোক বলে উঠলো, যদি আল্লাহ স্বয়ং আমাদের বলে দেন যে, এটি তাঁর প্রদত্ত কিতাব, তাহ’লেই কেবল আমরা বিশ্বাস করব, নইলে নয়। হতে পারে তুমি সেখানে চল্লিশ দিন বসে বসে এটা নিজে লিখে এনেছ। তখন মূসা (আঃ) আল্লাহর অনুমতিক্রমে তাদেরকে তাঁর সাথে তূর পাহাড়ে যেতে বললেন। বনী ইস্রাঈলরা তাদের মধ্যে বাছাই করা সত্তর জনকে মনোনীত করে মূসা (আঃ)-এর সাথে তূর পাহাড়ে প্রেরণ করল। সেখানে পৌঁছে তারা আল্লাহর বাণী স্বকর্ণে শুনতে পেল। এরপরেও তাদের অবাধ্য মন শান্ত হ’ল না। শয়তানী ধোঁকায় পড়ে তারা নতুন এক অজুহাত তুলে বলল, এগুলো আল্লাহর কথা না অন্য কারু কথা, আমরা বুঝবো কিভাবে? অতএব যতক্ষণ আমরা তাঁকে সশরীরে প্রকাশ্যে আমাদের সম্মুখে না দেখব, ততক্ষণ আমরা বিশ্বাস করব না যে, এসব আল্লাহর বাণী। কিন্তু যেহেতু এ পার্থিব জগতে চর্মচক্ষুতে আল্লাহকে দেখার ক্ষমতা কারু নেই, তাই তাদের এই চরম ধৃষ্টতার জবাবে আসমান থেকে ভীষণ এক নিনাদ এল, যাতে সব নেতাগুলোই চোখের পলকে অক্কা পেল।

 

অকস্মাৎ এমন ঘটনায় মূসা (আঃ) বিস্মিত ও ভীত-বিহবল হয়ে পড়লেন। তিনি প্রার্থনা করে বললেন, হে আল্লাহ! এমনিতেই ওরা হঠকারী। এরপরে এদের এই মৃত্যুতে লোকেরা আমাকেই দায়ী করবে। কেননা মূল ঘটনার সাক্ষী কেউ থাকল না আমি ছাড়া। অতএব হে আল্লাহ! ওদেরকে পুনর্জীবন দান কর। যাতে আমি দায়মুক্ত হ’তে পারি এবং ওরাও গিয়ে সাক্ষ্য দিতে পারে। আল্লাহ মূসার দো‘আ কবুল করলেন এবং ওদের জীবিত করলেন। এ ঘটনা আল্লাহ বর্ণনা করেন এভাবে-

 

 ‘আর যখন তোমরা বললে, হে মূসা! কখনোই আমরা তোমাকে বিশ্বাস করব না, যতক্ষণ না আমরা আল্লাহকে প্রকাশ্যে দেখতে পাব। তখন তোমাদেরকে পাকড়াও করল এক ভীষণ নিনাদ (বজ্রপাত), যা তোমাদের চোখের সামনেই ঘটেছিল’। ‘অতঃপর তোমাদের মৃত্যুর পর আমরা তোমাদেরকে পুনর্জীবিত করলাম, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর’ (বাক্বারাহ, আয়াত ৫৫-৫৬)।

 

(৪) বায়তুল মুক্বাদ্দাস অভিযানের নির্দেশ

 

সাগরডুবি থেকে মুক্তি পাবার পর হ’তে সিনাই উপত্যকা পেরিয়ে তূর পাহাড়ে পৌঁছা পর্যন্ত সময়কালে মূর্তিপূজার আবদার, গো-বৎস পূজা ও তার শাস্তি, তওরাৎ লাভ ও তা মানতে অস্বীকার এবং তূর পাহাড় উঠিয়ে ভয় প্রদর্শন, আল্লাহ্কে স্বচক্ষে দেখার যিদ ও তার পরিণতি প্রভৃতি ঘটনা সমূহের পর এবার তাদের মূল গন্তব্যে যাত্রার জন্য আদেশ করা হ’ল। অবাধ্য জাতিকে তাদের আদি বাসস্থানে রওয়ানার প্রাক্কালে মূসা (আঃ) তাদেরকে দূরদর্শিতাপূর্ণ উপদেশবাণী শুনান এবং যেকোন বাধা সাহসের সাথে অতিক্রম করার ব্যাপারে উৎসাহিত করেন। সাথে সাথে তিনি তাদেরকে বিগত দিনে আল্লাহর অলৌকিক সাহায্য লাভের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে অভয়বাণী শুনান। যেমন আল্লাহর ভাষায়,

 

 ‘আর যখন মূসা স্বীয় সম্প্রদায়কে বলল, হে আমার সম্প্রদায়! তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহরাজি স্মরণ কর, যখন তিনি তোমাদের মধ্যে নবীগণকে সৃষ্টি করেছেন, তোমাদেরকে রাজ্যাধিপতি বানিয়েছেন এবং তোমাদেরকে এমন সব বস্ত্ত দিয়েছেন, যা বিশ্বজগতের কাউকে দেননি’। ‘হে আমার সম্প্রদায়! পবিত্র ভূমিতে (বায়তুল মুক্বাদ্দাস শহরে) প্রবেশ কর, যা আল্লাহ তোমাদের জন্য নির্ধারিত করে দিয়েছেন। আর তোমরা পশ্চাদদিকে প্রত্যাবর্তন করবে না। তাতে তোমরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে’ (মায়েদাহ, আয়াত ২০-২১)।

 

নবুঅত-পরবর্তী ৪র্থ পরীক্ষা : বায়তুল মুক্বাদ্দাস অভিযান

 

আল্লাহ পাক মূসা (আঃ)-এর মাধ্যমে বনী ইস্রাঈলকে আমালেক্বা সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে জিহাদ করে শাম দখল করতে বলেছিলেন। সাথে সাথে এ সুসংবাদও দিয়েছিলেন যে, শামের ভূখন্ড তাদের ভাগ্যে লেখা হয়ে গেছে (মায়েদাহ, আয়াত ২১)। কাজেই তোমাদের বিজয় সুনিশ্চিত। কিন্তু এইসব বিলাসী কাপুরুষেরা আল্লাহর কথায় দৃঢ় বিশ্বাস আনতে পারেনি।

 

মূসা (আঃ) আল্লাহর নির্দেশ পালনের জন্য বনী ইস্রাঈলকে সাথে নিয়ে মিসর থেকে শাম অভিমুখে রওয়ানা হ’লেন। যথা সময়ে তাঁরা জর্দান নদী পার হয়ে ‘আরীহা’ পৌঁছে শিবির স্থাপন করলেন। এটি ছিল পৃথিবীর প্রাচীনতম মহানগরী সমূহের অন্যতম, যা জর্দান নদী ও বায়তুল মুক্বাদ্দাসের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত। যা আজও স্বনামে বিদ্যমান রয়েছে। মূসা (আঃ)-এর সময়ে এ শহরের অত্যাশ্চর্য জাঁক-জমক ও বিস্তৃতি ইতিহাসে বর্ণিত হয়েছে।

 

শিবির স্থাপনের পর মূসা (আঃ) বিপক্ষ দলের অবস্থা ও অবস্থান পর্যবেক্ষণের জন্য ১২ জন সর্দারকে প্রেরণ করলেন। যারা ছিলেন হযরত ইয়াকূব (আঃ)-এর বারো পুত্রের বংশধরগণের ‘বারোজন প্রতিনিধি, যাদেরকে তিনি আগেই নির্বাচন করেছিলেন স্ব স্ব গোত্রের লোকদের দেখাশুনার জন্য’ (মায়েদাহ, আয়াত ১২)। তারা রওয়ানা হবার পর বায়তুল মুক্বাদ্দাস শহরের উপকণ্ঠে পৌঁছলে বিপক্ষ দলের বিশালদেহী বিকট চেহারার একজন লোকের সঙ্গে সাক্ষাত হয়। ইস্রাঈলী রেওয়ায়াত সমূহে লোকটির নাম ‘আউজ ইবনে ওনুক’ বলা হয়েছে এবং তার আকার-আকৃতি ও শক্তি-সাহসের অতিরঞ্জিত বর্ণনা সমূহ উদ্ধৃত হয়েছে (ইবনু কাছীর)। যাই হোক উক্ত ব্যক্তি একাই বনু ইস্রাঈলের এই বার জন সরদারকে পাকড়াও করে তাদের বাদশাহর কাছে নিয়ে গেল এবং অভিযোগ করল যে, এই লোকগুলি আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার মতলব নিয়ে এসেছে। বাদশাহ তার নিকটতম লোকদের সাথে পরামর্শের পর এদের ছেড়ে দেবার সিদ্ধান্ত নেন এই উদ্দেশ্যে যে, এরা গিয়ে তাদের নেতাকে আমালেক্বাদের জাঁক-জমক ও শৌর্য-বীর্যের স্বচক্ষে দেখা কাহিনী বর্ণনা করবে। তাতে ওরা ভয়ে এমনিতেই পিছিয়ে যাবে। পরবর্তীতে দেখা গেল যে, বাদশাহর ধারণাই সত্যে পরিণত হয়েছিল। এই ভীত-কাপুরুষ সর্দাররা জিহাদ দূরে থাক, ওদিকে তাকানোর হিম্মতও হারিয়ে ফেলেছিল।

 

বনু ইস্রাঈলের বারো জন সর্দার আমালেক্বাদের হাত থেকে মুক্ত হয়ে স্বজাতির কাছে ফিরে এল এবং আমালেক্বাদের বিস্ময়কর উন্নতি ও অবিশ্বাস্য শক্তি-সামর্থ্যের কথা মূসা (আঃ)-এর নিকটে বর্ণনা করল। কিন্তু মূসা (আঃ) এতে মোটেই ভীত হননি। কারণ তিনি আগেই অহী প্রাপ্ত হয়েছিলেন এবং বিজয় সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলেন। সেমতে তিনি গোত্রনেতাদের যুদ্ধ প্রস্ত্ততি গ্রহণের নির্দেশ দিলেন এবং আমালেক্বাদের শৌর্য-বীর্যের কথা অন্যের কাছে প্রকাশ করতে নিষেধ করলেন। কিন্তু দেখা গেল যে, ইউশা‘ বিন নূন ও কালেব বিন ইউক্বেন্না ব্যতীত বাকী সর্দাররা গোপনে সব ফাঁস করে দিল (কুরতুবী, ইবনু কাছীর)। ফলে যা হবার তাই হ’ল। এই ভীতু আরামপ্রিয় জাতি একেবারে বেঁকে বসলো।

 

 ‘তারা বলল, হে মূসা! সেখানে একটি প্রবল পরাক্রান্ত জাতি রয়েছে। আমরা কখনো সেখানে যাব না, যে পর্যন্ত না তারা সেখান থেকে বের হয়ে যায়। যদি তারা সেখান থেকে বের হয়ে যায়, তবে নিশ্চিতই আমরা সেখানে প্রবেশ করব’ (মায়েদাহ, আয়াত ২২)। অর্থাৎ ওরা চায় যে, মূসা (আঃ) তার মু‘জেযার মাধ্যমে যেভাবে ফেরাঊনকে ডুবিয়ে মেরে আমাদের উদ্ধার করে এনেছেন, অনুরূপভাবে আমালেক্বাদের তাড়িয়ে দিয়ে তাদের পরিত্যক্ত অট্টালিকা ও সম্পদরাজির উপরে আমাদের মালিক বানিয়ে দিন। অথচ আল্লাহর বিধান এই যে, বান্দাকে চেষ্টা করতে হবে এবং আল্লাহর উপর ভরসা করতে হবে। কিন্তু বনু ইস্রাঈলরা এক পাও বাড়াতে রাযী হয়নি। এমতাবস্থায়

 

 ‘তাদের মধ্যকার দু’জন আল্লাহভীরু ব্যক্তি (সম্ভবতঃ পূর্বের দু’জন সর্দার হবেন, যাদের মধ্যে ইউশা‘ পরে নবী হয়েছিলেন), যাদের প্রতি আল্লাহ অনুগ্রহ করেছিলেন, তারা বলল, (মূসা (আঃ)-এর আদেশ মতে) ‘তোমরা ওদের উপর আক্রমণ করে (শহরের মূল) দরজায় প্রবেশ কর। (কেননা আমাদের নিশ্চিত বিশ্বাস যে,) যখনই তোমরা তাতে প্রবেশ করবে, তখনই তোমরা অবশ্যই জয়ী হবে। আর তোমরা আল্লাহর উপরে ভরসা কর, যদি তোমরা মুমিন হয়ে থাক’ (মায়েদা, আয়াত ২৩)।

 

কিন্তু ঐ দুই নেককার সর্দারের কথার প্রতি তারা দৃকপাত করল না। বরং আরও উত্তেজিত হয়ে তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে মূসা (আঃ)-কে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘হে মূসা! আমরা কখনোই সেখানে প্রবেশ করব না, যতক্ষণ তারা সেখানে আছে। অতএব তুমি ও তোমার পালনকর্তা যাও এবং যুদ্ধ কর গে। আমরা এখানেই বসে রইলাম’ (মায়েদাহ, আয়াত ২৪)। নবীর অবাধ্যতার ফলস্বরূপ এই জাতিকে ৪০ বছর তীহ্ প্রান্তরের উন্মুক্ত কারাগারে বন্দী থাকতে হয় (মায়েদাহ, আয়াত ২৬)। অতঃপর এইসব দুষ্টমতি নেতাদের মৃত্যুর পর পরবর্তী বংশধররা হযরত ইউশা‘ বিন নূন (আঃ)-এর নেতৃত্বে জিহাদ করে বায়তুল মুক্বাদ্দাস পুনর্দখল করে।

 

বনু ইস্রাঈলের এই চূড়ান্ত বেআদবী ছিল কুফরীর নামান্তর এবং অত্যন্ত পীড়াদায়ক। যা পরবর্তীতে প্রবাদবাক্যে পরিণত হয়ে গেছে। বদরের যুদ্ধের সময়ে শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) কিছুটা অনুরূপ অবস্থায় পতিত হয়েছিলেন। অপর্যাপ্ত ব্যবস্থাপনা ও ক্ষুৎ-পিপাসায় কাতর অল্প সংখ্যক সবেমাত্র মুহাজির মুসলমানের মোকাবেলায় তিনগুণ শক্তিসম্পন্ন সুসজ্জিত বিরাট কুরায়েশ সেনাবাহিনীর আগমনে হতচকিত ও অপ্রস্ত্তত মুসলমানদের বিজয়ের জন্য যখন নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) আল্লাহর নিকটে সাহায্য প্রার্থনা করছিলেন, তখন মিক্বদাদ ইবনুল আসওয়াদ আনছারী (রাঃ) দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে বলেছিলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা কস্মিনকালেও ঐকথা বলব না, যা মূসা (আঃ)-এর স্বজাতি তাঁকে বলেছিল, ‘তুমি ও তোমার প্রভু যাও যুদ্ধ করগে। আমরা এখানে বসে রইলাম’ (মায়েদা, আয়াত ২৪)। বরং আমরা আপনার ডাইনে, বামে, সামনে ও পিছনে থেকে শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করব। আপনি নিশ্চিন্তে যুদ্ধের প্রস্ত্ততি গ্রহণ করুন’। বিপদ মুহূর্তে সাথীদের এরূপ বীরত্বব্যঞ্জক কথায় আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) অত্যন্ত প্রীত হয়েছিলেন।

 

বালআম বাঊরার ঘটনা :

 

ফিলিস্তীন দখলকারী ‘জাববারীন’ তথা আমালেক্বা সম্প্রদায়ের শক্তিশালী নেতারা মূসা (আঃ) প্রেরিত ১২ জন প্রতিনিধিকে ফেরৎ পাঠিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে পারেনি। কারণ তারা মূসা (আঃ)-এর মু‘জেযার কারণে ফেরাঊনের সসৈন্যে সাগরডুবির খবর আগেই জেনেছিল। অতএব মূসা (আঃ)-এর বায়তুল মুক্বাদ্দাস অভিযান বন্ধ করার জন্য তারা বাঁকা পথ তালাশ করল। তারা অত্যন্ত গোপনে বনু ইস্রাঈলের ঐ সময়কার একজন নামকরা সাধক ও দরবেশ আলেম বাল‘আম ইবনে বা‘ঊরা কাছে বহু মূল্যবান উপঢৌকনাদিসহ লোক পাঠাল। বাল‘আম তার স্ত্রীর অনুরোধে তা গ্রহণ করল। অতঃপর তার নিকটে আসল কথা পাড়া হ’ল যে, কিভাবে আমরা মূসার অভিযান ঠেকাতে পারি। আপনি পথ বাৎলে দিলে আমরা আরও মহামূল্যবান উপঢৌকনাদি আপনাকে প্রদান করব। বাল‘আম উঁচুদরের আলেম ছিল। যে সম্পর্কে তার নাম না নিয়েই আল্লাহ বলেন,

 

‘আপনি তাদেরকে শুনিয়ে দিন সেই লোকটির অবস্থা, যাকে আমরা আমাদের নিদর্শন সমূহ দান করেছিলাম। অথচ সে তা পরিত্যাগ করে বেরিয়ে গেল। আর তার পিছনে লাগল শয়তান। ফলে সে পথভ্রষ্টদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল’ (আ‘রাফ, আয়াত ১৭৫)।

 

কথিত আছে যে, বাল‘আম ‘ইসমে আযম’ জানত। সে যা দো‘আ করত, তা সাথে সাথে কবুল হয়ে যেত। আমালেক্বাদের অনুরোধ ও পীড়াপীড়িতে সে অবশেষে মূসার বিরুদ্ধে দো‘আ করল। কিন্তু তার জিহবা দিয়ে উল্টা দো‘আ বের হ’তে লাগল যা আমালেক্বাদের বিরুদ্ধে যেতে লাগল। তখন সে দো‘আ বন্ধ করল। কিন্তু অন্য এক পৈশাচিক রাস্তা সে তাদের বাৎলে দিল। সে বলল, বনু ইস্রাঈলগণের মধ্যে ব্যভিচার ছড়িয়ে দিতে পারলে আল্লাহ তাদের উপরে নারায হবেন এবং তাতে মূসার অভিযান বন্ধ হয়ে যাবে’। আমালেক্বারা তার পরামর্শ গ্রহণ করল এবং তাদের সুন্দরী মেয়েদেরকে বনু ইস্রাঈলের নেতাদের সেবাদাসী হিসাবে অতি গোপনে পাঠিয়ে দিল। বড় একজন নেতা এফাঁদে পা দিল। আস্তে আস্তে তা অন্যদের মধ্যেও সংক্রমিত হ’ল। ফলে আল্লাহর গযব নেমে এল। বনু ইস্রাঈলীদের মধ্যে প্লেগ মহামারী দেখা দিল। কথিত আছে যে, একদিনেই সত্তর হাযার লোক মারা গেল। এ ঘটনায় বাকী সবাই তওবা করল এবং প্রথম পথভ্রষ্ট নেতাকে প্রকাশ্যে হত্যা করে রাস্তার উপরে ঝুলিয়ে রাখা হ’ল। অতঃপর আল্লাহর গযব উঠে গেল। এগুলি ইস্রাঈলী বর্ণনা। সম্ভবতঃ সম্প্রদায়ের নেতাদের ক্রমাগত অবাধ্যতা, শঠতা ও পাপাচারে অতিষ্ঠ হ’য়ে এবং একসাথে এই বিরাট জনশক্তি বিনষ্ট হওয়ায় মূসা (আঃ) বায়তুল মুক্বাদ্দাস অভিযানের সংকল্প পরিত্যাগ করেন।

 

তীহ্ প্রান্তরের ঘটনাবলী :

 

নবীর সঙ্গে যে বেআদবী তারা করেছিল, তাতে আল্লাহর গযবে তাদের ধ্বংস হয়ে যাওয়াটা স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু আল্লাহ পাক হয়ত এ জাতিকে আরও পরীক্ষা করতে চেয়েছিলেন এবং আল্লাহর অপার অনুগ্রহপুষ্ট একটি জাতি নিজেদের অবাধ্যতা ও হঠকারিতার ফলে কিভাবে আল্লাহর অভিসম্পাৎগ্রস্ত হয় এবং ক্বিয়ামত পর্যন্ত চিরস্থায়ী লাঞ্ছনার শিকার হয়, পৃথিবীর মানুষের নিকটে দৃষ্টান্ত হিসাবে তা পেশ করতে চেয়েছিলেন। ঠিক যেভাবে দৃষ্টান্ত হয়েছে ফেরাঊন একজন অবাধ্য ও অহংকারী নরপতি হিসাবে। আর তাই বনী ইস্রাঈলের পরীক্ষার মেয়াদ আরও বর্ধিত হ’ল। নিম্নে তাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহের কিছু নিদর্শন বর্ণিত হ’ল।-

 

১. মেঘ দ্বারা ছায়া প্রদান

 

ছায়াশূন্য তপ্ত বালুকা বিস্তৃত মরুভূমিতে কাঠফাটা রোদে সবচেয়ে প্রয়োজন যেসব বস্ত্তর, তন্মধ্যে ‘ছায়া’ হ’ল সর্বপ্রধান। হঠকারী উম্মতের অবাধ্যতায় ত্যক্ত-বিরক্ত মূসা (আঃ) দয়াপরবশ হয়ে আল্লাহর নিকটে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রার্থনা নিবেদন করেছেন। দয়ালু আল্লাহ তাঁর দো‘আ সমূহ কবুল করেছেন এবং বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে তাঁর বিশেষ রহমত সমূহ নাযিল করেছেন। তন্মধ্যে একটি হ’ল উন্মুক্ত তীহ্ প্রান্তরের উপরে শামিয়ানা সদৃশ মেঘমালার মাধ্যমে শান্তিদায়ক ছায়া প্রদান করা। যেমন আল্লাহ এই অকৃতজ্ঞ জাতিকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, ‘স্মরণ কর সে কথা, যখন আমরা তোমাদেরকে ছায়া দান করেছিলাম মেঘমালার মাধ্যমে’ (বাক্বারাহ, আয়াত ৫৭)।

 

২. ঝর্ণাধারার প্রবাহ :

 

ছায়ার পরেই গুরুত্বপূর্ণ বস্ত্ত হ’ল পানি। যার অপর নাম জীবন। পানি বিহনে তৃষ্ণার্ত পিপাসার্ত উম্মতের আহাজারিতে দয়া বিগলিত নবী মূসা স্বীয় প্রভুর নিকটে কাতর কণ্ঠে পানি প্রার্থনা করলেন। কুরআনের ভাষায়,

 

‘আর মূসা যখন স্বীয় জাতির জন্য পানি চাইল, তখন আমি বললাম, তোমার লাঠি দিয়ে পাথরের উপরে আঘাত কর। অতঃপর তা থেকে বেরিয়ে এলো (১২টি গোত্রের জন্য) ১২টি ঝর্ণাধারা। তাদের সব গোত্রই চিনে নিল (অর্থাৎ মূসার নির্দেশ অনুযায়ী নির্ধারণ করে নিল) নিজ নিজ ঘাট। (আমি বললাম,) তোমরা আল্লাহর দেওয়া রিযিক খাও আর পান কর। খবরদার যমীনে ফাসাদ সৃষ্টি করে বেড়িয়ো না’ (বাক্বারাহ, আয়াত ৬০)।

 

বস্ত্ততঃ ইহুদী জাতি তখন থেকে এযাবত পৃথিবী ব্যাপী ফাসাদ সৃষ্টি করেই চলেছে। তারা কখনোই আল্লাহর কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেনি।

 

৩. মান্না ও সালওয়া খাদ্য পরিবেশন :

 

মরুভূমির বুকে চাষবাসের সুযোগ নেই। নেই শস্য উৎপাদন ও বাইরে গিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ। কয়েকদিনের মধ্যেই মওজুদ খাদ্য শেষ হয়ে গেলে হাহাকার পড়ে গেল তাদের মধ্যে। নবী মূসা (আঃ) ফের দো‘আ করলেন আল্লাহর কাছে। এবার তাদের জন্য আসমান থেকে নেমে এলো জান্নাতী খাদ্য ‘মান্না ও সালওয়া’- যা পৃথিবীর আর কোন নবীর উম্মতের ভাগ্যে জুটেছে বলে জানা যায় না।

 

‘মান্না’ এক প্রকার খাদ্য, যা আল্লাহ তা‘আলা বনু ইস্রাঈলদের জন্য আসমান থেকে অবতীর্ণ করতেন। আর তা ছিল দুধের চেয়েও সাদা এবং মধুর চেয়েও মিষ্টি। আর ‘সালওয়া’ হচ্ছে আসমান থেকে আগত এক প্রকার পাখি।প্রথমটি দিয়ে রুটি ও দ্বিতীয়টি দিয়ে গোশতের অভাব মিটত। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘কামআহ হ’ল মান্ন-এর অন্তর্ভুক্ত’। এতে বুঝা যায় ‘মান্ন’ কয়েক প্রকারের ছিল। ইংরেজীতে ‘কামআহ’ অর্থ করা হয়েছে ‘মাশরূম’ (Mashroom)। আধুনিক গবেষণায় বলা হয়েছে যে, মান্ন একপ্রকার আঠা জাতীয় উপাদেয় খাদ্য। যা শুকিয়ে পিষে রুটি তৈরী করে তৃপ্তির সাথে আহার করা যায়। ‘সালওয়া’ একপ্রকার চড়ুই পাখি, যা ঐসময় সিনাই এলাকায় প্রচুর পাওয়া যেত। ব্যাঙের ছাতার মত সহজলভ্য ও কাই জাতীয় হওয়ায় সম্ভবত একে মাশরূম-এর সাথে তুলনীয় মনে করা হয়েছে। তবে মাশরূম ও ব্যাঙের ছাতা সম্পূর্ণ পৃথক জিনিস। কয়েক লাখ বনু ইস্রাঈল কয়েক বছর ধরে মান্না ও সালওয়া খেয়ে বেঁচে ছিল। এতে বুঝা যায় যে, মান্ন ছিল চাউল বা গমের মত কার্বো-হাইড্রেট-এর উৎস এবং সালওয়া বা চড়ুই জাতীয় পাখির গোশত ছিল ভিটামিন ও চর্বির উৎস। সব মিলে তারা পরিপূর্ণ খাবার নিয়মিত খেয়ে বেঁচে থাকতে সক্ষম হয়েছিল। দক্ষিণ ইউরোপের সিসিলিতে, আরব উপদ্বীপের ইরাকে ও ইরানে, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতবর্ষে মান্না জাতীয় খাদ্য উৎপন্ন হয়। অবাধ্য বনু ইস্রাঈলরা এগুলো সিরিয়ার তীহ্ প্রান্তরে ৪০ বছরের বন্দী জীবনে বিপুলভাবে পেয়েছিল আল্লাহর বিশেষ রহমতে। ঈসার সাথী হাওয়ারীগণ এটা চেয়েছিল (মায়েদাহ, আয়াত ১১২-১১৫)। কিন্তু পেয়েছিল কি-না, তা নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি।

 

দুনিয়ায় বসেই জান্নাতের খাবার, এ এক অকল্পনীয় অনির্বচনীয় আনন্দের বিষয়। কিন্তু এই হতভাগারা তাতেও খুব বেশীদিন খুশী থাকতে পারেনি। তারা গম, তরকারি, ডাল-পেঁয়াজ ইত্যাদি খাওয়ার জন্য পাগল হয়ে উঠলো। যেমন আল্লাহ বলেন,

 

 ‘... আমরা তোমাদের জন্য খাবার পাঠিয়েছি ‘মান্না’ ও ‘সালওয়া’। (আমরা বললাম) এসব পবিত্র বস্ত্ত তোমরা ভক্ষণ কর (কিন্তু ওরা শুনল না, কিছু দিনের মধ্যেই তা বাদ দেওয়ার জন্য ও অন্যান্য নিম্নমানের খাদ্য খাবার জন্য যিদ ধরলো)। বস্ত্ততঃ (এর ফলে) তারা আমার কোন ক্ষতি করতে পারেনি, বরং নিজেদেরই ক্ষতি সাধন করেছে’ (বাক্বারাহ, আয়াত ৫৭)।

 

আল্লাহ তাদের উদ্দেশ্যে বলেন,

 

 ‘যখন তোমরা বললে, হে মূসা! আমরা একই ধরনের খাদ্যের উপরে কখনোই ধৈর্য ধারণ করতে পারব না। কাজেই তুমি তোমার প্রভুর নিকটে আমাদের পক্ষে প্রার্থনা কর তিনি যেন আমাদের জন্য এমন খাদ্য-শস্য দান করেন, যা জমিতে উৎপন্ন হয়; যেমন তরি-তরকারি, কাকুড়, গম, রসুন, ডাল, পেঁয়াজ ইত্যাদি। মূসা বললেন, তোমরা উত্তম খাদ্যের বদলে এমন খাদ্য পেতে চাও যা নিম্নস্তরের? তাহ’লে তোমরা অন্য কোন শহরে চলে যাও। সেখানে তোমরা তোমাদের চাহিদা মোতাবেক সবকিছু পাবে’ (বাক্বারাহ, আয়াত ৬১)।

 

তওরাতের শব্দগত ও অর্থগত পরিবর্তন

 

ইহুদীরা তাদের এলাহী কিতাব তওরাতের শাব্দিক পরিবর্তন নবী মূসা (আঃ)-এর জীবদ্দশায় যেমন করেছিল, অর্থগত পরিবর্তনও তারা করেছিল। যেমন মূসা (আঃ) যখন তাদের ৭০ জন নেতাকে সাথে নিয়ে তূর পাহাড়ে গেলেন। অতঃপর আল্লাহর গযবে মৃত্যুবরণ করে পুনরায় তাঁর রহমতে জীবিত হয়ে ফিরে এল, তখনও এই গর্বিত জাতি তওরাত যে আল্লাহর নাযিলকৃত গ্রন্থ এ সাক্ষ্য দেওয়ার সাথে সাথে একথাও জুড়ে দিল যে, আল্লাহ তা‘আলা সবশেষে একথাও বলেছেন যে, তোমরা যতটুকু পার, আমল কর। আর যা না পার তা আমি ক্ষমা করে দিব’। অথচ এটা ছিল সম্পূর্ণ বানোয়াট কথা। তাদের এই মিথ্যা সাক্ষ্যের ফলে লোকেরা বলে দিল যে, তওরাতের বিধান সমূহ মেনে চলা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।

 

তখনই আল্লাহর হুকুমে ফেরেশতাগণ তূর পাহাড়ের একাংশ উপরে তুলে ধরে তাদের হুকুম দিলেন, হয় তোমরা তওরাত মেনে নাও, না হয় ধ্বংস হও। তখন নিরুপায় হয়ে তারা তওরাত মেনে নেয়। মূসা (আঃ)-এর মৃত্যুর পরেও তওরাত, যবূর ও ইঞ্জীল গ্রন্থগুলিতে তারা অসংখ্য শব্দগত ও অর্থগত পরিবর্তন ঘটিয়েছে। ফলে এই কিতাবগুলি আসল রূপে কোথাও আর পৃথিবীতে অবশিষ্ট নেই। ইহুদীদের তওরাত পরিবর্তনের ধরন ছিল তিনটি। এক. অর্থ ও মর্মগত পরিবর্তন, যা উপরে বর্ণিত হয়েছে। দুই. শব্দগত পরিবর্তন যেমন আল্লাহ বলেন, ‘ইহুদীদের মধ্যে একটা দল আছে, যারা আল্লাহর কালামকে (যেখানে শেষনবীর আগমন সংবাদ ও তাঁর গুণাবলী সম্বন্ধে বর্ণিত হয়েছে) তার স্বস্থান হ’তে পরিবর্তন করে দেয়’ (নিসা, আয়াত ৪৬ ; মায়েদাহ, আয়াত ১৩, ৪১)। এই পরিবর্তন তারা নিজেদের দুনিয়াবী স্বার্থে শাব্দিকভাবে এবং মর্মগতভাবে উভয়বিধ প্রকারে করত। ‘এভাবে তারা কখনো শব্দে, কখনো অর্থে এবং কখনো তেলাওয়াতে (মুখ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে) পরিবর্তন করত। পরিবর্তনের এ প্রকারগুলি কুরআন ও হাদীছে বর্ণিত হয়েছে। আজকাল পাশ্চাত্যের কিছু সংখ্যক খ্রীষ্টানও একথা কিছু কিছু স্বীকার করে’। আল্লাহর কিতাবের এইসব পরিবর্তন তাদের মধ্যকার আলেম ও যাজক শ্রেণীর লোকেরাই করত, সাধারণ মানুষ যাদেরকে অন্ধ ভক্তির চূড়ান্ত স্তরে পৌঁছে দিয়েছিল। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘ধ্বংস ঐসব লোকদের জন্য যারা নিজ হাতে কিতাব লিখে বলত, এটি আল্লাহর পক্ষ হ’তে অবতীর্ণ হয়েছে- যাতে এর বিনিময়ে তারা সামান্য অর্থ উপার্জন করতে পারে’ (বাক্বারাহ, আয়াত ৭৯)।

 

আল্লাহ বলেন, ‘এইসব লোকেরা মিথ্যা কথা শোনাতে এবং হারাম ভক্ষণে অভ্যস্ত’ (মায়েদাহ, আয়াত ৪২)। জনগণ তাদের কথাকেই সত্য ভাবত এবং এর বিপরীত কিছুই তারা শুনতে চাইত না। এভাবে তারা জনগণের রব-এর আসন দখল করেছিল। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘তারা তাদের আলেম ও দরবেশগণকে ‘রব’ হিসাবে গ্রহণ করেছিল আল্লাহ্কে বাদ দিয়ে’ (তওবাহ, আয়াত ৩১)। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, ‘তারা তাদেরকে সিজদা করতে বলত না বটে। কিন্তু মানুষকে তারা আল্লাহর অবাধ্যতামূলক কাজের নির্দেশ দিত এবং তারা তা মেনে নিত। সেকারণ আল্লাহ তাদেরকে ‘রব’ বলে আখ্যায়িত করেন’। খৃষ্টান পন্ডিত ‘আদী বিন হাতেম যখন বললেন যে,‘আমরা আমাদের আলেম-দরবেশদের পূজা করি না’। তখন তার জবাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘তারা কি আল্লাহকৃত হালালকে হারাম এবং হারামকে হালাল করে না? আর তোমরাও কি সেটা মেনে নাও না? ‘আদী বললেন, হাঁ। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ‘সেটাই তো ওদের ইবাদত হ’ল’।

 

মূসা ও খিযিরের কাহিনী

 

এ ঘটনাটি বনু ইস্রাঈলের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। বরং ঘটনাটি ব্যক্তিগতভাবে মূসা (আঃ)-এর সঙ্গে জড়িত। পিতা ইবরাহীম (আঃ) সহ বড় বড় নবী-রাসূলগণের জীবনে পদে পদে পরীক্ষা দিতে হয়েছে। মূসা (আঃ)-এর জীবনে এটাও ছিল অনুরূপ একটি পরীক্ষা। যে পরীক্ষায় জ্ঞানীদের জন্য শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ রয়েছে। আনুষঙ্গিক বিবরণ দৃষ্টে প্রতীয়মান হয় যে, ঘটনাটি তীহ্ প্রান্তরের উন্মুক্ত বন্দীশালায় থাকাকালীন সময়ে ঘটেছিল। ঘটনাটি নিম্নরূপ: ছহীহ বুখারী ও মুসলিমে হযরত উবাই বিন কা‘ব (রাঃ) প্রমুখাৎ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হ’তে বর্ণিত হাদীছ হ’তে এবং সূরা কাহফ ৬০ হ’তে ৮২ পর্যন্ত ২৩টি আয়াতে বর্ণিত বিবরণ থেকে যা জানা যায়, তার সংক্ষিপ্ত সার নিম্নে বিবৃত হ’ল।-

 

ঘটনার প্রেক্ষাপট

 

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, একদিন হযরত মূসা (আঃ) বনু ইস্রাঈলের এক সভায় ভাষণ দিচ্ছিলেন। এমন সময় জনৈক ব্যক্তি প্রশ্ন করল, লোকদের মধ্যে আপনার চেয়ে অধিক জ্ঞানী কেউ আছে কি? ঐ সময়ে যেহেতু মূসা ছিলেন শ্রেষ্ঠ নবী এবং তাঁর জানা মতে আর কেউ তাঁর চাইতে অধিক জ্ঞানী ছিলেন না, তাই তিনি সরলভাবে ‘না’ সূচক জবাব দেন। জবাবটি আল্লাহর পসন্দ হয়নি। কেননা এতে কিছুটা অহংকার প্রকাশ পেয়েছিল। ফলে আল্লাহ তাঁকে পরীক্ষায় ফেললেন। তাঁর উচিৎ ছিল একথা বলা যে, ‘আল্লাহই সর্বাধিক অবগত’। আল্লাহ তাঁকে বললেন, ‘হে মূসা! দুই সমুদ্রের সংযোগস্থলে অবস্থানকারী আমার এক বান্দা আছে, যে তোমার চেয়ে অধিক জ্ঞানী’। একথা শুনে মূসা (আঃ) প্রার্থনা করে বললেন, হে আল্লাহ! আমাকে ঠিকানা বলে দিন, যাতে আমি সেখানে গিয়ে জ্ঞান লাভ করতে পারি’। আল্লাহ বললেন, থলের মধ্যে একটি মাছ নিয়ে নাও এবং দুই সমুদ্রের সঙ্গমস্থলের (সম্ভবতঃ লোহিত সাগর ও ভূমধ্যসাগরের মিলনস্থল) দিকে সফরে বেরিয়ে পড়। যেখানে পৌঁছার পর মাছটি জীবিত হয়ে বেরিয়ে যাবে, সেখানেই আমার সেই বান্দার সাক্ষাৎ পাবে’। মূসা (আঃ) স্বীয় ভাগিনা ও শিষ্য (এবং পরবর্তীকালে নবী) ইউশা‘ বিন নূনকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। পথিমধ্যে এক স্থানে সাগরতীরে পাথরের উপর মাথা রেখে দু’জন ঘুমিয়ে পড়েন। হঠাৎ সাগরের ঢেউয়ের ছিটা মাছের গায়ে লাগে এবং মাছটি থলের মধ্যে জীবিত হয়ে নড়েচড়ে ওঠে ও থলে থেকে বেরিয়ে সাগরে গিয়ে পড়ে। ইউশা‘ ঘুম থেকে উঠে এই বিস্ময়কর দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেন। কিন্তু মূসা (আঃ) ঘুম থেকে উঠলে তাঁকে এই ঘটনা বলতে ভুলে গেলেন। অতঃপর তারা আবার পথ চলতে শুরু করলেন এবং একদিন একরাত চলার পর ক্লান্ত হয়ে এক স্থানে বিশ্রামের জন্য বসলেন। অতঃপর মূসা (আঃ) নাশতা দিতে বললেন। তখন তার মাছের কথা মনে পড়ল এবং ওযর পেশ করে আনুপূর্বিক সব ঘটনা মূসা (আঃ)-কে বললেন এবং বললেন যে, ‘শয়তানই আমাকে একথা ভুলিয়ে দিয়েছিল’ (কাহফ, ৬৩)। তখন মূসা (আঃ) বললেন, ঐ স্থানটিই তো ছিল আমাদের গন্তব্য স্থল। ফলে তাঁরা আবার সেপথে ফিরে চললেন। অতঃপর সেখানে পৌঁছে দেখতে পেলেন যে, একজন লোক আপাদ-মস্তক চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। মূসা (আঃ) তাকে সালাম করলেন। লোকটি মুখ বের করে বললেন, এদেশে সালাম? কে আপনি? বললেন, আমি বনু ইস্রাঈলের মূসা। আপনার কাছ থেকে ঐ জ্ঞান অর্জন করতে এসেছি, যা আল্লাহ আপনাকে বিশেষভাবে দান করেছেন’। খিযির বললেন, আপনি আমার সাথে ধৈর্য ধারণ করতে পারবেন না হে মূসা! আল্লাহ আমাকে যে জ্ঞান দান করেছেন, তা তিনি আপনাকে দেননি। পক্ষান্তরে আপনাকে তিনি যে জ্ঞান দান করেছেন, তা আমাকে দেননি’। মূসা বললেন, ‘আল্লাহ চাহেন তো আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন এবং আমি আপনার কোন আদেশ অমান্য করব না’ (কাহফ, ৬৯)। খিযির বললেন, ‘যদি আপনি আমার অনুসরণ করেনই, তবে কোন বিষয়ে আমাকে প্রশ্ন করবেন না, যে পর্যন্ত না আমি নিজে সে সম্পর্কে আপনাকে কিছু বলি’।

 

(১) অতঃপর তাঁরা চলতে লাগলেন। কিছু দূর গিয়ে নদী পার হওয়ার জন্য একটা নৌকা পেলেন। অতঃপর নৌকা থেকে নামার সময় তাতে ছিদ্র করে দিলেন। শারঈ বিধানের অধিকারী নবী মূসা বিষয়টিকে মেনে নিতে পারলেন না। কেননা বিনা দোষে অন্যের নৌকা ছিদ্র করে দেওয়া স্পষ্টভাবেই অন্যায়। তিনি বলেই ফেললেন, ‘নিশ্চয়ই আপনি একটা গুরুতর মন্দ কাজ করলেন’। তখন খিযির বললেন, আমি কি পূর্বেই বলিনি যে, ‘আপনি আমার সাথে ধৈর্য ধারণ করতে পারবেন না’। মূসা ক্ষমা চাইলেন। ইতিমধ্যে একটা কালো চড়ুই পাখি এসে নৌকার এক প্রান্তে বসল এবং সমুদ্র থেকে এক চঞ্চু পানি তুলে নিল। সে দিকে ইঙ্গিত করে খিযির মূসা (আঃ)-কে বললেন, ‘আমার ও আপনার এবং সমস্ত সৃষ্টিজগতের জ্ঞান মিলিতভাবে আল্লাহর জ্ঞানের মুকাবিলায় সমুদ্রের বুক থেকে পাখির চঞ্চুতে উঠানো এক ফোঁটা পানির সমতুল্য’। (২) তারপর তাঁরা সমুদ্রের তীর বেয়ে চলতে থাকলেন। কিছু দূর গিয়ে তাঁরা সাগরপাড়ে খেলায় রত একদল বালককে দেখলেন। খিযির তাদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর ও বুদ্ধিমান ছেলেটিকে ধরে এনে নিজ হাতে তাকে হত্যা করলেন। এ দৃশ্য দেখে মূসা আৎকে উঠে বললেন, একি! একটা নিষ্পাপ শিশুকে আপনি হত্যা করলেন? এ যে মস্তবড় গোনাহের কাজ’। খিযির বললেন, আমি তো পূর্বেই বলেছিলাম, আপনি ধৈর্য ধারণ করতে পারবেন না’। মূসা আবার ক্ষমা চাইলেন এবং বললেন, ‘এরপর যদি আমি কোন প্রশ্ন করি, তাহ’লে আপনি আমাকে আর সাথে রাখবেন না’ (কাহফ, ৭৫)।

 

(৩) ‘অতঃপর তারা চলতে লাগলেন। অবশেষে যখন একটি জনপদে পৌঁছলেন, তখন তাদের কাছে খাবার চাইলেন। কিন্তু তারা তাদের আতিথেয়তা করতে অস্বীকার করল। অতঃপর তারা সেখানে একটি পতনোন্মুখ প্রাচীর দেখতে পেয়ে সেটাকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে দিলেন। তখন মূসা বললেন, আপনি ইচ্ছা করলে তাদের কাছ থেকে এর বিনিময়ে পারিশ্রমিক নিতে পারতেন’। খিযির বললেন ‘এখানেই আমার ও আপনার মধ্যে সম্পর্কচ্ছেদ হ’ল। এখন যেসব বিষয়ে আপনি ধৈর্য ধারণ করতে পারেননি, আমি সেগুলির তাৎপর্য বলে দিচ্ছি’ (কাহফ, আয়াত ৭৮)।

 

তাৎপর্য সমূহ :

 

প্রথমতঃ নৌকা ছিদ্র করার বিষয়। সেটা ছিল কয়েকজন মিসকীন দরিদ্র ব্যক্তির। তারা এ দিয়ে সমুদ্রে জীবিকা অন্বেষণ করত। আমি সেটিকে ছিদ্র করে দিলাম এজন্য যে, ঐ অঞ্চলে ছিল এক যালেম বাদশাহ। সে বলপ্রয়োগে লোকদের নৌকা ছিনিয়ে নিত’। নিশ্চয়ই ছিদ্র নৌকা সে নিবে না। ফলে দরিদ্র লোকগুলি নৌকার সামান্য ত্রুটি সেরে নিয়ে পরে তাদের কাজে লাগাতে পারবে। দ্বিতীয়তঃ বালকটিকে হত্যার ব্যাপার। তার পিতা-মাতা ছিল ঈমানদার। আমি আশংকা করলাম যে, সে বড় হয়ে অবাধ্য হবে ও কাফের হবে। যা তার বাপ-মায়ের জন্য ফিৎনার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। তাই আমি চাইলাম যে, দয়ালু আল্লাহ তার পিতা-মাতাকে এর বদলে উত্তম সন্তান দান করুন, যে হবে সৎকর্মশীল ও বিশুদ্ধ চরিত্রের অধিকারী। যে তার পিতা-মাতাকে শান্তি দান করবে’। তৃতীয়তঃ পতনোন্মুখ প্রাচীর সোজা করে দেওয়ার ব্যাপার। উক্ত প্রাচীরের মালিক ছিল নগরীর দু’জন পিতৃহীন বালক। ঐ প্রাচীরের নীচে তাদের নেককার পিতার রক্ষিত গুপ্তধন ছিল। আল্লাহ চাইলেন যে, বালক দু’টি যুবক হওয়া পর্যন্ত প্রাচীরটি খাড়া থাক এবং তারা তাদের প্রাপ্য গুপ্তধন হস্তগত করুক। (খিযির বলেন,) ‘বস্ত্ততঃ আমি নিজ ইচ্ছায় এ সবের কিছুই করিনি’ (কাহফ, আয়াত ৮২)।

 

খিযির কে ছিলেন?

 

কুরআনে তাঁকে ‘আমাদের বান্দাদের একজন’ (কাহফ, আয়াত ৬৫) বলা হয়েছে। বুখারী শরীফে তাঁর নাম খিযির বলে উল্লেখ করা হয়েছে’। সেখানে তাঁকে নবী বলা হয়নি। জনশ্রুতি মতে তিনি একজন ওলী ছিলেন এবং মৃত্যু হয়ে গেলেও এখনও মানুষের বেশ ধরে যেকোন সময় যেকোন মানুষের উপকার করেন। ফলে জঙ্গলে ও সাগর বক্ষে বিপদাপদ থেকে বাঁচার জন্য আজও অনেকে খিযিরের অসীলা পাবার জন্য তার উদ্দেশ্যে মানত করে থাকে। এসব ধারণার প্রসার ঘটেছে মূলতঃ বড় বড় প্রাচীন মনীষীদের নামে বিভিন্ন তাফসীরের কেতাবে উল্লেখিত কিছু কিছু ভিত্তিহীন কল্পকথার উপরে ভিত্তি করে। যারা তাকে নবী বলেন, তাদের দাবীর ভিত্তি হ’ল, খিযিরের বক্তব্য ‘আমি এসব নিজের মতে করিনি’ (কাহফ, আয়াত ৮২)। অর্থাৎ সবকিছু আল্লাহর নির্দেশে করেছি। অলীগণের কাশ্ফ-ইলহাম শরী‘আতের দলীল নয়। কিন্তু নবীগণের স্বপ্নও আল্লাহর অহী হয়ে থাকে। যেজন্য ইবরাহীম (আঃ) স্বীয় পুত্রকে যবেহ করতে উদ্যত হয়েছিলেন। অতএব বালক হত্যার মত ঘটনা কেবলমাত্র নবীর পক্ষেই সম্ভব, কোন অলীর পক্ষে আদৌ নয়। কিন্তু সেখানেও প্রশ্ন থেকে যায় যে, নবী কখনো শরী‘আত বিরোধী কাজ করতে পারেন না। ঐ সময় শরী‘আতধারী নবী ও রাসূল ছিলেন হযরত মূসা (আঃ)। আর সে কারণেই খিযিরের শরী‘আত বিরোধী কাজ দেখে তিনি বারবার প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠেছিলেন। এ ব্যাপারে সবাই একমত যে, খিযির কোন কেতাবধারী রাসূল ছিলেন না, বা তাঁর কোন উম্মত ছিল না।

 

এখানে আমরা যদি বিষয়টিকে কুরআনের প্রকাশ্য অর্থের উপরে ছেড়ে দিই এবং তাঁকে ‘আল্লাহর একজন বান্দা’ হিসাবে গণ্য করি, যাঁকে আল্লাহর ভাষায় ‘আমরা আমাদের পক্ষ হ’তে বিশেষ রহমত দান করেছিলাম এবং আমাদের পক্ষ হ’তে দিয়েছিলাম এক বিশেষ জ্ঞান’ (কাহফ, আয়াত ৬৫)। তাহ’লে তিনি নবী ছিলেন কি অলী ছিলেন, তিনি এখনো বেঁচে আছেন, না মারা গেছেন, এসব বিতর্কের আর কোন অবকাশ থাকে না। যেভাবে মূসার মায়ের নিকটে আল্লাহ অহী (অর্থাৎ ইলহাম) করেছিলেন এবং যার ফলে তিনি তার সদ্য প্রসূত সন্তান মূসাকে বাক্সে ভরে সাগরে নিক্ষেপ করতে সাহসী হয়েছিলেন (ত্বোয়াহা, আয়াত ৩৮-৩৯) এবং যেভাবে জিব্রীল মানুষের রূপ ধরে এসে রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে ছাহাবীগণকে দ্বীনের প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন একই ধরনের ঘটনা মূসা ও খিযিরের ক্ষেত্রে হওয়াটাও বিস্ময়কর কিছু নয়।

 

মনে রাখা আবশ্যক যে, লোকমান অত্যন্ত উঁচুদরের একজন জ্ঞানী মানুষ ছিলেন। তাঁর জ্ঞানপূর্ণ উপদেশসমূহ কুরআনে বর্ণিত হয়েছে এবং তার নামে একটি সূরা নাযিল হয়েছে। কিন্তু তিনি নবী ছিলেন না। লোকমানকে আল্লাহ যেমন বিশেষ ‘হিকমত’ দান করেছিলেন (লোকমান, আয়াত ১২)। খিযিরকেও তেমনি বিশেষ ‘ইল্ম’ দান করেছিলেন (কাহফ, আয়াত ৬৫)। এটা বিচিত্র কিছু নয়।

 

আল কুরআনে হযরত মুসা (আঃ)

 

আল কুরআনে হযরত মুসা (আঃ) কে অনেক বড় মর্যাদাবান নবী বলে উলেখ করা হয়েছে। বর্ণনা করা হয়েছে তাঁর দীর্ঘ সংগ্রামের মর্মস্পর্শী ঘটনাবলী। আল কুরআনে হযরত মুসার নাম যতবেশী উল্লেখ করা হয়েছে আর কোন নবীর নাম এতো বেশী উল্লাখ করা হয়নি। আল কুরআনে হযরত মুসা (আঃ) এর নাম উল্লেখ হয়েছে ১৩৬ বার। হযরত মুসার সংগ্রামী জীবন বিস্তারিত জানতে পারবেন নিম্নোক্ত সুরাগুলো পড়লে – আল বাকারাঃ ৪০-১০২ আয়াত। আল আরাফঃ ১০৩-১৭১ আয়াত। ইউনুসঃ ৭৫-৯৩ আয়াত। আল কাহাফঃ ৬০-৮২ আয়াত। তোয়াহাঃ ৯-৯৮ আয়াত। শোয়ারা” ১০-৬৭ আয়াত। আল কাসাসঃ ৩-৪৭ আয়াত এবং ৭৬-৮৪ আয়াত। আল মুমিন/গাফিরঃ ২৩-৫৪ আয়াত।

 

হযরত মুসা (আঃ) এর এই জীবনী আল কুরআনের উল্লেখিত আয়াতের আলোকেই রচিত হয়েছে।

 

 

 

 

 

১৬।

 

হারুন (আঃ)

 

কি তাঁর পরিচয়?

 

নাম হারুন। তিনি আল্লাহর একজন রাসুল। মুসা কালিমুল্লাহ (আঃ) এর বড় ভাই। তিন বছরের বড় তিনি মুসার চেয়ে। আল্লাহ যখন মুসা (আঃ) কে রাসুল নিয়োগ করেন, তখন তিনি আল্লাহর কাছে দোয়া করেছিলেন তিনি যেনো তাঁর ভাই হারুনকেও রাসুল নিয়োগ করে তাঁর হাত শক্ত করেন। আল্লাহ তাঁর দোয়া কবুল করেন এবং হারুনকে মুসার সহযোগী রাসুল নিয়োগ করেন। হযরত হারুন ছিলেন বনী ইসরাইলদের শ্রেষ্ঠ রাসুলগনের একজন। তিনি ছিলেন সুবক্তা।

 

দাওয়াতী ও সাংগঠনিক জীবন

 

মহান আল্লাহ বলেন –

 

“আমি মূসা ও হারুনের প্রতি অনুগ্রহ করেছি। তাঁদের উভয়কে আমি উদ্ধার করেছি মহাকষ্ট থেকে। আমি তাঁদের সাহায্য করেছি। ফলে তারা বিজয়ী হয়েছে। তাঁদের আমি সঠিক পথ দেখিয়েছি। তাঁদের উভয়কে আমি সুস্পষ্ট কিতাব দান করেছি। পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তাঁদের উভয়ের সুনাম অক্ষুন্ন রেখেছি। মুসা ও হারুনের প্রতি বর্ষিত হোক সালাম। এভাবেই আমি উপকারী লোকদের প্রতিদান দিয়ে থাকি। আসলে ওরা দু’জনেই ছিলো আমার প্রতি বিশ্বস্ত দাস।” (সূরা আস সাফফাত, আয়াত ১১৪-১২২)

 

আল্লাহর এ বানী থেকে হযরত হারুনের সঠিক মর্যাদা বুঝা যায়। তিনি ভাই মুসার সাথে ফেরাউনের দরবারে উপস্থিত হন। ফেরাউনকে দাওয়াত প্রদান করেন। ফেরাউন তাঁদের দুজনকেই মিথ্যাবাদী বলে অস্বীকার করে। সে বলে, এরা দুই ভাই রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করার জন্যে এসেছে। অতপর ফেরাউন হযরত মুসা ও হারুন দুজনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে। অতপর মুসা ও হারুনের সাথে ফেরাউনের যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত হয়, তাঁর পরিনতিতে আল্লাহ ফেরাউনকে ধংস ও নির্মূল করে দেন। ফেরাউন ডুবে মরার পর সিনাই উপত্যকায় থাকাকালে হযরত মুসা হযরত হারুনকে নিজের খলিফা বা ভারপ্রাপ্ত নেতা মনোনীত করে চল্লিশ দিনের জন্যে তূর পাহাড়ে নির্জনবাসে যান। হযরত হারুন ভারপ্রাপ্ত নেতা থাকাকালেই সামেরি গ-বাছুর বানিয়ে সেটার পূজা করতে বলে সকলকে। হারুন তাঁকে বারন করেন। এ ব্যাপারে তিনি কঠোর পদক্ষেপ নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জাতি দ্বিধাবিভক্ত হবার উপক্রম হয়ে পড়ায় তিনি সেই পদক্ষেপ নেননি। হযরত মুসা চল্লিশ দিন পর তাওরাত নিয়ে ফেরত এসে হযরত হারুনের উপর ক্রোধান্বিত হন। এ ঘটনাটি কুরআনে এভাবে উল্লেখ করা হয়েছে –

 

“(গ-বাছুর পুজাকরতে নিষেধ করে) হারুন তাঁদের বলেছিলো, হে আমার জাতি তোমরা তো পরীক্ষায় পড়েছো। তোমাদের প্রভু বড় করুনাময়। কাজেই তোমরা আমার অনুসরন করো এবং আমার নির্দেশ মানো। কিন্তু তারা তাঁকে বলে দিলো মুসা ফিরে না আসা পর্যন্ত আমরা এর পূজা করবো। মুসা ফিরে এসে বললো- হে হারুন তুমি যখন দেখলে এরা পথভ্রষ্ট হয়ে যাচ্ছে, তখন এদেরকে আমার অনুসরনের পথে আনতে তোমাকে কিসে বাধা দিয়েছে? তুমি কি আমার হুকুম অমান্য করলে? হারুন বললো- হে আমার সহোদর ভাই, আমার দারি ও চুল ধরে টেনোনা। আমার ভয় হচ্ছিলো তুমি এসে বলবে- হারুন তুমি কেন বনী ইসরাইলদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করলে? কেন আমার কথা রক্ষা করোনি।” (সূরা তোয়াহা, আয়াত ৯০-৯৪)

 

অন্যস্থানে বলা হয়েছে-

 

“মুসা নিজের ভাইয়ের চুল ধরে টানলো। হারু বললো – হে আমার সহোদর, এই লোকগুলো আমায় কোণঠাসা করে ফেলেছিলো এবং আমাকে হত্যা করার জন্যে উদ্যত হয়েছিলো। কাজেই তুমি শত্রুদের কাছে আমায় হেয় করোনা এবং আমাকে যালিম গণ্য করোনা। তখন মুসা দোয়া করলো – হে প্রভু, আমাকে আর আমার ভাইকে ক্ষমা করে দাও। আর আমাদেরকে রবেশ করাও তোমার অনুগ্রহের মধ্যে। তুমিই তো সব দয়াবানের বড় দয়াবান।” (সূরা আল আরাফ, আয়াত ১৫০-১৫১)

 

এ থেকে বুঝা যায়, হযরত হারুন জীবনের ঝুকি নিয়েও নিজ কওমকে সত্য পথে পরিচালিত করার চেষ্টা করেছিলেন। তবে জাতির মধ্যে অনৈক্য ও বিভেদ সৃষ্টি হোক এটা তিনি চাননি। আসলে তিনি ছিলেন বড়ই প্রজ্ঞাবান ও মহান রাসুল।

 

হযরত মুসা (আঃ) এর মৃত্যুর এগারো মাস পূর্বে তিনি ইন্তেকাল করেন। ভাই মুসার মতই তিনি ছিলেন একজন বলিষ্ঠ সংগ্রামী পুরুষ। তারা দুই ভাই নেতৃত্ব প্রদান করেন এক বিশাল জাতির।

 

আল কুরআনে হযরত হারুন

 

আল কুরআনে হযরত হারুনের নাম ২০ বার উল্লেখ করা হয়েছে। যেসব স্থানে উল্লেখ হয়েছে, সেগুলো হলো –

 

আল বাকারা- ২৪৮। আন নিসা- ১৬৩। আল আনয়াম- ৮৪। আল আরাফ- ১২২, ১৪২। ইউনুস- ৭৫। মারিয়াম- ২৮, ৫৩। তোয়াহা- ৩০, ৭০, ৯০, ৯২। আল আম্বিয়া- ৪৮। আল মুমিনুন- ৪৫। আলফুরকান – ৩৫। আশ শুয়ারা- ১৩, ৪৮। আল কাসাস- ৩৪। আস সাফফাত- ১১৪, ১২০।

 

১৭।

 

সম্রাট নবী দাউদ

 

(আঃ)

 

দাউদ (আঃ) এর নাম তো আপনারা সবাই জানেন। মহান আল্লাহ তাঁকে দান করেছিলেন বিরাট মর্যাদা। তাঁকে অধিকারী করেছিলেন অনেক গুনাবলীর। তিনি ছিলেন একাধারে-

 

১। বিরাট উচ্চ মর্যাদার নবী।

 

২। তাঁর উপর নাযিল হয়েছিলো ‘যবুর’ কিতাব।

 

৩। তিনি ছিলেন অসীম সাহসী বীর সেনানী।

 

৪। তিনি ছিলেন এক বিরাট সাম্রাজ্যের সম্রাট।

 

৫। তিনি ছিলে একজন সফল বিজ্ঞানী ও আবিষ্কারক।

 

৬। ছিলেন মহাজ্ঞানী, ন্যায় বিচারক।

 

৭। তিনি ছিলেন মুমিনদের নেতা।

 

৮। ছিলেন আল্লাহর আইনের শাসক। শাসন পরিচালনা করতেন আল্লাহর অবতীর্ণ বিধানের ভিত্তিতে।

 

৯। তিনি ছিলেন আকর্ষণীয় সুবক্তা ও সুভাষী।

 

১০। পাখি ও পর্বত তাঁর সাথে আল্লাহর তসবিহতে মশগুল থাকতো।

 

১১। তিনি ছিলেন পরম জনদরদী, জনসেবক।

 

১২। মহান আল্লাহ প্রাকৃতিক জগতের অনেক কিছুকেই তাঁর অনুগত করে দিয়েছিলেন।

 

১৩। তিনি ছিলে পরম আল্লাহভীরু, আল্লাহওয়ালা।

 

১৪। তিনি ছিলে একজন নবীর পিতা। তাঁর পুত্র সুলাইমানকেও আল্লাহ নবুয়্যত দান করেছিলেন।

 

১৫। আল কুরআনে স্বয়ং আল্লাহ তাঁর উচ্চসিত প্রশংসা করেছেন।Powerd Bangladesh |

 

বিশেষ মর্যাদার অধিকারী হযরত দাঊদ

 

বিপুল শক্তি ও রাষ্ট্রক্ষমতার অধিকারী নবী ছিলেন মাত্র দু’জন। তাঁরা হ’লেন পিতা ও পুত্র দাঊদ ও সুলায়মান (আঃ)। বর্তমান ফিলিস্তীন সহ সমগ্র ইরাক ও শাম (সিরিয়া) এলাকায় তাঁদের রাজত্ব ছিল। পৃথিবীর অতুলনীয় ক্ষমতার অধিকারী হয়েও তাঁরা ছিলেন সর্বদা আল্লাহর প্রতি অনুগত ও সদা কৃতজ্ঞ। সে কারনে আল্লাহ তার শেষ নবীকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, ‘তারা যেসব কথা বলে তাতে তুমি ছবর কর এবং আমার শক্তিশালী বান্দা দাঊদকে স্মরণ কর। সে ছিল আমার প্রতি সদা প্রত্যাবর্তনশীল’ (ছোয়াদ, আয়াত ৩৮)। দাঊদ হলেন আল্লাহর একমাত্র বান্দা, যাকে খুশী হয়ে পিতা আদম স্বীয় বয়স থেকে ৪০ বছর কেটে তাকে দান করার জন্য আল্লাহর নিকটে সুফারিশ করেছিলেন এবং সেমতে দাঊদের বয়স ৬০ হ’তে ১০০ বছরে বৃদ্ধি পায়।

 

জালূত ও তালূতের কাহিনী এবং দাঊদের বীরত্ব

 

সাগরডুবি থেকে নাজাত পেয়ে মূসা ও হারূণ (আঃ) যখন বনু ইস্রাঈলদের নিয়ে শামে এলেন এবং শান্তিতে বসবাস করতে থাকলেন, তখন আল্লাহ তাদেরকে তাদের পিতৃভূমি ফিলিস্তীনে ফিরে যাবার আদেশ দিলেন এবং ফিলিস্তীন দখলকারী শক্তিশালী আমালেক্বাদের সঙ্গে জিহাদের নির্দেশ দিলেন। সাথে সাথে এ ওয়াদাও দিলেন যে, জিহাদে নামলেই তোমাদের বিজয় দান করা হবে (সূরা মায়েদা, আয়াত ২৩)। কিন্তু এই ভীতু ও জিহাদ বিমুখ বিলাসী জাতি তাদের নবী মূসাকে পরিষ্কার বলে দিল, ‘তুমি ও তোমার রব গিয়ে যুদ্ধ কর গে। আমরা এখানে বসে রইলাম’ (মায়েদা, আয়াত ২৪)। এতবড় বেআদবীর পরে মূসা (আঃ) তাদের ব্যাপারে নিরাশ হ’লেন এবং কিছু দিনের মধ্যেই দু’ভাই পরপর তিন বছরের ব্যবধানে মৃত্যু বরণ করলেন।

 

জিহাদের আদেশ অমান্য করার শাস্তি স্বরূপ মিসর ও শামের মধ্যবর্তী তীহ প্রান্তরে চল্লিশ বছর যাবত উন্মুক্ত কারাগারে অতিবাহিত করার পর মূসার শিষ্য ও ভাগিনা এবং পরবর্তীতে নবী ইউশা‘ বিন নূনের নেতৃত্বে জিহাদ সংঘটিত হয় এবং আমালেক্বাদের হটিয়ে তারা ফিলিস্তীন দখল করে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে তারা পুনরায় বিলাসিতায় গা ভাসিয়ে দেয় এবং নানাবিধ অনাচারে লিপ্ত হয়। তখন আল্লাহ তাদের উপরে পুনরায় আমালেক্বাদের চাপিয়ে দেন। বনু ইস্রাঈলরা আবার নিগৃহীত হ’তে থাকে। এভাবে বহু দিন কেটে যায়। এক সময় শ্যামুয়েল নবীর যুগ আসে। লোকেরা বলে আপনি আমাদের জন্য একজন সেনাপতি দানের জন্য আল্লাহর নিকট দো‘আ করুন, যাতে আমরা আমাদের পূর্বের ঐতিহ্য ফিরে পাই এবং বর্তমান দুর্দশা থেকে মুক্তি পাই। এই ঘটনা আল্লাহ তার শেষনবীকে শুনিয়েছেন নিম্নোক্ত ভাষায়-‘তুমি কি মূসার পরে বনু ইস্রাঈলদের একদল নেতাকে দেখনি, যখন তারা তাদের নবীকে বলেছিল, আমাদের জন্য একজন শাসক প্রেরণ করুন, যাতে আমরা (তার নেতৃত্বে) আল্লাহর পথে যুদ্ধ করতে পারি। নবী বললেন, তোমাদের প্রতি কি এমন ধারণা করা যায় যে, লড়াইয়ের নির্দেশ দিলে তোমরা লড়াই করবে? তারা বলল, আমাদের কি হয়েছে যে, আমরা আল্লাহর পথে লড়াই করব না? অথচ আমরা বিতাড়িত হয়েছি নিজেদের ঘর-বাড়ি ও সন্তান-সন্ততি হ’তে! অতঃপর যখন লড়াইয়ের নির্দেশ হ’ল তখন সামান্য কয়েকজন ছাড়া বাকীরা সবাই ফিরে গেল। বস্ত্ততঃ আল্লাহ যালেমদের ভাল করেই জানেন’ (বাক্বারাহ -২৪৬)। ঘটনাটি ছিল নিম্নরূপ:-

 

‘‘তাদের নবী তাদের বললেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তালূতকে তোমাদের জন্য শাসক নিযুক্ত করেছেন। তারা বলল, সেটা কেমন করে হয় যে, তার শাসন চলবে আমাদের উপরে। অথচ আমরাই শাসন ক্ষমতা পাওয়ার অধিক হকদার। তাছাড়া সে ধন-সম্পদের দিক দিয়েও সচ্ছল নয়। জওয়াবে নবী বললেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের উপরে তাকে মনোনীত করেছেন এবং স্বাস্থ্য ও জ্ঞানের দিক দিয়ে তাকে প্রাচুর্য দান করেছেন। বস্ত্ততঃ আল্লাহ যাকে ইচ্ছা রাজ্য দান করেন। তিনি হ’লেন প্রাচুর্য দানকারী ও সর্বজ্ঞ’। ‘নবী তাদেরকে বললেন, তালূতের নেতৃত্বের নিদর্শন এই যে, তোমাদের কাছে (তোমাদের কাংখিত) সিন্দুকটি আসবে তোমাদের প্রভুর পক্ষ হ’তে তোমাদের হৃদয়ের প্রশান্তি রূপে। আর তাতে থাকবে মূসা, হারূণ ও তাদের পরিবার বর্গের ব্যবহৃত কিছু পরিত্যক্ত সামগ্রী। সিন্দুকটিকে বহন করে আনবে ফেরেশতাগণ। এতেই তোমাদের (শাসকের) জন্য নিশ্চিত নিদর্শন রয়েছে, যদি তোমরা বিশ্বাসী হও’ (বাক্বারাহ, আয়াত, ২৪৭-২৪৮)। এক্ষণে যখন বনু ইস্রাঈলগণ পুনরায় জিহাদের সংকল্প করল, তখন আল্লাহ তাদেরকে উক্ত সিন্দুক ফিরিয়ে দিতে মনস্থ করলেন। অতঃপর এই সিন্দুকটির মাধ্যমে তাদের মধ্যেকার নেতৃত্ব নিয়ে ঝগড়ার নিরসন করেন। সিন্দুকটি তালূতের বাড়ীতে আগমনের ঘটনা এই যে, জালূতের নির্দেশে কাফেররা যেখানেই সিন্দুকটি রাখে, সেখানেই দেখা দেয় মহামারী ও অন্যান্য বিপদাপদ। এমনিভাবে তাদের পাঁচটি শহর ধ্বংস হয়ে যায়। অবশেষে অতিষ্ট হয়ে তারা একে তার প্রকৃত মালিকদের কাছে পাঠিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিল এবং গরুর গাড়ীতে উঠিয়ে হাঁকিয়ে দিল। তখন ফেরেশতাগণ আল্লাহর নির্দেশমতে গরুর গাড়ীটিকে তাড়িয়ে এনে তালূতের ঘরের সম্মুখে রেখে দিল। বনু ইস্রাঈলগণ এই দৃশ্য দেখে সবাই একবাক্যে তালূতের নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করল। অতঃপর তালূত আমালেক্বাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনার প্রস্ত্ততি শুরু করলেন।

 

সকল প্রস্ত্ততি সম্পন্ন হ’লে তিনি কথিত মতে ৮০ হাযার সেনাদল নিয়ে রওয়ানা হন। অল্প বয়ষ্ক তরুণ দাঊদ ছিলেন উক্ত সেনা দলের সদস্য। পথিমধ্যে সেনাপতি তালূত তাদের পরীক্ষা করতে চাইলেন। সম্মুখেই ছিল এক নদী। মৌসুম ছিল প্রচন্ড গরমের। পিপাসায় ছিল সবাই কাতর। এ বিষয়টি কুরআন বর্ণনা করেছে নিম্নরূপ: ‘অতঃপর তালূত যখন সৈন্যদল নিয়ে বের হ’ল, তখন সে বলল, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে পরীক্ষা করবেন একটি নদীর মাধ্যমে। যে ব্যক্তি সেই নদী হ’তে পান করবে, সে ব্যক্তি আমার দলভুক্ত নয়। আর যে ব্যক্তি স্বাদ গ্রহণ করবে না, সেই-ই আমার দলভুক্ত হবে। তবে হাতের এক আজলা মাত্র। অতঃপর সবাই সে পানি থেকে পান করল, সামান্য কয়েকজন ব্যতীত। পরে তালূত যখন নদী পার হ’ল এবং তার সঙ্গে ছিল মাত্র কয়েকজন ঈমানদার ব্যক্তি (তখন অধিক পানি পানকারী সংখ্যাগরিষ্ট) লোকেরা বলতে লাগল, আজকের দিনে জালূত ও তার সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধ করার শক্তি আমাদের নেই। (পক্ষান্তরে) যাদের বিশ্বাস ছিল যে, আল্লাহর সম্মুখে তাদের একদিন উপস্থিত হ’তেই হবে, তারা বলল, কত ছোট ছোট দল বিজয়ী হয়েছে বড় বড় দলের বিরুদ্ধে আল্লাহর হুকুমে। নিশ্চয়ই ধৈর্যশীলদের সাথে আল্লাহ থাকেন’ (বাক্বারাহ, আয়াত ২৪৯)।

 

বস্ত্ততঃ নদী পার হওয়া এই স্বল্প সংখ্যক ঈমানদারগণের সংখ্যা ছিল মাত্র ৩১৩ জন, যা শেষনবীর সাথে কাফেরদের বদর যুদ্ধকালে যুদ্ধরত ছাহাবীগণের সংখ্যার সাথে মিলে যায়। পানি পানকারী হাযারো সৈনিক নদী পারে আলস্যে ঘুমিয়ে পড়ল। অথচ পানি পান করা থেকে বিরত থাকা স্বল্প সংখ্যক ঈমানদার সাথী নিয়েই তালূত চললেন সেকালের সেরা সেনাপতি ও শৌর্য-বীর্যের প্রতীক আমালেক্বাদের বাদশাহ জালূতের বিরুদ্ধে। বস্ত্তবাদীগণের হিসাব মতে এটা ছিল নিতান্তই আত্মহননের শামিল। এই দলেই ছিলেন দাঊদ। আল্লাহ বলেন, ‘আর যখন তারা জালূত ও তার সেনাবাহিনীর সম্মুখীন হ’ল, তখন তারা বলল, হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদের ধৈর্য দান কর ও আমাদেরকে দৃঢ়পদ রাখ এবং আমাদেরকে তুমি কাফির সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সাহায্য কর’ (বাক্বারাহ, আয়াত ২৫০)। জালূত বিরাট সাজ-সজ্জা করে হাতীতে সওয়ার হয়ে সামনে এসে আস্ফালন করতে লাগল এবং সে যুগের যুদ্ধরীতি অনুযায়ী প্রতিপক্ষের সেরা যোদ্ধাকে আহবান করতে থাকল। অল্পবয়ষ্ক বালক দাঊদ নিজেকে সেনাপতি তালূতের সামনে পেশ করলেন। তালূত তাকে পাঠাতে রাযী হ’লেন না। কিন্তু দাঊদ নাছোড় বান্দা। অবশেষে তালূত তাকে নিজের তরবারি দিয়ে উৎসাহিত করলেন এবং আল্লাহর নামে জালূতের মোকাবিলায় প্রেরণ করলেন। বর্ণিত আছে যে, তিনি এ ঘোষণা আগেই দিয়েছিলেন যে, যে ব্যক্তি জালূতকে বধ করে ফিলিস্তীন পুনরুদ্ধার করতে পারবে, তাকে রাজ্য পরিচালনায় শরীক করা হবে। অস্ত্রে-শস্ত্রে সজ্জিত জালূতকে মারা খুবই কঠিন ছিল। কেননা তার সারা দেহ ছিল লৌহ বর্মে আচ্ছাদিত। তাই তরবারি বা বল্লম দিয়ে তাকে মারা অসম্ভব ছিল। আল্লাহর ইচ্ছায় দাঊদ ছিলেন পাথর ছোঁড়ায় উস্তাদ। সমবয়সীদের সাথে তিনি মাঠে গিয়ে নিশানা বরাবর পাথর মারায় দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। দাঊদ পকেট থেকে পাথর খন্ড বের করে হাতীর পিঠে বসা জালূতের চক্ষু বরাবর নিশানা করে এমন জোরে মারলেন যে, তাতেই জালূতের চোখশুদ্ধ মাথা ফেটে মগয বেরিয়ে চলে গেল। এভাবে জালূত মাটিতে লুটিয়ে পড়লে তার সৈন্যরা পালিয়ে গেল। যুদ্ধে তালূত বিজয় লাভ করলেন। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর তারা আল্লাহর হুকুমে তাদেরকে পরাজিত করল এবং দাঊদ জালূতকে হত্যা করল। আর আল্লাহ দাঊদকে দান করলেন রাজ্য ও দূরদর্শিতা এবং তাকে শিক্ষা দান করলেন, যা তিনি চাইলেন। বস্ত্ততঃ আল্লাহ যদি এভাবে একজনকে অপরজনের দ্বারা প্রতিহত না করতেন, তাহ’লে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যেত। কিন্তু আল্লাহ বিশ্ববাসীর প্রতি একান্তই দয়াশীল’ (বাক্বারাহ, আয়াত ২৫১)।

 

দাঊদ (আঃ)-এর জীবনের স্মরণীয় ঘটনাবলী

 

(১) ছাগপাল ও শস্যক্ষেতের মালিকের বিচার: একদা দু’জন লোক হযরত দাঊদের নিকটে একটি বিষয়ে মীমাংসার জন্য আসে। তাদের একজন ছিল ছাগপালের মালিক এবং অন্যজন ছিল শস্য ক্ষেতের মালিক। শস্যক্ষেতের মালিক ছাগপালের মালিকের নিকট দাবী পেশ করল যে, তার ছাগপাল রাত্রিকালে আমার শস্যক্ষেতে চড়াও হয়ে সম্পূর্ণ ফসল বিনষ্ট করে দিয়েছে। আমি এর প্রতিকার চাই। সম্ভবতঃ শস্যের মূল্য ও ছাগলের মূল্যের হিসাব সমান বিবেচনা করে হযরত দাঊদ (আঃ) শস্যক্ষেতের মালিককে তার বিনষ্ট ফসলের বিনিময় মূল্য হিসাবে পুরা ছাগপাল শস্যক্ষেতের মালিককে দিয়ে দিতে বললেন। বাদী ও বিবাদী উভয়ে বাদশাহ দাঊদ-এর আদালত থেকে বেরিয়ে আসার সময় দরজার মুখে পুত্র সুলায়মানের সাথে দেখা হয়। তিনি মোকদ্দমার রায় সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তারা সব খুলে বলল। তিনি পিতা দাঊদের কাছে গিয়ে বললেন, আমি রায় দিলে তা ভিন্নরূপ হ’ত এবং উভয়ের জন্য কল্যাণকর হ’ত’। অতঃপর পিতার নির্দেশে তিনি বললেন, ছাগপাল শস্যক্ষেতের মালিককে সাময়িকভাবে দিয়ে দেওয়া হউক। সে এগুলোর দুধ, পশম ইত্যাদি দ্বারা উপকার লাভ করুক। পক্ষান্তরে শস্যক্ষেতটি ছাগপালের মালিককে অর্পণ করা হউক। সে তাতে শস্য উৎপাদন করুক। অতঃপর শস্যক্ষেত্র যখন ছাগপালে বিনষ্ট করার পূর্বের অবস্থায় পৌঁছে যাবে, তখন তা ক্ষেতের মালিককে ফিরিয়ে দেওয়া হবে এবং ছাগপাল তার মালিককে ফেরৎ দেওয়া হবে’। হযরত দাঊদ (আঃ) রায়টি অধিক উত্তম গণ্য করে সেটাকেই কার্যকর করার নির্দেশ দেন। এই ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত করে আল্লাহ বলেন, ‘আর স্মরণ কর দাঊদ ও সুলায়মানকে, যখন তারা একটি শস্যক্ষেত সম্পর্কে বিচার করেছিল, যাতে রাত্রিকালে কারু মেষপাল ঢুকে পড়েছিল। আর তাদের বিচারকার্য আমাদের সম্মুখেই হচ্ছিল’। ‘অতঃপর আমরা সুলায়মানকে মোকদ্দমাটির ফায়ছালা বুঝিয়ে দিলাম এবং আমরা উভয়কে প্রজ্ঞা ও জ্ঞান দান করেছিলাম’ (আম্বিয়া, আয়াত ৭৮-৭৯)।

 

 (২) ইবাদত খানায় প্রবেশকারী বাদী-বিবাদীর বিচার: হযরত দাঊদ (আঃ) যেকোন ঘটনায় যদি বুঝতেন যে, এটি আল্লাহর তরফ থেকে পরীক্ষা, তাহ’লে তিনি সাথে সাথে আল্লাহর দিকে রুজু হ’তেন ও ক্ষমা প্রার্থনায় রত হ’তেন। এরই একটি উদাহরণ বর্ণিত হয়েছে নিম্নোক্ত আয়াতগুলিতে। যেমন আল্লাহ বলেন,

 

 ‘আপনার কাছে কি সেই বাদী-বিবাদীর খবর পৌঁছেছে, যখন তারা পাঁচিল টপকিয়ে দাঊদের ইবাদতখানায় ঢুকে পড়েছিল’? (ছোয়াদ ২১) ‘যখন তারা দাঊদের কাছে অনুপ্রবেশ করল এবং দাঊদ তাদের থেকে ভীত হয়ে পড়ল, তখন তারা বলল, আপনি ভয় পাবেন না, আমরা দু’জন বিবদমান পক্ষ। আমরা একে অপরের প্রতি বাড়াবাড়ি করেছি। অতএব আমাদের মধ্যে ন্যায় বিচার করুন, অবিচার করবেন না। আমাদেরকে সরল পথ প্রদর্শন করুন’। ‘(বিষয়টি এই যে,) সে আমার ভাই। সে ৯৯টি দুম্বার মালিক আর আমি মাত্র একটি মাদী দুম্বার মালিক। এরপরও সে বলে যে, এটি আমাকে দিয়ে দাও। সে আমার উপরে কঠোর ভাষা প্রয়োগ করে’। ‘দাঊদ বলল, সে তোমার দুম্বাটিকে নিজের দুম্বাগুলির সাথে যুক্ত করার দাবী করে তোমার প্রতি অবিচার করেছে। শরীকদের অনেকে একে অপরের প্রতি বাড়াবাড়ি করে থাকে, কেবল তারা ব্যতীত, যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে। অবশ্য এরূপ লোকের সংখ্যা কম। (অত্র ঘটনায়) দাঊদ ধারণা করল যে, আমরা তাকে পরীক্ষা করছি। অতঃপর সে তার পালনকর্তার নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা করল এবং সিজদায় লুটিয়ে পড়ল ও আমার দিকে প্রণত হ’ল’। অতঃপর আমরা তাকে ক্ষমা করে দিলাম। নিশ্চয়ই তার জন্য আমাদের নিকটে রয়েছে নৈকট্য ও সুন্দর প্রত্যাবর্তন স্থল’ (ছোয়াদ, আয়াত ২১-২৫)।

 

 (৩) শনিবার ওয়ালাদের পরিণতি: বনু ইস্রাঈলদের জন্য শনিবার ছিল সাপ্তাহিক ছুটির দিন এবং ইবাদতের জন্য নির্দিষ্ট ও পবিত্র দিন। এ দিন তাদের জন্য মৎস্য শিকার নিষিদ্ধ ছিল। তারা সমুদ্রোপকুলের বাসিন্দা ছিল এবং মৎস্য শিকার ছিল তাদের পেশা। ফলে দাঊদ (আঃ)-এর নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেই তারা ঐদিন মৎস্য শিকার করতে থাকে। এতে তাদের উপরে আল্লাহর পক্ষ হ’তে ‘মস্খ’ বা আকৃতি পরিবর্তনের শাস্তি নেমে আসে এবং তিনদিনের মধ্যেই তারা সবাই মৃত্যু মুখে পতিত হয়। ঘটনাটি পবিত্র কুরআনে নিম্নরূপে বর্ণিত হয়েছে। যেমন আল্লাহ মদীনার ইহুদীদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আর তোমরা তো তাদেরকে ভালভাবে জানো, যারা শনিবারের ব্যাপারে সীমা লংঘন করেছিল। আমরা তাদের বলেছিলাম, তোমরা নিকৃষ্ট বানর হয়ে যাও’। ‘অতঃপর আমরা এ ঘটনাকে তাদের সমসাময়িক ও পরবর্তীদের জন্য দৃষ্টান্ত হিসাবে এবং আল্লাহভীরুদের জন্য উপদেশ হিসাবে রেখে দিলাম’ (বাক্বারাহ, আয়াত ৬৫-৬৬)।

 

উক্ত বিষয়ে সূরা আ‘রাফের ১৬৪-৬৫ আয়াতের বর্ণনায় প্রতীয়মান হয় যে, সেখানে তৃতীয় আরেকটি দল ছিল, যারা উপদেশ দানকারীদের উপদেশ দানে বিরত রাখার চেষ্টা করত। বাহ্যতঃ এরা ছিল শান্তিবাদী এবং অলস ও সুবিধাবাদী। এরাও ফাসেকদের সাথে শূকর-বানরে পরিণত হয় ও ধ্বংস হয়ে যায়। যেমন আল্লাহ বলেন,

 

 ‘আর যখন তাদের মধ্যকার একদল বলল, কেন আপনারা ঐ লোকদের উপদেশ দিচ্ছেন, যাদেরকে আল্লাহ ধ্বংস করে দিতে চান কিংবা তাদের আযাব দিতে চান কঠিন আযাব? ঈমানদারগণ বলল, তোমাদের পালনকর্তার নিকট ওযর পেশ করার জন্য এবং এজন্য যাতে ওরা সতর্ক হয়’। ‘অতঃপর তারা যখন উপদেশ ভুলে গেল, যা তাদেরকে দেওয়া হয়েছিল, তখন আমরা সেসব লোকদের মুক্তি দিলাম, যারা মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করত এবং পাকড়াও করলাম যালেমদেরকে নিকৃষ্ট আযাবের মাধ্যমে তাদের পাপাচারের কারণে’ (আ‘রাফ, আয়াত ১৬৪-৬৫)।

 

তালূতের পরে বনু ইস্রাঈলগণের অবস্থা ক্রমেই শোচনীয় পর্যায়ে চলে যায়। যালেম বাদশাহদের দ্বারা তারা শাম দেশ হ’তে বিতাড়িত হয়। বিশেষ করে পারস্যরাজ বুখতানছর যখন তাদেরকে শাম থেকে বহিষ্কার করলেন, তখন তাদের একদল হেজাযে গিয়ে বসবাসের সিদ্ধান্ত নিল। এই উদ্দেশ্যে যে, আমরা দাঊদ ও সুলায়মানের নির্মিত বায়তুল মুক্বাদ্দাস হারিয়েছি। ফলে এক্ষণে আমরা আমাদের পূর্বপুরুষ ইবরাহীম-ইসমাঈলের নির্মিত কা‘বা গৃহের উদ্দেশ্যে যাত্রা করি। যাতে আমরা বা আমাদের বংশধররা শেষনবীর সাক্ষাৎ লাভে ধন্য হয়। সেমতে তারা আরবে হিজরত করে এবং ইয়াছরিবে বসবাস শুরু করে।

 

দাঊদ (আঃ)-এর জীবনীতে শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ

 

১. নেতৃত্বের জন্য প্রয়োজন স্বাস্থ্যবান ও আমানতদার হওয়া। আরও প্রয়োজন প্রজ্ঞা, ন্যায়নিষ্ঠা ও উন্নতমানের বাগ্মিতা। যার সব কয়টি গুণ হযরত দাঊদ (আঃ)-এর মধ্যে সর্বাধিক পরিমাণে ছিল।

 

২. এলাহী বিধান দ্বীন ও দুনিয়া দু’টিকেই নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করে। বরং দ্বীনদার শাসকের হাতেই দুনিয়া শান্তিময় ও নিরাপদ থাকে। হযরত দাঊদ-এর শাসনকাল তার জাজ্জ্বল্যমান প্রমাণ।

 

৩. দ্বীনদার শাসককে আল্লাহ বারবার পরীক্ষা করেন। যাতে তার দ্বীনদারী অক্ষুণ্ণ থাকে। দাঊদ (আঃ) সে পরীক্ষা দিয়েছেন এবং উত্তীর্ণ হয়েছেন। বস্ত্ততঃ তিনি ছিলেন আল্লাহর দিকে সদা প্রত্যাবর্তনশীল।

 

৪. যে শাসক যত বেশী আল্লাহর শুকরগুযারী করেন, আল্লাহ তার প্রতি তত বেশী সদয় হন এবং ঐ রাজ্যে শান্তি ও সমৃদ্ধি নাযিল করেন। বস্ত্ততঃ দাঊদ (আঃ) সর্বাধিক ইবাদতগুযার ছিলেন এবং একদিন অন্তর একদিন ছিয়াম পালন করতেন।

 

৫. যে শাসক আল্লাহর প্রতি অনুগত হন, আল্লাহ দুনিয়ার সকল সৃষ্টিকে তার প্রতি অনুগত করে দেন। যেমন দাঊদ (আঃ)-এর জন্য পাহাড়-পর্বত, পক্ষীকুল এবং লোহাকে অনুগত করে দেওয়া হয়েছিল।

 

কুরআনে উল্লেখ

 

আল কুরআনে হযরত দাউদ (আঃ) এর নাম উল্লেখ হয়েছে ১৬ বার। কোথায় কোথায় উল্লেখ হয়েছে তা আপনাদের বলে দিচ্ছি – সূরা আল বাকারা ; ২৫১। আন নিসা ; ২৬৩। আল মায়িদা ; ৭৮। আল আনয়াম ; ৮৪। বনি ইসরাইল ; ৫৫। আল আম্বিয়া ; ৭৮, ৭৯। আন নামল ; ১৫, ১৬। সাবা ; ১০, ১৩। সোয়াদ ; ১৭, ২২, ২৪, ২৬, ৩০।

 

১৮।

 

বিশ্বের অনন্য সম্রাট সুলাইমান

 

(আঃ)

 

হযরত দাঊদ (আঃ)-এর মৃত্যুর পর সুযোগ্য পুত্র সুলায়মান তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর আবির্ভাবের ন্যূনাধিক দেড় হাযার বছর পূর্বে তিনি নবী হন। সুলায়মান ছিলেন পিতার ১৯জন পুত্রের অন্যতম। আল্লাহ পাক তাকে জ্ঞানে, প্রজ্ঞায় ও নবুঅতের সম্পদে সমৃদ্ধ করেন। এছাড়াও তাঁকে এমন কিছু নে‘মত দান করেন, যা অন্য কোন নবীকে দান করেননি। ইমাম বাগাভী ইতিহাসবিদগণের বরাতে বলেন, সুলায়মান (আঃ)-এর মোট বয়স হয়েছিল ৫৩ বছর। তের বছর বয়সে রাজকার্য হাতে নেন এবং শাসনের চতুর্থ বছরে বায়তুল মুক্বাদ্দাসের নির্মাণ কাজ শুরু করেন। তিনি ৪০ বছর কাল রাজত্ব করেন। তবে তিনি কত বছর বয়সে নবী হয়েছিলেন সে বিষয়ে কিছু জানা যায় না। শাম ও ইরাক অঞ্চলে পিতার রেখে যাওয়া রাজ্যের তিনি বাদশাহ ছিলেন। তাঁর রাজ্য তৎকালীন বিশ্বের সবচেয়ে সুখী ও শক্তিশালী রাজ্য ছিল। কুরআনে তাঁর সম্পর্কে ৭টি সূরায় ৫১টি আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। আমরা সেগুলিকে একত্রিত করে কাহিনীরূপে পেশ করার চেষ্টা পাব ইনশাআল্লাহ।

 

বাল্যকালে সুলায়মান

 

(১) আল্লাহ পাক সুলায়মানকে তার বাল্যকালেই গভীর প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টি দান করেছিলেন। ছাগপালের মালিক ও শস্যক্ষেতের মালিকের মধ্যে পিতা হযরত দাঊদ (আঃ) যেভাবে বিরোধ মীমাংসা করেছিলেন, বালক সুলায়মান তার চাইতে উত্তম ফায়ছালা পেশ করেছিলেন। ফলে হযরত দাঊদ (আঃ) নিজের পূর্বের রায় বাতিল করে পুত্রের দেওয়া প্রস্তাব গ্রহণ করেন ও সে মোতাবেক রায় দান করেন। উক্ত ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত করে আল্লাহ বলেন, ‘‘আর স্মরণ কর দাঊদ ও সুলায়মানকে, যখন তারা একটি শস্যক্ষেত সম্পর্কে বিচার করছিল, যাতে রাত্রিকালে কারু মেষপাল ঢুকে পড়েছিল। আর তাদের বিচারকার্য আমাদের সম্মুখেই হচ্ছিল’। ‘অতঃপর আমরা সুলায়মানকে মোকদ্দমাটির ফায়ছালা বুঝিয়ে দিলাম এবং আমরা উভয়কে প্রজ্ঞা ও জ্ঞান দান করেছিলাম’’ (আম্বিয়া, আয়াত ৭৮-৭৯)।

 

ছোটবেলা থেকেই জ্ঞান ও প্রজ্ঞায় ভূষিত সুলায়মানকে পরবর্তীতে যথার্থভাবেই পিতার সিংহাসনের উত্তরাধিকারী করা হয়। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘‘সুলায়মান দাঊদের উত্তরাধিকারী হয়েছিলেন’ (নমল, আয়াত ১৬)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, ‘‘আমরা দাঊদের জন্য সুলায়মানকে দান ‘করেছিলাম। কতই না সুন্দর বান্দা সে এবং সে ছিল (আমার প্রতি) সদা প্রত্যাবর্তনশীল’’ (ছোয়াদ, আয়াত ৩০)।

 

(২) আরেকটি ঘটনা হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, যা নিম্নরূপ: ‘দু’জন মহিলার দু’টি বাচ্চা ছিল। একদিন নেকড়ে বাঘ এসে একটি বাচ্চাকে নিয়ে যায়। তখন প্রত্যেকে বলল যে, তোমার বাচ্চা নিয়ে গেছে। যেটি আছে ওটি আমার বাচ্চা। বিষয়টি ফায়ছালার জন্য দুই মহিলা খলীফা দাঊদের কাছে এলো। তিনি বয়োজ্যেষ্ঠ মহিলার পক্ষে রায় দিলেন। তখন তারা বেরিয়ে সুলায়মানের কাছে এলো এবং সবকথা খুলে বলল। সুলায়মান তখন একটি ছুরি আনতে বললেন এবং বাচ্চাটাকে দু’টুকরা করে দু’মহিলাকে দিতে চাইলেন। তখন বয়োকনিষ্ঠ মহিলাটি বলল, ইয়ারহামুকাল্লাহু ‘আল্লাহ আপনাকে অনুগ্রহ করুন’ বাচ্চাটি ঐ মহিলার। তখন সুলায়মান কনিষ্ঠ মহিলার পক্ষে রায় দিলেন’।

 

সুলায়মানের বৈশিষ্ট্য সমূহ :

 

দাঊদ (আঃ)-এর ন্যায় সুলায়ামন (আঃ)-কেও আল্লাহ বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য দান করেছিলেন, যা আর কাউকে দান করেননি। যেমন: (১) বায়ু প্রবাহ অনুগত হওয়া (২) তামাকে তরল ধাতুতে পরিণত করা (৩) জিনকে অধীনস্ত করা (৪) পক্ষীকূলকে অনুগত করা (৫) পিপীলিকার ভাষা বুঝা (৬) অতুলনীয় সাম্রাজ্য দান করা (৭) প্রাপ্ত অনুগ্রহ রাজির হিসাব না রাখার অনুমতি পাওয়া। নিম্নে বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হ’ল:

 

১. বায়ু প্রবাহকে তাঁর অনুগত করে দেওয়া হয়েছিল। তাঁর হুকুম মত বায়ু তাঁকে তাঁর ইচ্ছামত স্থানে বহন করে নিয়ে যেত। তিনি সদলবলে বায়ুর পিঠে নিজ সিংহাসনে সওয়ার হয়ে দু’মাসের পথ একদিনে পৌঁছে যেতেন। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘এবং আমরা সুলায়মানের অধীন করে দিয়েছিলাম বায়ুকে, যা সকালে এক মাসের পথ ও বিকালে এক মাসের পথ অতিক্রম করত...’ (সাবা, আয়াত ১২)।

 

আল্লাহ বলেন,

 

 ‘‘আর আমরা সুলায়মানের অধীন করে দিয়েছিলাম প্রবল বায়ুকে। যা তার আদেশে প্রবাহিত হ’ত ঐ দেশের দিকে, যেখানে আমরা কল্যাণ রেখেছি। আর আমরা সকল বিষয়ে সম্যক অবগত রয়েছি’ (আম্বিয়া, আয়াত ৮১)। অন্যত্র আল্লাহ উক্ত বায়ুকে رُخَاء বলেছেন (ছোয়াদ, আয়াত ৩৬)। যার অর্থ মৃদু বায়ু, যা শূন্যে তরঙ্গ-সংঘাত সৃষ্টি করে না। عَاصِفَةٌ ও رُخَاء দু’টি বিশেষণের সমন্বয় এভাবে হ’তে পারে যে, কোনরূপ তরঙ্গ সংঘাত সৃষ্টি না করে তীব্র বেগে বায়ু প্রবাহিত হওয়াটা ছিল আল্লাহর বিশেষ রহমত এবং সুলায়মানের অন্যতম মু‘জেযা।

 

২. তামার ন্যায় শক্ত পদার্থকে আল্লাহ সুলায়মানের জন্য তরল ধাতুতে পরিণত করেছিলেন। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘আমরা তার জন্য গলিত তামার একটি ঝরণা প্রবাহিত করেছিলাম...’ (সাবা, আয়াত ১২)। এর দ্বারা বুঝা যায় যে, ঐ গলিত ধাতু উত্তপ্ত ছিল না। বরং তা দিয়ে অতি সহজে পাত্রাদি তৈরী করা যেত। সুলায়মানের পর থেকেই তামা গলিয়ে পাত্রাদি তৈরী করা শুরু হয় বলে কুরতুবী বর্ণনা করেছেন। পিতা দাঊদের জন্য ছিল লোহা গলানোর মু‘জেযা এবং পুত্র সুলায়মানের জন্য ছিল তামা গলানোর মু‘জেযা। আর এজন্যেই আয়াতের শেষে আল্লাহ বলেন, ‘‘হে দাঊদ পরিবার! কৃতজ্ঞতা সহকারে তোমরা কাজ করে যাও। বস্ত্ততঃ আমার বান্দাদের মধ্যে অল্প সংখ্যকই কৃতজ্ঞ’’ (সাবা, আয়াত ১৩)।

 

দুটি সূক্ষ্মতত্ত্ব :

 

(ক) দাঊদ (আঃ)-এর জন্য আল্লাহ তা‘আলা সর্বাধিক শক্ত ও ঘন পদার্থ লোহাকে নরম ও সুউচ্চ পর্বতমালাকে অনুগত করে দিয়েছিলেন। পক্ষান্তরে সুলায়মান (আঃ)-এর জন্য আল্লাহ শক্ত তামাকে গলানো এবং বায়ু, জিন ইত্যাদি এমন সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বস্ত্তকে অনুগত করে দিয়েছিলেন, যা চোখেও দেখা যায় না। এর দ্বারা বুঝানো হয়েছে যে, আল্লাহর শক্তি বড়-ছোট সবকিছুর মধ্যে পরিব্যাপ্ত।

 

(খ) এখানে আরেকটি বিষয়ে ইঙ্গিত রয়েছে যে, আল্লাহর তাক্বওয়াশীল অনুগত বান্দারা আল্লাহর হুকুমে বিশ্বচরাচরের সকল সৃষ্টির উপরে আধিপত্য করতে পারে এবং সবকিছুকে বশীভূত করে তা থেকে খিদমত নিতে পারে।

 

৩. জিনকে তাঁর অধীন করে দিয়েছিলেন। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘আর জিনের মধ্যে কিছুসংখ্যক তার (সুলায়মানের) সম্মুখে কাজ করত তার পালনকর্তার (আল্লাহর) আদেশে...’ (সাবা, আয়াত ১২)।

 

অন্যত্র আল্লাহ বলেন, ‘এবং আমরা তার অধীন করে দিয়েছিলাম শয়তানদের কতককে, যারা তার জন্য ডুবুরীর কাজ করত এবং এছাড়া অন্য আরও কাজ করত। আমরা তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতাম’ (আম্বিয়া, আয়াত ৮২)।

 

অন্যত্র বলা হয়েছে,

 

 ‘‘আর সকল শয়তানকে তার অধীন করে দিলাম, যারা ছিল প্রাসাদ নির্মাণকারী ও ডুবুরী’। ‘এবং অন্য আরও অনেককে অধীন করে দিলাম, যারা আবদ্ধ থাকত শৃংখলে’’ (ছোয়াদ, আয়াত ৩৭-৩৮)।

 

বস্ত্ততঃ জিনেরা সাগরে ডুব দিয়ে তলদেশ থেকে মূল্যবান মণি-মুক্তা, হীরা-জহরত তুলে আনত এবং সুলায়মানের হুকুমে নির্মাণ কাজ সহ যেকোন কাজ করার জন্য সদা প্রস্ত্তত থাকত। ঈমানদার জিনেরা তো ছওয়াবের নিয়তে স্বেচ্ছায় আনুগত্য করত। কিন্তু দুষ্ট জিনগুলো বেড়ীবদ্ধ অবস্থায় সুলায়মানের ভয়ে কাজ করত। এই অদৃশ্য শৃংখল কেমন ছিল, তা কল্পনা করার দরকার নেই। আদেশ পালনে সদাপ্রস্ত্তত থাকাটাও এক প্রকার শৃংখলবদ্ধ থাকা বৈ কি!

 

‘শয়তান’ হচ্ছে আগুন দ্বারা সৃষ্ট বুদ্ধি ও চেতনা সম্পন্ন এক প্রকার সূক্ষ্ম দেহধারী জীব। জিনের মধ্যকার অবাধ্য ও কাফির জিনগুলিকেই মূলতঃ ‘শয়তান’ নামে অভিহিত করা হয়। আয়াতে ‘শৃংখলবদ্ধ’ কথাটি এদের জন্যেই বলা হয়েছে। আল্লাহর নিয়ন্ত্রণে থাকায় এরা সুলায়মানের কোন ক্ষতি করতে পারত না। বরং সর্বদা তাঁর হুকুম পালনের জন্য প্রস্ত্তত থাকত। তাদের বিভিন্ন কাজের মধ্যে আল্লাহ নিজেই কয়েকটি কাজের কথা উল্লেখ করেছেন। যেমন,

 

 ‘‘তারা সুলায়মানের ইচ্ছানুযায়ী দুর্গ, ভাষ্কর্য, হাউয সদৃশ বৃহদাকার পাত্র এবং চুল্লীর উপরে স্থাপিত বিশাল ডেগ নির্মাণ করত...’’ (সাবা, আয়াত ১৩)। উল্লেখ্য যে, تماثيل তথা ভাষ্কর্য কিংবা চিত্র ও প্রতিকৃতি অংকন বা স্থাপন যদি গাছ বা প্রাকৃতিক দৃশ্যের হয়, তাহ’লে ইসলামে তা জায়েয রয়েছে। কিন্তু যদি তা প্রাণীদেহের হয়, তবে তা নিষিদ্ধ।

 

৪. পক্ষীকুলকে সুলায়মানের অনুগত করে দেওয়া হয়েছিল এবং তিনি তাদের ভাষা বুঝতেন। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘‘সুলায়মান দাঊদের উত্তরাধিকারী হয়েছিল এবং বলেছিল, হে লোক সকল! আমাদেরকে পক্ষীকুলের ভাষা শিক্ষা দেওয়া হয়েছে এবং আমাদেরকে সবকিছু দেওয়া হয়েছে। নিশ্চয়ই এটি একটি সুস্পষ্ট শ্রেষ্ঠত্ব’’ (নমল, আয়াত ১৬)।

 

পক্ষীকুল তাঁর হুকুমে বিভিন্ন কাজ করত। সবচেয়ে বড় কথা এই যে, রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পত্র তিনি হুদহুদ পাখির মাধ্যমে পার্শ্ববর্তী ‘সাবা’ রাজ্যের রাণী বিলক্বীসের কাছে প্রেরণ করেছিলেন। এ ঘটনা পরে বিবৃত হবে।

 

৫. পিপীলিকার ভাষাও তিনি বুঝতেন। যেমন আল্লাহ বলেন,

 

 ‘‘অবশেষে সুলায়মান তার সৈন্যদল নিয়ে পিপীলিকা অধ্যুষিত উপত্যকায় পৌঁছল। তখন পিপীলিকা (নেতা) বলল, হে পিপীলিকা দল! তোমরা স্ব স্ব গৃহে প্রবেশ কর। অন্যথায় সুলায়মান ও তার বাহিনী অজ্ঞাতসারে তোমাদের পিষ্ট করে ফেলবে’’। ‘তার এই কথা শুনে সুলায়মান মুচকি হাসল... (নমল, আয়াত ১৮-১৯)।

 

৬. তাঁকে এমন সাম্রাজ্য দান করা হয়েছিল, যা পৃথিবীতে আর কাউকে দান করা হয়নি। এজন্য আল্লাহর হুকুমে তিনি আল্লাহর নিকটে প্রার্থনা করেছিলেন। যেমন আল্লাহ বলেন,

 

 ‘‘সুলায়মান বলল, হে আমার পালনকর্তা! আমাকে ক্ষমা কর এবং আমাকে এমন এক সাম্রাজ্য দান কর, যা আমার পরে আর কেউ যেন না পায়। নিশ্চয়ই তুমি মহান দাতা’’ (ছোয়াদ, আয়াত ৩৫)।

 

উল্লেখ্য যে, পয়গম্বরগণের কোন দো‘আ আল্লাহর অনুমতি ব্যতিরেকে হয় না। সে হিসাবে হযরত সুলায়মান (আঃ) এ দো‘আটিও আল্লাহ তা‘আলার অনুমতিক্রমেই করেছিলেন। কেবল ক্ষমতা লাভ এর উদ্দেশ্য ছিল না। বরং এর পিছনে আল্লাহর বিধানাবলী বাস্তবায়ন করা এবং তাওহীদের ঝান্ডাকে সমুন্নত করাই মূল উদ্দেশ্য ছিল। কেননা আল্লাহ জানতেন যে, রাজত্ব লাভের পর সুলায়মান তাওহীদ ও ইনছাফ প্রতিষ্ঠার জন্যই কাজ করবেন এবং তিনি কখনোই অহংকারের বশীভূত হবেন না। তাই তাঁকে এরূপ দো‘আর অনুমতি দেওয়া হয় এবং সে দো‘আ সর্বাংশে কবুল হয়।

 

৭. প্রাপ্ত অনুগ্রহরাজির হিসাব রাখা বা না রাখার অনুমতি প্রদান। আল্লাহ পাক হযরত সুলায়মান (আঃ)-এর রাজত্ব লাভের দো‘আ কবুল করার পরে তার প্রতি বায়ু, জিন, পক্ষীকুল ও জীব-জন্তু সমূহকে অনুগত করে দেন। অতঃপর বলেন, ‘‘এসবই আমার অনুগ্রহ। অতএব এগুলো তুমি কাউকে দাও অথবা নিজে রেখে দাও, তার কোন হিসাব দিতে হবে না’। ‘নিশ্চয়ই তার (সুলায়মানের) জন্য আমার কাছে রয়েছে নৈকট্য ও শুভ পরিণতি’’ (ছোয়াদ, আয়াত ৩৯-৪০)।

 

বস্ত্ততঃ এটি ছিল সুলায়মানের আমানতদারী ও বিশ্বস্ততার প্রতি আল্লাহর পক্ষ হ’তে প্রদত্ত একপ্রকার সনদপত্র। পৃথিবীর কোন ব্যক্তির জন্য সরাসরি আল্লাহর পক্ষ থেকে এ ধরনের কোন সত্যায়নপত্র নাযিল হয়েছে বলে জানা যায় না। অথচ এই মহান নবী সম্পর্কে ইহুদী-নাছারা বিদ্বানরা বাজে কথা রটনা করে থাকে।

 

সুলায়মানের জীবনে উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলী :

 

(১) ন্যায় বিচারের ঘটনা : ছাগপালের মালিক ও শস্যক্ষেতের মালিকের মধ্যকার বিরোধ মীমাংসায় তাঁর দেওয়া প্রস্তাব বাদশাহ দাঊদ (আঃ) গ্রহণ করেন ও নিজের দেওয়া পূর্বের রায় বাতিল করে পুত্র সুলায়মানের দেওয়া পরামর্শ অনুযায়ী রায় দেন ও তা কার্যকর করেন। এটি ছিল সুলায়মানের বাল্যকালের ঘটনা, যা আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বর্ণনা করেছেন (আম্বিয়া, আয়াত ৭৮-৭৯)। এ ঘটনা আমরা দাঊদ (আঃ)-এর কাহিনীতে বলে এসেছি।

 

(২) পিপীলিকার ঘটনা : হযরত সুলায়মান (আঃ) একদা তাঁর বিশাল সেনাবাহিনী সহ একটি এলাকা অতিক্রম করছিলেন। ঐ সময় তাঁর সাথে জিন, মানুষ পক্ষীকুল ছিল। যে এলাকা দিয়ে তাঁরা যাচ্ছিলেন সে এলাকায় বালির ঢিবি সদৃশ পিপীলিকাদের বহু বসতঘর ছিল। সুলায়মান বাহিনীকে আসতে দেখে পিপীলিকাদের সর্দার তাদেরকে বলল, তোমরা শীঘ্র পালাও। নইলে পাদপিষ্ট হয়ে শেষ হয়ে যাবে। সুলায়মান (আঃ) পিপীলিকাদের এই বক্তব্য শুনতে পেলেন। এ বিষয়ে কুরআনী বর্ণনা নিম্নরূপ: ‘‘সুলায়মান দাঊদের স্থলাভিষিক্ত হ’ল এবং বলল, হে লোক সকল! আমাদেরকে পক্ষীকুলের ভাষা শিক্ষা দেওয়া হয়েছে এবং আমাদেরকে সবকিছু দেওয়া হয়েছে। নিশ্চয়ই এটি একটি সুস্পষ্ট শ্রেষ্ঠত্ব’ (নমল, আয়াত ১৬)। ‘অতঃপর সুলায়মানের সম্মুখে তার সোনাবাহিনীকে সমবেত করা হ’ল জিন, মানুষ ও পক্ষীকুলকে। তারপর তাদেরকে বিভিন্ন ব্যুহে বিভক্ত করা হ’ল’। ‘অতঃপর যখন তারা একটি পিপীলিকা অধ্যুষিত এলাকায় উপনীত হ’ল, তখন এক পিপীলিকা বলল, ‘হে পিপীলিকা দল! তোমরা তোমাদের গৃহে প্রবেশ কর। অন্যথায় সুলায়মান ও তার বাহিনী অজ্ঞাতসারে তোমদেরকে পিষ্ট করে ফেলবে’। ‘তার কথা শুনে সুলায়মান মুচকি হাসল এবং বলল, ‘হে আমার পালনকর্তা! তুমি আমাকে ক্ষমতা দাও, যেন আমি তোমার নে‘মতের শুকরিয়া আদায় করতে পারি, যা তুমি আমাকে ও আমার পিতা-মাতাকে দান করেছ এবং যাতে আমি তোমার পসন্দনীয় সৎকর্মাদি করতে পারি এবং তুমি আমাকে নিজ অনুগ্রহে তোমার সৎকর্মশীল বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত কর’’ (নমল, আয়াত ১৬-১৯)।

 

উপরোক্ত আয়াতগুলিতে প্রমাণিত হয় যে, সুলায়মান (আঃ) কেবল পাখির ভাষা নয়, বরং সকল জীবজন্তু এমনকি ক্ষুদ্র পিঁপড়ার কথাও বুঝতেন। এজন্য তিনি মোটেই গর্ববোধ না করে বরং আল্লাহর অনুগ্রহের প্রতি শুকরিয়া আদায় করেন এবং নিজেকে যাতে আল্লাহ অন্যান্য সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত করেন সে প্রার্থনা করেন। এখানে আরেকটি বিষয় প্রমাণিত হয় যে, তিনি কেবল জিন-ইনসানের নয় বরং তাঁর সময়কার সকল জীবজন্তুরও নবী ছিলেন। তাঁর নবুঅতকে সবাই স্বীকার করত এবং সকলে তাঁর প্রতি আনুগত্য পোষণ করত। যদিও জিন ও ইনসান ব্যতীত অন্য প্রাণী শরী‘আত পালনের হকদার নয়।

 

(৩) হুদহুদপাখির ঘটনা : হযরত সুলায়মান (আঃ) আল্লাহর হুকুমে পক্ষীকুলের আনুগত্য লাভ করেন। একদিন তিনি পক্ষীকুলকে ডেকে একত্রিত করেন ও তাদের ভাল-মন্দ খোঁজ-খবর নেন। তখন দেখতে পেলেন যে, ‘হুদহুদ’ পাখিটা নেই। তিনি অনতিবিলম্বে তাকে ধরে আনার জন্য কড়া নির্দেশ জারি করলেন। সাথে তার অনুপস্থিতির উপযুক্ত কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করলেন। উক্ত ঘটনা কুরআনের ভাষায় নিম্নরূপ: ‘সুলায়মান পক্ষীকুলের খোঁজ-খবর নিল। অতঃপর বলল, কি হ’ল হুদহুদকে দেখছি না যে? না-কি সে অনুপস্থিত’ (নমল, আয়াত ২০)। সে বলল, ‘আমি অবশ্যই তাকে কঠোর শাস্তি দেব কিংবা যবহ করব অথবা সে উপস্থিত করবে উপযুক্ত কারণ’। ‘কিছুক্ষণ পরেই হুদহুদ এসে হাযির হয়ে বলল, (হে বাদশাহ!) আপনি যে বিষয়ে অবগত নন, আমি তা অবগত হয়েছি। আমি আপনার নিকটে ‘সাবা’ থেকে নিশ্চিত সংবাদ নিয়ে আগমন করেছি’ (নমল, আয়াত ২০-২২)।

 

এ পর্যন্ত বলেই সে তার নতুন আনীত সংবাদের রিপোর্ট পেশ করল। হুদহুদের মাধ্যমে একথা বলানোর মাধ্যমে আল্লাহ আমাদেরকে একথা জানিয়ে দিলেন যে, নবীগণ গায়েবের খবর রাখেন না। তাঁরা কেবল অতটুকুই জানেন, যতটুকু আল্লাহ তাদেরকে অবহিত করেন।

 

উল্লেখ্য যে, ‘হুদহুদ’ এক জাতীয় ছোট্ট পাখির নাম। যা পক্ষীকুলের মধ্যে অতীব ক্ষুদ্র ও দুর্বল এবং যার সংখ্যাও দুনিয়াতে খুবই কম। বর্ণিত আছে যে, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) একদা নও মুসলিম ইহুদী পন্ডিত আব্দুল্লাহ বিন সালাম (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করেন, এতসব পাখী থাকতে বিশেষভাবে ‘হুদহুদ’ পাখির খোঁজ নেওয়ার কারণ কি ছিল? জওয়াবে তিনি বলেন, সুলায়মান (আঃ) তাঁর বিশাল বাহিনীসহ ঐসময় এমন এক অঞ্চলে ছিলেন, যেখানে পানি ছিল না। আল্লাহ তা‘আলা হুদহুদ পাখিকে এই বৈশিষ্ট্য দান করেছেন যে, সে ভূগর্ভের বস্ত্ত সমূহকে এবং ভূগর্ভে প্রবাহিত পানি উপর থেকে দেখতে পায়। হযরত সুলায়মান (আঃ) হুদহুদকে এজন্যেই বিশেষভাবে খোঁজ করছিলেন যে, এতদঞ্চলে কোথায় মরুগর্ভে পানি লুক্কায়িত আছে, সেটা জেনে নিয়ে সেখানে জিন দ্বারা খনন করে যাতে দ্রুত পানি উত্তোলনের ব্যবস্থা করা যায়’। একদা হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) ‘হুদহুদ’ পাখি সম্পর্কে বর্ণনা করছিলেন। তখন নাফে‘ ইবনুল আযরক্ব তাঁকে বলেন, ‘জেনে নিন হে মহা জ্ঞানী! হুদহুদ পাখি মাটির গভীরে দেখতে পায়। কিন্তু (তাকে ধরার জন্য) মাটির উপরে বিস্তৃত জাল সে দেখতে পায় না। যখন সে তাতে পতিত হয়’। জবাবে ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, ‘যখন তাক্বদীর এসে যায়, চক্ষু অন্ধ হয়ে যায়’। চমৎকার এ জবাবে মুগ্ধ হয়ে ইবনুল ‘আরাবী বলেন, ‘এরূপ জওয়াব দিতে কেউ সক্ষম হয় না, কুরআনের আলেম ব্যতীত’।

 

(৪) রাণী বিলক্বীসের ঘটনা : হযরত সুলায়মান (আঃ)-এর শাম ও ইরাক সাম্রাজ্যের পার্শ্ববর্তী ইয়ামন তথা ‘সাবা’ রাজ্যের রাণী ছিলেন বিলক্বীস বিনতুস সারাহ বিন হাদাহিদ বিন শারাহীল। তিনি ছিলেন সাম বিন নূহ (আঃ)-এর ১৮তম অধঃস্তন বংশধর। তাঁর ঊর্ধ্বতন ৯ম পিতামহের নাম ছিল ‘সাবা’। সম্ভবতঃ তাঁর নামেই ‘সাবা’ সাম্রাজ্যের নামকরণ হয়।আল্লাহ তাদের সামনে জীবনোপকরণের দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন এবং নবীগণের মাধ্যমে এসব নে‘মতের শুকরিয়া আদায় করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু পরে তারা ভোগ-বিলাসে মত্ত হয়ে আল্লাহর অবাধ্য হয় এবং ‘সূর্য পূজারী’ হয়ে যায়। ফলে তাদের উপরে প্লাবণের আযাব প্রেরিত হয় ও সবকিছু ধ্বংস হয়ে যায়। আল্লাহ সূরা সাবা ১৫ হ’তে ১৭ আয়াতে এই সম্প্রদায় সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন।

 

দুনিয়াবী দিক দিয়ে এই ‘সাবা’ সাম্রাজ্য খুবই সমৃদ্ধ এবং শান-শওকতে পূর্ণ ছিল। তাদের সম্পর্কে হযরত সুলায়মানের কিছু জানা ছিল না বলেই কুরআনী বর্ণনায় প্রতীয়মান হয়। তাঁর এই না জানাটা বিস্ময়কর কিছু ছিল না। ইয়াকূব (আঃ) তাঁর বাড়ীর অনতিদূরে তাঁর সন্তান ইউসুফকে কূয়ায় নিক্ষেপের ঘটনা জানতে পারেননি। স্ত্রী আয়েশার গলার হারটি হারিয়ে গেল। অথচ স্বামী রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তা জানতে পারেননি। বস্ত্ততঃ আল্লাহ যতটুকু ইলম বান্দাকে দেন, তার বেশী জানার ক্ষমতা কারো নেই। পার্শ্ববর্তী ‘সাবা’ সাম্রাজ্য সম্পর্কে পূর্বে না জানা এবং পরে জানার মধ্যে যে কি মঙ্গল নিহিত ছিল, তা পরবর্তী ঘটনাতেই প্রমাণিত হয়েছে এবং রাণী বিলক্বীস মুসলমান হয়ে যান। বস্ত্ততঃ হুদহুদ পাখি তাদের সম্পর্কে হযরত সুলায়মানের নিকটে এসে প্রথম খবর দেয়। তার বর্ণিত প্রতিবেদনটি ছিল কুরআনের ভাষায় নিম্নরূপ :

 

‘‘আমি এক মহিলাকে সাবা বাসীদের উপরে রাজত্ব করতে দেখেছি। তাকে সবকিছুই দেওয়া হয়েছে এবং তার একটা বিরাট সিংহাসন আছে’। ‘আমি তাকে ও তার সম্প্রদায়কে দেখলাম তারা আল্লাহর পরিবর্তে সূর্যকে সিজদা করছে। শয়তান তাদের দৃষ্টিতে তাদের কার্যাবলীকে সুশোভিত করেছে। অতঃপর তাদেরকে সত্যপথ থেকে নিবৃত্ত করেছে। ফলে তারা সঠিক পথ প্রাপ্ত হয় না’’ (নমল, আয়াত ২৩-২৪)।

 

সুলায়মান বলল, ‘‘এখন আমরা দেখব তুমি সত্য বলছ, না তুমি মিথ্যাবাদীদের একজন’। ‘তুমি আমার এই পত্র নিয়ে যাও এবং এটা তাদের কাছে অর্পণ কর। অতঃপর তাদের কাছ থেকে সরে পড় এবং দেখ, তারা কি জওয়াব দেয়’। ‘বিলক্বীস বলল, হে সভাসদ বর্গ! আমাকে একটি মহিমান্বিত পত্র দেওয়া হয়েছে’। ‘সেই পত্র সুলায়মানের পক্ষ হ’তে এবং তা হ’ল এই: করুণাময় কৃপানিধান আল্লাহর নামে (শুরু করছি)’। ‘আমার মোকাবেলায় তোমরা শক্তি প্রদর্শন করো না এবং বশ্যতা স্বীকার করে আমার নিকটে উপস্থিত হও’। ‘বিলক্বীস বলল, হে আমার পারিষদ বর্গ! আমাকে আমার কাজে পরামর্শ দিন। আপনাদের উপস্থিতি ব্যতিরেকে আমি কোন কাজে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি না’। ‘তারা বলল, আমরা শক্তিশালী এবং কঠোর যোদ্ধা। এখন সিদ্ধান্ত আপনার হাতে। অতএব ভেবে দেখুন আপনি আমাদের কি আদেশ করবেন’।

 

‘রাণী বলল, রাজা-বাদশাহরা যখন কোন জনপদে প্রবেশ করে, তখন তাকে বিপর্যস্ত করে দেয় এবং সেখানকার সম্ভ্রান্ত লোকদের অপদস্থ করে। তারাও এরূপ করবে’। ‘অতএব আমি তাঁর নিকটে কিছু উপঢৌকন পাঠাই। দেখি, প্রেরিত লোকেরা কি জওয়াব নিয়ে আসে’। ‘অতঃপর যখন দূত সুলায়মানের কাছে আগমন করল, তখন সুলায়মান বলল, তোমরা কি ধন-সম্পদ দ্বারা আমাকে সাহায্য করতে চাও? আল্লাহ আমাকে যা দিয়েছেন, তা তোমাদের দেওয়া বস্ত্ত থেকে অনেক উত্তম। বরং তোমরাই তোমাদের উপঢৌকন নিয়ে সুখে থাক’। ‘ফিরে যাও তাদের কাছে। এখন অবশ্যই আমরা তাদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী সহ আগমন করব, যার মোকাবেলা করার শক্তি তাদের নেই। আমরা অবশ্যই তাদেরকে অপদস্থ করে সেখান থেকে বহিষ্কার করব এবং তারা হবে লাঞ্ছিত’। ‘অতঃপর সুলায়মান বলল, হে আমার পারিষদবর্গ! তারা আত্মসমর্পণ করে আমার কাছে আসার পূর্বে কে আছ বিলক্বীসের সিংহাসন আমাকে এনে দেবে?’ ‘জনৈক দৈত্য-জ্বিন বলল, আপনি আপনার স্থান থেকে ওঠার পূর্বেই আমি তা এনে দেব এবং আমি একাজে শক্তিবান ও বিশ্বস্ত’। ‘(কিন্তু) কিতাবের জ্ঞান যার ছিল সে বলল, তোমার চোখের পলক ফেলার পূর্বেই আমি তা এনে দিব। অতঃপর সুলায়মান যখন তা সামনে রক্ষিত দেখল, তখন বলল, এটা আমার পালনকর্তার অনুগ্রহ, যাতে তিনি আমাকে পরীক্ষা করেন যে, আমি শুকরিয়া আদায় করি, না অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। যে ব্যক্তি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, সে নিজের কল্যাণের জন্য তা করে থাকে এবং যে অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, সে জানুক যে, আমার পালনকর্তা অভাবমুক্ত ও কৃপাময়’ (নমল, আয়াত ৪০)।

 

‘সুলায়মান বলল, বিলক্বীসের সিংহাসনের আকৃতি বদলিয়ে দাও, দেখব সে সঠিক বস্ত্ত চিনতে পারে, না সে তাদের অন্তর্ভুক্ত যারা সঠিক পথ খুঁজে পায় না?’ ‘অতঃপর যখন বিলক্বীস এসে গেল, তখন তাকে জিজ্ঞেস করা হ’ল: আপনার সিংহাসন কি এরূপই? সে বলল, মনে হয় এটা সেটিই হবে। আমরা পূর্বেই সবকিছু অবগত হয়েছি এবং আমরা আজ্ঞাবহ হয়ে গেছি’। ‘বস্ত্ততঃ আল্লাহর পরিবর্তে সে যার উপাসনা করত, সেই-ই তাকে ঈমান থেকে বিরত রেখেছিল। নিশ্চয়ই সে কাফের সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল’। ‘তাকে বলা হ’ল, প্রাসাদে প্রবেশ করুন। অতঃপর যখন সে তার প্রতি দৃষ্টিপাত করল, তখন ধারণা করল যে, এটা স্বচ্ছ গভীর জলাশয়। ফলে সে তার পায়ের গোছা খুলে ফেলল। সুলায়মান বলল, এটা তো স্বচ্ছ স্ফটিক নির্মিত প্রাসাদ। বিলক্বীস বলল, হে আমার পালনকর্তা! আমি তো নিজের প্রতি যুলুম করেছি। আমি সুলায়মানের সাথে বিশ্বজাহানের পালনকর্তা আল্লাহর নিকটে আত্মসমর্পণ করলাম’ (নমল, আয়াত ২৭-৪৪)।

 

সূরা নমল ২২ হ’তে ৪৪ আয়াত পর্যন্ত উপরে বর্ণিত ২৩টি আয়াতে রাণী বিলক্বীসের কাহিনী শেষ হয়েছে। এর মধ্যে ৪০তম আয়াতে ‘যার কাছে কিতাবের জ্ঞান ছিল’ বলে কাকে বুঝানো হয়েছে, এ বিষয়ে তাফসীরবিদগণ মতভেদ করেছেন। তার মধ্যে প্রবল মত হ’ল এই যে, তিনি ছিলেন স্বয়ং হযরত সুলায়মান (আঃ)। কেননা আল্লাহর কিতাবের সর্বাধিক জ্ঞান তাঁরই ছিল। তিনি এর দ্বারা উপস্থিত জিন ও মানুষ পারিষদ বর্গকে বুঝিয়ে দিলেন যে, তোমাদের সাহায্য ছাড়াও আল্লাহ অন্যের মাধ্যমে অর্থাৎ ফেরেশতাদের মাধ্যমে আমাকে সাহায্য করে থাকেন। ‘আর এটি হ’ল আমার পালনকর্তার অনুগ্রহ’ (নমল ৪০)। দ্বিতীয়তঃ গোটা ব্যাপারটাই ছিল একটা মু‘জেযা এবং রাণী বিলক্বীসকে আল্লাহর সর্বোচ্চ ক্ষমতা প্রদর্শন করাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। বস্ত্ততঃ এতে তিনি সফল হয়েছিলেন এবং সুদূর ইয়ামন থেকে বায়তুল মুক্বাদ্দাসে বিলক্বীস তার সিংহাসনের আগাম উপস্থিতি দেখে অতঃপর স্ফটিক স্বচ্ছ প্রাসাদে প্রবেশকালে অনন্য কারুকার্য দেখে এবং তার তুলনায় নিজের ক্ষমতা ও প্রাসাদের দীনতা বুঝে লজ্জিত ও অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন। অতঃপর তিনি আল্লাহর নিকটে আত্মসমর্পণ করে মুসলমান হয়ে যান। মূলতঃ এটাই ছিল হযরত সুলায়মানের মূল উদ্দেশ্য, যা শতভাগ সফল হয়েছিল।

 

(৫) অশ্ব কুরবানীর ঘটনা :

 

পিতা দাঊদের ন্যায় পুত্র সুলায়মানকেও আল্লাহ বারবার পরীক্ষায় ফেলেছেন তাকে সর্বদা আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তনশীল রাখার জন্য। ফলে তাঁর জীবনের এক একটি পরীক্ষা এক একটি ঘটনার জন্ম দিয়েছে। কুরআন সেগুলির সামান্য কিছু উল্লেখ করেছে, যতটুকু আমাদের উপদেশ হাছিলের জন্য প্রয়োজন। কিন্তু পথভ্রষ্ট ইহুদী-নাছারা পন্ডিতগণ সেই সব ঘটনার উপরে রং চড়িয়ে এবং নিজেদের পক্ষ থেকে উদ্ভট সব গল্পের অবতারণা করে তাদেরই স্বগোত্র বনু ইস্রাঈলের এইসব মহান নবীগণের চরিত্র হনন করেছে। মুসলিম উম্মাহ বিগত সকল নবীকে সমানভাবে সম্মান করে। তাই ইহুদী-নাছারাদের অপপ্রচার থেকে নিজেদেরকে বাঁচিয়ে রাখে এবং পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের বর্ণনার উপরে নির্ভর করে। সেখানে যতটুকু পাওয়া যায়, তার উপরেই তারা বাক সংযত রাখে। আলোচ্য অশ্ব কুরবানীর ঘটনাটি সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের বর্ণনা নিম্নরূপ :

 

‘‘যখন তার সামনে অপরাহ্নে উৎকৃষ্ট অশ্বরাজি পেশ করা হ’ল’ (ছোয়াদ ৩১)। ‘তখন সে বলল, আমি তো আমার প্রভুর স্মরণের জন্যই ঘোড়াগুলিকে মহববত করে থাকি (কেননা এর দ্বারা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ হয়ে থাকে। অতঃপর সে ঘোড়াগুলিকে দৌড়িয়ে দিল,) এমনকি সেগুলি দৃষ্টির অন্তরালে চলে গেল’। ‘(অতঃপর সে বলল,) ঘোড়াগুলিকে আমার কাছে ফিরিয়ে আনো। অতঃপর সে তাদের গলায় ও পায়ে (আদর করে) হাত বুলাতে লাগল’ (ছোয়াদ, আয়াত ৩১-৩৩)। উপরোক্ত তরজমাটি ইবনু আববাস (রাঃ)-এর ব্যাখ্যার অনুসরণে ইবনু জারীরের গৃহীত ব্যাখ্যার অনুকূলে করা হয়েছে।

 

 (৬) সিংহাসনের উপরে একটি নিষ্প্রাণ দেহ প্রাপ্তির ঘটনা :

 

আল্লাহ বলেন- ‘আমরা সুলায়মানকে পরীক্ষা করলাম এবং রেখে দিলাম তার সিংহাসনের উপর একটি নিষ্প্রাণ দেহ। অতঃপর সে রুজু হ’ল’ (ছোয়াদ, আয়াত ৩৪)। এ বিষয়ে কুরআনের বর্ণনা কেবল এতটুকুই। এক্ষণে সেই নিষ্প্রাণ দেহটি কিসের ছিল, একে সিংহাসনের উপর রাখার হেতু কি ছিল, এর মাধ্যমে কি ধরনের পরীক্ষা হ’ল- এসব বিবরণ কুরআন বা ছহীহ হাদীছে কিছুই বর্ণিত হয়নি। অতএব এ বিষয়ে কেবল এতটুকু ঈমান রাখা কর্তব্য যে, সুলায়মান (আঃ) এভাবে পরীক্ষায় পতিত হয়েছিলেন। যার ফলে তিনি আল্লাহর প্রতি আরো বেশী রুজু হন ও ক্ষমা প্রার্থনা করেন। যা সর্বাবস্থায় আল্লাহর প্রতি তাঁর অটুট আনুগত্যের পরিচয় বহন করে।

 

(৭) ইনশাআল্লাহনা বলার ফল :

 

ছহীহ বুখারী ও মুসলিমে এ বিষয়ে বর্ণিত ঘটনার সারমর্ম এই যে, একবার হযরত সুলায়মান (আঃ) এ মনোভাব ব্যক্ত করলেন যে, রাত্রিতে আমি (আমার ৯০ বা ১০০) সকল স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হব। যাতে প্রত্যেকের গর্ভ থেকে একটি করে পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করে ও পরে তারা আল্লাহর পথে ঘোড় সওয়ার হয়ে জিহাদ করবে। কিন্তু এ সময় তিনি ‘ইনশাআল্লাহ’ (অর্থঃ ‘যদি আল্লাহ চান’) বলতে ভুলে গেলেন। নবীর এ ত্রুটি আল্লাহ পসন্দ করলেন না। ফলে মাত্র একজন স্ত্রীর গর্ভ থেকে একটি অপূর্ণাঙ্গ ও মৃত শিশু ভূমিষ্ট হ’ল’। এর দ্বারা বুঝানো হয়েছে যে, সুলায়মান বিশ্বের সর্বাধিক ক্ষমতাসম্পন্ন বাদশাহ হ’লেও এবং জিন, বায়ু, পক্ষীকুল ও সকল জীবজন্তু তাঁর হুকুম বরদার হ’লেও আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতীত তার কিছুই করার ক্ষমতা ছিল না। অতএব তাঁর ‘ইনশাআল্লাহ’ বলতে ভুলে যাওয়াটা ছোটখাট কোন অপরাধ নয়। এ ঘটনায় এটাও স্পষ্ট হয় যে, যারা যত বড় পদাধিকারী হবেন, তাদের ততবেশী আল্লাহর অনুগত হ’তে হবে এবং সর্বাবস্থায় সকল কাজে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করতে হবে। সর্বদা বিনীত হয়ে চলতে হবে এবং কোন অবস্থাতেই অহংকার করা চলবে না।

 

অনেক তাফসীরবিদ সূরা ছোয়াদ ৩৪ আয়াতে বর্ণিত ‘সিংহাসনের উপরে নিষ্প্রাণ দেহ’ রাখার ঘটনার সাথে কিছুটা সাদৃশ্য দেখে ছহীহ বুখারীতে বর্ণিত উপরোক্ত ঘটনাকে উক্ত আয়াতের তাফসীর হিসাবে সাব্যস্ত করেছেন। তারা বলেন যে, সিংহাসনে নিষ্প্রাণ দেহ রাখার অর্থ এই যে, সুলায়মান (আঃ)-এর জনৈক চাকর উক্ত মৃত সন্তানকে এনে তাঁর সিংহাসনে রেখে দেয়। এতে সুলায়মান (আঃ) বুঝে নেন যে, এটা তাঁর ‘ইনশাআল্লাহ’ না বলার ফল। সেমতে তিনি আল্লাহর দিকে রুজু হ’লেন ও ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। ক্বাযী আবুস সাঊদ, আল্লামা আলূসী, আশরাফ আলী থানভী প্রমুখ এ তাফসীর বর্ণনা করেছেন। এতদ্ব্যতীত ইমাম রাযীও আরেকটি তাফসীর করেছেন যে, সুলায়মান (আঃ) একবার গুরুতর অসুস্থ হয়ে এমন দুর্বল হয়ে পড়েন যে, সিংহাসনে বসালে তাঁকে নিষ্প্রাণ দেহ বলে মনে হ’ত। পরে সুস্থ হ’লে তিনি আল্লাহর দিকে রুজু হন...। এ তাফসীর একেবারেই অনুমান ভিত্তিক। কুরআনী বর্ণনার সাথে এর কোন মিল নেই।

 

বস্ত্ততঃ কুরআন পাকে এই ঘটনা উল্লেখ করার আসল উদ্দেশ্য হ’ল মানুষকে একথা বুঝানো যে, তারা কোন বিপদাপদে বা পরীক্ষায় পতিত হ’লে যেন পূর্বাপেক্ষা অধিকভাবে আল্লাহর দিকে রুজু হয়। যেমন সুলায়মান (আঃ) হয়েছিলেন।

 

(৮) হারূত ও মারূত ফেরেশতাদ্বয়ের কাহিনী :

 

সুলায়মান (আঃ)-এর রাজত্বকালে বেঈমান জিনেরা লোকদের ধোঁকা দিত এই বলে যে, সুলায়মান জাদুর জোরে সবকিছু করেন। তিনি কোন নবী নন। শয়তানদের ভেল্কিবাজিতে বহু লোক বিভ্রান্ত হচ্ছিল। এমনকি শেষনবী (ছাঃ)-এর সময়েও যখন তিনি সুলায়মান (আঃ)-এর প্রশংসা করেন, তখন ইহুদী নেতারা বলেছিল, আশ্চর্যের বিষয় যে, মুহাম্মাদ সুলায়মানকে নবীদের মধ্যে শামিল করে হক ও বাতিলের মধ্যে সংমিশ্রণ ঘটাচ্ছেন। অথচ তিনি ছিলেন একজন জাদুকর মাত্র। কেননা স্বাভাবিকভাবে কোন মানুষ কি বায়ুর পিঠে সওয়ার হয়ে চলতে পারে? (ইবনু জারীর)।

 

এক্ষণে সুলায়মান (আঃ) যে সত্য নবী, তিনি যে জাদুকর নন, জনগণকে সেটা বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য এবং নবীগণের মু‘জেযা ও শয়তানদের জাদুর মধ্যে পার্থক্য বুঝাবার জন্য আল্লাহ পাক হারূত ও মারূত নামে দু’জন ফেরেশতাকে ‘বাবেল’ শহরে মানুষের বেশে পাঠিয়ে দেন। ‘বাবেল’ হ’ল ইরাকের একটি প্রাচীন নগরী, যা ঐসময় জাদু বিদ্যার কেন্দ্র ছিল। ফেরেশতাদ্বয় সেখানে এসে জাদুর স্বরূপ ও ভেল্কিবাজি সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করতে থাকেন এবং জাদুকরদের অনুসরণ থেকে বিরত হয়ে যেন সবাই সুলায়মানের নবুঅতের অনুসারী হয়, সেকথা বলতে লাগলেন।

 

জাদু ও মু‘জেযার পার্থক্য এই যে, জাদু প্রাকৃতিক কারণের অধীন। কারণ ব্যতীত জাদু সংঘটিত হয় না। কিন্তু দর্শক সে কারণ সম্পর্কে অবহিত থাকে না বলেই তাতে বিভ্রান্ত হয়। এমনকি কুফরীতে লিপ্ত হয় এবং ঐ জাদুকরকেই সকল ক্ষমতার মালিক বলে ধারণা করতে থাকে। আজকের যুগে ভিডিও চিত্রসহ হাযার মাইল দূরের ভাষণ ঘরে বসে শুনে এবং দেখে যেকোন অজ্ঞ লোকের পক্ষে নিঃসন্দেহে বিভ্রান্তিতে পড়া স্বাভাবিক। তেমনি সেযুগেও জাদুকরদের বিভিন্ন অলৌকিক বস্ত্ত দেখে অজ্ঞ মানুষ বিভ্রান্তিতে পড়ত।

 

পক্ষান্তরে মু‘জেযা কোন প্রাকৃতিক কারণের অধীন নয়। বরং তা সরাসরি আল্লাহর নির্দেশে সম্পাদিত হয়। নবী ব্যতীত আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের প্রতি তাঁর ‘কারামত’ বা সম্মান প্রদর্শনের বিষয়টিও একইভাবে সম্পাদিত হয়। এতে প্রাকৃতিক কারণের যেমন কোন সম্পৃক্ততা নেই, তেমনি সম্মানিত ব্যক্তির নিজস্ব কোন ক্ষমতা বা হাত নেই। উভয় বস্ত্তর পার্থক্য বুঝার সহজ উপায় এই যে, মু‘জেযা কেবল নবীগণের মাধ্যমেই প্রকাশিত হয়। যারা আল্লাহভীতি, উন্নত চরিত্র মাধুর্য এবং পবিত্র জীবন যাপন সহ সকল মানবিক গুণে সর্বকালে সকলের আদর্শ স্থানীয় হন।

 

আর নবী ও অলীগণের মধ্যে পার্থক্য এই যে, নবীগণ প্রকাশ্যে নবুঅতের দাবী করে থাকেন। কিন্তু অলীগণ কখনোই নিজেকে অলী বলে দাবী করেন না। অলীগণ সাধারণভাবে নেককার মানুষ। কিন্তু নবীগণ আল্লাহর বিশেষভাবে নির্বাচিত বান্দা, যাদেরকে তিনি নবুঅতের গুরুদায়িত্ব অর্পণ করে থাকেন। নবীগণের মু‘জেযা প্রকাশে তাদের নিজস্ব কোন ক্ষমতা বা কৃতিত্ব নেই। পক্ষান্তরে দুষ্ট লোকেরাই জাদুবিদ্যা শিখে ও তার মাধ্যমে নিজেদের দুনিয়া হাছিল করে থাকে। উভয়ের চরিত্র জনগণের মাঝে পরিষ্কারভাবে পার্থক্য সৃষ্টি করে।

 

বস্ত্ততঃ সুলায়মান (আঃ)-এর নবুঅতের সমর্থনেই আল্লাহ তাঁর বিশেষ অনুগ্রহে হারূত ও মারূত ফেরেশতাদ্বয়কে বাবেল শহরে পাঠিয়ে ছিলেন। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘(ইহুদী-নাছারাগণ) ঐ সবের অনুসরণ করে থাকে, যা সুলায়মানের রাজত্বকালে শয়তানরা আবৃত্তি করত। অথচ সুলায়মান কুফরী করেননি, বরং শয়তানরাই কুফরী করেছিল। তারা মানুষকে জাদু বিদ্যা শিক্ষা দিত এবং বাবেল শহরে হারূত ও মারূত দুই ফেরেশতার উপরে যা নাযিল হয়েছিল, তা শিক্ষা দিত। বস্ত্ততঃ তারা (হারূত-মারূত) উভয়ে একথা না বলে কাউকে শিক্ষা দিত না যে, আমরা এসেছি পরীক্ষা স্বরূপ। কাজেই তুমি (জাদু শিখে) কাফির হয়ো না। কিন্তু তারা তাদের কাছ থেকে এমন জাদু শিখত, যার দ্বারা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটে। অথচ আল্লাহর আদেশ ব্যতীত তদ্বারা তারা কারু ক্ষতি করতে পারত না। লোকেরা তাদের কাছে শিখত ঐসব বস্ত্ত যা তাদের ক্ষতি করে এবং তাদের কোন উপকার করে না। তারা ভালভাবেই জানে যে, যে কেউ জাদু অবলম্বন করবে, তার জন্য আখেরাতে কোন অংশ নেই। যার বিনিময়ে তারা আত্মবিক্রয় করেছে, তা খুবই মন্দ, যদি তারা জানতো’। ‘যদি তারা ঈমান আনত ও আল্লাহভীরু হ’ত, তবে আল্লাহর কাছ থেকে উত্তম প্রতিদান পেত, যদি তারা জানত’ (বাক্বারাহ, আয়াত ১০২-১০৩)।

 

 (৯) বায়তুল মুক্বাদ্দাস নির্মাণ ও সুলায়মান (আঃ)-এর মৃত্যুর বিস্ময়কর ঘটনা :

 

বায়তুল মুক্বাদ্দাসের নির্মাণ সর্বপ্রথম ফেরেশতাদের মাধ্যমে অথবা আদম (আঃ)-এর কোন সন্তানের মাধ্যমে সম্পন্ন হয় কা‘বাগৃহ নির্মাণের চল্লিশ বছর পরে। অতঃপর স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে হযরত ইয়াকূব (আঃ) তা পুনর্নির্মাণ করেন। তার প্রায় হাযার বছর পরে দাঊদ (আঃ) তার পুনর্নির্মাণ শুরু করেন এবং সুলায়মান (আঃ)-এর হাতে তা সমাপ্ত হয়। কিন্তু মূল নির্মাণ কাজ শেষ হ’লেও আনুসঙ্গিক কিছু কাজ তখনও বাকী ছিল। এমন সময় হযরত সুলায়মানের মৃত্যুকাল ঘনিয়ে এল। এই কাজগুলি অবাধ্যতাপ্রবণ জিনদের উপরে ন্যস্ত ছিল। তারা হযরত সুলায়মানের ভয়ে কাজ করত। তারা তাঁর মৃত্যু সংবাদ জানতে পারলে কাজ ফেলে রেখে পালাতো। ফলে নির্মাণ কাজ অসম্পূর্ণ থেকে যেত। তখন সুলায়মান (আঃ) আল্লাহর নির্দেশে মৃত্যুর জন্যে প্রস্ত্তত হয়ে তাঁর কাঁচ নির্মিত মেহরাবে প্রবেশ করলেন। যাতে বাইরে থেকে ভিতরে সবকিছু দেখা যায়। তিনি বিধানানুযায়ী ইবাদতের উদ্দেশ্যে লাঠিতে ভর করে দাঁড়িয়ে গেলেন, যাতে রূহ বেরিয়ে যাবার পরেও লাঠিতে ভর দিয়ে দেহ স্বস্থানে দাঁড়িয়ে থাকে। সেটাই হ’ল। আল্লাহর হুকুমে তাঁর দেহ উক্ত লাঠিতে ভর করে এক বছর দাঁড়িয়ে থাকল। দেহ পচলো না, খসলো না বা পড়ে গেল না। জিনেরা ভয়ে কাছে যায়নি। ফলে তারা হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেটে কাজ শেষ করে ফেলল। এভাবে কাজ সমাপ্ত হ’লে আল্লাহর হুকুমে কিছু উই পোকার সাহায্যে লাঠি ভেঙ্গে দেওয়া হয় এবং সুলায়মান (আঃ)-এর লাশ মাটিতে পড়ে যায়। উক্ত কথাগুলি আল্লাহ বলেন নিম্নোক্ত ভাবে- ‘অতঃপর যখন আমরা সুলায়মানের মৃত্যু ঘটালাম, তখন ঘুনপোকাই জিনদেরকে তাঁর মৃত্যু সম্পর্কে অবহিত করল। সুলায়মানের লাঠি খেয়ে যাচ্ছিল। অতঃপর যখন তিনি মাটিতে পড়ে গেলেন, তখন জিনেরা বুঝতে পারল যে, যদি তারা অদৃশ্য বিষয় জানতো, তাহ’লে তারা (মসজিদ নির্মাণের) এই হাড়ভাঙ্গা খাটুনির আযাবের মধ্যে আবদ্ধ থাকতো না’ (সাবা, আয়াত ১৪)। সুলায়মানের মৃত্যুর এই ঘটনা আংশিক কুরআনের আলোচ্য আয়াতের এবং আংশিক ইবনে আববাস (রাঃ) প্রমুখ থেকে বর্ণিত হয়েছে (ইবনে কাছীর)।

 

সুলায়মানের এই অলৌকিক মৃত্যু কাহিনীর মধ্যে শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ :

 

(১) মৃত্যুর নির্ধারিত সময় উপস্থিত হ’লে নবী-রাসূল যে-ই হৌন না কেন, এক সেকেন্ড আগপিছ হবে না।

 

(২) আল্লাহ কোন মহান কাজ সম্পন্ন করতে চাইলে যেকোন উপায়ে তা সম্পন্ন করেন। এমনকি মৃত লাশের মাধ্যমেও করতে পারেন।

 

(৩) ইতিপূর্বে জিনেরা বিভিন্ন আগাম খবর এনে বলত যে, আমরা গায়েবের খবর জানি। অথচ চোখের সামনে মৃত্যুবরণকারী সুলায়মান (আঃ)-এর খবর তারা জানতে পারেনি এক বছরের মধ্যে। এতে তাদের অদৃশ্য জ্ঞানের দাবী অসার প্রমাণিত হয়।

 

সুলায়মান (আঃ)-এর জীবনী থেকে শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ :

 

১. নবুঅত ও খেলাফত একত্রে একই ব্যক্তির মাধ্যমে পরিচালিত হওয়া সম্ভব।

 

২. ধর্মই রাজনীতির প্রধান চালিকা শক্তি। ধর্মীয় রাজনীতির মাধ্যমেই পৃথিবীতে প্রকৃত শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।

 

৩. প্রকৃত মহান তিনিই, যিনি সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী হয়েও অহংকারী হন না। বরং সর্বদা আল্লাহর প্রতি বিনীত থাকেন।

 

৪. শত্রুমুক্ত কোন মানুষ দুনিয়াতে নেই। সুলায়মানের মত একচ্ছত্র এবং অপ্রতিদ্বন্দ্বী বাদশাহর বিরুদ্ধেও চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র ও মিথ্যাচার চালানো হয়েছে।

 

৫. সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থভাবে প্রজাসাধারণের কাজ করলেও তারা অনেক সময় না বুঝে বিরোধিতা করে। যেমন বায়তুল মুক্বাদ্দাস মসজিদের নির্মাণ কাজ সমাপ্ত না হওয়ায় আল্লাহ বাকী সময়ের জন্য সুলায়মানের প্রাণহীন দেহকে লাঠিতে ঠেস দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখেন জিন মিস্ত্রী ও জোগাড়েদের ভয় দেখানোর জন্য। যাতে তারা কাজ ফেলে রেখে চলে না যায় এবং নতুন চক্রান্তে লিপ্ত হবার সুযোগ না পায়।

 

সুলায়মানের মৃত্যু ও রাজত্বকাল :

 

সুলায়মান (আঃ) ৫৩ বছর বেঁচেছিলেন। তন্মধ্যে ৪০ বছর তিনি রাজত্ব করেন। তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর পুত্র রাহবা‘আম ১৭ বছর রাজত্ব করেন। অতঃপর বনু ইস্রাঈলের রাজত্ব বিভক্ত হয়ে যায়। সুলায়মান মনছূরপুরীর হিসাব মতে শেষনবী (ছাঃ)-এর আবির্ভাবের প্রায় ১৫৪৬ বছর পূর্বে সুলায়মান (আঃ) মৃত্যুবরণ করেন।

 

কুরআনে উল্লেখ

 

এবার আপনাকে বলে দিচ্ছি কুরআন থেকে হযরত সুলাইমানকে জানার সুত্র। আল কুরআনে হযরত সুলাইমানের নাম ১৭ বার উল্লেখ করা হয়েছে। যেসব জায়গায় উল্লেখ হয়েছে সেগুলো হলো – সূরা আল বাকারা ; ১০২। আন নিসা ; ১৬৩। আল আনয়াম ; ৮৪। আল আম্বিয়া ; ৭৮, ৭৯, ৮১। আন নামল ; ১৫, ১৬, ১৭, ১৮, ৩০, ৩৬, ৪৪। সাবা ; ১২। সোয়াদ ; ৩০, ৩৪। তবে বিস্তারিত ঘটনা আপনারা আরো জানতে পারবেন সূরা আল আম্বিয়া ; ৭৮-৮২ আয়াতে। সূরা আন নামল ; ১৫-৪৪ আয়াতে। সূরা সাবা ; ১২-১৪ আয়াতে এবং সূরা সোয়াদ ; ৩০-৪৪ নম্বর আয়াতে। আপনারা তো নিশ্চয়ই জানেন, আল কুরআনের বাংলা অনুবাদ হয়েছে, তাফসির হয়েছে। একবার সরাসরি কুরআন থেকে হযরত সুলাইমান (আঃ) এর জীবনী পড়ে নিন।

 

১৯।

 

ইলিয়াস

 

(আঃ)

 

ইলিয়াস (আঃ) ছিলেন বনী ইসরাইলদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নবী। ছিলেন বড় ইবাদাত গুজার, আল্লাহভীরু এবং বিশাল ব্যক্তিত্বের অধিকারী। কুরআন মাজীদে তাঁর নাম তিন বার উল্লেখ করা হয়েছে। উল্লেখ হয়েছে সূরা আনয়ামের ৮৫ আয়াতে এবং সূরা সাফফাতের ১২৩ ও ১৩০ আয়াতে। তিনি আল্লাহর কাছে বড় মর্যাদাবান ও সম্মানিত ছিলেন। কুরআন মাজীদে আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর উপর সালাম বর্ষিত হয়েছে। বাইবেলে তাঁর নাম বলা হয়েছে ‘ইলিয়া’।

 

হযরত ইলিয়াসের কাল ও এলাকা

 

আধুনিক কালের গবেষকগন খ্রিষ্টপূর্ব ৮৭৫ থেকে ৮৫০ এর মাঝামাঝি সময়টাকে তাঁর নবুয়্যত কাল বলে চিহ্নিত করেছেন। হযরত ইলিয়াস ছিলেন জিল’আদের অধিবাসী। সেকালে জিল’আদ বলা হত জর্ডানের উত্তরাঞ্চলকে। এলাকাটি ইয়ারমুক নদীর দক্ষিনে অবস্থিত। আপনি কি কখনো সে এলাকায় গিয়েছেন?

 

কুরআনে তাঁর মর্যাদার বর্ণনা

 

 কুরআনে হযরত ইলিয়াস (আঃ) –কে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর বংশধর শ্রেষ্ঠ নবীদের একজন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সূরা আল আনয়ামে বলা হয়েছে –

 

“ইব্রাহীমকে আনি ইসহাক ও ইয়াকুবের মতো সন্তান দিয়েছি। তাঁদের সবাইকে সত্য পথ প্রদর্শন করেছি, যা প্রদর্শন করেছিলাম ইতোপূর্বে নূহকে। তাছাড়া তাঁর বংশধরদের মধ্যে দাইদ, সুলাইমান, আইয়ুব, ইউসুফ, মুসা এবং হারুনকে সঠিক পথ দেখিয়েছি। উপকারী লোকদের আমি এভাবেই প্রতিদান দিয়ে থাকি। তাঁর সন্তানদের মধ্য থেকে যাকারিয়া, ইয়াহিয়া, ঈসা এবং ইলিয়াসকেও সঠিক প্রদর্শন করেছি। এরা প্রত্যেকেই ছিলো যোগ্য সংস্কারক। তাঁরই বংশ থেকে ইসমাঈল, আলইয়াসা, ইউনুস এবং লুতকেও সঠিক পথ দেখিয়েছি। এদের প্রত্যেককে আমি বিশ্ববাসীর উপর মর্যাদা দিয়েছি।” (সূরা আল আনয়াম, ৮৪-৮৬)

 

তাঁর সংস্কারমুলক কাজ

 

কুরআনের বর্ণনা থেকেই আপনারা জানতে পারলেন হযরত ইলিয়াস (আঃ) কতো বিরাট মর্যাদার অধিকারী নবী ছিলেন এবং আল্লাহর কতটা প্রিয় ছিলেন? সূরা আস-সাফফাতে তাঁর সংস্কারমুলক আন্দোলনের একটি সংক্ষিপ্ত অথচ চমৎকার বর্ণনা দেয়া হয়েছে –

 

“আর ইলিয়াসও ছিলো একজন রাসুল। স্মরণ করো, সে তাঁর জাতিকে যখন বলেছিলো, তোমরা কি সতর্ক হবেনা? তোমরা কি তোমাদের এবং তোমাদের পূর্ব পুরুষদের প্রভু মহামহিম স্রষ্টা আল্লাহকে পরিত্যাগ করে বা’আলের পূজা অর্চনা করবে? কিন্তু তারা তাঁকে অস্বীকার করলো। কাজেই এখন অবশ্যি তাঁদের হাজির করা হবে শাস্তি ভোগের জন্যে, তবে আল্লাহর নিষ্ঠাবান দাসদের নয়। আর পরবর্তী প্রজন্মের কাছে আমি ইলিয়াসের সুখ্যাতি অব্যাহত রেখেছি। ইলিয়াসের প্রতি সালাম। উপকারী লোকদের আমি এভাবেই প্রতিফল দিয়ে থাকি। সে ছিলো আমার একনিষ্ঠ মুমিন দাসদেরই একজন।” (সূরা ৩৭, আস-সাফফাত, আয়াত ১২৩-১৩২)

 

বা’আল কে?

 

আল্লাহর উপরোক্ত বানী থেকে আমরা জানতে পারলাম হযরত ইলিয়াসের জাতি বা’আলের পূজা অর্চনা করতো। বা’আলের কাছেই প্রার্থনা করতো এবং তাকেই খোদা বলে ডাকতো। তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে বা’আলকে মাবুদ বানিয়ে নিয়েছিলো। আপনারা কি জানেন এই বা’আল কে?

 

‘বা’আল’ এর আভিধানিক অর্থ স্বামী বা পতি। প্রাচীনকালে সিরিয়া ও জর্ডান অঞ্চলে পূজনীয়, উপাস্য, প্রভু এবং দেবতা অর্থে এ শব্দটি ব্যবহার করা হতো। সেকালে লেবাননের ফিনিকি সম্প্রদায়ের লোকেরা তাঁদের সবচে’ বড় দেবতাটিকে বলতো বা’আল। এ ছিলো পুরুষ দেবতা। এ মূর্তিটির স্ত্রীর নাম ছিলো আশারাত। এ ছিল সবচে’ বড় দেবী। আবার কোন কোন সম্প্রদায় সূর্য পূজা করতো। তারা সূর্যকেই বা’আল বলতো। আর চন্দ্র অথবা শুক্রগ্রহ ছিল এদের আশারাত। ইতিহাস থেকে জানা যায় সেকালে বেবিলন থেকে নিয়ে মিশর পর্যন্ত গোটা মধ্যপ্রাচ্যে বা’আলের পূজা বিস্তার লাভ করে। বিশেষ করে লেবানন, সিরিয়া এবং ফিলিস্তিন অঞ্চলের মুশরিক জাতিগুলো বা’আলের পুজায় আপাদমস্তক ডুবে গিয়েছিলো। এবার আপনারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন বা’আল কে?

 

বনী ইসরাইলের বা’আল পূজা

 

হযরত মুসা (আঃ) এর পর বনী ইসরাইলদের মধ্যে বা’আল পুজার প্রবনতা শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত তারা বা’আল পুজায় চরম আসক্ত হয়ে পড়ে। জানা যায় তারা কোন একস্থানে বা’আলের যজ্ঞবেদী তৈরি করে নিয়েছিল এবং সেখানে তারা বা’আলের নামে বলিদান করতো। একবার একজন খাঁটি মুমিন এই বেদীটি ভেঙ্গে ফেলে। পরদিন লোকেরা সমাবেশ লরে তাঁর মৃত্যুদণ্ড দাবী করে। অবশেষে হযরত সামুয়েল, তালুত, দাউদ এবং সুলাইমান বনী ইসরাঈলকে মূর্তি পুজার কলুষতা থেকে মুক্ত করেন। তারা মধ্যপ্রাচ্যে বিরাট শক্তিশালী ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। সে রাষ্ট্র থেকে শিরক ও মূর্তি পূজা উচ্ছেদ করেন। কিন্তু সুলাইমান (আঃ) এর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র রহুবমের অযোজ্ঞতার কারনে বনী ইসরাইল রাজ্য ভেঙ্গে দু’ভাগ হয়ে যায়। একভাগে ছিল বাইতুল মাকদাস সহ দক্ষিন ফিলিস্তিন নিয়ে গঠিত ইহুদী রাষ্ট্র। আর উত্তর ফিলিস্তিনের নাম থাকে ইসরাইল রাষ্ট্র।

 

ইসরাইল রাষ্ট্রের লোকেরা আবার মূর্তি পুজায় নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। তারা শিরক, মূর্তিপূজা, ফাসেকী, চরিত্রহীনতা এবং যাবতীয় বদ আমলের মধ্যে নিমজ্জিত হয়। বা’আল কে তারা দেবতা বানিয়ে নেয়। তারা নবীদের বংশধর হয়েও আল্লাহকে বাদ দিয়ে বা’আলের উপাসনায় লিপ্ত হয়ে পড়ে।

 

মুক্তির বানী নিয়ে এলেন ইলিয়াস

 

বনী ইসরাইল শিরক ও চরম পাপাচারের কারনে ধ্বংসের মুখোমুখি এসে দাড়ায়। এ সময় মহান আল্লাহ ইলিয়াসকে নবুয়্যত দান করেন। বনি ইসরাইলকে সতর্ক করার নির্দেশ দেন। তাঁদেরকে মুক্তি এবং কল্যাণের পথে আসার আহবান জানাতে বলেন। ইলিয়াস শাসকবর্গ ও জনগনের সামনে হাজির হন। তাঁদের সতর্ক করতে বলেন। আল্লাহকে ভয় করতে বলেন। মূর্তিপূজা ও পাপাচার ত্যাগ করতে বলেন। বা’আলকে পরিত্যাগ করতে বলেন। তাঁদেরকে আল্লাহর বিধানের ভিত্তিতে জীবন যাপন করতে বলেন। তখন ইসরাইলের রাজা ছিলেন আখিয়াব। আখিয়াব লেবাননের (সেকালে লেবাননকে বলা হত সাঈদা) মুশরিক রাজ কন্যাকে বিয়ে করে নিজেও মুশ্রিক হয়ে পড়েন। হযরত ইলিয়াস আখিয়াবের কাছে এসে বলে দেন, তোমার পাপের কারনে এখন আর ইসরাইল রাজ্যে এক বিন্দু বৃষ্টিও হবেনা। শিশির এবং কুয়াশাও পড়বে না।

 

আল্লাহর নবীর উক্তি অক্ষরে অক্ষরে সত্য হলো। সাড়ে তিন বছর পর্যন্ত ইসরাইল রাষ্ট্রে বৃষ্টিপাত বন্ধ হয়ে থাকলো। এবার আখিয়াবের হুশ হলো। সে হযরত ইলিয়াসকে সন্ধান করে আনলো। অনুনয় বিনয় করে হযরত ইলিয়াসকে বৃষ্টির জন্যে দোয়া করতে বললো। হযরত ইলিয়াস এই সুযোগে বা’আলকে মিথ্যা প্রমান করে দেবার সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি আখিয়াবকে শর্ত দিলেন, একটি জনসমাবেশ ডাকতে হবে। সেখানে বা’আলের পূজারীরা বা’আলের নামে বলিদান করবে এবং আমি আল্লাহর নামে কুরবানী করবো। গায়েবী আগুন এসে যে পক্ষের কুরবানীকে জালিয়ে ভস্মীভূত করে দিয়ে যাবে সে পক্ষের মা’বুদকেই সত্য বলে মেনে নিতে হবে। আখিয়াব এ শর্ত মেনে নিলো, তারপর কি হলো? তারপর আখিয়াব সাধারন জনসমাবেশ ডাকলো। সেখানে সাড়ে আটশো বা’আল পূজারী একত্রিত হলো। কুরবানী হলো, বলিদান হলো। তারপর? অতপর আকাশ থেকে আগুন এসে হযরত ইলিয়াসের কুরবানীকে ভস্মীভূত করে দিয়ে গেলো। সমস্ত জনগনের সামনে বা’আল মিথ্যা খোদা বলে প্রমানিত হলো। জনগন বা’আল পূজারীদের হত্যা করলো। হযরত ইলিয়াস সেখানেই আল্লাহর কাছে বৃষ্টির জন্যে দোয়া করলেন। সাথে সাথেই আকাশে মেঘ করলো। প্রচুর বৃষ্টিপাত হলো। জনগন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।

 

নবীর উপর নির্যাতন

 

কিন্তু আখিয়াব ছিলো স্ত্রৈণ। স্ত্রৈণ মানে স্ত্রীর অনুগত। সে স্ত্রীর গোলামী থেকে মুক্ত হতে পারেনি। তাঁর মুশরিক স্ত্রী হযরত ইলিয়াসের ঘোরতর শত্রু হয়ে পড়ে। স্ত্রীর খপ্পরে পড়ে আখিয়াব আল্লাহর নবীর উপর নির্যাতন শুরু করে। তাঁর স্ত্রী ইসাবেলা ঘোষণা করে দেয়, বা’আল পূজারীদের যেভাবে হত্যা করা হয়েছে, ইলিয়াসকেও সেভাবে হত্যা করা হবে। তারা অত্যাচার নির্যাতনের দাপটে জনগনের মুখ বন্ধ করে দিলো। ইলিয়াস একাকী হয়ে পড়লেন। তিনি বাধ্য হয়ে দেশ থেকে হিজরত করেন এবং সিনাই পর্বতের পাদদেশে আশ্রয় নেন।

 

সংস্কার কাজ চালিয়ে যান

 

হযরত ইলিয়াস কয়েকবছর সিনাইর পাদদেশে অবস্থান করেন। এরি মধ্যে দক্ষিন ফিলিস্তিনের ইয়াহুদী শাসক ইয়াহুরাম ইসরাইল রাজ্যের শাসক আখিয়াবের মুশরিক কন্যাকে বিয়ে করেন।

 

তাঁর প্রভাবে ইহুদী রাজ্যেও ব্যাপক ভাবে মূর্তিপূজার প্রচলন শুরু হয়। ইলিয়াস এখানে আসেন। তাঁদের সতর্ক করেন। তাদের আল্লাহর পথ দেখান। মূর্তিপূজা পরিত্যাগ করতে বলেন। মর্মস্পর্শী অনেক উপদেশ দিয়ে রাজা ইয়াহুরামকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পত্রও প্রদান করেন। কিন্তু তারা শিরক, মূর্তিপূজা ও পাপাচার থেকে বেরিয়ে আসেনি। শেষ পর্যন্ত রাজা ধ্বংস হয়ে যায়।

 

কয়েকবছর পর ইলিয়াস আবার ইসরাইল রাষ্ট্রে ফিরে আসেন। আখিয়াব ও তাঁর পুত্র আখযিয়াকে সঠিক পথে আনার আপ্রান চেষ্টা চালান। কিন্তু তাঁরাও আল্লাহর পথে ফিরে আসেনি। অবশেষে হযরত ইলিয়াসের বদদোয়ায় আখিয়াব রাজ পরিবার ধ্বংস হয়ে যায়।

 

হযরত ইলিয়াসের সুখ্যাতি

 

জীবদ্দশায় হযরত ইলিয়াসের প্রতি চরম অত্যাচার নির্যাতন চালালেও তাঁর মৃত্যুর পর বনী ইসরাইল তাঁর ভক্ত অনুরক্ত হয়ে পড়ে। বাইবেল থেকে জানা যায়, বনি ইসরাইল ধারনা করতো, ইলিয়াসকে আল্লাহ তায়ালা উঠিয়ে নিয়ে গেছেন এবং তিনি আবার পৃথিবীতে আসবেন। তারা ইলিয়াসের আগমনের প্রতীক্ষায় ছিলো। তাঁর আটশো বছর পরে হযরত ঈসা (আঃ) এর জন্ম হয়। তিনি তাঁর সাথীদের বলে যান, ইলিয়া (ইলিয়াস) আটশো বছর আগে অতীত হয়ে গেছেন। তিনি আর পৃথিবীতে আসবেননা। যাই হোক, পরবর্তী লোকদের মাঝে হযরত ইলিয়াসের প্রচুর সুখ্যাতি ছরিয়ে পড়ে। সেকথাই মহান আল্লাহ কুরআনে এভাবে বর্ণনা করেছেন-

 

“ আর পরবর্তী প্রজন্মের মাঝে আমি ইলিয়াসের সুখ্যাতি ছড়িয়ে দিয়েছি। ” (সুরা আস সাফফাত, আয়াত ১২৯)

 

‘সালামুন আ’লা ইলিয়াসিন।’

 

২০।

 

আলইয়াসা (আঃ)

 

আল কুরআনে হযরত আলইয়াসা

 

“ইসমাঈল, আলইয়াসা, ইউনুস এবং লুত এদের প্রত্যেককেই আমি বিশ্ববাসীর উপর মর্যাদাবান করেছি।” (সূরা আল আনয়াম, আয়াত ৮৬)

 

“আর ইসমাঈল, আলইয়াসা যুলকিফলের কথা স্মরণ করো। এরা প্রত্যেকেই ছিলো মহোত্তম।’’ (সূরা সোয়াদ, আয়াত ৪৮)

 

আল কুরআনে হযরত আলইয়াসার নাম এই দুইটি স্থানেই উল্লেখ হয়েছে। মহান আল্লাহ তাঁকে তাঁর শ্রেষ্ঠ নবী রাসুলদের মাঝে গণ্য করেছেন। তিনি তাঁকে দিয়েছিলেন অনেক বড় মর্যাদা ও উচ্চাসন। তিনি ছিলেন বনী ইসরাইলের শ্রেষ্ঠ নবীগনের অন্যতম। ইহুদী খ্রিষ্টানদের কাছে তাঁদের গ্রন্থাবলীতে তিনি ইলিশা (Elisha) হিসেবে পরিচিত।

 

প্রশিক্ষন ও মনোনয়ন

 

আলইয়াসা ছিলেন হযরত ইলিয়াসের ছাত্র ও শিষ্য। হযরত ইলিয়াস তাঁকে উত্তম প্রশিক্ষন দিয়ে যোগ্য করে গড়ে তোলেন। কুরআন মাজীদে তাঁর সম্পর্কে বিস্তারিত কোন বিবরন নেই। বাইবেলে বলা হয়েছে, আল্লাহ ইলিয়াসকে নির্দেশ প্রদান করেন আলইয়াসাকে নিজের স্থলাভিষিক্ত হিসেবে যোগ্য করে গড়ে তুলতে। এ নির্দেশ অনুযায়ী ইলিয়াস হযরত আলইয়াসার বসবাসের এলাকায় গিয়ে পৌঁছান।

 

ইলিয়াস দেখতে পান, আলইয়াসা বার জোড়া গরু নিয়ে জমিতে চাষ দিচ্ছেন। তিনি তাঁর পাশ দিয়ে যাবার কালে নিজের চাদর তাঁর গায়ে নিক্ষেপ করেন। সাথে সাথে আলইয়াসা ক্ষেতখামার চাষবাস ছেড়ে দিয়ে তাঁর সাথে চলে আসেন। প্রায় দশ বারো বছর আলইয়াসা হযরত ইলিয়াসের প্রশিক্ষনাধীনে থাকেন। অতঃপর ইলিয়াসকে উঠিয়ে নেবার পর আল্লাহ আলইয়াসাকে নবুয়্যত দান করেন এবং তাঁর স্থলাভিষিক্ত করেন। কোন কোন ঐতিহাসিক বলেছেন, হযরত আলইয়াসা হযরত ইলিয়াসের চাচাত ভাই ছিলেন।

 

 

 

সংশোধনের কাজ

 

হযরত ইলিয়াসের মৃত্যুর পর হযরত আলইয়াসা বলিষ্ঠভাবে ইসরাইলী শাসক ও জনগণকে সংশোধনের পদক্ষেপ নেন। শিরক, মূর্তিপূজা ও আনাচারের মূল অভিভাবক ও পৃষ্ঠপোষক ছিলো স্বয়ং রাজ পরিবার। হযরত আলইয়াসা তাঁদের সতর্ক করে দেন। আল্লাহর ভয় দেখান। কিন্তু কিছুতেই তারা আল্লাহর পথে আসতে রাজি হয়নি।

 

শেষ পর্যন্ত হযরত আলইয়াসা জনৈক যিহুকে রাজ পরিবারের বিরুদ্ধে দাড় করিয়ে দিলেন। যিহু রাজ পরিবারকে হত্যা করে এবং বা’আলের পূজা নিষিদ্ধ করে দেয়। কিন্তু জনগনের মনমগজে মূর্তি পুজার কুসংস্কার বদ্ধমূল হয়ে থাকে। হযরত আলইয়াসার মৃত্যুর পর পুনরায় ইসরাইলী সমাজ শিরকের পুতিগন্ধময় গহবরে নিমজ্জিত হয়।

 

২১।

 

মাছওয়ালা নবী ইউনুস

 

(আঃ)

 

“আর ইউনুস ছিলো অবশ্যই রাসুলদেরই একজন।” (আল কুরান-৩৮ ; ১৩৯)

 

 হযরত ইউনুস বিন মাত্তা (আঃ)-এর কথা পবিত্র কুরআনের মোট ৬টি সূরার ১৮টি আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। সূরা ইউনুস ৯৮ আয়াতে তাঁর নাম ইউনুস, সূরা আম্বিয়া ৮৭ আয়াতে ‘যুন-নূন’ এবং সূরা ক্বলম ৪৮ আয়াতে তাঁকে ‘ছাহেবুল হূত’ বলা হয়েছে। ‘নূন’ ও ‘হূত’ উভয়ের অর্থ মাছ। যুন-নূন ও ছাহেবুল হূত অর্থ মাছওয়ালা। একটি বিশেষ ঘটনার প্রেক্ষিতে তিনি উক্ত নামে পরিচিত হন। সামনে তা বিবৃত হবে।

 

ইউনুস কোন দেশের নবী?

 

হযরত ইউনুস (আঃ) একজন সম্মানিত নবী ছিলেন। তাঁর ব্যাপারে সরাসরি কুরআনে বিস্তারিত আলোচনা হয়নি। হাদিস, তাফসির ও ইতিহাসের বিভিন্ন বর্ণনা থেকে জানা যায়, তিনি সিরিয়ার লোক ছিলেন এবং ইসরাইল বংশের লোক ছিলেন। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে আসিরিয়াবাসীদের হিদায়াতের জন্যে ইরাকে যেতে নির্দেশ দেন। সে হিসেবে তিনি ইরাকে গিয়ে আসিরিয়াবাসীকে আল্লাহর পথে আনবার চেষ্টা সংরামে লিপ্ত হন। ইউনুস (আঃ) বর্তমান ইরাকের মূছেল নগরীর নিকটবর্তী ‘নীনাওয়া’ (نينوى) জনপদের অধিবাসীদের প্রতি প্রেরিত হন। তিনি তাদেরকে তাওহীদের দাওয়াত দেন এবং ঈমান ও সৎকর্মের প্রতি আহবান জানান। কিন্তু তারা তাঁর প্রতি অবাধ্যতা প্রদর্শন করে। বারবার দাওয়াত দিয়ে প্রত্যাখ্যাত হ’লে আল্লাহর হুকুমে তিনি এলাকা ত্যাগ করে চলে যান। ইতিমধ্যে তার কওমের উপরে আযাব নাযিল হওয়ার পূর্বাভাস দেখা দিল। জনপদ ত্যাগ করার সময় তিনি বলে গিয়েছিলেন যে, তিনদিন পর সেখানে গযব নাযিল হ’তে পারে। তারা ভাবল, নবী কখনো মিথ্যা বলেন না। ফলে ইউনুসের কওম ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে দ্রুত কুফর ও শিরক হ’তে তওবা করে এবং জনপদের সকল আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা এবং গবাদিপশু সব নিয়ে জঙ্গলে পালিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে তারা বাচ্চাদের ও গবাদিপশু গুলিকে পৃথক করে দেয় এবং নিজেরা আল্লাহর দরবারে কায়মনোচিত্তে কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। তারা সর্বান্ত:করণে তওবা করে এবং আসন্ন গযব হ’তে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করে। ফলে আল্লাহ তাদের তওবা কবুল করেন এবং তাদের উপর থেকে আযাব উঠিয়ে নেন। এ বিষয়ে আল্লাহ বলেন,

 

 “অতএব কোন জনপদ কেন এমন হ’ল না যে, তারা এমন সময় ঈমান নিয়ে আসত, যখন ঈমান আনলে তাদের উপকারে আসত? কেবল ইউনুসের কওম ব্যতীত। যখন তারা ঈমান আনল, তখন আমরা তাদের উপর থেকে পার্থিব জীবনের অপমানজনক আযাব তুলে নিলাম এবং তাদেরকে নির্ধারিত সময় পর্যন্ত জীবনোপকরণ ভোগ করার অবকাশ দিলাম” (সূরা ইউনুস, আয়াত ৯৮)। অত্র আয়াতে ইউনুসের কওমের প্রশংসা করা হয়েছে।

 

ওদিকে ইউনুস (আঃ) ভেবেছিলেন যে, তাঁর কওম আল্লাহর গযবে ধ্বংস হয়ে গেছে। কিন্তু পরে যখন তিনি জানতে পারলেন যে, আদৌ গযব নাযিল হয়নি, তখন তিনি চিন্তায় পড়লেন যে, এখন তার কওম তাকে মিথ্যাবাদী ভাববে এবং মিথ্যাবাদীর শাস্তি হিসাবে প্রথা অনুযায়ী তাকে হত্যা করবে। তখন তিনি জনপদে ফিরে না গিয়ে অন্যত্র হিজরতের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লেন। এ সময় আল্লাহর হুকুমের অপেক্ষা করাটাই যুক্তিযুক্ত ছিল। কিন্তু তিনি তা করেননি।

 

মাছের পেটে ইউনুস

 

আল্লাহ বলেন,

 

 “আর ইউনুস ছিল পয়গম্বরগণের একজন”। “যখন সে পালিয়ে যাত্রী বোঝাই নৌকায় গিয়ে পৌঁছল”। “অতঃপর লটারীতে সে অকৃতকার্য হ’ল”। “অতঃপর একটি মাছ তাকে গিলে ফেলল। এমতাবস্থায় সে ছিল নিজেকে ধিক্কার দানকারী” (সূরা ছাফফাত, আয়াত ১৩৯-১৪২)।

 

আল্লাহর হুকুমের অপেক্ষা না করে নিজস্ব ইজতিহাদের ভিত্তিতে ইউনুস (আঃ) নিজ কওমকে ছেড়ে এই হিজরতে বেরিয়েছিলেন বলেই অত্র আয়াতে তাকে মনিবের নিকট থেকে পলায়নকারী বলা হয়েছে। যদিও বাহ্যত এটা কোন অপরাধ ছিল না। কিন্তু পয়গম্বর ও নৈকট্যশীলগণের মর্তবা অনেক ঊর্ধ্বে। তাই আল্লাহ তাদের ছোট-খাট ত্রুটির জন্যও পাকড়াও করেন। ফলে তিনি আল্লাহর পরীক্ষায় পতিত হন।

 

হিজরতকালে নদী পার হওয়ার সময় মাঝ নদীতে হঠাৎ নৌকা ডুবে যাবার উপক্রম হ’লে মাঝি বলল, একজনকে নদীতে ফেলে দিতে হবে। নইলে সবাইকে ডুবে মরতে হবে। এজন্য লটারী হ’লে পরপর তিনবার তাঁর নাম আসে। ফলে তিনি নদীতে নিক্ষিপ্ত হন। সাথে সাথে আল্লাহর হুকুমে বিরাটকায় এক মাছ এসে তাঁকে গিলে ফেলে। কিন্তু মাছের পেটে তিনি হযম হয়ে যাননি। বরং এটা ছিল তাঁর জন্য নিরাপদ কয়েদখানা (ইবনে কাছীর, আম্বিয়া ৮৭-৮৮)। মাওয়ার্দী বলেন, মাছের পেটে অবস্থান করাটা তাঁকে শাস্তি দানের উদ্দেশ্যে ছিল না। বরং আদব শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে ছিল। যেমন পিতা তার শিশু সন্তানকে শাসন করে শিক্ষা দিয়ে থাকেন’ (কুরতুবী, আম্বিয়া ৮৭)।

 

ইউনুস (আঃ) মাছের পেটে কত সময় বা কতদিন ছিলেন, সে বিষয়ে মতভেদ রয়েছে। যেমন- (১) এক ঘণ্টা ছিলেন (২) তিনি পূর্বাহ্নে প্রবেশ করে অপরাহ্নে বেরিয়ে আসেন (৩) ৩ দিন ছিলেন (৪) ৭ দিন ছিলেন (৫) ২০ দিন ছিলেন (৬) ৪০ দিন ছিলেন। আসলে এইসব মতভেদের কোন গুরুত্ব নেই। কেননা এসবের রচয়িতা হ’ল ইহুদী গল্পকারগণ। প্রকৃত ঘটনা আল্লাহ ভাল জানেন।

 

ইউনুস কেন মাছের পেটে গেলেন?

 

এ বিষয়ে জনৈক আধুনিক মুফাসসির বলেন, রিসালাতের দায়িত্ব পালনে ত্রুটি ঘটায় এবং সময়ের পূর্বেই এলাকা ত্যাগ করায় তাকে এই পরীক্ষায় পড়তে হয়েছিল। আর নবী চলে যাওয়ার কারণেই তার সম্প্রদায়কে আযাব দানে আল্লাহ সম্মত হননি’। অথচ পুরা দৃষ্টিকোণটাই ভুল। কেননা কোন নবী থেকেই তাঁর নবুঅতের দায়িত্ব পালনে ত্রুটির কল্পনা করা নবীগণের নিষ্পাপত্বের আক্বীদার ঘোর বিপরীত। বরং তিনদিন পর আযাব আসবে, আল্লাহর পক্ষ হ’তে এরূপ নির্দেশনা পেয়ে তাঁর হুকুমেই তিনি এলাকা ত্যাগ করেছিলেন। আর তার কওম থেকে আযাব উঠিয়ে নেওয়া হয়েছিল তাদের আন্তরিক তওবার কারণে, নবী চলে যাওয়ার কারণে নয়।

 

ইউনুস মুক্তি পেলেন

 

আল্লাহ বলেন,

 

 “অতঃপর যদি সে আল্লাহর গুণগানকারীদের অন্তর্ভুক্ত না হ’ত” (ছাফফাত, আয়াত ১৪৩)। ‘তাহ’লে সে ক্বিয়ামত দিবস পর্যন্ত মাছের পেটেই থাকত’?। ‘অতঃপর আমরা তাকে একটি বিজন প্রান্তরে নিক্ষেপ করলাম, তখন সে রুগ্ন ছিল’। ‘আমরা তার উপরে একটি লতা বিশিষ্ট বৃক্ষ উদ্গত করলাম’। ‘এবং তাকে লক্ষ বা তদোধিক লোকের দিকে প্রেরণ করলাম’। ‘তারা ঈমান আনল। ফলে আমরা তাদেরকে নির্ধারিত সময় পর্যন্ত জীবন উপভোগ করার সুযোগ দিলাম” (ছাফফাত, আয়াত ১৪৩-১৪৮)।

 

আলোচ্য আয়াতে ‘ক্বিয়ামত দিবস পর্যন্ত সে মাছের পেটেই থাকত’-এর অর্থ সে আর জীবিত বেরিয়ে আসতে পারতো না। বরং মাছের পেটেই তার কবর হ’ত এবং সেখান থেকেই ক্বিয়ামতের দিন তার পুনরুত্থান হ’ত।

 

অন্যত্র আল্লাহ তাঁর শেষনবীকে উদ্দেশ্য করে বলেন,

 

 “তুমি তোমার পালনকর্তার আদেশের অপেক্ষায় ধৈর্য ধারণ কর এবং মাছওয়ালার (ইউনুসের) মত হয়ো না। যখন সে দুঃখাকুল মনে প্রার্থনা করেছিল’। ‘যদি তার পালনকর্তার অনুগ্রহ তাকে সামাল না দিত, তাহ’লে সে নিন্দিত অবস্থায় জনশূন্য প্রান্তরে পড়ে থাকত’। ‘অতঃপর তার পালনকর্তা তাকে মনোনীত করলেন এবং তাকে সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত করে নিলেন’ (ক্বলম, আয়া ৪৮-৫০)।

 

‘যদি আল্লাহর অনুগ্রহ তাকে সামাল না দিত, তাহ’লে সে নিন্দিত অবস্থায় জনশূন্য প্রান্তরে পড়ে থাকত’-এর অর্থ আল্লাহ যদি তাকে তওবা করার তাওফীক্ব না দিতেন এবং তার দো‘আ কবুল না করতেন, তাহ’লে তাকে জীবিত অবস্থায় নদী তীরে মাটির উপর ফেলতেন না। যেখানে গাছের পাতা খেয়ে তিনি পুষ্টি ও শক্তি লাভ করেন। বরং তাকে মৃত অবস্থায় নদীর কোন বালুচরে ফেলে রাখা হ’ত, যা তার জন্য লজ্জাষ্কর হ’ত।

 

‘অতঃপর তার পালনকর্তা তাকে মনোনীত করলেন’ অর্থ এটা নয় যে, ইতিপূর্বে আল্লাহ ইউনুসকে মনোনীত করেননি; বরং এটা হ’ল বর্ণনার আগপিছ মাত্র। কুরআনের বহু স্থানে এরূপ রয়েছে। এখানে এর ব্যাখ্যা এই যে, ইউনুস মাছের পেটে গিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করায় আল্লাহ তাকে পুনরায় কাছে টানলেন ও সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত করলেন।

 

অন্যত্র ইউনুসের ক্রুদ্ধ হয়ে নিজ জনপদ ছেড়ে চলে আসা, মাছের পেটে বন্দী হওয়া এবং ঐ অবস্থায় আল্লাহর নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা করা সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,

 

 “এবং মাছওয়ালা (ইউনুস)-এর কথা স্মরণ কর, যখন সে (আল্লাহর অবাধ্যতার কারণে লোকদের উপর) ক্রুদ্ধ হয়ে চলে গিয়েছিল এবং বিশ্বাসী ছিল যে, আমরা তার উপরে কোনরূপ কষ্ট দানের সিদ্ধান্ত নেব না’। ‘অতঃপর সে (মাছের পেটে) ঘন অন্ধকারের মধ্যে আহবান করল (হে আল্লাহ!) তুমি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। তুমি পবিত্র। আমি সীমা লংঘনকারীদের অন্তর্ভুক্ত’। ‘অতঃপর আমরা তার আহবানে সাড়া দিলাম এবং তাকে দুশ্চিন্তা হ’তে মুক্ত করলাম। আর এভাবেই আমরা বিশ্বাসীদের মুক্তি দিয়ে থাকি” (সূরা আম্বিয়া, আয়াত ৮৭-৮৮)।

 

ইউনুস (আঃ)-এর উক্ত দো‘আ ‘দো‘আয়ে ইউনুস’ নামে পরিচিত। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,

 

 ‘‘বিপদগ্রস্ত কোন মুসলমান যদি (নেক মকছূদ হাছিলের নিমিত্তে) উক্ত দো‘আ পাঠ করে, তবে আল্লাহ তা কবুল করেন’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,

 

 ‘’তোমরা আল্লাহর নবীগণের মধ্যে মর্যাদার তারতম্য করো না। আর কোন বান্দার জন্য এটা বলা উচিত নয় যে, আমি ইউনুস বিন মাত্তার চাইতে উত্তম’’। কুরতুবী এর ব্যাখ্যায় বলেন, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) এটা এজন্য বলেছেন যে, তিনি যেমন (মি‘রাজে) সিদরাতুল মুনতাহায় আল্লাহর নিকটবর্তী হয়েছিলেন, নদীর অন্ধকার গর্ভে মাছের পেটের মধ্যে তেমনি আল্লাহ ইউনুস-এর নিকটবর্তী হয়েছিলেন (কুরতুবী, আম্বিয়া ৮৭)। বস্ত্ততঃ এটা ছিল রাসূলের নিরহংকার স্বভাব ও বিনয়ের বহিঃপ্রকাশ মাত্র।

 

উপরোক্ত আয়াত সমূহে প্রতীয়মান হয় যে, ইউনুস (আঃ) মাছের পেটে থাকার পরে আল্লাহর হুকুমে নদীতীরে নিক্ষিপ্ত হন। মাছের পেটে থাকার ফলে স্বাভাবিকভাবেই তিনি রুগ্ন ছিলেন। ঐ অবস্থায় সেখানে উদ্গত লাউ জাতীয় গাছের পাতা তিনি খেয়েছিলেন, যা পুষ্টিসমৃদ্ধ ছিল। অতঃপর সুস্থ হয়ে তিনি আল্লাহর হুকুমে নিজ কওমের নিকটে চলে যান। যাদের সংখ্যা এক লক্ষ বা তার বেশী ছিল। তারা তাঁর উপরে ঈমান আনলো। ফলে পুনরায় শিরকী কর্মকান্ডে লিপ্ত না হওয়া পর্যন্ত আল্লাহ তাদেরকে অনুগ্রহ করেন এবং দুনিয়া ভোগ করার সুযোগ দেন।

 

শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ

 

(১) বিভ্রান্ত কওমের দুর্ব্যবহারে অতিষ্ট হয়ে তাদেরকে ছেড়ে চলে যাওয়া কোন সমাজ সংস্কারকের উচিত নয়।

 

(২) আল্লাহ তার নেক বান্দার উপর শাস্তি আরোপ করবেন না, যেকোন সংকটে এরূপ দৃঢ় বিশ্বাস রাখতে হবে।

 

(৩) আল্লাহর পরীক্ষা কিরূপ হবে, তা পরীক্ষা আগমনের এক সেকেন্ড পূর্বেও জানা যাবে না।

 

(৪) কঠিনতম কষ্টের মুহূর্তে কেবলমাত্র আল্লাহর কাছেই সাহায্য চাইতে হবে।

 

(৫) খালেছ তওবা ও আকুল প্রার্থনার ফলে অনেক সময় আল্লাহ গযব উঠিয়ে নিয়ে থাকেন। যেমন ইউনুসের কওমের উপর থেকে আল্লাহ গযব ফিরিয়ে নিয়েছিলেন।

 

(৬) আল্লাহ ইচ্ছা করলে যেকোন পরিবেশে ঈমানদারকে রক্ষা করে থাকেন।

 

(৭) পশু-পক্ষী, বৃক্ষ-লতা ও জলচর প্রাণী সবাই আল্লাহর হুকুমে ঈমানদার ব্যক্তির সেবায় নিয়োজিত হয়। যেমন মাছ ও লতা জাতীয় গাছ ইউনুসের সেবায় নিযুক্ত হয়েছিল।

 

(৮) বাহ্যদৃষ্টিতে কোন বস্ত্ত খারাব মনে হ’লেও নেককার ব্যক্তির জন্য আল্লাহ উত্তম ফায়ছালা করে থাকেন। যেমন লটারীতে নদীতে নিক্ষেপের সিদ্ধান্ত নিজের জন্য অতীব খারাব মনে হ’লেও আল্লাহ ইউনুসের জন্য উত্তম ফায়ছালা দান করেন ও তাকে মুক্ত করেন।

 

(৯) আল্লাহর প্রতি আনুগত্য ব্যতীত দো‘আ কবুল হয় না। যেমন গভীর সংকটে নিপতিত হবার আগে ও পরে ইউনুস আল্লাহর প্রতি আনুগত্যশীল ছিলেন। ফলে আল্লাহ তার দো‘আ কবুল করেন।

 

১০) আল্লাহর প্রতিটি কর্ম তার নেককার বান্দার জন্য কল্যাণকর হয়ে থাকে। যা বান্দা সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে না পারলেও পরে বুঝতে পারে। যেমন ইউনুস পরে বুঝতে পেরে আল্লাহর প্রতি অধিক অনুগত হন এবং এজন্য তিনি আল্লাহর প্রতি অধিক প্রত্যাবর্তনশীল বলে আল্লাহর প্রশংসা পান।

 

কুরআনে উল্লেখ

 

কুরআন মাজীদে হযরত ইউনুস (আঃ) এর নাম উল্লেখ হয়েছে ৬ বার। এর মধ্যে চার বার ইউনুস আর দুইবার মাছওয়ালা বলে উল্লেখ হয়েছে। কোথায় কোথায় উল্লেখ হয়েছে জেনে নিন ; সূরা আন নিসা ১৬৩। আল আনয়াম ৮৬। ইউনুস ৯৮। আস সাফফাত ১৩৯। আল আম্বিয়া ৮৭। আল কলম ৪৮।

 

২২।

 

যাকারিয়া

 

(আঃ)

 

শ্রেষ্ঠ রাসুলদের একজন

 

হযরত যাকারিয়ার নাম আপনারা নিশ্চয়ই শুনেছেন। তিনি ছিলেন শ্রেষ্ঠ রাসুলদের একজন। মহান আল্লাহ গোটা বিশ্ববাসীর উপর যাদের সম্মানিত করেছেন, তিনি তাঁদেরই অন্যতম। তাছাড়া তিনি সেইসব নবী রাসুলদেরও একজন, মানুষকে সত্য পথে আসার আহবান করার কারনে যাদেরকে আল্লাহর দুশমনরা যাদের হত্যা করেছিলো। তাই তিনি একজন শহীদ নবী। তিনি ছিলেন বনী ইসরাইলের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাসুল। হযরত ইবরাহীম ও ইয়াকুবের বংশধর তিনি। শুনুন আল্লাহর বানী –

 

“আর আমি ইব্রাহীমকে ইসহাক ও ইয়াকুবের মতো সন্তান দিয়েছি। তাঁদের প্রত্যেককে আমি সঠিক পথ দেখিয়েছি, যা দেখিয়েছিলাম ইতোপূর্বে নুহকে। একই পথ দেখিয়েছি আমি তাঁদের বংশধরদের মধ্যে দাউদ, সুলাইমান, আইয়ুব, ইউসুফ, মুসা, হারুণকে। মুহসিন লোকদের আমি এভাবেই প্রতিদান দিয়ে থাকি। আমি একই পথ দেখিয়েছি যাকারিয়া, ইয়াহিয়া, ইলিয়াস ও ঈসা কে। এরা সবাই ছিলো সংস্কারক। সেই পথই দেখিয়েছি আমি ইসমাঈল, আলইয়াসা, ইউনুস ও লুতকে। এদের প্রত্যেককেই আমি বিশ্ববাসীর উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি।” (সূরা আল আনয়াম ৮৪-৮৬)

 

দীনি নেতৃত্ব

 

বনি ইসরাইলের দীনি কার্যক্রমের কেন্দ্র ছিল বাইতুল মাকদাস। বনি ইসরাইলের মধ্যে হযরত হারুন (আঃ) এর বংশধর একটি গোত্রের উপর দায়িত্ব ছিল বাইতুল মাকদাসের রক্ষনাবেক্ষনের। হযরত যাকারিয়া (আঃ) ছিলেন এ গোত্রের প্রধান। গোত্রীয় প্রধান হিসেবে তিনিই ছিলেন এই মহান দীনি কেন্দ্রের পরিচালক ও তত্ত্বাবধায়ক। তাকেই লরতে হত এই ঘরের সেবা ও পরিচর্যা। দীনের দাওয়াত ও শিক্ষা প্রচার এবং সৎকাজের আদেশ এবং অন্যায় অসৎ কাজ থেকে বারন ও বাধা দানই ছিলো তাঁর দীনি মিশনের মূল কাজ। তিনি ছিলেন আল্লাহর অনুগত দাস এবং সত্য সততা ও আদর্শের মূর্ত প্রতীক।

 

একটি ছেলে দাও আল্লাহ

 

কিন্তু হযরত যাকারিয়া এই দীনি নেতৃত্বের উত্তরাধিকারী নিয়ে ছিলেন খুবই চিন্তিত। তাঁর বংশে এমন কোন যোগ্য লোক ছিলো না তাঁর মৃত্যুর পর যে এই মহান দীনি দায়িত্ব পালন করতে পারতো। তিনি ছিলেন নিঃসন্তান। তাই পরবর্তী দায়িত্বের ব্যাপারে তিনি সব সময়ই ছিলেন চিন্তিত। এখন তাঁর বয়েস প্রায় একশো বছর। চিন্তা তাঁর বেড়েই চললো। হঠাৎ ঘটে গেলো একটি ঘটনা। ঘতনাতির আছে একটি পূর্ব কথা, শুনুন তবে সে কথাটি –

 

হযরত ঈসা (আঃ) এর নানী আল্লাহর কাছে মানত করলেন, হে আল্লাহ, আমার এখন যে সন্তানটি হবে, আমি ওকে তোমার জন্যে নজরানা দিলাম। ও তোমার জন্যে উৎসর্গিত হবে। তুমি এই নজরানা কবুল করে নাও। তিনি আশা করেছিলেন তাঁর একটি ছেলে হবে এবং তিনি ওকে বাইতুল মাকদাসে দীনের কাজের জন্যে বিশেষভাবে নিয়োগ করবেন। কিন্তু মানুষ যা চায় তা হয় না। আল্লাহ যা চান তাই হয়। কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর একটি মেয়ে হলো। তিনি মেয়েটির নাম রাখলেন মরিয়ম। মরিয়ম প্রাপ্ত বয়স্ক হলে মানত অনুযায়ী ওকে তিনি পৌঁছে দিলেন বাইতুল মাকদাসে। এখন প্রশ্ন দেখা দিলো, সেখানে ওর দেখাশুনার দায়িত্ব পালন করবে কে? মরিয়মকে দেখাশুনার দায়িত্ব পালন করতে এগিয়ে এলেন অনেকে। এ দায়িত্ব পালনের জন্যে এগিয়ে এলেন হযরত যাকারিয়া। আরো এগিয়ে এলেন অন্যান্য গোত্রের ধর্মীয় নেতারা। তারা সবাই দাবী করলেন এ মহৎ সেবা প্রদানের। নিজের দাবী ত্যাগ করছেননা কেউই। ফলে অনুষ্ঠিত হলো কোরা (লটারি)। লটারিতে কার নাম উঠেছে জানেন? যাকারিয়া, হ্যাঁ, হযরত যাকারিয়ার নাম। তিনি দেখাশুনা শুরু করতে লাগলেন মরিয়মকে, এদিকে তিনি মরিয়মের খালু হন। হযরত যাকারিয়ার স্ত্রী এবং মরিয়মের মা সহোদর বন। ফলে মরিয়মের সেবা ও আদর যত্ন হতে লাগলো সুন্দর ও নিখুঁতভাবে। মরিয়ম ই’তেকাফ ও ইবাদাত বন্দেগীর মাধ্যমে নিজের আত্মার অনেক উন্নতি সাধন করেছেন। একদিনের ঘটনা। হযরত যাকারিয়া বাইতুল মাকদাসের সেই নির্দিষ্ট ঘরে দেখতে এলেন মরিয়মকে। কক্ষে ঢুকেই তিনি অবাক। দেখলেন মরিয়মের সামনে সাজানো রয়েছে অনেক সুস্বাদু ফল। এইসব ফল এই মওসুমের ফল নয়। জেরুজালেমে তো এখন এই ফল পাওয়া যায়না। বিস্মিত হয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, মরিয়ম এ ফল তুমি কোথায় পেলে?

 

মরিয়ম – আল্লাহ পাঠিয়েছেন।

 

এ জবাব শুনে হযরত যাকারিয়ার অন্তরে আশার উদয় হলো। তিনি ভাবলেন, যে আল্লাহ মরিয়মকে বেমওসুমের ফল দিতে পারেন, তিনি ইচ্ছে করলে তো আমাকেও বড়ো বয়েসে ছেলে দিতে পারেন। তিনি দু’হাত উঠালেন আল্লাহর দরবারে। একটি ছেলে চাইলেন আল্লাহর দরবারে। তাঁর সেই দোয়া কুরআনে উল্লেখ হয়েছে এভাবে –

 

“প্রভু, তোমার বিশেষ ক্ষমতা বলে আমাকে একটি সৎ সন্তান দান করো। তুমি তো অবশ্যি দোয়া স্রবণকারী। ” (সূরা আলে ইমরান, আয়াত ৩৭-৩৮)

 

“যাকারিয়া চুপে চুপে তাঁর প্রভুকে ডাকলো। সে বললো – প্রভু, আমার হাড়গুলো পর্যন্ত নরম হয়ে গেছে। মাথা বার্ধক্যে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে প্রভু। তোমার কাছে কিছু চেয়ে আমি কখনোই ব্যর্থ হইনি। আমি আমার পড়ে নিজের যোগ্য উত্তরাধিকারী না থাকার আশংকা করছি। এদিকে আমার স্ত্রী হলো বন্ধ্যা। তাই তুমি তোমার বিশেষ অনুগ্রহে আমাকে একজন উত্তরাধিকারী দান করো। যে হবে আমার ও ইয়াকুবের বংশের উত্তরাধিকারী। আর হে প্রভে, তুমি ওকে তোমার পছন্দনীয় মানুষ বানিয়ো।” (সূরা মরিয়ম, আয়াত ২-৬)

 

“আর যাকারিয়ার কথা স্মরণ করো। যখন সে তাঁর প্রভুকে ডেকে বলেছিল, প্রভু, আমাকে একাকী ছেড়ে দিও না আর সর্বোত্তম উত্তরাধিকারী তো তুমিই।” (সূরা আল আম্বিয়া, আয়াত ৮৯)

 

আল্লাহ সর্বশক্তিমান। তিনি যা চান তাই করেন। তিনি কিছু করতে চাইলে বলেন, ‘হও’ আর সাথে সাথে তা হয়ে যায়। তিনি তাঁর দাস ও রাসুল যাকারিয়ার দোয়া কবুল করলেন। তিনি বৃদ্ধ পিতা আর বন্ধ্যা মায়ের ঘরে সন্তান দান করলেন। একটি সুপুত্র। নাম তাঁর ইয়াহিয়া। তিনি হযরত যাকারিয়ার শুধু একটি সুপুত্রই ছিলেন না, সেই সাথে আল্লাহ তাঁকে রিসালাতও দান করেন।”

 

হত্যা করা হলো তাঁকে

 

এ যাবত পরার পর আপনারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন হযরত যাকারিয়া কোন সময়কার নবী? হ্যাঁ, তিনি হযরত ঈসা (আঃ) এর লাগভাগ পূর্বেকার নবী। তাঁর বয়েসের শেষ আর হযরত ঈসা (আঃ) এর আগমন প্রায় একই সময়। আর এসময়টা ছিল এখন থেকে মাত্র দুই হাজার বছর পূর্বে। এসময় ফিলিস্তিনের ইহুদীরা প্রকাশ্যে যিনা, ব্যাভিচার ও অশ্লীল কাজ করতো। যে দু চারজন ভালো মানুষ ছিলেন তারা ছিলেন নির্যাতিত। পাপ ও পাপিষ্ঠদের সমালোচনা করলে জীবনের নিরাপত্তা ছিলো না।

 

কিন্তু হযরত যাকারিয়া ছিলেন তো আল্লাহর নবী। মানুষকে অন্যায় অপ্রাধের কাজ থেকে সঠিক পথে আনার চেষ্টা করাই নবীর কাজ। নবী ও নবীর সত্যিকারের অনুসারী ঈমানদারেরা কখনো অত্যাচার ও নির্যাতনকে ভয় পান না। তাঁরা যে কোন পরিস্থিতিতে মানুষকে বিরত রাখার এবং সঠিক পথে ডাকার কাজ করে যান।

 

হযরত যাকারিয়া বনী ইসরাইলকে মন্দো কাজ করতে নিষেধ করেন। পাপের পথে বাধা সৃষ্টি করেন এবং তাঁদেরকে আল্লাহর পথে তথা সত্য ও ন্যায়ের পথে আসার আহবান জানাতে থাকেন। তাঁর ভালো কাজের আদেশ আর মন্দ কাজের বাধাদানকে পাপিষ্ঠ শাসক আর সমাজের অপরাধী নেতারা বরদাশত করতে পারেনি। তারা হযরত যাকারিয়াকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়। শেষ পর্যন্ত অন্যায়ের প্রতিবাদে সোচ্চার হওয়ার কারনে ইহুদী রাষ্ট্রের রাজা ইউআসের নির্দেশে আল্লাহর নবী হযরত যাকারিয়াকে ইহুদীরা হাইকালে সুলাইমানিতে পাথর মেরে হত্যা করে। এভাবে বনী ইসরাইল হত্যা করেছে বহু নবীকে। তাঁদের এইসব জঘন্য হত্যাকাণ্ডের কথা উল্লেখ করে আল কুরআনে মহান আল্লাহ বনী ইসরাইলকে লক্ষ্য করে বলেন –

 

“যখনই তোমাদের প্রবৃত্তির কামনার বিপরীত কোন জিনিস নিয়ে আমার কোন রাসুল তোমাদের কাছে এসেছে, তখনই তোমরা তাঁর বিরুদ্ধাচারন করেছো, কাউকেও মিথ্যা বলেছো আর কাউকেও হত্যা করেছো।” (সূরা আল বাকারা, আয়াত ৮৭)

 

কোন কোন বর্ণনা থেকে জানা যায়, ইহুদীরা হযরত যাকারিয়াকে করাত দিয়ে দ্বিখণ্ডিত করে ফেলেছিল।

 

আল কুরআনে হযরত যাকারিয়া

 

আল কুরআনে হযরত যাকারিয়াকে অতি উচ্চ মর্যাদার নবী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কুরআন মাজীদে তাঁর নাম উল্লেখ হয়েছে সাতবার। যেসব সূরা ও আয়াতে উল্লেখ হয়েছে সেগুলো নিম্নরূপ –

 

সূরা আলে ইমরানে ৩৭ নং আয়াতে দুইবার। একই সূরা আয়াত ৩৮। সূরা আল আনয়াম, আয়াত ৮৫। সূরা মরিয়ম, আয়াত ২ ও ৭। সূরা আল আম্বিয়া, আয়াত ৮৯।

 

হযরত যাকারিয়া (আঃ) সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্যে পড়ুন- সূরা আলে ইমরানে ৩৫-৪১ আয়াত। সূরা মরিয়ম ১-১৫ আয়াত। সূরা আল আম্বিয়া, আয়াত ৮৯-৯০।

 

কি শিক্ষা পেলাম?

 

আল কুরাআনের আলোকে আমরা হযরত যাকারিয়ার জীবনী থেকে কয়েকটি বড় বড় শিক্ষা লাভ করতে পারি। সেগুলো হলো –

 

১। পুত পবিত্র জীবন যাপন।

 

২। আল্লাহর প্রতি আনুগত্য ও বিনয়।

 

৩। যা কিছু চাওয়ার কেবল আল্লাহর কাছেই চাইতে হবে।

 

৪। আল্লাহকে সর্বশক্তিমান জানতে হবে।

 

৫। আল্লাহর কাছে সৎ ও নেক্কার সন্তান প্রার্থনা করতে হবে।

 

৬। মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকতে হবে।

 

৭। মন্দ কাজে প্রতিবাদ করতে হবে এবং বাধা দিতে হবে।

 

৮। ধৈর্য ও দ্রঢ়তার সাথে আল্লাহর পথে অটল থাকতে হবে।

 

৯। প্রয়োজনে আল্লাহর পথে শহীদ হবার জন্যে প্রস্তুত থাকতে হবে।

 

 

 

২৩

 

শহীদ ইয়াহইয়া (আঃ)

 

তাঁর জন্ম আল্লাহর একটি নিদর্শন

 

আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সমস্ত ক্ষমতার উৎস ও মালিক। এই পৃথিবীর সব তাঁর সৃষ্ট প্রাকৃতিক নিয়মে চলে। সব কিছুই তাঁর বেধে দেয়া নিয়ম ও বিধানের অধীন। কোনো কিছুতে তাঁর বেধে দেয়া নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটলে তা হয়ে যায় ধ্বংস। তাঁর বেধে দেয়া সুনির্দিষ্ট নিয়মেই জন্ম হয় সব মানুষের। নিয়ম যেহেতু তিনিই তৈরি করেছেন, তাই নিয়মের ব্যতিক্রম কিছু করলে তিনিই করতে পারেন, আর কেউ নয়। কখনো কখনো তিনি মানুষ সৃষ্টির ক্ষেত্রে নিয়মের ব্যতিক্রম কিছু করেছেন। বাবা মা ছাড়াই সৃষ্টি করেছেন আদম ও হাওয়াকে। বাবা ছাড়া শুধু মা থেকেই সৃষ্টি করেছেন হযরত ঈসা (আঃ) কে। আবার প্রায় শতায়ু বৃদ্ধ পিতা ইবরাহীম এবং অনুরুপ বৃদ্ধা-বন্ধ্যা মাতা হযরত সারাহকে দান করেছেন পুত্র ইসহাককে। এই একইরকম ঘটনা ঘটেছে হযরত ইয়াহিয়ার ক্ষেত্রে। প্রায় শতায়ু বৃদ্ধ পিতা হযরত যাকারিয়া এবং অনুরুপ বৃদ্ধা-বন্ধ্যা মাতার ঘরে জন্ম নিয়েছেন হযরত ইয়াহিয়া (আঃ)।

 

আপনারা হয়তো যাকারিয়ার জীবনীতে দেখেছেন, তাঁর কোন সন্তান ছিল না। বৃদ্ধ বয়সে বন্ধ্যা স্ত্রীর ঘরে তিনি আল্লাহর কাছে আল্লাহর পছন্দনীয় সন্তান প্রার্থনা করেন। মহান আল্লাহ তাঁর দোয়া কিবুল করে বলেন, তুমি সন্তান পাবে। আল্লাহ তাঁকে সুসুংবাদ দেন এভাবে –

 

“যাকারিয়া যখন মেহরাবে দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করতেছিলো তখন ফেরেস্তারা তাঁকে ডেকে বললো – আল্লাহ আপনাকে ইয়াহিয়ার সুসংবাদ দিচ্ছেন। সে (অর্থাৎ ঈসা আঃ) আল্লাহর একটি হুকুমকে সত্যায়িত করবে। সে হবে একজন নেতা, সততার প্রতীক এবং একজন সংস্কারক নবী।” (সূরা আলে ইমরান, আয়াত ৩৯)

 

সূরা মরিয়মে বলা হয়েছে – “হে যাকারিয়া, তোমার প্রার্থনার প্রেক্ষিতে আমি তোমাকে একটি পুত্রের সুসংবাদ দিচ্ছি। তাঁর নাম হবে ইয়াহিয়া। এ নামে কোন লোক আমি এর আগে সৃষ্টি করিনি।” (সূরা মরিয়ম, আয়াত ৭)

 

সূরা আল আম্বিয়াতে বলা হয়েছে –

 

“আমি তাঁর দোয়া কবুল করেছি আর তাঁকে ইয়াহিয়াকে দান করেছি আর এজন্যে তাঁর স্ত্রীকে যোগ্য করে দিয়েছিলাম গর্ভ ধারন করার জন্যে। কারন তারা কল্যাণের কাজে আপ্রান চেষ্টা করতো, ভয় আর আশা নিয়ে আমাকে ডাকতো এবং আমার প্রতি ছিলো তারা অবনত। ” (সূরা আল আম্বিয়া, আয়াত ৯০)

 

এভাবেই মহান আল্লাহ তাঁর বিশেষ কুদরতে বৃদ্ধ পিতা মাতার ঘরে জন্মের ব্যবস্থা করেন হযরত ইয়াহিয়ার। আল কুরআন থেকে আমরা একথাও জানতে পারলাম যে, ইয়াহিয়া নামটি সরাসরি আল্লাহর দেয়া নাম। মহান আল্লাহই পিতা যাকারিয়াকে নির্দেশ দিয়েছেন তাঁর পুত্রের নাম যেন ইয়াহিয়া রাখা হয়।

 

ইয়াহিয়া ও ঈসা

 

হযরত ইয়াহিয়া (আঃ) হযরত ঈসা (আঃ) এর তিন বা ছয় মাসের বড়। তারা ছিলেন নিকটাত্মীয় এবং পরস্পরের বন্ধু। তারা একজন আরেকজনকে ভাই বলে সম্বোধন করতেন। বয়স ত্রিশ বছর হবার পূর্বেই আল্লাহ তায়ালা হযরত ইয়াহিয়া (আঃ) কে নবুয়্যত দান করেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত জ্ঞানী, সত্তপন্থী, আল্লাহভীরু এবং পবিত্র জীবনের অধিকারী। হযরত ইয়াহিয়া (আঃ) ছিলেন হযরত ঈসা (আঃ) এর সত্যায়নকারী। হযরত ঈসা ছিলেন আল্লাহর বিশেষ নির্দেশ (কালেমা)। আল্লাহর নির্দেশে পিতা ছাড়াই তাঁর জন্ম হয়। লোকেরা তাঁর ব্যাপারে বিভিন্ন মোট প্রকাশ করতে থাকে। হযরত ইয়াহিয়া আল্লাহর পক্ষ থেকে ঈসার বিষয়ে সত্য তথ্য প্রকাশ করেন। তিনি ঘোষণা করেন আল্লাহর নির্দেশে বিনা বাপেই ঈসার জন্ম হয়েছে। তিনি আল্লাহর দাস ও রাসুল। আপনারা ঈসাকে আল্লাহর রাসুল হিসেবে গ্রহন করুন এবং তাঁর আনুগত্য করুন।

 

পাঁচটি কাজের নির্দেশ

 

হযরত ইয়াহিয়া ছোট বেলা থেকেই সব সময় আল্লাহর ভয়ে আল্লাহর ইবাদাতে মশগুল থাকতেন। আল্লাহর প্রতি বিনয়, আনুগত্য ও ইবাদাতের মাধ্যমে নিজের আত্মাকে অনেক উন্নত করেন। এরি মধ্যে আল্লাহ তায়ালা তাঁকে নির্দেশ দেন-

 

“হে ইয়াহিয়া, আল্লাহর কিতাবকে মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরো। ” (সূরা মরিয়ম, আয়াত ১২)

 

এখানে আল্লাহর কিতাব বলতে তাওরাতকে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা হযরত ইয়াহিয়াকে তাওরাতের বিধান কায়েম করতে এবং মানুষকে এ কিতাবের বিধান মতো জীবন যাপন করবার আহবান জানাতে নির্দেশ দেন।

 

তিরমিযি, ইবনে মাযাহ ও মুসনাদে আহমাদে হারেস আশয়ারী থেকে বর্ণিত একটি হাদিস থেকে জানা যায়, আল্লাহ তায়ালা হযরত ইয়াহিয়াকে হুকুম দিয়েছিলেন মানুষকে বিশেষভাবে পাঁচটি কাজের নির্দেশ দিতে। এ হাদিসে আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (সঃ) বলেন –

 

“আল্লাহ তায়ালা ইয়াহিয়া ইবনে যাকারিয়াকে বিশেষভাবে পাঁচটি কাজের নির্দেশনা দিয়েছিলেন। এই পাঁচটি কাজ যেন তিনি নিজে করেন এবং বনী ইসরাইলকে করবার নির্দেশ দেন। কোন কারনে বনী ইসরাইলকে এই পাঁচটি কাজের নির্দেশ দিতে তাঁর বিলম্ব হয়। ফলে হযরত ঈসা তাঁকে বললেন – আল্লাহ পাক আপনাকে পাঁচটি কাজ করতে এবং বনী ইসরাইলকে করবার জন্যে নির্দেশ দিতে বলেছেন। সে নির্দেশ কি আপনি তাঁদের পৌছাবেন না আমি পৌছাবো? ইয়াহিয়া বললেন- হে ভাই, আমার আশংকা হয়, আপনি যদি আমার আগে পৌঁছান তাহলে আল্লাহ আমাকে শাস্তি দেবেন বা জমিনের নীচে ধসিয়ে দেবেন।

 

অতপর তিনি বনী ইসরাইলকে বাইতুল মাকদাসে সমবেত করলেন। মানুষে মসজিদ পূর্ণ হয়ে গেলো। তখন তিনি মসজিদের মিম্বরে উঠলেন। আল্লাহর প্রশংসা ও গুনাবলী করলেন এবং বললেন – হে জনগন, আল্লাহ আমাকে পাঁচটি কাজের নির্দেশ দিয়েছেন যেনো আমি নিজে সেগুলো পালন করি এবং তোমাদেরকেও সেগুলো পালন করতে নির্দেশ দিয়েছেন। শুনো সেগুলো হলো –

 

১। তোমরা শুধুমাত্র আল্লাহর আনুগত্য এবং দাসত্ব করবে। তাঁর সাথে কাউকেও শরীক করবেনা।

 

২। তোমাদের তিনি নির্দেশ দিয়েছেন সালাত কায়েম করতে।

 

৩। তিনি নির্দেশ দিয়েছেন সিয়াম পালন করতে।

 

৪। তিনি তোমাদের নির্দেশ দিয়েছেন দান করতে।

 

৫। তিনি তোমাদের আরো নির্দেশ দিয়েছেন তাঁর স্মরণে তোমাদের জবানকে সিক্ত রাখতে। (এতোটুকু বলার পরে আমাদের প্রিয় নবী সাহাবীদের উদ্দেশ্যে বলেন) আমিও তোমাদের পাঁচটি কাজের নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছি। এই পাঁচটি কাজের নির্দেশ আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন। সেগুলো হলো –

 

১। সব সময় জামায়াত বদ্ধ থাকবে।

 

২। নেতার নির্দেশ স্রবণ করবে।

 

৩। নেতার নির্দেশ পালন করবে।

 

৪। হিজরত করবে (অর্থাৎ মন্দ কাজ ত্যাগ করবে বা এমন আবাসভূমি ত্যাগ করবে যেখানে বসে আল্লাহর হুকুম পালন করা সম্ভব নয়)।

 

৫। আল্লাহর পথে যিহাদ করবে। (অতপর তিনি বলেন) সাবধান, যে ব্যাক্তি জামায়াত থেকে এক বিঘত সরে যাবে, সে মূলত নিজের গলা থেকে ইসলামের রশিই খুলে ফেলবে। তবে পুনরায় জামায়াতে ফিরে আসলে ভিন্ন কথা।” (মুসনাদে আহমাদ, তিরমিযি, ইবনে মাজাহ)

 

বেশ হয়েছে, হযরত ইয়াহিয়ার পাঁচটি নির্দেশের সাথে আমরা আমাদের প্রিয় নবীর আরো পাঁচটি নির্দেশও পেয়ে গেলাম। আসলে হযরত ইয়াহিয়া (আঃ) অত্যন্ত মানব দরদী নবী। আল কুরআনে তাঁর একটি মহৎ গেনের কথা উল্লেখ করে মহান আল্লাহ বলেন –

 

“আমি নিজের পক্ষ থেকে তাঁকে দান করেছি হৃদয়ের কোমলতা।” (আল কুরআন ১৯ ; ২৩)

 

দাওয়াত দান, পাপ কাজে বাধাদান ও শাহাদাৎ

 

হযরত ইয়াহিয়া (আঃ) বনী ইসরাইলকে শিরক, বিদআত ও যাবতীয় মন্দ কাজ ত্যাগ করার দাওয়াত দিতে থাকেন। তাঁদেরকে শুধু এক আল্লাহর দাসত্ব ও আনুগত্য করতে এবং সততার সাথে চলতে আহবান জানাতে থাকেন। তিনি ট্রান্স জর্ডান এলাকায় তাঁর দাওয়াতী কাজ সম্প্রসারন করেন। মানুষকে তিনি পাপ কাজ থেকে তওবা করাতেন এবং যারা তওবা করতেন তাঁদেরকে ব্যাপটাইজ বা গোসল করাতেন। সেজন্যে তিনি ব্যাপটিষ্ট ইয়াহিয়া নামে পরিচিতি লাভ করেন। হযরত ইয়াহিয়ার সময় ইহুদীদের শাসক ছিলো হিরোদ এন্টিপাস। হিরোদ ইহুদী সমাজে রোমীয় নগ্ন সভ্যতার সয়লাব বিয়ে দেন। রাষ্ট্রীয়ভাবে যিনা, ব্যাভিচার, নগ্নতা, বেহায়াপনতা ও চরিত্রহীনতার প্রসার ঘটানো হতে থাকে। হিরোদ নিজেই ব্যাভিচার ও পাপাচারে লিপ্ত হয়। হযরত ইয়াহিয়া তাঁর অনৈতিক পাপাচারের প্রতিবাদ করতে থাকেন। হিরোদ নিজের অবস্থা বেগতিক দেখে হযরত ইয়াহিয়াকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে ফেলে রাখে। চরিত্রহীনরা দেখলো, হযরত ইয়াহিয়া মানুষের মাঝে সৎকর্ম ও পবিত্র জীবন যাপনের যে চেতনা সৃষ্টি করেছেন, তাঁর ফলে মানুষ তাঁদের চরমভাবে ঘৃণা করছে। তাঁদের বিরুদ্ধে বেড়েই চলেছে মানুষের ক্ষোভ। কারন মানুষ দেখলো, আল্লাহর নবীকে আটকে রাখা হয়েছে কারাগারে আর পাপিষ্ঠদের লালন করছে সরকার। এমতাবস্থায় শাসক হিরোদ তাঁর এক পালিত নর্তকীর আবদারে হত্যা করলো আল্লাহর নবী হযরত ইয়াহিয়া –কে। তাঁর মস্তক দ্বিখণ্ডিত করে উপহার দিলো নর্তকীকে। এভাবেই বনী ইসরাইলের বদবখত লোকেরা একের পর এক আল্লাহর নবীকে হত্যা করে। এদের সম্পর্কেই আল কুরআনে বলা হয়েছে –

 

“যারা আল্লাহর আয়াতকে অস্বীকার করে, অন্যায়ভাবে হত্যা করে আল্লাহর নবীদেরকে আর ঐ সব লোকদেরকে যারা ন্যায় ও সুবিচারের নির্দেশ দেয়, এসব অপরাধীদেরকে যন্ত্রনাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ দাও।” (সূরা আলে ইমরান, আয়াত ২১)

 

আমাদের নবীর সাথে সাক্ষাত

 

আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) এর যখন মে’রাজ হয়, তখন তাঁর সাথে হযরত ইয়াহিয়ার সাক্ষাত হয়। হযরত জিবরীলের সাথে প্রিয় নবী আকাশ পেরিয়ে উপরে উঠছিলেন।

 

তিনি বলেন –

 

“অতপর যখন দ্বিতীয় আকাশে পৌঁছলাম দেখলাম, সেখানে ইয়াহিয়া ও ঈসা। তারা দু’জন পরস্পর খালাতো ভাই। জিবরীল আমাকে বললেন – এরা ইয়াহিয়া ও ঈসা এদের সালাম করুন। আমি তাঁদের সালাম করলাম। তারা সালামের জবাব দিয়ে বললেন- মারহাবা-স্বাগতম হে আমাদের মহান ভাই ও মহান নবী।” (সহীহ বুখারী)

 

আল কুরআনে হযরত ইয়াহিয়া

 

আল কুরআনে হযরত ইয়াহিয়ার নাম উল্লেখ হয়েছে পাঁচবার। যেসব আয়াতে উল্লাখ হয়েছে সেগুলো হল- সূরা আলে ইমরান ; ৩৯। সূরা আল আনয়াম ; ৮৫। সূরা মরিয়ম ; ৭, ১২। সূরা আল আম্বিয়া ; ৯০। কুরআন মাজীদে হযরত ইয়াহিয়ার মর্যাদা বর্ণনা করা হয়েছে এভাবে-

 

“আমি শৈশবেই তাঁকে প্রজ্ঞা দান করেছি এবং দান করেছি নিজের পক্ষ থেকে কোমলতা ও পবিত্রতা। সে ছিল খুবই আল্লাহভীরু আর বাবা মার অধিকারের ব্যাপারে সচেতন। সে উদ্যত ছিলনা আবার অবাধ্যও ছিলনা। তাঁর প্রতি সালাম যেদিন তাঁর জন্ম হয় যেদিন তাঁর মরন হয় এবং যেদিন উঠানো হবে তাঁকে জীবিত করে। ” (সূরা মরিয়ম, আয়াত ১২-১৫)

 

 ২৪

 

ঈসা রুহুল্লাহ

 

(আঃ)

 

হযরত ঈসা (আঃ) ছিলেন বনু ইস্রাঈল বংশের সর্বশেষ নবী ও কিতাবধারী রাসূল। তিনি ‘ইনজীল’ প্রাপ্ত হয়েছিলেন। তাঁরপর থেকে শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর আবির্ভাব পর্যন্ত আর কোন নবী আগমন করেননি। এই সময়টাকে ‘রাসূল আগমনের বিরতিকাল’ বলা হয়। ক্বিয়ামত সংঘটিত হওয়ার অব্যবহিত কাল পূর্বে হযরত ঈসা (আঃ) আল্লাহর হুকুমে পুনরায় পৃথিবীতে অবতরণ করবেন এবং মুহাম্মাদী শরী‘আত অনুসরণে ইমাম মাহদীর নেতৃত্বে সারা পৃথিবীতে শান্তির রাজ্য কায়েম করবেন। তিনি উম্মতে মুহাম্মাদীর সাথে বিশ্ব সংস্কারে ব্রতী হবেন। তাই তাঁর সম্পর্কে সঠিক ও বিস্তৃত ধারণা দেওয়া অত্যন্ত যরূরী বিবেচনা করে আল্লাহ পাক শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিয়েছেন। উল্লেখ্য যে, মূসা (আঃ)-এর অনুসারী হওয়ার দাবীদার ইহুদীরা তাঁকে নবী বলেই স্বীকার করেনি। অত্যন্ত লজ্জাষ্করভাবে তারা তাঁকে জনৈক ইউসুফ মিস্ত্রীর জারজ সন্তান বলে আখ্যায়িত করেছে (নাঊযুবিল্লাহ)। অন্যদিকে ঈসা (আঃ)-এর ভক্ত ও অনুসারী হবার দাবীদার খৃষ্টানরা বাড়াবাড়ি করে তাঁকে ‘আল্লাহর পুত্র’ (তওবাহ, আয়াত ৩০) বানিয়েছে’। বরং ত্রিত্ববাদী খৃষ্টানরা তাঁকে সরাসরি ‘আল্লাহ’ সাব্যস্ত করেছে এবং বলেছে যে, তিনি হ’লেন তিন আল্লাহর একজন (মায়েদাহ, আয়াত ৭৩)। অর্থাৎ ঈসা, মারিয়াম ও আল্লাহ প্রত্যেকেই আল্লাহ এবং তারা এটাকে ‘বুদ্ধি বহির্ভূত সত্য’ বলে ক্ষান্ত হয়। অথচ এরূপ ধারণা পোষণকারীদের আল্লাহ দ্ব্যর্থহীনভাবে ‘কাফের’ বলে ঘোষণা করেছেন (মায়েদাহ, আয়াত ৭২-৭৩)। কুরআন তাঁর সম্পর্কে সঠিক তথ্য উপস্থাপন করেছে। আমরা এখন সেদিকে মনোনিবেশ করব।

 

উল্লেখ্য যে, হযরত ঈসা (আঃ) সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের মোট ১৫টি সূরায় ৯৮টি আয়াতেবর্ণিত হয়েছে।

 

ঈসার মা ও নানী

 

ঈসা (আঃ)-এর আলোচনা করতে গেলে তাঁর মা ও নানীর আলোচনা আগেই করে নিতে হয়। কারণ তাঁদের ঘটনাবলীর সাথে ঈসার জীবনের গভীর যোগসূত্র রয়েছে। পূর্ববর্তী পয়গম্বরগণের শরী‘আতে প্রচলিত ইবাদত-পদ্ধতির মধ্যে আল্লাহর নামে সন্তান উৎসর্গ করার রেওয়াজও চালু ছিল। এসব উৎসর্গীত সন্তানদের পার্থিব কোন কাজকর্মে নিযুক্ত করা হ’ত না। এ পদ্ধতি অনুযায়ী ঈসার নানী অর্থাৎ ইমরানের স্ত্রী নিজের গর্ভস্থ সন্তান সম্পর্কে মানত করলেন যে, তাকে বিশেষভাবে আল্লাহর ঘর বায়তুল মুক্বাদ্দাসের খিদমতে নিয়োজিত করা হবে। তিনি ভেবেছিলেন যে পুত্র সন্তান হবে। কিন্তু যখন তিনি কন্যা সন্তান প্রসব করলেন, তখন আক্ষেপ করে বললেন, ‘হে আল্লাহ! আমি কন্যা প্রসব করেছি’? (আলে ইমরান, আয়াত ৩৬)। অর্থাৎ একে দিয়ে তো আমার মানত পূর্ণ হবে না। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছা ছিল অন্যরূপ। তিনি উক্ত কন্যাকেই কবুল করে নেন। বস্ত্ততঃ ইনিই ছিলেন মারিয়াম বিনতে ইমরান, যিনি ঈসা (আঃ)-এর কুমারী মাতা ছিলেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যাকে জান্নাতের শ্রেষ্ঠ চারজন মহিলার অন্যতম হিসাবে বর্ণনা করেছেন। যেমন তিনি বলেন,

 

 ‘জান্নাতবাসী মহিলাগণের মধ্যে সেরা হ’লেন চারজন: খাদীজা বিনতে খুওয়ালিদ, ফাতেমা বিনতে মুহাম্মাদ, মারিয়াম বিনতে ইমরান এবং আসিয়া বিনতে মুযাহিম, যিনি ফেরাঊনের স্ত্রী’।

 

মারিয়ামের জন্ম ও লালন-পালন

 

মারিয়ামের জন্ম ও লালন-পালন সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,

 

 ‘যখন ইমরানের স্ত্রী বলল, হে আমার প্রভু! আমার গর্ভে যা রয়েছে তাকে আমি তোমার নামে উৎসর্গ করলাম সবার কাছ থেকে মুক্ত হিসাবে। অতএব আমার পক্ষ থেকে তুমি তাকে কবুল করে নাও। নিশ্চয়ই তুমি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ’ (আলে ইমরান, আয়াত ৩৫)। ‘অতঃপর সে যখন তাকে প্রসব করল, তখন বলল, হে প্রভু! আমি তো কন্যা সন্তান প্রসব করেছি! অথচ আল্লাহ ভাল করেই জানেন, সে কি প্রসব করেছে। (আল্লাহ সান্ত্বনা দিয়ে বললেন,) এই কন্যার মত কোন পুত্রই যে নেই। আর আমি তার নাম রাখলাম ‘মারিয়াম’। (মারিয়ামের মা দো‘আ করে বলল, হে আল্লাহ!) আমি তাকে ও তার সন্তানদেরকে তোমার আশ্রয়ে সমর্পণ করছি, অভিশপ্ত শয়তানের কবল হ’তে’। আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর তার প্রভু তাকে উত্তমভাবে গ্রহণ করে নিলেন এবং তাকে প্রবৃদ্ধি দান করলেন সুন্দর প্রবৃদ্ধি। আর তিনি তাকে যাকারিয়ার তত্ত্বাবধানে সমর্পণ করলেন। (অতঃপর ঘটনা হ’ল এই যে,) যখনই যাকারিয়া মেহরাবের মধ্যে তার কাছে আসতেন, তখনই কিছু খাদ্য দেখতে পেতেন। তিনি জিজ্ঞেস করতেন, মারিয়াম! এসব কোথা থেকে তোমার কাছে এল? মারিয়াম বলত, ‘এসব আল্লাহর নিকট থেকে আসে। নিশ্চয়ই আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বেহিসাব রিযিক দান করে থাকেন’ (আলে ইমরান, আয়াত ৩৫-৩৭)।

 

উল্লেখ্য যে, আল্লাহর নামে উৎসর্গীত সন্তান পালন করাকে তখনকার সময়ে খুবই পুণ্যের কাজ মনে করা হ’ত। আর সেকারণে মারিয়ামকে প্রতিপালনের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য রীতিমত প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। ফলে লটারীর ব্যবস্থা করা হয় এবং আল্লাহর ইচ্ছায় তাঁর বয়োবৃদ্ধ নবী হযরত যাকারিয়া (আঃ) মারিয়ামের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন (আলে ইমরান, আয়াত ৪৪)।

 

ঈসার জন্ম ও লালন-পালন

 

এভাবে মেহরাবে অবস্থান করে মারিয়াম বায়তুল মুক্বাদ্দাসের খিদমত করতে থাকেন। সম্মানিত নবী ও মারিয়ামের বয়োবৃদ্ধ খালু যাকারিয়া (আঃ) সর্বদা তাকে দেখাশুনা করতেন। মেহরাবের উত্তর-পূর্বদিকে সম্ভবতঃ খেজুর বাগান ও ঝর্ণাধারা ছিল। যেখানে মারিয়াম পর্দা টাঙিয়ে মাঝে-মধ্যে পায়চারি করতেন। অভ্যাসমত তিনি উক্ত নির্জন স্থানে একদিন পায়চারি করছিলেন। এমন সময় হঠাৎ মানুষের বেশে সেখানে জিবরাঈল উপস্থিত হন। স্বাভাবিকভাবেই তাতে মারিয়াম ভীত হয়ে পড়েন। এ বিষয়ে কুরআনী বর্ণনা নিম্নরূপ:

 

 (হে মুহাম্মাদ!) ‘আপনি এই কিতাবে মারিয়ামের কথা বর্ণনা করুন। যখন সে তার পরিবারের লোকজন হ’তে পৃথক হয়ে পূর্বদিকে একস্থানে আশ্রয় নিল’ (মারিয়াম, আয়াত ১৬)। ‘অতঃপর সে তাদের থেকে আড়াল করার জন্য পর্দা টাঙিয়ে নিল। অতঃপর আমরা তার নিকটে আমাদের ‘রূহ’ (অর্থাৎ জিব্রীলকে) প্রেরণ করলাম। সে তার কাছে গিয়ে পূর্ণাঙ্গ মানবাকৃতিতে আত্মপ্রকাশ করল’। ‘মারিয়াম বলল, আমি তোমার থেকে করুণাময় আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করছি, যদি তুমি আল্লাহভীরু হও’। ‘সে বলল, আমি তো কেবল তোমার প্রভুর প্রেরিত। এজন্য যে, আমি তোমাকে একটি পবিত্র পুত্র সন্তান দান করে যাব’। ‘মারিয়াম বলল, কিভাবে আমার পুত্র সন্তান হবে? অথচ কোন মানুষ আমাকে স্পর্শ করেনি এবং আমি ব্যভিচারিণী নই’। ‘সে বলল, এভাবেই হবে। তোমার পালনকর্তা বলেছেন, এটা আমার জন্য সহজ ব্যাপার এবং আমরা তাকে (ঈসাকে) মানবজাতির জন্য একটা নিদর্শন ও আমাদের পক্ষ হ’তে বিশেষ অনুগ্রহরূপে পয়দা করতে চাই। তাছাড়া এটা (পূর্ব থেকেই) নির্ধারিত বিষয়’ (মারিয়াম, আয়াত ১৬-২১)। অতঃপর জিব্রীল মারিয়ামের মুখে অথবা তাঁর পরিহিত জামায় ফুঁক মারলেন এবং তাতেই তাঁর গর্ভ সঞ্চার হ’ল (আম্বিয়া, আয়াত ৯১ ; তাহরীম, আয়াত ১২)। অন্য আয়াতে একে ‘আল্লাহর কলেমা’ (بِكَلِمَةٍ مِنْهُ) অর্থাৎ ‘কুন্’ (হও) বলা হয়েছে (আলে ইমরান, আয়াত ৪৫)।

 

অতঃপর আল্লাহ বলেন,

 

 ‘অতঃপর মারিয়াম গর্ভে সন্তান ধারণ করল এবং তৎসহ একটু দূরবর্তী স্থানে চলে গেল’ (মারিয়াম, আয়াত ২২)। ‘এমতাবস্থায় প্রসব বেদনা তাকে একটি খর্জুর বৃক্ষের মূলে আশ্রয় নিতে বাধ্য করল। তখন সে বলল, হায়! আমি যদি এর আগেই মারা যেতাম এবং আমি যদি মানুষের স্মৃতি থেকে বিলুপ্ত হয়ে যেতাম’। ‘এমন সময় ফেরেশতা তাকে নিম্নদেশ থেকে (অর্থাৎ পার্শ্ববর্তী নিম্নভূমি থেকে) আওয়ায দিয়ে বলল, তুমি দুঃখ করো না। তোমার পালনকর্তা তোমার পাদদেশে একটি ঝর্ণাধারা সৃষ্টি করেছেন’। ‘আর তুমি খর্জুর বৃক্ষের কান্ড ধরে নিজের দিকে নাড়া দাও, তা থেকে তোমার দিকে সুপক্ক খেজুর পতিত হবে’। ‘তুমি আহার কর, পান কর এং স্বীয় চক্ষু শীতল কর। আর যদি কোন মানুষকে তুমি দেখ, তবে তাকে বলে দিয়ো যে, আমি দয়াময় আল্লাহর জন্য ছিয়াম পালনের মানত করেছি। সুতরাং আমি আজ কারু সাথে কোন মতেই কথা বলব না’ (মারিয়াম, আয়াত ২২-২৬)।

 

উল্লেখ্য যে, ইসলাম-পূর্ব কালের বিভিন্ন শরী‘আতে সম্ভবতঃ ছিয়াম পালনের সাথে অন্যতম নিয়ম ছিল সারাদিন মৌনতা অবলম্বন করা। হযরত যাকারিয়া (আঃ)-কেও সন্তান প্রদানের নিদর্শন হিসাবে তিন দিন ছিয়ামের সাথে মৌনতা অবলম্বনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তবে ঐ অবস্থায় ইশারা-ইঙ্গিতে কথা বলার অবকাশ ছিল (মারিয়াম, আয়াত ১০-১১)। একইভাবে মারিয়ামকেও নির্দেশ দেওয়া হ’ল (মারিয়াম, আয়াত ২৬)।

 

আলোচনা

 

(১) যেহেতু ঈসা (আঃ)-এর জন্মগ্রহণের ব্যাপারটি সম্পূর্ণভাবে অলৌকিক, তাই তার গর্ভধারণের মেয়াদ স্বাভাবিক নিয়মের বহির্ভূত ছিল বলেই ধরে নিতে হবে। নয় মাস দশদিন পরে সন্তান প্রসব শেষে চল্লিশ দিন ‘নেফাস’ অর্থাৎ রজঃস্রাব হ’তে পবিত্রতার মেয়াদও এখানে ধর্তব্য না হওয়াই সমীচীন। অতএব ঈসাকে গর্ভধারণের ব্যাপারটাও যেমন নিয়ম বহির্ভূত, তার ভূমিষ্ট হওয়া ও তার মায়ের পবিত্রতা লাভের পুরা ঘটনাটাই নিয়ম বহির্ভূত এবং অলৌকিক। আর এটা আল্লাহর জন্য একেবারেই সাধারণ বিষয়। স্বামী-স্ত্রীর মাধ্যমে সন্তান জন্ম হবে, মাকে দশ মাস গর্ভধারণ করতে হবে ইত্যাদি নিয়ম আল্লাহরই সৃষ্টি এবং এই নিয়ম ভেঙ্গে সন্তান দান করাও তাঁরই এখতিয়ার। এদিকে ইঙ্গিত করেই আল্লাহ বলেন,

 

‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকটে ঈসার দৃষ্টান্ত হ’ল আদমের মত। তাকে তিনি মাটি দিয়ে সৃষ্টি করেন এবং বলেন, হয়ে যাও ব্যস হয়ে গেল’। ‘যা তোমার প্রভু আল্লাহ বলেন, সেটাই সত্য। অতএব তুমি সংশয়বাদীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না’’ (আলে ইমরান, আআয়ত ৫৯-৬০)। অর্থাৎ আদমকে যেমন পিতা-মাতা ছাড়াই সৃষ্টি করা হয়েছে, ঈসাকে তেমনি পিতা ছাড়াই শুধু মায়ের মাধ্যমেই সৃষ্টি করা হয়েছে। আর এটাই যে সত্য এবং এর বাইরে যাবতীয় জল্পনা-কল্পনা যে মিথ্যা, সে কথাও উপরোক্ত আয়াতে দ্ব্যর্থহীনভাবে বলে দেওয়া হয়েছে। দুর্ভাগ্য এই যে, যে বনু ইস্রাঈলের নবী ও রাসূল হয়ে ঈসা (আঃ)-এর আগমন ঘটলো, সেই ইহুদী-নাছারারাই আল্লাহর উক্ত ঘোষণাকে মিথ্যা বলে গণ্য করেছে। অথচ এই হতভাগারা মারিয়ামের পূর্বদিকে যাওয়ার অনুসরণে পূর্বদিককে তাদের ক্বিবলা বানিয়েছে।

 

(২) এখানে আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় যে, মারিয়ামকে খেজুর গাছের কান্ড ধরে নাড়া দিতে বলা হয়েছে, যাতে সুপক্ক খেজুর নীচে পতিত হয়। এটাতে বুঝা যায় যে, ওটা ছিল তখন খেজুর পাকার মৌসুম অর্থাৎ গ্রীষ্মকাল। আর খৃষ্টানরা কথিত যীশু খৃষ্টের জন্মদিন তথা তাদের ভাষায় X-mas Day বা বড় দিন উৎসব পালন করে থাকে শীতকালে ২৫শে ডিসেম্বর তারিখে। অথচ এর কোন ভিত্তি তাদের কাছে নেই। ইসলামে কারু জন্ম বা মৃত্যু দিবস পালনের বিধান নেই।

 

(৩) এখানে আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় যে, খেজুর গাছের গোড়া ধরে নাড়া দেওয়া কখনোই সম্ভব নয়। বিশেষ করে একজন সদ্য প্রসূত সন্তানের মায়ের পক্ষে। এর মধ্যে এ বিষয়ে ইঙ্গিত রয়েছে যে, নেকীর কাজে আল্লাহর উপরে ভরসা করে বান্দাকে অবশ্যই এগিয়ে যেতে হবে। যত সামান্যই হৌক কাজ করতে হবে। আল্লাহ তাতেই বরকত দিবেন। যেমন তালূত ও দাঊদকে আল্লাহ দিয়েছিলেন এবং যেমন শেষনবী (ছাঃ)-কে আল্লাহ সাহায্য করেছিলেন বিশেষভাবে হিজরতের রাত্রিতে মক্কা ত্যাগের সময়, হিজরতকালীন সফরে এবং বদর ও খন্দক যুদ্ধের কঠিন সময়ে। অতএব আমরা ধরে নিতে পারি যে, মারিয়ামের গর্ভধারণ, সন্তান প্রসব ও প্রসব পরবর্তী পবিত্রতা অর্জন সবই ছিল অলৌকিক এবং সবই অত্যন্ত দ্রুত সময়ের মধ্যে সম্পন্ন হয়।

 

এর পরের ঘটনা আমরা সরাসরি কুরআন থেকে বিবৃত করব। আল্লাহ বলেন,

 

‘‘অতঃপর মারিয়াম তার সন্তানকে নিয়ে তার সম্প্রদায়ের কাছে উপস্থিত হ’ল। তারা বলল, হে মারিয়াম! তুমি একটা আশ্চর্য বস্ত্ত নিয়ে এসেছ’। ‘হে হারূণের বোন! তোমার পিতা কোন অসৎ ব্যক্তি ছিলেন না কিংবা তোমার মাতাও কোন ব্যভিচারিণী মহিলা ছিলেন না’’ (মারিয়াম, আয়াত ২৭-২৮)। কওমের লোকদের এ ধরনের কথা ও সন্দেহের জওয়াবে নিজে কিছু না বলে বিবি মারিয়াম তার সদ্য প্রসূত সন্তানের দিকে ইশারা করলেন। অর্থাৎ একথার জবাব সেই-ই দিবে। কেননা সে আল্লাহর দেওয়া এক অলৌকিক সন্তান, যা কওমের লোকেরা জানে না। আল্লাহ বলেন,

 

 ‘‘অতঃপর মারিয়াম ঈসার দিকে ইঙ্গিত করল। তখন লোকেরা বলল, কোলের শিশুর সাথে আমরা কিভাবে কথা বলব’?। ঈসা তখন বলে উঠল, ‘আমি আল্লাহর দাস। তিনি আমাকে কিতাব (ইনজীল) প্রদান করেছেন এবং আমাকে নবী করেছেন’। ‘আমি যেখানেই থাকি, তিনি আমাকে বরকতময় করেছেন। তিনি আমাকে জোরালো নির্দেশ দিয়েছেন যতদিন জীবিত থাকি, ততদিন ছালাত ও যাকাত আদায় করতে’। ‘এবং আমার মায়ের অনুগত থাকতে। আল্লাহ আমাকে উদ্ধত ও হতভাগা করেননি’। ‘আমার প্রতি শান্তি যেদিন আমি জন্মগ্রহণ করেছি, যেদিন আমি মৃত্যুবরণ করব এবং যেদিন জীবিত পুনরুত্থিত হব’’ (মারিয়াম, আয়াত ২৯-৩৩)।

 

ঈসার উপরোক্ত বক্তব্য শেষ করার পর সংশয়বাদী ও বিতর্ককারী লোকদের উদ্দেশ্য করে আল্লাহ বলেন,

 

‘‘ইনিই হ’লেন মারিয়াম পুত্র ঈসা। আর ওটাই হ’ল সত্যকথা (যা উপরে বর্ণিত হয়েছে), যে বিষয়ে লোকেরা (অহেতুক) বিতর্ক করে থাকে’। ‘আল্লাহ এমন নন যে, তিনি সন্তান গ্রহণ করবেন (যেমন অতিভক্ত খৃষ্টানরা বলে থাকে যে, ঈসা ‘আল্লাহর পুত্র’)। তিনি মহাপবিত্র। যখন তিনি কোন কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন, তখন বলেন, হও! ব্যস, হয়ে যায়’। ‘ঈসা আরও বলল, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ আমার পালনকর্তা এবং তোমাদের পালনকর্তা। অতএব তোমরা তাঁর ইবাদত কর। (মনে রেখ) এটাই হ’ল সরল পথ’’ (মারিয়াম, আয়াত ৩৪-৩৬)।

 

কিন্তু সদ্যপ্রসূত শিশু ঈসার মুখ দিয়ে অনুরূপ সারগর্ভ কথা শুনেও কি কওমের লোকেরা আশ্বস্ত হ’তে পেরেছিল? কিছু লোক আশ্বস্ত হ’লেও অনেকে পারেনি। তারা নানা বাজে কথা রটাতে থাকে। তাদের ঐসব বাক-বিতন্ডার প্রতি ইঙ্গিত করেই পরবর্তী আয়াতে আল্লাহ বলেন,

 

‘‘অতঃপর তাদের মধ্যকার বিভিন্ন দল বিভিন্ন (মত ও পথে) বিভক্ত হয়ে গেল (দুনিয়াতে যার শেষ হবে না)। অতএব ক্বিয়ামতের মহাদিবস আগমন কালে অবিশ্বাসী কাফিরদের জন্য ধ্বংস’। ‘সেদিন তারা চমৎকারভাবে শুনবে ও দেখবে, যেদিন তারা সবাই আমাদের কাছে আগমন করবে। কিন্তু আজ যালেমরা প্রকাশ্য বিভ্রান্তিতে রয়েছে’’ (মারিয়াম, আয়াত ৩৭-৩৮)।

 

মারিয়ামের সতীত্ব সম্পর্কে আল্লাহর সাক্ষ্য

 

আল্লাহ পাক নিজেই মারিয়ামের সতীত্ব সম্পর্কে সাক্ষ্য দিয়ে বলেন,

 

 ‘‘তিনি দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেন ইমরান তনয়া মারিয়ামের, যে তার সতীত্ব বজায় রেখেছিল। অতঃপর আমি তার মধ্যে আমার পক্ষ হ’তে রূহ ফুঁকে দিয়েছিলাম এবং সে তার পালনকর্তার বাণী ও কিতাব সমূহকে সত্যে পরিণত করেছিল এবং সে ছিল বিনয়ীদের অন্যতম’’ (তাহরীম, আয়াত ১২)।

 

মারিয়ামের বৈশিষ্ট্য সমূহ

 

(১) তিনি ছিলেন বিশ্ব নারী সমাজের শীর্ষস্থানীয়া এবং আল্লাহর মনোনীত ও পবিত্র ব্যক্তিত্ব (আলে ইমরান, আয়াত ৪২)।

 

(২) তিনি ছিলেন সর্বদা আল্লাহর উপাসনায় রত, বিনয়ী, রুকু কারিনী ও সিজদাকারিনী (আলে ইমরান, আয়াত ৪৩)।

 

(৩) তিনি ছিলেন সতীসাধ্বী এবং আল্লাহর আদেশ ও বাণী সমূহের বাস্তবায়নকারিনী (তাহরীম, আয়াত ১২)।

 

(৪) আল্লাহ নিজেই তার নাম রাখেন ‘মারিয়াম’ (আলে ইমরান, আয়াত ৩৬)। অতএব তিনি ছিলেন অতীব সৌভাগ্যবতী।

 

শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ

 

(১) মারিয়াম ছিলেন তার মায়ের মানতের সন্তান এবং তার নাম আল্লাহ নিজে রেখেছিলেন।

 

(২) মারিয়ামের মা দো‘আ করেছিলেন এই মর্মে যে, আমি তাকে ও তার সন্তানদেরকে আল্লাহর আশ্রয়ে সমর্পণ করছি অভিশপ্ত শয়তানের কবল হ’তে এবং আল্লাহ সে দো‘আ কবুল করেছিলেন উত্তমরূপে। অতএব মারিয়াম ও তার পুত্র ঈসার পবিত্রতা সম্পর্কে কোনরূপ সন্দেহের অবকাশ নেই।

 

(৩) মারিয়াম আল্লাহর ঘর বায়তুল মুক্বাদ্দাসের খিদমতে রত ছিলেন এবং তাকে আল্লাহর পক্ষ হ’তে বিশেষ ফল-ফলাদির মাধ্যমে খাদ্য পরিবেশন করা হ’ত (আলে ইমরান, আয়াত ৩৭)। এতে বুঝা যায় যে, পবিত্রাত্মা মহিলাগণ মসজিদের খিদমত করতে পারেন এবং আল্লাহ তাঁর নেককার বান্দাদের জন্য যেকোন স্থানে খাদ্য পরিবেশন করে থাকেন।

 

(৪) মারিয়ামের গর্ভধারণ ও ঈসার জন্মগ্রহণ ছিল সম্পূর্ণরূপে অলৌকিক ঘটনা। আল্লাহ পাক নিয়মের স্রষ্টা এবং তিনিই নিয়মের ভঙ্গকারী। তাকে কোন বিষয়ে বাধ্য করার মত কেউ নেই। তিনি পিতা-মাতা ছাড়াই আদমকে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর পিতা ছাড়াই শুধু মাতার মাধ্যমে ঈসাকে সৃষ্টি করেছেন। তিনি যা খুশী তাই করতে পারেন।

 

(৫) ঈসার জন্ম গ্রীষ্মকালে হয়েছিল খেজুর পাকার মওসুমে। খৃষ্টানদের মধ্যে প্রচলিত ধারণা মতে ২৫শে ডিসেম্বরের প্রচন্ড শীতের সময়ে নয়।

 

(৬) ফেরেশতা মানবাকৃতি ধারণ করে অথবা অদৃশ্য থেকে নেককার বান্দাকে আল্লাহর হুকুমে সাহায্য করে থাকেন। যেমন জিব্রীল মানবাকৃতি ধারণ করে মারিয়ামের জামায় ফুঁক দিলেন। অতঃপর অদৃশ্য থেকে আওয়ায দিয়ে তার খাদ্য ও পানীয়ের পথ নির্দেশ দান করলেন।

 

(৭) বান্দাকে কেবল প্রার্থনা করলেই চলবে না, তাকে কাজে নামতে হবে। তবেই তাতে আল্লাহর সাহায্য নেমে আসবে। যেমন খেজুর বৃক্ষের কান্ড ধরে নাড়া দেওয়ার সামান্য প্রচেষ্টার মাধ্যমে আল্লাহর হুকুমে সুপক্ক খেজুর সমূহ পতিত হয়।

 

(৮) বিশেষ সময়ে আল্লাহর হুকুমে শিশু সন্তানের মুখ দিয়ে সারগর্ভ বক্তব্য সমূহ বের হ’তে পারে। যেমন ঈসার মুখ দিয়ে বের হয়েছিল তার মায়ের পবিত্রতা প্রমাণের জন্য। বুখারী শরীফে বর্ণিত বনু ইস্রাঈলের জুরায়েজ-এর ঘটনায়ও এর প্রমাণ পাওয়া যায়।

 

(৯) ঈসা কোন উপাস্য ছিলেন না। বরং তিনি ছিলেন অন্যদের মত আল্লাহর একজন দাস মাত্র এবং তিনি ছিলেন আল্লাহর একজন সম্মানিত নবী ও কিতাবধারী রাসূল।

 

(১০) ঈসা যে বিনা বাপে পয়দা হয়েছিলেন, তার অন্যতম প্রমাণ এই যে, কুরআনের সর্বত্র তাঁকে ‘মারিয়াম-পুত্র’ বলা হয়েছে (বাক্বারাহ, আয়াত- ৮৭, ২৫৩ ; আলে ইমরান, আয়াত ৪৫ প্রভৃতি)। পিতা-মাতা উভয়ে থাকলে হয়তবা তাঁকে কেবল ঈসা বলেই সম্বোধন করা হ’ত, যেমন অন্যান্য নবীগণের বেলায় করা হয়েছে। অথচ মারিয়ামকে তার পিতার দিকে সম্বন্ধ করে ‘মারিয়াম বিনতে ইমরান’ ‘ইমরান-কন্যা’ বলা হয়েছে (তাহরীম, আয়াত ১২)।

 

(১১) একমাত্র মারিয়ামের নাম ধরেই আল্লাহ তাঁর সতীত্বের সাক্ষ্য ঘোষণা করেছেন (তাহরীম, আয়াত ১২)। যা পৃথিবীর অন্য কোন মহিলা সম্পর্কে করা হয়নি। অতএব যাবতীয় বিতর্কের অবসানের জন্য এটুকুই যথেষ্ট। তাছাড়া আল্লাহ তাঁকে ‘ছিদ্দীক্বাহ’ অর্থাৎ কথায় ও কর্মে ‘সত্যবাদীনী’ আখ্যা দিয়েছেন (মায়েদাহ, আয়াত ৭৫)। যেটা অন্য কোন মহিলা সম্পর্কে দেওয়া হয়নি।

 

ঈসা (আঃ)-এর বৈশিষ্ট্য সমূহ

 

(১) তিনি ছিলেন বিনা বাপে পয়দা বিশ্বের একমাত্র নবী (আলে ইমরান, আয়াত ৪৬)। (২) আল্লাহ স্বয়ং যার নাম রাখেন মসীহ ঈসা রূপে (আলে ইমরান, আয়াত ৪৫)। (৩) তিনি শয়তানের অনিষ্টকারিতা হ’তে মুক্ত ছিলেন (ঐ,আয়াত ৩৬-৩৭)। (৪) দুনিয়া ও আখেরাতে তিনি ছিলেন মহা সম্মানের অধিকারী এবং আল্লাহর একান্ত প্রিয়জনদের অন্যতম (আলে ইমরান, আয়াত ৪৫)। (৫) তিনি মাতৃক্রোড়ে থেকেই সারগর্ভ বক্তব্য রাখেন (মারিয়াম, আয়াত ২৭-৩৩; আলে ইমরান, আয়াত ৪৬)। (৬) তিনি বনু ইস্রাঈলগণের প্রতি প্রেরিত হয়েছিলেন (আলে ইমরান, আয়াত ৪৯) এবং শেষনবী ‘আহমাদ’-এর আগমনের ভবিষ্যদ্বাণী করেন (ছফ, আয়াত ৬)। (৭) তাঁর মো‘জেযা সমূহের মধ্যে ছিল- (ক) তিনি মাটির তৈরী পাখিতে ফুঁক দিলেই তা জীবন্ত হয়ে উড়ে যেত (খ) তিনি জন্মান্ধকে চক্ষুষ্মান ও কুষ্ঠ রোগীকে সুস্থ করতে পারতেন (গ) তিনি মৃতকে জীবিত করতে পারতেন (ঘ) তিনি বলে দিতে পারতেন মানুষ বাড়ী থেকে যা খেয়ে আসে এবং যা সে ঘরে সঞ্চিত রেখে আসে (আলে ইমরান, আয়াত ৪৯; মায়েদাহ, আয়াত ১১০)।

 

(৮) তিনি আল্লাহর কিতাব ইনজীল প্রাপ্ত হয়েছিলেন এবং পূর্ববর্তী গ্রন্থ তওরাতের সত্যায়নকারী ছিলেন। তবে তওরাতে হারামকৃত অনেক বিষয়কে তিনি হালাল করেন (আলে ইমরান, আয়াত ৫০)। (৯) তিনি ইহুদী চক্রান্তের শিকার হয়ে সরকারী নির্যাতনের সম্মুখীন হন। ফলে আল্লাহ তাঁকে সশরীরে আসমানে উঠিয়ে নেন (আলে ইমরান, আয়াত ৫২, ৫৪-৫৫; নিসা, আয়াত ১৫৮)। শত্রুরা তাঁরই মত আরেকজনকে সন্দেহ বশে শূলে চড়িয়ে হত্যা করে এবং তারা নিশ্চিতভাবেই ঈসাকে হত্যা করেনি’ (নিসা, আয়াত ১৫৭)। (১০) তিনিই একমাত্র নবী, যাকে আল্লাহ জীবিত অবস্থায় দুনিয়া থেকে আসমানে উঠিয়ে নিয়েছেন এবং ক্বিয়ামতের প্রাক্কালে তিনি পুনরায় সশরীরে দুনিয়াতে অবতরণ করবেন এবং দাজ্জাল, ক্রুশ, শূকর প্রভৃতি ধ্বংস করবেন। অতঃপর ইমাম মাহদীর নেতৃত্বে সারা পৃথিবীতে ইসলামী শরী‘আত অনুযায়ী শান্তির রাজ্য কায়েম করবেন।

 

হযরত ঈসা (আঃ)-এর কাহিনী

 

সাধারণতঃ সকল নবীই ৪০ বছর বয়সে নবুঅত লাভ করেছেন। তবে ঈসা (আঃ) সম্ভবতঃ তার কিছু পূর্বেই নবুঅত ও কিতাব প্রাপ্ত হন। কেননা বিভিন্ন রেওয়ায়াত দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে, আকাশে তুলে নেবার সময় তাঁর বয়স ৩০ থেকে ৩৫-এর মধ্যে ছিল। তিনি যৌবনে আকাশে উত্তোলিত হয়েছিলেন এবং পৌঢ় বয়সে পুনরায় দুনিয়ায় ফিরে এসে মানুষকে তাওহীদের দাওয়াত দিবেন।

 

ঈসা (আঃ)-এর দাওয়াত

 

ঈসা (আঃ) নবুঅত লাভ করার পর স্বীয় কওমকে প্রধানতঃ নিম্নোক্ত ৭টি বিষয়ে দাওয়াত দিয়ে বলেন, ‘হে বনু ইস্রাঈলগণ! আমি তোমাদের নিকটে আগমন করেছি (১) আল্লাহর রাসূল হিসাবে (২) আমার পূর্ববর্তী তওরাত কিতাবের সত্যায়নকারী হিসাবে এবং (৩) আমার পরে আগমনকারী রাসূলের সুসংবাদ দানকারী হিসাবে, যার নাম হবে আহমাদ’... (ছফ, আয়াত ৬)। তিনি বললেন, ‘(৪) নিশ্চয়ই আল্লাহ আমার পালনকর্তা এবং তোমাদের পালনকর্তা। অতএব তোমরা তাঁর ইবাদত কর। এটাই সরল পথ’ (মারিয়াম, আয়াত ৩৬)।

 

তিনি বললেন, ‘আমার আনীত এ কিতাব (ইনজীল) পূর্ববর্তী কিতাব তাওরাতকে সত্যায়ন করে এবং এজন্য যে, (৫) আমি তোমাদের জন্য হালাল করে দেব কোন কোন বস্ত্ত, যা তোমাদের জন্য হারাম ছিল। আর (৬) আমি তোমাদের নিকটে এসেছি তোমাদের পালনকর্তার নিদর্শন সহ। অতএব (৭) তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং আমার আনুগত্য কর’ (আলে ইমরান, আয়াত ৫০)।

 

এটার ব্যাখ্যা এসেছে অন্য আয়াতে যে,

 

 ‘‘বস্ত্ততঃ ইহুদীদের পাপের কারণে আমরা তাদের উপরে হারাম করেছিলাম বহু পবিত্র বস্ত্ত, যা তাদের জন্য হালাল ছিল। এটা ছিল (১) আল্লাহর পথে তাদের অধিক বাধা দানের কারণে’। ‘এবং এ কারণে যে, (২) তারা সূদ গ্রহণ করত। অথচ এ ব্যাপারে তাদের নিষেধ করা হয়েছিল এবং এ কারণে যে, (৩) তারা অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভোগ করত। বস্ত্ততঃ আমরা কাফিরদের জন্য প্রস্ত্তত রেখেছি বেদনাদায়ক শাস্তি’’ (নিসা, আয়াত ১৬০-১৬১)। তিনি আরও বলেন,

 

‘‘এবং ইহুদীদের জন্য আমরা (১) প্রত্যেক নখবিশিষ্ট পশু হারাম করেছিলাম এবং (২) ছাগল ও গরু থেকে এতদুভয়ের চর্বি আমরা তাদের জন্য হারাম করেছিলাম। কিন্তু ঐ চর্বি ব্যতীত যা পৃষ্ঠে কিংবা অন্ত্রে সংযুক্ত থাকে অথবা অস্থির সাথে মিলিত থাকে। তাদের অবাধ্যতার কারণে আমরা তাদের এ শাস্তি দিয়েছিলাম। আর আমরা অবশ্যই সত্যবাদী’’ (আন‘আম, আয়াত ১৪৬)।

 

ঈসা (আঃ)-এর পেশকৃত পাঁচটি নিদর্শন

 

তাওহীদ ও রিসালাতের উপরে ঈমান আনার দাওয়াত দেওয়ার পরে তিনি বনু ইস্রাঈলকে তাঁর আনীত নিদর্শন সমূহ বর্ণনা করেন। তিনি বলেন,

 

‘‘নিশ্চয়ই আমি তোমাদের নিকটে তোমাদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে এসেছি নিদর্শনসমূহ নিয়ে। (যেমন-) (১) আমি তোমাদের জন্য মাটি দ্বারা পাখির আকৃতি তৈরী করে দেই। তারপর তাতে যখন ফুঁক দেই, তখন তা উড়ন্ত পাখিতে পরিণত হয়ে যায় আল্লাহর হুকুমে। (২) আর আমি সুস্থ করে তুলি জন্মান্ধকে এবং (৩) ধবল-কুষ্ঠ রোগীকে। (৪) আর আমি জীবিত করে দেই মৃতকে আল্লাহর হুকুমে। (৫) আমি তোমাদেরকে বলে দেই যা তোমরা খেয়ে আস এবং যা তোমরা ঘরে রেখে আস। এতে প্রকৃষ্ট নিদর্শন রয়েছে যদি তোমরা বিশ্বাসী হও’’ (আলে ইমরান, আয়াত ৪৯)।

 

উল্লেখ্য যে, যখন যে দেশে যে বিষয়ের আধিক্য ও উৎকর্ষ থাকে, তখন সেই দেশে সেই বিষয়ে সর্বোচ্চ ব্যুৎপত্তি সহ নবী প্রেরণ করা হয়। যেমন মূসার সময় মিসরে ছিল জাদুবিদ্যার প্রাদুর্ভাব। ফলে আল্লাহ তাঁকে লাঠির মো‘জেযা দিয়ে পাঠালেন। অনুরূপভাবে ঈসার সময়ে শাম বা সিরিয়া এলাকা ছিল চিকিৎসা বিদ্যায় সেরা। সেকারণ ঈসাকে আল্লাহ উপরে বর্ণিত অলৌকিক ক্ষমতা ও মো‘জেযা সমূহ দিয়ে পাঠান। যেমন শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর সময়ে আরবরা ভাষা ও সাহিত্যের সর্বোচ্চ অলংকারে ভূষিত ছিল। ফলে কুরআন তাদের সামনে হতবুদ্ধিকারী মো‘জেযা রূপে নাযিল হয়। যাতে আরবের স্বনামখ্যাত কবিরা মাথা নোয়াতে বাধ্য হয়।

 

দাওয়াতের ফলশ্রুতি

 

ঈসা (আঃ)-এর মো‘জেযা সমূহ দেখে এবং তাঁর মুখনিঃসৃত তাওহীদের বাণী শুনে গরীব শ্রেণীর কিছু লোক তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হ’লেও দুনিয়াদার সমাজ নেতারা তাঁর প্রতি বিরূপ হয়ে ওঠে। কারণ তাওহীদের সাম্য বাণী সমাজের কায়েমী স্বার্থবাদী নেতাদের স্বার্থেই প্রথম আঘাত হেনে থাকে। শয়তান তাদেরকে কুমন্ত্রণা দেয়। ফলে তারা ঈসা (আঃ)-এর বিরোধিতায় লিপ্ত হয়।

 

বিগত নবীগণের ন্যায় বনু ইস্রাঈলগণ তাদের বংশের শেষ নবী ঈসা (আঃ)-এর বিরুদ্ধে নানাবিধ চক্রান্ত শুরু করে। তারা প্রথমেই ঈসা (আঃ)-কে ‘জাদুকর’ বলে আখ্যায়িত করে। যেমন আল্লাহ বলেন, (হে ঈসা!) ‘‘যখন তুমি তাদের কাছে প্রমাণাদি নিয়ে এসেছিলে। অতঃপর তাদের মধ্যে যারা কাফের তারা বলল, এটা প্রকাশ্য জাদু ব্যতীত কিছুই নয়’’ (মায়েদাহ, আয়াত ১১০)।

 

উক্ত অপবাদে ঈসা (আঃ) ক্ষান্ত না হয়ে বরং আরও দ্বিগুণ বেগে দ্বীনের দাওয়াত দিয়ে যেতে থাকেন। তখন বিরোধীরা বেছে নেয় অতীব নোংরা পথ। তারা তাঁর মায়ের নামে অপবাদ রটাতে শুরু করে। যাতে ঈসা (আঃ) অত্যন্ত ব্যথা পেলেও নবুঅতের গুরুদায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সবকিছু নীরবে সহ্য করতে থাকেন। ফলে ঈসা (আঃ)-এর সমর্থক সংখ্যা যতই বাড়তে থাকে, অবিশ্বাসী সমাজ নেতাদের চক্রান্ত ততই বৃদ্ধি পেতে থাকে। এবার তারা তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র করল এবং সেজন্য দেশের বাদশাহকে তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে দেবার ষড়যন্ত্র করল। তারা অনবরত বাদশাহর কান ভারি করতে থাকে এই মর্মে যে, লোকটি আল্লাহ দ্রোহী। সে তাওরাত পরিবর্তন করে সবাইকে বিধর্মী করতে সচেষ্ট। এসব অভিযোগ শুনে অবশেষে বাদশাহ তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করেন। তখন ইহুদীদের এসব ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করার জন্য আল্লাহ স্বীয় কৌশল প্রেরণ করেন এবং ঈসা (আঃ)-কে সশরীরে আসমানে উঠিয়ে নেন।

 

ইহুদীদের উপর প্রেরিত গযব ও তার কারণ সমূহ

 

ঈসা (আঃ)-এর দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করার কারণে আল্লাহ ইহুদী কাফিরদের উপরে নানাবিধ দুনিয়াবী গযব নাযিল করেন। তাদেরকে কেন শাস্তি দেওয়া হয়েছিল- সে বিষয়ে অনেকগুলি কারণের মধ্যে আল্লাহ বলেন,

 

 ‘‘তারা যে শাস্তিপ্রাপ্ত হয়েছিল, তা ছিল (১) তাদের অঙ্গীকার ভঙ্গের কারণে, (২) অন্যায়ভাবে রাসূলগণকে হত্যা করার কারণে এবং (৩) তাদের এই উক্তির কারণে যে, ‘আমাদের হৃদয় আচ্ছন্ন’...। ‘আর (৪) তাদের কুফরীর কারণে এবং (৫) মারিয়ামের প্রতি মহা অপবাদ আরোপের কারণে’। ‘আর তাদের (৬) একথার কারণে যে, ‘আমরা মারিয়াম-পুত্র ঈসা মসীহকে হত্যা করেছি, যিনি ছিলেন আল্লাহর রাসূল। অথচ তারা না তাঁকে হত্যা করেছিল, না শূলে চড়িয়েছিল। বরং তাদের জন্য ধাঁধার সৃষ্টি করা হয়েছিল। বস্ত্ততঃ তারা এ ব্যাপারে নানাবিধ কথা বলে। তারা এ বিষয়ে সন্দেহের মাঝে পড়ে আছে। শুধুমাত্র ধারণার অনুসরণ করা ব্যতীত এ বিষয়ে তাদের কোন জ্ঞানই নেই। আর নিশ্চিতভাবেই তারা তাকে হত্যা করেনি’। ‘বরং তাকে আল্লাহ নিজের কাছে উঠিয়ে নিয়েছেন। আর আল্লাহ হ’লেন মহা পরাক্রান্ত ও প্রজ্ঞাময়’’ (নিসা, আয়াত ১৫৫-১৫৮)।

 

ইহুদীদের অভিশপ্ত হওয়ার ১০টি কারণ

 

সূরা নিসা ১৫৫-৬১ আয়াতে ইহুদীদের ইপর আল্লাহর গযব নাযিলের ও তাদের অভিশপ্ত হওয়ার যে কারণ সমূহ বর্ণিত হয়েছে, তা সংক্ষেপে নিম্নরূপ :

 

(১) তাদের ব্যাপক পাপাচার (২) আল্লাহর পথে বাধা দান (৩) সূদী লেনদেন (৪) অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ (৫) অঙ্গীকার ভঙ্গ করা (৬) নবীগণকে হত্যা করা (৭) আল্লাহর পথে আগ্রহী না হওয়া এবং অজুহাত দেওয়া যে, আমাদের হৃদয় আচ্ছন্ন (৮) কুফরী করা (৯) মারিয়ামের প্রতি মিথ্যা অপবাদ দেওয়া (১০) ঈসাকে শূলে বিদ্ধ করে হত্যার মিথ্যা দাবী করা।

 

ঈসা (আঃ)-কে হত্যার ষড়যন্ত্র ও তাঁর ঊর্ধ্বারোহন

 

তৎকালীন রোম সম্রাট ছাতিয়ূনুস-এর নির্দেশে (মাযহারী) ঈসা (আঃ)-কে গ্রেফতারের জন্য সরকারী বাহিনী ও ইহুদী চক্রান্তকারীরা তাঁর বাড়ী ঘেরাও করে। তারা জনৈক নরাধমকে ঈসা (আঃ)-কে হত্যা করার জন্য পাঠায়। কিন্তু ইতিপূর্বে আল্লাহ ঈসা (আঃ)-কে উঠিয়ে নেওয়ায় সে বিফল মনোরথ হয়ে ফিরে যায়। কিন্তু এরি মধ্যে আল্লাহর হুকুমে তার চেহারা ঈসা (আঃ)-এর সদৃশ হয়ে যায়। ফলে ইহুদীরা তাকেই ঈসা ভেবে শূলে বিদ্ধ করে হত্যা করে।

 

ইহুদী-নাছারারা কেবল সন্দেহের বশবর্তী হয়েই নানা কথা বলে এবং ঈসাকে হত্যা করার মিথ্যা দাবী করে। আল্লাহ বলেন, ‘‘এ বিষয়ে তাদের কোনই জ্ঞান নেই। তারা কেবলই সন্দেহের মধ্যে পড়ে আছে। এটা নিশ্চিত যে, তারা তাকে হত্যা করতে পারেনি’(নিসা, আয়াত ১৫৭)। বরং তার মত কাউকে তারা হত্যা করেছিল।

 

উল্লেখ্য যে, ঈসা (আঃ) তাঁর উপরে বিশ্বাসী সে যুগের ও পরবর্তী যুগের সকল খৃষ্টানের পাপের বোঝা নিজে কাঁধে নিয়ে প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ শূলে বিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন বলে খৃষ্টানদের দাবী স্রেফ প্রতারণা ও অপপ্রচার বৈ কিছুই নয়।

 

আল্লাহর পাঁচটি অঙ্গীকার

 

ইহুদীদের বিপক্ষে হযরত ঈসা (আঃ)-কে সাহায্যের ব্যাপারে আল্লাহ পাঁচটি ওয়াদা করেছিলেন এবং সবক’টিই তিনি পূর্ণ করেন। (১) হত্যার মাধ্যমে নয় বরং তার স্বাভাবিক মৃত্যু হবে (২) তাঁকে ঊর্ধ্বজগতে তুলে নেওয়া হবে (৩) তাকে শত্রুদের অপবাদ থেকে মুক্ত করা হবে (৪) অবিশ্বাসীদের বিপক্ষে ঈসার অনুসারীদেরকে ক্বিয়ামত অবধি বিজয়ী রাখা হবে এবং (৫) ক্বিয়ামতের দিন সবকিছুর চূড়ান্ত ফায়ছালা করা হবে। এ বিষয়গুলি বর্ণিত হয়েছে নিম্নোক্ত আয়াতে। যেমন আল্লাহ বলেন,

 

 ‘‘আর স্মরণ কর যখন আল্লাহ বললেন, হে ঈসা! আমি তোমাকে ওফাত দিব এবং তোমাকে আমার কাছে তুলে নেব এবং তোমাকে কাফিরদের হাত থেকে মুক্ত করব। আর যারা তোমার অনুসরণ করবে, তাদেরকে ক্বিয়ামত পর্যন্ত কাফিরদের বিরুদ্ধে বিজয়ী করে রাখবো। অতঃপর তোমাদের সবাইকে আমার কাছে ফিরে আসতে হবে, তখন আমি তোমাদের মধ্যকার বিবাদীয় বিষয়ে ফায়ছালা করে দেব’’ (আলে ইমরান, আয়াত ৫৫)।

 

উক্ত আয়াতে বর্ণিত অর্থ ‘আমি তোমাকে ওফাত দিব’। ‘ওফাত’ অর্থ পুরোপুরি নেওয়া। মৃত্যুকালে মানুষের আয়ু পূর্ণ হয় বলে একে ‘ওফাত’ বলা হয়। রূপক অর্থে নিদ্রা যাওয়াকেও ওফাত বা মৃত্যু বলা হয়। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ মানুষের প্রাণ নিয়ে নেন তার মৃত্যুকালে, আর যে মরেনা তার নিদ্রাকালে’ (যুমার, আয়াত ৪২)। সেকারণ যাহহাক, ফাররা প্রমুখ বিদ্বানগণ مُتَوَفِّيْكَ وَرَافِعُكَ إِلىَّ -এর অর্থ বলেন, আমি আপনাকে নিজের কাছে উঠিয়ে নেব এবং শেষ যামানায় (পৃথিবীতে নামিয়ে দিয়ে) স্বাভাবিক মৃত্যু দান করব। এখানে বর্ণনার আগপিছ হয়েছে মাত্র’ (কুরতুবী, ইবনু কাছীর)। যা কুরআনের বহু স্থানে হয়েছে। ঈসার অবতরণ, দাজ্জাল নিধন, পৃথিবীতে শান্তির রাজ্য স্থাপন ইত্যাদি বিষয়ে ছহীহ ও মুতাওয়াতির হাদীছ সমূহ বর্ণিত হয়েছে। প্রায় সকল বড় বড় নবীই হিজরত করেছেন। এক্ষণে পৃথিবী থেকে আসমানে উঠিয়ে নেওয়া, অতঃপর পুনরায় পৃথিবীতে ফিরিয়ে দিয়ে স্বাভাবিক মৃত্যু দান করা- এটা ঈসা (আঃ)-এর জন্য এক ধরনের হিজরত বৈ কি! পার্থক্য এই যে, অন্যান্য নবীগণ দুনিয়াতেই এক স্থান থেকে অন্য স্থানে হিজরত করেছেন। পক্ষান্তরে ঈসা (আঃ) দুনিয়া থেকে আসমানে হিজরত করেছেন। অতঃপর আসমান থেকে দুনিয়াতে ফিরে আসবেন। আল্লাহ সর্বাধিক অবগত এবং তিনিই সকল ক্ষমতার অধিকারী।

 

অতঃপর ঈসার অনুসারীদের ক্বিয়ামত অবধি বিজয়ী করে রাখার অর্থ ঈমানী বিজয় এবং সেটি ঈসা (আঃ)-এর ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর অনুসারীদের মাধ্যমেই সম্পন্ন হয়েছে। ঈমানী বিজয়ের সাথে সাথে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিজয় যেমন খেলাফত যুগে হয়েছে, ভবিষ্যতে আবারও সেটা হবে। এমনকি কোন বস্তিঘরেও ইসলামের বিজয় নিশান উড়তে বাকী থাকবে না। সবশেষে ক্বিয়ামত প্রাক্কালে ঈসা ও মাহদীর নেতৃত্বে বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক বিজয় সংঘটিত হবে এবং সারা পৃথিবী শান্তির রাজ্যে পরিণত হবে।

 

হাওয়ারীকারা?

 

حَوارِىّ শব্দটি حَوَرٌ ধাতু থেকে ব্যুৎপন্ন। অর্থ দেওয়ালে চুনকাম করার জন্য ধবধবে সাদা চুন। পারিভাষিক অর্থে ঈসা (আঃ)-এর খাঁটি অনুসারী শীর্ষস্থানীয় ভক্ত ও সাহায্যকারী ব্যক্তিগণকে ‘হাওয়ারী’ বলা হ’ত। কেউ বলেছেন যে, নাবাত্বী ভাষায় হাওয়ারী অর্থ ধোপা। ঈসার খাঁটি অনুসারীগণ ধোপা ছিলেন, যারা কাপড় ধৌত করতেন। পরে তারা ঐ নামেই পরিচিত হন। অথবা এজন্য তাদের উপাধি ‘হাওয়ারী’ ছিল যে, তারা সর্বদা সাদা পোষাক পরিধান করতেন। কোন কোন তাফসীরবিদ তাঁদের সংখ্যা ১২ জন বলেছেন। ঈসা (আঃ)-এর ভক্ত সহচরগণকে যেমন ‘হাওয়ারী’ বলা হয়; শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর ভক্ত সহচরগণকে তেমনি ‘ছাহাবী’ বলা হয়। আভিধানিক অর্থে ছাহাবী অর্থ সাথী বা সহচর হ’লেও পারিভাষিক অর্থে রাসূল (ছাঃ) ব্যতীত অন্যদের সাথীগণকে ‘ছাহাবী’ বলা হয় না। কেননা এই পরিভাষাটি কেবল ঐসকল পবিত্রাত্মা ব্যক্তিগণের জন্যেই সৃষ্টি হয়েছে। অবশ্য ‘হাওয়ারী’ শব্দটি কোন কোন সময় শুধু ‘সাহায্যকারী’ বা আন্তরিক বন্ধু অর্থেও ব্যবহৃত হয়। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একদা বলেন, ‘প্রত্যেক নবীর একজন ‘হাওয়ারী’ অর্থাৎ খাঁটি সহচর থাকে। তেমনি আমার ‘হাওয়ারী’ হ’ল যুবায়ের’।

 

ঈসা (আঃ) যখন বনু ইস্রাঈলের স্বার্থবাদী নেতাদের বিরোধিতা ও চক্রান্ত বুঝতে পারলেন, তখন নিজের একনিষ্ঠ সাথীদের বাছাই করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করলেন এবং সবাইকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের মধ্যে আমার সত্যিকারের ভক্ত ও অনুসারী কারা? একথাটিই কুরআনে বর্ণিত হয়েছে নিম্নোক্তভাবে-

 

 ‘‘যখন ঈসা বনু ইস্রাঈলের কুফরী অনুধাবণ করলেন, তখন বললেন, কারা আছ আল্লাহর পথে আমাকে সাহায্যকারী? তখন হাওয়ারীগণ বলল, আমরাই আল্লাহর পথে আপনার সাহায্যকারী। আমরা আল্লাহর উপরে ঈমান এনেছি। আপনি সাক্ষ্য থাকুন যে আমরা সবাই আত্মসমর্পণকারী’। ‘হে আমাদের পালনকর্তা! আমরা সেই সব বিষয়ের উপরে বিশ্বাস স্থাপন করেছি, যা তুমি নাযিল করেছ এবং আমরা রাসূলের অনুসারী হয়েছি। অতএব তুমি আমাদেরকে মান্যকারীদের তালিকাভুক্ত করে নাও’’ (আলে ইমরান, আয়াত ৫২-৫৩)

 

অন্যত্র এসেছে এভাবে-

 

 ‘‘হে বিশ্বাসী গণ! তোমরা আল্লাহর সাহায্যকারী হয়ে যাও। যেমন মারিয়াম-তনয় ঈসা হাওয়ারীদের বলেছিল, কে আছ আল্লাহর জন্য আমাকে সাহায্যকারী? হাওয়ারীরা বলেছিল, আমরাই আল্লাহর সাহায্যকারী। অতঃপর বনু ইস্রাঈলের একটি দল বিশ্বাস স্থাপন করল এবং অন্যদল প্রত্যাখ্যান করল। অতঃপর আমরা বিশ্বাসীদের সাহায্য করলাম তাদের শত্রুদের উপরে। ফলে তারা বিজয়ী হ’ল’’ (ছফ, আয়াত ১৪)।

 

অবশ্য হাওয়ারীদের এই আনুগত্য প্রকাশের ক্ষমতা আল্লাহ দান করেছিলেন তাঁর বিশেষ অনুগ্রহে। যেমন তিনি বলেন,

 

‘‘আর যখন আমি হাওয়ারীদের মনে জাগ্রত করলাম যে, আমার প্রতি ও আমার রাসূলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন কর, তখন তারা বলল, আমরা বিশ্বাস স্থাপন করলাম এবং আপনি সাক্ষী থাকুন যে, আমরা সবাই আত্মসমর্পণকারী’’ (মায়েদাহ, আয়াত ১১১)। এখানে হাওয়ারীদের নিকট ‘অহি’ করা অর্থ তাদের হৃদয়ে বিষয়টি সঞ্চার করা বা জাগ্রত করা। এটা নবুঅতের ‘অহি’ নয়।

 

বস্ত্ততঃ শত্রুদের উৎপীড়নে অতিষ্ঠ হয়ে ঈসা (আঃ) তাঁর অনুসারীগণের প্রতি উপরোক্ত আহবান জানাতে বাধ্য হয়েছিলেন। সাথে সাথে বার জন ভক্ত অনুসারী তাঁর ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন এবং আনুগত্যের শপথ নিয়েছিলেন। অতঃপর তারাই ঈসা (আঃ)-এর ঊর্ধ্বারোহণের পরে ঈসায়ী ধর্ম প্রচারে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। যদিও পরবর্তী কালে তাদের মধ্যে বহু ভেজাল ঢুকে পড়ে এবং তারা বহু দলে বিভক্ত হয়ে যায়। আজও বিশ্ব খৃষ্টান সমাজ রোমান ক্যাথলিক ও প্রটেষ্ট্যান্ট নামে প্রধান দু’দলে বিভক্ত। যাদের রয়েছে অসংখ্য উপদল। আর এরা সব দলই ভ্রান্ত।

 

ইমাম বাগাভী (রহঃ) সূরা ছফ ১৪ আয়াতের তাফসীরে আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, ঈসা (আঃ)-এর ঊর্ধ্বারোহণের পর খৃষ্টান জাতি তিন দলে বিভক্ত হয়ে যায়। একদল তাকে ‘আল্লাহ’ বলে। একদল তাঁকে ‘আল্লাহর পুত্র’ বলে এবং একদল তাকে ‘আল্লাহর দাস ও রাসূল’ বলে। প্রত্যেক দলের অনুসারী দল ছিল। তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-কলহ বাড়তে থাকে। অতঃপর শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর আগমন ঘটে এবং তিনি মুমিনদের দলকে সমর্থন দেন। ফলে তারাই দলীলের ভিত্তিতে জয়লাভ করে। বলা বাহুল্য মুমিন ঈসায়ীগণ সবাই ইসলাম কবুল করে ধন্য হন। ‘বিশ্বাসীদেরকে আল্লাহ সাহায্য করলেন ও তারা বিজয়ী হ’ল’ বলতে উম্মতে মুহাম্মাদীকে বুঝানো হয়েছে। যারা ঈসা ও মুহাম্মাদ উভয় নবীর উপরে বিশ্বাস স্থাপন করেছেন এবং অবিশ্বাসী কাফের মুশরিকদের উপর দুনিয়া ও আখেরাতে বিজয়ী হয়েছেন।

 

আসমান থেকে খাঞ্চা ভর্তি খাদ্য অবতরণ

 

মূসা (আঃ)-এর উম্মতগণের জন্য আল্লাহ আসমান থেকে মান্না ও সালওয়ার জান্নাতী খাবার নামিয়ে দিয়েছিলেন। সম্ভবতঃ তাতে উদ্বুদ্ধ হয়ে একদা হাওয়ারীগণ ঈসা (আঃ)-এর নিকটে অনুরূপ দাবী করে বসলো। বিষয়টির কুরআনী বর্ণনা নিম্নরূপ-

 

 ‘‘যখন হাওয়ারীরা বলল, হে মারিয়াম-পুত্র ঈসা! আপনার পালনকর্তা কি এরূপ করতে পারেন যে, আমাদের জন্য আকাশ থেকে খাদ্য ভর্তি খাঞ্চা অবতরণ করে দেবেন? তিনি বললেন, যদি তোমরা ঈমানদার হও, তবে আল্লাহকে ভয় কর’। ‘তারা বলল, আমরা তা থেকে খেতে চাই, আমাদের অন্তর পরিতৃপ্ত হবে এবং আমরা জেনে নেব যে, আপনি সত্য বলেছেন ও আমরা সাক্ষ্যদাতা হয়ে যাব’। ‘তখন মরিয়াম-তনয় ঈসা বলল, হে আল্লাহ! হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদের প্রতি আসমান থেকে খাদ্যভর্তি খাঞ্চা অবতীর্ণ করুন। তা আমাদের জন্য তথা আমাদের প্রথম ও পরবর্তী সবার জন্য আনন্দোৎসব হবে এবং আপনার পক্ষ হ’তে একটি নিদর্শন হবে। আপনি আমাদের রূযী দান করুন। আপনিই শ্রেষ্ঠ রূযীদাতা’। ‘আল্লাহ বললেন, নিশ্চয়ই আমি সে খাঞ্চা তোমাদের প্রতি অবতীর্ণ করব। অতঃপর যে ব্যক্তি অকৃতজ্ঞ হবে, আমি তাকে এমন শাস্তি দেব, যে শাস্তি বিশ্বজগতে অপর কাউকে দেব না’’ (মায়েদাহ, আয়াত ১১২-১১৫)।

 

উল্লেখ্য যে, উক্ত খাদ্য সঞ্চিত রাখা নিষিদ্ধ ছিল। তিরমিযীর একটি হাদীছে আম্মার বিন ইয়াসির (রাঃ) হ’তে বর্ণিত হয়েছে যে, উক্ত খাদ্যভর্তি খাঞ্চা আসমান হ’তে নাযিল হয়েছিল এবং হাওয়ারীগণ তৃপ্তিভরে খেয়েছিল। কিন্তু লোকদের মধ্যে কিছু লোক তা সঞ্চিত রেখেছিল। ফলে তারা বানর ও শূকরে রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছিল।

 

ঈসা (আঃ)-এর অনুসারীদের কুফরী এবং ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহর সঙ্গে ঈসা (আঃ)-এর কথোপকথন

 

ঈসা (আঃ)-এর ঊর্ধ্বারোহনের ফলে ঈসায়ীদের মধ্যে যে আক্বীদাগত বিভ্রান্তি দেখা দেয় এবং তারা যে কুফরীতে লিপ্ত হয়, সে বিষয়ে আল্লাহ ক্বিয়ামতের দিন ঈসাকে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন। যেমন আল্লাহ বলেন,

 

‘‘যখন আল্লাহ বলবেন, হে মরিয়াম-তনয় ঈসা! তুমি কি লোকদের বলেছিলে যে, তোমরা আল্লাহকে ছেড়ে আমাকে ও আমার মাতাকে উপাস্য সাব্যস্ত কর? ঈসা বলবেন, আপনি মহাপবিত্র। আমার জন্য শোভা পায় না যে, আমি এমন কথা বলি, যা বলার কোন অধিকার আমার নেই। যদি আমি বলে থাকি, তবে আপনি অবশ্যই তা জানেন। বস্ত্ততঃ আপনি আমার মনের কথা জানেন, কিন্তু আমি জানি না কি আপনার মনের মধ্যে আছে। নিশ্চয়ই আপনি অদৃশ্য বিষয়ে অবগত’। ‘আমি তো তাদের কিছুই বলিনি, কেবল সেকথাই বলেছি যা আপনি বলতে বলেছেন যে, তোমরা আল্লাহর দাসত্ব কর, যিনি আমার ও তোমাদের পালনকর্তা। বস্ত্ততঃ আমি তাদের সম্পর্কে অবগত ছিলাম, যতদিন আমি তাদের মধ্যে ছিলাম। অতঃপর যখন আপনি আমাকে লোকান্তরিত করলেন, তখন থেকে আপনিই তাদের সম্পর্কে অবগত রয়েছেন। আপনি সকল বিষয়ে পূর্ণ অবগত’। ‘এক্ষণে যদি আপনি তাদেরকে শাস্তি দেন, তবে তারা আপনার দাস। আর যদি আপনি তাদের ক্ষমা করেন, তবে আপনিই পরাক্রান্ত ও মহাবিজ্ঞ’’ (মায়েদাহ, আয়াত ১১৬-১১৮)।

 

উপরোক্ত ১১৭নং আয়াতে বর্ণিত فَلَمَّا تَوَفَّيْتَنِيْ বাক্যটিতে ঈসা (আঃ)-এর মৃত্যুর দলীল তালাশ করার এবং তাঁর ঊর্ধ্বারোহনের বিষয়টিকে অস্বীকার করার প্রমাণ হিসাবে উপস্থাপন করার কোন সুযোগ নেই। কেননা এ কথোপকথনটি ক্বিয়ামতের দিন হবে। যার আগে আসমান থেকে অবতরণের পর দুনিয়ায় তাঁর স্বাভাবিক মৃত্যু হয়ে যাবে।

 

ঈসা (আঃ)-এর কাহিনী থেকে শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ

 

হযরত ঈসা (আঃ)-এর নবুঅতী জীবন থেকে আমরা নিম্নোক্ত শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ জানতে পারি। যেমন-

 

(১) পিতা ইবরাহীম (আঃ)-এর কনিষ্ঠ পুত্র ইসহাক (আঃ)-এর বংশের হাযার হাযার নবী-রাসূলের মধ্যে সর্বশেষ নবী ও কিতাবধারী রাসূল ছিলেন হযরত ঈসা (আঃ)। তাঁর পূর্বেকার সকল নবী এবং তিনি নিজে শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন, যিনি ইবরাহীম (আঃ)-এর জ্যেষ্ঠ পুত্র ইসমাঈল (আঃ)-এর বংশের একমাত্র নবী এবং সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল। ঈসা (আঃ) পর্যন্ত সকল নবী ও রাসূল বনু ইস্রাঈল তথা স্ব স্ব গোত্রের প্রতি আগমন করলেও শেষনবী প্রেরিত হয়েছিলেন বিশ্ব মানবতার প্রতি বিশ্বনবী হিসাবে। অতএব ঈসা (আঃ)-এর প্রতিশ্রুত শেষনবী ‘আহমাদ’ বা মুহাম্মাদ-এর অনুসারী উম্মতে মুহাম্মাদীই হ’ল ঈসা (আঃ)-এর প্রকৃত অনুসারী ও প্রকৃত উত্তরসুরী। নামধারী খৃষ্টানরা নয়।

 

(২) মু‘জেযা প্রদর্শনের মাধ্যমে বিরোধী পক্ষকে ভয় দেখানো যায় বা চুপ করানো যায়। কিন্তু হেদায়াতের জন্য আল্লাহর রহমত আবশ্যক। যেমন ঈসা (আঃ)-কে যে মু‘জেযা দেওয়া হয়েছিল, সে ধরনের মু‘জেযা অন্য কোন নবীকে দেওয়া হয়নি। এমনকি তাঁর জন্মটাই ছিল এক জীবন্ত মু‘জেযা। কিন্তু তা সত্ত্বেও শত্রুরা হেদায়াত লাভ করেনি।

 

(৩) সবকিছু মানবীয় জ্ঞান দ্বারা পরিমাপ করা যায় না। বরং সর্বদা এলাহী সিদ্ধান্তের প্রতি বিশ্বাসী ও আকাংখী থাকতে হয়। যেমন মারিয়াম ও তৎপুত্র ঈসার জীবনের প্রতিটি ঘটনায় প্রমাণিত হয়েছে।

 

(৪) যারা নিঃস্বার্থভাবে সমাজের কাজ করেন ও পরকালীন মঙ্গলের পথ প্রদর্শন করেন, স্বার্থপর ও দুনিয়া পূজারী সমাজ নেতারা তাদের শত্রু হয় এবং পদে পদে বাধা দেয়। কিন্তু সাথে সাথে একদল নিঃস্বার্থ সহযোগীও তারা পেয়ে থাকেন। যেমন ঈসা (আঃ) পেয়েছিলেন।

 

(৫) দুনিয়াবী সংঘাতে দুনিয়াদারদের পার্থিব বিজয় হ’লেও চূড়ান্ত বিচারে তাদের পরাজয় হয় এবং তারা ইতিহাসে সর্বাধিক নিন্দিত ব্যক্তিতে পরিণত হয়। পক্ষান্তরে নবী ও সমাজ সংস্কারকগণ নির্যাতিত হ’লেও চূড়ান্ত বিচারে তারাই বিজয়ী হন এবং সারা বিশ্ব তাদেরই ভক্ত ও অনুসারী হয়। ঈসা (আঃ)-এর জীবন তারই অন্যতম প্রকৃষ্ট প্রমাণ।

 

আল কুরআনে উল্লেখ

 

 আল কুরআনে শ্রেষ্ঠ নবী রাসুলগনের সাথে হযরত ঈসা (আঃ) এর নাম উল্লেখ হয়েছে। তিনি ছিলেন একজন উচ্চ মর্যাদার রাসুল। আল কুরআনে রাত নাম উল্লেখ হয়েছে ২৫ বার। যে সব সূরায় উল্লেখ হয়েছে সেগুলো হল –

 

আল বাকারা, আয়াত ৮৭, ১৩৬, ২৫৩। আলে ইমরান ; ৪৫, ৫২, ৫৫, ৫৯, ৮৪। আন নিসা ; ১৫৭, ১৬৩, ১৭১। আল মায়িদা ; ৪৬, ৭৮, ১১০, ১১২, ১১৪, ১১৬। আল আনয়াম ; ৮৫। মরিয়ম ; ৩৪। আল আহযাব ; ৭। আশ শুরা ; ১৩। যুখরুফ ; ৬৩। আল হাদিদ ; ২৭। আস সফ ; ৬, ১৪।

 

হযরত ঈসা (আঃ) সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্যে আল কুরআনের নিম্নোক্ত সূরাগুলো পড়বেন –

 

সূরা আলে ইমরান, আয়াত ৩৫-৬০। সূরা আন নিসা, আয়াত ১৫৩-১৬৫ ও ১৭১-১৭৩। সূরা আল মায়িদা, আয়াত ৪৬-৫১, ৬৩-৭৮, ১০৯-১৬০। সূরা মরিয়ম, আয়াত ১৬-৪০। সূরা যুখরুফ, আয়াত ৫৭-৬৫। সূরা আস সফ, আয়াত ৬, ১৪।

 

হযরত ঈসা (আঃ) এর প্রকৃত অনুসারী হলেন তারা, যারা হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) এর প্রতি ঈমান এনে তাঁর অনুসরন এবং আনুগত্য করেছেন।

 

২৫।

 

বিশ্বনবী মুহাম্মাদ রাসুলুল্লাহ

 

(সাঃ)

 

নবুয়্যতের ধারা একটি কড়ির মালার মতো। এ মালার প্রথম কড়ির নাম আলম এবং শেষ কড়ির নাম মুহাম্মাদ। এ দুইটি কড়ির মাঝে রয়েছে শত শত হাজার হাজার কড়ি।

 

১। অনন্য তিন বৈশিষ্ট্য

 

অন্যসব নবী রাসুলের মতই মুহাম্মাদ রাসুলুল্লাহ (সাঃ) ছিলেন একজন মানুষ, একজন নবী ও একজন রাসুল। তবে মহা বিশ্বের মালিক আল্লাহ তায়ালা তাঁকে এমন তিনটি বৈশিষ্ট্য দান করেছেন যা অন্যসব নবী রাসুলদের দান করেননি। সে তিন বৈশিষ্ট্য হলো –

 

এক। সর্বশেষ নবী ও রাসুল। তাঁর মাধ্যমে মহান আল্লাহ তায়ালা নবুয়্যত ও রিসালাতের ধারা শেষ করেছেন। তাঁর নবুয়্যতী আদর্শই কিয়ামত পর্যন্ত অনুসরনীয়।

 

দুই। বিশ্বনবী। মহান আল্লাহ তাঁকে জাতি, বর্ণ, গোত্র, ধর্ম নির্বিশেষে কিয়ামত পর্যন্তকার সকল মানুষের নবী ও রাসুল নিযুক্ত করেছেন।

 

তিন। সমগ্র মানব জাতির জন্যে রহমত ও আশীর্বাদ। তাঁকে পাঠানো হয়েছে রহমত, আশীর্বাদ ও অনুকম্পা স্বরূপ সমগ্র মানব জাতির জন্যে। এ তিনটি বিষয়ের প্রমান হল আল কুরআনের নিম্নোক্ত তিন আয়াত। -

 

১। মুহাম্মাদ তোমাদের কোন পুরুষের পিতা নয়, বরং আল্লাহর রাসুল ও সর্বশেষ নবী। আল্লাহ প্রতিটি বিষয়ে জ্ঞাত। (সূরা আহযাব, আয়াত ৪০)

 

২। আমরা অবশ্যি তোমাকে রাসুল বানিয়ে পাঠিয়েছি সমগ্র মানব জাতির জন্যে সুসংবাদ দাতা ও সতর্ককারী হিসেবে। তবে অধিকাংশ মানুষই এলেম রাখেনা। (সূরা সাবা, আয়াত ২৮)

 

৩। হে মুহাম্মাদ, আমরা তোমাকে রাসুল মনোনীত করে পাঠিয়েছি সমগ্র জগতবাসীর জন্যে রহমত (অনুকম্পা ও আশীর্বাদ) হিসেবে। (সূরা আল আম্বিয়া, আয়াত ১০৭)

 

২। জীবনকাল

 

মুহাম্মাদ রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর জীবনকাল পূর্বকালের নবীগনের জীবনকালের মতো অজ্ঞাত ও অস্পষ্ট নয়। ইতিহাসে তাঁর জীবনকাল জ্ঞাত ও সুস্পষ্ট। ঈসা (আঃ) এর পরে তাঁর জন্ম হয়েছে। ঈসা (আঃ) এর জন্ম সাল থেকে খ্রিষ্ট সাল চালু হয়েছে। মুহাম্মাদ (সঃ) এর জীবনকালের হিসাব রাখা হয়েছে চন্দ্রমাসের হিসেবে। পরবর্তীকালে ঐতিহাসিকরা সেটাকে খৃষ্ট বর্ষের সাথে সংযুক্ত করেছেন। সে হিসেবে তাঁর জন্ম তারিখ হল ৯ই রবিউল আউয়াল, সোমবার, ২২ শে এপ্রিল, ৫৭১ খ্রিষ্টাব্দ। তবে পুরাবের মতটাই ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে সঠিক। এই পার্থক্যটা হয়েছে পরবর্তীকালে চন্দ্র মাসের হিসাবকে খৃষ্ট সনের সাথে মিলাতে গিয়ে এবং চান্দ্র বর্ষ ও সূর্য বর্ষের মধ্যে আত/দশ দিন ফারাক থাকার কারনে। তাঁর বয়স যখন চল্লিশ বছর ছয়মাস ষোলো দিন, তখন তিনি নবুয়্যত লাভ করেন। এটা ছিলো ৬১০ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারী মাস। চন্দ্রমাস ছিল রমযান। তিনি মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেন ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে। এ সময় তাঁর বয়স ছিল ৫৩ বছর।

 

তাঁর অফাত বা মৃত্যু হয়েছিলো সোমবার। এটা ছিল ১২ই রবিউল আউয়াল, ১১ হিজরি, ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দ। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মুহাম্মাদ রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর জীবনকাল ছিল ৬৩ বছর। নবুয়্যত ছিল ২৩ বছর। নবুয়্যত পূর্ব জীবন ছিল ৪০ বছর। ফলে তাঁর জীবনকাল একেবারেই সুস্পষ্ট।

 

৩। জন্ম কোথায়, কোন বংশে?

 

মুহাম্মাদ রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর জন্মস্থান মক্কায়। এটি একটি প্রাচীন শহর। মক্কা বর্তমানে সৌদি আরবের অন্তর্ভুক্ত। এটি লোহিত সাগরের পূর্ব তীরের জেদ্দা নদী বন্দর থেকে পঞ্চাশ মাইল পূর্বে অবস্থিত। চৌদ্দ শত বছর পূর্বের মক্কা ছিলো তরুলতা বিহীন পাহাড় টিলা আর পাথর কংকরময় এক মরু শহর। তখন তাঁদের প্রধান ফসল ছিল খেজুর, কোন কোন এলাকায় আঙ্গুর ও যব। শহরটি প্রধানত ছিল ব্যবসা ও আমদানী নির্ভর। এছাড়া এখানকার লোকেরা উট ও মেষ পালন করতো। আর ঘোড়া ছিল তাঁদের বাহাদুরীর প্রতীক।

 

খ্রিষ্টপূর্ব দুই হাজার বছরেরও কিছু আগের কথা। তখন মক্কায় কোন মানুষ বসবাস করতোনা। এটি ছিল জনমানবহীন পাথর পর্বতের এক ভুতুরে নির্জনভূমি। তখন মহানবী ইবরাহীম (আঃ) তাঁর দুই পুত্রের এক পুত্রকে এখানে পুনর্বাসন করেন। তিনি ছিলেন আল্লাহর রাসুল ইসমাঈল (আঃ)।

 

অতপর আল্লাহর নির্দেশে ইবরাহীম ও ইসমাঈল (আঃ) মক্কার বুকে নির্মাণ করেন আল্লাহর ঘর কা’বা ঘর। ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে ইসমাঈলের বংশধর। বাইরের কিছু লোকও এই শহরের আসে পাশে এসে বসবাস করতে থাকে। এভাবেই গড়ে ওঠে মক্কা নগরী। হযরত ইবরাহীম ও ইসমাঈলের বংশধরেরা পরবর্তীতে কুরাইশ বংশ নামে খ্যাতি অর্জন করে। এ বংশেরই একটি শাখার নাম বনু হাশেম। বনু হাশেমই কুরাইশদের নেতৃত্ব দান করতো। এই বনু হাশেম বংশেই কুরাইশ নেতা আব্দুল মুত্তালিবের পুত্র আব্দুল্লাহর ঔরসে এবং মা আমিনার গর্ভে জন্মগ্রহন করেন বিশ্বনবী মুহাম্মাদ রাসুলুল্লাহ (সঃ)। সুতরাং মুহাম্মাদ (সঃ) হযরত ইবরাহীম (আঃ) এর শ্রেষ্ঠ বংশধর।

 

৪। নবুয়্যত পূর্ব জীবন ও শৈশব

 

বিশ্বনবী (সঃ) মাতৃগর্ভে। এসময় তাঁর পিতা আব্দুল্লাহ সিরিয়ায় বাণিজ্যিক সফরে যান। সেখান থেকে ফেরার পথে তিনি পথিমধ্যে মদিনায় মৃত্যুবরণ করেন। বিধবা হয়ে পড়েন মা আমিনা। মাতৃগর্ভে থাকতেই ইয়াতিম হয়ে পড়েন বিশ্বনবী মুহাম্মাদ (সঃ)।

 

তাঁর জন্মকালে জীবিত ছিলেন কুরাইশ নেতা আব্দুল মুত্তালিব, বড় চাচা আবু তালিব, অন্যান্য চাচা এবং ফুফুরা। কুরাইশদের বংশীয় রীতি অনুযায়ী জন্মের কয়েকদিনের মধ্যেই লালন পালন ও বিশুদ্ধ আরবী ভাষা শিখানোর উদ্দেশ্যে তাঁকে ন্যস্ত করা হয় বেদুইন ধাত্রী মা হালিমার দায়িত্বে। ছয় বছর বয়েস হলে হালিমা তাঁকে মায়ের কোলে ফেরত দিয়ে যান। মা আমিনা ফিরে পান বুকের ধন মুহাম্মাদকে। দাদা আব্দুল মুত্তালিবের সবচেয়ে প্রিয় নাতী মুহাম্মাদ। চাচা এবং ফুফুদের কাছেও সর্বাধিক প্রিয়। শিশুকাল থেকেই সবাই হয়ে পড়েন তাঁর গুনমুগ্ধ। সুন্দরতম গুনাবলী আর মহোত্তম আচরনে তিনি শিশুকাল থেকেই সবার সেরা। ফলে সবার প্রিয় মুহাম্মাদ। ভবিষ্যতে নেতা এবং সেরা মানুষ হবার সব গুনাবলীই ফুতে উঠেছে শিশু মুহাম্মাদের চরিত্রের মধ্যে। মুহাম্মাদের বয়েস ছয় কি আট। এ সময় মা আমিনা সিদ্ধান্ত নেন ছেলেকে দেখাতে মদীনায় নিয়ে যাবেন ওর মাতুলালয়ে। তাছাড়া ওর বাবার কবরও ওখানে। দেখিয়ে আনবেন বাবার কবরও। ফলে তারা মদিনায় এলেন। থাকলেন মাস খানেক। তারপর—তারপর ফিরে চললেন মক্কার উদ্দেশ্যে। কিন্তু পথিমধ্যে প্রচণ্ড জ্বর আক্রমন করলো মা আমিনাকে। শেষ পর্যন্ত তিনি পথেই মারা গেলেন। সাথে ছিলেন মায়ের সেবিকা উম্মে আয়মান। মায়ের মতই তিনি মুহাম্মাদকে লালন পালন করেছেন সারাজীবন। তিনি মুহাম্মাদকে কোলে জড়িয়ে ফিরে এলেন মক্কায়। দাদা আব্দুল মুত্তালিব পরম আদর যত্নে গড়ে তুলছিলেন নাতি মুহাম্মাদকে। কিন্তু এরি মধ্যে দুই বছরের মাথায় তিনিও ইহকাল ত্যাগ করেন। পরিবর্তন হয় অভিভাবক। এবার মুহাম্মাদের অভিভাবকের দায়িত্ব নেন বড় চাচা আবু তালিব। আবু তালিব নিজ সন্তানদের চেয়েও অধিক স্নেহ এবং আদর যত্ন করতেন এতিম ভাতিজা মুহাম্মাদকে। আবু তালিব একবার বারো বছর বয়সে মুহাম্মাদকে বাণিজ্যিক সফরে সিরিয়ায় নিয়ে যান। এ সফরে আবু তালিব মুহাম্মাদের মধ্যে প্রতক্ষ করেন অনেক অলৌকিকত্ব। এভাবে তিনি উপযুক্ত অভিভাবকের অধিনেই বেড়ে ওঠেন ছোট বেলা থেকে। এ প্রসঙ্গেই মহান আল্লাহ তাঁকে উদ্দেশ্য করে বলেন –

 

“তিনি কি তোমায় ইয়াতিম পাননি? তারপর আশ্রয় দেননি।” (আল কুরআন ; ৯৩-৬)

 

৫। নবুয়্যত পূর্বজীবন ; যৌবনকাল

 

এরি মধ্যে মুহাম্মাদ নিজেকে দক্ষ ও সৎ ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। অপরদিকে সততা, সত্যবাদিতা, ন্যায়বিচার ও সমাজ সেবার মাধ্যমে তিনি মক্কার জনগণের নয়নমণিতে পরিনত হন। জনগন তাঁকে উপাধি দেয় ‘আল আমিন’ ও ‘আস সাদিক’। এর মানে পরম বিশ্বস্ত ও মহা সত্যবাদী। পঁচিশ বছর বয়েসে বিয়ে করেন খাদিজাকে। তিনি ছিলেন খাদিজা তাহিরা- পবিত্র নারী খাদিজা। রূপে গুনে এবং সহায় সম্পদে তিনি ছিলেন মক্কার সেরা নারী। মক্কার সেরা নেতা ও ধনীদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে তিনি নিজেই স্বামী হিসেবে পছন্দ করে নেন ভবিষ্যতের মহাপুরুষ মুহাম্মাদকে। খাদিজার গর্ভে জন্ম হয় বিশ্বনবীর চারকন্যা – উম্মে কুলসুম, যয়নব, রুকাইয়া এবং ফাতিমা। প্রথমে কাসেম নামে একটি পুত্রের জন্ম হয়, কিন্তু জন্মের পর স্বল্প সময়ের মধ্যেই কাসেম মারা যান। ইতোমধ্যে সামাজিক বিবাদ ফায়সালায়ও মুহাম্মাদের প্রশংসনীয় কৃতিত্ব সবার কাছে সমাদৃত হয়। জনগন তাঁকে তাঁদের ভবিষ্যতের নেতা ভাবতে থাকে। তাছাড়া সততা, সত্যবাদিতা, বিশ্বস্ততা, নযায়পরায়নতা ও মহৎ মানবীয় গুনাবলীর দিক থেকে জনগন এমন সেরা মানুষ আর কখনো দেখেনি।

 

৬। অন্ধকারে নিমজ্জিত সমাজ

 

সেকালে মানব সমাজ ছিল সকল দিক থেকে অন্ধকারে নিমজ্জিত। তারা ডুবে ছিল অন্ধ ও ভ্রান্ত বিশ্বাসের অটল গহবরে। তাঁদেরকে গ্রাস করে ফেলেছিলো চরিত্রহীনতা ও নৈতিক অধঃপতন। গোত্রীয় ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হাঙ্গামায় ছিল তারা পর্যদুস্ত। কুসংস্কারের বলীতে তারা ছিলো ধংসোন্মুখ। তাঁদের উপর ছায়া বিস্তার করে রেখেছিল অর্থনৈতিক দেউলিয়াত্ব। অধিকাংশ মানুষ ছিল দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ। নারীরা ছিল সম্পূর্ণ অসহায় ও মর্যাদাহীন। ভাস্কর্য পূজা তাঁদের নামিয়ে দিয়েছিলো মানবতার সর্বনিম্নস্তরে। এমতাবস্থায় মহান স্রষ্টার পক্ষ থেকে আসার প্রয়োজন ছিল এক সাহায্যপ্রাপ্ত মহাবীর মুক্তিদুত। এতিম মুহাম্মাদকেই মহান আল্লাহ গড়ে তুলছিলেন সেই মুক্তিদুত হিসেবে।

 

৭। নবুয়্যত লাভ

 

এদিকে তাঁর বয়েস যখন চল্লিশের কাছাকাছি তখন তিনি নির্জনতা অবলম্বন করতে থাকেন। ক্রমান্বয়ে নির্জনতা তাঁকে গভীরভাবে প্রভাবিত করতে থাকে। কা’বা থেকে মাইল তিনেক পূর্বদিকের একটি পাহাড়। এর বর্তমান নাম ‘জাবালুন্নুর’ বা জ্যোতির পাহাড়। এ পাহাড়ের চুড়ায় রয়েছে পশ্চিমমুখী বা কাবা মুখী একটি গুহা। গুহাটির নাম হেরা। জাবালুন নুরের চুড়ায় অবস্থিত হেরা গুহায় গিয়ে মুহাম্মাদ (সঃ) নীরবে নির্জনে ধ্যান করতে থাকেন। অজ্ঞতার অন্ধকার থেকে মানব সমাজের মুক্তির জন্যে তিনি এক আল্লাহর কল্যাণমুখী হন। ধ্যান করতে থাকেন। তাঁর মহিমা ও সৃষ্টিকে নিয়ে ভাবতে থাকেন। তাঁর সমস্ত মন মস্তিস্কে এক আল্লাহর ধ্যান এবং ভাবনা গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করে। এভাবে তাঁর বয়স যখন চল্লিশ বছর ছয়মাস, তখন রমযান মাসের এক শুভরাত্রে তাঁর কাছে আগমন ক্রেন আল্লাহর দূত হযরত জিব্রাইল আমিন। তখনো তিনি হেরা গুহায় ধ্যানরত। জিবরীল এসে তাঁকে বললেন- ‘পড়ুন’। তিনি বললেন- ‘আমি পড়তে জানিনা’। এবার জিবরীল তাঁকে প্রচণ্ড জোরে নিজের বুকের সাথে আঁকড়ে ধরেন। তারপর ছেড়ে দিয়ে বলেন – ‘পড়ুন’। জ্ঞানের আলোকে জ্যোতির্ময় হয়ে উঠলো তাঁর হৃদয়। সাথে সাথে তিনি পড়তে শুরু করলেন – “ইকরা বি ইসমি রাব্বিকাল্লাজি খালাক। খালাকাল ইনসানা মিন আলাক। ইকরা ওয়া রাব্বুকাল আকরাম। আল্লাযি আল্লামা বিল কালাম। আল্লামাল ইনসানা মালাম ইয়ালাম।” অর্থ “ পড়ো তোমার প্রভুর নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে শক্তভাবে আটকে থাকা শিশু থেকে। পড়ো, আর তোমার প্রভু বড়ই দয়াবান, মহিমা মণ্ডিত। তিনি শিক্ষা দিয়েছেন কলমের সাহায্যে। শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানতো না।”

 

এ অংশটি পরে রাসুল (সঃ) আল কুরআনের সূরা আলাকের প্রথম পাঁচটি আয়াত হিসেবে সংকলন করেন। মুহাম্মাদ রাসুলুল্লাহর প্রতি এটিই ছিল কুরআন নাযিল হবার সুচনা। এটাই ছিল তাঁর নবুয়্যতী জীবনের সূচনা। আর এটা ছিল ৬১০ খ্রিষ্টাব্দ। ফেব্রুয়ারী মাস। মুহাম্মাদ রাসুলুল্লাহ কোন অভিনব নবী ছিলেন না। তাঁর পূর্বেও বিগত হয়েছেন বহু নবী রাসুল। ইতোপূর্বে আমরা চব্বিশজন নবী রাসুলের জীবনী আলোচনা করে এসেছি। মুহাম্মাদ (সঃ) নবুয়্যতী মালার সর্বশেষ কড়ি। তাঁর প্রতি অবতীর্ণ আল কুরআন আসমানী সর্বশেষ কিতাব। তাঁর রিসালাত ও তাঁর প্রতি অবতীর্ণ আল কুরআন চিরন্তর এবং সার্বজনীন।

 

৮। আল্লাহর দিকে আহবানের গুরু দায়িত্ব

 

নবুয়্যত ও রিসালাত হল আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে এক মহান দায়িত্ব। এ হলো, মানব সমাজের কাছে আল্লাহর বার্তা পৌঁছে দেবার দায়িত্ব। এ হলো মানব সমাজকে এক অদ্বিতীয় সর্বশক্তিমান আল্লাহর দিকে আহবান করার দায়িত্ব। তাই, মুহাম্মাদ (সঃ) মানব সমাজের জন্যে মহান আল্লাহর নিযুক্ত –

 

১। বার্তাবাহক (রাসুল)।

 

২। আল্লাহর দিকে আহবায়ক (দায়ী ইলাল্লাহ)।

 

৩। সুসংবাদদাতা (বাশীর)।

 

৪। সতর্ককারী (নাযির)।

 

৫। সত্যের সাক্ষী (শাহেদ)।

 

৬। সর্বোত্তম আদর্শ (উসওয়াতুন হাসানা) এবং

 

৭। মহাসত্যের অনাবীল আলো বিতরণকারী এক সমুজ্জ্বল প্রদীপ (সিরাজাম মুনিরা)।

 

এ দায়িত্বগুলো তাঁর উপর অর্পিত হয়েছে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে। এ গুরু দায়িত্ব পালন করার জন্যে তিনি পাহাড় থেকে ঝাপিয়ে পড়লেন মানব সমাজে। গুহায় বসে ধ্যান করার দিন শেষ। মানবতার মুক্তির যে মহান উদ্দেশ্যে তিনি ধ্যানে মগ্ন হয়েছিলেন, সেই মহান উদ্দেশ্য হাসিলের সঠিক দিশা এবং নির্দেশিকা এবার তিনি পেয়ে গেছেন। তাই এবার মানব সমাজকে ধংসের হাত থেকে মুক্তির লক্ষে ঝাপিয়ে পড়লেন মানব সমাজে।

 

তাঁকে প্রদত্ত দায়িত্ব সম্পর্কে স্বয়ং মহান আল্লাহ বলেন-

 

  •  
  • হে মুহাম্মাদ, বলো- হে মানুষ, আমি তোমাদের সকলের প্রতি আল্লাহর বার্তাবাহক। (আল কুরআন ৭ ;১৫৮)
  •  
  • গোটা মানবজাতির জন্যে আমরা তোমাকে বার্তাবাহক নিযুক্ত করেছি। (আল কুরআন ৪ ; ৭৯)
  •  
  • যাতে করে রাসুল তোমাদের উপর সাক্ষী হয়। (আল কুরআন ২ ; ১৪৩)
  •  
  • হে নবী, আমরা তোমাকে পাঠিয়েছি সাক্ষী, সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী হিসেবে এবং আল্লাহর অনুমতিক্রমে তাঁর দিকে আহ্বানকারী হিসেবে আর আলো বিতরণকারী সমুজ্জ্বল প্রদীপ হিসেবে। (আল কুরআন ৩৩ ; ৪৫-৪৬)
  •  

 

এসব দায়িত্ব পালনে তিনি নিজেকে এতোটাই নিবেদিত করেছিলেন যে, তিনি নিজের জীবনের প্রতিও অনেকটা বেপরোয়া বা বেখেয়াল হয়ে ওঠেন। এ বিষয়ে মহান আল্লাহ তাঁকে এভাবে সতর্ক করেন-

 

“তারা এ বানীর প্রতি ঈমান আনেনা বলে সম্ভবত দুঃখে শোকে আর হতাশায় তুমি নিজেকেই বিনাশ করে ছাড়বে।” (আল কুরআন ১৮ ;৬)

 

৯। মানব সমাজকে মুক্তি ও সাফল্যের দিকে আহবান

 

মহান আল্লাহ মুহাম্মাদ (সঃ) কে রিসালাতের দায়িত্বে নিযুক্ত করার পর তিনি মানুষকে যেসব বিষয়ের প্রতি আহবানব করেন এবং যেসব বার্তা তাঁদেরকে পৌঁছান, সংক্ষেপে তা হলো –

 

১। মহাবিশ্বের একজন স্রষ্টা আছেন, তিনিই মহান আল্লাহ। মহাবিশ্ব, পৃথিবী ও মানুষ সব কিছুই তিনি সৃষ্টি করেছেন। তিনি সবার প্রভু। তিনিই মহাজগৎ মহাবিশ্বের প্রতিপালক, পরিচালক ও শাসক।

 

২। তিনি এক ও একক। তিনি সন্তান গ্রহন করেননা। তিনিও কারো সন্তান না। তাঁর সমকক্ষ কেউ নেই। কোন বিষয়েই তাঁর কোন শরীক বা অংশীদার নেই। কোন বিষয়েই তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন। কোন বিষয়েই কারো কাছ থেকে তাঁর কোন সাহায্য নেয়ার প্রয়োজন নেই। তিনি সর্বশক্তিমান, সর্বোচ্চ ও সকল ত্রুটি থেকে পবিত্র। সবাই ও সব কিছুই তাঁর সৃষ্টি এবং তাঁর দয়া, অনুগ্রহ ও সাহায্যের মুখাপেক্ষী।

 

৩। তিনি মানুষকে সৃষ্টি করে তাঁকে একটি সময়ের জন্যে এই পৃথিবী পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছেন। শুধুমাত্র তাঁর হুকুম ও বিধান মতো জীবন যাপন করার জন্যেই তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। এ উদ্দেশ্যে তিনি তাঁর বার্তাবাহক হিসেবে নবী রাসুল পাঠিয়েছেন। মানুষের জন্যে জীবন যাপনের নির্দেশিকা সম্বলিত কিতাব পাঠিয়েছেন এবং পৃথিবীকে তাঁর বিধান মতো পরিচালনা করার জন্যে মানুষেরই উপর দায়িত্ব অর্পণ করেছেন।

 

৪। তিনি বিবেক বুদ্ধি দিয়ে মানুষকে জ্ঞানী ও যুক্তিবাদী বানিয়েছেন। মানুষের মধ্যে পাশবিক প্রবৃত্তি এবং নৈতিক প্রবৃত্তি অন্তর্ভুক্ত করে দিয়েছেন। পাশবিক প্রবৃত্তিকে সুনিয়ন্ত্রিত করে বিবেক বুদ্ধি তথা নৈতিক শক্তিকে শক্তিশালী ও বিকশিত করতে বলেছেন।

 

তাঁকে আল্লাহর বিধান ও নৈতিক শক্তিতে হয়ে পার্থিব জীবন পরিচালনা করতে বলেছেন।

 

৫। পার্থিব জীবনের কার্যক্রমের জন্যে মানুষের বিচার হবে। আল্লাহর বিধান এবং মহৎ মানবীয় নৈতিক গুনাবলীর ভিত্তিতে সে তাঁর সামগ্রিক জীবন পরিচালনা করেছে কিনা, সেটাই হবে বিচারের বিষয়। এ উদ্দেশ্যে মানুষকে পুনরুত্থিত করা হবে। বিচারে সাফল্য অর্জনকারী লোকদের তিনি অনন্তকালের জন্যে মহাপুরস্কারে ভূষিত করবেন। অপরদিকে বিচারে যারা অপরাধী সাব্যস্ত হবে তাঁদেরকে নিমজ্জিত করা হবে যন্ত্রনাদায়ক শাস্তির মধ্যে।

 

৬। হে মানুষ, মহান আল্লাহ আমাকে তাঁর বার্তাবাহক নিযুক্ত করেছেন। তোমরা আমাকে আল্লাহর রাসুল মেনে নাও। আমি আমার নিজের পক্ষ থেকে তোমাদের কিছুই বলছিনা। আমি তোমাদের কাছে কেবল আল্লাহর বার্তা ও নির্দেশাবলীই পৌঁছে দিচ্ছি।

 

৭। হে মানুষ, তোমরা আল্লাহকে এক, অদ্বিতীয় ও সর্বশক্তিমান মেনে নাও। তোমরা কেবল তাঁরই হুকুম পালন করো। তাঁর সাথে কাউকেও এবং কোন কিছুকেই শরিক করো না। তোমরা তোমাদের মহৎ মানবীয় ও নৈতিক গুনাবলীকে উন্নত ও বিকশিত করে সৃষ্টি জগতের শ্রেষ্ঠ মর্যাদা অর্জন করো। তোমরা আল্লাহকে সর্বাধিক ভালোবাসো। সারাজীবন সমস্ত কাজ আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষে করো। আল্লাহর শাস্তিকে ভয় করো। পরকালীন সাফল্য অর্জনের লক্ষ্যে কাজ করো। সর্বপ্রকার অন্যায়, অপরাধ, পাপ, পংকিলতা ও যুলুম অবিচার পরাহার করো। এটাই তোমাদের মুক্তি ও সাফল্যের একমাত্র পথ।

 

১০। মক্কায় তের বছর দাওয়াত ও আহবান

 

উপরে যে বিষয়গুলো উল্লেখ করা হলো, সেগুলোই মুহাম্মাদ (সঃ) এর দাওয়াত ও আহবানের মূল বক্তব্য। মক্কায় তের বছর তিনি মানুষকে এই মূল বিষয়গুলোর দিকেই আহবান করেন। সর্বোত্তম পন্থা আর মর্মস্পর্শী উপদেশের মাধ্যমে তিনি মানুষকে আহবান করেন। তাঁর আহবানের উপকরন ছিল আল কুরআন। এই তের বছর তাঁর কাছে কুরআন নাযিল হয়েছে ঐ বিষয়গুলোকে চমৎকার যুক্তি, উপমা ও ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত সহকারে বাস্তব ও আকর্ষণীয় ভংগীতে উপস্থাপনের মাধ্যমে। তিনি তাঁর দাওয়াত ও আহবান হিসেবে মানুষের কাছে হুবহু উপস্থাপন করেন আল্লাহর বার্তা আল কুরআন। যারা তাঁর আহবান গ্রহন করেন, তাঁদের তিনি জামায়াতবদ্ধ করেন। তাঁদের মাঝে কুরআনের আলো বিতরন করেন। তাঁদেরকে আল কুরআন শিক্ষা দেন। তাঁদের মানবিক গুনাবলী উন্নত ও বিকশিত করেন। তাঁদের নৈতিক চরিত্র সংশোধন করেন। তাঁদের মাধ্যমে গঠন করেন একটি নতুন সমাজ। মূলত তাঁর দাওয়াত ও আহবানের ছিলো পাঁচটি স্তর। সেগুলো হলো-

 

১। মানুষের জীবন লক্ষের পরিবর্তন।

 

২। মানুষের ধ্যান ধারনা, চিন্তা-চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন।

 

৩। মানুষের নৈতিক চরিত্রের পরিবর্তন।

 

৪। সমাজনীতি ও সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন।

 

৫। নেতৃত্বের পরিবর্তন।

 

কুরআনের আলো বিতরন, শিক্ষা ও প্রশিক্ষন, দৃষ্টান্ত স্থাপন, এক আল্লাহর ইবাদাত ও আনুগত্য এবং সংঘবদ্ধ জীবন যাপনের মাধ্যমে তিনি সমাজ ও সাথীদের মাঝে এসব পরিবর্তন সাধন করেন। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন-

 

“এমনি করে আমরা তোমাদের মধ্য থেকেই তোমাদের মাঝে পাঠিয়েছি একজন রাসুল। সে তোমাদের প্রতি তেলাওয়াত করে আমাদের আয়াত, তোমাদের জীবনকে করে উন্নত ও বিকশিত, তমাদেওর শিক্ষা দেয় আল কুরআন ও হিকমাহ। আরো শিক্ষা দেয় তোমরা যা কিছু জানতেনা।”(আল কুরআন, ২ ; ১৫১, ৩ ; ১৬৪, ৬২ ; ০২)

 

তিনি তাঁর দাওয়াত ও আহবানের তালিকায় নিয়ে এসেছিলেন –

 

১। প্রতিভাবান যুবসমাজকে।

 

২। সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যাক্তিদেরকে।

 

৩। মজলুম ও সুবিধাবঞ্চিত মানুসদেরকে।

 

৪। নারী সমাজকে। এবং

 

৫। সত্য সন্ধানী ব্যাক্তিদেরকে। তিনি তাঁর এই দাওয়াত ও আহবানের কাজের সায়াহ্নের সেই মরু পথিকের মতই মানুষের দ্বারে দ্বারে ছুটে বেড়িয়েছিলেন, যে পথিক সূর্যাস্তের পূর্বেই পেরেশান হয়ে পৌছতে চায় মানব বসতিতে। তিনি দাওয়াত দিয়েছেন –

 

১। তাঁর বন্ধুদেরকে বন্ধুতার ভালোবাসায়।

 

২। দাওয়াত দিয়েছেন আত্মীয়স্বজনকে আত্মীয়তার হোক আদায়ে।

 

৩। দাওয়াত দিয়েছেন ব্যাক্তি পর্যায়ে ব্যাক্তিগত যোগাযোগ করে।

 

৪। দাওয়াত দিয়েছেন হাট-বাজারে জনসমষ্টিকে সম্বোধন করে।

 

৫। দাওয়াত দিয়েছেন মেলায় গিয়ে, পূজা পার্বণে গিয়ে।

 

৬। দাওয়াত দিয়েছেন হজ্জে আগত হাজীদেরকে।

 

৭। দাওয়াত দিয়েছেন মক্কায় আগত বনিক ও পর্যটকদেরকে।

 

১১। দাওয়াতের প্রতিক্রিয়া

 

সত্য, ন্যায় ও কল্যাণের দিকে আহবানের প্রতিক্রিয়া আছে। সমস্ত নবী রাসুল মানুষকে সত্য, ন্যায় ও কল্যাণের দিকে আহবান করেছেন এবং তাঁদের আহবানের প্রতিক্রিয়া হয়েছে। একইভাবে মুহাম্মাদ (সঃ) এর দাওয়াতেরও প্রতিক্রিয়া হয়েছে। তাঁর দাওয়াতের প্রতিক্রিয়া ছিলো নিম্নরূপ-

 

১। সত্য সন্ধানী ব্যাক্তিবর্গ, বিশেষ করে যুবক যুবতীরা তাঁর দাওয়াতে সাড়া দেয়। তারা ঈমান এনে রাসুলের সাথে কুরআনের ছায়াতলে আশ্রয় নেয়।

 

২। কিছু লোক এই দাওয়াতকে সত্য বলে জেনেও অত্যাচার নির্যাতনের ভয়ে কিংবা স্বার্থহানীর আশংকায় ঈমান আনা থেকে বিরত থাকে।

 

৩। সমাজের কর্ণধাররা, ধর্মীয় পুরোহিতরা এবং অর্থনৈতিক শোষকরা কোমর বেধে তাঁর বিরোধিতায় নেমে পড়ে।

 

৪। অধিকাংশ মানুষ নিরবে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে থাকে।

 

৫। আর কিছু লোক বিভিন্নভাবে বিরুদ্ধবাদীদের শিকলে আটকা থাকায় গোপনে ঈমান আনে এবং ঈমান আনার বিষয়টি সময় সুযোগের অপেক্ষায় গোপন রাখে।

 

প্রতিক্রিয়া যদিও এই পাঁচটি ধারায় বিভক্ত ছিলো, তবু এর মূল ধারা ছিলো দুইটি। অর্থাৎ

 

১। ঈমান এনে রাসুলের সাথীত্ব গ্রহনকারী ধারা। এবং

 

২। বিরুদ্ধবাদী ধারা।

 

এই তের বছরে তিন শতাধিক নারী পুরুষ প্রকাশ্যে ঈমান এনে ইসলামী কাফেলায় শরীক হয়ে যান। এরা আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষে ইসলামের পথে সব ধরনের ত্যাগ ও কুরবানী দিচ্ছিলেন। এদের মধ্যে প্রথম দিকেই ঈমান আনেন খাদিজা তাহেরা, আবু বকর, আলী, যায়েদ বিন হারিসা, সায়ীদ বিন যায়িদ, ফাতিমা বিনতে খাত্তাব, যুবায়ের, সা’দ বিনাবি ওয়াক্কাস, উসমান বিন আফফান, আব্দুর রহমান, জাফর বিন আবু তালিব, আবু সালামা, উম্মে সালামা, আবু উবায়দা, তালহা, উম্মে হাবিবা বিনতে আবু সুফিয়ান, উমর বিন খাত্তাব, আবু যর, হামজা বিন আব্দুল মুত্তালিব, বিলাল বিন রিবাহ, মুসআব, আম্মার, ইয়াসার, সুমাইয়া, খাব্বাব, আরকাম, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসুদ, সুহায়েব রুমী, উসমান বিন মাযঊন, উম্মে শুরাইক, রুকাইয়া বিনতে মুহাম্মাদ, উম্মু কুলসুম বিনতে মুহাম্মাদ, নঈম বিন আব্দুল্লাহ, লুবাইনা, উম্মে আব্দুল্লাহ বিনতে হাশমা, তাঁর স্বামী আমের বিন রাবীয়া, তোফায়েল দাওসী এবং আরো অনেকে রাদিয়াল্লাহু আনহুম।

 

অপরদিকে মানুষকে এক আল্লাহর দিকে আহবানের এই মহোত্তম কাজের বিরোধীতায় অগ্রনী ভুমিকা পালন করে স্বয়ং রাসুল (সঃ) এর চাচা আবু লাহাব, তাঁর স্ত্রী উম্মে জামিল, আবু জাহেল, হাকাম বিন আস, উকবার বিন আবু মুয়িত, উতবা, শাইবা, আবুল বুখতরি, আস বিন হিশাম, উমাইয়া বিন খালফ, মুনাব্বিহ, হিন্দা, আবু সুফিয়ান, সুহায়েল, আমর ইবনু আস, আকরামা, খালিদ বিন ওয়ালীদ এবং আরো অনেকে। অবশ্য এদের মধ্যে কয়েকজন পরে ইসলাম কবুল করে আল্লাহর সৈনিক হয়ে যান। তবে তাঁদের অনেকেই বদর যুদ্ধে নিহত হয়। সমাজের প্রভাবশালী ব্যাক্তিদের অনেকেই ইসলাম কবুল করেন। তবে সাহসী দৃঢ় প্রতিজ্ঞ যুবকরাই বেশীরভাগ ইসলাম গ্রহন করেন। অবশ্য নেতৃস্থানীয় অধিকাংশ ব্যাক্তিই রাসুল (সঃ) ও তাঁর সত্যের দাওয়াতের বিরধীতায় অবতীর্ণ হয়। তারা ঈমানে দীক্ষিত তাঁদের যুবক ছেলে মেয়েদের, আত্মীয়-স্বজনদের এবং দাস-দাসীদের উপরে চরম নির্যাতন চালাতে থাকে। এমতাবস্থায় রাসুল (সঃ) এর নির্দেশে তাঁর আশির অধিক সাহাবী নবুয়্যতের পঞ্চম বছরে পার্শ্ববর্তী দেশ আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন।

 

১২। বন্দী জীবন

 

কিন্তু রাসুল (সঃ) এবং তাঁর সাথীরা ইসলামের পথ এবং দাওয়াত ও আহবানের কাজ ত্যাগ না করায় কাফির নেতারা আরো কঠোর সিদ্ধান্ত নেয়। তারা রাসুল, তাঁর সাথীবৃন্দ এবং তাঁর গোত্র বনু হাশিমকে বয়কট করে। ফলে তারা শি’বে আবু তালিব নামক পার্বত্য উপত্যকায় অন্তরীন হয়ে পড়েন। এখানে চরম দুঃখ দারিদ্রের মধ্য দিয়ে তাঁদের দিন কাটতে থাকে। চরম খাদ্যাভাবে তারা গাছের পাতা গাছের ছাল আহার করেন। তারা ক্ষুধা এবং রোগক্লিষ্ট হয়ে পড়েন। নবুয়্যতের সপ্তম বর্ষ থেকে দশম বছরের সূচনা পর্যন্ত তিন বছর তারা এখানে বন্দী থাকেন। অতপর পরিবেশ পরিস্থিতির কারনে বাধ্য হয়ে বিরোধী নেতারা রাসুল (সঃ) এবং তাঁর সাথীদেরকে বন্দীত্ব থেকে মুক্ত করে দেয়। এই তিন বছরের নিপীড়নের ফলে এ বছরই অর্থাৎ নবুয়্যতের দশম বর্ষেই ইহকাল ত্যাগ করেন রাসুল (সঃ) এর অভিভাবক চাচা আবু তালিব এবং প্রেরনাদায়িনী স্ত্রী খাদিজা তাহেরা। এখন থেকে রাসুল (সঃ) নিরংকুশভাবে আল্লাহর উপর নির্ভরশীল হয়ে যান।

 

১৩। তায়েফে দাওয়াত

 

মক্কার পরেই তায়েফ ছিলো অধিকতর প্রভাবশালী শহর। মক্কার লোকদের আর ঈমান আনার লক্ষন ক্ষীন দেখে রাসুল (সঃ) তায়েফের সর্দারদের কাছে মহাসত্যের দাওয়াত পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে তায়েফ যান। তাঁদের দাওয়াত দেন আল্লাহর দিকে। মক্কার নেতারা তাঁর দাওয়াত গ্রহন না করায় এবং বিরোধিতা করায় তাঁরাও তাঁর দাওয়াত গ্রহন করতে অস্বীকার করে। শুধু তাই নয় তারা আল্লাহর রাসুল্কে লাঞ্ছিত করার লক্ষ্যে তাঁর পিছনে বখাটে যুবকদের লেলিয়ে দেয়। তারা রাসুল (সঃ) কে চরমভাবে নির্যাতন করে, লাঞ্ছিত করে। তাঁর সাথে গিয়েছিলেন তাঁর সেবক যায়েদ। অতপর তিনি যায়েদকে নিয়ে ফিরে আসেন মক্কায়।

 

১৪। মে’রাজ

 

চরম নির্যাতনের ফলে রাসুল (সঃ) এঁর একজন মহিলা সাহাবীসহ দুই তিনজন সাহাবী শাহাদাৎ বরন করেন। অনেকে আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন। রাসুল (সঃ) তায়েফের দিক থেকেও নিরাশ হয়েছেন। কিন্তু তাঁকে তো নিজের রাসুল নিযুক্ত করেছেন স্বয়ং মহাবিশ্বের মালিক মহান আল্লাহ। তিনি তাঁর রাসুলগনকে এবং রাসুলদের সাথীদেরকে সবসময় বিরোধিতা, অত্যাচার, নির্যাতন এবং প্রত্যাখ্যানের মুখোমুখি করে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হিসেবে গড়ে তুলেছেন। তাইতো আল্লাহ পাক মুহাম্মাদ (সঃ) কেও বলে দিয়েছেন –

 

“তোমার পূর্বেও বহু রাসুলকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। কিন্তু প্রত্যাখ্যানের মোকাবেলায় তারা অটল থেকেছে।” (সূরা ৬ আয়াত ৩৪)

 

এ সময় আল্লাহ পাক তাঁর রাসুলকে সামনে যে ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র উপহার দিতে যাচ্ছিলেন তাঁর মূলনীতিগুলো জানিয়ে দিতে চাইছিলেন। এ উদ্দেশ্যে তিনি তাঁকে মে’রাজ করান। দশম নবুয়্যত বর্ষে মে’রাজ সংঘটিত হয়। আল্লাহ পাক তাঁর রাসুলকে ঊর্ধ্বজগতে নিয়ে ইসলামী সমাজের মূলনীতি প্রদান করেন। এসময় আল্লাহ তায়ালা তাঁর উম্মতের জন্যে পাচ ওয়াক্ত নামাজও ফরয করে দেন। তাছাড়া আল্লাহ পাক তাঁর রাসুলকে নির্দেশ দেন তাঁর কাছে রাষ্ট্র ক্ষমতা প্রার্থনা করার জন্যে। মে’রাজ উপলক্ষে নাযিল হয়েছে সূরা বনী ইসরাইল। তখনকার প্রাসঙ্গিক উপদেশ ও মূলনীতিগুলো মওজুদ রয়েছে এই সূরা বনী ইসরাইলে।

 

১৫। মদিনায় ইসলামের আলো

 

মক্কায় রাসুল (সঃ) এর নবুয়্যতী জীবনের তের বছরের শেষ পর্যায়। নবুয়্যত বর্ষ বারো। হজ্জ উপলক্ষে মদিনা থেকে আগত ১২ জন লোক গোপনে রাসুল (সঃ) এর সাথে সাক্ষাত করেন। তারা ঈমান আনার ঘোষণা দেন এবং মদিনায় ইসলাম প্রচারের দায়িত্ব নিয়ে ফিরে যান। রাসুল (সঃ) তাঁর সাহাবী মুসআব –কে মদিনার লোকদেরকে ইসলাম শিক্ষা প্রদান এবং সেখানে ইসলামের দাওয়াতী কাজ প্রসারের উদ্দেশ্যে তাঁদের সাথে মদিনায় পাঠিয়ে দেন। ফলে পরের বছর হজ্জ উপলক্ষে ৭৫ জন লোক এসে গোপনে আকাবা নামক স্থানে রাসুল (সঃ) এর হাতে বাইয়াত গ্রহন করেন। তারা রাসুল (সঃ) কে মদিনায় হিজরত করার দাওয়াত দিয়ে যান। মদিনা আক্রান্ত হলে জান-মাল দিয়ে তা প্রতিরোধ করারও শপথ নিয়ে যান।

 

১৬। হিজরতের প্রস্তুতি

 

সাহাবীগনের উপরে অত্যাচার নির্যাতনের মাত্রা চরম পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিলো। রাসুল (সঃ) মনে মনে মদিনায় হিজরত করার প্রস্তুতি নিতে থাকেন। সে হিসেবে সাহাবীদেরকে যার যেভাবে সম্ভব গোপনে হিজরত করে মদিনায় চলে যাবার অনুমতি দেন। ফলে যাদেরই হিজরত করার সামর্থ্য ছিলো, তারা হিজরত করে মদিনায় চলে যান। থেকে যান আবুবকর। রাসুল (সঃ) তাঁকে নিজের হিজরতের সাথী বানানোর কথা জানিয়ে দেন।

 

১৭। হত্যার ষড়যন্ত্র

 

নবুয়্যতের তের বছর মাত্র পূর্ণ হয়েছে। অধিকাংশ সাহাবী হিজরত করে মক্কা ছেড়েছেন। এসময় ইসলামের শত্রুরা আল্লাহর রাসুলকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়। এক রাতে এসে তারা তাঁর বাড়ি ঘেরাও করে ফেলে। সকালে বের হলেই তাঁকে হত্যা করা হবে। তাদের এ ষড়যন্ত্রের কথা পরবর্তীতে কুরআনে উল্লেখ হয়েছে এভাবে –

 

“স্মরণ করো, কাফিররা তোমাকে বন্দী করার, কিংবা হত্যা করার, অথবা দেশ থেকে বহিস্কার করার ষড়যন্ত্র করছিলো। তারা লিপ্ত ছিল তাঁদের চক্রান্তে। এদিকে আল্লাহও তাঁর পরিকল্পনা পাকা করে রাখেন। আল্লাহই সবচে’ দক্ষ পরিকল্পনাকারী।” (সূরা আনফাল, আয়াত ৩০)

 

মহান আল্লাহ তাঁদের চক্রান্তের খবর আগেই তাঁর রাসুলকে জানিয়ে দেন। তিনি তাঁদের চোখে ধুলা দিয়ে বেড়িয়ে পড়েন হিজরতের উদ্দেশ্যে। ব্যর্থ হয়ে যায় আল্লাহর রাসুলকে হত্যার ষড়যন্ত্র।

 

১৮। রাসুলুল্লাহর হিজরত

 

রাসুলুল্লাহ (সঃ) হিজরতের উদ্দেশ্যে বের হয়ে প্রিয় সাথী আবুবকরের বাড়িতে আসেন। আবু বকরও আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলেন। এবার দু’জনে বেড়িয়ে পড়লেন মদানার উদ্দেশ্যে। শত্রুদের ষড়যন্ত্র মোকাবেলায় কৌশল একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মক্কা থেকে মদিনা উত্তর দিকে হলেও তারা প্রথমে রওয়ানা করেন দক্ষিন দিকে। কয়েক মাইল দক্ষিনের সওর নামক পাহাড়ের গুহায় তিন দিন অবস্থান করেন। তিন দিন পর সেখান থেকে মদিনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা করেন। এদিকে তার রক্ত পিপাসুরা হন্যে হয়ে খুজেও তাঁর নাগাল পায়নি। তারা তাঁকে ধরার জন্যে শত উট পুরস্কার ঘোষণা করে।

 

১৯। মদিনায় রাসুলুল্লাহ

 

রাসুলুল্লাহ (সঃ) আসছেন এ খবর আগেই পৌঁছে গেছে মদিনায়। আনন্দে মাতোয়ারা মদিনা। সম্বর্ধনার বিরাট আয়োজন। মদিনার আবাল বৃদ্ধ জনতা সানিয়াতুল বিদা উপত্যকা পর্যন্ত এগিয়ে এসে তাঁকে সম্বর্ধনা জানায়। মক্কা ত্যাগ করে। মদিনা তাঁকে বরন করে নেয়। তিনিও বরন করে নেন মদিনাকে। মক্কা বিজয়ের পরেও তিনি ত্যাগ করেননি মদিনা।

 

২০। মদিনার ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা নির্মাণের কাজ শুরু

 

মদিনার পূর্ব নাম ছিলো ইয়াসরিব। রাসুলুল্লাহর আগমনের ফলে পাল্টে যায় ইয়াসরিবের নাম। তখন থেকে এ শহরের নাম হয়ে যায় মদিনাতুন্নবী বা নবীর শহর। সংক্ষেপে মদিনা। মদিনায় আগমনের পরপরই তিনি এখানে ইসলামী সমাজ নির্মাণের কাজ শুরু করে দেন। শুরুর দিকে তিনি কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পাদন করেন। যেমন –

 

  •  
  • ১। প্রথমে চৌদ্দ দিন কুবা নামক স্থানে অবস্থান করেন। সেখানে তিনি একটি মসজিদ নির্মাণ করেন।
  •  
  • ২। তারপর আসেন মূল অবস্থানের জায়গায়। এখানে জমি ক্রয় করেন। কেন্দ্রীয় মসজিদ ‘মসজিদে নববী’ প্রতিষ্ঠা করেন।
  •  
  • ৩। এই মসজিদকে ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্রের কেন্দ্র ঘোষণা করেন। এখান থেকেই তিনি পরিচালনা করেন ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র।
  •  
  • ৪। হিজরত করে আসা সহায় সম্বলহীন মুসলিম এবং মদিনার স্থানীয় আনসার মুসলিমদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক স্থাপন করে দেন। ফলে মুহাজিররা আনসারদের পরিবারের সদস্য হয়ে যায়।
  •  
  • ৫। ‘মদিনা সনদ’ নামক খ্যাত মদিনার প্রতিরক্ষা চুক্তি সম্পাদন করেন। এই চুক্তির অন্তর্ভুক্ত করে নেন মদিনার স্থানীয় আনসার মুসলিমদেরকে, মদিনায় অবস্থানরত বিভিন্ন গোত্র ও কবিলাকে এবং সেখানকার ইহুদী গোত্রগুলোকে। এদের সবাইকে একটি ভৌগোলিক জাতি ঘোষণা করেন। শত্রুদের আক্রমন প্রতিহত করার ব্যাপারে সবাই মুহাম্মাদ (সঃ) এর নেতৃত্বে চুক্তিবদ্ধ হয়।
  •  

 

২১। ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্রের কার্যক্রম

 

মুহাম্মাদ (সঃ) মহান ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে মদিনায় একটি কল্যাণ রাষ্ট্রের গোড়া পত্তন করেন। এ রাষ্ট্রের আদর্শকে ভবিষ্যতের বিশ্ব ব্যবস্থায় রূপদানের কার্যক্রম তিনি হাতে নেন। এ মহান রাষ্ট্রের কয়েকটি প্রধান প্রধান মূলনীতি ও কার্যক্রম হলো। -

 

  •  
  • ১। তিনি এ রাষ্ট্র পরিচালনা করেন এক আল্লাহর সার্বভৌম বিধানের ভিত্তিতে।
  •  
  • ২। এ রাষ্ট্রের আদর্শ, প্রেরনা ও আইনের উৎস ছিল আল্লাহর কিতাব আল কুরআন এবং তাঁর রাসুলের সুন্নাহ।
  •  
  • ৩। এ রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য ছিল জনগনের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক মুক্তি, কল্যাণ ও সাফল্য।
  •  
  • ৪। এ রাষ্ট্রের সরকার ও নাগরিকদের প্রধান দায়িত্ব ছিলো স্রষ্টার প্রতি কর্তব্য পালন এবং সৃষ্টির প্রতি কর্তব্য পালন।
  •  
  • ৫। এ রাষ্ট্রের যাবতীয় কর্মসূচী ও কার্যক্রমের উদ্দেশ্য ও মূলনীতি ছিল জননিরাপত্তা, সুবিচার ও মানবকল্যাণ।
  •  
  • ৬। এ রাষ্ট্রের প্রধান প্রধান কর্মসূচী ছিলো – ১। রাষ্ট্র ও জনগনের নিরাপত্তা প্রদান, ২। এক আল্লাহর ইবাদাত প্রবর্তন ও সালাত কায়েম। ৩। শোষণমুক্ত ইনসাফ ভিত্তিক কল্যাণমুখী অর্থব্যবস্থার প্রচলন ও যাকাত ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা। ৪। পরামর্শ ভিত্তিক শাসন পরিচালনা। ৫। সততা, সুনীতি, সৎকর্ম ও সদাচারের সম্প্রসারন। ৬। দুর্নীতি ও দুষ্কর্মের অপসারন। ৭। ভালো কাজে প্রেরনা ও সহযোগিতা প্রদান। ৮। মন্দ কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি। ৯। জনগনের মানসিক ও নৈতিক উন্নয়নের জন্যে শিক্ষা ও প্রশিক্ষনের ব্যাপক সম্প্রসারন। ১০। জনস্বাস্থ্যের নিরাপত্তা বিধান ও গণপূর্ত।
  •  
  • ৭। বিশ্বব্যাপী মানবসমাজকে শান্তি ও কল্যাণের দিকে আহবান।
  •  

 

২২। কুরাইশদের আশংকা ও যুদ্ধের প্রস্তুতি

 

মুহাম্মাদ (সঃ) হিজরত করে মদিনায় চলে আসার কারনে কুরাইশরা নিজেদেরকে বড় ধরনের বিপদের ঝুকির মধ্যে অনুভব করছিলো। তারা চিন্তা ভাবনা করে দেখলো –

 

  •  
  • ১। মদিনায় থেকে মুহাম্মাদ স্বাধীনভাবে তাঁর ধর্মীয় মতাদর্শ প্রচার করার সুযোগ পেয়ে গেলো।
  •  
  • ২। মুহাম্মাদ গোটা আরবে তাঁর ধর্ম ছড়িয়ে দেবে এবং সব গোত্র ও কবিলার উপর নিজের প্রভাব বিস্তার করবে।
  •  
  • ৩। মুহাম্মাদ রাষ্ট্রীয় শক্তি অর্জন করবে।
  •  
  • ৪। তাঁর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি বৃদ্ধি পাবে।
  •  
  • ৫। সুযোগ মতো মুহাম্মাদ মক্কা আক্রমন করে আমাদের থেকে প্রতিশোধ গ্রহন করবে এবং আমাদের মক্কা থেকে উৎখাত করবে।
  •  

 

এসব ভেবে কুরাইশরা রাসুল (সঃ) এর ভিত মজবুত হবার আগেই মদিনা আক্রমন করে তাঁকে এবং তাঁর অনুসারীদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দেবার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে।

 

২৩। রাসুলের বিরুদ্ধে কুরাইশদের যুদ্ধ

 

এদিকে কুরাইশদের পক্ষ থেকে মদিনা আক্রমন হতে পারে এ কথা রাসুল (সঃ) নিজেও ভেবে রেখেছেন।

 

বদর যুদ্ধ - কুরাইশরা আবু জেহেলের নেতৃত্বে এক হাজার সুসজ্জিত বাহিনী নিয়ে মদিনা আক্রমনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করে। তাঁদের কাছে ছিল ঘোড়া এবং আধুনিক সব সমরাস্ত্র।

 

রাসুল (সঃ) তাঁদের প্রতিরোধ করার উদ্দেশ্যে তিনশো তের জনের একটি ক্ষুদ্র বাহিনী নিয়ে রওয়ানা করেন। বাহিনীর কাছে অশ্ব এবং আধুনিক অস্ত্র বলতে তেমন কিছুই ছিলোনা। দ্বিতীয় হিজরির ১২ বা ১৭ রমযান বদর প্রান্তরে উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ ছিলো এক ঐতিহাসিক আদর্শিক যুদ্ধ। --

 

  •  
  • ১। এক পক্ষ যুদ্ধ করতে এসেছিলো আল্লাহর জন্যে, আল্লাহর পথে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিলের লক্ষে। অপর পক্ষ যুদ্ধ করতে এসেছিলো তাগুতের পক্ষে, মিথ্যা বাতিলকে টিকিয়ে রাখার উদ্দেশ্যেএবং নিজেদের অবৈধ স্বার্থ হাসিলের পথ নিরাপদ রাখতে।
  •  
  • ২। এক পক্ষ নির্ভর করেছিলো আল্লাহর সাহায্যের উপর। অপর পক্ষ নির্ভর করেছিলো নিজেদের সমর শক্তির উপর।
  •  
  • ৩। এক পক্ষ যুদ্ধ করতে এসেছিলো জীবন দিয়ে শাহাদাতের মর্যাদা লাভ করার জন্যে। অপর পক্ষ যুদ্ধ করতে এসেছিলো নিজেদের জীবন রক্ষা করার জন্যে।
  •  
  • ৪। এক পক্ষের যুদ্ধ ছিল প্রতিরক্ষামূলক। অপর পক্ষের যুদ্ধ ছিলো আগ্রাসী।
  •  
  • ৫। এক পক্ষের যুদ্ধ ছিলো ব্যাক্তিগত ও পার্থিব স্বার্থের ঊর্ধ্বে। অপর পক্ষের যুদ্ধ ছিল ব্যাক্তিগত ও পার্থিব স্বার্থ রক্ষার লক্ষে।
  •  

 

অবশেষে এ যুদ্ধে ইসলামী বাহিনী বিজয়ী হয়। আগ্রাসী কুরাইশ বাহিনী চরমভাবে পরাজিত হয়। এ যুদ্ধে আগ্রাসী কুরাইশদের সেনাপতি আবু জেহেল সহ ৭০ জন নিহত হয় এবং আরো ৭০ জন মুসলিমদের হাতে বন্দী হয়। এদিকে ২২ জনজন মুসলিম সেনা শাহাদাৎ বরন করেন। পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে কুরাইশরা মক্কায় ফিরে যায়।

 

উহুদ যুদ্ধ- কুরাইশরা বদর যুদ্ধে পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে পরের বছর তৃতীয় হিজরির শাওয়াল মাসে আবার মদিনা আক্রমনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করে। এবার তারা তাঁদের প্রভাবিত পার্শ্ববর্তী এলাকার লোকদের সাথে নেয়। তারা তিন হাজার সুসজ্জিত বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হতে থাকে। রাসুল (সঃ) যথাসময়ে তাঁদের যাত্রার সংবাদ পেয়ে যান। যুবকদের আগ্রহের কারনে তিনি মদিনার বাইরে গিয়ে উহুদ পাহাড়ের কাছে শত্রু বাহিনীর মোকাবেলা করার সিদ্ধান্ত নেন। সাতশো জানবাজ সাহাবীর বাহিনী নিয়ে তিনি উহুদে এসে পৌঁছান। উহদ পাহাড়কে পেছনে রেখে রাসুল (সঃ) যুদ্ধ লড়ার স্থান নির্ধারণ করেন। পেছনের আইনান পাহাড়ে একটা সুড়ঙ্গ ছিলো। শত্রু বাহিনী এ সুড়ঙ্গ দিয়ে ঢুকে তাঁদের পেছন দিক থেকে আক্রমন করতে পারে এ আশংকায় রাসুল (সঃ) সুড়ঙ্গ মুখে পঞ্চাশ জন তীরন্দাজের একটি বাহিনী নিযুক্ত করেন। তাঁদের নির্দেশ দেন, যুদ্ধে আমাদের জয় পরাজয় যাই হোক না কেন, তোমরা কোন অবস্থাতেই এ স্থান ত্যাগ করবেনা। যুদ্ধ শুরু হল। মুসলিম বাহিনীর আক্রমনের তীব্রতায় টিকতে না পেরে কুরাইশ বাহিনী তাঁদের সাজ সরঞ্জাম ফেলে পালাতে শুরু করে। মুসলিম বাহিনী তাঁদের চরম তাড়া করে। এদিকে সুড়ঙ্গ মুখে নিয়োজিত লোকেরা ভাবলো, যুদ্ধে মুসলিম বাহিনী জয়ী হয়েছে। ফলে তাড়া তাঁদের সেনাপতি আব্দুল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে মূল বাহিনীর সাথে যোগদানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করে। আব্দুল্লাহ মাত্র বারো জন তীরন্দাজ নিয়ে নিজের অবস্থানে অটল থাকেন। এদিকে শত্রু পক্ষের অশ্বারোহী দলের প্রধান খালিদ বিন ওয়ালিদ সুড়ঙ্গ পথ অরক্ষিত পেয়ে এখান দিয়ে ঢুকে পড়েন। আব্দুল্লাহ এবং তাঁর সাথীরা তাঁদেরকে প্রতিহত করার প্রানপন চেষ্টা করে শাহাদাৎ বরন করেন। খালিদ তাঁর অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে পেছন দিক থেকে মুসলিম বাহিনীর উপর অতর্কিত হামলা করে। মুসলিম বাহিনী এদের প্রতিহত করার জন্যে পেছনমুখী হলে পলায়নপর শত্রু বাহিনী ঘুরে দাড়ায়। শুরু হয় দ্বিমুখী আক্রমন। ফলে মুসলিম বাহিনী হতভম্ব হয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। পরে রাসুল (সঃ) সবাইকে একত্রিত করেন এবং ঐক্যবদ্ধ হয়ে শত্রুপক্ষকে তাড়া করেন এবং তারা মক্কায় ফিরে যায়। এরই মধ্যে মুসলিম বাহিনীর বিরাট ক্ষতি হয়ে যায়। ৭০ জন সাহাবী শাহাদাৎ বরন করেন। আহত হন অনেকে। কয়েকজন সৈনিক কর্তৃক সেনাপতির নির্দেশ লংঘনের ফলে মুসলিম বাহিনীর উপর নেমে আসে এই বিরাট বিপর্যয়।

 

খন্দকের যুদ্ধ – পঞ্চম হিজরি সন। উহুদ যুদ্ধে মুসলিমরা বিজয়ী হতে না পারলেও কুরাইশরা ভালোভাবেই বুঝেছিল, তাঁরাও বিজয়ী হতে পারেনি। ইসলামী রাষ্ট্র পূর্বের অবস্থায়ই সদর্পে দাঁড়িয়ে ছিল। তাই তারা বিশাল প্রস্তুতি নেয়। আশেপাশের সব মিত্র গোত্রের যোদ্ধাদের সাথে নিয়ে তারা অগ্রসর হয় মদিনার দিকে। এদিকে রাসুল (সঃ) যথাসময়ে তাঁদের যাত্রার সংবাদ পেয়ে যান। এবার তিনি এক অভিনব কৌশল গ্রহন করেন। তাহলো, মদিনায় প্রবেশের গোটা এলাকা জুড়ে তিনি পরীখা খননের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি নিজে এবং সক্ষম সকল সাহাবীরাই পরীখা খননের কাজে অংশ নেন। দশ গজ চওড়া, পাঁচ গজ গভীর সাড়ে তিন মাইল দীর্ঘ পরীখা তারা খনন করে ফেলেন। এতে প্রায় তিন লাখ আট হাজার বর্গগজ মাটি খনন ও স্থানান্তর করতে হয়েছে। সাড়ে তিন হাজার জনবল নিয়ে রাসুল (সঃ) মাত্র পনের দিনে এ বিশাল যুদ্ধ কৌশল বাস্তবায়ন করেন। এতেই বুঝা যায়, তারা কতটা পরিশ্রম করেছেন। মাথা প্রতি প্রায় এক হাজার বর্গগজের চাইতে বেশী মাটি কাটতে ও স্থানান্তর করতে হয়েছে। পরিখা খননের কাজ শেষ হতে না হতেই কম বেশী দশ হাজার বাহিনীর সুসজ্জিত সৈন্য নিয়ে কুরাইশরা মদিনার উপকণ্ঠে এসে হাজির হয়। কিন্তু অভিনব কৌশলের পরিখা দেখে তাঁদের মাথায় হাত। তবে মদিনার ঘরের শত্রু ইহুদীরা কুরাইশদের সাথে গপনে হাত মিলিয়ে ফেলে। ফলে মুসলিমদের বাড়ি ঘরগুলো অরক্ষিত হয়ে পড়ে। কিন্তু মহান আল্লাহর সাহায্যে কুরাইশ বাহিনী দীর্ঘ এক মাস মদিনা অবরোধ করে রেখেও কোন সুবিধা করতে পারে নি। এ সময় এক রাত্রে প্রচণ্ড ঝড় বৃষ্টি শুরু হয়। ঝড় কুরাইশদের তাঁবুগুলো উড়িয়ে নিয়ে যায়। তাঁদের বাহিনী পুরোপুরি মনোবল হারিয়ে ফেলে এবং রাতের অন্ধকারেই তারা মদিনা অবরোধ ত্যাগ করে পালিয়ে যায়। এ ঘটনার পরপরই রাসুল (সঃ) মদিনা সনদ ভঙ্গকারী ইহুদী গোত্র বনু কুরাইযাকে চরমভাবে শায়েস্তা করেন। মহান আল্লাহ এ যুদ্ধের পর্যালোচনা করেছেন সূরা আহযাবের ৯-২৭ নং আয়াতে। মহান আল্লাহ বলেন-

 

“হে মুমিনরা, স্মরণ করো তোমরা তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহের কথা, যখন শত্রু বাহিনী তোমাদের এখানে এসে পড়েছিলো, তখন আমরা তাঁদের প্রতি পাঠিয়েছিলাম ঝরো হাওয়া আর এমন এক বাহিনী, যাদের তোমরা দেখতে পাওনি।” (আহযাব, আয়াত ৯)

 

কুরাইশরা চলে যাবার পড়ে রাসুল (সঃ) ঘোষণা দিলেন- “কুরাইশরা আর কখনো মদিনা আক্রমন করতে পারবেনা। ”

 

এগুলো ছিল বড় বড় যুদ্ধ, এ ছাড়াও আরো অনেক ছোট খাটো অভিযান পরিচালিত হয়েছে।

 

২৪। হুদাইবিয়ার সন্ধি এবং এর সুফল

 

ষষ্ঠ হিজরি সন। রাসুলুল্লাহ (সঃ) স্বপ্নে হজ্জ, উমরা ও আল্লাহর ঘর যিয়ারত করার নির্দেশ পান। জেনে রাখা ভালো, নবীদের স্বপ্নও অহী। সে অনুযায়ী তিনি এবছর যিলকদ মাসের শেষ দিকে চৌদ্দশত সাহাবী নিয়ে হজ্জের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। সাথে করে নেন কুরবানীর উট। হজ্জ, উমরা ও আল্লাহর ঘর যিয়ারতের উদ্দেশ্যে আসা লোকদের বাধা দেয়া মক্কার সনাতন ধর্মেও নিষেধ ছিলো। কিন্তু কুরাইশরা রাসুল (সঃ) এর কাফেলাকে মক্কার নিকটবর্তী হুদাইবিয়া নামক স্থানে এসে বাধা দেয়। তিনি উসমান (রা) –কে মক্কায় পাঠান তাঁদের নেতাদের একথা বলার জন্যে যে, আমরা যুদ্ধ করতে আসিনি। যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে আসিনি। আমরা হজ্জ, উমরা, কুরবানী ও যিয়ারত শেষে চলে যাবো। আমরা কুরবানীর পশু সাথে নিয়ে এসেছি। কিন্তু তারা তাঁর কথা শুনেনি। তারা তাঁকে আটকে রাখে। উসমানকে অর্থাৎ রাসুলের দূতকে আতক করার সংবাদ শুনে সাহাবীগন উসমানকে উদ্ধার করার প্রতিজ্ঞা করেন। তারা এ উদ্দেশ্যে রাসুল (সঃ) এর হাতে হাত রেখে বাইয়াত গ্রহন করেন। এ শপথে সন্তুষ্ট হয়ে মহান আল্লাহ সাহাবীদের প্রসঙ্গে বলেন –

 

“আল্লাহ মুমিনদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন।” (সূরা আল ফাতাহ, আয়াত ১৮)

 

অবশ্য পরে কুরাইশরা উসমান (র) কে ছেড়ে দেয়। তিনি ফিরে আসেন। তারা সন্ধির প্রস্তাব নিয়ে আসে। রাসুল (সঃ) তাঁদের আরোপিত শর্তানুযায়ী সন্ধি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। সন্ধির অধিকাংশ শর্তই ছিল বাহ্যিকভাবে মুসলমানদের জন্যে অপমানজনক। কিন্তু তাতে দশ বছর যুদ্ধ বিগ্রহ না করার একটি ধারা ছিল। সাহাবীগন মনঃক্ষুণ্ণ হওয়া সত্যেও রাসুল (সঃ) এই ধারাটিকে লুফে নিয়ে চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তিতে এ বছর উমরা না করে পরের বছর উমরা করার একটি শর্ত ছিলো। সে অনুযায়ী রাসুল (সঃ) কাফেলা নিয়ে ফিরে চললেন মদিনার দিকে। পথিমধ্যেই নাযিল হল সূরা আল ফাতাহ। এ সুরার প্রথম আয়াতেই বলা হয়েছে-

 

“হে নবী, আমরা তোমাকে এক সুস্পষ্ট বিজয় দিলাম।’’

 

সত্যিই এ ছিলো এক সুস্পষ্ট বিজয়। রাসুল (সঃ) সাহাবীগণকে নিয়ে নির্বিঘ্নে ইসলামের দাওয়াত সম্প্রসারন করতে থাকলেন। দুই বছরের মধ্যেই কুরাশরা বন্ধুহীন হয়ে পড়লো। খালিদ বিন অয়ালিদ এবং আমর ইবনুল আস সহ কুরাইশদের অনেক বড় বড় সেনাপতি এরই মধ্যে ইসলাম গ্রহন করেন।

 

২৫। মক্কা বিজয়

 

হুদাইবিয়ার সন্ধিতে যে অন্যায় শর্তাবলী দিয়ে চুক্তি সম্পাদিত করেছিল, সেগুলো তাঁদের জন্যেই বুমেরাং হয়ে দাড়ায়। ফলে সে চুক্তি তারা নিজেরাই ভংগ করে। অপরদিকে রাসুল (সঃ) নির্বিঘ্নে ইসলামের দাওয়াতী কাজ করতে থাকেন। ইসলামী জনবল বিপুলভাবে বৃদ্ধি পায়। আরবের অধিকাংশ গোত্রই পর্যায়ক্রমে কুরাইশদের সাথে মিত্রতা ত্যাগ করে। যাই হোক, চুক্তি ভংগের কারনে রাসুল (সঃ) মক্কা অভিযানের সিদ্ধান্ত নেন। অষ্টম হিজরি সনের ১০ রমযান। রাসুল (সঃ) দশ হাজার জিন্দাদিল ইসলামী সেনাদল সাথে নিয়ে রওয়ানা করলেন মক্কা অভিমুখে। ২০ রমযান মুহাম্মাদ (সঃ) বিজয়ীর বেশে প্রবেশ করেন মক্কায়। আজ আর তাঁকে বাধা দেয়ার কোন শক্তি কারো ছিলো না। সম্পূর্ণ বিনা বাধায় আল্লাহর প্রশংসা করতে করতে তিনি এবং তাঁর সাথীরা মক্কার হারাম শরীফে প্রবেশ করেন।

 

ভেঙ্গে ফেলেন আল্লাহর ঘরে রাখা ৩৬০ টি ভাস্কর্য মূর্তি। তাঁকে চরম কষ্ট দিয়ে থাকলেও তিনি ক্ষমা করে দেন মক্কার লোকদের। তিনি তাঁদের বলেন- ‘আজ আর তোমাদের বিরুদ্ধে আমার কোন অভিযোগ নেই। যাও, তোমরা মুক্ত। মক্কার আশেপাশের গোত্রগুলোতে রক্ষিত মূর্তিগুলোও নির্মূল করা হলো। মক্কা ভূমি থেকে উৎপাটিত করা হলো শিরকের শিকড়। ঘোষণা করা হলো আল্লাহর একত্ব, মহত্ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব। আল্লাহর রাসুল (সঃ) কয়েকদিন মক্কায় অবস্থান করেন। এখান থেকে গিয়ে অভিযান চালিয়েই জয় করেন, হাওয়াযীন ও বনু সাকিফ। হোনায়েন প্রান্তরে যুদ্ধ হয় এদের সাথে। তারা চরমভাবে পরাজিত হয়। এ সময় তিনি তায়েফও অধিকার করেন। মক্কা বিজয় উপলক্ষে রাসুল (সঃ) উনিশ দিন মক্কায় অবস্থান করেন। হোনায়েন ও তায়েফ যুদ্ধের পর ফিরে আসে মদিনায়।

 

২৬। ইসলামের ছায়াতলে জনতার ঢল

 

মক্কা বিজয়ের পর ইসলাম গ্রহনের জন্যে জনতার স্রোত প্রবাহিত হতে শুরু করে মদিনার অভিমুখে। আরব উপদ্বীপের ছোট বড় সব গোত্র তাঁদের প্রতিনিধি দল পাঠাতে থাকে আল্লাহর রাসুলের কাছে তাঁদের ইসলামের ছায়াতলে আগমনের সংবাদ জানাবার জন্যে। মক্কা বিজয়ের পরবর্তী বছর বড় ছোট শতাধিক প্রতিনিধিদল মদিনায় এসে তাঁদের এবং তাঁদের গোত্রের ইসলাম গ্রহনের ঘোষণা দেয়। ইসলামের ছায়াতলে এই জনস্রোতের আগমনের কথা মহান আল্লাহ কুরআন মাজীদে উল্লেখ করেছেন –

 

“যখন এসেছে আল্লাহর সাহায্য ও বিজয়, এবং তুমি দেখতে পাচ্ছো, লোকেরা দলে দলে প্রবেশ করছে আল্লাহর দীনে। তখন তোমার প্রভুর প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো এবং ক্ষমা প্রার্থনা করো তাঁর কাছে। অবশ্যি তিনি পরম ক্ষমাশীল দয়াবান।” (সূরা আন নাসর)

 

২৭। তাবুক যুদ্ধ

 

রাসুলুল্লাহ (সঃ) কর্তৃক সবচেয়ে বড় অভিযান ছিলো তাবুক অভিযান। এ অভিযান ছিলো বর্তমান সিরিয়া ও জর্ডান পর্যন্ত বিস্তৃত তৎকালীন বৃহৎশক্তি রোম সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে। অভিযানের রয়েছে পূর্ব ঘটনা। তাহলো, হুদাইবিয়ার সন্ধির পর রাসুল (সঃ) মানুষকে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেয়ার উদ্দেশ্যে গোটা আরবের বিভিন্ন অঞ্চলে দাওয়াতী প্রতিনিধি দল পাঠান। এছাড়া সর্দার ও শাসকদের কাছে পত্র মাধ্যমে দাওয়াত দিয়ে দূত পাঠান। সিরিয়া সীমান্তের কাছাকাছি তাঁর একটি পনের সদস্যের দাওয়াতী প্রতিনিধিদলকে খ্রিষ্টানরা হত্যা করে। প্রানে বেঁচে আসে শুধুমাত্র দলনেতা কাব বিন উমায়ের গিফারী। একই সময় রাসুল (সঃ) বুসরার গভর্নরের কাছে দাওয়াত নিয়ে পাঠিয়েছিলেন হারিস বিন উমায়েরকে। কিন্তু রোম সম্রাটের অনুগত এই খৃষ্টান সর্দার আল্লাহর রাসুলের দূতকে হত্যা করে। রোম সাম্রাজ্যের এসব অন্যায় ও অপরাধমূলক আগ্রাসী থাবা থেকে আরব অঞ্চলকে নির্বিঘ্ন করার উদ্দেশ্যে অষ্টম হিজরির জমাদিউল উলা মাসে রাসুল (সঃ) হযরত যায়েদ বিন হারেসার নেতৃত্বে তিন হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী সিরিয়ার দিকে পাঠান। কিন্তু এই সেনাদলটি মাআন নামক স্থানে পৌঁছে জানতে পারেন, বুসরার গভর্নর শুরাহবিল এক লাখ সৈন্য নিয়ে তাঁদের মোকাবেলা করার জন্যে এগিয়ে আসছে। সামনে অগ্রসর হয়ে মুতা নামক স্থানে শুরাহবিলের এক লাখ সুসজ্জিত বাহিনীর সাথে তিন হাজার জিন্দাদিল মুসলিম এক অসম যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। ব্যাপক হতাহত হয় শুরাহবিল বাহিনী। এ যুদ্ধে বারোজন মুসলিম সেনাও শহীদ হন। এই বারো জনের মধ্যে মুসলিম বাহিনীর তিন সেনাপতিও অন্তর্ভুক্ত। তারা হলেন- যায়িদ বিন হারিসা, জাফর বিন আবু তালিব এবং আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা (রা)। পরের বছর নবম হিজরিতে রোম সম্রাট কাইজার মুসলমানদের থেকে মুতা যুদ্ধের প্রতিশোধ নেয়া এবং তাঁদের অগ্রযাত্রা স্তব্ধ করার উদ্দেশ্যে সিরিয়া সীমান্তে ব্যাপক সামরিক প্রস্তুতি নিতে থাকে। জানা যায়, তারা সীমান্তে দুই লাখ সৈন্যের সমাবেশ ঘটায়। আরব ভূখণ্ডের দিকে আর এক কদমও অগ্রসর হওয়ার পূর্বেই রাসুল (সঃ) তাঁদেরকে প্রতিরোধ করার সিদ্ধান্ত নেন। এ অভিযান ছিল ব্যাপক দূরত্বের অভিযান। ছিলো গরমের মওসুম, অর্থনৈতিক সমস্যা, ফসল পাকার মওসুম, সোয়ারীর অভাব। তা সত্যেও রাসুল (সঃ) বৃহৎ শক্তির হামবড়া ভাব স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিলেন। নবম হিজরির রযব মাসে তিনি ত্রিশ হাজার জিন্দাদিল মুজাহিদকে সাথে নিয়ে রওয়ানা করেন সিরিয়া সীমান্তের দিকে। এদিকে রোম সম্রাট ত্রিশ হাজার মুসলিম সৈন্যের আগমনের সংবাদ পেয়ে বিচলিত হয়ে পড়েন। বিশ্বনবী (সঃ) তাবুক নামক স্থানে পৌঁছে খবর পান, কাইজার সিরিয়া সীমান্ত থেকে তাঁর বাহিনী গুটিয়ে নিয়েছে। ফলে সিরিয়া প্রবেশ না করে রাসুল (সঃ) বিশ দিন তাবুকে অবস্থান করেন। আরব ভূখণ্ডে কাইজারের যেসব ছোট ছোট করদ রাজ্য ছিলো, তিনি সেগুলোর সর্দারদের উদ্দেশ্যে ছোট ছোট বাহিনী পাঠান। এতে করে তারা মদিনার ইসলামী রাষ্ট্রের বশ্যতা স্বীকার করে নেয়। এভাবে আল্লাহ পাক স্বল্প সময়ের মধ্যে ইসলামের প্রভাব সিরিয়া সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছে দেন। সূরা আত তওবার ৩৮-৭২ নং আয়াত তাবুক যুদ্ধে যাত্রার প্রাক্কালে এবং ৭৩ থেকে শেষ আয়াত পর্যন্ত আয়াতগুলো তাবুক থেকে ফিরে আসার পরে নাযিল হয়। এ আয়াতগুলোতে তাবুক যুদ্ধে অংশগ্রহনের জন্যে উৎসাহ প্রদান এবং তাবুক যুদ্ধের পর্যালোচনা করা হয়েছে। সূরা তাওবার এ আয়াতগুলো পড়লে তাবুক যুদ্ধ সম্পর্কে সঠিক ধারনা পাওয়া যাবে।

 

২৮। বিদায় হজ্জ

 

হজ্জ ফরয হওয়ার পর রাসুল (সঃ) একবারই হজ্জ করেন। আবার এ হজ্জেই তিনি সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়েছিলেন। সে কারনে এ হজ্জকে বিদায় হজ্জ বলা হয়। অর্থাৎ রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর বিদায়ী হজ্জ। দশম হিজরি সন। এ বছর বিশ্বনবী, বিশ্বনেতা মুহাম্মাদ (সঃ) হজ্জ করার সিদ্ধান্ত নেন। তখন পর্যন্তকার গোটা মুসলিম মিল্লাতকে ঘোষণা দিয়ে জানিয়ে দেয়া হয়, রাসুলুল্লাহর হজ্জে যাবার খবর। সব গোত্র ও কবিলার সামর্থ্যবান মুসলিমরা হজ্জে যাবার প্রস্তুতি নিতে থাকেন। চতুর্দিকে বইয়ে চলছে আনন্দের বন্যা। দশ হিজরি সনের ২৬ জিলকদ তারিখে আল্লাহর রাসুল (সঃ) হজ্জের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করেন। ৫ জিলহজ্জ তারিখে মক্কায় পৌঁছান। হজ্জ শেষে ১৪ যিলহজ তারিখে ফিরে রওয়ানা করেন মদিনা অভিমুখে। এ হজ্জ উপলক্ষে আল্লাহর রাসুল (সঃ) দুটি ভাষণ প্রদান করেন। একটি আরাফার ময়দানে অপরটি মিনায়। তাঁর এ ভাষণ ছিলো ইসলামী রাষ্ট্রের মেনিফেস্টো। এক লাখ চব্বিশ হাজার, কোন কোন বর্ণনায় এক লাখ চুয়াল্লিশ হাজার সাহাবী তাঁর সাথে হজ্জে শরীক হয়েছিলেন। তাঁর এ হজ্জই মুসলিম উম্মাহর জন্যে হজ্জের মডেল।

 

২৯। বিদায় হজ্জের ভাষণ

 

হজ্জ উপলক্ষে রাসুল (সঃ) দুটি ভাষণ দিয়েছিলেন। একটি ৯ যিলহজ্জ তারিখে আরাফার ময়দানে। অপরটি ১০ যিলহজ্জ তারিখে মিনায়। এ দুটি ভাসনে তিনি অনেকগুলো মৌলিক নির্দেশনা তিনি প্রদান করেছিলেন। তাঁর কয়েকটি এখানে উল্লেখ করা হলো—

 

  •  
  • ১। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই। তিনি এক ও একক। তাঁর কোন শরীক নেই। মুহাম্মাদ তাঁর দাস ও রাসুল।
  •  
  • ২। আমি তোমাদের উপদেশ দিচ্ছি, তোমরা কেবল এক আল্লাহর ইবাদাত ও উপাসনা করবে।
  •  
  • ৩। তোমাদের প্রত্যেকের জীবন ও সম্পদ পরস্পরের নিকট পবিত্র। পরস্পরের জীবন ও সম্পদের ক্ষতি সাধন নিষিদ্ধ করা হলো।
  •  
  • ৪। আমানাত তাঁর প্রাপকের কাছে ফিরিয়ে দেবে।
  •  
  • ৫। সুদ প্রথা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হলো।
  •  
  • ৬। জাহেলী যুগের সমস্ত কুসংস্কার রহিত করা হলো।
  •  
  • ৭। খুনের প্রতিশোধ যুদ্ধ রহিত করা হলো।
  •  
  • ৮। ইচ্ছাকৃত হত্যার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। অনিচ্ছাকৃত হত্যার দণ্ড একশো উট।
  •  
  • ৯। তোমরা শয়তানের আনুগত্য করোনা।
  •  
  • ১০। তোমরা স্ত্রীদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো। স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের উপর তোমাদের অধিকার রয়েছে। স্ত্রীদের উপর স্বামীদের অধিকার হলো তারা স্বামী ছাড়া আর কারো সাথে যৌনাচার করবেনা। স্বামীর অনুমতি ছাড়া তারা তাঁর অর্থসম্পদ খরচ করবেনা।
  •  
  • ১১। স্বামীদের উপর স্ত্রীদের অধিকার হলো, তারা পবিত্র জীবন যাপন করলে স্বামী প্রচলিত উত্তম পন্থায় তাঁদের জীবন সামগ্রী প্রদান করবে।
  •  
  • ১২। একজনের অপরাধের জন্যে আর একজনকে দণ্ড দেয়া যাবেনা।
  •  
  • ১৩। তোমাদের নেতা কোন নাক বোঁচা হাবশি হলেও সে যদি আল্লাহর কিতাবের আনুগত্য করে, তবে তাঁর আদেশ পালন করবে।
  •  
  • ১৪। মুসলিমরা পরস্পর ভাই ভাই।
  •  
  • ১৫। সমস্ত মানুষের স্রষ্টা একজন। সবার পিতাও একজন। সুতরাং কোন মানুষের উপর অপর মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব নেই।
  •  
  • ১৬। তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক মর্যাদাবান সে, যে সর্বাধিক আল্লাহভীরু ও ন্যায়নীতিবান।
  •  
  • ১৭। তোমাদের অধিনস্তদের অধিকারের ব্যাপারে সচেতন হও। তাঁদের প্রতি অন্যায় করোনা। তাঁদের আঘাত করোনা। তোমরা যা খাবে, পরবে, তাদেরকেও তাই খেতে ও পরতে দেবে।
  •  
  • ১৮। বিবাহিত ব্যাভিচারীর শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।
  •  
  • ১৯। উত্তরাধিকার কে কতটুকু পাবে, স্বয়ং আল্লাহ তা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। সুতরাং ওয়ারিশদের জন্যে আর অসিয়ত করা যাবেনা।
  •  
  • ২০। মনে রেখো, ঋণ অবশ্যি পরিশোধ করতে হবে।
  •  
  • ২১। মনে রেখো, দীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করোনা। (দলাদলি ও কট্টরপন্থা অবলম্বন করবেনা।)
  •  
  • ২২। আমার পরে আর কোন নবী আসবেনা। আমি তোমাদের কাছে দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি। যতোদিন এ দুতিকে আঁকড়ে ধরে রাখবে, ততদিন তোমরা বিপথগামী হবেনা। একটি হলো আল্লাহর কিতাব আল কুরআন এবং অপরটি হলো সুন্নাতে রাসুলুল্লাহ।
  •  

 

যারা এখানে উপস্থিত আছো, তারা এ ফরমানগুলো অনুপস্থিতদের কাছে, পরবর্তীদের কাছে পৌঁছে দেবে।

 

৩০। মুহাম্মাদ (সঃ) এর মৃত্যু

 

কোন নবী রাসুলই চিরজীবী হননি। সবারই মৃত্যু হয়েছে। প্রতিটি মানুষেরই মৃত্যু অবধারিত। মুহাম্মাদ (সঃ) সম্পর্কেও আল্লাহ বলেন – “হে মুহাম্মাদ, তুমিও মরনশীল, তাঁরাও মরনশীল।” (আল কুরআন ৩৯ ; ৩০)

 

হজ্জ শেষে রাসুল (সঃ) যিলহজ মাসের শেষার্ধেই মদিনায় ফিরে আসেন। এরপর মহররম মাস মোটামুটি ভালোভাবেই অতিবাহিত করেন। সফর মাস থেকে তাঁর অসুস্থতা দেখা দেয়। ১১ হিজরির ১২ রবিউল আউয়াল তারিখে তিনি ইহজগত ত্যাগ করেন। দুনিয়া থেকে ইন্তেকাল করেন আখিরাতের দিকে। মৃত্যুর চার পাচদিন আগে তাঁর ইচ্ছানুযায়ী লোকেরা তাঁকে ধরাধরি করে মসজিদে নিয়ে এসেছিলো। সেদিন তিনি সাহাবীগনের মজলিশে সর্বশেষ একটি ছোট্ট ভাষণ দেন। তাতে তিনি বলেন-

 

“তোমাদের পূর্ববর্তী লোকেরা তাঁদের নবী ও পুণ্যবান লোকদের কবরকে সিজদার জায়গা বানিয়েছিল। তোমরা এমনটি করোনা। আমার মৃত্যুর পর তোমরা আমার কবরকে সিজদা ও উপাসনার জায়গা বানিয়ো না। যারা নবী ও পুণ্যবানদের কবর পূজা করবে, তাঁদের উপর আল্লাহর গযব। আমি তোমাদেরকে একাজ করতে নিষেধ করছি। আমি তোমাদের কাছে সত্য বানী পৌঁছে দিয়েছি। হে আল্লাহ, তুমি সাক্ষী থাকো।”

 

৩১। ইসলাম পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা

 

মুহাম্মদ (সঃ) এর মৃত্যুর মাধ্যমে শেষ হয়ে গেলো নবী রাসুল আগমনের সিলসিলা। পৃথিবীতে আর কোন নবী রাসুল আসবেন না। তাই মহান আল্লাহ মুহাম্মাদ (সঃ) এর মাধ্যমে দ্বীন ইসলাম বা ইসলামী জীবন ব্যবস্থাকে কিয়ামত পর্যন্ত সকল মানুষের উপযোগী করে পূর্ণাঙ্গ করে দিয়েছেন। বিদায় হজ্জ উপলক্ষে আরাফার ভাষণের সময় মহান আল্লাহ অহী নাযিল করে এ সংক্রান্ত ডিক্রি জারি করেন। তিনি বলেন-

 

“আজ আমি তোমাদের জন্যে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম তোমাদের দ্বীন (জীবন ব্যবস্থা), পরিপূর্ণ করে দিলাম তোমাদের প্রতি আমার নিয়ামত (কুরআন) এবং তোমাদের জন্যে দ্বীন (ধর্ম ও জীবন ব্যবস্থা) মনোনীত করলাম ইসলামকে।” (আল কুরআন ৫ ; ৩) এ ছাড়াও মহান আল্লাহ কুরআন মজীদে আরো বলে দিয়েছেন-

 

  •  
  • ১। “নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে দ্বীন হলো ইসলাম।” (আল কুরআন ৩ ; ১৯)
  •  
  • ২। “যে কেউ ইসলাম ছাড়া অন্য কোন দ্বীন (ধর্ম, মতাদর্শ ও জীবন পদ্ধতি) গ্রহন করবে, তাঁর থেকে তা গ্রহন করা হবেনা। আর আখিরাতে সে হবে ক্ষতিগ্রস্ত।” (আল কুরআন ৩ ; ৮৫)
  •  
  • ৩। “আল্লাহ কাউকেও সঠিক পথে চলার তৌফিক দিতে চাইলে ইসলামের জন্যে তাঁর হৃদয়কে উম্নুক্ত করে দেন। আর তিনি যাকে বিপথগামী করতে চান, তাঁর অন্তরকে করে দেন সংকীর্ণ। তখন তাঁর কাছে ইস্লামে প্রবেশ করাটা সিঁড়ি বেয়ে আকাশে উঠার মতই কষ্টসাধ্য মনে হয়। যারা ঈমান আনেনা, আল্লাহ এভাবেই তাঁদের লাঞ্ছিত করেন।” (আল কুরআন ৬ ; ১২৫)
  •  
  • ৪। “আল্লাহ যার হৃদয় উন্মুক্ত করে দেন ইসলামের জন্যে এবং যে রয়েছে তাঁর প্রভুর প্রদত্ত আলোর মধ্যে, সে কি ঐ ব্যক্তির সমতুল্য, যার অবস্থান এরকম নয়?” (আল কুরআন ৩৯ ; ২২)
  •  
  • ৫। “ঐ ব্যক্তির চাইতে বড় যালিম আর কে? যাকে ইসলামের দিকে ডাকা হলে সে মিথ্যা রচনা করে আল্লাহর দিকে আরোপ করে? ’’(আল কুরআন ৬১ ; ৭)
  •  
  • ৬। “আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে এসেছে একটি আলোকবর্তিকা (মুহাম্মাদ সাঃ) এবং একটি সুস্পষ্ট কিতাব (আল কুরআন)। এর মাধ্যমে আল্লাহ সে সব লোকদের সালামের (ইসলামের, শান্তির ও নিরাপত্তার) পথ দেখান, যারা তাঁর সন্তোষ লাভের আকাঙ্ক্ষী। আর তিনি নিজ অনুমতিক্রমে তাঁদের বের করে আনেন অন্ধকাররাশি থেকে আলোতে এবং তাঁদের পরিচালিত করেন সরল সঠিক পথে।”
  •  

 

(আল কুরআন ৫ ; ১৫-১৬)

 

সমাপ্ত

 

 

', 'নবীদের সংগ্রামী জীবন', '', 'publish', 'closed', 'closed', '', '%e0%a6%a8%e0%a6%ac%e0%a7%80%e0%a6%a6%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%b8%e0%a6%82%e0%a6%97%e0%a7%8d%e0%a6%b0%e0%a6%be%e0%a6%ae%e0%a7%80-%e0%a6%9c%e0%a7%80%e0%a6%ac%e0%a6%a8', '', '', '2019-10-26 17:25:03', '2019-10-26 11:25:03', '

কুরআনে বর্ণিত আম্বিয়ায়ে কেরামের জীবনকথা

 

নবীদের সংগ্রামী জীবন

 

আবদুস শহীদ নাসিম

 


 

স্ক্যান কপি ডাউনলোড

 

 

 

রাসুলদের পাঠানো হয়েছে কেন?

 

‘‘আমরা আমাদের রাসুলদের স্পষ্ট নির্দশন ও সঠিক পথের নির্দেশিকাসহ পাঠিয়েছি। আর তাহাদের সাথে অবতীর্ণ করেছি আল কিতাব ও পক্ষপাতহীন সুষম জীবন ব্যবস্থা, যাতে করে মানুষ সুবিচার (justice) এর উপর প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। তাছাড়া আমরা লোহা অবতীর্ণ করেছি, যার মধ্যে র‍য়েছে বিরাট শক্তি আর মানুষের জন্য না না কল্যাণ ও উপকারীতা। এটা করা হয়েছে এ জন্যে যে, আল্লাহ বাস্তবে যেনে নিতে চান, না দেখেও তারা তাঁকে আর তাঁর রাসুলদেরকে সাহায্য করে? নিশ্চয়ই আল্লাহ অত্যন্ত শক্তিধর ও মহা পরাক্রমশালী। ’’ সুরা ৫৭ আল হাদীদ আয়াত ; ২৫

 

 

 

বিসমিল্লাহির রাহমানীর রাহীম

 

এই বই সম্পর্কে কিছু কথা

 

নবী রাসুলগন সেরা মানুষ। তাঁরা আল্লাহর মনোনীত ও নিযুক্ত। তাঁদের কাছে মহান আল্লাহ অহী পাঠিয়েছেন, কিতাব পাঠিয়েছেন। তাঁরা ছিলেন নিষ্পাপ ও আদর্শ মানুষ। তাঁরা মানুষকে আল্লাহর দেয়া বিধান অনুযায়ী জীবন যাপন করতে বলেছেন।

 

মহান আল্লাহ আল-কুরানে হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) সহ পঁচিশ জন নবী-রাসুলের নাম উল্লেখ করেছেন। তাঁদের অনেকের কথা বার বার উল্লেখ করেছেন। তাঁদের আদর্শ ও সেরা জীবনের কথা উল্লেখ করেছেন। তাঁদের আদর্শ অনুসরনের আহবান জানিয়েছেন। তাই নবীদের পথই মানুষের মুক্তির একমাত্র পথ।

 

 আল-কুরানের আলোকে নবীগনের জীবন কথা ও জীবনাদর্শ লেখার বাসনা আমার অনেক দিনের। অবশেষে লেখার কাজে হাত দিলাম। কিশোর ও তরুণদের কথা সামনে রেখেই লেখার কাজ শুরু করেছি এর দশকে ‘কিশোর কণ্ঠ’ পত্রিকায় জীবনীগুলো ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ হয়েছে। অতঃপর হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর পূর্বেকার চব্বিশজন নবীর জীবনী দুই খণ্ডে প্রকাশ হয়। কিন্তু দুই খণ্ডে প্রকাশ করলে গ্রন্থটি পাঠকদের জন্য সহজলভ্য হয় না। এখন তাই পাঠকগণের সুবিধার্থে তিন খণ্ডের পূর্ণাঙ্গ জীবনী একত্র করে এক ভলিউমে প্রকাশ করা হল। হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর জীবনী সংক্ষিপ্ত আকারে প্রকাশ করা হল। তবে তাঁর জীবনীর উপরে আলাদা একটি বইও লেখা হয়েছে। এ বইয়ের ধারাবাহিকতায় লেখা হয়েছে হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর জীবনীর উপর সে বইটি। সেই বইটির শিরোনাম; বিশ্ব নবীর শ্রেষ্ঠ জীবন।

 

হ্যাঁ, যে কথাটি বলছিলাম, নবীগনের জীবনী লেখা সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা পবিত্র কুরানের আলোকে। কুরআনের আলোকেই লিখেছি। তবে কয়েকজন নবীর জীবন কথা কুরানে একেবারে সংক্ষেপে আলোচনা হয়েছে। তাঁদের ক্ষেত্রে হাদীস, তাফসীর ও ইতিহাস গ্রন্থের সাহায্য নিয়েছি।

 

আমরা এ গ্রন্থে নবীগনের ক্রমতালিকা সাজিয়েছি কুরান, হাদীস ও ঐতিহাসিক তথ্য প্রমান অনুযায়ী তাঁদের আগমন ও জীবন কালের ক্রমধারার ভিত্তিতে।

 

নবীগনের জীবনী লেখার ক্ষেত্রে রং চং লাগিয়ে গল্প কাহিনী লেখার চেস্টা করা হয় নি। কুরআনের আলোকে নিরেট জীবন কথাই লেখা হয়েছে। তাই এ বইতে কাহিনীগত রস পরিবেশনের পরিবর্তে জীবনাদর্শ পরিবেশনের প্রতি অধিক লক্ষ্য রাখা হয়েছে।

 

বস্তুনিষ্ঠ জীবন কথা জানতে জারা আগ্রহী, বিশেষ করে কিশোর ও তরুন সমাজের কাছে আশা করি এ বই অনেক ভালো লাগবে। কারন এতে তাঁরা কেবল ইতিহাসই জানবে না, সেই সাথে নিজেদের জীবনাদর্শ ও শ্রেষ্ঠ জীবন গড়ার এবং জীবন চলার পথও খুজে পাবে।

 

এ বই পড়ে নবী গনের আদর্শে যদি উদ্বুদ্ধ হয় আমার দেশের কিশোর- তরুন আর যুবকেরা, তবেই পূর্ণ হবে আমার দীলের তামান্না, মনের স্বপ্ন স্বাধ। প্রভু, তুমি এই গ্রন্থটিকে কবুল করো। আমীন।

 

 

 

আব্দুস শহীদ নাসীম।

 

 

 

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

 

আম্বিয়ায়ে কেরামের জীবন কথা

 

 

 

মানুষকে সঠিক পথ দেখানোর জন্যে আল্লাহ যুগে যুগে অনেক নবী- রাসূল নিযুক্ত করেছেন। নবীরা মানুষ ছিলেন। (সুরা ইবরাহীম-আয়াত ১১, সুরা আল কাহাফ-আয়াত ১১০)। তবে তাঁদেরকে নবী নিযুক্ত করে তাঁদের কাছে আল্লাহ নিজের বানী পাঠিয়েছেন। তাঁদেরকে তিনি সবকিছু সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান দান করেছেন।

 

সুতরাং তাঁরা একদিকে ছিলেন সত্য ও সঠিক জ্ঞানের অধিকারী। অন্নদিকে ছিলেন উন্নত চরিত্র ও নিষ্পাপ জীবনের অধিকারী। ছিলেন আদর্শ মানুষ। তাঁরা অহীর মাধ্যমে আল্লাহড় বাণী লাভ করতেন। তাঁরা কখনো আল্লাহর হুকুম অমান্য করতেন না।

 

আল্লাহ পৃথিবীতে মানুষ সৃষ্টি করেছেন তাঁর দাসত্ব করার জন্যে। তাঁর হুকুম পালন করার জন্যে। তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী জীবন যাপন করার জন্যে। সেই সাথে পৃথিবীটাকে তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী পরিচালনা করার জন্যে। এই হল মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য। মহান আল্লাহ নবীদের পাঠিয়েছেন মানুষকে তাঁদের সৃষ্টির উদ্দেশ্য জানিয়ে দিতে এবং কথাটা বার বার স্মরণ করিয়ে দিতে।

 

মহান আল্লাহ যাদের নবী নিযুক্ত করেছেন, তাঁরা সারা জীবন মানুষকে আল্লাহর পথে ডেকেছেন। মানুষকে আল্লাহ প্রদত্ত জীবন বিধান অনুযায়ী জীবন যাপন করতে বলেছেন। নফসের তাড়না এবং শয়তানের পথ পরিহার করে আল্লাহর সন্তুষ্টির পথে চলতে তাঁদের অনুপ্রানিত করেছেন।

 

নবীরা আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষকে জানিয়ে দিয়েছেন, মানুষ যদি আল্লাহর বিধান অনুযায়ী তাঁর সন্তুষ্টির পথে জীবন যাপন করে, তবে মৃত্যুর পর যে চিরন্তন জীবন আছে, সেখানে তাঁরা মহা সুখে জান্নাত লাভ করবে। কিন্তু যারা আল্লাহর বিধান অনুযায়ী জীবন ধারন করবেন না। মৃত্যুর পরের জীবনে তাঁদের জন্যে রয়েছে কঠিন শাস্তি আর শাস্তি।

 

নবী শব্দের অর্থ হল ‘সংবাদ বাহক’। রাসুল শব্দের অর্থ ‘বানী বাহক’। নবী- রাসুল গন আল্লাহর বানী এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে সঠিক পথের সংবাদ মানুষের কাছে পৌছে দিয়েছেন বলেই তাঁদেরকে নবী ও রাসুল বলা হয়। সকল রাসুলই নবী ছিলেন। তবে সকল নবী রাসুল ছিলেন না। অনেক নবীর কাছে আল্লাহ তায়ালা শুধু অহী পাঠিয়েছেন। আবার অনেক নবীর কাছে অহী এবং কিতাবও পাঠিয়েছেন। যারা সাধারনভাবে অহী লাভ করা ছাড়াও কিতাব লাভ করেছেন, তারাই ছিলেন রাসুল।

 

প্রথম নবী ছিলেন পৃথিবীর প্রথম মানুষ হযরত আদম (আঃ)। সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি

 

ওয়াসসালাম। তাঁর পরে পৃথিবীতে আল্লাহ আর কোন নবী নিযুক্ত করবেন না। পৃথিবীতে আল্লাহ তায়ালা ঠিক কত জন মানুষকে নবী নিযুক্ত করেছেন, তা মানুষের পক্ষে কখনোই জানা সম্ভব নয়। একটি বর্ণনা থেকে জানা যায়, আল্লাহ তায়ালা এক লক্ষ বিশ হাজার নবী পাঠিয়েছেন। এদের মধ্যে তিনশত পনের জন ছিলেন রাসুল। তবে তাঁদের প্রকৃত সংখ্যা মহান আল্লাহই ভালো জানেন।

 

আল্লাহ কুরানে পচিশজন নবীর নাম উল্লেখ করেছেন। তাঁরা সকলেই রাসুল ছিলেন। কুরআনে উল্লেখিত নবী-রাসুলগন হলেনঃ ১। আদম, ২। নূহ, ৩। ইদ্রিস, ৪। হুদ, ৫। সালেহ, ৬। ইব্রাহীম, ৭। লুত, ৮। ইসমাঈল, ৯। ইসহাক, ১০। ইয়াকুব, ১১। ইউসুফ, ১২। শুয়াইব, ১৩। আইউব, ১৪। যুল কিফল, ১৫। মূসা, ১৬। হারূন, ১৭। দাউদ, ১৮। সুলাইমান, ১৯। ইলিয়াস, ২০। আল ইয়াসা, ২১। ইউনুস, ২২। জাকারিয়া, ২৩। ইয়াহিয়া, ২৪। ঈসা, ২৫। মুহাম্মদ (সাঃ)

 

বাকী নবী রাসুলগনের নাম কুরআনে উল্লেখ করা হয় নি। তবে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, তিনি সকল জাতির কাছেই নবী পাঠিয়েছেন এবং প্রতিটি মানব বসতিতেই নবী পাঠিয়েছেন। (সুরা ফাতির – আয়াত ২৪, সুরা আর রায়াদ – আয়াত ৭)

 

নবী-রাসুলগনের প্রতি অবশ্যি ঈমান আনতে হবে। কুরআনে যে পঁচিশজনের নাম উল্লাখ আছে, তাঁদের প্রত্যেকের প্রতি পৃথকভাবে ঈমান আনতে হবে। তাঁদের কারো প্রতি ঘৃনা বিদ্বেষ পোষণ করা যাবে না। আর যেসব নবী রাসুলের নাম কুরানে উল্লেখ করা হয় নি, তাঁদের প্রতি সামগ্রিকভাবে ঈমান আনতে হবে।

 

সকল নবী একই দ্বীনের বাহক ছিলেন। তাঁরা সকলেই আল্লাহর নিযুক্ত ছিলেন। তাঁরা মানুষকে-

 

১। আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার দাওয়াত দিয়েছেন।

 

২। আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করতে নিষেধ করেছেন।

 

৩। এক আল্লাহর আনুগত্য ও দাসত্ব করতে বলেছেন।

 

৪। আল্লাহর দেয়া বিধান অনুযায়ী জীবন যাপন করতে বলেছেন।

 

৫। আল্লাহর দেয়া বিধান অনুযায়ী সমাজ জীবন পরিচালনা করতে বলেছেন। সুবিচার করতে বলেছেন।

 

৬। ঈমানের ভিত্তিতে ভ্রাতৃত্ব গড়তে ও হানাহানি পরিহার করতে বলেছেন।

 

৭। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে এবং তাঁর অসন্তুষ্টি থেকে আত্নরক্ষা করতে বলেছেন।

 

৮। জাহান্নাম থেকে বাঁচতে এবং জান্নাতের পথে চলতে বলেছেন।

 

নবীগন মানুষকে কল্যাণের পথে ডেকেছেন। কিন্তু মানুষ দুনিয়ার অন্ধ মোহে লিপ্ত হয়ে নবীদের বিরোধিতা করেছে। তাঁদের অনেক দুঃখ কষ্ট দিয়েছে। অত্যাচার নির্যাতন করেছে। অনেক নবীকে লোকেরা নিজের মাতভূমি ত্যাগ করতে বাধ্য করেছে। আল্লাহর এই মহান নবীগণকে মানুষ হত্যা করার কূট কৌশল করেছে। অগনিত নবীকে তাঁরা হত্যা করেছে। কাউকে অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করেছে। কাউকে তারা হত্যা করার জন্যে তাড়া করেছে। কাউকে হত্যা করার জন্যে বাড়ী ঘেরাও করেছে।

 

এত চরম বিরোধিতা স্বত্তেও নবীগন সত্য পথের দিকে দাওয়াত দান থেকে কখনই বিরত থাকেন নি। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করা পর্যন্ত তাঁরা প্রত্যেকেই মানুষকে সত্য পোঠে আসার আহবাণ জানিয়ে গেছেণ। তাঁরা আল্লাহর বিধান অনুযায়ী সমাজ গরার জন্য আজীবোণ সংগ্রাম কোড়ে গেছেণ। শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সাঃ)। তাঁর পরে আর কোন নবী রাসুল আসবেন না। সুতরাং আল্লাহ তাঁর অনুসারীদেরকে দায়িত্ব দিয়েছেন মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকবার। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর উম্মতের জ্ঞানী লোকেরা নবীর সত্যিকার উত্তরাধিকারী। তাঁরা মানুষকে আল্লাহর দাসত্ব করার, আল্লাহর ইচ্ছা অনুযায়ী জীবন যাপন করার এবং আল্লাহর বিধান অনুযায়ী জীবন যাপন করার এবং আল্লাহর বিধান মাফিক পৃথিবীকে সুন্দর করে গড়ার ও পরিচালিত করার দায়িত্ব পালন করবে।

 

এখন আমাদের কাছে এ কথা স্পস্ট হল যে, পৃথিবীতে মানুষের চলার পথ দুটি। একটি হল নবীদের দেখানো পথ। এটিই বিশ্ব জগতের স্রস্টা মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের পথ। এ পথের প্রতিদান হল জান্নাত বা বেহেশত।

 

অপরটি হল আল্লাহদ্রোহীতার পথ। এটি আল্লাহকে অমান্য করার পথ। আল্লাহর অসন্তুষ্টির পথ। নবীদের অমান্য করার পথ। শয়তানের পথ। আত্নার দাসত্বের পথ। এ পথের পরিনাম হল জাহান্নাম, চির শাস্তি, চির লাঞ্ছনা, চির অকল্যান আর ধংস। আমাদেরকে চলতে হবে আল্লাহর পথে। চলতে হবে নবীদের পথে। নবীদের দেখানো পথই হল আল্লাহর সন্তুস্টির পথ। নবীদের পথই দুনিয়ার কল্যানের পথ।

 

নবীদের পথই জান্নাতের পথ। নবীদের পথ শান্তির পথ। নবীদের দেখানো পথ সুন্দর পৃথিবী গড়ার পথ। নবীদের দেখানো পথ আদর্শ মানুষ হবার পথ। নবীদের পথ উন্নতির পথ, শ্রেষ্ঠত্বের পথ। তাই আসুন আমরা নবীদের জীবনী পড়ি। তাঁদের আদর্শকে জানি। তাঁদের ভালোবাসি। তাঁদের আদর্শের অনুসরন করি এবং তাঁদের দেখানো পথে চলি।

 

 

প্রথম মানুষ প্রথম নবী আদম

 

আলাইহিস সালাম

 

মহাবিশ্ব ও পৃথিবী

 

এই মহা বিশ্বে রয়েছে লক্ষ কোটি গ্রহ নক্ষত্র। মেঘমুক্ত আকাশে মাথার উপর শুন্যলোকে তাকিয়ে দেখুন, বলুনতো কী দেখতে পান? হ্যাঁ, দিনে প্রচণ্ড তেজদীপ্ত সূর্য। রাতে ঝলমল মিটমিটে তাঁরার আলো। এইতো আমরা দেখি দিবানিশি। বাপও দেখেছেন। দাদা দেখেছেন। পরদাদা দেখেছেন, পূর্বপুরুষরা সবাই দেখেছেন। কবে থেকে ওদের শুরু আর কবে যে হবে শেষ, কেউ জানে না তা। একই পথে, একই নিয়মে ওরা চলছে তো চলছেই। কে ওদের সৃষ্টি করেছেন? আপনি নিশ্চয়ই বলবেন, এক আল্লাহ ছাড়া আবার কে? হ্যাঁ তিনি গোটা বিশ্ব জগত সৃষ্টি করেছেন মাত্র ছয়দিনে। (দেখুন আল কুরআনঃ সুরা আরাফঃ ৪৫, সুরা ইউনুসঃ ৩, সুরা হুদঃ ৭, সুরা ফুরকানঃ ৫৯, সুরা সাজদাঃ ৪, সুরা কাহাফঃ ৩৮, সুরা হাদিদঃ ৪) ছয় দিনে মানে ছয়টি কালে। তিনিই গোটা বিশ্ব জগতের স্রস্টা, শাসক ও পরিচালক। তিনিই সমস্ত ক্ষমতার উৎস।

 

মহা বিশ্বে এই যে লাখো কোটি গ্রহ নক্ষত্র, ওদের আবার ভিন্ন ভিন্ন পরিবার আছে। একেক পরিবারের অনেক অনেক সদস্য আছে। ওদের যে মোট কয়টি পরিবার আছে, আর একেক পরিবারে যে কতজন সদস্য আছে, সে কথা কেউ বলতে পারবে না। আমাদের এই পৃথিবীও কিন্তু একটা গ্রহ। একটি নক্ষত্র পরিবারের সদস্য। এবার নিশ্চয়ই আপনি বুঝতে পেরেছেন, মহান আল্লাহর গোটা সৃষ্টিলোকের অতি ক্ষুদ্র একটি অংশই মাত্র আমাদের এই পৃথিবী।

 

তিনি এই পৃথিবীকে সৃষ্টি করেছেন মনের মত সুন্দর করে। সাজিয়েছেন অপরূপ সাজে। এখানে শান্ত সাগর গতিমান। চঞ্চল নদী বহমান। পর্বতমালা শিরতুলে উঁকি মারে আকাশে। দিনে সূর্যের আলো। রাতে মিষ্টি হাসি চাঁদের। সবুজের বন। গাছের ছায়া। পাখির কলতান। ফুলের গন্ধ। ফলের সমারোহ। সবকিছু আছে অফুরান। নেই শুধু সেই-----।

 

প্রতিনিধি পাঠাবার সিদ্ধান্ত

 

নেই শুধু সেই মানুষ। সেই মানুষ, যার জন্যে এই পৃথিবীর সবকিছু বানিয়েছেন তিনি।(সুরা ২ আল বাকারাঃ আয়াত ২৯) তিনি পৃথিবীতে তাঁর নতুন প্রতিনিধি পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। আর সিদ্ধান্ত নিলেন, মানুষ সৃষ্টি করে তাঁকেই পৃথিবীতে তাঁর নতুন প্রতিনিধি বানিয়ে পাঠাবেন। যেই সিদ্ধান্ত সেই কাজ। কে আছে তাঁর সিদ্ধান্ত নাড়াবার? তিনি তাঁর সিদ্ধান্তের কথা ফেরেস্তাদের জানিয়ে দিলেন। বললেন, ‘‘হে ফেরেস্তারা, পৃথিবী নামের নতুন যে গ্রহটি আছে, সেখানে আমি এক নতুন প্রজন্মকে প্রতিনিধি নিয়োগ করবো।’’

 

ঘোষণাটি শুনে তাঁরা আঁতকে ওঠে।

 

ফেরেস্তা কারা? হ্যাঁ, তারাও আল্লাহর সৃষ্টি। তাঁর দাস। তাঁর সাম্রাজ্যের একান্ত বিনীত বাধ্যগত কর্মচারী। আল্লাহর নির্দেশে তাঁরা গ্রহ নক্ষত্র পরিচালনা করে। পানি, বাতাস, মেঘমালা পরিচালনা করে। জীবন মৃত্যু দান করে। তাঁরই নির্দেশে আরো করে হাজারো রকমের কাজ। মোট কথা তাঁরা তাঁর দাস কর্মচারী। দাসত্ব করা ছাড়া তাঁরা আর কিছু জানে না,বুঝে না।

 

তাইতো তাঁরা প্রভুর বক্তব্যে ‘প্রতিনিধি’ শব্দটি শুনে আঁতকে ওঠে। কারন এ শব্দটির মধ্যে ‘স্বাধীনতার’ গন্ধ আছে। আর স্বাধীনতা পেলে স্বেচ্ছাচারীতার আশংকা থাকে। তাইতো তাঁরা বলে উঠলোঃ

 

‘‘আপনি কি সেখানে এমন কাউকেও পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যে সেখানকার ব্যবস্থাপনায় বিপর্যায় সৃষ্টি করবে, আর করবে হানাহানি রক্তপাত? আপনার প্রশংশা আর গুনগান করার জন্যেতো আমরাই নিযুক্ত রয়েছি।’’ (সুরা ২ আল বাকারা-আয়াত ৩০)

 

আল্লাহ তাঁদের বলে দিলেনঃ ‘‘আমি যা জানি, তোমরা তা জান না।’’ (সুরা ৬ আনয়ামঃ আয়াত ২, সুরা মুমিনুনঃ আয়াত ১২, সুরা সাজদাঃ আয়াত ৭)

 

সৃষ্টি করলেন আদমকে

 

তারপর কি হল? তারপর তিনি সৃষ্টি করলেন প্রথম মানুষ। সৃষ্টি করলেন তাঁকে মাটি দিয়ে। (সুরা ২ আল বাকারাঃ আয়াত ৩০) মাটির দেহ তৈরি হয়ে যাবার পর তার মধ্যে ঢুকিয়ে দিলেন জীবন। তিনি হয়ে গেলেন এক জ্যান্ত মানুষ। আল্লাহ তাঁর নাম দিলেন ‘আদম’। তিনি আদমকে শুধু জ্যান্ত মানুষই বানান্ নি। বরং ‘‘খালাকাল ইনসান, আল্লামাহুল বাইয়ান’’-তাঁকে মানুষ বানালেন এবং কথা বলা শিখালেন।

 

আদম পৃথিবীর সব মানুষের পিতা।

 

জ্ঞানী আদম

 

তারপর মহান আল্লাহ ‘আদমকে সব কিছুর নাম শিখালেন’। (সুরা আল বাকারাঃ আয়াত ৩১)

 

নাম শিখানোর মানে কী? নাম শিখানোর মানে পরিচয় শিখানো। গুনবৈশিষ্ট এবং ব্যাবহার বিধি জানানো। অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা আদমকে সব কিছুর পরিচয় জানিয়ে দিলেন। জানিয়ে দিলেন ব্যাবহার করার নিয়ম কানুন। প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করবার জন্যে এ শিক্ষা লাভ করার প্রয়োজন ছিল অনিবার্য। এবার ফেরেশতাদের দেকে বললেনঃ

 

‘‘তোমরা যে ধারনা করছিলে, তা যদি সঠিক হয়ে থাকে, তবে বল দেখি এই জিনিসগুলির নাম।’’ (সুরা ২ আল বাকারাঃ আয়াত ৩১)

 

কী করে বলবে তাঁরা? তাঁদের তো এগুলি সম্পর্কে কোন জ্ঞানই দেয়া হয় নি। তাঁরা বিনীত কয়ে বললো –‘‘ প্রভূ, ত্রুটিমুক্ত পবিত্র তোমার স্বত্বা। আমরা তো কিছুই জানি না। কেবলমাত্র তুমি যতটুকু শিখিয়েছ, ততটুকুই আমরা জানি। সমস্ত জ্ঞান ও বিজ্ঞতার মালিক তো তুমিই।’’ (সুরা আল বাকারাঃ আয়াত ৩২)

 

এবার তিনি আদমকে নির্দেশ দিলেন, ‘‘আদম, তুমি ওদেরকে এ জিনিসগুলির পরিচয় বলে দাও।’’ আদম (আঃ) সবগুলি জিনিসের পরিচয় তাঁদেরকে বলে দিলেন। (আল বাকারাঃ আয়াত ৩৩)

 

আদমের প্রতি সাজদাবনত হবার হুকুম

 

এই আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে ফেরেশতারা যা সন্দেহ করেছিলো, তারই জবাব দেয়া হয়েছে। তাঁদের বুঝিয়ে দেয়া হল, মানুষকে কেবল ক্ষমতা আর সাধীনতাই দেয়া হবে না, বরং তাঁদের ক্ষমতা ও স্বাধীনতা প্রয়গের জন্যে জ্ঞানও দেয়া হবে।

 

এবার আল্লাহ্‌ ফেরেশতাদের হুকুম দিলেনঃ ‘‘আদমের সামনে নত হও। ’’

 

আল্লাহর নির্দেশে সবাই আদমের সামনে অবনতো হলো। (আল বাকারাঃ আয়াত ৩৪)

 

ইবলিসের কাণ্ড

 

কিন্তু ইবলিস অবনতো হতে অস্বীকার করলো। সে অহংকার করে বললোঃ ‘‘আমি আদমের চাইতে উত্তম। কারন তুমি আমাকে আগুন দিয়ে সৃষ্টি করেছ। আর আদমকে তো মাটি দিয়ে তৈরি করেছ। ’’

 

এভাবে ইবলিস তিনটি অমার্জনীয় অপরাধ করলো। সেঃ

 

১। আল্লাহর হুকুম অমান্য করলো,

 

২। অহংকার করলো এবং

 

৩। নিজেই নিজেকে উত্তম বলে ঘোষণা করলো।

 

এই তিনটির চাইতে নিকৃষ্ট অসৎগুন আর হয় না। সুতরাং আল্লাহ্‌ তাঁকে ‘‘অভিশপ্ত শয়তান’’ বলে আখ্যা দিলেন। বললেনঃ ‘ তুই এখান থেকে নেমে যা। এখানে থেকে অহংকার করবার কোন অধিকার তোর নেই। যা, তুই বেরিয়ে যা। এখন থেকে তুই অপমানিত ও লাঞ্ছিতদেরই একজন।’’ (আল আরাফঃ আয়াত ১৩)

 

এবার সে সমস্ত কল্যাণ ও অনুগ্রহ থেকে নিরাশ হল। আর ‘ইবলিস’ মানেই নিরাশ। কিন্তু সে অহংকার ত্যাগ করলো না। সে ভাবল, আদমের কারনেই তো আমি বঞ্চিত আর অভিশপ্ত হয়েছি। সুতরাং আদম ও আদমের সন্তানদের ক্ষতি করার জন্য আমি সর্বশক্তি নিয়োগ করবো। সে আল্লাহকে বললোঃ ‘আমাকে পূনরুথ্যান দিবস পর্যন্ত অবকাশ দিন।’’ এই ‘অবকাশ দিন বলতে শয়তান আল্লাহর কাছে দুটি সুযোগ চাইলোঃ

 

১। কিয়ামত পর্যন্ত বেঁচে থাকার সুযোগ এবং

 

২। আদম সন্তানদের পথভ্রষ্ট করার সুযোগ।

 

‘‘আল্লাহ্‌ বললেন- যা তোকে সুযোগ দিলাম।’’ (আল আরাফঃ আয়াত ১৫, সুরা আল হিজরঃ আয়াত ৩৭) শয়তান বলল-

 

‘‘আদম সন্তানদের পথভ্রষ্ট করার জন্যে এখন থেকে আমি তোমার সরল সঠিক পথের বাঁকে বাঁকে ওঁৎ পেতে বসে থাকবো। সামনে পিছে, ডানে বামে, সব দিক থেকে আমি তাঁদের ঘিরে ফেলব। ফলে তাঁদের মধ্যে থেকে খুব কম লোককেই তুমি তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ পাবে।’’ (সুরা ৭ আল আরাফঃ আয়াত ১৬-১৭)

 

আল্লাহ বল্লেনঃ আমার বান্দাদের উপর তোর কোন প্রভাব প্রতিপত্তি চলবে না। তুই জোর করে তাঁদের সঠিক পথ থেকে ফেরাতে পারবি না। তুইতো পারবি কেবল চালবাজি করতে। মিথ্যা আশার লোভ দেখাতে। পাপের কাজকে চাকচিক্যময় করে দেখাতে। আর ভ্রান্ত পথের আকর্ষণ সৃষ্টি করতে। এই সুযোগই তো কেবল তোকে দেয়া হয়েছে। লোকদের জোর করে হেদায়েতের পথ থেকে গোমরাহির পথে টেনে নেবার ক্ষমতা তোকে দেয়া হয় নি। তবে যে সব মানুষ তোর প্রলোভনে পড়বে, আমি তাঁদেরকে আর তোকে দিয়ে জাহান্নাম ভর্তি করবো। (ইসরাঃ আয়াত ৬২-৬৫, সুরা হিজরঃ আয়াত ৪২)

 

এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছি, যে সব মানুষ আল্লাহর হুকুম মেনে চলবে, শয়তান তাঁদের পথভ্রষ্ট করতে পারবে না। সে ক্ষমতা শয়তানের নেই। শয়তান কেবল তাদেরই বিপথগামী করতে পারবে, যারা আল্লাহর হুকুম মেনে চলে না। কিংবা তাঁর হুকুম পালনে গাফলতি করে।

 

আদম ও হাওয়া জান্নাতে

 

তারপর কি হল? –তারপর মহান আল্লাহ্‌ শয়তানকে লাঞ্ছিত করে তাড়িয়ে দিলেন। আর আদমকে থাকতে দিলেন জান্নাতে। প্রথমত আদম ছিলেন একা। তারপর আল্লাহ্‌ আদমের (পাঁজরের হাড়) থেকে তাঁর স্ত্রী হাওয়াকে সৃষ্টি করলেন। (আন নিসাঃ আয়াত ১)

 

এবার তিনি আদমের কাছে কিছু নির্দেশ পাঠালেন। বল্লেনঃ ‘‘হে আদম, তুমি আর তোমার স্ত্রী দুজনেই জান্নাতে থাকো। যা খুশি ইচ্ছামত খাও। তবে শুনো ঐ যে গাছটি, সেটির কাছেও যেও না। সেটির ফল খেও না। খেলে জালিমদের মধ্যে গণ্য হবে।’’ (আল বাকারাঃ আয়াত ৩৫)

 

বাবা আদম আর মা হাওয়া দারুন সুখে জান্নাতে থাকতে লাগলেন। কী চমৎকার জায়গা জান্নাত। সুখ আর আনন্দের অন্ত নেই এখানে। কিন্তু আদম হাওয়ার এই আনন্দ, এই সুখ শয়তানের সহ্য হয় না। সে ভাবলো, আদমের কারনেই তো আমার এই লাঞ্ছনা। যে করেই হোক, আমি যেমন আল্লাহর হুকুম অমান্য করে লাঞ্ছিত হয়েছি। এস রকমভাবে আদমকে দিয়েও আল্লাহর হুকুম অমান্য করাতে হবে। তখন সেও হবে আমারত মত লাঞ্ছিত ও অপদস্থ।

 

শয়তান প্রতারনা করলো

 

আদম ও হাওয়া তখন পর্যন্ত শয়তানের ধোকা প্রতারনা সম্পর্কে কোন অভিজ্ঞতা লাভ করেন নি। এই সুযোগে শয়তান খুব ভালো মানুষের বেশে এসে তাঁদের ধোঁকা দিল। সে বললোঃ তোমাদের প্রভূ তোমাদের এই গাছের নিচে যেতে নিষেধ করেছেন কেন জান? আসলে এই গাছের ফল খেলে উচ্চ মর্যাদা লাভ করা যায়। ফেরেশতা হওয়া যায়। তাছাড়া চিরদিন বেঁচে থাকা যায়। তোমরা যেন আবার ফেরেশতা না হয়ে বস, যেন চিরকাল বেঁচে না থাকো, সে জন্যই তোমাদের প্রভূ এ গাছের ফল খেতে নিষেধ করেছেন। সে কসম করে বললোঃ ‘আমি তোমাদের ভালো চাই’। এভাবে সে দুজনকেই তার প্রতারনার জালে বন্দী করে ফেললো।(আল আরাফঃ আয়াত ২০-২২)

 

তাঁরা দুজনেই নিষিদ্ধ গাছের ফল খেয়ে বসলেন। আল্লাহর নিষেধের কথা ভুলে গেলেন তাঁরা। শয়তানের ধোঁকায় পড়ে তাঁরা অমান্য করে বসলেন মহান আল্লাহর নির্দেশ।

 

সাথে সাথে তাঁদের জান্নাতি পোশাক খশে পড়লো। তাঁরা গাছের পাতা দিয়ে নিজেদের লজ্জা আবৃত করতে থাকেন। এসময় আল্লাহ্‌ পাক তাঁদের দেকে বললেন- আমি কি তোমাদের নিষেধ করিনি এ গাছটির কাছে যেতে? আমি কি তোমাদের বলিনি শয়তান তোমাদের সুস্পষ্ট দুশমন।? (আল আরাফঃ আয়াত ২২)

 

আদম ও হাওয়ার অনুতাপ

 

আদম ও হাওয়া দুজনেই তাঁদের ভুল বুঝতে পারলেন। চরম অনুতপ্ত হলেন তাঁরা। অপরাধবোধ তাঁদের ভীষণ ব্যাকুল করে তুললো। কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন তাঁরা। অনুতপ্ত মনে কাতর কণ্ঠে তাঁরা ফরিয়াদ করলেন প্রভূর দরবারেঃ

 

‘‘ওগো প্রভূ, আমরা তো নিজেদের উপর অবিচার করে বসেছি। এখন তুমি যদি আমাদের ক্ষমা না করো, আমাদের প্রতি রহম না করো, তবে তো আমরা ধ্বংস হয়ে যাবো।’’ (সুরা ৭ আল আরাফঃ আয়াত ২৬)

 

আল্লাহ ক্ষমা করে দিলেন তাঁদের

 

তাঁদের এই আন্তরিক অনুশোচনা ও তওবা আল্লাহ কবুল করলেন। (আল বাকারাঃ আয়াত ৩৭)

 

ফলে আদম ও হাওয়া শয়তানের প্রতারনার জালে আবদ্ধ হয়ে যে অপরাধ করে ফেলেছিলেন, মহান আল্লাহ্‌ তা মাফ করে দিলেন। তাঁরা পূনরায় আগের মত নিষ্পাপ হয়ে গেলেন।

 

এখানে একটি জরুরি বিষয় বুঝে নেয়া দরকার। সেটা হলো, প্রথমে আমরা দেখেছি, ইবলিস আল্লাহর হুকুম অমান্য করে অভিশপ্ত হয়েছে। আর এখানে দেখলাম, আদম (আঃ) এবং তাঁর স্ত্রীও আল্লাহর হুকুম অমান্য করলেন। কিন্তু তাঁরা রয়ে গেলেন নিষ্পাপ ও আল্লাহর প্রিয়, এর কারন কি? – এর কারন হল, শয়তান আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করেছেঃ

 

১। বুঝে শুনে ইচ্ছাকৃতভাবে।

 

২। সে নিজেকে বড় মনে করেছে।

 

৩। সে নিজেকে উত্তম মনে করেছে।

 

৪। সে অহংকার করেছে।

 

৫। সে প্রকাশ্যে বিদ্রোহ করেছে।

 

৬। এই অপরাধের জন্যে সে মোটেও অনুতপ্ত হয় নি এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে নি।

 

অন্যদিকে আদম (আঃ) ও তাঁর স্ত্রী হাওয়াঃ

 

১। ইচ্ছাকৃতভাবে বুঝে শুনে আল্লাহর হুকুম অমান্য করেন নি।

 

২। তাঁরা বিদ্রোহও করেন নি।

 

৩। তাঁরা অহংকারও করেন নি।

 

৪। তাঁরা সচেতনভাবে মূলত আল্লাহর একান্তই আনুগত্য ছিলেন।

 

৫। তাঁরা অপরাধ করেছেন শয়তানের ধোঁকায় পড়ে।

 

৬। তাঁরা ভুল বুঝবার সাথে সাথে অনুতপ্ত হন। আল্লাহর ভয়ে কম্পিত হন এবং ক্ষমা প্রার্থনা করেন।

 

খেলাফতের দায়িত্ব নিয়ে পৃথিবীতে এলেন আদম

 

এভাবেই আদম (আঃ) আল্লাহর দাস ও খলিফা হবার মর্যাদা রক্ষা করেন। আল্লাহ্‌ তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হন। তাই আল্লাহ্‌ তাঁর মূল সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ইচ্ছা করলেন। অর্থাৎ তিনি আদম (আঃ) কে পৃথিবী নামক তাঁর প্রতিনিধি বানিয়ে দিলেন।কারন এ জন্যইতো তিনি তাঁকে সৃষ্টি করেছিলেন। মাঝখানে কিছুদিন জান্নাতে রেখে একটা পরীক্ষা নিলেন মাত্র। এ পরীক্ষার মাধ্যমে আসলে এক বিরাট অভিজ্ঞতা অর্জন করলেন হজরত আদম (আঃ)। প্রতিনিধি বানিয়ে পাঠাবার কালে, মহান আল্লাহ্‌ তাঁকে বলে দিলেনঃ যাও পৃথিবীতে অবতরন করো। তোমার শত্রু শয়তানও সেখানে যাবে। সেখানে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তোমরা বসবাস করবে। সেখানে তোমাদের জীবন সামগ্রীরও ব্যাবস্থা আছে। সেখানেই তোমাদের বাচতে হবে। সেখানেই তোমাদের মরতে হবে। আবার সেখান থেকেই তোমাদের বের করে আনা হবে, পুনরুত্থিত করা হবে। (আল আরাফঃ আয়াত ২৪-২৫)

 

এ প্রসঙ্গে তিনি হজরত আদম (আঃ) কে আর বলে দিলেন, আমার পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে জীবন পদ্ধতি যাবে। যে আমার দেয়া জীবন পদ্ধতির অনুসরন করবে, তাঁর কোন ভয় থাকবে না। থাকবে না, কোন দুঃখ, কোন বেদনা। অর্থাৎ সে অনায়াসে আবার জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং চিরকাল সুখে থাকবে। (আল বাকারাঃ আয়াত ২৮)

 

আল্লাহ আরো বলে দিলেনঃ তবে যারা আমার জীবন পদ্ধতি অমান্য করবে আর মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেবে আমার আয়াতকে, চিরদিন তাঁদের আগুনে ফেলে রাখবো। তাঁরা তাঁদের চির শত্রু অভিশপ্ত শয়তানের সাথে অনন্ত জীবন জাহান্নামের আগুনে জ্বলবে। (আল বাকারাঃ আয়াত ২৯)

 

এভাবে পৃথিবীর জন্যে সৃষ্টি করা মানুষ হজরত আদম (আঃ) –কে আল্লাহ্‌ তাঁর খলীফা ও নবী বানিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দিলেন। তিনি এবং তাঁর স্ত্রী আল্লাহর বিধান অনুযায়ী জীবন যাপন করতে থাকেন। আদম (আঃ) তাঁর সন্তানদেরকে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী জীবন যাপন করতে শিখান। শয়তানের ধোঁকা প্রতারনা সম্পর্কে সতর্ক করেন। তাঁর শয়তানের বিরদ্ধে সংগ্রাম করেই জীবন কাটান।

 

আদম (আঃ) ছিলেন পৃথিবীর প্রথম মানুষ। তিনিই ছিলেন পয়লা নবী। তিনি ছিলেন অত্যন্ত জ্ঞানী ভদ্র ও রূচিবান। ছিলেন উন্নত নৈতিক চরিত্রের অধিকারী। ছিলেন অত্যন্ত সঞ্জমশীল, আল্লহভীরু ও আল্লাহর প্রতি আত্মসমপির্ত। পোশাক ছিল তাঁর ভূষণ। এইসব মহান গুনাবলীর অধিকারী একজন সভ্য মানুষের মাধ্যমেই পৃথিবীতে শুরু হয় মানুষের শুভযাত্রা। আমরা এবং আমাদের আগের ও পরের সমস্ত মানুষই হজরত আদম (আঃ) এর সন্তান। মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ

 

‘হে মানুষ, তোমাদের প্রভূকে ভয় করো। তিনিইতো তোমাদেরকে একটি মাত্র প্রান থেকে সৃষ্টি করেছেন। তাঁর থেকেই তাঁর জুড়ি তৈরি করেছেন। আর তাঁদের দুজন থেকেই বিশ্বময় ছড়িয়ে দিয়েছেন অসংখ্য পুরুষ আর নারী। (আন নিসাঃ আয়াত ১)

 

জেনে রাখুন

 

শেষ করবার আগে কয়েকটি জরুরী কথা জানিয়ে দেই। জেনে রাখলে কাজে আসবে। কুরআন মাজীদে –

 

১। আদম (আঃ) এর নাম উচ্চারিত হয়েছে পঁচিশবার।

 

২। আট স্থানে মানুষকে আদমের সন্তান বলা হয়েছে।

 

৩। ইবলিস শব্দটি উল্লেখ রয়েছে এগারো বার।

 

৪। ৮৮ বার শয়তান শব্দের উল্লেখ হয়েছে। এর মধ্যে ৭০ বার এক বচনে আর আঠারো বার বহুবচনে। আল্লাহদ্রোহী মানব নেতাদেরকেও কুরানে শয়তান বলা হয়েছে। তাঁদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে বলা হয়েছে।

 

৫। নিম্নোক্ত সুরা গুলোয় হজরত আদম (আঃ) এর ইতিহাস আলোচনা করা হয়েছেঃ সুরা আল বাকারা, আল আরাফ, বনি ইসরাইল, আল কাহাফ, তোয়াহা, আল হিজর, সোয়াদ।

 

হজরত আদম (আঃ) এর জীবন কথা থেকে আমরা এই স্লোগান নিতে পারিঃ

 

আল্লাহর হুকুম মানতে হবে,

 

শয়তানের পথ ছাড়তে হবে।

 

জান্নাতে মোদের যেতে হবে,

 

শয়তানের বিরুদ্ধে লড়তে হবে।

 

 

উচ্চ মর্যাদার নবী ইদ্রীস

 

(আঃ)

 

আল কুরআনে যে পঁচিশ জন নবীর নাম উল্লেখ আছে, তাঁদেরই একজন ইদ্রিস (আঃ)। মহান আল্লাহ্‌ তাঁকে অনেক উচ্চ মর্যাদা দান করেছেন। আল কুরআনে তিনি ইদ্রিস (আঃ) সম্পর্কে বলেনঃ

 

‘‘এই মহাগ্রন্থে ইদ্রিসের কথা স্মরণ করো। সে ছিল একজন বড় সত্যপন্থী মানুষ ও নবী। আমি তাঁকে অনেক বড় উচ্চস্থানে উঠিয়েছি।’’ (সুরা মরিয়মঃ আয়াত ৫৬-৫৭)

 

দেখলেন তো, স্বয়ং আল্লাহ্‌ পাকই তাঁকে অনেক উচ্চ মর্যাদা দান করেছেন। আর মহান আল্লাহ্‌ যাকে উচ্চ মর্যাদা দান করেন, তাঁর চেয়ে বড় ভাগ্যবান ব্যাক্তি আর কে?

 

তিনি কোন সময়কার নবী?

 

ইদ্রিস (আঃ) প্রাগৈতিহাসিক যুগের নবী। তাই তিনি কোন সময়কার নবী, সে বিষয়ে মতভেদ আছে। তবে অনেক মুফাসসির বলেছেন, কুরআনের বর্ণনা থেকে বুঝা যায়, তিনি নূহ (আঃ) এর পূর্বেকার নবী ছিলেন এবং আদম (আঃ) এর সন্তান বা নিকট বংশধরদের একজন ছিলেন। ইতিহাসবিদ ইবনে ইসহাক লিখেছেন, আদম (আঃ) এক হাজার বছর বেঁচে ছিলেন। ইদ্রিস (আঃ) তাঁর জীবনের তিন শত আট বছর পেয়েছিলেন।

 

তিনি কোন দেশের নবী ছিলেন?

 

তিনি কোন সময়কার নবী ছিলেন, কুরআনে যেমন সে কথা বলা হয় নি, ঠিক তেমনি তিনি কোন দেশের নবী ছিলেন সে কথাও কুরআনে বলা হয় নি। তবে কোন কোন ঐতিহাসিক বলেছেন, তিনি বেবিলনের লোক। আবার কেউ কেউ বলেছেন- তিনি মিশরের লোক। আসলে দুটি কথাই ঠিক। তিনি বেবিলনে জন্ম গ্রহন করেন। এখানে নবুয়ত লাভ করেন, মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকেন। এখানে কিছু লোক ঈমান আনে, আর বাকী লোকেরা ঈমান আনতে অস্বীকার করে। শুধু তাই নয়, বরং তাঁরা হজরত ইদ্রিস ও তাঁর সঙ্গীদের বিরুদ্ধে চরম শত্রুতা আরম্ভ করে। ফলে ইদ্রিস (আঃ) তাঁর সংগী সাথীদেরকে নিয়ে মিশরের দিকে হিজরত করেন। এখানে এসে তিনি নীল নদের তীরে বসতি স্থাপন করেন এবং এখানকার মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকতে থাকেন।

 

ইদ্রিস (আঃ) এর নবুয়ত

 

হজরত আদম ও হজরত শীষ (আঃ) এর পরে আল্লাহ্‌ তায়ালা হজরত ইদ্রিসকে নবুয়ত প্রদান করেন। তিনি বড় জ্ঞানী লোক ছিলেন। তাঁকে প্রাচীনতম বিজ্ঞানী বলা হয়ে থাকে। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায় তিনিই সর্বপ্রথম কলম ব্যবহার করেন।

 

ইসরাইলী বর্ণনায় ইদ্রিস (আঃ) কে ‘হনোক’ বলা হয়েছে। তালমূদে বলা হয়েছে- ‘হনোক’ তিন শত তিপ্পান্ন বছর পর্যন্ত মানব সন্তানদের উপর শাসনকার্য পরিচালনা করেন। তাঁর শাসন ছিল ন্যায় ও সুবিচারপূর্ণ শাসন। তাঁর শাশনামলে পৃথিবীতে মহান আল্লাহর অফুরন্ত রহমত বর্ষিত হতে থাকে। (The Talmud Selections, pp. 18-21)

 

হজরত ইদ্রিস (আঃ) একসময় খারাপ লোকদের থেকে নিঃসম্পর্ক হয়ে আল্লাহর ইবাদাত বন্দেগী করছিলেন। এরি মধ্যে তাঁর কাছে আল্লাহর ফেরেশতা এসে তাঁকে ডেকে বললেন, ‘হে ইদ্রিস, ওঠো একাকি থাকার জীবন ত্যাগ করো। মানুষের মাঝে চলা ফেরা করো এবং তাঁদের সঠিক পথ দেখাও।’ এ নির্দেশ পেয়ে হজরত ইদ্রীস বের হয়ে আসেন এবং মানুষকে ডেকে উপদেশ দিতে শুরু করেন।

 

বেবিলনের লোকেরা খুবই খারাপ হয়ে গিয়েছিল। অবশ্য কিছু লোক হজরত ইদ্রিসের দাওয়াত কবুল করে আল্লাহর পথে চলতে আরম্ভ করেন। কিন্তু অধিকাংশ লোক আল্লাহর পথে আস্তে অস্বীকার করে। তাঁরা হজরত ইদ্রিস ও তাঁর সাথীদের সাথে খুবই খারাপ আচরন করে। তিনি যখন দেখলেন এদের আর সৎ পথে আসার আর কোন সম্ভাবনা নেই, তখন তিনি তাঁর সাথীদেরকে নিয়ে মিশরের দিকে হিজরত করেন এবং নীল নদের তীরে বসতি স্থাপন করেন। হজরত ইদ্রিস এখানকার লোকদেরকে সৎ পথে চলার উপদেশ দিতে আরম্ভ করেন। লোকেরা তাঁর প্রচেষ্টায় ব্যাপকভাবে আল্লাহর পথে আসতে থাকে। তিনি এসব লোকদের উপর আল্লাহর আইন অনুযায়ী শাসনকার্য পরিচালনা করেন। ফলে পৃথিবীর বুকে নেমে আসে শান্তি আর সুখের ফোয়ারা। হজরত ইদ্রিস (আঃ) মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকার কাজে এবং মানুষকে আল্লাহর আইন অনুযায়ী চালাবার কাজে যত বিরোধিতার এবং দুঃখ মুসিবতেরই সম্মুখীন হয়েছেন, তাতে তিনি চরম ধৈর্য ও সবর অবলম্বন করেন। তাইতো মহান আল্লাহ্‌ তায়ালা তাঁর প্রশংসা

 

করে পবিত্র কুরআনে বলেনঃ

 

‘‘আর ইসমাঈল, ইদ্রিস, যুলকিফল এরা প্রত্যেকেই ছিল ধৈর্যশীল। আমি তাঁদের প্রবেশ করিয়েছি আমার রহমতের মাঝে। তাঁরা ছিল সৎ এবং সংশোধনকামী।’’ (সুরা ২১ আল আম্বিয়াঃ আয়াত ৮৫)

 

হজরত ইদ্রিস (আঃ) এর উপদেশ

 

ইসরাইলী সূত্র এবং কিংবদন্তী আকারে হজরত ইদ্রিস (আঃ) এর বেশ কিছু উপদেশ এবং জ্ঞানের কথা প্রচলিত আছে। এখানে বলে দিচ্ছি তাঁর কিছু উপদেশ ও জ্ঞানের কথা-

 

১। আল্লাহর প্রতি ঈমানের সাথে যদি সংযোগ থাকে ধৈর্য ও সবরের, তবে বিজয় তাঁর সুনিশ্চিত।

 

২। ভাগ্যবান সে, যে আত্মসমালোচনা করে। আল্লাহ্‌ প্রভূর দরবারে প্রত্যেক ব্যাক্তির সুপারিশ হল তাঁর নেক আমল।

 

৩। সঠিকভাবে কর্তব্য পালনের মধ্যেই আনন্দ। শরিয়া দ্বীনের পূর্ণতা দান করে। আর যে ব্যাক্তি দ্বীনের দিক থেকে পূর্ণ, সেই ব্যাক্তিত্তশালী।

 

হজরত ইদ্রিস (আঃ) মানুষকে আল্লাহর হুকুম পালন করতে বলতেন। তাঁরই ইবাদাত ও দাসত্ব করতে বলতেন। তিনি মানুষকে উপদেশ দিতেনঃ পরকালে নিজেকে আল্লাহর আযাব থেকে বাঁচাতে, দুনিয়াতে নেক আমল করতে এবং এই ক্ষনস্থায়ী দুনিয়ার মোহ ত্যাগ করতে। তিনি নির্দেশ দিতেন সালাত কায়েম করতে, সিয়াম পালন করতে, যাকাত পরিশোধ করতে এবং পবিত্রতা অবলম্বন করতে।

 

কথিত আছে, হজরত ইদ্রিস (আঃ) এর সময়কালে বিরাশিটি ভাষা চালু ছিল। তিনি সবগুলি ভাষা জানতেন এবং সবগুলি ভাষাতেই কথা বলতে পারতেন। তিনি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের লোকদেরকে তাঁদের নিজেদের ভাষায় উপদেশ দিতেন। আল কুরআনে মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ

 

‘‘আমি যখনই কোন রাসুল পাঠিয়েছি, সে নিজ কওমের ভাষায় তাঁদের দাওয়াত দিয়েছে।’’ (সুরা ইব্রাহীমঃ আয়াত ৪)

 

জানা যায় হজরত ইদ্রিস (আঃ)- ই সর্বপ্রথম নগর রাজনীতির চালু করেন এবং নগর সভ্যতার ভিত্তি স্থাপন করেন। তাঁর সময় ১৮৮ টি নগর গড়ে উঠেছিলো।

 

তাঁর মৃত্যু ও তাঁর মর্যাদা

 

আল কুরআনে আল্লাহ্‌ তায়ালা ইদ্রিস (আঃ) সম্পর্কে বলেছেনঃ

 

‘আমি তাঁকে অনেক উচ্চ স্থানে উঠিয়েছি।’ এ আয়াতাংশের ব্যাখ্যায় অনেক তাফসীরকার বলেন- পৃথিবীতে হজরত ইদ্রিস (আঃ) এর মৃত্যু হয়নি, বরং আল্লাহ্‌ তায়ালা তাঁকে উঠিয়ে নিয়ে গেছেন। হতে পারে মহান আল্লাহ্‌ তায়ালা তাঁকে জীবন্ত উঠিয়ে নিয়ে গেছেন এবং অনেক উচ্চ মর্যাদা দান করেছেন। তবে আসল কথা আল্লাহই ভালো জানেন।

 

হ্যাঁ, এ প্রসঙ্গে আর একটি কথা বলে দিচ্ছি। তাহলো আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মাদ (সঃ) যখন মি’রাজে গিয়েছিলেন, তখন চতুর্থ আকাশে হজরত ইদ্রিস (আঃ) এর সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। হজরত ইদ্রিস তাঁকে দেখে বলে ওঠেনঃ ‘শুভেচ্ছা স্বাগতম, হে আমার মহান ভাই।’

 

কুরআন মাজীদে হজরত ইদ্রিস (আঃ) এর নাম দুইবার উল্লেখ হয়েছে। একবার সুরা মরিয়মে আর একবার সুরা আম্বিয়াতে। উভয় স্থানেই আল্লাহ্‌ তায়ালা ইদ্রিস (আঃ) এর উচ্চ গুনাবলীর এবং বড় মর্যাদার কথা উল্লেখ করেছেন। এই মহাপুরুষ ও মহান নবীর উপর বর্ষিত হোক চির শান্তি ও করুনাধারা।

 

 

 

৩।

 

হাজার বছরের সংগ্রামী নূহ

 

(আঃ)

 

অনেক অনেক বছর হলো আদম আলাইহিস সালাম বিদায় নিয়েছেন পৃথিবী থেকে। তাঁর স্ত্রী হাওয়াও আর বেঁচে নেই। তাঁদের মৃত্যুর পর শত শত বছরের ব্যবধানে অনেক বেড়ে গিয়েছিল তাঁদের বংশধারা। এখানে সেখানে ছড়িয়ে পড়ে অসংখ্য নারী পুরুষ আদম সন্তান। ইরাকসহ বর্তমান আরব দেশগুলিই ছিল তাঁদের বসবাসের এলাকা।

 

আদম (আঃ) এর মৃত্যুর পর দীর্ঘ দিন তাঁর সন্তানেরা ইসলামের পথেই চলে। চলে আল্লাহর পথে। মেনে চলে আল্লাহর বিধান। অনুসরন করে আল্লাহর নবী আদমের পদাংক। তাঁদের মাঝে জন্ম নেয় অনেক ইসলামী নেতা ও আলেম। তাঁরাও তাঁদেরকে সৎ পথে পরিচালিত করার চেষ্টা সাধনা করে যান। এরি মধ্যে হজরত ইদ্রিস (আঃ) ও অতীত হয়ে যান। কিন্তু কালক্রমে আদম সন্তানরা আদম আলাইহিস সালামের শিক্ষা ভুলে যান। ভুলে যান ইদ্রিস আলাইহিস সালামের উপদেশ। শয়তানের ধোঁকায় পড়ে যায় তাঁরা। ইসলামের পথ থেকে তাঁরা সড়ে পড়ে দূরে। বাঁকা পথে চলতে শুরু করে তাঁরা। বিপথে এগিয়ে যায় অনেক দূর।

 

ফলে তাঁরা শয়তানের অনুসারী হয়ে যায়। পরিনত হয় আত্নার দাসে। তাঁরা অহংকারি হয়ে পড়ে। দুনিয়ার জীবনটাকেই বড় করে দেখতে শুরু করে। এখানকার লাভ ক্ষতিকেই তাঁরা আসল লাভ ক্ষতি মনে করে। শুধু তাই নয়। বরং সব চাইতে বড় অপরাধটিও তাঁরা করে বসে। সেটা হল শিরক। তাঁরা শিরকে নিমজ্জিত হয়। মানে মনগড়া দেবদেবীদের তাঁরা আল্লাহর অংশীদার আর প্রতিপক্ষ বানিয়ে নেয়। পূজা করার জন্যে তাঁরা মূর্তি তৈরি করে নেয়। তাঁদের কয়েকটি মূর্তির নাম বলছি।

 

হ্যাঁ, তাঁদের বড় মূর্তিটির নাম ছিলপ ‘অদ্দ’। এ ছিল পুরুষ দেবতা। একটি মূর্তির নাম ছিল ‘সূয়া’। এটি ছিল দেবী। একটির নাম ছিল ‘ইয়াগুস’। এটির আকৃতি ছিল সিংহের মত। একটি মূর্তি ছিল ঘোড়ার আকৃতির। এটির নাম ছিল ‘ইয়াউক’। আরো একটি বড় মূর্তি ছিলো। ঈগল আকৃতির এই মূর্তিটির নাম ছিল ‘নসর’। (সুরা নূহ আয়াত ২৩)

 

এইসব মূর্তির তাঁরা পূজা করতো। এসব অসহায় দেবদেবীকে তাঁরা আল্লাহর অংশীদার বানিয়েছিলো। এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন মানুষ হয়েও তাঁরা দুবে গিয়েছিলো তাঁরা কতটা অন্ধকারে। তাঁদেরই এক উঁচু ঘরে জন্ম নেয় এক শিশু। সে বড়ো হয়ে ওঠে তাঁদেরই মাঝে। কৈশোর, তারুণ্য পার হয়ে যৌবনে এসে উপনীত হয়। তাঁর জ্ঞান, বুদ্ধি, যোগ্যতা, দক্ষতা দেখে সবাই ভাবে, ভবিষ্যতে সেই হবে তাঁদের নেতা। নেতৃত্বের সকল যোগ্যতাই উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে তাঁর মধ্যে। সে কখনো মিথ্যা বলে না। অন্যায় অপরাধে জড়িত হয় না। কারো প্রতি অবিচার করে না। উন্নত পবিত্র চরিত্রের সে অধিকারী।

 

ফলে সকলেরই সে প্রিয় পাত্র। তাঁর মতো বিশ্বস্ত দ্বিতীয় আর কেউ তাঁদের মধ্যে নেই। কী সেই যুবকটির নাম? নাম তাঁর নূহ। নূহ তাঁদের আশা ভরসার স্থল। তাঁদের পরিকল্পনা মতো নূহ- ই হবে তাঁদের প্রিয় নেতা। কিন্তু আল্লাহর পরিকল্পনা ভিন্ন। আল্লাহ্‌ নূহকে নবী মনোনীত করেন। তাঁর কাছে অহী পাঠানঃ ‘‘কঠিন শাস্তি আশার আগেই তুমি তোমার জাতির লোকদেরকে সাবধান করে দাও।’’ (সূরা নূহঃ আয়াত ১)

 

আল্লাহ্‌ নূহের কাছে তাঁর দ্বীন নাযীল করেন। দ্বীন মানে জীবন যাপনের ব্যবস্থা। আল্লাহর দ্বীনের নাম ‘ইসলাম’। আল্লাহর দ্বীন অনুযায়ী জীবন যাপন না করলে যে কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে, নিজ জাতিকে সে ব্যাপারে সতরক করার জন্যে আল্লাহ্‌ নূহ –কে নির্দেশ প্রদান করেন।

 

নূহ তাঁর জাতির লোকদের বললেন- ‘‘হে আমার জাতির ভাইয়েরা, তোমরা আল্লাহর দাসত্ব করো। তাঁর হুকুম মেনে চলো। তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোন ইলাহ নেই। তোমরা কেবল তাকেই ভয় করো। আর আমার কথা মেনে চলো। আমার আনুগত্য করো। যদি তাই না করো, আমার ভয় হচ্ছে, তবে তোমাদের উপর একদিন কথি শাস্তি এসে পড়বে। আমি কিন্তু তোমাদের স্পষ্ট ভাষায় সাবধান করে দিচ্ছি।’’

 

নূহ তাঁদের আর বলেনঃ ‘‘আমি তোমাদের যেভাবে চলতে বলছি, তোমরা যদি সেভাবে চলো, তবে আল্লাহ্‌ তোমাদের অপরাধ ক্ষমা করে দেবেন। আর একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তোমাদের বাঁচিয়ে রাখবেন। নইলে কিন্তু আগেই ধ্বংস হয়ে যাবে।’’ (সূরা নুহঃ আয়াত ২৪-২৫)

 

নূহের এই কল্যাণময় হিতাকাঙ্ক্ষী আহবানের জবাবে তাঁর জাতির নেতারা বললোঃ তুমি কেমন করে হলে আল্লাহর রাসুল? তুমি তো আমাদেরই মতো একজন মানুষ।(সূরা ১১ হুদঃ আয়াত ২৭)

 

সাধারন মানুষের উপর কিন্তু নূহের ছিলো দারুন প্রভাব। তাঁরা জাতির স্বার্থপর নেতাদের চাইতে নূহ-কেই বেসি ভালোবাসতো। নেতারা যখন দেখলো জনগন তো নূহের কথায় প্রভাবিত হয়ে পড়ছে। তাঁর সাথী হয়ে যাচ্ছে। তাঁদের সমস্ত কায়েমি স্বার্থ বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তখন তাঁরা জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্যে কূটকৌশলের আশ্রয় নেয়। তাঁরা জনগণকে বলেঃ

 

‘‘দেখো নূহের কাণ্ড, সে তো তোমাদের মতই একজন মানুষ মাত্র। কিন্তু সে নিজেকে আল্লাহর রাসুল বলে দাবী করছে। আসলে ওসব কিছু নয়। সে এভাবে দেশের প্রধান নেতা এবং করতা হতে চায়। কোন মানুষ যে আল্লাহর রাসুল হতে পারে, এমন কথা তো বাপদাদার কালেও শুনি নি। আল্লাহ্‌ যদি আমাদের মাঝে কোন রাসুল পাঠাতেনই তবে নিশ্চয়ই কোন ফেরেশতা পাঠাতেন। তোমরা ওর কথায় কান দিও না। ওকে আসলে জীনে পেয়েছে।’’ (সূরা আল মুমিনুনঃ আয়াত ২৩-২৫)

 

এভাবে বৈষয়িক স্বার্থের ধারক এই নেতারা জনগণকে বিভ্রান্ত করে দিলো। তাঁরা নূহের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হলো। নূহ দিন রাত তাঁদের সত্য পথে আসার জন্যে ডাকতে থাকেন বুঝাতে থাকেন। নূহ তাঁদের আল্লাহর পথে আনবার জন্যে যে কী আপ্রান চেষ্টা করেছেন, তা আমরা নূহ (আঃ) এর কথা থেকেই জানতে পারি। তিনি মহান আল্লাহর কাছে তাঁর কাজের রিপোর্ট দিতে গিয়ে বলেনঃ

 

‘‘হে আমার প্রভূ, আমি আমার জাতির লোকদের দিনরাত ডেকেছি তোমার দিকে। কিন্তু আমার আহবানে তাঁদের এড়িয়ে চলার মাত্রা বেড়েই চলেছে। আমি যখনই তাঁদের ডেকেছি তোমার ক্ষমার দিকে, তাঁরা তাঁদের কানে আঙুল ঢেসে দিয়েছে। কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকে দিয়েছে। এসব অসদাচরনে তাঁরা অনেক বাড়াবাড়ি করে চলেছে। তাঁরা সীমাহীন অহংকারে ডুবে পড়েছে। পরে আমি তাঁদের উঁচু গলায় ডেকেছি। প্রকাশে দাওয়াত দিয়েছি। গোপনে গোপনেও বুঝিয়েছি। আমি তাঁদের বলেছি, তোমরা তোমাদের মালিকের কাছে ক্ষমা চাও। তিনি বড় ক্ষমাশীল। তিনি আকাশ থেকে তোমাদের জন্যে পানি বর্ষণ করবেন। ধনমাল আর সন্তান দিয়ে তোমাদের সাহায্য করবেন। তোমাদের জন্যে বাগবাগিচা সৃষ্টি করে দেবেন। নদী-নালা প্রবাহিত করে দেবেন।” (সূরা ৭১ নূহঃ আয়াত ৫-১২)

 

নূহ তাঁদের বুঝালেন, কেন তোমরা আল্লাহর পথে আসবে না? তিনি তাঁদের বললেনঃ

 

“দেখনা, আল্লাহ্‌ কিভাবে স্তরে স্তরে সাতটি আকাশ বানিয়েছেন? চাঁদকে বানিয়েছেন আলো আর সূর্যকে প্রদীপ? আল্লাহই তো তোমাদেরকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন। আবার তিনি এই মাটিতেই তোমাদের ফিরিয়ে নেবেন। তারপর তোমাদের বের করবেন এই মাটি থেকেই। আল্লাহই তো পৃথিবীটাকে তোমাদের জন্যে সমতল করে বিছিয়ে দিয়েছেন, যাতে করে তোমরা উন্মুক্ত পথ ঘাট দিয়ে চলাচল করতে পার।” (সূরা ৭১ নূহঃ আয়াত ১৫-২০) এত করে বুঝাবার পরেও তাঁরা নূহের কথা শুনলনা। তাঁরা নিজেদের গোঁড়ামি আর অহংকারে অটল রইল। তাঁরা নূহকে বললোঃ

 

আমরা কেমন করে তোমার প্রতি ঈমান আনি? তোমার অনুসারী যে কয়জন হয়েছে, ওরা তো সব ছোট লোক। আমরা তোমাদেরকে আমাদের চাইতে বেশী মর্যাদাবান মনে করি না। বরং আমরা তোমাদের মিথ্যাবাদীই মনে করি।(সূরা ১১ হুদঃ আয়াত ২৭)

 

তারা আর বললোঃ “আমরাতো তোমাকে দেখছি স্পষ্ট মিথ্যাবাদী।” (সূরা আল আরাফঃ আয়াত ৬০)

 

নূহ তাদের আবারো বুঝালেন, “হে আমার জাতির ভাইয়েরা, আমি মোটেও বিপথে চলছি না। আমি তো বিশ্বজগতের মালিকের বানীবাহক। আমি তো কেবল আমার প্রভূর বানীই তোমাদের কাছে পৌছে দিচ্ছি। আমি তো কেবল তোমাদেরই কল্যাণই চাই। আমি আল্লাহর পক্ষ এমন সব জিনিস জানি, যা তোমরা জানো না। হে আমার দেশবাসী, তোমরা একটু ভেবে দেখো, আমি যদি মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে পাওয়া সুস্পষ্ট প্রমানের উপর থাকি আর তিনি যদি আমাকে তাঁর বিশেষ অনুগ্রহও দান করে থাকেন, কিন্তু তোমরা যদি তা না দেখতে পেলে, তবে আমার কি করবার আছে? তোমরা মেনে নিতে না চাইলে আমি তো আর তোমাদের উপর তা চাপিয়ে দিতে পারিনা। হে আমার ভাইয়েরা, আমি যে দিন রাত তোমাদের আল্লাহর পথে ডাকছি, তার বিনিময়ে তো আমি তোমাদের কাছে কিছুই চাই না। আমি তো কেবল আল্লাহর কাছে এর বিনিময় চাই। এতেও কি তোমরা বুঝতে পারছোনা যে, তোমাদের ডাকার এ কাজে আমার কোন স্বার্থ নেই?” (সূরা ৭ আল আরাফঃ আয়াত ৬১-৬২, সূরা ১১ হুদঃ আয়াত ২৮-২৯)

 

এভাবে আল্লাহর মহান ধৈর্যশীল নবী হজরত নূহ (আঃ) কয়েক শত বছর পর্যন্ত তাদের আল্লাহর পথে ডাকেন। তাদের সত্য পথে আনার অবিরাম চেষ্টা করেন। ধ্বংস ও শাস্তির হাত থেকে তাদের বাঁচাবার চেষ্টা করেন। কিন্তু তারা তাঁর এই মহৎ কাজের জবাব দেয় তিরস্কার, বিরোধিতা আর ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে। তাদের সমস্ত বিরোধিতা আর ষড়যন্ত্রের মোকাবেলায় হাজার বছর ধরে তিনি পরম ধৈর্যের সাথে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চালিয়ে যান। অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ভাষায় তাদের বুঝাবার চেষ্টা করেন।

 

কিন্তু তাঁর হাজারো মর্মস্পর্শী আবেদন নিবেদনের পর তারা তাঁর কথা শুনলো না। আল্লাহর দ্বীন কবুল করলো না তারা। স্বার্থপর নেতারা জনগণকে বলে দিলোঃ “তোমরা কিছুতেই নূহের কথায় ফেসে যাবে না। তাঁর কথায় কোন অবস্থাতেই তোমরা দেব দেবীদের ত্যাগ করতে পারবেনা। ত্যাগ করতে পারবেনা ‘অদ্দ’ আর ‘শুয়া’ কে। ইয়াগুস, ইয়াউক আর নসরকেও পরিত্যাগ করতে পারবে না। এভাবে তারা অধিকাংশ জনগণকে সম্পূর্ণ বিপথগামী করে দিলো।” (সূরা ৭১ নূহঃ আয়াত ২৩-২৪)

 

শুধু কি তাই? বরং তারা এর চাইতেও বড় ষড়যন্ত্র করলো। কি সেই ষড়যন্ত্র? তাহলো, তারা আল্লাহর নবী নূহ (আঃ) –কে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিলো। কুরআনের ভাষায়- ‘ওয়া মাকারু মাকরান কুব্বারা’ – তারা এক বিরাট ষড়যন্ত্র পাকালো। (সূরা ৭১ নূহঃ আয়াত ২২) তারা নূহ (আঃ) কে অহংকারী ভাষায় শাসিয়ে দিলোঃ “নূহ, তুমি যদি বিরত না হও, তবে বলে দিচ্ছি, তুমি হতভাগ্যদের অন্তর্ভুক্ত হবে।”১০ (সূরা ২৬ শুয়ারা” আয়াত ১১৬)

 

শুধু তাই নয়, তারা নূহ (আঃ) কে ধমকের সুরে আরো বললোঃ

 

“তুমি তো এতদিন আমাদের সাথে বড় বেশী বিবাদ করেছ। শুনো, তুমি যে আমাদের ধমক দিচ্ছিলে, তোমার কথা না শুনলে আমাদের উপর বিরাট শাস্তি নেমে আসবে, কোথায় সেই শাস্তি? তুমি যদি সত্যবাদী হয়ে থাকো, তবে শাস্তিটা নিয়ে এসে দেখাও।” (সূরা হুদঃ আয়াত ৩২)

 

নূহ (আঃ) বললেন, দেখো তোমাদের শাস্তি দেয়া তো আমার কাজ নয়। সেটা আল্লাহর কাজ। তিনি চাইলে তোমাদের শাস্তি দেবেন। আর তিনি শাস্তি দিতে চাইলে টা তোমরা কিছুতেই আটকাতে পারবেনা। শুধু তাই নয়, তখন যদি আমিও তোমাদের কোন উপকার করতে চাই, করতে পারবোনা। আল্লাহর ফায়সালা পরিবর্তন করার সাধ্য কারো নাই।” (সূরা হুদঃ আয়াত ৩৩-৩৪)

 

এবার মহান আল্লাহ্‌ অহীর মাধ্যমে তাঁর প্রিয় দাস নূহকে জানিয়ে দিলেন, “হে নূহ, তোমার জাতির যে কয়জন লোক ঈমান এনেছে, তাদের পর এখন আর কেউ ঈমান আনবে না। সুতরাং তুমি তাদের কার্যকলাপে দুঃখিত হইও না।” (সূরা হুদঃ আয়াত ৩৬)

 

আল্লাহর বিচক্ষন বান্দাহ ও নবী হজরত নূহ (আ) এটাকে তাঁর অবাধ্য ও চরম অধপতিত জাতির উপর অচিরেই আল্লাহর আজাব আসবার সবুজ সংকেত মনে করলে। তিনি আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করলেন, “আমার প্রভূ, তুমি এই কাফিরগুলির একজনকেও বাঁচিয়ে রেখো না। তুমি যদি তাদের ছেড়ে দাও, তাহলে তারা তোমার বান্দাদেরকে বিপথগামী করে ছাড়বে। আর তাদের ঔরসের প্রজন্মও দূরাচারী আর কাফিরই হবে। হে প্রভূ, তুমি আমাকে আর আমার বাবা মাকে মাফ করে দাও। আর সেসব নারী পুরুষকেও মাফ করে দাও, যারা মুমিন হয়ে আমার ঘরে প্রবেশ করেছে।” (সূরা ৭১ নূহঃ আয়াত ২৬-২৮)

 

 নূহ আরও বললেন, “প্রভূ, এই লোকগুলির মোকাবেলায় তুমি আমাকে সাহায্য করো। ওরা আমাকে মিথ্যা সাব্যস্ত করছে। আমাকে অস্বীকার করছে। এখন আমার আর তাদের মাঝে তুমি চুড়ান্ত ফায়সালা করে দাও। তবে আমাকে আর আমার সাথী মুমিনদের তোমার পাকড়াও থেকে বাঁচাও। ১১ (সূরা আল মুমিনুনঃ আয়াত ২৬, সূরা ২৬ শুয়ারা” আয়াত ১১৭-১১৮)

 

আপনারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, এবার চুড়ান্ত একটা ফায়সালা হয়ে যাবে। কী সেই ফায়সালা? ফায়সালাটা হলো, আল্লাহ্‌ নূহের জাতির এই দুষ্ট লোকগুলিকে ধ্বংস করে দেবার সিদ্ধান্ত নিলেন। এটাই আল্লাহর নিয়ম। কোন জাতি বিপথগামী হলে, আল্লাহ্‌ তাদের সত্য পথ দেখানোর জন্যে নবী বা সংশোধনকারী পাঠান। নবীরা তাদের সত্য পথে আনার জন্যে সর্বোত্তম প্রচেষ্টা চালান। অসৎ লোকদের সাংঘাতিক বিরোধিতাড় মূখেও তাঁরা জনগণকে সংশোধন করবার চেষ্টা সাধনা চালিয়ে যান। কিন্তু তাদের সকল চেস্টার পরও যখন আল্লাহ্‌ বাস্তবে দেখে নেন যে, এই লোকগুলি আর সত্য পথে আসবে না। তখন তিনি তাদের ধ্বংস করে দেন। নূহ (আঃ) এর জাতির বাস্তব অবস্থাও তাই ছিলো। আল্লাহর নবী নূহ (আঃ) হাজার বছর ধরে তাদের আল্লাহর পথে আনার চেষ্টা করেন। দিনরাত তিনি তাদের বুঝান। গোপনে গোপনে বুঝান। জনসভা, আলোচনা সভা করে বুঝান। তারা শুনতে চায় না, তবু তিনি জোড় গলায় তাদের ডেকে ডেকে বুঝান। তাঁকে দেখলে তারা কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকে নিত। তিনি কথা বলতে গেলে তারা কানে আঙ্গুল চেপে ধরত। হাজারো রকমের তিরস্কার তারা তাঁকে নিয়ে করতো। বলত এতো ম্যাজেসিয়ান। কিন্তু তিনি তাদের সত্য পথে আনার অবিরাম চেষ্টা সাধনা চালিয়েই যান। কিছু যুবক অবশ্য ঈমান আনে। কিন্তু জাতির সর্দার নেতারা পরবর্তী সময়ে জনগনের আল্লাহর পথে আসার সকল পথ বন্ধ করে দেয়। তখন তারা সবাই আল্লাহর চরম বিরোধী হয়ে যায়। তাদের সত্য পথে আসার আর কোন সম্ভাবনাই আর বাকী থাকে না। এমনকি তারা আল্লাহর নবীকে হত্যা করার পর্যন্ত ষড়যন্ত্র করে। অবশেষে আলাহ তাদের পৃথিবী থেকে ধ্বংস করার ফায়সালা করেন। তিনি নূহ (আ)-কে নির্দেশ দেন, “নূহ, আমার তদারকীতে তুমি একটি নৌযান তৈরি করো।”১২ (সূরা হুদঃ আয়াত ৩৭)

 

আল্লাহ্‌ নূহ (আ)-কে আর বলে দিলেন, “চুলা ফেটে যখন পানি উঠবে, তখন তুমি নৌযানের মধ্যে সব রকমের জীবজন্তু এক জোড়া এক জোড়া করে উঠাবে। তবে তাদের উঠাবেনা যাদের ব্যাপারে আমি ফায়সালা দিয়ে দিয়েছি, যে তারা ডুবে মরবে।”১৩ (সূরা আল মুমিনুনঃ আয়াত ২৭)

 

আল্লাহর নবী নূহ (আঃ) আল্লাহর নির্দেশে তৈরি করতে লাগলেন এক বিশাল নৌযান। জাতির অসৎ নেতারা যখন সেখান দিয়ে যাতায়াত করতো, তারা নৌযান তৈরি নিয়েও নূহের প্রতি বিদ্রুপ করতো। তারা তাঁকে তিরস্কার করতো।”১৪ (সূরা হুদঃ আয়াত ৩৮) আসলে তাদের আল্লাহর ক্ষমতার প্রতি ঈমানই ছিলো না। তারপর কি হলো? তারপর একদিন নৌযান তৈরি শেষ হলো। নূহ (আঃ) আল্লাহর নির্দেশের দিকে তাকিয়ে রইলেন। এরপর? এরপর একদিন হঠাৎ দেখা গেলো চুলা ফেটে মাটির নিচ থেকে অনর্গল পানি বেরুতে লাগলো। নূহ (আঃ) বুঝতে পারলেন আল্লাহর নির্দেশ এসে গেছে। নূহ ঈমানদারদের ডেকে বললেন, তোমরা জলদি করে নৌযানে ওঠে পড়ো। তিনি তারাতারি করে সমস্ত ঈমানদার লোকদের নৌযানে তুলে দিলেন। সব রকমের জীব জন্তু একেক জোড়া তুলে নিলেন। দুজন ছাড়া তাঁর পরিবারের সকলকে তুলে নিলেন।

 

কে সেই দু’জন? এদের একজন নূহ (আঃ) এর স্ত্রী। এই মহিলা কিন্তু বাপদাদার জাহেলি ধর্ম অনুসারীদের পক্ষ অবলম্বন করে। ফলে আল্লাহও তাঁকে প্লাবনের পানিতে ডুবিয়ে মারলেন। আরেক জন কে? আরেকজন হলো স্বয়ং নূহ (আঃ) এর হতভাগ্য পুত্র। সেও ঈমান আনে নি। নির্দেশমতো সবাই যখন নৌযানে উঠে গেল, তখন কি হলো? দেখতে দেখতে তখন ঘটে গেল এক অবাক কাণ্ড। চারিদিকে যমিন ফেটে সৃষ্টি হলো অসংখ্য ঝর্ণাধারা। প্লাবনের বেগে মাটির নিচে থেকে উঠতে শুরু করলো পানি আর পানি। সাথে সাথে শুরু হলো মুষলধারে বৃষ্টি। নিচে থেকেও উঠছে পানি। উপর থেকেও পড়ছে পানি। চারিদিকে পানি আর পানি। পানির উপরে ভাসতে শুরু করলো নৌযান। নূহ (আঃ) দোয়া করলেনঃ

 

“আল্লাহর নামে শুরু হচ্ছে এর চলা আর আলাহর নামেই থামবে এ নৌযান। আমার প্রভূ অবশ্যি অতিশয় ক্ষমাশীল দয়াময়।” (সূরা হুদঃ আয়াত ৪১)

 

অদূরেই নূহের কাফির পুত্রটি দাঁড়িয়ে ছিলো। নূহ দেখলেন, পাহারের মতো উঁচু হয়ে এক বিরাট ঢেউ এগিয়ে আসছে। তিনি চিৎকার করে ছেলেকে ডেকে বললেন, এখনো সময় আছে ঈমান এনে আমাদের সাথী হয়ে যা। কাফিরদের সাথী হইসনে। এক্ষুনি ডুবে মরবি।”

 

অসৎ ছেলেটি বললোঃ “আমি পাহাড়ে উঠে যাবো, পানি আমাকে কিছুই করতে পারবেনা।” নূহ (আঃ) বললেন- একমাত্র আল্লাহর অনুগ্রহ ছাড়া আজ কেঊ রক্ষা পাবে না।” এরি মধ্যে এক বিরাট ঢেঊ এসে ছেলেকে তলিয়ে নিয়ে গেলো।১৫ (সূরা হুদঃ আয়াত ৪২-৪৩)

 

আপনারা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন, নবীর পথে না চলার পরিনতি কতো ভয়াবহ। ঈমানের পথে না এলে নবীর ছেলে হলেও আল্লাহর পাকড়াও থেকে রক্ষা পাওয়া যায় না। নবীর স্ত্রী হলেও মুক্তি পাওয়া যায়না। দুনিয়া ও আখিরাতে মুক্তির একমাত্র পথ হলও ঈমানের পথ, নবী দেখানো পথ। এরপর ঘটনা কি হলো? এরপর পানিতে সমস্ত কিছু ভেসে গেলো। বড় বড় পাহাড় পানির মধ্যে তলিয়ে গেলো। দিন যায়, রাত আসে। মাস যায়, মাস আসে। আকাশ আর পাতালের পানিতে পৃথিবী তলিয়েই চলেছে। নূহ (আঃ) এর নৌযানের মানুষ আর প্রাণীগুলো ছাড়া সমস্ত জীবজন্তু মরে শেষ। একটি মানুষও আর বেঁচে নেই। সব দুষ্ট লোক আর আল্লাহর নবীর শত্রুরা ধ্বংস হয়ে শেষ হয়ে গেছে। আল্লাহ্‌ তায়ালা এভাবে তাঁর প্রিয় নবী নুহ (আঃ) ও তাঁর সাথীদেরকে রক্ষা করলেন যালিমদের অত্যাচার ষড়যন্ত্র থেকে। তাই তিনি নূহ (আঃ)- কে নির্দেশ দিলেন এই ভাষায় শোকর আদায় করতেঃ

 

“শোকর সেই মহান আল্লাহর, যিনি যালিমদের হাত থেকে আমাদেরকে রক্ষা করেছেন।” (সূরা আল মুমিনুনঃ আয়াত ২৮)

 

সেই সাথে আল্লাহ্‌ নূহ (আ)-কে এই দোয়া করতেও নির্দেশ দিলেনঃ

 

“প্রভূ, আমাকে বরকতপূর্ণ স্থানে অবতরন করাও, আর তুমিইতো সর্বোত্তম স্থানে অবতরন করিয়ে থাকো।” (সূরা আল মুমিনুনঃ আয়াত ২৯)

 

অবশেষে আলাহ একদিন হুকুম দিলেনঃ “হে পৃথিবী সমস্ত পানি গিলে ফেলো, হে আকাশ বর্ষণ বন্ধ করো।’’১৬ (সূরা হুদঃ আয়াত ৪৪)

 

মহান আল্লাহর নির্দেশে আকাশ পানি বর্ষণ বন্ধ করলো। পৃথিবী তাকে ডুবিয়ে রাখা সমস্ত পানি চুষে খেয়ে ফেললো। তারপর কি হলো? তারপর নূহ (আঃ) এর নৌযানটি জুদি১৭ (সূরা হুদঃ আয়াত ৪৪) পাহাড়ের চুড়ায় এসে ঠেকলো। জুদি পাহাড় কোথায় জানেন? আর্মেনিয়া থেকে কুর্দিস্তান পর্যন্ত রয়েছে এক দীর্ঘ পর্বতমালা। এই পর্বতমালারই একটি নাম হলো জুদি পর্বত। এটি কুর্দিস্তান অঞ্চলে ইবনে উমর দ্বীপের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত। মুসলমানরা হজরত উমর (রাঃ) এর খিলাফত আমলে যখন ইরাক ও আল জাজিরা বিজয় করেন, তখন মুসলিম সৈনিকদের অনেকেই জুদি পাহাড়ের উপর নূহ (আঃ) এর নৌযান দেখতে পান।

 

নৌযান জুদি পর্বতে ঠেকার পর কি হলো? এবার আল্লাহ্‌ নির্দেশ দিলেনঃ “হে নূহ, নেমে পড়ো। নেমে আসো পৃথিবীতে। এখন থেকে তোমার প্রতি আর তোমার সংগী সাথীদের প্রতি আমার নিকট হইতে রইলো শান্তি আর প্রাচুর্য।”১৮ (সূরা হুদঃ আয়াত ৪৮)

 

তাঁরা নেমে আসেন পৃথিবীতে। সুখে শান্তিতে বসবাস করতে থাকেন আল্লাহর অনুগত দাস হিসেবে। এভাবেই আল্লাহ্‌ সৎ লোকদেরকে প্রতিষ্ঠিত করে দেন পৃথিবীর বুকে।

 

সবশেষে কয়েকটি খবর জানিয়ে দিচ্ছি

 

১। কুরআনে নূহ (আঃ) এর নাম উচ্চারিত হয়েছে তিতাল্লিশ বার।

 

২। যে সব সুরায় নূহের কথা ও কাহিনী উল্লেখ হয়েছে। সেগুলো হলোঃ আলে ইমরান, আনয়াম, নিসা,আরাফ, তাওবা, ইউনুস, হুদ, ইবরাহীম, বনি ইসরাইল, মরিয়ম, আম্বিয়া, হজ্জ, মুমিনুন, ফুরকান, শুয়ারা, আন কাবুত, আহযাব, সাফফাত, সোয়াদ, মুমিন, শুরা, কাফ, যারিয়াত, নাজম, কামার, তাহরীম, নূহ।

 

৩। নূহ (আঃ) এর কাহিনী বিস্তারিত জানা যাবে সূরা আরাফ, হুদ, মুমিনুন, শোয়ারা এবং নূহে।

 

 

 

৪।

 

আদ জাতির নবী হুদ (আঃ)

 

নূহ (আঃ) এর পরে

 

আমরা আগেই জেনেছি, নূহ (আঃ) এর সময় আল্লাহ্‌ তাঁর দ্বীনের শত্রুদের প্লাবন দিয়ে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। বাঁচিয়ে রেখেছিলেন কেবল হযরত নুহ (আঃ) আর তাঁর ঈমানদার সাথিদের। এই বেঁচে থাকা মুমিনরা আর তাদের বংশধরেরা অনেকদিন আল্লাহর বিধান আর নবীর আদর্শ মাফিক জীবন যাপন করেন।

 

কিন্তু দীর্ঘদিন পর লোকেরা আবার ভুল পথে চলতে শুরু করে। তাঁরা নবীর আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়। এক আল্লাহকে ভুলে গিয়ে বহু মনগড়া খোদা বানিয়ে নেয়। এমনি করে তাঁরা ডুবে পড়লো শিরক আর মূর্খতার অন্ধকারে।

 

আদ জাতি

 

সেকালে আরবের সবচে’ শক্তিশালী জাতি ছিলো আ’দ জাতি। ইয়েমেন, হাজরামাউত ও আহকাফ অঞ্চল নিয়ে এরা এক বিরাট রাজ্য গড়ে তুলেছিলো। তাদের ছিলো অগাধ দৈহিক শক্তি আর ছিলো বিরাট রাজশক্তি। তাঁরা গড়ে তুলেছিলো বড় বড় শহর, বিরাট বিরাট গম্বুজধারী অট্টালিকা আর বিলাস সামগ্রী। নূহ (আঃ) এর পর আল্লাহ্‌ তায়ালা আ’দ জাতিকে ক্ষমতা প্রদান করেন। তাদের পৃথিবীতে প্রতিনিধি বানান। নিজের অপার অনুগ্রহে তাদের চরম উন্নতি দান করেন। ফলে গোটা আরবের উপর চলতে থাকে তাদের দাপট। কিন্তু এ উন্নতির ফলে তাঁরা গর্ব ও অহংকারে নিমজ্জিত হয়। নূহ (আঃ) এর দেখানো পথ থেকে তাঁরা দূরে সরে যায়। মহান আল্লাহকে ভুলে গিয়ে তাঁরা নিজেদের স্বার্থে বহু মনগড়া খোদা বানিয়ে নেয়। নূহ (আঃ) এর তুফানের পর তারাই সর্বপ্রথম মূর্তি পূজা শুরু করে। তাদের জাতীয় নেতাগন ছিলও যালিম, স্বৈরাচারী। জনগনকে তাঁরা নিজেদের হুকুমের দাস বানিয়ে নিয়েছিলো। তাঁরা এতই অহংকারী হয়ে উঠেছিলো যে, কাউকেই পরোয়া করতো না। তাঁরা ঘোষনা করলো, “আমাদের চেয়ে শক্তিশালী আর কে আছে?” (সূরা ৪১ হামিম আস সিজদাঃ আয়াত ১৫)

 

অথচ তাঁরা ভুলে গেলো যে, আলাহই সর্বশক্তিমান। আল্লাহই তাদের এতো উন্নতি দান করেছেন।

 

মুক্তির বার্তা নিয়ে এলেন হুদ

 

আদ জাতীকে সুপথ দেখাবার জন্যে আল্লাহ্‌ তাদের মাঝে একজন নবী পাঠাবার সিদ্ধান্ত নেন। এ জাতির সবচে’ ভালো লোক হুদকে আল্লাহ্‌ তাদের নবী মনোনীত করেন। মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ “আমি আদ জাতির কাছে তাদের ভাই হুদকে রাসুল বানিয়ে পাঠালাম। হুদ আমার বানী পেয়ে তাঁর জাতির লোকদের ডেকে বললোঃ

 

“হে আমার জাতির ভাইয়েরা, তোমরা আল্লাহর হুকুম পালন করো। তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোন ইলাহ নেই। তোমরা কি তোমাদের পাপ কাজের অশুভ পরিনতির ভয় করো না?” (সূরা ৭ আল আরাফঃ আয়াত ৬৫)

 

আল্লাহর নবী হুদ (আঃ) তাদের বুঝালেন-

 

“ভাইয়েরা আমার, তোমরা তোমাদের দয়াময় প্রভূর কাছে ক্ষমা চাও। তাঁর দিকে ফিরে এসো। তাহলে তিনি তোমাদের বৃষ্টি বর্ষীয়ে পানি দেবেন। তোমাদের বর্তমান শক্তিকে আরো শক্তিশালী করবেন। দেখো। তোমরা অপরাধীদের মতো তাঁকে উপেক্ষা করো না।” (সূরা ১১ হুদঃ আয়াত ৫২)

 

দরদভরা হৃদয় নিয়ে হজরত হুদ তাদের আর বললেনঃ

 

“তোমরা কি আল্লাহকে ভয় করবে না? দেখো, আমি তোমাদের জন্যে একজন বিশ্বস্ত রাসুল। সুতরাং আল্লাহকে ভয় করো। আর আমার কথা মেনে চলো। আমি যে তোমাদের বুঝাবার এতো চেষ্টা করছি, এর বিনিময়ে আমি তো তোমাদের কাছে কোন প্রতিদান চাইনা। এতে কি তোমরা বুঝতে পারছো না, এ কাজে আমার কোন স্বার্থ নেই? আমিতো কেবল তোমাদের কল্যাণ চাই। আমাকে প্রতিদান দেবেন তো আল্লাহ রাব্বুল আল আমীন।” (সূরা ২৬ শুয়ারা” আয়াত ১২৪-১২৭)

 

হুদ (আঃ) তাঁদের আরো বুঝালেনঃ

 

“তোমাদের এ কি হলো? প্রতিটি স্থানেই কেন তোমরা অর্থহীন স্মারক ইমারত (ভাস্কর্য) বানাচ্ছো? কেনই বা এতো অট্টালিকা গড়ে তুলছো? এগুলো কি তোমাদের চিরদিন বাঁচিয়ে রাখবে ভাবছো? তোমরা যখন কাউকেও পাকড়াও করো, তখন কেন নির্বিচারে অত্যাচারীর ভূমিকা পালন করো? এবার এসো আল্লাহকে ভয় করো আর আমার কথা মেনে নাও। সেই মহান প্রভূকে ভয় করো যিনি তোমাদের সবকিছুই দিয়েছেন। তোমরাতো জানোই তিনি তোমাদের দিয়েছেন অগনিত পশু, অসংখ্য সন্তান-সন্তুতি। দিয়েছেন কতোনা বাগ-বাগিচা, নদ-নদী, ঝর্ণাধারা। তোমাদের ব্যাপারে এক গুরতর দিনের শাস্তির আশংকা আমি করছি।” (সূরা ২৬ শুয়ারাঃ আয়াত ১২৮-১৩৫)

 

এভাবে হুদ (আঃ) তাঁর জাতির লোকদেরকে সঠিক পথে আনার চেষ্টা করেন। তাঁদের তিনি মহান প্রভূ আল্লাহর কথা স্মরণ করিয়ে দেন। বস্তুগত উন্নতির আল্লাহকে ভুলে থাকতে নিষেধ করেন। পরকালের খারাপ পরিনতির কথা তাঁদের স্মরণ করিয়ে দেন। তাঁদের ক্ষমা চাইতে বলেন। আল্লাহর দিকে ফিরে আসতে বলেন। আল্লাহর হুকুম পালন করতে এবং নবীর পথে চলতে বলেন। তিনি তাঁদের বলেনঃ এটাই পার্থিব কল্যাণ আর পরকালীন মুক্তির একমাত্র পথ।

 

নেতারা নবীর প্রতিপক্ষ হলো

 

এতো আন্তরিক আহবান আর কল্যাণময় উপদেশ সত্ত্বেও আদ জাতি নবীর কথা শুনলো না। আল্লাহর পথে এলো না। দুনিয়ার মোহ ত্যাগ করতে পারলো না। উল্টো তাঁরা নবীর সাথে বিতর্ক শুরু করলো। তাঁদের শাসকরা নবীকে বললোঃ

 

“আমরা মনে করি তুমি বোকা। তোমার কোন বুদ্ধি নেই। তাছাড়া আমাদের ধারনা, তুমি এসব মিথ্যা কথা বলছো।” (সূরা ৭ আল আরাফঃ আয়াত ৬৬)

 

তাঁরা আল্লাহর রাসুলকে আরো বললোঃ

 

“তোমার উপদেশ আমরা মানিনা। তোমার এসব উপদেশ সেকেলে লোকদের অভ্যাস ছাড়া আর কিছুই নয়। আসলে আমাদের উপর কোন শাস্তিই আসবে না।” (সূরা ২৬ শুয়ারাঃ আয়াত ১৩৬-১৩৮)

 

তাঁদের প্রতিবাদের জবাবে আল্লাহর নবী বললেনঃ

 

“হে আমার জাতির ভাইয়েরা, আমি কোন বোকা নির্বোধ ব্যাক্তি নই। বরং আমি বিশ্ব জগতের মালিক মহান আল্লাহর রাসুল। আমিতো কেবল তোমাদের কাছে মহান আমার আল্লাহর বার্তাই পৌছে দিচ্ছি। আর আমি তোমাদের একজন বিশ্বস্ত কল্যাণকামী। ” (সূরা ৭ আল আরাফঃ আয়াত ৬৭-৬৮)

 

হজরত হুদ তাঁদের আর বললেনঃ

 

“তোমাদের সতর্ক করার জন্যে তোমাদের জাতিরই এক ব্যাক্তির কাছে তোমাদের প্রভূর পক্ষ থেকে ‘উপদেশ বার্তা’ এসেছে বলে কি তোমরা বিস্মিত হচ্ছো? স্মরণ করো নূহের জাতির পর আল্লাহ্‌ তো তোমাদেরকেই পৃথিবীর প্রতিনিধি বানিয়েছেন। তোমাদের জনবল ও দেহবলের অধিকারী করেছেন। সুতরাং আল্লাহর দানশীলতাকে স্মরণ রেখো। আশা করা যায়, তাহলে তোমরা কল্যাণ লাভ করবে। ” (সূরা ৭ আল আরাফঃ আয়াত ৬৯)

 

পার্থিব কায়েমি স্বার্থ আর শয়তানের ধোঁকা আদ জাতির নেতাদের প্রতারিত করলো। তাঁরা আল্লাহর নবীকে বললোঃ

 

“হে হুদ, তুমি কি এ জন্যে নবী হয়ে এসেছো যে, আমরা কেবল এক খোদার ইবাদাত করবো আর আমাদের বাপদাদারা যে সব মা’বুদের (দেব দেবীর) পূজা করতো, তাঁদের ত্যাগ করবো? তুমি তো আমাদের কাছে কোন দলিল প্রমান নিয়ে আসো নি। আমরা কখনো তোমার কোথায় আমাদের খোদাগুলোকে ত্যাগ করবোনা। আমরা বলছি, আমাদের খোদাদের কোন একটির গজব তোমার উপর আপতিত হয়েছে।” (সূরা ৭ আল আরাফঃ আয়াত ৭০, সূরা ১১ হুদঃ আয়াত ৫৩-৫৪)

 

এবার আল্লাহর নবী হুদ (আঃ) তাঁদের বললেনঃ

 

“তোমাদের উপর তোমাদের মালিক আল্লাহর অভিশাপ আর গজব এসে পড়েছে। তোমরা কি আমার সাথে সেই সব মনগড়া খোদাদের ব্যাপারে বিতর্ক করছো, যেগুলোর নাম তৈরি করেছো তোমরা নিজেরা আর তোমাদের বাপ দাদারা? অথচ সেগুলোর পক্ষে আল্লাহর পক্ষ থেকে কোন প্রমান নেই। তোমরা যদি আমার কথা না শোনো, তবে অপেক্ষা করতে থাকো। আমিও তোমাদের সাথে অপেক্ষা করছি। ” (সূরা ৭ আল আরাফঃ আয়াত ৭১)

 

হজরত হুদ (আঃ) এর দীর্ঘ দাওয়াতের ফলে জনগনের মধ্যে একটা নাড়া পড়েছিল। তাঁরা শিরক করছিলো ঠিকই কিন্তু আল্লাহকে তাঁরা জানতো। আর হুদ (আঃ) যেহেতু তাঁদের আল্লাহর দিকেই ডাকছিলেন, সুতরাং তাঁর দাওয়াতের একটা বিরাট প্রভাব জনগনের উপর পড়ছিল। তাই জনগণ হজরত হুদের প্রতি ঈমান এনে ফেলতে পারে এই ভয়ে ক্ষমতাসীন শাসক ও নেতারা ময়দানে নেমে এলো। জনসভা করে তাঁরা হজরত হুদ (আঃ) এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ উপস্থাপন করতে লাগলো। তাঁরা জনগণকে বললোঃ

 

“এ ব্যাক্তি তো তোমাদেরই মতো একজন মানুষ। তোমরা যা খাও, সেও তাই খায়। তোমরা যা পান করো, সেও তাই পান করে। কেমন করে সে নবী হতে পারে? তবে তাঁর কথা মেনে নিলে তোমাদের দারুন ক্ষতি হবে। হুদ যে তোমাদের বলছে, তোমরা যখন মরে গিয়ে মাটির সাথে হাড়-গোড়ে পরিণত হবে, তখন তোমাদের আবার কবর থেকে বের করে আনা হবে। তাঁর এই অঙ্গীকার অসম্ভব। আমাদের এই পৃথিবীর জীবনটাই তো একমাত্র জীবন। আমাদের মরন বাচন সব এখানেই শেষ। আসলে আমাদের আর কখনো উঠানো হবে না। আল্লাহর নাম নিয়ে হুদ মূলতঃ মিথ্যে বলছে। আমরা তাঁর কথা মানি না। ”(সূরা আল মুমিনুনঃ আয়াত ৩৩-৩৮)

 

কিছু লোক ঈমান আনলো

 

বিবেকবান লোকদের মনে সত্যের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হলেও যালিম অত্যাচারী শাসকদের ভয়ে তাঁরা সত্য গ্রহন করতে এগিয়ে আসেনি। কেবল কিছু সংখ্যক সাহসী যুবক যুবতীই আল্লাহর পথে এগিয়ে এলো। তাঁরা নবীর সাথি হলো। জীবন বাজী রেখে তাঁরা আল্লাহর পথে কাজ করতে থাকলো। এখন জাতি সুস্পষ্টভাবে দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে গেলো। এক পক্ষে রয়েছেন আল্লাহর নবী আর তাঁর সাথী একদল যুবক যুবতী। গোটা জাতির তুলনায় এদের সংখ্যা ছিলো খুবই কম। প্রতিপক্ষে ছিল শাসক গোষ্ঠী আর ঐ সব লোক, বাতিল সমাজের সাথে জড়িয়ে ছিলো যাদের স্বার্থ। নবীর নেতৃত্বে এ সমাজ ভেঙ্গে নতুন সমাজ গঠিত হলে এদের স্বার্থ নষ্ট হবে বলে এরা সবাই নবী ও নবীর সাথীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুললো।

 

সময় ঘনিয়ে এলো

 

আল্লাহর নবী হুদ (আঃ) অবশেষে তাঁদের চরম বিরোধিতা ও প্রতিরোধের মোকাবেলায় বলে দিলেনঃ “আমি তোমাদের সামনে সাক্ষী হিসেবে স্বয়ং আল্লাহকেই পেশ করছি। আর তোমরা সাক্ষী থাকো, আল্লাহর সার্বভৌম ক্ষমতায় তোমরা যাদের অংশীদার বানাচ্ছো আমি তাঁদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করছি। তোমরা সবাই মিলে আমার বিরুদ্ধে যা করার করো। আমার ভরসা তো মহান আল্লাহর উপর। তিনি আমারো মালিক, তোমাদেরও মালিক। সমস্ত জীবের ভাগ্য নিয়ন্তা তো তিনিই। তিনি যা করেন, তাই সঠিক। ” (সূরা ১১ হুদঃ আয়াত ৫৪-৫৬)

 

হজরত হুদ তাঁদের আর বলে দিলেনঃ

 

“তোমরা যদি মুখ ফিরিয়ে নিতে চাও, নাও। কিন্তু জেনে রেখো, আল্লাহ্‌ আমাকে যে বার্তা নিয়ে পাঠিয়েছেন তা আমি তোমাদের কাছে পুরোপুরি পৌছে দিয়েছি। এখন আমার প্রভূ তোমাদের স্থলে অন্য জাতিকে বসাবেন এবং তোমরা তাঁর কোনই ক্ষতি করতে পারবে না। ” (সূরা ১১ হুদঃ আয়াত ৫৭)

 

অতঃপর সবধরনের চেষ্টা শেষ করার পর হজরত হুদ (আঃ) যখন দেখলেন এদের সৎ পথে আসার আর কোন সম্ভাবনা নাই, তখন মনে বড় কষ্ট নিয়ে তিনি দোয়া করলেনঃ

 

“আমার প্রভূ, এরা তো মিথ্যা বলে আমাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। এখন তুমিই আমাকে সাহায্য করো। ” (সূরা আল মুমিনুনঃ আয়াত ৩৯)

 

জবাব এলোঃ

 

“ অচিরেই এরা নিজেদের কৃতকর্মের (নিষ্ফল) অনুশোচনা করবে। ” (সূরা আল মুমিনুনঃ আয়াত ৪০)

 

ধ্বংস হলো আ’দ জাতি

 

আল্লাহর নবী হুদ (আঃ) আল্লাহর পক্ষ থেকে সংকেত পেলেন যে, তিনি এখন এ জাতিকে ধ্বংস করে দেবেন। বড় মনোবেদনার সাথে তিনি তাঁদের জানিয়ে দিলেনঃ “আল্লাহর রোষ এবং আযাব তোমাদের জন্যে অবধারিত হয়ে পড়েছে। ” জাতির শাসকরা অহংকার করে বললো, “আমাদের চাইতে শক্তিশালী আর কে আছে? ” তাঁরা হজরত হুদকে আরো বললো- “তুমি যে আমাদের শাস্তি দেয়ার অংগীকার করছো, তুমি সত্যবাদী হলে সেই শাস্তি দিয়ে দেখাও। ”

 

অবশেষে তাঁদের উপর আল্লাহর আযাব এসে পড়লো। উপত্যকার দিক থেকে আযাব তাঁদের দিকে ধেয়ে আসছিলো। তাঁরা বললো- এতো মেঘ, অনেক বৃষ্টি হবে। হুদ বললেনঃ

 

“এই সেই অংগীকার, যার জন্যে তোমরা তাড়াহুড়ো করছিলে। এটা প্রচণ্ড ঝড়। এতে রয়েছে চরম যন্ত্রনাদায়ক আযাব। এটা প্রতিটা বস্তুকে ধ্বংস করে রেখে যাবে। ” (সূরা ৪৬ আহকাফঃ আয়াত ২৪)

 

অল্প পরেই ধেয়ে এলো মেঘ। ধ্বংস করে দিয়ে গেলো সব কিছু। ধ্বংস হয়ে গেলো আল্লাহদ্রোহী শক্তি। আল কুরআনে তাঁদের ধংশের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে এভাবে-

 

“আর আ’দ জাতিকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে ঠাণ্ডা ঝড় বায়ু দিয়ে। সে বায়ু তিনি তাঁদের উপর দিয়ে চালিয়ে দেন একাধারে সাত রাত আট দিন। অতঃপর সেখানে তাঁরা চিৎপাত হয়ে পড়ে থাকলো যেন উপড়ানো খেজুর গাছের কাণ্ড। কোন পাপীই তা থেকে রক্ষা পায়নি। ” (সূরা ৬৯ আল হাক্কাহঃ আয়াত ৬-৮)

 

“এক বিকট ধ্বনি এসে তাঁদের পাকড়াও করলো। আর আমি তাঁদের ধ্বংস করে দিলাম খড় কুটোর মতো। ” (সূরা আল মুমিনুনঃ আয়াত ৪১)

 

এভাবে ধ্বংস হয়ে গেলো তৎকালীন বিশ্বের মহা শক্তিশালী আ’দ জাতি। আল্লাহ্‌ তাঁদের ধ্বংস করে দিলেন, ধ্বংস করে দিলেন তাঁদের দেশ ও সুরম্য শহর। ধূলিস্যাত হয়ে গেলো তাঁদের অহংকার। বিরান হয়ে গেলো তাঁদের জনবসতি। তাঁদের শহর ‘আহকাফ’ এখন এক বিরাট মরুভূমি। এখনো সেই ভূতুরে মরুভূমি অতিক্রম করতে লোকেরা ভয় পায়। শোনা যায়, সেই মরুভূমিতে যা কিছু পড়ে সবই তলিয়ে যায়।

 

প্রাচীনকালে এতই নাম করা ছিলও যে, এখনো লোকেরা তাঁদের নাম অনুযায়ী যে কোন প্রাচীন জাতিকে ‘আদি জাতি’, ‘আদি বাসী’ বলে থাকে। প্রাচীন ভাষাকে ‘আদি ভাষা’ বলে থাকে। এতো প্রতাপশালী একটি জাতিকেও মহান আল্লাহ্‌ ধ্বংস করে দিলেন তাঁর আয়াতকে অস্বীকার করা ও তাঁর নবীকে অমান্য করার ফলে। তাঁদের ধ্বংসের ইতিহাসের মধ্যে পৃথিবীর সকল জাতির জন্যেই রয়েছে উপদেশ।

 

হজরত হুদ ও তাঁর সাথিরা বেঁচে গেলেন

 

কিন্তু এই সর্বগ্রাসী ধ্বংস থেকে আল্লাহ্‌ হুদ (আঃ) ও তাঁর সাথিদের (ঈমানদার) বাঁচিয়ে দিলেন। মহান আল্লাহ্‌ বলেন-

 

“ যখন আমার হুকুম এসে গেলো, তখন আমি নিজ রহমতে হুদ ও তাঁর সাথে ঈমান গ্রহনকারীদের রক্ষা করলাম আর এক কঠিন আযাব থেকে তাঁদের বাঁচালাম। ” (সূরা ১১ হুদঃ আয়াত ৫৮)

 

আযাব আসার পূর্বক্ষণে আল্লাহ্‌ পাকের নির্দেশে হুদ (আঃ) তাঁর সাথিদের নিয়ে নিরাপদ এলাকায় আশ্রয় নেন। এভাবেই আল্লাহ্‌ তাঁদের ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেন। মহান আল্লাহ্‌ আ’দ জাতির যে সব পাপিষ্ঠদের ধ্বংস করে দিয়েছেন, তাঁরা ছিলো প্রথম আ’দ। ” (সূরা ৫৩ আন নাজমঃ আয়াত ৫০)। আর হজরত হুদ (আঃ) এর সাথে যারা বেঁচে গিয়েছিলেন তাঁরা ছিলেন দ্বিতীয় আ’দ। পরবর্তীকালে এই দ্বিতীয় আদ’ই আবার বড় আকার ধারন করে।

 

হুদ (আঃ) কিসের দাওয়াত দিয়েছেন?

 

হুদ (আঃ) তাঁর জাতিকে কি দাওয়াত দিয়েছেন? আসুন কুরআন মাজীদ দেখি। কুরআন বলে হজরত হুদ (আঃ) তাঁর জাতিকে বলেছিলেনঃ

 

১। হে আমার জাতি, তোমরা কেবল এক আল্লাহর হুকুম পালন করো।

 

২। আল্লাহ্‌ ছাড়া তোমাদের আর কোন ইলাহ নাই।

 

৩। নিজেদের অপরাধের জন্যে তোমরা আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও।

 

৪। তোমরা আল্লাহর দিকে ফিরে এসো।

 

৫। আমি তো কেবল আমার প্রভূর বার্তা তোমাদের কাছে পৌছে দিচ্ছি।

 

৬। আমি কেবল তোমাদের কল্যাণ চাই।

 

৭। আমি বোকা নই আমি আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামিনের রাসুল।

 

৮। কল্যাণ চাও তো মহান আল্লাহর দান সমূহকে স্মরণ করো।

 

৯। আমার প্রভূ সঠিক পথে পরিচালিত করেন।

 

১০। সমস্ত প্রানীর ভাগ্য আল্লাহর হাতে।

 

১১। আমি আমার মালিক ও তোমাদের মালিক আল্লাহর উপর ভরসা রাখি।

 

১২। তোমরা বিবেক খাটিয়ে চলো।

 

১৩। তোমরা মুখ ফিরিয়ে নিলে আল্লাহ্‌ অন্য কোন জাতিকে তোমাদের স্থানে বসাবেন।

 

১৪। আল্লাহর সার্বভৌম ক্ষমতায় তোমরা যাদের শরীক করছো, আমি তাঁদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করছি।

 

১৫। আমি তোমাদের জন্যে একজন বিশ্বস্ত রাসুল। সুতরাং আল্লাহকে ভয় করো আর আমার আনুগত্য করো।

 

১৬। আমি তোমাদের উপর এক কঠিন দিনের শাস্তির ভয় করছি।

 

১৭। মহান আল্লাহই সমস্ত জ্ঞানের উৎস।

 

১৮। এ কাজের বিনিময়ে আমি তোমাদের কছে কোন প্রতিদান চাই না। আমাকে প্রতিদান দেয়ার দায়িত্ব মহান আল্লাহর। (হুদ আলাইহিস সালামের এই আহবানগুলি কুরআন থেকে নেয়া হয়েছে)

 

কুরআনে হজরত হুদ ও আ’দ জাতির উল্লেখ

 

কুরআন মাজীদে হিজরত হুদ (আঃ) এর নাম উল্লেখ আছে সাত বার। আ’দ জাতির নাম উল্লেখ হয়েছে চব্বিশ বার। হুদ (আঃ) এর নাম উল্লেখ হয়েছে সূরা আ’রাফ আয়াত ৬৫ ; হুদ আয়াত ৫০,৫৩,৫৮,৬০, ৮৯ এবং সূরা শোয়ারা; আয়াত ১২৪। হজরত হুদ হজরত হুদ (আঃ) ও আ’দ জাতির কথা উল্লেখ যে সব সুরায় – সূরা আরাফ, সূরা তাওবা, সূরা হুদ, সূরা ইবরাহীম, সূরা হাজ্জ, সূরা শোয়ারা, সূরা ফুরকান, সূরা আনকাবুত, সূরা সোয়াদ, সূরা মুমিনুন, সূরা হামিম আস সিজদা, সূরা আহকাফ, সূরা কাফ, সূরা যারিয়াত, সূরা আন নাজম, সূরা আল কামার, সূরা আলহাক্কাহ এবং সূরা আল ফজরে। এসব সূরা থেকেই হজরত হুদ (আঃ) এর জীবন কথা লেখা হলো।

 

৫।

 

সামুদ জাতির নবী সালেহ

 

(আঃ)

 

আগেই বলেছি নবীকে অমান্য করার ফলে কি ভয়াবহ ধ্বংস নেমে এসেছিলো আ’দ জাতির উপর। সে জাতি অহংকারী লোকেরা পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে যায়। বেঁচে থাকেন কেবল হজরত হুদ (আঃ) আর তাঁর গুটি কয়েক অনুসারী। এঁরা এবং এদের সন্তানরা অনেক দিন আল্লাহর পথে চলতে থাকেন। কিন্তু ধীরে ধীরে তাঁরা মহান আল্লাহকে ভুলে যেতে থাকে। পার্থিব মোহ তাঁদের বিপথে পরিচালিত করে। দুনিয়ার আকর্ষণ তাঁদের পরকালীন সাফল্যের কথা ভুলিয়ে রাখে। ফলে পার্থিব উন্নতির জন্যে তাঁরা নবীর পথ থেকে বিচ্যুত হয়। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় সুবিধা ভোগীরা সমাজের স্বার্থকে নিজেদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করে নেয়। এরা মহান আল্লাহকে বাদ দিয়ে ‘যেমনী নাচাও তেমনী নাচি’ ধরনের অনেক দেব দেবীর মূর্তি বানিয়ে নেয়। এভাবে একদিকে তাঁরা শিরক, কুফর ও জাহেলিয়াতের চরম অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। অন্যদিকে জৈবিক ভোগ বিলাসের জন্যে পাহাড় খোঁদাই করে প্রাচীন ভারতীয় ইলোরা অজন্তার মতো অসংখ্য মনোহরী প্রাসাদ গড়ে তোলে। এই আল্লাহ্‌ বিমুখ বৈষয়িক উন্নতি তাঁদেরকে চরম হঠকারি ও অহংকারী বানিয়ে তোলে। এই হঠকারী জাতির নাম কি আপনারা জানেন?

 

হ্যা, এদের নামই সামুদ জাতি।

 

সামুদ জাতির আবাস

 

হুদ (আঃ) এঁর সাথে আ’দ জাতির যে লোকগুলো বেঁচে গিয়েছিলেন, সামুদ জাতি তাঁদেরই উত্তর পুরুষ। পরবর্তী কালে এ বংশের কোন প্রভাবশালী নেতার নামে এরা সামুদ জাতি নামে পরিচিত হয়। প্রথমে ‘আ’দের’ ধ্বংসের পর উত্তর দিকে সরে এসে এরা নিজেদের আবাস ও বসতি গড়ে তোলে। সেকালে এদের আবাস এলাকার নাম ছিল ‘হিজর’। এ কারনে কুরআনে এদেরকে ‘আসহাবুল হিজর’ বা হিজরবাসী নামেও অভিহিত করা হয়েছে। (সূরা ১৫ আল হিজর” আয়াত ৮০-৮৪)। তাঁদের সেই ঐতিহাসিক এলাকার বর্তমান নাম হলো ‘ফাজ্জুন্নাকাহ’ এবং ‘মাদায়েনে সালেহ’। এ স্থানটির অবস্থান হিজাজ ও সিরিয়ার গোটা মধ্যবর্তী অঞ্চল জুড়ে।

 

বৈষয়িক উন্নতি ও নৈতিক অধঃপতন

 

সামুদ জাতির বৈষয়িক ও নৈতিক অবস্থা ছিল আ’দ জাতিরই অনুরুপ। সামুদ জাতি সমতল ভুমি আর পাহাড়ের গাত্র খোদাই করে গড়ে তোলে ভুরি ভুরি সুরম্য অট্টালিকা। এগুলোর প্রযুক্তিগত কারুকাজ ছিল খুবই উন্নত। তাছাড়া এগুলো ছিল অত্যন্ত বিলাসবহুল। ছিল ঝর্নাধারা, বাগবাগিচা, থরে থরে খেজুরের বাগান। এতো সব প্রাসাদ, মনোরম উদ্যান আর স্মৃতিসৌধ তাঁরা কেন গড়ে তুলেছিল? কুরআন বলছে ‘ফারেহীন’ অর্থাৎ তাঁরা এগুলো গড়ে তুলেছিল গর্ব- অহংকার, ক্ষমতা, অর্থ আর প্রযুক্তিগত উন্নতি দেখানোর জন্যে। (সূরা ৪০ আল মুমিনুনঃ আয়াত ৮৩)

 

কুরআন আরো বলছে, তাঁরা সাধারন মানুষের উপর যুলুম ও শোষন করে তাঁদের দুর্বল করে রেখেছিল। গোটা জনগনের তুলনায় অল্প সংখ্যক লোকের হাতেই কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়েছিল রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় নেতৃত্ব।

 

মূর্তি পূজাকে তাঁরা তাঁদের ধর্ম বানিয়ে নিয়েছিল। আর মূর্তিগুলোর উপর পৌরোহিত্য করতো এসব নেতারা। দেব দেবীর মূর্তির নামেই জনগণকে করা হত শোষন। মনগড়া পূজা অর্চনা করার মধ্যেই ছিল তাঁদের যাবতীয় সুবিধা। ধর্মের মুখোশ পরেই তাঁরা আল্লাহদ্রোহীতার নেতৃত্ব দেয়।

 

এঁর পয়লা সুবিধা ছিল এই যে, দেব দেবীর নামে নেতাদের পক্ষে নিজেদের মনগড়া আইনই জনগনের উপর চাপিয়ে দেয়া ছিল অত্যন্ত সহজ। দ্বিতীয় সুবিধা ছিল, অসাড় দেব দেবীর পক্ষে ঠাকুরগিরি করে জনগণকে শোষণ করার পথ ছিল অত্যন্ত সুগম। তাছাড়া পুরোহিত সেজে জনগনের উপর কৃতিত্ব করা ছিল খুবই সহজ। এভাবে জনগন ছিল সমাজপতিদের দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ। অর্থাৎ জনগন ছিল সমাজপতিদের হুকুমের দাস। সমাজপতিরা ছিলো যালিম, প্রতারক আর শোষক। এই ঘুনে ধরা নোংরা নৈতিক ভিত্তির উপরই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তাঁদের শিল্প, কারিগরি ও প্রযুক্তিগত উন্নতির বাহার। বাইরের চাকচিক্য দিয়ে ঢেকে রেখেছিল তাঁদের ভেতরের কলুষতা।

 

আলোর মশাল নিয়ে এলেন সালেহ

 

এই অধঃপতিত জাতিকে মুক্তির পথ দেখানোর জন্যে মহান আল্লাহ্‌ সামুদ জাতির সবচাইতে সৎ ও যোগ্য ব্যাক্তি সালেহ কে তাঁদের নবী নিযুক্ত করলেন। আল্লাহর বানী আর হিদায়েতের আলো নিয়ে হজরত সালেহ আলাইহিস সালাম হাজির জনগন এবং জাতির নেতৃবৃন্দের কাছে। অত্যন্ত দরদ ভরা হৃদয় নিয়ে তিনি তাঁদের আহবান জানালেন কল্যাণ ও মুক্তির দিকে। আহবান জানালেন তাঁদের মালিক ও প্রভু মহান আল্লাহর দিকে। বললেন-

 

“হে আমার জাতির ভাইয়েরা, তোমরা এক আল্লাহর হুকুম পালন করো। তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোন ইলাহ নাই। নেই কোন হুকুমকর্তা। তিনিই তো যমীন থেকে তোমাদের সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর এখানেই তোমাদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সুতরাং তোমাদের অপরাধের জন্যে তাঁর কাছে ক্ষমা চাও আর তাঁর দিকে ফিরে এসো। তিনি অবশ্যই তোমাদের দাকে সাড়া দেবেন।” (সূরা ১১, হুদ আয়াত ৬১)

 

তাঁদের ভাই সালেহ তাঁদের আর উপদেশ দিলেন-

 

“তোমরা কি ভয় করবেনা? আমি তোমাদের জন্যে একজন বিশ্বস্ত রাসুল। সুতরাং আল্লাহকে ভয় করো আর আমার কথা মেনে নাও। তোমাদের বুঝাবার জন্যে আমি যে এতো কস্ট করছি, এর বিনিময়ে আমি তো তোমাদের কাছে কোন পারিশ্রমিক চাইনা। আমার পারিশ্রমিক তো আল্লাহর দায়িত্বে। তোমাদের এই সব উদ্যান, ঝর্নাধারা, ক্ষেত-খামার, বাগান ভরা রসাল খেজুর আর অহংকার প্রদর্শনের জন্যে পাহাড় গাত্রে নির্মিত বালাখানাসমূহের মধ্যে কি তোমাদের চিরদিন নিরাপদে থাকতে দেয়া হবে? সুতরাং আল্লাহকে ভয় করো আর আমার কথা মেনে নাও। এই সীমালংঘনকারী নেতাদের হুকুম মেনোনা। তাঁরা তো পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করছে। কোন সংস্কার সংশোধনের কাজ তাঁরা করছেনা।” (সূরা ২৬ আশ-শোয়ারা, আয়াত ১৪২-১৫২)

 

এসব মর্মস্পর্শী উপদেশের জবাবে জাতির নেতারা বললো –

 

“হে সালেহ, এতোদিন তোমাকে নিয়ে আমাদের কতই না আশা ভরশা ছিল। আর এখন কিনা তুমি আমাদেরকে আমাদের দেব দেবীদের পূজা উপাসনা থেকে বিরত রাখতে চাও। তোমার কোথায় আমাদের সন্দেহ- সংশয় রয়েছে।” (সূরা ১১, হুদ আয়াত ৬২)

 

সালেহ বললেনঃ

 

“ভাইয়েরা আমার, তোমরা একটু ভেবে দেখো। আমি যদি আমার প্রভূর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত এক উজ্জ্বল প্রমানের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকি আর তাঁর বিশেষ অনুগ্রহেও ধন্য হওয়া থাকি, তবে কে আমাকে তাঁর পাকড়াও থেকে রক্ষা করবে যদি তাঁর নির্দেশের খেলাফ করি? (সূরা ১১, হুদ আয়াত ৬৩)

 

তাঁদের কল্যাণের পথে আনার জন্যে হজরত সালেহ তাঁদের এতো করে বুঝালেন। কিন্তু তাঁরা বুঝলোনা। তারা শলা পরামর্শ করলোঃ “আমাদের সবার মাঝে সে একজন মাত্র লোক। আমরা সবাই তাঁর অনুসরন করবো? তাহলে আমরা তো ভ্রান্তি আর অগ্নিতে নিমজ্জিত হবো। আমাদের সবার মাঝে কেবল তাঁরই উপর উপদেশ অবতীর্ণ হলো? আসলে সে মিথ্যাবাদী।”

 

সাধারন জনগনের মন হজরত সালেহ (আঃ) এর উপদেশে বিগলিত হচ্ছিলো। কিন্তু এইভাবে তারা জনগণকে ডেকে এনে আবার বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করলো।

 

নিদর্শন দেখাবার দাবী

 

জাতির নেতারা এবার হজরত সালেহ (আঃ) এর প্রতি এক বিরাট চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলো। তারা বললো-

 

“তোমার উপর কেউ যাদু করেছে। নইলে তুমি তো আমাদেরই মতো একজন মানুষ। হ্যাঁ তবে তুমি যদি সত্য নবী হয়ে থাকো, তাহলে কোন নিদর্শন দেখাও।” (সূরা ২৬ আশ-শোয়ারা, আয়াত ১৫৩- ১৫৪)

 

কেউ কেউ বলেছেন, এ কথা বলে তারা একটি বড় পাথর খণ্ডের প্রতি ইঙ্গিত করে বললো- এই পাথরের ভেতর থেকে যদি গাভীন উটনী বের করে আনতে পারো, তবে আমরা তোমার প্রতি ঈমান আনবো এবং তোমার আনুগত্য করবো। তারা মনে করেছিলো, তাঁদের এ দাবী পূরন করা হজরত সালেহ (আঃ) এর জন্যে অসম্ভব। তারপর কি হলো? তারপর হজরত সালেহ তাঁদেরকে নিদর্শন দেখানোর জন্যে আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন। তাঁর বুক ভরা আশা ছিলো, নিদর্শন দেখালে হয়তো তারা ঈমান আনবে।

 

আল্লাহ বললেন- “হে সালেহ, আমি উটনী পাঠাচ্ছি ঠিকই। তবে এই উটনী হবে তাঁদের জন্যে চুড়ান্ত পরীক্ষা স্বরূপ। তুমি স্থির থাকো আর তাঁদেরকে বলে দাওঃ “কূপের পানি পান করার জন্যে তাঁদের মাঝে পালা ভাগ করে দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ একদিন পুরো পানি পান করবে সেই উটনী আর একদিন পান করবে তাঁর সবাই আর তাঁদের পশুরা।” (সূরা ২৬ আশ-শোয়ারা, আয়াত ১৫৫)

 

আল্লাহর নিদর্শনের উটনী

 

ব্যাস, আল্লাহর নির্দেশে সমস্ত মানুষের সামনে পাথর থেকে উটনী বেরিয়ে এলো। হজরত সালেহ এবার উটনীর ব্যাপারে মহান আল্লাহর ফরমান তাঁদের জানিয়ে দিলেন। একটি ছোট্ট ভাষন তিনি তাঁদের সামনে পেশ করলেন –

 

“হে আমার জাতির ভাইয়েরা, সত্যিই আল্লাহ ছাড়া তোমাদের আর কোন ইলাহ নাই। সুতরাং তোমরা কেবল তাঁরই হুকুম পালন করো। দেখো তোমাদের প্রভূর পক্ষ থেকে তোমাদের সামনে সুস্পষ্ট প্রমান এসে পড়েছে। এটি আল্লাহর উটনী। এটি তোমাদের জন্যে চুড়ান্ত নিদর্শন। সতরাং একে স্বাধীনভাবে ছেড়ে দাও। আল্লাহর যমীনে সে মুক্তভাবে চড়ে বেড়াবে। কেউ তার বিন্দুমাত্র ক্ষতি করার চেষ্টা করো না। তাহলে চরম পীড়াদায়ক শাস্তি তোমাদের গ্রাস করে নেবে। তোমরা সে সময়টার কথা স্মরণ করো, যখন মহান আল্লাহ আ’দ জাতির উপর তোমাদেরকে স্থলাভিষিক্ত করেন এবং এমনভাবে এ ভূখণ্ডে তোমাদের প্রতিষ্ঠিত করেন যে, তোমরা মুক্ত ময়দানে প্রসাদ নির্মাণ করছো আর পাহাড় কেটে বিলাস গ্রহ করছো। সুতরাং মহান আলাহর অনুগ্রহকে স্মরণ করো। দেশে বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের মতো সীমালঙ্ঘন করোনা।” (সূরা ৭ আল আরাফ, আয়াত ৭৩-৭৪)

 

জাতি বিভক্ত হয়ে গেলো দুইভাগে

 

মহান নবী হজরত সালেহ (আঃ) এর আহবানে সত্য উপলব্ধি করতে পেরে জাতির কিছু লোক ঈমান আনলো। আল্লাহর পয়হে এলো। নবীর সাথী হলো। তবে এদের সংখ্যা খুবই কম। কিন্তু জাতির নেতারা এবং তাঁদের অধিকাংশ অনুসারী ঈমান গ্রহন করলোনা। এই হঠকারী নেতারা ঐ নির্যাতিত মুমিন্দের লক্ষ্য করে বললো – ‘তোমরা কি সত্যি যানো যে, সালেহ তাঁর প্রভুর রাসুল?’ (সূরা ৭ আল আরাফ, আয়াত ৭৫)

 

মুমিনরা বললেন –‘আমরা অবশ্যই জানতে পেরেছি এবং তাঁর প্রতি ঈমান এনেছি।’ (সূরা ৭ আল আরাফ, আয়াত ৭৫)

 

অহংকারী নেতারা বললো- ‘তোমরা যে বিষয়ের প্রতি ঈমান এনেছ, আমরা তা মানিনা।’ (সূরা ৭ আল আরাফ, আয়াত ৭৬)

 

তারা হত্যা করলো উটনীকে

 

দেখলেন তো, লোকগুলো কত বড় গাদ্দার। তারাই নবীর কাছে নিদর্শন দাবী করেছিলো। তারাই বলেছিল প্রমান স্বরূপ নিদর্শন দেখাতে পারলে তারা ঈমান আনবে। নবী নিদর্শন দেখালেন। তাঁদের চোখের সামনে এতো বড় ঘটনা ঘটে গেলো। আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত নিদর্শন তাঁদের চোখের সামনে ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু অঙ্গীকার করেও তারা ঈমান আনলোনা। আসলে সকল নবীর সমকালীন লোকেরাই এভেবে নবীর কাছে নিদর্শন দাবী করতো। কিন্তু তা দেখার পর তারা আর ঈমান আনতোনা। এ জন্যেই আল্লাহ তায়ালা আমাদের নবী হজরত মুহাম্মাদ (সাঃ) –কে বলে দিয়েছেন, তোমার বিরোধীরা যতই নিদর্শন দাবী করুক, নিদর্শন দেখার পর আর তারা ঈমান আনবেনা। ফেরেস্তা এসেও যদি বলে, এমনকি মৃত ব্যক্তিও যদি ঘোষনা দেয়, ইনি আল্লাহর নবী, তবু তারা মানবেনা। যাই হোক আসল কথায় আসা যাক।

 

আল্লাহর উটনী স্বাধীনভাবে চরে বেড়াতে লাগলো। একদিনের সমস্ত পানিই উটনী পান করতো। তাঁদের ক্ষেত-খামারে সে অবাধে বিচরন করতো। এভাবে বেশ কিছুকাল অতিবাহিত হয়। ঈমান না আনলেও এই অলৌকিক উটের ব্যাপারে তাঁদের মনে ভয় ঢুকে গিয়েছিলো। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও উটনীকে তারা অনেকদিন বরদাশত করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা আর ধৈর্য ধরে থাকতে পারলোনা। তারা শলা পরামর্শ করলো। সিদ্ধান্ত নিল উটনীকে তারা হত্যা করবে। কিন্তু কে নেবে উটনীকে হত্যা করার দায়িত্ব? এক চরম হতভাগা এগিয়ে এলো। জাতির নেতারা তাঁর উপরে এ দায়িত্ব সপে দিলো। এক চরম ভয়াবহ পরিনতির ভয় তারা করলোনা। শেষ পর্যন্ত আল্লাহর উটনীকে তারা হত্যা করলো। এভাবে দ্রুত এগিয়ে এলো তারা নিজেদের করুন পরিনতির দিকে। তারপর কি হলো?

 

আর মাত্র তিন দিন

 

উটনী হত্যার খইবর পেয়ে, হজরত সালেহ কম্পিত হলেন। কিন্তু আফসোস, তাঁর জাতি বুঝলনা। তাঁর আর কিছুই করার নেই। তিনি দৌড়ে এলেন। তারা বললো- সালেহ, তুমি তো অংগীকার করেছিলে একে হত্যা করলে আমাদের উপর বিরাট বিপথ নেমে আসবে। কোথায় তোমার সেই বিপদ? যদি সত্যি তুমি রাসুল হয়ে থাকো, তবে এনে দেখাও দেখি সেই বিপদ। আল্লাহর নবী সালেহ এবার তাঁদের জানিয়ে দিলেন-

 

‘এখন তোমাদের শেষ পরিনতির সময় আর মাত্র তিনদিন বাকী আছে। নিজেদের সুরম্য প্রাসাদগুলোতে বসে এই তিনদিন ভালো করে ভোগ বিলাস করে নাও। এ এক অনিবার্য অংগীকার।”(সূরা ১১, হুদ আয়াত ৬৫)

 

এবার নবীকে হত্যার ষড়যন্ত্র

 

উটনীকে হত্যা করার পর এবার সামুদ জাতির নেতারা স্বয়ং হজরত সালেহ (আঃ)-কেই সপরিবারে হত্যা করার ফায়সালা করলো। তারা ভাবলো, সালেহই তো আমাদের পথের আসল কাঁটা। সে-ই তো আমাদের ভোগ বিলাসে বাধা দিচ্ছে। আমাদের জীবন পদ্ধতি বদলে দিতে চাচ্ছে। আমাদের ক্ষমতা হাতছাড়া করতে চাইছে। আমাদের সমালচোনা করছে। জনগণকে আমাদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলছে। তাঁর কারনেই তো এখন আমাদের উপর বিপদ আসার আশংকা দেখা দিয়েছে। সুতরাং তাঁর ভবলীলা সাঙ্গ করে দিলেই সব চুকে যায়। সামুদ জাতির নয়টি সম্প্রদায়ের নেতারা বসে শেষ পর্যন্ত ঐ তিন দিনের মধ্যেই নবীকে হত্যা করার চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়। তারা আরো সিদ্ধান্ত নেয়, হত্যার পরে সালেহর অলী-অভিভাবক হিসেবে যিনি তাঁর রক্তমূল্যের দাবীদার হবেন, তাঁকে বলবো, আমরা এ হত্যাকান্ডে জড়িত নই। এ ঘটনা কুরআন মাজীদে এভাবে বর্ণনা করেছে-

 

“শহরে ছিলো নয়জন দলপতি। তারা দেশকে অন্যায় অনাচারে বিপর্যস্ত করে তুলেছিলো। কোন প্রকার ভালো কাজ তারা করতোনা। তারা একে অপরকে বললো- আল্লাহর কসম খেয়ে অংগীকার করো, রাতেই আমরা সালেহ আর তাঁর পরিবারবর্গের উপর আক্রমন চালাবো। তারপর তাঁর অলীকে বলবো, তোমার বংশ ধ্বংস হবার সময় আমরা ওখানে উপস্থিতই ছিলাম না। আমরা সত্য সত্য বলছি।” (সূরা আন নামল ২৭ আয়াত ৪৮-৪৯)

 

ওদের এই ষড়যন্ত্র সম্পর্কে মহান আল্লাহ্‌ বলেন- “তারা একটা ষড়যন্ত্র পাকালো আর আমরাও একটা পরিকল্পনা বানালাম। যা তারা টেরই পেলোনা।” (সূরা আন নামল ২৭ আয়াত ৫০)

 

ধ্বংস হলো সামুদ জাতি

 

আল্লাহর সে পরিকল্পনাটি কী? তা হলো সামুদ জাতির ধ্বংস। আল্লাহ্‌ বলেন-

 

“এখন চেয়ে দেখো, তাঁদের ষড়যন্ত্রের পরিনতি কি হলো? আমি তাঁদের ধ্বংস করে দিলাম, সেই সাথে তাঁদের জাতিকেও। ” (সূরা আন নামল ২৭ আয়াত ৫১)

 

আল্লাহ্‌ সামুদ জাতিকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিলেন। তাঁদের গর্ব অহংকার ও ভোগ বিলাস সব তলিয়ে গেলো। মুফাসসিরগন তাঁদের ধ্বংসের বিবরন দিতে গিয়ে বলেছেন- হজরত সালেহ যে তাঁদের তিন দিনের সময় বেধে দিলেন, তাতে তাঁদের অন্তরে ভয় ঢুকে গেলো। প্রথম দিন তাঁদের চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে যায়। দ্বিতীয় দিন তাঁদের চেহারা লালবর্ণ হয়ে যায়, আর তৃতীয় দিনে তাঁদের চেহারা হয়ে যায় কালো। অতঃপর তিনদিন শেষ হবার পরপরই রাত্রিবেলা হঠাৎ এক বিকট ধ্বনি এবং সাথে সাথে ভুমিকম্প শুরু হয়ে যায়। বজ্রধ্বনি আর ভুকম্পনে তারা সম্পূর্ণ বিনাস হয়ে গেলো। মহান আল্লাহ্‌ বলেন-

 

“হঠাৎ বজ্রধ্বনি এসে তাঁদের পাকড়াও করলো। যখন ভোর হলো, তখন দেখা গেলো, তারা নিজেদের ঘর দোরে মরে উপর হয়ে পড়ে রইলো, যেনো এসব ঘরে তারা কোন দিনই বসবাস করেনি।”(সূরা ১১, হুদ আয়াত ৬৭-৬৮)

 

তাঁদের উন্নত প্রযুক্তির সুরম্য অট্টালিকা সমূহের ধ্বংসাবশেষ আজো তাঁদের অঞ্চলে শিক্ষনীয় হয়ে পড়ে আছে।

 

বেঁচে গেলেন সালেহ এবং তাঁর সাথীরা

 

তারা হজরত সালেহ- কে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেছিলো যে রাতে, সে রাতেই মহান আল্লাহ্‌ তাঁদের ধ্বংস করে দিলেন। সে ধ্বংস থেকে আল্লাহ্‌ পাক হজরত সালে এবং তাঁর সাথীদের রক্ষা করেছিলেন। তাঁদের নিরাপদে বাঁচিয়ে রাখলেন। মহান আল্লাহ্‌ বলেন-

 

“অতঃপর যখন ওদের দ্ধংশ হবার নির্দিষ্ট সময়টি আসলো, তখন আমরা সালেহ এবং তাঁর সাহে যারা ঈমান এনেছিল, তাঁদেরকে আমাদের বিশেষ রহমতের দ্বারা রক্ষা করলাম। সেদিনকার লাঞ্ছনা থেকে নিরাপদ রাখলাম। নিশ্চয়ই তোমার প্রভু দুর্দান্ত ক্ষমতার অধিকারী এবং মহাপরাক্রমশীল।” (সূরা ১১, হুদ আয়াত ৬৬)

 

সামুদ জাতি কেন ধ্বংস হলো?

 

সামুদ জাতি বৈষয়িকভাবে চরম উন্নতি লাভ করার পরও কেন ধ্বংস হলো? কেন তারা বিলীন হয়ে গেলো? কেন হলো তাঁদের এই অপমানকর বিনাশ? এর কারন খুব সহজ। এর কারন হলো-

 

১। তারা শিরকে লিপ্ত হয়েছিলো।

 

২। তারা এক আল্লাহর আইন ও বিধান মেনে নিতে অস্বীকার করেছিলো।

 

৩। তারা নবী ও নবীর পথকে প্রত্যাখ্যান করেছিলো।

 

৪। তারা দুষ্কৃতকারী ও দুর্নীতিবাজ নেতাদের অনুসরন করেছিলো।

 

৫। পরকালের তুলনায় বৈষয়িক জীবনকে তারা অগ্রাধিকার দিয়েছিল।

 

৬। লাগামহীন ভোগ বিলাসে তারা নিমজ্জিত হয়ে পড়েছিল।

 

৭। তারা সৎ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় বাধা দিয়েছিল।

 

৮। আল্লাহর নিদর্শন দাবী করেও তা তারা প্রত্যাখ্যান করেছিলো।

 

৯। তারা আল্লাহর নিদর্শন উটনীকে হত্যা করেছিল।

 

১০। তারা আল্লাহর নবীকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেছিলো।

 

১১। তারা অহংকার ও স্বেচ্ছাচারিতার মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছিলো।

 

কুরআনে সালেহ ও তাঁর জাতির উল্লেখ

 

এবার জানিয়ে দিচ্ছি কুরআনে হজরত সালেহ (আঃ) ও তাঁর জাতি সামুদের কথা কোথায় উল্লেখ আছে। হ্যাঁ, আল কুরআনে হজরত সালেহ (আঃ) এর নাম উল্লেখ আছে ৯ বার। যেসব সুরায় উল্লেখ আছে সেগুলো হলো- সূরা আল আরাফ, আয়াত ৭৩,৭৫,৭৭, সূরা হুদ, আয়াত ৬১,৬২,৬৬,৮৯, সূরা শোয়ারা, আয়াত ১৪২, সূরা নামল, আয়াত ৪৫।

 

আল কুরআনে সামুদ জাতির নাম উল্লেখ আছে ২৬ স্থানে। সেগুলো হলো- সূরা আল আরাফ,আয়াত ৭৩, তাওবা, ৭০, হুদ ৬১,৬৮,৬৮,৯৫, ইবরাহীম ৯, ইস্রা ৫৯, হজ্জ ৪২, ফুরকান ৩৮, শোয়ারা ১৪১, নামল ৪৫, আন কবুত ৩৮, সোয়াদ ১৩, মুমিন ৩১, হামিমুস সাজদা ১৩-১৭, কাফ ১৩, যারিয়াত ৪৩, আন নাজম ৫১, আল কামার ২৩, আল হাক্কাহ ৪,৫, বুরুজ ১৮, আল ফজর, আশ সামস ১১।

 

কুরআনের সুরাগুলো জানিয়ে দিলাম। সরাসরি কুরআন পড়লে আপনারা নিজেরাই এ ঘটনার আরো অনেক শিক্ষণীয় দিক জানতে পারবেন।

 

৬।

 

অগ্নী পরীক্ষায় বিজয়ী বীর ইবরাহীম

 

(আঃ)

 

জন্ম ও কৈশোর

 

হাজার হাজার বছর আগের কথা। আজ থেকে প্রায় চার হাজার বছর আগের কথা। নমরূদীয় ইরাকের ঊর নগরীতে জন্ম হয় এক শিশুর। একদিন সেই শিশুটিই হন কালের সাক্ষী এক মহাপুরুষ। ওর বাবা আজর ছিলেন বড় একজন ধর্মীয় পুরোহিত। তিনি নিজের হাতে মূর্তি তৈরি করতেন। আর ঐ মূর্তিগুলোকেই সারা দেশের মানুষ দেবতা বলে মানতো। ওদের পূজা উপাসনা করতো। ছেলে জন্ম হওয়ায় বাবা আজর দারূন খুশি। ভাবেন, আমার পরে আমার এই ছেলেই হবে ধর্মীয় পুরোহিত। নিজ হাতে সে দেবতা বানাবে। সে রক্ষা করবে আমার ধর্মীয় ঐতিহ্য। মনের খুশিতে আজর তাঁর পুত্রের নাম রাখেন ইব্রাহিম। কিন্তু আল্লাহর পরিকল্পনা ভিন্ন। তিনি ইব্রাহীমকে দিয়ে মূর্তি ভাংগার পরিকল্পনা করেন। আল্লাহর পরিকল্পনা অনুযায়ী ইব্রাহিম বড় হতে থাকে। ইব্রাহীমকে তিনি নিজ ভান্ডার থেকে দান করেন অগাধ জ্ঞান, বুদ্ধি আর দূরদৃষ্টি। কারন তিনি তো তাঁকে নবী বানাবেন। তিনি তো তাঁকে এক বিরাট নেতৃত্বের আসনে বসাবেন। তাই ছোট বেলা থেকেই তাঁর জ্ঞান বুদ্ধি দ্রুত বৃদ্ধি হতে থাকে। কিশোর বয়স থেকেই ইব্রাহিম সব কিছু যুক্তি দিয়ে বুঝার চেষ্টা করতে থাকেন।

 

চিন্তা করেন ইব্রাহিম

 

ইব্রাহিম ভাবেন, নিজেদের হাতে মূর্তি বানিয়ে সেগুলোকে খোদা মানা তো বিরাট বোকামি। যারা কারো উপকার করতে পারে না, কারো অপকারও করতে পারে না, তারা খোদা হয় কেমন করে? কেউ যদি ঐ দেবতাগুলির ক্ষতি করতে চায়, তা থেকেও দেবতাগুলি আত্মরক্ষা করতে পারেনা। তিনি বুঝতে পারেন, তাঁর পিতা ও সমাজের লোকেরা বিরাট ভুলের মধ্যে রয়েছে। তিনি তাঁর বাবাকে বলেন-

 

“বাবা, আপনি কি মূর্তিকে খোদা মানেন? আমিতো দেখছি, আপনি এবং আপনার জাতির লোকেরা পরিস্কার ভুলের মধ্যে আছেন।” (সূরা আল আনাম, আয়াত ৭৪)

 

ইব্রহীম দেখলেন, তাঁর জাতির লোকেরা চন্দ্র-সূর্য, নক্ষত্রেরও পূজা করছে। তারা মনে করলো, এগুলো তো শক্তিশালী দেবতা। কিন্তু এরা যে খোদা হতে পারেনা, তা তিনি যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন। রাত্রি বেলা নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে ইব্রাহিম বলেন- তোমরা বলছো এ আমার প্রভু, অতঃপর নক্ষত্র যখন ডুবে গেলো, তখন তিনি বলে দিলেন, অস্তমিত হওয়া জিনিসকে আমি পছন্দ করিনা। এরপর উজ্জ্বল চাঁদ উদয় হলো। তিনি বললেন- তবে এই হবে প্রভু, কিন্তু যখন চাঁদও ডুবে গেলো, তিনি তখন বললেন- এতো খোদা হতে পারেনা। আসল প্রভু মহাবিশ্বের মালিক নিজেই যদি আমাকে পথ না দেখান, তবে আমিতো বিপথগামীদের দলভুক্ত হয়ে পড়বো।

 

অতপর সকাল হলে পুবাকাশে ঝলমল করে সূর্য উঠলো। তবে তো এই হবে খোদা। কারন এতো সবার বড়। তারপর সন্ধ্যায় যখন সূর্য ডুবে গেলো, তখন তিনি তাঁর কওমকে সম্বোধন করে বললেন- তোমরা যাদেরকে মহান সৃষ্টিকর্তার অংশীদার ভাবছো, আমি তাঁদের সকলের দিক থেকে মুখ ফেরালাম। আমি সেই মহান প্রভুর নিকট আত্মসমর্পণ করছি, যিনি আসমান আর জমিনকে সৃষ্টি করেছেন। আমি তাঁর সাথে কাউকেও অংশীদার বানাবোনা।

 

শুরু হলো বিবাদ

 

এ সিদ্ধান্ত ঘোষণা করার পর জাতির লোকেরা তাঁর সাথে বিবাদে লিপ্ত হলো। তিনি তাঁদের বললেন- “তোমরা কি মহান আল্লাহর ব্যাপারে আমার সাথে বিতর্ক করছো? তিনি তো সঠিক পথ দেখিয়েছেন। তোমরা যাদেরকে আল্লাহর আংশীদার মানো, আমি ওদের ভয় করিনা। আমি জানি ওরা আমার কোন ক্ষতি করতে পারবেনা।

 

ইব্রাহিম তাঁর বাবাকে বললেন- “বাবা আপনি কেন সেই সব জিনিসের ইবাদাত করেন? যেগুলো কানে শুনেনা, চোখে দেখেনা এবং আপনার কোন উপকার করতে পারেনা। বাবা আমি সত্য জ্ঞান লাভ করেছি, যা আপনি লাভ করেননি। আমার দেখানো পথে চলুন, আমি আপনাকে সঠিক পথ দেখাবো। বাবা, কেন আপনি শয়তানের দাসত্ব করছেন? শয়তান তো দয়াময় আল্লাহর অবাধ্য।” (সূরা মরিয়ম, আয়াত ৪২-৪৪)

 

জবাবে ইব্রাহীমের পিতা বললেন- “ইব্রাহিম, তুই কি আমার খোদাদের থেকে দূরে সরে গেলি? শোণো, এই পথ থেকে ফেরত না এলে, আমি তোকে পাথর মেরে হত্যা করবো।” (সূরা মরিয়ম, আয়াত ৪৬)

 

মূর্তি ভাংগার পালা

 

কোন কিছুতেই যখন জাতির লোকেরা সত্য গ্রহনে প্রস্তুত হলোনা, তখন ইব্রাহিম একদিন ঘোষণা করলেন- তোমাদের অনুপস্থিতিতে একদিন তোমাদের এই মিথ্যা খোদাদের বিরুদ্ধে একটা চাল চালবো। ইব্রাহীমের কোথায় তারা তেমন একটা গুরুত্ব দিলোনা। একদিন সব লোক এক ধর্মীয় উৎসবে যোগ দিতে চলে গেলো। ইব্রাহীমকেও তারা উৎসবে যেতে বলে। ইন্তু অনেক পীড়াপীড়ি সত্ত্বেও তিনি গেলেন না। নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে বললেন- আমি পীড়িত। আমি যাবোনা। সুতরাং তাঁকে রেখেই তারা চলে গেলো। শহর পুরুষ শুন্য হয়ে পড়লো। এই সুযোগে ইব্রাহিম ওদের ঠাকুর ঘরে এলেন। দেখলেন, সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে ওদের মূর্তি দেবতাগুলো। ওদের সামনে রয়েছে দামি দামি খাবার জিনিস। ইব্রাহিম ওদের বললেন- “তোমাদের কি হয়েছে? এসব স্বাদের জিনিস খাওনা কেন? কি হলো, কথা বলছোনা কেন? তারপর তিনি মূর্তিগুলোকে আঘাত করে ভেঙ্গে ফেললেন। কিন্তু ঠাকুর দেবতাটিকে ভাংলেন না। ওকে ওর যায়গায়ই রেখে দিলেন।

 

উরসব শেষে লোকেরা ফিরে এলো। দেবতাদের অবস্থা দেখে সবার মাথায় হাত। তারা বলাবলি করতে লাগলো- কোন যালিম আমাদের খোদাদের সাথে এই ব্যাবহার করলো? কেউ কেউ বললো – আমরা যুবক ইব্রাহীমকে এদের ব্যাপারে সমালোচনা করতে শুনেছি।

 

নেতারা গোস্বায় ফেটে পড়লো। বললো – অপরাধীকে ধরে নিয়ে এসো সবার সামনে। ইব্রাহীমকে আনা হলো। তারা বললো- ‘ইব্রাহিম, আমাদের খোদাদের সাথে এই ব্যাবহার কি তুমি করেছো?” ইব্রাহিম ভাবলেন, ওদের খোদাদের অক্ষমতা প্রমান করার এটাই বড় সুযোগ। তিনি বললেন- নয়তো ওদেরকেই জিজ্ঞেস করুন, কে মেরেছে ওদের? ঐ বড়টাকেই জিজ্ঞেস করুন, সে-ই ভেঙ্গেছে নাকি?

 

ইব্রাহীমের কথা শুনে তারা লজ্জিত হলো। মনে মনে ভাবলো, আসলে আমরাই তো অন্যায়কারী। তারপর মাথানত করে তারা বললো- ‘ইব্রাহিম, দেবতাগুলো যে কথা বলতে পারেনা, তাতো তুমি ভালো করেই জানো।’

 

ইব্রাহিম সবাইকে সম্বোধন করে বললেন – “তোমরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে এমন সব জিনিসের পূজা উপাসনা করো, যেগুলো তোমাদের ভালোও করতে পারেনা, আবার মন্দও করতে পারেনা? দুঃখ তোমাদের জন্যে, কেন তোমরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে এগুলোর ইবাদাত করো? তোমাদের কি একটুও বিবেক বুদ্ধি নেই?” এবার তারা ইব্রাহীমকে ঘিরে ফেললো। চারদিকে হৈ হট্টগোল শুরু করে দিলো। ইব্রাহিম জোর গলায় বললেন – ‘তোমরা কি তোমাদের নিজেদের হাতে বানানো মূর্তির ইবাদাত করবে? অথচ তোমাদেরকে তো সৃষ্টি করেছেন আল্লাহ্‌।’

 

রাজ দরবারে আনা হলো

 

তারা ইব্রাহীমকে নিয়ে খুব চিন্তায় পড়লো। কী করবে তাঁকে নিয়ে? সে তো দেবতাদের আর কোন মান-ইজ্জতই বাকী রাখলোনা। তারা বিভিন্ন রকম শলা পরামর্শ করতে লাগলো। শেষ পর্যন্ত ইব্রাহীমের বিষয়টি তারা রাজ দরবারে তুললো। তাঁদের রাজা ছিলো নমরুদ। নমরূদকে তারা বুঝালো, ইব্রাহীমের ব্যাপারে বড় কোন সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে সে আমাদের ধর্মও বিনাশ করবে, আপনার রাজত্বও বিনাশ করবে।

 

রাজা বললেন- ইব্রাহীমকে আমার কাছে নিয়ে এসো। অতঃপর ইব্রাহীমকে নমরূদের সামনে হাজির করা হলো। নমরূদ তাঁর সাথে কথা বললেন। ইব্রাহিম তাঁকে আল্লাহর দিকে আহবান জানান। কিন্তু নমরূদ ইব্রাহীমের সাথে আল্লাহর ব্যাপারে বিতর্ক শুরু করলো। বললো- তোমার প্রভু কে?

 

ইব্রাহিম- আমার প্রভু তিনি জীবন দান করেন এবং মৃত দান করেন।

 

নমরূদ- আমিও মানুষকে মারতে পারি, আবার জীবিত রাখতে পারি। (নমরূদ মৃত্যুদন্ড দেউয়া দুজন কয়েদীকে এনে একজনকে হত্যা করলো, আর একজনকে ছেড়ে দিলো।)

 

ইব্রাহিম- ‘আমার আল্লাহ্‌ সূর্যকে পূর্বদিক থেকে উঠান, তুমি যদি সত্যি সত্যি প্রভু হয়ে থাকো, তবে সূর্যকে পশ্চিম দিক থেকে উঠাও তো দেখি।’ (সূরা ২ আল বাকারা, আয়াত ২৫৮)

 

একথা শুনে রাজা হতভম্ব, হতবাক ও নিরুত্তর হয়ে গেলো। আল্লাহ্‌ তো যালিমদের পথ দেখান না। এভাবে ইব্রাহীমের যুক্তির কাছে রাজা প্রজা সবাই পরাস্থ হলো। ইব্রাহিম যুক্তির মাধ্যমে মূর্তিকে খোদা মানার অসারতা প্রমান করে দিলেন। চন্দ্র, সূর্য ও নক্ষত্রকে খোদা মানা ভুল প্রমান করে দিলেন। রাজা বাদশাহকে প্রভু মানার ভ্রান্তি স্পষ্ট করে দিলেন। তাঁদের ধর্ম ও সব দেবতাই যে মিথ্যা, সেকথা দিবালোকের মতো স্পষ্ট করে দিলেন। সাথে তিনি তাঁদেরকে এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার আহবান জানালেন। আল্লাহর পয়গাম তিনি তাঁদের কাছে পৌছে দেন।

 

অগ্নীকুন্ডে নিক্ষেপ

 

কিন্তু তারা কিছুতেই ঈমান আনলো না। বরং নৈতিকভাবে ইব্রাহীমের কাছে পরাজিত হয়ে তারা তাঁর উপরে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো। অন্ধ বর্বরতায় মেতে উঠলো তারা। সিদ্ধান্ত নিলো ইব্রাহীমকে হত্যা করার। কিন্তু কিভাবে হত্যা করবে তাঁকে? তারা ফায়সালা করলো বিরাট অগ্নীকুন্ড বানাবে। তারপর তাতে পুড়িয়ে মারবে ইব্রাহীমকে। যে কথা সে কাজ। এক বিরাট অগ্নীকুন্ড বানালো তারা। এটা ছিলো ইব্রাহীমের জন্যে এক বড় পরীক্ষা। আল্লাহও ইব্রাহিমকে বাজিয়ে নিতে চাইলেন। তিনি দেখতে চাইলেন ইব্রাহিম কি জীবন বাঁচানোর জন্যে ঈমান ত্যাগ করে, নাকি ঈমান বাঁচানোর জন্যে জীবন কুরবানী করে? কিন্তু ইব্রাহিম তো অগ্নী পরীক্ষার বিজয়ী বীর। তিনি তো জীবন বাঁচানোর জন্যে কিছুতেই আল্লাহকে এবং আল্লাহর দ্বীনকে ত্যাগ করতে পারেননা। তিনি তো আল্লাহ্‌ এবং আল্লাহর দ্বীনকে জীবনের চাইতে অনেক অনেক বেশী ভালোবাসেন। কাফিররা তাঁকে অগ্নীকুন্ডে নিক্ষেপ করার জন্যে নিয়ে এলো। তিনি তাঁদের কাছে নতো হননি। জীবন ভিক্ষা চাননি। জীবন বাঁচানোর জন্যে নিজের দীন এবং ঈমান ত্যাগ করেননি। তাঁর তেজোদীপ্ত ঈমান তাঁকে বলে দিলো- ইব্রাহিম, জীবন মৃত্যুর মালিক তো তোমার মহান প্রভু আল্লাহ্‌। তাঁর ঈমান তাঁকে বলে দেয়, আল্লাহ্‌ যদি আমার কোন ক্ষতি করতে না চান, তবে গোটা পৃথিবী এক হয়েও তা থেকে আমাকে রক্ষা করতে পারবেনা।

 

নিশ্চিত মনে আল্লাহর উপর ভরসা করে তিনি অগ্নীকুন্ডের দিকে এগিয়ে গেলেন। ওরা তাঁকে নিষ্ঠুরভাবে নিক্ষেপ করলো নিজেদের তৈরি করা নরকে। আল্লাহ্‌ ইব্রাহীমের প্রতি পরম খুশি হয়ে আগুনকে বলে দিলেন- “হে আগুন, ইব্রাহীমের প্রতি সুশীতল এবং শান্তিময় হয়ে যাও।”

 

আগুনের কি সাধ্য আছে সৃষ্টিকর্তার হুকুম অমান্য করার?

 

সুতরাং অগ্নীকুন্ডে ইব্রাহিম সম্পূর্ণ নিরাপদ থেকে গেলেন। আগুন তাঁর কোনই ক্ষতি করলোনা। বরং আল্লাহর হুকুমে সে ইব্রাহীমের সেবায় নিয়োজিত হলো। ইব্রাহীমের জাতি আবার তাঁর কাছে পরাজিত হলো। ইব্রাহিম আবার তাঁদের কাছে প্রমান করে দিলেন, তাঁদের দেবতারা নিজেদের রক্ষা করতেই অক্ষম। আর তিনি যে মহান প্রভুর প্রতি তাঁদের ডাকছেন, তিনি যে কোন ক্ষতি থেকে বান্দাদের রক্ষা করতে সক্ষম। তিনি সর্বশক্তিমান। তিনিই একমাত্র সত্তা যার হুকুম পালন করা উচিত। যার ইবাদাত উপাসনা করা উচিত।

 

হিজরত করেন ইব্রাহিম

 

অগ্নিকুণ্ড থেকে রক্ষা পেয়ে ইব্রাহিম আল্লাহর পথে আসার জন্যে তাঁদেরকে অনেক বুঝান। কিন্তু তারা কিছুতেই নিজেদের পূর্বপুরুষদের ভুল পথ ত্যাগ করতে রাজি হয়নি। বরং ইব্রাহীমের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র পাকাতে থাকে। ইব্রাহিম দেখলেন, এ মানুষগুলোর আর হিদায়াতের পথে আসার সম্ভাবনা নেই। তখন তিনি আল্লাহর হুকুমে হিজরত করার সিদ্ধান্ত নিলেন। নিজের প্রিয় মাতৃভূমি ছেড়ে রওয়ানা করলেন। সাথে ছিলেন স্ত্রী সারাহ আর ভাতিজা লূত। জাতির লোকদের মধ্যে কেবল ভাতিজা লুতই ঈমান এনেছিলেন। প্রিয় জন্মভূমি থেকে হিজরত করেন ইব্রাহিম। এবার তিনি উন্মুক্ত বিশ্বে দাওয়াতী কাজ বিস্তার করা শুরু করেন। মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকতে ডাকতে তিনি সিরিয়ার দিকে যাত্রা করেন। সেখান থেকে চলে যান ফিলিস্তিন এলাকায়। আল্লাহর বার্তা বইয়ে নিয়ে যান তিনি মানুষের দুয়ারে দুয়ারে। দীর্ঘ পথের ভ্রমন, মানুষের বিরোধিতা, অত্যাচার নির্যাতন আর হাজারো রকমের কষ্ট তাঁকে ক্লান্ত করতে পারেনি। তিনি মানুষকে দাওয়াত দিয়েই চলেছেন।

 

এবার তিনি ফিলিস্তি থেকে যাত্রা শুরু করেন মিশরের দিকে। কেবল মানুষকে আল্লাহর দিকে আহবান জানানোর জন্যেই এ মহামানব ঘুরে বেড়ান দেশ থেকে দেশান্তরে। পাড়ি দেন মরু-প্রান্তর, সমুদ্র পাথার। এসব কিছুই করেন তিনি তাঁর মহান প্রভু দয়াময় আল্লাহকে খুশি করার জন্যে। তাইতো জন্মভূমি ত্যাগের সময় প্রশান্ত দীল ইব্রাহিম বলেছিলেন-

 

“আমি আমার প্রভুর উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। তিনিই আমাকে পথ দেখাবেন।” (সূরা ৩৭ আস সাফফাত, আয়াত ৯৯)

 

মিশরে এসে তিনি এখানকার মানুষকে দাওয়াত দিতে থাকেন আল্লাহর দিকে। সাথে তাঁর স্ত্রী সারাহ আর ভাতিজা লুত। মিশরে এসে দেখেন এখানকার বাদশাহ বড়ই স্বৈরাচারী-যালিম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাদশাহ হজরত ইব্রাহিম আর তাঁর স্ত্রীর আল্লাহ ভক্তিতে মুগ্ধ হন এবং ইব্রাহিম ও সারাহর সেবা করার জন্যে নিজ কন্যা হাজেরাকে ইব্রাহীমের নিকট বিয়ে দেন। ইব্রাহীমকে অনেক ধন-দৌলত প্রদান করেন।

 

আবার ফিলিস্তিনে

 

মিশর থেকে ইব্রাহিম (আঃ) আবার ফিরে আসেন ফিলিস্তিনে। এবার ফিলিস্তিনকেই তিনি তাঁর দাওয়াতী কাজের মূল কেন্দ্র বানান। ভাতিজা লুতকে জর্ডান এলাকায় নিজের প্রতিনিধি নিয়োগ করেন। আল্লাহ তায়ালা তাকেও নবুয়ত দান করেন।

 

ইব্রাহীমের মনে বড় দুঃখ, তিনি বৃদ্ধ বয়সে এসে উপনীত হয়েছেন, কিন্তু তাঁর কোন সন্তানাদী নেই। স্ত্রী সারাহ ছিলেন একজন বন্ধ্যা মহিলা। তাঁর কোন সন্তানাদী হতো না। ইব্রাহিম আল্লাহর কাছে দোয়া করেন-

 

“হে প্রভু, আমাকে একটি সৎ সন্তান দান করো।”(সূরা ৩৭ আস সাফফাত, আয়াত ১০০)

 

পরম দয়াময় আল্লাহ্‌ তাঁর দোয়া কবুল করেন। স্ত্রী হাজেরার ঘরে তাঁর এক সুন্দর ফুটফুটে ছেলের জন্ম হয়। তিনি পুত্রের নাম রাখেন ইসমাঈল। বৃদ্ধ বয়সে শিশু পুত্রের হাসিতে তাঁর মন ভরে উঠে। কিন্তু এই পুত্রের ভালবাসা নিয়েও আল্লাহ্‌ তাঁকে পরীক্ষায় ফেলেন। আল্লাহ্‌ তাঁকে বাজিয়ে দেখতে চান, তিনি পুত্রের ভালবাসার চেয়ে আল্লাহর হুকুম পালন করাকে বড় জানেন কী-না? ঈশমাঈলকে মক্কায় রেখে আসার নির্দেশ

 

এবার আল্লাহ্‌ ইসমাঈল আর তাঁর মা হাজেরাকে মক্কার জনমানব ও ফল পানি শস্যহীন মরুভূমিতে রেখে আসার নির্দেশ দেন। কিন্তু ইব্রাহিম যে, আল্লাহকে সবার চেয়ে বেশী ভালবাসেন। তিনি যে জানেন, আল্লাহর হুকুম অমান্য করা যায়না। তাইতো তিনি হাজেরা আর শিশু পুত্র ইসমাঈলকে নিয়ে শত শত মাইল পথ পাড়ি দিয়ে মক্কায় এসে উপস্থিত হন। আল্লাহর ইংগীতে তিনি তাঁদেরকে একটি নির্দিষ্ট স্থানে রেখে আবার ফিলিস্তিন অভিমুখে রওয়ানা করেন। হাজেরাকে বলে যান, আমি আল্লাহর হুকুমে তোমাদেরকে এখানে রেখে গেলাম। হাজেরাকে কিছু খাদ্য ও এক মশক পানি দিয়ে আসেন। প্রশান্ত সমুদ্রের মতো প্রশস্ত হৃদয় আর হিমালয়ের মতো অটল ধৈর্যশীল ইব্রাহিম আল্লাহ্‌ প্রদত্ত পরীক্ষায় বিজয়ী হয়ে ফিরে আসেন ফিলিস্তিনে।

 

আল্লাহর দীনের দাওয়াত নিয়ে ইব্রাহিম ঘুরে বেড়ান ফিলিস্তিন, জর্ডান আর হিজাযের বিভিন্ন এলাকায়। একাজ করাই তাঁর মূল দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালনের ফাকা ফাকে তিনি মক্কায় যান। স্ত্রী পুত্রকে দেখে আসেন। হাটি হাটি পা পা করে ছেলে বড় হয়ে ওঠে। সাথে সাথে ছেলের প্রতি ইব্রাহীমের মহব্বতও উপচে উঠে। ফলে আল্লাহ্‌ ইব্রাহীমকে আবার বাজিয়ে নিতে চান।

 

পুত্র কুরবানীর হুকুম

 

ইসমাঈলের এখন বুঝ বুদ্ধি হয়েছে। ইব্রাহীমের সাথে এখন পুত্র ইসমাঈল ঘরে বাইরে যাতায়াত করেন। পিতা যদি বৃদ্ধ বয়সে উদীয়মান কিশোর পুত্রকে নিজের সাহায্যকারী হিসেবে পান, তবে তাঁর প্রতি যে পিতার মহব্বত কতটা বেড়ে যায়, তা ভাষায় প্রকাশ করা যায়না। ঠিক এমনই এক সময়ে আল্লাহ্‌ পাক ইব্রাহীমকে স্বপ্নে ইসমাঈলকে কুরবানী করার নির্দেশ প্রদান করেন। বলে দেন, ‘ইব্রাহিম, তোমার প্রিয়তম পুত্রকে কুরবানী করো।’ আল্লাহর হুকুম লংঘন করা যায়না। তাঁর হুকুম পালন করা অবধারিত।

 

পুত্রের প্রতি ভালোবাসার বন্ধন ইব্রাহীমকে আল্লাহর হুকুম পালন করা থেকে বিরত রাখতে পারেনা। তিনি পুত্রকে ডেকে নিয়ে জানালেন- ‘পুত্রয়ামার, আল্লাহ্‌ আমাকে স্বপ্নে হুকুম করেছেন তোমাকে কুরবানী করার জন্যে। এ ব্যাপারে তোমার মতামত কি? ’

 

‘যেমন বাপ, তেমন ছেলে।’ উর্দু ভাষায় বলা হয় ‘বাপকা বেটা’।   আর আরবী ভাষায় বলা হয় ‘হওয়া ইবনু আবিহী’। কথাটি যেন ইসমাঈলের জন্যে একশো পারসেন্ট প্রযোজ্য। আল্লাহর হুকুমের কাছে তিনি পিতার মতই নুইয়ে দিলেন মাথা। বললেন- ‘আব্বু, আল্লাহর হুকুম কার্যকর করুন। ইনশা’য়াল্লাহ আপনি আমাকে অটল ধৈর্যশীল পাবেন।’ দয়া ও করুনার সাগর মহান আল্লাহ্‌ তো তাঁদের পিতা পুত্র দু’জনের কথা শুনছিলেন। এসময় তাঁদের প্রতি যে তাঁর মহব্বত ও রহমতের স্রোতধারা কিভাবে বইয়ে আসছিলো তা একমাত্র তিনিই জানেন। প্রভু রহমান এ সময়টির কথা নিজ ভাষায় এভাবে বর্ণনা করেন-

 

“ওরা দু’জনেই যখন আমার হুকুমের কাছে মাথা নত করে দিলো আর ইব্রাহিম পুত্রকে (জবাই করার জন্য) উপুড় করে শুইয়ে দিলো, তখন আমি তাঁকে ডাক দিয়ে বললাম, ইব্রাহিম তুমি স্বপ্নে দেখা তুমি স্বপ্নে দেখা হুকুমকে সত্যে পরিনত করে দেখালে পুণ্যবানদের এভাবেই আমি প্রতিফল দান করি। এটা ছিলো একটা বিরাট পরীক্ষা। অতঃপর একটি বড় কুরবানীর বিনিময়ে আমি তাঁর পুত্রটিকে ছাড়িয়ে নিলাম। আর পরবর্তী লোকদের মাঝে একথা স্থায়ী করে দিলাম যে, ইব্রাহীমের উপর শান্তি বর্ষিত হোক।” (সূরা ৩৭ আস সাফফাত, আয়াত ১০৩-১০৯)

 

ব্যাপারতো বুঝতেই পেরেছেন। বাপ ছেলে দুজনই আল্লাহর হুকুম পালন করার জন্যে তৈরি হয়ে গেলেন। ইব্রাহিম পুত্রকে কুরবানী করার জন্যে উপুড় করে শুইয়ে দিলেন। চোখ বন্ধ করে পুত্রের গলায় ছুরি চালিয়ে দিতে উদ্যত হলেন। ঠিক এমনই সময় তাঁর প্রিয়তম প্রভু ডাক দিয়ে বললেন- ইব্রাহিম থামো, তুমি আমার হুকুম পালন করেছো বলে প্রমান দিয়েছ। ইব্রাহিম চোখ খুলে দেখলেন সামনে একটি দুম্বা দাড়িয়ে আছে। আল্লাহ্‌ বলে দিলেন পুত্রের পরিবর্তে এবার এই দুম্বাটিকে কুরবানী করে দাও। আর তোমার এই কুরবানী হবে বিরাট এক ঐতিহাসিক কুরবানী।

 

এবার ইব্রাহিম দুম্বাটিকে যবেহ করে দিলেন। প্রিয় পুত্রকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। আল্লাহ্‌ ইব্রাহীমের ঐ বিরাট কুরবানীকে চির স্মরণীয় করে রাখার জন্যে মুসলিমদের মাঝে প্রতি বছর কুরবানী করার নিয়ম চালু করে দিলেন। আজো আমরা ইব্রাহিম (আঃ) এর সেই মহান কুরবানীর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রতি বছর ঐ তারিখে পশু কুরবানী করি। এভাবেই আল্লাহ্‌ ইব্রাহীমকে বানিয়েছেন কালের সাক্ষী এক মহাপুরুষ।

 

এই চরম পরীক্ষাটিতেও ইব্রাহিম যখন উত্তীর্ণ হলেন, তখন আল্লাহ্‌ একদিকে তাঁকে নিজের খলিল বা বন্ধু বানিয়ে নিলেন। আল কুরআনে তাঁর নেতৃত্বের বিষয়টি এভাবে তুলে ধরা হয়েছে –

 

“স্মরণ করো সেই সময়ের কথা, যখন ইব্রাহীমকে তাঁর প্রভু বেশ কয়েকটি বিষয়ে পরীক্ষা করলেন আর সব ক’টিতেই সে উত্তীর্ণ হলো, তখন তিনি তাঁকে বললেন- আমি তোমাকে সন মানুষের নেতা বানাতে চাই। ইব্রাহিম জানতে চাইলো- এই প্রতিশ্রুতি কি আমার সন্তানদের ব্যাপারেও প্রযোজ্য হবে? তিনি বললেন- আমার প্রতিশ্রুতি যালিমদের ব্যাপারে প্রযোজ্য হবেনা। (সূরা ২ আল বাকারা আয়াত ১২৪)

 

এটাই আল্লাহর নীতি। তিনি কাউকেও বড় কোন দায়িত্ব ও নেতৃত্ব দিতে চাইলে তাঁকে ভালোভাবে বাজিয়ে নেন। সব পরীক্ষায় বিজয়ী হওয়ার পরে তিনি ইব্রাহীমকে শুধু নেতৃত্বই দেননি, সেই সাথে বৃদ্ধ বন্ধ্যা স্ত্রী সারাহর ঘরেও একটি পুত্র সন্তান দান করেন। তাঁর নাম ইসহাক। শুধু তাই নয় মহান আল্লাহ্‌ তাঁর দুই ছেলেকেই নবী মনোনীত করেন।

 

আল্লাহর কুদরত দর্শন

 

ইব্রাহিম (আঃ) এর প্রতি আল্লাহর এতো বড় অনুগ্রহের কারন কি? তা হলো, আল্লাহর প্রতি তাঁর পরম আস্থা ও প্রত্যয়। মহান আল্লাহ্‌ তাঁকে আসমান ও যমীনের সমস্ত নিদর্শন দেখিয়ে দিয়েছিলেন। সে কারনেই তাঁর মধ্যে সৃষ্টি হয় আল্লাহর প্রতি মজবুত ও অটল প্রত্যয়। আল্লাহর প্রতি নিজের পরম আস্থাকে আরো মজবুত করে নেবার জন্যে তিনি আল্লাহর কাছে একটা আবদার করেন। সে আবদারটি কুরআনের বর্ণনায় শুনুন-

 

“সে ঘটনাটি স্মরণ করো, যখন ইব্রাহিম বলেছিল, আমার প্রভু, তুমি কেমন করে মৃত্যুকে জীবিত করো আমাকে একটু চোখের সামনে দেখিয়ে দাও। তিনি বললেন- তুমি কি তা বিশ্বাস করোনা? ইব্রাহিম বললো- অবশ্যি বিশ্বাস করি, তবে আমার মনের সান্ত্বনার জন্যে নিজের চোখে দেখতে চাই। তিনি বললেন- তবে তুমি চারটি পাখি ধরো। সেগুলোকে নিজের কাছে ভালোভাবে পোষ মানিয়ে নাও। তারপর সেগুলিকে (যবাই করে) সেগুলোর একেকটি অংশ একেক পাহাড়ে রেঝে এসো। অতঃপর তুমি ওদের ডাকো। দেখবে ওরা তোমার কাছে দৌড়ে আসবে। জেনে রাখো, আল্লাহ্‌ বড় ক্ষমতাশীল মহাবিজ্ঞানী।” (সূরা ২ আল বাকারা আয়াত ২৬০)

 

কুরআনের বিবরন থেকে ঘটনাটি নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন। ইব্রাহিম পাখিগুলোকে টুকরো টুকরো করে বিভিন্ন পাহাড়ে রেখে এসে ওদেরকে ডাক দেন। সাথে সাথে ওরা জীবিত হয়ে ইব্রাহীমের কাছে উড়ে আসে। আল্লাহ্‌ তাঁকে চাক্ষুস দেখিয়ে দিলেন, তিনি কিভাবে মৃতকে জীবিত করতে পারেন। এভাবেই আল্লাহ্‌ কিয়ামতের দিন সব মানুষকে জীবিত করবেন এবং সবাই হাশরের ময়দানে দৌড়ে এসে একত্রিত হবে। বিষয়টি ইব্রাহিম স্বচক্ষে দেখে পরম প্রত্যয় ও প্রশান্তি লাভ করেন।

 

কা’বা ঘর নির্মাণ

 

এবার আল্লাহ্‌ তাঁর প্রিয় ইব্রাহীমকে আরেকটি বিরাট দায়িত্ব অর্পণ করেন। তিনি তাঁকে কা’বা ঘর নির্মাণের নির্দেশ প্রদান করেন। কোন জায়গাটিতে কা’বা ঘর নির্মাণ করতে হবে, তাও তিনি বলে দেন। সেই জায়গাটি তো এখন আমাদের সকলেরই জানা। কা’বা ঘর নির্মাণ করেছিলেন ইব্রাহিম (আঃ) পুত্র ইসমাঈলকে সাথে নিয়ে। এটিতো সেই জায়গা যেখানে তিনি রেখে এসেছিলেন শিশু পুত্র ইসমাঈল আর তাঁর মা হাজেরাকে। এটি তো সেই স্থান, যার পাশে মিনাতেই কুরবানী করতে গিয়েছিলেন প্রিয়তম পুত্র ইসমাঈলকে। আল্লাহর নির্দেশে পিতা-পুত্র দু’জনে মিলে নিপুন কারিগরের মতো কা’বার ভীত উঠালেন। তারপর নির্মাণ সম্পন্ন করলেন আল্লাহর ঘর কা’বা ঘরের। এ সময় দু’জনেই দয়াময় রহমানের দরবারে দোয়া করলেন-

 

“আমাদের প্রভু, তুমি আমাদের এই কাজ কবুল করো। তুমিতো সবই শোন এবং সবই জানো। প্রভু, আমাদেরকে তোমার অনুগত রাখো। আমাদের বংশ থেকে তোমার অনুগত একটি উম্মত সৃষ্টি করে দাও। তোমার হুকুম পালন করার নিয়ম আমাদের জানিয়ে দাও। আমাদের ভুলত্রুটি ক্ষমা করে দাও। তুমি তো মহাক্ষমাশীল দয়াবান। আমাদের প্রভু, এদের মধ্য থেকেই এদের মাঝে একজন রাসুল পাঠিয়ো----।” (সূরা ২ আল বাকারা আয়াত ১২৮-১২৯)

 

মহান আল্লাহ্‌ ইব্রাহীমের তৈরি ঘরকে নিজের ঘর বলে ঘোষণা দিলেন। এ ঘরকে তিনি চিরদিন বাঁচিয়ে রাখলেন। তিনি ইব্রাহীমকে বলে দিলেন-

 

“এই ঘরে হজ্জ পালন করার জন্যে মানুষকে সাধারনভাবে অনুমতি দিয়ে দাও। মানুষ বহু দূর দুরান্ত থেকে পায়ে হেঁটে উটে চড়ে তোমার কাছে আসবে। ---এই প্রাচীনতম ঘরের তাওয়াফ করবে।” (সূরা আল হাজ্জ আয়াত ২৭-২৯)

 

এভাবে মহান আল্লাহ্‌ ইব্রাহিম (আঃ) এর কীর্তিসমূহকে চির স্মরণীয় করে রাখলেন। তাঁর নির্মাণ করা ঘরকে কেন্দ্র করে হজ্জ, তাওয়াফ ও কুরবানীর নিয়ম চিরস্থায়ী করে দিলেন। এই মহান ঘর ও ঘরের কাছে রেখে যাওয়া নিজ পরিবারের জন্যে তিনি আল্লাহর কাছে দোয়া করেছিলেন-

 

“প্রভু, এই শহরকে শান্তি ও নিরাপত্তার শহর বানাও। আমার প্রভু, আমার সন্তানদের একটি অংশকে তোমার এই মহাসম্মানিত ঘরের কাছে এনে পুনর্বাসিত করেছি। এটাতো পানি ও তরুলতাশুন্য এক মরু প্রান্তর। প্রভু, ওদের এখানে রেখেছি যেন, এরা সালাত কায়েম করে। সুতরাং তুমি ওদের প্রতি মানুষের মনকে অনুরক্ত বানিয়ে দাও। শোকর সেই মহান আল্লাহর, যিনি এই বৃদ্ধ বয়সে আমাকে দুটি সন্তান ইসমাঈল ও ইসহাককে দান করেছেন। প্রভু, আমাকে এবং আমার সন্তানদেরকে সালাত কায়েমকারী বানাও।” (সূরা ১৪ ইব্রাহিমঃ আয়াত ৩৫-৪০)

 

কুরআনে হজরত ইবরাহীমের প্রশংসনীয় গুনাবলী

 

মহান আল্লাহ্‌ তাঁর কিতাব আল কুরআনে ইব্রাহিম (আঃ) এর গুনবৈশিষ্টের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। এখানে আমরা কয়েকটি উল্লেখ করলাম-

 

১। “পৃথিবীর কাজের জন্যে আমি ইব্রাহীমকে বাছাই করেছিলাম।”

 

২। “তাঁর প্রভু যখন বললেন- ‘আত্মসমর্পণ করো’। সে বললো- ‘সারা জাহানের প্রভুর নিকট আমি আত্মসমর্পণ করলাম।’’

 

৩। “সে বললো- পুত্র আমার, মৃত্যু পর্যন্ত আলালহর কাছে আত্মসমর্পিত থাকো।”

 

৪। “তোমরা খাটিভাবে ইবরাহীমের পথ অনুসরন করো।”

 

৫। “আল্লাহ্‌ ইব্রাহীমকে তাঁর বন্ধু বানিয়েছেন।”

 

৬। “আমি ইব্রাহীমকে আসমান ও যমীনের সমস্ত নিদর্শন দেখিয়েছি।”

 

৭। “সে বললো- আমি আসমান ও যমীনের স্রষ্টার দিকে মুখ ফিরালাম।”

 

৮। “ইব্রাহিম ছিলো বড়ই ধৈর্যশীল কোমল হৃদয় ও আমার প্রতি অনুরক্ত।”

 

৯। “ইব্রাহিম নিজেই ছিলো একটি উম্মাহ। সে একমুখী হয়ে আল্লাহর অনুগত ছিল।”

 

১০। “আল্লাহর অনুগ্রহরাজির প্রতি সে ছিলো শোকরগুজার। তিনি তাঁকে পছন্দ করেছেন এবং সঠিক পথে পরিচালিত করেছেন।”

 

১১। “ইব্রাহিম ছিলো এক অতি সত্যবাদী মানুষ এবং নবী। ”

 

১২। “ইব্রাহীমকে আমি সতর্কবুদ্ধি ও জ্ঞান দান করেছি।”

 

১৩।“আমি বললাম- হে আগুন, তুমি ইবরাহীমের প্রতি সুশীতল, শান্তিময় ও নিরাপদ হয়ে যাও।”

 

১৪। “আমি ডেকে বললাম- হে ইব্রাহিম, তুমি স্বপ্নে দেখা হুকুমকে সত্যে পরিনত করেছো।”

 

১৫। “তোমাদের জন্যে উত্তম আদর্শ রয়েছে ইবরাহীমের মধ্যে-----।”

 

জেনে নিন

 

এবার কয়েকটি তথ্য জেনে নিন। সেগুলো হলো- কুরআন মাজীদে ইবরাহীমের নাম উচ্চারিত হয়েছে ৬৯ বার। যেসব সুরাতে ইব্রাহিম (আঃ) সম্পর্কে আলোচনা হয়েছে- সূরা আল বাকারা, আন নিসা, আন-আম, তাওবা, হুদ, ইব্রাহিম, হিজর, আন নাহল, মরিয়ম, আম্বিয়া, আল হাজ্জ, শোয়ারা, আন কাবুত, সাফফাত, যুখরুফ, যারিয়াত, মুমতাহিনা।

 

 

 

৭।

 

জর্ডান অঞ্চলের নবী লুত

 

(আঃ)

 

হজরত লুতের পরিচয়

 

হজরত লুত (আঃ) আল্লাহর এক সম্মানিত নবী। তিনি সেই সব নবীদের একজন, যাদের জাতি ঈমান আনেনি। হজরত লুতের জাতি যে কেবল ঈমান আনেনি, তা নয়, বরং তাঁর জাতির লোকেরা ছিলো সেকালের সবচেয়ে পাপিষ্ঠ লোক। হজরত লুত (আঃ) সেইসব নবীদেরও একজন, যাদের জাতিকে আল্লাহ্‌ ইসলামের বিরোধিতা করার কারনে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। হজরত নূহ, হজরত সালেহ ও হজরত হুদ (আঃ) এর জাতির মতোই লুত (আঃ) এর জাতিকেও আল্লাহ্‌ পাক ধ্বংস করে দিয়েছিলেন।

 

হজরত লুত (আঃ) ছিলেন মহান নবী হজরত ইব্রাহিম (আঃ) এর ভাতিজা। হজরত ইব্রাহিম (আঃ) যখন নিজ দেশ ইরাকে ইসলাম প্রচার করছিলেন, তখন সেখানে মাত্র দু’জন লোক ঈমান এনেছিলেন। এদের একজন ছিলেন হজরত ইব্রাহিম (আঃ) এর স্ত্রী সারাহ আর অন্নজন ছিলেন তাঁর ভাতিজা হজরত লুত (আঃ)। তিনি যখন ইরাক থেকে হিজরত করতে বাধ্য হন, তখন কেবল এ দু’জনই তাঁর হিজরতের সাথী হন।

 

হিজরত ও নবুয়্যত লাভ

 

রাজা নমরূদের অত্যাচারে যখন নিজ দেশে ইসলাম প্রচার করা অসম্ভব হয়ে পড়ে, তখন লুত চাচা ইব্রাহিম (আঃ) এর সাথে দেশ ত্যাগ করেন। চাচার সাথে দীন প্রচারের কাজে তিনি ফিলিস্তিন, সিরিয়া হয়ে আফ্রিকার মিশরে পাড়ি জমান। মহান নবী হজরত ইব্রাহীমের ইসলাম প্রচারের সাথী হিসেবে লুত অগাধ জ্ঞান ও প্রশিক্ষন লাভ করেন। ফলে আল্লাহ্‌ তায়ালা তাকেও নবুয়্যত দান করেন এবং জর্ডান এলাকায় একটি পাপিষ্ঠ জাতির কাছে ইসলাম প্রচারের গুরু দায়িত্বে নিযুক্ত করেন।

 

কোন সে জাতি?

 

কোন সে জাতি? যার কাছে ইসলাম প্রচারের দায়িত্ব অর্পিত হয় হজরত লুত (আঃ) এর উপর? কুরআনে এদেরকে ‘কওমে লুত বা লুতের জাতি’ বলা হয়েছে। এ জাতি যে অঞ্চলে বাস করতো, বর্তমানে সে অঞ্চলের নাম ট্রান্স জর্ডান। এ জায়গাটি ইরাক ও ফিলিস্তিনের মাঝামাঝি অবস্থিত। সেকালে এ জাতির প্রধান শহরের নাম ছিলো সাদুম। এছাড়াও তাঁদের আরো অনেকগুলো শহর ছিলো। চরম পাপাচারের কারনে আল্লাহ্‌ তায়ালা তাঁদেরকে ধ্বংস করে দেন। তাঁদের শহরগুলোকে তলিয়ে দেন। বর্তমানে যাকে লুত সাগর বা Dead Sea (মৃত সাগর) বলা হয়, তাঁদের শহরগুলো তলিয়ে এতেই মিশে গিয়েছিলো। লুত সাগরের পূর্ব-দক্ষিন অঞ্চলে আজো তাঁদের ধ্বংসাবশেষ বিদ্যমান আছে। হজরত ইব্রাহীম (আঃ) এর প্রতিনিধি হিসেবে এ এলাকাতেই হজরত লুত (আঃ) ইসলাম প্রচারের কাজে আত্মনিয়োগ করেন।

 

লুত জাতির পাপাচার

 

লুত (আঃ) এর জাতির মতো পাপিষ্ঠ জাতি খুব কমই ছিলো। তাঁদের চরিত্র এতো খারাপ ছিলো, যা ভাষায় প্রকাশ করা যায়না। তারা ছিলো সমকামী। তারা প্রকাশ্যে অশ্লীল কাজ এবং জনসমাবেশে কুকর্মে লিপ্ত হতো। ডাকাতি-রাহাজানি ছিলো, তাঁদের নিত্য দিনের কাজ।

 

তাঁদের এলাকায় কোন ভালো মানুষ এসে নিরাপদে ফিরে যেতে পারতোনা। কোনো ব্যাবসায়ী বণিক তাঁদের এলাকায় গেলে সব কিছু খুইয়ে আসতে হতো। তাঁদের মধ্যে সামান্যতম লজ্জা শরম পর্যন্ত ছিলোনা। তাঁদের মাঝে একজন সৎ লোকও ছিলোনা, যে পাপ কাজে বাধা দেবে। এমন একটি প্রানিও ছিলোনা, যে পাপকে ঘৃণা করতো। এমন একজন লোকও ছিলোনা, যে কোন অন্যায় কাজের প্রতিবাদ করতো।

 

হজরত লুতের আহবান

 

এই পাপিষ্ঠ লোকদের সত্য পথ দেখানোর জন্যেই মহান আল্লাহ্‌ হজরত লুত (আঃ) কে পাঠালেন। তিনি এসে তাঁদেরকে আল্লাহর দিকে ডাকলেন। মহান আল্লাহকে ভয় করতে বললেন, কুরআনের ভাষায়-

 

“লুতের জাতি রাসুলদেরকে অস্বীকার করেছিলো। লুত তাঁদের বলেছিল, তোমরা কি আল্লাহকে ভয় করবেনা? আমি তোমাদের জন্যে একজন বিশ্বস্ত রাসুল। সুতরাং তোমরা আল্লাহকে ভয় করো আর আমার কথা মেনে নাও।”

 

আল্লাহর পরম ধৈর্যশীল নবী তাঁদের আরো বললেন-

 

“তোমরা এমন পাপাচার করছো, যা তোমাদের আগে কোন জাতি করেনি। তোমরা একটি সীমালংঘনকারী জাতি।” (সূরা ৭ আল আরাফঃ আয়াত ৮০)

 

তিনি তাঁদের বলেছিলেন-

 

“কেন তোমরা নরদের সাথে নোংরা কাজ করো? কেন দাকাতি-রাহাজানি করো? আর জনসমাবেশে কুকাজে লিপ্ত হও।”

 

এভাবে লুত (আঃ) দীর্ঘদিন ধরে তাঁদের অনেক উপদেশ দিলেন, আল্লাহর পথে আসতে বললেন। পাপাচার থেকে বিরত হতে বললেন। কুকর্মের প্রতিবাদ করলেন। কিন্তু তাঁদের একটি লোকও উপদেশ গ্রহন করলোনা। বরং-------

 

হজরত লুতের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ

 

হ্যাঁ, ওরা হযরত লুতের উপদেশ তো গ্রহন করলোই না, সৎ পথে তো এলোই না, বরং হযরত লুতের সংশোধন কাজের বিরুদ্ধে গড়ে তুললো বিরাট প্রতিরোধ। কেউ তাঁদের ভালো হবার কথা বলুক এটা তারা সহ্য করতে পারতো না। পাপ কাজ ত্যাগ করার কথা তারা শুনতে পারতোনা। ফলে হযরত লুত (আঃ) এর বিরামহীন সংশোধন প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে তারা ক্ষেপে উঠলো। হযরত লুত যে তাঁদেরকে আল্লাহর আযাবের ভয় দেখিয়েছেন এর জবাবে তারা প্রথমে হযরত লুতকে বললো- আমরা তো তোমাকে আর তোমার খোদাকে প্রত্যাখ্যান করেছি। কই তোমার খোদার আযাব? তুমি যদি সত্যি খোদার নবী হতে তবে তো আল্লাহর আযাব এনে দেখাতে পারতে। তারা আল্লাহর নবী হযরত লুতকে শাসিয়ে বললো-

 

“লুত, যদি তুমি তোমার সংশোধন কাজ থেকে বিরত না হও, তবে তোমাকে অবশ্যই আমাদের দেশ থেকে বের করে দেব।” (সূরা ২৬ আশ-শোয়ারা, আয়াত ৬৭)

 

কিন্তু আল্লাহর কোন নবী তো আল্লাহর দ্বীন প্রচারের কাজে বিরত থাকতে পারেননা। মানুষকে সৎ পথে ডাকার ও সংশোধন করার কাজ থেকে বিরত হতে পারেননা। হযরত লুত তাঁর মিশন চালিয়ে যেতে থাকলেন। অবশেষে তারা আল্লাহর নবীর বিরুদ্ধে চরম সিদ্ধান্ত নিলো। নেতারা জনগণকে বললো –

 

“এই লুত আর তাঁর পরিবার পরিজনকে দেশ থেকে বের করে দাও। ওরা বড় পবিত্র লোক।”

 

এলো ধ্বংসের ফেরেস্তারা

 

আল্লাহর নবী হযরত লুত (আঃ) এর পুত পবিত্রতা নিয়ে ওরা যখন তিরস্কার করতে থাকলো, আর তাঁকে দেশ থেকে বের করে দেবার ষড়যন্ত্র পাকাপোক্ত করতে থাকলো, তখন সর্বশক্তিমান আল্লাহ্‌ ঐ জাতিটিকে পৃথিবীর বুক থেকে নির্মূল করার সিদ্ধান্ত নিলেন। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্যে ফেরেস্তা পাঠিয়ে দিলেন। ফেরেস্তারা প্রথমে হযরত ইব্রাহীমের কাছে এলো। তাঁর স্ত্রী সারাহর ঘরে তাঁর একটি পুত্র সন্তান হবার সুসংবাদ দিলো। বিদায় নেয়ার সময় ইব্রাহিম তাঁদের জিজ্ঞেস করলেন-

 

“হে দুতেরা, আপনারা কি কোন অভিযানে এসেছেন?

 

-হ্যাঁ, আমরা ঐ অঞ্চলকে (সাদুম) ধ্বংস করে দিতে এসেছি। আমাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে তাঁদেরকে পাথর মেরে ধংস করে দিতে। আপনার মহান প্রভু আল্লাহর পক্ষ থেকে পাথরে চিহ্ন লাগিয়ে দেয়া হয়েছে।

 

ইব্রাহিম বললেন- সেখানে তো লুত আছে, তাঁর কি উপায় হবে?

 

 ফেরেস্তারা বললেন- আমরা জানি সেখানে কারা আছে? লুত আর তাঁর পরিজনকে নিরাপদ রাখা হবে। অতপর ফেরেস্তারা সে এলাকায় চলে এলেন সুস্রী মানুষের বেশ ধরে। এসে হযরত লুতের ঘরে উঠলেন। লুত তাঁদের চিনতে পারেননি। বললেন- আপনাদের তো চিনতে পারছি না।

 

তারা বললো- আমরা আপনার কাছে এসেছি। এই লোকেরা যেই বিষয়ে সন্দেহ করছে আমরা সে বিষয়ে ফায়সালা করতে এসেছি। এতোক্ষনে হযরত লুতের বাড়িতে নতুন মেহমানদের আসার খবর পেয়ে গেছে শহরের সব মন্দ লোকেরা। বদমাশ লোকগুলো দৌড়ে এলো মেহমানদের সাথে খারাপ কাজ করার মতলবে। লুত তাঁদের বাধা দিলেন। আফসোস করে বললেন- তোমাদের মাঝে কি একজন ভালো মানুষও নেই?

 

ফেরেস্তারা হযরত লুতকে কানে কানে বলে দিলেন, আমরা আল্লাহর দূত ফেরেস্তা। এরা আমাদের কোনই ক্ষতি করতে পারবেনা। রাতের একটি অংশ পার হয়ে গেলে আপনি আপনার পরিবার- পরিজনকে নিয়ে এই এলাকা ত্যাগ করে চলে যাবেন। ওদের ধ্বংসের নির্ধারিত সময়টি হলো ভোর। ভোর তো ঘনিয়ে এলো। তারপর ক হলো? তারপর ভোর হয়ে এলো। ভোর হবার আগেই আল্লাহর নির্দেশে হযরত লুত এলাকা ছেড়ে চলে গেলেন। এদিকে ফেরেস্তারা গোটা এলাকার জমিনকে সম্পূর্ণ ওলট-পালট করে দিলেন। অবিরাম পাথর নিক্ষেপ করে সব কিছু ধ্বংস করে দিলেন। তাঁদের একটি লোককেও বাঁচিয়ে রাখা হলোনা। বিরান করে দেয়া হলো সবকিছু। সম্পূর্ণ বিনাশ হয়ে গেলো পাপিষ্ঠ জাতি। মহান আল্লাহ্‌ বলেন-

 

“আমি তাঁদের প্রচন্ড বর্ষণের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিলাম। সতর্ক করার পরও যারা সংশোধন হয়না, তাঁদের উপর এমন নিকৃষ্ট বর্ষণই করা হয়ে থাকে।”

 

নবীর দুর্ভাগা স্ত্রী

 

যারা ধ্বংস হয়েছে, তাঁদের সাথে হযরত লুত (আঃ) এর স্ত্রীও রয়েছেন। ইনি নবীর স্ত্রী হয়েও কুফরির পক্ষ ত্যাগ করেননি। নবীকে তাঁর দায়িত্ব পালনে সহযোগিতা করেননি। ফলে আল্লাহ্‌ তায়ালা কাফিরদের সাথে তাকেও ধ্বংস করে দেন। হযরত লুত যখন রাতে ঐ এলাকা ত্যাগ করেন, তখন তাঁর এই স্ত্রী তাঁর সাথে যাননি। কাফিরদের সাথে থেকে যান এবং আল্লাহর গযবে নিপতিত হয়ে ধ্বংস হয়ে যান। আল্লাহ্‌ বলেন-

 

“আমি লুত আর তাঁর পরিবার-পরিজনকে সেই ধ্বংস থেকে বাঁচালাম। তবে তাঁর বৃদ্ধা (স্ত্রী) কাফিরদের সাথে রয়ে গেলো। আর আমি তাঁদের সম্পূর্ণ ধংস করে দিলাম। ”

 

আল কুরআনের অন্য এক স্থানে মহান আল্লাহ্‌ বলেন-

 

“আল্লাহ্‌ কাফিরদের উপমা বানিয়েছেন নূহ আর লুতের স্ত্রীকে। তারা দু’জন আমার দুই নেক বান্দার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ ছিলো। কিন্তু তারা তাঁদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে। স্বামী নবী হয়েও আল্লাহর আযাব থেকে তাঁদের বাচাবার ব্যাপারে উপকারে আসলো না। তাঁদের নির্দেশ দেয়া হলো- দোযখীদের সাথে প্রবেশ করো দোযখে।” (সূরা ৬৬ আত তাহরিম। আয়াত ১০)

 

লুত জাতি কেন ধ্বংস হলো?

 

হযরত লুত (আঃ) এর জাতিকে আল্লাহ্‌ পাক কেন সমূলে ধংস করলেন? কারন, তারা-

 

১। আল্লাহর নবীকে অস্বীকার করেছিলো।

 

২। চরম অস্লীলতা ও নির্লজ্জতার মাঝে নিমজ্জিত হয়েছিলো।

 

৩। নিকৃষ্ট ধরনের পাপ কাজে (সমকামিতায়) ডুবে গিয়েছিল।

 

৪। ডাকাতি, রাহাজানি ও লুণ্ঠনের রাজত্ব গড়ে তুলেছিল।

 

৫। চরম কৃপণতা ও নিষ্ঠুরতা তাঁদের স্বভাবে পরিনত হয়েছিল।

 

৬। পুত পবিত্র জীবন যাপনকে তারা বিদ্রূপ ও ব্যাঙ্গ করতো।

 

৭। তারা নবীকে দেশ থেকে বের করে দেবার ষড়যন্ত্র করেছিলো।

 

৮। নবীকে বিদ্রূপ করে আল্লাহর আযাব আসার দাবী করেছিলো।

 

কুরআনে লুত (আঃ)

 

আল্লাহ্‌ তায়ালা আল কুরআনে ঘোষণা দিয়েছেন- “আমি ইসমাঈল, ইউশা, ইউনুস এবং লুতকে গোটা জগতবাসীর উপর মর্যাদা দান করেছি।’ সত্যিই মহান আল্লাহ্‌ তাঁর এই নবীকে বিরাট মর্যাদা দিয়েছেন। কুরআন মাজীদে লুত নামটি ২৭ বার উচ্চারিত হয়েছে। যেসব সুরায় উল্লেখ হয়েছে, সেগুলো বলে দিচ্ছি- আনআম-৮৬, আ’রাফ-৮০, হুদ-৭০,৭৪,৭৭,৮১, হিজর- ৫৯,৬১, আম্বিয়া- ৭১,৭৪, হাজ্জ-৪৩, শোয়ারা- ১৬০,১৬১,১৬৭, আন নামল-৫৪,৫৬, আনকাবুত- ২৬,২৭,৩২,৩, সাফফাত- ১৩৩, সয়াদ-১৩, কাফ-১৩, আল কামার- ৩৩,৩৪, আত তাহরিম-১০।

 

 

 

৮।

 

কুরবানীর নবী ইসমাঈল

 

(আঃ)

 

“এ কিতাবে ইসমাঈলকেও স্মরণ করো। সে ছিলো প্রতিশ্রুতি পালনকারী। ছিল একজন রাসূল ও নবী। সে তাঁর লোকজনকে সালাত ও যাকাতের নির্দেশ দিতো। আর সে ছিলো তাঁর প্রভুর অবারিত সন্তোষ প্রাপ্ত।” – (আল কুরআন ১৯- ৫৪,৫৫)

 

কে এই ইসমাঈল?

 

আল্লাহর অবারিত সন্তোষ প্রাপ্ত এই মানুষটি কে? কী তাঁর পরিচয়? কেনইবা আল্লাহ্‌ তাঁর উপর নিজ সন্তোষের দুয়ার খুলে দিয়েছেন? হ্যাঁ, আসুন আমরা তাঁকে জানি, খুজে দেখি আল্লাহর কিতাবে তাঁর কি পরিচয় দেয়া হয়েছে?

 

ইনি হলেন বিশ্বনেতা আল্লাহর নবী ইব্রাহিম (আঃ) এর পুত্র। তাঁর মায়ের নাম হাজেরা। ফিলিস্তিনে জন্মগ্রহন করেন। পরে মক্কায় মায়ের কোলে লালিত- পালিত হন। একটু বড় হলে আল্লাহ্‌ তাঁর পিতাকে নির্দেশ দেন তাঁকে কুরবানী করবার জন্যে। পিতার মতই তিনি আল্লাহর হুকুমের কাছে মাথা নত করে দেন।

 

এরপর তিনি পিতা ইব্রাহিম (আঃ) এর সাথে কা’বা ঘর নির্মাণ করেন। আল্লাহ্‌ তাঁকে নবয়্যত দান করেন। তিনি আরবের হিজাযে সালাত এবং যাকাত ভিত্তিক একটি সুন্দর সমাজ নির্মাণ করেন। ইনিই হলেন মহান আল্লাহর অবারিত সন্তোষ লাভকারী নবী হজরত ইসমাঈল (আঃ)।

 

মায়ের সাথে মক্কায় এলেন

 

ইব্রাহিম (আঃ) এর ছিলেন দু’জন স্ত্রী। বড়জন সারাহ আর ছোটজন হাজেরা। সারাহ বুড়ি হয়ে গেছেন, এখনো তাঁর কোন ছেলেমেয়ে হয়নি। কিন্তু আল্লাহ্‌ হাজেরাকে চাঁদের মতো ফুটফুটে একটি ছেলে দান করেন। বুড়ো বয়েসে ছেলে পেয়ে ইব্রাহীমের যে কি আনন্দ তা কি আর ভাষায় প্রকাশ করা যায়? তিনি ছেলের নাম রাখেন ইসমাঈল।

 

কিন্তু আল্লাহ্‌ ইব্রাহীমকে নিজের বন্ধু বানাবার জন্যে কতো যে পরীক্ষা করেছেন, তাঁর ইয়ত্তা নেই। শিশুপুত্রের ব্যাপারে তাঁকে পরীক্ষায় ফেললেন। বললেন- শিশু ইসমাঈল ও তাঁর মাকে মক্কার মরু প্রান্তরে রেখে এসো। ইব্রাহীমের কাছে আল্লাহর হুকুম শিরোধার্য। তিনি তাঁদের নিয়ে ফিলিস্তিন থেকে রওয়ানা করলেন মক্কার দিকে। সহীহ বুখারীতে এ ঘটনার বিবরন দিয়ে বড় একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে-

 

ইব্রাহিম হাজেরা ও শিশুপুত্র ইসমাঈলকে সাথে নিয়ে রওয়ানা করেন। পথে হজেরা শিশুকে দুধ পান করাতেন। অবশেষে একদিন তিনি তাদের নিয়ে মক্কায় এসে উপস্থিত হলেন। এখন যেখানে কা’বা ঘর ও যমযমের কূপ এখানেই একটি গাছের নিচে তাঁদের রাখেন। তখন মক্কায় কোন মানুষ ছিলোনা। পানিও ছিলো না। ইব্রাহিম তাঁদের এক থলে খেজুর আর এক মশক পানি দিয়ে ফিরে চললেন ফিলিস্তিনের দিকে। হাজেরা তাঁর পিছে পিছে দৌড়ে এলেন। বললেন- আপনি কি আল্লাহর হুকুমে আমাদের এখানে রেখে যাচ্ছেন? ইব্রাহিম জবাব দিলেন- হ্যাঁ। একথা শুনে হাজেরা বললেন- ‘ঠিক আছে, তাহলে নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌ আমাদের ধ্বংস করবেননা।’ একথা বলে তিনি ফিরে এলেন যথাস্থানে। এদিকে ইব্রাহিম যে প্রিয়তম পুত্র স্ত্রীকে রেখে ফিরে চলেছেন, তাঁর বুক তো ফেটে যাচ্ছিলো। তাঁর হৃদয়ের কান্না তখন আল্লাহ্‌ ছাড়া আর কেউ দেখেননি। কিন্তু এ যে আল্লাহর হুকুম। আর তাঁর হুকুম পালন করাতো অপরিহার্য। আল্লাহর হুকুমে ইব্রাহিম এতো বড় বিরহের কাজও করতে পারেন। বুকের মধ্যে মনকে চেপে ধরে নীরবে তিনি ফিরে চলেছেন। পিছনে ফিরে তাকাননি। তাকালে ওদের চেহারা তাঁকে আল্লাহর নির্দেশ পালনে বাধা দিতে পারে। তাঁর হৃদয় যেন সমুদ্রের মতো উদার আর হিমালয়ের মতো অবিচল। সামনে অগ্রসর হয়ে চলেছেন তিনি। কিছুদূর এসে একটি টিলার উপরে উঠে ফিরে দাঁড়ালেন। এখান থেকে আর ওদের দেখা যায়না। এখানে দাঁড়িয়ে ইব্রাহিম দয়াময় প্রভু মহান আল্লাহর দরবারে দুহাত তুলে অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে দোয়া করলেন-

 

“আমার প্রভু, এই দানা-পানিহীন মরুভূমিতে তোমারই সম্মানিত ঘরের পাশে আমার সন্তানের বসতি স্থাপন করে গেলাম। প্রভু, ওদের এখানে রেখে গেলাম যাতে ওরা সালাত কায়েম করে। তাই তুমি মানুষের মনকে ওদের প্রতি আকৃষ্ট করে দিও আর ফলফলারি দ্বারা ওদের জীবিকার ব্যবস্থা করে দিও, যেন ওরা তোমার শুকোরগুজার হয়ে থাকে।” (সূরা ইব্রাহিম, আয়াত ৩৭)

 

অতঃপর আল্লাহর ইচ্ছার উপর মনকে অটল রেখে ধীরে ধীরে ইব্রাহিম চলে এলেন ফিলিস্তিনের দিকে। এ দিকে হাজেরা থলের খেজুর আর মশকের পানি খেয়ে দিন কাটাতে থাকেন। শিশু ইসমাঈল মায়ের বুকের দুধ পান করেন। কিন্তু অচিরেই মশকের পানি শেষ হয়ে গেলো। পিপাসায় তাঁর ছাতি ফেটে যায়। বুকে দুধ আসেনা। বাচ্চাও ক্ষুদায় পিপাসায় ধড়পড় করছে। মৃত্যু যেন হাতছানি দিয়ে তাঁদের ডাকছে। চোখের সামনে অনাহারে শিশুপুত্রের করুন মৃত্যু কোন মা কি সহ্য করতে পারে? পুত্রকে বাঁচানোর জন্যে তিনি পানির খোজে দৌড়ালেন। সামনেই একটি পাহাড়। এই পাহাড়ের নাম সাফা পাহাড়। তিনি দৌড়ে সাফা পাহাড়ের উপরে উঠে গেলেন। চারিদিকে তাকিয়ে দেখলেন কোন মানুষ দেখতে পান কিনা? উদ্দেশ্য হলো মানুষ দেখতে পেলে কিছু পানি চেয়ে নেবেন। কিন্তু না কোথাও কোন মানুষ দেখা যায়না।

 

এবার দ্রুত পাহাড় থেকে নেমে পড়লেন। সামনে মাঠের ওপাশেই আর একটি পাহাড়। এর নাম মারওয়া পাহাড়। হাজেরা দৌড়ে এসে মারওয়া পাহাড়ের উপরে উঠলেন। দুই পাহাড়ের মাঝে সাত চক্কর দৌড়াদৌড়ী করলেন। চারদিকে তাকিয়ে দেখলেন, কোন মানুষের সন্ধান পেলেন না। ছেলে মৃত প্রায় আর নিজের জীবন ওষ্ঠাগত। হাজেরা চোখের সামনে বাচার আর কোন উপায় দেখেন না। এখন তিনি সম্পূর্ণ অসহায়।

 

আল্লাহর উপহার যমযমের কূপ

 

কিন্তু আল্লাহ্‌ যে অসহায়ের সহায়, হাজেরা হঠাৎ একটি আওয়াজ শুনলেন। আশার আলো নিয়ে সেদিকে কান খাড়া করলেন। বললেন- তুমি যেই হওনা কেন, সম্ভব হলে আমাকে সাহায্য করো। হঠাৎ তিনি একজন ফেরেস্তাকে দেখতে পেলেন। এখন যেখানে যমযমের কুপ, ফেরেস্তা সেখানে দাঁড়িয়ে মাটির উপরে পায়ের গোড়ালি দিয়ে একটি আঘাত করলেন। সাথে সাথে মাটির নিচ থেকে উপচে উঠতে লাগলো পানি। হাজেরা দৌড়ে এসে চারপাশে বাধ দিলেন। অঞ্জলি ভরে পানি পান করলেন। মশকে পানি ভরে নিলেন। বুকে দুধ এলো। ইসমাঈলকে প্রান ভরে দুধ পান করালেন। এর নামই যমযম কূপ। সুপেয় অনাবিল পানির অবিরাম ধারা। ফেরেস্তা বলে গেলেন আপনার ভয়ের কোন কারন নেই। এখানেই আল্লাহর ঘর রয়েছে। আপনার পুত্র বড় হয়ে তাঁর পিতার সাথে আল্লাহর ঘর পুনর্নির্মাণ করবে। আপনারা নিরাপদ।

 

ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠেন

 

আল্লাহর অসীম সাহায্য পেয়ে হাজেরা আল্লাহর শোকর আদায় করলেন। দিন যায় রাত আসে। ইসমাঈল ধীরে ধীরে বড় হয়ে ওঠেন। এদিকে পানির সন্ধান পেয়ে মক্কার আকাশে পাখি এলো। পানির সন্ধান পেয়ে ইয়েমেন দেশের জুরহুম গোত্রের একদল লোক মক্কায় বসবাস করার জন্যে হাজেরার অনুমতি চাইলো। তিনি তাঁদের অনুমতি দিলেন। ফলে মক্কায় জনবসতি গড়ে উঠলো। পানির ছোঁয়াচ পেয়ে মরুভূমিতে ফল ফলারি উৎপন্ন হতে থাকলো। আল্লাহ্‌ ইসমাঈল ও তাঁর মায়ের সব অসুবিধা দূর করে দিলেন। এখানে যে জনবসতি গড়ে উঠেছে তাঁর কৃতৃত্ব কিন্তু ইসমাঈলের মায়ের হাতেই থাকলো। ইব্রাহিম (আঃ) প্রায়ই প্রানপ্রিয় পুত্র ইসমাঈল ও স্ত্রী হাজেরাকে দেখার জন্যে মক্কায় আসেন। ইসমাঈলের হাঁটাহাঁটি দৌড়াদৌড়ি দেখে ইব্রাহীমের মন ভরে যায়। ফুটফুটে টুকটুকে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি আনন্দে আল্লাহর শোকর আদায় করেন। যখন আসে পাশের মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকার জন্যে বের হন, ইসমাঈলকে সাথে নিয়ে যান। এভাবে কিছু দিন মক্কায় থেকে আবার চলে যান ফিলিস্তিনে। আবার ফিরে আসেন মক্কায়। ইসমাঈল দিন দিন বেড়ে ওঠেন। পিতা তাঁকে মনের মতো সুন্দর করে গড়ে তোলেন। যেমন বাপ, তেমনি আল্লাহর অনুগত হয়ে গড়ে উঠে ইসমাঈল। ফলে পিতার মহব্বত বেড়ে যায় পুত্রের প্রতি। আল্লাহর প্রতি তাঁদের পিতা পুত্রের ভালোবাসাকে আল্লাহ্‌ পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেন।

 

যবাই হবার হুকুম পেলেন

 

ইব্রাহিম একদিন স্বপ্ন দেখেন তিনি তাঁর প্রাণপ্রিয় পুত্রের গলায় ছুরি চালাচ্ছেন। নবীদের স্বপ্নও একপ্রকার অহী বা আল্লাহর আদেশ। আল্লাহর হুকুম শিরোধার্য। কিন্তু ইসমাঈল কি এ হুকুম মেনে নেবে? আসলে আল্লাহ্‌ তো সে পরীক্ষাই নিতে চান। আল্লাহতো দেখতে চান ইসমাঈল আল্লাহর হুকুমের সামনে মাথা পেতে দেয় কিনা? নিজের জীবনের চাইতেও আল্লাহর হুকুম পালন করাকে বড় কর্তব্য মনে করে কিনা? আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে সে নিজের জীবনকে কুরবানী করতে প্রস্তুত আছে কিনা?

 

কিন্তু ইসমাঈলতো তাঁর পিতার মতই আল্লাহর অনুগত। আল্লাহর সন্তুষ্টির চাইতে বড় কোন কাম্য তাঁর নেই। পিতা ইব্রাহিম আল্লাহর পক্ষ থেকে কুরবানী করার হুকুম জানিয়ে দেয়ার সাথে সাথে আল্লাহর অতি সম্মানিত দাস ইসমাঈল বলে উঠেন –

 

“আব্বা, আপনি আল্লাহর নির্দেশ পালন করুন। ইনশা’য়াল্লাহ আপনি আমাকে অটল অবিচল ও দ্রঢ় মনোবলের অধিকারী পাবেন।” (সূরা ৩৭ আসসাফফাত, আয়াত ১০২)

 

তারপর যখন পিতা পুত্র দুইজনই আল্লাহর হুকুমের সামনে মাথা নত করে দিলেন এবং ইব্রাহিম পুত্রকে উপুড় করে শুইয়ে দিয়ে ছুরি চালাতে উদ্যত হলেন, তখন নিজের দুই ‘প্রভু পাগল’ দাসের জন্যে আল্লাহর মহব্বতের দরিয়া উথলে উঠলো। সাথে সাথে তিনি ডাক দিয়ে বললেন-

 

‘ইব্রাহিম, থামো। স্বপ্নকে তুমি সত্য প্রমান করে দেখিয়েছ।” (সূরা ৩৭ আসসাফফাত, আয়াত ১০৫)

 

ব্যাস, বাপ বেটা দুইজনই আল্লাহর পরীক্ষায় পাশ করলেন। আর আল্লাহর পরীক্ষায় পাশ করার চাইতে বড় বিজয় কি হতে পারে? আল্লাহর ফেরেস্তারা ইব্রাহীমের সামনে একটি দুম্বা এনে রেখে দিলেন এবং সেটিকে কুরাবানী করে দিতে বললেন। ইব্রাহিম কৃতজ্ঞ মনে পুত্রের পরিবর্তে দুম্বাটি যবাই করে দিলেন। মহান আল্লাহ্‌ বলেন-

 

“আমরা একটি মহান কুরবানীর বিনিময়ে ইসমাঈলকে ছাড়িয়ে নিলাম।” (সূরা ৩৭ আসসাফফাত, আয়াত ১০৭)

 

সত্যি এটা ছিলো একটা বিরাট কুরবানী। আল্লাহর হুকুম মতো পিতা পুত্রকে কুরবানী করতে রাজি হয়ে যান। আবার পুত্রও আল্লাহর হুকুমে যবাই হবার জন্যে ছুরির নিচে গলা পেতে দেন। তাইতো এটা একটা বিরাট কুরবানী, বিরাট আত্মত্যাগ। সে জন্যই আল্লাহ্‌ তায়ালা এই বিরাট কুরবনীকে চিরদিন স্মরণীয় করে রাখার জন্যে সেই তারিখে যেনো মুমিনেরা আল্লাহর হুকুমে নিজেদের আত্মত্যাগের প্রমান স্বরূপ পশু কুরবানী করে, এ নিয়ম চালু রেখেছেন। বিগত প্রায় চার হাজার বছর থেকে মানুষ ইসমাঈল ও তাঁর পিতার সেই বিরাট কুরবানীকে স্মরণ করে। প্রতি বছর ঐ তারিখে মুসলিমরা আল্লাহর উদ্দেশে পশু কুরবানী করে। যারা মক্কায় হজ্জ পালন করতে যায়, ঐ তারিখে সেখানে কুরবানী করা তাঁদের জন্যে অবশ্য করনীয় কাজ। যারা আল্লাহর হুকুমের সামনে বিনীত হয়ে মাথা নত করে দেন, আল্লাহ্‌ তাঁদের এভাবেই পুরস্কৃত করেন। পরীক্ষায় পাশের পর আল্লাহ্‌ ইসমাঈলকে নবুয়্যত দান করেন।

 

এর আগে ইসমাঈলের মা পানির সন্ধানে সাফা ও মারওয়া পাহাড়ে সাতবার দৌড়াদৌড়ি করলেন মহান আল্লাহ্‌ সেই ঘটনাটিকেও চির স্মরণীয় করে রাখলেন। যারাই মক্কায় হজ্জ করতে যাবে, তাঁদের জন্যে সাফা ও মারওয়া পাহাড়ে সাতবার দৌড়াদৌড়ি করার নিয়ম আল্লাহ্‌ চালু করে দিলেন। মা হাজেরার সেই কষ্টকে আল্লাহ্‌ স্মরণীয় করে রাখলেন কেন?

 

কারন তিনি যে আল্লাহর ইচ্ছায় মক্কার জনমানবহীন মরুভূমিতে বসবাস করতে রাজি হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর স্বামী ইব্রাহিম যখন বললেন, আল্লাহর ইচ্ছায় তাঁকে এই মরুভূমিতে রেখে যাচ্ছেন, তখন তিনি একমাত্র আল্লাহর উপরে ভরসা করে সেখানে থেকে গেলেন। তাঁর এই যে বিরাট আল্লাহ্‌নির্ভরতা, এরি বিনিময়ে আল্লাহ্‌ পাক তাঁকে চির স্মরণীয় ও সম্মানিত করে রাখলেন।

 

বিয়ে করলেন পিতা হলেন

 

দিন যায় রাত আসে। বছর ঘুরে আসে নতুন বছর। ইসমাঈল বড় হয়ে উঠেন। পাশেই বসবাস করছে জুরহুম গোত্রের লোকেরা। ইসমাঈল তাঁর সুন্দর ও চমৎকার মানবীয় গুনাবলীর জন্যে তাঁদের খুব প্রিয় হয়ে উঠেন। ইসমাঈল যৌবনপ্রাপ্ত হলে তারা তাঁদের এক মেয়েকে ইসমাঈলের কাছে বিয়ে দেয়। বিয়ের কিছুকাল পরেই তাঁর মা হাজেরা ইহলোক ত্যাগ করেন। আল্লাহ্‌ পাক ইসমাঈলের মাকে নিজ রহমতের ছায়াতলে স্থান দিন। এরই মাঝে ইব্রাহিম এলেন প্রিয় পুত্র ও স্ত্রীকে দেখার জন্যে। ইসমাঈল এসময় মক্কার বাইরে ছিলেন। ইব্রাহিম এসে পুত্রকে বাড়িতে পেলেননা। স্ত্রী হাজেরাও মৃত। ঘরে শুধু পুত্রবধু। কিন্তু পুত্রবধু একজন সত্যিকার মুমিন মহিলার মতো আচরন করেননি। একজন নবীর স্ত্রী আর একজন নবীর পুত্র বধু হিসেবে তো তাঁর আদর্শ মুসলিম মহিলা হওয়া উচিত ছিলো। ফলে পিতার নির্দেশে ইসমাঈল এ মহিলাকে তালাক দেন এবং আরেকজন সত্যিকার মুমিন মহিলাকে বিয়ে করেন। এ ঘরে তাঁর কয়েকটি ছেলেমেয়ে জন্ম হয়। তাঁরাও আদর্শ মুসলিম হিসেবে গড়ে উঠেন।

 

কা’বা নির্মাণে অংশ নিলেন

 

একদিন পিতা ইব্রাহিম ইসমাঈলকে ডেকে বললেন- ‘আল্লাহ্‌ আমাকে একটি কাজের হুকুম দিয়েছেন। তুমি কি আমাকে সে কাজে সাহায্য করবে? ইসমাঈল বললেন- হ্যাঁ, নিশ্চয়ই করবো।’ ইব্রাহিম সাম্নের উঁচু টিলাটি দেখিয়ে বললেন- ‘মহান আল্লাহ্‌ আমাকে এখানে একটি ঘর বানাবার নির্দেশ দিয়েছেন।’

 

অতঃপর বার বেটা দু’জন মিলে আল্লাহর ঘর কা’বা ঘর নির্মাণ কাজ শুরু করলেন। ইসমাঈল পাথর যোগান দেন আর ইব্রাহিম গাঁথুনি গেঁথে দেয়াল নির্মাণ করেন, ছাদ নির্মাণ করেন। গাঁথুনি যখন উপরে উঠছিলো, তখন ইসমাঈল একটি বড় পাথর এনে দিলেন। ইব্রাহিম সে পাথরের উপরে দাঁড়িয়ে নির্মাণ কাজ সমাপ্ত করেন। আজও সে পাথরটি কা’বা ঘরের সামনে বিদ্যমান আছে। আপনি যখন হজ্জ বা উমরা করতে যাবেন সে পাথরটি দেখতে পাবেন। ওখানে দু’রাকাত নামাজ পড়তে হয়। সে পাথরটির নাম মাকামে ইব্রাহিম। বাপ ছেলে মিলে যখন বাইতুল্লাহ (আল্লাহর ঘর) নির্মাণ শেষ করলেন, তখন দু’জনে প্রভু দয়াময় মহান আল্লাহর দরবারে দোয়া করলেন, তিনি যেন তাঁদের এই খিদমত কবুল করে নেন। মহান আল্লাহ্‌ তাঁদের এই বিরাট খিদমত কবুল করে নেন। তাঁদের নির্মাণ করা ঐ ঘরকে চিরদিনের জন্যে হজ্জ ও তাওয়াফের কেন্দ্রে পরিনত করে দেন। সারা পৃথিবী থেকে মানুষ আল্লাহর এই ঘরকে তাওয়াফ করার জন্য মক্কায় ছুটে যায়। আপনি সেই ঘরের তাওয়াফ করার নিয়ত করে রাখুন। হয়তো আল্লাহ্‌ একদিন সুযোগ করে দিবেন। অতঃপর ঐ ঘরকে কেন্দ্র করে মক্কা একটি স্থায়ী শহরে পরিনত হয়। সারা পৃথিবী থেকে আল্লাহ্‌ ভক্ত লোকেরা ছুটে আসে সেখানে। আল্লাহর ঘর ধরে তারা রোনাজারি করে।

 

সালাত ও যাকাত ভিত্তিক সমাজ গড়লেন

 

ইসমাঈলের পিতা ইব্রাহিম (আঃ) মহান আল্লাহ্‌ তায়ালার দরবারে দোয়া করেছিলেন- ‘আমাকে নেক্কার সন্তান দান করো।’ সত্যিই আল্লাহ্‌ তাঁকে নেক পুত্র দান করেন। ইব্রাহিম আরো দোয়া করেছিলেন- ‘প্রভু, আমাকে সালাত কায়েমকারী বানাও, আমার সন্তানদেরকেও।’

 

ইসমাঈলকে আল্লাহ্‌ তায়ালা শুধু নেক্কারই বানাননি, শুধু সালাত কায়েমকারীই বানাননি, সেই সাথে একজন আদর্শ নবীও বানিয়েছিলেন। তাইতো মহান আল্লাহ্‌ বলেন-

 

“ইসমাঈল, আলয়াসা, ইউনুস, লুত এদের প্রত্যেককেই আমি বিশ্ববাসীর উপর মর্যাদা দান করেছি।” (সূরা আল আনাম, আয়াত ৮৬)

 

ইসমাঈল মক্কা ও হিজাযের লোকদেরকে আল্লাহর পথে ডাকেন। তাঁদের তিনি আল্লাহকে জানার, বুঝার ও আল্লাহর পথে চলার তা’লিম দেন। তিনি তাঁদের সালাত কায়েম করার নির্দেশ দেন। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যাকাত ভিত্তিক সমাজ গড়ার শিক্ষা দেন। সালাত ও যাকাত ভিত্তিক একটি আদর্শ সমাজ গড়ার কাজ করতে গিয়ে তাঁকে অনেক বিপদ মুসিবত ও বাধার সম্মুখীন হতে হয়। তিনি সবার সাথে এসব কিছুর মোকাবেলা করেন। তাইতো আল্লাহ্‌ তাঁর প্রশংসা করে বলেন-

 

“ইসমাঈল, ইদ্রীস, যুলকিফল এরা সবাই ছিল সবর অবলম্বনকারী। আমি তাঁদেরকে আমার রহমতের ছায়াতলে স্থান দিয়েছি। তারা ছিলো যোগ্য লোক এবং সততার প্রতীক।” (সূরা ২১ আল আম্বিয়া, আয়াত ৮৫)

 

ইসমাঈল (আঃ) তাঁর লোকদেরকে নিয়ে কা’বা কেন্দ্রিক একটি আদর্শ ইসলামী সমাজ গড়েন। জানা যায়, তাঁর বারোজন পুত্র ছিলো এবং তারা সকলেই ছিলেন ইসলামী সমাজের কাণ্ডারি।

 

তাঁরই বংশে জন্ম নিলেন মুহাম্মাদ রাসুলুল্লাহ

 

মহান আল্লাহ্‌ ইসমাঈল (আঃ) কে আরো একটি বড় মর্যাদা দান করেছেন। সেটা হলো, তাঁরই বংশে পাঠিয়েছেন শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে। কা’বা নির্মাণের পর ইসমাঈল পিতা ইব্রাহীমের সংগে আল্লাহর কাছে দোয়া করেছিলেন।

 

“প্রভু, আমাদের বংশ থেকে তাঁদের মাঝে একজন রাসুল পাঠিও, যিনি ওদেরকে তোমার আয়াত পাঠ করে শোনাবেন, কিতাব ও হিকমাহ শিক্ষা দেবেন আর তাঁদের জীবনকে পরিশুদ্ধ পরিচ্ছন্ন করবেন। ” (সূরা বাকারা, আয়াত ১২৯)

 

আল্লাহ্‌ ইসমাঈল ও তাঁর পিতার দোয়া কবুল করেন। ইসমাঈলের বংশেই মুহাম্মাদ রাসুলুল্লাহর আবির্ভাব ঘটান। মুহাম্মাদ রাসুলুল্লাহ এসে পৃথিবীতে আবার ইব্রাহিম ও ইসমাঈল (আঃ) এর মতই কা’বা কেন্দ্রিক ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। এই কা’বা এবং কা’বা কেন্দ্রিক হজ্জ, কুরবানী, তাওয়াফ, সাফা মারওয়া দৌড়াদৌড়ি মাকামে ইব্রাহীমে সালাত আদায় ইত্যাদির মাধ্যমে আল্লাহ্‌ পাক ইব্রাহিম (আঃ), ইসমাঈল (আঃ) ও তাঁর সম্মানিত মা হাজেরা আলাইহিস সালামকে চিরদিন পৃথিবীতে স্মরণীয় করে রাখার ব্যবস্থা করলেন। মহান আল্লাহ্‌ তাঁর অনুগত দাসদের এভাবেই পুরস্কৃত করেন।

 

কুরআনে ইসমাঈল (আঃ)

 

মহান আল্লাহ্‌ তাঁর প্রিয় নবী ইসমাঈল (আঃ)-কে বিরাট সম্মান ও মর্যাদা দান করেছেন। কুরআন মাজীদে মোট বারোটি স্থানে আল্লাহ্‌ পাক ইসমাঈলের নাম উল্লেখ করেন। কয়েকটি আয়াত তো আগেই উল্লেখ করেছি। আল্লাহ তায়ালা হজরত ইসমাঈল (আঃ) সম্পর্কে আরো বলেন-

 

“স্মরণ করো, ইসমাঈল, আলয়াসা, যুলকিফলকে। এরা সবাই ছিলো উত্তম আদর্শ।” (সূরা ৩৮ সোয়াদ, আয়াত ৪৮)

 

“হে মুহাম্মাদ, তোমার কাছে আমি অহী পাঠাচ্ছি, যেমন পাঠিয়েছিলাম নূহ এবং তাঁর পরবর্তী নবীদের কাছে, যেমন পাঠিয়েছিলাম ইব্রাহিম ও ইসমাঈলের কাছে।” (সূরা ২ আল বাকারা, আয়াত ১৩৬)

 

“হে মুহাম্মাদ, বলো- আমরা আল্লাহকে মানি আর ইসমাঈল ও ইব্রাহীমের কাছে যা অবতীর্ণ হয়েছে তাও মানি।” (সূরা ২ আল বাকারা, আয়াত ১৩৬)

 

যেসব সুরায় ইসমাঈল (আঃ) এর কথা উল্লেখ হয়েছে, সেগুলো হলো- সূরা আল বাকারাঃ ১২৫-১৪০, আলে ইমরানঃ ৮৪, আন নিসাঃ ১৬৩, আল আনআমঃ ৮৬, ইব্রাহীমঃ ৩৯, মরিয়মঃ ৫৪, আল আম্বিয়াঃ ৮৫, সোয়াদঃ ৪৮।

 

৯।

 

ইবরাহীম পুত্র ইসহাক

 

(আঃ)

 

পূর্ব কথা

 

আপনারা আগেই জেনে এসেছেন মহান রাসুল আল্লাহর বন্ধু ইবরাহীম (আঃ) এর কাহিনী। শুনেছেন তাঁর অগ্নীপরীক্ষার কথা, হিজরতের কথা এবং আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্যে দেশ থেকে দেশান্তরে ঘুরে বেড়ানোর কথা। শেষ বয়েসে মহান আল্লাহ তাঁকে দুটি পুত্র সন্তান দান করেন। দুজনকেই নবয়্যত দান করেন এবং আরো দান করেন উচ্চ মর্যাদা। তাঁদের একজন ইসমাঈল (আঃ) এবং অপরজন ইসহাক (আঃ)। ইসমাঈলের ইতিহাস তো আগেই বলে এসেছি। এবার শুনা যাক ইসহাকের কথা। হযরত ইব্রাহীমের ছিলেন দুই জন স্ত্রী। একজন সারাহ আর অপরজন হাজেরা। সারাহ প্রথম স্ত্রী। তাঁকে সাথে নিয়েই হযরত ইবরাহীম তাঁর মাতৃভূমি ইরাক থেকে হিজরত করেন। অনেক দেশ ঘুরে মিশরে যান। সেখানে বিয়ে করেন দ্বিতীয় স্ত্রী হাজেরাকে। সেখান থেকে ফিরে আসেন ফিলিস্তিনে। এখানে আসার পর হাজেরার ঘরে তাঁর একটি পুত্র সন্তান জন্মলাভ করেন। সে পুত্রই ছিলেন কুরবানীর নবী হযরত ইসমাঈল (আঃ)। আল্লাহর হুকুমে হযরত ইবরাহীম শিশুপুত্র ইসমাঈল ও তাঁর মাকে মক্কায় নিয়ে রেখে আসেন। সারাহ ফিলিস্তিনেই থেকে যান। হযরত ইবরাহীমও ফিলিস্তিনেই থাকতেন। আবার মক্কায় গিয়ে স্ত্রী ও পুত্র ইসমাঈলকে দেখাশুনা করে আসতেন।

 

সারাহর দুঃখ

 

কিন্তু সারার বড় দুঃখ। তিনি একজন বৃদ্ধা মহিলা। তাঁর সন্তানাদি হয়না। অথচ সব নারীই মা হতে চায়। সন্তানের মুখ দেখতে চায়। সন্তানকে বুকভরা আদর আর স্নেহ মমতা দিয়ে জড়িয়ে রাখতে চায়। মা ডাক না শুনলে কোন নারীরই বুক ভরেনা। সন্তান ছাড়া নারীর কোল থাকে শুন্য। বুকভরা আশা নিয়ে সারাহ সবসময় দয়াময় আল্লাহর কাছে দোয়া করেন সন্তান চেয়ে। কিন্তু আজো তাঁর সন্তান হয়নি। তিনি বৃদ্ধা হয়ে পড়েছেন। বয়েস হয়ে গেছে নব্বই। স্বামীও এখন শতায়ু বৃদ্ধ। সন্তান লাভের আর কি আশা? এ ঘরে সন্তান লাভের ব্যাপারে এখন দুজনই নিরাশ। কিন্তু হঠাৎ একটা কাণ্ড ঘটে গেলো। কী সে কাণ্ড?

 

সুসংবাদ পেলেন সারাহ

 

হঠাৎ একদিন হযরত ইব্রাহীমের বাড়িতে এলো কয়েকজন তাগড়া যুবক। অতি সুন্দর সুশ্রী হৃষ্টপুষ্ট ওরা। যেনো শক্তিশালী যোদ্ধা এবং বিরাট কোন সম্রাটের সৈনিক। তাঁদের আকস্মিক আগমনে ইবরাহীম ভয় পেয়ে গেলেন। তবে তারা এসেই হযরত ইব্রাহীমকে সালাম দেন এবং তিনিও সালামের জবাব দিয়ে তাঁদেরকে মেহমান হিসেবে গ্রহন করেন।

 

মেহমান এলে হযরত ইবরাহীম অত্যন্ত খুশি হতেন। কারন তিনি ছিলেন বড় মেহেমান নেওয়াজ। ওদের বসতে দিয়ে তিনি ভেতরে চলে গেলেন। অল্পক্ষনের মধ্যেই তাজা গরুর গোশত ভুনা করে নিয়ে আসলেন। সারাও পিছে পিছে এসে পর্দার আড়ালে দাঁড়ালেন। ইবরাহীম সারার ভুনা করা মজাদার গোশত তাঁদের পরিবেশন করতে থাকলেন। কিন্তু অবাক কাণ্ড। ওরা হাত গুটিয়ে রাখলো। খাবার স্পর্শ করছেনা। ইবরাহীম ভাবলেন- নিশচয়ই এরা শত্রু হতে পারে। বললেন- আপনারা কারা? আপনাদের তো চিনতে পারছিনা? আপনাদেরকে আমার ভয় হচ্ছে।

 

এবার তারা মুখ খুললো। বললো- আপনি ভয় পাবেননা। আমরা আল্লাহর দূত ফেরেস্তা। আমরা আল্লাহর কাছ থেকে আপনার জন্যে সুসংবাদ নিয়ে এসেছি। সারার ঘরে আপনার একটি বিজ্ঞ পুত্র সন্তান জন্ম হবে। একথা শুনে সারাহ বিস্মিত হয়ে সামনে এগিয়ে এলেন। কপালে হাত মেরে বললেন- এতো এক বিস্ময়ের খবর, আমি হয়ে গেছি বুড়ি থুরথুড়ি। তাঁর উপরে জনমের বন্ধ্যা। শুধু কি তাই? আমার স্বামীও শতায়ু বৃদ্ধ। কেমন করে হবে আমার ছেলে?

 

ফেরেস্তারা বললেন- “এতো আল্লাহর সিদ্ধান্ত। আপনি কি আল্লাহর ফায়সালার ব্যাপারে বিস্ময় প্রকাশ করছেন? এ সুসংবাদ নির্ঘাত সত্য। এর কোন নড়চড় হবেনা। আপনার গর্ভে ইসহাক জন্ম নেবেই। শুধু তাই নয়, ইসহাক একজন নবী হবে আর তাঁর ঘরেও জন্ম নেবে আরেক নবী ইয়াকুব। এ হচ্ছে আল্লাহর রহমত। পথভ্রান্তরা ছাড়া কি কেউ আল্লাহর রহমাত থেকে নিরাশ হয়? আল্লাহ মহাজ্ঞানী, মহাকৌশলী, সপ্রসংশিত, অতিশয় মর্যাদাবান। তিনি যা চান তাই হয়। হে ঘরবাসী, আল্লাহর রহমত আর বরকতের ধারা বর্ষিত হোক আপনাদের প্রতি।” (সূরা ১১ হুদ-৭২,৭৩)

 

জন্ম নিলেন ইসহাক

 

আল্লাহর হুকুমের নড়চড় নেই। হযরত ইবরাহীম আর সারার ঘর উজ্জ্বল করে জন্ম গ্রহন করলেন ইসহাক। চাঁদের মতো ফুটফুটে ছেলে। বুড়ো বয়েসে ছেলে হলে আদরের সীমা থাকেনা। বাবা মার আদরে লালিত পালিত হয়ে বড় হতে থাকলেন ইসহাক। যেমন বাপ তেমন ছেলে। মহান আল্লাহ ইসহাককে দান করেছেন দারুন মেধা, জ্ঞান এবং বুঝ ও বুদ্ধি।

 

নবুয়্যত লাভ

 

বড় হলে ইসহাককে আল্লাহ তায়ালা নবুয়্যত দান করেন। একজন প্রশংসিত নবী হিসেবে কুরআন মাজীদে বার বার তাঁর নাম উল্লেখ হয়েছে। ফিলিস্তিন অঞ্চলে তিনি তাঁর পিতা হযরত ইবরাহীম (আঃ) প্রতিনিধি ও স্থলাভিষিক্ত হিসেবে দ্বীন ইসলামের প্রচার ও প্রসারের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। হযরত ইবরাহীম যে বিরাট অঞ্চলে ইসলাম কায়েম করে গিয়েছিলেন, পরবর্তীতে তারা দুই ভাই ইসমাঈল ও ইসহাক তার দায়িত্ব গ্রহন করেন। হিজায অঞ্চলে দায়িত্ব পালন করেন বড় ভাই ইসমাঈল (আঃ)। আর ফিলিস্তিন অঞ্চলের দায়িত্ব পালন করেন ছোট ভাই ইসহাক (আঃ)।

 

হযরত ইসহাকের বংশ

 

হযরত ইসহাককে আল্লাহ তায়ালা এক ঐতিহাসিক গোত্রের পূর্বপুরুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর পুত্র ইয়াকুবকে আল্লাহ তায়ালা নবী মনোনীত করেন। ইয়াকুবের আরেক নাম ছিলো ইসরাইল। তাঁর সন্তানরা বনী ইসরাইল (ইসরাইলের বংশধর) হিসেবে খুবই খ্যাতি অর্জন করেছে। মূলত এ বংশের ধারাবাহিকতা হযরত ইসহাক (আঃ) থেকেই আরম্ভ হয়। এ বংশে আল্লাহ অসংখ্য নবী প্রেরন করেছেন। ইসলামের সঠিক আদর্শ থেকে বিচ্যুত অবস্থায় এ বংশের লোকেরা আজো পৃথিবীতে বর্তমান আছে।

 

হযরত ইসহাকের প্রশংসনীয় গুনাবলী

 

আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআন মাজীদে তাঁর দাস ও নবী হযরত ইসহাক (আঃ) এর ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। এবার কুরআন থেকে তাঁর প্রশংসা আর গুনাবলী জেনে নেয়া যাক। মহান আল্লাহ বলেন-

 

১। “আমার দাস ইবরাহীম, ইসহাক আর ইয়াকুবের কথা স্মরণ করো। তারা ছিলো বড় কর্মঠ আর দুরদৃষ্টি সম্পন্ন। একটি খাঁটি গুনের কারনে আমি তাঁদের মর্যাদাবান করেছিলাম। আর টা হলো পরকালের চিন্তা। তারা আমার কাছে বাছাই করা আদর্শ মানুষ।” (সূরা সোয়াদ, আয়াত ১০২)

 

২। “অতপর আমি ইব্রাহীমকে ইসহাকের সুসংবাদ দিলাম। বললাম- সে হবে একজন নবী ও উন্নত আমলের সুযোগ্য লোক।” (সূরা আস সাফফাত, আয়াত ১১২)

 

৩। “আর আমি তাঁকে দান করেছি ইসহাককে। তাছাড়াও ইয়াকুবকে। তারা প্রত্যেকেই ছিলো সৎ সুযোগ্য। আমি তাঁদের নেতা বানিয়েছি। তারা আমার নির্দেশ মতো মানুষকে সঠিক পথ প্রদর্শন করতো। আমি তাঁদের কাছে অহী করেছিলাম কল্যাণমূলক কাজ করার, সালাত কায়েম করার ও যাকাত পরিশোধ করার। তারা ছিলো আমার একান্ত অনুগত। ” (সূরা আল আম্বিয়া, আয়াত ৭৩)

 

৪। “অতপর আমি তাঁকে ইসহাক ও ইয়াকুবের মতো সন্তান দান করলাম। আর তাঁদের প্রত্যেককেই বানালাম নবী। নিজ রহমতে তাঁদের ধন্য করলাম আর মানুষের মাঝে তাঁদেরকে সত্যিকার সুনাম ও সুখ্যাতি দান করলাম।” (সূরা মরিয়ম, আয়াত ৪৯-৫০)

 

৫। “হে মুহাম্মাদ, আমি তোমার প্রতি তেমনই অহী নাযিল করেছি, যেমন করেছিলাম নুহ এবং তাঁর মধ্যবর্তী নবীদের উপর। যেমন আমি অহী পাঠিয়েছি ইব্রাহীন, ইসমাঈল, ইসহাক---এর প্রতি--- এরা সবাই ছিলো সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী রাসুল।” (সূরা নিসা, আয়াত ১৬৩-১৬৫)

 

 কুরআন মাজীদের এ আয়াতগুলো থেকে আমরা হযরত ইসহাক (আঃ) এর অনেকগুলো প্রশংসিত গুনাবলীর কথা জানতে পারি। মহান আল্লাহ নিজেই তাঁর এসব গুনাবলীর কথা উল্লেখ করেছেন। গুনগুলো হলো-

 

১। পরকালের চিন্তা। অর্থাৎ পরকালমুখী চিন্তা ও পরকালমুখী কাজ।

 

২। কর্মঠ। অর্থাৎ দক্ষতা ও কর্মমুখীতা।

 

৩। দূরদৃষ্টি।

 

৪। সততা ও যোগ্যতা।

 

৫। উন্নত আমল।

 

৬। আল্লাহর আনুগত্য ও বাধ্যতা।

 

৭। সুসংবাদদাতা। অর্থাৎ মুমিনদের জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন।

 

৮। সতর্ককারী। অর্থাৎ আল্লাহর পাকড়াও সম্পর্কে মানুষকে সতর্ক করেছেন।

 

৯। সামাজিক নেতৃত্ব দান।

 

১০। নেতৃত্ব লাভের পর-

 

     ক. আল্লাহর বিধান মতো মানুষকে সঠিক পথ প্রদর্শনের ব্যবস্থা করেছেন।

 

     খ. জনকল্যাণমূলক সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছেন।

 

     গ. সালাত কায়েম করেছেন এবং

 

     ঘ. যাকাত ভিত্তিক অর্থনৈতিক সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছেন।

 

এসব কারনে আল্লাহ তাঁকে উচ্চ মর্যাদা ও সুনাম সুখ্যাতি দান করেছেন।

 

কুরআনে উল্লেখ

 

কুরআন মাজীদে হযরত ইসহাকের নাম উল্লেখ হয়েছে ১৭ বার। যেসব সুরাতে উল্লেখ হয়েছে, সেগুলো হলো –

 

সূরা আল বাকারাঃ ১৩৩,১৩৬,১৪০। আলে ইমরানঃ ৮৪। নিসাঃ ১৬৩। আল আনআমঃ ৮৪। হুদঃ ৭১। ইউসুফঃ ৬,৩৮। ইব্রাহীমঃ ৩৯। মরিয়মঃ ৪৯। আল আম্বিয়াঃ ৭২। আন কাবুতঃ ২৭। আস সাফফাতঃ ১১২,১১৩। সোয়াদঃ ৪৫।

 

১০।

 

ইসরাইলিদের পিতৃপুরুষ ইয়াকুব

 

(আঃ)

 

নাম ও বংশ পরিচয়

 

মহাকালের সাক্ষী এক মহাপুরুষ ইয়াকুব (আঃ)। পৃথিবীর এক ঐতিহাসিক বংশের তিনি আদি পুরুষ। সেকালে ইবরানী ভাষা নামে একটি ভাষা চালু ছিলো। বহ নবীর মুখের ভাষা ছিলো এই ইবরানী ভাষা। এ ভাষায় আল্লাহ তায়ালা কিতাবও নাযিল করেছেন। হযরত ইয়াকুব (আঃ) এর ভাষাও ছিলো এই ইবরানী ভাষা। এ ভাষায় তাঁর নাম ছিলো ইসরাইল। এর অর্থ কি? ইসরাইল মানে আল্লাহর দাস। অন্য সকল নবীর মতো তিনিও আল্লাহর দাসই ছিলেন। তবে সেই সাথে তাঁর নামটিও ছিলো ‘আল্লাহর দাস’। এর আরবী অনুবাদ হল ‘আব্দুল্লাহ’। হযরত ইয়াকুব (আঃ) ছিলেন অত্যন্ত মর্যাদাবান একজন নবী। পূর্বপুরুষের দিক থেকে তিনি এক সম্মানিত নবীর পুত্র আরেক সম্মানিত নবীর নাতি। অর্থাৎ তিনি ছিলেন হযরত ইব্রাহীমের নাতি আর হযরত ইসহাকের পুত্র। অন্যদিকে তাঁর বংশেও জন্ম নিয়েছেন অসংখ্য নবী। তিনি ইসরাইল নামে পরিচিত হবার কারনে তাঁর বংশধরদের বলা হয় ‘বনী ইসরাইল’ বা ইসরাইলের বংশধর।

 

কোন কোন সুত্র থেকে জানা যায় তাঁর বংশধরদের মধ্যে চার হাজার নবী জন্মগ্রহন করেন। হযরত ইউসুফ, মুসা, হারুন, দাউদ, সুলাইমান, যাকারিয়া, ইয়াহিয়া, ঈসা আলাইহিস সালাম প্রমুখ বিখ্যাত নবী রাসুলগন ছিলেন তাঁরই বংশধর।

 

জন্ম ও শৈশব

 

আপনারা আগেই জেনেছেন হযরত ইবরাহীম (আঃ) তাঁর প্রথম স্ত্রী সারাকে নিয়ে ফিলিস্তিনের কেনান শহরে বসবাস করতেন। এখানে সারার ঘরে জন্ম নেন হযরত ইসহাক (আঃ)। আর এ শহরেই জন্ম হয় ইসহাকের পুত্র হযরত ইয়াকুব (আঃ) এর। নবীর পুত্র শৈশব থেকেই জ্ঞানে গুনে নবীর মতো হয়ে গড়ে উঠতে থাকেন। তাঁর উন্নত জ্ঞান বুদ্ধি সুন্দর স্বভাব চরিত্র আর অমায়িক ব্যবহার দেখে ছোট বেলা থেকেই বুঝা যাচ্ছিলো, তিনি হবেন একজন মহামানব।

 

যৌবনকালে খালার বাড়ি

 

ইয়াকুব যখন যৌবনে পদার্পণ করেন, তখন একদিন তাঁর মা রিফকাহ তাঁকে তাঁর খালার বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। বললেন- তুই সেখানে গিয়ে থাকগে। যুবক ইয়াকুব মায়ের নির্দেশে খালার বাড়ি চলে এলেন। আপনারা নিশ্চয়ই ব্যবিলন শহরের নাম শুনেছেন। হ্যাঁ, এখন এই শহরটি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। শহরটি ছিলো ইরাকে। এই ব্যবিলনের ‘ফুদ্দানে আরাম’ নামক স্থানেই ছিলো ইয়াকুবের খালার বাড়ি। এখানে এসে ইয়াকুব শারীরিক ও মানসিক যোগ্যতা আর মেধা বৃদ্ধির বিরাট সুযোগ পেলেন।

 

বিয়ে করলেন ইয়াকুব

 

খালার বাড়িতে ইয়াকুব সতের বা বিশ বছর অবস্থান করেন। এখানেই তিনি বিয়ে শাদি করেন। তিনি চারটি বিয়ে করেন। বড় স্ত্রীর নাম ছিলো লিয়া, দ্বিতীয় স্ত্রী রাহিল, তৃতীয় স্ত্রী যুলফা আর চতুর্থ স্ত্রী ছিলেন বলুহা। তাঁর কোন স্ত্রীর ঘরে কয়টি ছেলে হয়েছিলো, ইতিহাসে তাও উল্লেখ আছে। আসুন তাঁর পুত্রদের নাম আপনাদের জানিয়ে দেই- লিয়ার ঘরে জন্ম হয় ছয়টি পুত্রের। ওদের নাম হলো- রুবিল, শামউন, লাভি, ইয়াহুযা, ইসাখার ও যাবলুন।

 

রাহিলের ঘরে জন্ম নেন দুইজন পুত্র সন্তান। তারা হলেন- ইউসুফ ও বনী ইয়ামীন।

 

যুলফার ঘরে জন্ম হয় দুই ছেলে জাদ ও আশির।

 

বলুহার ঘরেও দুইটি পুত্র সন্তান জন্মলাভ করে। তারা হলেন- দান ও নাফতালি।

 

এবার বলুনতো হযরত ইয়াকুবের মোট কয়টি ছেলে ছিলো? গুনে দেখুন, সব মিলে হলো- বারোটি। এই বারো ছেলে থেকেই জন্ম নেয় বনী ইসরাইলের বারোটি শাখা গোত্র। এদের মধ্যে লাভির বংশে জন্ম নেন হযরত মুসা ও হারুন (আঃ)। ইয়াহুযা ছিলেন ধর্মীয় দিক থেকে খুবই প্রভাবশালী। পরবর্তীকালে তাঁর নাম অনুসারেই আসল ধর্ম বিকৃত হয়ে জন্ম নেয় ইয়াহুদি ধর্মের। একপুত্র ইউসুফ (আঃ) তো পরে মিশরে গিয়ে সেখানকার শাসক হন।

 

ফিরে এলেন কেনানে

 

অনেক দিন হয়ে গেলো খালার বাড়ি। এবার ডাক পড়েছে নিজের বাড়ি ফিরে আসার। বিনিয়ামিন ছাড়া তাঁর এগারটি পুত্রের জন্ম খালার বাড়িতেই হয়। বিবি বাচ্চা সবাইকে নিয়ে ইয়াকুব রওয়ানা করলেন ফিলিস্তিনের দিকে। অনেক দিন দূরে থাকার পর এবার এসে পৌঁছে গেলেন নিজ মাতৃভূমি কেনানে। কেনানে আসার পর ছোট ছেলে বিনইয়ামিনের জন্ম হয়। এতোগুলো নাতি পেয়ে দাদা দাদি দারুন খুশি। বাড়ি ফিরে ইয়াকুব আল্লাহর পথে নিজের জানমাল পুরোপুরি নিয়োজিত করেন।

 

নবী হলেন ইয়াকুব

 

ইয়াকুব ছিলেন আল্লাহর জন্যে নিবেদিতপ্রান। আল্লাহও তাঁকে নিজের জন্যে বাছাই করে নেন। দান করেন নবুয়্যত। ফিলিস্তিন অঞ্চলে আল্লাহর দ্বীন প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করার জন্যে হযরত ইবরাহীম (আঃ) পুত্র ইসহাকের উপরে দায়িত্ব দিয়ে যান। ইসহাক (আঃ) বৃদ্ধ বয়েসে উপনীত হবার পরে স্বয়ং আল্লাহর পক্ষ থেকেই পুত্র ইয়াকুব তাঁর প্রতিনিধি মনোনীত হন। কিছুকাল পর হযরত ইয়াকুব (আঃ) এর পিতা হযরত ইসহাক (আঃ) ইহলোক ত্যাগ করেন। হযরত ইয়াকুব গোটা ফিলিস্তিন অঞ্চলে আল্লাহর দীনের পতাকা উড্ডীন করেন। মানুষের দুয়ারে দুয়ারে বয়ে নিয়ে যান আল্লাহর বানী। মানুষকে সমবেত করেন আল্লাহর দীনের পতাকাতলে।

 

ধৈর্য জ্ঞান ও আল্লাহ নির্ভরতার প্রতীক

 

প্রিয় নবী ইয়াকুব (আঃ) ছিলেন পরম ধৈর্যশীল ও ধৈর্যের পাহাড়। তাঁর প্রিয়তম পুত্র ইউসুফকে তাঁর ভাইয়েরা যখন অন্ধকূপে ফেলে বাড়ি এসে তাঁর কাছে বলেছিলো, ইউসুফকে বাঘে খেয়ে ফেলেছে। তখন এই চরম দুঃখ ও বেদনার সংবাদ শুনে তিনি কেবল এতোটুকুই বলেছিলেন-

 

“বরং তোমাদের নফস তোমাদের জন্যে একটি অসম্ভব কাজকে সম্ভব করে দিয়েছে। আমি ধৈর্য ধরবো, উত্তম ধৈর্য। তোমরা যে কথা সাজিয়েছ, তাঁর জন্যে কেবল আল্লাহর কাছেই সাহায্য চাওয়া যেতে পারে।” (সূরা ১২ ইউসুফঃ আয়াত ১৮)

 

ছোট ছেলে বিন ইয়ামিনকে যখন তাঁর ভাইয়েরা চুরির ঘটনার জন্যে মিশরে রেখে আসতে বাধ্য হয়েছিলো, তখনো তিনি একই ভাষায় বলেছিলেন-

 

“আমি উত্তমভাবেই ধৈর্য ধারন করলাম। মহান আল্লাহ হয়তো ওদের সবাইকেই আমার কাছে এনে দিবেন।” (সূরা ১২ ইউসুফঃ আয়াত ৮৩)

 

“আমি আমার দুঃখ বেদনার ফরিয়াদ কেবল আল্লাহর কাছেই করবো। আল্লাহর ব্যাপারে আমি যততুকু জানি তোমরা তা জানোনা। হে আমার ছেলেরা, তোমরা যাও, ইউসুফ ও তাঁর ভাইকে (বনিয়ামিন) খুজে দেখো। আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়োনা।” (সূরা ১২ ইউসুফঃ আয়াত ৮৬-৮৭)

 

হযরত ইয়াকুবের ঐ দুষ্ট প্রকৃতির দশটি ছেলে যখন মিশর শাসকের পরিচয় পেলো, তখন তারা দেখলো, এতো তাঁদেরই সেই ভাই ইউসুফ, যাকে তারা অন্ধকূপে ফেলে দিয়েছিলো। ইউসুফ তাঁদের ক্ষমা করে দিলেন। ইউসুফের জন্যে চিন্তা করতে করতে হযরত ইয়াকুবের দুটি চোখ অন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। ইউসুফ তাঁর ভাইদের কাছে নিজের জামা দিয়ে বললেন- এটি নিয়ে আমার আব্বার মুখমণ্ডলে রাখো, তাতে তিনি দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাবেন। তারা যখন ইউসুফের সসংবাদ আর তাঁর জামা নিয়ে কেনানের উদ্দেশে রওয়ানা করলো, তখন হযরত ইয়াকুব বাড়ির লোকদের বললেন-

 

“আমি ইউসুফের সুবাস পাচ্ছি।”(সূরা ১২ ইউসুফঃ আয়াত ৯৪)

 

অতপর সুসংবাদ বহনকারীরা যখন ইউসুফের জামাটি এনে তাঁর মুখমণ্ডলে রাখলো, সাথে সাথে তিনি দৃষ্টিশক্তি লাভ করলেন। তখন তিনি তাঁর ঘরের লোকদের বললেন-

 

 “আমি না তোমাদের বলেছিলাম, আমি আল্লাহর পক্ষ থেকে এমন সব কথা জানি, যা তোমরা জানোনা।” (সূরা ১২ ইউসুফঃ আয়াত ৯৬)

 

বৃদ্ধ বয়েসে মিশর এলেন

 

কি সৌভাগ্য হযরত ইয়াকুব (আঃ) এর। মহান আল্লাহ তাঁর হারানো ছেলে ইউসুফকে মিশরের শাসক বানিয়েছেন। ইউসুফ তাঁর ভাইদের বলে পাঠিয়েছেন পরিবারের সবাইকে মিশর নিয়ে আসতে। হযরত ইয়াকুবের সেই অপরাধী ছেলেগুলো বাড়ি এসে বললো-

 

“আব্বাজান, আপনি আমাদের অপরাধ মাফির জন্যে দোয়া করুন। সত্যিই আমরা অপরাধী ছিলাম।” (সূরা ১২ ইউসুফঃ আয়াত ৯৭)

 

হযরত ইয়াকুব বললেন-

 

“আমি আমার প্রভুর দরবারে তোমাদের ক্ষমা করে দেবার জন্যে আবেদন জানাবো। তিনি বড়ই ক্ষমাশীল ও পরম করুনাময়।” (সূরা ১২ ইউসুফঃ আয়াত ৯৮)

 

অতপর হযরত ইয়াকুব সপরিবারে মিশর চলে এলেন। এ সময় তিনি বৃদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন। তারা যখন মিশরে এসে পৌঁছলেন, তখন হযরত ইউসুফ বিরাট শোভাযাত্রা সহকারে তাঁর পিতা মাতাকে অভ্যর্থনা জানালেন। অত্যন্ত সম্মানের সাথে ইউসুফ তাঁর বাবা মাকে নিজের কাছে সিংহাসনে উঠিয়ে বসালেন।

 

মিশরে হিজরত করে আসার পর হযরত ইয়াকুব (আঃ) আরো সতের বছর বেঁচে ছিলেন। এ হিজরতের সময় তাঁর বয়স ছিলো একশো ত্রিশ বছর। একশো সাতচল্লিশ বছর বয়সে তিনি মিশরে ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি ছেলেদেরকে অসিয়ত করে যান, তাঁকে যেন ফিলিস্তিনে নিয়ে তাঁর পিতা মাতার পাশে সমাহিত করা হয়।

 

পুত্রদের প্রতি উপদেশ

 

হযরত ইয়াকুব জনগন ও তাঁর পুত্রদের যে উপদেশ দিয়েছিলেন, কুরআনের দুটি স্থানে তাঁর কিছু অংশ বর্ণিত হয়েছে। যখন তাঁর দশ ছেলে ছোট ছেলে বিনইয়ামিনকে সাথে নিয়ে খাদ্য শস্য আনার জন্যে মিশর যাত্রা করেছিলে, তখন তিনি তাঁদের উপদেশ দিলেন-

 

“হে আমার ছেলেরা, তোমরা মিশরের রাজধানীতে একটি প্রবেশ পথে ঢুকো না। বিভিন্ন গেইট দিয়ে প্রবেশ করো। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছা থেকে আমি তোমাদের রক্ষা করতে পারবোনা। সমস্ত কৃতিত্ব তো আল্লাহর হাতে। আমি তাঁরই উপর ভরসা করছি। সকল ভরসাকারীকে তাঁরই উপরে ভরসা করতে হবে।” (সূরা ১২ ইউসুফঃ আয়াত ৬৭)

 

আল্লাহর নবী ইয়াকুবের এই উপদেশটিতে কয়েকটি মৌলিক কথা রয়েছে। সেগুলো হলো-

 

১. যাবতীয় কাজে কর্মকৌশল (tactics) অবলম্বন করা উচিত।

 

২. কর্মকৌশল অবলম্বন করার পরই আল্লাহর ইচ্ছা ও ফায়সালার উপর সন্তুষ্ট থাকা উচিত।

 

৩. আল্লাহকেই সমস্ত ক্ষমতা ও কর্তিতের উৎস মনে করতে হবে।

 

৪. সকল বিষয়ে আল্লাহর উপর ভরসা করা উচিত।

 

সূরা বাকারায় হযরত ইয়াকুবের উপদেশগুলো এভাবে উল্লেখ হয়েছে-

 

“ইয়াকুব তাঁর সন্তানদের এই উপদেশ দিয়েছিলোঃ হে আমার সন্তানেরা, আল্লাহ তোমাদের জন্যে মনোনীত করেছেন ‘আদ দীন’ (অর্থাৎ দ্বীন ইসলাম) সুতরাং তোমরা মুসলিম (আত্মসমর্পণকারী) থাকো। সে মৃত্যুকালে তাঁর সন্তানদের জিজ্ঞেস করেছিলো- আমার মৃত্যুর পর তোমরা কার ইবাদাত ও দাসত্ব করবে? জবাবে তারা বলেছিল, আমরা সেই এক আল্লাহর ইবাদাত ও দাসত্ব করবো। যাকে আপনি ও আপনার পূর্বপুরুষ ইবরাহীম, ইসমাঈল এবং ইসহাক ইলাহ হিসেবে মেনেছেন। আমরা তাঁরই অনুগত হয়ে থাকবো।” (সূরা ২ আল বাকারাঃ আয়াত ১৩২-১৩৩)

 

হযরত ইয়াকুব (আঃ) এর এই উপদেশটিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি থেকে আমরা জানতে পারি-

 

১. ইসলামই হলো আল্লাহর মনোনীত দ্বীন বা জীবন ব্যবস্থা।

 

২. আল্লাহর মনোনীত দীনের অনুসারীরা মুসলিম।

 

৩. সকল নবী একই দীনের বাহক ও প্রচারক ছিলেন।

 

৪. আমৃত্যু আল্লাহর অনুগত বাধ্যগত হয়ে থাকাই প্রকৃত মুমিনের কাজ।

 

৫. মুসলিম হওয়া মানে আল্লাহর দাসত্ব করা।

 

আল কুরআনে উল্লেখ

 

কুরআন মাজীদে মহান আল্লাহ তাঁর দাস ও নবী হযরত ইয়াকুবের ভুয়সী প্রশংসা করেছেন। আল কুরআনে ১৬ বার তাঁর নাম উল্লেখ হয়েছে। যেসব আয়াতে তাঁর নাম উল্লেখ হয়েছে সে আয়াতগুলো এবং সেগুলোর তাফসির পড়লেই আপনারা তাঁর সম্পর্কে আরো জানতে পারবেন। এবার জেনে নিন কোথায় কোথায় উল্লেখ হয়েছে তাঁর নাম –

 

সূরা আল বাকারা- ১৩২, ১৩৩, ১৩৬, ১৪০।

 

সূরা আলে ইমরান- ৮৪।

 

সূরা আন নিসা- ১৬৩।

 

সূরা আল আনয়াম- ৮৪।

 

সূরা হুদ- ৭১।

 

সূরা ইউসুফ- ৬, ৩৮, ৬৮।

 

সূরা মরিয়ম- ৬, ৪৯।

 

সূরা আল আম্বিয়া- ৭২।

 

সূরা আল আনকাবুত- ২৭।

 

সূরা সোয়াদ- ৪৫।

 

 মহান আল্লাহ হজরত ইয়াকুব (আঃ) সম্পর্কে বলেন-

 

“সে (ইয়াকুব) ছিলো আমার দেয়া শিক্ষায় জ্ঞানবান। কিন্তু অধিকাংশ লোক প্রকৃত সত্য জানেনা।” (সূরা ইউসুফঃ আয়াত ৬৮)

 

১১।

 

মিশর শাসক ইউসুফ

 

(আঃ)

 

পূর্বাভাস

 

“আব্বু, আজ রাতে আমি স্বপ্ন দেখেছি, এগারটি তারা এবং সূর্য আর চাঁদ আমাকে সাজদা করছে।” (সূরা ১২ ইউসুফঃ আয়াত ০৪)

 

“পুত্র আমার, এ স্বপ্নের কথা তোমার ভাইদের বলোনা। ওরা জানতে পারলে তোমার ক্ষতি করার চিন্তা করবে। আর শয়তান তো মানুষের ঘোরতর শত্রু আছেই।” (সূরা ১২ ইউসুফঃ আয়াত ০৫)

 

ছোট্ট কচি ইউসুফ যেদিন এ স্বপ্ন দেখেন, সেদিনই তাঁর বিজ্ঞ পিতা বুঝতে পারেন, মহান আল্লাহ তাঁর এই পুত্রটিকে নবুয়্যত দান করবেন। তাই তো তিনি সতর্ক করে দিলেন। সেই সাথে আরো বললেন-

 

“তোমাকে তোমার প্রভু তাঁর কাজের জন্যে নির্বাচিত করবেন, কথার মর্ম বুঝতে শেখাবেন আর তোমার প্রতি ও ইয়াকুবের পরিবারের প্রতি ঠিক তেমনি করে তাঁর নিয়ামত পূর্ণ করবেন, যেমনটি করেছিলেন তোমার পিতামহ ইসহাক ও ইব্রাহীমের প্রতি।” (সূরা ১২ ইউসুফঃ আয়াত ৫-৬)

 

বংশ পরিচয়

 

সহীহ বুখারীতে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ (সা) বলেছেন- “করিম ইবনে করিম ইবনে করিম-ইউসুফ ইবনে ইয়াকুব ইবনে ইবনে ইসহাক ইবনে ইবরাহীম।” ‘করিম’ মানে সম্মানিত। অর্থাৎ সম্মানিত নবী হযরত ইউসুফ মহাসম্মানিত নবী ইবরাহীম (আঃ এর প্রপুত্র সম্মানিত নবী ইসহাকের পৌত্র আর সম্মানিত নবী ইয়াকুবের পুত্র।

 

হযরত ইউসুফ (আঃ) যেমনি ছিলেন মহান নবীদের সন্তান, তেমনি ছিলেন অত্যন্ত উন্নত চরিত্র ও পবিত্র জীবনের অধিকারী এক মহান নবী। আল্লাহ তাঁর সম্পর্কে বলেন-

 

“ইন্নাহু কা-না মিন ইবাদিনাল মুখলাসিন- সে ছিলো আমার একান্ত বাছাই করা দাসদের একজন। ” হযরত ইউসুফের জন্ম হয় নানার বাড়িতে। জন্মের পর পিতার সারহে দাদুর বাড়িতে চলে আসেন। দাদুর বাড়ি কোথায়? হ্যাঁ, তাঁর দাদুর বাড়ি মানে নিজের বাড়ি ছিলো ফিলিস্তিনের হেবরন শহরে। তাঁর মায়ের নাম ছিলো রাহিল। হযরত ইউসুফের পিতা ইয়াকুব (আঃ) চার বিয়ে করেছিলেন। চার ঘরে তাঁর ছিলেন মোট বারো ভাই। তবে হযরত ইউসুফের সহোদর ভাই ছিলেন মাত্র একজন, বিনয়ামিন। বারো ভাইদের মধ্যে বিনয়ামিন ছিলেন সর্ব কনিষ্ঠ। ইউসুফ ছিলেন সোনার ছেলে। যেমন বাপ তেমনি ছিলেন পুত্র ইউসুফ। নবীর ছেলে ঠিক নবীর মতো জ্ঞান বুদ্ধি আর চমৎকার আচার আচরন। ইবাদাত বন্দেগীতে অগ্রগামী। আল্লাহ ভীরু, আলালহ পরায়ন। বাপ দেখলেন আল্লাহর কাছে এই ছেলেই হবে তাঁর প্রকৃত উত্তরাধিকারী। বাব এমন ছেলেকে বেশি আদর করবেন না তো কাকে আদর করবেন?

 

দশ ভাইয়ের ষড়যন্ত্র

 

ইউসুফ আর বিনয়ামিনকে পিতা নিজেই দেখাশুনা করতেন। তাছাড়া অত্যন্ত সুস্বভাবের অধিকারী হবার কারনে তিনি তাঁদের নিজের কাছে কাছে রাখতেন। অপরদিকে তাঁর অন্য দশটি ছেলে ছিলো দুষ্ট প্রকৃতির। তাঁরা বাপের মতো হয়ে গড়ে উঠেনি। তাছাড়া অন্যায় স্বভাব চরিত্রের কারনে তাঁরা পিতার বিশ্বাসভাজনও হতে পারেনি। তাঁরা একজোট হয়ে একদিন ষড়যন্ত্র পাকালো। তাঁরা বলাবলি করলো-

 

“ইউসুফ আর তাঁর ভাই বিনয়ামিন আমাদের চেয়ে বাবার কাছে অধিক প্রিয়। অথচ আমরা দশজন একটি শক্তিশালী দল। বাবা খুব ভুল করছেন। চলো আমরা ইউসুফকে মেরে ফেলি বা কোথাও নিয়ে ফেলে আসি। তখন বাবার দৃষ্টি আমাদের দিকে ফিরে আসবে। এই অপরাধটা করার পর তোমরা আবার ভালো হয়ে যেও।” (সূরা ১২ ইউসুফঃ আয়াত ৮-৯)

 

যে কথা সে কাজ। তাঁরা তাঁদের পিতার কাছে এসে বললো- বাবা, আপনি ইউসুফের ব্যাপারে আমাদের উপর আস্থা রাখেননা কেন? আমরা তো সব সময় তাঁর ভালোই চাই। আগামীকাল ওকে আমাদের সাথে দিন। আমাদের সাথে গিয়ে ফলমূল খাবে আর দৌড়াদৌড়ি করে মন চাংগা করবে। আমরা তাঁর পূর্ণ হিফাজত করবো।

 

বাবা বললেন- তোমরা তাঁকে নিয়ে গেলে আমি চিন্তাগ্রস্ত থাকবো। আমার শংকা হয়, তোমরা ওর প্রতি অমনোযোগী হয়ে পড়বে আর এ ফাকে ওকে বাঘ খেয়ে ফেলবে।

 

দশ ভাই বললো- আমরা এতগুলো লোক থাকতে ওকে বাঘে খাবে? তবে তো আমরা বড় অকর্মণ্য বলে প্রমানিত হবো। তারপর কি হলো? ইনিয়ে বিনিয়ে বাবাকে এটা ওটা বুঝিয়ে ওরা পরদিন ইউসুফকে বনের দিকে নিয়ে গেলো।      আলালহভক্ত এই ছেলেটিকে ওদের হাতে ছেড়ে দিয়ে দারুন চিন্তার মধ্যে সময় কাটাতে থাকেন ইয়াকুব।

 

কূপে ফেলে দিলো ইউসুফকে

 

সে এলাকা দিয়ে ছিলো একটি আন্তর্জাতিক পথ। এ পথে মিশর থেকে সিরিয়া আর সিরিয়া থেকে মিশরে বাণিজ্য কাফেলা যাতায়াত করতো। ব্যবসায়ীদের পানি পানের সুবিধার্থে লোকেরা পথিমধ্যে এখানে সেখানে পানির কূপ খনন করে রাখতো। ব্যবসায়ীরা কূপের কাছে বিশ্রাম নিতে আর বালতি ফেলে কূপ থেকে পানি উঠিয়ে পান করতো।

 

ইউসুফের দুরাচার নিষ্ঠুর ভাইয়েরা তাঁকে নিয়ে গিয়ে এমনই একটি কূপে ফেলে দিলো। আল্লাহ ছাড়া সেখানে ইউসুফকে সাহায্য করবার আর কেউই ছিলোনা। ইউসুফ সকল ক্ষমতার মালিক একমাত্র আল্লাহর উপর ভরসা করলেন। তাঁর মহান প্রভু আল্লাহ অহীর মাধ্যমে তাঁকে শান্তনা দিলেন এবং ভবিষ্যতের সুসংবাদ জানিয়ে দিলেন।

 

বাপের কাছে বানোয়াট কাহিনী

 

এবার দশ ভাই ফন্দি আঁটলো বাপের কাছে এসে কি বলবে? যারা মিথ্যা বলতে পারে, তাঁদের জন্যে কোন একটা ফন্দি এঁটে নেয়া তো কঠিন নয়। ইউসুফকে কূপে ফেলে দেয়ার সময় তাঁরা তাঁর জামাটা রেখে দিয়েছিলো। একটা পশু যবাই করে এবার ইউসুফের জামায় সেটার রক্ত মেখে নিলো। সন্ধ্যার পর ভান করে কাঁদতে কাঁদতে দশ ভাই বাড়ি ফিরে এলো। ইউসুফের রক্তমাখা জামা বাপের সামনে রেখে দিয়ে বললো- “বাবা, আমরা দশভাই দৌড় প্রতিযোগিতা করছিলাম। এদিকে ইউসুফকে বসিয়ে রেখেছিলাম আমাদের জিনিসপত্রের কাছে। হঠাৎ এক নেকড়ে এসে ওকে খেয়ে ফেলে। আমরা সত্য কথা বলছি বাবা, জানি, আমরা যতই সত্য বলিনা কেন আপনি আমাদের কথা বিশ্বাস করবেননা।” (সূরা ১২ ইউসুফঃ আয়াত ১৭)

 

দেখলেন তো মিথ্যাবাদীদের সত্য বলার ধরন। তাঁদের পিতা মহান নবী হযরত ইয়াকুব এতো বড় ঘটনা ঘটে যাবার পরও কেবল আল্লাহর সাহায্য চেয়ে ধৈর্য ধারন করলেন।

 

রাখে আল্লাহ মারে কে?

 

এদিকে ইউসুফের কি হলো? ইউসুফ কি বেঁচে আছেন, না কূপে ডুবে মারা গেছেন? আল্লাহ যাকে বাচান তাঁকে মারার শক্তি কার আছে? আল্লাহ কূপের মধ্যে ইউসুফের বেঁচে থাকার ব্যবস্থা করেন। ইউসুফ সুস্থ শরীরে বেঁচে আছেন। ইতোমধ্যে সেখানে একটি বাণিজ্য কাফেলা এসে অবতরন করলো। তাঁরা তাঁদের একজনকে কূপ থেকে পানি উঠাতে পাঠালো। সে যখন পানির জন্যে বালতি ফেললো, ইউসুফ তাঁর বালতি ধরে উঠে এলেন। লোকটি চিৎকার করে উঠলো- কি চমৎকার, এ যে এক বালক। তাঁরা তাঁকে নিয়ে গিয়ে পণ্যদ্রব্য হিসেবে বিক্রি করে দিলো। বিক্রি করলো মাত্র সামান্য কয়েক দিরহামে।

 

মিশরে ইউসুফ

 

মিশরের ‘আযিয মিশর’ উপাধিধারী এক বড় মন্ত্রী ইউসুফকে বিনিকদের কাছ থেকে কিনে নেন। তিনি ইউসুফকে বাড়ি নিয়ে গিয়ে তাঁর স্ত্রীকে বললেন- ‘একটি ছেলে কিনে এনেছি। ওকে যত্ন করে রেখো। ও আমাদের উপকারে আসতে পারে, আর নয়তো তাঁকে আমরাই পুত্র বানিয়ে নেবো।’

 

এবার দেখুন আল্লাহর ক্ষমতা। তিনি কিভাবে ইউসুফকে বাঁচিয়ে নিয়ে এলেন সেকালের শক্তিশালী রাজ্য মিশরের ক্ষমতাবানদের ঘরে। আল্লাহ বলেন-

 

“এভাবে আমি ইউসুফের জন্যে সে দেশে প্রতিষ্ঠিত হবার পথ বের করে দিলাম। সেই সাথে আমি তাঁকে সবকিছুর মর্ম বুঝার শিক্ষাও দান করলাম।”

 

এ ঘরে ইউসুফ রাজপুত্রের সমাদরে বড় হতে থাকলেন। এখানেই তিনি যখন পূর্ণ যৌবনপ্রাপ্ত হলেন, তখন আল্লাহ তাঁকে নবুয়্যত দান করেন। তাঁকে নবুয়্যত দান করে আল্লাহ বলেন – “আমি নেক লোকদের এভাবেই প্রতিদান দিয়ে থাকি। ” (সূরা ১২ ইউসুফঃ আয়াত ২২)

 

জেলে যাবো তবু পাপ করবোনা

 

তখনকার মিশরের লোকদের নৈতিক চরিত্র ছিলো খুবই খারাপ। তাঁদের নারী পুরুষ সবাই নির্লজ্জের মতো পাপ কাজ করে বেড়াতো। কেউ পাপ কাজ করলে অন্যেরা সেটাকে খারাপ মনে করতোনা। ইউসুফ যেমন ছলেন জ্ঞানী, গুনী, বুদ্ধিমান, ঠিক তেমনি ছিলেন অত্যন্ত সুন্দর, সুশ্রী এক বলিষ্ঠ যুবক। সেই ‘আযিয মিশরের’ স্ত্রী এবং অন্যান্য শহুরে মহিলারা ইউসুফকে চারিদিক থেকে পাপ কাজে নামাবার জন্যে ফুসলাতে থাকে। আযীয মিশরের স্ত্রী জুলেখা একপক্ষীয়ভাবে ইউসুফের সাথে পাপ কাজে লিপ্ত হবার জন্যে পাগল হয়ে যায়। একদিন সে ঘরের সব দরজা বন্ধ করে দিয়ে ইউসুফকে বলে- ‘আসো’

 

ইউসুফ বলেন- “এমন কর্ম থেকে আমি আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই। আমার প্রভু আমাকে উচ্চ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছেন। যারা পাপ কাজ করে তাঁরা কখনো সাফল্য অর্জন করেনা।” (সূরা ১২ ইউসুফঃ আয়াত ২৩)

 

একথা বলে ইউসুফ ঘর থেকে বের হয়ে যাবার জন্যে দরজার দিকে দৌড়ালেন। মহিলাটিও তাঁকে ধরার জন্যে তাঁর পেছনে পেছনে দৌড়ালো। মহিলাটি পেছন থেকে ইউসুফের জামা টেনে ধরে। ইউসুফ দৌড়াতে থাকেন। ফলে টানাটানিতে তাঁর জামা ছিড়ে যায়। ইউসুফ দরজা পর্যন্ত চলে আসেন এবং দরজা খুলে ফেলেন। দরজা খুলতেই তাঁরা দু’জনে মহিলার স্বামী আযীয মিশরকে দরজার সামনে দাঁড়ানো দেখতে পায়। পাপিষ্ঠ মহিলাটি হন্তদন্ত হয়ে ইউসুফের প্রতি ইংগিত করে তাঁর স্বামীকে বলে উঠে- ‘যে আপনার স্ত্রীর সাথে বদ কাজ করতে চাইছে, তাঁকে কারাগারে নিক্ষেপ করুন অথবা কঠিন শাস্তি দিন।’

 

ইউসুফ বললেন- আমি নই, তিনিই আমাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছেন। দুই ধরনের কথার প্রেক্ষিতে আযিয মিশর বেকায়দায় পড়ে যান। এমতাবস্থায় মহিলার ঘরেরই একজন সাক্ষী দিয়ে বললো- ‘দেখুন, ইউসুফের জামা যদি সামনের দিক থেকে ছেড়া হয়ে থাকে, তাহলে ইউসুফ মিথ্যাবাদী এবং আপনার স্ত্রী সত্যবাদী। আর ইউসুফের জামা যদি পেছনের দিক থেকে ছেড়া থাকে, তাহলে ইউসুফ সত্যবাদী এবং আপনার স্ত্রী মিথ্যাবাদী।’ তাঁর স্বামী যখন দেখলেন, ইউসুফের জামা পেছন দিক থেকে ছেড়া, তখন তিনি তাঁর স্ত্রীকে বলেন- “এটা তোমারই চক্রান্ত। নারীদের ছলনা চক্রান্ত খুবই শক্তিশালী। হে ইউসুফ, তুমি বিষয়টা উপেক্ষা করো। হে আমার স্ত্রী, তুমি ক্ষমা চাও, কারন তুমিই দোষী।”

 

আযীয মিশরের স্ত্রীর এই ছিনালির খবর ছরিয়ে পড়ে চারিদিকে। কানাঘুষা চলতে থাকে উপরের তলার মহিলাদের মধ্যে। তাঁদের কথা হলো- ছিনালি করবি তো কর উপরের তলার কোন পুরুষের সাথে, ক্রীতদাসের করতে গেলি ক্যান?

 

তাঁদের এসব কথাবার্তার খবর এসে পৌঁছে যায় আযীয মিশরের স্ত্রী জুলেখার কানেও। তাঁর কথা হলো- ওরা আমার কাংখিত যুবকটি সম্পর্কে না জেনেই ওরা আমাকে দোষারোপ করছে।

 

ফলে জুলেখা তাঁদের ভুল ধারনা দূর করার সিদ্ধান্ত নেয়। সে উপর তলার মহিলাদের জন্যে আয়োজন করে এক ভোজ সভার। তাঁদেরকে নিমন্ত্রন জানায় নির্দিষ্ট দিন। খাবার টেবিলে খাবার সাজিয়ে রাখে। কেটে কেটে খাবার জন্যে তাঁদের প্রত্যেকের জন্যে সরবরাহ করে একটি করে ছুরি। সবাই ছুরি দিয়ে ফল কেটে কেটে খাচ্ছে, এমনি সময় জুলেখা ইউসুফকে তাঁদের সামনে আসতে আদেশ করে। ইউসুফ ডাইনিং হলে ঢুকতেই সবগুলো নারী বিস্ময়ে হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে ইউসুফের দিকে। তাঁরা আত্মভোলা হয়ে কেটে ফেলে নিজেদের হাত। তাঁরা স্বগত স্বত্বস্ফ্রত বলে উঠে- ‘আল্লাহর কসম, এতো মানুষ নয়, সাক্ষাত এক সম্মানিত ফেরেশতা।’ এবার জুলেখা বলে উঠে, দেখো, তোমরা না জেনে এমন একজন যুবকের ব্যাপারেই আমাকে তিরস্কার করছিলে। আমি অবশ্যি তাঁকে নিবেদন করেছি। কিন্তু সে আমার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। এখন থেকে সে যদি আমার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে তাহলে অবশ্যি আমি তাঁকে হীন ও লাঞ্ছিত করে কারাগারে নিক্ষেপ করবো। আল্লাহর একান্ত অনুগত দাস ইউসুফ তো কিছুতেই পাপ কাজে নিমজ্জিত হতে পারেননা। এখন তাঁদের সবার জালাতনে তিনি অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। উপর তলার সব মহিলার দৃষ্টি এখন ইউসুফের দিকে। নাগিনীদের চতুর্মুখী ছোবলের মুখে ইউসুফ এক মুহূর্তের জন্যেও তাঁর মহামনিব আল্লাহর অসন্তুষ্টির পথে পা বাড়াননি। ইউসুফ আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন-

 

“ওগো আমার প্রভু, এরা আমাকে যে কাজের দিকে ডাকছে তাঁর চাইতে কারাগারই আমার কাছে অধিকতর প্রিয়। আমার প্রভু, এদের চক্রান্ত থেকে তুমি যদি আমাকে না বাঁচাও, তাহলে তো আমি এদের ফাঁদে আঁটকে যাবো।’’ (সূরা ১২ ইউসুফঃ আয়াত ৩৩)

 

কারাগারে ইউসুফ

 

আল্লাহ ইউসুফের ফরিয়াদ কবুল করলেন। নারীদের চক্রান্ত থেকে তাঁকে রক্ষা করলেন। যাদের নারীরা ইউসুফের জন্যে উন্মাদ হয়ে পড়েছিলো, তাঁরা একটি মেয়াদের জন্যে ইউসুফকে কারাগারে পাঠিয়ে দিলো। অথচ তাঁরা জানতো ইউসুফ সম্পূর্ণ নির্দোষ। এভাবে ইউসুফ নৈতিক পরীক্ষায় মহাবীরের বেশে বিজয়ী হলেন। আর মিশরের অভিজাত মহল তাঁর চারিত্রিক আদর্শের কাছে চরমভাবে পরাজিত হলো।

 

দুই কয়েদীর স্বপ্ন এবং ইউসুফের দাওয়াতী কাজ

 

ইউসুফ জেলে এসে কৌশলের সাথে আল্লাহর দ্বীন প্রচারের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর জ্ঞান, বুদ্ধি, উন্নত চরিত্র আর দাওয়াতী কাজে আকৃষ্ট হয়ে কয়েদীরা তাঁর ভক্ত হয়ে পড়ে। এক রাতে দু’জন কয়েদী স্বপ্ন দেখলো। তাঁরা ভাবলো, ইউসুফ ছাড়া আর কেউ তাঁদের স্বপ্নের মর্মার্থ বলে দিতে পারবেনা। ছুটে এলো তাঁরা ইউসুফের কাছে।

 

একজন বললো- ‘আমি স্বপ্ন দেখেছি, আমি মদ তৈরি করছি’।

 

অপরজন বললো- ‘আমি স্বপ্ন দেখেছি, আমার মাথায় রুটি রাখা আছে আর পাখি তা থেকে খাচ্ছে।’

 

এরা দু’জন ছিলো মিশর রাজের কর্মচারী। একজন ছিলো রাজার মদ প্রস্তুতকারক, আর অপরজন ছিলো রাজার রুটি প্রস্তুতকারক।

 

ইউসুফ ওদের স্বপ্নের কথা শুনে বললেন- তোমাদের খাবার আসার আগেই আমি তোমাদের স্বপ্নের ব্যাখ্যা বলে দেবো। এই ফাকে তোমরা আমার কিছু কথা শুনো। আমি মহান প্রভু আল্লাহর দেয়া জ্ঞানের ভিত্তিতে তোমাদের বলছি-

 

“আল্লাহর সাথে কাউকেও শরীক করা উচিত নয়। এটা আমাদের এবং গোটা মানবজাতির উপর আল্লাহর বিরাট অনুগ্রহ, তিনি আমাদেরকে তাঁর ছাড়া অন্য কারো দাসত্ব করার জন্যে সৃষ্টি করেননি। কিন্তু অধিকাংশ লোক তাঁর শোকর আদায় করেনা।”

 

“হে আমার কারাসাথীরা, চিন্তা করে দেখো, ভিন্ন ভিন্ন বহু খোদা ভালো, নাকি একজন সর্বশক্তিমান আল্লাহ ভালো? তাঁকে বাদ দিয়ে তোমরা যার ইবাদাত করছো, তাঁরা তো মাত্র কতগুলো নাম। এ নামগুলো তো তোমরাই রেখেছো।”

 

“আসলে সকল ক্ষমতার উৎস একমাত্র মহান আল্লাহ। কৃতিত্ব শুধুমাত্র তাঁর। তিনি হুকুম দিয়েছেন তোমরা তাঁর ছাড়া আর কারো দাসত্ব করবেনা। এটাই হলো সঠিক সরল জীবন পদ্ধতি। কিন্তু অধিকাংশ লোক তা জানেনা।” (সূরা ১২ ইউসুফঃ আয়াত ৩৮-৪০)

 

ব্যাস, একটি মোক্ষম সময় বেছে নিলেন হজরত ইউসুফ ওদেরকে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেওয়ার জন্যে। এটি মোক্ষম সময় এ জন্যে ছিলো যে হজরত ইউসুফ দেখলেন-

 

১. তাঁরা তাঁর অত্যন্ত ভক্ত অনুরক্ত হয়েছে এবং

 

২. এ সময় তাঁরা মনোযোগ দিয়ে তাঁর কথা শুনবে।

 

হজরত ইউসুফ তাঁদেরকে কিসের দাওয়াত দিলেন? তিনি তাঁদের যে দাওয়াত দেন, তাঁর মৌলিক কথা হলো-

 

১. আল্লাহ এক, তাঁর কোন শরীক নাই।

 

২. আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন একমাত্র তাঁর দাসত্ব করার জন্যে। অন্য কারো দাসত্ব করার জন্যে নয়।

 

৩. আল্লাহ সর্বজয়ী, সর্বশক্তিমান।

 

৪. সমস্ত ক্ষমতা ও কৃতিত্বের মালিক একমাত্র আল্লাহর।

 

৫. তিনি মানুষকে কেবল তাঁর হুকুম মেনে চলার নির্দেশ দিয়াছেন।

 

৬. এক আল্লাহর নির্দেশ মতো জীবন যাপন করাই সত্য সঠিক ও বাস্তব দ্বীন বা জীবন পদ্ধতি।

 

এমনি চমৎকার ভাবে দাওয়াত পেশ করার পর এবার তিনি তাঁদের স্বপ্নের ব্যাখ্যা বলে দিলেন। বললেন-

 

“তোমাদের প্রথমজন তাঁর মনিবকে মদ পান করাবার চাকুরিতে ফিরে যাবে। আর দ্বিতীয়জনকে শুলে চরিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে এবং পাখি তাঁর মাথা ঠুকে ঠুকে মগজ খাবে। এই হলো তোমাদের স্বপ্নের ব্যাখ্যা।” (সূরা ১২ ইউসুফঃ আয়াত ৪১)

 

সত্যি তাই হলো। একজন মুক্তি পেলো এবং নিজের পূর্বের চাকুরিতে ফিরে গেলো। অপরজনকে শুলে করে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় এবং পাখি তাঁর মাথায় বসে মগজ খুঁটে খুঁটে খায়।

 

স্বপ্ন দেখেন রাজা

 

কারাগারে হজরত ইউসুফের আরো কয়েকটি বছর কেটে যায়। তিনি সেখানেই দীনের কাজ করতে থাকেন। এরি মধ্যে মিশরের রাজা এক স্বপ্ন দেখেন। তিনি স্বপ্ন দেখেন-

 

“সাতটি মতা তাজা গাভীকে সাতটি শুকনো হালকা পাতলা গাভী খেয়ে ফেলছে। আরো দেখেন সাতটি সবুজ শস্যের ছড়া আর সাতটি শুকনো ছড়া।”

 

রাজা তাঁর পারিষদবর্গকে এ স্বপ্নের ব্যাখ্যা করতে বললেন। কিন্তু তাঁরা কেউই এর ব্যাখ্যা করতে পারলোনা। এ সময় হঠাৎ ইউসুফের সেই কারা সাথিটির মনে পড়লো ইউসুফের কথা। সে বললো- আমাকে ইউসুফের কাছে পাঠিয়ে দিন, আমি স্বপ্নের ব্যাখ্যা এনে দিচ্ছি। তাই করা হলো। সে ছুটে এলো কারাগারে। ইউসুফের কাছে এসে বললো-

 

“হে মহাসত্যবাদী ইউসুফ, আমাদের রাজা এই স্বপ্নে দেখেছেন। আপনি এর ব্যাখ্যা বলে দিন।” ইউসুফ রাজার স্বপ্নের মর্ম বলে দিলেন। তিনি বললেন- “তোমরা সাত বছর লাগাতার চাষাবাদ করবে। এ সময় যে ফসল কাটবে, তা থেকে আহারের পরিমান ছড়া (শীষ) থেকে বের করবে, বাকিটা ছড়া সমেত রেখে দেবে। তারপর তোমাদের দেশে আসবে দুর্ভিক্ষের সাত বছর। এ সময় খুব কমই ফসলাদি হবে। এ সময় আগের সাত বছরের সংরক্ষিত ফসল খাবে। অতপর একটি বছর আসবে, তখন প্রচুর বৃষ্টিপাত হবে এবং প্রচুর ফসল উঠবে।”

 

(সূরা ১২ ইউসুফঃ আয়াত ৪৭-৪৯)

 

লোকটি এই স্বপ্নের ব্যাখ্যা নিয়ে গিয়ে রাজাকে বললো। এ ব্যাখ্যা রাজার মনের মতো হলো। তিনি ব্যাখ্যাটি দারুন পছন্দ করলেন আর কারাগারে লোক পাঠিয়ে দিলেন ইউসুফকে নিয়ে আসার জন্যে। রাজার দূত যখন ইউসুফকে কারাগার থেকে বের করে নিতে এলো, ইউসুফ তাঁকে বললেন, ফিরে যাও। রাজাকে গিয়ে বলো, আগে সেই মহিলাদের বিচার করতে, যারা চক্রান্ত করে আমাকে কারাগারে পাঠিয়েছে।

 

রাজা সেই মহিলাদের ডেকে পাঠালেন এবং তাঁদের কাছে কৈফিয়ত চাইলেন। তাঁরা বললো- “আল্লাহর কসম, ইউসুফ কোন অন্যায় করেনি, কোন পাপ করেনি। আমরাই তাঁকে ফাসাতে চেষ্টা করেছিলাম। সে সম্পূর্ণ নিষ্পাপ, নির্দোষ এবং সে অত্যন্ত সৎ ও সত্যবাদী।”

 

এ সত্য উদঘাটিত হবার পর ইউসুফ বললেন- আমি তো চেয়েছিলাম, এ সত্য প্রকাশিত হোক আর আযীয জানতে পারুক, আমি বিশ্বাস ঘাতকতা করিনি। আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ।

 

ইউসুফের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা লাভ

 

রাজা নির্দেশ দিলেন যাও, এবার ইউসুফকে আমার কাছে নিয়ে এসো। আমি তাঁকে একান্তভাবে নিজের জন্যে নিয়োগ করবো। ইউসুফ জেল থেকে বেরিয়ে এলেন। রাজা যখন তাঁর সাথে কথা বললেন, তিনি তাঁর অগাধ জ্ঞান, বুদ্ধিমত্তা আর বলিষ্ঠ নৈতিক চরিত্র দেখে অভিভূত হলেন। তিনি বললেন- আপনি এখন আমাদের এখানে পূর্ণ সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী। আপনি অত্যন্ত বিশ্বস্ত। ইউসুফ বললেন- আপনি দেশের অর্থ ভাণ্ডারের দায়িত্ব আমার উপর ন্যস্ত করুন। আমি তা যথাযথ সংরক্ষণ করবো। এ ব্যাপারে আমি জ্ঞান রাখি। রাজা তাই করলেন। আর এভাবেই মহান আল্লাহ ইউসুফের জন্যে রাষ্ট্রীয় কৃতিত্বের পথ পরিস্কার করে দিলেন। তিনি সৎলোকদের প্রতিদান কখনো বিনষ্ট করেননা। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে পৃথিবীতেও তাঁদের পুরস্কৃত করেন আর পরকালের প্রতিদান তো রয়েছেই। শেষ পর্যন্ত রাজা ইউসুফের সততা, দক্ষতা ও আন্তরিক নিষ্ঠার জন্যে গোটা দেশের শাসনভারই ছেড়ে দেন ইউসুফের উপর এবং নিজে তাঁর পৃষ্ঠপোষকতা করেন।

 

ইউসুফের ভাইয়েরা এলো মিশরে

 

হযরত ইউসুফ (আঃ) অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাবার পর সাত বছর খুব ফসল হয়। তিনি সুন্দরভাবে ফসল সংরক্ষন করেন। এরপর আসে পরবর্তী দুর্ভিক্ষের সাত বছর। এ সময় সংরক্ষিত ফসল ভাণ্ডার দিয়ে দুর্ভিক্ষের মোকাবেলা করেন। ফিলিস্তিনের দিকেও দেখা দেয় দুর্ভিক্ষ। মিশরে খাদ্য মজুদ থাকার খবর শুনে বিভিন্ন দেশের লোকেরা খাদ্য শস্যের জন্যে ছুটে আসে মিশরে। ইউসুফের ভাইয়েরাও খাদ্য কেনার জন্যে ছুটে আসে মিশরে। হ্যাঁ, ইউসুফের সেই দশভাই মিশরে এলো। তাঁরা অর্থকড়ি নিয়ে এসেছে খাদ্য শস্য কেনার জন্যে।

 

তাঁরা এসে অর্থমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করতে চাইলো। ফলে তাঁদেরকে নিয়ে যাওয়া হলো ইউসুফের কাছে। তাঁরা ইউসুফকে মোটেও চিনতে পারেনি। কিন্তু ইউসুফ তাঁদের চিনে ফেললেন। তাঁদের সাথে কথাবার্তা বললেন। খোঁজ খবর নিলেন। বললেন, একটি ভাইকে আবার বাড়িতে রেখে এলেন কেন? আবার আসার সময় তাকেও নিয়ে আসবেন। ছোট্টভাইটিকে অর্থাৎ বিনয়ামিনকে দেখার জন্যে ইউসুফের মন ছটফট করছিলো। তিনি তাঁদের বিদায় দেয়ার সময় বলে দিলেন, দেখুন আমি খুবই অতিথি পরায়ন। দেখছেন না আমি কি রকম পাত্র ভরে দিচ্ছি? আপনাদের ছোট ভাইটিকেও নিয়ে আসবেন। ওকে নিয়ে না এলে আপনাদের আর এখানে আসার দরকার নেই। আর আপনাদের খাদ্য শস্য দেয়া হবেনা। ইউসুফ এদিকে তাঁর কর্মচারীদের গোপনে বলে দিলেন, ওরা খাদ্য শস্যের বিনিময়ে যে অর্থ দিয়েছে সেগুলো চুপিসারে, তাঁদের শস্যের বস্তায় ঢুকিয়ে ফিরিয়ে দাও। বাড়ি ফিরে এসে তাঁরা তাঁদের পিতাকে বললো- আব্বা, বিনয়ামিনকে নিয়ে না গেলে এরপর আমাদের আর খাদ্যশস্য দেবেনা। এবার ওকে আমাদের সাথে দিন। আমরা অবশ্যি তাঁর হিফাজত করবো। বস্তা খোলার পর খাদ্যশস্যের সাথে অর্থকড়ি ফিরিয়ে দিয়েছে দেখে তাঁরা খুশিতে বাগবাগ হয়ে উঠলো। তাঁরা বলল- আব্বাজান, আমাদের আর কি চাই। এই দেখুন, আমাদের অর্থকড়ি ফিরিয়ে দিয়েছে। আমরা আবার যাবো। আমাদের ভাইয়ের হিফাজত করবো। তাঁদের পিতা হযরত ইয়াকুব বললেন- তোমাদের তো বিশ্বাস করা যায়না। আল্লাহই সত্যিকার হিফাজতকারী। আমি ততক্ষন পর্যন্ত ওকে তোমাদের সাথে দেবোনা, যতক্ষন না তোমরা আল্লাহর নামে ওকে ফিরিয়ে আনার শপথ না করবে। সুতরাং তাঁরা বিনয়ামিনকে ফিরিয়ে আনবে বলে আল্লাহর নামে শপথ করলো। এবার হযরত ইয়াকুব ওকে তাঁদের সাথে দিলেন। আর তাঁদের বলে দিলেন, তাঁরা যেন বিভিন্ন পথে মিশরে প্রবেশ করেন। একত্রে একই পথে যেনো না ঢুকে। এরপর কি হলো? এরপর তাঁরা মিশরে এলো। ইউসুফের কার্যালয়ে প্রবেশ করলো। ইউসুফ বিনয়ামিনকে একান্তে ডেকে নিয়ে নিজের পরিচয় দিলেন। ওহ, তখন দুই সহোদর ভাইয়ের কী যে আনন্দ, কিন্তু দশভাইকে তাঁরা এটা বুঝতে দেননি। তাঁদের মালপত্র প্রস্তুত করে দেউয়া হলো। এ সময় ইউসুফ নিজ ভাইয়ের মালের সাথে একটি সোনার পেয়ালা ঢুকিয়ে দিলেন। তাঁরা মালপত্র নিয়ে রওয়ানা করলো। কিছুদূর যেতে না যেতেই পিছে থেকে ডাক পড়লো। তাঁদের বলা হলো, তোমরা চোর।

 

তাঁরা জিজ্ঞেস করলো- কেন, আপনাদের কি হারিয়েছে?

 

 কর্মচারীরা বললো- বাদশাহর পানপাত্র হারিয়েছে। তাঁরা বললো- আল্লাহর কসম আমরা অনাসৃষ্টি করতে আসিনি। আর আমরা চোরও নই।

 

‘তোমাদের কথা মিথ্যা প্রমান হলে চোরের কি শাস্তি হবে?’

 

‘যার কাছে পেয়ালা পাওয়া যাবে, আপনারা তাঁকে রেখে দেবেন। আমাদের ওখানে যালিমদের শাস্তির বিধান এটাই।’

 

এবার তল্লাশি শুরু হলো। প্রথমেই দশভাইয়ের মাল তল্লাশি করা হলো। সবশেষে বিনয়ামিনের মালপত্র থেকে উদ্ধার করা হয় পেয়ালা।

 

দশভাই বললো- ‘এ যদি চুরি করে থাকে তাহলে অবাক হবার কিছু নেই। ইতিপূর্বে তাঁর সহোদর ইউসুফও চুরি করেছিলো।’ ইউসুফ তাঁদের অপবাদ নীরবে হজম করেন। সত্য তাঁদের কাছে এখনো প্রকাশ করলেননা। মনে মনে বললেন- তোমরা বড় বদ। আল্লাহ প্রকৃত সত্য অবগত আছেন। তাঁরা আবদার করলো, বিনয়ামিন ধরা পড়লেও তাঁর পরিবর্তে তাঁদের কোন একজনকে রেখে দিতে। ইউসুফ তা অন্যায় বলে অস্বীকার করলেন। ফলে তাঁরা নিরাশ হয়ে বাইরে গিয়ে ভাবতে থাকে এখন কী করবে?

 

তাঁদের মধ্যে যে ভাইটি সবচে বড়, সে বললো- তোমাদের কি মনে নেই তোমরা তোমাদের পিতার সাথে কি অংগীকার করে এসেছো? তোমরা বিনয়ামিনকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে বলে আল্লাহর নামে অংগীকার করে আসোনি? ইতোপূর্বে ইউসুফের ব্যাপারেও তোমরা বাড়াবাড়ি করেছো, তাও তোমাদের মনে আছে। এখন আমি এখানেই থেকে যাবো। আল্লাহর কোন ফায়সালা না হলে অথবা বাবা অনুমতি না দিলে আমি এখান থেকে ফিরে যাবোনা। তোমরা বাবার কাছে গিয়ে সব ঘটনা খুলে বলোগে।

 

ওরা বাড়ি ফিরে এসে যখন তাঁদের পিতা হজরত ইয়াকুবের কাছে ঘটনা বললো, তখন তিনি বললেন- আমি সবর করবো। মহান আল্লাহ ওদের দুই ভাইকেই আমার কাছে ফিরিয়ে আনতে পারেন। তিনি তো সবকিছু জানেন।

 

এদিকে দুঃখ বেদনায় হজরত ইয়াকুব জর্জরিত হয়ে পড়েন। কাঁদতে কাঁদতে তাঁর চোখ অন্ধ হয়ে যায়। তিনি ছেলেদের বলেন- যাও, ইউসুফ আর তাঁর ভাইকে অনুসন্ধান করো। আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না।

 

ইউসুফের সন্ধান লাভ

 

তাঁরা আবার ফিরে এলো মিশরে। ইউসুফের সাথে দেখা করে বললো- “হে আযীয, আমরা এবং আমাদের পরিবার পরিজন কঠিন বিপদের সম্মুখীন হয়েছি। সামান্য পুঁজি নিয়ে এসেছি। আপনি দয়া করে পুরো মাত্রায় খাদ্যশস্য দিন। আমাদের দান করুন। আল্লাহ দানকারীদের অবশ্যি প্রতিদান দিয়ে থাকেন।”

 

ওদের বক্তব্য শুনে ইউসুফ বললেন- “তোমাদের কি মনে নেই তোমরা যখন অজ্ঞ ছিলে তখন ইউসুফ আর তাঁর ভাইয়ের সাথে কি ব্যবহারটা করেছিলে?”

 

একথা শুনে তাঁরা আঁতকে উঠলো। বললো- “হায়, তুমিই কি ইউসুফ?”

 

“হ্যাঁ, আমিই ইউসুফ আর এই বিনয়ামিন আমার ভাই। মহান আল্লাহ আমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। যারাই আল্লাহকে ভয় করবে আর সবর অবলম্বন করবে, আল্লাহ সেই সৎ লোকদের কর্মফল নষ্ট করবেন না।”

 

ওরা দশভাই বললো- আল্লাহর কসম, আল্লাহ তোমাকে আমাদের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন। সত্যিই আমরা বড় অপরাধ করেছি।

 

ইউসুফ বললো- “আজ আর তোমাদের প্রতি আমার কোন অভিযোগ নেই। আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করুন। তিনি সব দয়ালুর বড় দয়ালু।”

 

এরপর ইউসুফ তাঁর গায়ের জামা তাঁদের দিয়ে বললেন- এ জামাটি নিয়ে বাড়ি চলে যাও। এটি আমার আব্বাজানের মুখমণ্ডলে রেখো। এতে তিনি দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাবেন। আর আমাদের আব্বা আম্মাসহ তোমাদের সমস্ত পরিবার পরিজনকে মিশরে নিয়ে এসো। দশভাই এবার মনের সুখে ফিলিস্তিন অভিমুখে যাত্রা করলো। এদিকে এরা যাত্রা করেছে আর ওদিকে হজরত ইয়াকুব বাড়ির লোকদের বললেন- আমি ইউসুফের সুবাস পাচ্ছি, তোমরা আমাকে বুড়ো বয়েসের বুদ্ধিভ্রষ্ট বলোনা।

 

ইতোমধ্যে ওরা ইউসুফের সুসংবাদ নিয়ে বাড়ি পৌঁছে গেলো। ঐ জামাটি হজরত ইয়াকুবের মুখমণ্ডলে স্পর্শ করার সাথে সাথে তিনি দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেলেন। আনন্দে খুশিতে হজরত ইয়াকুব আল্লাহর শুক্রিয়া আদায় করলেন। ওরা দশভাই বাবার কাছে ক্ষমা চাইলো। বাবাকে ওদের জন্যে আল্লাহর কাছে দোয়া করতে বললো। তিনি তাঁদের জন্যে দোয়া করলেন।

 

ইয়াকুব পরিবারের হিজরত

 

হজরত ইয়াকুব সবাইকে হিজরতের প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দিলেন। সহসাই বিরাট পরিবার পরিজনের বহর নিয়ে তাঁরা মিশরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। জানা যায় এ এসময় হজরত ইয়াকুবের পরিবারের সদস্য সংখ্যা ছিলো ৬৭ জন। তাঁরা যেদিন মিশরের রাজধানীর কাছে পৌঁছলেন, সেদিন মিশরে ছিলো একটি উৎসবের দিন। উৎসব উপলক্ষে বিপুল সংখ্যক লোক এক যায়গায় একত্রিত হয়। হজরত ইউসুফ সেনাবাহিনী ও জনগনের বিরাট এক শোভাযাত্রাসহ তাঁর পিতা মাতাকে অভ্যর্থনা জানান। ইউসুফের বাবা মা ও পরিবারবর্গের মিশরে আগমনের খবর শুনে জনগনের মাঝে খুশির জোয়ার বয়ে আসে। স্বয়ং মিশরের রাজা ইউসুফকে নির্দেশ দেন, তাঁদের বড় আকারে সংবর্ধনা জানাবার। বাবা মা ও আপনজনদের মিশর আগমনে আজ ইউসুফের মনে যে কী খুশি আর কত যে আনন্দ, তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। ইউসুফ তাঁদের মহাসমারোহে এগিয়ে আনেন। বাবা মাকে নিজের আসনে বসান। তাঁরা সবাই ইউসুফের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।

 

সত্য হলো ইউসুফের স্বপ্ন

 

ভাইয়েরা সবাই ইউসুফের কাছে নত হলো। তাঁর কাছে ক্ষমা চাইলো। বাবা মা ইউসুফকে পেয়ে আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায় করলেন। এভাবেই ইউসুফ ছোট্ট বেলায় যে স্বপ্ন দেখেছিলেন তা সত্যে পরিনত হলো। ইউসুফ বললেন-

 

“আব্বাজান, আমি যা স্বপ্ন দেখেছিলাম, এ হলো সেই স্বপ্নের মর্ম। আমার প্রভু, আমার স্বপ্নকে সত্যে পরিনত করেছেন। তিনি আমার প্রতি বিরাট অনুগ্রহ দেখিয়ে আমাকে কারাগার থেকে বের করে এনেছেন। আপনাদের মরু অঞ্চল থেকে বের করে এনে আমার সাথে মিলিত করেছেন। অথচ শয়তান আমার ও আমার ভাইদের মাঝে বিরোধ সৃষ্টি করে দিয়েছিলো। আমার প্রভু অতি সূক্ষ্ম কৌশলে তাঁর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেন। তিনি অত্যন্ত জ্ঞানী ও সুকৌশলী।”(সূরা ১২ ইউসুফঃ আয়াত ১০০)

 

আল্লাহর শোকর আদায়

 

ইউসুফের আর কি চাই? মহান আল্লাহ তাঁকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছেন। দাসত্ব থেকে মুক্ত করেছেন। কারাগার থেকে মুক্ত করেছেন। নবুয়্যত দান করেছেন। রাষ্ট্র ক্ষমতা দান করেছেন। বিপুল জনপ্রিয়তা দান করেছেন। অবশেষে বাবা মা আর সকল আত্মীয় স্বজনকেও এনে তাঁর সাথে মিলিয়ে দিয়েছেন। মহান আল্লাহর কত যে অনুগ্রহ তাঁর উপর। তিনি অত্যন্ত বিনীত কণ্ঠে শোকর আদায় করেন তাঁর মহান আল্লাহ তায়ালার দরবারে-

 

“আমার প্রভু, তুমি আমাকে রাষ্ট্র ক্ষমতা দান করেছো। কথার মর্ম বুঝতে শিখিয়েছ। হে আসমান যমীনের স্রষ্টা, দুনিয়া এবং আখিরাতে তুমিই আমার অভিভাবক। তোমার অনুগত অবস্থায় আমাকে মৃত্যু দিও আর নেক্কার লোকদের সাথে মিলিত করো।” (সূরা ১২ ইউসুফঃ আয়াত ১০১)

 

হযরত ইউসুফের কালের মিশর

 

বিভিন্ন ঐতিহাসিক গবেষণা থেকে জানা যায়, হযরত ইউসুফ যখন মিশর যান, তখন মিশরে পঞ্চদশতম রাজ পরিবারের শাসন চলছিলো। এ বংশের রাজাদের বলা হতো ‘রাখাল রাজা’ (Hyksos Kings)। এরা মিশরীয় ছিলো না। তাঁরা ফিলিস্তিন ও সিরিয়া অঞ্চল থেকে গিয়ে মিশরের রাজত্ব দখল করে। এ বংশের রাজাদের ‘আমালিক’ রাজাও বলা হয়। এরা বিদেশী হবার কারনে তাঁরা হজরত ইউসুফকে সাদরে গ্রহন করেছিলো। ইয়াকুব (আঃ) এঁর বংশধর বনী ইসরাইলকে দেশের সব চাইতে উর্বর এলাকায় বসতি স্থাপন করতে দিয়েছিলো। হযরত ইয়াকুবের বংশধরদের বনী ইসরাইল বলা হয়। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, রাখাল রাজাদের ‘আপোসিস’ নামক রাজাই ছিলেন হযরত ইউসুফের সময়কার রাজা।

 

এ রাজা হযরত ইউসুফকে অত্যন্ত সম্মান দান করেন। প্রথমে ইউসুফকে তিনি অর্থমন্ত্রী বানান। পড়ে দেশ শাসনের বিরাট দায়িত্ব ভার ইউসুফের উপর অর্পণ করেন। হযরত ইউসুফ যে বিরাট যোগ্যতা ও অগাধ জ্ঞানের ভিত্তিতে দেশ শাসন করেন রাজা তাতে খুব সন্তুষ্ট ছিলেন। শেষ পর্যন্ত হযরত ইয়াকুবের বংশধরেরা অর্থাৎ বনী ইসরাইলের লোকেরা ব্যাপকভাবে ক্ষমতায় অংশগ্রহন করে। বিভিন্ন স্তরে তাঁরা দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে।

 

কুরআনে হযরত ইউসুফ

 

কুরআনের একটি সুরাই রয়েছে হযরত ইউসুফের নামে। সুরাটির নাম ‘ইউসুফ’। এটি আল কুরআনের দ্বাদশ সূরা। মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছে। গোটা সুরায় হযরত ইউসুফের কাহিনীই বর্ণিত হয়েছে। কুরআন মাজীদে এ কাহিনীকে ‘আহাসানুল কাসাস’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এর মানে ‘সর্বোত্তম কল্যাণকর কাহিনী’। সত্যিই হযরত ইউসুফের জীবনীতে রয়েছে তরুন ও যুবকদের জন্যে অএন শিক্ষণীয় বিষয়। রয়েছে আদর্শ জীবন গড়ার উপাদান। আল কুরআনে হযরত ইউসুফের নাম ২৭ বার উল্লেখ করা হয়েছে। এঁর মধ্যে ২৫ বারই উল্লেখ হয়েছে সূরা ইউসুফে। তাছাড়া সূরা আনয়ামের ৮৪ ও সূরা আল মুমিনের ৩৪ নম্বর আয়াতে একবার একবার করে উল্লেখ হয়েছে। বিস্তারিত জানার জন্যে সূরা ইউসুফ পড়ে নেবেন।

 

হযরত ইউসুফের চারিত্রিক আদর্শ

 

হযরত ইউসুফ (আঃ) এর কাহিনীতে রয়েছে আমাদের জন্যে অনেক শিক্ষা। তাঁর জীবনাদর্শ থেকে পাওয়া শিক্ষাগুলো আমরা এখানে লিখে দিচ্ছি। আসুন মনোযোগ দিয়ে সেগুলো পড়ে নেই-

 

১. তাঁর পিতা হযরত ইয়াকুব ছিলেন আল্লাহর নবী। ফলে ইউসুফ ছোট বেলা থেকেই নবীর অনুসারী হন। নবীর পথে চলেন।

 

২. তিনি ছিলেন অত্যন্ত জ্ঞান পিপাসু। ফলে আল্লাহ তাঁকে অনেক জ্ঞান দান করেন। কথার মর্ম উপলব্ধি করার যোগ্যতা দেন।

 

৩. তিনি সব সময় পিতামাতার সাথে ভালো ব্যবহার করতেন। ফলে পিতা মাতাও তাঁকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন।

 

৪. তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিশ্বাসী। যে কেউ তাঁর উপর আস্থা রাখতে পারতো।

 

৫. তিনি ছিলেন অত্যন্ত উন্নত চরিত্রের অধিকারী।

 

৬. তিনি গোপনে এবং সুযোগ পেয়েও পাপ কাজ করেননি।

 

৭. তিনি সব সময় আল্লাহকে ভয় করতেন।

 

৮. তিনি কারা নির্যাতন সয়েছেন, কিন্তু কোন প্রকার অন্যায় ও পাপ কাজ করতে রাজি হন নি।

 

৯. তিনি ছিলেন অত্যন্ত আমানতদার। কখনো বিশ্বাস ঘাতকতা করেননি।

 

১০. তিনি অত্যন্ত ধৈর্যশীল ছিলেন। কখনো ধৈর্যহারা হননি।

 

১১. তিনি সুযোগ পেলেই মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকতেন। দাওয়াত দিতেন।

 

১২. সকল বিষয়ে তিনি আল্লাহর উপর ভরসা করতেন। আল্লাহর কাছেই সাহায্য চাইতেন। তাঁর কাছেই ফরিয়াদ করতেন।

 

১৩. তিনি তাঁর জ্ঞান ও প্রতিভার মাধ্যমে মানুষের উপকার করতেন। তাঁদের সমস্যার সনাধান বলে দিতেন

 

১৪. যেসব নারী তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিলো, সামাজিকভাবে তিনি তাঁদের মুখোশ খুলে দিয়েছিলেন।

 

১৫. তিনি সামাজিকভাবে নিজের নির্দোষ, নিষ্পাপ ও বিশ্বস্ত হবার কথা প্রমান করে দেন।

 

১৬. তিনি সুযোগ পেয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতা গ্রহন করেন।

 

১৭. তিনি অত্যন্ত যোগ্যতা ও দক্ষতার সাথে তাঁর উপর অর্পিত রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করেন।

 

১৮. ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তিনি ভাইদের অপরাধের প্রতিশোধ নেননি।

 

১৯. সুযোগ পেয়েও প্রতিশোধ গ্রহন না করে ভাইদের ক্ষমা করে দেন।

 

২০. তিনি পিতামাতা ও ভাইদেরকে সম্মানের সাথে পুনর্বাসিত করেন।

 

২১. তিনি সকল সৌভাজ্ঞের জন্যে কেবল মহান আল্লাহর শোকর আদায় করেন। তাঁরই কৃতজ্ঞ হয়ে থাকেন।

 

২২. তিনি আল্লাহর একান্ত অনুগত ও বাধ্যগত দাসের মতো অবস্থায় মৃত্যু কামনা করেন।

 

২৩. পরকালে তিনি নেক লোকদের সাথী হবার জন্যে মহান আল্লাহর কাছে আকুতি জানান।

 

আসুন, আমরা হযরত ইউসুফ (আঃ) এর এসব মহান আদর্শের অনুসরন করি। নিজেদের আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলি।

 

কুরআনে ইউসুফের একটি দোয়া

 

ইউসুফ রাষ্ট্র ক্ষমতা লাভ করেন। পিতা আল্লাহর নবী ইয়াকুবকে পরিবারবর্গসহ নিজের কাছে নিয়ে আসেন। আল্লাহ সকল দিক থেকে ইউসুফের প্রতি নিজের নিয়ামত পূর্ণ করেন। এ সময় ইউসুফ মহান আল্লাহর দরবারে দোয়া করেন-

 

“আমার প্রভু, তুমি আমাকে রাষ্ট্র ক্ষমতা দান করেছো, আমাকে কথার মর্ম উপলব্ধি করার শিক্ষা দিয়েছ, তুমিই আসমান যমীনের স্রষ্টা। দুনিয়া এবং আখিরাতে তুমিই আমার অলি (বন্ধু, অভিভাবক, পৃষ্ঠপোষক)। মুসলিম (তোমার প্রতি আত্মসমর্পিত) হিসেবে আমার ওফাত দিও আর আমাকে মিলিত করো ন্যায়পরায়ণদের সাথে।” (সূরা ১২ ইউসুফঃ আয়াত ১০১

 

১২।

 

শুয়াইব

 

(আঃ)

 

মহান আল্লাহ আল কুরআনে যেসব সম্মানিত নবীর নাম উল্লেখ করেছেন হযরত শুয়াইব (আঃ) তাঁদেরই একজন। অন্য সকল নবীর মতো তিনিও এই মহা সত্যের প্রতিই মানুষকে আহবান করেছিলেন-

 

“হে আমার জাতির ভাইয়েরা, তোমরা কেবল এক আল্লাহর দাসত্ব, আনুগত্য এবং হুকুম পালন করো। তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোন ইলাহ নেই।”

 

শুয়াইব কোন জাতির নবী ছিলেন?

 

কুরআন মাজীদে শুয়াইব (আঃ) কে মাদইয়ান ও আইকাবাসীদের নবী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কোন কোন মুফাসসির বলেছেন- এই দুটি নাম মূলত একটি গোত্রের দুটি নাম। আবার কেউ কেউ বলেছেন- এ দুটি আসলে দুটি গোত্রেরই নাম। হযরত শুয়াইব (আঃ) এই দুটি কওমের কাছেই নবী হিসেবে প্রেরিত হয়েছিলেন।

 

ঐতিহাসিক ও মুফাসসিরগনের মতে, এই দুটি গোত্র ইবরাহীম (আঃ) এর বংশধর। তাঁদের বসবাসও ছিলো পাশাপাশি। কুরআনে বলা হয়েছে এ দুটি জাতি উম্মুক্ত রাজপথে অবস্থান করতো। মাদইয়ানবাসীদের বসবাস ছিলো উত্তর হিজায থেকে ফিলিস্তিনের দক্ষিনাঞ্চল জুড়ে এবং সেখান থেকে সিনাই উপত্যকার শেষ পর্যন্ত আকাবা উপসাগর এবং লোহিত সাগরের তীর জুড়ে। মাদইয়ান ছিলো তাঁদের প্রধান শহর।

 

বর্তমান তাবুক অঞ্চলের প্রাচীন নাম ছিলো আইকাহ। তাবুকের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে আইকাবাসীরা বসবাস করতো। মাদইয়ান এবং আইকাবাসীদের মধ্যে বৈবাহিক, বাণিজ্যিক এবং অন্যান্য সামাজিক সম্পর্ক বিদ্যমান ছিলো। এ ছাড়া উভয় জাতি একই ধরনের অসামাজিক কাজকর্ম এবং অন্যায় ও অপরাধে লিপ্ত ছিলো। সে কারনে আল্লাহ তাঁদের উভয় জাতির হেদায়েতের জন্যে একজন ব্যাক্তিকেই নবী নিযুক্ত করেন।

 

হযরত শুয়াইবের জন্ম হয় মাদইয়ান গোত্রে। কুরআন মাজীদে মাদইয়ানবাসীদের হজরত শুয়াইবের জাতি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি তাঁদেরকে ‘হে আমার জাতির ভাইয়েরা’ বলে সম্বোধন করতেন।

 

হযরত শুয়াইব কোন সময়কার নবী?

 

হযরত শুয়াইব (আঃ) যে ঠিক কোন সময়কার নবী ছিলেন, সে কথাটি একেবারে নির্দিষ্ট করে বলা কঠিন। তবে কুরআনের বর্ণনা ভঙ্গি থেকে বুঝা যায়, শুয়াইব (আঃ) হজরত মুসা (আঃ) এর পূর্বেকার নবী ছিলেন। তবে কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে, হযরত মুসা (আঃ), হযরত শুয়াইব (আঃ) এর সাক্ষাত লাভ করেছিলেন।

 

মাদইয়ান ও আইকাবাসীদের দুরাচার

 

মাদইয়ান ও আইকাবাসী তাঁদের পূর্বপুরুষ ইবরাহীম (আঃ) এর প্রচারিত দ্বীন ইসলামেরই উত্তরাধিকারী ছিলো। কিন্তু কয়েকশ বছরের ব্যবধানে তাঁরা ইসলামকে বিকৃত করে ফেলে এবং বাস্তবে ইসলামের আদর্শ থেকে অনেক দূরে সরে পড়ে। বিশ্বাস ও চরিত্রের দিক থেকে তাঁরা যেসব অপরাধে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছিলো সেগুলো হলো-

 

১. তারা আল্লাহর দিনকে বিকৃত করে ফেলেছিলো।

 

২. তারা আল্লাহর সাথে শিরক করতো। মূর্তি পূজা করতো।

 

৩. তারা জীবন যাপনের সঠিক পথ থেকে দূরে সরে পড়েছিলো।

 

৪. তারা মাপে কম দিতো। লেনদেনে হেরফের করতো। মানুষকে ঠকাতো। প্রতারনা করতো।

 

৫. ডাকাতি ও হাইজ্যাকি ছিলো তাঁদের নিত্য দিনের কাজ।

 

৬. এছাড়াও অন্যান্য পাপাচার এবং ধ্বংসাত্মক কাজে তারা লিপ্ত ছিলো।

 

হযরত শুয়াইবের সংস্কার আন্দোলন

 

এই দুটি অধঃপতিত কওমকে সংশোধন করার জন্যে আল্লাহ তায়ালা মাদইয়ানের মহান চরিত্র ও ব্যাক্তিত্বের অধিকারী শুয়াইবকে নবী নিযুক্ত করেন। শুয়াইব ছিলেন অত্যন্ত সুভাষী ও বলিষ্ঠ ব্যাক্তিত্বের অধিকারী। তিনি মর্মস্পর্শী দাওয়াত এবং আহনবানের মাধ্যমে আল্লাহর দিনের প্রচার ও জাতিকে সংশোধনের সংগ্রাম শুরু করেন। তাঁর কর্মধারা সম্পর্কে মহান আল্লাহ পবিত্র আল কুরআনে বলেন –

 

“আর আমি মাদইয়ানবাসীদের কাছে তাঁদের ভাই শুয়াইবকে পাঠিয়েছি। সে তাঁদের বলেছিল- হে আমার জাতির ভাইয়েরা, তোমরা এক আল্লাহর দাসত্ব ও আনুগত্য করো, তিনি ছাড়া তোমাদের অপর কোন ইলাহ নাই। তোমাদের কাছে তোমাদের প্রভুর নিকট থেকে সুস্পষ্ট প্রমান এসে গেছে। তাই তোমরা তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী মাপ ও ওজন পূর্ণ করে দাও। মানুষকে তাঁদের দ্রব্য সামগ্রীতে ঠকিওনা। দেশে বিপর্যয় সৃষ্টি করোনা। এতেই তোমাদের জন্যে রয়েছে কল্যাণ। প্রতি পথে ডাকাত হয়ে বসোনা। সন্ত্রাস সৃষ্টি করোনা। যারা ঈমান এনেছে তাঁদেরকে আল্লাহর পথ থেকে বিরত রেখোনা এবং সহজ সরল পথকে বাঁকা করার চেষ্টা করোনা। চোখ খুলে দেখো অতীতে যারা ধ্বংসাত্মক কাজ করেছে তাঁদের পরিনতি কী হয়েছে? ” (সূরা আরাফ-আয়াতঃ ৮৫-৮৬)

 

মাদইয়ানবাসীদের মতো আইকাবাসীদেরও সংশোধন করার জন্যে হজরত শুয়াইব (আঃ) আপ্রান চেষ্টা করেন। তাঁর এ প্রচেষ্টা সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহ বলেন-

 

“আইকাবাসীরা রাসুলদের অস্বীকার করে। শুয়াইব যখন তাঁদেরকে বললো- তোমরা কি ভয় করোনা? আমি তোমাদের জন্যে একজন বিশ্বস্ত রাসুল, সুতরাং আল্লাহকে ভয় করো আর আমার আনুগত্য করো। এই উপদেশ দানের কাজে আমি তো তোমাদের কাছে কোন পারিশ্রমিক চাইনা। আমাকে পারিশ্রমিক দেয়ার দায়িত্ব তো মহান আল্লাহর। ওজন পূর্ণ করে দাও, মানুষকে তাঁদের মাল কম দিওনা, পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করোনা। সেই মহান স্রষ্টাকে ভয় করো যিনি তোমাদেরকে এবং তোমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্মকে সৃষ্টি করেছেন।” (সূরা আশ শোয়ারা, আয়াত ১৭৬-১৮৪)

 

এভাবে মর্মস্পর্শী ভাষায় হজরত শুয়াইব (আঃ) এই দুইটি জাতিকে সংশোধন করার চেষ্টা করেন, কিন্তু তারা তাঁর দাওয়াতকে প্রত্যাখ্যান করে এবং তাঁর সাথে বিতর্ক ও দ্বন্ধ-সংঘাতে লিপ্ত হয়। তারা বললো- “হে শুয়াইব তোমার সালাত কি তোমাকে এই শিক্ষাই দেয় যে, আমরা সেই সব মাবুদদের পরিত্যাগ করবো, আমাদের পূর্বপুরুষরা যাদের ইবাদাত করতো? আর আমাদের অর্থ সম্পদ ইচ্ছামত ব্যয় করার অধিকার আমাদের থাকবেনা? তুমি একজন মহৎ হৃদয়ের বড় সদাচারী ব্যাক্তিই রয়ে গেলে। ” (সূরা হুদ, আয়াত ৮৭)

 

তারা আর বললো- “তুমি একজন যাদুগ্রস্থ মানুষ, তুমি তো আমাদের মতই একজন সাধারন মানুষ ছাড়া আর কিছুই নও। আমরা তোমাকে পরিস্কার মিথ্যাবাদী মনে করি। তুমি যদি সত্যবাদী হও তাহলে এক টুকরা আকাশ ভেঙ্গে আমাদের উপর ফেলো দেখি।” (সূরা আশ শোয়ারা, আয়াত ১৮৫-১৮৭)

 

শুয়াইব বললো- “আমি তো কেবল তোমাদের সংশোধন চাই। আমার সাধ্য অনুযায়ী সংশোধনের এই চেষ্টা আমি করে যাবো। আমার বিরুদ্ধে তোমাদের হঠকারীতা যেন সেই পর্যায়ে না যায়, যার ফলে নূহ, হুদ, ও সালেহ এর জাতির উপর আল্লাহর আযাব এসেছিলো। আর লুত জাতির ধ্বংসের ইতিহাস তো তোমাদের থেকে বেশী আগের নয়। তোমরা আল্লাহর কাছে মাফ চাও এবং তাঁর দিকে ফিরে ফিরে এসো। তিনি বড় দয়ালু, বড় বন্ধু সুলভ।” (সূরা হুদ ৮৮-৯০)

 

এসব কথার জবাবে তারা বলছিলো – “শুয়াইব, তোমার অনেক কথাই আমাদের বুঝে আসেনা। ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক না থাকলে তোমাকে আমরা পাথর মেরে হত্যা করতাম। আমাদের চাইতে তোমার ক্ষমতা বেশী নয়।”

 

তাঁদের এসব কথা শুনে শুয়াইব বললেন – “আমার সাথে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক কি আল্লাহর চাইতেও সম্মানিত? তোমরা ভ্রাতৃত্বের সম্পর্কের কথা বলছো, অথচ আল্লাহর ব্যাপারে মোটেই তোয়াক্কা করছোনা? তোমরা অবশ্যই আল্লাহর বেষ্টনীতে আছো।” তিনি আরো বললেন – “আমার কাজ আমি অবশ্যই করে যাবো, তোমরা অচিরেই জানতে পারবে, কার উপর অপমানকর আযাব আসে আর মিথ্যাবাদীই বা কে? তোমরা অপেক্ষা করো, আমিও অপেক্ষা করছি।”

 

চরম বিরোধিতার মুখেও একদল যুবক হযরত শুয়াইবের প্রতি ঈমান আনে। চরম নির্যাতনের মুখেও তারা আল্লাহর নবীর সাথে দীনের পথে চলতে থাকে। কিন্তু বিরোধীনেতারা কিছুতেই এদের সহ্য করতে পারেনা। তারা অবশেষে হুংকার ছেড়ে ঘোষণা দিলো – “হে শুয়াইব, আমরা তোমাকে এবং তোমার সাথে যারা ঈমান এনেছে তাঁদেরকে দেশ থেকে বের করে দেবো। অথবা তোমাদেরকে আমাদের প্রচলিত ধর্মে ফিরে আসতে হবে।” (সূরা আরাফ-আয়াতঃ ৮৮)

 

তারা জনসভা করে জনগনের মাঝে ঘোষণা করে দিলো – তোমরা যদি শুয়াইবের দলে যোগ দাও তাহলে তোমাদের ধ্বংস কেউ ঠেকাতে পারবেনা। এ সব হুংকারের জবাবে হজরত শুয়াইব মহান আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করলেন –

 

“ওগো আমাদের প্রভু, আমাদের মাঝে আর আমাদের জাতির মাঝে সঠিক ফায়সালা করে দাও। তুমি তো সর্বোত্তম ফায়সালাকারী।” (সূরা আরাফ-আয়াতঃ ৮৯)

 

মাদইয়ান ও আইকাবাসীর ধ্বংস

 

হযরত শুয়াইবের অনেক চেষ্টা সাধনার পরেও যখন এই দুইটি জাতি আল্লাহর পথে আসলনা এবং নবী ও তাঁর সাথীদের উৎখাত করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলো, তখন আল্লাহ তায়ালা এই উভয় জাতিকে ধংস করে দিলেন। মাদইয়ানবাসীদের ধংস করলেন প্রচণ্ড বজ্রধ্বনি দিয়ে। এমনভাবে তাঁদের বিরান করে দিলেন, যেনো ওখানে কোন দিনই কোন লোক বসবাস করেনি। অপরদিকে আইকাবাসীদের ধংস করে দিলেন ছাতার মতো মেঘমালা পাঠিয়ে। মেঘ থেকে আযাব বর্ষিত হলো আর আইকাবাসীরা সম্পূর্ণভাবে ধংস হয়ে গেলো। কিন্তু মহান আল্লাহ হযরত শুয়াইব এবং তাঁর সাথীদেরকে এসব ধংসের আযাব থেকে রক্ষা করলেন। তাঁদের বাঁচিয়ে রাখলেন এবং এই মুমিনদের ঘরেই জন্ম নিলো পরবর্তী প্রজন্ম।

 

কুরআনে উল্লেখ

 

কুরআন মাজীদে সূরা আরাফ ও সূরা হুদে মাদইয়ানবাসীদের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। সূরা শোয়ারায় বর্ণিত হয়েছে আইকাবাসীদের ঘটনা। কুরআন মাজীদে হজরত শুয়াইবের নাম উল্লেখ হয়েছে ১১ বার। সে আয়াতগুলো হলো – সূরা আরাফঃ ৮৫, ৮৮, ৯০, ৯২। সূরা হুদঃ ৮৫, ৮৭, ৯১, ৯৪। আন কাবুতঃ ৩৬। শোয়ারাঃ ১৭৭।

 

আপনি যদি কুরআন পড়েন এবং সরাসরি কুরআন থেকেই এসব ঘটনাবলী জানার চেষ্টা করেন, তাহলে অনেক কিছুই জানতে পারবেন এবং শিখতে পারবেন অনেক কিছুই। আসুন আমরা সবাই কুরআন পড়ি। নবীদের ঘটনাবলী জানি এবং নবীদের আদর্শ অনুযায়ী জীবন গড়ি।

 

 

 

১৩।

 

ধৈর্যের পাহাড় আইয়ুব

 

(আঃ)

 

“আর আইয়ুবের কথা চিন্তা করে দেখো। সে যখন ফরিয়াদ করলো –“ওগো আমার প্রভু, আমি কঠিন রোগে বড় কষ্টের মধ্যে আছি আর তুমি তো সবচেয়ে বড় করুনাময়। অতপর আমি তাঁর ফরিয়াদ কবুল করলাম আর দূর করে দিলাম তাঁর সব কষ্ট।”?(সূরা আল আম্বিয়া, আয়াত ৮৩-৮৪)

 

হযরত আইয়ুবের পরিচয়

 

আল্লাহর প্রিয় নবী হযরত আইয়ুব (আঃ) এর কথা পবিত্র কুরআন শরীফের চারটি স্থানে উল্লেখ হয়েছে। সেগুলো হলো সূরা আন নিসার ১৬৩ নম্বর আয়াত, সূরা আল আনয়ামের ৮৪ নম্বর আয়াত, সূরা আল আম্বিয়ার ৬৩-৬৪ নম্বর আয়াত এবং সূরা সোয়াদের ৪১-৪৪ নম্বর আয়াত। হযরত আইয়ুবের বংশ পরিচয় পরিস্কারভাবে জানা যায়নি। এ ব্যাপারে মতভেদ আছে। কেউ কেউ বলেছেন, তিনি ছিলেন বনী ইসরাইলের একজন নবী। কেউ বলেছেন, তিনি ছিলেন মিশরীয়। তবে ঐতিহাসিক ইবনে ইসহাকের মতকে অনেকে সঠিক বলেছেন। তাঁর মতে, হযরত আইয়ুবের বংশ পরিচয় হলো হযরত ইব্রাহীমের পুত্র ইসহাক, হযরত ইসহাকের পুত্র ঈশু, ঈশুর পুত্র আমুশ, আমুশের পুত্র আইয়ুব। হযরত আইয়ুব (আঃ) খ্রিষ্টপূর্ব নবম বা দশম শতকের লোক ছিলেন।

 

 

 

ধনী হযরত আইয়ুব

 

হযরত আইয়ুব (আঃ) ছিলেন এক বিরাট ধনী ব্যাক্তি। তাঁর ধন সম্পদ ছিলো অগাধ। তিনি ছিলেন অনেক অনেক ভূমি ও বাগ বাগিচার মালিক। তাঁর ছিলো অগাধ অর্থকড়ি। ছিলো অনেক সন্তান সন্তুতি। ছিলো সুস্বাস্থ্য। কিন্তু এতো বড় ধনী হলে কি হবে, এ জন্যে তাঁর ছিলনা কোন গর্ব, ছিলনা কোনো অহংকার। তিনি এগুলোকে আল্লাহর দান ও অনুগ্রহ মনে করতেন। আল্লাহ তাঁকে এতো ধনসম্পদ দিয়েছেন বলে তিনি সব সময় আল্লাহর শোকর আদায় করতেন, আল্লাহর কৃতজ্ঞ হয়ে থাকতেন।

 

কঠিন পরীক্ষা

 

কিন্তু আল্লাহর নিয়ম হলো, তিনি মানুষকে দিয়েও পরীক্ষা করেন, নিয়েও পরীক্ষা করেন। আর যেসব মানুষ আল্লাহর বেশী প্রিয়, তিনি তাঁদের অনেক বড় পরীক্ষা নেন। হযরত আইয়ুব (আঃ) ছিলেন আল্লাহর একজন অতিপ্রিয় দাস ও নবী। তিনি যেমন তাকে ভালবাসতেন, তেমন কঠিন পরীক্ষাও তাঁর উপর চাপিয়ে দেন। হযরত আইয়ুব (আঃ) চারটি বড় বড় পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছিলেন –

 

১. তাঁর সমস্ত ধন সম্পদ জমাজমি নষ্ট হয়ে যায়।

 

২. তাঁর সারা শরীরে কঠিন যন্ত্রনাদায়ক এক রোগ দেখা দেয়। বছরের পর বছর কাটে কিন্তু তাঁর রোগ ভালো হয়না।

 

৩. তাঁর স্ত্রী ছাড়া সকল আপনজন তাঁকে ছেড়ে দূরে চলে যান। তিনি সম্পূর্ণ নিঃসহায় হয়ে পড়েন।

 

৪. এ অবস্থায় আল্লাহর প্রতি বিমুখ হওয়ার জন্যে শয়তান তাঁকে অনবরত প্ররোচনা দিতে থাকে।

 

এতো বড় পরীক্ষায় পড়েও হযরত আইয়ুব (আঃ) সবর অবলম্বন করেন, ধৈর্য ধারন করেন। প্রতি মুহূর্তে আল্লাহর কৃতজ্ঞতাই প্রকাশ করেন। তিনি সুসময়ে যেমন তাঁর প্রভুর কৃতজ্ঞ ছিলেন, দুঃসময়েও ঠিক তেমনি কৃতজ্ঞ ছিলেন। তিনি তাঁর সমস্ত দুঃখ কষ্টের জন্যে কেবল মহান আল্লাহর কাছেই ফরিয়াদ করতেন। কেবল তাঁরই কাছে সাহায্য চাইতেন। তিনি বলতেন-

 

“প্রভু, আমি বড় কষ্টে আছি। আর তুমি তো সব দয়ালুর বড় দয়ালু। প্রভু, শয়তান আমাকে বড় কষ্ট ও যন্ত্রনা দিচ্ছে, তুমিতো আমার অবস্থা দেখছো।”

 

হযরত প্রায় সতের আঠারো বছর এই কঠিন রোগ ও অসহায় অবস্থায় পড়ে থাকেন। অবশেষে আল্লাহ তাঁর দোয়া কবুল করেন। তিনি তাঁকে পা দিয়ে মাটিতে আঘাত করতে বলেন। (সূরা সোয়াদ, আয়াত ৪২)। হযরত আইয়ুব তাই করলেন। কী আশ্চর্য, পা দিয়ে মাটিতে আঘাত করার সাথে সাথেই সেখান থেকে সচ্ছ পানির একটা ঝর্নাধারা প্রবাহিত হলো। আল্লাহ তাঁকে এ পানি পান করতে এবং এ পানি দিয়ে গোসল করতে বলেন। তিনি তাই করলেন। এর ফলে আল্লাহর দয়ায় তাঁর রোগ ভালো হয়ে গেলো।

 

বিবি রাহমা

 

রাহমা নামে হযরত আইয়ুবের একজন স্ত্রী ছিলেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত আল্লাহভীরু, সতী এবং স্বামী পরায়না। দীর্ঘ রোগের কারনে আপনজন সবাই হযরত আইয়ুবকে ছেড়ে চলে যান। কিন্তু রাহমা। তাঁর স্ত্রী রাহমা তাঁকে ছেড়ে যাননি। বছরের পর বছর ধরে তিনি স্বামীর সেবা যত্ন করেন। অসাধারন ধৈর্যগুণ থাকলেই কোন নারী এতো বছর ধরে কঠিন রোগেও স্বামীর সেবা করে যেতে পারেন। শয়তান হযরত আইয়ুবকে সরাসরি কোন ধোঁকা দিতে না পেরে রাহমার কাছে এলো। সে রাহমাকে এই বলে প্ররোচনা দিতে থাকে, তুমি আর কতকাল সহ্য করবে? দিনের পর দিন শয়তান তাঁকে এভাবে অসঅসা দিতে থাকে। তাঁকে প্ররোচিত করতে থাকে। অবশেষে একদিন এসে তিনি স্বামীকে বললেন – এভাবে আর কতকাল পরীক্ষা চলবে? আর কতকাল বিপদ মুসিবত সইয়ে যাবো?

 

একথায় হযরত আইয়ুব অত্যন্ত মনোক্ষুণ্ণ হলেন। তিনি স্ত্রীকে বললেন – যতদিন দুঃখ কষ্টের মধ্যে আছো, তাঁর চেয়ে বেশী দিন কি সুখের মধ্যে কাটাওনি? যতোদিন আমি সুখে ছিলাম ততোদিন দুঃখ ভোগের আগে এ অবস্থা দূর করে দেয়ার জন্যে আল্লাহর কাছে আবদার করতে আমার লজ্জা হয়। হযরত আইয়ুব স্ত্রী রাহমাকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন। কিন্তু তাঁর মুখে যখন অধৈর্যের কথা শুনলেন এটাকে তিনি আল্লাহর প্রতি অকৃতজ্ঞতা মনে করলেন এবং অত্যন্ত রাগান্বিত হলেন। রাগের মাথায় তিনি কসম খেয়ে বললেন, এ অধৈর্যের জন্যে আমি তোমাকে একশত বেত্রাঘাত করবো। রাগ স্তিমিত হলে তিনি পেরেশান হয়ে উঠলেন, যদি কসম বাস্তবায়ন করি তাহলে তো একজন নিরপরাধকে শাস্তি দেয়া হয়। আর যদি কসম বাস্তবায়ন না করি তাহলে তো গুনাহগার হতে হয়। এর সমাধান চেয়ে তিনি আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করলেন। তিনি যতগুলো বেত্রাঘাত করার অংগীকার করেছেন, আল্লাহ তাঁকে ততগুলো শলা দিয়ে একটি আটি বানাতে বললেন। (সূরা সোয়াদ, আয়াত ৪৪)

 

আর সেই আটি দিয়ে বিবি রাহমাকে একটি মৃদু আঘাত করতে বললেন। ব্যাস, তিনি তাই করলেন। তাঁর অংগীকার পূর্ণ হয়ে গেলো। মহান আল্লাহ তাঁদের দুজনের চিন্তা দূর করে দিলেন এবং তাঁদেরকে নিজের রহমত দ্বারা সিক্ত করলেন।

 

ফিরে এলো সুখের দিন

 

এবার হযরত আইয়ুব (আঃ) এর সুখের দিন ফিরে এলো। আল্লাহ তাঁকে রোগ ভালো করে দিলেন। আবার প্রচুর ধন সম্পদ দান করলেন। তাঁর সন্তান ও আত্মীয় স্বজনরা ফিরে এলো তাঁর কাছে। তিনি সুস্থ শরীরে মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকতে লাগলেন। বহু দুঃখ কষ্টের পর বিবি রাহমার জীবনে আবার সুখের দিন ফিরে এলো। কোথায় বলে ‘সবুরে মেওয়া ফলে’। হযরত আইয়ুব সবর করেছিলেন, বিবি রাহমা সবর করেছিলেন। তাই সুখের দিন ফিরিয়ে দিয়ে আল্লাহ তাঁদের সবরের প্রতিদান দিলেন।

 

আল কুরআনে তাঁর প্রশংসা

 

মহান আল্লাহ কুরআন মাজীদে হযরত আইয়ুব (আঃ) এর ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। তিনি বলেন-

 

১. আমি আইয়ুবকে পেয়েছি পরম ধৈর্যশীল। সে ছিলো আমার এক উত্তম গোলাম, ছিলো আল্লাহমুখী। (সূরা সোয়াদ, আয়াত ৪৪)

 

২. আইয়ুবের ব্যাপারটি ছিলো বুদ্ধিমান লোকদের জন্যে শিক্ষণীয়। (সূরা সোয়াদ, আয়াত ৪৪)

 

৩. আইয়ুবের ঘটনা ইবাদাতকারীদের জন্যে শিক্ষণীয়। (সূরা আম্বিয়া, আয়াত ৮৪)

 

৪. হে মুহাম্মাদ, আমি তোমার কাছে অহী পাঠাচ্ছি ঠিক সেভাবে, যেভাবে পাঠিয়েছিলাম নুহ এবং তাঁর পরবর্তী নবীদের কাছে------- ঈসা, আইয়ুব, ইউনুস, হারুন এবং সুলাইমানের কাছে। (সূরা আন নিসা, আয়াত ১৬৩)

 

শিক্ষণীয় বিষয়

 

বুদ্ধিমান লোকদের জন্যে যে হযরত আইয়ুবের জীবন চরিত থেকে অনেক শিক্ষণীয় বিষয় আছে, তাতো মহান আল্লাহ পাকই পবিত্র কুরআনে বলেছেন। সত্যি তাই। আসুন দেখি, আমরা তাঁর জীবন চরিত থেকে আমরা কি কি শিক্ষা পাই।

 

১. প্রাচুর্যের সময় আত্মহারা হয়ে আল্লাহকে ভুলে যেতে নেই।

 

২. ধন সম্পদ, সন্তান সন্ততি, মান ইজ্জত এই সবকে আল্লাহর দান মনে করা উচিত এবং এগুলোর জন্যে আল্লাহর শোকর আদায় করা উচিত।

 

৩, রোগ শোক, দুঃখ কষ্ট ও বিপদে মুসিবতে ধৈর্যহারা হতে নেই। বরং ধৈর্যের সাথে আল্লাহর উপর আশা ভরসা করে থাকা উচিত।

 

৪, বিপদ মুসিবত, দুঃখ কষ্ট রোগ শোক ও অসহায় অবস্থায় শয়তান মুমিনদের সাথে প্রতারনা করার সুযোগ নেয়। তাই এসব অবস্থায় শয়তানের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। এবং শয়তানের প্ররোচনা থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাইতে থাকতে হবে।

 

৫, সুখের সময় আল্লাহর শোকর আদায় করা এবং দুঃখের সময় সবর অবলম্বন করা নবীদের আদর্শ।

 

৬, রাগ বশত কোন ভুল করে ফেললে সেজন্যে অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা উচিত।

 

৭, রোগ শোক, দুঃখ কষ্ট, বিপদ মুসিবতে একজন মুমিন স্ত্রীর কোনো অবস্থাতেই স্বামীর কাছ থেকে দূরে সরে যাওয়া উচিত নয়। বরং পরম ধৈর্য ও সবরের সাথে স্বামীর সেবা করা উচিত।

 

১৪।

 

যুলকিফল

 

(আঃ)

 

কুরআন মাজীদে ‘যুলকিফল’ নামটি দুবার উল্লেখ হয়েছে। দু’বারই অন্যান্য নবীদের সাথে তাঁর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। একবার উল্লেখ হয়েছে সূরা আল আম্বিয়াতে। সেখানে বলা হয়েছে এভাবে-

 

“আর ইসমাঈল, ইদ্রীস ও যুলকিফল, এরা সবাই ছিলো ধৈর্যশীল। আমার রহমত দ্বারা এদের সিক্ত করেছিলাম। এরা ছিলো যোগ্য সৎ কর্মশীল।” (সূরা ২১, আল আম্বিয়াঃ ৮৫-৮৬)

 

সূরা সোয়াদে তাঁর কথা উল্লেখ হয়েছে এভাবে-

 

“ইষমাঈল, আলইয়াসা আর যুলকিফলের কথা স্মরণ করো। এরা সবাই ছিলো উত্তম মানুষ।” (আয়াত- ৪৮)

 

যুলকিফল ছিলেন বনী ইসরাইলের একজন নবী। আবার কেউ কেউ বলেছেন, তিনি ছিলেন হযরত আইয়ুব (আঃ) এর পুত্র। ‘যুলকিফল’ শব্দের অর্থ ভাগ্যবান। দুনিয়াবী দৃষ্টিতে নয়, পরকালীন দৃষ্টিতে ভাগ্যবান। এটি তাঁর আসল নাম নয়, বরং এটি ছিলো তাঁর উপাধি। তাঁর মূল নাম ছিলো ‘বিশর’। যুলকিফল যদি আইয়ুব (আঃ) এর পুত্র হয়ে থাকেন, তবে পিতার পরেই তিনি নবী হয়েছিলেন। অনেকে মনে করেন যুলকিফল আসলে বাইবেলে উল্লেখিত যিহিস্কেল নবী। যিহিস্কেল মুসলমানদের কাছে হিযকীইল নামে পরিচিত। তাঁর এই পরিচয়টি সঠিক মনে হয়।

 

বাইবেলের যিহিস্কেল পুস্তক থেকে জানা যায়, রাজা বখতে নযর যখন শেষবার জেরুজালেম ধংস করেন, তাঁর আগে তিনি বহু বনী ইসরাইলীদের বন্দী করে নিয়ে যান। বখতে নযর ইরাকের খাবুর নদীর তীরে বনী ইসরাইলী বন্দীদের একটি উপনিবেশ গড়ে তোলেন। এর নাম ছিলো তেলআবিব। এখানেই খ্রিষ্টপূর্ব ৫৯৪ অব্দে হযরত হিযকীইল নবুয়্যত লাভ করেন। এ সময় তাঁর বয়েস ছিলো ত্রিশ বছর। এখানে তিনি বাইশ বছর যাবত বনী ইসরাইলীদের মাঝে নবুয়্যতের দায়িত্ব পালন করেন। দ্বীন প্রচারের কাজকে তিনি সর্বাধিক গুরুত্ব দিতেন। তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রীর মৃত্যুর পর লোকেরা যখন তাঁর বাড়িতে শোক প্রকাশের জন্যে আসে, তখন তিনি এতো দুঃখের মাঝেও তাঁদেরকে আল্লাহর আযাবের ভয় দেখাতে থাকেন।

 

এই হিযকীইল বা যিহিস্কেলই ছিলেন হযরত যুলকিফল (আঃ)। তিনি সেই সব নবীদের একজন যারা নিজেদের জীবনের একটি অংশ বন্দী হিসেবে কাটিয়েছেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত সৎ ও নিষ্ঠাবান। দিনরাত আল্লাহর দীনের কাজে নিমগ্ন থাকতেন। মানুষকে আল্লাহর ভয় দেখাতেন। তিনি শাসকদের সবসময় সত্য সততা ও ন্যায়পরায়নতার ব্যাপারে সতর্ক করতেন।

 

১৫।

 

মুসা কালিমুল্লাহ (আঃ)

 

মূসা (আঃ)-এর পরিচয়

 

মূসা ইবনে ইমরান বিন ক্বাহেছ বিন ‘আযের বিন লাভী বিন ইয়াকূব বিন ইসহাক্ব বিন ইবরাহীম (আঃ)।অর্থাৎ মূসা হ’লেন ইবরাহীম (আঃ)-এর ৮ম অধঃস্তন পুরুষ। মূসা (আঃ)-এর পিতার নাম ছিল ‘ইমরান’ ও মাতার নাম ছিল ‘ইউহানিব’। তবে মায়ের নামের ব্যাপারে মতভেদ আছে।উল্লেখ্য যে, মারিয়াম (আঃ)-এর পিতার নামও ছিল ‘ইমরান’। যিনি ছিলেন হযরত ঈসা (আঃ)-এর নানা। মূসা ও ঈসা উভয় নবীই ছিলেন বনী ইসরাঈল বংশীয় এবং উভয়ে বনী ইসরাঈলের প্রতি প্রেরিত হয়েছিলেন (সাজদাহ- ৩২, ছফ -৬১)। মূসার জন্ম হয় মিসরে এবং লালিত-পালিত হন মিসর সম্রাট ফেরাঊনের ঘরে। তাঁর সহোদর ভাই হারূণ (আঃ) ছিলেন তাঁর চেয়ে তিন বছরের বড় এবং তিনি মূসা (আঃ)-এর তিন বছর পূর্বেই মৃত্যুবরণ করেন। উভয়ের মৃত্যু হয় মিসর ও শাম-এর মধ্যবর্তী তীহ্ প্রান্তরে বনী ইসরাঈলের ৪০ বছর আটক থাকাকালীন সময়ে। মাওলানা মওদূদী বলেন, মূসা (আঃ) পঞ্চাশ বছর বয়সে নবী হয়ে ফেরাঊনের দরবারে পৌঁছেন। অতঃপর তেইশ বছর দ্বন্দ্ব-সংগ্রামের পর ফেরাঊন ডুবে মরে এবং বনী ইসরাঈল মিসর থেকে বেরিয়ে যায়। এ সময় মূসা (আঃ)-এর বয়স ছিল সম্ভবতঃ আশি বছর। তবে মুফতী মুহাম্মাদ শফী বলেন, ফেরাঊনের জাদুকরদের সাথে মুকাবিলার ঘটনার পর ঐতিহাসিক বর্ণনা অনুযায়ী মূসা (আঃ) বিশ বছর যাবত মিসরে অবস্থান করেন। এ সময় আল্লাহ মূসা (আঃ)-কে নয়টি মু‘জেযা দান করেন।

 

উল্লেখ্য যে, আদম, ইয়াহ্ইয়া ও ঈসা (আঃ) ব্যতীত প্রায় সকল নবীই চল্লিশ বছর বয়সে নবুয়ত লাভ করেছিলেন। মূসাও চল্লিশ বছর বয়সে নবুয়ত লাভ করেছিলেন বলে অধিকাংশ বিদ্বান মত পোষণ করেছেন। সেমতে আমরা মূসা (আঃ)-এর বয়সকে নিম্নরূপে ভাগ করতে পারি। যেমন, প্রথম ৩০ বছর মিসরে, তারপর ১০ বছর মাদিয়ানে, তারপর মিসরে ফেরার পথে তূর পাহাড়ের নিকটে ‘তুবা’ উপত্যকায় ৪০ বছর বয়সে নবুয়ত লাভ। অতঃপর ২০ বছর মিসরে অবস্থান করে সেখানকার অধিবাসীদেরকে তাওহীদের দাওয়াত প্রদান। তারপর ৬০ বছর বয়সে বনী ইস্রাঈলদের নিয়ে মিসর হ’তে প্রস্থান এবং ফেরাঊনের সলিল সমাধি। অতঃপর আদি বাসস্থান কেন‘আন অধিকারী আমালেক্বাদের বিরুদ্ধে জিহাদের হুকুম অমান্য করায় অবাধ্য ইস্রাঈলীদের নিয়ে ৪০ বছর যাবত তীহ্ প্রান্তরে উন্মুক্ত কারাগারে অবস্থান ও বায়তুল মুক্বাদ্দাসের সন্নিকটে মৃত্যু সম্ভবতঃ ৮০ থেকে ১০০ বছর বয়সের মধ্যে। মূসা (আঃ)-এর কবর হয় বায়তুল মুক্বাদ্দাসের উপকণ্ঠে। আমাদের নবী (ছাঃ) সেখানে একটি লাল ঢিবির দিকে ইশারা করে সেস্থানেই মূসা (আঃ)-এর কবর হয়েছে বলে জানিয়েছেন। উল্লেখ্য যে, আদম (আঃ) থেকে ইবরাহীম (আঃ) পর্যন্ত ১০/১২ জন নবী বাদে শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর আগমনের পূর্ব পর্যন্ত পৃথিবীতে আগত সর্বমোট এক লক্ষ চবিবশ হাযার নবী-রাসূলের প্রায় সবাই ইস্রাঈল বংশের ছিলেন এবং তাঁরা ছিলেন সেমেটিক। কেননা ইব্রাহীম (আঃ) ছিলেন সাম বিন নূহ-এর ৯ম অধঃস্তন পুরুষ। এজন্য ইবরাহীমকে ‘আবুল আম্বিয়া’ বা নবীদের পিতা বলা হয়।

 

মূসা ও ফেরাঊনের কাহিনী

 

সুদ্দী ও মুররাহ প্রমুখ হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস ও আব্দুল্লাহ ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) এবং বহু সংখ্যক ছাহাবী থেকে বর্ণনা করেন যে, ফেরাঊন একদা স্বপ্নে দেখেন যে, বায়তুল মুক্বাদ্দাসের দিক হ’তে একটি আগুন এসে মিসরের ঘর-বাড়ি ও মূল অধিবাসী ক্বিবতীদের জ্বালিয়ে দিচ্ছে। অথচ অভিবাসী বনী ইস্রাঈলদের কিছুই হচ্ছে না। ভীত-চকিত অবস্থায় তিনি ঘুম থেকে জেগে উঠলেন। অতঃপর দেশের বড় বড় জ্যোতিষী ও জাদুকরদের সমবেত করলেন এবং তাদের সম্মুখে স্বপ্নের বৃত্তান্ত বর্ণনা দিলেন ও এর ব্যাখ্যা জানতে চাইলেন। জ্যোতিষীগণ বলল যে, অতি সত্বর বনী ইস্রাঈলের মধ্যে একটি পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করবে। যার হাতে মিসরীয়দের ধ্বংস নেমে আসবে’।

 

মিসর সম্রাট ফেরাঊন জ্যোতিষীদের মাধ্যমে যখন জানতে পারলেন যে, অতি সত্বর ইস্রাঈল বংশে এমন একটা পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করবে, যে তার সাম্রাজ্যের পতন ঘটাবে। তখন উক্ত সন্তানের জন্ম রোধের কৌশল হিসাবে ফেরাঊন বনী ইস্রাঈলদের ঘরে নবজাত সকল পুত্র সন্তানকে ব্যাপকহারে হত্যার নির্দেশ দিল। উদ্দেশ্য ছিল, এভাবে হত্যা করতে থাকলে এক সময় বনী ইস্রাঈল কওম যুবক শূন্য হয়ে যাবে। বৃদ্ধরাও মারা যাবে। মহিলারা সব দাসীবৃত্তিতে বাধ্য হবে। অথচ বনী ইস্রাঈলগণ ছিল মিসরের শাসক শ্রেণী এবং উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন জাতি। এই দূরদর্শী কপট পরিকল্পনা নিয়ে ফেরাঊন ও তার মন্ত্রীগণ সারা দেশে একদল ধাত্রী মহিলা ও ছুরিধারী জাল্লাদ নিয়োগ করে। মহিলারা বাড়ী বাড়ী গিয়ে বনী ইস্রাঈলের গর্ভবতী মহিলাদের তালিকা করত এবং প্রসবের দিন হাযির হয়ে দেখত, ছেলে না মেয়ে। ছেলে হ’লে পুরুষ জাল্লাদকে খবর দিত। সে এসে ছুরি দিয়ে মায়ের সামনে সন্তানকে যবহ করে ফেলে রেখে চলে যেত। এভাবে বনী ইস্রাঈলের ঘরে ঘরে কান্নার রোল পড়ে গেল। ইবনু কাছীর বলেন, একাধিক মুফাসসির বলেছেন যে, শাসকদল ক্বিবতীরা ফেরাঊনের কাছে গিয়ে অভিযোগ করল যে, এভাবে পুত্র সন্তান হত্যা করায় বনী ইস্রাঈলের কর্মজীবী ও শ্রমিক শ্রেণীর ঘাটতি হচ্ছে। যাতে তাদের কর্মী সংকট দেখা দিয়েছে। তখন ফেরাঊন এক বছর অন্তর অন্তর পুত্র হত্যার নির্দেশ দেয়। এতে বাদ পড়া বছরে হারূণের জন্ম হয়। কিন্তু হত্যার বছরে মূসার জন্ম হয়। ফলে পিতা-মাতা তাদের নবজাত সন্তানের নিশ্চিত হত্যার আশংকায় দারুণভাবে ভীত হয়ে পড়লেন। এমতাবস্থায় আল্লাহ মূসা (আঃ)-এর মায়ের অন্তরে ‘ইলহাম’ করেন। যেমন আল্লাহ পরবর্তীতে মূসাকে বলেন, ‘‘আমরা তোমার উপর আরো একবার অনুগ্রহ করেছিলাম’। ‘যখন আমরা তোমার মাকে প্রত্যাদেশ করেছিলাম, যা প্রত্যাদেশ করা হয়’। ‘(এই মর্মে যে,) তোমার নবজাত সন্তানকে সিন্দুকে ভরে নদীতে ভাসিয়ে দাও’। ‘অতঃপর নদী তাকে তীরে ঠেলে দেবে। অতঃপর আমার শত্রু ও তার শত্রু (ফেরাঊন) তাকে উঠিয়ে নেবে এবং আমি তোমার উপর আমার পক্ষ হ’তে বিশেষ মহববত নিক্ষেপ করেছিলাম এবং তা এজন্য যে, তুমি আমার চোখের সামনে প্রতিপালিত হও’’ (ত্বোয়াহা -৩৭-৩৯)। বিষয়টি আল্লাহ অন্যত্র বলেন এভাবে, “আমরা মূসার মায়ের কাছে প্রত্যাদেশ করলাম এই মর্মে যে, তুমি ছেলেকে দুধ পান করাও। অতঃপর তার জীবনের ব্যাপারে যখন শংকিত হবে, তখন তাকে নদীতে নিক্ষেপ করবে। তুমি ভীত হয়ো না ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ো না। আমরা ওকে তোমার কাছেই ফিরিয়ে দেব এবং ওকে নবীদের অন্তর্ভুক্ত করব”। মূলতঃ শেষের দু’টি ওয়াদাই তাঁর মাকে নিশ্চিন্ত ও উদ্বুদ্ধ করে। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘মূসা জননীর অন্তর (কেবলি মূসার চিন্তায়) বিভোর হয়ে পড়ল। যদি আমরা তার অন্তরকে সুদৃঢ় করে না দিতাম, তাহ’লে সে মূসার (জন্য অস্থিরতার) বিষয়টি প্রকাশ করেই ফেলত। (আমরা তার অন্তরকে দৃঢ় করেছিলাম এ কারণে যে) সে যেন আল্লাহর উপরে প্রত্যয়শীলদের অন্তর্ভুক্ত থাকে’।

 

মূসা নদীতে নিক্ষিপ্ত হলেন

 

ফেরাঊনের সৈন্যদের হাতে নিহত হবার নিশ্চিত সম্ভাবনা দেখা দিলে আল্লাহর প্রত্যাদেশ (ইলহাম) অনুযায়ী পিতা-মাতা তাদের প্রাণাধিক প্রিয় সন্তানকে সিন্দুকে ভরে বাড়ীর পাশের নীল নদীতে ভাসিয়ে দিলেন। অতঃপর স্রোতের সাথে সাথে সিন্দুকটি এগিয়ে চলল। ওদিকে মূসার (বড়) বোন তার মায়ের হুকুমে সিন্দুকটিকে অনুসরণ করে নদীর কিনারা দিয়ে চলতে লাগল (ত্বোয়াহা -৪০)। এক সময় তা ফেরাঊনের প্রাসাদের ঘাটে এসে ভিড়ল। ফেরাঊনের পুণ্যবতী স্ত্রী আসিয়া বিনতে মুযাহিম ফুটফুটে সুন্দর বাচ্চাটিকে দেখে অভিভূত হয়ে পড়লেন। ফেরাঊন তাকে বনী ইস্রাঈল সন্তান ভেবে হত্যা করতে চাইল। কিন্তু সন্তানহীনা স্ত্রীর অপত্য স্নেহের কারণে তা সম্ভব হয়নি। অবশেষে ফেরাঊন নিজে তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। কারণ আল্লাহ মূসার চেহারার মধ্যে বিশেষ একটা মায়াময় কমনীয়তা দান করেছিলেন (ত্বোয়াহা-৩৯)। যাকে দেখলেই মায়া পড়ে যেত। ফেরাঊনের হৃদয়ের পাষাণ গলতে সেটুকুই যথেষ্ট ছিল। বস্ত্ততঃ এটাও ছিল আল্লাহর মহা পরিকল্পনারই অংশ বিশেষ। ফুটফুটে শিশুটিকে দেখে ফেরাঊনের স্ত্রী তার স্বামীকে বললেন, ‘এ শিশু আমার ও তোমার নয়নমণি। একে হত্যা করো না। এ আমাদের উপকারে আসতে পারে অথবা আমরা তাকে পুত্র করে নিতে পারি’। আল্লাহ বলেন, ‘অথচ তারা (আমার কৌশল) বুঝতে পারল না’। মূসা এক্ষণে ফেরাঊনের স্ত্রীর কোলে পুত্রস্নেহ পেতে শুরু করলেন। অতঃপর বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানোর জন্য রাণীর নির্দেশে বাজারে বহু ধাত্রীর কাছে নিয়ে যাওয়া হ’ল। কিন্তু মূসা কারুরই বুকে মুখ দিচ্ছেন না। আল্লাহ বলেন, “আমরা পূর্ব থেকেই অন্যের দুধ খাওয়া থেকে মূসাকে বিরত রেখেছিলাম’। এমন সময় অপেক্ষারত মূসার ভগিনী বলল, ‘আমি কি আপনাদেরকে এমন এক পরিবারের খবর দিব, যারা আপনাদের জন্য এ শিশু পুত্রের লালন-পালন করবে এবং তারা এর শুভাকাংখী’? রাণীর সম্মতিক্রমে মূসাকে প্রস্তাবিত ধাত্রীগৃহে প্রেরণ করা হ’ল। মূসা খুশী মনে মায়ের দুধ গ্রহণ করলেন। অতঃপর মায়ের কাছে রাজকীয় ভাতা ও উপঢৌকনাদি প্রেরিত হ’তে থাকল।এভাবে আল্লাহর অপার অনুগ্রহে মূসা তার মায়ের কোলে ফিরে এলেন। এভাবে একদিকে পুত্র হত্যার ভয়ংকর আতংক হ’তে মা-বাবা মুক্তি পেলেন ও নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া সন্তানকে পুনরায় বুকে ফিরে পেয়ে তাদের হৃদয় শীতল হ’ল। অন্যদিকে বহু মূল্যের রাজকীয় ভাতা পেয়ে সংসার যাত্রা নির্বাহের দুশ্চিন্তা হ’তে তারা মুক্ত হ’লেন। সাথে সাথে সম্রাট নিয়োজিত ধাত্রী হিসাবে ও সম্রাট পরিবারের সাথে বিশেষ সম্পর্ক সৃষ্টি হওয়ার ফলে তাঁদের পরিবারের সামাজিক মর্যাদাও বৃদ্ধি পেল। এভাবেই ফেরাঊনী কৌশলের উপরে আল্লাহর কৌশল বিজয়ী হ’ল। ফালিল্লাহিল হাম্দ।

 

আল্লাহ বলেন, ‘তারা চক্রান্ত করেছিল এবং আমরাও কৌশল করেছিলাম। কিন্তু তারা (আমাদের কৌশল) বুঝতে পারেনি’ (নমল, আয়াত ৫০)।

 

যৌবনে মূসা

 

দুগ্ধ পানের মেয়াদ শেষে মূসা অতঃপর ফেরাঊন-পুত্র হিসাবে তার গৃহে শান-শওকতের মধ্যে বড় হ’তে থাকেন। আল্লাহর রহমতে ফেরাঊনের স্ত্রীর অপত্য স্নেহ ছিল তাঁর জন্য সবচেয়ে বড় দুনিয়াবী রক্ষাকবচ। এভাবে ‘যখন তিনি যৌবনে পদার্পণ করলেন এবং পূর্ণবয়ষ্ক মানুষে পরিণত হ’লেন, তখন আল্লাহ তাকে বিশেষ প্রজ্ঞা ও জ্ঞান সম্পদে ভূষিত করলেন’। মূসা সমসাময়িক সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা সম্যকভাবে উপলব্ধি করলেন। দেখলেন যে, পুরা মিসরীয় সমাজ ফেরাঊনের একচ্ছত্র রাজনৈতিক কর্তৃত্বের অধীনে কঠোরভাবে শাসিত। ‘বিভক্ত কর ও শাসন কর’ এই সুপরিচিত ঘৃণ্য নীতির অনুসরণে ফেরাঊন তার দেশবাসীকে বিভিন্ন দলে বিভক্ত করেছিল ও একটি দলকে দুর্বল করে দিয়েছিল। আর সেটি হ’ল বনু ইস্রাঈল। প্রতিদ্বন্দ্বী জন্মাবার ভয়ে সে তাদের নবজাতক পুত্র সন্তানদের হত্যা করত ও কন্যা সন্তানদের বাঁচিয়ে রাখত। এভাবে একদিকে ফেরাঊন অহংকারে স্ফীত হয়ে নিজেকে ‘সর্বোচ্চ পালনকর্তা ও সর্বাধিপতি’ ভেবে সারা দেশে অনর্থ সৃষ্টি করছিল। এমনকি সে নিজেকে ‘একমাত্র উপাস্য’ বলতেও লজ্জাবোধ করেনি। অন্যদিকে মযলূম বনী ইস্রাঈলদের হাহাকার ও দীর্ঘশ্বাসে বাতাস ভারী হয়ে উঠছিল। অবশেষে আল্লাহ মযলূমদের ডাকে সাড়া দিলেন। আল্লাহ বলেন, ‘দেশে যাদেরকে দুর্বল করা হয়েছিল, আমরা চাইলাম তাদের উপরে অনুগ্রহ করতে, তাদেরকে নেতা করতে ও দেশের উত্তরাধিকারী করতে’। ‘এবং আমরা চাইলাম তাদেরকে দেশের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করতে এবং ফেরাঊন, হামান ও তাদের সেনাবাহিনীকে তা দেখিয়ে দিতে, যা তারা সেই দুর্বল দলের তরফ থেকে আশংকা করত’।

 

যুবক মূসা খুনী লেন

 

মূসার হৃদয় মযলূমদের প্রতি করুণায় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠলো। কিন্তু কি করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। ওদিকে আল্লাহর ইচ্ছা ছিল অন্য রকম। মূসা একদিন দুপুরের অবসরে শহরে বেড়াতে বেরিয়েছেন। এমন সময় তাঁর সামনে এক কান্ড ঘটে গেল। তিনি দুই ব্যক্তিকে লড়াইরত দেখতে পেলেন। যাদের একজন যালেম সম্রাটের ক্বিবতী বংশের এবং অন্যজন মযলূম বনু ইস্রাঈলের। মূসা তাদের থামাতে গিয়ে যালেম লোকটিকে একটা ঘুষি মারলেন। কি আশ্চর্য লোকটি তাতেই অক্কা পেল। মূসা দারুণভাবে অনুতপ্ত হলেন। এ বিষয়ে আল্লাহ বলেন, “একদিন দুপুরে তিনি শহরে প্রবেশ করলেন, যখন অধিবাসীরা ছিল দিবানিদ্রার অবসরে। এ সময় তিনি দু’জন ব্যক্তিকে লড়াইরত দেখতে পেলেন। এদের একজন ছিল তার নিজ গোত্রের এবং অপরজন ছিল শত্রুদলের। অতঃপর তার নিজ দলের লোকটি তার শত্রুদলের লোকটির বিরুদ্ধে তার কাছে সাহায্য চাইল। তখন মূসা তাকে ঘুষি মারলেন এবং তাতেই তার মৃত্যু হয়ে গেল। মূসা বললেন, ‘নিশ্চয়ই এটি শয়তানের কাজ। সে মানুষকে বিভ্রান্তকারী প্রকাশ্য শত্রু’। ‘হে আমার প্রভু! আমি নিজের উপরে যুলুম করেছি। তুমি আমাকে ক্ষমা কর। অতঃপর আল্লাহ তাকে ক্ষমা করলেন। নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমাশীল ও দয়াবান’।

 

পরের দিন ‘জনৈক ব্যক্তি ছুটে এসে মূসাকে বলল, হে মূসা! আমি তোমার শুভাকাংখী। তোমাকে পরামর্শ দিচ্ছি যে, এই মুহূর্তে তুমি এখান থেকে বের হয়ে চলে যাও। কেননা সম্রাটের পারিষদবর্গ তোমাকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করছে’। এই লোকটি মূসার প্রতি আকৃষ্ট ও তাঁর গুণমুগ্ধ ছিল। একথা শুনে ভীত হয়ে মূসা সেখান থেকে বের হয়ে পড়লেন নিরুদ্দেশ যাত্রাপথে। যেমন আল্লাহ বলেন,‘অতঃপর তিনি সেখান থেকে ভীত অবস্থায় বের হয়ে পড়লেন পথ দেখতে দেখতে এবং বললেন, হে আমার পালনকর্তা! আমাকে যালেম সম্প্রদায়ের কবল থেকে রক্ষা কর’। ‘এরপর যখন তিনি (পার্শ্ববর্তী রাজ্য) মাদিয়ান অভিমুখে রওয়ানা হ’লেন, তখন (দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে) বলে উঠলেন, ‘নিশ্চয়ই আমার প্রভু আমাকে সরল পথ দেখাবেন’।আসলে আল্লাহ চাচ্ছিলেন, ফেরাঊনের রাজপ্রাসাদ থেকে মূসাকে বের করে নিতে এবং সাধারণ মানুষের জীবনাচারের সঙ্গে পরিচিত করতে। সাথে সাথে আল্লাহ তাঁকে তৎকালীন একজন শ্রেষ্ঠ নবীর গৃহে লালিত-পালিত করে তাওহীদের বাস্তব শিক্ষায় আগাম পরিপক্ক করে নিতে চাইলেন।

 

মূসার পরীক্ষা সমূহ

 

অন্যান্য নবীদের পরীক্ষা হয়েছে সাধারণতঃ নবুঅত লাভের পরে। কিন্তু মূসার পরীক্ষা শুরু হয়েছে তার জন্ম লাভের পর থেকেই। বস্ত্ততঃ নবুঅত প্রাপ্তির পূর্বে ও পরে তাঁর জীবনে বহু পরীক্ষা হয়েছে। যেমন আল্লাহ মূসা (আঃ)-কে শুনিয়ে বলেন, ‘আর আমরা তোমাকে অনেক পরীক্ষায় ফেলেছি’ (ত্বোয়াহা, আয়াত ৪০)।

 

নবুঅত লাভের পূর্বে তাঁর প্রধান পরীক্ষা ছিল তিনটি। যথাঃ (১) হত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া (২) মাদিয়ানে হিজরত (৩) মাদিয়ান থেকে মিসর যাত্রা। অতঃপর নবুয়ত লাভের পর তাঁর পরীক্ষা হয় প্রধানতঃ চারটিঃ (১) জাদুকরদের মুকাবিলা (২) ফেরাঊনের যুলুমসমূহ মুকাবিলা (৩) সাগরডুবির পরীক্ষা (৪) বায়তুল মুক্বাদ্দাস অভিযান।

 

 

 

নবুঅত-পূর্ব ১ম পরীক্ষা : হত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া

 

মূসার জন্ম হয়েছিল তাঁর কওমের উপরে আপতিত রাষ্ট্রীয় হত্যাযজ্ঞের ভয়ংকর বিভীষিকার মধ্যে। আল্লাহ তাঁকে অপূর্ব কৌশলের মাধ্যমে বাঁচিয়ে নেন। অতঃপর তাঁর জানী দুশমনের ঘরেই তাঁকে নিরাপদে ও সসম্মানে লালন-পালন করালেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মা ও পরিবারকে করলেন উচ্চতর সামাজিক মর্যাদায় উন্নীত। অথচ মূসার জন্মকে ঠেকানোর জন্যই ফেরাঊন তার পশুশক্তির মাধ্যমে বনু ইস্রাঈলের শত শত শিশু পুত্রকে হত্যা করে চলছিল। এ বিষয়ে ইতিপূর্বে বর্ণিত হয়েছে।

 

২য় পরীক্ষা : মাদিয়ানে হিজরত

 

অতঃপর যৌবনকালে তাঁর দ্বিতীয় পরীক্ষা হ’ল- হিজরতের পরীক্ষা। মূলতঃ এটাই ছিল তাঁর জ্ঞানবুদ্ধি হবার পরে ১ম পরীক্ষা। শেষনবী সহ অন্যান্য নবীর জীবনে সাধারণতঃ নবুঅতপ্রাপ্তির পরে হিজরতের পরীক্ষা দিতে হয়েছে। কিন্তু মূসা (আঃ)-এর জীবনে নবুঅত প্রাপ্তির আগেই এই কঠিন পরীক্ষা উপস্থিত হয়। অনাকাংখিত ও আকস্মিক হত্যাকান্ডের আসামী হয়ে জীবনের ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত্র মূসা ফেরাঊনের রাজ্যসীমা ছেড়ে কপর্দকহীন অবস্থায় পার্শ্ববর্তী রাজ্য মাদিয়ানে গিয়ে উপস্থিত হ’লেন। ক্ষুধায়-তৃষ্ণায় কাতর মূসা এই ভীতিকর দীর্ঘ সফরে কিভাবে চলেছেন, কি খেয়েছেন সেসব বিষয়ে তাফসীরকারগণ বিভিন্ন চমকপ্রদ ঘটনাবলী উল্লেখ করেছেন। কিন্তু কুরআন এসব বিষয়ে চুপ থেকেছে বিধায় আমরাও চুপ থাকছি। তবে রওয়ানা হবার সময় যেহেতু মূসা নিজেকে সম্পূর্ণরূপে স্বীয় পালনকর্তা আল্লাহর উপরে সমর্পণ করেছিলেন এবং প্রত্যাশা করেছিলেন ‘নিশ্চয়ই আমার পালনকর্তা আমাকে সরল পথ দেখাবেন’, অতএব তাঁকে মাদিয়ানের মত অপরিচিত রাজ্যে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়া ও সসম্মানে সেখানে বসবাস করার যাবতীয় দায়িত্ব আল্লাহ নিয়েছিলেন। এর মধ্যে আমাদের জন্য শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে যে, সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর উপরে নিজেকে সঁপে দিলে আল্লাহ তাঁর নেককার বান্দাদের সব দায়িত্ব নিজে নিয়ে থাকেন। উল্লেখ্য যে, বর্তমান পূর্ব জর্দানের মো‘আন সামুদ্রিক বন্দরের অনতিদূরেই ‘মাদইয়ান’ অবস্থিত।

 

মাদিয়ানের জীবন : বিবাহ ও সংসার পালন

 

মাদিয়ানে প্রবেশ করে তিনি পানির আশায় একটা কূপের দিকে গেলেন। সেখানে পানি প্রার্থী লোকদের ভিড়ের অদূরে দু’টি মেয়েকে তাদের তৃষ্ণার্ত পশুগুলি সহ অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাঁর হৃদয় উথলে উঠলো। কেউ তাদের দিকে ভ্রুক্ষেপই করছে না। মূসা নিজে মযলূম। তিনি মযলূমের ব্যথা বুঝেন। তাই কিছুক্ষণ ইতঃস্তত করে মেয়ে দু’টির দিকে এগিয়ে গেলেন। তিনি তাদের সমস্যার কথা জিজ্ঞেস করলে তারা বলল, ‘আমরা আমাদের পশুগুলিকে পানি পান করাতে পারি না, যতক্ষণ না রাখালরা তাদের পশুগুলিকে পানি পান করিয়ে চলে যায়। অথচ আমাদের পিতা খুবই বৃদ্ধ’ (যিনি ঘরে বসে আমাদের অপেক্ষায় উদগ্রীব হয়ে আছেন)। ‘অতঃপর তাদের পশুগুলি এনে মূসা পানি পান করালেন’ (তারপর মেয়ে দু’টি পশুগুলি নিয়ে বাড়ী চলে গেল)। মূসা একটি গাছের ছায়ায় বসে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলেন, ‘হে আমার পালনকর্তা! তুমি আমার উপর যে অনুগ্রহ নাযিল করবে, আমি তার মুখাপেক্ষী’। হঠাৎ দেখা গেল যে ‘বালিকাদ্বয়ের একজন সলজ্জ পদক্ষেপে তাঁর দিকে আসছে’। মেয়েটি এসে ধীর কণ্ঠে তাকে বলল, ‘আমার পিতা আপনাকে ডেকেছেন, যাতে আপনি যে আমাদেরকে পানি পান করিয়েছেন, তার বিনিময় স্বরূপ আপনাকে পুরস্কার দিতে পারেন’।

 

উল্লেখ্য যে, বালিকাদ্বয়ের পিতা ছিলেন মাদইয়ান বাসীদের নিকটে প্রেরিত বিখ্যাত নবী হযরত শু‘আয়েব (আঃ)। মূসা ইতিপূর্বে কখনো তাঁর নাম শোনেননি বা তাঁকে চিনতেন না। তাঁর কাছে পৌঁছে মূসা তাঁর বৃত্তান্ত সব বর্ণনা করলেন। শু‘আয়েব (আঃ) সবকিছু শুনে বললেন, ‘ভয় করো না। তুমি যালেম সম্প্রদায়ের কবল থেকে মুক্তি পেয়েছ’। ‘এমন সময় বালিকাদ্বয়ের একজন বলল, আববা! এঁকে বাড়ীতে কর্মচারী হিসাবে রেখে দিন। কেননা আপনার কর্ম সহায়ক হিসাবে সেই-ই উত্তম হবে, যে শক্তিশালী ও বিশ্বস্ত’। ‘তখন তিনি মূসাকে লক্ষ্য করে বললেন, আমি আমার এই কন্যাদ্বয়ের একজনকে তোমার সাথে বিবাহ দিতে চাই এই শর্তে যে, তুমি আট বছর আমার বাড়ীতে কর্মচারী থাকবে। তবে যদি দশ বছর পূর্ণ করো, সেটা তোমার ইচ্ছা। আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাই না। আল্লাহ চাহেন তো তুমি আমাকে সদাচারী হিসাবে পাবে’। ‘মূসা বলল, আমার ও আপনার মধ্যে এই চুক্তি স্থির হ’ল। দু’টি মেয়াদের মধ্য থেকে যেকোন একটি পূর্ণ করলে আমার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ থাকবে না। আমরা যা বলছি, আল্লাহ তার উপরে তত্ত্বাবধায়ক’। মূলতঃ এটাই ছিল তাদের বিয়ের মোহরানা। সেযুগে এ ধরনের রেওয়াজ অনেকের মধ্যে চালু ছিল। যেমন ইতিপূর্বে ইয়াকূব (আঃ) তাঁর স্ত্রীর মোহরানা বাবদ সাত বছর শ্বশুর বাড়ীতে মেষ চরিয়েছেন। এভাবে অচেনা-অজানা দেশে এসে মূসা (আঃ) অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান এবং অন্যান্য নিরাপত্তাসহ অত্যন্ত মর্যাদাবান ও নির্ভরযোগ্য একজন অভিভাবক পেয়ে গেলেন। সেই সঙ্গে পেলেন জীবন সাথী একজন পতি-পরায়ণা বুদ্ধিমতী স্ত্রী। অতঃপর সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে মূসার দিনগুলি অতিবাহিত হ’তে থাকলো। সময় গড়িয়ে এক সময় মেয়াদ পূর্ণ হ’য়ে গেল। আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, তিনি চাকুরীর বাধ্যতামূলক আট বছর এবং ঐচ্ছিক দু’বছর মেয়াদ পূর্ণ করেছিলেন। কেননা এটাই নবী চরিত্রের জন্য শোভনীয় যে, কৃতজ্ঞতা স্বরূপ ঐচ্ছিক দু’বছরও তিনি পূর্ণ করবেন’।

 

আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাঃ) বলেন, ‘সর্বাধিক দূরদর্শী ব্যক্তি ছিলেন তিনজন: ১- ইউসুফকে ক্রয়কারী মিসরের আযীয (রাজস্বমন্ত্রী), যখন তিনি তার স্ত্রীকে বলেছিলেন, ‘একে সম্মানের সাথে রাখ, হয়তবা সে আমাদের কল্যাণে আসবে’ ২- মূসার স্ত্রী, যখন (বিবাহের পূর্বে) তিনি স্বীয় পিতাকে বলেছিলেন, ‘হে পিতা, এঁকে কর্মচারী নিয়োগ করুন। নিশ্চয়ই আপনার শ্রেষ্ঠ সহযোগী তিনিই হ’তে পারেন, যিনি শক্তিশালী ও বিশ্বস্ত’ এবং ৩- আবুবকর ছিদ্দীক, যখন তিনি ওমরকে তাঁর পরবর্তী খলীফা মনোনীত করেন’।

 

৩য় পরীক্ষা: মিসর অভিমুখে যাত্রা ও পথিমধ্যে নবুঅত লাভ

 

মোহরানার চুক্তির মেয়াদ শেষ। এখন যাবার পালা। পুনরায় স্বদেশে ফেরা। দুরু দুরু বক্ষ। ভীত-সন্ত্রস্ত্র মন। চেহারায় দুশ্চিন্তার ছাপ। তবুও যেতে হবে। পিতা-মাতা, ভাই-বোন সবাই রয়েছেন মিসরে। আল্লাহর উপরে ভরসা করে স্ত্রী-পরিবার নিয়ে বের হ’লেন পুনরায় মিসরের পথে। শুরু হ’ল তৃতীয় পরীক্ষার পালা। উল্লেখ্য, দশ বছরে তিনি দু’টি পুত্র সন্তান লাভ করেন এবং শ্বশুরের কাছ থেকে পান এক পাল দুম্বা। এছাড়া তাক্বওয়া ও পরহেযগারীর আধ্যাত্মিক প্রশিক্ষণ তো তিনি লাভ করেছিলেন বিপুলভাবে।

 

পরিবারের কাফেলা নিয়ে মূসা রওয়ানা হ’লেন স্বদেশ অভিমুখে। পথিমধ্যে মিসর সীমান্তে অবস্থিত সিনাই পর্বতমালার তূর পাহাড়ের নিকটবর্তী স্থানে পৌঁছলে হঠাৎ স্ত্রীর প্রসব বেদনা শুরু হ’ল। এখুনি প্রয়োজন আগুনের। কিন্তু কোথায় পাবেন আগুন। পাথরে পাথরে ঘষে বৃথা চেষ্টা করলেন কতক্ষণ। প্রচন্ড শীতে ও তুষারপাতের কারণে পাথর ঘষায় কাজ হ’ল না। দিশেহারা হয়ে চারিদিকে দেখতে লাগলেন। হঠাৎ অনতিদূরে আগুনের হলকা নজরে পড়ল। আশায় বুক বাঁধলেন। স্ত্রী ও পরিবারকে বললেন, ‘তোমরা এখানে অবস্থান কর। আমি আগুন দেখেছি। সম্ভবতঃ আমি তা থেকে তোমাদের জন্য কিছু আগুন জ্বালিয়ে আনতে পারব অথবা সেখানে পৌঁছে পথের সন্ধান পাব’ (ত্বোয়াহা-১০)। একথা দৃষ্টে মনে হয়, মূসা পথ হারিয়ে ফেলেছিলেন। পথিমধ্যে শাম অঞ্চলের শাসকদের পক্ষ থেকে প্রধান সড়কে বিপদাশংকা ছিল। তাই শ্বশুরের উপদেশ মোতাবেক তিনি পরিচিত রাস্তা ছেড়ে অপরিচিত রাস্তায় চলতে গিয়ে মরুভূমির মধ্যে পথ হারিয়ে ডান দিকে চলে তূর পাহাড়ের পশ্চিম প্রান্তে পৌঁছে গেলেন। মূলতঃ এ পথ হারানোটা ছিল আল্লাহর মহা পরিকল্পনারই অংশ।

 

মূসা আশান্বিত হয়ে যতই আগুনের নিকটবর্তী হন, আগুনের হল্কা ততই পিছাতে থাকে। আশ্চর্য হয়ে দেখলেন, সবুজ বৃক্ষের উপরে আগুন জ্বলছে। অথচ গাছের পাতা পুড়ছে না; বরং তার উজ্জ্বলতা আরও বেড়ে যাচ্ছে। বিস্ময়ে অভিভূত মূসা এক দৃষ্টে আগুনটির দিকে তাকিয়ে রইলেন। হঠাৎ এক গুরুগম্ভীর আওয়ায কানে এলো তাঁর চার পাশ থেকে। মনে হ’ল পাহাড়ের সকল প্রান্ত থেকে একই সাথে আওয়ায আসছে। মূসা তখন তূর পাহাড়ের ডান দিকে ‘তুবা’ উপত্যকায় দন্ডায়মান। আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর যখন তিনি আগুনের কাছে পৌঁছলেন, তখন আওয়ায এলো, হে মূসা!’ ‘আমিই তোমার পালনকর্তা। অতএব তুমি তোমার জুতা খুলে ফেল। তুমি পবিত্র উপত্যকা তুবায় রয়েছ’ (ত্বোয়াহা-১১-১২)। এর দ্বারা বিশেষ অবস্থায় পবিত্র স্থানে জুতা খোলার আদব প্রমাণিত হয়। যদিও পাক জুতা পায়ে দিয়ে ছালাত আদায় করা জায়েয।অতঃপর আল্লাহ বলেন, ‘আর আমি তোমাকে মনোনীত করেছি। অতএব তোমাকে যা প্রত্যাদেশ করা হচ্ছে তা মনোযোগ দিয়ে শুনতে থাক’। ‘নিশ্চয় আমিই আল্লাহ। আমি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। অতএব আমার ইবাদত কর এবং আমার স্মরণে ছালাত কায়েম কর’। ‘ক্বিয়ামত অবশ্যই আসবে, আমি তা গোপন রাখতে চাই; যাতে প্রত্যেকে তার কর্মানুযায়ী ফল লাভ করতে পারে’। ‘সুতরাং যে ব্যক্তি ক্বিয়ামতে বিশ্বাস রাখে না এবং নিজ প্রবৃত্তির অনুসরণ করে, সে যেন তোমাকে (ক্বিয়ামত বিষয়ে সতর্ক থাকা হ’তে) নিবৃত্ত না করে। তাহ’লে তুমি ধ্বংস হয়ে যাবে’ (ত্বোয়াহা-১৩-১৬)।

 

এ পর্যন্ত আক্বীদা ও ইবাদতগত বিষয়ে নির্দেশ দানের পর এবার কর্মগত নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ বলছেন, ‘হে মূসা! তোমার ডান হাতে ওটা কি?’ ‘মূসা বললেন, এটা আমার লাঠি। এর উপরে আমি ভর দেই এবং এর দ্বারা আমার ছাগপালের জন্য গাছের পাতা ঝেড়ে নামাই। তাছাড়া এর দ্বারা আমার অন্যান্য কাজও চলে’। ‘আল্লাহ বললেন, হে মূসা! তুমি ওটা ফেলে দাও’। ‘অতঃপর তিনি ওটা (মাটিতে) ফেলে দিতেই তা সাপ হয়ে ছুটাছুটি করতে লাগল’। ‘আল্লাহ বললেন, তুমি ওটাকে ধর, ভয় করো না, আমি এখুনি ওকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে দেব’ (ত্বোয়াহা, আয়াত ১৭-২১)। এটি ছিল মূসাকে দেওয়া ১ম মু‘জেযা। কেননা মিসর ছিল ঐসময় জাদুবিদ্যায় শীর্ষস্থানে অবস্থানকারী দেশ। সেখানকার শ্রেষ্ঠ জাদুকরদের হারিয়ে দেওয়ার মাধ্যমেই নবুঅতের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করা আবশ্যক ছিল। সেজন্যই আল্লাহ মূসাকে সবদিক দিয়ে প্রস্ত্তত করে দিচ্ছিলেন। এর ফলে মূসা নিজের মধ্যে অনেকটা শক্তি ও স্বস্তি লাভ করলেন।

 

১ম মু‘জেযা প্রদানের পর আল্লাহ তাকে দ্বিতীয় মু‘জেযা প্রদানের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘তোমার হাত বগলে রাখ। তারপর দেখবে তা বের হয়ে আসবে উজ্জ্বল ও নির্মল আলো হয়ে, অন্য একটি নিদর্শন রূপে’। ‘এটা এজন্য যে, আমরা তোমাকে আমাদের বিরাট নিদর্শনাবলীর কিছু অংশ দেখাতে চাই’ (ত্বোয়াহা, আয়াত ২২-২৩)।

 

নয়টি নিদর্শন

 

আল্লাহ বলেন,‘আমরা মূসাকে নয়টি নিদর্শন প্রদান করেছিলাম’ (ইসরা, আয়াত ১০১; নামল, আয়াত ১২)। এখানে ‘নিদর্শন’ অর্থ একদল বিদ্বান ‘মু‘জেযা’ নিয়েছেন। তবে ৯ সংখ্যা উল্লেখ করায় এর বেশী না হওয়াটা যরূরী নয়। বরং এর চেয়ে অনেক বেশী মু‘জেযা তাঁকে দেওয়া হয়েছিল। যেমন পাথরে লাঠি মারায় ১২টি গোত্রের জন্য বারোটি ঝর্ণাধারা নির্গমন, তীহ্ প্রান্তরে মেঘের ছায়া প্রদান, মান্না-সালওয়া খাদ্য অবতরণ প্রভৃতি। তবে এ নয়টি ছিল অধিক গুরুত্বপূর্ণ ও শ্রেষ্ঠ নিদর্শন সমূহের অন্তর্ভুক্ত, যা ফেরাঊনী সম্প্রদায়কে প্রদর্শন করা হয়েছিল।

 

আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) উক্ত ৯টি মু‘জেযা নিম্নরূপে গণনা করেছেন। যথা- (১) মূসা (আঃ)-এর ব্যবহৃত লাঠি, যা নিক্ষেপ করা মাত্র অজগর সাপের ন্যায় হয়ে যেত (২) শুভ্র হাত, যা বগলের নীচ থেকে বের করতেই জ্যোতির্ময় হয়ে সার্চ লাইটের মত চমকাতে থাকত (৩) নিজের তোতলামি, যা মূসার প্রার্থনাক্রমে দূর করে দেওয়া হয় (৪) ফেরাঊনী কওমের উপর প্লাবণের গযব প্রেরণ (৫) অতঃপর পঙ্গপাল (৬) উকুন (৭) ব্যাঙ (৮) রক্ত এবং অবশেষে (৯) নদী ভাগ করে তাকে সহ বনু ইস্রাঈলকে সাগরডুবি হ’তে নাজাত দান। তবে প্রথম দু’টিই ছিল সর্বপ্রধান মু‘জেযা, যা নিয়ে তিনি শুরুতে ফেরাঊনের নিকটে গিয়েছিলেন (সূরা নমল, আয়াত ১০, ১২)।

 

অবশ্য কুরআনে বর্ণিত আয়াত সমূহ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, প্রথমে ফেরাঊনের সম্প্রদায়ের উপরে দুর্ভিক্ষের গযব এসেছিল। যেমন আল্লাহ বলেন,‘আমরা পাকড়াও করেছিলাম ফেরাঊনের অনুসারীদেরকে দুর্ভিক্ষের মাধ্যমে এবং ফল-ফসলাদির ক্ষয়-ক্ষতির মাধ্যমে, যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করে’ (আ‘রাফ, আয়াত ১৩০)।

 

হাফেয ইবনু কাছীর ‘তোতলামী’টা বাদ দিয়ে ‘দুর্ভিক্ষ’সহ নয়টি নিদর্শন বর্ণনা করেছেন। অবশ্য ফেরাঊন সম্প্রদায়ের উপরে আরও একটি নিদর্শন এসেছিল ‘প্লেগ-মহামারী’ (আ‘রাফ, আয়াত ১৩৪)। যাতে তাদের ৭০ হাযার লোক মারা গিয়েছিল এবং পরে মূসা (আঃ)-এর দো‘আর বরকতে মহামারী উঠে গিয়েছিল। এটাকে গণনায় ধরলে সর্বমোট নিদর্শন ১১টি হয়। তবে ‘নয়’ কথাটি ঠিক রাখতে গিয়ে কেউ তোতলামি ও প্লেগ বাদ দিয়েছেন। কেউ দুর্ভিক্ষ ও প্লেগ বাদ দিয়েছেন। মূলতঃ সবটাই ছিল মূসা (আঃ)-এর নবুঅতের অকাট্ট দলীল ও গুরুত্বপূর্ণ মু‘জেযা, যা মিসরে ফেরাঊনী সম্প্রদায়ের উপরে প্রদর্শিত হয়েছিল। এগুলি সবই হয়েছিল মিসরে। অতএব আমরা সেখানে পৌঁছে এসবের বিস্তারিত বিবরণ পেশ করব ইনশাআল্লাহ।

 

সিনাই হতে মিসর

 

প্রসব বেদনায় কাতর স্ত্রীর জন্য আগুন আনতে গিয়ে মূসা এমন এক নতুন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হ’লেন, যা রীতিমত ভীতিকর, শিহরণমূলক ও অভূতপূর্ব। তিনি স্ত্রীর জন্য আগুন নিয়ে যেতে পেরেছিলেন কি-না বা পরিবারের সেবায় তিনি পরে কি কি ব্যবস্থা নিলেন- এসব বিষয়ে কুরআন চুপ রয়েছে। কুরআনের গৃহীত বাকরীতি অনুযায়ী এ সবের বর্ণনা কোন যরূরী বিষয় নয়। কেননা এগুলি সাধারণ মানবিক তাকীদ, যা যেকোন স্বামীই তার স্ত্রী ও পরিবারের জন্য করে থাকে। অতএব এখন আমরা সামনের দিকে আগাব।

 

আল্লাহ পাক মূসাকে নবুঅত ও প্রধান দু’টি মু‘জেযা দানের পর নির্দেশ দিলেন, হে মূসা! ‘তুমি ফেরাঊনের কাছে যাও। সে উদ্ধত হয়ে গেছে’। ভীত সন্ত্রস্ত মূসা বলল, ‘হে আমার পালনকর্তা! আমার বক্ষ উন্মোচন করে দিন’ ‘এবং আমার কাজ সহজ করে দিন’। ‘আমার জিহবা থেকে জড়তা দূর করে দিন’ ‘যাতে তারা আমার কথা বুঝতে পারে’ ‘এবং আমার পরিবারের মধ্য থেকে একজনকে আমার সাহায্যকারী নিযুক্ত করে দিন’। ‘আমার ভাই হারূণকে দিন’। ‘তার মাধ্যমে আমার কোমর শক্ত করুন’ ‘এবং তাকে (নবী করে) আমার কাজে অংশীদার করুন’। ‘যাতে আমরা বেশী বেশী করে আপনার পবিত্রতা ঘোষণা করতে পারি’ ‘এবং অধিক পরিমাণে আপনাকে স্মরণ করতে পারি’। ‘আপনি তো আমাদের অবস্থা সবই দেখছেন’ (ত্বোয়াহা, আয়াত ২৪-৩৫)।

 

মূসার উপরোক্ত দীর্ঘ প্রার্থনার জবাবে আল্লাহ বললেন, ‘হে মূসা! তুমি যা যা চেয়েছ, সবই তোমাকে দেওয়া হ’ল’। শুধু এবার কেন, ‘আমি তোমার উপরে আরও একবার অনুগ্রহ করেছিলাম’ (ত্বোয়াহা, আয়াত ৩৬-৩৭)। বলেই আল্লাহ মূসাকে তার জন্মের পর নদীতে ভাসিয়ে দেওয়ার ও ফেরাঊনের ঘরে লালন-পালনের চমকপ্রদ কাহিনী শুনিয়ে দিলেন।

 

আল্লাহর খেলা বুঝা ভার। হত্যার টার্গেট হয়ে জন্মলাভ করে হত্যার ঘোষণা দানকারী সম্রাট ফেরাঊনের গৃহে পুত্রস্নেহে লালিত-পালিত হয়ে পরে যৌবনকালে পুনরায় হত্যাকান্ডের আসামী হয়ে প্রাণভয়ে ভীত ও কপর্দকশূন্য অবস্থায় স্বদেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমালেন। অতঃপর সেখানে দীর্ঘ দশ বছর মেষপালকের চাকুরী করে স্ত্রী-পরিবার নিয়ে স্বদেশ ফেরার পথে রাহযানির ভয়ে মূল রাস্তা ছেড়ে অপরিচিত রাস্তায় এসে কনকনে শীতের মধ্যে অন্ধকার রাতে প্রসব বেদনায় কাতর স্ত্রীকে নিয়ে মহা বিপদগ্রস্ত স্বামী যখন অদূরে আলোর ঝলকানি দেখে আশায় বুক বেঁধে সেদিকে ছুটেছেন। তখন তিনি জানতেন না যে, সেখানে তার জন্য অপেক্ষা করছে এমন এক মহা সুসংবাদ যা দুনিয়ার কোন মানুষ ইতিপূর্বে দেখেনি, শোনেনি, কল্পনাও করেনি। বিশ্ব চরাচরের পালনকর্তা আল্লাহ স্বয়ং স্বকণ্ঠে, স্বশব্দে ও স্ব-ভাষায় তাকে ডেকে কথা বলবেন, এও কি সম্ভব? শংকিত, শিহরিত, পুলকিত মূসা সবকিছু ভুলে পুরা দেহ-মন দিয়ে শুনছেন স্বীয় প্রভুর দৈববাণী। দেখলেন তাঁর নূরের তাজাল্লী। চাইলেন প্রাণভরে যা চাওয়ার ছিল। পেলেন সাথে সাথে পরিপূর্ণভাবে। এতে বুঝা যায়, পারিবারিক সমস্যা ও রাস্তাঘাটের সমস্যা সবই আল্লাহর মেহেরবানীতে সুন্দরভাবে সমাধান হয়ে গিয়েছিল যা কুরআনে উল্লেখের প্রয়োজন পড়েনি।

 

ওদিকে মূসার প্রার্থনা কবুলের সাথে সাথে আল্লাহ হারূণকে মিসরে অহীর মাধ্যমে নবুঅত প্রদান করলেন (মারিয়াম, আয়াত ৫৩) এবং তাকে মূসার আগমন বার্তা জানিয়ে দিলেন। সেই সঙ্গে মূসাকে সার্বিক সহযোগিতা করার এবং তাকে মিসরের বাইরে এসে অভ্যর্থনা করার নির্দেশ দেওয়া হয়। তিনি বনু ইস্রাঈলের নেতৃবৃন্দকে নিয়ে এগিয়ে এসে যথাযথভাবে সে নির্দেশ পালন করেন। পালনকর্তা, আমি তাদের এক ব্যক্তিকে হত্যা করেছিলাম। তাই আমি ভয় করছি যে, তারা আমাকে হত্যা করবে’। ‘আমার ভাই হারূণ, সে আমার অপেক্ষা প্রাঞ্জলভাষী। অতএব তাকে আমার সাথে সাহায্যের

 

মূসা হলেন কালীমুল্লাহ :

 

তুবা প্রান্তরের উক্ত ঘটনা থেকে মূসা কেবল নবী হ’লেন না। বরং তিনি হ’লেন ‘কালীমুল্লাহ’ বা আল্লাহর সাথে বাক্যালাপকারী। যদিও শেষনবী (ছাঃ) মে‘রাজে আল্লাহর সঙ্গে কথা বলেছেন। কিন্তু দুনিয়াতে এভাবে বাক্যালাপের সৌভাগ্য কেবলমাত্র হযরত মূসা (আঃ)-এর হয়েছিল। আল্লাহ বিভিন্ন নবীকে বিভিন্ন বিষয়ে বিশিষ্টতা দান করেছেন। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘হে মূসা! আমি আমার বার্তা পাঠানোর মাধ্যমে এবং আমার বাক্যালাপের মাধ্যমে তোমাকে লোকদের উপরে বিশিষ্টতা দান করেছি। অতএব আমি তোমাকে যা কিছু দান করলাম, তা গ্রহণ কর এবং কৃতজ্ঞ থাক’ (আ‘রাফ, আয়াত ১৪৪)। এভাবে আল্লাহ পাক মূসা (আঃ)-এর সাথে আরেকবার কথা বলেন, সাগর ডুবি থেকে নাজাত পাবার পরে শামে এসে একই স্থানে ‘তওরাত’ প্রদানের সময় (আ‘রাফ, আয়াত ১৩৮, ১৪৫)। এভাবে মূসা হ’লেন ‘কালীমুল্লাহ’। মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর সাথে সরাসরি বাক্যালাপের পর উৎসাহিত ও পুলকিত মূসা এখানে তূর পাহাড়ের পাদদেশ এলাকায় কিছু দিন বিশ্রাম করলেন। অতঃপর মিসর অভিমুখে রওয়ানা হ’লেন। সিনাই থেকে অনতিদূরে মিসর সীমান্তে পৌঁছে গেলে যথারীতি বড় ভাই হারূণ ও অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন এসে তাঁদেরকে সাদর অভ্যর্থনা করে নিয়ে গেলেন।

 

মূসা (আঃ)-এর মিসরে প্রত্যাবর্তন

 

ফেরাঊন ও তার পারিষদবর্গের বিরুদ্ধে অলৌকিক লাঠি ও আলোকিত হস্ত তালুর দু’টি নিদর্শন নিয়ে মূসা (আঃ) মিসরে পৌঁছলেন। ফেরাঊন ও তার সভাসদ বর্গকে আল্লাহ ‘জাহান্নামের দিকে আহবানকারী নেতৃবৃন্দ’ হিসাবে এবং তাদের সম্প্রদায়কে ‘ফাসেক’ বা পাপাচারী বলে আখ্যায়িত করেছেন। আল্লাহ পাক মূসাকে বললেন ‘তুমি ও তোমার ভাই আমার নিদর্শনবলীসহ যাও এবং আমার স্মরণে শৈথিল্য করো না’। ‘তোমরা উভয়ে ফেরাঊনের কাছে যাও। সে খুব উদ্ধত হয়ে গেছে’। ‘তোমরা তার কাছে গিয়ে নম্রভাষায় কথা বলবে। তাতে হয়ত সে চিন্তা-ভাবনা করবে অথবা ভীত হবে’। ‘তারা বলল, হে আমাদের পালনকর্তা, আমরা আশংকা করছি যে, সে আমাদের উপরে যুলুম করবে কিংবা উত্তেজিত হয়ে উঠবে’। ‘আল্লাহ বললেন, ‘তোমরা ভয় করো না। আমি তোমাদের সাথে আছি। আমি তোমাদের (সব কথা) শুনবো ও (সব অবস্থা) দেখব’ (ত্বোয়াহা, আয়াত ৪২-৪৬)।

 

ফেরাঊনের নিকটে মূসা (আঃ)-এর দাওয়াত

 

আল্লাহর নির্দেশমত মূসা ও হারূণ ফেরাঊন ও তার সভাসদবর্গের নিকটে পৌঁছে গেলেন। অতঃপর মূসা ফেরাঊনকে বললেন, ‘হে ফেরাঊন! আমি বিশ্বপ্রভুর পক্ষ হ’তে প্রেরিত রাসূল’। ‘আল্লাহর পক্ষ থেকে যে সত্য এসেছে, তার ব্যতিক্রম কিছু না বলার ব্যাপারে আমি দৃঢ়চিত্ত। আমি তোমাদের নিকটে তোমাদের পালনকর্তার নিদর্শন নিয়ে আগমন করেছি। অতএব তুমি বনু ইস্রাঈলগণকে আমার সাথে পাঠিয়ে দাও’ (আ‘রাফ, আয়াত ১০৪-১০৫)। মূসার এদাবী থেকে বুঝা যায় যে, ঐ সময় বনী ইস্রাঈলের উপরে ফেরাঊনের ও তার সম্প্রদায়ের যুলুম চরম পর্যায়ে পৌঁছেছিল এবং তাদের সঙ্গে আপোষে বসবাসের কোন রাস্তা ছিল না। ফলে তিনি তাদেরকে সেখান থেকে বের করে আনতে চাইলেন। তবে এটা নিশ্চিত যে, মূসা তখনই বনু ইস্রাঈলকে নিয়ে বের হয়ে যাননি। মূসা ফেরাঊনকে বললেন,....‘তুমি বনু ইস্রাঈলদের উপরে নিপীড়ন করো না’। ‘আমরা আল্লাহর নিকট থেকে অহী লাভ করেছি যে, যে ব্যক্তি মিথ্যারোপ করে ও মুখ ফিরিয়ে নেয়, তার উপরে আল্লাহর আযাব নেমে আসে’ (ত্বোয়াহা, আয়াত ৪৭-৪৮)। একথা শুনে ফেরাঊন তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল, ‘মূসা! তোমার পালনকর্তা কে’? ‘মূসা বললেন, আমার পালনকর্তা তিনি, যিনি প্রত্যেক বস্ত্তকে তার যোগ্য আকৃতি দান করেছেন। অতঃপর পথ প্রদর্শন করেছেন’। ‘ফেরাঊন বলল, তাহ’লে অতীত যুগের লোকদের অবস্থা কি?’ ‘মূসা বললেন, তাদের খবর আমার প্রভুর কাছে লিখিত আছে। আমার পালনকর্তা ভ্রান্ত হন না এবং বিস্মৃতও হন না’। একথা বলার পর মূসা আল্লাহর নিদর্শন সমূহ বর্ণনা শুরু করলেন, যাতে ফেরাঊন তার যৌক্তিকতা মেনে নিতে বাধ্য হয়। তিনি বললেন, আমার পালনকর্তা তিনি, ‘যিনি তোমাদের জন্য পৃথিবীকে বিছানা স্বরূপ বানিয়েছেন এবং তাতে চলার পথ সমূহ তৈরী করেছেন। তিনি আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করেন এবং তা দ্বারা বিভিন্ন প্রকার উদ্ভিদ উৎপন্ন করেন’। ‘তোমরা তা আহার কর ও তোমাদের চতুষ্পদ জন্তুসমূহ চরিয়ে থাক। নিশ্চয়ই এতে বিবেকবানদের জন্য নিদর্শন সমূহ রয়েছে’ (ত্বোয়াহা, আয়াত ৪৯-৫৪)।

 

মুজেযা ও জাদু :

 

মু‘জেযা অর্থ মানুষের বুদ্ধিকে অক্ষমকারী। অর্থাৎ এমন কর্ম সংঘটিত হওয়া যা মানুষের জ্ঞান ও ক্ষমতা বহির্ভূত। (১) ‘মু‘জেযা’ কেবল নবীগণের জন্য খাছ এবং ‘কারামত’ আল্লাহ তাঁর নেককার বান্দাদের মাধ্যমে কখনো কখনো প্রকাশ করে থাকেন। যা ক্বিয়ামত পর্যন্ত জারি থাকবে। (২) মু‘জেযা নবীগণের মাধ্যমে সরাসরি আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়। পক্ষান্তরে জাদু কেবল দুষ্ট জিন ও মানুষের মাধ্যমেই হয়ে থাকে এবং তা হয় অদৃশ্য প্রাকৃতিক কারণের প্রভাবে। (৩) জাদু কেবল পৃথিবীতেই ক্রিয়াশীল হয়, আসমানে নয়। কিন্তু মু‘জেযা আল্লাহর হুকুমে আসমান ও যমীনে সর্বত্র ক্রিয়াশীল থাকে। যেমন শেষনবী (ছাঃ)-এর অঙ্গুলী সংকেতে আকাশের চন্দ্র দ্বিখন্ডিত হয়েছিল। (৪) মু‘জেযা মানুষের কল্যাণের জন্য হয়ে থাকে। কিন্তু জাদু স্রেফ ভেল্কিবাজি ও প্রতারণা মাত্র এবং যা মানুষের কেবল ক্ষতিই করে থাকে।

 

জাদুতে মানুষের সাময়িক বুদ্ধি বিভ্রম ঘটে। যা মানুষকে প্রতারিত করে। এজন্যে একে ইসলামে হারাম করা হয়েছে। মিসরীয় জাতি তথা ফেরাঊনের সম্প্রদায় ঐ সময় জাদু বিদ্যায় পারদর্শী ছিল এবং জ্যোতিষীদের প্রভাব ছিল তাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে অত্যধিক। সেকারণ তাদের চিরাচরিত ধারণা অনুযায়ী মূসা (আঃ)-এর মু‘জেযাকে তারা বড় ধরনের একটা জাদু ভেবেছিল মাত্র। তবে তারা তাঁকে সাধারণ জাদুকর নয়, বরং ‘বিজ্ঞ জাদুকর’ বলে স্বীকৃতি দিয়েছিল (আ‘রাফ, আয়াত ১০৯)। কারণ তাদের হিসাব অনুযায়ী মূসার জাদু ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির, যা তাদের আয়ত্তাধীন জাদু বিদ্যার বাইরের এবং যা ছিল অনুপম ও অনন্য বৈশিষ্ট্য মন্ডিত।

 

পরবর্তীকালে সুলায়মান (আঃ)-এর সময়ে ইরাকের বাবেল নগরী তৎকালীন পৃথিবীতে জাদু বিদ্যায় শীর্ষস্থান লাভ করে। তখন আল্লাহ সুলায়মান (আঃ)-কে জিন, ইনসান, বায়ু ও পশুপক্ষীর উপর ক্ষমতা দিয়ে পাঠান। এগুলিকে লোকেরা জাদু ভাবে এবং তার নবুঅতকে অস্বীকার করে। তখন আল্লাহ হারূত ও মারূত ফেরেশতাদ্বয়কে জাদু ও মু‘জেযার পার্থক্য বুঝানোর জন্য প্রেরণ করেন। যাতে লোকেরা জাদুকরদের তাবেদারী ছেড়ে নবীর তাবেদার হয়।

 

নবুঅত পরবর্তী ১ম পরীক্ষা : জাদুকরদের মুকাবিলা

 

মূসা (আঃ) ও ফেরাঊনের মাঝে জাদু প্রতিযোগিতার দিন ধার্য হবার পর মূসা (আঃ) পয়গম্বর সূলভ দয়া প্রকাশে নেতাদেরকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘দুর্ভোগ তোমাদের! তোমরা আল্লাহর প্রতি মিথ্যারোপ করো না। তাহ’লে তিনি তোমাদেরকে আযাব দ্বারা ধ্বংস করে দেবেন। যারাই মিথ্যারোপ করে, তারাই বিফল মনোরথ হয়’ (ত্বোয়াহা, আয়াত ৬১)। কিন্তু এতে কোন ফলোদয় হ’ল না। ফেরাঊন উঠে গিয়ে ‘তার সকল কলা-কৌশল জমা করল, অতঃপর উপস্থিত হ’ল’ (ত্বোয়াহা, আয়াত ৬০)। ‘অতঃপর তারা তাদের কাজে নিজেদের মধ্যে বিতর্ক করল এবং গোপনে পরামর্শ করল’। ‘তারা বলল, এই দু’জন লোক নিশ্চিতভাবেই জাদুকর। তারা তাদের জাদু দ্বারা আমাদেরকে আমাদের দেশ থেকে বহিষ্কার করতে চায় এবং আমাদের উৎকৃষ্ট জীবনধারা রহিত করতে চায়’। ‘অতএব (হে জাদুকরগণ!) তোমরা তোমাদের যাবতীয় কলা-কৌশল সংহত কর। অতঃপর সারিবদ্ধভাবে এসো। আজ যে জয়ী হবে, সেই-ই সফলকাম হবে’ (ত্বোয়াহা, আয়াত ৬৩-৬৪)।

 

জাদুকররা ফেরাঊনের নিকট সমবেত হয়ে বলল, জাদুকর ব্যক্তিটি কি দিয়ে কাজ করে? সবাই বলল, সাপ দিয়ে। তারা বলল, আল্লাহর কসম! পৃথিবীতে আমাদের উপরে এমন কেউ নেই, যে লাঠি ও রশিকে সাপ বানিয়ে কাজ করতে পারে (‘হাদীছুল কুতূন’ নাসাঈ, ইবনু জারীর, ইবনু কাছীর)। অতএব ‘আমাদের জন্য কি বিশেষ কোন পুরস্কার আছে, যদি আমরা বিজয়ী হই’? ‘সে বলল, হ্যাঁ। তখন অবশ্যই তোমরা আমার নিকটবর্তী লোকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে’ (আ‘রাফ, আয়াত ১১৩-১১৪)।

 

জাদুকররা উৎসাহিত হয়ে মূসাকে বলল, ‘হে মূসা! হয় তুমি (তোমার জাদুর লাঠি) নিক্ষেপ কর, না হয় আমরা প্রথমে নিক্ষেপ করি’ (ত্বোয়াহা, আয়াত ৬৫)। মূসা বললেন, ‘তোমরাই নিক্ষেপ কর। অতঃপর যখন তারা ‘তাদের রশি ও লাঠি নিক্ষেপ করল’ (শো‘আরা, আয়াত ৪৪), তখন লোকদের চোখগুলিকে ধাঁধিয়ে দিল এবং তাদের ভীত-সন্ত্রস্ত করে তুলল ও এক মহাজাদু প্রদর্শন করল’ (আ‘রাফ, আয়াত ১১৬)। ‘তাদের জাদুর প্রভাবে মূসার মনে হ’ল যেন তাদের রশিগুলো ও লাঠিগুলো (সাপের ন্যায়) ছুটাছুটি করছে’। ‘তাতে মূসার মনে কিছুটা ভীতির সঞ্চার হ’ল’ (ত্বোয়াহা, আয়াত ৬৬-৬৭)। এমতাবস্থায় আল্লাহ ‘অহি’ নাযিল করে মূসাকে অভয় দিয়ে বললেন, ‘তুমিই বিজয়ী হবে’ ‘তোমার ডান হাতে যা আছে, তা (অর্থাৎ লাঠি) নিক্ষেপ কর। এটা তাদের সবকিছুকে যা তারা করেছে, গ্রাস করে ফেলবে। তাদের ওসব তো জাদুর খেল মাত্র। বস্ত্ততঃ জাদুকর যেখানেই থাকুক সে সফল হবে না’ (ত্বোয়াহা, আয়াত ৬৮-৬৯)।

 

জাদুকররা তাদের রশি ও লাঠি সমূহ নিক্ষেপ করার সময় বলল, ‘ফেরাঊনের মর্যাদার শপথ! আমরা অবশ্যই বিজয়ী হব’ (শো‘আরা, আয়াত ৪৪)। তারপর মূসা (আঃ) আল্লাহর নামে লাঠি নিক্ষেপ করলেন। দেখা গেল তা বিরাট অজগর সাপের ন্যায় রূপ ধারণ করল এবং জাদুকরদের সমস্ত অলীক কীর্তিগুলোকে গ্রাস করতে লাগল’ (শো‘আরা, আয়াত ৪৫)।

 

এদৃশ্য দেখে যুগশ্রেষ্ঠ জাদুকরগণ বুঝে নিল যে, মূসার এ জাদু আসলে জাদু নয়। কেননা জাদুর সর্বোচ্চ বিদ্যা তাদের কাছেই রয়েছে। মূসা তাদের চেয়ে বড় জাদুকর হ’লে এতদিন তার নাম শোনা যেত। তার উস্তাদের খবর জানা যেত। তাছাড়া তার যৌবনকাল অবধি সে আমাদের কাছেই ছিল। কখনোই তাকে জাদু শিখতে বা জাদু খেলা দেখাতে বা জাদুর প্রতি কোনরূপ আকর্ষণও তার মধ্যে কখনো দেখা যায়নি। তার পরিবারেও কোন জাদুকর নেই। তার বড় ভাই হারূণ তো সর্বদা আমাদের মাঝেই দিনাতিপাত করেছে। কখনোই তাকে এসব করতে দেখা যায়নি বা তার মুখে এখনকার মত বক্তব্য শোনা যায়নি। হঠাৎ করে কেউ বিশ্বসেরা জাদুকর হয়ে যেতে পারে না। নিশ্চয়ই এর মধ্যে অলৌকিক কোন সত্তার নিদর্শন রয়েছে, যা আয়ত্ত করা মানুষের ক্ষমতার বাইরে। এ সময় মূসার দেওয়া তাওহীদের দাওয়াত ও আল্লাহর গযবের ভীতি তাদের অন্তরে প্রভাব বিস্তার করল। আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর সত্য প্রতিষ্ঠিত হ’ল এবং বাতিল হয়ে গেল তাদের সমস্ত জাদুকর্ম’। ‘এভাবে তারা সেখানেই পরাজিত হ’ল এবং লজ্জিত হয়ে ফিরে গেল’ (আ‘রাফ, আয়াত ১১৮-১১৯)। অতঃপর ‘তারা সিজদায় পড়ে গেল’। এবং ‘বলে উঠল, আমরা বিশ্বচরাচরের পালনকর্তার উপরে বিশ্বাস স্থাপন করলাম, যিনি মূসা ও হারূণের রব’ (শো‘আরা, আয়াত ৪৬-৪৮; ত্বোয়াহা, আয়াত ৭০; আ‘রাফ, আয়াত ১২০-১২১)।

 

পরাজয়ের এ দৃশ্য দেখে ভীত-বিহবল ফেরাঊন নিজেকে সামলে নিয়ে উপস্থিত লাখো জনতার মনোবল চাঙ্গা রাখার জন্য জাদুকরদের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো, ‘আমার অনুমতি দানের পূর্বেই তোমরা তাকে মেনে নিলে? নিশ্চয়ই সে (অর্থাৎ মূসা) তোমাদের প্রধান, যে তোমাদেরকে জাদু শিক্ষা দিয়েছে’ (ত্বোয়াহা, আয়াত ৭১; আ‘রাফ, আয়াত ১২৩; শো‘আরা, আয়াত ৪৯)। অতঃপর সম্রাট সূলভ হুমকি দিয়ে বলল,‘শীঘ্রই তোমরা তোমাদের পরিণাম ফল জানতে পারবে। আমি অবশ্যই তোমাদের হাত ও পা বিপরীত দিক থেকে কেটে ফেলব এবং তোমাদের সবাইকে শূলে চড়াব’ (শো‘আরা, আয়াত ৪৯)। জবাবে জাদুকররা বলল, ‘কোন ক্ষতি নেই। আমরা আমাদের পালনকর্তার কাছে প্রত্যাবর্তন করব’। ‘আশা করি আমাদের পালনকর্তা আমাদের ত্রুটি-বিচ্যুতি সমূহ ক্ষমা করবেন’ (শো‘আরা, আয়াত ৪৯-৫১; ত্বোয়াহা, আয়াত ৭১-৭৩; আ‘রাফ, আয়াত ১২৪-১২৬)।

 

ফেরাঊনের ছয়টি কুটচাল

 

জাদুকরদের পরাজয়ের পর ফেরাঊন তার রাজনৈতিক কুটচালের মাধ্যমে জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে ফিরিয়ে দিতে চাইল। তার চালগুলি ছিল, (১) সে বলল: এই জাদুকররা সবাই মূসার শিষ্য। তারা চক্রান্ত করেই তার কাছে নতি স্বীকার করেছে। এটা একটা পাতানো খেলা মাত্র। আসলে ‘মূসাই হ’ল বড় জাদুকর’ (ত্বোয়াহা, আয়াত ৭১)। (২) সে বলল, মূসা তার জাদুর মাধ্যমে ‘নগরীর অধিবাসীদেরকে সেখান থেকে বের করে দিতে চায়’ (আ‘রাফ, আয়াত ১১০) এবং মূসা ও তার সম্প্রদায় এদেশে আধিপত্য বিস্তার করতে চায়। (৩) সে বলল মূসা যেসব কথা বলছে ‘আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের মধ্যে সেসব কথা কখনো শুনিনি’। (৪) সে বলল, হে জনগণ! এ লোকটি তোমাদের ধর্ম পরিবর্তন করে দেবে ও দেশময় বিপর্যয় সৃষ্টি করবে’। (৫) সে বলল, মূসা তোমাদের উৎকৃষ্ট (রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক) জীবন ব্যবস্থা রহিত করতে চায়’ (ত্বোয়াহা, আয়াত ৬৩)। (৬) সে মিসরীয় জনগণকে বিভিন্ন দলে বিভক্ত করে দিয়েছিল এবং একটির দ্বারা অপরটিকে দুর্বল করার মাধ্যমে নিজের শাসন ও শোষণ অব্যাহত রেখেছিল। আজকের বহুদলীয় গণতন্ত্র বা দলতন্ত্র ফেলে আসা ফেরাঊনী তন্ত্রের আধুনিক রূপ বলেই মনে হয়। নিজেই সবকিছু করলেও লোকদের খুশী করার জন্য ফেরাঊন বলল, ‘অতএব হে জনগণ! তোমরা এখন কি বলতে চাও’? (শো‘আরা, ৩৫; আ‘রাফ, ১১০)। এযুগের নেতারা যেমন নিজেদের সকল অপকর্ম জনগণের দোহাই দিয়ে করে থাকেন।

 

জাদুকরদের সত্য গ্রহণ

 

ধূর্ত ও কুটবুদ্ধি ফেরাঊন বুঝলো যে, তার ঔষধ কাজে লেগেছে। এখুনি মোক্ষম সময়। সে সাথে সাথে জাদুকরদের হাত-পা বিপরীতভাবে কেটে অতঃপর খেজুর গাছের সাথে শূলে চড়িয়ে হত্যা করার আদেশ দিল। সে ভেবেছিল, এতে জাদুকররা ভীত হয়ে তার কাছে প্রাণভিক্ষা চাইবে। কিন্তু ফল উল্টা হ’ল। তারা একবাক্যে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলে দিল,

 

 ‘আমরা তোমাকে ঐসব সুস্পষ্ট নিদর্শন (ও মু‘জেযার) উপরে প্রাধান্য দিতে পারি না, যেগুলো (মূসার মাধ্যমে) আমাদের কাছে পৌঁছেছে এবং প্রধান্য দিতে পারি না তোমাকে সেই সত্তার উপরে যিনি আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন। অতএব তুমি যা ইচ্ছা তাই করতে পার। তুমি তো কেবল এই পার্থিব জীবনেই যা করার করবে’। ‘আমরা আমাদের পালনকর্তার উপরে বিশ্বাস স্থাপন করেছি, যাতে তিনি আমাদের পাপসমূহ এবং তুমি আমাদেরকে যে জাদু করতে বাধ্য করেছ, (তার পাপসমূহ) তা মার্জনা করেন। আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ ও চিরস্থায়ী’ (ত্বোয়াহা, আয়াত ৭২-৭৩)।

 

তারা আরও বলল, ‘আমরা (তো মৃত্যুর পরে) আমাদের পরওয়ারদিগারের নিকটে ফিরে যাব’। ‘বস্ত্ততঃ আমাদের সাথে তোমার শত্রুতা তো কেবল একারণেই যে, আমরা ঈমান এনেছি আমাদের পালনকর্তার নিদর্শন সমূহের প্রতি, যখন তা আমাদের নিকটে পৌঁছেছে। অতএব ‘হে আমাদের প্রভু! আমাদের জন্য ধৈর্যের দুয়ার খুলে দাও এবং আমাদেরকে ‘মুসলিম’ হিসাবে মৃত্যু দান কর’ (আ‘রাফ, আয়াত ১২৫-১২৬)। এটা ধারণা করা অযৌক্তিক হবে না যে, ইতিপূর্বে ফেরাঊনের দরবারে মূসার লাঠির মু‘জেযা প্রদর্শনের ঘটনা থেকেই জাদুকরদের মনে প্রতীতি জন্মেছিল যে, এটা কোন জাদু নয়, এটা মু‘জেযা। কিন্তু ফেরাঊন ও তার পারিষদবর্গের ভয়ে তারা মুখ খুলেনি। অবশেষে তাদেরকে সমবেত করার পর তাদেরকে সম্রাটের নৈকট্যশীল করার ও বিরাট পুরস্কারের লোভ দেখানো হয়। এগুলো নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক ও আর্থিক প্রলোভনের চাপ ভিন্ন কিছুই ছিল না।

 

জাদুকরদের মুসলমান হয়ে যাবার অন্যতম কারণ ছিল মুকাবিলার পূর্বে ফেরাঊন ও তার জাদুকরদের উদ্দেশ্যে মূসার প্রদত্ত উপদেশমূলক ভাষণ। যেখানে তিনি বলেছিলেন, ‘দুর্ভোগ তোমাদের! তোমরা আল্লাহর প্রতি মিথ্যারোপ করো না। তাহ’লে তিনি তোমাদেরকে আযাব দ্বারা ধ্বংস করে দেবেন। বস্ত্ততঃ তারাই বিফল মনোরথ হয়, যারা মিথ্যারোপ করে’ (ত্বোয়াহা, আয়াত ৬১)।

 

মূসার মুখে একথা শুনে ফেরাঊন ও তার সভাসদরা অহংকারে স্ফীত হ’লেও জাদুকর ও সাধারণ জনগণের মধ্যে দারুণ প্রতিক্রিয়া হয়। ফলে জাদুকরদের মধ্যে গ্রুপিং হয়ে যায় এবং তারা আপোষে বিতর্কে লিপ্ত হয়। যদিও গোপন আলোচনার ভিত্তিতে সম্ভবতঃ রাজকীয় সম্মান ও বিরাট অংকের পুরস্কারের লোভে পরিশেষে তারা একমত হয়।

 

জনগণের প্রতিক্রিয়া

 

আল্লাহ বলেন, ‘ফেরাঊন ও তার পারিষদবর্গের নির্যাতনের ভয়ে তার সম্প্রদায়ের কিছু লোক ব্যতীত কেউ তার প্রতি ঈমান আনেনি। আর ফেরাঊন তার দেশে ছিল পরাক্রান্ত এবং সে ছিল সীমালংঘনকারীদের অন্তর্ভুক্ত’ (ইউনুস, আয়াত ৮৩)। এতে বুঝা যায় যে, ক্বিবতীদের মধ্যে গোপনে ঈমান আনয়নকারীর সংখ্যা বেশী থাকলেও প্রকাশ্যে ঈমান আনয়নকারীর সংখ্যা নিতান্তই কম ছিল।

 

উল্লেখ্য যে, অত্র আয়াতে ‘তার কওমের কিছু লোক ব্যতীত’ বলতে ইবনু আববাস (রাঃ) ‘ফেরাঊনের কওমের কিছু লোক’ বলেছেন। কিন্তু ইবনু জারীর ও অনেক বিদ্বান মূসার নিজ কওম ‘বনু ইস্রাঈলের কিছু লোক’ বলেছেন। এর জবাবে হাফেয ইবনু কাছীর বলেন, এটা প্রসিদ্ধ কথা যে, বনু ইস্রাঈলের সকলেই মূসাকে নবী হিসাবে বিশ্বাস করত একমাত্র ক্বারূণ ব্যতীত। কেননা সে ছিল বিদ্রোহী এবং ফেরাঊনের সাথী। আর মূসার কারণেই বনু ইস্রাঈলগণ মূসার জন্মের আগে ও পরে সমানভাবে নির্যাতিত ছিল (আ‘রাফ, ১২৯)। অতএব অত্র আয়াতে যে মুষ্টিমেয় লোকের ঈমান আনার কথা বলা হয়েছে, তারা নিশ্চিতভাবেই ছিলেন ক্বিবতী সম্প্রদায়ের। আর তারা ছিলেন, ফেরাঊনের স্ত্রী আসিয়া, ফেরাঊনের চাচাতো ভাই জনৈক মুমিন ব্যক্তি যিনি তার ঈমান গোপন রেখেছিলেন এবং ফেরাঊনের খাজাঞ্চি ও তার স্ত্রী। যেকথা ইবনু আববাস (রাঃ) বলেছেন।

 

ফেরাঊনের স্ত্রীর প্রতিক্রিয়া

 

জাদুকরদের সঙ্গে মুকাবিলা তথা সত্য ও মিথ্যার এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার সময় ফেরাঊনের নেককার স্ত্রী ও মূসার পালক মাতা ‘আসিয়া’ উক্ত মুকাবিলার শুভ ফলাফলের জন্য সদা উদগ্রীব ছিলেন। যখন তাঁকে মূসা ও হারূণের বিজয়ের সংবাদ শোনানো হ’ল, তখন তিনি কালবিলম্ব না করে বলে ওঠেন, ‘আমি মূসা ও হারূণের পালনকর্তার উপরে ঈমান আনলাম’। নিজ স্ত্রীর ঈমানের এ খবর শুনে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে ফেরাঊন তাকে মর্মান্তিকভাবে নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করে। মৃত্যুর পূর্বে বিবি আসিয়া কাতর কণ্ঠে স্বীয় প্রভুর নিকটে প্রার্থনা করেন। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ ঈমানদারগণের জন্য দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেন ফেরাঊনের স্ত্রীর, যখন সে বলেছিল, ‘হে আমার পালনকর্তা! তোমার নিকটে জান্নাতে আমার জন্য একটি গৃহ নির্মাণ কর! আমাকে ফেরাঊন ও তার পারিষদবর্গের হাত থেকে উদ্ধার কর এবং আমাকে যালেম সম্প্রদায়ের কবল থেকে মুক্তি দাও’ (তাহরীম, আয়াত ১১)।

 

নবুঅত-পরবর্তী ২য় পরীক্ষা : বনু ইস্রাঈলদের উপরে আপতিত ফেরাঊনী যুলুম সমূহ

 

জাদুর পরীক্ষায় পরাজিত ফেরাঊনের যাবতীয় আক্রোশ গিয়ে পড়ল এবার নিরীহ বনু ইস্রাঈলগণের উপর। জাদুকরদের ঈমান আনয়ন, অতঃপর তাদের মৃত্যুদন্ড প্রদান, বিবি আসিয়ার ঈমান আনয়ন ও তাঁকে মৃত্যুদন্ড প্রদান ইত্যাদি নিষ্ঠুর দমন নীতির মাধ্যমে এবং অত্যন্ত নোংরা কুটচাল ও মিথ্যা অপবাদ সমূহের মাধ্যমে মূসার ঈমানী আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দেওয়ার চক্রান্ত করেছিল ফেরাঊন। কিন্তু এর ফলে জনগণের মধ্যে মূসার দাওয়াত দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল। তাতে ফেরাঊন ও তার অহংকারী পারিষদবর্গ নতুনভাবে দমন নীতির কৌশলপত্র প্রণয়ন করল। তারা নিজেরা বিধর্মী হ’লেও সাধারণ জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য ধর্মকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করল। অন্যদিকে ‘বিভক্ত কর ও শাসন কর’-এই কুটনীতির অনুসরণে ফেরাঊনের ক্বিবতী সম্প্রদায়কে বাদ দিয়ে কেবল বনু ইস্রাঈলদের উপরে চূড়ান্ত যুলুম ও নির্যাতনের পরিকল্পনা করল।

 

১ম যুলুমঃ বনু ইস্রাঈলের নবজাতক পুত্রসন্তানদের হত্যার নির্দেশ জারি

 

ফেরাঊনী সম্প্রদায়ের নেতারা ইতিপূর্বে ফেরাঊনকে বলেছিল, ‘আপনি কি মূসা ও তার সম্প্রদায়কে এমনি ছেড়ে দিবেন দেশময় ফাসাদ সৃষ্টি করার জন্য এবং আপনাকে ও আপনার উপাস্যদেরকে বাতিল করে দেবার জন্য? (আ‘রাফ, ১২৭)। নেতারা মূসা ও হারূণের ঈমানী দাওয়াতকে ‘ফাসাদ’ বলে অভিহিত করেছিল। এক্ষণে দেশময় মূসার দাওয়াতের ব্যাপক প্রসার বন্ধ করার জন্য এবং ফেরাঊনের নিজ সম্প্রদায়ের সাধারণ লোকদের ব্যাপকহারে মূসার দ্বীনের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার স্রোত বন্ধ করার জন্য নিজেদের লোকদের কিছু না বলে নিরীহ বনু ইস্রাঈলদের উপরে অত্যাচার শুরু করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে ফেরাঊন বলল, ‘আমি এখুনি টুকরা টুকরা করে হত্যা করব ওদের পুত্র সন্তানদেরকে এবং বাঁচিয়ে রাখব ওদের কন্যা সন্তানদেরকে। আর আমরা তো ওদের উপরে (সবদিক দিয়েই) প্রবল’ (আ‘রাফ, আয়াত ১২৭)। এভাবে মূসার জন্মকালে বনী ইস্রাঈলের সকল নবজাতক পুত্র হত্যা করার সেই ফেলে আসা লোমহর্ষক নির্যাতনের পুনরাবৃত্তির ঘোষণা প্রদান করা হ’ল।

 

দল ঠিক রাখার জন্য এবং সম্প্রদায়ের নেতাদের রোষাগ্নি প্রশমনের জন্য ফেরাঊন অনুরূপ ঘোষণা দিলেও মূসা ও হারূণ সম্পর্কে তার মুখ দিয়ে কোন কথা বের হয়নি। যদিও ইতিপূর্বে সে মূসাকে কারারুদ্ধ করার এমনকি হত্যা করার হুমকি দিয়েছিল (শো‘আরা,২৯; মুমিন ৪০)। কিন্তু জাদুকরদের পরাজয়ের পর এবং নিজে মূসার সর্পরূপী লাঠির মু‘জেযা দেখে ভীত বিহবল হয়ে পড়ার পর থেকে মূসার দিকে তাকানোর মত সাহসও তার ছিল না।

 

যাই হোক ফেরাঊনের উক্ত নিষ্ঠুর ঘোষণা জারি হওয়ার পর বনু ইস্রাঈলগণ মূসার নিকটে এসে অনুযোগের সুরে বলল, ‘তোমার আগমনের পূর্বেও আমাদেরকে নির্যাতন করা হয়েছে। আবার এখন তোমার আগমনের পরেও তাই করা হচ্ছে’ (আ‘রাফ, আয়াত ১২৯)। অর্থাৎ তোমার আগমনের পূর্বে তো এ আশায় আমাদের দিন কাটত যে, সত্বর আমাদের উদ্ধারের জন্য একজন নবীর আগমন ঘটবে। অথচ এখন তোমার আগমনের পরেও সেই একই নির্যাতনের পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। তাহ’লে এখন আমাদের উপায় কি? আসন্ন বিপদের আশংকায় ভীত-সন্ত্রস্ত কওমের লোকদের সান্ত্বনা দিয়ে মূসা (আঃ) বললেন, ‘তোমাদের পালনকর্তা শীঘ্রই তোমাদের শত্রুদের ধ্বংস করে দেবেন এবং তোমাদেরকে দেশে প্রতিনিধিত্ব দান করবেন। তারপর দেখবেন, তোমরা কেমন কাজ কর’ (আ‘রাফ, আয়ত ১২৯)। তিনি বললেন,‘তোমরা সাহায্য প্রার্থনা কর আল্লাহর নিকটে এবং ধৈর্য ধারণ কর। নিশ্চয়ই এ পৃথিবী আল্লাহর। তিনি স্বীয় বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা এর উত্তরাধিকারী বানিয়ে দেন। বস্ত্ততঃ চূড়ান্ত পরিণাম ফল আল্লাহভীরুদের জন্যই নির্ধারিত’ (আ‘রাফ, আয়াত ১২৮)।

 

মূসা (আঃ) তাদেরকে আরও বলেন, ‘হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা যদি আল্লাহর উপরে ঈমান এনে থাক, তবে তাঁরই উপরে ভরসা কর যদি তোমরা আনুগত্যশীল হয়ে থাক’। জবাবে তারা বলল, আমরা আল্লাহর উপরে ভরসা করছি। হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদের উপরে এ যালেম কওমের শক্তি পরীক্ষা করো না’। ‘আর আমাদেরকে অনুগ্রহ করে কাফের সম্প্রদায়ের কবল থেকে মুক্তি দাও’ (ইউনুস, আয়াত ৮৪-৮৬)।

 

উপরোক্ত আয়াত সমূহে বুঝা যায় যে, পয়গম্বর সূলভ দরদ ও দূরদর্শিতার আলোকে মূসা (আঃ) স্বীয় ভীত-সন্ত্রস্ত কওমকে মূলতঃ দু’টি বিষয়ে উপদেশ দেন। এক- শত্রুর মোকাবেলায় আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করা এবং দুই- আল্লাহর সাহায্য না আসা পর্যন্ত সাহসের সাথে ধৈর্য ধারণ করা। সাথে সাথে একথাও স্মরণ করিয়ে দেন যে, সমগ্র পৃথিবীর মালিকানা আল্লাহর। তিনি যাকে খুশী এর উত্তরাধিকারী নিয়োগ করেন এবং নিঃসন্দেহে শেষফল মুত্তাক্বীদের জন্যই নির্ধারিত।

 

ফেরাঊনের বিরুদ্ধে মূসার বদ দো

 

‘মূসা বলল, হে আমাদের পালনকর্তা! তুমি ফেরাঊনকে ও তার সর্দারদেরকে পার্থিব আড়ম্বর সমূহ ও সম্পদরাজি দান করেছ, যা দিয়ে তারা লোকদেরকে তোমার রাস্তা থেকে বিপথগামী করে। অতএব হে আমাদের প্রভু! তুমি তাদের সম্পদরাজি ধ্বংস করে দাও ও তাদের অন্তরগুলিকে শক্ত করে দাও, যাতে তারা অতক্ষণ পর্যন্ত ঈমান না আনে, যতক্ষণ না তারা মর্মান্তিক আযাব প্রত্যক্ষ করে’। জবাবে আল্লাহ বললেন, তোমাদের দো‘আ কবুল হয়েছে। অতএব তোমরা দু’জন অটল থাক এবং অবশ্যই তোমরা তাদের পথে চলো না, যারা জানে না’ (ইউনুস, আয়াত ৮৮-৮৯)।

 

মূসা ও হারূণের উপরোক্ত দো‘আ আল্লাহ কবুল করলেন। কিন্তু তার বাস্তবায়ন সঙ্গে সঙ্গে করলেন না। বরং সময় নিলেন অন্যূন বিশ বছর। এরূপ প্রলম্বিত কর্মপদ্ধতির মাধ্যমে আল্লাহ মাযলূমের ধৈর্য পরীক্ষার সাথে সাথে যালেমেরও পরীক্ষা নিয়ে থাকেন এবং তাদের তওবা করার ও হেদায়াত প্রাপ্তির সুযোগ দেন। যাতে পরে তাদের জন্য ওযর পেশ করার কোন সুযোগ না থাকে। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ ইচ্ছা করলে তাদের কাছ থেকে প্রতিশোধ নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তোমাদের কতককে কতকের দ্বারা পরীক্ষা করতে চান’ (মুহাম্মাদ, আয়াত ৪৭)।

 

প্রশ্ন হ’তে পারে, এত যুলুম সত্ত্বেও আল্লাহ তাদের হিজরত করার নির্দেশ না দিয়ে সেখানেই পুনরায় ঘর বানিয়ে বসবাসের নির্দেশ দিলেন কেন? এর জবাব দু’ভাবে দেওয়া যেতে পারে।

 

এক- ফেরাঊন তাদেরকে হিজরতে বাধা দিত। কারণ বনু ইস্রাঈলগণকে তারা তাদের জাতীয় উন্নয়নের সহযোগী হিসাবে এবং কর্মচারী ও সেবাদাস হিসাবে ব্যবহার করত। তাছাড়া পালিয়ে আসারও কোন পথ ছিল না। কেননা নীলনদ ছিল বড় বাধা। নদী পার হওয়ার চেষ্টা করলে ফেরাঊনী সেনারা তাদের পশ্চাদ্ধাবন করত।

 

দুই- ফেরাঊনী সম্প্রদায়ের মধ্যে মূসা ও হারূণের দাওয়াত সম্প্রসারণ করা। মূলতঃ এটিই ছিল আল্লাহর মূল উদ্দেশ্য। কেননা যতদিন তারা মিসরে ছিলেন, সেখানকার অধিবাসীদের নিকটে দ্বীনের দাওয়াত পেশ করেছেন এবং তার ফলে বহু আল্লাহর বান্দা পথের সন্ধান পেয়ে ধন্য হয়েছেন। ফেরাঊন দেখেছিল তার দুনিয়াবী লাভ ও শান-শওকত। কিন্তু আল্লাহ চেয়েছিলেন তাওহীদের প্রচার ও প্রসার ও মানুষের হেদায়াত। সেটিই হয়েছে। ফেরাঊনেরা এখন মিসরের পিরামিডের দর্শনীয় বস্ত্ততে পরিণত হয়েছে। অথচ মিসর সহ বলা চলে পুরা আফ্রিকায় এখন ইসলামের জয়-জয়কার অব্যাহত রয়েছে।

 

ফেরাঊনী সম্প্রদায়ের উপরে আপতিত গযব সমূহ এবং মূসা (আঃ)-এর মুজেযা সমূহ

 

ঐতিহাসিক বর্ণনা অনুযায়ী ফেরাঊনের জাদুকরদের সাথে শক্তি পরীক্ষার ঘটনার পর মূসা (আঃ) অন্যূন বিশ বছর যাবত মিসরে অবস্থান করে সেখানকার অধিবাসীদেরকে আল্লাহর বাণী শোনান এবং সত্য ও সরল পথের দিকে দাওয়াত দিতে থাকেন। এ সময়কালের মধ্যে আল্লাহ মূসা (আঃ)-কে প্রধান ৯টি মু‘জেযা দান করেন। তবে প্লেগ মহামারী সহ (আ‘রাফ, আয়াত ১৩৪)। মোট নিদর্শনের সংখ্যা দাঁড়ায় ১০টি। যার মধ্যে প্রথম দু’টি শ্রেষ্ঠ মু‘জেযা ছিল অলৌকিক লাঠি ও আলোকময় হস্ততালু। যার পরীক্ষা শুরুতেই ফেরাঊনের দরবারে এবং পরে জাদুকরদের সম্মুখে হয়ে গিয়েছিল। এরপর বাকীগুলি এসেছিল ফেরাঊনী কওমের হেদায়াতের উদ্দেশ্যে তাদেরকে সাবধান করার জন্য। মূলতঃ দুনিয়াতে প্রেরিত সকল এলাহী গযবের মূল উদ্দেশ্য থাকে মানুষের হেদায়াত। যেমন আল্লাহ বলেন,‘কাফির ও ফাসিকদেরকে (জাহান্নামের) কঠিন শাস্তির পূর্বে (দুনিয়াতে) আমরা অবশ্যই লঘু শাস্তি আস্বাদন করাব, যাতে তারা (আমার দিকে) ফিরে আসে’ (সাজদাহ, আয়াত ৩২)।

 

মযলূম বনু ইস্রাঈলদের কাতর প্রার্থনা এবং মূসা ও হারূণের দো‘আ আল্লাহ কবুল করেছিলেন। সেমতে সর্বপ্রথম অহংকারী ফেরাঊনী কওমের দুনিয়াবী জৌলুস ও সম্পদরাজি ধ্বংসের গযব নেমে আসে। তারপর আসে অন্যান্য গযব বা নিদর্শন সমূহ। আমরা সেগুলি একে একে বর্ণনা করার প্রয়াস পাব। যাতে এযুগের মানুষ তা থেকে উপদেশ হাছিল করে।

 

মোট নিদর্শন সমূহ, যা মিসরে প্রদর্শিত হয়-

 

(১) লাঠি (২) প্রদীপ্ত হস্ততালু (৩) দুর্ভিক্ষ (৪) তূফান (৫) পঙ্গপাল (৬) উকুন (৭) ব্যাঙ (৮) রক্ত (৯) প্লেগ (১০) সাগরডুবি। প্রথম দু’টি এবং মূসার ব্যক্তিগত তোতলামি দূর হওয়াটা বাদ দিয়ে বাকী ৮টি নিদর্শন নিম্নে বর্ণিত হ’ল-

 

 তূফান

 

দুর্ভিক্ষের পরে মূসা (আঃ)-এর দো‘আর বরকতে পুনরায় ভরা মাঠ ও ভরা ফসল পেয়ে ফেরাঊনী সম্প্রদায় পিছনের সব কথা ভুলে যায় ও গর্বে স্ফীত হয়ে মূসা (আঃ)-এর বিরুদ্ধে অপবাদ রটাতে থাকে। তারা সাধারণ লোকদের ঈমান গ্রহণে বাধা দিতে থাকে। তারা তাদের প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে পুনরায় ঔদ্ধত্য প্রকাশ করতে থাকে। ফলে তাদের উপরে গযব আকারে প্লাবন ও জলোচ্ছ্বাস নেমে আসে। যা তাদের মাঠ-ঘাট, বাগান-ফসল, ঘর-বাড়ি সব ভাসিয়ে নিয়ে যায়। এতে ভীত হয়ে তারা আবার মূসা (আঃ)-এর কাছে এসে কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। আবার তারা ঈমান আনার প্রতিজ্ঞা করে ও আল্লাহর নিকটে দো‘আ করার জন্য মূসা (আঃ)-কে পীড়াপীড়ি করতে থাকে। ফলে মূসা (আঃ) দো‘আ করেন ও আল্লাহর রহমতে তূফান চলে যায়। পুনরায় তারা জমি-জমা আবাদ করে ও অচিরেই তা সবুজ-শ্যামল হয়ে ওঠে। এ দৃশ্য দেখে তারা আবার অহংকারী হয়ে ওঠে এবং বলতে থাকে, আসলে আমাদের জমির উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি করার জন্যেই প্লাবন এসেছিল, আর সেকারণেই আমাদের ফসল এবার সর্বকালের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে ও বাম্পার ফলন হয়েছে। আসলে আমাদের কর্ম দক্ষতার ফল হিসাবে এটাই উপযুক্ত। এভাবে তারা অহংকারে মত্ত হয়ে আবার শুরু করল বনী ইস্রাঈলদের উপরে যুলুম-অত্যাচার। ফলে নেমে এল তৃতীয় গযব।

 

 পঙ্গপাল

 

একদিন হঠাৎ হাযার হাযার পঙ্গপাল কোত্থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে এসে ফেরাঊনীদের সব ফসল খেয়ে ছাফ করে গেল। তারা তাদের বাগ-বাগিচার ফল-ফলাদি খেয়ে সাবাড় করে ফেলল। এমনকি কাঠের দরজা-জানালা, আসবাব-পত্র পর্যন্ত খেয়ে শেষ করল। অথচ পাশাপাশি বনু ইস্রাঈলদের ঘরবাড়ি, শস্যভূমি ও বাগ-বাগিচা সবই সুরক্ষিত থাকে।

 

এবারও ফেরাঊনী সম্প্রদায় ছুটে এসে মূসা (আঃ)-এর কাছে কাতর কণ্ঠে নিবেদন করতে থাকে, যাতে গযব চলে যায়। তারা এবার পাকা ওয়াদা করল যে, তারা ঈমান আনবে ও বনু ইস্রাঈলদের মুক্তি দেবে। মূসা (আঃ) দো‘আ করলেন ও আযাব চলে গেল। পরে ফেরাঊনীরা দেখল যে, পঙ্গপালে খেয়ে গেলেও এখনও যা অবশিষ্ট আছে, তা দিয়ে বেশ কিছুদিন চলে যাবে। ফলে তারা আবার শয়তানী ধোঁকায় পড়ে প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করল ও পূর্বের ন্যায় ঔদ্ধত্য প্রদর্শন শুরু করল। ফলে নেমে এল পরবর্তী গযব ‘উকুন’।

 

 উকুন

 

‘উকুন’ সাধারণতঃ মানুষের মাথার চুলে জন্মে থাকে। তবে এখানে ব্যাপক অর্থে ঘুণ পোকা ও কেড়ি পোকাকেও গণ্য করা হয়েছে। যা ফেরাঊনীদের সকল প্রকার কাঠের খুঁটি, দরজা-জানালা, খাট-পালংক ও আসবাব-পত্রে এবং খাদ্য-শস্যে লেগেছিল। তাছাড়া দেহের সর্বত্র সর্বদা উকুনের কামড়ে তারা অতিষ্ঠ হয়ে উঠলো। এভাবে উকুন ও ঘুণপোকার অত্যাচারে দিশেহারা হয়ে এক সময় তারা কাঁদতে কাঁদতে মূসা (আঃ)-এর দরবারে এসে লুটিয়ে পড়ে ক্ষমা চাইতে লাগলো এবং প্রতিজ্ঞার পরে প্রতিজ্ঞা করে বলতে লাগলো যে, এবারে আযাব ফিরে গেলে তারা অবশ্যই ঈমান আনবে, তাতে বিন্দুমাত্র অন্যথা হবে না। মূসা (আঃ) তাদের জন্য দো‘আ করলেন এবং আযাব চলে গেল। কিন্তু তারা কিছু দিনের মধ্যেই প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করল এবং পূর্বের ন্যায় অবাধ্য আচরণ শুরু করল। আল্লাহর পক্ষ থেকে বারবার অবকাশ দেওয়াকে তারা তাদের ভালত্বের পক্ষে দলীল হিসাবে মনে করতে লাগল এবং হেদায়াত দূরে থাক, তাদের অহংকার ক্রমে বাড়তে লাগল। মূলতঃ এগুলো ছিল তাদের নেতৃস্থানীয় লোকদের অবস্থা। নইলে সাধারণ মানুষ মূসা ও হারূণের দাওয়াত অন্তরে কবুল করে যাচ্ছিল এবং তাদের সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছিল। আর এতেই ছিল মূসা (আঃ)-এর সান্ত্বনা। আল্লাহ বলেন, ‘যখন আমরা কোন জনপদকে ধ্বংস করার ইচ্ছা করি, তখন সেখানকার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদেরকে উদ্বুদ্ধ করি। অতঃপর তারা পাপাচারে লিপ্ত হয়। ফলে উক্ত জনগোষ্ঠীর উপরে আদেশ অবধারিত হয়ে যায়। অতঃপর আমরা উক্ত জনপদকে সমূলে বিধ্বস্ত করি’ (ইসরা, আয়াত ১৬)। ফেরাঊনীদের উপরে সেই অবস্থা এসে গিয়েছিল। তাদের নেতারা স্বাভাবিক বুদ্ধি-বিবেচনা হারিয়ে ফেলেছিল। তারা তাদের লোকদের বুঝাতে লাগলো যে, এসবই মূসার জাদুর খেল। আসলে আল্লাহ বলে কিছুই নেই। ফলে নেমে এল এবার ‘ব্যাঙ’-এর গযব।

 

ব্যাঙ

 

বারবার বিদ্রোহ করা সত্ত্বেও দয়ালু আল্লাহ তাদের সাবধান করার জন্য ও আল্লাহর পথে ফিরিয়ে আনার জন্য পুনরায় গযব পাঠালেন। এবার এল ব্যাঙ। ব্যাঙে ব্যাঙে ভরে গেল তাদের ঘর-বাড়ি, হাড়ি-পাতিল, জামা-কাপড়, বিছানা-পত্তর সবকিছু। বসতে ব্যাঙ, খেতে ব্যাঙ, চলতে ব্যাঙ, গায়ে-মাথায় সর্বত্র ব্যাঙের লাফালাফি। কোন জায়গায় বসা মাত্র শত শত ব্যাঙের নীচে তলিয়ে যেতে হ’ত। এই নরম জীবটির সরস অত্যাচারে পাগলপরা হয়ে উঠল পুরা ফেরাঊনী জনপদ। অবশেষে কান্নাকাটি করে ও কাকুতি-মিনতি করে তারা এসে ক্ষমা প্রার্থনা করতে লাগলো মূসা (আঃ)-এর কাছে। এবার পাকাপাকি ওয়াদা করল যে, আযাব চলে যাবার সাথে সাথে তারা ঈমান আনবেই। কিন্তু না, যথা পূর্বং তথা পরং। ফলে পুনরায় গযব অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠল। এবারে এল ‘রক্ত’।

 

রক্ত

 

তাদের অহংকার ও ঔদ্ধত্য চরমে উঠলে হঠাৎ একদিন দেখা গেল ‘রক্ত’। খাদ্য ও পানপাত্রে রক্ত, কূয়া ও পুকুরে রক্ত, তরি-তরকারিতে রক্ত, কলসি-বালতিতে রক্ত। একই সাথে খেতে বসে বনু ইস্রাঈলের থালা-বাটি স্বাভাবিক। কিন্তু ফেরাঊনী ক্বিবতীর থালা-বাটি রক্তে ভরা। পানি মুখে নেওয়া মাত্র গ্লাসভর্তি রক্ত। অহংকারী নেতারা বাধ্য হয়ে বনু ইস্রাঈলী মযলূমদের বাড়ীতে এসে খাদ্য ও পানি ভিক্ষা চাইত। কিন্তু যেমনি তাদের হাতে তা পৌঁছত, অমনি সেগুলো রক্তে পরিবর্তিত হয়ে যেত। ফলে তাদের খাওয়া-দাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। না খেয়ে তাদের মধ্যে হাহাকার পড়ে গেল। অবশেষে পূর্বের ন্যায় আবার এসে কান্নাকাটি। মূসা (আঃ) দয়া পরবশে আল্লাহর নিকটে প্রার্থনা করলেন। ফলে আযাব চলে গেল। কিন্তু ঐ নেতাগুলো পূর্বের মতই তাদের গোমরাহীতে অনড় রইল এবং ঈমান আনলো না। এদের এই হঠকারিতা ও কপট আচরণের কথা আল্লাহ বর্ণনা করেন এভাবে, ‘অতঃপর তারা আত্মম্ভরিতা দেখাতে লাগলো। বস্ত্ততঃ এরা ছিল পাপাসক্ত জাতি’ (আ‘রাফ, আয়াত ১৩৩)। ফলে নেমে এল এবার প্লেগ মহামারী।

 

 প্লেগ

 

রক্তের আযাব উঠিয়ে নেবার পরও যখন ওরা ঈমান আনলো না, তখন আল্লাহ ওদের উপরে প্লেগ মহামারী প্রেরণ করেন (আ‘রাফ, আয়াত ১৩৪)। অনেকে এটাকে ‘বসন্ত’ রোগ বলেছেন। যাতে অল্প দিনেই তাদের সত্তর হাযার লোক মারা যায়। অথচ বনু ইস্রাঈলরা ভাল থাকে। এলাহী গযবের সাথে সাথে এগুলি ছিল মূসা (আঃ)-এর মু‘জেযা এবং নবুঅতের নিদর্শন। কিন্তু জাহিল ও আত্মগর্বী নেতারা একে ‘জাদু’ বলে তাচ্ছিল্য করত।

 

প্লেগের মহামারীর ফলে ব্যাপক প্রাণহানিতে ভীত হয়ে তারা আবার এসে মূসা (আঃ)-এর নিকটে হাত জোড় করে ক্ষমা চাইতে লাগল। মূসা (আঃ) আবারও তাদের জন্য দো‘আ করলেন। ফলে আযাব চলে গেল। কিন্তু তারা পূর্বের ন্যায় আবারো ওয়াদা ভঙ্গ করল। ফলে তাদের চূড়ান্ত ধ্বংস অবধারিত হয়ে গেল। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই যাদের উপরে তোমার প্রভুর আদেশ নির্ধারিত হয়ে গেছে, তারা কখনো বিশ্বাস আনয়ন করে না, যদিও সব রকমের নিদর্শনাবলী তাদের নিকটে পৌছে যায়, এমনকি তারা মর্মান্তিক আযাব প্রত্যক্ষ করে’ (ইউনুস, আয়াত ৯৬-৯৭)।

 

 সাগর ডুবি

 

ক্রমাগত পরীক্ষা ও অবকাশ দানের পরও যখন কোন জাতি সম্বিত ফিরে পায় না। বরং উল্টা তাদের অহংকার বাড়তে বাড়তে তুঙ্গে ওঠে, তখন তাদের চূড়ান্ত ধ্বংস অনিবার্য হয়ে ওঠে। আল্লাহ পাক বলেন,

 

 ‘আমরা মূসার প্রতি এই মর্মে অহী করলাম যে, আমার বান্দাদের নিয়ে রাত্রিযোগে বের হয়ে যাও এবং তাদের জন্য সমুদ্রে শুষ্কপথ নির্ধারণ কর। পিছন থেকে এসে তোমাদের ধরে ফেলার আশংকা কর না এবং (পানিতে ডুবে যাওয়ার) ভয় কর না’ (ত্বোয়াহা, আয়াত ৭৭)।

 

আল্লাহর হুকুম পেয়ে মূসা (আঃ) রাত্রির সূচনা লগ্নে বনু ইস্রাঈলদের নিয়ে রওয়ানা হ’লেন। তাঁরা সমুদ্রের দিকে রওয়ানা হয়ে গেলেন। এ সমুদ্র কোনটা ছিল এ ব্যাপারে মুফতী মুহাম্মাদ শফী তাফসীর রূহুল মা‘আনীর বরাত দিয়ে ৮৬০ পৃষ্ঠায় লিখেছেন যে, ওটা ছিল ‘ভূমধ্যসাগর’। একই তাফসীরে ৪৭৯ পৃষ্ঠায় লিখেছেন ‘লোহিত সাগর’। কিন্তু মাওলানা মওদূদী খ্যাতনামা পাশ্চাত্য মনীষী লুইস গোল্ডিং-এর তথ্যানুসন্ধান মূলক ভ্রমণ কাহিনী IN THE STEPS OF MOSSES, THE LAW GIVER -এর বরাতে লিখেছেন যে, ওটা ছিল ‘লোহিত সাগর সংলগ্ন তিক্ত হরদ’। মিসরের আধুনিক তাফসীরকার তানতাভীও (মৃঃ ১৯৪০ খৃঃ) বলেন যে, লোহিত সাগরে ডুবে মরা ফেরাঊনের লাশ ১৯০০ খৃষ্টাব্দের মে মাসে পাওয়া গিয়েছিল’। যদিও তা ১৯০৭ সালে পাওয়া যায়।

 

উল্লেখ্য যে, হযরত ইয়াকূব (আঃ)-এর বারো জন পুত্র মিসরে এসেছিলেন। পরবর্তী চারশত বছরে তাদের বংশ বৃদ্ধি পেয়ে ইস্রাঈলী বর্ণনা অনুযায়ী ছয় লাখ ৩০ হাযার ছাড়িয়ে যায়। মাওলানা মওদূদী বলেন, ঐ সময় মিসরে মুসলিম অধিবাসীর সংখ্যা ছিল ১০ থেকে ২০ শতাংশের মাঝামাঝি। তবে কুরআন ও হাদীছ থেকে কেবল এতটুকু জানা যায় যে, তাদের বারোটি গোত্র ছিল এবং প্রত্যেক গোত্রের জনসংখ্যা ছিল বিপুল।

 

নবুঅত-পরবর্তী ৩য় পরীক্ষা ও নাজাত লাভ

 

মূসার নবুঅতী জীবনে এটি ছিল একটি চূড়ান্ত পরীক্ষা। ইবরাহীমের অগ্নি পরীক্ষার ন্যায় এটিও ছিল জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে এক মহা পরীক্ষা। পিছনে ফেরাঊনের হিংস্র বাহিনী, সম্মুখে অথৈ সাগর। এই কঠিন সময়ে বনু ইস্রাঈলের আতংক ও হাহাকারের মধ্যেও মূসা ছিলেন স্থির ও নিস্কম্প। দৃঢ় হিমাদ্রির ন্যায় তিনি আল্লাহর উপরে বিশ্বাসে অটল থাকেন এবং সাথীদের সান্ত্বনা দিয়ে আল্লাহর রহমত কামনা করেন। হিজরতের রাতে একইরূপ জীবন-মরণ পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছিলেন শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)। যাই হোক ফেরাঊন খবর জানতে পেরে তার সেনাবাহিনীকে বনু ইস্রাঈলদের পশ্চাদ্ধাবনের নির্দেশ দিল। আল্লাহ বলেন,

 

 ‘সূর্যোদয়ের সময় তারা তাদের পশ্চাদ্ধাবন করল’ (শো‘আরা, আয়াত ৬০)। ‘অতঃপর যখন উভয় দল পরস্পরকে দেখল, তখন মূসার সঙ্গীরা (ভীত হয়ে) বলল, ‘আমরা তো এবার নিশ্চিত ধরা পড়ে গেলাম’। ‘তখন মূসা বললেন, কখনই নয়, আমার সাথে আছেন আমার পালনকর্তা। তিনি আমাকে সত্বর পথ প্রদর্শন করবেন’। ‘অতঃপর আমরা মূসাকে আদেশ করলাম, তোমার লাঠি দ্বারা সমুদ্রকে আঘাত কর। ফলে তা বিদীর্ণ হয়ে গেল এবং প্রত্যেক ভাগ বিশাল পাহাড় সদৃশ হয়ে গেল’। ‘ইতিমধ্যে আমরা সেখানে অপরদলকে (অর্থাৎ ফেরাঊন ও তার সেনাবাহিনীকে) পৌঁছে দিলাম’। ‘এবং মূসা ও তার সঙ্গীদের সবাইকে বাঁচিয়ে দিলাম’। ‘অতঃপর অপর দলটিকে ডুবিয়ে দিলাম’ (শো‘আরা, আয়াত ৬০-৬৬)। এখানে ‘প্রত্যেক ভাগ’ বলতে তাফসীরকারগণ বারো গোত্রের জন্য বারোটি ভাগ বলেছেন। প্রত্যেক ভাগের লোকেরা পানির দেওয়াল ভেদ করে পরস্পরকে দেখতে পায় ও কথা বলতে পারে, যাতে তারা ভীত না হয়ে পড়ে। আমরা মনে করি এগুলো কল্পনা না করলেও চলে। মূসা ও বনু ইস্রাঈলকে সাগর পাড়ি দিয়ে ওপারে চলে যেতে দেখে ফেরাঊন সরোষে ঘোড়া দাবড়িয়ে সর্বাগ্রে শুষ্ক সাগর বক্ষে ঝাঁপিয়ে পড়ল। পিছনে তার বিশাল বাহিনীর সবাই সাগরের মধ্যে নেমে এলো। যখন তারা সাগরের মধ্যস্থলে পৌঁছে গেল, তখন আল্লাহর হুকুমে দু’দিক থেকে বিপুল পানি রাশি ধেয়ে এসে তাদেরকে নিমেষে গ্রাস করে ফেলল। আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর ফেরাঊন তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে তাদের পশ্চাদ্ধাবন করল। কিন্তু সমুদ্র তাদেরকে সম্পূর্ণরূপে গ্রাস করে ফেলল’ (ত্বোয়াহা, আয়াত ৭৮)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, ‘আর বনু ইস্রাঈলকে আমরা সাগর পার করে দিলাম। তারপর তাদের পশ্চাদ্ধাবন করল ফেরাঊন ও তার সেনাবাহিনী বাড়াবাড়ি ও শত্রুতা বশতঃ। অতঃপর যখন সে (ফেরাঊন) ডুবতে লাগল, তখন বলে উঠল, আমি ঈমান আনছি এ বিষয়ে যে, সেই সত্তা ব্যতীত কোন উপাস্য নেই, যার উপরে ঈমান এনেছে বনু ইস্রাঈলগণ এবং আমি আত্মসমর্পণকারীদের একজন’ (ইউনুস, আয়াত ৯০)। আল্লাহ বললেন,

 

‘এখন একথা বলছ? অথচ তুমি ইতিপূর্বে না-ফরমানী করেছিলে এবং ফাসাদ সৃষ্টিকারীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলে’। ‘অতএব আজ আমরা তোমার দেহকে (বিনষ্ট হওয়া থেকে) বাঁচিয়ে দিচ্ছি। যাতে তোমার পশ্চাদ্বর্তীদের জন্য তুমি নিদর্শন হ’তে পার। বস্ত্ততঃ বহু লোক এমন রয়েছে যারা আমাদের নিদর্শনাবলীর বিষয়ে বেখবর’ (ইউনুস, আয়াত ৯১-৯২)।

 

স্মর্তব্য যে, সাগরডুবির দৃশ্য স্বচক্ষে দেখার পরেও ভীত-সন্ত্রস্ত বনী ইস্রাঈলীরা ফেরাঊন মরেছে কি- না বিশ্বাস করতে পারছিল না। ফলে মূসা (আঃ) আল্লাহর নিকট দো‘আ করলেন। তখন আল্লাহ তার প্রাণহীন দেহ বের করে দিলেন। অতঃপর মূসার সাথীরা নিশ্চিন্ত হ’ল। উল্লেখ্য যে, ফেরাঊনের মমিকৃত দেহ অক্ষতভাবে পাওয়া যায় ১৯০৭ সালে এবং বর্তমানে তা মিসরের পিরামিডে রক্ষিত আছে।

 

এতে একথাও প্রমাণিত হয় যে, ফেরাঊনের সময় মিসরীয় সভ্যতা অনেক উন্নত ছিল। তাদের সময়ে লাশ ‘মমি’ করার মত বৈজ্ঞানিক কলাকৌশল আবিষ্কৃত হয়। পিরামিড, স্ফিংক্স হাযার হাযার বছর ধরে আজও সেই প্রাচীন সভ্যতার স্মৃতি ধারণ করে আছে, যা নিঃসন্দেহে বিস্ময়কর। আজকের যুগের কোন কারিগর প্রাচীন এসব কারিগরী কলা-কৌশলের ধারে-কাছেও যেতে পারবে কি-না সন্দেহ।

 

বনু ইস্রাঈলের অবাধ্যতা ও তাদের উপরে আপতিত পরীক্ষা সমূহের বিবরণ:

 

১. মূর্তি পূজার আবদার

 

বনু ইস্রাঈল কওম মূসা (আঃ)-এর মু‘জেযার বলে লোহিত সাগরে নির্ঘাত ডুবে মরা থেকে সদ্য নাজাত পেয়ে এসেছিল এবং গোটা ফেরাঊনী গোষ্ঠীকে সাগরে ডুবে মরার মর্মান্তিক দৃশ্য স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করে এসেছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও সিরিয়া আসার পথে কিছুদূর অগ্রসর হ’তেই তারা এমন এক জনপদের উপর দিয়ে অতিক্রম করল, যারা বিভিন্ন মূর্তির পূজায় লিপ্ত ছিল। তাদের পূজা-অর্চনার জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান দেখে তাদের মন সেদিকে আকৃষ্ট হ’ল এবং মূসা (আঃ)-এর কাছে গিয়ে আবেদন করল, ‘তাদের মূর্তিসমূহের ন্যায় আমাদের জন্যও একটা মূর্তি বানিয়ে দিন’। মূসা বললেন, ‘তোমরা দেখছি মূর্খতায় লিপ্ত জাতি’। তিনি বলেন, ‘এরা যে কাজে নিয়োজিত রয়েছে, তা ধ্বংস হবে এবং যা কিছু তারা করছে, তা সব বাতিল’। ‘তিনি আরও বললেন,‘আমি কি তোমাদের জন্য আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন উপাস্য সন্ধান করব? অথচ তিনি তোমাদেরকে সারা বিশ্বের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন’ (আ‘রাফ, আয়াত ১৩৮-১৪০)।

 

বস্ত্ততঃ মানুষ সর্বদা আনুষ্ঠানিকতা প্রিয় এবং অদৃশ্য সত্তার চেয়ে দৃশ্যমান বস্ত্তর প্রতি অধিকতর আসক্ত। ফলে নূহ (আঃ)-এর যুগ থেকেই অদৃশ্য আল্লাহর নৈকট্য হাছিলের অসীলা কল্পনা করে নিজেদের হাতে গড়া দৃশ্যমান মূর্তি সমূহের পূজা-অর্চনা চলে আসছে। অবশেষে আল্লাহ্কে ও তাঁর বিধানকে ভুলে গিয়ে মানুষ মূর্তিকে ও নিজেদের মনগড়া বিধানকে মুখ্য গণ্য করেছে। মক্কার মুশরিকরাও শেষনবীর কাছে তাদের মূর্তিপূজাকে আল্লাহর নৈকট্যের অসীলা বলে অজুহাত দিয়েছিল’ (যুমার, আয়াত ৩৯)। তাদের এই অজুহাত অগ্রাহ্য হয় এবং তাদের রক্ত হালাল গণ্য হয়। বদর, ওহোদ, খন্দক প্রভৃতি যুদ্ধসহ পরবর্তীকালের সকল জিহাদ মূলতঃ এই শিরকের বিরুদ্ধেই পরিচালিত হয়। মক্কা বিজয়ের দিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজ হাতে মূর্তি ভেঙ্গে অতঃপর পানি দিয়ে ধুয়ে কা‘বা গৃহ ছাফ করেন এবং আয়াত পাঠ করেন, ‘সত্য এসে গেল, মিথ্যা বিদূরিত হ’ল’ (ইসরা, আয়াত ৮১)।

 

কিন্তু দুর্ভাগ্য! মূর্তিপূজার সে স্থান আজ দখল করেছে মুসলমানদের মধ্যে কবর পূজা, ছবি-মূর্তি ও প্রতিকৃতি পূজা, স্মৃতিসৌধ, স্থানপূজা, শহীদ মিনার ও বেদী পূজা, শিখা ও আগুন পূজা ইত্যাদি। বস্ত্ততঃ এগুলি স্পষ্ট শিরক, যা থেকে নবীগণ যুগে যুগে মানুষকে সাবধান করেছেন। মূসা (আঃ) স্বীয় কওমকে তাদের মূর্খতাসূলভ আচরণের জন্য ধমকানোর পর তাদের হুঁশ ফিরলো এবং তারা বিরত হ’ল।

 

তওরাত লাভ

 

অতঃপর আল্লাহ মূসাকে অহীর মাধ্যমে ওয়াদা করলেন যে, তাকে সত্বর ‘কিতাব’ (তওরাত) প্রদান করা হবে এবং এজন্য তিনি বনু ইস্রাঈলকে সাথে নিয়ে তাকে ‘তূর পাহাড়ের দক্ষিণ পার্শ্বে’ চলে আসতে বললেন (ত্বোয়াহা, আয়াত ৮৩-৮৪)। অতঃপর মূসা (আঃ) আগে এসে আল্লাহর হুকুমে প্রথমে ত্রিশ দিন ছিয়াম ও এ‘তেকাফে মগ্ন থাকেন। এরপর আল্লাহ আরও দশদিন মেয়াদ বাড়িয়ে দেন (আ‘রাফ, আয়াত ১৪২)। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, এই দশদিন ছিল যিলহজ্জের প্রথম দশদিন, যা অতীব বরকতময়। ইবনু কাছীর বলেন, ১০ই যিলহজ্জ কুরবানীর দিন মূসার মেয়াদ শেষ হয় ও আল্লাহর সাথে কথা বলার সৌভাগ্য লাভ হয়। একই দিন শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর উপর দ্বীন পরিপূর্ণতার আয়াত নাযিল হয় (মায়েদাহ ৩)। যথাসময়ে আল্লাহ মূসার সঙ্গে কথা বললেন (আ‘রাফ, আয়াত ১৪৩)। অতঃপর তাঁকে তওরাত প্রদান করলেন, যা ছিল সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী ও সরল পথ প্রদর্শনকারী (বাক্বারাহ, আয়াত ৫৩)। দীর্ঘ বিশ বছরের অধিককাল পূর্বে মিসর যাওয়ার পথে এই স্থানেই মূসা প্রথম আল্লাহর সাথে কথোপকথনের ও নবুঅত লাভের মহা সৌভাগ্য লাভ করেন। আজ আবার সেখানেই বাক্যালাপ ছাড়াও এলাহী গ্রন্থ তওরাত পেয়ে খুশীতে অধিকতর সাহসী হয়ে তিনি আল্লাহর নিকটে দাবী করে বসলেন,

 

 ‘হে আমার পালনকর্তা! আমাকে দেখা দাও। আমি তোমাকে স্বচক্ষে দেখব। আল্লাহ বললেন, তুমি আমাকে (এ দুনিয়াতে) কখনোই দেখতে পাবে না। তবে তুমি (তূর) পাহাড়ের দিকে দেখতে থাক। সেটি যদি স্বস্থানে স্থির থাকে, তাহ’লে তুমি আমাকে দেখতে পাবে। অতঃপর যখন তার প্রভু উক্ত পাহাড়ের উপরে স্বীয় জ্যোতির বিকীরণ ঘটালেন, সেটিকে বিধ্বস্ত করে দিলেন এবং মূসা জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেল। অতঃপর যখন তার জ্ঞান ফিরে এল, তখন বলল, হে প্রভু! মহা পবিত্র তোমার সত্তা! আমি তোমার নিকটে তওবা করছি এবং আমি বিশ্বাসীদের মধ্যে অগ্রণী’ (আ‘রাফ, আয়াত ১৪৩)।

 

আল্লাহ বললেন, হে মূসা! আমি আমার ‘রিসালাত’ তথা বার্তা পাঠানোর মাধ্যমে এবং বাক্যালাপের মাধ্যমে লোকদের (নবীগণের) উপরে তোমাকে বিশিষ্টতা দান করেছি। সুতরাং যা কিছু আমি তোমাকে দান করলাম তা গ্রহণ কর ও কৃতজ্ঞ থাক’। ‘আর আমরা তার জন্য ফলক সমূহে লিখে দিয়েছিলাম সর্বপ্রকার উপদেশ ও সকল বিষয় বিস্তারিতভাবে। অতএব তুমি এগুলিকে দৃঢ়ভাবে ধারণ কর এবং স্বজাতিকে এর কল্যাণকর বিষয়সমূহ দৃঢ়তার সাথে পালনের নির্দেশ দাও। শীঘ্রই আমি তোমাদেরকে দেখাব পাপাচারীদের বাসস্থান’ (আ‘রাফ, আয়াত ১৪৪-১৪৫)।

 

উপরোক্ত আয়াত দ্বারা বুঝা যায় যে, তখতী বা ফলকে লিখিত অবস্থায় তাঁকে কিতাব প্রদান করা হয়েছিল। আর এই তখতীগুলোর নামই হ’ল ‘তওরাত’।

 

গো-বৎস পূজার শাস্তি

 

মূসা (আঃ) গো-বৎস পূজায় নেতৃত্ব দানকারী হঠকারী লোকদের মৃত্যুদন্ড দিলেন। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘আর যখন মূসা তার সম্প্রদায়কে বলল, হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা গো-বৎসকে উপাস্য নির্ধারণ করে নিজেদের উপরে যুলুম করেছ। অতএব এখন তোমাদের প্রভুর নিকটে তওবা কর এবং নিজেদেরকে পরস্পরে হত্যা কর। এটাই তোমাদের জন্য তোমাদের স্রষ্টার নিকটে কল্যাণকর’... (বাক্বারাহ, আয়াত ৫৪)। এভাবে তাদের কিছু লোককে হত্যা করা হয়, কিছু লোক ক্ষমাপ্রাপ্ত হয়।

 

তূর পাহাড় তুলে ধরা হ

 

এরপরেও কপট বিশ্বাসী ও হঠকারী কিছু লোক থাকে, যারা তওরাতকে মানতে অস্বীকার করে। ফলে তাদের মাথার উপরে আল্লাহ তূর পাহাড়ের একাংশ উঁচু করে ঝুলিয়ে ধরেন এবং অবশেষে নিরুপায় হয়ে তারা সবাই আনুগত্য করতে স্বীকৃত হয়। যেমন আল্লাহ বলেন,

 

‘আর যখন আমি তোমাদের কাছ থেকে অঙ্গীকার নিয়েছিলাম এবং তূর পাহাড়কে তোমাদের মাথার উপরে তুলে ধরেছিলাম এই বলে যে, তোমাদের যে কিতাব দেওয়া হয়েছে, তা মযবুতভাবে ধারণ কর এবং এতে যা কিছু রয়েছে তা স্মরণে রাখ, যাতে তোমরা আল্লাহভীরু হ’তে পার’ (বাক্বারাহ, আয়াত ৬৩)। কিন্তু গো-বৎসের মহববত এদের হৃদয়ে এমনভাবে বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিল যে, এতকিছুর পরেও তারা শিরক ছাড়তে পারেনি। আল্লাহ বলেন, ‘কুফরের কারণে তাদের অন্তরে গোবৎস প্রীতি পান করানো হয়েছিল’ (বাক্বারাহ, আয়াত ৯৩)। যেমন কেউ সরাসরি শিরকে নেতৃত্ব দিয়েছে, কেউবা মুখে তওবা করলেও অন্তরে পুরোপুরি তওবা করেনি। কেউবা শিরককে ঘৃণা করতে পারেনি। কেউ বা মনে মনে ঘৃণা করলেও বাহ্যিকভাবে মেনে নিয়েছিল এবং বাধা দেওয়ার কোন চেষ্টা করেনি। আল্লাহ যখন তূর পাহাড় তুলে ধরে ভয় দেখিয়ে তাদের আনুগত্যের প্রতিশ্রুতি নেন, তখনও তাদের কেউ কেউ (পরবর্তীতে) বলেছিল, ‘আমরা শুনলাম ও অমান্য করলাম’ (বাক্বারাহ, আয়াত ৯৩)। যদিও অমান্য করলাম কথাটি ছিল পরের এবং তা প্রমাণিত হয়েছিল তাদের বাস্তব ক্রিয়াকর্মে। যেমন আল্লাহ এইসব প্রতিশ্রুতি দানকারীদের পরবর্তী আচরণ সম্বন্ধে বলেন,

 

‘‘অতঃপর তোমরা উক্ত ঘটনার পরে (তোমাদের প্রতিশ্রুতি থেকে) ফিরে গেছ। যদি আল্লাহর বিশেষ করুণা ও অনুগ্রহ তোমাদের উপরে না থাকত, তাহ’লে অবশ্যই তোমরা ধ্বংস হয়ে যেতে’’ (বাক্বারাহ, আয়াত ৬৪)।

 

 (৩) আল্লাহকে স্বচক্ষে দেখার যিদ ও তার পরিণতি

 

মূসা (আঃ) তূর পাহাড়ে তওরাৎ প্রাপ্ত হয়ে বনু ইস্রাঈলের কাছে ফিরে এসে তা পেশ করলেন এবং বললেন যে, এটা আল্লাহ প্রদত্ত কিতাব। তোমরা এর অনুসরণ কর। তখন কিছু সংখ্যক উদ্ধত লোক বলে উঠলো, যদি আল্লাহ স্বয়ং আমাদের বলে দেন যে, এটি তাঁর প্রদত্ত কিতাব, তাহ’লেই কেবল আমরা বিশ্বাস করব, নইলে নয়। হতে পারে তুমি সেখানে চল্লিশ দিন বসে বসে এটা নিজে লিখে এনেছ। তখন মূসা (আঃ) আল্লাহর অনুমতিক্রমে তাদেরকে তাঁর সাথে তূর পাহাড়ে যেতে বললেন। বনী ইস্রাঈলরা তাদের মধ্যে বাছাই করা সত্তর জনকে মনোনীত করে মূসা (আঃ)-এর সাথে তূর পাহাড়ে প্রেরণ করল। সেখানে পৌঁছে তারা আল্লাহর বাণী স্বকর্ণে শুনতে পেল। এরপরেও তাদের অবাধ্য মন শান্ত হ’ল না। শয়তানী ধোঁকায় পড়ে তারা নতুন এক অজুহাত তুলে বলল, এগুলো আল্লাহর কথা না অন্য কারু কথা, আমরা বুঝবো কিভাবে? অতএব যতক্ষণ আমরা তাঁকে সশরীরে প্রকাশ্যে আমাদের সম্মুখে না দেখব, ততক্ষণ আমরা বিশ্বাস করব না যে, এসব আল্লাহর বাণী। কিন্তু যেহেতু এ পার্থিব জগতে চর্মচক্ষুতে আল্লাহকে দেখার ক্ষমতা কারু নেই, তাই তাদের এই চরম ধৃষ্টতার জবাবে আসমান থেকে ভীষণ এক নিনাদ এল, যাতে সব নেতাগুলোই চোখের পলকে অক্কা পেল।

 

অকস্মাৎ এমন ঘটনায় মূসা (আঃ) বিস্মিত ও ভীত-বিহবল হয়ে পড়লেন। তিনি প্রার্থনা করে বললেন, হে আল্লাহ! এমনিতেই ওরা হঠকারী। এরপরে এদের এই মৃত্যুতে লোকেরা আমাকেই দায়ী করবে। কেননা মূল ঘটনার সাক্ষী কেউ থাকল না আমি ছাড়া। অতএব হে আল্লাহ! ওদেরকে পুনর্জীবন দান কর। যাতে আমি দায়মুক্ত হ’তে পারি এবং ওরাও গিয়ে সাক্ষ্য দিতে পারে। আল্লাহ মূসার দো‘আ কবুল করলেন এবং ওদের জীবিত করলেন। এ ঘটনা আল্লাহ বর্ণনা করেন এভাবে-

 

 ‘আর যখন তোমরা বললে, হে মূসা! কখনোই আমরা তোমাকে বিশ্বাস করব না, যতক্ষণ না আমরা আল্লাহকে প্রকাশ্যে দেখতে পাব। তখন তোমাদেরকে পাকড়াও করল এক ভীষণ নিনাদ (বজ্রপাত), যা তোমাদের চোখের সামনেই ঘটেছিল’। ‘অতঃপর তোমাদের মৃত্যুর পর আমরা তোমাদেরকে পুনর্জীবিত করলাম, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর’ (বাক্বারাহ, আয়াত ৫৫-৫৬)।

 

(৪) বায়তুল মুক্বাদ্দাস অভিযানের নির্দেশ

 

সাগরডুবি থেকে মুক্তি পাবার পর হ’তে সিনাই উপত্যকা পেরিয়ে তূর পাহাড়ে পৌঁছা পর্যন্ত সময়কালে মূর্তিপূজার আবদার, গো-বৎস পূজা ও তার শাস্তি, তওরাৎ লাভ ও তা মানতে অস্বীকার এবং তূর পাহাড় উঠিয়ে ভয় প্রদর্শন, আল্লাহ্কে স্বচক্ষে দেখার যিদ ও তার পরিণতি প্রভৃতি ঘটনা সমূহের পর এবার তাদের মূল গন্তব্যে যাত্রার জন্য আদেশ করা হ’ল। অবাধ্য জাতিকে তাদের আদি বাসস্থানে রওয়ানার প্রাক্কালে মূসা (আঃ) তাদেরকে দূরদর্শিতাপূর্ণ উপদেশবাণী শুনান এবং যেকোন বাধা সাহসের সাথে অতিক্রম করার ব্যাপারে উৎসাহিত করেন। সাথে সাথে তিনি তাদেরকে বিগত দিনে আল্লাহর অলৌকিক সাহায্য লাভের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে অভয়বাণী শুনান। যেমন আল্লাহর ভাষায়,

 

 ‘আর যখন মূসা স্বীয় সম্প্রদায়কে বলল, হে আমার সম্প্রদায়! তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহরাজি স্মরণ কর, যখন তিনি তোমাদের মধ্যে নবীগণকে সৃষ্টি করেছেন, তোমাদেরকে রাজ্যাধিপতি বানিয়েছেন এবং তোমাদেরকে এমন সব বস্ত্ত দিয়েছেন, যা বিশ্বজগতের কাউকে দেননি’। ‘হে আমার সম্প্রদায়! পবিত্র ভূমিতে (বায়তুল মুক্বাদ্দাস শহরে) প্রবেশ কর, যা আল্লাহ তোমাদের জন্য নির্ধারিত করে দিয়েছেন। আর তোমরা পশ্চাদদিকে প্রত্যাবর্তন করবে না। তাতে তোমরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে’ (মায়েদাহ, আয়াত ২০-২১)।

 

নবুঅত-পরবর্তী ৪র্থ পরীক্ষা : বায়তুল মুক্বাদ্দাস অভিযান

 

আল্লাহ পাক মূসা (আঃ)-এর মাধ্যমে বনী ইস্রাঈলকে আমালেক্বা সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে জিহাদ করে শাম দখল করতে বলেছিলেন। সাথে সাথে এ সুসংবাদও দিয়েছিলেন যে, শামের ভূখন্ড তাদের ভাগ্যে লেখা হয়ে গেছে (মায়েদাহ, আয়াত ২১)। কাজেই তোমাদের বিজয় সুনিশ্চিত। কিন্তু এইসব বিলাসী কাপুরুষেরা আল্লাহর কথায় দৃঢ় বিশ্বাস আনতে পারেনি।

 

মূসা (আঃ) আল্লাহর নির্দেশ পালনের জন্য বনী ইস্রাঈলকে সাথে নিয়ে মিসর থেকে শাম অভিমুখে রওয়ানা হ’লেন। যথা সময়ে তাঁরা জর্দান নদী পার হয়ে ‘আরীহা’ পৌঁছে শিবির স্থাপন করলেন। এটি ছিল পৃথিবীর প্রাচীনতম মহানগরী সমূহের অন্যতম, যা জর্দান নদী ও বায়তুল মুক্বাদ্দাসের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত। যা আজও স্বনামে বিদ্যমান রয়েছে। মূসা (আঃ)-এর সময়ে এ শহরের অত্যাশ্চর্য জাঁক-জমক ও বিস্তৃতি ইতিহাসে বর্ণিত হয়েছে।

 

শিবির স্থাপনের পর মূসা (আঃ) বিপক্ষ দলের অবস্থা ও অবস্থান পর্যবেক্ষণের জন্য ১২ জন সর্দারকে প্রেরণ করলেন। যারা ছিলেন হযরত ইয়াকূব (আঃ)-এর বারো পুত্রের বংশধরগণের ‘বারোজন প্রতিনিধি, যাদেরকে তিনি আগেই নির্বাচন করেছিলেন স্ব স্ব গোত্রের লোকদের দেখাশুনার জন্য’ (মায়েদাহ, আয়াত ১২)। তারা রওয়ানা হবার পর বায়তুল মুক্বাদ্দাস শহরের উপকণ্ঠে পৌঁছলে বিপক্ষ দলের বিশালদেহী বিকট চেহারার একজন লোকের সঙ্গে সাক্ষাত হয়। ইস্রাঈলী রেওয়ায়াত সমূহে লোকটির নাম ‘আউজ ইবনে ওনুক’ বলা হয়েছে এবং তার আকার-আকৃতি ও শক্তি-সাহসের অতিরঞ্জিত বর্ণনা সমূহ উদ্ধৃত হয়েছে (ইবনু কাছীর)। যাই হোক উক্ত ব্যক্তি একাই বনু ইস্রাঈলের এই বার জন সরদারকে পাকড়াও করে তাদের বাদশাহর কাছে নিয়ে গেল এবং অভিযোগ করল যে, এই লোকগুলি আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার মতলব নিয়ে এসেছে। বাদশাহ তার নিকটতম লোকদের সাথে পরামর্শের পর এদের ছেড়ে দেবার সিদ্ধান্ত নেন এই উদ্দেশ্যে যে, এরা গিয়ে তাদের নেতাকে আমালেক্বাদের জাঁক-জমক ও শৌর্য-বীর্যের স্বচক্ষে দেখা কাহিনী বর্ণনা করবে। তাতে ওরা ভয়ে এমনিতেই পিছিয়ে যাবে। পরবর্তীতে দেখা গেল যে, বাদশাহর ধারণাই সত্যে পরিণত হয়েছিল। এই ভীত-কাপুরুষ সর্দাররা জিহাদ দূরে থাক, ওদিকে তাকানোর হিম্মতও হারিয়ে ফেলেছিল।

 

বনু ইস্রাঈলের বারো জন সর্দার আমালেক্বাদের হাত থেকে মুক্ত হয়ে স্বজাতির কাছে ফিরে এল এবং আমালেক্বাদের বিস্ময়কর উন্নতি ও অবিশ্বাস্য শক্তি-সামর্থ্যের কথা মূসা (আঃ)-এর নিকটে বর্ণনা করল। কিন্তু মূসা (আঃ) এতে মোটেই ভীত হননি। কারণ তিনি আগেই অহী প্রাপ্ত হয়েছিলেন এবং বিজয় সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলেন। সেমতে তিনি গোত্রনেতাদের যুদ্ধ প্রস্ত্ততি গ্রহণের নির্দেশ দিলেন এবং আমালেক্বাদের শৌর্য-বীর্যের কথা অন্যের কাছে প্রকাশ করতে নিষেধ করলেন। কিন্তু দেখা গেল যে, ইউশা‘ বিন নূন ও কালেব বিন ইউক্বেন্না ব্যতীত বাকী সর্দাররা গোপনে সব ফাঁস করে দিল (কুরতুবী, ইবনু কাছীর)। ফলে যা হবার তাই হ’ল। এই ভীতু আরামপ্রিয় জাতি একেবারে বেঁকে বসলো।

 

 ‘তারা বলল, হে মূসা! সেখানে একটি প্রবল পরাক্রান্ত জাতি রয়েছে। আমরা কখনো সেখানে যাব না, যে পর্যন্ত না তারা সেখান থেকে বের হয়ে যায়। যদি তারা সেখান থেকে বের হয়ে যায়, তবে নিশ্চিতই আমরা সেখানে প্রবেশ করব’ (মায়েদাহ, আয়াত ২২)। অর্থাৎ ওরা চায় যে, মূসা (আঃ) তার মু‘জেযার মাধ্যমে যেভাবে ফেরাঊনকে ডুবিয়ে মেরে আমাদের উদ্ধার করে এনেছেন, অনুরূপভাবে আমালেক্বাদের তাড়িয়ে দিয়ে তাদের পরিত্যক্ত অট্টালিকা ও সম্পদরাজির উপরে আমাদের মালিক বানিয়ে দিন। অথচ আল্লাহর বিধান এই যে, বান্দাকে চেষ্টা করতে হবে এবং আল্লাহর উপর ভরসা করতে হবে। কিন্তু বনু ইস্রাঈলরা এক পাও বাড়াতে রাযী হয়নি। এমতাবস্থায়

 

 ‘তাদের মধ্যকার দু’জন আল্লাহভীরু ব্যক্তি (সম্ভবতঃ পূর্বের দু’জন সর্দার হবেন, যাদের মধ্যে ইউশা‘ পরে নবী হয়েছিলেন), যাদের প্রতি আল্লাহ অনুগ্রহ করেছিলেন, তারা বলল, (মূসা (আঃ)-এর আদেশ মতে) ‘তোমরা ওদের উপর আক্রমণ করে (শহরের মূল) দরজায় প্রবেশ কর। (কেননা আমাদের নিশ্চিত বিশ্বাস যে,) যখনই তোমরা তাতে প্রবেশ করবে, তখনই তোমরা অবশ্যই জয়ী হবে। আর তোমরা আল্লাহর উপরে ভরসা কর, যদি তোমরা মুমিন হয়ে থাক’ (মায়েদা, আয়াত ২৩)।

 

কিন্তু ঐ দুই নেককার সর্দারের কথার প্রতি তারা দৃকপাত করল না। বরং আরও উত্তেজিত হয়ে তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে মূসা (আঃ)-কে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘হে মূসা! আমরা কখনোই সেখানে প্রবেশ করব না, যতক্ষণ তারা সেখানে আছে। অতএব তুমি ও তোমার পালনকর্তা যাও এবং যুদ্ধ কর গে। আমরা এখানেই বসে রইলাম’ (মায়েদাহ, আয়াত ২৪)। নবীর অবাধ্যতার ফলস্বরূপ এই জাতিকে ৪০ বছর তীহ্ প্রান্তরের উন্মুক্ত কারাগারে বন্দী থাকতে হয় (মায়েদাহ, আয়াত ২৬)। অতঃপর এইসব দুষ্টমতি নেতাদের মৃত্যুর পর পরবর্তী বংশধররা হযরত ইউশা‘ বিন নূন (আঃ)-এর নেতৃত্বে জিহাদ করে বায়তুল মুক্বাদ্দাস পুনর্দখল করে।

 

বনু ইস্রাঈলের এই চূড়ান্ত বেআদবী ছিল কুফরীর নামান্তর এবং অত্যন্ত পীড়াদায়ক। যা পরবর্তীতে প্রবাদবাক্যে পরিণত হয়ে গেছে। বদরের যুদ্ধের সময়ে শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) কিছুটা অনুরূপ অবস্থায় পতিত হয়েছিলেন। অপর্যাপ্ত ব্যবস্থাপনা ও ক্ষুৎ-পিপাসায় কাতর অল্প সংখ্যক সবেমাত্র মুহাজির মুসলমানের মোকাবেলায় তিনগুণ শক্তিসম্পন্ন সুসজ্জিত বিরাট কুরায়েশ সেনাবাহিনীর আগমনে হতচকিত ও অপ্রস্ত্তত মুসলমানদের বিজয়ের জন্য যখন নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) আল্লাহর নিকটে সাহায্য প্রার্থনা করছিলেন, তখন মিক্বদাদ ইবনুল আসওয়াদ আনছারী (রাঃ) দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে বলেছিলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা কস্মিনকালেও ঐকথা বলব না, যা মূসা (আঃ)-এর স্বজাতি তাঁকে বলেছিল, ‘তুমি ও তোমার প্রভু যাও যুদ্ধ করগে। আমরা এখানে বসে রইলাম’ (মায়েদা, আয়াত ২৪)। বরং আমরা আপনার ডাইনে, বামে, সামনে ও পিছনে থেকে শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করব। আপনি নিশ্চিন্তে যুদ্ধের প্রস্ত্ততি গ্রহণ করুন’। বিপদ মুহূর্তে সাথীদের এরূপ বীরত্বব্যঞ্জক কথায় আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) অত্যন্ত প্রীত হয়েছিলেন।

 

বালআম বাঊরার ঘটনা :

 

ফিলিস্তীন দখলকারী ‘জাববারীন’ তথা আমালেক্বা সম্প্রদায়ের শক্তিশালী নেতারা মূসা (আঃ) প্রেরিত ১২ জন প্রতিনিধিকে ফেরৎ পাঠিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে পারেনি। কারণ তারা মূসা (আঃ)-এর মু‘জেযার কারণে ফেরাঊনের সসৈন্যে সাগরডুবির খবর আগেই জেনেছিল। অতএব মূসা (আঃ)-এর বায়তুল মুক্বাদ্দাস অভিযান বন্ধ করার জন্য তারা বাঁকা পথ তালাশ করল। তারা অত্যন্ত গোপনে বনু ইস্রাঈলের ঐ সময়কার একজন নামকরা সাধক ও দরবেশ আলেম বাল‘আম ইবনে বা‘ঊরা কাছে বহু মূল্যবান উপঢৌকনাদিসহ লোক পাঠাল। বাল‘আম তার স্ত্রীর অনুরোধে তা গ্রহণ করল। অতঃপর তার নিকটে আসল কথা পাড়া হ’ল যে, কিভাবে আমরা মূসার অভিযান ঠেকাতে পারি। আপনি পথ বাৎলে দিলে আমরা আরও মহামূল্যবান উপঢৌকনাদি আপনাকে প্রদান করব। বাল‘আম উঁচুদরের আলেম ছিল। যে সম্পর্কে তার নাম না নিয়েই আল্লাহ বলেন,

 

‘আপনি তাদেরকে শুনিয়ে দিন সেই লোকটির অবস্থা, যাকে আমরা আমাদের নিদর্শন সমূহ দান করেছিলাম। অথচ সে তা পরিত্যাগ করে বেরিয়ে গেল। আর তার পিছনে লাগল শয়তান। ফলে সে পথভ্রষ্টদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল’ (আ‘রাফ, আয়াত ১৭৫)।

 

কথিত আছে যে, বাল‘আম ‘ইসমে আযম’ জানত। সে যা দো‘আ করত, তা সাথে সাথে কবুল হয়ে যেত। আমালেক্বাদের অনুরোধ ও পীড়াপীড়িতে সে অবশেষে মূসার বিরুদ্ধে দো‘আ করল। কিন্তু তার জিহবা দিয়ে উল্টা দো‘আ বের হ’তে লাগল যা আমালেক্বাদের বিরুদ্ধে যেতে লাগল। তখন সে দো‘আ বন্ধ করল। কিন্তু অন্য এক পৈশাচিক রাস্তা সে তাদের বাৎলে দিল। সে বলল, বনু ইস্রাঈলগণের মধ্যে ব্যভিচার ছড়িয়ে দিতে পারলে আল্লাহ তাদের উপরে নারায হবেন এবং তাতে মূসার অভিযান বন্ধ হয়ে যাবে’। আমালেক্বারা তার পরামর্শ গ্রহণ করল এবং তাদের সুন্দরী মেয়েদেরকে বনু ইস্রাঈলের নেতাদের সেবাদাসী হিসাবে অতি গোপনে পাঠিয়ে দিল। বড় একজন নেতা এফাঁদে পা দিল। আস্তে আস্তে তা অন্যদের মধ্যেও সংক্রমিত হ’ল। ফলে আল্লাহর গযব নেমে এল। বনু ইস্রাঈলীদের মধ্যে প্লেগ মহামারী দেখা দিল। কথিত আছে যে, একদিনেই সত্তর হাযার লোক মারা গেল। এ ঘটনায় বাকী সবাই তওবা করল এবং প্রথম পথভ্রষ্ট নেতাকে প্রকাশ্যে হত্যা করে রাস্তার উপরে ঝুলিয়ে রাখা হ’ল। অতঃপর আল্লাহর গযব উঠে গেল। এগুলি ইস্রাঈলী বর্ণনা। সম্ভবতঃ সম্প্রদায়ের নেতাদের ক্রমাগত অবাধ্যতা, শঠতা ও পাপাচারে অতিষ্ঠ হ’য়ে এবং একসাথে এই বিরাট জনশক্তি বিনষ্ট হওয়ায় মূসা (আঃ) বায়তুল মুক্বাদ্দাস অভিযানের সংকল্প পরিত্যাগ করেন।

 

তীহ্ প্রান্তরের ঘটনাবলী :

 

নবীর সঙ্গে যে বেআদবী তারা করেছিল, তাতে আল্লাহর গযবে তাদের ধ্বংস হয়ে যাওয়াটা স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু আল্লাহ পাক হয়ত এ জাতিকে আরও পরীক্ষা করতে চেয়েছিলেন এবং আল্লাহর অপার অনুগ্রহপুষ্ট একটি জাতি নিজেদের অবাধ্যতা ও হঠকারিতার ফলে কিভাবে আল্লাহর অভিসম্পাৎগ্রস্ত হয় এবং ক্বিয়ামত পর্যন্ত চিরস্থায়ী লাঞ্ছনার শিকার হয়, পৃথিবীর মানুষের নিকটে দৃষ্টান্ত হিসাবে তা পেশ করতে চেয়েছিলেন। ঠিক যেভাবে দৃষ্টান্ত হয়েছে ফেরাঊন একজন অবাধ্য ও অহংকারী নরপতি হিসাবে। আর তাই বনী ইস্রাঈলের পরীক্ষার মেয়াদ আরও বর্ধিত হ’ল। নিম্নে তাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহের কিছু নিদর্শন বর্ণিত হ’ল।-

 

১. মেঘ দ্বারা ছায়া প্রদান

 

ছায়াশূন্য তপ্ত বালুকা বিস্তৃত মরুভূমিতে কাঠফাটা রোদে সবচেয়ে প্রয়োজন যেসব বস্ত্তর, তন্মধ্যে ‘ছায়া’ হ’ল সর্বপ্রধান। হঠকারী উম্মতের অবাধ্যতায় ত্যক্ত-বিরক্ত মূসা (আঃ) দয়াপরবশ হয়ে আল্লাহর নিকটে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রার্থনা নিবেদন করেছেন। দয়ালু আল্লাহ তাঁর দো‘আ সমূহ কবুল করেছেন এবং বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে তাঁর বিশেষ রহমত সমূহ নাযিল করেছেন। তন্মধ্যে একটি হ’ল উন্মুক্ত তীহ্ প্রান্তরের উপরে শামিয়ানা সদৃশ মেঘমালার মাধ্যমে শান্তিদায়ক ছায়া প্রদান করা। যেমন আল্লাহ এই অকৃতজ্ঞ জাতিকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, ‘স্মরণ কর সে কথা, যখন আমরা তোমাদেরকে ছায়া দান করেছিলাম মেঘমালার মাধ্যমে’ (বাক্বারাহ, আয়াত ৫৭)।

 

২. ঝর্ণাধারার প্রবাহ :

 

ছায়ার পরেই গুরুত্বপূর্ণ বস্ত্ত হ’ল পানি। যার অপর নাম জীবন। পানি বিহনে তৃষ্ণার্ত পিপাসার্ত উম্মতের আহাজারিতে দয়া বিগলিত নবী মূসা স্বীয় প্রভুর নিকটে কাতর কণ্ঠে পানি প্রার্থনা করলেন। কুরআনের ভাষায়,

 

‘আর মূসা যখন স্বীয় জাতির জন্য পানি চাইল, তখন আমি বললাম, তোমার লাঠি দিয়ে পাথরের উপরে আঘাত কর। অতঃপর তা থেকে বেরিয়ে এলো (১২টি গোত্রের জন্য) ১২টি ঝর্ণাধারা। তাদের সব গোত্রই চিনে নিল (অর্থাৎ মূসার নির্দেশ অনুযায়ী নির্ধারণ করে নিল) নিজ নিজ ঘাট। (আমি বললাম,) তোমরা আল্লাহর দেওয়া রিযিক খাও আর পান কর। খবরদার যমীনে ফাসাদ সৃষ্টি করে বেড়িয়ো না’ (বাক্বারাহ, আয়াত ৬০)।

 

বস্ত্ততঃ ইহুদী জাতি তখন থেকে এযাবত পৃথিবী ব্যাপী ফাসাদ সৃষ্টি করেই চলেছে। তারা কখনোই আল্লাহর কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেনি।

 

৩. মান্না ও সালওয়া খাদ্য পরিবেশন :

 

মরুভূমির বুকে চাষবাসের সুযোগ নেই। নেই শস্য উৎপাদন ও বাইরে গিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ। কয়েকদিনের মধ্যেই মওজুদ খাদ্য শেষ হয়ে গেলে হাহাকার পড়ে গেল তাদের মধ্যে। নবী মূসা (আঃ) ফের দো‘আ করলেন আল্লাহর কাছে। এবার তাদের জন্য আসমান থেকে নেমে এলো জান্নাতী খাদ্য ‘মান্না ও সালওয়া’- যা পৃথিবীর আর কোন নবীর উম্মতের ভাগ্যে জুটেছে বলে জানা যায় না।

 

‘মান্না’ এক প্রকার খাদ্য, যা আল্লাহ তা‘আলা বনু ইস্রাঈলদের জন্য আসমান থেকে অবতীর্ণ করতেন। আর তা ছিল দুধের চেয়েও সাদা এবং মধুর চেয়েও মিষ্টি। আর ‘সালওয়া’ হচ্ছে আসমান থেকে আগত এক প্রকার পাখি।প্রথমটি দিয়ে রুটি ও দ্বিতীয়টি দিয়ে গোশতের অভাব মিটত। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘কামআহ হ’ল মান্ন-এর অন্তর্ভুক্ত’। এতে বুঝা যায় ‘মান্ন’ কয়েক প্রকারের ছিল। ইংরেজীতে ‘কামআহ’ অর্থ করা হয়েছে ‘মাশরূম’ (Mashroom)। আধুনিক গবেষণায় বলা হয়েছে যে, মান্ন একপ্রকার আঠা জাতীয় উপাদেয় খাদ্য। যা শুকিয়ে পিষে রুটি তৈরী করে তৃপ্তির সাথে আহার করা যায়। ‘সালওয়া’ একপ্রকার চড়ুই পাখি, যা ঐসময় সিনাই এলাকায় প্রচুর পাওয়া যেত। ব্যাঙের ছাতার মত সহজলভ্য ও কাই জাতীয় হওয়ায় সম্ভবত একে মাশরূম-এর সাথে তুলনীয় মনে করা হয়েছে। তবে মাশরূম ও ব্যাঙের ছাতা সম্পূর্ণ পৃথক জিনিস। কয়েক লাখ বনু ইস্রাঈল কয়েক বছর ধরে মান্না ও সালওয়া খেয়ে বেঁচে ছিল। এতে বুঝা যায় যে, মান্ন ছিল চাউল বা গমের মত কার্বো-হাইড্রেট-এর উৎস এবং সালওয়া বা চড়ুই জাতীয় পাখির গোশত ছিল ভিটামিন ও চর্বির উৎস। সব মিলে তারা পরিপূর্ণ খাবার নিয়মিত খেয়ে বেঁচে থাকতে সক্ষম হয়েছিল। দক্ষিণ ইউরোপের সিসিলিতে, আরব উপদ্বীপের ইরাকে ও ইরানে, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতবর্ষে মান্না জাতীয় খাদ্য উৎপন্ন হয়। অবাধ্য বনু ইস্রাঈলরা এগুলো সিরিয়ার তীহ্ প্রান্তরে ৪০ বছরের বন্দী জীবনে বিপুলভাবে পেয়েছিল আল্লাহর বিশেষ রহমতে। ঈসার সাথী হাওয়ারীগণ এটা চেয়েছিল (মায়েদাহ, আয়াত ১১২-১১৫)। কিন্তু পেয়েছিল কি-না, তা নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি।

 

দুনিয়ায় বসেই জান্নাতের খাবার, এ এক অকল্পনীয় অনির্বচনীয় আনন্দের বিষয়। কিন্তু এই হতভাগারা তাতেও খুব বেশীদিন খুশী থাকতে পারেনি। তারা গম, তরকারি, ডাল-পেঁয়াজ ইত্যাদি খাওয়ার জন্য পাগল হয়ে উঠলো। যেমন আল্লাহ বলেন,

 

 ‘... আমরা তোমাদের জন্য খাবার পাঠিয়েছি ‘মান্না’ ও ‘সালওয়া’। (আমরা বললাম) এসব পবিত্র বস্ত্ত তোমরা ভক্ষণ কর (কিন্তু ওরা শুনল না, কিছু দিনের মধ্যেই তা বাদ দেওয়ার জন্য ও অন্যান্য নিম্নমানের খাদ্য খাবার জন্য যিদ ধরলো)। বস্ত্ততঃ (এর ফলে) তারা আমার কোন ক্ষতি করতে পারেনি, বরং নিজেদেরই ক্ষতি সাধন করেছে’ (বাক্বারাহ, আয়াত ৫৭)।

 

আল্লাহ তাদের উদ্দেশ্যে বলেন,

 

 ‘যখন তোমরা বললে, হে মূসা! আমরা একই ধরনের খাদ্যের উপরে কখনোই ধৈর্য ধারণ করতে পারব না। কাজেই তুমি তোমার প্রভুর নিকটে আমাদের পক্ষে প্রার্থনা কর তিনি যেন আমাদের জন্য এমন খাদ্য-শস্য দান করেন, যা জমিতে উৎপন্ন হয়; যেমন তরি-তরকারি, কাকুড়, গম, রসুন, ডাল, পেঁয়াজ ইত্যাদি। মূসা বললেন, তোমরা উত্তম খাদ্যের বদলে এমন খাদ্য পেতে চাও যা নিম্নস্তরের? তাহ’লে তোমরা অন্য কোন শহরে চলে যাও। সেখানে তোমরা তোমাদের চাহিদা মোতাবেক সবকিছু পাবে’ (বাক্বারাহ, আয়াত ৬১)।

 

তওরাতের শব্দগত ও অর্থগত পরিবর্তন

 

ইহুদীরা তাদের এলাহী কিতাব তওরাতের শাব্দিক পরিবর্তন নবী মূসা (আঃ)-এর জীবদ্দশায় যেমন করেছিল, অর্থগত পরিবর্তনও তারা করেছিল। যেমন মূসা (আঃ) যখন তাদের ৭০ জন নেতাকে সাথে নিয়ে তূর পাহাড়ে গেলেন। অতঃপর আল্লাহর গযবে মৃত্যুবরণ করে পুনরায় তাঁর রহমতে জীবিত হয়ে ফিরে এল, তখনও এই গর্বিত জাতি তওরাত যে আল্লাহর নাযিলকৃত গ্রন্থ এ সাক্ষ্য দেওয়ার সাথে সাথে একথাও জুড়ে দিল যে, আল্লাহ তা‘আলা সবশেষে একথাও বলেছেন যে, তোমরা যতটুকু পার, আমল কর। আর যা না পার তা আমি ক্ষমা করে দিব’। অথচ এটা ছিল সম্পূর্ণ বানোয়াট কথা। তাদের এই মিথ্যা সাক্ষ্যের ফলে লোকেরা বলে দিল যে, তওরাতের বিধান সমূহ মেনে চলা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।

 

তখনই আল্লাহর হুকুমে ফেরেশতাগণ তূর পাহাড়ের একাংশ উপরে তুলে ধরে তাদের হুকুম দিলেন, হয় তোমরা তওরাত মেনে নাও, না হয় ধ্বংস হও। তখন নিরুপায় হয়ে তারা তওরাত মেনে নেয়। মূসা (আঃ)-এর মৃত্যুর পরেও তওরাত, যবূর ও ইঞ্জীল গ্রন্থগুলিতে তারা অসংখ্য শব্দগত ও অর্থগত পরিবর্তন ঘটিয়েছে। ফলে এই কিতাবগুলি আসল রূপে কোথাও আর পৃথিবীতে অবশিষ্ট নেই। ইহুদীদের তওরাত পরিবর্তনের ধরন ছিল তিনটি। এক. অর্থ ও মর্মগত পরিবর্তন, যা উপরে বর্ণিত হয়েছে। দুই. শব্দগত পরিবর্তন যেমন আল্লাহ বলেন, ‘ইহুদীদের মধ্যে একটা দল আছে, যারা আল্লাহর কালামকে (যেখানে শেষনবীর আগমন সংবাদ ও তাঁর গুণাবলী সম্বন্ধে বর্ণিত হয়েছে) তার স্বস্থান হ’তে পরিবর্তন করে দেয়’ (নিসা, আয়াত ৪৬ ; মায়েদাহ, আয়াত ১৩, ৪১)। এই পরিবর্তন তারা নিজেদের দুনিয়াবী স্বার্থে শাব্দিকভাবে এবং মর্মগতভাবে উভয়বিধ প্রকারে করত। ‘এভাবে তারা কখনো শব্দে, কখনো অর্থে এবং কখনো তেলাওয়াতে (মুখ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে) পরিবর্তন করত। পরিবর্তনের এ প্রকারগুলি কুরআন ও হাদীছে বর্ণিত হয়েছে। আজকাল পাশ্চাত্যের কিছু সংখ্যক খ্রীষ্টানও একথা কিছু কিছু স্বীকার করে’। আল্লাহর কিতাবের এইসব পরিবর্তন তাদের মধ্যকার আলেম ও যাজক শ্রেণীর লোকেরাই করত, সাধারণ মানুষ যাদেরকে অন্ধ ভক্তির চূড়ান্ত স্তরে পৌঁছে দিয়েছিল। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘ধ্বংস ঐসব লোকদের জন্য যারা নিজ হাতে কিতাব লিখে বলত, এটি আল্লাহর পক্ষ হ’তে অবতীর্ণ হয়েছে- যাতে এর বিনিময়ে তারা সামান্য অর্থ উপার্জন করতে পারে’ (বাক্বারাহ, আয়াত ৭৯)।

 

আল্লাহ বলেন, ‘এইসব লোকেরা মিথ্যা কথা শোনাতে এবং হারাম ভক্ষণে অভ্যস্ত’ (মায়েদাহ, আয়াত ৪২)। জনগণ তাদের কথাকেই সত্য ভাবত এবং এর বিপরীত কিছুই তারা শুনতে চাইত না। এভাবে তারা জনগণের রব-এর আসন দখল করেছিল। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘তারা তাদের আলেম ও দরবেশগণকে ‘রব’ হিসাবে গ্রহণ করেছিল আল্লাহ্কে বাদ দিয়ে’ (তওবাহ, আয়াত ৩১)। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, ‘তারা তাদেরকে সিজদা করতে বলত না বটে। কিন্তু মানুষকে তারা আল্লাহর অবাধ্যতামূলক কাজের নির্দেশ দিত এবং তারা তা মেনে নিত। সেকারণ আল্লাহ তাদেরকে ‘রব’ বলে আখ্যায়িত করেন’। খৃষ্টান পন্ডিত ‘আদী বিন হাতেম যখন বললেন যে,‘আমরা আমাদের আলেম-দরবেশদের পূজা করি না’। তখন তার জবাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘তারা কি আল্লাহকৃত হালালকে হারাম এবং হারামকে হালাল করে না? আর তোমরাও কি সেটা মেনে নাও না? ‘আদী বললেন, হাঁ। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ‘সেটাই তো ওদের ইবাদত হ’ল’।

 

মূসা ও খিযিরের কাহিনী

 

এ ঘটনাটি বনু ইস্রাঈলের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। বরং ঘটনাটি ব্যক্তিগতভাবে মূসা (আঃ)-এর সঙ্গে জড়িত। পিতা ইবরাহীম (আঃ) সহ বড় বড় নবী-রাসূলগণের জীবনে পদে পদে পরীক্ষা দিতে হয়েছে। মূসা (আঃ)-এর জীবনে এটাও ছিল অনুরূপ একটি পরীক্ষা। যে পরীক্ষায় জ্ঞানীদের জন্য শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ রয়েছে। আনুষঙ্গিক বিবরণ দৃষ্টে প্রতীয়মান হয় যে, ঘটনাটি তীহ্ প্রান্তরের উন্মুক্ত বন্দীশালায় থাকাকালীন সময়ে ঘটেছিল। ঘটনাটি নিম্নরূপ: ছহীহ বুখারী ও মুসলিমে হযরত উবাই বিন কা‘ব (রাঃ) প্রমুখাৎ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হ’তে বর্ণিত হাদীছ হ’তে এবং সূরা কাহফ ৬০ হ’তে ৮২ পর্যন্ত ২৩টি আয়াতে বর্ণিত বিবরণ থেকে যা জানা যায়, তার সংক্ষিপ্ত সার নিম্নে বিবৃত হ’ল।-

 

ঘটনার প্রেক্ষাপট

 

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, একদিন হযরত মূসা (আঃ) বনু ইস্রাঈলের এক সভায় ভাষণ দিচ্ছিলেন। এমন সময় জনৈক ব্যক্তি প্রশ্ন করল, লোকদের মধ্যে আপনার চেয়ে অধিক জ্ঞানী কেউ আছে কি? ঐ সময়ে যেহেতু মূসা ছিলেন শ্রেষ্ঠ নবী এবং তাঁর জানা মতে আর কেউ তাঁর চাইতে অধিক জ্ঞানী ছিলেন না, তাই তিনি সরলভাবে ‘না’ সূচক জবাব দেন। জবাবটি আল্লাহর পসন্দ হয়নি। কেননা এতে কিছুটা অহংকার প্রকাশ পেয়েছিল। ফলে আল্লাহ তাঁকে পরীক্ষায় ফেললেন। তাঁর উচিৎ ছিল একথা বলা যে, ‘আল্লাহই সর্বাধিক অবগত’। আল্লাহ তাঁকে বললেন, ‘হে মূসা! দুই সমুদ্রের সংযোগস্থলে অবস্থানকারী আমার এক বান্দা আছে, যে তোমার চেয়ে অধিক জ্ঞানী’। একথা শুনে মূসা (আঃ) প্রার্থনা করে বললেন, হে আল্লাহ! আমাকে ঠিকানা বলে দিন, যাতে আমি সেখানে গিয়ে জ্ঞান লাভ করতে পারি’। আল্লাহ বললেন, থলের মধ্যে একটি মাছ নিয়ে নাও এবং দুই সমুদ্রের সঙ্গমস্থলের (সম্ভবতঃ লোহিত সাগর ও ভূমধ্যসাগরের মিলনস্থল) দিকে সফরে বেরিয়ে পড়। যেখানে পৌঁছার পর মাছটি জীবিত হয়ে বেরিয়ে যাবে, সেখানেই আমার সেই বান্দার সাক্ষাৎ পাবে’। মূসা (আঃ) স্বীয় ভাগিনা ও শিষ্য (এবং পরবর্তীকালে নবী) ইউশা‘ বিন নূনকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। পথিমধ্যে এক স্থানে সাগরতীরে পাথরের উপর মাথা রেখে দু’জন ঘুমিয়ে পড়েন। হঠাৎ সাগরের ঢেউয়ের ছিটা মাছের গায়ে লাগে এবং মাছটি থলের মধ্যে জীবিত হয়ে নড়েচড়ে ওঠে ও থলে থেকে বেরিয়ে সাগরে গিয়ে পড়ে। ইউশা‘ ঘুম থেকে উঠে এই বিস্ময়কর দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেন। কিন্তু মূসা (আঃ) ঘুম থেকে উঠলে তাঁকে এই ঘটনা বলতে ভুলে গেলেন। অতঃপর তারা আবার পথ চলতে শুরু করলেন এবং একদিন একরাত চলার পর ক্লান্ত হয়ে এক স্থানে বিশ্রামের জন্য বসলেন। অতঃপর মূসা (আঃ) নাশতা দিতে বললেন। তখন তার মাছের কথা মনে পড়ল এবং ওযর পেশ করে আনুপূর্বিক সব ঘটনা মূসা (আঃ)-কে বললেন এবং বললেন যে, ‘শয়তানই আমাকে একথা ভুলিয়ে দিয়েছিল’ (কাহফ, ৬৩)। তখন মূসা (আঃ) বললেন, ঐ স্থানটিই তো ছিল আমাদের গন্তব্য স্থল। ফলে তাঁরা আবার সেপথে ফিরে চললেন। অতঃপর সেখানে পৌঁছে দেখতে পেলেন যে, একজন লোক আপাদ-মস্তক চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। মূসা (আঃ) তাকে সালাম করলেন। লোকটি মুখ বের করে বললেন, এদেশে সালাম? কে আপনি? বললেন, আমি বনু ইস্রাঈলের মূসা। আপনার কাছ থেকে ঐ জ্ঞান অর্জন করতে এসেছি, যা আল্লাহ আপনাকে বিশেষভাবে দান করেছেন’। খিযির বললেন, আপনি আমার সাথে ধৈর্য ধারণ করতে পারবেন না হে মূসা! আল্লাহ আমাকে যে জ্ঞান দান করেছেন, তা তিনি আপনাকে দেননি। পক্ষান্তরে আপনাকে তিনি যে জ্ঞান দান করেছেন, তা আমাকে দেননি’। মূসা বললেন, ‘আল্লাহ চাহেন তো আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন এবং আমি আপনার কোন আদেশ অমান্য করব না’ (কাহফ, ৬৯)। খিযির বললেন, ‘যদি আপনি আমার অনুসরণ করেনই, তবে কোন বিষয়ে আমাকে প্রশ্ন করবেন না, যে পর্যন্ত না আমি নিজে সে সম্পর্কে আপনাকে কিছু বলি’।

 

(১) অতঃপর তাঁরা চলতে লাগলেন। কিছু দূর গিয়ে নদী পার হওয়ার জন্য একটা নৌকা পেলেন। অতঃপর নৌকা থেকে নামার সময় তাতে ছিদ্র করে দিলেন। শারঈ বিধানের অধিকারী নবী মূসা বিষয়টিকে মেনে নিতে পারলেন না। কেননা বিনা দোষে অন্যের নৌকা ছিদ্র করে দেওয়া স্পষ্টভাবেই অন্যায়। তিনি বলেই ফেললেন, ‘নিশ্চয়ই আপনি একটা গুরুতর মন্দ কাজ করলেন’। তখন খিযির বললেন, আমি কি পূর্বেই বলিনি যে, ‘আপনি আমার সাথে ধৈর্য ধারণ করতে পারবেন না’। মূসা ক্ষমা চাইলেন। ইতিমধ্যে একটা কালো চড়ুই পাখি এসে নৌকার এক প্রান্তে বসল এবং সমুদ্র থেকে এক চঞ্চু পানি তুলে নিল। সে দিকে ইঙ্গিত করে খিযির মূসা (আঃ)-কে বললেন, ‘আমার ও আপনার এবং সমস্ত সৃষ্টিজগতের জ্ঞান মিলিতভাবে আল্লাহর জ্ঞানের মুকাবিলায় সমুদ্রের বুক থেকে পাখির চঞ্চুতে উঠানো এক ফোঁটা পানির সমতুল্য’। (২) তারপর তাঁরা সমুদ্রের তীর বেয়ে চলতে থাকলেন। কিছু দূর গিয়ে তাঁরা সাগরপাড়ে খেলায় রত একদল বালককে দেখলেন। খিযির তাদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর ও বুদ্ধিমান ছেলেটিকে ধরে এনে নিজ হাতে তাকে হত্যা করলেন। এ দৃশ্য দেখে মূসা আৎকে উঠে বললেন, একি! একটা নিষ্পাপ শিশুকে আপনি হত্যা করলেন? এ যে মস্তবড় গোনাহের কাজ’। খিযির বললেন, আমি তো পূর্বেই বলেছিলাম, আপনি ধৈর্য ধারণ করতে পারবেন না’। মূসা আবার ক্ষমা চাইলেন এবং বললেন, ‘এরপর যদি আমি কোন প্রশ্ন করি, তাহ’লে আপনি আমাকে আর সাথে রাখবেন না’ (কাহফ, ৭৫)।

 

(৩) ‘অতঃপর তারা চলতে লাগলেন। অবশেষে যখন একটি জনপদে পৌঁছলেন, তখন তাদের কাছে খাবার চাইলেন। কিন্তু তারা তাদের আতিথেয়তা করতে অস্বীকার করল। অতঃপর তারা সেখানে একটি পতনোন্মুখ প্রাচীর দেখতে পেয়ে সেটাকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে দিলেন। তখন মূসা বললেন, আপনি ইচ্ছা করলে তাদের কাছ থেকে এর বিনিময়ে পারিশ্রমিক নিতে পারতেন’। খিযির বললেন ‘এখানেই আমার ও আপনার মধ্যে সম্পর্কচ্ছেদ হ’ল। এখন যেসব বিষয়ে আপনি ধৈর্য ধারণ করতে পারেননি, আমি সেগুলির তাৎপর্য বলে দিচ্ছি’ (কাহফ, আয়াত ৭৮)।

 

তাৎপর্য সমূহ :

 

প্রথমতঃ নৌকা ছিদ্র করার বিষয়। সেটা ছিল কয়েকজন মিসকীন দরিদ্র ব্যক্তির। তারা এ দিয়ে সমুদ্রে জীবিকা অন্বেষণ করত। আমি সেটিকে ছিদ্র করে দিলাম এজন্য যে, ঐ অঞ্চলে ছিল এক যালেম বাদশাহ। সে বলপ্রয়োগে লোকদের নৌকা ছিনিয়ে নিত’। নিশ্চয়ই ছিদ্র নৌকা সে নিবে না। ফলে দরিদ্র লোকগুলি নৌকার সামান্য ত্রুটি সেরে নিয়ে পরে তাদের কাজে লাগাতে পারবে। দ্বিতীয়তঃ বালকটিকে হত্যার ব্যাপার। তার পিতা-মাতা ছিল ঈমানদার। আমি আশংকা করলাম যে, সে বড় হয়ে অবাধ্য হবে ও কাফের হবে। যা তার বাপ-মায়ের জন্য ফিৎনার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। তাই আমি চাইলাম যে, দয়ালু আল্লাহ তার পিতা-মাতাকে এর বদলে উত্তম সন্তান দান করুন, যে হবে সৎকর্মশীল ও বিশুদ্ধ চরিত্রের অধিকারী। যে তার পিতা-মাতাকে শান্তি দান করবে’। তৃতীয়তঃ পতনোন্মুখ প্রাচীর সোজা করে দেওয়ার ব্যাপার। উক্ত প্রাচীরের মালিক ছিল নগরীর দু’জন পিতৃহীন বালক। ঐ প্রাচীরের নীচে তাদের নেককার পিতার রক্ষিত গুপ্তধন ছিল। আল্লাহ চাইলেন যে, বালক দু’টি যুবক হওয়া পর্যন্ত প্রাচীরটি খাড়া থাক এবং তারা তাদের প্রাপ্য গুপ্তধন হস্তগত করুক। (খিযির বলেন,) ‘বস্ত্ততঃ আমি নিজ ইচ্ছায় এ সবের কিছুই করিনি’ (কাহফ, আয়াত ৮২)।

 

খিযির কে ছিলেন?

 

কুরআনে তাঁকে ‘আমাদের বান্দাদের একজন’ (কাহফ, আয়াত ৬৫) বলা হয়েছে। বুখারী শরীফে তাঁর নাম খিযির বলে উল্লেখ করা হয়েছে’। সেখানে তাঁকে নবী বলা হয়নি। জনশ্রুতি মতে তিনি একজন ওলী ছিলেন এবং মৃত্যু হয়ে গেলেও এখনও মানুষের বেশ ধরে যেকোন সময় যেকোন মানুষের উপকার করেন। ফলে জঙ্গলে ও সাগর বক্ষে বিপদাপদ থেকে বাঁচার জন্য আজও অনেকে খিযিরের অসীলা পাবার জন্য তার উদ্দেশ্যে মানত করে থাকে। এসব ধারণার প্রসার ঘটেছে মূলতঃ বড় বড় প্রাচীন মনীষীদের নামে বিভিন্ন তাফসীরের কেতাবে উল্লেখিত কিছু কিছু ভিত্তিহীন কল্পকথার উপরে ভিত্তি করে। যারা তাকে নবী বলেন, তাদের দাবীর ভিত্তি হ’ল, খিযিরের বক্তব্য ‘আমি এসব নিজের মতে করিনি’ (কাহফ, আয়াত ৮২)। অর্থাৎ সবকিছু আল্লাহর নির্দেশে করেছি। অলীগণের কাশ্ফ-ইলহাম শরী‘আতের দলীল নয়। কিন্তু নবীগণের স্বপ্নও আল্লাহর অহী হয়ে থাকে। যেজন্য ইবরাহীম (আঃ) স্বীয় পুত্রকে যবেহ করতে উদ্যত হয়েছিলেন। অতএব বালক হত্যার মত ঘটনা কেবলমাত্র নবীর পক্ষেই সম্ভব, কোন অলীর পক্ষে আদৌ নয়। কিন্তু সেখানেও প্রশ্ন থেকে যায় যে, নবী কখনো শরী‘আত বিরোধী কাজ করতে পারেন না। ঐ সময় শরী‘আতধারী নবী ও রাসূল ছিলেন হযরত মূসা (আঃ)। আর সে কারণেই খিযিরের শরী‘আত বিরোধী কাজ দেখে তিনি বারবার প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠেছিলেন। এ ব্যাপারে সবাই একমত যে, খিযির কোন কেতাবধারী রাসূল ছিলেন না, বা তাঁর কোন উম্মত ছিল না।

 

এখানে আমরা যদি বিষয়টিকে কুরআনের প্রকাশ্য অর্থের উপরে ছেড়ে দিই এবং তাঁকে ‘আল্লাহর একজন বান্দা’ হিসাবে গণ্য করি, যাঁকে আল্লাহর ভাষায় ‘আমরা আমাদের পক্ষ হ’তে বিশেষ রহমত দান করেছিলাম এবং আমাদের পক্ষ হ’তে দিয়েছিলাম এক বিশেষ জ্ঞান’ (কাহফ, আয়াত ৬৫)। তাহ’লে তিনি নবী ছিলেন কি অলী ছিলেন, তিনি এখনো বেঁচে আছেন, না মারা গেছেন, এসব বিতর্কের আর কোন অবকাশ থাকে না। যেভাবে মূসার মায়ের নিকটে আল্লাহ অহী (অর্থাৎ ইলহাম) করেছিলেন এবং যার ফলে তিনি তার সদ্য প্রসূত সন্তান মূসাকে বাক্সে ভরে সাগরে নিক্ষেপ করতে সাহসী হয়েছিলেন (ত্বোয়াহা, আয়াত ৩৮-৩৯) এবং যেভাবে জিব্রীল মানুষের রূপ ধরে এসে রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে ছাহাবীগণকে দ্বীনের প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন একই ধরনের ঘটনা মূসা ও খিযিরের ক্ষেত্রে হওয়াটাও বিস্ময়কর কিছু নয়।

 

মনে রাখা আবশ্যক যে, লোকমান অত্যন্ত উঁচুদরের একজন জ্ঞানী মানুষ ছিলেন। তাঁর জ্ঞানপূর্ণ উপদেশসমূহ কুরআনে বর্ণিত হয়েছে এবং তার নামে একটি সূরা নাযিল হয়েছে। কিন্তু তিনি নবী ছিলেন না। লোকমানকে আল্লাহ যেমন বিশেষ ‘হিকমত’ দান করেছিলেন (লোকমান, আয়াত ১২)। খিযিরকেও তেমনি বিশেষ ‘ইল্ম’ দান করেছিলেন (কাহফ, আয়াত ৬৫)। এটা বিচিত্র কিছু নয়।

 

আল কুরআনে হযরত মুসা (আঃ)

 

আল কুরআনে হযরত মুসা (আঃ) কে অনেক বড় মর্যাদাবান নবী বলে উলেখ করা হয়েছে। বর্ণনা করা হয়েছে তাঁর দীর্ঘ সংগ্রামের মর্মস্পর্শী ঘটনাবলী। আল কুরআনে হযরত মুসার নাম যতবেশী উল্লেখ করা হয়েছে আর কোন নবীর নাম এতো বেশী উল্লাখ করা হয়নি। আল কুরআনে হযরত মুসা (আঃ) এর নাম উল্লেখ হয়েছে ১৩৬ বার। হযরত মুসার সংগ্রামী জীবন বিস্তারিত জানতে পারবেন নিম্নোক্ত সুরাগুলো পড়লে – আল বাকারাঃ ৪০-১০২ আয়াত। আল আরাফঃ ১০৩-১৭১ আয়াত। ইউনুসঃ ৭৫-৯৩ আয়াত। আল কাহাফঃ ৬০-৮২ আয়াত। তোয়াহাঃ ৯-৯৮ আয়াত। শোয়ারা” ১০-৬৭ আয়াত। আল কাসাসঃ ৩-৪৭ আয়াত এবং ৭৬-৮৪ আয়াত। আল মুমিন/গাফিরঃ ২৩-৫৪ আয়াত।

 

হযরত মুসা (আঃ) এর এই জীবনী আল কুরআনের উল্লেখিত আয়াতের আলোকেই রচিত হয়েছে।

 

 

 

 

 

১৬।

 

হারুন (আঃ)

 

কি তাঁর পরিচয়?

 

নাম হারুন। তিনি আল্লাহর একজন রাসুল। মুসা কালিমুল্লাহ (আঃ) এর বড় ভাই। তিন বছরের বড় তিনি মুসার চেয়ে। আল্লাহ যখন মুসা (আঃ) কে রাসুল নিয়োগ করেন, তখন তিনি আল্লাহর কাছে দোয়া করেছিলেন তিনি যেনো তাঁর ভাই হারুনকেও রাসুল নিয়োগ করে তাঁর হাত শক্ত করেন। আল্লাহ তাঁর দোয়া কবুল করেন এবং হারুনকে মুসার সহযোগী রাসুল নিয়োগ করেন। হযরত হারুন ছিলেন বনী ইসরাইলদের শ্রেষ্ঠ রাসুলগনের একজন। তিনি ছিলেন সুবক্তা।

 

দাওয়াতী ও সাংগঠনিক জীবন

 

মহান আল্লাহ বলেন –

 

“আমি মূসা ও হারুনের প্রতি অনুগ্রহ করেছি। তাঁদের উভয়কে আমি উদ্ধার করেছি মহাকষ্ট থেকে। আমি তাঁদের সাহায্য করেছি। ফলে তারা বিজয়ী হয়েছে। তাঁদের আমি সঠিক পথ দেখিয়েছি। তাঁদের উভয়কে আমি সুস্পষ্ট কিতাব দান করেছি। পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তাঁদের উভয়ের সুনাম অক্ষুন্ন রেখেছি। মুসা ও হারুনের প্রতি বর্ষিত হোক সালাম। এভাবেই আমি উপকারী লোকদের প্রতিদান দিয়ে থাকি। আসলে ওরা দু’জনেই ছিলো আমার প্রতি বিশ্বস্ত দাস।” (সূরা আস সাফফাত, আয়াত ১১৪-১২২)

 

আল্লাহর এ বানী থেকে হযরত হারুনের সঠিক মর্যাদা বুঝা যায়। তিনি ভাই মুসার সাথে ফেরাউনের দরবারে উপস্থিত হন। ফেরাউনকে দাওয়াত প্রদান করেন। ফেরাউন তাঁদের দুজনকেই মিথ্যাবাদী বলে অস্বীকার করে। সে বলে, এরা দুই ভাই রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করার জন্যে এসেছে। অতপর ফেরাউন হযরত মুসা ও হারুন দুজনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে। অতপর মুসা ও হারুনের সাথে ফেরাউনের যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত হয়, তাঁর পরিনতিতে আল্লাহ ফেরাউনকে ধংস ও নির্মূল করে দেন। ফেরাউন ডুবে মরার পর সিনাই উপত্যকায় থাকাকালে হযরত মুসা হযরত হারুনকে নিজের খলিফা বা ভারপ্রাপ্ত নেতা মনোনীত করে চল্লিশ দিনের জন্যে তূর পাহাড়ে নির্জনবাসে যান। হযরত হারুন ভারপ্রাপ্ত নেতা থাকাকালেই সামেরি গ-বাছুর বানিয়ে সেটার পূজা করতে বলে সকলকে। হারুন তাঁকে বারন করেন। এ ব্যাপারে তিনি কঠোর পদক্ষেপ নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জাতি দ্বিধাবিভক্ত হবার উপক্রম হয়ে পড়ায় তিনি সেই পদক্ষেপ নেননি। হযরত মুসা চল্লিশ দিন পর তাওরাত নিয়ে ফেরত এসে হযরত হারুনের উপর ক্রোধান্বিত হন। এ ঘটনাটি কুরআনে এভাবে উল্লেখ করা হয়েছে –

 

“(গ-বাছুর পুজাকরতে নিষেধ করে) হারুন তাঁদের বলেছিলো, হে আমার জাতি তোমরা তো পরীক্ষায় পড়েছো। তোমাদের প্রভু বড় করুনাময়। কাজেই তোমরা আমার অনুসরন করো এবং আমার নির্দেশ মানো। কিন্তু তারা তাঁকে বলে দিলো মুসা ফিরে না আসা পর্যন্ত আমরা এর পূজা করবো। মুসা ফিরে এসে বললো- হে হারুন তুমি যখন দেখলে এরা পথভ্রষ্ট হয়ে যাচ্ছে, তখন এদেরকে আমার অনুসরনের পথে আনতে তোমাকে কিসে বাধা দিয়েছে? তুমি কি আমার হুকুম অমান্য করলে? হারুন বললো- হে আমার সহোদর ভাই, আমার দারি ও চুল ধরে টেনোনা। আমার ভয় হচ্ছিলো তুমি এসে বলবে- হারুন তুমি কেন বনী ইসরাইলদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করলে? কেন আমার কথা রক্ষা করোনি।” (সূরা তোয়াহা, আয়াত ৯০-৯৪)

 

অন্যস্থানে বলা হয়েছে-

 

“মুসা নিজের ভাইয়ের চুল ধরে টানলো। হারু বললো – হে আমার সহোদর, এই লোকগুলো আমায় কোণঠাসা করে ফেলেছিলো এবং আমাকে হত্যা করার জন্যে উদ্যত হয়েছিলো। কাজেই তুমি শত্রুদের কাছে আমায় হেয় করোনা এবং আমাকে যালিম গণ্য করোনা। তখন মুসা দোয়া করলো – হে প্রভু, আমাকে আর আমার ভাইকে ক্ষমা করে দাও। আর আমাদেরকে রবেশ করাও তোমার অনুগ্রহের মধ্যে। তুমিই তো সব দয়াবানের বড় দয়াবান।” (সূরা আল আরাফ, আয়াত ১৫০-১৫১)

 

এ থেকে বুঝা যায়, হযরত হারুন জীবনের ঝুকি নিয়েও নিজ কওমকে সত্য পথে পরিচালিত করার চেষ্টা করেছিলেন। তবে জাতির মধ্যে অনৈক্য ও বিভেদ সৃষ্টি হোক এটা তিনি চাননি। আসলে তিনি ছিলেন বড়ই প্রজ্ঞাবান ও মহান রাসুল।

 

হযরত মুসা (আঃ) এর মৃত্যুর এগারো মাস পূর্বে তিনি ইন্তেকাল করেন। ভাই মুসার মতই তিনি ছিলেন একজন বলিষ্ঠ সংগ্রামী পুরুষ। তারা দুই ভাই নেতৃত্ব প্রদান করেন এক বিশাল জাতির।

 

আল কুরআনে হযরত হারুন

 

আল কুরআনে হযরত হারুনের নাম ২০ বার উল্লেখ করা হয়েছে। যেসব স্থানে উল্লেখ হয়েছে, সেগুলো হলো –

 

আল বাকারা- ২৪৮। আন নিসা- ১৬৩। আল আনয়াম- ৮৪। আল আরাফ- ১২২, ১৪২। ইউনুস- ৭৫। মারিয়াম- ২৮, ৫৩। তোয়াহা- ৩০, ৭০, ৯০, ৯২। আল আম্বিয়া- ৪৮। আল মুমিনুন- ৪৫। আলফুরকান – ৩৫। আশ শুয়ারা- ১৩, ৪৮। আল কাসাস- ৩৪। আস সাফফাত- ১১৪, ১২০।

 

১৭।

 

সম্রাট নবী দাউদ

 

(আঃ)

 

দাউদ (আঃ) এর নাম তো আপনারা সবাই জানেন। মহান আল্লাহ তাঁকে দান করেছিলেন বিরাট মর্যাদা। তাঁকে অধিকারী করেছিলেন অনেক গুনাবলীর। তিনি ছিলেন একাধারে-

 

১। বিরাট উচ্চ মর্যাদার নবী।

 

২। তাঁর উপর নাযিল হয়েছিলো ‘যবুর’ কিতাব।

 

৩। তিনি ছিলেন অসীম সাহসী বীর সেনানী।

 

৪। তিনি ছিলেন এক বিরাট সাম্রাজ্যের সম্রাট।

 

৫। তিনি ছিলে একজন সফল বিজ্ঞানী ও আবিষ্কারক।

 

৬। ছিলেন মহাজ্ঞানী, ন্যায় বিচারক।

 

৭। তিনি ছিলেন মুমিনদের নেতা।

 

৮। ছিলেন আল্লাহর আইনের শাসক। শাসন পরিচালনা করতেন আল্লাহর অবতীর্ণ বিধানের ভিত্তিতে।

 

৯। তিনি ছিলেন আকর্ষণীয় সুবক্তা ও সুভাষী।

 

১০। পাখি ও পর্বত তাঁর সাথে আল্লাহর তসবিহতে মশগুল থাকতো।

 

১১। তিনি ছিলেন পরম জনদরদী, জনসেবক।

 

১২। মহান আল্লাহ প্রাকৃতিক জগতের অনেক কিছুকেই তাঁর অনুগত করে দিয়েছিলেন।

 

১৩। তিনি ছিলে পরম আল্লাহভীরু, আল্লাহওয়ালা।

 

১৪। তিনি ছিলে একজন নবীর পিতা। তাঁর পুত্র সুলাইমানকেও আল্লাহ নবুয়্যত দান করেছিলেন।

 

১৫। আল কুরআনে স্বয়ং আল্লাহ তাঁর উচ্চসিত প্রশংসা করেছেন।Powerd Bangladesh |

 

বিশেষ মর্যাদার অধিকারী হযরত দাঊদ

 

বিপুল শক্তি ও রাষ্ট্রক্ষমতার অধিকারী নবী ছিলেন মাত্র দু’জন। তাঁরা হ’লেন পিতা ও পুত্র দাঊদ ও সুলায়মান (আঃ)। বর্তমান ফিলিস্তীন সহ সমগ্র ইরাক ও শাম (সিরিয়া) এলাকায় তাঁদের রাজত্ব ছিল। পৃথিবীর অতুলনীয় ক্ষমতার অধিকারী হয়েও তাঁরা ছিলেন সর্বদা আল্লাহর প্রতি অনুগত ও সদা কৃতজ্ঞ। সে কারনে আল্লাহ তার শেষ নবীকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, ‘তারা যেসব কথা বলে তাতে তুমি ছবর কর এবং আমার শক্তিশালী বান্দা দাঊদকে স্মরণ কর। সে ছিল আমার প্রতি সদা প্রত্যাবর্তনশীল’ (ছোয়াদ, আয়াত ৩৮)। দাঊদ হলেন আল্লাহর একমাত্র বান্দা, যাকে খুশী হয়ে পিতা আদম স্বীয় বয়স থেকে ৪০ বছর কেটে তাকে দান করার জন্য আল্লাহর নিকটে সুফারিশ করেছিলেন এবং সেমতে দাঊদের বয়স ৬০ হ’তে ১০০ বছরে বৃদ্ধি পায়।

 

জালূত ও তালূতের কাহিনী এবং দাঊদের বীরত্ব

 

সাগরডুবি থেকে নাজাত পেয়ে মূসা ও হারূণ (আঃ) যখন বনু ইস্রাঈলদের নিয়ে শামে এলেন এবং শান্তিতে বসবাস করতে থাকলেন, তখন আল্লাহ তাদেরকে তাদের পিতৃভূমি ফিলিস্তীনে ফিরে যাবার আদেশ দিলেন এবং ফিলিস্তীন দখলকারী শক্তিশালী আমালেক্বাদের সঙ্গে জিহাদের নির্দেশ দিলেন। সাথে সাথে এ ওয়াদাও দিলেন যে, জিহাদে নামলেই তোমাদের বিজয় দান করা হবে (সূরা মায়েদা, আয়াত ২৩)। কিন্তু এই ভীতু ও জিহাদ বিমুখ বিলাসী জাতি তাদের নবী মূসাকে পরিষ্কার বলে দিল, ‘তুমি ও তোমার রব গিয়ে যুদ্ধ কর গে। আমরা এখানে বসে রইলাম’ (মায়েদা, আয়াত ২৪)। এতবড় বেআদবীর পরে মূসা (আঃ) তাদের ব্যাপারে নিরাশ হ’লেন এবং কিছু দিনের মধ্যেই দু’ভাই পরপর তিন বছরের ব্যবধানে মৃত্যু বরণ করলেন।

 

জিহাদের আদেশ অমান্য করার শাস্তি স্বরূপ মিসর ও শামের মধ্যবর্তী তীহ প্রান্তরে চল্লিশ বছর যাবত উন্মুক্ত কারাগারে অতিবাহিত করার পর মূসার শিষ্য ও ভাগিনা এবং পরবর্তীতে নবী ইউশা‘ বিন নূনের নেতৃত্বে জিহাদ সংঘটিত হয় এবং আমালেক্বাদের হটিয়ে তারা ফিলিস্তীন দখল করে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে তারা পুনরায় বিলাসিতায় গা ভাসিয়ে দেয় এবং নানাবিধ অনাচারে লিপ্ত হয়। তখন আল্লাহ তাদের উপরে পুনরায় আমালেক্বাদের চাপিয়ে দেন। বনু ইস্রাঈলরা আবার নিগৃহীত হ’তে থাকে। এভাবে বহু দিন কেটে যায়। এক সময় শ্যামুয়েল নবীর যুগ আসে। লোকেরা বলে আপনি আমাদের জন্য একজন সেনাপতি দানের জন্য আল্লাহর নিকট দো‘আ করুন, যাতে আমরা আমাদের পূর্বের ঐতিহ্য ফিরে পাই এবং বর্তমান দুর্দশা থেকে মুক্তি পাই। এই ঘটনা আল্লাহ তার শেষনবীকে শুনিয়েছেন নিম্নোক্ত ভাষায়-‘তুমি কি মূসার পরে বনু ইস্রাঈলদের একদল নেতাকে দেখনি, যখন তারা তাদের নবীকে বলেছিল, আমাদের জন্য একজন শাসক প্রেরণ করুন, যাতে আমরা (তার নেতৃত্বে) আল্লাহর পথে যুদ্ধ করতে পারি। নবী বললেন, তোমাদের প্রতি কি এমন ধারণা করা যায় যে, লড়াইয়ের নির্দেশ দিলে তোমরা লড়াই করবে? তারা বলল, আমাদের কি হয়েছে যে, আমরা আল্লাহর পথে লড়াই করব না? অথচ আমরা বিতাড়িত হয়েছি নিজেদের ঘর-বাড়ি ও সন্তান-সন্ততি হ’তে! অতঃপর যখন লড়াইয়ের নির্দেশ হ’ল তখন সামান্য কয়েকজন ছাড়া বাকীরা সবাই ফিরে গেল। বস্ত্ততঃ আল্লাহ যালেমদের ভাল করেই জানেন’ (বাক্বারাহ -২৪৬)। ঘটনাটি ছিল নিম্নরূপ:-

 

‘‘তাদের নবী তাদের বললেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তালূতকে তোমাদের জন্য শাসক নিযুক্ত করেছেন। তারা বলল, সেটা কেমন করে হয় যে, তার শাসন চলবে আমাদের উপরে। অথচ আমরাই শাসন ক্ষমতা পাওয়ার অধিক হকদার। তাছাড়া সে ধন-সম্পদের দিক দিয়েও সচ্ছল নয়। জওয়াবে নবী বললেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের উপরে তাকে মনোনীত করেছেন এবং স্বাস্থ্য ও জ্ঞানের দিক দিয়ে তাকে প্রাচুর্য দান করেছেন। বস্ত্ততঃ আল্লাহ যাকে ইচ্ছা রাজ্য দান করেন। তিনি হ’লেন প্রাচুর্য দানকারী ও সর্বজ্ঞ’। ‘নবী তাদেরকে বললেন, তালূতের নেতৃত্বের নিদর্শন এই যে, তোমাদের কাছে (তোমাদের কাংখিত) সিন্দুকটি আসবে তোমাদের প্রভুর পক্ষ হ’তে তোমাদের হৃদয়ের প্রশান্তি রূপে। আর তাতে থাকবে মূসা, হারূণ ও তাদের পরিবার বর্গের ব্যবহৃত কিছু পরিত্যক্ত সামগ্রী। সিন্দুকটিকে বহন করে আনবে ফেরেশতাগণ। এতেই তোমাদের (শাসকের) জন্য নিশ্চিত নিদর্শন রয়েছে, যদি তোমরা বিশ্বাসী হও’ (বাক্বারাহ, আয়াত, ২৪৭-২৪৮)। এক্ষণে যখন বনু ইস্রাঈলগণ পুনরায় জিহাদের সংকল্প করল, তখন আল্লাহ তাদেরকে উক্ত সিন্দুক ফিরিয়ে দিতে মনস্থ করলেন। অতঃপর এই সিন্দুকটির মাধ্যমে তাদের মধ্যেকার নেতৃত্ব নিয়ে ঝগড়ার নিরসন করেন। সিন্দুকটি তালূতের বাড়ীতে আগমনের ঘটনা এই যে, জালূতের নির্দেশে কাফেররা যেখানেই সিন্দুকটি রাখে, সেখানেই দেখা দেয় মহামারী ও অন্যান্য বিপদাপদ। এমনিভাবে তাদের পাঁচটি শহর ধ্বংস হয়ে যায়। অবশেষে অতিষ্ট হয়ে তারা একে তার প্রকৃত মালিকদের কাছে পাঠিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিল এবং গরুর গাড়ীতে উঠিয়ে হাঁকিয়ে দিল। তখন ফেরেশতাগণ আল্লাহর নির্দেশমতে গরুর গাড়ীটিকে তাড়িয়ে এনে তালূতের ঘরের সম্মুখে রেখে দিল। বনু ইস্রাঈলগণ এই দৃশ্য দেখে সবাই একবাক্যে তালূতের নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করল। অতঃপর তালূত আমালেক্বাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনার প্রস্ত্ততি শুরু করলেন।

 

সকল প্রস্ত্ততি সম্পন্ন হ’লে তিনি কথিত মতে ৮০ হাযার সেনাদল নিয়ে রওয়ানা হন। অল্প বয়ষ্ক তরুণ দাঊদ ছিলেন উক্ত সেনা দলের সদস্য। পথিমধ্যে সেনাপতি তালূত তাদের পরীক্ষা করতে চাইলেন। সম্মুখেই ছিল এক নদী। মৌসুম ছিল প্রচন্ড গরমের। পিপাসায় ছিল সবাই কাতর। এ বিষয়টি কুরআন বর্ণনা করেছে নিম্নরূপ: ‘অতঃপর তালূত যখন সৈন্যদল নিয়ে বের হ’ল, তখন সে বলল, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে পরীক্ষা করবেন একটি নদীর মাধ্যমে। যে ব্যক্তি সেই নদী হ’তে পান করবে, সে ব্যক্তি আমার দলভুক্ত নয়। আর যে ব্যক্তি স্বাদ গ্রহণ করবে না, সেই-ই আমার দলভুক্ত হবে। তবে হাতের এক আজলা মাত্র। অতঃপর সবাই সে পানি থেকে পান করল, সামান্য কয়েকজন ব্যতীত। পরে তালূত যখন নদী পার হ’ল এবং তার সঙ্গে ছিল মাত্র কয়েকজন ঈমানদার ব্যক্তি (তখন অধিক পানি পানকারী সংখ্যাগরিষ্ট) লোকেরা বলতে লাগল, আজকের দিনে জালূত ও তার সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধ করার শক্তি আমাদের নেই। (পক্ষান্তরে) যাদের বিশ্বাস ছিল যে, আল্লাহর সম্মুখে তাদের একদিন উপস্থিত হ’তেই হবে, তারা বলল, কত ছোট ছোট দল বিজয়ী হয়েছে বড় বড় দলের বিরুদ্ধে আল্লাহর হুকুমে। নিশ্চয়ই ধৈর্যশীলদের সাথে আল্লাহ থাকেন’ (বাক্বারাহ, আয়াত ২৪৯)।

 

বস্ত্ততঃ নদী পার হওয়া এই স্বল্প সংখ্যক ঈমানদারগণের সংখ্যা ছিল মাত্র ৩১৩ জন, যা শেষনবীর সাথে কাফেরদের বদর যুদ্ধকালে যুদ্ধরত ছাহাবীগণের সংখ্যার সাথে মিলে যায়। পানি পানকারী হাযারো সৈনিক নদী পারে আলস্যে ঘুমিয়ে পড়ল। অথচ পানি পান করা থেকে বিরত থাকা স্বল্প সংখ্যক ঈমানদার সাথী নিয়েই তালূত চললেন সেকালের সেরা সেনাপতি ও শৌর্য-বীর্যের প্রতীক আমালেক্বাদের বাদশাহ জালূতের বিরুদ্ধে। বস্ত্তবাদীগণের হিসাব মতে এটা ছিল নিতান্তই আত্মহননের শামিল। এই দলেই ছিলেন দাঊদ। আল্লাহ বলেন, ‘আর যখন তারা জালূত ও তার সেনাবাহিনীর সম্মুখীন হ’ল, তখন তারা বলল, হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদের ধৈর্য দান কর ও আমাদেরকে দৃঢ়পদ রাখ এবং আমাদেরকে তুমি কাফির সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সাহায্য কর’ (বাক্বারাহ, আয়াত ২৫০)। জালূত বিরাট সাজ-সজ্জা করে হাতীতে সওয়ার হয়ে সামনে এসে আস্ফালন করতে লাগল এবং সে যুগের যুদ্ধরীতি অনুযায়ী প্রতিপক্ষের সেরা যোদ্ধাকে আহবান করতে থাকল। অল্পবয়ষ্ক বালক দাঊদ নিজেকে সেনাপতি তালূতের সামনে পেশ করলেন। তালূত তাকে পাঠাতে রাযী হ’লেন না। কিন্তু দাঊদ নাছোড় বান্দা। অবশেষে তালূত তাকে নিজের তরবারি দিয়ে উৎসাহিত করলেন এবং আল্লাহর নামে জালূতের মোকাবিলায় প্রেরণ করলেন। বর্ণিত আছে যে, তিনি এ ঘোষণা আগেই দিয়েছিলেন যে, যে ব্যক্তি জালূতকে বধ করে ফিলিস্তীন পুনরুদ্ধার করতে পারবে, তাকে রাজ্য পরিচালনায় শরীক করা হবে। অস্ত্রে-শস্ত্রে সজ্জিত জালূতকে মারা খুবই কঠিন ছিল। কেননা তার সারা দেহ ছিল লৌহ বর্মে আচ্ছাদিত। তাই তরবারি বা বল্লম দিয়ে তাকে মারা অসম্ভব ছিল। আল্লাহর ইচ্ছায় দাঊদ ছিলেন পাথর ছোঁড়ায় উস্তাদ। সমবয়সীদের সাথে তিনি মাঠে গিয়ে নিশানা বরাবর পাথর মারায় দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। দাঊদ পকেট থেকে পাথর খন্ড বের করে হাতীর পিঠে বসা জালূতের চক্ষু বরাবর নিশানা করে এমন জোরে মারলেন যে, তাতেই জালূতের চোখশুদ্ধ মাথা ফেটে মগয বেরিয়ে চলে গেল। এভাবে জালূত মাটিতে লুটিয়ে পড়লে তার সৈন্যরা পালিয়ে গেল। যুদ্ধে তালূত বিজয় লাভ করলেন। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর তারা আল্লাহর হুকুমে তাদেরকে পরাজিত করল এবং দাঊদ জালূতকে হত্যা করল। আর আল্লাহ দাঊদকে দান করলেন রাজ্য ও দূরদর্শিতা এবং তাকে শিক্ষা দান করলেন, যা তিনি চাইলেন। বস্ত্ততঃ আল্লাহ যদি এভাবে একজনকে অপরজনের দ্বারা প্রতিহত না করতেন, তাহ’লে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যেত। কিন্তু আল্লাহ বিশ্ববাসীর প্রতি একান্তই দয়াশীল’ (বাক্বারাহ, আয়াত ২৫১)।

 

দাঊদ (আঃ)-এর জীবনের স্মরণীয় ঘটনাবলী

 

(১) ছাগপাল ও শস্যক্ষেতের মালিকের বিচার: একদা দু’জন লোক হযরত দাঊদের নিকটে একটি বিষয়ে মীমাংসার জন্য আসে। তাদের একজন ছিল ছাগপালের মালিক এবং অন্যজন ছিল শস্য ক্ষেতের মালিক। শস্যক্ষেতের মালিক ছাগপালের মালিকের নিকট দাবী পেশ করল যে, তার ছাগপাল রাত্রিকালে আমার শস্যক্ষেতে চড়াও হয়ে সম্পূর্ণ ফসল বিনষ্ট করে দিয়েছে। আমি এর প্রতিকার চাই। সম্ভবতঃ শস্যের মূল্য ও ছাগলের মূল্যের হিসাব সমান বিবেচনা করে হযরত দাঊদ (আঃ) শস্যক্ষেতের মালিককে তার বিনষ্ট ফসলের বিনিময় মূল্য হিসাবে পুরা ছাগপাল শস্যক্ষেতের মালিককে দিয়ে দিতে বললেন। বাদী ও বিবাদী উভয়ে বাদশাহ দাঊদ-এর আদালত থেকে বেরিয়ে আসার সময় দরজার মুখে পুত্র সুলায়মানের সাথে দেখা হয়। তিনি মোকদ্দমার রায় সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তারা সব খুলে বলল। তিনি পিতা দাঊদের কাছে গিয়ে বললেন, আমি রায় দিলে তা ভিন্নরূপ হ’ত এবং উভয়ের জন্য কল্যাণকর হ’ত’। অতঃপর পিতার নির্দেশে তিনি বললেন, ছাগপাল শস্যক্ষেতের মালিককে সাময়িকভাবে দিয়ে দেওয়া হউক। সে এগুলোর দুধ, পশম ইত্যাদি দ্বারা উপকার লাভ করুক। পক্ষান্তরে শস্যক্ষেতটি ছাগপালের মালিককে অর্পণ করা হউক। সে তাতে শস্য উৎপাদন করুক। অতঃপর শস্যক্ষেত্র যখন ছাগপালে বিনষ্ট করার পূর্বের অবস্থায় পৌঁছে যাবে, তখন তা ক্ষেতের মালিককে ফিরিয়ে দেওয়া হবে এবং ছাগপাল তার মালিককে ফেরৎ দেওয়া হবে’। হযরত দাঊদ (আঃ) রায়টি অধিক উত্তম গণ্য করে সেটাকেই কার্যকর করার নির্দেশ দেন। এই ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত করে আল্লাহ বলেন, ‘আর স্মরণ কর দাঊদ ও সুলায়মানকে, যখন তারা একটি শস্যক্ষেত সম্পর্কে বিচার করেছিল, যাতে রাত্রিকালে কারু মেষপাল ঢুকে পড়েছিল। আর তাদের বিচারকার্য আমাদের সম্মুখেই হচ্ছিল’। ‘অতঃপর আমরা সুলায়মানকে মোকদ্দমাটির ফায়ছালা বুঝিয়ে দিলাম এবং আমরা উভয়কে প্রজ্ঞা ও জ্ঞান দান করেছিলাম’ (আম্বিয়া, আয়াত ৭৮-৭৯)।

 

 (২) ইবাদত খানায় প্রবেশকারী বাদী-বিবাদীর বিচার: হযরত দাঊদ (আঃ) যেকোন ঘটনায় যদি বুঝতেন যে, এটি আল্লাহর তরফ থেকে পরীক্ষা, তাহ’লে তিনি সাথে সাথে আল্লাহর দিকে রুজু হ’তেন ও ক্ষমা প্রার্থনায় রত হ’তেন। এরই একটি উদাহরণ বর্ণিত হয়েছে নিম্নোক্ত আয়াতগুলিতে। যেমন আল্লাহ বলেন,

 

 ‘আপনার কাছে কি সেই বাদী-বিবাদীর খবর পৌঁছেছে, যখন তারা পাঁচিল টপকিয়ে দাঊদের ইবাদতখানায় ঢুকে পড়েছিল’? (ছোয়াদ ২১) ‘যখন তারা দাঊদের কাছে অনুপ্রবেশ করল এবং দাঊদ তাদের থেকে ভীত হয়ে পড়ল, তখন তারা বলল, আপনি ভয় পাবেন না, আমরা দু’জন বিবদমান পক্ষ। আমরা একে অপরের প্রতি বাড়াবাড়ি করেছি। অতএব আমাদের মধ্যে ন্যায় বিচার করুন, অবিচার করবেন না। আমাদেরকে সরল পথ প্রদর্শন করুন’। ‘(বিষয়টি এই যে,) সে আমার ভাই। সে ৯৯টি দুম্বার মালিক আর আমি মাত্র একটি মাদী দুম্বার মালিক। এরপরও সে বলে যে, এটি আমাকে দিয়ে দাও। সে আমার উপরে কঠোর ভাষা প্রয়োগ করে’। ‘দাঊদ বলল, সে তোমার দুম্বাটিকে নিজের দুম্বাগুলির সাথে যুক্ত করার দাবী করে তোমার প্রতি অবিচার করেছে। শরীকদের অনেকে একে অপরের প্রতি বাড়াবাড়ি করে থাকে, কেবল তারা ব্যতীত, যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে। অবশ্য এরূপ লোকের সংখ্যা কম। (অত্র ঘটনায়) দাঊদ ধারণা করল যে, আমরা তাকে পরীক্ষা করছি। অতঃপর সে তার পালনকর্তার নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা করল এবং সিজদায় লুটিয়ে পড়ল ও আমার দিকে প্রণত হ’ল’। অতঃপর আমরা তাকে ক্ষমা করে দিলাম। নিশ্চয়ই তার জন্য আমাদের নিকটে রয়েছে নৈকট্য ও সুন্দর প্রত্যাবর্তন স্থল’ (ছোয়াদ, আয়াত ২১-২৫)।

 

 (৩) শনিবার ওয়ালাদের পরিণতি: বনু ইস্রাঈলদের জন্য শনিবার ছিল সাপ্তাহিক ছুটির দিন এবং ইবাদতের জন্য নির্দিষ্ট ও পবিত্র দিন। এ দিন তাদের জন্য মৎস্য শিকার নিষিদ্ধ ছিল। তারা সমুদ্রোপকুলের বাসিন্দা ছিল এবং মৎস্য শিকার ছিল তাদের পেশা। ফলে দাঊদ (আঃ)-এর নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেই তারা ঐদিন মৎস্য শিকার করতে থাকে। এতে তাদের উপরে আল্লাহর পক্ষ হ’তে ‘মস্খ’ বা আকৃতি পরিবর্তনের শাস্তি নেমে আসে এবং তিনদিনের মধ্যেই তারা সবাই মৃত্যু মুখে পতিত হয়। ঘটনাটি পবিত্র কুরআনে নিম্নরূপে বর্ণিত হয়েছে। যেমন আল্লাহ মদীনার ইহুদীদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আর তোমরা তো তাদেরকে ভালভাবে জানো, যারা শনিবারের ব্যাপারে সীমা লংঘন করেছিল। আমরা তাদের বলেছিলাম, তোমরা নিকৃষ্ট বানর হয়ে যাও’। ‘অতঃপর আমরা এ ঘটনাকে তাদের সমসাময়িক ও পরবর্তীদের জন্য দৃষ্টান্ত হিসাবে এবং আল্লাহভীরুদের জন্য উপদেশ হিসাবে রেখে দিলাম’ (বাক্বারাহ, আয়াত ৬৫-৬৬)।

 

উক্ত বিষয়ে সূরা আ‘রাফের ১৬৪-৬৫ আয়াতের বর্ণনায় প্রতীয়মান হয় যে, সেখানে তৃতীয় আরেকটি দল ছিল, যারা উপদেশ দানকারীদের উপদেশ দানে বিরত রাখার চেষ্টা করত। বাহ্যতঃ এরা ছিল শান্তিবাদী এবং অলস ও সুবিধাবাদী। এরাও ফাসেকদের সাথে শূকর-বানরে পরিণত হয় ও ধ্বংস হয়ে যায়। যেমন আল্লাহ বলেন,

 

 ‘আর যখন তাদের মধ্যকার একদল বলল, কেন আপনারা ঐ লোকদের উপদেশ দিচ্ছেন, যাদেরকে আল্লাহ ধ্বংস করে দিতে চান কিংবা তাদের আযাব দিতে চান কঠিন আযাব? ঈমানদারগণ বলল, তোমাদের পালনকর্তার নিকট ওযর পেশ করার জন্য এবং এজন্য যাতে ওরা সতর্ক হয়’। ‘অতঃপর তারা যখন উপদেশ ভুলে গেল, যা তাদেরকে দেওয়া হয়েছিল, তখন আমরা সেসব লোকদের মুক্তি দিলাম, যারা মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করত এবং পাকড়াও করলাম যালেমদেরকে নিকৃষ্ট আযাবের মাধ্যমে তাদের পাপাচারের কারণে’ (আ‘রাফ, আয়াত ১৬৪-৬৫)।

 

তালূতের পরে বনু ইস্রাঈলগণের অবস্থা ক্রমেই শোচনীয় পর্যায়ে চলে যায়। যালেম বাদশাহদের দ্বারা তারা শাম দেশ হ’তে বিতাড়িত হয়। বিশেষ করে পারস্যরাজ বুখতানছর যখন তাদেরকে শাম থেকে বহিষ্কার করলেন, তখন তাদের একদল হেজাযে গিয়ে বসবাসের সিদ্ধান্ত নিল। এই উদ্দেশ্যে যে, আমরা দাঊদ ও সুলায়মানের নির্মিত বায়তুল মুক্বাদ্দাস হারিয়েছি। ফলে এক্ষণে আমরা আমাদের পূর্বপুরুষ ইবরাহীম-ইসমাঈলের নির্মিত কা‘বা গৃহের উদ্দেশ্যে যাত্রা করি। যাতে আমরা বা আমাদের বংশধররা শেষনবীর সাক্ষাৎ লাভে ধন্য হয়। সেমতে তারা আরবে হিজরত করে এবং ইয়াছরিবে বসবাস শুরু করে।

 

দাঊদ (আঃ)-এর জীবনীতে শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ

 

১. নেতৃত্বের জন্য প্রয়োজন স্বাস্থ্যবান ও আমানতদার হওয়া। আরও প্রয়োজন প্রজ্ঞা, ন্যায়নিষ্ঠা ও উন্নতমানের বাগ্মিতা। যার সব কয়টি গুণ হযরত দাঊদ (আঃ)-এর মধ্যে সর্বাধিক পরিমাণে ছিল।

 

২. এলাহী বিধান দ্বীন ও দুনিয়া দু’টিকেই নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করে। বরং দ্বীনদার শাসকের হাতেই দুনিয়া শান্তিময় ও নিরাপদ থাকে। হযরত দাঊদ-এর শাসনকাল তার জাজ্জ্বল্যমান প্রমাণ।

 

৩. দ্বীনদার শাসককে আল্লাহ বারবার পরীক্ষা করেন। যাতে তার দ্বীনদারী অক্ষুণ্ণ থাকে। দাঊদ (আঃ) সে পরীক্ষা দিয়েছেন এবং উত্তীর্ণ হয়েছেন। বস্ত্ততঃ তিনি ছিলেন আল্লাহর দিকে সদা প্রত্যাবর্তনশীল।

 

৪. যে শাসক যত বেশী আল্লাহর শুকরগুযারী করেন, আল্লাহ তার প্রতি তত বেশী সদয় হন এবং ঐ রাজ্যে শান্তি ও সমৃদ্ধি নাযিল করেন। বস্ত্ততঃ দাঊদ (আঃ) সর্বাধিক ইবাদতগুযার ছিলেন এবং একদিন অন্তর একদিন ছিয়াম পালন করতেন।

 

৫. যে শাসক আল্লাহর প্রতি অনুগত হন, আল্লাহ দুনিয়ার সকল সৃষ্টিকে তার প্রতি অনুগত করে দেন। যেমন দাঊদ (আঃ)-এর জন্য পাহাড়-পর্বত, পক্ষীকুল এবং লোহাকে অনুগত করে দেওয়া হয়েছিল।

 

কুরআনে উল্লেখ

 

আল কুরআনে হযরত দাউদ (আঃ) এর নাম উল্লেখ হয়েছে ১৬ বার। কোথায় কোথায় উল্লেখ হয়েছে তা আপনাদের বলে দিচ্ছি – সূরা আল বাকারা ; ২৫১। আন নিসা ; ২৬৩। আল মায়িদা ; ৭৮। আল আনয়াম ; ৮৪। বনি ইসরাইল ; ৫৫। আল আম্বিয়া ; ৭৮, ৭৯। আন নামল ; ১৫, ১৬। সাবা ; ১০, ১৩। সোয়াদ ; ১৭, ২২, ২৪, ২৬, ৩০।

 

১৮।

 

বিশ্বের অনন্য সম্রাট সুলাইমান

 

(আঃ)

 

হযরত দাঊদ (আঃ)-এর মৃত্যুর পর সুযোগ্য পুত্র সুলায়মান তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর আবির্ভাবের ন্যূনাধিক দেড় হাযার বছর পূর্বে তিনি নবী হন। সুলায়মান ছিলেন পিতার ১৯জন পুত্রের অন্যতম। আল্লাহ পাক তাকে জ্ঞানে, প্রজ্ঞায় ও নবুঅতের সম্পদে সমৃদ্ধ করেন। এছাড়াও তাঁকে এমন কিছু নে‘মত দান করেন, যা অন্য কোন নবীকে দান করেননি। ইমাম বাগাভী ইতিহাসবিদগণের বরাতে বলেন, সুলায়মান (আঃ)-এর মোট বয়স হয়েছিল ৫৩ বছর। তের বছর বয়সে রাজকার্য হাতে নেন এবং শাসনের চতুর্থ বছরে বায়তুল মুক্বাদ্দাসের নির্মাণ কাজ শুরু করেন। তিনি ৪০ বছর কাল রাজত্ব করেন। তবে তিনি কত বছর বয়সে নবী হয়েছিলেন সে বিষয়ে কিছু জানা যায় না। শাম ও ইরাক অঞ্চলে পিতার রেখে যাওয়া রাজ্যের তিনি বাদশাহ ছিলেন। তাঁর রাজ্য তৎকালীন বিশ্বের সবচেয়ে সুখী ও শক্তিশালী রাজ্য ছিল। কুরআনে তাঁর সম্পর্কে ৭টি সূরায় ৫১টি আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। আমরা সেগুলিকে একত্রিত করে কাহিনীরূপে পেশ করার চেষ্টা পাব ইনশাআল্লাহ।

 

বাল্যকালে সুলায়মান

 

(১) আল্লাহ পাক সুলায়মানকে তার বাল্যকালেই গভীর প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টি দান করেছিলেন। ছাগপালের মালিক ও শস্যক্ষেতের মালিকের মধ্যে পিতা হযরত দাঊদ (আঃ) যেভাবে বিরোধ মীমাংসা করেছিলেন, বালক সুলায়মান তার চাইতে উত্তম ফায়ছালা পেশ করেছিলেন। ফলে হযরত দাঊদ (আঃ) নিজের পূর্বের রায় বাতিল করে পুত্রের দেওয়া প্রস্তাব গ্রহণ করেন ও সে মোতাবেক রায় দান করেন। উক্ত ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত করে আল্লাহ বলেন, ‘‘আর স্মরণ কর দাঊদ ও সুলায়মানকে, যখন তারা একটি শস্যক্ষেত সম্পর্কে বিচার করছিল, যাতে রাত্রিকালে কারু মেষপাল ঢুকে পড়েছিল। আর তাদের বিচারকার্য আমাদের সম্মুখেই হচ্ছিল’। ‘অতঃপর আমরা সুলায়মানকে মোকদ্দমাটির ফায়ছালা বুঝিয়ে দিলাম এবং আমরা উভয়কে প্রজ্ঞা ও জ্ঞান দান করেছিলাম’’ (আম্বিয়া, আয়াত ৭৮-৭৯)।

 

ছোটবেলা থেকেই জ্ঞান ও প্রজ্ঞায় ভূষিত সুলায়মানকে পরবর্তীতে যথার্থভাবেই পিতার সিংহাসনের উত্তরাধিকারী করা হয়। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘‘সুলায়মান দাঊদের উত্তরাধিকারী হয়েছিলেন’ (নমল, আয়াত ১৬)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, ‘‘আমরা দাঊদের জন্য সুলায়মানকে দান ‘করেছিলাম। কতই না সুন্দর বান্দা সে এবং সে ছিল (আমার প্রতি) সদা প্রত্যাবর্তনশীল’’ (ছোয়াদ, আয়াত ৩০)।

 

(২) আরেকটি ঘটনা হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, যা নিম্নরূপ: ‘দু’জন মহিলার দু’টি বাচ্চা ছিল। একদিন নেকড়ে বাঘ এসে একটি বাচ্চাকে নিয়ে যায়। তখন প্রত্যেকে বলল যে, তোমার বাচ্চা নিয়ে গেছে। যেটি আছে ওটি আমার বাচ্চা। বিষয়টি ফায়ছালার জন্য দুই মহিলা খলীফা দাঊদের কাছে এলো। তিনি বয়োজ্যেষ্ঠ মহিলার পক্ষে রায় দিলেন। তখন তারা বেরিয়ে সুলায়মানের কাছে এলো এবং সবকথা খুলে বলল। সুলায়মান তখন একটি ছুরি আনতে বললেন এবং বাচ্চাটাকে দু’টুকরা করে দু’মহিলাকে দিতে চাইলেন। তখন বয়োকনিষ্ঠ মহিলাটি বলল, ইয়ারহামুকাল্লাহু ‘আল্লাহ আপনাকে অনুগ্রহ করুন’ বাচ্চাটি ঐ মহিলার। তখন সুলায়মান কনিষ্ঠ মহিলার পক্ষে রায় দিলেন’।

 

সুলায়মানের বৈশিষ্ট্য সমূহ :

 

দাঊদ (আঃ)-এর ন্যায় সুলায়ামন (আঃ)-কেও আল্লাহ বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য দান করেছিলেন, যা আর কাউকে দান করেননি। যেমন: (১) বায়ু প্রবাহ অনুগত হওয়া (২) তামাকে তরল ধাতুতে পরিণত করা (৩) জিনকে অধীনস্ত করা (৪) পক্ষীকূলকে অনুগত করা (৫) পিপীলিকার ভাষা বুঝা (৬) অতুলনীয় সাম্রাজ্য দান করা (৭) প্রাপ্ত অনুগ্রহ রাজির হিসাব না রাখার অনুমতি পাওয়া। নিম্নে বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হ’ল:

 

১. বায়ু প্রবাহকে তাঁর অনুগত করে দেওয়া হয়েছিল। তাঁর হুকুম মত বায়ু তাঁকে তাঁর ইচ্ছামত স্থানে বহন করে নিয়ে যেত। তিনি সদলবলে বায়ুর পিঠে নিজ সিংহাসনে সওয়ার হয়ে দু’মাসের পথ একদিনে পৌঁছে যেতেন। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘এবং আমরা সুলায়মানের অধীন করে দিয়েছিলাম বায়ুকে, যা সকালে এক মাসের পথ ও বিকালে এক মাসের পথ অতিক্রম করত...’ (সাবা, আয়াত ১২)।

 

আল্লাহ বলেন,

 

 ‘‘আর আমরা সুলায়মানের অধীন করে দিয়েছিলাম প্রবল বায়ুকে। যা তার আদেশে প্রবাহিত হ’ত ঐ দেশের দিকে, যেখানে আমরা কল্যাণ রেখেছি। আর আমরা সকল বিষয়ে সম্যক অবগত রয়েছি’ (আম্বিয়া, আয়াত ৮১)। অন্যত্র আল্লাহ উক্ত বায়ুকে رُخَاء বলেছেন (ছোয়াদ, আয়াত ৩৬)। যার অর্থ মৃদু বায়ু, যা শূন্যে তরঙ্গ-সংঘাত সৃষ্টি করে না। عَاصِفَةٌ ও رُخَاء দু’টি বিশেষণের সমন্বয় এভাবে হ’তে পারে যে, কোনরূপ তরঙ্গ সংঘাত সৃষ্টি না করে তীব্র বেগে বায়ু প্রবাহিত হওয়াটা ছিল আল্লাহর বিশেষ রহমত এবং সুলায়মানের অন্যতম মু‘জেযা।

 

২. তামার ন্যায় শক্ত পদার্থকে আল্লাহ সুলায়মানের জন্য তরল ধাতুতে পরিণত করেছিলেন। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘আমরা তার জন্য গলিত তামার একটি ঝরণা প্রবাহিত করেছিলাম...’ (সাবা, আয়াত ১২)। এর দ্বারা বুঝা যায় যে, ঐ গলিত ধাতু উত্তপ্ত ছিল না। বরং তা দিয়ে অতি সহজে পাত্রাদি তৈরী করা যেত। সুলায়মানের পর থেকেই তামা গলিয়ে পাত্রাদি তৈরী করা শুরু হয় বলে কুরতুবী বর্ণনা করেছেন। পিতা দাঊদের জন্য ছিল লোহা গলানোর মু‘জেযা এবং পুত্র সুলায়মানের জন্য ছিল তামা গলানোর মু‘জেযা। আর এজন্যেই আয়াতের শেষে আল্লাহ বলেন, ‘‘হে দাঊদ পরিবার! কৃতজ্ঞতা সহকারে তোমরা কাজ করে যাও। বস্ত্ততঃ আমার বান্দাদের মধ্যে অল্প সংখ্যকই কৃতজ্ঞ’’ (সাবা, আয়াত ১৩)।

 

দুটি সূক্ষ্মতত্ত্ব :

 

(ক) দাঊদ (আঃ)-এর জন্য আল্লাহ তা‘আলা সর্বাধিক শক্ত ও ঘন পদার্থ লোহাকে নরম ও সুউচ্চ পর্বতমালাকে অনুগত করে দিয়েছিলেন। পক্ষান্তরে সুলায়মান (আঃ)-এর জন্য আল্লাহ শক্ত তামাকে গলানো এবং বায়ু, জিন ইত্যাদি এমন সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বস্ত্তকে অনুগত করে দিয়েছিলেন, যা চোখেও দেখা যায় না। এর দ্বারা বুঝানো হয়েছে যে, আল্লাহর শক্তি বড়-ছোট সবকিছুর মধ্যে পরিব্যাপ্ত।

 

(খ) এখানে আরেকটি বিষয়ে ইঙ্গিত রয়েছে যে, আল্লাহর তাক্বওয়াশীল অনুগত বান্দারা আল্লাহর হুকুমে বিশ্বচরাচরের সকল সৃষ্টির উপরে আধিপত্য করতে পারে এবং সবকিছুকে বশীভূত করে তা থেকে খিদমত নিতে পারে।

 

৩. জিনকে তাঁর অধীন করে দিয়েছিলেন। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘আর জিনের মধ্যে কিছুসংখ্যক তার (সুলায়মানের) সম্মুখে কাজ করত তার পালনকর্তার (আল্লাহর) আদেশে...’ (সাবা, আয়াত ১২)।

 

অন্যত্র আল্লাহ বলেন, ‘এবং আমরা তার অধীন করে দিয়েছিলাম শয়তানদের কতককে, যারা তার জন্য ডুবুরীর কাজ করত এবং এছাড়া অন্য আরও কাজ করত। আমরা তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতাম’ (আম্বিয়া, আয়াত ৮২)।

 

অন্যত্র বলা হয়েছে,

 

 ‘‘আর সকল শয়তানকে তার অধীন করে দিলাম, যারা ছিল প্রাসাদ নির্মাণকারী ও ডুবুরী’। ‘এবং অন্য আরও অনেককে অধীন করে দিলাম, যারা আবদ্ধ থাকত শৃংখলে’’ (ছোয়াদ, আয়াত ৩৭-৩৮)।

 

বস্ত্ততঃ জিনেরা সাগরে ডুব দিয়ে তলদেশ থেকে মূল্যবান মণি-মুক্তা, হীরা-জহরত তুলে আনত এবং সুলায়মানের হুকুমে নির্মাণ কাজ সহ যেকোন কাজ করার জন্য সদা প্রস্ত্তত থাকত। ঈমানদার জিনেরা তো ছওয়াবের নিয়তে স্বেচ্ছায় আনুগত্য করত। কিন্তু দুষ্ট জিনগুলো বেড়ীবদ্ধ অবস্থায় সুলায়মানের ভয়ে কাজ করত। এই অদৃশ্য শৃংখল কেমন ছিল, তা কল্পনা করার দরকার নেই। আদেশ পালনে সদাপ্রস্ত্তত থাকাটাও এক প্রকার শৃংখলবদ্ধ থাকা বৈ কি!

 

‘শয়তান’ হচ্ছে আগুন দ্বারা সৃষ্ট বুদ্ধি ও চেতনা সম্পন্ন এক প্রকার সূক্ষ্ম দেহধারী জীব। জিনের মধ্যকার অবাধ্য ও কাফির জিনগুলিকেই মূলতঃ ‘শয়তান’ নামে অভিহিত করা হয়। আয়াতে ‘শৃংখলবদ্ধ’ কথাটি এদের জন্যেই বলা হয়েছে। আল্লাহর নিয়ন্ত্রণে থাকায় এরা সুলায়মানের কোন ক্ষতি করতে পারত না। বরং সর্বদা তাঁর হুকুম পালনের জন্য প্রস্ত্তত থাকত। তাদের বিভিন্ন কাজের মধ্যে আল্লাহ নিজেই কয়েকটি কাজের কথা উল্লেখ করেছেন। যেমন,

 

 ‘‘তারা সুলায়মানের ইচ্ছানুযায়ী দুর্গ, ভাষ্কর্য, হাউয সদৃশ বৃহদাকার পাত্র এবং চুল্লীর উপরে স্থাপিত বিশাল ডেগ নির্মাণ করত...’’ (সাবা, আয়াত ১৩)। উল্লেখ্য যে, تماثيل তথা ভাষ্কর্য কিংবা চিত্র ও প্রতিকৃতি অংকন বা স্থাপন যদি গাছ বা প্রাকৃতিক দৃশ্যের হয়, তাহ’লে ইসলামে তা জায়েয রয়েছে। কিন্তু যদি তা প্রাণীদেহের হয়, তবে তা নিষিদ্ধ।

 

৪. পক্ষীকুলকে সুলায়মানের অনুগত করে দেওয়া হয়েছিল এবং তিনি তাদের ভাষা বুঝতেন। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘‘সুলায়মান দাঊদের উত্তরাধিকারী হয়েছিল এবং বলেছিল, হে লোক সকল! আমাদেরকে পক্ষীকুলের ভাষা শিক্ষা দেওয়া হয়েছে এবং আমাদেরকে সবকিছু দেওয়া হয়েছে। নিশ্চয়ই এটি একটি সুস্পষ্ট শ্রেষ্ঠত্ব’’ (নমল, আয়াত ১৬)।

 

পক্ষীকুল তাঁর হুকুমে বিভিন্ন কাজ করত। সবচেয়ে বড় কথা এই যে, রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পত্র তিনি হুদহুদ পাখির মাধ্যমে পার্শ্ববর্তী ‘সাবা’ রাজ্যের রাণী বিলক্বীসের কাছে প্রেরণ করেছিলেন। এ ঘটনা পরে বিবৃত হবে।

 

৫. পিপীলিকার ভাষাও তিনি বুঝতেন। যেমন আল্লাহ বলেন,

 

 ‘‘অবশেষে সুলায়মান তার সৈন্যদল নিয়ে পিপীলিকা অধ্যুষিত উপত্যকায় পৌঁছল। তখন পিপীলিকা (নেতা) বলল, হে পিপীলিকা দল! তোমরা স্ব স্ব গৃহে প্রবেশ কর। অন্যথায় সুলায়মান ও তার বাহিনী অজ্ঞাতসারে তোমাদের পিষ্ট করে ফেলবে’’। ‘তার এই কথা শুনে সুলায়মান মুচকি হাসল... (নমল, আয়াত ১৮-১৯)।

 

৬. তাঁকে এমন সাম্রাজ্য দান করা হয়েছিল, যা পৃথিবীতে আর কাউকে দান করা হয়নি। এজন্য আল্লাহর হুকুমে তিনি আল্লাহর নিকটে প্রার্থনা করেছিলেন। যেমন আল্লাহ বলেন,

 

 ‘‘সুলায়মান বলল, হে আমার পালনকর্তা! আমাকে ক্ষমা কর এবং আমাকে এমন এক সাম্রাজ্য দান কর, যা আমার পরে আর কেউ যেন না পায়। নিশ্চয়ই তুমি মহান দাতা’’ (ছোয়াদ, আয়াত ৩৫)।

 

উল্লেখ্য যে, পয়গম্বরগণের কোন দো‘আ আল্লাহর অনুমতি ব্যতিরেকে হয় না। সে হিসাবে হযরত সুলায়মান (আঃ) এ দো‘আটিও আল্লাহ তা‘আলার অনুমতিক্রমেই করেছিলেন। কেবল ক্ষমতা লাভ এর উদ্দেশ্য ছিল না। বরং এর পিছনে আল্লাহর বিধানাবলী বাস্তবায়ন করা এবং তাওহীদের ঝান্ডাকে সমুন্নত করাই মূল উদ্দেশ্য ছিল। কেননা আল্লাহ জানতেন যে, রাজত্ব লাভের পর সুলায়মান তাওহীদ ও ইনছাফ প্রতিষ্ঠার জন্যই কাজ করবেন এবং তিনি কখনোই অহংকারের বশীভূত হবেন না। তাই তাঁকে এরূপ দো‘আর অনুমতি দেওয়া হয় এবং সে দো‘আ সর্বাংশে কবুল হয়।

 

৭. প্রাপ্ত অনুগ্রহরাজির হিসাব রাখা বা না রাখার অনুমতি প্রদান। আল্লাহ পাক হযরত সুলায়মান (আঃ)-এর রাজত্ব লাভের দো‘আ কবুল করার পরে তার প্রতি বায়ু, জিন, পক্ষীকুল ও জীব-জন্তু সমূহকে অনুগত করে দেন। অতঃপর বলেন, ‘‘এসবই আমার অনুগ্রহ। অতএব এগুলো তুমি কাউকে দাও অথবা নিজে রেখে দাও, তার কোন হিসাব দিতে হবে না’। ‘নিশ্চয়ই তার (সুলায়মানের) জন্য আমার কাছে রয়েছে নৈকট্য ও শুভ পরিণতি’’ (ছোয়াদ, আয়াত ৩৯-৪০)।

 

বস্ত্ততঃ এটি ছিল সুলায়মানের আমানতদারী ও বিশ্বস্ততার প্রতি আল্লাহর পক্ষ হ’তে প্রদত্ত একপ্রকার সনদপত্র। পৃথিবীর কোন ব্যক্তির জন্য সরাসরি আল্লাহর পক্ষ থেকে এ ধরনের কোন সত্যায়নপত্র নাযিল হয়েছে বলে জানা যায় না। অথচ এই মহান নবী সম্পর্কে ইহুদী-নাছারা বিদ্বানরা বাজে কথা রটনা করে থাকে।

 

সুলায়মানের জীবনে উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলী :

 

(১) ন্যায় বিচারের ঘটনা : ছাগপালের মালিক ও শস্যক্ষেতের মালিকের মধ্যকার বিরোধ মীমাংসায় তাঁর দেওয়া প্রস্তাব বাদশাহ দাঊদ (আঃ) গ্রহণ করেন ও নিজের দেওয়া পূর্বের রায় বাতিল করে পুত্র সুলায়মানের দেওয়া পরামর্শ অনুযায়ী রায় দেন ও তা কার্যকর করেন। এটি ছিল সুলায়মানের বাল্যকালের ঘটনা, যা আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বর্ণনা করেছেন (আম্বিয়া, আয়াত ৭৮-৭৯)। এ ঘটনা আমরা দাঊদ (আঃ)-এর কাহিনীতে বলে এসেছি।

 

(২) পিপীলিকার ঘটনা : হযরত সুলায়মান (আঃ) একদা তাঁর বিশাল সেনাবাহিনী সহ একটি এলাকা অতিক্রম করছিলেন। ঐ সময় তাঁর সাথে জিন, মানুষ পক্ষীকুল ছিল। যে এলাকা দিয়ে তাঁরা যাচ্ছিলেন সে এলাকায় বালির ঢিবি সদৃশ পিপীলিকাদের বহু বসতঘর ছিল। সুলায়মান বাহিনীকে আসতে দেখে পিপীলিকাদের সর্দার তাদেরকে বলল, তোমরা শীঘ্র পালাও। নইলে পাদপিষ্ট হয়ে শেষ হয়ে যাবে। সুলায়মান (আঃ) পিপীলিকাদের এই বক্তব্য শুনতে পেলেন। এ বিষয়ে কুরআনী বর্ণনা নিম্নরূপ: ‘‘সুলায়মান দাঊদের স্থলাভিষিক্ত হ’ল এবং বলল, হে লোক সকল! আমাদেরকে পক্ষীকুলের ভাষা শিক্ষা দেওয়া হয়েছে এবং আমাদেরকে সবকিছু দেওয়া হয়েছে। নিশ্চয়ই এটি একটি সুস্পষ্ট শ্রেষ্ঠত্ব’ (নমল, আয়াত ১৬)। ‘অতঃপর সুলায়মানের সম্মুখে তার সোনাবাহিনীকে সমবেত করা হ’ল জিন, মানুষ ও পক্ষীকুলকে। তারপর তাদেরকে বিভিন্ন ব্যুহে বিভক্ত করা হ’ল’। ‘অতঃপর যখন তারা একটি পিপীলিকা অধ্যুষিত এলাকায় উপনীত হ’ল, তখন এক পিপীলিকা বলল, ‘হে পিপীলিকা দল! তোমরা তোমাদের গৃহে প্রবেশ কর। অন্যথায় সুলায়মান ও তার বাহিনী অজ্ঞাতসারে তোমদেরকে পিষ্ট করে ফেলবে’। ‘তার কথা শুনে সুলায়মান মুচকি হাসল এবং বলল, ‘হে আমার পালনকর্তা! তুমি আমাকে ক্ষমতা দাও, যেন আমি তোমার নে‘মতের শুকরিয়া আদায় করতে পারি, যা তুমি আমাকে ও আমার পিতা-মাতাকে দান করেছ এবং যাতে আমি তোমার পসন্দনীয় সৎকর্মাদি করতে পারি এবং তুমি আমাকে নিজ অনুগ্রহে তোমার সৎকর্মশীল বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত কর’’ (নমল, আয়াত ১৬-১৯)।

 

উপরোক্ত আয়াতগুলিতে প্রমাণিত হয় যে, সুলায়মান (আঃ) কেবল পাখির ভাষা নয়, বরং সকল জীবজন্তু এমনকি ক্ষুদ্র পিঁপড়ার কথাও বুঝতেন। এজন্য তিনি মোটেই গর্ববোধ না করে বরং আল্লাহর অনুগ্রহের প্রতি শুকরিয়া আদায় করেন এবং নিজেকে যাতে আল্লাহ অন্যান্য সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত করেন সে প্রার্থনা করেন। এখানে আরেকটি বিষয় প্রমাণিত হয় যে, তিনি কেবল জিন-ইনসানের নয় বরং তাঁর সময়কার সকল জীবজন্তুরও নবী ছিলেন। তাঁর নবুঅতকে সবাই স্বীকার করত এবং সকলে তাঁর প্রতি আনুগত্য পোষণ করত। যদিও জিন ও ইনসান ব্যতীত অন্য প্রাণী শরী‘আত পালনের হকদার নয়।

 

(৩) হুদহুদপাখির ঘটনা : হযরত সুলায়মান (আঃ) আল্লাহর হুকুমে পক্ষীকুলের আনুগত্য লাভ করেন। একদিন তিনি পক্ষীকুলকে ডেকে একত্রিত করেন ও তাদের ভাল-মন্দ খোঁজ-খবর নেন। তখন দেখতে পেলেন যে, ‘হুদহুদ’ পাখিটা নেই। তিনি অনতিবিলম্বে তাকে ধরে আনার জন্য কড়া নির্দেশ জারি করলেন। সাথে তার অনুপস্থিতির উপযুক্ত কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করলেন। উক্ত ঘটনা কুরআনের ভাষায় নিম্নরূপ: ‘সুলায়মান পক্ষীকুলের খোঁজ-খবর নিল। অতঃপর বলল, কি হ’ল হুদহুদকে দেখছি না যে? না-কি সে অনুপস্থিত’ (নমল, আয়াত ২০)। সে বলল, ‘আমি অবশ্যই তাকে কঠোর শাস্তি দেব কিংবা যবহ করব অথবা সে উপস্থিত করবে উপযুক্ত কারণ’। ‘কিছুক্ষণ পরেই হুদহুদ এসে হাযির হয়ে বলল, (হে বাদশাহ!) আপনি যে বিষয়ে অবগত নন, আমি তা অবগত হয়েছি। আমি আপনার নিকটে ‘সাবা’ থেকে নিশ্চিত সংবাদ নিয়ে আগমন করেছি’ (নমল, আয়াত ২০-২২)।

 

এ পর্যন্ত বলেই সে তার নতুন আনীত সংবাদের রিপোর্ট পেশ করল। হুদহুদের মাধ্যমে একথা বলানোর মাধ্যমে আল্লাহ আমাদেরকে একথা জানিয়ে দিলেন যে, নবীগণ গায়েবের খবর রাখেন না। তাঁরা কেবল অতটুকুই জানেন, যতটুকু আল্লাহ তাদেরকে অবহিত করেন।

 

উল্লেখ্য যে, ‘হুদহুদ’ এক জাতীয় ছোট্ট পাখির নাম। যা পক্ষীকুলের মধ্যে অতীব ক্ষুদ্র ও দুর্বল এবং যার সংখ্যাও দুনিয়াতে খুবই কম। বর্ণিত আছে যে, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) একদা নও মুসলিম ইহুদী পন্ডিত আব্দুল্লাহ বিন সালাম (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করেন, এতসব পাখী থাকতে বিশেষভাবে ‘হুদহুদ’ পাখির খোঁজ নেওয়ার কারণ কি ছিল? জওয়াবে তিনি বলেন, সুলায়মান (আঃ) তাঁর বিশাল বাহিনীসহ ঐসময় এমন এক অঞ্চলে ছিলেন, যেখানে পানি ছিল না। আল্লাহ তা‘আলা হুদহুদ পাখিকে এই বৈশিষ্ট্য দান করেছেন যে, সে ভূগর্ভের বস্ত্ত সমূহকে এবং ভূগর্ভে প্রবাহিত পানি উপর থেকে দেখতে পায়। হযরত সুলায়মান (আঃ) হুদহুদকে এজন্যেই বিশেষভাবে খোঁজ করছিলেন যে, এতদঞ্চলে কোথায় মরুগর্ভে পানি লুক্কায়িত আছে, সেটা জেনে নিয়ে সেখানে জিন দ্বারা খনন করে যাতে দ্রুত পানি উত্তোলনের ব্যবস্থা করা যায়’। একদা হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) ‘হুদহুদ’ পাখি সম্পর্কে বর্ণনা করছিলেন। তখন নাফে‘ ইবনুল আযরক্ব তাঁকে বলেন, ‘জেনে নিন হে মহা জ্ঞানী! হুদহুদ পাখি মাটির গভীরে দেখতে পায়। কিন্তু (তাকে ধরার জন্য) মাটির উপরে বিস্তৃত জাল সে দেখতে পায় না। যখন সে তাতে পতিত হয়’। জবাবে ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, ‘যখন তাক্বদীর এসে যায়, চক্ষু অন্ধ হয়ে যায়’। চমৎকার এ জবাবে মুগ্ধ হয়ে ইবনুল ‘আরাবী বলেন, ‘এরূপ জওয়াব দিতে কেউ সক্ষম হয় না, কুরআনের আলেম ব্যতীত’।

 

(৪) রাণী বিলক্বীসের ঘটনা : হযরত সুলায়মান (আঃ)-এর শাম ও ইরাক সাম্রাজ্যের পার্শ্ববর্তী ইয়ামন তথা ‘সাবা’ রাজ্যের রাণী ছিলেন বিলক্বীস বিনতুস সারাহ বিন হাদাহিদ বিন শারাহীল। তিনি ছিলেন সাম বিন নূহ (আঃ)-এর ১৮তম অধঃস্তন বংশধর। তাঁর ঊর্ধ্বতন ৯ম পিতামহের নাম ছিল ‘সাবা’। সম্ভবতঃ তাঁর নামেই ‘সাবা’ সাম্রাজ্যের নামকরণ হয়।আল্লাহ তাদের সামনে জীবনোপকরণের দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন এবং নবীগণের মাধ্যমে এসব নে‘মতের শুকরিয়া আদায় করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু পরে তারা ভোগ-বিলাসে মত্ত হয়ে আল্লাহর অবাধ্য হয় এবং ‘সূর্য পূজারী’ হয়ে যায়। ফলে তাদের উপরে প্লাবণের আযাব প্রেরিত হয় ও সবকিছু ধ্বংস হয়ে যায়। আল্লাহ সূরা সাবা ১৫ হ’তে ১৭ আয়াতে এই সম্প্রদায় সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন।

 

দুনিয়াবী দিক দিয়ে এই ‘সাবা’ সাম্রাজ্য খুবই সমৃদ্ধ এবং শান-শওকতে পূর্ণ ছিল। তাদের সম্পর্কে হযরত সুলায়মানের কিছু জানা ছিল না বলেই কুরআনী বর্ণনায় প্রতীয়মান হয়। তাঁর এই না জানাটা বিস্ময়কর কিছু ছিল না। ইয়াকূব (আঃ) তাঁর বাড়ীর অনতিদূরে তাঁর সন্তান ইউসুফকে কূয়ায় নিক্ষেপের ঘটনা জানতে পারেননি। স্ত্রী আয়েশার গলার হারটি হারিয়ে গেল। অথচ স্বামী রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তা জানতে পারেননি। বস্ত্ততঃ আল্লাহ যতটুকু ইলম বান্দাকে দেন, তার বেশী জানার ক্ষমতা কারো নেই। পার্শ্ববর্তী ‘সাবা’ সাম্রাজ্য সম্পর্কে পূর্বে না জানা এবং পরে জানার মধ্যে যে কি মঙ্গল নিহিত ছিল, তা পরবর্তী ঘটনাতেই প্রমাণিত হয়েছে এবং রাণী বিলক্বীস মুসলমান হয়ে যান। বস্ত্ততঃ হুদহুদ পাখি তাদের সম্পর্কে হযরত সুলায়মানের নিকটে এসে প্রথম খবর দেয়। তার বর্ণিত প্রতিবেদনটি ছিল কুরআনের ভাষায় নিম্নরূপ :

 

‘‘আমি এক মহিলাকে সাবা বাসীদের উপরে রাজত্ব করতে দেখেছি। তাকে সবকিছুই দেওয়া হয়েছে এবং তার একটা বিরাট সিংহাসন আছে’। ‘আমি তাকে ও তার সম্প্রদায়কে দেখলাম তারা আল্লাহর পরিবর্তে সূর্যকে সিজদা করছে। শয়তান তাদের দৃষ্টিতে তাদের কার্যাবলীকে সুশোভিত করেছে। অতঃপর তাদেরকে সত্যপথ থেকে নিবৃত্ত করেছে। ফলে তারা সঠিক পথ প্রাপ্ত হয় না’’ (নমল, আয়াত ২৩-২৪)।

 

সুলায়মান বলল, ‘‘এখন আমরা দেখব তুমি সত্য বলছ, না তুমি মিথ্যাবাদীদের একজন’। ‘তুমি আমার এই পত্র নিয়ে যাও এবং এটা তাদের কাছে অর্পণ কর। অতঃপর তাদের কাছ থেকে সরে পড় এবং দেখ, তারা কি জওয়াব দেয়’। ‘বিলক্বীস বলল, হে সভাসদ বর্গ! আমাকে একটি মহিমান্বিত পত্র দেওয়া হয়েছে’। ‘সেই পত্র সুলায়মানের পক্ষ হ’তে এবং তা হ’ল এই: করুণাময় কৃপানিধান আল্লাহর নামে (শুরু করছি)’। ‘আমার মোকাবেলায় তোমরা শক্তি প্রদর্শন করো না এবং বশ্যতা স্বীকার করে আমার নিকটে উপস্থিত হও’। ‘বিলক্বীস বলল, হে আমার পারিষদ বর্গ! আমাকে আমার কাজে পরামর্শ দিন। আপনাদের উপস্থিতি ব্যতিরেকে আমি কোন কাজে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি না’। ‘তারা বলল, আমরা শক্তিশালী এবং কঠোর যোদ্ধা। এখন সিদ্ধান্ত আপনার হাতে। অতএব ভেবে দেখুন আপনি আমাদের কি আদেশ করবেন’।

 

‘রাণী বলল, রাজা-বাদশাহরা যখন কোন জনপদে প্রবেশ করে, তখন তাকে বিপর্যস্ত করে দেয় এবং সেখানকার সম্ভ্রান্ত লোকদের অপদস্থ করে। তারাও এরূপ করবে’। ‘অতএব আমি তাঁর নিকটে কিছু উপঢৌকন পাঠাই। দেখি, প্রেরিত লোকেরা কি জওয়াব নিয়ে আসে’। ‘অতঃপর যখন দূত সুলায়মানের কাছে আগমন করল, তখন সুলায়মান বলল, তোমরা কি ধন-সম্পদ দ্বারা আমাকে সাহায্য করতে চাও? আল্লাহ আমাকে যা দিয়েছেন, তা তোমাদের দেওয়া বস্ত্ত থেকে অনেক উত্তম। বরং তোমরাই তোমাদের উপঢৌকন নিয়ে সুখে থাক’। ‘ফিরে যাও তাদের কাছে। এখন অবশ্যই আমরা তাদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী সহ আগমন করব, যার মোকাবেলা করার শক্তি তাদের নেই। আমরা অবশ্যই তাদেরকে অপদস্থ করে সেখান থেকে বহিষ্কার করব এবং তারা হবে লাঞ্ছিত’। ‘অতঃপর সুলায়মান বলল, হে আমার পারিষদবর্গ! তারা আত্মসমর্পণ করে আমার কাছে আসার পূর্বে কে আছ বিলক্বীসের সিংহাসন আমাকে এনে দেবে?’ ‘জনৈক দৈত্য-জ্বিন বলল, আপনি আপনার স্থান থেকে ওঠার পূর্বেই আমি তা এনে দেব এবং আমি একাজে শক্তিবান ও বিশ্বস্ত’। ‘(কিন্তু) কিতাবের জ্ঞান যার ছিল সে বলল, তোমার চোখের পলক ফেলার পূর্বেই আমি তা এনে দিব। অতঃপর সুলায়মান যখন তা সামনে রক্ষিত দেখল, তখন বলল, এটা আমার পালনকর্তার অনুগ্রহ, যাতে তিনি আমাকে পরীক্ষা করেন যে, আমি শুকরিয়া আদায় করি, না অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। যে ব্যক্তি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, সে নিজের কল্যাণের জন্য তা করে থাকে এবং যে অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, সে জানুক যে, আমার পালনকর্তা অভাবমুক্ত ও কৃপাময়’ (নমল, আয়াত ৪০)।

 

‘সুলায়মান বলল, বিলক্বীসের সিংহাসনের আকৃতি বদলিয়ে দাও, দেখব সে সঠিক বস্ত্ত চিনতে পারে, না সে তাদের অন্তর্ভুক্ত যারা সঠিক পথ খুঁজে পায় না?’ ‘অতঃপর যখন বিলক্বীস এসে গেল, তখন তাকে জিজ্ঞেস করা হ’ল: আপনার সিংহাসন কি এরূপই? সে বলল, মনে হয় এটা সেটিই হবে। আমরা পূর্বেই সবকিছু অবগত হয়েছি এবং আমরা আজ্ঞাবহ হয়ে গেছি’। ‘বস্ত্ততঃ আল্লাহর পরিবর্তে সে যার উপাসনা করত, সেই-ই তাকে ঈমান থেকে বিরত রেখেছিল। নিশ্চয়ই সে কাফের সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল’। ‘তাকে বলা হ’ল, প্রাসাদে প্রবেশ করুন। অতঃপর যখন সে তার প্রতি দৃষ্টিপাত করল, তখন ধারণা করল যে, এটা স্বচ্ছ গভীর জলাশয়। ফলে সে তার পায়ের গোছা খুলে ফেলল। সুলায়মান বলল, এটা তো স্বচ্ছ স্ফটিক নির্মিত প্রাসাদ। বিলক্বীস বলল, হে আমার পালনকর্তা! আমি তো নিজের প্রতি যুলুম করেছি। আমি সুলায়মানের সাথে বিশ্বজাহানের পালনকর্তা আল্লাহর নিকটে আত্মসমর্পণ করলাম’ (নমল, আয়াত ২৭-৪৪)।

 

সূরা নমল ২২ হ’তে ৪৪ আয়াত পর্যন্ত উপরে বর্ণিত ২৩টি আয়াতে রাণী বিলক্বীসের কাহিনী শেষ হয়েছে। এর মধ্যে ৪০তম আয়াতে ‘যার কাছে কিতাবের জ্ঞান ছিল’ বলে কাকে বুঝানো হয়েছে, এ বিষয়ে তাফসীরবিদগণ মতভেদ করেছেন। তার মধ্যে প্রবল মত হ’ল এই যে, তিনি ছিলেন স্বয়ং হযরত সুলায়মান (আঃ)। কেননা আল্লাহর কিতাবের সর্বাধিক জ্ঞান তাঁরই ছিল। তিনি এর দ্বারা উপস্থিত জিন ও মানুষ পারিষদ বর্গকে বুঝিয়ে দিলেন যে, তোমাদের সাহায্য ছাড়াও আল্লাহ অন্যের মাধ্যমে অর্থাৎ ফেরেশতাদের মাধ্যমে আমাকে সাহায্য করে থাকেন। ‘আর এটি হ’ল আমার পালনকর্তার অনুগ্রহ’ (নমল ৪০)। দ্বিতীয়তঃ গোটা ব্যাপারটাই ছিল একটা মু‘জেযা এবং রাণী বিলক্বীসকে আল্লাহর সর্বোচ্চ ক্ষমতা প্রদর্শন করাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। বস্ত্ততঃ এতে তিনি সফল হয়েছিলেন এবং সুদূর ইয়ামন থেকে বায়তুল মুক্বাদ্দাসে বিলক্বীস তার সিংহাসনের আগাম উপস্থিতি দেখে অতঃপর স্ফটিক স্বচ্ছ প্রাসাদে প্রবেশকালে অনন্য কারুকার্য দেখে এবং তার তুলনায় নিজের ক্ষমতা ও প্রাসাদের দীনতা বুঝে লজ্জিত ও অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন। অতঃপর তিনি আল্লাহর নিকটে আত্মসমর্পণ করে মুসলমান হয়ে যান। মূলতঃ এটাই ছিল হযরত সুলায়মানের মূল উদ্দেশ্য, যা শতভাগ সফল হয়েছিল।

 

(৫) অশ্ব কুরবানীর ঘটনা :

 

পিতা দাঊদের ন্যায় পুত্র সুলায়মানকেও আল্লাহ বারবার পরীক্ষায় ফেলেছেন তাকে সর্বদা আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তনশীল রাখার জন্য। ফলে তাঁর জীবনের এক একটি পরীক্ষা এক একটি ঘটনার জন্ম দিয়েছে। কুরআন সেগুলির সামান্য কিছু উল্লেখ করেছে, যতটুকু আমাদের উপদেশ হাছিলের জন্য প্রয়োজন। কিন্তু পথভ্রষ্ট ইহুদী-নাছারা পন্ডিতগণ সেই সব ঘটনার উপরে রং চড়িয়ে এবং নিজেদের পক্ষ থেকে উদ্ভট সব গল্পের অবতারণা করে তাদেরই স্বগোত্র বনু ইস্রাঈলের এইসব মহান নবীগণের চরিত্র হনন করেছে। মুসলিম উম্মাহ বিগত সকল নবীকে সমানভাবে সম্মান করে। তাই ইহুদী-নাছারাদের অপপ্রচার থেকে নিজেদেরকে বাঁচিয়ে রাখে এবং পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের বর্ণনার উপরে নির্ভর করে। সেখানে যতটুকু পাওয়া যায়, তার উপরেই তারা বাক সংযত রাখে। আলোচ্য অশ্ব কুরবানীর ঘটনাটি সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের বর্ণনা নিম্নরূপ :

 

‘‘যখন তার সামনে অপরাহ্নে উৎকৃষ্ট অশ্বরাজি পেশ করা হ’ল’ (ছোয়াদ ৩১)। ‘তখন সে বলল, আমি তো আমার প্রভুর স্মরণের জন্যই ঘোড়াগুলিকে মহববত করে থাকি (কেননা এর দ্বারা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ হয়ে থাকে। অতঃপর সে ঘোড়াগুলিকে দৌড়িয়ে দিল,) এমনকি সেগুলি দৃষ্টির অন্তরালে চলে গেল’। ‘(অতঃপর সে বলল,) ঘোড়াগুলিকে আমার কাছে ফিরিয়ে আনো। অতঃপর সে তাদের গলায় ও পায়ে (আদর করে) হাত বুলাতে লাগল’ (ছোয়াদ, আয়াত ৩১-৩৩)। উপরোক্ত তরজমাটি ইবনু আববাস (রাঃ)-এর ব্যাখ্যার অনুসরণে ইবনু জারীরের গৃহীত ব্যাখ্যার অনুকূলে করা হয়েছে।

 

 (৬) সিংহাসনের উপরে একটি নিষ্প্রাণ দেহ প্রাপ্তির ঘটনা :

 

আল্লাহ বলেন- ‘আমরা সুলায়মানকে পরীক্ষা করলাম এবং রেখে দিলাম তার সিংহাসনের উপর একটি নিষ্প্রাণ দেহ। অতঃপর সে রুজু হ’ল’ (ছোয়াদ, আয়াত ৩৪)। এ বিষয়ে কুরআনের বর্ণনা কেবল এতটুকুই। এক্ষণে সেই নিষ্প্রাণ দেহটি কিসের ছিল, একে সিংহাসনের উপর রাখার হেতু কি ছিল, এর মাধ্যমে কি ধরনের পরীক্ষা হ’ল- এসব বিবরণ কুরআন বা ছহীহ হাদীছে কিছুই বর্ণিত হয়নি। অতএব এ বিষয়ে কেবল এতটুকু ঈমান রাখা কর্তব্য যে, সুলায়মান (আঃ) এভাবে পরীক্ষায় পতিত হয়েছিলেন। যার ফলে তিনি আল্লাহর প্রতি আরো বেশী রুজু হন ও ক্ষমা প্রার্থনা করেন। যা সর্বাবস্থায় আল্লাহর প্রতি তাঁর অটুট আনুগত্যের পরিচয় বহন করে।

 

(৭) ইনশাআল্লাহনা বলার ফল :

 

ছহীহ বুখারী ও মুসলিমে এ বিষয়ে বর্ণিত ঘটনার সারমর্ম এই যে, একবার হযরত সুলায়মান (আঃ) এ মনোভাব ব্যক্ত করলেন যে, রাত্রিতে আমি (আমার ৯০ বা ১০০) সকল স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হব। যাতে প্রত্যেকের গর্ভ থেকে একটি করে পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করে ও পরে তারা আল্লাহর পথে ঘোড় সওয়ার হয়ে জিহাদ করবে। কিন্তু এ সময় তিনি ‘ইনশাআল্লাহ’ (অর্থঃ ‘যদি আল্লাহ চান’) বলতে ভুলে গেলেন। নবীর এ ত্রুটি আল্লাহ পসন্দ করলেন না। ফলে মাত্র একজন স্ত্রীর গর্ভ থেকে একটি অপূর্ণাঙ্গ ও মৃত শিশু ভূমিষ্ট হ’ল’। এর দ্বারা বুঝানো হয়েছে যে, সুলায়মান বিশ্বের সর্বাধিক ক্ষমতাসম্পন্ন বাদশাহ হ’লেও এবং জিন, বায়ু, পক্ষীকুল ও সকল জীবজন্তু তাঁর হুকুম বরদার হ’লেও আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতীত তার কিছুই করার ক্ষমতা ছিল না। অতএব তাঁর ‘ইনশাআল্লাহ’ বলতে ভুলে যাওয়াটা ছোটখাট কোন অপরাধ নয়। এ ঘটনায় এটাও স্পষ্ট হয় যে, যারা যত বড় পদাধিকারী হবেন, তাদের ততবেশী আল্লাহর অনুগত হ’তে হবে এবং সর্বাবস্থায় সকল কাজে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করতে হবে। সর্বদা বিনীত হয়ে চলতে হবে এবং কোন অবস্থাতেই অহংকার করা চলবে না।

 

অনেক তাফসীরবিদ সূরা ছোয়াদ ৩৪ আয়াতে বর্ণিত ‘সিংহাসনের উপরে নিষ্প্রাণ দেহ’ রাখার ঘটনার সাথে কিছুটা সাদৃশ্য দেখে ছহীহ বুখারীতে বর্ণিত উপরোক্ত ঘটনাকে উক্ত আয়াতের তাফসীর হিসাবে সাব্যস্ত করেছেন। তারা বলেন যে, সিংহাসনে নিষ্প্রাণ দেহ রাখার অর্থ এই যে, সুলায়মান (আঃ)-এর জনৈক চাকর উক্ত মৃত সন্তানকে এনে তাঁর সিংহাসনে রেখে দেয়। এতে সুলায়মান (আঃ) বুঝে নেন যে, এটা তাঁর ‘ইনশাআল্লাহ’ না বলার ফল। সেমতে তিনি আল্লাহর দিকে রুজু হ’লেন ও ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। ক্বাযী আবুস সাঊদ, আল্লামা আলূসী, আশরাফ আলী থানভী প্রমুখ এ তাফসীর বর্ণনা করেছেন। এতদ্ব্যতীত ইমাম রাযীও আরেকটি তাফসীর করেছেন যে, সুলায়মান (আঃ) একবার গুরুতর অসুস্থ হয়ে এমন দুর্বল হয়ে পড়েন যে, সিংহাসনে বসালে তাঁকে নিষ্প্রাণ দেহ বলে মনে হ’ত। পরে সুস্থ হ’লে তিনি আল্লাহর দিকে রুজু হন...। এ তাফসীর একেবারেই অনুমান ভিত্তিক। কুরআনী বর্ণনার সাথে এর কোন মিল নেই।

 

বস্ত্ততঃ কুরআন পাকে এই ঘটনা উল্লেখ করার আসল উদ্দেশ্য হ’ল মানুষকে একথা বুঝানো যে, তারা কোন বিপদাপদে বা পরীক্ষায় পতিত হ’লে যেন পূর্বাপেক্ষা অধিকভাবে আল্লাহর দিকে রুজু হয়। যেমন সুলায়মান (আঃ) হয়েছিলেন।

 

(৮) হারূত ও মারূত ফেরেশতাদ্বয়ের কাহিনী :

 

সুলায়মান (আঃ)-এর রাজত্বকালে বেঈমান জিনেরা লোকদের ধোঁকা দিত এই বলে যে, সুলায়মান জাদুর জোরে সবকিছু করেন। তিনি কোন নবী নন। শয়তানদের ভেল্কিবাজিতে বহু লোক বিভ্রান্ত হচ্ছিল। এমনকি শেষনবী (ছাঃ)-এর সময়েও যখন তিনি সুলায়মান (আঃ)-এর প্রশংসা করেন, তখন ইহুদী নেতারা বলেছিল, আশ্চর্যের বিষয় যে, মুহাম্মাদ সুলায়মানকে নবীদের মধ্যে শামিল করে হক ও বাতিলের মধ্যে সংমিশ্রণ ঘটাচ্ছেন। অথচ তিনি ছিলেন একজন জাদুকর মাত্র। কেননা স্বাভাবিকভাবে কোন মানুষ কি বায়ুর পিঠে সওয়ার হয়ে চলতে পারে? (ইবনু জারীর)।

 

এক্ষণে সুলায়মান (আঃ) যে সত্য নবী, তিনি যে জাদুকর নন, জনগণকে সেটা বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য এবং নবীগণের মু‘জেযা ও শয়তানদের জাদুর মধ্যে পার্থক্য বুঝাবার জন্য আল্লাহ পাক হারূত ও মারূত নামে দু’জন ফেরেশতাকে ‘বাবেল’ শহরে মানুষের বেশে পাঠিয়ে দেন। ‘বাবেল’ হ’ল ইরাকের একটি প্রাচীন নগরী, যা ঐসময় জাদু বিদ্যার কেন্দ্র ছিল। ফেরেশতাদ্বয় সেখানে এসে জাদুর স্বরূপ ও ভেল্কিবাজি সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করতে থাকেন এবং জাদুকরদের অনুসরণ থেকে বিরত হয়ে যেন সবাই সুলায়মানের নবুঅতের অনুসারী হয়, সেকথা বলতে লাগলেন।

 

জাদু ও মু‘জেযার পার্থক্য এই যে, জাদু প্রাকৃতিক কারণের অধীন। কারণ ব্যতীত জাদু সংঘটিত হয় না। কিন্তু দর্শক সে কারণ সম্পর্কে অবহিত থাকে না বলেই তাতে বিভ্রান্ত হয়। এমনকি কুফরীতে লিপ্ত হয় এবং ঐ জাদুকরকেই সকল ক্ষমতার মালিক বলে ধারণা করতে থাকে। আজকের যুগে ভিডিও চিত্রসহ হাযার মাইল দূরের ভাষণ ঘরে বসে শুনে এবং দেখে যেকোন অজ্ঞ লোকের পক্ষে নিঃসন্দেহে বিভ্রান্তিতে পড়া স্বাভাবিক। তেমনি সেযুগেও জাদুকরদের বিভিন্ন অলৌকিক বস্ত্ত দেখে অজ্ঞ মানুষ বিভ্রান্তিতে পড়ত।

 

পক্ষান্তরে মু‘জেযা কোন প্রাকৃতিক কারণের অধীন নয়। বরং তা সরাসরি আল্লাহর নির্দেশে সম্পাদিত হয়। নবী ব্যতীত আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের প্রতি তাঁর ‘কারামত’ বা সম্মান প্রদর্শনের বিষয়টিও একইভাবে সম্পাদিত হয়। এতে প্রাকৃতিক কারণের যেমন কোন সম্পৃক্ততা নেই, তেমনি সম্মানিত ব্যক্তির নিজস্ব কোন ক্ষমতা বা হাত নেই। উভয় বস্ত্তর পার্থক্য বুঝার সহজ উপায় এই যে, মু‘জেযা কেবল নবীগণের মাধ্যমেই প্রকাশিত হয়। যারা আল্লাহভীতি, উন্নত চরিত্র মাধুর্য এবং পবিত্র জীবন যাপন সহ সকল মানবিক গুণে সর্বকালে সকলের আদর্শ স্থানীয় হন।

 

আর নবী ও অলীগণের মধ্যে পার্থক্য এই যে, নবীগণ প্রকাশ্যে নবুঅতের দাবী করে থাকেন। কিন্তু অলীগণ কখনোই নিজেকে অলী বলে দাবী করেন না। অলীগণ সাধারণভাবে নেককার মানুষ। কিন্তু নবীগণ আল্লাহর বিশেষভাবে নির্বাচিত বান্দা, যাদেরকে তিনি নবুঅতের গুরুদায়িত্ব অর্পণ করে থাকেন। নবীগণের মু‘জেযা প্রকাশে তাদের নিজস্ব কোন ক্ষমতা বা কৃতিত্ব নেই। পক্ষান্তরে দুষ্ট লোকেরাই জাদুবিদ্যা শিখে ও তার মাধ্যমে নিজেদের দুনিয়া হাছিল করে থাকে। উভয়ের চরিত্র জনগণের মাঝে পরিষ্কারভাবে পার্থক্য সৃষ্টি করে।

 

বস্ত্ততঃ সুলায়মান (আঃ)-এর নবুঅতের সমর্থনেই আল্লাহ তাঁর বিশেষ অনুগ্রহে হারূত ও মারূত ফেরেশতাদ্বয়কে বাবেল শহরে পাঠিয়ে ছিলেন। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘(ইহুদী-নাছারাগণ) ঐ সবের অনুসরণ করে থাকে, যা সুলায়মানের রাজত্বকালে শয়তানরা আবৃত্তি করত। অথচ সুলায়মান কুফরী করেননি, বরং শয়তানরাই কুফরী করেছিল। তারা মানুষকে জাদু বিদ্যা শিক্ষা দিত এবং বাবেল শহরে হারূত ও মারূত দুই ফেরেশতার উপরে যা নাযিল হয়েছিল, তা শিক্ষা দিত। বস্ত্ততঃ তারা (হারূত-মারূত) উভয়ে একথা না বলে কাউকে শিক্ষা দিত না যে, আমরা এসেছি পরীক্ষা স্বরূপ। কাজেই তুমি (জাদু শিখে) কাফির হয়ো না। কিন্তু তারা তাদের কাছ থেকে এমন জাদু শিখত, যার দ্বারা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটে। অথচ আল্লাহর আদেশ ব্যতীত তদ্বারা তারা কারু ক্ষতি করতে পারত না। লোকেরা তাদের কাছে শিখত ঐসব বস্ত্ত যা তাদের ক্ষতি করে এবং তাদের কোন উপকার করে না। তারা ভালভাবেই জানে যে, যে কেউ জাদু অবলম্বন করবে, তার জন্য আখেরাতে কোন অংশ নেই। যার বিনিময়ে তারা আত্মবিক্রয় করেছে, তা খুবই মন্দ, যদি তারা জানতো’। ‘যদি তারা ঈমান আনত ও আল্লাহভীরু হ’ত, তবে আল্লাহর কাছ থেকে উত্তম প্রতিদান পেত, যদি তারা জানত’ (বাক্বারাহ, আয়াত ১০২-১০৩)।

 

 (৯) বায়তুল মুক্বাদ্দাস নির্মাণ ও সুলায়মান (আঃ)-এর মৃত্যুর বিস্ময়কর ঘটনা :

 

বায়তুল মুক্বাদ্দাসের নির্মাণ সর্বপ্রথম ফেরেশতাদের মাধ্যমে অথবা আদম (আঃ)-এর কোন সন্তানের মাধ্যমে সম্পন্ন হয় কা‘বাগৃহ নির্মাণের চল্লিশ বছর পরে। অতঃপর স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে হযরত ইয়াকূব (আঃ) তা পুনর্নির্মাণ করেন। তার প্রায় হাযার বছর পরে দাঊদ (আঃ) তার পুনর্নির্মাণ শুরু করেন এবং সুলায়মান (আঃ)-এর হাতে তা সমাপ্ত হয়। কিন্তু মূল নির্মাণ কাজ শেষ হ’লেও আনুসঙ্গিক কিছু কাজ তখনও বাকী ছিল। এমন সময় হযরত সুলায়মানের মৃত্যুকাল ঘনিয়ে এল। এই কাজগুলি অবাধ্যতাপ্রবণ জিনদের উপরে ন্যস্ত ছিল। তারা হযরত সুলায়মানের ভয়ে কাজ করত। তারা তাঁর মৃত্যু সংবাদ জানতে পারলে কাজ ফেলে রেখে পালাতো। ফলে নির্মাণ কাজ অসম্পূর্ণ থেকে যেত। তখন সুলায়মান (আঃ) আল্লাহর নির্দেশে মৃত্যুর জন্যে প্রস্ত্তত হয়ে তাঁর কাঁচ নির্মিত মেহরাবে প্রবেশ করলেন। যাতে বাইরে থেকে ভিতরে সবকিছু দেখা যায়। তিনি বিধানানুযায়ী ইবাদতের উদ্দেশ্যে লাঠিতে ভর করে দাঁড়িয়ে গেলেন, যাতে রূহ বেরিয়ে যাবার পরেও লাঠিতে ভর দিয়ে দেহ স্বস্থানে দাঁড়িয়ে থাকে। সেটাই হ’ল। আল্লাহর হুকুমে তাঁর দেহ উক্ত লাঠিতে ভর করে এক বছর দাঁড়িয়ে থাকল। দেহ পচলো না, খসলো না বা পড়ে গেল না। জিনেরা ভয়ে কাছে যায়নি। ফলে তারা হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেটে কাজ শেষ করে ফেলল। এভাবে কাজ সমাপ্ত হ’লে আল্লাহর হুকুমে কিছু উই পোকার সাহায্যে লাঠি ভেঙ্গে দেওয়া হয় এবং সুলায়মান (আঃ)-এর লাশ মাটিতে পড়ে যায়। উক্ত কথাগুলি আল্লাহ বলেন নিম্নোক্ত ভাবে- ‘অতঃপর যখন আমরা সুলায়মানের মৃত্যু ঘটালাম, তখন ঘুনপোকাই জিনদেরকে তাঁর মৃত্যু সম্পর্কে অবহিত করল। সুলায়মানের লাঠি খেয়ে যাচ্ছিল। অতঃপর যখন তিনি মাটিতে পড়ে গেলেন, তখন জিনেরা বুঝতে পারল যে, যদি তারা অদৃশ্য বিষয় জানতো, তাহ’লে তারা (মসজিদ নির্মাণের) এই হাড়ভাঙ্গা খাটুনির আযাবের মধ্যে আবদ্ধ থাকতো না’ (সাবা, আয়াত ১৪)। সুলায়মানের মৃত্যুর এই ঘটনা আংশিক কুরআনের আলোচ্য আয়াতের এবং আংশিক ইবনে আববাস (রাঃ) প্রমুখ থেকে বর্ণিত হয়েছে (ইবনে কাছীর)।

 

সুলায়মানের এই অলৌকিক মৃত্যু কাহিনীর মধ্যে শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ :

 

(১) মৃত্যুর নির্ধারিত সময় উপস্থিত হ’লে নবী-রাসূল যে-ই হৌন না কেন, এক সেকেন্ড আগপিছ হবে না।

 

(২) আল্লাহ কোন মহান কাজ সম্পন্ন করতে চাইলে যেকোন উপায়ে তা সম্পন্ন করেন। এমনকি মৃত লাশের মাধ্যমেও করতে পারেন।

 

(৩) ইতিপূর্বে জিনেরা বিভিন্ন আগাম খবর এনে বলত যে, আমরা গায়েবের খবর জানি। অথচ চোখের সামনে মৃত্যুবরণকারী সুলায়মান (আঃ)-এর খবর তারা জানতে পারেনি এক বছরের মধ্যে। এতে তাদের অদৃশ্য জ্ঞানের দাবী অসার প্রমাণিত হয়।

 

সুলায়মান (আঃ)-এর জীবনী থেকে শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ :

 

১. নবুঅত ও খেলাফত একত্রে একই ব্যক্তির মাধ্যমে পরিচালিত হওয়া সম্ভব।

 

২. ধর্মই রাজনীতির প্রধান চালিকা শক্তি। ধর্মীয় রাজনীতির মাধ্যমেই পৃথিবীতে প্রকৃত শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।

 

৩. প্রকৃত মহান তিনিই, যিনি সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী হয়েও অহংকারী হন না। বরং সর্বদা আল্লাহর প্রতি বিনীত থাকেন।

 

৪. শত্রুমুক্ত কোন মানুষ দুনিয়াতে নেই। সুলায়মানের মত একচ্ছত্র এবং অপ্রতিদ্বন্দ্বী বাদশাহর বিরুদ্ধেও চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র ও মিথ্যাচার চালানো হয়েছে।

 

৫. সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থভাবে প্রজাসাধারণের কাজ করলেও তারা অনেক সময় না বুঝে বিরোধিতা করে। যেমন বায়তুল মুক্বাদ্দাস মসজিদের নির্মাণ কাজ সমাপ্ত না হওয়ায় আল্লাহ বাকী সময়ের জন্য সুলায়মানের প্রাণহীন দেহকে লাঠিতে ঠেস দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখেন জিন মিস্ত্রী ও জোগাড়েদের ভয় দেখানোর জন্য। যাতে তারা কাজ ফেলে রেখে চলে না যায় এবং নতুন চক্রান্তে লিপ্ত হবার সুযোগ না পায়।

 

সুলায়মানের মৃত্যু ও রাজত্বকাল :

 

সুলায়মান (আঃ) ৫৩ বছর বেঁচেছিলেন। তন্মধ্যে ৪০ বছর তিনি রাজত্ব করেন। তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর পুত্র রাহবা‘আম ১৭ বছর রাজত্ব করেন। অতঃপর বনু ইস্রাঈলের রাজত্ব বিভক্ত হয়ে যায়। সুলায়মান মনছূরপুরীর হিসাব মতে শেষনবী (ছাঃ)-এর আবির্ভাবের প্রায় ১৫৪৬ বছর পূর্বে সুলায়মান (আঃ) মৃত্যুবরণ করেন।

 

কুরআনে উল্লেখ

 

এবার আপনাকে বলে দিচ্ছি কুরআন থেকে হযরত সুলাইমানকে জানার সুত্র। আল কুরআনে হযরত সুলাইমানের নাম ১৭ বার উল্লেখ করা হয়েছে। যেসব জায়গায় উল্লেখ হয়েছে সেগুলো হলো – সূরা আল বাকারা ; ১০২। আন নিসা ; ১৬৩। আল আনয়াম ; ৮৪। আল আম্বিয়া ; ৭৮, ৭৯, ৮১। আন নামল ; ১৫, ১৬, ১৭, ১৮, ৩০, ৩৬, ৪৪। সাবা ; ১২। সোয়াদ ; ৩০, ৩৪। তবে বিস্তারিত ঘটনা আপনারা আরো জানতে পারবেন সূরা আল আম্বিয়া ; ৭৮-৮২ আয়াতে। সূরা আন নামল ; ১৫-৪৪ আয়াতে। সূরা সাবা ; ১২-১৪ আয়াতে এবং সূরা সোয়াদ ; ৩০-৪৪ নম্বর আয়াতে। আপনারা তো নিশ্চয়ই জানেন, আল কুরআনের বাংলা অনুবাদ হয়েছে, তাফসির হয়েছে। একবার সরাসরি কুরআন থেকে হযরত সুলাইমান (আঃ) এর জীবনী পড়ে নিন।

 

১৯।

 

ইলিয়াস

 

(আঃ)

 

ইলিয়াস (আঃ) ছিলেন বনী ইসরাইলদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নবী। ছিলেন বড় ইবাদাত গুজার, আল্লাহভীরু এবং বিশাল ব্যক্তিত্বের অধিকারী। কুরআন মাজীদে তাঁর নাম তিন বার উল্লেখ করা হয়েছে। উল্লেখ হয়েছে সূরা আনয়ামের ৮৫ আয়াতে এবং সূরা সাফফাতের ১২৩ ও ১৩০ আয়াতে। তিনি আল্লাহর কাছে বড় মর্যাদাবান ও সম্মানিত ছিলেন। কুরআন মাজীদে আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর উপর সালাম বর্ষিত হয়েছে। বাইবেলে তাঁর নাম বলা হয়েছে ‘ইলিয়া’।

 

হযরত ইলিয়াসের কাল ও এলাকা

 

আধুনিক কালের গবেষকগন খ্রিষ্টপূর্ব ৮৭৫ থেকে ৮৫০ এর মাঝামাঝি সময়টাকে তাঁর নবুয়্যত কাল বলে চিহ্নিত করেছেন। হযরত ইলিয়াস ছিলেন জিল’আদের অধিবাসী। সেকালে জিল’আদ বলা হত জর্ডানের উত্তরাঞ্চলকে। এলাকাটি ইয়ারমুক নদীর দক্ষিনে অবস্থিত। আপনি কি কখনো সে এলাকায় গিয়েছেন?

 

কুরআনে তাঁর মর্যাদার বর্ণনা

 

 কুরআনে হযরত ইলিয়াস (আঃ) –কে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর বংশধর শ্রেষ্ঠ নবীদের একজন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সূরা আল আনয়ামে বলা হয়েছে –

 

“ইব্রাহীমকে আনি ইসহাক ও ইয়াকুবের মতো সন্তান দিয়েছি। তাঁদের সবাইকে সত্য পথ প্রদর্শন করেছি, যা প্রদর্শন করেছিলাম ইতোপূর্বে নূহকে। তাছাড়া তাঁর বংশধরদের মধ্যে দাইদ, সুলাইমান, আইয়ুব, ইউসুফ, মুসা এবং হারুনকে সঠিক পথ দেখিয়েছি। উপকারী লোকদের আমি এভাবেই প্রতিদান দিয়ে থাকি। তাঁর সন্তানদের মধ্য থেকে যাকারিয়া, ইয়াহিয়া, ঈসা এবং ইলিয়াসকেও সঠিক প্রদর্শন করেছি। এরা প্রত্যেকেই ছিলো যোগ্য সংস্কারক। তাঁরই বংশ থেকে ইসমাঈল, আলইয়াসা, ইউনুস এবং লুতকেও সঠিক পথ দেখিয়েছি। এদের প্রত্যেককে আমি বিশ্ববাসীর উপর মর্যাদা দিয়েছি।” (সূরা আল আনয়াম, ৮৪-৮৬)

 

তাঁর সংস্কারমুলক কাজ

 

কুরআনের বর্ণনা থেকেই আপনারা জানতে পারলেন হযরত ইলিয়াস (আঃ) কতো বিরাট মর্যাদার অধিকারী নবী ছিলেন এবং আল্লাহর কতটা প্রিয় ছিলেন? সূরা আস-সাফফাতে তাঁর সংস্কারমুলক আন্দোলনের একটি সংক্ষিপ্ত অথচ চমৎকার বর্ণনা দেয়া হয়েছে –

 

“আর ইলিয়াসও ছিলো একজন রাসুল। স্মরণ করো, সে তাঁর জাতিকে যখন বলেছিলো, তোমরা কি সতর্ক হবেনা? তোমরা কি তোমাদের এবং তোমাদের পূর্ব পুরুষদের প্রভু মহামহিম স্রষ্টা আল্লাহকে পরিত্যাগ করে বা’আলের পূজা অর্চনা করবে? কিন্তু তারা তাঁকে অস্বীকার করলো। কাজেই এখন অবশ্যি তাঁদের হাজির করা হবে শাস্তি ভোগের জন্যে, তবে আল্লাহর নিষ্ঠাবান দাসদের নয়। আর পরবর্তী প্রজন্মের কাছে আমি ইলিয়াসের সুখ্যাতি অব্যাহত রেখেছি। ইলিয়াসের প্রতি সালাম। উপকারী লোকদের আমি এভাবেই প্রতিফল দিয়ে থাকি। সে ছিলো আমার একনিষ্ঠ মুমিন দাসদেরই একজন।” (সূরা ৩৭, আস-সাফফাত, আয়াত ১২৩-১৩২)

 

বা’আল কে?

 

আল্লাহর উপরোক্ত বানী থেকে আমরা জানতে পারলাম হযরত ইলিয়াসের জাতি বা’আলের পূজা অর্চনা করতো। বা’আলের কাছেই প্রার্থনা করতো এবং তাকেই খোদা বলে ডাকতো। তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে বা’আলকে মাবুদ বানিয়ে নিয়েছিলো। আপনারা কি জানেন এই বা’আল কে?

 

‘বা’আল’ এর আভিধানিক অর্থ স্বামী বা পতি। প্রাচীনকালে সিরিয়া ও জর্ডান অঞ্চলে পূজনীয়, উপাস্য, প্রভু এবং দেবতা অর্থে এ শব্দটি ব্যবহার করা হতো। সেকালে লেবাননের ফিনিকি সম্প্রদায়ের লোকেরা তাঁদের সবচে’ বড় দেবতাটিকে বলতো বা’আল। এ ছিলো পুরুষ দেবতা। এ মূর্তিটির স্ত্রীর নাম ছিলো আশারাত। এ ছিল সবচে’ বড় দেবী। আবার কোন কোন সম্প্রদায় সূর্য পূজা করতো। তারা সূর্যকেই বা’আল বলতো। আর চন্দ্র অথবা শুক্রগ্রহ ছিল এদের আশারাত। ইতিহাস থেকে জানা যায় সেকালে বেবিলন থেকে নিয়ে মিশর পর্যন্ত গোটা মধ্যপ্রাচ্যে বা’আলের পূজা বিস্তার লাভ করে। বিশেষ করে লেবানন, সিরিয়া এবং ফিলিস্তিন অঞ্চলের মুশরিক জাতিগুলো বা’আলের পুজায় আপাদমস্তক ডুবে গিয়েছিলো। এবার আপনারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন বা’আল কে?

 

বনী ইসরাইলের বা’আল পূজা

 

হযরত মুসা (আঃ) এর পর বনী ইসরাইলদের মধ্যে বা’আল পুজার প্রবনতা শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত তারা বা’আল পুজায় চরম আসক্ত হয়ে পড়ে। জানা যায় তারা কোন একস্থানে বা’আলের যজ্ঞবেদী তৈরি করে নিয়েছিল এবং সেখানে তারা বা’আলের নামে বলিদান করতো। একবার একজন খাঁটি মুমিন এই বেদীটি ভেঙ্গে ফেলে। পরদিন লোকেরা সমাবেশ লরে তাঁর মৃত্যুদণ্ড দাবী করে। অবশেষে হযরত সামুয়েল, তালুত, দাউদ এবং সুলাইমান বনী ইসরাঈলকে মূর্তি পুজার কলুষতা থেকে মুক্ত করেন। তারা মধ্যপ্রাচ্যে বিরাট শক্তিশালী ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। সে রাষ্ট্র থেকে শিরক ও মূর্তি পূজা উচ্ছেদ করেন। কিন্তু সুলাইমান (আঃ) এর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র রহুবমের অযোজ্ঞতার কারনে বনী ইসরাইল রাজ্য ভেঙ্গে দু’ভাগ হয়ে যায়। একভাগে ছিল বাইতুল মাকদাস সহ দক্ষিন ফিলিস্তিন নিয়ে গঠিত ইহুদী রাষ্ট্র। আর উত্তর ফিলিস্তিনের নাম থাকে ইসরাইল রাষ্ট্র।

 

ইসরাইল রাষ্ট্রের লোকেরা আবার মূর্তি পুজায় নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। তারা শিরক, মূর্তিপূজা, ফাসেকী, চরিত্রহীনতা এবং যাবতীয় বদ আমলের মধ্যে নিমজ্জিত হয়। বা’আল কে তারা দেবতা বানিয়ে নেয়। তারা নবীদের বংশধর হয়েও আল্লাহকে বাদ দিয়ে বা’আলের উপাসনায় লিপ্ত হয়ে পড়ে।

 

মুক্তির বানী নিয়ে এলেন ইলিয়াস

 

বনী ইসরাইল শিরক ও চরম পাপাচারের কারনে ধ্বংসের মুখোমুখি এসে দাড়ায়। এ সময় মহান আল্লাহ ইলিয়াসকে নবুয়্যত দান করেন। বনি ইসরাইলকে সতর্ক করার নির্দেশ দেন। তাঁদেরকে মুক্তি এবং কল্যাণের পথে আসার আহবান জানাতে বলেন। ইলিয়াস শাসকবর্গ ও জনগনের সামনে হাজির হন। তাঁদের সতর্ক করতে বলেন। আল্লাহকে ভয় করতে বলেন। মূর্তিপূজা ও পাপাচার ত্যাগ করতে বলেন। বা’আলকে পরিত্যাগ করতে বলেন। তাঁদেরকে আল্লাহর বিধানের ভিত্তিতে জীবন যাপন করতে বলেন। তখন ইসরাইলের রাজা ছিলেন আখিয়াব। আখিয়াব লেবাননের (সেকালে লেবাননকে বলা হত সাঈদা) মুশরিক রাজ কন্যাকে বিয়ে করে নিজেও মুশ্রিক হয়ে পড়েন। হযরত ইলিয়াস আখিয়াবের কাছে এসে বলে দেন, তোমার পাপের কারনে এখন আর ইসরাইল রাজ্যে এক বিন্দু বৃষ্টিও হবেনা। শিশির এবং কুয়াশাও পড়বে না।

 

আল্লাহর নবীর উক্তি অক্ষরে অক্ষরে সত্য হলো। সাড়ে তিন বছর পর্যন্ত ইসরাইল রাষ্ট্রে বৃষ্টিপাত বন্ধ হয়ে থাকলো। এবার আখিয়াবের হুশ হলো। সে হযরত ইলিয়াসকে সন্ধান করে আনলো। অনুনয় বিনয় করে হযরত ইলিয়াসকে বৃষ্টির জন্যে দোয়া করতে বললো। হযরত ইলিয়াস এই সুযোগে বা’আলকে মিথ্যা প্রমান করে দেবার সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি আখিয়াবকে শর্ত দিলেন, একটি জনসমাবেশ ডাকতে হবে। সেখানে বা’আলের পূজারীরা বা’আলের নামে বলিদান করবে এবং আমি আল্লাহর নামে কুরবানী করবো। গায়েবী আগুন এসে যে পক্ষের কুরবানীকে জালিয়ে ভস্মীভূত করে দিয়ে যাবে সে পক্ষের মা’বুদকেই সত্য বলে মেনে নিতে হবে। আখিয়াব এ শর্ত মেনে নিলো, তারপর কি হলো? তারপর আখিয়াব সাধারন জনসমাবেশ ডাকলো। সেখানে সাড়ে আটশো বা’আল পূজারী একত্রিত হলো। কুরবানী হলো, বলিদান হলো। তারপর? অতপর আকাশ থেকে আগুন এসে হযরত ইলিয়াসের কুরবানীকে ভস্মীভূত করে দিয়ে গেলো। সমস্ত জনগনের সামনে বা’আল মিথ্যা খোদা বলে প্রমানিত হলো। জনগন বা’আল পূজারীদের হত্যা করলো। হযরত ইলিয়াস সেখানেই আল্লাহর কাছে বৃষ্টির জন্যে দোয়া করলেন। সাথে সাথেই আকাশে মেঘ করলো। প্রচুর বৃষ্টিপাত হলো। জনগন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।

 

নবীর উপর নির্যাতন

 

কিন্তু আখিয়াব ছিলো স্ত্রৈণ। স্ত্রৈণ মানে স্ত্রীর অনুগত। সে স্ত্রীর গোলামী থেকে মুক্ত হতে পারেনি। তাঁর মুশরিক স্ত্রী হযরত ইলিয়াসের ঘোরতর শত্রু হয়ে পড়ে। স্ত্রীর খপ্পরে পড়ে আখিয়াব আল্লাহর নবীর উপর নির্যাতন শুরু করে। তাঁর স্ত্রী ইসাবেলা ঘোষণা করে দেয়, বা’আল পূজারীদের যেভাবে হত্যা করা হয়েছে, ইলিয়াসকেও সেভাবে হত্যা করা হবে। তারা অত্যাচার নির্যাতনের দাপটে জনগনের মুখ বন্ধ করে দিলো। ইলিয়াস একাকী হয়ে পড়লেন। তিনি বাধ্য হয়ে দেশ থেকে হিজরত করেন এবং সিনাই পর্বতের পাদদেশে আশ্রয় নেন।

 

সংস্কার কাজ চালিয়ে যান

 

হযরত ইলিয়াস কয়েকবছর সিনাইর পাদদেশে অবস্থান করেন। এরি মধ্যে দক্ষিন ফিলিস্তিনের ইয়াহুদী শাসক ইয়াহুরাম ইসরাইল রাজ্যের শাসক আখিয়াবের মুশরিক কন্যাকে বিয়ে করেন।

 

তাঁর প্রভাবে ইহুদী রাজ্যেও ব্যাপক ভাবে মূর্তিপূজার প্রচলন শুরু হয়। ইলিয়াস এখানে আসেন। তাঁদের সতর্ক করেন। তাদের আল্লাহর পথ দেখান। মূর্তিপূজা পরিত্যাগ করতে বলেন। মর্মস্পর্শী অনেক উপদেশ দিয়ে রাজা ইয়াহুরামকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পত্রও প্রদান করেন। কিন্তু তারা শিরক, মূর্তিপূজা ও পাপাচার থেকে বেরিয়ে আসেনি। শেষ পর্যন্ত রাজা ধ্বংস হয়ে যায়।

 

কয়েকবছর পর ইলিয়াস আবার ইসরাইল রাষ্ট্রে ফিরে আসেন। আখিয়াব ও তাঁর পুত্র আখযিয়াকে সঠিক পথে আনার আপ্রান চেষ্টা চালান। কিন্তু তাঁরাও আল্লাহর পথে ফিরে আসেনি। অবশেষে হযরত ইলিয়াসের বদদোয়ায় আখিয়াব রাজ পরিবার ধ্বংস হয়ে যায়।

 

হযরত ইলিয়াসের সুখ্যাতি

 

জীবদ্দশায় হযরত ইলিয়াসের প্রতি চরম অত্যাচার নির্যাতন চালালেও তাঁর মৃত্যুর পর বনী ইসরাইল তাঁর ভক্ত অনুরক্ত হয়ে পড়ে। বাইবেল থেকে জানা যায়, বনি ইসরাইল ধারনা করতো, ইলিয়াসকে আল্লাহ তায়ালা উঠিয়ে নিয়ে গেছেন এবং তিনি আবার পৃথিবীতে আসবেন। তারা ইলিয়াসের আগমনের প্রতীক্ষায় ছিলো। তাঁর আটশো বছর পরে হযরত ঈসা (আঃ) এর জন্ম হয়। তিনি তাঁর সাথীদের বলে যান, ইলিয়া (ইলিয়াস) আটশো বছর আগে অতীত হয়ে গেছেন। তিনি আর পৃথিবীতে আসবেননা। যাই হোক, পরবর্তী লোকদের মাঝে হযরত ইলিয়াসের প্রচুর সুখ্যাতি ছরিয়ে পড়ে। সেকথাই মহান আল্লাহ কুরআনে এভাবে বর্ণনা করেছেন-

 

“ আর পরবর্তী প্রজন্মের মাঝে আমি ইলিয়াসের সুখ্যাতি ছড়িয়ে দিয়েছি। ” (সুরা আস সাফফাত, আয়াত ১২৯)

 

‘সালামুন আ’লা ইলিয়াসিন।’

 

২০।

 

আলইয়াসা (আঃ)

 

আল কুরআনে হযরত আলইয়াসা

 

“ইসমাঈল, আলইয়াসা, ইউনুস এবং লুত এদের প্রত্যেককেই আমি বিশ্ববাসীর উপর মর্যাদাবান করেছি।” (সূরা আল আনয়াম, আয়াত ৮৬)

 

“আর ইসমাঈল, আলইয়াসা যুলকিফলের কথা স্মরণ করো। এরা প্রত্যেকেই ছিলো মহোত্তম।’’ (সূরা সোয়াদ, আয়াত ৪৮)

 

আল কুরআনে হযরত আলইয়াসার নাম এই দুইটি স্থানেই উল্লেখ হয়েছে। মহান আল্লাহ তাঁকে তাঁর শ্রেষ্ঠ নবী রাসুলদের মাঝে গণ্য করেছেন। তিনি তাঁকে দিয়েছিলেন অনেক বড় মর্যাদা ও উচ্চাসন। তিনি ছিলেন বনী ইসরাইলের শ্রেষ্ঠ নবীগনের অন্যতম। ইহুদী খ্রিষ্টানদের কাছে তাঁদের গ্রন্থাবলীতে তিনি ইলিশা (Elisha) হিসেবে পরিচিত।

 

প্রশিক্ষন ও মনোনয়ন

 

আলইয়াসা ছিলেন হযরত ইলিয়াসের ছাত্র ও শিষ্য। হযরত ইলিয়াস তাঁকে উত্তম প্রশিক্ষন দিয়ে যোগ্য করে গড়ে তোলেন। কুরআন মাজীদে তাঁর সম্পর্কে বিস্তারিত কোন বিবরন নেই। বাইবেলে বলা হয়েছে, আল্লাহ ইলিয়াসকে নির্দেশ প্রদান করেন আলইয়াসাকে নিজের স্থলাভিষিক্ত হিসেবে যোগ্য করে গড়ে তুলতে। এ নির্দেশ অনুযায়ী ইলিয়াস হযরত আলইয়াসার বসবাসের এলাকায় গিয়ে পৌঁছান।

 

ইলিয়াস দেখতে পান, আলইয়াসা বার জোড়া গরু নিয়ে জমিতে চাষ দিচ্ছেন। তিনি তাঁর পাশ দিয়ে যাবার কালে নিজের চাদর তাঁর গায়ে নিক্ষেপ করেন। সাথে সাথে আলইয়াসা ক্ষেতখামার চাষবাস ছেড়ে দিয়ে তাঁর সাথে চলে আসেন। প্রায় দশ বারো বছর আলইয়াসা হযরত ইলিয়াসের প্রশিক্ষনাধীনে থাকেন। অতঃপর ইলিয়াসকে উঠিয়ে নেবার পর আল্লাহ আলইয়াসাকে নবুয়্যত দান করেন এবং তাঁর স্থলাভিষিক্ত করেন। কোন কোন ঐতিহাসিক বলেছেন, হযরত আলইয়াসা হযরত ইলিয়াসের চাচাত ভাই ছিলেন।

 

 

 

সংশোধনের কাজ

 

হযরত ইলিয়াসের মৃত্যুর পর হযরত আলইয়াসা বলিষ্ঠভাবে ইসরাইলী শাসক ও জনগণকে সংশোধনের পদক্ষেপ নেন। শিরক, মূর্তিপূজা ও আনাচারের মূল অভিভাবক ও পৃষ্ঠপোষক ছিলো স্বয়ং রাজ পরিবার। হযরত আলইয়াসা তাঁদের সতর্ক করে দেন। আল্লাহর ভয় দেখান। কিন্তু কিছুতেই তারা আল্লাহর পথে আসতে রাজি হয়নি।

 

শেষ পর্যন্ত হযরত আলইয়াসা জনৈক যিহুকে রাজ পরিবারের বিরুদ্ধে দাড় করিয়ে দিলেন। যিহু রাজ পরিবারকে হত্যা করে এবং বা’আলের পূজা নিষিদ্ধ করে দেয়। কিন্তু জনগনের মনমগজে মূর্তি পুজার কুসংস্কার বদ্ধমূল হয়ে থাকে। হযরত আলইয়াসার মৃত্যুর পর পুনরায় ইসরাইলী সমাজ শিরকের পুতিগন্ধময় গহবরে নিমজ্জিত হয়।

 

২১।

 

মাছওয়ালা নবী ইউনুস

 

(আঃ)

 

“আর ইউনুস ছিলো অবশ্যই রাসুলদেরই একজন।” (আল কুরান-৩৮ ; ১৩৯)

 

 হযরত ইউনুস বিন মাত্তা (আঃ)-এর কথা পবিত্র কুরআনের মোট ৬টি সূরার ১৮টি আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। সূরা ইউনুস ৯৮ আয়াতে তাঁর নাম ইউনুস, সূরা আম্বিয়া ৮৭ আয়াতে ‘যুন-নূন’ এবং সূরা ক্বলম ৪৮ আয়াতে তাঁকে ‘ছাহেবুল হূত’ বলা হয়েছে। ‘নূন’ ও ‘হূত’ উভয়ের অর্থ মাছ। যুন-নূন ও ছাহেবুল হূত অর্থ মাছওয়ালা। একটি বিশেষ ঘটনার প্রেক্ষিতে তিনি উক্ত নামে পরিচিত হন। সামনে তা বিবৃত হবে।

 

ইউনুস কোন দেশের নবী?

 

হযরত ইউনুস (আঃ) একজন সম্মানিত নবী ছিলেন। তাঁর ব্যাপারে সরাসরি কুরআনে বিস্তারিত আলোচনা হয়নি। হাদিস, তাফসির ও ইতিহাসের বিভিন্ন বর্ণনা থেকে জানা যায়, তিনি সিরিয়ার লোক ছিলেন এবং ইসরাইল বংশের লোক ছিলেন। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে আসিরিয়াবাসীদের হিদায়াতের জন্যে ইরাকে যেতে নির্দেশ দেন। সে হিসেবে তিনি ইরাকে গিয়ে আসিরিয়াবাসীকে আল্লাহর পথে আনবার চেষ্টা সংরামে লিপ্ত হন। ইউনুস (আঃ) বর্তমান ইরাকের মূছেল নগরীর নিকটবর্তী ‘নীনাওয়া’ (نينوى) জনপদের অধিবাসীদের প্রতি প্রেরিত হন। তিনি তাদেরকে তাওহীদের দাওয়াত দেন এবং ঈমান ও সৎকর্মের প্রতি আহবান জানান। কিন্তু তারা তাঁর প্রতি অবাধ্যতা প্রদর্শন করে। বারবার দাওয়াত দিয়ে প্রত্যাখ্যাত হ’লে আল্লাহর হুকুমে তিনি এলাকা ত্যাগ করে চলে যান। ইতিমধ্যে তার কওমের উপরে আযাব নাযিল হওয়ার পূর্বাভাস দেখা দিল। জনপদ ত্যাগ করার সময় তিনি বলে গিয়েছিলেন যে, তিনদিন পর সেখানে গযব নাযিল হ’তে পারে। তারা ভাবল, নবী কখনো মিথ্যা বলেন না। ফলে ইউনুসের কওম ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে দ্রুত কুফর ও শিরক হ’তে তওবা করে এবং জনপদের সকল আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা এবং গবাদিপশু সব নিয়ে জঙ্গলে পালিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে তারা বাচ্চাদের ও গবাদিপশু গুলিকে পৃথক করে দেয় এবং নিজেরা আল্লাহর দরবারে কায়মনোচিত্তে কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। তারা সর্বান্ত:করণে তওবা করে এবং আসন্ন গযব হ’তে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করে। ফলে আল্লাহ তাদের তওবা কবুল করেন এবং তাদের উপর থেকে আযাব উঠিয়ে নেন। এ বিষয়ে আল্লাহ বলেন,

 

 “অতএব কোন জনপদ কেন এমন হ’ল না যে, তারা এমন সময় ঈমান নিয়ে আসত, যখন ঈমান আনলে তাদের উপকারে আসত? কেবল ইউনুসের কওম ব্যতীত। যখন তারা ঈমান আনল, তখন আমরা তাদের উপর থেকে পার্থিব জীবনের অপমানজনক আযাব তুলে নিলাম এবং তাদেরকে নির্ধারিত সময় পর্যন্ত জীবনোপকরণ ভোগ করার অবকাশ দিলাম” (সূরা ইউনুস, আয়াত ৯৮)। অত্র আয়াতে ইউনুসের কওমের প্রশংসা করা হয়েছে।

 

ওদিকে ইউনুস (আঃ) ভেবেছিলেন যে, তাঁর কওম আল্লাহর গযবে ধ্বংস হয়ে গেছে। কিন্তু পরে যখন তিনি জানতে পারলেন যে, আদৌ গযব নাযিল হয়নি, তখন তিনি চিন্তায় পড়লেন যে, এখন তার কওম তাকে মিথ্যাবাদী ভাববে এবং মিথ্যাবাদীর শাস্তি হিসাবে প্রথা অনুযায়ী তাকে হত্যা করবে। তখন তিনি জনপদে ফিরে না গিয়ে অন্যত্র হিজরতের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লেন। এ সময় আল্লাহর হুকুমের অপেক্ষা করাটাই যুক্তিযুক্ত ছিল। কিন্তু তিনি তা করেননি।

 

মাছের পেটে ইউনুস

 

আল্লাহ বলেন,

 

 “আর ইউনুস ছিল পয়গম্বরগণের একজন”। “যখন সে পালিয়ে যাত্রী বোঝাই নৌকায় গিয়ে পৌঁছল”। “অতঃপর লটারীতে সে অকৃতকার্য হ’ল”। “অতঃপর একটি মাছ তাকে গিলে ফেলল। এমতাবস্থায় সে ছিল নিজেকে ধিক্কার দানকারী” (সূরা ছাফফাত, আয়াত ১৩৯-১৪২)।

 

আল্লাহর হুকুমের অপেক্ষা না করে নিজস্ব ইজতিহাদের ভিত্তিতে ইউনুস (আঃ) নিজ কওমকে ছেড়ে এই হিজরতে বেরিয়েছিলেন বলেই অত্র আয়াতে তাকে মনিবের নিকট থেকে পলায়নকারী বলা হয়েছে। যদিও বাহ্যত এটা কোন অপরাধ ছিল না। কিন্তু পয়গম্বর ও নৈকট্যশীলগণের মর্তবা অনেক ঊর্ধ্বে। তাই আল্লাহ তাদের ছোট-খাট ত্রুটির জন্যও পাকড়াও করেন। ফলে তিনি আল্লাহর পরীক্ষায় পতিত হন।

 

হিজরতকালে নদী পার হওয়ার সময় মাঝ নদীতে হঠাৎ নৌকা ডুবে যাবার উপক্রম হ’লে মাঝি বলল, একজনকে নদীতে ফেলে দিতে হবে। নইলে সবাইকে ডুবে মরতে হবে। এজন্য লটারী হ’লে পরপর তিনবার তাঁর নাম আসে। ফলে তিনি নদীতে নিক্ষিপ্ত হন। সাথে সাথে আল্লাহর হুকুমে বিরাটকায় এক মাছ এসে তাঁকে গিলে ফেলে। কিন্তু মাছের পেটে তিনি হযম হয়ে যাননি। বরং এটা ছিল তাঁর জন্য নিরাপদ কয়েদখানা (ইবনে কাছীর, আম্বিয়া ৮৭-৮৮)। মাওয়ার্দী বলেন, মাছের পেটে অবস্থান করাটা তাঁকে শাস্তি দানের উদ্দেশ্যে ছিল না। বরং আদব শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে ছিল। যেমন পিতা তার শিশু সন্তানকে শাসন করে শিক্ষা দিয়ে থাকেন’ (কুরতুবী, আম্বিয়া ৮৭)।

 

ইউনুস (আঃ) মাছের পেটে কত সময় বা কতদিন ছিলেন, সে বিষয়ে মতভেদ রয়েছে। যেমন- (১) এক ঘণ্টা ছিলেন (২) তিনি পূর্বাহ্নে প্রবেশ করে অপরাহ্নে বেরিয়ে আসেন (৩) ৩ দিন ছিলেন (৪) ৭ দিন ছিলেন (৫) ২০ দিন ছিলেন (৬) ৪০ দিন ছিলেন। আসলে এইসব মতভেদের কোন গুরুত্ব নেই। কেননা এসবের রচয়িতা হ’ল ইহুদী গল্পকারগণ। প্রকৃত ঘটনা আল্লাহ ভাল জানেন।

 

ইউনুস কেন মাছের পেটে গেলেন?

 

এ বিষয়ে জনৈক আধুনিক মুফাসসির বলেন, রিসালাতের দায়িত্ব পালনে ত্রুটি ঘটায় এবং সময়ের পূর্বেই এলাকা ত্যাগ করায় তাকে এই পরীক্ষায় পড়তে হয়েছিল। আর নবী চলে যাওয়ার কারণেই তার সম্প্রদায়কে আযাব দানে আল্লাহ সম্মত হননি’। অথচ পুরা দৃষ্টিকোণটাই ভুল। কেননা কোন নবী থেকেই তাঁর নবুঅতের দায়িত্ব পালনে ত্রুটির কল্পনা করা নবীগণের নিষ্পাপত্বের আক্বীদার ঘোর বিপরীত। বরং তিনদিন পর আযাব আসবে, আল্লাহর পক্ষ হ’তে এরূপ নির্দেশনা পেয়ে তাঁর হুকুমেই তিনি এলাকা ত্যাগ করেছিলেন। আর তার কওম থেকে আযাব উঠিয়ে নেওয়া হয়েছিল তাদের আন্তরিক তওবার কারণে, নবী চলে যাওয়ার কারণে নয়।

 

ইউনুস মুক্তি পেলেন

 

আল্লাহ বলেন,

 

 “অতঃপর যদি সে আল্লাহর গুণগানকারীদের অন্তর্ভুক্ত না হ’ত” (ছাফফাত, আয়াত ১৪৩)। ‘তাহ’লে সে ক্বিয়ামত দিবস পর্যন্ত মাছের পেটেই থাকত’?। ‘অতঃপর আমরা তাকে একটি বিজন প্রান্তরে নিক্ষেপ করলাম, তখন সে রুগ্ন ছিল’। ‘আমরা তার উপরে একটি লতা বিশিষ্ট বৃক্ষ উদ্গত করলাম’। ‘এবং তাকে লক্ষ বা তদোধিক লোকের দিকে প্রেরণ করলাম’। ‘তারা ঈমান আনল। ফলে আমরা তাদেরকে নির্ধারিত সময় পর্যন্ত জীবন উপভোগ করার সুযোগ দিলাম” (ছাফফাত, আয়াত ১৪৩-১৪৮)।

 

আলোচ্য আয়াতে ‘ক্বিয়ামত দিবস পর্যন্ত সে মাছের পেটেই থাকত’-এর অর্থ সে আর জীবিত বেরিয়ে আসতে পারতো না। বরং মাছের পেটেই তার কবর হ’ত এবং সেখান থেকেই ক্বিয়ামতের দিন তার পুনরুত্থান হ’ত।

 

অন্যত্র আল্লাহ তাঁর শেষনবীকে উদ্দেশ্য করে বলেন,

 

 “তুমি তোমার পালনকর্তার আদেশের অপেক্ষায় ধৈর্য ধারণ কর এবং মাছওয়ালার (ইউনুসের) মত হয়ো না। যখন সে দুঃখাকুল মনে প্রার্থনা করেছিল’। ‘যদি তার পালনকর্তার অনুগ্রহ তাকে সামাল না দিত, তাহ’লে সে নিন্দিত অবস্থায় জনশূন্য প্রান্তরে পড়ে থাকত’। ‘অতঃপর তার পালনকর্তা তাকে মনোনীত করলেন এবং তাকে সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত করে নিলেন’ (ক্বলম, আয়া ৪৮-৫০)।

 

‘যদি আল্লাহর অনুগ্রহ তাকে সামাল না দিত, তাহ’লে সে নিন্দিত অবস্থায় জনশূন্য প্রান্তরে পড়ে থাকত’-এর অর্থ আল্লাহ যদি তাকে তওবা করার তাওফীক্ব না দিতেন এবং তার দো‘আ কবুল না করতেন, তাহ’লে তাকে জীবিত অবস্থায় নদী তীরে মাটির উপর ফেলতেন না। যেখানে গাছের পাতা খেয়ে তিনি পুষ্টি ও শক্তি লাভ করেন। বরং তাকে মৃত অবস্থায় নদীর কোন বালুচরে ফেলে রাখা হ’ত, যা তার জন্য লজ্জাষ্কর হ’ত।

 

‘অতঃপর তার পালনকর্তা তাকে মনোনীত করলেন’ অর্থ এটা নয় যে, ইতিপূর্বে আল্লাহ ইউনুসকে মনোনীত করেননি; বরং এটা হ’ল বর্ণনার আগপিছ মাত্র। কুরআনের বহু স্থানে এরূপ রয়েছে। এখানে এর ব্যাখ্যা এই যে, ইউনুস মাছের পেটে গিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করায় আল্লাহ তাকে পুনরায় কাছে টানলেন ও সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত করলেন।

 

অন্যত্র ইউনুসের ক্রুদ্ধ হয়ে নিজ জনপদ ছেড়ে চলে আসা, মাছের পেটে বন্দী হওয়া এবং ঐ অবস্থায় আল্লাহর নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা করা সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,

 

 “এবং মাছওয়ালা (ইউনুস)-এর কথা স্মরণ কর, যখন সে (আল্লাহর অবাধ্যতার কারণে লোকদের উপর) ক্রুদ্ধ হয়ে চলে গিয়েছিল এবং বিশ্বাসী ছিল যে, আমরা তার উপরে কোনরূপ কষ্ট দানের সিদ্ধান্ত নেব না’। ‘অতঃপর সে (মাছের পেটে) ঘন অন্ধকারের মধ্যে আহবান করল (হে আল্লাহ!) তুমি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। তুমি পবিত্র। আমি সীমা লংঘনকারীদের অন্তর্ভুক্ত’। ‘অতঃপর আমরা তার আহবানে সাড়া দিলাম এবং তাকে দুশ্চিন্তা হ’তে মুক্ত করলাম। আর এভাবেই আমরা বিশ্বাসীদের মুক্তি দিয়ে থাকি” (সূরা আম্বিয়া, আয়াত ৮৭-৮৮)।

 

ইউনুস (আঃ)-এর উক্ত দো‘আ ‘দো‘আয়ে ইউনুস’ নামে পরিচিত। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,

 

 ‘‘বিপদগ্রস্ত কোন মুসলমান যদি (নেক মকছূদ হাছিলের নিমিত্তে) উক্ত দো‘আ পাঠ করে, তবে আল্লাহ তা কবুল করেন’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,

 

 ‘’তোমরা আল্লাহর নবীগণের মধ্যে মর্যাদার তারতম্য করো না। আর কোন বান্দার জন্য এটা বলা উচিত নয় যে, আমি ইউনুস বিন মাত্তার চাইতে উত্তম’’। কুরতুবী এর ব্যাখ্যায় বলেন, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) এটা এজন্য বলেছেন যে, তিনি যেমন (মি‘রাজে) সিদরাতুল মুনতাহায় আল্লাহর নিকটবর্তী হয়েছিলেন, নদীর অন্ধকার গর্ভে মাছের পেটের মধ্যে তেমনি আল্লাহ ইউনুস-এর নিকটবর্তী হয়েছিলেন (কুরতুবী, আম্বিয়া ৮৭)। বস্ত্ততঃ এটা ছিল রাসূলের নিরহংকার স্বভাব ও বিনয়ের বহিঃপ্রকাশ মাত্র।

 

উপরোক্ত আয়াত সমূহে প্রতীয়মান হয় যে, ইউনুস (আঃ) মাছের পেটে থাকার পরে আল্লাহর হুকুমে নদীতীরে নিক্ষিপ্ত হন। মাছের পেটে থাকার ফলে স্বাভাবিকভাবেই তিনি রুগ্ন ছিলেন। ঐ অবস্থায় সেখানে উদ্গত লাউ জাতীয় গাছের পাতা তিনি খেয়েছিলেন, যা পুষ্টিসমৃদ্ধ ছিল। অতঃপর সুস্থ হয়ে তিনি আল্লাহর হুকুমে নিজ কওমের নিকটে চলে যান। যাদের সংখ্যা এক লক্ষ বা তার বেশী ছিল। তারা তাঁর উপরে ঈমান আনলো। ফলে পুনরায় শিরকী কর্মকান্ডে লিপ্ত না হওয়া পর্যন্ত আল্লাহ তাদেরকে অনুগ্রহ করেন এবং দুনিয়া ভোগ করার সুযোগ দেন।

 

শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ

 

(১) বিভ্রান্ত কওমের দুর্ব্যবহারে অতিষ্ট হয়ে তাদেরকে ছেড়ে চলে যাওয়া কোন সমাজ সংস্কারকের উচিত নয়।

 

(২) আল্লাহ তার নেক বান্দার উপর শাস্তি আরোপ করবেন না, যেকোন সংকটে এরূপ দৃঢ় বিশ্বাস রাখতে হবে।

 

(৩) আল্লাহর পরীক্ষা কিরূপ হবে, তা পরীক্ষা আগমনের এক সেকেন্ড পূর্বেও জানা যাবে না।

 

(৪) কঠিনতম কষ্টের মুহূর্তে কেবলমাত্র আল্লাহর কাছেই সাহায্য চাইতে হবে।

 

(৫) খালেছ তওবা ও আকুল প্রার্থনার ফলে অনেক সময় আল্লাহ গযব উঠিয়ে নিয়ে থাকেন। যেমন ইউনুসের কওমের উপর থেকে আল্লাহ গযব ফিরিয়ে নিয়েছিলেন।

 

(৬) আল্লাহ ইচ্ছা করলে যেকোন পরিবেশে ঈমানদারকে রক্ষা করে থাকেন।

 

(৭) পশু-পক্ষী, বৃক্ষ-লতা ও জলচর প্রাণী সবাই আল্লাহর হুকুমে ঈমানদার ব্যক্তির সেবায় নিয়োজিত হয়। যেমন মাছ ও লতা জাতীয় গাছ ইউনুসের সেবায় নিযুক্ত হয়েছিল।

 

(৮) বাহ্যদৃষ্টিতে কোন বস্ত্ত খারাব মনে হ’লেও নেককার ব্যক্তির জন্য আল্লাহ উত্তম ফায়ছালা করে থাকেন। যেমন লটারীতে নদীতে নিক্ষেপের সিদ্ধান্ত নিজের জন্য অতীব খারাব মনে হ’লেও আল্লাহ ইউনুসের জন্য উত্তম ফায়ছালা দান করেন ও তাকে মুক্ত করেন।

 

(৯) আল্লাহর প্রতি আনুগত্য ব্যতীত দো‘আ কবুল হয় না। যেমন গভীর সংকটে নিপতিত হবার আগে ও পরে ইউনুস আল্লাহর প্রতি আনুগত্যশীল ছিলেন। ফলে আল্লাহ তার দো‘আ কবুল করেন।

 

১০) আল্লাহর প্রতিটি কর্ম তার নেককার বান্দার জন্য কল্যাণকর হয়ে থাকে। যা বান্দা সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে না পারলেও পরে বুঝতে পারে। যেমন ইউনুস পরে বুঝতে পেরে আল্লাহর প্রতি অধিক অনুগত হন এবং এজন্য তিনি আল্লাহর প্রতি অধিক প্রত্যাবর্তনশীল বলে আল্লাহর প্রশংসা পান।

 

কুরআনে উল্লেখ

 

কুরআন মাজীদে হযরত ইউনুস (আঃ) এর নাম উল্লেখ হয়েছে ৬ বার। এর মধ্যে চার বার ইউনুস আর দুইবার মাছওয়ালা বলে উল্লেখ হয়েছে। কোথায় কোথায় উল্লেখ হয়েছে জেনে নিন ; সূরা আন নিসা ১৬৩। আল আনয়াম ৮৬। ইউনুস ৯৮। আস সাফফাত ১৩৯। আল আম্বিয়া ৮৭। আল কলম ৪৮।

 

২২।

 

যাকারিয়া

 

(আঃ)

 

শ্রেষ্ঠ রাসুলদের একজন

 

হযরত যাকারিয়ার নাম আপনারা নিশ্চয়ই শুনেছেন। তিনি ছিলেন শ্রেষ্ঠ রাসুলদের একজন। মহান আল্লাহ গোটা বিশ্ববাসীর উপর যাদের সম্মানিত করেছেন, তিনি তাঁদেরই অন্যতম। তাছাড়া তিনি সেইসব নবী রাসুলদেরও একজন, মানুষকে সত্য পথে আসার আহবান করার কারনে যাদেরকে আল্লাহর দুশমনরা যাদের হত্যা করেছিলো। তাই তিনি একজন শহীদ নবী। তিনি ছিলেন বনী ইসরাইলের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাসুল। হযরত ইবরাহীম ও ইয়াকুবের বংশধর তিনি। শুনুন আল্লাহর বানী –

 

“আর আমি ইব্রাহীমকে ইসহাক ও ইয়াকুবের মতো সন্তান দিয়েছি। তাঁদের প্রত্যেককে আমি সঠিক পথ দেখিয়েছি, যা দেখিয়েছিলাম ইতোপূর্বে নুহকে। একই পথ দেখিয়েছি আমি তাঁদের বংশধরদের মধ্যে দাউদ, সুলাইমান, আইয়ুব, ইউসুফ, মুসা, হারুণকে। মুহসিন লোকদের আমি এভাবেই প্রতিদান দিয়ে থাকি। আমি একই পথ দেখিয়েছি যাকারিয়া, ইয়াহিয়া, ইলিয়াস ও ঈসা কে। এরা সবাই ছিলো সংস্কারক। সেই পথই দেখিয়েছি আমি ইসমাঈল, আলইয়াসা, ইউনুস ও লুতকে। এদের প্রত্যেককেই আমি বিশ্ববাসীর উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি।” (সূরা আল আনয়াম ৮৪-৮৬)

 

দীনি নেতৃত্ব

 

বনি ইসরাইলের দীনি কার্যক্রমের কেন্দ্র ছিল বাইতুল মাকদাস। বনি ইসরাইলের মধ্যে হযরত হারুন (আঃ) এর বংশধর একটি গোত্রের উপর দায়িত্ব ছিল বাইতুল মাকদাসের রক্ষনাবেক্ষনের। হযরত যাকারিয়া (আঃ) ছিলেন এ গোত্রের প্রধান। গোত্রীয় প্রধান হিসেবে তিনিই ছিলেন এই মহান দীনি কেন্দ্রের পরিচালক ও তত্ত্বাবধায়ক। তাকেই লরতে হত এই ঘরের সেবা ও পরিচর্যা। দীনের দাওয়াত ও শিক্ষা প্রচার এবং সৎকাজের আদেশ এবং অন্যায় অসৎ কাজ থেকে বারন ও বাধা দানই ছিলো তাঁর দীনি মিশনের মূল কাজ। তিনি ছিলেন আল্লাহর অনুগত দাস এবং সত্য সততা ও আদর্শের মূর্ত প্রতীক।

 

একটি ছেলে দাও আল্লাহ

 

কিন্তু হযরত যাকারিয়া এই দীনি নেতৃত্বের উত্তরাধিকারী নিয়ে ছিলেন খুবই চিন্তিত। তাঁর বংশে এমন কোন যোগ্য লোক ছিলো না তাঁর মৃত্যুর পর যে এই মহান দীনি দায়িত্ব পালন করতে পারতো। তিনি ছিলেন নিঃসন্তান। তাই পরবর্তী দায়িত্বের ব্যাপারে তিনি সব সময়ই ছিলেন চিন্তিত। এখন তাঁর বয়েস প্রায় একশো বছর। চিন্তা তাঁর বেড়েই চললো। হঠাৎ ঘটে গেলো একটি ঘটনা। ঘতনাতির আছে একটি পূর্ব কথা, শুনুন তবে সে কথাটি –

 

হযরত ঈসা (আঃ) এর নানী আল্লাহর কাছে মানত করলেন, হে আল্লাহ, আমার এখন যে সন্তানটি হবে, আমি ওকে তোমার জন্যে নজরানা দিলাম। ও তোমার জন্যে উৎসর্গিত হবে। তুমি এই নজরানা কবুল করে নাও। তিনি আশা করেছিলেন তাঁর একটি ছেলে হবে এবং তিনি ওকে বাইতুল মাকদাসে দীনের কাজের জন্যে বিশেষভাবে নিয়োগ করবেন। কিন্তু মানুষ যা চায় তা হয় না। আল্লাহ যা চান তাই হয়। কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর একটি মেয়ে হলো। তিনি মেয়েটির নাম রাখলেন মরিয়ম। মরিয়ম প্রাপ্ত বয়স্ক হলে মানত অনুযায়ী ওকে তিনি পৌঁছে দিলেন বাইতুল মাকদাসে। এখন প্রশ্ন দেখা দিলো, সেখানে ওর দেখাশুনার দায়িত্ব পালন করবে কে? মরিয়মকে দেখাশুনার দায়িত্ব পালন করতে এগিয়ে এলেন অনেকে। এ দায়িত্ব পালনের জন্যে এগিয়ে এলেন হযরত যাকারিয়া। আরো এগিয়ে এলেন অন্যান্য গোত্রের ধর্মীয় নেতারা। তারা সবাই দাবী করলেন এ মহৎ সেবা প্রদানের। নিজের দাবী ত্যাগ করছেননা কেউই। ফলে অনুষ্ঠিত হলো কোরা (লটারি)। লটারিতে কার নাম উঠেছে জানেন? যাকারিয়া, হ্যাঁ, হযরত যাকারিয়ার নাম। তিনি দেখাশুনা শুরু করতে লাগলেন মরিয়মকে, এদিকে তিনি মরিয়মের খালু হন। হযরত যাকারিয়ার স্ত্রী এবং মরিয়মের মা সহোদর বন। ফলে মরিয়মের সেবা ও আদর যত্ন হতে লাগলো সুন্দর ও নিখুঁতভাবে। মরিয়ম ই’তেকাফ ও ইবাদাত বন্দেগীর মাধ্যমে নিজের আত্মার অনেক উন্নতি সাধন করেছেন। একদিনের ঘটনা। হযরত যাকারিয়া বাইতুল মাকদাসের সেই নির্দিষ্ট ঘরে দেখতে এলেন মরিয়মকে। কক্ষে ঢুকেই তিনি অবাক। দেখলেন মরিয়মের সামনে সাজানো রয়েছে অনেক সুস্বাদু ফল। এইসব ফল এই মওসুমের ফল নয়। জেরুজালেমে তো এখন এই ফল পাওয়া যায়না। বিস্মিত হয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, মরিয়ম এ ফল তুমি কোথায় পেলে?

 

মরিয়ম – আল্লাহ পাঠিয়েছেন।

 

এ জবাব শুনে হযরত যাকারিয়ার অন্তরে আশার উদয় হলো। তিনি ভাবলেন, যে আল্লাহ মরিয়মকে বেমওসুমের ফল দিতে পারেন, তিনি ইচ্ছে করলে তো আমাকেও বড়ো বয়েসে ছেলে দিতে পারেন। তিনি দু’হাত উঠালেন আল্লাহর দরবারে। একটি ছেলে চাইলেন আল্লাহর দরবারে। তাঁর সেই দোয়া কুরআনে উল্লেখ হয়েছে এভাবে –

 

“প্রভু, তোমার বিশেষ ক্ষমতা বলে আমাকে একটি সৎ সন্তান দান করো। তুমি তো অবশ্যি দোয়া স্রবণকারী। ” (সূরা আলে ইমরান, আয়াত ৩৭-৩৮)

 

“যাকারিয়া চুপে চুপে তাঁর প্রভুকে ডাকলো। সে বললো – প্রভু, আমার হাড়গুলো পর্যন্ত নরম হয়ে গেছে। মাথা বার্ধক্যে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে প্রভু। তোমার কাছে কিছু চেয়ে আমি কখনোই ব্যর্থ হইনি। আমি আমার পড়ে নিজের যোগ্য উত্তরাধিকারী না থাকার আশংকা করছি। এদিকে আমার স্ত্রী হলো বন্ধ্যা। তাই তুমি তোমার বিশেষ অনুগ্রহে আমাকে একজন উত্তরাধিকারী দান করো। যে হবে আমার ও ইয়াকুবের বংশের উত্তরাধিকারী। আর হে প্রভে, তুমি ওকে তোমার পছন্দনীয় মানুষ বানিয়ো।” (সূরা মরিয়ম, আয়াত ২-৬)

 

“আর যাকারিয়ার কথা স্মরণ করো। যখন সে তাঁর প্রভুকে ডেকে বলেছিল, প্রভু, আমাকে একাকী ছেড়ে দিও না আর সর্বোত্তম উত্তরাধিকারী তো তুমিই।” (সূরা আল আম্বিয়া, আয়াত ৮৯)

 

আল্লাহ সর্বশক্তিমান। তিনি যা চান তাই করেন। তিনি কিছু করতে চাইলে বলেন, ‘হও’ আর সাথে সাথে তা হয়ে যায়। তিনি তাঁর দাস ও রাসুল যাকারিয়ার দোয়া কবুল করলেন। তিনি বৃদ্ধ পিতা আর বন্ধ্যা মায়ের ঘরে সন্তান দান করলেন। একটি সুপুত্র। নাম তাঁর ইয়াহিয়া। তিনি হযরত যাকারিয়ার শুধু একটি সুপুত্রই ছিলেন না, সেই সাথে আল্লাহ তাঁকে রিসালাতও দান করেন।”

 

হত্যা করা হলো তাঁকে

 

এ যাবত পরার পর আপনারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন হযরত যাকারিয়া কোন সময়কার নবী? হ্যাঁ, তিনি হযরত ঈসা (আঃ) এর লাগভাগ পূর্বেকার নবী। তাঁর বয়েসের শেষ আর হযরত ঈসা (আঃ) এর আগমন প্রায় একই সময়। আর এসময়টা ছিল এখন থেকে মাত্র দুই হাজার বছর পূর্বে। এসময় ফিলিস্তিনের ইহুদীরা প্রকাশ্যে যিনা, ব্যাভিচার ও অশ্লীল কাজ করতো। যে দু চারজন ভালো মানুষ ছিলেন তারা ছিলেন নির্যাতিত। পাপ ও পাপিষ্ঠদের সমালোচনা করলে জীবনের নিরাপত্তা ছিলো না।

 

কিন্তু হযরত যাকারিয়া ছিলেন তো আল্লাহর নবী। মানুষকে অন্যায় অপ্রাধের কাজ থেকে সঠিক পথে আনার চেষ্টা করাই নবীর কাজ। নবী ও নবীর সত্যিকারের অনুসারী ঈমানদারেরা কখনো অত্যাচার ও নির্যাতনকে ভয় পান না। তাঁরা যে কোন পরিস্থিতিতে মানুষকে বিরত রাখার এবং সঠিক পথে ডাকার কাজ করে যান।

 

হযরত যাকারিয়া বনী ইসরাইলকে মন্দো কাজ করতে নিষেধ করেন। পাপের পথে বাধা সৃষ্টি করেন এবং তাঁদেরকে আল্লাহর পথে তথা সত্য ও ন্যায়ের পথে আসার আহবান জানাতে থাকেন। তাঁর ভালো কাজের আদেশ আর মন্দ কাজের বাধাদানকে পাপিষ্ঠ শাসক আর সমাজের অপরাধী নেতারা বরদাশত করতে পারেনি। তারা হযরত যাকারিয়াকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়। শেষ পর্যন্ত অন্যায়ের প্রতিবাদে সোচ্চার হওয়ার কারনে ইহুদী রাষ্ট্রের রাজা ইউআসের নির্দেশে আল্লাহর নবী হযরত যাকারিয়াকে ইহুদীরা হাইকালে সুলাইমানিতে পাথর মেরে হত্যা করে। এভাবে বনী ইসরাইল হত্যা করেছে বহু নবীকে। তাঁদের এইসব জঘন্য হত্যাকাণ্ডের কথা উল্লেখ করে আল কুরআনে মহান আল্লাহ বনী ইসরাইলকে লক্ষ্য করে বলেন –

 

“যখনই তোমাদের প্রবৃত্তির কামনার বিপরীত কোন জিনিস নিয়ে আমার কোন রাসুল তোমাদের কাছে এসেছে, তখনই তোমরা তাঁর বিরুদ্ধাচারন করেছো, কাউকেও মিথ্যা বলেছো আর কাউকেও হত্যা করেছো।” (সূরা আল বাকারা, আয়াত ৮৭)

 

কোন কোন বর্ণনা থেকে জানা যায়, ইহুদীরা হযরত যাকারিয়াকে করাত দিয়ে দ্বিখণ্ডিত করে ফেলেছিল।

 

আল কুরআনে হযরত যাকারিয়া

 

আল কুরআনে হযরত যাকারিয়াকে অতি উচ্চ মর্যাদার নবী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কুরআন মাজীদে তাঁর নাম উল্লেখ হয়েছে সাতবার। যেসব সূরা ও আয়াতে উল্লেখ হয়েছে সেগুলো নিম্নরূপ –

 

সূরা আলে ইমরানে ৩৭ নং আয়াতে দুইবার। একই সূরা আয়াত ৩৮। সূরা আল আনয়াম, আয়াত ৮৫। সূরা মরিয়ম, আয়াত ২ ও ৭। সূরা আল আম্বিয়া, আয়াত ৮৯।

 

হযরত যাকারিয়া (আঃ) সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্যে পড়ুন- সূরা আলে ইমরানে ৩৫-৪১ আয়াত। সূরা মরিয়ম ১-১৫ আয়াত। সূরা আল আম্বিয়া, আয়াত ৮৯-৯০।

 

কি শিক্ষা পেলাম?

 

আল কুরাআনের আলোকে আমরা হযরত যাকারিয়ার জীবনী থেকে কয়েকটি বড় বড় শিক্ষা লাভ করতে পারি। সেগুলো হলো –

 

১। পুত পবিত্র জীবন যাপন।

 

২। আল্লাহর প্রতি আনুগত্য ও বিনয়।

 

৩। যা কিছু চাওয়ার কেবল আল্লাহর কাছেই চাইতে হবে।

 

৪। আল্লাহকে সর্বশক্তিমান জানতে হবে।

 

৫। আল্লাহর কাছে সৎ ও নেক্কার সন্তান প্রার্থনা করতে হবে।

 

৬। মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকতে হবে।

 

৭। মন্দ কাজে প্রতিবাদ করতে হবে এবং বাধা দিতে হবে।

 

৮। ধৈর্য ও দ্রঢ়তার সাথে আল্লাহর পথে অটল থাকতে হবে।

 

৯। প্রয়োজনে আল্লাহর পথে শহীদ হবার জন্যে প্রস্তুত থাকতে হবে।

 

 

 

২৩

 

শহীদ ইয়াহইয়া (আঃ)

 

তাঁর জন্ম আল্লাহর একটি নিদর্শন

 

আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সমস্ত ক্ষমতার উৎস ও মালিক। এই পৃথিবীর সব তাঁর সৃষ্ট প্রাকৃতিক নিয়মে চলে। সব কিছুই তাঁর বেধে দেয়া নিয়ম ও বিধানের অধীন। কোনো কিছুতে তাঁর বেধে দেয়া নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটলে তা হয়ে যায় ধ্বংস। তাঁর বেধে দেয়া সুনির্দিষ্ট নিয়মেই জন্ম হয় সব মানুষের। নিয়ম যেহেতু তিনিই তৈরি করেছেন, তাই নিয়মের ব্যতিক্রম কিছু করলে তিনিই করতে পারেন, আর কেউ নয়। কখনো কখনো তিনি মানুষ সৃষ্টির ক্ষেত্রে নিয়মের ব্যতিক্রম কিছু করেছেন। বাবা মা ছাড়াই সৃষ্টি করেছেন আদম ও হাওয়াকে। বাবা ছাড়া শুধু মা থেকেই সৃষ্টি করেছেন হযরত ঈসা (আঃ) কে। আবার প্রায় শতায়ু বৃদ্ধ পিতা ইবরাহীম এবং অনুরুপ বৃদ্ধা-বন্ধ্যা মাতা হযরত সারাহকে দান করেছেন পুত্র ইসহাককে। এই একইরকম ঘটনা ঘটেছে হযরত ইয়াহিয়ার ক্ষেত্রে। প্রায় শতায়ু বৃদ্ধ পিতা হযরত যাকারিয়া এবং অনুরুপ বৃদ্ধা-বন্ধ্যা মাতার ঘরে জন্ম নিয়েছেন হযরত ইয়াহিয়া (আঃ)।

 

আপনারা হয়তো যাকারিয়ার জীবনীতে দেখেছেন, তাঁর কোন সন্তান ছিল না। বৃদ্ধ বয়সে বন্ধ্যা স্ত্রীর ঘরে তিনি আল্লাহর কাছে আল্লাহর পছন্দনীয় সন্তান প্রার্থনা করেন। মহান আল্লাহ তাঁর দোয়া কিবুল করে বলেন, তুমি সন্তান পাবে। আল্লাহ তাঁকে সুসুংবাদ দেন এভাবে –

 

“যাকারিয়া যখন মেহরাবে দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করতেছিলো তখন ফেরেস্তারা তাঁকে ডেকে বললো – আল্লাহ আপনাকে ইয়াহিয়ার সুসংবাদ দিচ্ছেন। সে (অর্থাৎ ঈসা আঃ) আল্লাহর একটি হুকুমকে সত্যায়িত করবে। সে হবে একজন নেতা, সততার প্রতীক এবং একজন সংস্কারক নবী।” (সূরা আলে ইমরান, আয়াত ৩৯)

 

সূরা মরিয়মে বলা হয়েছে – “হে যাকারিয়া, তোমার প্রার্থনার প্রেক্ষিতে আমি তোমাকে একটি পুত্রের সুসংবাদ দিচ্ছি। তাঁর নাম হবে ইয়াহিয়া। এ নামে কোন লোক আমি এর আগে সৃষ্টি করিনি।” (সূরা মরিয়ম, আয়াত ৭)

 

সূরা আল আম্বিয়াতে বলা হয়েছে –

 

“আমি তাঁর দোয়া কবুল করেছি আর তাঁকে ইয়াহিয়াকে দান করেছি আর এজন্যে তাঁর স্ত্রীকে যোগ্য করে দিয়েছিলাম গর্ভ ধারন করার জন্যে। কারন তারা কল্যাণের কাজে আপ্রান চেষ্টা করতো, ভয় আর আশা নিয়ে আমাকে ডাকতো এবং আমার প্রতি ছিলো তারা অবনত। ” (সূরা আল আম্বিয়া, আয়াত ৯০)

 

এভাবেই মহান আল্লাহ তাঁর বিশেষ কুদরতে বৃদ্ধ পিতা মাতার ঘরে জন্মের ব্যবস্থা করেন হযরত ইয়াহিয়ার। আল কুরআন থেকে আমরা একথাও জানতে পারলাম যে, ইয়াহিয়া নামটি সরাসরি আল্লাহর দেয়া নাম। মহান আল্লাহই পিতা যাকারিয়াকে নির্দেশ দিয়েছেন তাঁর পুত্রের নাম যেন ইয়াহিয়া রাখা হয়।

 

ইয়াহিয়া ও ঈসা

 

হযরত ইয়াহিয়া (আঃ) হযরত ঈসা (আঃ) এর তিন বা ছয় মাসের বড়। তারা ছিলেন নিকটাত্মীয় এবং পরস্পরের বন্ধু। তারা একজন আরেকজনকে ভাই বলে সম্বোধন করতেন। বয়স ত্রিশ বছর হবার পূর্বেই আল্লাহ তায়ালা হযরত ইয়াহিয়া (আঃ) কে নবুয়্যত দান করেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত জ্ঞানী, সত্তপন্থী, আল্লাহভীরু এবং পবিত্র জীবনের অধিকারী। হযরত ইয়াহিয়া (আঃ) ছিলেন হযরত ঈসা (আঃ) এর সত্যায়নকারী। হযরত ঈসা ছিলেন আল্লাহর বিশেষ নির্দেশ (কালেমা)। আল্লাহর নির্দেশে পিতা ছাড়াই তাঁর জন্ম হয়। লোকেরা তাঁর ব্যাপারে বিভিন্ন মোট প্রকাশ করতে থাকে। হযরত ইয়াহিয়া আল্লাহর পক্ষ থেকে ঈসার বিষয়ে সত্য তথ্য প্রকাশ করেন। তিনি ঘোষণা করেন আল্লাহর নির্দেশে বিনা বাপেই ঈসার জন্ম হয়েছে। তিনি আল্লাহর দাস ও রাসুল। আপনারা ঈসাকে আল্লাহর রাসুল হিসেবে গ্রহন করুন এবং তাঁর আনুগত্য করুন।

 

পাঁচটি কাজের নির্দেশ

 

হযরত ইয়াহিয়া ছোট বেলা থেকেই সব সময় আল্লাহর ভয়ে আল্লাহর ইবাদাতে মশগুল থাকতেন। আল্লাহর প্রতি বিনয়, আনুগত্য ও ইবাদাতের মাধ্যমে নিজের আত্মাকে অনেক উন্নত করেন। এরি মধ্যে আল্লাহ তায়ালা তাঁকে নির্দেশ দেন-

 

“হে ইয়াহিয়া, আল্লাহর কিতাবকে মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরো। ” (সূরা মরিয়ম, আয়াত ১২)

 

এখানে আল্লাহর কিতাব বলতে তাওরাতকে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা হযরত ইয়াহিয়াকে তাওরাতের বিধান কায়েম করতে এবং মানুষকে এ কিতাবের বিধান মতো জীবন যাপন করবার আহবান জানাতে নির্দেশ দেন।

 

তিরমিযি, ইবনে মাযাহ ও মুসনাদে আহমাদে হারেস আশয়ারী থেকে বর্ণিত একটি হাদিস থেকে জানা যায়, আল্লাহ তায়ালা হযরত ইয়াহিয়াকে হুকুম দিয়েছিলেন মানুষকে বিশেষভাবে পাঁচটি কাজের নির্দেশ দিতে। এ হাদিসে আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (সঃ) বলেন –

 

“আল্লাহ তায়ালা ইয়াহিয়া ইবনে যাকারিয়াকে বিশেষভাবে পাঁচটি কাজের নির্দেশনা দিয়েছিলেন। এই পাঁচটি কাজ যেন তিনি নিজে করেন এবং বনী ইসরাইলকে করবার নির্দেশ দেন। কোন কারনে বনী ইসরাইলকে এই পাঁচটি কাজের নির্দেশ দিতে তাঁর বিলম্ব হয়। ফলে হযরত ঈসা তাঁকে বললেন – আল্লাহ পাক আপনাকে পাঁচটি কাজ করতে এবং বনী ইসরাইলকে করবার জন্যে নির্দেশ দিতে বলেছেন। সে নির্দেশ কি আপনি তাঁদের পৌছাবেন না আমি পৌছাবো? ইয়াহিয়া বললেন- হে ভাই, আমার আশংকা হয়, আপনি যদি আমার আগে পৌঁছান তাহলে আল্লাহ আমাকে শাস্তি দেবেন বা জমিনের নীচে ধসিয়ে দেবেন।

 

অতপর তিনি বনী ইসরাইলকে বাইতুল মাকদাসে সমবেত করলেন। মানুষে মসজিদ পূর্ণ হয়ে গেলো। তখন তিনি মসজিদের মিম্বরে উঠলেন। আল্লাহর প্রশংসা ও গুনাবলী করলেন এবং বললেন – হে জনগন, আল্লাহ আমাকে পাঁচটি কাজের নির্দেশ দিয়েছেন যেনো আমি নিজে সেগুলো পালন করি এবং তোমাদেরকেও সেগুলো পালন করতে নির্দেশ দিয়েছেন। শুনো সেগুলো হলো –

 

১। তোমরা শুধুমাত্র আল্লাহর আনুগত্য এবং দাসত্ব করবে। তাঁর সাথে কাউকেও শরীক করবেনা।

 

২। তোমাদের তিনি নির্দেশ দিয়েছেন সালাত কায়েম করতে।

 

৩। তিনি নির্দেশ দিয়েছেন সিয়াম পালন করতে।

 

৪। তিনি তোমাদের নির্দেশ দিয়েছেন দান করতে।

 

৫। তিনি তোমাদের আরো নির্দেশ দিয়েছেন তাঁর স্মরণে তোমাদের জবানকে সিক্ত রাখতে। (এতোটুকু বলার পরে আমাদের প্রিয় নবী সাহাবীদের উদ্দেশ্যে বলেন) আমিও তোমাদের পাঁচটি কাজের নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছি। এই পাঁচটি কাজের নির্দেশ আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন। সেগুলো হলো –

 

১। সব সময় জামায়াত বদ্ধ থাকবে।

 

২। নেতার নির্দেশ স্রবণ করবে।

 

৩। নেতার নির্দেশ পালন করবে।

 

৪। হিজরত করবে (অর্থাৎ মন্দ কাজ ত্যাগ করবে বা এমন আবাসভূমি ত্যাগ করবে যেখানে বসে আল্লাহর হুকুম পালন করা সম্ভব নয়)।

 

৫। আল্লাহর পথে যিহাদ করবে। (অতপর তিনি বলেন) সাবধান, যে ব্যাক্তি জামায়াত থেকে এক বিঘত সরে যাবে, সে মূলত নিজের গলা থেকে ইসলামের রশিই খুলে ফেলবে। তবে পুনরায় জামায়াতে ফিরে আসলে ভিন্ন কথা।” (মুসনাদে আহমাদ, তিরমিযি, ইবনে মাজাহ)

 

বেশ হয়েছে, হযরত ইয়াহিয়ার পাঁচটি নির্দেশের সাথে আমরা আমাদের প্রিয় নবীর আরো পাঁচটি নির্দেশও পেয়ে গেলাম। আসলে হযরত ইয়াহিয়া (আঃ) অত্যন্ত মানব দরদী নবী। আল কুরআনে তাঁর একটি মহৎ গেনের কথা উল্লেখ করে মহান আল্লাহ বলেন –

 

“আমি নিজের পক্ষ থেকে তাঁকে দান করেছি হৃদয়ের কোমলতা।” (আল কুরআন ১৯ ; ২৩)

 

দাওয়াত দান, পাপ কাজে বাধাদান ও শাহাদাৎ

 

হযরত ইয়াহিয়া (আঃ) বনী ইসরাইলকে শিরক, বিদআত ও যাবতীয় মন্দ কাজ ত্যাগ করার দাওয়াত দিতে থাকেন। তাঁদেরকে শুধু এক আল্লাহর দাসত্ব ও আনুগত্য করতে এবং সততার সাথে চলতে আহবান জানাতে থাকেন। তিনি ট্রান্স জর্ডান এলাকায় তাঁর দাওয়াতী কাজ সম্প্রসারন করেন। মানুষকে তিনি পাপ কাজ থেকে তওবা করাতেন এবং যারা তওবা করতেন তাঁদেরকে ব্যাপটাইজ বা গোসল করাতেন। সেজন্যে তিনি ব্যাপটিষ্ট ইয়াহিয়া নামে পরিচিতি লাভ করেন। হযরত ইয়াহিয়ার সময় ইহুদীদের শাসক ছিলো হিরোদ এন্টিপাস। হিরোদ ইহুদী সমাজে রোমীয় নগ্ন সভ্যতার সয়লাব বিয়ে দেন। রাষ্ট্রীয়ভাবে যিনা, ব্যাভিচার, নগ্নতা, বেহায়াপনতা ও চরিত্রহীনতার প্রসার ঘটানো হতে থাকে। হিরোদ নিজেই ব্যাভিচার ও পাপাচারে লিপ্ত হয়। হযরত ইয়াহিয়া তাঁর অনৈতিক পাপাচারের প্রতিবাদ করতে থাকেন। হিরোদ নিজের অবস্থা বেগতিক দেখে হযরত ইয়াহিয়াকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে ফেলে রাখে। চরিত্রহীনরা দেখলো, হযরত ইয়াহিয়া মানুষের মাঝে সৎকর্ম ও পবিত্র জীবন যাপনের যে চেতনা সৃষ্টি করেছেন, তাঁর ফলে মানুষ তাঁদের চরমভাবে ঘৃণা করছে। তাঁদের বিরুদ্ধে বেড়েই চলেছে মানুষের ক্ষোভ। কারন মানুষ দেখলো, আল্লাহর নবীকে আটকে রাখা হয়েছে কারাগারে আর পাপিষ্ঠদের লালন করছে সরকার। এমতাবস্থায় শাসক হিরোদ তাঁর এক পালিত নর্তকীর আবদারে হত্যা করলো আল্লাহর নবী হযরত ইয়াহিয়া –কে। তাঁর মস্তক দ্বিখণ্ডিত করে উপহার দিলো নর্তকীকে। এভাবেই বনী ইসরাইলের বদবখত লোকেরা একের পর এক আল্লাহর নবীকে হত্যা করে। এদের সম্পর্কেই আল কুরআনে বলা হয়েছে –

 

“যারা আল্লাহর আয়াতকে অস্বীকার করে, অন্যায়ভাবে হত্যা করে আল্লাহর নবীদেরকে আর ঐ সব লোকদেরকে যারা ন্যায় ও সুবিচারের নির্দেশ দেয়, এসব অপরাধীদেরকে যন্ত্রনাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ দাও।” (সূরা আলে ইমরান, আয়াত ২১)

 

আমাদের নবীর সাথে সাক্ষাত

 

আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) এর যখন মে’রাজ হয়, তখন তাঁর সাথে হযরত ইয়াহিয়ার সাক্ষাত হয়। হযরত জিবরীলের সাথে প্রিয় নবী আকাশ পেরিয়ে উপরে উঠছিলেন।

 

তিনি বলেন –

 

“অতপর যখন দ্বিতীয় আকাশে পৌঁছলাম দেখলাম, সেখানে ইয়াহিয়া ও ঈসা। তারা দু’জন পরস্পর খালাতো ভাই। জিবরীল আমাকে বললেন – এরা ইয়াহিয়া ও ঈসা এদের সালাম করুন। আমি তাঁদের সালাম করলাম। তারা সালামের জবাব দিয়ে বললেন- মারহাবা-স্বাগতম হে আমাদের মহান ভাই ও মহান নবী।” (সহীহ বুখারী)

 

আল কুরআনে হযরত ইয়াহিয়া

 

আল কুরআনে হযরত ইয়াহিয়ার নাম উল্লেখ হয়েছে পাঁচবার। যেসব আয়াতে উল্লাখ হয়েছে সেগুলো হল- সূরা আলে ইমরান ; ৩৯। সূরা আল আনয়াম ; ৮৫। সূরা মরিয়ম ; ৭, ১২। সূরা আল আম্বিয়া ; ৯০। কুরআন মাজীদে হযরত ইয়াহিয়ার মর্যাদা বর্ণনা করা হয়েছে এভাবে-

 

“আমি শৈশবেই তাঁকে প্রজ্ঞা দান করেছি এবং দান করেছি নিজের পক্ষ থেকে কোমলতা ও পবিত্রতা। সে ছিল খুবই আল্লাহভীরু আর বাবা মার অধিকারের ব্যাপারে সচেতন। সে উদ্যত ছিলনা আবার অবাধ্যও ছিলনা। তাঁর প্রতি সালাম যেদিন তাঁর জন্ম হয় যেদিন তাঁর মরন হয় এবং যেদিন উঠানো হবে তাঁকে জীবিত করে। ” (সূরা মরিয়ম, আয়াত ১২-১৫)

 

 ২৪

 

ঈসা রুহুল্লাহ

 

(আঃ)

 

হযরত ঈসা (আঃ) ছিলেন বনু ইস্রাঈল বংশের সর্বশেষ নবী ও কিতাবধারী রাসূল। তিনি ‘ইনজীল’ প্রাপ্ত হয়েছিলেন। তাঁরপর থেকে শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর আবির্ভাব পর্যন্ত আর কোন নবী আগমন করেননি। এই সময়টাকে ‘রাসূল আগমনের বিরতিকাল’ বলা হয়। ক্বিয়ামত সংঘটিত হওয়ার অব্যবহিত কাল পূর্বে হযরত ঈসা (আঃ) আল্লাহর হুকুমে পুনরায় পৃথিবীতে অবতরণ করবেন এবং মুহাম্মাদী শরী‘আত অনুসরণে ইমাম মাহদীর নেতৃত্বে সারা পৃথিবীতে শান্তির রাজ্য কায়েম করবেন। তিনি উম্মতে মুহাম্মাদীর সাথে বিশ্ব সংস্কারে ব্রতী হবেন। তাই তাঁর সম্পর্কে সঠিক ও বিস্তৃত ধারণা দেওয়া অত্যন্ত যরূরী বিবেচনা করে আল্লাহ পাক শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিয়েছেন। উল্লেখ্য যে, মূসা (আঃ)-এর অনুসারী হওয়ার দাবীদার ইহুদীরা তাঁকে নবী বলেই স্বীকার করেনি। অত্যন্ত লজ্জাষ্করভাবে তারা তাঁকে জনৈক ইউসুফ মিস্ত্রীর জারজ সন্তান বলে আখ্যায়িত করেছে (নাঊযুবিল্লাহ)। অন্যদিকে ঈসা (আঃ)-এর ভক্ত ও অনুসারী হবার দাবীদার খৃষ্টানরা বাড়াবাড়ি করে তাঁকে ‘আল্লাহর পুত্র’ (তওবাহ, আয়াত ৩০) বানিয়েছে’। বরং ত্রিত্ববাদী খৃষ্টানরা তাঁকে সরাসরি ‘আল্লাহ’ সাব্যস্ত করেছে এবং বলেছে যে, তিনি হ’লেন তিন আল্লাহর একজন (মায়েদাহ, আয়াত ৭৩)। অর্থাৎ ঈসা, মারিয়াম ও আল্লাহ প্রত্যেকেই আল্লাহ এবং তারা এটাকে ‘বুদ্ধি বহির্ভূত সত্য’ বলে ক্ষান্ত হয়। অথচ এরূপ ধারণা পোষণকারীদের আল্লাহ দ্ব্যর্থহীনভাবে ‘কাফের’ বলে ঘোষণা করেছেন (মায়েদাহ, আয়াত ৭২-৭৩)। কুরআন তাঁর সম্পর্কে সঠিক তথ্য উপস্থাপন করেছে। আমরা এখন সেদিকে মনোনিবেশ করব।

 

উল্লেখ্য যে, হযরত ঈসা (আঃ) সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের মোট ১৫টি সূরায় ৯৮টি আয়াতেবর্ণিত হয়েছে।

 

ঈসার মা ও নানী

 

ঈসা (আঃ)-এর আলোচনা করতে গেলে তাঁর মা ও নানীর আলোচনা আগেই করে নিতে হয়। কারণ তাঁদের ঘটনাবলীর সাথে ঈসার জীবনের গভীর যোগসূত্র রয়েছে। পূর্ববর্তী পয়গম্বরগণের শরী‘আতে প্রচলিত ইবাদত-পদ্ধতির মধ্যে আল্লাহর নামে সন্তান উৎসর্গ করার রেওয়াজও চালু ছিল। এসব উৎসর্গীত সন্তানদের পার্থিব কোন কাজকর্মে নিযুক্ত করা হ’ত না। এ পদ্ধতি অনুযায়ী ঈসার নানী অর্থাৎ ইমরানের স্ত্রী নিজের গর্ভস্থ সন্তান সম্পর্কে মানত করলেন যে, তাকে বিশেষভাবে আল্লাহর ঘর বায়তুল মুক্বাদ্দাসের খিদমতে নিয়োজিত করা হবে। তিনি ভেবেছিলেন যে পুত্র সন্তান হবে। কিন্তু যখন তিনি কন্যা সন্তান প্রসব করলেন, তখন আক্ষেপ করে বললেন, ‘হে আল্লাহ! আমি কন্যা প্রসব করেছি’? (আলে ইমরান, আয়াত ৩৬)। অর্থাৎ একে দিয়ে তো আমার মানত পূর্ণ হবে না। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছা ছিল অন্যরূপ। তিনি উক্ত কন্যাকেই কবুল করে নেন। বস্ত্ততঃ ইনিই ছিলেন মারিয়াম বিনতে ইমরান, যিনি ঈসা (আঃ)-এর কুমারী মাতা ছিলেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যাকে জান্নাতের শ্রেষ্ঠ চারজন মহিলার অন্যতম হিসাবে বর্ণনা করেছেন। যেমন তিনি বলেন,

 

 ‘জান্নাতবাসী মহিলাগণের মধ্যে সেরা হ’লেন চারজন: খাদীজা বিনতে খুওয়ালিদ, ফাতেমা বিনতে মুহাম্মাদ, মারিয়াম বিনতে ইমরান এবং আসিয়া বিনতে মুযাহিম, যিনি ফেরাঊনের স্ত্রী’।

 

মারিয়ামের জন্ম ও লালন-পালন

 

মারিয়ামের জন্ম ও লালন-পালন সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,

 

 ‘যখন ইমরানের স্ত্রী বলল, হে আমার প্রভু! আমার গর্ভে যা রয়েছে তাকে আমি তোমার নামে উৎসর্গ করলাম সবার কাছ থেকে মুক্ত হিসাবে। অতএব আমার পক্ষ থেকে তুমি তাকে কবুল করে নাও। নিশ্চয়ই তুমি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ’ (আলে ইমরান, আয়াত ৩৫)। ‘অতঃপর সে যখন তাকে প্রসব করল, তখন বলল, হে প্রভু! আমি তো কন্যা সন্তান প্রসব করেছি! অথচ আল্লাহ ভাল করেই জানেন, সে কি প্রসব করেছে। (আল্লাহ সান্ত্বনা দিয়ে বললেন,) এই কন্যার মত কোন পুত্রই যে নেই। আর আমি তার নাম রাখলাম ‘মারিয়াম’। (মারিয়ামের মা দো‘আ করে বলল, হে আল্লাহ!) আমি তাকে ও তার সন্তানদেরকে তোমার আশ্রয়ে সমর্পণ করছি, অভিশপ্ত শয়তানের কবল হ’তে’। আল্লাহ বলেন, ‘অতঃপর তার প্রভু তাকে উত্তমভাবে গ্রহণ করে নিলেন এবং তাকে প্রবৃদ্ধি দান করলেন সুন্দর প্রবৃদ্ধি। আর তিনি তাকে যাকারিয়ার তত্ত্বাবধানে সমর্পণ করলেন। (অতঃপর ঘটনা হ’ল এই যে,) যখনই যাকারিয়া মেহরাবের মধ্যে তার কাছে আসতেন, তখনই কিছু খাদ্য দেখতে পেতেন। তিনি জিজ্ঞেস করতেন, মারিয়াম! এসব কোথা থেকে তোমার কাছে এল? মারিয়াম বলত, ‘এসব আল্লাহর নিকট থেকে আসে। নিশ্চয়ই আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বেহিসাব রিযিক দান করে থাকেন’ (আলে ইমরান, আয়াত ৩৫-৩৭)।

 

উল্লেখ্য যে, আল্লাহর নামে উৎসর্গীত সন্তান পালন করাকে তখনকার সময়ে খুবই পুণ্যের কাজ মনে করা হ’ত। আর সেকারণে মারিয়ামকে প্রতিপালনের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য রীতিমত প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। ফলে লটারীর ব্যবস্থা করা হয় এবং আল্লাহর ইচ্ছায় তাঁর বয়োবৃদ্ধ নবী হযরত যাকারিয়া (আঃ) মারিয়ামের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন (আলে ইমরান, আয়াত ৪৪)।

 

ঈসার জন্ম ও লালন-পালন

 

এভাবে মেহরাবে অবস্থান করে মারিয়াম বায়তুল মুক্বাদ্দাসের খিদমত করতে থাকেন। সম্মানিত নবী ও মারিয়ামের বয়োবৃদ্ধ খালু যাকারিয়া (আঃ) সর্বদা তাকে দেখাশুনা করতেন। মেহরাবের উত্তর-পূর্বদিকে সম্ভবতঃ খেজুর বাগান ও ঝর্ণাধারা ছিল। যেখানে মারিয়াম পর্দা টাঙিয়ে মাঝে-মধ্যে পায়চারি করতেন। অভ্যাসমত তিনি উক্ত নির্জন স্থানে একদিন পায়চারি করছিলেন। এমন সময় হঠাৎ মানুষের বেশে সেখানে জিবরাঈল উপস্থিত হন। স্বাভাবিকভাবেই তাতে মারিয়াম ভীত হয়ে পড়েন। এ বিষয়ে কুরআনী বর্ণনা নিম্নরূপ:

 

 (হে মুহাম্মাদ!) ‘আপনি এই কিতাবে মারিয়ামের কথা বর্ণনা করুন। যখন সে তার পরিবারের লোকজন হ’তে পৃথক হয়ে পূর্বদিকে একস্থানে আশ্রয় নিল’ (মারিয়াম, আয়াত ১৬)। ‘অতঃপর সে তাদের থেকে আড়াল করার জন্য পর্দা টাঙিয়ে নিল। অতঃপর আমরা তার নিকটে আমাদের ‘রূহ’ (অর্থাৎ জিব্রীলকে) প্রেরণ করলাম। সে তার কাছে গিয়ে পূর্ণাঙ্গ মানবাকৃতিতে আত্মপ্রকাশ করল’। ‘মারিয়াম বলল, আমি তোমার থেকে করুণাময় আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করছি, যদি তুমি আল্লাহভীরু হও’। ‘সে বলল, আমি তো কেবল তোমার প্রভুর প্রেরিত। এজন্য যে, আমি তোমাকে একটি পবিত্র পুত্র সন্তান দান করে যাব’। ‘মারিয়াম বলল, কিভাবে আমার পুত্র সন্তান হবে? অথচ কোন মানুষ আমাকে স্পর্শ করেনি এবং আমি ব্যভিচারিণী নই’। ‘সে বলল, এভাবেই হবে। তোমার পালনকর্তা বলেছেন, এটা আমার জন্য সহজ ব্যাপার এবং আমরা তাকে (ঈসাকে) মানবজাতির জন্য একটা নিদর্শন ও আমাদের পক্ষ হ’তে বিশেষ অনুগ্রহরূপে পয়দা করতে চাই। তাছাড়া এটা (পূর্ব থেকেই) নির্ধারিত বিষয়’ (মারিয়াম, আয়াত ১৬-২১)। অতঃপর জিব্রীল মারিয়ামের মুখে অথবা তাঁর পরিহিত জামায় ফুঁক মারলেন এবং তাতেই তাঁর গর্ভ সঞ্চার হ’ল (আম্বিয়া, আয়াত ৯১ ; তাহরীম, আয়াত ১২)। অন্য আয়াতে একে ‘আল্লাহর কলেমা’ (بِكَلِمَةٍ مِنْهُ) অর্থাৎ ‘কুন্’ (হও) বলা হয়েছে (আলে ইমরান, আয়াত ৪৫)।

 

অতঃপর আল্লাহ বলেন,

 

 ‘অতঃপর মারিয়াম গর্ভে সন্তান ধারণ করল এবং তৎসহ একটু দূরবর্তী স্থানে চলে গেল’ (মারিয়াম, আয়াত ২২)। ‘এমতাবস্থায় প্রসব বেদনা তাকে একটি খর্জুর বৃক্ষের মূলে আশ্রয় নিতে বাধ্য করল। তখন সে বলল, হায়! আমি যদি এর আগেই মারা যেতাম এবং আমি যদি মানুষের স্মৃতি থেকে বিলুপ্ত হয়ে যেতাম’। ‘এমন সময় ফেরেশতা তাকে নিম্নদেশ থেকে (অর্থাৎ পার্শ্ববর্তী নিম্নভূমি থেকে) আওয়ায দিয়ে বলল, তুমি দুঃখ করো না। তোমার পালনকর্তা তোমার পাদদেশে একটি ঝর্ণাধারা সৃষ্টি করেছেন’। ‘আর তুমি খর্জুর বৃক্ষের কান্ড ধরে নিজের দিকে নাড়া দাও, তা থেকে তোমার দিকে সুপক্ক খেজুর পতিত হবে’। ‘তুমি আহার কর, পান কর এং স্বীয় চক্ষু শীতল কর। আর যদি কোন মানুষকে তুমি দেখ, তবে তাকে বলে দিয়ো যে, আমি দয়াময় আল্লাহর জন্য ছিয়াম পালনের মানত করেছি। সুতরাং আমি আজ কারু সাথে কোন মতেই কথা বলব না’ (মারিয়াম, আয়াত ২২-২৬)।

 

উল্লেখ্য যে, ইসলাম-পূর্ব কালের বিভিন্ন শরী‘আতে সম্ভবতঃ ছিয়াম পালনের সাথে অন্যতম নিয়ম ছিল সারাদিন মৌনতা অবলম্বন করা। হযরত যাকারিয়া (আঃ)-কেও সন্তান প্রদানের নিদর্শন হিসাবে তিন দিন ছিয়ামের সাথে মৌনতা অবলম্বনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তবে ঐ অবস্থায় ইশারা-ইঙ্গিতে কথা বলার অবকাশ ছিল (মারিয়াম, আয়াত ১০-১১)। একইভাবে মারিয়ামকেও নির্দেশ দেওয়া হ’ল (মারিয়াম, আয়াত ২৬)।

 

আলোচনা

 

(১) যেহেতু ঈসা (আঃ)-এর জন্মগ্রহণের ব্যাপারটি সম্পূর্ণভাবে অলৌকিক, তাই তার গর্ভধারণের মেয়াদ স্বাভাবিক নিয়মের বহির্ভূত ছিল বলেই ধরে নিতে হবে। নয় মাস দশদিন পরে সন্তান প্রসব শেষে চল্লিশ দিন ‘নেফাস’ অর্থাৎ রজঃস্রাব হ’তে পবিত্রতার মেয়াদও এখানে ধর্তব্য না হওয়াই সমীচীন। অতএব ঈসাকে গর্ভধারণের ব্যাপারটাও যেমন নিয়ম বহির্ভূত, তার ভূমিষ্ট হওয়া ও তার মায়ের পবিত্রতা লাভের পুরা ঘটনাটাই নিয়ম বহির্ভূত এবং অলৌকিক। আর এটা আল্লাহর জন্য একেবারেই সাধারণ বিষয়। স্বামী-স্ত্রীর মাধ্যমে সন্তান জন্ম হবে, মাকে দশ মাস গর্ভধারণ করতে হবে ইত্যাদি নিয়ম আল্লাহরই সৃষ্টি এবং এই নিয়ম ভেঙ্গে সন্তান দান করাও তাঁরই এখতিয়ার। এদিকে ইঙ্গিত করেই আল্লাহ বলেন,

 

‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকটে ঈসার দৃষ্টান্ত হ’ল আদমের মত। তাকে তিনি মাটি দিয়ে সৃষ্টি করেন এবং বলেন, হয়ে যাও ব্যস হয়ে গেল’। ‘যা তোমার প্রভু আল্লাহ বলেন, সেটাই সত্য। অতএব তুমি সংশয়বাদীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না’’ (আলে ইমরান, আআয়ত ৫৯-৬০)। অর্থাৎ আদমকে যেমন পিতা-মাতা ছাড়াই সৃষ্টি করা হয়েছে, ঈসাকে তেমনি পিতা ছাড়াই শুধু মায়ের মাধ্যমেই সৃষ্টি করা হয়েছে। আর এটাই যে সত্য এবং এর বাইরে যাবতীয় জল্পনা-কল্পনা যে মিথ্যা, সে কথাও উপরোক্ত আয়াতে দ্ব্যর্থহীনভাবে বলে দেওয়া হয়েছে। দুর্ভাগ্য এই যে, যে বনু ইস্রাঈলের নবী ও রাসূল হয়ে ঈসা (আঃ)-এর আগমন ঘটলো, সেই ইহুদী-নাছারারাই আল্লাহর উক্ত ঘোষণাকে মিথ্যা বলে গণ্য করেছে। অথচ এই হতভাগারা মারিয়ামের পূর্বদিকে যাওয়ার অনুসরণে পূর্বদিককে তাদের ক্বিবলা বানিয়েছে।

 

(২) এখানে আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় যে, মারিয়ামকে খেজুর গাছের কান্ড ধরে নাড়া দিতে বলা হয়েছে, যাতে সুপক্ক খেজুর নীচে পতিত হয়। এটাতে বুঝা যায় যে, ওটা ছিল তখন খেজুর পাকার মৌসুম অর্থাৎ গ্রীষ্মকাল। আর খৃষ্টানরা কথিত যীশু খৃষ্টের জন্মদিন তথা তাদের ভাষায় X-mas Day বা বড় দিন উৎসব পালন করে থাকে শীতকালে ২৫শে ডিসেম্বর তারিখে। অথচ এর কোন ভিত্তি তাদের কাছে নেই। ইসলামে কারু জন্ম বা মৃত্যু দিবস পালনের বিধান নেই।

 

(৩) এখানে আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় যে, খেজুর গাছের গোড়া ধরে নাড়া দেওয়া কখনোই সম্ভব নয়। বিশেষ করে একজন সদ্য প্রসূত সন্তানের মায়ের পক্ষে। এর মধ্যে এ বিষয়ে ইঙ্গিত রয়েছে যে, নেকীর কাজে আল্লাহর উপরে ভরসা করে বান্দাকে অবশ্যই এগিয়ে যেতে হবে। যত সামান্যই হৌক কাজ করতে হবে। আল্লাহ তাতেই বরকত দিবেন। যেমন তালূত ও দাঊদকে আল্লাহ দিয়েছিলেন এবং যেমন শেষনবী (ছাঃ)-কে আল্লাহ সাহায্য করেছিলেন বিশেষভাবে হিজরতের রাত্রিতে মক্কা ত্যাগের সময়, হিজরতকালীন সফরে এবং বদর ও খন্দক যুদ্ধের কঠিন সময়ে। অতএব আমরা ধরে নিতে পারি যে, মারিয়ামের গর্ভধারণ, সন্তান প্রসব ও প্রসব পরবর্তী পবিত্রতা অর্জন সবই ছিল অলৌকিক এবং সবই অত্যন্ত দ্রুত সময়ের মধ্যে সম্পন্ন হয়।

 

এর পরের ঘটনা আমরা সরাসরি কুরআন থেকে বিবৃত করব। আল্লাহ বলেন,

 

‘‘অতঃপর মারিয়াম তার সন্তানকে নিয়ে তার সম্প্রদায়ের কাছে উপস্থিত হ’ল। তারা বলল, হে মারিয়াম! তুমি একটা আশ্চর্য বস্ত্ত নিয়ে এসেছ’। ‘হে হারূণের বোন! তোমার পিতা কোন অসৎ ব্যক্তি ছিলেন না কিংবা তোমার মাতাও কোন ব্যভিচারিণী মহিলা ছিলেন না’’ (মারিয়াম, আয়াত ২৭-২৮)। কওমের লোকদের এ ধরনের কথা ও সন্দেহের জওয়াবে নিজে কিছু না বলে বিবি মারিয়াম তার সদ্য প্রসূত সন্তানের দিকে ইশারা করলেন। অর্থাৎ একথার জবাব সেই-ই দিবে। কেননা সে আল্লাহর দেওয়া এক অলৌকিক সন্তান, যা কওমের লোকেরা জানে না। আল্লাহ বলেন,

 

 ‘‘অতঃপর মারিয়াম ঈসার দিকে ইঙ্গিত করল। তখন লোকেরা বলল, কোলের শিশুর সাথে আমরা কিভাবে কথা বলব’?। ঈসা তখন বলে উঠল, ‘আমি আল্লাহর দাস। তিনি আমাকে কিতাব (ইনজীল) প্রদান করেছেন এবং আমাকে নবী করেছেন’। ‘আমি যেখানেই থাকি, তিনি আমাকে বরকতময় করেছেন। তিনি আমাকে জোরালো নির্দেশ দিয়েছেন যতদিন জীবিত থাকি, ততদিন ছালাত ও যাকাত আদায় করতে’। ‘এবং আমার মায়ের অনুগত থাকতে। আল্লাহ আমাকে উদ্ধত ও হতভাগা করেননি’। ‘আমার প্রতি শান্তি যেদিন আমি জন্মগ্রহণ করেছি, যেদিন আমি মৃত্যুবরণ করব এবং যেদিন জীবিত পুনরুত্থিত হব’’ (মারিয়াম, আয়াত ২৯-৩৩)।

 

ঈসার উপরোক্ত বক্তব্য শেষ করার পর সংশয়বাদী ও বিতর্ককারী লোকদের উদ্দেশ্য করে আল্লাহ বলেন,

 

‘‘ইনিই হ’লেন মারিয়াম পুত্র ঈসা। আর ওটাই হ’ল সত্যকথা (যা উপরে বর্ণিত হয়েছে), যে বিষয়ে লোকেরা (অহেতুক) বিতর্ক করে থাকে’। ‘আল্লাহ এমন নন যে, তিনি সন্তান গ্রহণ করবেন (যেমন অতিভক্ত খৃষ্টানরা বলে থাকে যে, ঈসা ‘আল্লাহর পুত্র’)। তিনি মহাপবিত্র। যখন তিনি কোন কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন, তখন বলেন, হও! ব্যস, হয়ে যায়’। ‘ঈসা আরও বলল, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ আমার পালনকর্তা এবং তোমাদের পালনকর্তা। অতএব তোমরা তাঁর ইবাদত কর। (মনে রেখ) এটাই হ’ল সরল পথ’’ (মারিয়াম, আয়াত ৩৪-৩৬)।

 

কিন্তু সদ্যপ্রসূত শিশু ঈসার মুখ দিয়ে অনুরূপ সারগর্ভ কথা শুনেও কি কওমের লোকেরা আশ্বস্ত হ’তে পেরেছিল? কিছু লোক আশ্বস্ত হ’লেও অনেকে পারেনি। তারা নানা বাজে কথা রটাতে থাকে। তাদের ঐসব বাক-বিতন্ডার প্রতি ইঙ্গিত করেই পরবর্তী আয়াতে আল্লাহ বলেন,

 

‘‘অতঃপর তাদের মধ্যকার বিভিন্ন দল বিভিন্ন (মত ও পথে) বিভক্ত হয়ে গেল (দুনিয়াতে যার শেষ হবে না)। অতএব ক্বিয়ামতের মহাদিবস আগমন কালে অবিশ্বাসী কাফিরদের জন্য ধ্বংস’। ‘সেদিন তারা চমৎকারভাবে শুনবে ও দেখবে, যেদিন তারা সবাই আমাদের কাছে আগমন করবে। কিন্তু আজ যালেমরা প্রকাশ্য বিভ্রান্তিতে রয়েছে’’ (মারিয়াম, আয়াত ৩৭-৩৮)।

 

মারিয়ামের সতীত্ব সম্পর্কে আল্লাহর সাক্ষ্য

 

আল্লাহ পাক নিজেই মারিয়ামের সতীত্ব সম্পর্কে সাক্ষ্য দিয়ে বলেন,

 

 ‘‘তিনি দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেন ইমরান তনয়া মারিয়ামের, যে তার সতীত্ব বজায় রেখেছিল। অতঃপর আমি তার মধ্যে আমার পক্ষ হ’তে রূহ ফুঁকে দিয়েছিলাম এবং সে তার পালনকর্তার বাণী ও কিতাব সমূহকে সত্যে পরিণত করেছিল এবং সে ছিল বিনয়ীদের অন্যতম’’ (তাহরীম, আয়াত ১২)।

 

মারিয়ামের বৈশিষ্ট্য সমূহ

 

(১) তিনি ছিলেন বিশ্ব নারী সমাজের শীর্ষস্থানীয়া এবং আল্লাহর মনোনীত ও পবিত্র ব্যক্তিত্ব (আলে ইমরান, আয়াত ৪২)।

 

(২) তিনি ছিলেন সর্বদা আল্লাহর উপাসনায় রত, বিনয়ী, রুকু কারিনী ও সিজদাকারিনী (আলে ইমরান, আয়াত ৪৩)।

 

(৩) তিনি ছিলেন সতীসাধ্বী এবং আল্লাহর আদেশ ও বাণী সমূহের বাস্তবায়নকারিনী (তাহরীম, আয়াত ১২)।

 

(৪) আল্লাহ নিজেই তার নাম রাখেন ‘মারিয়াম’ (আলে ইমরান, আয়াত ৩৬)। অতএব তিনি ছিলেন অতীব সৌভাগ্যবতী।

 

শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ

 

(১) মারিয়াম ছিলেন তার মায়ের মানতের সন্তান এবং তার নাম আল্লাহ নিজে রেখেছিলেন।

 

(২) মারিয়ামের মা দো‘আ করেছিলেন এই মর্মে যে, আমি তাকে ও তার সন্তানদেরকে আল্লাহর আশ্রয়ে সমর্পণ করছি অভিশপ্ত শয়তানের কবল হ’তে এবং আল্লাহ সে দো‘আ কবুল করেছিলেন উত্তমরূপে। অতএব মারিয়াম ও তার পুত্র ঈসার পবিত্রতা সম্পর্কে কোনরূপ সন্দেহের অবকাশ নেই।

 

(৩) মারিয়াম আল্লাহর ঘর বায়তুল মুক্বাদ্দাসের খিদমতে রত ছিলেন এবং তাকে আল্লাহর পক্ষ হ’তে বিশেষ ফল-ফলাদির মাধ্যমে খাদ্য পরিবেশন করা হ’ত (আলে ইমরান, আয়াত ৩৭)। এতে বুঝা যায় যে, পবিত্রাত্মা মহিলাগণ মসজিদের খিদমত করতে পারেন এবং আল্লাহ তাঁর নেককার বান্দাদের জন্য যেকোন স্থানে খাদ্য পরিবেশন করে থাকেন।

 

(৪) মারিয়ামের গর্ভধারণ ও ঈসার জন্মগ্রহণ ছিল সম্পূর্ণরূপে অলৌকিক ঘটনা। আল্লাহ পাক নিয়মের স্রষ্টা এবং তিনিই নিয়মের ভঙ্গকারী। তাকে কোন বিষয়ে বাধ্য করার মত কেউ নেই। তিনি পিতা-মাতা ছাড়াই আদমকে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর পিতা ছাড়াই শুধু মাতার মাধ্যমে ঈসাকে সৃষ্টি করেছেন। তিনি যা খুশী তাই করতে পারেন।

 

(৫) ঈসার জন্ম গ্রীষ্মকালে হয়েছিল খেজুর পাকার মওসুমে। খৃষ্টানদের মধ্যে প্রচলিত ধারণা মতে ২৫শে ডিসেম্বরের প্রচন্ড শীতের সময়ে নয়।

 

(৬) ফেরেশতা মানবাকৃতি ধারণ করে অথবা অদৃশ্য থেকে নেককার বান্দাকে আল্লাহর হুকুমে সাহায্য করে থাকেন। যেমন জিব্রীল মানবাকৃতি ধারণ করে মারিয়ামের জামায় ফুঁক দিলেন। অতঃপর অদৃশ্য থেকে আওয়ায দিয়ে তার খাদ্য ও পানীয়ের পথ নির্দেশ দান করলেন।

 

(৭) বান্দাকে কেবল প্রার্থনা করলেই চলবে না, তাকে কাজে নামতে হবে। তবেই তাতে আল্লাহর সাহায্য নেমে আসবে। যেমন খেজুর বৃক্ষের কান্ড ধরে নাড়া দেওয়ার সামান্য প্রচেষ্টার মাধ্যমে আল্লাহর হুকুমে সুপক্ক খেজুর সমূহ পতিত হয়।

 

(৮) বিশেষ সময়ে আল্লাহর হুকুমে শিশু সন্তানের মুখ দিয়ে সারগর্ভ বক্তব্য সমূহ বের হ’তে পারে। যেমন ঈসার মুখ দিয়ে বের হয়েছিল তার মায়ের পবিত্রতা প্রমাণের জন্য। বুখারী শরীফে বর্ণিত বনু ইস্রাঈলের জুরায়েজ-এর ঘটনায়ও এর প্রমাণ পাওয়া যায়।

 

(৯) ঈসা কোন উপাস্য ছিলেন না। বরং তিনি ছিলেন অন্যদের মত আল্লাহর একজন দাস মাত্র এবং তিনি ছিলেন আল্লাহর একজন সম্মানিত নবী ও কিতাবধারী রাসূল।

 

(১০) ঈসা যে বিনা বাপে পয়দা হয়েছিলেন, তার অন্যতম প্রমাণ এই যে, কুরআনের সর্বত্র তাঁকে ‘মারিয়াম-পুত্র’ বলা হয়েছে (বাক্বারাহ, আয়াত- ৮৭, ২৫৩ ; আলে ইমরান, আয়াত ৪৫ প্রভৃতি)। পিতা-মাতা উভয়ে থাকলে হয়তবা তাঁকে কেবল ঈসা বলেই সম্বোধন করা হ’ত, যেমন অন্যান্য নবীগণের বেলায় করা হয়েছে। অথচ মারিয়ামকে তার পিতার দিকে সম্বন্ধ করে ‘মারিয়াম বিনতে ইমরান’ ‘ইমরান-কন্যা’ বলা হয়েছে (তাহরীম, আয়াত ১২)।

 

(১১) একমাত্র মারিয়ামের নাম ধরেই আল্লাহ তাঁর সতীত্বের সাক্ষ্য ঘোষণা করেছেন (তাহরীম, আয়াত ১২)। যা পৃথিবীর অন্য কোন মহিলা সম্পর্কে করা হয়নি। অতএব যাবতীয় বিতর্কের অবসানের জন্য এটুকুই যথেষ্ট। তাছাড়া আল্লাহ তাঁকে ‘ছিদ্দীক্বাহ’ অর্থাৎ কথায় ও কর্মে ‘সত্যবাদীনী’ আখ্যা দিয়েছেন (মায়েদাহ, আয়াত ৭৫)। যেটা অন্য কোন মহিলা সম্পর্কে দেওয়া হয়নি।

 

ঈসা (আঃ)-এর বৈশিষ্ট্য সমূহ

 

(১) তিনি ছিলেন বিনা বাপে পয়দা বিশ্বের একমাত্র নবী (আলে ইমরান, আয়াত ৪৬)। (২) আল্লাহ স্বয়ং যার নাম রাখেন মসীহ ঈসা রূপে (আলে ইমরান, আয়াত ৪৫)। (৩) তিনি শয়তানের অনিষ্টকারিতা হ’তে মুক্ত ছিলেন (ঐ,আয়াত ৩৬-৩৭)। (৪) দুনিয়া ও আখেরাতে তিনি ছিলেন মহা সম্মানের অধিকারী এবং আল্লাহর একান্ত প্রিয়জনদের অন্যতম (আলে ইমরান, আয়াত ৪৫)। (৫) তিনি মাতৃক্রোড়ে থেকেই সারগর্ভ বক্তব্য রাখেন (মারিয়াম, আয়াত ২৭-৩৩; আলে ইমরান, আয়াত ৪৬)। (৬) তিনি বনু ইস্রাঈলগণের প্রতি প্রেরিত হয়েছিলেন (আলে ইমরান, আয়াত ৪৯) এবং শেষনবী ‘আহমাদ’-এর আগমনের ভবিষ্যদ্বাণী করেন (ছফ, আয়াত ৬)। (৭) তাঁর মো‘জেযা সমূহের মধ্যে ছিল- (ক) তিনি মাটির তৈরী পাখিতে ফুঁক দিলেই তা জীবন্ত হয়ে উড়ে যেত (খ) তিনি জন্মান্ধকে চক্ষুষ্মান ও কুষ্ঠ রোগীকে সুস্থ করতে পারতেন (গ) তিনি মৃতকে জীবিত করতে পারতেন (ঘ) তিনি বলে দিতে পারতেন মানুষ বাড়ী থেকে যা খেয়ে আসে এবং যা সে ঘরে সঞ্চিত রেখে আসে (আলে ইমরান, আয়াত ৪৯; মায়েদাহ, আয়াত ১১০)।

 

(৮) তিনি আল্লাহর কিতাব ইনজীল প্রাপ্ত হয়েছিলেন এবং পূর্ববর্তী গ্রন্থ তওরাতের সত্যায়নকারী ছিলেন। তবে তওরাতে হারামকৃত অনেক বিষয়কে তিনি হালাল করেন (আলে ইমরান, আয়াত ৫০)। (৯) তিনি ইহুদী চক্রান্তের শিকার হয়ে সরকারী নির্যাতনের সম্মুখীন হন। ফলে আল্লাহ তাঁকে সশরীরে আসমানে উঠিয়ে নেন (আলে ইমরান, আয়াত ৫২, ৫৪-৫৫; নিসা, আয়াত ১৫৮)। শত্রুরা তাঁরই মত আরেকজনকে সন্দেহ বশে শূলে চড়িয়ে হত্যা করে এবং তারা নিশ্চিতভাবেই ঈসাকে হত্যা করেনি’ (নিসা, আয়াত ১৫৭)। (১০) তিনিই একমাত্র নবী, যাকে আল্লাহ জীবিত অবস্থায় দুনিয়া থেকে আসমানে উঠিয়ে নিয়েছেন এবং ক্বিয়ামতের প্রাক্কালে তিনি পুনরায় সশরীরে দুনিয়াতে অবতরণ করবেন এবং দাজ্জাল, ক্রুশ, শূকর প্রভৃতি ধ্বংস করবেন। অতঃপর ইমাম মাহদীর নেতৃত্বে সারা পৃথিবীতে ইসলামী শরী‘আত অনুযায়ী শান্তির রাজ্য কায়েম করবেন।

 

হযরত ঈসা (আঃ)-এর কাহিনী

 

সাধারণতঃ সকল নবীই ৪০ বছর বয়সে নবুঅত লাভ করেছেন। তবে ঈসা (আঃ) সম্ভবতঃ তার কিছু পূর্বেই নবুঅত ও কিতাব প্রাপ্ত হন। কেননা বিভিন্ন রেওয়ায়াত দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে, আকাশে তুলে নেবার সময় তাঁর বয়স ৩০ থেকে ৩৫-এর মধ্যে ছিল। তিনি যৌবনে আকাশে উত্তোলিত হয়েছিলেন এবং পৌঢ় বয়সে পুনরায় দুনিয়ায় ফিরে এসে মানুষকে তাওহীদের দাওয়াত দিবেন।

 

ঈসা (আঃ)-এর দাওয়াত

 

ঈসা (আঃ) নবুঅত লাভ করার পর স্বীয় কওমকে প্রধানতঃ নিম্নোক্ত ৭টি বিষয়ে দাওয়াত দিয়ে বলেন, ‘হে বনু ইস্রাঈলগণ! আমি তোমাদের নিকটে আগমন করেছি (১) আল্লাহর রাসূল হিসাবে (২) আমার পূর্ববর্তী তওরাত কিতাবের সত্যায়নকারী হিসাবে এবং (৩) আমার পরে আগমনকারী রাসূলের সুসংবাদ দানকারী হিসাবে, যার নাম হবে আহমাদ’... (ছফ, আয়াত ৬)। তিনি বললেন, ‘(৪) নিশ্চয়ই আল্লাহ আমার পালনকর্তা এবং তোমাদের পালনকর্তা। অতএব তোমরা তাঁর ইবাদত কর। এটাই সরল পথ’ (মারিয়াম, আয়াত ৩৬)।

 

তিনি বললেন, ‘আমার আনীত এ কিতাব (ইনজীল) পূর্ববর্তী কিতাব তাওরাতকে সত্যায়ন করে এবং এজন্য যে, (৫) আমি তোমাদের জন্য হালাল করে দেব কোন কোন বস্ত্ত, যা তোমাদের জন্য হারাম ছিল। আর (৬) আমি তোমাদের নিকটে এসেছি তোমাদের পালনকর্তার নিদর্শন সহ। অতএব (৭) তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং আমার আনুগত্য কর’ (আলে ইমরান, আয়াত ৫০)।

 

এটার ব্যাখ্যা এসেছে অন্য আয়াতে যে,

 

 ‘‘বস্ত্ততঃ ইহুদীদের পাপের কারণে আমরা তাদের উপরে হারাম করেছিলাম বহু পবিত্র বস্ত্ত, যা তাদের জন্য হালাল ছিল। এটা ছিল (১) আল্লাহর পথে তাদের অধিক বাধা দানের কারণে’। ‘এবং এ কারণে যে, (২) তারা সূদ গ্রহণ করত। অথচ এ ব্যাপারে তাদের নিষেধ করা হয়েছিল এবং এ কারণে যে, (৩) তারা অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভোগ করত। বস্ত্ততঃ আমরা কাফিরদের জন্য প্রস্ত্তত রেখেছি বেদনাদায়ক শাস্তি’’ (নিসা, আয়াত ১৬০-১৬১)। তিনি আরও বলেন,

 

‘‘এবং ইহুদীদের জন্য আমরা (১) প্রত্যেক নখবিশিষ্ট পশু হারাম করেছিলাম এবং (২) ছাগল ও গরু থেকে এতদুভয়ের চর্বি আমরা তাদের জন্য হারাম করেছিলাম। কিন্তু ঐ চর্বি ব্যতীত যা পৃষ্ঠে কিংবা অন্ত্রে সংযুক্ত থাকে অথবা অস্থির সাথে মিলিত থাকে। তাদের অবাধ্যতার কারণে আমরা তাদের এ শাস্তি দিয়েছিলাম। আর আমরা অবশ্যই সত্যবাদী’’ (আন‘আম, আয়াত ১৪৬)।

 

ঈসা (আঃ)-এর পেশকৃত পাঁচটি নিদর্শন

 

তাওহীদ ও রিসালাতের উপরে ঈমান আনার দাওয়াত দেওয়ার পরে তিনি বনু ইস্রাঈলকে তাঁর আনীত নিদর্শন সমূহ বর্ণনা করেন। তিনি বলেন,

 

‘‘নিশ্চয়ই আমি তোমাদের নিকটে তোমাদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে এসেছি নিদর্শনসমূহ নিয়ে। (যেমন-) (১) আমি তোমাদের জন্য মাটি দ্বারা পাখির আকৃতি তৈরী করে দেই। তারপর তাতে যখন ফুঁক দেই, তখন তা উড়ন্ত পাখিতে পরিণত হয়ে যায় আল্লাহর হুকুমে। (২) আর আমি সুস্থ করে তুলি জন্মান্ধকে এবং (৩) ধবল-কুষ্ঠ রোগীকে। (৪) আর আমি জীবিত করে দেই মৃতকে আল্লাহর হুকুমে। (৫) আমি তোমাদেরকে বলে দেই যা তোমরা খেয়ে আস এবং যা তোমরা ঘরে রেখে আস। এতে প্রকৃষ্ট নিদর্শন রয়েছে যদি তোমরা বিশ্বাসী হও’’ (আলে ইমরান, আয়াত ৪৯)।

 

উল্লেখ্য যে, যখন যে দেশে যে বিষয়ের আধিক্য ও উৎকর্ষ থাকে, তখন সেই দেশে সেই বিষয়ে সর্বোচ্চ ব্যুৎপত্তি সহ নবী প্রেরণ করা হয়। যেমন মূসার সময় মিসরে ছিল জাদুবিদ্যার প্রাদুর্ভাব। ফলে আল্লাহ তাঁকে লাঠির মো‘জেযা দিয়ে পাঠালেন। অনুরূপভাবে ঈসার সময়ে শাম বা সিরিয়া এলাকা ছিল চিকিৎসা বিদ্যায় সেরা। সেকারণ ঈসাকে আল্লাহ উপরে বর্ণিত অলৌকিক ক্ষমতা ও মো‘জেযা সমূহ দিয়ে পাঠান। যেমন শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর সময়ে আরবরা ভাষা ও সাহিত্যের সর্বোচ্চ অলংকারে ভূষিত ছিল। ফলে কুরআন তাদের সামনে হতবুদ্ধিকারী মো‘জেযা রূপে নাযিল হয়। যাতে আরবের স্বনামখ্যাত কবিরা মাথা নোয়াতে বাধ্য হয়।

 

দাওয়াতের ফলশ্রুতি

 

ঈসা (আঃ)-এর মো‘জেযা সমূহ দেখে এবং তাঁর মুখনিঃসৃত তাওহীদের বাণী শুনে গরীব শ্রেণীর কিছু লোক তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হ’লেও দুনিয়াদার সমাজ নেতারা তাঁর প্রতি বিরূপ হয়ে ওঠে। কারণ তাওহীদের সাম্য বাণী সমাজের কায়েমী স্বার্থবাদী নেতাদের স্বার্থেই প্রথম আঘাত হেনে থাকে। শয়তান তাদেরকে কুমন্ত্রণা দেয়। ফলে তারা ঈসা (আঃ)-এর বিরোধিতায় লিপ্ত হয়।

 

বিগত নবীগণের ন্যায় বনু ইস্রাঈলগণ তাদের বংশের শেষ নবী ঈসা (আঃ)-এর বিরুদ্ধে নানাবিধ চক্রান্ত শুরু করে। তারা প্রথমেই ঈসা (আঃ)-কে ‘জাদুকর’ বলে আখ্যায়িত করে। যেমন আল্লাহ বলেন, (হে ঈসা!) ‘‘যখন তুমি তাদের কাছে প্রমাণাদি নিয়ে এসেছিলে। অতঃপর তাদের মধ্যে যারা কাফের তারা বলল, এটা প্রকাশ্য জাদু ব্যতীত কিছুই নয়’’ (মায়েদাহ, আয়াত ১১০)।

 

উক্ত অপবাদে ঈসা (আঃ) ক্ষান্ত না হয়ে বরং আরও দ্বিগুণ বেগে দ্বীনের দাওয়াত দিয়ে যেতে থাকেন। তখন বিরোধীরা বেছে নেয় অতীব নোংরা পথ। তারা তাঁর মায়ের নামে অপবাদ রটাতে শুরু করে। যাতে ঈসা (আঃ) অত্যন্ত ব্যথা পেলেও নবুঅতের গুরুদায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সবকিছু নীরবে সহ্য করতে থাকেন। ফলে ঈসা (আঃ)-এর সমর্থক সংখ্যা যতই বাড়তে থাকে, অবিশ্বাসী সমাজ নেতাদের চক্রান্ত ততই বৃদ্ধি পেতে থাকে। এবার তারা তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র করল এবং সেজন্য দেশের বাদশাহকে তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে দেবার ষড়যন্ত্র করল। তারা অনবরত বাদশাহর কান ভারি করতে থাকে এই মর্মে যে, লোকটি আল্লাহ দ্রোহী। সে তাওরাত পরিবর্তন করে সবাইকে বিধর্মী করতে সচেষ্ট। এসব অভিযোগ শুনে অবশেষে বাদশাহ তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করেন। তখন ইহুদীদের এসব ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করার জন্য আল্লাহ স্বীয় কৌশল প্রেরণ করেন এবং ঈসা (আঃ)-কে সশরীরে আসমানে উঠিয়ে নেন।

 

ইহুদীদের উপর প্রেরিত গযব ও তার কারণ সমূহ

 

ঈসা (আঃ)-এর দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করার কারণে আল্লাহ ইহুদী কাফিরদের উপরে নানাবিধ দুনিয়াবী গযব নাযিল করেন। তাদেরকে কেন শাস্তি দেওয়া হয়েছিল- সে বিষয়ে অনেকগুলি কারণের মধ্যে আল্লাহ বলেন,

 

 ‘‘তারা যে শাস্তিপ্রাপ্ত হয়েছিল, তা ছিল (১) তাদের অঙ্গীকার ভঙ্গের কারণে, (২) অন্যায়ভাবে রাসূলগণকে হত্যা করার কারণে এবং (৩) তাদের এই উক্তির কারণে যে, ‘আমাদের হৃদয় আচ্ছন্ন’...। ‘আর (৪) তাদের কুফরীর কারণে এবং (৫) মারিয়ামের প্রতি মহা অপবাদ আরোপের কারণে’। ‘আর তাদের (৬) একথার কারণে যে, ‘আমরা মারিয়াম-পুত্র ঈসা মসীহকে হত্যা করেছি, যিনি ছিলেন আল্লাহর রাসূল। অথচ তারা না তাঁকে হত্যা করেছিল, না শূলে চড়িয়েছিল। বরং তাদের জন্য ধাঁধার সৃষ্টি করা হয়েছিল। বস্ত্ততঃ তারা এ ব্যাপারে নানাবিধ কথা বলে। তারা এ বিষয়ে সন্দেহের মাঝে পড়ে আছে। শুধুমাত্র ধারণার অনুসরণ করা ব্যতীত এ বিষয়ে তাদের কোন জ্ঞানই নেই। আর নিশ্চিতভাবেই তারা তাকে হত্যা করেনি’। ‘বরং তাকে আল্লাহ নিজের কাছে উঠিয়ে নিয়েছেন। আর আল্লাহ হ’লেন মহা পরাক্রান্ত ও প্রজ্ঞাময়’’ (নিসা, আয়াত ১৫৫-১৫৮)।

 

ইহুদীদের অভিশপ্ত হওয়ার ১০টি কারণ

 

সূরা নিসা ১৫৫-৬১ আয়াতে ইহুদীদের ইপর আল্লাহর গযব নাযিলের ও তাদের অভিশপ্ত হওয়ার যে কারণ সমূহ বর্ণিত হয়েছে, তা সংক্ষেপে নিম্নরূপ :

 

(১) তাদের ব্যাপক পাপাচার (২) আল্লাহর পথে বাধা দান (৩) সূদী লেনদেন (৪) অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ (৫) অঙ্গীকার ভঙ্গ করা (৬) নবীগণকে হত্যা করা (৭) আল্লাহর পথে আগ্রহী না হওয়া এবং অজুহাত দেওয়া যে, আমাদের হৃদয় আচ্ছন্ন (৮) কুফরী করা (৯) মারিয়ামের প্রতি মিথ্যা অপবাদ দেওয়া (১০) ঈসাকে শূলে বিদ্ধ করে হত্যার মিথ্যা দাবী করা।

 

ঈসা (আঃ)-কে হত্যার ষড়যন্ত্র ও তাঁর ঊর্ধ্বারোহন

 

তৎকালীন রোম সম্রাট ছাতিয়ূনুস-এর নির্দেশে (মাযহারী) ঈসা (আঃ)-কে গ্রেফতারের জন্য সরকারী বাহিনী ও ইহুদী চক্রান্তকারীরা তাঁর বাড়ী ঘেরাও করে। তারা জনৈক নরাধমকে ঈসা (আঃ)-কে হত্যা করার জন্য পাঠায়। কিন্তু ইতিপূর্বে আল্লাহ ঈসা (আঃ)-কে উঠিয়ে নেওয়ায় সে বিফল মনোরথ হয়ে ফিরে যায়। কিন্তু এরি মধ্যে আল্লাহর হুকুমে তার চেহারা ঈসা (আঃ)-এর সদৃশ হয়ে যায়। ফলে ইহুদীরা তাকেই ঈসা ভেবে শূলে বিদ্ধ করে হত্যা করে।

 

ইহুদী-নাছারারা কেবল সন্দেহের বশবর্তী হয়েই নানা কথা বলে এবং ঈসাকে হত্যা করার মিথ্যা দাবী করে। আল্লাহ বলেন, ‘‘এ বিষয়ে তাদের কোনই জ্ঞান নেই। তারা কেবলই সন্দেহের মধ্যে পড়ে আছে। এটা নিশ্চিত যে, তারা তাকে হত্যা করতে পারেনি’(নিসা, আয়াত ১৫৭)। বরং তার মত কাউকে তারা হত্যা করেছিল।

 

উল্লেখ্য যে, ঈসা (আঃ) তাঁর উপরে বিশ্বাসী সে যুগের ও পরবর্তী যুগের সকল খৃষ্টানের পাপের বোঝা নিজে কাঁধে নিয়ে প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ শূলে বিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন বলে খৃষ্টানদের দাবী স্রেফ প্রতারণা ও অপপ্রচার বৈ কিছুই নয়।

 

আল্লাহর পাঁচটি অঙ্গীকার

 

ইহুদীদের বিপক্ষে হযরত ঈসা (আঃ)-কে সাহায্যের ব্যাপারে আল্লাহ পাঁচটি ওয়াদা করেছিলেন এবং সবক’টিই তিনি পূর্ণ করেন। (১) হত্যার মাধ্যমে নয় বরং তার স্বাভাবিক মৃত্যু হবে (২) তাঁকে ঊর্ধ্বজগতে তুলে নেওয়া হবে (৩) তাকে শত্রুদের অপবাদ থেকে মুক্ত করা হবে (৪) অবিশ্বাসীদের বিপক্ষে ঈসার অনুসারীদেরকে ক্বিয়ামত অবধি বিজয়ী রাখা হবে এবং (৫) ক্বিয়ামতের দিন সবকিছুর চূড়ান্ত ফায়ছালা করা হবে। এ বিষয়গুলি বর্ণিত হয়েছে নিম্নোক্ত আয়াতে। যেমন আল্লাহ বলেন,

 

 ‘‘আর স্মরণ কর যখন আল্লাহ বললেন, হে ঈসা! আমি তোমাকে ওফাত দিব এবং তোমাকে আমার কাছে তুলে নেব এবং তোমাকে কাফিরদের হাত থেকে মুক্ত করব। আর যারা তোমার অনুসরণ করবে, তাদেরকে ক্বিয়ামত পর্যন্ত কাফিরদের বিরুদ্ধে বিজয়ী করে রাখবো। অতঃপর তোমাদের সবাইকে আমার কাছে ফিরে আসতে হবে, তখন আমি তোমাদের মধ্যকার বিবাদীয় বিষয়ে ফায়ছালা করে দেব’’ (আলে ইমরান, আয়াত ৫৫)।

 

উক্ত আয়াতে বর্ণিত অর্থ ‘আমি তোমাকে ওফাত দিব’। ‘ওফাত’ অর্থ পুরোপুরি নেওয়া। মৃত্যুকালে মানুষের আয়ু পূর্ণ হয় বলে একে ‘ওফাত’ বলা হয়। রূপক অর্থে নিদ্রা যাওয়াকেও ওফাত বা মৃত্যু বলা হয়। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ মানুষের প্রাণ নিয়ে নেন তার মৃত্যুকালে, আর যে মরেনা তার নিদ্রাকালে’ (যুমার, আয়াত ৪২)। সেকারণ যাহহাক, ফাররা প্রমুখ বিদ্বানগণ مُتَوَفِّيْكَ وَرَافِعُكَ إِلىَّ -এর অর্থ বলেন, আমি আপনাকে নিজের কাছে উঠিয়ে নেব এবং শেষ যামানায় (পৃথিবীতে নামিয়ে দিয়ে) স্বাভাবিক মৃত্যু দান করব। এখানে বর্ণনার আগপিছ হয়েছে মাত্র’ (কুরতুবী, ইবনু কাছীর)। যা কুরআনের বহু স্থানে হয়েছে। ঈসার অবতরণ, দাজ্জাল নিধন, পৃথিবীতে শান্তির রাজ্য স্থাপন ইত্যাদি বিষয়ে ছহীহ ও মুতাওয়াতির হাদীছ সমূহ বর্ণিত হয়েছে। প্রায় সকল বড় বড় নবীই হিজরত করেছেন। এক্ষণে পৃথিবী থেকে আসমানে উঠিয়ে নেওয়া, অতঃপর পুনরায় পৃথিবীতে ফিরিয়ে দিয়ে স্বাভাবিক মৃত্যু দান করা- এটা ঈসা (আঃ)-এর জন্য এক ধরনের হিজরত বৈ কি! পার্থক্য এই যে, অন্যান্য নবীগণ দুনিয়াতেই এক স্থান থেকে অন্য স্থানে হিজরত করেছেন। পক্ষান্তরে ঈসা (আঃ) দুনিয়া থেকে আসমানে হিজরত করেছেন। অতঃপর আসমান থেকে দুনিয়াতে ফিরে আসবেন। আল্লাহ সর্বাধিক অবগত এবং তিনিই সকল ক্ষমতার অধিকারী।

 

অতঃপর ঈসার অনুসারীদের ক্বিয়ামত অবধি বিজয়ী করে রাখার অর্থ ঈমানী বিজয় এবং সেটি ঈসা (আঃ)-এর ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর অনুসারীদের মাধ্যমেই সম্পন্ন হয়েছে। ঈমানী বিজয়ের সাথে সাথে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিজয় যেমন খেলাফত যুগে হয়েছে, ভবিষ্যতে আবারও সেটা হবে। এমনকি কোন বস্তিঘরেও ইসলামের বিজয় নিশান উড়তে বাকী থাকবে না। সবশেষে ক্বিয়ামত প্রাক্কালে ঈসা ও মাহদীর নেতৃত্বে বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক বিজয় সংঘটিত হবে এবং সারা পৃথিবী শান্তির রাজ্যে পরিণত হবে।

 

হাওয়ারীকারা?

 

حَوارِىّ শব্দটি حَوَرٌ ধাতু থেকে ব্যুৎপন্ন। অর্থ দেওয়ালে চুনকাম করার জন্য ধবধবে সাদা চুন। পারিভাষিক অর্থে ঈসা (আঃ)-এর খাঁটি অনুসারী শীর্ষস্থানীয় ভক্ত ও সাহায্যকারী ব্যক্তিগণকে ‘হাওয়ারী’ বলা হ’ত। কেউ বলেছেন যে, নাবাত্বী ভাষায় হাওয়ারী অর্থ ধোপা। ঈসার খাঁটি অনুসারীগণ ধোপা ছিলেন, যারা কাপড় ধৌত করতেন। পরে তারা ঐ নামেই পরিচিত হন। অথবা এজন্য তাদের উপাধি ‘হাওয়ারী’ ছিল যে, তারা সর্বদা সাদা পোষাক পরিধান করতেন। কোন কোন তাফসীরবিদ তাঁদের সংখ্যা ১২ জন বলেছেন। ঈসা (আঃ)-এর ভক্ত সহচরগণকে যেমন ‘হাওয়ারী’ বলা হয়; শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর ভক্ত সহচরগণকে তেমনি ‘ছাহাবী’ বলা হয়। আভিধানিক অর্থে ছাহাবী অর্থ সাথী বা সহচর হ’লেও পারিভাষিক অর্থে রাসূল (ছাঃ) ব্যতীত অন্যদের সাথীগণকে ‘ছাহাবী’ বলা হয় না। কেননা এই পরিভাষাটি কেবল ঐসকল পবিত্রাত্মা ব্যক্তিগণের জন্যেই সৃষ্টি হয়েছে। অবশ্য ‘হাওয়ারী’ শব্দটি কোন কোন সময় শুধু ‘সাহায্যকারী’ বা আন্তরিক বন্ধু অর্থেও ব্যবহৃত হয়। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একদা বলেন, ‘প্রত্যেক নবীর একজন ‘হাওয়ারী’ অর্থাৎ খাঁটি সহচর থাকে। তেমনি আমার ‘হাওয়ারী’ হ’ল যুবায়ের’।

 

ঈসা (আঃ) যখন বনু ইস্রাঈলের স্বার্থবাদী নেতাদের বিরোধিতা ও চক্রান্ত বুঝতে পারলেন, তখন নিজের একনিষ্ঠ সাথীদের বাছাই করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করলেন এবং সবাইকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের মধ্যে আমার সত্যিকারের ভক্ত ও অনুসারী কারা? একথাটিই কুরআনে বর্ণিত হয়েছে নিম্নোক্তভাবে-

 

 ‘‘যখন ঈসা বনু ইস্রাঈলের কুফরী অনুধাবণ করলেন, তখন বললেন, কারা আছ আল্লাহর পথে আমাকে সাহায্যকারী? তখন হাওয়ারীগণ বলল, আমরাই আল্লাহর পথে আপনার সাহায্যকারী। আমরা আল্লাহর উপরে ঈমান এনেছি। আপনি সাক্ষ্য থাকুন যে আমরা সবাই আত্মসমর্পণকারী’। ‘হে আমাদের পালনকর্তা! আমরা সেই সব বিষয়ের উপরে বিশ্বাস স্থাপন করেছি, যা তুমি নাযিল করেছ এবং আমরা রাসূলের অনুসারী হয়েছি। অতএব তুমি আমাদেরকে মান্যকারীদের তালিকাভুক্ত করে নাও’’ (আলে ইমরান, আয়াত ৫২-৫৩)

 

অন্যত্র এসেছে এভাবে-

 

 ‘‘হে বিশ্বাসী গণ! তোমরা আল্লাহর সাহায্যকারী হয়ে যাও। যেমন মারিয়াম-তনয় ঈসা হাওয়ারীদের বলেছিল, কে আছ আল্লাহর জন্য আমাকে সাহায্যকারী? হাওয়ারীরা বলেছিল, আমরাই আল্লাহর সাহায্যকারী। অতঃপর বনু ইস্রাঈলের একটি দল বিশ্বাস স্থাপন করল এবং অন্যদল প্রত্যাখ্যান করল। অতঃপর আমরা বিশ্বাসীদের সাহায্য করলাম তাদের শত্রুদের উপরে। ফলে তারা বিজয়ী হ’ল’’ (ছফ, আয়াত ১৪)।

 

অবশ্য হাওয়ারীদের এই আনুগত্য প্রকাশের ক্ষমতা আল্লাহ দান করেছিলেন তাঁর বিশেষ অনুগ্রহে। যেমন তিনি বলেন,

 

‘‘আর যখন আমি হাওয়ারীদের মনে জাগ্রত করলাম যে, আমার প্রতি ও আমার রাসূলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন কর, তখন তারা বলল, আমরা বিশ্বাস স্থাপন করলাম এবং আপনি সাক্ষী থাকুন যে, আমরা সবাই আত্মসমর্পণকারী’’ (মায়েদাহ, আয়াত ১১১)। এখানে হাওয়ারীদের নিকট ‘অহি’ করা অর্থ তাদের হৃদয়ে বিষয়টি সঞ্চার করা বা জাগ্রত করা। এটা নবুঅতের ‘অহি’ নয়।

 

বস্ত্ততঃ শত্রুদের উৎপীড়নে অতিষ্ঠ হয়ে ঈসা (আঃ) তাঁর অনুসারীগণের প্রতি উপরোক্ত আহবান জানাতে বাধ্য হয়েছিলেন। সাথে সাথে বার জন ভক্ত অনুসারী তাঁর ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন এবং আনুগত্যের শপথ নিয়েছিলেন। অতঃপর তারাই ঈসা (আঃ)-এর ঊর্ধ্বারোহণের পরে ঈসায়ী ধর্ম প্রচারে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। যদিও পরবর্তী কালে তাদের মধ্যে বহু ভেজাল ঢুকে পড়ে এবং তারা বহু দলে বিভক্ত হয়ে যায়। আজও বিশ্ব খৃষ্টান সমাজ রোমান ক্যাথলিক ও প্রটেষ্ট্যান্ট নামে প্রধান দু’দলে বিভক্ত। যাদের রয়েছে অসংখ্য উপদল। আর এরা সব দলই ভ্রান্ত।

 

ইমাম বাগাভী (রহঃ) সূরা ছফ ১৪ আয়াতের তাফসীরে আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, ঈসা (আঃ)-এর ঊর্ধ্বারোহণের পর খৃষ্টান জাতি তিন দলে বিভক্ত হয়ে যায়। একদল তাকে ‘আল্লাহ’ বলে। একদল তাঁকে ‘আল্লাহর পুত্র’ বলে এবং একদল তাকে ‘আল্লাহর দাস ও রাসূল’ বলে। প্রত্যেক দলের অনুসারী দল ছিল। তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-কলহ বাড়তে থাকে। অতঃপর শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর আগমন ঘটে এবং তিনি মুমিনদের দলকে সমর্থন দেন। ফলে তারাই দলীলের ভিত্তিতে জয়লাভ করে। বলা বাহুল্য মুমিন ঈসায়ীগণ সবাই ইসলাম কবুল করে ধন্য হন। ‘বিশ্বাসীদেরকে আল্লাহ সাহায্য করলেন ও তারা বিজয়ী হ’ল’ বলতে উম্মতে মুহাম্মাদীকে বুঝানো হয়েছে। যারা ঈসা ও মুহাম্মাদ উভয় নবীর উপরে বিশ্বাস স্থাপন করেছেন এবং অবিশ্বাসী কাফের মুশরিকদের উপর দুনিয়া ও আখেরাতে বিজয়ী হয়েছেন।

 

আসমান থেকে খাঞ্চা ভর্তি খাদ্য অবতরণ

 

মূসা (আঃ)-এর উম্মতগণের জন্য আল্লাহ আসমান থেকে মান্না ও সালওয়ার জান্নাতী খাবার নামিয়ে দিয়েছিলেন। সম্ভবতঃ তাতে উদ্বুদ্ধ হয়ে একদা হাওয়ারীগণ ঈসা (আঃ)-এর নিকটে অনুরূপ দাবী করে বসলো। বিষয়টির কুরআনী বর্ণনা নিম্নরূপ-

 

 ‘‘যখন হাওয়ারীরা বলল, হে মারিয়াম-পুত্র ঈসা! আপনার পালনকর্তা কি এরূপ করতে পারেন যে, আমাদের জন্য আকাশ থেকে খাদ্য ভর্তি খাঞ্চা অবতরণ করে দেবেন? তিনি বললেন, যদি তোমরা ঈমানদার হও, তবে আল্লাহকে ভয় কর’। ‘তারা বলল, আমরা তা থেকে খেতে চাই, আমাদের অন্তর পরিতৃপ্ত হবে এবং আমরা জেনে নেব যে, আপনি সত্য বলেছেন ও আমরা সাক্ষ্যদাতা হয়ে যাব’। ‘তখন মরিয়াম-তনয় ঈসা বলল, হে আল্লাহ! হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদের প্রতি আসমান থেকে খাদ্যভর্তি খাঞ্চা অবতীর্ণ করুন। তা আমাদের জন্য তথা আমাদের প্রথম ও পরবর্তী সবার জন্য আনন্দোৎসব হবে এবং আপনার পক্ষ হ’তে একটি নিদর্শন হবে। আপনি আমাদের রূযী দান করুন। আপনিই শ্রেষ্ঠ রূযীদাতা’। ‘আল্লাহ বললেন, নিশ্চয়ই আমি সে খাঞ্চা তোমাদের প্রতি অবতীর্ণ করব। অতঃপর যে ব্যক্তি অকৃতজ্ঞ হবে, আমি তাকে এমন শাস্তি দেব, যে শাস্তি বিশ্বজগতে অপর কাউকে দেব না’’ (মায়েদাহ, আয়াত ১১২-১১৫)।

 

উল্লেখ্য যে, উক্ত খাদ্য সঞ্চিত রাখা নিষিদ্ধ ছিল। তিরমিযীর একটি হাদীছে আম্মার বিন ইয়াসির (রাঃ) হ’তে বর্ণিত হয়েছে যে, উক্ত খাদ্যভর্তি খাঞ্চা আসমান হ’তে নাযিল হয়েছিল এবং হাওয়ারীগণ তৃপ্তিভরে খেয়েছিল। কিন্তু লোকদের মধ্যে কিছু লোক তা সঞ্চিত রেখেছিল। ফলে তারা বানর ও শূকরে রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছিল।

 

ঈসা (আঃ)-এর অনুসারীদের কুফরী এবং ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহর সঙ্গে ঈসা (আঃ)-এর কথোপকথন

 

ঈসা (আঃ)-এর ঊর্ধ্বারোহনের ফলে ঈসায়ীদের মধ্যে যে আক্বীদাগত বিভ্রান্তি দেখা দেয় এবং তারা যে কুফরীতে লিপ্ত হয়, সে বিষয়ে আল্লাহ ক্বিয়ামতের দিন ঈসাকে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন। যেমন আল্লাহ বলেন,

 

‘‘যখন আল্লাহ বলবেন, হে মরিয়াম-তনয় ঈসা! তুমি কি লোকদের বলেছিলে যে, তোমরা আল্লাহকে ছেড়ে আমাকে ও আমার মাতাকে উপাস্য সাব্যস্ত কর? ঈসা বলবেন, আপনি মহাপবিত্র। আমার জন্য শোভা পায় না যে, আমি এমন কথা বলি, যা বলার কোন অধিকার আমার নেই। যদি আমি বলে থাকি, তবে আপনি অবশ্যই তা জানেন। বস্ত্ততঃ আপনি আমার মনের কথা জানেন, কিন্তু আমি জানি না কি আপনার মনের মধ্যে আছে। নিশ্চয়ই আপনি অদৃশ্য বিষয়ে অবগত’। ‘আমি তো তাদের কিছুই বলিনি, কেবল সেকথাই বলেছি যা আপনি বলতে বলেছেন যে, তোমরা আল্লাহর দাসত্ব কর, যিনি আমার ও তোমাদের পালনকর্তা। বস্ত্ততঃ আমি তাদের সম্পর্কে অবগত ছিলাম, যতদিন আমি তাদের মধ্যে ছিলাম। অতঃপর যখন আপনি আমাকে লোকান্তরিত করলেন, তখন থেকে আপনিই তাদের সম্পর্কে অবগত রয়েছেন। আপনি সকল বিষয়ে পূর্ণ অবগত’। ‘এক্ষণে যদি আপনি তাদেরকে শাস্তি দেন, তবে তারা আপনার দাস। আর যদি আপনি তাদের ক্ষমা করেন, তবে আপনিই পরাক্রান্ত ও মহাবিজ্ঞ’’ (মায়েদাহ, আয়াত ১১৬-১১৮)।

 

উপরোক্ত ১১৭নং আয়াতে বর্ণিত فَلَمَّا تَوَفَّيْتَنِيْ বাক্যটিতে ঈসা (আঃ)-এর মৃত্যুর দলীল তালাশ করার এবং তাঁর ঊর্ধ্বারোহনের বিষয়টিকে অস্বীকার করার প্রমাণ হিসাবে উপস্থাপন করার কোন সুযোগ নেই। কেননা এ কথোপকথনটি ক্বিয়ামতের দিন হবে। যার আগে আসমান থেকে অবতরণের পর দুনিয়ায় তাঁর স্বাভাবিক মৃত্যু হয়ে যাবে।

 

ঈসা (আঃ)-এর কাহিনী থেকে শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ

 

হযরত ঈসা (আঃ)-এর নবুঅতী জীবন থেকে আমরা নিম্নোক্ত শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ জানতে পারি। যেমন-

 

(১) পিতা ইবরাহীম (আঃ)-এর কনিষ্ঠ পুত্র ইসহাক (আঃ)-এর বংশের হাযার হাযার নবী-রাসূলের মধ্যে সর্বশেষ নবী ও কিতাবধারী রাসূল ছিলেন হযরত ঈসা (আঃ)। তাঁর পূর্বেকার সকল নবী এবং তিনি নিজে শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন, যিনি ইবরাহীম (আঃ)-এর জ্যেষ্ঠ পুত্র ইসমাঈল (আঃ)-এর বংশের একমাত্র নবী এবং সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল। ঈসা (আঃ) পর্যন্ত সকল নবী ও রাসূল বনু ইস্রাঈল তথা স্ব স্ব গোত্রের প্রতি আগমন করলেও শেষনবী প্রেরিত হয়েছিলেন বিশ্ব মানবতার প্রতি বিশ্বনবী হিসাবে। অতএব ঈসা (আঃ)-এর প্রতিশ্রুত শেষনবী ‘আহমাদ’ বা মুহাম্মাদ-এর অনুসারী উম্মতে মুহাম্মাদীই হ’ল ঈসা (আঃ)-এর প্রকৃত অনুসারী ও প্রকৃত উত্তরসুরী। নামধারী খৃষ্টানরা নয়।

 

(২) মু‘জেযা প্রদর্শনের মাধ্যমে বিরোধী পক্ষকে ভয় দেখানো যায় বা চুপ করানো যায়। কিন্তু হেদায়াতের জন্য আল্লাহর রহমত আবশ্যক। যেমন ঈসা (আঃ)-কে যে মু‘জেযা দেওয়া হয়েছিল, সে ধরনের মু‘জেযা অন্য কোন নবীকে দেওয়া হয়নি। এমনকি তাঁর জন্মটাই ছিল এক জীবন্ত মু‘জেযা। কিন্তু তা সত্ত্বেও শত্রুরা হেদায়াত লাভ করেনি।

 

(৩) সবকিছু মানবীয় জ্ঞান দ্বারা পরিমাপ করা যায় না। বরং সর্বদা এলাহী সিদ্ধান্তের প্রতি বিশ্বাসী ও আকাংখী থাকতে হয়। যেমন মারিয়াম ও তৎপুত্র ঈসার জীবনের প্রতিটি ঘটনায় প্রমাণিত হয়েছে।

 

(৪) যারা নিঃস্বার্থভাবে সমাজের কাজ করেন ও পরকালীন মঙ্গলের পথ প্রদর্শন করেন, স্বার্থপর ও দুনিয়া পূজারী সমাজ নেতারা তাদের শত্রু হয় এবং পদে পদে বাধা দেয়। কিন্তু সাথে সাথে একদল নিঃস্বার্থ সহযোগীও তারা পেয়ে থাকেন। যেমন ঈসা (আঃ) পেয়েছিলেন।

 

(৫) দুনিয়াবী সংঘাতে দুনিয়াদারদের পার্থিব বিজয় হ’লেও চূড়ান্ত বিচারে তাদের পরাজয় হয় এবং তারা ইতিহাসে সর্বাধিক নিন্দিত ব্যক্তিতে পরিণত হয়। পক্ষান্তরে নবী ও সমাজ সংস্কারকগণ নির্যাতিত হ’লেও চূড়ান্ত বিচারে তারাই বিজয়ী হন এবং সারা বিশ্ব তাদেরই ভক্ত ও অনুসারী হয়। ঈসা (আঃ)-এর জীবন তারই অন্যতম প্রকৃষ্ট প্রমাণ।

 

আল কুরআনে উল্লেখ

 

 আল কুরআনে শ্রেষ্ঠ নবী রাসুলগনের সাথে হযরত ঈসা (আঃ) এর নাম উল্লেখ হয়েছে। তিনি ছিলেন একজন উচ্চ মর্যাদার রাসুল। আল কুরআনে রাত নাম উল্লেখ হয়েছে ২৫ বার। যে সব সূরায় উল্লেখ হয়েছে সেগুলো হল –

 

আল বাকারা, আয়াত ৮৭, ১৩৬, ২৫৩। আলে ইমরান ; ৪৫, ৫২, ৫৫, ৫৯, ৮৪। আন নিসা ; ১৫৭, ১৬৩, ১৭১। আল মায়িদা ; ৪৬, ৭৮, ১১০, ১১২, ১১৪, ১১৬। আল আনয়াম ; ৮৫। মরিয়ম ; ৩৪। আল আহযাব ; ৭। আশ শুরা ; ১৩। যুখরুফ ; ৬৩। আল হাদিদ ; ২৭। আস সফ ; ৬, ১৪।

 

হযরত ঈসা (আঃ) সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্যে আল কুরআনের নিম্নোক্ত সূরাগুলো পড়বেন –

 

সূরা আলে ইমরান, আয়াত ৩৫-৬০। সূরা আন নিসা, আয়াত ১৫৩-১৬৫ ও ১৭১-১৭৩। সূরা আল মায়িদা, আয়াত ৪৬-৫১, ৬৩-৭৮, ১০৯-১৬০। সূরা মরিয়ম, আয়াত ১৬-৪০। সূরা যুখরুফ, আয়াত ৫৭-৬৫। সূরা আস সফ, আয়াত ৬, ১৪।

 

হযরত ঈসা (আঃ) এর প্রকৃত অনুসারী হলেন তারা, যারা হযরত মুহাম্মাদ (সঃ) এর প্রতি ঈমান এনে তাঁর অনুসরন এবং আনুগত্য করেছেন।

 

২৫।

 

বিশ্বনবী মুহাম্মাদ রাসুলুল্লাহ

 

(সাঃ)

 

নবুয়্যতের ধারা একটি কড়ির মালার মতো। এ মালার প্রথম কড়ির নাম আলম এবং শেষ কড়ির নাম মুহাম্মাদ। এ দুইটি কড়ির মাঝে রয়েছে শত শত হাজার হাজার কড়ি।

 

১। অনন্য তিন বৈশিষ্ট্য

 

অন্যসব নবী রাসুলের মতই মুহাম্মাদ রাসুলুল্লাহ (সাঃ) ছিলেন একজন মানুষ, একজন নবী ও একজন রাসুল। তবে মহা বিশ্বের মালিক আল্লাহ তায়ালা তাঁকে এমন তিনটি বৈশিষ্ট্য দান করেছেন যা অন্যসব নবী রাসুলদের দান করেননি। সে তিন বৈশিষ্ট্য হলো –

 

এক। সর্বশেষ নবী ও রাসুল। তাঁর মাধ্যমে মহান আল্লাহ তায়ালা নবুয়্যত ও রিসালাতের ধারা শেষ করেছেন। তাঁর নবুয়্যতী আদর্শই কিয়ামত পর্যন্ত অনুসরনীয়।

 

দুই। বিশ্বনবী। মহান আল্লাহ তাঁকে জাতি, বর্ণ, গোত্র, ধর্ম নির্বিশেষে কিয়ামত পর্যন্তকার সকল মানুষের নবী ও রাসুল নিযুক্ত করেছেন।

 

তিন। সমগ্র মানব জাতির জন্যে রহমত ও আশীর্বাদ। তাঁকে পাঠানো হয়েছে রহমত, আশীর্বাদ ও অনুকম্পা স্বরূপ সমগ্র মানব জাতির জন্যে। এ তিনটি বিষয়ের প্রমান হল আল কুরআনের নিম্নোক্ত তিন আয়াত। -

 

১। মুহাম্মাদ তোমাদের কোন পুরুষের পিতা নয়, বরং আল্লাহর রাসুল ও সর্বশেষ নবী। আল্লাহ প্রতিটি বিষয়ে জ্ঞাত। (সূরা আহযাব, আয়াত ৪০)

 

২। আমরা অবশ্যি তোমাকে রাসুল বানিয়ে পাঠিয়েছি সমগ্র মানব জাতির জন্যে সুসংবাদ দাতা ও সতর্ককারী হিসেবে। তবে অধিকাংশ মানুষই এলেম রাখেনা। (সূরা সাবা, আয়াত ২৮)

 

৩। হে মুহাম্মাদ, আমরা তোমাকে রাসুল মনোনীত করে পাঠিয়েছি সমগ্র জগতবাসীর জন্যে রহমত (অনুকম্পা ও আশীর্বাদ) হিসেবে। (সূরা আল আম্বিয়া, আয়াত ১০৭)

 

 

 

 

 

২। জীবনকাল

 

মুহাম্মাদ রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর জীবনকাল পূর্বকালের নবীগনের জীবনকালের মতো অজ্ঞাত ও অস্পষ্ট নয়। ইতিহাসে তাঁর জীবনকাল জ্ঞাত ও সুস্পষ্ট। ঈসা (আঃ) এর পরে তাঁর জন্ম হয়েছে। ঈসা (আঃ) এর জন্ম সাল থেকে খ্রিষ্ট সাল চালু হয়েছে। মুহাম্মাদ (সঃ) এর জীবনকালের হিসাব রাখা হয়েছে চন্দ্রমাসের হিসেবে। পরবর্তীকালে ঐতিহাসিকরা সেটাকে খৃষ্ট বর্ষের সাথে সংযুক্ত করেছেন। সে হিসেবে তাঁর জন্ম তারিখ হল ৯ই রবিউল আউয়াল, সোমবার, ২২ শে এপ্রিল, ৫৭১ খ্রিষ্টাব্দ। তবে পুরাবের মতটাই ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে সঠিক। এই পার্থক্যটা হয়েছে পরবর্তীকালে চন্দ্র মাসের হিসাবকে খৃষ্ট সনের সাথে মিলাতে গিয়ে এবং চান্দ্র বর্ষ ও সূর্য বর্ষের মধ্যে আত/দশ দিন ফারাক থাকার কারনে। তাঁর বয়স যখন চল্লিশ বছর ছয়মাস ষোলো দিন, তখন তিনি নবুয়্যত লাভ করেন। এটা ছিলো ৬১০ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারী মাস। চন্দ্রমাস ছিল রমযান। তিনি মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেন ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে। এ সময় তাঁর বয়স ছিল ৫৩ বছর।

 

তাঁর অফাত বা মৃত্যু হয়েছিলো সোমবার। এটা ছিল ১২ই রবিউল আউয়াল, ১১ হিজরি, ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দ। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মুহাম্মাদ রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর জীবনকাল ছিল ৬৩ বছর। নবুয়্যত ছিল ২৩ বছর। নবুয়্যত পূর্ব জীবন ছিল ৪০ বছর। ফলে তাঁর জীবনকাল একেবারেই সুস্পষ্ট।

 

৩। জন্ম কোথায়, কোন বংশে?

 

মুহাম্মাদ রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর জন্মস্থান মক্কায়। এটি একটি প্রাচীন শহর। মক্কা বর্তমানে সৌদি আরবের অন্তর্ভুক্ত। এটি লোহিত সাগরের পূর্ব তীরের জেদ্দা নদী বন্দর থেকে পঞ্চাশ মাইল পূর্বে অবস্থিত। চৌদ্দ শত বছর পূর্বের মক্কা ছিলো তরুলতা বিহীন পাহাড় টিলা আর পাথর কংকরময় এক মরু শহর। তখন তাঁদের প্রধান ফসল ছিল খেজুর, কোন কোন এলাকায় আঙ্গুর ও যব। শহরটি প্রধানত ছিল ব্যবসা ও আমদানী নির্ভর। এছাড়া এখানকার লোকেরা উট ও মেষ পালন করতো। আর ঘোড়া ছিল তাঁদের বাহাদুরীর প্রতীক।

 

খ্রিষ্টপূর্ব দুই হাজার বছরেরও কিছু আগের কথা। তখন মক্কায় কোন মানুষ বসবাস করতোনা। এটি ছিল জনমানবহীন পাথর পর্বতের এক ভুতুরে নির্জনভূমি। তখন মহানবী ইবরাহীম (আঃ) তাঁর দুই পুত্রের এক পুত্রকে এখানে পুনর্বাসন করেন। তিনি ছিলেন আল্লাহর রাসুল ইসমাঈল (আঃ)।

 

অতপর আল্লাহর নির্দেশে ইবরাহীম ও ইসমাঈল (আঃ) মক্কার বুকে নির্মাণ করেন আল্লাহর ঘর কা’বা ঘর। ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে ইসমাঈলের বংশধর। বাইরের কিছু লোকও এই শহরের আসে পাশে এসে বসবাস করতে থাকে। এভাবেই গড়ে ওঠে মক্কা নগরী। হযরত ইবরাহীম ও ইসমাঈলের বংশধরেরা পরবর্তীতে কুরাইশ বংশ নামে খ্যাতি অর্জন করে। এ বংশেরই একটি শাখার নাম বনু হাশেম। বনু হাশেমই কুরাইশদের নেতৃত্ব দান করতো। এই বনু হাশেম বংশেই কুরাইশ নেতা আব্দুল মুত্তালিবের পুত্র আব্দুল্লাহর ঔরসে এবং মা আমিনার গর্ভে জন্মগ্রহন করেন বিশ্বনবী মুহাম্মাদ রাসুলুল্লাহ (সঃ)। সুতরাং মুহাম্মাদ (সঃ) হযরত ইবরাহীম (আঃ) এর শ্রেষ্ঠ বংশধর।

 

৪। নবুয়্যত পূর্ব জীবন ও শৈশব

 

বিশ্বনবী (সঃ) মাতৃগর্ভে। এসময় তাঁর পিতা আব্দুল্লাহ সিরিয়ায় বাণিজ্যিক সফরে যান। সেখান থেকে ফেরার পথে তিনি পথিমধ্যে মদিনায় মৃত্যুবরণ করেন। বিধবা হয়ে পড়েন মা আমিনা। মাতৃগর্ভে থাকতেই ইয়াতিম হয়ে পড়েন বিশ্বনবী মুহাম্মাদ (সঃ)।

 

তাঁর জন্মকালে জীবিত ছিলেন কুরাইশ নেতা আব্দুল মুত্তালিব, বড় চাচা আবু তালিব, অন্যান্য চাচা এবং ফুফুরা। কুরাইশদের বংশীয় রীতি অনুযায়ী জন্মের কয়েকদিনের মধ্যেই লালন পালন ও বিশুদ্ধ আরবী ভাষা শিখানোর উদ্দেশ্যে তাঁকে ন্যস্ত করা হয় বেদুইন ধাত্রী মা হালিমার দায়িত্বে। ছয় বছর বয়েস হলে হালিমা তাঁকে মায়ের কোলে ফেরত দিয়ে যান। মা আমিনা ফিরে পান বুকের ধন মুহাম্মাদকে। দাদা আব্দুল মুত্তালিবের সবচেয়ে প্রিয় নাতী মুহাম্মাদ। চাচা এবং ফুফুদের কাছেও সর্বাধিক প্রিয়। শিশুকাল থেকেই সবাই হয়ে পড়েন তাঁর গুনমুগ্ধ। সুন্দরতম গুনাবলী আর মহোত্তম আচরনে তিনি শিশুকাল থেকেই সবার সেরা। ফলে সবার প্রিয় মুহাম্মাদ। ভবিষ্যতে নেতা এবং সেরা মানুষ হবার সব গুনাবলীই ফুতে উঠেছে শিশু মুহাম্মাদের চরিত্রের মধ্যে। মুহাম্মাদের বয়েস ছয় কি আট। এ সময় মা আমিনা সিদ্ধান্ত নেন ছেলেকে দেখাতে মদীনায় নিয়ে যাবেন ওর মাতুলালয়ে। তাছাড়া ওর বাবার কবরও ওখানে। দেখিয়ে আনবেন বাবার কবরও। ফলে তারা মদিনায় এলেন। থাকলেন মাস খানেক। তারপর—তারপর ফিরে চললেন মক্কার উদ্দেশ্যে। কিন্তু পথিমধ্যে প্রচণ্ড জ্বর আক্রমন করলো মা আমিনাকে। শেষ পর্যন্ত তিনি পথেই মারা গেলেন। সাথে ছিলেন মায়ের সেবিকা উম্মে আয়মান। মায়ের মতই তিনি মুহাম্মাদকে লালন পালন করেছেন সারাজীবন। তিনি মুহাম্মাদকে কোলে জড়িয়ে ফিরে এলেন মক্কায়। দাদা আব্দুল মুত্তালিব পরম আদর যত্নে গড়ে তুলছিলেন নাতি মুহাম্মাদকে। কিন্তু এরি মধ্যে দুই বছরের মাথায় তিনিও ইহকাল ত্যাগ করেন। পরিবর্তন হয় অভিভাবক। এবার মুহাম্মাদের অভিভাবকের দায়িত্ব নেন বড় চাচা আবু তালিব। আবু তালিব নিজ সন্তানদের চেয়েও অধিক স্নেহ এবং আদর যত্ন করতেন এতিম ভাতিজা মুহাম্মাদকে। আবু তালিব একবার বারো বছর বয়সে মুহাম্মাদকে বাণিজ্যিক সফরে সিরিয়ায় নিয়ে যান। এ সফরে আবু তালিব মুহাম্মাদের মধ্যে প্রতক্ষ করেন অনেক অলৌকিকত্ব। এভাবে তিনি উপযুক্ত অভিভাবকের অধিনেই বেড়ে ওঠেন ছোট বেলা থেকে। এ প্রসঙ্গেই মহান আল্লাহ তাঁকে উদ্দেশ্য করে বলেন –

 

“তিনি কি তোমায় ইয়াতিম পাননি? তারপর আশ্রয় দেননি।” (আল কুরআন ; ৯৩-৬)

 

৫। নবুয়্যত পূর্বজীবন ; যৌবনকাল

 

এরি মধ্যে মুহাম্মাদ নিজেকে দক্ষ ও সৎ ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। অপরদিকে সততা, সত্যবাদিতা, ন্যায়বিচার ও সমাজ সেবার মাধ্যমে তিনি মক্কার জনগণের নয়নমণিতে পরিনত হন। জনগন তাঁকে উপাধি দেয় ‘আল আমিন’ ও ‘আস সাদিক’। এর মানে পরম বিশ্বস্ত ও মহা সত্যবাদী। পঁচিশ বছর বয়েসে বিয়ে করেন খাদিজাকে। তিনি ছিলেন খাদিজা তাহিরা- পবিত্র নারী খাদিজা। রূপে গুনে এবং সহায় সম্পদে তিনি ছিলেন মক্কার সেরা নারী। মক্কার সেরা নেতা ও ধনীদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে তিনি নিজেই স্বামী হিসেবে পছন্দ করে নেন ভবিষ্যতের মহাপুরুষ মুহাম্মাদকে। খাদিজার গর্ভে জন্ম হয় বিশ্বনবীর চারকন্যা – উম্মে কুলসুম, যয়নব, রুকাইয়া এবং ফাতিমা। প্রথমে কাসেম নামে একটি পুত্রের জন্ম হয়, কিন্তু জন্মের পর স্বল্প সময়ের মধ্যেই কাসেম মারা যান। ইতোমধ্যে সামাজিক বিবাদ ফায়সালায়ও মুহাম্মাদের প্রশংসনীয় কৃতিত্ব সবার কাছে সমাদৃত হয়। জনগন তাঁকে তাঁদের ভবিষ্যতের নেতা ভাবতে থাকে। তাছাড়া সততা, সত্যবাদিতা, বিশ্বস্ততা, নযায়পরায়নতা ও মহৎ মানবীয় গুনাবলীর দিক থেকে জনগন এমন সেরা মানুষ আর কখনো দেখেনি।

 

৬। অন্ধকারে নিমজ্জিত সমাজ

 

সেকালে মানব সমাজ ছিল সকল দিক থেকে অন্ধকারে নিমজ্জিত। তারা ডুবে ছিল অন্ধ ও ভ্রান্ত বিশ্বাসের অটল গহবরে। তাঁদেরকে গ্রাস করে ফেলেছিলো চরিত্রহীনতা ও নৈতিক অধঃপতন। গোত্রীয় ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হাঙ্গামায় ছিল তারা পর্যদুস্ত। কুসংস্কারের বলীতে তারা ছিলো ধংসোন্মুখ। তাঁদের উপর ছায়া বিস্তার করে রেখেছিল অর্থনৈতিক দেউলিয়াত্ব। অধিকাংশ মানুষ ছিল দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ। নারীরা ছিল সম্পূর্ণ অসহায় ও মর্যাদাহীন। ভাস্কর্য পূজা তাঁদের নামিয়ে দিয়েছিলো মানবতার সর্বনিম্নস্তরে। এমতাবস্থায় মহান স্রষ্টার পক্ষ থেকে আসার প্রয়োজন ছিল এক সাহায্যপ্রাপ্ত মহাবীর মুক্তিদুত। এতিম মুহাম্মাদকেই মহান আল্লাহ গড়ে তুলছিলেন সেই মুক্তিদুত হিসেবে।

 

৭। নবুয়্যত লাভ

 

এদিকে তাঁর বয়েস যখন চল্লিশের কাছাকাছি তখন তিনি নির্জনতা অবলম্বন করতে থাকেন। ক্রমান্বয়ে নির্জনতা তাঁকে গভীরভাবে প্রভাবিত করতে থাকে। কা’বা থেকে মাইল তিনেক পূর্বদিকের একটি পাহাড়। এর বর্তমান নাম ‘জাবালুন্নুর’ বা জ্যোতির পাহাড়। এ পাহাড়ের চুড়ায় রয়েছে পশ্চিমমুখী বা কাবা মুখী একটি গুহা। গুহাটির নাম হেরা। জাবালুন নুরের চুড়ায় অবস্থিত হেরা গুহায় গিয়ে মুহাম্মাদ (সঃ) নীরবে নির্জনে ধ্যান করতে থাকেন। অজ্ঞতার অন্ধকার থেকে মানব সমাজের মুক্তির জন্যে তিনি এক আল্লাহর কল্যাণমুখী হন। ধ্যান করতে থাকেন। তাঁর মহিমা ও সৃষ্টিকে নিয়ে ভাবতে থাকেন। তাঁর সমস্ত মন মস্তিস্কে এক আল্লাহর ধ্যান এবং ভাবনা গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করে। এভাবে তাঁর বয়স যখন চল্লিশ বছর ছয়মাস, তখন রমযান মাসের এক শুভরাত্রে তাঁর কাছে আগমন ক্রেন আল্লাহর দূত হযরত জিব্রাইল আমিন। তখনো তিনি হেরা গুহায় ধ্যানরত। জিবরীল এসে তাঁকে বললেন- ‘পড়ুন’। তিনি বললেন- ‘আমি পড়তে জানিনা’। এবার জিবরীল তাঁকে প্রচণ্ড জোরে নিজের বুকের সাথে আঁকড়ে ধরেন। তারপর ছেড়ে দিয়ে বলেন – ‘পড়ুন’। জ্ঞানের আলোকে জ্যোতির্ময় হয়ে উঠলো তাঁর হৃদয়। সাথে সাথে তিনি পড়তে শুরু করলেন – “ইকরা বি ইসমি রাব্বিকাল্লাজি খালাক। খালাকাল ইনসানা মিন আলাক। ইকরা ওয়া রাব্বুকাল আকরাম। আল্লাযি আল্লামা বিল কালাম। আল্লামাল ইনসানা মালাম ইয়ালাম।” অর্থ “ পড়ো তোমার প্রভুর নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে শক্তভাবে আটকে থাকা শিশু থেকে। পড়ো, আর তোমার প্রভু বড়ই দয়াবান, মহিমা মণ্ডিত। তিনি শিক্ষা দিয়েছেন কলমের সাহায্যে। শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানতো না।”

 

এ অংশটি পরে রাসুল (সঃ) আল কুরআনের সূরা আলাকের প্রথম পাঁচটি আয়াত হিসেবে সংকলন করেন। মুহাম্মাদ রাসুলুল্লাহর প্রতি এটিই ছিল কুরআন নাযিল হবার সুচনা। এটাই ছিল তাঁর নবুয়্যতী জীবনের সূচনা। আর এটা ছিল ৬১০ খ্রিষ্টাব্দ। ফেব্রুয়ারী মাস। মুহাম্মাদ রাসুলুল্লাহ কোন অভিনব নবী ছিলেন না। তাঁর পূর্বেও বিগত হয়েছেন বহু নবী রাসুল। ইতোপূর্বে আমরা চব্বিশজন নবী রাসুলের জীবনী আলোচনা করে এসেছি। মুহাম্মাদ (সঃ) নবুয়্যতী মালার সর্বশেষ কড়ি। তাঁর প্রতি অবতীর্ণ আল কুরআন আসমানী সর্বশেষ কিতাব। তাঁর রিসালাত ও তাঁর প্রতি অবতীর্ণ আল কুরআন চিরন্তর এবং সার্বজনীন।

 

৮। আল্লাহর দিকে আহবানের গুরু দায়িত্ব

 

নবুয়্যত ও রিসালাত হল আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে এক মহান দায়িত্ব। এ হলো, মানব সমাজের কাছে আল্লাহর বার্তা পৌঁছে দেবার দায়িত্ব। এ হলো মানব সমাজকে এক অদ্বিতীয় সর্বশক্তিমান আল্লাহর দিকে আহবান করার দায়িত্ব। তাই, মুহাম্মাদ (সঃ) মানব সমাজের জন্যে মহান আল্লাহর নিযুক্ত –

 

১। বার্তাবাহক (রাসুল)।

 

২। আল্লাহর দিকে আহবায়ক (দায়ী ইলাল্লাহ)।

 

৩। সুসংবাদদাতা (বাশীর)।

 

৪। সতর্ককারী (নাযির)।

 

৫। সত্যের সাক্ষী (শাহেদ)।

 

৬। সর্বোত্তম আদর্শ (উসওয়াতুন হাসানা) এবং

 

৭। মহাসত্যের অনাবীল আলো বিতরণকারী এক সমুজ্জ্বল প্রদীপ (সিরাজাম মুনিরা)।

 

এ দায়িত্বগুলো তাঁর উপর অর্পিত হয়েছে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে। এ গুরু দায়িত্ব পালন করার জন্যে তিনি পাহাড় থেকে ঝাপিয়ে পড়লেন মানব সমাজে। গুহায় বসে ধ্যান করার দিন শেষ। মানবতার মুক্তির যে মহান উদ্দেশ্যে তিনি ধ্যানে মগ্ন হয়েছিলেন, সেই মহান উদ্দেশ্য হাসিলের সঠিক দিশা এবং নির্দেশিকা এবার তিনি পেয়ে গেছেন। তাই এবার মানব সমাজকে ধংসের হাত থেকে মুক্তির লক্ষে ঝাপিয়ে পড়লেন মানব সমাজে।

 

তাঁকে প্রদত্ত দায়িত্ব সম্পর্কে স্বয়ং মহান আল্লাহ বলেন-

 

  •  
  • হে মুহাম্মাদ, বলো- হে মানুষ, আমি তোমাদের সকলের প্রতি আল্লাহর বার্তাবাহক। (আল কুরআন ৭ ;১৫৮)
  •  
  • গোটা মানবজাতির জন্যে আমরা তোমাকে বার্তাবাহক নিযুক্ত করেছি। (আল কুরআন ৪ ; ৭৯)
  •  
  • যাতে করে রাসুল তোমাদের উপর সাক্ষী হয়। (আল কুরআন ২ ; ১৪৩)
  •  
  • হে নবী, আমরা তোমাকে পাঠিয়েছি সাক্ষী, সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী হিসেবে এবং আল্লাহর অনুমতিক্রমে তাঁর দিকে আহ্বানকারী হিসেবে আর আলো বিতরণকারী সমুজ্জ্বল প্রদীপ হিসেবে। (আল কুরআন ৩৩ ; ৪৫-৪৬)
  •  

 

এসব দায়িত্ব পালনে তিনি নিজেকে এতোটাই নিবেদিত করেছিলেন যে, তিনি নিজের জীবনের প্রতিও অনেকটা বেপরোয়া বা বেখেয়াল হয়ে ওঠেন। এ বিষয়ে মহান আল্লাহ তাঁকে এভাবে সতর্ক করেন-

 

“তারা এ বানীর প্রতি ঈমান আনেনা বলে সম্ভবত দুঃখে শোকে আর হতাশায় তুমি নিজেকেই বিনাশ করে ছাড়বে।” (আল কুরআন ১৮ ;৬)

 

৯। মানব সমাজকে মুক্তি ও সাফল্যের দিকে আহবান

 

মহান আল্লাহ মুহাম্মাদ (সঃ) কে রিসালাতের দায়িত্বে নিযুক্ত করার পর তিনি মানুষকে যেসব বিষয়ের প্রতি আহবানব করেন এবং যেসব বার্তা তাঁদেরকে পৌঁছান, সংক্ষেপে তা হলো –

 

১। মহাবিশ্বের একজন স্রষ্টা আছেন, তিনিই মহান আল্লাহ। মহাবিশ্ব, পৃথিবী ও মানুষ সব কিছুই তিনি সৃষ্টি করেছেন। তিনি সবার প্রভু। তিনিই মহাজগৎ মহাবিশ্বের প্রতিপালক, পরিচালক ও শাসক।

 

২। তিনি এক ও একক। তিনি সন্তান গ্রহন করেননা। তিনিও কারো সন্তান না। তাঁর সমকক্ষ কেউ নেই। কোন বিষয়েই তাঁর কোন শরীক বা অংশীদার নেই। কোন বিষয়েই তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন। কোন বিষয়েই কারো কাছ থেকে তাঁর কোন সাহায্য নেয়ার প্রয়োজন নেই। তিনি সর্বশক্তিমান, সর্বোচ্চ ও সকল ত্রুটি থেকে পবিত্র। সবাই ও সব কিছুই তাঁর সৃষ্টি এবং তাঁর দয়া, অনুগ্রহ ও সাহায্যের মুখাপেক্ষী।

 

৩। তিনি মানুষকে সৃষ্টি করে তাঁকে একটি সময়ের জন্যে এই পৃথিবী পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছেন। শুধুমাত্র তাঁর হুকুম ও বিধান মতো জীবন যাপন করার জন্যেই তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। এ উদ্দেশ্যে তিনি তাঁর বার্তাবাহক হিসেবে নবী রাসুল পাঠিয়েছেন। মানুষের জন্যে জীবন যাপনের নির্দেশিকা সম্বলিত কিতাব পাঠিয়েছেন এবং পৃথিবীকে তাঁর বিধান মতো পরিচালনা করার জন্যে মানুষেরই উপর দায়িত্ব অর্পণ করেছেন।

 

৪। তিনি বিবেক বুদ্ধি দিয়ে মানুষকে জ্ঞানী ও যুক্তিবাদী বানিয়েছেন। মানুষের মধ্যে পাশবিক প্রবৃত্তি এবং নৈতিক প্রবৃত্তি অন্তর্ভুক্ত করে দিয়েছেন। পাশবিক প্রবৃত্তিকে সুনিয়ন্ত্রিত করে বিবেক বুদ্ধি তথা নৈতিক শক্তিকে শক্তিশালী ও বিকশিত করতে বলেছেন।

 

তাঁকে আল্লাহর বিধান ও নৈতিক শক্তিতে হয়ে পার্থিব জীবন পরিচালনা করতে বলেছেন।

 

৫। পার্থিব জীবনের কার্যক্রমের জন্যে মানুষের বিচার হবে। আল্লাহর বিধান এবং মহৎ মানবীয় নৈতিক গুনাবলীর ভিত্তিতে সে তাঁর সামগ্রিক জীবন পরিচালনা করেছে কিনা, সেটাই হবে বিচারের বিষয়। এ উদ্দেশ্যে মানুষকে পুনরুত্থিত করা হবে। বিচারে সাফল্য অর্জনকারী লোকদের তিনি অনন্তকালের জন্যে মহাপুরস্কারে ভূষিত করবেন। অপরদিকে বিচারে যারা অপরাধী সাব্যস্ত হবে তাঁদেরকে নিমজ্জিত করা হবে যন্ত্রনাদায়ক শাস্তির মধ্যে।

 

৬। হে মানুষ, মহান আল্লাহ আমাকে তাঁর বার্তাবাহক নিযুক্ত করেছেন। তোমরা আমাকে আল্লাহর রাসুল মেনে নাও। আমি আমার নিজের পক্ষ থেকে তোমাদের কিছুই বলছিনা। আমি তোমাদের কাছে কেবল আল্লাহর বার্তা ও নির্দেশাবলীই পৌঁছে দিচ্ছি।

 

৭। হে মানুষ, তোমরা আল্লাহকে এক, অদ্বিতীয় ও সর্বশক্তিমান মেনে নাও। তোমরা কেবল তাঁরই হুকুম পালন করো। তাঁর সাথে কাউকেও এবং কোন কিছুকেই শরিক করো না। তোমরা তোমাদের মহৎ মানবীয় ও নৈতিক গুনাবলীকে উন্নত ও বিকশিত করে সৃষ্টি জগতের শ্রেষ্ঠ মর্যাদা অর্জন করো। তোমরা আল্লাহকে সর্বাধিক ভালোবাসো। সারাজীবন সমস্ত কাজ আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষে করো। আল্লাহর শাস্তিকে ভয় করো। পরকালীন সাফল্য অর্জনের লক্ষ্যে কাজ করো। সর্বপ্রকার অন্যায়, অপরাধ, পাপ, পংকিলতা ও যুলুম অবিচার পরাহার করো। এটাই তোমাদের মুক্তি ও সাফল্যের একমাত্র পথ।

 

১০। মক্কায় তের বছর দাওয়াত ও আহবান

 

উপরে যে বিষয়গুলো উল্লেখ করা হলো, সেগুলোই মুহাম্মাদ (সঃ) এর দাওয়াত ও আহবানের মূল বক্তব্য। মক্কায় তের বছর তিনি মানুষকে এই মূল বিষয়গুলোর দিকেই আহবান করেন। সর্বোত্তম পন্থা আর মর্মস্পর্শী উপদেশের মাধ্যমে তিনি মানুষকে আহবান করেন। তাঁর আহবানের উপকরন ছিল আল কুরআন। এই তের বছর তাঁর কাছে কুরআন নাযিল হয়েছে ঐ বিষয়গুলোকে চমৎকার যুক্তি, উপমা ও ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত সহকারে বাস্তব ও আকর্ষণীয় ভংগীতে উপস্থাপনের মাধ্যমে। তিনি তাঁর দাওয়াত ও আহবান হিসেবে মানুষের কাছে হুবহু উপস্থাপন করেন আল্লাহর বার্তা আল কুরআন। যারা তাঁর আহবান গ্রহন করেন, তাঁদের তিনি জামায়াতবদ্ধ করেন। তাঁদের মাঝে কুরআনের আলো বিতরন করেন। তাঁদেরকে আল কুরআন শিক্ষা দেন। তাঁদের মানবিক গুনাবলী উন্নত ও বিকশিত করেন। তাঁদের নৈতিক চরিত্র সংশোধন করেন। তাঁদের মাধ্যমে গঠন করেন একটি নতুন সমাজ। মূলত তাঁর দাওয়াত ও আহবানের ছিলো পাঁচটি স্তর। সেগুলো হলো-

 

১। মানুষের জীবন লক্ষের পরিবর্তন।

 

২। মানুষের ধ্যান ধারনা, চিন্তা-চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন।

 

৩। মানুষের নৈতিক চরিত্রের পরিবর্তন।

 

৪। সমাজনীতি ও সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন।

 

৫। নেতৃত্বের পরিবর্তন।

 

কুরআনের আলো বিতরন, শিক্ষা ও প্রশিক্ষন, দৃষ্টান্ত স্থাপন, এক আল্লাহর ইবাদাত ও আনুগত্য এবং সংঘবদ্ধ জীবন যাপনের মাধ্যমে তিনি সমাজ ও সাথীদের মাঝে এসব পরিবর্তন সাধন করেন। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন-

 

“এমনি করে আমরা তোমাদের মধ্য থেকেই তোমাদের মাঝে পাঠিয়েছি একজন রাসুল। সে তোমাদের প্রতি তেলাওয়াত করে আমাদের আয়াত, তোমাদের জীবনকে করে উন্নত ও বিকশিত, তমাদেওর শিক্ষা দেয় আল কুরআন ও হিকমাহ। আরো শিক্ষা দেয় তোমরা যা কিছু জানতেনা।”(আল কুরআন, ২ ; ১৫১, ৩ ; ১৬৪, ৬২ ; ০২)

 

তিনি তাঁর দাওয়াত ও আহবানের তালিকায় নিয়ে এসেছিলেন –

 

১। প্রতিভাবান যুবসমাজকে।

 

২। সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যাক্তিদেরকে।

 

৩। মজলুম ও সুবিধাবঞ্চিত মানুসদেরকে।

 

৪। নারী সমাজকে। এবং

 

৫। সত্য সন্ধানী ব্যাক্তিদেরকে। তিনি তাঁর এই দাওয়াত ও আহবানের কাজের সায়াহ্নের সেই মরু পথিকের মতই মানুষের দ্বারে দ্বারে ছুটে বেড়িয়েছিলেন, যে পথিক সূর্যাস্তের পূর্বেই পেরেশান হয়ে পৌছতে চায় মানব বসতিতে। তিনি দাওয়াত দিয়েছেন –

 

১। তাঁর বন্ধুদেরকে বন্ধুতার ভালোবাসায়।

 

২। দাওয়াত দিয়েছেন আত্মীয়স্বজনকে আত্মীয়তার হোক আদায়ে।

 

৩। দাওয়াত দিয়েছেন ব্যাক্তি পর্যায়ে ব্যাক্তিগত যোগাযোগ করে।

 

৪। দাওয়াত দিয়েছেন হাট-বাজারে জনসমষ্টিকে সম্বোধন করে।

 

৫। দাওয়াত দিয়েছেন মেলায় গিয়ে, পূজা পার্বণে গিয়ে।

 

৬। দাওয়াত দিয়েছেন হজ্জে আগত হাজীদেরকে।

 

৭। দাওয়াত দিয়েছেন মক্কায় আগত বনিক ও পর্যটকদেরকে।

 

১১। দাওয়াতের প্রতিক্রিয়া

 

সত্য, ন্যায় ও কল্যাণের দিকে আহবানের প্রতিক্রিয়া আছে। সমস্ত নবী রাসুল মানুষকে সত্য, ন্যায় ও কল্যাণের দিকে আহবান করেছেন এবং তাঁদের আহবানের প্রতিক্রিয়া হয়েছে। একইভাবে মুহাম্মাদ (সঃ) এর দাওয়াতেরও প্রতিক্রিয়া হয়েছে। তাঁর দাওয়াতের প্রতিক্রিয়া ছিলো নিম্নরূপ-

 

১। সত্য সন্ধানী ব্যাক্তিবর্গ, বিশেষ করে যুবক যুবতীরা তাঁর দাওয়াতে সাড়া দেয়। তারা ঈমান এনে রাসুলের সাথে কুরআনের ছায়াতলে আশ্রয় নেয়।

 

২। কিছু লোক এই দাওয়াতকে সত্য বলে জেনেও অত্যাচার নির্যাতনের ভয়ে কিংবা স্বার্থহানীর আশংকায় ঈমান আনা থেকে বিরত থাকে।

 

৩। সমাজের কর্ণধাররা, ধর্মীয় পুরোহিতরা এবং অর্থনৈতিক শোষকরা কোমর বেধে তাঁর বিরোধিতায় নেমে পড়ে।

 

৪। অধিকাংশ মানুষ নিরবে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে থাকে।

 

৫। আর কিছু লোক বিভিন্নভাবে বিরুদ্ধবাদীদের শিকলে আটকা থাকায় গোপনে ঈমান আনে এবং ঈমান আনার বিষয়টি সময় সুযোগের অপেক্ষায় গোপন রাখে।

 

প্রতিক্রিয়া যদিও এই পাঁচটি ধারায় বিভক্ত ছিলো, তবু এর মূল ধারা ছিলো দুইটি। অর্থাৎ

 

১। ঈমান এনে রাসুলের সাথীত্ব গ্রহনকারী ধারা। এবং

 

২। বিরুদ্ধবাদী ধারা।

 

এই তের বছরে তিন শতাধিক নারী পুরুষ প্রকাশ্যে ঈমান এনে ইসলামী কাফেলায় শরীক হয়ে যান। এরা আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষে ইসলামের পথে সব ধরনের ত্যাগ ও কুরবানী দিচ্ছিলেন। এদের মধ্যে প্রথম দিকেই ঈমান আনেন খাদিজা তাহেরা, আবু বকর, আলী, যায়েদ বিন হারিসা, সায়ীদ বিন যায়িদ, ফাতিমা বিনতে খাত্তাব, যুবায়ের, সা’দ বিনাবি ওয়াক্কাস, উসমান বিন আফফান, আব্দুর রহমান, জাফর বিন আবু তালিব, আবু সালামা, উম্মে সালামা, আবু উবায়দা, তালহা, উম্মে হাবিবা বিনতে আবু সুফিয়ান, উমর বিন খাত্তাব, আবু যর, হামজা বিন আব্দুল মুত্তালিব, বিলাল বিন রিবাহ, মুসআব, আম্মার, ইয়াসার, সুমাইয়া, খাব্বাব, আরকাম, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসুদ, সুহায়েব রুমী, উসমান বিন মাযঊন, উম্মে শুরাইক, রুকাইয়া বিনতে মুহাম্মাদ, উম্মু কুলসুম বিনতে মুহাম্মাদ, নঈম বিন আব্দুল্লাহ, লুবাইনা, উম্মে আব্দুল্লাহ বিনতে হাশমা, তাঁর স্বামী আমের বিন রাবীয়া, তোফায়েল দাওসী এবং আরো অনেকে রাদিয়াল্লাহু আনহুম।

 

অপরদিকে মানুষকে এক আল্লাহর দিকে আহবানের এই মহোত্তম কাজের বিরোধীতায় অগ্রনী ভুমিকা পালন করে স্বয়ং রাসুল (সঃ) এর চাচা আবু লাহাব, তাঁর স্ত্রী উম্মে জামিল, আবু জাহেল, হাকাম বিন আস, উকবার বিন আবু মুয়িত, উতবা, শাইবা, আবুল বুখতরি, আস বিন হিশাম, উমাইয়া বিন খালফ, মুনাব্বিহ, হিন্দা, আবু সুফিয়ান, সুহায়েল, আমর ইবনু আস, আকরামা, খালিদ বিন ওয়ালীদ এবং আরো অনেকে। অবশ্য এদের মধ্যে কয়েকজন পরে ইসলাম কবুল করে আল্লাহর সৈনিক হয়ে যান। তবে তাঁদের অনেকেই বদর যুদ্ধে নিহত হয়। সমাজের প্রভাবশালী ব্যাক্তিদের অনেকেই ইসলাম কবুল করেন। তবে সাহসী দৃঢ় প্রতিজ্ঞ যুবকরাই বেশীরভাগ ইসলাম গ্রহন করেন। অবশ্য নেতৃস্থানীয় অধিকাংশ ব্যাক্তিই রাসুল (সঃ) ও তাঁর সত্যের দাওয়াতের বিরধীতায় অবতীর্ণ হয়। তারা ঈমানে দীক্ষিত তাঁদের যুবক ছেলে মেয়েদের, আত্মীয়-স্বজনদের এবং দাস-দাসীদের উপরে চরম নির্যাতন চালাতে থাকে। এমতাবস্থায় রাসুল (সঃ) এর নির্দেশে তাঁর আশির অধিক সাহাবী নবুয়্যতের পঞ্চম বছরে পার্শ্ববর্তী দেশ আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন।

 

 

 

১২। বন্দী জীবন

 

কিন্তু রাসুল (সঃ) এবং তাঁর সাথীরা ইসলামের পথ এবং দাওয়াত ও আহবানের কাজ ত্যাগ না করায় কাফির নেতারা আরো কঠোর সিদ্ধান্ত নেয়। তারা রাসুল, তাঁর সাথীবৃন্দ এবং তাঁর গোত্র বনু হাশিমকে বয়কট করে। ফলে তারা শি’বে আবু তালিব নামক পার্বত্য উপত্যকায় অন্তরীন হয়ে পড়েন। এখানে চরম দুঃখ দারিদ্রের মধ্য দিয়ে তাঁদের দিন কাটতে থাকে। চরম খাদ্যাভাবে তারা গাছের পাতা গাছের ছাল আহার করেন। তারা ক্ষুধা এবং রোগক্লিষ্ট হয়ে পড়েন। নবুয়্যতের সপ্তম বর্ষ থেকে দশম বছরের সূচনা পর্যন্ত তিন বছর তারা এখানে বন্দী থাকেন। অতপর পরিবেশ পরিস্থিতির কারনে বাধ্য হয়ে বিরোধী নেতারা রাসুল (সঃ) এবং তাঁর সাথীদেরকে বন্দীত্ব থেকে মুক্ত করে দেয়। এই তিন বছরের নিপীড়নের ফলে এ বছরই অর্থাৎ নবুয়্যতের দশম বর্ষেই ইহকাল ত্যাগ করেন রাসুল (সঃ) এর অভিভাবক চাচা আবু তালিব এবং প্রেরনাদায়িনী স্ত্রী খাদিজা তাহেরা। এখন থেকে রাসুল (সঃ) নিরংকুশভাবে আল্লাহর উপর নির্ভরশীল হয়ে যান।

 

১৩। তায়েফে দাওয়াত

 

মক্কার পরেই তায়েফ ছিলো অধিকতর প্রভাবশালী শহর। মক্কার লোকদের আর ঈমান আনার লক্ষন ক্ষীন দেখে রাসুল (সঃ) তায়েফের সর্দারদের কাছে মহাসত্যের দাওয়াত পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে তায়েফ যান। তাঁদের দাওয়াত দেন আল্লাহর দিকে। মক্কার নেতারা তাঁর দাওয়াত গ্রহন না করায় এবং বিরোধিতা করায় তাঁরাও তাঁর দাওয়াত গ্রহন করতে অস্বীকার করে। শুধু তাই নয় তারা আল্লাহর রাসুল্কে লাঞ্ছিত করার লক্ষ্যে তাঁর পিছনে বখাটে যুবকদের লেলিয়ে দেয়। তারা রাসুল (সঃ) কে চরমভাবে নির্যাতন করে, লাঞ্ছিত করে। তাঁর সাথে গিয়েছিলেন তাঁর সেবক যায়েদ। অতপর তিনি যায়েদকে নিয়ে ফিরে আসেন মক্কায়।

 

১৪। মে’রাজ

 

চরম নির্যাতনের ফলে রাসুল (সঃ) এঁর একজন মহিলা সাহাবীসহ দুই তিনজন সাহাবী শাহাদাৎ বরন করেন। অনেকে আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন। রাসুল (সঃ) তায়েফের দিক থেকেও নিরাশ হয়েছেন। কিন্তু তাঁকে তো নিজের রাসুল নিযুক্ত করেছেন স্বয়ং মহাবিশ্বের মালিক মহান আল্লাহ। তিনি তাঁর রাসুলগনকে এবং রাসুলদের সাথীদেরকে সবসময় বিরোধিতা, অত্যাচার, নির্যাতন এবং প্রত্যাখ্যানের মুখোমুখি করে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হিসেবে গড়ে তুলেছেন। তাইতো আল্লাহ পাক মুহাম্মাদ (সঃ) কেও বলে দিয়েছেন –

 

“তোমার পূর্বেও বহু রাসুলকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। কিন্তু প্রত্যাখ্যানের মোকাবেলায় তারা অটল থেকেছে।” (সূরা ৬ আয়াত ৩৪)

 

এ সময় আল্লাহ পাক তাঁর রাসুলকে সামনে যে ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র উপহার দিতে যাচ্ছিলেন তাঁর মূলনীতিগুলো জানিয়ে দিতে চাইছিলেন। এ উদ্দেশ্যে তিনি তাঁকে মে’রাজ করান। দশম নবুয়্যত বর্ষে মে’রাজ সংঘটিত হয়। আল্লাহ পাক তাঁর রাসুলকে ঊর্ধ্বজগতে নিয়ে ইসলামী সমাজের মূলনীতি প্রদান করেন। এসময় আল্লাহ তায়ালা তাঁর উম্মতের জন্যে পাচ ওয়াক্ত নামাজও ফরয করে দেন। তাছাড়া আল্লাহ পাক তাঁর রাসুলকে নির্দেশ দেন তাঁর কাছে রাষ্ট্র ক্ষমতা প্রার্থনা করার জন্যে। মে’রাজ উপলক্ষে নাযিল হয়েছে সূরা বনী ইসরাইল। তখনকার প্রাসঙ্গিক উপদেশ ও মূলনীতিগুলো মওজুদ রয়েছে এই সূরা বনী ইসরাইলে।

 

১৫। মদিনায় ইসলামের আলো

 

মক্কায় রাসুল (সঃ) এর নবুয়্যতী জীবনের তের বছরের শেষ পর্যায়। নবুয়্যত বর্ষ বারো। হজ্জ উপলক্ষে মদিনা থেকে আগত ১২ জন লোক গোপনে রাসুল (সঃ) এর সাথে সাক্ষাত করেন। তারা ঈমান আনার ঘোষণা দেন এবং মদিনায় ইসলাম প্রচারের দায়িত্ব নিয়ে ফিরে যান। রাসুল (সঃ) তাঁর সাহাবী মুসআব –কে মদিনার লোকদেরকে ইসলাম শিক্ষা প্রদান এবং সেখানে ইসলামের দাওয়াতী কাজ প্রসারের উদ্দেশ্যে তাঁদের সাথে মদিনায় পাঠিয়ে দেন। ফলে পরের বছর হজ্জ উপলক্ষে ৭৫ জন লোক এসে গোপনে আকাবা নামক স্থানে রাসুল (সঃ) এর হাতে বাইয়াত গ্রহন করেন। তারা রাসুল (সঃ) কে মদিনায় হিজরত করার দাওয়াত দিয়ে যান। মদিনা আক্রান্ত হলে জান-মাল দিয়ে তা প্রতিরোধ করারও শপথ নিয়ে যান।

 

১৬। হিজরতের প্রস্তুতি

 

সাহাবীগনের উপরে অত্যাচার নির্যাতনের মাত্রা চরম পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিলো। রাসুল (সঃ) মনে মনে মদিনায় হিজরত করার প্রস্তুতি নিতে থাকেন। সে হিসেবে সাহাবীদেরকে যার যেভাবে সম্ভব গোপনে হিজরত করে মদিনায় চলে যাবার অনুমতি দেন। ফলে যাদেরই হিজরত করার সামর্থ্য ছিলো, তারা হিজরত করে মদিনায় চলে যান। থেকে যান আবুবকর। রাসুল (সঃ) তাঁকে নিজের হিজরতের সাথী বানানোর কথা জানিয়ে দেন।

 

১৭। হত্যার ষড়যন্ত্র

 

নবুয়্যতের তের বছর মাত্র পূর্ণ হয়েছে। অধিকাংশ সাহাবী হিজরত করে মক্কা ছেড়েছেন। এসময় ইসলামের শত্রুরা আল্লাহর রাসুলকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়। এক রাতে এসে তারা তাঁর বাড়ি ঘেরাও করে ফেলে। সকালে বের হলেই তাঁকে হত্যা করা হবে। তাদের এ ষড়যন্ত্রের কথা পরবর্তীতে কুরআনে উল্লেখ হয়েছে এভাবে –

 

“স্মরণ করো, কাফিররা তোমাকে বন্দী করার, কিংবা হত্যা করার, অথবা দেশ থেকে বহিস্কার করার ষড়যন্ত্র করছিলো। তারা লিপ্ত ছিল তাঁদের চক্রান্তে। এদিকে আল্লাহও তাঁর পরিকল্পনা পাকা করে রাখেন। আল্লাহই সবচে’ দক্ষ পরিকল্পনাকারী।” (সূরা আনফাল, আয়াত ৩০)

 

মহান আল্লাহ তাঁদের চক্রান্তের খবর আগেই তাঁর রাসুলকে জানিয়ে দেন। তিনি তাঁদের চোখে ধুলা দিয়ে বেড়িয়ে পড়েন হিজরতের উদ্দেশ্যে। ব্যর্থ হয়ে যায় আল্লাহর রাসুলকে হত্যার ষড়যন্ত্র।

 

১৮। রাসুলুল্লাহর হিজরত

 

রাসুলুল্লাহ (সঃ) হিজরতের উদ্দেশ্যে বের হয়ে প্রিয় সাথী আবুবকরের বাড়িতে আসেন। আবু বকরও আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলেন। এবার দু’জনে বেড়িয়ে পড়লেন মদানার উদ্দেশ্যে। শত্রুদের ষড়যন্ত্র মোকাবেলায় কৌশল একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মক্কা থেকে মদিনা উত্তর দিকে হলেও তারা প্রথমে রওয়ানা করেন দক্ষিন দিকে। কয়েক মাইল দক্ষিনের সওর নামক পাহাড়ের গুহায় তিন দিন অবস্থান করেন। তিন দিন পর সেখান থেকে মদিনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা করেন। এদিকে তার রক্ত পিপাসুরা হন্যে হয়ে খুজেও তাঁর নাগাল পায়নি। তারা তাঁকে ধরার জন্যে শত উট পুরস্কার ঘোষণা করে।

 

১৯। মদিনায় রাসুলুল্লাহ

 

রাসুলুল্লাহ (সঃ) আসছেন এ খবর আগেই পৌঁছে গেছে মদিনায়। আনন্দে মাতোয়ারা মদিনা। সম্বর্ধনার বিরাট আয়োজন। মদিনার আবাল বৃদ্ধ জনতা সানিয়াতুল বিদা উপত্যকা পর্যন্ত এগিয়ে এসে তাঁকে সম্বর্ধনা জানায়। মক্কা ত্যাগ করে। মদিনা তাঁকে বরন করে নেয়। তিনিও বরন করে নেন মদিনাকে। মক্কা বিজয়ের পরেও তিনি ত্যাগ করেননি মদিনা।

 

২০। মদিনার ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা নির্মাণের কাজ শুরু

 

মদিনার পূর্ব নাম ছিলো ইয়াসরিব। রাসুলুল্লাহর আগমনের ফলে পাল্টে যায় ইয়াসরিবের নাম। তখন থেকে এ শহরের নাম হয়ে যায় মদিনাতুন্নবী বা নবীর শহর। সংক্ষেপে মদিনা। মদিনায় আগমনের পরপরই তিনি এখানে ইসলামী সমাজ নির্মাণের কাজ শুরু করে দেন। শুরুর দিকে তিনি কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পাদন করেন। যেমন –

 

  •  
  • ১। প্রথমে চৌদ্দ দিন কুবা নামক স্থানে অবস্থান করেন। সেখানে তিনি একটি মসজিদ নির্মাণ করেন।
  •  
  • ২। তারপর আসেন মূল অবস্থানের জায়গায়। এখানে জমি ক্রয় করেন। কেন্দ্রীয় মসজিদ ‘মসজিদে নববী’ প্রতিষ্ঠা করেন।
  •  
  • ৩। এই মসজিদকে ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্রের কেন্দ্র ঘোষণা করেন। এখান থেকেই তিনি পরিচালনা করেন ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র।
  •  
  • ৪। হিজরত করে আসা সহায় সম্বলহীন মুসলিম এবং মদিনার স্থানীয় আনসার মুসলিমদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক স্থাপন করে দেন। ফলে মুহাজিররা আনসারদের পরিবারের সদস্য হয়ে যায়।
  •  
  • ৫। ‘মদিনা সনদ’ নামক খ্যাত মদিনার প্রতিরক্ষা চুক্তি সম্পাদন করেন। এই চুক্তির অন্তর্ভুক্ত করে নেন মদিনার স্থানীয় আনসার মুসলিমদেরকে, মদিনায় অবস্থানরত বিভিন্ন গোত্র ও কবিলাকে এবং সেখানকার ইহুদী গোত্রগুলোকে। এদের সবাইকে একটি ভৌগোলিক জাতি ঘোষণা করেন। শত্রুদের আক্রমন প্রতিহত করার ব্যাপারে সবাই মুহাম্মাদ (সঃ) এর নেতৃত্বে চুক্তিবদ্ধ হয়।
  •  

 

২১। ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্রের কার্যক্রম

 

মুহাম্মাদ (সঃ) মহান ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে মদিনায় একটি কল্যাণ রাষ্ট্রের গোড়া পত্তন করেন। এ রাষ্ট্রের আদর্শকে ভবিষ্যতের বিশ্ব ব্যবস্থায় রূপদানের কার্যক্রম তিনি হাতে নেন। এ মহান রাষ্ট্রের কয়েকটি প্রধান প্রধান মূলনীতি ও কার্যক্রম হলো। -

 

  •  
  • ১। তিনি এ রাষ্ট্র পরিচালনা করেন এক আল্লাহর সার্বভৌম বিধানের ভিত্তিতে।
  •  
  • ২। এ রাষ্ট্রের আদর্শ, প্রেরনা ও আইনের উৎস ছিল আল্লাহর কিতাব আল কুরআন এবং তাঁর রাসুলের সুন্নাহ।
  •  
  • ৩। এ রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য ছিল জনগনের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক মুক্তি, কল্যাণ ও সাফল্য।
  •  
  • ৪। এ রাষ্ট্রের সরকার ও নাগরিকদের প্রধান দায়িত্ব ছিলো স্রষ্টার প্রতি কর্তব্য পালন এবং সৃষ্টির প্রতি কর্তব্য পালন।
  •  
  • ৫। এ রাষ্ট্রের যাবতীয় কর্মসূচী ও কার্যক্রমের উদ্দেশ্য ও মূলনীতি ছিল জননিরাপত্তা, সুবিচার ও মানবকল্যাণ।
  •  
  • ৬। এ রাষ্ট্রের প্রধান প্রধান কর্মসূচী ছিলো – ১। রাষ্ট্র ও জনগনের নিরাপত্তা প্রদান, ২। এক আল্লাহর ইবাদাত প্রবর্তন ও সালাত কায়েম। ৩। শোষণমুক্ত ইনসাফ ভিত্তিক কল্যাণমুখী অর্থব্যবস্থার প্রচলন ও যাকাত ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা। ৪। পরামর্শ ভিত্তিক শাসন পরিচালনা। ৫। সততা, সুনীতি, সৎকর্ম ও সদাচারের সম্প্রসারন। ৬। দুর্নীতি ও দুষ্কর্মের অপসারন। ৭। ভালো কাজে প্রেরনা ও সহযোগিতা প্রদান। ৮। মন্দ কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি। ৯। জনগনের মানসিক ও নৈতিক উন্নয়নের জন্যে শিক্ষা ও প্রশিক্ষনের ব্যাপক সম্প্রসারন। ১০। জনস্বাস্থ্যের নিরাপত্তা বিধান ও গণপূর্ত।
  •  
  • ৭। বিশ্বব্যাপী মানবসমাজকে শান্তি ও কল্যাণের দিকে আহবান।
  •  

 

 

 

২২। কুরাইশদের আশংকা ও যুদ্ধের প্রস্তুতি

 

মুহাম্মাদ (সঃ) হিজরত করে মদিনায় চলে আসার কারনে কুরাইশরা নিজেদেরকে বড় ধরনের বিপদের ঝুকির মধ্যে অনুভব করছিলো। তারা চিন্তা ভাবনা করে দেখলো –

 

  •  
  • ১। মদিনায় থেকে মুহাম্মাদ স্বাধীনভাবে তাঁর ধর্মীয় মতাদর্শ প্রচার করার সুযোগ পেয়ে গেলো।
  •  
  • ২। মুহাম্মাদ গোটা আরবে তাঁর ধর্ম ছড়িয়ে দেবে এবং সব গোত্র ও কবিলার উপর নিজের প্রভাব বিস্তার করবে।
  •  
  • ৩। মুহাম্মাদ রাষ্ট্রীয় শক্তি অর্জন করবে।
  •  
  • ৪। তাঁর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি বৃদ্ধি পাবে।
  •  
  • ৫। সুযোগ মতো মুহাম্মাদ মক্কা আক্রমন করে আমাদের থেকে প্রতিশোধ গ্রহন করবে এবং আমাদের মক্কা থেকে উৎখাত করবে।
  •  

 

এসব ভেবে কুরাইশরা রাসুল (সঃ) এর ভিত মজবুত হবার আগেই মদিনা আক্রমন করে তাঁকে এবং তাঁর অনুসারীদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দেবার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে।

 

২৩। রাসুলের বিরুদ্ধে কুরাইশদের যুদ্ধ

 

এদিকে কুরাইশদের পক্ষ থেকে মদিনা আক্রমন হতে পারে এ কথা রাসুল (সঃ) নিজেও ভেবে রেখেছেন।

 

বদর যুদ্ধ - কুরাইশরা আবু জেহেলের নেতৃত্বে এক হাজার সুসজ্জিত বাহিনী নিয়ে মদিনা আক্রমনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করে। তাঁদের কাছে ছিল ঘোড়া এবং আধুনিক সব সমরাস্ত্র।

 

রাসুল (সঃ) তাঁদের প্রতিরোধ করার উদ্দেশ্যে তিনশো তের জনের একটি ক্ষুদ্র বাহিনী নিয়ে রওয়ানা করেন। বাহিনীর কাছে অশ্ব এবং আধুনিক অস্ত্র বলতে তেমন কিছুই ছিলোনা। দ্বিতীয় হিজরির ১২ বা ১৭ রমযান বদর প্রান্তরে উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ ছিলো এক ঐতিহাসিক আদর্শিক যুদ্ধ। --

 

  •  
  • ১। এক পক্ষ যুদ্ধ করতে এসেছিলো আল্লাহর জন্যে, আল্লাহর পথে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিলের লক্ষে। অপর পক্ষ যুদ্ধ করতে এসেছিলো তাগুতের পক্ষে, মিথ্যা বাতিলকে টিকিয়ে রাখার উদ্দেশ্যেএবং নিজেদের অবৈধ স্বার্থ হাসিলের পথ নিরাপদ রাখতে।
  •  
  • ২। এক পক্ষ নির্ভর করেছিলো আল্লাহর সাহায্যের উপর। অপর পক্ষ নির্ভর করেছিলো নিজেদের সমর শক্তির উপর।
  •  
  • ৩। এক পক্ষ যুদ্ধ করতে এসেছিলো জীবন দিয়ে শাহাদাতের মর্যাদা লাভ করার জন্যে। অপর পক্ষ যুদ্ধ করতে এসেছিলো নিজেদের জীবন রক্ষা করার জন্যে।
  •  
  • ৪। এক পক্ষের যুদ্ধ ছিল প্রতিরক্ষামূলক। অপর পক্ষের যুদ্ধ ছিলো আগ্রাসী।
  •  
  • ৫। এক পক্ষের যুদ্ধ ছিলো ব্যাক্তিগত ও পার্থিব স্বার্থের ঊর্ধ্বে। অপর পক্ষের যুদ্ধ ছিল ব্যাক্তিগত ও পার্থিব স্বার্থ রক্ষার লক্ষে।
  •  

 

অবশেষে এ যুদ্ধে ইসলামী বাহিনী বিজয়ী হয়। আগ্রাসী কুরাইশ বাহিনী চরমভাবে পরাজিত হয়। এ যুদ্ধে আগ্রাসী কুরাইশদের সেনাপতি আবু জেহেল সহ ৭০ জন নিহত হয় এবং আরো ৭০ জন মুসলিমদের হাতে বন্দী হয়। এদিকে ২২ জনজন মুসলিম সেনা শাহাদাৎ বরন করেন। পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে কুরাইশরা মক্কায় ফিরে যায়।

 

উহুদ যুদ্ধ- কুরাইশরা বদর যুদ্ধে পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়ার জন্যে পরের বছর তৃতীয় হিজরির শাওয়াল মাসে আবার মদিনা আক্রমনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করে। এবার তারা তাঁদের প্রভাবিত পার্শ্ববর্তী এলাকার লোকদের সাথে নেয়। তারা তিন হাজার সুসজ্জিত বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হতে থাকে। রাসুল (সঃ) যথাসময়ে তাঁদের যাত্রার সংবাদ পেয়ে যান। যুবকদের আগ্রহের কারনে তিনি মদিনার বাইরে গিয়ে উহুদ পাহাড়ের কাছে শত্রু বাহিনীর মোকাবেলা করার সিদ্ধান্ত নেন। সাতশো জানবাজ সাহাবীর বাহিনী নিয়ে তিনি উহুদে এসে পৌঁছান। উহদ পাহাড়কে পেছনে রেখে রাসুল (সঃ) যুদ্ধ লড়ার স্থান নির্ধারণ করেন। পেছনের আইনান পাহাড়ে একটা সুড়ঙ্গ ছিলো। শত্রু বাহিনী এ সুড়ঙ্গ দিয়ে ঢুকে তাঁদের পেছন দিক থেকে আক্রমন করতে পারে এ আশংকায় রাসুল (সঃ) সুড়ঙ্গ মুখে পঞ্চাশ জন তীরন্দাজের একটি বাহিনী নিযুক্ত করেন। তাঁদের নির্দেশ দেন, যুদ্ধে আমাদের জয় পরাজয় যাই হোক না কেন, তোমরা কোন অবস্থাতেই এ স্থান ত্যাগ করবেনা। যুদ্ধ শুরু হল। মুসলিম বাহিনীর আক্রমনের তীব্রতায় টিকতে না পেরে কুরাইশ বাহিনী তাঁদের সাজ সরঞ্জাম ফেলে পালাতে শুরু করে। মুসলিম বাহিনী তাঁদের চরম তাড়া করে। এদিকে সুড়ঙ্গ মুখে নিয়োজিত লোকেরা ভাবলো, যুদ্ধে মুসলিম বাহিনী জয়ী হয়েছে। ফলে তাড়া তাঁদের সেনাপতি আব্দুল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে মূল বাহিনীর সাথে যোগদানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করে। আব্দুল্লাহ মাত্র বারো জন তীরন্দাজ নিয়ে নিজের অবস্থানে অটল থাকেন। এদিকে শত্রু পক্ষের অশ্বারোহী দলের প্রধান খালিদ বিন ওয়ালিদ সুড়ঙ্গ পথ অরক্ষিত পেয়ে এখান দিয়ে ঢুকে পড়েন। আব্দুল্লাহ এবং তাঁর সাথীরা তাঁদেরকে প্রতিহত করার প্রানপন চেষ্টা করে শাহাদাৎ বরন করেন। খালিদ তাঁর অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে পেছন দিক থেকে মুসলিম বাহিনীর উপর অতর্কিত হামলা করে। মুসলিম বাহিনী এদের প্রতিহত করার জন্যে পেছনমুখী হলে পলায়নপর শত্রু বাহিনী ঘুরে দাড়ায়। শুরু হয় দ্বিমুখী আক্রমন। ফলে মুসলিম বাহিনী হতভম্ব হয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। পরে রাসুল (সঃ) সবাইকে একত্রিত করেন এবং ঐক্যবদ্ধ হয়ে শত্রুপক্ষকে তাড়া করেন এবং তারা মক্কায় ফিরে যায়। এরই মধ্যে মুসলিম বাহিনীর বিরাট ক্ষতি হয়ে যায়। ৭০ জন সাহাবী শাহাদাৎ বরন করেন। আহত হন অনেকে। কয়েকজন সৈনিক কর্তৃক সেনাপতির নির্দেশ লংঘনের ফলে মুসলিম বাহিনীর উপর নেমে আসে এই বিরাট বিপর্যয়।

 

খন্দকের যুদ্ধ – পঞ্চম হিজরি সন। উহুদ যুদ্ধে মুসলিমরা বিজয়ী হতে না পারলেও কুরাইশরা ভালোভাবেই বুঝেছিল, তাঁরাও বিজয়ী হতে পারেনি। ইসলামী রাষ্ট্র পূর্বের অবস্থায়ই সদর্পে দাঁড়িয়ে ছিল। তাই তারা বিশাল প্রস্তুতি নেয়। আশেপাশের সব মিত্র গোত্রের যোদ্ধাদের সাথে নিয়ে তারা অগ্রসর হয় মদিনার দিকে। এদিকে রাসুল (সঃ) যথাসময়ে তাঁদের যাত্রার সংবাদ পেয়ে যান। এবার তিনি এক অভিনব কৌশল গ্রহন করেন। তাহলো, মদিনায় প্রবেশের গোটা এলাকা জুড়ে তিনি পরীখা খননের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি নিজে এবং সক্ষম সকল সাহাবীরাই পরীখা খননের কাজে অংশ নেন। দশ গজ চওড়া, পাঁচ গজ গভীর সাড়ে তিন মাইল দীর্ঘ পরীখা তারা খনন করে ফেলেন। এতে প্রায় তিন লাখ আট হাজার বর্গগজ মাটি খনন ও স্থানান্তর করতে হয়েছে। সাড়ে তিন হাজার জনবল নিয়ে রাসুল (সঃ) মাত্র পনের দিনে এ বিশাল যুদ্ধ কৌশল বাস্তবায়ন করেন। এতেই বুঝা যায়, তারা কতটা পরিশ্রম করেছেন। মাথা প্রতি প্রায় এক হাজার বর্গগজের চাইতে বেশী মাটি কাটতে ও স্থানান্তর করতে হয়েছে। পরিখা খননের কাজ শেষ হতে না হতেই কম বেশী দশ হাজার বাহিনীর সুসজ্জিত সৈন্য নিয়ে কুরাইশরা মদিনার উপকণ্ঠে এসে হাজির হয়। কিন্তু অভিনব কৌশলের পরিখা দেখে তাঁদের মাথায় হাত। তবে মদিনার ঘরের শত্রু ইহুদীরা কুরাইশদের সাথে গপনে হাত মিলিয়ে ফেলে। ফলে মুসলিমদের বাড়ি ঘরগুলো অরক্ষিত হয়ে পড়ে। কিন্তু মহান আল্লাহর সাহায্যে কুরাইশ বাহিনী দীর্ঘ এক মাস মদিনা অবরোধ করে রেখেও কোন সুবিধা করতে পারে নি। এ সময় এক রাত্রে প্রচণ্ড ঝড় বৃষ্টি শুরু হয়। ঝড় কুরাইশদের তাঁবুগুলো উড়িয়ে নিয়ে যায়। তাঁদের বাহিনী পুরোপুরি মনোবল হারিয়ে ফেলে এবং রাতের অন্ধকারেই তারা মদিনা অবরোধ ত্যাগ করে পালিয়ে যায়। এ ঘটনার পরপরই রাসুল (সঃ) মদিনা সনদ ভঙ্গকারী ইহুদী গোত্র বনু কুরাইযাকে চরমভাবে শায়েস্তা করেন। মহান আল্লাহ এ যুদ্ধের পর্যালোচনা করেছেন সূরা আহযাবের ৯-২৭ নং আয়াতে। মহান আল্লাহ বলেন-

 

“হে মুমিনরা, স্মরণ করো তোমরা তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহের কথা, যখন শত্রু বাহিনী তোমাদের এখানে এসে পড়েছিলো, তখন আমরা তাঁদের প্রতি পাঠিয়েছিলাম ঝরো হাওয়া আর এমন এক বাহিনী, যাদের তোমরা দেখতে পাওনি।” (আহযাব, আয়াত ৯)

 

কুরাইশরা চলে যাবার পড়ে রাসুল (সঃ) ঘোষণা দিলেন- “কুরাইশরা আর কখনো মদিনা আক্রমন করতে পারবেনা। ”

 

এগুলো ছিল বড় বড় যুদ্ধ, এ ছাড়াও আরো অনেক ছোট খাটো অভিযান পরিচালিত হয়েছে।

 

২৪। হুদাইবিয়ার সন্ধি এবং এর সুফল

 

ষষ্ঠ হিজরি সন। রাসুলুল্লাহ (সঃ) স্বপ্নে হজ্জ, উমরা ও আল্লাহর ঘর যিয়ারত করার নির্দেশ পান। জেনে রাখা ভালো, নবীদের স্বপ্নও অহী। সে অনুযায়ী তিনি এবছর যিলকদ মাসের শেষ দিকে চৌদ্দশত সাহাবী নিয়ে হজ্জের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। সাথে করে নেন কুরবানীর উট। হজ্জ, উমরা ও আল্লাহর ঘর যিয়ারতের উদ্দেশ্যে আসা লোকদের বাধা দেয়া মক্কার সনাতন ধর্মেও নিষেধ ছিলো। কিন্তু কুরাইশরা রাসুল (সঃ) এর কাফেলাকে মক্কার নিকটবর্তী হুদাইবিয়া নামক স্থানে এসে বাধা দেয়। তিনি উসমান (রা) –কে মক্কায় পাঠান তাঁদের নেতাদের একথা বলার জন্যে যে, আমরা যুদ্ধ করতে আসিনি। যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে আসিনি। আমরা হজ্জ, উমরা, কুরবানী ও যিয়ারত শেষে চলে যাবো। আমরা কুরবানীর পশু সাথে নিয়ে এসেছি। কিন্তু তারা তাঁর কথা শুনেনি। তারা তাঁকে আটকে রাখে। উসমানকে অর্থাৎ রাসুলের দূতকে আতক করার সংবাদ শুনে সাহাবীগন উসমানকে উদ্ধার করার প্রতিজ্ঞা করেন। তারা এ উদ্দেশ্যে রাসুল (সঃ) এর হাতে হাত রেখে বাইয়াত গ্রহন করেন। এ শপথে সন্তুষ্ট হয়ে মহান আল্লাহ সাহাবীদের প্রসঙ্গে বলেন –

 

“আল্লাহ মুমিনদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন।” (সূরা আল ফাতাহ, আয়াত ১৮)

 

অবশ্য পরে কুরাইশরা উসমান (র) কে ছেড়ে দেয়। তিনি ফিরে আসেন। তারা সন্ধির প্রস্তাব নিয়ে আসে। রাসুল (সঃ) তাঁদের আরোপিত শর্তানুযায়ী সন্ধি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। সন্ধির অধিকাংশ শর্তই ছিল বাহ্যিকভাবে মুসলমানদের জন্যে অপমানজনক। কিন্তু তাতে দশ বছর যুদ্ধ বিগ্রহ না করার একটি ধারা ছিল। সাহাবীগন মনঃক্ষুণ্ণ হওয়া সত্যেও রাসুল (সঃ) এই ধারাটিকে লুফে নিয়ে চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তিতে এ বছর উমরা না করে পরের বছর উমরা করার একটি শর্ত ছিলো। সে অনুযায়ী রাসুল (সঃ) কাফেলা নিয়ে ফিরে চললেন মদিনার দিকে। পথিমধ্যেই নাযিল হল সূরা আল ফাতাহ। এ সুরার প্রথম আয়াতেই বলা হয়েছে-

 

“হে নবী, আমরা তোমাকে এক সুস্পষ্ট বিজয় দিলাম।’’

 

সত্যিই এ ছিলো এক সুস্পষ্ট বিজয়। রাসুল (সঃ) সাহাবীগণকে নিয়ে নির্বিঘ্নে ইসলামের দাওয়াত সম্প্রসারন করতে থাকলেন। দুই বছরের মধ্যেই কুরাশরা বন্ধুহীন হয়ে পড়লো। খালিদ বিন অয়ালিদ এবং আমর ইবনুল আস সহ কুরাইশদের অনেক বড় বড় সেনাপতি এরই মধ্যে ইসলাম গ্রহন করেন।

 

২৫। মক্কা বিজয়

 

হুদাইবিয়ার সন্ধিতে যে অন্যায় শর্তাবলী দিয়ে চুক্তি সম্পাদিত করেছিল, সেগুলো তাঁদের জন্যেই বুমেরাং হয়ে দাড়ায়। ফলে সে চুক্তি তারা নিজেরাই ভংগ করে। অপরদিকে রাসুল (সঃ) নির্বিঘ্নে ইসলামের দাওয়াতী কাজ করতে থাকেন। ইসলামী জনবল বিপুলভাবে বৃদ্ধি পায়। আরবের অধিকাংশ গোত্রই পর্যায়ক্রমে কুরাইশদের সাথে মিত্রতা ত্যাগ করে। যাই হোক, চুক্তি ভংগের কারনে রাসুল (সঃ) মক্কা অভিযানের সিদ্ধান্ত নেন। অষ্টম হিজরি সনের ১০ রমযান। রাসুল (সঃ) দশ হাজার জিন্দাদিল ইসলামী সেনাদল সাথে নিয়ে রওয়ানা করলেন মক্কা অভিমুখে। ২০ রমযান মুহাম্মাদ (সঃ) বিজয়ীর বেশে প্রবেশ করেন মক্কায়। আজ আর তাঁকে বাধা দেয়ার কোন শক্তি কারো ছিলো না। সম্পূর্ণ বিনা বাধায় আল্লাহর প্রশংসা করতে করতে তিনি এবং তাঁর সাথীরা মক্কার হারাম শরীফে প্রবেশ করেন।

 

ভেঙ্গে ফেলেন আল্লাহর ঘরে রাখা ৩৬০ টি ভাস্কর্য মূর্তি। তাঁকে চরম কষ্ট দিয়ে থাকলেও তিনি ক্ষমা করে দেন মক্কার লোকদের। তিনি তাঁদের বলেন- ‘আজ আর তোমাদের বিরুদ্ধে আমার কোন অভিযোগ নেই। যাও, তোমরা মুক্ত। মক্কার আশেপাশের গোত্রগুলোতে রক্ষিত মূর্তিগুলোও নির্মূল করা হলো। মক্কা ভূমি থেকে উৎপাটিত করা হলো শিরকের শিকড়। ঘোষণা করা হলো আল্লাহর একত্ব, মহত্ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব। আল্লাহর রাসুল (সঃ) কয়েকদিন মক্কায় অবস্থান করেন। এখান থেকে গিয়ে অভিযান চালিয়েই জয় করেন, হাওয়াযীন ও বনু সাকিফ। হোনায়েন প্রান্তরে যুদ্ধ হয় এদের সাথে। তারা চরমভাবে পরাজিত হয়। এ সময় তিনি তায়েফও অধিকার করেন। মক্কা বিজয় উপলক্ষে রাসুল (সঃ) উনিশ দিন মক্কায় অবস্থান করেন। হোনায়েন ও তায়েফ যুদ্ধের পর ফিরে আসে মদিনায়।

 

২৬। ইসলামের ছায়াতলে জনতার ঢল

 

মক্কা বিজয়ের পর ইসলাম গ্রহনের জন্যে জনতার স্রোত প্রবাহিত হতে শুরু করে মদিনার অভিমুখে। আরব উপদ্বীপের ছোট বড় সব গোত্র তাঁদের প্রতিনিধি দল পাঠাতে থাকে আল্লাহর রাসুলের কাছে তাঁদের ইসলামের ছায়াতলে আগমনের সংবাদ জানাবার জন্যে। মক্কা বিজয়ের পরবর্তী বছর বড় ছোট শতাধিক প্রতিনিধিদল মদিনায় এসে তাঁদের এবং তাঁদের গোত্রের ইসলাম গ্রহনের ঘোষণা দেয়। ইসলামের ছায়াতলে এই জনস্রোতের আগমনের কথা মহান আল্লাহ কুরআন মাজীদে উল্লেখ করেছেন –

 

“যখন এসেছে আল্লাহর সাহায্য ও বিজয়, এবং তুমি দেখতে পাচ্ছো, লোকেরা দলে দলে প্রবেশ করছে আল্লাহর দীনে। তখন তোমার প্রভুর প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো এবং ক্ষমা প্রার্থনা করো তাঁর কাছে। অবশ্যি তিনি পরম ক্ষমাশীল দয়াবান।” (সূরা আন নাসর)

 

 

 

২৭। তাবুক যুদ্ধ

 

রাসুলুল্লাহ (সঃ) কর্তৃক সবচেয়ে বড় অভিযান ছিলো তাবুক অভিযান। এ অভিযান ছিলো বর্তমান সিরিয়া ও জর্ডান পর্যন্ত বিস্তৃত তৎকালীন বৃহৎশক্তি রোম সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে। অভিযানের রয়েছে পূর্ব ঘটনা। তাহলো, হুদাইবিয়ার সন্ধির পর রাসুল (সঃ) মানুষকে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেয়ার উদ্দেশ্যে গোটা আরবের বিভিন্ন অঞ্চলে দাওয়াতী প্রতিনিধি দল পাঠান। এছাড়া সর্দার ও শাসকদের কাছে পত্র মাধ্যমে দাওয়াত দিয়ে দূত পাঠান। সিরিয়া সীমান্তের কাছাকাছি তাঁর একটি পনের সদস্যের দাওয়াতী প্রতিনিধিদলকে খ্রিষ্টানরা হত্যা করে। প্রানে বেঁচে আসে শুধুমাত্র দলনেতা কাব বিন উমায়ের গিফারী। একই সময় রাসুল (সঃ) বুসরার গভর্নরের কাছে দাওয়াত নিয়ে পাঠিয়েছিলেন হারিস বিন উমায়েরকে। কিন্তু রোম সম্রাটের অনুগত এই খৃষ্টান সর্দার আল্লাহর রাসুলের দূতকে হত্যা করে। রোম সাম্রাজ্যের এসব অন্যায় ও অপরাধমূলক আগ্রাসী থাবা থেকে আরব অঞ্চলকে নির্বিঘ্ন করার উদ্দেশ্যে অষ্টম হিজরির জমাদিউল উলা মাসে রাসুল (সঃ) হযরত যায়েদ বিন হারেসার নেতৃত্বে তিন হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী সিরিয়ার দিকে পাঠান। কিন্তু এই সেনাদলটি মাআন নামক স্থানে পৌঁছে জানতে পারেন, বুসরার গভর্নর শুরাহবিল এক লাখ সৈন্য নিয়ে তাঁদের মোকাবেলা করার জন্যে এগিয়ে আসছে। সামনে অগ্রসর হয়ে মুতা নামক স্থানে শুরাহবিলের এক লাখ সুসজ্জিত বাহিনীর সাথে তিন হাজার জিন্দাদিল মুসলিম এক অসম যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। ব্যাপক হতাহত হয় শুরাহবিল বাহিনী। এ যুদ্ধে বারোজন মুসলিম সেনাও শহীদ হন। এই বারো জনের মধ্যে মুসলিম বাহিনীর তিন সেনাপতিও অন্তর্ভুক্ত। তারা হলেন- যায়িদ বিন হারিসা, জাফর বিন আবু তালিব এবং আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা (রা)। পরের বছর নবম হিজরিতে রোম সম্রাট কাইজার মুসলমানদের থেকে মুতা যুদ্ধের প্রতিশোধ নেয়া এবং তাঁদের অগ্রযাত্রা স্তব্ধ করার উদ্দেশ্যে সিরিয়া সীমান্তে ব্যাপক সামরিক প্রস্তুতি নিতে থাকে। জানা যায়, তারা সীমান্তে দুই লাখ সৈন্যের সমাবেশ ঘটায়। আরব ভূখণ্ডের দিকে আর এক কদমও অগ্রসর হওয়ার পূর্বেই রাসুল (সঃ) তাঁদেরকে প্রতিরোধ করার সিদ্ধান্ত নেন। এ অভিযান ছিল ব্যাপক দূরত্বের অভিযান। ছিলো গরমের মওসুম, অর্থনৈতিক সমস্যা, ফসল পাকার মওসুম, সোয়ারীর অভাব। তা সত্যেও রাসুল (সঃ) বৃহৎ শক্তির হামবড়া ভাব স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিলেন। নবম হিজরির রযব মাসে তিনি ত্রিশ হাজার জিন্দাদিল মুজাহিদকে সাথে নিয়ে রওয়ানা করেন সিরিয়া সীমান্তের দিকে। এদিকে রোম সম্রাট ত্রিশ হাজার মুসলিম সৈন্যের আগমনের সংবাদ পেয়ে বিচলিত হয়ে পড়েন। বিশ্বনবী (সঃ) তাবুক নামক স্থানে পৌঁছে খবর পান, কাইজার সিরিয়া সীমান্ত থেকে তাঁর বাহিনী গুটিয়ে নিয়েছে। ফলে সিরিয়া প্রবেশ না করে রাসুল (সঃ) বিশ দিন তাবুকে অবস্থান করেন। আরব ভূখণ্ডে কাইজারের যেসব ছোট ছোট করদ রাজ্য ছিলো, তিনি সেগুলোর সর্দারদের উদ্দেশ্যে ছোট ছোট বাহিনী পাঠান। এতে করে তারা মদিনার ইসলামী রাষ্ট্রের বশ্যতা স্বীকার করে নেয়। এভাবে আল্লাহ পাক স্বল্প সময়ের মধ্যে ইসলামের প্রভাব সিরিয়া সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছে দেন। সূরা আত তওবার ৩৮-৭২ নং আয়াত তাবুক যুদ্ধে যাত্রার প্রাক্কালে এবং ৭৩ থেকে শেষ আয়াত পর্যন্ত আয়াতগুলো তাবুক থেকে ফিরে আসার পরে নাযিল হয়। এ আয়াতগুলোতে তাবুক যুদ্ধে অংশগ্রহনের জন্যে উৎসাহ প্রদান এবং তাবুক যুদ্ধের পর্যালোচনা করা হয়েছে। সূরা তাওবার এ আয়াতগুলো পড়লে তাবুক যুদ্ধ সম্পর্কে সঠিক ধারনা পাওয়া যাবে।

 

২৮। বিদায় হজ্জ

 

হজ্জ ফরয হওয়ার পর রাসুল (সঃ) একবারই হজ্জ করেন। আবার এ হজ্জেই তিনি সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়েছিলেন। সে কারনে এ হজ্জকে বিদায় হজ্জ বলা হয়। অর্থাৎ রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর বিদায়ী হজ্জ। দশম হিজরি সন। এ বছর বিশ্বনবী, বিশ্বনেতা মুহাম্মাদ (সঃ) হজ্জ করার সিদ্ধান্ত নেন। তখন পর্যন্তকার গোটা মুসলিম মিল্লাতকে ঘোষণা দিয়ে জানিয়ে দেয়া হয়, রাসুলুল্লাহর হজ্জে যাবার খবর। সব গোত্র ও কবিলার সামর্থ্যবান মুসলিমরা হজ্জে যাবার প্রস্তুতি নিতে থাকেন। চতুর্দিকে বইয়ে চলছে আনন্দের বন্যা। দশ হিজরি সনের ২৬ জিলকদ তারিখে আল্লাহর রাসুল (সঃ) হজ্জের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করেন। ৫ জিলহজ্জ তারিখে মক্কায় পৌঁছান। হজ্জ শেষে ১৪ যিলহজ তারিখে ফিরে রওয়ানা করেন মদিনা অভিমুখে। এ হজ্জ উপলক্ষে আল্লাহর রাসুল (সঃ) দুটি ভাষণ প্রদান করেন। একটি আরাফার ময়দানে অপরটি মিনায়। তাঁর এ ভাষণ ছিলো ইসলামী রাষ্ট্রের মেনিফেস্টো। এক লাখ চব্বিশ হাজার, কোন কোন বর্ণনায় এক লাখ চুয়াল্লিশ হাজার সাহাবী তাঁর সাথে হজ্জে শরীক হয়েছিলেন। তাঁর এ হজ্জই মুসলিম উম্মাহর জন্যে হজ্জের মডেল।

 

২৯। বিদায় হজ্জের ভাষণ

 

হজ্জ উপলক্ষে রাসুল (সঃ) দুটি ভাষণ দিয়েছিলেন। একটি ৯ যিলহজ্জ তারিখে আরাফার ময়দানে। অপরটি ১০ যিলহজ্জ তারিখে মিনায়। এ দুটি ভাসনে তিনি অনেকগুলো মৌলিক নির্দেশনা তিনি প্রদান করেছিলেন। তাঁর কয়েকটি এখানে উল্লেখ করা হলো—

 

  •  
  • ১। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই। তিনি এক ও একক। তাঁর কোন শরীক নেই। মুহাম্মাদ তাঁর দাস ও রাসুল।
  •  
  • ২। আমি তোমাদের উপদেশ দিচ্ছি, তোমরা কেবল এক আল্লাহর ইবাদাত ও উপাসনা করবে।
  •  
  • ৩। তোমাদের প্রত্যেকের জীবন ও সম্পদ পরস্পরের নিকট পবিত্র। পরস্পরের জীবন ও সম্পদের ক্ষতি সাধন নিষিদ্ধ করা হলো।
  •  
  • ৪। আমানাত তাঁর প্রাপকের কাছে ফিরিয়ে দেবে।
  •  
  • ৫। সুদ প্রথা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হলো।
  •  
  • ৬। জাহেলী যুগের সমস্ত কুসংস্কার রহিত করা হলো।
  •  
  • ৭। খুনের প্রতিশোধ যুদ্ধ রহিত করা হলো।
  •  
  • ৮। ইচ্ছাকৃত হত্যার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। অনিচ্ছাকৃত হত্যার দণ্ড একশো উট।
  •  
  • ৯। তোমরা শয়তানের আনুগত্য করোনা।
  •  
  • ১০। তোমরা স্ত্রীদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো। স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের উপর তোমাদের অধিকার রয়েছে। স্ত্রীদের উপর স্বামীদের অধিকার হলো তারা স্বামী ছাড়া আর কারো সাথে যৌনাচার করবেনা। স্বামীর অনুমতি ছাড়া তারা তাঁর অর্থসম্পদ খরচ করবেনা।
  •  
  • ১১। স্বামীদের উপর স্ত্রীদের অধিকার হলো, তারা পবিত্র জীবন যাপন করলে স্বামী প্রচলিত উত্তম পন্থায় তাঁদের জীবন সামগ্রী প্রদান করবে।
  •  
  • ১২। একজনের অপরাধের জন্যে আর একজনকে দণ্ড দেয়া যাবেনা।
  •  
  • ১৩। তোমাদের নেতা কোন নাক বোঁচা হাবশি হলেও সে যদি আল্লাহর কিতাবের আনুগত্য করে, তবে তাঁর আদেশ পালন করবে।
  •  
  • ১৪। মুসলিমরা পরস্পর ভাই ভাই।
  •  
  • ১৫। সমস্ত মানুষের স্রষ্টা একজন। সবার পিতাও একজন। সুতরাং কোন মানুষের উপর অপর মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব নেই।
  •  
  • ১৬। তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক মর্যাদাবান সে, যে সর্বাধিক আল্লাহভীরু ও ন্যায়নীতিবান।
  •  
  • ১৭। তোমাদের অধিনস্তদের অধিকারের ব্যাপারে সচেতন হও। তাঁদের প্রতি অন্যায় করোনা। তাঁদের আঘাত করোনা। তোমরা যা খাবে, পরবে, তাদেরকেও তাই খেতে ও পরতে দেবে।
  •  
  • ১৮। বিবাহিত ব্যাভিচারীর শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।
  •  
  • ১৯। উত্তরাধিকার কে কতটুকু পাবে, স্বয়ং আল্লাহ তা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। সুতরাং ওয়ারিশদের জন্যে আর অসিয়ত করা যাবেনা।
  •  
  • ২০। মনে রেখো, ঋণ অবশ্যি পরিশোধ করতে হবে।
  •  
  • ২১। মনে রেখো, দীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করোনা। (দলাদলি ও কট্টরপন্থা অবলম্বন করবেনা।)
  •  
  • ২২। আমার পরে আর কোন নবী আসবেনা। আমি তোমাদের কাছে দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি। যতোদিন এ দুতিকে আঁকড়ে ধরে রাখবে, ততদিন তোমরা বিপথগামী হবেনা। একটি হলো আল্লাহর কিতাব আল কুরআন এবং অপরটি হলো সুন্নাতে রাসুলুল্লাহ।
  •  

 

যারা এখানে উপস্থিত আছো, তারা এ ফরমানগুলো অনুপস্থিতদের কাছে, পরবর্তীদের কাছে পৌঁছে দেবে।

 

৩০। মুহাম্মাদ (সঃ) এর মৃত্যু

 

কোন নবী রাসুলই চিরজীবী হননি। সবারই মৃত্যু হয়েছে। প্রতিটি মানুষেরই মৃত্যু অবধারিত। মুহাম্মাদ (সঃ) সম্পর্কেও আল্লাহ বলেন – “হে মুহাম্মাদ, তুমিও মরনশীল, তাঁরাও মরনশীল।” (আল কুরআন ৩৯ ; ৩০)

 

হজ্জ শেষে রাসুল (সঃ) যিলহজ মাসের শেষার্ধেই মদিনায় ফিরে আসেন। এরপর মহররম মাস মোটামুটি ভালোভাবেই অতিবাহিত করেন। সফর মাস থেকে তাঁর অসুস্থতা দেখা দেয়। ১১ হিজরির ১২ রবিউল আউয়াল তারিখে তিনি ইহজগত ত্যাগ করেন। দুনিয়া থেকে ইন্তেকাল করেন আখিরাতের দিকে। মৃত্যুর চার পাচদিন আগে তাঁর ইচ্ছানুযায়ী লোকেরা তাঁকে ধরাধরি করে মসজিদে নিয়ে এসেছিলো। সেদিন তিনি সাহাবীগনের মজলিশে সর্বশেষ একটি ছোট্ট ভাষণ দেন। তাতে তিনি বলেন-

 

“তোমাদের পূর্ববর্তী লোকেরা তাঁদের নবী ও পুণ্যবান লোকদের কবরকে সিজদার জায়গা বানিয়েছিল। তোমরা এমনটি করোনা। আমার মৃত্যুর পর তোমরা আমার কবরকে সিজদা ও উপাসনার জায়গা বানিয়ো না। যারা নবী ও পুণ্যবানদের কবর পূজা করবে, তাঁদের উপর আল্লাহর গযব। আমি তোমাদেরকে একাজ করতে নিষেধ করছি। আমি তোমাদের কাছে সত্য বানী পৌঁছে দিয়েছি। হে আল্লাহ, তুমি সাক্ষী থাকো।”

 

৩১। ইসলাম পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা

 

মুহাম্মদ (সঃ) এর মৃত্যুর মাধ্যমে শেষ হয়ে গেলো নবী রাসুল আগমনের সিলসিলা। পৃথিবীতে আর কোন নবী রাসুল আসবেন না। তাই মহান আল্লাহ মুহাম্মাদ (সঃ) এর মাধ্যমে দ্বীন ইসলাম বা ইসলামী জীবন ব্যবস্থাকে কিয়ামত পর্যন্ত সকল মানুষের উপযোগী করে পূর্ণাঙ্গ করে দিয়েছেন। বিদায় হজ্জ উপলক্ষে আরাফার ভাষণের সময় মহান আল্লাহ অহী নাযিল করে এ সংক্রান্ত ডিক্রি জারি করেন। তিনি বলেন-

 

“আজ আমি তোমাদের জন্যে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম তোমাদের দ্বীন (জীবন ব্যবস্থা), পরিপূর্ণ করে দিলাম তোমাদের প্রতি আমার নিয়ামত (কুরআন) এবং তোমাদের জন্যে দ্বীন (ধর্ম ও জীবন ব্যবস্থা) মনোনীত করলাম ইসলামকে।” (আল কুরআন ৫ ; ৩) এ ছাড়াও মহান আল্লাহ কুরআন মজীদে আরো বলে দিয়েছেন-

 

  •  
  • ১। “নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে দ্বীন হলো ইসলাম।” (আল কুরআন ৩ ; ১৯)
  •  
  • ২। “যে কেউ ইসলাম ছাড়া অন্য কোন দ্বীন (ধর্ম, মতাদর্শ ও জীবন পদ্ধতি) গ্রহন করবে, তাঁর থেকে তা গ্রহন করা হবেনা। আর আখিরাতে সে হবে ক্ষতিগ্রস্ত।” (আল কুরআন ৩ ; ৮৫)
  •  
  • ৩। “আল্লাহ কাউকেও সঠিক পথে চলার তৌফিক দিতে চাইলে ইসলামের জন্যে তাঁর হৃদয়কে উম্নুক্ত করে দেন। আর তিনি যাকে বিপথগামী করতে চান, তাঁর অন্তরকে করে দেন সংকীর্ণ। তখন তাঁর কাছে ইস্লামে প্রবেশ করাটা সিঁড়ি বেয়ে আকাশে উঠার মতই কষ্টসাধ্য মনে হয়। যারা ঈমান আনেনা, আল্লাহ এভাবেই তাঁদের লাঞ্ছিত করেন।” (আল কুরআন ৬ ; ১২৫)
  •  
  • ৪। “আল্লাহ যার হৃদয় উন্মুক্ত করে দেন ইসলামের জন্যে এবং যে রয়েছে তাঁর প্রভুর প্রদত্ত আলোর মধ্যে, সে কি ঐ ব্যক্তির সমতুল্য, যার অবস্থান এরকম নয়?” (আল কুরআন ৩৯ ; ২২)
  •  
  • ৫। “ঐ ব্যক্তির চাইতে বড় যালিম আর কে? যাকে ইসলামের দিকে ডাকা হলে সে মিথ্যা রচনা করে আল্লাহর দিকে আরোপ করে? ’’(আল কুরআন ৬১ ; ৭)
  •  
  • ৬। “আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে এসেছে একটি আলোকবর্তিকা (মুহাম্মাদ সাঃ) এবং একটি সুস্পষ্ট কিতাব (আল কুরআন)। এর মাধ্যমে আল্লাহ সে সব লোকদের সালামের (ইসলামের, শান্তির ও নিরাপত্তার) পথ দেখান, যারা তাঁর সন্তোষ লাভের আকাঙ্ক্ষী। আর তিনি নিজ অনুমতিক্রমে তাঁদের বের করে আনেন অন্ধকাররাশি থেকে আলোতে এবং তাঁদের পরিচালিত করেন সরল সঠিক পথে।”
  •  

 

(আল কুরআন ৫ ; ১৫-১৬)

 

 

 

সমাপ্ত

নবীদের সংগ্রামী জীবন

আবদুস শহীদ নাসিম

book স্ক্যান কপি ডাউনলোড